You dont have javascript enabled! Please enable it!

১৩ ডিসেম্বর সােমবার ১৯৭১

ঢাকার পতন যতই ঘনিয়ে আসে পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের অবাঙালি ও দক্ষিণপন্থি দোসরদের বুদ্ধিজীবী গুমের তৎপরতা ততই বেড়ে যায়। সকালে জানা যায়, গতরাতে বিবিসির সংবাদদাতা নিজামউদ্দিন আহম্মদ ও দৈনিক পূর্বদেশের শিফটু-ইন-চার্জ এ এন এম গােলাম মােস্তফাকে তাদের বাসভবন থেকে ঘাতকরা অপহরণ করে নিয়ে গেছে। রাতে একইভাবে অপহৃত হন অবজারভারের ক্রীড়া সম্পাদক এম এ মান্নান (লাডু ভাই)। ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সমস্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনী যুদ্ধের কৌশল পরিবর্তন করে। যেহেতু সামনে বিজয় অপেক্ষা করছে, তাই যৌথবাহিনী জানমাল ও সময় আর নষ্ট করতে চায় না। বিজয়ী বাহিনীর লক্ষ্য তখন যত শীঘ্র সম্ভব রাজধানী ঢাকা জয় করা। কেননা, ঢাকার পতন হলে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের বিভক্তি সম্পন্ন হবে। অধিকাংশ স্থানে পাকিস্তানি বাহিনী ইতােমধ্যে আত্মসমর্পণ করেছে। মুক্তাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন। কেবল বাকি ঢাকা, চট্টগ্রাম আর কয়েকটি সামরিক ছাউনি। মুক্তিযােদ্ধাদের সহযােগিতায় মিত্রবাহিনী ঢাকার ওপর চারধারা আক্রমণ শাসানাের সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সকালে যৌথবাহিনী নরসিংদী থেকে ঢাকার পথে অগ্রসর হয়। সন্ধ্যার দিকে মুক্তিবাহিনীর দুটি দল ডেমরা ও বাসাবােতে অবস্থান নেয়। অপরদিকে, ভােরে টাঙ্গাইল অধিকারের পর যৌথবাহিনীর আরেকটি দল টাঙ্গাইল থেকে ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকে। পথে দু-এক জায়গায় ছােটখাটো সংঘর্ষ হয়। কাদেরিয়া বাহিনীও টাঙ্গাইল থেকে ঢাকার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করে। শত্রুরা কুলিয়ে না উঠে ঢাকার দিকে আসতে থাকে। যৌথবাহিনীও তাদের পিছু নেয়। চট্টগ্রামের কুমিরায় মুক্তিবাহিনীর সাথে পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। সারারাত ধরে চলে উভয়পক্ষের গােলাগুলি বিনিময়। উত্তরাঞ্চলে যৌথবাহিনী দুপুরে গােবিন্দগঞ্জ থেকে ঢাকা মহাসড়ক ধরে বগুড়ার উদ্দেশে রওয়ানা হয়। বগুড়ায় তখন শত্রুবাহিনীর কামান ও ট্যাঙ্কসহ একটি রেজিমেন্ট অবস্থান করছে। হিলি রক্ষাব্যুহ ছেড়ে আগেই পাকসৈন্যরা বগুড়ায় চলে আসে। গড়ে তুলে শক্তিশালী প্রতিবন্ধ। রাতে যৌথবাহিনী চারদিকেথেকে বগুড়া শহর ঘিরে ফেলে।

মধ্যরাতে যৌথবাহিনীর তিনটি ব্যাটালিয়ান উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব-উত্তর দিক থেকে শত্রুর ওপর আঘাত হানে। | সিলেট সেক্টরে তুমুল যুদ্ধ চলে। বেশ কিছু সৈন্য আত্মসমর্পণ করে। রাতে চাঁদপুর শহরে সদর্পে প্রবেশ করে মুক্তিযােদ্ধারা। পতন ঘটে নীলফামারী, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জের সােনারগাঁও ও সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার । | যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই পাকিস্তানিরা বাধা দেওয়ার পরিবর্তে দলে দলে আত্মসমর্পণ করছে। কোথাও কোথাও তারা একটি গুলিও না ছুঁড়ে অস্ত্র সংবরণ করছে। ঢাকায় অবস্থানরত সৈন্যদের মনােবলও ভেঙ্গে পড়েছে। এই অবস্থায় বাঁচার একমাত্র পথ আত্মসমর্পণ । রাতে তাবেদার গভর্নর ডা. মালিক আত্মসমর্পণের অনুমতি চেয়ে ইসলামাবাদে জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে জরুরি  তারবার্তা পাঠান। একই সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের অধিনায়ক জেনারেল নিয়াজী ও ইয়াহিয়াকে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নেওয়ার জন্য অনুরােধ জানান। কিন্তু ইয়াহিয়া উভয়ের অনুরােধ নাকচ করে দিয়ে জানান, নিশ্চয় চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য হস্তক্ষেপ করবে। অপেক্ষা করাে এবং যুদ্ধ চালিয়ে যাও। কিন্তু তখন ঢাকায় অবস্থানরত ইয়াহিয়ার জেনারেলরা যুদ্ধ চালানাের বদলে অস্ত্র সংবরণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। ঢাকায় সকাল ৮টায় কয়েক ঘণ্টার জন্য সান্ধ্য আইন শিথিল করা হলে দলে দলে লােকজন নগরী ত্যাগ করে।

সূত্র : দিনপঞ্জি একাত্তর – মাহমুদ হাসান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!