You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.03 | ৩ মার্চ বুধবার ১৯৭১ দিনলিপি - সংগ্রামের নোটবুক

৩ মার্চ বুধবার ১৯৭১

শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ঢাকায় দ্বিতীয় দিন এবং সমগ্র বাংলাদেশে প্রথম দিনের মতাে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। হরতালের সময় শহরের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে যায়। বেলা ২টা পর্যন্ত হরতাল পালনের আহ্বান জানানাে হলেও রাজধানীতে প্রকৃতপক্ষে সারাদিন হরতাল পালিত হয়। লােকজন রাস্তায় রাস্তায় লাঠিসােটা নিয়ে বিক্ষোভ করে। সকালে ২ মার্চ দিবাগত রাতে সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত বীর শীহদদের লাশসহ শশাভাযাত্রা বের হয়। গতরাতে কারফিউ জারি হবার পর শহরের বেশ কিছু এলাকায় জনসাধারণ বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের ওপর মেশিনগানের গুলিবর্ষণ করে। গতরাতে একমাত্র ঢাকাতেই ২৩ জন নিহত ও ৩ শতাধিক আহত হয়। | হরতাল চলাকালে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণে ও বিভিন্ন ঘটনায় সারাদেশে শতাধিক ব্যক্তি নিহত হয়। ঢাকা ছাড়াও রংপুর ও সিলেটে কারফিউ জারি করা হয়। | রংপুরে পাক সেনাবাহিনী ও জনতার মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে দুপুর আড়াইটা থেকে ২৪ ঘণ্টাব্যাপী কারফিউ জারি করা হয়। সিলেটে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে সকাল সাড়ে ৭টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়। ঢাকায় কারফিউয়ের মেয়াদ শিথিল করে রাত ১০টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত বলবৎ করা হয়। | হরতাল চলাকালে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চট্টগ্রামে অগ্নিকাণ্ড, হামলা, প্রতিহামলা, বন্দুকের গুলিবর্ষণ, সংঘর্ষ ও সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের ঘটনায় ৭৫ জন নিহত ও কয়েক শ লােক আহত হয়। ঢাকায় বুলেট, বেয়নেট ও বােমায় আহত ১২০ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মালিবাগে জাতীয় পরিষদ সদস্য  ও আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির হুইপ আবদুল মান্নান সেনাবাহিনীর জওয়ানদের হাতে প্রহৃত হন। তাঁকে আহত অবস্থায় হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। |

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক ঘােষণায় আগামী ১০ মার্চ ঢাকায় নেতৃবৃন্দের সম্মেলন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। রাওয়ালপিন্ডির প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে ঘােষণা করা হয়, এই সম্মেলন অনুষ্ঠানের পর দুই সপ্তাহের মধ্যে জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে মিলিত হবার জন্য জাতীয় পরিষদের পার্লামেন্টারি গ্রুপের নেতাদের কাছে আমন্ত্রণলিপি পাঠানাে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আমন্ত্রণ তাৎক্ষণিক প্রত্যাখ্যান করেন। আওয়ামী লীগ প্রধান। ১০ মার্চ ঢাকায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সম্মেলনে যােগদানের জন্য ইয়াহিয়ার আমন্ত্রণকে ‘বন্দুকের নলের মাথায় আমন্ত্রণের নামে নিষ্ঠুর তামাশা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, বেতারে প্রচারিত এই আমন্ত্রণের পটভূমিতে রয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের পাইকারী হারে হত্যার বেদনাদায়ক অধ্যায়। বঙ্গবন্ধু বলেন, যে মুহূর্তে বীর শহীদদের রক্তের দাগ রাজপথের বুক থেকে এখনও শুকিয়ে যায়নি, যখন বহু শহীদের নশ্বর দেহ দাফনের প্রতীক্ষায় পড়ে আছে, যখন শত বুলেটবিদ্ধ মানুষ হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে চলেছে সেই মুহূর্তে এই সম্মেলনের আমন্ত্রণ নিষ্ঠুর তামাশা। বঙ্গবন্ধু বলেন, যখন সামরিক প্রস্তুতি অব্যাহত সেই মুহূর্তে এই আমন্ত্রণ বন্দুকের নলের মাথায় আমন্ত্রণেরই শামিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের আমন্ত্রণ গ্রহণের কোনাে প্রশ্নই ওঠে না।

সন্ধ্যায় পিপলস পার্টি ঘােষণা করে, পার্টি প্রধান জেড, এ. ভুট্টো প্রেসিডেন্ট কর্তৃক ১০ মার্চ ঢাকায় আহূত নেতৃবৃন্দের সম্মেলনে যােগদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। | বিকেলে ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগ ও জাতীয় শ্রমিক লীগের যৌথ উদ্যোগে আয়ােজিত জনসভায় ভাষণ দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনতার তুমুল করতালির মধ্যে তার জলদগম্ভীর কণ্ঠে ঘােষণা করেন, বাংলার গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা সমর্পণ করে সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত সরকারের সাথে স্বাধিকারকামী বাংলার মানুষ আর সহযােগিতা করবে না। কোনাে কর-খাজনাও দেবে না। | বঙ্গবন্ধু ভাষণে সর্বাত্মক অহিংস—অসহযােগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের প্রতি নির্দেশ দেন পুনরায় আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত আপনারা অফিস-আদালতে যাওয়া বন্ধ রাখুন। প্রচার মাধ্যমের প্রতি নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, যদি আমাদের বক্তব্য-বিবৃতি, আমাদের আন্দোলনের খবর প্রকাশ-প্রচারের ওপর বিধিনিষেধ আরােপ করা হয় সে নির্দেশ আপনারা লংঘন করুন। | বঙ্গবন্ধু জনাব ভুট্টোর উদ্দেশে বলেন, গণতান্ত্রিক নিয়মে প্রণীত এক শাসনতন্ত্র যদি না চান তাহলে আপনাদের শাসনতন্ত্র আপনারা রচনা করুন। বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র আমরাই রচনা করব। | তিনি বলেন, বাংলার মানুষ খাজনা দেয়, ট্যাক্স দেয় রাষ্ট্র চালানাের জন্য, গুলি খাওয়ার জন্য নয় । গরিব বাঙালির পয়সায় কেনা বুলেটের ঘায়ে কাপুরুষের মতাে গণহত্যার বদলে অবিলম্বে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিন। বাংলার শাসনভার বাংলার নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে তুলে দিন। | মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে মুখরিত পল্টনের উত্তাল জনসমুদ্রের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু ঘােষণা করেন, আমরা প্রস্তুত। দানবের সঙ্গে সংগ্রামের জন্য আমরা প্রস্তুত। তিনি বলেন, ২৩ বছর ধরে রক্ত দিয়ে আসছি । প্রয়ােজনে আমার বুকের রক্ত দেব। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে বীর শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করব না।  তিনি আরও বলেন, দেশের বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতির জন্য আমরা দায়ী নই। এজন্য দায়ী গণপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া বানচাল প্রয়াসী ষড়যন্ত্রকারী দল। তিনি বলেন, দেশের মেজরিটি জনগণ আমার পেছনে। কিন্তু জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের বেলায় আমার সঙ্গে আলােচনা করা হয়নি। ভুট্টো পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা হয়নি। অস্ত্র ধরা হয়েছে বাংলার নিরস্ত্র শান্তিকামী মানুষের বিরুদ্ধে। 

বঙ্গবন্ধু হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, আগুন নিয়ে খেলা করবেন না। যদি করেন, পুড়ে ছাই হয়ে যাবেন। বাংলার মানুষকে মৃত্যুর ভয় দেখাবেন না। শক্রর সঙ্গে, দুর্যোগের সঙ্গে কোলাকুলি করে আমরা বেঁচে আছি। তিনি বলেন, মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে, মৃত্যুকে বুক পেতে বরণ করেই আমরা স্বাধিকার আদায় করব। জাতীয় পরিষদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান আরও বলেন, হয়তাে এটিই আপনাদের সামনে আমার শেষ ভাষণ। ৭ মার্চ রেসকোর্সে আমার বক্তৃতা করার কথা। কিন্তু সে সুযােগ আমাকে নাও দেওয়া হতে পারে; তাই আজ আপনাদের কাছে আমি বলে যাচ্ছি, আমি যদি নাও থাকি আন্দোলন যেন না থামে। বঙ্গবন্ধু বলেন, ভাইয়েরা আমার আমি বলছি, আমি থাকি আর না থাকি, আমার সহকর্মীরা আছেন। তারাই নেতৃত্ব দেবেন। আর যদি কেউই না থাকে তবু আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। বাংলার ঘরে ঘরে প্রতিটি বাঙালিকে নেতা হয়ে নির্ভয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। যে-কোনাে মূল্যে বাংলার স্বাধিকার ছিনিয়ে আনতে হবে। 

বঙ্গবন্ধু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বুলেটে আহতদের জীবনরক্ষার জন্য জনগণের প্রতি ব্লাড ব্যাংকে রক্তদানের উদাত্ত আহ্বান জানান। তিনি জনসাধারণকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, বাংলার স্বাধিকারবিরােধী বিশেষ মহল নিজস্ব এজেন্টদের দিয়ে লুটতরাজ, অগ্নিসংযােগ ও উজ্জ্বল ঘটনা ঘটাচ্ছে। স্বাধিকার আন্দোলন বিপথগামী করার এ অশুভ চক্রান্ত রুখতেই হবে। বিপথগামী করে আন্দোলন বানচাল করাই তাদের লক্ষ্য। যে-কোনাে মূল্যে এদের প্রতিহত করতে হবে। | বঙ্গবন্ধু দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে আরও বলেন, আপনাদের প্রতি আমার নির্দেশ, সর্বাত্মক আন্দোলন চালিয়ে যান। এই আন্দোলন হবে শান্তিপূর্ণ, অহিংস, সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত। গণআন্দোলনে সাফল্যের জন্য শৃঙ্খলাবােধের প্রয়ােজন সবচেয়ে বেশি। উদ্ধৃঙ্খলতা আন্দোলনকে বিপথগামী। করতে পারে। বঙ্গবন্ধু বলেন, আমার সুস্পষ্ট নির্দেশ রইল, যে যেখানে থাকুন নিষ্ঠার সাথে। নিজ দায়িত্ব পালন করুন। আন্দোলনকে সংযত রাখুন। সভায় স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়। 

সূত্র : দিনপঞ্জি একাত্তর – মাহমুদ হাসান