You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.19 | ১৯ মার্চ শুক্রবার ১৯৭১ দিনপঞ্জি - সংগ্রামের নোটবুক

১৯ মার্চ শুক্রবার ১৯৭১

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে অসহযােগ আন্দোলনের অষ্টাদশ দিবস। ঢাকার অদূরে জয়দেবপুরে জনতা ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে কমপক্ষে ৫০ জন স্বাধীনতা সংগ্রামী নিহত ও দুশতাধিক আহত হন। সন্ধ্যায় জয়দেবপুর শহরে অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। জয়দেবপুর রাজবাড়ীতে অবস্থানরত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি জওয়ানদের সেনানিবাসে ফিরিয়ে নেওয়ার পূর্ব চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে সামরিক কর্তৃপক্ষ সকালে বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করার উদ্দেশ্যে জনৈক পাঞ্জাবি ব্রিগেডিয়ারের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি দলকে ঢাকা থেকে জয়দেবপুরে পাঠান। সকাল এগারােটার দিকে সেনাবাহিনীর দলটি জয়দেবপুর বাজারে পৌঁছেই স্থানীয় লােকজনের ওপর চড়াও হয়। এরপর তারা জয়দেবপুর চৌরাস্তায় নিরস্ত্র ও নিরপরাধ লােকজনের ওপর হামলা চালায়। সকাল থেকেই বেসামরিক লােকজন জয়দেবপুর চৌরাস্তার ওপর ব্যারিকেড রচনা করেছিলেন। ঢাকা থেকে আসা সেনাবাহিনী চৌরাস্তায় জনসাধারণকে ব্যারিকেড ভাঙার নির্দেশ দিলে জনগণ তা প্রত্যাখ্যান করায় তাদের ওপর হামলা চালানাে হয়। নিরস্ত্র জনতা সেনাবাহিনীর।  হামলা প্রতিরােধ করার চেষ্টা করলে তাদের ওপর নির্বিচার গুলিবর্ষণ শুরু হয়। সেনাবাহিনীর গুলিতে এখানে বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী হতাহত হয়। সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের খবর ছড়িয়ে পড়লে সারা শহর উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে দলে লােকজন তীর-ধনুক, বল্লম-টোটা, দা-কুড়াল, বন্দুক প্রভৃতি নিয়ে শহরের দিকে ছুটে আসে। পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যাতে জয়দেবপুর রাজবাড়ীতে অবস্থানরত বাঙালি সৈনিকদের নিরস্ত্র করতে এবং সমরাস্ত্র কারখানা দখল করে সেখান থেকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঢাকা যেতে না পারে সে জন্য জনতা স্থানে স্থানে অসংখ্য ব্যারিকেড গড়ে তােলে। সৈন্যদের প্রতিরােধের জন্য জয়দেবপুর রেলগেটের ওপর রেলবগি ও অন্যান্য ভারী জিনিস দিয়ে সুদৃঢ় ব্যারিকেড তৈরি করা হয়। 

দুপুর আড়াইটার দিকে রেলগেটের ওপর জনতা ও সেনাবাহিনী মুখােমুখি হয়। এ সময় শত শত লােক সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে বিক্ষোভ প্রদর্শন করার সময় সৈন্যরা কোনাে হুঁশিয়ারি ছাড়াই জনতার ওপর ফের গুলিবর্ষণ শুরু করে। এখানে জনতার পক্ষ থেকে সৈন্যদের প্রতি পাল্টা গুলিবর্ষণ করা হলে উভয় পক্ষে বন্দুকযুদ্ধ শুরু হয়। পরে এই সংঘর্ষ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। রাজবাড়ী এলাকায় বাঙালি ও পাকিস্তানি সৈন্যদের মধ্যে এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে গুলি বিনিময় হয়। পরে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দলটি ঢাকা ফিরে যাবার সময় চৌরাস্তায় জনতা তাদের বাধা দিলে এখানে তুমুল সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় সৈন্যরা আশপাশের গ্রামবাসীর ওপরও হামলা চালায়। তারা নারী ও শিশুদের ওপর নির্যাতন চালায়। সৈন্যরা ঢাকায় ফেরার পথে টঙ্গীর বাের্ডবাজারে জনতার প্রতিরােধের মুখােমুখি হয়। এখানে তারা নিরস্ত্র জনতার ওপর বেয়নেট চার্জ করে। সন্ধ্যায় সেনাবাহিনী জয়দেবপুরে সান্ধ্য আইন জারি করে তাদের খােয়া যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র অনুসন্ধানের নামে নিরীহ ও নিরপরাধ লােকজনের ওপর পাশবিক অত্যাচার চালায়। বহু লােককে অজ্ঞাতস্থানে ধরে নিয়ে যায় ।  জয়দেবপুরে নিরস্ত্র নাগরিকদের ওপর সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা জানিয়ে সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, যারা বুলেট বা শক্তি দিয়ে গণআন্দোলন স্তব্ধ করবেন বলে ভেবেছেন তারা বােকার স্বর্গে বাস করছেন। বাংলাদেশের মানুষ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়। কিন্তু এর অর্থ এই নয়, তারা শক্তি প্রয়ােগকে ভয় পায়। নিজ বাসভবনে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের বলেন, জয়দেবপুরে গুলিবর্ষণের ঘটনা উস্কানিমূলক। সামরিক বাহিনী ঘােষণা করেছে, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফেরত নেওয়া হয়েছে। যদি তাই সত্যি হয়, তাহলে কিভাবে সেনাবাহিনীর লােকেরা জয়দেবপুরে নিরস্ত্র নাগরিকদের ওপর গুলি চালাল? প্রেসিডেন্ট ও সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে আমি এ প্রশ্নের জবাব চাই।  

