You dont have javascript enabled! Please enable it!

লাহােরে গােপন নথি-পত্র উধাও

প্রত্যেকটি বিমান বন্দরে কড়া পাহাড়াও ব্যাপক তল্লাসির ব্যবস্থা। ৩রা অক্টোবর-লাহাের ইন্টার কন্টিনেন্টাল হােটেল হতে বাংলাদেশ সম্পর্কে রাষ্ট্র পূঞ্জের কিছু একান্ত গােপনীয় নথি-পত্র লাপাত্তা হয়ে যাওয়ায় পাকিস্তান এবং পাক কবলিত বাংলাদেশের প্রত্যেকটি বিমান বন্দরে কড়া পাহাড় ও ব্যাপক তল্লাসির ব্যবস্থা করা হয়েছে।  এই নিয়ে লাহাের, করাচি, পিণ্ডি ও ইসলামবাদে তােলপাড়া আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। এগুলি ছিল রাষ্ট্র পুঞ্জের শরণার্থী ও ত্রান এবং পুনর্বাসন মিশনের নেতা মিঃ জন আর, কেলির হেফাজতে। | পাক প্রশাসনের কানে এই দুঃসংবাদটি পৌছামাত্র ‘টপ প্রায়রিটি সার্চ” এর হুকুম দেন। ‘টপ প্রায়রিটি’ মার্কা এই অনুসন্ধানে বিশেষ নিরাপত্তা দফতর পররাষ্ট্র দফতর; সামরিক ও অসামরিক গােয়েন্দা বিভাগ, পুলিশ ও বিমান বন্দর নিরাপত্তা বিভাগ একযােগে চেষ্টা শুরু করেছে। ওই নথি-পত্রগুলি ইসলামাবাদে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল।

প্রতিনিধি ॥ ১:৩ ১৫ অক্টোবর ১৯৭১

পাক সরকারের স্বীকারােক্তি বাংলাদেশের জনজীবন স্বাভাবিক ও সাবলীল ভাবে চলছে বলে পাক সরকারের বিভ্রান্তিকর মিথ্যে প্রচার কার্য্য বাংলাদেশ তথা বিশ্ববাসীকে কিভাবে ধাপ্পা দিচ্ছে নিম্নে প্রদত্ত পাকসরকারের কয়েকটি গােপনীয় ‘সারকুলার’ তা ফাস করে দিয়েছে ?

অনুলিপি ঃ

No. 482 (158) – Poll/5(1) Govt. of East Pakistan Home (Political) Deptt. Fornigntly Secret Report on the situation in East Pakistan for the first half of Aug 1971

১৭নং

কুমিল্লা, রাজশাহী, যশাের বাের্ড কর্তৃক অনুষ্ঠিত স্কুল ফাইন্যাল ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা গত ৫-৮-‘৭১ তারিখে এবং ঢাকা বাের্ডের পরীক্ষা ১২-৮-‘৭১ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু উপস্থিত পরীক্ষার্থীর সংখ্যা খুবই কম।

১৯নং

পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ও কলেজগুলাে গত ২-৮৭১ তারিখ হতে খােলা হয়েছে, কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীর উপস্থিতি নেই বললেই চলে। ধারণা করা হচ্ছে অধিকাংশ ছাত্র ও আওয়ামী লীগের বিগত অসহযােগ আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেছিল এবং কর্তৃপক্ষ কতুক তারা কারারুদ্ধ হয়েছে।

বিবিধ বিভিন্ন জেলায় বিপ্লবীদের এক পক্ষকালের ক্ষয় ক্ষতির খতিয়ানঃ

(ii) খুলনার পারুলিয়া অঞ্চলে ‘হাইওয়ে-ব্রিজ’ পাহারারত একজন এ-এস-আই এবং দুজন কনেস্টবল। মুক্তি বাহিনীর আক্রমণে নিহত হয়। | (iv) গত ৬-৮-৭১ তারিখ রাত তিন ঘটিকায় ৪০ জন মুক্তি বাহিনী যশােহরের শৈলকুপা থানা আক্রমণ করে সি-ও, এস আই এবং কয়েকজন কনেস্টবলকে ধরে নিয়ে যায় এবং থানার প্রভুত ক্ষতি সাধন করে।

(v) গত ১০-৮-‘৭১ তারিখ অনুমানিক ১২-১৫ মিনিটের সময় মুক্তি বাহিনীর এক অতর্কিত আক্রমণে ৯১ নং বৈদ্যুতিক টাওয়ার সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়।

যথাক্রমে ২-৮-৭১, ৬-৮-৭১ এবং ১১-৮-‘৭১ তারিখে ঢাকার জিন্না এভিনিউ, নিউ মার্কেট বাস ষ্ট্যান্ড এবং ‘হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল’ মুক্তিবাহিনীর হাতবােমা ও গ্রেনেড় আক্রমণে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

বিপ্লবী বাংলাদেশ ও ১: ৯ ১৭ অক্টোবর ১৯৭১

ইয়াহিয়ার প্রস্তাব নিতান্তই এক ধাপ্পা

গার্ডিয়ান সম্প্রতি জাতির উদ্দেশ্য বেতার ভাষণে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যে সব প্রস্তাব করেছেন, প্রধান প্রধান বৃিটিশ সংবাদপত্রগুলি তাতে নৈরাশ্য প্রকাশ করেন। লনডনের ‘গারডিয়ান’- এর সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে যে,  গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি (ইয়াহিয়া) সত্যিকার কোন পরিকল্পনা ও প্রস্তাব দেননি, তার প্রস্তাব নিতান্তই এক ধাপ্পা এটা লজ্জার কথা। শেখ মুজিবর ও তার দলের লােকদের কার্যকলাপের জন্যই বাংলাদেশে সামরিক ব্যবস্থা নিতে হয় বলে পাক জঙ্গীশাহী যে যুক্তি দিয়েছে, তার উল্লেখ করে সংবাদপত্রে মন্তব্য করা হয়েছে তিনি (মুজিবর) কখনও প্রকাশ্য বলেননি যে তিনি অস্ত্রশ ব্যবহার করবেন। | টাইমস বলেছেনঃ জেনারেল ইয়াহিয়ার দীর্ঘ প্রতীক্ষিত প্রস্তাবগুলিতে পূর্ববঙ্গের জনগণের আশাআকাথা পূর্ণ হবে না। গতকাল এমন কিছু বলা হয়নি যাতে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে তিক্ত সম্পর্কের অবসান ঘটবে। | নতুন সংবিধানে জেনারেল ইয়াহিয়া যে প্রাদেশিক স্বাধিকারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ডেলি টেলিগ্রাফ সে সম্পর্কে মন্তব্য করেন। বলা হয়েছে, এই সংবিধানে পূর্ব বঙ্গকে কলােনি হিসাবেই গণ্য করা হবে।

