১০ মার্চ বুধবার ১৯৭১
স্বাধীনতা সংগ্রামের কাণ্ডারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে সারাদেশে সরকারি ও আধাসরকারি অফিসের কর্মচারীরা কাজে যােগদানে বিরত থাকেন। বেসরকারি অফিস, ব্যাংক ও ব্যবসা কেন্দ্র খােলা থাকে। ঘরে ঘরে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ে। সরকারি ও বেসরকারি ভবন, ব্যবসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষে কালাে পতাকা ওড়ে। এমন কি রাজারবাগ পুলিশ লাইন, থানা ও হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির বাসবভনেও কালাে পতাকা উড়ানাে হয়। সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিগত যানবাহনের পাশাপাশি পুলিশ বাহিনীর গাড়ি-জিপগুলােও কালাে পতাকা লাগিয়ে রাজপথে চলাচল করে। সকালে নারায়ণগঞ্জ জেলখানা ভেঙে ৪০ জন কয়েদি পালিয়ে যায়। জেল পালাবার সময় কারারক্ষী ও কয়েদিদের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে ২৭ জন আহত হয়। রাতে সামরিক কর্তৃপক্ষ রাজশাহী শহরে অনির্দিষ্টকালব্যাপী জারি করা আট ঘণ্টার নৈশ-কারফিউ প্রত্যাহার করে সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বীয় বাসভবনে একদল বিদেশি সাংবাদিকের সাথে সাক্ষাৎকার বৈঠকে মিলিত হন। বঙ্গবন্ধু এ সময় বলেন, সাত কোটি বাঙালি আজ নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন। যে-কোনাে মূল্যে তারা এই অধিকার আদায়ে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত বাঙালিরা অনেক রক্ত দিয়েছে। এবার আমরা এই রক্ত দেওয়ার পালা শেষ করতে চাই। বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, সাত কোটি বাঙালি আজ তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি চায়। এ ব্যাপারে আমরা কোনাে আপস করতে রাজি নই। গত তেইশ বছর ধরে শশাষক ও শাসক শ্রেণী বাংলাদেশকে কলােনি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। বাঙালিরা আজ শশাষণ ও শাসনের অবসান চায়।
তিনি বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিপতি ও শিল্পপতিদের বাজার রক্ষার জন্যই বাংলাদেশের তাঁত ও অন্যান্য কুটির শিল্প ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের খাদ্য। সমস্যাসহ কোনাে উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষমতা বাঙালিদের হাতে নেই। বাংলাদেশের মানুষ আজ অমানুষিক ও দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সার্জেন্ট জহুরুল হক হল প্রাঙ্গণে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উদ্যোগে এক কর্মিসভা অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ, ডাকসুর সহসভাপতি আ, স, ম, আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদুস মাখন বক্তৃতা করেন। পরে ছাত্রলীগ ও ডাকসু নেতৃবৃন্দের স্বাক্ষরিত স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এক বিবৃতিতে বাঙালি সৈন্য, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের প্রতি পাকিস্তানি উপনিবেশবাদী সরকারের সাথে সহযােগিতা না করার জন্য আবেদন জানানাে হয়। বিবৃতিতে বাংলাদেশের। প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিককে স্বাধীনতা সংগ্রামের কাজে নিয়ােজিত প্রতিটি মুক্তিসেনাকে সব ধরনের সাহায্য করার জন্য অনুরােধ জানানাে হয়। বিকেলে ওয়ালীপন্থী ন্যাপের উদ্যোগে শোষণমুক্ত স্বাধীন বাংলার দাবিতে ঢাকা নিউমার্কেট এলাকায় পথসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ সভাপতিত্ব করেন। লেখক-শিল্পী মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ’-এর ব্যানারে লেখক ও শিল্পীরা রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। মতিয়া গ্রুপ ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ শেষে মিছিল বের করা হয়। ফরােয়ার্ড স্টুডেন্ট ব্লক বায়তুল মােকাররম প্রাঙ্গণে জনসমাবেশের আয়ােজন করে । সিভিল সার্ভিসের দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মচারীদের প্রতিনিধিরা এক সভায় মিলিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনে চলার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। নিউইয়র্কে প্রবাসী বাঙালি ছাত্ররা জাতিসংঘ সদর দফতরের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। ছাত্ররা নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যা বন্ধের বিষয়ে জাতিসংঘের হস্ত ক্ষেপ দাবি করে জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্টের কাছে স্মারকলিপি পেশ করেন। গণঐক্যের নেতা এয়ার মার্শাল আসগর খান কয়েক দিন বঙ্গবন্ধু ও নেতৃবৃন্দের সাথে আলােচনা শেষে সন্ধ্যায় করাচির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন।
