You dont have javascript enabled! Please enable it!

লন্ডনের চিঠি

বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিয়ে রাজনৈতিক সমাধান জলের উপর আলপনা কাটার নামান্তর | ॥ মাহমুদ হােসেন প্রদত্ত । পাকিস্তান সরকারের পৃষ্ঠপােষকতায় বিশিষ্ট ইংরেজি দৈনিক মর্নিং নিউজের’ করাচী সংস্করণের অন্যতম সহকারী সম্পাদক মি, এ্যান্টনি মাসকারেনহাস সম্প্রতি পাকিস্তান থেকে সপরিবারে এখানে চলে এসে ‘সানডে টাইমস’ পত্রিকায় বাংলাদেশের ‘হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে যে বিস্তারিত বিবরণী দিয়েছেন তাতে থলের বিড়াল। বেরিয়ে পড়েছে। ত্যাগী পাকিস্তানী সাংবাদিক মি, মাসকারেনহাস তােমাকে জানাই অভিনন্দন। | কালজয়ী নির্ভীক সাংবাদিক বন্ধু মি. মাসকারেনহাস প্রদত্ত ‘সানডে টাইমসের’ সেই স্টোরি পাকিস্তানী কাগজ ছাপবে না এ জানি। কিন্তু সকল দেশের স্বাধীন পত্র পত্রিকা তা ছাপিয়েছে সম্ভবত ভারতীয় পত্র পত্রিকাও তা ছাপাতে কুণ্ঠিত হয় নি। এখানে বন্ধু মি, মাসকারেনহাসের সাথে আমার আলাপ হয়েছে। তিনি তার দেশের (পাকিস্তান) অন্যান্য সাতজন সাংবাদিকের সাথে সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিক্ষুদ্ধ বাংলাদেশ সফর করেছেন। প্লেন, হেলিকপ্টার, ট্রেন, মােটর ও স্পিডবােটে তারা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকে দিনাজপুর কমবেশী সব জায়গায় গেছেন। প্রত্যক্ষ করেছেন ধ্বংসলীলা। বিরাট জনপদগুলাে দেখে কান্না পেয়েছে তার।

এই কিছুদিন আগেও বাংলাদেশের যে সব জনপদ ছিল প্রাচুর্যে ভরা, হাসি গানে মুখরিত। সেসব জনপদে এখন কবরের নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। অধিকাংশ ঘর বাড়িতে মানুষ নেই এমন কি নেই জানালা দরজা। দোকান পাট খা খা করছে। সবগুলি দোকানই ভেঙ্গে লুঠপাট হয়েছে। ঘর-বাড়ি দোকান-পাট সহ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি যে লুট ও অগ্নিসংযোেগ করা হয়েছিল তা দেখেই উপলব্ধি করা যায়। দূর থেকে দেখা যায় জনমানবহীন বিধ্বস্ত গ্রামগুলিকে। সরকারি বা বেসরকারি অফিসগুলাে দরজা খােলা থাকলেও কোনাে কর্মচারী দেখেন নি তিনি। যেসব উর্দুভাষী মানুষ তার চোখে পড়েছে তাদের দেহ অনশন ক্লীষ্ট বা রােগাজীর্ণ। আর দেখেছেন অগণিত মানুষের ফসিল। কল-কারখানায় চাকা বন্ধ, মাঠে মাঠে ফসল নেই আছে ঘাস ও অন্যান্য তৃণের সমাহার। আর দেখেছেন জলে স্থলে অন্তরীক্ষে শুধু সেনাবাহিনীর অশুভ পদচারনা। যাদের চোখ বাজপাখির মতাে সর্বত্র শিকার খুঁজছে। সে শিকারটি কি তা আর বলে দিতে হয় না। যদিও পাকিস্তানের সামরিক জুন্টা সরকার সফরকারী সাংবাদিককে পশ্চিম পাকিস্তানের নাগরিক এবং বাংলাদেশে বসবাসকারী উর্দুভাষী বাসিন্দাদের দ্বারা সৃষ্ট কৃত্রিম স্বাভাবিক পরিবেশ দেখানাের চেষ্টা করেছিল কিন্তু তা দিয়ে বিভীষিকাকে ঢাকা যায় নি, যায় না। তবে মাসকারেনহাস আপ্রাণ প্রচেষ্টায় খুব গােপনে এবং সতর্কতার সাথে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাক্ষাত লাভে সমর্থ হয়েছিলেন। তাদের সাথে আলাপ করে তিনি জানতে পেরেছেন কোনাে আপোষ নয়, বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত না করা পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে। মাসকারেনহাসের মন্তব্য এইতাে কথা মতাে কথা । ভেতাে বলে অপবাদ থাকলেও বাঙ্গালিরা সত্যি বীরের জাত। অধিকার সচেতন বাঙ্গালিরা নিজেদের মৌলিক দাবী প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে এ ব্যাপারে কাউকে তােয়াক্কা রাখে না।

মাসকারেনহাসের রিপাের্টে বিশ্বে যে আলােড়ন সৃষ্টি করেছে, এই বিংশ শতাব্দীর সাংবাদিকতার ইতিহাসে এখানে তা অনুভব করা যায়। এখন আর কিছুই লুক্কায়িত নেই বাংলাদেশের চলমান ঘটনাবলির কাছে মাইলাইর হত্যাযজ্ঞ তুচ্ছ বলে এখানে অনেকে অভিমত প্রকাশ করেছেন। অবশ্যি ঘটনার শুরুতে ভারতের বার্তা সরবরাহ প্রতিষ্ঠান পিটি আই বাংলাদেশের জনৈক হাইপারসােনালিটির বরাত দিয়ে এ ধরনের একটি খবর ক্রিড করেছিলেন। তা আজ সত্য বলে প্রমানিত হয়েছে। প্রমানিত হয়েছে যে এটা যখন পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যাপার হতে পারে না। এমনি বাংলাদেশের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিঘােষিত স্বাধীনতা মেনে না নিয়ে কোনও রাজনৈতিক মীমাংসা হওয়াও অসম্ভব ব্যাপার। এটা বিশ্বের জনমত। কারণ পাকিস্তান আর বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষে ভৌগলিকগত ভাবে এবং অনেক দিক থেকে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যহীন। সুতরাং এ দুটোকে এক সুতােয় বেঁধে রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড় করানাে যায় না। আর যেহেতু বাংলাদেশের জনসংখ্যা পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় বেশি সে ক্ষেত্রে নীতিগতভাবে বাংলাদেশের অধিবাসীরা প্রশাসনিক  ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃত্ব মেনে নিতে পারে না। এবং তা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা হলে জলের উপর। আলপনা কাটার নামান্তর।

