You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
২৬শে মার্চ, ১৯৭৩, সোমবার, ১২ই চৈত্র, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ

স্বাধীন স্বদেশের তৃতীয় বর্ষে পদার্পণ

আজ স্বাধীনতা দিবস। দু’বৎসর হয়ে গেলো আমরা স্বাধীন হয়েছি। স্বশাসনে শাসিত হবার জন্য আমাদের সংগ্রাম করতে হয়েছে সুদীর্ঘ দিন। রক্ত ঝরাতে হয়েছে অনেক। এ সবই স্বাধীনতার মূল্য। স্বাধীনতার জন্য সর্বশেষ আমাদের যে মূল্য দিতে হয়েছে তা বিশ্বের ইতিহাসে নজীরবিহীন। এমনি করে শোষকেরা, সাম্রাজ্যবাদীরা মুক্তিকামী মানুষের কাছ থেকে স্বাধীনতার মূল্য আদায় করে নেয়। জঙ্গুলে এ রীতি নিয়ম চলে এসেছে সেই সুদীর্ঘ কাল থেকে, সভ্যতার এই শীর্ষ দেশের পৌঁছেও বিশ্ব সমাজের সেই রীতিনীতির রদবদল ঘটেনি এতটুকু।
আমরা স্বাধীনতা চেয়েছিলাম। আরো বহু জাতি স্বাধীনতা চেয়েছিলো; এখনো চাইছে এমন জাতিসমূহের সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু মানব মনের সেই চিরন্তন অনুভবকেই পদদলিত করবার মতো হিংস্র এবং বর্বর ঔপনিবেশিক শক্তির কমতি নেই। নানা তত্ত্বকথা, নানা কৌশল আর অবশেষে আদিম বর্বরতার উলঙ্গ রূপ শক্তির ব্যবহারে শ্বাশত সত্যকে তারা চাপা দিতে তৎপর অতীতে এবং বর্তমানে। পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শক্তিও এ থেকে ভিন্ন কোন পথ গ্রহণ করেনি। তারা শক্তির আশ্রয় নিয়ে চেয়েছিলো সাড়ে সাত কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং চেতনাকে নস্যাৎ করতে। পারেনি তারা ইতিহাসের নিয়মেই। মৃত্যু আর নির্যাতন মানুষকে তার স্বাভাবিক বিকাশের পথ থেকে বিচ্যূত করতে পারে না। ক্ষমতার মদমত্ততায় এই সহজ সরল কথাটাও অনেকে বিস্মৃত হন।
সবকিছুর পরও আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। ত্রিশ লক্ষ আত্মজনের বিয়োগ ব্যথা, সম্পদ সম্ভ্রমের হানি আমাদের পিছপা করতে পারেনি। আমরা লড়েছি এবং ইপ্সিত স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে এনেছি। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে তাই মুক্ত কন্ঠে আমরা বলতে পেরেছি আমাদের সম্পদ আমরা খেটে খাওয়া মেহনতী মানুষেরা ভোগ করবো। এ সম্পদ যেমন আমার তেমনি এর বৃদ্ধির তথা অধিকতর ভোগের দায়িত্ব এবং অধিকারও আমার। আমরা মাঠে ফসল ফলাবো আমাদেরই জন্য, কারখানায় উৎপাদন চলবে আমাদেরই প্রয়োজনে। এটা একটা বোধ যা দায়িত্ব সম্বন্ধে মানুষকে অধিকতর সচেতন করে তোলে। দায়িত্বহীন মানুষের জন্য যেমন স্বাধীনতা অর্থহীন তেমনি স্বাধীনতা এই দায়িত্বহীনদের মনে কোন বোধের সৃষ্টি করতে পারে না।
স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে আমরা নতুন যাত্রা পথে পাড়ি জমিয়েছি। জনগণের চিন্তা চেতনা এবং অংশীদারিত্বে রাষ্ট্রতরী তার লক্ষ্যপথে এগিয়ে চলেছে। শোষণহীন এক সমাজব্যবস্থা গড়ার শপথ দৃপ্ত প্রত্যয় নিয়ে প্রতিটি মানুষ তার উপর অর্পিত দায়িত্ব সুষ্ঠু এবং সুন্দরভাবে পালন করবেন এটাই স্বাধীনতার মূল শিক্ষা। সেই শিক্ষাকে সামনে রেখেই আমাদের এই নব্য রাষ্ট্র তৃতীয় বর্ষে পদার্পণ করছে। তার সেই যাত্রাপথে শুধু শুভেচ্ছা নয় সহযাত্রীর কর্মভাগ আমরাও গ্রহণ করছি।

