১০ ডিসেম্বর শুক্রবার ১৯৭১
মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় ঢাকা বেতার কেন্দ্রের সম্প্রচার কাজ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। সম্মিলিত বাহিনী উত্তরবঙ্গে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যদের ঢাকায় যাবার পথ প্রায় রুদ্ধ করে দেয়। | যশাের পতনের পর পাকবাহিনী মাগুরা হয়ে ফরিদপুরের দিকে পালাতে থাকে। এ ছাড়া শত্রুবাহিনীর ১০৭ নং পদাতিক ব্রিগেড খুলনার দিকে পালাতে শুরু করে। যৌথবাহিনী তাদের পিছু ধাওয়া করে। অবশ্য আগেই খুলনা মুক্তিবাহিনীর করায়ত্ত হয়। সন্ধ্যায় যৌথ নৌবাহিনীর ‘আলফা ফোর্সের হাতে মংলা বন্দরের পতন ঘটে। অপরদিকে কুষ্টিয়ায় যৌথবাহিনী শত্রুর ওপর আক্রমণ চালালে তারা অবস্থান ছেড়ে নাটোর ও পাবনার দিকে পালিয়ে যায়। পালানাের সময় তারা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ধ্বংস করে দিয়ে যায়। | উত্তর-পশ্চিম সেক্টরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি পলাশবাড়ি যৌথবাহিনীর দখলে আসলে রংপুর ও দিনাজপুরে অবস্থানরত পাকিস্তান বাহিনী বগুড়া ও রাজশাহী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সড়কপথে পালাবার পথ বন্ধ হয়ে গেলে রংপুর ও সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টের পাকসৈন্যরা সন্ধ্যায় রেলপথে ঢাকা যাত্রা। করে। শত্রুদের পলায়নের খবর পেয়ে সাথে সাথে যৌথবাহিনী ফুলছড়ি ফেরিঘাটের দিকে এগিয়ে যায়। পথে গাইবান্ধা মুক্ত হয়। রাতে সম্মিলিত বাহিনী ফুলছড়ি ফেরিঘাটের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে শত্রুর পশ্চাদপসরণের চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। গভীর রাতে ফুলছড়ি ঘাটের অপর পার বাহাদুরবাদ ফেরিঘাট যৌথবাহিনীর দখলে আসে। খুলনায় রূপসা নদীতে ভয়াবহ নৌ-যুদ্ধে বীরবিক্রমে শত্রুকে মােকাবেলা করে শহীদ হন রুহুল আমিন। পরবর্তীকালে তাঁকে মরণােত্তর বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব প্রদান করা হয়। সম্মিলিত বাহিনী উত্তরাঞ্চলের যুদ্ধে সর্বাত্মক সাফল্য অর্জন করে। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যৌথ অভিযান চালিয়ে দিনাজপুর, রংপুর ও সৈয়দপুরের শত্রুবাহিনীকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় । যৌথবাহিনী এই তিন শহর ছাড়া রংপুর ও দিনাজপুর জেলা শত্রুমুক্ত করে। রাতে পাকিস্তান বাহিনী জামালপুর গ্যারিসন ছেড়ে ঢাকার দিকে পালাবার সময় শহরের অদূরে যৌথবাহিনীর প্রতিবন্ধকের মুখােমুখি হয়। এ যুদ্ধে প্রায় ১৫০০ পাকসেনা হতাহত হয়। বাকিরা আত্মসমর্পণ করে।
অপরদিকে যৌথবাহিনী আশুগঞ্জে মেঘনার পূর্বতীর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনে। | চট্টগ্রাম মুক্ত করার উদ্দেশে মুক্তিবাহিনী ফেনী নদী পার হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের শুভপুর ব্রিজের কাছকাছি অবস্থান নেয়। সম্মিলিত বাহিনীর ভয়ে পাকসৈন্যরা চট্টগ্রামের মিরেরশ্বরাই দিয়ে সীতাকুণ্ডুতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। হানাদার বাহিনী পিছনে হটার সময় দেশের সর্বত্র ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। সেতু-কালভার্ট ধ্বংস করে দেয়। ব্যাংক কোষাগার, ধন সম্পদ লুট করে। আগুন