দৈনিক বাংলাদেশ ১; ৭! ১৮ জুন, ১৯৭১

পশ্চিম পাক দস্যুরা ইসলামের নামে এতকাল শােষণ করেছে

— অধ্যাপক আবদুল হাফিজ

আমার মাকে দেখেছি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করছেন। আবার সংসারে কাজও করছেন। আল্লাহু মানুষের রুজি-রােজগার যােগান, কাজেই যিনি সৃষ্টিকর্তা, যিনি আহার দেন, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন খুবই । স্বাভাবিক ঘটনা। প্রার্থনার মাধ্যমে অদ্যাবধি ধর্মভীরু মানুষ, তার সমস্ত মানসিক সংকটের পরিত্রাণ খুঁজেছে। মাকে দেখেছি, ইসলামের বিধি-বিধান থেকে যাতে তার বিচ্যুতি না ঘটে, সে ব্যাপারে বড় সাবধানে থাকতেন। কিন্তু, এও দেখেছি আশেপাশের প্রতিবেশীদের প্রতি তিনি সর্বদা বিনয়ের সঙ্গে কথা বলতেন, গরিব-মজুরের দুঃখের দিনে তাদের যতটা পারতেন সাহায্য করতেন। রােগ-ব্যাধি হলে সকলের পাশে এসে দাঁড়াতেন। অন্য মায়ের পরামর্শ নিতেন। আরও দেখেছি, বাড়ির গরু-ছাগল হাঁস-মুরগি সকলের প্রতি তার একটা সহমর্মিতা ছিল। জন্তু জানােয়ারের প্রতি অযথা নিষ্ঠুরতা তিনি সইতে পারতেন না। গাছ-পালাও তার স্নেহাদর থেকে বাদ পড়ে নি। কেউ রাতের বেলা গাছের ফল বা পাতা ছিড়লে তিনি ক্ষেপে যেতেন। বলতেন, সবারই বিশ্রাম নেবার সময় আছে এবং গাছপালা তরুলতারও আছে। ধর্ম বলতে আমি আজও যেটুকু বুঝি, সেটুকু আমি শিখেছি আমার মায়ের কাছে। ধর্ম মানে যে শুধু আচার নয়, তার সঙ্গে হৃদয়ের গভীর আত্মীয়তা। দরকার, সেই শিক্ষা মায়ের কাছে আমি পেয়েছিলাম । অন্য কোনাে জাতির বিরুদ্ধে কখনও কথা বলতেন নাঅন্য ধর্মের বিরুদ্ধেও বলতেন না। আমাকে বলেছিলেন, খােদা তাে সবাইকে সৃষ্টি করেছেন, সবাইকে তিনি। আহার দিচ্ছেন। কে ভালাে আর কে মন্দ, সে বিচার করবেন খােদা। কে পাপী আর কে পুণ্যবান, সেটাও তিনিই স্থির করবেন। কাজেই খােদার সৃষ্ট জীব হয়ে অন্যান্য সৃষ্ট জীবের বিচার করবার অধিকার আমার। নেই। দেখাে না, খােদা সকলেরই অন্ন দিচ্ছেন-কে কোন ধর্মে বিশ্বাসী, তা দেখে তাে তিনি অন্ন দেন না। আল্লার দেওয়া আলাে হাওয়া শুধু পুণ্যমানই ভােগ করবে এমন তাে নয় বাবা। পাপী-তাপীরাও তা সমানভাবে। পায়। যদি আল্লাহ স্বয়ং পাপী-তাপী-বিধর্মী সবাইকে তাঁর স্নেহাদর দিতে পারেন সমানভাবে, তাহলে আমার। কি ক্ষমতা যে আমি সবকিছুর বিচার করি। মা যেভাবে বলতেন, সেভাবে আমি বলতে পারি না। শুধু অনুভব। করতাম, কথা বলার সময় মায়ের চোখে বিশ্বাসের আলাে কমণীয় হয়ে ফুটে উঠতাে।

হঠাৎ মায়ের কথা মনে পড়েছিল। মায়ের সঙ্গে কতদিন দেখা হয় নি। আর কি দেখা হবে? হয়তাে হবে । ইয়াহিয়ার খুনী সেনারা দশ লক্ষ খুন করেছে। আরও দশ লক্ষ করবে প্রয়ােজনবােধে। মাগো, তােমার। সঙ্গে যদি আর দেখা না হয়, ক্ষমা করাে আমাকে ক্ষমা করাে তােমার অকৃতজ্ঞ সন্তানকে। মাগাে, শুধু আমি। একা নই, তােমারই মতো স্নেহপরায়ণতা মায়ের কত সন্তান নিখোঁজ হয়েছে। কত যুবক ইয়াহিয়ার জল্লাদ সেনাবাহিনীর হাতে প্রাণ দিয়েছে। আর মাগাে, তুমি কেঁদো না। মনে কোরাে, এই আমার চিঠি। ঠিকানাবিহীন চিঠি আজ যা বলছি-তা বলছি, তােমাকে লেখা আমার চিঠি থেকে।  তুমি তাে ধর্মের কথা বলতে মা। ইয়াহিয়াও ধর্মের কথা বলছে। কিন্তু কী ভীষণ পার্থক্য! পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিপতিরা ইসলাম ধর্মকে নিজেদের সেবাদাসী করে ফেলেছে। ১৯৪৭ সাল থেকে সেই যে। শােষণ শুরু হলাে, তার আর শেষ হলাে না। তােমার তাে মনে আছে মা, ১৯৫৪ সালে একমন ধান বেচে। তুমি আমাকে এক দিস্তা কাগজ কিনে দিয়েছিলে। কারণটা তােমার জানা ছিল না। চন্দ্রঘােনা পেপার মিলের । কাগজ প্রথমে যেতাে পশ্চিম পাকিস্তানে, তারপর ফিরে আসতাে ঢাকায় বিক্রির জন্য। কাগজের এজেন্টরা ছিল সবাই পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিপতি। তামাক চাষের কথা তাে তুমিও জানাে মা। কি হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে তামাক আমরা উৎপন্ন করতাম। অথচ আমরা তার দাম পেতাম না। যে মুহূর্তে তামাক পুঁজিপতির ঘরে যেত, অমনি তার দাম বেড়ে যেত। পশ্চিম পাকিস্তানীরা এভাবেই ধর্মের নামে ইসলামের নামে আমাদের। 

শােষণ করেছে। বলেছে, মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই। কিন্তু আজ তাে দেখছাে মা, আমরা সব ঠাই ঠাই ।। ধর্মের নামে শােষণ বেশিদিন চললাে না। বাঙলার সন্তানেরা সব বুঝে ফেললাে। তাই তারা রচনা করলেন বিপ্লবের পথ, মুক্তির পথ।  মার্চ মাস থেকে শুরু হলাে বিপ্লবের জয়যাত্রা। বাঙলার অগ্নি সন্তানেরা ঝাপিয়ে পড়লেন আন্দোলনে। ইয়াহিয়ার জল্লাদ সেনাবাহিনীও ঝাপিয়ে পড়লাে। ওরা কি বলে জানাে মা, ওরা নাকি ইসলাম ধর্মকে বাঁচাতে এসেছে। বাঙালি জাতটা নাকি উচ্ছন্নে গেছে, তাই তাদের শায়েস্তা করা দরকার। কিন্তু অবাক লাগে যখন ওরা শশাষণ করে। ওদেরকে যদি বলা যায় তােমরা যদি এতই মুসলমান হয়ে থাকে, তাহলে বাঙলাদেশের মানুষকে এভাবে শােষণ করাে কেন? কেন হিন্দু মুসলমানে বিভেদ সৃষ্টি করাে। কেন বাঙালি-অবাঙালির মধ্যে দাঙ্গা বাঁধাও। কিন্তু না ওরা এসব প্রশ্নের জবাব দেয় না। কেননা জবাব দেবার কিছুই থাকে না। কিন্তু তারা ইসলামের কথা বলে। কারণ ওরা সাধারণ মুসলমানকে বিভ্রান্ত করতে চায়। ওরা শশাষণ আর অত্যাচারের কাহিনী গােপন করার জন্যে ইসলামের কথা বলে। আর এখন এই মুহূর্তে ইসলামের নামেই তারা বাঙালি মায়ের সন্তানকে হত্যা করছে। সে হত্যা, খুন, ধর্ষণ, অত্যাচারের কাহিনী শুনবে মা। অবশ্য তুমি তাে চোখের সামনেই সব দেখছাে। তবু বলি মা শােননা।

