You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.18 | ১৮ মার্চ বৃহস্পতিবার ১৯৭১ দিনপঞ্জি - সংগ্রামের নোটবুক

১৮ মার্চ বৃহস্পতিবার ১৯৭১

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে চলমান অহিংস অসহযােগ আন্দোলনের সপ্তদশ দিবস। সরকারি-বেসরকারি ভবনের শীর্ষে কালাে পতাকা উড়িয়ে, অফিস আদালতে অনুপস্থিত থেকে সর্বশ্রেণীর কর্মচারীরা নেতা ঘােষিত সংগ্রামের কর্মসূচিকে সফল করে তােলেন। | ঢাকার রাজপথ ছাত্র-শ্রমিক-জনতার পদচারণায় প্রকম্পিত হয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিভিন্ন সংগঠন ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা সংগ্রামের কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য দীপ্ত শপথ গ্রহণ করেন। সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ছাত্র-জনতা অকুণ্ঠ চিত্তে এককণ্ঠ হয়ে বাংলাদেশের নেতার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালনের কথা ঘােষণা করেন। গতকাল মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকের পর পরবর্তী বৈঠকের কোনাে সময় নির্ধারিত না হওয়ায় জনমনে উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়। ভাের থেকে রাত পর্যন্ত উৎসুক জনতা তাদের আশা-আকাক্ষার প্রতীক বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ভিড় জমান। পয়লা মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনটি কেবল সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী যে জনগণ, তাদের পরিচালন কেন্দ্রেই পরিণত হয়নি, সেই সাথে হয়ে ওঠে মুক্তিকামী মানুষের মিলন ক্ষেত্রও। ১ মার্চ সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বাংলার মানুষের মৌলিক অধিকার অগণতান্ত্রিকভাবে খর্ব করার পর থেকে বঞ্চিত-নির্যাতিত-বিক্ষুব্ধ। গণমানুষের ঢল নামে বাংলাদেশের জনগণের অবিসংবাদিত নেতার বাসভবনে। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা সমাজের সর্বস্তরের হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসে তাদের প্রাণপ্রিয় নেতার প্রতি সমর্থন জানাতে। নেতার জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনে, নির্দেশ নিয়ে, স্বাধীনতার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ফিরে যান তার নিজ নিজ অবস্থানে। তারপর সংগঠিত করেন নিজেদের, গড়ে তােলেন সংগ্রাম পরিষদ, প্রস্তুতি নিতে থাকেন চূড়ান্ত সংগ্রামের জন্য, আর অপেক্ষায় থাকেন নেতার পরবর্তী নির্দেশের। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা ঘােষণা করে দেশবাসীকে চূড়ান্ত সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দেওয়ার পর থেকেই ৭ কোটি বাঙালির দৃষ্টি কেবল নয়, সারা বিশ্বের দৃষ্টি বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে নিবদ্ধ। সারাদিন ধরে মিছিলের পর মিছিল করে বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ স্বাধীনতা। সংগ্রামের মহানায়কের প্রতি তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন জানাতে এলে বঙ্গবন্ধু প্রতিটি মিছিলের প্রতি ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে সমবেত জনতার স্লোগান ও করতালির জবাব দেন। সহকর্মীদের সাথে আলােচনার ফাকে ফাকে বঙ্গবন্ধু বার বার বৈঠক। থেকে উঠে এসে শােভাযাত্রাকারীদের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। একের পর। এক সমবেত মিছিলকারীদের প্রতি স্বাধীনতা সংগ্রামের সর্বাধিনায়ক বলেন, তােমরা চরম প্রস্তুতি নিয়ে ঘরে ঘরে সংগ্রামী দুর্গ গড়ে তােল। যদি তােমাদের ওপর আঘাত আসে তা প্রতিহত করে শক্রর ওপর পাল্টা আঘাত হেনেনা। 

