১১ ডিসেম্বর শনিবার ১৯৭১
বাংলাদেশ হাতছাড়া হয়ে যাবার আশঙ্কায় সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠেন পাকিস্তানি জেনারেলরা। ইসলামাবাদে ইয়াহিয়া খান বেসামাল । ঢাকায় জেনারেল নিয়াজী, রাও ফরমান আলীরা দিশেহারা। চারদিক থেকে ঢাকার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে সম্মিলিত বাহিনী। জনমনে আতঙ্ক, ঢাকায় প্রচণ্ড লড়াই হবে। সেই আশঙ্কায় বিপুলসংখ্যক মানুষ রাজধানী ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে যেতে শুরু করে। ঢাকার আশপাশের পল্লী এলাকা তখন মুক্তাঞ্চল । সম্মিলিত বাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। মুক্তিবাহিনী দেশের অধিকাংশ থানা মুক্ত করে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। হিলি সীমান্তে মিত্রবাহিনী প্রচণ্ড প্রতিরােধের মুখােমুখি হয়। সন্ধ্যায় সম্মিলিত বাহিনী বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের মধ্যবর্তী গােবিন্দগঞ্জে শক্তিশালী ঘাঁটির ওপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। সারারাত যুদ্ধের পর পাকিস্তানিরা ভােরের দিকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। খুলনার দৌলতপুরে সম্মিলিত বাহিনীর সাথে পাকবাহিনীর তুমুল সংঘর্ষ ঘটে। যশাের ডিভিশনের শত্রুসৈন্যরা মধুমতি নদী পার হয়ে ফরিদপুরে পালাবার সময় মিত্রবাহিনীর প্রতিবন্ধকের মুখখামুখি হয় । | জামালপুর গ্যারিসন সম্মিলিত বাহিনীর কাছে অস্ত্র সমর্পণ করে। জামালপুরের পূর্বে হালুয়াঘাট এলাকায় প্রচণ্ড সংঘর্ষের পর পাকিস্তান বাহিনীর আর একটি ব্রিগেড প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে অস্ত্র-গােলাবারুদ ফেলে টাঙ্গাইলের দিকে পালিয়ে যেতে শুরু করে ।
পলায়নের সময় শত্রুবাহিনী রাস্তার সমস্ত বড় বড় সেতু ধ্বংস করে দিয়ে যায়। অপরদিকে, ময়মনসিংহে অবস্থানরত শত্রুবাহিনীর আর একটি পদাতিক ব্রিগেড শহর ত্যাগ করে টাঙ্গাইলে তাদের প্রতিরক্ষামূলক ঘাঁটিতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সম্মিলিত বাহিনী রাতে বিনা প্রতিরােধে জামালপুর দখলে নেয় । যৌথবাহিনীর কবজায় আসে মুন্সীগঞ্জ, কুষ্টিয়া ও টাঙ্গাইল সদর। পূর্ব সেক্টরে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথ অভিযান চালিয়ে ফেঞ্চুগঞ্জ মুক্ত করে। যৌথবাহিনীর আক্রমণে টিকতে না পেরে শত্রুবাহিনী মৌলভীবাজার ছেড়ে সিলেটে পশ্চাদপসরণ করে। আশুগঞ্জে মেঘনা নদী পার হয়ে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী ঢাকার অদূরে মহকুমা শহর নরসিংদী নিয়ন্ত্রণে আনে। ভৈরবে পাকিস্ত নিদের দুটি প্রতিরক্ষা ঘাঁটি ধ্বংস করে দেয়। জাতিসংঘের অনুরােধে মিত্রবাহিনীর বিমান হামলা সকালে সাময়িক স্থগিত রাখা হয়। উদ্দেশ্য বিদেশি নাগরিকদের ঢাকা ত্যাগের ব্যবস্থা করার জন্য বিমানবন্দর মেরামতের সুযােগ করে দেওয়া। সন্ধ্যায় মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী যুদ্ধবিরতি ও পাকিস্তানিদের ঢাকা থেকে অপসারণের ব্যবস্থা করার জন্য জাতিসংঘ সদর দফতরে জরুরি আবেদন জানান। মার্কিন সপ্তম নৌবহরের টাস্কফোর্স দ্রুত বঙ্গোপসাগরের দিকে ধেয়ে আসতে থাকে। ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর বিশেষ বিমানসমূহে ঢাকা থেকে ব্রিটিশ ও বিদেশি নাগরিকদের অপসারণ করা হয়। ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের জানান, যদিও পূর্বাঞ্চলের যুদ্ধাবস্থা খুব ভালাে নয় তথাপি আমাদের আত্মসমর্পণের কোনাে প্রশ্নই ওঠে না। ঢাকায় বিকাল ৩টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্ধ্য আইন জারি করা হয়।
সূত্র : দিনপঞ্জি একাত্তর – মাহমুদ হাসান