মহাসচিবের আবেদন : খাদ্যশস্য আসছে

জাতিসংঘের মহাসচিব ডঃ কুর্ট ওয়াল্ড হেইম সম্প্রতি বাংলাদেশকে খাদ্যশস্য সাহায্যদানের জন্যে যে আবেদন জানিয়েছিলেন তাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিপুলভাবে সাড়া দিয়েছেন। জানা গেলো, নিউজিল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় অর্থনৈতিক গোষ্ঠী এবং অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশকে খাদ্যশস্য সাহায্যদানের সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
স্মরণ করা যেতে পারে যে, কিছু দিন আগে জাতিসংঘের মহাসচিব কুর্ট ওয়াল্ড হেইম বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। বাংলাদেশ সফরকালে তিনি এখানকার খাদ্য পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন এবং বাংলাদেশের খাদ্য ঘাটতিতে তিনি বিচলিত হন। বাংলাদেশে যাতে খাদ্য ঘাটতি এবং দুর্ভিক্ষ না দেখা দেয়, সে জন্যে তিনি বাংলাদেশকে খাদ্যশস্য সাহায্য প্রেরণের জন্য বিশ্বব্যাপী আবেদন জানান। এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নিউজিল্যান্ড ডঃ ওয়াল্ড হেইমকে খাদ্যশস্য ক্রয়ের জন্য নগদ ১ লাখ ৩৫ হাজার ডলার এবং খাদ্য বন্টনে সাহায্য করার জন্য জাতিসংঘকে আরো ৬৭,৫৩১ ডলার দেবে বলে জানিয়েছে। ইউরোপীয় অর্থনৈতিক গোষ্ঠী বাংলাদেশকে ১ লাখ ৭৫ হাজার টন খাদ্যশস্য দেবার কথা ঘোষণা করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের খাদ্যখাতে সাধারণ ত্রাণ কর্মসূচী অনুযায়ী জাতিসংঘকে ২৫ লাখ ডলার দেবে। এছাড়া, অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশকে ন্যূনতম ৫৪ হাজার মেট্রিক টন গম সাহায্যদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের খাদ্য সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য এই বিদেশী সাহায্য খুবই উপযোগী। আজকের বিশ্বে শুধু বাংলাদেশে নয় অন্যান্য দেশেও খাদ্য ঘাটতি রয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতি পড়াটা একেবারে অস্বাভাবিক নয়। একটি রক্তাক্ত বিপ্লবের পর বাংলাদেশও তাই অনিবার্য কারণে অন্যান্য সংকটের সঙ্গে খাদ্য সংকটে নিমজ্জিত হয়েছে। বিদেশ থেকে এইসব খাদ্যশস্য বাংলাদেশে এসে পৌঁছানোর পর এখানকার খাদ্য সমস্যার একটা সুরাহা হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।
জাতিসংঘের মহাসচি বাংলাদেশকে খাদ্যশস্য সাহায্যের জন্য আবেদন জানিয়ে একটি মহানুভবতারই পরিচয় দিয়েছেন। সেই সঙ্গে যেসব দেশ বাংলাদেশের জন্য খাদ্যশস্য এবং খাদ্যদ্রব্য ক্রয়ের জন্য আর্থিক সাহায্যদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তারাও বাংলার মানুষের কৃতজ্ঞতা ভাজন হবেন। আশা করা যায়, স্বাধীনতার অব্যবহিত পর পরই যখন খাদ্যের অভাবে বাংলার মানুষ মরেনি, তখন বঙ্গবন্ধুর জীবন থাকতে বাংলার মানুষ অন্ততঃ দু’মুঠো অন্নের অভাবে আর মরবে না।
কিন্তু বিদেশী সাহায্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকলেই চলবে না। আমাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে এবং সে জন্যে খাদ্যজাত ফসলের উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে হলে সবুজ বিপ্লবের কর্মসূচীকে ফলপ্রসূ করে তুলতে হবে। যেহেতু বাংলাদেশ একটি কৃষি নির্ভর দেশ সেহেতু কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কৃষি সম্প্রদায়কে নিরলস পরিশ্রম করে খাদ্যজাত দ্রব্যের উৎপাদন বাড়ানো একান্ত দরকার। ভিক্ষের ঝুলি নিয়ে দ্বারে দ্বারে ধর্ণা দেয়ার মধ্যে কোন জাতিরই আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি পায় না। কাজেই মাঠে মাঠে সোনালী ফসল ফলিয়ে বাংলার মানুষের ক্ষুধার অন্ন যোগানোর জন্য তৎপর হোন—সোনার বাংলা সোনায় গড়ুন।