স্বদেশ ১:৪ | ২১ অক্টোবর ১৯৭১

দালাল শিবিরে কোন্দল

(নিজস্ব প্রতিনিধি) পাকিস্তানের অখণ্ডতা, জাতীয় সংহতি ও ইসলামের নামে ইয়াহিয়া গােষ্ঠী তাহাদের গণহত্যার রাজনীতির পশ্চাতে সমগ্র দক্ষিণপন্থী রাজনীতিক ও শক্তি সমূহকে সংহত ও ঐক্যবন্ধ করিতে চাহিয়াছিল। কিন্তু ইহারা। ঐক্যবদ্ধ হওয়া দূরের কথা পারস্পরিক কোন্দলে লিপ্ত হইয়াছে। ভূট্টো, কাইয়ুম, ফজলুল কাদের প্রভৃতি দক্ষিণপন্থী “গায়ে মানেনা আপনি মােড়ল” নেতারা পরস্পর পরস্পরের গায়ে থুথু ছিটাইতেছে। | একচেটিয়া, পুঁজিপতি, সামন্ত ভূস্বামী ও সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থরক্ষাকারী পাকিস্তানের প্রাসাদ রাজনীতির বনেদী দল মুসলিম লীগের তিন উপদলকে একত্রিত করিবার জন্য শাসকগােষ্ঠী আদাজল খাইয়া লাগিয়াছিল অথচ বর্তমানে কাইয়ুম খান ও মালিক কাশেম পরস্পরের বিরুদ্ধে রণহুঙ্কার দিয়া ফিরিতেছে। কাইয়ুম খান বাঙলাদেশের অধিকৃত অঞ্চলের কনভেনশন মুসলিম লীগের নেতা শামসুল হুদাকে প্রধান সংগঠক নিযুক্ত করিয়াছিল। পেশাদার দালাল কুখ্যাত ফজলুল কাদের চৌধুরী এই হুদা-নেতৃত্বের কমিনিটি ভাঙিয়া দিয়াছে। অন্যদিকে ফজলুল কাদের মনােনীত প্রাদেশিক সভাপতি ও বাঙলাদেশের অধিকৃত এলাকার পুতুল সরকারের মন্ত্রী আখতারউদ্দিন এই লীগের সদর দফতরে প্রবেশাধিকারও পায় নাই বলিয়া অধিকৃত অঞ্চলের দৈনিক ইত্তেফাক জানাইতেছে।

ভূট্টোর দলে ভাঙন তবে হাল জামানার বড় তরফের নেতা ভূট্টোর নাটক সম্ভবত সর্বাধিক জমিয়াছে। এই ব্যক্তি ক্ষমতা লাভের জন্য শােষক গােষ্ঠীর গণহত্যার রাজনীতির প্রধান প্রবক্তার ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছিল। কিন্তু আজ সামরিক গােষ্ঠীর ক্ষমতা আঁকড়াইয়া থাকার নীতি ও তাহাদের কাইয়ুম প্রীতির ফলে তাহার ক্ষমতা লাভের স্বপ্নসৌধ ভাঙিয়া যাইতে বসিয়াছে। ক্ষমতা লাভের আশা স্তিমিত হওয়ায় পি পি পি’র ভাঙন অপ্রতিরােধ্য হইয়া পড়িয়াছে। ইহার লায়ালপুর শাখার সভাপতি মােখতার রানা পদত্যাগ করিয়াছে ও সুযােগ সন্ধানী নেতাদের গণআদালতে বিচার করিবে বলিয়া হুমকি দিতেছে। এ খবর জানাইয়াছেন ক্ষমতাসীন গােষ্ঠীর অন্যতম প্রধান মুখপত্র দৈনিক পাকিস্তান। ঐ পত্রিকাটি আরও জানায় যে, অপর এক এম, এন, এ, আহমদ রাজা কাসুরী। ভূট্টোকে চেয়ারম্যান পদ হইতে বরখাস্ত করিয়া নিজেকে চেয়ারম্যান বলিয়া ঘােষণা করিয়াছে এবং গত ২৪ সেপ্টেম্বর লাহােরে ঘােষণা করিয়াছে যে, মােট ৬৩ জন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য তাহার পক্ষে। এই রাজা। গ্রুপই নাকি ভূট্টোর তথাকথিত “ক্ষমতার উৎস” পাঞ্জাবে মন্ত্রীসভা গঠন করিবে। | ভাষা আন্দোলনের খুনী নুরুল আমীনও মহা ফাপরে পড়িয়াছে। গত ২২ সেপ্টেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের পত্র পত্রিকায় প্রকাশ পায় যে, শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্তি দিলে বাঙলাদেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হইবে বলিয়া তিনি উক্তি করিয়াছেন। ২৫ শে সেপ্টেম্বর তারিখে তিনি উহা বেমালুম অস্বীকার করি নি। 

সমর নায়কদের কোন্দল অন্যদিকে সরিষাতে ও ভূত দেখা দিয়াছে। সমর নায়কেরা নিজেরাও অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হইয়া পড়িয়াছে। টিক্কা-নিয়াজী-ইয়াহিয়া দ্বন্দ্ব আজ দিবালােকের মত স্পষ্ট। টিক্কা গদিচ্যুত হইয়াছে। জেনারেল ওমর প্রাণ হারাইয়াছে। সাবেক এয়ার মার্শাল আসগর খান খােলাখুলিভাবে সামরিক জান্তার নীতি সমূহের প্রতিবাদ করিতেছে। | পক্ষান্তরে মুক্তি সংগ্রামের ছয়মাস অতিবাহিত হইয়া যাইবার পর সামরিক কর্তারা তথাকথিত “বিদ্রোহ দমন করিতে পারা দূরের কথা সারা বাঙলাদেশব্যাপী প্রশাসন ও যােগাযােগ ব্যবস্থা দাঁড় করাইতেও অসমর্থ হইয়াছে। স্বাভাবিক অর্থনৈতিক জীবন আজও দাঁড়ায় নাই। খােদ ঢাকা শহরে প্রকাশ্য দিবালােকে ব্যাঙ্ক আক্রান্ত হইতেছে, চালনা-চট্টগ্রাম গেরিলাবাহিনীর ভয়ে বিদেশী জাহাজ চলাচল প্রায় বন্ধ হইতে চলিয়াছে। বৃটিশ বীমা সংস্থা পাকিস্তানের যুদ্ধাবস্থার দরুণ বীমার প্রিমিয়াম দ্বিগুণ বাড়াইয়া দিয়াছে। ক্যান্টনমেন্টের বাহিরে শহর এলাকাসমূহও পাক-সেনাদের কাছে নিরাপদ নহে। আজ তাই পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিপতিরা পাক সরকারের বিজয় সম্পর্কে আস্থা হারাইতে শুরু করিয়াছে। অথচ বিপুল যুদ্ধ-ব্যয় ও বাঙলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অচলাবস্থার দরুন পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিপতিদের নাভিশ্বাস উঠিয়াছে।

পশ্চিম পাকিস্তানও খণ্ড খণ্ড হইতে চলিয়াছে পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সংহতির জন্য যাহারা জান কোরবান দিয়া পড়িয়াছিল এখন সেই মহামানবেরা পশ্চিম খােদ পাকিস্তানের অখণ্ডতা লইয়াই ভাবিত হইয়া পড়িয়াছে। | পেশােয়ার হইতে ২৩ শে ক্ষমতাসীন গােষ্ঠীর সংবাদ ও এ পি পি জানাইতেছে যে, অনুপ্রবেশকারীরা নাকি পাকিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ করিতেছে। কষ্ট হয় না যে, বিগত মাস ধরিয়া পাখতুনি যে-বীর জনগণ তাহাদের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। তাহা চূড়ান্তরূপ চলিয়াছে। স্মরণ করা যেতে পারে যে, পাখতুনিস্তানের বাদি নেতা গফফার খানে ওয়ালী খান কিয়ৎকাল বলিয়াছিলেন যে, | বিগত কয় বছর নীতিসমূহের ফলে,… ভাঙিয়া খণ্ড-বিখণ্ড যাইতেছে। তাই সকল রাজনৈতিক নেতাকে ঐক্যবদ্ধ করিবার বজ্র আঁটুনি গেরােয় পরিণত হইয়াছে।

মুক্তিযুদ্ধ। ১:১৬। ২৪ অক্টোবর ১৯৭১

পাঞ্জাবী কবির প্রতি পাক সামরিক আদালতে দণ্ডাদেশ | ঢাকা, ১৯ শে অক্টোবর-বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন জানাবার অভিযােগ লাহােরের একটি সামরিক আদালতে বিশিষ্ট পাঞ্জাবী কবি মিঃ আমেদ সালিমকে ছয় মাস সশ্রয় কারাদণ্ড এবং দুই হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে | আরও তিন মাস সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন।  মিঃ আমেদ সালিম ‘সদা জয় বাংলাদেশ’ নামে একটি কবিতা লিখেছেন এবং কবিতাটি আওয়ামী আওয়াজ’ নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।  অভিযােগ করা হয় যে, পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি এবং পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সংহতি | ব্যাহত করার উদ্দেশ্য নিয়েই কবিতাটি রচিত। •

বাংলাদেশ (১)১: ১৮। ২৫ অক্টোবর ১৯৭১

আতংকিত ইয়াহিয়া। | বাংলার সূৰ্য্য সন্তানরা নরখাদক ইয়াহিয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণের তীব্রতা যতই বাড়িয়ে তুলছে ততই | এই নর-পিচাশদের পৈচাশিকতা মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এর বাস্তব প্রমাণ বােমারু বিমান থেকে গোলাবর্ষণ। | হানাদার ইয়াহিয়া বাহিনীকে হটিয়ে দিয়ে মুক্তিফৌজ যে সব এলাকাকে মুক্ত করে নিচ্ছে সে সব এলাকায়

নর পশুরা এখন অন্যপথ না দেখে বিমান থেকে গোলার্ষণ আরম্ভ করেছে। তেমনি ঘটনা ঘটেছে গত 

মঙ্গলবার কুমিল্লা জেলার মন্দাভাগ অঞ্চলে। মুক্তিফৌজের ঘাটি লক্ষ্য করে বিমান থেকে করা হয়েছে গোলাবর্ষণ। এমনি ঘটনা ঘটেছে আবার সিলেট জেলাতেও। বিশ্ব বিবেকের কাছ থেকে ধীকৃত হয়ে এবং নিজের সীমিত ক্ষমতার শেষ প্রান্তে পৌছে ইয়াহিয়া একদিকে যেমন শেষ ঝাল মিটাবার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে আতঙ্কগ্রস্থ জেনারেল সৈনিক সুলভ সুর পাল্টাতে শুরু করেছেন। সম্প্রতি বিদেশী সাংবাদিকের। কাছে এক উক্তিতে ইয়াহিয়া বলেছেন জনগণ যদি চায় তবে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে তার আপত্তি নেই। লিখতে হাসি পায় এই কিছুদিন পূর্বেও দাম্ভিক শিরােমনি ইয়াহিয়া সদর্পে ঘােষণা করেছিলেন। দেশদ্রোহীতার জন্য শেখ সাহেবকে ফাসী কাঠে ঝােলাবেন। ভারতের বিরুদ্ধে অভিযােগ করেছিলেন ভারতীয় অনুচর ও দুষ্কৃতকারীরা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তা করছেন। আর সেদিনও রণ হুঙ্কার ছেড়েছিলেন ভারতের বিরুদ্ধে। কিন্তু কি আশ্চর্য্য ইরাণ থেকে ফিরে এসে জেনারেল ইয়াহিয়া কেমন যেন চুপসে যাচ্ছেন। এর মধ্যে আবার ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জগজীবন রাম বলিষ্ঠ কণ্ঠে। বিশ্ববাসীকে জানিয়ে বলেছেন ইয়াহিয়া খান যদি সত্যই যুদ্ধই বাধিয়ে তােলেন তবে পশ্চিম পাকিস্তানে যে সব এলাকা ভারত দখল করে নেবে সেগুলি আর ছাড়া হবে না। এ ধরণের শক্ত কথা বােধ হয় জেনারেল ইয়াহিয়া খান আশা করেন নি। এদিকে স্বাধীন বাংলার অস্থায়ী রাষ্ট্র প্রধান জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম ঘােষণা করেছেন অতি শীঘ্রই ঢাকা শহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে গার্ড অব অনার দিয়ে বিজয় উৎসব পালন করা হবে। প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজুদ্দিন সাহেবও বলেছেন বাংলাদেশের মুক্তি আর খুব বেশী দূরে নয়। সুতরাং সবদিক বিচার করলে একদিকে ইয়াহিয়ার আতঙ্কগ্রস্থতা আর অন্যদিকে বাংলাদেশের মুক্তির ব্যাপারটা যেন ক্রমশই চরম পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে বলে মনে হয়।

বাংলাদেশ (১) ১: ১৮৪ ২৫ অক্টোবর ১৯৭১

ব্ল্যাক মেইলিং এর নয়া পায়তারা তথাকথিত পাকিস্তান বেতারের এক খবরে প্রকাশ, সম্প্রতি ইরাণের পারসেপােলিতে সােভিয়েট প্রেসিডেন্ট পদগণীর সাথে দু’ঘন্টাব্যাপী এক আলােচনা বৈঠকে পাকিস্তানের জঙ্গীশাহীর নায়ক জেনারেল ইয়াহিয়া খান নাকি সীমান্ত থেকে সৈন্যবাহিনী সরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে দুটো শর্ত আরােপ করেছেন। এই শর্তগুলাে হল ঃ ভারত নিজেও সীমান্ত থেকে সমস্ত সৈন্য সরিয়ে নেবে এবং ভারত পূর্ব পাকিস্তান গেরিলাদের কোন রকমে সাহায্য দিতে পারবে না। আলােচনাকালে জেনারেল ইয়াহিয়া নিজেই নাকি এই প্রস্তাব দিয়েছেন।

জয়বাংলা (১) ১:২৫ ২৯ অক্টোবর ১৯৭১

ইয়াহিয়াকে সদুপদেশ ইরাণে বাংলাদেশ সম্পর্কে ঘরােয়া আলােচনায় যুগশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট টিটো ইয়াহিয়া খাকে যথেষ্ট বােঝাবার চেষ্টা করেছেন বলে খবরে প্রকাশ। তিনি নাকি ইয়াহিয়াকে বলেছেন, বাঙ্গালীদের আবেগ ও সংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকে অস্বীকার করে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান করা যাবে না। বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান করতে হলে বাঙ্গালীদের আবেগ ও সংস্কৃতির উপর গুরুত্ব আরােপ করতে হবে।

জয়বাংলা (১) ১: ২৫ ২৯ অক্টোবর ১৯৭১

ইয়াহিয়ার সেদিন আর এদিন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট দু’মাস আগে ঘােষণা করেন : মুক্তি বাহিনী যদি পাকিস্তানের কোন অঞ্চল দখল করে তবে জগত জেনে রাখুক, আমরা যুদ্ধ ঘােষণা করবাে। আর এই যুদ্ধে আমরা একা থাকবাে না। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট তার এই বিবৃতি দেবার সময়, একা যুদ্ধ করবেনা বলতে কি বুঝাতে চেয়েছিলাে  তা আমরা জানি না। তবে পাকিস্তানের পত্র পত্রিকায় চীনের নাম উল্লেখ করা হত। পাকিস্তান টাইমস’-এর শিরােনামায় বলা হয়েছিল, ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ বাধলে চীন পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়াবে। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে চীন বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে আর মাথা ঘামাতে রাজি নয়। বর্তমানে সে তার আভ্যন্তরীন অবস্থা নিয়েই বেশী ব্যস্ত। | পাকিস্তান ভাবছিল, মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে তাদের সহায়তা করে চলবে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে। তাছাড়া ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধাতে পারলে, আমেরিকার কূটনৈতিক সমর্থন লাভ করা চলবে। মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে আসবে রাষ্ট্র সষ্মের মাধ্যমে। ফলে সম্ভব হবে বাংলাদেশ সমস্যাকে ধামা চাপা দেওয়া। কিন্তু এখন সে আশাতেও ভাটা পড়েছে। কারণ, এবার পাকভারত যুদ্ধ বাধলে তার সমাধান আগের কোন যুদ্ধের মত হবে । ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জগজীবন রাম বলেছেন, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে যদি যুদ্ধ বাধান হয় তবে তার যল মারাত্মক হবে। ভারত পাকিস্তানের কোন এলাকা দখল করলে, তা আর ছাড়বে না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ভারত যুদ্ধ চায় না। তবে পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করলে ভারত তার প্রতি উত্তর যথাবিহিত ভাবে প্রদান করবে। | পাকিস্তান এখন প্রচার করছে, সে যুদ্ধ চায় না। ভারত তার উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে। পাকিস্তান একথা প্রচার করেছিল যে, চারটি বৃহৎ শক্তি ভারতকে সংযত হবার অনুরােধ জানিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হল গ্রেট বৃটেন। কিন্তু বৃটেনের সরকারী মহল, এরকম কোন অনুরােধ ভারতকে জানান নি বলে বিবৃতি দিয়েছেন।

এ থেকেই বােঝা যায় পাকিস্তান সরকার কি পরিমাণ মিথ্যায় বেসাতি করছে। পাকিস্তান গােড়া থেকেই বাংলাদেশ সমস্যাকে পাক-ভারত সমস্যায় পরিণত করতে চাচ্ছিল, কিন্তু বিশ্বজনমত আজ তার বিপক্ষে। অন্যদিকে বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনী আজ এত শক্তিশালী হয়ে দাড়িয়েছে যে, এই বাহিনীর হাতে তার পরাজয় নিশ্চিত। ইয়াহিয়া তাই আজ দিশাহারা। ছাব্বিশে মার্চ ইয়াহিয়া তারা বেতার বক্তৃতায় ঘােষণা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একজন বিশ্বাসঘাতক । তাকে দেশদ্রোহিতার জন্য চরম শাস্তি প্রদান করা হবে। এখন একই ইয়াহিয়াকে বলতে হচ্ছে, যদি দেশ বাসী চায় তবে শেখ মুজিবকে কোন প্রকার শাস্তি দেওয়া হবে না। নিজের হাতে সাজান বিচার প্রহসনে দোষী প্রমাণিত হওয়ায় আগেই শেখ মুজিবকে শাস্তি দিতে চেয়েছিলেন ইয়াহিয়া আর সেই ইয়াহিয়াকে এখন বলতে হচ্ছে বিচার শেষ হবার আগে শাস্তি মকুব করবার কথা। এরকম কোন অবস্থার সম্মুখীন হলে অন্য যে কোন দেশের প্রেসিডেন্ট নিজে থেকেই পদত্যাগ করতাে। কিন্তু ইয়াহিয়া ও তার জঙ্গী চক্রের কোন লজ্জা নেই। একের পর এক মিথ্যা কথা বলে চলেছে পাক সামরিক সরকার। আর তাদের মিথ্যাবাদী চেহারা সারা দুনিয়ার কাছে নগ্ন হয়ে ফুটে উঠেছে।

সেদিন বেশী দূরে নয়, যেদিন বাংলাদেশ থেকে ইয়াহিয়া বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে হবে। পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের কাছে ইয়াহিয়া ও তার সহযােগীদের জবাবদিহি করতে হবে, কেন তারা বাংলাদেশে চালাতে গিয়েছিল তাদের ব্যর্থ অভিযান। জনগণ শেষ ক্ষমতার অধিকারী জনতার রায়কে অস্বীকার করে রক্ত স্নানের মাধ্যমে একটি জাতির আশা আকাঙ্খকে চিরতরে রুদ্ধ করে রাখা যায় না। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী গণতন্ত্রী জনগণের জয় অবধারিত।

জয়বাংলা (১): ১: ২৫ ও ২৯ অক্টোবর ১৯৭১

নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যই সামরিক জান্তা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করতে চায়

(এয়ার কমােডর জাঞ্জুয়া)। সাবেক পাকিস্তান বিমান বাহিনীর প্রাক্তন এয়ার কমােডর কে, জাঞ্জুয়া সম্প্রতি লণ্ডনে এক বিবৃতিতে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার জন্য তার দেশবাসীর প্রতি আবেদন জানিয়েছেন।  এক বিবৃতিতে জাঞ্জুয়া বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ফ্যাসীবাদের সনাতন পথ ধরেছে। তাদের কাজকারবার আমাদের হিটলারের যুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। হিটলার পশুবল প্রয়ােগে বহু জাতিকে নির্যাতিত ও লাঞ্চিত করেছে, প্রায় ৬০ লাখ মানুষকে শুধুমাত্র তাদের সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদতার অভিযােগে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। | এয়ার কমােডর বলেন : আমাদের সামরিক জান্তা সশস্ত্র প্রতিরােধ সংগ্রাম চালানাের ব্যাপারে বাঙালীর দক্ষতা ও ক্ষমতাকে নেহায়েত খাটো করে দেখেছিল। তার ফলে তারা আজ বাংলাদেশে সঙ্কটের এক চোৱা বালিতে আটকা পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর হাতে তাদের শােচনীয় পরাজয় যে অত্যাসন্ন তা তারা আজ বুঝতে পারছে। সেজন্য সমূহ সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্য তারা আজ অন্ধকারে হাতড়িয়ে মরছে। সুতরাং, তার ব্যবস্থা হিসাবে তারা পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধ উন্মাদনা শুরু করছে। এবং ভারত-বিরােধী প্রচারণা শুরু করেছে। সামরিক জান্তা নিজেদের উন্মত্ত কাজ কারবারের দ্বারা যে মারাত্মক ও ধ্বংসকর পরিস্থিতিতে নিপতিত হয়েছে তা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ধাবিত করার জন্যই তারা তা করছে।  জানুয়া বলেনঃ ভারতের বিরুদ্ধে সীমাবদ্ধ যুদ্ধ করার ব্যাপারে ইয়াহিয়া জন্তিীর দুটো উদ্দেশ্য আছে। প্রথমত। এর ফলে বাংলাদেশ সমস্যা একটা আন্তর্জাতিক রূপ নেবে এবং সামরিক জান্তা বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে যে অপরাধ করেছে ও মুক্তিবাহিনীর হাতে যে বিপুল সংখ্যক পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য হতাহত হয়েছে তা চাপা দেওয়া যাবে।

দ্বিতীয়তঃ তদ্বারা পশ্চিম পাকিস্তানে প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনও দমন করা যাবে। সামরিক জান্তার এই চক্রান্ত ও প্রতারণার বিরুদ্ধে আমরা পশ্চিম পাকিস্তান ও আজাদ কাশ্মীরের জনগণকে সতর্ক করে দিতে চাই। আমরা সামরিক জান্তার ও অপরাপর ফ্যাসিবাদী শক্তির বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ হামলার বিরুদ্ধে বিশেষভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রগতিশীল শক্তিগুলােকেও সতর্ক করে দিতে চাই।

উপসংহারে জনাব জাগুয়া স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের হত্যাকারী সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে হত্যাকারী সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সংগ্রামে বাঙ্গালীদের পাশে দাঁড়াবার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের প্রতি আবেদন জানান।

জয়বাংলা (১) ১: ২৫ ২৯ অক্টোবর ১৯৭১

বাংলাদেশে পণ্য বিক্রী হচ্ছে না। পাকিস্তানের শেয়ার বাজারে সৃষ্টি হচ্ছে সংকট

(অর্থনৈতিক ভাষ্যকার) | একটা দেশের ব্যবসা বাণিজ্যের হল মােটামুটি ভাবে বুঝতে হলে সে দেশের শেয়ার মারকেটের সাধারণ গতি প্রকৃতির উপর লক্ষ্য রাখতে হয়। ব্যবসার অবস্থা মােটের উপর ভাল হলে, শেয়ারের বাজারে শেয়ার কেনাবেচা বেশী হয়। ব্যবসায় মন্দাভাব দেখা দিলে বিভিন্ন শেয়ারের দাম যেমন কমে তেমনি শেয়ার ক্রয় বিক্রয়ের হারও কমে যেতে থাকে। যুদ্ধের সম্ভাবনার কথা প্রচার করা হলে, একটা দেশের শেয়ার বাজারে সঙ্কট দেখা দেয়। সকলে শেয়ার বেচে দিয়ে হাতে নগদ টাকা পেতে চায়। এছাড়া যুদ্ধের ফলে বিদেশে পণ্য রপ্তানী এবং বিক্রি না হবার জন্য বাজারে জিনিস জমে যায়। এভাবে পণ্যের চলাচল বন্ধ হয়ে যাবার জন্যও শেয়ার মারকেটে শেয়ারের দাম কমতে থাকে। শেয়ার কিনবার লােকের অভাব দেখা যায়। করাচীর ইংরাজী দৈনিক এর এক খবরে প্রকাশ, করাচীর শেয়ার মাকের্টে খুব মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। করাচীর শেয়ার মার্কেটে যেখানে আগে প্রতি।দন দশ থেকে কুড়ি হাজার শেয়ার হাত বদল হত, এখন তা হচ্ছে না। শেয়ারের দামও বাজারে দ্রুত নেমে যাচ্ছে। যা থেকে বােঝা যায় পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবসা বাণিজ্যে সঙ্কট সৃষ্টি হবার কথা। পত্রিকাটিতে আরাে বলা হয়েছে যে, বাজারে পণ্য সামগ্র ক্রমশঃই চাহিদার অভাবে জমে যাচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তানের পণ্য দ্রব্যের প্রধান বাজার ছিল বাংলাদেশ। পশ্চিম পাকিস্তানের কলগুলােতে যে পরিমাণ কাপড় 

তৈরি হত তার অধিকাংশ বিক্রি হত বাংলাদেশে। কিন্তু এই বাজার এখন বন্ধ। এছাড়া পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা, পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্ত ব্যবসা বাণিজ্যকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। | শুধু করাচীতেই যে শেয়ার বাজারে মন্দা দেখা দিয়েছে, কেনা-বেচা কমে গিয়েছে, তা নয়। লাহােরের শেয়ার মার্কেটেও সৃষ্টি হয়েছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। যুদ্ধের সম্ভাবনা তীব্র হবার সাথে সাথে লাহোের শেয়ার বাজারের অবস্থাও খারাপ হয়ে পড়েছে। লাহাের থেকে প্রকাশিত পাকিস্তান টাইমস পত্রিকাতেও করাচীর। ‘ডন’ পত্রিকার মত শেয়ার বাজারের সঙ্কটের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে বােঝা যাচ্ছে, পাকিস্তানের অর্থনীতি দ্রুত এগিয়ে চলেছে এক বিরাট সঙ্কটের পথে।

 জয়বাংলা (১) + ১: ২৫! ২৯ অক্টোবর ১৯৭১

নিয়াজীর গােপন রিপাের্ট ফাঁস মুজিবনগর ৮ই কার্তিক। তথাকথিত পাকিস্তানের “খ” এলাকার সামরিক প্রধান লেঃ জেঃ এ, কে, নিয়াজী ইসলামাবাদে ইয়াহিয়ার নিকট এক গােপন রিপাের্ট প্রেরণ করেছেন। উক্ত রিপাের্ট মুজিবনগরে প্রকাশ করা  নিয়াজী লিখেছেন, আমরা ইজ্জত বাঁচাবার জন্যে লড়ছি-সৈন্যগণ দীর্ঘদিনের ব্যস্ততায় বড় ক্লান্ত, সৈন্যদের মনােবল ভেঙ্গে পড়েছে; অত্যাধিক দৌড়াদৌড়িতে স্বাস্থ্যও ভেঙ্গে পড়েছে, উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মচারীরা পরিদর্শনে এলে সৈন্যেরা স্বস্তি বােধ করে কিন্তু কেউ আসছেন না। নিয়াজী লিখেছেন, বিদ্রোহীরা এখন খুবই তৎপর। আর নতুন সৈন্য পাঠালে ভাল হয়। রাজাকারদের উপর নির্ভর করা যায় না। ওরা প্রথম সুযােগেই বিদ্রোহীদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে শুরু করেছে। জনসাধারণের কাছ থেকে উল্লেখযােগ্য সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না, মালিকের মন্ত্রিসভার উপরও আস্থা স্থাপন করা যায় না। বিদ্রোহীরা পুল ধ্বংস করে, নৌপথে অচলাবস্থার সৃষ্টি করে যােগাযােগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। এখন শুধু বিমান বাহিনীর উপরই যা ভরসা কিন্তু সীমান্তে পরিস্থিতি খুবই জটিল; ভারতের সাথে যুদ্ধ বাধলে বিমান হামলাও সম্ভব হবে না।