বঙ্গবন্ধু আরও ঘােষণা করেন, পরিণতি যাই হােক না কেন জনগণের সংগ্রাম চলবেই। বাঙালিরা রক্ত দিতে, প্রাণ দিতে শিখেছে, তাদের দাবায়ে রাখার সাধ্য আর কারও নেই। এর আগে রাজধানীতে জয়দেবপুরে সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের খবর এসে পৌছলে নগরবাসী বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এসে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। লাঠি-সােটা, বর্শা-বল্লম নিয়ে শােভাযাত্রা বের করা হয়। বিকেলে বিক্ষুব্ধ মিছিলকারীরা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে সমবেত হলে সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা করে বঙ্গবন্ধু বলেন, যত শক্তিই প্রয়ােগ করা হােক, সাত কোটি বাঙালির দাবি নস্যাৎ করা যাবে না । প্রত্যয়দৃপ্ত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু জনতার উদ্দেশে বলেন, আপনাদের স্বাধীকার অর্জনের জন্য কোনাে ত্যাগকেই অসাধ্য বলে বিবেচনা করা হবে না। বাঙালি জাতির নেতা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উদ্দেশে বলেন, তােমরা আর কত রক্ত চাও? বাঙালির আর কত রক্ত পান করলে তােমাদের তৃষ্ণা মিটবে? তােমরা আর অস্ত্রের জোরে বাঙালিদের শাসন করতে চেও না। শক্তি প্রয়ােগ করে। আর বাঙালি জাতিকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যার সমাধান চাই। একদিন বিরতির পর সকালে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যে তৃতীয় দফা আলােচনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় । প্রেসিডেন্ট ভবনে দেড় ঘণ্টা স্থায়ী এই আলােচনা অনুষ্ঠানে তৃতীয় কেউ উপস্থিত ছিলেন না। প্রেসিডেন্ট ভবনে যাওয়া-আসার পথে রাস্তার দুধারে অপেক্ষমাণ জনতা ও পথচারী তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে ‘জয়বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনি দিয়ে স্বাগত জানায়। বৈঠক শেষে নিজ বাসভবনে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বঙ্গবন্ধু বলেন, আগামীকাল সকালে আবার বৈঠক শুরু হবে। এ বৈঠকে দলের শীর্ষ নেতারা আমার সঙ্গে থাকবেন। তার আগে, আজ সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে আমার দলের ও প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টারা আলােচনায় মিলিত। হবেন।  সাংবাদিক সাক্ষাৎকারের সময় আগামীকালের উপদেষ্টা পর্যায়ের বৈঠক আজকের আলােচনার অগ্রগতির ইঙ্গিতবহ কি না প্রশ্ন করা হলে জবাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, এ ব্যাপারে আপনাদের খুশিমতাে যা কিছু মনে করতে পারেন। দেশ ও বিশ্ববাসীর কাছে আমার ভূমিকা অত্যন্ত সুস্পষ্ট। বৈঠক চূড়ান্তের পথে কি না জানতে চাওয়া হলে বঙ্গবন্ধু বলেন, চূড়ান্ত কি না জানি না। তবে সমস্যার সমাধান যেমন সহজসাধ্য নয়, তেমনি সময় সাপেক্ষও বটে। 

