বাংলার বাণী
২৩শে মার্চ, ১৯৭৩, শুক্রবার, ৯ই চৈত্র, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ
একের বোঝা অন্যের ঘাড়ে?
পাকিস্তানকে সাহায্যদানকারী বিশ্বব্যাংকের কনসোর্টিয়াম গত একুশে মার্চ প্যারিসে বৈঠকে বসেছে। উদ্দেশ্য পাকিস্তানকে দেয়া ঋণ সম্বন্ধে একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। এদিকে দৈনিক স্টেটসম্যানের ওয়াশিংটনস্থ সংবাদদাতা জানিয়েছেন যে উক্ত বৈঠকে পাকিস্তানকে দেয়া ঋণের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বাংলাদেশের কাঁধে চাপিয়ে দেয়ার একটা পরিকল্পনা ইতিমধ্যেই গ্রহণ করা হয়েছে। এর যুক্তি হিসাবে পাকিস্তানকে দেয়া বিশ্বব্যাংকের এই ঋণের অংশ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিলো বলে বলা হচ্ছে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যেতে পারে যে, পাকিস্তান বিশ্বব্যাংকের নিকট থেকে সর্বমোট তিনশ’ পঞ্চাশ কোটি ডলার ঋণ গ্রহণ করেছে যার মধ্য থেকে একশ’ দশ কোটি ডলার বাংলাদেশের নিকট থেকে আদায় করা হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংক উন্নয়নশীল দেশসমূহের উন্নয়নে সাহায্য ও সহযোগিতার হস্ত সম্প্রসারিত রেখেছেন। বহু উন্নয়নশীল দেশ এই সাহায্য-সহযোগিতা থেকে লাভবান হয়েছেন একথা সত্য। উন্নয়নকামী দেশ হিসেবে বাংলাদেশও তাদের সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হবেনা এ বিশ্বাস আমাদের রয়েছে। কিন্তু প্যারিস বৈঠকে পাকিস্তানে প্রদত্ত ঋণ যে ভাবে উসুল করবার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে তা শুধু অন্যায়ই নয়—নীতিধর্ম বিরোধীও। পাকিস্তান বিশ্বব্যাংকের ঋণে পর্যাপ্ত লাভবান হয়েছে। গণমুখী চিন্তা-চেতনা নিয়ে সে ঋণ প্রাপ্ত অর্থের সদ্ব্যবহার করা না হলেও পুঁজিপতি ও সামরিক নেতৃত্বের স্বার্থে সে অর্থের যথাযোগ্য ব্যবহার করা হয়েছে। ব্যক্তি মালিকানায় শিল্প গড়ে উঠেছে, সামরিক বাহিনীর জৌলুস গেছে বেড়ে। কৃষিক্ষেত্রে অবশ্য এ অর্থের কিছু বিনিয়োগও সম্ভব হয়েছে। ঋণ করা টাকায় প্রসাধনী দ্রব্য আমদানীতেও পাকিস্তান রেখেছে বিরল দৃষ্টান্ত। এ সবই পাকিস্তানের ব্যাপার। বিশ্বব্যাংক যে ঋণ দিয়েছে তার প্রায় সবটাই ব্যয় হয়েছে সেখানে। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান এবং আজকের বাংলাদেশের খাতে যে অর্থ ঋণ করা হয়েছিলো তাও কোন্ পথ ধরে পাকিস্তানের ভান্ডারে গিয়ে পড়তো তা আজ আর কারো অজানা নেই। সে সময়ে বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহুবার এই ঋণের অপব্যবহার তথা ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ ন্যায্য হিস্যা পাচার হয়ে যাওয়া সম্বন্ধে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। সেদিন কেউ তাঁর কথায় কান দেননি। সবকিছু জেনেশুনেও ডলার ঢেলেছেন পাকিস্তানের সামরিক একনায়কদের থলিতে। আজ সেই ‘পূর্ব পাকিস্তানের খাতে বরাদ্দকৃত’ ঋণের বোঝা বাংলাদেশের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার কোন প্রচেষ্টা চালানোর পূর্বে কি তাদের অতীত দিনের সে সকল কথা ভেবে দেখা উচিত ছিলো না?
