You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
৩০শে মার্চ, ১৯৭৩, শুক্রবার, ১৬ই চৈত্র, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ

উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে?

পাকিস্তানকে ঋণদানকারী বিশ্বব্যাংক কনসোর্টিয়াম এই সেদিন বৈঠকে বসেছিলেন প্যারিসে। পাকিস্তানকে দেয়া এতদিনের ঋণ কি করে উসুল করা যাবে এ ছিলো সেই বৈঠকের আলোচনার মুখ্য বিষয়। আলোচনায় কি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে আমরা জানি না কিন্তু বাংলাদেশের কাঁধে যে সে ঋণের একটা বোঝা চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা চলেছে তা বিভিন্ন সংবাদসূত্রে আমরা লক্ষ্য করেছি। আগামী কাল ঢাকায় বিশ্বের উন্নয়নকামী রাষ্ট্রসমূহকে সাহায্যদানকারী ঊনিশটি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের একটা বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই বৈঠকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ছাড়াও বিশ্বব্যাংক অংশ গ্রহণ করবে।
মুখ্যতঃ বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনাসমূহ পর্যালোচনা করে দেখার কথা জানা গেলেও বিশ্বব্যাংক যে আর এক ধাপ এগিয়ে আসবেন না এমন কথা বলা যায় না। কারণ পাকিস্তানকে ঋণদানকারী কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে যে সকল দেশ জড়িত তাদের অনেকেই ঢাকার অধিবেশনে যোগ দিচ্ছেন। অনুমান করা হচ্ছে যে, প্যারিস বৈঠকে বাংলাদেশের কাঁধে পাকিস্তানের যে ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা বেসরকারীভাবে গ্রহণ করা হয়েছে ঢাকা বৈঠকে তা বাস্তবায়নের নানা কৌশল গৃহীত হবে। যুক্তি হিসাবে নাকি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের খাতে বরাদ্দকৃত ঋণের কথা তোলা হচ্ছে।
এ বিষয়ে স্বাধীনতা উত্তরকালেই শুধু নয়, পাকিস্তান আমলে যখন এই ঋণ প্রদান করা হয় তখনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সুস্পষ্ট বক্তব্য রেখেছিলেন। পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শক্তিকে অর্থসাহায্য দিয়ে জিইয়ে রাখার বিরুদ্ধে তিনি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন ঋণ প্রদানকারী সংস্থা এবং রাষ্ট্রসমূহকে। পূর্ব পাকিস্তানের বরাত দিয়ে যে ঋণ সেদিন সংগ্রহ হয়েছিলো তার কত অংশ অথবা আদৌ তা থেকে কোন অর্থ পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয়িত হচ্ছে কিনা সে বিষয়টা তিনি তদন্ত করে দেখবার আহ্বান জানিয়েছিলেন। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি সেদিন বলেছিলেন যে ঋণ আমাদের জন্য ব্যয় করা হবে না তা শোধ করবার কোন দায়িত্বও স্বাভাবিকভাবে আমাদের উপর বর্তাবে না। এছাড়া তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতো তা থেকেও তাকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিলো। এ সবই যে ঋণদানকারী সংস্থা বা রাষ্ট্রসমূহ জানতেন না তা নয়।
সে যাইহোক, পুরোন কাসুন্দি ঘেটে আজ আর কোন লাভ নেই। নতুন করে আজ যখন আবার পাকিস্তানের ঋণের বোঝা বাংলাদেশের কাঁধে চাপানোর অপচেষ্টা চলেছে তখন আমরা একে নিন্দা না করে পারছি না। বিশ্বব্যাংক তথা আন্তর্জাতিক ঋণদানকারী সংস্থাসমূহের সাহায্য আমাদের প্রয়োজন রয়েছে। এবং আমরা মনে করি তারা সে সাহায্য এবং সহযোগিতা দানে কার্পণ্য করবেন না। কিন্তু একটা ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবেই তাদের জ্ঞান রাখা উচিত যে বাংলাদেশ কোন শর্তযুক্ত ঋণ গ্রহণ করবে না। এটা তার রাষ্ট্রীয় আদর্শেরই পরিপন্থী। কানে আগলা পানি ঢেলে ভিতরের পানি বের করে আনার কৌশল অবশ্যই পরিত্যাগ করতে হবে। একের বোঝা কোন যুক্তিতেই অপরের কাঁধে চাপিয়ে দেয়া চলতে পারে না। আমরা আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের বৈঠককে অভিনন্দন জানাচ্ছি কিন্তু তা যেন একমাত্র বাংলাদেশের উন্নয়ন সংক্রান্ত বিষয়েই সীমাবদ্ধ থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে আহ্বান জানাচ্ছি।

লেবাননের স্বীকৃতি

গত পরশুদিন লেবানন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। লেবাননের এ কূটনৈতিক স্বীকৃতির ঘটনা বেশ খানিকটা স্বাতন্ত্র্যের দাবী রাখে। আরব রাষ্ট্রের বিভিন্ন দেশগুলো যখন বিশ্বের মুসলিম দেশের সঙ্গে একত্রিত হয়ে পাকিস্তানের ও পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে নির্লজ্জ ওকালতি করছে তখন লেবানন তার বিপ্লপাত্মক সিদ্ধান্ত দ্বারা বাংলাদেশের স্বীকৃতির মাধ্যমে প্রগতিশীল রাজনৈতিক চিন্তাধারার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। উল্লেখযোগ্য, সম্প্রতি তথাকথিত ইসলামিক সম্মেলনের নামে বেনগাজীতে অধিবেশন বসেছিলো। এতে বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশ যোগদান করেছিলো। জানা গেছে উক্ত সম্মেলনে বাংলাদেশে বন্দী পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদেরকে বিনা বিচারে ছেড়ে দেবার জন্যে ভারত সরকার ও জাতিসংঘের মহাসচিবের নিকট এক প্রস্তাব করা হয়েছে। ঠিক সেই মুহূর্তে লেবানন বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দান করেছে। এবং এ কারণেই লেবাননের এই প্রগতিশীল সিদ্ধান্ত আরব বিশ্বের ইতিহাসে একটি বৈপ্লবিক ঘটনা। এক কথায় মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি এতোকাল বেশ পশ্চাৎমুখীনতার পরিচয় বহন করে এসেছে। বিশ্বের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে তারা যেন নিজেদেরকে একাত্ম করে নিতে পারেনি। কুসংস্কার ও চিরাচরিত ট্রাডিশনের দ্বারা তারা পরিচালিত হয়ে আসছে। অথচ বিশ্বে এতোদিন বহু বড় বড় গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন সমাপ্ত হয়ে গেছে। যার প্রতিক্রিয়া বিশ্বের মানবজাতির উপর একটা বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছে। মানুষের রাজনৈতিক-সামাজিক জীবনে পরিবর্তন এনেছে। মানবতাবাদের এক অপূর্ব স্ফুরণ আজ সুপ্রকাশিত। ঠিক এমন এক বিবর্তনের কালেও আরব দুনিয়ায় তেমন উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তন এতোদিন লক্ষ্য করা যায়নি। তাই ইতিপূর্বে বাংলাদেশকে ইরাকের ও গত পরশুদিন লেবাননের স্বীকৃতি দান এক ঐতিহাসিক ঘটনা। এই স্বীকৃতি দানের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই আজ বিশ্বের মানবতাবাদী জাতিগোষ্ঠী আরব জগতে একটি প্রগতিশীল চেতনার উন্মেষ লক্ষ্য করতে পারছে। বাংলাদেশ একটি বাস্তব ঘটনা আজ। বিশ্বের একশতটি দেশ বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিয়েছে। বিশ্বের ইতিহাসের এক বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী নেতা জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ সম্পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা ও গতিবেগ লাভ করেছে। এদেশের বাস্তবতা আজ আর কারো দয়ার উপর নির্ভরশীল নয়। তবু আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশসমূহকে আমরা আহ্বান জানাবো বাংলাদেশের বাস্তবতাকে মেনে নেবার জন্যে। আমরা সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে লেবাননের সরকার ও জনগণকে কৃতজ্ঞতা জানাই আমাদের প্রতি তাদের স্বীকৃতির জন্যে।

নকল বিরোধী অভিযান

বাংলাদেশ ছাত্রলীগসহ অন্যান্য ছাত্র প্রতিষ্ঠান একত্রিশে মার্চ থেকে সারাদেশব্যাপী নকল প্রতিরোধ দিবস পালনের কর্মসূচী নিয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। নকল প্রতিরোধ দিবসের কর্মসূচীর মধ্যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছাত্র সভা, শোভা যাত্রা, দেয়াল পত্র, ও প্রচার পত্র বিলি করা হবে। তারা এই কর্মসূচীকে সফল করে তোলার জন্য দলমত নির্বিশেষে সকল ছাত্র-ছাত্রী ভাইবোনদেরকে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানিয়েছে। আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা ক্রটিপূর্ণ থাকায় যেমন ‘মানুষ’ সৃষ্টির পরিবর্তে কেরানী সৃষ্টির পথই ছিলো সুগম, তেমনি সেই শিক্ষা ব্যবস্থার দরুণই নকল প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে একথা বুদ্ধিজীবী, চিন্তাবিদ, ছাত্র সমাজ সবাই বিভিন্ন আলোচনা সভা সেমিনার ইত্যাদিতে প্রকাশ করেছেন। এবং সে জন্য তাঁরা শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধনের জোর দাবী জানিয়েছেন এবং সুপারিশ করেছেন।
শীঘ্রই সরকার গঠিত শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ পাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। নতুন শিক্ষা ব্যবস্থায় এবং পরীক্ষা পদ্ধতিতে নকলের কোন সুযোগই থাকবে না বলে সবাই আশা করছেন। প্রচলিত ক্রুটিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থা, পরীক্ষা পদ্ধতি এবং ছাত্র সমাজের পরিবর্তিত মানসিকতার দরুণ স্বাধীনতা উত্তরকালে আমাদের দেশে অনুষ্ঠিত প্রতিটি পরীক্ষায় যে ব্যাপক হারে নকল (গণটুকাটুকি) চলছিলো তাতে বুদ্ধিজীবী নেতৃবর্গ, চিন্তাবিদ ও সুখী সমাজ সকলেই বিশেষ চিন্তান্বিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন। বিদেশেও এর প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে এবং ফলে বিদেশের কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয় সাম্প্রতিক কালে অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ডিগ্রীধারীদের ডিগ্রীকে মেনে নেবার কথা অস্বীকার করেছে। এর চেয়ে লজ্জার এবং দুঃখজনক আর কিছু থাকতে পারে না। আর তাই প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির এই অধঃপাতের জন্য গভীর উদ্বেগ এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং যে কোন উপায়ে নকল প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নকলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য ছাত্র সমাজ ও অভিভাবকের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন। আশার কথা প্রধানমন্ত্রীর ডাকে ছাত্র নেতৃবর্গ তথা গোটা ছাত্র সমাজ সাড়া দিতে শুরু করেছেন। আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে আশা পোষণ করি বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলন এবং সংগ্রামে যেমন ছাত্র সমাজ সাফল্য অর্জন করেছেন, তেমনি এই নকল প্রতিরোধের আন্দোলনেও তাঁরা সফল হবে।
সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত বিশ্বের কনিষ্ঠতম সার্বভৌম রাষ্ট্র বিধ্বস্ত বাংলাদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা প্রকৃত জ্ঞানের কষ্টিপাথরে পরীক্ষিত হয়ে এদেশকে সুখী সমৃদ্ধিশালী আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলে এই দেশকে পৃথিবীর বুকে একটি বিশিষ্ট স্থানে অধিষ্ঠিত করবো, নকল প্রতিরোধ দিবসে এটাই হোক আমাদের সকলের বলিষ্ঠ শপথ।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!