You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
১৯ই মার্চ, ১৯৭৩, সোমবার, ৫ই চৈত্র, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ

স্বাধীন ও জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি

নতুন মন্ত্রিসভায় দফতর বন্টনে গুরুত্বপূর্ণ রদবদল হয়েছে। পররাষ্ট্র দফতরের নয়া দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে জনাব কামাল হোসেনের উপরে। দফতর বন্টনের এই রদবদলে সরকারের নীতি সংক্রান্ত বিষয়ে কোন পরিবর্তন দেখা দিবে কিনা মহল বিশেষের মনে এ নিয়ে বেশ জল্পনা-কল্পনার সৃষ্টি হয়েছিলো। সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে গত শুক্রবার জনৈক সরকারী মুখপাত্র যে বক্তব্য রেখেছিলেন তাই আরো সুস্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ করেছেন আমাদের নয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ স্বাধীন ও জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতিই অনুসরণ করে যাবে। কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়, সব্বার সঙ্গে বন্ধুত্ব এই নীতি স্বাধীনতা উত্তরকাল থেকেই বাংলাদেশ অনুসরণ করে আসছে এবং ভবিষ্যতেও তাই করবে। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন যে, বাংলাদেশের এই স্বাধীন ও জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি তাকে বৃহৎ শক্তিবর্গের খেলা থেকে দূরে রাখবে এবং বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং পাকিস্তানে আটক বাঙালীদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে দ্রুত এবং দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলেও মন্ত্রীমহোদয় বক্তব্য রেখেছেন। তিনি বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি পুরোদমে চলছে। এপ্রিলের শেষ নাগাদ এই প্রস্তুতি সম্পন্ন হবে বলে জনাব কামাল হোসেন আশা প্রকাশ করেন। যে কোন মূল্যে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতেই এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অনুষ্ঠিত হবে বলে তিনি আশ্বাস প্রদান করেন। গত পরশু জনাব কামাল হোসেন বিদায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আবদুস সামাদের নিকট থেকে তাঁর নয়া দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
আমাদের এই স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির কথা পূর্বেও বলা হয়েছে নতুন মন্ত্রিসভার নয়া মন্ত্রীমহোদয় আবারও বলেছেন। পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে দিনে-রাত্রে পরিবর্তন আসতে পারে এমনটা আশা করাই নির্বুদ্ধিতার কাজ। আজকের জটিল রাজনীতির জগতে একটি দেশের পররাষ্ট্র নীতি সে দেশের স্বার্থে অনেক ভেবে চিন্তে এবং সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যকে সামনে রেখেই প্রণীত হয়ে থাকে। আমাদের দেশেও তেমনটি হয়েছে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ তাদের নীতি আদর্শের ভিত্তিতে এই স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির কথা বলে আসছেন সেই গোড়া থেকেই।
আমরা নিজেরা সরকারের এই পররাষ্ট্র নীতির প্রতি পরিপূর্ণভাবে শ্রদ্ধাবান। বিশ্বশান্তি ও জাতির অগ্রগতির স্বার্থে এই নীতি সরকারের যে প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটিয়েছে তা অভিনন্দনযোগ্য। আমরা অবশ্যই জোট নিরপেক্ষ থাকবো, কোন শক্তি বা সামরিক জোটের সঙ্গে আমরা গাটছড়া বাধতে যাবো না। কিন্তু এই নিরপেক্ষতা অর্থ অবশ্যই শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সব্বার সঙ্গে নিরপেক্ষতা নয়। স্বাধীনতা সংগ্রামের সুকঠিন দিনগুলোতে আমাদের শত্রু এবং মিত্র বেছে নিতে অসুবিধে হয়নি। মিত্রের সঙ্গে যেমন আমরা বন্ধুর হাত বাড়িয়ে দেবো তেমনি যারা এদেশের ত্রিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা ও তার স্বাধীনতা সংগ্রামকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্রে পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলো তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়তে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হবো। তাই সব্বার সঙ্গে বন্ধুত্বের আহ্বান জানাতে গিয়েও পাকিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহের বিষয়টিতে উদ্বেগ প্রকাশ না করে পারেননি আমাদের নয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তাঁকে বলতে হয়েছে এই অস্ত্র সরবরাহ উপমহাদেশে শান্তির স্বার্থহানি ঘটাবে, এতদাঞ্চলে বসবাসকারী জনসাধারণের দুর্ভোগ বেড়ে যাবে। ভবিষ্যতে তাই উপমহাদেশের শান্তিতে ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী এবং জনসাধারণের দুর্ভোগ বাড়িযে তোলার মোক্তার মহাজনদের প্রতি বন্ধুত্বের নীতি নির্ধারণে আমাদের অতি সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। গ্রহণ করতে হবে সেই মহাপ্রাচীরের ক্ষেত্রে যা জাতিংসঘে আমাদের সদস্যভুক্তির মাঝে অবস্থান করছে।

