ভারতের চিঠি | দেশ বাংলা | ৪ নভেম্বর ১৯৭১
(কলিকাতা প্রতিনিধি) রুশ ভারত মৈত্রী ও সহযােগীতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর ভারতের প্রায় সব কটি রাজনৈতিক দল তাকে অভিনন্দন জানায়। ক্ষমতাসীনদের এবং রুশপন্থী ভারতীয় কমুনিষ্ট পার্টি তাে বটেই, মাকসবাদী কমুনিষ্ট পাটিসহ অন্যান্য কট্টর সরকারীবিরােধী দলগুলিও এ ব্যাপারে পিছিয়ে থাকে নি। মাকসবাদী কমুনিষ্ট পার্টির বিবৃতিতে অন্যদের মত উদাস ছিল না। তবে জনসংখ্যা স্বতন্ত্র দল ও সংগঠন কংগ্রেসের দু’একজন ছাড়া আর কাউকে প্রকাশ্য বিরােধিতা করতে দেখা যায়নি। মােটামুটিভাবে বলা যেতে পারে যে, এই রুশ-ভারত চুক্তিকে ভারতবাসীরা প্রায় সর্বসম্মতভাবেই অভিনন্দিত করেছেন। | কিন্তু তাই বলে বিষয়টির এখানেই নিস্পত্তি ঘটেনি। এখন এক সময়ে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে যখন। ভারতের বিরুদ্ধে তার প্রতিবেশী পাকিস্তান কার্যত: যুদ্ধ ঘােষণা করেছে এবং তার সীমানার মধ্যে বাংলাদেশের কমপক্ষে নব্বই লক্ষ শরণার্থী বসবাস করছে, মানবিক কারণে যাদের ভরণ পােষণ ও বাসস্থানের ব্যবস্থাও ভারতকেই করতে হচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভারত সােভিয়েত চুক্তিকে অভিনন্দন। জানাবার পশ্চাতে সম্ভবত: এই জাতীয় দুর্যোগ সম্পর্কিত উদ্বেগ বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছে। বাংলাদেশ সমস্যার সন্তোষজনক সুরাহা হােক, আপাততঃ ভারতের সর্বশ্রেণীর মানুষের সামনে এটাই সবচে বড় কথা। সে জন্য যে কোন পন্থার আশ্রয় নেওয়া হােকনা কেন জনসাধারণ তাতেই সায় দিতে প্রস্তুত। বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত প্রথম থেকেই যেভাবে বন্ধুহীন অবস্থায় বিশ্বময় ঢু মেরে আসছে, তা ভারতবাসীদের মর্ম-পীড়ার কারণ। হয়েছে। ভারত এখন বন্ধু চায় প্রকৃত বন্ধু। ভারতের মতের সাথে যার পূর্ণ ঐকমত্য থাকবে। অন্তত : বাংলাদেশ প্রশ্নে। কারণ বাংলাদেশ আজ কেবল বাংলাদেশের মানুষ কিংবা পাকিস্তানের জন্যই সমস্যা নয়, ভারতের জন্যও এটা একটা বিরাট বােঝা হয়ে দাড়িয়েছে। এ বােঝা ভারত নিজে থেকে মাথায় নেয়নি; বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ এ বােঝা নামিয়ে রাখলেও চলবে না। কারণ তাতে করে ভারত। সরকার বা ভারতবাসীদের মর্যাদবােধই শুধু ক্ষুন্ন হবে না, ভারতের রাজনীতিক্ষেত্রে আভ্যন্তরীণ ভারসাম্যেও বিরাট বাতাস দেখা দেওয়া এক রকম নিশ্চিত। কারণ নীতিগতভাবে ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানের স্থলে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বাংলাদেশের জন্য উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস ‘ভারতীয় চিন্তাভাবনার বিজয় হিসাবে চিহ্নিত হতে পারে। অন্য দিকে, শত্রুভাবাপন্ন যুদ্ধরাজ পাকিস্তানের স্থলে, দুর্বল পশ্চিম পাকিস্তান এবং মিত্র বাংলাদেশ নিয়ে উপমহাদেশে তথা ভুগােলকের এই অংশে ভারতের বহুমুখী সুবিধারও সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিরক্ষা খাতে জাতীয় অর্থনীতির রক্তক্ষরণ বন্ধ করা সম্ভব হলে ভারত তার উন্নয়ন তৎপরতা বাড়াতে সক্ষম হবে এবং বাংলাদেশের বাজারে ব্যবসায়ের বিরাট সুযােগ লাভ একরকম নিশ্চিত। আন্তর্জাতিক রাজনীতি ক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলাদেশ এবং ভারতের পারস্পরিক সৌহার্দ ভারতের মর্যাদা বাড়াবে এবং অন্ততঃ এশিয়ার বুকে প্রধান শক্তি হিসাবে ভারত তার প্রতিবেশী অন্যান্য দেশেরও আরাে ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ পাবে। দেশের আরাে ঘনিষ্ঠ হবার সুযোেগ বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারত বিরাট ঝুঁকি নিয়েছে এবং সমগ্র ভারতের, বিশেষ করে পশ্চিমবাংলা, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও আসামের অধিবাসীদের এজন্য প্রচুর দুর্ভোগ পােহাতে হচ্ছে। কেবলমাত্র এসব বৃহত্তর সম্ভাবনার কথা ভেবেই সবাই সবকিছু নির্বিবাদে মেনে নিচ্ছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কোন সমাধান’ বাংলাদেশের মানুষের নিকট গ্রহণীয় কি-না, সে প্রশ্নের চাইতে সেট, ভারতীয় জনগণের নিকট গ্রহণীয় কিনা, ভারতীয় নেতৃবৃন্দকে সেটা বিশেষ করে ভেবে দেখতে হবে। বঃ স্বাধীন বাংলাদেশ আজ কেবল বাংলাদেশের মানুষেরই নয়, ভারতেও জাতীয় আকাংখার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। | ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের এবং সাধারণ মানুষের রুশ-ভারত চুক্তিকে স্বাগত জানানাের মধ্য নিয়ে এই জাতীয় আকাংখার বাস্তবায়নে অধীর আগ্রহেরই প্রকাশ ঘটেছে। যেসব দল কট্টর রুশ বা কম্যুনিস্ট
বিরােধী সে সব দলও এটাকে ‘necessary cvil’ ধরে নিয়ে সমর্থন জানিয়েছে। সবারই আশা-আন্তজার্তিক ক্ষেত্রে ভারতের একাকীত্ব ঘুচবে। বাংলাদেশ প্রশ্নে রাশিয়ার সমর্থনে ভারতীয় নীতি কার্যকরী করা সম্ভব হবে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি ত্বরান্বিত হবে। বাংলাদেশই এখন ভারতের রাজনৈতিক মহলে রুশ-ভারত চুক্তির সাফল্যের ব্যারােমিটার। এখানকার রাজনৈতিক মহল প্রতিনিয়তই এ বিষয়ে নিজেদের চিন্তাভাবনাকে নানাভাবে তুলে ধরছেন। বাতাস যখন বাংলাদেশের অনুকূলে তখন তারা রুশ ভারত চুক্তির প্রশস্তি কীর্তন করেন। পরক্ষণেই আকাশ যদি মেঘাচ্ছন দেখা যায় তখনই তারা অভিযােগ তােলেন, ভারতের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ হয়েছে, ‘ভারত এখন নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারছে না; ‘আমরা সবই দিলাম, পেলাম না কিছুই ইত্যাদি। | কিন্তু সত্যই কতটা দেওয়া হয়েছে, আর তা থেকে কতটা কি পাওয়া যাবে, সে বিচারের সময় সম্ভবত এখনাে আসেনি। | রুশ-ভারত চুক্তি কি পণ্ডিত নেহেরুর জোট-নিরপেক্ষতার নীতি থেকে ভারতকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে। এরপরও কি ভারত নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির ধারক থাকবে?
সমালােচকরা এটাকে ‘নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির অপমৃত্যু হিসাবে উল্লেখ করলেও প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এবং অন্যান্য সরকারী মুখপাত্রগণ জোর গলায় বলেছেন যে, এতে ভারতের জোট নিরপেক্ষতার নীতিতে কোন ব্যত্যয় ঘটেনি, কারণ এটা কোন প্রকার যুদ্ধজোট নয়। নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি তিন স্তম্ভের অন্যতম যুগােশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট টিটো (অপর দু’জন পণ্ডিত নেহেরু এবং প্রেসিডেন্ট নাসেরের পরলােকগমন করেছেন) গত মাসে ভারত সফরে এসে সম্ভবতঃ এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা চেয়েছেন। কারণ দীর্ঘকাল আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জোট নিরপেক্ষ দেশ হিসাবে ভারত ও যুগােশ্লাভিয়া পাশাপাশি থেকেছে এবং ভারতের পক্ষে জোট নিরপেক্ষতার নীতি পরিহার যুগােশ্লাভিয়ার জন্য খুবই অস্বস্তিকর। প্রেসিডেন্ট টিটোর সাথে এ ব্যাপারে ভারত সরকারের ঠিক কি ধরনের আলাপ হয়েছে জানা যায়নি, কারণ ভারত যুগােশ্লাভিয়া। যুক্ত বিবৃতিতে এ সম্পর্কে কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। এ ব্যাপারে হয়তােবা ভারত সরকার প্রেসিডেন্ট টিটোকে আশ্বস্ত করতে পেরেছেন। অথবা তারা দ্বিমতের প্রশ্নে একমত’ হয়ে পারস্পরিক সৌহার্দ পূর্ববত রাখার দিকে মনােযােগী হয়েছে। শ্ৰীমতী গান্ধী বিদেশ সফরেও বিভিন্ন স্থানে এ সব প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন। সর্বত্রই তিনি বলেছেন, ভারত এখনাে জোট নিরপেক্ষই আছে। তার পিতার নীতি থেকে ভারত মােটেই বিচ্যুত হয়নি। কিন্তু একথা ঠিক যে, জোট নিরপেক্ষতার ব্যাপারে ভারতের মানুষের মাথাব্যথা এখন খুব আছে। জোট-নিরপেক্ষতা আঁকড়ে থাকার জন্য শ্রীমতী গান্ধীর উপর জনসাধারণ থেকে চাপ আসবে, তার লক্ষণ খুব কিছু নেই। বরঞ্চ অনেকেই যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। অনেকে এটাকে একাকীত্ব থেকে মুক্তি’ হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন এবং জোট নিরপেক্ষতার অন্তসার শূন্যতা নিয়ে ভারতীয় পত্রপত্রিকায় প্রচুর লেখালেখিও হয়েছে। মােট কথা ভারতের মানুষ নিষ্ক্রিয়তার বদলে সক্রিয়তা, দার্শনিকসুলভ ন্যায়নিষ্ঠার চাইতে বিষয়ী সুলভ কর্মতৎপরতার জন্য এখন বেশী উদগ্রীব। তাতে করে জোট নিরপেক্ষতার নীতি হিমাগারে রক্ষিত হলেও কারাে কিছু আপত্তি আছে বলে মনে হয় না। | কেন্দ্রের নির্দেশে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সদস্য শরণার্থী শিবিরে রেশন বিলি ব্যবস্থা নিজেদের হাতে নিয়ে নেবেন বলে স্থির করেছেন। এখন পর্যন্ত বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান সমূহ রিলিফের খাদ্য সামগ্রী বিলি করছেন। শরণার্থী ত্রান কমিশনার শ্রী বি. কে, ভট্টাচার্য্য বলেন যে, সরকার রেশন সরবরাহের ব্যাপারে “ইউনিসেফ’ কর্তৃক প্রদত্ত ট্রাক ও জীপগুলিকে কাজে লাগাবেন। এগুলাে এখন বিনা কাজে কলকাতায় পড়ে রয়েছে। এগুলিকে আগে ব্যবহার করা হয় নাই কেন মর্মে এক প্রশ্নের জবাবে শ্রী ভট্টাচার্য বলেন যে, উত্তর বঙ্গে রাস্তাঘাট এতদিন গাড়ী চলাচলের উপযােগী ছিল না। তা ছাড়া গাড়ীগুলােকে পরীক্ষা করে রেজিষ্টেশনের ব্যবস্থা করা এবং ড্রাইভার নিয়ােগ নিয়ােগ করারও কিছু সময় লেগেছে।
এদিকে পশ্চিম বঙ্গের গভর্ণর শ্রী এ, এল, ডায়াস প্রত্যেক জেলায় একজন একাউন্ট অফিসার ও দুজন একাউন্টেট সহ পাঁচ সদস্যের এক একটা দল পাঠাতে মনস্থ করেছেন। তারা জেলায় জেলায় ঘুরে শরণার্থী শিবিরের হিসাবগুলি পরীক্ষা করবেন।
দেশ বাংলা ১:২ ৪ নভেম্বর ১৯৭১