You dont have javascript enabled! Please enable it!

শােষণ মুক্ত সমাজ ব্যবস্থাই আমার কাম্য

জাতিসঙ্রে মাধ্যমে নয়া চক্রান্ত বাংলাদেশের এবং ভারতের সীমান্তে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক দল মােতায়েন করার প্রস্তাব করা হয়েছে । জাতিসঙ্রে উদ্ধান্ত পুনর্বাসন দপ্তরের হাই কমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন বাংলাদেশের জাতিসঙ্রে চল্লিশজন পরিদর্শক পাঠাবার প্রস্তাবও করেছেন। উদ্দেশ্য হিসাবে বলা হয়েছে, ভারতে চলে গিয়েছেন এমন লক্ষ লক্ষ শরণার্থী যাতে নিরাপদে স্বদেশে ফিরে আসতে পারেন এবং তারা পুনর্বাসিত হন তার তদারকি করা। দৃশ্যতঃ প্রস্তাবটি খুবই নির্দোষ ও সাধু। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই বােঝা যাবে দৃশ্যত সাধু ও নির্দোষ প্রস্তাবটির আড়ালে রয়েছে জাতিসঙ্ঘ ও তার প্রধান মুরুব্বি যুক্তরাষ্ট্রের নিকসন এডমিনিস্ট্রেশনের নতুন চক্রান্ত। কেবল একটি প্রস্তাব এসেছে তাদের পাকিস্তান ঘেঁষা এজেন্ট প্রিন্স সদরুদ্দিনের মারফৎ। গণ প্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকার এবং ভারত সরকারও সঙ্গে সঙ্গে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক মোতায়েনের ‘সাধু প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিছুদিন আগে, জাতিসংঘের তরফ থেকে বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের পরিদর্শকের নামে ভারত, পাকিস্তান ও অধিকৃত বাংলাদেশ সফরে এসে ও সদরুদ্দিন নানা উল্টা-পাল্টা কথা বলে গেছেন। উদ্দেশ্য ছিল সম্ভবত | তার দোস্ত ইয়াহিয়ার গণহত্যার পাপ যথাসম্ভব কমিয়ে দেখানাে। | প্রিন্স সদরুদ্দিনের কথা থাক। বাংলাদেশের ও ভারতে জাতিসঙ্ঘের পর্যবেক্ষক মােতায়েন করার প্রস্তাব শুনে অতি দুঃখের মধ্যেও আমাদের একটি পুরনাে গল্প মনে পড়ছে। একবার এক সার্জেনের কাছে একজন রােগী দেখে বললেন, এমন কিছু বড় অপারেশন নয়। এখনি তিনি রােগীকে রােগমুক্ত করে দেবেন। ঘটা করে সার্জেন রােগীর দেহে অস্ত্রোপচার করলেন। প্রায় ঘন্টা খানেক পরে কক্ষের বাইরে এসে রােগীর রুদ্ধশ্বাস আত্মীয়দের বললেন, “আপনাদের কি বলবাে, অপারেশন অত্যন্ত সাকসেসফুল হয়েছে। তবে দুঃখের কথা এইটুকু যে, রােগী মারা গেছেন।

বাংলাদেশের ইয়াহিয়ার দস্যুচক্র বেপরােয়া গণহত্যা চালাচ্ছে আজ চার মাস হয়ে গেল। দখলীকৃত। বাংলাদেশ এখন ধ্বংসস্তুপে পরিণত। এখনাে বাংলার জীবন ও সম্পত্তি ধ্বংসের কোনাে সঠিক হিসাব হয়নি। বেসরকারি হিসাবে আশঙ্কা করা হয়েছে, মৃত্যের সংখ্যা দশলাখ, গুরুতর ভাবে আহতের সংখ্যা পঁচিশ হাজার, সাধারণভাবে আহত তিন লাখ, নির্যাতিতা নারীর সংখ্যা পনের হাজার থেকে বিশ হাজার। আর বাংলাদেশ থেকে হিন্দু মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান নির্বিশেষে শরণার্থী ভারতে ঠেলে দেয়া হয়েছে ৭০ লাখের উপরে। এই পৈশাচিক ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাকাণ্ড যখন চলছিল, তখন বাংলাদেশের নেতারা বার বার জাতিসঙ্ ও বৃহৎ রাষ্ট্রবর্গের কাছে মানবতা ও বিশ্বশান্তির নামে আকুল আবেদন জানিয়েছেন, এই শিশুঘাতী ও নারীঘাতী বর্বরতা বন্ধে সক্রিয় হােন, বাংলাদেশের মানবতার স্বার্থে জাতিসঙ্রে হস্তক্ষেপ চাই। জাতিসক্স কোটি কোটি মানুষের এই বিপন্ন আর্তনাদে কান দেন নি। আর বৃহৎ রাষ্ট্রবর্গের মধ্যে আমেরিকা জাহাজ বাঝাই করে অস্ত্র পাঠিয়েছে- এই অস্ত্র নিরীহ ও নিরস্ত্র নর-নারী হত্যার কাজে লাগানাে হবে এই তথ্য জেনেও। এই দীর্ঘ চার মাস পরে-যখন ইয়াহিয়া চক্রের ধ্বংস যজ্ঞ প্রায় সমাপ্ত হয়ে এসেছে, তখন জাতিসংজ্ঞ কর্তৃপক্ষ পর্যবেক্ষক পাঠাতে চান কি প্রয়ােজনে সেখানে স্তুপীকৃত মৃতদেহের সংখ্যা গুণতে? ধ্বংসস্তুপে পরিণত দখলীকৃত বাংলাদেশে জাতিসজের তথাকথিত ত্রাণকার্যের মহড়া দিতে? হ্যা, তাতে জাতিসঙ্ঘের ত্রাণ কার্যের অপারেশন অবশ্যই সাকসেসফুল হবে, কিন্তু রােগী বাঁচবে না। এই ধ্বংসস্তুপ ও মৃতদেহের স্তুপের উপর দাঁড়িয়েই জাতিসঙ্ঘের পর্যবেক্ষকেরা তখন হয়ত দাবী করবেন, বাংলাদেশ ধ্বংস হয়ে গেছে, তাতে আমাদের কি? আমাদের অপারেশন (অভিযান) সাকসেসফুল।’