আলােচনার ধারা সম্পর্কে আওয়ামী লীগ প্রধান আশাবাদী কি না প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমরা সবসময়ই ভালােটা আশা করি। তবে সবচেয়ে খারাপ কোনাে কিছুর জন্যও আমরা সবসময় তৈরি থাকি।  বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সঙ্গে শাসনতান্ত্রিক সংকট সমাধানের ব্যাপারে আলােচনা-বৈঠকে মিলিত হবেন কি না জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, যিনিই আমার সঙ্গে আলােচনা করতে চান আমি তাকেই স্বাগত জানাবাে। সবার জন্যই আমার দুয়ার খােলা। জনগণের নেতা আরও বলেন, আপনারা নিশ্চয় লক্ষ করেছেন, পথের মানুষও যখন খুশি আমার বাসভবনে এসে আমার সঙ্গে দেখা করতে পারে, তার কথা। আমাকে জানাতে পারে এবং আমি তাদের প্রতিটি কথাই মনােযােগ দিয়ে শােনার চেষ্টা করি। এ সময় জনৈক বিদেশি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন—আমরা দেখছি, আপনি সবসময় জনসাধারণকে ‘জয় বাংলা’ বলে সম্ভাষণ জানান। এই ধ্বনির মধ্যে বাংলার বিজয়ের কোনাে সংকেত আছে কি? জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমি মুসলমান। সকালে ঘুম থেকে উঠে আল্লাহকে স্মরণ করার পরই আমি ‘জয় বাংলা’ বলি। মৃত্যুর সময় আমি আল্লাহর নাম নিয়ে ‘জয় বাংলা’ বলে ইহধাম থেকে বিদায় নিতে চাই।

রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি ভবন ও বাসভবনে কালাে পতাকা উত্তোলন করা হয়। সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে। কর্মবিরতি চলে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। সারা বাংলায় স্বাধীনতার দাবিতে সভা-শােভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্রছাত্রী ও তরুণ-তরুণীদের কুচকাওয়াজ ও অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণ চলে। বায়তুল মােকাররম মসজিদসহ সারা দেশের মসজিদে বাদ জুম্মা শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ মােনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে উপদেষ্টা পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় । এই বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও ড. কামাল হােসেন এবং সরকারের পক্ষে বিচারপতি এ, আর, কর্নেলিয়াস, লে. জেনারেল পীরজাদা ও কর্নেল হাসান অংশ নেন। আলােচনা দুঘণ্টা স্থায়ী হয়। সন্ধ্যায় চট্টগ্রামে ন্যাপ প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া অহেতুক ঢাকায় এসে সময় নষ্ট করছেন। ইয়াহিয়া খানের বােঝা উচিত শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা অর্পণ ছাড়া। পাকিস্তানকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। জেনারেল ইয়াহিয়ার মনে রাখা উচিত যে, তিনি জনগণের প্রতিনিধি নন।

সুতরাং জনগণের ওপর কর্তৃত্ব করার কোনাে অধিকার তার নেই। প্রবীণ সংগ্রামী নেতা মাওলানা ভাসানী জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে শেখ মুজিবুর রহমানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন  করতে দেওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, এ প্রস্তাব যদি অগ্রাহ্য করা হয় তাহলে বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান নতুন সরকার গঠনের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করবেন। | বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় পশ্চিম পাকিস্তানি নেতা করাচি থেকে ঢাকায় আসেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মিয়া মােমতাজ মােহাম্মদ দৌলতানা, মুসলিম লীগ নেতা সর্দার শওকত হায়াত খান ও জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মওলানা মুফতি মাহমুদ। করাচিতে জাতীয় পরিষদের স্বতন্ত্র দলীয় সদস্যসহ সংখ্যালঘু দলসমূহের পার্লামেন্টারি পার্টির নেতারা এক বৈঠকে মিলিত হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে একটি ভুট্টোবিরােধী যুক্তফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচিতে পশ্চিম পাকিস্তানে একটি গণআন্দোলন শুরুর লক্ষ্যে তার দলের প্রস্তুতি গ্রহণের কথা ঘােষণা করেন। সাংবাদিক সম্মেলনে জনাব ভুট্টো বলেন, ক্ষমতার ব্যাপারে পিপলস পার্টিকে হিস্যা থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র করা হলে আমি চুপ করে বসে থাকব না। পিপলস পার্টি প্রধান সাংবাদিকদের বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের লােকদের শক্তি দেখেছেন। এবার আপনারা পশ্চিম পাকিস্তানিদের শক্তি দেখতে পাবেন।

সূত্র : দিনপঞ্জি একাত্তর – মাহমুদ হাসান