You dont have javascript enabled! Please enable it!

২৮ মার্চ রবিবার ১৯৭১

পাকিস্তানি নৌবাহিনী বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় গােলাবর্ষণ করে। শুভপুর ব্রিজে পাক বাহিনী ও মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে সারাদিন ধরে যুদ্ধ চলে। যুদ্ধে পাকিস্তানিরা বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। নৌবন্দর এলাকায় পাক নৌবাহিনী। বাঙালি নৌ-সেনাদের নিরস্ত্র করে হত্যা করে। পাক বাহিনী ঢাকার আশপাশে অপারেশন চালায়। ঢাকার ওপারে জিঞ্জিরা দখল নিয়ে পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের গােলাগুলি বিনিময় হয়। যশাের, দিনাজপুর, কুষ্টিয়ায় দখল প্রতিষ্ঠা নিয়ে দুদলের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ হয়। দেশের তিন-চতুর্থাংশ এলাকা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। রাতে চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের জন্য পুনরায় বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানানাে হয় । ঢাকায় কারফিউ সকাল সাতটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত শিথিল করা হয়। পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি খান আবদুল কাইয়ুম খান পেশােয়ারে বলেন, আওয়ামী লীগের ছয়দফা ছিল বিচ্ছিন্নতাবাদের কর্মসূচি এবং একটি সুস্পষ্ট দেশদ্রোহী কার্যকলাপ । তিনি বলেন, সম্প্রতি ঢাকা সফরকালে আমরা যা দেখেছি তা হলাে উন্মুক্ত বিদ্রোহ। এ প্রেক্ষিতে সামরিক বাহিনীর গৃহীত ব্যবস্থা অত্যন্ত সঠিক ও সময়ােপযােগী এবং ন্যায়সঙ্গত পদক্ষেপ। 

২৯ মার্চ মােমবার ১৯৭১

বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা থেকে করাচি নিয়ে যাওয়া হয়। সন্ধ্যায় সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে বঙ্গবন্ধুকে সেনানিবাস থেকে তেজগাঁও বিমানবন্দরে নিয়ে আসা হয় এবং রাতে সামরিক বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানযােগে তাঁকে করাচি নিয়ে যাওয়া হয় ।

৩০ মার্চ মঙ্গলবার ১৯৭১

সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও সাহায্যদানের জন্য বিশ্বের গণতান্ত্রিক সরকার ও জনগণের প্রতি আবেদন জানানাে হয়। রাতে পাকিস্তান বিমান বাহিনী কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের ওপর বােমাবর্ষণ করে। চট্টগ্রাম শহরকে শত্রু সেনারা ঘেরাও করে বােমাবর্ষণ শুরু করে। সারারাত নগরীর আশপাশে ছত্রীসেনা। নামানাে হয়। ভোের পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী বীর বিক্রমে বীর চট্টলা রক্ষা করে।

৩১ মার্চ বুধবার ১৯৭১

চট্টগ্রাম নগরীর পতন হয়। মুক্তিবাহিনী গভীর অরণ্যে আশ্রয় নেয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে এক কিলােওয়াটের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপন করা হয় । পাকিস্তান সেনাবাহিনী দেশের অধিকাংশ সেনা ছাউনির নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করে।  মুক্তিবাহিনী দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সরে গিয়ে সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলােতে সমবেত ও সংগঠিত হতে থাকে। তবে অধিকাংশ জেলা ও মহকুমা শহর থাকে মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। এক লাখেরও বেশি মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। নয়াদিল্লিতে ভারতীয় পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের। জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রতি তার নিজের, ভারতীয় জনগণ ও সরকারের পক্ষ থেকে একাত্মতা ও সংহতি ঘােষণা করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা প্রসঙ্গে লােকসভায় আনীত এক প্রস্তাবের ওপর পাঁচ দিনব্যাপী আলােচনা শেষে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী তার বিবৃতিতে বলেন, পূর্ববঙ্গের সমগ্র জনগণের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে সর্বাত্মক আক্রমণ চালিয়েছে তাতে ভারতীয় পার্লামেন্ট উদ্বেগ প্রকাশ করছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী বেয়নেট, মেশিনগান, ট্যাঙ্ক, গােলান্দাজ নিয়ে যেভাবে পূর্ববঙ্গের নাগরিকদের ওপর নগ্ন হামলা চালিয়েছে, তাতে তারা (বাঙালিরা) ভীতসন্ত্রস্ত ও অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে।  শ্রীমতী গান্ধী বলেন, আমাদের ভূখণ্ডের একেবারে সন্নিকটে নিরস্ত্র ও নিরপরাধ মানুষের ওপর যে নজিরবিহীন নির্যাতন চালানাে হচ্ছে আমাদের জনগণ তার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন না করে পারে না। ভারত যেহেতু শান্তি বজায় ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখার বিষয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ সেহেতু আমরা অবিলম্বে পূর্ববঙ্গের অসহায় জনগণের ওপর হত্যাযজ্ঞ ও শক্তি প্রয়ােগ বন্ধের দাবি জানাচ্ছি। আমরা পূর্ববঙ্গে গণহত্যা বন্ধ করার জন্য পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে। জরুরি ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সারা বিশ্বের জনগণ ও সরকারসমূহের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।  তিনি বলেন, পূর্ববঙ্গের সাড়ে সাত কোটি জনগণের এই ঐতিহাসিক গণসংগ্রামের অনিবার্য বিজয়ের প্রতি ভারতীয় সংসদ দৃঢ় আস্থা জ্ঞাপন করছে এবং ঘােষণা করছে, পূর্ববঙ্গের জনগণের এই মহান সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের প্রতি ভারতের জনগণের সমর্থন ও সহৃদয় সহানুভূতি অব্যাহত থাকবে।  

সূত্র : দিনপঞ্জি একাত্তর – মাহমুদ হাসান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!