ওরা কিভাবে ইসলাম ধর্মের সেবা করছে শােনাে। মুসলমানরা নামাজ আদায় করে মসজিদে, সেই মসজিদ ওরা ভেঙ্গে দিয়েছে বহু জায়গায়। একটি মসজিদে মুসলমানরা নামাজ পড়ছে ওরা সেসব নামাজীদেরকে হত্যা করলাে। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ছিল বহু পুরানাে কালীবাড়ী তা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলাে। চট্টগ্রামে বৌদ্ধদের বিহার ও মন্দির ওরা তছনছ করে দিয়েছে। খ্রিস্টানদের গির্জা বাড়ি ও স্কুলঘর ওরা ধ্বংস করেছে। সত্যি মা এমনভাবে ইসলাম ধর্মের সেবা কেউ কখনাে করে নি। সব ধর্মের প্রতি ওরা সমান উদার। কাউকে ওরা রেহাই দেয় না। দশলক্ষ বাঙালিকে ওরা শুধু হত্যাই করে নি, মুসলমান-হিন্দু-খ্রিস্টান সবার মৃতদেহ ওরা শেয়াল-কুকুর, শকুনি-গৃধিনী দিয়ে খাইয়েছে। আজো রাস্তায় রাস্তায় নর-কঙ্কাল পড়ে আছে। নদীতে নদীতে ভেসে যাচ্ছে মৃতদেহ। সেদিন এক জায়গায় দেখছি একটি মৃতদেহ পড়ে আছে। দুটি কাক মৃতদেহের চোখ দুটি উপড়ে নিচ্ছে। মাগাে, আমার কি মনে হয় জানাে, ওগুলাে কাক নয়-ওগুলাে পশ্চিম পাকিস্তানী খুনী জল্লাদদের প্রেতাত্মা। কী অত্যাচার মা। তােমার পেটের সন্তান আমি-অথচ ধরাে তােমার চোখের সামনেই আমাকে যদি ওরা খুন করে। মা তুমি সহ্য করতে পারবে। কিন্তু খুন তাে সামান্য কথা। আমার মা-বােনকে ওরা কীভাবে ধর্ষণ করছে তা ভাবা যায় না। মা-বাপের সামনে মেয়েকে ধর্ষণ করছে ইয়াহিয়ার সেনারা। কিন্তু তাতেও যখন সুখ হলাে না, তখন বেয়নেট দিয়ে আমার বােনদের হত্যা করে। সন্তানের একমাত্র আশ্রয়, মায়ের স্তন্যকে ওরা কেটে নাবিয়ে দিয়েছে। হাজার হাজার মা-বােনকে ধরে নিয়ে গিয়ে সামরিক ছাউনিতে রেখেছে-তাতেও সাধ মেটে নি। আজ তাদেরকে পাঠানাে হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানে ইয়াহিয়া খানের সেবাদাসী করবার জন্যে।

মাগো, এভাবেই ওরা ইসলাম ধর্মের সেবা করছে

মাগাে, ভেবে পাই না, তুমি যে আল্লাকে ডাকো, আর রুদ্ররোষ কেন এদেরকে আঘাত হানে না। কেন ধরণী দ্বিধা হয় না, কেন আকাশ ভেঙে পড়ে না মাথায়, কেন বজ্র এসে এদেরকে ধ্বংস করে না। মাগাে, আমরা বুঝেছি এমনি কিছু হবে না। তাই মা মুক্তি বাহিনীর হয়ে লড়াই করছি। জয় আমাদের সুনিশ্চিত। যদি আর দেখা না হয় মা, তুমি জেনে রেখাে তােমার সন্তান দেশের জন্য লড়ছে। মা, আমারই তাে তােমার একছেলে কবিতা লিখে অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। তার কবিতা তােমাকে পড়ে শােনাচ্ছি : অনেক রক্ত দিয়েছি আমরা, বুঝি আরাে দিতে হবে এগিয়ে চলার প্রত্যেক উৎসবে। তবুও আজকে ভরসা, যেহেতু তােমরা রয়েছে পাশে, তােমরা রয়েছ এদেশের নিঃশ্বাসে। তােমরা রয়েছ, আমরা রয়েছি, দুর্জয় দুর্বার, পদাঘাতে পদাঘাতেই ভাঙব মুক্তির শেষ দ্বার। আবার জ্বালাবাে বাতি, 

 

শেখ মুজিবরের বিচার প্রহসন জঙ্গী শাসন ও পশ্চিমা শোষণে জর্জরিত বাংলাদেশ আজ মুক্তির সংগ্রামে লিপ্ত, বর্বর পশ্চিম পাকিস্তানী। জঙ্গীশাহী বিশ্বের ইতিহাসের সমস্ত অত্যাচারকে স্নান করিয়া দিয়া বাংলাদেশের উপর তুলনাহীন ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করিয়াছে। যাহার ফলে প্রায় আশি লক্ষ লােক শরণার্থী হিসাবে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য। হইয়াছে এবং অগণিত লােক এখনও ভারতে যাইতেছে। পৃথিবীর দুইটি বৃহৎ রাষ্ট্র পাকিস্তানকে অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্য দেওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধবাজদের অত্যাচার বাড়িয়াই চলিয়াছে। এমন কি সে ভারতকে আক্রমণ করার হুমকি দিতেছে। ভারতের অপরাধ সে শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়াছে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতি জানাইয়াছে। অন্যদিকে বর্বর জঙ্গীশাহী জিঘিংসা চরিতার্থ করার জন্য সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিচার শুরু করিয়াছে। বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রই ইহাতে উদ্বেগ প্রকাশ করিয়াছে। তবুও যুদ্ধবাজদের চৈতন্য হয় নাই। ভারত ও সােভিয়েট ইউনিয়ন এই দুই দেশের মধ্যে সম্প্রতি যে শান্তি ও মৈত্রী চুক্তি সম্পাদিত হইয়াছে; তাহাতে হয়ত বা পশ্চিম পাকিস্তানী যুদ্ধবাজদের ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকি স্তিমিত হইতে পারে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে দমন করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধবাজরা যতই অত্যাচার ও গণহত্যা করুক না কেন, উহাকে কোনাে প্রকারে স্তব্ধ করিতে পারিবে না। সম্প্রমি জয় যুক্ত হইবেই। দুনিয়ার কোনাে জাতির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সংগ্রাম নিস্ফল হয় নাই। ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী বিরাট শরণার্থী সমস্যার সমাধান করিতে হইলে বর্তমানে বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করিলে স্বাধীন বাংলা” দেশই ইহার চূড়ান্ত সমাধান। দুনিয়ার সমস্ত গণতান্ত্রিক দেশ ও সকল গণতন্ত্রকামী সংস্থার নিকট আমাদের আবেদন : বাংলাদেশের এই স্বাধীনতা সংগ্রামকে সর্ব রকমে সাহায্য করিয়া জয় যুক্ত করুন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের বিচার প্রহসন বন্ধ করার জন্য বিশ্বের সমস্ত দেশ গুলির সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ। করা উচিত। যদি তাহারা কোনাে বাস্তব পন্থা না নিতে পারেন তবে যে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হইবে, তাহাতে আর কোনাে মীমাংসার পথ উন্মুক্ত থাকিবে না। শ্রী দেবেন্দ্র নাথ ঘোষ (বরিশাল) বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল।

