You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ৩ এপ্রিল মঙ্গলবার, ২০শে চৈত্র, ১৩৭৯

খাদ্য সংকট প্রসঙ্গে

জাতিসংঘের ত্রাণ ও পূর্ণবাসন সংস্থার বাংলাদেশ প্রধান মিঃ উমব্রিখট তার বিদায়ের প্রাক্কালে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভাষণ দান করেছেন। ভাষণে আনরড প্রধান জোরের সঙ্গে ঘোষণা করেছেন বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা নেই। তিনি খাদ্য ঘাটতি পূরণে বাংলাদেশ সরকার সম্পূর্ণ সক্ষম বলে মন্তব্য করেছেন। এছাড়া দেশে যে বর্তমানে ছাব্বিশ লক্ষ টন খাদ্য ঘাটতি রয়েছে তা এবছরই পূরণ করা সম্ভব হবে বলে তিনি আশাবাদী। তিনি আরো বলেছেন, বাংলাদেশ অনাহারে কেউ মরেনি। মিঃ উমব্রিখট গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন যে, বাংলাদেশ সরকার কৃষি খাতকে অগ্রাধিকার দেয়ায় আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে সক্ষম হবে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যেতে পারে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ সতেরো লক্ষ টন খাদ্য সংগ্রহ করেছে এবং আরও পাঁচ লক্ষ বাহাত্তর হাজার টন খাদ্য পাওয়ার আশ্বাস লাভ করেছে। আগামী বছরের আর্থিক বাকী খাদ্য সংগৃহীত হবে বলে আশা করা যায়। আনরড প্রধান জানিয়েছেন, জাতিসংঘের এই সংস্থায় পর্যন্ত বাংলাদেশকে একশত বত্রিশ কোটি ডলার সাহায্য দান করেছে। দেশের খাদ্য সমস্যা ও পুনর্বাসন এর কাজ ত্বরান্বিত করার জন্য যে সকল দেশে সাহায্য পাওয়া গেছে তার মধ্যে প্রথমে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র ও পরে ভারতের রাজধানী সবচেয়ে বেশী। আনরড প্রধান একথা উল্লেখ করে বাংলাদেশের আনরডের ভূমিকা ব্যাখ্যা করেন।
বস্তুতঃপক্ষে বাংলাদেশের বর্তমান খাদ্য পরিস্থিতি বেশ আশঙ্কাজনক। আনরড প্রধান খাদ্যের ঘাটতি পূরণে যে আশাবাদের বক্তব্য রেখেছেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও সাধারণ মানুষের মনে এটা একটা বড় প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে। স্বাধীনতার পর বিশ্বের অনেক দেশ ও পত্র-পত্রিকা অভিমত পোষণ করেছিল যে, বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ নিশ্চিত হয়ে উঠবে এবং তা মহামারী আকার ধারণ করে বহু প্রাণহানি ঘটাবে। তৎকালে জাতিসংঘের সাহায্য পুনর্বাসন সংস্থা ছাড়াও বিশ্বের অনেক দেশ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এসেছিল। এবং বাংলাদেশের নিশ্চিত দুর্ভিক্ষ মহামারী রোগ করে দেশের উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণের সাহায্য করেছিল। দেশে এখনও প্রচুর খাদ্য ঘাটতি রয়েছে। মানুষের মনে আজ চাল, গম ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অগ্নি মূল্য নিদারুণভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে কি দেবে না এ প্রশ্ন না তুললে বরং আসল সমস্যার গভীরে আমাদের সরকারকে প্রবেশ করতে হবে। এবং সর্বশক্তি দিয়ে সমস্যার মোকাবেলা করতে হবে। দেশের সকল শ্রেণীর মানুষের ও অনুধাবন করতে হবে সমস্যার বাস্তবতা। এ ব্যাপারে তাদের ও করণীয় রয়েছে বহু। অন্যদিকে দেশের অন্যান্য মতালম্বী সংগঠনগুলোকেও খাদ্য সমস্যা সমাধানে সরকারের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে হবে। খাদ্য সমস্যার মত নিদারুণ বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করা মোটেই সমীচীন নয়। বিশ্বের সকল বন্ধুদের প্রতি আমাদের বিশ্বাস ও আস্থা রয়েছে যে, তারা মানবতার ডাকে একদিন যেমন এগিয়ে এসেছিলেন এবারও তেমনি ভাবে এগিয়ে আসবেন। আমাদের দুঃখ জয়ের সংগ্রামে তারাও আমাদের পাশে দাঁড়াবেন। সরকার এককভাবে নয় বরং ঐক্যবদ্ধভাবে খাদ্য সংকট কাটিয়ে উঠার সংগ্রামে আমাদের সকলকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।

