You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
৩১শে মার্চ, ১৯৭৩, শনিবার, ১৭ই চৈত্র, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ

মার্কিন সৈন্যমুক্ত ভিয়েতনাম

ভিয়েতনামের মাটিতে আর কোন মার্কিন সৈন্য নেই। ভিয়েতনাম এখন মার্কিন সৈন্যমুক্ত। গত ২৯শে মার্চ মার্কিন যুদ্ধবন্দীদের সর্বশেষ দলটি হ্যানয় থেকে বিমানযোগে ফিলিপাইন যাত্রা করে এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামের মার্কিন বাহিনীর প্রধান সেনাপতি ফ্রেডারিক গুয়েন্টও বিমানযোগে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে হ্যানয় ত্যাগ করেছেন বলে খবরে জানা গেছে।
সুদীর্ঘ একযুগ ধরে মার্কিন সৈন্যরা ভিয়েতনামের মাটিতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে ভিয়েতনামের গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে পুরিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। নির্বিচারে নাপাম বোমা বর্ষন করে ভিয়েতনামের জনজীবনে এক কালো অধ্যায়ের সূচনা করেছিলো। ভিয়েতনাম মার্কিন সৈন্য মুক্ত হওয়াতে সর্বনাশা যুদ্ধোন্মাদ পরিস্থিতিরই শুধু অবসান হলো না, ইতিহাসের পাতায় সূচিত হলো একটি নতুন অধ্যায়। মার্কিন সৈন্য ভিয়েতনামের বুকে যে ভয়াবহ যুদ্ধ পরিচালনা করেছে, তাতে ভিয়েতনামের সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে এসেছে এক কালো অধ্যায়। এই বিধ্বংসী যুদ্ধের মাশুল হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিপুল পরিমাণ অর্থের অপচয় করতে হয়েছে। মার্কিন সৈন্যরা নিহত এবং আহতও হয়েছে দেদার। ভিয়েতনাম থেকে মার্কিন সৈন্যরা পাততাড়ি গুটানোর সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন জনগণ আত্মসমর্পণের গ্লানিকর অবমাননার হাত থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট নিক্সন নিজেই স্বীকার করেছেন যে, শান্তি চুক্তি সম্পাদন ছাড়া মার্কিনীদের কোন উপায় নেই। এই শান্তি চুক্তির শর্ত অনুযায়ীই ভিয়েতনাম থেকে মার্কিন শেষ সৈন্যটিও স্বদেশের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছে।
পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামে যে বিপুল পরিমাণ অত্যাধুনিক সামরিক অস্ত্র সম্ভার, সৈন্য, অর্থ ও রসদের অপচয় করেছে তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও অপব্যয়িত হয়নি। প্যারিস শান্তি চুক্তি ইন্দোচীনের এই অঞ্চলকে ঔপনিবেশিকতাবাদী দখলকার মার্কিন সৈন্যের রাহুগ্রাস থেকে রক্ষা করেছে। এবং এতে ভিয়েতনামের স্বাধীনতাকামী জনগণেরই বিজয় সূচিত হয়েছে।
মার্কিন সৈন্যরা ভিয়েতনামের মাটি ছেড়ে চলে গেছে ; কিন্তু ভিয়েতনামের সামাজিক জীবনে রেখে গেছে এক দুঃসহ যাতনা ও অভিশাপ। ১৯৬১ সালের পরবর্তী দিনগুলোতে ভিয়েতনামে মার্কিনী সৈন্যরা পাপ ও ব্যভিচারের স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলেছিলো।
ভিয়েতনাম থেকে সমুদয় মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহৃত হলো ঠিকই কিন্তু মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মিঃ রিচার্ডসন ওয়াশিংটনে ঘোষণা করেছেন যে, মার্কিন সৈন্য দক্ষিণ ভিয়েতনাম থেকে প্রত্যাহার করা হলেও এশিয়ায় মার্কিন সৈন্য বহাল রাখা হবে। রেডিও জাপান থেকে এই খবর প্রচার করা হয়েছে।
মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মিঃ রিচার্ডসনের এই ঘোষণা থেকে এ কথাই সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে নিজের আধিপত্য কিছুতেই খর্ব করতে রাজী নয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মার্কিনী প্রাধান্য অব্যাহত রাখার জন্যই এশিয়ায় সৈন্য বহাল রাখার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। সুদীর্ঘ দেড় শতাব্দী কাল ধরে ভিয়েতনামের বুকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে অন্ধকার যুগের সূচনা করেছিলো, ভিয়েতনাম থেকে শেষ সৈন্যটি পর্যন্ত প্রত্যাহার করে সেখানে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা দেখা গেলেও এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রাধান্য বিস্তার করে রাখতেই আগ্রহী। কিন্তু শান্তিকামী জনগণ কি এশিয়ার বুকে মার্কিনী আধিপত্য বরদাস্ত করবে? দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শান্তিকামী জনগণ কি মার্কিনী আধিপত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে না?
আমাদের বিশ্বাস, মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মিঃ রিচার্ডসনের এই আস্ফালনের সমুচিত জবাব দানের জন্য এশিয়ার মানুষ দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবে। এবং ভিয়েতনাম থেকে যেমন করে মার্কিন সৈন্যদের প্রত্যাহার করা হয়েছে, ঠিক তেমনি ভাবেই এশিয়ার বুক থেকেও মার্কিনী সৈন্যদের পাততাড়ি গুটাতে হবে। এশিয়ার জনগণও নিজ নিজ মর্যাদা নিয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে চায়। কাজেই এশিয়াবাসীদের উপর মার্কিনী প্রাধান্য ইতিহাসের অমোঘ নিয়মেই ভন্ডুল হয়ে যাবে। ভিয়েতনামের গ্লানি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে শিক্ষা নেয়া উচিত বলেই আমরা বিশ্বাস করি।

বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী

শিল্পমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম গত পরশু বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা বার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সমিতি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী কোন সুবিধাবাদ, স্বার্থবোধ বা সংকীর্ণতার উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। মিথ্যে প্রচারণার মাধ্যমে এই মৈত্রী বন্ধনে ফাটল ধরানো সম্ভব নয়। তিনি আরো বলেছেন বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠাকল্পে এবং উপমহাদেশে উত্তেজনা প্রশমিত করার জন্যে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীর গভীর তাৎপর্য রয়েছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত শ্রী সুবিমল দত্ত এই একই অনুষ্ঠানে বলেছেন, ভারত ও বাংলাদেশের বন্ধুত্বে সহেন্দের বীজ বপন করার জন্য একটি চক্রান্তকারী গোষ্ঠী প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু আমাদের বন্ধুত্ব শিথিল করার প্রয়াস নিরর্থক। কারণ এই বন্ধুত্ব কোন ব্যক্তি বিশেষের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। এই দু’দেশের বন্ধুত্বের বন্ধন সহজ ও স্বাভাবিক।
একটি প্রতিক্রিয়াশীল স্বাধীনতা বিরোধী চক্র বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুত্ব সুনজরে দেখছে না বরং এই বন্ধুত্বের বন্ধনকে শিথিল করার জন্য নানারকম কারসাজি করে বেড়াচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের শিল্পমন্ত্রী এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত বন্ধুত্ব বিরোধী চক্রকে সুস্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন যে, বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী বন্ধনকে কিছুতেই শিথিল করা যাবে না। এ বন্ধুত্ব পরীক্ষিত সত্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তাল দিনগুলোতে ভারত মুক্ত হস্তে বাংলাদেশের সাহায্যকল্পে এগিয়ে এসেছিলো এবং নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে হানাদার পাক বাহিনীর মোকাবেলা করেছিলো। স্বাধীনতার পরও বাংলাদেশের প্রতি ভারতীয় সাহায্য ও সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে। কাজেই যে কুচক্রী মহল এই বন্ধুত্বের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতারও বিরোধিতা করছে বলে আমাদের বিশ্বাস।
পারস্পরিক মর্যাদার ভিত্তিতে বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুত্ব আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। এই বন্ধুত্ব বিপন্নের কোন চেষ্টাই তাই বাংলার সাধারণ মানুষ মাথা পেতে মেনে নেবে না। কারণ, বাংলার মানুষ এই সহজ সত্যটি অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছে যে, বিপদে যে পাশে এসে দাঁড়ায়, সে-ই-ই সত্যিকার বন্ধু। বাংলার চরম দুর্দিনে ভারত আমাদের পাশে এসে পরম বন্ধুর মতো দাঁড়িয়েছিলো। সে জন্যেই এই প্রতিবেশী দুই মিত্র রাষ্ট্রের বন্ধুত্ব চির অমলিন থাকবে। চক্রান্তকারীদের চক্রান্ত খড় কুটোর মতো ভেসে যাবে। বাংলাদেশের মাটিতে ষড়যন্ত্রকারীদের কোন স্থান নেই সেই কথাটি তাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।

বল মা তারা দাঁড়াই কোথা?
সংবাদটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ঘটনাস্থল হলো রাজশাহী। সংবাদে প্রকাশ, রাজশাহী কলেজ ও চাঁপাই নবাবগঞ্জ কেন্দ্রের স্নাতক পরীক্ষার্থীরা “নকল করতে দিতে হবে, নয়তো আমরা হল ছেড়ে চলে যাবো” বলে দাবি জানান। শুধু তাই নয় বাস্তবেও তাই করেছেন। নকল করার সুযোগ না পেয়ে তারা পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে আসেন। গত ২৮শে মার্চ এ ঘটনাটি ঘটে।
ঘটনা সম্পর্কে রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কন্ট্রোলার এই প্রসঙ্গে জানিয়েছেন যে, প্রথম দিন সুস্থ পরিবেশেই পরীক্ষা চলছিল। কিন্তু দ্বিতীয় দিনেও নকল করার সুযোগ না পেয়ে কতিপয় ছাত্র উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং পরীক্ষার হল বর্জন করে। এতেও তাদের হলো না। তারা জোর করে অন্যান্য পরীক্ষার্থীদের হলের বাইরে নিয়ে আসে, তাদের খাতায় ও প্রশ্নপত্রে আগুন ধরিয়ে দেয়। উপরন্তু পরীক্ষা হলের দরজা-জানালায় ইট-পাটকেল ছুড়ে আসবাবপত্র ভেঙ্গে ফেলে। নিরুপায় হয়ে অন্যান্য পরীক্ষার্থীরাও হল ছেড়ে চলে যায়।
রাজশাহী কলেজ ও চাঁপাই নবাবগঞ্জ কেন্দ্রের স্নাতক পরীক্ষার্থীরা নকলের দাবীতে যা করলেন তার তুলনা নেই। এরপর যদি কেউ বলে যে, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, খুন, চোরাচালান, মজুতদারী ও অবাধ মুনাফা অর্জনের দাবী মেনে নিতে হবে তাহলেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
ভাবতে অবাক লাগে বাংলাদেশ একটা রক্তাক্ত বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পর আমাদের ছাত্র ভাইদের মন ও মানসিকতা কোন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের সংগ্রামী ছাত্র সমাজের একটা ঐতিহ্য রয়েছে। পাকিস্তানী আমলের দীর্ঘ চব্বিশ বছর ছাত্রসমাজ অন্যায়, অসত্য, অত্যাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। অথচ সেই ছাত্র সমাজেরই একটি অংশ যখন অন্যায় ও অসঙ্গত দাবীদাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পরীক্ষার হল বজন করে, পরীক্ষা খাতায় আগুন লাগায়, শিক্ষক-শিক্ষিকাকে অপমান করে তখন বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয়। সব কিছু দেখে শুনেই বলতে হয়, বল মা তারা দাঁড়াই কোথায় ? যারা দেশের ভবিষ্যত, জাতির ভবিষ্যত তাদের অধঃপতকে রুখতে না পারলে জাতীয় জীবনে যে ভয়াবহ দূর্যোগের ঘনঘটা নেমে আসবে এতে কোন সন্দেহ নেই।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!