১৩ মার্চ শনিবার ১৯৭১
বাংলার সার্বিক মুক্তিসংগ্রামের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৭ মার্চ রেসকোর্সের জনসমুদ্রে বাঙালি জাতির প্রতি যে আহ্বান জানান, নেতার সেই ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে-শহরে-বন্দরে গড়ে উঠছে সংগ্রাম কমিটি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী সেই সংগ্রাম কমিটি বাংলার প্রতিটি গৃহকে একেকটি দুর্জয় দুর্গ হিসেবে গড়ে তুলছে। সারাদেশে সার্থকভাবে পরিচালিত হচ্ছে অসহযােগ আন্দোলন। দেওয়ানি-ফৌজদারি আদালতসহ সমস্ত সরকারি ও আধাসরকারি অফিস এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ । প্রতিটি গৃহে, ভবনের শীর্ষে উড়ছে কালাে পতাকা। অবিরাম চলছে সভা-শােভাযাত্রা। সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষ ১১৫ নং সামরিক আইন জারি করে আগামী ১৫ মার্চ সকাল ১০টার মধ্যে প্রতিরক্ষা বিভাগের বেসামরিক কর্মচারীদের কাজে যােগদানের নির্দেশ দেন। এই সামরিক নির্দেশে বলা হয়, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজে যােগদানে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্টদের চাকরিচ্যুত ও পলাতক ঘােষণা করে সামরিক আদালতে বিচার করা হবে। নির্দেশ অমান্যকারীদের সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হবে। | এই সামরিক নির্দেশ জারির পর পরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু বলেন, যখন খােদ সামরিক শাসন প্রত্যাহারের জন্য আমরা বাংলার জনগণের প্রচণ্ড দাবির কথা ঘােষণা করেছি ঠিক তখনই নতুন করে এ ধরনের সামরিক নির্দেশ জারি করা পক্ষান্তরে জনসাধারণকে উস্কানিরই শামিল। বঙ্গবন্ধু বলেন, সামরিক কর্তৃপক্ষের এই সত্যটি উপলব্ধি করা উচিত, জনগণ। আজ তাদের ইস্পাতদৃঢ় সংকল্পে ঐক্যবদ্ধ। সামরিক সরকারের এ ধরনের ভীতি প্রদর্শনের মুখে তারা কিছুতেই নতি স্বীকার করবে না ।
বঙ্গবন্ধু সামরিক কর্তৃপক্ষের প্রতি উস্কানিমূলক তৎপরতা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, জনগণকে যত ভয় দেখানাে হােক না কেন, তারা তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। কেননা, জনগণ জানে ঐক্যবদ্ধ মানুষের শক্তির বিরুদ্ধে কোনাে কিছুরই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির ক্ষমতা নেই। ন্যাপের সভাপতি খান আবদুল ওয়ালী খান ও ন্যাপ নেতা গাউস বক্স বেজেঞ্জো সকালে করাচি থেকে বিমানে ঢাকায় আসেন। ঢাকা বিমানবন্দরে ন্যাপ প্রধান সাংবাদিকদের বলেন, বর্তমান সংকট উত্তরণের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলােচনার জন্য আমি ভােলা মন নিয়ে ঢাকায় এসেছি। সামরিক শাসন প্রত্যাহার ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পর্কিত শেখ মুজিবুর রহমানের দাবির প্রশ্নে আমি তার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। সকালে রমনা পার্কে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে জনসভা এবং শীতলক্ষ্যায় অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের উদ্যোগে দীর্ঘ নৌমিছিল বের করা হয়। চট্টগ্রামে বেগম উমরতুল ফজলের সভানেত্রীত্বে অনুষ্ঠিত মহিলাদের এক সমাবেশে বাংলাদেশের জনগণের পরিপূর্ণ মুক্তি অর্জন না হওয়া পর্যন্ত বিলাদ্রব্য বর্জন ও কালাে ব্যাজ ধারণের জন্য নারী-পুরুষ সবার প্রতি আহ্বান জানানাে হয়। বিশিষ্ট শিল্পী জয়নুল আবেদীন ও সাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য আবদুল হাকিম পাকিস্তান সরকার প্রদত্ত খেতাব ও পদক বর্জন করেন। ঢাকাস্থ জাতিসংঘ ও পশ্চিম জার্মান দূতাবাসের কর্মচারী ও এঁদের পরিবারবর্গসহ ইতালি, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার ২৬৫ জন নাগরিক বিশেষ বিমানে বাংলাদেশ ত্যাগ করেন।
লাহােরে জাতীয় পরিষদের সংখ্যালঘিষ্ঠ পাঁচটি দলের পার্লামেন্টারি পার্টির নেতারা এক সভায় মিলিত হয়ে অবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান। সভায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে অবিলম্বে বাংলাদেশে গিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলােচনা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের অনুরােধ জানানাে হয়। এ সভায় কাউন্সিল মুসলিম লীগ, কনভেনশন লীগ, জামায়াতে ইসলামী, জমিয়তে ইসলাম ও জমিয়তে ওলামায়ের নেতৃবৃন্দসহ কয়েকজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য অংশ নেন। ভৈরবে এক জনসভায় ন্যাপ প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বলেন, বর্তমানে পূর্ব বাংলা আসলে স্বাধীন। আমরা একটি পূর্ণাঙ্গ সরকার গঠনের অপেক্ষায় আছি। তিনি বলেন, কিভাবে মুক্তিসংগ্রামে বুকের রক্ত দিতে হয় তা পূর্ব বাংলার মানুষ জানে। আজ সংগ্রামী মুক্তি পাগল মানুষের নজিরবিহীন ঐক্য সৃষ্টি। হয়েছে। তিনি খাজনা প্রদান বন্ধ রাখার জন্য শেখ মুজিব যে নির্দেশ দিয়েছেন তা মেনে চলার আহ্বান জানান। তিনি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও চোরাচালান রােধে সংগ্রাম কমিটি গঠন করতে বলেন। বিদেশি বস্ত্র, মদ ও গাঁজা ত্যাগ করার জন্যও তিনি অনুরােধ জানান। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আ. স. ম. আবদুর রব ও আবদুল কুদুস মাখন এক যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশ ত্যাগকারীদের বাড়ি-গাড়ি-সম্পদ কিনে বাংলার অর্থ বিদেশে পাচারে সহযােগিতা না করার জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান। সাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য আফাজউদ্দিন ফকির এক বিবৃতিতে ‘লেটার। অব অথরিটি’র মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান জানান। তিনি অবিলম্বে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর পরিচালনার দায়িত্ব একজন বাঙালি জেনারেলের কাছে হস্তান্তর, বেঙ্গল রেজিমেন্টের সবকটি ব্যাটালিয়নের পরিচালনা কর্তৃত্ব বাঙালি অফিসারদের হাতে অর্পণ এবং বিগত এক মাসে বাংলাদেশের যে অতিরিক্ত পাকিস্তানি সৈন্য আনা হয়েছে তাদের বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহারের দাবি জানান।
সূত্র : দিনপঞ্জি একাত্তর – মাহমুদ হাসান