You dont have javascript enabled! Please enable it!

১৮ এপ্রিল রবিবার ১৯৭১

অবরুদ্ধ ঢাকার গভর্নর লে. জেনারেল টিক্কা খান রাতে এক বেতার ভাষণে বলেন, বিচ্ছিন্নতার হাত থেকে দেশকে রক্ষা ও ভারতের দাসত্বের কবল থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে মুক্ত রাখার দায়িত্ব পালনের জন্যই সশস্ত্র বাহিনীকে ডাকা হয়েছে। যারা পাকিস্তানের শুভাকাক্ষী তাদের ভয়ের কোনাে কারণ নেই। এখন যেহেতু দুষ্কৃতকারী ও ফ্যাসিস্টদের দমন করা হয়েছে এবং শান্তি বিরাজ করছে, তাই সরকারি কর্মচারী যারা অফিসে যােগদান করতে পারেননি তাদের জাতির সেবায় আত্মনিয়ােগ করা উচিত। সামরিক বাহিনী, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও পুলিশ বিভাগের কিছু সদস্য যারা পরিবার-পরিজনের চিন্তায় অথবা কতিপয় নীতিজ্ঞানহীন ঊর্ধ্বতন কর্মচারীর দ্বারা ভুল পথে পরিচালিত হয়ে কর্মস্থল ত্যাগ করে চলে যান, তাদের আমি দুষ্কৃতকারী ও দেশের শত্রুদের ত্যাগ করে নিকটতম সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে রিপাের্ট করার উপদেশ দিচ্ছি। অন্যথায় তাদের সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হবে। সেনাবাহিনী অনুপ্রবেশকারী ও দুষ্কৃতকারীদের ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর। আমি নাগরিকদের হুশিয়ার করে দিচ্ছি। তারা যেন এদের প্রশ্রয় না দেন। অন্যথায় তারা নিজেরাই বিপদে পড়বেন। ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ এক ঘােষণায় দুষ্কৃতকারীদের (মুক্তিযােদ্ধা) কোনাে। রকম আশ্রয় না দেওয়ার জন্য নাগরিকদের প্রতি পুনরায় নির্দেশ জারি করেন।  নেজামে ইসলাম পার্টির সহ-সভাপতি সৈয়দ মাহমুদ আল মােস্তফা আল । মাদানীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল গভর্নর টিক্কা খানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তারা সরকারের সাথে পূর্ণ সহযােগিতা করবেন বলে জেনারেল টিক্কা খানকে আশ্বাস দেন। 

পাকিস্তানি বাহিনী কুমিল্লা সেক্টরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আখাউড়ায় এবং কুষ্টিয়া সেক্টরে চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরােধের মুখােমুখি হয় । চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে সারাদিন ধরে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়।  ইসলামাবাদস্থ ব্রিটিশ হাইকমিশন থেকে ঘােষণা করা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের দুঃখজনক পরিস্থিতির জন্য হাইকমিশন আগামী ২১ এপ্রিল রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের জন্ম দিবস উদ্যাপন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।  ভারতস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং বােম্বাইয়ে সাংবাদিকদের বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাপ্রবাহ আন্তর্জাতিক বিশ্বের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং একে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে গ্রহণ করা যায় না। সাবেক জাতীয় পরিষদের ডেপুটি স্পিকার এ. টি. এম. আবদুল মতিন বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য ভারত সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের মাধ্যমে যে নাশকতামূলক কাজ শুরু করেছে, সে জন্য তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের উপায় উদ্ভাবনের উদ্দেশ্যে আমি অবিলম্বে মুসলিম দেশসমূহের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলন আহ্বান করার সুপারিশ করছি। প্রাদেশিক সরকারের সাবেক মন্ত্রী নবাব খাজা হাসান আসকারীর বাসভবনে ঢাকার নেতৃস্থানীয় সরদারদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সরদারদের মধ্যে ব্যবসায়ী আবু নসর, ঢাকা হােটেলের মালিক আবদুল মাজেদ ও শিল্পপতি সিরাজুদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া মৌলবী ফরিদ আহমদ ও মওলানা নুরুজ্জামান বিশেষ নিমন্ত্রণে সভায় যােগ দেন। পাকিস্তান পিপলস পাটির ভাইস চেয়ারম্যান মিয়া মাহমুদ আলী কাসুরী লাহােরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, আওয়ামী লীগ আগেই পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য স্ট্র্যাটেজি স্থির করেছিল। শেখ মুজিবুর রহমান একতরফাভাবে স্বাধীনতা ঘােষণার উদ্দেশ্যে কাজ করছিলেন এবং এ জন্য তিনি সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, এ কথা বিশ্বাসযােগ্য নয় ঢাকায় অকস্মাৎ কিছু ঘটেছে এবং পূর্ব পাকিস্তানিরা কেন্দ্রের ক্ষমতাকে অবজ্ঞা করে শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের সার্বভৌম প্রধানরূপে প্রতিষ্ঠার জন্য রাতারাতি নিজেদের প্রস্তুত করেছে।

