বর্তমান পর্যায় ও বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন প্রসঙ্গে
— সিকান্দার আবু জাফর
আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধ প্রথম স্তর উত্তীর্ণ হয়ে দ্বিতীয় স্তরে পড়েছে। আজ গেরিলা কায়দায় যুদ্ধের নতুন নতুন সাফল্য, হাজার হাজার শত্রু সৈন্যের মৃত্যু (লাশের মাঝে বেঁচে থাকা সৈন্যের মৃত্যু) যন্ত্রণার মুখ একদিকে যেমন দেখছি পাশাপাশি তেমনি দেখছি বাংলাদেশের গর্ভর্যন্ত্রণার মুখ-স্বাধীনতা শিশুর জন্মের পূৰ্ব্বক্ষণে। আজ আমাদের মুক্তাঞ্চল গুলােতে শক্তিশালী ঘাঁটিগুলাে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হচ্ছে। আজ শত্রু সৈন্যরা সাহস পাচ্ছে মুক্ত ঘাটিতে আসবার। তাদের যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন প্রায়। সুতরাং, ইয়াহিয়া সৈন্যের বিরুদ্ধে আজ আঘাত হানার সময় এগিয়ে আসছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশের সংগ্রামী শক্তিকে আরাে সুদৃঢ় ও সুসংহত করার প্রয়ােজন। মুক্তিযুদ্ধের পরিপূর্ণ সফলতা নির্ভরশীল সমগ্র জনতার ঐক্যের উপর। আর এই ঐক্য আনার দায়িত্ব প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের। প্রয়ােজন মিলিত শক্তির। সঠিক কর্মসূচি। | প্রয়ােজন সব স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক দলের সমম্বয়ে জাতীয় মুক্তিফ্রন্টের। আমরা যদি বিশ্বের বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের দিকে তাকাই তাহলে দেখবাে মুক্তিযুদ্ধের মহান কর্তব্য সাধনের জন্যই শত্রুর বিরুদ্ধে সব রাজনৈতিক দলের ঐক্য মাের্চা গড়ে তােলা হয়েছে। আমরা ভিয়েতনামের দিকে তাকালে দেখছি ২৩টি ছােট বড় রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে সেখানে গড়ে উঠেছে জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের এই মুক্তিযুদ্ধ কেবল পাকজঙ্গী চক্রের বিরুদ্ধে নয়, এটা সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী যুদ্ধও বটে। বাংলাদেশের ঘটনায় মার্কিন নয়া উপনিবেশবাদীদের ভূমিকা আজ আর কারাে কাছে অস্পষ্ট নয়। দুনিয়ার যেখানেই মুক্তিযুদ্ধ সেখানেই তাকালে দেখা যায় সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা পৃষ্ঠপােষিত কোনও সামরিক চক্রের বিরুদ্ধ সংগ্রাম করে জাতীয় মুক্তি অর্জন করতে হলে জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন করা অত্যাবশ্যক। সেরূপ জাতীয় মুক্তিফ্রন্টের নেতৃত্বে শ্রমিক, কৃষক মধ্যবিত্ত ও সাধারণ মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয় এবং চুড়ান্ত লক্ষ্যে উপনীত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যায় ।
এদের জন্যই উড়বে, যদি ঢাকায় সেই ছায়া সুনিবিড় বাড়িটিতে আবার ফিরতে পারি তবে এদের জন্যই পারবাে। বাংলাদেশের গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারের সাফল্যও প্রকৃত পক্ষে নির্ভর করে এই মুক্তিবাহিনীর সফল। রণনীতির উপর। | ভরসার কথা যখন উঠলাে, তখন একটা কথা বলি। জাতিসঙ্ আমেরিকা এবং রাশিয়া কোন সমস্যায় যখন এই ব্রাহ্ স্পর্শের যােগ ঘটেছে, তখন সেই সমস্যার আর সমাধান হয় নি। ইউরােপে বার্লিন বিভক্ত হয়েছে সেই কবে ১৯৪৫ সালে। তা আর জোড়া লাগে নি। কোন্দল ও থামেনি। দুঃখ দুর্দশা বাড়ছে কেবল। জার্মান জাতির। আমেরিকা এতবড় বন্ধু তাইওয়ানের চিয়াং কাইশেকের আজ তাকেই কলা দেখিয়ে নিক্সন চলেছেন পিকিংয়ে নতুন পীরিতির নেশায় । আরব জাতীয়তাবাদের এত বড় বন্ধু সােভিয়েট রাশিয়া ১৯৬৬ সালের জুন যুদ্ধে যে ভুখণ্ড আরবেরা হারিয়েছে, তার এক ইঞ্চিও আর পুনরুদ্ধতার করতে পারে নি। সমস্যা পৃথিবীর সর্বত্র। প্যালেন্টাইন, এঙ্গোলা, মােজাম্বিক, ভিয়েৎনাম, রােডেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা জাতিসঙ্ কিম্বা রাশিয়া আমেরিকা মিলে কোথায় কোন্ সমস্যার সমাধান হয়েছে, আমি জানিনা। | ফরাসী বুদ্ধিজীবী আঁদ্রে মারলাের সঙ্গে আমি তা-ই একমত। যুদ্ধ ছাড়া বাংলাদেশের মুক্তির দ্বিতীয় কোন। পথ নেই। আর এই যুদ্ধ অব্যাহত রাখার জন্য পৃথিবীর যে কোনাে প্রান্ত থেকে যে কোনাে প্রয়াসে অস্ত্র সংগ্রহ করতে হবে মুক্তি ফৌজের হাতে অস্ত্র তুলে দিতে হবে। যারা ভাবছেন, বিশ্ব-বিবেকের তাড়ায় ইয়াহিয়া মাথানত করবেন কিম্বা বিশ্ব রাজনীতির হাওয়া বদলানাের দরুণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা তরান্বিত হবে তারা হয়তাে একটা সত্য এখনাে উপলব্ধি করতে পারেন নি যে, বাংলদেশ সমস্যা ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক স্নায়ুযুদ্ধের হিমাগারে পৌছে গেছে। | এখন মুক্তির একটিই পথ এবং তাহল সশস্ত্র সংগ্রাম। অপরের কৃপা কিম্বা অনুগ্রহ ভিক্ষা নয় ।
