পাকিস্তানকে সমর্থন চীনের বিরাট বিশ্বাসঘাতকতা
সি.পি.এম বাঙলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে দমনের জন্য পাকিস্তানী জঙ্গী শাসকচক্রকে সমর্থন করার জন্য ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি (সি,পি,এম) চীনের তীব্র সমালাচনা করেছেন। সি,পি, এম-এর পলিট ব্যুরাে ‘পাকিস্তানের প্রতি চীনের সমর্থনকে বড় রকমের বিশ্বাস ঘাতকতা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। চীন কেন যে বাঙলাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে সমর্থন করছে না-তা তারা ভেবে পাচ্ছেন না বলে পলিট ব্যুরাে মন্তব্য করেন।
অপর দিকে এক খবরে প্রকাশ সাউথ চায়না নিউজ পােষ্ট-এ এই মর্মে মন্তব্য করা হয়েছে যে, ‘এক চীন ছাড়া আর কেউই পাকিস্তানের পাশে নেই।
বাঙলাদেশ। ১:২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
পাখতুনদের আত্ননিয়ন্ত্রণের অধিকার দাবি। বেতারযােগে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, ভারতে নিযুক্ত আফগান রাষ্ট্রদূত জনাব আবদুল হাকিম বিবি পশ্চিম পাকিস্তানের পশুতুভাষী জনগণের জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দাবি করিয়াছেন। সম্প্রতি নয়াদিল্লীতে আজাদ পাখতুনিস্তান দিবস উপলক্ষে এক সমাবেশে প্রদত্ত ভাষণে তিনি উপরােক্ত দাবি জানান। | পর্যবেক্ষণগণ মনে করিতেছেন যে, পশতুভাষী জনগণের স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবিতে দীর্ঘ ও কঠোর আন্দোলন- বিশেষতঃ ‘পাকিস্তানের ভাঙন অনিবার্য’ বলিয়া ওয়ালী খানের সাম্প্রতিক উক্তির পটভূমিতে আফগান রাষ্ট্রদূতের এই উক্তি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
মুক্তিযুদ্ধ। ১:৯ ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
ন্যাপ প্রধান ওয়ালী খান বলেনপাকিস্তান খণ্ড-বিখণ্ড হবেই
(নিজস্ব প্রতিনিধি)। “পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের পক্ষে দীর্ঘদিন বাঙলাদেশ দখল করে রাখা অসম্ভব। আমেরিকার মত শক্তিশালী দেশও যখন ভিয়েতনামের বীর জনগণকে বশে আনতে পারেনি, তখন খুদে পঃ পাকিস্তান যার আর্থিক ও সামরিক বাজেট পূর্ব বাঙলার উপর নির্ভরশীল কি করে এই অসম্ভব কাজ করবে?” সম্প্রতি কাবুলে পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) সভাপতি খান আবদুল ওয়ালী খান নয়াদিল্লীর সাপ্তাহিক পত্রিকা নিউ ওয়েভ’এর জনৈক প্রতিনিধির কাছে উপরােক্ত মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের রাজনীতি এখন এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে, যেখান থেকে আর ফেরা সম্ভব নয়। পাকিস্তানের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া আর এড়ানাে যাবেনা। ধর্ম যে একটা দেশের ঐক্যের বন্ধন হতে পারে সেই মােহ চিরকালের জন্য ভেঙ্গেছে। ওয়ালী খানের কাছে বাঙলাদেশের প্রতিরােধ আন্দোলনের গুরুত্ব এখানেই। মুসলমান আর একজন মুসলমানকে হত্যা করেছে। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন-“কোথায় গেল ইসলামী ভ্রাতৃত্ববােধ?’ জঙ্গীশাহীর অত্যাচার শুরু হবার কয়েক দিন আগে ওয়ালী খান ঢাকায় ছিলেন। তিনি বলেনঃ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা নির্বাচিত হয়েছেন। পাকিস্তানের নতুন সরকার গঠনের অধিকার একমাত্র তাঁরই রয়েছে। কিন্তু জঙ্গীশাসকরা মুজিবরকে তার আইন সম্মত অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছেন। জনগণের রায় মেনে নেওয়া হলে এবং মুজিবরকে পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী পদে স্বীকার করা হলে এই অভূতপূর্ব রক্তক্ষয়’ এড়ানাে যেত। কিন্তু এখন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যে, পানি না তাে টুকরাে হবেই-একে আর রোধ করা য ।।
বর্তমান পরিস্থিতিতে পাঠান নেতা ওয়ালী খান গভীর বেদনা প্রকাশ করে বলেন, ‘পাকিস্তানের ভবিষ্যত অত্যন্ত বিপদ জনক। পূর্ব বাঙলার নেতাদের সঙ্গে সম্মানজনক মিমাংসার সুযােগ হারানাে হয়েছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানকে পূর্ব বাঙলা হারাতে হবে।’ | রাওয়ালপিণ্ডির এখনকার পরিস্থিতি কিরূপ? ওয়ালীখানের ভাষায় “কলসী ভেঙ্গে গিয়েছে। দুধ চার দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে। তার চার পাশে বসে তারা কাঁদছে।”
বাঙলাদেশ ॥ ১:২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
পাকিস্তানকে সমাধি দিয়েছে, জঙ্গীশাহী
গাফফার খান। ১লা আগষ্ট, কাবুল-পাখতুন দিবসে সীমান্ত গান্ধী খান গফফার খান আবার পাক সরকারের গণহত্যার নিন্দা করেছেন। বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্রগুলি বাংলাদেশের ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করায় তিনি বিশ্ব মুসলিম বিবেকের সমালােচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, জঙ্গীশাহী লাখাে লাখাে লোককে হত্যা করেছে। বাংলাদেশের শহর গ্রামগুলিকে পুড়িয়ে দিয়েছে, লক্ষ লক্ষ লােককে দেশছাড়া করেছে, আজ এসব নিরাশ্রয় মানুষগুলাে পাহাড়ে পর্বতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। এসব করে ইয়াহিয়া সরকার নিজেই পাকিস্তানকে সমাধি দিয়েছে। তিনি বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের কাছে এক আবেদন জানিয়ে বলেছেন, অবিলম্বে বাংলাদেশের ব্যাপারে বিশ্ববাসীকে এগিয়ে আসতে হবে।
বিপ্লবী বাংলাদেশ ১: ৪ ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
আমার পথ থেকে সরে দাঁড়ান।
ভুট্টোর প্রতি ইয়াহিয়া ৯ই সেপ্টেম্বর, বাংলাদেশ। ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী জানিয়ে এক গােপন সংবাদে জানা গেছে প্রেসিডেন্ট। ইয়াহিয়া লারাকনার নবাবজাদা ভুট্টোর সমস্ত দাবী প্রত্যাখ্যান করেছেন। এবং ভূট্টোকে এই বলে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন, “আমার পথ থেকে সরে দাঁড়ান, না হলে আপনাকেও বন্দী করা হবে। জানা গেছে ভুট্টো নাকি ইয়াহিয়ার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী জানিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ এখন আমার পিপলস পার্টিই পাকিস্তানের একমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। সেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ দলেল দাবী মেনে নেওয়া উচিত। প্রেসিডেন্টের বিগত জুন মাসের বেতার ভাষণের উল্লেখ করে ভূট্টো দাবী করে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনা করার দায়িত্ব জাতীয় পরিষদের উপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। কেননা সামরিক সরকার জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। তাই সামরিক সরকার দ্বারা তৈরী শাসনতন্ত্র জনগণের কাছে গ্রহণযােগ্য হবে না। কিন্তু পাক প্রেসিডেন্ট এ প্রস্তাবে অসম্মতি প্রকাশ করলে ভূট্টো এই বলে হুমকি দেন, আমার দাবী মেনে নেওয়া না হলে আমার দল আন্দোলন শুরু করবে। এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে পাক প্রেসিডেন্ট উপরােক্ত কথা বলে সতর্ক করে
প্রকাশ এই, ভুট্টোর পরামর্শে বিগত মার্চ মাসে ইয়াহিয়া বাংলাদেশ লুণ্ঠন, অগ্নিসংযােগ, নারী, ধর্ষণ, নারী হত্যা, শিশু হত্যা শুরু করেছিলেন। এহেন ভুট্টোর বর্তমান অবস্থা দৃষ্টে রাজনৈতিক মহল মনে করছেন ভুট্টো যদি বেশী বাড়াবাড়ি শুরু করেন তা হলে ভূট্টো এবং তার দলের সমাধি হবে ইয়াহিয়ার হাতে। | জানা গেছে ভূটো প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে বর্তমানে অসুস্থতার ভান করে অন্দরে প্রবেশ করেছেন।
বিপ্লবী বাংলাদেশ। ১:৫ ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
ভূট্টোর পরিণতি
মেহেরুন আমিন। সিন্ধুর অন্তর্গত কারনার জায়গীরদার সন্তান কুখ্যাত জুলফিকার ভূট্টোর আবার খায়েস হয়েছে রাজনৈতিক নেতা রূপে নিজেকে জাহির করবার । ভুট্টো কোনদিনই “পলিটিকেল এলিমেন্ট” ছিল না। সােনার চামচ মুখে। দিয়ে হয়েছে তার জন্ম। বিলাস ব্যসনের মধ্যে কেটেছে তার কৈশাের ও যৌবন। হঠাৎ “পিতা আয়ুবের” প্রয়ােজনে তাকে রাজনৈতিক আসরে টেনে আনা হয়। অফুরন্ত স্বৈরাচারী ক্ষমতা ও দেশ ভ্রমণের আনন্দ তাকে পাইয়ে দেয় এক অপূর্ব স্বাদ। তাসখন্দ চুক্তির ব্যাপক অস্বীকৃতির সুযােগে ভূট্টো নেমে এল আয়ুবের বিরােধিতায়। পশ্চিম পাকিস্তানের “নবাব যুগ ও ধর্মান্ধ মােল্লী গােষ্ঠীর রাজনৈতিক দালালীতে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ ভূট্টোর লম্বা লম্বা বুলিতে বিভ্রান্ত হয়ে তাকে নেতা বলে স্বীকার করে এবং পরিণতিতে ভূট্টোর পিপলস্ পাটি বিপুল সংখ্যক আসনে জয়লাভ করে। | উচ্চভিলাষী, দাম্ভিক, দায়িত্বহীন অরাজনৈতিক ভূট্টো কিন্তু পাকিস্তানের জনগণের রায় মেনে নিতে রাজী হল না। শুরু হল পাকিস্তানের “চিরাচরিত ষড়যন্ত্রের রাজনীতি”। যে করেই হউক বঙ্গবন্ধুর ছয় দফাকে বানচাল করতে হবে এবং ষড়যন্ত্রকারীরা নিশ্চিন্ত ছিল যে সেক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু জাতির নিকট দেয়া তার ওয়াদা ভঙ্গ করে পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করবেন না। ভূট্টো গােপন শলাপরামর্শের মাধ্যমে আবার নূতন “পিতা” হিসাবে গ্রহণ করলে ডিক্টেরটর ইয়াহিয়াকে। আশা দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসাবে প্রধান মন্ত্রীত্বের চাকুরী অবশ্যই সে পাবে। প্রশয় দিল ইয়াহিয়া ভূট্টোকে তার বলগাহীন বানােয়াট ভাষণ চালিয়ে যেতে । অতি চালাক ভূট্টো কিন্তু বুঝতে পারল না যে ইয়াহিয়া তাকে গ্রহণ করেছে “জুতার ফিতা হিসাবে”। রাজনৈতিক মুর্থ। সামরিক জান্তার প্রতিটি কাৰ্য্যে সম্মতি নিজের কবর রচনায় হাত দিলে। ১৯৭১ সালের ২৮ শে জুনের ইয়াহিয়া প্রদত্ত বক্তৃতাই প্রথম তার মদের নেশার আমেজে ভাঙ্গন ধরাল। কিন্তু বড় দেরী হয়ে গেছে। ইতিমধ্যেই ভূট্টোকে ইয়াহিয়া চিনে নিয়েছে দালাল হিসেবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ বুঝে ফেলেছে যে ভূট্টো একটি “ক্লাউন”। শেষ চেষ্টা হিসাবে ভূট্টো কয়েক দফা বৈঠকে বসে ইয়াহিয়ার মন গলাতে চেষ্টা করেছে কিন্তু ইয়াহিয়ার প্রয়ােজন ফুরিয়ে গেছে ভূট্টোর। তাই আজ ভূট্টোকে দূরে বহু দূরে চলে যেতে হবে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে ।
বিপ্লবী বাংলাদেশ ১:৬ ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
জল্লাদের প্রেম! তথাকথিত পাকিস্তান সরকার সিলেটের জনৈক মাহমুদ আলীর নেতৃত্বে এবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যে প্রতিনিধি দলটি পাঠিয়েছেন তাতে মােট ১০ জন সদস্য রয়েছে। এর মধ্যে ৭ জনই ‘বাঙালী’। অতীতে যেখানে এসব প্রতিনিধিদলে প্রায় ক্ষেত্রেই কোন বাঙালী স্থান পেত না সেক্ষেত্রে এবার শতকরা ৭০ ভাগ বাঙ্গালীদের জন্য ছেড়ে দেওয়ায় কেউ হয়ত ভাবতে পারেন যে বাঙ্গালী-প্রেমে ইয়াহিয়ার দিল একেবারে গলে গেছে। আসলে কিন্তু তা নয়। মুক্তিকামী বাঙ্গালীদের বিভ্রান্ত করার এটা আরেকটা চাল মাত্র।
এবার দেখা যাক এরা কারা?
১। মাহমুদ আলী ওরফে চোস্ত পাজামা- গত নির্বাচনে শােচনীয়ভাবে পরাজিত ও জামানত বাজেয়াপ্ত । ২। শাহ্ আজিজুর রহমান-ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের সময় মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক। আজীবন দালাল ও ডিগবাজী বিশারদ। গত নির্বাচনে জামানত বাজেয়াপ্ত।
৩। জুলমাত আলী খান ময়মনসিংহের এক অখ্যাত উকিল, পুলিশের টাউট, পাড়-মাতাল। গত নির্বাচনে জামানত বাজেয়াপ্ত।
৪। বেগম এনায়েত উল্লাহ- পেশা ও স্বামীর নাম জানা যায়নি।
৫। এ টি, সাদী-মাঝে মাঝে মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে। কিছুকাল আগেও উলঙ্গ অবস্থায় রাস্তায় বের হয়ে পড়ত। তাই আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুরা তাকে ঘরে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছিলেন। সেই সময় লােকটি এক সদস্য বিশিষ্ট একটি সংস্থা গঠন করে এবং আজও তার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। মাথা এখনও বিকল এবং সেই অবস্থায় ডাঃ মালিকের কারখানায় স্থানান্তরিত ।
৬। ডঃ ফাতিমা সাদিক- জনৈক উর্দুভাষী সাদিকের দ্বিতীয় পত্নী।
৭। রাজিয়া ফয়েজ নাম দেখে মনে হয় ফয়েজ নামক কোন লােকের স্ত্রী। তবে তিনি কে তা জানা যায়নি।