জয়বাংলা (১)১:১৬। ২৭ আগষ্ট ১৯৭১

ডাইরির পাতা থেকে

–অধ্যাপক অরবিন্দ ঘােষ

রাত কতটা হয়েছে ঠাহর করতে পারে না হাসনা, মাথার উপর জমাট বাঁধা কাল আকাশ। একটি তারাও জ্বলে না আকাশে। ভরা ভাদরের বাংলাদেশ, একটু আগে নামে মাত্র বৃষ্টি ধরেছে, দূরে বৃষ্টি ঝরার অস্পষ্ট শব্দ ক্রমশ এগিয়ে আসছে দ্রুত থেকে দ্রুততর গতিতে। জন শূন্য মাঠ, পায়ের নিচে হাঁটু পর্যন্ত কাদা। হাসান হাঁপাচ্ছে আর তার সাথে ছােট বােন হেনা। বাড়ি থেকে প্রাণ নিয়ে নয় দেহ নিয়ে পালিয়ে এসেছে হাসনা। কতক্ষণ কোন পথে ছুটে এসেছে কিছুই বলতে পারবে না। বন বাদাড়, খাল ডােবা পেরিয়ে এখানে এসে হাপাচ্ছে হাসনা। হেনা আর চলতে পারে । অঝাের ঝরে বৃষ্টি ঝরছে, শন্ শন করে বাতাস-হাসনা এক বার চারিদিকে চাইছে যদি কোনাে ধারে এতটুকু আলাের সন্ধান মেলে। ধপ করে শব্দ, চমকে ওঠে হাসনা, কম্পিত কণ্ঠে ডাকে হেনাকে। কোনাে উত্তর আসে না। পায়ের তলায় কি যেন নরম মাংসপিণ্ড আৎকে উঠে হাসনা তবে কি হেনার……। হেনা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে, সমস্ত শরীর হিম হয়ে গিয়েছে, শুধু বুকের কাছে ধক ধক করছে মাত্র। বুকের কাছে হাত রাখতেই হাসনার হাতের তলায় কেমন যেন চট চট করে উঠে আতঙ্কিত হয়ে উঠে হাসনা। সব মনে পড়ে যায় তারই চোখের সামনেই তাে ঘটেছে; হেনাকে জাপটে ধরেছে পেছনে হাত মােড়া দিয়ে আর এক জন। 

মুখে রুমাল চেপে ধরেছে আর একজন ভাবতে পারে না হাসনা বুকের উপর হাত রেখে অনুভব করে হাসনা মাতৃত্বের বহিঃ প্রকাশের একটি অঙ্গ হেনার কামাতুর লােভী জন্তর থাবার আর কামড়ে ক্ষতবিক্ষত। বুকের সাথে পিষে ধরেছিল হেনাকে-এক মুহূর্ত দেরী করে নি হাসনা …।। | ‘৭১ এর ২৭ শে মার্চ হাসনাদের সদর মহকুমা দপ্তর থেকে সান্ধ্য আইন জারি হয়েছে। দেখলেই গুলি ছুড়বে, ভীত সন্ত্রস্থ পৌর এলাকা। বেলা পাঁচটা থেকেই সান্ধ্য আইন ঘােষিত হয়েছে, রাস্তায় রাস্তায় সামরিক যান মেশিন গান উচিয়ে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। সন্ধ্যার আকাশ গাঢ় হলেই সামরিক তালিকাভূক্তদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াবে তারপর গর্জন করে উঠবে হাতের আগ্নেয়াস্ত্র। তারপর সব শেষ হয়ে যাবে; এমনি তৎপরতা চলেছে পশু হানাদারদের। রাত আটটা বেজে কয়েক মিনিট হয়েছে সকলেই রুদ্ধদ্ধারে রুদ্ধশ্বাসেচাপা শব্দ বেতারের……। কী ভীষণ নীরবতা। হঠাৎ রাতের অন্ধকার খান খান করে সামরিক ছাউনী হতে গর্জন করে উঠে মেশিন গান উৎকণ্ঠিত হৃদয় বুঝিবা আবার কি ঘটবে। কি ভয়ঙ্কর দুর্যোগময় ২৭ শের রাত্রি। একদিকে হাজার কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি অপর দিকে মর্টারের আকাশভেদী গর্জন। রাত দশটা। সামরিক ছাউনীর শীর্ষ কেন্দ্রে জয় বাংলার পতাকা। হাজার কণ্ঠের ধ্বনি একবার স্তব্ধ করে দিয়েছে মেশিনগান ও মর্টারের গর্জন। মুক্ত হয়েছে হাসনার সমগ্র মহকুমা অঞ্চল। হাসনা হেনার দু’ভাই মুক্তিযােদ্ধা। নিশ্বাস ফেলার অবকাশ নেই তাদের। মা রােগ শয্যায়, বৃদ্ধ পিতার শত অনুরােধ কোনাে কিছুতেই ঘরে বেঁধে রাখতে পারেনি নবারুণ ও কামরুণকে। নবারুণ বলে জানিস হাসানহেনা আমাদের স্বপ্ন, আমাদের বাঁচার প্রশ্নে আজ বাস্তব হতে হয়েছে হেনা সব কথা বুঝতে পারে না, কেমন যেন জিজ্ঞাসা নেত্রে চেয়ে থাকে। স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দেবে সে। শ্যামলা বরণ, আলুলায়িত কুঞ্চিত মসৃণ চুল, টানা টানা সজল কাজল চোখে ঘুমন্ত দীপ্ত দোহরা গঠন হেনার। ভাইদের মুখের কথা শুনে হেনারও বুক গর্বে ফুঠে উঠে। হেনা যে বাংলার মেয়ে। |

হাসনা বি-এ পরীক্ষা দেবে। দেশ উদ্ধারের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিতা। ওদের রক্ত শপথ মুক্তি সংগ্রামী ভাইদের। সাথে পা মিলিয়ে চলবে। ভাবে হাসনা, কি জঘন্য ষড়যন্ত্র ইয়াহিয়া ভুট্টোর। দেশের সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করেও আমরা হ’ব উপেক্ষিত অসম্ভব। মাথায় খুন চেপে বসে, চোখের কোনে আগুন জ্বল জ্বল করে উঠে। ৩রা মার্চ, সাড়ে সাতকোটি বাঙালির স্মরণীয় দিন। আসন্ন প্রসব যন্ত্রণায় বঙ্গ জননী বিভাের, দীর্ঘ চব্বিশ বছর পর বঙ্গমাতা মুক্তি পাবে লুণ্ঠনকারীর হাত থেকে জন্ম হবে স্বাধীন বাঙালির। অথচ ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস সাড়ে সাতকোটি বাঙালির। সেই দিনই জাতির জন্মলগ্নে জয় ধ্বনির পরিবর্তে বাঙালার আকাশবাতাস কাপিয়ে গর্জন করে জাতিকে অভ্যর্থনা জানাল কামান, মর্টার ও মেশিনগান। ঢাকার রাজপথে রক্তের প্লাবন ক্রমে সেই প্লাবনের ঢেউ লাগল বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে। | হাসনাহেনা আর নবারূণ কামরূণ ঢাকা থেকে কোনাে রকমে দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে অতিক্রম করে ফিরে এসেছে দেশের বাড়িতে। এখন ওদের অনেক কাজ নিশ্বাস ফেলবার অবকাশ নেই ওদের। মুক্ত হয়েছে। নিজের মহকুমার সমগ্র অঞ্চল। কি আশ্চর্য্য পরিবর্তন সকলের। সকলের কণ্ঠে একই হুঙ্কার জয় বাংলা, সকলের চোখে একই স্বপ্ন। সমগ্র মহকুমার প্রশাসনিক ক্ষমতা মুক্তকামী নেতৃবৃন্দের হাতে। স্তব্ধ পঙ্গু হয়ে গিয়েছে ইয়াহিয়ার অফিস আদালত স্কুল কলেজ। কিন্তু ইতিহাস তার তাে মৃত্যু নেই যুগ ও কালের ব্যবধান অতিক্রমে সে এসে দাঁড়ায় সবার অজান্তে। আজ সিরাজ নেই কিন্তু মীরজাফর? সে কি মহাকালের মহাআবর্তে মিশিয়ে নিয়েছে খুঁজে না পাওয়ার অতল গহ্বরের রাস্তায় রাস্তায় বেরিকেড, মােড়ে মােড়ে অতন্দ্র প্রহরী মরণ বরণ করবে তবু তারা এক কদমও এগিয়ে আসতে দেবে না পবিত্র বাংলার মাটিতে। নবারূণ কামরূণের দল আজ রক্ত পাগল। মাথার উপর দিয়ে ঝড় বাদল চলে যাচ্ছে- দিনের সূর্য আগুন ছড়াচ্ছে রাতে আকাশ বজ্ৰ হানছে তবু ওরা অতন্দ্র প্রহরী । যে মাটিতে জন্ম নিয়েছে বীর নবারুণের দল সেই মাটিতে জন্মেছে। মীরজাফর দল। কেমন করে কি যেন হয়ে গেল মুক্ত অঞ্চল। হীন বিশ্বাসঘাতক জাতির কলঙ্ক মীরজাফরের দল গােপনে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল পাক-হানাদারদের সাথে। তারপর যা হবার তাই হ’ল। ১৫ই এপ্রিল হাসান হেনাদের গ্রাম মিলিটারি রেড করেছে, বর্ষণ ধারায় গুলি ছুটছে, অসহায় নিরস্ত্র  গ্রামবাসী। কি পৈশাচিক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। মায়ের বুক থেকে ছেলেকে ছিনিয়ে বেয়নেট দিয়ে এফোড় ওফেঁড় করে মায়ের কোলে ছুঁড়ে দিচ্ছে, বাবার সামনে মেয়েকে ধর্ষণ করেছে দেহলালসার রক্ত ক্ষুধায়। | হতচকিত হাসনা। কদিন থেকে পাড়ার দালাল দেলু ও সাত্তারের অত্যাচার খুব বেড়ে গেছে, রাতের আধারে গ্রামের মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে, লুটপাট করছে সংবাদ দিয়ে আসছে পশু জল্লাদদের কাছে। সমস্ত এলাকা জুড়ে যেন মৃত্যু নেচে নেচে বেড়াচ্ছে কি অজস্র ধারায় গুলি বর্ষণ হচ্ছে। হাসনা ভাবে কেমন করে গ্রামের মেয়েদের নারীত্ব রক্ষা করবে।  ১৮ই এপ্রিলের ভয়ঙ্কর রাত। গত তিনদিন হলাে গ্রাম একবার মিলিটারি রেড করে গিয়েছে; সন্তানহারা মায়ের আর্তনাদে মুখরিত গ্রামের বাতাস হায় ওকে যদি একবার সান্ত্বনা দিয়ে আসতে পারতাম ভাবে হাসনা। মৃত্যু যন্ত্রনায় মা ছট ফট করছে, বৃদ্ধ পিতার দু’চোখ বেয়ে পানি ঝরছে, হেনা ভয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। দেলু আর সাত্তার ভীষণ ভাবে শাসিয়ে গিয়েছে, নবারূণদের খবর বলে না দিলে তাদের ধরে নিয়ে যাবে সামরিক ছাউনীতে। এক অব্যক্ত যন্ত্রনায় ছটফট করছে হাসনা। দরজায় করাঘাত; হাসনা বুঝতে পারে মৃত্যুদণ্ড এসেছে ওদের দ্বার প্রান্তে। মুহূর্তের মধ্যে প্রস্তুত হয়ে যায় হাসনা।

-হাসনা আমি নবারূণ। চীৎকার করে ওঠে হেনা; মুখ চেপে ধরে নবারূণ।- সময় নেই ভেতরে আই হাসনা ….। মা ও বাবার কদম বুচি করে নিঃশব্দে বেরিয়ে যায় নবরূণ। পাশের গায়ে তখন আগুনের লেলিহান শিখা আকাশ লাল করে দিয়েছে রাইফেল ও ব্রেন গান থেকে গুলি ছুটছে। বাইরে জিপ থামার শব্দ। দেলু ডাকছে? সশব্দে গেট ভেঙ্গে ঢুকে পড়েছে জন কয়েক পাক দস্যু। পেছনে দেলু আর সাত্তার। | বাবার ঘরে ভারী বুটের শব্দ করে ঢুকে পশু দু’জন। থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে হাসনা আর হেনা । হাসনার সামনে ভেসে উঠেছে ফুলবানুর দৃশ্য। পশুরা তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে যন্ত্রের মত দেহ পান করেছে; পরের দিন রাস্তার ধারে রক্তমাখা কাপড়ে পড়ে থাকতে দেখেছে। বুক ফেটে দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসে হাসনার – জানি না ওর ভাগ্যে কি আছে! কি বলবে গিয়ে কোনাে উত্তর না পেয়ে বাবা ও মাকে গুলি করে মারল, হাসনা দেখছে, দাঁড়িয়ে তার বাবা মা কি অস্পষ্ট শব্দ করে বুক চেপে ধরে খাটের নিচে লুটিয়ে পড়ল। চীঙ্কার করে ওঠে হেনা। শব্দহীন হাসান। হেনাকে ওরা ধরে ফেলেছে, হাসির স্রোত ওদের ঠোটের কোলে-দেহ পানের উলঙ্গ উৎসবে নেচে উঠেছে ওরা হাসনা দেখছে। হেনার হাত দুটি পেছন দিয়ে মুড়িয়ে ধরেছে দেলু আর সাত্তার। মুখে কাপড় দিয়ে চেপে ধরেছে, হাসনার হাতের মুঠো শক্ত হয়ে ওঠে। হেনার বুকের উপর পশু উঠে বসেছে, বুকের কাপড় লণ্ডভণ্ড-হাসনা দেখছে পশুটা বুকের সাথে চেপে ধরবে হেনাকে …….।  মুহূর্তের মধ্যে গর্জন করে উঠে হাসনার রিভলবার। | হাসনাহেনা ছুটছে আর ছুটছে, হাসনা দেখেছে ওর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় নি, জাতির কলঙ্ক দেলু, সাত্তার আর পশুগুলাে কেউ রেহাই পায়নি হাসনার লক্ষ্য থেকে। হাসনার বড় সান্ত্বনা নবারূণের দেওয়া হাতিয়ার গুর কাজে লেগেছে-এখনও আরাে কয়েকটার কাজ বাকী। সংজ্ঞাহীন হেনা হাসনার কাধে-সংজ্ঞাহীন হেনা হাসনার কাঁধে-হাসনা শুধু ছুটছে, কোথায় ছুটছে জানে না। একবার পেছনে তাকায় হাসনা। পেছনের আকাশ লালে লাল কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে ধুমাে উঠছে- কে জানে কার বাবা মার দেহ এ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল কি না। কে জানে ওখানে কেমন মৃত্যুর উৎসব চলেছে।