জয়বাংলা (১) ঃ ১: ২০ ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
বাংলাদেশ আন্দোলনের পটভূমি প্রথম পর্যায় : পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ইতিহাস
–অনিল মুখার্জী
সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার জন্য বর্তমানে যে রক্তক্ষয়ী গণসংগ্রাম চলছে তার মর্মার্থ উপলব্ধি করতে হলে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিশেষভাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ইতিহাস আমাদের জানা থাকা দরকার। পূর্বকথা বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের প্রথম জাতীয় বিদ্রোহ ঘটে ১৮৫৭ সালে। পরাধীনতার বিরুদ্ধে এই জাতীয় সংগ্রামকে ইংরেজরা আখ্যায়িত করেছে “সিপাহী বিদ্রোহ” বলে। কিন্তু ইংরেজদের ভারতীয় সিপাহীরাই শুধু নয়, অনেক জায়গায় এমন কি সিপাহীরা বিদ্রোহ শুরু করার আগেই সে জায়গার সাধারণ মানুষ ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করে এবং বিশেষভাবে উত্তর ও মধ্য ভারতে ইহা জনসাধারণের একটা প্রকৃত রাজনৈতিক সশস্ত্র সংগ্রামের রূপ নেয়। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতের এই প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের হিন্দু জলাধারণ যেমন অংশ গ্রহণ করে তেমন মুসলমান জনসাধারণও অংশ নেয়,বরং হিন্দুদের তুলনায় অনেক #ত্রে মুসলমানদের অংশ গ্রহণ বেশি দেশবাসীর প্রতি সম্রাট বাহাদুর শাহের ঘােষণায় মুসলমানী শরিয়ত এলঃ হিন্দু সন্তের বাণী সমভাবে ব্যবহৃত হয় এবং হিন্দু মুসলমানের ঐক্য ও সৌভ্রাতৃত্বের প্রকাশ ছিল এই বিদ্রোহের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য। হিন্দু জনসাধারণের মনে যাতে কোনাে রকম আঘাত লাগতে না পারে এবং ইংরেজ শাসকরা ভারতবাসীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির কোনাে সুযােগ যাতে না পায় সেজন্য সম্রাট বাহাদুর শাহ এমন কি ঈদুজ্জোহার দিন গরু জবেহ বন্ধ করে দেন। এই বিদ্রোহের ইতিহাস রচনা কালে ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জি, ডর, ফরেস্ট মন্তব্য করেন, “ভারতের বিদ্রোহ ঐতিহাসিকদের
ও শাসনকর্তাদের নিকট যে সকল শিক্ষা উপস্থিত করেছে তার মধ্যে কোনােটাই এই সতর্কবাণীর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয় যে, ভারতে এমন একটা বিপ্লব সম্ভবপর যাতে ব্রাহ্মণ আর শূদ্র, মুসলমান আর হিন্দু সকলেই আমাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ।” ১৮৫৭-৫৮ এর ভারতীয় বিদ্রোহ ইংরেজ শাসকরা বর্বরভাবে দমন করে সত্য, কিন্তু ইংরেজ শাসনের সাথে ভারতীয়রা কোনােদিনও আপস করে নাই। ইংরেজ শাসনে ক্রমে ক্রমে ভারত হতে মুসলমানী ফৌজদারী ও দেওয়ানী আইন উঠে গেল, কাজীরা বেকার হলেন, সরকারি ভাষা হিসেবে ফার্সি লােপ পেল। বিদ্রোহের সাথে সম্পর্কে অভিযােগে প্রায় সমুদয় উচ্চশ্রেণীর মুসলমানরা তাদের সম্পত্তি হারালেন। মুসলমানদের গর্বে আঘাত করা হল। উচ্চবিত্ত মুসলমানদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা দূরীভূত হল, তারা অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। বিদ্রোহের পর হতে তারা সরকারী চাকরি ও উন্নত শাে হতে বাদ পড়লেন। | ১৮৭০ সাল পর্যন্ত মুসলমানদের মধ্যে ওয়াহাবী আন্দোলনের প্রবল প্রভাব লক্ষ্য করা যায় । ইসলাম ধর্মের শুদ্ধি করে তার পবিত্রতা রক্ষা করা যেমন এই আন্দোলনের একটা মূল কথা, তেমন কাফের ইংরেজদের শাসন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করাও উহার অন্যতম লক্ষ্য। ১৮৫৯-৬১ সালের বাংলাদেশের নীলচাষীদের বিদ্রোহে হিন্দু-মুসলমান চাষীরা একসঙ্গে লড়াই করেন। উনবিংশ শতাব্দীর চতুর্থভাগেও ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের বিক্ষোভ বেড়েই চলে। সাধারণ হিন্দু-মুসলমানেরা যেমন ইংরেজদের শােষণও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে থাকে, তেমন ইংরেজ শিক্ষায় শিক্ষিত “ভারতীয় সাহেবরাও” স্বাধীনতার গ্লানি-যেমন সরকারি চাকুরীর ও সৈন্য বাহিনীতে উচ্চ পদ না পাওয়া, দেশ শাসনের ক্ষেত্রে তাদের কোন অধিকার না থাকা প্রভৃতি সম্বন্ধে সজাগ হয়ে ওঠে এবং ইংরেজদের কথার ওপর আস্থা হারাতে থাকে। দেশ শাসনের ক্ষেত্রে কোনাে অধিকার না থাকা শুধু একটা জাতীয় অপমানের ব্যাপারেই নয়, এর ফলে ভারতের নবজাত বুর্জোয়াশ্রেণীর স্বার্থের উপর আঘাত পড়ে এবং তারা ইংরেজ শাসন মেনে নিলেও তার সম্বন্ধে সমলােচনা মুখর হয়ে উঠে।
