You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.03.29 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মসমালোচনা | ঢাকা-আলজেরিয়া যুক্ত ইশতেহার | তেল শোধনাগার বন্ধ | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
২৯শে মার্চ, ১৯৭৩, বৃহস্পতিবার, ১৫ই চৈত্র, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ

আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মসমালোচনা

‘স্বাধীন দেশে আজ মানবতার মৃত্যু হয়েছে। ছিনতাই, রাহাজানি, বাড়ী দখল আর অবাধ দুর্নীতির লীলাক্ষেত্র এই বাংলাদেশে দশ জনের স্বীকৃতি অনাচারে, শিক্ষিত সন্তানদের ভূমিকা দেখে লোকে শিউরে উঠছে। তাই এই স্বাধীনতা দিবসে নিজের চেহারাটা আয়নাতে দেখুন।’
গত সোমবার স্বাধীনতার দ্বিতীয় বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে স্থানীয় নজরুল একাডেমী আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক আহমদ উপরোক্ত মন্তব্য করেন।
স্বাধীনতা দিবসকে আত্মসমালোচনার দিন বলে অভিহিত করে তিনি সকলকে বিবেকের সামনে আত্মজিজ্ঞাসায় উপনীত হওয়ার আহ্বান জানান।
স্বাধীনতার দ্বিতীয় বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী জনাব মোশতাক আহমদ সহ অন্যান্যরা যে বক্তব্য পেশ করেছেন তার মূল কথা হলো জীবনের আয়নায় নিজেদের চেহারাটা দেখে নিয়ে অনাগত দিনগুলোর দিকে এগিয়ে যাওয়া।
একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বাংলার মানুষের সামগ্রিক জীবনে যে চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিলো—যে চেতনার আগুনে উদ্দীপ্ত হয়ে বাংলার মানুষ হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রক্তাক্ত সংগ্রাম করেছে, আত্মাহুতি দিয়েছে—সেই চেতনায় যেন ভাটা পড়েছে। দেশের একটি বৃহৎ অংশ যেন নিস্তেজ হয়ে গেছে। ফলে দেশপ্রেমিক মানুষের সমাজ ও দেশের প্রতি তেমন কোন একটা সক্রিয় ও বলিষ্ঠ ভূমিকার লক্ষণগুলো প্রতীয়মান হচ্ছে না। আর এতে করে সমাজবিরোধী দুষ্কৃতিকারীই প্রাধান্য পাচ্ছে অত্যাধিক মাত্রায়। ওদেরই কুকর্মের স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে সমাজের বিভিন্ন খাতে। যারা একদিন দেশের জন্য বলিষ্ঠ হাতে অস্ত্র ধারণ করেছিলো তাদেরই মধ্যে অনেকে সমাজবিরোধী কাজে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। এদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আন্দোলন গড়ে তোলার কোন সর্বাত্মক প্রচেষ্টাই গড়ে উঠছে না। সকলেই বলছেন দুর্নীতি, চোরাচালান, মুনাফাখোরী, মওজুতদারী, খুন, ডাকাতি ও রাহাজানি বন্ধ করতে হবে কিন্তু সমাজবিরোধী তৎপরতা বন্ধ করার জন্য একমাত্র সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েই নিজেদের দায়িত্ব পালন করছেন। সুতরাং সমাজবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত না থেকেও আমরা যে পরোক্ষভাবে ঐসব সমাজবিরোধী কাজই সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি এতে কোন সন্দেহ নেই। অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তাকে তৃণসম দহন যদি না করে তাহলে অন্যায়কারীর মতই সে সমান অপরাধী—এ সত্যকে উপলব্ধি করার মধ্যেই রয়েছে দেশ ও জাতির বৃহত্তর মঙ্গল। তাই আজ জাতির জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন আত্মসমালোচনা ও আত্মজিজ্ঞাসা। যে দু’টো আলোকবর্তিকাকে সমুন্নত রেখে আমরা এগিয়ে যাবো অনাগত ভবিষ্যতের দিকে।

ঢাকা-আলজেরিয়া যুক্ত ইশতেহার

বাংলাদেশের জোটনিরপেক্ষ ভূমিকাকে আলজেরিয়া অভিনন্দিত করেছে এবং সাম্য, সার্বভৌমত্ব ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে আলজেরিয়া বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের আশা প্রকাশ করেছে। ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনার ডঃ এ.আর. মল্লিকের আলজেরিয়া সফর শেষে গত পরশু যুগপৎ ঢাকা-আলজেরিয়া থেকে প্রকাশিত এক যুক্ত ইশতেহারে উপরোক্ত কথা বলা হয়েছে। ডঃ এ.আর. মল্লিক সম্প্রতি এক শুভেচ্ছা মিশনের নেতা হিসেবে আলজেরিয়া সফর করেন। যুক্ত ইশতেহারে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সমস্যাবলী সম্পর্কে উভয়ই পক্ষই অভিমত ব্যক্ত করে। ভ্রাতৃসুলভ সমঝোতা ও একে অপরের নিজস্ব বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার ভিত্তিতে উভয় দেশের বন্ধুত্ব গড়ে উঠবে বলে ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়েছে। দু’পক্ষই বর্তমান বছরের সেপ্টেম্বর মাসে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য জোটনিরপেক্ষ দেশের আসন্ন শীর্ষ সম্মেলনকে স্বাগতম জানিয়েছে। ইশতেহারে দুই দেশই সংগ্রামী আরব জনগণ ও বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের প্রতি বিশেষ করে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে যারা সংগ্রাম করছেন তাদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন।
ঢাকা-আলজিয়ার্স যুক্ত ইশতেহার দেরীতে হলেও আমাদের কাছে এই সত্যই প্রতিভাত করলো যে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো যতোই পাকিস্তানের প্রতি প্রেমে গদগদ হোক না কেন, বাংলাদেশের বাস্তবতাকে তাদের না স্বীকার করে কোন উপায় নেই। কারণ স্বীকৃতির তোয়াক্কা করে বাংলাদেশের জন্ম হয়নি, বাংলাদেশ টিকে থাকার জন্যই জন্ম নিয়েছে এবং বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ টিকে থাকবেই। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বাংলাদেশ সম্পর্কে এতোদিন যে একচক্ষু হরিণের নীতি অনুসরণ করে আসছিলো, ধীরে ধীরে সেই একরৈখিক নীতির পরিবর্তন সূচীত হচ্ছে। ঢাকা-আলজিয়ার্স যুক্ত ইশতেহার সেই পরিবর্তনশীল নীতিরই উজ্জল প্রমাণ। মিসর, সুদান ও লেবাননও বাংলাদেশের বাস্তবতাকে অচিরেই মেনে নেবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। মিসর সহ অন্যান্য আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কে ক্রমশঃ নতুন চিন্তা-চেতনার উন্মেষ ঘটছে।
আমরা আশা করি, উপমহাদেশের শান্তি প্রতিষ্ঠাকল্পে আরব রাষ্ট্রগুলো আর কোন হেরফের দেখাবেন না। উপমহাদেশে বাংলাদেশ শান্তি চায়। অতএব, শান্তিকামী দেশগুলো এ ব্যাপারে বাংলাদেশের বাস্তবতা মেনে নিয়ে শান্তির অন্বেষণে ব্রতী হবেন বলেই আমাদের বিশ্বাস। আলজেরিয়া আজ বাংলাদেশের জোটনিরপেক্ষ ভূমিকাকে অভিনন্দন জানিয়েছে, তাতে আমরা অবাক বা বিস্মিত হইনি। আরব রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না জানানো পর্যন্ত আমরা নিশংসয় হতে পারি না। পাকিস্তানের প্রতি আরব রাষ্ট্রগুলো প্রেমের যে পরাকাষ্ঠা দেখাচ্ছেন, আমরা জানি সেই প্রেমের রজ্জু একদিন না একদিন ছিন্ন হবেই শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই আরব বিশ্বকে বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুত্বের হাত সম্প্রসারিত করতে হবে। শান্তির স্বপক্ষে বাংলাদেশের বক্তব্য সুস্পষ্ট। বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনে আলজেরিয়া যে যুক্ত ইশতেহার প্রকাশ করেছে, তাতে আমাদের মনে এ ধারণারই জন্ম হচ্ছে যে, অন্যান্য আরব রাষ্ট্রগুলোরও চৈতন্যোদয় হবে। আজ হোক, কাল হোক, বাংলাদেশের বাস্তবতাকে তাদের স্বীকার না করে কোন উপায়ন্তর নেই।

তেল শোধনাগার বন্ধ

তাই ঘটেছে যা ঘটবে বলে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা সংশ্লিষ্ট মহলকে বারবার সতর্ক করে দিয়েছিলো। তাদের সতর্ক বাণীতে কোন কাজ হয়নি। অপরিশোধিত তেলের অভাবে দেশের একমাত্র শোধনাগার ইষ্টার্ণ রিফাইনারী গত পরশু বন্ধ হয়ে গেছে। আগামী দশ পনের দিনের মধ্যে আর তা চালু হবার কোন সম্ভাবনা নেই। রিফাইনারীর একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, এপ্রিল মাসের আট ন’ তারিখ নাগাদ আবার এই শোধনাগার চালু হতে পারে। অবশ্য অপরিশোধিত তেল নিয়ে যে জাহাজটির আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে চিটাগাং পৌঁছানোর কথা, তা যদি সঠিক সময়ে বন্দরে নোঙ্গর করে।
এমনিতেই তেলের বাজার বেশ চড়া। এজেন্ট ডিলাররা মুনাফা অর্জনের মহাজনী পন্থা গ্রহণ করার ফলে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিলো। সরকারের ডিলারশীপ জাতীয়করণ এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাবে বলে অনেকেই আশা করেছিলো। কিন্তু হা হতোস্মি! এবার মূল জায়গাতেই ফ্যাকরা। ইষ্টার্ণ রিফাইনারীতে অপরিশোধিত তেলের অভাব ঘটবে এটা রিফাইনারী কর্তৃপক্ষের না জানার কথা নয়। বিভিন্ন সংবাদপত্রেও এ সম্বন্ধে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিলো। কিন্তু ফল হয়নি। যারা উচ্চপদে সমাসীন তারা পরের কথায় কান দেন না। নিজেরা যা বোঝেন তাই করেন। সেটা জনগণের স্বার্থের দিকে চেয়েই হোক আর ব্যবসায়ীদের মুনাফার স্বার্থেই হোক।
রিফাইনারী বন্ধ হয়ে গেছে এই একটা খবরই তেলের বাজারে আগুন ধরিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট। তেল মওজুত করে কেউ রাখেননি এমন কথা বলা যায় না। এই সুযোগটা তাদের হাতে স্বর্গ পৌঁছিয়ে দেবার মতো। টিপে টিপে মাল ছেড়ে মুনাফা গুণতে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন তেলের কারবারীরা। কিন্তু অপরিশোধিত তেলের সরবরাহ যদি ঠিক মতো চলতো তবে এতসব ভাববার কোন অবকাশই থাকতো না। সুযোগ হতো না সাধারণ মানুষের গাঁট কেটে পয়সা লোটার। তাই শোধনাগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লাভ হয়েছে মওজুতদারের, মাথায় হাত পড়েছে ক্রেতার।
আমরা মনে করি শোধনাগারের চাহিদা সম্পর্কে পূর্ব ধারণার অভাব বা অপরিশোধিত তৈল আমদানীর ব্যাপারে আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতা অথবা মওজুতদারদের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হবার ফলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে রিফাইনারী বন্ধ করে দিতে হয়েছে। আমরা যা ভাবতে চাইনা তা হলো ডিলারশীপ বাতিল করে দিয়ে সরকার জনগণের স্বার্থে তৈল সরবরাহ যখন রেশনের মাধ্যমে চালু করার একটা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তখন স্বার্থান্বেষী মহল সরকারের অন্যান্য অনেক প্রগতিশীল পদক্ষেপের মতোই এই পদক্ষেপকেও বানচাল করবার অপচেষ্টায় মেতে উঠেছেন। যাই হোকনা কেন, বিষয়টি তলিয়ে দেখা দরকার।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন