You dont have javascript enabled! Please enable it!

ইয়াহিয়ার শয়তানী চাল

১২ই অক্টোবর রাতে নরঘাতক ইয়াহিয়া খান যে বেতার ভাষণ দিয়াছে তার সারমর্ম হইল ভারতের বিরুদ্ধে বিষােদাগার ও যুদ্ধের হুংকার । অবশ্য, এই সঙ্গে সঙ্গে খুনী ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য তার। “পরিকল্পনা ও প্রকাশ করিয়াছে। ভারতের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া খানের বিষােদগার ও যুদ্ধের হুংকারে আমরা বাঙলাদেশের জনগণ-মােটেই বিস্মিত হই নাই। ১৯৫২ সনের ভাষা আন্দোলন হইতে শুরু করিয়া ১৯৬৮-৬৯ সালের গণ অভুথান পর্যন্তবাংলাদেশে যতগুলি গৌরবময় গণ সংগ্রাম অনুষ্ঠিত হইয়াছে, সে সমস্ত সংগ্রামকে বিধ্বস্ত করার জন্য পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগােষ্ঠী সব সময়ই একদিকে তার দমননীতি চালাইয়াছে, অন্যদিকে গণমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য ঐ সব গণসংগ্রামকে ভারতের কারসাজি’ বলিয়া প্রচার করিয়াছে। নরপশু ইয়াহিয়া খানও সেই ঐতিহ্য অনুসরণ করিয়া আমাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের বিরুদ্ধে একদিকে লেলাইয়া দিয়াছে তাদের বর্বর সেনাবাহিনী এবং অন্যদিকে অনুপ্রবেশ, “ভারত কর্তৃক দুষ্কৃতকারীদের অস্ত্র ও অর্থ সাহায্য দান” প্রভৃতি কাহিনী প্রচার করিয়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে দেশের ও দুনিয়ার জনগণের মনে একট বিভ্রান্তি সৃষ্টি করিতে চেষ্টা করিয়াছে। | কিন্তু, বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের বিরুদ্ধে খুনী ইয়াহিয়া চক্রের পশুশক্তি প্রয়ােগ বা ভারত বিদ্বেষী প্রচার, এর কোনােটাই কার্যকর হয় নাই। দুনিয়ার জনমতও ইয়াহিয়া চক্রের ঐ প্রচারে বিশ্বাস স্থাপন করে নাই। বরং সােভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার অধিকাংশ দেশ সহ দুনিয়ার বহু দেশ বাংলাদেশে ইয়াহিয়া চক্রের গণহত্যা প্রভৃতির কঠোর নিন্দা করিয়াছে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি ও বাংলাদেশের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান দাবি করিয়াছে। বস্তুতপক্ষে, বাংলাদেশ ইয়াহিয়া চক্রের পক্ষে আজ এক দারুণ সমস্যা সৃষ্টি করিয়াছে। মুক্তি বাহিনী ও গেরিলা বাহিনীর হাতে পাক সেনাদল ও রাজাকাররা অবিরত নাজেহাল হইতেছে এবং উহাদের বহু ক্ষতি হইতেছে। তা ছাড়া, বাংলাদেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত।

অনেক কল-কারখানা বন্ধ। যে-সব কল-কারখানা। খােলা আছে, সেগুলি ও চলে আংশিকভাবে। মুক্তিবাহিনী ও গেরিলাদের অবিরত আক্রমণে রেল চলাচল ও অন্যান্য পরিবহন ব্যবস্থায় দারুণ বিশৃঙ্খলা। সমগ্র ব্যবসা বাণিজ্যে সংকট। অথচ বাংলাদেশ হইল পশ্চিম পাকিস্তানের ২২টি একচেটিয়া পরিবারের শিল্পজাত পণ্যের প্রধান বাজার। বাংলাদেশের পাট প্রভৃতি কাঁচামাল হইতেই পাকিস্তানের শােষকরা সবচেয়ে বেশি বিদেশী মুদ্রা অর্জন করে। সেই বাংলাদেশের অর্থনীতির ঐ বিপর্যস্ত অবস্থা হেতু পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতিতেও সংকট দেখা দিয়াছে। সেখানে বেশ। কিছু কারখানায় লক আউট ঘােষণা করা হইয়াছে এবং শ্রমিকদের ছাঁটাই ও লে-অফ করা হইতেছে।  

এই পটভূমিতেই আসিয়াছে ইয়াহিয়ার ১২ ই অক্টোবরের ভাষণ। ঐ জল্লাদের ভাষণ হইতে বুঝা যায় | যে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের অস্ত্র ও অর্থ সাহায্য এবং চীনের নেতাদের সমর্থনের উপর নির্ভর করিয়া ইয়াহিয়া-চক্র এখন ভারতের সঙ্গে একটা যুদ্ধ বাধাইতে চাহিতেছে। ঐ খুনীর দল হিসাব করিতেছে যে, পাক-ভারত যুদ্ধ বাধাইয়া দিলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টা চাপা পড়িয়া তখন গােটা ব্যাপারটা হইয়া দাড়াইবে পাক-ভারতের ভিতর বিরােধের বিষয়। সে অবস্থায় মার্কিনী সাম্রাজ্যাৰদীরা ‘শান্তি’ ‘শান্তি’ বুলি তুলিয়া জাতিসংঘের মাধ্যমে আমাদের দেশে হস্তক্ষেপ করিতে পারিবে এবং এইভাবে আমাদের স্বাধীনতা। সংগ্রামকে বিপর্যস্ত করা যাইবে। | এই হিসাব করিয়াই ইয়াহিয়া খানের ১২ ই অক্টোবরের ভাষণে যুদ্ধের হুংকার ছাড়া হইয়াছে। বাংলাদেশ। নিয়া পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী যে মরণ-সংকট পড়িয়াছে, তাহা হইতে বাঁচার জন্য আজ তারা মরিয়া হইয়া পাক-ভারত যুদ্ধ বাধাইবার জুয়াখেলায় মাতিয়া উঠিয়াছে। | বাস্তবক্ষেত্রেও এই যুদ্ধের প্রস্তুত চলিতেছে। বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলগুলিকে পাক সেনাদল এখন নুতন নুতন ঘাটি, বাংকার প্রভৃতি স্থাপন করিতে সচেষ্ট রহিয়াছে। প্রকাশ যে যুদ্ধ প্রস্তুতির একটা অঙ্গরূপেই সীমান্তের বহু গ্রামে নতুন করিয়া গণহত্যা প্রভৃতি চালাইয়া সে অঞ্চলগুলি জনশূন্য করিয়া ফেলা হইতেছে, যাতে সামরিক ঘাঁটি বিমান ও সেনা চলাচলের কোনাে অসুবিধা না হয়। বিভিন্ন দেশের বেতার সংবাদে এটাও। প্রকাশ যে, পশ্চিম পাকিস্তান-ভারত সীমান্ত বরাবরও পাক সেনাদল সমাবেশ করা হইতেছে। কাজেই পাক ভারত যুদ্ধের বিপদ সম্পর্কে আত্মসন্তুষ্ট থাকার কোনাে অবকাশ নাই।। ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুংকার দেওয়া ছাড়া ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণে “২০ শে ডিসেম্বর শাসনতন্ত্র ঘােষণা”, ‘১৭শে ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের অধিবেশন” ও “সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার গঠন” প্রভৃতি যে-সব কথা বলা হইয়াছে সে সম্পর্কে বেশি আলােচনার প্রয়ােজন নাই। | গত নির্বাচনে যে-দল জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করিয়াছিল, সেই আওয়ামী লীগ এখনও বেআইনী। বাংলাদেশের জনগণের অবিসংবাদী নেতা শেখ মুজিবর রহমান এখনও বন্দি। বিচারের প্রহসনে তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র চলিতেছে । | সর্বোপরি পাক সেনাদল এখনও বাংলাদেশে গণহত্যা ও অন্যান্য পাশবিক নির্যাতন চালাইতেছে। সামরিক আইন এখনও জারি আছে। এই অবস্থায়, ‘উপ-নির্বাচন’ বা শাসনতন্ত্র ঘােষণা” প্রভৃতি যে একটা দারুণ প্রহসন তা বেশি ব্যাখ্যার প্রয়ােজন পড়ে না।

 তবুও ইয়াহিয়া চক্র উপ-নির্বাচন প্রভৃতির কথা বলিতেছে কেন? কারণ, ঐ খুনীর দল দুনিয়াকে বুঝাইতে চায় যে, “বাংলাদেশের অবস্থা এখন স্বাভাবিক এবং পাকিস্তানের শাসকরা এখন “ক্ষমতা হস্তান্তর” ও “গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নিয়াছে। কিন্তু গােলমাল বাধাইতেছে ভারত। এইভাবে দুনিয়ার সামনে একটা সাফাই গাহিয়া পাক ভারত যুদ্ধ বাধাইবার চক্রান্তই ইয়াহিয়াচক্র করিয়াছে।  বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী প্রতিটি মানুষকে, প্রত্যেকটি মুক্তি যােদ্ধাকে ও প্রতিটি গণতান্ত্রিক কর্মীকে আজ ইয়াহিয়াচক্র ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের এই যুদ্ধ চক্রান্ত সম্পর্কে হুশিয়ার থাকিতে হইবে এবং ইহার মােকাবিলা করিতে প্রস্তুত হইতে হইবে। আমাদের মুক্তি যুদ্ধকে বিধ্বস্ত করার জন্যই ঐ প্রতিক্রিয়াশীলরা এই উপমহাদেশে মানব-বিধ্বসী যুদ্ধের আগুন জ্বালাইতে চাহিতেছে। ইহার জবাবে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে এখন আরও তীব্র এবং আরও প্রসারিত করিতে হইবে। মুক্তিযুদ্ধের প্রবলতর আঘাতেই সমস্ত যুদ্ধ চক্রান্ত ব্যর্থ। করিতে হইবে। সেজন্য প্রয়ােজন হইল সমস্ত মুক্তি যােদ্ধা এবং সমস্ত গণতান্ত্রিক ও সংগ্রামী শক্তির ভিতর সুদৃঢ় একতা। বস্তুত, ইয়াহিয়ার জঙ্গী ভাষণ এবং পাক শাসকবর্গ ও মার্কিনী সাম্রাজ্যবাদীদের যুদ্ধ চক্রান্ত আমাদের মুক্তি সংগ্রামের সম্মুখে যে সমস্যাবলী সৃষ্টি করিতেছে, সে পরিস্থিতিতে সমস্ত গণতান্ত্রিক ও সংগ্রামী শক্তির এবং সমস্ত মুক্তিযােদ্ধাদের ভিতর সকল স্তরে সুদৃঢ় একতা গঠন আজ আরও জরুরি হইয়া উঠিয়াছে। এই কর্তব্য সম্পাদন ও মুক্তিযুদ্ধকে তীব্রতর করিয়াই ইয়াহিয়ার চ্যালেঞ্জের মােকাবিলা করিতে হইবে।

মুক্তিযুদ্ধ ॥ ১: ১৫। ১৭ অক্টোবর ১৯৭১ 

চলাে চলাে ঢাকা চলাে

মাত্র ক’দিন আগে মুক্তাঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর ক্যাডেট অফিসারদের ট্রেনিং সমাপ্তির অনুষ্ঠানে আমাদের অস্থায়ী। রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছেন, “সেদিনের আর বেশি দেরি নেই, যেদিন শত্রুর জেল থেকে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে এসে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ করবেন। সেদিনই হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার পূর্ণতা প্রাপ্তি। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আরাে বলেছেন, “মুক্তি বাহিনীর বীর যােদ্ধারা শীঘ্রই পাকিস্তানী হানাদারদের বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করবে।’ সৈয়দ নজরুলের এই ভাষণের বিবরণ বাসি হতে না হতেই খবর এসেছে সিলেটের শিল্প নগরী ছাতক স্বাধীন বাংলার পতাকা। উডঙীন হয়েছে। এই নিবন্ধ যখন লেখা হচ্ছে, তখন ছাতক বাজার দখলের জন্য হানাদারদের সঙ্গে মুক্তি বাহিনীর প্রবল যুদ্ধ চলছে। সম্ভবত এই সংখ্যা “জয়বাংলা’ প্রকাশিত হওয়ার আগেই শুধু ছাতক বাজার নয়, সিলেট শহরেও স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়বে। মুক্তিবাহিনী ইতিমধ্যেই সুরমা নদীর উত্তর পাড়ে নগরী ছাতক দখল করার পর সিলেট টাউনের সঙ্গে ছাতকের রেল ও সড়ক যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন। | মুক্তি বাহিনীর ট্রেনিং সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে সর্বাত্মক মুক্তি যুদ্ধেরও প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। হানাদারদের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনা নৌযান দ্বারা ইতিমধ্যেই স্বাধীন বাংলাদেশের নৌবহর গড়ে তােলা হয়েছে। বাঙালি বৈমানিকেরা আকাশ-যুদ্ধের ও প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ এবার শুধু হিট এ্যাণ্ড রান’ পদ্ধতির গেরিলাযুদ্ধ নয় এবার সম্মুখ যুদ্ধ । নারীঘাতী-শিঘাতী হানাদার বর্বরদের সমুচিত শিক্ষা দেয়া এবং তাদের সমূলে ধ্বংস করার জন্য মুক্তি বাহিনী এখন সবরকম প্রস্তুত। 

সুনিশ্চিত পরাজয়ের আশঙ্কায় ইয়াহিয়ার অবস্থা এখন ফাদে পড়া পাগলা কুকুরের মত। বিদেশী সাংবাদিকের ভাষায় এখন সে trapped animal। ইরান সফরে গিয়ে ইয়াহিয়া সােভিয়েট প্রেসিডেন্ট পদগনি সহ কয়েকজন রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে ধরণা দিয়েছেন। কিন্তু এই ‘মিথ্যাবাদী রাখাল বালককে বাঁচাবার জন্য এবার আর কেউ এগিয়ে আসতে রাজি নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সাফ বলে দিয়েছে, কোনও সালিশির। মধ্যে সে নেই। | এখন ইয়াহিয়ার সামনে একটি মাত্র পথ খােলা রয়েছে তাহলাে, মুক্তি বাহিনীর হাতে পরাজয় স্বীকারের চাইতে ভারতের উপর সব দোষ চাপিয়ে ভারত আক্রমণ এবং ভারতের হাতে পরাজিত হওয়ার গৌরব। অর্জন। এই গেীরব অর্জনের জন্যই এই পশুর চাইতেও নিকৃষ্ট দ্বিপদ জন্তুটি ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধায়ােজনে। মেতে উঠেছে। এই যুদ্ধায়ােজনের মধ্যেই ইয়াহিয়া সহ পাকিস্তানের বর্বর জঙ্গীতন্ত্রের পতন ও মৃত্যু নিহিত। এই অবধারিত পতন ও ধ্বংসের দিকেই এগিয়ে চলেছে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের জারজ সন্তান পাকিস্তানী। জঙ্গীতন্ত্র। এই জঙ্গীতন্ত্রের কবরের উপরেই সারা এশিয়ার জন্য শান্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের নতুন ফুল প্রস্ফুটিত হবে। দ্বিতীয় মীরজাফরের মৃত্যু বাংলাদেশের আকাশে এক জঘন্য কুগ্রহের আবির্ভাব ঘটেছিল প্রায় এক দশক পূর্বে। সেই কুগ্রহের নাম আব্দুল মােনেম খান। বাংলাদেশের মৃত্যু ভাবনাহীন দুই দামাল মুক্তি যােদ্ধা সেই মােনেম নামধারী পাপাত্মা। কুহকে বধ করেছে।

 বাংলাদেশের মানুষের কাছে মােনম খান শুধুমাত্র একটি নাম নয়, শুধুমাত্র একটি ব্যক্তি নয়। মােনেম। খান অত্যাচারী, ষড়যন্ত্রকারী আর দেশদ্রোহীদের প্রতীক। পিভি-ইসলামাবাদের এই পা-চাটা জীব বিশেষ বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার হরণের বিশ্বস্ত লাঠিয়াল হিসেবে সারা বাংলায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। মুছে দিতে চেয়েছিল বাংলাদেশের মানুষের জাতীয় সত্বা। নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল বাঙালির নিজস্ব ভাষা, সাহিত্যে আর সংস্কৃতি। জঘন্য আক্রমণ চালিয়েছিল বাংলাদেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিবুদ্ধি সম্পন্ন বিবেকবান শিক্ষকদের ওপর। জাতীয়তাবাদী ও প্রগতিশীল জাগ্রত ছাত্র সমাজের নৈতিক চরিত্র ভেঙে দেয়ার জন্যে শিক্ষায়তনের অভ্যন্তরে গড়ে তুলেছিল একশ্রেণীর পােষা গুণ্ডাবাহিনী। শিক্ষায়তনে তারা ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছিল, শিক্ষার পবিত্র অঙ্গনকে করেছিল কলুষিত। 

এরই আরও মৃণ্য, আরও বর্বর আর পৈশাচিক রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি পঁচিশে মার্চের মধ্যরাত থেকে, | ইয়াহিয়ার জল্লাদবাহিনীর হত্যাকাণ্ডের মধ্যে। এটা মােনেম খান অনুসৃত নীতিরই পরবর্তী চরম পর্যায় । তাই মােনেম খান নিধনের তাৎপর্য কেবলমাত্র একটি ব্যক্তিকে বধ করার তাৎপর্যই নয়। বাংলাদেশের মানুষকে ঔপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খলে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখার জন্যে পিন্ডি-ইসলামাবাদ- লাহাের চক্রের যে দৃশ্য অদৃশ্য সহস্র বাহু বাংলাদেশের মানুষের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে শাখা প্রশাখা বিস্তার করেছিল এদেশী দালালদের সহযােগিতায় মােনেম খান নামটি তারই প্রতীক। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তিকামী মানুষ ও তাদের মুক্তি যুদ্ধের অগ্রসেনা মুক্তি বাহিনীর সংগ্রামও সেই সহস্রবাহু উপনিবেশিক দানবেরই বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের মাটিতে জন্মে বাংলাদেশের জলবায়ুতে বর্ধিত হয়ে যে দালালরা সেই সহস্র বাহু উপনিবেশিক দানবকে এদেশের অধিকার হরণে, রক্তক্ষরণে সাহায্যে করেছে ও করছে তাদেরকে সমূলে উচ্ছেদ করাও এই মুক্তি সংগ্রামের অপরিহার্য অঙ্গ। তাই মােনেম-বধের তাৎপর্য শুধু ওই একটি ব্যক্তিকে বধ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। স্বৈরাচার আর দেশদ্রোহীতার এই প্রতীককে হত্যা বাংলাদেশের সকল দেশদ্রোহী দালাল, বাংলাদেশের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার শত্রুর, নারী ও শিশুঘাতী, গণহত্যাকারী জল্লাদদের সমর্থকদের মৃত্যু পরােয়ানা আরও বাস্তব আরও প্রত্যক্ষ করে তুলেছে।

জয়বাংলা (১): ১: ২৪ ২২ অক্টোবর ১৯৭১।

আমাদের স্বাধীনতা

সংগ্রাম রক্তের একটা নদী পেরিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে-এর সত্য আজ বিশ্বের প্রতিটি মানুষের কাছে দিবালােকের মতাে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করলেও হানাদার মুক্ত হতে পারে নি আজো। সাম্রাজ্যবাদ পুষ্ট পশ্চিম পাকিস্তানের বর্বর সৈন্যরা রাহুগ্রাসের মতাে বাংলাদেশ আঁকড়ে আছে। | এই পশ্চিমা নাগপাশ থেকে জননী জন্মভূমি মুক্ত করতে হলে সর্বাগ্রে চাই একতা। মুক্তিযােদ্ধারা যেমন আজ বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে একতাবদ্ধ হতে পেরেছে তেমনি জনগণকেও একতাবদ্ধ হতে হবে। প্রতি মুহূর্তে স্মরণ রাখতে হবে একটা দেশের মুক্তি আন্দোলন তখনই সার্থক হয় যখন সে দেশের জনগণ সমস্ত সংকীর্ণতার উর্ধে উঠতে পারে। তার চেয়েও বড়কথা আমরা এমন একটা দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছি, যে দেশের সৈন্যরা আমাদের ঘর পুড়িয়েছে, মা-বােনের ইজ্জত ছিনিয়েছে, বাবা-ভাইকে নির্মম ভাবে হত্যা করেছে, এক কথায় মনে রেখেই স্বাধীনতা আন্দোলনে সবাইকে অংশ গ্রহণ করতে হবে। স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের জাতীয় কর্তব্য। | বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে আজকে যে সমস্যা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হলাে রাজনৈতিক মতানৈক্য। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিক কোন্দল মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। এতে আন্দোলন বিঘ্নিতই হবে। আজকে জাতির যুগসন্ধিক্ষণে দেশমাতৃকার মুক্তিই প্রতিটি দলের সমর্থকদের মুখ্য লক্ষ্য হওয়া উচিত। রাজনৈতিক মতামতের সময় অনেক পাওয়া যাবে কিন্তু আজকের এই পরম মুহূর্তকে যদি কোন্দলের দ্বারা অবহেলা করা হয় তাহলে আগামী দিনের বংশধররা কিছুতেই আমাদের ক্ষমা করবে না। | কে কতটুকু ক্ষমতা আঁকড়ে আছে এই সংকীর্ণতার বেড়াজাল ভেঙ্গে জাতির দুর্দিনে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এক কাতারে। মানুষের চেয়ে মানুষের কর্ম বড়। তাই ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করলে তাকে ছুঁড়ে ফেলা হয় জাতির অঙ্গন থেকে ডাষ্টবিনে, তা এই পৃথিবীর শুরু থেকে হয়ে আসছে। | জনতাই দেশের মালিক। দেশ স্বাধীন হলে কোন দল কিংবা কোন ব্যক্তি দেশের প্রকৃত বন্ধু তার বিচার করবে দেশের জনতা, তাই আমাদের উচিত জনতার সামনে সেই দিনটি উপস্থিত করা। সেই শুভদিনটির জন্য দলমত নির্বিশেষে মুক্তিযােদ্ধাদের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে। কোন দল বা মতের ভাবাদর্শে উদ্বুব্ধ না হয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্যার্থে কিংবা মুক্তিযােদ্ধা হতে প্রতিটি দলের প্রতিটি সমর্থককে এগিয়ে আসতে হবে। এ সংগ্রামে যদি আমরা উত্তীর্ণ হতে পারি তবে বিশ্বে বাংলাদেশকে নিয়ে সমস্ত ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে। অচিরেই বাংলাদেশকে হানাদার মুক্ত করা যাবে। 

বাংলাদেশের অনেক হিন্দু যুবকদের মুখে শােনা যায়, “আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচার হয়েছে সবচেয়ে বেশি অতএব আমরা স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দেব কেন?” অত্যাচার হয়েছে একথা সত্য। কিন্তু এমন ধারণা পােষণ করে এখনাে যারা মুক্তির সংগ্রাম থেকে দূরে সরে আছে তাদের উদ্দেশ্যে আমরা এ কথাই বলব যে, তারা ভুল ধারণা পােষণ করে এখনাে তুচ্ছ সংকীর্ণতার আবর্তে হাবুডুবু খাচ্ছে। পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভের পর স্বার্থবাদী শাসক চক্র হিন্দুদেরকে সংখ্যালঘু বলে চিরদিন দাবিয়ে রেখেছে। ক্ষমতার রাজনীতি পাক স্বার্থবাদী গােষ্ঠী বার বার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়িক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। অথচ তারা প্রথম থেকেই যদি শাসক চক্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেন তা হলে হয়তাে স্বার্থবাদী গােষ্ঠীর চক্রান্ত তাসের ঘরের মতাে ভেঙ্গে গুড়িয়ে যেত। আজো তেমনি ভুলের বশবর্তী হয়ে কিছু সংখ্যক যুবক নিরপেক্ষকের ভূমিকা অবলম্বন করেছে, এ সত্যি দুঃখজনক ঘটনা। | বাংলাদেশে যখনি ন্যায়ের দাবীতে জনতার কণ্ঠ সােচ্চার হয়ে উঠেছে তখনি স্বার্থবাদী শাসক সম্প্রদায় ভারতের সঙ্গে বিরােধ, নয় তাে ধর্মের নামে ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে জনতার কণ্ঠকে স্তব্ধ করেছে। এর জন্য বার বার বলি হয়েছে নিরীহ মানুষ। বার বার রক্তে রঞ্জিত হয়েছে বাংলার মাটি। কিন্তু স্বার্থবাদী গােষ্ঠীর মুখােস খুলে গেছে এবার। তাই বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ লক্ষ লক্ষ শহীদের বেদীমূলে পঁড়িয়ে ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতা বিসর্জন দিতে সক্ষম হয়েছে। পাক সাম্প্রদায়িক সরকারের সবরকমের উস্কানী ব্যর্থ করে দিয়েছে বাংলার সংগ্রামী জনতা। বাংলার মানুষ আজ বাঙ্গালি। হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান নয়, তারা বাংলার মানুষ। জাতি ধর্মের উপরে যে মানব ধর্ম সেই মহান ধর্মে উদ্বুদ্ধ আজ বাঙ্গালি জাতি। লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে যে বাংলাদেশ আজ পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে সে শুধু মুসলমানদের নয়। হিন্দু-মুসলমানদের, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবার দেশ বাংলাদেশ। | তাই আসুন আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশমাতৃকার শৃঙ্খল ছিন্ন করে হানাদার শেষ করে পুত পবিত্র করে গড়ে তুলি জননী জন্মভূমি বাংলাদেশকে।