এই অবস্থায় ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সমালােচনা ও বিক্ষোভকে একটা শান্তিপূর্ণ ও আইন সঙ্গত রূপ দিয়ে গণআন্দোলন প্রশমিত করার মানসে ব্রিটিশ শাসকদের উদ্যোগে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস গঠিত হয় ১৮৮৫ সালে। কংগ্রেস ছিল সেই কালের উদীয়মান বুর্জোয়াদের সংগঠন এবং সেই কারণেই নরমপন্থী। হিন্দু-প্রধান কলকাতা, বােম্বাই ও মাদ্রাজকে কেন্দ্র করে ভারতে ইংরেজ শাসন গড়ে ওঠে। এই সকল অঞ্চলেই ইংরেজী শিক্ষিত নতুন মধ্যবিত্ত সমাজ ও বুর্জোয়ারা গড়ে ওঠে। এরাই ছিল কংগ্রেসের প্রধান শক্তি এবং এই কারণেই কংগ্রেস ছিল হিন্দু প্রধান। সামগ্রিকভাবে ব্রিটিশ শাসনের মধ্যেই কিছুটা ভারতীয় প্রতিনিধিত্ব ছিল কংগ্রেসের দাবি। কিন্তু, সামান্য কয়েক বছরের মধ্যেই কংগ্রেস নেতৃত্ব ব্রিটিশ শাসন সম্পর্কে মােহ কাটাতে থাকে। শিক্ষিত সমাজের কংগ্রেসের মধ্যে ব্যাপকভাবে যােগদান এবং এদের মধ্যে উৎসাহ সৃষ্ট ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের মধ্যে কংগ্রেসের প্রগতিশীল সম্ভাবনা সম্পর্কে ভয় সৃষ্টি করে। ১৮৮৫ সালে যে ব্রিটিশ বড়লাট লর্ড ডাফারিন কংগ্রেস গঠনে সাহায্য করেন, ১৮৮৮ সালের মধ্যেই তিনি সেই কংগ্রেসের তীব্র সমালােচক হয়ে উঠেন। কংগ্রেসের কাজে সরকার পরিষ্কার বাধা দিতে শুরু করে এবং ১৮৯০ সালে সরকারি কর্মচারীদের উপর এক নিষেধাজ্ঞা জারী হয় যে, তারা দর্শক হিসেবে কংগ্রেস অধিবেশনে উপস্থিত থাকতে পারবেন না। ১৯০০ সালে বড়লাট লর্ড কার্জন ইংল্যান্ডে ভারত। সচিবকে লেখেন, ‘ভারতে আমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ আকাঙখা হল কংগ্রেসের শান্তিপূর্ণ মৃত্যুতে সাহাৰ্য্য করা। ব্রিটিশের ভেদনীতি ব্রিটিশ শাসনকালে বঙ্গদেশেই প্রথম ব্যবসা বাণিজ্য ও শিক্ষার প্রসার ঘটে এবং বাঙ্গালি জাতি একটি সুসংবদ্ধ আধুনিক জাতি হিসাবে গড়ে উঠতে থাকে। ইহা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়ায়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা এ বিষয়ে সজাগ ছিল যে, যে-মুহূর্তে ভারতীয়দের বিদ্রোহ সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী পােক্ত জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে দাঁড়াবে যে মুহূর্তে তাদের ভারত সাম্রাজ্য ত্যাগ করতে হবে। তাই প্রথমবাধিই। ব্রিটিশ শাসকরা ভারতে বিভাগ করও শাসন কর’ নীতি অনুসরণ করে এবং ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পরে ইহাই সরকারী নীতি হিসাবে গৃহীত হয়। বিভিন্ন ইংরেজ শাসনকর্তা ও ঐতিহাসিকদের বক্তব্যের মধ্যে ইহার সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলে।
ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলমানরা একত্রে শত শত বছর বসবাস করেছে, কিন্তু স্বতন্ত্র ধর্মমতের কারণে তাদের মধ্যে কোনাে রাজনৈতিক বিভেদ ছিল না। অতীতে হিন্দু শাসিত কি মুসলমান শাসিত রাজ্য ও ছিল। এবং এই সকল রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ ও হয়েছে, কিন্তু এই সকল যুদ্ধবিগ্রহ কখনও হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ, রেষারেষী কি সাম্প্রদায়িক কলহের রূপ নেয় নাই। এমন কি ১৯২৭ সালের সাইমন কমিশনের রিপাের্টে ও একথা স্বীকার করতে হয় যে, ব্রিটিশ শাসনের শেষের দিকেই সাম্প্রদায়িকতা বৃদ্ধি পেয়েছে, “ব্রিটিশ ভারতে এক পুরুষ আগেও নাগরিক শান্তি বিঘ্নিত করার মতাে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার প্রায় অস্তিত্বই ছিল না। হিন্দু মুসলমান সাম্প্রদায়িক লড়াই ইংরেজ শাসনের বিশেষত ইহার শেষ যুগের সৃষ্টি। ভারতে পাশাপাশি দুইটি বৃহৎ ধর্মমতের অবস্থান সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের খুবই আশান্বিত করে এবং তারা ইহাকে “ভারতে আমাদের রাজনৈতিক অবস্থানের ক্ষেত্রে শক্ত অঙ্গ” বলে উল্লেখ করে। | জাতীয়তার উন্মেষকে সাম্প্রদায়িকতা দ্বারা আচ্ছন্ন করে ইংরেজ শাসন ও শােষণ সুনিশ্চিত রাখার মানসে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা ১৯০৫ সালে বঙ্গ দেশকে দ্বিধা বিভক্ত করে। কিন্তু এতে বঙ্গদেশ মুশড়ে না পড়ে গর্জে উঠল এবং সারা ভারত আহত বাঙ্গালি জাতিকে সাহায্য দিতে এগিয়ে এল। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর যে দিন বঙ্গ বিভাগ কার্যকরী হয়েছিল শােক-প্রকাশের দিন। সে দিন সমগ্র বঙ্গদেশে বঙ্গ বিভাগের প্রতিবাদে যে রকম বিপুল জনসমাবেশ ও শােভাযাত্রা হয় তা এ যাবৎ ভারতের ইতিহাসে অতুলনীয়। কলকাতা ও অন্যান্য শহরে জনসাধারণ উপবাস করে এবং খালি পায়ে চলে, দোকান-পসার বন্ধ থাকে, “রাখী-বন্ধন” নামে বাঙ্গালিদের মধ্যে এক উৎসবের জন্ম হয়। ভ্রাতৃত্বের নির্দশন স্বরূপ প্রত্যেক শােভাযাত্রাকারীর হাতের কজিতে হরিত্বর্ণের সুতা বেঁধে দেওয়া হতাে এবং এই শপথ গ্রহণ করা হয় যে প্রত্যেক বাঙ্গালি বাঙলার অখণ্ডতা রক্ষা করার জন্য সাধ্যায়ত্ত সব কিছু করবেন। কলকাতার সুবিশাল জনসমাবেশে ১লা নভেম্বর বাঙ্গলা প্রদেশের পক্ষ হতে সুরেন বাড়জো যে-শপথপত্র পাঠ করেন তাতে বলা হয়, “বাঙ্গালি জাতির সর্বজনীন প্রতিবাদ সত্ত্বেও সরকার বঙ্গ বিভাগে প্রবৃত্ত হওয়ায় আমরা এতদ্বারা প্রতিজ্ঞা নিচ্ছি এবং ঘােষণা করছি যে, আমাদের প্রদেশকে টুকরা করার কুফলসমূহ প্রতিরােধ করতে এবং আমাদের জাতির অখণ্ডতা রক্ষা করতে একটি জাতি হিসেবে আমরা আমাদের সর্বশক্তি নিয়ােগ করব”। আইন পরিষদে গােখলে বড় লাট কার্জনের কাছে আবেদন করলেন, “মহােদয়, বাংলার মন জয় করুন।”
অবশেষে ভারত সচিব মলিকে বলতে হলাে যে, বঙ্গ বিভাগ সম্পূর্ণ ও চূড়ান্তভাবে সংশ্লিষ্ট অধিবাসীদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়েছে, তবে একবার গৃহীত “সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত” পাল্টান যায় না। অবশ্য ভারতব্যাপী গণ-আন্দোলনের মুখে ১৯১১ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদিগকে তাদের এই গর্ব বিসর্জন দিয়ে “সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত” পাল্টাতে হয়েছিল। কংগ্রেসের দুর্বলতা ইহা লক্ষণীয় যে, কংগ্রেস যখন হতে একটা সাম্রাজ্যবাদবিরােধী জঙ্গী আন্দোলনকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে উঠতে থাকে তখন হতে ইহা হিন্দু ধর্ম এবং প্রাচীন ভারতীয় (হিন্দু) বীরদের সম্বন্ধে কিম্বদন্তির উপর ভিত্তি। রচনা করতে থাকে। কোনাে বিজ্ঞানসম্মত সামাজিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে এই আন্দোলন গড়ে উঠে নাই এবং ইহা শ্রমিকশ্রেণী ও কৃষক সমাজের সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক মুক্তিসংগ্রামের ভিত্তিতে জনতাকে সংগঠিত করার বদলে প্রধানত নিম্ন মধ্যবিত্তদের উপরে নির্ভর করে এবং তাদের উৎসাহিত করার উপরে জোর দেয়। একটা বৈজ্ঞানিক সামাজিক ও রাজনৈতিক মতবাদের মনে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস, ঐতিহ্য, রাজনীতি ও বিধানসমূহ হয়ে পঁাড়াল জঙ্গী ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তি। প্রাচীন ভারতীয় আর্য” সভ্যতা যে কোনও ধরনের আধুনিক “পশ্চিমী সভ্যতার চেয়ে উৎকৃষ্ট এটাই ছিল জাতীয়বাদীদের মূল। বক্তব্য। একদিকে রাজনৈতিক অগ্রসরতা, অন্য দিকে সামাজিক পশ্চাদপদতা ছিল তাদের বৈশিষ্ট্য। এরা নিম্ন মধ্য বিত্তদের অসন্তোষকে জনগণের সমস্যাবলী ও আন্দোলনের সাথে মিলাতে ব্যর্থ হলেন। ভারতীয় জঙ্গী জাতীয়তাবাদ এবং হিন্দু পুনরুদয় একার্থক হয়ে পড়ল। ভারতীয় সমাজের বিকাশের সেই স্তরে অন্যরূপ আশা করাও ভুল। এই জাতীয়তাবাদ মুসলমান বিদ্বেষী কি বিরােধী ছিল না, কিন্তু স্বাভাবতঃই মুসলমান সম্প্রদায় এই আন্দোলনে খুব উসহ বােধ করে নাই।
এদিকে উনিশ শতকের শেষাংশে ইংরেজ সরকার মুসলমান উচ্চ ও মধ্যবিত্ত সমাজকে বন্ধুভাবে গ্রহণ করে এবং তাদের উৎসাহ দিতে শুরু করে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের প্রসারের সাথে সাথে ব্যবসা ও চাকরি ক্ষেত্রে সুবিধাদির ফলে যে-নবীন মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে উঠতে থাকে তাদের মুখপাত্র হয়ে দাড়ান স্যার সৈয়দ আহমদ। ১৮৮৭ সালে তার এক বিখ্যাত বক্তৃতায় তিনি খােলাখুলিভাবে মুসলমান সমাজকে সতর্ক করেন যে, তাদেরকে কংগ্রেস হতে দূরে থাকতে হবে এবং রাজভক্তি, আনুগত্য ও সরকারি অনুগ্রহের সাহায্য মুসলমান পেশাজীবী শ্রেণীদের সমৃদ্ধিসাধন করতে হবে। উন্মেষােমুখ মুসলমান বুর্জোয়াদের কল্যাণের জন্য সার সৈয়দ তখনকার ভারতীয় বুর্জোয়দের (প্রধানত হিন্দু) জাতীয় আন্দোলনের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজ যে-স্তর পার হয়ে এসেছে মুসলমান মধ্যবিত্তদের অধিকাংশ তখন মাত্র সেই স্তরে পৌচেছে। তাই ব্যক্তিগতভাবে অনেক মুসলমান কংগ্রেস আন্দোলনে যােদ দিলেও মুসলমান সমাজের ব্যাপক অংশ দূরে রয়ে গেল। ১৮৮৭ সালে কংগ্রেসের অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে জনাব। বদরুদ্দিন তায়েবজি আক্ষেপ করে বলেন যে, সমগ্র ভারতের সাধারণ রাজনৈতিক সমস্যাবলী নিয়েই। কংগ্রেসের আলােচনা ও আন্দোলন, তাই মুসলমানরা ও সকলের সর্বাঙ্গীন কল্যাণের জন্য এতে জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকল দেশবাসীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কেন কাজ করবেন না তার আমি বুঝি না। সাম্প্রদায়িকতার আমদানী হিন্দু-মুসলমান ব্যবধানের এই সুযােগ নিয়ে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা তাদের বিভেদ নীতি প্রয়ােগ করে ভারতের সাম্রাজ্যবাদ-বিরােধী জাতীয় আন্দোলনকে অঙ্কুরেই ধ্বংস করতে প্রবৃত্ত হল। ১৯০৬ সালে অর্থাৎ জঙ্গী জাতীয়তাবাদী বিক্ষোভ আন্দোলনের সূচনাতেই ইংরেজ শাসকরা এমন এক ঘৃণা শাসনতান্ত্রিক কৌশল অবলম্বন করল যা কালক্রমে ভারতের রাজনৈতিক জীবনকে কলুষিত করে ফেলল। ১৮৯০ সালে স্যার সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে সরকারের সহিত ঘনিষ্ঠ একটি গ্রুপ মুসলমানদের জন্য আইন পরিষদে স্বতন্ত্র অধিকার ও বিশেষ স্থানের দাবি করলেন। কিন্তু দায়িত্বশীল মুসলমান জনমত এই প্রস্তাবের তীব্র বিরােধিতা করায় ইংরেজরা তখন ইহা কার্যকর করতে পারে নাই। সৈয়দ আহমেদের প্রস্তাব সম্বন্ধে “মােছলেম হেরাল্ড” নামক পত্রিকা তীব্র প্রতিবাদ করে মন্তব্য করল যে, ইহা অবধারিতভাবে “গ্রাম ও শহরে সমাজ ও জীবনকে দূষিত করে তুলবে এবং ভারতকে এক দোজখে পরিণত করবে।
কিন্তু ১৯০৬ সালে সরকারী প্রচেষ্টায় বড় লাটের নিকট আগা খার নেতৃত্বে এক মুসলমান ডেপুটেশনের ব্যবস্থা করা হল। এঁরা নির্বাচনী ব্যবস্থায় মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র ও বিশেষ সুবিধার দাবি তুললেন, আর বড়লাট লর্ড মিন্টো তখনই এই “প্রতিনিধিমণ্ডলীকে” আশ্বস্ত করলেন যে, তাদের দাবি ন্যায্য এবং “আমি আপনাদের সাথে সম্পূর্ণ একমত”। এইভাবে ভারতে সাম্প্রদায়িক নির্বাচকমণ্ডলী, সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্ব এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য অতিরিক্ত সুবিধা ও আসনের ব্যবস্থা করে গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থার মূলেই কুঠারাঘাত করা হলাে এবং এমন এক সাম্প্রদায়িক বিষবৃক্ষ রােপণ করা হল যা কালক্রমে ভারতের রাজনৈতিক এবং সমাজ-জীবনকেও আচ্ছন্ন করল এবং সুষ্ঠু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রসারের ক্ষেত্রে দুস্তর বাধার সৃষ্টি করল। এই ব্যবস্থা ভারতবাসীকে রাজনৈতিকভাবে ভারতীয় হিসাবে নয়, হিন্দু ও মুসলমান হিসাবে স্বতন্ত্রভাবে চিন্তা করতে অভ্যস্ত করতে লাগল। আইন পরিষদের প্রতিনিধিরা সমগ্র ভারতের স্বার্থের তথা জাতীয় স্বার্থের প্রতিনিধি নন, তারা হলেন। বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক স্বার্থের প্রতিনিধি। মুসলিম লীগের জন্ম সাম্প্রদায়িক নির্বাচকমণ্ডলীর এই বিধানকে পাকাপোক্তভাবে কার্যকর করে মুসলমান সমাজকে সর্বভারতীয় জাতীয় আন্দোলন হতে দূরে রাখার জন্য ইংরেজ শাসকদের প্রচেষ্টাতেই ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ নামক রাজনৈতিক পার্টির উদ্ভব হয়। কিন্তু এইভাবে বেশিদিন মুসলমান সমাজকে ইংরেজ বিরােধী আন্দোলন হতে দূরে রাখা গেল না। ১৯১৬ সালে কংগ্রেস ও লীগ চুক্তিবদ্ধ হয় যে, তারা ভারতে স্বরাষ্ট্র শাসন (Dominion Status) প্রতিষ্ঠার জন্য একযােগে আন্দোলন করবে। অবশ্য এই চুক্তিতে পৌছার জন্য কংগ্রেসকে স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলীর ব্যবস্থা স্বীকার করে নিতে হল এবং এর বিষক্রিয়া চলতেই থাকল। |
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পরপর ভারতে ‘স্বরাজ’ প্রতিষ্ঠার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে। প্রচণ্ড ঐক্যবােধ সৃষ্টি করে। এই সময়ে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে যে রকম ভ্রাতৃত্ববােধের প্রকাশ ঘটে তাকে সরকারি রিপাের্টসমূহতেও “অভূতপূর্ব”, “অসাধারণ প্রভৃতি বিশেষণে আখ্যায়িত করা হয়। এই সময়ে। মুসলিম লীগও এক প্রস্তাবে (১৯১৯) ভারতীয় সৈন্যবাহিনীতে মুসলমানদের যােগদান করতে নিষেধ করেন। খিলাফত কমিটির নেতারা পুনঃ পুনঃ কংগ্রেসকে অনুরােধ করেন যাতে কংগ্রেস “স্বরাজের” পরিবর্তে “পূর্ণ। স্বাধীনতার” লক্ষ্য ঘােষণা করে। কিন্তু কংগ্রেস নেতারা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং গান্ধীজী ইহাকে “দায়িত্বজ্ঞানহীতা” বলে তীব্র সমালােচনা করেন। ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আন্দোলনের চরম মুহূর্তে। হিংসার অভিযােগ তুলে গান্ধীজী “অহিংস অসহযােগ আন্দোলন প্রত্যাহার করলে খিলাফত নেতারা তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং কংগ্রেস- খিলাফত যুক্ত সংগ্রামের ভিতর দিয়ে যে-গৌরবময় হিন্দু মুসলমান ঐক্য গড়ে উঠেছিল তা ভেঙে যায় তা লক্ষ্যণীয় যে, কয়েকজন অত্যাচারী পুলিষকে বিক্ষুব্ধ জনতা পুড়িয়ে মেরেছে এই “নৃশংস” হিংসার অভিযােগে আন্দোলন প্রত্যাহৃত হলেও প্রত্যাহারের আসল কারণ ছিল দেশব্যাপী কৃষক। সমাজের মধ্যে খাজনা ও ট্যাক্স বন্ধ আন্দোলনের প্রসারের সম্ভাবনা। | অসহযােগ আন্দোলন প্রত্যাহার করার ফলে দেশময় যে-রাজনৈতিক হতাশার সৃষ্টি হলাে সাম্রাজ্যবাদীরা। তার পূর্ণ সুযােগ গ্রহণ করে। সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়া মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। স্বাধীনতার জন্য হিন্দু মুসলমানের। ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের স্থান নেয় সাম্প্রদায়িক ভেদবিভেদ, কলহ এবং দাঙ্গাহাঙ্গামা। ১৯২২ সালের পরে কংগ্রেস। পরিচালিত ভারতের সাম্রাজ্যবাদবিরােধী বিভিন্ন জাতীয় আন্দোলনগুলিতে (১৯৩০-৩১, ১৯৪২) মুসলমান। সমাজের তেমন ব্যাপক অংশ গ্রহণ আর দেখা যায় না এবং সাম্প্রদায়িক দল হিসাবে মুসলিম লীগ ক্রমে ক্রমে। মুসলমানদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৩৭-৪৫-এর মধ্যে মুসলিম লীগ মুসলমানদের প্রধান। রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত হয়। ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগ ভারতের পরিপূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব করে, যে।
ভারত হবে স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রপুঞ্জের ফেডারেশন। কিন্তু ১৯৪০ সালে কুখ্যাত “লাহাের প্রস্তাবে মুসলিম লীগ হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায় দুইটি স্বতন্ত্র জাতি এইরূপ ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভাগ। এবং ভারতের মুসলমান প্রধান অঞ্চলগুলিতে স্বতন্ত্র মুসলমান রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবি তােলে। ১৯৩৩। সালেও কিন্তু মুসলিম লীগ নেতারা কবি ইকবালের এবং মুসলমান ছাত্রের ঐ ধরনের দাবিকে “ছাত্রদের স্বপ্ন”। এবং “অসার ও অবাস্তব বলে ব্যঙ্গ করেছিলেন।” ১৯৪৫-এর ডিসেম্বর মাসে লাহাের প্রস্তাব সম্বন্ধে উল্লেখ করে মােহাম্মদ আলী জিন্না মন্তব্য করেন, “ভারতের। অচল অবস্থা ভারত ও ব্রিটিশের মধ্যে ততটা নয়। এটা হিন্দু কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে । ….। পাকিস্তান না দেয়া পর্যন্ত কোনও কিছু সমাধান সম্ভব নয় ও হবে না।… ব্যক্তিগতভাবে আমি ব্রিটিশ সরকারের। আন্তরিকতা সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ পােষণ করি না। কিন্তু ভারতের মুসলমানদের পূর্ণ পাকিস্তান না দিয়ে যারা। সমস্যা সমাধানের আশা রাখেন তাদের আন্তরিকতা সম্বন্ধে আমি সন্দিহান।” ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবে। প্রধানত মুসলমান অধ্যুষিত ভারতের উত্তর পশ্চিম এবং পূর্ব অঞ্চল সমূহে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ” গঠনের দাবি করা হয়েছিল যে রাষ্ট্রসমূহের অন্তর্ভুক্ত ইউনিটগুলি হবে “স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম”। কিন্তু ১৯৪৬ সালে আইন পরিষদসমূহের মুসলিম লীগ সভ্যদের কনভেনশনে বলা হয় যে ভারতের উত্তর পশ্চিম ও পূর্ব অঞ্চল। লইয়া একটা সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। ১৯৪৬-এর আগস্ট মাসে মুসলিম লীগ পাকিস্তান। দাবিতে এক প্রত্যক্ষ আন্দোলনের আহ্বান জানায়। এটাকে বলা যায় মুসলিম লীগের চল্লিশ বছরের ইতিহাসে। একমাত্র প্রত্যক্ষ সগ্রামের আহ্বান। কাহার বিরুদ্ধে এই প্রত্যক্ষ সংগ্রাম তাহার কোনও সুস্পষ্ট উল্লেখ ছিল। নী। জিন্না সাহেবের উপরে উল্লেখিত বক্তব্য হতে বুঝা যায় যে, “হিন্দু কংগ্রেসের” তথা হিন্দুদের বিরুদ্ধেই এই সংগ্রাম-এর লক্ষ্য ছিল ভারতের হিন্দু মুসলমান জনতার মধ্যে স্থায়ী শত্রুতা সৃষ্টি করে মিলনের পথ বন্ধ করা এবং হিন্দুদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করে তাদের পাকিস্তান দাবি গ্রহণ করতে বাধ্য করা।
এই ব্যাপারে ইংরেজ সরকারের আন্তরিকতা সম্বন্ধে তাে মুসলিম লীগ নিঃসন্দেহেই ছিল। ফলত ১৬ই আগস্ট মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস ভারতের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে এক কলঙ্কময় কালাে দিবসে পরিণত হয়। এই দিন হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে রাজনৈতিক দাঙ্গারূপী যে আত্মঘাতী হানাহানি শুরু হয় তা ১৯৪৭-এর ভারত বিভাগের পরেও চলতে থাকে। মুসলিম লীগ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে একটা রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে গ্রহণ করে। এই অসার তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান দাবি তােলা হয় যে স্বতন্ত্র ধর্মাবলম্বী হিন্দু ও মুসলমানগণ দুইটি স্বতন্ত্র জাতি-হিন্দু ও মুসলমানরা ভারতের সর্বত্র একত্রে মিলিয়া মিশিয়া থাকিতে পারে, এমন কি তারা পরস্পর সহােদর ভাই সম্পর্কিতও হতে পারে, কিন্তু তাহারা স্বতন্ত্র জাতি। জাতি সম্বন্ধে দুনিয়াতে যত সংজ্ঞা রয়েছে এই উদ্ভট