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ অবশ্য মূল পরিকল্পনা পরিবর্তন করে। সে পরিকল্পনা অনুযায়ী বেআইনি আওয়ামী লীগের প্রথমে পাকিস্তানের কর্তৃত্ব গ্রহণ এবং পরে পশ্চিম পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য করানাের কথা ছিল। দেশের রাজনৈতিক কার্যকলাপের প্রেক্ষিতে এ পরিকল্পনা পরিবর্তন করা হয় এবং ২৬ মার্চ শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার স্ট্যাটেজি গ্রহণ। করা হয়।  তিনি বলেন, জাতিসংঘে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে গ্রহণের জন্য আবেদন জানানাের উদ্দেশ্যে একটি খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছিল। এ  আবেদনের খসড়াটি মূলত শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ছিল, কিন্তু পরে এ আবেদন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় বসবাসকারী পূর্ব পাকিস্তানিদের নামে করা হয় এবং বেসরকারি ও ব্যক্তিগত পর্যায়ের এ আবেদনটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা সংক্রান্ত লিগ্যাল কমিটির কাছে জমা দেওয়া হয়। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ প্রধান যখন ১৫ মার্চ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলাচনা অব্যাহত রাখেন, তখন ঢাকায় পাকিস্তানের প্রতিটি প্রতীক একই সাথে ধ্বংস করা হচ্ছিল। ২৩ মার্চ পুরাে শহরে সরকারি ও বেসরকারি ভবনের শীর্ষে বাংলাদেশের পতাকা তােলা হয়। এ অবস্থা একদিনে করা সম্ভব হয়নি। ২৩ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর। কুচকাওয়াজে অভিবাদন গ্রহণ করেন এবং বাংলাদেশের সার্বভৌম শাসকরূপে নিজেকে তুলে ধরেন।  কাসুরী বলেন, তার কাছে প্রমাণ আছে, সে সময় পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে আওয়ামী লীগ প্রধানের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং তিনি নিজেই এসব নির্দেশ দেন, যার ফলে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠিত হতে পারে। কলকাতাস্থ পাকিস্তান মিশনের ডেপুটি হাইকমিশনার হােসেন আলীসহ দূতাবাসের ১১ জন বাঙালি কর্মকর্তা ও কর্মচারী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করেন। কলকাতার পাকিস্তান মিশনে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা তােলা হয়।