আর বলতে পারে না হাসনা-হুচোট খেয়ে পড়ছে, রক্ত ক্ষরিত হচ্ছে তবু হাসনা বলছে তাকে চলতেই | হবে, এখন ও তার অনেক কাজ বাকী। নবারুণের কাছে তার অগ্নি শপথ বৃথা যেতে দেবে না। পাকা রাস্তার মােড় পেয়েছে হাসনা । ‘ডান পাশে থােক থেকে অন্ধকার জমে আছে। হাসনা দেখে এগুলাে ছাউনীর তাবু। পথের পাশে হেনার সংজ্ঞাহীন দেহকে নামিয়ে রাখে। পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় হাসনা; ছাউনীর কোল ঘেঁসে দাঁড়ায়; হাতে শক্তিশালী বিস্ফোঃ হাসনা ভাবে উড়িয়ে দেবে? …..নাযদি শয়তানেরা কেউ না থাকে? কি মৃত্যুশীতল নীরবতা! গাছের মাথায় আলাের ছটা দেখে হাসনা বুঝতে পারে সামরিক গাড়ি আসছে। কিন্তু কি | দেখছে হাসনা পথের ধারে । হেনা উঠে দাড়িয়েছে, সর্বাঙ্গে তার রক্তের ছাপ। হেনাকে তুলে নিয়েছে ওরা গাড়িতে। শিহরিয়ে ওঠে হাসনা। ওরা সব এক এক করে ছাউনীর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে-হেনার বুকফাটা  আর্তনাদ পশুর ছােবল থেকে নিজেকে বাঁচাবার আপ্রাণ চেষ্টা। কয়েক মুহূর্ত: হেনা! আমার বােন বাঙলার বিপ্লবী মেয়ে ওকে যদি রক্ষা করতে হয় তবে হাজার হাজার মা-বােনদের দেহপানকারীরা বেঁচে যাবে। কিন্তু ; তার আদরের হেনা যাক, রক্ষা পাক হাজার হেনা এই ধর্ষণকারীদের হাত থেকে। ভীষণ শব্দ করে পর পর দুটি বিস্ফোরক ফেটে গেল। মুহূর্তের মধ্যে কোথায় উড়ে গেল সব… হাসনা ছুটছে…

বাংলার কথা ১: ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

আমরা ক্ষুদিরামের রক্ত ধারায় প্রাণ পেয়েছি

আমরা সূর্য সেনের রক্ত ধারায় প্রাণ পেয়েছি “রক্ত অনেক দিয়েছি, প্রয়ােজন হলে আরও রক্ত দেব” এ আর আজ শুধু বঙ্গবন্ধুর একার কথা নয়, এ কথা আমাদের সকলের; ক্ষুদিরাম -সূর্য সেনের উত্তপ্ত রক্তধারায় উদ্ধ- অনুপ্রাণিত বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তি পাগল মানুষের।  পৃথিবীর যে কোনাে বৃহৎ বা মহৎ কাজের পেছনে রয়েছে ততােধিক বৃহৎ ও মহৎ আত্মত্যাগের ইতিহাস। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা ধরেই আদায় করে নিতে হয় বাঁচার অধিকার। জীবন মৃত্যুকে যে পায়ের ভূত করতে পেরেছে, সেই তাে জয় করে নিয়েছে মরণ জয়ের মালা। মহাবিপ্লবী কিশাের ক্ষুদিরাম আর সূর্যসেনের দেশপ্রেমের সার্থক উত্তরাধিকারী শেখ মুজিবুর রহমানকে তাই দেখি জেলখানায় প্রবেশের মুহূর্তে বাংলার মাটি মাথায় তুলে নিয়ে বলছেন, “এই মাটির মন্ত্রেই যেন আমার জীবন গড়ে উঠে-এ দেশের মাটিতেই যেন আমার মরণ হয়!” আমরা সবাই সেই বিপ্লব আর মাটির মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছি। 

যে ক্ষুদিরাম ছিল ইংরেজদের চোখে দেশদ্রোহী, সেই কিশাের ক্ষুদিরামের মৃত্যুই ভারতের মানুষকে দিয়েছিল বিপ্লবের মন্ত্র স্বাধীনতার অমর বাণী-স্বাধীন হয়ে মুক্ত হয়ে বেঁচে থাকার অগ্নি শপথ। সেই শপথের পথ ধরে এগিয়ে এসেছেন শেখ মুজিবর আর তার সাত কোটি মানুষ। রক্ত দিয়েই শুধু তারা রাঙা রক্তের ঋণ। ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, প্রফুল্ল চাকি, অর্ধেন্দু দস্তিদার, কল্পনা-প্রীতিলতা হাসতে হাসতে ফাসির রজ্জ্ব গলায় পরে অমর হয়ে আছেন। আমরাও বাঁচব, ওঁদের ঐ রক্তঝরা মৃত্যুর পর এগিয়ে গিয়েই বাঁচব। অনিল … চট্টগ্রামের জালালাবাদ পাহাড়। আজ থেকে অনেকদিন আগে যে পাহাড় শীর্ষে উড়েছিল বাংলার স্বাধীন প্রথম প্রতীক, ঠিক সেই পাহাড় চূড়াতেই গত ২০ শে মার্চ আবার উত্তোলিত হলাে বাংলাদেশের পতাকা। সেদিনের নায়ক ছিলেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের বিপ্লবী নায়ক মাষ্টারদা আর তার ক্ষুদ্র দলের সদস্যরা। আজকের নায়ক বিভিন্ন ফাড়ি দখলের। সারা বাঙলার মানুষ-ক্ষুদিরাম সূর্য সেনের বৈপ্লবিক চেতনার ঐতিহ্যবাহী আমরা সাড়ে সাত কোটি বাঙালি। | আজকের মতাে সেদিনও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের চিহ্নিত করা হয়েছে, বিদ্রোহ এবং সন্ত্রাসবাদীরূপে । জেলে, ফাঁসির মঞ্চে, ফায়ারিং স্কোয়াডে হাসতে হাসতে প্রাণ দিয়েছে দেশ প্রেমিক অসংখ্য বাঙালি তরুণতরুণী। কিন্তু বৃথা যায় নি তাদের সেই রক্তদান আর প্রাণ বিসর্জন। তাদের রক্তবিন্দু থেকে বাংলার ঘরে ঘরে জন্ম নিয়েছে হাজারাে ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন। তাদের দেশপ্রেমের শিক্ষায় শিক্ষিত । বিপ্লবী দীক্ষায় দীক্ষিত এবং মাতৃ মুক্তির মন্ত্রে আঁজ উদ্বুদ্ধ অনুপ্রাণিত বাংলার বীর মুক্তিসেনারা। রাজশাহীর কারাগারে অন্ধকারে যাদেরকে খুন করা হয়েছিল, বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে যাঁরা শহীদ হলেন, আটষট্টি- উনসত্তরে যে সব ক্ষুদিরাম সূর্যসেনের বংশধরদের রক্তধারায় ঢাকার রাজপথ ভেসে গেল-তাঁদের সেই রক্তধারা আজ এসে মিশেছে লাখাে মানুষের রক্ত স্রোতে- সৃষ্টি হয়েছে রক্তের নদী-স্বাধীনতা সংগ্রাম। সালেহা চক্রবর্তী। সম্পাদিকা, মহিলা, বিভাগ, দৈনিক সংবাদ, ঢাকা।

সাপ্তাহিক বাংলা ১:১ ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ 

মত ও পথ–আব্দুল গাফফার চৌধুরী

বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান কোন্ পথে? কূটনীতির মারপ্যাচে? স্নায়ুযুদ্ধের বিস্তারে? না, বিশ্ববিবেক-বিশেষ করে বৃহৎ শক্তিবর্গের শুভবুদ্ধির কাছে আবেদন জানিয়ে সম্প্রতি এই প্রশ্নটিরই একটি চমৎকার জবাব দিয়েছেন ফ্রান্সের বিখ্যাত লেখক আঁদ্রে মরলাে। বিখ্যাত লেখক আঁদ্রে মরলাে। বাংলদেশ সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রস্তুতি কমিটির চেয়ারম্যান শ্রীজয়প্রকাশ নারায়ণের কাছে লিখিত এক চিঠিতে মরলাে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ঘটনা হচ্ছে বিশ্বের বিরাট ও মর্মান্তিক ট্রাজেডি গুলাের একটা। বাংলাদেশের মানুষ এখন কোনাে রাজনৈতিক পদ্ধতি রক্ষার জন্য চেষ্টা করছে না, সে এখন তার জীবন রক্ষার যুদ্ধে ব্যস্ত। তাকে ভিয়েনামের মত আক্রমণের জবাব দিতে হবে। যে জবাবের সার কথা হবে, আমাদের যদি মরতে হয়, আমরা সকলে মরবাে। কিন্তু আমাদের মারতে গিয়ে তােমাদের এত শক্তি ক্ষয় হবে যে, শেষ পর্যন্ত তােমাদের চলে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না।” মরলাে আরও লিখেছেন পিটার শাের, আর্থার বটমলি এই সেদিন মার্কিন সরকারের পররাষ্ট্র নীতির সব চাইতে দুমুখ সমলােচক বলে খ্যাত মি, গলব্রেথ । সকলেই শরণার্থীদের দুঃখে কাতর হয়ে রুমালে চোখ মুছেছেন। তার পরই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সাংবাদিক সম্মেলনের কক্ষে ফিরে গিয়ে বলেছেন, রাজনৈতিক সমাধানের কথা। অর্থাৎ আপােষের কথা। ব্রিটেনের শ্রমিক দলের আর্থার বটমলি সাহেব, যিনি বাংলাদেশে গিয়ে নিজের চোখে দেখেছেন ইয়াহিয়া -টিকার পারবত বর্বরতা, বঙ্গ বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চেয়ে যিনি প্রত্যাখ্যাত হয়ে রেগে ইয়াহিয়াকে আখ্যা দিয়েছিলেন, পাওয়ার ট্রাঙ্ক জেনারেল’ সম্প্রতি তিনিও লন্ডনে বসে নরমসুরে বলেছেন, ইয়াহিয়ার উচিত মুজিবের সঙ্গে কথা বলা। আমরা যাই বলি না কেন, ভারত বা পাকিস্তানের আরাে অঙ্গচ্ছেদ হােক, তা চাই । অর্থাৎ বটমলি সাহেবেরা চান না বলে বাংলাদেশের সাড়ে সাতকোটী মানুষকে স্বাধীনতা ঘােষণা থেকে মরলাে আরাে লিখেছেন, “যে আদর্শবাদ মৃত, তার জন্য-বাংলাদেশের আজ মােটেই মাথা ঘামানাে উচিত নয়।

বরং তার এই প্রবাদ বাক্যটি স্মরণ রাখা উচিত, “হয়তাে আমরা সকলেই মরবাে। তবু কেউ নিরাশ হব না। বাংলাদেশে যা ঘটছে, তাকে গণতন্ত্রের কথা বলা এখন অর্থহীন।” মরলাের বক্তব্যের মধ্যে যে অংশটুকু সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ তা হল, “চল্লিশ বছরের পুরনাে এ্যাংলাে স্যাকসন উদার নৈতিকতাবাদের (লিবারেলিজম) কাছে আবেদন জানিয়ে কিংবা অন্যমনস্ক আমেরিকানদের সুবুদ্ধির উপর ভরসা করে বাংলাদেশের কোন লাভ নেই। বাংলাদেশকে তার আত্মশক্তির উপর নির্ভর করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ সকল সময়ই সাহসের পরিচয় দিয়েছে । দরখাস্ত করে বা আবেদন নিবেদন জানিয়ে কোন লাভ হবে না। যা জরুরী দরকার, তা হচ্ছে সামরিক সংগঠন। বাংলাদেশকে হয় ইতস্তত: বিক্ষিপ্ত যুদ্ধে শেষ হয়ে যেতে হবে, নইলে গেরিলা সৈন্যদের সংঘঠিত করে পাকিস্তানকে পরাজিত করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের মত মহাশক্তিও ভিয়েনামীদের পরাজিত করতে পারে নি।” ফরাসী বুদ্ধিজীবি আঁদ্রে মরলাের কথাগুলাে আমার এতই ভালাে লেগেছে যে, তার বক্তব্যের প্রায় সবটুকই উপরে তুলে দিলাম। বাংলাদেশ প্রশ্নে অকপটে এমন সত্য কথা আর কেউ বলেন নি। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন প্রভৃতি কত দেশ থেকেই না বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদেরা এসেছেন বাংলাদেশের মুক্ত এলাকায়। দেখেছেন যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলার রূপ। ভারতে গিয়ে দেখেছেন শরণার্থী শিবিরে লক্ষ লক্ষ নরনারীর অবর্ণনীয় ক্লেশ। এসেছেন এডােয়ার্ড কেনেডী, সিনেটর পার্সি, সরে গিয়ে বিংশ শতাব্দীর সব চাইতে ভয়াবহ নরমেধ যজ্ঞের হােতা ইয়াহিয়া কবে আপােষ আলােচনার জন্য ডাক দেবেন, তজন্য অপেক্ষা করতে হবে। তাহলে ১৯০৯ সালে পােল্যাণ্ড আক্রমণ করার পর ব্রিটেন কেন যুদ্ধ ঘােষণা করেছিল জার্মানীর বিরুদ্ধে। গণতন্ত্র, মানব স্বাধীনতা রক্ষার অত বহু বিঘােষিত ঘােষণা কি ছিল তাহলে একেবারেই ধাপ্পা? গলব্রেথ সাহেবও পাকিস্তানকে সাহায্য দেয়ার নিক্সন এডমিষ্ট্রেশনের ব্যাপান্ত করে ছাড়েন। কিন্তু কলকাতায় এসে বাংলাদেশের শরণার্থী বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে আলোচনায় তিনি নাকি স্বাধীন বাংলাদেশর ইকোনমিক ভায়াবিলিটি’ সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছিলেন। ষােল লাখ মানুষের যার অধিকাংশ আবার আরব রিফুজি এবং কৃত্রিম পায়ে সৃষ্ট জর্দানের। 

