You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.02.14 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | নেতায়-জনতার কথা হবে | আবার দাম বেড়েছে | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: মঙ্গলবার ১লা ফাল্গুন, ১৩৭৯ ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩

নেতায়-জনতার কথা হবে

বঙ্গবন্ধু দু’দিনের জন্য গণসংযোগ সফরে বেরিয়েছে। এই দু’দিনে তিনি টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ এবং নেত্রকোনার বিভিন্ন জনসভায় ভাষণ দেবেন। স্বাধীনতাউত্তরকালে বিরামহীন কাজের ফাঁকে যখুনি একটু সময় করে নিতে পেরেছেন তিনি তাঁর প্রিয় ‘ভাইদের’ সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত করার জন্য, তাদের অভাব-অভিযোগ স্বকর্ণে শোনার জন্য ছুটে গিয়েছেন বাংলার প্রত্যন্ত প্রান্তরে। বাংলার সর্বহারা মানুষ যে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর আস্থা তাঁর উপর অর্পণ করেছে তারই আন্তরিক আহবানে সাড়া দিয়ে তিনি বুক মিলিয়েছেন, উষ্ণতা অনুভব করেছেন গ্রামগঞ্জের সেই সর্বত্যাগী মানুষদের।
এবারও তিনি বেরিয়েছে। যুদ্ধত্তোর বাংলার বিধ্বস্ত রূপ তাঁকে হয়তো ক্ষণিকের জন্য অনুভূতিপ্রবণ করে তুলবে যে মা তার শিশু হারিয়েছে, যে নারী তার সর্বস্ব খুইয়ে বসেছে তাদের অশ্রু ভেজা মুখ যে ভয়াবহ অতীতের রূপছায়া তুলে ধরবে তাকে শুধু সহানুভূতির পরশ দিয়ে মুছে দেয়া যাবেনা; যাবে না অলৌকিক শক্তি বলে দূর অতীতের সুখোজ্জ্বল মুহূর্তকে ফিরিয়ে আনা। পাশাপাশি তিনি দেখবেন হাল-জোয়াল হারানো কৃষক আবার নতুন উদ্যমে ক্ষেতে চাষাবাদ শুরু করেছে, ধ্বংসপ্রাপ্ত কারখানায় আবার সিটি ফুকিয়ে সকালের কাজ শুরু করেছে, দেখবেন হাতে হাতে জনে জনে দেশের পুনর্গঠন কাজে নিয়োজিত অসংখ্য মেহনতী মানুষকে। শোকার্ত অতীত আর কর্মচঞ্চল বর্তমান তাঁর মনে ভবিষ্যৎ বাংলা সমৃদ্ধি আনয়নের সুস্পষ্ট ছবি তুলে ধরবে। ছেলে হারানো মা আর সর্বস্ব খুইয়ে বসা নারীকে তিনি দেখে দেখাতে পারবেন স্বর্ণোজ্জ্বল ভবিষ্যতে সোপান শ্রেণি, ঐ সেই নতুন দিন আসছে-আমরা সব্বাই যার জন্য বছরের পর বছর চরম অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করেছি, হারিয়েছি আত্মজন, সহায়-সম্পদ সর্বস্ব।
সেদিন আসছে। ডাক শুনেছে বাংলার মানুষ। সামনে জনরায় ঘোষণার মাহেন্দ্রক্ষণ। আমরা সমৃদ্ধি চাই, শান্তি চাই, না উশৃংখলতা আর রক্তপাতের দিকে দেশকে ঠেলে দিতে চাই। আগামী নির্বাচনে জনগণ শান্তি ও সমৃদ্ধির স্বপক্ষে রায় দেবে, রায় দেবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জাতীয় অগ্রগতি সাধন এর স্বপক্ষে। স্বাধীনতা আমাদের অধিকার কে ফিরিয়ে দিয়েছে। অধিকতর দায়িত্ব সচেতন হয়ে আমরা সেই দায়িত্ব পালন করব। যে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য কে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধু একদিন ডাক দিয়েছিলেন এই ঔপনিবেশিক নিগড় কে ভাঙতে হবে, চলার পথকে করতে হবে কন্টকহীন, আমরা সেই আহবানে সাড়া দিয়ে লড়াইয়ে নেমেছিলাম। আজ সেই উপনিবেশিক শাসনের অবসান হয়েছে। তাই আজ মূল লক্ষ্য পথে আমাদের যাত্রা।