জ্বালিয়ে ছারখার করে। দেয় জনপদের পর জনপদ। নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে অসামরিক জনগণকে। কিন্তু তাতে একটুও দমিত হয়নি বাংলার মানুষ। যেখানেই যৌথবাহিনী সেতু ধ্বংসের কারণে কিংবা খাল-বিলের জন্য প্রতিবন্ধকতার মুখােমুখি হয়েছে সেখানেই হাজার হাজার মানুষ তাদের সাহায্য সহযােগিতায় এগিয়ে এসেছে। মাটি কেটে বিকল্প সড়ক তৈরি করে দিয়েছে। নদী পারাপারের ব্যবস্থা করেছে। সামরিক সরঞ্জাম বয়ে নিয়ে গেছে ।
খাদ্য যােগান দিয়েছে। ফলে কোনাে প্রতিবন্ধকতাই যৌথবাহিনীর অগ্রাভিযানকে রুখতে পারেনি । ঢাকাকে মুক্ত করতে তারা শরীক হয়েছে অভিযাত্রী দলের সাথে। বাংলার মানুষ চেয়েছে যত দ্রুত সম্ভব তাদের রাজধানী মুক্ত হােক। দিবাগত রাতে স্বাধীনতাবিরােধী গুপ্তঘাতক দল দৈনিক ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হােসেন ও পিপিআই-র চিফ রিপাের্টার সৈয়দ নাজমুল হককে তাদের নিজ বাসভবন থেকে অপহরণ করে। লাকসাম, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, হালুয়াঘাট, রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া ও খুলনায় প্রচণ্ড লড়াই চলে। বিভিন্ন রণাঙ্গনে পাকিস্তান বাহিনী ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে। জাতিসংঘ থেকে ঘােষণা করা হয় সাধারণ পরিষদে গৃহীত যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব পাকিস্তান মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভােলা, ময়মনসিংহ, নড়াইল, মাদারীপুর শহর দখল করে স্বাধীন বাংলার পতাকা তােলা হয় । ভারতের প্রধানমন্ত্রী নয়াদিল্লিতে বলেন, যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত জাতিসংঘের আহ্বান ভারত প্রত্যাখ্যান করেনি বা গ্রহণও করেনি। প্রস্তাবটি সরকারের বিবেচনাধীন রয়েছে। জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থী কোনাে চাপ এলে ভারত তা গ্রহণ করবে না। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিজয় শুধু তখনই সম্পূর্ণ হবে, যখন ঢাকায় বাংলাদেশ সরকার কায়েম হবে এবং বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত এক কোটি শরণার্থী তাদের বাস্তুভিটায় ফিরে যেতে পারবে। |
ঢাকায় সেনাবাহিনীর জনৈক মুখপাত্র বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের সার্বিক প্রতিরক্ষার কৌশলগত কারণে পূর্ব পাকিস্তানের যেসব এলাকা ছেড়ে দিয়ে এসেছে সেসব জায়গায় ভারতীয় বাহিনীর অধীনে ‘তথাকথিত’ বাংলাদেশের সমর্থকরা বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছে। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেল (বর্তমান হােটেল রূপসী বাংলা) ও হলি ফ্যামিলি রেড ক্রস হাসপাতালকে নিরপেক্ষ জোন ঘােষণা করা হয়। কূটনৈতিক ও বিদেশি নাগরিকরা হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আশ্রয় নেন। রাওয়ালপিন্ডিতে সেনাবাহিনীর জনৈক মুখপাত্র বলেন, বর্তমান যুদ্ধে আমরাই বিজয়ী হচ্ছি এ সম্পর্কে আমরা সুনিশ্চিত। পূর্বাঞ্চলে লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজীর অধিনায়কত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। পূর্ব। পাকিস্তানের পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে।
সূত্র : দিনপঞ্জি একাত্তর – মাহমুদ হাসান