১৯ এপ্রিল সােমবার ১৯৭১

কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক মালিক মােহাম্মদ কাশেম গভর্নর হাউসে জেনারেল টিক্কা খানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। নেতৃবৃন্দ গভর্নরকে দলের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযােগিতার আশ্বাস দেন। পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচিতে এক সভায় বলেন, যারা পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে কাজ করছে তাদের সম্পর্কে সরকারের কাছে রিপাের্ট করুন। সঙ্কট নিরসনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার হাতকে শক্তিশালী করার কাজে আত্মনিয়ােগ করুন।  ঢাকা নগরীর বিভিন্ন মহল্লার শান্তি কমিটির লিয়াজো অফিসার বা আহ্বায়কদের নাম ঘােষণা করা হয়। শান্তি কমিটির ৫ নং এলিফ্যান্ট রােডমগবাজারস্থ কেন্দ্রীয় অফিসের সচিব হিসেবে এডভােকেট নূরুল হক মজুমদারকে নিযুক্ত করা হয়। শান্তি কমিটির লিয়াজো অফিসাররা হলেন (১) এ, আই, আহমেদ শের, আহসান মঞ্জিল, ১৭ আহসানউল্লাহ রােড; (২) সাখী সুলতান,  কসাইটোলা; (৩) আলহাজ্ব নাজির হােসেন, চেয়ারম্যান লালবাগ ইউনিয়ন, ৫৩ নং জগন্নাথ সাহা রােড; (৪) এস, এম, হাবিবুল হক, হাউস নং ৬১২, রােড নং ১৮, ধানমন্ডি; (৫) এডভােকেট নােয়ব আলী, সেন্ট্রাল রােড; (৬) আলহাজ্ব সিরাজুদ্দীন (সাবেক এমপিএ), ৯১ নং হৃষিকেশ দাস রােড; (৭) মাহতাবুদ্দীন খান, ৫৪ নং আর. কে. মিশন রােড; (৮) ফজলুল হক, ১২ নং ফরাশগঞ্জ; (৯) তমিজ উদ্দিন, ৩১ জরিয়াতলি লেন; (১০) আবদুর রশিদ, ১৬ নং রথখােলা; (১১) ইকবাল ইদ্রিস, ৭৫ ইন্দিরা রােড; (১২) মাহবুবুর রহমান গুরহা; (১৩) মােহাম্মদ নােয়াব আলী, হেডমাস্টার, আই, পি, এইচ, স্কুল, মহাখালী; (১৪) নায়েক আহমদ সিদ্দিকী, ২৬ এ/সি মিরপুর প্রথম কলােনি; (১৫) এম. এ. বাকের, ৩০/৬ মােহাম্মদপুর কলােনি; (১৬) ডা. ওসমান, মােহাম্মদপুর; (১৭) সৈয়দ মােহাম্মদ ফারুক, মােহাম্মদপুর; (১৮) এডভােকেট শফিকুর রহমান, ৬৮ ঝিকাতলা; (১৯) আবদুল রহিম চৌধুরী, হাউস নং ৭৯০, রােড নং ১৮, ধানমন্ডি; (২০) এডভােকেট আতাউল হক খান, ১৯৭ বড় মগবাজার; (২১) এডভােকেট জি, এ. খান, ২৪ দিলু রােড; (২২) অধ্যাপক এ হাসেম; (২৩) এডভােকেট জুলমত আলী খান, ১ নং পুরানা পল্টন; (২৪) ডা. মােহাম্মদ আইউব আলী, চৌধুরী পাড়া, খিলগাঁও; (২৫) এ. ওয়াদুদ মিয়া, এডভােকেট, শান্তিনগর ।  সিলেটের সালুটিকর বিমান ঘাঁটি দখল নিয়ে মুক্তিবাহিনী ও পাকসেনাদের মধ্যে দিনব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। পাক বিমানবাহিনী এ সময় সিলেটে বােমাবর্ষণ করে। দর্শনায় উভয় দলের মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ শেষে পাকসেনারা পর্যদস্ত বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালায়। | মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ১৮ দফা নির্দেশনামা জারি করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সরকারের আদেশ মেনে চলার জন্য দেশবাসীর প্রতি আবেদন জানান। নির্দেশনা কটি নিমরূপ (১) কোনাে বাঙালি কর্মচারী শত্রু পক্ষের সাথে সহযােগিতা করবেন না। প্রতিটি কর্মচারী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশ অনুসারে কাজ করবেন। শক্রকবলিত এলাকায় অবস্থা বিশেষে বিচার-বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করবেন। (২) সরকারি-আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা নিজ নিজ ক্ষমতা অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিফৌজকে সাহায্য করবেন। (৩) সকল কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য অবিলম্বে নিকটতম মুক্তিসেনা শিবিরে যােগ দেবেন। শক্রর সাথে সহযােগিতা করবেন না। (৪) বাংলাদেশ সরকার ছাড়া অন্য কারও বাংলাদেশ থেকে কর, খাজনা ও শুল্ক আদায়ের অধিকার নেই। (৫) যােগাযােগ ব্যবস্থা, বিশেষ করে নৌ চলাচল সংস্থার কর্মচারীরা কোনাে অবস্থায় শত্রুর সাথে সাহায্য করবেন না। (৬) নিজ নিজ এলাকায় খাদ্য ও নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যের চাহিদার ওপর লক্ষ্য রাখবেন। (৭) চুরি, ডাকাতি, কালােবাজারি, মজুদদারের ওপর কঠোর নজর রাখবেন । (৮) ধর্মের দোহাই দিয়ে  ও অখণ্ডতার বুলি আউড়ে এক শ্রেণীর দেশদ্রোহী মানুষকে বিভ্রান্ত করছে—এদের চিহ্নিত করে রাখুন। এদের সম্পর্কে সাবধানতা অবলম্বন করুন। তাদের মুক্তিফৌজদের হাতে অর্পণ করুন। (৯) গ্রামে গ্রামে রক্ষীবাহিনী গড়ে তুলুন এবং রক্ষীবাহিনীর স্বেচ্ছাসেবকদের মুক্তিবাহিনীর নিকটতম ক্যাম্পে পাঠানাের ব্যবস্থা। করবেন। (১০) শত্রপক্ষের গতিবিধির খবর সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে জানাবেন। (১১) মুক্তিবাহিনীর চলাচলের জন্য চাহিবামাত্র সরকারি যানবাহন হস্তান্তর করতে হবে। (১২) বাংলাদেশ সরকার বা মুক্তিবাহিনী ছাড়া জ্বালানি বিক্রি করা চলবে না। (১৩) কেউ পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অথবা তাদের এজেন্টদের সাহায্য করবেন না। যে করবে তাকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। (১৪) গুজবে কান দেবেন না। চূড়ান্ত সাফল্য সম্পর্কে নিরাশ হবেন না। (১৫) সকল সুস্থ ও সবল ব্যক্তিকে নিজ নিজ আগ্নেয়াস্ত্রসহ নিকটতম মুক্তিবাহিনী শিবিরে রিপাের্ট করতে হবে। (১৬) শত্রুবাহিনী ধরা পড়া কিংবা আত্মসমর্পণকারী সৈন্যকে মুক্তিবাহিনীর কাছে সােপর্দ করতে হবে। (১৭) পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সকল প্রকার যােগাযোেগ ও সরবরাহ ব্যবস্থা যাতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত না হতে পারে সে ব্যাপারে লক্ষ রাখতে হবে এবং (১৮) তথাকথিত পাকিস্তান বেতারের মিথ্যা প্রচারণা আদৌ বিশ্বাস করবেন না।