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সেই যাত্রা পথে অগ্রসেনা। আর বঙ্গবন্ধু আমাদের দিশারী। দু’দিনের গণসংযোগ সফরে তিনি গ্রামগঞ্জের মানুষকে পথ নির্দেশ দেবেন। সেই পথ আমাদের সার্বিক মুক্তির পথ। এ পথ-যাত্রায় চক্রান্তকারী আর ষড়যন্ত্রকারীদের নানা চক্রান্ত হয়তো ক্ষণিকের জন্য হলেও একটা ক্ষুদ্রতর গোষ্ঠীর মধ্যে বিভ্রান্তি আসতে পারে কিন্তু তা আমাদের চলার পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারবে না। জনগণের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা আর স্নেহাশীষকে পাথেয় করে আওয়ামী লীগ তার মূল লক্ষ্যপথে এগিয়ে যাবে। স্বাধীনতার সুবর্ণ ফসল গিয়ে পৌঁছবে গ্রাম-বাংলার ঘরে ঘরে। সেই আকাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছবে পথ-নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছে গ্রামগঞ্জের মানুষ আমরা কৃষক-শ্রমিক সর্বস্তরের জনসাধারণ।

আবার দাম বেড়েছে

বাজারে কেরোসিনের মূল্য আবার বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃদ্ধি পেয়েছে সিগারেট ও অন্যান্য কয়েকটি জিনিসের মূল্যও। জানা গেছে এ সকল জিনিস নাকি বাজারে রয়েছে তবুও মূল্য বেড়েই চলেছে। ঢাকা সহ দেশের প্রায় সর্বত্রই কেরোসিন তেলের দাম বেড়েছে। সিগারেটের দাম বেশ কিছুদিন পূর্ব থেকেই বেড়ে রয়েছে। দেশে বর্তমানে সকল জিনিসের দাম কম বেশি বেড়েছে। মানুষের জীবন আজ দীর্ঘদিন ধরে জিনিসপত্রের অগ্রিমমূল্য নিদারুণভাবে জর্জরিত। আজ দেশের সর্ব প্রধান সমস্যা হলো জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি। এদেশের সাধারন মানুষের মনে হাজারো চাহিদা নেই। বাংলার মানুষ সামান্যতেই খুশি হয়। এটা বাঙালি জাতির একটা প্রকৃতিগত স্বভাব। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য যদি তাদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকে তাহলেই তারা খুশী। বেশি আদর্শ বা নীতির কথায় এরা খুশি হয় না। বাংলাদেশের প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। এসবের যদি কোনদিন সত্যিকার অর্থে স্বদব্যবহার হয় তাহলে একদিকে লাভবান হবে যেমন জাতি তেমনি লাভবান হবে এদেশের কৃষককূল।
জিনিসপত্রের যখন মূল্য বৃদ্ধি পায় তখন সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ। যাদের ক্রয় ক্ষমতা নিতান্তই কম। যাদের জীবন ব্যবস্থা সাধারণ নিয়মে আর্বতিত। আর এরাই দেশের শতকরা পঁচাশি ভাগ। দেশে আজ কেরোসিনের দাম বেড়েছে ধান চালের দাম আশি-পঁচাশি টাকা মণের নিচে নামেনি, অন্যান্য আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্রের দাম একই হারে বেড়ে রয়েছে। মানুষের আয়ের ক্ষমতা অত্যন্ত স্বল্প। দেশের ধান ও পাট ছাড়া অন্যান্য ফসল নানা প্রতিকূল কারণে উল্লেখযোগ্যভাবে উৎপাদিত হয়নি। এমনতো অবস্থায় জিনিসপত্রের অধিক অগ্নি মূল্য দেশের সাধারণ মানুষকে দিনদিন নৈরাশ্যের দিকে টেনে নিচ্ছে। আমরা লক্ষ্য করেছি-জিনিসপত্রের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে সরকার বারবার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। আন্তরিকতা ও দেখিয়েছেন। কিন্তু কোন অশুভ শক্তি যেন বারবার সেই পদক্ষেপকে বাধা দিয়ে চলেছে। কেরোসিন তেল বর্তমানে বাজারে রয়েছে বলে জানা যায় অথচ এর মূল্য বারবার উঠানামা করছে। এর পেছনে যাদের ষড়যন্ত্র রয়েছে তারা কারা-তা খুঁজে বের করার দ্রুত প্রচেষ্টা যদি সরকার অবিলম্বে গ্রহণ না করেন তাহলে এর মত মারাত্মক অপরাধ আর হবেনা বলে আমরা মনে করি। জাতির প্রতি কতৃপক্ষের এ ধরনের অপরাধ অনাদিকাল ধরে দেশবাসী সহ্য করতে পারে না।
প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ব্যাপারে একটি ব্যবসায়িক নিয়ম বা আইন এর প্রবর্তন করতে হবে। যাতে করে ইচ্ছাকৃত কেউ ফায়দা লুটার অবকাশ না পায়। বর্তমানে যারা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ব্যবসা করছেন তারা যে নির্দ্বিধায় জনগণের দরিদ্রতার সুযোগ নিয়ে ফায়দা লুটছেন এটা আজ সম্পূর্ণ সুস্পষ্ট। অন্যান্য জিনিসের কথা বাদ দিলেও শুধু কেরোসিন তেলের বিক্রি ও সরবরাহ নিয়ে যে কারসাজি চলছে তা থেকে আমরা জানতে পারি এক সময় ঢাকার মাত্র চারজন ডিলার সমস্ত ঢাকা শহরে শুধু তেল সরবরাহ করতো। বর্তমানে ডিলারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে চুয়ান্নজন। এদের মধ্যে অধিকাংশই নবাগত। নবাগতদেরকে সুযোগ দেয়ার ব্যাপারে সরকারের যে আন্তরিকতা রয়েছে তাকে আমরা স্বাগত জানালেও-নবাগতদের ক’জনের সত্যিকারের দোকান আছে এবং ক’জন ব্যবসা করেন এ প্রশ্ন আমরা তুলতে পারি। যারা ব্যবসা করেন না বা যাদের দোকান নেই অথবা ঢাকার বাইরের ডিলারশিপ লাইসেন্স পেয়ে চোরা বাজারে জিনিসপত্র ঢাকাতেই বিক্রি করে যান তাদের সম্পর্কে কতৃপক্ষের একবার ভাববার রয়েছে। এ ধরনের অব্যবসায়িক প্রবৃত্তি যদি বন্ধ করতে সরকার ব্যর্থ হন তাহলে নবাগতদের দেওয়া সকল লাইসেন্স, পারমিট ও ডিলারশিপ বাতিল করে দেওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। ঢাকায় বর্তমানে যে সকল জিনিসপত্রের দাম অত্যাধিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে তার পেছনে নবাগত ও মজুতদার মুনাফাখোরদের কারসাজি রয়েছে।
কতৃপক্ষকে নতুন করে ভাবতে হবে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ব্যবসা সম্পর্কে। ন্যায্য মূল্যের দোকান এর মাধ্যমে সকল জিনিসপত্রের সরবরাহ করার চেয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে তা যথার্থ অর্থে বাস্তবায়িত করা উচিত। সরকার অবিলম্বে কেরোসিন সিগারেট সহ অন্যান্য জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি রোধকরে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলেই আমরা মনে করি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন