You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২ এপ্রিল, সোমবার ১৯শে চৈত্র, ১৩৭৯

বন্ধুর মনোভাব নিয়ে সহযোগিতা

ছ’টি আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ সতেরটি দেশের প্রতিনিধিরা ঢাকায় এক বৈঠকে বসেছেন। উদ্দেশ্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করা। সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে অর্থমন্ত্রী বাংলাদেশের উন্নয়নে বৈদেশিক সাহায্যের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে বিগত প্রায় দেড় বছরে অর্থনৈতিক ক্রিয়া কর্মের একটা চিত্র তুলে ধরেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে বিভিন্নমুখী সমস্যা এবং সে সকল সমস্যা মোকাবেলায় বাংলার মানুষের অদম্য কর্মপ্রেরণা কথা উল্লেখ করে তিনি উপস্থিত প্রতিনিধিদের উন্নয়নক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামগ্রিক জনশক্তি সচেষ্ট থাকবে বলে আশ্বাস প্রদান করেন। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে তার প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন প্রায় শেষ করে এনেছে। আগামী জুলাই থেকে এর বাস্তবায়ন শুরু হবে। দেশের জনসাধারণ এই পরিকল্পনায় তাদের আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক লক্ষ্যের পৌঁছাবার বাস্তব দিকনির্দেশ পাবে বলেন মন্ত্রী মহোদয় আশা প্রকাশ করেন।
বিত্তশালী দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা সমূহের এমন বৈঠক বাংলাদেশে এই প্রথম। বৈঠকে উপস্থিত দেশসমূহ স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বাস্তব রূপ পরিদর্শন করতে পারবেন। এটাও নিশ্চয় তারা দেখতে পাবেন যে পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শক্তি কি নির্মমতার সঙ্গে একটা জাতির অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড কে একবারে পঙ্গু করে দিয়ে গেছে। তাদের সেই দস্থ্যুতার চরম শিকার বাংলাদেশ একটা শূন্যের কোঠা থেকে নিজেদের অর্থনীতিকে শুধু পুনর্গঠিত করার প্রচেষ্টায় নয় বরং এর উন্নয়নের কাজেও কি নিরলসভাবে সংগ্রাম করে চলেছে। পৃথিবীর সর্বকনিষ্ঠ এবং হয়তো সবচাইতে দরিদ্রদের বাংলাদেশ চায় বাঁচতে আত্মসমগ্র নিয়ে। সমৃদ্ধি অভিলক্ষ তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। অব্যবহৃত সম্পদ আর বিরাট জনশক্তি একটা সম্ভাবনার দীপশিখা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চাই বন্ধুপ্রতিম দেশসমূহের সহযোগিতা।
আমরা সহযোগিতা চাই পারস্পারিক স্বার্থেই। ঋণ আমাদের প্রয়োজন। কিন্তু সে সহযোগিতা, সে ঋণ কোন অবস্থায় আমাদের মর্যাদা কে আঘাত করতে যাতে কোন দিন উদ্যোগী হতে না পারে সেদিকে রয়েছে পনেরো কোটি চোখের সতর্ক দৃষ্টি। ঋণ গ্রহণ বা সহযোগিতা প্রার্থীর ব্যাপারে আমাদের দুটো দিকের প্রতি অবশ্যই নজর রাখতে হবে। প্রথমটি হলো শর্তসাপেক্ষ কোনো ঋণ আমরা গ্রহণ করব না। দ্বিতীয়টি আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে যে, আমরা একটা সমাজবাদী সমাজ গড়ে তুলতে চাই। যে ঋণ আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতির বিরোধী সে ঋণ যতই লোভনীয় হোক না কেন আমরা তা গ্রহণ করবনা। আর যে ঋণ অথবা সহযোগিতা সমাজবাদী সমাজ গঠনে এতোটুকু প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে পারে তা আমরা প্রত্যাখ্যান করবো। যারা ঢাকার সম্মেলনে বসেছেন তারা বাংলাদেশের সুস্পষ্ট বক্তব্য সম্বন্ধের নিশ্চয়ই ওয়াকেবহাল। আমরা জানি বন্ধু রাষ্ট্রসমূহ আমাদের উন্নয়নের তাদের সহযোগিতা দানে অত্যন্ত আগ্রহী। আমরা জানি গণতান্ত্রিক এবং সমাজবাদী রাষ্ট্র বাংলাদেশের বান্ধবের অভাব নেই। কিন্তু সর্তকতা একটা শব্দ যাকে কেউ কোনদিন অবহেলা করতে পারে না। বিত্তশালী দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের সম্মেলন এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রশ্নে তাদের আগ্রহ কে আমরা অভিনন্দন জানাই। আমরা আশা করি এতে করে বিশ্ব রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অধিকতর দৃঢ় হবে।

পাকিস্তানী যুদ্ধ বন্দী মুক্তির প্রশ্ন

পাকিস্তানের ব্যাপার স্যাপারই আলাদা। বাংলাদেশ প্রশ্নের প্রেসিডেন্ট ভুট্টো সাহেবের ও টালবাহানার কোন আদি অন্ত নেই। একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বর পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী ভারত বাংলাদেশ যুক্ত কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। বাংলাদেশ হয়েছে হানাদারমুক্ত-বিশ্বের মানচিত্রে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। তারপর দীর্ঘ পনেরোটি মাস কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে বিশ্বের প্রায় শতাধিক রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতির তিলক পরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, পাকিস্তান আজ অবধি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। বরং বাংলাদেশ ও ভারত বৈরীতাই পাকিস্তানের মুখ্য তৎপরতা হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘে একটি পাকিস্তানী প্রতিনিধি দল এই অশুভ তৎপরতা বেশি তোড়জোড়ের সঙ্গেই চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতি পাকিস্তানের এই বৈরী নীতির পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী পর্যবেক্ষক মিশনের একজন মুখপাত্র সম্প্রতি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন যে, পাকিস্তান যদি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয় তাহলে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের মুক্তির পরিবেশ সৃষ্টি হবে না।
এটা খুবই যুক্তিসঙ্গত বক্তব্য। কিন্তু এই সংগঠক প্রশ্নটি কি প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর পাকিস্তান বিবেচনা করে দেখেছে? পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের মুক্তির প্রশ্নটি নিয়ে পাকিস্তান যে হারে বাংলাদেশ ও ভারত বিরোধিতায় অবতীর্ণ হয়েছে, তাতে উপমহাদেশে অশান্তি আবহাওয়ায় প্রবাহিত হচ্ছে। এই উপমহাদেশে শান্তির পথ প্রশস্ত এবং উন্মুক্ত করতে হলে পাকিস্তানকে অবশ্যই বাস্তব সত্যকে সহজভাবে স্বীকার করে নিতে হবে। পাকিস্তানের হাবভাব দেখে আমাদের ধারণা হচ্ছে যে, বাস্তব সত্যের প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান সহজ-সরল পথে পা মাড়াতে রাজি নয়। পাকিস্তান যুদ্ধ বন্দীদের মুক্তি চায় এবং এই যুদ্ধবন্দীদের সম্বল করে উপমহাদেশে অশান্তির ধূম্রজাল সৃষ্টি করে রাখতে চায়। শুধু তাই নয়, যুদ্ধবন্দী মুক্তির প্রশ্নে পাকিস্তান জাতিসংঘ নানা রকম ফ্যাকরা বাধায়।
ভারত-বাংলাদেশ সংযুক্ত কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানীরা বন্দীদের মুক্তি প্রশ্নটি শুধু একটি মানবিক প্রশ্ন নয়, একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন বটে। কাজেই যুদ্ধ বন্দী মুক্তির প্রশ্নে আলাপ-আলোচনা রাজনৈতিকভাবে সমাধা করতে হবে। এ প্রশ্নে পাকিস্তান যদি আলাপ আলোচনা করতে চায় তাহলে ভারত ও বাংলাদেশের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছা দরকার। আমরা মনে করেছিলাম ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সিমলা চুক্তি এ ব্যাপারে সহায়ক হবে কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ প্রসঙ্গে বারংবার সুস্পষ্টভাবে মন্তব্য করেছেন যে, বাংলার মাটিতেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে। যুদ্ধাপরাধী এবং যুদ্ধবন্দী যেহেতু এক জিনিস নয়, সেহেতু যুদ্ধবন্দীদের মুক্তির প্রশ্নে পারস্পরিক সমঝোতা একান্ত দরকার। পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও দেবে না অথচ যুদ্ধবন্দী যুদ্ধবন্দী করে উপমহাদেশে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির উদ্ভব করবে এবং বাংলাদেশ ও ভারত বিরোধিতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখাবে, তা কোনক্রমেই মেনে নেয়া যায় না। সবার আগে স্বীকৃতি চাই, তারপর পাকিস্তানের যুদ্ধবন্দী মুক্তির প্রশ্নটিই আলোচিত হতে পারে। পাকিস্তানের ৪ লাখ নিরপরাধ বাঙালি আটকে পড়ে আছে। এবং অকথ্য নির্যাতনের মধ্যে দুঃসহ দিন কাটাচ্ছে। মানবিক প্রশ্ন পাকিস্তান কি এ ব্যাপারে টু শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করেছে? পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দী প্রশ্নে তবুও বাংলাদেশ প্রশ্নাতীত ঔদার্যের চেয়ে পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান? উপমহাদেশে শান্তির পথ বিঘ্নিত করে চলেছে অবিরত।
পরিশেষে আমরা সুস্পষ্ট রায় ঘোষণা করতে চাই যে, পাকিস্তান বাংলাদেশকে যদি স্বীকৃতি না দেয় তাহলে যুদ্ধ বন্দী মুক্তির কথাই বলুন, আর উপমহাদেশের শান্তির কথাই বলুন, সবকিছুই অসারের তর্জন-গর্জনে এ পরিণত হবে।

ডিজেল সংকট নিরসন করুন

সমস্যা আর সংকটে দেশ আজ আকন্ঠ নিমজ্জিত। ঢাকা শহর ও শহরতলীতে চলাচলকারী প্রায় দেড় হাজার বাস ও ট্রাক হাইস্পীড ডিজেলের অভাবে চলাচলে অক্ষম হয়ে পড়েছে বলে ঢাকা মোটর ভেহিকেলস গ্রুপের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানা গেছে। শহর ও শহরতলীর তৈল কোম্পানিগুলো হাইস্পীড ডিজাইন সরবরাহে অপারগতা প্রকাশ করায় নাকি এই অচলাবস্থার উদ্ভব হয়েছে। হাইস্পীড ডিজেলের অভাব তাই ঢাকা মোটর ভেহিকেলস গ্রুপকেই উদ্বিগ্ন করেনি, এ সংকট সচেতন নাগরিকদের রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছে। আজ কল কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কাল পরিবহন চলাচলে অচলাবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে, এমনিভাবে সমগ্র দেশ দিনের-পর-দিন এক অচলায়তনে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু কেন এরকম হচ্ছে, এরকম অচলাবস্থা মোকাবিলা করার জন্য কোন রকম পূর্বপ্রস্তুতি কেন নেয়া হচ্ছে না, তা কি আমাদের ভেবে দেখার অবকাশ নেই? খবরের কাগজের পাতা ওল্টালেই এরকম একটা না একটা সমস্যা সংকটের চিত্র নিত্য নিয়ত আমাদের নজরে পড়ছে।
আমরা ভেবে পাই না, বিদেশ থেকে যেসব জিনিস আমদানী করা হয় তা মওজুদ থাকতে কেন নতুন করে আমদানি করার কথা চিন্তা করা হয় না? মজুদকৃত দ্রব্যাদি ফুরিয়ে গেলে কেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিদ্রাভঙ্গ হয়? ঢাকা শহর ও শহরতলীতে যদি বাস ও ট্রাক চলাচল বন্ধ হয়ে যায় তাহলে পরিবহন ব্যবস্থা যে নিদারুণ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সময় থাকতে সচেতন হোন না কেন? এ ব্যাপারে সরকারি পর্যবেক্ষণ একান্ত দরকার। শহর ও শহরতলিতে বাস-ট্রাক চলাচল কে সুগম করার জন্য তাই আমরা জরুরী ভিত্তিতে হাইস্পীড ডিজেল আমদানির ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানাই। কারণ, অচলাবস্থা দেশ ও জাতির পক্ষে অমঙ্গলের পদধ্বনি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!