প্রতিনিধি দলের পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্যগণ হলেন : ১। জাকিউদ্দিন খান- লাহােরের এক উকিল। তিনি যখন যেমন তখন তেমন নীতিতে বিশ্বাসী। ২। ডঃ কামাল ফারুকী- তিনি কিসের ডাক্তার তা জানা যায়নি।
৩। যখন বাবর- কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম স্থপতি ও সরকার পক্ষের অন্যতমঃ কৌশলী। বাঙ্গলীর রুদ্ধরােষে পড়ে কিভাবে যে পালিয়ে ছিল তা আজো অজ্ঞাত।
এছাড়া প্রতিনিধিদলে কয়েকজন সরকারী কর্মচারীও রয়েছে। কিন্তু তাদের মধ্যে একজন’ও বঙ্গবাসী ও বঙ্গ সন্তান নাই।
জয়বাংলা (১): ১: ২০ ও ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
পশ্চিম পাকিস্তান থেকেও হিন্দুদের বিতাড়ন করা হচ্ছে। বাংলাদেশে ধর্ম, বর্ণ, গােত্র নির্বিশেষে বাঙ্গালী হত্যাভিযান চালানাের পর ইয়াহিয়ার নরঘাতক বাহিনী। (পশ্চিম) পাকিস্তানে যে অল্প কিছুসংখ্যক হিন্দু রয়েছে তাদের গােপনে হত্যা এবং দেশত্যাগে বাধ্য করছে। ইয়াহিয়ার মাতাল প্রশাসন যন্ত্র পাকিস্তানে ধর্মান্ধ মােল্লা জাতীয় মুসলমান ছাড়া আর কাউকে যে বাঁচার সুযােগ দেবে না তাদের সাম্প্রতিক কার্যক্রম সে প্রমাণ বহন করছে। শিয়ালকোট জেলা থেকে আরও পাঁচটি হিন্দু পরিবারকে সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে ভারতে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ পাঁচটি পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৭৫ জন।সিন্ধু, বান্নএবং সােয়াত থেকে গত এক মাসে আরও ৬০ টি হিন্দু পরিবারকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা সকলেই পূর্ব পাঞ্জাবের মগ সীমান্ত পােষ্ট দিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। সংসর চন্দ নামক একজন শরণার্থী বলেছেন, হিন্দুদের পক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানে বসবাস করা অসম্ভব। শিয়ালকোটে প্রায় দু’হাজার হিন্দু বসবাস করতাে। এদের অধিকাংশই ক্ষেত মজুর। সংসর চন্দ বলেন যে, দু’চার মাসের মধ্যে তারা প্রত্যেকটি হিন্দুকেই খেদিয়ে দেবে। সংসর চন্দ বলেন, বাংলাদেশ সঙ্কট সৃষ্টির পর থেকেই সামরিক কর্তৃপক্ষ হিন্দুদের নানা অজুহাতে গ্রেফতার এবং হয়রানী করতে শুরু করে।
জয়বাংলা (১) ১: ২০ ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
পাকিস্তানে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে করাচীতে অসন্তোষ
মুজিবনগর, ৩ রা অক্টোবর করাচী থেকে ঢাকা হয়ে এখানে উপনীত জনৈক অফিসার করাচীর বর্তমান অবস্থার বিবরণ দেন। ভদ্রলােক সঙ্গত কারণেই তার নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক। তিনি বলেন যে, পাকিস্তানে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানেও অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠছে। এবং প্রশাসনকে অমান্য করার লক্ষণসমূহ প্রকাশ পাচ্ছে। তিনি বলেন যে, করাচী শহরের বহু স্থানে দেয়ালের গায়ে ইংরেজী ও উর্দুতে মােটা হরফে সামরিক শাসন নিপাত যাক দেখা দেখা যাচ্ছে। ভদ্রলােক আরও জানান যে, করাচীর সাধারণ মানুষ ভাবছেন যে, ছয় দফা দাবীর ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গ আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেয়া হয়েছিল এবং জনসাধারণ শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগকেই ভােট দিয়ে জরুরী কালু। এখন শেখ সাহেবকে দেশের শাসনকার্যে পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া উচিত। আওয়ামী লীগকে দেশ শাসনের ভার দেয়া হলে তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা দাবী করতেন না। তিনি বলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন শ্রেণীর লােকের সঙ্গে কথা বলে তার স্পষ্ট ধারণা হয়েছে | যে, শেখ মুজিবরের প্রাণদণ্ড তারা বরদাস্ত করবে না।
বাংলাদেশ (১)। ১:১৫ ৪ অক্টোবর ১৯৭১
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে হিন্দু খেদানাে হচ্ছে