যুগোশ্লাভ প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগতম

মার্শাল টিটোর দেশ সমাজতান্ত্রিক যুগোশ্লাভিয়ার প্রধানমন্ত্রী কমরেড বিজেডিক গতকাল রোববার চার দিনের শুভেচ্ছা সফরে সস্ত্রীক রাজধানী ঢাকায় এসে পৌঁছেছেন। আজ সোমবার বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা বার্ষিকী উপলক্ষে যুগোশ্লাভ প্রধানমন্ত্রী মিঃ বিজেডিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করবেন। এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় ও উপমহাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি সহ আন্তর্জাতিক বিষয়াদি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করবেন।
আমরা যুগোশ্লাভিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশের মাটিতে সদর স্বাগতম জানাই। গতকাল তেজগাঁও বিমান বন্দরে এই মহান অতিথিকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সস্ত্রীক স্বাগতম জানিয়েছেন।
পাকিস্তানী বর্বর হানাদার বাহিনীর সঙ্গে আমাদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনাকাল থেকেই যুগোশ্লাভিয়া নির্যাতিত বাঙালী জাতির ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামের প্রতি আন্তরিক সমর্থন জানিয়েছেন এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানকারী দেশগুলোর মধ্যেও যুগোশ্লাভিয়া চতুর্থ স্থানের অধিকারী। জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নেও যুগোশ্লাভিয়া নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়েছে। বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর মিঃ বিজেডিক দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী, যিনি বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী প্রথম একটি বন্ধু রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশ সফর করার গৌরব অর্জন করেন।
যুগোশ্লাভিয়া বাংলাদেশের অকৃত্রিম সমর্থনদানকারী বন্ধু দেশ হিসেবে আমাদের কাছে পরিচিত। এই মহান দেশের মহান অতিথির আগমনে বাংলাদেশ ও যুগোশ্লাভিয়ার মৈত্রী বন্ধন আরো সুদৃঢ় হবে বলেই আমরা বিশ্বাস করি। যুগোশ্লাভ প্রধানমন্ত্রীকে স্বাধীনতার দ্বিতীয় বার্ষিকীতে তাই স্বাগত জানাই। বাংলাদেশের নেতৃবর্গের সঙ্গে যুগোশ্লাভ প্রধানমন্ত্রীর আলোচনা ফলপ্রসূ হোক এবং এই দুই সমাজতান্ত্রিক দেশের বন্ধুত্ব উত্তরোত্তর জোরদার ও অটুট থাক।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!