You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ১ এপ্রিল, রোববার ১৮ই চৈত্র, ১৩৭৯

আর ধর্মের নামে রাজনীতি নয়

যে চারটি মৌলিক কাঠামোর উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে সৃষ্টি-ধর্ম নিরপেক্ষতা তার মধ্যে অন্যতম। আর ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয় বাংলাদেশে বসবাসকারী মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান, জৈন বা অগ্নিউপাসক যে তিনি কোন ধর্মাবলম্বী হোন না কেন অবাধ এবং স্বাধীনভাবে তিনি তার ধর্ম-কর্ম করবেন। কেউ কোন বাধা দিতে পারবে না। বাংলাদেশের সংবিধানে একথাটি অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। বাস্তবায়িত হচ্ছে।
বাঙালি জাতি ও জাতীয়তাবাদের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বার বারই স্বার্থহীন কন্ঠে কথা বলেছেন। গত শুক্রবার ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা ময়দানে মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতি ও ইসলামী শিক্ষা সংস্কার সংস্থার জাতীয় সম্মেলন উদ্বোধন কাল বঙ্গবন্ধু একথা আবার স্বার্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন।
এ অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন ধর্মের নামে রাজনীতি করা অন্ততঃ বাংলাদেশের আর চলবে না চলতে-দেওয়া হবে না। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পক্ষ থেকে মুক্ত হয়ে সামগ্রিক ও ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের কল্যাণমুখী রাজনীতিতে সমৃদ্ধ হবে। বস্তুতঃ ধর্মভিত্তিক রাজনীতি পাকিস্তানী আমলে এদেশের সাধারণ মানুষের জন্য বয়ে এনেছিল যত প্রকারের সামাজিক অনাচার, দুর্নীতি। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির মাধ্যমে বাঙালিরা শোষিত হয়েছিল পাকিস্তানী শাষক আর তাদের পূর্বসূরী শোষকদের হাতে।
দ্বিজাতিতত্ত্বের উদ্ভট বাহানা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর অবৈধ সন্তান পাকিস্তানের। ইসলামের মৌলিক বিধান বিবর্জিত রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্ম থেকেই আজকের বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের অসারতা বুঝতে পেরেছিলেন এবং প্রতিবাদের উচ্চকিত কন্ঠে সেদিন তিনি এগিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু সেদিনের শোষকগোষ্ঠী আর তাদের পদলেহী তথাকথিত আলেম সমাজ সেদিন বঙ্গবন্ধুকে ইসলামবিরোধী বলে চিহ্নিত করে তার কন্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে চেষ্টার কসুর করেনি। কিন্তু সত্য সবসময়ই অম্লান। সত্যের জয় সুনিশ্চিত। বঙ্গবন্ধু সেদিন যে সত্যি টিকে উপলব্ধি করে তার বাস্তবায়নে এগিয়ে এসেছিলেন-তা আজ বিধাতার অন্যতম সত্য সৃষ্টি মতোই ভাস্কর ভাস্বর।
কেননা সেকালে যারা এদেশে ইসলামের নামে রাজনীতি করেছিল তারা ইসলামকে দলীয় ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করে ইসলামের চরম অবমাননা করেছিল। ধর্মকে মূলধন করে যারা রাজনৈতিক ফায়দা লুটেছিল, তারা কোনদিনই ধর্মীয় অনুশাসন কে অন্তর দিয়ে গ্রহন করেনি। তাদের ধর্মপ্রীতি ছিল নিতান্তই লোক দেখানো। তারই প্রমাণ পাকিস্তানি আমলে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলি খাঁ, গোলাম মোহাম্মদ চৌধুরী, মোহাম্মদ আলী থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে আয়ুব খাঁ, ইয়াহিয়া খাঁ আর আজকের দিনে ভুট্টোর মুখে ইসলামের বুলি। জিন্না থেকে আয়ুব পর্যন্ত পাকিস্তানী শাসকরা আজকের বাংলাদেশ এবং তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সকল রকমের শাসন নির্যাতন চালিয়েছিলেন ইসলামের নাম নিয়েই। মাওলানা মওদুদী, থানাবী আর পীর পাগারোর মত তথাকথিত জগৎ বিখ্যাত আলেম রাশি একই ইসলামের নাম নিয়েই এই নরহত্যা কে সমর্থন দিয়েছিলো। ফ,কা ফরিদ, নুরুল আমিন, সবুর মাহমুদ আলী, হামিদুল হকের মতো বাঙালি বিশ্বাসঘাতকরা ইসলামের নাম নিয়েই তাদের পাকিস্তানী প্রভুদের সকল কার্যক্রম সবসময় সমর্থন করেছিলো।
কাজেই ধর্ম নিয়ে রাজনীতি তথা ইসলামের নামে রাজনীতি করার চেয়ে মূল্য বাংলাদেশ যুগ যুগ ধরে দিয়েছে তাতে করে এই দেশে আর সেই রাজনীতি করার মত করতে দেয়ার সুযোগই বা কোথায়! তাই বাংলাদেশে এখন রাজনীতি হবে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের জন্য সাধারণ মানুষের রাজনীতি ধর্ম ভিত্তিক নয়।

