You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশ ও এশীয় রাজনীতি

চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই অবশেষে মুখ খুলেছেন। যুগােশ্লাভিয়ার একজন সংবাদপত্র সম্পাদকের সঙ্গে আলােচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “ভারতীয় উপমহাদেশ এবং ভারত মহাসাগর বর্তমানে দু’টি বৃহৎ শক্তির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং চীন এই এলাকাকে মুক্ত করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাবে।” চীনা প্রধানমন্ত্রী আরাে বলেছেন, “চীন কখনােই বৃহৎ শক্তির মতাে আচরণ করবে না এবং মাঝারি ও ছােট দেশগুলাের দাবীর প্রতি সমর্থন জানিয়েই সে একথা প্রমাণ করবে।”  নয়া চীন শুধু এশিয়ার নয়, বিশ্বের একটি বৃহৎ দেশ। কম্যুনিস্ট চীনের আবির্ভাবের আগে চিয়াং-শাসিত মহাচীনও ছিল বিশ্বের পঞ্চশক্তির অন্যতম শক্তি এবং অদ্যাবধি জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা চিয়াং-শাসিত ফরমােজা গােটা চীনের প্রতিনিধি হিসাবে একটি আসন দখল করে রয়েছে। যদিও বিশ্বের অন্যান্য শান্তিকামী দেশের মানুষের মতাে বাংলাদেশের মানুষও মনে করে, জাতিসক্স ও নিরাপত্তা পরিষদে চীনের আসনটি কম্যুনিষ্ট চীনেরই প্রাপ্য, ফরমােজার নয়; তথাপি যুক্তরাষ্ট্রের নয়া উপনিবেশবাদী এশীয় নীতির দরুণ আজ পর্যন্ত নয়াচীন জাতিসঙ্ েআসন লাভ করে নি। এটা যেমন চীনের জন্য, তেমনি এশিয়ার সকল গণতন্ত্রকামী ও শান্তিকামী মানুষের জন্যও ক্ষোভ ও হতাশার কারণ। যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক চীনকে এশিয়ার রাজনীতিতে একঘরে’ করে রাখার নীতি এশিয়ায় গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে স্থিতিশীল হতে দেয় নি এবং আমেরিকার আগ্রাসী নীতিও এশিয়ার মাটিতে সফল হয় নি। ইন্দোচীনে দিয়েন বিয়েন ফু’র যুদ্ধে ফরাসিরা যে ভাগ্য বিপর্যয় বরণ করেছে, আজ ইন্দোচীনের ভিয়েনামে যুক্তরাষ্ট্র সেই একই বিপর্যয়ের সম্মুখীন। ভিয়েৎনামের যুদ্ধব্যয় যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক ব্যবস্থায় কি গুরুতর চাপ সৃষ্টি করেছে, তার প্রমাণ নিনের সাম্প্রতিক ডলার সম্পর্কিত নীতি। ১৯৩০ সালের পর মার্কিন ডলার সম্ভবত এত বড় সঙ্কটের সম্মুখীন আর কখনাে হয় নি। | অবস্থার চাপে আমেরিকা আজ নয়াচীনের দুয়ারে আপােষ-প্রস্তাব নিয়ে হাজির। নয়াচীনও এই আপােষ আলােচনায় সম্মত হয়েছে। এই আপােষ হােক বা না হােক বর্তমানের বিশ্ব-উত্তেজনা প্রশমনে তা যথেষ্ট সহায়ক হবে বলে অনেকেই মনে করেন। অন্যদিকে খবর রটেছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। বাংলাদেশের সমস্যা সম্পর্কে চীনা প্রধানমন্ত্রীর কাছে এক চিঠি লিখেছেন। এই চিঠির জবাব এখনাে আসে নি। কিন্তু চীন আফ্রো এশীয় টেবিল টেনিস টুর্ণমেন্টে ভারতকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। পিকিংয়ে নিযুক্ত ভারতীয় দূত এবং দিল্লীতে নিযুক্ত চীনা দূতও নাকি নিজ নিজ সরকারের সঙ্গে আলােচনার জন্য স্বদেশ যাচ্ছেন। দেখে শুনে মনে হয়, এশিয়ায় এতদিনের রাজনৈতিক অচলাবস্থার বরফ গলতে শুরু করেছে।

বিশ্ব-রাজনীতির এই দ্রুত ও নাটকীয় পরিবর্তনের মুখে মিঃ চৌ এন লাই এমন নতুন কথা বলবেন, যাতে এশিয়ার নিপীড়িত জাতি সমূহ নতুন করে স্বস্তি ও ভরসা লাভ করবে এটাই আমরা আশা করেছিলাম। বিশ্বের রাজনীতিতে-বিশেষ করে এশিয়ার রাজনীতিতে সত্তর কোটি মানুষের দেশ নয়াচীন তার নিজস্ব ভূমিকা গ্রহণ করুক, তা আমরাও চাই। কিন্তু এই ভূমিকা হােক বন্ধুত্বের, মৈত্রী ও সহযােগিতার প্রভুত্ব অথবা মুরুব্বিয়ানার নয়। কিন্তু এটা বেদনাদায়ক সত্য, চীনা প্রধানমন্ত্রী যতই বলুন, চীন কখনােই বৃহৎ শক্তির মতাে। আচরণ করবে না, কিন্তু তার মন্তব্যে বৃহৎ শক্তি মুরুব্বিয়ানার সুরই ধ্বনিত হয়েছে। চীনা প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ভারতীয় উপমহাদেশ ও ভারত মহাসাগর এখন দু’টি বৃহৎ শক্তির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। চীন এই এলাকাকে মুক্ত করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাবে। আমাদের আশঙ্কাও এখানেই নিহিত। ভারতীয় উপমহাদেশ তথা গােটা এশিয়াকে বৃহৎ শক্তির স্নায়ুযুদ্ধের আওতামুক্ত করার জন্য চীন একা কেন চেষ্টা করবে? এশিয়ার নিপীড়িত ও গণতন্ত্রী দেশগুলাের সঙ্গে তার সহযােগিতা ও সহমর্মিতার পথে বাধা কোথায়? এশিয়ার সদ্য-স্বাধীন গণতন্ত্রকামী দেশগুলাের সঙ্গে সহযােগিতার পথ এড়িয়ে কেবল মাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসে এশিয়ার ভবিষ্যৎ নির্ধারণের চেষ্টা কি তাহলে দুই বৃহৎ শক্তির মধ্যে নতুন ভাগীদার হিসাবে নয়াচীনের অনুপ্রবেশের চেষ্টা বলে বিবেচিত হবে না? ভারতীয় উপমহাদেশ ও ভারত মহাসাগরে দুই বৃহৎ শক্তির সঙ্গে তৃতীয় শক্তি হিসাবে চীনের প্রভাবে ও কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেয়া হলেই কি এশিয়ার সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে?

আমাদের দুঃখ ও বেদনার কারণ এই যে, চীনা প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘ বিবৃতির কোথাও বাংলাদেশ সমস্যা এবং বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নির্যাতনের কথার উল্লেখ নেই। ইন্দোচীনের কয়েক লাখ মানুষকে যিনি কল্পিত জাপানী সাম্রাজ্যেবাদের কবলমুক্ত করার জন্য বদ্ধপরিকর, তিনি এশিয়ার সর্বাধিক ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা বাংলাদেশ পাঞ্জাবি ইয়াহিয়া চক্রের বর্বর হত্যাভিযানের বিরুদ্ধে একটি কথা বলাও প্রয়ােজন মনে করেন নি। অথচ মি, চৌ এন লাই জানেন, ১৯৫৬ সালে তিনি যখন বাংলাদেশ সফরে আসেন, তখন বাংলাদেশের মানুষই তাকে প্রথম ঐতিহাসিক সম্বর্ধনা জানায় এবং এশিয়ার নেতা দীর্ঘজীবী হােন বলে। শ্লোগান প্রদান করে। এশিয়ার সেই বহু বিঘােষিত নেতা এবং সাম্রাজ্যবাদী কাগুজে বাঘের বিরুদ্ধে সদা খড়গহস্ত মি, চৌ এন লাই আজ বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার ঘৃণ্য ফ্যাসিষ্ট চক্রের অত্যাচারের বিরুদ্ধে টু শব্দটি করা দূরে থাক, বরং তাদেরই অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সাহায্যে জোগাচ্ছেন কম্যুনিজম ও লেনিনিজমের নামে, এটা কি কম্যুনিজম ও লেনিনজমের জন্য বিশ শতকের সব চাইতে দুঃখজনক ট্রাজেডি নয়? সংকীর্ণ ও সুবিধাবাদী। জাতীয় স্বার্থ কিভাবে সাম্যবাদী আন্তর্জাতিকতার স্বচ্ছ দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করতে পারে, বিভ্রান্ত করতে পারে, তার প্রমাণ খোঁজার জন্য এশিয়ার মানুষের আজ আর বেশি দূরে দৃষ্টি নিক্ষেপের প্রয়ােজন নেই।

আমরা বিশ্বাস করি, চীনের সত্তর কোটি মানুষ যদি বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট ইয়াহিয়া চক্রের পাশবিক  নির্যাতনের প্রকৃত খবর জানতে পারতেন, তাহলে তারাও বাংলাদেশের জন্য সাহায্য ও সহানুভূতির প্রেরণায় উদ্বেল হয়ে উঠতেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আজ গােটা এশিয়ার রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে চলেছে। এই বাস্তব সত্যকে অস্বীকার করার অর্থ, উট পাখির মতাে বালুতে মুখ গুঁজে অন্ধ হয়ে থাকা। বাংলাদেশের সমস্যাকে এড়িয়ে পিং পং কূটনীতি যেমন সফল হবে না, তেমনি সফল হবে না, কাগুজে বাঘের সঙ্গে কাগুজে বৈঠক। নয়াচীন যদি সত্য সত্যই এশিয়ায় শান্তি,স্বাধীনতা ও প্রগতির ভিত্তি শক্তিশালী করতে চায়, তাহলে বৃহৎ রাষ্ট্র সুলভ পুরনাে মুরুব্বিয়ানার ঢং ত্যাগ করে তাকে এই মহাদেশের ক্ষুদ্র বৃহৎ সকল রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সমন্বয় বিধান করে সহ অবস্থানের নীতিতে ফিরে যেতে হবে। পঞ্চাশ দশকের তিব্বতী দাওয়াই’ এখন সত্তর দশকে আর প্রযােজ্য নয়। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধীনতার সংগ্রামেও নয়াচীনকে সহযােগিতার হাত বাড়াতে হবে। মধ্যযুগীয় নাদির শাহী বর্বরতার প্রতীক ফ্যাসিস্ট ইয়াহিয়া চক্রকে মদদ জুগিয়ে এশিয়ায় শুধু এশিয়ায় কেন, গােটা বিশ্বে শান্তি ও প্রগতি নিশ্চিত করার উপায় নেই।

আদমশুমারি বন্ধ রয়টার খবর দিয়েছেন, আগামী ডিসেম্বর মাসে অধুনালুপ্ত পাকিস্তানে যে আদমশুমারি হওয়ার কথা ছিল, তা এক বছরের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। ইসলামবাদ থেকে সরকারিভাবে ঘােষণা করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের পরিস্থিতির দরুণ আদমশুমারি বন্ধ রাখা হল। এখানে উল্লেখযােগ্য যে, অধুনালুপ্ত পাকিস্তানে শেষ লােকসংখ্যা গণনা করা হয়েছে ১৯৬১ সালে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে আবার তা গণনা করার কথা ছিল। এখন প্রশ্ন হলাে, হঠাৎ আদমশুমারির কাজ বন্ধ করে দেয়ার কারণ কি? এই প্রশ্নের একটি সহজ ও সরল জবাব রয়েছে। সুতরাং অধিক গবেষণার প্রয়ােজন নেই। এই জবাবটি হলাে, গত মার্চ মাস থেকে আজ পর্যন্ত ইয়াহিয়ার জল্লাদ-বাহিনী কম পক্ষে ১০ লাখ মানুষ হত্যা করেছে। একমাত্র ভারতেই শরণার্থী গিয়েছে ৮০ লাখের উপর। এখনাে প্রত্যহ হাজার হাজার শরণার্থী ভারতে চলে যাচ্ছে। আগামী ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত যদি ইয়াহিয়ার হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় অবস্থান করে, তাহলে এই চার মাসে আরাে ৮০ লাখ নর নারীর বাংলাদেশ ত্যাগ করার আশঙ্কা রয়েছে। যেসব শরণার্থী ভারতে না গিয়ে বার্মা চলে গেছেন, তাদের হিসাব এতে ধরা হয় নি।  এই নৃশংশ অত্যাচারের কাহিনী চাপা দেয়ার জন্য ইয়াহিয়া এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গরা রাতদিন পাগলা মেহেরালির মতাে চীকার করে বলছেন, সব ঝুটহায়। অর্থাৎ সবই মিথ্যা। তারা কতিপয় ‘দুষ্কৃতিকারী’ ছাড়া কোনও বাঙালির গায়ে হাত তােলেন নি। কিন্তু আগামী ডিসেম্বর মাসে যদি আদমশুমারি হয়, তাহলে হয়তাে দেখা যাবে, বাংলাদেশের লােক সংখ্যা ৭ কোটি ২০ লাখ থেকে নেমে হঠাৎ ৫ কোটি ২০ লাখ বা সাড়ে চার কোটি হয়ে গেছে। ইয়াহিয়া চক্র এই সত্যটি চাপা দেবেন কি করে? ২৫শে মার্চের রাত্রের বর্বর হত্যাভিযান চাপা দেয়ার জন্য তারা এক ডজন বিদেশী সাংবাদিককে প্রায় উলঙ্গ করে ঢাকা থেকে বের দিয়েছেন। কিন্তু তারপর সত্য চাপা থাকে নি। সুতরাং ডিসেম্বর মাসে আদমশুমারি শেষ করে সত্য চাপা দেয়ার অপপ্রয়াস সফল হবে, এমন ভরসা ইয়াহিয়া চক্র নিশ্চয়ই করেন না। প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা বলা দরকার। ইয়াহিয়া-চক্র অধুনালুপ্ত পাকিস্তানের লােক গণনার কাজ বন্ধ করে ভালােই করেছেন। পাকিস্তান নামে যে দেশের অস্তিত্ব আজ নেই, তার আবার আদমশুমারি কি? তার বদলে ইয়াহিয়া চক্র একটা কাজ করতে পারেন। জামাতে ইসলামীর নেতা মােল্লা মওদুদীকে ডেকে ইসলামাবাদের কবরস্থানে তাদের সাধের পাকিস্তানের জানাজা পাঠের আয়ােজন করতে পারেন। কারণ, মৃতদেহ যত তাড়াতাড়ি কবরস্থ করা যায়, ততই ভালাে। নইলে পচা দুর্গন্ধ শৃগাল ও শকুনি ডেনে আনতে পারে।

জয়বাংলা (১) ১:১৭। ৩রা সেপ্টেম্বর ১৯৭১

সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ১০

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!