You dont have javascript enabled! Please enable it!

৪ এপ্রিল রবিবার ১৯৭১

হবিগঞ্জ মহকুমার তেলিয়াপাড়ায় বহু বাঙালি বিদ্রোহী উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসারের আগমন ঘটে। এরা হলেন, কর্নেল এম এ জি ওসমানী, লে. কেনল আবদুর রব, লে. কর্নেল সালেহউদ্দিন মােহাম্মদ রেজা, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর কাজী নূরুজ্জামান, মেজর খালেদ মােশাররফ, মেজর নূরুল ইসলাম, মেজর শাফায়াত জামিল, মেজর মঈনুল হােসেন চৌধুরী।  সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, মুক্তিযুদ্ধ একটি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে পরিচালিত হবে এবং এর দায়িত্ব দেয়া হবে একজন প্রবীণ অফিসারকে। রাজনৈতিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে রাজনীতিবিদদের একটি সরকার গঠন করার প্রস্তাব দেওয়া হবে। সভা শেষ হওয়ার সাথে সাথে এমএনএ এবং এমপিএ-দের আগরতলায় একত্রিত করার কাজে সবাই লেগে যায়। এ সভায় যুদ্ধ সম্পর্কিত এলাকার দায়িত্ব বণ্টন করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সিলেট এলাকার কমান্ড দেয়া হয় মেজর কে.এম. শফিউল্লাহকে। কুমিল্লা-নােয়াখালী এলাকার কমান্ড দেয়া হয় মেজর খালেদ মােশাররফকে। মেজর জিয়াউর রহমানের কমান্ডে আসে চট্টগ্রাম-চট্টগ্রাম পার্বত্য এলাকা এবং সবাই “মুক্তি বাহিনী” পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করে। ঢাকায় পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক পার্টি (পিডিপি) প্রধান নূরুল আমিনের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রশাসক জেনারেল টিক্কা খানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। প্রতিনিধি দলে ছিলেন-মৌলভী ফরিদ আহমদ, অধ্যাপক গােলাম আজম, খাজা খয়রুদ্দিন, শফিকুল ইসলাম ও মওলানা নূরুজ্জামান প্রমুখ। তারা জেনারেল টিক্কাকে পূর্ণ সমর্থন জানান এবং সহযােগিতার আশ্বাস দেন। এ ব্যাপারে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে নাগরিক কমিটি গঠন করার প্রস্তাব দেন। 

৫ এপ্রিল সােমবার ১৯৭১

ঢাকায় পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ ঘােষণা করেন প্রদেশের পরিস্থিতি সশস্ত্র বাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন রয়েছে। সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের (মুক্তিযােদ্ধা) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বন করা হচ্ছে। পাকিস্তান বিরােধীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ঢাকায় কারফিউর মেয়াদ ভাের ৫টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত শিথিল করা হয়। এ সময় নাগরিকরা দলে দলে নগরী ত্যাগ করে। ঢাকায় পিডিপি প্রধান নূরুল আমিন এক বেতার ভাষণে বলেন, ভারতীয় পার্লামেন্টে প্রস্তাব গৃহীত হবার পর আমাদের দেশের পূর্বাঞ্চলে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের জন্য প্রকাশ্যে উস্কানি দেওয়া হয়েছে। আমি ভারতের আক্রমণাত্মক ও যুদ্ধবাজ অভিসন্ধির তীব্র নিন্দা জানাই এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিতে চাই, পূর্ব পাকিস্তানি জনসাধারণ ভারতের এ মনােভাবকে অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখে এবং তারা তাদের দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর এ ধরনের হস্তক্ষেপ বরদাশত করতে রাজি নয়।  কাইয়ুম মুসলিম লীগের প্রাক্তন মহাসচিব খান এ সবুর ঢাকায় এক। বিবৃতিতে বলেন, শেখ মুজিবের ৬ দফা এবং তার বেআইনি ঘােষিত আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের সরলমনা জনসাধারণকে ধোঁকা দেওয়ার ছদ্মাবরণ ছাড়া আর কিছুই নয়। বাস্তবিকপক্ষে ৬ দফা ফ্যাসিস্ট পদ্ধতিতে পাকিস্তানকে খণ্ড-বিখণ্ড করার একটি অতিসূক্ষ্ম পদ্ধতি। ভারত দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগ প্রধান এবং তার দলকে অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ করে আসছিল। জেনারেল ইয়াহিয়ার সময়ােচিত হস্তক্ষেপে ভারতের বিরাট দুরভিসন্ধি ব্যর্থ হয়েছে। | তিনি বলেন, ভারত পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী প্রেরণ করছে এবং তথাকথিত বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে মদদ যােগাচ্ছে। মুজিবুর রহমানের অনুসারীদের দ্বারা কাল্পনিক প্রতিরােধের খবর প্রচার করছে। তিনি বলেন, আমি পূর্ব পাকিস্তানের দেশদরদী জনগণের প্রতি আকাশবাণী প্রচারিত মিথ্যা গুজবে কর্ণপাত না করার আহবান জানাচ্ছি। দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষের সাথে সর্বান্তকরণে সহযােগিতার আহ্বান জানাচ্ছি।
পিডিপি নেতা মৌলভী ফরিদ আহমদ ঢাকায় এক বেতার ভাষণে বলেন, জনগণের একটি অংশ যদি আইন ও শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে আর কোনাে নয়া সমস্যা সৃষ্টিতে উৎসাহিত না হতাে তাহলে শক্তি প্রয়ােগের ক্ষেত্রে যে সামান্য। পরিমাণ শক্তি প্রদর্শনের বেদনাদায়ক প্রয়ােজন হয়েছে, তার দরকার হতাে না। তিনি বলেন, গােড়ার দিকে দু-তিনদিন প্রদেশের বিভিন্ন এলাকায় কোনাে গােলযােগ দেখা দেয়নি। কিন্তু ভারতীয় বেতার থেকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ঘােষণা। করা হয়েছে এবং তথাকথিত মুক্তিবাহিনী যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে ও দেশের বহু অংশে  তারা প্রাধান্য লাভ করেছে প্রভৃতি মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে জনসাধারণকে অস্ত্র ধারণের জন্য উৎসাহ ও উস্কানি দেওয়ায় পূর্ব পাকিস্তানিদের মনে বিভ্রান্তি ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ঘৃণার মনােভাব সৃষ্টি হয়েছে।  করাচিতে পাকিস্তান পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিলার আলী ভুট্টো এক বিবৃতিতে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান গঠন করতে চেয়েছিলেন। সেজন্যই তিনি (ভুট্টো) জাতীয় পরিষদের দুটি কমিটি গঠনের সুপারিশ করেছিলেন।

৬ এপ্রিল মঙ্গলবার ১৯৭১

চট্টগ্রামের দোহাজারীতে মুক্তিবাহিনীর সাথে পাক সেনাদের প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। পাকসেনারা পিছু হটে যায়। চট্টগ্রাম জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার স্বাধীন সরকারের কর্তৃত্বে থাকে। সৈয়দপুর ও দিনাজপুর শহর ছাড়া সমগ্র উত্তরবঙ্গ মুক্তিবাহিনীর করায়ত্তে। দলে দলে তরুণরা মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে যােগ দেয়।  জেনারেল ইয়াহিয়া খান সােভিয়েত প্রেসিডেন্ট পদগনির ৩ এপ্রিলে পাঠানাে চিঠির জবাবে বলেন, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কারও হস্তক্ষেপ পাকিস্তান বরদাশত করবে না। ইয়াহিয়া বলেন, দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নিজস্ব ধারায় চলতে দেওয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে তার চেয়ে সচেতন আর কেউ নেই। ভারত পাকিস্তানের বর্তমান ঘটনায় প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপ করে কিছু লােকজনকে অনুপ্রেরণা ও সহযােগিতা দিয়ে গােলমাল সৃষ্টি করার মাধ্যমে পরিস্থিতিকে আরও উত্তেজনাপূর্ণ। করে তুলতে চাইছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ দেশকে ধ্বংস করার কোনাে ম্যান্ডেট পায়নি। অথচ তারা জাতিবিরােধী গােষ্ঠীকে উৎসাহ যােগাচ্ছেন। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্বমূলক নেতৃবর্গের সাথে তিনি আলাপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।  সিলেটের করিমগঞ্জ সীমান্তে মুক্তিবাহিনী ও পাকসেনাদের মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই শেষে পাকসেনারা পশ্চাদপসরণ করে বলে ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ পরােক্ষভাবে স্বীকার করেন।  ঢাকায় পিডিপির সহ-সভাপতি মাহমুদ আলী এক বিবৃতিতে বলেন, পাকিস্তান যখন গণতন্ত্রের নতুন যুগে প্রবেশ করতে চাইছিল ঠিক সে সময় ভারত পাকিস্তানের ওপর এক সশস্ত্র বিদ্রোহ চাপিয়ে দিয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর আমীর মওলানা আবুল আলা মওদুদী লাহােরে এক বিবৃতিতে বলেন, খােদা না করুন, ভারতের সাহায্যে পূর্ব পাকিস্তান যদি বিচ্ছিন্ন হয় তাহলে সেখানকার মুসলমানরা তাদের স্বাধীনতা হারাবে। তারা হিন্দুদের   নিমস্তরের দাস হবে এবং ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে যে দাসত্বের শিকার হয়েছিল তার সাথে যুক্ত হবে। তিনি বলেন, তথাকথিত বাংলাদেশ আন্দোলন ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য দেশের সশস্ত্র বাহিনীকে পূর্ণ সমর্থনদানে এগিয়ে আসতে আমি পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানাই।  পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী, জামায়াতে ইসলামীর প্রাদেশিক প্রধান অধ্যাপক গােলাম আজম, পীর মােহসেনউদ্দিন আহমদ (দুদু মিয়া) ও আইনজীবী এ, টি, সাদী ঢাকায় জেনারেল টিক্কা খানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তারা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতের হস্তক্ষেপের নিন্দা জানান এবং সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের (মুক্তিযােদ্ধা) দমনে সশস্ত্র বাহিনীকে সার্বিক সহযােগিতার আশ্বাস দেন। পরে এক বিবৃতিতে হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, ভারত পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়। এজন্য ভারতীয় বেতার হাজার হাজার মানুষ হত্যা ও শহর ধ্বংসের ভিত্তিহীন প্রচারণা চালাচ্ছে। ভারত এ উদ্দেশে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দিয়ে চলেছে।

৭ এপ্রিল বুধবার ১৯৭১

নয়াদিল্লিস্থ পাকিস্তান দূতাবাসের দুজন কর্মকর্তা শাহাবউদ্দিন আহমদ ও আমজাদুল হক পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে বাংলাদেশের প্রতি তাদের আনুগত্য ঘােষণা করেন। তারা হলেন বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘােষণাকারী প্রথম কূটনীতিক।  মুসলিম লীগ নেতা খান এ, সবুর ঢাকায় সামরিক আইন প্রশাসক লে, জেনারেল টিক্কা খানের সাথে সাক্ষাৎ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পূর্ণ সহযােগিতার আশ্বাস দেন।  জামায়াতে ইসলামীর প্রাদেশিক আমীর অধ্যাপক গােলাম আজম, অধ্যাপক গােলাম সারওয়ার ও মওলানা নূরুজ্জামান ঢাকায় এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, আমরা বিশ্বাস করি পূর্ব পাকিস্তানের দেশপ্রেমিক জনসাধারণ ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের (মুক্তিযােদ্ধা) যেখানেই দেখবে সেখানেই তাদের ধ্বংস সাধন করবে। পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীরা কোনাে অবস্থাতেই অনুপ্রবেশকারীদের পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব নিয়ে খেলা করতে দেবে না। আমরা সীমান্ত এলাকার স্বদেশবাসী ভাইদের প্রতি আবেদন জানাই, তারা যেন জাতীয় আজাদী সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের সব ধরনের তৎপরতা ব্যর্থ করে দেন। দুষ্কৃতকারীদের দমনে নিয়ােজিত সশস্ত্র বাহিনীকে এ ব্যাপারে সহযােগিতার জন্য আমরা সবার প্রতি অনুরােধ জানাই।
জমিয়াতে ওলামায়ে ইসলামের প্রাদেশিক সভাপতি পীর মােহসেনউদ্দিন আহমদ (দুদু মিয়া) ঢাকায় বলেন, সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের (মুক্তিযােদ্ধা) সহযােগিতার মাধ্যমে ভারত সরকার পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে চলেছেন, যা আন্তর্জাতিক রীতিনীতির খেলাফ।  মুসলিম লীগের প্রাদেশিক সাধারণ সম্পাদক এ. এন. এম. ইউসুফ ঢাকায় এক বিবৃতিতে বলেন, দুষ্কৃতকারীদের (মুক্তিযােদ্ধা) মদদ ও তথাকথিত বাংলাদেশে সরকারকে সমর্থন দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণকে বিভ্রান্ত তথা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে চলেছেন ইসলামিক রিপাবলিক পার্টির সভাপতি মওলানা নূরুজ্জামান খান ঢাকায় এক বিবৃতিতে বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী দুষ্কৃতকারীদের (মুক্তিযোেদ্ধা) দমনে নিয়ােজিত। দেশপ্রেমিক নাগরিকরা দেশরক্ষায় তাদের সমর্থন ও সহযােগিতা করুন।