পরীক্ষার্থীদেরও এগিয়ে আসতে হবে

গতকাল মঙ্গলবার থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ডিগ্রি পরীক্ষা শুরু হয়েছে। এ পরীক্ষা যাতে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে চলতে পারে সেজন্য পরীক্ষাকেন্দ্রে ২০০ গজ এর মধ্যে কার্ফু জারি করা হয়েছে। পরীক্ষার্থী এবং পরীক্ষা গ্রহণকারীরা ছাড়া পরীক্ষা কেন্দ্রের ২০০ গজের মধ্যে কেউ প্রবেশ করতে পারবেন না। কার্ফু জারি করে ডিগ্রি পরীক্ষা গ্রহণ কথাটা শুনতে যতই অবাক লাগুক না কেন, কেউ কেউ যতই লজ্জা বোধ করুন না কেন, তবুও এ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়েছে। অন্ততঃ এ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েছেন।
কেননা দেশ স্বাধীন হবার পর থেকে আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বত্র যে এক বেপরোয়া প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা হচ্ছে, লেখাপড়া না করে পরীক্ষা হলে গিয়ে প্রকাশ্যে বই খুলে লেখা অর্থাৎ গণটোকাটুকি অন্য কথায় নকল করার বেপরোয়া প্রবণতা তার মধ্যে অন্যতম। স্বাধীনতার পর থেকে এস, এস, সি. এইচ এস, সি-সহ বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যে ক’টি পরীক্ষায় গৃহীত হয়েছে সেসব পরীক্ষা চলাকালে প্রায় কেন্দ্রে গণটোকাটুকির খবর পাওয়া গেছে।
অনেক ক্ষেত্রে শোনা গেছে যে পরীক্ষার্থীদের এই গণটোকাটুকি থেকে নিরস্ত করতে গিয়ে প্রশিক্ষকরা পরীক্ষকরা নাজেহাল হয়েছেন। বেশী দিন আগের কথা নয়, নরসিংদীতে গতবছর একজন শিক্ষক নকল ধরার ‘অপরাধে’ প্রাণ দিয়েছেন। কিছুদিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ একটি ডিগ্রী পরীক্ষাকেন্দ্রে পরীক্ষার্থীরা নকল করার সুযোগ না পেয়ে পরীক্ষায় বয়কট করেছেন। তাঁরা কেউ কেউ নাকি সেই কলেজের অধ্যক্ষ ও একজন অধ্যাপক কে নাজেহাল করতে ছাড়েন নি।
এই যখন অবস্থা তখন কার্ফু জারি করে পরীক্ষা গ্রহণ করা ছাড়া তো আর কোন গত্যন্তর নেই।
অপরদিকে নকল প্রতিরোধের জন্য বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন ছাত্র প্রতিষ্ঠান আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নকল না করার জন্য ছাত্র সমাজ তথা পরীক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বার বার নকল করে ডিগ্রিধারী না হয়ে লেখাপড়া করে মানুষ হবার জন্য তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
কিন্তু এতো কিছু সত্বেও পরীক্ষার্থীরা কেউ কিছু বলছেন না। নকলের বিরুদ্ধে কোনো কথা শোনা যাচ্ছে না তাদের মুখ থেকে। অথচ পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ লোকের অভাব রয়েছে বা ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নের কোন আদর্শ নেই অথবা দেশকে হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করার জন্য অস্ত্র হাতে নিয়েছেন এমন কেউ নেই-কথাটা কোনোমতেই বিশ্বাস যোগ্য নয়। কিন্তু তবুও তাঁদের মধ্যে থেকে কেউ মুখ খুলছেন না। দীপ্ত কণ্ঠে বলেছেন নাঃ আমরা নকল করব না। এটা কি কম পরিতাপের।
এমনতো অবস্থায় জাতির পিতার আহ্বান বুদ্ধিজীবীসহ দেশবাসীর আবেদন, ছাত্র প্রতিষ্ঠানগুলোর আন্দোলন বা কার্ফু জারী করে পরীক্ষা গ্রহণ ইত্যাদি হয়তো সাময়িক ভাবে নকল বন্ধে প্রচেষ্টা হতে পারে-কিন্তু স্থায়ী সমাধান হবে না। অন্ততঃ যতক্ষণ পর্যন্ত না পরীক্ষার্থীরা নিজেরাই এ ব্যাপারে বলিষ্ঠ কণ্ঠে দৃঢ় পদক্ষেপে আন্তরিকতা সহকারে এগিয়ে না আসবেন।