জাতিসক্স নামক একটি বিশ্ব প্রতিষ্ঠানের যদি যথার্থই কোনও অস্তিত্ব থাকতাে, তাহলে তারা ভারতে তাে দূরের কথা, বাংলা দেশেও পর্যবেক্ষক পাঠাবার নাম এখন মুখে আনতেন না। জাতিসঙ্ঘের কর্তাব্যক্তিদের স্মরণ আছে কিনা আমরা জানি না, এপ্রিল-মে মাসের দিকে দখলীকৃত বাংলাদেশের ইয়াহিয়ার গণ-হত্যা যজ্ঞ যখন পুরােদমে চলেছে, তখন জাতিসঙ্ সেখানে ত্রাণ সামগ্রী প্রেরণ এবং নিজেদের তদারকিতে তা বন্টনের জন্য প্রস্তাব দিয়েছিল। তারপর জাতিসষ্মের পক্ষ থেকে আবার নরম ভাষায় প্রস্তাব।  

দেয়া হলাে, জাতিসক্সের ত্রাণ সমাগ্রী ইয়াহিয়ার সরকারি সংস্থাগুলােই বন্টন করবে, তবে তদারকি করবে জাতিসজের লােকেরা। এই প্রস্তাবও প্রথমে ইয়াহিয়ার মনােঃপূত হয় নি। ইয়াহিয়ার কাছে জাতিসত্ম আমল পায় নি। এমন কি তার পৈশাচিক গণহত্যা ও গণ উৎপাদন বন্ধ করতেও জাতিসঙ্ পারেন নি। আক্রমণকারীও অত্যাচারী বর্বরতা বন্ধ করতে সাহসের সঙ্গে না এগিয়ে দীর্ঘ চারমাস পর এখন সক্রিয় হয়েছেন পর্যবেক্ষক নিয়ােগের নামে আক্রান্ত পক্ষের আত্মরক্ষার প্রস্তুতি ও উদ্যোগ আয়ােজন নষ্ট করার জন্য। এ না হলে আর জাতিসত্ম। আসলে জাতিসঙ্ নামক বিশ্বসংস্থাটির বহুদিন আগেই অস্তিত্ব লােপ পেয়েছে। নিউ ইয়কে জাতিসঙ্ঘ সদর দপ্তর নামে যে ভবনটি আছে, তা প্রকৃত পক্ষে একটি বৃহৎ শবাধার । আর এই শবাধারটি বহনের জন্য সর্বাগ্রে এগিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের নিকসন এডমিনিস্ট্রেশন এবং সর্ব শেষ ব্যক্তি | নিমন্ত্রিত হয়েছেন পাকিস্তান নামক একটি অধুনালুপ্ত রাষ্ট্রের বে আইনী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া।

| সব চাইতে মজার ব্যাপার এই যে, জাতিসংঘ ভারত সীমান্তেও পর্যবেক্ষক মোতায়েন করতে চেয়েছেন। | এ যেন মামার বাড়ির আব্দার। ভারত সরকার অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে এ ব্যাপারে না বলে দিয়েছেন। তথাপি প্রশ্ন থেকে যায়, ভারতে পর্যবেক্ষক পাঠিয়ে কি হবে? গৃহস্থ বাড়িতে ডাকাত পড়েছে। ডাকাত না বেঁধে, গৃহস্থ বাধার এমন চমক্কার প্রস্তাব আর কখনাে শােনা যায় নি। অপরাধ করেছে পাকিস্তান। সত্তর লাখ শরণার্থী সে ভারতের ঘাড়ে চালিয়েছে। ভারত এই শরণার্থীদের সাময়িকভাবে আশ্রয় দিয়ে বিরাট মানবতাবাদী ভূমিকায় পরিচয় দিয়েছে। এক্ষণে অপরাধী পাকিস্তানের সঙ্গে মানবতাবাদী ভারতকে একাসনে বসিয়ে ভারতের ঘাড়ে ও পর্যবক্ষেক বসিয়ে দেয়ার প্রস্তাব বাতুলতা না নতুন চক্রান্ত পরিবর্তিত বিশ্ব-পরিস্থিতিতেই তা বিচার্য। এখানে আরাে একটি কথা বলা দরকার; শরণার্থীরা ভারতে গিয়ে বিপন্ন হয় নি, তারা বিপন্ন হয়েছে পাকিস্তান ঘেঁষা জাতিসঙ্ঘ- প্রতিনিধি- প্রিন্স সদরুদ্দিন ইয়াহিয়ার অনেক দুষ্কর্ম চাপা দিতে চাইলে ও বলতে বাধ্য হয়েছে, ‘পাকিস্তানে ফিরে গেলে শরণার্থীদের জীবন বিপন্ন হবে না, এমন গ্যারান্টি আমি দিতে পারি না।’ যে স্বীকারােক্তির একমাত্র অর্থ, পাকিস্তানে এখনাে অত্যাচার চলছে এবং দেশত্যাগীদের প্রত্যাবর্তন সেখানে নিরাপদ নয়। এই অবস্থায় জাতিসঙ্রে যদি সত্যই কোন দায়িত্ব বােধ থাকে, তাহলে তাদের একমাত্র কর্তব্য হচ্ছে, অধিকৃত বাংলাদেশ থেকে অবিলম্বে অত্যাচারী হানাদার বাহিনী অপসারণের ব্যবস্থা করা এবং লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিরাপদ ও নিশ্চিত করার জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে তাদের বৈধ কর্তৃত্ব সম্প্রসারণের সাহায্য করা। তা না করে শরণার্থীদের জন্য মেকি দরদ দেখিয়ে বাংলাদেশে এবং ভারতে পর্যবেক্ষক প্রেরণের প্রস্তাব আনলে নতুন মােড়কে একটি পুরনাে সাম্রজাবাদী চক্রান্ত মাত্র। জাতিসঙ্ঘ এই চক্রান্তেরই বহু ব্যবহৃত মাধ্যম।

জাতিসঙ্ পর্যবেক্ষক ও জাতিস বাহিনীর মােতায়েনের ‘চমক্কার ফল’ বিশ্ববাসী একবার মধ্যপ্রাচ্যে এবং আরেকবার কঙ্গোতে প্রত্যক্ষ করেছে। জাতিসঙ্রে চমৎকার পর্যবেক্ষক ও খবরাদি প্যালেস্টাইনেও দেখেছে। কঙ্গোতে বিপুল ভােটাধিক্যে নির্বাচিত প্রথম জাতীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী লুমুম্বা দেশের আভ্যন্তরীন শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসঙ্ বাহিনীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিজ দেশে নিয়েছিলেন। এই জাতিসক্স বাহিনীর নাকের ডগায় দাঁড়িয়ে কঙ্গোর ফ্যাসিষ্ট চক্র মহান দেশ নায়ক লুমুম্বকে পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করেছে। জাতিসক্স এই হত্যাকাণ্ডের নীরব দর্শক ছিলেন মাত্র। সুতরাং বাংলাদেশের শরণার্থীদের | সেবার উছিলায় সূঁচ হয়ে ঢুকে জাতিসক্স কাদের জন্য ফাল্ হতে চান্ তা বুঝতে ‘বােকা বাঙ্গালিরও খুব বেশি দেরী হয় নি।  জাতিসঙ্গের মাধ্যমে এই নয়া চক্রান্তের উদ্দেশ্য অতি স্পষ্ট। দখলীকৃত বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার হানাদার বাহিনী এখন ক্রমবর্ধিত গেরিলা তৎপরতার কাবু হয়ে পড়েছে। মুক্ত অঞ্চলে মুক্তি বাহিনী হানাদার বাহিনীর উপর চূড়ান্ত আঘাত হানার প্রস্তুতি নিচ্ছে। জাতিসকে সংগঠিত ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং ইয়াহিয়ার হানাদার চক্রান্তের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করে তারা নেপথ্যের মুরুব্বিরা চাচ্ছে, হানাদারের এই চরম মার থেকে বাঁচাতে পর্যবেক্ষক মােতায়েনের নামে যদি বাংলাদেশে ও ভারত সীমান্তে জাতিসঙ্গবাহিনী মােতায়েন করা যায়, তাহলে মুক্তিবাহিনী ও গেরিলাদের তৎপরতারােধ করা যাবে এবং তাদের মার থেকে হানাদারবাহিনীকে বাঁচানােও যাবে, এই তাদের দুরাশা। পাকিস্তানকে এখনাে অস্ত্র প্রদানের যুক্তি হিসাবে। নিক্সন সরকার যে অভিনব তথ্য আবিষ্কার করেছেন তাহলাে, বাংলাদেশ উগ্রপন্থীদের দমনের জন্য অস্ত্র প্রেরণ দরকার। ভবিষ্যতে এই তথাকথিত উগ্রপন্থীদের দমনের নামে মুক্তিবাহিনীকে দমনেরও এক চমৎকার যুক্তি নিক্সন সাহেবেরা খাড়া করতে পারেন। বাংলাদেশে যখন জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ চলছে, তখন সেখানে যারা “উগ্রপন্থীদের অস্তিত্ব বা তাদের প্রভাব আবিষ্কার করতে পারেন, তাদের পক্ষে সবই সম্ভব। ভিয়েনামের কিছু উদ্ধৃত্ত মার্কিন সৈন্য জাতিসক্স পর্যবেক্ষকবাহিনীতে ঢুকিয়ে যদি বাংলাদেশে পাঠানাে যায়, তাহলে এখানেও আরেকটি ভিয়েম সৃষ্টিতে দেরী হবে না এবং মার্কিন অস্ত্র ব্যবসায়ীদের অস্ত্র ব্যবসায়েও ভাটা পড়বে না। যুক্তরাষ্ট্রের শান্তিকামী ও গণতন্ত্রকামী মানুষেরও তাই উচিৎ, তাদের দেশের রক্ত ব্যবসায়ীদের এই নতুন চক্রান্ত সম্পর্কে সজাগ হওয়া। 