মহিলা ও শিশু নিয়ে ৪৫ জন হিন্দু পশ্চিম পাকিস্তানের শিয়ালকোট জেলায় ভলুওয়াল গ্রামে তাঁদের পৈতৃক ঘরবাড়ি ছেড়ে ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য কয়েক দিন আগে হােসেনিওয়ালা সীমান্ত দিয়ে ভারতে। প্রবেশ করেছেন বলে মুজিব নগরে প্রাপ্ত এক খবরে জানা গেছে। এই দলের নেতা শ্ৰী আমিন চাঁদ (৪৫) জানিয়েছেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের বসবাস করা অসম্ভব হয়ে। পড়েছে। কেননা, বর্তমানে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রচণ্ড হিন্দু-বিরােধী প্রচার চলছে। তাই তারা ভারতে চলে। আসতে বাধ্য হয়েছেন।
সাপ্তাহিক বাংলা ১: ৩ ১০ অক্টোবর ১৯৭১
পাকিস্তানে খৃষ্টানরা নিরাপদ নয়
পশ্চিম পাকিস্তানের মুসারত পত্রিকায় এক চাঞ্চল্যকর খবর প্রকাশিত হয়েছে। পত্রিকাটিতে বলা হয়েছে যে, পাকিস্তানের খৃষ্টান অধিবাসীরা নিরাপত্তার অভাব বােধ করছেন এবং নানা মহল থেকে তাদের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। পত্রিকায় এক বিশেষ সংখ্যায় লাহােরের বিশপ ও অন্যান্য বিশিষ্ট পাকিস্তানী খৃষ্টান নেতাদের বরাত দিয়ে। বলা হয় যে, পরলােকগত কায়েদে আজম জিন্নাহ সংখ্যালঘুদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা রক্ষা করা হচ্ছে। । দুজন খৃষ্টধর্মীকে সন্দেহ ক্রমে গ্রেপ্তার করে পুলিশ হেফাজতে প্রহারের চোটে মেরে ফেলা হয় । পত্রিকাটিতে সে সংবাদও ফলাও করে প্রকাশ করা হয়েছে। ঐসব সংবাদ প্রকাশ করার জন্য পাক সরকার পত্রিকাটিকে এক সপ্তাহ মুদ্রণ প্রকাশ স্থগিত রাখার নির্দেশ। দেন।
সাপ্তাহিক বাংলা ১:৩১০ অক্টোবর ১৯৭১
ইরাণী ও পশ্চিম পাকিস্তানী ইসলাম ধর্মের নমুনা রাজতন্ত্রের আড়াই হাজার বৎসর পূর্তি উপলক্ষে
বার্ষিকী পালনের দাওয়াতে ডিক্টেটর ইয়াহিয়া আমন্ত্রিত। সংবাদে প্রকাশ, ইরাণী রাজতন্ত্রের আড়াই হাজার বৎসর পূর্তি উপলক্ষে বিশেষ আঁকজমকের সহিত বার্ষিকী পালনের ব্যবস্থা করেছেন ইরাণের শিয়া বাদশা শাহূরেজা পাহলভী। কিন্তু কৌতুকের ব্যাপার এই যে বর্তমান বাদশার পিতা রেজাশাহ এক সাধারণ সৈনিক থেকে ভাগ্যের হাত ছানিতে একদিন ইরাণের সিংহাসন দখল করে বসেছিলেন। তস্য পুত্র কিন্তু যে বাষির্ক পালন করছেন উহা মুসলিম রাজতন্ত্রের নহে। আরবেরা ইরাণ দখলের পুর্বে ইরাণীরা অগ্নিপূজক ছিলেন। বাদশা কারকাউস, কায়খসরু এবং বিশ্ববিখ্যাত বীরপুরুষ রুস্তম প্রমূখ ব্যক্তিগণ ইরাণের গেীরব। ওঁরা সকলেই অগ্নিপূজক ছিলেন। ইরাণের বাদশা শাহ রেজা ওঁদেরই স্মৃতিচারণ উৎসব পালন করছেন এবং তাতে নিমন্ত্রিত হয়ে যােগ দিয়েছেন পাকিস্তান নামক তথাকথিত মুসলিম রাষ্ট্রের ডিক্টেটর আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খান। ইরাণের বাদশা আসলে নিজেকে ইসলামী রাজতন্ত্রের নয়, তাদের পূর্বপুরুষ অগ্নিপূজকদের উত্তরাধিকারী বলতেই গেীরব বােধ করেন। ইয়াহিয়া খানের পূর্বসুরী আয়ুব খান আগ্নেয়াস্ত্রের জোরে ক্ষমতায় এসে ডিক্টেটর হয়ে বসলে পরে তাঁর পুত্র ক্যাপ্টেন গওহর আয়ুব মাসিক ছয়শাে টাকা বেতনের ফৌজী চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসায় নেমে পিতার দৌলতে মাত্র এক বৎসরের মধ্যেই পাকিস্তানের ২২ পরিবারের অন্যতম হয়ে ওঠেন। এবং নিজের কারখানার নাম রাখেন ‘গান্ধারা ইন্ডাষ্ট্রী। ‘গান্ধারা সভ্যতা’ ইসলমাদর্শের আবির্ভাবের বহু পূর্বের । বৌদ্ধ যুগের । কিন্তু এই আয়ুবেরাই বাংলাদেশ বা পাকিস্তানী রাজনীতিতে ইসলাম ধর্মের জিগির তুলেন। ওদিকে কিন্তু নিজেদেরকে ‘গান্ধার’ সভ্যতার উত্তরাধিকারী বলে পরিচয় দিতে গৌরব বােধ করে থাকেন এবং এসব কারণেই পশ্চিম পাকিস্তানীরা বাংলায় মুসলমানদেরকে নিজেদের সমতুল্য বলে
মনে করেনা। যেমন আরবেরা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মুসলমানদেরকে নিজেদের তুলনায় হীন বলেই মনে করে থাকে। সেজন্যই মােহাম্মদ আলী জিন্নাকে ‘কায়েদ আলম (দুনিয়ার নেতা) না বলে কায়েদে আজম’ (অনারবের নেতা) বলা হয়ে থাকে।
মুক্তবাংলা ১: ৪ ১১ অক্টোবর ১৯৭১
বেকুফের মতাে বাংলাদেশের ধ্বংস করতে গিয়ে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডকে ভেঙে ফেলেছে সামরিক জান্তা
কলকারখানা বন্ধ হবার যােগাড়। শতকরা ৫০ ভাগ শ্রমিক বেকার। প্রশাসনিক ব্যবস্থা বিকল। বাংলাদেশে জংগী আক্রমণের অকল্পনীয় ব্যয়ভার পাকিস্তানের অর্থনীতিকে ভেঙে ফেলেছে। ১৯৬৫ সালের ১৭ দিনের পাকভারত যুদ্ধের ধাক্কা পাকিস্তানী অর্থনীতি আজও সামলিয়ে উঠতে পারেনি। আর বর্তমানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ঘায়েল করার জন্য দৈনিক এক কোটি টাকা খরচ করতে হচ্ছে ইয়াহিয়া সরকারকে। এদিকে বাংলাদেশের পাট ও অন্যান্য শিল্প কারখানর অচলাবস্থা ও যুদ্ধের প্রভূত ব্যয়ের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিপতিদের নাভিশ্বাস উঠছে। দীর্ঘ ছয়টি মাস অতিক্রান্তের পরেও কিন্তু বাঙালীদের। সংগে যুদ্ধে পাকিস্তানী শাসকচক্র বিজয়ের আশা করতে সাহস পাচ্ছেনা। করাচীর দৈনিক ‘সান’ পত্রিকা। জানাচ্ছেন, কলকারখানা চালানাের ব্যয়ভার বহন করতে অপারগ তবে শিল্পপতিরা শ্রমিক ছাটাই করা শুরু করেছেন। গত কয়েক সপ্তাহে সাড়ে চার হাজার শ্রমিককে ছাটাই করা হয়েছে এবং তার ফলে ক্রমেই শ্রমিক অসন্তোষ উদ্বেগজনক আকার ধারণ করছে। শাসকগােষ্ঠীর অপর একটি মুখপত্র দৈনিক ‘ডন’ জানাচ্ছেন, করাচীর টক্ মার্কেট পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভণরপদে ডাক্তার মালিকের নিয়ােগকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। শুধু সাধারণ ঔৎসুকের সহিত উহা লক্ষ্য করছে মাত্র। কারণ তারা বিশ্বাস করতে পারছেনা যে, ডাক্তার মালিকের নিয়ােগে পূর্ব পাকিস্তানের বন্ধ হয়ে যাওয়া মিলগুলাে পুনরায় চালু করা যাবে বলে । শ্রমিকরা কাজ করতে রাজি হবে বলে। ওদিকে মিঃ ভূট্টো এতদিন বাংলাদেশের নিধন যজ্ঞে সামরিক জান্তার প্রধান পরামর্শদাতা। ও প্রবক্তার ভূমিকা পালন করে আসছিলাে। কিন্তু মিঃ ভূট্টো ও সামরিক জান্তাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কাজেই সমগ্র দেশটা জুড়ে প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা দেউলিয়াপনা প্রকট হয়ে ওঠার দরুন পুঁজিপতিমহল তাদের পুঁজিকে নিরাপদ করতে ব্যস্ত। দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড এমতাবস্থায় ভেঙে না পড়ে উপায় নেই এবং তার প্রতিক্রিয়া দেশের সর্বত্রই দেখা দিয়েছে। সিন্ধু দেশের দরিদ্র ও হারী কৃষকদের মধ্যে অসন্তোষ প্রকট হয়ে উঠছে দিনকে দিন।
মুক্তবাংলা ১; ৪ ১১ অক্টোবর ১৯৭১
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে খৃষ্টান বিতাড়ণ
(জয়বাংলা প্রতিনিধি) বাংলাদেশ থেকে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খৃষ্টানদের নির্বিচারে হত্যা ও বিতাড়ণের লােমহর্ষক ও মর্মন্তুদ সংবাদের আংশিক বিবরণ প্রকাশিত হওয়ার পর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে খৃষ্টানদের বিতাড়ণের তথ্য নির্ভরযােগ্য খবরে পাওয়া গেছে। বাংলাদেশকে অমুসলিম শূন্য ও যে সব মুসলমান দেশে থেকে যাবে তাদের দাসে পরিণত করা এবং পশ্চিম পাকিস্তানকে কেবলমাত্র মুসলমানদের আবাসস্থলে পরিণত করার গােপন চক্রান্তের সংবাদ ফাস হয়ে গেছে।
উল্লেখ্য যে, পশ্চিম পাকিস্তানকে ১৯৪৭-৪৮ সালের মধ্যেই হিন্দু ও শিখ শূন্য অঞ্চলে পরিণত করা। হয়েছে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে সরকারী পর্যায়ে দাঙ্গা বাঁধিয়ে দেড় কোটির মতাে হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত নাগরিককে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়ণ করা হয়েছে। এরপর এদের সম্পত্তি বিহারের মুসলিম অধিবাসীরা বাংলাদেশে গিয়ে সরকারী সম্মতিতে দখল করে নিয়েছিল। ১৯৭১ সালে।
হিন্দুদের সার্বিক বিতাড়ণ কাজ যথেষ্ট তৎপরতা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী সমাধা করা হয়েছে। তবে এবার জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙ্গালী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খৃস্টানদের ঝেটিয়ে বিদায় করা হয়েছে। কিন্তু এক সময় পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মিঃ জিন্নাহ বলেছিলেনঃ ‘পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের পূর্ণ অধিকার থাকবে। জাতি-ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে তারা পাকিস্তানের নাগরিক অধিকার ভােগ করবে। সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের নাগরিকদের মতােই অধিকার এবং সুযােগ সুবিধে পাবে।” কিন্তু ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বেশ কিছু সংখ্যক খৃষ্টান বিতাড়ণের পর বাংলাদেশে গণহত্যা শুরুর পর সামরিক জান্তা পশ্চিমাঞ্চলকে খৃষ্টান শূন্য এলাকায় পরিণত করার পরিকল্পনা নিয়ে বর্তমানে ঝাপিয়ে পড়েছে।