বিদ্যুৎ বিভ্রাট

খুলনা, যশোর ও পাবনার কল-কারখানাগুলো মারাত্মক অচলাবস্থার সম্মুখীন হয়েছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, গোয়ালপাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে অনিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং বিদ্যুত সরবরাহের স্বল্পতার জন্য কেবলমাত্র খুলনা ও যশোরের ১৫টি মিল-কারখানা গত দু’মাসে ৮কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এবং পাবনা জেলার শিল্পকারখানাগুলো প্রতিদিন গড়ে একলাখ টাকার বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ছ’মাস আগের চিত্র আরো ভয়াবহ। জানা গেছে স্বাধীনতার পর শুধুমাত্র বিদ্যুৎ বিভ্রাটের জন্য পাবনা জেলার কল-কারখানাগুলো এ পর্যন্ত সর্বমোট ২০ কোটিরও বেশি আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গোয়ালপাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনিয়মিত ও অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য কল কারখানাগুলোতে শুধু উৎপাদন ব্যাহতই হচ্ছে না, মিল কারখানাগুলো অচিরেই বন্ধ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। গোয়ালপাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সর্বমোট ৬টি জেনারেটর রয়েছে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের অবস্থা এমন শোচনীয় যে ৩টি জেনারেটর ন্যাপথল অয়েল দিয়ে চালু রাখা সম্ভব হলেও বাকি ৩টি জেনারেটর তেলের অভাবে একবারে বন্ধ রয়েছে। আশংকার আরো কারণ এই যে গতকাল থেকে মজুদকৃত ন্যাপথাল অয়েলও নিঃশেষ হয়ে গেছে। ফলে গোয়ালপাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি আর সচল রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এই অবস্থায় খুলনা, যশোর ও পাবনার বিভিন্ন কলকারখানাগুলো যে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যাবে তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।
গোয়ালপাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৬টি জেনারেটর এর মধ্যে তিনটি চালু থাকার জন্য প্রতি শিফটে যেখানে ৮ঘণ্টা করে কাজ করা সম্ভব সেখানে গত দুমাস ধরে প্রতিদিন প্রায় মাত্র ৪ঘণ্টা করে কাজ হয়েছে কোন কোন মিলের শ্রমিক ও কর্মচারীরা অর্ধেক মজুরি পেয়েছে মাত্র। কল-কারখানাগুলো এই অচলাবস্থার মূল কারণ কি? জানা গেছে, চট্টগ্রামে ইস্টার্ণ রিফাইনারী-ই/গোয়ালপাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ন্যাপথাল অয়েল সরবরাহ করতো কিন্তু বিগত দু’মাস ধরে ইস্টার্ণ রিফাইনারী গোয়ালপাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে ন্যাপথাল অয়েল সরবরাহ করে নি। দেখা যাচ্ছে, ইস্টার্ণ রিফাইনারী ন্যাপথাল তেল সরবরাহ করতে পারছে না বলেই গোয়ালপাড়া বিদ্যুৎ তেল বন্ধ হয়ে গেছে এবং গোয়ালপাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি জেনারেটর চালু রাখতে না পারার জন্যই খুলনা-যশোর ও পাবনার কল-কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
এখন দেখছি, ইস্টার্ণ রিফাইনারী বন্ধ হয়ে যাওয়াতে দেশের কল-কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দেশের একমাত্র তেল শোধনাগার যাতে বন্ধ হয়ে না যায় সেজন্য ইস্টার্ণ রিফাইনারী কতৃপক্ষ আগে থেকে সতর্ক হন নি এবং কোনরকম কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি বলেই আজ দেশের উৎপাদন যন্ত্র গুলো বন্ধ হয়ে গেলো। আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসুত্রিতা যে দেশের কত বড় বিপর্যয় ডেকে আনে তারই উজ্জ্বল প্রমাণ ইস্টার্ণ রিফাইনারী কতৃপক্ষ আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। কলের চাকা না ঘুরলে, কারখানায় ধোয়া না উড়লে যে উৎপাদন ব্যাহত হবে, শ্রমিকদের জীবন বিষময় হবে এবং দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে, সেই সত্যিটিই কি তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটির স্মরণ রাখা উচিত ছিল না? কল কারখানা বন্ধ রাখা কোনক্রমেই দেশের মঙ্গল ডেকে আনে না। আমরা জরুরী ভিত্তিতে এই সমস্যার সমাধান হওয়া দরকার বলে মনে করি। কারণ তেল ছাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র চলবে না, বিদ্যুৎকেন্দ্র সচল না থাকলে কল-কারখানা অচল হয়ে যাবে। অতএব সমস্যার মূল ধরে টান দিতে হবে।