বাংলাদেশ সমস্যায় জাতিসঙ্ যদি কোনাে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করতে চায়, তার পথ এখনাে উন্মুক্ত রয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাঁর সাম্প্রতিক এক ভাষণে এই পথের কথাই সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন। এই পথ হলাে, বাংলাদেশ থেকে পাক হানাদার বাহিনী অবিলম্বে সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করা, স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকার ও জাতিসঙ্ েস্থান দেয়া, গত তেইশ বছর ধরে। বাংলাদেশে যে শােষণ চালানাে হয়েছে বিশেষ করে গত ২৫শে মার্চের পর যে ধ্বংস সাধন করা হয়েছে, ইসলামাবাদ সরকারের কাছ থেকে তার ক্ষতিপূরণ আদায় করা এবং শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনে সাহায্য করা। একমাত্র এ পথেই বাংলাদেশ সমস্যার শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়সঙ্গত সমাধান সম্ভব। জাতিসঙ্ঘের তাই উচিৎ, কোনও নেপথ্য চক্ৰীদলের চক্রান্তের মাধ্যম না হওয়া এবং ভাওতাবাজির আশ্রয় না নেয়া। বাংলাদেশের মানুষ এখন অপরের কৃপাপ্রার্থী নয়। তারা নিজেরাই নিজেদের সমস্যা সমাধান ও হানাদার উৎসাদনে কৃতসংকল্প।

জয়বাংলা (১)১ ১২ ৩০ জুলাই ১৯৭১

এশিয়ার রাজনীতি

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সনের প্রস্তাবিত পিকিং সফর সম্পর্কে এখনাে জল্পনা-কল্পনা শেষ হয় নি। তবে এই সফরের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর বিশ্বে যতটা সােরগােল পড়বে বলে প্রত্যাশা করা হয়েছিল ততটা হয় নি। বরং খবরটা ফাস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে নাটকীয় উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল, তা ক্রমশঃই থিতিয়ে যাচ্ছে। কোনাে ঢাক ঢাক গুড় গুড় নীতি অনুসরণ না করে যদি নিক্সন ঘোষণা করতেন, তিনি আগামী দশ মাসের মধ্যে কোন এক উপযুক্ত সময়ে চীন সফরে যাবেন, তাহলে বিশ্ববাসী হঠাৎ চমকে যেতাে না। কিন্তু ডা. হেনরি কিসিঙ্গারের পিন্ডি থেকে গােপনে পিকিং গমন এবং তারপর আকস্মিকভাবে নিক্সনের চীন সফরের সিদ্ধান্ত ঘােষণা, মনে হয় বিশ্বে চমক সৃষ্টির জন্যই অত্যন্ত কৌশলে সাজানাে হয়েছিল। নিক্সন সাহেব হয়ত আশা করেছিলেন এই অতি নাটকীয় চমক সৃষ্টি দ্বারা তিনি বাংলাদেশ ও ভিয়েম সমস্যা থেকে তার দেশবাসীর দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নেবেন এবং এইভাবে আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সহজেই বাজিমাত করে ফেলবেন। কিন্তু নিক্সন সাহেবদের আশা পূর্ণ হয় নি। তার প্রস্তাবিত চীন সফরের চমক অল্প দিনেই ফেটে গেছে এবং বিশ্ববাসী বুঝে ফেলেছে, এটা একটা বড় রকমের স্ট্যান্ট। আমেরিকার প্রাক্তন সিনেটর ম্যাকার্থি তাে স্পষ্টই বলে দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের আগামী নির্বাচনে বাংলাদেশ একটা বড় ইস্যু হবে। অন্যদিকে জনপ্রিয় মার্কিন সিনেটর এডােয়ার্ড কেনেডি ঘােষণা করেছেন, তিনিও চীন সফরে যাবেন। | ওদিকে আমেরিকার সঙ্গে বৈঠকের খবর প্রচারিত হওয়ার পর চীনের অবস্থাও যে খুব সুবিধের হয়েছে তা নয়। চীন এদ্দিন বলে এসেছে, আমেরিকা কাগজের বাঘ এবং এই কাগজের বাঘের সঙ্গে যারা দোস্তি করে তারা শােধনবাদী। নিক্সনের সঙ্গে চীনা নেতাদের প্রস্তাবিত বৈঠকের খবর প্রচারিত হওয়ার পর চীনের। যারা আন্তরিক সমর্থক, তাদের মধ্যেও এই বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে যে, কাগজের বাঘের সঙ্গে দোস্তি পাতিয়ে চীনও কি তাহলে তাদেরই কথিত শোধনবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী লেজুড় বৃত্তির নীতি অনুসরণ করবে? 

বিশ্বময় এই বিভ্রান্তি ও সংশয় দূর করার জন্যই চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইকে তাড়াতাড়ি সাংবাদিকদের কাছে বলতে হয়েছে, তাদের ছয় দফা শর্ত মেনে নিলে তবে চীন মার্কিন আঁতাত সম্ভব। এই ছয় দফার মধ্যে এমন সব শর্ত রয়েছে, যা মেনে নেওয়া আমেরিকার পক্ষে এই মুহূর্তে অসম্ভব। তাহলে শেষ পর্যন্ত ‘নয় মন তেলও হবে না, রাধাও নাচবে না’ এই অবস্থা দাঁড়ায়। | এদিকে যে ইন্দোচীন ৰা ভিয়েনাম নিয়ে চীন মার্কিন এত মন কষাকষি, সেই ভিয়েনামের মুক্তি বাহিনীর নেতারা স্পষ্ট ঘােষণা করেছেন, এশিয়ায় ক্ষুদ্র, দুর্বল ও নির্যাতিত জাতিগুলাের স্বার্থকে পাশ কাটিয়ে যদি চীন ও আমেরিকার মধ্যে এই মহাদেশে শক্তি, সাম্য ও স্বার্থ ভাগাভাগির প্রশ্ন দেখা দেয়, তাহলে নিপীড়িত জাতিগুলাে সে সম্পর্কে কিছুমাত্র উৎসাহিত বােধ করবে না। শুধু ভিয়েনাম নয়, ভিয়েৎনাম ও কম্বােডিয়ার চাইতেও এশিয়ার বড় প্রশ্ন আজ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। নিজেদের ক্ষুদ্র রাষ্ট্রীয় স্বার্থে যদি নিক্সন এডমিনিস্ট্রেশন ও চীন সরকার সাড়ে সাত কোটী মানুষের বাঁচা-মরার প্রশ্নকে বাইপাশ করতে চান, সেক্ষেত্রে তাদের সম্পর্কে বাংলাদেশকে তার নীতি পুনর্বিবেচনা করে দেখতে হবে। বাংলাদেশ বিশ্বের সকল দেশের প্রতি মৈত্রী ও বন্ধুত্বের হস্ত প্রসারণে ইচ্ছুক, কিন্তু তা তার স্বার্থ, অধিকার ও মর্যাদার বিনিময়ে নয়।

“মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল” বাংলা ভাষায় একটা প্রবাদ আছে, ‘মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল।’ অধুনালুপ্ত পাকিস্তানের জবরদখলকারী শাসক ইয়াহিয়া চক্রের কাণ্ডকারখানা দেখে মনে হয়, এদেরও আর পাগল হতে বেশি দেরি নেই। মাত্র কিছু দিন আগে এক বিদেশী সাংবাদিকের কাছে ইয়াহিয়া হুঙ্কার দিয়ে বলেছে, “বিশ্ববাসী জেনে যাক, আমি যুদ্ধ করব। ভারত যদি বাংলা দেশের কোনও এলাকা দখল করে, তাহলে যুদ্ধে নামতে আমি দ্বিধা করবাে না।”তারপর এক হপ্তা ঘােরেনি, ইয়াহিয়া আবার যুদ্ধের হুঙ্কার দিয়েছে। প্রকাশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি বৃহৎ রাষ্ট্রকে ইয়াহিয়া জানিয়ে দিয়েছে ভারত সীমান্ত থেকে যদি কামানের গােলা বর্ষিত হয়, তাহলে সামরিক সংঘর্ষ দেখা দেবে।’ প্রশ্ন হলাে, বার বার এই যুদ্ধ হুঙ্কার কেন? মাস দুয়েক আগেও ইয়াহিয়ার গলার স্বর খুব নরম ছিল। তখন তার মুখে ভালাে ভালাে কথা শােনা গেছে। ইয়াহিয়া বলেছে, ‘যুদ্ধ আমি চাই না। ইন্দিরা গান্ধী ও নিশ্চয়ই যুদ্ধ চান না। কারণ, যুদ্ধ দ্বারা কোনও সমস্যার সমাধান হতে পারে না। এই ইয়াহিয়াই এখন বলছে, সে যুদ্ধ করবে। এর অর্থ কি?  এই ব্যাপারে নানা মুনির অবশ্য নানা মত। কেউ কেউ বলছেন, আমেরিকার কাছ থেকে অস্ত্র এবং চীনের কাছ থেকে অস্ত্র এবং সমর্থন দুইই পেয়ে ইয়াহিয়ার সাহস বেড়ে গেছে। ইয়াহিয়া তাই-জোর গলায় বলছে, যুদ্ধ বাধলে আমরা একা যুদ্ধ করবাে না। এর একমাত্র অর্থ হচ্ছে, তাদের পেছনে চীন রয়েছে। এই যুক্তি বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়া কঠিন। আমরা মনে করি, বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার খুঁটি যত নড়বড়ে হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য যতই অনিবার্য হয়ে উঠছে, ইয়াহিয়া তত বেশি ঘাবড়ে যাচ্ছে এবং গলার স্বর ততই বাড়ছে। দু’মাস আগে ইয়াহিয়া নিশ্চিত ধরে নিয়েছিল যে, বাংলাদেশের মুক্তি যােদ্ধারা খতম হয়ে গেছে এবং এখন সে কিছু দালালকে সামনে রেখে নিশ্চিন্ত মনে বাংলাদেশে একটি পাপেট গভর্নমেন্ট বসিয়ে শাসনশােষণ চালাতে পারবে।