পশ্চিম পাকিস্তান বর্তমানে ৭ লাখ খৃষ্টান রয়েছে। খৃষ্ট ধর্মাবলম্বীরা মনে করেন যে, সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে জিন্নার উক্তিটি শুধুমাত্র সরকারী নথিপত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। বাস্তব অবস্থার সাথে ঘােষিত জিন্না নীতির কোন মিল নেই। পশ্চিম পাকিস্তানী খৃষ্টানরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গুপ্তচর বৃত্তি চালাচ্ছে বলে সম্প্রতি নতুন অভিযােগের ঝড় তােলা হয়েছে। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পরও খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের পক্ষে গুপ্তচর বৃত্তির প্রতিহিংসামূলক অভিযােগ এনে বহু খৃষ্টানকে বিতাড়ণ করা হয়েছিল। এরপর তাদের সম্পত্তি এলাকার ভূস্বামীরা দখল করে নেয়। বাংলাদেশ সঙ্কটে ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তান যুদ্ধের পাঁয়তারা শুরু হওয়ার পর সামরিক জান্তা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাকী খৃষ্টানদের বিতাড়ণ শুরু করে দিয়েছে। পাকিস্তানের প্রতি যদিও খৃষ্টানরা অনুগত তবুও তাদের বিরুদ্ধে গুপ্তচর বৃত্তির অভিযােগ করা হচ্ছে। সরকার অথবা প্রশানসের তাদের কোন অংশ নেই। সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অধিকার থেকে খৃষ্টানদের বঞ্চিত করে তাদের প্রায়শঃই পাকিস্তান ত্যাগ করে কানাডা অথবী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় গ্রহণের জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে।
লাহাের এবং কারাচীর কতিপয় খৃষ্টান নেতা পৃথক বিবৃতিতে জঙ্গীশাহীর এই অমানবিক কার্যকলাপের পরােক্ষ নিন্দা করে পশ্চিম পাকিস্তানী খৃষ্টানদের পাকিস্তানী জাতিত্বের অঙ্গীভূত করে নেওয়ার জন্য আকুল আবেদন জানিয়েছেন।
লাহােরের বিশপ মহামান্য ইনিয়াং মাসিহ এক বিবৃতিতে বলেছেন যে, খৃষ্টানদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা না হলে বােঝা যাবে যে, তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। সঙ্গীনের সন্ত্রাসের রাজত্বে বসবাসরত পশ্চিম পাকিস্তানী খৃষ্টান নেতা পরেক্ষিভাবে তারা যে পাকিস্তানে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক তা বলেই দিয়েছেন। বিশপ মাসিহ বলেছেন যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই খুষ্টানদের সাথে বিভেদমূলক ব্যবহার করে আসা হচ্ছে। পাকিস্তানী পতাকার সাদা অংশ যদিও সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব করছে তবু বিনা দ্বিধায় বলা যায় তাদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য কোন ব্যবস্থাই এ পর্যন্ত কোন সরকার নেয় নি। স্বাধীন খৃষ্টান লীগের প্রেসিডেন্ট মিঃ যশাের ফজল দীন বলেছেন যে, পাকিস্তান সরকার পশ্চিম পাকিস্তানী খৃষ্টানদের পাকিস্তানী জাতিত্বের বাইরে রেখেছেন। বিশ্ববিবেক জঙ্গী ইয়াহিয়া শাসনের বিরুদ্ধে সক্রীয়ভাবে সােচ্চার এবং মানবতার দরবারে তাদের আসামীর কাঠগড়ায় উঠাতে না পারলে অচিরেই পশ্চিম পাকিস্তান খৃষ্টান শুন্য হয়ে যাবে।
জয়বাংলা (১) : ২৩ ১৫ অক্টোবর ১৯৭১
লাহােরে গােপন নথি-পত্র উধাও
প্রত্যেকটি বিমান বন্দরে কড়া পাহাড়াও ব্যাপক তল্লাসির ব্যবস্থা ৩রা অক্টোবর-লাহাের ইন্টার কন্টিনেন্টাল হােটেল হতে বাংলাদেশ সম্পর্কে রাষ্ট্র পূঞ্জের কিছু একান্ত গোপনীয় নথি-পত্র লাপাত্তা হয়ে যাওয়ায় পাকিস্তান এবং পাক কবলিত বাংলাদেশের প্রত্যেকটি বিমান বন্দরে কড়া পাহাড় ও ব্যাপক তল্লাসির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
হিন্দুদের সার্বিক বিতাড়ণ কাজ যথেষ্ট তৎপরতা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী সমাধা করা হয়েছে। তবে এবার জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙ্গালী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খৃস্টানদের ঝেটিয়ে বিদায় করা হয়েছে। কিন্তু এক সময় পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মিঃ জিন্নাহ বলেছিলেন পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের পূর্ণ অধিকার থাকবে। জাতি-ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে তারা পাকিস্তানের নাগরিক অধিকার ভােগ করবে। সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের নাগরিকদের মতােই অধিকার এবং সুযােগ সুবিধে পাবে।”
কিন্তু ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বেশ কিছু সংখ্যক খৃষ্টান বিতাড়ণের পর বাংলাদেশে গণহত্যা শুরুর পর সামরিক জান্তা পশ্চিমাঞ্চলকে খৃষ্টান শূন্য এলাকায় পরিণত করার পরিকল্পনা নিয়ে বর্তমানে ঝাপিয়ে পড়েছে। | পশ্চিম পাকিস্তান বর্তমানে ৭ লাখ খৃষ্টান রয়েছে। খৃষ্ট ধর্মাবলম্বীরা মনে করেন যে, সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে জিন্নার উক্তিটি শুধুমাত্র সরকারী নথিপত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। বাস্তব অবস্থার সাথে ঘােষিত জিন্না নীতির কোন মিল নেই। পশ্চিম পাকিস্তানী খৃষ্টানরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গুপ্তচর বৃত্তি চালাচ্ছে বলে সম্প্রতি নতুন অভিযােগের ঝড় তােলা হয়েছে। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পরও খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের পক্ষে গুপ্তচর বৃত্তির প্রতিহিংসামূলক অভিযোগ এনে বহু খৃষ্টানকে বিতাড়ণ করা হয়েছিল। এরপর তাদের সম্পত্তি এলাকার ভূস্বামীরা দখল করে নেয়। বাংলাদেশ সঙ্কটে ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তান যুদ্ধের পাঁয়তারা শুরু হওয়ার পর সামরিক জান্তা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাকী খৃষ্টানদের বিতাড়ণ শুরু করে দিয়েছে। | পাকিস্তানের প্রতি যদিও খৃষ্টানরা অনুগত তবুও তাদের বিরুদ্ধে গুপ্তচর বৃত্তির অভিযােগ করা হচ্ছে। সরকার অথবা প্রশানসের তাদের কোন অংশ নেই। সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অধিকার থেকে খৃষ্টানদের বঞ্চিত করে তাদের প্রায়শঃই পাকিস্তান ত্যাগ করে কানাডা অথবী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় গ্রহণের জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। | লাহাের এবং কারাচীর কতিপয় খৃষ্টান নেতা পৃথক বিবৃতিতে জঙ্গীশাহীর এই অমানবিক কার্যকলাপের পরােক্ষ নিন্দা করে পশ্চিম পাকিস্তানী খৃষ্টানদের পাকিস্তানী জাতিত্বের অঙ্গীভূত করে নেওয়ার জন্য আকুল আবেদন জানিয়েছেন। লাহােরের বিশপ মহামান্য ইনিয়াং মাসিহ এক বিবৃতিতে বলেছেন যে, খৃষ্টানদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা না হলে বােঝা যাবে যে, তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। সঙ্গীনের সন্ত্রাসের রাজত্বে বসবাসরত পশ্চিম পাকিস্তানী খৃষ্টান নেতা পরােক্ষভাবে তারা যে পাকিস্তানে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক তা বলেই দিয়েছেন।
বিশপ মাসিহ বলেছেন যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই খুষ্টানদের সাথে বিভেদমূলক ব্যবহার করে আসা হচ্ছে। পাকিস্তানী পতাকার সাদা অংশ যদিও সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব করছে তবু বিনা দ্বিধায় বলা যায় তাদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য কোন ব্যবস্থাই এ পর্যন্ত কোন সরকার নেয় নি। | স্বাধীন খৃষ্টান লীগের প্রেসিডেন্ট মিঃ যশাের ফজল দীন বলেছেন যে, পাকিস্তান সরকার পশ্চিম পাকিস্তানী খৃষ্টানদের পাকিস্তানী জাতিত্বের বাইরে রেখেছেন। | বিশ্ববিবেক জঙ্গী ইয়াহিয়া শাসনের বিরুদ্ধে সক্রীয়ভাবে সােচ্চার এবং মানবতার দরবারে তাদের আসামীর কাঠগড়ায় উঠাতে না পারলে অচিরেই পশ্চিম পাকিস্তান খৃষ্টান শুন্য হয়ে যাবে।
জয়বাংলা (১) : ২৩ ১৫ অক্টোবর ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ১০