বিপ্লবী বাংলাদেশ ১:১০। ২৪ অক্টোবর ১৯৭১ মার্কিন সাম্রাজ্যেবাদের দ্বিমুখী নীতির স্বরূপ খবরে প্রকাশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নাকি সরাসরি বাংলাদেশ সরকারের সহিত আলােচনা চালাইবার জন্য ইয়াহিয়া খানের উপর চাপ সৃষ্টি করিতেছে শুধু তাহাই নহে, বাংলাদেশ সরকারের নেতাদের সহিত এই উদ্দেশ্যে যােগাযােগ স্থাপন করা হইতেছে। পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য বলবৎ রাখিয়া এ ধরনের প্রচেষ্টা বিশ্বজনমতকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা ছাড়া কিছুই নহে। বাংলাদেশ গণহত্যা শুরু করার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উহার নিন্দা করা দূরে থাকুক বরং ইহাকে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলিয়া বার বার ইয়াহিয়ার কুযুক্তিকে সমর্থন করিয়াছে। বাংলাদেশ সরকারও সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালির লৌহ দৃঢ় সংকল্পের মুখে আজ নিক্সন সরকারকে ভােল পাল্টাইতে হইতেছে। শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তির দাবীকে ইয়াহিয়া খান ও তাহার সাঙ্গো পাঙ্গোরা উপেক্ষা করিয়া বিচার প্রহসন চালাইয়াছে। তাহাদের উদ্দেশ্য ভরাডুবির মুখে শেখ মুজিবের মুক্তিকে বাজী। রাখিয়া শেষরক্ষা করা। বাংলাদেশের বহু অঞ্চল এখন মুক্তিযােদ্ধারা শক্রকবলমুক্ত করিয়াছে। পাকিস্তান তাই মরিয়া হইয়া ভারতের বিরুদ্ধে একদিকে যুদ্ধের পায়তারা করিতেছে এবং অপরদিকে পাকিস্তানের কাঠামাের মধ্যে বাংলাদেশকে রাখিবার জন্য তাহার সুহৃদদের সাহায্য চক্রান্ত চালাইতেছে। মার্কিন সরকারের সাম্প্রতিক উদ্যোগ উহারই বহিঃপ্রকাশ। মুক্তিযুদ্ধে পাঁচ পার্টির ঐক্যে ফাটল ধরাইবার সাম্রাজ্যবাদী অপকৌশল ব্যর্থ হওয়ার পর নুতন করিয়া। সমস্যা সমাধানের নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আসরে নামিয়াছে। লক্ষ্য, পাকিস্তানকে তাহার স্বখাত সলিল হইতে উদ্ধার করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতে বাংলাদেশের দুঃখ জনক ও মর্মান্তিক ঘটনাবলী ‘পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার’, যদি তাই হয় তবে উহার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আমেরিকা আজ উদগ্রীব কেন? 

বাংলাদেশের জনগণও এবং রাজনৈতিক দলগুলি বাংলাদেশের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান কামনা করিয়াছিল। সমস্ত উস্কানী ও বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনীর হত্যাভিযানের মুখে ঢাকায় শেখ মুজিবর রহমান গত মার্চ মাসে ইয়াহিয়ার সহিত আলােচনা বৈঠকে মিলিত হইয়াছিলেন। তাহার পরবর্তী ঘটনাবলী বিশ্ববাসী অবগত রহিয়াছে। ইসলামাবাদের বলদর্পী জঙ্গী সরকারই সামরিক সমাধানের জন্য বাংলাদেশ ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম গণহত্যা শুরু করিয়াছে। আজও তাহা অব্যাহত। তখন অনােন্যপায় বাঙ্গালিরা অস্ত্র ধরিয়াছে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য। এখন বাংলাদেশের সামনে একটিই রাজনৈতিক সমাধান রহিয়াছে। তাহা হইল বাংলাদেশকে দখলকারী বাহিনীর কবলমুক্ত করা। মুক্তিফৌজ সেই উদ্দেশ্যই লড়াই চালাইতেছে। মুক্তিফৌজ নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত। সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালি সমর্থনপুষ্ট মুক্তিফৌজের জয় অবধারিত বুঝিয়াই আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। তাই-সেও রাজনৈতিক সমাধানের জন্য ব্যগ্র । এই রাজনৈতিক সমাধানের স্বরূপ কি? কিছুদিন পূর্বে ইরান মারফত আমেরিকা টোপ ফেলিয়াছিল ; শেখ মুজিবের মুক্তির বিনিময়ে মুক্তিফৌজের অস্ত্র সংবরণের কথা ও পাকিস্তান কাঠামাের মধ্যে বাংলাদেশ ছিল তাহার মােদ্দা যথা আমাদের সরকার ও সংগ্রামী বাঙ্গালি জাতি তাহা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান। করিয়াছে। আমেরিকা তাই নিজেই সরাসরি উদ্যোগী হইয়াছে। কিন্তু বক্তব্যের কোনাে নূতনত্ব নাই । রাষ্ট্রসংঘে পাকিস্তান বাংলাদেশ সমস্যাকে চাপা দিতে ব্যর্থ হইয়াছে। খােদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পত্র পত্রিকাও। আজ বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার নৃশংস কাণ্ডকারখানার নিন্দায় মুখর হইয়াছে। ওয়াশিংটন পােস্ট’ পত্রিকায়। খােলাখুলি ভারত উপমহাদেশে-যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টির জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করিয়াছে। নিঝন সাহেবের স্বদেশেই আজ হাওয়া বদলাইয়া গিয়াছে। তাই ওয়াশিংটনের কর্তৃপক্ষের উদ্বেগ এবং বিকল্প শ্রেষ্ঠ সমাধানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের সহিত আলাপ করার নিমিত্ত ইয়াহিয়া খানকে পরামর্শ দিয়াছে । কিন্তু অস্ত্র সাহায্য বন্ধ না করিলে শক্তির দম্ভে অন্ধ জঙ্গীশাহীর চোখ খুলিবে না। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আমাদের উপদেশ ঘােড়ার আগে গাড়ি না যুতিয়া প্রথমে পাকিস্তান সরকারকে অন্ত্র সাহায্য বন্ধ রাখুন। নতুবা বরের ঘরে পিসী ও কনের ঘরে মাসী সাজায় পুরাতন খেলায় জাগ্রত বাঙ্গালি ভুলিবে না।