পাকিস্তানের ঋণ সম্বন্ধে আমাদের সাফ কথা, ওদের ঋণের বোঝা আমরা বইতে যাবো না। দুধের দাম তারাই দেবেন যারা ওটা পান করেছেন। বাংলাদেশের সঙ্গে সে ঋণের কোন সম্পর্ক নেই। সেই শিল্পপতি সামরিক বাহিনীর অধিশ্বররা যারা পরের ধনে নিজেদের দেহে মাখন মেখেছেন দেনা শোধের দায়িত্বটাও তো তাদেরই। স্বচ্ছ জলে কাদা গুলিয়ে কোন লাভ নেই। পাকিস্তানে সাহায্যদানকারী বিশ্বব্যাংকের কনসোর্টিয়াম বৈঠকে বসেছেন ভালো কথা। তাদের দেয়া ঋণ তারা অবশ্যই ফেরৎ পেতে আগ্রহী হবেন। কিন্তু তৃতীয় পক্ষকে জড়ানো কেন? ঋণ দান এবং ঋণ গ্রহণে দু’টো পক্ষই সক্রিয় থাকে। একজন ঋণদাতা এবং অন্যজন ঋণ গ্রহীতা। আলোচ্য বিষয়েও পক্ষ দু’টি : ঋণদাতা কনসোর্টিয়াম এবং ঋণ গ্রহীতা পাকিস্তান। দেনা পাওনা, সুবিধা-অসুবিধা এ সবই তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকুক।
বর্ণবৈষম্য বিলুপ্তির সংগ্রাম
জাতিসংঘের মহাসচিব উঃ কুর্ট ওয়াল্ড হেইম বর্ণবৈষম্যের তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন যে, বর্ণবৈষম্যবাদ রক্তাক্ত সংঘর্ষ ও প্রবল তিক্ততার জন্ম দিয়েছে। গত পরশু ২১শে মার্চ ছিলো জাতিসংঘের মানবাধিকার দিবস। ১৯৬০ সালের ২১শে মার্চ দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণের নাগরিক অধিকারের দাবীতে লার্পভিলে নিগ্রোদের এক শান্তিপূর্ণ মিছিলে ওপর দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্যবাদী সরকারের পুলিশ নৃশংস হামলা চালিয়েছিল। পুলিশের গুলীবর্ষণে নিহত হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার অসংখ্য কৃষ্ণকায় মানুষ। পৃলিশের নৃশংস হামলায় নিহত কৃষ্ণাঙ্গদের স্মরণে এবং সমগ্র বিশ্ব থেকে জাতিগত বৈষগ্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ জাতিসংঘ প্রতিবছর ২১শে মার্চ তারিখটি মানবধিকার দিবস হিসাবে পালন করে আসছে। কাজেই এই দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিবৃতি প্রচার করাটা খুবই স্বাভাবিক। এতে আমরা কিছুমাত্র আশ্চর্যান্বিত হইনি। জাতিসংঘের মুহাসচিবকে ধন্যবাদ জানাই যে, প্রথামাফিক হলেও তিনি ক্যান্সারের ক্ষতের মতো জঘন্য বর্ণবৈষম্যবদিতার নিন্দা করেছেন এবং বর্ণবৈষম্য-বিলুপ্তির জন্য উচ্চকণ্ঠ হয়েছেন।
আজ থেকে শত সহস্র বছর আগেই জাতিবৈরী ও বর্ণবৈষম্য বিদূরিত করা জন্য অনেক মহাপুরুষের আবির্ভাব হয়েছে। কিন্তু তবুও আফ্রিকায় প্যাট্রিস লুমুম্বার মতো মানুষকেও দিতে হয়েছে আত্মহুতি। দক্ষিণ আফ্রিকা, রোডেশিয়া এবং আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্রেতাঙ্গদের মধ্যে বর্ণবৈষম্য নীতি প্রকট আকার ধারণ করেছে। কালো আদমীরা সাদা চামড়ওয়ালাদের নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকারে নিয়ত নিষ্পেষিত হচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্যবাদিত এতোই প্রকট আকার ধারণ করেছে যে, সেখানে কালো আদমীরা কালো আদমীদের রক্তের অভাবে আজো মর্মান্তিক মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নিতে বাধ্য হচ্ছে। শেতাঙ্গ আদম সন্তানরা নিগ্রোদের চিকিৎসা কিংবা জীবন রক্ষার জন্য একবিন্দু রক্ত দিতেও নারাজ। বরং শ্বেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি নানা রকম অত্যাচার, নির্যাতন ও শোষণ চালাতেই উৎসাহী। চামড়ার রং-ই যেনো সব-রক্তের রং বর্ণবৈষ্যবাদীদের কাছে ফিকে।
তাই জাতিসংঘ মানবাধিকার দিবস পালন করুন আর যাই করুন, চামড়ার রং এখনো মানুষে মানুষে পর্বত প্ৰমাণ বৈষম্য রচনা করে রেখেছে। মানব সভ্যতা থেকে এই সাদা কালোর বৈষম্যের অবসান না হওয়া পর্যন্ত মানবাধিকার দিবসের সার্থকতা সূচিত হতে পারে না।
কৃষ্ণাঙ্গ বলুন আর শ্রেতাঙ্গই বলুন, চামড়ার বর্ণ যাই হোক, পৃথিবীর সব মানুষের রক্তের রং-ই লাল। নিগ্রোদেরও যে রক্তের রং লাল দুনিয়ার মানব সভ্য এই সত্য উপলব্ধি করলেই ধর্ণবৈষম্যের তীব্রতা স্তিমিত হওয়া সম্ভব। এবং এই পথেই জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে বলে আমাদের বিশ্বাস।
বিজ্ঞাপনের খেসারত
খবরের কাগজে যারা বিজ্ঞাপন দেন, তারা কি আদ্যোপান্ত ভাবনাচিন্তা করে বিজ্ঞাপন প্রচার করেন, না খেয়াল খুশী মতো ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার জন্য বিজ্ঞাপনের ভাষা প্রয়োগ করেন? বিজ্ঞাপনের ভাষা এবং বিষয়বস্তু নির্বাচনের ব্যাপারে না ভেবেচিন্তে বিজ্ঞাপন প্রচার করা জন্য মিউনিখের এক পোশাক বিক্রেতা সম্প্রতি দারুণ বিপাকে পড়েছিলেন বলে জানা গেছে।
প্রকাশ, মিউনিখের এক পোশাক বিক্রেতা তার নতুন দোকান উদ্বোধনের আগে খবরের কাগজে একটি অভিনব বিজ্ঞাপন দিয়ে বলেছিলেন যে, তার দোকানে সর্বপ্রথম যে পাঁচজন ক্রেতা আসবেন তাদের তিনি বিনামূল্যে আপাদমস্তক পোশাকে আবৃত করে দেবেন। তবে শর্ত হলো ক্রেতাদের সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে দোকানে আসতে হবে। দোকান উদ্ভোধনীর নির্দিষ্ট দিনের অতি প্রত্যুষে একজন নয় দুজন নয় আটত্রিশ জন ক্রেতা দিগম্বর হয়ে হাড় কাঁপানো শীত উপেক্ষা করে পোশাকের দোকানে এসে হাজির। বিজ্ঞাপন মোতাবেক দোকানী তার কথা রেখেছেন, প্রথম পাঁচজনকে আপাদমস্তক পোশাকে আবৃত করে দিয়েছেন এবং বাকি তেত্রিশ জন দিগম্বর ক্রেতাকে প্যান্ট এবং মোজা দিয়েছেন।
পাশ্চাত্য সমাজে যে নগ্নতার ঢেউ বয়ে যাচ্ছে, তার প্রভাবেই পোশাক বিক্রেতা ওই ধরনের অভিনব বিজ্ঞাপন প্রচার করেছিলেন এবং তাকে সে জন্য আক্কেল সেলামীও কড়ায় গন্ডায় চুকিয়ে দিতে হয়েছে।
উক্ত পোশাক বিক্রেতা বলেছিলেন, “আমি ভেবেছিলাম এ বিজ্ঞাপনের প্রতি কেউ সাড়া দিয়ে অন্ততঃ আর যাই করুন, দিগম্বর হবেন না।” কিন্তু ঘটনাটি যে এরকম ঘটবে তা তিনি আঁচ করতে পারিনি। না ভেবেচিন্তে শুধু যৌন বিলাসিতার জন্যই পোশাক বিক্রেতা বিজ্ঞাপন দেয়াতে তাকে তার খেসারত দিতে হয়েছে। যারা বিজ্ঞাপন দেয়ার সময় আগ-পিছু না ভেবে কাণ্ডজ্ঞান ও নীতিহীনতার কাজ করেন, তারা এরকমই বিজ্ঞাপন বিড়ম্বনার সম্মুখীন হবেন বলে আমাদের ধারণা। বিজ্ঞাপনদাতারা এখন থেকে ওই ধরনের চমক সৃষ্টি না করে সুমার্জিত ও সুচিন্তিত বিজ্ঞাপন প্রচারের প্রতিই উৎসাহিত হবেন বলে আশা করি। কারণ, প্রবাদে আছে, ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক