You dont have javascript enabled! Please enable it!

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সংকট ও পঁচাত্তর-পরবর্তীতে নানা অভিযোগ

স্বাধীনতাযুদ্ধের নয় মাসে এদেশীয় পাকিস্তানপন্থীরা যে বিভৎস অত্যাচার, খুন, লুটপাট ইত্যাদি সন্ত্রাসী ঘটনার আশ্রয় নিয়েছিল, তার অপরাধের তুলনায় খুব কমই বিচারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। যুদ্ধ-পরবর্তী সরকার হিসেবে আওয়ামী লীগের কাছে এটা অত্যন্ত মহৎ কর্মসূচী হিসেবেই দেখা দেওয়া উচিত ছিল। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে রাজাকার-আলবদরদের বিচার হবে সে সময় সমগ্র বাঙালীর কাছে তা ছিল অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা। কারণ ১৬ ডিসেম্বর (১৯৭১)-এর যুদ্ধের পর দেখা গেল এমন একটি বাঙালী পরিবার নেই, যাদের কেউ-না-কেউ রাজকার-আলবদর অথবা পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে নিহত হয়নি।
তবে যুদ্ধ-অপরাধীদের বিচার করা খুব একটা সহজও ছিল না। কারণ :

১. সারাদেশে এ নিয়ে একটা বড় ধরনের বিশৃঙ্খলাও সৃষ্টি হয়ে গেল। দেখা গেল, ব্যক্তিগত শত্রুতা ধরেও অনেকে প্রতিশোধ-আকাঙ্ক্ষায় একে অপরকে রাজাকার বানাচ্ছে, প্রতিশোধ নিচ্ছে, হত্যা করছে কিন্তু গ্রেফতার করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছেও দিচ্ছে না। ফলে সত্যিকারের অপরাধীরা গা-ঢাকা দিতে সমর্থ হয়। অনেক নিরীহ লোকও এর ফলে প্রাণ হারাতে থাকে।

২. রাজাকার-আলবদররা আশ্রয় পেতে থাকে মুক্তিযুদ্ধ-সমর্থক অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তির কাছেও। ব্যক্তিগত আত্মীয়তার সূত্র ধরে এ আশ্রয়লাভ ব্যাপক আকারে রাজাকার-আলবদরদের প্রাণে বাঁচিয়ে দেয়।

৩. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কথিত ‘মহান হৃদয়’ রাজাকার-আলবদরদের বিচারে রাজনৈতিকক্ষেত্রে প্রধানভাবে বিঘ্ন ঘটায়। অধিক রক্তপাতের আশঙ্কা থেকে অথবা স্বাধীন দেশে তারা আর কিইবা করতে পারবে এই হালকা রাজনৈতিক চিন্তার কারণেও যুদ্ধ-অপরাধীরা বেঁচে যায়।
দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, খান এ সবুর, পাকিস্তান মুসলিম লীগের নেতা—মুক্তিযুদ্ধে যিনি সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষে এবং গণহত্যায় অংশ নিয়েছিলেন, তিনি জেল থেকে বঙ্গবন্ধুকে এক চিঠিতে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং প্রতিশ্রুতি দেন যে, ভবিষ্যতে তিনি আর বাংলাদেশে রাজনীতি করবেন না। এ-কথা বিশ্বাস করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব সবুর খানকে মাফ করে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে দেন।
মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয়টি মাস প্রত্যক্ষ যুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতি এই যুদ্ধের ভয়াবহতা ও কঠিনতা সম্পর্কে তাঁর অনভিজ্ঞতাই এই হালকা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অন্যতম কারণ হিসেবে প্রতিপন্ন করা যায়।

৪. তবে যুদ্ধ-অপরাধীদের শাস্তি বা বিচার না-করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তৎকালীন বিরোধীদলগুলোও কম দায়ী নয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নিজেদের শক্তিশালী করার সুবিধাবাদী রাজনৈতিক মানস-চেতনা থেকেও বিরোধীদলগুলো স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তিদের কেন্দ্র থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত আশ্রয়দান অব্যাহত রেখেছিল।