৮ এপ্রিল বৃহস্পতিবার ১৯৭১

ত্রিপুরায় বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ৯টি শিবির খোলা হয়। ঢাকায় জাতীয় পরিষদের সাবেক ডেপুটি স্পিকার এ. টি. এম, আবদুল মতিন এক বিবৃতিতে বলেন, পাকিস্তানের ঘরােয়া বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপ প্রতিরােধ করতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কসুর করবে না। প্রদেশের বর্তমান গােলযােগের জন্য ভারতই দায়ী। জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহী জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের কাছে পাঠানাে এক নােটে বলেন, ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে। ভারত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রত্যক্ষ মদদ যােগাচ্ছে। ভারতীয় পার্লামেন্টে পূর্ববঙ্গের জন্য সর্বান্তকরণে সমর্থন জানিয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান একটি ব্যাপক রাজনৈতিক সমঝােতায় আসার বার বার চেষ্টা করার পর আলােচনার শেষ পর্যায়ে তার আর কোনাে সন্দেহ ছিল না, কতিপয় ব্যক্তির দেশকে বস্তুত বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্য রয়েছে। অতঃপর দেশকে বিচ্ছিন্নতার হাত থেকে বাঁচানাের জন্য সরকারের কঠোর ব্যবস্থাবলম্বন করা ছাড়া আর কোনাে উপায় ছিল না। ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ ঘােষণা করেন, পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র বাহিনী যে তৎপরতা চালাচ্ছে বিমানবাহিনী তাতে সাহায্য করছে। দুষ্কৃতকারীরা (মুক্তিবাহিনী) পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণভাবে যানবাহন চলাচলে অন্তরায় সৃষ্টির জন্য রাস্তায় যে প্রতিবন্ধক তৈরি করেছে বিমানবাহিনী সেসব ধ্বংস করছে। বিমানবাহিনী সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের আস্তানায় ও যানবাহনের ওপর আঘাত হানছে।
কৃষক শ্রমিক পার্টির সভাপতি এ. এস, এম, সােলায়মান ঢাকায় এক বিবৃতিতে বলেন, কালবিলম্ব না করে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে সমাজ ও রাষ্ট্রবিরােধীদের প্রতিরােধ করে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি শামসুল হুদা ঢাকায় বিবৃতিতে বলেন, তথাকথিত স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলন প্রসঙ্গে ভারতের মিথ্যা ও কল্পিত প্রচারণা যুদ্ধকালীন নাৎসি প্রচারণাকে শুধু হার মানায়নি বরং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তা মিথ্যা প্রচারের এক নয়া নজির স্থাপন করেছে।  প্রাদেশিক ইত্তেহাদুল উলেমার সাধারণ সম্পাদক মওলানা মিয়া মফিজুল হক ঢাকায় এক বিবৃতিতে বলেন, ভারত সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে বিপথে পরিচালিত করছে। যারা ভারতের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী হয়ে ভারতীয়দের সাহায্য লাভের আশায় আছেন তারা বােকার স্বর্গে বাস করছেন।

৯ এপ্রিল শুক্রবার ১৯৭১

ইসলামিক রিপাবলিক পার্টির সভাপতি মওলানা নূরুজ্জামান ঢাকায় ঘরে ঘরে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের জন্য প্রদেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।  সামরিক কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করেন বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে রাষ্ট্রদ্রোহী ও সমাজবিরােধীদের (মুক্তিবাহিনী) বিতাড়িত করা হয়েছে। ফজলুল কাদের চৌধুরী, মৌলবী ফরিদ আহমদসহ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা চট্টগ্রামের সামরিক কর্তৃপক্ষের সাথে দেখা করে পূর্ণ সহযােগিতার আশ্বাস দেন। ইসলামাবাদে ঘােষণা করা হয় শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সহচররা যে একটি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পূর্ব প্রস্তুতি নিয়েছিলেন নির্ভরযােগ্যসূত্রে সে সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সন্দেহজনক লােকজনের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত এক নতুন সামরিক বিধি জারি করেন।  ঢাকায় লে. জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে শপথ। নেন। শপথ পরিচালনা করেন ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি, এ, সিদ্দিকী। ঢাকা জেলা বারের ৫১ জন আইনজীবী এক যুক্ত বিবৃতিতে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতের নগ্ন হস্তক্ষেপের নিন্দা করে সম্ভাব্য সকল উপায়ে অনুপ্রবেশকারীদের (মুক্তিযােদ্ধা) প্রতিহত করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন আবদুল মতিন, মােহাম্মদ ইদরিস, সৈয়দ আলতাফ হােসেন, জালালউদ্দিন আহমদ, কে, এ. এম. তৌফিকুল ইসলাম,  ফকরুদ্দিন আহমদ, এম, ইকবাল আহমদ, সৈয়দ শহীদুল হক, কলিমউদ্দিন আহমদ, সিরাজুল ইসলাম, এ. কিউ, এন, শফিকুল ইসলাম ও মেসবাহউদ্দিন প্রমুখ ।  খেলাফত রব্বানী পার্টির চেয়ারম্যান এ. এস, এম, মােফাখখার, প্রাদেশিক মুসলিম লীগের (কাইয়ুম গ্রুপ) যুগ্ম সম্পাদক মাহবুবুল হক দোলন ও পাকিস্তান পার্টির আহ্বায়ক মােহাম্মদ আলী সরকার পৃথক বিবৃতিতে বলেন, সীমান্তের ওপার থেকে সশস্ত্র ব্যক্তিদের অনুপ্রবেশ মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। পাকিস্তানকে খণ্ডিত করার প্রচেষ্টায় জনগণের কোনাে সাড়া পাওয়া যাবে না। পাকিস্তান মুসলিম লীগের (কাইয়ুম) প্রধান সংগঠক কাজী আবদুল কাদের এক বিবৃতিতে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে অরাজকতার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানই দায়ী।
তিনি গােটা পরিস্থিতিকে সঠিকভাবে পরিচালিত না করার জন্যই পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রতিক সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে। তার রাজনীতি কেবল পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি ঘৃণার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। শেখ মুজিবুর রহমান গােটা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার সুবর্ণ সুযােগ পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ভারতের পক্ষে কাজ করছিলেন এবং ভারতের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন বলেই তার রাজনীতি পূর্ব পাকিস্তানে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। কাজী কাদের বলেন, কোনাে দেশপ্রেমিক পূর্ব পাকিস্তানি দেশ ভাঙার স্বপ্ন দেখছে না। রাষ্ট্রবিরােধীদের বিরুদ্ধে। সেনাবাহিনী যে ব্যবস্থা নিয়েছে আমি তার সমর্থন জানাই। আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে ধন্যবাদ জানাই এ জন্য যে, তিনি আওয়ামী লীগ নেতাদের ষড়যন্ত্র অঙ্কুরেই বিনাশ করে তার রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন। | বেনাপােল সীমান্তে মুক্তিবাহিনী ও পাকসেনাদের মধ্যে সারাদিন ধরে সংঘর্ষ চলে।  ঢাকায় খাজা খয়েরউদ্দিনকে আহ্বায়ক করে ১৪০ সদস্যের নাগরিক শান্তি কমিটির গঠন করা হয়। শান্তি কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্যরা হচ্ছেন : এ, কিউ, এম, শফিউল ইসলাম, অধ্যাপক গােলাম আজম, মওলানা সৈয়দ মােহাম্মদ মাসুম, আবদুল জব্বার খদ্দর, মাহমদু আলী, এম. এ. কে. রফিকুল হােসেন, ইউসুফ আলী চৌধুরী, আবুল কাসেম, মৌলবী ফরিদ আহমদ, অধ্যাপক গােলাম সারওয়ার, সৈয়দ আজিজুল হক (নান্না মিয়া), এ. এস, এম, সােলায়মান, পীর মােহসেন উদ্দিন আহমদ (দুদু মিয়া), এডভােকেট শফিকুর রহমান, মেজর (অব.) মুহঃ আফসার উদ্দিন, সৈয়দ মহসিন আলী, এডভােকেট ফজলুল হক চৌধুরী, আলহাজ্ব সিরাজউদ্দিন, এডভােকেট এ. টি. সাদী, এডভােকেট আতাউল হক খান, মকবুলুর রহমান, আলহাজ্ব মােঃ আকিল, অধ্যক্ষ রুহুল কুদুস, নূরুজ্জামান (ইয়ং পাকিস্তান সম্পাদক), মওলানা মিয়া মফিজুল হক, এডভােকেট আবু সালেক ও এডভােকেট আবদুল নায়েম প্রমুখ। ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকাস্থ ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশন থেকে বেতার ট্রান্সমিটার অপসারণের নির্দেশ দেন।  

সূত্র : দিনপঞ্জি একাত্তর – মাহমুদ হাসান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!