২০ এপ্রিল মঙ্গলবার ১৯৭

গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক লে. জেনারেল টিক্কা খান আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, এস, নজরুল ইসলাম, আবদুল মান্নান, তােফায়েল আহমদ ও দি পিপল সম্পাদক আবিদুর রহমানকে আগামী ২৬ এপ্রিল সকাল ৮টায় ঢাকার এক নম্বর সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন।  নেজামে ইসলাম পার্টির আলহাজ্ব সৈয়দ মােস্তফা আল মাদানী, হাজী আকিল সাহাব, এডভােকেট সৈয়দ আনিসুর রহমান, মওলানা আজিজুল হক ও হাফেজ আহমদ করিম ঢাকায় এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, ভারতের সহযােগিতায় সশস্ত্র হানাদারদের (মুক্তিযােদ্ধা) অনুপ্রবেশ পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের ওপর পরিষ্কার হামলাস্বরূপ। পাক সেনাবাহিনীর দুটি ব্যাটালিয়ান ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মিরেশ্বরাইয়ে মুক্তিবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। ভাের থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধে শতাধিক শক্রসেনা প্রাণ হারায়। মুক্তিবাহিনীরও প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। রাতে মুক্তিযােদ্ধারা মিরেশ্বরাই ত্যাগ করে মাস্তান নগরে প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তােলে। মধ্যরাতে পাকবাহিনী ট্যাঙ্ক নিয়ে মাস্তান নগর আক্রমণ করে। ভাের রাতে মুক্তিবাহিনী অবস্থান ত্যাগ করে হিংগুলিতে গিয়ে নতুন প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তােলে।  ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ মুক্তাঞ্চল থেকে এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন। তিনি বিবৃতিতে বাংলাদেশের একমাত্র বৈধ সাংবিধানিক সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বিশ্বের মুক্তি ও গণতন্ত্রকামী রাষ্ট্র ও জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।