এর পক্ষে উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, মশিউর রহমান যাদু মিঞা যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে মুক্তিযোদ্ধাদের ও তাঁর দলকে পরিত্যাগ করে পালিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কাছে প্রকাশ্যে গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়েছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কার্যকলাপ প্রকাশ্যে চালু রেখেছিলেন, স্বাধীনতার পর ভাসানী-ন্যাপ প্রকাশ্যে তাঁর মুক্তি দাবি করতে থাকে। বিরোধীদলের রাজনৈতিক চাপে আওয়ামী লীগ অবশেষে যাদু মিঞাকে মুক্তি দিলে ঢাকায় ইসলামিক একাডেমী (বর্তমান ইসলামিক ফাউন্ডেশন) মিলনায়তনে তাকে ‘বীর’ হিসেবে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। মওলানা ভাসানীর প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় যাদু মিঞার এই সংবর্ধনা সভায় অন্যতম প্রধান বক্তা হিসেবে যোগ দেযন মুক্তিযোদ্ধা কাজী জাফর আহমেদ ও রাশেদ খান মেনন। শুধু তাই নয়, জনাব কাজী জাফর ও মেনন, যাদু মিঞাকে গলায় তাজা ফুলের মালাও পরিয়ে দেন।
তৎকালীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর কেন্দ্রীয় পর্যায়ে এবং ন্যাপ (মোজাফফর)-এর থানা-জেলা পর্যায়ে স্বাধীনতাবিরোধীরা আশ্রয় জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে আশ্রয় পায়। জাসদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে মওলানা মতিনের মতো লোকও স্থান লাভ করতে সমর্থ হয়। আল মাহমুদ, যিনি পরে জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক আদর্শ গ্রহণ করেন, তিনি ছিলেন জাসদের প্রধান মুখপত্র ‘গণশক্তি’র প্রধান সম্পাদক। স্বয়ং জাসদ সভাপতি মেজর এমএ জলিল পরে মৌলবাদী রাজনীতিতেই যোগদান করেন।১
জাসদের থানা ও জেলা পর্যায়ের অনেক তরুণ-কর্মী ও নেতা ছিল মূলত পলাতক রাজাকার অথবা আলবদরদের সন্তানরা। তাঁরা খুবই জঙ্গীকর্মী হিসেবে রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়েছিল। একদিকে তারা দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করছিল, অন্যদিকে সমাজতন্ত্রেরও সর্বনাশ করে দিচ্ছিল। জাসদে অবস্থানকারী সত্যিকারের সমাজতন্ত্রীরা তাদের কাছে অসহায় হয়ে পড়ে।
যুদ্ধ-অপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদলের যুগবৎ এই দোলাচল, দুর্বলতা, রাজনৈতিক সুবিধাবাদ ও অসচেতনতা এবং কান্ডজ্ঞানহীনর পরও স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকার যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তার দৃষ্টান্তও সামান্য নয়।২
কিন্তু এতসব দুর্বলতা সত্ত্বেও স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকার যুদ্ধ-অপরাধীদের বিচারকার্য দৃষ্টান্তমূলক ভাবেই শুরু করেছিল। এই বিষয়ে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনাপঞ্জি :

১৯৭২
৪ জানুয়ারী : সাবেক পাকিস্তানী নামের সকল সংস্থা ও সমিতি বাতিল ঘোষণা।

১৮ জানুয়ারী : শহীদ বুদ্ধিজীবীদের জাতীয় বীরের মর্যাদা দানের সিদ্ধান্ত।

৭ ফেব্রুয়ারী : বাংলাদেশ দালাল আদেশ সংশোধনী আদেশ জারি।

৯ ফেব্রুয়ারী : পাকিস্তানী দালাল নূরুল আমীন, হামিদুল হক চৌধুরী ও খান এ সবুরকে ফেরার ঘোষণা এবং তাদের বিষয়সম্পত্তি ক্রোক।

১৭ ফেব্রুয়ারী : ৫৪ জনক পাকিস্তানী দালালের সম্পত্তি ক্রোক।

১৮ ফেব্রুয়ারী : বাংলাদেশ পরিত্যক্ত সম্পত্তি উদ্ধার আদেশ জারি।

২১ ফেব্রুয়ারী : খুনীদের বিচার হবেই বলে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা।

২২ ফেব্রুয়ারী : দালাল সবুর খানকে গ্রেফতার।
০০০

১. মেজর জলিল জাসদ-সভাপতি হিসেবে মার্কসবাদের ওপর বই লিখেছিলেন। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ, ঐতিহাসিক বস্তুবাদ, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কী এবং কেন ইত্যাদি বই লিখে তিনি নিজেকে সমাজতন্ত্রী বা কমিউনিস্ট বলে জাহির করতে প্রয়াস পান।
২. ১৯৭৫-পরবর্তী সরকারগুলো (জিয়া, এরশাদ ও খালেদা সরকার) কর্তৃক স্বাধীনতাবিরোধীদের ঢালাওভাবে রাষ্ট্রীয় ও জাতীয়ভাবে যে পুনর্বাসন ও পুরস্কৃত করার প্রতিযোগিতা শুরু করে, আওয়ামী লীগ আমলেই তার পটভূমি বলে ঐ সরকার-সমর্থকদের থেকে যে প্রচারণা চালানো হয়, তা বস্তুত ধোপে টেকে না। জিয়া এবং এরশাদ আমলের সমর্থকগণ প্রায়শই বলে থাকেন যে, মুজিব আমলেই স্বাধীনতাবিরোধীদের ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছিল। এবং এই কথা বলে তারা প্রকারান্তরে এটাই বলতে চান যে, যেহেতু মুজিব আমলেই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছিল, তাই দালাল ও খুনীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা এমনকি ১৯৭৯ সালে দালাল শাহ আজিজকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং ১৯৯১ সালে রাজাকার আবদুর রহমান বিশ্বাসকে তারা দেশের রাষ্ট্রপতি করে ছেড়েছিলেন।
০০০

১ মার্চ : পাকিস্তানী খুনী জেনারেল টিক্কা-নিয়াজীর গংদের অপরাধ তদন্তের জন্যে বিশেষ সংস্থা নিয়োগ।

২৮ মার্চ : দালালদের বিচারের জন্যে ৭৩টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ঘোষণা।

১২ এপ্রিল : স্বাধীনতা সংগ্রামে বীরত্বের জন্যে ৪৩ জনকে খেতাব দান।

৫ জুন : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী ৪ জন রাষ্ট্রদূতসহ ৮ জন কূটনীতিক বরখাস্ত।

৮ জুন : কুষ্টিয়ার বিশেষ ট্রাইব্যুনালে দালালীর দায়ে রাজাকার চিকন আলীর মৃত্যুদন্ড।

১২ জুন : দুর্নীতিবাজ, দালাল ও পাকিস্তানমনা সরকারী কর্মচারীদের বাছাই করার জন্যে ২টি স্ক্রিনিং বোর্ড গঠন করে রাষ্ট্রপতি আদেশ জারি।

১৯ জুন : পরিকল্পনামতোই যুদ্ধ-অপরাধীদের বিচার করা হবে বলে রয়টারের সাথে সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুর আশ্বাস।

২৯ জুন : দালালীর দায়ে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের ডেপুটি স্পীকার আসগর হোসেনের ৮ বছরের সশ্রম কারাদন্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা।

১৩ জুলাই : স্বাধীনতা সংগ্রামের তথ্যনিষ্ঠ ইতিহাস রচনার জন্যে ১৩ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠিত।

১৪ জুলাই : দালালীর অভিযোগে খুলনায় ৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড।

১৭ জুলাই : শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সারকে হত্যার দায়ে জামায়াতে ইসলামী নেতা আবদুল খালেককে ৭ বছর সশ্রম কারাদন্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা।
২৫ জুলাই : ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে শহীদ সেনানীদের স্মৃতিফলক উন্মোচন।

৩১ জুলাই : দালাল আইন সংশোধনের জন্যে আওয়ামী লীগের সুপারিশ।

২৯ আগস্ট : দালাল আইন সংশোধনী আদেশ জারি।

৩০ আগস্ট : আইয়ুব খানের দালাল গভর্নর মোনায়েম খানের পুত্রদের জামিনের আবেদন না-মঞ্জুর।

১ সেপ্টেম্বর : পাকিস্তানে আটক বাঙালীদের জীবনের নিরাপত্তা বিধানের দাবিতে সারাবিশ্বে বঙ্গবন্ধুর আবেদন।
বাংলাদেশ নির্ধারিত অপরাধ (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল সংশোধনী) আদেশ জারি।

২৭ সেপ্টেম্বর : মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শান্তিকমিটির সদস্য ও কর্মীদের গ্রেফতারের নির্দেশ।

৫ অক্টোবর : শহীদ অধ্যাপক ড. আজাদকে হত্যার দায়ে ৩ জন আলবদরের মৃত্যুদন্ড।

৭ অক্টোবর : দালালীর অভিযোগে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন টিক্কা খানের গভর্নর ডা. আবদুল মালেককে আদালতের সামনে হাজিরা।

১০ অক্টোবর : মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন।

৫ নভেম্বর : দালালীর অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. সাজ্জাদ হোসেনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল।

২০ নভেম্বর : দালালীর অভিযোগে টিক্কা খানের গভর্নর ডা. মালিকের যাবজ্জীবন কারাদন্ড।

২৪ নভেম্বর : মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের স্মৃতি চিরঞ্জিব রাখার জন্যে জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত।

২৫ নভেম্বর : দালাল ডা. মালিকের মন্ত্রীসভার সদস্য জসিমউদ্দিনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড।

৩০ নভেম্বর : জাতিসংঘের প্রস্তাবে আটক বাঙালী ও পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি-বিনিময় সিদ্ধান্ত গ্রহণ।

২২ ডিসেম্বর : মিরপুরে আলবদর ও পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে নিহত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতিফলক বঙ্গবন্ধু কর্তৃক উন্মোচন।