ন’টার গাড়ি ক’টায় আসবে!

দশ বা পনেরো মিনিটে যা হতে পারতো তা হয়নি শেষ পর্যন্ত। না হওয়ার ব্যাপারটি সংঘটিত হয়েছে সচিবালয়ে। গতকাল ‘বাংলার বাণী’তে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, গত শনিবার প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সচিবালয় আগমন করে জানতে পারেন যে সচিবালয়ের লিফটটি যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য অকেজো হয়ে পড়ে আছে। সোমবারে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সাবেক মুখ্যসচিব শ্রী পি, এন, হাকসার ও বিশ্ব ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট মিঃ কারগিলের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানের কর্মসূচী নির্ধারিত থাকার ফলে অবিলম্বে লিফটটি চালু করার জন্য বঙ্গবন্ধু নিজে নির্দেশ দেন। কিন্তু সোমবারে আইনমন্ত্রী শ্রী মনোরঞ্জন ধর ও অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ সমভিব্যাহারে সচিবালয়ে আগমন করে দেখেন যে লিফটটি পূর্ববৎ অবস্থায় অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। অতঃপর পর তিনি বাধ্য হয়েই অতিথিদের সাক্ষাৎকারের স্থান পরিবর্তন করে গণভবনে তাদের সঙ্গে মিলিত হন।
ব্যাপারটা ভাববার মতই বটে। প্রধানমন্ত্রী যেখানে আদেশ দিলেন জরুরী ভিত্তিতে কাজটি করতে যেখানে শনিবার পেরিয়ে সোমবারেও তা হলো না। অথচ এ কাজ করতে সময়ের প্রয়োজন মাত্র দশ বা পনেরো মিনিটের।
এ যেন ঠিক সেই চন্দননগরের আগুন লাগার মতই অবস্থা। প্রধানমন্ত্রী হয়তো কোন আমলাকে হুকুম দিয়েছিলেন তিনি আবার হুকুম দিয়েছেন আরেকজনকে। তিনি দিয়েছেন অন্য কাউকে ফলে দশ বা পনেরো মিনিটের কাজটি আটচল্লিশ ঘন্টায়ও হয়নি।
খোদ সচিবালয়ের যদি দশ মিনিটের কাজ আটচল্লিশ ঘণ্টায়ও না হয় তাহলে সারা বাংলাদেশের অবস্থাটা কি হবে তা বেশ ভালো করেই বোঝা যাচ্ছে। অথচ এসব আমলাই দায়িত্বপূর্ণ পদে জাঁকিয়ে বসে আছেন-দেশের ভবিষ্যৎ এদেরই উপরে নির্ভরশীল।
প্রকাশ, এজন্যে নাকি চারজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী কে সাসপেন্ড করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আমরা বলতে চাই যে শুধুমাত্র সাসপেন্ড বা কর্মচ্যুতিতে এ ব্যাধি দূর হবে এমন মনে হয় না। এ এক জটিল সমস্যা, এ সমস্যার সমাধান করতে না পারলে সব সময়েই এই একই অবস্থা চলতে থাকবে। তারই ফলশ্রুতিতে ন’টার গাড়ি যে ক’টায় আসবে তা কেউ বলতে পারবে না।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!