| নুতন বাংলা ॥ ১: ১১ ২৮ অক্টোবর ১৯৭১ |

জাতিসংঘ গণচীন ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ

মার্কিন ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে জাতিসঙ্ েগণপ্রজাতন্ত্রী চীন আসন লাভ করেছে এবং মার্কিন পদলেহী চিয়াং-চক্র জাতিসঙ্ থেকে বহিস্কৃত হয়েছে। জাতিসঙ্রে ছাব্বিশ বছরের নাতিদীর্ঘ জীবনে এটাই সম্ভবত উল্লেখ করার | মতাে অন্যতম প্রধান একটি ঘটনা। গণচীনের জাতিসঙ্ঘভূক্তি উপলক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ গণচীন সরকারকে অভিনন্দন জানিয়ে বাণী প্রেরণ করেছেন। জাতিসক্সে গণচীনের অন্তর্ভূক্তি শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চীনা নীতির ব্যর্থতা নয়, দুই চীনা নীতিরও পরাজয়। গত বছর জাতিসক্সে গণচীনের অন্তর্ভূক্তির প্রশ্নটি ভােলা হলে তখন প্রস্তাবের পক্ষে ভােট পড়েছিল ৫১টি, বিপক্ষে ৪৯টি। ২৫টি দেশ ভােটাভুটিতে অংশ নেয় নি। তখনই সম্ভবত মার্কিনী কর্তারা বুঝতে পেরেছিলেন জাতিসক্সের সদস্য রাষ্ট্রদের চোখ রাঙিয়ে তারা আর বেশি দিন গণচীনকে একঘরে করে রাখতে পারবেন না। ফলে এ বছর নাটকীয়ভাবে কিসিংগারের চীন সফর, প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পিকিং সফরের ব্যবস্থা এবং পিংপং কুটনীতির সূচনা। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমানে লক্ষ্য ছিল গণচীনকে জাতিসক্সে ঢুকতে দেয়া এবং সেই সঙ্গে তাইওয়ানের সদস্যপদও বহাল রাখা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুই চীন নীতির মার্কিনী ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান মুক্তিযুদ্ধে আমরা যারা প্রত্যাশা করি, আমেরিকা একটি গণতন্ত্রী দেশ এবং সে দেশের গণতন্ত্র-সরকার বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি সমর্থন জানাবেন, তাদের স্মরণ রাখা উচিৎ এই যুক্তরাষ্ট্র সরকারই ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৭০ কোটি মানুষের দেশ গণচীনকে জাতিসঙ্ েঢুকতে দেয় নি এবং তার বৈধ সরকারের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয় নি। প্রায় ৭০ কোটি লােকের সরকারের বাস্তব অস্তিত্ব যে দেশের সরকার দীর্ঘ বাইশ বছর স্বীকার করে নেয় নি, তারা মাত্র ছ’মাসে সাড়ে সাত কোটি মানুষের গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারে বৈধ অস্তিত্বের প্রতি সহানুভূতি 

অথবা সমর্থন জানাবে এরূপ আশা করা বাতুলতা। গণচীন কারাে কৃপায় বা দয়ার পাত্র হয়ে জাতিসঙ্গে প্রবেশ করে নি। সে নিজের শক্তি ও অস্তিত্বকে উপলব্ধি করতে জাতিসঙ্কে বাধ্য করেছে এবং শেষ পর্যন্ত গোয়ার নিঝন সাহেব পর্যন্ত পিকিংয়ের দরজায় ধর্না দিয়েছেন। এই ঘটনা থেকে বাংলাদেশের মানুষের একটা বড়শিক্ষা গ্রহণ করার রয়েছে। জাতিসঙ্ঘ কিম্বা কোনাে ছােট বড় দেশ কৃপা করে বা গণতন্ত্র বা মানবতার স্বার্থে বাংলাদেশের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেবে না। সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে শক্তি বলে স্বাধীনতার চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌছতে হবে এবং সেদিন শুধু জাতিসঙ্ঘ নয়, নিক্সন সাহেবেরাও হয়ত নতুন করে বাণিজ্যের আশায় বন্ধুত্বের ডালি নিয়ে ঢাকায় এসে ধর্ণা দেবেন। গণচীন তার স্বাধীনতা অর্জনের পরও দীর্ঘ বাইশ বছর সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তে জাতিসজে তার আসন পায় নি। সুতরাং বাংলাদেশের মুক্তি যােদ্ধারা ও দু’মাসে, এক বছরে ধৈর্যহারা হবেন না। দরকার হলে তারাও তাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য বাইশ বছরেরও বেশি সময় সংগ্রাম করবে। কায়েমী স্বার্থবাদী রাষ্ট্রজোট যেমন জাতিস গণচীনের অন্তর্ভূক্তি ঠেকাতে পারে নি; বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতিও তারা ঠেকাতে পারবে না। সাময়িকভাবে বিঘ্ন ঘটাতে পারবে মাত্র। | জাতিসঙ্গে আসন লাভ -তথা বিশ্ব স্বীকৃতি লাভের পর নয়াচীনও তার বর্তমান ভূমিকা ত্যাগ করে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সৌহার্দ রক্ষা এবং সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী জনগণের সংগ্রামে দৃঢ় সমর্থন দানের ভূমিকা গ্রহণ করবে এটাই আমরা আশা করি। জাতিসঙ্ েগণচীনকে গ্রহণের ব্যাপারে ভারত একটি গণতান্ত্রিক প্রতিবেশী দেশ হিসেবে প্রশংসনীয় মনােভাব দেখিয়েছে। ১৯৫০ সাল থেকে ভারত জাতিসঙ্ েগণচীনের অন্তর্ভূক্তির প্রতিটি প্রস্তাবে সমর্থন দান করেছে, ১৯৬২ সালের ভারত-চীন সংঘর্ষ সত্ত্বেও এই সমর্থন সে প্রত্যাহার করে নি। যুক্তরাষ্ট্রের দুই চীন নীতিও ভারত সমর্থন করে নি। এশিয়ায় শান্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের ভিত্তি দৃঢ় করার জন্য গণচীনের উচিৎ ইয়াহিয়ার গণবিরােধী ফ্যাসিস্ট চক্রের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করা এবং গণতন্ত্রী প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে মৈত্রী ও সৌহার্দ বৃদ্ধি করা। অন্যদিকে বাংলাদেশের জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রামেও গণচীনের সমর্থনও সাহায্য দান অবশ্য কর্তব্য। একমাত্র তাহলেই গণচীন তার বিঘােষিত নীতির যথার্থতা প্রমাণ করতে পারবে, যে নীতির ভিত্তি হলাে-গণবিরােধী ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম। আমরা গণচীনের জাতিসংঘে প্রবেশ উপলক্ষ্যে চীনের জনগণকে আমাদের সংগ্রামী অভিনন্দন জ্ঞাপন করছি।

জয়বাংলা (১)। ১; ২৫। ২৯ অক্টোবর ১৯৭১

বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের পটভূমিতে গণসাহিত্য

বাংলাদেশের পরিবর্তিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সাহিত্যের মুক্তি অবশ্যম্ভাবী। দেশে এখন যুদ্ধ চলছে। এটা মানুষের মুক্তির যুদ্ধ। অনেক বছরের শােষণের প্রতিবাদে শান দেওয়া হাতিয়ার চকচকে। জনতার সাগরে জাগ রবে বাংলার এক প্রান্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অন্য প্রান্ত পচাগড় পর্যন্ত জনবসতি মুখরিত । তাই সাহিত্যের অঙ্গনে একটা সুস্পষ্ট পরিবর্তন যুদ্ধের অস্ত্রের মতাে প্রয়ােজনীয়। কেননা সংস্কৃতি হচ্ছে বিপ্লবের হাতিয়ার। তবে সেই সংস্কৃতি নয় যা গণমানুষের প্রগতি বিমুখী।

| সাহিত্য সংস্কৃতির একটি অংশ। তাই বর্তমান অবস্থাতে সাহিত্যের মূল্যবােধ অনস্বীকার্য। আর সেই সাহিত্য হতে হবে গণ সাহিত্য। জনতার প্রয়ােজনে সমাজের অগ্রগতির জন্য যে সাহিত্য তাই গণ সাহিত্য। বাংলাদেশের মানুষ এখন মুক্তি চায়। সমস্ত পরাধীনতার আবদ্ধ থেকে সে মুক্তির দাবী। বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে তারই একটি বলিষ্ঠ আভাষ যাকে স্পস্টতর করার জন্য সাহিত্যের দরকার। এ দেশের যুবকেরা শিক্ষা অঙ্গন ছেড়ে দিয়ে মাঠে নেমেছে। এ মাঠ যুদ্ধের মাঠ যাকে অতিক্রম করতে অসীম ধৈৰ্য্য আর সুস্থ মানসিকতার প্রয়ােজন। সুস্থ মানসিকতা শিক্ষাকে আশ্রয় করেই গড়ে ওঠে। সে শিক্ষা গণসাহিত্যের শিক্ষা। গণ সাহিত্য জনতার বিপ্লবের পথকে বাতলে দেয়। বাস্তবতাকে আশ্রয় করে গণ সাহিত্য গড়ে ওঠে। এটা প্রয়ােগধর্মী….

মুক্তি। ১। ১ কার্তিক, ১৩৭  ৮ (অক্টোবর) ১৯৭১ 

পাকিস্তানী সেনা : নারী নির্যাতন ও আলেম সমাজ

বাংলাদেশটি পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছিল একমাত্র ধর্মীয় প্রবণতাকে গুরুত্ব দিয়েই। নইলে দ্বিতীয় কোনাে যুক্তি ছিল না। যদিও বাঙালি মুসলমান সমাজ হানাফী মতাবলম্বী এবং পশ্চিম পাকিস্তান কাদিয়ানী, শিয়া হানাফী, শাফেয়ী ও মালিকীদের আবাস ভূমি। | ইসলাম ধর্মের কট্টর শত্রুও স্বীকার করেছেন যে, নারীজাতিকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়েছে ইসলাম ধর্ম । সাধারণ গৃহকোণ থেকে সিংহাসন পর্যন্ত নারীর মর্যাদা স্বীকৃত। মহাপুরুষ হযরত মুহম্মদের (দঃ) বাণী : সন্তানের বেহেশত্ জননীর পদতলে।’ ইসলাম ধর্মের বুনিয়াদ মহাগ্রন্থ কুরআন মজিদে পুরুষ জাতির প্রতি কড়া নির্দেশ রয়েছে নারীজাতিকে যথােপযুক্ত সম্মান দেওয়ার জন্য। নিজের বিবাহিতা স্ত্রী ব্যতীত অন্য নারী নিষিদ্ধ করা হয়েছে পুরুষের জন্য। পৈতৃক সম্পত্তিতে পুত্র সন্তানের মতাে কন্যা সন্তানের ও ওয়ারিসী স্বত্ব স্বীকৃত। একদা দিল্লীর সিংহাসনে ম্রাজ্ঞী সুলতানা রেজিয়া ও দাক্ষিণাত্যের বিজাপুরে বীরাঙ্গনা চাঁদ সুলতানা তারি ফলশ্রুতি। হালজামানায় অবশ্যি সভ্য জগতের সর্বত্রই নারী জাতির সম অধিকার স্বীকৃত।  কিন্তু বাংলাদেশকে ধ্বংস করার জন্য প্রেরিত ডিক্টেটর ইয়াহিয়া খানের সৈন্যবাহিনী ইসলাম ধর্মের অবশ্য পালনীয় নির্দেশকে অগ্রাহ্য করে বিভিন্ন শিবিরে অনুন ২০ হাজার নারী আটক করে রেখেছে নিজেদের পাশৰ বাসনা চরিতার্থের উদ্দেশ্যে। কলেজও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী চাকুরীজীবী মহিলা, কুলবধু কেউই ওদের হিংস্র থাবা থেকে রেহাই পান নি। | ইসলাম ধর্মের অনুশাসন বেপরােয়াভাবে অগ্রাহ্যকারী মুসলমান ধর্মীয় পরিভাষায় : কাফের এবং নারীজাতির সতীত্বের প্রতি সম্মান দেখানাে ইসলাম ধর্মের একটি কড়া অনুশাসন। সুতরাং বাংলাদেশে আগত ইয়াহিয়া খানের সৈন্যবাহিনী মুসলমান নয়, কাফের।

 ওই কাফেরদের বিরুদ্ধে কিন্তু আমাদের আলেম সমাজ আজ পর্যন্ত একটা টু-শব্দ ও উচ্চারণ করেন নি। সম্প্রতি যে ভাগ্যাহীনা মেয়েগণ খান সেনাদের শিবির থেকে পরিত্যাক্তা হয়েছে ওরা মৈথুনকার্যে অনুপযুক্ত, রােগে ভুগে জীর্ণশীর্ণ এবং গর্ভবতী এবং সেই হেতু পরিত্যাক্তা। ইহার পরিপ্রেক্ষিতে আলেম সমাজের প্রতি আমাদের জিজ্ঞাসা ; ওই ভাগ্যহীনরা যদি আপনাদেরই স্ত্রী কন্যা পুত্রবধূ হতাে তাহলে আপনারা কি করতেন? | অবশ্যি আমরা জানি আপনারা বসে নেই। ইয়াহিয়া খানের ঔপনিবেশিক শাসনকে বাংলাদেশ কায়েম রাখার জন্য দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন আপনাদের অনেকে। বর্তমান জগতের অন্যতম আশ্চর্য বস্তু বাংলাদেশের উপ-নির্বাচনী প্রহসনকে বাস্তবে পরিণত করার অপচেষ্টায় আপনারা গলদঘর্ম। কিন্তু আমরা ভুলি নি মুয়াবিয়াপুত্র ইয়াজিদ ইসলাম ধর্মের শ্রেষ্ঠ অবদান গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেছিল আপনাদেরই পূর্বসুরীদের সহায়তার। প্রতিষ্ঠিত করেছিল উমাইয়া রাজবংশ। ওদের সমর্থনে আপনাদের পূর্বসূরী আলেমগণ আবিষ্কার ও করেছিলেন : আল সুলতানু জিলুল্লাহ (শাসক আল্লার ছায়া) এর মতােন একটা অদ্ভুত মিথ্যা স্তোক্য ইসলামের নামে এবং এখন বাংলাদেশে আপনারা প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছেন ‘আগে রাজবংশ’। এখনাে ভাবছেন আমরা বিশ্বাস করি, ‘আল সুলতানু জিল্লুল্লাহ’। | সতর্ক হউন। ওই পশ্চিমা কাফেরদের সঙ্গে আমাদের আর কোনাে সম্পর্ক নেই। যে ধর্মের গ্রন্থি আমাদেরকে জুড়ে দিয়েছিল ওদের সঙ্গে ওদের আচরিত ধর্ম থেকে আমাদের সেই ধৰ্ম্মের রূপ ভিন্ন, আলাদা। কাজেই বিবেকের চাবুকের তীব্র আঘাতে আপনারা সােচ্চার হয়ে উঠুন ওদের বিরুদ্ধে। ওরা আপনাদের ২০ হাজার নিস্পাপ মেয়ের ধর্ম নষ্ট করেছে, জীবন নষ্ট করেছে এবং ওদের গর্ভে রেখেছে অপসৃষ্টি।

মুক্তবাংলা ১: ৭  ১ নভেম্বর ১৯৭১

শয়তানের মুখে খােদার নাম

কথায় বলে গুতাের নাম বাবাজি। বাংলাদেশে মুক্তি বাহিনীর হাতে চরম মার খেয়ে পিন্ডির বর্বর জঙ্গীচক্রের নেতা ইয়াহিয়ার গলা ক্রমেই এখন খাটো হচ্ছে। এজন্যই কথায় বলা হয়, মারের মতাে মহৌষধ আর কিছুই নেই। শেখ মুজিবকে যিনি ফাঁসি দেবেন, শেখ মুজিবর যার চোখে একজন ক্রিমিন্যাল’ এবং এই সেদিন যে ইয়াহিয়া গলাবাজি করে বলেছিল, ‘বিশ্ববাসীর জেনে রাখা দরকার আমি যুদ্ধ করবাে’, এখন তার গলা থেকেই শােনা গেছে, যুদ্ধ দ্বারা কোনাে সমস্যার সমাধান হবে না এবং দেশের মানুষ চাইলে শেখ মুজিবকে ছেড়ে দেয়া হবে।’ ইয়াহিয়া সম্পর্কে যুগােশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট টিটো বলেছেন আরাে মজার কথা। তিনি বলেছেন, ‘পার্সিপােলিসে’ ইরানের রাজার সঙ্গে দেখা হলে রাজা তাকে বলেছেন, ইয়াহিয়ার মাথার গরম কমে গেছে।’ প্রেসিডেন্ট টিটো সৌজন্য বশত বাকি কথাটুকু সম্ভবত বলেন নি। এই কথা হলাে, মাতলামির ঘাের কমলে তার মাথার চাঁদি আরাে ঠাণ্ডা হবে।’ | আর ঠাণ্ডা না হয়ে উপায় কি? ৭২ ঘন্টায় বাঙালিদের ঠাণ্ডা করবেন ভেবে যিনি সারা বাংলায় রক্তের বন্যা বইয়েছেন, নারীর সম্ভ্রম নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছেন, দর্প করে বলেছেন, ‘আমার সৈন্যেরা ঢাকায় ফুটবল ম্যাচ খেলতে যায় নি, তারা হত্যা করতে গেছে’ আজ মাতলামির ঘাের কেটে যেতেই ঠাণ্ডা মাথায় তিনি দেখেছেন। ৭২ ঘন্টাতাে দূরের কথা, সাতমাসেও বাঙালিরা ঠান্ডা হয়নি বরং তাদের হাতে এখন অস্ত্র । গােটা বাংলাদেশে তার পেশাদার সৈন্যেরা বাঙালি অপেশাদার গেরিলাদের হাতে কচুকাটা হচ্ছে। ট্রেনিং শেষে বাঙালি মুক্তি যযাদ্ধারা এখন ইয়াহিয়ার নরপশু সৈন্যদের উপর চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত।| পরাজয় অত্যাসন্ন জেনে নির্লজ্জ নরপ ইয়াহিয়া এখন নতুন সুরে কথা বলতে শুরু করেছেন। সম্প্রতি বিলাতের ‘ডেইলি মেইল’ পত্রিকার প্রতিনিধির কাছে ইয়াহিয়া নামক এই বেহায়া খান বলেছে, ‘আমাদের চাইতে ৫ গুণ বড়ও শক্তিশালী ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করে আমরা কিভাবে জয়লাভ করতে পারি? বেহায়া খান জানে, তার সৈন্যদের যুদ্ধ হবে এবং হচ্ছে বাঙালি মুক্তি ফৌজের সঙ্গে। এই মুক্তি বাহিনীর হাতেই তাদের পরাজয় অবধারিত। এই অনিবার্য পরাজয়ের লজ্জা এড়ানাের জন্য বেহায়া খান এখন যুদ্ধের দায়িত্ব ভারতের কাঁধে চাপাচ্ছে। আগে তাদের মতলবও ছিল তাই। মুক্তি বাহিনী চূড়ান্ত পাল্টা আঘাত হানলেই তারা ভারত আক্রমণ করে বসবে।

কিন্তু ভারতের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির মুখে বেহায়ার সেই দিবাস্বপ্ন ও ভেঙে গেছে। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন, এবার যদি ভারত আক্রমণ করা হয়, তাহলে লাহাের এবং শিয়ালকোট ভারত দখল করে নেবে। ফলে ডেইলি মেলের প্রতিনিধির কাছে স্বনিযুক্ত প্রেসিডেন্ট বেহায়া। খান যে সমস্ত কথা বলেছে, তা হচ্ছে পরাজয়-ভীত এক কাপুরুষের উক্তি। সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালির যে। প্রাণপ্রিয় নেতাকে বেহায়া খান ক্রিমিন্যাল ও ট্রেইটর আখ্যা দেয়ার ধৃষ্টতা দেখিয়েছিল, এখন সেই বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়ার জন্য বেহায়া খা এক কথায় রাজি আছে বলে ডেইলি মেলের’ প্রতিনিধিকে জানিয়েছে। বেহায়া খা বলেছে, ‘ভারত যদি বাংলাদেশের তাবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাহলে বাধ্য হয়েই তাকে যুদ্ধে নামতে হবে, যদিও পরাজয় যে অনিবার্য, তা তারা জানে।’ বেহায়া খাঁর বেহায়া নাম এখানেই সার্থক। কারণ বাংলাদেশের সাথে সাত কোটী মানুষের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে যে স্বাধীন ও সার্বভৌম সরকার গঠন করেছে, বেহায়া খাঁর চোখে তারা তাবেদার, আর বেহায়া খাঁ চোখের ডাক্তার, পতিতালয়ের দালাল, বীমা কোম্পানীর দালাল, মাইনাকারচরের এক কানকাটা প্রাক্তন স্কুল শিক্ষক প্রভৃতি কয়েকটি আস্তাকুড়ের জীব কুড়িয়ে এনে দখলীকৃত ঢাকায় যে তথাকথিত অসামরিক সরকার গঠন করেছে, তারা হলাে বাংলাদেশের নবাবী আমলের আস্তাবলের ঘােড়াগুলােও যে হাসছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। | বেহায়া ঘর ভাড়ামীরও সত্যই তুলনা নেই। মিলাতী পত্রিকাটিতে সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে সে আরাে বলেছে, ‘পশ্চিম পাকিস্তানীরা বাঙ্গালিদের প্রতি এতকাল ন্যায়সঙ্গত আচরণ করে নি। এই বৈষম্যমূলক আচরণের অবসান ঘটানাের জন্যই নতুন শাসনতন্ত্র তৈরি করা হচ্ছে। শুনে হাসবাে না কাদবাে, তা আমরা বুঝে উঠতে পারছি না। বাঙালিদের প্রতি ন্যায়সঙ্গত আচরণ করার জন্য তাদের নির্বাচনী রায় বন্দুকের গুলিতে উড়িয়ে দিয়ে দশলাখ বাঙালিকে হত্যা করে এখন বেহায়া খাঁ নিজ একটি শাসনতন্ত্র জারী করতে চায়। মনে হয়, বাংলাদেশ যেন বেহায়া খার মতাে এক সেপাইর বাচ্চার ভিটে বাড়ির প্রজা। প্রজাদের প্রতি ন্যায়সঙ্গত আচরণ করার জন্য এখন সে ফরমান জারী করবে। বেহায় খার জেনে রাখা উচিত, বাঙালিরা কারাে কৃপরি। প্রার্থী নয়। তারা তাদের অধিকার এবার অস্ত্রের মুখে আদায় করে নেবে। বাঙালিরা বুঝেছে, মিঠা কথায় চিড়া ভেজে না। আজ যে বেহায়া খার মুখে এত মিঠা বাত, তাও এই রাম তার ফল। 

| বেহায়া খার মাতলামীর নেশা ছুটে গিয়ে এখন তার অবস্থা কি দাঁড়িয়েছে, ‘ডেইলি মেলের’ প্রতিনিধির কাছে বলা একটি কথাতেই তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। বেহায়া কাতর কণ্ঠে বলেছে, ‘আমি খােদার কাছে প্রার্থনা করছি, তিনি যেন মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে এ-কথাটা বুঝতে দেন স্বাধীন বাংলাদেশ শুধু পাকিস্তানকেই খণ্ড খণ্ড করবে না, ভারতের জন্যও তা হবে সর্বনাশের সূচনা।’ হায় বেহায়া খা! এতদিন খুটার জোরে ভেড়ার মতাে নেচে এখন মুখে খােদার নাম। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ভারতের সর্বজনন্দিত নেত্রী। তিনি গণতান্ত্রিক ভারতের নেতা। তিনি ভালােভাবেই জানেন, ভারতের গণতন্ত্রের বিপদ স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ থেকে কোনােদিনই সূচিত হবে না। এই বিপদ সর্বক্ষণের হুমকির মতাে ঝুলে আছে পাকিস্তানের বর্বর ফ্যাসিবাদী মিলিটারি ডিকটেটর শিপের কাছ থেকে। ঘরের পাশে নগ্ন ও বর্বর ফ্যাসিবাদ ভারতের গণতন্ত্রের জন্যও এক ভয়ঙ্কর হুমকি। পাকিস্তানে এই ফ্যাসিবাদের কবর রচনা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভুদয়ই এশিয়ায় গণতন্ত্র, শান্তি ও সমৃদ্ধির নবযুগ সৃষ্টি করবে। অন্ধকারের পেঁচা বেহায়া খাঁ এই আলাের উদার অ্যুদয়ের সম্ভাবনাতেই আজ চেঁচামেচি শুরু করেছে। শয়তানের কাতর কণ্ঠে আজ খােদার নাম। আর শয়তানের কণ্ঠে। কখন খােদার নাম শােনা যায়, তা আমাদের মতাে বিশ্বের সকল মানুষের জানা আছে সে হলাে শয়তানের চূড়ান্ত বিপর্যয়ের পূর্বক্ষণ।

জয়বাংলা (১) : ২৬ ০৫ নভেম্বর ১৯৭১

হিন্দু না ওরা মুসলিম, জিজ্ঞাসে কোন জন?

পশ্চিম পাঞ্জাবী দস্যুবৃত্তির শিকার হয়ে বাংলাদেশ থেকে যারা ভারতে চলে গিয়েছেন তাদের অধিকাংশই হিন্দু, এই ধুয়া তুলে জনৈক পশ্চিমা সাংবাদিক দিল্লীতে মিসেস গান্ধীকে প্রস্তাব দিয়েছেন, এদের সবাইকে ভারতের নাগরিক করে নিলে কেমন হয়? | প্রস্তাবটি ওই সাংবাদিকের নিজস্ব হলে ক্ষতি ছিল না। শােনা যায় মহল বিশেষ থেকে পরিকল্পিত ভাবে এই ‘ফিলার পরিবেশন করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের নব্দুই লক্ষ মানুষ গৃহহারা, সর্বহারা হয়ে প্রাণভয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে গেছে। তাদের অপরাধ তারা নিজ দেশে পরবাসী হয়ে থাকতে চায় নি। তাদের অপরাধ তারা তাদের স্বদেশের মাটিতে বিদেশী বেনিয়া প্রভূত্ব মেনে নিতে পারে নি। সেই অপরাধের খেসারত দিতেই তাদের আজ স্বদেশ স্বজন থেকে দূরে অপরিসীম দুঃখ দুর্দশাকে বরণ করে নিতে হয়েছে। কিন্তু দূর দূরান্তে বসে যারা চিরকাল এই উপমহাদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে, তারা কি এই পরিস্থিতিতেও নতুন করে ঘােলাপানিতে মাছ শিকারের স্বপ্ন দেখছে? বাংলাদেশের এক কোটি মানুষকে বিদেশী বানিয়ে, তথাকথিত পাকিস্তানের কাঠামাের মধ্যে বাঙ্গালিকে সংখ্যালঘিষ্ঠ করে চিরদিনের মতাে ভারত পাকিস্তান সংঘাত জিইয়ে রাখার নতুনতর ফন্দি আঁটা হচ্ছে কি?

শরণার্থীরা বেশিরভাগ হিন্দু। বিভেদকামী পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ সঠিক জায়গাতেই ঘা দিয়েছে। কিন্তু তাদের মনে রাখা উচিত আজকের বাংলাদেশ ১৯৪৬ এর বাংলাদেশ নয়। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প থেকে। মুক্ত বাঙালি জাতীয়তার মূর্ত পীঠস্থান এই বাংলাদেশ। বাংলার মুসলমান বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিষ্টান, বাংলার আদিবাসী তাদের নিজ নিজ ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকবে সন্দেহ নেই, কিন্তু জাতীয়তা এবং রাষ্ট্রীয়তার প্রশ্নে তাদের একমাত্র পরিচয় তারা বাঙালি, বাংলাদেশের নাগরিক।

| বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রমাণ করে দিয়েছে ধর্ম জাতীয়তার একমাত্র নিয়ামক হতে পারে না, ভাষা-সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক একাত্মতাই জাতীয়ভাবে মৌল ভিত্তি। এই নবলব্ধ অভিজ্ঞতা কেবল এই উপমহাদেশের জন্য নয়, গােটা পৃথিবীর জন্যই এক অভিনব শিক্ষা। বাংলাদেশের মানুষ নিজের জন্মগত অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আপন ইচ্ছায় আপন শক্তিতে শক্তিমান হয়ে স্বাধীনতার পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরেছে। আজও গোটা পৃথিবীর তাবৎ বৃহৎ শক্তির দ্রুকুটি উপেক্ষা করে বাংলার দামাল ছেলেরা শত্রুর সঙ্গে সমযুদ্ধে পাঞ্জা লড়ছে। এ যুদ্ধে তাদের বিজয় অবশ্যম্ভাবী জেনেই কি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা নতুন নতুন ফন্দি আবিষ্কারের চেষ্টায় মেতেছে? 

বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যেই ঘােষণা করেছেন যে, শরণার্থীদের সকলকেই স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। শরণার্থীরাও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলছেন, তাঁদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ। ভারতে তাদের অবস্থান স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রয়ােজনেই। অধিকৃত বাংলা থেকে হানাদার সৈন্যরা বিতাড়িত হলে দেশে ফিরে যেতে তাদের এতটকুও বিলম্ব হবে না। মনে রাখতে হবে, বাঙালি শরণার্থীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেবার অধিকার ভারতেরও নেই। তারা হিন্দু, না মুসলিম, সে প্রশ্নের সমাধি রচিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের অভূদয়ে। এ প্রশ্ন নতুন করে যারা তুলতে চাইবে, তাদের ‘লাল মুখ কালাে করে দেবে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির ইস্পাত কঠিন ঐক্য। অতএব, সাধু সাবধান।

দেশবাংলা ও ১; ৪ ১৮ নভেম্বর ১৯৭১

মুক্তি বাহিনীর নৌ-কম্যান্ডাে | মুক্তিবাহিনীর নৌ-কমান্ডােদের হাতে জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে পাকিস্তানের যুদ্ধ জাহাজ ‘শের আফগান ধ্বংস হয়েছে এবং একটি অস্ট্রেলিয়ান জাহাজকে চট্টগ্রাম বন্দরে নৌ-কম্যান্ডােদের তাড়া খেয়ে পালাতে হয়েছে। চালনা বন্দরে একটি আমেরিকান জাহাজ নিমজ্জিত এবং একটি ব্রিটিশ জাহাজ ঘায়েল হয়ে কোনও রকমে কলকাতা বন্দরে যেতে সমর্থ হয়েছে। গত ৩রা নভেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরে একটি অয়েল ট্যাঙ্কার নিমজ্জিত হয়েছে। যুদ্ধের শুরু থেকেই নৌ-কম্যান্ডােরা মারাত্মক আঘাত হেনে চলেছেন। মাস ছয়েক আগে তারা চট্টগ্রাম এবং চালনা বন্দরে পাঁচটি জাহাজ ও একটি অয়েল ট্যাঙ্কার নিমজ্জিত করে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। নৌ কমান্ডােদের তৎপরতার সামরিক শাসকেরা নাকি নার্ভাস ফিল করেছেন। আর ঘটনাগুলি ও এমন বে-কায়দা ধরণের যে ধামাচাপা দেবার উপায় পর্যন্ত থাকছে না। কারণ বিদেশের কাছে সংবাদগুলাে পৌছে যাচ্ছে। ফলে নাজেহাল ইয়াহিয়াদের নরমসুরে এবং কাটছাট দিয়েও কিছু স্বীকার করতে হচ্ছে। কিন্তু ইয়াহিয়ারা কোনাে দিনই সত্যকে স্বীকার করতে চায় না এবং চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিলেও স্বভাব মােতাবেক একটু ন্যাকামাে করতে কসুর করে না। পুরানাে অভ্যাস মতাে তাই ওদের বলতে শুনি ভারতীয় এজেন্টরা এগুলাে করছে। | বাংলাদেশের নৌ-কম্যান্ডােদের এ হেন সাফল্যে বাংলাদের মানুষের উল্লাসিত হবার যথেষ্ট কারণ আছে তেমনি অন্য দৃষ্টিকোণে চিন্তা করলে এ-জাতীয় জয় খুবই প্রত্যাশিত। নদীজপমালাধূত বাংলার নদীর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক শুধু দৈহিক নয়, আত্মিকও। দ্বিতীয়ত পাকিস্তানের নৌ বাহিনীতে বাঙ্গালির সংখ্যা যত কমই। হােক তারাই হচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ অংশ, বর্তমান অবস্থায় তাদের অসহযােগিতার ফলে পাকিস্তানের নৌ-বাহিনী। স্বাভাবিক ভাবেই পঙ্গু হয়ে পড়েছে। সুতরাং নৌ-যুদ্ধে পাকিস্তানের ভরাডুবি রুখবে কে? বাংলার মাটিতে ইয়াহিয়ারা এখন প্রমাদ গুণছেন কারণ, জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ।

উত্তালপদ্ম ১:১ ২৪ নভেম্বর ১৯৭১

সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ১০

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!