জনতাকে চূড়ান্ত লড়াইয়ে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, মুক্তিসংগ্রামের পতাকা আরও ওপরে তুলে ধর। সাত কোটি শােষিত-বঞ্চিত বাঙালির সার্বিক মুক্তি না আসা পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাও। মনে রাখবা, চরম ত্যাগের বিনিময়ে হলেও আমরা মূল লক্ষ্যে পৌছাবই। প্রয়ােজনে আমরা রক্ত দিয়েই আমাদের দাবি আদায় করব। তবু বীর শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে দেব  বঙ্গবন্ধু প্রতিটি মিছিলের উদ্দেশে সুশৃঙ্খল ও ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, দাবি আদায় করতেই হবে। এ জন্য ধৈর্য, শৃঙ্খলা ও ঐক্য চাই । শান্তিপূর্ণভাবে দাবি আদায় হয় তাে ভালাে, নইলে সংগ্রামের দুর্গম পথ ধরেই আমরা আমাদের ঈপ্সিত লক্ষ্যস্থলে পৌছাবাে। অনেক সময় মিছিলকারীরা স্বাধীনতার সপক্ষে শ্লোগান দিতে থাকলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার উদ্যোক্তা তাদের উদ্দেশে বলেন, তােমরা স্বাধীনতা পাবে, ধৈর্য ধরাে।  বঙ্গবন্ধু তার বাসভবনের সামনে সমবেত ব্যাংক কর্মচারীদের উদ্দেশে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলেন, প্রয়ােজন হলে বাংলাদেশের সমস্ত ব্যাংক জনগণের নিয়ন্ত্রণে আনা হবে। বাংলাদেশে কার্যরত ব্যাংকগুলাে জাতীয়করণের পর এগুলাের পরিচালন কাজ জনগণ নিয়ন্ত্রণ করবে। বিপুলসংখ্যক দেশি-বিদেশি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এসে তার সাথে দেখা করেন। বঙ্গবন্ধু বিদেশি সাংবাদিকদের দৃষ্টি তার বাসভবনে আসা জনতার ঢলের প্রতি আকর্ষণ করে বলেন, বন্ধুরা দেখুন, আমার দেশের মানুষ আজ মুক্তির প্রতিজ্ঞায় কী অটল-অবিচল । দেখুন, সংগ্রাম আর ত্যাগের মন্ত্রে তারা কেমন উজ্জীবিত। কার সাধ্য আছে এই উত্তাল জনসমুদ্রকে রােখে? বঙ্গবন্ধু বিদেশি সাংবাদিকদের বলেন, আপনারা দেখুন, আমার দেশ আজ জেগেছে। আমার জনগণ স্বাধীনতার জন্য জীবন দিতে শিখেছে। স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগের অগ্নিশপথদীপ্ত জাগ্রত জনতার এই জীবন জোয়ারকে, এই গণবিস্ফোরণকে স্তব্ধ করবে এমন শক্তি মেশিনগানেরও নেই।  বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকারকালে জনৈক সাংবাদিক জানতে চান, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে আরও সৈন্য আনা হচ্ছে সে সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু কিছু জানেন কি না? জবাবে বাংলাদেশের নেতা বলেন, আমার দেশের মাটিতে যা কিছুই ঘটে সব খবরই আমি রাখি। এর আগে সকালে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ও ওয়ালী ন্যাপ প্রধান ওয়ালী খান এক বৈঠকে মিলিত হন। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে রুদ্ধদ্বার কক্ষে এক ঘণ্টা স্থায়ী এ বৈঠকে পশ্চিম পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি গাউস বক্স বেজোঞ্জাও উপস্থিত ছিলেন।  

