এরই নাম হল মার্কিণ নীতি
এক দিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংরক্ষনের সংগ্রামকে পাশব শক্তি দ্বারা বিপর্যস্ত করার জন্য নিক্সন সরকার তাদের দেশ সহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশের জনগণের সােচ্চার বিরােধীতার প্রতি কর্ণপাত না করে জঙ্গী সমর নায়ক ইয়াহিয়া সরকারকে সর্বাধুনিক সমরাস্ত্র সরবরাহ করে যাচ্ছে। অন্যদিকে নিক্কন সরকারের পররাষ্ট্র সচিব উইলিয়ম রজার্স বাংলদেশে “সক্রীয় রাজনৈতিক সমাধানের জন্য অবশ্যই প্রচেষ্টা চালবার পক্ষে নসিহত দান করেছেন। সক্রীয় রাজনৈতিক সমাধান যদি বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা না বােঝায় তা হলে এ জাতীয় প্রচেষ্টা বাংলাদেশের জনগণ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করবে বলে বাংলাদেশ সরকার দ্বর্তহীনভাবে ঘােষণা করেছেন। বাংলাদেশ সরকারের রাজনৈতিক বিবৃতিতে লাখাে লাশের নীচে পাকিস্তান চাপা পড়ে গেছে’ বলে অভিমত প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্র প্রধান তার সাম্প্রতিক বেতার বক্তৃতায় ঘােষণা করেছেন যে বাঙ্গালী জাতি হিসেবে হয় আমরা বাঁচবাে না হয় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবাে-এর মধ্যে মধ্যবর্তী কোন পথ নেই। এরপরও ভিয়েনামে জনগণের হাতে প্রচন্ড মার খেয়ে বেত্রাহত কুকুরের মতাে স্বদেশ পলায়নমুখী মার্কিণ সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রধান মুখপাত্র দীর্ঘ দিন নীরবতার পর অগ্নি গর্ভ বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধানের প্রচেষ্টা পরিচালনার ওপর জোর দিয়েছেন। গুড়াে দুধের নাম করে যে শক্তি বাংলাদেশের মানুষ হত্যার জন্য গােপনে অস্ত্রশস্ত্র পাঠায়, স্বাধীনতা। সংগ্রামীদের তপ্ত রক্তে বাংলার শ্যামল মাটি লাল করে দেওয়ার জন্য জাহাজ জাহাজ সমরাস্ত্র পাঠিয়ে আবার মুরুব্বিয়ানা করার কসরত করে তাদের পাকিস্তানকে অখণ্ড রাখার গোপন প্রচেষ্টা জনগণের ঘৃণায় নীচে চাপা পড়ে যাবে। ৪ঠা অক্টোবর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দান কালে মার্কিণ পররাষ্ট্র মন্ত্রী পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলীকে “পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে মার্কিণ প্রশাসনিক মনােভাবের পুনরুল্লেখ করে বাংলাদেশে “শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি এবং মানব জীবন রক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন। অবশ্য এই প্রথম বার তিনি বাংলাদেশের ঘটনা “দক্ষিণ এশিয়ার শান্তির প্রতি হুমকী স্বরূপ” বলে অভিমত দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশে সমস্যার কাৰ্য্যকর রাজনৈতিক মীমাংসার জন্য তিনটি উদ্দেশ্য সিদ্ধির প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। সে গুলাে হলােঃ (১) উপমহাদেশে অবশ্যই সংযম রক্ষা করে চলতে হবে (২) দুর্ভিক্ষ প্রতিরােধ করার জন্য এবং শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাগমনের উপযুক্ত অবস্থার সৃষ্টির জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্যের কর্মসূচী সম্প্রসারিত করতে হবে এবং (৩) বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য অবশ্যই সক্রীয় প্রচেষ্টা চালাতে হবে। মিঃ রজার্স বাংলাদেশকে পূর্ব পাকিস্তান’ বলে উল্লেখ করেছেন। মার্কিণ পররাষ্ট্র সচিব বলেন যে, তাঁর সরকার এই উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সমাধানের জন্য শুধু মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র কেন পৃথিবীর যে সরকারই চেষ্টা করুন না কেন তাকে সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর একমাত্র বৈধ সরকার স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের সাথে আলােচনা করেই ব্যবস্থা গ্রহণের পদক্ষেপ নিতে হবে।