জাতিতত্ত্ব তার কোনােটারই অন্তর্ভুক্ত নয়। একই ভাষা, অঞ্চল, অর্থনৈতিক জীবনযাত্রা এবং একটা সাধারণ সংস্কৃতিতে প্রকাশ মানসিক গড়নের ভিত্তিতে ঐতিহাসিকভাবে বিবর্তিত একটা স্থায়ী মানবগােষ্ঠীকে বলা চলে একটা স্বতন্ত্র জাতি। ধর্ম তাে দুরের কথা, এমন কি শুধূ এক ভাষা বা এক অঞ্চল, কিংবা অর্থনৈতিক জীবনযাত্রা কি সংস্কৃতি এক হলেই এক জাতি বলে কোনাে মানবগােষ্ঠীকে বর্ণনা চলে না। ভারতের মুসলমানদের ভাষা একটা নয়, তাদের বসবাস ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, তাদের সংস্কৃতি বিভিন্ন ….. একমাত্র ধর্ম এবং প্রাচীন মুসলিম সংস্কৃতির কিছু অবশেষের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে মিল রয়েছে। জাতির সংজ্ঞা নিয়ে এই আলােচনা নিরর্থক নয়, কেননা জাতি সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকলে আমরা পরবর্তী পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিকাশকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করে সঠিক সমাধানে পৌছুতে পারব না। সমগ্রভাবে ভারতের এবং পাকিস্তান অঞ্চলের ভৌগােলিক বৈশিষ্ট্য বিচার করলেই পাকিস্তান জাতিতত্ত্বের অসারতা প্রমাণ হয়। ভারতের যে ৬টি প্রদেশ নিয়ে পাকিস্তান গঠনের দাবি করা হয় সেগুলির সমগ্র জনসংখ্যার মাত্র ৫৫% ছিল মুসলমান, অর্থাৎ “মুসলমান জাতির রাষ্ট্র পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই রয়ে যায় অন্য জাতির (মুসলিম লীগের সংজ্ঞা অনুযায়ী) মানুষ ; পক্ষান্তরে মুসলিম লীগের দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভাগে “মুসলমান জাতির” পাঁচ-ভাগের দুই ভাগই পড়ে যায় “হিন্দুজাতির রাষ্ট্রে। সুতরাং মুসলিম লীগের দ্বিজাতিতত্ত্ব হলাে একটা অযৌক্তিক অদ্ভুত প্রস্তাব। | কিন্তু মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবি ভারতের মুসলমান জনসাধারণের মনে তুমুল আলােড়ন সৃষ্টি করে।
ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনাতেও বাংলাদেশে পাকিস্তান আন্দোলন প্রবল জনসমর্থন লাভ করে। ইহার কারণ এই যে, রাজনৈতিক আন্দোলনের অগ্রগতির সাথে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতির মধ্যে ক্রমে যে জাতীয় চেতনার বিকাশ ঘটছিল এবং জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা কায়েম করার জন্য জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের যে চিন্তা জাগছিল পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবির মধ্যে খুব অস্পষ্ট এবং বিভ্রান্তিকর ও বিকৃত আকারে হলেও সেই জাতীয় আকাকার অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটেছে। | বাংলাদেশে যে প্রখর জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটেছিল তা মােহাম্মদ আলী জিন্নার দ্বি-জাতি তত্ত্বের প্রভাবে বিকৃত রূপ নিয়ে বাঙালি মুসলমানদের চেতনায় উপস্থিত হলাে-তথাকথিত মুসলিম জাতীয়তাবাদের শিকার হয়ে পড়ল বাঙালী মুসলমানরা। জিন্নার ‘ধর্মভিত্তিক জাতির’ অদ্ভূত তত্ত্ব যে বাঙালী মুসলমানদের এমন প্রবলভাবে আকৃষ্ট করতে পেরেছিল তার আরও একটা বিশেষ কারণ আছে। ঐতিহাসিক কারণে বাংলাদেশে অধিকাংশ জনসাধারণ ছিল মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত কৃষক এবং এ দেশের প্রায় সকল জমিদারই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। ইংরেজ শাসন প্রবর্তনের পর বিশেষত ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রচলিত হওয়ার পর, মােগল আমলের বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত মুসলমান ভূস্বামীদের স্থানে নয়াজমিদার রূপে হিন্দু জমিদারেরা উদিত হয়। এর কারণ অবশ্য ইংরেজদের হিন্দু প্রীতি নয়। মুসলমান ভূস্বামীদের আমলেও কর সংগ্রহ, জমিদারি পরিচালনা প্রভৃতি কাজ করতেন হিন্দু কর্মচারীরা। সে কারণেই ইংরেজ আমলে কর সংগ্রহে দক্ষ ঐ সকল হিন্দু কর্মচারীরা ক্রমে সব জমিদারি কিনে নেয়, কারণ এক্ষেত্রে ইংরেজের একমাত্র নজর ছিল ঠিকমত কর আদায়ের দিকে।
সূর্যাস্ত আইনের (নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের পূর্বে কর না দিলে জমিদারি নিলাম হয়ে যেত)। অমােঘ নিয়মেই হিন্দুদের হাতে সব জমিদারি চলে যায়। বিংশ শতাব্দীতে সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তে আবার এ সত্যটাই ভিন্ন চেহারা দিয়ে উদিত হল। যা ছিল সামন্ত শােষণ-প্রজার ওপর জমিদারের শােষণ-তাই প্রতিভাত হলাে মুসলমানের ওপর হিন্দুর উৎপীড়ন বলে। | অপর দিকে দরিদ্র কৃষক পরিবার থেকে আগত বাঙালি মুসলমানরা উচ্চশিক্ষা লাভে এগিয়ে আসতে শুরু করেন মাত্র বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক থেকে। এর কারণটা মূলত অর্থনৈতিক। এ শতাব্দীর শুরুতে পাটের মূল্য বৃদ্ধির ফলেই বাঙালি মুসলমান কৃষকদের হাতে টাকা আসে এবং তাঁদের সন্তানেরা ব্যয়বহুল উচ্চশিক্ষার দিকে এগিয়ে আসতে সক্ষম হন। বিলম্বে আগত মুসলমান শিক্ষিত সমাজ তাই স্বভাবতই চাকরির ক্ষেত্রে হিন্দুদের তুলনায় পিছিয়ে পড়েন। এ পরিস্থিতিও জিন্নার তত্ত্বের সহায়ক হয়ে দাঁড়ায়। যা ছিল ব্রিটিশের সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শােষণের ফলশ্রুতি, সাধারণ মুসলমানদের তাই প্রতিভাত হয় হিন্দু আধিপত্যের প্রকাশ রূপে।