এই ব্যাপারে একমাত্র অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে ভারত। সুতরাং ভারতকে তােয়াজ করে ঠাণ্ডা রাখতে পারলেই সব সমস্যার সমাধান। কিন্তু দু’মাসের মধ্যে ইয়াহিয়া চক্রের এই খােয়াব ভেঙে গেছে। মে ও জুন মাসের মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারা সংগঠিত ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং তাদের হাতে মার খেয়ে হানাদার বাহিনীর মধ্যে চরম ত্রাস সৃষ্টি হয়েছে। এটা এখন আরাে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, চলতি আগস্ট মাসের মধ্যে না হলেও সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে বাংলাদেশের মুক্ত এলাকা অনেক বেড়ে যাবে, এমনকি কুমিল্লা অথবা চট্টগ্রামের মতাে শহরও মুক্তি বাহিনীর অধিকারে চলে আসবে। এই সম্ভাবনা যত বাড়ছে ইয়াহিয়ার, অস্থিরতা তত বেড়ে যাচ্ছে। মুক্তি বাহিনী দখলীকৃত বাংলাদেশের একটা বড় অংশ শীঘ্রই দখল করবে এই সম্ভাবনা স্বীকার করা ইয়াহিয়ার পক্ষে মৃত্যু তুল্য। ইয়াহিয়া তাই মিথ্যাবাদী রাখাল বালকের মতাে চীৎকার শুরু করেছে, ভারত বাংলাদেশের কোনও এলাকা দখল করলে আমি যুদ্ধ করবাে। ভারত থেকে কামানের গোলা বর্ষিত হলে যুদ্ধ বাধবে। ইত্যাদি। এর অর্থ, মুক্তি বাহিনী দখলীকৃত বাংলাদেশের কোনও একটা অংশে যে শীঘ্রই পুনরুদ্ধার করবে, ইয়াহিয়া তা বুঝতে পেরেছে। এখন পরাজয়ের লজ্জা আগে ভাগেই এড়ানাের জন্য এই হাঁক ডাক। | এটা গেল ইয়াহিয়ার চীৎকারের একদিক। এর অন্যদিকও রয়েছে। আকাশ পথে দেড় হাজার মাইল। এবং স্থল পথে তিন হাজার মাইল দূরে থেকে বাংলাদেশে যুদ্ধ চালাতে গিয়ে ইসলামবাদ এখন বলতে গেলে প্রায় ফতুর। রেশন ও রসদের অভাবে হানাদার বাহিনীর মধ্যে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। বিমান বাহিনীতে। দলত্যাগের হিড়িক দেখা দিয়েছে। আসন্ন বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে পিভির সামরিক জান্তার মধ্যে আজ পীরিত । আর নেই। ইয়াহিয়া বলছে, এই অবস্থার জন্য টিক্কা দায়ী, টিক্কা বলছে ইয়াহিয়া দায়ী। লন্ডনে খবর রটে। গেছে, যে কোনও সময় ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান হতে পারে। পাকিস্তানের এবং নিজেদের এই চরম বিপর্যয়ের মুখে ইয়াহিয়া চক্রের এখন বাঁচার একমাত্র উপায়, যদি । বাইরের বৃহৎ রাষ্ট্রবর্গ বাংলাদেশ সমস্যায় বিরােধ মিটানাের নামে এগিয়ে আসেন এবং ইয়াহিয়া চক্রকে । নিজেদের সৃষ্ট পাক চক্র থেকে টেনে তােলেন। ইয়াহিয়া তাই ক্ষিপ্ত জন্তর মতাে চীৎকার করে বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে আর বলছে, যুদ্ধ এই লাগলাে বলে। অর্থাৎ, তােমরা এগিয়ে না এলে যুদ্ধ বাধবে। সুতরাং তােমরা এগিয়ে আসে এবং আমাদের বাঁচাও। | কিন্তু ইয়াহিয়া-চক্রের সেই প্রবাদটি জানা উচিৎ, “শেষের সেদিন বড়ই ভয়ঙ্কর।’ ইয়াহিয়া-চক্রের”। শেষের সেদিন আজ সমুপস্থিত। চীনের নাম করে ভারতকেও আর ব্লাকমেইলিং করা যাবে না। বাংলাদেশ। ইয়াহিয়াকে একাই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে এবং মরতে হবে, এই তার নিয়তির বিধান মাথার ঘায়ে কুকুর। পাগল হলে কি হবে, বিশ্ববাসী জানে, ‘যে কুকুর ঘেউ ঘেউ করে, সে কামড়ানাে বা কামড়াতে পারে না।’

জয়বাংলা (১) ১:১৩ ৬ আগস্ট ১৯৭১।

বাংলাদেশ ও জাতিসংঘ

জাতিসংঘ নামে বিশ্বের বুকে একটা আন্তর্জাতিক বিশ্ব সংগঠনের অস্তিত্ব আছে-একথা সংগ্রামী বাংলার মানুষ। আজ আর বিশ্বাস করতে চায় না। একদিন তারা জানতাে বিশ্ব মানবতার জন্য এনামে একটা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। লীগ অব ন্যশন্স-এর পরিবর্তিত, সংশােধিত রূপ এই জাতিসংঘ মানব কল্যাণের জন্য, অত্যাচার, নির্যাতন ও মানবীয় শােষণের অবসানের জন্য কিছু করা অন্তত করার দায়িত্ব নিয়ে প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব হয়েছে। এ বিশ্বাসও বাংলাদেশের জনগণের ছিল। কিন্তু আজ আর তারা একথা বিশ্বাস করতে চায় না আর চাইবে। কিনা তাতেও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। | কেননা জাতিসংঘের সফলতার দিকটার চাইতে দুর্বলতার দিকটা, ব্যর্থতার দিকটা অত্যাচারিত, শােষিত, বঞ্চিত, সংগ্রামী বিশ্বের জনতার কাছে বেশি প্রকট হয়েছে। যে আশা নিয়ে, আকাখা, নিয়ে। সাহায্যের তীব্র ইচ্ছা নিয়ে সর্বোপরি মানবতার সেবা পাবার আগ্রহ নিয়ে যখনই তারা হাত বাড়িয়েছে তখনি । জাতিসংঘের সদর মহলের প্রবেশ পথে কালাে পর্দা ঝুলে পড়েছে। তারা রিক্ত হস্তে করুণভাবে ফিরে। এসেছে। বিশ্বের এই সংগ্রামী মানুষগুলাের সাথে বাংলার সংগ্রামী আসছে। হয়তাে এমনি পেয়ে আরও বহু বার ফিরে আসতে হবে। | মূলত কার্যদৃষ্টে একথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, জাতিসংঘ নামে আন্তর্জাতিক এই প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের । গুটিকয় বড় শক্তির বৈঠকখানা বিশেষ। চা খাওয়া, আড্ডা দেয়া, প্রয়ােজনবােধে তাস পাশা খেলার সুন্দর। ব্যবস্থা বিশেষ এই জাতিসংঘের সদর দফতরটি। তার কর্মকর্তারা বৃহৎ শক্তিগুলাের হর্তা-কর্তা। আড্ডাবাজদের হুকুমের কর্মচারী বিশেষ। এই পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের কাছ থেকে সংগ্রামী বাংলাদেশ কি। আশা করতে পারে। পক্ষান্তরে বিশ্বের দুটি শক্তি ক্ষমতার রাজনীতির নেশায় এমনভাবে মজেছে যে, মানবদরদী, শােষণ নির্যাতনের বিরােধী বলে পরিচিত এই দুই রাষ্ট্রের বিবেকের সকল অনুভূতির যেন বিলুপ্তি ঘটেছে। অন্যান্যরা আজ মেরুদণ্ডহীন প্রাণী বিশেষ। আত্মবিশ্বাস, আত্মশক্তি, ন্যায়বােধ বলতে যে তাদের। কিছুই নাই। 

এদিকে আজকের বিশ্বের বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, যার শক্তি নাই, সম্পদ নাই, আত্মবিশ্বাস নাই, সম্মান ও মর্যাদাবােধ নাই তার কদর নিজের কাছে তাে নাই, পরের কাছে তাে মােটেও নাই। সম্পদ ও ক্ষমতা এ দুটোই আমােঘ অস্ত্র। এ দুটোর নির্দেশেই সবাই উঠানামা- বসা শােয়া করছে। জাতিসংঘও তাই বৃহৎ শক্তিগুলাের ক্রীড়নক হয়ে কাজ করুক তাতে তাদের মেরুদণ্ড বিবেক-হীন অস্থিমজ্জায় বাধে না। বাধবে না। | জাতিসংঘ ও বৃহৎ শক্তিগুলাের বাংলদেশ নিয়ে খেলার অবস্থা দৃষ্টে একথা স্পষ্ট ভাবে বলা যায় যে, নিজেদের ক্ষমতা ছাড়া তাদের মুক্তি সম্ভব নয়-স্বাধীনতা কখনাে আসবে না। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দের অভিমত ও তাই। ইতিপূর্বেই তারা একথা স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। | অবশ্য এই ঘৃণ্য, মানবতাবিরােধী মানসিকতার বিরুদ্ধে যে শক্তিশালী রাষ্ট্র ও বিবেকবান মানুষ তাই, তা নয়। তারাও কাজ করছেন। করবেন। তারাই একমাত্র বাংলাদেশের জনগণের বাইরের সম্পদ। মুক্তিযােদ্ধারা মাতৃভূমি থেকে পাক-হানাদারের একে একে খতম করছে। করবে। তাদের শেষ অপচেষ্টা শীঘ্রই তাদের মৃত্যুমুখী আঘাতে সম্পূর্ণ নির্মূল হবে-এদৃঢ় বিশ্বাস ও আত্ননিষ্ঠা তাদের রয়েছে। | সাড়ে সাতকোটি মানুষ বিশ্বের বুকে কনিষ্ঠতম জাতি হবে, শশাষক গােষ্ঠীকে সাম্রাজ্যেবাদী ক্রীড়নক শক্তিগুলাে উৎখাত করবে বিশ্বের বুক থেকে এ কামনা বাংলার প্রতিটি মানুষই করছে। আর এই জন্য সার্বিক সাফল্য তাদের জন্য সুনিশ্চিত।

বাংলার মুখ ১: ৩ : ২৭ আগস্ট ১৯৭১

বাংলাদেশে কুইসলিং-এর স্থান নাই

২৫শে মার্চ বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আক্রমণ চালাইবার সময় জল্লাদ ইয়াহিয়াচক্র হিসাব। করিয়াছিল যে, মার্কিনী মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত তাহাদের বর্বর সেনাবাহিনীর এক আঘাতেই তাহারা গণতন্ত্র ও স্বাধীনতাকামী জনগণের কণ্ঠ স্তব্ধ করিয়া দিবে, নিশ্চিহ্ন করিয়া দিবে সমস্ত সংগ্রামী ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে। তাহাদের এই হিসাবের কথাই ধ্বনিত হইয়াছিল রক্তলােলুপ টিক্কা খানের সদম্ভ উক্তিতে- “আমি দুই দিনেই নক্কারজনক ব্যাপারটা শেষ করিয়া দিব।” (I shall finish the whole bloody thing in two days”)। এইরূপ হিসাব করিয়াই জল্লাদের দল ২৫শে মার্চ নিশুতি রাতে যখন সমস্ত দেশ সুসন্তিতে নিমগ্নতখন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রাণকেন্দ্র ঢাকা নগরীতে অতর্কিতে চালিয়েছিল এমন এক সশস্ত্র হামলা, যা শুধু একটা যুদ্ধাবস্থাতেই সম্ভব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানার ই.পি. আর ব্যারাক, রায়সাহেবের বাজার, নয়া বাজার, তাঁতি বাজার, শাখারি বাজার প্রভৃতি স্থানে ইয়াহিয়া-চক্র নিরস্ত্র, ঘুমন্ত জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করিয়াছিল আধুনিক স্থল যুদ্ধের সবরকম উপকরণট্যাঙ্ক, ভারী মর্টার, মেশিনগান, রকেট-লাঞ্চার, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল প্রভৃতি এবং হত্যা করিয়াছিল হাজার হাজার নির্দোষ মানুষকে, ধ্বংস করিয়াছিল লাখ-লাখ টাকার সম্পদ। “আচমকা এক প্রচণ্ড আঘাতেই সব খতম কর”- ফ্যাসিস্টদের এই নীতি পাকিস্তানের রক্তলােলুপ সমর নায়করা সে দিন বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে প্রয়ােগ করিয়াছিল।

কিন্তু জল্লাদের দল হিসাবে একটু ভুল করিয়াছিল তাহারা বাংলাদেশের জনগণকে তাহাদের ধর্তব্যের মধ্যে আনে নাই। তাহারা চিনে নাই বাংলাদেশের জাগ্রত স্বাধীনতাকামী তরুণদের, চিনে নাই শ্রমিক কৃষকদের, চিনে নাই। বিদ্রোহী ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই.পি, আর ও পুলিশ বাহিনীর লােকদের । ইহারাই তখন নরঘাতক ইয়াহিয়াচরে সমস্ত হিসাব বানচাল করিয়া দিয়াছিল। যদিও ঢাকা নগরীতে ইয়াহিয়া চক্রের দস্যু বাহিনীর অতর্কিত ও বিশীল সশস্ত্র আক্রমণের বিরুদ্ধে বড় রকমের প্রতিরােধ গড়া সম্ভব হয় নাই, কিন্তু ঢাকার নরমেধ যজ্ঞের প্রতিক্রিয়ার বাংলাদেশের অন্য সমস্ত স্থানে গড়িয়া উঠিয়াছিল এক মহান মুক্তি সংগ্রাম এবং বাংলাদেশের মাটিতে জন্ম নিয়াছিল বীর মুক্তি বাহিনী। ২৫শে মার্চের সেই কালরাত্রির পরে পাঁচটি মাস অতিবাহিত হইয়া গিয়াছে। এই সময়ের মধ্যে  নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হইয়াছে যে, ইয়াহিয়া চক্রের সমস্ত হিসাবই গরমিল হইয়া গিয়াছে। টিক্কা খানের “দুই। দিনের” স্থানে দেড় শত দিন অতিবাহিত হইয়া গেলেও বাংলাদেশের নক্কারজনক ব্যাপারটা শেষ হয় নাই। বরং, আজ ঢাকা নগরী সহ বাংলা দেশের এমন কোনও জেলা নাই যেখানে মুক্তিবাহিনী ও গেরিলা বাহিনী কর্মতৎপর না রহিয়াছে। বাংলাদেশে আজ এমন কোনও স্থান নাই যেখানে ইয়াহিয়াচক্রের দস্যু বাহিনী নিশ্চিন্তে ঘুমাইতে পারে । কখন মুক্তি বাহিনী ও গেরিলা বাহিনী আক্রমণ করে এই ভয়ে দস্যু বাহিনী ও দালালরা সদাসন্তপ্ত রহিয়াছে। বাংলাদেশ আজ ইয়াহিয়াচক্রের গলায় এক মরণ কাটার মতাে বিধিয়া রহিয়াছে। তাহারা উহাকে বাহির ও করিতে পারে না, গিলিতেও পারে না। ইহাদের মরণ সুনিশ্চিত। এই বিষম অবস্থাতে পড়িয়াই জল্লাদ ইয়াহিয়া -চক্র আজ মরিয়া হইয়া জনগণের উপর অত্যাচারের তীব্রতা বাড়াইয়াছে, ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধাইবার ষড়যন্ত্র করিতেছে এবং সঙ্গে সঙ্গে কুইসলিং-এর মতাে কোনও দালাল দিয়া একটা পুতুল সরকার বানাইয়া অবস্থার “স্বাভাবিকত্ব প্রমাণ করার জন্য এক নূতন চাল চালিয়াছে। এই উদ্দেশ্যই ঐ দস্যুর দল বাংলাদেশের গণ নির্বাচিত ৭৯ জন জাতীয় পরিষদ সদস্যকে “নাটক” করিয়া বাকী ৮৮ জনের সদস্যপদ বহাল রাখিয়াছে, ৭৯ জনের “শূন্য আসনগুলিতে” “উপনির্বাচনের প্রহসন করার তােড়জোড় করিতেছে এবং বলিতেছে যে, “উপ-নির্বাচন হইয়া গেলে জনপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা হইবে।” ঐ একই উদ্দেশ্য টিক্কা খানের মতাে হিংস্র পশুও আজ বাংলাদেশের “৮৮ জন জাতীয় পরিষদ সদস্যের নিকট আবেদন” জানাইতেছে যে, “তােমরা আসিয়া তােমাদের দায়িত্ব পালন কর, আমি তােমাদের নিরাপত্তা বিধান করিব। 

কিন্তু, সবই বৃথা দু’একজন দুই-কান-কাটা দালাল ছাড়া বাংলাদেশের কেহই জল্লাদ ইয়াহিয়াচক্রের সাহায্যে অগ্রসর হইতেছে না। সেখানেও ঐ নরঘাতক দস্যুদের সাক্ষাৎ ভুট্টো, মওদুদী গং ছাড়া কোনও গণতন্ত্রকামী ইয়াহিয়াচক্রের এই চালে ভুলিতেছেন না। ইয়াহিয়াচক্রের এই নূতন চালও আঁতুড় ঘরেই মরিতেছে। | কিন্তু, তবুও আমরা বলি যে, বাংলাদেশের কোনও বেইমান যদি ইয়াহিয়াচক্রের সাহায্যে আগাইয়া আসে, যদি “৮৮ জন জাতীয় পরিষদ সদস্যের কাহারও “দায়িত্ব পালনের খায়েশ হয়, যদি কেহ “উপনির্বাচনের” প্রহসনে প্রার্থী” হয় তাহা হইলে তাহাদের জীবনের ঝুঁকি নিতে হইবে। বাংলাদেশের জাগ্রত জনগণ, মুক্তি বাহিনী ও গেরিলা বাহিনী জল্লাদ ইয়াহিয়াচক্রের নূতন চাল ব্যর্থ করিয়া দিবেন। আজিকার বাংলাদেশ কুইসলিং এর স্থান হইবে না।

মুক্তিযুদ্ধ। ১:৮ ২৯ আগস্ট ১৯৭১

সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ১০

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!