করাচিতে সাংবাদিকদের সাথে আলােচনাকালে ন্যাপ প্রধান ওয়ালী খান। বলেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে মতবিনিময়ের জন্য আগামী ১৩ মার্চ ঢাকায় আসবেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ক্ষমতা যাতে হস্তান্তর করা যায় সে জন্য আগে আমাদের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের চেষ্টা করতে হবে। করাচিতে ওয়ালী ন্যাপের পশ্চিম পাকিস্তান শাখার মহাসচিব মীর গাউস বখস বেজেঞ্জো এক বিবৃতিতে বলেন, আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাবে কেবল বাংলাদেশের নয় বরং সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান ও পাঞ্জাবের জনগণের আশা-আকাক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে। লাহােরে সাবেক পিডিএম প্রধান নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খানের আহ্বানে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের এক সভায় বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদ। অধিবেশনে যােগদানের জন্য যে পূর্বশর্ত দিয়েছেন তার প্রতি নীতিগতভাবে পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করা হয়। লাহােরে কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি মিয়া মমতাজ মােহাম্মদ খান দৌলতানা এক বিবৃতিতে বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার অবিলম্বে ঢাকায় গিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করা উচিত। অপরদিকে করাচিতে কাউন্সিল মুসলিম। লীগের কেন্দ্রীয় নেতা জেড, এইচ, লারী এক বিবৃতিতে বলেন, আওয়ামী লীগ পূর্ব। পাকিস্তানে গণহত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও সেনাবাহিনীকে ছাউনিতে ফিরিয়ে নেওয়ার যে দাবি করেছে তা অবিলম্বে পূরণ করা উচিত, তবে শাসনতন্ত্র প্রণয়নসাপেক্ষে সামরিক আইন প্রত্যাহার ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্ত র সম্পর্কিত দাবি দুটির বিবেচনা স্থগিত রাখা উচিত। ইসলামাবাদে পাঞ্জাব আওয়ামী লীগের সভাপতি এম, খুরশীদ আজ রাতে প্রেসিডেন্ট ইয়হিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছা ও অনিচ্ছাই আজ শেষ কথা। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণের নামে আমি যে নির্দেশ দিয়েছি সচিবালয়সহ সরকারি ও আধাসরকারি অফিস-আদালত, রেলওয়ে ও বন্দরগুলােতে তা পালিত হচ্ছে । বঙ্গবন্ধু বলেন, যারা মনে করেছিলেন যে, শক্তির দাপটে আমাদের ওপর তাদের মতামত চাপিয়ে দেবেন, বিশ্বের দরবারে তাদের চেহারা আজ নগ্ন হয়ে ধরা পড়েছে। তিনি বলেন, বিশ্ব-জনমতের কাছে কিংবা পশ্চিম পাকিস্তানের সৎ চিন্তাশীল মানুষের কাছে তারা বাংলার নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষের ওপর শক্তির নগ্ন প্রয়ােগের যুক্তি প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, তা সত্ত্বেও বিবেকবর্জিত সেই গণবিরােধী শক্তি তাদের বেপরােয়া পথই অনুসরণ করে চলেছেন। তাদের সমরসজ্জা সমানে অব্যাহত। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রতিদিন সামরিক বাহিনীর লােকজন ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসা হচ্ছে। বিনাশী শক্তির এই সমাবেশ ঘটিয়েও তাদের মনােবাঞ্ছা পূরণ হয়নি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার বিবৃতিতে আরও বলেন, ক্ষমতাসীন চক্র প্রতিহিংসাপরায়ণ মনােবৃত্তি নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে গভীর চক্রান্তে লিপ্ত। তারা বাংলাদেশের সর্বত্র এক ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের ভীতসন্ত্রস্ত করে বাংলাদেশ ত্যাগে বাধ্য করছেন। সামরিক সজ্জা অব্যাহত রেখে তারা বাংলার বুকে এক জরুরি অবস্থা কায়েম রাখার প্রয়াসী। | বঙ্গবন্ধু বলেন, জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট বাংলাদেশ থেকে জাতিসংঘের কর্মচারীদের অপসারণের অনুমতি দিয়েছেন। সামরিক বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশে বসবাসরত বিদেশিদের জীবন ও সম্পদ কতটা বিপন্ন করে তুলেছেন জাতিসংঘ মহাসচিবের এই নির্দেশে তারই স্বীকৃতি মেলে। জাতিসংঘ মহাসচিবের অনুধাবন করা উচিত কেবল জাতিসংঘের কর্মীদের অপসারণ করলেই এ ব্যাপারে তার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। | বঙ্গবন্ধু বলেন, কেননা যে হুমকি আজ উদ্যত সে হুমকি গণহত্যার । সে হুমকি বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য জাতিসংঘ সনদে সংরক্ষিত মৌলিক মানবাধিকার অস্বীকৃতিরই নামান্তর। | বঙ্গবন্ধু বিবৃতিতে উল্লেখ করেন, মুক্তির লক্ষ্যে পৌঁছে স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বসবাসের অধিকার অর্জনের জন্য বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ সর্বস্ব পণ করে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে সংকল্পবদ্ধ। তাদের এই উচ্চ মনােবল বিশ্বের স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষ মাত্রেরই প্রেরণার উৎস। | বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলাদেশের মানুষ জানে ইতিহাসের রায় তাদেরই অনুকূলে। ধ্বংসকারী যত অন্ত্রেই সুসজ্জিত থাকুন না কেন কোনাে শক্তিই আর বাঙালিদের। চূড়ান্ত বিজয় থেকে বঞ্চিত করতে পারবে না।
সূত্র : দিনপঞ্জি একাত্তর – মাহমুদ হাসান