You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
২৫শে মার্চ, ১৯৭৩, রবিবার, ১১ই চৈত্র, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ

রক্তঝরা পঁচিশে মার্চ

সময় কারো জন্যে বসে থাকে না। এগিয়ে চলে। সময়ের পথ বেয়ে যে একাত্তরের পঁচিশে মার্চকে আমরা পেছনে ফেলে এসেছি সেই ভয়াবহ স্মৃতি-বেদনায় ভারাক্রান্ত দিনটি আবার এসেছে।
পঁচিশে মার্চকে বাঙালীর স্মৃতির মণিকোঠা থেকে কোনদিনই মুছে ফেলা যাবে না। পঁচিশ বছর ধরে বাঙালী জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার যে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তে মেতে উঠেছিলো পাকিস্তানী শাসক ও শোষক গোষ্ঠী তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিলো পঁচিশে মার্চের কাল রাতে। হানাদার বাহিনী বিশ্বের অত্যাধুনিক অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সেদিন ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো বাংলার মানুষের উপর। ‘মানুষ চাই না মাটি চাই’ এই ছিলো হানাদার বাহিনীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। ওরা সেদিন ভেবেছিলো অস্ত্রের ঝঙ্কারে স্তব্ধ করে দেবে বাংলার মানুষের সোচ্চার কন্ঠকে। ভেবেছিলো বাংলার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতারা মৃত্যু ভয়ে ভীত হয়ে ওদের কাছে আত্মসমর্পণ করবে, গোলামী জিঞ্জিরকে হাসিমুখে গলার মালা রূপে বরণ করে নেবে।
হানাদার বাহিনী সেদিন ভুল করেছিলো বাংলার মানুষকে চিনতে। হিসাব ওদের মেলেনি। বাংলার মাটি যে দুর্জয় ঘাঁটি দুর্বৃত্তরা তা বুঝতে পারেনি। তাই ওরা ক্ষ্যাপা কুকুরের মতই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। কিন্তু ‘ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে মোদের বাঁধন ততই শেষে টুটবে’ এ সত্যকে উপলব্ধি করতে পারেনি ওরা। ক্ষমতার দর্প বোধ হয় মানুষকে এমনিভাবেই অন্ধ করে দেয়। যেমন অন্ধ করে দিয়েছিলো সেদিন চেঙ্গিস, হালাকু, নাদির আর হিটলারকে। জল্লাদ শিরোমণি ইয়াহিয়াও সেদিন অন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। জ্ঞানচক্ষু তার উন্মিলিত হয়নি। তাই ইয়াহিয়া আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা পঁচিশে মার্চের কাল রাতেই ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো বাংলার নয়নমণি, বাংলার বজ্রকন্ঠ, বাংলার চেতনা, স্বাধিকার ও স্বাধীনতার প্রেরণার উৎস বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে। ওরা সেদিন ক্ষণিকের তরেও উপলব্ধি করতে পারেনি যে, এক শেখ মুজিবকে ছিনিয়ে নিয়ে গেলেও বাংলার মাটিতে লক্ষ মুজিবের কন্ঠ গর্জন করে উঠবে। মুজিবের চেতনা ও প্রত্যয়ে উদ্দীপ্ত হয়ে ছিনিয়ে আনবে স্বাধীনতার সুর্যকে।
একাত্তরের পঁচিশে মার্চ আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিলো। সেদিন সে পথ ছিলো অনিশ্চয়তার অন্ধকারে নিমজ্জিত। তবু সেদিন প্রতিটি বাঙালীর কন্ঠে ছিলো একটি মাত্র কথা আর তাহলো ‘হয় মারবো না হয় মরবো’। শত্রুর হাতে আত্মসর্ম্পণ করে পরাধীনতার গ্লানি নিয়ে আমরা বেঁচে থাকবো না।
ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমরা জয়ী হয়েছি। বিশ্বের মানচিত্রে অযুত সম্ভাবনাময় একটি নতুন দেশের জন্ম হয়েছে। কবিগুরু বাঙালীর দৈন্যদশা দেখে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালী করে মানুষ করোনি’। বাংলার মানুষ অনেক রক্ত, ত্যাগ, তিতিক্ষা আর সংগ্রামের বিনিময়ে কবিগুরুর স্বপ্নকে সফল করেছে। বাঙালী মানুষ হয়েছে। বিশ্ব সভায় আজ বাঙালী চিহ্নিত হয়েছে বীরের জাতিরূপে। বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর—এই সোচ্চার ধ্বনিকে আমরা বাস্তবায়িত করেছি।
পঁচিশে মার্চ যে অনাগত ভবিষ্যতের দিকে আমরা তরী ভাসিয়েছিলাম, সে-তরী স্বাধীনতার ঘাটে এসে ভিড়েছে ঠিকই তবুও আমাদের যাত্রাপথ শেষ হয়নি। সোনার বাংলার সোনালী দ্বীপে আমাদের পৌঁছুতে হবে। পঁচিশে মার্চের দুয়ারে দাঁড়িয়ে আমরা সেই শপথই নেবো। পঁচিশে মার্চ দুঃখের দিন, বেদনার দিন, আনন্দের দিন। পঁচিশে মার্চই হলো সকল প্রেরণা আর অফুরন্ত উদ্দীপনার দিন। পঁচিশে মার্চকে তাই আমরা আজ স্মরণ করি—ভবিষ্যতেও করবো।

গণতান্ত্রিক শক্তিকে হত্যার ষড়যন্ত্র

পাকিস্তানে বিরোধী দলীয় গণতান্ত্রিক শক্তিকে টুটি টিপে হত্যা করার জন্য ভুট্টো সরকার ফ্যাসিবাদী আক্রমণাত্মক নীতি অনুসরণ করে চলেছেন। গত শুক্রবার রাওয়ালপিন্ডির অন্যতম জনবহুল এলাকা লিয়াকত পার্কে বিরোধী দলীয় যুক্তফ্রন্ট আয়োজিত জনসভায় গুলিবর্ষণের ফলে কমপক্ষে দশজন মর্মান্তিক মৃত্যুবরণ করেছেন। এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে জনসভায় যোগদানকারী বিরোধীদলীয় সমর্থক বহনকারী ১৫টি বাস আগুন ধরিয়ে জ্বালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে।
প্রকাশিত সংবাদে জানা যায় যে, ঐ জনসভায় ন্যাপ প্রধান ওয়ালী খানসহ আটজন বিরোধীদলীয় নেতার বক্তৃতা দেবার কথা ছিলো। সাতটি বিরোধীদল এবং জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত নির্দলীয় সদস্যদের সমন্বয়ে এই সংযুক্ত গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠন করা হয়েছে।
গত শুক্রবার ২৩শে মার্চ ছিলো পাকিস্তান জাতীয় দিবস। এ উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত সশস্ত্র বাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ করেন এবং তার কয়েক ঘন্টা পরই পিন্ডির লিয়াকত পার্কে অনুষ্ঠিতব্য বিরোধীদলের জনসভা পন্ড করার জন্য রক্তাক্ত হামলা পরিচালিত হয়।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যেতে পারে যে, একই স্থানে গত ডিসেম্বর মাসে প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর জনসভাও সশস্ত্র ব্যক্তিরা বানচাল করে দিয়েছিলো। পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানও এই একই স্থানে আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছিলেন।
পিন্ডির সেই লিয়াকত পার্কেই ভুট্টোর বিরোধীদের জনসভা পন্ড এবং নিহতের ঘটনা তাই খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। নবগঠিত সংযুক্ত বিরোধীদলের কন্ঠকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্যই যে এই নাশতকামূলক কার্যকলাপ পরিচালিত হয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। ভুট্টো সরকার পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক পরিবেশ রচিত হোক এটা চান না। ঐদিকে, পাকিস্তানে গণতন্ত্রের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য বিরোধী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংযুক্ত গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠন করেছে। এই গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট নেতাদের কোন বক্তব্যই যাতে জনসাধারণের দরবারে পৌঁছুতে না পারে সে জন্যে ভুট্টো সরকার সমর্থকরা জনসভা পন্ড ও নরহত্যার পথ বেছে নিয়েছে।
অবস্থাদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তানে বিদ্রোহ ও অসন্তোষ ক্রমাগত ধূমায়িত হয়ে উঠছে। একদিকে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এই ঐক্যের বন্ধনকে ছিন্ন করার জন্য চলছে হামলা ও নাশকতামূলক কার্যকলাপ। যা শুধু গণতন্ত্রকে হত্যা করছে না, পাকিস্তানের ভাগ্যেও ডেকে আনছে চরম বিপর্যয়। ভুট্টো সরকার এই গণতান্ত্রিক শক্তির বিকাশকে কতদিন রুদ্ধ করে রাখতে পারবে সেটাও একটা মহা সমস্যার ব্যাপার হয়ে দেখা দিয়েছে। গণতান্ত্রিক শক্তিকে হামলা ও আক্রমণ করে কোনদিনই শেষ রক্ষা করা যায় না। ইতিহাসের নিয়মেই জনাব ভুট্টো সাহেবকে সেই শিক্ষা নিতে হবে। নইলে পাকিস্তানে আবার এক নতুন অধ্যায় সৃষ্টি হবে। গণতান্ত্রিক শক্তির বিজয় অবশ্যম্ভাবী, ভুট্টো সাহেব যেন এ কথা ভুলে না যান।

যা চক চক করে তাই সোনা নয়

খবরে প্রকাশ, ঢাকায় পুলিশ নাকি কাচি দিয়ে বেশ কয়েকজনের লম্বা চুল কেটে দিয়েছে। শুজবটি ছড়িয়ে পড়ার সংগে সংগে লম্বা চুলওয়ালা ভীড় জমিয়েছে নরসুন্দরদের দুয়ারে।
ছেলেদের লম্বা চুল রাখা কোন কালেও ফ্যাশন ছিল বলে অদ্যাবলি কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। অথচ পাশ্চাত্য দেশে একদল তরুণ তারুণ্যের উচ্ছাসে অথবা চলমান ক্ষয়িষ্ণু জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে লম্বা চুল দাড়ি রেখে বিভিন্ন রঙ বেরঙের পোশাক পরে হিপ্পিবাদের আশ্রয় নিয়েছে। আমাদের দেশে এখনো হিপ্পিবাদের প্রসার ঘটেনি সত্য, কিন্তু প্রসার ঘটতে যাচ্ছে এ কথা বললে বোধ করি ভুল বলা হবে না। হিপ্পিবাদ, গোগো ড্যান্স, টুয়িস্ট ইত্যাদি ইদানিং পাশ্চত্য সংস্কৃতিতে বেশ আলেড়ন সৃষ্টি করেছে এবং এর প্রত্যক্ষ ও চূড়ান্ত ফল যে কি দাঁড়াচ্ছে তা সে সব দেশের দৈনিকের পাতা উল্টালে দেখা যাবে।
ছেলেদের লম্বা চুল মেয়েদের খাটো চুল। একের বিপরীতমুখী অন্যটি। প্রেরসী কিংবা মানসীর যে লম্বা চুল দেখে কবিরা কাব্য করেছেন ‘চুল তার কবে কার অন্ধকার বিদিশার নিশা’ মেয়েদের সৌন্দর্যের অন্যতম প্রতীক সেই চুল তারা ছেঁটে পশ্চিমা দেশের মেয়েদের চুলের মত করবার প্রবণতা বেশ বেড়ে চলেছে। পোশাকের বেলায়ও একই। সৌন্দর্যের নামে নগ্নতার প্রতিযোগিতা। ফলে আমরা না হচ্ছি বাঙ্গালী না হচ্ছি পশ্চিম দেশীয়, না অন্য কিছু। সব মিলিয়ে জগা খিচুড়ি বই আর কিছু নয়।
তারুণ্যের উচ্ছলতায় তারা হয়ত বা নতুন সব কিছুই চমক লাগতে পারে একথা স্বীকার করি। কিন্তু সেই ভালো লাগার চূড়ান্ত ফল যদি তার জন্য এবং সর্বোপরি জাতির জন্য অকল্যানকর হয়, তাহলে সে ভালো লাগার নিশ্চয়ই কোন মূল্য নেই। সুরাতাং কোন কিছুকে গ্রহণ করার আগে নিশ্চয় ভেবে দেখা দরকার সেটা আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি এবং জাতীয় সত্তার প্রতি অসঙ্গতিপূর্ণ কিংবা হানিকর কিনা। স্মরণ করা প্রয়োজন, যা কিছু চক চক করে তাই সোনা নয়।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!