You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: সোমবার ২৯শে মাঘ, ১৩৭৯ ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩

গণতন্ত্রে জনগণের অধিকার ও দায়িত্ব

গত পরশু গণভবনে অনুষ্ঠিত ডেপুটি কমিশনার এবং পুলিশ সুপারদের এক সম্মেলনের উদ্বোধন করতে গিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে তাদের অনলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের মধ্যে কোনো বৈষম্য সৃষ্টি না করে সরকারি কর্মচারীদের উচিত জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও রাজনৈতিক চেতনার প্রতিফলন ও সক্রিয় সহযোগিতা প্রদান করা। এ উদ্দেশ্যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিকী কারণ এবং শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ সৃষ্টিতে তাদের নিজ নিজ দায়িত্বের কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে। গণতন্ত্রের মানসপুত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন জনসাধারণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত করে ছিলেন। কোনো ভয়-ভীতি, নির্যাতন তাঁকে এই মহান ব্রত থেকে এতটুকু বিচ্যুত করতে পারেনি। স্বাধীনতা-উত্তরকালে তাই তিনি অর্জিত গণতান্ত্রিক অধিকার সংরক্ষণ এবং রীতি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এর পূর্ণ বিকাশে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যুদ্ধরতনানা জটিল সমস্যার মধ্যেও তিনি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা প্রণীত সেই শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে সদ্য স্বাধীন দেশের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কর্মসূচী গ্রহণ করেন। সেই আকাঙ্খিত নির্বাচন অনুষ্ঠানের আর মাত্র তেইশ দিন বাকী। দলমত নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে অনুষ্ঠিতব্য এই প্রথম সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন।
সকল মতালম্বী নির্বাচনে অংশগ্রহণে (অস্পষ্ট) গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশে যতটুকু আশান্বিত হওয়া যায় কিছু কিছু রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গণতন্ত্রবিরোধী আচরণ জনগণকে তেমনি আশঙ্কিত করে তোলে। নির্বাচনে অংশ গ্রহণের পরও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্বন্ধে প্রকাশ্যে অনাস্থা প্রকাশ, কথায় কথায় অস্ত্রের হুমকি প্রদান এবং অন্ধকারে লুকায়িত থেকে সুযোগ বুঝে আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল বৃত্তাকার নানা ঘটনা জনগণকে গণতন্ত্রের স্বাভাবিক বিকাশ সম্বন্ধে ক্ষণিকের জন্য হলেও যে সংশয়াকুল করে তোলে এটা অস্বীকার করা যাবে না।
আরো রয়েছে পাকিস্তান আমলের প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী বিশেষ। সুযোগ বুঝে তারা আশ্রয় নিয়েছে বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে। সাম্প্রদায়িকতার বীজ ছড়িয়ে তারা নির্বাচনের পূর্বে জনগণের মধ্যে একটা উত্তেজনার সৃষ্টি করতে চায়। চায় মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পরম সহৃদয় হয়ে যারা সহযোগিতার হস্ত সম্প্রসারিত করেছিল সেই মহান বন্ধুরাষ্ট্র ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে জনমনকে বিনষ্ট করে তুলতে। সরকারের সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি বানচাল করে দেবার অপচেষ্টায় তারা শ্রমিককে শ্রমিকের বিভেদ, কলকারখানায় অচলাবস্থা এবং প্রতিক্রিয়াশীল আমলা ও অসৎ ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা ও জনগণের জন্য দেয়া সুযোগ-সুবিধা নস্যাৎ করে দিতে সচেষ্ট।
বঙ্গবন্ধু নিজেও বলেছেন, গণতন্ত্রে জনগণের যেমন একটা অধিকার থাকে তেমনি তাদের কিছু দায়-দায়িত্ব মেনে চলতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক বিরোধী দলের মধ্যেই অধিকার এবং দায়-দায়িত্ব বোধ এদু’টোরই অভাব পরিলক্ষিত হয়ে আসছে। গণতন্ত্রের প্রাথমিক নীতিমালা মেনে চলতে তারা নারাজ জাতীয় রাজনীতিতে তাই প্রশ্রয় পেয়ে চলেছে কুষলতা, গুন্ডামি, নৈরাজ্য এবং সন্ত্রাস। এ সম্বন্ধে সময় থাকতেই তাই সর্তকতা অবলম্বন এর প্রয়োজন রয়েছে। প্রয়োজন রয়েছে গণতন্ত্রের স্বাভাবিক বিকাশের পথে বাধা সৃষ্টিকারী এই সকল জঞ্জাল-আবর্জনা ঝেড়ে মুছে ফেলার। সরকার ও প্রশাসনের সঙ্গে তাই সহযোগিতার হাত প্রসারিত করতে হবে গণতন্ত্রমনা প্রগতিশীল সকল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকেও। বহু সংগ্রাম ও রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ বহুদিনের আকাঙ্ক্ষিত গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা আজ প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। সেই স্বর্ণোজ্জ্বল পথে যাতে করে কোন প্রকার অন্তরায় সৃষ্টি হতে না পারে জনগণের স্বার্থেই সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখার প্রয়োজন রয়েছে। গণতন্ত্র ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী রাজনৈতিকদের মধ্যে কোন বৈষম্য সৃষ্ট সমর্থন করে না যেমন করেনা বিরোধিতার আবরণে উচ্ছৃংখলতা ও সমাজদ্রোহীতাকে। গণতন্ত্রের বিকাশকে তাই গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল হয়েই ত্বরান্বিত করা সম্ভব। আর বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সাফল্য এর উপরই নির্ভরশীল।

