You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
২৪শে মার্চ, ১৯৭৩, শনিবার, ১০ই চৈত্র, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলে শুদ্ধি অভিযান

স্বর্ণসূত্র পাটই হলো বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রথম ও প্রধান মাধ্যম। সাবেক পাকিস্তানের তথাকথিত বাইশ পরিবারের কর্তাব্যক্তিরা বিদেশের বাজারে বাংলাদেশের পাট বিক্রি করে মুনাফার পাহাড় সৃষ্টি করে ফুলে ফেঁপে উঠেছিলো। একমাত্র পাটের বিনিময়ে অর্জিত হতো তিনশ’ কোটি টাকা। একটা রক্তাক্ত বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর সরকার দেশের বৃহত্তর সংখ্যক জনসাধারণের দিকে তাকিয়ে পাটকলগুলো জাতীয়করণ করেছেন। শুধু পাটকলই নয়, পাট ব্যবসা থেকে আরম্ভ করে ব্যাংক বীমা ও অন্যান্য বৃহৎ কলকারখানাগুলোও একই উদ্দেশ্য নিয়ে জাতীয়করণ করা হয়েছে। অথচ দুঃখের সঙ্গেই বলতে হচ্ছে যে, স্বাধীনতা অর্জনের পর একটি বছর অতিক্রান্ত হতে চললো এখনও পর্যন্ত পাটকলগুলোতে পুরোপুরিভাবে উৎপাদনের কাজ শুরু হতে পারেনি। এখনো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে হচ্ছে।
দেশের বৃহত্তম পাটকল আদমজী জুটমিলে দৈনিক উৎপাদনের পরিমাণ ৮০ টন। অথচ বর্তমানে কোন-কোন দিন নাকি এই পাটকলে উৎপাদনের পরিমাণ এসে দাঁড়িয়েছে ৮ টনে। খবরে প্রকাশ, বিদ্যুতের অভাবে খুলনার ১৪টি জুট মিলে নিয়মিত উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। গত ফেব্রুয়ারী মাস থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত অনিয়মিতভাবে উৎপাদন ব্যাহত হবার ফলে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে বৈদেশিক বিনিময় মুদ্রায় ২ কোটি টাকা।
গতকাল বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে, বাংলাদেশ জুটমিলস কর্পোরেশন রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো থেকে দুর্নীতি উৎখাত করার জন্যে আভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোতে অনুসন্ধান শুরু করেছেন।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের একজন মুখপাত্র বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে বলেছেন যে, ইতিমধ্যে দুর্নীতির দায়ে একজন অফিসার বরখাস্ত ও তিনজনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। এছাড়া সাত জন অফিসারকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হয়েছে। কর্পোরেশন পাটকলগুলোকে দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য যে শুদ্ধি অভিযান চালিয়েছেন তাকে আমরা অভিনন্দন জানাবো বৈকি! তবে এসঙ্গে একথাও বলবো যে, শুধুমাত্র অফিসার বা ব্যক্তি বিশেষকে বরখাস্ত করলেই কিন্তু আসল সমস্যার সমাধান হবে বলে আমরা মনে করি না। উৎপাদন বৃদ্ধি যদি আসল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হয় তাহলে মূল সমস্যা কোথায় তারই সন্ধান করতে হবে। যদি দেখা যায় যে, পাকিস্তানী মনোভাবাপন্ন দুর্নীতিবাজ অফিসারদের জন্য উৎপাদনের কাজ ব্যাহত হচ্ছে তাহলে তৎক্ষণাৎ তাকে অপসারণ করতে হবে। অন্যদিকে আবার শ্রমিকদের অনেকেই রয়েছেন যারা ধীরে চলো নীতিতে এগিয়ে চলেছেন। তাঁদের ধারণা বেতন তো মাসে মাসে পাচ্ছি সুতরাং উৎপাদন ব্যাহত হলে তাঁদের কোন যায় আসেনা। আবার অন্যদিকে আরেক সমস্যা রয়েছে। এ সমস্যা হলো পরস্পরের প্রতি দোষারোপের সমস্যা। শ্রমিকদের অভিযোগ খারাপ পাট, যন্ত্রাংশের অভাব ও প্রশাসকদের বিরুদ্ধে, আর পাটকলগুলির কর্তৃপক্ষের অভিযোগ শ্রমিকদের দাবী দাওয়ার বিরুদ্ধে। আর এ দু’য়ের টানাপোড়েনে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
পরিশেষে আমরা একথাই বলবো শুদ্ধি অভিযানের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য হতে হবে উৎপাদন। উৎপাদনের পথে যাঁরাই প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে তাদের বিরুদ্ধেই যথাযথ ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে—তিনি প্রশাসক হোন বা শ্রমিকই হোন তাতে কোন এসে যায় না।

চোরাকারবারী ও দৃষ্কৃতকারী দমনে সেনাবাহিনী

চোরাকারবারী, মওজুতদার, মুনাফাখোর অসাধু ব্যবসায়ী এবং সশস্ত্র দৃষ্কৃতকারীদের দৌরাত্ম্য দিন দিন সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এদের শোষণ ও অত্যাচারে দেশের জনজীবন আজ চরম দুর্গতির মধ্যে কাটছে। জনসাধারণকে এই অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইতিপূর্বে বহুবার হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। কিছুতেই চিড়ে ভিজেনি। বরং চোরাকারবারী ও মুনাফাশিকারী চক্র সুযোগ পাওয়া মাত্রই জনগণের রক্ত শোষণের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিক হারে চড়িয়ে দিচ্ছে এবং বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে জনজীবনে বিপর্যয় ডেকে আনছে। এইসব সমাজবিরোধী গণদুশমনরা দিনের পর দিন দেশ ও দেশের মানুষকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
গণদুশমনদের কবল থেকে দেশ ও দেশবাসীকে রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অবশেষে কড়াকড়ি ব্যবস্থা অবলম্বন করেছেন। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমাজবিরোধী চক্রান্ত সমূলে উৎখাতের জন্য প্রয়োজনবোধে সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
গত পরশু নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আবদুল মালেক উকিল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন যে, বাংলাদেশ সরকার সেনাবাহিনী, রক্ষীবাহিনী ও বাংলাদেশ রাইফেলস্-এর প্রতি সশস্ত্র দুষ্কৃতকারী, কালোবাজারী, মওজুতদার, চোরাকারবারী ও অসৎ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি সাংবাদিকদের জানান, যে সব অশুভ চক্র দেশের জনসাধারণের বাঁচা-মরার প্রশ্নে জীবন ও মুখের অন্ন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্যেই ঐ কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বিত হচ্ছে।
সমাজবিরোধী ও দুষ্কৃতকারী দমনে সেনাবাহিনী নিয়োগ করা হলে এইসব অশুভ চক্রের ঘাঁটি নিশ্চয়ই আবিষ্কার করা সম্ভব হবে এবং দুষ্কৃতকারীদের সমুচিত শাস্তিদান করা সম্ভব হবে বলেই আমাদের ধারণা।
ঐদিকে গত পরশু রাষ্ট্রপতি মজুতদারদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ১৯৭৩ সালের বাংলাদেশ অত্যাবশ্যকীয় পণ্য গুদামজাতকরণ, মওজুত রাখা ও বিক্রয় আদেশ জারী করেছেন। রাষ্ট্রপতির এই আদেশ কার্যকরী করা হলে মওজুতদাররা অত্যন্ত ফাঁপরে পড়বেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কালোবাজারী, মওজুতদার ও মুনাফাশিকারী চক্র রাষ্ট্রপতির এই ব্যবহার্য পণ্য আদেশ মোতাবেক কোনক্রমেই পণ্যদ্রব্য ত্রিশ দিনের বেশী মওজুত রাখতে পারবে না। এটা খুবই সুপরিকল্পিত বিধান। আমরা আশা করি এ নিয়মের ফলে মওজুতদার ও চোরাকারবারীরা আর কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করতে সক্ষম হবেনা।
গত পরশু বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ২১ সদস্য বিশিষ্ট মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেও খাদ্য পরিস্থিতি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য ও আইন-শৃঙ্খলাসহ দেশের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়েছে। তাছাড়া সমাজবিরোধী ও দুষ্কৃতকারীদের উপর কড়া নজর রাখার জন্য এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে সক্রিয় সাহায্যের জন্য সরকার দেশের সকল স্তরের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দিয়েছেন।
মোদ্দা কথা, দেশ থেকে সমাজবিরোধী ও দুষ্কৃতকারী অসাধুয চক্র নির্মূলের জন্য সরকার সব রকম কার্যকরী পন্থা গ্রহণ করেছেন। এরপরও যদি অশুভ চক্র দমন করা সম্ভব না হয় এবং চোরাকারবারী, মওজুতদার ও দুষ্কৃতকারীরা আত্মসংশোধনের পথ বেছে না নেয়, তা হলে দেশ এক চরম হতাশার পংকে নিমজ্জিত হবে। এবং দেশবাসী বিরাজিত দুর্দশার কবল থেকে পরিত্রাণ পাবেনা। বঙ্গবন্ধুর সরকারের এ মহতী অভিযানকে সার্থক করে তোলার জন্য দেশের জনসাধারণকেও পরিপূর্ণ সহযোগিতা করতে হবে। কারণ, যাদের শান্তি, সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য সরকার দুষ্কৃতকারী নির্মূলের এ অভিযান শুরু করেছেন, এ ব্যাপারে তাদেরও সক্রিয় ও অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। জনগণের নির্বাচিত সরকারকে সাহায্যকল্পে জনগণ যে এগিয়ে আসবেন, তাতে আমাদের কোন সংশয় নেই।
আমরা বিশ্বাস করি, চোরাকারবারী, মওজুতদার, মুনাফাখোর, অসৎ ব্যবসায়ী এবং সশস্ত্র দুষ্কৃতকারীরা বাংলার মাটি থেকে একদিন উৎখাত হবেই এবং সেদিন খুব বেশী দূরে নয়।

বাংলাদেশ-পোল্যান্ড ঋণ চুক্তি

খবরে প্রকাশ, গত পরশু বাংলাদেশ ও পোল্যান্ডের মধ্যে ৫০ লাখ পাউন্ড স্টার্লিংয়ের একটি ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। বছরে শতকরা আড়াইভাগ সুদের এই ঋণ অতিরিক্ত দুই বছরের বর্ধিত সময় সহ দশ বছরে পরিশোধযোগ্য। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার পোল্যান্ড থেকে কল-কারখানার সরঞ্জাম, যন্ত্রপাতি, বয়নশিল্প, বৈদ্যুাতিক যন্ত্রপাতি ও ক্ষুদ্রশিল্পের সরঞ্জামাদি সহ অন্যান্য ভারী সরঞ্জামাদি আমদানী করবেন।
বাংলাদেশ-পোল্যান্ডের মধ্যে এই ঋণ চুক্তির ফলে দু’দেশের মধ্যে মৈত্রীবন্ধন ও পারস্পরিক সহযোগিতা আরো ‍বৃদ্ধি পাবে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর পোলিশ প্রতিনিধি দলের নেতা বলেছেন যে, এই ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে দু’দেশের মধ্যকার অর্থনৈতিক সহযোগিতার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হলো। এবং তিনি দু’দেশের বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে বলে আশাবাদী।
পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশের মতো একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সমৃদ্ধি ঘটা সম্ভব নয়। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সমাজতান্ত্রিক দেশ পোল্যান্ডের সহযোগিতা অবশ্যই বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সহায়ক হবে। ইতিপূর্বে পোল্যান্ড বাংলাদেশকে ৫ লাখ স্টার্লিং সরাসরি সাহায্য মঞ্জুর করেছিলো এবং গত বছরের গোড়ার দিকে বাংলাদেশ ও পোল্যান্ডের মধ্যে ৬০ লাখ স্টার্লিংয়ের একটি বিনিময় বাণিজ্যিক প্রটোকলও স্বাক্ষরিত হয়েছিলো। বরাবরাই পোল্যান্ড বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহযোগিতা করার ব্যাপারে এগিয়ে আসছে। সমাজতন্ত্রের পথে অগ্রসরমান বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি সুদৃঢ় করতে হলে পারস্পরিক মর্যাদার ভিত্তিতেই বিশ্বের বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করা দরকার। সমাজতান্ত্রিক দেশ পোল্যান্ড যে বাংলাদেশের প্রতি সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করেছে তাতে আমাদের ধারণা, এই দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক সহযোগিতার নতুন দিগনত্ উন্মোচিত হলো।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!