স্বাধীনতা… এবং রাজা হােসেনের সিংহাসন-রক্ষার জন্য আম্মানে সৈন্য প্রেরণের সময় কিন্তু গলব্রেথ সাহেবেরা ইকোনমিক ভাষাবিলিটির প্রশ্ন তােলেন না।- জর্দানের নিজস্ব কোন বাজেট নেই বলতে গেলে। তার বাজেটের মােটা বরাদ্দ আসতে বৃটেনের ‘সার্বসিডি’ থেকে। পরে মিসরের প্রেসিডেন্ট নাসের ও কয়েকটি রাষ্ট্র মিলে এই সাবসিডি দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই জর্দানের ইকোনমিক ভায়াবিলিটিটা কি? এই বিংশ শতাব্দীতে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট এবং সাহায্যদাতা কনসটিয়ামের যুগে ইকোনমিক ভায়বিলিটি কথাটার অর্থ কি অনেকাংশ পাল্টে যায়নি? তাও তাে, বাংলাদেশ জর্দান নয়। তার লােক সংখ্যা সাড়ে সাত কোটী। আয়তন যে-কোন মাঝারি দেশের মত। পাট, চা, তুলা, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সম্পদ। রয়েছে জনশক্তি এবং জলশক্তি। বাংলাদেশের টাকায় আজ পশ্চিম পাকিস্তান শিল্পোন্নত। তিন তিনটে মহানগরী গড়ে তুলেছে সে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে নিজস্ব সম্পদের বলেই সে নিজেকে গড়ে তুলতে পারবে। অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের এটা স্পষ্ট মত। তাছাড়া প্রতিবেশী দেশ বিশেষ করে ভারত, বার্মা, ও নেপালের সঙ্গে তার স্বাভাবিক ব্যবসা বানিজ্য শুরু হলে এবং তাকে পশ্চিম পাকিস্তানী পণ্যের ক্লোজড় মার্কেট হয়ে থাকতে না হলে বাংলাদেশ হবে স্বর্ণপ্রসবিনী, সােনার বাংলা। এতে কোন সন্দেহ নেই। তবু গলব্রেথ সাহেবেরা জেনে শুনেও প্রশ্ন তুলেছেন। সংশয় বাড়াচ্ছেন। কারণটা বাংলাদেশের মানুষ কে না জানে, তা নয়। পাকিস্তানে লগ্নীকৃত আমেরিকার ঢালাও ডলার পুঁজি। বাংলাদেশ ভাগ হয়ে গেলে এই নিয়ােজিত পুঁজির ভবিষ্যৎ যে ফাঁকা। যুক্তরাষ্ট্রের সব চাইতে উদারচেতা মানুষ হিসাবে খ্যাত গলব্রেথ সাহেবকেও ঢােক গিলে বলতে হচ্ছে, ‘স্বাধীন বাংলাদেশের ইকোনমিক ভায়া-বিলটি আছে তাে?”

কেবল এ্যাংলাে-স্যাকসন উদার নৈতিকতার মৃত্যু হয়নি। মৃত্যু হয়েছে সাম্যবাদ সখ্যতারও। নইলে এ যুগে কে ভাবতে পারে, ইয়াহিয়ার মত বর্বর ফ্যাসিষ্টকে মদত জোগাবে চীন। চীনা অন্ত্রে মরছে নিরস্ত্র বাঙালী আর ভিয়েনামীদের রক্ত হাত থেকে মুছে না ফেলা সত্ত্বেও সেই রক্ত মাথা হাতে নিক্সন আমন্ত্রিত নয়াচীনে। কোথায় বিশ্ববিবেক? কোথায় বিশ্ব-মানবতা? সিরিয়া আর মিশর পাশাপাশি দেশ। একই আরব জাতি। একই ভাষায় কথা বলে। ধর্ম ও এক ইসলাম। তবু সিরিয়া ভাগ হয়ে গিয়েছিল মিসর থেকে মুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র থেকে। তাতে ইসলাম বিপন্ন হয় নি। কিন্তু দু’হাজার মাইলের ভৌগােলিক ব্যবধান নিয়ে অবাস্তব উপায়ে গঠিত পাকিস্তান-যার ভাষা এক নয়, সংস্কৃতি এক নয়, এমন কি জলবায়ু এক নয়, স্বাভাবিক কারণে তা বিভক্ত হলে নাকি ইসলাম বিপন্ন হবে। আর তাই নাকি বলছেন মধ্যপ্রাচ্যের কোন কোন মুসলিম দেশ। তাহলে আর কার ভরসা? বিশ্ব বিবেকের দুয়ারে বৃথা করাঘাত কেন? বিশ্ববিবেকের চূড়ান্ত অগ্নি পরীক্ষা হয়নি, বায়াক্ৰায়, এঙ্গোলায়, ভিয়েৎনামে বাংলাদেশের পাশে এখন একমাত্র বন্ধু ভারত। অহিংসাবাদ ভারত। কিন্তু তার অহিংসা মন্ত্রে বিশ্ব-বিবেক জাগ্রত হবে, ইয়াহিয়ার চিত্তশুদ্ধি ঘটবে এমন আশা সম্ভবত : দুরাশা। তাই মরলাে, বলেছেন বাংলাদেশের সামনে এখন একটাই পথ আঘাত-আঘাত-আরাে জোরে আঘাত হানার প্রস্তুতি। এই আঘাত আক্রমণ ও যুদ্ধজয় ছাড়া যারা অন্য পথে বাংলাদেশের সমস্যার সমাধানের কথা ভাবছেন, তারা মায়া মরিচিকার পেছনে ঘুরছেন।

সাপ্তাহিক বাংলা ১:১ ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ১০

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!