You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.16 | স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্রলীগের ভূমিকা - সংগ্রামের নোটবুক

স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্রলীগের ভূমিকা

সিরাজ উদ্দিন আহমেদ প্রাক্তন সভাপতি, সিলেট জেলা ছাত্রলীগ বাংলাদেশে আজকে যুদ্ধ চলছে। এ যুদ্ধকে কেউ দেখছেন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের যুদ্ধ হিসাবে, কেউ দেখছেন পশ্চিম পাকিস্তানীদের শােষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসাবে, কেউ বা দেখছেন দুষ্কৃতকারীদের সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা হিসাবে। কিন্তু সবার উপরে যে সত্য বাংলাদেশের দিকে তাকালে প্রতীয়মান হয়, সে হচ্ছে-বাংলাদেশকে ও বাঙালি জাতিকে দীর্ঘদিনের পরাধীনতা এবং উপনিবেশিকতা থেকে উদ্ধার করার মুক্তিসংগ্রাম।  দীর্ঘ দিনের পরাধীনতা ও ষড়যন্ত্রের ফলে সৃষ্ট গুটিকয়েক পরগাছা ছাড়া প্রত্যেকটি বাঙালি আজকের এই সংগ্রামে যােগ দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, এটা কোনও রাজনৈতিক দল বা গােষ্ঠী বিশেষের সংগ্রাম নয়, এটা বাঙালি জাতির সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম!

কূটনৈতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত করে চিরতরে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে নস্যাৎ করার মানসে স্থায়ী ধারাবাহিক এমন কি আন্তর্জাতিক পরিকল্পনার শিকারে পরিণত হয়েও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে টিকিয়ে রাখতে এবং আজকের এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জন্ম দিতে দীর্ঘকাল থেকে প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে ‘ছাত্রলীগ (পাকিস্তানের কাঠামােতে থাকাকালে এই সংগঠন অবশ্য ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’ নামে পরিচিত ছিল)।  পাকিস্তানের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে যখনই বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের উপর আক্রমনাত্মক কোনও ষড়যন্ত্রের আভাস পাওয়া গেছে, তখনই সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সুষম অর্থনৈতিক বন্টনের নিশ্চয়তা দানকারী এই জাতীয়তাবাদী সংগঠনটি সুদৃঢ় হস্তে তার মােকাবেলা করেছে।

সাম্প্রতিককালে পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিভিন্ন ষড়যন্ত্র বাঙ্গালিদেরকে স্বতন্ত্র করে ভাবার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। বিশেষ করে ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং ১৯৭০ সালে সামুদ্রিক জলােচ্ছ্বাস আমাদের অসহায়তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। তাই গত নির্বাচনে বাঙ্গালিদের বিজয়ের পর থেকেই একটা কালাে হাতের আভাস পাওয়া গেল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। নির্বাচন ওয়াদার মাধ্যমে ছাত্রলীগ দেশের জনগণকে সংগঠিত করার কাজ চালাতে থাকল।  বিজয়ীদের পরামর্শকে অবজ্ঞা করে কুচক্রীদের ইচ্ছানুযায়ী জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের তারিখের দু’দিন আগে আকস্মিকভাবে অধিবেশন বাতিল করে দেয়ায় বেশ কিছুদিনের সুপ্ত সন্দেহ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। কালাে হাতের অস্তিত্ব প্রকাশ পেল, ষড়যন্ত্র ধরা পড়ল। তাই, অধিবেশন বাতিল ঘোষণার সাথে সাথে ছাত্রলীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করা, বাংলাদেশের সর্বশ্রেণীর জনতা ও ঘােষণাকে স্বাগত জানালাে।

ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং আজকের মুক্তি সংগ্রামের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অহিংস অসহযােগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। সর্বোচ্চ সরকারি কর্মচারী থেকে শুরু করে দিন-মজুর পর্যন্ত সবাই বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দিলেন। ষড়যন্ত্রকারীদের টনক নড়ে উঠল। সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু আন্দোলনের গতিনির্দেশ করে দিলেন। এরই মধ্যে ছাত্রলীগ বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীতের নমুনা দিলেন সবাইকে। বাংলাদেশের মানুষ এ দুটি জিনিসকেই লুফে নিলেন। সামনে আসল ২৩ শে মার্চ। ১৯৪০ সালে এই দিনে লাহােরে শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক। ব্রিটিশের অধীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতার দাবী করতে গিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন। পরে অবশ্য কূটনৈতিক চালে সে দাবীকে বাস্তবায়িত করা যায় নি। ছাত্রলীগ এ দিবসটিকে জাতীয় দিবস হিসাবে গ্রহণ করে এবং সরকারিভাবে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলনের বিপক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের কর্মসূচি ঘােষণা করে। সামরিক ছাউনিগুলাে ছাড়া বাকি সর্বত্র বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতার প্রতি বাংলাদেশের মানুষের সমর্থনও সেদিন পরীক্ষা হয়ে যায়। এখানে উল্লেখযােগ্য যে। পাকিস্তানের বিভিন্ন জাতীয় দিবসে যতগুলাে পাকিস্তানী পতাকা উডডীন দেখা যেত, সেদিন তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি দেখা যায় বাংলাদেশের নতুন পতাকা। স্বাধীনতার প্রতি এই দিনের সমর্থন পাকিস্তানী সামরিক শাসক-চক্র ও তার পদলেহীদের বিভ্রান্ত করে দেয় তারা দিক বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ে। জঙ্গীচক্র এই আন্দোলনের প্রবণতা এবং জনসাধারণের মনোেবলের দৃঢ়তা দেখে ভেংগে পড়ে। ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে তাদের কেউ কেউ বাংলাদেশ থেকে পাততাড়ি গুটাবার পরামর্শ দেয়। পরিশেষে তারা সিদ্ধান্ত নেয় মরণ কামড় দেবীর।  ২৫শে মার্চ রাত্রির অন্ধকারে কোনােরকম হুঁসিয়ারী সংকেত না দিয়েই দুনিয়ার সর্বশ্রেণীর সভ্যতার মুখে  কলংক লেপন করে বর্বরভাবে জঙ্গীশাহী আক্রমণ চালায় বাঙালিদের উপর। শুরু হয় স্বাধীনতা সংগ্রামের উপর চরম আঘাত। ছাত্রলীগের সদস্যরা আগে থেকেই সামরিক প্রশিক্ষণ শুরু করেছিল। তারা এগিয়ে আসে এ হামলা প্রতিরােধ করতে। তাদের এ হামলাকে প্রতিরােধ করতে তথা বাংলাদেশকে শত্রুদের হাত থেকে উদ্ধার করতে তরুণ। ছাত্রলীগ কর্মীরা আজকে দলে দলে সামরিক শিক্ষা গ্রহণ করছে। ‘বাংলা মাকে মুক্ত করতে হবে’- ছাত্রলীগের এই দৃঢ়-প্রত্যয়ের সামনে পাকিস্তানী সামরিক চক্র দিন দিন কাবু হচ্ছে আর আমাদের বিজয় নিশ্চিত ও ত্বরান্বিত হচ্ছে।

সাপ্তাহিক বাংলা ১:১৫ ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ১০

বাংলাদেশের ছাত্রআন্দোলনের ইতিহাস ১৮৩০ থেকে ১৯৭১ ড মোহাম্মদ হান্নান