২১ এপ্রিল বুধবার ১৯৭১

ঢাকায় মুসলিম লীগ নেতা খান এ. সবুর খান এক বিবৃতিতে বলেন, শত্রুর চ্যালেঞ্জ মােকাবিলা করার উদ্দেশে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে সব ধরনের সাহায্য প্রদান বর্তমানে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধুয়া তুলে পাকিস্তান সৃষ্টির আসল উদ্দেশ্যকেই ধ্বংস করতে চেয়েছিল। জনাব সবুর সামরিক কর্তৃপক্ষকে সহযােগিতা করার জন্য নিজ নিজ এলাকায় ভিজিলেন্স কমিটি গঠনের জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের (মুক্তিযােদ্ধা) সম্পর্কে সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্যও জনগণকে উপদেশ দেন। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী তনয়া বেগম আখতার সােলায়মান করাচিতে এক বিবৃতিতে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযান চালানাে ছাড়া পাকিস্তান সরকারের অন্য কোনাে উপায় ছিল না। তিনি বলেন, মার্চের প্রথম দিকে যখন ধারণা করা হচ্ছিল যে, শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘােষণা। করতে পারেন, তখন তিনি ঢাকা গিয়ে তার মরহুম পিতার দোহাই দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে এ ধরনের মারাত্মক কাজ থেকে বিরত থাকার অনুরােধে জানিয়েছিলেন। 

সাবেক প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী আলহাজ্ব মফিজ উদ্দিন আহমদ ও প্রাক্তন স্বতন্ত্র এমপিএ আবদুল মতিন ঢাকায় পৃথক বিবৃতিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।  পাকিস্তান সেনাবাহিনী হিলি ও সাতক্ষীরা সীমান্তে এবং গােয়ালন্দে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরােধ ব্যুহের ওপর আক্রমণ চালায়। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী মুক্তাঞ্চল থেকে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট, গণচীনের চেয়ারম্যান মাও সেতুং ও প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই, সােভিয়েত রাশিয়ার নেতা ব্রেজনেভ, প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন ও প্রেসিডেন্ট পদগনি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট পাম্পিডাে, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ, যুগােশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট টিটো, মিসরের প্রেসিডেন্ট আনােয়ার সাদাত, আরব লীগের মহাসচিব আবদেল খালেক।  হাসুনা ও আরব ঐক্য সংস্থার মহাসচিব দায়লাে টেলির কাছে পাঠানাে পৃথক পৃথক বার্তায় অবিলম্বে বাংলাদেশের গণহত্য বন্ধ করার লক্ষ্যে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ওপর চাপ প্রয়ােগের জন্য আবেদন জানান। তিনি বাংলাদেশে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বর্বরতা অবলােকনের জন্য নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দল পাঠানাের আবেদন জানান। তিনি বাংলাদেশের জনগণকে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের লড়াইয়ে সমর্থন ও সহযােগিতাদানের জন্যও বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতি আবেদন জানান। লন্ডনে আইরিশ শ্রমিক দলের বৈদেশিক বিষয়ক কর্মকর্তা ড. কোনার কুইজ বলেন, পূর্ববঙ্গের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তান যে ব্যবস্থা নিয়েছে তা সাম্রাজ্যবাদী ও দমনমূলক যুদ্ধের এক দৃষ্টান্ত।

সূত্র : দিনপঞ্জি একাত্তর – মাহমুদ হাসান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!