অন্যথায় বাংলাদেশ সরকার কোন প্রচেষ্টার সাথেই নিজেদের যুক্ত করবেন না। রজার্স বলেন, বাংলাদেশের ঘটনাবলীর ফলাফল-যথা ভারতের শরণার্থী গমন, দুর্ভিক্ষের বিপদাশঙ্কা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা পৃথিবীর সব দেশেরই উদ্বেগের কারণ। তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি কার্যকর আন্তর্জাতিক কর্মসূচী সংগঠনের ব্যাপারে রাষ্ট্র সংঘের প্রচেস্টায় আন্তরিক সমর্থন জানিয়েছে। মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তানের ত্রাণ ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীদের জন্য ২০ কোটি ডলারের ও অধিক সাহায্য মঞ্জুর করেছে। এ ছাড়া প্রেসিডেন্ট নিক্সন ত্রাণ বাবদ আরও ২৫ কোটি টাকার জন্য অনুরােধ জানিয়েছে। বাংলদেশে দুর্ভিক্ষ পাকিস্তানকে সাহায্যদান সম্পর্কিত জাতিসংঘের কো-অর্ডিনেটর মিঃ মরিস উইলিয়মস সিনেট সাব-কমিটিকে বলেছেন যে, এখন থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে পূর্ব বঙ্গ ভয়াবহ ধরণের দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হবে। তিনি বলেন যে, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি পূরণের জন্যে বাংলাদেশ যখন প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল তখন সে দেশে পুনরায় যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। | বাংলাদেশের বীর মুক্তিযােদ্ধারা জীবন বাজী রেখে মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত। তাদের সঙ্গে দেশপ্রেমিক, কৃষক, মজুর, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক-এক কথায় ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ যার যার নিজের কর্মক্ষেত্রে এই মুক্তি সংগ্রামের অংশভাগী হয়ে দেশ মাতৃকার শৃংখল মােচনের জন্য সর্বস্ব পণ করেছে। অসহ্য দুঃখ-কষ্ট-লাঞ্ছনা ও প্রতিমুহূর্তে নিশ্চিত মৃত্যু সম্ভাবনার মুখেও তারা জাতীয় মুক্তির প্রশ্নে আপােষহীন। মুক্তির প্রভাত সূর্যের সম্ভাবনায় প্রত্যয়শীল। মাত্র চব্বিশ বছর আগে সাম্প্রদায়িক জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে যে রাষ্ট্রের পতন হয়েছিল, সেই রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সাম্প্রদায়িকতা পরিহার করে ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ভৌগলিক জাতীয়তার ভিত্তিতে।
জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্কিশষে ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতার জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে অর্জনের জন্যে সশস্ত্র সংগ্রামে কাতারবন্দী হয়েছে। শুধু মাঠে ময়দানে শ্লোগান দেয়া নয়-এক সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাতিয়ার হাতে। পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীকে হত্যা করছে, প্রাণ দিচ্ছে। বাংলাদেশের সকল ধর্মীয় বিশ্বাসের মানুষ, বাঙালী জাতি হিসেবে প্রাণ নেয়া ও দেয়ায় মিলিত রক্ত ধারায় যে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলেছে, এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তা অনন্য। সাম্প্রদায়িকতাবাদের কবর রচনায় ইতিহাসের এই অনন্য অধ্যায়ের ভূমিকা অপরিসীম। এবং সুদূর প্রসারী। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের এটি জাতীয়তাবাদকে প্রতিহত করা। এটাই সাম্প্রদায়িকতাবাদী ঔপনিবেশিক শক্তির লক্ষ্য। জামাতে ইসলামী মুসলিম লীগ প্রভৃতি দালাল দলগুলাে পশ্চিম পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শক্তির সেই লক্ষ্য পূরণের কাজে আত্মনিয়ােগ করেছে। কিন্তু এই দালালরা চিহ্নিত ও ধিকৃত। তাদের শক্তি পুরােপুরিভাবে সামরিক জান্তার পশুশক্তির পৃষ্ঠপােষকতার ওপর নির্ভরশীল। এরা মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যােদ্ধাদের আক্রমণে এখন নিজেরাই সন্ত্রস্ত। তবে সংখ্যায় একেবারে নগণ্য হলেও স্বদেশেও বিদেশে প্রগতিবাদী এবং বামপন্থী বলে কিছু কিছু লােক আছেন যারা এই মুক্তি সংগ্রামকে পশ্চিম পাকিস্তানী বুর্জোয়াদের প্রতিষ্ঠিত করার যুদ্ধ বলে অভিহিত করে এই মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা ও স্বার্থকতার প্রশ্ন উথাপন করে থাকেন। অবশ্য এ কথা ঠিক যে, ‘জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে প্রতিটি মানুষই কাতারবন্দী হবে এমন আশা সব সময় করঃ যায় না। কিন্তু তা নত্ত্বেও বলতে হয়। যে, প্রগতিবাদের নাম করে যারা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ভূমিকা ও তাৎপর্য সম্পর্কে সংসয়বাণী প্রশ্ন।
তুলে নিজেদেরকে এই সংগ্রাম থেকে দূরে রাখেন তারা প্রকৃত পক্ষে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামেরই বিরােধীতা করছেন। সেদিক থেকে পরিণামে জামাত বা মুসলিম লীগের ভূমিকা থেকে এদের ভূমিকার আসলে খুব পদাঘাত করে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক ক্লেদমুক্ত সাংস্কৃতিক ভৌগলিক জাতীয়তার ভিত্তি যে সংগ্রাম চলছে তার প্রসারি গুরুত্ব ও প্রভাব হয় অনুধাবন করতে পারেন নয়তাে হিসেবের মধ্যে আনা হয় নি। তা ছাড়া ঔপনিবেশিক শােষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তির লক্ষ্য অর্জনের জন্যে সশস্ত্র সংগ্রাম যে চরিত্রগতভাবে প্রগতিশীল সংগ্রাম বাধ্য, বিশেষ করে বিশ শতকের শেষ পর্যায়ে বিশ্বের সমাজ চেতনার পরিমণ্ডলে অবস্থান করে, তাও হয়তাে হিসেবের বাইরে রয়ে গিয়েছে। বিশ শতকের শেষ ভাগে বর্তমান যুগের সমাজ চেতনার পরিচিত পরিমণ্ডলের মধ্যে বাংলাদেশের সর্বশ্রেণীর সমর্থনে ও সক্রিয় সহযােগিতায় যে মুক্তি সংগ্রাম চলছে সেই যুদ্ধের সফল পরিণতি কোন দিনই দেশী বাইশ পরিবার গড়ে উঠতে দেবে না। বাংলাদেশের সর্বশ্রেণীর সমন্বয়ে গঠিত মুক্তি যােদ্ধাদের রক্ত ক্ষরণের ভেতর দিয়ে যে সমাজ শক্তি ও সমাজ চেতনা দৃঢ়মূল হচ্ছে সেই শক্তিও চেতনাই তেমন ধরনের সম্ভাবনার পথ রুদ্ধ করবে। এ কথাও বুঝতে হবে যে মুক্তিযােদ্ধারা ভাড়াটিয়া সৈন্য নয়। দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষও শুধু শুধু জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়নি। এর পেছনে অবশ্যই সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির সুনিশ্চিত আশ্বাস রয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘােষণা করেন।
জয়বাংলা (১) ১: ২৩ ১৫ অক্টোবর ১৯৭১