কি বিচিত্র এই দেশ স্যালুকাস

গতকাল বিনা নোটিশে রাজধানী সব ক’টি সিনেমা হল বন্ধ ছিল। সংবাদে প্রকাশ, পুলিশ গত বৃহস্পতিবার সিনেমার টিকিট কালোবাজারে বিক্রি করার অভিযোগে স্থানীয় ছয়টি সিনেমা হল থেকে পঁয়তাল্লিশ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার প্রতিবাদে সিনেমা হলগুলো বন্ধ থাকে।
স্বাধীন বাংলাদেশের ব্যাপার-স্যাপার ভালোই চলছে। কেননা সিনেমা হলগুলো আকস্মিকভাবে বন্ধ থাকার নেপথ্য কারণ যা জানা গেছে তাতে আমাদের ধারণা হচ্ছে সিনেমার টিকিট কালোবাজারি করার মৌলিক অধিকারটুকু দেওয়া হলেই আর এত সব ঝামেলা হোত না। সিনেমার টিকিটের কালোবাজারিদের রামধাক্কায় দর্শকদের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। ন্যায্য দামে সিনেমা হলের টিকিট পাওয়া তো একটা সাংঘাতিক ব্যাপার। রাজধানীর যে কোন সিনেমা হলে সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালেই দেখা যাবে তা ‘প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ’ সাইনবোর্ড ঝুলছে আর তারই সামনে কালোবাজারিরা এক টাকার টিকিট চার টাকায় চার টাকার টিকিট দশ টাকায় দিব্বি বিক্রি করছে। ওদের হাতে শোভা পাচ্ছে টিকিটের বান্ডিল। প্রশ্ন উঠতে পারে এত টিকিট তবে কালোবাজারিরা পায় কোথায়? উত্তর হল হলের কাউন্টারের ভিতর থেকে আসে। আর সেই কাউন্টারের নেপথ্যে রয়েছেন কর্মচারীরা। কালোবাজারি দেয় সঙ্গে যোগাযোগ থাকার ফলে পুলিশ অতর্কিত হামলা চালিয়ে কয়েকটি সিনেমা হলের কয়েকজন কর্মচারীকে গ্রেফতার করে। আর তারই পরিণতিতে সিনেমা হল বন্ধ।
সবকিছু দেখে শুনে মনে হচ্ছে বাংলাদেশের কিছু সংখ্যক মানুষ যা কিছু অন্যায় তাকেই ন্যায়সঙ্গত করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। আর তারই ফলশ্রুতিতে ছাত্ররা বলছে-নকলের অধিকার চাই। সিনেমার টিকিট কালোবাজারির হয়তো একই পথ অনুসরণ করে বলবে-সিনেমার টিকিট কালোবাজারিদের অধিকার চাই। অবশ্য ব্যাপারটা বাস্তবে কিন্তু তাই হয়েছে নয়তো সিনেমা হলগুলো বন্ধ থাকবে কেন? পরলোকগত নাট্যকার ডি. এল. রায়ের নাটকের ভাষাতেই তাই বলতে হয় বড় বিচিত্র এই দ্যাশ সেলুকাস। যে দেশের মানুষ রক্তের নদী পেরিয়ে স্বাধীনতা সূর্যকে ছিনিয়ে এনেছে সে দেশের মানুষের কি অভাবনীয় পরিবর্তন।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!