জাগ্রত বাংলা ১:৫ ৩০ অক্টোবর ১৯৭১

পাক সেনাদের চা পান নিষিদ্ধ হল ২৯ শে অক্টোবর বিশ্বস্তসূত্রে পাওয়া খবরে জানা গেছে জঙ্গীশাহী অবশেষে বাংলাদেশে হানাদারদের জন্য চা পান নিষিদ্ধ করেছে। এর কারণ বাংলাদেশে মুক্তি যুদ্ধ শুরু হবার পর চা বাগানগুলির কাজ একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে, তা ছাড়া মুক্তি যােদ্ধারা বহুসংখ্যক চা বাগান ধ্বংস করে দিচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশে চা দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। শুধু বাংলাদেশেই নয় রাওয়ালপিণ্ডি, করাচী, ইসলামাবাদেও চায়ের ব্যাপক অভাব দেখা দিয়েছে। এ অভাব পূরণ করতে হলে জঙ্গীশাহীকে বিদেশ থেকে চা আমদানী করতে হবে তার জন্য প্রায় ৫০ কোটি টাকর বৈদেশিক মুদ্রার দরকার হবে। কিন্তু হালে জঙ্গীশাহীর ভাগাড় শুন্য। অস্ত্রশস্ত্র কেনাই দুষ্কর। চা তাে দূরের কথা। এইসব দিক বিবেচনা করে জঙ্গীশাসক কর্তৃপক্ষ সেনাদের চা পান নিষিদ্ধ করেছে।

বিপ্লবী বাংলাদেশ ১: ১১ ৩১ অক্টোবর ১৯৭১

ফিফথ কলম তেনারা তেপ্পান্ন জন পাকিস্তান রেডিওর খবরে প্রকাশ, জাতীয় পরিষদের উপনির্বাচনে পূর্ব বাংলা থেকে ৫৩ জন প্রার্থী বিনা। প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। প্রকাশ, অন্য কোন প্রার্থী না থাকায় তাদের ভাগ্যেই শিকা ছিড়লাে। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে, বিগত নির্বাচনে এই সব মহারথীরা সবাই যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। কিন্তু বড়ই বদ নসিব, প্রত্যেকে আমানত হারাতে হয়েছিল।

এবারের নির্বাচনের পুরস্কার স্বরূপ অবশ্য তাদের গতবারের জামানতের টাকা ফেরৎ দেওয়া হবে কিনা। তা এখনাে জানা যায়নি।  ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি? পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এবং পাকিস্তানের প্রাক্তন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী মিঃ এ, আর কর্ণেলিয়াস বিগড়ে বসেছেন। ইয়াহিয়া খানের ‘আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে পাকিস্তানের ভবিষ্যত শাসনতন্ত্র রচনার ভার এখন তার উপর ন্যস্ত রয়েছে। কর্ণেলিয়াস সাহেব নাকি এ দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়েছেন। কারণ, ভূট্টো তার অমুসলমান হওয়ার প্রশ্ন তুলে তাকে ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রণয়নের অযােগ্য বলে ঘােষণা করেছেন। কিন্তু পাক-রাজত্বে কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। অব্যহতি চাইলেই কি পাওয়া যায়। ইয়াহিয়া মিঃ কর্ণেলিয়াসের পদত্যাগ পত্র গ্রহণ করে নি।

কম্বলকে ছাড়লেও, কম্বল যে ছাড়ে না। যাদু মিঞার নয়া খেল ভূট্টো সাহেবের ‘পানীয় সখা’ মশিহুর রহমান ওরফে যাদু মিঞা পাক বেতারে এক বিবৃতি ঝেড়েছেন। তাঁর দল নাকি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের উপনির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবে না। স্মরণ থাকতে পারে যে পাক হানাদারদের আকস্মিক আক্রমণের প্রথম ধাক্কায় তিনি ভারতে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু ঘােলা পানিতে মাছ ধরার কোন সুযােগ করতে না পেরে তার উপযুক্ত ক্ষেত্রের…।

দেশবাংলা ১:২ ৪ নভেম্বর ১৯৭১

পাকিস্তান ভারতের সাথে যুদ্ধ করতে বদ্ধপরিকর।

(রাজনৈতিক ভাষ্যকার)। পাকিস্তান বাংলাদেশে তাদের যুদ্ধের নিশ্চিত পরাজয়কে রােধ করবার জন্য পাক-ভারত যুদ্ধ বাধাবার ফিকির খুজছে। সীমান্ত অঞ্চলে সে করে চলেছে নানা প্রকার উস্কানিমূলক কর্ম। খবরে প্রকাশ, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী গত জুলাই মাস থেকে জন্ম ও কাশ্মীরের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ২০ বার সীমানা লঙ্ঘন করেছে। এই সময় তারা ভারতের আকাশ সীমাও লজ্জন করেছে। এই সব কারণে যুদ্ধবিরতি রেখার বিভিন্ন জায়গায় রাষ্ট্রসংঘের পর্যবেক্ষক নিয়ােগ করা হয়েছে। রাষ্ট্রসংজ্ঞা পর্যবেক্ষকদের প্রদত্ত একটি নােটে পাকিস্তানের সীমানা লঙ্ন করা হয়েছে বলে মন্তব্য করা হয়েছে। কাশ্মীরে ভারত পাকিস্তান সীমান্ত চুক্তি লঙ্ঘন করে এবং ভারতীয় পিকেটগুলির উপর গুলি বর্ষণ করে অবিরাম যে প্ররােচনা সৃষ্টি করে চলেছে, রাষ্ট্র সংঘের সামরিক পর্যবেক্ষকরা তার উপর প্রভূত গুরুত্ব আরােপ করেছেন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে প্রকাশ। পাক সৈন্যরা প্ররােচনা মূলক কাজ করছে বলে রাষ্ট্রসংজ্ঞ। পর্যবেক্ষরা হতাশা প্রকাশ করেছেন। নােটে বলা হয়েছে গত ১৪ ই অক্টোবর থেকে একদল পাকিস্তানী সশস্ত্র সৈন্য উরি খণ্ডে বিনা প্ররােচনায় গ্রেণেড ও মর্টারের সাহায্যে আক্রমণ চালায় ও গুলি বর্ষণ করে একটি ভারতীয় পিকেট দখলের জন্য চেষ্টা চালায়। ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী পাল্টা গুলি চালায়। পাকিস্তানের এই সব কার্যকলাপ থেকে এখন এই কথা পরিষ্কার হয়ে উঠেছে, পাকিস্তান যুদ্ধ চায়।

জয়বাংলা (১)১:২৬ ৫ ৫ নভেম্বর ১৯৭১

ডাণ্ডাবাহিনী বনাম পিপলস্ গার্ড পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি পিপলস গার্ড’ নাম দিয়ে নিজ দলের একটা সেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পিপলস গার্ডের প্রধান সংগঠক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আকবর খান বলেন, পিপলস্ পার্টিকে অন্যারা ডাণ্ডাবাহিনীতে সংগঠিত করে অবিরাম সন্ত্রস্ত করছে এবং চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে বলে পার্টির চেয়ারম্যান জেড, এ ভূটো আমাদের নিজেদের বাহিনী গঠন করতে নির্দেশ দিয়েছেন।

জয়বাংলা (১) ১: ২৬। ৫ নভেম্বর ১৯৭১ 

গঙ্গা ও সিন্ধুর জল রক্তে লাল হয়ে যাবে। | মুজিবনগর, ৯ই নভেম্বর-ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হলে, তা হবে সামগ্রিক যুদ্ধ-প্রতিটি বাড়িতে | বাড়িতে লড়াই হবে। গঙ্গা ও সিন্ধুর জল রক্তপাতে লাল হয়ে যাবে। চীন সফররত পাক প্রতিনিধি দলের নেতা জুলফিকার আলী ভূট্টো গত রবিবার পিকিং এ এই কথা। বলেন। সাপ্তাহিক বাংলা । ১৪। ১১ নভেম্বর ১৯৭১ পত্র-পত্রিকার দৃষ্টিতে নির্বাচন প্রহসন বার্তা প্রতিষ্ঠানের খবরে প্রকাশ, পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃস্থানীয় সংবাদ পত্রগুলি বাংলা দেশের অধিকৃত অঞ্চলে জঙ্গীশাহী আয়ােজিত তথাকথিত ‘উপনির্বাচন’ এর ন্যায্যতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করিয়াছে। এইসব | পত্রিকার মধ্যে রহিয়াছে ‘ডন’, ‘কোহিস্তান ও আজাদ। করাচীতে ‘ডন’ পত্রিকায় ভূট্টোর পিপলস পার্টির ৬ জন প্রার্থীর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনে বিস্ময় প্রকাশ করা হয়। ৩ মুসলিম লীগ, পি-ডি পি ও জামাতে ইসলামী সমন্বয়ে গঠিত জোট ঐ ৬টি আসন হইতে রাতারাতি তাহাদের প্রার্থী প্রত্যাহার করিয়া লয় এবং জোটের নেতা নূরুল আমিন নাকি এই সম্পর্কে কিছুই জানিতেন লাহােরের দৈনিক উর্দু পত্রিকা ‘কোহিস্তান অভিযােগ করেন যে, ভূট্টো ঐ ৬টি আসন লাভের জন্য ১১ লক্ষ টাকা ব্যয় করিয়াছেন। পত্রিকাটির মতে এই টাকা খাইয়াই ঐ জোটের প্রার্থীরা নাম প্রত্যাহার করিয়া। | লইয়াছে। নতুন বাংলা ১:১৩ ৪ ১১ নভেম্বর ১৯৭১ ডন পত্রিকা ইয়াহিয়ার সমালােচনা শুরু করেছে মুজিবনগর, ১৪ই অক্টোবর জঙ্গী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণ করাচীর দৈনিক ইংরেজী ‘ডন’ পত্রিকার। মতে পাকিস্তানের পুনর্গঠিত জাতীয় পরিষদ যে সংবিধানই প্রণয়ন করুক না কেন, তা গণতান্ত্রিক হতে পারে  কারণ তার পিছনে কোন জনসমর্থন থাকছে না। ইয়াহিয়ার মতে আগামী ডিসেম্বরে আয়ােজিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করা হবে। কিন্তু বাংলাদেশের জনসংখ্যা পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় সংখ্যাগরিষ্ঠ। | করাচীর ‘ডন’ পত্রিকার মতে বাংলাদেশের উপনির্বাচনের পর ২৭ শে ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে বসবে। অর্থাৎ গত বৎসর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের ঠিক এক বৎসর কুড়িদিন পরে ইয়াহিয়ার মনগড়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবার কথা চলছে। | অনুষ্ঠিত বিগত সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাটি আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের ১৬২ টি আসন লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল। পরে ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগকে যে আইনী ঘােষণা করে জাতীয় পরিষদের ৭৯ জন আওয়ামী লীগ সদস্যের পদ বাতিল করে দেন।  ডনের সংবাদে আরাে প্রকাশ, বাংলাদেশের ৮৮ জন সদস্যের নির্বাচন বহাল রাখা সত্ত্বেও এদের মধ্যে মাত্র কয়েক জন সদস্য অধিবেশনে যােগ দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। পরিষদের আরম্ভ হলে কমপক্ষে সত্তরটি আসন শূন্য থাকবে। ফলে এই সত্তরটি আসন পূরণ করতে আর এক দফা নির্বাচনের প্রয়ােজন হবে। | করাচীর দৈনিক ইংরেজী পত্রিকা ‘ডন বলেছেন, যে জাতীয় পরিষদের আসন খালি রেখে অধিবেশন চালালে সেই জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের কোন গুরুত্বই থাকবে না। জাতীয় পরিষদে যখন সংবিধান সংশােধন করবে তখন বাংলাদেশ হবে সংখ্যালঘিষ্ঠ । তাই সে সংবিধান কখনাে গণতন্ত্র সম্মত হতে পারে না।

সাপ্তাহিক বাংলা ও ১ : ৪ ও ১১ নভেম্বর ১৯৭১

সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ১০

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!