You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.06 | ৬ মার্চ শনিবার ১৯৭১ দিনপঞ্জি - সংগ্রামের নোটবুক

৬ মার্চ শনিবার ১৯৭১

সংগ্রামী বাংলা সভা-সমাবেশ-মিছিলে উত্তাল। রাজধানী ঢাকাসহ সারা বাংলায় সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ঢাকায় ষষ্ঠ দিনের মতাে হরতাল পালনকালে স্বাধিকারকামী জনতার অগণিত মিছিলে, ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে যেন উত্তাল। সাগরের ক্ষুব্ধ গর্জন ওঠে। সকাল থেকে সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে আসে।  সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে সভা-সমাবেশ-মিছিল। সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে শান্তিপূর্ণ হরতাল পালন শেষে তাঁরই নির্দেশে বেলা আড়াইটা থেকে বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত ব্যাংক ও যেসব বেসরকারি অফিসের কর্মচারীরা বেতন পাননি সেসব অফিস বেতন প্রদানের জন্য। খােলা থাকে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা কাজে যােগদান থেকে বিরত থাকেন। বিকেলে মহিলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে রাজধানীতে এক বিরাট শােভাযাত্রা বের করা হয়। সন্ধ্যায় ছাত্রলীগের উদ্যোগে এক বিরাট মশাল মিছিল বের করা হয়। পেশাদার শিল্পী ও সাংবাদিকদের উদ্যোগে সভা ও মিছিল, মাধ্যমিক শিক্ষক, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ), গণ-শিল্পীগােষ্ঠী, উদীচী শিল্পীগােষ্ঠী, স্বজনী ও ফরােয়ার্ড স্টুডেন্টস ব্লকের উদ্যোগে বিক্ষুব্ধ মিছিল এবং বাংলা ন্যাশনাল লীগের উদ্যোগে জনসভা ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। মহিলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে কেন্দ্রিয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বাংলার বিক্ষুব্ধ নারী সমাজ বাঁশের লাঠি, লােহার রড ও কালাে পতাকা নিয়ে উপস্থিত হন এবং সমাবেশ শেষে জঙ্গি মিছিল বের করেন। বিকেলে বায়তুল মােকাররম প্রাঙ্গণে ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের উদ্যোগে এক সাংবাদিক-জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সকাল ১১টার দিকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের গেট ভেঙে ৩৪১ জন কয়েদি পালিয়ে যায়। জেল পালানাের সময় পুলিশের গুলিতে ৭ জন কয়েদি নিহত ও ৩০ জন আহত হয়।

সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া দুপুরে এক বেতার ভাষণে ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। ভাষণে তিনি বলেন, যাই ঘটুক না কেন। যদ্দিন পর্যন্ত পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আমার হুকুমে রয়েছে এবং আমি পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান রয়েছি তদ্দিন পর্যন্ত আমি পূর্ণাঙ্গ ও নিরঙ্কুশভাবে পাকিস্ত েিনর সংহতির নিশ্চয়তা বিধান করব। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেন, এই দেশকে রক্ষার জন্য পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের কোটি কোটি বাসিন্দার জন্য আমার দায়িত্ব রয়েছে। তারা আমায় কাছ থেকে তা আশা করেন এবং আমি তাদের হতাশ করব না। | তিনি বলেন, আমি কিছু লােককে কোটি কোটি নিরীহ ও নিরপরাধ পাকিস্ত নির স্বদেশভূমিকে ধ্বংস করতে দেব না। পাকিস্তানের ঐক্য, সংহতি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ওপর ন্যস্ত এবং এ দায়িত্ব পালনে। তারা কখনাে ব্যর্থ হয়নি। জেনারেল ইয়াহিয়া বলেন, পরিবেশ শাসনতন্ত্র রচনার উপযােগী ছিল না বলেই ইতিপূর্বে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় । কারণ, পশ্চিম পাকিস্তানের বিপুলসংখ্যক প্রতিনিধি ৩ মার্চের অধিবেশনে যােগদান  করতে অসম্মতি জানিয়েছিল। তিনি বলেন, ঐ তারিখে অধিবেশন অনুষ্ঠান নিরর্থক হতাে এবং এর ফলে জাতীয় পরিষদই ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা ছিল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেন, পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশন স্থগিতের সিদ্ধান্তে আমাদের পূর্ব পাকিস্তানি নেতৃত্ব যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন তাতে ধ্বংসকারী শক্তি রাস্তায় নেমেছে।

এই প্রেক্ষিতে নিরীহ জনগণের জানমাল রক্ষার জন্য ন্যূনতম প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা আমার নৈতিক দায়িত্ব ছিল। অন্যথায় তারা চরমপন্থীদের শিকারে পরিণত হতাে। তিনি বলেন, ব্যাপক শক্তি প্রয়ােগে পরিস্থিতি আয়ত্তে আনা সম্ভব হতাে বলে উপলব্ধি করলেও হত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযােগ বন্ধ করার জন্য আমি ন্যূনতম শক্তি প্রয়ােগের নির্দেশ দেই।  প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণের অব্যবহিত পরেই বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও বাংলাদেশ শাখার ওয়ার্কিং কমিটির এক যুক্ত জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কয়েক ঘণ্টার রুদ্ধদ্বার এই বৈঠকে প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণের আলােকে দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলােচনা হয়।  এদিকে ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণের পরপরই ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেশ কয়েকটি প্রতিবাদ মিছিল বেরােয়। রাওয়ালপিন্ডিতে পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণকে স্বাগত জানিয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, তাঁর দল ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনের আগেই আলােচনার মাধ্যমে শাসনতন্ত্রের মােটামুটি একটি কাঠামাে স্থির করতে চায়। সাংবাদিক সম্মেলনে জনাব ভুট্টো আরও বলেন, শাসনতন্ত্রের যেসব প্রশ্ন জটিল সে বিষয়গুলাে অধিবেশনের আগেই নিস্পত্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়। অন্যথায় পরিস্থিতি আরও জটিল হবে এবং খােদ পরিষদের ভবিষ্যৎ আরও বিপন্ন হয়ে পড়বে। তিনি বলেন, অধিবেশনের আগে তিনি দেশের সংহতির স্বার্থে আরেকবার আওয়ামী লীগের সাথে আলােচনার উদ্যোগ নিতে প্রস্তুত। ৬ দফার ভিত্তিতে সমঝােতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা সহজ কাজ নয়। কারণ, এজন্যে ৬ দফার রদবদল প্রয়ােজন। পেশােয়ারে পাকিস্তান মুসলিম লীগ প্রধান খান আবদুল কাইয়ুম খান ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের সিদ্ধান্তকে অভিনন্দিত করে এক বিবৃতিতে বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পশ্চিম পাকিস্তান পিডিপি প্রধান নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান ও কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মিয়া মমতাজ দৌলতানা ইয়াহিয়া খানের ঘােষণাকে স্বাগত জানান। লাহােরে কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা এয়ার মার্শাল (অব.) নূর খান এক সমাবেশে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের দেশ শাসনের বৈধ অধিকার রয়েছে । ক্ষমতা হস্তান্তরের সব বাধা অবিলম্বে দূর করতে হবে। পরিষদ কক্ষে ৬ দফা সংক্রান্ত সমস্ত বিরােধের মােটামুটি নিষ্পত্তি সম্ভব।

প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণে পরিস্থিতির অবনতির জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর । রহমানের ওপর দোষারােপ করায় নূর খান দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, বিরােধ। নিস্পত্তির পথ এটা নয় বরং এতে মতামতের ক্ষেত্রে বিরােধ আরও বাড়বে। তিনি । বলেন, ৬ দফার প্রশ্নে নয় বরং শাসনতন্ত্র রচনার পর ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রশ্নই প্রকৃত বিরােধের কারণ। জনাব ভুট্টো ও সরকারের উপদেষ্টারা শাসন কাঠামােতে ক্ষমতার হিসসায় নিজেদের প্রাপ্তিযােগের প্রশ্নে রীতিমতাে উদ্বিগ্ন রয়েছেন। আমলারাই বিশেষভাবে গণতন্ত্রের ব্যাপারে ভীত এবং গণতন্ত্রের পথে তাই বাধা সৃষ্টির জন্য তারা ব্যর্থ চেষ্টা করছেন। | গণঐক্য আন্দোলনের প্রধান এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তার ধানমন্ডির বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন। ছাত্রলীগ ও ডাকসু নেতৃবৃন্দ এক বিবৃতিতে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি বাংলাদেশের সকল বেতার কেন্দ্র থেকে রিলে করার দাবি। জানান।  প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া লে, জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত করেন। লাহােরে বিকেলে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বি, এ, সলিমী ও পাঞ্জাব প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হামিদ। সরফরাজসহ ১৫ জনকে একটি বিক্ষোভ মিছিল থেকে গ্রেফতার করা হয়।

সূত্র : দিনপঞ্জি একাত্তর – মাহমুদ হাসান