১৯৭৩
৩ জানুয়ারী : চারজন সিএসপি সহ ৯ জন পদস্থ কর্মকর্তা অপসারিত।

৬ জানুয়ারী : শহীদ সাংবাদিক নাজমুল হককে অপহরণের অভিযোগে জনৈক খলিলের যাবজ্জীবন কারাদন্ড।

১০ ফেব্রুয়ারী : দালালমন্ত্রী ইসহাকের যাবজ্জীবন কারাদন্ড।

২৯ মার্চ : পাকিস্তান আমলের সব ট্রেড লাইসেন্স বাতিল।

১৭ এপ্রিল : বিশেষ ট্রাইব্যুনালে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার করার সিদ্ধান্ত।

২১ এপ্রিল : নুরুল আমীন, হামিদুল হক চৌধুরী, গোলাম আযম সহ ৩৯ জন পাকিস্তানী দালালের নাগরিকত্ব বাতিল।

২৪ এপ্রিল : দালালমন্ত্রী ওবায়দুল্লাহ মজুমদারের যাবজ্জীবন কারাদন্ড।

২৯ জুন : শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেনের অপহরণ মামলায় রাজাকার জনৈক খলিলের যাবজ্জীবন কারাদন্ড।

৩০ জুন : শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী হত্যা মামলায় দু’জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড।

৪ জুলাই : শহীদ সাংবাদিক নিজামুদ্দিন অপহরণ মামলার রায়ে দু’জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড।
১৭ জুলাই : জাতীয় সংসদে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) বিল পাস।

১৮ জুলাই : পাকিস্তানপন্থী মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর কারাগারে বন্দী অবস্থায় মৃত্যু।

২৮ আগস্ট : দিল্লীতে আটক বাঙালী ও পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দী বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষর।
১৯৫ জন পাকসেনাকে যুদ্ধ-অপরাধের দায়ে রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত।

৩১ আগস্ট : বিশেষ ট্রাইব্যুনালে রাজাকার মুন্নার মৃত্যুদন্ড।

দেখা যাচ্ছিল এই ১৯৭৩ সালের প্রথম থেকেই আওয়ামী লীগ সরকার জাতীয়ভাবে কিছু বিরোধীদলের চাপে এবং আন্তর্জাতিকভাবেও পাকিস্তানী দালাল, গণহত্যার সাথে জড়িতদের বিচারের বিষয়ে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছিল। এরই সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটে ১৬ মে ১৯৭৩ সালে। এদিন সরকার দালাল আইনে অভিযুক্ত বা সাজাপ্রাপ্ত কয়েক শ্রেণীর লোকের প্রতি ক্ষমাপ্রদর্শন করেছে।
এই ঘোষণার ৫ মাস পরেই সরকার দালাল আইনের ব্যাপারে তার রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে মৌলিক পরিবর্তন ঘটায়। ৩০ নভেম্বর (১৯৭৩) সরকার দালাল আইনে আটক ও সাজাপ্রাপ্ত সকল আসামীর প্রতি ক্ষমা ঘোষণা করে। এদিন ক্ষমা ঘোষণার সাথে ইসলামের ইতিহাসের মক্কা বিজয়ের পরের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, এটা হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর শিক্ষা।
১০ এপ্রিল (১৯৭৪) ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধ-অপরাধীকেও ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যকার চুক্তি অনুযায়ী ক্ষমা করা হয়।
বস্তুত দালাল ও সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত খুনীদের ক্ষমা করার বিষয়টি ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের জন্যে একটি বড় ধরনের রাজনৈতিক বিপর্যয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরবর্তীকালে এই ক্ষমা-ঘোষণা অত্যন্ত বিস্ময়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, যাতে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশটির অস্তিত্ব নিয়েই টানাটানি পড়ে যায়। ১৯৭৫-পরবর্তী সরকারগুলো দালালদের ঘটা করে রাষ্ট্রীয় জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত করে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম নির্লজ্জতার পরিচয় দেয়।
তবে আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক দালালদের বিচারের ইতি টানলেও দেখা যাচ্ছিল, পরবর্তী সময়েও বিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধ-অপরাধী ও খুনীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অব্যাহত ছিল। ১৯ জুলাই (১৯৭৪) দালালীর অভিযোগে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট জনৈক হাফিজ শাহ মোহাম্মদকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করে। ১১ আগস্ট (১৯৭৫) দালালীর অভিযোগে আরো ৬ জনের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়।
ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত যুদ্ধ-অপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল। দুর্বলতা সত্ত্বেও এই প্রক্রিয়া দেশের আদর্শিক অবস্থানকে সংহত করছিল।

Ref: বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস বঙ্গবন্ধুর সময়কাল – ড. মোহাম্মদ হাননান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!