বাল্যাবস্থায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে খেলা এবং পরবর্তীকালেও সাম্রাজ্যবাদীদের সহযােগিতা করা ও তা আন্তরিকতায় আস্থা প্রকাশ হিন্দু-মুসলমান ঐক্য ও সাম্রাজ্যবিরােধী আন্দোলনের পরিবর্তে মুসলমান বিরােধ ও সাম্প্রদায়িকতাকে রাজনৈতিক অস্ত্র ব্যবহার করা এবং অসার দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপন সত্ত্বেও কিন্তু মুসলিম লীগ বা মুসলমান জনসাধারণের রাজনৈতিক পার্টিতে পরিণত হয়। ১৯২০ সালের ১৯২১-২২ সালের, ১৯৩৯ সালের এবং ১৯৪২ সালের ক্রমিক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা আন্দোলনগুলি হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে ভারতের ব্যাপক সাধারণের মধ্যে রাজনীতির …..
বাঙলাদেশ আন্দোলনের পটভূমি। … মধ্যে পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক সংখ্যা ছিল পাকিস্তানের অন্যান্য অংশের তুলনায় সর্বাধিক। পশ্চিম পাকিস্তানে পাঞ্জাব এবং সিন্ধুতে, বিশেষত পাঞ্জাবে ব্রিটিশের গােলাম স্যার সিকান্দার হায়াত ও ছটুরামের মত ইউনিয়নিস্ট পার্টির চরম প্রতিক্রিয়াশীলদের শোষণ অত্যাচারের ফলে মুসলিম লীগের জনসমর্থন কিছুটা। ছিল একথা সত্যি, তেমনি আবার উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মুসলমানদের ব্যাপক অধিকাংশ ছিলেন কংগ্রেস সমর্থক। বেলুচিস্তানে মুসলিম লীগের কোনও পাত্তাই ছিল না। সেখানকার রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মধ্যে বরং কিছুটা কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী প্রভাব ছিল। বস্তুত পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় পূর্ব বাংলার মুসলমান অধিবাসীদের সক্রিয় সমর্থনই চুড়ান্ত ভূমিকা পালন করে। এবং পূর্ব বাঙলায় জিন্নার সাম্প্রদায়িক দ্বি-জাতি তত্ত্বের জনসমর্থন লাভের কারণ আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের ঔপনিবেশিক শােষণের প্রত্যক্ষ ফলশ্রুতিতে বাঙলাদেশের তথ্য ভারতের জনগণের মধ্যে যে ফাটল সৃষ্টি হয়েছিল তার দরুন ভারতের, বিশেষত বাঙলার মুসলমানদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল এমন এক উর্বর ক্ষেত্র যা ব্রিটিশ অনুসৃত বিভেদ সৃষ্টির নীতিকে কার্যকর করতে এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছিল। |
২। সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে কংগ্রেস নেতৃত্বের প্রচণ্ড দোদুল্যমানতা ছিল। তারা সব সময়েই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সাথে রক্ষা করতে উৎসাহী ছিল। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়গুলিতে আন্দোলন প্রত্যাহার করে তারা জনতার মনে হতাশা সৃষ্টি করেছে। এর ফলে মুসলিম লীগ মুসলমান জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার সুযােগ পেয়েছে। মুসলমান জনসাধারণ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী জাতীয় কংগ্রেস এবং সাম্রাজ্যবাদের সাহায্যপুষ্ট ও সমর্থক সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগের মধ্যে কোনও গুণগত পার্থক্য উপলব্ধি করতে পারে নাই। মুসলমান হিসাবে স্বভাবত মুসলিম লীগকেই সাধারণ মুসলমানরা তাদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী সংগঠন হিসাবে বেছে নিয়েছে।
৩। মজুর ও কৃষকদের শ্রেণী দাবীগুলিকে সমর্থন করা তাে দূরের কথা, কংগ্রেস সাধারণত শ্রেণী আন্দোলনের বিরােধিতা করেছে। এক্ষেত্রে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে কোনও তারতম্য লক্ষ্য করা যায় নাই। তাই মুসলমান শ্রমিক কৃষক তথা গরিব মুসলমান শ্রমিক কৃষক তথা গরিব মুসলমান জনতার নিকট কংগ্রেসের কোন বিশেষ আবেদন ছিল না। ৪। ভারতবর্ষ বহুজাতিক দেশ-এদের বিভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি প্রভৃতি রয়েছে। কংগ্রেস প্রকারান্তরে বিভিন্ন জাতির অস্তিত্ব …
| মুক্তিযুদ্ধ। ১: ১২ ২৬ সেপ্টেম্বর, ১১:১৩। ৩ অক্টোবর ও ১:১৫ ১৭ অক্টোবর ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ১০