রাতে বঙ্গবন্ধু সেনাবাহিনী তলব সংক্রান্ত তদন্ত কমিটি প্রসঙ্গে সংবাদপত্রে একটি বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বলেন, আমরা এ ধরনের তদন্ত কমিশন চাইনি। আমরা চেয়েছিলাম সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রকাশ্য তদন্ত। যে তদন্ত কমিশনের কথা ঘােষণা করা হয়েছে তা বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে আমার উত্থাপিত দাবির পরিপূরক নয়। তাই আমি এই কমিশন মেনে নিতে পারি । বঙ্গবন্ধু সামরিক তদন্ত কমিশনের সাথে সহযােগিতা না করার জন্য সবার প্রতি নির্দেশ দিয়ে বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের জনসাধারণ এ ধরনের ধোকাবাজ তদন্ত কমিশনের সাথে কোনাে সহযােগিতা করতে পারে না। অতএব কেউ এই কমিশনের কোনাে সদস্য মনােনীত হবেন না এবং কেউ এর অধীনে কাজ করবেন না। | রাতে সরকারিভাবে ঘােষণা করা হয়, আগামীকাল সকাল এগারােটায় প্রেসিডেন্ট ভবনে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের মধ্যে বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট সম্পর্কে তৃতীয় দফা আলােচনা অনুষ্ঠিত হবে। সকালে সেনাবাহিনীর সদস্যরা তেজগাঁওয়ে ও মহাখালীতে শ্রমিকদের ট্রাকে হামলা চালায়। সৈন্যরা এই দুই স্থানে নিরস্ত্র ট্রাক আরােহীদের নির্মমভাবে প্রহার করে এবং তাদের টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয়। এসব ঘটনায় নগরীতে জনসাধারণের মধ্যে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। জনগণ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। শ্রমিকরা মিছিল করে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এসে এসব ঘটনা সম্পর্কে তাকে অবহিত করে। রাতে এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির উপনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম সংবাদপত্রে একটি বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, আমাদের বারবার প্রতিবাদ সত্ত্বেও সেনাবাহিনীর দায়িত্বজ্ঞানহীন কার্যকলাপ অব্যাহত রয়েছে। ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় সৈন্যরা সম্পূর্ণ বিনা অজুহাতে নিরস্ত্র-নিরীহ-নিরপরাধ অসামরিক বাসিন্দাদের অপদস্থ, হয়রানি ও নির্যাতন করছে। ঢাকাসহ সারাদেশে সেনাবাহিনীর উস্কানিমূলক তৎপরতা অব্যাহত থাকায় জনগণ আজ বিক্ষুব্ধ। আমরা পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিতে চাই, এ ধরনের উস্কানিমূলক আচরণ তা যে-কোনাে মহলেরই হােক না কেন, আর সহ্য করা হবে না। এর ফলাফলের দায়িত্ব উস্কানিদাতাদেরই সম্পূর্ণ বহন করতে বাংলাদেশের জন্য খাদ্যশস্যবাহী ইরনা এলিজাবেথ’ নামের আরেকটি জাহাজের গতিপথ বদল করে চট্টগ্রাম থেকে করাচি নিয়ে যাওয়া হয়। চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক গুলিবর্ষণ ও অন্যান্য ঘটনা সম্পর্কে সরেজমিনে তদন্তের জন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তিন সদস্যের একটি দলীয় তদন্ত দল। 

ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যান। ঢাকায় বিমান বাহিনীর প্রাক্তন বাঙালি সৈনিকরা স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে একাত্মতা ঘােষণা করে সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন। প্রাক্তন বিমানসেনারা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তাদের সর্বশক্তি ও সম্পদ নিয়ােগ করে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যে-কোনাে ত্যাগ স্বীকারের শপথ নেন। | করাচিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে পিপলস পাটি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে আলােচনার জন্য তাকে ঢাকায় আসার যে আমন্ত্রণ জানান তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। | এ প্রসঙ্গে জনাব ভুট্টো বলেন, ঢাকা যাওয়ার ব্যাপারে তিনি প্রেসিডেন্টের। কাছে কয়েকটি বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন। কিন্তু সে ব্যাপারে ঢাকা থেকে কোনাে জবাব না আসায় তিনি ঢাকা না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। | কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা মিয়া মমতাজ দৌলতানা করাচিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, তার দল কেন্দ্র ও প্রদেশগুলােতে বিরােধী দলের ভূমিকা পালন করতে রাজি আছে। তার দল মনে করে, আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের চার দফা পূর্বশর্ত মেনে নেওয়া উচিত। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের উচিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের জন্য উদ্যোগ নেওয়া। তবে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে তাতে অবশ্যই পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন দলেরও প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। 

সূত্র : দিনপঞ্জি একাত্তর – মাহমুদ হাসান