পাকিস্তানের ইতিহাস রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডেরই ইতিহাস
করাচীর একটি উর্দু দৈনিক ন-ই রৌসনীতে’ খবর বেরিয়েছে, মিস ফাতেমা জিন্নাকে করাচীতে তার বাসভবনে হত্যা করা হয়। যদিও সরকারীভাবে ঘােষণা করা হয় ফাতেমা জিন্না হৃদরােগে মারা গিয়েছেন। ঐ খবরের কাগজে যারা মিস ফাতেমা জিন্নার লাশ গােছল করায়, তাদের তিন জনের মন্তব্য উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে যে, তারা আরাে বলেছে মিস জিন্নার তলপেটেও আঘাতের চিহ্ন ছিল। মনে হয়, তার গলায় ও তল পেটে ছুরিকাঘাত করা হয়েছিল। তার কাপড় রক্তে ভেজা ছিল। মশারির চাল ও বিছানার চাদরেও ছিল রক্তের দাগ। সংবাদ পত্রটিতে আরাে বলা হয়েছে, মিস জিন্নার শরীর সাদা কাপড়ে জড়ান ছিল। কেবল তার মুখের এক অংশ দেখা যাচ্ছিল। একদল ছাত্র পরলােকগত নেত্রীর মৃত দেহ দেখতে চাইলে পুলিশ তাদের সরাবার জন্য লাঠি চালায় ও কাঁদুনে গ্যাস প্রয়ােগ করে।
ফাতিমা জিন্না রাজনীতিতে ছিলেন গণতন্ত্রবাদী ও সামরিক শাসনের বিরােধি। প্রবল প্রতাপ আইয়ুব | শাহীর বিপক্ষে তিনি নির্বাচনে দাঁড়ান। তার লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু নির্বাচনে আইয়ুব জয় লাভ করেন, ষড়যন্ত্র করে। তার বুনিয়াদী গণতন্ত্রের নির্বাচনে অন্যের জয় লাভ করবার সম্ভাবনা ছিল কম। তাছাড়া সেনা বাহিনী ও আমলাতন্ত্র ছিল তার পক্ষে। কিন্তু নির্বাচনে জয় লাভ করেই সম্ভবত ও সামরিক এক নায়ক আইয়ুবের রাগ যায়না ফাতিমা জিন্নার উপর। আইয়ুব অথবা তার সমর্থকদের নির্দেশে খুন হন ফাতিমা জিন্না। বাইরে প্রচার করা হয়, তিনি মারা গিয়েছেন আকস্মিক ভাবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে । এমনি ছিল আইয়ুবী শাসনের কড়া ব্যবস্থা যে তখন এই খুনের কথা প্রকাশিত হতে পারেনি। কিন্তু এখন তা প্রকাশ হতে পারছে, বােধ হয় আইয়ুব আজ আর ক্ষমতার আসনে নেই বলেই। তবে এর পেছনেও অন্য কোন ষড়যন্ত্র আছে কিনা তা বলা মুস্কিল।
পাকিস্তান আজ বাঙালীদের কাছে একটা মৃত বাস্তবতা। কিন্তু তবুও এই খুনের রাজনীতির কথা আলােচনা করতে হয়। কারণ, এই ষড়যন্ত্র ও খুনের রাজনীতির মূলে ছিল, পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক ভাবধারার অভাব। পাকিস্তানের যে অংশে গণতান্ত্রিক ভাবধারা বিশেষভাবে ছিল, তা হল বাঙলাদেশ। বাঙলাদেশে হত্যার রাজনীতি ছিল না। যেসব রাজনৈতিক খুন হয়েছে তার সবগুলিই সংঘটিত হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে। সেখানকার রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাদের চক্রান্তই কাজ করেছে এই সব খুনের পশ্চাতে। | খুনের রাজনীতি আরম্ভ হয় পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই। পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নার চিকিৎসক কর্ণেল ইলাহী বক্স তার বইতে জিন্নার মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে ঘটেছিল কিনা সে বিষয় সংশয় প্রকাশ করেছেন। ১৯৪৮ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর মিঃ জিন্নার আকস্মিক মৃত্যুর পর জানান হয়েছিল যে তিনি দীর্ঘ দিন থেকে ক্যান্সারে ভুগছিলেন। অথচ তকালীন পাকিস্তান জাতি এমন কি মিঃ জিন্নার ব্যক্তিগত চিকিৎসক পর্যন্ত তা আগে জানতে পারেন নি। মিস ফাতেমা জিন্নাহ ও যে জানতেন না তার প্রমাণ মিঃ জিন্নার প্রতিটি মৃত্যু বার্ষিকীতে প্রদত্ত বাণীতে তিনি ব্যাপারটার প্রতি ইঙ্গিত করতেন। | মিঃ জিন্নার মৃত্যুর পর এমনও খবর পাওয়া গিয়েছিল যে, তার মৃত্যুর দুই তিন দিন পূর্বে জিয়ারত থেকে কোন এক মহল জাতির পিতার ব্যবহারের জন্য কিছু সাদা কাপড় পাঠাতে করাচীতে এত্তেলা পাঠিয়েছিল। পরে সেই সাদা কাপড়েই মিঃ জিন্নার মৃত্যুদহে জিয়ারত থেকে করাচীতে আনা হয়।
এরপর ১৯৫১ সালের ১৬ই অক্টোবর পিণ্ডির প্রকাশ্য জন সভায় প্রধান মন্ত্রী লিয়াকত আলী খুন হল। খুনের রহস্য এখনও উদঘাটিত হয়নি। কারণ, এই খুনের পেছনে যারা ছিলেন, তাঁরা সকলেই ছিলেন উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন। | এদের মধ্যে তকালীন পাকিস্তানের প্রধান সেনাপতি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সহ অনেকেই ছিলেন বলে বিভিন্ন মহলের সন্দেহ জনক। তার পর লিয়াকত হত্যার তদন্তকারী আর্মী অফিসার ব্রিগেডিয়ার শের আলি খান ও ব্রিগেডিয়ার ইফতিখার উদ্দীনকে বিমান বিধ্বস্ত করে মারার পর এ সন্দেহ আরাে ঘনীভূত হয়। কেননা, এ দুজনের সাথে ছিল লিয়াকত হত্যার তদন্ত সংক্রান্ত যাবতীয় দলিল দস্তাবেজ।
| এরপর ঘাতকের হস্তে প্রাণ দেন সীমান্ত গান্ধীর ভ্রাতা ডঃ খান সাহেব। ডঃ খান সাহেবের মতাে একজন নিষ্কলুষ চরিত্রের মানুষকে ব্যক্তিগত কারণে কোন ঘাতকের হত্যা করার প্রয়ােজন ছিলাে না। সুতরাং এটা যে একটা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড তাতে কারাে কোন সন্দেহ নেই। | পশ্চিম পাকিস্তানের এককালীন গভর্ণর ও সাবেক প্রেসিডেন্ট আইয়রেৰ শত কুকর্মের দোসর কালাবাগের আমীরের হত্যাকাণ্ডও একটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। এই লােকটি আইয়ুবের দোসর হিসাবে সারা পশ্চিম পাকিস্তানে খুন-খারাবির মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। ১৯৬৪ সালের নির্বাচনের সময়ে কালাবাগের আমীরের লােকেরা তকালীন আওয়ামী লীগ নেতা জনাব বাকা বালুচের প্রাণনাশ করতে গিয়ে ভুলক্রমে পি,পি, আই-এর প্রতিনিধি জনাব জমীর কোরেশীকে খুন করে। অনুরূপ অসংখ্য রাজনৈতিক খুন সম্পাদন করেছিল কালাবাগের আমীর। কিন্তু পরবর্তী কালে ব্যক্তিগত স্বার্থ ও উচ্চাভিলাষের কারণে আইয়ুবের সাথে কালাবাগের আমীরের মন কষাকষি হয়। ফলে কালাবাগের আমীর গভর্নর পদ হারায় এবং
বাড়িতে গিয়ে চাষাবাদের ফাকে আইয়ুব বিরােধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। সুতরাং আইয়ুব উপায়ান্তর না দেখে কালাবাগের নবাবের পুত্রকে দিয়েই তাকে ধরাধাম থেকে চির বিদায় দেবার ব্যবস্থা করে। | হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর হত্যাকাণ্ডও ছিল আরেকটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। জনাব সােহরাওয়াদী এন ডি এফ গঠন করে আইয়ুবী শাসনের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘােষণা করেন। তারপর স্বাস্থ্যগত কারণে তিনি বিদেশ চলে যান। ১৯৬৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে আওয়ামী লীগ পুনঃজীবনের প্রশ্ন নিয়ে দেখা দেয় মতানৈক্য। শেখ মুজিবর রহমান লণ্ডন গিয়ে নেতার সাথে আলাপ আলােচনা করেন এবং নেতাকে দেশে ফিরে আসতে অনুরােধ করেন। শহীদ সাহেব তাকে কথা দিয়েছিলেন যে তিনি ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে দেশে ফিরবেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস নির্দিষ্ট তারিখের কয়েকদিন আগেই খবর আসে যে শহীদ সাহেব বৈরুতের এক হােটেলে আকস্মিকভাবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। শহীদ সাহেব দেশে | ফিরলে যাদের সিংহাসন কেঁপে উঠত তারাই তাকে বৈরুতে হত্যা করেছে বলে সর্বসাধারণের ধারণা জন্মে। | এ ধারণা পরে আরাে বদ্ধমূল হয় নানা কারণে। কারণ বৈরুতের হােটেলের যে কক্ষে শহীদ সাহেব থাকতেন তা বাহির থেকে বন্ধ থাকত। অথচ শহীদ সাহেবের মৃত্যুর পর কক্ষটা খােলা পাওয়া গিয়েছিল।
সর্বোপরি সােহরাওয়ার্দী সাহেবের কন্যা বেগম সােলায়মান আজ ইয়াহিয়া খানদের প্রকাশ্য দালালী করছেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে ঢাকায় এসে হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বসে আওয়ামী লীগে ভাঙ্গন ধরানাের প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন এবং এখনও সে অপচেষ্টা থেকে নিবৃত হননি। অতি সম্প্রতি তিনিও বিদেশী। সাংবাদিকের কাছে সাক্ষাৎকারে তার পিতার মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু ছিলনা বলে…মরহুম হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর ভাৰ শিষ্য এবং বঙ্গ বন্ধুর শ্রদ্ধেয় পরামর্শদাতা দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক জনাব তফাজ্জল হােসেন ওরফে মানিক মিয়ার মৃত্যুও স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না। ইয়াহিয়া খানই পাকিস্তানের চা। বাের্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান জনৈক ব্রিগেয়ািরের মাধ্যমে তাঁকে পিণ্ডিতে ডেকে নিয়েছিল। মৃত্যুর কয়েক মিনিট আগেও সেই কীর্তিমান ব্রিগেডিয়ার মানিক মিয়াকে ইয়াহিয়ার সরকারের মন্ত্রীত্ব গ্রহণের প্রস্তাব | দিয়েছিল। কিন্তু জনাব মানিক মিয়া কি বলেছিলেন পাকিস্তানে ২২ পরিবারের অন্যতম সদরে ইস্পাহানীর জবানীতেই পরে তা জানা গিয়েছিল। জনাব মানিক মিয়া বলেছিলেন : “আমি পদাঘাতে মন্ত্রীত্বের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করব।’ এর কয়েক মিনিট পরেই মানিক মিয়ার মৃত্যু হয়। এই সবের কারণ অনেক। পাকিস্তান হবার পর পাকিস্তানের মূল রাষ্ট্রিক ক্ষমতা চলে যায় পাঞ্জাবী ভূস্বামী। শ্রেণীর হাতে। পাঞ্জাবের এই শ্রেণীর হাতেই এসে পড়ে সেনা বাহিনীও প্রশাসনের ক্ষমতা। কারণ, সেনা বাহিনী ও প্রশাসন যন্ত্রের উচ্চ পদে বহাল অধিকাংশ অফিসার, ভূ-স্বামী শ্রেণীর সন্তান। এদের মধ্যে আবার। ছিল ও আছে গণতান্ত্রিক চেতনার। এরা ডাণ্ডাবাজি ও লােক খুনের ঐতিহ্যের মধ্যেই ছিল প্রতিপালিত। এরা আধুনিক ইউরােপের কাছ থেকে গ্রহণ করেছে পােশাক-পরিচ্ছদ, চাল-চলন। কিন্তু ইউরােপের মানব অধিকার ও গণতন্ত্রের ধারণা এদের চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করতে পারেনি। অন্যদিকে বাঙলাদেশের নেতৃত্ব। ভার যাদের হাতে ছিল ও আছে তারা অধিকাংশই মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। তারা যে রাজনীতির ঐতিহ্য বাহী, তা গণতান্ত্রিক। ইউরােপীয় ভাবধারার সাথে বাঙালী মনের যােগাযােগের ফলে যে নবজাগরণ আসে বাঙলাদেশে, এরা সেই ভাবধারার ধারক বাহক। বাংলাদেশে তাই রাজনৈতিক নেতা খুনের রাজনীতি প্রায়শ পেতে পারেনি। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে এই খুনের রাজনীতিই প্রাধান্য পেতে চেয়েছে। বাংলাদেশের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরােধ কেবল মাত্র অর্থনৈতিক নয়-এই বিরােধ মনধারার। এই বিরােধ, ভাবাদর্শের। বাঙলাদেশের মানুষ আজ তার স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে। এই স্বাধীনতা যুদ্ধ কেবল মাত্র পশ্চিম পাকিস্তানের ধন কুবেরদের শােষণের নাগপাশ থেকে মুক্তির জন্য নয়-দেশে সত্যিকার গণতন্ত্র ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও এর লক্ষ্য। পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে সংযুক্ত থেকে বাঙলাদেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা সম্ভব ছিল না বলেই বাঙলাদেশকে ঘােষণা করতে হয়েছে আপন স্বাধীনতা। সর্বপ্রকার স্বৈরশাসনের অবসান ।
জয়বাংলা (১)১:১৭ ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ১০