You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
২০শে মার্চ, ১৯৭৩, মঙ্গলবার, ৬ই চৈত্র, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ

শপথ দিবসের ডাক

শপথ দিবস পালন করা হয়েছে গত পরশুদিন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আহ্বানে সারা দেশব্যাপী আঠারই মার্চ শপথ দিবস হিসেবে জনগণের সামনে আওয়ামী লীগের কর্মী ও নবনির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্যরা শপথ নিয়েছেন মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার জন্যে। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দিয়েছেন। ভাষণে তিনি তাঁর সুখী ও সমৃদ্ধিশালী সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘আমি একদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলাম—আমার সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে। এখন আমি সোনার বাংলা দেখে মরতে চাই।’ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ভাষণে সোনার বাংলা গড়ার কাজে দেশবাসীকে সর্বাত্মক সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসারও আহ্বান জানিয়েছেন। দেশের মাটি থেকে সকলপ্রকার দুর্নীতি, ঘুষ, স্বজনপ্রীতির মূলোচ্ছেদ করার জন্যে সরকার যে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন জনসাধারণকে তার প্রতি সমর্থন জানানোর জন্যে তিনি আহ্বান জানান। নির্বাচনে বিপুল জয়লাভের পর বঙ্গবন্ধু প্রথম এই জনসভায় ভাষণ দিলেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে এদেশের দুখী মানুষের প্রাণের বাণীর প্রতিধ্বনি করেছেন। মানুষের জীবনে আজ যে বিষাদ ঘনীভূত হয়ে এসেছে তাকে রোধ করে সুখী ও সমৃদ্ধিশালী দেশ গড়ার কাজে আজ আত্মনিয়োগ করতে হবে সবাইকে। শপথ দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিলো এটাই। বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতার একাংশে বলেছেন—‘আমি বিশ তারিখের পর থেকে দেশে লাল ঘোড়া ছুটাবো।’ বঙ্গবন্ধুর এ লাল ঘোড়া ছুটাবার ঘোষণা বেশ ‍পুরোনো এবং অর্থবহ। সমাজদেহ থেকে সকল প্রকার দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও কালোবাজারী দূর করার জন্যেই বঙ্গবন্ধু তাঁর লাল ঘোড়া দাবড়ানোর কথা উল্লেখ করেছেন। জাতিকে সত্যিকার মুক্তির জন্যে এ পদক্ষেপ অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে এবং তা বাস্তবায়িত করতে হবে। দেশের আপামর জনগণের সর্বাত্মক সমর্থন রয়েছে বঙ্গবন্ধুর এ পদক্ষেপের প্রতি। অন্যদিকে নিজেদের ভিতর আজো যারা সংশোধন হতে পারেনি তাদের প্রতিও বঙ্গবন্ধু হুঁশিয়ারী বাণী উচ্চারণ করেছেন। তিনি তাই দেশ গড়ার কাজে সোনার মানুষ চান। এই দেশকে যদি সত্যিকার অর্থে সুন্দর করে গড়ে তুলতে হয় তবে অবশ্যই সৎকর্মী ও সৎনেতার নেতৃত্ব প্রয়োজন। সবাইকে আত্মনিবেদনের উদার মনোবৃত্তি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। একটি প্রগতিশীল জাতি ও দেশ গঠনের জন্যে সেটাই আজ সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। সে কারণেই দরকার আদর্শ যুব সমাজের। বঙ্গবন্ধু তাই তাঁর বক্তব্যে শিক্ষাঙ্গন থেকে নকল দূর করারও আহ্বান জানিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকার দেশের জন্যে অবশ্যই কিছু কাজ করতে চান। এ ব্যাপারে কোনরূপ দ্বিধা নেই সরকারের। কিন্তু এই কলুষ সমাজের বেষ্টিতে আবদ্ধ থেকে কোন শুভ কর্মসূচীই বাস্তবায়িত করা অসম্ভব ব্যাপার। তাই সর্বপ্রথম সমাজকে কলুষমুক্ত করার পদক্ষেপ নিতে হবে। বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় যে দৃঢ় প্রত্যয় প্রকাশ করেছেন তাঁকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা দিতে হবে জাতিকে। সকল দুঃখ কষ্টের মাঝেও তাদেরকে দেশ গড়ার মহান ব্রতে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারী সদিচ্ছা কোনদিনও বাস্তবে রূপায়িত হবে না যতদিন না দেশের মানুষ ভালো হয়—সমাজ থেকে কলুষতা দূরীভূত না হয়। সরকারের ঘোষিত কঠোর পদক্ষেপের প্রতি সারা দেশের মানুষের বিপুল সমর্থন রয়েছে তা আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি। এবার সত্যিই কিছু করতে হবে।

দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন

দুষ্কৃতিকারীদের দমনে জনসাধারণের সহযোগিতা প্রয়োজন। আর এই প্রয়োজনকে সামনে রেখে ঢাকা সিটি পুলিশ জনসাধারণকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে তারা সমাজবিরোধী ব্যক্তি ও দুষ্কৃতিকারীদের সম্পর্কে তথ্যাদি পুলিশকে জানানোর জন্য অনুরোধ করেছেন। বলেছেন তথ্য সরবরাহকারীদের নাম ও ঠিকানা গোপন রাখা হবে। এই সকল সমাজবিরোধী ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে বলে জানা গেছে।
প্রশাসন কর্তৃপক্ষ সহযোগিতা চেয়েছেন, সৎ নাগরিক হিসেবে সেই সহযোগিতা দানে এগিয়ে আসবেন এমন লোকের অভাব বাংলাদেশে নেই। তবে প্রেস বিজ্ঞপ্তির ভাষ্য থেকে একটা কথা বেশ বোঝা যাচ্ছে—মুনাফাখোর, মওজুতদার, চোরাচালানী, সশস্ত্র দুর্বৃত্ত যাদের কথাই বলা হোক না কেন তারা বেশ প্রভাবশালী। এদের সম্বন্ধে তথ্য সরবরাহকারীদের নিরাপত্তার দিকে দৃষ্টি রেখেই তাদের নাম ঠিকানা গোপন রাখার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। বস্তুতঃ স্বাধীনতাউত্তরকালে অনেক কিছুর সঙ্গে সমাজবিরোধী দুর্বৃত্তদেরও পরিবর্তন হয়েছে। আগে যারা চুরি-ডাকাতি করে নিজেদের ভরণপোষণ করতো—স্টেন, এলএমজি’র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় তাদের অনেকেই খড়-কুটোর মতো ভেসে গেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে একটা অগোছালো আর অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে মুনাফাখোর মওজুতদারেরা প্রভাবশালী মহল বিশেষের পক্ষপুটে আশ্রয় নিয়েছে।
আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা তথা দুষ্টের দমন শিষ্টের পালনের নানা পদক্ষেপ এর আগেও নেয়া হয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে তা সফলও হয়েছে। কিন্তু না জানা কারণে সে পদক্ষেপ সমূহকে নানা সময়ে ঝিমিয়ে পড়তেও দেখা গেছে। সরকারের জোর নির্দেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহকে কোন কোন সময় চাঙ্গা হয়ে উঠতে দেখা গেলেও সে স্ফুলিঙ্গ যেন ক্ষণেকের। জ্বলেই আবার নিভে যায়। এই নিভে যাওয়ার পেছনে কোন কারণ থাকতে পারে তা খুঁজে দেখা প্রয়োজন। সমস্যার গভীরে না ঢুকে সমাধানের পথ খোঁজার কোন অর্থ হয় না। মুনাফাখোরী, দুর্নীতি-দস্যুতা আর সমাজবিরোধী অন্যান্য কার্যকলাপের মূল কোথায় প্রোথিত এটা আমাদের নতুন করে ভেবে দেখবার সময় এসেছে। নতুন সরকার নব উদ্যমে চলার শপথ নিয়েছে। সেই চলার পরিশ্রম যাতে সফল হয়, সার্থক হয় সেই প্রার্থনা নিয়েই আমাদের অভিমত জানিয়ে দিলাম।

পণ্যের মূল্য নির্ধারণ

সরকার বিদেশ থেকে আমদানীকৃত ও স্বদেশে উৎপাদিত সকল পণ্য সামগ্রীর ন্যায্য দাম বেঁধে দেয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সম্পন্ন করেছেন। শুধু দর বেঁধে দেয়াই নয়, মওজুতকৃত পণ্য সামগ্রী সম্পর্কে সরকার মাঝে মাঝে খোঁজ খবরও নেবেন। নবনিযুক্ত বাণিজ্যমন্ত্রী জনাব এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান শপথ দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে রাজশাহীতে আয়োজিত জনসভায় এ তথ্য প্রকাশ করেছেন।
জনাব কামরুজ্জামান বলেছেন, জিনিসপত্রের দামে স্থিতিশীলতা আনয়নের জন্য ফড়িয়া ব্যবস্থা বিলোপ করা হবে এবং সত্যিকার ব্যবসায়ীদের মধ্যে বন্টন কোটা দেয়া হবে।
বাণিজ্যমন্ত্রী আরো প্রকাশ করেছেন যে, যারা মওজুতদারী, চোরাচালানী, কালোবাজারী ও পণ্যের মূল্য বাড়াচ্ছে তাদের শাস্তিদানের জন্য সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
এ কথা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, জিনিসপত্রের অগ্নিমূল্যের চাপে দেশের জনজীবন আজ চরম দুর্দশা কবলিত। কালোবাজারী ও মুনাফাখোরদের দৌরাত্ম এমনই চরমে উঠেছে যে, অত্যাবশ্যক পণ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতি থেকে সাধারণ মানুষ অবিলম্বে মুক্তি চায়। বাণিজ্যমন্ত্রী মহোদয় পণ্যমূল্যের দর নির্ধারণ সম্পর্কে সরকারী পদক্ষেপের যে তথ্য প্রকাশ করেছেন, তাতে সাধারণ মানুষের মনে আশার সঞ্চার হওয়াটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের মনে বার বার একটি প্রশ্নই কাঁটার মতো খোঁচাচ্ছে যে, পণ্যমূল্যের দাম বেঁধে দেয়ার পরও যদি দামে স্থিতিশীলতা দেখা না দেয়, তাহলে? এ ব্যাপারে সরকার কি প্রয়োজনীয় কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বনের প্রস্তুতি নিয়েছেন?
স্বাধীনতার পর পণ্যমূল্য নিয়ে কালোবাজারী, চোরাচালানী ও মুনাফাশিকারীরা যে হরিলুটের খেলা জমিয়ে বসেছে তাতে আমাদের মনে এ ধারণার জন্ম হওয়াই স্বাভাবিক যে, পণ্যমূল্যের দর সরকারীভাবে নির্ধারণ করে দেয়াটাই যথেষ্ট নয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অপ্রত্যাশিত অগ্নিমূল্য রোধ করতে হলে সর্বপ্রথমেই পর্যাপ্ত সরবরাহের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। এবং সত্যিকার ব্যবসায়ীদের মধ্যে পণ্য বন্টন করে মধ্যস্বত্ব প্রথা ও ফড়িয়া প্রথা সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করে দিতে হবে। সেই সঙ্গে দেশীয় পণ্যের উৎপাদন বাড়াতে হবে। নইলে দেশের মানুষের বিপর্যস্ত ভাগ্যোন্নয়নের সম্ভাবনা সুদূরপরাহত।
নবনিযুক্ত বাণিজ্যমন্ত্রী জনাব কামরুজ্জামান উপরোক্ত ব্যবস্থার প্রতি সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। বিদেশ থেকে আমদানীকৃত দ্রব্যাদি আমদানীকারকদের কাছে মওজুত রাখার নির্দেশ এবং মওজুতকৃত মালামাল সম্পর্কে সরকারীভাবে অনুসন্ধানও চালানো হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। জনসাধারণকে কালোবাজারী, মুনাফাশিকারীদের রাহুগ্রাস থেকে উদ্ধার না করা পর্যন্ত বাংলার মানুষের জীবন থেকে দুর্দশার কালোমেঘ অপসারিত হবে না। পণ্যমূল্য রোধের এই সরকারী প্রচেষ্টা জনগণের সহায়তায় সাফল্যমন্ডিত হোক, মানুষের অশান্ত জীবন স্থিতিশীল হোক, এই আমাদের কামনা।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!