বিষদাঁত ভেঙে দিতে হবে

মানুষ খেকো বাঘ যেমন একবার রক্তের স্বাদ পেলে তা আর ভুলতে পারে না, অর্ধগৃত্বু মুনাফাখোররাও তেমনি একবার মুনাফার স্বাদ পেলে তা আর ছাড়তে চায় না। মুনাফার নেশায় মাতোয়ারা মুনাফাশিকারীদের বিরুদ্ধে বারংবার সরকারী হুঁশিয়ারী উচ্চারিত হয়েছে। মুনাফার লোভ থেকে কখনো কখনো এই সব অসৎ ব্যবসায়ীরা বিরত থাকলেও তাদের গলাকাটা নীতি ও শোষক চরিত্রের কোনই হেরফের হয়নি।
বাংলার মানুষ আশা করেছিলো যে, গত ৭ই মার্চের নির্বাচনের পর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার আওতাধীন হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য এমনই যে, নির্বাচনের অব্যবহিত পর পরই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বাড়তে শুরু করেছে। নির্বাচনের পর একটি সপ্তাহ অতিক্রম হয়ে গেছে। এই একটি সপ্তাহের মধ্যে চাল, কেরোসিন, মাছ-মাংস, তরিতরকারী ও শিশু খাদ্যের দাম আতঙ্কজনক হারে বেড়েছে। দেশের জনসাধারণ তাই স্বাভাবিক কারণেই জীবন বাঁচানোর তাগিদে অতিশয় শংকিত হয়ে উঠেছে।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, নির্বাচনের আগে যে বালাম চালের দাম ছিলো প্রতি মণ ৮৬ টাকা। বর্তমানে তা প্রতি মণ ৯৮ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। শুধু চাল নয়, চালের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে কেরোসিনের দামও প্রতি গ্যালন ৫ টাকায় উন্নীত হয়েছে। মাছ-মাংস, তেল-লবণ এবং তরিতরকারীর দামও আকাশচুম্বী। সোয়াবিন তেল প্রতি সের ৬ টাকা, গরুর মাংস প্রতি সের বর্তমানে ৮ টাকা করে বিক্রি করা হচ্ছে। তরিতরকারীর দামও তথৈবচ। শিশু খাদ্যের বাজারে আগুন জ্বলছে।
যেখানে মানুষ আশা করেছিলো যে, নির্বাচনের পর নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমবে, সেখানে নির্বাচনের পর পরই সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে। নির্বাচনের আগে পর্যন্ত অবশ্য জিনিসপত্রের দাম একটা স্থিতিশীল পর্যায়ে ছিলো। কিন্তু নির্বাচন শেষে জিনিসপত্রের দামের এই ঊর্ধ্বগতির যৌক্তিক কারণ কি?
সাধারণ মানুষ মনে করেন যে, একটি অশুভ শক্তির কলকাঠিতেই এই অবাঞ্ছিত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে কাজ করছে। নির্বাচনের পর বাংলার মানুষ একটু সুখে শান্তিতে এবং স্বাচ্ছন্দে থাকতে চেয়েছিলো। কিন্তু অতিরিক্ত মুনাফা শিকারীরা দেশের সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্তদের দৈনন্দিন জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। মওজুতদার এবং মুনাফাখোর অসৎ ব্যবসায়ীরা আজ সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। সৃষ্টি করছে জীবন-মরণ সমস্যা। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের সর্বনাশা প্রকোপ থেকে সাধারণ মানুষ আজ তাই মুক্তি চায়। মুনাফাশিকারী ‘শাইলক’ ব্যবসায়ীদের হিংস্র ছোবল থেকে দেশের মানুষকে রক্ষা করার জন্য সরকার নিশ্চয়ই এই অর্থলোভীদের বিষদাঁত ভাঙার জন্য যথোপযুক্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলেই আমাদের বিশ্বাস।

ইতিহাস কথা বলে
কম্বোডিয়ার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের উপর বোমা বর্ষণ করার দরুন মার্শাল লননল সমগ্র দেশে এ জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেছেন। নমুপেনের এক খবরের কাগজে প্রকাশ, একটি কম্বোডীয় বিমান থেকে প্রাসাদের উপর বোমা বর্ষণ করা হয়। প্রেসিডেন্ট লননল বোমার আঘাতে প্রাণ হারাননি কারণ তিনি নাকি তখন প্রাসাদে ছিলেন না। বোমা বর্ষণের পরপরই লননল তার প্রেসিডেন্সিয়াল দায়িত্ব পালন করলেন সমগ্র দেশব্যাপী জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে ও দেশের সংবিধানের ব্যক্তি স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধারক ৭, ৮ ও ৯ নং ধারা বাতিল করে দিয়ে। লননল তার সামান্য এক নির্দেশেই ব্যক্তি তথা সমগ্র জাতীয় সত্ত্বা ও বাক স্বাধীনতাকে হরণ করলেন। লননল সামরিক অধিকর্তা তাই তিনি দেশবাসীর আশা-আকাঙ্খার ধার ধারলেন না। এটাই স্বাভাবিক। কারণ যেখানেই বা যে দেশেই সামরিক নায়ক দেশের অধিকর্তা সেজেছেন সেখানেই ব্যক্তি স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা এককথায় গণতন্ত্রের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়েছে- তাদের আশা আকাঙ্খা ও স্বাধীনতা পর্যদস্ত হয়েছে।
লননল সরকার ক্ষমতার দম্ভে সামান্য ছুতো ধরে আজ সেখানকার জনগনের অধিকার হরণ করে নিতে সক্ষম হয়েছে সত্য তবে এ দম্ভ জবরদস্তি যে, কম্বেডীয় জনগনের ঐক্যজোট ও স্বাধিকার আদায়ের লড়াইয়ের কাছে পর্যদস্ত হবে জনগনের স্বাধিকার আর মুক্তির সংগ্রাম জয়যুক্ত হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। অন্ততঃ ইতিহাস তাই বলে। ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ তথা সমগ্র বিশ্বের স্বাধীনতা সংগ্রাম সেই ইঙ্গিতই বহন করে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!