তারা একদিনের বেতন দেবেন

খবরে প্রকাশ, বঙ্গবন্ধুর নির্বাচনী প্রচারের জন্য তেজগাঁর শ্রমিকরা তাদের একদিনের বেতন প্রদান করবেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আগামী সাধারণ নির্বাচনে উত্তরাঞ্চল থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন লাভ করেছেন। তেজগাঁ শিল্পাঞ্চল এর শ্রমিকদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। ‘৬৬-এর ৬-দফা আন্দোলনে অত্র এলাকার শ্রমিক সমাজ সংগ্রামী প্রত্যয় নিয়ে বঙ্গবন্ধু পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। পরবর্তী কালের রক্তক্ষরা দিনগুলোতেও শ্রমিক সমাজ ছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সংগ্রামের অগ্রসেনা।
সত্তুরের নির্বাচনে তেজগাঁর শ্রমিক সমাজের প্রতি তার আন্তরিক সম্পর্কের নিদর্শন হিসেবে তিনি উক্ত এলাকা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং অভূতপূর্ব সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করেন। বলা বাহুল্য তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা ক্যারিজ আমানত রক্ষা করতে পারেননি। এবারও তিনি প্রার্থী হয়েছেন সেই একই এলাকা থেকে। তেজগাঁর শ্রমিক সমাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। হৃদয়ের অর্ঘ দিয়ে তারা বরণ করে নিয়েছে তাদের সুখ দুঃখ ও সংগ্রামের মহান সাথেই বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধু শুধু তাদের নয় সারা বাংলাদেশে সাড়ে সাতকোটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রার মহানায়ক। তিনি দিশারী পথ দেখাবেন দারিদ্রের কষাঘাতে মূক হয়ে যাওয়া প্রতিটি মানুষকে। তার পদক্ষেপে প্রত্যয় আর পরামর্শে শোষিত বাংলা ফিরে পাবে তার গৌরবাসন। বলা যেতে পারে চলার মত ন্যূনতম প্রয়োজনকে সামনে রেখেই বাংলার মেহেনতি মানুষ আজ একত্রিত হয়েছে সেই সংগ্রামী মহানায়ক এর পিছনে।
তেজগাঁর শ্রমিক সমাজের এই উদ্যোগ বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রমজীবি মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন ও আন্তরিকতারই বহিঃপ্রকাশ। তেজগাঁর এই সংগ্রামী শ্রমিকেরা বাংলাদেশের মহান শ্রমজীবী মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। প্রতিনিধিত্ব করেছেন সারাবাংলা শোষিত বঞ্চিত মানুষের। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাদের শ্রদ্ধা এবং আস্থা শুধু তাদের এই গান দিয়েই পরিমাপ করা যায় না। প্রয়োজনে যে তারা এর চাইতেই অনেক বেশী, এমনকি জীবন দিয়েও বঙ্গবন্ধু প্রচেষ্টা ও আদর্শকে বাস্তবায়িত করবেন তা আমরা জানি। আমরা জানি অতীতে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী সাথী হিসেবে তারা অনেক রক্ত দিয়েছেন, অনেক সংসার জালিমদের কোপানলে পড়ে ছাড়খার হয়ে গেছে। কিন্তু তবুও আদর্শ আর প্রত্যয়ের প্রশ্নে তারা মাথা নত করেনি। মাথা নত করবেনা ভবিষ্যতেও। কুচক্রীদের চক্রান্তজাল ছিন্ন করে বাংলার মেহেনতি মানুষই একদিন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন কৃষকরাজ-শ্রমিকরাজ প্রতিষ্ঠা করবেন। সেই দৃঢ় আশ্বাস নিয়ে তেঁজগা শ্রমিকদের আমরা সংগ্রামী অভিনন্দন জানাই। অভিনন্দন জানাই তাদের রাজনৈতিক চেতনাকে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!