You dont have javascript enabled! Please enable it!

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৫৪। কলেরা নিয়ন্ত্রণের বাইরে টেলিগ্রাফ ৫ জুন ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৫৪, ৩৭৪-৩৭৫>

টেলিগ্রাফ, ৫ জুন ১৯৭১
কলেরা ‘নিয়ন্ত্রণের বাইরে’
কলকাতায় ফ্যান ওয়ার্ড

গতকাল রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিচালক ডাঃ মিরা হরিলাল সাহা বলেছেন পশ্চিমবঙ্গের কলেরা মহামারী “সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে”।

আন্তর্জাতিক সাহায্যের জন্য জরুরী ভিত্তিতে অনুরোধ চেয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের কলেরা-বিরোধী ভ্যাকসিন দরকার, র্যাপিড ইনজেকশন মেশিন, অ্যান্টিবায়োটিক, গুড়াদুধ – ইত্যাদি প্রয়োজন – এক কথায় যে কোন কিছু যা যা আপনারা দান করতে পারেন।’

ডাঃ সাহা জানান পূর্ব পাকিস্তানের ৮০০ মাইল বর্ডার দিয়ে প্রায় দশ বারো হাজার কলেরা রোগী রয়েছেন।

ভ্যাক্সিন দেবার পরেও প্রায় ২৫৫০ জন মারা গেছে।

ডঃ সাহা কলকাতায় স্বাধীন ত্রাণ সংস্থায় এসে রিপোর্ট করেন যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে গত কয়েক সপ্তাহে প্রায় এক মিলিয়ন শরনার্থি ভারতীয় সীমান্তের ভিতরে বন্যার মত প্রবেশ করেছেন।

ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয় ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে এখন মোট প্রায় পাঁচ মিলিয়ন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ডাঃ সাহা বলেন কলেরা আক্রান্ত রোগী উত্তরে দিনাজপুর থেকে মালদা, মুরশিদাবাদ, নদীয়া হয়ে কোলকাতা পর্যন্ত বিস্তৃতিলাভ করেছে।

সমস্যা বাড়ার পাশাপাশি আরও বেশী গৃহহীন মানুষ প্রবেশ করছে। তাদের অঞ্চলের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অন্যায় ক্রমেই বাড়ার জন্য এমনটা হচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলেন কলেরা ক্রমাগত বাড়ছে এবং “সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। মৃতের সংখ্যা ৫০০০ ছাড়িয়ে যাবে।

তবুও সবচেয়ে খারাপ অবস্থাসম্পর্ন এলাকা নদীয়ার প্রধান মেডিকেল অফিসার বলেছেন, প্রায় ৬০০০ রোগী আছে যার ফলে এটি মহামারীর আকার ধারণ করেছে কিন্তু পরিস্থিতি ‘নিরাপত্তাহীন হলেও নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়।’

কর্মকর্তা ডাঃ এস চক্রবর্তী গতকাল বলেন, “এটা বলা অসম্ভব যে কলেরা বা অস্ত্রপ্রদাহের মত অনুরূপ রোগ সর্বোচ্চ মৃত্যুর হার ঘটাচ্ছে কিনা।’’

মহামারীর আকার সম্পর্কে ধারনা করা যাচ্ছে না কারণ পর্যাপ্ত পরীক্ষাগার সুবিধা নাই। ভুক্তভোগীদের বেশিরভাগ হচ্ছে নারী ও শিশু।

ডাঃ চক্রবর্তী বলেন, তার বিভাগে ভ্যাকসিন, ড্রিপ, স্যালাইন, গ্লুকোজ এবং এন্টিবায়োটিক স্বল্পতা আছে। নার্সিং কর্মীও দরকার।

স্থানীয় ভারতীয়রা রোগে আক্রান্ত হওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন আছেন।

নিহতদের লাশ রাস্তার পাশে সীমান্ত দিয়ে পরে আছে, এবং কিছু কিছু স্থানীয় জালাঙ্গি নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে যার ফলে গুরুতর দূষণের হুমকি দেখা দিয়েছে। মানুষ যাতে দুষিত নদীর পানি ব্যাবহার না করে সেজন্য পাহারা বসানো হয়েছে।

শরণার্থী সংকট নয়া দিল্লি কেন্দ্রীয় সরকার এবং পাঁচটি পৃথক রাজ্য কর্তৃপক্ষের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে – কারণ ওইসব রাজ্যে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু প্রবেশ করছে যাদের জন্য তাদের কোন প্রস্তুতি ছিলোনা।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৫৫। গণহত্যা সানডে টাইমস ১৩ জুন, ১৯৭১

Zulkar Nain
<১৪, ১৫৫, ৩৭৬-৩৯৫>

সানডে টাইমস, ১৩ জুন, ১৯৭১
“গণহত্যা”
অ্যান্থনি মাস্কারেনহাস

সানডে টাইমসের এক প্রতিবেদক পাঁচ কোটি লোক কেনো পালিয়েছে তার ভয়াবহ কাহিনী নিয়ে পাকিস্তান ছেড়ে চলে এসেছে।

মার্চ মাসের শেষের দিকে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে হাজার হাজার বেসামরিক লোককে হত্যা করে। মার্চ মাসের শেষের দিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সরকারের প্রভাবে সংবাদ চেপে যাওয়ার পিছনে এটাই ছিল ভয়ঙ্কর বাস্তবতা। এই কারণেই কলেরা এবং দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি নিয়ে পাঁচ লাখেরও বেশি শরণার্থী পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে পালিয়েছে।

পাকিস্তানে সানডে টাইমসের সংবাদদাতা এন্থনি মাসকারেনহাস কতৃক প্রথমবারের মতো এই নীরবতার পর্দা ভেঙ্গে যায়। তিনি দেখেছেন পাকিস্তান সেনাবাহিনী কি করছে। তিনি বিশ্ববাসীকে বলার জন্য পাকিস্তান ত্যাগ করেছেন।

সেনাবাহিনী একটি স্বাধীন পূর্ববাংলা তথা বাংলাদেশ চিন্তার সমর্থকদের নিছকই হত্যা করেনি। এটা অন্যদের উপর ইচ্ছাকৃতভাবে চালানো হত্যাযজ্ঞ। হিন্দু ও বাঙালি মুসলমান। হিন্দুরা গুলিবিদ্ধ হয়ে মরছে এবং তাদের পিটিয়ে মারা হচ্ছে কারণ তারা হিন্দু। গ্রামগুলি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাচারের বিক্ষিপ্ত এবং অনিশ্চিত প্রতিবেদনগুলি কিছুক্ষনের জন্য বাইরের জগতে পৌঁছাচ্ছে, বিশেষত উদ্বাস্তু, মিশনারি এবং কূটনীতিকদের কাছ থেকে। অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের প্রত্যক্ষদর্শী প্রতিবেদনটি তাই নির্ভুলতা ও নির্ভরযোগ্যতার দিক থেকে অদ্বিতীয়। তিনি বাংলার অন্তর্নিহিত দুঃখদুর্দশার সংবাদ সরবরাহ করেন: কেন শরণার্থীরা পালিয়ে গেছে?

এন্থনি মাস্কারেনহাসের রিপোর্টের পিছনে একটি অসাধারণ গল্প রয়েছে।

মার্চ মাসের শেষের দিকে বাঙালি বিদ্রোহীদের চিহ্নিত করতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীরা যখন পূর্ব পাকিস্তানের দুটি বিভাগে বহাল ছিল, এটি গোপনে সরানো হয়। কিন্তু প্রায় দুই সপ্তাহ পরে পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার জন্য আটজন পাকিস্তানি সাংবাদিককে আমন্ত্রণ জানায়। তাদের পরিকল্পনা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণকে পূর্ব অর্ধাংশে “স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসার”

একটা সুনিশ্চিত ধারণা দেওয়া, যেমনটা সরকারি কর্মকর্তা কতৃক সাংবাদিকদের নিশ্চিত করা হয়। সাংবাদিকদের সাতজনই তাদের উদ্দেশ্য অনুযায়ী কাজ করেছিলেন। কিন্তু বাকি একজন ছিলেন মাস্কারেনহাস, যিনি করাচিতে মর্নিং নিউজের সহকারী সম্পাদক ছিলেন, এবং দ্য সানডে টাইমস পত্রিকার পত্রিকাও ছিলেন।

১৮ই মে মঙ্গলবার, লন্ডনে দ্য সানডে টাইমস অফিসে অপ্রত্যাশিতভাবে তিনি আসেন। সেখানে তিনি আমাদের বলেছিলেন, তিনি একটি গল্প লিখতে চেয়েছিলেন: পূর্ব বাংলায় ঘটে যাওয়া প্রকৃত ঘটনা যা পাঁচ মিলিয়ন মানুষকে পালাতে বাধ্য করে।

তিনি বুঝেছিলেন যে তিনি যদি তার গল্প লিখেন তবে তার জন্য করাচিতে ফিরে যাবার সম্ভাবনা নেই, এবং তিনি সেটা সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, তিনি পাকিস্তান ত্যাগ করার জন্য মনস্থির করেছেন: বাড়ি, অধিকাংশ সম্পদ এবং তার চাকরি তিনি ছেড়ে দিতে চান, তার চাকরি ছিল দেশের সবচেয়ে সম্মানিত সাংবাদিকদের একজনের সমতুল্য। তার একমাত্র শর্ত ছিল, তিনি পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে তার স্ত্রী ও পাঁচ সন্তানকে নিয়ে আসা পর্যন্ত আমরা যেন তার গল্প প্রকাশ না করি। সানডে টাইমস সম্মত হন, এবং মাসকারেনহাস আবার করাচীতে ফিরে যান। দশ দিন অপেক্ষার পর, সানডে টাইমস নির্বাহীর ব্যক্তিগত ঠিকানায় একটি বিদেশী তারবার্তা পৌছায়।

“প্রত্যাবর্তনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ”, এটা বলছে, “সোমবার থেকে যাত্রা শুরু”। মাসকারেনহাস তার স্ত্রী ও পরিবারের জন্য দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার অনুমতি পেতে সফল হন। তাকে ছেড়ে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। যেভাবেই হোক তিনি চলে যাওয়ার একটি উপায় খুঁজে পেয়েছেন।

পাকিস্তানের মধ্যে তার শেষ পদচিহ্ন রাখার সময়, তিনি তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের একজন উর্ধতন কর্মকর্তার, যাকে তিনি ভালোভাবে জানেন, বিপরীতে করিডোরে বসা অবস্থায় নিজেকে খুজে পান। বিমানবন্দর থেকে আসা একটা ফোনেই তার গ্রেফতার হতে পারে।

যাহোক, কোন ফোন আসেনি, এবং গত মঙ্গলবার তিনি লন্ডনে ফিরে আসেন। মাস্কারেনহাস তার বিশেষ ক্ষমতা ও বস্তুনিষ্ঠতা দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে যা দেখেছেন তাই লিখেছেন। একটি গোয়ানি খ্রিস্টান বংশধর হিসাবে, তিনি কোন হিন্দু বা মুসলিম নন। এখনকার পাকিস্তানে তার সারাজীবন কাটিয়ে, ১৯৪৭ সালে রাষ্ট্র গঠন হওয়ার পর থেকে পাকিস্তানি পাসপোর্ট সঙ্গে করে, এবং সেসময় থেকে বহু পাকিস্তানি নেতার আস্থা অর্জন করেও, ব্যক্তিগত অনুতাপ থেকে তিনি তার প্রতিবেদন লিখেছিলেন। তিনি বলেন, “আমাদের তথ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা কতৃক আমাদের সেনাবাহিনীর কর্মকান্ডকে দেশপ্রেম হিসাবে দেখানো হয়েছিলো।

তার প্রতিবেদন নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই, তিনি দেখেছিলেন তার নিজের সংবাদপত্রের জন্যই। তাকে একটা গল্প জমা দিতে বলা হয়েছিল, যা ২রা মে সানডে টাইমস-এ প্রকাশিত হয়েছিল, যেখানে কেবল ২৫/২৬শে মার্চে যখন বাঙালি সৈন্যরা বিদ্রোহ করেছিলো এবং অবাঙালিদের বিরুদ্ধে নৃশংসতা চালিয়েছিল তার প্রতিবেদন ছিল।

এমনকি দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি সম্পর্কিত একটা তথ্যও ছিল যা সমালোচকরা মুছে দিয়েছিল। এটি তার বিবেকের সংকীর্নতা বাড়িয়ে দিয়েছে।

কিছুদিনের ‘দ্বিধাদ্বন্দ্বের’ পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন,তার নিজের কথায়, ‘হয় আমি যা দেখেছি তার পুরো গল্পটি লিখব, অথবা আমার লেখা বন্ধ করতে হবে; আমি আর কখনো নিরপেক্ষতার সাথে লিখতে পারব না”। এবং সেজন্য তিনি একটি প্লেনে ওঠেন এবং লন্ডনে এসেছিলেন।

পূর্ববঙ্গের পুরো ঘটনা নিয়ে বিস্তৃত জ্ঞান থাকার এবং বস্তুনিষ্ঠ কূটনৈতিক সূত্র এবং সাথে অন্যান্য শরণার্থী যারা পূর্ব বাংলার পুরো ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন তাদের সাহায্যে, আমরা তার (মাস্কারেনহাস) গল্প অত্যন্ত গভীরভাবে যাচাই করতে সক্ষম হয়েছি।

গণহত্যা: সম্পূর্ণ প্রতিবেদন

আব্দুল বারি দুর্ভাগ্যক্রমে দৌড় দিছিলেন। পূর্ববাংলায় হাজার হাজার লোকের মত তিনিও ভুল করেছেন, টহলরত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সম্মুখে দৌড়ানোর মত মারাত্মক ভুল।

তিনি ২৪ বছর বয়সী, সৈন্যবাহিনী দ্বারা বেষ্টিত একজন সামান্য মানুষ। তিনি কাঁপছিলেন, কারণ তাকে প্রায় গুলি করা হচ্ছিলো।

কুমিল্লার প্রায় ২0 মাইল দক্ষিণে মুদফরগঞ্জের কাছে একটি ছোট্ট গ্রামের উপকণ্ঠে আমরা দাঁড়িয়ে, আমি ৯তম ডিভিশনের জি-২ অপারেশনের মেজর রাঠোরের কথাবার্তা শুনেছিলাম, “সাধারনত আমরা তাকে মেরে ফেলতাম যেহেতু সে দৌড় দিছিলো,” “কিন্তু আমরা আপনার জন্য তাকে পরিক্ষা করতেছিলাম। আপনি এখানে নতুন এবং আমি দেখছি আপনি বেশ খুঁতখুঁতে রুচির মানুষ”।

“কেন তাকে মেরেছ?” আমি গভীর উদ্বেগের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলাম।

“কারণ সে একজন হিন্দু অথবা বিদ্রোহী হতে পারে, সম্ভবত একজন ছাত্র বা আওয়ামী লীগ হতে পারে। তারা জানে যে আমরা তাদের চিহ্নিত করছি এবং তারা দৌড় দিয়ে নিজেদের সাথে বেঈমানি করছে”।

“কিন্তু কেন তুমি তাদের হত্যা করছো? এবং কেন বেঁছে বেঁছে হিন্দুদের মারছো? আমি প্রশ্ন করতেই থাকলাম।

“আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে” রাঠোর বলেন, “কীভাবে তারা পাকিস্তানকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছিল? এখন যুদ্ধের ছলে আমরা তাদের শেষ করে ফেলার চমৎকার সুযোগ পেয়েছি”।

“অবশ্যই,” তিনি অবিলম্বে যোগ করেন, “আমরা কেবল হিন্দু পুরুষদেরকেই হত্যা করছি। আমরা সৈন্যরা, বিদ্রোহীদের মতো কাপুরুষ নই, তারা আমাদের নারী ও শিশুকেও হত্যা করে”।

আমি পূর্ব বঙ্গের সবুজ ভূমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রক্তের দাগের প্রথম আভাস পাচ্ছিলাম। প্রথমে এটি ছিল বাঙালি ঘৃণার প্রতিহিংসা স্বরূপ অবাঙালিদের গণহত্যা। এখন এটা ইচ্ছাকৃতভাবে পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনী দ্বারা সংঘটিত গণহত্যা।

খুনের শিকার শুধুমাত্র পূর্ববাংলার হিন্দু নয়, যারা ৭৫ মিলিয়ন জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ- সাথে হাজার হাজার বাঙালি মুসলমানরাও। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ ছাত্র, শিক্ষক, আওয়ামী লীগ এবং বামপন্থী রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা অন্তর্ভুক্ত এবং অন্যান্য ১৭৬,০০০ বাঙালি সৈন্য এবং পুলিশ যাদের সেনাবাহিনী ধরেছিলো, যারা ২৬শে মার্চে সামনাসামনি বিদ্রোহ করেছিলো যদিও সেটা ছিল একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্রের বাংলাদেশের তৈরি করতে একটা অসম্পূর্ন এবং বিপজ্জনক প্রচারণা।

এপ্রিলের শেষের ১০ দিনে আমি পূর্ব বঙ্গে আমার নিজের চোখ ও কান দিয়ে যে অবিশ্বাস্য ঘটনা দেখেছি এবং শুনেছি তাতে এটা স্পষ্ট যে হত্যাকান্ডগুলি সামরিক কমান্ডারদের ক্ষেত্রে ঘটা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।

পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরাই কেবলমাত্র পূর্ববাংলাতে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছেনা। ২৫শে মার্চের রাতে পাকিস্তানি সেন্সর কর্তৃক আমাকে রিপোর্ট করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল যে, পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত বাঙালি সৈন্য ও আধা-সামরিক বাহিনী বিদ্রোহ করেছিল এবং বর্বরতার সাথে অবাঙালিদের আক্রমণ করেছিল।

হাজার হাজার হতভাগ্য মুসলমান পরিবার নির্দয়ভাবে নষ্ট হয়ে যায়, যাদের অধিকাংশই বিহার থেকে আসা শরণার্থী, যারা ১৯৪৭ সালে বিভাজন দাঙ্গার সময় পাকিস্তানকে বেছে নিয়েছিল। নারীরা ধর্ষিত হয়, বা বিশেষভাবে-সজ্জিত ছুরি দিয়ে তাদের স্তন ছিন্ন করা হয়। শিশুরাও এই আতঙ্ক থেকে বাচতে পারেনি: ভাগ্যবানরা তাদের পিতামাতার সাথে নিহত হয়; কিন্তু বহু হাজার হাজার শিশুকে উপড়ানো চোখ অথবা কাটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে সারাজীবন বেঁচে থাকতে হবে। চট্টগ্রাম, খুলনা ও যশোরের প্রধান শহরগুলোতে ২0 হাজারেরও বেশি অবাঙালি মৃতদেহ পাওয়া যায়। মৃতের প্রকৃত সংখ্যা প্রায় ১০০,০০০ এর থেকে বেশি হতে পারে, যা আমাকে পূর্ববাংলার সর্বত্র থেকে বলা হয়; হাজার হাজার অ-বাঙালি কোন চিহ্ন ছাড়াই অদৃশ্য হয়ে গেছে।

পাকিস্তান সরকার এই প্রথম ভয়াবহতা সম্পর্কে বিশ্বকে জানতে দেয়। এবং আরও ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ডের পর যখন তাদের নিজস্ব সেনাবাহিনী হত্যা শুরু করে, তখন দ্বিতীয়বারের মত জানায় এটি কীভাবে দমন করা হয়েছে। দুর্ভিক্ষ ও রোগে যারা মারা গেছে তাদের গণনায় না ধরেই, পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে হিসাব করে দেখেন যে, উভয় পক্ষই ২৫০,০০০ জনকে হত্যা করেছে।

প্রদেশটির, যেখানে দেশের অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যা রয়েছে, প্রায় সফল ভাঙ্গন সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানাতে, জেনারেল ইয়াহিয়া খান এর সামরিক সরকার পূর্ববাংলার সমস্যাগুলির নিজস্ব “চূড়ান্ত সমাধানের” মাধ্যমে চাপ দিচ্ছে।

“আমরা পূর্ব পাকিস্তানকে এবারের এবং সকল বিচ্ছিন্ন হুমকির জন্য শুদ্ধ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছি, এমনকি এতে যদি দুই মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করতে হয় এবং ৩০ বছরের জন্য উপনিবেশ হিসেবে প্রদেশ শাসন করতে হয় তবুও, ঢাকা এবং কুমিল্লার জ্যেষ্ঠ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা কতৃক আমাকে বারবার করে বলে দেওয়া হয়েছে।

পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা পূর্ব বাংলায় ভয়ঙ্কর পুণ্যের সাথে ঠিক সেটাই করছে।

চাঁদপুরের একটি সফরের পর আমরা যখন সূর্যের অস্ত যাওয়ার দ্রুত গাড়ি চালিয়ে ফিরছি (পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনারা বুদ্ধি করে গৃহঅভ্যন্তরে থাকতো) তখন টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজারের পেছন থেকে এক জওয়ান (বেসরকারি) হেঁকে উঠলো: “সাহেব একজন মানুষ দৌড়াচ্ছে”।

মেজর রাঠোর অপ্রত্যাশিতভাবে গাড়ি থামালেন, একই সাথে তার চায়নিজ হালকা মেশিনগান দিয়ে দরজা বরাবর তাক করলেন। ২০০ গজের কম দূরত্বে হাটু সমান ধান ক্ষেতে একজন মানুষ লাফিয়ে চলছে।

“ঈশ্বরের দোহাই গুলি করো না”, আমি চিৎকার করে বললাম। “সে নিরস্ত্র। সে কেবলমাত্র একজন গ্রামবাসী”।

রাঠোর আমাকে একটি নোংরা চাহনি দেয় এবং এর মাধ্যমে একটি সতর্কবার্তা দেয় আমাকে।

যেহেতু মানুষটা (ধান ক্ষেতের) ঘন সবুজ গালিচার মধ্যে নিচু হয়ে লুকিয়ে গেছে, সেজন্য দুজন জাওয়ান ইতোমধ্যে বেরিয়ে গেছে তাকে ধরে আনতে।

জিজ্ঞাসাবাদের পুর্বে কাঁধ জুড়ে থাকা রাইফেলের হাতলে ধপ ধপ শব্দ করছে।

“তুমি কে?”

“রহমত করুন, সাহেব! আমার নাম আবদুল বারী। আমি ঢাকা নতুন বাজারের একজন দরজী”।

“আমার কাছে মিথ্যা বলো না তুমি একজন হিন্দু, কেন পালাচ্ছো?” “কারফিউ সময় প্রায় হয়ে গেছে সাহেব। তাই আমি আমার গ্রামে ফিরে যাচ্ছিলাম।”

“আমাকে সত্য করে বলো, কেন তুমি দৌড়াচ্ছিলে?”

একটি জওয়ান যখন দ্রুত অস্ত্র দিয়ে তার লুঙ্গী সরানোর চেষ্টা করলো, লোকটা উত্তর দেবার আগেই হটাত ভয় পেয়ে গেলো। চর্মের অঙ্গটি তার শরীরের সুন্নতের (লিঙ্গাগ্রচর্মছেদন) বিশেষ চিহ্ন বহন করে, যা মুসলমানদের জন্য বাধ্যতামূলক।

লক্ষ্য বিপুল সংখ্যক মানুষ

অন্ততপক্ষে, এটি স্পষ্টভাবে দেখা গেছিল যে বারী হিন্দু ছিলনা।

জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।

“আমাকে বলো, কেন তুমি দৌড়াচ্ছিলে?”

ভয়ংকরভাবে কাঁপতে থাকা বারী, আতঙ্কিত চোখে এবার আর উত্তর দিতে পারেনি।

সে তাদের হাটু গেঁড়ে পড়েছিলো।

“স্যার, তাকে মুক্তিফৌজ মনে হচ্ছে” বারী যেহেতু তার পায়ের উপর পড়ে ছিল, একটা জওয়ান তাকে সরিয়ে নিলো। (ফৌজি সৈন্যদের উর্দু প্রতিশব্দ, সেনাবাহিনীরা “বাংলার বিদ্রোহীদের” জন্য এটি ব্যবহার করছে।)

আমি রাঠোর মৃদুভাবে বলতে শুনলাম, “হতে পারে”।

আবদুল বারীকে রাইফেলের বাট দিয়ে কয়েকবার মাথায় আঘাত করা হলো, তারপর আকস্মিকভাবে একটা দেয়ালের সাথে চেপে ধরা হলো। তার আত্মচিতকারে আশেপাশের একটা কুড়েঘর থেকে একটি তরুণের মাথা বের করতে দেখা যায়। বারি বাংলায় চিৎকার করে কি যেন একটা বললো। হটাত মাথাটা উধাও হয়ে গেলো। একমুহুর্ত পর একজন দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ লোক কুড়িঘর থেকে বেরিয়ে এলো। রাঠোর তার দিকে তাকালেন।

“আপনি কি এই লোকটিকে চিনেন?”

“হ্যাঁ, সাহেব। তিনি আবদুল বারী।”

“সে কি ফৌজি?”

“না, সাহেব, তিনি ঢাকার একজন দরজী।”

“আমাকে সত্যকথা বলো।”

“খুদার কসম (ঈশ্বরের শপথ), সাহেব, তিনি একজন দর্জি।”

হঠাৎ একটা নীরবতা। আমি বললাম, “ঈশ্বরের দোহাই তাকে যেতে দাও। আর কি প্রমাণ চাও তার নিরাপরাধের সপক্ষে?

কিন্তু জওয়ানরা দৃশ্যত অসন্তোষ প্রকাশ করছিল এবং বারির চারপাশে ঘুরতেছিল। আমি তখন তার পক্ষে আরও একবার অনুরোধ করেলাম যে রাঠোর বারীকে মুক্তি দিতে বলেছে। সেই সময় তিনি বেপরোয়া ছিলেন, এক অকথ্য মূর্তিমান সন্ত্রাস। কিন্তু তার (বারি) জীবন বেঁচে গেছিল।

অন্যরা এতটা ভাগ্যবান হয়নি।

কুমিল্লার ৯তম ডিভিশনের সদর দফতরের কর্মকর্তাদের সাথে ছয় দিনের জন্য ভ্রমণ করার সুবাদে, আমি অনেক কাছ থেকে এসব হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী ছিলাম। আমি দেখেছিলাম গ্রাম থেকে গ্রামে এবং ঘর ঘরে হিন্দুদের তল্লাসী করা হয়, এবং দ্রুত “ছোট অস্ত্র পরিদর্শন” করে তাদের লিঙ্গাগ্রচ্ছেদন করা হইছে কিনা দেখে তাদের গুলি করে মেরে ফেলা হয়। আমি কুমিল্লায় সার্কিট হাউস (সিভিল প্রশাসনিক সদর দফতর) এর প্রাঙ্গনে আঘাত করতে করতে মেরে ফেলা অনেক মানুষের আর্তনাদ শুনেছি। আমি অন্য অসংখ্য মানুষকে টার্গেট হতে দেখেছি এবং তাদের সাহায্য করার মত মানবতা যাদের ছিল কিন্তু “নিয়ন্ত্রনের জন্য” কারফিউ এবং অন্ধকারের আচ্ছাদনে সেটা বাধাগ্রস্থ হতে দেখেছি। আমি সেনা ইউনিট হিসাবে “বিদ্রোহীদের হত্যা এবং পুড়ানো” এর নিষ্ঠুরতা দেখেছি, বিদ্রোহীদের সাফ করার পর, শহর ও গ্রামগুলিতে দাঙ্গা চালিয়ে যাচ্ছে।

আমি “শাস্তিমূলক পদক্ষেপ” দ্বারা বিধ্বস্ত পুরো গ্রাম দেখেছি।

এবং অফিসারদের কোয়ার্টারে রাতের বেলা আমি অবিশ্বাস্যভাবে সাহসী ও সম্মানিত মানুষগুলোকে তাদের দিনের বেলা করা খুন নিয়ে গর্বের ভঙ্গিতে গল্পগুজব করতে শুনেছি।

“আপনি কতটা পেয়েছেন?”

উত্তরগুলো আমার স্মৃতিকে অনুভূতিহীন করে তুলতো।

কোন পাকিস্তানি কর্মকর্তা আপনাকে “একতা, সততা ও পাকিস্তানি মতাদর্শের সংরক্ষণ” সম্পর্কে যেমনটা বলবেন, তার সবই করা হচ্ছে। সেজন্য অবশ্যই এটা অনেক দেরী হয়ে গেছে। ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা প্রায় এক হাজার মাইল দূরে থাকা দুই প্রদেশকে একসঙ্গে রাখাতে সামরিক বাহিনী কতৃক যে কার্যক্রম করা হয়েছিল তা এখন সত্যিকার অর্থে মতাদর্শগত এবং মনস্তাত্ত্বিকভাবে বিষয়টা নিশ্চিত করেছে। পূর্ববাংলা শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর ভারী অস্ত্র দ্বারা পাকিস্তানে রাখা যেতে পারে। এবং পাঞ্জাবীদের দ্বারা সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত হয়, যারা ঐতিহ্যগতভাবে বাঙালিদের অবজ্ঞা ও ঘৃণা করে।

এই দূরত্ব আজ এতোটাই পরিপুর্ন যে খুব অল্প কয়েকজন বাঙালিকে স্বেচ্ছায় পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে দেখা যাবে। ঢাকা পরিদর্শনকালে আমি এক পুরানো বন্ধুর সাথে যখন দেখা করতে গিয়েছিলাম, এই ধরনের একটি দুর্দশামূলক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। “আমি দুঃখিত,” তিনি আমাকে বলেছিলেন, “সবকিছু পালটে গেছে। যে পাকিস্তানকে আমি এবং আপনি জানতাম তা অস্তিত্বহীন হয়ে গেছে। আসুন এটাকে আমরা আমাদের পিছনে রাখি।”

সেনাবাহিনী নিয়ে যাওয়ার আগে অবাঙালিদের গণহত্যার ব্যাপারে কয়েক ঘন্টা পর একজন পাঞ্জাবি সেনা কর্মকর্তা আমাকে বলেছিল: “তারা আমাদের সাথে ১৯৪৭ সালে বিভাজন দাঙ্গায় শিখদের তুলনায় আরও নিষ্ঠুর আচরণ করেছিল। কিভাবে এটা আমরা কখনো ভুলতে বা ক্ষমা করতে পারি?”

হাড়-পেষণকারী সামরিক অপারেশনের দুটি স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এক, যা কর্তৃপক্ষ “শুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া” বলতে চান: গণহত্যার জন্য একটি ধূর্ততা। অন্যটি হল “পুনর্বাসন প্রচেষ্টা”। পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিমাঞ্চলীয় একটি দলীয় উপনিবেশে পরিণত করার জন্য এই পদক্ষেপগুলি একটি উপায় বলা যায়। এই সাধারণভাবে ব্যবহৃত অভিব্যক্তি এবং পুনরাবৃত্তিমূলক অফিশিয়াল তথ্যসুত্রে বলা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী উপকারে “দুষ্কর্মকারী” এবং “অনুপ্রবেশকারীদের” জন্য আইন প্রনয়ন করা হচ্ছে। এসব অপপ্রচার দূরে সরান, এবং বাস্তবতা হলো উপনিবেশিকরণ এবং হত্যা করা।

১৮ই এপ্রিল একটি রেডিও সম্প্রচারে আমি পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেলের টিক্কা খানের ভাষণ শুনি, হিন্দুদের নৃশংসতার পক্ষে যুক্তিই ছিল তার সে উদ্ধৃতি। তিনি বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা, যারা পাকিস্তান সৃষ্টির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, সেটা তারা জীবিত রাখতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ”। যাহোক, হিংস্র এবং আগ্রাসী সংখ্যালঘুদের দ্বারা জবরদস্তিপূর্বক জীবন ও সম্পত্তির হুমকির মাধ্যমে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠের কণ্ঠস্বর দমন করা হয়, যার ফলে আওয়ামী লীগকে ধ্বংসাত্মক পথ গ্রহণ করতে বাধ্য করে”।

অন্যরা গোপনে কথা বলতে বলতে ন্যায়পরায়ণতা খুঁজতে ব্যস্ত ছিল।

কুমিল্লায় অফিসারের মেসে ৯তম বিভাগের সদর দফতরের কর্নেল নায়ার্ন আমাকে বলেন, “হিন্দুরা তাদের অর্থ দিয়ে মুসলিম জনগণকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করেছে”। তারা সাদা প্রদেশকে রক্তাক্ত করেছে। ভারতে সীমান্ত দিয়ে অর্থ, খাদ্য এবং উত্পাদন প্রবাহিত হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা কলকাতায় শিক্ষিত হওয়ার জন্য কলেজ ও স্কুলের অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষাকর্মী এবং নিজেদের সন্তানদের পাঠিয়েছিল। এটি এমন অবস্থানে পৌঁছেছিল যেখানে বাঙালি সংস্কৃতি প্রকৃতপক্ষে হিন্দু সংস্কৃতি ছিল এবং পূর্ব পাকিস্তান কলকাতার মারওয়ারি ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। আমাদের জনগণ ও জনগণের ভূখণ্ডকে তাদের বিশ্বাসের দিকে ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছি”।

অথবা মেজর বশিরকে নিয়ে যান তিনি কর্মী র্যাং ক থেকে উঠে এসেছেন। তিনি কুমিল্লায় ৯ম ডিভিশনের এসএসও এবং তিনি ব্যক্তিগতভাবে ২৮ জনের শরীর গর্বিত। যা ঘটেছে সেজন্য জন্য তার নিজস্ব কারণ রয়েছে। তিনি এক কাপ সবুজ চা দিতে দিতে আমাকে জানান, এটা শুদ্ধ এবং অশুদ্ধের মধ্যে যুদ্ধ। “হয়তো এখানের মুসলমানদের মুসলিম নাম আছে এবং তারা নিজেদেরকে মুসলমান বলে। কিন্তু মনের দিক থেকে তারা হিন্দু। আপনি বিশ্বাস করবেন না যে ক্যান্টনমেন্ট মসজিদটির মৌলভী এখানে শুক্রবার নামাজের সময় ফতোয়া জারি করেছে, যারা পশ্চিম পাকিস্তানিদেরকে হত্যা করবে তারা জান্নাতে যাবে। আমরা এসব বেজন্মাদের চিহ্নিত করেছি এবং এখন অন্যদেরকেও করছি। যারা যাকি আছে তারা প্রকৃত মুসলমান হবে এবং এমনকি আমরা তাদেরকে উর্দু শিক্ষা দেব”।

সবখানে, আমি কর্মকর্তা ও পুরুষদের তাদের নিজেদের কুসংস্কারের বেড়াজালে কল্পনাপ্রসূত ন্যায়পরায়ণতার পোশাক তৈরি করতে দেখেছি। বলির পাঁঠাদের বৈধতা লাভ করতে হতো তাদের নিজস্ব বিবেকের জন্যই, যার ভয়ানক “সমাধান” ছিল আসলে একটা রাজনৈতিক সমস্যা: বাঙালিরা নির্বাচনে জিতেছিল এবং শাসন করতে চেয়েছিল। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাকিস্তানের পাঞ্জাবীরা যেহেতু উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও স্বার্থপরতা নিয়ে সরকারের নীতির ওপর আধিপত্য করে, তাই তাদের ক্ষমতার কোন ক্ষতি হবে না। সেনাবাহিনী তাদের সমর্থন করছিল।

সেনাবাহিনী আসার আগে, কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে অবাঙালিদের গনহত্যার প্রতিশোধে যা করা হয়েছে তার বৈধতা প্রদান করে। কিন্তু ঘটনাগুলো স্পষ্ট করে যে এই দাঙ্গা কোন স্বতঃস্ফূর্ত বা অশাসিত প্রতিক্রিয়ার ফল নয়। এটা ছিল পরিকল্পিত।

এটা স্পষ্ট যে, লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান যখন মৃদু, স্বেচ্ছাসেবী থেকে পূর্ববাংলার গভর্নর নিযুক্ত হন, তখন থেকেই এই “চিহ্নিতকরণ” এর পরিকল্পনা করা হয়েছিল। পণ্ডিত লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাহেবজাদা খান থেকে অ্যাডমিরাল আহসান, এবং সেখানের সামরিক কমান্ড। মার্চ মাসের শুরুতে বাঙালির বহু আকাঙ্ক্ষিত সমাবেশ বৈঠক যখন স্থগিত করা হলো, শেখ মুজিবুর রহমানের বেসামরিক আইন অমান্য আন্দোলনে গতি এসেছিল। এটা বলা হয়েছে, পূর্ববাংলায় অবস্থানরত পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের ক্রমবর্ধমান অপমানের কারণে শীর্ষস্থানীয় সামরিক প্রতিষ্ঠানে হওয়া অসন্তোষের জোয়ারে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান মৌন সম্মতি দিয়েছিল। ঢাকায় পাঞ্জাবি ইস্টার্ন কমান্ড কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি প্রতিষ্ঠা করা অব্যাহত রাখে। (সম্ভবত এটি উল্লেখযোগ্য যে, খানেরা এর সাথে জড়িত নয়: খান পাকিস্তানের সাধারণ উপনাম।)

সেনা ইউনিটগুলি ২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় বিদ্রোহের বিরুদ্ধে ঢাকায় দমন অভিযান চালায়। পরদিন সকালে কয়েক ঘণ্টার জন্য বিদ্রোহের পরিকল্পনা করা হয়। তাদের মধ্যে অনেক লোকজনকে তালিকাভুক্ত করা হয়। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলো, হিন্দু এবং বহু সংখ্যক মুসলিম, ছাত্র, আওয়ামী লীগ, অধ্যাপক, সাংবাদিক; এবং যারা শেখ মুজিবের আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকায় ছিলেন। প্রকাশ্য অভিযোগ করা হয় যে জগন্নাথ হল, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু ছাত্ররা থাকে, থেকে সেনাবাহিনীদের উপর কামান দিয়ে আক্রমন করা হয় যা রমনা রেসকোর্সে মন্দিরের চারপাশে নির্মিত দুটি হিন্দু উপনিবেশ এবং পুরনো শহরের অভ্যান্তরে শঙ্করপট্টির তৃতীয় উপনিবেশের ধ্বংসাত্মকতা খুব কমই সমর্থন করে। ২৬ ও ২৭শে মার্চ রাতে কারফিউ চলাকালীন সময়ে ঢাকা এবং আশপাশের শিল্পকেন্দ্র নারায়ণগঞ্জের উল্লেখযোগ্য হিন্দু জনগোষ্ঠী কেন সম্পূর্ণভাবে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল তাও ব্যাখ্যা করে না।

অনুরূপভাবে কারফিউ চলাকালীন যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল সেই সংখ্যালঘু মুসলমানদের কোনও চিহ্ন নেই। পরিকল্পিত অভিযানে সেসব ব্যক্তিদের অপসারন করা হয়েছে: হিন্দু আগ্রাসনের একটি উদ্দীপ্ত প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত ভিন্ন ফলাফল।

একটি পেন্সিলের খোঁচা, একটি মানুষ ‘খতম’

১৫ই এপ্রিল ঢাকায় ঘুরে বেড়ানোর সময়, ইকবাল হলের হোস্টেলের ছাদে চারজন ছাত্রের পচে যাওয়া মাথা খুঁজে পেয়েছিলাম। তত্ত্বাবধায়ক বলেন, ২৫শে মার্চের রাতে তারা নিহত হয়। দুটি সিঁড়িতে এবং চারটি কক্ষের প্রতিটাতে প্রচুর রক্ত পাওয়া গেছে। বিশেষ কারণে ইকবাল হলের পিছনের একটি বড় আবাসিক ভবন সৈন্যরা বেছে নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। দেয়ালগুলিতে বুলেটের আঘাতে ছোট ছোট গর্ত তৈরি হয়েছে এবং সিড়িগুলিতে এখনো রয়েছে দীর্ঘদিনের দুর্গন্ধ, যদিও ব্যপকভাবে ডিডিটি পাওডার ছড়ানো হয়েছে। প্রতিবেশীরা বলেছে যে ২৩টি মহিলা ও শিশু মৃতদেহ মাত্র কয়েক ঘন্টা আগেই স্থানান্তর করা হয়েছে। ২৫শে মার্চের পর থেকে তারা ছাদে পচতেছে। এটা অনেক প্রশ্ন করার পরেই প্রমাণিত হয়েছিল যে শিকারটি প্রায় কাছাকাছি বসবাসকারী হিন্দু বস্তির। সেনাবাহিনী বন্ধ করে দেওয়ার কারণে তারা ভবনটিতে আশ্রয় চেয়েছিল।

এই গণহত্যা আশ্চর্যরকম উদ্দেশ্যহীনতার সাথে পরিচালিত হচ্ছে। কুমিল্লা শহরের সেনাশাসন প্রশাসক মেজর আগার অফিসে বসে, ১৯শে এপ্রিল সকালের দিকে আমি দেখলাম, কিভাবে ভাবনা-চিন্তা বিহীনভাবে শাস্তি নির্ধারন করা যায়। পুলিশের এক বিহারি উপ-পরিদর্শক পুলিশ লক-আপে আটক বন্দীদের তালিকা নিয়ে এগিয়ে আসেন। আগা সেটা দেখেন। এরপর, তিনি তার পেন্সিলের এক খোঁচায় আকস্মিকভাবে চারটি নামে টিক চিহ্ন দিয়ে দেন।

তিনি বলেন, “নিষ্পত্তির জন্য আজ সন্ধ্যায় এই চারটিকে আমার কাছে আনো”। তিনি আবার তালিকায় তাকান। পেন্সিল দিয়ে আরো একবার খোঁচা দিলেন। “এবং এই চোরটাকেও তাদের সঙ্গে আনবে।”

এক গ্লাস নারকেল দুধ খেতে খেতে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়েছিল। আমি জানতাম যে দুই বন্দী হচ্ছেন হিন্দু, তৃতীয়জন ‘ছাত্র’ এবং চতুর্থজন আওয়ামী লীগ সংগঠক। জানা যায়, “চোরটা” হলো সেবাস্তিয়ান নামে এক বালক যে তার এক হিন্দু বন্ধুর বাড়ি থেকে জিনিসপত্র নিজের বাড়ি নেওয়ার সময় ধরা পড়ে।

পরে সেই সন্ধ্যায় আমি এইসব লোককে দেখেছিলাম, তাদের হাত ও পা একটি দড়ি দিয়ে বাধা অবস্থায় সার্কিট হাউস প্রাঙ্গণের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ৬টায় কার্ফিউ শেষ হবার একটু পর, হাড় এবং মাংসের সাথে মিলিত কাঠের খটখট শব্দে কুহূ কুহূ করা এক ঝাঁক ময়না পাখি বিরক্ত হয়ে তাদের গান থামিয়ে দেয়।

মেসের রসিকতা অনুযায়ী, বেলুচ রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন আজমাত দুটি খ্যাতি অর্জনের দাবীদার। এক, ৯ম বিভাগের কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেলের শওকত রাজার জন্য তার এডিসি হিসাবে কাজ করা। অন্যটি, তার সহকর্মীরা র্যাভগিং এর মাধ্যমে তার ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল।

জানা যায়, আজমাত ছিল গ্রুপের একমাত্র কর্মকর্তা যে কখনো হত্যা করেনি। মেজর বশির তাকে নির্মমভাবে খুঁচিয়েছিলেন।

বশির এক রাতে তাকে বলেছিলো, “আসো আজমাত,” “আমরা তোমাকে পুরুষ বানাতে যাচ্ছি। আগামীকাল আমরা দেখতে পাব কিভাবে তুমি তাদের দৌড়ের উপর রাখতে পারো। এটা খুবই সহজ।”

একটা বিশেষ ব্যাপার নির্দেশ করতে বশির তার দীর্ঘ বক্তব্যের মধ্যে চলে যায়। এসএসও হিসাবে তাঁর দায়িত্ব ছাড়াও বশির ছিলেন সদর দফতরের “শিক্ষা কর্মকর্তা”। তিনিই কেবলমাত্র পাঞ্জাবি কর্মকর্তা ছিলেন যিনি অনর্গল বাংলা বলতে পারতেন। সাধারণ সম্মতিতে বশির ছিলেন স্ব-শিক্ষিত বিরক্তিকর লোক যিনি নিজের কণ্ঠ নিয়ে গর্বিত ছিলেন।

আমাদের জানানো হয়েছিল, একজন দাড়িওয়ালা (দাড়িযুক্ত মানুষ) লোক সকালে তার ভাই, যিনি কুমিল্লার একজন বিশিষ্ট আওয়ামী লীগের সংগঠক, এর খোজ নিতে বশিরের কাছে এসেছেন, যিনি কয়েকদিন আগে সেনা কর্তৃক নিখোঁজ হয়েছে। তাকে ধরেছিলাম, বশির তাকে বলেছিলেন: “সে পালিয়ে গেছে”। বুড়ো মানুষ বুঝতে পারে না যে তার ভাই একটি ভাঙা পায়ে কীভাবে পালিয়ে যেতে পেরেছিল। আমিও পারিনি। সুতরাং বশির চোখ টিপ মেরে আমাকে বুঝিয়ে দেয়।

রেকর্ড হয়তো বলবে ধর গায়া: “পালানোর সময় গুলিবিদ্ধ”। আমি কখনোই জানতে পারিনি ক্যাপ্টেন আজমাত কাওকে মারতে পেরেছিল কিনা। বিদ্রোহী বাঙ্গালী বাহিনী যারা চট্টগ্রামের উত্তরে ৭০ মাইল পর্যন্ত কুমিল্লার ফেনী হাইওয়েতে গর্ত খুঁড়েছিল, তারা সেতু ও সাঁকো ধ্বংস করে ৯ম বিভাগকে বন্ধ করে দিয়েছিল।

জেনারেল রেজা ঢাকায় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড থেকে নরকের যন্ত্রনা পোহাচ্ছেন, পালিয়ে যাওয়া বিদ্রোহীদের জন্য দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় সীমানা বন্ধ করে দেওয়ার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ছিলেন। চট্টগ্রাম বন্দরে স্তুপকৃত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করতে উত্তর-পূর্বের এই একমাত্র জমির রুটটি উন্মুক্ত করা অত্যন্ত জরুরী ছিল।

এসব সঙ্গত কারণেই জেনারেল রেজা খিটখিটে ছিলেন। তিনি প্রায় প্রতিদিনই এলাকা ত্যাগ করেন। তিনি ফেনীতে ফাটল ধরা সেতুটি দখল রাখতে কয়েক ঘণ্টা ব্যয় করেন। স্বাভাবিকভাবে, ক্যাপ্টেন আজমাত জেনারেলের মত ছিলেন। আমি তাকে আর দেখতে পাইনি। কিন্তু অভিজ্ঞতা যদি কোন নির্দেশক হয়, তাহলে সম্ভবত আজমাতকে তার “খুন” এবং র্যা গিং নিয়ে আরো তিন সপ্তাহের জন্য ঘাম ঝরাতে হবে। ৯ম বিভাগ ৮ই মে ফেনী এবং পার্শ্ববর্তী এলাকাটি পরিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিল। এরমধ্যেই জোরপূর্বক অবিরাম বোমা ও কামান বাহিনী কারণে বাংলা বিদ্রোহীরা তাদের অস্ত্রসহ নিয়ে তাদের প্রতিবেশী সীমান্ত পাড়ি দেয়।

বাঙালি বিদ্রোহীদের এই বিপুলসংখ্যক সশস্ত্র ও নিয়মিত বাহিনীর পলায়ন, ৯ম বিভাগ সদর দফতরের লেফটেন্যান্ট জেনারেল আসলাম বেগের মধ্যে গভীর উদ্বেগের কারণ হয়েছিল। তিনি ব্যাখ্যা করেন, “ভারতীয়রা” স্পষ্টতই তাদের সেখানে বসতি স্থাপন করার অনুমতি দেবে না। এটা খুব বিপজ্জনক হবে। তাই তারা যতদিন সীমান্ত ওপারে থাকবে ততদিন পর্যন্ত তাদের ভোগান্তিতে রাখা হবে। আমরা তাদের খুন করতে না পারলে, আমরা দীর্ঘসময়ের জন্য গুরুতর সমস্যায় পড়ব”।

লেফটেন্যান্ট কর্ণেল বেগ একজন জনপ্রিয় আর্টিলারি অফিসার ছিলেন যিনি পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর চীনে কাজ করেছিলেন, যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী চীনা সরঞ্জামে রূপান্তরিত হচ্ছিল। তাকে একজন গর্বিত পরিবারিক মানুষ বলা হয়েছিল। তিনি ফুলও পছন্দ করেন। তিনি চাপা গর্বের সাথে আমাকে বলেছিলেন যে, কুমিল্লায় পূর্ববর্তী পোস্টিংয়ের সময় তিনি চীনের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে টকটকে লালরঙা বড় শাপলাফুল এনেছিলেন যা দফতরের বিপরীত দিকের পুকুরে শোভা পাচ্ছে। মেজর বশির তাকে খুব পছন্দ করেন। একজন অফিসারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে বশির আমাকে বলেছিলেন যে, একবার তারা এক বিদ্রোহী অফিসারকে ধরেছিলেন, তাকে কি করা যায় সেটা নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা হয়েছিল। “অন্যরা যখন নির্দেশাবলীর জন্য টেলিফোন করায় ব্যস্ত ছিলো” তিনি বলেন, “তিনি এই সমস্যাটির সমাধান করেছেন। ডিলিয়ারগায়া। খাঁদ থেকে শুধুমাত্র লোকটির পা বেরিয়ে ছিল”।

এত সৌন্দর্যের মাঝে এতো বেশি নৃশংসতা কল্পনা করা কঠিন। এপ্রিলের শেষের দিকে যখন গেছিলাম, কুমিল্লা তখন সজ্জিত ছিল। রাস্তার উভয় দিকের দিগন্তে ছড়িয়ে থাকা সমৃদ্ধশালী ধানের সবুজ গালিচা উজ্জ্বল লাল রঙের ছটা দ্বারা এখানে সেখানে বিভক্ত ছিল। যেটাকে পূর্ন প্ররিস্ফুটিত গো/মোহর এবং যথোপযুক্তভাবে “অরণ্যের শিখা” খেতাব দেয়া যায়। গ্রামাঞ্চলের আম ও নারকেল গাছ ফল দিয়ে ভরা ছিল। এমনকি রাস্তার পাশে ছোট কুকুর সাইজের ছাগল চড়ে বেড়ানো থেকেই বাংলার প্রকৃতির প্রাচুর্যের প্রমাণ পাওয়া যায়। “আপনি নারী থেকে পুরুষকে শুধুমাত্র একটা উপায়ে আলাদা করতে পারেন”, তারা আমাকে বলেছিল, “সব মাদি ছাগল কি গর্ভবতী হয়।”

তাদের প্রতিহিংসাকে হত্যা করো এবং পুড়িয়ে দাও

সমগ্র জগতের সর্বাধিক জনবহুল এলাকা – কুমিল্লা জেলায় জনসংখ্যার ঘনত্ব মাত্র ১,৯০০ বর্গ মাইল – শুধুমাত্র কোথাও কোন মানুষের দেখা নাই।

কয়েকদিন আগে ঢাকা শহরের অদ্ভুত ফাকা গলিতে আমি আমার সহচরকে জিজ্ঞাসা করলাম, “বাঙালিরা কোথায়”? তার উত্তর ছিল, “তারা গ্রামে চলে গেছে”। এখন গ্রামাঞ্চলেও কোন বাঙালি নেই। ঢাকার মত কুমিল্লা শহরও ব্যাপকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এবং পূর্বের নিশ্চুপ গ্রামগুলো রেখে লাক্ষ্মামের দিকে যেতে দশ মাইল রাস্তায়, আমি কৃষক দেখেছি যাদের সংখ্যা দুই হাতের আঙ্গুল দিয়ে গননা করা যায়।

সেখানে অবশ্য স্বয়ংক্রিয় রাইফেল হাতে শতশত খাকি পোষাক পরিহিত সৈন্যবাহিনী ছিল যাদের মুখে কোন হাসি ছিলনা। আদেশ অনুযায়ী, কখনো তারা হাতের রাইফেল ত্যাগ করেনি। শক্ত, সমর্থ-সুখী পুরুষরা ক্রমাগত রাস্তাগুলি পাহারা দিচ্ছে। যেখানে সেনাবাহিনী আছে, সেখানে আপনি বাঙালিদের খুঁজে পাবেন না।

রেডিও এবং সংবাদমাধ্যমে সামরিক আইনের আদেশ ক্রমাগত পুনরাবৃত্তি হচ্ছে, সন্ত্রাসী আইনের মধ্যে কেউ ধরা খেলে তার মৃত্যুদণ্ড ঘোষনা করছে। যদি কোন রাস্তা আটকানো হয় বা একটি সেতু ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস করা হয়, তবে জায়গাটির ১০০ গজের মধ্যে সকল বাড়ীঘর ধ্বংস করা হবে এবং তাদের বাসিন্দাদের বেধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

শব্দটি যতটুকু নির্দেশ করে তার থেকে সেটার অনুশীলন আরও ভয়ংকর। “শাস্তিমূলক ব্যবস্থা” এমন কিছু বিষয় যা শুনলে বাঙালিরা কাঁপে।

এটার অর্থ কি বুঝায় আমরা সেটা দেখলাম ১৭ই আগষ্ট সকালে যখন হাজীগঞ্জ রওনা দিলাম, যে রাস্তাটি আলাদা হয়ে চাঁদপুরের দিকে গেছে। হাজিগঞ্জের কয়েক মাইল আগে, ঐ এলাকায় সক্রিয় থাকা বিদ্রোহীরা গতকাল রাতে ১৫ ফুটের সেতুটি ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। মেজর রাঠোর (জি-২ অপারেশন) অনুযায়ী, তৎক্ষণাৎ একদল সৈন্য পাঠানো হলো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য। ক্ষতিগ্রস্ত সেতু থেকে এক মাইলের এক চতুর্থাংশ দূরত্ব পর্যন্ত দীর্ঘ ধোঁয়ার প্রবাহ সব দিকে দেখা যায়। এবং আমরা যখন সচেতনতার সাথে কাঠের সাঁকো, যা দ্রুত মেরামত করা হয়েছে, এর উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছি, তখন গ্রাম্য বাড়িগুলাতে আগুন ধরা শুরু করলো।

গ্রামের পিছনে কিছু জওয়ান শুকনো নারকেল পাতা দিয়ে আগুন ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছিল। তারা আগুন জ্বালানোর চমত্কার রসদ তৈরি করছিল এবং যা সাধারণত রান্নার জন্য ব্যবহৃত হয়। আমরা গ্রামের প্রবেশপথ ও নারকেল গাছের মধ্যে হামাগুড়ি দিতে থাকা একটি দেহ দেখতে পাই। রাস্তার অন্য দিকে ধানক্ষেতের পাশে আরেকটি গ্রামে আগুনের প্রমাণ পাওয়া যায় যা ডজন খানেক বাশের তৈরি কুড়েঘর পুড়িয়েছে। সেনাবাহিনী আসার আগে শত শত গ্রামবাসী পালিয়ে যায়। নারকেল গাছের মধ্যের মানুষটার মত অন্যরা ধীরে ধীরে চলে যায়।

আমরা চলতে থাকলাম, মেজর রাঠোর বলেন, “এটার জন্য তারা নিজেরা দায়ী”। আমি বললাম কিছু বিদ্রোহীদের কর্মকাণ্ডের জন্য নিরপরাধ মানুষের প্রতি এটা অবশ্যই অত্যন্ত ভয়াবহ প্রতিহিংসা। তিনি উত্তর দেন নি।

কয়েক ঘণ্টার পরে আমরা যখন আবার চাঁদপুর থেকে হাজিগঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন প্রথমবারের মত আমার সাথে “হত্যা ও অগ্নিসংযোগ মিশন” এর বর্বরতার পরিচয় ঘটে।

আমরা তখনও একটি গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঝড়ের পরিণতির মধ্যে পড়েছিলাম, যেটি এলাকাটিতে বিকালে আঘাত হেনেছে। শহরের উঁচু মসজিদ টাওয়ারের উপর একটি ঘন মেঘের ভূতুড়ে ছায়া। হালকা গুঁড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে ক্যাপ্টেন আজহার এবং আমাদের পেছনে থাকা জীপ গাড়ির চার জনের ইউনিফর্ম ভিজতে শুরু করেছে।

আমরা এক কোণায় গাড়ি থামালাম এবং মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটা ট্রাক দেখলাম। আমি গুনে দেখলাম সাতটা, সবগুলো যুদ্ধপোষাক পরিহিত জওয়ানে ভর্তি। সারির একেবারে সামনে একটা জীপ গাড়ি। তৃতীয় একজনের তত্ত্বাবধানে রাস্তার ওপাশে দুইজন মানুষ রাস্তায় সারিবাঁধা একশোর বেশি দোকানের একটির দরজা ভাঙার চেষ্টা করছিল। নকশা করা সেগুন কাঠের দরজাটি দুটি কুড়ালের আঘাতে প্রায় খুলতে শুরু করেছে, মেজর রাঠোর টয়োটা থামালো।

“এইটা কি করতেছ তুমি?”

তিনজনের যিনি তত্ত্বাবধানে ছিলেন, তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখলেন।
“মিয়া,” (ভারি কণ্ঠে) তিনি চিৎকার করে বলেছিলেন, “আপনি কি মনে করেন আমরা কি করছি?”

কণ্ঠস্বর চিনতে পেরে রাঠোর জল-তরমুজ হাসি দিলেন। তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন, এটা তার পুরনো বন্ধু “ইফতি” ছিল – ১২তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রাইফেলের মেজর ইফতিখার।

রাঠোর: “আমার ধারণা করছিলাম কেউ লুটপাট করছে”

ইফতিখার: “লুটপাট? না। আমরা হত্যা করছি আর জ্বালাচ্ছি।”

হাত নেড়ে দোকানে ঢুকার ইশারা করে বললেন, তিনি গুদাম ধ্বংস করতে যাচ্ছিলেন।

রাঠোর: “আপনি কতটা পেয়েছেন?”

ইফতিখার লাজুক ভঙ্গিতে হাসলেন।

রাঠোর: “আরে বলো। তুমি কতটা পেয়েছ?”

ইফতিখার: “মাত্র বারোটা এবং ঈশ্বরের জন্যই আমরা তাদের ধরতে পেরেছিলাম। আমরা হয়তো তাদের হারিয়ে ফেলতাম, যদি আমি আমার পেছন থেকে লোক না পাঠাতাম।”

মেজর রাঠোরের লাঠির মৃদু খোঁচা খেয়ে ইফতিখার তখন পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ননা করতে চললেন হবিগঞ্জে এতো খোঁজাখুঁজির পর কিভাবে তিনি শহরের প্রান্তে এক বাড়িতে লুকিয়ে থাকা ১২জন হিন্দুর খোঁজ পেলেন। এদের খতম করা হয়েছে। এখন মেজর ইফতেখার তার মিশনের দ্বিতীয় পর্বে: জ্বালানো।

দোকানের সামনের ছোট প্রদর্শনী বাক্সটি প্যাটেন্ট ওষুধ, কাশির সিরাপ, আমের জুস, ইমিটেশনের গহনা, রঙিন সূতার গুটি, এবং ইলাস্টিক অন্তর্বাসের প্যাকেটে ঠাসা ছিলো। ইফতিখার লাথি মেরে ফেলে দিলো, কাঠের জিনিসপত্র ভেঙে আগুন জ্বালানোর উপকরন বানালো। এরপর একটা তাক থেকে তিনি কিছু পাটের শপিং ব্যাগ নিয়ে প্রস্তুত করলেন। অন্যখান থেকে কিছু প্লাস্টিকের খেলনা নিলেন। রূমালের বাণ্ডিল এবং লাল কাপড়ের ছোট বোঝা মেঝেতে থাকা স্তুপে রাখলেন। ইফতিখার সেগুলোকে একসাথে গাদা করেন এবং আমাদের টয়োটাতে বসে থাকা এক জওয়ানের কাছ থেকে একটা (ম্যাচ) বক্স ধার করেন। কিন্তু জওয়ানের নিজস্ব চিন্তা ছিল। গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে দৌড়ে সে দোকানের মধ্যে যায় এবং দোকানের নিচু ছাদ থেকে ঝুলতে থাকা একটা ছাতা নেওয়ার চেষ্টা করে। ইফতিখার তাকে বের হয়ে যেতে আদেশ করলো।

তাকে রূঢ়ভাবে স্মরণ করিয়ে দিল, লুটপাট আদেশ বিরুদ্ধ।

শীঘ্রই ইফতেখার আগুন জ্বালালেন। তিনি পুড়তে থাকা পাটের ব্যাগ ছুড়ে দিলেন দোকানের এক কোণে; কাপড়ের বোঝা দিলেন অন্য কোনায়। দোকান জ্বলজ্বল করে পুড়তে শুরু করলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে আমরা শাটার দরজায় আগুনের চড়চড় শব্দ শুনতে পেলাম, যেহেতু দোকানটির বাম দিকে আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল, তারপর পরেরটাতে।

এই সময়ে, অন্ধকার বাড়তে থাকায় রাঠোর উদ্বিগ্ন হতে শুরু করে। তাই আমরা চলতে থাকলাম।

পরের দিন মেজর ইফতেখারের সাথে দেখা করার পর তিনি ক্রুদ্ধভাবে আমাকে বলেছিলেন, আমি কেবলমাত্র ছয়টি বাড়ি পুড়িয়েছি “বৃষ্টি নাহলে আমি আরো অনেকগুলো পুড়াতে পারতাম।”

মুদাফারগঞ্জ থেকে কয়েক মাইল দূরে একটি গ্রামের কাছে পৌঁছে একজন লোককে মাটির দেওয়াল ঘেষে নিচু হয়ে আছে দেখে আমরা থামতে বাধ্য হলাম। একজন জওয়ান সতর্ক করে বললো এটি ফাউজি স্নাইপার হতে পারে। কিন্তু সাবধানে অনুসন্ধানের পর দেখা গেলো একটা সুন্দর যুবতি হিন্দু মেয়ে। সে তার মানুষের জন্য শান্তভাবে সেখানে বসে ছিল, ঈশ্বরই জানেন কার জন্য অপেক্ষা করছে সে। একজন জওয়ান ১০ বছর ধরে পূর্ব পাকিস্তানী রাইফেলের সাথে ছিল এবং হালকা বাঙলা বলতে পারে। তাকে বলা হলো মেয়েটাকে গ্রামে ফিরে যাওয়ার আদেশ দিতে। সে (মেয়েটা) উত্তরে কিছু বলার চেষ্টা করে, কিন্তু সে যেখানে ছিল সেখানেই বসে থাকল, কিন্তু তাকে দ্বিতীয়বার আদেশ দেওয়া হলো। সেখান থেকে চলে আসলাম, তখনো সে সেখানেই বসে ছিল। আমাকে জানানো হয়েছিল, ” তার যাওয়ার কোন জায়গা নেই – পরিবার নেই, বাড়ি নেই”।

হত্যা এবং পোড়ানো মিশনের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার মধ্যে মেজর ইফতেখার ছিলেন একজন। সেনাবাহিনীরা বিদ্রোহীদের সাফ হওয়ার পর তারা আসে সবকিছু উচ্ছেদ করতে এবং হিন্দু ও “দুষ্কৃতকারীদের” (বিদ্রোহীদের আনুষ্ঠানিক উপাধি) ধ্বংস করতে এবং সেনাবাহিনীদের গুলিবিদ্ধ থেকে শুরু করে সবকিছু পুড়য়ে ফেলতে তারা আসে।

এই রোগাপটকা পাঞ্জাবী কর্মকর্তা তার কাজ নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করেন। গাড়িতে বসে ইফতারখারের সাথে সার্কিট হাউসে আরেকটি অনুষ্ঠানে যেতে যেতে তিনি তার সর্বশেষ কর্ম সম্পর্কে আমাকে জানিয়েছিলেন।

তিনি বলেন, “আমরা এক বৃদ্ধকে পেয়েছিলাম”। “বেজন্মাটা দাড়ি রেখেছিলো এবং একটি ধর্মপ্রাণ মুসলিম হবার ভাব নিচ্ছিল। এমনকি নিজের নাম বলেছিল আব্দুল মান্নান। কিন্তু আমরা তার মেডিকেল পরিক্ষা করলাম এবং সে ধরা খেয়ে গেলো।

ইফতিখার বলতে থাকলেন: “আমি তাকে তৎক্ষণাৎ শেষ করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার লোকজন আমাকে বলেছিল যে এই ধরনের বেজন্মার ঐখানে (লিঙ্গে) গুলি প্রাপ্য। তাই আমি তার অণ্ডকোষে একটা গুলি করলাম, তারপর পাকস্থলি বরাবর একটা, তারপর মাথায় গুলি করে আমি তাকে শেষ করলাম”।

যখন আমি মেজর ইফতেখারকে ছেড়ে দিয়েছিলাম তখন তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উত্তর দিকে অগ্রসর হন। তার মিশন: অন্য একটি হত্যা এবং পুড়ানো।

সন্ত্রাস আচ্ছন্ন হয়ে বাঙালিরা দুটি প্রতিক্রিয়ার যেকোন একটি বেঁছে নেয়। যারা পালিয়ে যেতে পারে, মনে হয় উধাও হয়ে গেছে। সেনাবাহিনী আসার সাথে সাথে সমগ্র শহরগুলি পরিত্যক্ত হয়েছে। যারা কৃপণ্ঠিত দাসত্ব থেকে পালাতে পারে না, এটা কেবল তাদের দুর্দশার সাথে অপমান যোগ করে।

চাঁদপুর প্রথম উদাহরণ।

অতীতে মেঘনা নদীর এই প্রধান নদী বন্দরটি তার সমৃদ্ধ ব্যবসার জন্য এবং আনন্দোচ্ছল জীবনের জন্য সুপরিচিত ছিল। রাতে হাজার হাজার ছোট ছোট নৌকা নদীর তীরে নোঙর ফেলতো এবং (নৌকার) প্রজ্বলিত আলোয় এটাকে কল্পনার দেশ মনে হতো। ১৮ই এপ্রিলে, চাঁদপুরে অচলাবস্থা ছিল। কোন মানুষ নেই, কোন নৌকা নেই। জনসংখ্যার মাত্র এক শতাংশই রয়ে গেছে। বিশেষ করে হিন্দুরা পালিয়ে গিয়েছিল যারা মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক।

অদ্ভুত ব্যাপার হলো প্রতিটা বাড়ি, দোকান এবং ছাদে তারা হাজার হাজার উড়ন্ত পাকিস্তানি পতাকা রেখে পালিয়েছে। ব্যাপারটা ছিল যেন কোন রকম ভিড় ছাড়াই জাতীয় দিবস উদযাপন হচ্ছে। এটা ভুতুড়ে পরিবেশকে আরো ভুতুড়ে বানিয়ে দিচ্ছিলো।

প্রসঙ্গক্রমে পতাকাগুলো ছিল বীমার মত।

যেকোনভাবে একটা কথা চারদিকে প্রচার হয়েছিল যে পাকিস্তানি পতাকা বিহীন যেকোন ঘরবাড়ী শত্রুভাবাপন্ন এবং ফলস্বরুপ সেটাকে ধ্বংস করা হবে। পাকিস্তানি পতাকাগুলি কীভাবে তৈরি হয়েছিল, সেটা কোন ব্যাপার না যতক্ষণ পর্যন্ত তাতে অর্ধচন্দ্র এবং তারকা সজ্জিত থাকছে। সুতরাং পতাকা গুলো ছিলো বিভিন্ন আকারের এবং রঙের। কোন কোনটাতে প্রথাগত সবুজ রঙের বদলে নীল রঙের ব্যাকগ্রাউন্ড ছিলো। স্পষ্টতই তারা নিখুঁত নীল রঙের বাংলাদেশি পতাকার জন্য ব্যবহৃত কাপড়ে অতি দ্রুত এসব জিনিস যোগ করেছে। সত্যিকার অর্থেই সবুজের থেকে নীল রঙের পাকিস্তানি পতাকা বেশি ছিল। চাঁদপুরের মত একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে হাজীগঞ্জ, মুদাফারগঞ্জ, কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও; সমস্ত প্রেতাত্মাময় শহরগুলি পতাকা শোভিত।

একটি ‘সামরিক মহড়া’ এবং একটি বুদ্ধিদীপ্ত চক্ষু ইশারা

লাক্ষ্মাম ছিল অন্য প্রতিক্রিয়ার একটি উদাহরণ: অবনমন

বিদ্রোহীদের সাফ হওয়ার পর সকালে আমি যখন শহরে ঢুকেছিলাম, তখন আমি সেখানে সেনাবাহিনী এবং আক্ষরিকভাবে হাজার হাজার পাকিস্তানি পতাকা ছাড়া কিছুই দেখিনি। সেখানে দায়িত্বরত মেজর পুলিশ স্টেশনে একটা ক্যাম্প করেছিলো, এবং মেজর রাঠোর আমাকে এবং আমার এক সহকর্মী, যিনি একজন পাকিস্তানি টিভি ক্যামেরাম্যান, কে সেখানে নিয়ে গেছিল, “স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়ার” উপরে একটা প্রপাগান্ডা ফিল্ম তৈরি করার জন্য – যাতে অন্তহীনভাবে প্রতিদিন স্বাগত প্যারেড এবং “শান্তি বৈঠক” সম্প্রচারিত হবে।

আমি বিস্ময়ের সাথে দেখি উনি কিভাবে এতোসব সামলান, কিন্তু মেজর বলেন এটা কোন ব্যাপারই না। “নাটক করার জন্য যথেস্ট সংখ্যক বেজন্মা এখনো বাকি আছে। আমাকে ২0 মিনিট সময় দিন”।

৩৯তম বেলুচের লেফটেন্যান্ট জাভেদকে কিছু জনতা গ্রেফতার করার কাজে নিয়োগ করা হয়েছিল। তিনি একজন দাড়িওয়ালা বয়স্ক ব্যক্তিকে ডাকেন যাকে দৃশ্যত জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা হয়েছিল। লোকটা তার নাম বলেছিলো মওলানা সাঈদ মো সাইদুল হক, জোর গলায় বলেন তিনি একজন দৃঢ়চিত্ত মুসলিম লীগ ছিলেন, আওয়ামী লীগের নয়। (১৯৪৭ সালে স্বাধীন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে মুসলিম লীগ নেতৃত্ব দিয়েছিলো) তিনি খুব আগ্রহী ছিলেন। তিনি জাভেদ বলেন, “২0 মিনিটের মধ্যেই আমি অন্তত ৬০ জন লোক ধরে দিতে পারবো”। “তবে আপনি যদি আমাকে দুই ঘণ্টা সময় দেন তবে আমি ২00 নিয়ে আসব”।

মওলানা সাঈদুল হক তাঁর বক্তব্যের মতই ছিলেন। আমরা সতেজকারক নারকেল দুধ কম খাচ্ছিলাম যা মেজর অনেক চিন্তাভাবনা করে সরবরাহ করেছিলেন যখন তিনি দূরে একটা চিৎকার শুনলেন। তারা শ্লোগান দিচ্ছিলো, “পাকিস্তান জিন্দাবাদ!” “পাকিস্তান সেনাবাহিনী জিন্দাবাদ!” “মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ”। (জিন্দাবাদ হলো “দীর্ঘ জীবনের” উর্দু প্রতিশব্দ)। পরে তারা দেখতে পেল, প্রায় ৫০ জন বয়স্ক ও নিম্নবিত্ত পুরুষ এবং হাঁটুর সমান উচ্চতার শিশু সবাই পাকিস্তানি পতাকা উড়াচ্ছিল এবং সর্বোচ্চ জোর গলায় চিৎকার করতেছিল। লেফটেন্যান্ট জাভেদ আমাকে একটি বুদ্ধিদীপ্ত চোখ টিপুনি দিলেন।

কয়েক মিনিটের মধ্যে “সামরিক মহড়া” একটা “জনসভায়” পরিনত হলো যেখানে পরিবর্তন অনুযায়ী একটি পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেম এবং অতিদ্রুত ভাবি বক্তার সংখ্যা বেড়ে গেলো।

জনাব মাহবুব-উর-রহমান সেনাবাহিনীকে স্বাগত জানানোর জন্য বলা হলো। তিনি নিজেকে এন. এফ. কলেজের “ইংরেজী ও আরবি” বিভাগের অধ্যাপক হিসাবে পরিচয় করিয়ে দেন, যিনি ইতিহাসের জন্যেও চেষ্টা করেছিলেন এবং মহান মুসলিম লীগ পার্টির আজীবন সদস্য ছিলেন।”

মাহবুব-উর-রাহমান জবাব দিলেন, ভূমিকা শেষ। তিনি বলেন “পাঞ্জাবি ও বাঙালি,” “পাকিস্তানের জন্য একতাবদ্ধ এবং আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ছিল। কিন্তু আমরা হিন্দু ও আওয়ামী লীগের দ্বারা সন্ত্রাসী হয়েছি এবং বিভ্রান্ত হয়েছি। এখন আমরা ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই যে পাঞ্জাবি সৈন্যরা আমাদের বাঁচিয়েছে। তারা বিশ্বের সেরা সৈনিক এবং মানবতার নায়ক। আমরা আমাদের অন্তরের অন্তস্থল থেকে তাদের ভালোবাসি ও সম্মান করি”। এবং তাই অন্তহীনভাবে একই শিরার মধ্যে।

“সভা’র” পরে আমি মেজরকে জিজ্ঞেস করি, তিনি বক্তৃতা সম্পর্কে কি চিন্তা করেছেন। তিনি বলেছিলেন, “উদ্দেশ্য সাধন করো”। “কিন্তু আমি এই বেজন্মাকে বিশ্বাস করি না। আমি তাকে আমার তালিকায় উঠাবো।”

পূর্ব বাংলার অন্তর্বেদনার শেষ নেই। সম্ভবত সবচেয়ে খারাপ এখনো আসেনি। সম্পূর্ণ “সাফ” না করা পর্যন্ত সেনাবাহিনী এরূপ কর্মকান্ড চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র অর্ধেক কাজ সম্পন্ন হয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৯তম ও ১৬তম বিভাগকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পাঠানো হয়েছে বিদ্রোহী ও হিন্দুদের চিহ্নিত করতে। এটি পাকিস্তান সম্পদের একটা দেশের জন্য এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং যৌক্তিক কৌশল ছিল। পশ্চিম থেকে পূর্বে ২৫,000 এরও বেশি লোক পাঠানো হয়। ২৮শে মার্চে, দুটি বিভাগকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আসার নোটিস দেওয়া হয়েছিল। তাদের খারিয়ান এবং মুলতান থেকে ট্রেনে করে করাচীতে আনা হয়েছিল। শুধুমাত্র হালকা বিছানা এবং যুদ্ধসরঞ্জামের বোঁচকা (তাদের সরঞ্জাম সমুদ্র দিয়ে আসছিলো) নিয়ে সৈন্যরা পিয়াইএ (জাতীয় এয়ারলাইন) এর মাধ্যমে ঢাকাতে চলে এসেছিল। সাতটি বোয়িং বিমানের বহর আন্তর্জাতিক এবং স্বদেশী রুট দিয়ে এসেছিল এবং ক্রমাগত সেলনের মাধ্যমে ১৪ দিনের জন্য দীর্ঘ যাত্রা করেছিল। বিমান বাহিনীর কিছু পরিবহন বিমান সাহায্য করেছিল।

১৪তম ডিভিশন থেকে ধার করা সরঞ্জাম দিয়ে সৈন্যরা তৎক্ষণাৎ কাজ শুরু করেছিল তারপর থেকে সেটা পূর্ব কমান্ড গঠন করে। কুমিল্লা থেকে চালানো ৯তম বিভাগ বিদ্রোহীদের আন্দোলন এবং তাদের সরবরাহ বন্ধ করতে পূর্ব সীমান্ত বন্ধ করার আদেশ দিয়েছিল। ১৬তম বিভাগের কাজ ছিল যশোরের সদর দফতরের সাথে মিলে প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে অনুরূপ কাজ করা। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে তারা তাদের কার্য সম্পন্ন করে। বিদ্রোহীদের যারা ভারতে পালাতে পারেনি – ইস্পাত ও আগুনে বন্ধী হয়, দুই বাহিনী বিভাগ নিষ্ঠুর চিরুনি অভিযান শুরু করেছে। এটা নিঃসন্দেহে বোঝা যাচ্ছে যে, সীমান্ত অঞ্চলের অভিজ্ঞতা এখন মধ্যবর্তী অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে। এটি আরও বেদনাদায়ক হতে পারে। মানুষের পালানোর কোন জায়গা থাকবেনা।

২0শে এপ্রিল ৯তম ডিভিশনের পুষ্প-প্রেমী জি-আই লেফটেন্যান্ট-কর্নেল বেগ ধারণা করেছিলেন যে চিরুনি অভিযান চলবে জুন মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত, যাতে প্রায় দুই মাস লেগে যাবে। কিন্তু এই পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে মনে হচ্ছে। গেরিলা কৌশল ব্যবহার করে বিদ্রোহী বাহিনীদের পরাজিত করা যতটা সহজ ভেবেছিল সেনাবাহিনী, ততটা সহজ হচ্ছেনা। বিচ্ছিন্ন এবং দৃশ্যত অস্পৃশ্য, বিদ্রোহীরা সড়ক ও রেলপথের নিয়মিত ধ্বংসযজ্ঞের কারণে অনেক জায়গায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ফাঁদে ফেলে রেখেছে, যেগুলো ছাড়া সেনাবাহিনী চলতে পারে না। একজনের জন্য ৯ম বিভাগ সময়সূচী নিয়ে হতাশ ছিল। এখন মৌসুম বর্ষার তিন মাস সামরিক অপারেশন বন্ধ করার হুমকি দিয়েছে।

বর্ষাকালের জন্য, মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকিস্তান সরকার চীনের কাছ থেকে নয়টি কামানবাহী নৌকা পান। আরো আসার কথা আছে। বিপুল পরিমানে গুলি বহনকারী ৮0 টনের এই কামানবাহী নৌকা এই সময়টাতে বিমান বাহিনী এবং কামান বাহিনীর কিছু দায়িত্ব নিতে পারবে, যেগুলো বৃষ্টির সময় কার্যকারী না। শত শত দেশবিদেশ তাদের সহায়তা করবে, যার জন্য লিখিতভাবে অনুরোধ জানানো হয়েছে, এবং সেগুলো সামরিক কাজে ব্যবহারের জন্য নৌকার বাইরের দিকে মোটর দিয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। বিদ্রোহীদের খোঁজে সেনাবাহিনী জলের দিকে যেতে চায়।

পূর্ববাংলার উপনিবেশীকরণ

বণ্টন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কারণে দুর্ভিক্ষের স্পষ্ট সম্ভাবনাও রয়েছে। সাধারণভাবে, পূর্ব পাকিস্তানের ২৩টি জেলার ১৭টিতে খাদ্যের সংকট এবং চাল ও গমের ব্যাপক আমদানির মাধ্যমে সরবরাহ করতে হবে। গৃহযুদ্ধের কারণে এই বছরে সেটা সম্ভব হবে না। ছয়টি প্রধান সেতু এবং হাজার হাজার ছোটখাটো সেতু ধ্বংস করা হয়েছে, অনেক জায়গায় রাস্তাগুলি দুরূহ। রেলওয়ে ব্যবস্থা একইভাবে বিঘ্নিত হয়েছে, যদিও সরকার দাবি করছে অবস্থা “প্রায় স্বাভাবিক”।

চট্টগ্রাম ও উত্তর বন্দরের মধ্যে সড়ক ও রেলপথগুলি পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বিদ্রোহীদের কার্যক্রমে যারা ৭ই মে পর্যন্ত ফেনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও রেল জংশন দখল করে রেখেছিল। এই ধ্বংসযজ্ঞের কারণে মজুদ খাদ্য স্থানান্তর হতে পারছেনা। স্বাভাবিক অবস্থায় চট্টগ্রাম থেকে দেশের অভ্যন্তরে ১৫ শতাংশ খাদ্যশস্য যেত নৌকায় করে। বাকি ৮৫ শতাংশ সড়ক ও রেলপথে যেতো। এমনকি নদী চলাচল ১০০ ভাগ উন্নত করলেও চট্টগ্রামের গুদামে ৭০ শতাংশেরও বেশি খাদ্যশস্যের অবমূল্যায়ন হবে।

অন্য দুটি কারণ যোগ করা আবশ্যক। একটা হলো দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাস পেয়েছে এমন কিছু লোকজন প্রচুর পরিমাণে খাদ্যশস্য গোপনে মজুদ করেছে। এটি সংকটপূর্ন অবস্থা আরো অসীম কঠিন করে তুলেছে। অন্যটি হলো আসন্ন দুর্ভিক্ষের বিপদ প্রকাশ্যে স্বীকার করতে পাকিস্তান সরকার অপরাগ। পূর্ব বাংলার সামরিক গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান ১৮ই এপ্রিল একটি রেডিও সম্প্রচারে স্বীকার করেন যে, তিনি খাদ্য সরবরাহের ব্যাপারে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তারপর থেকে পুরো সরকারিভাবে খাদ্যশস্য সঙ্কটের ব্যাপারটা চেপে যাওয়া হচ্ছে। কারণ এটি একটি দুর্ভিক্ষ, এর আগে যেমন সাইক্লোন হয়েছিল, সেকারণে বিদেশী সাহায্য আসার সম্ভবনা আছে এবং সেজন্য বিতরণ পদ্ধতি পরিদর্শন করতে বাইরে থেকে লোক আসবে। যেটা বহিঃবিশ্ব থেকে এই সাম্প্রদায়িক সহিংসতা লুকিয়ে রাখা অসম্ভব করে তুলবে। তাই যতদিন না সাফ করা শেষ হচ্ছে, ক্ষুধার্তরা ধুকে ধুকে মরুক।

শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে এই সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার সময় কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান জনাব কার্নি স্পষ্টস্বরে বলেন, “তাদের আভ্যন্তরীণ নাশকতা দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি করেছে”। তাই তাদের মরতে দাও। তখন সম্ভবত বাঙালির হুশ হবে”।

সামরিক সরকারের পূর্ববাংলা নীতি এতটাই পরস্পরবিরোধী এবং আত্মবিধ্বংসী যে এটির অর্থ পাকিস্তানের শাসনকারীরা কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা। বল প্রয়োগের মাধ্যমে প্রাথমিক ক্ষতি সংঘটিত করার পর, এইক্ষেত্রে সরকার একগুঁয়েভাবে মুর্খের মত আচারন করছে।

এই বিচারের মধ্যে ভাসাভাসা যুক্তি আছে।

একদিকে, এটা সত্য যে সন্ত্রাসের রাজত্বের কোনও অবকাশ নেই। নিশ্চিতভাবেই, পূর্ববাংলায় পুঁজিবাজারের নীতি জোরদার করা হচ্ছে। এটি প্রতিদিনই সরকারের জন্য হাজার হাজার নতুন শত্রু তৈরি করছে এবং পাকিস্তানের দুই অংশের পৃথক আরো দ্বিগুণ মাত্রায় সুনির্দিষ্ট করে তুলছে।

অন্যদিকে, কোনো সরকারের অজানা থাকতে পারেনা যে, এই নীতি অবশ্যই ব্যর্থ হবে। (পূর্ব পাকিস্তানে অধিক সংখ্যক লোককে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধরে রাখার মত যথেষ্ট পশ্চিম পাকিস্তানি নেই।) কঠিন প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কারণে এবং বাহ্যিক বিশেষ করে আমেরিকার উন্নয়ন সহায়তার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার জন্য যত দ্রুত সম্ভব রাজনৈতিক নিষ্পত্তির প্রয়োজন। ২৫শে জুন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এর প্রেস কনফারেন্সে তিনি প্রস্তাব দেন যে, এই বিষয়গুলির শক্তি তিনি স্বীকার করেন: এবং তিনি বলেন যে জুনের মাঝামাঝি সময়ে তিনি প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের জন্য তার পরিকল্পনা ঘোষণা করবেন।

এই সব থেকে বোঝা যায় যে, দেশের ২৪ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সঙ্কটকে সামলাতে পাকিস্তানের সামরিক সরকার বিপর্যস্তভাবে বিপরীত দিকে ছুটছে।

এটি একটি স্থুলভাবে দেখানো দৃশ্য। এটি যৌক্তিক শোনাচ্ছে। কিন্তু এটা কি সত্য?

আমার নিজের মতামত হলো এটা সত্য নয়। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা কি বলছে এবং পূর্বদেশে তারা কী করছে সেটা দেখার প্রথম দুর্ভাগ্যজনক সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।

আমি মনে করি যে প্রকৃতপক্ষে সরকারের পূর্ববাংলা নীতিতে কোন দ্বন্দ্ব নেই। পূর্ববাংলা উপনিবেশ করা হচ্ছে।

এটা আমার কোন খামখেয়ালি মতামত নয়। ঘটনাগুলো নিজেরাই একথা বলছে।

পূর্ববাংলায় বিচ্ছিন্নতাবাদ সৃষ্টিই হলো সেনাবাহিনীর প্রথম বিবেচ্য বিষয় এবং এটাই সর্বকালের ধ্বংসাত্মক ঘটনা। ২৫শে মার্চের পর থেকে সরকার পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয়দিকেই এই ধারা অব্যাহত রেখেছে। এই সিদ্ধান্তটি সামরিক শাসকদের দ্বারা নিঃসন্দেহে গৃহীত হয়েছে এবং তারা খুব ঠান্ডামাথায় এসব করে যাচ্ছে।

যতদিন দাঙ্গা অব্যাহত থাকবে, ততদিন পূর্ববাংলায় কোনও অর্থপূর্ণ বা কার্যকর রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব নয়।

গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল: হত্যা কি থামবে?

১৬ই এপ্রিল কুমিল্লায় আমাদের প্রথম বৈঠকে, ৯ম ডিভিশনের কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল শওকত রাজা কতৃক আমাকে সেনাবাহিনীর উত্তর দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, “আপনাকে অবশ্যই নিশ্চিত হতে হবে”, “আমরা এমন কোন কঠোর ও ব্যয়বহুল অপারেশনের দায়িত্বগ্রহন করছিনা যা কিনা লোকবল এবং অর্থ উভয় দিক দিয়েই ব্যায়বহুল। আমরা একটা কাজের দায়িত্ব নিয়েছি। আমরা এটি শেষ করতে যাচ্ছি, রাজনীতিবিদদের কাছে অর্ধেকেরও বেশি নয় যাতে তারা আবারো তালগোল পাকাতে পারে। সেনাবাহিনী এভাবে প্রতি তিন বা চার বছর পরপর ফিরে আসতে পারবে না। তাদের আরো গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। আমি আপনাদের আশ্বস্ত করছি যে, আমরা কাজটা যেভাবে করছি যাতে এই ধরনের অপারেশনের জন্য আর কখনো প্রয়োজন হবে না”।

মেজর-জেনারেল শওকত রাজা হলো রণক্ষেত্রে থাকা তিন বিভাগীয় কমান্ডারদের মধ্যে একজন। তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছেন। তাকে তার টুপির মাধ্যমে কথা বলতে দেওয়া হয়নি।

উল্লেখযোগ্যভাবে, পূর্ব পাকিস্তানে আমার ১০ দিনের মধ্যে আমি প্রত্যেক সামরিক অফিসারের সাথে কথা বলে দেখেছি জেনারেল শওকত রাজার ধারণাগুলি প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জানেন যে, যারা সৈন্যদলকে মাটিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা হলো পাকিস্তানের গন্তব্যের কার্যত সালিসকারী।

সামরিক অপারেশনের মধ্যদিয়েই সেনাবাহিনীর একক মনোভাবাপন্নতা ধরা পড়ে। যেকোন মানদন্ডে এটা একটি বিরাট ঝুঁকি। এটি এমন কিছু নয় যেটা কোন দুঃখজনক পরিণতি ছাড়াই চালু এবং বন্ধ করা যেতে পারে।

সেনাবাহিনী অবস্থান করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ

সেনাবাহিনী ইতিমধ্যে মৃত ও আহত নিয়ে মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। গোপনভাবে এটি ঢাকাতে বলা হয়েছিল যে আরও অনেক কর্মকর্তারা নিহত হয়েছেন এবং পূর্ববাংলায় হতাহতদের তালিকা ইতিমধ্যেই ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সীমা অতিক্রম করেছে। সেনাবাহিনী নিশ্চিতভাবেই ছলাকলামূলক রাজনৈতিক বিবেচনার জন্য এই “বলিদান” এর হিসাব রাখবেনা, যা অতীতে খুব অর্থহীন বলে প্রমাণিত হয়েছে।

এই পর্যায়ে কার্যক্রম বন্ধ করা অসমর্থনযোগ্য এই সিদ্ধান্ত নেবে সামরিক বাহিনী এবং সৈন্যরা। এতে বাঙালি বিদ্রোহীদের সাথে আরো বেশি ঝামেলা হবে। অবিচ্ছিন্ন ঘৃণা উভয় পক্ষের উপর প্রদর্শন করা হয়েছে।

এখানে কোন যুদ্ধবিরতি বা আপোষে নিষ্পত্তি হতে পারবে না; কেবলমাত্র পূর্ন বিজয় অথবা পূর্ন পরাজয়। সময় এখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পাশে, বিচ্ছিন্ন, অস্বাভাবিক অবৈধ অস্ত্রধারী বিদ্রোহী গোষ্ঠীর পাশে নয়। অন্য পরিস্থিতিতে, যেমন একটি বর্ধিত দ্বন্দ্ব যা অন্য ক্ষমতা হিসেবে, অবশ্যই দৃশ্য পরিবর্তন করতে পারে। কিন্তু আজকের দিনটি যেমন দাঁড়িয়ে আছে তেমনি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সন্দেহ নেই যে এটি অবশেষে তার উদ্দেশ্য অর্জন করবে। এ কারণে হত্যাকাণ্ডগুলি দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করা হয়েছে।

পূর্ববাংলার অপারেশনে ইতিমধ্যেই বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে এবং এর অব্যাহত খরচ সরকারের সংকল্পের সাক্ষ্য দিচ্ছে। এমন অলঙ্ঘনীয় পদ্ধতিতে এই তহবিল ভরা হয়েছে সেটা স্পষ্ট করে দেয় যে সামরিক শাসনবিন্যাস, যারা হিসাব করে শক্তি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এই ব্যয়কে একটি প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ হিসাবে গ্রহণ করেছে। অযথা ২৫ হাজার সৈন্যকে পূর্ববাংলায় উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যা একটি সাহসী ও ব্যয়বহুল অনুশীলন। ৯ম এবং ১৬তম, এই দুটি বিভাগ পশ্চিম পাকিস্তানে সামরিক জনবল গঠন করেছে। এখন ব্যয়বহুলভাবে নতুন নিয়োগ দিয়ে তাদের সেখানে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে।

চীনারা সরঞ্জাম দিয়ে সাহায্য করেছে যা কারাকোরাম মহাসড়কটি ডুবিয়ে দিচ্ছে। বন্যা কমে যাচ্ছে এরকম কিছু প্রমাণ আছে: সম্ভবত চীনারা পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতির বিষয়ে বিকল্প অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার ইউরোপীয় অস্ত্র সরবরাহকারীদের কাছে বিদেশী বিনিময় পিপার নীচে থেকে নগদ ১0 লাখ ডলারেরও বেশি অর্থ ব্যায়েও দ্বিধা করছেনা।

ঢাকা, রাওয়ালপিন্ডি ও করাচির উর্ধতন সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে কথোপকথনে এটা নিশ্চিত হয় যে তারা পূর্ববাংলার অপারেশনের দ্রুত সমাপ্তিতে এই সমস্যাটির সমাধান দেখতে পাচ্ছে, তা প্রত্যাহারের শর্তে নয়। সেজন্য এই উদ্দেশ্যে যে টাকা প্রয়োজন তা অন্যান্য সমস্ত সরকারি ব্যয় থেকে অগ্রাধিকার পাবে। উন্নয়ন কার্যত থেমে গেছে।

এক বাক্যে, পূর্ববাংলার অপারেশন পরিত্যাগ করার জন্য সরকার খুব বেশিদূর এগোয়নি, যদি এটি আন্তরিকভাবে রাজনৈতিক সমাধান চায় তবে তা করতে হবে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বাঘের পিঠে চড়ে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু তিনি সেখানে আরোহণ করতে হিসাব করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

তাই সেনাবাহিনী পিছাবেনা। পূর্ব কমিশন সদরদপ্তরে পূর্ববাংলার জন্য সরকারের নীতি সম্পর্কে আমাকে বলা হয়েছিল। এর তিনটি বিষয়বস্তু রয়েছে: –

(1) বাঙালিরা নিজেদের “অবিশ্বস্ত” প্রমাণ করেছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা শাসিত হওয়া উচিত;
(২) সঠিক ইসলামী পথে বাঙালিদেরকে পুনরায় শিক্ষিত করা হবে। “জনসাধারণের ইসলামীকরণ” – এই অর্থহীন কথার মুল অভিব্যক্তি হল-বৈষম্যমূলক প্রবণতাগুলি দূর করা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে একটি শক্তিশালী ধর্মীয় বন্ধন প্রদান করা:
(3) মেরে এবং পালাতে বাধ্য করে হিন্দুদের নির্মূল করা হয়, তখন তাদের সম্পত্তি সুযোগসুবিধা বঞ্চিত মধ্যবিত্ত মুসলমানদের উপর জয়লাভ করতে একটি সোনার গাজর হিসাবে ব্যবহার করা হবে। এটি ভবিষ্যতে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কাঠামো স্থাপনের জন্য ভিত্তি প্রদান করবে।

এই নীতি চরম অসমতার সঙ্গে পশ্চাদ্ধাবন করা হচ্ছে।

বিদ্রোহের কারণেই, এটি আনুষ্ঠানিকভাবে আইন জারি করা হয়েছে যে প্রতিরক্ষা বাহিনীতে পরবর্তি কোন নিয়োগ বাঙালিদের সুযোগ দেওয়া হবেনা। সিনিয়র বিমান বাহিনী এবং নৌবাহিনীর কর্মকর্তাদের, যারা কোনও ভাবে জড়িত ছিলনা, “সতর্কতা হিসাবে” অ-সংবেদনশীল পদে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। বাঙালি যোদ্ধা পাইলট যাদের মধ্যে বিমান বাহিনীর কয়েকজন সদস্য ছিল, তাদের অপমান করা হয় এবং বিমান চালাতে হয়না এমন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এমনকি পিআইএ এয়ার ক্রু যারা দেশের দুই অংশের মধ্যে কাজ করে, সেখানেও বাঙালিদের ছেঁকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

বিদ্রোহের পর থেকে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসকে স্থগিত রাখা হয়েছে যা একসময় প্রায় একটি বাঙালি আধাসামরিক বাহিনী ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে বিহারি এবং স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়োগের মাধ্যমে একটি নতুন বাহিনী সিভিল ডিফেন্স ফোর্স গঠন করা হয়েছে। বাঙালিদের পরিবর্তে বিহারিরাও পুলিশের জন্য মৌলিক উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনী ও সেনা বাহিনী সেকেন্ডারী অফিসারগণ কর্তৃক তাদের তত্ত্বাবধান করা হচ্ছে। এপ্রিলের শেষে চাঁদপুরে পুলিশের নতুন সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন সামরিক পুলিশ প্রধান।

শতশত পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারের সরকারি কর্মচারী, ডাক্তার, এবং রেডিও, টেলিভিশন, টেলিগ্রাফ এবং টেলিফোন সেবার প্রযুক্তিবিদদের ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছে। আরো অনেককে এক ধাপ অথবা দুই ধাপ প্রমোশনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে উৎসাহিত করা হচ্ছে। কিন্তু যখন চাইবে বাধ্যতামূলক স্থানান্তরিত হতে হবে। রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া সম্প্রতি একটি আদেশ জারি করেছেন যে তারা বেসামরিক কর্মকর্তাদের তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পাকিস্তানে যে কোন অংশে হস্তান্তর করতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ‘চিহ্নিত’

আমাকে বলা হয়েছিল যে ভবিষ্যতে পূর্ববাংলা এবং জেলা প্রশাসকের সকল কমিশনার হবে পশ্চিম পাকিস্তানের বিহারি অথবা বেসামরিক কর্মকর্তা। আওয়ামী লীগ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সাথে জেলার জেলা প্রশাসকগণ খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে তাদের ধরা হয়েছিল এবং গুলি করে মারা হয়েছিল যেমন কুমিল্লার ডেপুটি কমিশনার। এই বিশেষ কর্মকর্তা ২0শে মার্চ সামরিক বাহিনীর ক্রোধের মুখে পড়েন যখন তিনি “শেখ মুজিবুর রহমানের চিঠি” ছাড়া পেট্রল ও খাদ্য সরবরাহের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন।

পূর্ববাংলার বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলির উপরেও সরকার ক্ষেপে ওঠেন। তারা ষড়যন্ত্র তৈরির উত্তম জায়গা হিসাবে বিবেচিত হয় এবং তাদের “চিহ্নিত” করা হচ্ছে।

অনেক অধ্যাপক পালিয়ে গেছে। কিছু গুলি করে মারা হয়েছে। তাদের পরিবর্তে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নতুন নিয়োগ দেওয়া হবে।

বেসামরিক ও বিদেশী সংস্থার সংবেদনশীল পদগুলি থেকেও বাঙালি কর্মকর্তাদের ছাটাই করা হচ্ছে। বর্তমানে সবাইকে ব্যাপকভাবে নজরে রাখা হচ্ছে।

প্রশাসন যতটা চাচ্ছে উপনিবেশকরণ প্রক্রিয়া স্পষ্টভাবে তার অর্ধেকও কাজ করছেনা। কুমিল্লার সামরিক আইন প্রশাসক মেজর আঘা এই বিষয়ে আমাকে অনেক স্পষ্ট প্রমাণ দিয়েছিলেন। স্থানীয় বাঙালি নির্বাহী প্রকৌশলীকে দিয়ে বিদ্রোহীদের দ্বারা ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সেতু এবং রাস্তাগুলি মেরামত করাতে তার কিছু সমস্যা হচ্ছে। এই সমস্যাটি লাল ফিতায় বাধা পড়েছে এবং সেতুগুলি মেরামত বিহীন পড়ে আছে। আঘা অবশ্যই এর কারণ জানত। তিনি আমাকে বলেন, “আপনি তাদের থেকে কাজ আশা করতে পারেন না”, “যখন আপনি তাদের হত্যা করছেন এবং তাদের দেশ ধ্বংস করছেন। অন্ততপক্ষে এটাই তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, এবং আমরা এর মাশুল গুনছি।”

বেলুচ রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন দুরানি যিনি কুমিল্লার বিমানবন্দরে কোম্পানি পাহারার দায়িত্বে ছিলেন, এই সমস্যা নিরসনে তার নিজস্ব পদ্ধতি ছিল। কন্ট্রোল টাওয়ারের দায়িত্বে থাকা বাঙালিদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমি তাদের বলেছি”, “যে সন্দেহজনক কিছু করছে এমন যে কাওকে আমি গুলি করবো”। দুররানি তার কথা রেখেছিলেন। একটি বাঙালিকে গুলি করা হয়েছিল যে কয়েক ঘণ্টার আগে বিমানবন্দরে গিয়েছিল। তাকে আমাকে বলা হয়েছিল, “বিদ্রোহী হতে পারে”। দুররানির আরো একটি খ্যাতির দাবী দার। বিমানবন্দরের চারপাশের গ্রামগুলো সাফ করার সময় তিনি ব্যক্তিগতভাবে “৬০ জন পুরুষ” মারার জন্য দায়ী ছিলেন।

পূর্বাঞ্চলে উপনিবেশকরণের কঠিন বাস্তবতা লজ্জাহীন জানালার পর্দা দিয়ে গোপন রাখা হচ্ছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানে তারা যা করছে সেজন্য রাজনৈতিক সহায়তা পাবার চেষ্টা করছে। ফলাফল ঠিক সন্তোষজনক হচ্ছেনা। এখন পর্যন্ত আসন্ন সহায়তা এসেছে ঢাকার বাঙালি আইনজীবী মৌলভী ফরিদ আহমদ, ফজলুল কাদের চৌধুরী এবং জামাত ইসলামের অধ্যাপক গোলাম আযম, এর মত লোকদের কাছ থেকে। গত ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে যাদের সবাইকেই পরাজিত করা হয়েছিল।

এই উদ্দেশ্যে আবির্ভূত একমাত্র বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব প্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মওদুদ নূরুল আমিন এবং জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত দুইজন আওয়ামী লীগের একজন ছিলেন। সে এখন তার সত্তর দশকে। কিন্তু নূরুল আমিন খুব সতর্কতা অবলম্বন করেন নি। এপর্যন্ত তার দুইটা প্রকাশ্য সাক্ষাত্কারেই তিনি “ভারতীয় হস্তক্ষেপ” নিয়ে উদ্বিগ্ন।

যারা “সহযোগিতা” করে, বাঙালিরা তাদের অবজ্ঞা করে। ফরিদ আহমদ ও ফজলুল কাদির চৌধুরী বেদনাদায়ক এই বিষয়ে জ্ঞাত। ফরিদ আহমদ তার জানালা বন্ধ করে রাখছে এবং যাদের যাচাই বাছাই করা হয় এবং সামনের দরজার ছিদ্র দিয়ে চেনা যায় তাদেরকেই কেবল ঘরে ঢুকতে দেওয়া হয়।

একচেটিয়া ভোঁতা পদ্ধতির মাধ্যমে সরকার আওয়ামী লীগ থেকে ৩১ জনকে পেতে সক্ষম হয়েছেন যারা জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হয়েছেন। তাদেরকে “প্রতিনিধি সরকার” প্রতিষ্ঠাপন উপলক্ষ্যে পরিবার থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ঢাকায় রাখা হচ্ছে। কিন্তু স্পষ্টতই এখন তারা অন্যকারো নয় বরং নিজেদেরই প্রতিনিধিত্ব করছে।

দর্জি আব্দুল বারি ২৪ বছর বয়সী ছিলেন যিনি ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছিলেন। অর্থাৎ পাকিস্তানের সমবয়সী। সেনাবাহিনী অবশ্যই শক্তি প্রয়োগ করে দেশকে একত্রে রাখতে পারে। কিন্তু পূর্ববাংলাতে এটি যা করেছে তাতে ১৯৪৭ সালে তারা দুটি সমান অংশে একটি মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন দেখেছিল তা এখন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের পাঞ্জাবীরা এবং পূর্ববঙ্গের বাঙালিরা এখন নিজেদের একটি সমজাতির সহজাত নাগরিক মনে করবে এরকম সামান্যতম সম্ভাবনা আসতেও দীর্ঘদিন লেগে যাবে। বাঙালিদের জন্য, ভবিষ্যৎ এখন নিরানন্দ: বিজয়ীদের কাছে একটি উপনিবেশের অসুখকর নতিস্বীকার।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৫৬।যুদ্ধ এবং শরনার্থী পরিস্থিতি ডেইলি টেলিগ্রাফ জুলাই ৯, ১৯৭১

Ashraful Mahbub
<১৪, ১৫৬, ৩৯৬-৩৯৮>

ডেইলি টেলিগ্রাফ, জুলাই ৯, ১৯৭১
শান্ত পাকিস্তান সীমান্তে- যুদ্ধের উত্তেজনা বৃদ্ধি
ক্লেয়ার হলিংওয়ার্থ – বেনাপোল, পূর্ব পাকিস্তান

পাকিস্তানি ও ভারতীয় সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ১৫০০ মাইল বরাবর সীমান্ত পারাপার হবার সকল মূল রাস্তার নো-ম্যান্স ল্যান্ড এর ৫ থেকে ৫০ গজ দূরত্বে পরস্পর বিপজ্জনকভাবে মুখোমুখি অবস্থান করছে ।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে, প্রতিদিন ছোট অস্ত্র,দুই-ইঞ্চি মর্টার মাঝেমধ্যে আর্টিলারি বিক্ষিপ্ত গোলাগুলির কারণে সীমান্তে উত্তেজনার তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা স্পষ্টত যুদ্ধের মত অবস্থার মধ্যে রয়েছে।

তারা যাতে কোন ছোট-খাট কিন্তু সংঘবদ্ধ হামলাকারী বাহিনীর আক্রমন থেকে পাঁচ মিনিটের জন্য নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারে সেজন্য তারা নিজেদের বাংকার খনন, প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান এবং সীমান্তে যতদূর সম্ভব বলয় তৈরি করছে।

ঘন ঘন সতর্কতা জারি- কিছু বাস্তব কিন্তু অন্যগুলো ভূয়া। যখন সবাইকে জলাবদ্ধ পরিখার মধ্যে ঢুকতে বাধ্য করা হয়, তখন এই বিপজ্জনক যুদ্ধ খেলায় উত্তেজনা বৃদ্ধি করে যা একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনাকে সহজেই বাস্তব জিনিসে রূপ নিতে পারে।

উভয় পক্ষের প্রেস এবং রেডিওতে প্রতিদিন ক্রমবর্ধমানভাবে একে-অপরকে “শত্রু” বলে ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে।

অনেক স্থানে, যখন পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ এ দায়িত্ব গ্রহণ করে, তখন বাংলাদেশকে সমর্থন জানিয়ে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস দ্বারা দখলকৃত স্থায়ী সীমান্ত পোস্টগুলো পূর্ণদখল করতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে ইতিমধ্যে মারাত্নক যুদ্ধ করতে হয়েছে ।

এই সাবেক সীমান্ত বাহিনী তাদের অস্ত্র এবং চারদিকে স্থায়ীভাবে নির্মিত পজিশনগুলোকে তাদের সাবেক কমরেডদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তাক করে রেখেছে।

উত্তেজনা অব্যাহত রয়েছে

তারা এখনও ভারতীয় সীমান্তে কার্যক্রম চালাচ্ছে , তাদের কে জমির ঘাস পরিষ্কার করে তারা ওখানে আক্রমনের পজিশন তৈরি করতে দেখা যায়। সময়ে সময়ে তারা তাদের প্রফুল্লতা এবং উত্তেজনা বজায় রাখার জন্য উন্মুক্ত গোলাবর্ষণ করছে, এতে এটা নিশ্চিত যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সীমান্ত থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে পারছে না।

ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যরাও ভারতের একটু ভিতরে বাংলাদেশী গেরিলাদের শিবিরে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।

ছয় সপ্তাহ আগে, আমি ভারতের ভিতরে তিন-লেনের ট্রাঙ্ক রোডের মাত্র কয়েকশ গজ দূরে, পাকিস্তানী দিক থেকে ছোড়া ছয় বা সাতটি মর্টার বোমা পড়তে দেখেছি এবং লক্ষ্যনীয় বিষয় যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী ছদ্মবেশী বাংকার এবং আত্মরক্ষামূলক অবস্থান নির্মাণ করেছিল।

বাংলাদেশ গেরিলারা প্রতি রাতে সীমান্ত অতিক্রম করে পরিত্যক্ত গ্রামে সেনাবাহিনীর টহলের সময় বোমা ছোড়ে , টাইম বোমা পেতে আসে এবং ফাঁড়িতে হ্যান্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। গেরিলারা সীমান্ত এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য ক্রমবর্ধমান হুমকি হয়ে উঠছে, যেখানে প্রায় সব টেলিফোন এবং বৈদ্যুতিক তারের লাইন কেটে দেয়া হয়েছে।

প্রাণবন্ত চোরাচালান

স্বাভাবিকভাবেই উভয় পক্ষই জানে যে অন্যরা কি করছে, এজেন্টরা প্রতিদিন অনেকবার পার হয় এতে বোঝা যায়, এখনও চোরাচালান ব্যবসা প্রাণবন্ত রয়েছে।

ভারতীয় অংশ উদ্বাস্তুদের দ্বারা পরিপূর্ণ এবং সেনাবাহিনীর কাছে পাকিস্তান বাহিনীকে একটি সম্পূর্ণরূপে মানব বসতিহীন গ্রামাঞ্চলে পরিচালনা করা সহজ ছিল না, গ্রাম বা এমনকি শহরে যেখানে দুই-এক জন খোড়াঁ বা একজন অন্ধ লোক রয়ে গিয়েছে।

এটা খুবই বিস্ময়কর যে উদ্বাস্তুরা তাদের জন্য পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের তৈরী করা অভ্যর্থনা কেন্দ্রে উল্লেখযোগ্য হারে ফিরছে না। প্রতি রাতে কয়েকটি পরিবার পাঁচ বা ছয়টি “অননুমোদিত রুট” দিয়ে এখানে অনুপ্রবেশ করে এবং তাদেরকে সেনাবাহিনী ধরে নিয়ে যায়।

তাদেরকে ট্রানজিট ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে তাদেরকে খাবার ও কলেরা প্রতিষেধক টিকা দেয়া হয় এবং তারা যে “পাকিস্তান থেকে” তাদের এই দাবির প্রক্ষিতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

নাগরিক কর্তৃপক্ষ এবং প্রকৃতপক্ষে উভয় পক্ষের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা সীমান্ত সংঘাত নিয়ে বাস্তবে খুবই উদ্বিগ্ন।

ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা এবং ব্যাটালিয়ন এবং কোম্পানী কমান্ডারদের মারমুখো মনোভাব প্রদর্শনের পরিপ্রক্ষিতে জাতিসংঘের শান্তি রক্ষার বাহিনীর উপস্থিতিই সবচেয়ে ভালো সমাধান ।

ভারতীয় রাজ্য উদ্বাস্তুতে পরিপূর্ণ
ত্রিপুরা থেকে পিটার গিল
পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের স্রোত ক্ষুদ্র ভারতীয় রাজ্য ত্রিপুরায় প্রবেশ করছে, উদ্বিগ্ন কর্মকর্তারা বহির্বিশ্বের সাথে তাদের অপর্যাপ্ত সরবরাহ রুট সংরক্ষণ করার জন্য প্রাণপ্রণে চেষ্টা চালাচ্ছেন।
বাঙালি কৃষক, তাদের অধিকাংশই মুসলমান এবং কয়েকজন শেল এবং মর্টার বোমার বীভৎত ক্ষত নিয়ে, প্রতিদিন গড়ে কমপক্ষে ১০,০০০ হারে ত্রিপুরায় পালাচ্ছে।

ত্রিপুরা কর্তৃপক্ষকে খরা মৌসুমে ১,৬০০,০০০ বাসিন্দা জনসংখ্যার খাদ্যের পাশাপাশি এখন সম্পূর্ণরূপে কর্মহীন অতিরিক্ত ১ মিলিয়ন শরণার্থীকে সামাল দিতে হচ্ছে ।

গত কয়েক দিন ধরে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে ত্রিপুরার ৫৬০ মাইল সীমান্ত বরাবর সীমান্ত এলাকায় পরিদর্শনের সময়, ভারতীয় গ্রামগুলোকে মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে কান্নাভেজা, ঘরহারা পাকিস্তানি কৃষকদের স্রোত এ পরিপূর্ণ হয়ে যেতে দেখেছি।

প্রানঘাতী গোলাগুলি

তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং একটি স্বাধীন পূর্ববাংলা জন্য লড়াইরত মুক্তি ফৌজ গেরিলাদের মধ্যে একটি ভয়াবহ গোলাগুলির মধ্যে পড়েছিল। এক তরুণ চাষী যে ভারতীয় সীমান্ত পোস্ট এর কাছাকাছি দেবিপুর অতিক্রম করেছেন তিনি সেদিন তার গ্রামে সংগ্রহ করা চারটি মর্টার বোমার টুকরা দেখিয়েছেন।

আমরা যখন আরেকটি সীমান্ত গ্রাম অতিক্রম করছিলাম ১২ বছরের একটি মেয়ে আমাদের জীপকে ধাক্কা দিয়ে সামনে এগিয়ে দিল। শিহরিত হয়ে কেপেঁ ওঠলাম যে, তার খোঁড়া এবং মোটামুটিভাবে ব্যান্ডেজ করা হাতে দিনের শুরুতে একটি শেল স্প্লিন্টার এর আঘাত লেগেছিল। এখনো ক্ষত থেকে রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে।

এই ঘটনাগুলোর ফলে ত্রিপুরার সরকারি কর্মকর্তারা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসার সম্ভাবনা নিয়ে স্পষ্টত সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠেছেন ।

এখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের গেরিলা শত্রুদের বিরুদ্ধে একটি পূর্ণ মাপের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। এবং গেরিলাদের আশ্রয়ের সন্দেহভাজন গ্রাম ব্যাপক প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছে ফলে হিন্দু ও মুসলমান উভয়ই পালাতে করতে বাধ্য হচ্ছে।

পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধের পরিব্যাপ্তিতে শরণার্থী সংখ্যার হিসাব নিকাশ ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করে থাকেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী গ্রামে দূরপাল্লার কামান, মানববিংধ্বসী “বায়ু বিস্ফোরক” শেল, মর্টার বোমা ও মেশিনগান মোতায়েন করেছে।

একবার ভারতীয় এলাকায়, আগরতলার কাছাকাছি শরণার্থীরা গেরিলাদের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা স্বীকার করেছে, বাজারঘাটে শরণার্থী শিবির এ একজন গ্রামবাসী বলল, “এখন আমরা সবাই মুক্তি ফৌজ” ।

এখানে সরবরাহ পরিস্থিতি খুব শীঘ্রই সংকটপূর্ণ হয়ে ওঠবে, সবকিছু কলকাতা থেকে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত ঘুরে ১০০০ মাইল পাড়ি দিয়ে আসবে।

ব্যক্তিগতভাবে, ত্রিপুরার কর্মকর্তারা তাদের রাজ্যের দিকে ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারের অসহযোগিতামূলক মনোভাবের তিব্র সমালোচনা করেছে । তারা অভিযোগ করেছেন অস্ট্রেলিয়ান এয়ার ফোর্স এর খাদ্য ও সংস্থানের সরাসরি ত্রানবাহী বিমানকে অযৌক্তিকভাবে কলকাতায় পুনরায় ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে।

৮ মিলিয়ন গৃহহীন: পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা

ঢাকা থেকে তারবার্তায় আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক: ভারতের চেয়ে আরও বেশি “উদ্বাস্তু” পূর্ব পাকিস্তানের ভেতরে রয়েছে। স্বভাবতই মানুষ বড় বড় দলে হিন্দু-মুসলিম একসংঙ্গে দেশের বিভিন্ন এলাকা পাড়ি দিচ্ছে, সবসময় ভীতি নিয়ে মাঝেমধ্যে দিশাহীনভাবে কিন্তু কোন অনধিকৃত গ্রামে আশ্রয় খুজতে।

মেজর জেনারেল ফরমান আলী, পূর্ব পাকিস্তানে বেসামরিক বিষয়ক দায়িত্বে রয়েছেন, স্বীকার করেছেন যে এই সাত বা আট মিলিয়ন বাস্তুচ্যুত মানুষকে নিয়ন্ত্রন করা অত্যন্ত কঠিন ।

অনেক ছোটখাট দল প্রধান সড়কের দোকান, পেট্রল পাম্প, বাজার স্টল, এবং অন্যান্য স্থাপনার দখল নিতে চেষ্টা করছে এবং এটি আরও বড় সমস্যা তৈরি করছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৫৭। ধর্মান্ধ ও পাষন্ডদের রাজত্ব সানডে টাইমস ১১ জুলাই,১৯৭১

Hasan Tareq Imam
<১৪, ১৫৭, ৩৯৯-৪০৫>

দ্যা সানডে টাইমস, লন্ডন, জুলাই ১১,১৯৭১
দুর্বৃত্ত ও ধর্মান্ধদের রাজত্ব
মারি সাইল

গত সপ্তাহে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তাদের দাবী পুনরাবৃত্তি করে বলেছে যে বিদ্রোহী ও দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ অভিযানের পর পূর্ব পাকিস্তানের জীবনযাত্রা প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে এবং উদ্বাস্তুদের ভারত থেকে দেশে ফিরে আসার মত পরিস্হিতি সৃষ্টি হয়েছে।

গত সপ্তাহে আমি এমন একটি এলাকা পরিদর্শন করেছি, যেখান থেকে ব্যাপকহারে উদ্বাস্তুরা ভারতে পালিয়ে গিয়েছে এবং আমি বলতে পারি যে পাকিস্তানের দাবী সত্য নয়; বরং ধীরে ধীরে এমন একটি প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে যে শরণার্থীদের ফিরে আসার সুযোগ দিনে দিনে আরও কমে যাচ্ছে।

যদি কখনো উদ্বাস্তুরা ঘরে ফিরে যেতে পারে, তবে আমি লোটাপাহাড়পুর গ্রামে যা দেখেছি ঠিক সেরকম দৃশ্য তাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে। খুলনা থেকে ছয় মাইল উত্তরে অবস্থিত এলাকাটি পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় নদীবন্দর, পুরো এলাকা জুড়ে ছনের ছাউনি দেয়া মাটির ঘর। লোটাপাহাড়পুর যশোর থেকে খুলনাগামী মহাসড়কের পাশে অবস্থিত। রাস্তাটি সেনা সদস্যদের চলাচলের কারণে ব্যাস্ত। সৈন্যরা চকচকে আমেরিকান ট্রাকে বসে আছে, হাতে চীনা অটোমেটিক রাইফেল। হঠাৎ হঠাৎ ৩০৩ লী এনফিল্ড রইফেল হাতে বেসামরিক মানুষও দেখা যাচ্ছে।

আমি সদর রাস্তা বাদ দিয়ে পাশের একটি ছোট রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। ফসলী জমির ফাঁকে ফাঁকে জলাশয়গুলো দেখে মনে হচ্ছিল যেন সবুজ-রূপালি রঙে ছককাটা দাবার বোর্ড।

এখানে সেখানে দু-একজন কৃষক গরু বা মহিষের সাহায্যে জমি চাষ করছে, কিন্তু এরকম জনবহুল দেশের তুলনায় খুব কম লোককেই কাজ করতে দেখা যাচ্ছে।

একসময় আমি লোটাপাহাড়পুরে পৌছাই। দুই পাশে সারি সারি তালগাছের মাঝখান দিয়ে কর্দমাক্ত রাস্তা ধরে আমি এগুচ্ছিলাম। আপাতদৃষ্টিতে আর দশটা পূর্ব পাকিস্তানী গ্রামের সাথে গ্রামটির কোন তফাৎ নেই। বাড়িগুলো সুন্দরভাবে বৃত্তাকারে সাজানো, বন্যার হাত থেকে বাঁচার জন্য সমতল থেকে একটু উঁচু করে তৈরি। কিন্তু লুঙিপরা কর্মরত পুরুষ, উজ্জ্বল শাড়ি পরা মহিলা, কলাবাগানের মধ্য দিয়ে ছুটোছুটি করতে থাকা দুরন্ত শিশু বা ছুটতে থাকা কুকুর- গ্রামের কোন পরিচিত কোন দৃশ্যই দেখতে পাওয়া গেলনা।
পূর্ব বাংলার অনেকগুলো গ্রাম আমি দেখেছি, যেগুলোকে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে বা যেগুলোতে অল্প কিছু মানুষ বসবাস করছে। এই প্রথম আমি একটা গ্রাম দেখলাম যেটাকে আপাতদৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্হ মনে হচ্ছেনা; কিন্তু গ্রামটা পরিত্যাক্ত-জনমানবশূন্য।

কোন সূত্র নেই

দোভাষীকে সাথে নিয়ে আমি আশপাশ ঘুরে দেখলাম। হাতিমুখো দেবতা গণেশের একটা রঙীন ছবি দেখে বুঝতে পারলাম গ্রামটা হিন্দুদের। কিন্তু গ্রামবাসীরা কেন গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছে খালি বাড়িগুলো দেখে সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল না। এমন সময় ছেঁড়া শাড়ি পরা এক মহিলা তিনটি বাচ্চা সাথে নিয়ে শঙ্কিত পায়ে এগিয়ে এল।

মহিলা একজন মুসলমান এবং শরণার্থী। তার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। সে পালাতে পেরেছে এবং ঘটনাক্রমে পরিত্যাক্ত এই গ্রামটা খুঁজে পেয়েছে। হিন্দুদের ফেলে যাওয়া চাল খেয়ে সে এত দিনবেঁচে ছিল, কিন্তু এখন সে চালও ফুরিয়ে গিয়েছে। বাচ্চাদের খাবার জোগাড় করার কোন উপায়ই সে খুঁজে পাচ্ছেনা। সে কর্তৃপক্ষের কাছে যেতে চায় না কারণ, তাহলে জেনে যাবে তার স্বামী ‘জয় বাংলা’র সমর্থক ছিল। ‘জয় বাংলা’ হচ্ছে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের স্লোগান।

এরপর আরও কিছু মানুষ কথা বলার জন্য এগিয়ে এল, তারা এখান থেকে কয়েকশ গজ দূরের আরামঘাটা নামক গ্রামের মুসলমান কৃষক। তারা যে গল্প শোনাল তা গত সপ্তাহে শোনা আরও দশটা কাহিনীর মত একই।

আলী হামেদ ও শওকত নামের দুজন একটা ঢেউটিনের মালিকানা নিয়ে ঝগড়া ছিল। এপ্রিলের কোনো এক সময়ে হামেদ দুই ট্রাক ভর্তি পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যেদের রাস্তা দেখিয়ে গ্রামে নিয়ে এসেছিল। সৈন্য ও গ্রামবাসীদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয় এবং সৈন্যদের ছোঁড়া গুলিতে ছয়জন গ্রামবাসী মারা যায়।

মৃতদের মধ্যে দুই জন ছিলেন স্থানীয় কাউন্সিলের সদস্য; একজন হলেন কৃষক ইন্দু বাবু এবং অন্যজন তার আত্মীয় স্কুলের হেডমাস্টার প্রফুল্ল বাবু। দুই জনই হিন্দু। সেনাবাহিনী চলে যাবার পরপরই গ্রামের বাকি ১৫০ জন হিন্দু পালিয়ে যায়।

আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম যে তারা কেন আমাকে এই কাহিনী শোনাচ্ছে। তারা বললো যে কাহিনীর শেষ অংশ এখনো বাকি। ঘটনার সময় কি হচ্ছে সেটা দেখতে গ্রামের কয়েকজন মুসলমান এগিয়ে আসে। সৈন্যরা তাদের মধ্য থেকে চারজনকে ধরে কোরান থেকে কোন একটা সূরা পড়তে বলে।

প্রাণভয়ে কাতর চার মুসলমান মাত্র শুরু করতে পারে “বিসমিল্লাহ হির রহমানির রাহিম …” ( সূরা তেলওয়াতের আগে যেটা পড়তে হয়)। সৈন্যরা এসময় চিৎকার করে ওঠে, “এরা মুসলমান নয়! আমাদের ফাঁকি দেবার জন্য এরা এসব শিখে রেখেছে!” তারপর তারা চারজনকেই গুলি করে হত্যা করে।

গ্রামবাসীদের কাছ থেকে আরো জানা গেল যে হিন্দু প্রতিবেশীদের সঙ্গে তাদের কোনো সমস্যা না থাকাটা সেনা সদস্যদের মধ্যে ক্রোধের উদ্রেক করেছিল। হামিদ এখন ঢেউটিনের মালিক, সে রাইফেল হাতে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। গ্রামবাসীরা বলে সে একজন রাজাকার (স্বেচ্ছাসেবক), এই রাজাকার শব্দটা ঘুরে-ফিরে আবার শুনলাম।

হিন্দুদের জমি নিয়ে কি হয়েছিল? গ্রামবাসীরা আশে-পাশের সবুজ ক্ষেতের দিকে আঙুল তুলে দেখাল, সেখানে তিসির চাষ হয়।তিসি অত্যন্ত মূল্যবান ফসল। জুন মাসে সামরিক সরকারপক্ষের কিছু কর্মকর্তা প্রকৃত মালিকের অনুপস্থিতিতে ২০০০ একর জমির নিলাম ডাকে।

এই জমির প্রকৃত দাম একর প্রতি ৩০০ রুপি। কিন্তু সেগুলো বিক্রি করা হয় একর প্রতি মাত্র দেড় রুপিতে। তবে নামমাত্র মূল্যে এই জমি কিনেও ক্রেতাদেরও লাভ হয়নি। বেশীরভাগ জায়গায়ই তারা ফসল ফলানোর জন্য নিয়োগ দেয়ার মানুষ খুঁজে পায়নি আর এখন সব জমিই পানির নীচে।

প্রকৃত পরিস্হিতি

লোটাপাহাড়পুর আমার কাছে উদ্বাস্তুদের সম্মন্ধে একটি পরিস্কার চিত্র তুলে ধরে। এখানে কেউই ভাবছেনা যে শরণার্থীরা ফিরে আসতে পারে । কারণ পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি এখনো ভীতিকর এবং তাদের ফিরে আসার সত্যিকার বাধাগুলো এখনও দূর হয়নি। তাদের ঘর-বাড়ি, জমিজমা, ফসল, ব্যবসা সবই তাদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় শত্রদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে এবং সেই সুবিধাভোগীরা অবশ্যই চাইবে শরণার্থীরা যেন ফিরে না আসুক। সামরিক কর্তৃপক্ষ অবশ্য ঠিকই ‘অভ্যর্থনা-কেন্দ্র’ ও ‘ট্রানজিট ক্যাম্প’ খুলে বসে আছে।

আমি তাদের প্রস্তুতি দেখার জন্য গাড়ি চালিয়ে ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি বেনাপোলে গেলাম। সেখানে খুলনা এলাকার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লেঃ কর্নেল শামস-উজ-জামান আমাকে তার সদর দফতরে অভ্যর্থনা জানালেন। তিনি আমাকে জানালেন যে সীমান্তে বহুবার ভারতীয় সৈন্যদের সঙ্গে মর্টারের গোলা বিনিময় হয়েছে। তার ভাষ্যমতে সবসময়ই ভারতের পক্ষ থেকে গোলাবর্ষণ শুরু হয়।

কর্ণেল শামস বলেন, “এদের রক্ষা করার জন্য এখানে অবশ্যই আমাদের থাকা প্রয়োজন। এই বাঙালিরা জানেনা কীভাবে লড়াই করতে হয়। আমি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে এসেছি, আমাদের শরীরে রয়েছে যোদ্ধার রক্ত। দশ বছর বয়স থেকেই আমি রাইফেল ব্যবহার করে আসছি। আমাদের সাহস আছে।”

কর্নেল শামসের পরিকল্পনায় গত তিন মাস ধরে এখানে সামরিক তৎপরতা চলছে। ২৫-২৯ মার্চে খুলনা শহরের নিরাপত্তার জন্য সামরিক অভিযান শুরু হয়। কর্ণেল শামস জানান যে দুষ্কৃতিকারী ও বিদ্রোহীদের হাত থেকে মাত্র গত মাসে তারা পুরো জেলাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে।

অবস্হাদৃষ্টে মনে হচ্ছে কর্ণেল শামসই খুলনা অঞ্চলে রাজাকারদের হাতে পুলিশদের রাইফেল তুলে দেয়ার ব্যবস্থা চালু করেছেন। এদের সম্পর্কে তার মূল্যায়ন, “এরা ভালো মানুষ, ভালো মুসলমান ও খাঁটি পাকিস্তানি।”
সামরিক কর্তৃপক্ষের হিসেব মতে পূর্ব পাকিস্তানে এখন প্রায় ৫,০০০ রাজাকার রয়েছে, যাদের মধ্যে ৩০০ জনই খুলনা অঞ্চলের। তাদের প্রতিদিন তিন টাকা করে মাইনে দেয়া হচ্ছে, যেটা সরকারী রেটের ২৫%। তাদের সাত দিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় যেটার মূল উদ্দেশ্য পুলিশি লি-এনফিল্ড রাইফেলের মাধ্যমে কীভাবে গুলি করতে হয় তা শেখানো। এই রাজাকাররা স্থানীয় শান্তি কমিটির অধীনে পরিচালিত এবং তাদের মূল কাজ হচ্ছে সৈন্যদের আওয়ামী লীগের সমর্থকদের বাড়ি চিনিয়ে দেয়া। এই শান্তি কমিটিও গঠিত হয়েছে পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে। আসলে শান্তিকমিটি হচ্ছে বিগত নির্বাচনে বিপুলভাবে পরাজিত রাজনৈতিক দলের কর্মী, বিভিন্ন রকমের অপরাধী এবং ধর্মান্ধ মুসলমানদের নিয়ে গঠিত একটি দল, যারা মনে করে অস্ত্র দ্বারা হলেও তাদের ধর্ম রক্ষা করতে হবে।

খুলনা জেলার নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষন করলেই বোঝা যায় যে শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের রাজনৈতিক ভিত্তি কতটা দুর্বল। বর্তমানে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ খুলনা জেলার আটটি আসনের সবগুলোতে জয়লাভ করে এবং মোট ভোটের শতকরা ৭৫ ভাগ পায়। মুসলিম লীগের তিন অংশ মিলে শতকরা ৩ থেকে ৪ ভাগ ভোট এবং মৌলবাদী দল জামাতে ইসলামী শতকরা ৬ ভাগ ভোট পায়।

ঢাকা থেকে কলকাতাগামী প্রধান সড়কের উপর বেনাপোল অবস্হিত এবং এই সীমান্তের ওপারেই পশ্চিমবঙ্গে বড়ো বড়ো কয়েকটি উদ্বাস্ত শিবির রয়েছে। আমি কর্ণেল শামসের কাছে জানতে চাইলাম যে তার লোকজন যেভাবে মেশিনগান নিয়ে প্রধাণ রাস্তা দখল করে মহড়া দিচ্ছে, তখন তিনি কীভাবে আশা করেন যে উদ্বাস্তুরা বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ফিরে আসবে?

তিনি বললেন, সীমান্ত এলাকার নদী বা ধানী জমির মধ্য দিয়ে আসতে তাদের কোনো বাধা নেই। তিনি সার্বক্ষণিক টহলের ব্যবস্থা করেছেন যাতে দুষ্কৃতিকারী, বিদ্রোহী ও ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীরা ভেতরে আসতে না পারে। তিনি বললেন, “তাদের আসতে দিন, আমরা তাদের জন্য প্রস্তুত ।”

তিনি কাদের জন্য প্রস্তুত, উদ্বাস্তু না ভারতীয় সৈন্য সেটা অবশ্য স্পষ্টভাবে বোঝা গেলনা।

কর্নেল শামস তার বাহিনীর একজন ক্যাপ্টেনকে আমার সঙ্গী হিসাবে দিয়ে দিলেন। তার সাথে হেঁটে আমি সীমান্ত থেকে এক মাইল দূরে বেনাপোল উদ্বাস্তু অভ্যর্থনা কেন্দ্রে ফিরে এলাম।

ক্যাপ্টেনের মোটা গোঁফ আছে এবং তিনি প্যারাট্রুপারদের পোশাক পরিহিত ছিলেন। বাঁশের টুপি মাথায় দিয়ে জমিতে কাজ করতে থাকা কিছু বাঙালী কৃষককে দেখিয়ে ক্যাপ্টেন সাহেব বললেন, ” আমরা খুব সমস্যায় আছি। ওদের দেখেন। আমাদের কাছে ওদের সবাইকেই একরকম লাগে। আমরা কীভাবে বুঝবো যে কে দুষ্কৃতিকারী আর কে সাধারণ মানুষ?”

অভাগা কুকুরের দল

বেনাপোল অভ্যর্থনা কেন্দ্রে কেবল পাঁচটি আশ্রয়হীন কুকুর ছাড়া আর কাউকে দেখা গেল না।

ক্যাপ্টেন বললেন যে সীমান্তের খুব কাছাকাছি হবার কারণে হয়তো কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তিনি আমাকে সাতক্ষীরার দিকে আরেকটি শরণার্থী প্রত্যাবর্তন কেন্দ্রের কথা জানালেন। আমি গাড়ি চালিয়ে সাতক্ষীরারা দিকে গেলাম এবং সেখানে ১৩ জন উদ্বাস্তুকে পাওয়া গেল। তাদের মধ্যে ৩ জন হিন্দু। ক্যাম্পের ভেতর একটি বোর্ডে শরণার্থীদের আসা-যাওয়ার হিসাব লেখা ছিল। ক্যাম্প ঘুরে দেখার সময় আমি দুই জন রাজাকারের কাছ থেকে মিলিটারি কায়দায় দেয়া স্যালুট পেলাম। তারা বয়সে তরুণ, তাদের হাতে শটগান ছিল। আমাকে বলা হলো যে তারা এই ক্যাম্পটি পাহারা দেবার কাজে নিযুক্ত আছে (কাদের ভয়ে এই পাহারা? দুষ্কৃতিকারী, বিদ্রোহীদের ভয়ে?)। তারা নিরাপত্তা পরিদর্শনের কাজেও সাহায্য করছে। এমন সময় আরও ১০০ জন উদ্বাস্তু আসার ঘোষণা দেয়া হয়।

ফিরে আসা লোকগুলোর পরনে ছিল ভালো পোশাক এবং তাদের স্বাস্হ দেখে মনে হলনা তাদের খাবারদাবারের কোনো সমস্যা আছে । তারা সবাই ভারতীয় সীমান্তের ওপাশেই হাসনাবাদ থেকে একই দিনে, একসঙ্গে এসেছে। তারা সেখানে গিয়েও ছিল একই সময়ে এবং ২২ দিন থাকার পর তারা একসঙ্গে ফিরে এসেছে।

তাদের কাছে ভারতীয় রেশন কার্ড দেখতে চাইলে তারা সেটা দেখাতে পারেনি কারণ তাদের কেউই নাকি ভারতীয় রেশন কার্ড সংগ্রহ করতে সমর্থ হয় নি। ক্যাম্পটা বেশ বড়, স্কুল ঘর এবং পাশের দালান মিলিয়ে সহজেই ২০০০ মানুষকে আশ্রয় দেয়া যায় ।আমি ক্যাম্পের দায়িত্বে নিযুক্ত লোকদের জিজ্ঞেস করলাম যে-যারা আসলেই ভারতীয় সীমান্তের ওপাশে উদ্বাস্তু হিসেবে থাকে নি, তারা এখানে সাহায্য পাবার যোগ্য কিনা। উত্তরে তারা জানাল যে না, তারা সাহায্য পাবার যোগ্য নয়।

সাতক্ষীরা থেকে আমি এই এলাকার প্রধান শহর খুলনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। যাবার পথে আমি একটা সেতু পার হলাম, যেটি কোনো রকমে মেরামত করা হয়েছে। দশ দিন আগে এক মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণে এটা বিধ্বস্ত হয়েছিল। স্থানীয় লোকজনের কাছে জানা গেল যে ২৫ জন রাজাকার ব্রিজটির পাহারা দিচ্ছিল, কিন্তু প্রথম গুলির আওয়াজেই তারা পালিয়ে যায়। পরে রাজাকার হাই কমান্ডের সঙ্গে দেখা হলে তাকে এবিষয়ে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি এঘটনা স্বীকার করেন নি।

গত আদমশুমারির হিসেবে খুলনা জেলার লোকসংখ্যা ৩০ লাখ। এরমধ্যে চার ভাগের এক ভাগ মানুষই নিখোঁজ, হয় মৃত অথবা ভারতে পালিয়ে গিয়েছে। স্থানীয় বেসামরিক প্রসাশনের হিসাবমতে জেলার অর্ধেক জমিতেই এবছর কোন চাষ হয়নি। ঢাকা থেকে আসা সরকারী আদেশ মোতাবেক শান্তিকমিটি কর্তৃক নির্বাচিত ‘তত্ত্বাবধায়ক’-দের হাতে পরিত্যক্ত জমি, দোকান-পাট ও সম্পত্তি তুলে দেয়ার ব্যাবস্হা নেয়া হচ্ছে।

বেসামরিক প্রশাসনের দৈনন্দিন কাজকর্ম বন্ধ। খুলনায় সেনা অভিযান শুরু করার পর থেকেই জেলার সিনিয়র ম্যাজিস্ট্রেট রাজেন্দ্র লাল সরকার, যিনি একজন হিন্দু নিখোঁজ রয়েছেন। অনুমান করা হচ্ছে যে তাকে হত্যা করা হয়েছে।

সিনিয়র মুসলমান ম্যাজিস্ট্রেট চৌধুরী সানোয়ার আলীকে সেনাবাহিনী গ্রেফতার করেছে। তিনি বর্তমানে কোথায় আছেন কেউ বলতে পারে না।

পুলিশ প্রধাণ, আব্দুল রাকিব খন্দকাকে বদলি করা হয়েছে এবং জেলা প্রশাসক নূরুল ইসলাম খানকে জানানো হয়েছে যে তাকে বদলি করা হবে।

পালাবদলের খেলা

পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনে এখন এধরণের পালাবদল চলছে। উপোরল্লিখিতদের মত অন্য বাঙালি অফিসারদেরও খুব দ্রুততার সঙ্গে বদলি করা হচ্ছে। স্থানীয় সরকারের ৩০০ কেরানির মধ্যে ৬৬ জন ছিল হিন্দু। তাদের মধ্যে কেবল দু-জন এপর্যন্ত টিকে আছেন; বাকিদের কেউ যদি বেঁচেও থাকেন তবে তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।

বিভিন্ন সূত্র থেকে আমাকে বার বার জানানো হয়েছে যে সংখ্যালঘু হিন্দুদের চাকরি দেবার সময় কঠোর বাছাই প্রক্রিয়া এবং একটি কালো তালিকা অনুসরণ করা হয়।

যদিও সরকারীভাবে এই ব্যাপারগুলো অস্বীকার করা হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে হিন্দু তরুণ অরবিন্দ সেন খুলনা প্রশাসনের একটি কেরানিপদের চাকরির জন্য ৫০০ জন প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা প্রথম স্হান অধিকার করেন। প্রশাসনে লোকবলের চরম অভাব থাকা সত্বেও গত সপ্তাহ পর্যন্ত তাকে নিয়োগ দেয়া হয়নি।

সামরিক বাহিনী অনেক জিনিষপত্র রিকুইজিশন করে নিয়ে যাওয়ায় খুলনা বেসামরিক প্রশাসনের কাজকর্মে চরম ব্যাঘাত ঘটছে। খাদ্য বিতরণ, বন্যানিয়ন্ত্রণ এবং এই ধরনের কাজকর্মে ব্যবহার করার জন্য জেলা প্রসাশনের অনেকগুলো লঞ্চ ছিল (জেলার অর্ধেক এলাকায় পৌছাতে জলপথ ব্যবহার করতে হয়)। কিন্তু সেনাবাহিনী লঞ্চগুলো রিকুইজিশন করে সেগুলোতে মেশিনগান স্থাপন করে নদীপথে টহল দেয়ার কাজে ব্যাবহার করছে। জেলা প্রশাসন জরুরি ভিত্তিতে লঞ্চগুলো ফিরে পেতে চাচ্ছে অথবা নতুন লঞ্চ খুঁজছে, কারণ তারা খবর পেয়েছে যে কৃষকরা তাদের নিচু জমিকে বন্যার কবল থেকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় বাঁধ নির্মাণ করতে পারে নি। এখন লোনা পানি যদি এই জমিগুলোকে প্লাবিত করে তবে অনেক বছরের জন্য জমিগুলো চাষের অনুপযুক্ত হয়ে যাবে।

পাকিস্তান রিভার সার্ভিসের একটি টাগবোটকে নৌবাহিনীর একটি গানবোট গোলার আঘাতে ডুবিয়ে দিয়েছে। স্থানীয় নৌবাহিনীর প্রধান আলহাজ্জ্ব গুলজারিন আমাকে জানিয়েছেন যে যে টাগবোটটি দুষ্কৃতিকারীরা দখল করে নেয়ায় সেটি ডুবিয়ে দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। কারণ তারা টাগবোটটি ব্যাবহার করে নৌবাহিনীর একটি জাহাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। যদিও স্থানীয় মাঝিদের কাছ থেকে জানা যায় যে টাগবোটটিতে সাধারণ ক্রুরাই ছিল এবং পাল্টা জবাব দেবার কোনো সুযোগই তারা পায় নি।

স্থানীয় শান্তি কমিটি ও রাজাকার হাই কমান্ড এলাকায় স্বাভাবিক অবস্হা ফিরিয়ে আনতে সফল হয়েছে, একথা বলারও কোন উপায় নেই। গত মাসে তাদের দু-জন সদস্য- জেলা কাউন্সিলের ভাইস-চেয়ারম্যান গোলাম সারওয়ার মোল্লা এবং খুলনা মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস-চেয়্যারম্যান আব্দুল হামিদ মুখোশধারী ব্যক্তির গুলিতে নিহত হয়েছে। সরকারী হিসাবে গত এক মাসে সারা জেলায় ২১ জন শান্তি কমিটির সদস্য নিহত হয়েছে। খুলনা হাসপাতালে বর্তমানে ১৬ জন গুরুতর অবস্হায় চিকিৎসাধীন আছে,যাদের ১২ জন গুলির আঘাতে আহত এবং চারজনের শরীরে ছুরি/ড্যাগারের আঘাতের চিন্হ রয়েছে।

একটি অপারেশনে সক্রিয় থাকা অবস্থায় আমি একজন রাজাকার কমান্ডার আব্দুল ওয়হাব মহলদার-এর সাথে আমার কথা হয়। তার মতে বিগত কয়েক সপ্তাহে খুলনায় অন্তত ২০০ জন রাজাকার ও শান্তিকমিটির সদস্য নিহত হয়েছে। মহলদার বলেন তার নিজের গ্রুপ দু-জন দুষ্কৃতিকারী-কে হত্যা করেছে।

খুলনা পুলিশের কাছে রাজাকারদের বিরুদ্ধে নিরীহ মানুষকে হত্যা করার দুটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। রাজাকাররা দুজন স্কুল শিক্ষককে বিনা অপরাধে কোনো আগাম হুঁশিয়ারি না দিয়েই হত্যা করেছে, এখবর পুলিশের কাছে এসেছে। এধরনের মামলার ব্যাপারে পুলিশের কিছুই করার নেই, কারন সামরিক প্রজ্ঞাপনা অনুযায়ী রাজাকারদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের তদন্ত কেবল সামরিক বাহিনীই করতে পারবে। ঠিক একই কারণে খুলনা পুলিশ শান্তিকমিটির অবাঙালি সদস্য মতি উল্লাহর বিরুদ্ধে তদন্ত পরিচালনা করতে পারছে না। অথচ সেনাবাহিনী শহরের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবার আগের দিন তার কাছ থেকে বিস্ফোরক দ্রব্য উদ্ধার করা হয়েছিল।

একজন গুন্ডা

অতীতে মতিউল্লাহর বিরুদ্ধে নির্যাতন ও হুমকি প্রদর্শনের মাধ্যমে অর্থ আদায়ের অভিযোগ ছিল । কিন্তু শান্তিকমিটির দায়িত্ব পাবার পর তার জামিন হয়ে যায়। তার বাড়ির পেছনে একদিন বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়- প্রতিবেশীদের অভিযোগ, দাঙ্গার সময় ব্যবহারের জন্য সে ডিনামাইট মজুত করে রাখছিল। সে এমনই লোক যাকে বন্দুকের লাইসেন্স পর্যন্ত নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি। পুলিশের খাতায় সে গুন্ডা হিসেবেই পরিচিত।

যুদ্ধের গণ্ডগোল ও সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা অভিযানে ঠিক কতজন লোক মারা গেছে তা আমি শেষ পর্যন্ত স্থির করতে পারলাম না। প্রত্যক্ষদর্শী একজন সরকারী ম্যাজিস্ট্রেট, যিনি তিন দিনের কারফিউয়ে ঘরে বন্দি ছিলেন জানালেন নদীর পাশে অবস্হিত নিজের বাড়ি থেকে তিনি অভিযানেরর দিন দশ মিনিটের মধ্যে ৪৮টি লাশ ভেসে যেতে দেখেছেন। শহরের অনেক এলাকাতেই আগুন দেয়া হয়েছে, কর্তৃপক্ষের ভাষায়:- ‘বস্তি নির্মূল অভিযান’। খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলে যাওয়ার রাস্তার দুই পাশে এক মাইলেরও বেশী এলাকা জুড়ে সবকিছু সম্পূর্ণরুপে ধ্বংস করা হয়েছে।

কর্নেল শামস আমাকে জানান যে বিদ্রোহীদের সঙ্গে তার জোর লড়াই হয়েছে বটে, কিন্তু তিনি কখনোই ভারী অস্ত্র ব্যবহার করেন নি। তিনি আরো বলেন দালানে বড় বড় যে আঘাতের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে, সেটা দুষ্কৃতিকারীদের পেট্রোলবোমা ব্যবহারের ফল। সেনাদের হতাহতের সংখ্যা জানতে গেলে অন্য একটি সেনা সূত্র আমাকে জানিয়েছে যে কোন সেনাসদস্য নিহত হয়নি, মাত্র সাতজন আহত হয়েছে।

সেনাঅভিযানের কালে খুলনা হাসপাতালে বুলেটবিদ্ধ অবস্হায় ১৫৯ জন, গুলিতে আহত ২৫ জন এবং ছুরি, ড্যাগার ও বেয়নটের আঘাতে ৭০ জন ভর্তি হয়। কিছু ক্ষেত্রে লড়াইয়ে সময় বাঙালিদের হাতে যেমন অবাঙালি বিহারীরা নিহত হয়েছে, অবাঙালিদের হাতেও বাঙালিরা নিহত হয়েছে। আর সেনাবাহিনীর গণহত্যা তো রয়েছেই। কিন্তু ভারী অস্ত্র-শস্ত্র সব ছিল সেনাবাহিনীরই হাতে। যেহেতু কোনো সরকারী তদন্ত হচ্ছে না, হতাহত বা ধ্বংসযজ্ঞের কোন সঠিক পরিসংখ্যান কখনো নাও জানা যেতে পারে। পাকিস্তান পুলিশকে প্রতিটি গুলির লিখিত হিসাব রাখতে হয় এবং ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ছাড়া তারা গুলি করতে পারেনা। সেনা সদস্যরা এধরণের কোন নিয়মে আওতায় পড়ছেনা।

মংলা বন্দরে কী ঘটেছে সেটাও অস্পষ্ট।মংলাতে নৌকাযোগে পৌছান যায়, সেখানে দেখা যাচ্ছে বন্দরের ঘরবাড়ি ও বাজারের দোকানপাট পোড়ানো হয়েছে। বন্দরের পাশের ইট/কংক্রিটের দালানগুলোতে গুলির দাগ।

স্থানীয় পুলিশের প্রধান, সাবইন্সপেক্টর হাদি খান একজন অবাঙালি। মাত্র গত মাসে তার প্রমোশন হয়েছে এবং এধরনের পদে আসার জন্য যে পরীক্ষায় পাশ করতে হয়, তাকে সেধরনের কোনো পরীক্ষাই দিতে হয়নি। বন্দরের ধ্বংসযজ্ঞ এপর্যন্ত আমার দেখা সবচেয়ে বেশি মারাত্মক ধ্বংসযজ্ঞ, অথচ এই সম্পর্কে হাদি খান জানান যে বাজারের কোনো একটা দোকান থেকে হ্যারিকেন উল্টে যেয়ে নাকি এই অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে।

কিন্তু পিএনএস তিতুমীর এর কমান্ডার জারিন বললেন অন্য কথা। তার ভাষ্যে, “মংলায় দুষ্কৃতিকারীদের সঙ্গে আমাদের জোর লড়াই হয়েছে। রাস্কেলগুলো আমাদের বিরুদ্ধে হাতবোমা ও পাইপগান নিয়ে যুদ্ধ করতে এসেছিল। কিন্তু গুলি নিক্ষেপের সময়ই তা বিস্ফোরিত হয় এবং অর্ধেক এলাকা পুড়ে যায়।”

ঘটনার কথা মনে করে কমান্ডার হেসে উঠেন। নদীর পাশের দালানগুলোতে গুলির দাগের কোনো ব্যাখ্যা তিনি আমাকে দিতে পারলেন না। মংলায় আমি এবিষয়ে আমি খুব বেশী অনুসন্ধান করতে পারলাম না কারণ আমার নিরাপত্তার জন্য সবসময় দু-জন বন্দুকধারী সৈনিক আমার সাথে ছায়ার মত লেগে ছিল। তাদের ভয়ে এলাকাবাসী মুখ খুলতে পারছিল না।

প্রত্যেকটা ঘটনা সম্পর্কে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দেয়া আজগুবি সব ব্যাখ্যা শুনে যাওয়া আমার কাছে বিরক্তিকর লাগছিল।

অভ্যর্থনা পাওয়ার সম্ভাবনা

শরণার্থীদের ফিরে আসা প্রসঙ্গে বলা যায় যে কেবল অতি সাহসী এবং অতি বোকা লোকই এই মুহূর্তে দেশে ফিরে আসতে চাইবে এবং কেউ যদি ফিরেও আসে তবে তাকে অভ্যর্থনা জানানো হবে কিনা সেব্যাপারে সন্দেহ আছে। কেবল ভারত ও পাকিস্তানের যৌথ উদ্যোগই উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেরকম হবার কোনো সম্ভাবনা নেই।

আরও আশংকার কথা, শান্তিকমিটি ও রাজাকারদের দাপটে পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসন ক্রমশ ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েছে এবং এই রাজাকার বাহিনী একটি সমান্তরাল সরকার ব্যাবস্হা গড়ে তুলেছে। বর্তামানে সেখানে ভাড়াটে গুন্ডা, ধর্মান্ধ এবং চোর-ছ্যাঁচোড়দের শাসন চলছে।

অনেক আগে ব্রিটিশরা জ্বালাও-পোড়াও, নিরিহ জনগণকে হত্যা করে শান্তিপ্রতিষ্ঠার যে কায়দা প্রদর্শন করেছিল, সেই পদ্ধতি এই জনবহুল ও শান্তিপূর্ণ পূর্ব পাকিস্তানে প্রয়োগ করা অত্যন্ত ক্ষতিকর হয়েছে। বরং হিটলার ও মুসোলিনির রাজনৈতিক পদ্ধতি প্রয়োগ করলে সেটা অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতির কারণ হত।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৫৯। বাঙ্গালীদের দেশ ত্যাগ এখনো চলছে সানডে টেলিগ্রাফ ২৫ জুলাই ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৫৯, ৪০৬-৪০৭>

সানডে টেলিগ্রাফ, লন্ডন, ২৫ জুলাই, ১৯৭১
বাঙ্গালীদের দেশ ত্যাগ এখনো চলছে

পিটার গিল গত দুই মাস পূর্ববাংলায় সেখানকার সংকট নিয়ে রিপোর্ট করছেন।

বাঙালিদের সঙ্গে দুই মাস থাকার পরে, আপনি সহজেই বাকিদের থেকে শরনার্থিদের আলাদা করতে সক্ষম হবেন। পাশে থাকার সুবিধা হল বর্ষার বৃষ্টিতে গাড়ীর জানালা না খুলেই ভেতর থেকে বলে দিতে পারবেন কার অবস্থা কি।

সংখ্যাটা পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে। টাইম ম্যাগাজিনের সাংবাদিক হিসেবে আমি গত বুধবার কলকাতার অদূরেই বনগাঁ থেকে ১২ মাইল গাড়ি চালিয়ে পূর্ববাংলার সীমান্তে বগুড়ায় পৌছাই। কিছু জিনিস এর মাঝে চোখে পড়ল। এগুলো ব্রিটিশ সানডে ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ ও রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত টেলিভিশন ফিচার ফিল্ম হিসেবে চলবে।

হিন্দু ও মুসলমান কোন বিষয় না – বিষয় হল তারা বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমান।

মুসলমান পুরুষরা লুঙ্গি পরে। এটি একটুকরো কাপড় যা কোমর বৃত্তাকারভাবে বাঁধা থাকে এবং কাফ পর্যন্ত ঝুলে থাকে। হিন্দুরা প্রধানত ধুতি পরে। এটি একটু জটিল ধরনের গান্ধীবাদী প্যাঁচানো ধরণের কাপড় যেটা আলগা এবং মাটি পর্যন্ত বিস্তৃত। সেদিন সেখানে বেঁচে থাকার পদব্রজে হিন্দু ও মুসলমান উভয় লোক ছিল।

বিধবাদেরকেও আলাদা করা যায়। রঙ্গিন সুন্দরী মেয়েদের এবং বিবাহিত মহিলাদের মত রঙ্গিন শাড়ির পরিবর্তে তারা পূর্ব বাংলা বাজার থেকে কেনা সস্তা প্লেইন সাদা ফ্যাব্রিক পরে। তাদের বেশিরভাগ অনেক বৃদ্ধ , দুর্বল এবং খোঁড়া। কিন্তু তবুও তাদের পূর্ববঙ্গ থেকে বৃষ্টির মধ্যে ভারত শিবিরে যেতে হবে।

শরণার্থীরা যাকিছু আছে তার সব কিছুই বহন করছে। সবকিছু পুরনো শাড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে একটি থলির মত বানিয়ে তার ভেতরে করে নিয়ে যাচ্ছে। একজন বৃদ্ধ মানুষ তার হাতে একটি হাঁড়িতে মাছ নিয়ে সেটিকে হাতের সাথে ঝুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। একজন বিদেশী নিউট্রিশনিস্ট আমাকে বলেছিল ওটাই হবে তার শেষ বারের মত দুই এক বেলার আমিষের যোগানদাতা।

আমাদের রাস্তা ছিল পূর্ববাংলার একটি অঞ্চল যেটা পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিল – যা এখন স্বাধীন বাংলাদেশ।

কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনের দুজন লোক আমাদের সঙ্গে ছিলেন। একজনের কাছে একটা সামান্য টেপ রেকর্ডার ছিল, যা দিয়ে সে স্বাধীনতাকামীদের অনুভূতি রেকর্ড করতে যাচ্ছিলেন। এবং অন্যজন স্যার ওয়াল্টার রেলির (Sir Walter Raleigh) দেশপ্রেমের কবিতার কিছু চরণ শোনাচ্ছিল।

স্থানীয় গেরিলা কমান্ডার আমাদের সাথে দেখা করতে আসলেন। তিনি বললেন “আপনি ইতিমধ্যে হয়ত দেখেছেন এখানকার মানুষের উচ্চ মনোবল।”

সত্যি বলতে, আমি দেখিনি। তারা ভারতের রিফুজি ক্যাম্পে যাবার যে পথযাত্রা তাদের ভেতরে ছিলোনা। তাই দেখার সুযোগ হয়নি। তাদের উদ্যম ছিল কম। হয়ত পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশ তাদের কাছে একই রকমের। যদি গেরিলারা না থাকত আর আর্মি দুরেই থাকত তারা হয়ত এখানে থেকে শুধু ফসল উৎপাদন আর বিক্রি করে জীবন পার করে দিতেন।

বাংদা গ্রামে আজ হাটের দিন। এলাকার গেরিলা কমান্ডার বললেন বাংদা-বাজারে বুধবার ও শনিবার হাট বসে। টেপ রেকর্ডার সঙ্গে রাখা ব্যাক্তিটি মাইক্রোফোন ঠিক করলেন এবং গেরিলারা ও ছাত্র-স্বেচ্ছাসেবকরা চিয়ার্স আরম্ভ করার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগল।

মাইকে চিৎকার দিয়ে বলল “শেখ মুজিবুর রহমান।”
“জিন্দাবাদ” (অর্থাৎ চিরজীবী হন)।

উদ্বাস্তুরা ধীরে ধীরে আমাদের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল। তারা ভারতে যাচ্ছে – সেখানকার সরকার দুই মাসে তেমন কিছু করতে পারেনি। ভারত চেষ্টা করেছে কিন্তু কমই করতে পেরেছে। পাকিস্তান পেরেছে – যদিও তারা কোন কিছুরই প্রস্তাব দেয়নি। পশ্চিমারা শুধু নিন্দা করেছে এবং বেশিরভাগই নির্লিপ্ত রয়েছে।

এমনকি পশ্চিমাদের ত্রাণ প্রচেষ্টা বর্ষার কাদার মধ্যে ম্লান হয়ে গেছে। লন্ডনের স্টার্লিং, ওয়াশিংটনের ডলার এবং জেনেভার দান কাগজেই সুন্দর দেখায়। সত্য এটাই যে ভারতে অবস্থিত একজন বাঙ্গালী রিফুজিকে ভালো কোন আশ্রয় দেয়া হয়নি বা তাদের স্বাস্থ্য দুই মাস আগে যা ছিল সেরকম মোটেও নেই।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৬০। বাঙলায় পাকিস্তানীদের দিন শেষ হয়ে আসছে ইকোনমিস্ট ৩১ জুলাই ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৬০, ৪০৮-৪০৯>

দি ইকোনমিস্ট, লন্ডন, ৩১ জুলাই ১৯৭১
বাঙলায় পাকিস্তানীদের দিন শেষ হয়ে আসছে

পূর্ব পাকিস্তানে শরনার্থিদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে একটি ছোট্ট প্রথম পদক্ষেপটি অর্জন করা হয়েছে। পাকিস্তান জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকদের সেখানে কাজ করার অনুমতি দিয়েছে। ভারত এই সপ্তাহে এই প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা মনে করে সীমান্তের এদিকে পর্যবেক্ষক থাকা উচিত। কিন্তু শরণার্থীদের ফিরে আসার প্রধান বাধাটি পূর্ব পাকিস্তানে গভীরভাবে বজায় রয়েছে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া থেকে প্রশংসা ছাড়া আর কিছুই পায়নি। যখন কেউ পূর্ব পাকিস্তানে ভ্রমণ করবে তখন তার কাছে সুস্পষ্ট হবে যে তারা অত্যধিক শক্তি ব্যবহার করেছে। প্রদেশ জুড়ে যে ক্ষতি করা হয়েছে তা বিশাল হয়ে উঠেছে, এবং এটির একটি অফিসিয়াল কাহিনি ছিল – সেটা হল সৈন্যদের যখন গুলি করা হয়েছে শুধুমাত্র তখনি তারা গুলি করেছে। সর্বাধিক আক্রান্ত হয়েছে বাজার এলাকা, যেখানে তারা সর্বাধিক ক্ষয়ক্ষতি ও অগ্নিকান্ড ঘটিয়েছে।

প্রদেশের প্রধান সড়কগুলির দুইপাশের কুটির পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে এবং বেশিরভাগ এলাকায় চারপাশে রাস্তা এবং ব্রিজগুলি থেকে মানব বসতি সাফ করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর দাবি যে মাত্র আটজন সৈন্য, যাদের মধ্যে কোনও কর্মকর্তা নেই – যাদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে বাড়াবাড়ির জন্য। রিপোর্ট আছে যে কমপক্ষে একজন ব্রিগেডিয়ার তার কমান্ড দিয়েছেন। কর্তৃপক্ষ যদি এই ধরনের শৃঙ্খলাবদ্ধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে তাহলে এটা বিদেশী সাহায্য দাতা এবং উদ্বাস্তুদের সন্তস্ট করতে পারে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোনও সমালোচনার ব্যাপারে ভয়ঙ্কর কথা বলছে, যারা পাকিস্তানের সৃষ্টির পর থেকে কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।

বেশিরভাগ শরণার্থী হিন্দু – মোট প্রায় ৭ মিলিয়নের প্রায় ৬ মিলিয়ন হিন্দু। রাষ্ট্রপতি আশ্বস্ত করেছেন, নতুন সংবিধান আগের তুলনায় আরো বেশি ইসলামী হবে; এবং এটা এখনও অস্পষ্ট যে সেনাবাহিনী কিভাবে এটা থামাবে। ২১ শে জুন – রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের দুই দিন পর – ঢাকার সবচেয়ে বিখ্যাত হিন্দু মন্দিরকে গুড়িয়ে ফেলা হয়। এবং দুর্বৃত্তরা আশেপাশের গ্রামে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালিত করে। যেগুলোর বেশিরভাগ ছিল হিন্দুদের।

হিন্দু শরণার্থী এখনও পূর্ব পাকিস্তান থেকে চলে যাচ্ছে। যারা সীমান্তে সাক্ষাৎকার দিয়েছে তারা বলে যে তারা চলে যাচ্ছে কারণ তাদের কাছে স্পষ্ট হচ্ছে যে ভবিষ্যতে পাকিস্তানে তারা কোন স্থান পাবে না। সেনাবাহিনীর পাশাপাশি তারা যেসব অভিযোগ করে, তারা হচ্ছে জামায়াত-শিবিরের ধর্মীয় দলসমূহ জামায়াত ইসলামী ও মোসলেম লীগের বাঙ্গালী সদস্য যারা গত ডিসেম্বরে ‘নির্বাচন’এ হেরেছিল এবং বিহারি যারা যারা ভারত থেকে মোসলেম শরণার্থী হিসেবে এসেছিল।

দু’টি নতুন দল “শান্তি কমিটি” গঠন করেছে। এখন পর্যন্ত এই কমিটি সেনাবাহিনীকে আওয়ামী লীগের সদস্যদের এবং হিন্দুদের সম্পর্কে তথ্য দেয়ার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। অনেক লোক পালিয়ে গেছে এবং বরাদ্দ কমিটি করা হয়েছে যারা এইসব পতিত জমি দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করবে। অফিসিয়ালি এসব জমি থেকে প্রাপ্ত আয়ের অর্ধেক যাবে রিলিফ ফান্ডে এবং যার সম্পদ সে যদি ফিরে আসে তাহলে তাকে তার জমি বুঝিয়ে দেয়া হবে। যেহেতু ফিরে আসার সম্ভবনা খুব কম তাই বাস্তবে তা ঘটবে কিনা সন্দেহ আছে। ফিরে আসা শরনার্থিদের পক্ষে তাদের জমি আবার ফিরে পেতে কষ্ট হবে – কারণ এগুলোর দায়িত্বে আছে বিহারী ওঁ মুসলিমরা যারা এই মুহুর্তে বর্তমান সামরিক সরকারের লোক।

শান্তি কমিটির অধীনে রাজাকাররা কাজ করে, এরা হোম গার্ড-টাইপ স্বেচ্ছাসেবক যাদের সামান্য মজুরি দেওয়া হয় – যারা মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের ব্যাপারে গুপ্তচরবৃত্তি করে পুলিশকে সহায়তা করে। তাদের বেশিরভাগই কেবল স্থানীয় ঠগ। বলা আছে যাদের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেইস আছে তারা যদি রাজাকারে নাম লেখায় তাহলে তাদের কেইস উঠিয়ে নেয়া হবে। এবং তারা সাথে অস্ত্র বহনের ন্যায্য অধিকার পাবে।

শান্তি কমিটি এবং রাজাকার, সুবিধাবাদী সহযোগীদের সমন্বয়ে একটি দল, যাদের মুক্তি ফৌজ গেরিলারা তাদের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিয়েছে। তারা তাদের একটি পর্যাপ্ত সংখ্যায় হত্যা করেছে। ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ বেসামরিক সমর্থন বাড়ানোর জন্য তাদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। প্রকৃতপক্ষে জেনারেল ফরমান আলী, যিনি পূর্ব পাকিস্তানের সিভিল প্রশাসনের দায়িত্বে আছেন, তিনি সর্বজনীনভাবে স্বীকার করেছেন যে শান্তি কমিটিতে কিছু খারাপ মানুষ রয়েছে।

কিন্তু সময় সামরিক সরকারের পক্ষে নেই। মুক্তি ফজকে দেখিয়ে দিয়েছে যে তারা ঢাকাতেও কাজ করতে পারে এবং ইতিমধ্যেই যেসব বাঙালি সামরিক কর্তৃপক্ষের সাথে চলবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেবে। এবং যতদিন মুক্তিবাহিনী কাজ চালাচ্ছে ততদিন পর্যন্ত সরকার বাঙালি কাউকে প্রশাসনে দিতে সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। ৬০০০০ সৈন্য এবং ৫ হাজার পশ্চিম পাকিস্তানি পুলিশ ছাড়াও সরকার “সম্ভাব্য উপনিবেশিক” হিসাবে যতটা সম্ভব কম রাখার চেষ্টা করেছে বলে মনে হয়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি সিভিল সার্ভিসের লোকদের স্বরাষ্ট্র ও তথ্য মন্ত্রণালয়ে রাখা হয়েছে। এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক হিসেবে আনা হয়েছে: পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের কিছু লোক সরানো হয়েছে – ৮৫০ টি ফ্লাইট ওঁ গ্রাউন্ড স্টাফদের মার্চের পড় থেকে ছাঁটাই করা হয়েছে। পিআইএ-তে নিরাপত্তা অপরিহার্য। কারণ এটি দেশের দুটি উইংসের মধ্যে একমাত্র লিংক।

রাষ্ট্রপতির পক্ষেও সময় নেই যদি মুক্তি ফৌজ অর্থনীতিকে তাদের টার্গেট সেট করে থাকে। ব্রিজ এবং যোগাযোগের ক্ষয়ক্ষতি করা হয় মূলত সেনাবাহিনীর চলাচল কমিয়ে দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে। এখন তারা পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান শস্য – পাট – চায়ের বিরুদ্ধে একটি যৌথ অভিযান শুরু করেছে; এগুলো পাকিস্তানের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী শস্য – এগুলোর খুব কম পরিমাণ মিলে আসে। তারা মিলের কাছে ছোট্ট চিরকুট পাঠাচ্ছে। উৎপাদনকারী ও ডিলারদের কাছে মুক্তিফৌজ চিঠি পাঠাচ্ছে যাতে লেখা আছে এগুলোকে না সরানোর ব্যাপারে। অনেক গুলি চিঠিতে পোস্ট মার্ক আছে যার অর্থ তাদের নিজস্ব ডাক ব্যাবস্থা আছে। যা গেরিলাদের নিজেদের কাজে ব্যাবহ্রিত হচ্ছে। এবং মিলগুলি যে সামান্য পরিমাণ পাট পায় তাও বিহারী ও বাঙালি শ্রমিকের দ্বন্দ্বের ফলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ভারতীয় সীমান্ত থেকে কিছু অঞ্চলে শেলিং হয়েছে এবং মুক্তিবাহিনী আটটি কারখানা উড়িয়ে দিয়েছে।

কিন্তু এখন পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার উপর সামান্য চাপ দেখা যাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে সংবাদ ব্যাপকভাবে সেন্সর করা হয় এবং শুধুমাত্র ভারতীয় সম্প্রচার থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানা যায়। এবং যেহেতু অর্থনৈতিক সংকোচন ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে বিজনেস লবি রাষ্ট্রপতির সাথে উপস্থাপিত হচ্ছেনা। শুধুমাত্র জনাব ভুট্টো অব্যাহত মার্শাল লঙ্ঘনের বিষয়ে মাঝে মাঝে অভিযোগ করে, এবং এটি কেবলমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানে তার নির্বাচনী সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবার জন্য করে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৬১। বাংলাদেশের অবস্থা ভালো নয় টেলিগ্রাফ ১ আগস্ট, ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৬১, ৪১০>
দ্যা সানডে, টেলিগ্রাফ, ১ আগস্ট, ১৯৭১
ইয়াহিয়া ঢাকা পরিদর্শন করবেন
-ঢাকা থেকে ক্লেয়ার হলিংওর্থ

আশা করা হচ্ছে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া আজ বা আগামী মঙ্গলবারে পূর্ব পাকিস্তান ভ্রমণ করবেন। এমন একটি সময়ে তিনি ঢাকা আসবেন যখন সেখানে গেরিলাদের একটি মানসিক যুদ্ধের প্রচারাভিযান চরম পর্যায়ে আছে।

এটি পশ্চিম পাকিস্তানী বা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নয় বরং ভবিষ্যতের কর্মকাণ্ডে বাঙালি জনগোষ্ঠীকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করার জন্য এটির পরিকল্পনা করা হয়েছে।

গেরিলাদের দাবি তারা শীঘ্রই “নাটকীয় একশন” নেবে। বিমানবন্দরের কাছাকাছি না যেতে বাঙালিদের সতর্ক করা হয়েছে।

সংঘর্ষে ৬ জন নিহত
শুক্রবার রাতে ফার্মগেটে গেরিলা ও সেনাবাহিনীর মধ্যে একটি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, এটি শহর ও বিমানবন্দরের মধ্যবর্তী একটি শিল্প উপনগর।

স্বয়ংক্রিয় অগ্নি বিস্ফোরণের শব্দ সারা শহরে শোনা যায় এবং ৬ জন গেরিলা নিহত হয়।

লৌডারিয়া, নলচটা এবং দারপাড়ার কাছাকাছি তিনটি খ্রিস্টান গ্রামে সেনারা আরও বেশি মারাত্মক ধ্বংসলীলা চালায়। এটি টঙ্গী থেকে অরিখোলা পর্যন্ত একটি উচ্চ বাঁধের উপর অবস্থিত যেখানে একটি ব্রাঞ্চ রেললাইন আছে।

ট্রেন লাইনচ্যুত
এটি প্রথমবারের মতো ডিফেন্স বাহিনী খ্রিস্টীয় সম্প্রদায়ের ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। গেরিলারা কিছু মাইল দূরত্বে ট্রেন লাইনচ্যুত করে – আমি এই কর্মের ফলাফল দেখেছি।

এই মুহূর্তে এই গ্রামগুলি সম্পূর্ণরূপে জল দ্বারা ঘেরা এবং এদের মধ্যে অনেকে ঢাকায় অফিস এবং হোটেলে কজ করেন। তারা বলেছেন যে ৩০০০ থেকে ৪০০০ খ্রিস্টান গৃহহীন হয়েছে এবং কয়েকশ লোককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সেনাবাহিনী ধরে নিয়ে গেছে।

যদিও বুধবার এই ঘটনা ঘটেছিল তবে আমি সামরিক কোন মুখপাত্র থেকে কোনও মন্তব্য পেতে ব্যর্থ হয়েছি, যেহেতু তখন থেকে তাদের কাউকে পাইনি। এই এলাকার ক্যাথলিক পাদরিরা গভীরভাবে তাদের সম্প্রদায়ের সদস্যদের উপর এই প্রথম হামলার দ্বারা উদ্বিগ্ন।
শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৬২। পূর্ব পাকিস্তানে দুর্ভিক্ষ অনিবার্য টেলিগ্রাফ ৩১ আগস্ট ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৬২, ৪১১-৪১২>

টেলিগ্রাফ, ৩১ আগস্ট ১৯৭১
এই শীতে পূর্ব পাকিস্তান দুর্ভিক্ষ অনিবার্য
– ঢাকা থেকে ক্লেয়ার হলিংওর্থ

খাদ্যসামগ্রীর স্বল্পতার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের কিছু অংশে শীতকালীন দুর্ভিক্ষ অনিবার্য।

এটা কিছু আমেরিকান এবং অন্যান্য বিদেশী বিশেষজ্ঞদের মত যারা গত ৬ মাস ধরে এই প্রদেশের খাদ্য ও পরিবহন পরিস্থিতি মূল্যায়ন করেছেন।

অভাব যাই থাকুক দুর্ভিক্ষ হবে কিনা তা নির্ভর করছে বিতরণ ব্যবস্থার দক্ষতার উপর ।

অনেক বিদেশি পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক শাসনকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের উপর বিরক্ত। কারণ তিনি জাতিসংঘের অধীনে বিদেশী স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের দ্বারা বিতরণ করার অনুমতি দিচ্ছেন না।

তিনি জোর দিয়ে বলেন এটি পাকিস্তান প্রশাসন করবে যা স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর অধীনে ন্যাস্ত হয়।

সশস্ত্র ভলান্টিয়ার্স

সিদ্ধান্ত হয় যে শান্তি কমিটি ও তাদের নিয়োগকৃত সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবকরা খাদ্য বিলি করার কাজ করবে।

অল্প কিছু মানুষ শান্তি কমিটি গঠন করেছে যারা মূলত মুসলিম লীগের লোকজন এবং বর্তমানে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা দখল করার চেষ্টা করছেন।

কিন্তু বেশিরভাগই সুবিধাবাদী, যারা পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহ-অবস্থান দ্বারা স্থানীয়ভাবে ক্ষমতাবান হবার সুযোগ পেলে খুশি হন।

স্থানীয় শান্তি কমিটি টেকনিক্যালি সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দেয় যারা মূলত রাজাকার, এবং যারা অনেক এলাকায় মানুষ ঠকানো এবং সহিংসতার জন্য সুনাম অর্জন করেছে।

সেখানে ভয় দেখানো হচ্ছে যারা স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের সমর্থনের জন্য কাজ করবে তাদের চাইতে যারা সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযোগী হিসেবে কাজ করবে তাদের বেশী চাল এবং গম দেয়া হবে।

বাঘাই তাওয়িল নামে জাতিসংঘের একজন কর্মি সেখানে ছিলেন। তিনি এই সমস্যা দূরীকরণের জন্য কিছু পদক্ষেপ হাতে নিয়েছেন। তিনি ৭৩ জন কর্মকর্তা নিয়ে এমনভাবে কাজ করবেন যাতে খাবার সঠিক ব্যাক্তির কাছে পৌঁছায়।

কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের ৬৫ থেকে ৭০ মিলিয়ন মানুষের কাছে পৌঁছানো তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

জীপ অধিগৃহীত

কিছু কিছু এলাকায় সেনাবাহিনী এখনও ইউনিসেফের জীপ ব্যাবহার করছে। এগুলো ২৫ মার্চ তারা নিয়ে যায় যখন তারা “শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন”। এগুলোর সামান্যই এখন আর ফিরে পাওয়া যাবে।

ইতিমধ্যেই চট্টগ্রাম ও খুলনা পোর্টে চাল প অন্যান্য খাবারের মজুদ আছে এবং আমেরিকা থেকে আরও আসছে। চীন থেকেও কিছু খাদ্য পুর্ব পাকিস্তানে আসার কথা আছে।

এসব চালান আভ্যন্তরীণ বন্দরগুলোতে পাঠানোর জন্য নৌকা ক্রয় করা হয়েছে কিন্তু নৌ চলাচল যথেষ্ট ঝুকিপূর্ন।

মুক্তি ফৌজ ও গেরিলাদের রাস্তায় সেট করা মাইনের জন্য সড়কপথে এবং ছোট নৌকা চলাচলে যথেষ্ট হয়রানির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। রাতে তো চলাফেরা করা একদমই সম্ভব নয় এমনকি দিনের বেলায়ও বিপজ্জনক হতে পারে।

সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যা দুর্ভিক্ষের সম্ভবনা আরও বাড়িয়েছে। ২৬০০০০০ একর জমির ধান নষ্ট হয়েছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৬৩। বাংলাদেশকে স্বাধীন করতেই হবে স্টেটসম্যান ১০ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

Ashik Uz Zaman
<১৪, ১৬৩, ৪১৩-৪১৫>

নিউ স্টেটসম্যান, ১০ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
বাংলাদেশকে স্বাধীন করতেই হবে

পিটার শোর কতৃক লিখিত প্রতিবেদন যিনি সদ্যই ভারত সফর করে ফিরেছেন যার মধ্যে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবির পরিদর্শনও ছিলো।

বাঙলার গুরুতর সঙ্কটকালের মূলে রয়েছে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাঙন। যেটি জিন্নাহ তাঁর ধর্মান্ধ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে গঠন করেছিলেন ১৯৪৭ সালে এখন সেটি চূড়ান্তভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ইয়াহিয়া খানের নির্বুদ্ধিতা এবং তাঁর সেনাপতিদের হিংস্রতার ফলে।

স্বভাবতই, একক রাষ্ট্র হিসেবে ২৪ বছরের অস্তিত্বের কোনো পর্যায়েই একে একত্রে ধরে রাখা এবং একক রাজনৈতিক পরিমণ্ডল হিসেবে জুড়ে রাখা সহজ ছিল না, পশ্চিম পাকিস্তানের ৫ কোটি মানুষ এবং সুদূর পূর্ব বাঙলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষকে। কিন্তু যে সম্ভাবনাই থেকে থাকুক না কেনো, জিন্নাহর উত্তরসূরিরা তা হেলায় হারিয়েছে।

দুঃখজনক হলেও সত্যি, গত বছরের নির্বাচন, যেটিতে বাঙলা-ভিত্তিক আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয়ী হয় এবং এর পরবর্তীকালে সুদুর-পরাহত স্বায়ত্তশাসন নিয়ে শেখ মুজিব এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের মধ্যকার আলোচনা, একক পাকিস্তান রক্ষার একটি শেষ সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। এই সুযোগটি নষ্ট হয়ে যায় শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণার জন্য নয়, বরং এর আগেই প্রেসিডেন্টের তাঁর সামরিক বাহিনীকে দেয়া আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার এবং যা তারা জীবনেও ভুলতে পারবে না বাঙালীদেরকে এমন শিক্ষা দেয়ার নির্দেশের কারণে।

তিনি যতই লুকানোর চেষ্টা করুন না কেন, পরিস্থিতি এখন আর প্রেসিডেন্টের হাতের নাগালে নেই। টিক্কা খানের সৈন্যদের হিংস্রতা এমন এক শক্তিকে মুক্ত করেছে যা আজ হোক বা কাল শুধু ওদেরকেই নয় বরং পাকিস্তানকেই ধ্বংস করে দেবে। এখন বিশ্বের কাছে মূল প্রশ্ন, এটা নয় যে পাকিস্তান কিভাবে টিকে থাকবে বরং কিভাবে, অন্যান্য পরাশক্তির সাথে বিরোধের ইন্ধন না জুগিয়ে এবং বাঙলার উপর আরো অসহ্য দুর্দশা না হেনে, বাঙলায় তার শাসনের অবসান ঘটাবে। এক্ষেত্রে বাস্তবিকই সমূহ বিপদ রয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের বিড়ম্বনাকর ফলাফলের কারণে হিংস্র দমনপীড়ন মানবজাতির ইতিহাসে অজ্ঞাত নয়, যদি মার্চে শুরু হওয়া দমনপীড়ন শুধুমাত্র নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ সমর্থকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো, বিশ্বমত হয়তো অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও তা মেনে নিত, কিন্তু দমনপীড়ন এমন নিষ্ঠুরতার সাথে এবং এতো দীর্ঘ সময় ধরে চালানো হয়েছে যে মানুষ পালিয়ে গেছে, শুধুমাত্র তাদের বাড়িঘর থেকে নয় বরং তাদের দেশ থেকে অবিশ্বাস্য হারে গত ৫ মাস ধরে প্রতিমাসে ১৫ লক্ষ করে – এবং এখনো যা কমার কোনো লক্ষন নেই – ইংগিত দেয় দমন শক্তির অপব্যবহারে প্রায়োন্মাদনার। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, তাহলে, যে পাকিস্তানের সীমান্তের অনেক বাইরেও এক ক্রমবর্ধমান চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। এতেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে বিশেষ করে ভারত, অপেক্ষা করছে এবং নজর রাখছে অস্বাভাবিক নিবিড়তার সাথে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে পারস্পরিক নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষরে বাধিত বোধ করছে।

এটা স্বভাবতই, পাকিস্তানের শাসকদের জন্য একটি মরিয়া চেষ্টা হবে যদি তারা এখন ভারতের উপর সামরিক আক্রমন পরিচালনা করে। কিন্তু ভারত এই হুমকিকে গুরুত্বের সাথে নিয়ে ঠিক কাজই করছে। পূর্ব বাঙলাকে ধরে রাখার জন্য পাকিস্তানের জান্তার কাছে সামান্যই আশা রয়েছে যদি তারা গণতন্ত্র এবং বাঙালী জাতীয়তাবাদের সাথে তাদের আভ্যন্তরীণ বিরোধকে মুসলমান এবং হিন্দুদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রুপান্তর, এবং সে থেকে ভারতের সাথে এক বাহ্যিক সংঘর্ষ হিসেবে দেখাতে পারে।

এসব গত কয়েক মাসের অত্যাধিক দমনপীড়নের পেছনের উদ্ভট যুক্তি। যেখানে প্রথম শরণার্থীদের ঢলটি ছিল মুসলমান আওয়ামী লীগের সমর্থকদের, পরবর্তী ঢেউগুলো – অতিসম্প্রতি পর্যন্ত যখন মুসলমান শরণার্থীর সংখ্যা আবারো বাড়তে থাকে – ব্যাপকভাবে হিন্দু অধ্যুষিত ছিল কেননা সেনাবাহিনী এবং রাজাকাররা, বা বিশেষ পুলিশবাহিনী, উদ্দীপিত করেছে এবং, কিছু ক্ষেত্রে, বাধ্য করেছে বেসামরিক জনগণকে তাদের হিন্দু প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে যেতে। দেশের ভেতরে এবং বাইরে পাকিস্তানের সরকারী প্রচারণা বাঙলার পুরো সমস্যাটিকে গুটিকয়েক বিশ্বাসঘাতক রাজনীতিকের অপচেষ্টা হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছে। হিন্দুদের অর্থ এবং ভারতীয় মদদ। যতক্ষণ পর্যন্ত ইয়াহিয়া খান এই ব্যপারে বিশ্বাসযোগ্য থাকছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁর আশা আছে গড়ে তোলার, তাঁর সরকারের পক্ষে বাঙলার ভেতরেই বাঙালী মতবাদ, পাঞ্জাবে জনপ্রিয়তা অর্জন এবং বাইরের দেশগুলোকে দেখাতে, সবসময়ের মতোই আভ্যন্তরীণ ব্যপারে স্পর্শকাতর থেকে, কিছু অজুহাত নিয়ে, যতই দুর্বল হোক না কেনো, তাদের নিজেদের লজ্জাজনক নীরবতার জন্য।

ঠিক একই কারণে, কেননা ভারত জানে যে এটাই পাকিস্তানের উদ্দেশ্য এবং কেননা ভারত চায় যে বিশ্ব দেখুক সঙ্কটটির আসল রূপ, পাকিস্তানের সমস্যার জন্য ভারতীয় সরকার প্রতিক্রিয়া জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। অটলভাবে দাবী করে যাচ্ছে যে এটা পাকিস্তানের “আভ্যন্তরীণ” সমস্যা, বাঙলায় দমনপীড়নের সাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যকে আড়াল করে, নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের সাথে সরাসরি সংঘর্ষ এড়িয়ে, ভারতের অবস্থান আপোষহীনভাবে প্রতিরক্ষামূলক।

ইতোমধ্যে ভারতকে নজিরবিহীন সংখ্যক শরণার্থী আগমনের কষ্ট এবং খরচ এবং অসংহতি মেনে নিতে হচ্ছে, যা প্লাবিত করছে পশ্চিম বঙ্গ, ত্রিপুরা এবং আসাম এবং পুরো ভারতীয় অর্থনীতির স্বল্পমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণভাবে ম্লান করে দিচ্ছে। এক পর্যায়ে এরকম মনে হচ্ছে যেন তারা ভয়াবহ এক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে এটাই প্রতিষ্ঠা করতে যে পাকিস্তানের যন্ত্রণা হানার ক্ষমতা ভারতের যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতার চেয়ে বেশি না কম। এখন পর্যন্ত ভারত নিজেকে রক্ষা করে আসছে – এবং পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সরাসরি আক্রমণের আশঙ্কা কিছুটা কমে গেছে ভারত-সোভিয়েত চুক্তি স্বাক্ষরের পর।

কিন্তু প্রতিযোগিতা এখনও শেষ হয়নি। যে ৮০ লক্ষ মানুষ প্লাবিত করেছে পশ্চিম বঙ্গ এবং ভারতের অন্যান্য প্রদেশকে তারা দুর্ভিক্ষের শরণার্থী নয় বরং তারা দমন এবং আতঙ্কের শরণার্থী। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে যখন পূর্ব বঙ্গে খাদ্যাভাব ছড়িয়ে পড়বে তখন মানুষের দ্বিতীয় ঢল, এবার দুর্ভিক্ষের শরণার্থীরা, সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এমন সংখ্যায় আসতে পারে যা কল্পনা করাও কঠিন। এই সমস্যাগুলোর মোকাবিলা করতে হলে, ভারতের আশা করার অধিকার আছে ত্রাণ এবং উৎসাহ আসবে যুক্তরাজ্য, এবং পশ্চিম এবং পূর্বের অন্যান্য পরাশক্তিগুলোর কাছ থেকে। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত না ভারতের জন্য তার বিপুল দায়ের যথোপযুক্ত পরিমাণ সাহায্য আসছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এটা তাদের ভার কিছুটা লাঘব করার চেয়ে বেশি কিছু নয়। কারণ সমস্যা আসলে ভারত নয় বরং পাকিস্তান, এবং তাহলে নীতি বাতিল করার উদ্দেশ্য হবে যত দ্রুত সম্ভব পাকিস্তানকে বাধ্য করা পূর্ব বাঙলার স্বাধীনতা এবং স্বায়ত্তশাসন মেনে নিতে।

ইয়াহিয়া খানকে একমুহূর্তের জন্যও এটা বিশ্বাস করার সুযোগ দেয়া যাবে না যে এই সপ্তাহে গদাইলস্করি চালে চালু করা কূটনৈতিক শান্তি-প্রচেষ্টা, সফল হবার সামান্যতম আশা আছে। যখন মিঃ ভুট্টো টিক্কা খানের অপসারণ এবং একজন বেসামরিক ব্যক্তিকে বাঙলার প্রশাসক নিয়োগ দেয়াকে “অভিযোগ দূর করার চেষ্টা” হিসেবে বর্ণনা করেন এবং যেদিন যুক্তরাজ্যের দুতবাস পাকিস্তানে যুক্তরাজ্যের সংবাদপত্র বিতরণ স্থগিত করে ঐ একই দিনে যখন পাকিস্তানের সরকার ঘোষণা দেয় প্রচারমাধ্যমের নিরীক্ষণ শিথিল করার তাতে কারো উদ্বিগ্ন হওয়া হয়তো অসঙ্গত। কিন্তু এটাও স্বীকার করা উচিত যে এগুলো এবং পাকিস্তান সরকারের অন্যান্য চাল গুলো পরিকল্পিত হয়েছে পূর্ব বঙ্গে তাদের শাসনের দায়িত্বের নিদর্শন দেয়া এবং এভাবে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে অর্থনৈতিক সাহায্য পুনরায় আসা শুরু করার পথ করে দেয়া।

এটা অপরিহার্য যে এই চাল গুলো যাতে সফল না হয়। এই অক্টোবরে পাকিস্তানের জন্য সঙ্গবদ্ধ সাহায্য যাতে কিছুতেই পুনরারম্ভ না হয়। এই সিদ্ধান্তে, যুক্তরাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে মতপ্রকাশের এবং আমাদের বিশেষ উদ্দেশ্য থাকবে এই অস্থিরমতি যুক্তরাষ্ট্রের সরকারকে বন্ধ করতে উদ্বুদ্ধ করা, শুধুমাত্র সঙ্গবদ্ধ সাহায্য নয় বরং অন্যান্য অর্থনৈতিক এবং সামরিক সাহায্য কার্যক্রমও। পাকিস্তানের অর্থনীতি বস্তুত চলমান অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধের কারণে অরক্ষিত কিন্তু, অন্য যে কোনো কিছুর চেয়ে এব্যপারে একটি পরিষ্কার সিদ্ধান্ত গুঁড়িয়ে দিতে পারবে তাদের আত্মপ্রসাদ এবং “পার পেয়ে যাবার” ব্যপারে আত্ম-নির্ধারণকে যা ইসলামাবাদের নীতিনির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

সবশেষে, একটি কূটনৈতিক ভুমিকাও রয়েছে। এটা খুবই আশ্চর্যজনক হবে যদি প্রধান পরাশক্তিগুলো নিজেদের মধ্যে পর্যাপ্ত সংখ্যক স্বীকৃত ভিত্তি না পায়, অন্তত পাকিস্তানের ভেঙে পড়ার আসন্ন পূর্বাভাষ এবং হয়তো পূর্ব বঙ্গ এলাকায় স্থায়িত্ব পরিমাপ করার প্রয়োজনীয়তার ব্যপারে ……

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৬৪। আরও শরনার্থি আসতে পারে ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড ৮ অক্টোবর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৬৪, ৪১৬>

সান্ধ্য স্ট্যান্ডার্ড, ৮ অক্টোবর, ১৯৭১
ভারতে আরও শরনার্থি আসতে পারে

কলকাতা। শুক্রবার। ভারতে পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থী সংখ্যা ইতিমধ্যে নয় মিলিয়ন পেরিয়ে গেছে যা আগামী তিন মাসে আরও বাড়তে পারে।

পর্যবেক্ষকরা এর দুটি কারণ বের করেছেন – দুর্ভিক্ষ এবং সামরিক ক্রিয়াকলাপ।

পাকিস্তানী আর্মি বা পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিবাহিনী এদের যে কেউ যদি তাদের কর্মকান্ড বাড়ায় তাহলেই উদ্বাস্তু আসা বাড়তে থাকবে। মার্শাল ল ক্র্যাক ডাউন শুরু হবার পর থেকে ৬ মাস ধরে দিনে ১৫০০০ থেকে ৪০০০০ শরনার্থি প্রবেশ করছে।

পর্যবেক্ষকরা আশা করছেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এমাসের শেষে অথবা নভেম্বর এর শুরুতে বর্ষা শেষে পানি সরে গেলে আরও আক্রমণাত্মক হবে।

সংগ্রাম
মুক্তিবাহিনী নিঃসন্দেহে আগামী ৬ মাসকে স্বাধীনতার সংগ্রামের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় হিসেবে বিবেচনা করছে।

কিছু পর্যবেক্ষক দক্ষিণ ভিয়েতনামের আক্রমণের সাথে তুলনা করছেন।
কিন্তু পার্থক্য হচ্ছে মুক্তিবাহিনীর কাছে ভারী অস্ত্র নেই যা ভারতের কাছে চাইলেও তেমন পাওয়া যাচ্ছেনা।

তার পরেও ধারণা করা হচ্ছে তীব্রতর গেরিলা কার্যকলাপ দিয়েই পাকিস্তানি সামরিক উদ্যোগ মোকাবেলার জন্য গুরুতর প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।

শরণার্থীদের অনিবার্যভাবে প্রবেশের ফলে ভারতের আভ্যন্তরীণ পরিবেশ আরও খারাপ দিকে যাবে। (রয়টার)

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৬৫। পাকিস্তানীদের প্রতিশোধমূলক হত্যা টেলিগ্রাফ ২৭ অক্টোবর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৬৫, ৪১৭>

ডেইলি টেলিগ্রাফ, লন্ডন, ২৭ অক্টোবর ১৯৭১
পাকিস্তানীরা প্রতিহিংসামূলকভাবে হত্যা করছে

ঢাকার দয়াগঞ্জের আবাসিক এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবকরা প্রায় ৫০ জন নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে।

এক সপ্তাহ আগে দুই জন লোক যাদেরকে মুক্তিবাহিনী ধারনা করা হয়েছে – তারা সেনাবাহিনীর ৬ জন সৈন্যকে গুলি করলে চারজন নিহত হয় – সেকারণে তখন এই গ্রামে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হয়েছিল।

তাই প্রতিহিংসামূলকভাবে সেনা, পুলিশ ও রাজাকারদের সহায়তায় ঘর ঘরে গিয়ে গুলি চালাচ্ছে।

দোকানদার, শ্রমিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের কমপক্ষে ৫০ টি বাড়ি পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এ ঘটনা রাজধানী শহর জুড়ে প্রায় রাতেই ঘটতে থাকা গুলি বিনিময়ের জের বলে প্রকাশ করা হয়েছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৬৬। নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের উপর অত্যাচার অব্যাহত ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস ২৭ অক্টোবর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৬৬, ৪১৮-৪১৯>

ফাইনানশিয়াল টাইমস, লন্ডন, ২৭ অক্টোবর ১৯৭১
নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের উপর অত্যাচার অব্যাহত
ঢাকা থেকে পি প্রতিবেদন

সামরিক শাসন এর সত্ত্বেও অস্বীকার, পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং পুলিশ সাধারণ নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক বর্বরতা চালিয়ে যাচ্ছে। যেখানে মুক্তিবাহিনী থাকতে পারে সন্দেহ হচ্ছে এমনকি ঢাকা শহরের মাঝখানে নতুন বেসামরিক গভর্নরের বাসভবনে এসব চলছে। জানা যায় আমেরিকান সরকারও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে এটা বন্ধ করতে বলছে যাতে শরনার্থিরা ফিরে আসার ব্যাপারে আশা পায়। ২৫ মার্চ পাকসেনাদের অপারেশনের পড় থেকে এবং আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হবার সময় থেকে ৭৫ মিলিয়নের বাংলাদেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে থেকে দেয়।

সূত্র জানায় আমেরিকান কংগ্রেসম্যান পিটার এইচ বি ফ্রিলিং হুসেন (রিপাবলিক .. নিউ জার্সি) বলেন যখন তিনি পাকিস্তান সফর করতে চলতি মাসে রাওয়ালপিন্ডিতে যান তিনিত সামরিক নেতা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কে নিরস্ত্র ব্যাক্তিদের ওপর হামলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন এবং থামাতে অনুরোধ করেন।

সূত্র জানায়, প্রেসিডেন্ট অস্বীকার করে বলেন গুলিবর্ষণে বন্ধ আছে এবং ঘটনাক্রমে কোথাও হতে পারে। প্রতিহিংসামূলকভাবে নারায়ণগঞ্জের দয়াগঞ্জে , নদীবন্দর থেকে ঢাকা রেল লাইনের সংযোগ পথ থেকে ১১ মাইল দূরে ২০০ বর্গ গজ এলাকা পুড়িয়ে দেয়া হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীর মতে সেনা, পুলিশ এবং “রাজাকার” রা ঘরবাড়ি ও মানুষের কয়েক ডজন শট স্কোর জ্বালিয়ে দেয় এক সপ্তাহ আগে । এক ঘন্টা পরে মুক্তিবাহিনী সন্দেহে ধারণা করা দু’জন লোককে দিনের আলোতে ছয় সৈন্য গুলি করে হত্যা করে। যারা বেঁচে গেছেন তারা জানান প্রতিহিংসার শিকার হয়ে অন্তত ৫০ ব্যক্তি নিহত হয় এবং অনেকে আহত হয়। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে এসব বাহিনী ঘোরে ঘোরে ঢুকে গুলি চালাচ্ছিল এবং ঘর থেকে বাইরে এসে জ্বালিয়ে দিচ্ছিল।

উঁচু এক সেতু থেকে কমপক্ষে ৬০ জনকে মাটিতে ফেলে দেয়া হয়েছে বলে জানান। বাসিন্দারা জানিয়েছেন দোকানদার, শ্রমিক, এবং ছোট ছোট সরকারি কর্মকর্তাদের ৩০০ ঘর পালিয়ে গেছে। ‘কোন মুক্তিবাহিনী ছিলনা যখন সেনাবাহিনী আসে “, এক সরকারি কর্মকর্তা জানান। ‘’আমি একজন সরকারী কর্মচারী এবং আমি আপনাকে বলছি কোন ব্যক্তি কাছে কোন অস্ত্র ছিলোনা’’ বাসিন্দারা নির্দ্ধিধায় হামলা সম্পর্কে এ পি কে বলেন। কাছের একটি রেল সেতু তে সশস্ত্র রক্ষিবাহিনী ছিল। তারা নদী পাড় হচ্ছিল – কিন্তু তাদের নাম তারা জানাতে রাজি হয়নি প্রকাশনার ভয়ে।

নতুন বাঙ্গালী সরকারী গভর্নর কর্মচারি ডাঃ এ এম মালিকের বাসা বাসা থেকে ৩ মাইন দূরে ঘর পোড়ার দৃশ্য, কোঁকড়ানো টিনের চাল দেখা যাচ্ছিল ২৫ মার্চ ঢাকা আক্রমণের সময়। ব্রিজ গার্ড জানায় মুক্তিবাহিনী অন্তত চার সেনা নিহত করে এবং ২ জন আহত হয়। আক্রমণকারীরা তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। ঘটনা সময় অনেক গুলি বিনিময় হয় এবং অধিবাসীদের একজন বলেন রাজধানী শহর জুড়ে রাত্রিকালীন প্রায় সব সময় এমন ঘটনা ঘটমান থাকে। দয়াগঞ্জের বাড়িতে এখনো রক্ত মাখা দেয়াল, মেঝে, এবং বেয়নেটের খোঁচায় তাদের বাঁশ দরজা এবং দেয়ালে চিনহ লেগেছিল। সেনা পক্ষের তাৎক্ষণিকভাবে কোন মন্তব্য ছিল না কিন্তু কর্মকর্তা বলেন যখন তাদের উপর ফায়ার হয় তখন তাদেরকে শুধু মাত্র গুলি করতে বলা হয়েছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৬৭। গেরিলারা ১২ মাস ব্যাপী যুদ্ধের লক্ষ্য স্থির করেছে গার্ডিয়ান ৩রা নভেম্বর, ১৯৭১

Ashik Uz Zaman
<১৪, ১৬৭, ৪২০-৪২১>

গার্ডিয়ান, ৩রা নভেম্বর, ১৯৭১
গেরিলারা ১২ মাস ব্যাপী যুদ্ধের লক্ষ্য স্থির করেছে

পাক-ভারত সীমান্তের একটি ঘাঁটি থেকে জিম হোগল্যান্ড-এর প্রতিবেদন

বয়রা নামক ছোট্ট সীমান্ত চৌকি থেকে কয়েকশো গজ দূরে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে ভারতের সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিস্ফোরন্মুখ সীমান্ত, যেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন তরুণ লেফটেন্যান্ট হাসিমুখে গোড়ালি পর্যন্ত কাদায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে সীমান্তের দিকে দেখাচ্ছিল। “আমি আপনাদের সাথে যাচ্ছি না”, আধা-ডজন বিদেশী সাংবাদিক যারা পায়ে হেঁটে সীমান্ত অতিক্রম করার জন্য কিছুক্ষণের মধ্যেই রওনা দেবে তাদের কে সে বলে, “আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আমাদের সীমান্ত অতিক্রম করা নিষেধ”।

বয়রার ভারতীয় সেনাবাহিনীর ঘাঁটির ভিতর দিয়ে সাথে করে নিয়ে আসার সময় এই অফিসার সাংবাদিকদের প্রতি এই বাগাড়ম্বরপূর্ণ মন্তব্য বেশ কয়েকবারই পুনরাবৃত্তি করেছে। স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে যে সে অত্যন্ত আগ্রহের সাথে এই কথাগুলো অনুশীলন করেছে যা পূর্ব পাকিস্তানে চলমান ঘটনাবলী এবং এসব ঘটনাবলীতে ভারতের বিতর্কিত ভূমিকার ব্যপারে ভারতের স্পর্শকাতরতারই প্রতিফলন।

এই ভারতীয় লেফটেন্যান্ট একজন উষ্কখুষ্ক চেহারার মানুষের কাছে যার বয়স হয়তো ৬০ যে একটি পুরাতন কার্বাইন (ক্ষুদ্র অস্ত্র) বহন করছিল এবং নিজের পরিচয় দেয় “মুক্তি বাহিনী” – গেরিলা সামরিক শাখা – এর একজন হিসেবে তার কাছে সাংবাদিকদেরকে হস্তান্তর করে এবং প্রবল ঝড়বৃষ্টির মধ্যে দ্রুত পায়ে হেঁটে ফিরে যায়। ঘন কাদায় হোঁচট খেতে খেতে, সাংবাদিকেরা মুক্তি বাহিনীর সদস্যটিকে অনুসরণ করে চার-মাইল দীর্ঘ আঁকাবাঁকা পথ ধরে ধান ক্ষেতের ভেতর দিয়ে এবং ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানকে বিভক্তকারী সীমান্ত চিহ্নিতকারী খুঁটির পাশ দিয়ে। দ্রুতপায়ে হাঁটার শেষে পাওয়া যায় একটি পরিত্যক্ত স্কুল ঘর, যেটির বর্তমান পরিচয় একটি ব্যনারে লেখা আছে “বাংলাদেশ মুক্তি বাহিনী”-র সাব-সেক্টর সদর দপ্তর হিসেবে।

মেজর নাজমুল হুদা, ৩৩-বছর-বয়স্ক একজন স্পষ্টভাষী মানুষ যিনি আমাদেরকে বলেন যে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন ছিলেন, কর্তৃত্বের সাথে দাবী করেন যে এই স্কুল ঘর থেকে তিনি ১৫০ বর্গ মাইল এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁর সাথে প্রায় একশো নিয়মিত বাহিনীর সৈন্য রয়েছে যারা বিদ্রোহীদের পক্ষে সেনাবাহিনী থেকে দলত্যাগ করে, এবং ৭,০০০ গ্রামবাসী যাদেরকে তাঁর সহযোগীরা প্রশিক্ষণ দিয়েছে। গেরিলারা দাবী করে যে তারা পুরো পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে এরকম সদর দপ্তর স্থাপন করেছে, এবং তারা জানায় যে তারা তাদের আক্রমণ আরো তীব্র করবে যা এক বছরের মধ্যে এই দেশ থেকে পাকিস্তানের নিয়মিত সেনাবাহিনীকে বিতাড়িত করবে।

বিদ্রোহীদের এলাকায় খুব দ্রুত একবার গিয়ে এবং ঘুরে এসে তাদের দাবির ন্যায্যতা বিচার করা অসম্ভব। কিন্তু নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ এই গেরিলা সংস্থাটিকে সাত মাসের মধ্যে শূন্য থেকে শুরু হয়ে ৮০,০০০ থেকে ১,০০,০০০ সৈন্যের বাহিনীতে পরিণত হওয়ার কৃতিত্ব দেয়, যে সংখ্যাটি মোটামুটিভাবে তাদের বিরুদ্ধে মোতায়েনকৃত পাকিস্তানের নিয়মিত সেনাবাহিনীর সৈন্য সংখ্যার সমান। এই বিশ্লেষকেরা মনে করেন যে মুক্তি বাহিনী হয়তো সমাজের নিম্নশ্রেণীর লোকদের নিয়ে তাড়াহুড়ো করে জোড়াতালি দিয়ে তৈরী করা একটি বাহিনী থেকে এমন একটি সংস্থায় রূপান্তরিত হচ্ছে যাদের সম্মিলিত কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষমতা ক্রমবর্ধমান।

এখানকার কূটনৈতিক মহলে প্রচারিত নির্ভরযোগ্য প্রতিবেদনগুলোও মেজর হুদা-র দাবীগুলোকে সমর্থন করে যে মুক্তি বাহিনী “গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে অনেক বেশী আক্রমণাত্মক এবং কার্যকরী হয়ে উঠেছে”। বিগত ২০ দিনে, যোগাযোগ মাধ্যম ও সরবরাহ প্রবাহের উপর বিদ্রোহীদের কেন্দ্রীভূত আক্রমণ একটি নমুনা প্রদর্শন করছে গেরিলাদের অস্ত্র সরবরাহ এবং প্রশিক্ষণের ক্রমবর্ধমান উৎকর্ষের, এই প্রতিবেদনগুলো অনুযায়ী, যা এই ধারণাকে আরো জোরদার করছে যে ভারত হয়তো সম্প্রতি গেরিলাদের প্রতি তাদের যুদ্ধ কৌশলগত সাহায্যের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে সীমান্ত জুড়ে পাকিস্তানী সৈন্যদের বিচ্ছিনভাবে ছড়িয়ে পড়া তাদেরকে এব্যপারে সাহায্য করেছে।

দেশের ভেতরে গেরিলাদের সাফল্য আপাতদৃষ্টিতে ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকায় পাকিস্তানী বাহিনীর প্রতিশোধমূলক আক্রমণ বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে সেখানে গেরিলারা আশ্রয় নিচ্ছে এরকম সন্দেহ থেকে। প্রতিদিন খবর আসছে বিভিন্ন গ্রামে গোলাবর্ষণের এবং কিছু ক্ষেত্রে পাকিস্তানী জঙ্গিবিমান থেকে ভারতীয় এলাকায় গুলিবর্ষণের।

বয়রা এমন একটি এলাকায় অবস্থিত যেখানে গত সপ্তাহেই গোলাবর্ষণ করা হয়। সেখানে ঘাঁটি গেঁড়ে থাকা ভারতীয় সৈন্যরা যাতে গেরিলাদের সাহায্য করার জন্য সীমান্ত অতিক্রম না করে তারই ইংগিতজ্ঞাপক। তারা অন্য কোন ভাবে গেরিলাদেরকে সাহায্য করছে কিনা তা তিক্ত বিতর্কের বিষয়। যেখানে ভারতীয়রা অস্বীকার করে যে তারা কোন সাহায্য করছে। সেখানে পাকিস্তানীরা নিয়মিতভাবে গেরিলাদেরকে ভারতের দালাল বা তাদের দ্বারা পরিচালিত পুতুল হিসেবে বর্ণনা করে।

মেজর হুদা অস্বীকার করেন যে তাঁর লোকেরা ভারতীয়দের কাছ থেকে অস্ত্র বা প্রশিক্ষন পাচ্ছে। তিনি বলেন তাঁর লোকদের হাতে অস্ত্রের সংখ্যা লক্ষণীয় হারে বেড়ে যাওয়ার পেছনে গত কয়েক সপ্তাহে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তাদের অনুগত বেসামরিক লোকদের মধ্যে যে রাইফেল বিতরণ করেছে সেগুলো দখল করা দায়ী।

কিন্তু নিশ্চিত খবর রয়েছে যে আনুমানিক ১০ দিন আগে থেকে ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকায় নতুন অস্ত্রের ব্যাপক সরবরাহ শুরু হয়েছে। একটি ভাষ্যমতে, যেটি নিশ্চিত করা যায়নি, গেরিলাদের জন্য ভারতীয় অস্ত্রের সরবরাহ বেড়ে গেছে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে নিশ্চয়তা দেয়ার পর যে বিদ্রোহী বাহিনীকে দেয়া প্রতিটি সোভিয়েত অস্ত্র তারা প্রতিস্থাপন করবে।

আহত গেরিলাদেরকে সীমান্ত পেড়িয়ে ভারতে পাঠানো হচ্ছে চিকিৎসা সেবা নেয়ার জন্য, এবং এই এলাকার গ্রামবাসীরা ভারতীয় রেড ক্রস এবং অক্সফাম-এর কাছ থেকে খাদ্য সাহায্য পাচ্ছে, মেজর হুদা বলেন।

গেরিলা এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী নিঃসন্দেহে নিজেদের মধ্যে তথ্য আদানপ্রদান করে। পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে যে তথ্য ফাঁস হচ্ছে, এখানকার ভারতীয় নির্ভরযোগ্য সুত্রের নিশ্চয়তা অনুযায়ী, ভারতের কাছে দেশজুড়ে পাকিস্তানী বাহিনীর অবস্থানের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে।

মুক্তি বাহিনীর মধ্যে একত্রে থাকার ক্রমবর্ধমান প্রবণতা এবং মেজর হুদার মতো কার্যত জেলা প্রশাসকের আবির্ভাবের প্রবণতা পশ্চিমা পর্যবেক্ষকেরা খুবই সতর্কতার সাথে সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করছে।

“আমাদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করে যে পূর্ব পাকিস্তান বাস্তবিকই কোন এক পর্যায়ে স্বাধীন দেশ হবে” একজন পশ্চিমা কূটনৈতিক বলেন। “আমরা জানি না এর জন্য ছয় মাস না ছয় বছর লাগবে। কিন্তু যদি তা ঘটে তাহলে নতুন প্রজন্মের নেতারা আসবে যারা গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে সঙ্ঘটিত হয়েছে, এবং এটা জানা জরুরী যে তারা আসলে কি”। – ওয়াশিংটন পোস্ট।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৬৮। গেরিলা বাহিনী রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ শুরু করেছে টেলিগ্রাফ ৩ নভেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৬৮, ৪২২>

ডেইলি টেলিগ্রাফ, ৩ নভেম্বর, ১৯৭১
পূর্ব পাকিস্তানে গেরিলার রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ করছে
-ঢাকায থেকে ক্লেয়ার হলিংওর্থ

চল্লিশ হাজার বাংলাদেশ গেরিলা এখন পূর্ব পাকিস্তানের অপারেশন চালাচ্ছে। তারা পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে নাজেগাল করছে। ভারত সীমান্তের ১৩০০ মাইল বিস্তৃত এলাকায় তারা অবস্থান করছে।

সেখানে প্রতিদিন প্রায় ২০ জন মিলিটারি হতাহত হচ্ছে। এর কারণ শহরে মুক্তিফৌজ ও গেরিলাদের আক্রমণ বেড়েছে। তারা এখন তাদের শক্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তাদের সাথে স্থানীয় লোকদের সাপোর্ট আছে।

সেদিন চট্টগ্রাম মার্কেটে বিকেলে বন্দুকযুদ্ধে ২ জন পাকসেনা, ১ জন পাক পুলিশ ও ১ জন গেরিলা নিহত হয়।

মার্চের পর মার্শাল ল জারি করার পর থেকে দিনের বেলায় এটাই প্রথম পথের উপর যুদ্ধ।

পুরনো ঢাকায় অনেকক্ষণ ধরে গুলি বিনিময় চলেছে। প্রতি রাতে ৩/৪ টা বিস্ফোরণ ঘটছে। সকালে কিছু সনাক্তবিহীন লাশ পাওয়া যাচ্ছে।

সমর্থনের জোয়ার

এক পাকিস্তান আর্মি অফিসার আমাকে বললেন: “গত দুই মাসে মুক্তিফৌজদের প্রতি সাধারণ মানুষের সাপোর্ট জোয়ারের মত বেড়েছে।”

এটা সেনাবাহিনীকে সমস্যায় ফেলে দিয়েছে। গ্রাম অঞ্চলের এলাকায় অল্প লোক দিয়ে এলাকা দখল করে রেখেছে – বিশেষ করে মেইন রাস্তা থেকে দূরের এলাকাগুলো। গেরিলারা সেগুলোকে ‘মুক্তঅঞ্চল’ ঘোষনা দিয়েছে। শুধু রাতেই নয় এখন দিনের বেলাতেও তাদের দখল বজায় আছে।
ঢাকায় গতকাল দুটি বোমা দিয়ে একটি গ্যারেজ এবং একটি পেট্রল স্টেশন ধ্বংস করা হয়। রবিবার রাতে শহরের কেন্দ্রে নির্বাচন কমিশন বিল্ডিং উড়িয়ে দেয়া হয়। কয়েক রাত আগে গেরিলারা টেলিভিশন স্টুডিও বিল্ডিং ধ্বংস করে।

ব্যাংক ডাকাতি আরও বেড়ে গেছে কারণ তিন গ্রুপ গেরিলাদের খাবার ও অন্যান্য খরচ বাবদ অর্থের প্রয়োজন। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের চেয়ে শহরে চাহিদা বেশী।

স্কুল ধ্বংস করা হচ্ছে। অনেক অভিভাবক তাদের বাচ্চাদের এখন বাড়ীতেই রাখছেন।

ক্রমবর্ধমান স্পর্ধা

কর্তৃপক্ষ স্থানীয় অধিবাসীদের উপর “শাস্তিমূলক কর” চালু করতে চাচ্ছেন। এতে করে স্থানীয় বাসিন্দারা হয়ত গেরিলাদের দমাতে চেষ্টা করতে পারে অথবা গেরিলাদের থেকে ক্ষতিপূরণ নিতে পারে।

তবে এটা বর্তমান হারে মুক্তিফৌজদের থেকে আদায় সম্ভব নয়। গত সপ্তাহে এক হাজার গেরিলা বরিশালের বন্দরের কাছে একটি সম্মেলন করেছে। স্বাধীনতার পতাকা নিয়ে আর্মি পোস্টের থেকে মাত্র ৩ মাইল দূরে তারা অবস্থান করছিল।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৬৯। যে যুদ্ধ বিশ্বের প্রতি হুমকি স্বরূপ ডেইলি মিরর ৪ঠা ডিসেম্বর, ১৯৭১

Ashik Uz Zaman
<১৪, ১৬৯, ৪২৫>

দি ডেইলি মিরর, লন্ডন, ৪ঠা ডিসেম্বর, ১৯৭১
যে যুদ্ধ বিশ্বের প্রতি হুমকি স্বরূপ

আজকে ভারতীয় উপমহাদেশের একমাত্র মুখ্য সত্যটি, মনে হচ্ছে, যুক্তরাজ্যে এসে পৌঁছেনি। সত্যটি হোলো যে পাকিস্তান, ভারত নয়, পুরো পশ্চিম এশিয়াকে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে।

একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিকে অতি-সরলিকরন করা এর অভিপ্রায় নয়, আবার ভারতের সাম্প্রতিক সকল কার্যকলাপকে উপেক্ষা করাও নয়।

কিন্তু শাস্তিযোগ্য পর্যায়ের অনবহিত এবং বিপদজনক একটি অভিমত যুক্তরাজ্যে তৈরি হচ্ছে বলে মনে হয় যেটি বলছে ভারত হচ্ছে “হামলাকারী”।

এই অভিমতের বিপদজনক দিক হচ্ছে, যে এটি গত ৮ মাসে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীকে আমলে না নিয়ে, ভারতকে একঘরে, বন্ধুবিহীন করে দেবে, শান্তি প্রতিষ্ঠার যা কিছু উপায় ভারতের কাছে আছে তা কেড়ে নেবে, এবং এমন এক যুদ্ধ ঘটতে সাহায্য করবে যেটিতে সম্পৃক্ত থাকবে চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া।

যদি এরকম একটি অভিমত কে শক্তিসঞ্চয় করার সুযোগ দেয়া হয় তাহলে জাতিসংঘ, এবং এমনকি হয়তো যুক্তরাজ্য সরকারও, এক পাকিস্তানী জান্তার পক্ষে মধ্যস্ততা করতে বাধ্য হবে যারা হত্যা করেছে, মার্চ মাস থেকে, হয়তো ১০,০০,০০০ মানুষকে।

আমরা আমাদের সাম্প্রতিক ইতিহাসটি সঠিক ভাবে জেনে নিই। মার্চ মাসে, ফিল্ড-মার্শাল ইয়াহিয়া খান এবং তাঁর সেনাপতিরা নিষ্পিষ্ট করে পূর্ব পাকিস্তানের, বর্তমানে বাংলাদেশ, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে।

তখন থেকে, তারা একটি পরিকল্পিত গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে পূর্ব বাঙলার ৭,৫০,০০,০০০ মানুষের উপর।

তারা তালিকা ধরে হাজার হাজার নির্বাচিত রাজনীতিক, শিক্ষক, ছাত্র, চিকিৎসক এবং ব্যবসায়ীকে হত্যা করেছে।

একই সময়ে, তারা তাদের মূলত পাঞ্জাবী অধ্যুষিত সৈন্য বাহিনীকে একের পর এক পাশবিক অত্যাচার চালানর সুযোগ করে দিয়েছে।
তারা যুবকদের রক্ত ঝড়িয়েছে। তারা প্রকাশ্যে পুরুষদের খোজা করেছে। তারা ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং হত্যা করেছে এবং ধর্ষণ করেছে।

তাদের এই সন্ত্রাস এতটাই বিস্তৃত ছিল যে ১,১০,০০,০০০ মানুষ পালিয়ে ভারতে চলে আসে, যাদের বেশিরভাগই এখন বর্ণনাতীত যন্ত্রণা পোহাচ্ছে।

যারা পালিয়ে যেতে পারেনি, তারা হয়তো খাদ্য এবং ত্রাণ না পাওয়ার আতঙ্কে আছে অথবা এই অপরাধের ব্যাপ্তি উপলব্ধি করা থেকে বিরত রয়েছে।

পশ্চিম পাকিস্তানে অস্ত্রের সরবরাহ বজায় রয়েছে, এবং বাণিজ্যও তাই।

ইতিমধ্যে, ফিল্ড মার্শাল ইয়াহিয়া খান, যাকে দেখলে গিলবার্ট ও সুলিভান অপেরার রানী ভিক্টোরিয়ার আমলের কোন নাটকের কোন চরিত্রের কথা মনে পড়তো যদিনা সে এতোটা ক্ষমতাশালী হোতো, সপ্তাহর পর সপ্তাহ ধরে ভারতকে জ্বালাতন করছে সীমান্ত এলাকায় বেসামরিক জনগণ এবং শরণার্থীদের উপর গোলাবর্ষণের আদেশ দিয়ে।

এগারো দিন আগে, ভারত, যার রাজস্বভাণ্ডার প্রায় শেষ হয়ে এসেছে তার প্রতিবেশী দেশের শরণার্থীদের দেখভাল করতে গিয়ে, এবং পশ্চিমা সরকারগুলোর কাছে যার সাহায্যের আবেদন বড়জোর ঘৃনাভরে সরিয়ে রাখা হয়েছে, সিদ্ধান্ত নেয় যে সে আর সহ্য করবে না।

সে সীমান্তে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতি-আক্রমণ শুরু করে যাতে করে বাংলাদেশের গেরিলা যোদ্ধারা উৎকৃষ্টতর পাকিস্তানী অস্ত্রের বিরুদ্ধে কিছুটা সুবিধা পায়।

এটি পুরোপুরি সফল হয়নি, কিন্তু এখন পর্যন্ত ভারত সংযত থেকেছে। নিশ্চয়ই, আর কোনো আধুনিক নেতা ইন্দিরা গান্ধীর মতো সংযম দেখাননি।

এর পর থেকে, পাকিস্তানী গোলাবর্ষণ আরো বেড়ে গেছে, এবং বৃহস্পতিবারে, তিনটি পাকিস্তানী জেট বিমান ভারতের ত্রিপুরা প্রদেশের একটি বিমান ঘাঁটিতে বোমা বর্ষণ করে, এতে পাঁচজন নিহত এবং পঁয়তাল্লিশজন আহত হয়।

একই সময়ে, পাকিস্তান আবেদন জানায় জাতিসঙ্ঘ আরোপিত “যুদ্ধ-বিরতি”-এর জন্য, এটা জেনে যে জাতিসঙ্ঘের হস্তক্ষেপ তাদেরকে বাংলাদেশের উপর তাদের সার্বভৌমত্ব ধরে রাখতে সাহায্য করবে, একই সাথে বাঙালী জনতার উপর শাসন বজায় রাখতেও।

ভারত, তাদের বাহিনীকে বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করিয়ে, এখন আক্রমণকারী দেশের ভুমিকায় পতিত হবে।

মিসেস গান্ধী মাত্রই বলেছেনঃ “যদি কোনো দেশ মনে করে যে আমাদেরকে আক্রমণকারী দেশ হিসেবে আখ্যা দিয়ে, তারা আমাদেরকে আমাদের জাতীয় স্বার্থ ভুলে যেতে চাপ প্রয়োগ করতে পারবে, তাহলে সেই দেশটি তাদের নিজস্ব বোকার স্বর্গে বসবাস করছে”।

“সেই সময় বিগত হয়েছে যখন চামড়ার রঙের শ্রেষ্ঠতার ভিত্তিতে কোনো জাতি তিন বা চার হাজার মাইল দূর থেকে ভারতীয়দেরকে যা খুশি তাই করার আদেশ দিতে পারতো, ভারত বদলে গেছে এবং এটি এখন আর অসভ্য জাতির দেশ নয়”।

যুদ্ধ বা শান্তির সিদ্ধান্ত এখন আর মিসেস গান্ধীর উপর নির্ভরশীল নয়। এই সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে সেইসব সরকারের উপর যারা এখন পাকিস্তানী সেনাপতিদের সমর্থন করে এবং তাদের কথা শোনে।

যদি ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তাহলে এমন এক যুদ্ধ ঘটতে পারে যাতে শুধু ভারত এবং পাকিস্তানই সম্পৃক্ত থাকবে না, এ এমন এক যুদ্ধ হবে যা কেউ চায়নি।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৭০। অবরুদ্ধ ঢাকা টাইম্‌স ৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭১

Ashik Uz Zaman
<১৪, ১৭০, ৪২৫-৪২৬>

দি টাইম্‌স, মঙ্গলবার, ৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭১
ঢাকা মোমের আলোয় খাবার খাচ্ছে দিনভর বিমান থেকে গুলিবর্ষণের পর
একটি কুকুর ডাকছে, শিশুরা ছাদ থেকে দেখছে বিমান মহড়ার জমকালো প্রদর্শনী …… যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রাজধানীতে জীবন এগিয়ে চলে
ঢাকা থেকে জেমস পি. স্টেরবা কর্তৃক, ডিসেম্বর ১ (বিলম্বিত)

পুরো শহর অন্ধকারে ঢেকে আছে রাত ৮:৩০ মিনিটে। কোনোকিছুই নড়ছে না। সন্ধ্যা ৫:৩০ মিনিট থেকে জারি করা কারফিউর কারণে রাস্তায় কেউ নেই। ঘরের পর্দা টানা, জানালা থেকে দূরে ঢাকা দেয়া মোমবাতি জ্বলছে। খুব সামান্যই শব্দ হচ্ছে। মাঝে মাঝে একটা কুকুর ডাকছে, একটা জীপ বা লরি (ট্রাক) চলে যাচ্ছে, বাতি নেভানো।

মেঘ চাঁদের আলো স্তিমিত করে দিয়েছে, তারাগুলো ঝাপসা। কাকগুলো, দিনভর ভারতীয় এবং পাকিস্তানী জঙ্গিবিমানগুলোর সাথে আকাশে ওড়ার পর, তাদের কোলাহলপূর্ণ সতর্ক প্রহরায় ক্ষান্ত দিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী কান পেতে অপেক্ষায় রয়েছে।
রাত ৮:৩২ মিনিটে দূর থেকে তিনটি বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পায় ঢাকা। একটি সাইরেন বাজতে থাকে। জেটবিমানের কোন শব্দ নেই। আবারো গভীর-শব্দের একটি সাইরেন বাজতে থাকে।

এখন রাত ৮:৩৭ মিনিটে একটি জেটবিমানের উড়ে যাবার শব্দ শোনা যায়। সেটি অনেক উঁচুতে এবং দূরে রয়েছে। একের অধিক বিমান রয়েছে, তাদের কোনটিই এখনো পর্যন্ত গুলি ছুঁড়ছে না।

জাতি সঙ্ঘের কর্মচারী, ঠিকাদার, ত্রান-সংস্থার কর্মী – মার্কিন, ব্রিটিশ, অস্ট্রেলীয় এবং অন্যান্য দেশের – তাড়াহুড়ো করে গুছানো স্যুটকেস নিয়ে গাদাগাদি করে আশ্রয় নিয়েছে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে, উদ্ধারের অপেক্ষায়।

তাদেরকে বলা হয়েছিল জাতিসংঘের একটি বিমান, একটি মার্কিন সি-১৩০ হারকিউলিস, ব্যাংকক থেকে আসছে তাদেরকে বের করে নিয়ে যেতে। শিশুরা বিহ্বল, কেউ কেউ কান্না করছে। হোটেলটির হলঘরের আলো জ্বলছে কিন্তু অন্য ঘরগুলোর এবং নিচ-তলার আলোগুলো নিভিয়ে দেয়া হয়েছে এবং জানালাগুলো টেপ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে।

স্কটল্যান্ডের বাবুর্চি আরেকটি রাতের খাবার তৈরী করেছে মুরগী এবং ভেড়ার মাংসের তরকারি, ভাত, শসা দিয়ে রান্না করা মাছ, ঠাণ্ডা বাসনকোসন দিয়ে; কোন বিয়ার বা কোক নেই। খাদ্য পরিবেশনের দায়িত্বে থাকা লোকটি আমাকে জানায় বিকেল থেকেই সবাই জড়ো হতে শুরু করেছে। সবাই মোমের আলোতে রাতের খাবার খাচ্ছে, গুজব নিয়ে এবং অবস্থা আরো খারাপ হবে না ভালো হবে তাই নিয়ে আলোচনা করছে। বেশীরভাগই মনে করছে যে অবস্থা আরো খারাপ হবে।
প্রায় ৫০ জন সাংবাদিক এই হোটেলে অবস্থান করছে মোমের আলোয় তাদের টাইপরাইটার টিপছে এবং ছিটেফোঁটা তথ্য সংগ্রহ করছে। চিত্রগ্রাহক এবং চলচিত্র কর্মী এবং লেখকেরা তাদের চলচিত্র এবং লেখা কিভাবে পাঠাবে তাই নিয়ে চিন্তিত। বাইরের খবরের আশায় ক্রমাগত রেডিওর ষ্টেশন খোঁজা হচ্ছে।

বিকেলেই হোটেল পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। উদ্ধারের অপেক্ষায় থাকা মানুষদের পাশাপাশি বিমান বন্দর থেকে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহণের কর্মীরাও এসে জড়ো হয়েছে, প্রতি ঘরে তিন বা চার জন করে। আজকে বিমান বন্দরের উপর চালানো ভারতীয় বিমান হামলায় তাদের নয়জন সহকর্মী নিহত হয়েছে। তারা জানায় এই বিমান হামলাগুলো গতকাল রাত ৩ টায় শুরু হয় এবং মাঝ বিকালে শেষ হয়।

“অবশ্যই, তাদেরকে চা পানের বিরতি নিতেই হতো”, কেউ একজন বলে ওঠে।

এখন রাত ৯:১৪ মিনিট এবং দূর থেকে আরেকটি বিস্ফোরণের ভোঁতা শব্দ শোনা যায়, আরেকটি সাইরেন বেজে ওঠে।

সরকারী তথ্য দপ্তরের কর্মকর্তারা সন্ধ্যা ৭:৩০ মিনিটে বলেন যে আজ পাকিস্তানের দুই অংশ মিলিয়ে ৩১টি ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করা হয়েছে, যদিও কেউই আসলে তা বিশ্বাস করছে না। পূর্ব পাকিস্তানে তেরটি বিমান ভূপাতিত করা হয়েছে, সে বলে। সাংবাদিকেরা ঢাকার আকাশে চারটি বিমানকে ভূপাতিত হতে দেখেছে এবং অন্য তিনটি বিমান থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখেছে বিমান-বিধ্বংসী কামানের গোলা লেগে।

পাকিস্তান বিমান বাহিনীর দাবী তারা নয়জন ভারতীয় পাইলটকে আটক করেছে, তাদের মধ্যে একজন উইং কমান্ডারসহ। তারা আরো জানায় একটি ভারতীয় এস ইউ ৭, রাশিয়ার তৈরী জঙ্গিবিমান, কে বিমান ঘাঁটিতে অক্ষত অবস্থায় অবতরণ করতে বাধ্য করা হয়।

দুটি পাকিস্তানী এফ-৮৬ জঙ্গিবিমান ভূপাতিত হয়েছে, তারা বলে, এগুলোর মধ্যে একটি ভারতীয় একটি মিগ ২১ বিমানকে ধাওয়া করার সময় পাকিস্তানী বিমান-বিধ্বংসী গোলায় আঘাতগ্রস্ত হয়। “এটি খুবই দুঃখজনক ব্যপার, কিন্তু অন্তত ভারতীয়রা তো আর এটিকে ভূপাতিত করতে পারেনি”, তারা যোগ করে।

এই বিমান হামলাগুলো হাজার হাজার ঢাকা বাসীর জন্য এক জমকালো প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে। ছোট্ট শিশুরা ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে ভালো করে দেখার জন্য যখন ভারতীয় মিগ জঙ্গিবিমানগুলো শহরের মাঝখান দিয়ে উড়ে যায় বিমানবন্দরে তাদের গুলি এবং বোমা বর্ষণের জন্য।

মানুষেরা দালানের উপর থেকে দেখছিল মাঝে মাঝে মাথা নিচু করে যখন বিমান-বিধ্বংসী গোলা খুব কাছে বিস্ফোরিত হয়। হোটেলের বাসিন্দারা ছাদে উঠে আসে, যেখানে রঙিন-টেলিভিশনের ক্যামেরা দিয়ে রেকর্ড করা হয় ব্যালে নৃত্যের মতো বিমান যুদ্ধ এবং বিমানবন্দরের উপর তাদের আক্রমণ।

একটি চলচিত্র গ্রাহক দল তাদের সাঁতারের পোশাক পড়ে কাজ করছিল এই বলে যে এই সুযোগে তারা সূর্যস্নান করে নিতে চায়। অন্যরা ঠাণ্ডা পানীয় এবং দুপুরের খাবার পরিবেশন করতে বলে সেখানেই।

যখন একটি মিগ বিমান পিছনে দুটি স্যাবর বিমানের তাড়া খেয়ে উড়ে যায় এবং তারপর নিচু দিয়ে উড়ে যায় বিমান বন্দরের উপর দিয়ে, একজন ক্যামেরাম্যান তখন একজন ওয়েটারের দিকে ফিরে বলেঃ “হে ওয়েটার, ওয়েটার। দ্বিগুণ পানীয়ের ফরমাশ করছি – ফল মিশ্রিত পানীয় এবং লেবুর রস আর বরফ দেয়া চা”।

দুপুর ১২:৩০ মিনিটে সামরিক অফিসাররা সাংবাদিকদেরকে বিমানবন্দরে নিয়ে যায় ভূপাতিত একটি ভারতীয় মিগ বিমান দেখাতে। তারা ঠিক এমন সময়ে পৌঁছে যে তাদের কাছ থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে একটি হ্যাঙ্গারের পাশে রাখা জাতি সঙ্ঘের এক-ইঞ্জিন বিশিষ্ট তিনটি বিমানের মধ্যে দুটি মিগ বিমানের গুলির আঘাতে ধ্বংস হয়ে যায়।

কয়েকজন টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যান চিত হয়ে শুয়ে পড়ে, বিমান-বিধ্বংসী গোলাবৃষ্টির মধ্যে দিয়ে ভারতীয় জঙ্গিবিমানের চলচিত্র গ্রহণ করার জন্য, যখন ওগুলি পরপর চারবার আক্রমণ করে। ওগুলির মধ্যে একটি গোলার আঘাতে, আগুনের কুণ্ডলীর মতো বিস্ফোরিত হয় এবং কাছেই ভূপাতিত হয়।

জঙ্গিবিমানগুলি – মিগ, ন্যাট এবং এস ইউ ৭ – রকেট এবং গুলি চালায়, বোমা হামলা নয়, সরকারী কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী। জঙ্গিবিমানগুলি বিমান এবং হ্যাঙ্গারগুলোকে আক্রমণ করেছে। ওগুলি কাছের সামরিক ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করেনি বা রানওয়ের কোন ক্ষতি করেনি।

কর্মকর্তারা বলেন যে চট্টগ্রাম হচ্ছে একমাত্র অন্য আরেকটি শহর যেটি ভারতীয় জঙ্গিবিমানের আক্রমণের শিকার হয়, সেখানে জ্বালানী তেল সঞ্চয় করে রাখার আধার এবং একটি তেল শোধনাগারকে নিশানা করা হয়।

রাত ১০:০২ মিনিটে চারিদিক আবার নিশ্চুপ। আজ রাতে আর কোন বিমান আক্রমণ হয়নি এখনো পর্যন্ত। একটি কুকুর ডেকেই চলেছে।
-নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদ সেবা থেকে

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৭১। জীবিত এবং মুক্ত ডেইলি মিরর ৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭১

Ashik Uz Zaman
<১৪, ১৭১, ৪২৭-৪২৯>

দি ডেইলি মিরর, ৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭১
জীবিত এবং মুক্ত
মিরর পত্রিকার সাংবাদিক জন পিলগার প্রতিবেদন করেন বাংলাদেশের জন্মের উপর, যে জাতি তার ঘাতকদের ফাঁকি দিয়েছে

কোলকাতা, সোমবার। পাঁচ মাস আগে আমি ভারত এবং তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যকার সীমান্ত পাড়ি দেই, এবং বাংলাদেশ নামক একটি দেশের অস্তিত্ব আছে এমন প্রতিবেদন পেশ করি; এবং জানাই বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষকে কিভাবে হত্যা করা হচ্ছে তারা স্বাধিকারের ইচ্ছা পোষণ করে বলে।

ঐদিন, মিরর পত্রিকার প্রচ্ছদে শিরোনাম ছাপা হয় “একটি জাতির মৃত্যু”। বাংলাদেশ, তখন মনে হয়েছিল, মৃতাবস্থায় জন্ম নিতে যাচ্ছে, কেননা ইতিমধ্যেই ৫,০০,০০০ মানুষকে হত্যা করেছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, এবং ৭০,০০,০০০ মানুষ পালিয়ে গেছে ভারতে, যেখানে অগুনিত মানুষ মারা গেছে কলেরার মত বিভিন্ন রোগে।

তখন পশ্চিমা দেশের অধিবাসী আমরা পরোয়া করেছি খুব সামান্যই, আমরা দয়ার দান করেছি যতক্ষণ পর্যন্ত না ওদের দুঃসহ যন্ত্রণার কাহিনী আর তাৎক্ষনিক খবর নয়।

কিন্তু আসলেও, আমরা আমাদের ঔপনিবেশিক অতীতের এই বাক্সওয়ালাদের ব্যপারে আদতেই পরোয়া করিনি; আমরা পরোয়া করিনি বা বোঝার চেষ্টাও করিনি এই ঔপনিবেশিক অতীতের প্রতি তাদের বিদ্রোহকে; এবং এর উত্তরাধিকারী, পশ্চিম পাকিস্তানের স্বেচ্ছাচারী সামরিক শাসকেরা যাদের প্রায় কৌতুকপ্রদ বিভ্রম রয়েছে তাদের আর্য শ্রেষ্ঠতা নিয়ে যা নাৎসি জার্মানির সাথে তুলনীয়, এবং যাদের বাঙলা শাসন করার দৃঢ়সঙ্কল্পের মধ্যে গণহত্যার নীতিও ছিলো; আরো সঠিকভাবে বললে, একটি জাতির মৃত্যু।

আমি এখন বিবরণ পেশ করছি একটি জাতির জন্মের। বাংলাদেশ, ভারতীয় উপমহাদেশের সোনার বাঙলার ক্লাইভ, গত এক বছরে যে হারিয়েছে ১০,০০,০০০-এরও বেশী মানুষকে যুদ্ধ, ঘূর্ণিঝড় এবং অসুখে, এবং এখন সম্ভবত আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়েও, বেঁচে আছে।

নৈতিক আন্দোলন

আজ সকালে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, পুরো মানব জাতির ২ শতাংশ যার অংশীভূত, স্বীকৃত হয়েছে ভারত সরকার কর্তৃক, যার সামরিক বাহিনী এইমুহূর্তে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বাইশটি যুদ্ধক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে আক্রমণ করে যাচ্ছে।
আজ রাত এবং আগামীকালের মধ্যে অন্তত আরো এক ডজন অন্যান্য দেশ একে স্বীকৃতি প্রদান করবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

এখানকার অন্যান্য সাংবাদিকদের মতো, যারা বাঙালীদের পাশাপাশি এখানে কাজ করেছেন, আমি বাংলাদেশের প্রতি আমার সমর্থন লুকানোর চেষ্টা করিনা, যেটি আমি মনে করি স্পেনের গৃহ যুদ্ধে যারা যুদ্ধ করেছিল এবং হেরেছে তাদের পর সবচাইতে নৈতিক জাতীয় আন্দোলন।

আমার এই অনুভূতি বাঙালীদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা থেকে উদ্ভূত নয় যারা কিনা পৃথিবীর সবচে আকর্ষণীয় এবং হার না মানা মানুষদের মধ্যে অন্যতম, বরং এই জ্ঞান থেকে যে তাদের আজকের এই বিজয় – যা এখনো নিশ্চিত করা বাকি আছে এই যুদ্ধে ভারতের জয়ের মাধ্যমে – এসেছে আরোপিত এক দারিদ্র্য সত্ত্বেও যা মানব জাতির দুই-তৃতীয়াংশের জন্য বৈশিষ্ট্যসুচক, এবং আমাদের মতো পশ্চিমা দেশে অকল্পনীয়।

সাধারণত আমরা যারা পশ্চিমা দেশে থাকি, যারা পৃথিবীর সবচাইতে ধনী, নতুন জাতিদের, যারা গরীব, খুব দ্রুত একনায়কতন্ত্র এবং দুর্নীতির কবলে পড়তে দেখি।

ঠিক তাই ঘটেছে লাতিন আমেরিকাতে, কঙ্গোর মতো আফ্রিকার দেশে, এবং পশ্চিম পাকিস্তানে।

আমরা এই দরিদ্র জাতিগুলোর কাছে প্রচার করেছি, যাদের অস্তিত্বের উপর এমন সব হুমকি রয়েছে যা আমাদের ধারণারও বাইরে, যে প্রথমে তাদেরকে অবশ্যই ওয়েস্টমিনিস্টার বা ওয়াশিংটনের আদলে একটি সংসদীয় গণতন্ত্র গড়ে তুলতে হবে, আমাদের আশীর্বাদ পাওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে, যা, খুব বেশী হলে, রাজনৈতিক সূত্র জড়িত ত্রাণই হবে।

শরণার্থী শিবির

কোনো ভাবে, বাংলাদেশ আমাদের ধাপ্পাবাজি ধরে ফেলেছে। যেভাবেই হোক গত ডিসেম্বর মাসে পূর্ব বঙ্গের ৯৮ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছে সংসদীয় গণতন্ত্র, এবং একজন মধ্যপন্থী মানুষ শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী করার জন্য।

তারা পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারের কাছ থেকে স্বাধীন হওয়ার জন্য ভোট দেয়নি, যারা হাজার মাইল দূরে রয়েছে; তারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্যে থেকেই শুধুমাত্র গণতান্ত্রিক স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিল। এ কারণে, তারা গত মার্চ মাসে ইয়াহিয়া খানের সামরিক বাহিনীর হাতে নিষ্পেষিত হয়েছিল।

তখন থেকে, কোন মানুষই, এমনকি ইহুদিরাও নয়, বাঙালীদের মতো এমন দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করেনি। যারা তাদের দেশে থেকে গিয়েছিল তারা মারা গেছে বলপ্রয়োগে বা না খেতে পেয়ে। যারা ভারতে পালিয়ে গিয়েছিল তারা এমন এক যন্ত্রণার পথ পাড়ি দিয়ে শরণার্থী শিবিরগুলোতে পৌঁছেছে, তাদেরকে দেখে, মনে হচ্ছিল, তারা যেন আর মানুষ নেই।

ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনী আক্রমণ করার আগেই গত নভেম্বরে এক ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে নিহত হয় দুই লক্ষ পঞ্চাশ হাজার মানুষ। বাঙলা এবং গাঙ্গেয় বদ্বীপ সবসময়ই ছিল এক ভৌগলিক কফিন।
এবং তারও অনেক আগে, ভারতের ক্লাইভ সোনার বাঙলাকে নিঃস্ব করেছে যাকে সে বর্ণনা করেছিল লুকায়িত “অশেষ ধনভাণ্ডার” হিসেবে এবং সেই সময়ের এক ইতিহাসবিদের ভাষ্যমতে, এমন এক সময় যখন কোলকাতায় বিশাল ঐশ্বর্য আহরণ করা হয়েছে সেক্ষণে ৩,০০,০০,০০০ মানুষকে হীনাবস্থার শেষ প্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

অবশেষে, ১৯৪৭ সালে, যুক্তরাজ্য বাঙলাকে দুই ভাগে বিভক্ত করে এবং এর দারিদ্র্য নিশ্চিত করে, কেউ কেউ বলে, এক শতাব্দী বা তারচেয়েও বেশী সময়ের জন্য।

বাঙলা এবং ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাঁর দেশের মানুষদের সম্বন্ধে লিখেছেনঃ “মানুষগুলোর শরীর কত ছোট, দুঃসহ যন্ত্রণার সময় তাদের শক্তি কি বিশাল”। কিন্তু এই অপরাহ্ণে আমার ট্যাক্সি যখন কোলকাতার সার্কাস এভিনিউয়ে বাংলাদেশের দূতাবাসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, ততক্ষণে ইতিহাসের কালিমা দূর হয়েছে।

হাতে হাত বেঁধে

এক মহল্লা দূরে থাকতেই আমি কয়েকশত বাঙালির গুঞ্জন এবং গানের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম (রাজনীতি এবং গানের ব্যপারে ওরা ওয়েলস প্রদেশের বাসিন্দাদের মতো) এবং আমি যখন সেখানে পৌঁছাই তারা একসাথে দাঁড়িয়ে ছিল, হাতে হাত বেধেঃ এবং অনেকেই কাঁদছিল (তাদের অনুভূতি প্রকাশে তারা ইহুদীদের মতো)।

একটি বেতার যন্ত্র থেকে খবর শোনা যাচ্ছিল যে, বহু শতাব্দী পরে, বাঙলা আজ আনুষ্ঠানিকভাবে এক দেশ হিসেবে স্বীকৃত। এর সমতুল্য হিসেবে আর একটি ঘটনার কথাই আমি চিন্তা করতে পারছি যেটি ছিল ইসরায়েল রাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রদান।

দূতাবাসের বাগানে নির্বাসিত সংসদ সদস্যরা, স্যুট এবং সাদা সার্ট পরিহিত, দাঁড়িয়ে আছেন মুক্তি বাহিনীর দাড়িওয়ালা তরুণদের সাথে, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার যোদ্ধা। যে জাতীয়তাবাদ তারা প্রকাশ করছিল তা, তাদের মতোই, শান্ত। তারা এই জাতীয় সংগীতটি গাইছিলঃ

আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি!
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে
ঘ্রানে পাগল করে

ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে
আমি কি দেখেছি মধুর হাসি
আমার সোনার বাংলা

আবর্জনা খোঁটা

এবং এরপর তারা কোলকাতার রাস্তায় নেমে আসে ব্রিটিশ রাজের সোনার বাংলার মাছিপড়া শবদেহের উপর পয়োনালীর পাশে পড়ে থাকা ছোট পুঁটলিগুলো যার কিছু ঘুমিয়ে বা অসুস্থ বা মৃত, এবং পাখির মতো আবর্জনা খুঁটে বেড়ানো শিশু, এবং ভিখারি এবং কুষ্ঠরোগী এবং এক বা দুইজন সাদাচামড়ার সাহেবদের পাশ কাটিয়ে।

বৃদ্ধ লোক এবং শিশুসমেত ছেঁড়া কাপড় পড়া নারী, এবং রাগী-চোখের তরুণ যুবকেরা দরজা এবং গলিপথ থেকে বেরিয়ে আসছে এবং ট্রাম এবং বাস থেকে নেমে এসে যোগ দিচ্ছে তাদের মিছিলে, এবং চিৎকার করছে “জয় বাংলা”, যার মানে “বাঙালী জাতি দীর্ঘজীবী হোক”।

আমি যখন দুতাবাস ছেড়ে চলে আসি তখন আমার এক বন্ধু, মওদুদ আহমেদ, যে একজন অন্যতম সদস্য নতুন, সম্ভবত অসাম্প্রদায়িক এই সরকারের, চিৎকার করে আমাকে বলেঃ “তোমার মনে পড়ে তোমার ‘একটি জাতির মৃত্যু’-র কথা। দয়া করে ওদেরকে বোলো যে এখন একটি নতুন শিরোনামের প্রয়োজন দেখা দিয়েছেঃ একটি জাতির জন্ম”।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৭২। বাংলাদেশ মুক্ত ডেইলি মিরর ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৭২, ৪৩০-৪৩১>

ডেইলি মিরর, ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১
মুক্ত!

এই শহরে (যশোর)আমরা জানি আট মাস আগে কিছুই ছিলোনা। এটাকে সম্পুর্ন ধ্বংস করা হয়েছিল। আমি অনুমান করছি, এখানে জীবিত কেউ থাকতে পারেনি।

আজ এটা মুক্ত হল এবং ১৯৪৪ সালের প্যারিসে পরিণত হয়েছে।

এই তুলনা বাড়াবাড়ি নয়।

মার্চে পাকিস্তান আর্মি দখলের পড় থেকে এই প্রথম আজ সন্ধ্যার পরপর আর্মি ট্র্যাক, জিপ আর রিকশায় করে বিদেশীরা শহরে প্রবেশ করল। সাথে সাথে প্রচুর মানুষ হর্ষধ্বনিতে আমাদের ঘিরে ধরল।

মেইন রাস্তা, সিটি স্কয়ার সহ সকল বাড়ির দরজায় জানালায় মানুষের হাস্যোজ্জল মুখ দেখা যাচ্ছিল। তারা আনন্দের সাথে স্বাগত জানাচ্ছিল।

আক্রমণ

গত রাতে ভারতীয় সেনাবাহিনী যশোরে আক্রমণ শুরু করে। এটা ছিল রাজধানী ঢাকার পরে বাংলাদেশের সবচাইতে গুরুত্তপূর্ন শহর।

যশোর ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ম্যাগিনট লাইন। এখানে ছিল বাংকারের নেটওয়ার্ক এবং আমরা আগে বলেছিলাম এখানে ছিল এশিয়ার সবচেয়ে বড় অস্ত্রের মজুদ। তথাপি তারা পালিয়ে গেল।

গতকাল পর্যন্ত যশোর ছিল পাক বাহিনীর ৯ম ডিভিশনের হেডকোয়ার্টার। ছয় হাজার বন্দি অপেক্ষা করছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর আক্রমণের জন্য।

শক্ত কাজ

এবং তারপর, ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিজস্ব নবম ডিভিশন শহরে প্রবেশ করল। প্রশিক্ষিত পাকসেনারা এবং শক্ত সৈনিকরা চল্লিশ মাইল দূরে নদী দিয়ে পালিয়ে যায়।
শহরের পথে ভারতীয়রা সাড়েচার পাকিস্তানি ব্যাটালিয়নকে পরাজিত করে এবং তারপর উপকণ্ঠে স্থগিত অন্য আড়াই ব্যাটালিয়নের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। হঠাৎ ২০০০ জনের মত মানুষ ফিরে আসে এবং বাস , লরি এবং রিকশা চলাচল শুরু করে।

আটককৃতদের মধ্যে প্রায় ৩০০ জন তাদের স্ত্রী এবং পরিবারের সাথে ছিল। তাদের অনেকে ১২ মাইল দূর থেকে শহরে পৌঁছেছেন। আজ রাতে তাদের ঘিরে রাখা হয়েছে।

ভারতীয় কমান্ডার মেজর জেনারেল দালবীর সিং বলেন, “আমরা জানিনা তাদের সঙ্গে কি করতে হবে।’

“আমরা তাদের হাত উঁচু করে বেরিয়ে আসতে বলি। আমরা বলি যদি তোমরা বেরিয়ে না আসো তাহলে তোমাদের শেষ করে দেয়া হবে।’

যশোর সড়কের দু’পাশে গ্রামগুলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঝলসিয়ে দিয়েছে যা তাদের পোড়ামাটি নীতির অংশ।

এভাবে কয়েক মাইল হাঁটার পর আমরা দেখলাম মানুষ তাদের স্বর্বস্ব মাথায় পিঠে করে নিয়ে আমাদের সাথে হাঁটছে। তারা ছিল ভারতে থাকা ১১ মিলিয়ন উদ্বাস্তুদের মধ্যে ফিরে আসাদের দলের অগ্রপথিক।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৭৩। স্বাধীন বাংলা সান ৯ই ডিসেম্বর, ১৯৭১

Ashik Uz Zaman
<১৪, ১৭৩, ৪৩২>

দি সান, বৃহস্পতিবার, ৯ই ডিসেম্বর, ১৯৭১
বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করছে
গুরুত্বপূর্ণ শহর ভারতের দখলে আসায় রাস্তায় রাস্তায় নৃত্যোৎসব

গতকাল যখন ভারতীয় সৈন্যরা বিজয়ীর বেশে শহর অতিক্রম করছে তখন যশোরের গাইতে থাকা, নাচতে থাকা পূর্ব পাকিস্তানীরা আনন্দে উদ্দাম হয়ে ওঠে।

ভারতীয় ট্যাংকগুলো যখন গর্জন করতে করতে প্রধান সড়ক ধরে যাচ্ছিল – তখন রেডিও পাকিস্তান থেকে বারবার প্রচার করা হচ্ছিলঃ “যশোর এখনো আমাদের দখলে”।

হাজার হাজার শহরবাসী একত্র হয়ে, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিল “জয় বাংলা!” – “স্বাধীন বাংলার জয় হোক”।

ভয়াবহ

তাদের জন্য, ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপস্থিতির মানে হচ্ছে এই বছরের শুরুতে বাংলাদেশের বিদ্রোহ দমন করার জন্য পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আরোপিত আতঙ্ক এবং ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার অবসান।

প্রতিটি জানালায়, এই নতুন বিদ্রোহী রাষ্ট্রটির সবুজ-এবং-হলুদ পতাকা উড়ছিল।

শহরের বাইরে তিনদিন ধরে প্রচণ্ড যুদ্ধ করার পর পাকিস্তানী সৈন্যরা রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেছে, ভারতীয় বাহিনীর অবরোধের দেয়ালের সর্বশেষ ফোঁকর গলে।

সকালে, বাংলাদেশের গেরিলা যোদ্ধারা শয়ে শয়ে অস্থায়ী প্রতিবন্ধকতাগুলো পেড়িয়ে আসে এবং শহরে প্রবেশ করে।

তারা জেলখানা দখল করে নেয় এবং ৬৫০ জন বন্দীকে মুক্ত করে।

এদের মধ্যে ছিলেন দুই জন ত্রাণ কর্মী – ২১-বছর-বয়সী গর্ডন স্লাভেন, হ্যাম্পস্টেড থেকে, এবং ২৭ বছর-বয়সী মার্কিন নাগরিক মিসেস এলেন কনেট – যাদেরকে দাতব্য কাজে বেআইনি ভাবে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশের দায়ে এখানে কয়েদ করে রাখা হয়।

অভিযান

সামরিক পর্যবেক্ষকেরা হতবাক হয়ে যান এতো সহজে যশোর মুক্ত হয়ে যাওয়াতে। কিন্তু মনে হচ্ছে যে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্ব প্রদেশে সবাইকে পশ্চাদপসরণের আদেশ দিয়েছেন, রাজধানী ঢাকার চারপাশে দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য।

গতকাল ঢাকার চারপাশের ইস্পাতের বাঁধুনি আরেকটু আঁটো করা হয়েছে।

ভারতীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, তারা ঢাকা থেকে মাত্র ২২ মাইল দূরে রয়েছে।

দাবী

কিন্তু রেডিও পাকিস্তান থেকে বারবার প্রচার করা হচ্ছে যে যশোর এবং সিলেটের মতো এলাকা – যেগুলো ভারতীয়রাও দাবী করছে – এখনো খুব ভালোভাবে তাদের দখলে রয়েছে। এদিকে পশ্চিম রণাঙ্গনে পাকিস্তানী সৈন্যরা নতুন করে ভারতীয় অবস্থানের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করেছে বলে দাবী করা হচ্ছে।

ইসলামাবাদে একজন পাকিস্তানী মুখপাত্র বলেনঃ “চাম্ব এলাকায় আমাদের সৈন্যরা ভারতীয় বাহিনীর উপর তাদের আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে”।

একজন ভারতীয় মুখপাত্র স্বীকার করেনঃ “আমাদের সৈন্যরা প্রবল চাপের মুখে রয়েছে”।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৭৪। পাকিস্তানীদের প্রতিরোধ ব্যাবস্থা যথেষ্ট নয় ডেইলি টেলিগ্রাফ ৯ই ডিসেম্বর, ১৯৭১

Ashik Uz Zaman
<১৪, ১৭৪, ৪৩৩-৪৩৪>

দি ডেইলি টেলিগ্রাফ, ৯ই ডিসেম্বর, ১৯৭১
সংসদে পরিত্রাণের উপায় নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই বিমানঘাঁটির পতন
প্রতিরোধ স্পৃহা নিয়ে সন্দেহ যেখানে ভারতীয়রা ঢাকার দিকে অগ্রসর হচ্ছে
কোলকাতা থেকে পিটার গিল কর্তৃক

গত সপ্তাহে ভারতীয় সৈন্যরা যেখানে পূর্ব বাংলার কেন্দ্রবিন্দুর দিকে তাদের অগ্রগতি অব্যাহত রেখেছে, সেখানে সন্দেহ রয়ে যায় যে কোলকাতায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিবৃতিতে যতটা দাবী করা হয়েছিল পাকিস্তানীদের প্রতিরোধ আসলেই ততটা শক্ত হবে কি না।

এই ধারণা আরো ঘনীভূত হয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান, “স্যাম” মানেকশ-এর বক্তৃতার তর্জনগর্জনে, যেটি পূর্ব বাংলায় অবস্থানরত পাকিস্তানী সৈন্যদের উদ্দেশ্যে গতকাল রাতে প্রচারিত হয়।

তাঁর পূর্বোক্ত বক্তৃতাগুলোর চেয়ে ভিন্নভাবে, এই বক্তব্যটি ইংরেজীসহ উর্দু, হিন্দি এবং পাঠান ভাষায়ও প্রচারিত হয় এবং এথেকে পরিস্কার বোঝা যায় যে এটি অফিসারদের উদ্দেশ্যেই প্রচারিত।

“আমি জানি যে আপনারা নারায়ণগঞ্জ (ঢাকা থেকে ৮ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে) এবং বরিশাল (ঢাকা থেকে ৭০ মাইল দক্ষিণে) এলাকায় জড়ো হচ্ছেন”, জেনারেল বলেন। “এবং আমি জানি যে আপনারা আশা করছেন আপনারা পালাতে সক্ষম হবেন বা আপনাদেরকে উদ্ধার করা হবে”।

“আপনারা যদি আত্মসমর্পণের আহ্বান গ্রাহ্য না করেন এবং পালানোর চেষ্টায় থাকেন, আমি আশ্বাস দিচ্ছি যে নিশ্চিত মৃত্যু অপেক্ষা করছে আপনাদের জন্য। আমাকে পরবর্তীতে বলবেন না যে আমি আপনাদের হুঁশিয়ারি দেইনি”।

অগ্রসরমান বাহিনী

কৌশলগত ভাবে গুরুত্বপূর্ণ পশ্চিমা সেনানিবাস শহর যশোর অতিক্রম করার পর, যেটি গত মঙ্গলবার দখল করা হয়, ভারতীয় সেনাবাহিনীর দুইটি বাহিনী গতকাল পাকিস্তানী সৈন্যদের ধাওয়া করে খুলনা এবং ফরিদপুরের দিকে আসছিল।

যেসব সাংবাদিক সাম্প্রতিককালে যশোর শহর পরিদর্শন করেছেন তারা বলেন যে এমনকি মাঝারি ধরণের প্রতিরোধের মাধ্যমেও, ভারতীয় সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে শহরটি যে ২৪ ঘণ্টা আসলেই টিকে ছিল তারচেয়ে অনেক বেশী সময় এটি টিকে থাকতে পারতো।

এটি বিতর্কিত বিষয় যে প্রতিরোধের “শক্ত খোলস” যদিও ভেঙে ফেলা গেছে, কিন্তু “কোমল অন্তর্ভাগ” ভারতীয় পূর্বাঞ্চলের সেনাবাহিনী যতটা ধারণা করছে ততটা সহজে ভারতীয়দের মুঠোয় আসবে না।

গতকাল ভারতীয় সৈন্যদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তা হচ্ছে কুমিল্লার সীমান্তের কয়েক মাইলের মধ্যে পৌঁছানো, পাকিস্তানের এই প্রদেশটির পূর্ব অংশে। ময়নামতি সেনানিবাস, যেটি কয়েক মাইল পশ্চিমে অবস্থিত, কিছুদিন আগেও বিভাগীয় সদরদপ্তর হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিলো উত্তরে আরো ভেতর দিকে আশুগঞ্জে সরিয়ে নেয়ার আগ পর্যন্ত।

বিমানঘাঁটির পতন

যদিও সেনানিবাসটি ভারতীয় আক্রমণ প্রতিরোধ করে চলছিল, এর সৈন্য সংখ্যা একেবারেই “কমে” গেছে, পূর্বাঞ্চলের বাহিনীর ভাষ্য অনুযায়ী, এবং এর চূড়ান্ত পতন আসন্ন।

ভারতীয় সেনাবাহিনী গতকাল কুমিল্লার বিমানঘাঁটি দখল করে নেয়, যেটি শহর এবং সেনানিবাসের মাঝখানে অবস্থিত। শহরটি ইতিমধ্যেই ভারতের দখলে রয়েছে।

বিমানঘাঁটি দখলের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই, লেঃ-জেন. জে. এস. অরোরা, পূর্বাঞ্চলের জেওসি, বিমানে করে সেখানে আসেন আগরতলা, পূর্ব ভারতীয় প্রদেশ ত্রিপুরার দুর্গম রাজধানী থেকে। উদ্দ্যাম হর্ষধ্বনিরত “মুক্তিপ্রাপ্ত” জনতা তাঁকে স্বাগত জানায় বলে জানানো হয় সেনাবাহিনীর তরফ থেকে।

জেন. অরোরা ভারতীয় সৈন্যদের পরিদর্শন করেন যারা ইতিমধ্যেই কুমিল্লা থেকে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে ঢাকার ২৫ মাইলের মধ্যে পৌঁছে গেছে। পূর্বাঞ্চলের বাহিনী এই পরিদর্শন কে “মনোবল বর্ধক” হিসেবে বর্ণনা করে, যা আরো ইঙ্গিত দিচ্ছে যে পূর্ব বাংলার যুদ্ধ শেষ হতে আরো অনেক বাকি আছে।

গতকাল রাতে ভারতীয় কর্মকর্তাদের দেয়া হিসেব অনুযায়ী গত চারদিনের যুদ্ধে পাকিস্তানীদের ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে একজন অফিসার ও ৩৩১ জন সৈন্য নিহত এবং ১৮১ জন আহত হয়েছে। ২১ জন জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার এবং অন্যান্য পদমর্যাদার ২৮৫ জন সহ ৯ জন অফিসারকে আটক করা হয়েছে।

গোনার সময় নেই

কিন্তু যশোরে গত ২৪ ঘণ্টার যুদ্ধে পাকিস্তানের নিহত এবং আহতের কোন সংখ্যা পূর্বাঞ্চল থেকে ঘোষণা করা হয়নি। মেজর জেন. জে. এফ. আর. জ্যাকব, যিনি পূর্বাঞ্চলের চীফ অব স্টাফ, বলেন যে তাঁর সৈন্যদের “গোনার সময় ছিল না”।

পূর্বাঞ্চলের পক্ষ থেকে চমৎকার ভাবে তাদের যশোর দখল করার সাথে সামঞ্জস্য রেখে ক্ষয়ক্ষতির বিশাল সংখ্যা প্রকাশের অপারগতা এই ইঙ্গিতই দেয় যে এই সেনানিবাস শহরটি তারা যতটা স্বীকার করতে চায় তারচেয়ে অনেক সহজেই তারা দখল করতে পেরেছে।

পূর্বাঞ্চলের বাহিনী অটলভাবে পূর্ব বঙ্গে ভারতীয় ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত বিবরণ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে, শুধুমাত্র এই বলে যে “তারা সবসময়ই কম ক্ষতির সম্মুখীন হয়, এবং কখনই বেশী নয়”।

ধারাভাষ্যকাররা বলেন যে যশোরের পতনের পেছনে চমৎকার ভারতীয় রণকৌশলের চেয়ে পাকিস্তানীদের দেশের অভ্যন্তরভাগে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আকাঙ্খার অবদানই বেশী কেননা পূর্ব বঙ্গে অবস্থানকারী তার ৮০,০০০ সৈন্য নৈরাশ্যজনকভাবে সংখ্যালঘু হয়ে আছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৭৫। ঢাকার উপর স্কাইট্রুপার ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড ১১ ডিসেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৭৫, ৪৩৬- ৪৩৭>

ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড ১১ ডিসেম্বর ১৯৭১
ঢাকার উপর স্কাইট্রুপার
স্ট্যান্ডার্ড ফরেন নিউজ ডেস্ক

ভারতীয় প্যারাট্রুপাররা আজ পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠে পাকিস্তানি অবস্থানের উপর আঘাত করেছে।

কলকাতার ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনাল রিপোর্টার কেনেথ Braddick বলেন আনুমানিক ৫০০০ প্যারাট্রুপারকে দমদম বিমানবন্দরে ৫০সি ৭ এবং সি-১১৯”উড়ন্ত বক্স-কার” বিমানে বোর্ডিং করতে দেখা যায়।

সামরিক ও কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ড্রপ করার লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের “ঢাকার উপকণ্ঠে।”

ভারতীয় বাহিনী এর আগে উত্তর-পূর্ব-ঢাকার ৪০ মাইল দুরে মেঘনা নদী জুড়ে একটি ব্রিজহেড প্রতিষ্ঠা করে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৭৬। পশ্চাদগামী পাকিস্তানীদের প্রতিশোধ ওয়ার্কার প্রেস ১১ ডিসেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৭৬, ৪৩৬-৪৩৭>

ওয়ার্কার প্রেস, ডিসেম্বর ১১ , ১৯৭১
পশ্চাদগামী পাকিস্তানীদের প্রতিশোধ
একজন বিদেশী সাংবাদিক

বেঙ্গল রেজিমেন্টের পাকিস্তানি সৈন্যরা ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর হাতে অপসৃত হবার পথে তাদের পরাজয়ের গ্লানি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উপর ভয়ানক প্রতিশোধ হিসেবে প্রয়োগ করছে।

চট্টগ্রাম থেকে রিপোর্টে জানা যায় এখনও ইয়াহিয়া খানদের বাহিনীর হাতে, শহরেরশত শত শ্রমিক নিহত হচ্ছে।
ধারণা করা হচ্ছে ভারতীয় সৈন্যদের আক্রমণের কারণে আর্মি ইউনিট চট্টগ্রাম থেকে সমুদ্রপথে পালানর প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

চট্টগ্রামে ট্রেড ইউনিয়নগুলোর প্রচুর কেন্দ্র থাকার জন্য সেখানে প্রচুর শ্রমিকদের অবস্থানের আছে। সে কারণে এই এলাকা ছিল সবচেয়ে সক্রিয় যা প্রথম দিন থেকেই খানের বাহিনীকে প্রতিরোধের দিকে অন্যতম ছিল।

পূর্ব বাংলা ধরে রাখতে না পেরে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী যত ইচ্ছা বাঙ্গালী শ্রমিক নিহত করেছে বাংলাদেশের উপর ঘৃণা স্বরূপ।
যখন ভারতীয় বাহিনী এই সপ্তাহের শুরুর দিকে যশোর ঢুকে তখন তারা আশেপাশের গ্রামগুলোতে প্রচুর ধ্বংস যজ্ঞ দেখতে পান।

ইতালীয় ক্যাথলিক পুরোহিতদের একজন যিনি পাকিস্তান দখলদারদের ওখানে বসবাস করতেন তিনি সংবাদদাতাদের বলেন যে স্বাধীনতার আগে গত সপ্তাহ এখানকার পরিস্থিতি খুব কঠিন ছিল।

নিপীড়ন ক্রমাগত নিষ্ঠুরতাকে হার মানছিল। যশোর সেনানিবাসের ভিতরে ছিল হত্যা আর নির্যাতনের কেন্দ্রবিন্দু।

মঙ্গলবার বিকেলে ভারতের সৈন্য শহরের উপকণ্ঠে সমবেত হয়। পাকিস্তানি সেনারা এখনো জিম্মি রেখেছিল ।

ভারতীয় সমর্থিত আওয়ামী লীগের দ্বারা গঠিত বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রধান নেতৃবৃন্দ রাজাকারদের ধরার জন্য আবেদন জানান।

এই নেতারা এখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অনেক জায়গায় তাদের প্রশাসন স্থান করেছে । যেখানে মুক্তিযুদ্ধ কমিটি ইতিমধ্যে স্থানীয়ভাবে প্রশাসনের কাজ শুরু করেছেন।

প্রায় দেড় লাখ অনিয়মিত বাহিনীর বাঙ্গালীদের কাছে থাকা অস্ত্র নিয়েও তারা শঙ্কিত। তারা আশা করছেন যাতে কোন নতুন আন্দোলন মাথা চারা দিয়ে না ওঠে।

প্রতিক্রিয়াশীল মতামত প্রকাশিত হয় নয়া দিল্লির প্রতিনিধি হুমায়ুন চৌধুরীর খবরে যেখানে বলা হয় যে মুক্তিবাহিনীকে ভারতের পশ্চিম সীমান্তে সংগ্রামে অংশ নিতে পাঠানো উচিত । এই সপ্তাহের শুরুর দিকে এই প্রস্তাব করা হয়।

কিন্তু কর্মী এবং বাংলাদেশের কৃষক দেড় ভারতের কাশ্মীরে যেতে আগ্রহী হয়নি – যা ছিল পশ্চিমে ভারতের মূল যুদ্ধ ক্ষেত্র।
চৌধুরীর প্রস্তাব ছিল বাঙ্গালী বিদ্রোহী যোদ্ধাদের ঠেকানোর প্রথম পদক্ষেপ যাতে ভারতীয় রুলিং ক্লাসের সাথে বুর্জোয়াদের আইন বাংলাদেশ বলবত থাকে।

প্রাভদা গতকাল স্বতন্ত্র্র ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের বর্তমানে পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে ভারতের সাথে যোগদান করতে। বর্ষীয়ান ভাষ্যকার ইউরি জুখভ আবারও পাকিস্তান সরকারের ওপর মস্কোর আহবানকে জোর দিয়ে প্রচার করেন যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নিষ্পত্তির পদক্ষেপ নেয়ার অনুরোধের কথা বলা ছিল।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৭৭। ডেক্কা (ঢাকা) ডায়েরি অবজার্ভার ১২ ডিসেম্বর, ১৯৭১

Abdulla Al Asif
<১৪, ১৭৭, ৪৩৮-৪৪০>

ডেক্কা (ঢাকা) ডায়েরি
ডেইলি অবজার্ভার, ১২ ডিসেম্বর, ১৯৭১
-গ্যাভিন ইয়াং

১৯৭১ সালে ইন্দো-পাক যুদ্ধের শুরু থেকেই ডেইলি অবজার্ভারের সাংবাদিক গ্যাভিন ইয়াং ঢাকার ঘটনা নিয়ে অনেক গুলো রিপোর্ট করেছিলেন। ঐ সপ্তাহ গুলোতে গ্যাভিন ইয়াং এর কাছ থেকে নীচের মেসেজ গুলো আমাদের কাছে পৌছেছিল। যুদ্ধ অবস্থার কারনে তিনি একবারে একটা মেসেজই পাঠাতে পারতেন।

মঙ্গলবারঃ
আমি ভারতীয় মিগ বিমান গুলোর ক্রমবর্ধমান আনাগোনা দেখেছিলাম, খুবই কাছ দিয়ে তারা উড়ে যেতো যা আমি সবসময়ই দেখতে চাইতাম। ভূপাতিত ভারতীয় বিমান দেখবার জন্য আমি এবং আমার এক সাংবাদিক বন্ধু একদিন ঢাকা বিমান বন্দরের দিকে গিয়েছিলাম। আমরা সেখানে গিয়ে আক্রমনের স্বীকার হই। আমি আক্রমন থেকে বাঁচার জন্য একটা মাঝারি ধরনের খেজুর গাছের তলায় শুয়ে পড়েছিলাম। আমি প্রচন্ড হতচকিত হয়ে গেছিলাম এবং নিজেকে মনে হচ্ছিল সদ্য স্নান ঘরে ঢোকা নারীর মত যার পায়ে শুধু একটা জুতো আছে। খুব নিরাপত্তা হীনতায় ভুগছিলাম। বিভিন্ন দিক থেকে আসা মর্টারের গোলা গুলো মাথার খুব কাছ দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। আমার মনে হলো তাদের মর্টার গুলো ছোড়ার পর সেগুলো মাথার ২০ থেকে ৩০ ফুট উপর দিয়ে যাচ্ছিল। বিস্ফোরণের শব্দগুলোও খুব জোরে জোরে হচ্ছিলো। এদিকে পাকিস্তানীদের শত্রু বিমান আক্রমন প্রতিরোধী ব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবার কারনে তাদের প্রতিরোধ ঝিমিয়ে গেছিলো। দেখলাম বিমান বন্দরের হ্যাংগারে রাখা জাতিসংঘের একটা বিমান মর্টারের গোলায় আগুন ধরে গেলো। গোটা ব্যাপারটাই ছিল শ্বাসরুদ্ধকর। ঐ দিন ভারতীয় বিমান গুলোতে যদি রকেট কিংবা নাপাম বোমা থাকত তাইলে অনেক সাংবাদিককে হয়ত বেঁচে ফিরতে হতো না।

বুধবার:

আজ আমি ঢাকা থেকে ১২ মাইল দূরের বড় একটা নদী বন্দর নারায়ণগঞ্জে নিজে গাড়ি চালিয়ে গিয়েছিলাম। আগেই শুনেছিলাম সেখানে বিশাল কিছু ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে, কিন্তু পৌছানোর পরে ততটা মনে হলো না। নারায়ণগঞ্জ বন্দরের চারিদিকে কাঁটাতার আর ফেলে যাওয়া বন্দুক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখেছি। গতরাতেই ভারতীয় বিমান সেনারা একটা আবাসিক এলাকায় বিমান হামলা করেছে যেটা পাওয়ার স্টেশন থেকে মাত্র আধা মাইল দূরে অবস্থিত। এলাকাটার অধিকাংশ মানুষই প্রচন্ড গরীব। এই হামলায় চার থেকে পাঁচশত জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে এবং ১৫০ জনকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। মৃতরা যে যেভাবে ঘুমিয়েছিল সেভাবেই সমাহিত হয়ে গেছে।
আরেকটা ব্যাপার খেয়াল করলাম যে, রাস্তার পাশের কিছু গ্রাম যেগুলো পুড়ে গেছে বলে মনে হলো সেগুলো কিন্তু ভারতীয় বিমান হামলার কারনে পুড়ে যায় নি। আসলে সেগুলো পাকিস্তান সেনাবাহিনী আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন যে, লন্ডনের সম্পাদকেরা ঢাকার যুদ্ধাবস্থা সম্পর্কে কি ধরনের খবর জানতে চান। লন্ডন থেকে প্রতিদিনই দেরিতে খবর পৌছানোর কৈফিয়ত জানতে চাওয়া হচ্ছে বলে জানিয়ে রাখি এখানে বিভিন্ন দৈনিক সংবাদপত্র ও বার্তা সংস্থার করেসপন্ডেন্টসরাও অনেক দেরিতে তাদের এজেন্সি থেকে নির্দেশনা পাচ্ছেন। অথচ লন্ডন প্রতিদিনের খবরই আমাদের কাছে জানতে চাইছে। আরো জানতে চাইছে কেন প্রতিদিন একটা করে সংবাদ ফাইল বা তার বার্তা তাদেরকে পাঠানো হচ্ছে না? লন্ডন কি বুঝতে পারছে না যে আমরা ঢাকাতে ঘর থেকে বেরই হতে পারছি না সেখানে আমরা সংবাদ কিভাবে তাদেরকে পাঠাবো? এখানে একজন সংবাদ কর্মীকে তার এডিটর জিজ্ঞাসা করেছিল, অন্যান্য এয়ার লাইন্সের বিমান চলাচল যখন বন্ধ আছে তাইলে কেন সে পাকিস্তান এয়ার লাইন্সের বিমানে করে সেখান থেকে চলে আসছে না? যাই হোক প্রশ্নটা আমার কাছে হাস্যকর লাগল। তার এডিটর কি জানে না যে, এখানে পাকিস্তান এয়ার লাইনের শেষ বিমানের ফ্লাইটটাও গত শুক্রবারেই ছেড়ে চলে গেছে?

বৃহস্পতিবার

এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়াবহ খবরটা হলো গতকাল ভোর ৪টার সময় ঢাকাতে একটা ইসলামী এতিমখানায় ভারতীয় বিমান সেনারা বোমা হামলা করেছে। তিনশোর মত ছেলে-মেয়ে থাকত সেখানে। আমি সূর্য ওঠার পরেই সেখানে গিয়েছিলাম। বিমান হামলায় সব কিছু তছনছ হয়ে গেছে, প্রায় সব কিছুই ধবংস হয়েছে এলাকাটার। প্রায় সবাই মারা গেছে। ধ্বংসস্তুপের নীচে তখনো কেউ কেউ বেঁচে ছিল। তবে কতজন, কিভাবে, আহত হয়ে পড়ে আছে কেউ বলতে পারল না। কারন উদ্ধার করার মত সেখানে কেউই ছিল না। এখানে রাতকালীন বিমান হামলায় প্রচুর প্রানহানী ঘটাচ্ছে, এবং এই রাতকালীন হামলার কোন দরকার আছে বলে আমি মনে করি না। এই বোমা গুলো বিমান বন্দরের রানওয়ে তাক করে ছোড়া হয়েছিল। গত পাঁচদিন ধরে ভারতীয়রা রানওয়ে ধ্বংস করার জন্য দিনের আলোতে হামলা করেছিল তবে তারা পর পর পাঁচ দিনই ব্যার্থ হয়। তবে আজ মধ্যদুপুরে এক পাইলট সেই বহু কাঙ্ক্ষিত কাজটা করতে পেরেছে বলে জানা গেছে। অর্থাৎ রানওয়েটা এখন ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত আমরা সবাই অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিকের দেয়া এক তত্ত্বের সাথে একমত ছিলাম। তত্ত্বটাও বেশ মজার যে, ভারতীয় সেনাদের হাতের নিশানা এতই খারাপ যে, তাদের ১০ মিটার দূরে যদি একটা গরুও রাখা হয় তাও তারা সেটাকে ঠিকঠাক নিশানা করতে পারবে না। আমরা ভারতীয় জেট বিমান গুলোকে আকাশ থেকে গোত্তা খেতে খেতে পড়ে যেতে দেখেছি, একের পর এক গুলি খেয়ে ভুপাতিত হতে দেখেছি। আমি গত মাসেই সাত থেকে নয়টা এমন গোত্তা খেতে খেতে পড়ে যাওয়া বিমান দেখেছি তবে সংখ্যাটা আরো বেশিও হতে পারে এখন ঠিক মনে পড়ছে না। বড় আকারের রাশিয়ান সুখোই-৭ জেট বিমান গুলোকে গোত্তা খেয়ে পড়তে দেখতে আরো বেশি মজার। ধীরে ধীরে, পাক খাওয়া ঘুড়ির মতো করে পড়ে যায়। মনে হয় আকাশে বিমানের ব্যালে নৃত্য দেখছি।

বোমা হামলার পর আমরা রাস্তায় এসেছিলাম। আমি আর আমার সহকর্মী নিরাপদ আশ্রয় খুজতে শুরু করলাম। বাইরের অবস্থাটা একেবারেই জগাখিচুড়ি পাকানো সাথে আমাদের অবস্থাও ঠিক সেরকমই ছিল। সাদা শার্ট-প্যান্ট, কালো জুতা, অগোছালো চুল মনে হচ্ছিল ছাইয়ে ডুবে গেছি। চারিদিকে প্রচন্ড ধোয়া। কঙ্গালসার রিক্সাওয়ালা গোত্তা খেয়ে নীচে পড়ে আছে। রাস্তার মরা দেহ, মাংস সব কাকে টেনে টেনে খাচ্ছে। মুখে নিয়ে উড়ে চলে যাচ্ছে। একজায়গায় দেখলাম জীর্ণ-শীর্ন অনেক মানুষ একটা বট গাছের নীচে বসে আছে। যাদের নিস্প্রভ চোখ, রোদে পোড়া কালো চামড়া, বুভুক্ষ চেহারাই বলে দিচ্ছে তারা অনেক অনেক গরীব। না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছে। তারা কেন সাইরেন বাজাতো? বোমার শব্দেই তো পৃথিবী কেঁপে উঠতো। সাথে সাথে দেখতাম বৃদ্ধ লোকটি বড় কদমে শহরের অন্য প্রান্তে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তার মলিন সাদা চুল বাতাসে উড়ছে তার হাতে দৌড়ানোর অবলম্বনের জন্য একটা লাঠি। তিনি দৌড়াচ্ছেন যেন মনে হচ্ছে ভাববাদী এক পাগল। লক্ষহীন ভাবেই দৌড়াচ্ছেন তবে ঐ লক্ষে সময় মত পৌছাতে পারলেই হয়ত তার সেই অদ্ভুত ভাববাদ সত্য হয়ে যাবে।

শুক্রবার সকাল

আজানের শব্দে আমার চিন্তার জগতে ছেদ পড়ে গেলো। এখন আমরা প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দ শুনছি। মনে হলো খুব কাছেই শব্দ হচ্ছে। ভারতীয় বিমানগুলো প্রচন্ড বোমা বর্ষন করছে। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের লম্বা ইস্পাত কাঠামোটা একটা চারা গাছের নড়ে ওঠার মতো করে নড়ে উঠল। আবারও জাতিসংঘ দ্বারা পরিচালিত অনির্ধারিত মার্সি ফাইট এবং সিঙ্গাপুর থেকে ছাড়তে চাওয়া রয়েল এয়ার ফোর্সের বিমানের ফ্লাইট গুলা বাতিল ঘোষনা করা হয়েছে। ঢাকাতে বহু নারী ও শিশু আটকা পড়ে আছে। কে বা কারা এই ন্যাক্কার জনক কাজের জন্য দায়ী আমরা সেটা বুঝতে পারছি না। তবে যেই করুক না কেন তাদেরকে আমরা প্রচন্ড ধিক্কার দিয়েছি যে কেন তারা এই নিরীহ মানুষ গুলাকে বাধা দিচ্ছে? আমরা জানি না। তবে সেটা কি ভারত সরকার? পাকিস্তানিদের এই ধরনের কাজ করার কোন কারণ নেই।

একটা ব্যাপারে আন্তর্জাতিক জনমত তৈরী করা দরকার। সেটা হলো ভারতীয় বিমান বাহিনীর রাতকালীন বিমান হামলাকে বন্ধ করা। যেখানে অন্যান্য দেশের মতো রাতকালীন বিমান হামলায় ভারতীয় বিমান সেনারাও প্রচন্ড ভাবে অদক্ষ। আরেকটা কাজ করা যায় যে, ঢাকাকে মুক্ত শহর বলে ঘোষনা করা যেতে পারে। আমি এটাও বিশ্বাস করি যে পাকিস্তানিরাও আমার সাথে একমত হবে কারন পরিকল্পিত গণহত্যা বন্ধ এবং একটি বেসামরিক অভ্যুত্থান ঠেকাতে ঢাকাকে মুক্ত রাখা জরুরী। যেখানে ঢাকার রাস্তায় দুটো রিক্সা পাশাপাশি রাখলে একটা ট্রাফিক জ্যামের সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে। সেখানে অবশ্যই দুই পক্ষের সম্মতিতেই ঢাকাকে মুক্তাঞ্চল বলে ঘোষনা করা যেতে পারে। অভিযান চলা সত্ত্বেও ঢাকা শহরে একটা স্থিরতা আছে। ব্যাংক এবং দোকানগুলো আগে যেমন চলতো এখনও তেমনিই চলে। ঢাকার মানুষেরা শুধুমাত্র ভারতীয় জেট বিমানের হামলা ও পাকিস্তানি শত্রু বিমান আক্রমন প্রতিরোধী গোলার আঘাত থেকে বাঁচতেই ঘর এবং দেয়ালের পিছনে আশ্রয় নেয়। এখানে চারিদিকে ট্রেঞ্চ খোড়া রয়েছে। হোটেল লন গুলো সুন্দরভাবে একটা ফালি করা কেকের মতো করে সোজা লাইন করে কাটা হয়েছে। এটা কি তবে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য শেষবার ঘুরে দাড়ানো কোন বীরের শেষ প্রচেষ্টা? বলা অসম্ভব।

আমরা বিবিসি থেকে জানতে পারলাম যে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর কিছু সাঁজোয়াযান রয়েছে এবং তারা মুহুর্তের মধ্যেই নদী পার হবার জন্য ব্রিজ বানাতে সক্ষম। তবে আমার কেন জানি মনে হচ্ছে ভারতীয় সেনারা আসল নদীর পাড়ে এসে উপস্থিত হয়েছে যেখানে তারা আসলে ব্রিজ বানাতে অক্ষম। তারা বোধ হয় পশ্চিমের পদ্মার উপর এসে পড়েছেন এবং পূর্ব অংশে যার সবচেয়ে বড় উপনদী। পদ্মার স্রোত এখানে সবচেয়ে বেশি এবং হ্রদের ধারার স্রোতস্বীনি। এইরকম একটা জায়গায় সেনা নামানো খুবই কঠিন কারণটা হলো সেনাদের স্রোতের পাশাপাশি শত্রু সেনাদেরকেও প্রতিরোধ করতে হতে পারে। এছাড়া মাটি ও মাঠগুলো খুবই ভেজা ও স্যাতস্যাতে সাথে শত্রু সেনাদের দ্বারা খোড়া পরিখা গুলো ট্যাংকের জন্য একেকটা ফাঁদ হিসাবে কাজ করবে।

ভারতীয় বাহিনীর এই সকল দুর্বলতাই পাকিস্তানিদের সাহায্য করতে পারে। যদিও তাদের এখনও খাবার ও অন্যান্য সরবরাহ, যোগাযোগ ও প্রচুর গোলাবারুদ আছে। কিন্তু তারা কি পারবে?

শুক্রবার সন্ধ্যা
শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতিসংঘ ঢাকাকে একটি মুক্ত শহর ঘোষনায় ব্যর্থ হয়। কিছু কৌশলে অসুবিধায় পড়ে যাবার ভয়ে ভারতীয়রা এতে একমত হবে না এটা আমি ঠিকই বুঝতে পারছি।

পল মার্ক হেনরি (জাতিসংঘের স্থানীয় প্রতিনিধি), জাতিসংঘের হয়ে মানবিক বেষ্টনী গড়ে তোলার প্রতি আহ্বান জানান। মিঃ হেনরি যিনি আসলে রুপকথার গল্পের মতো অস্থির একজন লোক বলে মনে হয়, যার প্রতিটা কাজেই তড়িঘড়ি করতে দেখা গেছে। যিনি অতি সহজেই ডি গলের মন্ত্রীসভার একজন সভ্য হতে পারতেন অথচ তাকে এখন দেখা যায় জাতিসংঘের নীল সাদা মার্ক পতাকা হাতে নিয়ে হেড অফিসে গিয়ে নিরপেক্ষতার জন্য দৌড়াদৌড়ি করছেন। হাস্যকর ব্যাপার বটে! তার প্রতিদিনের কাজের মধ্যে প্রধান কাজটা হলো কনসোল প্রতিনিধিদের সাথে মিনিটে মিনিটে আলোচনা করা যাতে একটা উপায় বের হয় যে কিভাবে এই আটকে পড়ে যাওয়া নারী ও শিশুদের বের করে নিয়ে যাওয়া যায়।

আরেকটা অভিযোগ সবসময়ই উঠছে যেটা আসলেই বন্ধ করা দরকার সেটা হলো ত্রানবাহী ভারতীয় বিমান গুলো ঢাকা থেকে কলকাতায় ত্রান আনা নেয়া করছে। তাদের দাবি তারা “বাংলাদেশ” নামক রাষ্ট্রকে গুরুত্বের সাথে সহায়তা করছে। সুতরাং এই সব কারনে আমরা প্রায় এক সপ্তাহ যাবত যুদ্ধ এলাকা ছাড়তে চাইলেও ছাড়তে পারছি না। আজ সকালে জাতিসংঘের ভবন থেকে কিছুটা দূরে ভারতীয় বিমান থেকে বোমা হামলা চালানো হয়েছে।

কিছুক্ষন পর হেনরি ও তার সহকর্মীরা জাতিসংঘের স্থানীয় অফিসটা বন্ধ করে দেবার জন্য নিউইয়র্কে বার্তা পাঠিয়েছে।

চারিদিকে প্রচুর গুজব ছড়িয়ে আছে এবং এখনো ছড়াচ্ছে। এগুলো মূলত ছড়াচ্ছে ভারতীয় রেডিও চ্যানেল গুলা থেকে। দুই দিন আগে পাকিস্তানী এক কমান্ডারকে নিয়ে একটা মারাত্বক গুজব ছড়ানো হয়েছিল। গুজবটা ছিল কোন এক রাতে জেনারেল নিয়াজি ছোট একটা বিমানে করে ঢাকাতে চলে গেছেন। খবরটা শুনেছিলাম দিল্লি থেকে প্রচারিত একটা রেডিও সংবাদে।

কিন্তু গুজব সত্য বলে প্রমাণিত হয় যখন নিয়াজীকে আজই ঢাকার রাজপথে দেখলাম। তার গাড়িটা মাঝখানে আর চারিপাশে তার আত্নরক্ষার জন্য এসকর্ট দিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমার বিশ্বাস নিয়াজী তার সাহসের জন্য কখনোই তিরোস্কৃত হননি। তিনি রিবন দিয়ে মোড়ানো একটি সামরিক ক্রস পরে ছিলেন যা তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের সাথে যুদ্ধ জয়ের পর অর্জন করেছিলেন। দ্বিতীয় ব্যাপারটা হলো মেজর জেনারেল ফরমান আলী খান গত সপ্তাহেই কয়েকবার সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন। এখানে এখন ছোট-গ্রুপ থেকে শীর্ষ প্রশাসনিক পদাধিকারীরা চব্বিশ ঘন্টাই নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তারা আসলে কি কাজ করছেন এই ব্যাপারে মনে হচ্ছে তাদের কিছুই বলার নাই। এইসব কর্মযজ্ঞে তারা অনেকেই খুশি না।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৭৮। সাত কোটি মানুষের যুদ্ধ সানডে টাইমস ১২ ডিসেম্বর ১৯৭১

Abdulla Al Asif
Razibul Bari Palash
<১৪, ১৭৮, ৪৪১-৪৪৮>

পাকিস্তান ৭ কোটি মানুষের সাথে জুয়ার যুদ্ধে হেরে গেছে
সানডে টাইমস
১২ ডিসেম্বর, ১৯৭১
“সানডে টাইমসের বাংলাদেশের রক্তাক্ত জন্মের সংবাদ থেকে নেয়া”

প্রথম দিন
ঘটনার প্রথম থেকেই শুরু করি। তিন খন্ড নাটকের শুরুটা হয়েছিল ১৯৪৭ সালের বিয়োগান্তক দেশ বিভাজনের মাধম্যে। প্রথম ভাগের পর্দা উঠেছিল ২৫ মার্চে, যখন পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ও মানুষকে দমন করতে চেয়েছিল। দ্বিতীয় ভাগ শুরু হয় ২২ নভেম্বর, যখন ভারতীয় সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামী গেরিলা, মুক্তিবাহিনীর সাহায্যের জন্য সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছিল এবং এককাতারে এসে যুদ্ধ শুরু করেছিলো।

নাটকের তৃতীয় দৃশ্যের অবতারনা হয় যখন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সব ফ্রন্ট থেকেই যুদ্ধ শুরু হয়। ভারত পাকিস্তানের সাড়ে আটষট্টি কোটি লোক কারাকোরামের পাদদেশ থেকে গ্রেট ইন্ডিয়ান মরুভূমি, সিন্ধু সেচের কৃষিজমি থেকে পদ্মার জলমগ্ন দ্বীপপুঞ্জে পর্যন্ত যুদ্ধ যুদ্ধ রবে জেগে ওঠে।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা জরুরী অবস্থার ভিতরে মুরে শায়লি রাওয়ালপিন্ডি থেকে রিপোর্ট করেছে। সেনাবাহিনীর ভিতরে বহু উপর পর্যায়ের সেনা কর্মকর্তা পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় আগ্রাসনের ব্যাপারে জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে চাপ দিয়েছে।

পূর্ব পাকিস্তানে নিযুক্ত কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমিন আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী বলেছিলেন যে, তিনি ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদেরকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন। সেই সময়ের মধ্যে বর্ষা মৌসুম শুরু হবে সাথে নদীর পানি ফুলে ফেপে উঠবে। যা তাদের সৈন্যদেরকে কিছুটা হলেও মুক্তিবাহিনীর আক্রমন থেকে সুরক্ষিত রাখবে। সে সময় নিয়াজী আরো বলেছিলেন যে, রাজনৈতিক ভাবে কিছু স্ট্রেটেজি নেয়া হবে যাতে করে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা গ্রামাঞ্চলে তাদের সমর্থন ও জনপ্রিয়তা হারানো শুরু করবে। সেখানে কি কৌশল ঠিক করা হয়েছিল আশা করি তা আমরা কিছুদিনের মধ্যেই দেখতে পাবো। তাদের এই কৌশলে কিছু ব্যাপার আছে যা হতে পারে কফিনের শেষ পেরেক ঠোকার মতোঃ তবে যুদ্ধের শেষে বোঝা গেলো যে তাদের কৌশল একটা ভুল ধারনার উপর ভিত্তি করে করা যা আসলে এখন প্রমাণিত হয়েছে।

জেনারেল নিয়াজী তার সেনাবাহিনীকে অতিরিক্ত সৈন্য ও গোলাবারুদের সরবরাহ ছাড়াই আগামী ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু তার দেয়া আদেশটা ছিল অনুমানের উপর ভিত্তি করে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার একটা পন্থা। তার ধারনাটা ছিল ভারতীয় বাহিনী সীমান্ত বরাবর মর্টার হামলা ও মুক্তিফৌজ গেরিলাদের সাহায্য করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

কিন্তু পাকিস্তানের প্রতি পূর্ব পাকিস্তান ইস্যুতে ভারতীয় চাপ বৃদ্ধি পেতেই থাকে এবং এক পর্যায়ে ২২ নভেম্বর থেকে ভারত প্রকাশ্যে যুদ্ধে যোগ দেয়। এই ঘটনার পর স্বল্প সংখ্যক পাকিস্তানী সেনার পক্ষে গুলি চালু রেখে ভারতীয় সেনা ও গেরিলাদের ঠেকিয়ে রাখাটা গোলাবারুদের অপচয় ছাড়া আর কিছুই ছিল না। বুধবার ১ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজী ইয়াহিয়া খানকে রিপোর্ট করেন যেভাবে গোলাবারুদ ব্যবহার হচ্ছে তাতে স্টক এক সপ্তাহের বেশী স্থায়ী হবে না।

* হেনরি ব্রান্ডন; নিকোলাস ক্যারল; গডফ্রে হজসন দ্বারা সম্পাদিত
একই দিনে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত সেনাদের কাছে একটা লিখিত আদেশ গিয়ে পৌছায় যে, যেভাবেই হোক গোলাবারুদের অপচয় রোধ করতে হবে এবং প্রতিটা গুলির সদ্বব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এটা এমনই এক আদেশ ছিল যাতে পূর্ব পাকিস্তানে নিয়োজিত সেনাদের মনোবল ধরে রাখা যায়। যা আসলে ছিল পাকিস্তানী জেনারেল কতৃক একপ্রকারের আত্নসমার্পনের বহিঃ প্রকাশ।
দ্বিতীয় দিন: পাকিস্তানের ব্যর্থতা দ্রুত ঘনিয়ে আসছিলো

দ্বিতীয় দিনঃ

কলকাতার একটা সংক্ষিপ্ত সফর শেষে মিসেস গান্ধী কলকাতা থেকে দিল্লি ফিরে আসেন এবং শনিবার মধ্যরাতের কিছু সময় পর তিনি সংবাদটা পান। তিনি রেডিওব্রডকাস্টের মাধ্যমে বলেন, ভারত একটি মারাত্বক যুদ্ধের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। পরের দিন সংসদেও একই কথা বলেছিলেন তিনি।ভারতের রাজনীতিবিদরা সংসদে বসে টেবিল চাপড়ে এবং পূর্ন উদ্যমের সাথেই তড়িঘড়ি করে প্রতিরক্ষা বিল পাস করে, যাতে মিসেস গান্ধীর হাতে জরুরি ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল।

তৃতীয় দিনঃ পশ্চাৎধাবন করো অথবা মুক্তিবাহিনীর হাতে মরো

রোববার ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটা ছোট কৌশল পরিবর্তন, পূর্ব ফ্রন্টে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত দুর্গ দখল করতে সাহায্য করেছিল। ঐ দিন ঢাকাতেই দুটো সাঁড়াশি আক্রমন চালানো হয়েছিল।

যত দ্রুত সম্ভব প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকাকে দখল করা ছিল ভারতীয়দের অন্যতম উদ্দেশ্য। এবং তারা গোটা পূর্ব পাকিস্তান কে সামরিক ভাবে দুটো অংশে ভাগ করতে চাইছিল। যার দুটো পাশেই থাকবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিচ্ছিন্ন কিন্তু আত্বরক্ষায় মগ্ন সেনাদের দল। এই পরিকল্পনাটা মুক্তিফৌজ বা ভারতীয় সেনাদের পিছু হটতে কিংবা সহজেই ঢাকাকে দখল করতে সাহায্য করত। যুদ্ধের শেষের দিকে গোটা পরিকল্পনাটাই পূর্ব পাকিস্তানের সর্বনিন্ম ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে হটাতে সাহায্য করেছিলো। ভারতীয়রা আশা করেছিলো, এই কম ক্ষয়ক্ষতি অথচ বিজয় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে তার অর্থনৈতিক পুর্নগঠনে সাহায্য করবে।

কুমিল্লার লাকসাম রেল জংশনের চল্লিশ মাইল দক্ষীনে একটা ভারতীয় সেনাবাহিনীর দল সীমান্ত পার হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের ভিতরে ঢুকে পড়ে। ঢাকা থেকে দাউদকান্দি পর্যন্ত সোজাসুজি একটা রাস্তা আছে এবং নদী পথে পূর্ব ঢাকা থেকে যার দূরত্ব মাত্র ২২ মাইল। এসব এলাকায় ভারতীয় বিমান সেনার অভিযানে হানাদার দখল মুক্ত হয়। এই এলাকা গুলোতে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর দ্বারা কোন কৌশলী বিমান আক্রমন হয় নি। ভারতীয় বিমান বাহিনী দাবি করেছিল যে তারা পূর্ব পাকিস্তানে থাকা চারটি বাদে সব গ্রাউন্ড স্টেশন ধ্বংস করে দিয়েছে। এবং যে গুলো অক্ষত আছে সেগুলো ঢাকাতেই রয়েছে। যে একটা অক্ষত রানওয়ে আছে সেটাও ঢাকা বিমান বন্দরেই রয়েছে।

যশোরে ভারতীয় আর্মি ইউনিট প্রবেশের পর, ৫০০০ থেকে ৭০০০ পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে সরাসরি সম্মুখ যুদ্ধ এড়ানোর জন্য তাদেরকে বাইপাস করে ঢাকা অভিমুখে চলে যাবার সুযোগ করে দেয়া হয়। পূর্ববাংলার পূর্ব সীমান্তে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কিছু অংশ আগরতলা থেকে আশুগঞ্জ অভিমুখে প্রবেশ করে যার পথমধ্যেই ঢাকা অভিমুখী একটা প্রধান সেতু ছিল।

চট্টগ্রাম ছিল করাচি থেকে পূর্ব পাকিস্তানে আসা সকল সরবরাহের পূর্ব টার্মিনাল যা ভারতীয় বিমানবাহী রণতরী বিক্রান্ত তে থাকা সেনাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছিলো। এবং চট্টগ্রামের সাথে ঢাকা ও প্রদেশের উত্তর অংশে যোগাযোগের জন্য রাস্তা ও রেললাইন যা প্রচন্ড ভাবে পাকিস্তানী সেনাদের ক্ষয়ক্ষতির হুমকিতে ছিল সেগুলোও ফেনী অভিমুখে থাকা ভারতীয় সেনাদের কিছু ইউনিট সুরক্ষা দিয়েছিলো। কুমিল্লা ও ফেনীর মধ্যবর্তী স্থানের বসানো হয়েছিলো একটা কমিউনিকেশন স্টেশন।

চতুর্থ দিনঃ ট্যাংক গুলোর প্রবেশ এবং কিছু শকুন

৬ ডিসেম্বর সোমবার, ভারত দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর “বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের” স্বীকৃতি দিয়েছিল। মিসেস গান্ধী ভারতের লোকসভাতে এমপিদেরকে জানান যে, “পাকিস্তান বাংলাদেশের জনগণকে তাদের অধীনে ফিরিয়ে নিতে সম্পূর্ণভাবে ব্যার্থ হয়েছে। এখন পাকিস্তান ভারতের সাথে একটা চাপানো যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে, স্বাভাবিক দ্বিধাতে ভুগে আমরা যদি এখন কিছু না করি তাহলে আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধে হস্তক্ষেপের কোন মানেই থাকবে না। পাকিস্তান স্বাধীনতার সূচনা লগ্নেই ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় শত্রুতার জেরে ভারতের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে সকল কূটনৈতিক সম্পর্ক বন্ধ করে দিয়েছিল। এদিকে পূর্ব পাকিস্তানে, ভারতীয় সেনাদের দ্বারা ফেনী পতনের পর থেকে চট্টগ্রামের সাথে ঢাকার যোগাযোগের সকল রাস্তা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গেছে। ভারতীয়রা এখন আশুগঞ্জ ও দাউদকান্দির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে যেখানে মেঘনা নদী পার হয়েই তারা ঢাকাতে হামলা করতে পারবে বলে আশা করছে।

ষষ্ঠ দিনঃ পাকিস্তানীদের মনোবল তাদের জুতোতে এসে ঠেকেছে

বুধবার ভারতীয় বিমান করাচিতে প্রচন্ড বোমাবর্ষণ করেছে এবং একই সাথে রাশিয়ার তৈরী ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্রবাহী জাহাজ গুলোও সমুদ্র থেকেও করাচীতে বোমাবর্ষন করেছে। যা তিনটি মালবাহী জাহাজকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে তাদের ভিতর একটা ব্রিটিশ জাহাজও ছিল। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানই এখনো ভারতীয়দের যুদ্ধ জয়ের বিশ্বাসের জায়গা হয়ে রয়েছে। একটা ছোটখাটো ভুল বোঝাবুঝির কারনে আমাদের সাংবাদিক ফিলিপ জ্যাকোবসন ও তার ফটোগ্রাফার কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে রয়েছে। পেনি টুইডির সাথে অন্য তিনজন সাংবাদিক যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় সাফল্য দেখার জন্য সেনাবাহিনীর অনুমতি ছাড়া আবার সীমান্ত পার হতে গিয়ে যশোরের কাছে ধরা পড়েছে। যশোর জায়গাটা পাকিস্তানি ১৬ তম ডিভিশনের সদর দপ্তর ছিল, এবং পূর্ব পাকিস্তানের সমগ্র পশ্চিম সীমান্তের সবচেয়ে শক্তিশালী দূর্গ বলে পরিচিত ছিল। জ্যাকবসন বোঝার চেষ্টা করেছিল যে কেন সেখানকার পাক-সেনাদের প্রতিরোধ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। যশোরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতিরোধ শক্তি ভেঙ্গে পড়াটা পুরো পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধের সবচেয়ে বড় একটা ধাধা ছিলো। পুরো সপ্তাহ ধরেই , ভারতীয় সেনাবাহিনীর সূত্র এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞ পর্যবেক্ষকরা পূর্বাভাষ দিয়েছিলেন যে, যশোর সেনানিবাসের বিশাল সামরিক এলাকা ও পার্শবর্তী যশোর শহরের আশেপাশের এলাকা গুলো দখল করতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। গত সপ্তাহের শুরুতেই ভারতীয় গোয়েন্দারা রিপোর্ট করে যে, যশোর সেনানিবাস রক্ষায় একটি সম্পূর্ণ পদাতিক ব্রিগেড নিয়োজিত আছে যাতে ভারী কামান, ৪০ টা ট্যাংক, গোলক ধাধার মতো মাইন ফিল্ড, কনক্রিটের বাংকার, ট্যাংক ধ্বংসকারী কামান সমেত প্রায় ৫০০০ সেনা ও আফিসার রয়েছে। সমস্ত পূর্বাভাষই ছিল পাকিস্তানিদের পক্ষে এবং বলা হচ্ছিল তারা দাঁড়িয়ে থাকবে এবং প্রচন্ড যুদ্ধ হবে। শুধু ৯ম ডিভিশনের এক দৃঢ় প্রতিজ্ঞ কমান্ডিং অফিসার কর্নেল পি এস দেশপান্ডে বলেছিলেন যে, তারা পালিয়ে যাবে। কিন্তু ২৪ ঘন্টারও কম সময়ের ভিতরে ভারতীয় ট্যাঙ্ক ও পদাতিক বাহিনী অনেকটা সুবিধা করে নিয়েছিলো অথচ তারা ভেবেছিলো, এত কিছু দখল করতে তাদের ১ সপ্তাহের চেয়ে বেশি সময় ধরে তীব্র লড়াই চালাতে হবে। আক্ষরিক অর্থে, একটি গুলি ছোড়া ব্যাতিত যশোরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন সামরিক স্থাপনা হিসাবে যশোর বিমানবন্দর দখল করা হয়েছে। এই খবর পাওয়ার পর কর্নেল দেশপান্ডে উল্লাসিতভাবে বলে উঠেছিলেন, “এখন এক দফা হয়ে যাক”। এই বিস্ময়কর পতনের অনেক গুলো কারনের মধ্যে অন্যতম কারনটা হলো বাংলাদেশে থাকা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মারাত্বক শৃঙ্খলার অভাব। গত সপ্তাহ জুড়ে,পাকিস্তানী সেনা ইউনিট বিনা প্রতিরোধেই বিভিন্ন জায়গায় আত্নসমার্পন করেছে। কমলাপুরে, ৩১ বেলুচ রেজিমেন্ট যারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সবচেয়ে ভালো যোদ্ধা বলে পরিচিত তাদের ১৬০ জন, গুলি ছোড়া ছাড়াই আত্নসমার্পন করেছে। কুমিল্লার কাছে, ২৫ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স, যারাও ভালো যোদ্ধা বলে পরিচিত ছিল তাদের কমান্ডিং অফিসার ১০০ জন সৈন্য সহ ভারতীয় প্লাটুনের কাছে আত্নসমার্পন করেছে। রেলওয়ে যুদ্ধের কৌশলগত আখাউড়া শহর, যা ঢাকা প্রতিরক্ষায় একটি অত্যাবশ্যক স্থাপনা বলে বিবেচিত ছিল। যেখানে অতিরিক্ত সেনা, অস্ত্রশস্ত্র ও ভারী কামান মোতায়েন করে রাখা হয়েছিল, তা ভারতীয় সেনা ও গেরিলারা নামে মাত্র যুদ্ধ করেই দখল করে নিয়েছিলো।
এটা আসলে কেন হয়েছিল সেটা বলা মুশকিল কিন্তু কর্নেল দেশপান্ডের করা প্রাণবন্ত উক্তির মধ্য দিয়ে তা সবচেয়ে ভালো ভাবে প্রকাশ করা যায়। তিনি বলে ছিলেন, পাকি সৈন্যদের মনোবল এখন তাদের বুটের নীচে গিয়ে ঠেকেছে। “ গত পনেরো দিন আগে থেকেই পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর উর্ধতন কর্মকর্তারা তাদের স্ত্রী ও পরিবার নিয়ে ঢাকা থেকে দূরে চলে গেছিলেন। অসমর্থিত সূত্র থেকে একটি গুজব শোনা যাচ্ছিলো যে, সেনা ও তাদের পরিবারকে পশ্চিম পাকিস্তানে বিশেষ ফ্লাইট যোগে নিয়ে যাওয়া হবে যাতে তারা নিরাপদে দেশে ফিরে যেতে পারে।

পাকিস্তানী দেনারা ইতিমধ্যে এই ফ্লাইট সম্পর্কে প্রচুর দুশ্চিন্তা করছিল। ভারতীয়দের বোমারু বিমান গুলো পাকিস্তানী অবস্থান চিহ্নিত করে বোমা ফেলেই চলেছিল আর লাউডস্পিকার, লিফলেট, এবং রেডিও সম্প্রচারের মাধ্যমে একটি সহজ কিন্তু অনমনীয় বার্তা বলেই চলেছিল। বার্তাটি ছিল:
“মুক্তিবাহিনী (বাংলাদেশ গেরিলা) ধরার পূর্বে আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করো।”

কিছু ভয়ঙ্কর ঘটনা ইতোমধ্যে ঘটে গিয়েছিল এবং তা ঘটেই চলেছিলো। ভারতীয় সেনারা পূর্ব পাকিস্তানে আসার আগেই মুক্তিবাহিনী নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে কিছু পাকিস্তানী সৈন্যের লাশ এদিক সেদিক পড়ে থাকতে দেখা গেছিলো অথবা নদীতে ভাসমান অবস্থায় পাওয়া গেছিলো।
গত সপ্তাহের যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর দৃশ্যমান অগ্রগতি ছিল যে তারা শুধুমাত্র পাকিস্তানী সেনাদের শৃঙ্খলাভঙ্গ করে দিয়েছিলো। কয়েক জায়গায়, তারা সাহসের সঙ্গে লড়াই করেছিল। ভারতীয় সেনারা পার্বত্য অঞ্চল গুলোতে প্রচন্ড নিশ্চুপ ছিল যেখানে পাকিস্তানি বাহিনীর খুবই নগন্য এবং সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন একটি প্রতিরোধ যুদ্ধের আশঙ্কা করা হয়েছিলো।

যশোর কাছাকাছি, সেখানে দুদিক থেকে (ভারতীয় এবং মুক্তি বাহিনী) একটি প্রতিরোধ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। যশোরের নিয়ন্ত্রন নেবার জন্য কর্নেল দেশপান্ডের অতি উৎসাহ থাকা সত্ত্বেও তারা শহর ও সেনানিবাস উপর হঠকারীভাবে হামলা করে বসে।

এটা স্পষ্ট যে, পাকিস্তানীরা ভারতীয় অগ্রগতি সম্পর্কে অত্যান্ত খারাপভাবে মূল্যায়ন করেছিলো। যশোর শহর ও সেনানিবাস আক্রমনের জন্য অপারেশন রুমের ম্যাপে ভারতীয় অবস্থানের চার্টটা যারা দেখেছিলো তাদের বক্তব্য ছিলো, তারা আরেকদিনের জন্য একটি পূর্ণমাত্রার আক্রমণ প্রত্যাশা করে নি। যা হবে তা আজই চুকিয়ে ফেলতে হবে।

বুধবার ৪ঃ২০ মিনিটে যখন দ্রুতগতিতে জায়গা খালি করা শুরু হলো, তখন ভারতীয়রা ছিল ৬০০০ গজ দূরে। পাকিস্তানিরা এত তড়িঘড়ি করে সেদিন ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে চলে যায় যে, ঐ দিনের কমান্ড ও অন্যান্য কাগজপত্র ও জেরক্স মেশিনের মধ্যে পাওয়া গেছিল। সেখানকার অফিসার্স মেসে অর্ধ প্রস্তুত খাবারও ছিল।

অধিকাংশ পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে গেছে বলে মনে হয়েছিল। যদিও কেবল খুলনায় সড়ক বরাবর সন্দেহজনক নিরাপত্তা বলয় তখন ও চালু ছিল এবং তারা সেখান থেকে চলে যাবার সময় সাথে করে তাদের আর্টিলারী গুলো ও নিয়ে গেছিলো। এই আর্টিলারী গুলো সম্ভবত সেনানিবাসের কয়েল মাইল পিছনে ছিল এবং সেগুলো রক্ষা করা তাদের জন্য সবচেয়ে সহজ ছিল। আমি ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে শুধুমাত্র একটা পাকিস্তানি ট্যাংকের ধবংসাবশেষ নিজেই দেখেছি যা তখনও পুড়ছিল। পাকিস্তানিরা চলে যাবার সময় তাদের প্রায় ৬০০০ টন গোলাবারুদ এবং সাধারণ সরবরাহ পিছনে ফেলে গেছিলো যা পালানোর সময় তাদেরকে মারাত্বক আত্নদ্বন্দে ভোগাবে বলে মনে করি।

আমরা যশোর পৌঁছানোর পর সবচেয়ে উদ্ভট যে জিনিসটা দেখেছিলাম তা হলো সেনানিবাসের গেইট। কলকাতা থেকে ৮৫ মাইল এবং ৫ ঘন্টার একটা নিরবিচ্ছিন্ন ভ্রমন শেষে আমরা সেখানে পৌছেছিলাম একটা ক্ষীণ হলুদ ট্যাক্সিতে করে। আমরা পেট্রাপোলের সীমান্ত পোস্টে পৌছানোর পরেই দেখেছিলাম উৎফুল্ল জনতা সেখানে ভীড় জমিয়েছে। সেখান থেকে যশোর 25 মাইল দূরে। পুরো রাস্তা জুড়ে ছিল জনতার হর্ষধ্বনি সঙ্গে গ্রামবাসীর হাতে ছিল রেখাযুক্ত নতুন লাল, সাদা, স্বর্ণ ও সবুজ খচিত বাংলাদেশের পতাকা। তাদের গলায় জোরে জোরে ধবনিত হচ্ছিল সেই পরিচিত “জয়বাংলা” শ্লোগান। বাংলাদেশ যে এখন বিজয়ী, সেটাই ফুটিয়ে তোলা হচ্ছিল গ্রামবাসীর জোর গলায়।

সুন্দর ও নেশা ধরানো সবুজ বেষ্টিত গ্রামাঞ্চলের মধ্য দিয়ে গাড়ী চলার সময় মনে হচ্ছিল ধান গাছ মন্ডিত গাঢ় সবুজ একটি দাবার ছক।বাদামী পানি এবং উজ্জ্বল গাছপালা সবই যেন সাক্ষ্য দিচ্ছিল পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পশ্চাদপসরণ করেছে। আরো লক্ষ্য করলাম একেকটি গোপন বাংকার যেন যুদ্ধ করা ছাড়াই পরিত্যক্ত অবস্তায় পড়ে আছে এবং বাংকার গুলোতে প্রায়ই তাদের ফেলে যাওয়া অস্ত্রসস্ত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো।
আশ্চর্যজনক ভাবে ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারদের চোখে দৃষ্টিগোচর হয় যে, অপসৃত পাকিস্তানি সৈন্যরা বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকার অত্যাবশ্যকীয় পিচের রাস্তা এবং রাস্তার মাঝে গর্তও করে রেখেছিলো। এমনকি চলার পথের সেতু গুলোও ধবংস করে রেখে গেছে। নাভারনের বেতনা নদীর ওপর একটি সেতু ও পাকিস্তানীরা ধবংস করে রেখে যায়। পরে ভারতীয়রা এসে একটা বাইপাস রাস্তা তৈরীর মাধ্যমে সারাদেশের সাথে যোগাযোগ পুনঃস্থাপনে সক্ষম হয়। সেনাবাহিনীর কয়েকটি লরিতে ইট ও মাটির গুড়া এনে খারাপ রাস্তা গুলোকে সংস্কার করার জন্য দিনরাত কাজ করতে থাকে এবং অবশেষে রাস্তা আবার চালু করা হয়।

ঝিকরগাছাতেও একই ব্যাপার চোখে পড়ে। আমরা একটি নতুন প্রথম উদ্বেগজনক কিছু প্রমাণ পাই। এটা ছিল বাংলাদেশ নামক দেশ হওয়ার আগেই যে হত্যা ও গনহত্যা হয়েছে তার নমুনা ছিল এবং যা ছিল মারাত্বক অস্বাভাবিক। একটা রেল ট্রাকের উপরে তিনটি অল্পবয়সী পুরুষের লাশ বোঝাই করা ছিলো। যাদের প্রত্যেকের গায়েই ছিলো কাদামাখা স্কার্টের মত লুঙ্গি। তাদের চোখ ছিল বাঁধা, হাত ও পা পেছন দিক দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিলো।তাদের গলা কেটে জবাই করা হয়েছে এবং রক্ত বাদামী মাটিতে পড়ে জবজব করছিলো।

গ্রামবাসী জানায়, মৃত ব্যক্তিরা ছিলো পাকিস্তানীদের সহযোগী ও বিশ্বাসঘাতক যারা পাকিস্তানি সেনাদের ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও হত্যার সাহায্য করেছিলো। তবে, কেউ মুক্তিবাহিনীই যে তাদেরকে হত্যা করেছে সে কথাটা কাউকে বলতে শুনিনি। গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে, ক্রমাগত গুজব শোনা যাচ্ছিলো যে, মুক্তিবাহিনী তাদের নিজেদের বিবেচনার উপর বাংলাদেশের সাথে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তাদের উপর এক ভয়ানক প্রতিশোধ নিচ্ছে। অন্ধকার গুজব শোনা যাচ্ছে ক্যাঙ্গারু টাইপের আদালতে বিচারের পর দোষী ব্যাক্তিদেরকে সাথে সাথেই মৃত্যুদন্ড দেয়া হচ্ছে। তা সত্ত্বেও, বাংলাদেশের অন্যান্য অনেক জায়গা মত, ঝিকরগাছাতে এই ধরনের প্রতিশোধের যথেষ্ঠ কারন আছে। কারন কেউ কেউ বলছে গত সপ্তাহে যখন পাকিস্তানীরা পালিয়ে যাচ্ছিলো, সেই সময় তারা ১০০ জন গ্রামবাসীর উপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল।

৭ম দিনঃ যশোরের রণাঙ্গন থেকে
খুলনা সড়ক, একটি প্রধান নদীবন্দর এবং পূর্ববাংলার সবচেয়ে বড় শহর যশোর ও যশোর সেনানিবাসের নিয়ন্ত্রন নেওয়ার পর ভারতীয় সৈন্যরা যুদ্ধচালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর ছিলো। সে সময় ফিলিপ জ্যাকবসন তাঁদের সঙ্গে ছিলেন:

যশোরের “দুর্ভেদ্য” অবস্থান থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিভীষিকাময় পশ্চাদপসরণ চিহ্ন শহর জুড়েই বোঝা যাচ্ছিল। আলকাতরা-মেশান নুড়িরাস্তা বিক্ষত হয়েছিল এবং মেশিনগান বুলেট এবং রকেট দ্বারা আশেপাশের দেয়াল ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলো। এক ডজন পোড়ানো-জিপ এবং লরি পরিখা মধ্যে পড়ে ছিলো। পাকিস্তানি নিয়মিত সেনাদের অদ্ভুত ও নিথর দেহ গুলো জানান দিচ্ছিল তাদের অন্তর্বেদনার ভঙ্গি। কিছু মৃতদেহ পুড়ে গেছিলো এবং কালো হয়ে গেছিলো; অন্যদের দেহগুলোতেও ছিল ভয়ানক ক্ষত। মাছি গুলো লাশকে ঢেকে ফেলেছিলো।

যুদ্ধ শুরু হওয়া পর্যন্ত এই ৮ নং সেক্টরের তারাই ছিল প্রথম মৃত পাকিস্তানি সৈন্য যাদেরকে আমরা এই অবস্থায় দেখলাম। তারা মূলত ভারতীয় ট্যাঙ্ক এবং জেট দ্বারা আক্রান্ত হয়ে যশোর সেনানিবাসের আশেপাশে মরে পড়েছিলো। তারা তাদের গাড়ি ছেড়ে এবং পরিখার দিকে উদ্দেশ্যহীনভাবে দৌড়ে পালিয়েছিল। মৃতদেহের চারপাশে স্থানীয়দের প্রচন্ড ভিড় দেখেছিলাম এবং তারা ডান হাত উচু করে একটাই শ্লোগান দিচ্ছিল ‘জয় বাংলা!”।

রাস্তার নিচে আরো একটি মাইল পথ যেখানে রুপদিয়ার কিছু অংশ বিদ্যমান, পাকিস্তানি সৈন্য দের বিলম্বিত পদক্ষেপের দৃশ্য হিসেবে যথেষ্ট অপ্রত্যাশিত ছিল, পেছনে ২000 মানুষ ছিল যাদের মধ্যে যশোরের পদায়িত অফিসারেদের প্রায় ১০০০ স্ত্রী-পরিবার ছিল। ছিটানো কুঁড়েঘরগুলি এখনও জ্বলছে এবং তিনটি বাস যা ব্যারিকেডের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে – সেগুলো বুলেট দিয়ে শেষ পর্যন্ত ঝাঁঝরা করে দেয়া হয়েছে।

আমরা মাদ্রাসি রেজিমেন্টের একটি ব্যাটেলিয়ন-এর সামনে ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাই, ছোটো, লোকগুলো হাসিমুখে আমাদের দিকে হাত নাড়া দিচ্ছিল -আমাদের ফটোগ্রাফার পেনি টুইডি এবং আমি ভারতের ৬৩ তম ক্যাসলির রাশিয়ান নির্মিত টি৫৫ ট্যাঙ্কের করে একটি স্বল্প যাত্রা শুরু করেছিলাম। পাকিস্তানি পজিশনের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য সরু রাস্তা দিয়ে ১০৫ মিলিমিটারের বড় বন্দুক নিয়ে ভারতীয় দের সামনের পয়েন্টে পৌঁছলাম। ১৪৫৫ জনের একটি সম্পূর্ণ স্কোয়াড্রন খুলনা সড়কের পরবর্তী পুশ ডাউনে মাদ্রাসির সমর্থনে একত্রিত হল।

ট্যাঙ্কের ভিতরে আরামে থাকলেও পিছনে ক্রমাগত পাকিস্তানীদের শেলিং এ শব্দে আমি নার্ভাস হচ্ছিলাম। আমাদের আশেপাশেই ১০৫ মি মি বন্দুকের থেকে আক্রমণ আসছিল। আমরা দেখলাম ভারতীয় বাহিনী খুব সাবধানে পাকিস্তানীদের অবস্থান জানার চেষ্টা করছিল। সামনে সম্ভবত ২৭ বালুচ রেজিমেন্টের এক কোম্পানি পাকিস্তানী ইনফ্যান্ট্রি ছিল। তারা মেশন গান ওঁ মর্টার থেকে গুলি করছিল। শত গজ দূর থেকেও হাল্কা অস্ত্রের গুলির আওয়াজ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল।

শেলিং করে পাকিস্তানিদের সরাতে ব্যর্থ হলে স্থানীয় কমান্ডার লে নরেনজিয়ার-একজন মর্যাদাবান, অযাচিত মাদ্রাজি-এয়ার সাপোর্টের জন্য কল করার সিদ্ধান্ত নিলেন। রেডিওতে দ্রুততার সাথে জানানো হল – ম্যাপ চেক করা হল।

সবাই আশা নিয়ে ঊর্ধ্বমুখী তাকাল। কিছুক্ষণ কিছু ঘটেনি। তারপর, খুব হঠাৎ, ভারতীয় বিমান বাহিনীর দুই রাশিয়ান এস ইউ ৭ নীল আকাশে দেখা গেল। কয়েক মিনিট তারা চক্কর দিল। যেভাবে শিকারের জন্য চিল ঘুরতে থাকে।

তারপর, একটি ট্যাংক থেকে নীল ধোঁয়া সম্পন্ন শেলিং করা হল – তারা খাড়া ডাইভ দিল – সোজা – একদম গাছের মাথার লেভেলে। আমি ৩০ ক্যালিবারের মেশিন গান থেকে আলোক ছটা দেখতে পেলাম। জেট থেকে পাকিস্তানী অবস্থানে গুলিবর্ষন করা হচ্ছিল।

যখন বিমানগুলো কলকাতার দিকে চলে যাচ্ছিল তখন পাকিস্তানী অবস্থান থেকে কোন গুলির আওয়াজ আসছিলনা। আবার ট্যাঙ্ক আগাতে লাগল। উজ্জ্বল হলুদ শর্শে খেতের ভেতর দিয়ে সেগুলো এগিয়ে চলল। পেছনে মাদ্রাজি ইনফ্যান্ট্রি। কর্নেল নারেগিয়ান তার কমান্ড জিপ থেকে জানালেন খুলনা শেষ।

দিন ৮: ০১১ রাজধানীর কাছাকাছি
শুক্রবার পাকিস্তানের আশা শেষ হতে লাগল। পূর্বদিক থেকে ভারতীয় সৈন্যরা ঢাকার দিকে আগাতে লাগল। সেখানে বাঙালিরা অপেক্ষা করছিল। আর সেখানে বিহারী ও পাঞ্জাবি মুসলিমরা ভয়ে ছিল। পশ্চিমে পাকিস্তানীদের কাশ্মীরের কাজ আপাতত বন্ধ আছে। এখন পাকিস্তান এর শক্তভাবে সামরিক প্রতিষ্ঠান গুড়িয়ে দেবার সময়। জাতিসংঘের গভর্নর পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক উপদেষ্টা মেজর-জেনারেল রাও ফরমান আলীর কাছ থেকে একটি আপিল গ্রহণ করেন। তিনি কিছু শর্তাবলী দিয়ে যুদ্ধের সমাপ্তির জন্য সাহায্য চান যা পাকিস্তানের হেরে যাবার স্পষ্ট প্রমাণ।

ফরমান আলী জাতিসংঘের পক্ষ থেকে পাকিস্তানি সেনা ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানালে তাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চান। পাশাপাশি তিনি পূর্ব পাকিস্তানে একটি নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উত্থাপন করেন।

তবে নিরাপত্তা পরিষদ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছ থেকে একটি বার্তা এসে পৌঁছানোর কথা বলে ফরমান আলী এর আপিল কথা তেমন গুরুত্বের সাথে দেখে নাই। এবং ঢাকায় গুজব ওঠে যে ফর্মান আলীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, এলএল-জেনারেল এএ কে নিয়াজি – জিওসি ইস্টার্ন কমান্ড, দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন – তিনি ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে সবার সামনে এসে সে গুজব ভেঙ্গে দেন। “আমি এখানে আছি – আল্লাহর ইচ্ছানুসারে আমার সৈন্যবাহিনী কমান্ড করছি”, তিনি বলেন। “এবং আমি কখনও তাদের কাছে সমর্পিত হবনা।”

ঢাকার কমান্ডিং জেনারেল ফরমান আলীকে জেনারেল স্যাম মানেকশো তার ব্যক্তিগত রেডিও বার্তায় আত্মসমর্পণ করার পরামর্শ দেন: “প্রতিরোধ করলে অযথা অনেক সাধারণ সৈনিকের মৃত্যু হবে।” – তিনি জানান।

ম্যানেকশো অতিরঞ্জিত কিছু করেননি। ভারতীয় সৈন্যরা পশ্চিম থেকে ঢাকায় ঢুকেছে ও উত্তর থেকে এসে মেঘনা নদীর তীরে তাদের প্রথম অবস্থান তৈরি করে। সৈন্যদের আশুগঞ্জে হেলিকপ্টার দিয়ে নদী পার করে আনা হচ্ছে। এটি ঢাকা থেকে মাত্র ৪০ মাইল উত্তর-পূর্ব দিকে যেখান থেকে সরাসরি রাস্তা দিয়ে শহরে প্রবেশ করা যায়।

সকালে ও বিকেলে ঢাকায় বোমা বর্ষণ করা হয়-এই সপ্তাহে বেশিরভাগ দিন এমন ছিল। শহরটির বাসিন্দারা বোমা হামলায় অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছিল। বিমানবন্দরের কাছে তারা ২৫০ পাউন্ডের একটি বোমা পায় যেটা আমেরিকার তৈরি।

পশ্চিমাঞ্চলে কাশ্মীরের পাকিস্তানি সেনারা আক্রমণ বাড়িয়ে তুলেছে। পাকিস্তানীদের সাহসী আক্রমণে যেখানে আর্টিলারি ও অস্ত্রসজ্জিত ব্যাটিয়ন ছিল – তারা অগভীর মুনাওয়ার তাভি নদীতে পূর্ব দিক থেকে ভারতীয় বাহিনীকে আক্রমণ করে।

ভারত স্বীকার করে যে, এতে তাদের ব্যাপকভাবে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল এবং পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা চেম্বের এলাকায় হামলা চালায়। একই সময়ে ভারত সম্ভবত জাতিসঙ্গের যুদ্ধবিরতিতে রাজি হতে পাড়ে যখন বাংলাদেশ সরকার স্থাপিত হবে।

দিন ৯: এক্ট ৩ শেষ

গতকাল, এটি স্পষ্ট ছিল যে এক্ট-৩ শেষ। পাকিস্তানি সৈন্যরা দলে দলে আত্মসমর্পণ করতে শুরু করেছে।

ভারতীয় বাহিনী শেষ বড় জলের বাধা অতিক্রম করেছে, ইতিমধ্যে ঢাকার চারপাশে আংটির মত ঘিরে ফেলেছে।

পশ্চিমে ভারতীয়রা যুদ্ধক্ষেত্র লাইন বরাবর দ্রুত আগাচ্ছে, যদিও পাকিস্তানিরা তাদের উপর আক্রমণ চালাচ্ছে।

তবে এটি সমানভাবে স্পষ্ট ছিল যে এক্ট -৩ সবকিছুর শেষ নয়।
একটি এক্ট ৪ হতে হবে।

দিল্লিতে, নিকোলাস ক্যারল দেখেছিলেন যে, বাংলায় ভারতীয় সাফল্যগুলির পরে, ভবিষ্যত পরিকল্পনাটি খুব সহজ এবং দৃশ্যত অনিবার্য। ভারতীয় কর্মকর্তাদের মনের মধ্যে একই চিন্তা ভাবনা আছে। পাকিস্তানি সৈন্যদের শেষ পর্যন্ত মারা যেতে হবে। এমনকি যদি ঢাকায় টাইম টেবিল মেনে চলা হয় তবুও তাদের কোন পথ থাকবে না।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায়, শেখ মুজিবের দুই ঘনিষ্ঠ সহযোগী সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দিন আহমেদ যশোরে শনিবার বিকেলে যথাক্রমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হবেন।

পাকিস্তানি বন্দীদেরকে দ্রুত বাড়ি পাঠানো হবে, যদিও কোনো দয়ায় নয় (“কেন আমরা ওইসব বেজন্মাদের খাওয়াব?” একজন সিনিয়র ভারতীয় কর্মকর্তা ক্যারোলকে জিজ্ঞেস করেছিলেন।) ভারত তখন তার সৈন্য প্রত্যাহার করবে।

ভারতীয়রা অনুমান করে চিন কিছুটা ঝামেলা সৃষ্টি করতে চেষ্টা করবে। তারা পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তার চেষ্টা করবে। এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেটা গিলতে অস্বীকৃতি জানাবে এবং ইসরায়েলের মত অবস্থায় থাকতে চেষ্টা করবে।

দীর্ঘমেয়াদে, পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র বাহিনী যে চরম দুর্ভোগে ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের তা বহুদিন বয়ে বেড়াতে হবে।

কিন্তু ৯ দিনের সামরিক সংঘর্ষ শেষ হয়েছে। তবুও পাকিস্তানি বাহিনী এখনও মজুদ সৈন্য আছে তার কমান্ডার আত্ম
বিশ্বাসী ছিল।
ভারতীয় স্ট্র্যাটেজিস্টরা অনুমান করে নিয়েছিল, এবং পাকিস্তানি কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, এক্ট-৪ হতে পাড়ে একটি যবন মৃত্যু আইন। কিন্তু এই সময়ে এক্ট- ৩ এ নামতে হচ্ছে। শনিবারের একটি সংক্ষিপ্ত সময়ের পর, “একটি খুব খারাপভাবে শোনা রেডিও ট্রান্সমিটার নিজেকে রেডিও পাকিস্তান হিসেবে ঘোষণা করে,এখনও বিবিসির মনিটর ঢাকা থেকে তুলে নিতে পারে – রেডিও ঢাকা শেষ পর্যন্ত ম্লান হয়ে যাচ্ছে। বাংলায় পাঞ্জাবি শাসনের শব্দ কোন, “জয়বাংলা!”র আওয়াজে চাপা পরে গেছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৭৯। গেরিলারা এখন ঢাকার ভেতরে টাইমস ১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৭৯, ৪৪৯>

টাইমস, ১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১
গেরিলারা এখন ঢাকার ভেতরে যুদ্ধ করছে
– ডিফেন্স প্রতিনিধি হেনরি স্ট্যানহোপ

কলকাতা, ১২ ডিসেম্বর- ১৮৫ জন ব্রিটিশ নাগরিক সহ মোট ৪৩৫ জন বিদেশী নাগরিক আজ ঢাকা থেকে বিমানে নিরাপদে কলিকাতা পৌঁছেছেন। জানা যায় ভারতীয় সৈন্য শুক্রবার মেঘনা নদী পাড় হয়েছে। তারা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী থেকে মাত্র ২০ মাইল দূরে আছে এবং খুব দ্রুত আগাচ্ছে।

৫ রাত ক্রমাগত বোমাবর্ষনের ফলে ফিরে আসা লোকগুলো খুব ক্লান্ত। তারা জানায় পাকসেনাদের মনোবল একদম ধ্বংস হয়ে গেছে। সেনারা ঠিক মত জানেইনা এ কোন দিকে রওনা দিতে হবে। ইতোমধ্যে প্রায় ১০০০ মুক্তিবাহিনী (বাংলাদেশী গেরিলা) শহরে যুদ্ধ করছে।

ভারতের দুইটি প্যারাসুট ব্রিগেডের একজন লোক জানালেন তারা গতকাল ঢাকার বাইরের ডিফেন্সে যে আক্রমণ করেছেন তার চূড়ান্ত রিপোর্ট এখন জানেন না। তবে ভারত নিশ্চিত করেছে যে পাকিস্তানের কাউন্টার এটাকের বিপরীতে তারা ওদের ভালো রকম ক্ষয়ক্ষতি করেছে।

তিনটি আরএএফ হারকিউলিস পরিবহন বিমান দিয়ে বিদেশীদের সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এগুলোর একটি এখন দ্বিতীয় বারের মত যাত্রার জন্য লোড হচ্ছে। সকল ব্রিটিশ নাগরিকদের সিঙ্গাপুরে নেয়া হচ্ছে। কিন্তু আরও প্রায় ১০০০ জন কলিকাতার হোটেলে আজ রাতে অবস্থান করবেন। তাদের হাতের হাল্কা লাগেজটাই শুধু তাদের সাথে বিমানে নিতে দেয়া হচ্ছে।

সপ্তমবারের মত এবার ঢাকা থেকে বিদেশীদের বেড় করে নিয়ে আসা হল। তারা জানালেন কিছুদিন আগে একটি বিমান হঠাত করে আক্রান্ত হবার কারণে যাত্রা বাতিল হয়েছিল। মহিলা ও শিশুদের কান্নার কোন শেষ ছিলোনা তখন।

তারা জানায় কিছুদিন আগে একটি এতিমখানায় ৫০০ থেকে ১০০০ পাউন্ড বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে যেটি রেলওয়ে থেকে ১০৫ গজ দূরে ছিল এবং পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ জানায় প্রায় ৩০০ ছেলে নিহত হয়েছে। জার্মানির একটি টেলিভিশন ক্যামেরাম্যান বলেছেন যে তিনি ২০ টি লাশ দেখেছেন কিন্তু তিনি বিশ্বাস করেন যে আরো লাশ ধ্বংসস্তুপের নিচে চাপা পড়ে ছিল।

তবে ক্যামেরাম্যান, হের জেনস উই স্কিমার বলেন ঢাকার বেশীর ভাগ অঞ্চল এখনো আক্রান্ত নয় এবং সামরিক অবস্থান তাদের মূল টার্গেট।

রিপোর্টে জানা যায় ঢাকায় প্রায় ২০০০০ থেকে ৩০০০০ পাকসেনা আছে যাদের বিপক্ষে ১০০০ মুক্তিবাহিনী হাল্কা অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।

হের স্কিমার বলেন যে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের বাইরে একটি সাম্প্রতিক সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তানের চিফ অব স্টাফ জানান তিনি শহরের প্রতিরক্ষার ব্যাপারে আশাবাদী। আমাদের চালাক জেনারেলরা তেমন বিপদের সম্ভবনা দেখছেন না। তাই তারা অতিরিক্ত কোন প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে বলে মনে করছেন না।

শহরে এখন অল্প কিছু বিদেশী নাগরিক আছেন। তারা হলেন প্রেস সংবাদদাতারা এবং কিছু রেড ক্রস কর্মী।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৮০-a। ঢাকা ধ্বংসের মুখোমুখি গার্ডিয়ান ১৩ডিসেম্বর, ১৯৭১

Tashrik Mohammad Sikder
<১৪, ১৮০-a, ৪৫০-৪৫১>

গার্ডিয়ান, লন্ডন, মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ১৩, ১৯৭১
ঢাকা ধ্বংসের মুখোমুখি
লি ল্যাস্কাজে থেকে, ঢাকা

ঢাকা ধ্বংস পতনের জন্যে অপেক্ষমাণ একটি নগরী। কেউ জানে না কত ক্ষতি সয়ে এই শহর টিকে থাকবে যখন ভারতীয় সেনাবাহিনী এখানে তার আক্রমণ প্রর্দশন করবে কিন্তু পাকিস্তানি কমান্ডাররা তাদের শহর উপকণ্ঠে এবং পাবলিক বিল্ডিংয়ের অবস্থিত তাদের ক্যাম্প থেকে যতদিন সম্ভব যুদ্ধ করার জন্য দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ।

লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ. এ. কে. নিয়াজি সাংবাদিকদের বলেন, ঢাকায় যে কোন ধ্বংস স্বাধীনতার মৃত্যুর মূল্য হবে। ঢাকায় একটি সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারে সিনিয়র কমান্ডার এখানে আবার অঙ্গীকার করেছেন যে, তার বাহিনীর শেষ সদস্যটি বেঁচে থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ করবে। জেনারেলের কথা শেষ করা মাত্রেই তার চারপাশে জড়ো হওয়া অবাঙালি বেসামরিক নাগরিকদের একটি ছোট দল স্লোগান দিয়ে উঠল “পাকিস্তান জিন্দাবাদ” এবং “ভারত নিপাত যাক্”। তারা ঢাকা অধিবাসীদের মধ্যে কিছু লোক যারা কারফিউর ছয় ঘন্টা বিরতিতে যে রাস্তায় মিছিলের অনুমোদনের সুযোগ ভোগ করছে।

এখানে পারিপার্শ্বিক দৃশ্য অদ্ভুতভাবে শান্তিপূর্ণ ভারতীয় বাহিনীর এগিয়ে আসা সত্ত্বেও। বাসিন্দাদের অনেকেই গ্রামের নিরাপত্তার খোঁজে ঢাকা ত্যাগ করেছেন কিন্তু যুদ্ধের দামামা থেমে থেমে শোনা যায় যা এগিয়ে আসতে থাকা যুদ্ধের কথা থেকে যাওয়া বাসিন্দাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে। বিমানবিধ্বংসী কামান খানিক বিরতিতে খোলা আকাশে ফায়ার করে চলে যদিও শত্রুবিমান পর্যবেক্ষকরা ফাঁকা নীল আকাশে কোনো বিমান দেখতে পায়না। আর্টিলারির গোলার আওয়াজ এখনও অনেক দূরেই রয়েছে।

হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে কয়েকজন সাংবাদিক সুইমিং পুলের পাশে সূর্যস্নান করছে, যখন একজন পুল পরিচর্যাকারী একটি চুম্বকের সাহায্যে ছিপ দিয়ে মাছ ধরার মতো জল থেকে শার্পনেলের টুকরা তুলছে। সাংবাদিকেরা নিজেরাই পালাক্রমে হোটেল গেট পাহারা দিচ্ছে, সশস্ত্র লোকজনদের ভবনে প্রবেশ প্রতিরোধ করতে চাইছেন যা এখন একটি রেড ক্রস নিরপেক্ষ অঞ্চল এবং যার ফলে এই এলাকাটার নিরস্ত্রীকরণ বৈশিষ্ট্য বজায় রাখা প্রয়োজনীয়।

হোটেলে থাকা পাকিস্তানি নাগরিকরা, তাদের সবাই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা তারা তাদের সময় কাটায় লবিতে টেলিভিশন দেখে এবং টেবিল টেনিস খেলা খেলে। সকালের খবর কাগজের দাবি ভারতীয় আগ্রাসন থামানো হয়েছে।

যুদ্ধ সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া প্রায় অসম্ভব। মহানগরী এবং শহরের একপ্রান্ত হতে অন্যপ্রান্তে পুরোটা চষেও প্রায় কেউই ভারতীয় সেনাবাহিনীর দেখেনি। প্রাপ্ত সংবাদ অনুযায়ী ঢাকা থেকে ১৫ মাইলের কম বেশি দুই জায়গায় ভারতীয় ছত্রীসেনার অবতরণ কেউ দেখেনি, এবং কেউই ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেনি কখন ভারতীয় আক্রমণের আরম্ভ হবে।

সিনিয়র পাকিস্তানী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন তারা আশা করছেন মঙ্গলবার সন্ধ্যার আগেই ঢাকার জন্য যুদ্ধ শুরু হবে, কিন্তু তাদের এসব ভবিষ্যদ্বাণী অন্যদের সবার মতোই ভারতীয় কমান্ডার এর উদ্দেশ্য না জেনেই করা।

কূটনীতিক ও সাংবাদিক ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যয় করছে ধাঁধা উপর কিভাবে ভারতীয় ছত্রীসেনার ব্যাটালিয়ন ঢাকার কাছাকাছি অবতরণ হলে তাদের সরবরাহ কিভাবে হবে, এবং কিভাবে তারা অন্যান্য ভারতীয় ইউনিটের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। নতুন ভারতীয় সৈন্য অবতরণের গুজব ঘনঘন শোনা যায়, যদিও তা অসমর্থিত সূত্রে।

বিতর্কের জন্য আরেকটি জনপ্রিয় বিষয় হচ্ছে ১১তলা হোটেলটির উপরের তলা অথবা নিচের তলা নিরাপদ বেশী হবে। নিচেরতলা পছন্দনীয় যদি ভারতীয়রা শুরুতেই বোমাবর্ষণ করে, আর যখন রাস্তার কোন যুদ্ধের এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ হতে সুরক্ষার কথা আসে তখন উপরের তলাতেই বেশি নিরাপত্তা এবং চারপাশের দৃশ্যপটও ভালোভাবে দেখা যায়।
যুদ্ধবিরতি শুরু হবার কিছুপরেই প্রায় ৪০০জনের মতো বিদেশীদের ঢাকা হতে গতকাল অপসারিত করা হয়েছে আরএএফ হারকিউলিস পরিবহনে করে, একটি ভারতীয় বিমান ঢাকা বিমানবন্দরে বোমা হামলা চালায়, সম্ভবতঃ ভালোর জন্য রানওয়ে বন্ধ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এছাড়া ঢাকার বিরুদ্ধে আর কোনো বম্বিং মিশন ছিলোনা। ৪ঠা ডিসেম্বর যুদ্ধ শুরু হবার পর হতে এটাই সম্ভবত সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ দিন ছিলো।

জাতিসংঘ কর্মীদের ভেতর প্রায় ৪০জন ঢাকায় থেকে যায়, এই আশায় যে তাঁরা যখন যুদ্ধ শেষ হবে তখন তারা ত্রাণ সাহায্যের বিতরণ উপযোগী হতে পারবে। জাতিসংঘ ও সাংবাদিকদের মধ্যে একটি ফুটবল ম্যাচ আয়োজন করার কিছু আলাপ চলছিল। কিন্তু এটাও কয়েকটি খেলার একটি যা এখনো বাস্তবিক পরিণত হয়নি। এটা অপ্রতুল পরিবহন সমস্যাকে আরো ভুলেভরা ভয়াবহ করে তুলতো এবং কারণ কারফিউ শীঘ্রই শুরু হবে, রাত্রিকালীন ব্ল্যাকআউট হোটেলের বাসিন্দাদের দাবা এবং তাস খেলার জন্যে একত্রিত করে মোমবাতি এবং মদের বোতল হাতেহাতে ভাগাভাগি করা হবে। যুদ্ধ আরাম্ভ হবার আগপর্যন্ত ঢাকায় কালক্ষেপন করার অন্যউপায় এছাড়া কিছুই নেই।

-ওয়াশিংটন পোস্ট।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৮১-a। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক যশোরে ক্ষমতা গ্রহণ ডেইলি টেলিগ্রাম ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৮১-a, ৪৫২-৪৫৩>

ডেইলি টেলিগ্রাফ, সোমবার ১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক যশোরের দায়িত্ব গ্রহণ
প্রথম অগ্রাধিকার আইন ও বিচারব্যবস্থা পুনরুদ্ধার
যশোর থেকে পিটার গিল

স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার সাবেক পাকিস্তানি জেলা রাজধানী যশোরে সপ্তাহান্তে ফিরে আসেন এবং দেশে আইন-শৃঙ্খলা পুনঃস্থাপন তাদের প্রথম অগ্রাধিকার বলে ঘোষণা করেন।

সশস্ত্র গেরিলা ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সামরিক পুলিশের নেতৃত্বে একটি জয়যুক্ত মিছিলে জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ এবং সভাপতি, দুই টি কমান্ডিয়ার্ড পাকিস্তানি কূটনৈতিক কোরের Chevrolets এ ভারতীয় সীমান্তের পেট্রাপোল থেকে শনিবার যশোরে আসে।

শহরের কেন্দ্রে হাজার হাজার জনগণের ভিড়ে দুই বাঙালি নেতৃবৃন্দ তাদের জনগণের প্রতি তাদের নিজের হাতে “বিশ্বাসঘাতক এবং পাকিস্তানী দোসরদের”কাউকে হত্যা করে আইন নিজ হাতে না নিতে আহ্বান জানিয়েছেন ।

তিনি বলেন অতি দ্রুত একটি বিশেষ যুদ্ধ ট্রাইব্যুনাল করা হবে ঢাকায় যার মাধ্যমে এই লোকদের বিচার করা হবে।

তারা আরও বলেন শত্রুদের কাছ থেকে যেসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাওয়া গেছে সেগুলো মুক্তিবাহিনী অথবা গেরিলাদের কাছে হস্তান্তর করতে হবে।

যারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন তাদের ধারনা এই দুই নেতার নিজেদের অনুসারীদের মধ্যে সম্ভাব্য অনাচার হবার সম্ভবনা ছিল। কমপক্ষে ২০০০ বন্দুক তাৎক্ষণিক যশোর এলাকায় গেরিলাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে এবং ইতিমধ্যে সেগুলো কর্মঅক্ষম করার পরিকল্পনা আছে।

সশস্ত্র বেসামরিক নাগরিক

জনাকীর্ণ রাস্তায় সমাবেশটি রাইফেল এবং হালকা মেশিনগান ব্যারেলের সন্নিবেশে একটি পিনকুশনের মত দেখা যাচ্ছিল। যদিও নিয়মিত পোশাকধারী গেরিলারাও সেখানে ছিল। তবে বেশিরভাগ অস্ত্র বহন করছিল সাধারণ বাঙ্গালী জনগণ যাদের কোন নির্দিস্ট পোশাক ছিলোনা।

যশোর ৬০০০০ লোকের একটি শহরে যা দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে। পাকিস্তানি সামরিক অভিযান এর জন্য গত মার্চের পর প্রায় সব মহিলাসহ অর্ধেকেরও বেশি মানুষ গ্রামাঞ্চলের দিকে পালিয়ে যান।

বাংলাদেশ সরকার নতুন জেলা প্রশাসক জনাব ওয়ালি উল ইসলামকে নিযুক্ত করেছেন। এই পদে থাকা পাকিস্তানি অ্যাডমিনিস্ট্রেটর আর্মি গ্যারিসন থেকে গত সপ্তাহে খুলনা দিকে পালিয়ে গেছেন।

পুলিশসহ সবচেয়ে জুনিয়র প্রশাসনিক কর্মকর্তারা রয়ে গেছেন এবং তাদেরকে নতুন শাসককের অধীনে কাজ চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।

একটি ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য মধ্যপন্থী দল আওয়ামী লীগ দির্ঘদিন চেষ্টা করে যাচ্ছে । তার পথ ধরে সরকার সপ্তাহান্তে চারটি মুসলিম রাজনৈতিক দলের উপর নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে। সেগুলো হল মুসলিম লীগ , জামায়াতে ইসলামী, নিজামী ইসলাম ও পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি।

সরকার সব দেশের প্রতি বন্ধুত্ব – এই নীতির ওপর তার পররাষ্ট্র নীতি ঘোষণা করেছে। জনাব আহমেদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তীক্ষ্ণ ব্যাঙ্গোক্তি করা থেকে বিরত থাকেন যারা পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় আগ্রাসনের বিরোধিতা করেছিল। আবার তারাই শীঘ্রই সম্ভবত কঠোর সমালোচনা এড়াতে স্বাধীন বাংলাদেশকে সাহায্য দেবার জন্য এগিয়ে আসছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৮২-a। বাংলাদেশে পাকিস্তানীদের পরাজয় অবধারিত ডেইলি টেলিগ্রাফ ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৮২-a, ৪৫৪>

দ্যা ডেইলি টেলিগ্রাফ, ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১
পশ্চিম সীমান্ত শান্ত – পূর্বাঞ্চলে পাক আর্মির পতন সুনিশ্চিত
ঢাকায় পরাজিতরা অপ্রস্তুত এবং বহির্ভূত
– ঢাকা থেকে ক্লেয়ার হলিংওর্থ

ঢাকার জন্য যুদ্ধ এখনো শেষ হয় নাই, কিন্তু ঢাকায় পাকিস্তানি আর্মির পতন হয়েছে। পূর্বের পরাজয়ের মৌলিক কারণগুলি হল অপর্যাপ্ত প্রস্তুতি।

ইসলামাবাদের পরিকল্পনাকারীরা কাশ্মীরের ওপর তাদের মনোযোগ দিয়েছিলেন। অন্যদিকে স্থানীয় সেনা কমান্ডার লে এ কে নিয়াজী, তার ভারতীয়দের বিপরীতে সংখ্যায় ছিলেন অপ্রতুল।

জুলাই থেকে ভারতীয়রা ভারতের সাথে ১৩০০ মাইল সীমান্তে বাংলাদেশে গেরিলাদের সাথে ধারাবাহিক হামলা চালিয়েছে, একই সময়ে গেরিলারা কর্মকান্ডে জড়িত ছিল এবং দেশের অভ্যন্তরে বিচ্ছিন্ন অঞ্চলগুলি দখল করার চেষ্টা করেছিল।

এখানে বা সেখানে একটি ক্ষুদ্র উত্সাহ প্রদান ছাড়াও জেনারেল নিয়াজী তার সৈন্যবাহিনীকে নিদারুণভাবে অত্যধিক চাপের মুখোমুখি করেছেন।

ভারতীয়রা তখন খুব ধীরে যুদ্ধটি গড়ে তোলেন যাতে করে শুধুমাত্র ৪ ডিসেম্বর ঢাকার বিমানবন্দরে বিমান হামলা করেন। অনেকদিন পড় সীমান্ত প্রতিরক্ষাবুহ্য নষ্ট হয়। জেনারেল নিয়াজীকে রক্ষণাত্মক অবস্থানের জন্য প্রাক্তন রক্ষাকবচ পথ প্রত্যাহারের আদেশ দেন।

পরিকল্পনা

রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি প্রধান বন্দর চট্টগ্রাম, এবং খুলনাকে রক্ষা করার জন্য রক্ষণাত্মক ভাবে সৈন্যদের পুনঃনিয়োগের জন্য একটি আঞ্চলিক ধারাবাহিক পরিকল্পনা করেন।

গত তিন দিন, সামরিক মুখপাত্র, সামান্যই বলেছেন বা তেমন কিছুই বলেন নাই। তারা সংবাদ প্রতিনিধিদের থেকে দূরে থেকেছেন।

ইসলামাবাদে জারি করা সরকারি বার্তাগুলি ৪৮ ঘণ্টার পিছনে রয়েছে এবং সেগুলো জুড়ে সামরিক প্রচারের মত ঘটনার পরিবর্তে আরো বেশি আশাবাদী কথা যুক্ত করা হয়েছে।

গেরিলাদের অপেক্ষা

এখন পর্যন্ত কঠোর ব্ল্যাকআউট চলছে, সকাল-সন্ধা কারফিউ এবং সুশৃঙ্খল সড়ক ব্লকগুলি শহরের কেন্দ্রে কোনও গেরিলা কর্মকান্ডকে বাধা দিচ্ছে। কিন্তু শুধু ঢাকায় শত শত লোক লুকিয়ে অবস্থান করছে যারা ভারতীয় সেনা বাহিনী যখন এসে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে বের হবে।

এদিকে ভারতীয়রা সিলেটের দক্ষিণে শমশেরনগর বিমান বন্দর ব্যবহার করছে এবং সম্ভবত তারা পশ্চিম সীমান্ত থেকে গঙ্গা পর্যন্ত ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের থেকে হিলি পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৮৩ – a
১। নিয়াজির প্রসস্ততি
২। ইয়াহিয়ার সৈন্য বাহিনীর লজ্জা ডেইলি মেইল ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৮৩-a, ৪৫৫-৪৫৭>

ডেইলি মেইল, ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১
টাইগার হত্যার জন্য অপেক্ষা করছে
– ঢাকা থেকে মেইল প্রতিনিধি

একটি রাস্তার কোণে একটি শুটিং স্টিকের উপর বসে, পাকিস্তানের পূর্ব কমান্ডের সভাপতি গতকাল শেষ মানুষটি জীবিত থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবার ঘোষণা দিয়েছেন।

জেনারেল এ কে টাইগার নিয়াজি অঙ্গীকার করেছিলেন যে অগ্রগামী হিসাবে ভারতীয়রা ছয় মাইল পর্যন্ত এসে আটকে যাবে।

তিনি বলেন, দেশের অন্যান্য প্যানের কাছ থেকে আক্রমণকারীরা ঢাকা পৌঁছেছেন: “এটা কোন ব্যাপার না … এটা এখন জীবন বা মৃত্যুর একটি প্রশ্ন এবং ‘আমরা শেষ মানুষটি জীবিত থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ করব।’

তিনি জেনারেল স্যাম মানকশো, ভারতীয় চীফ অফ স্টাফের দেয়া আত্তসমর্পনের প্রস্তাব পুরো উড়িয়ে দিয়েছেন।

এটি ছিল এই সপ্তাহে জেনারেল মানকশার তৃতীয় কল এবং যেখানে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শেষ বড় যুদ্ধে ‘অপ্রয়োজনীয় ক্ষতি ও প্রাণ হারানো’ প্রতিরোধ করার কথা বলা ছিল।

বার্তাটিতে বলা হয়েছে: ‘আরও প্রতিরোধের করার চেষ্টা অজ্ঞানতা। আমার বাহিনী ঢাকার কাছাকাছি এবং আমাদের সৈন্যবাহিনী সীমানার মধ্যে রয়েছে। নির্দোষ রক্তপাত প্রতিরোধ করার দায়িত্ব আপনার।’

গত ২৪ ঘন্টায় ভারতীয় ইনফ্যান্ট্রি উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ও উত্তরে নরসিংদী থেকে ২৫ মাইল উত্তর-পূর্ব পর্যন্ত শহরের দিকে অগ্রসর হয়েছে।

এবং দুই প্যারাট্রুপ ব্যাটেলিয়ন টাঙ্গাইল নেমেছে, যার একটি উত্তর-পশ্চিমে ৫০ মাইল দূরে, এবং অন্যটি ভৈরব বাজার, ৪০ মাইল উত্তর-পূর্বাঞ্চলে।

খুলনার জন ওয়েব; ইস্ট পাকিস্তান, রিপোর্ট:’

যশোর থেকে ৩৫ মাইল দূরে রাস্তায় যাতায়াতকারী বারো শত পাকিস্তানি এই নদী বন্দরে বীরত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরি করছে।

১০৭ তম ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের বাকি সৈন্যবাহিনী একত্রিত হয়ে ভারতীয় আক্রমণের গতি কমিয়েছে।

গতকাল পাকিস্তানের বন্দুকধারীদের কাছ থেকে যুদ্ধের ব্রিফিংয়ের জন্য আমি ৫০০ ইয়ার্ড দূরে একটি লন্ড্রিতে বসেছিলাম। অস্থায়ী ফিল্ড সদর দফতরের ব্রিগেডিয়ার সন্ধু সিং, যিনি ভারতীয় ৯ম বিভাগের সি.ও. তিনি এটার নেতৃত্বে ছিলেন।

রক্ষিত
লন্ড্রি রাস্তায় একটি বাঁক দ্বারা ছোট অস্ত্রের আগুন থেকে সুরক্ষিত ছিল। আকরা গ্রামের একমাত্র একটি কংক্রিটের বিল্ডিং ছিল যেখানে আমি একটি যোগাযোগের জীপে পৌঁছেছিলাম।

৪৮ ঘণ্টারও কম সময়ের আগে এটি পশ্চিমা পাকিস্তানীদের শি ও ব্রিগেডিয়ার হেদায়েত খানকে সার্ভিস দিয়েছিল।

মাথার উপর দিয়ে আর্টিলারি শেল শব্দ করে যাচ্ছিল। ব্রিগেডিয়ার সিংহকে একটি খাকি পোশাকে ছিলেন, সুর্যের আলো থেকে রক্ষাকারী মুখোশ লাগানো ছিল, তিনি বলেন: আমরা শত্রুদের বিরুদ্ধে আমাদের সাধারণ কুশাল অবলম্বন করতে পারছিনা কারণ রাস্তার একপাশে আছে একটি নিচু জলাধার আর অন্যপাশে বিস্তৃত নদী ভৈরব।

আমাদের সড়কটি দিয়ে আগাতে হবে – যা সর্বোচ্চ ৩০ ইয়ার্ড চওড়া – এবং এখানে প্রচুর শত্রু বাঙ্কার স্থাপন করা আছে এবং ডিফেন্স আছে।

দুই রাতের আগে পাকিস্তানিদের জন্য আত্মসমর্পণের ব্যাবস্থা করা হয়েছিল। তাদের বলা হয়েছিল তিনটি ফায়ার করতে এবং তাদের সবাইকে বের হতে বলা হয়।

সনাক্ত
কিন্তু কিছুই ঘটেনি, আর লড়াই চলছে।

নিউ দিল্লিতে ইয়ান মাথার রিপোর্ট করেছেন:
চীনের সৈন্যরা ভারতে সীমান্ত এলাকায় সম্ভাব্য ভূমিকা পালন করছে।

গতকাল রাতে ভারতীয় পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র বলেছিলেন যে কতজন চীনা সৈন্য জড়িত ছিল বা কোথায় তা সনাক্ত হয়েছে।
তিনি বলেন: আমরা বিশ্বাস করি যে, তাদের এই প্রচেষ্টা পাকিস্তানের সাথে রাজনৈতিক সংহতি প্রকাশের পরিকল্পনার অংশ।
‘আমরা এখনও বিশ্বাস করি যে, চীন এই দ্বন্দ্বকে বাড়িয়ে তুলবে না’

ইয়াহিয়ার আর্মির লজ্জা
এটি গণহত্যা, পরাজয় না
জন ওয়েব এর একটি বিশেষ প্রতিবেদন

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অপমান তাদের পরাজয়ে নয়। ইয়াহিয়া খান এর সৈন্যদের লজ্জা পূর্ব পাকিস্তানে ৭৫ মিলিয়ন মানুষের উপর তাদের ভয়ঙ্কর অসদাচরণ।

যেভাবেই হোক বাঙালি খুন, ধর্ষণ ও লুটপাখি সত্ত্বেও তাদের সাহস বজায় রেখেছে। তারা তাদের চোখ অশ্রু দিয়ে ‘স্বাধীনতা’ র কথা বলেছে।

প্রতিটি রাস্তায় তাদের মাথার উপর ছোট ছোট পাত্র নিয়ে তারা হাঁটছে সাথে শুধুমাত্র একজন মহিলা আছে।

আমি ৪০ বছর বয়েসী সাবদ আলী মণ্ডলের সাথে সাক্ষাত করলাম – তিনি একজন কেরানি – সবার্সার কাছাকাছি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন – তিনি তার বাড়ি জাফরনগরের দিকে যাচ্ছিলেন – সেখানে তার সাত বন্ধুর সাথে মিলে তার পরিবারের ফেরার জন্য প্রস্তুতি নেবেন।

তিনি আমাকে বলেছিলেন যে তারা কীভাবে অভ্যন্তরীণভাবে পালিয়ে যান – কারণ সীমান্তের কাছাকাছি পাকিস্তানি সৈন্যরা হামলা চালিয়েছে।

‘আমরা পিটানো হয়েছে এবং লাথি মারা হয়’ – তিনি বলেছিলেন। তারা আমাদেরকে ছোট বানর বলে গালি দেয়।

সীমান্ত

যখন একটি সীমান্তবর্তী শহরে সৈন্যবাহিনী তিনজন নারীকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল তখন আমরা আমাদের মহিলাদের ও শিশুদেরকে পাঠিয়ে দিলাম। যখন পাকিস্তানিরা সবাইকে যাকে পেল তাকেই গুলি করতে শুরু করল তখন আমরাও দৌড় দিলাম।

সাহারসায় হেডমাস্টার সিদ্দিকুর রহমান (৩১) বলেন, গ্রামবাসীরা বাঙ্কার গড়ে তুলতে বাধ্য হয়েছে।

একদিন সকাল ৯ টায় তারা গৈরা-কগমারির গ্রামে যায়, যা এখান থেকে খুব কাছাকাছি, এবং তারা তাদের সবাইকে মেরে ফেলে। আমরা ১০৪ টি মৃতদেহ গণনা করেছি। তারা আমার মা এবং আমার তিন ভাতিজা সহ অনেক নারী ও শিশুকে হত্যা করে।’

হেডমাস্টার তার হাত মাথায় রেখে বাচ্চাদের মত কাঁদছিলেন যখন তিনি আমাদের সাথে কথা বলছিলেন।

‘তিনি পাঁচ ভাই হারিয়েছেন’, তিনি বলেন।

গ্রামবাসীরা তাদের ছাদের ছাদ মেরামত করছিল এবং পাকিস্তানি বাঙ্কার ভেঙ্গে কাঠের বিম এবং গ্যাল্ভানাইজড আয়রনের টিন বের করছিল।

আমি একটি চকচকে লাল হন্ডা মোটর বাইকের উপর দুইজন মুক্তিবাহিনীর লোকের মাঝে স্যান্ডউইচের মত বসে যাচ্ছিলাম।

আমরা যখন থামলাম, সেখানে ছিলেন ফাদার তেদেস্কো সেবাস্টিয়ান – ইতালিয়ান পুরোহিত – তিন বছর ধরে শিমুলা মিশনে গিয়েছিলেন – তিনি আমাদের নিশ্চিত করেছেন যে পাকিস্তানিরা শেষ পর্যন্ত তাদের উপরেও সন্ত্রাসী প্রচারণা চালিয়েছে।

ঝাঁঝরা

দুই সপ্তাহ আগে একজন অধিনায়ক এবং তিনজন সৈন্য একটি জিপের পিছনে দুইজন গ্রামবাসীকে রাস্তার উপর দড়ি দিয়ে তার অন্য প্রান্ত জিপের সাথে বেঁধে জিপ চালিয়ে দেয়। বাঁধার পরে তাদের মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা করে।

ঝিকরগাচা বাজারের কাছে নিয়মিত পাকিস্তানি সৈন্য প্রত্যাহারের পর এলাকাবাসী রাজাকার আটক করে। তারা রাজাকারের মুখে ঘুষি, চড় ও কিল দিচ্ছিল।তারা লাঠি দিয়ে তাকে আঘাত করেছিল এবং পাথর ছুঁড়েছে। সে যখন মারা যায় তখন তারা থামে।

বাইরে, আওয়ামী লীগের সদর দফতরে ৩০০ জনের বেশি গ্রামবাসীরা প্রচারিত রাজনৈতিক বক্তৃতাগুলির জন্য রোদে আনন্দের সাথে বসে ছিল।

ডাক্তার বললেন এটি হল তাদের হত্যা করার স্থান। তারা প্রতিদিন ২১ জন মানুষকে এখানে নিয়ে আসেন, তাদের অত্যাচার করেন, তারপর তাদেরকে অপহরণ করেন বা তাদের গলা কেটে দেন।

তারপর ডাঃ আবদুর রহিম খান এবং কাজিম আবুল রাশেদ, কর ইন্সপেক্টর, আমাকে জঙ্গলের ২০০ গজ ভেতরে নিয়ে গেলেন।

জবাই করার স্থানটি ভয়ঙ্করভাবে শান্ত ছিল, এবং বাতাসে দুর্গন্ধ ছিল। বৃদ্ধ গ্রামবাসী এবং অনেক শিশু আমাদের অনুসরণ করছিল তারা ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল।

তারপর ছেলেমেয়েরা এগিয়ে গিয়ে আমাকে ডাকল এবং দস্যুদের হত্যাযজ্ঞের আরও কিছু কবরের পিট দেখাল। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় ছিল যে তারা জানতো যে এগুলো কোথায়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৮৪-a. ঢাকার সমাপ্তি
গার্ডিয়ান ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৮৪-a, ৪৫৮>

দ্যা গার্ডিয়ান, লন্ডন, ডিসেম্বর ১৫, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
ঢাকার সমাপ্তি

জেনারেল টাইগার নিয়াজী তাত্পর্যপূর্ণ বিষয় নিয়ে পরিচিতিমূলক আলোচনা করেন। “এটি এখন জীবন বা মৃত্যুর একটি প্রশ্ন এবং আমরা শেষ মানুষটি টিকে থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে। সেনাবাহিনী মারা যাবে। কোন সৈন্য ফিরে যাওয়া বাকি থাকবে না।” গৌরবের সময়; কিন্তু ধ্বংস এবং অসীম নৃশংসতারও সুর। কেন পাকিস্তানি বাহিনীর হাজার হাজার সৈন্যকে ধীরে ধীরে টুকরো করে কেটে ফেলা হবে তার কোন কারণ নেই। কোনও কারণ নেই যে কেন ঢাকার বস্তিতে শেলিং করে ধ্বংস করা উচিত। কোনও কারণ নেই যেহেতু একটি বেসামরিক প্রশাসন স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করছে যে, ইয়াহিয়া খান তার বীরত্বপূর্ণ কল্পকাহিনীকে দীর্ঘায়িত করবেন। বাংলাদেশ আছে। বাংলাদেশকে নিয়ে সমঝোতা হবেনা। মিসেস গান্ধীর মুঠোয় এখন পূর্বঅঞ্চলের জয়। জেনারেল নিয়াজির ঔধ্যত্ত শুধু তাকে ইতিহাসের একটি পাদটিকাই দিয়েছে – এর বেশি কিছু নয়।

তাহলে কীভাবে হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা যেতে পারে? বিশ্ব চাপ যেভাবে রাজনৈতিক জ্বল ঘোলা করেছে এবং পরিস্থিতিকে জটিল দিকে নিয়েছে তাতে আর কোন আশা নেই। পূর্বের অবস্থা কেবল দুইজনের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়তে পারে: মিসেস গান্ধী ও ইয়াহিয়া খান। যদি মিসেস গান্ধী তার বাহিনীকে না থামান, তবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতিকে সত্যের মুখোমুখি হতে হবে যে কারণ তিনি গত এক বছর শান্তির পরিবর্তে জিহাদ চালিয়েছেন – আলোচনার পরিবর্তে তিক্ততা সৃষ্টি করেছেন। উপরন্তু, তার আমেরিকান জোটের একটি দৃঢ় কর্তব্য আছে তাকে যথেষ্ট বলার। নয়া দিল্লির বিরুদ্ধে হোয়াইট হাউসের দেয়া নির্মল বক্তৃতার এখন পুরনো বিষয়।

অবশ্যই (গার্ডিয়ান যেভাবে যুক্তি দিয়েছিল) মিসেস গান্ধীকে থামাতে হবে। হত্যার ঝুঁকি খুবই বড়; একটি পুতুল রাষ্ট্রের সম্ভবনা খুব স্পষ্ট। বাংলাদেশ দীর্ঘস্থায়ী রক্তপাতের চেয়ে ভাল কিছু আশা করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, এর একটি প্রধান কারণ হল ধ্বংস বন্ধ করার ব্যাপারে ভারতের দাবি প্রত্যাখ্যান এবং পাকিস্তানকে আমেরিকার নিরবচ্ছিন্ন মদদ। আমরা জানি যে রাষ্ট্রপতি নিক্সন ইয়াহিয়াকে ধরে রেখেছেন। আমাদেরকে বলা হয়েছে, বুশ এবং ভুট্টো উভয়ই বলেছিলেন যে, নয়াদিল্লি যখন হামলা করে তখন আওয়ামী লীগের সাথে ইসলামাবাদের আলোচনা চলছিল। হাজার হাজার লোক মারা গেছে এবং ১০০ মিলিয়ন পাউন্ডের সামরিক হার্ডওয়্যার (চার মাস ধরে ৯ মিলিয়ন শরণার্থীকে খাওয়ানো সহ) ধ্বংস হয়ে গেছে যার জন্য ভারত অপেক্ষা করবে না।

এই চার্জগুলির কিছু অস্বস্তিকর; কিছু কিছু মিসেস গান্ধীর তার বাকি কর্মজীবনের জন্য ভারী হয়ে থাকবে। কিন্তু সেগুলো এখন অপ্রাসঙ্গিক এবং পরোক্ষভাবে একটি বিস্ময়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে: যেহেতু স্বায়ত্তশাসিত বাংলার জন্য ভারতকে দেয়া ইয়াহিয়া এবং মিঃ নিক্সন এর “মিনিট দূরের” প্রস্তাব এখন নেতিয়ে পড়েছে – যে মুহুর্তে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সৈন্যবাহিনী ধ্বংসের মুখোমুখি। ইসলামাবাদ কি মিথ্যা গর্ব করবে, নিয়াজি কি আদেশ দেবে ; বাংলাদেশের স্বাধীনতা স্বীকার করবে; শেখ মুজিবকে মুক্ত করে বাড়ি পাঠাবে? এইভাবে জীবন বাঁচানো সম্ভব। এটাই উপমহাদেশে সত্যিকারের রাজনৈতিক পদক্ষেপ, যা পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানের কণ্ঠ হওয়া উচিত। শেখ মুজিব এবং তাঁর অনুগামীরা নতুন দিল্লির সাথে কৌতুক খেলতে চান না। যাইহোক, অনুভূতি এখন মজার, পশ্চিমের সাথে কিছু ভবিষ্যত লিঙ্ক হতে পারে। সব বাণিজ্য ভেঙে নাও যেতে পারে, অথবা সব বন্ধুত্ব। শেষ মানুষটি পর্যন্ত যুদ্ধ – এই লক্ষ্যে পাকিস্তানের কিছুটা হারানোর সম্ভবনা আছে। এবং ইয়াহিয়া খান, একটি ভুল থেকে পরের ভুল করতেও দেরী করে ফেলছেন – আমি জানি।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৮৫-a। বর্তমান বাংলাদেশ টেলিগ্রাফ ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৮৫-a, ৪৫৯>

ডেইলি টেলিগ্রাফ, ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
বর্তমান বাংলাদেশ

ভারতীয় বাহিনীর পূর্ব পাকিস্তান দখলের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামটি পরিণতি লাভ করে। এবং একটি যুদ্ধবিরতির জন্য ঢাকা ও নয়াদিল্লির সামরিক কমান্ডারদের মধ্যে একটি সংলাপের মাধ্যমে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের অন্ততপক্ষে প্রথম পর্যায় সমাপ্ত হয়। আশা করা যায় যে এখানেই যুদ্ধ শেষ। এর জন্য দুইটি জিনিস সর্বোপরি প্রয়োজন হবে: পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার সুযোগ গ্রহণের কোনও অভিযোগ ভারত কর্তৃক প্রত্যাখ্যান। পশ্চিমাঞ্চলে পূর্বের মতো রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া ভারত অধ্যুষিত কাশ্মীর এবং পাঞ্জাবের মধ্যে কোন দরকষাকষি করবেন না।

এইসব ঘটনার প্রেক্ষিতে ভারত পাকিস্তানকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার চেষ্টা করতে পারে – এটা অসম্ভব দেখায়। ভারত সরকারের বাইরে অ ভেতরে নিশ্চিতভাবে এমন লোক আছে যারা ভারত উপমহাদেশের বিভক্তি চায় না। তবে মিসেস গান্ধি যে তাদের ইচ্ছা পুড়ন করবেন এমন সম্ভবনা ক্ষীণ। যদি তিনি সামান্যতম ইচ্ছা পোষণ করেন সেক্ষেত্রে এই বিষয়ে ভারতের অবস্থান পরিবর্তিত হয়ে যাবে। এটা হিথেরর চাইতে আরও জোরালোভাবে বিশ্বশক্তিগুলোকে জড়িত করবে। এবং এতে করে ভারত তার নিজের জন্য আরও বিপদ ডেকে আনবে।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সমস্যাগুলি তিক্ত। সৈনিক হিসেবে তার ধারণা হতে পারে পূর্বের সৈন্যদের নিরাপদে পশ্চিমে আনার নিশ্চয়তার জন্য সে পশ্চিমে সৈন্য বাড়াতে পারেন। এটা আশা করা হয় যে তিনি বুদ্ধিমান সংযত পদক্ষেপ নেবেন।

যাইহোক, বাংলায় এখন চূড়ান্ত পরিণতি আসতে যাচ্ছে। নতুন রাষ্ট্র ভারতের নীতির সাথে থাকছে – শুধু ভারত নয় – গোটা সমস্যার সাথেই থাকছে। শুধুমাত্র ভারতীয় সেনাবাহিনী আইন ও শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করতে পারে, সাম্প্রদায়িক গণহত্যার বিপদ থামাতে পারে এবং একটি নতুন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর পটভূমি প্রদান করতে পারে। রাশিয়া, চীন এবং আমেরিকা সব ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট হবে। ব্রিটেন, ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক বজায় রেখেছে। বাংলাদেশের জন্মের সময় লন্ডন থেকে প্রাপ্ত সাহায্য, যদি নিশর্তে প্রস্তাবিত হয়, তাহলে স্বাগত জানানো হতে পারে।

শিরোনাম
সূত্র তারিখ
১৮৬। বাংলাদেশের বিরাট বিজয় ওয়ার্ক্স প্রেস ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৮৬, ৪৬০-৪৬১>

ওয়ার্কার্স প্রেস, ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১
বাংলাদেশের একটি মহান বিজয়
– জন স্পেন্সর

গতকাল পাকিস্তান বাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী দুর্দান্তভাবে হর্ষধ্বনি দিয়ে সংসদে বলেছেন যে, ‘ঢাকা এখন একটি স্বাধীন দেশের মুক্ত রাজধানী’।

ভারত ইতিমধ্যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে যা এখন বাঙ্গালীর মনে স্বীকৃত রাষ্ট্রের অনুভব দিচ্ছে।

চূড়ান্ত আত্মসমর্পণ হল বর্ধিত অস্ত্রবিরতির মেয়াদ শেষ হওয়ার মাত্র দশ মিনিট আগে। ভারত হুমকি দিয়েছিল যদি তার আত্মসমর্পণের আহ্বান পালন না হয় তাহলে পরিস্থিতি ভালো হবেনা।

বাংলাদেশ সরকার আজ ঢাকায় অফিস নিয়ে যায়। বেশিরভাগ আওয়ামী লীগ নেতারা পরিবহন সমস্যার কারণে সেখানে গতকাল পৌঁছাতে পারেনি।

জয়

পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের থেকে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা বাঙালির জন্য একটি অসাধারণ অর্জন। কিন্তু অবস্থা এখনও ঝুঁকিপূর্ণ।

আওয়ামী লীগ একটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে রক্ষণশীল এবং বুর্জোয়া প্রোগ্রাম গ্রহণ করতে যাচ্ছে। ঘোষণাপত্রের বাইরে শ্রমিক ও কৃষকদের দেবার মত আপাতত কিছুই আর নেই।

আওয়ামী লীগ ভূমি মালিকানার ‘যৌক্তিকীকরণ’ এবং ভূমিহীন কৃষকদের অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি ছাড়া কোন বাস্তব কৃষি সংস্কার প্রস্তাব দেয়নি।

এর ফলে দীর্ঘদিনের কৃষি সমস্যা দূর হবেনা যেখানে বেশিরভাগ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে।

নতুন সরকারের দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী শিল্পের একাধিপত্যবাদীতা থেকে ‘কার্যকরভাবে কাজ করার’ অবস্থা একইভাবে অস্পষ্ট ও জননেতাসুলভ।

বাঙ্গালী শ্রমিক ও কৃষকদের আওয়ামী লীগ ও গান্ধীর বুর্জোয়া নেতাদের প্রতিশ্রুতির উপর কোন নির্ভরতা স্থাপন করতে পারে না।

তাদের পুঁজিবাদী শ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে হবে এবং তাদের নিরস্ত্র করার সব প্রচেষ্টা নিতে হবে।

পশ্চিম পাকিস্তানীরা আত্মসমর্পন সম্পর্কে অবহিত ছিলোনা। যদিও সরকার রেডিওতে গত দুই সপ্তাহ ধরে মার্শাল ল’র কথা বলেছে। আর বলা হয়েছে পুর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি গুরুতর।

আত্মসমর্পণ

অবশেষে, ইয়াহিয়া খান রেডিওতে পূর্ব অঞ্চলে আত্মসমর্পণের ঘোষণা দিলেন এবং বললেন পশ্চিম অংশে যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে।

তিনি বলেন ‘আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাব’। তিনি জনগণকে ধৈর্যশীল হতে বলেন এবং আরও ত্যাগ স্বীকারের কথা বলেন।

তিনি চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মুসলিম রাষ্ট্রগুলিকে তাদের সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ জানান।

চীন গতকাল সিকিম সীমান্তে একটি আইন লঙ্ঘনের প্রতিবাদ জানিয়ে নয়া দিল্লিতে একটি শক্ত নোট পাঠিয়েছে। একটি পৃথক ঘোষণায় চীন সংবাদ সংস্থা বলেছে চীন পাকিস্তানে বস্তুগত সমর্থন অব্যাহত রাখবে এবং অভিযোগ করে যে ভারত চেয়েছিল সমগ্র পাকিস্তান ধ্বংস করতে।

অ্যামেরিকা পাকিস্তানকে সমর্থনকারী অন্যতম দেশে। তারা বঙ্গোপসাগরের বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বিমান ক্যারিয়ার ‘এন্টারপ্রাইজ পাঠিয়েছে যেখানে ৯০ টি প্লেন ছিল।

যদি আমেরিকা একটি উদ্ধার অপারেশন করতে চায় সেক্ষেত্রে আসলে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কারণ পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করেছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৮৭-a। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে বাংলাদেশের ঘটনাবলির ওপর বি বি সি প্রচারিত সংবাদ বি বি সি লন্ডন ২৬ মার্চ – ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৮৭-b, ৪৬৫- ৪৮৬>

১।
২৬/০৩/৭১ এ-৩১ ২২০০ পাকিস্তান – এক

পূর্ব পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সরকারের কর্তৃত্ব পুনঃআরোপের ঘোষণা ও ভারত থেকে প্রাপ্ত রিপোর্টে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার খবরের পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানে প্রচুর যুদ্ধ-বিগ্রহ চলছে। পূর্ব অংশের রাজধানী ডাকায় আমেরিকান কনস্যুলেটর জেনারেল জানান সেখানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ট্যাঙ্ক ব্যাবহার করা হচ্ছে। এর আগে ভারত থেকে জানা যায় যে পূর্ব পাকিস্তানে একটি গোপন রেডিও বার্তায় জানা গেছে বিভিন্ন স্থানে ভারী যুদ্ধ চলছে। বাঙ্গালী সেনাবাহিনীর লোকদের চাকরি ছেড়ে দেবার অনুরোধ করা হয়েছে এবং মুক্তিবাহিনীর জাঠে যোগ দিতে অনুরোধ করা হয়েছে। সরাসরি পাকিস্তান থেকে কন সংবাদ পাওয়া যায়নি।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তার সম্প্রচারিত ভাষণে দৃঢ়ভাষায় জানান যে শেখ মুজিব কে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে এবং তাকে আটক করা হয়েছে ও তার দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তিনি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের সব রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন ও সংবাদপত্রের সেন্সরশিপ আরোপ করেন।
Para One: RW 2100 (when US new)
fighting detail from 2030
Yahya snaps from 1520; Ind. from 1650

২।
২৭-৩-৭১ সি ৮৩ ২০৩ পাকিস্তান – এক

পাকিস্তান থেকে সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, ঢাকার মূল পয়েন্ট সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে। ট্যাঙ্ক ব্যাবহার করার ফলে পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণ। পাকিস্তান সরকারী রেডিও জানিয়েছে শহরে রোজ ৯ ঘণ্টার হরতাল রবিবার থেকে তুলে নেয়া হবে। রেডিওতে বলা হয় কেউ যদি রাস্তা অবরোধ করে বা কোন ব্যারিকেড দেয় তাহলে কঠোর ব্যাবস্থা নেয়া হবে। বলা হয় সমস্ত দেশ আর্মির পূর্ন নিয়ন্ত্রণে আছে। তারা একটি গোপন রেডিও বিবৃতি অস্বীকার করে। সেই বিবৃতিতে বলা ছিল যে শেখ মুজিবুর রহমানের সমর্থকরা চট্টগ্রাম বন্দর এবং কুমিল্লা ও যশোর শহর দখল করেছে। এবং মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটর জেনারেল টিক্কা খাঁ আহত হয়েছেন। খবরটি ভারতীয় নিউজ এজেন্সির বরাত দিয়ে জানা যায়। কঠোর সেন্সরশিপ থাকার কারণে সেখানে প্রকৃতপক্ষে কি চলছে তা জানা কঠিন।

RW. 1900 with Mon (Pakistan) on curfew, denials.
Bombing 1530: complete control 1300: TRH(16) 2004/SK.

৩।
২৭-৩-৭১ সি- ৬২ ১৯০০ পাকিস্তান – দুই

তিন দিন আগে বি বি সি র একজন প্রতিনিধিকে অন্য অনেকের সাথে ঢাকা ত্যাগ করতে বলা হয়। তিনি ছিলেন চাক্ষুষ স্বাক্ষিদের মধ্যে অন্যতম। তিনি দেখেছেন কিভাবে সেনাবাহিনী নির্মমভাবে মানুষের উপর পূর্বপরিকল্পিত অপারেশন চালিয়েছে। আমাদের প্রতিনিধি জানান যদিও ছাত্রদের কাছে সামান্য অস্ত্র ছিল তবে সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক আর ট্রাকভর্তি সৈন্যের কাছে তা কিছুই না। প্রচুর গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল আর অনেক দালানে আগুন জ্বলছিল। আমাদের প্রতিনিধি আর তার ফিল্ম ক্রু কে তিনবার ভালভাবে চেক করা হয়। এবং বিমানে ওঠার আগে তাদের সকল কাগজপত্র ও ফিল্ম রেখে দেয়া হয়। তিনি জানান মিলিটারি শাসকদের উদ্যেশ্য ছিল যাতে কোন রকমের আনসেন্সর্ড খবর ছাপা না হয়। আমাদের প্রতিনিধি বলেন পাকবাহিনী নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিব-উর-রহমান গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে যে বিবৃতি দিয়েছে তা সম্ভবত সঠিক।
Correspondent, Clayton (London) ML /IMP 1852/SK

৪।
২৮/৩/৭১ সি ৬১ ১৯০০ পাকিস্তান – এক
পাকিস্তানের সরকারী রেডিওতে বলা হয় পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক। মানুষ কাজে যাচ্ছে। সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ ব্যাংক খোলা রাখতে বলেছেন। কারফিউ গতকাল (রবিবার) শিথিল হবার পর আবার জারি করা হয়েছে। তবে রেডিও বলেছে আজ আবার (সোমবার) প্রত্যাহার করা হবে।পাকিস্তান রেডিও ছাড়াও কিছু খবর ভারতের মাধ্যমে আসছে। সেখানে বলা হয়েছে গতকাল (রবিবার) ঢাকায় আরো গুলি চলেছে। কলকাতায় অবস্থিত একটি গোপন রেডিও সম্প্রচারে বলা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতি বাংলাদেশ সরকার গঠন করেছে। ভারতীয় সংবাদ সংস্থা রিপোর্ট বলেছে যে বাংলাদেশের উত্তরে রংপুর শহর মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানীসৈন্যদের থেকে মুক্ত করেছে। পাকিস্তান বলেছে ভারত পাকিস্তানের ব্যাপারে নাগ গলাচ্ছে। ভারত তা প্রত্যাখ্যান করেছে। এই খবর দিয়েছে ভারতে অবস্থিত ভয়েস অব বাংলাদেশ নামক একটি গোপন বেতার কেন্দ্র।
RW 1630 (when Dacca firing new),’ Provo govt.. Rangpur 1540
Restfrom 1000
JML/1MP 1844/JEF

৫। বাঙলা
৩০/৩/৭১ এ-৩১ ২২১৩০ পাকিস্তান
পূর্ব পাকিস্তানে কঠোর সেন্সরশিপ এখনও বলবৎ আছে। বিস্তারিত খবর পাওয়া দুষ্কর। সরকারী পাকিস্তান রেডিও বলেছে ঢাকায় কারফিউ বারো ঘন্টার জন্য আবার প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের সকল ব্যাংক তিন দিনের জন্য আবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রেডিও বলেছে যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে দোকান খুলছে এবং কিছু সংবাদপত্র প্রকাশ করা হচ্ছে।
ঢাকা থেকে একজন ঘুরে এসে নয়াদিল্লীতে পৌঁছে জানান যে শহরে বেশিরভাগ দোকান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং খাবারে সহজপ্রাপ্যতা নেই বললেই চলে। আরেকজন একই ফ্লাইটে এসেছেন – তিনি জানান সেনাবাহিনী সম্পুর্ন শহর নিয়ন্ত্রণে রেখেছে এবং পুরো শহর প্রচন্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

পাকিস্তান ভারতকে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অভিযোগ করেছে। ইসলামাবাদে ভারতীয় হাই কমিশনারকে বলা হয়েছে যে যদি ভারতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগঠিত বিক্ষোভ হয় তবে তার প্রভাব গুরুতর হবে। হাইকমিশনারকে আরো বলা হয়, হুগলী নদীর মুখে অবস্থিত একটি গোপন বেতার থেকে মিথ্যা খবর প্রচারিত হচ্ছে। ভারত ইতোমধ্যে এটা প্রত্যাখ্যান করেছে।

Banks:1330
Travelers: 2030
Protest: 1730 with denial
DUN
2110/CK

৬। বাংলা
১/৪/৭১ সি- ৯০ ২১৩০ পাকিস্তান – দুই

সম্প্রতি পূর্ব পাকিস্তানে সংবাদপত্র প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্টে জানা যায় যে রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য বড় শহর সামরিক নিয়ন্ত্রণে আছে। তারা আরও জানায়, যখন সেনাবাহিনী প্রথম সেখানে যায় তখন ঢাকায় প্রচুর গণহত্যা হয়। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সমর্থকদের। পাঞ্জাব থেকে আসা পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং কর্মীদের গণহত্যার জন্য দায়ী। শহরের বেশিরভাগ অঞ্চল ধ্বংস করা হয়েছে এবং এখনো জ্বলছে। কিছু রিপোর্টে যানা যায় শহরের বাইরে এখনো সমস্যা চলমান। ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনালের একজন আমেরিকান সংবাদদাতা বলেন তিনি ভারত সীমান্তের অদূরে যশোরে গিয়েছিলেন। তাকে নারী ও শিশুদের বেয়নেট বিদ্ধ লাশ দেখানো হয় যেগুলো পাকসেনারা চলে যাবার আগে মেরে রেখে গেছে।

পাকিস্তান অভিযোগ করে যে সশস্ত্র ভারতীয়রা পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে সীমান্ত পার হয়ে প্রবেশ করছে। ভারতীয় সরকারের মুখপাত্র এ খবর অস্বীকার করেন।

Reports: D/PCORR (SMITH); UP! Indian denial 1443
Infiltration 1000
AMK 2/20/B

৭। বাংলা
২/৪/৭১ এস-৪ SNAPADO Pakistan

বিবিসির একজন বিশেষ সংবাদদাতা যশোর থেকে ফিরে এসে জানান যে, এটা স্পষ্ট যে পাকিস্তান সরকার সত্য কথা বলছে না – তারা নারী ও শিশুসহ এবং নিরপরাধ বেসামরিক মানুষকে হত্যা করছে।

আমাদের প্রতিনিধি জানান, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তার নিষ্ঠুরতা দিয়ে পুর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনোবল ধ্বংস করতে ব্যার্থ হয়েছেন।
WATO Interview
DES 1541/SK.

৮। বাংলা
২-৪-৭১ সি- ১০৬ ২২৩০ পাকিস্তান – দুই

পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি উপর, রেডিও বলছে যে বড় বড় শহর শান্ত আছে -কিন্তু স্বীকার করে যে কিছু এলাকায় সমস্যা হচ্ছে। শান্তিপূর্ণ নাগরিকদের সন্ত্রস্ত করতে দুর্বৃত্তরা চেষ্টা করছে।

একজন বিবিসির বিশেষ সংবাদদাতা যিনি যশোর থেকে ফিরে এসে – এটি পূর্ব পাকিস্তানের ২৫ মাইল বা ৪০ কিলোমিটার ভেতরে – জানান যে যুদ্ধ এখনো চলছে। সরকারি বাহিনী প্রচুর নারী ও শিশু হত্যা করছে এবং ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তিনি চলে যাবার প্রাক্বালে সেনাবাহিনী সেখানে আবারো আক্রমণ করেছে এবং প্রায় ১ মাইল দূর থেকে আর্টিলারি ও মর্টার থেকে বোমাবর্ষন করেছে।

R W 2000
Radio 1530
Hart snapped 1341
VBO/DB
221U/FD

৯। বাংলা
২/৪/৭১ সি-৯৭ ২১৩০ রেড ক্রস – পাকিস্তান

আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটির প্রতিনিধিদেরকে পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণসামগ্রী প্রবেশ করার অনুমতি দিতে অস্বীকার করেছে। জেনেভায় রেড ক্রস একটি বিবৃতিতে বলে যে তারা তাদের প্রতিনিধিদের সহ – দুই জন ডাক্তার এবং একটি রেড ক্রস বিমান ফিরিয়ে নিচ্ছে যেখানে একটি কার্গো ভর্তি প্রায় ৮ টন মেডিকেল ও রিলিফ দ্রব্য ছিল। জেনেভায় এক সংবাদদাতা, বিবিসিকে বলেন পাকিস্তান সরকারের কর্মকর্তা তাদের বলেছেন যে বাইরে থেকে কোন ধরনের অনুপ্রেবেশ সহ্য করা হবেনা। এমনকি সেটা যদি কোন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাও হয়।

ম্যাকগ্রেগর 51 (snapped 1924)
VBO / ডিবি 2105 / পার্ক
RTR: এ এফ পি.

১০। বাংলা
২/৪/৭১ সি-৩৫ ১০০০ পাকিস্তান-এক

পুর্ব পাকিস্তান থেকে অব্যাহতভাবে সহিংসতার খবর আসছিল। লন্ডন টাইমসের একজন সংবাদদাতা যশোরের পরিস্থিতির একজন প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি বলেন, পাকিস্তান সরকার এলাকা থেকে তাদের সৈন্য ও সামরিক ক্যাম্প প্রত্যাহার করেছে। শহর এখন পুর্ব পাকিস্তান বাহিনী ও শেখ মুজিবুর রহমানের সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণে। তিনি দেখতে পান পুর্ব পাকিস্তানের অনিয়মিত বাহিনীকে একটি বাজারের কাছে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনারা শাস্তিমূলকভাবে মার্চ করাচ্ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধে। তিনি বলেন বন্দীদের পাকসেনারা নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে।

পশ্চিম পাকিস্তানের রেডিও বলেছে যে পূর্ব প্রদেশের সব বড় শহর শান্ত আছে। কিন্তু ভারত জাতিসঙ্ঘের কাছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আবেদন করছে – তারা বলছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্লেন, ট্যাংক এবং রকেট ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিহিংসামূলক অপারেশন চালাচ্ছে।

MON (কা রা CHI রা Dio) SPS / বিজেপি 0936 / এমএইচ
(U.N. কল এবং প্রতিহিংসামূলক দুই দিন থেকে)

১১। বাংলা
৩/৪/৭১ এ-১২ ১৫০০ পাকিস্তান – এক

সর্বশেষ রেডিও পাকিস্তান জানিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি এখন ঢাকা ও গ্রামাঞ্চলে শান্ত আছে। রেডিও জানায় তেমন কোন দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। গত শুক্রবার প্রচুর লোক ঢাকার মসজিদে সমবেত হয়। অল ইন্ডিয়া রেডিও এবং প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া থেকে প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী জানা যায় পাকিস্তানের বিমানবাহিনী গতকাল কিছু শহরে আক্রমণ চালায় এবং শেখ মুজিবুর রহমানের সমর্থকরা প্রতিরোধ করে। অল ইন্ডিয়া রেডিও জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনারা চাপে আছে এবং তারা কুমিল্লায় বিমান অবতরণ করাতে পারেনি।

আর ডব্লিউ 1300 (সোম: 1000 থেকে শান্ত পাকিস্তান)
ভারত রিপোর্টসমূহ (RTR). জাবি 1440 / mw.

১২। বাংলা
৪/৪/৭১ সি-৩০ ১২৩০ পাকিস্তান ওপিএস

পূর্ব পাকিস্তান থেকে কোন সাম্প্রতিক স্বাধীন রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। ঢাকায় সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ একটি ঘোষণায় বলছেন যে দেশে স্বাভাবিক জীবন ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ঘোষণায় জনগণকে গুজবে কান না দেবার উপদেশ দেয়া হয়। আরও জানানো হয় যে, সোমবার থেকে কারফিউ কমানো হবে।

এদিকে, অল ইন্ডিয়া রেডিও পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাওয়া রিপোর্টে জানায় যে সেখানে সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ গতকাল বড় বিমান হামলা চালায় এবং চট্টগ্রামে ও অন্য পাঁচটি বেসামরিক এলাকায় নাপাম বোমা ফেলে। রেডিও আরেকটি রিপোর্ট অনুযায়ী বলে যে সেনারা যশোরের সীমান্তবর্তী শহরে দূর পাল্লার কামান ব্যবহার করছে। পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সমর্থকরা সেগুলো নিয়ন্ত্রণে আনছে। অল ইন্ডিয়া রেডিওর এই রিপোর্টগুলো অসমর্থিত।

পুনর্বিন্যস্ত করা 1030
ঢাকা 1030
অল ইন্ডিয়া রেডিও 1000 JKJ / 1225 / এফডি

১৩। বাংলা
৬/৪/৭১ সি-২৯ ১১৩০ পাকিস্তান- ব্রিটেন

লন্ডনে, সংসদে সকল দলের মোট ১৮০ জন সদস্য পাকিস্তানে যুদ্ধবিরতির আবেদনে স্বাক্ষর করে ব্রিটিশ সরকারকে অনুরোধ করে একটি আবেদন করেন। বিবিসির সংসদীয় সংবাদদাতা বলেন যে এমপিদের এই পত্রের জবাবে পররাষ্ট্র সচিব স্যার অ্যালেক ডগলাস হোম বিবৃতি দিয়েছেন যে ব্রিটিশ সরকার পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। কিন্তু তারা সমানভাবে উদ্বিগ্ন যে পাকিস্তানি সরকারকে বিলম্ব ছাড়াই শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তির ব্যাপারে প্রভাবিত করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন।
GNS মাধ্যমে Herdiman স্কট
রিটার্নিং ওয়াই / KWC 1110 / বি এইচ

১৪। বাংলা
৭-৪-৭১ সি ৩১ ১১৩০ পাকিস্তান উদ্বাস্তু

বিভিন্ন জাতীয়তার কয়েকজন লোক পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ভারতের কোলকাতা পৌঁছেছেন। তারা সেখানকার গণহত্যা ও রাস্তায় মৃতদেহের স্তূপ এর কথা বলেছেন। কেউ কেউ বলেন গত দুই সপ্তাহ সময়ে ভারী যুদ্ধ হয়েছে। একজন আমেরিকান সংবাদদাতা বলেন যে চট্টগ্রাম একটি প্রেতাত্মার শহরের মত ছিল – শুধু সেনা, লাশ এবং কুকুর ছাড়া আর কিছু নেই।
তিনি বলেন, তারা সাধারণত চট্টগ্রাম চষে বেড়ান আর হত্যা করেন। তিনি জানান তাকে শহরের আশেপাশে নিয়ে যাওয়া হয় – সৈন্যরা বিদ্যুৎ সরবরাহ পুনরায় চালুর চেষ্টা করছিলেন। তিনি রাস্তায় কিছু হত্যাকাণ্ড দেখেন। চট্টগ্রামের সর্বত্র মৃতদেহের দুর্গন্ধ ছিল। অণু একজন জানান পুর্ব পাকিস্তানীদের আর্মিরা দেখা মাত্র তৎক্ষণাৎ গুলি করে মারছিল। একইভাবে বন্দরের মানুষদেরকেও হত্যা করছিল।

RW J000 when American new, deleting reference to SELIS Killings from 0200
ROY/MH 11/2lrh

১৫। বাংলা
৭-৪-৭১ সি-৭৭ ২১৩০ পাকিস্তান

প্রথমবার মত রেডিও পাকিস্তান জানাল যে বিমানবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে একশনে গেছে। বলা হয় যে তিনটি শহরে সেনাবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে এই অভিযান। সেনাবাহিনী এখন সমগ্র উত্তরাঞ্চলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। বিবিসির কমনওয়েলথ সংবাদদাতা- ১ মাস পর পূর্ব পাকিস্তান থেকে লন্ডনে ফিরে পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্যার কথা জানান। বিদেশী প্রচারমাধ্যমে এগুলো তেমন প্রচারিত হয়নি। তার কাছে মনে হয়েছে যে পুর্ব বাংলার মানুষ তাদের পরিণতি এভাবে শেষ হতে দেবেনা। আমাদের সংবাদদাতা বলছেন যে একটি টানা এবং তিক্ত সংগ্রাম চলবে বলে মনে হচ্ছে।
ফোঁড়া 2100! নতুন 1900.
HMK / 2110 / পার্ক

১৬। বাংলা
৯-৪-৭১ সি-৫৮ ১৯০০ পাকিস্তান

রেডিও পাকিস্তান জানিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রাষ্ট্রবিরোধী এবং সমাজবিরোধী দের সাফ করা হয়েছে। রেডিও জানিয়েছে তাদের অধিকাংশই সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। আরও জানানো হয় যে অনেক দোকান এবং শহরে বাজার খুলেছে এবং মানুষ তাদের ঘরবাড়ি ফিরে আসছে। আরেকটি বিবৃতিতে জানানো হয় নতুন সামরিক আইন প্রবিধান জারি করা হয়েছে শুধুমাত্র সন্দেহজনক চলাফেরা সীমিত করতে এবং জননিরাপত্তার বিরুদ্ধে যায় এমন বিষয়গুলো থামাতে।

অল ইন্ডিয়া রেডিও জানিয়েছে যে গত ২ দিন পাকিস্তানি বিমানবাহিনী উত্তরাঞ্চলীয় শহর রাজশাহীতে নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করে ব্যার্থ হয়েছে। তারা বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলা করে। পাকিস্তান আবারো এটাকে মিথ্যা গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছে এবং বলেছে আসল পরিস্থিতির সাথে এর কোন মিল নেই।
Para It: MON
Para 2: MON: UP1.
J OR/ A WB 1845/Park

১৭। বাংলা
১০-৪-৭১ সি-৭৩ ২২৩০ ভারত- পাকিস্তান

ভারতের একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায় শত শত পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারত সীমান্ত অতিক্রম করে চলে আসছে। একজন রয়টার সংবাদদাতা বলছেন এদের অনেকে হিন্দু। ভারত থেকে অন্যান্য অসমর্থিত প্রতিবেদনে পূর্ব বাংলার গ্রেপ্তারকৃত রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সমর্থকদের সাথে অন্তত সাতটি শহরে পাকিস্তানি সেনাদের সাথে যুদ্ধ হয়। কিন্তু পাকিস্তানের সরকারী রেডিও জানায় পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক জীবন ফিরে আসা অব্যাহত আছে। রেডিওতে তারা আরও বলে রাজধানী ঢাকায় একটি নাগরিক শান্তি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর আগে রেডিওতে বলা হয় ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের দুজন সশস্ত্র সদস্যদের পূর্ব পাকিস্তানের ভিতরে বন্দী করা হয়। (যশোর জেলায়)। পাকিস্তান আরও বলেছে ভারত পুর্ব পাকিস্তান হাই কমিশন অফিসে একটি গোপন রেডিও ট্রান্সমিটার বসিয়েছে – তারা সেটিকে সরিয়ে ফেলতে বলে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দলিতে একথা অস্বীকার করে বলে যে কোন অননুমোদিত ট্রান্সমিটার ব্যবহার করা হচ্ছে না।

Refugees:RTR
Clashes,normal
Committee: 2030
Rest: 1700 GIL/MIW 22201BH

১৮। বাংলা
১৩-৪-৭১ এ-১৯ ১২৩০ পাকিস্তান ফলো (হাব)

সম্প্রতি একজন আমেরিকান সংবাদদাতা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি বলেন ঘন জনবসতিপুর্ন জেলায় হাজার হাজার ঘরবাড়ি ও বাঁশের খুঁটি পুড়ে ছাই হয়ে আছে। তিনি নিউজ এজেন্সির সংবাদদাতা। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস জানায় যে শহরে কঠোর কারফিউ জারি আছে। রাতে পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যরা টহল দেয়। এবং রাতে রাইফেলের শব্দ শোনা যায়। ঢাকায় থাকাকালীন প্রতিনিধি জানান পশ্চিম পাকিস্তানী সেনারা বিমানযোগে প্রবেশ করছিল। তবে অপরিহার্য সেবাগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছিল তেমন কিছু লক্ষণ দেখা গেছে এবং দোকানগুলো পুনরায় খুলছিল।

কে ডব্লিউ আই (এক্সএক্স) (0200 থেকে): জাবি 1225: শনি

১৯। বাংলা
১৬-৪-৭১ এ-৪৯ ২৩০০ ভারত-পাকিস্তান (মেইনলি হাবস)
রেডিও পাকিস্তান বলছে যে গত বৃহস্পতিবার পুর্ব পাকিস্তানে চট্টগ্রামের বন্দরের কাছে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎকেন্দ্র উড়িয়ে দেবার ষড়যন্ত্র করা হয়। তবে কোন ক্ষতি করার আগেই পাকসেনারা তাদের হটিয়ে দেয়। রেডিওতে আরও বলা হয় তারা মেঘনা নদীর পাশের পাওয়ার স্টেশনে ডিনামাইট সেট করতে ব্যার্থ হয়।ঢাকায় এখন সরকারী কর্মকর্তা ভারতের বর্ডারে পাকসেনাদের গুলির কথা অস্বীকার করেন।
করেসপন্ডেন্ট বলেন যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী চুয়াডাঙ্গা এগিয়ে যাচ্ছে। এটি শেখ মুজিবুর রহমানের সমর্থকদের একটি অন্যতম শক্ত ঘাঁটি।
থেকে 2000 অস্বীকার MON (পাকিস্তান) চুয়াডাঙ্গা (একটি পি-Neeld) স্যাবোটাজ (টাইমস-Hornsby)

২০। বাংলা
১৭-৪-৭১ সি-৪২ ১৫০০ পাকিস্তান

পূর্ব পাকিস্তানের একদল ঘোষণা করেছে যে তারা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি জনাব নজরুল ইসলামের অধীনে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করেছে। বৈদ্যনাথতলা নামক একটি গ্রামে জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম একটি আমবাগানে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের উপস্থিতিতে একটি ইশতেহার পাঠ করেন। তিনি বিশ্বের সকল সরকারকে তার দেশের মানুষকে সাহায্য করার আবেদন করেন। তিনি তার মন্ত্রীসভার নাম ঘোষণা করেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ এবং জনাব কে এম আহমেদ পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে ছিলেন। ভারত থেকে সীমান্ত হয়ে কিছু বিদেশী সংবাদদাতা সেখানে উপস্থিন ছিলেন।

SNAP 1354.-RTR
Last para fighting new 1300 Pakistan
Dacca 0930 “A ” storx
NK/H
1440/BH

২১। বাংলা
২১-৪-৭১ সি-৩৭ ১১৩০ পাকিস্তান

পাকিস্তানের সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ স্থানীয় ৫ জন নেতাকে কিছু ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য সোমবার ঢাকা হেডকোয়ার্টারে তলব করেছে।
যদি তারা না আসে তাহলে তাদের অনুপস্থিতিতে বিচার করা হবে। পাঁচজন হলেন নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ঊর্ধ্বতন নেতা। তাদের মধ্যে একজন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ – যাকে বিচ্ছিন্নতাকামী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গত সপ্তাহে ঘোষণা করা হয়।

আর ডব্লিউ 06:00 টায় লড়াইয়ের: নতুন 0500

২২। বাংলা
২৮-৪-৭১ সি- ৮৪ ১৯৩০ পাকিস্তান
পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ বলছে সেখানে রাজধানী ঢাকায় খুব সমস্যা হচ্ছে। ওপেন ফায়ারে ৭ জন নিহত হয়। কর্তৃপক্ষ জানায়, সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ড, ছুরিকাঘাত, লুটপাট ও আতঙ্ক সৃষ্টি করার চেষ্টা চলছে। ৪৫ জন আটক হয়েছে। কর্তৃপক্ষ জানায় তাদের একটি সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচার করা হবে এবং দৃঢ়ভাবে দণ্ডিত করা হবে।

ঢাকা অসুবিধা: আর ডব্লিউ 1730 (snapped) 1640): প্রতিবাদ: RTR, সোম
(অল ইন্ডিয়া রেডিও). গিল / MIW

২৩। বাংলা
২৮-৪-৭১ এ-৪৯ ১৯৩০ পাকিস্তান (মেইনলি হাবস)

পুর্ব পাকিস্তানে এক সপ্তাহের অবস্থান শেষে ব্রিটিশ লেবার পার্টির সংসদ সদস্য, জনাব ব্রুস ডগলাস মান-লন্ডনে এসে পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপক নৃশংসতার সুস্পষ্ট প্রমাণ বর্নিত করেন। তিনি অনুমান করেন যে, তার সফরকালীন সময়ে অন্তত এক চতুর্থাংশ মিলিয়ন মানুষ হত্যা করা হয়েছে। জনাব ডগলাস মান বলেন, তিনি ব্রিটিশ সরকারকে পাকিস্তানে শান্তি ফিরে আসার আগ পর্যন্ত তাদের আর্থিক ও অন্যান্য সাহায্য দেয়া বন্ধ করার অনুরধ করবেন। তিনি আরো বলেন, ব্রিটেনের উচিৎ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া।

পি একটি ROY / Ege 1910 / কেএল

২৪। বাংলা
৩-৫-৭১ এ-১৯ ১৩– পাকিস্তান রিলিফ (হাবস)
তিনটি বৃহত্তম ব্রিটিশ ত্রাণ সংগঠন-অক্সফাম. ওয়ার অন ওয়ান্ট এবং খ্রিস্টান এইড – একটি সম্মিলিত বিবৃতিতে ব্রিটিশ সরকারকে পূর্ববাংলার ট্রাজেডি ও গৃহহীন পরিবারগুলোর ভারতে পালিয়ে যাবার বিবরণ দেন। তারা হিসাব করে জানান যে প্রায় এক মিলিয়ন লোকের তাঁবু, গুঁড়া দুধ, শিশুখাদ্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস প্রয়োজন। প্রথম সাহায্য চালান এই সপ্তাহের শেষ দিকে সাপ্লাই করা হবে। পুরো অপারেশন ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সমন্বিত করা হবে।

বিবিসির কমনওয়েলথ সংবাদদাতা স্মরণ করেন যে গত বছর ব্রিটিশ জনগণ পূর্ব পাকিস্তানে সাইক্লোনের সময় ত্রাণ কাজের জন্য অর্ধমিলিয়ন পাউন্ড দান করেছেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানী সরকার ত্রাণ সংস্থাকে পূর্ব পাকিস্তানে কাজ করার অনুমতি দেয় না, তাই কিছু দীর্ঘ মেয়াদী প্রকল্প কার্যকর করা হয় নি। উদাহরণস্বরূপ, চল্লিশ টি ট্রাক্টর ব্রিটেন থেকে পাঠানো হয়েছিল একটি ট্র্যাক্টর প্রশিক্ষণ স্কুল সেট আপ করার জন্য কিন্তু সেগুলো সম্ভবত ব্রিটেনে ফিরিয়ে আনতে হবে।

Dipcorr (WALKER)
DUN
1230/fes

২৫। বাংলা
সি-৫৬ ১৪৩০ কলেরা

আন্তর্জাতিক ত্রাণ অভিযানে সহায়তা করতে ভারতে ইস্ট পাকিস্তানি শরণার্থীদের মধ্যে কলেরার প্রাদুর্ভাব জানা যায়। সেখানে আরো শরণার্থী এখনও সীমান্ত পার হয়ে আসছে। ইতোমধ্যে আনুমানিক সাড়ে চার মিলিয়ন এসেছে। কলিকাতার কাছে দমদম বিমান বন্দরের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে চল্লিশ হাজার শরণার্থীর একটি ক্যাম্প আছে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এখানে এসে পরিস্থিতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে একথা জানান। কলকাতায় বিবিসির সংবাদদাতা জানান উদ্বাস্তু দের মধ্যে কলেরায় মৃত্যু ইতিমধ্যে তিন থেকে চার হাজার হয়েছে এবং এবং মৌসুমী বৃষ্টিপাতের সময় আরো খারাপ হতে পারে। জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সতেরো টন ঔষধ সরবরাহ প্রস্তুত আছে কিন্তু যানবাহনের অভাবে পাঠান যাচ্ছে না। ব্রিটেনে একটি মিলিয়ন ডোজ কলেরা রোধী টিকা বহনকারী একটি বিমান লন্ডন ছেড়েছে। এবং সোমবার রয়েল এয়ার ফোর্স বিমান আরও ভ্যাকসিন এবং মোবাইল হাসপাতালসহ ভারতে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এছাড়াও রয়াল এয়ারফোর্স সিঙ্গাপুর থেকে তাঁবু পাঠাচ্ছে। অন্যান্য আরও অনেক দেশ মেডিকেল সরবরাহ পাঠাচ্ছে এবং এবং জাতিসংঘের আবেদনের প্রেক্ষিতে অনেক দেশ থেকে কয়েক মিলিয়ন পাউন্ড পাওয়া গেছে।

আর ডব্লিউ 1030 কলেরা (যখন-গান্ধী আগমনের নতুন) LVW / DMW1440; ইউপিএল সঙ্গে Je: 201; Dipcorr (Brierly); RTR

২৬। বাংলা
১০-৬-৭১ সি-৪২ ১৩৩০ পাকিস্তান
পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান, সব শরণার্থীদের ভারতে থেকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। তিনি বলেন, তারা তাদের দেশের বাকি অংশের সাথে সমান অংশীদার হিসেবে থাকতে পারে। রেডিও পাকিস্তান বলছে যে তিনি বলেছেন যে রাজনৈতিক নেতাদেরকেও স্বাগত জানানো হবে। সেইসাথে ছাত্র, ব্যবসায়ী, সুশীল সমাজ এবং সশস্ত্র বাহিনী ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদেরও স্বাগত জানানো হবে। জেনারেল টিক্কা খান বলেন সীমান্তে অভ্যর্থনা কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সাথে খাদ্য, আশ্রয়, চিকিৎসা সেবা ও পরিবহন সুবিধা দেয়া হচ্ছে। তিনি আরো বলেন যে পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে। জেনারেল টিক্কা খান বলেন শরণার্থীরা মিথ্যা গুজবের প্রভাবে দেশ ছেড়ে চলে গেছে এবং অকারণে অপুষ্টি ও রোগে ভুগছে।

বিবিসির কমনওয়েলথ সংবাদদাতা বলছেন পর্যবেক্ষকরা জেনারেল টিক্কা খানের বিবৃতির উপর সন্দেহ পোষণ করছেন। পর্যবেক্ষকরা মনে করে শরণার্থীদের পালিয়ে যাবার কারণে পাকিস্তান তার দেশের ভাবমুর্তি রক্ষা করার জন্য এসব বলছেন।

Tikka Khan from 1000 with JTFJRMH 1330/BU Walker D.282

২৭। বাংলা
২০-৬-৭১ সি-২১ ১০০০ পাকিস্তান

পাকিস্তান স্বেচ্ছায় পূর্ব পাকিস্তানে বিদেশী সংবাদদাতাদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। একটি সরকারি ঘোষণায় বলা হয়েছে যেহেতু আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তাই বিদেশি সাংবাদিকরা এখন প্রদেশে প্রবেশের জন্য পূর্ব অনুমতি বা সরকারী রক্ষীবাহিনী ছাড়া পরিদর্শন করতে পারেন। গত মার্চে পরিস্থিতি খারাপ ছিল বলে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। এই মাসের শুরুর দিকে সেন্সরশিপ প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে ভিডিও করার ব্যাপারে বিধিনিষেধ তুলে নেয়া হয়েছে কিনা তা এখনো নিশ্চত না। এছাড়াও চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বিদেশে যাচ্ছে বিদেশি সরকারগুলোকে পাকিস্তানের অবস্থান ব্যাখ্যা করার জন্য এবং পরিবেশ স্বাভাবিক আছে তা জানানোর জন্য।

ভারতে কর্তৃপক্ষ জানায় কলকাতা বিমানবন্দরে রানওয়ের কাছে নির্মিত ক্যাম্পে চল্লিশ হাজার উদ্বাস্তু আছে যাদের সরানোর জন্য জরুরী প্রচেষ্টা চলছে। বিমানসংস্থা অপারেটররা বলেন যে, যদি শরণার্থীদের না সরানো হয়, তাহলে নিরাপত্তার ভিত্তিতে সেবা বন্ধ করা লাগতে পারে।

BAN এএফপি, এপি, ইউপি আমি, এইচ এন (0800 থেকে) ‘এ’ গল্প 2030
রানওয়ে: ক্লেটন N.S (0800 থেকে)
ই পাক. Deleg, এন.কে / বিজেপি (2030 ‘এ’ থেকে)

২৮। বাংলা
৩-৭-৭১ সি-৪১ ১৩৩০ পাকিস্তান এম পি
ব্রিটিশ সংসদীয় প্রতিনিধিদল পাকিস্তান পরিদর্শন শেষ ভারত সরকারের নেতাদের সঙ্গে দিল্লি বৈঠকের পর লন্ডন ফিরে যান। সাবেক কমনওয়েলথ সেক্রেটারি জনাব বটমলে বলেন, তিনি এবং তার প্রতিনিধিদলের অন্যান্য সদস্যদের ধারনা পাকিস্তানে যতক্ষণ রাজনৈতিক সমাধান না হবে ততক্ষণ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসার কোন সম্ভবনা নেই। পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল টিক্কা খানের সাথে মিটিং করে জনাব বটমলে জানান গভর্নর অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে কিছুই জানেন না এবং পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে তার সম্পুর্ন দায়িত্ব অবশ্যই নিবেন।

জনাব বটমলে আবারও উদ্বাস্তুদের সাহায্য করার ভারতীয় প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধীর মনোভাবের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। আরেকটি প্রতিনিধিদল সদস্য, জনাব প্রেন্টিস-সাবেক বৈদেশিক বিষয়ক মন্ত্রী – জানান পূর্ব পাকিস্তানের দুর্ভোগ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে এবং বলেন এখানে মিলিটারি দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা খুবই দুঃখজনক।

আর ডব্লিউ জে 300 (নতুন) যোগ
প্রেন্টিস কারমেন !: পি উ TLL 1330 / mw

২৯। বাংলা
১২-৮-৭১ এ-৩৯ ২২০০ মুজিব

জাতিসংঘের একজন মুখপাত্র বলেছেন, মহাসচিব উ থান্ট, পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যাপারে কূটনৈতিক বঝাপরারর জন্য ব্যাক্তিগত উদ্যোগ নিয়েছেন। মুখপাত্র আরো বলেন যে উ থান্ট প্রকাশ্যে এই ব্যাপার সম্পর্কে কিছু বলার জন্য প্রস্তুত নন। তিনি নিশ্চিত করেন যে, জাতিসংঘের ভারতীয় রাষ্ট্রদূত উ থান্টের হাতে শেখ মুজিবের বিচার সম্পর্কে মিসেস গান্ধীর থেকে প্রাপ্ত একটি যোগাযোগ পত্র হস্তান্তর করেছে।
শেখের বিচার পশ্চিম পাকিস্তানের কোন এক স্থানে গত বুধবার হয়েছে। কিন্তু তার কোন সংবাদ প্রকাশ করা হয়নি এবং এটি জানা যায়নি যে আদৌ শুরু হয়েছে কিনা।

APRTR
EVS/CEG 2135/AN

৩০। বাংলা
১৯-৯-৭১ এ-৩২ ২১০০ থান্ট-পাকিস্তান ( Embergoed till then follows central story)

উ থান্ট তার রিপোর্টে আরেকটি সতর্কবানি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন ভারত উপমহাদেশে যেকোন সময় বড় ধরণের সমস্যা শুরু হতে পারে। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের মৌলিক সমস্যা রাজনৈতিক নিষ্পত্তি ছাড়া সমাধান করা যাবে না। তিনি বলেন রিলিফের জন্য তিনি যে আবেদন করেছেন তা অপ্রতুল। ভারত পাকিস্তান সম্পর্ক পুর্ব পাকিস্তানের সমস্যার অন্যতম কারণ। সন্দেহ নেই যে উভয় দেশ সমাধান চায় তবে সীমান্তে টেনশন বাড়ছে। সীমান্তে নানারকম অবৈধ কর্মকান্ড ঘটছে।

RTR / এএফপি LVT / HYD
1835 / জেএল

৩১।
২৪-৯-৭১ এ-৩৪ ১৮৩০ শিপ
সরকারি মুখপাত্র বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তানে একটি আমেরিকান জাহাজ মাইনে ধন্সগ হয়েছে। এটা ডেল্টা গঙ্গার চালনায় হয়েছে। তিনি এর জন্য ভারত থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীদের দায়ী করেন। জাহাজটি খাবার নিয়ে এসেছিল। সম্প্রতি একটি ব্রিটিশ জাহাজ চালনায় ধ্বংস হয়। বাংলাদেশের আন্দোলনকারীরা এর দায় স্বীকার করেছে।

MON (রেডিও Pax) EVS / DMW 1809 / এমএইচ INF সংবাদ ব্রিটিশ জাহাজে

ব্রিটিশ সরকার নিশ্চিত করেছে যে ট্রেনিংপ্রাপ্ত ডুবুরিরা একটি ব্রিটিশ কার্গো গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটি বারো হাজার টনের জাহাজ। এই টেভিওট ব্যাঙ্কটি চালনা বন্দরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশের আন্দোলনকারীরা এর দায় স্বীকার করে। কলিকাতা জানায় যে ডুবুরিরা লিম্পেট মাইন দিয়ে এটি ধ্বংস করেছে এবং ডুবিয়ে দেবার চেষ্টা করেছে। এর পর গত রবিবার আরেকটি ব্রিটিশ জাহাজ চালনা থেকে রওনা দেয়। এটিকে বন্দুক দিয়ে আক্রমণ করা হয় তবে তেমন কোন ক্ষতি বা হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

৩২।
২৩-৯-৭১ সি-৪৫ ১৩৩০ শিপ
টাইমস:
নিশ্চিতকৃত Dipcorr (Briky): VBO. DGE

৩৩।
৪-১০-৭১ সি-জে ০১০০ পোপ

এই বছরের শুরুর দিকে পোপ পল পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধআক্রান্ত মানুষের জন্য সাহায্যের আবেদন করেন। তিনি এর জন্য প্রার্থনার আয়োজন করেন এবং রবিবার ১ দিনের উপোষ থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি একটি জনসভায় বলেন – তিনি মনে করছেন বিশ্ববাসী চুপ করে বসে থাকবে না। এবং সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসবে। খাদ্য, কাপড় ও ওষুধ দেয়া যেতে পারে। তিনি ভারতে শরনার্থি ক্যাম্পে অসুস্থ, দুর্বল ও রোগাক্রান্ত ৮ লক্ষ শিশুদের জন্য সাহায্যের আবেদন করেন। রিপোর্টে জানা যায়, তিনি সেখানে দুর্যোগের তুলনায় অপ্রতুল সেবা-ব্যাবস্থার কথাও উল্লেখ করেছেন।
HW1600 (A and C)
with more another look at RTR: IJ PI 0035/UWSPS

৩৪। বাংলা
১৮-১০-৭১ এ-৫৫ ২২০০ পাকিস্তান
ব্রিটেন ভারতে শরণার্থীদের জন্য আরও সাড়ে সাত মিলিয়ন পাউন্ড ত্রাণ কাজের জন্য দিয়েছে। আরও এক মিলিয়ন পাউন্ড পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণ কাজের জন্য দেয়া হবে। এটা জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্টের ও হাই কমিশনার ফর রিফুজির প্রিন্স আগা খানের আবেদনের প্রেক্ষিতে দেয়া হয়েছে। এতে ব্রিটেনের পূর্ববর্তী অবদানের চাইতে দ্বিগুণ সাহায্য আসল। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হোম লন্ডনের সংসদে এই ঘোষণা দেন। স্যার অ্যালেক পরে জানান দুই দেশের মধ্যে একটি স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ব্রিটেন সবকিছু করবে।

স্ট্রাসবার্গে, কাউন্সিল অফ ইউরোপ এর কমিটির সতেরো জন সদস্য পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের সহায়তা বাড়ানোর জন্য সরকারগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
আর ডব্লিউ 2100 RTR সঙ্গে কাউন্সিল ব্রিটিশ সাহায্যের উপর snapped 1553

MJH 2158 / Jo

৩৫।
৯-১১-৭১ এ-৩৫ ১৯০০ পূর্ব পাকিস্তান (হাবস)
রিপোর্টে জানা যায় যে পাকিস্তান সরকার যেসব এলাকায় দেশ বিরোধী কর্মকাণ্ড হবে সেখানে জরিমানার আইন করেছে। ঢাকায় বিবিসির সংবাদদাতা জানান বিদ্রোহী হামলা বেড়ে যাওয়ায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। রাজধানী ঢাকায় বিদ্রোহীরা অনেক সাহস দেখাচ্ছে। একটি ঘটনায় একটি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রধারী বিদ্রোহী বাহিনী একজন স্টেশনমাস্টারকে ও তিনজন রেলওয়ে পুলিশকে ধরে নিয়ে যায়। আমাদের সংবাদদাতা বলছেন স্কুলে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে।

Robson N65. N66.
LVT / CEG 1845 / এএন

৩৬। বাংলা
১৭-১১-৭১ সি-৩৯ ১২০০ ঢাকা
পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়েছে। ভোরবেলা সম্প্রচার মাধ্যমে মানুষকে পরবর্তি নোটিশ না দেয়া পর্যন্ত বাড়ীতে থাকতে বলা হয়। ঘরে ঘরে তল্লাসি চলছে। সব লাইসেন্সবিহীন অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দিতে বলা হয়েছে। যদি জমা দেয়া হয় তাহলে যারা জমা দেবে তাদের বিরুদ্ধে মিলিটারিরা কোন একশন নেবেনা বলে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। সকল ট্রাফিক স্থগিত করা হয়েছে। শুধু অ্যাম্বুলেন্স ও বিদ্যুৎ বোর্ডের যানবাহন ও পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনস চলাচল করবে। রাজধানীর ছয়টি পুলিশ ডিস্ট্রিক্ট ব্রিগেডিয়ারদের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে।

গতমাসে ঢাকা এবং ঢাকার আশেপাশে গেরিলা কার্যকলাপ হয়েছে। বোমা বিস্ফোরণ এবং গুলিতে অনেক লোক হতাহত হয়। বিদ্যুৎ সাপ্লাই বাধাগ্রস্ত হয়। স্কুলে আক্রমণ করে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়।

আর ডব্লিউ 1100 (যখন নতুন)
পটভূমি সংবাদ তথ্য দিয়ে: RWS / FJG 1135 / থানা 37.

৩৭। বাংলা
২৩-১১-৭১ সি-৫৩ ১৪০০ পাকিস্তান-ভারত
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। রেডিও পাকিস্তান বলছে জরুরী কারণে আগ্রাসনের হুমকির জন্য রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান এই ঘোষণা দিয়েছেন। সকল আভ্যন্তরীণ বিমান বন্ধ করা হয়েছে এবং পাকিস্তানিরা বলে যে যশোর বিমানঘাঁটি ভারতীয় আর্টিলারির পাল্লার ভেতর চলে এসেছে। পাকিস্তান জানায় যশোরে ক্রমাগত আক্রমণ হচ্ছে। এতে সীমান্ত দিয়ে প্রায় ১ লক্ষ ভারতীয় সেনা অস্ত্র নিয়ে নিয়জিত আছে। ভারত এটা অস্বীকার করে বলে যে পূর্ব বাংলার গেরিলাদেরকে ভারতের সৈন্য বলে চালানো হচ্ছে। অল ইন্ডিয়া রেডিও জানায় গেরিলারা পূর্ব পাকিস্তানের সিলেট জেলার ভেতরে অগ্রসর হচ্ছে এবং যশোর ও রংপুর অঞ্চলে তীব্র যুদ্ধ চলছে। রেডিও পাকিস্তান বলেছে যশোর, সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে তীব্র যুদ্ধ চলছে। কিন্তু শত্রু অগ্রগতি থামানোর চেষ্টা চলছে এবং ভারী হতাহত হচ্ছে।

RW 1130
Grounded: Snap 13J5,. Robson IC3,’
Emergency.. 0858, Pak. charge.. 2300;
India react.. 0100:’India guerrs. & AIR: 1130
Pak. fghtg.. MON. AP, RTR J MLS
13481J EE

৩৮। বাংলা
২৫-১১-৭১ এ-২১ হাবস পাকিস্তান রিওার্ডেড
পূর্ব পাকিস্তানের সরকার দুর্বৃত্তদের ধরিয়ে দিতে সাহায্য কোড়লে দশ হাজার টাকা পুরস্কার দেয়া প্রস্তাব করেছে। সরকার ঘোষণা দিয়েছে মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধাদের খাদ্য, আশ্রয়, পরিবহণ ও নাশকতামূলক লিফলেট প্রকাশে সাহায্য কোড়লে সেটাও দুর্বৃত্তের সংজ্ঞায় পড়বে।
ঢাকা থেকে রিপোর্ট বলে যে দুটি বিস্ফোরণে শহরের ১০ মাইল দুরে কাজলায় একটি কারখানা ধ্বংস হয়েছে।

এপি
আহমদ N13; Dun 1200 / পি এস

৩৯।
২৭-১১-৭১ সি-২ ০০৩০ পাকিস্তান-দুই
অল ইন্ডিয়া রেডিও বলছে বাংলাদেশ বাহিনী যশোর ও সিলেটে তাদের ফরোয়ার্ড পজিশনে সংহত হয়েছে এবং চারটি অঞ্চল মুক্ত করেছে। রেডিও জানায় গেরিলারা দিনাজপুর জেলার পঞ্চগড় শহর দখল করেছে। এছাড়া যশোরের উপকণ্ঠে একটি ভয়ানক যুদ্ধ চলছে বলে রিপোর্টে জানা যায়। অন্যান্য এলাকায় ভারী যুদ্ধ চলছে। রেডিও জানায় দিনাজপুর সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় বাহিনীর হামলায় ৮০ জন পাকসেনা নিহত হয়েছে।

MON (বায়ু): RTR 80 মৃত 1800 পিডব্লিউ 0025 / নতুন

৪০। বাংলা
৩০-১১-৭১ এ-৩৪ ১৩৩০ ইন্দো-পাকিস্তান

পাকিস্তান জানায় পূর্ব পাকিস্তানের ভারতীয় বাহিনী যশোর ও সিলেট অঞ্চলে যে হামলা করেছে তা প্রতিহত করা হয়েছে। তবে ভারতীয় বাহিনী জানিয়েছে যে পুর্ব পাকিস্তানের গেরিলারা সফল হয়েছে। তারা জানায় গেরিলারা সিলেট জেলার রাধানগরের নিয়ন্ত্রণ অর্জন করেছে। এবং যশোরের কাছাকাছি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর নাভারংএর অভিযান শুরু করেছে। ঢাকায় একজন সংবাদদাতা বিবিসির মারফত জানান পাকিস্তান আর্মির অভিযোগ করেছে যে ভারতীয় বাহিনী রাশিয়ান বন্দুক দিয়ে যশোর এলাকায় রেলিং করছে। রিপোর্টে জানা যায় ভারত গত সপ্তাহে দুইটি পাকিস্তানী সরকারী পাট গুদাম সহ মোট ৬ টি স্থানে আক্রমণ চালায়। গেরিলারা চট্টগ্রামে অপারেশন চালাচ্ছে। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নবনির্বাচিত সদস্যদের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে যারা বন্দরের নিরাপত্তা উন্নত করার চেষ্টা করবেন।

আর ডব্লিউ 1230 যশোর উপর নিজামউদ্দিন আহমেদ ( “দাবী” এবং “বিদ্রোহী” রেফারেন্স মোছা),
shelled, পাট (এছাড়াও এপিপি) ও চট্টগ্রাম.
ভারতীয় রিপোর্ট নতুন 0930. NH,

৪১। বাংলা
২-১২-৭১ সি-৫০ ১৩৩০ ভারত-পাকিস্তান

ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে পাকিস্তানি স্যাবর জেট উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় বিমানঘাঁটিতে বোমাবর্ষণ করেছে। প্লেন-বিরোধী অস্ত্র দিয়ে সেগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আশু আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। করেসপন্ডেন্টস বলেন অতীতে ভারত সরকার জানিয়েছিল যে এটাকে বলা হয়েছে যে ভারতীয় সেনা পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকেছে। এর আগে পূর্ব পাকিস্তানের রংপুর জেলার অংশে এবং আগরতলা শহরে আর্টিলারি ও মর্টার আক্রমণ হয়। উভয় পক্ষ জানায় ঢাকার উত্তর-পূর্বে সিলেট অঞ্চলে ও যশোরে তীব্র যুদ্ধ হয়েছে।
ঢাকায় একজন পাকিস্তানি মুখপাত্র বলেন, ভারতীয় আর্টিলারি দর্শনা নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত বর্তি রেল শহরে শেলিং করছে। এর আগে ঢাকায় এক সংবাদদাতা, বিবিসির মাধ্যমে জানান পাকিস্তান অভিযোগ করেছে যে ভারতীয় বাহিনী আর্টিলারি দিয়ে কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের প্রধান সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াস নিচ্ছে। রিপোর্ট জানায় সেই চেষ্টা ব্যার্থ হয়েছে।

RW I130 (when new) with snap lead rimed 1235 (RTR: AP):
& Nizamuddin (timed 0950) on Darsana; RPH: JG I325.dat

৪২। বাংলা
২-১২-৭১ এ-৫২ ২২৩০ ভারত- পাকিস্তান
ঢাকায় বিবিসির বিশেষ সংবাদদাতা জানান গেরিলারা ধীরে ধীরে তাদের কার্যক্রম জোরদার করছে এবং সেনাবাহিনী বিশ্বাস করে যে, ঢাকায় অন্তত দুই হাজার গেরিলা আছে। তিনি জানান সর্বশেষ ঘটনায় রাজধানীতে হাল্কা অস্ত্র দিয়ে গুলি চলেছে এবং ঢাকার উপকণ্ঠে দুটি গ্রামের কিছু অংশে অগ্নিসংযোগের ঘটন ঘটে। গুলিবিদ্ধ হয়ে অনেকে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন যাদের মধ্যে তিন জন্য সৈন্য আছেন। পুলিশ রিপোর্ট অনুযায়ী, শহরে একটি পেট্রোল পাম্প উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এবং আমাদের সংবাদদাতা বলেছেন এলাকার বিভিন্ন স্থানে সামরিক সার্চ চলছে।

রবসন 112.
SPS 2205 / সিএ

৪৩। বাংলা
৩-১২-৭১ এ-৪৭ ২২০০ হাব পূর্ব পাকিস্তান
রিপোর্ট জানয় পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত বরাবর ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধ অব্যাহত আছে। পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক গভর্নর ডঃ আব্দুল মালেক একটি সতর্কবার্তা দেন যে পাকিস্তান একটি বিধ্বংসী যুদ্ধের মুখোমুখি আছে। ঢাকায় একজন সংবাদদাতা বিবিসিকে জানান শমসেরনগর, দিনাজপুর, যশোর, রংপুর, খুলনা ও ময়মনসিংহ সহ সব অঞ্চলে ভারী যুদ্ধ চলছে। আমাদের সংবাদদাতা জানান পাকিস্তান সেনাবাহিনী দাবি করে যে ভারতকে জবাব দেয়া হচ্ছে এবং তাদের হতাহতের পরিমান অনেক বেশী। অল ইন্ডিয়া রেডিওতে ভারতীয় বাহিনী বলেছে তারা প্রতিরক্ষার জন্য বুধবার থেকে আগরতলা, ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানীতে পাকিস্তানী আর্মির শেলিং বন্ধ করার চেষ্টা করছে। রেডিও বলেছে পূর্ব পাকিস্তানের গেরিলারা ঠাকুরগাঁও ও সিলেটের দক্ষিণ-পূর্ব দিকের শহর শমসেরনগর দখল করেছে। কিন্তু রাওয়ালপিণ্ডির সামরিক মুখপাত্র বলেছে ভারতীয়রা ছোটখাট কৌশলী কাজ কোড়লেও ঠাকুরগাঁওয়ের বিমানবন্দর এখনও পাকিস্তানী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে।

আর ডব্লিউ 2000 (ঠাকুর নতুন 1900 উপর শমসের Ami পাক অস্বীকার) মালিক 1200 এসপি; জায়গার নাম আরো নিজামউদ্দিন 33 2145 / বন্ধ

৪-১২-৭১ এ-৪৭ ২৩০০ ইন্দ-পাকিস্তান (ফলোস ওয়েস্ট)

পাকিস্তান দাবী করেছে যে তারা ৪৬ টি ভারতীয় বিমান ক্ষতিগ্রস্ত করেছে – যাদের মধ্যে ফাইটার ও বোম্বার উভয় প্রকারের বিমান আছে। রেডিও পাকিস্তান জানিয়েছে যে ৫ জন ভারতীয় পাইলটকে বন্দী করা হয়েছে। ভারত বলছে তারা এগারোটি প্লেন হারিয়েছে এবং তেত্রিশটি পাকিস্তানি বিমান ধ্বংস করেছে। তারা বলেছে এর মধ্যে ৯ টি পাকিস্তানি এয়ারক্র্যাফট করাচীর কাছে ভূপতিত হয়েছে। সব বিমান পূর্ব পাকিস্তান বেইজের।
ঢাকায় বি বি সির বিশেষ প্রতিনিধি বলেছেন শহরে ক্রমাগত বিমান স্থাপনায় ভারতীয় বিমান রকেট ও কামানের শেলিং করছে। তিনি দুইটি বিমানকে গ্রাউন্ড টায়ারের আক্রমণে ভূপতিত হতে দেখেন।

R W 2 J30 & 2030 C. (when 46 new) with MON, RTR: AP : UPI on details Robson N126
SPS 2240/BJF

৪৪। বাংলা
৬-১২-৭১ এ-৫৮ ২২৩০ ভারত-পাকিস্তান
ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ নিয়েছে। ভারতীয় সামরিক মুখপাত্র বলেন, তাদের বাহিনী পনেরটি পয়েন্ট থেকে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। তারা পশ্চিম ফ্রন্টে বিজয় দাবি করেছে। পাকিস্তানও উভয় ফ্রন্টে স্থল ও আকাশপথে সফলতার কথা বলেছে। ভারত বলছে যশোর সেক্টরে প্রচণ্ড লড়াই চলছে। তবে কিছু বাহিনী রাজধানী ঢাকা আক্রমণের ব্যাপারে উৎসাহী। একজন সামরিক মুখপাত্র বলেন ঢাকা ও যশোরের মধ্যে সড়ক লিঙ্ক কাটা হয়েছে এবং ক্যারিয়ারবোর্ন প্লেন ঢাকার কেন্দ্রে আঘাত করেছে। তিনি দাবী করেছেন, ঢাকার উভয় বিমানঘাঁটি অচল করে দেয়া হয়েছে। এবং চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও চালনার পোতাশ্রয়ে আক্রমণ করা হয়েছে।

এএফপি: পি: UPI: সঙ্গে RTR “সি” গল্প & MON (বায়ু: আরপি) (14) RLB AGB VOC

৪৫। বাংলা
৮-১২-৭১ এ-১১ ১৩০০ ইন্দো-পাক – দুই (মেইনলি হাবস)

একজন ভারতীয় সেনা মুখপাত্র বলেছেন, ভারতীয়রা ঢাকার ৩০ মাইল (৪৮ কিলোমিটার )অদূরে কুমিল্লা শহরের বিমানবন্দর দখল করেছে এবং চারিদিক থেকে কুমিল্লা আসছে।

ঢাকা রেডিও পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য অংশে হিংস্র যুদ্ধে রিপোর্ট করেছে। পাকিস্তান ভারী ভারতীয় চাপ সত্ত্বেও লাকসাম দখল করে আছে। তারা রংপুর ও দিনাজপুর এলাকায় ভারতীয় আক্রমণকে প্রতিহত করে দিচ্ছে। ঢাকা রেডিও জানায় সিলেটে ভারতীয় হেলিকপ্টার বাহিত সৈন্যবাহীনিকে দমিয়ে দেয়া হয়েছে।

অল ইন্ডিয়া রেডিও বলছেন যে পূর্ব পাকিস্তানে লড়াই শুরু হবার পর থেকে ভারতীয়রা পাকিস্তানের আঠার শত জন বন্দী করেছে এবং ৪০০ পাকসেনা হত্যা করেছে।
MON (DACCA):
JMS/RMH (II) J307/JH

৪৬। বাংলা
১০-১২-৭১ এ-৪৪ ১৯৩০ ইন্দো-পাক- দুই

আমাদের সংবাদদাতা বলেছেন ক্যাম্ব সেক্টরে ভারতীয় ভূখণ্ডের প্রায় পঞ্চাশ বর্গমাইল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যা অস্থায়ী ছিল। ভারতীয়রা বলেছে উত্তর ক্যাম্ব সেক্টরে তারা যুদ্ধবিরতি লাইন বরাবর বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানিদের পুশব্যাক করেছে।

পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয়রা কিছু এলাকায় শক্ত প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু তারা হেলিকপ্টার এবং স্টিমার ব্যবহার করে সৈন্যদের মেঘনা নদী পার করিয়েছে এবং ঢাকার পঁয়তাল্লিশ মাইল (প্রায় ৭০ কিলোমিটার) উত্তর পূর্বে একটি বড় ঘাঁটি স্থাপন করেছে। তারা বলেছে এই পয়েন্ট থেকে ঢাকা সরাসরি হুমকির সম্মুখীন। এবং তাদের বাহিনীর কোন বড় প্রাকৃতিক বাধা নাই। ভারতীয় বাহিনী দক্ষিণ-পূর্ব ও পশ্চিম থেকে রাজধানীর দিকে আগাচ্ছে। এর মাঝে অনেক নদী আছে যেগুলো ঢাকার প্রাকৃতিক ডিফেন্স দিচ্ছে। রাজধানীতে কয়েক ঘণ্টার জন্য রেডিও পাকিস্তান সম্প্রচার বন্ধ করা হয়েছে এবং ভারত বলছে এটা হয়েছে ট্রান্সমিটারের উপর বিমান বাহিনীর রকেট হামলার কারণে।

আর ডব্লিউ 1700 রান নিগ্ গল্প.
ব্যারন্স খাগড়া 1545 প্রতিরোধী 1430. RWS / Ege. copters 113V. ডি রেডিও 1522 snapped (ব্যাপার 01) 00)
1910 / PMS

৪৭। বাংলা
১২১২৭১ এ-২১ ১২৩০ ইন্দো-পাকিস্তান – এক

পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয়রা রাজধানী ঢাকার চারপাশে প্যারাট্রুপ্স নামিয়েছে। স্থল বাহিনী শহরের দিকে আগাচ্ছে। ভারতের পূর্ব অঞ্চলের কমান্ডার মেজর জেনারেল জ্যাকব বলেন, গতকাল আকাশপথে অপারেশন চালানো হয়েছিল এবং তারা সফল হয়েছেন। কিন্তু তিনি কোনও বিবরণ দেন নাই। ভারতীয় কমান্ডার আরো বলেন যে স্থল বাহিনী যারা আগে মেঘনা নদী পার হয়েছে তারা শহরর প্রায় বিশ মাইল (৩২ কিলোমিটার) এর মধ্যে আছে। তারা কিছু বাঁধার সম্মুখীন হয়েছে। ভারতীয়রা জানায় তাদের সৈন্য এখন নদীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এবং তারা কুমিল্লার সব এলাকার দখল নিয়েছে। মেজর জেকব আরও বলেন ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ইউনিট খুব সক্রিয় এবং ঢাকায় যুদ্ধ চলছে।

MON ( AIR) 0;1 Jacob (first at 0900)
Chittagong , domination Meghna ( now)
PAK 110 surrender 0900 MJS/JCA
1220/kt

৪৮। বাংলা
১৩-১২-৭১ এ-১৬ ১৩০০ ইন্দো-পাকিস্তান – এক

ভারতীয়রা বলছে তাদের বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার দিকে যাচ্ছে এবং আরো প্রায়াট্রুপ্স আনা হচ্ছে। সর্বশেষ রিপোর্টে জানা যায় ভারতীয় বাহিনী ঢাকা থেকে বিশ মাইলের কম দূরে অবস্থান করছে। অল-ইন্ডিয়া রেডিও বলছে তারা দ্রুত আগাচ্ছে। কিন্তু ভারতীয়রা বলেছে যেসকল প্যারাট্রুপ্স রবিবার নেমেছে তারা বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছে।

পাকিস্তানিরা বলেছে তাদের সৈন্য ঢাকার উত্তর-পশ্চিমে টাঙ্গাইল জেলায় ভারতীয় প্যারাট্রুপ্সের সাথে যুদ্ধ করছে।

একজন সংবাদ সংস্থার সংবাদদাতা বলেছেন যে ঢাকা এখন নীরব এবং তিনি কোন আর্টিলারী বা যুদ্ধের শব্দ শুনছেন না। তিনি বলেন, সকালে চব্বিশ ঘন্টার কারফিউ কয়েক ঘণ্টার জন্য তুলে নেয়া হয়েছে যাতে করে ভারতীয় আক্রমণ শুরু হবার পূর্বে সবাই শেষ মুহুর্তের কেনাকাটা শেষ করতে পারেন।

Paratroopers, ভারত প্রতিরোধের. বায়ু 1030 UPI সংবাদদাতা উপর, ও টাঙ্গাইল যুদ্ধ
GAP / JCA 1245 / KT

৪৯। বাংলা
১৩-১২-৭১ এ-৫৭ ২২৩০ ইন্দো পি কে-এক (প্রধানত হাবের জন্য)

ভারতীয় সেনাদল ঢাকা অবরুদ্ধ করার প্রাক্বালে পাকিস্তান বাহিনীর প্রধান (জেনারেল নিয়াজী) তার সৈন্যদের বলেছেন শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে। আর তিনি ভারতীয় বাহিনী প্রধান (জেনারেল স্যাম মানেকশ) এর আত্মসমর্পণ করার অনুরোধ অস্বীকার করেছেন। ভারতীয়রা বলেছে দুটি সাঁজোয়া কলাম সামনে নিয়ে ঢাকার উত্তর পশ্চিমে টাঙ্গাইল থেকে প্রায়াট্রুপার এগিয়ে যাচ্ছে এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নরসিংদী থেকে আগাচ্ছে। কিছু আগাম ইউনিট ঢাকার আর্মি বেইজ এর উত্তরে সেখান থেকে আর রাজধানীর সংবাদদাতা জানান শহরের ৯ মাইল দক্ষিণে ধর্মঘাঁট নদীর কাছে ভারতীয় সৈন্য অবস্থান করছে। ভারত বলছে এখনও খুলনার কাছে দৌলতপুর সেনা ঘাঁটিতে যুদ্ধ চলছে। এবং সৈনিকরা দক্ষিণের চালনা বন্দরে শক্ত প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছে। নয়া দিল্লি থেকে একজন মুখপাত্র বলেছেন ভারতীয় বাহিনী নদীর নেটওয়ার্কের কারণে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।

RTR সঙ্গে “সি” গল্প: MON (বায়ু, আরপি) পি: এএফপি
অবস্থান এবং বিবরণ GJ উপর / এজি বি 2200 / উদাঃ

৫০।
১৫-১২-৭১ এ- ২৪ এডিডি স্ন্যাপ লিড ইন্দো- পাকিস্তান- এক

সংবাদদাতারা জানান ঢাকার উপকণ্ঠে কামানের শব্দ শোনা যাচ্ছে। বিশেষ করে সকালের পর থেকে উত্তর-পূর্ব অংশে জোরালভাবে শোনা যাচ্ছে। ভারতীয় বিমান ঢাকায় লিফলেট ফেলছে। এখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ এর বক্তব্য লেখা। জেনারেল মানেকশ ভারতীয় সৈন্যদের বিদেশী নাগরিকদের এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের সম্পূর্ণ সুরক্ষা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। লিফলেটে সমস্ত সৈন্য ও আধা সামরিক বাহিনীর যারা আত্নসমর্পন করবে তাদের সাথে ন্যায্য ব্যাবহার করতে বলা হয়েছে।

Robson / BRILEY N.21: 1330 / JII

৫১। বাংলা
১৫-১২-৭১ এস ৪ স্ন্যাপ লিড ভারত-পাকিস্তান-এক

ভারতীয়রা বলেছে তারা ভারী কামান দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় বোমাবর্ষন করছে এবং ভারতীয় সৈন্য এবং বাংলাদেশের গেরিলারা আউটার ডিফেন্স এ আক্রমণ করছে। ঢাকা থেকে প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে জানা যায় রেড ক্রস ও পাকিস্তানি কমান্ডার জেনারেল নিয়াজীর মধ্যে যুদ্ধবিরতির জন্য যোগাযোগের চেষ্টা চলছে। কিন্তু এখনও সিদ্ধানে পৌঁছানো হয়নি। জানা যায় যে ঢাকা ও তার আশেপাশে আক্রমণ চলছে – বিশেষ করে জেনারেল নিয়াজির হেডকোয়ার্টার ও অন্যান্য মিলিটারি স্থাপনার উপর।

BRILE Y H 21 LVT. 1310/LS

৫২। বাংলা
১৫-১২-৭১ এ-১৭ ১২৩০ ইন্দো-পাক – এক

এক রিপোর্টে বলা হয়েছে যে ভারতীয় মুখপাত্র বলছে যে ভারতীয় বাহিনী টঙ্গী শিল্প শহরতলীর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। রেডিও পাকিস্তান থেকে সর্বশেষ রিপোর্ট বলেছে যে ভারতীয় বাহিনী শুধুমাত্র ঢাকার উপর চাপ সৃষ্টি করছে। এর আগে পাকিস্তানি রেডিও বলেছে ভারতীয় প্যারাট্রুপ্সকে তারা ভূপতিত করেছে এবং তাদের অগ্রগতি থামিয়ে দিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক সরকারের পদত্যাগ করার জন্য ঢাকায় পাকিস্তানের শেষ দায়িত্ব এখন সেনাবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল নিয়াজীর হাতে। পাকিস্তানী কিছু সিনিয়র সরকারী কর্মচারি গতকাল ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে অবস্থান নেন – কারণ এটিকে একটি নিরাপদ এলাকা হিসেবে মনে করা হচ্ছে।

ভারতীয়রা জানায় অন্য একটি অপারেশনে তারা বৃহত্তম বন্দর চট্টগ্রাম থেকে চার মাইল (৬ কিলোমিটার) দুরে অবস্থান করছেন। এর আগে তারা জানায় বিমানের রকেট হামলায় বন্দর এখন অব্যবহারযোগ্য।
TONG !: ইউপিএল
ঢাকা 0250 ভারতীয়দের; পাক Rad. সোম ,. পি
পদত্যাগ 1600 Chiltagong 500 1220 / কেএল

৫৩। বাংলা
১৬-১২-৭১ সি-৭৪ ১৩৩০ লিড ভারত-পাকিস্তান

পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ শেষ হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। রেডিও পাকিস্তান বলেছে যে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে এবং ভারতীয় বাহিনী রাজধানী ঢাকায় প্রবেশ করেছে। পাকিস্তান বলেছে স্থানীয়ভাবে পাকিস্তান ও ভারতীয় সেনা কমান্ডারদের মধ্যে একটি ব্যবস্থা গ্রহণের পর এই অবস্থা হয়েছে। দিল্লিতে সংসদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী বলেন, দুই পক্ষের প্রতিনিধিরা ঢাকায় একটি আত্মসমর্পণ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। মিসেস গান্ধী বলেন পাকিস্তানের নিঃশর্ত চুক্তি ছিল। তিনি বলেন, তিনি আশা করেন পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান — যিনি পশ্চিম পাকিস্তানে অবরুদ্ধ আছেন – তিনি দ্রুত তার নিজের জায়গা করে নেবেন এবং বাংলাদেশকে শান্তির পথে এগিয়ে নেবেন। মিসেস গান্ধী বলেন ভারতীয় বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে প্রয়োজনের অধিক সময় অবস্থান করবেনা। এবং তিনি যোগ করেন, লাখ লাখ শরণার্থী ইতিমধ্যে স্বদেশাভিমুখে রওনা হয়েছে।

এর আগে দুই ভারতীয় জেনারেল ঢাকা আসেন এবং দিল্লীতে বিবিসির সংবাদদাতা বলেছেন তারা নুন্যতম অনিয়ম ছাড়া সম্পুর্ন প্রক্রিয়া যাতে শেষ হয় সেটা তদারক করতে গেছেন।

পাকিস্তান ১২৫৬ পরাজয় স্বীকার করে;
আত্মসমর্পণের ছবি (প্রথম ১২০৭)
ওসমান 101 / শেখ উপর RTR / Ringmain সঙ্গে. ROY / এন কে 131 ওহিও

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৮৮-a। বিবিসির এশিয়া বিষয়ক আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ বিবিসি লন্ডন ২৭ মার্চ ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৮৮-a, ৪৮৭-৫২৬>

এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
পাকিস্তানের বিষয়ে ব্রিটিশ প্রেস

১।
২৭ মার্চ – উইলিয়াম ক্রলি (৮)

আজ সকালে সকল ব্রিটিশ পত্রিকা ব্যাপকভাবে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট নিয়ে লিখেছে। বেশিরভাগ কাগজপত্র শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্ববাংলার স্বাধীনতার ঘোষণার উপরে রিপোর্ট করে। এবং গৃহযুদ্ধের উপরে বর্ণনা করে। বেশিরভাগ কাগজপত্র গতকাল জাতির উদ্দেশে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ভাষণ উদ্ধৃত করেছে। পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ রিপোর্টের জন্য তারা ভারত থেকে পাওয়া রিলে খবর এবং প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া এর তথ্যের উপর নির্ভর করে। এগুলোর উৎস ছিল একটি গোপন রেডিও স্টেশন যেখান থেকে শেখ মুজিবের ভাষণ রিলে করা হয়েছিল।

সব রিপোর্ট জানায় যে শেখ মুজিব বাংলাদেশের জনগণের একমাত্র নেতা। এবং যতক্ষণ না শেষ শত্রু সৈন্য পরাজিত হয় ততক্ষণ স্বাধীনতার জন্য তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া উচিত। এছাড়াও বেশ কিছু কাগজপত্র করাচিতে আগমনের সময় জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোর বক্তব্য উদ্ধৃত করে। তিনি বলেছেন ‘সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান রক্ষা পেল।’ ডেইলি টেলিগ্রাফ, পূর্ব পাকিস্তান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল টিক্কা খানের বক্তব্য কোট করে বলে যে পাকিস্তানের অব্যাহত অখণ্ডতা এবং নিরাপত্তা রক্ষার একমাত্র পথ হচ্ছে বর্তমানে সেখানে যে ধ্বংসাত্মক প্রবণতা চলছে তা বন্ধ করা।

গোপন বেতার সম্প্রচারে জানা যায় যে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস এর সদস্যরা চট্টগ্রাম ও অন্যান্য শহরে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের ঘিরে ফেলেছে। টাইমস এবং ফাইনানশিয়াল টাইমস – উভয় পত্রিকা ঢাকায় সৈন্য এবং ট্যাংক মোতায়েন সম্পর্কে সেখানে আমেরিকান কনসুলেটর জেনারেল এর বিবৃত্তি উদ্ধৃত করেছে। বেশিরভাগ পত্রিকা বলছে পূর্ববঙ্গে আনুমানিক ৭০০০০ পাকিস্তানি সেনা অবস্থান করছে।

বেশ কিছু কাগজপত্র এগুলো মূল্যায়ন করে সম্পাদকীয় লিখেছে। টাইমস পত্রিকা মনে করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পুলিশি কর্মকাণ্ড সেখানে গৃহযুদ্ধ শুরু করতে পারে। টাইমস মনে করে গত কিছু সপ্তাহের ঘটনায় মনে হয় পুর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রক্রিয়ায় দেরি হতে পারে। যদিও স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন সাময়িক স্থবির হয়ে যেতে পারে তবে তা দমানো সম্ভব না। টাইমস মনে করে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারেন। সেনাবাহিনীর চাপ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে একশনে যেতে বলেছে।

একটি সম্পাদকীয়তে ডেইলি টেলিগ্রাফ বলেছে কোন সন্দেহ নেই যে পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। সম্পাদকীয় বলছে যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের আলাদা হওয়া যুক্তিসঙ্গত। সম্পাদকীয়তে বলা হয় গত ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর উচ্চাশা জেগেছে যে পুর্ব পাকিস্তান অবশেষে সঠিক সরকারপদ্ধতির দিকে আগাচ্ছে। এখানকার জনগণকে দ্বিতীয় শ্রেণীর জনগণ হিসেবে দেখা হত। টেলিগ্রাফ বলছে সামরিক সরকার যা কিছুই করুক একটি স্থায়ী ও টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যাবস্থা তৈরি করতে পারবেনা।

টেলিগ্রাফের সংবাদদাতা ডেভিড লসাক দিল্লী থেকে এক প্রতিবেদনে বলেছেন সেনাবাহিনী যদি পুর্ব পাকিস্তানের আন্দোলন দমিয়েও দেয় – তথাপি দুই পাকিস্তানকে একসাথে রাখার সম্ভবনা শেষ হয়ে গেছে। তিনি বলেন আলোচনার মাধ্যমে কোন দির্ঘস্থায়ী চুক্তি বা সমঝোতায় আসার সম্ভবনা নেই। দুই অংশ গভীরভাবে বিচ্ছিন্ন। রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের আলোচনা ছিল মূলত সেনাবাহিনীর কাজ শুরু করার প্রস্তুতির জন্য একটু সময় বের করা। গার্ডিয়ান পত্রিকা বলেছে যে এটাই তার উদ্যেশ্য ছিল। গার্ডিয়ান সম্পাদকীয় আর বলে যে যাই হোক না কেন দুর্বিপাক আর রক্তপাত বাড়বে। প্রেসিডেন্ট বলেছেন যেকোনভাবে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করা হবে – এই কথার কারণে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষনা এখন অপ্রতিরোধ্য।

টাইমসের পল মারটিন শেখ মুজিবের সাক্ষাতকার নিয়েছে। তিনি বলেছেন জনগণ তার পেছনে আছে। বন্দুক দিয়ে বাঙ্গালীর মুখ বন্ধ করা যাবেনা। মারটিন সাবেক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের আমলে শেখ মুজিবের কারাভোগের কথা জানান। তিনি মুজিবের একটি উধ্রিতি উল্লেখ করেন – ‘আমি আশাবাদী। আমি সবচেয়ে ভালোটাই আশা করি আর সবচেয়ে খারাপের জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকি।’

গার্ডিয়ান এছাড়াও ব্রিটেনের পুর্ববাংলার বাঙালিদের কার্যক্রম রিপোর্ট করেছে। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় গত রাতে পাক হাই কমিশনের সামনে বিক্ষোভের সময় ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। একজন মুখপাত্র বলেছেন যে বিক্ষোভের কারণ এক্সহিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা উদযাপন। এবং এটা আওয়ামী লীগের ব্রিটিশ শাখা আয়োজন করে। এখানে পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় ১০০ জন ছাত্র সারারাত উৎসব পালন করে।

এছাড়াও গার্ডিয়ান রিপোর্ট করে যে বেঙ্গল স্টুডেন্টস একশন কমিটির একটি প্রতিনিধি দল আজ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জনাব হিথের কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার ব্যাপারে বলার জন্য সাক্ষাতের আবেদন করেছে।

গার্ডিয়ান আরও জানায়, সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অফ রেড ক্রস জানিয়েছে যে তারা পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির উপর নজর রাখছে। গত বছরের বন্যার সময় থেকে পূর্ব পাকিস্তানে তাদের প্রতিনিধি আছে। তারা সেখানে মেডিকেল ও অন্যান্য রিলিফের ব্যাপারে অবগত আছে।
২।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
২৯ মার্চ ১৯৭১
ব্রিটিশ প্রেসে পাকিস্তান বিষয়ে আলোচনা
– বাই মার্ক টালি (এস)

আজ আবার ব্রিটেনের নেতৃস্থানীয় কাগজপত্র ব্যাপকভাবে পাকিস্তানের পরিস্থিতি বর্ননা করেছে। চাক্ষুষ সাক্ষীদের বিবরণ ছাড়াও অনেকে সম্পাদকীয় মতামত ও সঙ্কটের পটভূমি ব্যাখ্যা করেছেন।

টাইমস একজন নেতার মতামত প্রকাশ করেছে যিনি মনে করেন পাকিস্তানের পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে তা বলা অসম্ভব। এই বিষয়ে জড়িয়ে পড়ার জন্য ভারতের উপরে চাপ থাকবে। তবে টাইমস মনে করে যে ভারত এক্ষেত্রে সাবধানী পথ অবলম্বন করবয়ে কারণ তারাও অনিশ্চিত যে কি ঘটতে যাচ্ছে। গেরিলা আন্দোলন বাড়লে চীনের প্রভাব বাড়বে। টাইমস আরও মনে করে পশ্চিমবঙ্গের বাংলাকে একত্রীকরণ আন্দোলন চাঙ্গা হতে পারে যে আসলে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। টাইমস মনে করে যে ইয়াহিয়ার চাইতে মিসেস গান্ধীর সমস্যা কম নয় – কারণ তিনি ইতোমধ্যে সেটা বুঝতে পেরেছেন।

পিটার হ্যাজেলহার্স্ট জনাব ভুট্টো সম্পর্কে টাইমসে লিখেছেন। তিনি বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্যরা একটি শক্তিশালী সংখ্যালঘুর স্বার্থ সংরক্ষণ করছে। কোন চিন্তাশীল পাকিস্তানি বিশ্বাস করবে না যে জনাব ভুট্টো গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনবেন। পশ্চিম পাকিস্তানে চলবে একনায়কতন্ত্র এবং পুর্ব পাকিস্তানে চলবে নির্মম সামরিক শাসন। হ্যাজেলহার্স্ট বলেন সংবিধান প্রণয়ন সঙ্ক্রান্ত আলোচনার সময় ভুট্টোর আচরণ বাঙ্গালীদের চরম অবস্থান নিতে বাধ্য করে। বিশেষ করে তিনি যখন রাষ্ট্রপতিকে ৩ মার্চের এসেম্বলি বন্ধ ঘোষণা করার জন্য চাপ দিলেন তখন। এবং তিনি বললেন তার দলকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তিনি বলেন, ভুট্টো ও প্রেসিডেন্টকে মনে রাখতে হবে শেখের বিচার করা মানে সমগ্র পুর্ব পাকিস্তানের বিচার করা।

টাইমস পল মার্টিনের একটি নিবন্ধ ছাপিয়েছে। মার্টিন বলেছেন যে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম পূর্ব পাকিস্তানে চরমপন্থীদের আন্দোলনকে যৌক্তিকতা দিয়েছে এবং তারা মনে করে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে সহাবস্থান অসম্ভব। এর অর্থ এই যে যারা শেখের অহিংস আন্দোলনের পক্ষপাতী ছিলেন তারা এখন সহিংস বিপ্লবের সমর্থনে থাকবেন।

গার্ডিয়ান শুধু ঢাকা থেকে আসা মার্টিন এডেন্সির একটি দীর্ঘ নিবন্ধ প্রকাশ করে। তিনি বলেন, সেনাবাহিনী সম্ভবত চট্টগ্রাম ব্যতীত বাকি সব জায়গায় তাদের হোল্ড ধরে রাখার চেষ্টা করছে। পূর্ব পাকিস্তানের গেরিলা আন্দোলন আকারে ক্ষুদ্র ও দুর্বল অস্ত্রসজ্জিত। সেনাবাহিনী পুর্ব পাকিস্তানে শক্তি বৃদ্ধি করছে এবং এখন সেখানে তিন ডিভিশন সৈন্য আছে। এডেন্সি বলেন গত সপ্তাহে চট্টগ্রামের ঘটনায় পাক সেনাবাহিনী যে সমস্যায় পড়েছে তাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার হস্তক্ষেপ জরুরী হয়ে পড়েছে। সেখানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রূপ নিতে যাচ্ছে যা আওয়ামী লীগ নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। গত কয়েক সপ্তাহে পূর্ব বাংলার মানুষ স্বাধীনতার ব্যাপারে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। তবে তারা শংকিত যে এতে করে সেনাবাহিনীর কর্মকান্ড জোরালো হবে।

তিনি বলেন যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদ সেনাশাসক দ্বারা সম্পূর্নরূপে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে কারণ সেনা অফিসারগণ বাংলা সহ্য করতে পারেননি। প্রেস্টন মনে করেন এখন আর আপস করার কোন সম্ভবনা নেই। তিনি বলেন যে, ইয়াহিয়া সব শেষ করেছেন, তিনি মুজিবকে শহীদ বানিয়েছেন, একটি রক্ষণশীল আন্দোলনকে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে পরিণত করেছেন এবং তা গনঅভ্যুত্থানে রূপ নেবেই। তিনি সেনাবাহিনীকে অতিরিক্ত ব্যাবহার করেছেন এবং তাকে জাতিসংঘের সম্মুখীন হতে হবে।

ফাইনানশিয়াল টাইমস এর দূরপ্রাচ্য প্রতিবেদক চার্লস স্মিথের একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অসুবিধার একটি আংশিক কারণ হল এটা পাকিস্তানের অংশ। পার্টিশনের পূর্বে পূর্ব পাকিস্তানে পাট, টেক্সটাইল মিল ও উর্বর জমি ছিল কিন্তু পশ্চিমে শুধু মাটি ছিল – কার্যত কোন শিল্প ছিল না। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার বাণিজ্য বন্ধ হওয়ায় ও পশ্চিম পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান শিল্পায়নের ফলে পূর্ব পাকিস্তান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্বভাবতই পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প উৎপাদন খরচ বেশী ছিল।

স্মিথ মনে করেন সেনাবাহিনী স্বল্প মেয়াদে সফল হবে কিন্তু চীন , রাশিয়া কিংবা ভারত স্বাধীনতা আন্দোলনকে তেমন জোরালো সমর্থন দেবেনা। তবে স্মিথ মনে করেন পাকিস্তানের সমস্যা সামরিক কর্ম দ্বারা সমাধান করা যাবে না। তাদের ধৈর্য, সময় ও পারশপরিক সংযম প্রয়োজন।

ডেইলি টেলিগ্রাফ একজন নেতার বরাত দিয়ে বলেছে বর্তমান ট্রাজেডি আইয়ুব খানের শাসনামলে বেশী বিস্তার লাভ করে কারণ এই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানকে চরম অবহেলা করা হয়েছে। কাগজে আরও বলা হয়, সেনাবাহিনী বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ধ্বংস করতে পারবেনা। হয় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে আবার গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য আলোচনা শুরু করতে হবে নতুবা দ্রুতই দেশ বিভক্ত হবে। পত্রিকাটি মনে করে সাংবিধানিক আলোচনা আবার শুরু করার জন্য একটি অলৌকিক ঘটনার প্রয়োজন হবে। কিন্তু টেলিগ্রাফ বলে – যদি তারা তা শুরু না করেন তাহলে অবর্ননীয় রক্তপাতের বিনিময়ে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করবে যাতে পশ্চিম পাকিস্তানের কোন লাভ হবেনা।

৩।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
২ এপ্রিল, ১৯৭১
পূর্ব পাকিস্তানে ব্রিটিশ প্রেস
– উইলিয়াম ক্রওলে

আরও কিছু প্রত্যক্ষদর্শীর নানান ঘটনা পত্রিকায় এসেছে যারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে সম্প্রতি এসেছেন। ব্রিটিশ প্রেস আজ সকালে পূর্ব বর্ণিত ঢাকা ও প্রদেশের অন্যান্য শহরে হত্যার রিপোর্ট নিশ্চিত করেছে। অধিকাংশ কাগজপত্র যশোর শহরের পরিস্থিতির উপর পশ্চিমা সাংবাদিকদের রিপোর্টকে প্রাধান্য দিয়েছে। একজন টাইমস প্রতিবেদক নিকোলাস টমালিন – যিনি গতকাল ভারত থেকে যশোর এসেছেন – তিনি জানান – বাঙ্গালী বাহিনী ও বেসামরিক লোকেরা পাঞ্জাবি সৈন্যদের দ্বারা যশোরে বেসামরিক নাগরিক হত্যার প্রতিবাদ হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানি বেসামরিক নাগরিকদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করছে। টমালিন বলেন যে তিনি ‘পাঞ্জাবি বন্দী’দের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা দেখেছেন। কিছু পর্যবেক্ষক বলেন যশোরের অবস্থা পূর্ব পাকিস্তানের অন্য এলাকাগুলোর সাদৃশ্যমূলক পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা দেয়। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা যশোরে তাদের সেনা প্রত্যাহার করেছে এবং বাঙ্গালীদের কাছে ছেড়ে দিয়েছে এবং এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। কিন্তু নিয়মিত সৈন্য দিয়ে পুনরায় হামলা চালিয়েছে। (স্কটসম্যান পত্রিকা একজন সুইডিশ সাংবাদিকের বরাত দিয়ে জানায় – যিনি নিজেও যশোরে গিয়েছেন – তিনি দেখেছেন সেখানে কোন পাঞ্জাবি সৈন্য নেই। তবে তিনি যশোরে বাঙালিদের দ্বারা প্রতিহিংসামূলকভাবে কিছু পশ্চিম পাকিস্তানীদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিশ্চিত করেন।)

এছাড়াও টাইমস কলিকাতায় অবস্থিত পিটার হ্যাজেলহার্স্টের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তিনি সেখানে আসা শরনার্থিদের কাছে জেনেছেন যে কুমিল্লা ও যশোরের বেশিরভাগ স্বনামধন্য রাজনৈতিক নেতাদের পাকসেনারা হত্যা করেছে। হ্যাজেলহার্স্ট জানান অবাঙ্গালী মুসলমান, যারা মূলত বিহার থেকে ভারতে এসেছেন, তারাও যথেষ্ট ভীতির মধ্যে আছেন। হ্যাজেলহার্স্ট বলছেন এদের অনেকেই ভারতে ফিরে আসতে শুরু করেছেন।(তিনি রিপোর্ট করেন যে বিভিন্ন বিহারি মুসলমান গতকাল সীমান্তে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করে পশ্চিম পাকিস্তানে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।) হ্যাজেলহার্স্ট বলেছেন যদিও পশ্চিম পাকিস্তানীরা সমুদ্রপথে অবাঙালিদের পূর্বপাকিস্তান থেকে সরিয়ে নিচ্ছে তবে অনেকেই সেখানে আটকে পড়বে। কারণ প্রচুর পরিমাণে অবাঙ্গালী মুসলমান সেখানে অবস্থান করছে।

টাইমস পত্রিকার সুপরিচিত সাংবাদিক লুই হেরেন, একজন অজ্ঞাত পরিচয় যুবক – যে গত দুই বছর পূর্ব পাকিস্তানে কাটিয়েছিলেন এবং এই সপ্তাহের শুরুতে ঢাকা ত্যাগ করেছেন – এমন একজনের সাক্ষাতকার প্রকাশ করেছেন। এই সাক্ষী দাবি করেন যে, সেখানে চিহ্নিত কিছু লোক আক্রমণের শিকার – এদের মধ্যে আছে আওয়ামী লীগ নেতা, ছাত্র, অধ্যাপক ও তাদের পরিবার এবং হিন্দুরা। তিনি টাইমসকে আরও বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের আসল উদ্যেশ্য ছিল পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও বুদ্ধিজীবীদের নির্মুল করা যাতে করে অন্তত আগামী ১০ বছরে কোন নেতৃত্বের অস্তিত্ব না থাকে।

ডেইলি টেলিগ্রাফ ও গার্ডিয়ান পত্রিকা ভারতের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত পরিস্থিতি এবং পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে সে ব্যাপারে ভারতীয় উদ্বেগের সংবাদকে প্রাধান্য দেয়।

৪।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
৭ এপ্রিল, ১৯৭১
নিউজনোটঃ চট্টগ্রাম
– মার্ক টালি

গতকাল বিভিন্ন জাতীয়তার ১২০ জন মানুষ পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কলকাতায় পৌঁছেছেন। তাদের থেকে পাওয়া রিপোর্ট অনুযায়ী সাংবাদিকরা চট্টগ্রামে কী ঘটেছিল এবং সেখানকার বর্তমান পরিস্থিতি কি সেই ব্যাপারে প্রথমবারের মত একটি সম্মিলিত ধারণা পেতে যাচ্ছেন। একজন বি বি সি সংবাদদাতা এবং ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যমের রিপোর্ট মতে চট্টগ্রাম থেকে আসা উদ্বাস্তুরা জানিয়েছে যে সেনাবাহিনী শহরের নিয়ন্ত্রণ রেখেছে কিন্তু অনেক মানুষ শহর ছেড়ে পালিয়ে গেছে। উদ্বাস্তুরা নিশ্চিত করেছে যে সেখানে ব্যাপক প্রাণহানি হয়েছে এবং সেনাবাহিনী নির্বিচারে মানুষের উপর গুলি চালায়। একজন মিল ম্যানেজার জানায় যে বাঙ্গালীদের মধ্যে কিছু অপরাধী তার মিলে লুটপাট করে ও তার চারজন পশ্চিম পাকিস্তানী সহকর্মী পরিচালককে হত্যা করে। গার্ডিয়ান রিপোর্ট বলছে যে উদ্বাস্তুরা নিশ্চিত করেছে যে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস ও বেঙ্গল রেজিমেন্ট চট্টগ্রামে বিদ্রোহ করেছে। টাইমস রিপোর্ট অনুযায়ী উদ্বাস্তুরা বলেন যে চট্টগ্রামের বন্দর আগুন দ্বারা ধ্বংস করা হয়েছে এটা সত্য নয়।(উদ্বাস্তুদের মধ্যে একটি ছোট্ট দল ডেইলি টেলিগ্রাফকে জানায় তারা কীভাবে চট্টগ্রাম সীমানার উত্তর পশ্চিম দিক থেকে ৪৫ মাইল পেরিয়ে এসেছে যা মূলত বাঙ্গালী নিয়ন্ত্রিত ছিল।)

টাইমস আজ একজন জার্মান প্রযুক্তিবিদের রিপোর্ট ছাপিয়েছে যিনি ঢাকা থেকে কলকাতায় পৌঁছেছেন। তিনি টাইমস সংবাদদাতাকে জানান যে সৈন্যরা শহরের কেন্দ্রীয় অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ রেখেছে। মানুষ খুব ভীতির মধ্যে আছে। তিনি আরো বলেন, জেনারেল টিক্কা খান আগের রিপোর্টমতো জীবিত আছেন।

গার্ডিয়ান পত্রিকায় মার্টিন ওয়াল্কটের একটা লেখা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি ভারত সীমান্তের ২০ মাইল দুরবর্তি চুয়াডাঙ্গায় আছেন। তিনি জানান যে শহর স্থানীয় জনগণের নিয়ন্ত্রণে এবং লিবারেশন ফ্রন্টের সেখানে একটি সামরিক কমান্ড আছে যিনি দক্ষিণ পশ্চিম অংশের অপারেশনের জন্য ভারপ্রাপ্ত। তিনি একজন পশ্চিম পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তার স্বাক্ষাতকার নিয়েছেন যাকে চুয়াডাঙ্গার ২০ মাইল পূর্ব দিকে কুষ্টিয়া শহরে বন্দী করা হয়েছে। তিনি বলেন যে তার কোম্পানি কুষ্টিয়া থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ওয়ালকট বলেন, চুয়াডাঙ্গার মানুষের মনোবল অনেক বেশী কারণ তারা কুষ্টিয়ায় সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করেছে কারণ তারা সেনা কর্তৃক নির্যাতনের কারণে খুবই ক্রুদ্ধ ছিলেন। এটাই সেখানে পাকসেনাদের পরাজয়ের মূল কারণ। ওয়ালকট মনে করেন যে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের যশোর ও খুলনায় ক্যান্টনমেন্ট রেখে অন্যান্য শহরের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা পাকসেনাদের জন্য খুব বিপজ্জনক হয়ে যাবে। ওয়ালকট বলেন সেনাবাহিনী এখন যশোরের নিয়ন্ত্রণ নেবার চেষ্টা করছে।

৫।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
১৩ এপ্রিল ১৯৭১
পাকিস্তানের ব্রিটিশ প্রেস
– উইলিয়াম ক্রওলি

পাকিস্তান সংকটের উপর ব্রিটিশ জাতীয় প্রেস আজ সকালে সেখানকার অভ্যন্তরীণ সামরিক পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক মতামত তুলে ধরেছেন।

টাইমস একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে যা দুই দিন আগে আমেরিকান অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের সাংবাদিকডেনিস নেল্ড ঢাকা থেকে পাঠিয়েছেন। তিনি লিখেছেন শহর এখন আর্মির নিয়ন্ত্রণে তবে হাজার হাজার মানুষ তাদের গ্রামের বাড়ি পালিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেছেন বাঙ্গালীদের বাড়িতে লুটতরাজ একটি স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা এখনও আওয়ামী নেতাদের ও অন্যান্য বিশিষ্ট বাঙালিদের ধরপাকড় করছে। ঢাকায় রাতে কারফিউ চলছে। নেল্ড বলছেন যে গত ১৫ দিনে প্রায় ১০০০০ পাকসেনা পূর্ব পাকিস্তানে এসেছে এবং এখানে এখন প্রায় ৩৫০০০ হাজার সেনা আছে। আগের রিপোর্ট মতে এখানে এখন প্রায় ৭০০০০ সৈন্য আছে যা আসলে একটু বাড়িয়ে বলা হয়েছে।

টাইমস ও দ্য গার্ডিয়ান রিপোর্টে জানা গেছে যে সেনাবাহিনীর পক্ষে পূর্ববঙ্গের সব প্রধান শহুরের দখল নেয়া কয়েক দিনের ব্যাপার মাত্র। টাইমস প্রতিবেদক মতে, পাকিস্তান আর্মির কোন সরবরাহ সমস্যা নাই। সরবরাহের ধারাবাহিকতা বজায় আছে এবং প্রধান জলপথ তাদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। গার্ডিয়ান প্রতিবেদক মার্টিন ওয়ালকট, কলকাতা থেকে রিপোর্ট করেছেন যে, পূর্ব বাংলার পশ্চিম অঞ্চল কয়েক দিনের মধ্যে দমিয়ে রাখা হবে। সেনারা পাকশি সেতুর দখল নিয়েছে যা পূর্ববাংলার দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের যোগাযোগ রক্ষা করে।

টাইমসের পিটার হ্যাজেলহার্স্ট সঙ্কটের আন্তর্জাতিক প্রভাব নিয়ে লিখেছেন। তিনি রিপোর্ট করেছেন যে ভারতে বিদেশি কূটনীতিকদের আশংকা যে, পূর্ববাংলার সীমান্তে ভারত ও পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে একটি ব্যাপক সঙ্ঘর্ষ হতে পারে। তিনি বলছেন পূর্ব বাংলার স্বাধীনতাকামী বাহিনীর সদস্যরা সীমান্ত জুড়ে তাদের ক্যাম্পে অবস্থান নিতে পারে যে কারণে পাকিস্তানী বাহিনী তাদের সীমান্ত জুড়ে অবস্থান ন্যাসঙ্গত মনে করবে। তিনি আরও বলেন ভারতীয় সামরিক কৌশলবিদরা বিশ্বাস করেন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি পূর্ণ বিরোধ বাধলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ভারত-চীন সীমান্তে বেষ্টনী তৈরির ব্যাপারে চিনকে বলতে পারেন।

ডেইলি টেলিগ্রাফের, ক্লেয়ার হলিংওর্থ করাচি থেকে রিপোর্ট করেছেন এবং বলেছেন যে পূর্ব পাকিস্তান আরেকটি ভিয়েতনাম হয়ে উঠছে। তিনি বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসাবে জেনারেল টিক্কা খানের নিয়োগের ফলে সেনাবাহিনী সরকারের সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানের মওকা পেল। তিনি বলেছেন যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক কর্মের ফলে আন্তর্জাতিক বিশ্বে পাকিস্তানের যে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে তা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবেন।

৬.
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
১৫ এপ্রিল, ১৯৭১

পাকিস্তানের উপর প্রেস রিভিউ
– মার্ক টালি

ডেইলি এক্সপ্রেস, একটি জনপ্রিয় ব্রিটিশ দৈনিক, পূর্ব পাকিস্তানের উত্তর পূর্ব অংশে সিলেট জেলা থেকে তাদের প্রতিবেদক ডোনাল্ড সীম্যান এর একটি রিপোর্ট আজ প্রকাশ করেছে। তিনি সেখানে ভোগান্তির একটি কষ্টদায়ক বর্ননা দিয়েছেন। এছাড়া সিলেট থেকে ডেইলি টেলিগ্রাফ এর ডেভিড লোসাক একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন। তিনি জানান যে সৈন্যবাহিনী বর্ষা শুরুর আগে যতদূর সম্ভব ঘরবাড়ি ঘংস করার চেষ্টা করছেন। যদিও যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবেনা। লসাকের মতে যোদ্ধাদের মনোবল এখনো অনেক উঁচু। যদিও তাদের সরঞ্জাম অপ্রতুল। খাদ্য অপ্রতুল। সেনাবাহিনীর কৌশল সর্বাধিক পীড়া দিয়ে জনগণকে হটিয়ে দেয়া এবং এলাকার ক্ষতি সাধন করা। তিনি বলেন সিলেট একটি প্রেতাত্মার শহর। লোসাক বলেন বর্ষার আগে সেনাবাহিনীর এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়া সম্ভব না।

এছাড়া সাইমন ড্রিং যিনি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার আগে ঢাকায় ছিলেন এবং আর্মি আসার পর এলাকা ঘুরে দেখেছেন – টেলিগ্রাফে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন। ড্রিং বলেছেন প্রতিরোধ দীর্ঘস্থায়ী হবে না কারণ তারা পর্যাপ্ত সংগঠিত এবং সূসজ্জিত নয়।

টাইমস এর মাইকেল হরন্সবি একটি রিপোর্ট কলকাতা থেকে লিখেছেন। তার মতানুযায়ী সেনাবাহিনী প্রতিরোধ এখন কমে যাবে। প্রকাশিত স্বাধীন সরকার গঠন এই অবস্থায় কোন ভূমিকা রাখতে পারবেনা। হরন্সবি অস্থায়ী সরকার গঠনের প্রতিবেদন সম্পর্কে সন্দিহান কারণ ভারতীয় রিপোর্ট এই তথ্যের একমাত্র উৎস হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতারের নাম উল্লেখ করছে। হরন্সবির মতে সংকট সম্পর্কে ভারতীয় কভারেজ প্রচার করা মূল উদ্যেশ্য নয়। তিনি দেখিয়েছেন যে ভারতীয় প্রেস বাঙালিদের দ্বারা অবাঙালিদের হত্যার ব্যাপারে তেমন কোন তদন্ত করার চেষ্টা করেনি।

৭.
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
জে স্টোনহাউজ এর সঙ্গে সাক্ষাৎকার
এমপি ও মার্ক টালি

পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতিতে সহায়তা সমস্যার ব্যাপারে আলোচনা।
লেবার পার্টির দুইজন ব্রিটিশ সংসদ সদস্য সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ থেকে ফিরে এসেছেন। তারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছেন। তারা শরণার্থীদের সাথে কথা বলে কি পরিমাণ ত্রাণ দরকার সেটা হিসেব করার চেষ্টা করেছেন। জাস্টিস ফর ইস্ট বেঙ্গল কমিটির পক্ষে ব্রুস ডগ্লাস মান স্বল্প সময়ের জন্য বর্ডার পেরিয়ে পূর্ব বাংলায় আসেন। এবং জন স্টোনহাউজ দুইটি ব্রিটিশ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে সেখানে ত্রাণ কাজের জন্য টাকা সংগ্রহে যান। জে স্টোনহাউজ যিনি গত ব্রিটিশ সরকারের মন্ত্রী ছিলেন তিনি মার্ক টালির সাথে শরণার্থী সমস্যা সম্পর্কে কথা বলেন।

জন স্টোনহাউজ: “এটা একেবারে বিরাট ছিল। আমি যখন সেখানে গিয়েছি তখন ইতিমধ্যে সীমান্ত জুড়ে ৩০০,০০০ শরণার্থী আসা গিয়েছিল। এখন সম্ভবত অর্ধ মিলিয়ন হতে পারে। আমি ভারতীয় কর্তৃপক্ষ যে ব্যাবস্থা করেছে তাতে খুব অভিভূত। তবে যদি এই সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তেই থাকে তবে তা ভারত সরকারের সাধ্যের বাইরে চলে যাবে এবং আমি মনে করি তখন পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোর এগিয়ে আসা উচিৎ।

জন স্টোনহাউজ বলতে লাগলেন সাহায্য দেবার ব্যাপারে কি কি চিন্তা করছেন।

জে এসঃ “দাতব্য সংস্থাগুলো অতীতে অনেক টাকা জোগাড় করেছে এবং আমি বিশ্বাস করি যে, তারা এর জন্য আবারও টাকা ওঠাতে পারেন।শুধু ক্যাম্পে সাহায্য না দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানেও দিতে হবে। আমি মনে করি আছে সরকারী সাহায্যও এখানে করা উচিৎ। আমি মনে করি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আগে যে টাকা তোলা হয়েছে তার কিছু ক্যাম্পেও ব্যাবহার করা উচিৎ। এবং পাকিস্তানে দুর্ভিক্ষ এড়ানোর জন্য কিছু জমা করাও দরকার।

মার্ক টালি: জন স্টোনহাউজ বলেন পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তুদের ত্রাণসাহায্য করার ফলে আরো বেশী মানুষ সীমান্ত পার হতে উত্সাহিত হবে।

জে এসঃ “একজন মানুষ যখন নিজের জীবন নিয়ে শংকিত তখন বর্ডারের ঘটনা নিয়ে সে আদৌ চিন্তিত কিনা সেটা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। সে বের হবার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। ‘

জন স্টোনহাউজ বলেন পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সাহায্য পাবার ব্যাপারে সমস্যায় পড়তে পারে। তবে তিনি বলেন –

জে এসঃ ভয়াবহতা এখন এত বেশী এবং এতটাই শক্তিশালী যে, বড় ক্ষমতাশালী দেশগুলো পাকিস্তান সরকারকে সর্বোচ্চ চাপ দেবে। “তারা যথেষ্ট করেন নাই।যা করা হয়েছে তা দৃষ্টির বাইরে। মি মনে করি আন্তর্জাতিক শান্তির জন্য গুরুতর হুমকি নিয়ে আলোচনা করার জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের একটি তাৎক্ষণিক বৈঠক হওয়া উচিত।

আমি মনে করি ব্রিটেন এই ব্যাআপ্রে পদক্ষেপ নিতে পারে। কারণ ব্রিটেন কমনওয়েলথের সদস্য এবং আমি মনে করি কমনওয়েলথ রাষ্ট্রগুলো কিছু ব্যাবস্থা নিতে পারে। এছাড়াও জাতিসঙ্ঘে ব্রিটেনের অনেক প্রভাব আছে এবং এটা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যাতে পাকিস্তান বিশ্বের মতামত বুঝতে পারে।

ব্রিটেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশের সাথে যোগাযোগ করে পাকিস্তানে যে এইড দেয়া হচ্ছে সেটা পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সন্তোষজনকভাবে সমাধান হবার আগে পর্যন্ত চালিয়ে যাবার ব্যাপারে আলোচনা করত পারে।

৮. এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
১৪ মে ১৯৭১
পূর্ব পাকিস্তান ইস্যুতে প্রেস রিপোর্ট
– উইলয়াম ক্রওলি

আজ সকালে দুইজন ব্রিটিশ সাংবাদিকের রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে যারা পাকিস্তান সরকারের আমন্ত্রণে পূর্ব পাকিস্তান সফরে গিয়েছিলেন।

গার্ডিয়ান পত্রিকায় রয়টারের সংবাদদাতা মরিস কুয়াইন্ট্যান্স একটি রিপোর্ট করেছেন। তিনি জানান বিদেশী সংবাদদাতাদের পাকিস্তান আর্মি সার্বক্ষনিক পাহারায় রেখেছিল এবং তাদের প্রতিবাদের পর তাদেরকে সাধারণ মানুষের সাথে বিনা নজরদারিতে কথা বলতে দেয়া হয়। রয়টার প্রতিবিধি জানান যে সাধারণ মানুষের মধ্যে মুখ খুলতে ভীত দেখা যাচ্ছিল। তিনি বলেন সরকার স্বীকার করেছে যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ৩ মাস আগে যেমন ছিল তেমনটা হতে এক বছর সময় লেগে যাবে। প্রতিনিধি জানান যে পাটশিল্প স্বাভাবিকের চেয়ে ২০% নিচে নেমে গেছে। তিনি বাঙালিদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর এবং অবাঙালির বিরুদ্ধে বাঙালিদের দ্বারা সংঘটিত নৃশংসতার রিপোর্ট উদ্ধৃত করেন।

রাজশাহী থেকে ঘুরে আসা ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিনিধি হার্ভে স্টকুইনের একটি প্রতিবেদন আজ প্রকাশিত হয়। তিনি সেখানে গেরিলা কার্যক্রমের কথা বলেন। তিনি বলেন আর্মি ও সরকারী কর্মকর্তাদের মতে রাজশাহী ও পাবনায় পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট দের কার্যক্রম বাড়তে পারে এবং পশ্চিমবঙ্গে ভারত সীমান্তে নকশালের কার্যক্রম বাড়তে পারে।কিন্তু তিনি মনে করেন বাঙ্গালীরা অনেক ভীতির মধ্যে আছে এবং একজন কমিউনিস্টের সাথে কথার বরাত দিয়ে তিনি জানান পরিস্থিতি বিপ্লবী সহিংসতার দিকে না যেয়ে চরম আকার ধারণ করতে পারে। স্টকউইন মনে করেন গেরিলাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম ভয়ানক হতে পারে। তিনি জেনারেল টিক্কা খানের কথা উধ্রিত করেন – টিক্কা খান বলেছেন নক্সালের কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে তাদের কেউ মদদ দিচ্ছে এবং তার জন্য ভুক্তভোগী হবে সাধারণ জনগণ।

স্টকউইন মনে করেন যদি গেরিলা কার্যক্রম বাড়ে তাহলে কমিউনিস্টরা আরও বেশী করে তাতে অংশ নেবে। সঠিক নেতৃত্বের অভাবে মুক্তিবাহিনীর মনোবল নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তা হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানে এবং বাঙ্গালীদের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানীদের দূরত্ব বৃদ্ধি পাওয়া।

ইয়াহিয়া খান কর্তৃক আন্তর্জাতিক সাহায্য না নেয়ার কারণ হিসেবে স্টকউইন মনে করেন সেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। জাতিসংঘের উপস্থিতি অবস্থা জটিল করে তুলতে পারে। তিনি বলেছেন, যে কোন ত্রাণ মূলত আর্মি-বিহারী জোটের কাছে যাবে যা সরকার স্বাভাবিক মনে করছেন।

৯.
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
১৪ মে ১৯৭১
পাকিস্তান বিষয়ে হাউজ অফ কমন্সে আলোচনা
– মার্ক টালি

গতকাল (শুক্রবার) ব্রিটিশ হাউস অফ কমন্স পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করে। মার্ক টালি গতকাল হাউস অব কমন্সে ছিলেন – তিনি বিতর্কের তাৎপর্য উল্লেখ করেন।

শুক্রবার স্বাভাবিকভাবে কমন্সে বিতর্ক করার জন্য ভাল দিন নয়। সংসদের অনেক সদস্য শুক্রবার তাদের নিজ নির্বাচনী এলাকায় কাটাতে চান। গতকালের বিতর্কও একটি নির্দলীয় আলোচনা ছিল। প্রথমে পেছন থেকে বিরোধী দলের একজন সদস্য বিষয়টি তোলেন এবং পরে সরকারদলীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এটিকে সমর্থন জানান। তাই হাউজের অবস্থান শুধুমাত্র উপস্থিত এম পি দের সংখ্যা থেকে নির্নয় করা সম্ভব ছিলোনা। উপস্থিতি কম ছিল। কিন্তু বিতর্ক ৫ ঘণ্টা স্থায়ী হয়, অনেকে বক্তব্য দেন এবং বিরোধী দল থেকে চার সাবেক মন্ত্রী বক্তৃতা করেন।

হাউজ পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং ব্রিটিশ সরকারকে পূর্ব পাকিস্তানের অস্থিতিশীল পরিবেশের সমাধান এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য বাড়ানোর জন্য পদক্ষেপ নিতে চাপ দেবার ব্যাপারে আলোচনা হয়।

বিতর্ক সম্পর্কে প্রথমেই যেটা বলা যায় তা হল সমস্ত হাউজ পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনায় পাকিস্তান সরকারের উপর আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন বলে মনে করেন। এবং তারা মনে করেন ব্রিটিশ সরকারের উচিৎ সাহায্য করতে এগিয়ে আসা।

মূল বিতর্ক ছিল সাহায্য সংগ্রহের ব্যাপারে। জনাব ব্রুস ডগলাস মান – যিনি মূল আলোচনা উত্থাপন করেন তিনি গত মাসের শেষে পশ্চিম পাকিস্তান ছিলেন। এবং তিনি বর্ডার পেরিয়ে পূর্ব পাকিস্তানেও আসেন। তিনি যা দেখেছেন তাতে তিনি খুব শক্ত ভাবে ব্রিটিশ সরকারকে অনুরোধ করেন পাকিস্তানে সমস্ত সহায়তা বন্ধ করার জন্য। অথবা অন্তত নতুন কোন সাহায্য চুক্তি যেন করা না হয় যতদিন পূর্ব পাকিস্তান থেকে আর্মি সরে না যায়। তিনি মনে করেন অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করা হলে যুদ্ধ থামানো সম্ভব। বৈদেশিক উন্নয়ন মন্ত্রী জনাব রিচার্ড উড বলেছেন যে, সরকার এইড সমস্যা নিয়ে ভেবে দেখছেন। তিনি বিশ্বাস করেন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জন্য অবিলম্বে ত্রাণ সেবা জাতিসংঘ দিতে পারে। সেকারণে ব্রিটিশ সরকার জাতিসঙ্ঘের সেক্রেটারিকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করেন যাতে তারা পাকিস্তান সরকারের কাছে পূর্ব পাকিস্তানে জাতিসংঘের টিম ঢোকার জন্য ব্যবস্থা করতে চেষ্টা করেন। জনাব উড বলেন যে তিনি মনে করেন না যে শুধুমাত্র সাহায্য দিয়ে পাকিস্তানের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা যাবে। তবে তিনি মনে করেন এইড পলিটিক্স ব্যাবহার করে সরকার চাইলে সেখানকার শান্তি ও মানবাধিকারের ব্যাপারে আলোচনা করতে পারেন। কয়েকজন সমস্য মনে করেন সাহায্য বন্ধ করলে সাধারণ জনগণের আরও সমস্যা হতে পারে। তারা সবাই উদ্বিগ্ন।

অনেক সদস্য পাকিস্তানের একতাবদ্ধ থাকার ব্যাপারে মত দেন। সাবেক প্রতিরক্ষা সচিব ডেনিশ হেনলি বলেন যে যদি পাকিস্তান বিভক্ত হয় তাহলে সেখানে অরাজকতা শুরু হবে যা পুরো উপ-মহাদেশের স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকি হবে। অন্যদিকে কিছু সদস্য মনে করেন যে পূর্ব পাকিস্তান তাদের নিজদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করতে পারবে। তবে সাম্প্রতিক ঘটনা দুই অংশের এক থাকাকে অসম্ভব করেছে। জনাব উড বলেন যে তিনি পাকিস্তানে শান্তি পুনরায় ফিরে আসবে এমন সম্ভবনা দেখেন না।

কালকের বিতর্ক থেকে এটা স্পষ্ট যে ব্রিটিশ সরকার স্বাভাবিক পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করার জন্য সব যথাসাধ্য করতে যাচ্ছে। তবে তারা জানেন তাদের ক্ষমতা সীমিত কারণ মূল দায়িত্ব পাকিস্তান সরকারের উপর বর্তায়।

১০।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
ফিনান্সিয়াল টাইমস এর আর্টিকেল
স্বেচ্ছা সমাধানের আবেদন – হার্ভে স্টকউইন
– মার্ক ট্যালি (এস) দ্বারা সম্পাদিত
– ২১ মে, ১৯৭১

ফাইনানশিয়াল টাইমস আজ তাদের বিশেষ সংবাদদাতা হার্ভে স্টকউইনের একটি আর্টিকেল প্রকাশ করেছে। তিনি পাকিস্তান সরকার অনুমোদিত পূর্ব পাকিস্তান পরিদর্শনের সাংবাদিক টিমের অন্যতম একজন সদস্য। এই মাসের শুরুতে তারা এই অনুমতি পেয়েছিলেন। তিনি তার সফর সম্পর্কে লিখেছেন। তিনি মনে করেন সেখানে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। এবং দুর্ভিক্ষ অবশ্যাম্ভাবী। তিনি বলেন বাঙ্গালী ২৫ মার্চের আগে অতিআত্মবিশ্বাসী ছিল। শেখ মুজিব মনে করেন বাঙ্গালীর আকাঙ্খার সাথে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য দায়িত্ব নিতে হবে। তিনি দ্বিধান্বিত এবং রাজনৈতিকভাবে সরল ছিলেন। স্টকউইন বিশ্লেষণ করে দেখেছেন আন্দোলনের পেছনে বাঙ্গালীর প্রবল আবেগ এবং তাদের ভেতরের প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তিও তিনি দেখেছেন। তাদের নিজেদের উপর প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস রয়েছে। এই বিশ্বাস থেকেই আন্দোলন তরান্বিত হয়েছে এবং আইয়ুব খানের পতন হয়েছে। আর্মি সাইক্লোনের পরবর্তি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করলেও পূর্ব বাংলার জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। এছাড়াও তিনি মনে করেন বাঙ্গালিত্তের কারণে বিহারীদের সাথে নানান বিবাদও ঘটছে। তিনি বলেন বিহারী সহ ভারত থেকে আসা উদবাস্তুরাও বাঙ্গালীদের সাথে মিশতে পারেনি। আর্মির ভূমিকা উপরের নির্দেশ অনুযায়ী সব সময় হচ্ছেনা বলে তিনি মনে করেন – যেমনটি গের রিপোর্টে বলা হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিমা বাহিনীর সাইক্লোনের ব্যার্থতা বিশ্বপত্রপত্রিকায় বিরূপভাবে আসায় পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া ভালো ছিলোনা। তবে পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারেও তাদের প্রতিক্রিয়া স্বল্পতা ছিল। স্টকউইনের মতে নির্বাচনের পরেও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া স্বল্পতা ছিল। পুরো নির্বাচন চলাকালীন সময়ে তারা অনেক শান্ত ছিল। এমনকি নির্বাচন পরবর্তি মুহুর্তেও। কিন্তু যখন শেখ পূর্ব বাংলার আন্দোলন নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তখন ছাত্রদের চরম আন্দোলনে সেনাবাহিনী চরম ভয়ংকর ও জাতিগত রূপে আবির্ভুত হতে পারত। তিনি দেখেছেন আন্দোলন কীভাবে দেশ ভাগের আন্দোলনে মোড় নেয়। তিনি দেখেন ঢাকার বাইরে বাঙ্গালীরা প্রথমে অবাঙ্গালি ও সেনাদের উপর চড়াও হয় যার ফলে অবাঙ্গালীরাও বাঙ্গালীদের উপর চড়াও হয়।

১১।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তু:
অব্যাহত উদ্বেগ
– মার্ক টালি (এস)
২৮ মে ১৯৭১

ভারতে উদ্বাস্তুর অব্যাহত প্রবাহের জন্য ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজমান। এই অন্তঃপ্রবাহ এবং সমস্যার কারণ হিসেবে মার্ক টালি কিছু বিষয় বিবেচনায় নিয়েছেন-

প্রায় আট সপ্তাহ ধরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেছেন, ২৫ মার্চ, পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি হয় যা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সেনাবাহিনী চেষ্টা করেছিল। তাছাড়া সরকারি মুখপাত্র জানিয়েছে শুধু আন্দোলনকারীদের দমাতেই নয় বরং বাঙ্গালী- বিহারী কোন্দল নিয়ন্ত্রণ করাও প্রয়োজন ছিল। পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য ও প্যারামিলিটারিতে বাঙ্গালিদে প্রাধান্য থাকায় তাদের সাথে বিহারীদের জাতিগত দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। এগুলোর বিস্তারিত দেখার জন্য আন্তর্জাতিক একটি দলকে পুর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করতে দেয়া হয় এই মাসের শুরুতে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে রেডিও পাকিস্তান বলছে যে পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক।

কিন্তু যদিও প্রদেশ থেকে সংবাদদাতারা কোন রিপোর্ট পাঠাননাই তবুও অন্যান্য প্রমাণাদি বলে পরিস্থিতি স্বাভাবিকের থেকে অনেক দুরে অবস্থান করছে। উদ্বাস্তুরা এখনো পালিয়ে আসছে ভারতে।

ভারত সরকারের হিসাব যে সাড়ে তিন মিলিয়ন উদ্বাস্তু ইতিমধ্যে ভারতে প্রবেশ করেছে এবং তারা এখনও আসছে। যখন খুব দীর্ঘ সীমান্ত দিয়ে এভাবে মানুষ প্রবেশ করতে থাকে তখন সেঁতা গণনা করা অসম্ভব। তবে উদ্বাস্তুদের জন্য জাতিসংঘের হাই কমিশন থেকে আসা দলের শরণার্থী শিবির দেখে সমস্যার তীব্রতা সম্পর্কে সম্যক ধারনা হয়েছে। তাদের পরিদর্শনের পরে জাতিসংঘ মহাসচিব পর উ থান্ট জানান ভারতের প্রতিবেশী রাজ্য পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রচুর মানুষ প্রবেশের অকাট্য প্রমাণ রয়েছে।তিনি ৩ মিলিয়ন পাউন্ড শরণার্থীদের জন্য সাহায্যের ওয়াদা করেন। এই শরণার্থীরা পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত নৃশংসতার গল্প বলেছে। রিপোর্টারদের মন্তব্য অন্য যারা শিবির পরিদর্শন করেছেন তারা সমর্থন করেছেন।

বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে আতঙ্ক দ্রুত ছড়িয়ে পরে। কোন সন্দেহ নেই, অনেক শরণার্থী শুধু সেনাবাহিনী না দেখেই পালিয়ে এসেছে। নিঃসন্দেহে সেখানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, রাহাজানি হয়েছে এবং প্রদেশে লুটপাট হয়েছে। কিন্তু কঠিন বাস্তবতা হল যে প্রায় সব শরণার্থী বিদেশী পর্যবেক্ষকের কাছে জোর দিয়ে বলেন যে তারা সেনাবাহিনীর ভয়ে ভীত ছিল। কেন্দ্রীয় সরকার দুই পাকিস্তানের একতা রক্ষার জন্য এই পদক্ষেপ নিলেও বেসামরিক জনগণকে জীবন রক্ষার জন্য পালিয়ে যেতে হচ্ছে।

পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যাই হোক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেছেন পূর্ব পাকিস্তানে ২/৩ সপ্তাহের জন্য বৃহৎ পরিমাণ সৈন্য মোতায়েন করা হবে। কিন্তু সাধারণ উদ্বাস্তুদের থেকে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যতদিন সেনাবাহিনী বলবত রাখবেন ততদিন পরিস্থিতি কীভাবে স্বাভাবিক করবেন সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে। বরং যদি আরও বহু সংখ্যক শরনার্থি আস্তে থাকে তাহলে তিনি আরও বড় সমস্যায় পড়বেন। একারণেই বিশ্ববাসী শরনার্থিদের থেকে সেনাবাহিনীর কর্মকান্ড জেনে সেই ব্যাপারে আরও উদ্বেগ প্রকাশ করছে।

বাংলা ডন নিউজ টক – ২৮/২৯ মে ১০৯৭১

১২।

এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
শরণার্থীদের ব্যাপারে ব্রিটেনের ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের উপর আলোচনা
৭ ই জুন ১৯৭১
– মার্ক টালি (এস)

গত একসপ্তাহ ধরে ভারতে ইস্ট পাকিস্তান শরণার্থীদের ব্যাপারে ব্রিটিশ প্রেস আরও মনোযোগ প্রদান করেছে। মার্ক টালি গত সপ্তাহের ব্রিটিশ প্রেস থেকে জানাচ্ছেন –

আরো অনেক বিদেশী সংবাদপত্রের প্রতিনিধিরা সীমান্ত এলাকায় আসছে। সংবাদদাতারা উল্লেখ করেছেন যে, পাকিস্তান সরকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক বললেও শরনার্থিদের অনুপ্রবেশ বেড়েই চলছে। তারা বলেছেন যে শরনার্থিদের প্রবেশে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এবং যেসকল রাজ্যের পূর্ব পাকিস্তানের সাথে সীমান্ত আছে তারা অনেক চাপের মুখে আছেন। শরনার্থিদের মধ্যে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। বেশিরভাগ পত্রিকা নেতাদের শরণার্থীদের দুর্দশার ব্যাপারে অবিলম্বে তাদের সাহায্য করার ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছেন। এবং বলেছেন উদ্বাস্তুদের বাড়িতে পাঠানোর জন্য কি করা যাতে পারে।

গত সপ্তাহের মঙ্গলবার এবং বুধবার টাইমস শরণার্থীদের সম্পর্কে আলোচনার জন্য নেতাদের ডেকেছিল এবং আবার আজ একজন নেতাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। সাত দিনের মধ্যে তিন জন নেতাকে সি ব্যাপারে কথা বলার জন্য ডাকায় টাইমস পত্রিকা অবস্থার প্রতি যে অধিকতর জোর দিয়েছেন সেটাই প্রতীয়মান হয়। টাইমস তার পত্রিকার প্রথম পাতায় পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা পিটার হ্যাজেলহার্স্টএর রিপোর্ট ছাপিয়েছে। আজ টাইমসের ডেপিটি ইডিটর লুই হেরেন জানিয়েছেন কেন হ্যাজেলহার্টস্ট এই পরিস্থিতির ওপর প্রতিবেদন করেছেন। তিনি জানিয়েছেন এতই সমস্ত বিশ্বকে নারা দিয়েছে এবং সেখানে লাখ লাখ নিরীহ মানুষের উপর ইতিহাসের অন্যতম মানব সৃষ্ট দুর্যোগের বর্ননা উঠে এসেছে। সম্পাদকীয়তে আজ বলা হয়েছে এই মুহুর্তে কোন রাজনৈতিক সমাধানের পথ নেই যা ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের কাছে কাম্য। তাছাড়া এই মুহুর্তে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন দিলে তা পাকিস্তানকে বিভাজিত করার প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করবে বলে পত্রিকায় মোট দেয়া হয়। টাইমস মনে করে যদি তা হয় তবে তা ভারতের জন্যও হুমকি।

গত সপ্তাহে গার্ডিয়ান, ফাইনানশিয়াল টাইমস এবং ডেইলি টেলিগ্রাফ শরণার্থীদের নিয়ে ব্যাপক কভারেজ দিয়েছে। একটি সম্পাদকীয়তে আজ টেলিগ্রাফ বলছে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির কারণ কি। পত্রিকাটি মনে করেন যে, পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থকে গুরুত্ব দেবে তত দ্রুত সেখানে আইন-শৃঙ্খলা পুনঃস্থাপন করতে তারা সক্ষম হবেন। টেলিগ্রাফ মনে করে যদি পাকিস্তান সরকার এই পথে কাজ করে তাহলে তাদের সব রকমের সহায়তা দেয়া যেতে পারে।

ব্রিটিশ দুটি সাপ্তাহিক এই সপ্তাহে তাদের প্রথম গল্প হিসেবে বাংলার অবস্থার উপড়ে নিবন্ধ তুলে ধরে। বাম পক্ষের নিউ স্টেটসম্যান এবং ডানপন্থী স্পেকটেটর উভয়ে প্রস্তাব করে যে ব্রিটেনের এই ব্যাপারে একটি বিশেষ ভূমিকা নেয়া উচিৎ।

গতকাল তিনটি ব্রিটিশ সানডে পত্রিকা শরণার্থীদের দুর্দশার শিরোনাম করেছে। তারা শরণার্থীদের দুর্দশার খুব মর্মভেদী ফটোগ্রাফ প্রকাশ করেছে। সানডে টাইমস কালার ম্যাগাজিন উদ্বাস্তুদের ছবিসহ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। নিকোলাস টমালিনের আবেদনও প্রকশিত হয় যিনি পূর্ব পাকিস্তানের আর্মি একশন শুরু হবার পরে সেখানে প্রবেশ করেছিলেন। টমালিন বলেন বিশ্বে শরনার্থিদের চাইতে বেশী সহানুভূতি কেউ আশা করতে পারেনা।

আজকের লন্ডন সান্ধ্য পেপারেও উদ্বাস্তুদের উপর প্রতিবেদন এসেছে। সামনে পাতায়। ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড আজ সামনের পাতার প্রায় অর্ধেক জুড়ে জেমস ক্যামেরনের প্রতিবেদন দিয়েছে। ক্যামেরন বলেন যে, তিনি ২৫ বছর ধরে শরণার্থী পরিস্থিতিতে কাজ করছেন কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের শরনার্থিদের মত এত ভয়াবহ পরিস্থিতি তিনি আগে কোথাও দেখেন নাই। তিনি বলেন পশ্চিমবঙ্গ এখন যেসব সমস্যায় জর্জরিত কলেরা সমস্যা তার মধ্যে নগণ্য একটি সমস্যা মাত্র।

১৩।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
পাকিস্তানের প্রেস ও টেলিভিশন
৮ জুন, ১০৭১
– মার্ক টালি (এস)

যেকন মিডিয়ার চেয়ে টেলিভিশন ভারতে উদ্বাস্তুদের দুর্ভোগ ও সমস্যার কথা ভালো করে ফুটিয়ে তুলতে পারে। ভারত সরকার কি ধরণের চাপে আছে তা প্রকাশ করতে পারে। গত রাতে বি বি সি টেলিভিশনে এন্থনি লরেন্সের একটি ভিডিও প্রকাশিত হয় যেখানে দেখা যায় শরনার্থিরা ক্যাম্পে আসার পথেই ধুকে ধুকে মারা যাচ্ছে। ছবিগুলো এতোই বীভৎস ছিল যে প্রদর্শিত করার আগে বলা হয়েছিল যারা গভীর ভাবে মর্মাহত হলেও দেখতে পারবেন শুধুমাত্র তাঁদের দেখতে অনুরোধ করা হল। লরেন্স জানান ভারত সরকারযেসকল ব্যাবস্থা নিয়েছেন এই কঠিন পরিস্থিতিতে সেটা না নিলে ভোগান্তি আর মৃত্যুর পরিমাণ আর ভয়াভহ হত।

এছাড়াও বিবিসি টেলিভিশনে গত রাতে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হোম এর সঙ্গে একটি সাক্ষাত্কার ছিল। স্যার অ্যালেক ত্রাণ তহবিল থেকে এ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকারের নানা অবদান বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ব্রিটেন পাকিস্তানে এইড বন্ধ করবে না যেহেতু সেখানে অবস্থা অত্যন্ত করুন – তবে তারা রাজনৈতিক সমাধান তরান্বিত করতে চাপ দেবেন যার উপর ভবিষ্যৎ এইড নির্ভর করবে।

সকল ব্রিটিশ সংবাদপত্র আজ কলকাতায় যেসকল রিলিফ যাচ্ছে ও গতকাল যেসকল অন্যান্য উন্নয়ন সাধন করা হয়েছে তা বর্ননা করে।

গার্ডিয়ান আরো একটি সম্পাদকীয় লিখেছে যেখানে বলা আছে বিশ্ব সম্প্রদায়ের লজ্জা পাওয়া উচিৎ যে কত ধীরে তারা সব জানতে পারছে। পত্রিকাটি মনে করে এটা এখন স্পষ্ট যে ত্রাণ তৎপরতা সমন্বয়ের জন্য একটি পৃথিবীব্যাপী সমন্বিত আয়োজনের প্রয়োজন এবং তা খুব দ্রুত গঠন করা উচিৎ। ইউ এন সেরা সমন্বয়ের প্রতিষ্ঠান হতে পারে। গার্ডিয়ান বলেছে যে জাতিসংঘ ইতিমধ্যে একটি প্রকল্প বিবেচনায় রেখেছে যা এই বছরের শরত্কালীন সভায় সাধারণ পরিষদে বিবেচনা করা হবে। গার্ডিয়ান স্বীকার করে যে ইউ এন দুর্যোগ সংস্থা তেমন সফল হবে না যদি সরকার সহযোগিতা করতে অনিচ্ছুক হয়। তবে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন যে পাকিস্তান সরকার বাইরের সহায়তা গ্রহণ করবে কিনা। গার্ডিয়ান বলে যে নিরাপত্তা পরিষদ এই ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে পারে যাতে তারা জাতিসঙ্ঘ দুর্যোগ সংস্থার সাহায্য গ্রহণ করতে সরকারকে চাপ দিতে পারে।

সান ট্যাবলয়েড পত্রিকা যেটি খুবই প্রচলিত – এটি তাঁদের সম্পাদকীয়তে জোরালো ভাষায় শরণার্থীদের দুর্ভোগ ও পূর্ব পাকিস্তানে অসুবিধার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে দায়ী করেছে। পাশাপাশি সান মনে করে যে সহায়তা সেখানে পাঠানো হচ্ছে তা কোন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত হওয়া উচিৎ। সেটি জাতিসঙ্ঘও হতে পারে। আরেকটি জনপ্রিয় কাগজ, ডেইলি এক্সপ্রেস, একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। তারা বলে সকল সরকারের উচিৎ তাঁদের সর্বোচ্চ সহায়তা প্রদান করা। এবং পত্রিকাটি পরিস্থিতির জন্য পাকিস্তান সরকারকে দায়ী করেছে।

এছাড়া সাংবাদিক ও টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব ম্যালকম মাগারিজ টাইমস এবং টেলিগ্রাফে লেখা এক চিঠিতে বলেছেন যারা শরণার্থীদের সাহায্য করতে চান তারা কলিকাতায় মাদার তেরেসার চ্যারিটি মিশনারিজে টাকা পাঠাতে পারেন। স্যালভেশন আর্মি মানুষকে তাঁদের কাজ থেকে উপার্জিত অর্থ শরণার্থীদের মাঝে দেবার বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। আজ রাতে টেলিভিশনে বিপর্যয় জরুরী কমিটির একটি আপিল প্রচারিত হবে।

১৪।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
নিউজনোট: সংসদে বিরোধী সদস্যরা মোশন অন পাকিস্তান এর জন্য স্বাক্ষর করেছে
২৬ জুন, ১৯৭১
– মার্ক টালি (এস)

গত রাতে ব্রিটিশ হাউস অফ কমন্স এর বিরোধী লেবার পার্টির সদস্যদের প্রায় অর্ধেক সদস্য একটি মোশন স্বাক্ষর করেন। এটি ছিল পাকিস্তান সরকার কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের উপর নির্ম অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞের উপর। সেখানে বলা হয় পূর্ব পাকিস্তান শাসন করার কোন অধিকার পাকিস্তান সরকারের নেই। আরও বলা হয় জাতিসঙ্ঘ কর্তৃক পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা পর্যন্ত বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার পূর্ব বাংলার জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন অনুযায়ী কাজ করবে। মোশনটির প্রধান স্পন্সর ছিলেন মিস্টার জন স্টোনহাউজ – যিনি সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী ছিলেন।

আরও কিছু সাবেক মন্ত্রী মোশনটি স্বাক্ষর করেন। তাঁদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী জনাব রেগ প্রেন্টিস, ওভারসিজ ডেভেলপমেন্ট এবং জনাব রিচার্ড ক্রসম্যান – সাবেক মন্ত্রী যিনি এখন নিউ স্টেটসম্যান এর সম্পাদকআছেন। ওভারসিজ ডেভেলপমেন্ট এর মিসেস বর্তমান শ্রম মুখপাত্র জুডিথ হার্ট স্বাক্ষর করেনি। টাইমস জানায়, এই মোশন সংসদ সদস্যদের কাছে কমনওয়েলথ দেশের কোন সরকারের ওপর সবচেয়ে বড় আক্রমণ হিসাবে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার ব্যাপারে বিরোধী দলের জনমত বাড়তে থাকে। এবং তারা একমত হন যে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি এখন শুধুমাত্র পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়। তবে লেবার পার্টি পাকিস্তান ইস্যুতে সরকারের পলিসির বিরোধিতা করেনি।

১৫।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
পূর্ব পাকিস্তান থেকে ব্রিটিশ প্রেস রিপোর্ট
৩ জুন, ১৯৭১
– টউইন ম্যাসন (এস)

কয়েকদিন আগে ঘোষণা করা হয়েছিল যে বিদেশি সংবাদদাতাদের পূর্ব পাকিস্তানে অবাধে চলাফেরা এবং রিপোর্ট করতে অনুমতি প্রদান করা হবে। আজ প্রথম তিন জন প্রতিনিধিদের রিপোর্ট প্রকাশিত হয় যারা এই সিদ্ধান্তের ফলে পূর্ব পাকিস্তানে আছেন।

রিপোর্ট করেছেন টাইমস প্রতিনিধি মাইকেল হর্ন্সবি, গার্ডিয়ান সংবাদদাতা মার্টিন উলকট, এবং ডেইলি টেলিগ্রাফ প্রতিবেদক, ক্লেয়ার হলিংওর্থ। ঢাকা থেকে প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় তারা প্রায় একই রকম রিপোর্ট করেছেন। তিনজন সংবাদদাতা মনে যদিও ঢাকায় জীবন শান্ত এবং ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে তবে সেখানে এখনও অন্তর্নিহিত টান, ভয় ও তিক্ততা বিরাজমান। টাইমস সংবাদদাতা, মাইকেল হর্ন্সবি বলছেন যে ঢাকায় দোকানের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ বন্ধ আছে। এবং সেনাবাহিনীর চলাফেরা প্রকট। ডেইলি টেলিগ্রাফ এর ক্লেয়ার হলিংওর্থ বলেছেন সেনাবাহিনী ঢাকার শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করেছে কিন্তু ভয়, ঘৃণা এবং পরোক্ষ প্রতিরোধ বজায় আছে। গার্ডিয়ান প্রতিনিধি মার্টিন উলকট বলছেন “ঢাকার শহর শান্ত, বরং খুব শান্ত। এবং সেখানে বাজারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ছবি বিক্রি হয় কিন্তু মানুষের মাঝে গম্ভীরতা এবং আবেগ প্রতীয়মান হচ্ছে।’

তিনজন সংবাদদাতা জানান ঢাকা বাইরে সামরিক কর্ম ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ অব্যাহত আছে। বিশেষ করে টাঙ্গাইল কাছে মধুপুর বন এলাকায়। তারা বলেন প্রাদেশিক শহরগুলোতে অবস্থা ঢাকার মত ভালো নয়।

১৬।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়ার বিবৃতির উপর ব্রিটিশ প্রেসের আলোচনা
২৯ জুন, ১৯৭১
ইয়ান চার্লটন সম্পাদিত

পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ব্রডকাস্ট গতকাল তিনটি নেতৃস্থানীয় ব্রিটিশ সংবাদপত্রে সমালোচিত হয়েছে।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ব্রডকাস্ট প্রকাশ করে যে তিনি জাতীয় পরিষদের সামনে চার মাসের একটি কমিটি দ্বারা প্রণীত একটি নতুন সংবিধান উপস্থাপন করার পরিকল্পনা করেছেন। সামরিক আইন চলমান থাকবে – যদিও তিনি তার চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে বেসামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলেছেন। কোন নতুন সাধারণ নির্বাচন হবে না। শুধুমাত্র শূন্য স্থানে যেখানে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর অযোগ্যতার জন্য খালি আছে অথবা তার ভাষায় যেসব প্রতিনিধিরা অপরাধমূলক বা সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকায় তাঁদের পদ খালি হয়েছে সেই সকল পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

ডেইলি টেলিগ্রাফ নোট করে যে পূর্ব পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাংবিধানিক পরিকল্পনার সাথে রিপোর্টে প্রকাশিত অভিশপ্ত পূর্ববাংলার ঘটনাবলী জড়িত। তিনি কয়েক সপ্তাহ ধরে বাঙ্গালী প্রতিনিধিদের দিয়ে একটি প্রাদেশিক প্রশাসন সেট আপ করতে চান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে একটি বেসামরিক জাতীয় সরকার গঠনের জন্য চেষ্টা করবেন। কি ঘটছে তিনি আসলে তার বাইরে আছেন। তিনি এখন আরও বিনয়ী এবং দূরবর্তী গোল সেট করছেন।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া গণপরিষদ বাদ দিয়ে চার মাসের ভেতর একটি কমিটি দিয়ে সংবিধান প্রণয়ন করতে চাচ্ছেন যা একটি বেসামরিক সরকার কর্তৃক পরিচালিত হবে। তবে এরকম হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। ডেইলি টেলিগ্রাফ বলেছে পূর্ব পাকিস্তানকে কলোনি হিসেবে চালানোর প্রমাণ আছে। তাই তাঁদের কতটুকু স্বাধীনতা দেয়া হবে তা তাঁদের ভাগ্যের উপর নির্ভরশিল।

টাইমস এর মতে- প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রস্তাব ভাল কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের মানসিক চাহিদা পূরণ হবে না। তিন মাসে রাজনৈতিকভাবে সমস্যার বাইরে সেখানে যথেষ্ট সামরিক নৃশংসতা হয়েছে যার জন্য তাড়া অসন্তুষ্ট আছে। যা প্রয়োজন তা হল দক্ষ কমিটি দিয়ে সংবিধান প্রণয়ন না করে বরং একটু নম্রতার সাথে তাদেরকে ম্যানেজ করা। বাঙ্গালীদের আশার বাইরে কোন কিছু করলে তা দির্ঘ দিনের জন্য বজায় থাকবেনা।

এই মুহুর্তে সত্যিকার অর্থেই বাঙ্গালীদের জন্য ভালো হয় এমন কিছু করতে হবে। এতে তাঁরা ভাবতে শুরু করবে যে হয়ত কোন শান্তিপূর্ন সমাধান সামনে হতে পারে। হয়ত গেরিলা আক্রমণ নাও শুরু হতে পারে। এত ভোগান্তি নাও হতে পারে। শুধু ব্যাটালিয়ন অর্ডারে তাঁরা খুশী হবেনা।

সবচেয়ে রুঢ়ভাবে সমালোচনা করেছে গার্ডিয়ান পত্রিকা। তাঁরা বলেছে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের স্বপ্ন বিশ্বের কাছে কোন আশানুরূপ কিছু মনে হচ্ছেনা। তাকে বিশ্বাস করা যায় না এবং যা হচ্ছে তা দুঃখজনক। তার আসলে এখন কোন সত্যিকারের পরিকল্পনা নেই। গার্ডিয়ানের মতে তিনি গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য যে পন্থা দিয়েছেন তা লজ্জাজনক। গার্ডিয়ান মনে করে শুধুমাত্র শেখ মুজিবুর রহমান পারেন যে ৫০ লক্ষ মানুষ পালিয়ে গেছে তাঁদের জন্য আশানুরূপ কিছু করতে। এবং একই ভাবে যারা রয়ে গেছে তাঁদের জন্যও তিনি গুরুত্তপূর্ন। গার্ডিয়ানের মতে মুজিব পাকিস্তানের শেষ ভরসা।

স্কচম্যান নামক চতুর্থ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে ইয়াহিয়া খান হয়ত সেনাবাহিনী দিয়ে পাকিস্তান শাসন করতে পারেন কিন্তু বাস্তবে পাকিস্তান ধরে রাখা তার জন্য কঠিন হবে। যদি তিনি ভাবেন তিনি আন্তর্জাতিক সমর্থনের উপর নির্ভর করে চলবেন তবে তিনি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবেন। যদি তিনি তা বিশ্বাস না করেন তাহলে বুঝতে হবে তিনি পাকিস্তানের জনগণের মনোভাব বুঝতে ব্যার্থ হয়েছেন। তার নিষ্ঠুর পরিকল্পনা আন্তর্জাতিক সমর্থন হারাবে। একটি বিষয় স্পষ্ট যে বিদেশী সরকারগুলো ইয়াহিয়ার মনকে পাল্টাতে পারেনি এবং তাকে একটি স্বাভাবিক শাসন ব্যাবস্থা চালু করাতে রাজি করাতে পারেনি।

১৭। এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
১ লা জুলাই, ১৯৭১
– মার্ক টালি
– ইয়াহিরা প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের মনোভাব
– ইভান চার্লটন দ্বারা সম্পাদিত (এস)

বিবিসির পূর্ব অংশের প্রতিনিধি মার্ক টালি, ঢাকা থেকে তারের মাধ্যমে জানিয়েছেন তিনি ১০ জন ব্যবসায়ী, সাংবাদিক এবং সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলার পর স্পষ্ট হয়েছেন যে তাঁরা কেউ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সর্বশেষ রাজনৈতিক কর্মসূচির উপর সন্তস্ট নন। এতে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য কিছু নাই। সবাই এমনটাই বলেছেন। প্রেসিডেন্ট আওয়ামী লীগ নেতাদের নিন্দা করেছেন – এতে করে যারা নূন্যতম স্বাভাবিক পরিস্থিতির আশা করেছিলেন তাঁরা আশাহত হয়েছেন। সামরিক বাহিনীর ব্যাপারে তার অবস্থান সবাইকে হতাশ করেছে। ইসলামকে জোর দেয়ার ব্যাপারে তিনি যা বলেছেন তাতে হিন্দুদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়বে। এতে যেসকল হিন্দুরা এখনো আছে তাঁরা হতাশ হয়েছে আর যারা চলে গেছে তাঁদের ফিরে আসার সম্ভবনা কমবে। আসলে বাঙ্গালীরা মনে করে সেনাবাহিনী এখানে ভালো কোন উদ্যেশ্য নিয়ে আসেনি। ঢাকার ৫০ মাইল দুরে ৮ টি গ্রাম ধ্বংস করে দেয়ায়া বোঝা যায় সেনাবাহিনী এখানে আসলে কি করবে। জানা যাচ্ছে সেনাবাহিনী মানুষকে ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে যাচ্ছে এবং তাঁরা আর ফিরে আসছে না। ধর্ষন করছে, টাকাপয়সা কেড়ে নিয়েছে, সম্পদ নিয়ে গেছে। এই পরিবেশে সেনাবাহিনীর পক্ষে আস্থা ফিরিয়ে আনা অসম্ভব। এবং আসলে তাঁরা সেরকম কোন চেষ্টাও করছেনা। পাঞ্জাবি পুলিস শহরে সশস্ত্র পাহাড় দিচ্ছে এবং তারা পরিষ্কারভাবে খুব নার্ভাস। এছাড়াও অনিয়মিত সেনারা মেশিনগান সহ টহল দিচ্ছে। মানুষকে টেলিগ্রাফ অফিসে যাওয়ার আগে অনুসন্ধান করা হচ্ছে এবং সেখানে রাস্তায় স্পট চেক করা হচ্ছে। বেশ কিছু মানুষ যাদের সাথে আমি কথা বলেছি তাঁরা আমার সাথে দেখা করার জন্য ভীত ছিল। বাজারে ব্যবসায়িক কাজ যুক্তিসঙ্গতভাবে ভেঙ্গে পড়েছে এবং রাতে পথে খুব কম মানুষ দেখা যাচ্ছে। অফিস উপস্থিতির উন্নতি হয়েছে কিন্তু অধিকাংশ হিন্দু অফিসে ফিরে আসেনি। আসলে সেনাবাহিনী যে ধ্বংসাত্মক কাজ করেছে তা পুনঃমেরামতের কোন চেষ্টা তাঁরা করছেনা। বাঙালি ও উর্দুভাষী মধ্যে সাম্প্রদায়িক তিক্ততা এখনও খুব শক্তিশালী। এই পরিস্থিতিতে যাহাই হউক না কেন সরকার পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দিয়ে মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারবে না।

১৮।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
১ লা জুলাই, ১৯৭১
পাকিস্তানের ব্যাপারে ব্রিটিশ প্রেস
উইলিয়াম ক্রওলি সম্পাদিত (এস)

আজ সকালের প্রেস পূর্ন পাকিস্তানের দুই জন রিপোর্টারের রিপোর্ট ছাপিয়েছে। টাইমসে মাইকেল হর্ন্সবি পাকসেনাদের দ্বারা হিন্দুদের উপর অত্যাচারের কথা লিখেছেন। তিনি ঢাকার ৪০ মাইল উত্তর পশ্চিমে সিন্দূরই গ্রামে যান। এটি অন্যতম হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা। তিনি জানান গত ৫ দিনে এখানে লট তরাজ চলেছে। গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন এই কাজ কোন নিরাপত্তা রক্ষার কারণ হিসেবে করার কথা না।

ডেইলি টেলিগ্রাফ এ ক্লেয়ার হলিংওর্থ ঢাকা থেকে রিপোর্ট করেছেন। তিনি আসাম সীমান্তের চারশো গজের মধ্যে পাকিস্তানি সেনা সীমান্ত চৌকি পর্যন্ত ছিলেন। তিনি দেখেছেন গেরিলারা ভারতীয় বর্ডার অঞ্চল থেকে পূর্ব পাকিস্তানে কিছু ধ্বংসাত্মক কাজ করেছেন। তারা সেখানে ৫০০০ পাকিস্তানী উদ্বাস্তুকে আটক করেছেন। তিনি বলেছেন পাকসেনারা মনে করে ভারতীয় বাহিনী তাদের দেশের অর্থনিতিকে ধ্বংস করতে চায়। এবং শেলিং করার জন সামরিক কারণ নেই। গেরিলারা চা বাগান ধ্বংস করে দিচ্ছে। প্রায় ১২। ১৩ টা বাগান তারা মর্টার দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। তিনি জানান প্রতিদিন অনেক চা বাগান কর্মি ঢাকায় চলে যাচ্ছেন কারণ এখানকার পরিস্থিতি খুব বিপদজনক।

কলকাতা থেকে ডেইলি টেলিগ্রাফ সংবাদদাতা পিটার গিল রিপোর্ট করেন যে জনাব টবি জেসেল, যিনি বর্তমানে ব্রিটিশ সরকারের স্পন্সরে পাকিস্তান ও ভারত উভয় দেশ পরিদর্শন করছেন – যিনি এখানে আসা চারজন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্যদের একজন – তিনি গত রাতে বলেন যে তিনি বিশ্বাস করেছেন যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হিন্দু গ্রামে আক্রমণ পরিচালনা করছে।

১৯।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
ঢাকা থেকে মার্ক টালির প্রস্তান
৫ জুলাই, ১৯৭১
– ইভান চার্লটন দ্বারা সম্পাদিত (এস)

ঢাকা থেকে একটি তারবার্তায় বিবিসির মার্ক টালি বলেন যে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে। শুক্রবার রাতে আরেকটি বিদ্যুৎ তোরণ ঢাকায় ধ্বংস করা হয়। ঢাকা কিছু অংশে বিশ ঘন্টার জন্য বিদ্যুৎ ছিল না। গত সপ্তাহে বিভিন্ন এলাকায় বোমা নিক্ষেপের রিপোর্ট করা হয়েছিল। এর মধ্যে সরিষাবাড়ি বাজার, ময়মনসিংহ এর উত্তরে – এলাকাটি উল্লেখযোগ্য। ধ্বংসাত্মক কাজের জন্য এবং আর্মি একশনের জন্য এখানকার পাটকল বন্ধ হয়ে গেছে। পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক। পাবনায় শুক্রবার রাতে কমপক্ষে একটি বোমা নিক্ষেপ হয়েছে। রাজশাহীতে গত সপ্তাহে একটি ব্রিজ উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। শনিবার রাতে বোমা বর্ষন হয়েছে। কর্তৃপক্ষ জানায় শনিবার আর্মি ওপেন ফায়ার করে এবং যারা ভারত থেকে ঢোকার চেষ্টা করেছে তাদের আক্রমণ করে। তারা মূলত ভারত থেকে গঙ্গা পেরিয়ে আসছিল। সেদিন থেকে কিছু গুলি এসেছে। গেরিলাদের কাজের সঠিক ধারনা করা কঠিন। কর্তৃপক্ষ এটা নিয়ে চিন্তিত। যেভাবেই হোক এটা থামাতে হবে। এসব রিপর্ট বর্তমান অবস্থায় আসলেও তার সোর্স কিসেবে কিছু সরকারি সোর্সও আছে। অনেক লোক গ্রামে চলে যাচ্ছে। অর্থনিতি ধ্বংসের চেষ্টা চলছে। এলোমেলো ধ্বংসাত্মক কাজ চলছে। সরকারকে অসহযোগিতা চলছে।

২০।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
পাকিস্তানে ব্রিটিশ প্রেস
৯ জুলাই, ১৯৭১
উইলিয়াম ক্রলি সম্পাদিত (এস)

আজ সকালে ডেইলি টেলিগ্রাফ এর ক্লেয়ার হলিংওর্থ পূর্ব পাকিস্তান থেকে রিপোর্ট করেছেন। তিনি জানান পাকিস্তানি ও ভারতীয় সৈন্যরা অতি নিকটে একে অপরের মুখোমুখি সীমান্তে অবস্থান করছে এবং সেখানে রোজ সীমান্ত জুড়ে বিক্ষিপ্ত ছোট আকারের গুলি বিনিময় চলছে। বাংলাদেশ গেরিলারা প্রতি রাতে সীমান্ত ক্রস করে প্রবেশ করছে। ও তারা সীমান্ত এলাকায় যোগাযোগ ব্যাবস্থার ক্ষতি করছে। ভারতীয় পার্শ্ব, উদ্বাস্তু দ্বারা পূর্ন। আর পাকিস্তানের পাশ অনেকটা ফাঁকা। কিছু উদ্বাস্তু পাকিস্তান ফিরে আসছে। তিনি মনে করেন এই অবস্থায় জাতিসংঘের শান্তি মিশনের বাহিনীর উপস্থিতি খুব দরকার। পরিস্থিতি ক্রমাগত উত্তপ্ত হচ্ছে।

আরেকজন টেলিগ্রাফ প্রতিবেদক, পিটার গিল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে রিপোর্ট করেছেন। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীরা ক্রমাগত ভারতে প্রবেশ করছে। তাদের মধ্যে অনেক মুসলমান বাঙ্গালী আছেন যারা পাকিস্তানী বাহিনী ও মুক্তিফৌজের আক্রমণের সময় গুলিবদ্ধ হয়েছেন।

ফাইনানশিয়াল টাইমস, নেভিল ম্যাক্সওয়েল করাচি থেকে রিপোর্ট করেছেন। তিনি ব্রিটেনের পশ্চিম পাকিস্তানের উপর রাগের ব্যাপারে লেখেন। তিনি বলেন পাকিস্তান সব সময় মনে করেছে যে ব্রিটেন হিন্দুদের পক্ষ নিচ্ছে। তিনি বলেন ঠিক উল্টো কথাটা ভারত সব সময় বলে আসছে। তিনি বলেছেন পাকিস্তান সরকার ব্রিটেনের সঙ্গে তার সম্পর্কের একটি মৌলিক হ্রস্যকরণ করতে চায়। (তিনি বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে বিদেশী প্রতিবেদন পশ্চিম পাকিস্তানী ও পশ্চিম পাকিস্তানে বাস করা ব্রিটিশদের কাছে উপেক্ষিত।)

ম্যাক্সওয়েল বলেছেন যে এয়ার মার্শাল আসগর খান, যিনি সম্প্রতি পূর্ব পাকিস্তান থেকে ফিরে এসেছেন – তার কথাও উপেক্ষা করা হয়েছে। ম্যাক্সওয়েল মতে, এয়ার মার্শাল আসগর খানের উপলব্ধি পাকিস্তান সরকারের থেকে ভিন্ন ছিল।

২১।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
পাকবাহিনী ও মুক্তি বাহিনী
২৩ জুলাই ১৯৭১
– মার্ক টালি (এস)

পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তি বাহিনীর নাশকতা চলছে। মার্ক টালি এখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে পরিস্থিতির মুখোমুখি সে ব্যাপারে লিখেছেন।

প্রথমে কেউ পূর্ব পাকিস্তানে আসলে মনে করবে এখানকার পরিস্থিত স্বাভাবিক হচ্ছে। কিছু এলাকার জন্য কথা সত্যি।

পরিস্থিতি যাই হোক মানুষকে খেতে হবে, আয় করতে হবে। তবে স্বাভাবিক হবার পরিবেশ গেরিলা একশনে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মুক্তি বাহিনীর দুইটি অস্ত্র, ভয় এবং অর্থনীতির ভাঙ্গন। স্বাধীন বাংলা বেতারে মুক্তিফৌজ ঘোষণা করেছে যে যদি কেউ সেনাবাহিনীকে সাহায্য করে তবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেয়া হবে। তারা শান্তি কমিটি ও অন্যান্য বিশিষ্ট সহযোগী সদস্যদের হত্যা করছে এবং কারখানা শ্রমিক, চা বাগান শ্রমিক ও পাট চাষীদের শাসানি দিচ্ছে। অর্থনৈতিক ফ্রন্টে তারা অত্যাবশ্যক কিছু ইনস্টলেশন সাবোটাজ করছে এবং ধ্বংস করছে। তারা যোগাযোগ ব্যাবস্থা যাতে পুনরায় ঠিক করা না যায় সেরকম ব্যাবস্থা নিচ্ছে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই হুমকি পূরণ করার চেষ্টা করছে কিন্তু তারা একটি খুব কঠিন ঝামেলায় আছে। প্রথমতঃ তারা গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে অনেক সৈন্য রাখছে কারণ তারা মনে করছে বড় আক্রমণ হতে পারে। বাকিরা মূলত সীমান্তে আছে। এর মানে হল এই যে, কিছু জায়গায় তাদের ট্রেনিং দেয়া স্বেচ্ছাসেবকদের – যাদের রাজাকার বলা হয় – তাদের রাখা হয়েছে। এই স্বেচ্ছাসেবকদের সংখ্যা বাড়ছে এবং তাদের প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে। তবে তারা প্রায়ই সাহায্যের চেয়ে হুমকি হয়ে যাচ্ছে। আরেকটা সমস্যা হচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশ বাহিনী কার্যত অনেক জায়গায় নিখোঁজ। জনসংখ্যার মনোভাব এখনও সেনাবাহিনীর প্রতিকূল এবং সেনাবাহিনী তাদের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পায় না। তবে আরেকটি সম্ভবনা আছে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ মুক্তি ফোউজের প্রতিকূলে যাবে যদি তাদের দৈনন্দিন জীবন ব্যাহত হয়। কিন্তু যদি সেনাবাহিনী শান্তি ফিরিয়ে না আনতে পারে তাই সাধারণ জনগণ মুক্তিফৌজের কোন তথ্য সেনাবাহিনীকে দেবে না। আসল সোর্স হল গেরিলা বাহিনী যারা ভারতের বর্ডারে অবস্থিত ক্যাম্পে অবস্থান করে। মুক্তিফৌজ খুব সহজেই আর্মিদের পোস্টের কাছে ঘুমাতে পারে আর যার ফলে মাঝে মাঝেই তাদের সীমান্ত দিয়ে আক্রমণ করতেও সমস্যা হয় না। ভারত ও পাকিস্তান আর্মিদের মধ্যে ক্ষণে ক্ষণে শেলিং চলতে থাকে।

এটা বলা সম্ভব নয় যে গেরিলাদের সংখ্যা কত – তবে সমস্ত সীমান্ত জুড়েই তাদের অবস্থান। পাকিস্তান সেনাবাহিনী কার্যত একটি অসম্ভব কাজের সম্মুখীন হয়েছে। তারা এমন একটি এলাকায় অবস্থান করছে যেখানে যোগাযোগ ব্যাবস্থা পুরোটাই গেরিলাদের নখদর্পনে। তবে তারা পাকিস্তানের দুটি প্রধান ক্ষেত্র চা আর পাট সেক্টরের নিরাপত্তা বিধান করতে পেরেছেন। আরও কিছু গেরিলাদের প্ল্যান ভেস্তে দেয়া হয়েছে। গেরিলাদের এখনো অনেক কিছু শেখা বাকি। সব কিছু নর্ভর করছে তারা কতসিন তাদের মনোবল ধরে রাখতে পারে এবং টিকে থাকতে পারে।

বাংলা ডন নিউজ টক – ২৪/২৫ জুলাই ১৯৭১

২২।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
পাকিস্তানের শ্বেতপত্র
৬ আগস্ট ১৯৭১
– মার্ক টালি (এস)

পাকিস্তান সরকার একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট নিয়ে। মার্ক টালি সেটার বিশ্লেষণ করেছেন।

শ্বেতপত্রে ২৫ মার্চের মিলিটারি একশনের ঘটনা আছে। পাক সরকার বলেছে যে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি ভেঙ্গে যাওয়ায় তারা এই ব্যাবস্থা নিয়েছেন। এখানে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সংবিধান প্রণয়নে ব্যার্থতাকে এই ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়। তারা সংবিধান মেনে নেন নাই কারণ আওয়ামী লীগ চাচ্ছিল তাদের প্রদেশের স্বায়ত্তশাসন। শ্বেতপত্রে বলা হয় আওয়ামীলীগ ভারতের সহায়তায় একটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলছে। এখানে ১৯৬৭ সালের আগরতলা মামলার বিস্তারিত বর্ননা করা হয়। যেসকল গণহত্যা হয়েছে সেগুলোকে আওয়ামীলীগের সন্ত্রাস বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলোর সবগুলো উল্লেখ করা না হলেও বলা হয় যে ের অনেক গুলোই আর্মি একশন শুরুর অনেক পরেও হয়েছে। শ্বেতপত্রে প্রেসিডেন্টের সাথে ঢাকায় রাজনৈতিক নেতাদের ১৫ থেকে ২৫ মার্চের আলোচনা অন্তর্ভুক্ত হয়।

শ্বেতপত্রের অন্যতম অসুবিধা হল এখানে আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে আলোচনা করা হয় নাই। এটা আসলে এক পক্ষীয়। তাই অনেকের কাছে এটা গ্রহণযোগ্য হবে না। এখানে একচোখা রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। এর দুইটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। আওয়ামীলীগের অনেক হত্যাকাণ্ডের কথা এখানে বলা হয়েছে। তবে আর্মির হত্যাকাণ্ড সমপর্কে কিছু বলা হয় নাই। এমনকি তাদের মিলিটারি বিচারের সম্পর্কে কিছু বলা নাই। তাছাড়া রিপোর্টে ১ মার্চ প্রেসিডেন্টের জাতীয় এসেম্বলি বাতিল করার ঘোষণা সম্পর্কে কিছু বলা হয় নাই। অনেকে মনে করেন এই একটি সিদ্ধান্তই প্রেসিডেন্টএর সদিচ্ছাকে দমিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট। শ্বেতপত্রে শুধুমাত্র প্রেসিডেন্টের ভাষণের কথাগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে এসেম্বলি বন্ধ করার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যেহেতু পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা এখানে অংশগ্রহণ না করার হুমকি দিয়েছেন। তারপরে বলা হয় দায়দায়িত্ব শেখ মুজিবুর রহমানের উপর যাবে কারণ তিনি হরতালের ডাক দিয়েছিলেন।

রিপোর্টের সময়জ্ঞান বোঝা একটু কঠিন। পাকিস্তান সরকার বলেন ২৫ মার্চের আগে আওয়ামী লীগ জঙ্গিদের নৃশংসতা ও সংঘটিত অরাজকতার কাজগুলো তেমন প্রচারিত হয়নি। কিন্তু তার বক্তব্যে ২৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতিকে বলেন আওয়ামী লীগ বৃহৎ সংখ্যক খুন করেছে। আমাদের লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালী ভাই যারা পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থান করছেন তারা ভীতির মধ্যে আছেন আর অনেকেই ভয়ে দেশ ত্যাগ করেছেন। ২৬ মার্চের ভাষণের পরে চার মাস দেরি করে শ্বেতপত্র প্রকাশের কারণ রহস্যজনক।

ভারতীয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এতে বোঝা যায় যে পাকিস্তান সরকার জানত যে ১৯৬৭ সালে শেখ মুজিব ভারতের সাথে ষড়যন্ত্র করেছিল পাকিস্তান বিভক্ত করার ব্যাপারে। এবং এটা ১৯৭১ সালে সবাইকে জানানো হল ফেব্রুয়ারিতে একটি ভারতীয় বিমান ছিনতাইয়ের পরে। যেসব প্রমাণ প্রতিবেদনে দেয়া হয়েছে তার বেশিরভাগ সেই সময়ে তারা জানত। তাহলে এতদিন পরে কেন সেটা উন্মোচন করা হল? তাহলে কি প্রেসিডেন্ট আওয়ামীলীগের সাথে সমঝোতার চেষ্টা করেছিলেন? কেন প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ মুজিবকে বর্ণনা করেছেন?

কিন্তু সম্ভবত রিপোর্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনা হল এখন এর কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। শুরুতে বলা হয়েছে যে শ্বেতপত্রে পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান সংকট আলোচিত হয়েছে। কিন্তু রিপোর্টের কোথাও তেমন কিছু বলা নাই। এমনকি সরকার কি আশা করে বা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছু বলা নাই। অথচ এটাই বিশ্ব শুনতে চায়।
২৩.
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
গার্ডিয়ান পত্রিকার আর্টিকেলের উপর আলোচনা
১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
– উইলিয়াম ক্রলি সম্পাদিত, (এস)
– রেফারেন্স নাম্বার – ৭০ জে ২১৮

আজ সকালে দ্য গার্ডিয়ানের মার্টিন উলকট কোলকাতা থেকে রিপোর্ট লিখেছেন। তিনি বাংলাদেশের জন্য যারা সংগ্রামে জড়িত তাদের লক্ষ্য ও আদর্শ নিয়ে লিখেছেন। অনেকে এটাকে আশির্বাদ মনে করেন যে ভারত বাংলাদেশের সাথে এক হয়ে যুদ্ধে জড়াতে চায় না। কারণ তারা এটাকে ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসেবে চান না।

তিনি বলেন বাংলাদেশের আন্দোলনের নেতৃত্বকে চার ভাগে বিভক্ত করা যায়। প্রথমতটি আওয়ামী লীগ। যেখানে শেখ মুজিবুর ‘রহমান শুধুমাত্র এখন বহুমুখী ক্ষমতাধর ব্যাক্তিই নন বরং ন্যায্যতার দাবীর দিক দিয়ে তারা এগিয়ে। দ্বিতীয়ত কিছু সাবেক পাকিস্তানী আর্মি অফিসার আছেন। তৃতীয়ত, শিক্ষা ও বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কমবয়সী একটি গ্রুপ, যারা কোন দলের সাথে যুক্ত নয়। তারা ব্যক্তিগত সচিব ও নীতি পরিকল্পক হিসেবে কাজ করেন। ওয়াল্কট মনে করেন তাদের প্রভাব আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পাবে।

সবশেষে আছে বিভিন্ন বামপন্থী ও কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ভাসানী ও মুজাফফর গ্রুপ ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব। তারা একটি আনুষ্ঠানিক পরামর্শমূলক কমিটির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত আছে। এই দলগুলোর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষপাতী এবং তরুণ বুদ্ধিজীবীদের সাথে আছে যারা আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য কাজ করছে।

ওয়াল্কট বলছেন যে রাজনৈতিক ভবিষ্যত অনিশ্চিত এবং সামনে শীতকালে যুদ্ধ পরিস্থিতি কি হবে তার উপর অনেকটা নির্ভরশিল। কারণ ধারনা করা হচ্ছে আর্মি সেই সময়ে গেরিলাদের উপর আরও বেশী আক্রমণ করবে।

২৪.
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
পূর্ব পাকিস্তান এর অবস্থা নিয়ে আলোচনা
১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
– মার্ক টালি দ্বারা সম্পাদিত

গতকাল পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে দুটি রিপোর্ট ঢাকায় বিবিসির সংবাদদাতা থেকে এসেছে। রোনাল্ড রবসন দাবি করেন যে মুক্তিবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের বৃহৎ অংশের দখল রেখেছে। তবে ঢাকা এটি দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছে।

পূর্ব পাকিস্তানে কয়েক শত মাইল ভ্রমণ করে আমি ব্যক্তিগতভাবে দখল করে রাখার তেমন কোন প্রমাণ পেলাম না। বিদ্রোহীরা হঠাৎ করে সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে ধ্বংসাত্মক কাজ চালিয়ে আবার দ্রুত সরে যায়। এলতি এলাকা দখলে তেমন কোন লক্ষণ দেখা যায়না। বর্ডার পার হওয়া অনেক সহজ। ১৭৮০ মাইলের মত বিশাল সীমান্তে অনুপ্রবেশকারীদের প্রবেশ ঠেকানো যেকোন সেনাবাহিনীর জন্য প্রায় অসম্ভব। গত মাসে নাশকতার কর্মকাণ্ড কম হয়েছে। বেসামরিক স্বেচ্ছাসেবকরা অনেক সেতু এবং অন্যান্য ঝুঁকিপ্রবন পয়েন্ট পাহারা দিচ্ছে। ফলে নিয়মিত সৈন্য অন্যত্র পাহারায় থাকতে পারছে। পাকিস্তানি বাহিনীর অনেক হতাহত হচ্ছে। সীমান্তে শেলিং এর অন্যতম কারণ। তবে পূর্ব পাকিস্তানে পর্যবেক্ষকদের মতে প্রতি মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩০০০ জন হতাহত হচ্ছে।

দ্বিতীয় রিপোর্টটি ইয়ান ম্যাকডোনাল্ড করেছেন। তিনি ৩ টি ব্রিটিশ দাতব্য সংস্থার ত্রাণ সমন্বয়ক এবং সম্প্রতি পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসেছেন। সেখানে কৃষি প্রজেক্টের কাজ বন্ধ আছে। তিনি গত রাতে একটি বিবিসি রেডিও প্রোগ্রাম এডাম রাফায়েলকে বলেছিলেন যে, তিনি ভিত এইকারনে যে পূর্ব পাকিস্তানে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হবে। তিনি এই ফসল রোপণের সময় মাঠ বিনা চাষে পরে থাকতে দেখেছিলেন। পেট ফোলা বাচ্চারা পথের পাশে শুয়ে ছিল, ভিখারিদের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে,। তিনি কৃষকদের সাথে কথা বলেছেন। তারা গত বছর ফসলের করুন দশার কারণে ঋণগ্রস্ত আছেন। তিনি বলেন যদি জাতিসঙ্ঘ প্রয়োজনীয় খাবর সরবরাহ করতে চায় তাহলে তার জন্য মহাযজ্ঞের আয়োজন করতে হবে। জানুয়ারিতে যে খাবার এসেছে তা এখনো বন্দরে পরে আছে। কিছুদিন আগে প্রায় ১০০ তি জাতিসঙ্ঘ ট্রাক এসেছে কিন্তু তিনি চলে আসার আগ পর্যন্ত মাত্র ৩০ জন ড্রাইভার পাওয়া গেছে।

জাতিসংঘ বলেছে তারা খাদ্য বিতরণ করতে বিদ্যমান প্রশাসনের উপর নির্ভর করবে কিন্তু ম্যাকডোনাল্ড খুব সন্দিহান যে স্থানীয় প্রশাসন এই বিশাল সমস্যা কাঁধে নেবে কিনা। কারণ তারা গত কয়েক মাস ধরে অনেক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন জাতিসঙ্ঘের চেষ্টা আমলাতন্ত্রের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে গেছে। ৩ মাস চেষ্টা করেও তারা স্থানীয়ভাবে কাজ শুরু করতে পারে নাই। ম্যাকডোনাল্ড প্রকৃতপক্ষে মনে করেন যে পরবর্তী কয়েক মাসে পূর্ব পাকিস্তানের খাদ্য সমস্যার কোন সমাধান আসলে হবেনা।

২৫। এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
ইভান চার্ল্টন
লেবার পার্টি কনফারেন্সে পাকিস্তান সম্পর্কে বিবৃতি
৭ ই অক্টোবর, ১৯৭১
– মার্ক টালি সম্পাদিত (গুলি)

লেবার পার্টির আজকের দিনের প্রথম এজেন্ডা হল পাকিস্তানের বিবৃতি জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে গ্রহণ করে নেয়া। এটা করা হয়েছে। আলোচনার জন্য আধা ঘণ্টা রাখা হয়েছে। এটা নিয়ে কোন দ্বিমত ছিলোনা। সবাই মনে করেন পূর্ব বাংলায় মিলিটারি একশন বন্ধ না করলে এবং শেখ মুজিবকে মুক্তি না দিলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না। জনাব ব্রুস ডগলাস মান এমপি ব্রিটিশ সরকারের কার্যনির্বাহি কল সমর্থন করেন যেখানে বলা আছে বিষয়টি জাতিসংঘের চলতি অধিবেশনে উত্থাপন করার হবে। অন্যথায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি সৃষ্টি হবে। পূর্ব বাংলা গেরিলাদের লড়াই এর লক্ষ্য একটাই। সেটা হল যুদ্ধে জিততে হবে। তিনি মনে করেন পাকিস্তান মৃত। জনাব জন স্টোনহাউজ এমপি. বলেন এটি অনেক বড় দুর্যোগ এবং জাতিসংঘের উচিৎ অগ্রণী ভূমিকা নেয়া এবং তিনি মনে করেন বাংলাদেশের সৃষ্টিই এখন এই সমস্যা থেকে নিষ্কৃতির একমাত্র বাস্তবতা। সাউথ ব্র্যাডফোর্ডের এম পি টম টমি বলেছেন দুই অঞ্চলের অভিবাসীদের অনেক পার্থক্য আছে এবং দুই অঞ্চলের মানুষের দর্শন ও ভিন্ন। এবং প্রায় সম্পূর্ন বিপরীতমুখী। ব্রিটেনের প্রধান উদ্বেগ ব্যাপক হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা এবং আলোচনার ব্যাবস্থা করা। তিনি আরও পদক্ষেপ নিতে ব্রিটিশ সরকারের ওপর চাপ দিতে চান।

মিসেস জুডিথ হার্ট পাকিস্তান সরকারকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য চাপ দেবার ব্যাপারে জোর দেন। তিনি বলেন নির্বাহীদের বিবৃতি পাকিস্তান সরকারের দায়িত্ব ও ট্রাজেডির বিশ্লেষণের উপর নির্ভরশিল। দির্ঘমেয়াদি সমাধান হচ্ছে রাজনৈতিক সমাধান। তবে তিনি বলেন এশিয়ায় যুদ্ধ লাগার সম্ভবনা অনেক বেশী। এবং এই ব্যাপারে জাতিসঙ্ঘের আশু পদক্ষেপ খুবই গুরুত্তপূর্ন।

পাকিস্তানের উপর বিবৃতি সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয় এবং সম্মেলন ইউরোপের পূর্ব-পশ্চিম সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা শুরু করে।

২৬.
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
ইন্দো-পাকিস্তান পরিস্থিতি রিপোর্ট
১২ অক্টোবর, ১৯৭১
– ইভান চ্যারিটন সম্পাদিত (এস)

টাইমস এর পিটার হ্যাজেলহার্স্ট নয়া দিল্লি থেকে একটি তারবার্তায় রিপোর্ট পাঠিয়েছেন। তিনি জানান জনাব জগজিবন রাম, যিনি ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন পাকিস্তান যদি ঝটিকা আক্রমণ করে তাহলে ভারত পাকিস্তানের উপর আক্রম করবে। হ্যাজেলহার্স্ট জানান এই সন্দেহ করার কারণ হল জানা গেছে যে পাকিস্তান তাদের পশ্চিম সীমান্ত থেকে জনসাধারণকে অন্যত্র সরে যেতে বলেছে। এবং সীমান্তে কিছু ভারি অস্ত্র সমাবেশ ঘটানো হয়েছে। ভারত বলেছে পাকিস্তান তাদের সীমান্তে শক্তি বৃদ্ধি করেছে। উত্তেজনা ভয়ানক আকার ধারণ করেছে। উভয় পাশেই। উভয় পাশে সামরিক কর্মীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে এবং তেল ও পেট্রলের রিজার্ভ বাড়ানো হচ্ছে।

হ্যাজেলহার্স্টএর প্রতিবেদন অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় পাঁচটি ডিভিশন এবং পশ্চিম সীমান্তে ১০ তি ডিভিশন জড়ো করেছেন। ভারত বলেছে তারা তাদের ২৭ টি ডিভিশনের ১২-১৩ টি পশ্চিম সীমান্তে, ১০ টি চাইনিজ সীমান্তে এবং ৩-৪ টি পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে জড়ো করেছে।

তিনি মনে করেন ভারত মনে করে যদি গেরিলারা পূর্ব পাকিস্তানে পাক আর্মিকে উত্যাক্ত করে তাহলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পশ্চিম সীমান্তে আক্রমণ করতে পারে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সামরিক বিশেষজ্ঞদের পরিকল্পনা হচ্ছে যদি পাকিস্তান আক্রমণ করে তাহলে শীতকালীন হিমালয়ের হিমবাহ শুরুর আগেই তারা পকিস্তানকে আক্রমণ করবেন। পাশাপাশি তারা মনে করেন জোর করে যদি ভারত পূর্ব পাকিস্তানের শরনার্থিদের পূর্ব পাকিস্তানে ঠেলে পাঠায় তাহলে তাতে কোন ভালো কিছু হবে না।

পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে একটি দীর্ঘ গবেষণায় ফাইনানশিয়াল টাইমস এর কেভিন রেফারটি বলেন যে, এটা নিশ্চিত নয় যে সেনাবাহিনী বর্ষার পরেই গেরিলাদের বিরুদ্ধে তাদের আক্রমণ শুরু করবে কিনা। তার জন্য দরকারি খাবার ও রসদ পাঠানো শুরু করবে কিনা তাও নিশ্চিত নয়। যদি তারা দ্বিতীয় পথ বেছে নেয় অর্থাৎ যুদ্ধের আশংকা বাড়ার সাথে সাথে সীমান্তে উত্তেজনা বাড়ে তাহলে আরও বেশী শরনার্থিদের প্রবেশ ঘটবে এবং নিহতের পরিমাণ অনেক বাড়বে। রেফার্টি বলেন, এটাই দেখার বিষয় যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কোনটিকে প্রাধান্য দেবেন। তিনি আরও বলেন, ইয়াহিয়ার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে পূর্ব পাকিস্তানের ৪০ মিলিয়ন মানুষের দুর্ভিক্ষের সম্ভবনা।

২৭।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
গেরিলা ও খাদ্য
১৫ অক্টোবর, ১৯৭১
– মার্ক টালি দ্বারা (এস)

পূর্ব পাকিস্তানে জাতিসংঘের রিলিফ অপারেশন হেড বৃহস্পতিবার বলেন, আগামী চার মাসে পূর্ব পাকিস্তানে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ করা যাবে কিনা তা নির্ভর করছে খাদ্য বণ্টন দক্ষতার উপর। মার্ক টালি সাম্প্রতিক রিপোর্টের আলোকে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন।

পূর্ব পাকিস্তানে মার্চের শেষে সামরিক একশন শুরুর পর থেকেই দুর্ভিক্ষ এর ভয়ানক সতর্কবার্তা আছে। পূর্ব পাকিস্তানে যারা সম্প্রতি ভ্রমণ করে এসেছেন তারা জানিয়েছেন সেখানে বড় রকমের অপুষ্টি পরিস্থিতি চলছে। কিন্তু যারা সেখানে গিয়েছিল তাদের প্রায় সবাই জানিয়েছে কে পূর্ব পাকিস্তানের সামনে খুব বিপদ আছে।

জনাব পল মার্ক হেনরি যিনি পূর্ব পাকিস্তানে জাতিসংঘের রিলিফ অপারেশনের দায়িত্বে আছেন তিনি গত বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে বলেন তিনি মনে করেন না যে সেখানে মজুদের ঘাটতি আছে। প্রধান সমস্যা হল বণ্টন। পূর্ব পাকিস্তানের রেলপথ আমদানি করা খাদ্যের প্রায় ৬০% বহন করার জন্য যোগ্য তবে একজন বিদেশী সংবাদদাতা ঢাকা থেকে রিপোর্ট করেছেন যে এখন মাত্র ২০% রেলপথ স্বাভাবিক আছে। জাতিসঙ্ঘ তাই জল ও সড়ক পথে দেবার চেষ্টা করছেন। তারা প্রায় এক হাজার যানবাহন ও বিভিন্ন কোস্টার এবং নৌকা সরবরাহ করবে। কিন্তু রিপোর্ট করা হয় যে রাস্তার অবস্থা এত খারাপ যে জাতিসংঘের ১০০ টি ট্রাকের মধ্যে ৭০ টি এখনো চট্টগ্রামে বন্দরে আটকে আছে।

এখানে গেরিলাদের ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। কারণ গেরিলাদের বিভিন্ন গ্রুপ রাস্তার অবস্থা খারাপ করেছে নানা রকম আক্রমণ করে। সম্প্রতি অন্তত তিনটি জাহাজ চালনা পোতাশ্রয়ে মাইন দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে এবং এর কারণে একটি ব্রিটিশ লাইন পূর্ব পাকিস্তানের শিপিং বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। যদিও এটা এখন বিশ্বাস করা হয় যে, এগুলোর কোনটিতে খাদ্য ছিলোনা। যদি মূল বন্দর নিরাপদ না রাখা যায় তাহলে খাদ্য সরবরাহে সমস্যা দেখা দেবে। যোগাযোগ ধ্বংস করা ছাড়াও গেরিলারা আরও অংকে সমস্যা সৃষ্টি করছে যাতে করে তাদের বিরুদ্ধে একশন নিতে সেনাবাহিনী বাধ্য হচ্ছে। সেনাবাহিনীর এই একশন অতি দ্রুত থামানো উচিৎ কারণ গেরালারা ক্রমাগত তাদের কর্মপরিধি বাড়াচ্ছে। যেসকল এলাকায় মিলিটারি একশন চলছে সেখানে খাদ্য সরবরাহ করা দুষ্কর।

গত মাসে জনাব মোশতাক আহমেদ, যিনি বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আছেন, তিনি ভারতের একজন বিদেশী সংবাদদাতাকে বলেছেন যে তিনি আশা প্রকাশ করেন পূর্ব পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক ত্রাণ অপারেশন পরিচালিত হবে। কিন্তু তিনি বলেন, এটি পূর্ণ মাত্রায় সফল করতে হলে আন্তর্জাতিক সংস্থাকে খাদ্য বণ্টনে এগিয়ে আসতে হবে। তার বক্তব্য এই সপ্তাহে লন্ডন প্রতিনিধির কাছে পৌঁছানো হয়। তিনি মনে করেন পাকিস্তান আর্মির চাইতে রিলিফ অপারেশন জাতিসঙ্ঘের পরিচালনা করা উচিৎ।

বাংলাদেশ আন্দোলনকারীরা জানান যেহেতু এখন পর্যন্ত কেউ তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসছেনা তাই তাদেরকে গেরিলা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে।

২৮।
বাংলা ডন নিউজ টক
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
প্রেস অন পাকিস্তান
২০ অক্টোবর ১৯৭১
– মার্ক টালি

আসামে গৌহাটি থেকে আজ ডেইলি টেলিগ্রাফ এর এক প্রতিবেদনে ক্লেয়ার হলিংওর্থ জানিয়েছেন যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমণ আসন্ন এবং কর্নেল ওসমানীর অধীনে ৩০০০০ জওয়ান প্রস্তুত আছে। তিনি জানান সিলেট জেলা ও কুমিল্লার কাছাকাছি ছাতকে ভারী যুদ্ধ হয়েছে। তিনি জানান চীনারা গেরিলাদের বস্তুগত ও নৈতিক সমর্থন দিচ্ছে। ভারতীয় কর্মকর্তারা গেরিলাদের মধ্যে বামপন্থী প্রবণতার লোকের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়ে উদ্বিগ্ন আছেন। তিনি আরও জানান কলকাতায় অবস্থিত বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের দল এবং ত্রিপুরার গেরিলা নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে যার ফলে এই সুযোগে বামপন্থিরা গেরিলাদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার বৃদ্ধি করতে পারে বলে তিনি আশংকা করেন।

টাইমস গতকাল দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের উপর একটি ব্যাপক আলোচনা প্রকাশ করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ভারত যুদ্ধ চায়না এবং যুদ্ধ শুরু হতে পারে এমন কোন উসকানি দিতে চায়না। মিসেস গান্ধী আরো বলেন যে তিনি পাকিস্তান সরকারের সাথে আলোচনার কোন কারণ দেখেন না। কারণ সমস্যা পাকিস্তানের সরকার ও তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাঝে।

গতকাল এবং আজ (রবিবার ও সোমবার) ব্রিটিশ প্রেস রিপোর্ট ভারত ও পাকিস্তান ইস্যুতে ব্যাপকভাবে আলোচনা করেছে। মার্ক টালি এই প্রেস কভারেজ সম্পর্কে জানাচ্ছেন – –

২৯.
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
ভারত পাকিস্তান ও প্রেস
২৫ অক্টোবর, ১৯৭১
– মার্ক টালি (এস)

যে কেউ যিনি গতকালের এবং আজকের ব্রিটিশ পত্রিকা পড়েছেন তিনি বিভ্রান্তিতে পরে যাবেন। মূল প্রশ্ন যা আলোচনা করা হয়েছে তা হোল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা। আজকে টাইমস এবং স্কচম্যান পত্রিকা নিন। টাইমস পিটার হ্যাজেলহার্স্ট এর বরাত দিয়ে জানিয়েছে, “মিসেস গান্ধী যুদ্ধের হুমকির পরিবর্তে বিদেশে রওনা দিলেন”। অন্যটিতে লেখা হয়েছে যুদ্ধের আশঙ্কা বাদ দিয়ে মিসেস গান্ধী “বিদেশী সফরের জন্য’’ রওনা দিয়েছেন। সানডে টেলিগ্রাফ গতকাল দিল্লি থেকে রীপোর্ট করেছে যেখানে বলা হয়েছে বিদেশ ভ্রমণের প্রাক্বালে জাতির সামনে দেয়া মিসেস গান্ধীর ক্ষণস্থায়ী ভাষণে সীমান্ত এলাকার উত্তেজনা পরিস্থিতি কিছুটা হলেও হ্রাস পাবে। যদিও রবিবারের রিপোর্টে প্রকাশিত সামরিক কর্মকান্ড যথেষ্ট ভীতিকর। তবে অন্যদিকে দুইটি রিপোর্টে বলা হয়েছে ভারত সেনা রিজার্ভিস্টদের ডেকেছে। অবজারভার প্রতিনিধি জানান সীমান্তে রিজার্ভ বাহিনীকে ভারত সরকারের শো আপ রাখতে ও পাকিস্তানের অনুরূপ বিল্ড আপ পূরণের জন্য তলব করা হয়েছে।

আজকের ডেইলি টেলিগ্রাফ দুটি প্রতিবেদন যার শিরোনাম ভীতিকর। একটি রিপোর্ট করেছেন লাহোর থেকে ডেভিড লোসাক – তিনি শিরোনাম করেছেন “পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতের বিপক্ষে যেতে উৎসাহী” – অন্যদিকে ক্লেয়ার হলিংওর্থ লিখেছেন “ভারতীয় সেনারা ধর্মঘটে যাচ্ছেন।’ লসাক জানান পাকিস্তান সেনারা লাহোর সীমান্তে শক্তি বৃদ্ধি করেছে। লসাক মনে করেন এই অবস্থা থেকে উত্তরণের কোন পথ নেই। এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার কোন চেষ্টা পাকিস্তান সরকারকে করতে দেখা যাচ্ছে না। ক্লেয়ার হলিংওর্থ জানান মিসেস গান্ধি চলে যাবার আগে তাঁর মন্ত্রীসভা ও সেনাবাহিনীর অফিসারদের সাথে দীর্ঘসময় বৈঠক করেছেন।

জন গ্রিগ যিনি সম্প্রতি সরকারী অতিথি হিসেবে ভারত সফর করে ফিরে এসেছেন তিনি গতকাল অবজারভার পত্রিকায় একটি দির্ঘ রিপোর্ট লিখেছেন। তিনি জানান মিসেস গান্ধি একটি শান্তিপূর্ন সমাধানের জন্য এখনো উদ্বিগ্ন। তবে তিনি যুদ্ধ থেকে সরে যাবেন না যদি পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করে। তিনি মনে করেন মিসেস গান্ধির বিদেশ সফর শান্তির শেষ প্রচেষ্টা। তিনি পশ্চিমা দেশগুলোকে জিজ্ঞেস করবেন পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা পরিবর্তন ও শরনার্থিদের প্রত্যাবর্তনের জন্য তারা নূন্যতম সহায়তা বয়া সমর্থন দেবেন কিনা।

অন্যদিকে, স্যার ফ্রেডারিক বেনেট যিনি পার্লামেন্টের সদস্য তিনি আজ টেলিগ্রাফে একটি চিঠি প্রকাশ করেছেন। তিনি সম্প্রতি পাকিস্তানের উভয় অংশ সফর করে এসেছেন। তিনি মনে করেন বাংলাদেশের বিষয়টি বায়াফ্রার মত। স্যার ফ্রেডারিক বেনেট উল্লেখ করেন জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকরা পরামর্শ দিয়েছেন যে উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে নেবার একমাত্র পথ হোল সীমান্তে উত্তেজনা কমানো।তিনি বলেন যদি গেরিলা কার্যক্রম চলে তাহলে যুদ্ধ অবশ্যাম্ভাবি হবে।

টাইমসে আজ পিটার হ্যাজেলহার্স্ট একটি নিবন্ধে ভারতীয় এবং পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আপেক্ষিক শক্তি বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি বলেন যে, উভয় বাহিনী সুশৃঙ্খল এবং সশস্ত্র। সংখ্যাসূচকভাবে ইন্ডিয়ার শক্তি তিনগুন বেশী। তবে সমস্যা হল ২৭ ডিভিশনের ১০ টাই চীনের সাথে উত্তর সীমান্তে নিযুক্ত। লজিস্টিক সাপোর্ট পাক আর্মির বেশী আছে। তিনি বলেছেন ভারত চায় না পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করতে – কারণ এতে করে প্রদেশ গুলোতে অস্থিরতা সৃষ্টি হবে। আর ৭০ মিলিয়ন শরনার্থি তাদের পুষতে হবে। তবে তিনি বলেন গেরিলারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে হয়রানি করে তাহলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যুদ্ধের ঘোষণা দিতে পারেন। সম্ভবত কাশ্মীরে এটা শুরু হতে পারে। এবং নিরাপত্তা পরিষদের সাথে সাক্ষাত করতে চাইতে পারেন।

অবশেষে, উভয় স্কচম্যান এবং গার্ডিয়ান আজ সম্পাদকীয় লিখেছে। উভয় কাগজ সম্মত হয় যে যেহেতু মিসেস গান্ধী দূরে আছেন তাই যুদ্ধ হয়ত শুরু হবেনা। স্কচম্যান বলেছে ভারত সংযমের আপিল করেছে এবং যদি মিসেস গান্ধি শরনার্থিদের ব্যাপারে বিশ্ব সফরে কোন সমাধান না পান তাহলে তিনি তাঁর পরিকল্পনা পরিবর্তন করবেন। বিশেষ করে আমেরিকার কাছে তিনি দাবি করবেন। অন্যথায় সামরিক একশনের চাপ বৃদ্ধি পাবে। গার্ডিয়ান জানায় মিসেস গান্ধি আমেরিকা থেকে পাকিস্তানে অস্ত্র চালান থামাতে পারবেন এবং জাতিসঙ্ঘ ফোর্সকে পূর্ব পাকিস্তানে আসা থামাতে পারবেন। অন্যথায় তিনি ভারতের চরমপন্থিদের ঠেকাতে পারবেন না। তবে গার্ডিয়ান মনে করে ভারতের উচিৎ জাতিসঙ্ঘ টিমকে শরনার্থি এলাকায় প্রবেশ করতে দেয়া।

৩০.
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
প্রেস রাউন্ডআপ
১ লা নভেম্বর ১৯৭১
– উইলিয়াম ক্রলি সম্পাদিত (এস)

আজ সকালে এবং পুরো সপ্তাহ জুড়ে পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে রিপোর্ট হয়েছে। গতকাল সকালে সানডে টাইমস ঢাকা থেকে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এটিতে কোন স্বাক্ষর ছিল না তবে জানা যায় যে এটি সাম্প্রতিক ও নির্ভরযোগ্য। মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা ঢাকায় সরকারী ভবনের উপর দিনের আলোতে আক্রমণ করেছে। প্রতিবেদনে দুই সপ্তাহের আগের ঘটনা উল্লেখিত হয়ছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকায় অবস্থিত বিদেশীরা মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ও রাজাকার – উভয়দের থেকে ঝুঁকির মুখে আছে। ১৫ সেপ্টেম্বর পাকবাহিনী ৮০ জন গেরিলাকে আটক করার পড় তাদের আক্রমণ নতুন রূপ নিয়েছে।

ডেইলি টেলিগ্রাফ আজ ডেভিড লোসাক পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে রিভিউ করেছে। তিনি কলকাতায় থেকে রিপোর্ট করেছেন। তিনি বলেন গত ১০ মাস্যা পাকিস্তান সরকার অনেক ভুল করেছে। তিনি বলেন যেহেতু দেশটি যুদ্ধের সম্মুখীন অনেক গুরুত্তপূর্ন সিদ্ধান্ত তারা এড়িয়ে গেছেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পূর্ব পাকিস্তানে রাখার জন্য অনেক অর্থ খরচ হচ্ছে এবং পাকিস্তানের অর্থনীতি এখন ধ্বংসের সম্মুখীন। শ্রমিক অসন্তোষ বেড়েছে। তারা বেকার বসে আছে। আর পশ্চিম অংশের সাথে জাতিগত বিভেদ বাড়ছেই।

ফাইনানশিয়াল টাইমস আজ সকালে মিসেস গান্ধীর ব্রিটেনে সফরের উপর একটি সম্পাদকীয় লিখেছে। ফাইনানশিয়াল টাইমস বলে যে, যদি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ না হয় তাহলে মিসেস গান্ধির সফর ব্যার্থ হবেনা।
পত্রিকাটি বলছে যে ব্রিটেনের নীতি হওয়া উচিৎ ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ বন্ধ করতে কাজ করা। সাথে আমেরিকা ও রাশিয়ার সাথে সমন্বয় প্রয়োজন। ফাইনানশিয়াল টাইমস বলছে যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জনাব হিথের উচিৎ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়ে ভারতের সঙ্গে ও বাঙালিদের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতার চেষ্টা করা। এতে করে যুদ্ধের বিকল্প কিছু হতে পারে। পত্রিকাটি মনে করে একই রকমের মেসেজ প্রেসিডেন্ট নিক্সনকেও দেয়া উচিৎ। যাতে আমেরিকাও একই অবস্থান নেয়।

৩১.
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
পাকিস্তান ইস্যুতে ব্রিটিশ প্রেসের সংবাদের উপর আলোচনা
৩ নভেম্বর ১৯৭১
– উইলিয়াম ক্রলি (এস)

ঢাকা থেকে পাঠানো ক্লেয়ার হলিংওর্থ এর একটি রিপোর্ট আজ সকালে প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক টেলিগ্রাফে। তিনি বলছেন যে চল্লিশ হাজার বাংলাদেশ গেরিলা এখন পূর্ব পাকিস্তানের ভিতরে কাজ করছে। তিনি বলেছেন যে একজন আর্মি অফিসার জানিয়েছেন যে গত দুই মাস্যা মুক্তিফৌজে র সমর্থন স্রোতের মত বেড়েছে। তিনি বলছেন যে গেরিলারা মার্চ সংঘর্ষের পর এই প্রথম শহরের ভিতরে তাদের আক্রমণ বৃদ্ধি করেছে। তারা দিনের আলোতে সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে। তিনি বলেছেন ঢাকায় গেরিলাদের তিনটি গ্রুপ আছে। ব্যাংক ডাকাতি হচ্ছে। স্কুলে আক্রমণ হচ্ছে।অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের বাসায় রাখছে।

তিনি বলেন সেনাবাহিনী চাপের মুখে আছে। তারা সীমান্তে পাহারা দিচ্ছে। মফস্বলে তাদের পরিমাণ কম। পাকিস্তান সরকার জানিয়েছে যেসকল অঞ্চলে গেরিলা কর্মকান্ড বৃদ্ধি পাবে সেখানকার মানুষকে জরিমানা করা হবে। তবে এটা বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে।

ক্লেয়ার জানান বরিশালে একটি সেনা ফাঁড়ির তিন মাইলের মধ্যে গত সপ্তাহে প্রায় ১০০০ গেরিলাদের একটি সম্মেলন হয়। সম্মেলন একজন নকশাল নেতা হত্যার পর তার অনুসারীরা গেরিলা গ্রুপের সাথে যুক্ত হয়।

নিউ দিল্লিতে কুলদীপ নায়ার থেকে একটি রিপোর্ট করেছে টাইমস। তিনি বলেছেন যে বাঙালি নেতারা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সামরিক অভিযান সম্পর্কে আগে কিছু অনুমান করতে পারে নাই। আর দিল্লীর আপাত অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে তারা চুপ করে বসে থাকবে এবং যতদূর সম্ভব গেরিলাদের সাহায্য করবে। তিই বলেন মুক্তিবাহিনী তাদের নেতাদের বেশী করে চাপ দিচ্ছে চীনের সমর্থন নেবার জন্য। চরমপন্থিরা তর্ক করছে এই নিয়ে যে ভারত বাংলাদেশ যুদ্ধে জরাতে চায় না।

৩২.
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা
১১ নভেম্বর ১৯৭১
– মার্ক টালি (এস)

এই সপ্তাহের শুরুতে রিপোর্ট করা হয়েছিল যে পাক সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে যেখানে নাশকতামূলক বা রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রম চলছে সেখানে তারা জরিমানা করবে। মার্ক টালি এই ব্যাপারে জানাচ্ছেন।

পাকিস্তান সরকারের জরিমানা আরোপের সিদ্ধান্তে বোঝা আয় এই সরকার পূর্ব পাকিস্তানের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সঠিক করার জন্য কতটা মরিয়া হয়ে উঠেছে। যদিও জানা যায় যে আর্মি এবং পুলিশ অনেক নাশকতামূলক কাজ করছে কিন্তু সেগুলো সরকার অস্বীকার করছে এবং কিছু ক্ষেত্রে তারা বলছে যে এগুলো অফিসিয়াল পলিসি। পাকিস্তান সরকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছেন বলে জানাচ্ছেন অথচ বিশ্ব বলছে যে তাদের পূর্ব পাকিস্তানের উপর কোন নিয়ন্ত্রণই নেই। বরং তারা পূর্ব বাংলার বিশাল জনগণের উপড়ে অপারেশন চালাচ্ছে। সরকারকে বুঝতে হবে যে জরিমানার এই বিষয়টি আসলে তেমন নয়।

পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাওয়া রিপোর্ট বলে যে সেখানে গেরিলা কার্যক্রম বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের একটি টার্গেট হোল স্কুল ও কলেজ। গেরিলারা ছাত্রদের ক্লাসে আসতে বাঁধা দিতে চায়। অর্থনিতিও একটি টার্গেট। সম্প্রতি ৩ টি পাট গুদাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। গেরিলারা যারা পাকসেনাদের সহযোগী তাদের দিকেও মনোযোগ দিচ্ছে। রবিবার জাতীয় পরিষদের একজন সদস্য যিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সিল পেয়েছেন তাকে গুলি করা হয়েছে। আরেকটি রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা হয়েছে।রিপোর্টে বলা হয় যে পূর্ব পাকিস্তানের কমপক্ষে ৭ টি স্থান আছে যেখানে পাকিস্তান সরকার নিয়ন্ত্রণ করছেনা।

সরকার সবচেয়ে বড় যে সমস্যায় পড়ছে তা হোল তারা রাজাকারদের উপর নির্ভর করতে পারছেনা। যে কাজ পুলিশ বয়া আর্মি দিয়ে করা হচ্ছে। নিয়মিত পুলিশ দুর্বল হয়ে গেছে। সেনাবাহিনীর কাজের ফলে তাদের কাজ দমিয়ে আছে। জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পরিকল্পনা তেমন কাজ করছে না। জনগণ তেমন সায় দিচ্ছেনা এবং সরকারকে সহায়তা করছে না। মনে হচ্ছে সাম্প্রতিক নিষিদ্ধ করা দল আওয়ামীলীগের বিপরীতে আর কোন নতুন দল সৃষ্টি হচ্ছেনা। পরের মাস্যা জাতীয় পরিষদের উপনির্বাচনের জন্য ৭৮ টি আসনে নির্বাচন হবার কথা। রিপোর্ট জানাচ্ছে যে এর মধ্যে ৫২ টি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে আছে। যেহেতু বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতরা বেশিরভাগ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসেছে তাই ধারণা করা হচ্ছে যে এরা নির্বাচিত হলেও এই এলাকার মানুষের উপর কর্তৃত্ব চালাতে ও সাংবিধানিক কাজকর্ম করতে পারবে না।

আরেকটি রাজনৈতিক সমস্যা হল একটি বৃহৎ অংশ যারা আওয়ামীলীগ থেকে নির্বাচিত হয়েছিল পরবর্তি জাতীয় পরিষদের জন্য। সরকার তাদেরকে সরিয়ে দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে তাদের বেশিরভাগ এখন ভারতে অবস্থান করছে।

লক্ষণে বোঝা যায় পূর্র পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা এখন স্বাভাবিকের চাইতে অনেক দূরে। এই অবস্থায় কিভাবে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে তা অনিশ্চিত।

৩৩।
এশিয়া সম্পর্কে আলোচনা
ইন্দো-পাকিস্তান ইস্যুতে ব্রিটিশ প্রেস
৩০ নভেমেব্র ১৯৭১
– উইলিয়াম ক্রলি (এস)

বেশিরভাগ ব্রিটিশ পত্রিকা আজ ভারতের একটি ঘটনা নিয়ে লিখেছে। বলা হয়েছে ভারত পূর্ব পাকিস্তানের বালুর ঘাট পার্বত্য এলাকায় ট্যাঙ্ক ও ইনফ্যান্ট্রি নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। কলকাতায় ডেইলি টেলিগ্রাফের প্রতিনিধি ডেলিড লোসাক বলেছেন পূর্ব পাকিস্তানের মিলিটারি সংকট পাকিসেনা ও মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এটি নিয়ে সরকারিভাবে প্রচার ছাড়া আর কেউ কিছু বলে নাই।

টাইমসের ডেভিড হূসেগো রাওয়ালপিন্ডি থেকে রিপোর্ট করেছেন যে ভারতীয় এবং গেরিলা বাহিনী পাকসেনাদের উপর বারবার আক্রমণ করে তাদের উসকানি দিচ্ছে এবং অন্যদিকে পাকিস্তান সেনারা যাতে পর্যাপ্ত সরবরাহ না পায় তাতে বাঁধা দিচ্ছে। হুসেগো বলছেন যে উত্তর অঞ্চলের আকাশপথ সংকটাপন্ন যেখান দিয়ে পাকিস্তান আর্মির রসদ আসে। তিনি আরও বলছেন যে রাওয়ালপিন্ডিতে পর্যবেক্ষকরা দেখতে চান কিভাবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তার সিদ্ধান্তে লম্বা সময়ের জন্য অটল থাকেন, অথবা পূর্ব বা পশ্চিম অংশে আক্রমণ করেন অথবা রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টা করেন।

ঢাকা থেকে গার্ডিয়ান লেখা, ওয়াশিংটন পোস্টের লি লেস্কেজ বলছেন যে এটা স্পষ্ট যে যুদ্ধ কিছু ছোট এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে এবং ভারত আক্রমণাত্মক জায়গা নিয়েছে। ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের ইচ্ছা যে ওপর পক্ষ আগ্রাসক হিসাবে আসুক কিন্তু এই উদ্বেগেই অঘোষিত সীমান্ত যুদ্ধ পরিবেশ চলছে। কিন্তু লেস্কেজ মনে করেন ভারতীয় আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী ভারসাম্য বজায় রেখেছে। তিনি মনে করেন যে ভারত আশা করে পাকিস্তানি সেনারা আক্রমণ করুন যাতে করে তারা পাকিস্তানি আগ্রাসনের প্রমাণ প্রদান করতে পারে। এবং এর ফলে আরও শক্তিশালী মিলিটারি একশনে যেতে পারবে ভারত।

এছাড়াও আজকের গার্ডিয়ান একটি সম্পাদকীয় লিখেছে যেখানে তারা শিরোনাম করেছে যে ভারত যুদ্ধের উদ্রেককারী হিসেবে কাজ করছে। গার্ডিয়ান বলছে যে ভারতীয় সামরিক আক্রমণের লক্ষ্য হয় শেখ মুজিবের মুক্তি এবং একটি স্বায়ত্তশাসিত বাংলাদেশ বা সরাসরি সামরিক বিজয়। কিন্তু গার্ডিয়ান বলছে যে ভারতের কৌশল আরো বেশী অস্পর্শী। তারা কূটনৈতিক, রাজনৈতিক এবং মানসিকভাবে বিধ্বংসী। কূটনৈতিকভাবে কেউ এখন বিশ্বাস করেনা যে এটা আসলে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ বিষয়। রাজনৈতিকভাবে পাকিস্তানের একটি পাল্টা আক্রমণ এখন এত উত্যক্ত করার পর একটি কাঙ্ক্ষিত প্রতিক্রিয়া বলে মনে হতে পারে এবং মানসিকভাবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এই মুহুর্তে শেখ মুজিবকে মুক্তি দেবেনা এবং গার্ডিয়ান বলেছে যে শেখ মুজিব ছাড়া বাংলাদেশ দ্রুত পৃথক্ হয়ে যাবে।

৩৪.
এশিয়ান সম্পর্কিত আলোচনা
ঢাকা থেকে আহমেদ নিজামুদ্দিন
২ ডিসেম্বর ১৯৭১
– মার্ক টালি সম্পাদিত (এস)

ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখপাত্রদের মতে, ভারতীয় সৈন্যরা উৎরে সিলেট জেলার শমসেরনগর এয়ারপোর্টে এবং পশ্চিম সীমান্ত কুষ্টিয়া জেলার দর্শনা রেলস্টেশনে ঢোকার চেষ্টা করছে। সেনাবাহিনীর মুখপাত্র অগ্রিম ব্লাফ বলে দাবি করেন। একটি সূত্র অবশ্য বলেন, গুরুতর যুদ্ধ অপেক্ষমাণ কিন্তু ঢাকায় পৌঁছানো খবরে বলা হয়েছে যে ভারতীয় সৈন্যরা এখনও সীমান্তে আছে। আরও কিছু বর্ডার অঞ্চলে আক্রমণ হয়েছে। ভোমরা ও খুলনার সারকারা, আফ্রা, সিমিলিয়া, ভদ্রা, খালিশপুর শিল্পনগর, উস্টাইল এবং খুলনার আন্দাল্বার, ময়মনসিংহের কামাল্পুর, শমসেরনগর এবং সিলেট জেলার উনাচম, কসবা, সালদানদী, বরজালা, গেনাগাদার বাজার, পাথরনগর এবং কুমিল্লার হরিমঙ্গল এবং চট্টগ্রাম জেলার ছোটা হারিনা উল্লেখযোগ্য। একটি সামরিক সূত্র আজ ৫১৫ গুর্খা রেজিমেন্টের দুই ভারতীয় সৈন্যের ছবি এবং তাদের সনাক্তকরণ নম্বর প্রকাশ করে। পূর্ব পাকিস্তান অঞ্চলের ভেতরে জৈন্তাপুর অঞ্চলে তারা নিহত হয়েছিল। ছবি দুটি প্রকাশ করে তারা প্রমাণ করতে চেয়েছে যে যুদ্ধে ভারত জড়িত আছে।

এদিকে বিদ্রোহীরা যাদের কর্মকর্তারা দুর্বৃত্ত হিসাবে বর্ণনা করেন তারা গত ২৪ ঘন্টায় পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী শহরের বিভিন্ন অংশে পাঁচটি বোমা বিস্ফোরিত করেছে। একটি বোমা একটি বামপন্থী দল অফিসে বিস্ফোরিত হয়। সে সময় ডানপন্থী নেতা গোলাম আযম ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন যে, একটি জাতীয় সরকার অদূর ভবিষ্যতে পাকিস্তানে গঠিত হতে পারে। জনাব ভুট্টোকে সরকারে অন্তর্ভুক্ত করার সম্ভাবনা আছে। গোলাম আযম আরো দাবি করেন জাতীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদের থেকে নিয়োগ দেয়া হবে যাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আস্থা সরকার ফিরে পায়।

আরেকটি বিস্ফোরণ খারাপভাবে রামপুরা, মালিবাগ এলাকায় বৈদ্যুতিক খুঁটি ক্ষতিগ্রস্ত করে। আরমানিটোলা মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়ে দুটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। পুলিশ মারফত জানা যায় নতুন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও রহমতুল্লাহ হাইস্কুলে ধ্বংস সাধন করা হয়। বিমান বন্দর রোডে একটি পেট্রোল পাম্প ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দুই ব্যক্তি আহত হন। তাদের একজনের অবস্থা গুরুতর। ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালে উত্স বলেন যে আরও দুজন বুলেট বিদ্ধ মানুষ সেখানে ভর্তি হয়েছে । নিকটবর্তী কেরানীগঞ্জ এলাকা থেকে ৩৫ জন এধরনের রোগী এসেছে।

পাকিস্তান সরকারের মুখপাত্র বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান এর ট্রায়াল “শেষ হয়নি”। দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম পার্শ্ববর্তী জেলা ও ঢাকা শহরের ২০ মাইল পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। ঢাকা শহরের দক্ষিণ দিক থেকে ২২ মাইল দূরের মেদিনীমণ্ডল থেকে একজন বুড়ো লোক, জনাব আফজাল হোসেন, কেরোসিনে তেল, ওষুধ ও কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে এসেছেন। ঢাকা সিটিতে সরকার শহরবাসীদের জন্য শুধুমাত্র যাদের রেশন কার্ড আছে তাদের কাছে কেরোসিন তেল বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যখন আমি একটি ন্যায্যমূল্যের দোকান পরিদর্শন করলাম আমি দেখলাম সেখানে মানুষ তাদের স্বাভাবিক কাজ রেখে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাথাপিছু এক গ্যালন তেল নেবার জন্য প্রায় শ খানেক লোক লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। গ্রাম অঞ্চলে ভোক্তাদের বক্তব্য অনুযায়ী কার্যত কোন কেরোসিন তেল ছিল না এবং সব স্থানীয় কাগজপত্র তাদের সম্পাদকীয়তে এই সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেন। দিনের পর দিন কেরোসিন তেলের তীব্র ঘাটতি হয়েছে। এর অন্যতম কারণ হল বিদ্রোহীরা চট্টগ্রাম বন্দরে একটি তেল ট্যাঙ্কার বিস্ফোরিত করে। পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ কেরোসিন ব্যাবহার করে। তারা সন্ধ্যায় আলো জ্বালানোর জন্য এবং শহরে রান্নার জন্য তারা কেরোসিন ব্যাবহার করে।

৩৫.
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
ভারত / পাকিস্তান ইস্যুতে প্রেস রিভিউ
২ ডিসেম্বর ১৯৭১
– উইলিয়াম ক্রলি, (এস)

আজ সকালে ব্রিটিশ প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্টে জানা যায় বলে ভারতীয় বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের ভিতরে দুটি পয়েন্টে রেললাইন কেটে দিয়েছে। টাইমসএর পিটার হ্যাজেলহার্স্ট দিল্লি থেকে রিপোর্ট করেন যে ভারতীয় সেনারা হিলি অঞ্চলের রেল লাইন দখল করে আছে। ক্লেয়ার হলিংওর্থ, ঢাকা থেকে ডেইলি টেলিগ্রাফে লিখেছেন যে ভারতীয় আর্টিলারি যা গেরিলাদের দ্বারা সমর্থিত সেগুলো দিয়ে তারা ঢাকা চট্টগ্রাম রেল সংযোগ এবং চট্টগ্রাম এর ৩৮ মাইল উত্তরের কুমিল্লার ফেনী শহরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।

তিনি বলেন যে ভারতীয় অপারেশন ব্যাটালিয়ন স্তর (৬০০-৮০০ লোক) এর বেশী জমা হয় নি। এবং বেশিরভাগ অপারেশন এক কোম্পানী (১২০ জন পুরুষ) সৈন্য দিয়েই করা হয়েছে। তিনি জানান গতকাল ভারতীয় সেনারা পাকিস্তানী আর্টিলারি অবস্থানের উপর প্রচণ্ড শেলিং করতে থাকে। এটা ছিল রংপুরের কাছে। গানারদের গুলি করতে নিরুৎসাহিত করা হয়। একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, এই সেক্টরে ভারতের সীমান্ত পারাপার ছাড়া ছোট পাল্টা হামলা চালানোও অসম্ভব হবে, এবং তিনি তা না করার কড়া আদেশ দিয়েছিলেন।

টাইমস এবং ডেইলি টেলিগ্রাফ এর করেসপন্ডেন্টস কিছু বিদেশী সাংবাদিকদের সাথে ছিলেন যারা ইন্দো- পাকিস্তান সীমান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে সফর করার জন্য অনুমোদিত ছিলেন। এটা ছিল ভারতীয় দিকে বনগাঁর কাছাকাছি। সেখানে কিছু মেশিন গান ফায়ার ছাড়া তেমন কোন সঙ্ঘর্ষ ছিলোনা। ডেইলি টেলিগ্রাফ এর পিটার গিল রিপোর্ট করেন যে সেখানে পাকিস্তানি সেনারা ছিল না বলে মনে করা হচ্ছে এবং একটি বাংলাদেশের পতাকা সীমান্তের ওপারে উড়ছিল।

একটি বিলম্বিত রিপোর্ট এশিয়ান নিউজ সার্ভিসের এ বি মুসা, যিনি খুলনা জেলার সাতক্ষীরাতে মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের সঙ্গে ছিলেন – তার একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। মুসা রিপোর্ট করেন যে দুই প্লাটুন মুক্তিবাহিনী ইছামতি নদী পার হয়েছিল এবং পাকিস্তানি সেনাদের একটি দলকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। মুসা বলেন যে গেরিলাদের কেউ কেউ ১২ বছর বয়সী ছিল।

পূর্ব পাকিস্তানের ভিতরে গেরিলা কার্যক্রম এর উপড়ে একটি চলচ্চিত্র গত রাতে বিবিসি টেলিভিশনে দেখানো হয়েছিল। একজন আমেরিকান সাংবাদিক এটি চিত্রায়িত করে। এবং এখানে পাকিস্তানি লাইনের বিপরীতে গেরিলাদের অবস্থান দেখানো হয়। তাদের কাছে স্বল্প অস্ত্র ও সরঞ্জাম ছিল। তবে তারা অনেক বৃহৎ পরিসরে অপারেশন চালাচ্ছিল। তাদের দখল করা বন্দুক, গোলাবারুদ এবং মোটর ইঞ্জিনচালিত নৌকা ব্যাবহার করতে দেখা গেছে। একটি পূর্ণ বেসামরিক প্রশাসন গেরিলা লাইন অপারেটিং করছে বলে জানানো হয়।

৩৬.
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
ঢাকা থেকে আহমেদ নাজুমুদ্দিন
৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
– উইলিয়াম ক্রলি সম্পাদিত (এস)

০১১ ঢাকা ফিল্ডে একটি দিনের আকাশ যুদ্ধের পড় গতকাল বিকেল পর্যন্ত আবার ১১০ টি এয়ার এটাক হয়েছে। গতরাতে ০২৩০ টায় ইন্ডিয়ান বিমান বাহিনী ঢাকা শহরে আক্রমণ করেছে। আমি ঢাকা শহরের উপকণ্ঠে বোমার শব্দ শুনতে পাই কিন্তু ক্ষতির কোন খবর পাওয়া যায়নি। এদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সূত্র জানিয়েছে যে ভারতীয়রা কুমিল্লা জেলার আখাউরা ও ময়মনসিংহ জেলার কামালপুর ও উৎরে দিনাজপুরে যুদ্ধ সীমান্ত বাড়িয়েছে। সোর্স জানায় পাকিস্তানী সেনারা আক্রমণ প্রতিহত করেছে।

ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও পূর্ব পাকিস্তানের বন্দর শহর চট্টগ্রামে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়েছে এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য ব্ল্যাক আউট চলছে। ঢাকার সঙ্গে এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার সাথে যোগাযোগের সকল মাধ্যম সম্পূর্ণরূপে বিঘ্নিত হয়েছে এবং স্বাভাবিক জীবন থেমে গেছে। দোকান, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও অন্যান্য অফিস, বন্ধ রয়েছে। ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্র গত রাতে ভারতীয় বিমান ও স্থল হামলা দেখিয়েছে। বিমান হামলা, বিমানঘাঁটি, ধ্বংসপ্রাপ্ত প্লেন এবং বন্দী পাইলটদের দেখানো হয়েছে। স্থানীয় কাগজপত্র যুদ্ধের বড় খবর দিয়েছে। যশোর, কুমিল্লা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ভয়ানক যুদ্ধের খবর এখনো আসছে।

৩৭।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
ভারত ও পাকিস্তান সম্পর্কে ব্রিটিশ প্রেস এর উপর আলোচনা
৭ ই ডিসেম্বর ১৯৭১
ইভান চার্লটন সম্পাদিত (এস)

ব্রিটিশ প্রেস আজ ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের ব্যাপক কভারেজ দিয়েছে। বড় বড় পত্রিকায় সম্পাদকীয় ছাপা হয়েছে।

ডেইলি টেলিগ্রাফ বলে যে, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ” হিসেবে মিসেস গান্ধি পূর্ব বাংলাকে সম্বোধন করার ভারতের সিদ্ধান্ত ঘোষণায় মিসেস গান্ধী আরো তার অবস্থান আরও স্পষ্ট করলেন। কাজেই এখন বিনা দ্বিধায় আমরা বাংলাদেশের শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করতে পারব এবং আমাদের গৃহীত পদক্ষেপ ‘নাক গলানো’ হিসেবে বিবেচিত হবে না। পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা বিবেচনায় ভারতের পলিসি যুক্তিযুক্ত। মিসেস গান্ধিকে সেই ক্রেডিট দেয়া উচিৎ। তিনি বলেন রাজনৈতিক কোন সমাধানে পৌঁছাতে না পারায় সেই মার্চ থেকে শুরু হওয়া শরনার্থি সমস্যা খুব ভারি হয়ে আমাদের ঘাড়ে চেপে আছে।

টেলিগ্রাফ বলে ভারতকে ফলো করার সঠিক প্রতিনিধি হবে রাশিয়া। হয়ত আরও ১২ টি পূর্ব ইউরোপীয় দেশ আগে এগিয়ে আসতে পারে। চায়না পাকিস্তানের সমর্থক কিন্তু যদি একটি নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয় তাহলে এগিয়ে আসতে পারে। ওয়াশিংটন তার যথারীতি ভারত-বিরোধী অবস্থানের কারণে স্বীকৃতির বিরোধিতা করবে। বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর জন্য শুধু ভারতকে দোষী করলেই হবে না এবং সাহায্য বন্ধ করলেই চলবে না। কারণ মাসের পর মাস এখানকার শান্তি হুমকির মুখোমুখি আছে – জানায় টেলিগ্রাফ।

গার্ডিয়ান সম্পাদকীয়তে বলা হয় “জনাব নিক্সন হয়ত সম্পূর্ন বিজয় পছন্দ নাও করতে পারেন। চীন এটা ঘৃণা করতে পারে। কিন্তু সত্য পরিষ্কারভাবে উদ্ভাসিত হবেই”। গার্ডিয়ান মন্তব্য করে, বাংলাদেশ, যে অঞ্চল রক্তস্নাত ও জন্মের জন্য মরিয়া – সে বাস্তবতা এখন আর দূরে নয়।

এটা যুদ্ধের প্রথম প্রধান ট্রফি কিন্তু গার্ডিয়ান যুক্তি দেয় যে ভারতীয় বিজয় আরও প্রশ্ন তৈরি করবে। বাংলার স্বায়ত্তশাসন একটি ন্যায়পরায়ণ ও যোগ্য চাহিদা। কিন্তু সেটা পাকিস্তানের ঘোর শত্রু দ্বারা ভূষিত করা যাবে না। এটাকে একটি পুতুল রাষ্ট্র করা যাবে না। তাই বাংলাকে তার নিজের সমস্যার সমাধানে তার নিজস্ব নেতা দরকার।

টাইমস বলছে ভারত পূর্ববাংলার রাজনৈতিক সমস্যার একটি সামরিক সমাধান চাইছে কিন্তু তার কোন সুযোগ রাখা হয়নি। এটা ঠিক যে ভারত বলেছে যে পাকিস্তান বাংলাদেশের জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করতে সম্পূর্ণ অক্ষম। এই প্রচারের ফলে এখন পর্যন্ত অস্বীকৃত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যৌক্তিক মনে হতে পারে।

যদি তা দ্রুত করা হয় তাহলে ভারত ১৯৬২ সালের চীনা অনুকরণ করার চেষ্টা করতে পারে এবং এটি কোন যুদ্ধ ছিল না বলে ঘোষণা দিতে পারে। আর সেই সমাধান সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত রাশিয়ানরা নিরাপত্তা পরিষদে স্টোনওয়াল হিসেবে কাজ করবে। অবশ্য এরকম কিছু নাও ঘটতে পারে। পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তানের একশন থামবে না যদি এমনকি যদি পূর্ব পাকিস্তান পদদলিত হয়েও যায়।

এখানেই বিপদ নিহিত। একারণেই এদেরকে আলাদা করা এবং যুদ্ধ শেষ করা কঠিন হবে। তবে জাতিসঙ্ঘ আশা করতে পারে আপাতত যুদ্ধের পরিবর্তে কোন রকম একটা বোঝা পড়ায় আসা যায় কিনা। যাতে করে শেষ পর্যন্ত ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ ঠেকানো যায়।

৩৮.
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
ভারত / পাকিস্তান সম্পর্কে ব্রিটিশ সংবাদপত্রের পর্যালোচনা
৮ ডিসেম্বর ১৯৭১
উইলিয়াম ক্রলি সম্পাদিত (এস)

ব্রিটিশ প্রেসের অনেক প্রতিনিধিদের প্রতিবেদন এসেছে।
ডেইলি টেলিগ্রাফ এর পিটার গিল কলকাতা থেকে রিপোর্ট করেছেন। তিনি বলেছেন ভারতীয় সেনাবাহিনী যশোর দখল করে খুব গুরুত্তপূর্ন অর্জন করেছে। পিটার গিল বলেছেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কমান্ড পাকিস্তানি বাহিনীকে ধোঁকা দিয়েছিল এই বলে যে এই শহর দখলের চেষ্টায় কোন ফল নেই; শুধু শুধু রক্তপাত মাত্র। কিন্তু ইস্টার্ন কমান্ডের চীফ অব স্টাফ গতকাল কলকাতায় বলেছেন ভারতীয় কৌশল ছিল মূলত সব এলাকা থেকে পাকিস্তানি সেনা সরানো। পিটার গিল রিপোর্ট করেছেন যে পাকিস্তানি বাহিনীর গেরিলাদের হাতে পড়ার চেয়ে একটি নিয়মিত বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে পছন্দ করছে। ক্লেয়ার হলিংওর্থ শহর থেকে নারী ও শিশুদের উদ্বাসন ব্যবস্থা করতে জাতিসংঘের প্রচেষ্টার ওপর নজর দেন। জনাব পল মার্ক হেনরি, জাতসঙ্ঘ সহকারী মহাসচিব রেডক্রসের এখতিয়ারভুক্ত হয়ে ঢাকায় একটি নিরপেক্ষ অঞ্চল করতে চাচ্ছেন। ক্লেয়ার রিপোর্ট করেন যে ঢাকায় যখন বিমানহানার শব্দ হচ্ছে তখন সাধারণ মানুষ তেমন শঙ্কিত হচ্ছেন না কারণ তারা জানেন ভারতীয়রা মূলত মিলিটারি স্থাপনাগুলোতে আক্রমণ করছে।

৩৯.
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
নিউজনোট: ভারত ও পাকিস্তান
৮ ডিসেম্বর ১৯৭১
– মার্ক টালি

গতকাল, ব্রিটিশ লেবার পার্টির আন্তর্জাতিক কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে একটি জরুরী রেজল্যুশন পাশ করে যা পাকিস্তানের জোরালোভাবে সমালোচনামূলক ছিল। রেজল্যুশন বলে যে বর্তমান সংঘাতের কারণ হচ্ছে দেশটির পূর্ব শাখার মানুষের দ্বারা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতাদের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক সমাধান দরাদরি করতে পাকিস্তান সরকারের অস্বীকার। রেজল্যুশনে এছাড়াও ভারত বা পাকিস্তানে কোন অস্ত্র পাঠানো বন্ধ করতে সব দেশের প্রতি আহ্বান জানান হয়। লেবার পার্টির আন্তর্জাতিক কমিটি একটি পাঁচ দফা পরিকল্পনা করেছে
যা উভয় পক্ষের প্রতি যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ করতে আহ্বান করে। এছাড়া শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি এবং একটি রাজনৈতিক সমাধান যা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে সন্তস্ট করবে সেই আবেদনও জানানো হয়।

রাজনৈতিক সমাধানের পরে উদ্বাস্তুদের সুশৃঙ্খল ভাবে ফিরে আসার জন্য ব্যাবস্থা করতে হবে। এবং বিশ্বের সাহায্য ব্যাপক পরিমাণে বাড়াতে হবে। কমিটির সকল সদস্যদের মতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতির ব্যাপারটি আপাতত স্থগিত রাখা হোক কারণ এটি যুদ্ধ থামানোর ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারের প্রচেষ্টার বিপরীতে যেতে পারে। পাকিস্তানের নিন্দা সত্ত্বেও, লেবার পার্টি মনে করে তাদের এই রেজল্যুশন পাশ করানো উচিৎ। অন্তত সরকারের নীতি সমর্থন অব্যাহত রাখার জন্য।

ব্রিটিশ সরকার পরিষ্কারভাবে ভারত ও পাকিস্তানের উপর যতটা সম্ভব প্রভাব বজায় রাখতে চেষ্টা করছেন। কূটনৈতিক সূত্র মতে, ব্রিটেন স্পষ্টভাবে ভারতে এইড বন্ধ করার ব্যাপারে আমেরিকাকে ফলো করতে যাচ্ছে না। ব্রিটিশ সরকার দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে দিতে চাচ্ছেনা। সাধারণ পরিষদের ভোট না দেয়া ১০ টি দেশের মধ্যে ব্রিটেন একটি যারা উভয় পক্ষকে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য আহ্বান করেছে। ব্রিটিশ সরকার নিরাপত্তা পরিষদের আলোচনায় ভারতীয় বা পাকিস্তানি কারো পক্ষে অবস্থান করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয় নাই। ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের আপসের পথ খুঁজে বের করার আশা যাতে ছেড়ে না দেন সেটাই বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।

৪০.
এশিয়া সম্পর্কে আলোচনা
ঢাকা থেকে আহমেদ নিজামুদ্দিন
১০ ই ডিসেম্বর ১৯৭১
– মার্ক টালি সম্পাদিত (এস)

এটি ঢাকা থেকে নিজামউদ্দিন আহমেদ থেকে পাওয়া। এটা গতকাল সকালে পাঠানো হয়েছে।
(বৃহস্পতিবার সকালে)

অবরোধ ও যোগাযোগের সব মাধ্যম ভেঙ্গে পড়ায় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ও অভাব বেড়েছে। ঢাকা থেকে সকল ডাক সেবা বন্ধ। কয়েকটি শহর ও জেলা সদরে টেলিযোগাযোগ বাদে বাকি সর্বত্র স্থগিত হয়ে গেছে। শহরে ব্যক্তিগত গাড়ি , বাস ও পাবলিক বাহন চলছে না। তবে সামরিক বাহিনী, পুলিশ ও অন্যান্য সরকারি সংস্থার গাড়ি রাস্তায় আছে। পেট্রোলের সীমাবদ্ধতা থাকায় তা সরবরাহ করা হচ্ছে। লবণ, কেরোসিন তেল, সরিষার তেল এবং পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য খোলা বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছে। সরকার নগরবাসীর সাপ্তাহিক খাদ্য রেশন এক চতুর্থাংশ কমিয়েছে। চিনি ও চাল উচ্চ দরে বিক্রি হচ্ছে।

শহর বাজারে মাছ ও মাংস সরবরাহ অপর্যাপ্ত। দোকান এবং অফিস দুপুর ২ টায় বন্ধ হয়। ব্যাংকিং সেবা অন্যান্য শিল্প বিমান অভিযানের কারণে ব্যাহত হচ্ছে। তবে সাধারণভাবে মানুষ বিমান যুদ্ধ অনেক উপভোগ করে। সংবাদপত্র ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ এলাকায় সীমাবদ্ধ আছে।

৪১.
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
ভারত / পাকিস্তান এর উপর ব্রিটিশ প্রেস রিপোর্ট
১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১
উইলিয়াম ক্রলি সম্পাদিত (এস)

ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যমে আজ সকালে জাতিসঙ্ঘের ব্যাপারে অনেক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এবং আরও আলোচিত হয়েছে যে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী একটি শান্তিনিষ্পত্তির জন্য বিবেচনা করতে পারেন। পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি বাহিনীর ভবিষ্যত অনিশ্চিত। পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক গভর্নর এর সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল ফরমান আলী খান পাকিস্তানি বাহিনী প্রদেশ থেকে প্রত্যাহারের জন্য আলোচনা শুরু করার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছিলেন যা কমান্ডিং অফিসার জেনারেল নিয়াজি এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান নিজে ভেটো দিয়েছিলেন। সকালের খবরের কাগজের রিপোর্ট বলে মেজর জেনারেল ফরমান আলী খানের অবস্থান সন্দেহজনক। ক্লেয়ার ঢাকা থেকে ডেইলি টেলিগ্রাফ এ রিপোর্ট করে জানান অফিসার সম্ভবত গৃহবন্দী আছেন।

ক্লেয়ার জানান এটা গতকাল অনুমান করা হয় যে কমপক্ষে ৫০০০ পাকিস্তানি সেনারা এখনো ঢাকা রয়ে গেছে। এবং এটি প্রত্যাশিত যে ভারতীয় বাহিনী পরবর্তী ২ দিনের মধ্যে শহর দখল করে নেবে।

নয়া দিল্লি থেকে ডেইলি টেলিগ্রাফ এর ডেভিড লোসাক জানান চীন ও পাকিস্তান চাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে সরিয়ে নিতে। ভারতীয় গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে চীন ও পাকিস্তানের হাই কমান্ড কিছু উদ্ধারকারী জাহাজ গাঙ্গেয় বদ্বীপে সমবেত করেছে। ডেভিড জানান এটা ধারণা করা হচ্ছে যে, এই জাহাজ যাতে চীনা পতাকা উড়ছে – এগুলো পাকিস্তানি সেনাদের সরিয়ে নিতে এসেছে। জানা যায় এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে পাকিস্তানের ৭০০০০ শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বেঁচে যাওয়া অনেকে গঙ্গা পোর্ট হয়ে বার্মার দিকে যাবার পথ তৈরি করছেন। লোসাক জানান ঢাকা ভারতীয় ইউনিটের উল্লেখিত প্যারাশুট অবতরণের কারণ আক্রমণ করা নয় বরং ঢাকা থেকে পালানর রাস্তা ধ্বংস করা – যাতে করে পোর্টের দিকে পাকিস্তানী সৈন্যরা পালিয়ে যেতে না পারে। lOsak janan ze ভারত সরকার উদ্ধার অভিযানে চীনা হস্তক্ষেপের কারণে চিন্তিত।

টাইমস পত্রিকায় হেনরি স্ট্যানহোপ কলিকাতা থেকে রিপোর্ট করেছেন। তিনি যশোরে বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠার ওপর রিপোর্ট করেছেন। সরকারের প্রথম কাজ যুদ্ধ ট্রাইবুনাল করে যারা পাকিস্তানি সেনা শাসকদের সঙ্গে সহযোগী ছিল তাদের বিচারের ঘোষণা দেয়া হয়। তিনি জানান মুক্তিবাহিনী স্থানীয় পুলিশ বাহিনীর সাথে মিলে নাগরিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য চেষ্টা করছে। স্ট্যানহোপ জানান যে ভারতীয় সেনাদের ব্যাবহার ভালো ছিল এবং তাদের কারো বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ শোনা যায়নি।

একজন গার্ডিয়ান প্রতিনিধি, ওয়াশিংটন পোস্টের লরেন্স স্টার্ন, যশোর থেকে রিপোর্ট করেছেন। তিনি জানান ইন্ডিয়ান ও বাংলা শহরগুলোতে মানুষ সবচেয়ে বন্ধুসুলভ অবস্থায় আছে। বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম যশোরে একটি বক্তৃতায় বলেন “যারা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট করতে চাইবে তাদের আমরা সহ্য করব না।’ জ্যাকসন বলেন যে ভারতের আগ্রহ হচ্ছে ইসলামাবাদের সামরিক জান্তাকে ভেঙ্গে ফেলা তবে পশ্চিম পাকিস্তানকে নয়।

৪২।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
ভারত / পাকিস্তান সম্পর্কে ব্রিটিশ প্রেস রিপোর্ট
১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১
উইলিয়াম ক্রলি সম্পাদিত (এস)

আজ সকালের পত্রিকায় গতকালের ঢাকায় ভারত ও পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর পূর্ব পাকিস্তান কমান্ডারদের দ্বারা আত্মসমর্পণের চুক্তিপত্র স্বাক্ষরের খবর বড় করে প্রকাশিত হয়। কিছু কিছু পত্রিকা আত্মসমর্পণ সনদের পূর্ণ টেক্সট ছাপায়। সেখানে বলা আছে বিদেশী নাগরিক, জাতিগত সংখ্যালঘু এবং পশ্চিম পাকিস্তানীদের পূর্ণ সুরক্ষা দেবে ভারতীয় সেনাবাহিনী।

নিউ ইয়র্কে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব ভুট্টোর সঙ্গে একটি সাক্ষাতকার টাইমসে প্রকাশিত হয়। নিউ ইয়র্ক টাইমস নিউজের হেনরি ট্যানার জানাচ্ছেন যে ভূট্টো সাহেব মনে করেন পাকিস্তানের উচিৎ ভারতের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি মেনে নেয়া এবং পূর্ব বাংলার ও ভারত সরকারের বিদ্রোহীদের সমস্যা সমাধানে একটি স্থায়ী বন্দোবস্তর ব্যাবস্থা করা।

তবে জনাব ভুট্টো জানান যে, তিনি পূর্ব পাকিস্তানের চূড়ান্ত ক্ষতি স্বীকার করেন নি এবং তিনি বলেন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতারা অল্পদিনের মধ্যেই ভারতীয়দের গোলাম হয়ে কাজ করতে পারে। তিনি বলেন, আজ না হোক কাল যুদ্ধবিরতির প্রয়োজন ছিল।

এই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া ছিল নিছক পাগলামি এবং পাকিস্তানের সমস্যা এতে সমাধান হত না।
আরেকটি রীপোর্টে জানা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ বিরতিকে স্বাগত জানিয়েছে। এবং পাশাপাশি পশ্চিমে ভারতের যুদ্ধবিরতিকেও স্বাগত জানিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দফতরের এক মুখপাত্র বলেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধবিরতির ঘটনায় প্রভাবক ছিল না।

ফাইনানশিয়াল টাইমস পত্রিকায় রবার্ট গ্রাহাম একটি বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন। তিনি নয়া দিল্লীতে অবস্থান করছেন। তিনি পূর্ব অঞ্চলে তাদের বিজয়ের ভবিষ্যৎ ও তাদের স্বীকৃতি দেয়া রাষ্ট্র বাংলাদেশের সাথে ভবিষ্যৎ সমপর্ক নিয়ে লিখেছেন। ভারত বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাবে না কিন্তু কিন্তু ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক বিষয়ের উপর তাদের ঘনিষ্ঠতা নির্ভর করবে। রবার্ট গ্রাহাম বলেছেন, নয়াদিল্লি যতটা সম্ভব আর্থিক ও অর্থনৈতিক সমর্থন দেবে।

দ্য গার্ডিয়ান একটি ছোট প্রশ্ন করেছে। বাংলাদেশের নাগরিক যারা হবে তাদের কি নামে ডাকা হবে? লন্ডনে চারজন বাংলার অধ্যাপক জানিয়েছেন “বাংলাদেশিয়া” বলা যেতে পারে। কিন্তু লন্ডনেঢ় বাংলাদেশ মিশন সেটিকে “বাংলাদেশী” হিসেবে সংশোধিত করে।

শিরোনাম সুত্রঃ তারিখঃ
১৮৯-a। বাংলাদেশ সম্পর্কে বিবিসি প্রচারিত অনুষ্ঠানমালাঃ সাম্প্রতিক ঘটনাবলী
বিবিসি, লন্ডন
২৬ মার্চ- ১ ডিসেম্বর, ১৯৭১

Raisa Sabila
<১৪, ১৮৯-a, ৫২৭- ৫৩৪>

সাম্প্রতিক বিষয়ে আলোচনাঃ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এর বক্তব্য
সম্প্রচারেঃ মার্ক টালি
২৬ মার্চ, ১৯৭১

দুইদিন আগেও ঢাকায় যে আলোচনা চলছিল তা ফলপ্রসু হবে বলে ধারনা করা হচ্ছিল। কিন্তু, সেদিন সন্ধ্যার মধ্যেই হঠাত এ আলোচনা ভেস্তে যাওয়া, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার করাচি গমন এবং কঠোর মার্শাল আইন জারি হওয়া স্পষ্টতই হতাশাব্যাঞ্জক। শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন বলে খবর পাওয়া গেছে জানিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে যে ভাষন দিয়েছেন, তাতে এখন পরিস্থিতি কতটা গুরুতর তা বোঝা যাচ্ছে।

বেশ আক্রমণাত্মক ভাষায়, বক্তব্যের শুরুতেই মিঃ প্রেসিডেন্ট রাজনৈতিক নেতাদের সাথে সমঝোতায় আসার লক্ষ্যে তার গৃহীত উদ্যোগগুলোর বিবরন দেন। এরপর তিনি বলেন, অবশেষে তিনি বুঝতে পারলেন যে শেখ মুজিবর রহমান যেসকল প্রস্তাব দিচ্ছিলেন, তা কেবল বিশৃঙ্খলারই সৃষ্টি করবে। তিনি বলেন, শেখ মুজিব অসহোযোগ আন্দোলনের ঘোষণা ও তার পরিচালনার মাধ্যমে দেশদ্রোহিতা করেছেন, তিনি পাকিস্তানের পতাকা ও জাতির জনকের প্রতিকৃতিকে অসম্মান করেছেন, তিনি দেশে ত্রাশ, অরাজকতা ও অনিরাপদ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন। একি সাথে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে বসবাস স্থাপনকারী পশ্চিম পাকিস্তানি নাগরিকদেরকেও বিপন্ন অবস্থায় ফেলেছেন। এধরনের অপমানকে ক্ষমাসূচক দৃষ্টিতে দেখার জন্য প্রেসিডেন্ট তার ভাষণে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের অভিবাদন জানান।
প্রেসিডেন্ট আরো বলেন যে তিনি শেখের বিরুদ্ধে আরো আগেই ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারতেন, কিন্তু তিনি চাননি যে সংলাপে কোন ধরনের বিভ্রান্তি থাকুক। তিনি বলেন যে, আওয়ামী লীগ দলটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তিনি আরো জানান যে, শীঘ্রই তিনি আরো কিছু সামরিক আইন ব্যবস্থার ঘোষণা দিবেন।

ভবিষ্যতের কথা বলতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট বলেন, তিনি এখনও জনগনের মনোনীত প্রার্থীর হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যত দ্রুত সম্ভব, তিনি এর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার ঘোষণা দিবেন। সুতরাং, এ মুহূর্তে, পূর্ব পাকিস্তানের সর্বাধিক সমর্থিত দল, একটি বাদে যারা পূর্ব পাকিস্তানের সকল আসনে জয়লাভ করে জাতীয় পরিষদে বিজয়ী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল, তাদের নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট তার বক্তব্যে স্পষ্টভাবেই এই সংকটময় পরিস্থিতির জন্য মুজিব ও তার সমর্থকদের দোষারোপ করেছেন।

কেউ জানে না, পূর্ব পাকিস্তানে ঠিক কত সংখ্যক সৈন্য দল অবস্থান করছে, তবে তাদের সংখ্যা যতই হোক না কেন, যে কঠিন পরিস্থিতির মোকাবেলা সেখানে তাদের করতে হবে তাকে খাটো করে দেখার কোন সুযোগ নেই; বিশেষ করে শহরের বাইরের এলাকাগুলোতে যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবি সঙ্গীন। কিছুদিন আগের হাইজ্যাকিং এর ঘটনার পর, ভারত দেশটির দুই প্রদেশে যাতায়াতের জন্য তাদের আকাশ সীমা ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দেয়াতে সেনাদের সমস্যা আরো বেড়ে গিয়েছে। খুব সম্ভবত সৈন্যরা মুলত শহরগুলোতেই কার্যক্রম চালাবে। তবে যতই কঠোর ভাষায় ভাশন দিন না কেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পশ্চিম পাকিস্তানেও সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন, কেননা এ অঞ্চলও এখনও পর্যন্ত সামরিক আইনের আওতাধীন। মিঃ ভুট্টোর পিপলস পার্টি, পাঞ্জাবের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রদেশে যারা অত্যন্ত প্রভাবশালী, ইতিমধ্যেই অসহিষ্ণুতার জানান দিয়েছে এবং তাদেরো সকল রাজনৈতিক কর্মকান্ডের উপর সাধারন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। শুরু থেকেই মিঃ ভুট্টো বিনাশর্তে শেখ মুজিবের দাবী মেনে নেয়ার বিরোধিতা করে এসেছেন। পশ্চিম অংশে তার দল সর্বাধিক আসনে বিজয়ী হওয়ায় যেখানে তিনি তার দলকে ক্ষমতা হস্তান্তর করার দাবী জানিয়ে আসছেন সেখানে তিনি কোনভাবেই সামরিক আইনের শাসন আরো দীর্ঘায়িত হওয়াকে সুনজরে দেখবেন না।

প্রেসিডেন্ট এর এই ভাষণের মাধ্যমে সুস্পষটভাবেই আপাতত পাকিস্তানে পরীক্ষামুলকভাবে গনতন্ত্র চালু করার প্রক্রিয়া রহিত করা হল। তিনি অঙ্গীকার করেন যে তিনি এখনও ক্ষমতা হস্তান্তর করতে ইচ্ছুক, কিন্তু এ মুহূর্তে এ বিষয়ে পরবর্তী কোন ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এ মুহূর্তে সামরিক আইন আরো কিছুদিন বহাল রাখা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। যদিও এই সামরিক আইন কতখানি সফল হবে তাও অনিশ্চিত।

সাম্প্রতিক বিষয়ে আলোচনাঃ পাকিস্তানের ভবিশ্যতঃ
২রা এপ্রিল, ১৯৭১
সম্প্রচারেঃ মারটিন এডিনি

ধারাবাহিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানে চলমান সহিংসতার খবর আসছে। মাত্র এক সপ্তাহেরও কম সময় পূর্বে লন্ডন ভিত্তিক ‘গারডিয়ান” পত্রিকার পক্ষ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় অবস্থান করছিলেন মারটিন এডিনি। তার মন্তব্য এখানে উল্লেখ করা হলঃ

এক সপ্তাহ আগে আমি এবং আমার অন্যান্য সহকর্মী সাংবাদিকবৃন্দ দেখেছি কিভাবে পাকিস্তানি আর্মি পূর্ব বাংলার শহরগুলো এবং শেখ মুজিবের দল আওয়ামীলীগের সমর্থকদের উপর ভয়াবহ সেনা হামলা চালিয়েছে। জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে বিজয়ী দল আওয়ামীলীগ এক অপ্রত্যাশিত কঠোর প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়েছে। সরকার পরিচালিত ও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত পাকিস্তান রেডিও নাগরিকদের উদ্দ্যেশ্যে একটি সর্তকবানী প্রচার করেছে যে, তারা যেন ব্যারিকেড দিয়ে এই দুর্বৃত্ত বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর অভিযানে কোন ধরনের বাধা সৃষ্টি না করে। এর মধ্যে যেসকল পশ্চিমা সাংবাদিকগন ভারত সীমান্ত থেকে ২৫ মাইল দূরে অবস্থিত যশোরে যেতে পেরেছেন, তারা বলছেন সেখানে আর্মিদের ক্যান্টনমেন্ট থেকে উৎখাত করা হয়েছে, শহর সম্পূর্ণভাবে সাধারন মানুষের দখলে। যদিও সেনাদের পরাজিত হবার কোন খবর এপর্যন্ত শোনা যায়নি।

আমি এবং অন্যান্য সাংবাদিকরা যা দেখেছি, তাতে মনে হয়েছে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, শেখ মুজিব ও মিঃ ভুট্টোর মধ্যে চলমান সাংবিধানিক সংলাপ ভেঙ্গে যাওয়ার মাত্র ছয় ঘন্টা পর চালানো এই সামরিক অভিযানের মুল লক্ষ্য অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় ও পরিকল্পিত ভাবে স্থির করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শেলিং এর ফলে সুশীল নাগরিকদের মধ্যে প্রবল ভিতীর সঞ্চার, বস্তি এলাকাগুলোতে অগ্নিসংযোগ, রাস্তায় এলোপাথারি মেশিনগানের গুলিবর্ষণ, সেই সাথে এ প্রদেশের মুল রাজনৈতিক নেতা ও আদর্শের গ্রেফতারের ঘটনায় রাজধানী ঢাকায় যেন কবরের নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। গ্রামে ও শহরাঞ্চলে, সেনাঘাটিগুলোর নাগালের বাইরে মানুষ ধীরে ধীরে জোটবদ্ধ হচ্ছে বলে মনে হলেও, এই বিশাল সংখ্যক পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের তুলনায় তাদের শক্তি খুবি দুর্বল। আধুনিক সশস্ত্র এই সেনাবাহিনীকে তারা কতক্ষন তাদের এই সামান্য কিছু মাধান্তা আমলের অস্ত্র দিয়ে ঠেকাতে পারবে, সেটাও আরেকটি ভাবনার বিষয়। তবে আর কয়েক সপ্তাহ পরেই বরষা শুরু হয়ে যাবে, ফলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষে কিছু সুনির্দিষ্ট ঘাটি ছাড়া অন্যত্র নিয়ন্ত্রন বজায় রাখা অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে পড়বে।

শেখ মুজিবের ডাকা চার সপ্তাহের অসহোযোগ আন্দোলনের ফলে সেনাবাহিনী যে হেনস্থার স্বীকার হয়েছিল, নিঃসন্দেহে এই সহিংসতার মধ্যে দিয়ে তারা সেই হয়রানির শোধ তুলে নিয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান, এবং পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসনের প্রধান লেফটেন্যান্ট টিক্কা খান যদি এই প্রদেশের লোকদের শিক্ষা দেয়ার জন্য, তাদেরকে পুনরায় কেন্দ্রিয় সরকারের প্রতি অনুগত করে তোলার উদ্দেশ্যে এ হামলা চালিয়ে থাকেন, তবে সেটিকে কার্যকর করতে তাদের আরো নতুন নতুন এবং বন্ধুত্বপূর্ণ কৌশল অবলম্বন করতে হবে। এ প্রদেশে এখনও স্বাধীন বলে ঘোষিত হয়নি এবং সরকারকে অবশ্যই দেখাতে হবে যে তারা এটিকে একটি ভাল সম্ভাবনার সুচনা হিসেবে দেখছেন।

এই সবকিছুর মধ্যে, সবচেয়ে বেশি দুরবস্থার মধ্যে পরেছে অবাঙ্গালিরা, বিশেষ করে দেশভাগের পর ভারত ও বিহার থেকে এদেশে আসা দরিদ্র শরণার্থীগন। পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক না থাকলেও, অবাঙ্গালি হিসেবে চিনহিত হওয়ায় অসুরক্ষিত এই গোশঠির লোকরাই বেশিরভাগ পূর্বাঞ্চলের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।

পাকিস্তানের এই সামরিক অভিযানের বন্ধ করতে বিশ্বের সকল রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছে ভারত। অন্যদিকে পাকিস্তানও ভারতের বিরুদ্ধে সীমান্তের এপারে সশস্ত্র ভারতীয় সেনাদের অনুপ্রবেশ ও তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর অভিযোগ এনেছে। যদিও ভারত এসকল অভিযোগই অস্বীকার করছে।

১৯৬৫ এর যুদ্ধের পর থেকে দুই দেশের মধ্যেকার শত্রুতা মৌখিকভাবেই সীমাবদ্ধ থাকলেও, এখন তা চুরান্ত অবস্থায় পোউছেছে। দুই দেশের বাঙ্গালীদের জাতিগত সম্প্রীতি এই বৈরিতাকে আরো বৃদ্ধি করছে। শেখ মুজিবকে রাজনৈতিক ও বাস্তবিকভাবে ধ্বংস করে দেয়ার এ চক্রান্ত ভারতে তিক্ত হতাশার সৃষ্টি করেছে। ভারতের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য গৃহীত তার নীতিমালা এবং কাস্মীর বিষয়ে তার তুলনামুলক নির্লিপ্ত অবস্থান দুই দেশের মধ্যকার পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক করে তুলবে বলে আসা করেছিল ভারত। এখনও পর্যন্ত সত্যিকারের সসস্ত্র সংঘর্ষের কোন সম্ভাবনা না দেখা গেলেও, কোন পাকিস্তানি সেনাদলকে সীমান্ত পার করতে দেখা মাত্র গুলি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে। পূর্ব বাঙ্গালিরা একা অসহায় অবস্থাতেই রয়ে গেছে।

সাম্প্রতিক বিষয়ে আলোচনাঃ ভারত ও পাকিস্তানঃ
Distribution “A” DIPLOMATIC ESCALATION
তারিখঃ ২৬শে এপ্রিল, ১৯৭১
হিলারি হেন্সন

পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কের ক্রমাগত অবনতি আজ থেকে আরো চরম তিক্ত অবস্থা ধারন করতে যাচ্ছে। কারন, আজ ভারত আকস্মিকভাবে এক সিদ্ধান্তে জানিয়েছে যে, পাকিস্তানি কোন কুটনৈতিক ভারত সরকারের অনুমতি ছাড়া দেশ ত্যাগ করতে পারবে না। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ভারত ভিয়েনা কনভেনশনে গৃহীত কুটনৈতিকদের সঙ্গে আচরনের বিধিমালা লঙ্ঘন করছে।
পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি আর্মিদের চালানো হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্ক আরো বেশি টানাপোড়েনের মধ্যে পরে গেছে। এই কুটনৈতিক পর্যায়ের লড়াইটা শুরু হয়, এক সপ্তাহ আগে থেকেই, যখন কলকাতায় অবস্থিত পাকিস্তানের ডেপুটী হাই কমিশন অফিসের কিছু পূর্ব পাকিস্তানি কর্মকর্তা, মুক্তিযোদ্ধাদের ঘোষণাকৃত, বাংগালীদের জন্য স্বাধীন ও নতুন দেশ বাংলাদেশের প্রতি তাদের সমর্থন প্রদর্শন করে। পাকিস্তানি সরকার তাদের বদলে নতুন লোক পাঠানোর চেষ্টা করলেও, কিন্তু নতুন ব্যক্তি সেখানে পৌছাতে পারেননি। পশ্চিম বঙ্গের মানুষরাও তাকে বেশ তিক্ত অভ্যর্থনা জানিয়েছে। কমিশন যারা দখল করে রেখেছে, তদেরকে সরিয়ে দিতে কোন ধরনের কোন সাহায্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে ভারত। ভারত বলছে এটা সম্পূর্ণভাবে তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।

পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে পাকিস্তান জানিয়েছে যে যেহেতু ঠিকভাবে চলছে না, সুতরাং তারা কলকাতার মিশন অফিস বন্ধ করে দিবে, একি সাথে তারা দাবী করছে যে ভারতকেও অতি দ্রুত ঢাকায় অবস্থিত দুতাবাস অফিসটি বন্ধ করে দিতে হবে। আজ সকালে দুইটি অফিসই আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ ছিল। এর ফলে কলকাতা মিশনে অবস্থানকারী সকল পূর্ব পাকিস্তানিদের নাগরিকত্ব বাতিল করেছে পাকিস্তান সরকার। ভারত দাবী করছেন যে এই ব্যক্তিরা রাজনৈতিক শরণার্থী, ফলে তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করা বৈধ নয়।

স্পষ্টতই ভারত আশংকা করছে যে তারা সব বাঙালি দুতাবাসের কর্মীদের ফেরত না পাঠালে ঢাকা মিশনে তাদের যেসব কর্মকর্তা আছেন, পাকিস্তান তাদের জিম্মি করতে পারে। দিল্লীতে পাঠানো পাকিস্তান হাই কমিশনারের বার্তা বেশ হুমকিস্বরূপ বলেই মনে হচ্ছে, যেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন কুটনৈতিকদের সাথে আচরনবিধি, দুতাবাস ও সেখানের কাগজপত্রের নিরাপত্তার বিষয়ে লক্ষ্য রাখার কথা এবং আরো বেশ কিছু বিষয়, কিন্তু তিনি বেশ কঠোরভাবে বলেছেন যে এক্ষেত্রে ভারত যেরুপ আচরন করবে, পাকিস্তানও সেভাবেই আচরন করবে। ভারত ইতিমধ্যেই ঢাকা দুতাবাসের উপ প্রধান এর পত্নী মিসেস সেন গুপ্তার সাথে গত বুধবার করাচি এয়ারপোরটে যেধরনের বর্বর আচরন করা হয় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। তার বদলে অভিযোগনামার একটি কূটনৈতিক স্মারকলিপি ভারতও পেয়েছে। নিষেধাজ্ঞার সাথে সাথে ভারতীয়রা পাকিস্তানি কুটনৈতিকদের জিম্মি করার হুমকিও দিয়ে যাচ্ছে। কারন হিসেবে তারা বলেছে যে তাদের নিষেধাজ্ঞার ফলে এর মধ্যেই ভারতীয় কুটনৈতিকদের উপর নানাধরনের নিয়ম চাপানো হয়েছে, তাদের পাকিস্তান থেকে আসতেও দেয়া হচ্ছেনা। ভারত দাবী করছে যে, কুটনৈতিকদের ফেরত পাঠানোর বদলে তারাও পাকিস্তানিদের প্রতিহিংসার নীতি অনুসরন করছে।

সাম্প্রতিক ঘটনাবলীঃ বুদাপেস্ট শান্তি সম্মেলন ও বাংলাদেশঃ
১৩ই মে,১৯৭১
প্রতিবেদকঃ ডেভিড গ্রাহাম

আজ “বিশ্ব শান্তি সংস্থা” এর আয়োজিত কনফারেন্সে প্রায় ১২৪ টী দেশের ৭০০ জন প্রতিনিধি সমবেত হয়েছেন বুদাপেস্ট এ। পূর্ব পাকিস্তানের সংবাদ এই সম্মেলঙ্কে এক অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যায় ফেলে দিয়েছে। বিশ্ব শান্তি সংস্থার সেক্রেটারি জেনারেল মিঃ রমেশ চন্দ্র, যিনি এই শান্তি সম্মেলনের অন্যতম একজন আয়োজক, একি সাথে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বস্থানীয় একজন ব্যক্তিত্বও বটে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি বিশ্বের সকল কমিউনিস্ট পার্টির কাছে সংবাদ পাঠিয়েছে এবং তাদেরকে অনুরোধ করেছে যে তারা যেন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টিকে ও পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশ এর স্বাধীনতাকে সমর্থন করে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি একি সাথে মিঃ রমেশ চন্দ্রকে দায়িত্ব দিয়েছে যেন তিনি মস্কো, বুদাপেস্ট ও অন্যান্য যেখানে সম্ভব, সেখানে বাংলাদেশের জন্য সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন।

এই ৭০০ জন প্রতিনিধি যারা এই মুহূর্তে বুদাপেস্টে সমবেত হয়েছেন, তাদের জন্য এটিই একটি সমস্যার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে, কেননা, তারা এধরনের কিছু নিশ্চয়ই আসা করেননি, যখন তারা এখানে আসার আমন্ত্রন পেয়েছিলেন।

“আন্তর্জাতিক শান্তি সংস্থা” সোভিয়েত ফরেন পলিসির ক্ষেত্রে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হাতিয়ার। যখন জানুয়ারিতে ফিনল্যান্ডের হেলসিংকিতে মিঃ রমেশ এই সম্মেলনের এজেন্ডা বলেছিলেন, তখন মনে হয়েছিল এই এজেন্ডার মুল দিকগুলো হবে, ইউরোপের নিরাপত্তা সম্মেলন, ভিয়েতনামে ও মধ্য প্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা, আফ্রিকা নব্য-কলোনি তৈরির প্রচেষ্টাকে রুখে দেয়া, অস্ত্রের দমনের প্রতিবাদ ইত্যাদি। এসকল বিষয়ে এর আগেও প্রচুর বক্তব্য দেয়া হয়েছে, অনেক বিধিমালা পাশ করা হয়েছে, এবং যদি এর দ্বারা এ সমস্যাসমুহের সমাধান সম্ভব হত, তবে অনেক আগেই তা হয়ে যেত। কিন্তু, এই নাছোরবান্দা সিকিউরিটি জেনারেল মিঃ রমেশ চন্দ্র লাতিন আমেরিকায় ইতিমধ্যে ভ্রমন করে এসেছেন, যেন তারা বুদাপেস্টে অংশগ্রহন করে, ফেব্রুয়ারিতে তিনি কিউবা ও ভেনিজুয়েলাও ভ্রমন করেন। আজ সকালে যখন ঘোষণা দেয়া হয় যে এই সম্মেলনে ১২৪টি দেশ থেকে ৭০০ জন প্রতিনিধি একত্রিত হয়েছেন, তখনি বোঝা যাচ্ছিল যে এটি হবে একটি দারুন সম্মেলন। উপস্থিত অতিথিদের মধ্যে ৭ জন প্রতিনিধি স্বনামধন্য, বাকিরাও নিজ নিজ দেশের বেশ গুরুতবসম্পন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।

বুদাপেস্টে কনফারেন্সেও দায়সারা গোছের আলোচনা হচ্ছিল। প্রেসিডেন্ট পদ্গমি, যিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন এর প্রধান, তিনি তার উদ্ভোদনী বক্তৃতায় পাকিস্তান, বা পূর্ব পাকিস্তানি শরনারথীগন, যারা এখন বন্যার মত ভারতের সীমান্তে আশ্রয় গ্রহন করছেন, তাদের নিয়ে কোন আলোচনাই করেননি। অন্যদিকে হাঙ্গেরির “প্যাট্রিওটিক পিপলস ফ্রন্ট” এর জেনারেল সেক্রেটারি অমীমাংসিত সঙ্ঘরষগুলোর প্রসঙ্গ তুললে সেক্রেটারি গেনারেল রমেশ চন্দ্র বলেন যে তার দৃঢ় বিশ্বাস যে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যাটি এধরনেরি। তিনি এবং বুদাপেস্ট এর এই মিটিঙে উপস্থিত তার সমর্থকরা সর্বচ্চো চেষ্টা করবেন যেন উপস্থিত অতিথিরা অনুধাবন করতে পারে যে ভারত ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পারটিগুলোর দাবী কতখানি যুক্তিসঙ্গত এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন হওয়া কতটা প্রয়োজন। মস্কোর এমন একটি আনুষ্ঠানিক মুহূর্তে এটি খুবি অসবস্তিকর ও অনাকাঙ্ক্ষিত উদ্যোগ হলেও, সম্মেলন শেষে এর ফল কি দাড়ায় তা অনেকের মধ্যেই কৌতুহল সৃষ্টি করছে যে রমেশ চন্দ্রকে কি আবারো সংস্থাটির সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে নির্বাচিত করা হবে নাকি না।

সাম্প্রতিক বিষয়ে আলোচনাঃ পাকিস্তানের দীর্ঘকালীন রাজনৈতিক সমস্যাসমুহ
ডিস্ট্রিবিউশন- এঃ
তাঃ ৭ জুন, ১৯৭১
সম্প্রচারেঃ মারক টালি

ভারতের রাজনীতিবিদরা পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থী ও কলেরা মহামারী সংকট কতখানি ভয়াবহ আকার ধারন করেছে তা জানাতে তাদের আন্তর্জাতিক প্রচারনা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিবিসি পূর্ব বারতায় মারক টালি যে মন্তব্য করেন তা হলঃ ৬ জুন, রবিবার, ভারতীয় প্রধান মন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বলেন যে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীগুলোর একটি অবশ্যকর্তব্য পাকিস্তানকে বোঝানো যে গনতান্ত্রিক প্রয়োজন অস্ত্রের জোরে দমন করা সম্ভব নয়। এখন, পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ বিষয় বেশ আইনানুগ ভাবেই ভারতের মাথা ব্যাথার কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতে অবস্থানরত শরণার্থীর সংখ্যা এখন প্রায় ৪০ লক্ষ এবং এ সংখ্যা রোজ আরও অজস্র শরণার্থীর আগমনে কেবল বেড়েই যাচ্ছে, যার ফলে এটি ভারতের জন্যও একটি বেশ বড় অভ্যন্তরীণ সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে। ভারতের সরকার মনে করছে যে এই শরণার্থীদের অত্যন্ত দ্রুত পূর্ব পাকিস্তানের ফিরত পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে, কেননা এখন না তাদেরকে আশ্রয় দেয়ার মত যথেষ্ট স্থান রয়েছে আর না তাদের পালনের মত পর্যাপ্ত অর্থ রয়েছে। কিন্তু, তারা এটাও অনুধাবন করতে পারেন যে, যতক্ষন পূর্ব পাকিস্তানিরা তাদের নিজ ভুমিতে জীবনের ঝুকি অনুভব করবেন, ততক্ষন তাদেরকে ফেরত পাঠানো সম্ভবপর হবে না। তাই, ভারত সরকারের মনে হচ্ছে যে, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এমন পরিস্থিতি সৃষ্টিতে পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করার উদ্যোগ যথেষ্ট পরিমানে নীতিসঙ্গত।

পাকিস্তান সরকার যে সমস্যার এখন মুখোমুখি হচ্ছে, তা হল কি করে পূর্বাংশের মানুষদের মধ্যে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা যায়। দুই সপ্তাহ আগে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে তিনি অত্যন্ত দ্রুতই জনতার কাছে তাদের ক্ষমতা ফিরিয়ে দিবেন। সময় চলে যাচ্ছে, এবং এখনও এধরনের কোন ঘোষণা ইসলামাবাদ থেকে আসেনি। এখনও পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে পকিস্তানে যা বলা হয়েছে, তা হল, জাতীয় পরিষদ তারাই গঠন করবে যারা গত ডিসেম্বরের ইলেকশনে বিজয়ী হয়ে আসন লাভ করেছেন। কেবল মাত্র যেসকল সদয়কে রাজদ্রোহের অপ্রাধে গ্রেফতার করা হয়েছে, তারা বাদে আর সকলেই এই পরিষদ গঠনে সামিল হবেন। কিন্তু, আমাদের প্রতিবেদকদের খবর দেখে মনে হচ্ছেনা যে কোন আওয়ামী সমর্থক পাকিস্তানের বা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার এধরনের সমাধানকে মেনে নিবে এবং জাতীয় পরিষদে অংশগ্রহন করবে।

যদিও, গনতান্ত্রিক সরকারের আওতাধিন অবস্থায় থেকেই সেনাবাহিনী চাইলে কিছুদিন প্রসাসন চালাতে পারে, কিন্তু সেইটিও যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধই থেকে যাবে, কেননা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ আর সহসা সেনাবাহিনীর উপর নির্ভর করবে বলে মনে হয় না।

ভারত সরকার এবং অন্যান্য ব্যক্তিরা মনে করেন, যেসকল দেশ পাকিস্তানকে সাহায্য করে, তাদেরই উচিত পাকিস্তানকে চাপ প্রদান করা যে যতক্ষন পর্যন্ত তারা এই সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধানে না পৌছাতে পারছে, ততক্ষন পর্যন্ত তারা কোন ধরনের সাহায্য পাবে না। এ প্রস্তাবের সবচাইতে বড় সমস্যাটি হল এটি এখনও ধারনা করছে যে এ সমস্যার একটি সন্তোষজনক সমাধান পাওয়া যাবে। দ্বিতীয়ত, সাহায্য রুখে দেয়ার মানে পূর্ব পাকিস্তানকে সমর্থন করা, আর ত্রিতিয়ত এই সাহায্যকারি দেশগুলো খুব ভালভাবেই জানে কিভাবে সাহায্যকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে হয়। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে পাকিস্তানের যেমন সাহায্য দরকার, একি সাথে পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি ফিরিয়ে আনাও পাকিস্তানের জন্য অবস্যকর্তব্য হয়ে পরেছে।

এটাই আপাত দ্রিষ্টিতে মনে হচ্ছে যে অন্য কোন দেশের এক্ষেত্রে আর কিছু করার কোন সুযোগ নেই, পাক্সিতান সরকারের উপর আর্থিক চাপ সৃষ্টি করা ছাড়া। জাতিসঙ্ঘও পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণ দেয়া ছাড়া আর কোন সাহায্য করতে পারছে না। সুতরাং, সমস্যা এখন এমন এক অবস্থানে পৌছেছে, যেখানে এর সমাধান ইয়াহিয়াকে একাই করতে হবে। ভারত এর পক্ষেও এই চাপ বেশিদিন নেয়া সম্ভব হবেনা, ধীরে ধীরে তারা এ বিষয়ে আরো বেশি জরিয়ে পড়বে।

সাম্প্রতিক বিষয়ে আলোচনা মিসেস গান্ধী, পাকিস্তান ও সামগ্রিক বিশ্ব
১৬ই জুন, ২৯৭১
সম্প্রচারেঃ ফ্র্যাঙ্ক বারবার

ভারতীয় সংসদের এক অধিবেশনে অত্যন্ত শোকাবহ গলায়, প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বলেন, প্রতিটা দিন যাওয়ার সাথে সাথে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধান পাওার আসা ক্ষীণ হয়ে আসছে। বিবিসি সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর প্রতিবেদক ফ্র্যাঙ্ক বারবারের মন্তব্য অনুযায়ীঃ
পাকিস্তানি আর্মিদের হামলার পর তিন মাস কেটে গেছে। যারা পূর্ব পাকিস্তানের এই সংকটের কথা জানেন, তারা সকলেই আসা করছেন, একটা কিছু ভাল সংবাদ শোনার। সকল প্রমান থাকা স্বত্বেও, পাকিস্তান সরকার প্রমান করার চেষ্টা করেই যাচ্ছে যে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার দাবী শুধুই একটা বিচ্ছিন্ন আন্দোলন, এবং পরিস্থিতি আবারো স্বাভাবিক অবস্থায় চলে আসবে। এ সপ্তাহেই সেনাবাহিনীর গভরনর জেনারেল টিক্কা খান বলেছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক এবং শান্তিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। যদিও বাইরের পৃথিবীতে, যারা এ মুহূর্তে উদ্ভুত কলেরা পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পরেছেন, এবং এবিষয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে আসছেন, তারাও মোটামুটি নিশ্চিত যে খাবার, কম্বল এবং পর্যাপ্ত ঔষধ সরবরাহ না করা হলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে এগিয়ে যাবে। ভারতীয় উপমহাদেশের ভাগ্যে কি ঘটবে তার একটি সম্ভাব্য পরযালোচনার ভার পরেছে মিসেস গান্ধির উপরে, “আমাদের হয়ত নরকের মধ্য দিয়ে দিন পার করতে হবে”, এবার যখন তিনি প্রায় ৬০ লক্ষ ও ক্রমশ ব্রিদ্ধিশীল শরণার্থী কে আশ্রয় দেয়া নিয়ে ভারতীয় সংসদে বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তখন তিনি এ বক্তব্য দেন। কিন্তু, তারপরি তিনি আবার এবিশয়ের উপরো জোর দেন যে- তারপরও তাদেরকে কেবল মাত্র অস্ত্রের মুখে নিহত হওয়ার জন্য, ভারত তাদেরকে তাড়িয়ে দিবেনা। তিনি বলেন যে এই সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধান যত দিন যাচ্ছে, তত অসম্ভব হয়ে পরছে।মিসেস গান্ধির এই পর্যালোচনা শরণার্থীদের বর্তমান অবস্থার থেকেও করুন এক পরিনতির দিকে ইঙ্গিত করে। রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা যত কমে আসবে, ততই এই গ্রিহহীন অভিবাসীদের ঢাকায় ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে আসবে, যা পৃথিবীর অন্যতম একটি দরিদ্র অঞ্চলের জন্য খুবি হতাসাব্যাঞ্জক একটি পরিনতি। একটা বেশ অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, মার্চের শেষের দিকে পাকিস্তান আর্মিদের হামলার প্রায় ১২ সপ্তাহ পরও শরণার্থীরা দলে দলে দেশ ত্যাগ করছে। এখন সকলেই সন্দিহান যে আদৌ প্রথমদিকের শরণার্থীরা আর্মিদের ভয়াবহ হামলার ভয়ে দেশ ত্যাগ করেছিল কিনা, কেননা ধারনা করা হয়েছিল যে এই গতি ধীরে ধীরে কমে আসবে। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ বলছেন যে কিছু বিচ্ছিন্ন ও অকার্যকর প্রতিরোধ ও দেখা গেছে। এমনকি বিচ্ছিন্নতাবাদী সমর্থকরাও আর্মিদের প্রতিরোধ করার বেশি কোন কার্যক্রমের কথা বলছেন না। এই ক্রমাগত শরণার্থীদের মিছিলের কারনেই মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বলেছেন, অদুর ভবিষ্যতেও শান্তি আনার ক্ষেত্রে এই শরণার্থীদের মিছিল একটি হুমকি স্বরূপ, আর তার দায় বহন করতে হবে সারা পৃথিবীকেই। যদিও এখনও পৃথিবীর নেতাদের এই দায় স্বীকার করার কোন উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। তবে, বৈদেশিক অনেক সাহায্যই করা হয়েছে। জাতিসঙ্ঘ প্রায় ৭৩ মিলিয়ন ডলার সাহায্য চাইলেও এখন পর্যন্ত প্রায় ১২.৫ মিলিয়ন সংগৃহীত হয়েছে, যার বেশিরভাগই যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য দিয়েছে। যদিও, ভারত যা চেয়েছিল, ৭৩ মিলিয়ন ডলার তার অর্ধেকেরও কম।

মিসেস ইন্দিরা গান্ধী সমাধান হিসেবে একি কথা বারবার বলে যাচ্ছেন, আর তা হল, সারা পৃথিবীর নেতাগন মিলে পাকিস্তানকে চাপ দিতে হবে, যেন তারা পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদের সাথে একটা শান্তিপূর্ণ সমঝোতায় আসে, সেইসব নেতাদের কথা এখানে বলা হচ্ছে, যাদের ইয়াহিয়া ইতিমধ্যে বিদ্রোহী বলে ঘোষণা করেছেন। এই ধরনের উপদেশ দেয়া বেশ বিপদজনকই বটে, কেননা, এমন উপদেশের মানে হল, কোন দেশ তার নিজস্ব সমস্যা কিভাবে মোকাবেলা করবে, সে বিষয়ে কথা বলা, সে দেশের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করা। তবুও, ভারতের উপর যে সমস্যা এখন চেপে বসেছে, তা অবশ্যই এই সমস্যাকে একটি আন্তর্জাতিক সমস্যায় পরিণত করেছে। এ অবস্থায়, সারা পৃথিবীর মিসেস গান্ধির এই উপদেশ মেনে নেয়াই যুক্তিগত মনে হবে, কেননা, পাকিস্তানও বুঝতে পারছে যে একটি রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া এ সমস্যার আর কোন সমাধান নেই।

সাম্প্রতিক বিশয়াবলীঃ ইয়াহিয়া খান ও মিসেস গান্ধী বিষয়কঃ
১ম ডিসেম্বর, ১৯৭১
প্রচারেঃ জন টুসা, একজন এশিয়া বিষয়ক লেখক, ইয়াহিয়া খানের জাতিসংঘের কাছে করা আপিলের আবেদন এর নেপথ্য ঘটনা নিয়ে আলোচনা করেছেন।

যদি পৃথিবীকে মনে করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন পরে যে, ভারত পূর্ব পাকিস্তানের বিষয়ে নাক গলাবেনা বলে পূর্বে যে নীতিমালা গ্রহন করেছিল, তা থেকে কতখানি সরে এসেছে, তাহলে এ সপ্তাহে তাদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মিঃ জগজীবন রামের কথাই তা আবার মনে করিয়ে দিতে যথেষ্ট, কেননা তিনি বলছেন, পাকিস্তানিদের অস্ত্রকে থামাতে প্রয়োজনে তারা পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করবেন। মিঃ রাম আরো বলেছেন যে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার দাবি পুরন করে চাইলে এই যুদ্ধকে এড়ানো সম্ভব। একি সময়ে মিসেস ইন্দিরা গান্ধীও পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় কর্তব্য সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন। নিউ দিল্লীর সংসদে এই সুলিখিত বক্তব্যে মিসেস গান্ধী আবারো তার পূর্বে উল্লেখিত রাজনৈতিক সমাধানের কথা উল্লেখ করেন, সেই সাথে আরো বলেন যে আওয়ামীলীগ নেতা শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তিও এই যুদ্ধকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে।
অন্যদিকে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার পাকিস্তান বর্ডারে জাতিসংঘের পরিদর্শকদের আহবান করা দেখে মনে হচ্ছে যে তারা ভারতের এর পূর্বে দুইদিকেই পরিদর্শক রাখার প্রস্তাবের বিরোধিতার প্রতি নত হয়ে এসেছেন। যদিও, এটাই ছিল পাকিস্তানের ভারত বিরোধী সবচাইতে জোরালো পদক্ষেপ। আসলে, পাকিস্তানও এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল যে পূর্ব পাকিস্তান বিষয়ে তাদের আবেদন খুবি নাজুক, আবার এবিষয়ে ভারতের অবস্থান বেশ শক্ত। এমন পরিস্থিতিতে, জাতিসংঘের পরিদর্শক আহবান করাই তাদের জন্য সবচাইতে কার্যকর পন্থা ছিল।

সেনাবাহিনীর দিক থেকে, পাকিস্তানি সেনারা সংখ্যায় কমে এসেছে এবং তাদের অস্ত্রের জোরও বেশ কমে গিয়েছে ভারতের দিক থেকে। সেনাদের দুই পক্ষে ভাগ হয়ে যাওয়া আরো শক্তি দুর্বল হওয়ার জন্য দায়ী। এই দুই কারণই ব্যাখ্যা করছে, কেন ইয়াহিয়া খান কাশ্মীর বা পশ্চিম অংশে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করার সুযোগ থাকা স্বত্বেও অস্ত্র বেছে নেয়ার সবচাইতে দুর্বল সিদ্ধান্তটি বেছে নিয়েছেন। আওয়ামীলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, শেখ মুজিবর রহমানকেও জেলে পাঠানো হয়েছে। জাতীয় আওয়ামী পার্টি, যেটি দেশের পশ্চিমাংশে কার্যকর ছিল, সেটিকেও সম্প্রতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর ফলে, ডিসেম্বরে যে নির্বাচন হয়েছিল, সেই নির্বাচনে একমাত্র যেই পার্টি এখনও অক্ষত আছে, তা হল, মিঃ জে, এ ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি, যারা পশ্চিম পাকিস্তানের হ্রিদপিন্ড হিসেবে গন্য হওয়া পাঞ্জাব ও সিন্ধু এর মত প্রদেশ নিয়ন্ত্রন করে। যদিও, বলা হচ্ছে যে প্রেসিডেন্ট পরিকল্পনা করছেন, যে তিনি ক্ষমতা ভুট্টোর হাতে নয়, মিঃ নুরুল আমিনের হাতে তুলে দিবেন, যার পার্টি গত ডিসেম্বরে কেবলমাত্র একটি সিট পেয়েছিল। এর থেকে বেশি অদ্ভুত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আর হতে পারেনা, আর বরতমানে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তাই নিয়ে যাচ্ছেন এক্তার পর একটা।

মনে হচ্ছে, ভারতের পন্থা হচ্ছে, এইসকল দ্বিধাকেই এক্টার পর এক্তা কাজে লাগিয়ে যাওয়া। এর সাথে আরও একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে, এই পূর্ব পাকিস্তানি শরণার্থীরা যেন একটি স্থায়ী দায় হয়ে চেপে না বসে, যেমনটি ফিলিস্তিনী শরণার্থীরা মধ্যপ্রাচ্যের জন্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু, বর্তমান পরিস্থিতি মিসেস গান্ধির সুনামকে খুন্ন করছে, এবং পরিস্থিতির উপর তার হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা ক্রমশ হ্রাস করছে। এমুহূর্তে পৃথিবীর মনোযোগ শরণার্থী বা পুরবা পাকিস্তানে কি হচ্ছে, তা থেকে আবারও ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সীমান্ত বিষয়ক বিবাদের দিকে সরে গিয়েছে। রাজনৈতিকভাবে এই শরণার্থীর সমস্যাকে একটি আন্তর্জাতিক সমাধানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রন করার বদলে মিসেস গান্ধী যুদ্ধকেই বেছে নিয়েছেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৮০-b। বাংলাদেশের ঘটনাবলীর ওপর প্রেরিত প্রতিবেদন বিবিসি, লন্ডন ৩০শে মার্চ-১৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭১

Ashik uz Zaman
<১৪, ১৮০-b, ৫৩৫-৫৪৮>

১।
প্রতিবেদন
৩০শে মার্চ, ১৯৭১
– ইভান চার্লটন

লন্ডনের একজন আইনের ছাত্র যিনি সদ্যই ঢাকা থেকে এসে পৌঁছেছেন তিনি সেখানে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব গ্রহণ করার বিবরণ দিয়েছেন।

একটি সাক্ষাৎকার নেয়ার সময় মিঃ এ. কে. এম. সামসুল আলম চৌধুরী বলেন যে তিনি পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কর্তৃত্ব নেয়ার আগেই লন্ডনে যাবার একটি বিমান টিকেট কেনেন। তিনি গতকাল সকালে ঢাকা থেকে আরো অনেক পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে একটি বিমানে উঠতে সক্ষম হন। তিনি যখন ঢাকা ছাড়েন তখন ঢাকার পরিস্থিতি কেমন ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেনঃ “ভয়াবহ”। যেখানে পাকিস্তানের সাংবিধানিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা চলছে সেখানে এধরণের অতর্কিত সামরিক আক্রমণ চালানোর পেছনে কি কারণ থাকতে পারে এ ব্যপারে তাঁর মতামত জানতে চাইলে, তিনি বলেন যে তিনি মনে করেন পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে পরামর্শ দিয়েছেন, যাদের মধ্যে মিঃ জুলফিকার আলী ভুট্টো অন্যতম, যে তিনি যেন শেখ মুজিবুর রহমান-এর পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তাবিত শর্তাবলী মেনে না নেন এবং অস্ত্রপ্রয়োগের সাহায্য নেন। এরপর সন্ধ্যার দিকে ঢাকার জনগণ জানতে পারে যে প্রেসিডেন্ট এবং পশ্চিমের অন্যান্য নেতারা ঢাকা ছেড়ে চলে গেছেন। শহরজুড়ে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে সেনাবাহিনী আক্রমণ করতে যাচ্ছে এবং জনগণ স্বতঃস্ফুর্তভাবে রাস্তায় রাস্তায় অবরোধ তৈরী করতে শুরু করে। তিনি বলেন প্রতিরক্ষা বাহিনীতে পূর্ব পাকিস্তানের যে অংশটি ছিল সেখানে পরিকল্পিত কোন বিদ্রোহ দেখা দেয়নি। রাস্তার অবরোধগুলো সেনাবাহিনী ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়; এরপর চলতে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে ধ্বংসযজ্ঞ এবং হত্যালীলা।

মিঃ আলম নিশ্চিত যে শেখ মুজিব জীবিত এবং মুক্ত আছেন। তাঁর এই বিশ্বাসের ভিত্তি হচ্ছে শেখ মুজিবের কাছের লোকদের সূত্র ধরে। তিনি আওয়ামী লীগের একজন কর্মকর্তা কিনা জানতে চাইলে, মিঃ আলম বলেন যে তিনি লন্ডনে শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত প্রতিনিধি। সেনাবাহিনী কর্তৃত্ব গ্রহণ করার আগে শেখ মুজিব তাকে বলেছিলেন যে যদি পরিস্থিতি খারাপ হয় তাহলে তিনি যেন পূর্ব পাকিস্তান থেকে বের হয়ে যাবার চেষ্টা করেন এবং বিশ্বের কাছে আবেদন জানান – বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের জনগণের কাছে যাতে তারা বাঙালীদের রক্ষা করতে সাহায্য করে।

পূর্ব পাকিস্তানে এরপর কি ঘটবে সে ব্যপারে মিঃ আলম স্মরণ করেন ৭ই মার্চে এক বিশাল গনসমাবেশে দেয়া শেখ মুজিবের ভাষণের কথা যেখানে তিনি প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার জন্য জনগণকে পরামর্শ দেন। মিঃ আলম নিশ্চিত যে শহরগুলোতে সেনাবাহিনী সাময়িকভাবে প্রতিরোধ চূর্ণ করতে পারলেও, পরিণামে জনগণ পশ্চিমা সেনাবাহিনীর উপর বিজয়ী হবেই।

২।
লন্ডন থেকে প্রতিবেদন
জিম বিডালফ কর্তৃক
৭ই এপ্রিল, ১৯৭১

আমাদের কমনওয়েলথ প্রতিনিধি জিম বিডালফ, আজ দেশে ফিরে এসেছেন, পাকিস্তানে একমাস অতিবাহিত করার পর।

গত দশদিন ধরে আমি পশ্চিম পাকিস্তানে ছিলাম – সেনাবাহিনী কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত হয়ে এবং বাকি জনগোষ্ঠীর সাথে সরকারী বিবৃতি ও অস্বীকৃতির ধুম্রজাল ভেদ করে আসলেই ঠিক কি ঘটছে তা বোঝার চেষ্টায়।

পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ, যারা শুধুমাত্র তাদের সরকারের কথাই শোনে, তাদের কোন ধারণাই নেই পূর্ব পাকিস্তানে আদৌ কিছু ঘটেছে কিনা, কারো নিহত হবার কথা জানা তো দুরের কথা। কিন্তু এখন রাষ্ট্রীয় গোলযোগের ব্যাপ্তি সরকারী অস্বীকৃতি ভেদ করে ধীরে ধীরে পরিস্কার হচ্ছে। গত সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী, ঢাকা, এবং দেশটির দক্ষিনে অবস্থিত বন্দরনগরী চট্টগ্রামে, পরিচালিত হত্যা ও ধ্বংসের অসংখ্য প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া গেছে। গতকাল পাকিস্তান বেতার থেকে প্রচার করা হয়েছে যে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদেরকে উত্তরপূর্ব এবং উত্তরপশ্চিমের শহরগুলো থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। এবং এই প্রথম বারের মতো, পাকিস্তান বিমানবাহিনী এই অভিযানগুলোতে অংশ নিয়েছে বলে জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয় বেসামরিক জানমালের কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

সীমান্তের ওপারে ভারতে, সংবাদ সংস্থাগুলি দাবী করে যে পূর্ব পাকিস্তানের চারটি শহরে বোমা হামলা করা হয়েছে, এবং তাদের বক্তব্য অনুযায়ী বেশ কয়েকটি বিজয় এসেছে তারা যাদেরকে বলছে “মুক্তি বাহিনী”-এর দ্বারা।

এই দাবীগুলো, ভারত থেকে আসা, পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারী কার্যালয়গুলোতে ক্রোধ এবং উপহাসের সাথে গৃহীত হবে যেখানে মানুষ রাগান্বিতভাবে বলে থাকে যে ভারতীয় প্রতিবেদনগুলো ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে চলমান কথার যুদ্ধের একটি অংশ হিসেবে তৈরী মনগড়া প্রতিবেদন মাত্র।

নিরীক্ষণ থাকুক বা না থাকুক, পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ অবশ্যই জানতে পেড়েছে, গুজব বা বিদেশী প্রচার থেকে, কি ঘটছে তার একটি ভালো অংশ এবং ব্যক্তিগত কথোপকথনে আমি গভীর দুঃখ দেখতে পেয়েছি আবার একই সময়ে, দৃঢ়প্রতিজ্ঞা যে পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা হয়ে যাবার সুযোগ দেয়া হবে না।

স্বল্প মেয়াদে, সেনাবাহিনী অবশ্যই অনেক শহরে ঘাঁটি গড়ে তুলতে পারে, কিন্তু সারাদেশ জুড়ে শহরের পর শহর থেকে গণ্ডগোলের খবর যখন আসতে থাকে, পাকিস্তানের দাবী এ ঘটনাগুলো কিছু দুষ্কৃতিকারী এবং সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীরা ঘটাচ্ছে তা যে ক্রমশ ক্ষীণ হতে থাকে, এবং একটি দীর্ঘ মেয়াদী, তিক্ত সংগ্রামের, সম্ভাবনা তখন খুবই বাস্তব মনে হয়।
বুশ হাউস সংবাদ নকলনবিসি শাখা কর্তৃক তৈরী পাণ্ডুলিপি থেকে গৃহীত

৩।
ওয়াশিংটন থেকে প্রতিবেদন
চার্লস হুইলার কর্তৃক
৭ই এপ্রিল, ১৯৭১
যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্তান

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আজ বলেছে যে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানকে অনুরোধ জানিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘর্ষ বন্ধ করার জন্য সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ নিতে, এবং বাঙালী বিদ্রোহীদের সাথে একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে উপনীত হতে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানান এটি এবং পূর্ব পাকিস্তানে চলমান সংগ্রামের ব্যপারে অন্যান্য মার্কিন অভিমতগুলো ওয়াশিংটনে উপস্থিত দেশটির রাষ্ট্রদূত, আগা হিলালি কে, সোমবারে অবহিত করা হয়। পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকেও ইসলামাবাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে এব্যপারে একই ভাবে মার্কিন উদ্বেগ প্রকাশ করার নির্দেশ দেয়া হয়। এই মুখপাত্র এটা পরিস্কার করে বলেন যে যুক্তরাষ্ট্র, চলমান সহিংসতার ব্যপারে দুঃখ প্রকাশের পাশাপাশি, দুর্দশা লাঘবে আন্তর্জাতিক সাহায্যের প্রস্তাবগুলো কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সরকারী কর্মকর্তাদের ব্যর্থতায় হতাশা প্রকাশ করে। তিনি পুনরাবৃত্তি করেন যে পাকিস্তানে পরিচালিত যে কোন আন্তর্জাতিক মানবহিতৈষী কার্যক্রমে সাহায্য করতে যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুত আছে।

৪।
করাচী থেকে প্রতিবেদন
রবার্ট রবসন কর্তৃক
১০ই এপ্রিল, ১৯৭১.
নিয়ন্ত্রণ

পাকিস্তানে এক কঠোর নতুন সামরিক আইনের নিয়ন্ত্রণ সীমিত করতে পারে যেকোনো সন্দেহভাজন ব্যক্তির চলাচল, তাদের কর্মসংস্থান; যে সাজসরঞ্জাম তাদের কাছে থাকতে পারে বা তারা ব্যবহার করতে পারে, অন্যদের সাথে তাদের যোগাযোগ এবং সংবাদ প্রচারের সাথে জড়িত তাদের কার্যক্রম বা অভিমতের প্রচার। এই নতুন আইনের বিভিন্ন ধারা ভঙ্গ করলে গুরুতর দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে, যার মধ্যে জরিমানা এবং ৭ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ডও রয়েছে। করাচী থেকে জানাচ্ছেন রবার্ট রবসন।

এই নতুন আইনটি রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক বা পাকিস্তানের নিরাপত্তা, জননিরাপত্তা, বা স্বার্থ বা প্রতিরক্ষার প্রতি হুমকিস্বরূপ যেকোনো কর্মকাণ্ড প্রতিহত করার সাথে সম্পর্কিত বলে জানানো হয়েছে। এই আইনটির সেইসব কর্মকাণ্ডও প্রতিহত করার কথা যেগুলি নাগরিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা, অন্যান্য পরাশক্তির সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক বজায় রাখা, পাকিস্তানের যে কোন অঞ্চলে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সরবরাহ এবং সেবাসমুহ চালু রাখার প্রতি হুমকিস্বরূপ। সন্দেহভাজন বিদেশী নাগরিকদেরকে দেশত্যাগ করতে বলা এবং তাদের ফিরে আসার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে, অথবা তাদেরকে আটক করা বা তাদের চলাচল সীমিত করে দেয়া বা তাদের চলাচলের প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সশরীরে দেখা করতে বলা হতে পারে। এর প্রভাব অবশ্য পাকিস্তানী নাগরিকদের উপরও সমভাবে পড়ছে শুধুমাত্র তাদেরকে দেশত্যাগ করতে বলা ছাড়া।

এই নতুন আইনটি এই মুহূর্তে জারি করার নির্দিষ্ট কারণটি তাৎক্ষনিকভাবে জানা যায়নি। এটা অবশ্য সুস্পষ্ট যে সংবাদপত্র, বেতার অথবা টেলিভিশনের সাংবাদিক বা ক্যামেরাম্যান, অথবা অন্যান্য সাংবাদিক বিদেশী বা স্থানীয় যাই হোক না কেন তাদের উপর এটি প্রয়োগের বিশেষ সুযোগ রয়েছে যদিও প্রদত্ত ক্ষমতার ব্যাপ্তি এতই ব্যাপক যে সমভাবাপন্ন বা অন্যান্য ক্ষেত্রের অনেক ব্যক্তির উপরই এর প্রভাব পড়তে পারে।

৫।
কোলকাতা থেকে প্রতিবেদন
ডেভিড সেলস কর্তৃক
১৬ই এপ্রিল, ১৯৭১

পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কর্তৃক বিচ্ছিন্নতাবাদী পূর্ব পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার ব্যপারে ভারতের আচরণ অত্যন্ত সাবধানী ছিল সবসময়ই। কিন্তু ভারত সরকারের মধ্যে উদ্বেগের লক্ষন দেখা যাচ্ছে ভারত এবং পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যকার দীর্ঘ সীমান্ত জুড়ে সশস্ত্র সংঘর্ষ শুরু হওয়ার আশংকা থেকে। ডেভিড সেলস-এর প্রতিবেদনঃ

পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বাঙালী জনগোষ্ঠীর ওপর যে দমনপীড়ন চলছে তার সাথে সম্পৃক্ততা এড়াতে মিসেস গান্ধী অত্যন্ত সতর্ক আছেন। আমার অন্তত তাই ধারণা হয়েছে সীমান্তের দুই পাশের এলাকা দেখে। সামরিক পরিপ্রেক্ষিতে, পূর্ব অংশের অবরুদ্ধ অনিয়মিত যোদ্ধাদের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই করা হয়নি, যদিও তাদের অস্ত্র, গোলাবারুদ, জ্বালানী এবং খাদ্যের সঙ্কট ছিল। অনানুষ্ঠানিকভাবেও, যতটুকু বোঝা যাচ্ছে খুব সামান্যই সাহায্য করা হয়েছে, অন্তত সংগঠিতভাবে তো নয়ই। সত্যিকারের সহানুভূতি ছিল অনেকই, কিন্তু কার্যকর সহায়তা করা হয়েছে খুব সামান্যই, পশ্চিম সীমান্ত ধরে অবশ্যই। এটা সত্যি যে সব শরণার্থীকেই গ্রহণ করে নেয়া হচ্ছে যাদের মধ্যে আহত অনিয়মিত যোদ্ধা ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এর মুলত বাঙালী প্রাক্তন সদস্যরা রয়েছে এবং তাদেরকে প্রাথমিকভাবে খাদ্য এবং আশ্রয় দেয়া হচ্ছে। আহতরা ভারতীয় হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে।

চলতি সপ্তাহ পর্যন্ত সীমান্ত পুরোপুরি খোলা ছিল, পূর্ব পাকিস্তান পার্শ্বে কিছুই ছিল না, ভারতীয় পার্শ্বে যথারীতি বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স ছাড়া অন্য আর কোনো বাহিনীর চিহ্নও ছিল না। যখন পাকিস্তান বেতার থেকে প্রচার করা হয় যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ছয়টি ডিভিশন পূর্ব পাকিস্তানের সাথে ভারতের পশ্চিম বঙ্গের সীমান্তবর্তী এলাকায় জড়ো হচ্ছে তখন সেখানে আসলে কোনোধরণের সামরিক কর্মকাণ্ড পরিলক্ষিত হয়নি তাছাড়া ২,০০,০০০ সৈন্যের উপস্থিতি কারো চোখ এড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়। সামরিক সূত্র জানিয়েছে এই খবরটি একেবারেই সত্যি নয়। তবে এটা সত্যি যে ভারতীয় নির্বাচন চলাকালে অশান্ত কোলকাতা এলাকায় যে এক ডিভিশন সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছিল তাদেরকে ওখানেই রেখে দেয়া হয়েছে।
গত কয়েকদিনে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ছোট ছোট দল পশ্চিম বঙ্গের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে এসে পৌঁছাতে শুরু করেছে, যদিও নিয়মিত সেনাবাহিনী সীমান্তের অন্তত তিন মাইল ভিতরে থাকবে পাকিস্তানের সাথে বেশ কয়েকবছর ধরে বলবত থাকা এরূপ অনুক্ত চুক্তি অনুযায়ী তারা ঠিক সীমান্তের পাশে থাকছে না। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এই চুক্তির ব্যাত্যায় ঘটলে ভারত মনে করছে তাদের সেজন্য প্রস্তুত থাকা প্রয়োজন। কিন্তু দলগুলোর ছোট আকার দেখে, মনে হচ্ছে এগুলি নিত্যনৈমিত্তিক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা ছাড়া আর কিছু নয়।

তাদের মনের গভীরে এই ভয়ও আছে যে পাকিস্তান সরকারের সাথে সাথে চীনারাও তিব্বতের দিকে মনোযোগ ভিন্নমুখী করার জন্য কিছু সামরিক কার্যক্রম শুরু করতে পারে, যা কিনা ভুটান এবং সিকিমের মাঝখানে অবস্থিত যেখানে ভারত নিজেকে বিশেষভাবে অরক্ষিত মনে করে। এখন পর্যন্ত, এবং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ভারতের কোনো ভয়ই বাস্তবে রূপ নেয়নি এবং তাদের দিক থেকে সামরিক পরিপ্রেক্ষিতে, তার সাথে রাজনৈতিকভাবেও, তারা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে কাজ করছে বলেই মনে হচ্ছে।

৬।
জেনেভা থেকে প্রতিবেদন
অ্যালান ম্যাকগ্রেগর কর্তৃক
৭ই এপ্রিল, ১৯৭১
পূর্ব পাকিস্তান

মিঃ স্ট্যানলি মিটন, ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অব চার্চেস এর ইমারজেন্সি রিলিফ অফিসার, জেনেভায় ফিরে এসেছেন তার পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকা, কোলকাতার উত্তর পূর্ব এলাকা, এবং সেখান থেকে করাচী এবং লাহোর হয়ে সপ্তাহব্যাপী পরিদর্শন শেষ করে। তিনি কাউন্সিলের কাছে প্রতিবেদন পেশ করেছেন যে বর্তমান পরিস্থিতিতে যেসব এলাকায় যুদ্ধ চলছে সেখানে চিকিৎসা বা খাদ্য সরবরাহ করার জন্য কিছুই করার উপায় নেই। জেনেভা থেকে, আলান ম্যাকগ্রেগর এই প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন।

আন্তর্জাতিক রেড ক্রসের মতোই, ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অব চার্চেসও তৈরী আছে পূর্ব পাকিস্তানে জরুরী ত্রাণ পাঠানোর জন্য, কিন্তু তারা সেটা করতে পারছেনা কেননা পাকিস্তানী সরকার বলছে যে বাইরে থেকে কোনো ধরণের হস্তক্ষেপ তারা চায় না, এমনকি চিকিৎসা সেবাদানকারী দলের আকারেও নয়। এটি বস্তুত মিঃ মিটন কাউন্সিলের সদরদপ্তরে যে প্রতিবেদন পেশ করেছেন তারই কথা। বনগাঁয়ে, কোলকাতা থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে পঁয়তাল্লিশ মাইল দূরে সীমান্তের ভারতীয় পার্শ্বে, তিনি মুসলিম এবং হিন্দু উভয় ধর্মের শরণার্থীদের সাথেই কথা বলেছেন এক হিন্দু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের তৈরী আশ্রয় শিবিরে, যেটিকে তিনি বর্ণনা করেন খাদ্যসঙ্কটবিহীন একটি সুসংগঠিত শিবির হিসেবে। শরণার্থীরা তাঁকে বলে তাদের গ্রামে বোমা হামলার কথা। তাদের কেউ কেউ পেড়িয়ে যায় সীমান্ত, কদাচিৎ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর টহলদল ছাড়া যা আপাত অরক্ষিত, তাদের ফসলের ক্ষেতের যত্ন নিতে এবং এরপর আবার ভারতীয় পার্শ্বের শিবিরে ফিরে আসে।

মিঃ মিটন বলেন যে ব্যক্তিগতভাবে কিছু ভারতীয় নাগরিক কিছু পরিমাণ ত্রাণ, ওষুধপত্রসহ পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে গেছে। তিনি দুটি ইউরোপীয় মিশনারি পরিবারের সাথে কথা বলেছেন যারা পায়ে হেঁটে ভারতে এসে পৌঁছেছেন ঠেলাগাড়িতে করে তাদের যাবতীয় অস্থাবর সম্পত্তি নিয়ে। তারা বলেছেন স্থানীয়ভাবে খাদ্যসঙ্কট রয়েছে, তবে যেহেতু বেশীরভাগ চাষী সেপ্টেম্বর মাসে ফসল তোলার জন্য তাদের বীজ বোনার কাজ শেষ করতে পেরেছে, একটি দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি হয়তো এড়ানো যাবে।

৭।
কলম্বো থেকে প্রতিবেদন
২২শে এপ্রিল, ১৯৭১
রনাল্ড রবসন কর্তৃক
পাকিস্তানের অর্থনীতি

পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির কারণে পাকিস্তানের অর্থনীতি কিভাবে প্রভাবিত হচ্ছে তা নিয়ে লিখেছেন রনাল্ড রবসন।

গৃহযুদ্ধ শুরু হবার আগে পাকিস্তানের অর্থনীতি রুগ্ন ছিল। এই রোগশয্যা অতি দ্রুতই মৃত্যুশয্যায় পরিণত হতে পারে। পূর্ব অংশটি সবসময়ই পশ্চিম অংশের চেয়ে বেশী বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করে আসছে পাকিস্তানের জন্য। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকে উৎখাত করার জন্য যে আন্দোলন হয় তাতে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বাধাগ্রস্থ হয়েছিল। ঐ সময়ে শুরু হওয়া গোলযোগ আসলে আর কখনই থামেনি। তবে চলমান সঙ্কট পূর্ব অংশের অর্থনীতিকে কার্যত অচল করে দিয়েছে। ইতোমধ্যে শুধুমাত্র পাট এবং পাটজাত পণ্য উৎপাদনে যা ক্ষতি হয়েছে তা একাই অনেক গুরুতর। পহেলা মার্চের পর থেকে চা রপ্তানিও বন্ধ রয়েছে। দেশটির পশ্চিম অংশ যা কিনা পূর্ব অংশের চায়ের ওপর নির্ভরশীল তাদেরকে দেশের বাইরে থেকে চা আমদানি করতে হয়েছে। নিউজপ্রিন্ট কাগজ আসতো দেশটির পূর্ব অংশ থেকে। সেটিও এখন বিদেশী উৎস থেকে আমদানি করতে হচ্ছে এবং তিনগুন দাম দিয়ে। এরকম পরিস্থিতি হয়তো ধনী কোনো দেশ সাময়িক বিব্রতকর পরিস্থিতি হিসেবে কাটিয়ে দিতে পারতো, কিন্তু পাকিস্তান বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র একটি দেশ, যা বৈদেশিক সাহায্যের উপর গভীরভাবে নির্ভরশীল।

এ মাসের শুরুতে পাকিস্তান একটি মার্কিন ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বৃদ্ধি করার জন্য আবেদন করেছে, এবং পশ্চিম অংশে খোলাখুলিভাবে প্রচারিত তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তান অন্যান্য দেশ এবং বিশ্বব্যাংকের কাছেও তাদের ঋণের মেয়াদ বৃদ্ধি করার জন্য আবেদন করবে বলে বোঝা যাচ্ছে।

গত ফেব্রুয়ারী মাসের পর থেকে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ের পরিমাণ প্রকাশ করা হচ্ছে না যেখানে এটি ইতিমধ্যেই পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে যে এই সঞ্চয়ের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় ব্যাংক বিধিবদ্ধ আইনগত বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী তার প্রচলিত নোটের নির্দিষ্ট পরিমাণ অংশকে সোনা এবং বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ের বিপরীতে নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ নাগাদ মাত্র তেরো শতাংশের কিছু বেশী পরিমাণ প্রচলিত মুদ্রার নোট এভাবে নিশ্চিত করা ছিল। এবং আমাকে বলা হয় যে পাকিস্তান কতিপয় আরব রাষ্ট্রের কাছ থেকে অর্থনৈতিক সাহায্য পাবার আশা করছে।

পূর্ব পাকিস্তানের চলমান সঙ্কটের কারণে দেশটির দুই অংশের মধ্যে অর্থের প্রবাহ বন্ধ আছে অনেকদিন ধরে। দেশটির পশ্চিম অংশটি, উদাহরণস্বরূপ, তুলাজাত পণ্য বিক্রি করে পূর্ব অংশে এবং তা থেকে অর্জিত অর্থ ফিরে আসার উপর পশ্চিম অংশে পণ্যের পুনঃউৎপাদন নির্ভর করে। অর্থ ফিরে আসা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে পশ্চিম অংশে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানে যে পাটের চারা রোপণ করার কথা ছিল তা করা হয়নি। চাষিরা এর পরিবর্তে ধান বুনেছে খাদ্য উৎপাদনের জন্য। পাটের বাজার পড়তির দিকে থাকলেও এটি এখনো বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস। মনে হচ্ছে ভবিষ্যৎ উৎপাদন ব্যাহত হতে বাধ্য। এই চলমান বিবাদের কারণে চা উত্তোলনকারী শ্রমিকেরা, যারা মুলত হিন্দু ধর্মাবলম্বী, চা বাগান ছেড়ে পালিয়ে গেছে। চা গাছের পর্যাপ্ত যত্ন না নেয়ার কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং এর দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। অবশ্যই যুক্তরাজ্যের কিছু স্বার্থ এখানে সংশ্লিষ্ট আছে। পাকিস্তানে যুক্তরাজ্যের বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় দশ কোটি পাউন্ড, যার বেশীরভাগই পূর্ব অংশে। পাকিস্তান যুক্তরাজ্যের বৈদেশিক সাহায্যের বড় গ্রাহক এবং যুক্তরাজ্যের সাথে পাকিস্তানের একটি সন্তোষজনক বাণিজ্য সমতা বজায় রয়েছে।

পূর্ব অংশে এই মুহূর্তে দুর্ভিক্ষের কোনো আশঙ্কা থাকার কথা নয়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে খাদ্যশস্য পাঠানো হচ্ছিল, কিন্তু সঙ্কট শুরু হবার পর অন্তত প্রথম ছয় সপ্তাহ, শস্যগুলো চট্টগ্রাম বন্দরে খোলা অবস্থায় পড়ে থেকে পচে যাচ্ছিল, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী। দেশের ভেতরে যে কোন সরবরাহ নিয়ে যাওয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়ছিল, শ্রমিক অসন্তোষ চলার সময় তারা শহর ছেড়ে পালিয়ে যেত গ্রামে, যার মানে হচ্ছে কাজের প্রচুর ক্ষতি। অনেক শ্রমিক ভারতে পালিয়ে গেছে এবং তারা হয়তো আর কখনই ফিরে আসবে না।

যে সামরিক কার্যক্রম চলছে সেটি নিজেই অনেক খরচান্ত ব্যপার। সৈন্যদেরকে উপ-মহাদেশের পাশ দিয়ে উড়িয়ে ঢাকায় নিয়ে যেতে হচ্ছে যেহেতু পাকিস্তানী বিমান ভারতের উপর দিয়ে উড়ে যেতে পারবে না। জ্বালানী তেলের জন্য অনেক টাকা খরচ হচ্ছে এবং অতিরিক্ত বিমান ভাড়া করতে হচ্ছে। মানুষের জীবনের দামের হিসেবে কত খরচ হয়েছে তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। সেনাবাহিনীর কার্যক্রম শুরু করার পর কতজন নিহত-আহত হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা অনুমান করা যাচ্ছে না। এভাবে বাধাগ্রস্ত হবার পর এটা আশা করা ঠিক নয় যে কেউ ডিক্রী জারি করলেই পূর্ব পাকিস্তানের স্বাভাবিক অর্থনীতি আবার চালু হয়ে যাবে।

পাকিস্তানকে সাহায্য প্রদানের জন্য সংঘ, যেটি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, ইটালি, জাপান, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়া কে নিয়ে গঠিত সেটি জুন মাসে বৈঠকে বসবে। বৈঠকের পর বৈঠক মুলতুবী করা হয়েছে। লক্ষন দেখে মনে হচ্ছে দাতা দেশগুলো ঠিক কি ঘটছে সে ব্যপারে আরো পরিস্কার ধারণা পাবার জন্য অপেক্ষা করছে এবং তাদের মনোভাব একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে। পাকিস্তানের মোট বাজেটের পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশী বরাদ্দ করা হয় প্রতিরক্ষা খাতে। যদি দেশটির পূর্ব অংশ যেটি বেশীরভাগ অর্থ উপার্জন করতো, শেষ পর্যন্ত আলাদা হয়ে যায় বা কার্যত অনুৎপাদনশীল থেকে যায় তাহলে পশ্চিম অংশের জন্য এককভাবে তার বর্তমান সেনাবাহিনীর ভরণপোষণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠবে।

আমি মাত্র কয়েকটি সমস্যার কথা এখানে বলেছি কিন্তু প্রমাণাদির ভিত্তিতে, যেকোনো দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা হোক না কেন পাকিস্তানের অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনিত হয়েছে।

৮।
করাচী থেকে তারবার্তা
২৬শে জুন ১৯৭১
মার্ক টালি কর্তৃক

মিঃ এম. এম. আহমেদ, প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, ১৯৭১/৭২ অর্থবছরের জন্য পাকিস্তানের বাজেট ঘোষণা করেন। করাচী থেকে মার্ক টালি কর্তৃক প্রেরিত প্রতিবেদনঃ

মিঃ আহমেদ বলেন তিনি বাজেট উপস্থাপন করছিলেন অস্বাভাবিক প্রতিকূল অবস্থায়। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় থেকে চল্লিশ কোটি রুপির এক বিশাল পতন ঘটেছে। রাজস্ব আয় বাজেটে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১১৬ কোটি ৪০ লক্ষ রুপি কম হয়েছে; এবং উন্নয়নখাতে ব্যয় নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম হয়েছে। ১৯৭০-৭১ অর্থবছরে পাকিস্তানের অর্থনীতির কার্য-সম্পাদন খারাপ হওয়ার মূল কারণ পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক জীবনে বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এবং নাগরিক বিশৃঙ্খলার কারণে ব্যঘাত সৃষ্টি হওয়া। মিঃ আহমেদ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন দেশটিকে আরো স্ব-নির্ভর হওয়া শিখতে হবে কেননা আগামী বছরে বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনাগুলো খুবই অনিশ্চিত। তিনি বলেন দেশটি ইতিমধ্যেই বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরতা কমিয়ে এনেছে এবং তিনি রপ্তানিকে উৎসাহিত করার জন্য নতুন পন্থা উপস্থাপন করেন। আভ্যন্তরীণভাবে তিনি নতুন কোন অধিক গুরুত্বপূর্ণ কর আরোপ করেননি কিন্তু কোম্পানি কর খাত থেকে প্রত্যক্ষ কর আদায় বৃদ্ধি করার প্রতি গুরুত্ব দেন, এবং উন্নতমানের সিগারেটের উপর উচ্চ-ফলনশীল কর বৃদ্ধি করেন। মিঃ আহমেদ তবুও উন্নয়ন খাতে ব্যয় কমাতে এবং বাজেট ঘাটতির ৩৬ কোটি টাকা জোগাড় করার জন্য নতুন আরোপিত কর থেকে অর্জিত রাজস্ব আয়ের উপর নির্ভর করতে বাধ্য হন যা কিনা এরূপ রাজস্ব আয়ের অর্ধেকেরও বেশী হবে। প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বিশেষ বাড়ানো হয়নি। পাকিস্তান যেসব অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে এই বাজেটটি সেসব সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য যথেষ্ট জোরালো হয়েছে কিনা তা অনেকাংশে নির্ভর করছে তিনটি অতিসূক্ষ্ম জিনিশের উপর – পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি, বৈদেশিক সাহায্যের প্রবাহ, নতুন আরোপিত কর আদায়ে সংশ্লিষ্ট রাজস্ব কর্তৃপক্ষের কর্মদক্ষতা।

৯।
২৩শে অগাস্ট, ১৯৭১
পাকিস্তানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব

দেশটির পূর্ব অংশে সাম্প্রতিককালে সঙ্ঘটিত গোলযোগের পর পাকিস্তানের প্রতি মার্কিন নীতি কি হওয়া উচিত তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বিভক্ত মতামত রয়েছে। ওয়াশিংটন থেকে জানাচ্ছেন জন ওসমান।

পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটেছে তার বর্ণনা দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গণহত্যা শব্দটিকেই ব্যবহার করা হচ্ছে, অভিযোগ হচ্ছে বিছিন্নতাবাদের শাস্তি হিসেবে সরকার তার নিজের নাগরিকদের উপরই লাগামহীন জাতিগত হত্যাকাণ্ড শুরু করেছে। ম্যাসাচুসেস্ট থেকে নির্বাচিত সিনেটর, এডওয়ার্ড কেনেডি পাকিস্তানীদেরকে গণহত্যার জন্য দায়ী করার কাজে দায়িত্বপ্রাপ্তদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালীদের অন্যতম। আরেকজন হচ্ছেন ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত, চেস্টার বৌলস। বেশীরভাগ মানুষের চেয়ে পরিস্থিতি সম্বন্ধে কেনেডি সম্ভবত বেশী ওয়াকিবহাল আছেন যদিও এটা সত্যি যে তিনি সমস্যাটি সম্বন্ধে গবেষণা করার সুযোগ পেয়েছেন শুধুমাত্র সীমান্তের ভারতীয় পার্শ্ব থেকেই। তাঁর পাকিস্তান সফর করার কথা ছিল কিন্তু তাঁর সেখানে যাওয়ার অনুমতি বাতিল করা হয় কেননা ততক্ষণে, পাকিস্তানীদের বক্তব্য অনুযায়ী, তিনি নিজেকে পাকিস্তানীদের বিপক্ষে পক্ষপাতদুষ্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন। কেনেডির প্রকাশিত বিবৃতিগুলো পড়ার পর এব্যপারে পাকিস্তানীদেরকে দোষারোপ করা বেশ কঠিন কেননা এটা বেশ পরিস্কার বোঝা গেছে যে পুরোপুরি খোলা মন নিয়ে সিনেটর সেখানে যেতেন না। যদিও এটা সত্যি, যেমনটা কেনেডি বলেছেন, যে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে পরিচালিত মামলাটি যেকোনো আন্তর্জাতিক আইনের ধারনায়ই চরম নিষ্ঠুরতা ছাড়া আর কিছুই নয় একইভাবে এটা অবশ্যই অভিমতের ব্যপার, যেটি সিনেটরের রয়েছেই, মুজিব একমাত্র অপরাধে অপরাধী যে তিনি একটি নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। পাকিস্তানের সরকারের মতে তিনি জাতির অর্ধেকেরও বেশী মানুষকে নিয়ে আলাদা হয়ে যাচ্ছিলেন, এ এমন একটি কাজ যা সম্ভবত আত্মসঙ্কল্পের অধিকন্তু রাষ্ট্রদ্রোহিতারও।

এখানকার সরকারী কর্মকর্তারা পরিস্থিতির ব্যপারে কেনেডির মূল্যায়নের উপর সন্দেহের উদ্রেক করার জন্য এইসব বিষয়গুলো নিয়ে আসছেন যদিও তারা নিজেরাই পরিস্কারভাবে বিভক্ত হয়ে আছেন ঠিক কিভাবে এই সমস্যার মোকাবেলা করলে ভালো হবে সেই ব্যপারে। অতিরিক্ত ভারত-ঘেঁষা হবার কারণে চেস্টার বউই-র ধারণাগুলিকে বাতিল করে দেয়া হয়।

তাহলে এত জনপ্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ উভয় ধরনের সমালোচনা করার পর সরকারের কাছে আর কি ধরণের নীতি অবশিষ্ট থাকলো? মূলত এটি ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা যাকে বর্ণনা করছে ত্রাণ, সংযম এবং সামঞ্জস্যবিধানের নীতি। প্রথমত হোয়াইট হাউজ এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চেষ্টা করছে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে একটা যুদ্ধ বেঁধে যাওয়া প্রতিরোধ করতে, দ্বিতীয়ত দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধে সাহায্য করতে এবং শরণার্থীদের দুর্দশা লাঘব করতে যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থা করেছে ৩,০০,০০০ টন খাদ্যশস্যের এবং এগুলোকে বহন করে নিয়ে যাবার জন্য জাহাজ ভাড়া করা হয়েছে ৩০ লক্ষ ডলার ব্যয় করে। তৃতীয়ত, আমেরিকা চায় পুরো ভারতীয় উপ-মহাদেশে রাশিয়া এবং চীনের সাথে ক্ষমতার কোন এক ধরণের ভারসাম্য বজায় রাখতে।

যে বড় প্রশ্নটি এখন এখানে তোলা হয়েছে তা হচ্ছে ভারত-সোভিয়েত মিত্রতা চুক্তি কিভাবে এই নীতিকে প্রভাবিত করবে। এখানে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত, আগা হিলালির কাছে এটি ভারতের জোট-নিরপেক্ষতা নীতির অবসান চিহ্নিত করছে। ভারতীয়দের কাছে এটি বিশেষ কারো প্রতি সরাসরি আক্রমণাত্মক হিসেবে উদ্দিষ্ট নয় যদিও লক্ষ্য করা গেছে যে ভারতের বাম পন্থী প্রচার মাধ্যম আগামী শরৎকালে মিসেস গান্ধীর এখানে আসার প্রস্তাবিত সফরের বিরুদ্ধে এক প্রচারাভিযান চালু করেছে। ভারতীয়রা মার্কিনীদেরকে পাকিস্তানের অস্ত্র সরবরাহকারি হিসেবে দেখে, মার্কিনীরা বিশ্বাস করে ভারতীয়রা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট বাড়িয়ে তোলার দোষে অপরাধী। সবমিলিয়ে ওয়াশিংটন এবং নয়া দিল্লীর মধ্যে সম্পর্ক এখন খুবই নিম্ন পর্যায়ে রয়েছে যেখানে ইসলামাবাদ এবং এখানের মধ্যে রয়েছে সহানুভূতিশীল সম্পর্ক, সরকার দুঃখভারাক্রান্ত হচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যেগুলোকে বলছে পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনাবলী, কিন্তু একই সময়ে পাকিস্তানকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলছে শেখ মুজিবের উপরে যেকোনো ধরণের প্রতিশোধপরায়ণ পদক্ষেপ নেয়া হলে তা মার্কিন সমর্থন শেষ হয়ে যাবার পথ করে দেবে। এটা সবাই জানে যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ব্যপারে মিঃ নিক্সন অতি উচ্চ ধারণা পোষণ করেন এবং মার্কিন নীতির উদ্দেশ্য মূলত পাকিস্তানের একতা বজায় রাখা তবে তা যেকোনো মুল্যে নয়।

১০।
ঢাকা থেকে প্রতিবেদন (আংশিক)
৩০শে নভেম্বর, ১৯৭১
নিজামুদ্দিন আহমেদ কর্তৃক
পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি

তীব্র যুদ্ধের খবর এসে পৌঁছাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী, ঢাকা,-তে সিলেট, দিনাজপুর এবং যশোর থেকে। ভারতীয় সৈন্যরা বারবার চেষ্টা করেছে পাকিস্তানীদের কাছ থেকে কামালপুর ফাঁড়ি দখল করতে এবং যশোর জেলা সদরের দিকে অগ্রসর হতে। কিন্তু পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদেরকে চৌগাছার ওপারে ভারতীয় প্রদেশ পশ্চিম বঙ্গের সাথে সীমান্তের কাছে থামিয়ে দিয়েছে। ভারতীয়রা রাশিয়ার তৈরী একশ ত্রিশ মিলিমিটার কামান ব্যবহার করছে, যশোর রণাঙ্গনে। ভারতীয়রা, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সূত্র অনুযায়ী, দিনাজপুর জেলার পঞ্চগড়ে রাশিয়ার তৈরী সর্বাধুনিক ট্যাঙ্কও ব্যবহার করেছে, পূর্ব পাকিস্তানের একেবারে উত্তর সীমান্তে দুদিন আগে। সেখানে এখনো যুদ্ধ চলছে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আরো সাত জন ভারতীয় সৈন্যকে আটক করেছে যাদের নিয়ে গত তিন সপ্তাহে আটককৃত নিয়মিত বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো তেরোতে, অধিকন্তু কয়েকজন ভারতীয় আধা-সামরিক বাহিনী – “বর্ডার স্পেশাল ফোর্স”-র সদস্য।

বিদ্রোহী যাদেরকে সরকারীভাবে বর্ণনা করা হচ্ছে “ভারতীয় দালাল” এবং “দুষ্কৃতিকারী” হিসেবে, তারা একটি যাত্রীবাহী ষ্টীমার আক্রমণ করেছে যেটি পাকিস্তান রিভার ষ্টীমার কোম্পানির মালিকানাধীন, সেটি ব্রিটিশ “সাহায্যপুষ্ট” একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান জেনারেল নেভিগেশন অ্যান্ড রিভার ষ্টীমার নেভিগেশন কোম্পানি লিমিটেডের, যাত্রী বহনরত অবস্থায়। একজন যাত্রী নিহত হন এবং আরো দুইজন আহত হন। ঢাকা এবং দুর্গম বরিশাল জেলার মধ্যে এটিই একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম ছিল যেহেতু অন্যান্য ব্যক্তিগত যান্ত্রিক নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একদিন চলাচল বন্ধ থাকার পর, এই ষ্টীমারটি এখন ঢাকা থেকে একদিন পর পর চলাচল করবে।

১১।
বুশ হাউজের কূটনৈতিক শাখা থেকে প্রতিবেদন
৪ঠা ডিসেম্বর, ১৯৭১
টনি পেইন্টিং কর্তৃক

পাকিস্তানের পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়াতে, যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদের এক অধিবেশন ডেকেছে।

এটি আসলেই একটি তীব্র আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডময় দিন ছিল যার চূড়ান্ত পরিণতিতে নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন ডাকা হয়। আরো গুরুত্বপূর্ণ একটি খবর আসে যে জাপানের সরকার উভয় পক্ষকেই সংযম প্রদর্শনের জন্য আহ্বান জানিয়েছে। এই আহ্বানটি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে ইতিপূর্বে পাঠানো বার্তাগুলোর সাথে প্রতিধ্বনিত হয়েছে – এবং যেটি আসলে, গোলযোগ শুরু হবার পর থেকেই যুক্তরাজ্যের তরফ থেকে ঘন ঘন করা প্রচেষ্টাগুলোকে বিশেষায়িত করেছে।

যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট টিটো এক্ষেত্রে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব খাটান যখন তিনি এই যুদ্ধের ব্যপারে তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং যুদ্ধরত পক্ষগুলোকে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করার প্রয়োজনিতার ব্যপারে আহ্বান জানান। সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী, মিঃ কসিগিন, অধিকন্তু তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। কিন্তু তিনি সোভিয়েত মধ্যস্ততার সম্ভাবনা নাকচ করে দেন যেধরনের মধ্যস্ততার কল্যাণে ১৯৬৬ সালে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে তাসখন্দ চুক্তি স্বাক্ষর হয়। তিনি এরকম মন্তব্য করেছেন বলে শোনা গেছে যে এবার সোভিয়েত ইউনিয়ন একা অগ্রসর হতে পারবে না। তাঁর এই মন্তব্য অবধারিতভাবে পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি জাতিসংঘের দিকে ফিরিয়ে দিয়েছে এবং বিশেষ করে নিরাপত্তা পরিষদের জরুরী অধিবেশনের প্রতি। না ভারত না পাকিস্তান কেউই কোন পদক্ষেপ নিতে রাজি আছে বলে মনে হয়নি। কিন্তু সব পরাশক্তির মধ্যে, যুক্তরাষ্ট্রকেই শুধু তাৎক্ষনিকভাবে উদ্বিগ্ন বলে মনে হয়েছে। পররাষ্ট্র সচিব, মিঃ রজার্স তাঁর আইসল্যান্ড সফর বাতিল করেন। পরবর্তীতে জানা যায় যে তিনি এবং সরকারের অন্যান্য বিভাগগুলো যতটুকু গভীরভাবে সম্ভব সংশ্লিষ্ট ছিল এবং, পরিশেষে দেখা গেল যে মার্কিনীরা, জাপান এবং অন্য আরো কয়েকটি দেশের সাথে একত্রে এই উদ্যোগ নিয়েছে। অবশ্যই তাদের প্রতি যুক্তরাজ্যের সমর্থন আছে, যার কূটনীতিকেরা সূক্ষ্মভাবে তাদেরকে ঠেলে দিচ্ছিলেন নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনের দিকে। মিঃ কসিগিনের মন্তব্যও এই ইশারা দেয় যে সোভিয়েত ইউনিয়নও একটি অধিবেশন চায়। প্রশ্নবোধক চিহ্ন হচ্ছে, অবশ্য, নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়া এবং চীনের মধ্যে বিরোধের আশঙ্কা। ভারতের সাথে রাশিয়ার মিত্রতা চুক্তি রয়েছে এবং চীন, কিছুদিন আগে জাতিসংঘের কাছে স্বীকার করেছে এবং নিরাপত্তা পরিষদে তাদের স্থায়ী আসনের কাছে যে, তারা পাকিস্তানকে সমর্থন জানাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

১২।
ঢাকা থেকে তারবার্তা
৮ই ডিসেম্বর, ১৯৭১
রনাল্ড রবসন কর্তৃক

পাকিস্তানের জন্য যে একটি জাতীয় সরকার গঠন করা হয়েছে তা এখনো পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে বহুল প্রচারিত নয় যে তার প্রতিক্রিয়া জানা যাবেঃ

প্রথম যে বিষয়টি স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়েছে বলে মনে হচ্ছে যে মিঃ জুলফিকার আলী ভুট্টো, সহকারী প্রধান মন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দ্বৈত দ্বায়িত্বে থাকা সেই ব্যক্তি যাকে হিসাবে ধরে চলতে হবে। যদিও তিনি প্রধান মন্ত্রী, মিঃ নুরুল আমিন এর বয়স আটাত্তর বছর, এবং যদিও তিনি দুর্বল নন, তবুও মিঃ ভুট্টোর মতো প্রাণশক্তিও তাঁর নেই।

মিঃ ভুট্টো সবসময়ই ভারতের প্রতি অনমনীয় মনোভাব পোষণ করে এসেছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের দৃষ্টিকোণ থেকে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে, তিনি সন্দেহাতীতভাবে এই খবর পেয়ে অনুপ্রানিত হয়েছেন যে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কাশ্মীরের অনেকখানি ভেতরে অগ্রসর হতে সক্ষম হয়েছে। এটাও সন্দেহাতীত যে মিঃ ভুট্টো পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত সামরিক পরিস্থিতি সম্বন্ধেও পূর্ণ ওয়াকিবহাল আছেন। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের কাছে এখন মনে হচ্ছে এরকম একটি ধারণা তৈরী করার পেছনে এখন কিছু যুক্তি আছে যা তিন মাস আগেই পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু মহলে সাম্প্রতিক বিষয় হিসেবে আলোচিত হয়েছে, এই মর্মে যে পাকিস্তানের রণকৌশল এরকম হওয়া উচিত যে এক হাজার মাইল দুরের পূর্ব অংশটিকে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করা যাবে না এটা বুঝতে পারা, এবং পাকিস্তানের লক্ষ্য থাকতে হবে এরকম যে পশ্চিমে সমপরিমাণ ভূখণ্ড দখল করে নেয়া যেটি ভারতের সাথে দর কষতে কাজে লাগবে।

এই যুক্তিটি কাজে লাগবে, যেমনটা উনিশশ পঁয়ষট্টি সালে হয়েছিল, যদি বহির্বিশ্বের চাপে সংঘর্ষের সমাপ্তি নিশ্চিত হয়। এখন পর্যন্ত জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধ বিরতি নিশ্চিত করার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।

ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের দুর্দশা চলছে। সবেমাত্র পরিস্কারভাবে জানা গেছে যে শনিবার ভোরে অতি উচ্চতা থেকে পরিচালিত ভারতীয় বোমারু বিমানের হামলার সময়, চারটি বোমার একটি গুচ্ছ ঢাকার আদমজী-নগর এলাকার একটি পাটকলের শ্রমিকদের বস্তির উপর পড়ে। একটি বোমা বিস্ফোরিত হতে ব্যর্থ হয়। বাকি তিনটি বোমা ছয়শ বর্গগজ জুড়ে পলকা বসতবাড়ির মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে। অনুমান করা হচ্ছে যে পাঁচশ মানুষ নিহত হয়েছে, এবং আরো আড়াইশত মানুষ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে যেগুলো শ্রমিকেরা খালি হাতেই সরানোর চেষ্টা করছে।

১৩।
দিল্লী থেকে প্রতিবেদন
১১ই ডিসেম্বর, ১৯৭১
জন ওসমান কর্তৃক (১)

কোলকাতা থেকে ভারতীয় সংবাদ সংস্থা পি. টি. আই. এবং অল-ইন্ডিয়া রেডিও প্রচার করেছে যে কানাডার রাজকীয় বিমান বাহিনীর একটি এবং যুক্তরাজ্যের রাজকীয় বিমান বাহিনীর আরেকটি হারকিউলিস বিমানকে ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণের অনুমতি দেয়নি সেখানকার পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ এবং বিমানদুটি কোলকাতায় ফিরে আসে। এই বিমানদুটি চারটি বিমানের অংশ, একটি কানাডীয় এবং তিনটি যুক্তরাজ্যের, যেগুলিকে ভারতীয় বিমান বাহিনী নিরাপদে কাজ করার নিশ্চয়তা দিয়েছে ২৪ ঘণ্টাব্যাপী অপসারণ কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য ভারতীয় স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬ টা, দুপুর ১২ টা ৩০ মিনিট লন্ডন স্থানীয় সময় পর্যন্ত। পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষকে গতকালই এই কার্যক্রম চালানোর অনুমতি দেবার কথা বলা হয়েছিল কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে বলে মনে হচ্ছে। নয়া দিল্লী থেকে জানাচ্ছেন জন ওসমান।

প্রায় ৫০০ জন বিদেশী নাগরিককে ঢাকা থেকে অপসারণের পরিকল্পিত কার্যক্রম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে, কানাডীয় বিমানটি, যেটির শরীরে জাতি সঙ্ঘের চিহ্ন আঁকা ছিল, প্রথমে কোলকাতার উদ্দেশ্যে ফিরিয়ে দেয়া হয় বলে জানা যায়, তারপর যুক্তরাজ্যের বিমান বাহিনীর বিমানগুলোও একই পথে ফিরে আসে। ঢাকার কর্তৃপক্ষ, আমি এখানকার বিশ্বস্তসূত্রে জানতে পেরেছি, বিমানগুলোকে সেখানে অবতরণ করার অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানায়, এবং কারণ হিসেবে বলা হয় যে পাকিস্তানীরা একারণে আপত্তি জানায় যে বিমানগুলি এসেছে ভারত – শত্রু এলাকা থেকে। এদিকে ভারতীয়রা এখন পর্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলে আসছে যে ঢাকাগামী বিমানগুলো যেন কোলকাতা হয়ে যায় যাতে করে তাদের যাত্রাপথের বিশদ বিবরণ জানা থাকায় সম্ভাব্য বিপর্যয় এড়ানো যায়, এবং এর সাথে সাথে এটাও নিশ্চিত করা যায় যে এই বিমানগুলো মানবিক প্রয়োজন ছাড়া আর অন্য কোন কাজে ব্যবহার করা না হয়।

ভারতীয়দের আরোপিত শর্তাবলী এখন পরিবর্তিত হবে কি হবে না তা অনুমান করা দুস্কর, এবং পাকিস্তানীরা ঠিক কি চাইছে সেটাও বুঝতে পারা কঠিন, যদিনা তারা সরাসরি ব্ল্যাকমেইল করার চিন্তা করে থাকে এবং বিদেশী নাগরিকদেরকে জিম্মি হিসেবে ধরে রেখে অন্যান্য দেশগুলোর উপর চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করতে চায় যাতে করে ঐ দেশগুলি জাতিসঙ্ঘ এবং অন্যান্য জায়গায় পাকিস্তানকে সমর্থন করে। এধরণের প্রস্তাবনা অবশ্য নিন্দাত্মক এবং এমন কোন প্রমাণ নেই যা থেকে বিশ্বাস করা যায় যে পাকিস্তানের মনে এধরণের ভাবনা রয়েছে।

ভারতীয় শর্তাবলীর শিথিলকরণেও এই সমস্যা সমাধানে সাহায্য হবার সম্ভাবনা রয়েছে। কানাডীয় বিমানটি খুব সহজেই ব্যাংকক থেকে এবং যুক্তরাজ্যের রাজকীয় বিমান বাহিনীর বিমানগুলো সরাসরি সিঙ্গাপুর থেকে আসতে পারে যদি অন্য কোন উপায়ে ভারতীয় শর্তাবলী পুরন করার ব্যবস্থা করা যায়। এই পর্যায়ে আমরা শুধুমাত্র ঘটনা কোন দিকে গড়ায় তার জন্য প্রতীক্ষা করতে পারি যেখানে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চলতে থাকবে এই অচলাবস্থা দূর করতে। ইতোমধ্যে আমি যখন এই বার্তা প্রেরণ করছি ততক্ষনে ভারতীয় নিরাপত্তা নিশ্চয়তার সময়সীমা পেরিয়ে যাচ্ছে।

১৪।
কোলকাতা থেকে প্রতিবেদন
৯ই ডিসেম্বর ১৯৭১
ডেভিড সেলস কর্তৃক

সাক্ষাৎকার গ্রাহকঃ
আপনি যশোরে গিয়েছিলেন ডেভিড এবং আপনি নিশ্চয়তা দিয়ে বলছেন যে এই শহরটি এখন পুরোপুরিভাবে ভারতীয়দের দখলে রয়েছে তাই কি?

সেলসঃ ওরা গতকাল এই শহর পেরিয়ে গেছে। ওরা বড় সামরিক ঘাঁটিটিতেও গিয়েছিল যেটি শহর থেকে দুই বা তিন মাইল উত্তর দিকে অবস্থিত এবং বিমান ঘাঁটিটিও এই সবকিছু এখন ভারতীয় দখলে রয়েছে এবং আমরা তা স্বচক্ষে দেখেছি।

পাকিস্তানীরা যাবার পথে বেশ কয়েকটি সেতু ধ্বংস করে দিয়েছে তারা অত্যন্ত দক্ষতার সাথেই তা করেছে।

খোদ যশোর শহরটি বরং অনেকটা জনমানবশূন্য ছিল। মানুষজন সবেমাত্র শহরে ফিরে আসতে শুরু করেছে এবং তারা ভারতীয় সৈন্যদেরকে দেখে উল্লসিত ছিল।

১৫।
দিল্লী থেকে প্রতিবেদন
৯ই ডিসেম্বর, ১৯৭১
জন ওসমান কর্তৃক

এই মুহূর্তে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ চলছে, লন্ডন সময় সকাল ৫ টায়। নয়া দিল্লীতে সদ্য স্বীকৃতি প্রাপ্ত বাংলাদেশ দূতাবাসে আনুষ্ঠানিক পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।

এই সপ্তাহান্তের মধ্যে ঢাকা দখলের যুদ্ধ শুরু হবে বলে প্রকাশিত হয়েছে এখানে। পূর্ব রণাঙ্গনে পাকিস্তানীদের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ছে বলে মনে হচ্ছে কিন্তু পাকিস্তানীদের উদ্দেশ্য আসলে কি সে ব্যপারে প্রশ্ন রয়ে গেছে। সেখানে আটকে পড়া সৈন্যরা কি একটি মরণপণ শেষ চেষ্টা করবে এবং সমুদ্রপথে অপসারণ করতে চাইবে নাকি তারা আত্মসমর্পণ করবে। ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান দ্বিতীয় বারের মত পাকিস্তানীদেরকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন হয় আত্মসমর্পণ কর নয় মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকো। ইতোমধ্যে ভারতীয় সৈন্যদেরকে আদেশ দেয়া হয়েছে যে তাদেরকে মনে রাখতে হবে যে তারা মুক্তিদাতা হিসেবে পূর্ব বঙ্গে প্রবেশ করছে বিজেতা হিসেবে নয় এবং তাদের আচরণ যেন সেরূপ হয়। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ভারতীয় বিমান বাহিনীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন তারা পূর্ব বঙ্গে পাকিস্তানী বিমান বাহিনীকে সম্পূর্ণরুপে ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়েছে বলে। কোলকাতা থেকে প্রাপ্ত অসমর্থিত প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা গেছে যে পূর্ব বঙ্গের পাকিস্তানী সামরিক সর্বাধিনায়ক পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেছেন সাথে করে অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং তাদের পরিবারবর্গকে নিয়ে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয় যে সহকারী সামরিক আইন প্রশাসককে রেখে যাওয়া হয় তার পক্ষে যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করে যাওয়ার জন্যে।

১৬।
দিল্লী থেকে প্রতিবেদন
১০ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ জন ওসমান কর্তৃক

অল ইন্ডিয়া রেডিও আজ জানিয়েছে যে ঢাকা এখন কার্যত ঘেরাও হয়ে আছে এবং বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। নয়া দিল্লী থেকে জানাচ্ছেন, জন ওসমান।

সরকারীভাবে মেঘনা নদীর পূর্ব পাড়ের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল করে নেয়ার খবর প্রকাশিত হবার পর এখান থেকে দেখে মনে হচ্ছে ভারতীয়দের জন্য ঢাকায় প্রবেশ করার দুয়ার এখন প্রায় খুলে গেছে। এই শহর তিনটি হচ্ছে রেলসংযোগসহ নদীবন্দর চাঁদপুর, দাউদকান্দি এবং আশুগঞ্জ। এই তিনটির মধ্যে ঢাকায় যাওয়ার সবচে সহজ পথ হচ্ছে আশুগঞ্জ, কিন্তু পশ্চিম পাড়ের সাথে সংযোগ রক্ষাকারী সেতুটি পশ্চাদপসরণকারী পাকিস্তানীরা উড়িয়ে দিয়েছে। অন্য দুটি শহর থেকে অগ্রসর হতে হলে আরো কয়েকটি নদী পার হতে হবে এবং এই জল প্রতিবন্ধকতাগুলিকে ভারতীয় সেনানায়করা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা রেখা হিসেবে প্রথম থেকেই বিবেচনা করে আসছিলেন। তাই এখনো সব শেষ হয়ে যায়নি। কিন্তু অল ইন্ডিয়া রেডিও বলছে ঢাকা পুরোপুরিভাবে অবরুদ্ধ এবং পাকিস্তানীরা হয়তো একটি শেষ চেষ্টা করার পরিকল্পনা করছে শহরটির পার্শ্ববর্তী এলাকায়। ইতোমধ্যে, ভারতীয় কর্মকর্তারা দাবী করছেন সামরিক বাহিনীর তিনটি শাখা থেকেই বন্যার মতো সাফল্যের সংবাদ আসছে এবং সেনানায়কদের নাম এমনভাবে সরাসরি বলা হচ্ছে যে যদি এই সংবাদগুলো পরবর্তীতে অতিরঞ্জিত বলে প্রতীয়মান হয় তাহলে তা ওদের জন্য অত্যন্ত অপেশাদারসুলভ বলে মনে হবে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতীয় বিমান বাহিনীর পশ্চিম বিভাগের প্রধান, এয়ার-মার্শাল ইঞ্জিনিয়ার, বলেন পাকিস্তানী বিমান বাহিনীর পশ্চিম বিভাগের একচতুর্থাংশ ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে যেখানে পূর্ব বিভাগে গত দুই দিন ধরে অভিযান চালানোর পর ভারতীয়রা এখন দাবী করছে যে সেখানে পাকিস্তানী বিমান বাহিনীকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। এবং শিলং, আসামের রাজধানী থেকে প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী ভারতীয় জঙ্গিবিমান ঢাকার কাছে নারায়ণগঞ্জে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর পূর্ব বিভাগের অবশিষ্টাংশদের বহনকারী জলযান ডুবিয়ে দিয়েছে। এই খবরে বলা হয় ষ্টীমার এবং বজরা থেকে শুরু করে যন্ত্রচালিত নৌযান এবং টহলদানকারী নৌযান মিলিয়ে প্রায় একশো জলযান ধ্বংসপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখানে মনে করা হচ্ছে যে পাকিস্তানীরা হয়তো বরিশাল বা নারায়ণগঞ্জের মতো এলাকা দিয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছে, কিন্তু ভারতের প্রচারিত খবরে এবং প্রচারপত্রে তাদেরকে বারবার বলা হচ্ছে যে তাদের আর কোন আশা নেই। ইতোমধ্যে, ভারতীয় নৌবাহিনী দাবী করছে যে তারা গভীর সমুদ্রে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে এবং তারা তাদের ইচ্ছা মোতাবেক করাচী ও পাকিস্তানের অন্যান্য বন্দর আক্রমণ করতে সক্ষম। এখান থেকে দেখে যা মনে হচ্ছে, এবং এর উপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে যে এখান থেকে দেখে পাকিস্তানের জন্য পরিস্থিতি খুবই হতাশাব্যঞ্জক বলে মনে হচ্ছে।

১৭।
ঢাকা থেকে প্রতিবেদন
১১ই ডিসেম্বর, ১৯৭১
রনাল্ড রবসন কর্তৃক

বেশী মানুষকে দেখা যাচ্ছে ঢাকার রাস্তায় তাদের স্বল্প অস্থাবর সম্পত্তি ঠেলাগাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছে যেহেতু পরিবারগুলো সেইসব এলাকা থেকে সরে যাচ্ছে যেগুলো ভারতীয় বিমানের আক্রমণের শিকার হচ্ছে বা নারায়ণগঞ্জের মতো নদীতীরবর্তী এলাকা থেকে যেখানে তারা মনে করছে যুদ্ধ হবে ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হবার সময়।

বিমান আক্রমণের সময় ঢাকা শহরবাসীরা অদ্ভুতরকম শান্ত থাকে।

পূর্ব বাংলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক, জেনারেল নিয়াজি, কে ঢাকায় দেখা গেছে, যা সেইসব গুজবগুলোকে বাতিল করে দেবে যেগুলো প্রচারিত হয়েছিল যে সে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে গেছে।

১৮।
রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রতিবেদন
১৫ই ডিসেম্বর, ১৯৭১
হ্যারল্ড ব্রাইলি কর্তৃক

পাকিস্তানের জনগণ যখন জাতিসংঘে শান্তি প্রচেষ্টার অগ্রগতির লক্ষন দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, সেখানে সামরিক বাহিনী নিজেদেরকে প্রস্তুত করছে যেটিকে দেখে মনে হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ভাগ্য নির্ধারণী যুদ্ধ এর রাজধানী ঢাকার প্রতিরক্ষার যুদ্ধ। রাওয়ালপিন্ডি থেকে জানাচ্ছেন হ্যারল্ড ব্রাইলিঃ

পূর্ব বাংলায় অবস্থানরত পাকিস্তানী বাহিনী ব্যাপক পুনর্বিন্যাস কাজে নিয়োজিত রয়েছে তাদের মুখপাত্রের ভাষ্য অনুযায়ী তাদের পূর্ব অঙ্গরাজ্যটির সর্বোত্তম উপায়ে প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য। তারা বিস্তারিত জানাতে অস্বীকৃতি জানায়। “আমাদের শত্রুরা ঠিক এটাই জানতে চায়” একজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা আমাকে বলেন, “তাদেরকে অনেক সময় ব্যয় করতে হবে এটা জানার জন্য এবং আমি আশা করি তারা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হবে”। তাদের কথা মেনে নিলে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা যারা পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ নাগরিক তারা ঢাকার পরিপূর্ণ রাস্তাকে স্টালিনগ্রাদে পরিণত করে রাখতে পারবে দিনের পর দিন ধরে এবং তাদের বার্তা সর্বদাই একই রকমঃ আমরা শেষ মানুষটি বেঁচে থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ করে যাবো। পাকিস্তানী স্থল বাহিনী নিজেদের মধ্যে পুনর্বিন্যাস করছে ভারতীয় ছত্রীসেনা এবং হেলিকপ্টার থেকে অবতরণকারী সৈন্যদের দ্বারা তাদের অবস্থানের ভিতরে বারংবার অনুপ্রবেশের ঘটনা বিবেচনা করে। পূর্ব বাংলার আকাশে ভারতীয় আধিপত্য নিশ্চিত হবার কারণে তারা কার্যত কোনো বাধা ছাড়াই এটা করতে পারছে যতক্ষণ পর্যন্ত তারা মাটিতে নেমে আসছে আরকি এবং তারপর পাকিস্তানীরা বলছে যে এই ছত্রী অনুপ্রবেশকারীদেরকে তারা মেরে থেঁৎলে দিচ্ছে এবং এই ছত্রী সেনারা তেমন কোনো অগ্রগতি করতে সমর্থ হয়নি। পূর্ব বঙ্গে অবস্থানকারী পাকিস্তান বিমান বাহিনীর দুর্বল শক্তি অনেকদিন আগে থেকেই কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। একটি অবসন্ন বাহিনী যাদের কোনো ঘাঁটি নেই কার্যক্রম পরিচালনা করার। ঢাকা বিমান বন্দরে অবস্থিত এর একমাত্র ঘাঁটিটি অবিরত বিমান আক্রমণে অচল হয়ে আছে। পরিস্থিতির কঠিন বাস্তবতা যাই হোক না কেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের মনোবল দুর্বল হয়ে যাবার কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না।

স্রোতের মতো পাকিস্তানীদের বীরত্বের খবর আসছে যে তারা অসংখ্য ভারতীয় সৈন্যকে পিছু হটতে বাধ্য করছে এবং তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটাচ্ছে। এটাই তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মনোভাব, তারা সবাই ঢাকার পতন হবার সম্ভাবনাকে মনে স্থান দিচ্ছে না এবং তাই তাদের চমকিত প্রতিক্রিয়া কেমন হবে তা আন্দাজ করা কঠিন।
১৯।
ঢাকা থেকে প্রতিবেদন
১৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭১
রয়টার্সের গ্র্যানভিল ওয়াল্টস কর্তৃক

আমি আজ একজন ভারতীয় জেনারেলের জিপগাড়ির সামনে সামনে একটি ট্যাঙ্কে চড়ে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানীতে প্রবেশ করি যখন বিজয়ী ভারতীয় সেনাবাহিনী পতিত শহরটিতে ঢুকছে। রাজধানী জুড়ে বিশাল জনসমুদ্র একত্রিত হয় ভারতীয় সেনাদেরকে শুভেচ্ছা জানাতে, ফুল ছড়িয়ে, হাত নেড়ে এবং চিৎকার করতে করতেঃ “ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব দীর্ঘজীবী হোক”।

এখানে ব্রিগেডিয়ার মিশ্রা, চৌকস ৩৭তম ডিভিশনের অধিনায়ক, অন্যান্যদের সাথে একত্রে ভারতীয় গণ্যমান্যদের আগমনে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন, যাদের মধ্যে লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরাও আছেন, যিনি পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় বাহিনীর সর্বাধিনায়ক, যারা দশটি ভারতীয় হেলিকপ্টারের বহর নিয়ে এসেছেন। ক্রমবর্ধমান আনন্দ এবং হৈ চৈ-এর মাঝে জেনারেল অরোরা এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনীর প্রধানগন, ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে রেসকোর্স ময়দানের দিকে অগ্রসর হন, যেখানে আত্মসমর্পণের দলিলটি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষরিত হয়, একটি খুবই সাধারণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ঠিক সেই স্থানে অনুষ্ঠিত হয় যেখান থেকে শেখ মুজিবুর রহমান, আওয়ামী লীগের নেতা, তাঁর বিখ্যাত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভাষণ দেন গত মার্চ মাসে সেনাবাহিনীর কঠোর অবস্থান নেয়ার আগে।

বেশীরভাগ বাঙালির জন্য শেখ মুজিবের অনুপস্থিতি একমাত্র খারাপ বিষয় ছিল যেটি সে রাতের উৎসবমুখর পরিবেশকে ম্লান করে দেয়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৮১-b। বাংলাদেশ আন্দোলন সম্পর্কিত বিবিধ প্রতিবেদন বি বি সি , লন্ডন এপ্রিল- ডিসেম্বর ১৯৭১

Shakeel Syed Badruddoza
<১৪, ১৮১-b, ৫৪৯-৫৬০>

পাকিস্তানকে সহায়তা (টুয়েন্টি ফোর আওয়ারস )
পূর্ব পাকিস্তানকে সহায়তা প্রদানের প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করতে গতকাল ব্রিটিশ ত্রাণ সংস্থা ‘ওয়ার অন ওয়ান্ট’-এর প্রধানগণ মিলিত হন। ওয়ার অন ওয়ান্ট, খ্রিস্টান এইড এবং অক্সফাম-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলির সমন্বয়কারী ইয়ান ম্যাকডোনাল্ড এক সাক্ষাৎকারে বিবিসি টেলিভিশনের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তিনি জানান, “আমরা ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় কবলিত এলাকায় দেড় মিলিয়ন মানুষ পেয়েছি যারা নতুন ফসল না ওঠা পর্যন্ত নিজেদের মুখের আহার যোগাতে আক্রান্ত এলাকার বাইরে থেকে নিয়মিত আসা খাদ্য শস্যের ওপর নির্ভর করছে। দ্বিতীয়তঃ সেই ফসল তারা তখনই ফলাতে পারবে যখন তাদের বীজের যোগান থাকবে, যন্ত্রপাতির মধ্যে জ্বালানি এবং ট্র্যাক্টর থাকবে। পূর্ব পাকিস্তানে চলমান যুদ্ধ এসব যোগান ব্যাহত করবে এবং চাষাবাদ বন্ধ করে দেবে।”

তিনি বলেন যে, ঘূর্ণিঝড় কবলিত এলাকাবাসী শস্য ঘরে তুলতে পারেনি আর তারা আহার জোটাতেও পারবে না। তিনি জানান, “আমরা এরপর পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য এলাকায় দেখলাম যে মানুষজন আমদানি করা খাবারের উপর নির্ভরশীল। কারণ, ঘূর্ণিঝড় আক্রান্ত এলাকা গুলোতে খাদ্য শস্যের অভাব–যা ঘূর্ণিঝড়ে নষ্ট হয়ে গেছে, চট্টগ্রামে খাদ্যশস্য আটকা পড়ে আছে এবং গত এক মাস যাবত সেখান থেকে চালান আসতে পারেনি।” সমন্বিত ত্রাণ বিষয়ক বৈঠকের ফলাফল সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে জনাব ম্যাক ডোনাল্ড বলেন, “আমরা এখন যেটা চেষ্টা করছি সেটা হলো, যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে রাখা যাতে পরিস্থিতি পুরোটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই পাঠানোর মতো লোকবল ও ত্রাণ সামগ্রী তৈরি থাকে। আমরা পাকিস্তান সরকারকে তাদের মতের বিরুদ্ধে আমাদের ঢুকতে দিতে রাজি করাতে পারবো না, তবে ব্রিটিশ সরকারের কাছে আন্তর্জাতিক খাদ্য কর্মসূচী চালু করতে চাইতে পারি, যাতে সেইসব এলাকায় সরবরাহ করা সম্ভব হয়।”

পাকিস্তানে মাইকেল স্টুয়ার্ট
১০ এপ্রিল, ১৯৭১
ইভান শারল্টন সম্পাদিত

জনাব মাইকেল স্টুয়ার্ট, ব্রিটেনের সমাজতন্ত্রী সরকারের সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তার মতামত ব্যক্ত করেন।
ঘটমান পরিস্থিতি নিয়ে কেনেথ অ্যালসপ-এর অনুষ্ঠান ‘ টুয়েন্টি ফোর আওয়ারস’-এ জনাব মাইকেল স্টুয়ার্ট বিবিসি টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকার দেন।
জনাব স্টুয়ার্টকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, বিয়াফ্রা পরিস্থিতি এবং পূর্ব পাকিস্তানে চলা ঘটনাসমুহের মধ্যে কোন সরাসরি তুলনা করছেন কি না। তিনি বলেন, রাজনৈতিক অবস্থা খুবই ভিন্ন, অবশ্য দুই ক্ষেত্রেই আমরা ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছি। তিনি আশা করেন যে, ব্রিটিশ সরকার এবং সকল কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্র ত্রাণ পৌঁছানোর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবে, এবং ত্রাণ প্রদান ও সংগঠনে সাহায্য করতে সক্ষম হবে। যদি রেড ক্রস, ত্রাণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে পাকিস্তান সরকারের কোন সমস্যা সৃষ্টি হয়, তাহলে ব্রিটিশ সরকার হয়তো সাহায্য করতে পারবে, যেমন করেছিল যখন রেড ক্রসের সাথে নাইজেরিয়ান সরকারের সমস্যা দেখা দিয়েছিল।

ব্রিটিশ সরকার সত্যি সত্যি এমন কোন পদক্ষেপ নেবে কি না–এ প্রশ্নের জবাবে জনাব স্টুয়ার্ট বলেন, ত্রাণের ব্যাপারে এমন সহায়তা করতেই পারে। এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, তারা প্রধানতঃ জোর দিয়েছে মানুষের দুর্ভোগ লাঘব করতে, পাকিস্তানের গোলযোগের রাজনৈতিক উত্তর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে না।

জনাব স্টুয়ার্ট স্বীকার করেন যে, এ ক্ষেত্রে (ব্রিটিশ সরকারের) অন্য একটি দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, এবং তিনি এও বলেন যে এ ব্যাপারটা গ্রাহ্য করাই হবে বিচক্ষণতা। একটা বিবেকবর্জিত কাজ বা কথা দিয়ে কেউ সম্পর্ক তিক্ত করতে বা ত্রাণকার্য আরো কঠিন করে তুলতে চাইবে না। তবে তিনি মনে করেন, ব্রিটিশ সরকার এ ব্যাপারটিকে অনেক স্বচ্ছ করতে পারে যে, আসলে এটা মানুষের দুর্ভোগ বা কিসের সাথে সংশ্লিষ্ট, আর সব কমনওয়েলথ কাঠামোর ভেতর দিয়েই এটা হতে পারে, যাতে করে এমন মনে না হয় যে ব্রিটিশ সরকার পাকিস্তানকে বলার চেষ্টা করছে তার বিষয়গুলো কিভাবে চালাতে হবে, বরং পাকিস্তানী জনগণের বন্ধু হিসেবে কমনওয়েলথ তার শুভেচ্ছা ও মধ্যস্থতা প্রদান করছে।

জনাব স্টুয়ার্ট আশংকা করেন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম। তবে তিনি জানতে উৎসুক যে দিগন্ত খানিক বিস্তৃত করে, শত প্রতিকূলতা স্বত্বেও ভারত এবং পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের জনতা ও সরকার, সমগ্র উপমহাদেশের সাধারণ প্রয়োজনগুলো এক করে দেখতে পারে কি না। জনাব স্টুয়ার্ট জানতে আগ্রহী যে, কোন পরাশক্তি সংশ্লিষ্ট হলে সেটা কতখানি ভয়াবহ হবে তা বিবেচনা করে, এবং সাময়িক ঘূর্ণিঝড়ের প্রাকৃতিক বিপর্যয়, গৃহযুদ্ধের মানবিক বিপর্যয় বিবেচনা করে তাদের নিজেদের স্বার্থে একজোট হয়ে কাজ করা কতখানি প্রয়োজন সেটা বুঝতে পারে কি না।

দেশভাগ অনিবার্য মনে করেন কি না–এমন প্রশ্ন করা হলে জনাব স্টুয়ার্ট বলেন, তিনি এখানে দেশভাগ শব্দটি ব্যবহার করতে চান না, তবে মনে করেন সমঝোতা হওয়াটা আপাতদৃষ্টিতে কঠিন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, গৃহযুদ্ধ এবং ছিন্ন পাকিস্তান ব্রিটিশ ও পশ্চিমা স্বার্থের উপর ঠিক কতখানি হুমকি। উত্তরে তিনি বলেন, পাকিস্তান দুইভাগ হলে সেটা হবে দুঃখজনক, কারণ এতে দারিদ্র্য বিমোচন এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের মতো মুখ্য বিষয়গুলো সামলে উঠতে সরকারের শক্তি হ্রাস করবে। এসব সমস্যা সমাধান করা আরো জটিল হবে। ব্রিটেনের প্রধান আগ্রহ হলো একটি সমৃদ্ধিশালী পাকিস্তান।
পরিস্থিতির দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনা কী?-জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, সবচেয়ে খারাপ হবে ধরুন পাকিস্তানকে জোর করে এক করে রাখা হলো অথচ সেখানে কোন সদ্ভাব থাকবে না এবং সার্বক্ষণিক তিক্ততা ও সংঘর্ষ লেগে থাকবে। তথাপি তিনি আশার সুরে তাঁর সাক্ষাৎকার সমাপ্ত করেন। “মানুষ চরম দুরাবস্থার আশংকার মাঝেও কখনো উঠে দাঁড়ায়। কেবল পূর্ব পশ্চিম পাকিস্তানেই নয়, হয়তো পাকিস্তান ভারতের মধ্যেও একটা ভালো সমঝোতা হতে পারে।”

১৬ এপ্রিল, ১৯৭১
টুয়েন্টি ফোর আওয়ার্স-এ জনাব জাকারিয়া চৌধুরী

বিবিসি টেলিভিশনের দর্শকরা গতরাতে সমসাময়িক পরিস্থিতি নিয়ে অনুষ্ঠান ” টুয়েন্টি ফোর আওয়ার্স”-এ একটি সাক্ষাৎকার উপভোগ করেন জনাব জাকারিয়া চৌধুরীর–যিনি নিজেকে অন্তর্বর্তীকালীন বাংলাদেশ সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক গুপ্তচর হিসেবে পরিচয় দেন।

জনাব চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল ‘পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদেরকে প্রতিরোধ করার সামর্থ্য ভেঙ্গে পড়ছে’–এমন খবরে তাঁর প্রতিক্রিয়া কি। তিনি এ সংবাদ অস্বীকার করেন এবং পূর্ব বাংলার তিন চতুর্থাংশ গ্রামে প্রতিরোধ শক্তির নিয়ন্ত্রণ রয়েছে বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, যদিও শহরের বেশিরভাগ সৈন্যদের দখলে, গ্রামে তাদের কঠিন মাটিতে চলতে হয়। তিনি আন্দাজ করেন আগামী বর্ষায় পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদল নিজেদের ক্যান্টনমেন্টেই জলাবদ্ধ হয়ে থাকবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের স্বীকৃতির প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে জনাব চৌধুরী জানান যে, তিনি আশা করেন সকল রাষ্ট্র ধীরে ধীরে তাদের দাবীর যথার্থতা বিশ্বাস করবে। বাইরে থেকে অস্ত্র আসুক আর না আসুক তাদের লড়াই করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী তাঁকে প্রশ্ন করেন এত কষ্ট স্বত্বেও তিনি কেন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চান, তিনি উত্তর দেন, পূর্ব পাকিস্তানীরা পাকিস্তান ভাগ হয়ে যাক এমনটা চায় নি, এই যুদ্ধ তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।

১৭ এপ্রিল, ১৯৭১
সাপ্তাহিক পত্রিকায় পাকিস্তান

বামপন্থী সাপ্তাহিক, দ্য নিউ স্টেট্ম্যান, পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে প্রথম পাতায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। দ্য নিউ স্টেট্ম্যান বলে যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সাম্প্রতিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে দৃঢ়ভাবে তাদের ইচ্ছের কথা জানিয়েছে। অবশ্য, দ্য নিউ স্টেট্ম্যান পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থনের বহরের আশা রাখে না । দ্য নিউ স্টেট্ম্যান মনে করে যে, অর্থনৈতিকভাবে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন স্বত্ত্বা হিসেবে অধিকতর টেকসই, আর এক সময় স্বাধীন হয়েই যাবে, যেহেতু দ্য নিউ স্টেট্ম্যান-এর চোখে জোটবদ্ধ পাকিস্তান একটি কৃত্রিম কাঠামো।

দ্য স্পেকটেইটর–যা দ্য নিউ স্টেট্ম্যান এর চেয়ে ডানপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি রাখে–তার প্রধান প্রতিবেদনও পূর্ব পাকিস্তানকে নিয়ে। দ্য স্পেকটেইটর বিশ্বাস করে যে, পাকিস্তান প্রাকৃতিকভাবে এক থাকার মতো রাষ্ট্র নয়। পত্রিকাটি বোধ করে যে, পশ্চিম পাকিস্তানের ভারতের সাথে রেষারেষি এর দুই পক্ষের মধ্যে আরো টানাপড়েন সৃষ্টি করেছে; আর রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের অধীনে পশ্চিম পক্ষ পূর্ব পাকিস্তানকে অবহেলা করেছে। দ্য স্পেকটেইটর মনে করে যে, সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ তৈরিতে সক্ষম হবে, কিন্তু সাথে এও আশংকা করে যে, সেই নিয়ন্ত্রন স্বৈরাচারে রূপ নেবে। পরিশেষে দ্য স্পেকটেইটর বলে, সেনাবাহিনী পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা ঐক্যবদ্ধ করে ফেলবে। দ্য স্পেকটেইটর আশা করে, হয়তো এর মধ্যবর্তী সময়ে ব্রিটেন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করবে এবং যতদিন সৈন্যরা ত্রাণকার্য শুরু না করছে ততদিন পর্যন্ত সকল প্রকার সাহায্য সহায়তা স্থগিত করবে। তবে পত্রিকাটি আশংকা করে, ব্রিটেন এই অবস্থান গ্রহণ করবে না।

ইকনোমিস্ট পত্রিকায় এশিয়ার পরাশক্তির ভূমিকা নিয়ে লম্বা একটা প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। ইকনোমিস্ট রাশিয়া এবং চীনের এশিয়ার প্রতি আগ্রহের কারণগুলো তুলে ধরেছে, এবং লিখেছে যে, স্বার্থের সংঘাত এশিয়ার অনেকগুলো দেশের মধ্যে অস্থিতিশীলতার জন্য আংশিকভাবে দায়ী। দ্য ইকনোমিস্ট মনে করে পশ্চিমা শক্তিগুলোর এশিয়ার প্রতি আরো বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত, এবং যেসব দেশে এখনো কোন না কোনভাবে গণতান্ত্রিক শাসন চলছে তাদের সহায়তা করা উচিত।
ইকনোমিস্ট-এ নির্দিষ্ট করে পাকিস্তান নিয়েও একটি প্রতিবেদন রয়েছে। দ্য ইকনোমিস্ট মনে করে যে, প্রতিরোধ আন্দোলন (পূর্ব পাকিস্তানের) শহরগুলোতে লড়াই হেরে গিয়েছে। পত্রিকাটি জানায় যে, অন্যান্য দেশ স্বীকৃতি দিতে নাও পারে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে–যেটাকে বানোয়াট বলা হচ্ছে যেহেতু কোন এলাকার উপর এর দৃঢ় দখল নেই। ইকনোমিস্ট-এর আশংকা হলো সীমান্তের ঘটনা ভারত পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষের সূত্রপাত করতে পারে। রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের উপর চাপ প্রয়োগ করার একমাত্র উপায় হলো, দ্য ইকনোমিস্ট উল্লেখ করেছে, সাহায্যের জন্য তার বর্তমান অনুরোধকে প্রত্যাখ্যান করা যতক্ষণ না তিনি সামরিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করেন। উপসংহারে ইকনোমিস্ট সতর্ক করে যে, খাদ্যাভাব, ব্যাপক হতাহতের সংখ্যা, এবং সম্ভাব্য বন্যা পূর্ব পাকিস্তানে মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, যদি না এর মধ্যেই কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থা না আসে।

১৭ এপ্রিল, ১৯৭১
পাকিস্তানের প্রতি বহির্বিশ্বের মনোযোগ
নিকোলাস ক্যারোল

পাকিস্তান প্রেস এবং পাকিস্তান সরকার অভিযোগ করেছে যে, পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত সাম্প্রতিক ঘটনাসমুহ সংবাদে ভুলভাবে পরিবেশিত করা হয়েছে, এবং অন্যান্য দেশ পূর্ব পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে । ‘সানডে টাইমস’-এর নিকোলাস ক্যারোল এসব অভিযোগ পর্যালোচনা করেছেন।

যে মুহূর্তে পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানে নিজের নিয়ন্ত্রণ রাখতে সেনাবাহিনী ব্যবহার শুরু করেছে, সমগ্র পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে প্রেসের ওপর কঠিন কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। তাই প্রত্যেক দেশের সাংবাদিককে, বিশেষ করে ব্রিটিশ ও ভারতীয় সাংবাদিকদের, নিজেদেরই সর্বোচ্চ উদ্যোগ নিতে হয় জানার জন্য আসলে কি হচ্ছে। এটা যখন হয়েছে, পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার আন্তর্জাতিক সীমানায় সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে নি, তাই অনেক সাংবাদিক পূর্ব বাংলায় প্রবেশ করতে পেরেছেন।

ফলশ্রুতিতে, কি ঘটেছে তার কিছু নিরপেক্ষ চিত্র বিশ্ব পেয়েছে। সেটা মর্মভেদী এক চিত্র, আর এরই ভিত্তিতে সবখানে পত্রিকার সম্পাদকীয়তে পাকিস্তানী সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সাড়া উঠেছে, যার সবচেয়ে বেশি হচ্ছে ভারতীয় ও ব্রিটিশ পত্রিকায়।

যে স্বৈরাচার নেতৃত্ব নিজের জনগনের একটা বিদ্রোহী অংশের ওপর সশস্ত্র বাহিনী ব্যবহার করে গোপনে নৃশংসভাবে শৃঙ্খলিত করতে চায়–তার চেয়ে সমালোচনার প্রতি সংবেদনশীল বোধ হয় আর কিছু নেই। পাকিস্তানী প্রেস এবং তার সরকারী মুখপাত্রের বিবরণ বিবেচনা করলে, বিদেশী সমালোচনা ঘরেও শুরু হয়ে যায়। এটার একটা নমুনা হলো পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশী সরকারের হস্তক্ষেপের অলীক অভিযোগ–যার প্রধান দোষ দেয়া হচ্ছে ভারতের প্রতি।

এখন যদি একটা কাজ থাকে যা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কখনোই করতে চাইবে না– তা হলো পূর্ব পাকিস্তানের বিপর্যয়ে সরাসরি যুক্ত হওয়া। মিসেস গান্ধির নতুন সরকার যথেষ্ট সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত–এমতাবস্থায় ভারত সীমান্তের ওপারের সমস্যায় জড়িয়ে পড়ার কোন অর্থ হয়না। মানবিক সহানুভূতি পেতে নিজেদের মতো জনগোষ্ঠী যখন দোরগোড়ায়, তাদের কঠিন দুর্ভোগ লাঘব আর সরকারী কর্মপন্থার মধ্যে একটা স্পষ্ট সীমারেখা অবশ্যই টানা প্রয়োজন ।

এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারের সদস্যবৃন্দ, মিসেস গান্ধী স্বয়ং, এবং বিশেষ করে পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী জনাব সোয়ারান সিং, দৃঢ়ভাবে নিজেদের অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। তবে পাকিস্তানী কর্মকাণ্ডের মধ্যে সরাসরি হস্তক্ষেপের তুলনায় তা একটু ভিন্ন বটে। সবার কাছে সুস্পষ্ট যে, ভারতের প্রধান আগ্রহ নিহিত একটি শান্তিপূর্ণ পাকিস্তানে–যেখানে এর দুই ভাগই স্বাভাবিকভাবে এক সাথে কাজ করছে।
একই যুক্তি পশ্চিমা পরাশক্তিদের ক্ষেত্রেও খাটে। ব্রিটিশ সরকারের প্রতিক্রিয়া আজ অবধি নিঃশব্দ। এটা পরিষ্কার করতেই পররাষ্ট্র সচিব হাউজ অব কমন্স-এ পিছু হটেছেন। ব্রিটেন মানে যে চলমান দুর্দশা আসলে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার এবং আশা করে এর মিটমাট হয়ে যাবে। পূর্ব বাংলার জাতীয়তাবাদের পক্ষে কোনোভাবে কোন ধরনের হস্তক্ষেপের অর্থ হয় না। কিভাবে বাঙালীদের সাহায্য হবে? এতে ব্রিটেনের লাভটাই বা কোথায়?

প্রাথমিক মানবতার প্রেক্ষিতে, অর্থনৈতিক এবং অনুধাবনযোগ্য যে কোন পরিপ্রেক্ষিতে, ব্রিটেন এবং বিশ্ববাসী চায় একটা শান্তিপূর্ণ অবিভক্ত পাকিস্তান।

পরষ্পর দোষারোপের সময় শেষ। ভারত সরকারের মতো ব্রিটেনও চায় সামরিক কর্মকাণ্ডের অবসান হোক এবং পাকিস্তানের সামরিক শাসক এবং পূর্ব বাংলার জনপ্রতিনিধির মধ্যে–তিনি যেই হন না কেন–পুনরায় আলোচনার সূচনা হোক ।

১১ মে, ১৯৭১
পাকিস্তানের সম্পর্কে হোম
অ্যান্ড্রু ওয়াকার

ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব, স্যার অ্যালেক ডগলাস হোম, প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন যে, পাকিস্তান সরকার একটি আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দলকে পূর্ব পাকিস্তানে কি ধরনের ত্রাণ লাগতে পারে তা দেখার অনুমতি দেবে। খবর জানিয়েছেন অ্যান্ড্রু ওয়াকার, বিবিসি কমনওয়েলথ।

স্যার অ্যালেক সংসদে বক্তব্য রাখছিলেন, তিনি যে প্রশ্নের উত্তরে এ কথা বলেন তা সকল দলের সদস্যদের (পূর্ব পাকিস্তানে) নজিরবিহীন মানবিক দুর্দশায় উদ্বেগ প্রকাশের কারণে উত্থাপিত হয়। তিনি বলেন যে, তিনি এবং মার্কিন পররাষ্ট্র বিষয়ক সচিব, জনাব রজারস, যুগ্মভাবে জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব উ থান্ট-এর প্রতি একটি বার্তা পাঠিয়েছেন, যেখানে আন্তর্জাতিক সহায়তা প্রদানের প্রস্তাব নবায়ন করতে বলা হয়েছে । উ-থান্ট পাকিস্তান সরকারের সাথে যোগাযোগ রেখে ছিলেন, তাই (স্যার অ্যালেক বলেন,) “আমি আশা করি তারা (পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ) একটি বিশেষজ্ঞ দলকে কি প্রয়োজন তার বস্তুনিষ্ঠ হিসেব তৈরি করতে দেবে, এবং যদি তা আন্তর্জাতিক মহলে আসলেই প্রয়োজন বলে বিবেচিত হয় তাহলে (পূর্ব পাকিস্তানে) সহায়তা গ্রহন করতে প্রস্তুত থাকবে।” তিনি আবারো বলেন, ব্রিটেন যে কোন আন্তর্জাতিক ত্রাণ প্রচেষ্টায় অংশ নিতে প্রস্তুত, যেটা সবচেয়ে ভালোভাবে সংগঠিত হবে যদি জাতিসংঘের মাধ্যমে হয়।

পররাষ্ট্র সচিবের যুক্তি ছিল যে, যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটার কারণে পূর্ব পাকিস্তানে এ বছরের শেষ নাগাদ চরম খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। অধিকিন্তু সেখানে শরণার্থী সমস্যাও রয়েছে যারা ভারতের সীমান্ত অতিক্রম করে ঢুকে পড়ছে। সর্বশেষ প্রাক্কালন অনুযায়ী সে অনুপ্রবেশের হার হলো প্রতিদিন ত্রিশ হাজার করে মানুষ। ব্রিটিশ ত্রাণ সংস্থাগুলো সেখানে রসদ উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। স্যার অ্যালেক সেই সরবরাহে সহায়তা করার জন্য নগদ অনুদানের ঘোষণা দিয়েছেন।

লেবার পার্টির পররাষ্ট্র বিষয়ক মুখপাত্র, জনাব ডেনিস হেলি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এই বলে যে, পাকিস্তানে একটা রাজনৈতিক মিমাংসা হওয়া প্রয়োজন। স্যার অ্যালেক উত্তরে বলেন, আমরা পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখেছি। তবে এটা (মিমাংসা) আসতে হবে দেশের মানুষের খাতিরে, বাইরে থেকে তো আর এটা চাপিয়ে দেয়া যায় না।

বার্মিজ অংশ
৬ জুন, ১৯৭১
পাকিস্তান প্রেস পরিক্রমা
বেসিল ক্লার্ক

আজ ব্রিটেনে রবিবারের পত্রিকাগুলো পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থী প্রসঙ্গে ক্রমবর্ধনশীল উদ্বেগের নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছে। প্রধান প্রধান রবিবারের পত্রিকাগুলোর মধ্যে তিনটি শরণার্থীদের দুরাবস্থা হেডলাইন করেছে। দ্য অবজারভার বলেছে “বাংলার বেদনা”, দ্য সানডে টাইমস বলেছে শরণার্থীরা “লাখে লাখে মারা পড়তে পারে”, যেখানে দ্য সানডে টেলিগ্রাফ জনাব গান্ধীর নেয়া পদক্ষেপ “ব্যাপক ছড়িয়ে পড়ার পরিকল্পনা” হেডলাইন করেছে ।

পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্রিটিশ নাগরিকদের উদ্বেগও সম্পাদকীয়তে প্রতিফলিত হয়েছে।

দ্য সানডে টাইমস শরণার্থী সমস্যাকে দুইভাগে ভাগ করেছে। প্রথমতঃ কিভাবে তাদের তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত রসদ সরবরাহ করা যায়। এবং দ্বিতিয়তঃ পূর্ব পাকিস্তানে কিভাবে পরিস্থিতি অনুকূলে আনা যায় যাতে শরণার্থীদের সেখানে নিরাপদে ফেরত যাওয়া সম্ভব হয়। শরণার্থীদের রসদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য সানডে টাইমস এর মতে আন্তর্জাতিক ত্রাণ প্রচেষ্টার বিকল্প নেই। পত্রিকাটি নির্দেশ করে যে, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনের উচিত সমন্বিত ত্রাণের ব্যবস্থা করা।

কিন্তু বড় সমস্যার কী হবে? শরণার্থীদের কিভাবে নিরাপদে বাড়ি পাঠানো যায়? দ্য সানডে টাইমস বলে, একটা আলোচনা চলছে পাকিস্তান সরকার যতদিন না পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রত্যাহার করছে এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন নিশ্চিত করছে ততদিন বিদেশী অর্থনৈতিক সহায়তা বন্ধ রাখা হবে। পত্রিকাটি স্বীকার করে যে, এটি হবে রাজনৈতিক লক্ষ্যে সহায়তার ব্যবহার।

দ্য অবজারভার পত্রিকার সম্পাদকীয়তে যে সমাধান দেয়া হয়েছে তার সাথে দ্য সানডে টাইমস এর প্রস্তাবের কিছুটা সাদৃশ্য রয়েছে, তবে অবজারভার জাতিসংঘের ওপর আরো বড় ভূমিকা আরোপ করে। অবজারভার জানায়, দুইটি সম্পূরক পদক্ষেপ সম্ভব হতে পারে। প্রথমতঃ পাকিস্তানকে সতর্ক করা হবে যে, তার বৈদেশিক সাহায্য স্থগিত থাকবে যতদিন জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণে মনে হয় যে শরণার্থীদের দেশে ফেরা নিরাপদ। দ্বিতীয়তঃ পত্রিকাটি প্রস্তাব করে যে, নিরাপত্তা কাউন্সিলের একটি সংকল্প নেয়া উচিত যেটা জাতিসংঘের একটি দলকে পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে চলাচলের অনুমতি দেবে, যাতে করে তাদের মধ্যে আপস-রফা করা যায়–যেমনটা মধ্য প্রাচ্যে অনৈক্যের ক্ষেত্রে করা হয়েছিল । অবজারভার জোর দিয়ে বলে যে, এই সমাধান কেবল পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক ভবিষ্যতের প্রশ্নই সমাধান করে না, বরং চল্লিশ লাখ শরণার্থীকে ফেরত পাঠায় এবং পাক-ভারত উত্তেজনা প্রশমন করে।

১৬ জুলাই ১৯৭১
পাকিস্তান প্রসঙ্গে সাপ্তাহিকসমূহ
উইলিয়াম ক্রলী সম্পাদিত

এ সপ্তাহে দ্য নিউ স্টেটম্যান পত্রিকা জনাব রেগ প্রেন্টিসের একটি প্রতিবেদন ছাপে, যিনি চলমান সংকট নিরসনে পাকিস্তান ভারত ভ্রমণকারী চার সদস্য বিশিষ্ট ব্রিটিশ সাংসদীয় প্রতিনিধিদের একজন। জনাব প্রেন্টিস জানান যে, প্রতিনিধিরা রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান কর্তৃক আশ্বস্ত হয়েছিলেন যে তারা যেখানে ইচ্ছে যেতে পারেন, এবং তাদেরকে কোথাও আটকানো হয়নি। অবশ্য তারা কেবল সরকারী পক্ষের মতামতই শুনছিলেন এবং সংবাদদাতারা প্রশ্নের উত্তর দিতে অনিচ্ছুক ছিল। তারা একটা দেশকে আতংকের কবলে থাকার নমুনা দেখেছেন। এমন মনে করার কারণ হলো, জনাব প্রেন্টিস বলেন, অনেক লোক প্রতিনিধিদেরকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কিছু তথ্য দেন। এসব গোপন তথ্য নির্দেশ করে সেনাবাহিনী মার্চ এবং এপ্রিল মাসে ব্যাপক হত্যা- নির্যাতন চালিয়েছে এবং এখনো চালিয়ে যাচ্ছে, লিখেছেন জনাব প্রেন্টিস। দেশের আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ডে ভাটা পড়েছে। বেশিরভাগ শ্রমিক, যারা গ্রামে পালিয়ে গিয়েছিলেন, তারা এখনো শহরে ফিরে আসেন নি।
পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রতিনিধিদের বলা হয়েছিল যে, কোন শরণার্থী ভারতে পালিয়ে যায় নি; কিন্তু তাদের পরিদর্শনের সময় কর্তৃপক্ষ স্বীকার করে যে কিছু শরণার্থী গিয়েছিল। কর্তৃপক্ষ দাবি করে যে শরণার্থীর সংখ্যা সর্বোচ্চ ১২ লাখ, এবং ভারতীয়রা শরণার্থীদেরকে বাড়ী (পূর্ব পাকিস্তানে) ফিরে আসতে বাধা দিচ্ছে। অবশ্য জনাব প্রেন্টিস বলেন যে, প্রতিনিধিদল তথ্যের এই পাকিস্তানী সংস্করণ বিশ্বাস করতে পারেন নি যখন তারা সীমান্তের ভারতীয় অংশে শরণার্থীদের অবস্থা প্রত্যক্ষ করেন। তারা দুই দিন ধরে শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন এবং বিভিন্ন জায়গায় শরণার্থীদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। শরণার্থীরা বলেন যে তারা ফিরে যেতে চান যখন সেটা নিরাপদ হবে। শরণার্থীদের সংস্থান করতে কি বিরাট সমস্যা সেটা জনাব প্রেন্টিস লিখেছেন, এবং প্রশ্ন করেছেন (ভারতীয়) স্থানীয়দের সাথে শরণার্থীদের সাংঘাতিক রেষারেষি শুরু হতে কি দেরি আছে? জনাব প্রেন্টিস বলেন, ভারত পাকিস্তানের মধ্যে আরো বিপর্যয় এড়ানো যাবে শুধুমাত্র পূর্ব বাংলার জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে।

দ্য ইকনোমিস্ট পত্রিকার ভারতীয় প্রতিনিধি পর্যালোচনা করেছেন যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধীর ওপর পূর্ব পাকিস্তান ইস্যুতে তৎপর হতে চাপ বাড়ছে। বাংলাদেশের স্বাখ্যাত নির্বাসিত সরকার অনুযোগ করেছে যে, এটি ভারত থেকে যথেষ্ট অস্ত্র পাচ্ছে না। যেসব ভারতীয় বাংলাদেশের স্বীকৃতি দাবি করছেন তারা গেরিলা যোদ্ধাদের বর্তমান সহায়তার পরিমাণে সন্তুষ্ট নন, জানিয়েছেন ইকনোমিস্টের মুখপাত্র । তিনি বলেন যে, রাজনৈতিক দল্গুলো তাদের বক্তব্য সহনীয় করতে সহযোগিতা করছে, এবং আসামে ছাড়া আর কোথাও কোনো সাম্প্রদায়িক সমস্যা দেখা দেয় নি, কিন্তু তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ার আশংকা রয়েছে। একটা অদ্ভুত কথাও চলছে যে, লাখ লাখ শরণার্থীকে খাওয়ানোর চেয়ে (পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত) যুদ্ধ করলেই অনেক কম খরচে হয়ে যেত! ভারত সরকার যদিও এ আলোচনায় অংশ নেয় নি, তবু মনে হচ্ছে তারা ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না যে কি করা উচিত। দ্য ইকনোমিস্ট মন্তব্য করেছে যে, গেরিলাদের আরো অস্ত্র সাহায্য করলে শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে ভারত যা সুনাম কুড়িয়েছে, তাকে বিপন্ন করবে।

ইন্দো- পাকিস্তান যুদ্ধ সম্পর্কে প্রেস
৫ ডিসেম্বর ১৯৭১
মার্ক টুলী

ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ আজকের সবগুলো পত্রিকায় উঠে এসেছে। সেখানে ঘটনার সর্বশেষ সংবাদ, পর্যালোচনা, প্রতিবেদন এবং সম্পাদকীয় বিদ্যমান। দ্য সানডে টাইমস এর সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, যুদ্ধ কে শুরু করেছে এ নিয়ে তর্ক করে বিশেষ লাভ নেই। পত্রিকাটির আশংকা যে, এ যুদ্ধের সম্ভাব্য ফলাফল হবে বিভেদ, বিশৃঙ্খলা এবং ব্যাপক দুর্ভোগ। সানডে টাইমস সরবোচ্চ আশা করে যে, পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসনের ব্যাপারে শেখ মুজিবের সাথে সমঝোতায় পৌঁছবে, এ পদ্ধতিতে শরণার্থীদের দেশে ফেরার পথ সুগম হবে। এর অর্থ হবে, পত্রিকাটির মতে, যে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানকে রাষ্ট্রপতির পদ অন্য কাউকে হস্তান্তর করে যেতে হবে। কিন্তু প্রথমেই যুদ্ধ বন্ধ হওয়া জরুরী। নিরাপত্তা পরিষদে এ দ্বন্দের বিষয়ে আলোচনা হওয়ার ঘটনাকে দ্য সানডে টাইমস স্বাগত জানিয়েছে।

দ্য অবজারভারের সম্পাদকীয়তে এ যুদ্ধকে ‘সীমাহীন দুঃখজনক’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আরো দুঃখজনক হলো, সারা বিশ্ব এই পাগলামি তৈরি হতে শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছে। অবজারভারের মতে, পাকিস্তান সরকারের সেনাবাহিনী ব্যবহার করে পূর্ব পাকিস্তানে সমাধান খুঁজতে যাবার সময় থেকেই পরিস্থিতি যুদ্ধের দিকে এগিয়ে চলছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনীর খোলাখুলি জড়িয়ে পড়ার পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধ আন্তর্জাতিক যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়।

সবচেয়ে বিচক্ষণ আন্তর্জাতিক লক্ষ্য হবে, অবজারভার জানায়, আলাপালোচনার মাধ্যমে পাকিস্তানের উভয় অর্ধে জাতীয় সৌহার্দ্য পুনরুদ্ধার করা, সেই সাথে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন। যদি তা সম্ভব না হয়, তবে ভারত এবং পাকিস্তানের থেকে স্বাধীন একটি পূর্ব পাকিস্তান হবে দ্বিতীয় সেরা সমাধান। এর দিকে এবং নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধাবসানের বৈঠকের প্রতি ইঙ্গিত করে পত্রিকাটি বলে, আন্তর্জাতিক সমাজের শরণার্থীদেরকে সহায়তা প্রদানের প্রতি আরো বড় অবদান রাখা উচিত।

দ্য সানডে টেলিগ্রাফ-ও মনে করে যে, সংকটের সবচেয়ে সেরা সমাধান হবে রাজনৈতিক আপস যেখানে পূর্ব পাকিস্তান প্রকৃত স্বাধীনতা লাভ করবে, অবশ্য পত্রিকাটি এটাও সন্দেহ প্রকাশ করে যে, বিশ্বের পরাশক্তিরা গোপনে দেশদুটির সাথে যোগাযোগ করে এমন আপস করতে পারবে কি না। যদি কুটনীতি কিছু করতে না পারে, টেলিগ্রাফ মনে করে যে, সেরা সমাধান হবে পূর্বে ভারতের বিজয় এবং গঙ্গা ব-দ্বীপের নতুন যাত্রা। তবে পত্রিকাটি গুরুত্ব আরোপ করে যে, একটি কুটনৈতিক সমাধান হবে অনেক বেশি সন্তোষজনক। যদি পরাশক্তিদ্বয় কোনো কুটনৈতিক সমাধান প্রস্তুত করতে না পারে, টেলিগ্রাফ বিশ্বাস করে যে তাদের উচিত হবে যুদ্ধরত দুই পক্ষের কোনো পক্ষে অস্ত্র সরবরাহ না করা।

জনপ্রিয় অন্যান্য পত্রিকাগুলোর মধ্যে, দ্য সানডে মিরর আক্ষেপ করে যে ধনী দেশগুলো এ দুর্যোগ এড়াতে সামান্যই কাজ করেছে। তবে পত্রিকাটির ভাষ্য মতে, ধনী দেশগুলো ক্ষমতাহীন এবং যুদ্ধ থামাতে অক্ষম। তথাপি, সানডে মিরর আশা করে যে একটি দ্রুত সমাধান পাওয়া যেতে পারে হয় জাতিসংঘ বা চীন যদি পাকিস্তানকে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য চাপ দেয়। দ্য নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড এবং সানডে এক্সপ্রেস উভয়েই মনে করে যে, ব্রিটিশ সরকারের মধ্যস্ততা করার প্রস্তাব দেয়া উচিত কারণ ভারত ও পাকিস্তান দুটোই কমন ওয়েলথভুক্ত দেশ।
অবজারভারে আরো আছে বর্তমান যুদ্ধের পটভূমি সম্পর্কে সিরিল ডান কর্তৃক দীর্ঘ একটি পর্যালোচনা– যিনি পত্রিকাটির ভারত ও পাকিস্তান বিষয়ক প্রধান সংবাদদাতা। ডান-এর দৃষ্টিতে, উপমহাদেশ যখন প্রথমত দুইভাগ হয়েছিল তখনই সমস্যার গোড়াপত্তন হয়।

তবে জনাব ডান মনে করেন, যদি কাশ্মীর পাকিস্তানের অংশে যেত, তাহলে দুই দেশই একসাথে শান্তিতে বসবাস করতে পারতো। তার মতে, পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে ভারত সরকারের বর্ণিত অভিপ্রায়কে কিছুটা সন্দেহের চোখে না দেখা কঠিন। অবশ্য তিনি মানেন যে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের পাকিস্তান ছাড়তে চাইবার পেছনে যথেষ্ট কারণ আছে। ডান আশংকা করেন যে, যদি চলমান লড়াই চলতে থাকে এবং পরিশেষে একটি নতুন মুসলিম রাষ্ট্রের জন্ম হয়, তাহলে হিন্দু শরণার্থীরা আর বাংলাদেশে ফেরত যেতে পারবেন না, এবং বাংলাদেশও বেশিদিন স্বাধীন থাকতে পারবে না।

সানডে টাইমস এ জন গ্রিগ লিখেছেন যে, সবচেয়ে বেশি মনে রাখা প্রয়োজন যে, এ যুদ্ধের পটভূমি হলো ভারতের ওপর শরণার্থীদের বিশাল বোঝা। তিনি বিশ্বাস করেন যে, শরণার্থীদের কারণে আর্থিক ক্ষতি প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করেছে এবং তারা যে সামাজিক উৎকণ্ঠা তৈরি করেছে তাও প্রায় অসহনীয়। গ্রিগ বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে নিয়মিত সৈন্য ব্যবহার করতে মিসেস গান্ধী ছিলেন সবচেয়ে অনিচ্ছুক, এবং তিনি এটা শুধু এ কারনেই করেছেন যে তিনি বুঝে গিয়েছিলেন পরাশক্তিরা রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানকে তার নীতি পরিবর্তন করাতে পারবে না বা করবে না। জন গ্রিগ আরো বলেন যে, মিসেস গান্ধীর এখন ব্রিটেনের সমর্থন প্রাপ্য।

সানডে টাইমস এ অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের আরেকটি দীর্ঘ প্রতিবেদন রয়েছে যিনি খুব সম্প্রতি ভারত পরিদর্শন করে গিয়েছেন। মাসকারেনহাস বিশ্বাস করেন যে, গত আট মাসে হতাশাজনক আন্তর্জাতিক সহায়তা পেয়ে ভারত অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই উপসংহারে পৌঁছেছিল যে, শরণার্থী সমস্যা সমাধানে যুদ্ধের কোনো বিকল্প নেই। তিনি মনে করেন, ভারত বিশেষ করে হতাশ হয়েছিলো মার্কিন সরকারের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানকে চাপ প্রয়োগে ব্যর্থ হওয়ায়। তিনি ভারত সরকারের এক কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দেন, “আমরা আমেরিকায় গিয়াছিলাম সাহায্য চাইতে, আর যা পেলাম তা হলো ধৈর্য এবং ক্ষমার পরামর্শ!” মাসকারেনহাস জানান যে, ভারত সরকার একটি সম্ভাবনার কথা ভেবেছিল যে হিন্দু শরণার্থীদের ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে দেয়া হবে। কিন্তু রাজ্য সরকারসমূহ তাদের গ্রহন করতে ইচ্ছুক ছিলো না, কারণ তারা এ বাড়তি বোঝা নিতে চায় নি ।

মাসকারেনহাস বলেন যে, এখন ভারতের উদ্দেশ্য হলো একটি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা যাতে করে শরণার্থীরা ফিরে যেতে পারেন, এবং পরবর্তীতে পাকিস্তান যাতে আর কখনো ভারতের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে না পারে।

পাল্টা আঘাত হিসেবে পাকিস্তান কেবল আশা করতে পারে পশ্চিমে আরেকটু জায়গা জয় করার। মাসকারেনহাস বলেন যে, যদিও একটা যুদ্ধ শুধু দুই দেশের অর্থনৈতিক সমস্যাই বাড়িয়ে তুলবে, এটা দেখা কঠিন যে আর কোনভাবে ঘটনা এগোতে পারতো, কারণ পাকিস্তান সরকার যে কোনো মুল্যে পূর্ব পাকিস্তান ধরে রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

১২ ডিসেম্বর ১৯৭১
ভারত ও পাকিস্তান প্রসঙ্গে ব্রিটিশ প্রেসের পর্যালোচনা
বেসিল ক্লার্ক

আজ ব্রিটেনে, রবিবারের পত্রিকাগুলো ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধ নিয়ে চারটি সম্পাদকীয় ছাপিয়েছে। সম্পাদকীয় গুলো ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন– সকলেরই জিজ্ঞাসা কি হতে যাচ্ছে। পত্রিকার তিনটি– দ্য সানডে টেলিগ্রাফ, দ্য সানডে টাইমস, এবং দ্য পিপল ভবিষ্যতে বাংলাদেশ কি ভাবে গড়ে উঠবে তাই নিয়ে উৎকণ্ঠিত। আবার দ্য অবজারভার ভবিষ্যত দেখছে সমগ্র অবকাঠামোর ওপর যুদ্ধের প্রভাব, এবং বিশ্বজুড়ে বিদেশী সম্পর্কের প্রেক্ষিতে।

দ্য অবজারভার অনুমান করছে যে, ভারত সেনাদল শীঘ্রই পূর্ব পাকিস্তানে তাদের বিজয় সম্পন্ন করবে, আর এর পর তারা সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার প্রতিষ্ঠা করবে। একমাত্র চীন অথবা (হয়তো) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপই একে প্রতিহত করতে পারে, অবজারভার জানায়, –যদিও তার সম্ভাবনা খুব কম। দ্য অবজারভার লিখেছে, জাতিসংঘের সদস্য অপর একটি দেশের রাজ্যকে বিচ্ছিন্ন করতে ভারতের পদক্ষেপ যতটাই নীতি বহির্ভূত হোক না কেন, এটা মানতেই হবে যে, যেকোনো শান্তিপ্রসূ সমাধানের সূচনা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণই নিরূপণ করবে। এটা, পত্রিকাটি বলেছে, হয়তো স্বল্প মেয়াদে পরিস্থিতি ঠান্ডা করবে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের জন্য এর পরিণতি হবে সূদুর প্রসারী। এর মধ্যে প্রধান তিনটি ফলাফল হলো; প্রথমতঃ এ যুদ্ধ দেখিয়েছে পরাশক্তিদের যেকোনো ঘটনা প্রভাবিত করার ক্ষমতা কতটা সীমিত। প্রকৃতপক্ষে, এ যুদ্ধ তুলে ধরেছে যে এশিয়াতে রাশিয়া চীন দ্বন্দ্ব সত্তরের দশকের মতো নতুন শীতল যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। দ্বিতিয়তঃ ইসরায়েলের মতো ভারতও দেখিয়েছে যে মধ্যশক্তি অথবা ক্ষুদ্র শক্তির দেশও সফলভাবে লড়াই জয় করতে পারে, যদি না পরাশক্তিরা হস্তক্ষেপ করে। পরিশেষে, দ্য অবজারভার যুদ্ধের কারণে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেকার সম্পর্কের প্রতি আলোকপাত করেছে।

বাকি তিনটি সম্পাদকীয় বাংলাদেশের কি হবে সেটা নিয়ে উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশ কি ভারতের একটি পুতুল রাজ্যে পরিনত হবে? প্রশ্ন সানডে টাইমস এর। কতদিন পর্যন্ত ভারতীয় সেনাদের সেখানে অবস্থান করতে হবে? কী ধরনের রাজনৈতিক ধারা পুনর্গঠিত হবে? দ্য সানডে টাইমস মনে করে যে, (বাংলাদেশকে) ব্রিটেনের স্বীকৃতি প্রদানের সম্ভাবনা তৈরি হবার পূর্বেই এ সকল প্রশ্নের উত্তর বাঞ্ছনীয়। তবে এ প্রশ্নগুলোর উত্তর নতুন সমস্যার উদ্রেক করবে বলে জানিয়েছে সানডে টাইমস। যেমন, যদি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ‘জনগণের সিদ্ধান্ত’ চূড়ান্ত হয়, তবে কাশ্মিরের ক্ষেত্রেও তাই প্রযোজ্য। পরিস্থিতির ভয়াবহতার ফলে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, এবং চীনের মধ্যেকার সম্পর্কে কি প্রভাব পড়বে তাও সানডে টাইমস গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে। পত্রিকাটির ভাষ্যমতে, যদিও পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছেদ ভৌগোলিকভাবে যৌক্তিক, এটি স্থিতিশীল কোনো ঘটনা নয় যেহেতু বিজয় কেবল ভারতেরই নয় বরং রাশিয়ারও। এর অর্থ দাঁড়ায় চীন আগের চেয়েও বাংলাদেশের ভবিষ্যতের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে। তদুপরি, মার্কিনীরা এই এলাকায় তাদের প্রভাব টিকিয়ে রাখতে নিজের পাকিস্তানপন্থী অবস্থান (যেমনটা পত্রিকায় আখ্যা দেয়া হয়) থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য অধীর হয়ে উঠবে। সানডে টাইমস ইতি টানে এই বলে যে, যদিওবা পরাশক্তিরা যুদ্ধের ময়দান থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছিলো, এ যুদ্ধের কারণে সুয়েজ এবং সাইগোন-এর মধ্যে একটি চরম সংবেদনশীল অঞ্চল উন্মোচিত হয়েছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৮২-b. বিশৃঙ্খলার আবর্তে সিডনি ও মর্নিং হেরাল্ড ২৯ মার্চ, ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৮২-b, ৫৬১>

সিডনি ও মর্নিং হেরাল্ড, ২৯ মার্চ, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
বিশৃঙ্খলার আবর্তে

পূর্ব পাকিস্তানে কি ঘটছে তা জানা অসম্ভব। রেডিও পাকিস্তান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্ব অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। শেখ মুজিবুর রহমানকে “বিশ্বাসঘাতক” হিসেবে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং ভারতীয়দের প্রতিবেদন অনুযায়ী সেখানে জীবন স্বাভাবিকের দিকে ফিরে আসছে। শেখ মুজিবুর মুক্ত, ১৬ হাজার শক্তিশালী পূর্ব পাকিস্তানী (বাংলা) রাইফেল এবং পুলিশ জেনারেল টিক্কা খানের সেনাদের প্রতিরোধ করছে এবং দুই দিনের গৃহযুদ্ধে ইতিমধ্যে প্রচুর বেসামরিক লোক মারা গেছে (১০০০০ / ১০০০০০?)। যা স্পষ্ট তা হল যে, বিশ্ব জানছে পাকিস্তানে শান্তি আসতে একটি অলৌকিক রাজনৈতিক ঘটনার প্রয়োজন হবে।

এমন অলৌকিক ঘটনা বিশ্বাসযোগ্য নয়। রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া, ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তাক্ত অধ্যায়, আয়ারল্যান্ডে ব্রিটিশদের মত, আলজেরিয়ায় ফরাসিদের মত এবং আরো অনেক কিছুর মত, সশস্ত্র বাহিনী দিয়ে সংহতি পুনঃস্থাপন করার চেষ্টা করছে। তার ফলাফল এত দুঃখজনক হত না যদি তার ধারাবাহিকতা এমন না হত। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানী সংখ্যালঘুদের দিয়ে কৃত্রিম পাকিস্তানকে অনুগত করার চেষ্টা করেছেন, তিনি আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করেছেন ৭৫ মিলিয়ন বাঙালির উপর যারা ইতিমধ্যেই গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিপুল ভোটের মাধ্যমে দেখিয়েছে যে তাদের আনুগত্য শেখ মুজিবের উপর এবং তারা তাদের স্বায়ত্তশাসিত পূর্ব পাকিস্তানের জন্য দাবি করেছে। শেখ মুজিবুর রহমান যিনি এসেম্বলিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়েছেন তিনি পূর্ব পাকিস্তানে তার নিজের বেসামরিক সরকার গঠন করেছেন। এটি করেছেন মার্শাল ল ঘোষণার পরে। রাষ্ট্রপতির সাথে তার আলোচনা ভেঙে যাওয়ার পরেই তিনি স্বাধীনতার আহ্বান জানান। তিনি ভাঙ্গনের জন্য প্রেসিডেন্টকে দায়ী করেছেন। তিনি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ফলাফলকে সংখ্যালঘু পশ্চিমাদের করালে রাখার বিরোধিতা করেছেন।

পূর্ব পাকিস্তানের শহরগুলিতে অস্থায়ী বিজয় অর্জনের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পাওয়ার-ট্যাংক, আর্টিলারি এবং প্লেন আছে। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে, তার বাহিনী বেইস থেকে ১০০০ মাইল দূরে গেরিলা যুদ্ধ কিভাবে থামাবে- যা বাঙালি জাতীয়তাবাদ দ্বারা অনুপ্রাণিত – যা পূর্বাঞ্চলের দুর্গম গ্রামাঞ্চলে অনির্দিষ্টকালের জন্য চলতে থাকবে। মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভারতের অবস্থান স্পষ্ট নয় যেখানে তারাও পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর দখলের মত পশ্চিমবঙ্গে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির আশঙ্কায় ভুগবে। এমনকি ব্রিটেনও, বায়াফ্রান সংখ্যালঘুদের সাথে যুদ্ধের স্মৃতি মনে করে যুদ্ধ থেকে এতে জড়িত হওয়া থেকে বিরত থাকবে – যদিও সে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়ার দ্বিতীয় চিন্তাধারা দীর্ঘমেয়াদি ট্র্যাজেডি প্রতিরোধ করতে পারে। এবং তিনি সম্ভবত বিশৃঙ্খলার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৮৩-b। দুর্যোগের আবর্তে পাকিস্তান দি এজ ২৯ মার্চ ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৮৩-b ৫৬২>

দি এজ, ক্যানবেরা, ২৯ মার্চ, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
পাকিস্তান ট্রাজেডি

পাকিস্তানের সাংবিধানিক সংকটের একদিন আগে গৃহযুদ্ধ শুরু হল। সেখানে ছিল আশা যা তিক্তভাবে বিভক্ত হল। শান্তিপূর্ন রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে দুই জাতি একত্রে অবস্থান করতে পারত। এবং সম্ভবত খুব দ্রুত বেসামরিক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যাবস্থায় ফিরে আসতে পারত। কিন্তু সে আশা গত কয়েক দিনের ট্র্যাজিক ঘটনায় শেষ হয়ে গেছে। পূর্ব পাকিস্তানে হিংস্রভাবে আন্দোলনের মূল কারণ স্পষ্ট নয়। কঠোর সামরিক শাসন ও বিদেশি প্রতিনিধিদের সেখান থেকে বিতাড়নের ফলে সত্যটা ঢাকা পরে আছে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সম্ভবত জনপ্রিয় বাঙালি নেতা শেখ মুজিবুর রহমান – যিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাদের নির্মম শোষণের ফলে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের দাবি করেছিলেন – তার প্রধান দাবিগুলো মেনে নিতে চেয়েছিলেন।

একটি আপস নিষ্পত্তির প্রক্রিয়ায় যখন সবাই আশান্বিত ছিল ঠিক তখনি সেটা পুরো উল্টো দিকে মোড় নিল। যেমন কথা ছিল যে সেনারা ব্যারাকে ফিরে যাবে ও মার্শাল ল তুলে নেয়া হবে – তেমনটি না করে পূর্ব পাকিস্তানে ভয়াবহ দমন নীতি অবলম্বন করা হল এবং শেখ মুজিবের দল আওয়ামীলিগকে অবৈধ ঘোষণা করা হল। শেখ একটি গোপন বেতার কেন্দ্র থেকে তার অঞ্চলের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। বাঙালির দির্ঘদিনের আশা প্রকাশিত হল। শেখ সামরিক বাহিনীর মুখোমুখি হবার জন্য যে কারো থেকে দক্ষ – তবে এটা হতাশার ব্যাপার হতে পারে। তবে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়ার কাছে এটা স্পষ্টতই দেশদ্রোহিতা এবং তিনি মনে করেন বিদ্রোহী বাঙালিকে বর্বর রক্তপাতের মাধ্যমে তা পরিশোধ করতে হবে।

এমনকি রিপোর্ট যদি সত্য হয় যে সেনাবাহিনী বিদ্রোহকে চূর্ণবিচূর্ণ করতে চেষ্টা করছে – তবুই একটি শক্তিশালী যুক্ত দেশ হিসেবে পাকিস্তানকে একত্রিত রাখার জন্য রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়ার যে লক্ষ্য সে আশা বাস্তবতা থেকে অতি দূর। তাঁর সৈন্যরা হয়ত পূর্ব পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় শাসনের জন্য একটি সাময়িক সামঞ্জস্য পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হতে পারে। তারা হয়ত আওয়ামী লীগকে দমন করতে সক্ষম হতে পারে, যে দলটি শুধুমাত্র পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অসাধারণ সমর্থন নয় বরং পরবর্তীতে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে একটি পূর্ণাঙ্গ সংখ্যাগরিষ্ঠতাও অএয়েছে – যারা প্রথম বারের মত ইলেক্টোরাল সুবিধা পেয়েছে যা পশ্চিম পাকিস্তানী সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তির মত নয়।

কিন্তু একটি জাতি যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ ও নিরস্ত্র মানুষ তারা অনির্দিস্টকালের জন্য একটি সামরিক দমন দ্বারা শোষিত হতে পারেনা। বর্তমানে নিদ্যমান জাতিগত, সংস্কৃতি, ভাষা এবং ভৌগলিক পার্থক্য শুধুমাত্র ঘৃণা এবং অস্থিরতা বৃদ্ধি করবে। যদি গত কয়েকদিনের ঘটনাবলি ন্যায় ও শান্তির প্রচেষ্টাকে শেষ করে না দ্বিত্ব – ইয়াহিয়া যদি ফেডারেল ব্যাবস্থা গঠনের জন্য যে প্রস্তাব তা মেনে নেবার মত জ্ঞ্যান দেখাতেন – তাতে করে পূর্ব পাকিস্তান নিজেদের শাসন করার জন্য একটি ন্যায্য পথে খুঁজে পেত এবং এতে পাকিস্তান সম্পূর্ন বিভক্ত হত না। কিন্তু সবার আগে হত্যাকাণ্ড অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৮৪-b। পূর্ব পাকিস্তান নিউ হেরাল্ড ৩০ মার্চ ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৮৪-b, ৫৬৩>

দ্যা নিউ হেরাল্ড, কাঠমন্ডূ, ৩০ মার্চ, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
পূর্ব পাকিস্তান

আমরা আশা করি আমাদের পাকিস্তানি বন্ধুরা এখন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের সাথে চলমান যুদ্ধের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশের বিষয়টি উপলব্ধি করবে। প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগের অনুসারীদের বিরুদ্ধে – যা কেবল মানবতার অনুভূতি থেকে ‘বাংলাদেশ’এর মানুষদের প্রতিনিধিত্ব করে – তাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বারা পরিচালিত সামরিক অভিযানের ব্যাপারে এই উদ্বেগ। এটা অনস্বীকার্য যে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনা কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের উপর সঙ্ঘটিত নিষ্ঠুরতা সমগ্র বিশ্বকে আন্দোলিত করেছে। সত্যিকার অর্থে – পুর্ব বা পশ্চিমের যত দেশ আছে – সেখানকার কোন মানুষই পূর্ব বাংলার মানুষের আশাআকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন না করে পারবেনা।

পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্ব পাকিস্তানের অসহায় মানুষের বিরুদ্ধে – যারা স্বাধীনতা ছাড়া কিছুই চায়নি – তাদের বিরুদ্ধে নির্দয় সেনাবাহিনী লেলিয়ে দেয়। এতে করে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান একত্রে থাকার শেষ আশাটুকুও শেষ হয়ে যায়। সাংবিধানিক সংকট মোকাবিলা করতে যেয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের জন্য অবর্ননীয় বিপদ সৃষ্টি করেন। যার থেকে তিনি সম্ভবত কখনো বেরিয়ে আসতে পারবেন না। পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার লক্ষ্যে সেখানকার স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের বিরুদ্ধে তার নেয়া রক্তক্ষয়ী সেনা ব্যাবস্থা এযাবৎ কালে তার নেয়া সিদ্ধান্তসমূহের মধ্যে সবচেয়ে ভুল বলে প্রতীয়মান হয়।

পাকিস্তানি সামরিক শাসন দ্বারা আরোপিত কঠোর সামরিক সেন্সরশিপের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য জানা কঠিন। কিন্তু এক টি জিনিস স্পষ্ট। পূর্ব পাকিস্তানিরা, যারা সংখ্যায় বেশি এবং নিরস্ত্র – তারা কঠোর সামরিক শাসকদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে। এটাও স্পষ্ট যে স্বাধীনতার জন্য তাদের হাজার হাজার মানুষ তাদের জীবন উৎসর্গ করছে।

পশ্চিম পাকিস্তানিরা যত দ্রুত উপলব্ধি করবেন যে পূর্ব পাকিস্তানিদের উপর তাদের কর্তৃত্ব বেশিদিন স্থায়ী হবে না তা তাদের জন্য মঙ্গলজনক। তারা সকল মিলিটারি অপারেশন বন্ধ করে – বর্তমান সংকটের অবসানের জন্য মুজিবুর রহমানের প্রস্তাব গ্রহণের মাধ্যমে পরিস্থিতি পুনরুদ্ধার করতে পারে। যদিও পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে এটি একটি দুর্বল ফেডারেশন হতে পারে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৮৫-b। বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে পাক বর্বর অভিযানের উপর দুটি সোভিয়েত পত্রিকার মন্তব্য প্রাভদা ও ইউ এস এস আর ২ এপ্রিল ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৮৫-b, ৫৬৪>

কমসমল্যা প্রাভদা, মস্কো, ২ এপ্রিল ১৯৭১
‘’নির্লজ্জ সহিংসতা”

সেনাবাহিনীর এই কাণ্ড নির্লজ্জ স্বেচ্ছাচার ও সহিংসতা ছাড়া কিছুই নয় যা সোভিয়েত নাগরিকদের মধ্যে গুরুতর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে তা অবশ্যই রাজনৈতিক উপায়ে সমাধান করতে হবে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রেস, টি আর ইউ ডি , ২ এপ্রিল ১৯৭১
পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর পদক্ষেপ

জানা যায় যে, পশ্চিম পাকিস্তানী সেনারা শহর ও অন্যান্য জনবহুল এলাকায় নিষ্ঠুর বোমা হামলা চালিয়েছে। অনেক জায়গায় সেনাবাহীনি এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে ভারী যুদ্ধ হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে ট্যাংক এবং অন্যান্য ভারী অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। সংবাদ সংস্থা Kiodo Tsusin রিপোর্ট করেছে যে ২৯ মার্চ সন্ধ্যায় (৩০ মার্চ রিপোর্ট হয়েছে) চট্টগ্রাম বন্দরে থাকা জাপানি জাহাজের ক্রুরা অনেক লাশ’ বন্দরের জলসীমায় ভেসে থাকতে দেখে। পিটিআই সংবাদ সংস্থা স্বাধীন বাংলা বেতার মাধ্যমের বরাত দিয়ে জানায় ২৫ মার্চ থেকে ২ দিনে সেনাবাহিনী প্রায় ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে।

পূর্ব পাকিস্তানের রক্তাক্ত সংঘর্ষের যে বিবরণ সংবাদ সংস্থাগুলো দিচ্ছে তাতে বিশ্বের প্রগতিশীল এবং গণতান্ত্রিক দেশগুলো উদ্বিগ্ন।

সোভিয়েত ইউনিয়নের মানুষ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে গৃহীত নিষ্ঠুর পদক্ষেপে গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের মানুষ আশা করে পাকিস্তান তার জনগণের স্বার্থ রাজনৈতিক উপায়ে সমাধান করবে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৮৬-b। পাক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের উপর চিলি, তুরস্ক এবং অস্ট্রীয় পত্রিকার মন্তব্য এল মার্কুরিয়, আক্সাম সজলবার্গার নাকরিকটেন ৭ এপ্রিল ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৮৬-b, ৫৬৫>

এল মার্কুরিয়, চিলিয়ান ডেইলি

মাই লাইতে শত শত মৃত্যু সমস্ত বিশ্বকে নাড়ীয়ে তুলেছিল এবং যুক্তরাষ্ট্রে একটি অভ্যন্তরীণ সংকট সৃষ্ট হয়েছিল সেটা নিয়ে কারণ সেখানে এই ঘটনা প্রেসে প্রকাশ ও সম্প্রচার করা হচ্ছিল। ৩ লক্ষ বা ২০,০০০ সংখ্যা যাই হোক না কেন, পূর্ববাংলার শহরগুলোর রাস্তায় যে লাশ পড়ে আছে তা বিশ্বকে তেমন জাগাতে পারেনি কারণ সেগুলোর কোন ভিডিও চিত্রায়িত করা সম্ভব হয়নি।

তুর্কির পত্রিকা আক্সাম

দৃশ্যত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক ঔপনিবেশিক ধরনের। ধর্ম ছাড়া তাদের মধ্যে কোন মিল নাই। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানি উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে মুক্তিসংগ্রাম করছে…

স্যালজ বার্গার নাকরিকটেন (একটি অস্ট্রীয় দৈনিক)

বাংলা প্রজাতন্ত্র টিকুক বা না টিকুক, যদি বাঙ্গালীদের বেয়নেট দিয়ে শেষ করে দেয়া হয় আমরা জানি সেখানকার বেশিরভাগ জনগণ সেটাকে ঘৃণা করবে। বায়াফ্রাতে এবং দক্ষিণ সুদানের সংখ্যাগুরুরা সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করছে। পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তার বিপরীতটা সত্য।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৮৭-b। পরিকল্পিত হত্যা লা মণ্ড ৯ এপ্রিল ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৮৭-b, ৫৬৬>

লা মণ্ড, প্যারিস, এপ্রিল ৯, ১৯৭১
পরিকল্পিত হত্যা

পাকিস্তান পরিষ্কারভাবে একটি গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে যা দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। আপসের চেষ্টা না করে ইয়াহিয়া খান উল্টো জনগণের উপর নিপীড়ন চালাচ্ছেন যা বর্বরতার এক বিস্ময়কর রূপ ধারণ করেছে যা দেখলে যে কেউ বলবেন এটা পূর্বকল্পিত।

কিন্তু ইয়াহিয়া খানের পরিকল্পনা হতাশজনক। এটা ঠিক যে, সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে কিছু স্থিরতা এসেছে কিন্তু তা কতদিন? অন্যান্য এলাকার মত ঢাকাতেও জোরালো আন্দোলন হবে। পারশপরিক বিবাদ আরও বাড়বে। সমস্যার সমাধান আরও দুরহ হয়ে উঠবে। অবস্থা দেখে আরও বেশি গুরুতর মনে হচ্ছে কারণ একজন বিশেষ ব্যক্তি যিনি এই আলোচনার অন্যতম অংশীদার তিনি নিখোঁজ আছেন। তিনি হলেন শেখ মুজিবুর রহমান।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৮৮-b। বাংলায় গণহত্যা এক্সপ্রেশন ১২ এপ্রিল ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৮৮-b, ৫৬৭>

এক্সপ্রেশন, স্টকহোম, ১২ এপ্রিল ১৯৭১
বাংলায় গণহত্যা

পাকিস্তানের সামরিক সরকার একটি ছবি প্রকাশ করেছে যাতে প্রমাণিত হয়েছে মুজিবুর রহমান বন্দী আছেন।

তাকে বন্দী হিসেবে দেখিয়ে তারা পূর্ব পাকিস্তানের মনোবল দুর্বল করতে চাইছে। কিন্তু এই ছবির প্রমাণ যথেষ্ট বিশ্বাসী নয়। কেন এটা এত আগে দেখানো হল? কেন কোন তারিখ দেওয়া হয়নি? কেন তারা মুজিবকে দেখাচ্ছেনা?

এটা সুস্পষ্ট যে ইয়াহিয়া খানের সরকার রহমানকে শহীদ হওয়া থেকে প্রতিরোধ করতে চায়। প্রশ্ন হল, তাতে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থার পরিবর্তন হবে কিনা। রহমান সহ বা রহমান ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ সরে দাঁড়াবে না।

এখন আমরা জানি সামরিক শাসক তথ্যগুলো লুকাতে কি কি করেছেন। শরণার্থীরা পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য দ্বারা ব্যাপক বোমাবাজি, বেপরোয়া ধাওয়া এবং গণহত্যার শিকার হচ্ছেন।

হাজার হাজার মানুষ তাদের ঘর-বাড়ী থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। অনাহারের সম্মুখীন তারা। এটা বোঝানো হচ্ছে যে পাকিস্তানের একতা রক্ষা করতে হবে। সামরিক শাসক সহিংসতা ব্যবহার করে দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অবজ্ঞা করতে চাচ্ছেন। শাসকরা এই নির্বাচনের ফলাফল গেলার জন্য প্রস্তুত ছিল না। তার পরিবর্তে তারা সামরিক শাসন চালাচ্ছে। এটা নিশ্চিত যে এই পদ্ধতি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের পুনর্মিলন করবে না। নির্মমতার ধারাবাহিকতা চলবে অথবা যুদ্ধ শুরু হবে – এই দুটো পথই খোলা আছে।

এই পলিসিকে অবশ্যই নিন্দা করা উচিৎ।

শিরোনাম
সূত্র তারিখ
১৮৯-b। বাংলাদেশের যন্ত্রণা দ্য অস্ট্রেলিয়ান ১৪ এপ্রিল ১৯৭১

Rajvi Bd
<১৪, ১৮৯-b, ৫৬৮-৫৬৯>

“বাংলাদেশের যন্ত্রণা
– মার্টিন উলাকট
– দ্য অস্ট্রেলিয়ানে ১৪ এপ্রিল ১৯৭১ এ প্রকাশিত”

পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাদেশ বিদ্রোহের পরিস্থিতি দিনকে দিন হৃদয়বিদারক ও দুঃখজনক হয়ে উঠছে।
সকল শ্রেণীর মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থনে, নিজেদের স্বাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে এই বিংশ শতাব্দীতে প্রায় অপ্রস্তুত ও ন্যূনতম যোগাড়যন্ত্র ছাড়া এমন ব্যাপক আন্দোলন আর কোনটি হয়নি।

পূর্ব বাংলায় প্রায় ২০০ মাইল যাত্রা শেষে ভারতীয় সীমানা থেকে ৯০ মাইল দূরে, ফরিদপুরে গঙ্গা নদীর তীরে মানুষের এখন মুল চাহিদা হচ্ছে আরও বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই আন্তর্জাতিক সহায়তা। এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বল্পস্থায়ী প্রভাব বলা যায় এটাকে।

পাঁচ ডিভিশনেরও বেশি পাকিস্তানি সেনা এখন তিন দিনের সফরে দ্রুত গতিতে বাংলাদেশের দখলে থাকা শহরগুলো কব্জা করতে এগিয়ে যাচ্ছে। এই তিন দিনের সফরে আমি শহরের ব্যস্ততম এলাকাগুলোতে, প্রশাসনিক কার্যালয়গুলোতে, রাস্তার পাশের ওষুধের দোকানগুলোতে, সেনানিবাসগুলোতে শুধু একটি আকুতিই শুনেছি, “কেন সারা পৃথিবী আমাদের সহায়তা করছে না?”
যশোর ও ফরিদপুরের মাঝে মাগুরায় কর্মরত প্রধান বেসামরিক প্রশাসক, মধ্যবয়সী আইনজীবী নাসির উল ইসলাম স্বাধীনতাকামী মানবতার প্রতি লিখিতভাবে এক উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন, “সভ্যতা ধ্বংসের লীলাখেলায় মত্ত পাঞ্জাবী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়া পুরো বাংলাদেশ ও জাতিকে এই ক্রান্তিকালে সাহায্যের জন্য মানবতার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।” এবং কয়েকশ মানুষের সামনে আমি সেটা আমার ব্যাগে রেখে দিয়েছি।

খাদ্য, জ্বালানীসহ অন্যান্য ব্যাবহারিক পণ্যের পরিমাণে সীমাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহের অবস্থাও জনস্বাস্থ্যের প্রতি আশঙ্কাজনক।

মাগুরায় একটা হাফ কোম্পানির সমতুল্য রাইফেলস আছে। নদী পার হবার সময় প্রতিরক্ষার দায়িত্বে থাকা এক প্রাক্তন পাকিস্তানি বিমানচালক অবশ্য কথা প্রসঙ্গে আমাকে জানালেন যে তাদের কাছে ৪টি লিএনফিল্ড রাইফেল ও দুটি ডামি রাইফেল আছে।

ঝিনাইদহ ও যশোরে সম্ভবত মুক্তিসেনাদের সবচেয়ে বড় দলটি অবস্থান করছে যাদের সংখ্যা কমপক্ষে ৭৫০ জন। এদের মাঝে মাত্র ২০০ জন হচ্ছে ট্রেনিংপ্রাপ্ত ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনা। বাকিরা সাধারণ মুক্তিকামী।
বাংলাদেশের প্রশাসন এখনও বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে যাচ্ছে। ছোট ছোট শহরগুলোতে এখনও দাপ্তরিক কাজ চলছে।

সন্ধ্যায় যাবতীয় অর্থ সঞ্চয় নিষিদ্ধ, সরকারি – বেসরকারি সকল কর্মকর্তা কর্মচারীকে নিজ নিজ কাজে ফিরে যাওয়ার আদেশ এবং সকল ছাত্রকে মিলিটারি ট্রেনিং ও অন্যান্য কাজের জন্য কমান্ড হেডকোয়ার্টারগুলোতে রিপোর্ট করতে বলা শীর্ষক নির্দেশনা এসেছে।

সদলবলে তদারকি করতে আসা ক্যাপ্টেন মাহবুবউদ্দিন আহমেদ ও তার সহযোগীরা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের কথা বলেছেন, “আমাদের স্বাধীনতা অবশ্যই প্রয়োজন, এমনকি সামাজিক স্বাধীনতাও। তবে চীনাদের মত স্বাধীনতা দরকার নেই যেখানে কেউ কথা বলতে পারেনা এবং সবকিছু নিয়ন্ত্রিত।”

নির্মম শারীরিক নির্যাতনের গল্প ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে যার কিছু কিছু সন্দেহাতীতভাবে সত্য। ফরিদপুর জেলা স্পোর্টস ক্লাব, যা কিনা শহরের সেনাসদর দপ্তর হয়ে উঠেছে, সেখানে খুলনা থেকে আগত এক তরুণ ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে জানালেন যে শান্তিপূর্ণ এক আন্দোলনে নির্বিচারে গুলিবর্ষণের একটি ঘটনা তিনি নিজ চোখে দেখেছেন এবং কয়েকজন আর্মি অফিসারের এই ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের কথা তিনি তখনি নিজের জিপ নিয়ে সেনা দপ্তরে গিয়ে কর্নেলকে অবহিত করেছেন। তিনি আরও জানালেন, “কর্নেল আমার অভিযোগকে উড়িয়ে দিয়েছেন এবং বলেছেন যে এরপর গুলি করে যাদের মারা হবে তাদের মধ্যে প্রথম সারিতে থাকব আমি।”

যশোরে মৃত গণনায় ক্যাথলিক মিশনারিদের সংখ্যা মুসলিমদের চেয়ে বেশি হওয়ায় পুনরায় গণনার জন্য এক তরুণকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

কয়েকজন স্থানীয় খ্রিস্টান সহযোগীসহ পাদ্রীকে গুলি করে হত্যার পর এক পাঞ্জাবী ব্রিগেডিয়ারের আগমন ও পুরো ঘটনাকে “দুর্ঘটনা” বলে ক্ষমা প্রার্থনার ব্যাপারটা সেই তরুণ খুব উত্তেজিতভাবে বর্ণনা করেছে। অপর আরেক পাদ্রী অবশ্য এই দুর্ঘটনার ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন এই বলে যে মিশনের ছাদে রেড ক্রসের পতাকা থাকা অবস্থাতেও কিভাবে এই ঘটনা ঘটে?

স্বাধীনতাকামী এলাকার নেতারা পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতির বুনিয়াদ ভেঙ্গে দেয়ার দিকে নিজেদের বাস্তবসম্মত লক্ষ্য স্থির করেছেন।

পাটের জায়গায় ধান বপনের মাধ্যমে খ্যাতি অর্জন করা ফরিদপুরের এক তরুণ হিসাবরক্ষক আমাকে জানালেন, “ওদের অর্থনীতি এভাবে ছয় মাস অথবা এক বছরও থাকতে পারবে না। ওরা ভুলে গেছে যে ইন্দো পাকিস্তান ১৭ দিনের যুদ্ধ অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিয়েছে।”

সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সাথে এক হবার নীতিগত ভুল সিদ্ধান্ত।
মাগুরায় নাসিরুল ইসলাম বলেছেন, “আমি নিজেও ভুল করেছি। আমরা সবাই ভুল করেছি এবং এখন তারই মাশুল দিচ্ছি।”

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৯০। বীরোচিত সংগ্রাম ওয়াং ওয়া ইট পো ১৪ এপ্রিল ১৯৭১

Rajvi Bd
<১৪, ১৯০, ৫৭০>

বীরোচিত সংগ্রাম
ওয়াং ওয়া ইট পো
১৪ এপ্রিল ১৯৭১

গত চার সপ্তাহের গৃহযুদ্ধে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ট্যাংক ও বম্বার প্লেনের সাহায্যে সাধারণ মানুষের ওপর নির্মম গণহত্যা চালিয়ে প্রথম ধাপে জয়লাভ করতে পেরেছে।

শোষণের হাত থেকে বাঁচতে পূর্ব পাকিস্তানের পচাত্তর মিলিয়ন মানুষের এই সংগ্রাম একই সাথে স্বাধীনতা অর্জনের দিকেও ধাবিত হচ্ছে। গণহত্যার মৃত্যুভয় পেছনে ফেলে সমগ্র পূর্ব বাংলার মানুষ আওয়ামী লীগের ছায়াতলে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে নিজেদের সর্বাত্মক ত্যাগ স্বীকার করার মানসিকতা নিয়ে। পাকিস্তানি সেন্সরশিপের কবলে থাকা “সত্য” সংবাদগুলো আমরা প্রত্যাখ্যান করেছি কারণ আমরা নিজেরা ভালো করেই পূর্ব বাংলার এই বীর জাতির বীরোচিত সংগ্রাম অনুভব করতে পারছি।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৯১। এই গণহত্যা বন্ধ কর জাকার্তা টাইমস ১৫ এপ্রিল ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৯১, ৫৭১>

জাকার্তা টাইমস, ১৫ এপ্রিল, ১৯৭১
এই গণহত্যা বন্ধ কর

রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, ছাত্র, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এবং এমনকি নিরস্ত্র বেসামরিক নারী ও শিশুরা পূর্ব পাকিস্তানে নির্মমতার শিকার হচ্ছে। মুসলিম বিশ্ব কি এই কষ্ট দেখে বসে থাকবে? ইসলাম কি সশস্ত্র মুসলমানদের দ্বারা নিরস্ত্র মুসলমানদের হত্যার অনুমোদন করে? ইসলামী নীতি কি সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের তাগিদে সংখ্যাগরিষ্ঠদের দ্বারা সংখ্যালঘু দের উপর অত্যাচারকে ন্যায্যতা দেয়?

মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর দ্রুত এগিয়ে আসা উচিৎ। ভাল মুসলমানরা অন্য মুসলমানদের উপর নির্যাতন চালাতে পারেনা। ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক সংগঠন পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থায় নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকা উচিত হবে না। গণহত্যা যথাসাধ্য বন্ধ করার জন্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের সব ব্যাবস্থা নিতে হবে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলতে পারেন যে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা জাতীয় ব্যাপার কিন্তু যদি পূর্ব পাকিস্তান একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হত – তাহলে সেখানে যা হচ্ছে তাতে কিং বিশ্বের অন্যান্য মুসলমান দেশগুলো উদ্বিগ্ন হতও না?

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৯২। শরনার্থি সমস্যার সমাধান করতেই হবে ব্যাংকক ওয়ার্ড ২৪ এপ্রিল, ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৯২, ৫৭২>

দ্যা ব্যাংকক ওয়ার্ড, ২৪ এপ্রিল, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
শরনার্থি সমস্যার সমাধান করতেই হবে

পূর্ব পাকিস্তানের গুরুতর ঘটনাগুলির রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাবের জটিলতাগুলি উপেক্ষা করা যায় না। সেখানে যে অযৌক্তিক, অমানবিক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তা অবিলম্বে মনোযোগের দাবীদার।

পাকিস্তান থেকে পাঁচশত হাজার শরণার্থী ইতোমধ্যে ভারতে প্রবেশ করেছে এবং এই সমস্যাটি মোকাবেলা করার জন্য দেশটি দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ দেখা যাচ্ছে যে। তবেআন্তর্জাতিক সহায়তা দ্রুতই প্রয়োজন হবে।

ভারত তার সহানুভূতি দেখাচ্ছে কিন্তু ক্রমবর্ধমান খরচ এবং ক্রমবর্ধমানভাবে বাড়তে থাকা শরণার্থীদেরকে পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য শীঘ্রই তা যেকোনো একক ক্ষমতার সামর্থ্যের বাইরে চলে যাবে।

গত বছর যখন বিপুল সংখ্যক পাকিস্তানি নিহত হয়েছিল, তখন জরুরী-ত্রাণ বাহিনী প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল যা দুর্যোগ এলাকা থেকে জীবিতদের সাহায্য করতে পারে।

আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন রেড ক্রস, জাতিসংঘের বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং অন্যান্যরা এই ক্ষেত্রে তাদের প্রচেষ্টার জন্য স্মরণীয় প্রশংসার যোগ্যতা রাখেণ। কিন্তু এটি দেখা যায় যে, তারা যতটা ভালো কাজ করে, সেগুলিও কাজে জড়িত লোকেরা পরিচালনা করতে পারে না।

ভারত এখন যে শরণার্থী সমস্যার মুখোমুখি, তা নিঃসন্দেহে একটি দৃষ্টান্ত হবে। শত শত এবং সম্পূর্ণভাবে অসহায় শরণার্থীদের শত শত হাজার হাজার শরণার্থীকে থাকতে দেয়া , খাওয়ানো এবং চিকিৎসার প্রয়োজন মেটানো একটি ভয়ানক দায়বদ্ধতা। এটি যে কোনও জাতি বা গোষ্ঠীর উপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করবে।

জীবন ধ্বংসের জন্য প্রচুর সম্পদ থাকা সত্ত্বেও, এটি অসম্ভব বলে মনে হয় না যে এটিকে অন্য দিকে পরিচালিত করা যায়। মহাকাশের রহস্যগুলি আবিষ্কারের জন্য প্রচুর পরিমাণে ব্যয় করা হচ্ছে। তবে পেছনে পরে থাকা দুর্ভোগের পেছনেও কিছু ব্যয় করা উচিত।

শরণার্থীদের প্রস্থানের কারণ দূর করা প্রায় অসম্ভব তবে মানবিকতার দিক দিয়ে জরুরি ভিত্তিতে সমস্যাটাকে দেখা উচিত। এটি করা আবশ্যক, এটি দ্রুত সম্পন্ন করা আবশ্যক, এবং এটি কার্যকরভাবে করা আবশ্যক।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৯৩। লাখো গৃহহীন মানুষ অটোয়া সিটিজেন ১০ মে ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৯৩, ৫৭৩>

অটোয়া সিটিজেন, ১০ মে, ১০৭১
সম্পাদকীয়
পূর্ব পাকিস্তান থেকে লাখো উদ্বাস্তু ভারতে

জাতিসংঘের টিম নয়াদিল্লীতে এসেছে পুর্ব পাকিস্তান থেকে শরনার্থিদের হৃদয়স্পর্শী করুন অবস্থা দেখার জন্য যা অদূর ভবিষ্যতে অপ্রতিরোধ্য হয়ে যেতে পারে।

ভারত দাবি করে যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে এখন পর্যন্ত ১৪৮১০০০ জন উদ্বাস্তু প্রবেশ করেছে এবং তারা প্রায় ১৩ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে।

যদি এই তথ্য সঠিক হয় তাহলে ভারতের একার জন্য এটা মারাত্মক বোঝা যেখানে এরা কেউই ভারতের নাগরিক নন। কারণ ভারতের নিজস্ব লক্ষ লক্ষ লোক আছেন যাদের প্রয়োজন মেটাতে তারা হিমশিম খাচ্ছে।

খাদ্য, আশ্রয়, পোশাক ও ওষুধ প্রদানের পাশাপাশি এখন তাদের বড় সমস্যা হচ্ছে এদের ভবিষ্যতের ভার নেয়া। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের অতিরিক্ত জনসংখ্যার উপর এত সংখ্যক উদ্বাস্তুদের ভার সেখানে অস্থিরতা ও সহিংসতা তৈরি করবে।

তাদের নিজের দেশে ফিরে যেতে হবে কিন্তু তার জন্য সেখান থেকে যে ভয়ে তারা এখানে এসেছে সেটা দূর করতে হবে। এখনো তারা নতুন করে সব শুরু করতে পারবে।

সম্ভবত কিছু বিদেশী সহায়তা যা পাকিস্তান এই উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য দাবী করেছে সেগুলো এদিকে আনা প্রয়োজন। সব বিদেশী সহায়তার পিছনে মৌলিক প্রেরণা হচ্ছে সাধারণ মানুষের জন্য উন্নত জীবন নিশ্চিতকরণ।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৯৪। ভয়ংকর অভিজ্ঞতার বর্ননা পালাভার ২০ মে ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৯৪, ৫৭৪>

পালাভার, এ সি সি আর এ , ২০ মে, ১৯৭১
ভয়ংকর অভিজ্ঞতার বর্ননা

বিশ্ব পূর্ব পাকিস্তানের নিষ্ঠুর শাসকদের দ্বারা সেখানকার জনগণের বিরুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যার মর্মভেদী চিত্র পর্যবেক্ষন করেছে। অপরাধের জনগণের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে নির্যাতন করতে থাকা ক্রমাগত অজনপ্রিয় সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে বিশ্বকে এখনি সোচ্চার হওয়া উচিৎ।

কিন্তু আমরা বারবার পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক শাসককে বলেছি যে গণহত্যার জনগণের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা কে দমাতে পারবে না । এমনকি এটা শেষের শুরু নয় – বরং শুরুর শেষ।

পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসক মনে করতে পারে যে তারা বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা দমন করতে সক্ষম হয়েছে কিন্তু আমরা বলতে চাই সময় আসছে – লক্ষ লক্ষ যেসব পূর্ব পাকিস্তানীকে তারা ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেছে সেই রক্তের প্রতিশোধ শুরু হবে।

পালাভার: একটি স্বাধীন সাপ্তাহিক।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৯৫। বিশ্ব কিছুই করছেনা ব্যাংকক পোস্ট ২৪ মে ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৯৫, ৫৭৫>
ব্যাংকক পোস্ট, ২৪ মে ১৯৭১
সম্পাদকীয়
বিশ্ব কিছুই করছেনা

আমরা যদি এমন পরিস্থিতি চিন্তা করি যে ব্যাঙ্কক এবং থানবাসির প্রত্যেক নাগরিকের খাদ্য, বাড়ি, চাকরি, এবং চিকিত্সার সুযোগ নেই, তবে আমরা বুঝতে পারব পূর্ব পাকিস্তানিদের ২.৬ মিলিয়নের অবস্থা কি। সেখানে এই মানুষগুলো নিজের ভিটেয় টিকে থাকতে না পেরে শরনার্থি হয়েছে। এই সংখ্যাটা হল তাদের যারা গত সাত সপ্তাহে দেশের যুদ্ধ এড়িয়ে চলতে ভারতে পারি জমিয়েছে। আরও কত মানুষ ঘর ছাড়া হয়েছে তা অনুমান করা অসম্ভব। অন্যদিকে গত শুক্রবার রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান তার বিবৃতিতে বলেছেন পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা স্বাভাবিকের দিকে ফিরে এসেছে এবং ভারতে অবস্থিত সমস্ত উদ্বাস্তু এখন দেশে ফিরে আসতে পারেন।এটা স্পষ্ট যে বিস্তৃত সাহায্যের জন্য বিশ্ববাসীর জরুরি সাহায্য প্রয়োজন।

শ্রীযুক্ত মহাত্মা গান্ধী গত সপ্তাহে তীব্র অভিযোগ করেছিলেন যে, কোনও সমৃদ্ধ দেশ এই শরণার্থীদের সহায়তায় আসেনি এবং তাদের যত্ন নেয়ার কাজটি বিপজ্জনকভাবে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। ভারত ইতিমধ্যেই সম্পদের সমস্যায় আছে। যদিও তার কথা রাজনৈতিক উপাদান সমৃদ্ধ হতে পারে তথাপি যথেষ্ট যৌক্তিকতা আছে। এই শরণার্থীদের সহায়তার জন্য কোন সুশৃঙ্খল সংগঠন নেই বলে মনে হয়।এটা মনে হয় যে বিশ্ব বিরক্ত হয়ে গেছে, সন্দেহে পরে গেছে এবং ভারত উপমহাদেশের পরিস্থিতিতে হতাশ। তারা কোন কিছু শুনছে না বা সাহায্যে এগিয়ে আসছেনা।

গত বছর যখনভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল তখন পূর্ব পাকিস্তানে তেমন কোনও সহায়তার ব্যবস্থা ছিল না যেমনটা আমরা দেখেছি। তখন বাইরের সাহায্যের চাওয়া হচ্ছিল। কিন্তু এবার কোনও রয়াল মেরিন বঙ্গোপসাগরে আসেনি – কোনও মার্কিন হেলিকপ্টার চাল দিতে মাটিতে নামেনি। পৃথিবী সব সময় পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল এবং বলেছে এবার তাদেরকে নিজেদের সমস্যার সমাধান করতে দিন। কিন্তু আমরা এই ঘটনা চলতে দিতে পারি না।মানবতার নামে, আমরা গৃহ যুদ্ধ শুরু করতে পারিনা। বিশ্ব পূর্ব পাকিস্তানে অনেক ভালো কিছু করতে পারে। গত সপ্তাহে জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্ট শরণার্থীদের সহায়তার জন্য তহবিল গঠনের জন্য একটি আবেদন করেছেন। তার কথাগুলো জরুরি নয় যদিও তিনি বলেছেন যে কত কঠিনভাবে তারা সাহায্য করতে চেষ্টা করছেন। থাইল্যান্ড একটি ধনী দেশ নয় এবং একেবারে দরিদ্রও নয়। অবশ্যই আমরা বল রোলিং করতে শুরু করতে পারি। এবং নিশ্চিতভাবেই আমাদের অনেক চাল অতিরিক্ত আছে। আমরা যদি সত্যিকার অর্থে শান্তি স্থাপন করতে যাই তাহলে সেটাই হবে প্রথম পদক্ষেপ।আমরা যদি সত্যি পৃথিবীতে শান্তি চাই তাহলে ক্ষুধার্তদের খাওয়ানো, অসুস্থদের পরিচর্যা করা এবং পূর্ব পাকিস্তানে গৃহহীনদের বাসস্থান দেয়া থেকেই তা শুরু করতে হবে। যদি আমরা নিজেরা অপরাজনীতির উপরে নির্ভর না করি যা দীর্ঘমেয়াদি আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে এসেছে তবে আমাদের পাকিস্তানের নাগরিকদের জন্য কিছু করতে হবে – সেটি আমাদের নিজেদের জন্যও করা হবে। অন্তত, আমরা চেষ্টা করে দেখতে পারি।
শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৯৬। সাহায্য নিউ হেরাল্ড ২৬ মে ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৯৬, ৫৭৬>

নিউ হেরাল্ড, কাঠমুন্ডু, ২৬ মে ১৯৭১
সম্পাদকীয়
সাহায্য

পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে শরণার্থীদের ব্যাপক অন্তঃপ্রবাহে বোঝা যায় এটি এখন আর পাকিস্তানের নিজস্ব কোন ব্যাপার না – যা সাধারণত তারা ও তাদের সহযোগীরা এতদিন বলে এসেছে। এতে প্রমাণিত হয় পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ, ১৯৭১ থেকে সেখানে কি ভয়ানক সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। সন্ত্রাস এখনো চলছে যার ফলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতের পূর্ব দিকের রাজ্যগুলোতে বাঙালিদের প্রবেশ অব্যাহত আছে। উদ্বাস্তুদের সংখ্যা ইতিমধ্যে প্রায় ৩.৫ মিলিয়নে পৌঁছেছে। ভারত স্বাভাবিকভাবেই গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এতে ভারতের সম্পদের উপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই ভারত পূর্ব পাকিস্তানের কারণে তাদের উপর যে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে সেঁতা বিশ্ববাসীকে জানানোর চেষ্টা করছে। নিজেদের অর্থনৈতিক দুরবস্থার উপর দাঁড়িয়ে ভারতের পক্ষে শরনার্থিদের অনির্দিষ্টকালের জন্য খাওয়ানো সম্ভব না। বিশ্ব জনমত এখন ধীরে ধীরে ভারতের পক্ষে যাচ্ছে। জাতিসঙ্ঘ ও বিশ্বশক্তিগুলো ধীরে ধীরে ভারত সরকারের ত্রাণ প্রচেষ্টায় সহায়তা করার জন্য এগিয়ে আসছে।

ভারতকে শরণার্থীদের ত্রাণ দেবার জন্য আন্তর্জাতিক সকল দেশকে দ্রুত এগিয়ে আসা উচিৎ। দেশের সচেতন মানুষও এটা বুঝতে পেরেছেন বলে মনে হয়। আমরাও আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ যা করা সম্ভব সেটা করব।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৯৭। জাতিসঙ্ঘের প্রতি চ্যালেঞ্জ দি এজ ২৫ মে ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৯৭, ৫৭৭>

দি এজ, ক্যানবেরা, ২৬ মে ১৯৭১
সম্পাদকীয়
জাতিসঙ্ঘের প্রতি চ্যালেঞ্জ

পূর্ব পাকিস্তানি ট্র্যাজেডির পূর্ণ মাত্রার প্রমাণ পাওয়া যায় ভারত সীমান্ত জুড়ে বসবাসরত অসহায় উদ্বাস্তুদের বিশাল পরিমাণ দেখে এবং তাদের অব্যাহত প্রবাহের মাধ্যমে। প্রধানমন্ত্রী (শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী) অনুমান করেছেন যে পশ্চিমবঙ্গে তাদের সংখ্যা এখন ৩৫০০০০০ জন যা প্রতিদিন ৬০,০০০ জন করে বাড়ছে। অনেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বারা বিদ্রোহ দমন এবং নির্মম অভিযানের মধ্য দিয়ে সঙ্ঘটি ক্রমাগতভাবে হত্যার ব্যাপারে জানিয়েছেন। যদি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হত- যেমনটি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলছেন – তাহলে সমস্ত বিষয় সপ্তাহ খানেক আগে থেকেই থেমে যেত। কিন্তু আসলে তা নয়।

নিরাপত্তার জন্য এত প্রচুর মানুষের চলে যাওয়া একটি বড় সমস্যার সৃষ্টি করেছে। প্যালেস্টিনিয়ান শরনার্থিদের চাইতে এদের পরিণতি আরও নিষ্ঠুর। ভারত হঠাত করেই এত বিপুল মানুষকে খাদ্য, বাহন ও স্বাস্থ্য সহায়তা দেবার জন্য বাধ্য হচ্ছে যাদের সংখ্যা ভিটোরিয়ার জনসংখ্যার চাইতেও বেশি। এর ফলে তারা অপ্রত্যাশিতভাবে বড় রকমের অর্থনৈতিক ধ্বসের সম্মুখীন হবে। জাতিসঙ্ঘের সভাপতি ু থান্ট প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে বলেছেন তার মজুদকরা খাদ্য বণ্টন করার ব্যাপারে। তিনি একটি আংশিক এম্নেস্টি প্রদান করেছেন শরনার্থিদের ফিরে আসার ব্যাপারে – কিন্তু এতে কোন লাভ হবেনা যতক্ষণ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয়।

আসন্ন উত্তর গ্রীষ্মে ভারতকে এটি তেমন কোন সয়াহয়া করবে না। পশ্চিমবঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রের সংঘর্ষের মত পরিবেশ সৃষ্টির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সাহায্যের প্রয়োজন। লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের মধ্যে দুর্ভিক্ষ ও মহামারী সৃষ্টি ঠেকাতে তাত্ক্ষণিকভাবে সাহায্য প্রয়োজন। মিসেস গান্ধী প্রভাবশালী বিশ্বশক্তিগুলোকে রাজনৈতিক ভাষায় চাপ সৃষ্টি করার জন্য বলেছেন – তিনি উদ্বিগ্ন যে তাদের উচিত পাকিস্তান সরকারকে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা স্বাভাবিক করার জন্য চাপ দেয়া। এতে করে জনগণের আন্দোলন থেমে যাবে। কিন্তু এই সময়ে জাতিসঙ্ঘ ইউএনএইচসিআর (উদ্বাস্তুদের সাথে সম্পর্কযুক্ত) এবং ইউনিসেফ (শিশু তহবিল) এই সংস্থার মাধ্যমে ভারতকে তার ভয়ঙ্কর নতুন সমস্যা মোকাবেলা করতে সাহায্য করা উচিত। যদি তারা বিশ্বের বিবেকের প্রতিনিধিত্ব করে তবে তাদের এটা প্রমাণ করার জন্য এটি একটি চ্যালেঞ্জ।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৯৮। একটি মানবিক দৃষ্টিকোণ দি কমনার ১ জুন ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ১৯৮, ৫৭৮>

দি কমনার, কাঠমন্ডূ, ১ জুন ১৯৭১
সম্পাদকীয়
একটি মানবিক দৃষ্টিকোণ

এটি কোনও লঙ্ঘন বা নেতিবাচকতা বা নিরপেক্ষতা এবং অ-বিন্যাসের সাথে জড়িত নয়। যখন মানুষের প্রয়োজন হবে, যেমন যারা গত কয়েক সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে পালিয়ে গেছে আমাদের অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে তাদের সাহায্য করার ব্যাপারে।

প্রেস রিপোর্ট বলেছে, পূর্ব পাকিস্তান থেকে লাখ লাখ লোক ভারতে এসেছে। পেছনে তাদের সম্পত্তি ফেলে রেখে এসেছে। তারা ভারত-পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত বরাবর বিভিন্ন পয়েন্টে উদ্বাস্তু শিবিরে অবস্থান করছে। স্বাভাবিকভাবেই এটি তাদের জন্য একটি সুখী জীবিকা নয়। সম্প্রতি, সংবাদ প্রতিবেদনগুলিতে দেখা যাচ্ছে যে বিভিন্ন ধরনের ক্যাম্পে নানা রোগ যেমন কলেরা, এবং গ্যাস্ট্রো-এন্টারটাইসিস শুরু হয়েছে। তাদের জীবন অনেক কষ্টের সম্মুখীন। এই ধরনের ঘটনা অস্বাভাবিক নয় যখন মানুষের এই ধরনের ব্যাপক প্রবাহ ঘটে। এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে ভারত যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। কিন্তু এই বোঝা শুধুমাত্র ভারতের কাঁধে প্রত্যাশা করা যাবে না। এই শরণার্থী কেবল ভারতের দায়িত্ব নয়। তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে এবং যে কোনও সাহায্য দিয়ে এইসব লোককে সাহায্য করতে হবে।

এই বিষয়ে ইসলামাবাদের অনুভূতি পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা সম্পর্কিত। তবে আজ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের অবস্থা যাই হোক একথা বলা যায় না যে উদ্বাস্তুদের এই আগমন ভারতের উৎসাহে হয়েছে। এটা বোধগম্য নয় যে শুধু সুধু কেন ভারত বা কোন রাষ্ট্র স্বেচ্ছায় এত বড় বোঝাকে আমন্ত্রণ জানাবে। অনুরূপভাবে, এটি খুব স্পষ্ট যে, যখন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে পালিয়ে যেতে হবে তখন যাবার মত একমাত্র স্থান ছিল ভারত। ভৌগলিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে, যা বিতর্ক ও রাজনীতির দ্বারা মুছে ফেলা যাবে না। তাই উদ্বাস্তু বোঝার জন্য ভারতকে দোষারোপ করা যায় না। এই বোঝা এভাবে কেউ সহ্য করতে পারেনা। যদিও এটা সুস্পষ্ট যে তার ইসলামাবাদের জন্য কোন সহানুভূতি নেই। তার উদ্বেগ প্রকাশ হচ্ছে। এই মুহুর্তে উদ্বাস্তুদের জন্য বিশ্বের কাছে সাহায্য চাইতে শুরু করেছে। কিন্তু যদি তার সমস্যা আরও জটিলতার দিকে না চলে, তবে এটাও দেখতে হবে, এমনকি পাকিস্তানের স্বার্থেও, যে এই লক্ষ লক্ষ লোককে তারা যেখান থেকে এসেছিল সেখানে কিভাবে ফিরিয়ে নেয়া যায়। কিভাবে উদ্বাস্তু সমস্যা বিশ্বের বিভিন্ন অংশে বসতি এবং শান্তি ব্যাহত করছে সেদিকে আমাদের নির্দেশ করতে হবে না।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৯৯। বাংলায় পীড়ন ও প্রতিক্রিয়া সানডে অস্ট্রেলিয়ান ৬ জুন, ১৯৭১

Sajib Barman
<১৪, ১৯৯, ৫৭৯-৫৮০>

দ্য সানডে অস্ট্রেলিয়ান, ৬ জুন, ১৯৭১ সম্পাদকীয়
বাংলা
পীড়ন ও প্রতিক্রিয়া

পশ্চিম বাংলায় আমরা আজ যে মানবিক বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করছি তার সমকক্ষ বিংশ শতাব্দীর ভয়ালতম ইতিহাসেও খুব একটা নেই। এই ধংসযজ্ঞের বৃহৎ ব্যপকতা এবং অনন্য মর্ম বিদীর্ণ করা ভোগান্তির সমকক্ষ কিছুই নেই যা এই মুহুর্তে পুর্ব পাকিস্তানের শরনার্থীরা ভোগ করছে। এ পর্যন্ত জানা পরিসংখ্যায় মৃত এবং উদ্বাস্তুদের সংখ্যা খুবই আতঙ্কজনক; আর এর ফলশ্রুতি তার চেয়েও ভয়াবহ। এই ভয়াবহতা আমাদের অনেককেরই ইচ্ছাশক্তিকে অবশ করে দিয়েছে, মনের অনুভূতি বিলোপ করেছে এবং এই সন্ধিক্ষণে সমস্যার অত্যাবশ্যকীয়তা ধরতে পারছি না। মনে করুন, মেলবোর্ন এবং সিডনির সমগ্র জনগোষ্ঠীকে একসাথে তাদের বাড়িঘর থেকে মারমুখী আর্মি মেরে তাড়িয়ে দিল, প্রানভয়ে তারা ক্ষুধার্ত হয়ে বনে আশ্রয় নিল, খাদ্য-পানি এবং আশ্রয়হীন এই মানুষেরা কী নিদারুণ যন্ত্রণায় তাড়িত হবে, যারা খাদ্যাভাব এবং রোগবালাইয়ে মরার জন্য ধাবিত হবে।

পুর্ব পাকিস্তানে ইতিমধ্যে অনেক বেশি বিপর্যয় ঘটেছে। সাম্প্রতিক সময়ে পোল্যান্ড এবং ভিয়েতনামের মতই এটি একটি অন্যতম দুর্ভাগা দেশ। ছয়মাসও হয়নি সাইক্লোনে এদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, হাজার হাজার মানুষ নিহত এবং গৃহহীন হয়েছে। দুই মাস চলছে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিশোধ পরায়ণ আর্মি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উপর নির্মম আক্রমণ চালাচ্ছে এবং হত্যা ও ধংসযজ্ঞ জারি রেখেছে। ইতিহাসে এর চেয়ে নির্মম কৌতুক আর কিছু হতে পারেনা, যেখানে লাখ লাখ দারিদ্র পীড়িত, ভয়ার্ত মানুষ প্রাণ বাচাতে পালিয়ে যাচ্ছে এমন একটি দেশে যে দেশটি নিজেই সমপর্যায়ে দরিদ্র, অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে জর্জরিত, রোগবালাইয়ে বিপর্যস্ত এবং প্রায় একই রকম সমস্যাগ্রস্ত।

এই বিয়োগান্ত পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে বিশ্ব অনেক বেশি দেরি করে ফেলেছে। বিদেশী সরকারগুলোর সাহায্য অত্যন্ত ধীর এবং অপ্রতুল, এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সরকারকে নিন্দা করে এখনো কিছুই বলেনি যারা এমন ভাব করছে যেন শরনার্থী সমস্যাকে ইচ্ছা করে বড় করে প্রচার করা হচ্ছে। রেড ক্রস এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর প্রাথমিক সমীক্ষা অন্তত এটা সন্দেহাতীত ভাবে প্রমান করে যে পশ্চিম বাংলায় অনুপ্রবেশকারী শরনার্থীর সংখ্যা মাত্রাধিক এবং তা ভারত সরকারের উপর অতিরিক্ত বোঝা হয়ে দাড়িয়েছে। তাদেরকে একা করে দেওয়া যায়না। ভারতের হিসার মতে এই পরিমাণ শরনার্থীকে আগামী ছয়মাস বাচিয়ে রাখতে হলে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। এই রকম ব্যয় সাপেক্ষ ভার যা ভারত সরকার স্বেচ্ছায় নিয়েছে তা চালিয়ে গেলে অতি শীঘ্রই পশ্চিম বাংলা সরকারের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে ফেলবে। ইতিমধ্যে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন যে ভারতের হয়ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও শরনার্থীদের প্রত্যাবাসন করতে হতে পারে। সেহেতু সামাজিক অবক্ষয় ও কলেরার মত মহামারি পশ্চিম বাংলায় একটা আলাদা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা সারা ভারতে অস্থিতিশীলতা তৈরি করবে।

এখন পর্যন্ত দুই পাকিস্তানকে শান্ত করে একটা রাজনৈতিক মতানৈক্যে পৌছানোর কোন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। এটা খুবই অসম্ভাবনীয় যে এই পরিস্থিতিতে শরনার্থীরা দেশে ফিরে যেতে চাইবে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত তাদের উপর থেকে হত্যার হুমকি উঠছে এবং কিছুটা রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও স্বায়ত্বশাসন নিশ্চিত হচ্ছে। এর দায়দায়িত্ব পুরোটাই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের। বর্তমান নিদারুণ দুর্ভোগের আর কোন সমাধানই হতে পারে না যতক্ষণ পর্যন্ত না শরনার্থীদের তাদের জঘন্য নোংরা শিবির থেকে সরিয়ে তাদের নিজেদের দেশে অথবা অন্য কোন নিরাপদ জায়গায় নেওয়া হচ্ছে।

কিন্তু এই মুহুর্তে নিতান্ত প্রয়োজন হল পঞ্চাশ লক্ষাধিক মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে বাচানো। অতি অবশ্যই এখানে বহির্বিশ্বের সচেতনতা এবং সাহায্য প্রয়োজন এবং তা থেকে পালিয়ে বাচার কোন উপায় নেই। অস্ট্রেলিয়া ৫ লক্ষ ডলারের সাহায্য ঘোষণা করেছে, যা শরনার্থীদের একদিন খাইয়ে পড়িয়ে বাচিয়ে রাখবে এবং সময় মত টিকা দেবে। এটা যথেষ্ট নয়। আমরা বিশ্বাস করি সরকারের উচিত সম্পুর্ন প্রকারে সাহায্য করা এবং অস্টকেয়ারের আহ্বানে সাড়া দেওয়া যে সংস্থাটি ইতিমধ্যে তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে এই দুর্যোগের ব্যাপারে অস্ট্রেলিয়ানদের সচেতন করেছে। কিন্তু, রিলিফ সাহায্য কে সত্যকার অর্থে কাজে লাগাতে হলে তা পরিকল্পনা করে বৈশ্বিকভাবে এগুতে হবে। এটা অবশ্যই পাকিস্তান সরকারের মধ্য দিয়ে করা যাবে না, যা দিয়ে তারা তাদের আর্মিকে আরো প্রস্তুত করতে পারে এবং তাদের দমননীতি আরো দীর্ঘায়িত করতে পারে। এক সময় এটা জাতিসঙ্ঘ কে দিয়ে করানো যেতে পারে। কিন্তু তারা এ পর্যন্ত অত্যাবশকীয় কিছুই করেনি। জাতিসঙ্ঘের অনুপস্থিতে অস্ট্রেলিয়া সরকার নিজের উদ্যোগেই কাজ করতে পারেঃ ভ্যাক্সিন এই মুহুর্তে অতি প্রয়োজনীয়, খাবার স্যালাইন এবং টিকাদান যন্ত্র খুবই অত্যাবশকীয় শরনার্থীদের কলেরা প্রতিরোধে। এই মুহূর্তে আমরা দূরে বসে আরামে থাকতে পারিনা। অস্ট্রেলিয়ানদের এটা একটা সুযোগ তাদের দয়া এবং সমবেদনা দেখাবার। আমাদের সবকিছু দিয়ে সাহায্য করা উচিত, মনে রাখা দরকার যে আমাদের এমনকি একটি ডলারের বিনা সাহায্য এবং একদিনের দেরি শরনার্থিদের জীবন দিয়ে শোধ করতে হবে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২০০। পূর্ব পাকিস্তানে হত্যা বিউনো এয়ারেস হ্যারাল্ড ৭ জুন ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২০০, ৫৮১>

বিউনো এয়ারেস হ্যারাল্ড ৭ জুন ১৯৭১
সম্পাদকীয়
পূর্ব পাকিস্তানে হত্যা

এই এলাকার লোকজনদের জীবিত রাখতে একটি বিশাল আকারের আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহায়তা অপারেশন দরকার। এটা খুবই খারাপ যে বিশ্বমত পূর্ব পাকিস্তানে হত্যাকাণ্ড থামাতে পারেনি। কিন্তু বিশ্ব অলসভাবে বসে থাকতে পারেনা এবং আরেকটি ট্রাজেডির সুযোগ দিতে পারেনা। মানুষকে জাগরিত করতে পারলে মানুষের দুর্ভোগ প্রশমিত করা সম্ভব। সহানুভূতিকে সাহায্যে পরিণত করা কঠিন নয়। সমস্যা হচ্ছে মানুষকে মানবতার দিকে আগ্রহী করে তোলা।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২০১। পূর্ব বাঙলায় শরনার্থী স্ট্রেইটস টাইমস ৮ জুন ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২০১, ৫৮২>
স্ট্রেইটস টাইমস, মালয়েশিয়া, ৮ জুন ১৯৭১
সম্পাদকীয়
পূর্ব বাঙলায় শরনার্থী

পূর্ব পাকিস্তানি সঙ্কটকে এখন আর আভ্যন্তরীণ বিষয় বলা যাবেনা। চার মিলিয়ন শরণার্থী ভারতে চলে গেছে। অনেক শরণার্থী শিবিরে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে।এখন মৃত্যুর সংখ্যা এখন ৮০০০ এর কাছাকাছি। কলকাতায় মহামারীতে রোগের বিস্তার প্রতিরোধে ভারতীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত বন্ধ করার কথা ভাবছেন। কিন্তু এতে করে শরনার্থি প্রবেশ থামবে না বা কলেরা ছড়ানো থাম্বেনা।

নতুন দিল্লি এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে স্পষ্টভাবে অক্ষম। এবং তারা এটি গোপন করেনি। মিসেস ইন্দিরা গান্ধী তার পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে ছয় দেশে সফরে পাঠান যাদের কাছে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় অসহনীয় সংকট, যা উপমহাদেশের শান্তি বিনষ্ট হবার ব্যাপারগুলো বলবেন। ওয়েস্টার্ন প্রেস এবং ইউরোপের রাজনৈতিক নেতা এবং আমেরিকার নেতাদের ধন্যবাদ – তাদের থেকে সাহায্য পাবার কিছুটা সম্ভবনা আছে। অক্সফাম এন্টীকলেরা ভ্যাকসিন ও ওষুধ সরবরাহ করেছে এবং রয়েল এয়ার ফোর্স দাঁড়িয়ে আছে এই মিশনে উড়ে যাবার জন্য। ওয়াশিংটন যথেষ্ট সহায়তা দিচ্ছে পরিবহন সুবিধা দিচ্ছে যার ফলে সীমান্ত অঞ্চল থেকে শরণার্থীদেরকে ভালো সুবিধা আছে তেমন অঞ্চলে নেয়া হচ্ছে। কিন্তু ভয়াবহ বিপর্যয় রোধে যথেষ্ট সহায়তা কি ভারত ও পাকিস্তানের কাছে পৌঁছাবে? উত্তর আসন্ন বর্ষায় জানা যাবে।

পাকিস্তানও ব্যাপক সাহায্যের জন্য অনুরোধ করেছে কিন্তু আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া সাবধানতা অবলম্বন করছে। গত বছরের ঘূর্ণিঝড়ের পরে পাঠানো সাহায্য পাকিস্তান সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারেনি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে অনুমতি দেওয়ার ব্যাপারে তারা অনিচ্ছা প্রকাশ করেছে এবং এতে অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে। পূর্ববাংলার মানুষ ও সামরিক প্রশাসনের মধ্যকার বিরোধ অনেক গভীরে বিস্তৃত। এটি সহজেই মুছে ফেলা যাবেনা।

অন্ততপক্ষে পাকিস্তান অবাক হয়ে দেখছে। ইউনাইটেড নেশন্স সেক্রেটারি জেনারেলের দু’জন প্রতিনিধি ইউ এন ত্রাণ তহবিল এর কাজ শুরু করার অগ্রগতি দেখার জন্য ঢাকা যান। এখানে সময় জরুর বিষয়। পূর্ব পাকিস্তানের অনেক অংশ নদীর কারণে দুর্গম। সেখানে নৌকা ছাড়া যাওয়া যায়না। চট্টগ্রাম বন্দর এখন কাজ করছে না। এবং ইসলামাবাদের একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় রাজি হওয়া উচিত – অন্যথায় শরনার্থিরা ভারতে যেতেই থাকবে এবং যারা গিয়েছে তারা হয়ত থেকে যাবে।

পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা কেবল তাদের একটি অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। এমনকি বাইরের সহায়তা ছাড়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে না। আরও বিষয় হল, তারা ভারতকেও জড়িয়েছে এবং বিপদ তৈরি করেছে।
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২০২। একটি বিশ্ব সমস্যা স্ট্রেইটস ইকো ১০ জুন ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২০২, ৫৮৩>

স্ট্রেইটস ইকো, মালয়েশিয়া, ১০ জুন ১৯৭১
সম্পাদকীয়
একটি বিশ্ব সমস্যা

বিশ্ব অনেক অপেক্ষা করেছে। এটা সত্য যে সাহায্য দেওয়া হয়েছিল এবং শুরুতে এটি পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একটি নৈতিক অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়েছে যদিও সেখানে মানুষকে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হচ্ছিল। তেমন প্রমাণ চাওয়া হয়নি। রক্তপাত এবং ধ্বংস এত পরিমাণে হয়ে যে এটাকে পগ্রমের (পগ্রম হচ্ছে একটি নির্দিস্ত গ্রুপের উপর ঘটানো পরিকল্পিত ধ্বংসলীলা) সাথে তুলনা করা যেতে পারে।

কিন্তু পাকিস্তানিদের কর্মকান্ডের প্রমাণ পরিলক্ষিত হচ্ছে ভারতে। অনেক আগেই সেই সংখ্যা ১০ মিলিয়নে পৌঁছেছে। তাদের অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে গেছে। তারা পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের শাসনের বিরিধিতা করছিল।

এটা মনে করা কষ্টকর যে এই সব প্রমাণ বিশ্বব্যাপী এবং জাতিসংঘকে ততটা আগ্রহী করেনি যে তারা ইসলামাবাদকে তাদের সন্ত্রাস বন্ধ করতে বলবে এবং একটি বেসামরিক প্রশাসন চালু করতে বলবে। তবে ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও অন্যান্য পশ্চিম পাকিস্তানী নেতারা এসব অগ্রাহ্য করেছে যখন ক্র্যাকডাউন শুরু হয়েছে। সপ্তাহ যেতেই তাদের কাছে পরিষ্কার হল যে তারা কত বর্ব ভুল করেছে। গৃহযুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। জাতি প্রায় ভেঙ্গে পড়েছে। পুনর্নির্মাণের অত্যাশ্চর্য সমস্যাগুলি সামনে রয়েছে। সব শেষে কি পরিণতি অপেক্ষা করছে?

যদি কলেরা মহামারীটি শুরু হয় তবে ভারতের লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর কি হবে?” এটা ভারতর সমস্যা নয়। সীমান্তে সন্ত্রাসবাদের তীব্রতা যা দাঁড়িয়েছে সেই পরিস্থিতি অনুধাবনের বাইরে।

এটি একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও জাতিসংঘকে শরণার্থীদের নিজেদের স্বদেশে পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিতে হবে। অর্থাৎ পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের অবস্থা তৈরি করতে হবে যাতে শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন সম্ভব হয় এবং তাদের ফিরে যেতে তারা সাহায্য করবে।

বলের ব্যবহার পাকিস্তানের জন্য একটি তিক্ত ব্যাপার হয়েছে এবং এটি আরও আগালে জাতীয় বিভেদ সৃষ্টি হতে পারে। এখনও জাতীয় সমঝোতার জন্য একটি সুযোগ রয়েছে। বিশ্বের উচিত পাকিস্তানকে জোর করা।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২০৩। অবর্ননিয় পরিস্থিতি ন্যাশনাল জাইট্যুং ১৩ জুন ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২০৩, ৫৮৪>

ন্যাশনাল জাইট্যুং, বার্নি, ১৩ জুন ১৯৭১
অবর্ননিয় পরিস্থিতি
-হেন্রিখ কুন

গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকায় যা ঘটছে তা সংকীর্ণ অর্থে সিভিল ওয়ার নয় বরং এটি প্রতিহিংসামূলক নিষ্ঠুর এবং রক্তাক্ত খেলা যা পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক চক্রের উস্কানিতে হচ্ছে।

ইসলামাবাদের বারবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে বলে যে পুনরাবৃত্তি করছে – সেই কথা আমাদের নির্ভরযোগ্য সূত্রের সাথে মিলছে না। সেখানকার পরিস্থিতি শোচনীয়। শহর ও গ্রাম ধ্বংস করা হয়েছে এবং সেখানকার অর্থনৈতিক জীবন সম্পূর্ণ স্থবির হয়ে পড়েছে।

ঠিক এই মুহূর্তে বাংলার ট্র্যাজেডি স্ক্যান্ডালে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাশালী বড় দেশগুলোর কেউ বাঙ্গালীদের উপর এই নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে আঙ্গুল উঁচু করছে না।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২০৪। মানবতার ধ্বংসলীলা জাম্বিয়া ডেইলি মেইল ১৪ জুন ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২০৪, ৫৮৫>

জাম্বিয়া ডেইলি মেইল, ১৪ জুন ১৯৭১
মানবতার ধ্বংসলীলা

আমরা মনে করি পুরো বিশ্বকে ট্যাংক, সেল, দুর্ভিক্ষ ও মহামারীতে মানবজীবনের যে ধ্বংসলীলা চলছে তার পাশে দাঁড়ানো। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সরকার জোর করে তার কর্তৃত্ব গ্রহণ মেনে নিতে পূর্ব পাকিস্তানিদের বাধ্য করার চেষ্টা করছে।কয়েক মাস আগে দন্ধ শুরু হবার পর থেকে হাজার হাজার মানুষ বুলেট, অনাহার এবং রোগে মারা যাচ্ছে। সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি এবং কখনোই জানা যাবেনা। পাকিস্তানের সরকারি সেনারা গণহত্যা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ আছে।

প্রতিটি সরকারের বিদ্রোহী দমনের অধিকার আছে। কিন্তু আমরা মনে করি যে, পাকিস্তানের ক্ষেত্রে, প্রাণ ক্ষয় অস্বাভাবিক অনুপাত পৌঁছেছে। এটা মনে হচ্ছে যে এখান ইচ্ছাকৃতভাবে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়েছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২০৫। পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সিডনি মর্নিং হেরাল্ড ১৪ জুন ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২০৫, ৫৮৬>

সিডনি মর্নিং হেরাল্ড, ১৪ জুন ১৯৭১
সম্পাদকীয়
পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ

পশ্চিম পাকিস্তানে শরণার্থীদের ভয়াবহ দুরবস্থ, পূর্ব পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনীর কাজ এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের আলোচনায় আসার সিদ্ধান্ত নষ্ট হওয়ার বিষয়গুলোতে এখন বিশ্ববাসীর মনোযোগ নিবদ্ধ হয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গির কোন বিচ্যুতি হতে পারেনা। তবে আশার বিষয় যে কলেরার প্রাদুর্ভাব কিছুটা কমেছে। উদ্বাস্তুদের সংখ্যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে এবং ভারতে বর্তমানে তাদের প্রায় ছয় মিলিয়ন শরনার্থি আছে এবং বর্ষা মৌসুমের সমস্যার পাশাপাশি অপুষ্টি এবং অন্যান্য রোগবালাই এর চিন্তাও এখন যুক্ত। এটা সাময়িক সমস্যা। এর পরে রয়েছে এদের প্রত্যাবর্তনের সমস্যা। শ্রীযুক্ত রায় শুক্রবার স্পষ্টভাবে বলেন ভারতের জন ইচ্ছা নাই অনন্ত সময়ের জন্য উদ্বাস্তুদের গ্রহণ করার। প্রত্যাবর্তন পাকিস্তানের ভবিষ্যতের অনেক গুরুতর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা উত্থাপন করবে।

ব্যাপক জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ ও বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদীদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকারের জোরদার পদক্ষেপের ফলে সেখানে নানান ক্ষত সৃষ্টি করা হয়েছে, যার ফলে এ অঞ্চল প্রায় মৃত্যুর মুখোমুখি হতে পারে। আর্মি কার্যত প্রশাসনকে ধ্বংস করেছে। তারা আন্দারগ্রাউন্ড সরকারি কর্মকর্তাদের ও নেতাদের হত্যা করছে, বন্দি করছে। গ্রাম বা শহর নির্বিশেষে। তারা এখানকার কৃষি ধ্বংস করেছে যা এখানকার অর্থনিতির প্রধান চালিকাশক্তি। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পাট শিল্প। তা ইতোমধ্যে ভারতের সাথে প্রতিযোগিতার সম্মুখীন ছিল। পাটের বিকল্প সিনথেটিক উপাদান এসে পড়ায় পাট উৎপাদনকারীরা ধান উৎপাদনের দিকে ঝুঁকে পরছেন। কিন্তু রাস্তা ঘাঁট ওঁ ব্রিজ ধ্বংস হবার ফলে মার্কেটিং সুবিধা মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। চা পূর্ব পাকিস্তানের দ্বিতীয় রপ্তানি পণ্য। এটিও অবস্থা বিপন্ন। সর্বোপরি, তিন মাসের মধ্যে দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা রয়েছে। কোন সন্দেহ নেই যে এখন মুসলমানরা সীমান্তে ভারতীয়দের শরণার্থী ক্যাম্পের দিকে অনুসরণ করছে।

পশ্চিম পাকিস্তানের ভবিষ্যৎও হতাশাজনক। এখানে জখমটা আত্মঘাতী। পূর্ব পাকিস্তানের থেকে পাওয়া রপ্তানি আয়ের (যা সমগ্র দেশের বাণিজ্যিক রাজস্বের প্রায় অর্ধেক) ক্ষতি এবং পশ্চিম পাকিস্তানি উত্পাদনে বিঘ্ন ঘটেছে। ইসলামাবাদ এখন বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের সম্মুখীন, সম্ভবত জুলাই এর আগেই। তাছাড়া তাকে পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্যবাহিনীর জন্য ধারাবাহিক খরচ করতে হচ্ছে। তারা মূলত শহর গুলির নিয়ন্ত্রণ করছে কিন্তু গ্রামাঞ্চল তাদের আয়ত্তের বাইরে আছে যেখানে জনসংখ্যার অধিকাংশ লোক বাস করে এবং যেখানে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদ এর শিকড় আছে।

অন্য কথায় বলা যায়, রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া তার রাজনৈতিক সমস্যাগুলি সামরিক শক্তির মাধ্যমে সমাধান করতে চেয়েছেন যা একটি বাহিনীর অপব্যবহার ছাড়া কিছুই নয়। বাইরের দেশের কাছে আর্থিক সহায়তার জন্য তাকে চাইতে হচ্ছে যা তার সাথে তাদের সম্পর্ক নষ্ট করছে – বিশেষ করে আমেরিকা – যারা সাহায্য দিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছে যা ছিল তাদের সামরিক খাতে খরচের মূল যোগানদাতা। তারা পূর্ব পাকিস্তানের চিত্র স্বাভাবিক করতে চাচ্ছেন – কিন্তু কার নেতৃত্বে? আওয়ামীলীগের সাথে ন্যাশনাল এলেম্বলিতে বসার ব্যাপারটিও এখন ঘোলাটে। এই অবস্থায় ছয় মিলিয়ন উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবাসন খুব কঠিন কাজ হতে পারে। তাদের ভবিষ্যত এখন একটি হাহাকার করা সমস্যা। এটি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সমস্যাও সৃষ্টি করতে পারে।

শিরনাম সূত্র তারিখ
২০৬। বাংলার বিপর্যয় রেডিও পরাগ, উধ্রিতিঃ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস ১৪ জুন ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২০৬, ৫৮৭-৫৮৮>

রেডিও প্রাগ, চেকোস্লোভাকিয়া, ১৪ জুন, ১৯৭১
বাংলার ট্রাজেডি
আফ্রো-এশিয়ান সার্ভিসের উপরে প্রচারিত ভাষ্য

যখন একটি রাষ্ট্রের প্রধান স্বীকার করেন যে পূর্ব পাকিস্তানে তাদের প্রতিহিংসামূলক কাজের সময় পাকিস্তানি বাহিনী খারাপ আচরণ করেছে তখন এটা ধরে নিতে হয় যে বিশ্বের অন্য অংশে থেকে প্রচারিত ভীতিকর রিপোর্ট সত্য। এমনকি একথা যদি স্বীকার নাও করা হত তবুও শরণার্থীদের প্রবেশ থেকে একথা অনুমান করা যায় যে পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটছে।

এটা কোন সহজ কাজ নয় – রাজনৈতিক এডভেঞ্চার ছাড়া নিজের দেশ ত্যাগ করা। এরকম করার নিশ্চই কোন গুরুতর কারণ আছে। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামীলীগের এত বড় বিজয়ের পরেও সেখান থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ মিলিয়ন মানুষের শরনার্থি হয়ে আসার ব্যাপারটির পেছনের নিশ্চই একটি গুরুতর কারণ রয়েছে। বাস্তবিকভাবে দলটি পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব ভোট পেয়েছে এবং পুরো দেশের ৫০% এর বেশি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। পাকিস্তান পার্লামেন্ট ন্যসঙ্গত ছিল এবং তারাই জনগণের ন্যাসঙ্গত চাওয়া ও অভিযোগকে প্রকাশ করেছেন। নির্বাচণী স্লোগানের মধ্যে তারা জাতীয় আয়ের সুষম বণ্টন দাবি করেছিলেন এবং একটি উঁচু মানের স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিলেন। এই উভয় পয়েন্টে দলটির অবস্থান বাস্তবসম্মত ছিল। পূর্ব পাকিস্তানে দেশের মোট জনসংখ্যার বেশিরভাগ লোক অবস্থান করে – সেই হিসেবে সে সাধারণ তহবিলে বেশি অবদান রাখছে।

যদিও দলের এই দাবির ফাঁকে কিছু চরমপন্থি সম্পূর্ন স্বাধীনতা চাচ্ছে – তবে আওয়ামীলীগকে দ্বিভাগপন্থী বলা যাবেনা।

পরিস্থিতি দুর্ভাগ্যজনকভাবে অন্যদিকে মোড় নিল। যখন পশ্চিম পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ মনে করল পূর্ব পাকিস্তানের দাবি দেশের স্বার্বভৌমত্তের জন্য হুমকি স্বরূপ। ২৫ মার্চ তারা মিলিটারি দিয়ে রাজনৈতিক আলোচনার দ্বার বন্ধ করে দিল। সাধারণ জ্ঞ্যান অনুযায়ী আলোচনার সদিচ্ছা নষ্ট হয়ে গেল। জনগণ এলোমেলোভাবে জোরালো প্রতিবাদ করল। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য মরিয়া হয়ে ডাক দিল। শেষ পর্যন্ত এই আক্রোশ আর্মির একশনে দমিত হল – যাদের বেশিরভাগ পশ্চিম পাকিস্তানি। বিষয় হল, শরনার্থিদের মধ্যে প্রায় ১০ লাখ মুসলিম আছে। এতে প্রমাণ হয় আর্মি ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের লোকদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ব্যাবস্থা নেয় নি।

শরনার্থিদের ভাগ্যে – যারা বাড়ীতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনিশ্চিত জীবন যাপন করছে – ভারতের মাটিতে শরনার্থি ক্যাম্পে বসে ক্ষুধা আর কলেরার সাথে লোরাই করছে – এটা এই টট্র্যাজেডির একটি দিক মাত্র। আরেকটি আরও গুরুতর আন্তর্জাতিক ইস্যু আছে – সেটা হল ভারত পাকিস্তানের মধ্যে টান টান উত্তেজনা। ৫ থেকে ৬ মিলিয়ন উদ্বাস্তুদের দেখাশোনা করা ভারতের জন্য বিশাল বোঝা। ভারত পাকিস্তান সীমান্তে গুলি বিনিময় এবং উভয় পক্ষের অবস্থান একটি জরুরি সতর্কবার্তা যে এর থেকে একটি আন্তর্জাতিক বিরোধ শুরু হয়ে যেতে পারে।

জাতিসঙ্ঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্ট এর নেয়া রিলিফ ব্যাবস্থাপনা গুরুত্তপূর্ন ভূমিকা রাখবে এবং নিকট ভবিষ্যতে ক্যাম্পে উদ্বাস্তুদের দুর্দশা কিছুটা লাঘব করবে। যদিও সকল রিলিফ ব্যাবস্থা নেয়া হচ্ছে পরিস্থিতির ধারাবাহিকতায় এবং ভোগান্তির মূল কারণের ও সৃষ্ট উত্তেজনার জন্য কোন সুরাহা করা হচ্ছেনা।

রুডে প্রাভো, চেকোস্লোভাকিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির দৈনিক পত্রিকা আজ লিখেছে যে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের অবস্থা মানবিক দিক দিয়ে খুবই ধোঁয়াশার মধ্যে আছে – এবং পাশাপাশি বৈদেশিক রাজনৈতিক পরিবেশ ভয়ানক রূপ ধারণ করছে। তারা জোর দেয় যে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ হচ্ছে অতি সত্বর শরনার্থিদের বাড়ী ফিরে যাবার মত পরিবেশ তৈরি করে দেয়া।

বিষয়ের গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পায় যখন গত সপ্তাহে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং আনঅফিসিয়ালি মস্কোতে আসেন এবং সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী মিস্টার আলেক্সি কসিজিন এর সাথে সাক্ষাত করেন। কসিজিন বলেন সোভিয়েত সরকার মনে করে যে পাকিস্তান সরকার সমস্যার সমাধানে অতি দ্রুত পদক্ষেপ নেবে।

এই ক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখা দরকার যে ৫ বছর আগে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বে গুরুত্তপূর্ন ভূমিকা রেখেছিল। তার নাম তাসখন্দ চুক্তির সফলতার সাথে লেখা রয়েছে। তাছাড়া এই সতর্কবার্তা পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের কাছে আজ পৌঁছে দেয়া হবে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২০৭। শরনার্থিদের ব্যাপারে আশংকা গায়ানা ইভনিং পোস্ট ১৭ জুন ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২০৭, ৫৮৯>

গায়ানা ইভনিং পোস্ট, ১৭ জুন, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
শরনার্থিদের ব্যাপারে আশংকা

ছয় কোটি মানুষের হঠাৎ অন্তঃপ্রবাহ ভারতের জনগণের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে মারাত্মকভাবে প্রভাব সৃষ্টি করেছে , কিন্তু মানবতার কারণে এই ছাড় দিতে হবে।

মিসেস গান্ধীর মতে, বিশ্বের অন্য কোন দেশে এই মাত্রার অনুপ্রবেশ ঘটেনি। এমনকি এর দশ ভাগের এক ভাগও না। কিন্তু, মিসেস গান্ধী বলেন, শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য ভারত প্রয়োজনবোধে ‘জাহান্নামের মধ্য দিয়ে যাবে’।

কিন্তু স্পষ্টতই, এই অবস্থা শুধু ভারতকে উদ্বিগ্ন করার কথা না। পুরো বিশ্বের সহায়তা প্রয়োজন। সবচেয়ে জরুরী প্রয়োজন খাদ্য, আশ্রয় ও ওষুধ। গায়ানার জনগণ তহবিল সংগ্রহ করতে পারেন। ভারতের এই সঙ্কটের মধ্যে গায়ানার এগিয়ে আসা উচিৎ। গিয়ানা নিজেই একটি দরিদ্র দেশ কিন্তু ভারত যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে তাতে গায়ানার মানুষকে ত্যাগস্বীকার করতে হবে এবং গায়ানার মানুষ জানে কিভাবে ত্যাগস্বীকার করতে হয়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২০৮। বাংলায় ভয়াবহ অবস্থা সানডে টাইমস ২০ জুন ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২০৮, ৫৯০>

সানডে টাইমস, ওয়েলিংটন, ২০ জুন ১৯৭১
বাংলায় আতঙ্কজনক পরিস্থিতি

বাংলায় আতঙ্কজনক পরিস্থিতি বিবেচনায় যারা এখনো টিকে আছে তাদের অবিলম্বে সাহায্য পাঠানো উচিত।

উদ্বাস্তু ও পশ্চিমবঙ্গে তাদের যারা আশ্রয় দিয়েছে তারা সবাই চায় শরনার্থিদের খাদ্য ও ওষুধ সহায়তা দেবার জন্য সমস্ত বিশ্ব এগিয়ে আসা উচিৎ – এবং তারা যে ভূখণ্ড থেকে পালিয়ে এসেছে সেখানকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিৎ।

কিন্তু যখন এই সমস্যার আবেদন মেটানো হবে -পাকিস্তানী সরকারকে রাজনৈতিক যথেচ্চার করতে দেয়া হবেনা এবং তারা যে গণহত্যা ও নিষ্ঠুরতা চালিয়ে যাচ্ছে তা চলতে দেয়া যাবেনা।

ভয়ংকর সত্যগুলো এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। যদিও আমরা জানি এটা আরও বাড়ছে এবং দক্ষিণ আফ্রিকার পরিস্থিতির চাইতেও কয়েক গুণ ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে যতক্ষণ পর্যন্ত ইয়াহিয়া খানের শোষণের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান জেগে না ওঠে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২০৯। হিংসাত্মক তৎপরতা বন্ধ করতে হবে দাগেন্স নাইহেটার ২৭ জুন ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২০৯, ৫৯১>

দ্যা দাগেন্স নাইহেটার, স্টকহোম, ২৭ জুন ১৯৭১
হিংসাত্মক তৎপরতা বন্ধ করতে হবে

পূর্ববাংলাতে সন্ত্রাসের রাজত্ব হচ্ছে প্রায় চার মাস। পালিয়ে যাওয়া মানুষ এখনও ভারতে সীমান্ত জুড়ে অবস্থান করছে। পাকিস্তানি সামরিক একনায়কত্বের নিষ্ঠুরতার কোন সীমা নেই- খুব অল্প সংখ্যক নেতার বাঙ্গালী গ্রুপের সন্ত্রাসী হামলাকে আগ্রাসীরা নির্মূল করার চেষ্টা করছে। এছাড়াও সাধারণ মানুষ ‘চূড়ান্ত সমাধানের’ শিকারে পরিণত হয়, যা ক্ষমতার অজুহাতে পাকিস্তানি আর্মি প্রদর্শন করছে। তারা দশকের বেশি সময় ধরে ভুলভ্রান্তির মধ্য দিয়ে সরকার পরিচালনা করছে। পূর্ববঙ্গ ও ভারতের মধ্যকার সীমান্তে দৈনিক সংঘর্ষের ফাঁকে তারা এই মিথ্যা প্রচার করছে যে পরিস্থিতি ‘স্বাভাবিকতার দিকে ফিরে’ আসছে। এর মাধ্যমে একনায়ক নেতৃত্ব তার নিজের জনগণের বিরুদ্ধে করা অপকর্ম ঢাকার চেষ্টা করছে।

এই যুদ্ধ যত দীর্ঘ হবে – এই নিপীড়ন এবং ধ্বংস চলতেই থাকবে। আমাদের নিন্দা ততই বাড়তে থাকবে। সরকার রক্তক্ষয় বন্ধ করার জন্য কোন একটি দৃঢ় প্রচেষ্টা নেয়নি। আমরা বাঙালি নারীর চোখে নির্যাতনের যে চিত্র দেখেছি তা আমাদের যুগের শাসনতন্ত্রের একটি বিরল চিত্র। বাইরে থেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে চাপ দেবার ব্যার্থতা – নৈতিক, রাজনৈতিক এবং সব অর্থনৈতিক চাপ- শত্রুতার ঊর্ধ্বে ভবিষ্যতে পাকিস্তানি সামরিক একনায়কত্বকে বিশ্বের এই অংশে স্থায়ী রূপ দিতে পারে।

যাইহোক, ওয়াশিংটন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, যারা পাকিস্তানের বড় সাহায্যদাতাও বটে – তারা সম্প্রতি মানবিকভাবে বিবেচনায় আর নতুন করে কিছু মঞ্জুর না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্তটি সম্ভবত পাকিস্তানে সৃষ্টি হওয়া অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার কারণে নেয়া হয়েছে – যেহেতু পাকিস্তানী একনায়ক সরকার পূর্ববাংলাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে- যে সামান্য বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ ছিল সেগুলি দিয়ে তারা আরও বেশি অস্ত্র কিনছে সহিংসতা আরও বাড়ানোর জন্য।

পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর আগ্রাসী নীতিমালার আওতায় এটি প্রথম আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ হবে। একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নেবার জন্য আরও কিছু পদক্ষেপ নেয়া হবে। পাকিস্তানের সামরিক একনায়করা ধ্বংসের মাঝে যেভাবে অবস্থান করছেন তাতে করে পাকিস্তানের অস্তিত্বের জন্য একক জরিপের ব্যাবস্থা করা হবে।

শিরোনামঃ সূত্রঃ তারিখঃ
২১০। পাকিস্তানের আকাশে বিপর্যয়ের ছায়া ম্যানিলা ক্রনিকল
৫ জুলাই, ১৯৭১

Nobel Himura
অনুবাদঃ মোঃ রাশেদ হাসান
<১৪,২১০,৫৯২-৫৯৪>

ম্যানিলা ক্রনিকল, জুলাই ৫, ১৯৭১
পাকিস্তানের আকাশে বিপর্যয়ের ছায়া
লিখেছেনঃ পিটার হ্যাজেলহার্স্ট

মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যাবধানে পূর্ব এবং পশ্চিম বঙ্গ হঠাৎ করেই আন্তর্জাতিক সমস্যার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। গৃহযুদ্ধের কবলে পড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘরছাড়া হয়েছেন, হাজার হাজার মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছে, দুর্ভিক্ষ আর মহামারি ইতমধ্যে সীমান্ত এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে এবং ইন্ডিয়া-পাকিস্তানের মাঝে যে কোন মুহুর্তে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

তবে সব থেকে অস্বস্তিকর ব্যাপার হল যে এই অবস্থা এখন শুধু আরও খারাপ হতেপারে ভাল হবার কোন সম্ভাবনা নেই। বিশ্ব নেতারা বরাবরের মতই পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের মাঝে একটি রাজনৈতিক সমঝোতার আশা নিয়ে বসে আছেন। কিন্তু পাকিস্তান বিষয়ে সব থেকে বোকা ছাত্রটিও এখন জানে যে রাজনৈতিক সমঝোতার প্রশ্নই ওঠেনা।

আগামী দিনগুলোতে মানুষ সৃষ্ট এই হলোকাস্টের আইনগত দিক গুলো নিয়ে বিশ্বের রাজধানী সমূহে এবং আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মে তুমুল বিতর্ক হবে। কিন্তু অনেক বিষয়াদি যা এই হঠাৎ মারাত্মক পরিবর্তিত অবস্থার জন্য দায়ী তা দেশভাগ অথবা গণহত্যা এবং অভিযোগ- পালটা অভিযোগের দ্বারা মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আছে। যদি কোন একজন পাকিস্তানী নেতার দিকে কেউ অভিযোগের আঙুল তুলতে চান তবে এই পর্যায়ে দাঁড়িয়ে তাকে নির্মোহ ভাবে বিপর্জয় শুরুর আগ পর্যন্ত ঘটনা সমূহের ক্রমধারার দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে।

জানুয়ারী ১৯৭০, থেকে শুরু করা অযৌক্তিক হবেনা যখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিহা খান, যেকিনা কথা দিয়েছিলেন- অধিক জনপ্রিয় কোন সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে, গণতান্ত্রিক পরিষদের নির্বাচনের পূর্বশর্ত হিসেবে পাকিস্তানের দুই প্রদেশের উপর থেকে রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলেদেন। সংবিধান প্রণয়ন দ্রুততম সময়ে করতে এবং পূর্ব পাকিস্তানিদের দ্বারা পাকিস্তানের একতা ধ্বংস হবে- পশ্চিম পাকিস্তানিদের এমন কাল্পনিক ভয় দূরকরতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আগে থেকেই L.F.O (Legal Framework Order) পাশ করে রাখেন যা তাকে যে কোন সময় সংবিধান পরিবর্তন বা অমান্যের ক্ষমতা দেয়।

এটা অবশ্যম্ভাবী হয়েছিল যে প্রাক্তন বিদেশ মন্ত্রী জনাব জুলফিকার আলী ভুট্ট পশ্চিম পাকিস্তানের জনপ্রিয় নেতা হিসেবে উঠে আসবেন এবং পূর্ব বাংলার অগ্নিদীপ্ত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ইতিমধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তানের রাজপথে তাঁর সক্ষমতা প্রদর্শন করে দেখিয়েছেন।

কিন্তু যেই মুহুর্তে তারা নির্বাচনি প্রচারণা শুরু করলেন, সেই মুহুর্তে এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই গ্রাউন্ড থেকে নির্বাচন করছেন এবং আগামী পরিষদে এই দুই প্রদেশের মাঝে কোন কমন গ্রাউন্ড খুঁজে পাওয়া যাবেনা। জনাব ভুট্টের সম্পূর্ন রাজনৈতিক ভিত্তি স্থাপিত হয়ে আছে কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে সহিংস পাঞ্জাবী অবসেশনের উপর। ভারতের সাথে হাজার বছরের যুদ্ধের বক্তব্য দিয়ে তিনি পশ্চিম পাকিস্তান প্রদেশকে উত্তেজনার কাঁপন ধরিয়ে রাখেন। এই উত্তেজনা ধরে রাখতে তিনি আস্বস্ত করেন যে যুদ্ধের মাধ্যমে কাশ্মীর মুক্ত করতে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার এবং শক্তিশালী মিলিটারি পক্ষে তিনি দাঁড়িয়েছেন।

গত বছর লক্ষ লক্ষ পাকিস্তানী ভোট কেন্দ্রে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে যখন ভোট দিতে যান তখন জেনারেল ইয়াহিয়া এবং তার মিত্ররা রুদ্ধশ্বাসে নির্বাচনের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া অবশ্যম্ভাবী ভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চায়ছিলেন কিন্তু তিনি হয়ত আশা করেছিলেন যে নির্বাচনের ফলাফল দুই প্রদেশের নেতাদের এক কাতারে নিয়ে আসবে যা দেশের ঐক্য ধরে রাখতে পারবে। কিন্তু জেনারেলরা দুইটি বিষয় আমলে নিতে ভুলে করেছিলেন। একদম শেষ মুহুর্তে আওয়ামীলীগের প্রধান বিরোধী প্রার্থি বামপন্থি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নির্বাচন বয়কটের মাধ্যমে আওয়ামীলীগকে নির্বাচনের মাঠে একলা ছেড়ে দেয়।

প্রায় প্রত্যেক বাঙালি শেখ মুজিবের ছয় দফা (৬ দফা) প্রস্তাবনা ধারণ করেছিলেন এবং এটি তাদের ভোট প্রদানকে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করেছিল। আওয়ামীলীগ অপ্রতিরুদ্ধ ভাবে নির্বাচন কোরে বাঙালি প্রদেশের ১৬৯টি আসনের মাঝে ১৬৭টি অর্জন করে নেয় এবং পশ্চিম প্রদেশের পাঞ্জাবী বিরোধী প্রার্থিদের সমর্থন নিয়ে সাধারণ পরিষদের ৩১৩টি আসনের দুই তৃতীয়াংশ আসন অর্জনের বিষয়ে শেখ মুজিবুর রহমান আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। পশ্চিম প্রদেশের জন্য বরাদ্দকৃত ১৩৮টি আসনের মাঝে জনাব ভুট্টের পিপলস পার্টি ৮২টি আসন অর্জন করে। পাঞ্জাব প্রদেশ মর্যাদা হারানোর হুমকির মুখে পড়ে যখন এটা দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে যায় যে সাধরণ পরিষদের সভা শুরু হবার সাথে সাথেই বাঙালিরা তাদের নিজেদের সংবিধান প্রণয়ন করতে সমর্থ হবে।

নির্বাচনের পরের রাতে একজন আইনজীবী তার (ইয়াহিয়ার) প্লানের বিষয়ে কিছু ধারণা আমাকে জানানঃ ‘আমি এখন কি করব বলে তোমার মনেহয়? শেখ মুজিব তার নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতার বলে তাঁর সংবিধান বাস্তবায়নে অগ্রসর হবেন এবং সকল দায়দায়িত্ব এসে পড়বে প্রেসিডেন্টের উপর। তবে আমার মনেহয়না পশ্চিম পাকিস্তানীদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় এমন কিছু তিনি প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে সাইন করিয়ে নিতে পারবেন।‘

অর্থাৎ জনাব ভুট্ট লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার বহাল রাখার বিষয়ে আগ্রহী হবেন কিন্তু তিনি আমাকে বলেছেন যে অধিবেশন শুরু হওয়া মাত্র শেখ সাহেব সাধারণ পরিষদকে সায়ত্বশাসিত ঘোষণা করতে যাচ্ছেন এমন কথা তিনি শুনেছেন। যার ফলে লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার এবং পাঞ্জাবীদের ভেটো দুটোই অকার্যকর হয়ে পড়বে।

কিন্তু জনাব ভুট্টোর অন্য পরিকল্পনাও ছিল। প্রথমে তিনি দ্রুত সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরু করার বিরোধিতা করেন কিন্তু ফেব্রুয়ারির ১৩ তারিখ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঘোষণা দেন যে ৩রা মার্চ অধিবেশন শুরু হবে। এর দুই দিন পর ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখ মূল সমস্যা সামনে আসে যখন জনাব ভুট্টো ঘোষণা করেন তার পার্টি সংবিধান পরিষদের অধিবেশন বয়কট করবে এবং একই সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের যে সকল নেতা অচিরেই ঢাকা সফরের পরিকল্পনা করছিলেন তাদের না যাবার জন্য হুমকি দেন। ভুট্টো ধীরে ধীরে প্রেসিডেন্টের উপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন।

একই সাথে জনাব ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার একাধিক জেনারেলের সাথে দেখা করতে থাকেন যারা পূর্ব বাংলার বিষয়ে আগ্রাসী ছিল। তারা প্রেসিডেন্টের গভর্নর হিসেবে জেনারেল টিক্কা খানকে ঢাকায় নিয়োগ করেন।

এসবের মাঝেই ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে কিছু পশ্চিম পাকিস্তানী নেতা ভুট্টোর হুমকি অগ্রাহ্য করে সংবিধানের খসড়া প্রণয়নে অংশ নিতে ঢাকা সফরে আসেন। হিসাবে বলা যায় পাকিস্তানের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ প্রতিনিধি ঢাকায় একত্রিত হয়েছিল।

কিন্তু ফেব্রুয়ারীর ২৮ তারিখ জনাব ভুট্টো রাওয়াল পিন্ডি উড়ে যান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে এটা মনেকরিয়ে দিতে যে যদি তিনি পাঞ্জাবীদের বা পাঞ্জাবী ডোমিনেটেড আর্মির অমতে সংবিধান প্রণয়ন করেন তবে তার বিপরীতে ফলাফল কেমন হতে পারে।

প্রেসিডেন্ট তার প্রথম ভুলটি করলেন। পাঞ্জাবী চাপের প্রতি নতি স্বীকার করে তিনি পাকিস্তানের সর্ববৃহত পার্টির নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে কোন রকম আলোচনা না করেই মার্চের সাংবিধানিক পরিষদ বাতিল করে দেন।

বাঙালিরা এটাকে গোভিত ষড়যন্ত্র হিসেবে নিয়ে তীব্র প্রতীবাদ শুরু করলেন এবং আর্মি ডাকা হল ঢাকার পরিস্থিতি বল প্রয়োগ করে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। বাঙালিরা প্রেসিডেন্টের উপর আস্থা হারালেন এবং প্রথমবারের মত ঢাকার প্রকাশ্য রাজপথে বাংলাদেশের জন্য শ্লোগান শোনা যেতে লাগলো।

বাংলাদেশের জন্য কান্না যতই তীব্র হচ্ছিল ততই সমস্ত প্রদেশের জীবন যাত্রা স্থবির হয়ে আসছিল। এমন পরিস্থিতিতে মার্চের ১৬ তারিখ দুটি বিকল্প প্রস্তাব নিয়ে প্রেসিডেন্ট ঢাকা আসেন। (১) তিনি বলেন যে তিনি দ্রুত তম সময়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে খমতা হস্তান্তর করতে চায়ছেন যদি শেখ মুজিব দুই প্রদেশে প্রাদেশিক পর্যায়ে দুটি আলাদা জাতীয় সরকার গঠনে সম্মত হন। অথবা

(২) সে প্রদেশ গুলোতে খমতা পুনর্বহাল করবেন এবং তার নিয়ন্ত্রণাধীন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংবিধান প্রণয়নের আগপর্যন্ত দেশের প্রতিদিনকার প্রয়োজনের দেখভাল করবেন।

যখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শেখ মুজিবকে জিজ্ঞেস করেন যে তিনি (শেখ মুজিব) ভুট্টোকে বৃহত্তর পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান ধরে নিয়ে একটি কেন্দ্রীয় কোয়ালিশন সরকার গঠনে প্রস্তুত আছেন কিনা তখন শেখ মুজিব তাকে (ইয়াহিয়াকে) গণতান্ত্রিক নিয়ম নিতির উদাহরণ মনেকরিয়ে দিয়ে বলেন যে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্টির নেতা হিসেবে তার অবশ্যই নিজের সহকর্মি নির্বাচনের অধিকার থাকা উচিৎ। এখানে আবারও মনেরাখা প্রয়োজন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় বিষয়াদিতে অংশগ্রহনের তাঁর (শেখ মুজিবের) আগ্রহ প্রমাণ করেনা যে তিনি দুই প্রদেশকে বিভক্ত করতে চায়ছেন। কিন্তু তারপরেও প্রেসিডেন্ট জনাব ভুট্টের পূর্বেকার হুমকির প্রতি আস্থা রাখলেন এবং একটি জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাবনা বাতিল করে দিলেন।

যেহেতু সময় চলে যাচ্ছিল সেহেতু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এবং শেখ মুজিব দ্বিতীয় একটি আপস ফর্মুলায় একমত হলেনঃ প্রাদেশিক পর্যায়ে অতিসত্বর খমতা পুনর্বহাল হবে। শেখ মুজিব প্রেসিডেন্টকে অনতিবিলম্বে একটি ঘোষণা জারির মাধ্যমে মার্শাল ল তুলে নিতে বললেন এবং পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের চার প্রদেশে সিভিলিয়ান খমতা পুনর্বহাল করতে বললেন। একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নের আগ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন এই শর্তে শেখ মুজিব সম্মতি দিলেন।

সমর সাজে সৈন্যদের ব্যারাকে আসতে দেখে ক্ষুব্ধ এবং হতাশ বাঙালিরা ঢাকায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করতে শুরু করেন। ভুট্টই ছিল সেই ব্যাক্তি যে কিনা শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্টকে এমন একটি সিধান্ত নিতে উৎসাহিত করে যা পূর্ব বাংলায় আগুন লাগিয়ে দেয়। যখন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাব ভুট্টোর কাছে তুলে ধরেন তখন ভুট্টো তাকে এই বলে (ইয়াহিয়াকে) বোঝান যে যদি মার্শাল ল তুলে নেওয়া হয় তাহলে পাকিস্তান ৫টি পৃথক সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হবে যেই মুহুর্তে প্রদেশ গুলোতে প্রেসিডেন্ট সিভিলিয়ান খমতা পুনবহাল করবেন। তিনি ভয় দেখান যে মুজিব কেন্দ্রীয় সরকারকে ধ্বংস করে দিতে চাচ্ছেন। কারণ প্রেসিডেন্ট মার্শাল ল তুলে নিলে আইনগত ভাবে তিনি আর রাষ্ট্রের কর্তা থাকবেন না।

এ সকল কথায় অর্ধেক কনভিন্সড হয়ে প্রেসিডেন্ট পুনরায় শেখ মুজিবের কাছে ফিরে যান এবং তার ভয়ের কারণ গুলো জানান। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে এই বলে শপথ করেন যে যেই মুহুর্তে সাধারণ পরিষদের অধিবেশন বসবে এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে কোনরকম কিছু একটা ভ্যালিডিটি দিবে সেই মুহুর্তে সে (ইয়াহিয়া) মার্শাল ল তুলে নিবেন। প্রেসিডেন্টের এই কথার পর শেখ মুজিব তাঁর পূর্বেকার অতিসত্বর মার্শাল ল তুলে নেওয়ার অবস্থান থেকে সরে আসেন এবং এতে করে প্রেসিডেন্ট তার জেনারেলদের পক্ষে চলে যান কারণ তিনি পূর্ণ কনভিন্সড হন যে শেখ মুজিব তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন।

ঘটনা গুলোকে যৌক্তিক উপসংহারে নিলে নিঃসন্দেহে বলা যায় বর্তমান অপ্রত্যাশিত গণহত্যা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কারণেই হচ্ছে যখন তিনি বাঙালিদের সাথে কোন রকম আলোচনা না করে এসেম্বলি বাতিল করে দেন, কিন্তু এর থেকেও বেশী দায়ী মার্চের ৩ তারিখ এসেম্বলি বয়কটের ভুট্টের একগুঁয়ে সিধান্ত।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২১১। বেয়োনেটের সাহায্যে স্বাভাবিক অবস্থা ভেসার্নজে নভস্তি ৮ জুলাই ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২১১, ৫৯৫>

ভেসার্নজে নভস্তি, যুগোস্লাভিয়া, ৮ জুলাই ১৯৭১
বেয়োনেটের সাহায্যে স্বাভাবিক অবস্থা

প্রায় তিনমাস হল স্বাধীনতাকামী বাঙ্গালীদের দমাতে মিলিটারি এটাক শুরু হয়েছে। এই প্রথম সেখানে বিনা পাহারায় একজন বিদেশী সাংবাদিককে প্রবেশ করতে দেয়া হয়েছে। যদিও বেশিরভাগ চিহ্ন সরিয়ে ফেলা হয়েছে তবে তাদের নৃশংসতার কিছু প্রমাণ এখনো আছে।

রাজধানী ঢাকা এখনো ভয়, সহিংসতা ও সন্ত্রাসের শহর। সরকার বলছে “স্বাভাবিক পরিস্থিতি” যদিও রাস্তায় মানুষজন প্রায় চুপিসারে চলছে আর গাড়ী তেমন দেখা যাচ্ছেনা। ঢাকায় অনেক সৈন্য আছে তবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে স্পেশাল পুলিশ স্কোয়াড আনা হয়েছে। তারা যানবাহন ও মানুষকে চেক করছে এবং গ্রেপ্তারের হার প্রচুর।

‘স্বাভাবিক’ এর একটি নমুনা হচ্ছে যদি কেউ বাংলা রেডিও-স্টেশনের অনুষ্ঠান শোনে তাহলে তার শাস্তি ভয়াবহ। অসংখ্য দোকান এখনো বন্ধ। গাড়ীর নম্বর-প্লেটের বাংলা পরিবর্তন করে ইংরেজিতে লেখা হয়েছে। এবং রাস্তায় কানাঘুষা চলছে যে পাকসেনারা এখনো বাঙ্গালীদের সাথে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে – তাদের গ্রেপ্তার করছে এবং কখনো কখনো মেরে ফেলছে।

যদিও ট্যাংক এবং রকেট এর ট্রেস মুছে ফেলা হয়েছে তবুও ভয়ের ছায়া স্পষ্ট। পুরনো ঢাকা সবচেয়ে দরিদ্র এলাকা এবং এখানে আওয়ামীলীগের সমর্থকের সংখ্যা বেশী। মার্কেটের অবস্থা খুব করুন। নোংরা সরু পথ দিয়ে যেতে যেতে দুই পাশের ধ্বংস করা দালান দেখা যাচ্ছে। এগুলোর বেশিরভাগের মালিকানা ছিল হিন্দুদের। তারা ঘর ছেড়ে যাবার আগ পর্যন্ত তাদের নির্মমভাবে অত্যাচার করা হয়।

ভারতে চলে যাওয়া সাড়ে ৬ মিলিয়ন পাকিস্তানিদের মধ্যে ৪ মিলিয়ন ছিল হিন্দু। এদের বন্দুকের মুখে যেতে হয়েছে। সরকার তাদের মন্দির জ্বালিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর তাদের ফেলে যাওয়া ঘরবাড়িগুলো “অনুগত” নাগরিকদের দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২১২। সাহায্যের জন্য আর্তনাদ পালাভার উইকলি ৮ জুলাই ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২১২, ৫৯৬- ৫৯৭>

পালাভার উইকলি, ঘানা, জুলাই, ১৯৭১
সাহায্যের জন্য পূর্ব পাকিস্তানিদের আহাজারি

২৫ মার্চ ১৯৭১ রাতের অন্ধকারে রচিত হয় মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অপরাধে এক চিত্র। সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানের পঁচাত্তর মিলিয়ন জনগণের বিরুদ্ধে একটি রক্তপিপাসু সামরিক জান্তা ঝাঁপিয়ে পড়ে।

বহু সংবাদপত্র ফটোগ্রাফ এবং প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ননা দিয়ে ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ গণহত্যার রিপোর্ট প্রামাণিক আকারে প্রকাশ করে।

প্রখ্যাত ব্রিটিশ এম পি, রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য রাষ্ট্রযন্ত্রের লোক ও জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব সহ অনেকে সরাসরি এই অপরাধের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিবাদ করেন।

সমস্ত প্রমাণ ও রিপোর্টে এটিকে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দ্বারা নির্মমভাবে সম্পাদিত ইচ্ছাকৃতভাবে পরিকল্পিত ভয়াবহ গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মানব ইতিহাসে এমন নৃশংসতার অন্য কোনো নজির নেই। পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী, প্রখ্যাত অধ্যাপক, আইনজীবী, সাংবাদিক, ডাক্তার ও ছাত্রসহ সকলকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হচ্ছে।

এটা সবার জানা যে এই মানুষগুলোর একমাত্র অপরাধ ২৩ বছরের ইতিহাসে দেশের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা। তারা প্রায় এক বাক্যে তাদের নেতা হিসেবে আওয়ামীলীগের শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে রায় দেন।

শেখ মুজিব ও তার দলের একমাত্র অপরাধ যে তারা গণতন্ত্রের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের ওপর নেমে আসা তৎকালীন ঔপনিবেশিক অবস্থা শেষ করতে চেয়েছিলেন – একটি বিশিষ্ট ও সম্মানিত পর্যায়ে দেশকে নিতে চেয়েছিলেন।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা আবশ্যক যে পূর্ব পাকিস্তানের ট্রাজেডি বায়াফ্রার মতন নয়। সমান্তরাল হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকা বা রোডেশিয়ার সাথে তুলনা করা যায় যেখানে অল্প কিছু মানুষ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর উপর ক্ষমতা ফলাচ্ছে।

যদিও এটা খুব সামান্যই মিলে যায়। এমনকি ভ্রষ্টার বা ইয়ান স্মিথ পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তার মত সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে পারেনি। তবুও বলা হচ্ছে এটা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ বিষয়। আসলেই কি তাই?

এর উত্তর হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় ৬ মিলিয়ন সন্ত্রাস-পীড়িত মানুষ প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রবেশ করেছে যারা এসব ট্রাজেডির ‘সাক্ষী’ হয়ে আছে।

পাকিস্তানের এক নম্বর শত্রু হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র মানবিক কারণে ভারত নিজের জনসংখ্যা বিস্ফোরণের চাপ মাথায় থাকার পরেও এইসব উদ্বাস্তুদের আশ্রয় এবং খাবার দিচ্ছে।

পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে পালিয়ে যাবার সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে এবং এখন তা দিনে ৫০০০০। যদি কোন সরকার জোর করে তাদের জনগণকে অন্য দেশে পাঠিয়ে দেয় তাহলে সেই সরকারের ক্ষমতায় থাকার কি অধিকার থাকতে পারে।

এখন যে রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে তাতে এইসব শরণার্থীদের ফিরে যাবার আশা ক্ষীণ।

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নতুন সাংবিধানিক প্রস্তাব পরিষ্কারভাবে সংখ্যালঘুদের শাসন চিরস্থায়ী করার পন্থা। এখন সময় এসেছে জাতিসংঘ এবং বিশ্বের সকল স্বাধীনতা প্রেমী জাতির এগিয়ে আসার। তাদের উচিৎ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের নির্বাচিত প্রতিনিধি আওয়ামীলীগের শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে চাপ দেয়া। শুধুমাত্র তখনই ভারতে অবস্থানরত পূর্ব পাকিস্তানের লাখ লাখ শরণার্থী নিজের দেশে ফিরে যেতে নিরাপদ বোধ করবে।

ইতিমধ্যে তৈরি হওয়া বিপজ্জনক এবং ভয়ানক পরিবেশকে আরও বিধ্বংসী অবস্থায় যাওয়া ঠেকাতে এটাই একমাত্র পথ।

পালাভার আরও একবার বিশ্বের সুচিন্তাসম্পন্ন মানুষকে পূর্ব পাকিস্তানের অসহায় লোকদের উপর পাকিস্তানের সামরিক জান্তা দ্বারা ঘটিত নির্যাতনের বিরুদ্ধে একসাথে সোচ্চার হবার আবেদন জানাচ্ছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২১৩। ভারতীয় অর্থনিতির জন্য একটি বড় বোঝা জা রুবেজম ১৬ জুলাই ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২১৩, ৫৯৮>

* জা রুবেজম, ১৬ জুলাই ১৯৭১
ভারতীয় অর্থনীতির জন্য ভারী বোঝা

পাকিস্তানে ঘটতে থাকা বিয়োগান্তক ঘটনার এখন প্রায় চার মাস হতে চলল। ঘরবাড়ি ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তানের লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও বিহারের রাজ্যগুলোতে আশ্রয় চাচ্ছে।

শরণার্থীদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।সরকারী হিসেব মতে মে মাসে ছিল সাড়ে তিন মিলিয়ন যা এখন ৬ মিলিয়নের বেশী। বর্ডার পাড় হবার পরে এরা খড়ের কুঁড়েঘর বা খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে। খুব সামান্য কিছু লোক ব্যারাক ও সরকারি ভবনগুলোতে আছে।

বিশাল পরিমাণ লোক একসাথে অবস্থানের কারণে মহামারির সম্ভবনা দেখা দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে ইতোমধ্যে প্রবেশ করা ৫ মিলিয়ন শরনার্থিদের অনেকে কলেরায় ভুগছেন। তবে আনন্দের বিষয় প্রথম মহামারি নিয়ন্ত্রণ করা গেছে।

উদ্বাস্তুদের অন্তঃপ্রবাহ ভারতীয় অর্থনীতির জন্য বিশাল বোঝা। ভারত সরকার মনে করে যে, পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের জন্য আগামী ছয় মাসে তিন বিলিয়ন রুপি প্রয়োজন এবং তার জন্য জাতীয় বাজেটে চাপ পড়বে।

অনেকে উস্কানি দিচ্ছিল পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে জড়ানোর ব্যাপারে যাতে করে শরনার্থিরা ফিরে যেতে পারে। ইন্দিরা গান্ধী উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধানের জন্য সাহায্য চাইলেন।

সোভিয়েত সরকার এই অনুরোধের প্রতি সাড়া দিল এবং ইতিমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের জন্য ভারত ৫০০০০ টন চাল পেয়েছে।

এখন দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপারে অনেক দেশের উদ্বেগ ও সহানুভূতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে এবং তারা আশা করছে খুব দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে যাতে শরণার্থীদের বাড়ী ফিরে যাবার স্বাভাবিক পরিবেশ তৈরি হয়।

* একটি রাশিয়ান সাপ্তাহিক

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২১৪। কায়হান পত্রিকার কয়েকটি প্রতিবেদন কায়হান ২৭ জুলাই – ১ আগস্ট ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২১৪, ৫৯৯-৬১৮>

কায়হান ইন্টারন্যাশনালের আমির তেহেরি সম্প্রতি পাকিস্তানের সপ্তাহব্যাপী সফর করেছেন। তিনি উভয় অঞ্চল পরিদর্শন করেছেন। রাষ্ট্রপতি আগা মুহাম্মদ ইয়াহিয়া খানসহ পাকিস্তানি কিছু নেতাদের সাথে তিনি দেখা করেছেন। এখানে তিনি ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতকারের একটি বিবরণ দেন। সাম্প্রতিক ঘটনায় এটাই প্রথম লেখা যখন পাকিস্তান গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে।

পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্সিয়াল প্রাসাদ দেখতে সাধারণ একটি বাড়ির মতই। দরজার দিকে সতর্ক সেন্ট্রি আছে। একজন লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাপা, ধীর পদক্ষেপে ওয়েটিং রুমেনিয়ে গেলেন। কয়েকজন ব্রিগেডিয়ার সবুজ লম্বা লনে পায়চারি করছে, ওয়েটাররা ভিজিটরদের কালো কফি পরিবেশন করছে। বিশাল করিডোর আর অফিসে কর্মচারিরা স্মিত হাস্যে কাগজপত্র নিয়ে চলাচল করছেন।

লাল রংয়ের মখমলের গৃহসজ্জা সম্পন্ন প্রেসিডেন্সিয়াল অফিস কর্তৃপক্ষের স্থানও রয়েছে। দেয়ালে পাকিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর একটি বিশাল প্রতিকৃতি রয়েছে।

হৃদয়ে সৈনিক
এই কক্ষে যিনি কাজ করেন তিনি একজন চার তারকা জেনারেল। আগা মুহাম্মাদা ইয়াহিয়া খান। আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি। কিন্তু অন্তরে এখনওএকজন খাঁটি সৈনিক। যে কেউ সহজেই বিগলিত হয়ে যাবে। সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক তাঁর অবস্থানে যে কেউ খুশি হবে।

এটাই প্রথম পয়েন্ট যার উপর তিনি জোর দিচ্ছেন। তার কাছের সহকারীরা বন্ধুত্তপূর্ন দর্শানার্থিদের জানায় যে প্রেসিডেন্ট এখনো নিজেকে আর্মি সি ইন সি হিসেবে পরিচয় দিতেই ভালবাসেন – যখন তিনি কোন ক্লাবে ভিজিট করেন – অথবা কোন প্রদর্শনিতে যান ও অথবা কোন অরাজনৈতিক অনুষ্ঠানে যান।

আমরা ইয়াহিয়া খানের সাথে অন্য এক দিন সাক্ষাৎ করেছিলাম যখন তিনি কয়েক দিনের জন্য আবত্যাহাদে ছুটিতে ছিলেন। এটি উত্তর-পশ্চিম পাহাড়ি সীমান্ত প্রদেশের কয়েকটি প্রধান অঞ্চলের একটি যেখান থেকে অনেক বীর সৈন্যের জন্ম হয়েছে। সেখানে প্রেসিডেন্ট কিছু সেনাপ্রধানদের সাথে মিটিং করেন এবং গত গৃহযুদ্ধের অশান্ত ঘটনা সম্পর্কে আলোচনা করেন।

৫৬ বছর বয়সী একজন পাঠান সৈন্য – যিনি গভীর আনকোরা স্বরে কথা বলেন – যিনি প্রেসিডেন্সি চান নাই – তাকে যখন পিণ্ডি তে পাঠানো হল তখন ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান পদত্যাগ করেন। এটি ছিল দুই বছর আগের ঘটনা। যখন ইয়াহিয়া খান প্রথম প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে এবং পরে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসেন, তখন তিনি আশা করেননি যে একসময় তাকে পূর্ব পাকিস্তানে- তার মতে ভারতের উসকানিতে চলা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন থামাতে সেনাবাহিনী পাঠাতে হবে।

তিনি আমাদের বলেন, “ শুরু থেকেই আমার একমাত্র উদ্দেশ্য দেশে আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং একটি নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। কিন্তু সে উদ্দেশ্য অপরিবর্তিত রয়ে গেলো।”

অবাধ নির্বাচন
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সত্যিকারের উদ্যেশ্য ছিল রাজনীতির বাইরে থাকা। আইয়ুব খানের রাজনৈতিক কর্মকান্ডের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া এবং পুরনো ও নতুন দলের সমন্বয়ে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের অনুমতি প্রদান। এরপরে গত বছর সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কয়েক মাসের অনিশ্চয়তার পরে মনে হচ্ছিল যেন পাকিস্তানে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসছে যেখানে গণতান্ত্রিক দলগুলো একে অপরের সাথে লড়াই করে জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে ক্ষমতায় আসবে।

কয়েক মাস পরে পূর্ব পাকিস্তানের দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়লাভ করেছিল যেটা নিষিদ্ধ করা হয় এবং তার প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান কে উচ্চ বিশ্বাসঘাতকতা ও দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়।

পাকিস্তান পিপলস পার্টি যারা ভৌগলিকভাবে দেশের পশ্চিম শাখার মধ্যের আসনগুলোতে নির্বাচনে জয়ী হয়েছে তাদের ক্ষমতায় আসার সম্ভবনা খুব কম।

ইয়াহিয়া খান আমাদের বিষণ্ণ সূরে জানালেন যে “আমি পাকিস্তানের ঐক্য রক্ষার জন্য সকল প্রচেষ্টাই নিয়েছি।’ “আমি এই চেয়ারের প্রতি আগ্রহী ছিলাম না এবং প্রথম সুযোগ পেলেই আবার সৈনিক জীবনে ফিরে যাব।’

নৈরাশা ভাব নিয়ে তিনি জানালেন তাকে রাজনীতিবিদরাই নিচে নামিয়েছেন যারা নিজেদের কলহই থামাতে অপারগ। এবং পরবর্তিতে যারা দেশ বিভক্তির চিন্তা করছেন।

মুজিবের সাথে সমঝোতা

তিনি স্মরণ করলেন কিভাবে তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে আপসে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছিলেন। তিনি ঢাকা গিয়েছিলেন শেখের সাথে দেখা করার জন্য এবং যদিও তার পিণ্ডিতে আসা উচিৎ ছিল।

“এমনকি আমি তাকে বলেছিলাম, আপনি পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন, আমি বিশ্বাস করি না সে মানুষ সম্পর্কে কি বলা হচ্ছিল এবং ভেবেছিলাম তিনি পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চান।’ আমি জানতাম যে, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের বৈধ ক্ষোভ ছিল এবং আমি আওয়ামী লিগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। আমাকে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে পাকিস্তানকে দুটি পৃথক দেশে বিভক্ত করা হবে না।’

ইয়াহিয়া খান আরো বলেন যে তিনি পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসনের রাজনৈতিক ইতিহাসের পরিমাপে বৃহত্তম একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার পরিবর্তে তাকে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়েছিল কারণ শেখ মুজিব বিচ্ছিন্নতার জন্য একটি পূর্ণ পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন।
পাকিস্তানকে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনতে রাষ্ট্রপতিকে অনেক কঠিন পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। তবে কিছু মানুষ ও সেনাবাহিনীর কেউ কেউ মনে করেন এর জন্য কোন প্রচেষ্টা করা হয়নি।

এবং এখনো ইয়াহিয়া খান মনে করেন যে বেসামরিক সরকারকেই দায়িত্ব নিতে হবে। তিনি আমাদের বলেছেন, তিনি আশা করছেন অক্টোবরে ইরানের রাজতন্ত্রের ২৫০০ তম বার্ষিকীর আগেই এ ধরনের একটি সরকার হবে।

“আমি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে প্রস্তুত আছি। ‘ তিনি জোর দিয়ে বলেন।

পূর্ব পাকিস্তানের উপনির্বাচন

এই মুহূর্তে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে সিরিজ উপনির্বাচনের ব্যাবস্থা করেছেন যার ভিত্তিতে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদের শূন্য সদস্যপদ – যে পদের সদস্যরা ভারতে চলে গেছেন – সেগুলো ভরাট করা হবে। আওয়ামী লীগের ডেপুটি যারা ভারতে পালিয়ে গেছেন ধারণা করা হচ্ছে ১৬৮ জনের মধ্যে এরকম সদস্যদের সংখ্যা ৪০ হবে। তাদের কেউ কেউ হয়ত ফিরে আসবে এবং তাদের আসন ধরে রাখতে সক্ষম হবে – যেহেতু তাদের রাজনৈতিক অপরাধের একটি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে।

শুধুমাত্র উচ্চ রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত অথবা “হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, সহিংসতা ও সশস্ত্র ডাকাতি”তে দোষী সাব্যস্ত মানুষদের ব্যতিক্রম ধরা হয়েছে।

অযোগ্য ডেপুটিরা

প্রেসিডেন্ট একথা প্রত্যাখ্যান করলেন যে অনেক আওয়ামী লীগের ডেপুটিদের অযোগ্য ঘোষণা করা হবে। তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেন যে একটি ঘোষণা খুব শীঘ্রই দেয়া হবে। একটি বিশেষ কমিটি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

উপনির্বাচন একদিনে সবে না – কারণ তিনি জানান “আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে তিনি আর চাপে ফেলে চান না। যেসকল আওয়ামীলীগ সদস্যরা দোষী প্রমাণিত হন নাই তারা সবাই ভোটে দাড়াতে পারবেন । রাষ্ট্রপতি আগামী কয়েক দিনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে পরিদর্শন করতে যাবেন ও উপনির্বাচন আগামী আগস্টে হবে।
একবার সব খালি ভরা হয়ে গেলে জাতীয় পরিষদ অবিলম্বে আহূত হবে। সংবিধান প্রণয়ন এর কাজগুলো শুরু করা হবে এবং একটি সরকার গঠন করতে বলা হবে। একটি বিস্তৃত কাঠামো হিসেবে রাষ্ট্রপতির নিজের উপদেষ্টাদের দ্বারা প্রস্তুতকৃত একটি খসড়া সংবিধান পরিষদে জমা দেওয়া হবে। সমাবেশর ভালোর জন্য যে কোন কিছু করা হবে।

ইয়াহিয়া খান জানালেন খসড়া সংবিধান হবে দলগুলোর দাবির উপর ভিত্তি করে। আমি জানি রাজনীতিবিদরা কি চান এবং আমি আমার উপদেষ্টাদের বলেছি তাদের সব দাবি আমলে নিতে। মনে রাখতে হবে দেশের ঐক্য বজায় রাখার জন্য দরকারি সব ব্যাবস্থা আমাদের নিতে হবে।

আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছি তিনি কিছু অজনপ্রিয় লোকদের দিয়ে কোন “পুতুল বেসামরিক সরকার” উভয় অঞ্চলে গঠন করবেন কিনা? তিনি বলেন, এটি একটি গুজব এবং একজন সৈনিক হিসেবে তিনি মনে করেন গুজব ছড়ানো “একটি অপরাধ”।

“আমি গুজবে কান দেই না,” তিনি জোর দিয়ে বলেন। “আমি একজন সৈনিক এবং সবসময় খোলা মনে কথা বলতে পছন্দ করি। আমি ওরকম কোন কৌশল ব্যবহার করি না”।

বেসামরিক সরকার

আমরা জিজ্ঞাসা করলাম তিনি জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপলস পার্টির সাহায্যে একটি সরকার গঠন করার ব্যাপারে বিবেচনা করছেন কিনা? তিনি বলেন, ভুট্টোর শুধুমাত্র পশ্চিম অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল, কিন্তু একটি বেসামরিক সরকারের ‘দেশের দুই অংশে “প্রতিনিধি থাকা দরকার।
যে কোন ক্ষেত্রে, যদি একটি বেসামরিক সরকার গঠন করা হয় তাহলে সব দল আরেক্টু অপেক্ষা করতে পারে। তিনি বলেন, “আমি চাই পুরো জাতির প্রতিনিধিত্বকারীরা একটি পূর্ণ জাতীয় সমাবেশে উপস্থিত থাকুক।’ “আমি প্রতিনিধি সভায় একটি বেসামরিক সরকার দেখতে পেলে খুশি হব। সেটা না হলে কোন বিশেষ দল বা ব্যাক্তির কাছে ক্ষমতা দেয়া ঠিক হবেনা।

এদিকে প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানের পঞ্চবার্ষিকী উন্নয়ন পরিকল্পনা অব্যাহত রাখার জন্য সবুজ সংকেত দিয়েছেন। “আমি একটি সুশীল সরকার গঠনের আসায় অর্থনীতিকে ফেলে রাখতে পারিনা।” বলেন তিনি। “রাজনৈতিক অসুবিধার জন্য জাতীয় অর্থনীতি স্থবির হয়ে পরে থাকলে চলবে না।’
একবার একটি বেসামরিক সরকার গঠিত হয়ে গেলে নতুন সরকার তাদের ইচ্ছা ও পলিসি মোতাবেক পরিবর্তন করতে পারবে বলে তিনি আশ্বাস দেন।

আমরা প্রেসিডেন্টকে জিজ্ঞাসা করলাম যদি আওয়ামী লীগ উপনির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের সব আসনে জয়ী হয় তাহলে কই হবে? যদি তারা আবার সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং তারা যদি একই নীতি অবলম্বন করে – অর্থাৎ সেনাবাহিনীর বক্তব্য অনুযায়ী তারা যদি দেশ ভাগ্যের পরিকল্পনায় থাকে তাহলে কি হবে?

তিনি জবাব দিলেন যে, আওয়ামী লীগ গত নির্বাচনে “ভীতিপ্রদর্শন, সন্ত্রাস এবং অপকর্ম” করে জয়ী হয়েছিল। আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম শেখ মুজিবের দল যেহেতু সব নষ্ট করছিল তাহলে তখন আপনারা নির্বাচন বন্ধ করেন নাই কেন?

নির্বাচনে প্রতিটি দেশেই দুর্নিতি হয় – এমনকি অনেক আধুনিক দেশেও – প্রেসিডেন্ট জবাব দিলেন। যেকরেই হোক সেই সময়ে তার কাছে আওয়ামীলীগ সম্পর্কে সেরকম তথ্য আসেনি। এখন আমরা বুঝতে পেরেছি প্রত্যেকটা আসনে জয়লাভ করার জন্য মুজিব কি কি করেছেন। বেশিরভাগ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন কারণ তাদের ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার সাহস কেউ পায়নি। তিনি মূলত পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যালঘু হিন্দুদের ভোটে জিতেছেন। ২০% এর বেশি মুসলমান ভোটার তার দলের লোকদের সাথে ছিলনা।

উচ্চ বিশ্বাসঘাতকতা

তিনি বললেন, “মামলা হবার পরেই শেখ মুজিবকে খুব দ্রুত উচ্চ বিশ্বাসঘাতকতার জন্য বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে।’

আমরা জিজ্ঞাসা করেছিলাম আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচার করা হবে কিনা এবং আহূত নতুন জাতীয় সমাবেশএর আগে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে কিনা। তিনি বললেন, এটি সামরিক আইনের উপর নির্ভর করে। তিনি বিচারের সঠিক কোন তারিখ দিতে পারেননাই। ‘তাকে কোর্ট মার্শালে বিচার করা হবে এবং আমি জানিনা আগামী এসেম্বলির আগে তিনি জীবিত থাকবেন কিনা।’

জিজ্ঞাসা করা হল ভারতে অবস্থিত পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের সম্পর্কে তার সরকারের সিদ্ধান্ত কী? তিনি জানান যে তিনি সবাইকে ফিরে আসার আহবান জানিয়েছেন। তবে তিনি জানেন না তার বার্তা ঠিক মত পৌঁছে দেয়া হয়েছে কিনা। সরকারি তথ্য মোতাবেক জানানো হয় প্রায় ১০০০০ শরণার্থী ফিরে এসেছে এবং প্রতিদিন প্রায় ১০০০ জন ফিরে আসছে। তবে ইন্দিরা গান্ধি তাদের আস্তে দিচ্ছেন না কারণ তিনি একটি রাজনৈতিক ইস্যু তৈরি করতে চাচ্ছেন।

তিনি বলেন, ভারত তার এলাকায় বিদ্রোহীদের জন্য ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করেছে। প্রায় ৩৫০০০ বিদ্রোহীকে ট্রেনিং দেয়া হয়েছে। এবং যারা চলে গেছে তাদের দিয়ে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা চলছে।

আমরা জিজ্ঞাসা করলাম সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি নয়া তাস্খন্দ প্রস্তাব করেছেন – সেই সম্পর্কে। প্রেসিডেন্ট জানালেন এই ব্যাপারে কোন সরকারি তথ্য তার কাছে নেই। তিনি আর বলেন আমি যে কোনো সময় যে কোন স্থানে ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় প্রস্তুত আছি – রাজনৈতিক না, বরং মানবিক কারণে।”কিন্তু তারা আমাদের সব অফার প্রত্যাখ্যান করেছে এবং তারা পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য কাজ করছে এবং জাতিসংঘের কাজে স্যাবোটাজ করছে।

তিনি আরো বলেন ভারত প্রকাশ্যে বলেছে যে, শরণার্থীদের তারা ইয়াহিয়ার পাকিস্তানে পাঠাবে না – মুজিবের বাংলাদেশে পাঠাবে।

চাপের মধ্যে

তিনি বলেন, “এটা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে স্পষ্ট হস্তক্ষেপ এবং স্পষ্টত, আমরা এটা মানি না”।
তিনি বার বার বলেন যে তিনি একজন সৈনিক ছিলেন এবং কোনো চাপের কাছে নতিস্বীকার করবেন না। “তারা বলে আমি অমুক বৃহৎ শক্তির চাপে আছি। এটা আজেবাজে কথা। যারা এটা বলে তারা আমাকে চেনে না। একজন মানুষ চাপে থাকতে পারেন যদি তিনি এই চেয়ারের প্রতি লোভী থাকেন। আমি তা না। আমি এটা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই যে আমি দাতাদের মুখের সামনে তাদের সাহায্য ছুড়ে ফেলে দেব যদি তারা সাহায্যের সাথে কোন শর্ত জুড়ে দেন।

ইয়াহিয়া খান বলেন যে সোভিয়েত এবং আমেরিকা সরকার সংকট শুরুর থেকে পাকিস্তানের প্রতি একটি সঠিক নীতি অবলম্বন করেছে তবে তিনিব্রিটেনের ব্যাপারে একই কথা বলতে পারছেননা।
ব্রিটিশ সরকার প্রকাশ্যে আমাদের প্রতিকূলে অবস্থান নিয়েছেন এবং আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ করছেন। তাদের পররাষ্ট্র সচিব এটা স্পষ্ট করেছেন। কমনওয়েলথ এর সদস্য হিসেবে আমি আশা করেছিলাম ব্রিটেন আমাদের পক্ষ না নিক অন্তত নিরপেক্ষ থাকবে – এভাবে খোলাখুলিভাবে ভারতের পক্ষ নেবেনা।

আমরা আলোচনা শুনেছি আরও অন্তত দুই বছর ইয়াহিয়া খান রাষ্ট্রপতি থাকবেন।

“আমি আগ্রহী নই,” বলেন তিনি। “আমার কথা স্পষ্ট: আর তা হল দেশের ঐক্য ধরে রাখা এবং এটি একটি বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা দেয়া এবং তারপর প্রস্থান করা।’

আমরা তাকে স্মরণ করিয়ে দেন যে পিপলস পার্টির পশ্চিম শাখার প্রধান রাজনৈতিক শক্তি, চেয়েছিলেন তাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে থাকার জন্য একটি বেসামরিক সরকার গঠিত হয় প্রদান.
“পিপলস পার্টি শুধুমাত্র দেশের একটি অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। জাতীয় সমাবেশে যদি দেশের মানুষের সমষ্টিগত ইচ্ছার আমাকে থাকতে বলে তবে আমি থাকব। অন্যথায় আমি আর্মিতে ফিরে যেতে পারলে খুব খুশি হব।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আমাদের সাথে ইরান সম্পর্কে উষ্ণ আলোচনা করেছেন। এটা ৭৫ মিনিট চলে। তিনি এই শাহানশাহ কে পাকিস্তান এর সর্বশ্রেষ্ঠ কল্যাণকামী ইদেবে উল্লেখ করেন। এবং বলেন ইরান আমাদের জন্য একটি বড় শক্তির উৎস। “তিনি ইতিহাস জুড়ে পাকিস্তানকে করা ইরানের সাহায্যের কথা স্মরণ করে বলেন, পাকিস্তান গর্ব বোধ করে যে এই এলাকার সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ ইরান এখন আমাদের পক্ষে।

তিনি একটি ইরানী শ্লোক বলেছেন যার অর্থ হল আমরা দুই দেহ কিন্তু আমাদের আত্মা একটি।

“আমি নিজেকে একজন ইরানী।” ইয়াহিয়া বললেন। “আমার পূর্বপুরুষ ইরান থেকে উপমহাদেশে আসেন। বাড়িতে আমাদের ভাষা ফার্সি এবং আমরা আমাদের জাতির সাংস্কৃতিক সম্বন্ধ ইরানের সাথে মিলিয়ে রাখছি। আমি বহিরাগত হিসাবে নয় বরং আমার নিজের ভাই বা ছেলে হিসেবে আপনাদের সাথে কথা বলছি। ইরানের প্রতি আমার বার্তা হচ্ছে এক পরিবারের পক্ষ থেকে আরেক পরিবারকে সালাম জানানো। আমাদের দেশে বেড়াতে আসার মানে হল আপনি ইরানেরই একটি এলাকায় বেড়াতে এসেছেন। আমরা স্রস্টাকে ধন্যবাদ জানাই ইরানকে অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা শক্তি দেয়ার জন্য এবং আমরা এই শাহানশাহের সাফল্যের জন্য স্রস্টাকে ধন্যবাদ জানাই – যা ইরান – পাকিস্তান সহ সমস্ত মুসলিম বিশ্বের জন্য মঙ্গলজনক।

কায়হান ইন্টারন্যাশনাল – ২ জুলাই, ১৯৭১
একটি বিয়োগান্তক ঘটনার পাঁচটি মতামত
– আমি তাহেরি

“ওহ।এখন এটা ইতিহাসবিদদের জন্য একটি ব্যাপার,” – বললেন এক পূর্ব পাকিস্তানী বন্ধু। অন্যদিন যখন আমি ঢাকায় ছিলাম তখন এক বন্ধু আমাকে জানাল কিভাবে গত বসন্তের রক্তপাতে একটি অশান্ত দেশের সৃষ্টি হল। সে সম্ভবত ঠিকই বলেছে। কিন্তু সাংবাদিকতা হল বর্তমান মুহুর্তের ইতিহাস লেখার মত। আমি কয়েকজন মানুষকে জিজ্ঞেস করেছি পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা সম্পর্কে জানাতে। কুয়াশা কেটে গিয়ে সঠিক তথ্য উদ্ভাসিত হতে হয়ত অনেক বছর লেগে যাবে। তবুও, বর্তমান অবস্থা নিয়ে একটি সাদামাটা চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করা যেতেই পারে। এই প্রবন্ধে আমরা বসন্তের নাটকীয় ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন মতামত দেখতে পাব।
(১) লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান

টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর।যখন সেনাবাহিনীর সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চরম পর্যায়ে চলছিল তখন তিনি আসেন। তিনি বিস্তৃতভাবে হাসেন, সামান্য স্নায়বিক টিকস আছে এবং তীব্র বেগে কথা বলেন। তিনি ঢাকার কেন্দ্রে তার প্রাসাদে আমাদের গ্রহণ করলেন। তাঁর সাড়ে তিন বছর বয়সী ছেলে সভায় উপস্থিত ছিলেন।সে তার খেলনা চাবুক দিয়ে কাল্পনিক মাছিদের আঘাত দিচ্ছিল। আমি প্রশ্ন করার পরে টিক্কা খান নিম্নের জবাবগুলো দিয়েছিলেন। –

আমি এখানে ঘটনা চরম আকার ধারণ করার পরে এসেছি। আমাকে দুটি জিনিস করতে বলা হয়েছে: প্রথমত, সেনাবাহিনীর ঐক্য ধরে রাখা এবং দ্বিতীয়ত মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আরও আলোচনার জন্য দরজা খোলা রাখা। রাষ্ট্রপতি আমাকে পরিষ্কার বলেছেন কোন পরিস্থিতিতেই যেন আমি আলোচনার সব সম্ভাবনা বন্ধ না করে দেই। কিন্তু এটা আমার বুঝতে সময় লাগেনি যে মুজিব দেশভাগের জন্য নাছোড়বান্দা হয়ে গেছেন। তার দল এবং বন্ধুরা সেই পথেই আগাচ্ছিল।তা সত্ত্বেও, আমি শেষ মূহুর্তের আগে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেইনি। আমরা সবাই চেয়েছি একটি সুরাহা হোক।

নির্বাচনী প্রচারণার সময়, মুজিব প্রকাশ্যে এবং বেসরকারীভাবে বলেছিল যে ছয় দফা কর্মসূচি নির্বাচনের পরে বোঝাপড়া করে নেয়া যাবে। ওই পদক্ষেপে দেশ মূলত আলাদাই হয়ে যায় কিন্তু তার পরেও আমরা মুজিবের বিরুদ্ধে কোন ব্যাবস্থা নেই নাই। পরে দুটি নাটকীয় ঘটনা ঘটেছে। প্রথমে মুজিব প্রকাশ্যে বলেছে যে ছয়দফার সাথে কোনো আপস হবেনা। এটা বলে সে চুক্তি ভঙ্গ করেছে।

তারপর তিনি একটি সমান্তরাল সরকার গঠন করলেন যখন আমরা এখানে আছি। তিনি ঢাকায় ন্যাশনাল ব্যাংক বন্ধ করলেন এবং তার দায়িত্ব অন্য একটি ব্যাঙ্ক কে দিলেন। তিনি পাকিস্তানি ব্যাঙ্ক নোট স্ট্যাম্পড করেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশ ঘোষণা করেন। তিনি পরিষ্কার ভাষায় বলে দেন যে তিনিজাতীয় পরিষদে যোগ দেবেন না – যদি সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা থাকেন। তিনি দুইটি পরিষদ চাইলেন।

উপরন্তু, তিনি সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচারিত করতে থাকেন এবং বলেন তিনি আমাদের সবার বিচার করবেন। তার এজেন্ট এর মাধ্যমে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সৈন্য ও অফিসারদের বলেন সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশ ত্যাগ করতে। যেহেতু তিনি একটি নিজের প্যারামিলিটারি প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। বরাবর আমরা আশা করেছি যে তিনি বুঝতে পারবেন যেসেনাবাহিনী তাঁকে পাকিস্তান বিভক্ত করার অনুমতি দেবে না। কিন্তু তিনি আমাদের সংকল্পকে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি প্রেস রেডিও এবং পূর্ব পাকিস্তানের টেলিভিশনকে বলেছিলেন পাকিস্তানের কোনো সংবাদ সম্প্রচার না করতে। এবং আমরা যে তথ্যই দেই না কেন সেগুলো প্রচার না করতে। তারপর সব সরকারি ভবন ও ব্যাংক থেকে পাকিস্তানী পতাকা সরানোর আদেশ দেন। একটি অনুষ্ঠানে তার সমর্থকরা পাকিস্তানী পতাকা এবং জিন্নাহ (পাকিস্তান এর প্রতিষ্ঠাতা) এর সব ছবি পুড়িয়ে ফেলা হয়।

আপনি কল্পনা করতে পারছেন যে আমাদের ধৈর্যের সীমা ছিলনা। যখন পাকিস্তান দিবস আসল মুজিব ও তার সমর্থকরা তাকে “বাংলাদেশ দিবস” বলল। তারা টিভিকে বলল পাকিস্তানের পতাকা না দেখাতে। আমি টিভিকে বললাম যদি তারা সেটা করে আমি প্রোগ্রাম বন্ধ করে দেব। তারা মাঝরাতের পরে কয়েক সেকেন্ড পতাকা দেখাল যার কিছুক্ষণ পরেই পাকিস্তান দিবস শেষ হল। তার পরেই তারা মজা করতে শুরু করল এই বলে যে এখন তাদের বাংলাদেশ দিবস শুরু হল। শেখ মুজিব আসলেন এবং একটি বাংলাদেশের পতাকা ঢেউয়ের মত দোলাতে লাগলেন।

তাঁতেই শেষ নয়। আমরা খবর পেলাম অবাঙ্গালি অফিসারদের হেডকয়ার্টারে আক্রমণ করা হল – গণহত্যা সঙ্ঘটিত করা হল – রেগুলার আর্মির অফিসারররা এতে জড়িত ছিলেন যারা বিহারি ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে এটা করেছেন।

সেই সময়ে আমার বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের ৫৫০০০ বর্গ মাইল এর মাত্র ২০ বর্গমাইল দখল করে রেখেছিল।মুজিব ও তার ভারতীয় সমর্থক ভেবেছিল আমাদের পক্ষে ছড়িয়ে পড়া এবং এত দ্রুত গতিতে সকল প্রধান অঞ্চলের দখল নেয়া অসম্ভব। যদিও আমরা তা করেছি যখন আমাদের সৈন্যের অনুপাত ছিল ১ এর বিপরীতে ১৮। বিদ্রোহীদের ছিল ৮০০০০ সশস্ত্র মানুষ। তাদের বেশিরভাগ আমাদের থেকে ট্রেনিং করেছে এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট আর ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এর সদস্য। ভারতীয়রা তাদের অনেক অস্ত্র দিয়েছে। তারা তাদের পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারদের হত্যা করেছে। তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের হত্যা করেছে। সমস্ত দেশে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।

আমার মনে আছে আমাকে যেদিন সেই আদেশ দিতে হয়েছিল সেদিন আমাদের একটা ক্রিকেট ম্যাচ হবার কথা ছিল – কিন্তু আমাকে তা বাতিল করতে হয়। ছেলেরা জানত তাদের অনেক প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু তারা পাকিস্তানের জন্য লড়াই করেছে। এটা তাদের দ্বিগুণ শক্তিশালী করেছে। আমরা বিদ্রোহীদের দ্রুত বিতাড়িত করেছি এবং সীমান্ত সুরক্ষিত করেছি যাতে ভারতীয়রা পূর্ব পাকিস্তানে তাদের নিয়মিত সৈন্যদের প্রবেশ ঘটিয়ে কোন এলাকা দখল করে নিতে না পারে। এবং এটাকে বাংলাদেশ না করতে পারে – যা তারা ভেবে রেখেছে।

আমি বলব না যে পরিস্থিতি আগের মত স্বাভাবিক হয়েছে। তবে সেনাবাহিনী পূর্ন দখল নিয়েছে। কোন যুদ্ধ হচ্ছেনা – যদিও কোথাও কোথাও ছোট খাট বাধা আসছে। অনেক গুপ্ত আক্রমণ হচ্ছে – সেদিন ঢাকাতেই ৩ টি স্থানে বোমা বর্ষন করা হয়েছে যার মধ্যে একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে। পাটের বাহনে আক্রমণ হচ্ছে বারবার। এখন আমরা পাট চট্টগ্রামে সৈন্য পাহারায় পাঠাই।

ভারতীয়রা যে মিথ্যা কথা বলে তা জেনে আমার হাসি পায়। সমস্যা তৈরির দ্বিতীয় দিনে তারা বলেছিল আমাকে গুপ্তহত্যা করা হয়েছে। একই দিনে আমেরিকার কনস্যুলেট জেনারেল আমাকে জানালেন তার কথাও বলা হয়েছে যে সে নাকি আমার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় উপস্থিত ছিল।

তারপরে তারা রটাতে থাকে যে আমার মাথার উপর তারা জ্বলছে এবং আমি একটা ক্ষমতা লোভী খুনি। তারা বলেছে আমরা হিন্দুদের শেষ করে দিচ্ছি যেহেতু আমাদের নাকি আর কিছু করার নেই। আমাদের ছেলেরা ঢাকার পাশে একটি গ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে একশন নিতে গেলে দুই জন গ্রামবাসী নিহত হয়। ভারতীয়রা বলেছে আমরা ২০০০ হিন্দু মেরেছি। কিন্তু আসলে ওই দুইজনের একজন ছিল হিন্দু।

এখন ভারতীয়রা মুজিবের তথাকথিত বাহিনী মুক্তিফৌজ (মুক্তিবাহিনী) কে ট্রেনিং দিচ্ছে। আমাদের বর্ডারের চারপাশ দিয়ে ট্রেনিং ক্যাম্পগুলো বিস্তৃত। তবে তারা আমাদের গুরুতর খতি করতে পারবে না যতক্ষণ না তারা পূর্ণ সামরিক বাহিনী দিয়ে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পরে। সেটা হবে আর্মির সাথে আর্মির যুদ্ধ এবং আমরা সেই ব্যাপারটা দেখব।

আওয়ামী লিগার এম এস

এম এস – যিনি তার পরিচয় দিতে চান না – তিনি আওয়ামীলীগের একজন সক্রিয় কর্মি। আমি তার সাথে গত শীতে ঢাকায় পরিচিত হই। এবং তিনি গত সপ্তাহে আমাকে আবার পূর্ব পাকিস্তানে ডেকে পাঠিয়েছেন। যখন সমস্যা শুরু হয় তিনি প্রত্যন্ত এলাকায় চলে যান। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ক্ষমা ঘোষণার পরে তিনি ঢাকায় আসেন। তিনি আমাকে যা বলেছেন তা নিম্নরূপ –
২৬ মার্চ রাত ঢাকায় ছিল সত্যিকারের ইন্দোনেশিয়ান রাত। সবাই জানত যে আক্রমণ হবে। এবং পাল্টা আক্রমণও হবে। আর্মি আওয়ামীলীগের কর্মীদের তালিকা করে রেখেছিল এবং স্বাভাবিকভাবেই কারফিউ জারি করে তাদের ধরে ধরে আনছিল। ছাত্রনেতা যাদের বেশিরভাগ নক্সাল কর্মী – যারা পশ্চিম পাকিস্তানের পরিবারগুলোর উপর আক্রমণ করেছিল – তারা ছিল প্রধান টার্গেট। অন্যরা পালিয়ে যাবার সময় তাদের হত্যা করা হয়।

আওয়ামীলীগ চরমপন্থিরা ইতোমধ্যে তাদের প্রতিশোধ নিতে শুরু করে এবং যতটা সম্ভব অবাঙ্গালিদের ধরার চেষ্টা করে। একটি রাজনৈতিক সমাধানের পথ শেষ হয়ে যায়। এত দ্রুততার সাথে শেষ হয় যে আমাদের মত যারা কম্প্রোমাইজের চেষ্টা করছিল তারাও পিছু হটে।

আর্মি একশন শুরু হবার পর আওয়ামিলিগাররা গ্রামে ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের শহরে বসবাস করা অবাঙ্গালিদের হত্যা করতে থাকে যাদের তারা গুপচর সন্দেহ করেছিল। যেকারনেই হোক তারা ভেবেছিল যে ওইসব অবাঙ্গালিরা বিদ্রোহীদের আর্মিদের কাছে চিনিয়ে দেবার ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে। তাই তারা বিহারী, পাঞ্জাবি ও অন্যান্যদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।

শুধু ঢাকায় ১০০০০ জনগণকে হত্যা করা হয় যদিও কিছু কিছু মানুষ সংখ্যাটাকে বাড়িয়ে ৫ লক্ষ বলে। তবে সঠিক সংখ্যা বলা সম্ভব নয়। অনেক লোক শহর ছেড়ে পালিয়েছে এবং এখনো অনেকে গ্রামে লুকিয়ে আছে। তাই যাদের বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনরা মনে করছে যে তাঁরা মারা গেছেন। আমার এক বন্ধু আমাকে মৃত ধরে নিয়েছে যখন আমি লুকিয়ে ছিলাম। তাই যাদের মৃত বলে ধরা হয়েছিল তাদের সংখ্যাটা আস্তে আস্তে কমছে।

আমাদের বেশিরভাগ মনে করে যে মুজিব দেশভাগ চেয়েছে। যদিও ছাত্রনেতারা ও তাদের বন্ধু যারা নেতৃত্বে আছে তারা এটা চায়নি। আমার নিজের মত হচ্ছে মুজিব পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলা কে আলাদা করতে চেয়েছিলেন – তবে এখনই নয় – কিন্তু তাকে তার কাজের গতিতে চাপ দেয়া হয়েছে – নক্সাল আর কলকাতায় বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদীদের চাপের মুখে সে তার পরিকল্পনা প্রকাশ করতে বাধ্য হয়।

আমি বলতে পারছিনা এর পরে কি হবে। কেউ পারবেনা। মিলিটারি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও রাজনৈতিক সমস্যা পরেই আছে। সমস্যা হল এত বেশি ঘৃণা ও সন্দেহ তৈরি হয়েছে যে এই অবস্থায় জনগণ আর আর্মির মধ্যে আলোচনায় বসা সম্ভব না। এমনকি বাঙ্গালি সরকারি কর্মচারী যারা সাহায্য করতে চেয়েছে তারাও সন্দেহে আছে। শত শত সরকারি কর্মকর্তা পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেছে। এবং তাদের কাজ হল পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি কর্মচারিদের দেখে রাখা।

আমি জানিনা ঢাকার বাইরের অবস্থা কি। তবে শুনেছি চট্টগ্রাম ও কক্স বাজারে আর্মি বিমানে বোমা মারা হয়েছে এবং নেভিকে শেলিং করা হয়েছে। সম্ভবত উত্তর-পূর্ব অঞ্চলেও যুদ্ধ চলছে। কিন্তু যতক্ষণ ভারত সরাসরি প্রবেশ না করছে ততক্ষণ বাংলাদেশ ফোর্সের ক্ষমতা নাই টিক্কা খানের সুশৃঙ্খল ও উচ্চ ট্রেনিংপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীকে দমাতে পারে। মুজিব ছাড়া আওয়ামীলীগের কোন স্বীকৃত নেতা নাই। এবং ইতোমধ্যে তার দলে রেষারেষী ও হিংসাবিদ্বেষ শুরু হয়ে গেছে। যা কিছু হচ্ছে তা দুই পাকিস্তানের লোকদের ভুলতে অনেক অনেক সময় লাগবে। আমি আশা করি বেশি সময় লাগবে না কারণ দিন যত যাচ্ছে বোঝাপড়ার সম্ভবনা তত কমছে।

পূর্ব পাকিস্তানি নেতাদের পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের সাথে কথা বলা সহজ। তবে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের কিছু বলার নাই – অন্তত এই সময়ে। তাছাড়া, ভারত নিশ্চই নিজেদের এই পরিস্থিতিতে সমঝোতাকারি হিসেবে দাবি করতে পারে। সেই লক্ষ্যে তারা মুজিবের সাথে কথা বলছে এবং ধীরে ধীরে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ইচ্ছাকে প্রকাশ করছে। বিপদ হল যদি দুই অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতারা যদি আলোচনায় না বসে তাহলে দ্রুতই আর্মি আর ভারত উভয় পক্ষের হয়ে ব্যাবস্থা নিতে শুরু করবে যা যুদ্ধকে আমন্ত্রণ জানাবে।

(৩) মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি

মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি একজন দীর্ঘকায়, বুদ্ধিমান ও নরম ভাবে কথা বলা একজন সৈনিক যিনি মার্শাল ল চলাকালীন সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক বিষয়গুলো দেখাশোনা করেন। তিনি এই এলাকাকে ভালো চেনেন এবং তার মত একজন পেশাজীবী সৈনিকের পক্ষে রাজনৈতিক অবস্থাটা বোঝা একটু অস্বাভাবিক। তিনি যা বলেছেন তা নিম্নরূপ –

প্রথমে আমি যে ব্যাপারটা পরিষ্কার করতে চাই তা হল, আমরা কি এখনো বুঝতে পারিনি যে মুজিব ও তার দল পাকিস্তানকে বিভক্ত করতে চায়? তা না হলে আমরা এই একশন নিতাম না। আমরা রাজনৈতিক ক্ষমতা চাইতাম না। আমরা নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছি এবং সকল ভীতি দূর করেছি। যদি আমরা ক্ষমতাই চাইতাম তাহলে আমরা নির্বাচন দিতাম না এবং আর কোন ব্যাবস্থা না নিয়ে অবস্থান করতাম। আপনারা দেখেছেন যে আমরা আওয়ামীলীগকে ভেঙ্গে ফেলেছি। আমরা এটা আরও আগেই পারতাম যখন মুজিব আরও দুর্বল ছিলেন। আমি মুজিবকে অনেক দিন ধরে চিনি। গত কয়েক বছর প্রায় প্রতিদিন আমার তার সাথে যোগাযোগ হয়। সে একজন দুর্বল মানুষে পরিণত হয়ে পারত – হাইপোক্রিটিকাল হতে পারত। সে আমাদের সাথে প্রাইভেটলি যা বলে মানুষের সামনে ঠিক তার উল্টোটা বলে। সে মনে করে সে আমাদের সকল আর্মিকে ঘোরাতে থাকবে – এবং সে আমাদের রাজনৈতিক সমঝোতার চেষ্টাকে আমাদের দুর্বলতা মনে করেছে।

এমন অপারেশন চালানো আর্মির পক্ষে গৌরবজনক কিছু নয়। আমরা এটা করতাম না – মুজিবের কারণে যদি না আমরা করতে বাধ্য হতাম। এই মানুষটি নেতৃত্বের জন্য অযোগ্য কারণ সে নিজেকে বড় মনে করে এবং সে নিজের জনপ্রিয়তা হারানোর ভয়ে যেকোন ধরনের কাজ করতে পারে। সে মানুষকে ক্ষেপীয়ে তুলতে পারে – যদিও কিছু ঘটনা ঘটেছে – তাকে স্টেটসম্যান হতে জোর করা হয়েছে।

আমি এখন এমন কিছু বলব যা এর আগে আমি কাউকে বলিনি। আমার উপরস্থদের ছাড়া। সমস্যা শুরুর একদিন আগে এবং আর্মি একশন শুরুর আগে আমি মুজিবকে একটি পরিণতিতে আসার জন্য শেষবারের মত ডাকলাম। তিনি বললেন ‘আমার এখন আর বলার কিছু নাই।’ তিনি বলেছেন তিনি বুঝতে পেরেছেন যে তাকে যেকোন মুহূর্তে হত্যা করা হবে।

তিনি বলেছেন – ‘তোমরা যা চাও আমি যদি তা করি তবে ছাত্ররা আমাকে মেরে ফেলবে। তারা যা চায় তা যদি আমি করি তাহলে তোমরা আমাকে মেরে ফেলবে। যেকন দিক দিয়েই আমি আসলে শেষ।’

এখন আপনার কি মনে হয় একজন স্টেটসম্যানের ক্যারিয়ারের এমন মুহুর্তে একথা বলা সঠিক? আমি কোন রাজনীতিবিদ না এবং কখনো তা হবার কথা ভাবিওনা। কিন্তু একজন মানুষ এত ভীতিতে থাকলে কিভাবে রাজনীতি করে? আমরা মুজিবের থেকে যেকন কিছুই আশা করেছিলাম – কিছুটা দেশভাগের ব্যাপারটাও। সে তার ওই রূপটা দেখাতে চায়নি কারণ সে সবার মাঝে জনপ্রিয় থাকতে চেয়েছে। কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব? আপনি হয়ত বলতে পারেন তাকে দ্বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ভালো, সেক্ষেত্রে আমার কথা হল যাকে খুনি হতে জোর করা হচ্ছে – যারা জোর করছে তাদেরই এজেন্ট হিসেবে সে কাজ করছে।

এখন আসুন অন্যদিকে একটু দেখি। ভারতীয়রা বলছে আমরা প্রেসিডেন্ট ও মুজিবের সাথে বোঝাপড়ার কথা বলে সময় ক্ষেপণ করছি মূলত পূর্ব পাকিস্তানে গ্রিন ট্রুপ্স আনার জন্য। আমি সৈনিকের মুখের সন্মান থেকে আপনাকে একটি কথা বলি – এই সময়ে একটি মানুষও এখানে প্রবেশ করেনি। আমরা মার্চ ২৫ এর পর থেকে সেটা শুরু করেছি। আমাদের অফিসারদের অবস্থা শোচনীয় এবং সাধারণ জনগণের উপর আক্রমণ চলছে। প্রথম কিছু দিন আমরা অবস্থার সাথে পেরে উঠছিলাম না। সাহায্যের দরকার ছিল। যদি আমরা আগে থেকে লোক আনতে চাইতাম তাহলে তা এমনিতেই পারতাম।

এছাড়াও ভারতীয়রা বলে, বিদ্রোহীরা প্রায় ৩৫০০০ পাকসেনা হত্যা করেছে গত কয়েক মাসে। আমি আপনাকে বলতে চাই, যদি এই তথ্য সত্যি হত তাহলে এই মুহুর্তে পূর্ব পাকিস্তানে কোন সৈন্যই থাকত না।

তারা আরও বলে যে প্রায় ১০ লক্ষ লোক মারা হয়েছে এবং ৮০ লক্ষ মানুষ শরনার্থি হয়েছে। তার মানে ৭ কোটি মানুষের মধ্যে ৯০ লক্ষ মানুষ। এটা কিভাবে একজন বিশ্বাস করে? হাজার হাজার মানুষ নিজ স্থান থেকে শরে গেছে কিন্তু আমি আপনাকে বলতে পারি সমস্যার সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে যে মানুষ মারা গেছে তাদের সংখ্যা ১০০০০ এর বেশি হবে না – যাদের মধ্যে অর্ধেক হচ্ছে অবাঙ্গালি যারা মুজিবের ঝোড়ো বাহিনী ও পূর্ব পাকিস্তান আর্মির বিদ্রোহীদের দ্বারা নিহত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকায় উভয় পক্ষের ৩৬৫ জনের বেশি নিহত হয় নাই। এখন ভারতীয়রা বলে এটা ১০০০০ বা কখনো বলে ৫ লাখ। আমি আপনাকে একটা কাজ করতে বলি। ঢাকার পথে পথে মানুষকে জিজ্ঞেস করুন কতজন লোক মারা গেছে। সম্ভবনা আছে তারা বলবে কয়েক হাজার বার তারও বেশি। কিন্তু তাকে জিজ্ঞেস করুন তার নিজের কেউ মারা গেছে কিনা – বা এমন কোন আত্মীয় বা বন্ধু আছে কিনা যে হারিয়ে গেছে। আমি নিশ্চিত সে আপনার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে ‘না’ বলবে।

একই কথা যেসব মানুষ অন্যত্র শরে গেছে তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ঢাকার জনসংখ্যার ১০% পার্শবর্তী গ্রাম-গঞ্জে পালিয়ে গেছে। তাই আপনি দেখতে পাবেন দোকান পাট বন্ধ আছে। কিছু ঘর পরিত্যাক্ত। কিন্তু আমি নিশ্চিত আপনি দেখবেন যে ভারতীয়রা এই সংখ্যাটাও বাড়িয়ে বলবে। প্রশাসন যতটা উদ্বিগ্ন আছে তাতে আমি মনে করি খুব দ্রুতই স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে। প্রায় ৯০% সরকারি কর্মচারি তাদের চাকুরীতে যোগ দিয়েছেন। তাদের কেউ কেউ ভয়ে লুকিয়েছেন। কারণ তারা মনে করেছেন মুজিবের বাহিনীর কারণে তাদের অবস্থা ভয়ানক হতে পারে। তাদের অঞ্চল থেকে আর্মি শরে যাওয়া মাত্রই তারা স্বাভাবিক কাজে যোগ দিচ্ছে। আমরা সৈনিক এবং আমরা সরকারি কাজে যোগ দিতে চাইনা। আমাদের একমাত্র কাজ হচ্ছে প্রশাসনের পরিবেশ পুনরুদ্ধার যেখানে দরকার সেখানে। এক্ষেত্রে আমরা আর্মির সুপিরিয়র অর্গানাইজেশন, শৃঙ্খলা ও সম্পদকে ব্যাবহার করে সেবা দিচ্ছি। এর বাইরে আমার প্রশাসনের ব্যাপারে কিছু করার নেই। অর্থনিতি বা কৃষি – এসব ব্যাপারে আমি কি-ই বা জানি?

হাজার হাজার অন্যত্র সরে যাওয়া মানুষ ঘরে ফিরছে এবং আমরা তাদের গ্রামে ফিরে আস্তে সাহায্য করছি এবং তারা যাতে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কাজ পুনরায় শুরু করতে পারে সেই চেষ্টা করছি। সীমান্তে আমাদের ২০ ট রিসিপশন কেন্দ্র আছে – আপনারা দেখতে পারেন। এবং সকল সরে যাওয়া মানুষদের পুনর্বাসনের জন্য আমরা ক্র্যাশ প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছি। তাতে তারা পাকিস্তানের ভেতর থেকে বা অথবা ভারত – যেখান থেকেই আসুক না কেন। যারা ভারত থেকে ফিরে আসছে তাদের অস্বাভাবিক পথে আস্তে হচ্ছে – কারণ ভারতীয় সেনারা তাদের বর্ডার পার হয়ে আসতে দিচ্ছে না। আপনারা জানেন যে প্রেসিডেন্ট সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন এবং সবাই নিরাপদে ঘরে ফিরে আসতে পারে।

(৫) সাবেক বিচ্ছিন্নতাবাদী এ এ

এ এ – একজন বিহারী – ঢাকায় থাকেন। গত ফেব্রুয়ারিতে আমি তার সাথে প্রথম সাক্ষাত করি। যখন সে আমাকে বলেছিল পূর্ব পাকিস্তান একটি আলাদা দেশ হওয়া উচিত। সেই সময়ে সে খুব খারাপ ভাবে মুজিবের বিরোধিতা করেছিল। কারণ আওয়ামীলীগের এই নেতা দেশভাগের বিপক্ষে ছিলেন। যখন পূর্ব পাকিস্তানে সমস্যা শুরু হল এ এ গা ঢাকা দিলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট কর্তৃক সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরে আবার শহরে ফিরে আসেন। তার কথার কিয়দংশ –

আমি এখনো শোকমুক্ত হইনি। একজন বিহারী হিসেবে আমি ঝুঁকিতে ছিলাম যে আওয়ামীলীগের লোকেরা আমাকে মেরে ফেলতে পারে। দেশভাগের পক্ষে থাকায় আমি হিংসুটে সৈনিকদের কাছেও লক্ষ্যবস্তু ছিলাম। তবু দেখুন, আমি এখনো বেচে আছি। বেচে আছি কিন্তু ভয়ে আছি। আমি দেশভাগের পক্ষে ছিলাম কারণ আমি দেখছি এই দেশ মাঝাখানে ভারত দিয়ে প্রায় ১০০০ মাইল দূরে দূরে অবস্থিত – যা অসমর্থনীয়। যখন দেশভাগ হল আমরা ছিলাম উদ্বাস্তু – পাকিস্তান নিয়ে অনেক আশা ছিল। কিন্তু একনায়কতন্ত্র আমাদের আশা ধূলিসাৎ করে দিয়েছে এবং বাস্তবিক অর্থে পূর্ব পাকিস্তান উভয় পাকিস্তানের কিছু ক্যাপিটালিস্টের হাতে জিম্মি।

আইয়ুবের পতনের আগে পশ্চিম পাকিস্তানের কেউ আমাদের ব্যাপারে সচেতন ছিলনা। দুই অঞ্চল আজ যে ভোগান্তি ভোগ করছে তার জন্য প্রধান দায়ী ব্যাক্তি আইয়ুব। ইতিহাসে একটি জাতিকে বারবার সুযোগ দেয়া হয় না। পাকিস্তান জাতি হিসেবে প্রায় সবগুলো সুযোগ হারিয়েছে আইয়ুবের আমলে।

আমি উভয় অঞ্চলের গণহত্যার ব্যাপারে তেমন জানিনা। আমরা বিহারীরা – যেকরেই হোক – মুজিবের মুক্তিবাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত। তারা আমার অনেক আত্মীয় ও বন্ধুদের জবাই করেছে। এবং আমি জানি সেখানে ভারতীয় সৈন্যও ছিল। পশ্চিমবঙের ভলান্টিয়ারও ছিল তাদের তালিকায়। এখন আমি জানি বাংলাদেশ হতে যাচ্ছে যেমন আমি ভাবতাম আমার হয়ত আজ বেচে থাকার কথা না।

মানুষ মানসিক বিকারে ভুগছে। তারা পরিস্থিতির শিকার। তারা পরাস্ত, তিক্ত, ধ্বংসপ্রায় আর নিতান্ত অসহায় বোধ করছে। সবচেয়ে খারাপ জিনিস তাদের বন্ধু আর আত্মীয়দের মৃত্যু নয়। সেটা হল আশার মৃত্যু। এবং এই মানুষগুলো – এমনি জানেন – আশার উপর নির্ভর করে বেচে আছে। মানুষের দরকার দয়া, উদারতা এবং আধ্যাত্মিক ক্ষতগুলো সারানোর দরকার। যাতে তারা পুরপুরি ভেঙ্গে না পরে। এটা বিষয় নয় যে কে দায়ী। বিষয় হচ্ছে এই মানুষগুলোকে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়া থেকে বাঁচানো।

আমি বিশ্বাস করিনা যে মুজিব সত্যিকার অর্থে দেশভাগ চেয়েছিলেন। সে রাজনৈতিক চালের খেলনামাত্র। সে কি সত্যিই বাংলাদেশ চেয়েছিল? সে পারত প্রধানমন্ত্রীর আসন নিয়ে সেনাদের ব্যারাকে পাঠিয়ে দিতে এবং ধীরে ধীরে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করতে। পূর্ব পাকিস্তানের কোন প্রশাসনিক যন্ত্রব্যাবস্থা বা নিজস্ব আর্মি ছিলনা যা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের থাকতে হয় – থাকতে হয় তার অস্তিত্বের জন্য। যদি মুজিব বাংলাদেশের জন্ম ঘোষণা দিতেন তাহলে তাকে দিনের পর দিন টিকে থাকার জন্য ভারতের উপর নির্ভর করতে হত। পূর্ব বাংলা হত ভারতের একটি কলোনি। এর অন্য পথটি হতে পারত পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে বাঙ্গালিদের একত্র করা যেত। এর জন্য পশ্চিম বঙ্গেও অনেক বড় আন্দোলন হয়েছে। সেক্ষেত্রে, অবশ্য ভারত আর পশ্চিম পাকিস্তান মিলে একসাথে হাত লাগাত সংযুক্ত বাংলাদেশ না গড়তে দেবার ব্যাপারে।

এটা কোন বিষয় নয় যে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে থাকবে কিনা। যেকন অবস্থায় এটাই সবচেয়ে ভালো পথ ছিল। আসল কথা হল, পূর্ব পাকিস্তানকে বাঁচতে হবে।

(৫) তাহসিন মুহাম্মাদ

তাহসিন মুহাম্মাদ একজন পি আই এ গোমস্তা। তিনি গত কয়েকমাস ধরে করাচী ও ঢাকা যাওয়া আসা করছেন। তিনি যা বলেছিলেন তা নিম্নরূপ –

যখন সমস্যা আসলো আমরা পাগলের মত ঢাকা যাওয়া আসা করছিলাম। আহত মহিলা শিশুদের ভর্তি করে যেতে হচ্ছিল। বেশিরভাগ বিহারী। হাজারখানেক নিয়ে গেছি আমরা। অনেকের চোখ উপড়ে ফেলেছে বাংলাদেশ ফোর্সের লোকজন। অনেক মহিলার স্তন কেটে ফেলা হয়েছে। নিষ্পাপ শিশুদের সামনে তাদের বাবাকে জবাই করা হয়েছে।

আমি এত বীভৎস দৃশ্য দেখেছি যে তা আমার বাকি জীবন রাতের ঘুম হারাম করার জন্য যথেষ্ট। জিন্না যখন পাকিস্তান আন্দোলন করেছিল তখন আমরা ছোট ছিলাম। আমরা ভারতের হিন্দুদের দ্বারা লন্ডভণ্ড হবার ভয়ে ছিলাম। কিন্তু কোনোদিন ভাবিনি যে একজন মুসলমান আরেকজন মুসলমানকে হিটলারের মত জবাই করবে।

কায়হান ইন্টারন্যাশনাল, ১ আগস্ট, ১৯৭১
শেখ মুজিবের উত্থান- পতন
– আমি তেহারি

ঢাকার মাঝখানে ফ্যাশনেবল ধান্মন্ডি এলাকায় একটি ফ্যাকাসে- হলুদ তিনতলা বাড়ি – যেখানে নাকি শোনা যায় বর্ষার রাতে ভুতের আশ্রয় হয়। বেশিরভাগ জানালা ভাঙ্গা। প্রায় সবগুলো দেয়ালে গুলির চিনহ। বৃষ্টিতে ভেজা ইট বিবর্ন হয়ে গেছে। পুরনো গাছের পাতার ফাঁক গলে দেখা যাচ্ছে একটি স্লোগান সাঁটা – ‘জয় বাংলা’।

যারা এই বাড়ীর পাশ দিয়ে যান তারা যথেষ্ট দূরত্ব মেনে চলেন। যা ইতোমধ্যেই কিংবদন্তি হয়ে গেছে।

এই বাড়ীর মালিক শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি আওয়ামীলীগের প্রধান নেতা। যার বিপুল জনপ্রিয়তা ও পতন ও উত্থান সমানুপাতিকভাবে লাখো মানুষকে একাধারে দুঃস্বপ্ন আবার কখনো তার বক্তব্যে বছরখানেক ধরে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকে।

একটি ঘরে যা মুজিবের ঘর আমরা দেখতে পেলাম অনেকগুলো চিঠির গাদা – যার বেশির ভাগ এখনো খোলা হয়নি। বিয়ের দাওয়াতের কার্ড, এটা- সেটার অনুরোধ, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা বাংলায় লেখা নানান কাগজ পত্র। সব চিঠিই মার্চের মাঝামাঝি সময়ে এসেছে – কিন্তু শেখ মার্চের ২৬ তারিখে আটক হন – তাই চিঠি খোলার সময় তার নেই।

তার ডেস্কে স্যার আইভর জেনিংস এর ‘পাকিস্তানের সাংবিধানিক সমস্যা’ বইটা পেলাম যা তিনি মুজিবকে উতসর্গ করেছেন – যা একজন প্রাক্তন শিক্ষক হিসেবে উতসর্গীকৃত। কাভারের ভেতরের দিকে আমরা পড়লাম – রাজনীতি ক্ষমতার দিকে ধাবিত হতে সাহায্য করে কিন্তু ‘জ্ঞ্যান’ও ক্ষমতা। এবং মুজিব লিখেছেন এটা এমন একটি বই যা আমি সব সময় পড়ি – যখন আমি জেলে থাকি। কিন্তু এবার বইটা নেবার সময় তার হয়নি।

অন্য রুমগুলোতে প্রচুর বই, রেকর্ডপত্র ছড়ানো আছে – সাথে সাথে অনেক ছিন্ন ফুল, রঙ্গিন বাল্ব, কালো পতাকা ও পার্টী স্লোগান তাতে পূর্ন। পুরো বাড়ীর চেহারা এমন যে একটি বড় দল ঢুকে সব লন্ডভণ্ড করে দিয়েছে।

স্বাধীনতার শেষ ৪৮ ঘণ্টায় শেখ খুব অস্থির ছিলেন। নির্বাচনে বিপুল বিজয় আর পূর্ব পাকিস্তানে কোন প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় তিনি নিজেকে পূর্ব পাকিস্তানের দরিদ্র ৭৫ মিলিয়ন মানুষের মসিহ মনে করতে পারেন।

জটিল চাল আর পাল্টা চালের পর পাকিস্তানের প্রথম অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শেখ একজন দক্ষ শিল্পীর মত কাজ করেছেন এবং সব সময় ভুল পথে এগিয়েছেন।

তিনি ৬ দফা নিয়ে কাজ করেছেন এবং পূর্নাঙ্গ স্বাধীনতা চেয়েছেন – সত্যিকার অর্থে তা প্রয়োগ করা হলে কেন্দ্রীয় সরকারের পূর্ব পাকিস্তানের উপর কোন ক্ষমতাই থাকেনা। পাশাপশি তিনি তার দল আওয়ামীলীগকে একীভূত করতে ও নেতৃত্ব দিতে পেরেছেন এবং নানা রকম আর্থ-সামাজিক লক্ষ্য ও রাজনৈতিক পরিকল্পনা ঠিক করেছেন। তার কেন্দ্রীয় সরকারের মাঝে প্রো-মাও কমিউনিস্ট, এন্টি-কমিউনিস্ট জমিদার, ধনি ব্যাবসায়ী, বিদ্রোহী ছাত্রসমাজ, পম্পাস মিডল ক্লাস আইনজীবী থেকে শুরু করে প্রান্তিক পাটচাষি পর্যন্ত আছে।

জাতীয় পরিষদ গঠনের জন্য নির্বাচন হয়েছিল – যারা পাকিস্তানের সংবিধান রচনা করবে। কিন্তু মার্চের শেষ দিকে তিনি তার বিদ্রোহী নেতাদের কথায় মিলিটারি সরকারকে এসেম্বলিতে জরুরি ভিত্তিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি করেন।

এটা করার জন্য অনেকেই তাকে উৎসাহ দেন যাদের মধ্যে আছেন পশ্চিম পাকিস্তানি নেতা মুসলিম লিগের কায়ুম খান ও অন্যান্য ছোট ছোট ব্যাক্তিত্ত যেমন এয়ার মার্শাল আসগার খান, নাস্রুল্লাহ ও মিয়া মুমতাজ দৌলাতানা। তাই তিনি ভেবেছিলেন তার এই মুহুর্তে মার্শাল ল বন্ধ করা ও এসেম্বলিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃকও সমর্থিত হবে। একমাত্র ব্যাক্তি যাকে তিনি হিসেবে ধরেন নি – সে হল জুলফিকার আলি ভুট্টো – পশ্চিম পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান – এসেম্বলির দ্বিতীয় বৃহত্তম দল – যে এসেম্বলি এখনো হয়নি।

মুজিব এসেম্বলি বন্ধের কারণ হিসেবে ভুট্টোকে দায়ী করেন। এবং যখন প্রেসিডেন্ট নতুন তারিখ দেন তখন তিনি আর আগ্রহ দেখাননি। তিনি ক্ষমতা চাচ্ছিলেন তখন থেকে। তিনি দেখলেন মিলিটারি প্রধান দুর্বল তবে হয়ত জাতিকে দুর্বল হতে বাধা দেবেন – কিন্তু আসলে এটি একটি দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের সূচনা করবে।

এর পরে কিছু গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় ৩০০ বাঙ্গালি নিহত হয়। যার প্রেক্ষিতে মার্শাল ল জারি করা হয়।

তার কাজে অনভিজ্ঞতার ছাপ আছে। তিনি চেয়েছিলেন যে জেনারেলরা তার হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেবে। আসলে তার ইচ্ছা চাপিয়ে দেবার এছাড়া আর কোন পথ ছিলনা।

মার্চের মাঝামাঝি সময়ে তার হরতাল চলছিল যদিও একই সময়ে তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে বোঝাপড়া করছিলেন। তিনি এমনভাবে কথা বলেন যেন মনে হয় তিনি ইতোমধ্যে ক্ষমতা পেয়ে গেছেন এবং এটা পরিষ্কার করে দেন যে তখন থেকেই তিনি আসলে মিলিটারি সরকারকে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের এসেম্বলি মেম্বারদেরকে নির্দেশ দিতে শুরু করে দিয়েছিলেন।

এটা বলার পরিবর্তে তিনি জেরারেলদের বিচারের দাবি জানাতে পারতেন। মুজিব সে সরকার গঠনের পলিসি দিয়েছেন সেখানে ভালো কিছু নেই। তিনি বলেন নাই যে এটা শুধুমাত্র পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কাঠামো – নাকি পুরো পাকিস্তানের জন্য এটা প্রযোজ্য হতে যাচ্ছে। প্রথম বিকল্প পথটা বেশি গ্রহণযোগ্য যেহেতু আওয়ামীলীগ ভুট্টোকে সম্পূর্ন এড়িয়ে যেতে পারেনি – সেক্ষেত্রে হয়ত তাদের সরকার গঠনের সম্ভবনা ছিল।

মুজিব তার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। তিনি তর্ক করলেন যে মার্শাল ল পূর্ব পাকিস্তানে কাজ করার অধিকার হারিয়েছে। এবং তিনি নিজের ইচ্ছা মত করছিলেন সব। তিনি ইয়াহিয়াকে বললেন তার দল নির্বাচনে জিতেছে এবং এভাবে তিনি ক্ষমতা পেয়েছেন। মিলিটারি সরকার পশ্চিম পাকিস্তানে কি করছে সেটা তার দেখার বিষয় না।

এই পয়েন্টে তিনি আসলে ভাঙ্গনের কথা বলেছেন। কেউ জানত না এর পরের স্টেপ কি হবে। আলোচনার পথ বন্ধ হওয়ায় সেটাকে আওয়ামীলীগের চরমপন্থিরা ‘বিজয়’ হিসেবে দেখল। তারা সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করা শুরু করল এবং বাঙ্গালি সৈন্য ও অফিসারদের বলল তাদের পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে।

অন্যদিকে ইয়াহিয়া খানকে শেখের সাথে এসব কাজের ফলাফলকে পুনরালচনা করার সুযোগ দেয়া হলনা। তিনি দেখলেন তার সেনাবাহিনীর এলোমেলো অবস্থা। তিনি দেখলেন তার সরকার শুধু পূর্ব পাকিস্তান নয় পশ্চিম পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ হারাতে বসেছে। মুজিব যা করছেন তাতে পশ্চিম অঞ্চলের মিলিটারি কাঠামোও ভেঙ্গে পড়বে। অসহায় হয়ে পরিস্থিতি থেকে নিষ্কৃতির জন্য প্রেসিডেন্ট আর্মিকে বেছে নিলেন।

এটা করে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের করা সমস্যার সমাধান করলেন। এরপর কি? মুজিব সফলভাবে হরতাল তুলে নিলেন কিন্তু আর্মিকে নির্মূল করার জন্য দেশের সর্বত্র নির্দয় গুণ্ডা ও নক্সাল বিদ্রোহীদের দিয়ে একটি আইন-কাঠামো তৈরি করার চেষ্টা করলেন। দুইটা লক্ষ্য অর্জন করতে তিনি সমর্থ ছিলেন না । তার কাছে যেহেতু খেলার জন্য আর কোন তাস নেই তাই তিনি সাধারণ পথে এগুতে থাকলেন। আর্মির সাথে আওয়ামীলীগকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে তিনি তার দলের ধ্বংস থামাতে পারলেন না।

তাকে তার জুনিয়র মিলিটারি অফিসাররা বলল ‘বাংলাদেশে’র স্বাধীনতা ঘোষণা করতে এবং অতি দ্রুত ভারতের কাছে মিলিটারি সহায়তা চাইতে। যদিও তিনি নিশ্চিত নন যে ভারত তার হয়ে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হবে কিনা। তিনি জানতেন পশ্চিমবঙ্গে একটি ভয়ানক প্রতিবাদ হবে – ভারতীয়রা এটাকে স্বাগত জানাবে না।

তিনি আশা করছিলেন কোন ভাবে জাদুকরী কিছু তাকে দেয়ালে ঠেকে যাওয়া থেকে রক্ষা করবে।

তার মধ্যবর্তী সমর্থকরা ধীরে ধীরে ব্যান্ড-ওয়াগন ছেড়ে যাচ্ছিল। তারা পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে পুরোটা যাবার চাইতে পূর্ব পাকিস্তানের বাণিজ্যে শেয়ার পাবার আশায় যোগ দিচ্ছিল। তারা খুব দ্রুত গৃহযুদ্ধ বাধানোর আশায় শেখের সাথে যোগ দেয় নি। কারণ এতে করে তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

সবাই তখন ভয় পেয়ে গেল এবং ‘আইন শৃঙ্খলা’ মেনে নিল। মুজিবের থেকে সমর্থন তুলে নিল। যদিও খোলাখুলিভাবে নয়।মুজিব তাদেরকে বলল আর্মিকে না খাইয়ে রাখতে। কিন্তু ব্যারাকে সাপ্লাই যেতে লাগল। মিলিটারি প্রধানদের সাথে কয়েক দফা গোপন বৈঠক হল।

চরমপন্থি ছাত্ররা মুজিবকে ছেড়ে যেতে শুরু করল – যদিও তাদের কারণ ভিন্ন। তারা তাকে চাচ্ছিল মাও-পন্থি করতে আর তিনি হচ্ছিলেন গান্ধি-পন্থি। তার ক্যারিয়ারের সর্বশেষ সময়ে কিছু অনির্ভরযোগ্য সাধারণ বাঙ্গালিদের সমর্থন ছিল। এগুলো খুব দ্রুত ঘটছিল। এবং দ্রুত তার অথোরিটি তাতে ঢাকা পরে গেল। তাদের মধ্যে আছে তাজউদ্দীন আহমেদ, আওয়ামীলীগের দ্বিভাগের মতে বিশ্বাসী সেক্রেটারি জেনারেল ও নুর-এ-আলম সিদ্দিকি ও এ এস এম আব্দুর রবের মত ছাত্রনেতারা।

অন্যদিকে লে জে টিক্কা খান পাঞ্জাব থেকে উঠে আসা অফিসারদের মধ্যে অন্যতম একজন অফিসার হিসেবে প্রশংসিত হলেন।

রোমান্টিক, সিদ্ধান্তহীন ও কনফিউজড রাজনীতিবিদ অভিনেতা মুজিবের জন্য কোণ যায়গা থাকল না। তখন থেকে ডায়লগের একমাত্র ভাষা ছিল বুলেট।

আওয়ামীলীগের চরমপন্থিরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করল যে মুহুর্তে মুজিবুর রহমান তার ধান্মন্ডির বাসায় বসে এরেস্ট হবার অপেক্ষা করছেন।

২৬ মার্চ সকালেই মুজিবকে আটক করে করাচী নিয়ে যাওয়া হয়। প্লেনে সে একঘণ্টার মত ঘুমায়। কারো সাথে কথা বলেনি। করাচী বিমান বন্দর থেকে তাকে কুয়েটার উদ্যেশ্যে প্লেন পরিবর্তন করতে হয়। এটা বেলুচিস্তানের রাজধানী। তাকে ভি আই পি লাউঞ্জে নেয়া হয় এবং ইংলিশ চা পরিবেশন করা হয়। তিনি ব্ল্যাক কফি চান। তারপরে দুইজন পুলিশ তার পেছনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলে।

খুব কম মানুষ এখন মুজিবের অবস্থান জানে। তাকে এক কারাগার থেকে অন্য কারাগারে নেয়া হচ্ছে। গত মাসে সে অনশনে গিয়েছিল কিন্তু তিনি খেতে রাজি হন যখন তার স্ত্রী ও সন্তানদের তার সাথে দেখা করতে নিয়ে যাওয়া হয়। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তিনি অনেক লেখালেখি করছেন। কেউ জানেনা তিনি কি লিখছেন – তবে অনেকের ধারনা তিনি তার বিচারের ডিফেন্সের জন্য কাগজপত্র তৈরি করছেন।

গুজব প্রচলিত আছে যে মুজিব মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং কয়েকদিন ধরে এলোমেলো বক্তব্য দিচ্ছেন। কিন্তু আমার কাছে ফার্স্ট হ্যান্ড তথ্য আছে যে এটা সত্য নয়। আওয়ামীলীগের এই নেতা ভালোই আছেন এবং তাকে কোন রকম নির্যাতন করা হয়নি বা অসন্মান করা হয়নি। বরং পরিস্থিতি এমন যে তিনি একজন ভি আই পি যিনি একটি বারে কিছু সময় পার করছেন।

কিছু আইনজীবী ও মিলিটারি প্রধানদের একটি গ্রুপ তার বিরুদ্ধে মামলার কাগজপত্র প্রস্তুত করছেন। তার বিচার কয়েকদিনের মধ্যেই হাই ট্রিজন চার্জে শুরু হবে। সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা।

পশ্চিম পাকিস্তানের কম লোকই বিশ্বাস করে যে মুজিবের মৃত্যুদণ্ড হবে। পাকিস্তানের ইতিহাসে রাজনৈতিক মৃত্যুদণ্ডের এযাবৎ কোন দৃষ্টান্ত নেই। এবং এটা খুব শক্তভাবে বিশ্বাস করা হয় যে এর অন্যথা হবেনা। বেশিরভাগ পশ্চিম পাকিস্তানি মনে করে যে মুজিব দেশ ভাগ চেয়েছেন এবং ভারতের সাথে মিলে চক্রান্তে অংশ নিয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানে মুজিবের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে এখনো ধারনা পাওয়া যাচ্ছেনা। খুব কম লোক তার ব্যাপারে কথা বলতে চান। এবং এদের মধ্যে যারা কথা বলতে চান – তারা হলেন দলের সাবেক সদস্য যারা এখন তাকে দায়ী করছেন তাদেরকে ফাঁদে ফেলার জন্য।

তথাপি, মুজিবকে পাকিস্তানের রক্তক্ষয়ী ঘটনার কারণ দর্শাতে হবে। ইসলামাবাদে যখন তার বিচার শুরু হবে তখন তাকে আইনের মুখোমুখি হতে হবে – শুধু কোর্ট মার্শালের কাছে নয় – সমস্ত ইতিহাসের কাছে।

কায়হান ইন্টারন্যাশনাল, ২ আগস্ট, ১৯৭১
একটি ক্ষুধার্ত দৈত্যের ভয়ংকর ছায়া
– আমির তেহারি

দুপুর বেলা ঢাকার নদীর পাশের শহরটিতে ছিল কাবাব খাবার সময়। প্রায় ২০ টা টং খোলা হয়েছে টিন আর কাছের গুড়ি দিয়ে। আটার গোলা দিয়ে কিছু একটা বানানো হচ্ছে আর সাথে ভেড়ার ভুঁড়ি ভেঁজে কাবাব হিসেবে দেয়া হচ্ছে। পূর্ন ভিড়ে এই আশ্চার্যজনক মিশ্র খাবারই সবার ক্ষুধা মেটানোর পাথেয়। এখানে হাজার হাজার জেলে, ভেন্ডর, জ্যোতিষী, ক্র্যাপ-সুটার, শুয়ে-বসে থাকা মানুষ, মাঝি, ভিক্ষুক, সবহারা পথিক যারা শহর দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, রোদে শুকিয়ে যাওয়া অর্ধউলঙ্গ কংকালসাড় মানুষ সবাই লাঞ্চ টাইমে কাবাবের দোকানে ভিড় করে।

সম্পূর্ন খাবারের দাম সিকি রুপি ( প্রায় আড়াই রিয়াল) এবং বেশিরভাগ মানুষ যারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাঁজা দেখতে থাকে তাদের বেশিরভাগই এগুলো কেনার ক্ষমতা রাখে না। দাঁড়িয়ে থাকা প্রতি ১০ জনের মধ্যে এক বয়া দুইজন মাত্র কিনতে পারে। তারা খুব আনন্দের সাথে খায় যেন একটুকরো স্বর্গ হাতে পেয়েছে। ভিড়ের বাকিরা অবাক হয়ে আফসোসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

সত্য বলা সম্ভব নয় – বলছিলেন পূর্ব পাকিস্তান পানি ও বিদ্যুৎ বোর্ডের এক সুদর্শন বাঙ্গালি। এলাকার সমস্যা নিয়ে বলার সময় তিনি একথা আমাদের বলেন। আমরা পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ন দেশ আর আমাদের মাথা পিছু আয় সবচেয়ে কম। খুব দুঃখ নিয়ে বললেন তিনি। ৫৫০০০ বর্গমাইল এলাকায় ৭৫ মিলিয়ন লোকের বাস। এই দশক শেষে জনসংখ্যা ১০০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে।

পূর্ব পাকিস্তান একটি সমতল ভূমি। একটি খালি গামলার কেন্দ্রের মত নেপাল ও ভারতের সমস্ত উঁচু যায়গার পানি আমাদের দিকে আসে। প্রতি বছর এটা বন্যায় ডুবে যায় – যখন বর্ষায় বিস্তির্ন সবুজের উপর ভারি বৃষ্টি হয়।

পানি ও বিদ্যুৎ বিভাগের প্রধান আমাদের জানান যে ৫ বিলিয়ন ডলার দরকার যদি এই বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হয় এবং সেচ নেটওয়ার্ক করতে হয়। যদি বর্তমান জীবনযাপন প্রণালির এমন সর্বনিম্ন পর্যায়ে থাকে আর আগামী দুই দশকে এটা করতে হয়। এটা পাকিস্তানের প্রতি বছরের জি এন পির প্রায় এক তৃতীয়াংশ। জাতীয় সরকারের আসলে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য কোন রিসোর্স নেই।

প্রদেশের বেশিরভাগ অঞ্চল মহামারির ঝুঁকিতে। সাম্প্রতিক সমস্যায় অর্থ, খাবার এবং প্রচুর শ্রমের ক্ষতিসাধন হয়েছে যা পরিস্থিতিকে আরও মারাত্মক অবস্থায় নিয়ে গেছে। দেশের প্রধান ফসল পাটের অধিকাংশ – যা আমাদের প্রধান অর্থকরি ফসল এবং পাকিস্তানের একমাত্র বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রার উৎস – সেটা খুব সম্ভবত আগামী বছর হারিয়ে যাবে। অনেক জমি পরিত্যাক্ত হয়ে আছে এবং খুব কম মানুষ তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। পরিস্থিতি যতদিন স্বাভাবিক না হবে ততদিন এটা বিরাজমান থাকবে।

আনারস রপ্তানিতেও দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে। ভারত তার দেশের উপর দিয়ে পাকিস্তানি বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তাই আকাশপথে আনারস রপ্তানি ব্যায়বহুল হয়ে পরেছে।

পরিস্থিতি আরও খারাপ করতে গুপ্ত আক্রমণে প্রধান যোগাযোগব্যাবস্থা ধ্বংস করা হয়েছে – সকল বাণিজ্যিক যোগাযোগকে মিলিটারি অপারেশনের মত ধ্বংস করা হচ্ছে। বগুড়া, সিলেটের মত প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বিদ্রোহীরা কর্মরত আছে – তারা সাধারণ জনগণের উপর সন্ত্রাস চালাচ্ছে এবং তাদেরকে জমি চাষ ও ফার্মিংএ বাধা দিচ্ছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজ বসতি ছেড়ে চলে গেছে এবং সরকারের বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ উন্নয়ন পরিকল্পনা কাগুজে স্বপ্ন হয়েই রয়ে গেছে।

এমনি ব্রিটিশ আমলের চেয়ে আমরা পিছিয়ে পড়ছি – কলিকাতার দুরবর্তি পরিত্যাক্ত অঞ্চলের মত আমাদের দারিদ্র্যকে তুলনা করা যায়। ওই সময়ে মালথুসিয়ান পদ্ধতিতে বলা ছিল কলেরা ও দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে সঠিক পদক্ষেপ না নিতে পারলে এখানে জনগণ টিকতে পারবে না। পাকিস্তান সরকারের ২০ বছরের চেষ্টা এবং অর্ধ ডজন বিদেশি রাষ্ট্রের সাহায্যের ফলে এই এলাকার মানুষ জীবিত আছে – কিন্তু বেশিভাগ আধাপেটে থাকে। এই এলাকার পিছুগামিতার জন্য, দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক অর্গানাইজেশনের অনিয়মের জন্য ধারাবাহিকভাবে পূর্ব পাকিস্তান পিছনে পরেছে – তাই এর চাইতে বেশি অগ্রগতি সম্ভব ছিলনা।

মুক্ত অর্থনিতিতে এটাই স্বাভাবিক ছিল। এই পদ্ধতিতে বিনিয়োগ নির্ভর করে লাভের পরিমাপের উপর ও পশ্চিম পাকিস্তানের উপর। পূর্ব থেকে কমপক্ষে ২০০ বছর এগিয়ে থাকা পশ্চিম পাকিস্তানে স্বাভাবিকভাবেই লাভ বেশি হবে। এটা একটা আচ্ছেদ্য চক্রের মত। পূর্ব পাকিস্তানের খরচে পশ্চিম পাকিস্তান যত উন্নত হবে ততই পূর্ব পাকিস্তান আরও বেশি বিনিয়োগে আগ্রহ হারাবে।

গত প্রায় ৩ বছর ধরে কেন্দ্রীয় সরকার ও পশ্চিম পাকিস্তানের একটি বৃহৎ সংখ্যার জনগণ বিষয়টি লক্ষ্য করেছেন। কিন্তু বছরের পর বছর অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতার কারণে পূর্ব পাকিস্তানকে আরও নিচে নেমে যাওয়া থেকে ঠেকানো যাচ্ছেনা।

পশ্চিম পাকিস্তানিরা এখন এখানকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছে তাদের পূর্ব পাকিস্তান রক্ষার আন্দোলন শুরু করার আগে। তারা স্বীকার করেছে যে তাদের ২০ বছর আগে মনোযোগ দেয়া উচিত ছিল যা তারা দুর্নিতি ও একের পর এক অযোগ্য কেন্দ্রীয় সরকার থাকায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

কখন পূর্ব পাকিস্তানের সম্পূর্ন শান্তি ফিরে আসবে তা কেউ কল্পনা করতে পারেনা। প্রায় ৩৫০০০ গেরিলারা ভারতে ট্রেনিং নিচ্ছে। একটি বৃহৎ পরিমাণ জনগণ যারা পূর্ব থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেছে তাদের ফিরে আসার সম্ভবনা কম। শুধুমাত্র বিদ্রোহী আর গুপ্তঘাতকরা ছাড়া। শক্তিশালী ধ্বংস সাধন করার জন্য ফোর্স কাজ করছে। হারকিউলিয়ান এপক্যালিপ্সের চার ঘোড়সওয়ারিদের থেকে পূর্ব অঞ্চলকে রক্ষা করার মত রিসোর্স পাকিস্তানের নাই

মিলিটারি অথোরিটি জানিয়েছে ভারত তাদের পাকিস্তান বিভক্ত করার ক্যাম্পেইন থামানোর পরে তারা পূর্ব পাকিস্তানের জন্য কাজ শুরু করবে।

কিছু পশ্চিম পাকিস্তানি নেতা – যেমন পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলি ভুট্টো মনে করেন বেসামরিক শাসন চালু করলে কিছু একটা উপায় হতে পারে। তিনি আরও বলেন মিলিটারি শাসকদের থেকে কোন বেসামরিক সরকার ব্যাবস্থা ক্ষমতা নিলেও পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা ঠিক হতে কমপক্ষে ৫ বছর লাগবে।

কিছু ক্ষুদ্র কিন্তু উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পশ্চিম পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবীরা মনে করেন যে দারিদ্র্য ও বিদ্রোহীদের সামলানোর যুদ্ধে আমরা ইতোমধ্যে হেরে গেছি। তারা পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থাকে পুরো দক্ষিণ এশিয়া লণ্ডভণ্ড হবার প্রথম সূচনা বলে মনে করেন।

তারা মনে করেন মিলিটারিরা পূর্ব অঞ্চল ধরে রাখতে পারবে না। এতে করে পূর্ব অঞ্চল আলাদা হবে এবং পরবর্তিতে পশ্চিমবঙ্গ ভারত থেকে আলাদা হবে। তারা একটি পয়েন্ট উল্লেখ করে বলেন যে – পশ্চিমবঙ্গে আন্দোলন চলছে এবং গত দশক ধরে সেখানে ভারচুয়াল মিলিটারি বাহিনী গড়ে উঠেছে। এইসব ঘটনা পাকিস্তান – ভারত যুদ্ধের অবতারণা করবে যা দক্ষিণ এশিয়ার মোজাইক জাতিগুলোকে ভেঙ্গে টুকরো করে ফেলবে।

১৯৬৫ সালের যুদ্ধের ক্ষতি ভারত বা পাকিস্তান কেউই এখনো পুষিয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু উভয় পক্ষে অস্ত্রধারী বাহিনী আছে যারা মনে করে যুদ্ধই হবে এর চূড়ান্ত সমাধান।

ভারতীয়রা মনে করছে যে পাকিস্তানকে দুই টুকরো করতে পারলে তারা তাদের একতা ধরে রাখতে পারবে। কিন্তু পাকিস্তানিরাও সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবে এবং ভারতকে তাদের সাথেই টেনে নিচে নামাবে।

এখানে বড় শক্তিগুলোর কিছু করার আছে।

পশ্চিমারা ভারতকে বাফার স্টেট হিসেবে রাখতে চাচ্ছে এই এলাকায় তাদের প্রভাব বজায় রাখার আশায়। এবং সাথে চায়নাও। অন্যদিকে পিকিং বাফার হিসেবে পাকিস্তানকে চায় ভারতের সাথে সমতা রক্ষার কবচ হিসেবে।

কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার ভাগ্য ওয়াশিংটন বা পিকিং নির্ধারন করতে পারবে না। এটা ঠিক করতে পারে দুই বাংলা – যারা দরিদ্র – যারা ভাবে তাদের হারানোর কিছু নাই – কিন্তু তারা তা করবে যখন তাদের মধ্যে চরম অবস্থা বিরাজ করবে।

পূর্ব পাকিস্তানের কিছু সংখ্যক মানুষ মনে করছে যে দক্ষিণ এশিয়ার অরাজকতা মানব ইতিহাসের সকল দৃষ্টান্তকে হার মানাবে। দেশভাগের সময় লক্ষ লক্ষ লোক মারা গেছে এবং আরেকটি বিভক্তি এখন দ্বারপ্রান্তে। সম্ভবত দক্ষিণ এশিয়ার ২০ টি ভিন্ন ভিন্ন জাতি এই বিস্তর ধ্বংসলীলা ও গণহত্যায় সামিল হবে।

পুর্ব পাকিস্তানের গত কয়েক মাসের মর্মান্তিক ঘোটনা পাকিস্তান ও ভারতের মিলিটারি কার্যক্রম বাড়িয়ে তুলেছে। মিলিটারি প্রধানরা একশন নেবার জন্য ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে উঠেছে। তারা ইসলামাবাদ ও দিল্লি উভয় স্থানেই তাদের প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা চালাচ্ছে। যদিও দুই দেশেরই মিলিটারি মাথা ক্ষীণকায় দেহের তুলনায় ভারী। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ অস্ত্রে মুখোমুখি অবস্থান করছে এবং আরও কয়েক লক্ষ অস্ত্রে সজ্জিত হচ্ছে। যদি সঙ্ঘর্ষ বাধে জানিনা তা কতটা নিষ্ঠুর আকার ধারণ করবে।

যখন নক্সাল বিদ্রোহীরা পশ্চিমবঙ্গে পুরো আক্রমণাত্মক ছিল তখন পাকিস্তান তাদের সব রকম সহায়তা দিয়েছিল ভারতকে দুর্বল করার আশায়। বিদ্রোহীরা পূর্ব পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিল। এবং তারা চায়নার থেকে যত অস্ত্র পেয়েছিল তার বেশিরভাগ এসেছে দিনাজপুর ও রাজশাহী হয়ে। পরিণতিতে পশ্চিমবঙ্গ শাসন করা দুর্বিসহ হয়ে গেল। এখন ভারতীয়রা তাদের প্রতিশোধ নিচ্ছে। তারা পূর্ব পাকিস্তানি বিদ্রোহীদের আশ্রয় দিচ্ছে, ট্রেনিং দিচ্ছে ও অস্ত্র দিচ্ছে। তাছাড়া তাদের সম্পূর্ন রাজনৈতিক সহায়তা দিচ্ছে। এতে করে হতে পারে দুই বাংলা একীভূত হবার সুযোগ পেতে পারে যারা দুই দেশের কাছে আটকা পরে আছে।

ইয়াহিয়া খানের সরকার সম্ভবত শেষ সরকার হতে যাচ্ছে যারা ভারতের সাথে একটি স্বচ্ছ চুক্তিতে আসতে পারে। কিন্তু এই সরকার চাইলেও নয়াদিল্লী তা ছুড়ে ফেলে দেবে। পাশাপাশি মিসেস গান্ধির সরকার মিলিটারি জান্তার কাছে আটকে যেতে পারে যদি অবস্থা আরও খারাপ হয়। পাকিস্তানকে পিছন থেকে ছুড়ি মারতে যেয়ে শেষে না জানি নিজেদের জন্যই আত্মঘাতী না হয়ে যায়।

কিন্তু এগুলো সবই কৌশল পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল। এই মুহুর্তে যা দরকারি তা হল পূর্ব পাকিস্তানকে মহামারি থেকে বাঁচানো এবং পশ্চিমবঙ্গকে অর্থনৈতিক ধ্বস থেকে বাঁচানো – যা হচ্ছে শরনার্থিদের আগমনের জন্য। আমেরিকা ইতোমধ্যে পাকিস্তানকে প্রচুর আর্থিক ও খাদ্য সহায়তা দেবার কথা বলেছে। প্রথম চালান গ্রীষ্ম শেষ হবার আগে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু আরও দরকার। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা সমস্ত বিশ্বকে অন্যতম গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। এশিয়ান ট্রাজিডির বীজ থেকে উদ্ভাসিত সমস্যা আজ দারিদ্র্য আর ক্ষুধার বিরুদ্ধে

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২১৫। অকল্পনীয় বিপর্যয় ইন্দোনেশিয়ান অবজারভার ৩০ অগাস্ট ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২১৫, ৬১৯>

ইন্দোনেশিয়ান অবজারভার, জাকার্তা, ৩০ আগস্ট, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
অকল্পনীয় বিপর্যয়

পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা ব্যাপক প্রেস কভারেজ পাবার কারণ হচ্ছে পুর্ব পাকিস্তানের বিয়োগান্তক পরিস্থিতি এবং ভারতে অবিরাম উদ্বাস্তুদের প্রবেশ।

সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি উদ্বাস্তুদের মার্কিন সিনেট জুডিশিয়ারি সাব-কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থী শিবিরে সফর করেছেন। তিনি বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে পাঁচ মাস ব্যাপী দ্বন্দ্বের কারণে ৫ লক্ষ বাঙালি ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।

শরণার্থী সেন্টার সফরের পর কেনেডি বলেন, এমন দৃশ্য আধুনিক সময়ের যেকোন দুর্বিপাকের চাইতে আতঙ্কজনক হিসাবে বর্ণনা করা যেতে পারে।
ইয়াহিয়া সরকার মিলিটারি কায়দায় রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে চাচ্ছেন। আইয়ুব খানের থেকেই শুধু পূর্ব পাকিস্তান নয় সম্পূর্ন দেশেই এই পলিসি নিচ্ছেন।

পূর্বসুরিদের থেকে ইয়াহিয়া খানের শাসনের পার্থক্য হল তিনি তার সম্পুর্ন সেনাবাহিনী লক্ষ লক্ষ নিরস্ত্র বাঙালিদের বিরুদ্ধে নিয়োগ করেছেন, নিরর্থক রক্তপাত আর নির্যাতনের মাধ্যমে তাদের ভারতে ঠেলে দিচ্ছেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২১৬। শরনার্থীদের নিয়ে ভারতের সমস্যা লা সোলেইল ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২১৬, ৬২০-৬২২>

লা সোলেইল (ডাকার) সেনেগাল, ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
শরনার্থীদের নিয়ে ভারতের সমস্যা
– বারা দাইউফ

ভারত বর্তমানে তার ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর নাটক স্ক্রীনিং করছে। ৫০০০০ শরণার্থী প্রতিদিন তার সীমানার মধ্যে প্রবেশ করছে। বাংলায় ৮ মিলিয়নেরও বেশি লোক রয়েছে। সরকার তাদের খাওয়ানোর জন্য প্রতিদিন ২০ মিলিয়ন রুপি খরচ করছে। তাদের দুর্ভোগের মহাসাগরে এটি একফোঁটা জলকণা মাত্র। এটা পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধের ফল। বাংলাদেশ রাষ্ট্র ২৬ শে মার্চ ১৯৭১ জন্মগ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আন্দোলনের পথিকৃৎ। তারা ব্যাখ্যা করে যে পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তান মাঝখানে ভারত দিয়ে ১৫০০ কিলোমিটার দূরত্বে বিভক্ত। তাদের ভাষা ভিন্ন। এমনকি ইসলাম – যা তাদের ধর্ম – সেখানেও কিছু রীতি নীতিতে তফাত আছে। এই অবস্থায় কিভাবে একটি কালচারাল একতা হতে পারে যাতে করে দুই জাতি এক থাকতে পারে?

সবচেয়ে খারাপ বিষয়, তারা যোগ করে, পশ্চিম পাকিস্তান আমাদের তাদের একটি উপঅংশ হিসেবে দেখে – আমাদের উপকারের পরিবর্তে আমাদের উপনিবেশ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রশাসন, সেনাবাহিনী, পুলিশ, পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের জন্য দায়িত্বের সকল পদ সংরক্ষিত। ব্যাংক, বীমা কোম্পানি শিল্প এবং বাণিজ্য তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এটি একটি অসম্ভব উপনিবেশকরণ। পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পরে বিষয়গুলি আরও খারাপ হয়ে গিয়েছিল, যেখানে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ সফলভাবে জয়ী হয়েছিল। ভবিষ্যতের অধিবেশনে ৩০০ জন সদস্যের মোট ১৬৯ জন সদস্য নিয়ে তারা একটি সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে যা শেখ মুজিবের জন্য সরকার গঠনের জন্য যথেষ্ট এবং স্বভাবতই তার দল সকল সরকারি কর্মকাণ্ড, আইনগত কাঠামোর আচার-আচরণ, এবং আইনগত কাঠামোর উল্লেখযোগ্য দায়িত্ব গ্রহণের অধিকার রাখে।

জেনারেল ইয়াহিয়া খান কি আগে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা রক্ষা করতে প্রস্তুত আছেন? তিনি বলেছেন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি সংবিধান দেবেন সর্বাধিক স্বায়ত্বশাসনের বিস্তারের জন্য । ২৫ শে মার্চে তার সশস্ত্র হস্তক্ষেপের পর এটি আর মনে হয় না। ১৯৭১ সালে রক্তাক্ত নিপীড়নের জন্য একটি সংকেত প্রদান করা হয়, অপ্রত্যাশিতভাবে বাঙালি “আতঙ্কিত” হয়। বেশিরভাগ পর্যবেক্ষক মনে করেন এর ফলে ঢাকায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়।

পূর্ব পাকিস্তানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ২০ হাজার গেরিলারা শক্তি প্রয়োগে ইয়াহিয়া খান বাহিনীর আধুনিক অস্ত্র দিয়ে সজ্জিত ৭০ হাজার সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনে সক্ষম হবে বলে আশা করা যায়। যুদ্ধের বিষয়টি নিয়ে কোন সন্দেহ নেই তবে প্রতিরোধ ও জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধ এক নয়। এটি প্রধান রাজ্যের শাস্ত্রীয় যুদ্ধের মতো নিয়ম অনুযায়ী হয় না। এই মুহূর্তে এটি প্রতিবেশী ভারতের সাথে জড়িয়ে গেছে। তারা অকস্মাৎভাবে এই ট্র্যাজেডির সাথে জড়িয়ে পড়েছে যা পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহতার দিকে নিয়ে যাবে।

কলকাতা সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং কঠিন শহর। এটি ভারতের প্রাক্তন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একটি রত্ন, এটি এখন মানুষের দুঃখের ও বিহ্বলতার বোঝা বইছে।

তার নাটকটি শুরু হয় ১৯১২ সালে। যখন কর্তৃপক্ষ উত্তর-পশ্চিমে ১৫(এইচ) কিলোমিটার দূরে দিল্লিতে তার রাজধানী স্থানান্তরিত করে। ১৯৪৭ সালের বিভাজনে, বাংলার বিভাগটিতে কলিকাতা ছিল বাণিজ্যিক এবং শিল্পনগরী এবং বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগের সর্ববৃহত বন্দর ছিল তাদের, যা আর কখনো পুনরুদ্ধার হবে না। পাট, যা ছিল তার সমৃদ্ধির উত্স এবং যা আসতো পূর্ব পাকিস্তানের সমৃদ্ধ ভূমি থেকে, – সেগুলো এখন আর কলিকাতার কারখানায় আসেনা। পোর্ট নিজেই, যা একটি সক্রিয় জায়গা ছিল, তা এখন সংকটাপন্ন। আজ কলকাতার ৮ মিলিয়ন জনসংখ্যার সঙ্গে তার নিজস্ব ছায়ার তুলনা আর নেই। কলঙ্কিত এবং অধিক জনবহুল কলকাতা এখন একটি ভোগান্তির শহর যা শরণার্থীদের অবিরাম প্রবাহের কারণে আরও সংকটাপন্ন। বাইসাইকেল, রিক্সা, অটো রিকশা, চটকদার যানবাহন তার রাস্তায় রাস্তায় হুড়োহুড়ি করে চলছে, অনেকে মাঝে মাঝে মুক্ত গাভী খুঁজে পায়, যা ভারতে পবিত্রতার প্রতীক।

হাজার হাজার ছোট ব্যবসায়ী এখন সংকীর্ণ ফুটপাথে বসতি স্থাপন করেছেন। ক্ষুদ্র ও অলঙ্ঘনীয় দোকানগুলি, দরিদ্র পরিবারের অধিবাসীরা কাঠের কাঠামোর তুলনায় ভালো নয়, ট্র্যাফিক অসম্ভব এবং অকারণে অদ্ভুত এবং বেপরোয়া ব্যক্তিদের জন্য সর্বদাই এটা এডভেঞ্চারাস , এটাই এই মুহূর্তে কলকাতার ছবি যখন ভারত সম্ভবত তার ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম সময় পার করছে। ওবেরয় হোটেল থেকে যে গাইডটি আমাকে নিয়ে এসেছিল সে জানাল তাদের অতীতের কাহিনী অনেক দীর্ঘ ও কঠিন। সে আমাকে শরনার্থিদের স্থানে নিয়ে গেল।

পূর্ব পাকিস্তানের সাথে ভৌগোলিক অবস্থার কারণে এবং বাংলার একটি পুরনো রাজধানী হওয়ায় এই শহরটি পূর্ব পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধের ব্যাপারে যুক্ত। শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরেই অনেক হেক্টর সমতল ভূমি। সেখানে মানুষ অবর্ননিয় দুঃখে কষ্টে দিন যাপন করছে যা দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। শরণার্থী শিবিরে ২০০০০০ জন মানুষ আছে যারা সন্ত্রাস থেকে পালিয়ে গিয়েছিল এবং এখন কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কলকাতার আশেপাশের নতুন শহর তৈরি করেছে। চারপাশের গুমোট গন্ধ এবং অশুচি আমাকে অবিস্ট করছিল। তাঁবুর সামনে শিশুরা একসাথে জড়সড় হয়ে শুয়ে ছিল রোদের নিচে। তাদের বিষণ্ণ এবং একরকম বিস্ময়কর লাগছিল। তাদের মুখের হাসি চলে গেছে বলে মনে হয়, যদিও তারা যথেষ্ট মিষ্টি ছিল। তাদের কাছ থেকে একটু দূরে ছিল তাদের বাবা-মা, যাদের মধ্যে মহিলা ও বয়স্ক ব্যক্তিরা ছিল, যারা ফ্যাকাসে রঙের পোশাক পরিহিত, তারা তাদের খাবারের রেশনের জন্য সারি বেধে দৌড়াচ্ছিলেন, যা যা অনেক সংকীর্নতার সাথে বিতরণ করা হচ্ছিল। দুধ, পাতলা শুকনো সবজি ছিল কিন্তু খাবারের অভাব ছিল স্পষ্ট। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও ভারতীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এটা নিষ্পত্তি করার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি মোকাবেলা করা কঠিন যা দুর্ভাগ্যবশত প্রতিদিনই আরও কঠিন পড়েছে। কলকাতায় উদ্বাস্তুদের দুইটি শিবির আছে যার প্রত্যেকটিতে প্রায় ২ লাখ লোক আছে। আরও প্রায় ২০ টি ক্যাম্প বাংলাদেশের চারপাশে ছড়িয়ে আছে। প্রশাসনিক কারণে একটি ক্যাম্প ওঁ খাবার বণ্টনের জন্য আলাদা একটি অংশে ভাগ করা হয়েছে। ত্রাণ দিচ্ছে ইউনিসেফ , এফএও, ইউএন। শরণার্থীদের জন্য করা হাই কমিশন, আন্তর্জাতিক রেড ক্রস , বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত মানবিক সংস্থা। কিন্তু এখনও এটা যথেষ্ট না। ১৫ ই আগস্ট, ১৯৭১ শরণার্থীদের সংখ্যা ৮ মিলিয়ন পর্যন্ত বেড়ে ওঠে এবং বিশেষজ্ঞদের মতে প্রতিদিন ৫০০০০ করে শরণার্থীর হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারত সরকার এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রতিদিন ২০ মিলিয়ন রুপী খরচ করছে এবং আন্তর্জাতিক সহায়তার জন্য চেষ্টা করছে।

বনগাঁ, কলকাতা থেকে প্রায় ৫২ মাইল দূরে, সীমান্ত শহর যা শরণার্থীদের প্রবেশের প্রধান পথ। সেখানে পৌঁছানোর জন্য আমার দুই ঘন্টা লাগে এবং একটি ভয়ঙ্কর মাত্রার দুর্দশা দেখার জন্য আরো দুই ঘন্টা কাটিয়েছি। যে গাড়িটি করে আমি ভ্রমণ করছিলাম এই পথ একটি রুক্ষ কিন্তু চলনসই। বাঁধের উভয় পাশে চাল ও পাটের প্রচুর ক্ষেত ছিল। এটি বর্ষা ঋতু, ভয়ঙ্কর বর্ষার ঋতু, ঠান্ডা ভারতে ভয়াবহ আকার ধারণ করে প্রায়শ। সড়কের উভয়ই পাশে স্থায়ী জলের আঁধার আছে এবং উদ্বাস্তুরা শীতে কাঁপছে এবং অসুস্থ এবং ক্ষুধার্ত অক্ষম মানুষেরা পরে আছে। তারা বাঁশ ও পাটের দুর্বল আশ্রয়স্থলগুলিতে আশ্রয় নিচ্ছে এবং বর্ষা তাদের দুর্যোগ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

এই শরণার্থীরা এখনো সরকার কর্তৃক তালিকাভুক্ত হয়নি কারণ তারা অনেক দিন ধরে হাঁটতে হাঁটতে – মাথায় হাল্কা মালামাল নিয়ে সীমান্ত পারি দিয়ে এই পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। ভারতীয় অঞ্চলে প্রবেশের আশাটাই তাদের কাছে প্রধান ছিল। প্রথম যে রিলিফ তাদের দরকার তা হল মেডিকেল রিলিফ। পোস্টে তাদের সবাইকে টিকা দেওয়া হয়- প্লেগ, কলেরা; এবং পক্সের টিকা ইত্যাদি। একজন কর্মকর্তা আমাকে বলেছিলেন যে এই পর্যায়ে সরকার শরণার্থীদের সংখ্যা নির্দিষ্ট করে জানতে চায়। তারা চিকিৎসা ফাইলগুলিতে রেকর্ড রাখছে। আমি যখন তার সাথে কথা বলছিলাম, তখন একটি স্ট্রেচারে দুই ত্রাণ কর্মী ২০ বছর বয়সী একজন মহিলাকে নিয়ে যাচ্ছিল যার চোখ নিথর ও নির্জিব। তার পাশে কঙ্কাল কাঠামোর একটি শিশু শুয়ে ছিল। এটা স্পষ্ট ছিল যে এই সন্তানের মা অবশ্যই মারা যাচ্ছিল। কিছুই কম নিশ্চিত ছিলনা।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২১৭। পূর্ব বাঙলার অধিবাসীদের সাহায্য করুন দাগাব্লাডেট ৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২১৭, ৬২৩>

দাগাব্লাডেট, নরওয়ে, ৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
পূর্ব বাঙলার অধিবাসীদের সাহায্য করুন

পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর যে আঘাত করা হয়েছে সেটি বিশ্বব্যাপী এখনো তেমনভাবে অনুভূত হয়নি। বছরের শেষে ১০ মিলিয়ন মানুষ দেশ ছেড়েছেন এবং প্রতিবেশী দেশ ভারত, যেখানে উদ্বাস্তুরা অবস্থান করছে সেখানে তারা প্রচুর পুষ্টির সমস্যার সম্মুখীন।

যারা সেখানে কাজ করছেন তারা বলছেন যে এখন পর্যন্ত ১০০০০০ শিশু খাদ্যের ওভাবে মৃত্যুর ঝুঁকিতে আছে। যদি দ্রুত খাদ্যের ব্যাবস্থা না করা হয় তবে তারা মৃত্যু মুখে ঝুঁকে পড়বে। পশ্চিমবঙ্গের ভারতীয়রা প্রায় ৩ মিলিয়ন শরণার্থীর জন্য ক্যাম্পে যায়গা করেছে। এই ভারতীয় রাজ্যে ৫ মিলিয়ন শরণার্থী এসেছে। এর অর্থ হচ্ছে ২ মিলিয়নেরও বেশি লোক গ্রামাঞ্চলে রাস্তায়, শহরে এবং অন্যান্য স্থানে প্যাভআউটগুলিতে বসবাস করছে যেখানে একটু থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

ক্ষুধা ছাড়াও কলেরা এখনো আছে। মহামারী একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় স্থিত হয়েছে তবে রোগবালাই এখনো যারা দুর্বল রোগপ্রতিরোধক্ষমতাসম্পন্ন ওঁ অপুষ্টিতে ভুগছে তাদের আক্রমণ করছে। সবচেয়ে কম রোগপ্রতিরোধক্ষমতাসম্পন্ন হল শিশুরা। এদের প্রায় ১০০০০০ জন সরাসরি মৃত্যুর ঝুঁকিতে আছে। প্রায় ৩০০০০০ জন শিশু অপুষ্টিতে আছে।

এই পরিসংখ্যানগুলিতে একটি ট্রাজেডি রয়েছে যা বাইরের লোকের পক্ষে বোঝা সম্ভব না। এটির বিস্তার এত বিশাল যে তা বায়াফ্রার ঘটনাকেও ছাড়িয়ে যায়।

এই ত্রাণ কাজ এতদূর পর্যন্ত যথেষ্ট হয়েছে কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। প্রায় অর্ধ বিলিয়ন নরওয়েজিয়ান ক্রোনারের মত সাহায্য প্রদান করা হয়েছে। এতে বোঝা যায় এই ট্র্যাজেডির বিশালতা। এবং এটা চাহিদা থেকে অনেক নগণ্য। এই মাসের শেষে, ইউএন এর রেফিউজি কমিশনকে আরো ৭০০ মিলিয়ন ক্রোনার দিতে হবে যদি এটাকে সচল রাখতে হয়।

এটি এই অসম্পূর্ণ ব্যাকগ্রাউন্ডের ভিত্তিতে যে ৫ টি নরওয়েজীয় রিলিফ সংস্থা নরওয়েতে তাদের বৃহৎ সংগ্রহের প্রচারাভিযান শুরু করেছে এবং ২০ শে সেপ্টেম্বর নির্বাচন দিবসে, ১০০০০ স্বেচ্ছাসেবক নির্বাচনী এলাকার বাইরে থাকবে এবং ৮০ শতাংশ ভোটদাতারা কাছে সাহায্য চাইবে যারা সেদিনের নির্বাচনে ভোট দিতে আসবে।

আমরা আশা করি যে প্রত্যেকের কিছু না কিছু দেবার ক্ষমতা আছে।
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২১৮। পাকিস্তানে যা করনীয় টরেন্টো টেলিগ্রাম ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২১৮, ৬২৪>

দ্যা টরেন্টো টেলিগ্রাম (কানাডা), ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
সম্পাদকীয়
পাকিস্তানে যা করনীয়

পূর্ব পাকিস্তানে দুর্ভিক্ষ রোধে প্রায় তিন মিলিয়ন টন খাদ্যশস্যের আমদানি প্রয়োজন – একথা বলেছেন একজন আমেরিকান ডাক্তার যিনি সম্প্রতি টরন্টোতে এক সম্মেলনে উপমহাদেশের ট্র্যাজেডি নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি ডাঃ জন রোড, হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুল থেকে, তিনি ব্রিটিশ মেডিক্যাল ম্যাগাজিন ল্যান্সেটে লিখেছেন যে পূর্ব পাকিস্তানের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ২৫ মিলিয়ন মানুষ ক্ষুধার সম্মুখীন হচ্ছে। ডাঃ রোড গত মাসে টর্নেডোতে দক্ষিণ এশিয়া সম্মেলনে বক্তৃতা করেন। তিনি সেখানে পশ্চিমবঙ্গ এবং অন্যান্য ভারতীয় সীমান্ত রাজ্যের শরণার্থী ক্যাম্পে ভ্রমণের পর তার কথা বলেন। হাজার হাজার বিশিষ্ট আমেরিকানদের মধ্যে তিনি রয়েছেন যারা পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহতভাবে নিন্দা করে আসছেন এই বলে যে এটি কেবলমাত্র দেশে অব্যাহত শত্রুতা বাড়াবে। ২৫ মিলিয়ন লোকের সংখ্যাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন নাগরিক এবং ডাক্তারের কাছে অতিমাত্রায় প্রকাশিত কিনা তা বোঝা কঠিন। কিন্তু সম্ভাবনা অবশ্যই বিদ্যমান, কারণ এটা এক বছরের কম সময়ের মধ্যে হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের দেশের সবচেয়ে খারাপ ঘূর্ণিঝড় হয়েছে, বন্যা হয়েছে এবং উপমহাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর সামরিক অভিযান আঘাত হানছে। পরিস্থিতি এতটাই জটিল হয়ে উঠেছে যে পূর্ব পাকিস্তানের ৭৫ মিলিয়ন জনগণের মধ্যে আট মিলিয়ন আগেই ভারতে পালিয়ে গেছে। এটি কেবলমাত্র পাঁচ মাসের মধ্যে ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ স্থানান্তরণ। ২৫ মার্চ থেকে দেশে গৃহযুদ্ধ চলছে। ফসল অবহেলা করা হয়েছে, সড়ক রেলওয়ে যোগাযোগ বন্ধ, ঘরবাড়ি, দোকান এবং গ্রাম লুট করা এবং পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এটি সুস্পষ্ট যে কয়েক ডজন মিলিয়ন মুখ খাদ্যের জন্য হাহাকার করছে। পরিস্থিতির অবাক করা বিষয় হচ্ছে যে বিশ্বে খাদ্যশস্য উদ্বৃত্ত আছে – বিশেষ করে চালের উদ্বৃত্তের মাত্রা বাড়ছে। শুধু জাপানের কাছে ৬.৪ মিলিয়ন টন চাল উদ্বৃত্ত আছে। যার ৬৪ শতাংশ সরকার কর্তৃক উৎপাদিত হয়। গত বছর ভারত, ইন্দোনেশিয়া, সিওলোন, কম্বোডিয়া, দক্ষিণ কোরিয়াতে রেকর্ড পরিমাণ ফসল হয়েছে। এগুলোর সবগুলোই তুলনার দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানের সমমানের।

মৌলিক সমস্যা হবে কীভাবে খাদ্য বিতরণ করা হবে এবং কখন এগুলো দেশে আসবে। এমনকি ভালো সময়েও সড়ক ও অন্যান্য যোগাযোগগুলি খুব খারাপ। তবে স্পষ্টতই পূর্ব পাকিস্তানে জরুরী সাহায্য দরকার। যদি বিশ্ব সম্প্রদায় এই অসুখী ভাগ্যবিড়ম্বিত জাতিকে আরেকটি বড় বিপর্যয় রোধ করতে চায় তবে তাদের ব্যাবস্থা নিয়েই হবে। জাতিসংঘ একটি সংস্থা যাকে সামনের মাসগুলিতে পাকিস্তানের ঘটনায় আরও গভীরভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২১৯। ব্যাপক ব্যবধান এবং তীব্র ঘৃণা অটোয়া সিটিজেন ১৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

Ashik Uz Zaman
<১৪, ২১৯, ৬২৫-৬২৭>

দি অটোয়া সিটিজেন (অটোয়া), ১৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
ব্যাপক ব্যবধান এবং তীব্র ঘৃণা – পাকিস্তান কি আর কখনই আগের মত হতে পারবে?

লেখক আজ পাকিস্তানে বিভিন্ন মনোভাব নিয়ে আলোচনা করবেন। অনেক দেশ সময়ে সময়ে বিভক্ত হয়েছে – গৃহযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র, তার তীব্র যন্ত্রণার সময়ে নাইজেরিয়া। কিন্তু মনে হচ্ছে পাকিস্তানীরা আরো গভীরভাবে বিভক্ত। তরুণ পাঞ্জাবী একজন সনদপ্রাপ্ত হিসাবরক্ষক বলেনঃ “পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের সমস্যা একটাই – আমাদের কাছে সবগুলো ভারত-প্রেমীকে হত্যা করার মত পর্যাপ্ত গুলি নেই”। ভারত থেকে আসা একজন শরণার্থী, যিনি এখন সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারী বলেনঃ “এটা সত্যি যে আমরা এখন তাদেরকে একটি উপনিবেশের মতো শাসন করছি এবং ভবিষ্যতেও করবো। নারী, পুরুষ এবং শিশু নির্বিশেষে তারা যে নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে এরপর, এটা তাদের প্রাপ্য। আপনি এটা বিশ্বাস করবেন না। ওরা পশুর চেয়েও খারাপ আচরণ করেছে”। একজন পূর্ব পাকিস্তানী স্পর্ধাসহকারে বলেনঃ “তোমরা চাইলে মুজিবকে হত্যা করতে পারো। আমরা সবাই মুজিব। তোমরা আমাদের সবাইকে হত্যা করতে পারবে না। অথবা আজীবন আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না”। একজন বাঙালী গৃহপরিচারক একটি জুতো হাতে নেয় এবং টেলিভিশনের পর্দায় ছুড়ে মারে যেখানে দেখাচ্ছিল যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বিদেশী সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছেন। পুলিশ ডাকা হয় এবং ওরা তাকে থানায় নিয়ে যায়, যেতে যেতে সে বারবার বলছিলঃ “আমাদের বাহিনী ভারতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। আমরা অচিরেই স্বাধীন হব”। পাকিস্তানীদের মধ্যকার ব্যবধান এবং ঘৃণা অবিশ্বাস্য ধরণের বলেই মনে হচ্ছে।

পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশ বাহিনী মার্চ মাসে বিদ্রোহ করে। যখন সরকারের কাজে ফিরে আসার আহ্বানে কেউ সাড়া দেয়নি, তখন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জাহাজে করে পুলিশ বাহিনী নিয়ে আসা হয়। জাহাজভর্তি করে শ্রমিক নিয়ে আসা হয় কারখানাগুলোতে কাজ করার জন্য কেননা বাঙালীরা শহর ছেড়ে সবাই গ্রামে চলে গেছে। একইভাবে সরকারী কর্মচারী এবং আমলাদেরও নিয়ে আসা হয় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। আস্তে আস্তে এখন পূর্ব পাকিস্তানীরা তাদের শহরে এবং কাজে ফিরে আসছে। কিছু পুলিশ সদস্য ফিরে এসে তাদের কাজে যোগ দিয়েছে, কিন্তু তাদেরকে কোন অস্ত্র দেয়া হয়নি এখনো পর্যন্ত। কেন্দ্রীয় সরকারে, যেসব পূর্ব পাকিস্তানীরা আছে তাদেরকে পুরো বেতনই দেয়া হচ্ছে কিন্তু তাদেরকে এমন সব জায়গায় বদলি করা হয়েছে যেখান থেকে তারা তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। এই সাবধানতামূলক পদক্ষেপগুলোকে বর্তমানে ন্যায্য মনে হতে পারে – এবং খুব বেশিদিন আগের কথা নয় যে একজন বাঙালী রাঁধুনিকে কোয়েটার সামরিক হাসপাতালে যে খাবার পরিবেশন করার কথা ছিল তাতে বিষ মেশানোর সময় হাতেনাতে ধরা হয়। এই কাহিনীগুলো শুনে, যে কেউ বিস্মিত হতেই পারে এই ভেবে যে এমন একটি দ্বিধাবিভক্ত জাতিকে শক্তিপ্রয়োগ ছাড়া আর কিভাবে এক করা সম্ভব।

পশ্চিম পাকিস্তানে কিছুটা আশা এখনও আছে এই যুক্তির উপর ভিত্তি করে যে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করার বা তাদেরকে স্বায়ত্তশাসন থেকে বঞ্চিত করার কোনো আগ্রহই নেই পশ্চিম পাকিস্তানের এবং পূর্ব পাকিস্তানীরা যখন বুঝতে পারবে যে ইসলামাবাদ শুধু বিদেশী সাহায্য প্রসূত একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমন করেছে মাত্র তখন তারা আবার ফিরে আসবে। অন্যরা মনে করে ঘা এতই গভীর যে তা আর কোনোদিনই ঠিক হবেনা। সব পশ্চিম পাকিস্তানীই, তাই বলে তাদের সরকারকে সমর্থন করেনা আবার সব পূর্ব পাকিস্তানীই দেশ ভাগের পক্ষে নয়। পশ্চিম পাকিস্তানে, ২৫শে মার্চের আগে অনেকেই সোচ্চার ছিলেন যেকোনো শক্ত পন্থা অবলম্বনের বিরুদ্ধে। পাকিস্তান নৌবাহিনীর সাবেক প্রধান অ্যাডমিরাল এস. এম. আহসান, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে হুশিয়ারি দিয়ে বলেন যে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক হামলা করা অনৈতিক হবে এবং দীর্ঘমেয়াদে অকার্জকর হবে। তাকে গভর্নরের দায়িত্ব থেকে অপসারণ করা হয়। একইভাবে লেঃ-জেনারেল ইয়াকুবকেও প্রতিস্থাপন করা হয়।

এয়ার মার্শাল নূর খান, বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান যিনি পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর এবং উপ সামরিক প্রশাসকের দায়িত্ব পান যখন জেনারেল ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট হন। তিনি পরবর্তীতে পদত্যাগ করেন। ইয়াহিয়া সংসদ অধিবেশন মুলতবী ঘোষণা করার একদিন পর, নূর বলেনঃ “প্রেসিডেন্ট যেন অবশ্যই আবার অধিবেশন ডাকেন আগামী মার্চ মাসে, নইলে এমন ক্ষতি হবে যা মেরামতের অসাধ্য। উচ্চপদে আসীন একজন প্রেসিডেন্টকে ভুল পরামর্শ দিচ্ছেন। যদি ক্ষমতার পালাবদল না হয়, তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানে সর্বদাই সামরিক শাসন বজায় থাকবে”। এয়ার-মার্শাল আসগর খান, সাবেক বিমানবাহিনী প্রধান, ৬ই মার্চ বলেনঃ “মুজিবের হাতে এখনই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের জন্য আমাদের হৃদয়ে রক্তাশ্রুক্ষরণ হচ্ছে”। ১২ই মার্চ মেজর-জেনারেল শের আলি খান, ইয়াহিয়ার মন্ত্রিসভার সাবেক তথ্যমন্ত্রী প্রেসিডেন্টের কাছে এমন কিছু না করার জন্য আবেদন জানিয়ে তারবার্তা পাঠান যাতে করে “এই ইসলামিক প্রজাতন্ত্রটিকে ধ্বংস করার অপবাদ” তার ওপর পরে। ২০শে মার্চ, পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক হামলা চালানোর পাঁচ দিন আগে পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যালঘু দলগুলি করাচীতে এক সম্মেলনের আয়োজন করে এবং জাতীয় সংসদের ৪০ জন নির্বাচিত সদস্য সামরিক শাসন বাতিল এবং জনগনের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী জানিয়ে একটি স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর করেন।

৪ঠা এপ্রিল পাকিস্তানে আমেরিকান ছাত্রদের এসোসিয়েশন, পুরো পাকিস্তানে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, শহর থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার, মুজিবের মুক্তি এবং আওয়ামী লীগকে দিয়ে সরকার গঠনের আহ্বান জানায়। আর পূর্ব পাকিস্তানে, নির্বাচনের আগে এবং পরে অনেকেই আওয়ামী লীগের কঠোর কার্জপদ্ধতির নিন্দা করেছে।

১লা ফেব্রুয়ারি, ১৯৭০, এ ঢাকায় একটি গন সমাবেশে ব্যঘাত ঘটার পর পাকিস্তান গণতান্ত্রিক দলের সভাপতি নুরুল আমিন, যিনি পরে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন, বলেনঃ “আওয়ামী লীগের এসব কার্জকলাপের নিন্দা জানানোর মতো কোনো ভাষা আমার নেই যেখানে, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, তারা নিজেদের পরিকল্পনা অন্যদের উপর চাপিয়ে দেয়ার জন্যই পরিকল্পিতভাবে এসব করছে”। আওয়ামী লীগ একটি অত্যন্ত উস্কানিমূলক নির্বাচনী প্রচারণা চালায়। একটি গণসমাবেশে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমেদ বলেনঃ “এত বছর ধরে বাঙালীদের রক্ত এবং মাংস শোষণ করেছে শোষক এবং ডাকাতেরা। আগামী নির্বাচনে এই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে এদেরকে ধুয়েমুছে নিশ্চিহ্ন করতে হবে”। নির্বাচনের পরে আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা আসলেও আসতে পারতো যদি তারা বিচক্ষণতা বা অন্তত নমনীয়তা দেখাতো। কিন্তু তারা অনড় থাকে এবং এরপর যা ঘটে তার দায় তাদেরকেও অবশ্যই নিতে হবে।

নির্বাচনের পর ইয়াহিয়া সকল প্রধান নেতৃবৃন্দকে আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানান। আলোচনায় বসতে মুজিবের অস্বীকৃতি পশ্চিম পাকিস্তানে তাঁর অভিপ্রায় সম্বন্ধে শুধু সন্দেহের উদ্রেকই করেনি বরং মুজিবের প্রতিদ্বন্দ্বী ভুট্টোকে এককভাবে ইয়াহিয়ার কান ভারী করার সুযোগও করে দেয়। যদিও এটি ভুট্টোর পরামর্শ মতো ইয়াহিয়ার কাজ করাকে ন্যায্য প্রমাণ করেনা, কিন্তু ঘটনাগুলো কেন এভাবে ঘটলো তার ব্যাখ্যা দিতে সাহায্য করে। ইয়াহিয়া, প্রায় সবার মতে, সংসদের অধিবেশন মুলতবী করে সবচেয়ে বড় ভুল করে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে প্রবল প্রতিক্রিয়ার মুখে ইয়াহিয়া পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হয় এবং ৩রা মার্চ সে সংসদের ১২ জন নির্বাচিত প্রতিনিধিকে ঢাকায় অধিবেশনে বসতে আমন্ত্রণ জানায় সঙ্কট নিরসনের জন্য। মুজিব এতেও অস্বীকৃতি জানান।

৬ই মার্চ, ইয়াহিয়া ঘোষণা দেয়, ২৫শে মার্চ সংসদ অধিবেশন বসবে। মুজিব চারদফা দাবী জানান, তাৎক্ষনিকভাবে কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক পর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার দাবিসহ, তিনি অংশ নেবেন কিনা তা বিবেচনা করার আগে।

হতাশ হয়ে, ইয়াহিয়া বিমানযোগে ঢাকায় আসে মুজিবের সাথে আলোচনায় বসতে। এমনকি প্রেসিডেন্ট বাসভবনে যে পূর্ব পাকিস্তানীরা কাজ করতো তারাও ধর্মঘটরত ছিল এবং ইয়াহিয়া একারনে অস্বস্তিকর সময় কাটায় বলে জানা যায়। কিন্তু যদিও সে আওয়ামী লীগের ছয় দফা মেনে নেয়, তবুও তার কাছে নতুন দাবী উত্থাপন করা হয়, যার মধ্যে পাকিস্তানকে একটি সম্মিলিত রাষ্ট্র থেকে সার্বভৌম প্রদেশের মৈত্রী রাষ্ট্রে পরিবর্তন করার দাবীও ছিল। ২৫শে মার্চের আগে এবং পরে পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু-ভাষী বেসামরিক জনগনের উপর চালানো নিষ্ঠুরতার কারণে পশ্চিম পাকিস্তানের জনমত বাঙালীদের বিরুদ্ধে চলে যায়। এই খবরগুলো পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি, হয়তো একারনেই যে পশ্চিমা সাংবাদিকেরা যখন ঢাকায় ইয়াহিয়া-মুজিব আলোচনার প্রতিবেদন করছিলেন তখন ভেতরে ভেতরে এই ঘটনাগুলো ঘটছিলো। পাকিস্তানী সরকারও এই খবরগুলো প্রাথমিকভাবে প্রকাশ করেনি যাতে করে পশ্চিম পাকিস্তানের বাঙালীদেরকে প্রতিশোধমুলক ঘটনার হাত থেকে বাঁচানো যায়।

যদি কোনো ষড়যন্ত্র থেকেই থাকে তাহলে ষড়যন্ত্রকারীরা যা চেয়েছিল আওয়ামী লীগ ঠিক তাই করেছে। একটু নমনীয়তা এবং ভাতৃত্তবোধ তাদেরকে ক্ষমতায় বসাতে পারতো এবং তারা তাদের কর্মসূচী বাস্তবায়ন করার একটি সুযোগ পেত এবং হাজার হাজার বাঙালী এবং অ-বাঙালীর হত্যা প্রতিরোধ করা যেত। পাকিস্তান আর কখনই আগের মতো হতে পারবে কিনা তা এখন আর কেউই জানে না।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২২০। ইয়াহিয়ার উভয় সংকট সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২২০, ৬২৮>

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২২১। বাংলার আগুন
ফ্রাঙ্কফুটার আলমেইন জাইটুং, দ্যা ডেইলি ফ্রাঙ্কফুটার, পশ্চিম জার্মানি ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

Raisa Sabila
<১৪, ২২১, ৬২৯-৬৩০>

বাংলার আগুন
সুত্রঃ ফ্রাঙ্কফুটার আলমেইন জাইটুং, দ্যা ডেইলি ফ্রাঙ্কফুটার, পশ্চিম জার্মানি
তাঃ ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
রচনায়ঃ ক্লস নাটরপ

বাংলার চলমান দুর্দশার কোন সুরাহা এখনও পর্যন্ত হয়নি। সত্যিই কি এই পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব নয়? বিষয়টি অনেক আগেই এমন এক পর্যায়ে পৌছে গেছে, যেখান থেকে এখন আর এটিকে নিছকই পাকিস্তানের “অভ্যন্তরীণ বিষয়” বলে গন্য করা যাচ্ছেনা। যে অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে দিয়ে লক্ষ লক্ষ বাঙালি দিন কাটাচ্ছে, তাতে সংশ্লিষ্ট দলগুলোর এই বিষয়ে প্রশ্ন তোলাই স্বাভাবিক। তবে তারাই বা কি করতে পারেন?

এমুহূর্তে মানবিক সাহায্যই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরী। ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী পূর্ব পাকিস্তানি শরণার্থীদের মত প্রচন্ড দুর্দশা ও অভাবের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বাঙ্গালিরাও। তাদের সহায়তা করার কার্যক্রমকে আরো উন্নত করা যেতে পারে। কিন্তু, সেটাই শেষ কথা নয়। সমস্যার উপসর্গ নয়, বরং মুল সমস্যাকেই সমুলে উৎপাটন করতে হবে। এই সমাধানের ক্ষেত্রে দুইটি বিষয় খুবি জরুরী। প্রথমত, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ শান্তি ফিরিয়ে আনতে হবে,যার মানে হল, ১৯৪৭ এ একত্রিত হওয়া এই দুই অঞ্চলের মধ্যে বর্তমানে যে বিচ্ছিন্ন অবস্থান চলমান, তা নিরসন করে পুনরায় তাদের একত্রিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, পূর্ব বাংলার এই সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে উপমহাদেশীয় দুই প্রতিবেশি পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যে বিপদজনক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে তা হ্রাস করা। যতদুর মনে হয়, দ্বিতীয় উল্লেখিত সমস্যাটির ক্ষেত্রে এখন কিছুটা শিথিলতার লক্ষন দেখা যাচ্ছে। যুদ্ধের ঝুকি কিছুটা কমেছে বলেই মনে হচ্ছে। যদিও যুদ্ধের দামামা বাজছে দুই দেশেই, তবে বাংগালির স্বাধীনতা আন্দোলন দমন করতে গিয়ে যে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে এ মুহূর্তে একটি সামরিক যুদ্ধ যে দুই দেশের জন্যই দুর্ভোগ বয়ে আনবে তা মনে হয় নিউ দিল্লী ও ইসলামাবাদের নেতারা উপলব্ধি করতে পারছেন।

যুদ্ধের সম্ভাবনা কমিয়ে আনতে গত ৯ই অগাস্ট স্বাক্ষরিত ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তিরও একটি ভুমিকা আছে বলে মনে হচ্ছে। নিজের দক্ষিন সীমান্তের এত কাছে কোন বিশৃঙ্খল সংঘর্ষ হোক তা সোভিয়েত ইউনিয়ন কখনই চাইবেনা; বিশেষ করে যদি সেখান থেকে চায়নার উপকৃত হবার কোন সম্ভাবনা থেকে থাকে, তারা প্রতিরোধ করবেই। প্রথম দিকে, মস্কো একপেশে ভাবে ভারত ও ভারতের তীব্র সমর্থনপুষ্ট বাঙ্গালী স্বাধীনতা আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হলেও, অচিরেই তা ভুল বলে প্রমানিত হল। ভারত ও পাকিস্তানের প্রতি সমআচরনের যে নীতি ১৯৬৬ সালে তাশখন্দে প্রবর্তিত হয়েছিল, সোভিয়েত নেতারা তা অনুসরন করে যাচ্ছেন এখনও। তার উপর, পাকিস্তানের স্থিতিশীলতা অব্যাহত রাখার বিষয়ে দেশটি আগ্রহী বলে সম্প্রতি একটি ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এমনকি ইতিমধ্যেই, পাকিস্তানকে উন্নয়ন সহায়তা দেয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের অবস্থান প্রমান করে দিয়েছে। সম্ভবত এই অবস্থান ভারতকে সংযত হতে প্রভাবিত করেছে। স্বভাবতই ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তির ফলে পাকিস্তানও কিছুটা শান্ত আচরন করছে। ভারতের সাথে ঝামেলায় জড়ালে ইসলামাবাদের সরকারকে সর্বক্ষণ আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে থাকতে হবে। তবে যাইহোক, যে কারনে মুলত এ উত্তেজনার সৃষ্টি, সেটিরই সমাধান যেহেতু এখনও হয়নি, সেহেতু উপমহাদেশের এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ হবার সম্ভাবনাও একেবারে শেষ হয়ে যায়নি।

পূর্ব বাঙ্গলার স্বাধীনতা আন্দোলনের অংশগ্রহণকারীরাও এখন পাকিস্তানের জন্য একটি বড় সমস্যার কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে, যে আন্দোলন মুলত পরিচালিত হয় ভারত থেকে। সম্মুখ যুদ্ধে সীমান্ত লঙ্ঘন হতেই পারে, কিন্তু হয়ত এটিই যুদ্ধের আগুনকে আরেকটু উস্কে দিবে। বর্ষা শেষ হতে হতে সাধারন মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকখানি ভাল অবস্থানে চলে আসার সম্ভাবনাই বেশি। সেক্ষেত্রে সংঘাতের সংখ্যাও আরো বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়। সুতরাং খুবি জরুরী ভিত্তিতে একজন নিরপেক্ষ মধ্যস্ততাকারীর প্রয়োজন যিনি অবস্থা আরো খারাপ হবার আগেই ভারত ও পাকিস্তানকে আলোচনার জন্য এক টেবিলে নিয়ে আসতে পারবেন। এসময়ে পূর্ব পাকিস্তানি শরণার্থীদের কিভাবে দ্রুত ভিত্তিতে ফেরত পাঠানো যায় সে বিষয়েও আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। স্থায়ীভাবে তাদের দায়িত্ব নেয়া ভারতের জন্য একটি অসহনীয় বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। স্বাভাবিকভাবেই, সেক্ষেত্রে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি আলোচনায় উঠে আসবে, যার ফলে শরণার্থী পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে পরছে। কেননা, নিজদেশে নিরাপত্তা ও সেনাদের ব্যারাকে ফেরত যাওয়ার নিশ্চয়তা না পেলে কোন শরণার্থী ফেরত যেতে সম্মত হবে না।

কিন্তু, পাকিস্তানি পূর্ব বাংলার অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিয়ে কারো সাথেই, এমনকি কোন নিরপেক্ষ পক্ষের সাথে আলোচনা করতেও ইচ্ছুক নয়। কেননা তা করতে গেলে ইসলামাবাদ সরকারকে স্বীকার করে নিতে হবে যে এ সমস্যা সমাধানের জন্য প্রথমে যেটি প্রয়োজন, সেই দুই প্রদেশের পুনর্মিলিত হবার সম্ভাবনা যদি থেকেও থাকে তাও খুবি কম। দেশের জনসাধারণের বেশিরভাগই পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের দখলদার বাহিনী বলে ভাবে। তারা বেসামরিক প্রশাসন চায়। তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত বেসামরিক সরকার নির্বাচিতও করেছিল, কিন্তু তার ফলে আজ তাদের বিদ্রোহী বলে চিনহিত করা হচ্ছে। ভারতের সাহায্য ছাড়াই তারা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ প্রতিরোধ করে যাচ্ছে। গ্রেফতার হওয়া নেতা শেখ মুজিবর রহমানকেই তারা আজো তাদের আদর্শ ভাবে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যদি তার সাধারন ক্ষমার আওতার মধ্যে শেখ মুজিবর রহমান এবং আওয়ামীলীগের অন্যান্য নেতাদের অন্তর্ভুক্ত না করে, তবে অভ্যন্তরীণ কোন সমঝোতায় আসার সম্ভাবনা খুবি কম।
সবকিছু নতুনভাবে শুরু করা ছাড়া এই সেনাদের নিপীড়ন, প্রতিরোধ, প্রতিশোধ, ষড়যন্ত্র, সঙ্ঘাত, ক্ষুধা, রোগ বালাই এবং আরো যত সম্ভাব্য বিপর্যয় হতে পারে, তার দুষ্টচক্র ভাঙ্গা সম্ভব হবে না। তবে এখনও পর্যন্ত, পাকিস্তান নতুনভাবে সবকিছু শুরু করার অনুপ্রেরনা খুব কমই পেয়েছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২২২। বিশ্ব শরণার্থীদের কথা ভুলে গেছে অয়েস্টার্ণ মেইল ২৪ সেপ্টেম্বের ১৯৭১

Masroor Ahmed Makib
<14,222,631-633>

বিশ্ব শরণার্থীদের কথা ভুলে গেছে
সুত্রঃ ওয়েস্টার্ন মেইল (কার্ডিফ)
তারিখ ২৪শে সেপ্টেম্বর ১৯৭১ ।
লেখকঃ সুনন্দ দানা রায় ।

পূর্ববাংলা শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন জন্য প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দ্বারা নির্ধারিত ছয় মাসের সময়সীমা শেষ হয়ে গিয়েছে । ভারত এর বিপর্যস্ত ত্রাণ কর্মকর্তারা বিশ্ব নিরপেক্ষতা এবং ভারী বর্ষনের ফলে সৃষ্ট বন্যার বিরুদ্ধে নিদারুণভাবে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন । সরকারীভাবে ঘোষিত ৯ মিলিয়ন শরণার্থীর মধ্যে সাড়ে পাঁচ মিলিয়ন শরণার্থী খাদ্য ওষুধ এবং বস্ত্র সব সরবরাহ থেকে বঞ্চিত আছে । বন্যা আক্রান্ত হয়ে জলাবদ্ধ থাকার কারনে স্থানগুলোতে দ্রুত মজুদ শেষ হয়ে যাওয়া জিনিসগুলো সরবরাহ করার কাজও জটিল হয়ে পড়েছে । শিবিরের হতাশাগ্রস্ত ৮ জন তরুন ডাক্তার ও ২০০০ নার্স অভিযোগ করেছেন যে সবচেয়ে বেশী হওয়া গ্যাস্ট্রোন্টারিটিটিস এবং স্ক্যাবিস রোগের ঔষধ ডিসপেনসারিগুলোতে পাওয়া যাচ্ছেনা এবং চালের সরবরাহ ৫০০ গ্রাম থেকে জোর করে কমিয়ে ৩৫০ গ্রামে আনা হয়েছে । হাজার হাজার বাশের তৈরি অস্থায়ী আবাসের কঙ্কাল ত্রিপল বা পলিথিনের আচ্ছাদন ছাড়া পড়ে আছে ।

দুর্ভিক্ষ একটি তাত্ক্ষণিক বিপদ নয় , তবে কর্মকর্তারা আরেকটি ভয়ঙ্কর রোগের প্রাদুর্ভাবকে ভয় করছেন যা হলো কলেরা । মে মাসে এই রোগে ৬০০০০ জন আক্রান্ত হয়েছিলো যার মধ্যে ৯০০০ প্রান হারান । নতুন নতুন বিপদ যতটা না শরণার্থী শিবির থেকে আসে তার চেয়ে বেশী আসে বিভিন্ন সংবাদ থেকে । পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার জন্য গেরিলা মুক্তিবাহিনীর আক্রমনের ফলে পাকিস্তানী বাহিনীর চালানো প্রতিহিংসামূলক কর্মকাণ্ডে সিলেট থেকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে ১৬০০০ এর বেশি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে । তাদের বেশিরভাগই কলেরায় আক্রান্ত হয়ে এসেছে , যাদের এক সপ্তাহের মধ্যে চিকিৎসা শুরু করা প্রয়োজন কিন্তু কলকাতায় অবস্থিত রিলিফ হেডকোরারটার মেডিসিনের বাহী একটি কার্গোর চালান পাঠাতে পারছেনা আসামে যা দক্ষিন- পূর্বে ত্রান সরবরাহের একটি প্রধান কেন্দ্র । কলকাতা থেকে গৌহাটি পর্যন্ত ঐতিহ্যবাহী নদী পথ ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় পাকিস্তান দ্বারা বন্ধ করে দেয়া হয় ।

বিশ্ব শরণার্থীদের দেয়া তাদের আশ্বাস রাখেনি। বিশ্বজুড়ে জাতিগুলির প্রতিশ্রুত অর্থের দশ ভাগেরও কম পরিমাণ অর্থ পাওয়া যায় । যদিও উদ্বাস্তুদের দৈনিক প্রবাহ আগস্ট এ আসা ৩৪০০০ থেকে সেপ্টেম্বরে ২৬০০০ এ পর্যন্ত নেমে এসেছে । পরিকল্পনাকারী যারা পূর্বে প্রত্যাশা করেছিলো – তার কিছুটা আশাবাদী হিসাবে এটি দেখা যাচ্ছে যে সমস্যা মাসের শেষের দিকে কমে আসবে এবং তারা সামনের ৬ মাসের পরিকল্পনা ও বাজেট প্রনয়নে ব্যস্ত সময় পার করছেন । অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও ত্রাণের কার্যক্রম যেভাবে অব্যাহত ভাবে চলেছে সেটি একটি অলৌকিক ঘটনা । কিন্তু শরণার্থী শিবিরগুলোতে চরম হতাশার মাঝেও অনেক আশার আলো ঘুরে বেড়ায়। ক্যাম্পগুলোতে শুধু রয়েছে অক্ষম বৃদ্ধ , মহিলা ও শিশুরা । তরুনেরা মুক্তি বাহীনিতে যোগদানের জন্য শিবির ত্যাগ করেছে । ৫০০০ জন লোকের শরনারথী শিবিরে আমি দেখেছি সামান্য ছোটমাছ আর শাক রাখা আছে ছোট্ট ছোট্ট দোকানে যা স্থানীয়রা খেয়ে থাকে । বালকেরা মাছ ধরার জাল বোনায় ব্যস্ত ছিলো এবং একজন কুজো হয়ে যাওয়া বৃদ্ধ মহিলা আবহমানকাল ধরে চলে আসা গ্রামীন আতিথিয়তা দ্বারা বরন করে নিয়েছিলেন । তিনি আমাদের ব্রিটিশ দাতব্য সংস্থা অক্সফমের দেয়া মল্ট ফ্লেভারের ত্রাণের বিস্কুট দিয়ে আপ্যায়ন করেছিলেন । এটিই হচ্ছে উদ্বাস্তু জীবনের বাস্তবতা । এখানে রয়েছে স্কুল , সপ্তাহিক গানের আসর এবং উদ্বাস্তু দের থেকে নির্বাচিত স্বেচ্ছাসেবীদের দ্বারা পরিষ্কার পরিচ্ছতা অভিযান । কিন্তু যেসব জেলায় ক্যাম্প বন্ধ করা হয়েছে, সেখানের জীবনের চেয়ে বিপজ্জনক কিছু আর হতে পারে না । অতি বর্ষণে নদী ও খাল উপচে পড়া পানিতে পশ্চিমবঙ্গ ঘোলাপানির এক ক্রুদ্ধ সাগরে পরিণত হয়েছে । প্রদেশের শহরগুলো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে , ব্রিজগুলো ভেঙ্গে পড়েছে , রাস্তা ও রেললাইন ভেসে গেছে । পশ্চিমবঙ্গের বন্যাতে মৃতের সংখ্যা হাজারেরও বেশি ছাড়িয়েছে । ত্রান সরবরাহের অন্যতম প্রধান সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা । পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিকের পাঁচটি জেলা- পশ্চিম দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, কোচ বিহার, দার্জিলিং ও মালদা । কলকাতার ২০০ মাইল দক্ষিনে অবস্থিত ফারাক্কায় গঙ্গার তীব্র স্রোতের কারনে প্রায় ৩৫০০০০ শরণার্থীর যোগাযোগ বিছিন্ন অবস্থায় রয়েছে । এটি আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরা প্রদেশের তিনটি উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলির প্রধান রাস্তা ছিল, যা দিয়ে প্রায় দুই মিলিয়ন শরণার্থী পাঠানো হয়েছিলো । কলকাতা হলো সকল কিছু সাপ্লাইয়ের মূল ঘাটি । আগামী কয়েদিনের মধ্যে যোগাযোগ পুনরায় চালু না হলে সেখানে অবস্থিত ৪০০ ক্যাম্পের ( ঐ ৫ রাজ্যের মোট ৯৪০ টির মধ্যে ) ঔষধ , কাপড় , খাবার ও নির্মাণ সামগ্রীর মজুদ শেষ হয়ে যাবে ।

এই হতাশাজনক পরিস্থিতিতে অক্সফম যাদের পাচটি সাহায্য বোঝাই ট্রাক পানিতে ভেসে গেছে , বাধ্য হচ্ছে বিমান পরিবহনের মধ্যমে ঔষধ পাঠাতে । কিন্তু এই পথে পন্য পাঠানোর ক্ষেত্রে একমাত্র ভরসা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আমলের পুরোনো ডাকোটা বিমান যারা এই ক্রাসিসের সুযোগে ভাড়া বাড়িয়েছে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় মালামাল পাঠানর ক্ষেত্রে । ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্লেন ইতিমধ্যেই সেখানে এক ডজনের বেশী ফ্লাইট পরিচালনা করেছে কিন্তু এটি যথেষ্ট নয় । অক্সফাম আঞ্চলিক পরিচালক জুলিয়ান ফ্রান্সিস বলছেন যে তিনি এই বছরের শেষ নাগাদ পূর্ববঙ্গ উদ্বাস্তুদের জন্য প্রায় £ ৬৩৪০০০ ব্যয় করার আশা করছেন। কিন্তু অক্সফাম বিহারের হুড্সের জন্য ৪২ হাজার পাউন্ড এর ত্রাণ প্রকল্পে কাজ শুরু করে এবং খরচ কমাতে গত সপ্তাহে ফ্রান্সিস তিনটি গাড়ি পাঠিয়েছে যার প্রতিটিতে নয় টন করে হাই প্রোটিনযুক্ত খাবার , ঔষদ ও কাপর পাঠানো হবে বিকল্প রাস্তা ব্যবহার করে বন্যা দুর্গত রাস্তা এড়িয়ে চলার জন্য ।

সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে. বর্ষা মৌসুমে সবচেয়ে খারাপ পর্যায় এখন শেষ হতে পারে কিন্তু স্টোরেজ সুবিধা উত্তর ও উত্তর-পূর্বের মধ্যে অপর্যাপ্ত এবং এটি হচ্ছে সাপ্লাই এর চালান এলাকাগুলোর মধ্যে বিপজ্জনকভাবে কম চলাচলের জন্য । রাস্তাগুলির এ অবস্থার কারণে গত ২০ দিন ধরে কলকাতা রাস্তায় জাতিসংঘ প্রদত্ত প্রায় ২৩০টি জাপানী ট্রাক অচল বসে আছে । এই দুর্দশার বিবরন একজন চাষীর পক্ষে বর্ণনা করা প্রায় অসম্ভব । যেখানে শরনরথী ও চাষী দুই পক্ষই এখন গৃহহীন । হুড এলাকায় যেখানে পানিতে তলিয়ে থাকা রাস্তা মাথা উচু করে দাড়িয়েছে সেখানে রয়ছে বন্যার ফলে সৃষ্ট অমানবিক পরিস্তিতি ও গন ক্ষুধা যা ছড়িয়ে আছে বনগাঁ শহর থেকে চল্লিশ মাইল দূরে পাকিস্তান সীমানায় ।

একজন ভারতীয় রোমান ক্যাথলিক চার্চ এর প্রিস্ট বলেছেন তিনি তার দায়িত্বে থাকা ১৭ টির মধ্যে এখন মাত্র ৩ টি ক্যাম্পে ভ্রমন করতে পারছেন বাকিগুলো হয় বন্যায় নিমজ্জিত নাহয় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন । ক্যাথলিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ক্যারিতাস প্রিস্ট কে কিছু অর্থ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং প্রিস্ট চেষ্টা করছেন কিছু স্থানীয় নৌকা কেনার জন্য যার মাধ্যমে তিনি পুনরায় ঐসকল ক্যাম্প এর সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারবেন । এতকিছু সত্তেও ত্রানের কাজ অব্যাহত রয়েছে এবং এই কার্যক্রমের প্রধান ভারতীয় কর্মকর্তা কর্নেল পি এন লুথরা বলেছেন ত্রাণ কার্যক্রমের সুচী আগের অবস্থান থেকে সরে নতুন ভাবে করা হয়েছে । এখন পাঁচ ধাপে এই কারযক্রম পরিচালনা করার কারনে কিছু সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে । শরণার্থীদের গ্রহন করা হচ্ছে এরপর প্রতিষেধক দেয়া হচ্ছে তারপর তারা পাকিস্তানী এজেন্ট কিনা তা ক্রসচেক করে দেখা হচ্ছে এরপর তাদের থাকার জায়গা দেয়া হচ্ছে অন্যান্য সুবিধাযুক্ত কার্ড প্রদান সহ এবং এসবকিছুই হচ্ছে এরা ভারতে প্রবেশের মাত্র তিন দিনের মধ্যেই ।এরপর দ্বিতীয় পর্যায়ে ছোট ও বিচ্ছিন্ন ক্যাম্পে থাকা শরনাথীদের একত্র করা হচ্ছে এবং বড় শহরের বড় ক্যাম্পে পাঠানো হচ্ছে । প্রতিটি ক্যাম্পের ধারন ক্ষমতা এক লক্ষ । জলপাইগুড়ির ৫৪টি ক্যাম্প এর সংখ্যা ইতমধ্যে ২২ এ নেমে এসেছে এবং প্রত্যাশা করা যাচ্ছে শীঘ্রই তা ১২ তে নামিয়ে আনা যাবে । তাদের প্রধান সড়কের পাশে উঁচু স্থানে তৈরি ক্যাম্পে পাঠানোর ব্যাপারে কর্নেল লুথরার যুক্তি হচ্ছে এতে তাদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রন সহজ হবে তাদের মেডিকেল সুবিধা ও ত্রান সরবরাহও সহজে করা যাবে । কিন্তু কথা হচ্চে তাদের আসলে কিছুই দেয়া যাবেনা যদিনা বৈদেশিক সাহায্য বা নতুন ত্রানের ব্যবস্থা না হয় । তৃতীয় পর্যায়ের সম্ভাব্য পরিকল্পনায় রয়েছে শরণার্থীদের তাদের দেশে নির্বিঘ্নে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়াটি , কিন্ত কর্নেল লুথরা যিনি একজন তরুন অফিসার বর্তমান কার্যক্রমের এই করুন পরিস্থিতি দেখে শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়ার আগেই পদত্যাগ করতে পারেন ।

শিরনাম সূত্র তারিখ
২২৩। বাঙ্গালিদের পরিকল্পনা ফার ইস্টার্ণ ইকনমিক রিভিউ ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২২৩, ৬৩৪-৬৩৫>

ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ, ২৫ সেপ্টেম্বর , ১৯৭১
বাঙ্গালিদের পরিকল্পনা
– টি জে এস জর্জ

হংকং: বাংলার আকাশ আগামী মাসে আবার শুষ্ক থাকবে। ট্যাংক আবার চলবে, বিমান উড়তে পারবে এবং সৈন্য আসতে পারবে। বর্ষা শুরুর আগে সামরিক কর্তৃপক্ষ সীমান্তর সুরক্ষার জন্য জেঁকে বসেছে। দ্রুত সীমান্ত শহরগুলো যা বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল সেগুলো নিরাপদ করার জন্য ব্যাবস্থা নেবে। যখন বর্ষা শেষ হবে তখন সম্ভবত তারা সমান গতিতে অন্যান্য অঞ্চলে অপারেশন শেষ করবে।

এই সম্ভাবনা দাবি করেছেন একজন সরকারিভাবে করেছেন – আওয়ামী লীগের পার্লামেন্ট সদস্য বা কূটনীতিকদের মতে তাদের আন্দোলন বছরের শেষ দিকে মিলিটারি একশনে শেষ হবে। একটি কথাই তারা বলেছেন – তা হল – হয় আগামী ২/৩ মাসের মধ্যে তারা স্বাধীন হবে অথবা একটি দীর্ঘ গেরিলা সংগ্রাম চলতে থাকবে।

এটা ইচ্ছামত চিন্তা নয়। পাঁচ হাজার অত্যন্ত ভাল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলা গত মাসে যুদ্ধে যোগদান করেছে। যদিও তারা মেয়াদ উত্তীর্ন অস্ত্র দিয়ে কাজ চালাচ্ছে। সাবেক বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস এর ১০০০০ সদস্য এখনো দেশ ভিতরে সক্রিয় আছে।

বাংলাদেশ “সরকার” (অবস্থান অজানা) এছাড়াও নিবিড় সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য চাপ দিচ্ছে এবং এর ফলে ৬০০০০ থেকে ৭০০০০ মানুষের একটি ‘নিয়মিত বাহিনী’ তৈরি হবে। এরা শরণার্থীদের থেকে আসছে – যাদের সংখ্যা ভারতীয়দের হিসেব অনুযায়ী সাড়ে আট মিলিয়ন। আর পাকিস্তানের মতে ২ মিলিয়নের কাছাকাছি।

মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হিসাবে কার্যকর হবে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নেতাদের পূর্ণ আস্থা আছে। তারা বলে – অস্ত্র – কোন সমস্যা নয়। তারা বিদেশী বাঙালিদের থেকে ফান্ড সংগ্রহ করেছে, বাণিজ্যিকভাবে অস্ত্রবাজারে আধুনিক অস্ত্রের প্রাপ্যতা এবং ইস্রায়েলের মত কিছু দেশের সম্মতি তাদের কাজে লাগবে। তারা এটা উল্লেখ করে নাই কিন্তু ভারতের “নির্ভরযোগ্য এলাকা” এই গণনার একটি বড় কারণ হবে।

এসব গণনার বেশিরভাগ যুক্তিযুক্ত। এটা বলা কঠিন যে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য ঘুরে দাঁড়াবে না। সাম্প্রতিক সময়ে ধারনা দেয়া হয় যে একটি বেসামরিক সরকার প্রশাসনে আসতে পারে তার সাথে সেনাবাহিনী সমন্বয় করে চলতে পারে। সম্প্রতি বেসামরিক গভর্নর ১০ জন মানুষ নিয়ে একটি তত্ত্বাবধায়ক মন্ত্রীসভা করেছেন এবং পূর্ব অঞ্চলে উপনির্বাচন নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হবে। এই সময়ের মধ্যে সংবিধান প্রস্তুত করা শেষ হয়ে যাবে।

এসকল পদক্ষেপ বাঙ্গালিকে আরও তিক্ত করে তুলবে। তারা তারা গভর্নর এ এম মালেককে চেনেনা। এই মন্ত্রিসভা দক্ষিণপন্থী দলগুলোর সদস্যদের নিয়ে গঠিত যারা নির্বাচনে হেরে গেছে। আওয়ামী লীগে উপ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের আরও একটি বিষয় সাহায্য করতে পারে। তা হলপশ্চিম পাকিস্তানের অস্থিরতা। বাংলার সংগ্রাম ধীরে ধীরে পশ্চিম অংশে উপজাতীয় স্বায়ত্তশাসনের জন্য যে আন্দোলন তার উপর একটি প্রভাব ফেলতে পারে। খাইবার মেল সম্প্রতি রিপোর্ট করেছে যে মুক্তির জন্য বেলুচিস্থান ন্যাশনাল ফ্রন্ট কার্যক্রম চালাচ্ছে, কাবুল (আফগানিস্তান) রেডিও সম্প্রতি জানায় যে পাঠানরা একটি সভা করেছে একটি সার্বভৌম পাখতুনিস্তান গঠনের দাবিতে।

শহরাঞ্চলে সম্ভবত আরো উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে শ্রমিক ও ছাত্রদের মধ্যে। এই মুহূর্ত তারা জুলফিকার আলি ভুট্টোকে তাদের অঞ্চলের নেতৃত্বে চাচ্ছেন।

ভুট্টো চেষ্টা করছেন। তিনি এখনও তার ককটেল সহচরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত সম্পর্ক বজায় রাখছেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে সম্প্রতি বলেছেন যদি ইয়াহিয়া “জাতীয় প্রধানমন্ত্রী” হতেন। অন্যদিকে তিনি কনিষ্ঠ মধ্যম সারির কর্মকর্তাদের বলেন তিনি যথেষ্ট বয়স পার করে এসেছেন।

এটা ভুট্টোর জন্য কল্পনাতীত যে জুনয়র অফিসারদের থেকে সামরিক অভ্যুত্থান হবে ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে কারণ সম্ভবত ইয়াহিয়াকে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে তারা দেখে।

ভুট্টো যদি ড্রাইভারের সীট পায়, তবে সে হয়ত পূর্ব পাকিস্তানের উপর নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করতে পারবে। কিন্তু অন্যদের হস্তক্ষেপ হতে পারে – কনিষ্ঠ কর্মকর্তারা পূর্বাঞ্চলে সামরিক অবস্থান থেকে বিরত থাকতে পারে -ভারতের সেনাবাহিনী একটি সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারে – বাঙ্গালি ফোর্স হরতাল দিতে পারে।

আসল ব্যাপার হল এসব সম্ভাবনা নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের আলোচনা শুরু হয়েছে। জনগণের পক্ষ থেকে একটি চাহিদা তৈরি হতে পারে পূর্ব অঞ্চলের করা অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি থামানোর ব্যাপারে। যেভাবেই হোক – অক্টোবর-নভেম্বর পাকিস্তানের জন্য একটি নিষ্পত্তিমূলক সময় হতে পারে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২২৪। অবস্থার উন্নতি হচ্ছেনা ইয়াঙ্কি ২০-২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২২৪, ৬৩৬>

(ইয়াঙ্কি, আঙ্কারা নিউজ ম্যাগাজিন, ২০-২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১)
পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না

জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সরকার চালাবে বলে ইয়াহিয়া খান যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা সম্ভবত বাস্তবায়ন হবেনা। পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হওয়ায় বেসামরিক শাসন পদ্ধতি শুরু করা সম্ভব নয়। কিন্তু আসল কারণ হচ্ছে উচ্চাভিলাষী সামরিক শাসক ক্ষমতার লাগাম ছাড়তে চাচ্ছেনা।

পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল টিক্কা খানের জায়গায় একজন বেসামরিক লোককে পদায়ন করা হয়েছে। বিদেশী কূটনীতিকরা কেউ কেউ এ সিদ্ধান্ত সমর্থন করেছেন। যতদিন টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর থাকবেন ততদিন একটি মধ্যমেয়াদী নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে ৭৮ টি আসনের জন্য “উপযুক্ত” প্রার্থী খুঁজে পাওয়া অসম্ভব হবে।

সামরিক চক্র মুসলিম লীগকে সমর্থন করে যারা গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে একটি সিটও জিততে পারেনি। আরেকটি বিকল্প ছিল পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি যার নেতৃত্বে ছিলেন নুরুল আমিন। কিন্তু আমিন মানুষের মধ্যে মোটেই জনপ্রিয় নন।

পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর সাবেক কমান্ডার মার্শাল আসগর খানের দলকে জাতীয় পরিষদে সংবিধান প্রস্তুতির দায়িত্ব দেয়া হবে।

যতক্ষণ মুজিবুর রহমানের মুক্তি না হবে এবং আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিতে সুযোগ না দেয়া হবে ততোক্ষণ পাকিস্তানের ঐক্য স্থাপন অসম্ভব। যদিও বর্তমান শাসনাধীনে তার প্রশ্নই ওঠে না …

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২২৫। পূর্ব বাঙলা শরনার্থী – একটি বিশ্ব সমস্যা এডভান্স ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২২৫, ৬৩৭>

এডভান্স, মাউরিটিয়াস, ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
সম্পাদকীয়
পূর্ব বাঙলা শরনার্থী – একটি বিশ্ব সমস্যা

ভিয়েতনামের ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ড শেষ হতে না হতেই পূর্ববাংলাতে তার চাইতেও ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড শুরু হয়ে যায়। প্রায় সাড়ে আট মিলিয়ন মানুষ তাদের বাড়ি থেকে পালিয়ে তাদের সর্বস্ব ত্যাগ করে চলে গেছে এবং তাবুতে বসবাস করছে – শুধুমাত্র বেঁচে থাকার আশায়।

মার্চ থেকে যখন ট্রাজেডি শুরু হয় তখন থেকেই উদ্বাস্তুরা ভারতে পালাতে শুরু করে।ইতিমধ্যে এটি খুবজনবহুল। প্রতিদিন পঞ্চাশ হাজার লোক সীমান্ত পেরিয়ে আসছে। এখানকার জনসংখ্যা এখন লন্ডন বা প্যারিসের থেকে বেশি। প্রথম দিকে বিশ্ব ভাবেনি যে দেশটির অর্থনীতিতে এটি এমন ভাবে প্রভাব ফেলতে পারে। স্বাধীনতার পড় থেকেই এই দেশ প্রতি বছর বন্যা, খরা, ক্রমবর্ধমান জন্মহার এবং বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর সকল অংশের ব্যক্তিদের ধন্যবাদ যারা মানব ইতিহাসের সর্বকালের সর্ববৃহৎ স্থানত্যাগের এই ঘটনাকে প্রচার করেছেন, গণহত্যাকে সংবাদপত্রে প্রকাশ করেছেন। জনমত সৃষ্টি করেছেন। নানা ধর্মের ও সমাজের মানুষেরা এসেছেন যাদের থেকে জানা যায় নারী ও শিশুদের নানা বীভৎস মৃত্যুকাহিনী – যা ক্রমাগত সীমান্তের ওপারে ঘটে চলেছে। এত বিপুল পরিমাণ শরণার্থীদের উপস্থিতি কেবল এই রাজ্যের অর্থনীতি ও জীবনকেই প্রকাশ করেনা বরং এই এলাকাটির শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য একটি ঝুঁকি। যেকন মুহুর্তে এখানে বস্তুগত দ্বন্দ্ব এবং দাঙ্গা বিস্তৃতি লাভ করতে পারে।

যতক্ষণ না বিশ্বের দেশগুলি একত্রিত হয় এবং এটি সম্পর্কে কিছু করে তার আগ পর্যন্ত এটি আরেকটি ভিয়েতনাম হতে যাচ্ছে। একমাত্র পার্থক্য হল যে এটির প্রভাব আরো মারাত্মক হবে এবং এর ফল আরো বিপজ্জনক হবে। তখন এটি কোন স্থানীয় সমস্যা হিসেবে আর থাকবে না। এটা হয়ে যাবে সমস্ত বিশ্বের সমস্যা – কারণ বিশ্ব তাদেরকে তাদের ঘর ছাড়া করেছে।

তার বয়স হওয়া সত্ত্বেও, আন্দ্রে মালরুয়েক্স সেখানে যেতে চান এবং তাদের জন্য যুদ্ধ করতে চান। তাঁর মতো, বিশ্বব্যাপী লেখক ও শিল্পীগণ সবার কাছে মানবিক আবেদন করেছেন এইসব লাখ লাখ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য যারা ক্ষুধা ও ঠান্ডার সাথে লড়াই করছে। কলকাতার কাছাকাছি শরণার্থীদের ক্যাম্পে যাওয়ার সময় সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি অশ্রুতে ভেঙে পড়েন। প্রতিটি দেশের প্রেস আরও সাহায্য পাঠানোর জন্য আন্তর্জাতিক ভাবে আহ্বান জানাচ্ছে। বিশ্ববিবেকের জাগরণের জন্য সুইস স্বেচ্ছাসেবক সম্প্রদায় অনশন ধর্মঘট করে যাচ্ছেন। এবং শুধুমাত্র গতকালই, কারিতাস সমস্ত বিশ্বের কাছে বাংলার গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে আবেদন জানিয়েছেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২২৬। শরনার্থিদের ফিরে আসার আবেদন আল-আম্বা ২ অক্টোবর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২২৬, ৬৩৮>

অ্যালান বি এ এ (সাপ্তাহিক) বৈরুত, ২ অক্টোবর ১৯৭১
শরনার্থিদের বাংলাদেশে ফিরে আসার আবেদন

ভারত থেকে সফরের সময় আমরা উপলব্ধি করেছি বাঙালিরা সত্যিই ভয়ঙ্কর ট্রাজেডির মধ্যে দিনাতিপাত করছে। এবং তাদের উপর যে নিপীড়ন করা হয়েছে তা কল্পনাতীত। নারী, শিশু ও বুদ্ধিজীবীদের উপর সংঘটিত অত্যাচার আমাদের আমাদের ফিলিস্তিনে ইসরাইলি অত্যাচারের কথা মনে করিয়ে দেয়। উদ্বাস্তুদের সংখ্যা এখন আট মিলিয়ন অতিক্রম করেছে।

আমরা এই গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছি, এই লোকদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার আবেদন করছি এবং শরণার্থীদের ফেরত তাদের মাতৃভূমিতে ফেরত পাঠানোর অবস্থা তৈরির আবেদন করছি।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২২৭। ইয়াহিয়া খানের নতুন রাজনীতি লা মানড ২ অক্টোবর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২২৭, ৬৩৯-৬৪০>

দি ডেইলি লা মানড (প্যারিস) , ২ অক্টোবর ১৯৭১
পাকিস্তানঃ ইয়াহিয়া খান বাঙালির বিশ্বাস ফিরে পেতে চেষ্টা করছেন
– ভিরাটেলি

পাকিস্তান সরকার ভারতকে পূর্ব পাকিস্তানের দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি তৈরির জন্য দায়ী করেছে। ৩০ শে সেপ্টেম্বর জারি করা একটি সরকারি সূত্র অনুযায়ী, ভারতে প্রশিক্ষিত ফ্রগম্যান আটক করা হয়, যখন তারা চট্টগ্রামের বন্দরের কাছে মাইন সেট করছিল। অন্যদিকে, মিঃ ভুট্টো বুধবার পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সোভিয়েত হস্তক্ষেপের নিন্দা করেছেন। তিনি দেশের গণতন্ত্র পুনঃস্থাপন করার ব্যাপারে ইয়াহিয়া খানকে আশ্বাস দেন। যদি এই বছরের শেষের আগে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার না হয়, তিনি যোগ করেন, তাহলে দেশ বাঁচাতে খুব দেরি হয়ে যাবে। বাংলার সংকটের ছয় মাস পর, জেনারেল ইয়াহিয়া খান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আস্থা অর্জনে এবং দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করছে। গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে একটি সাধারণ অ্যামনেস্টি প্রদান করেছে, তবে যারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করেছে বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নেতারা এর আওতার বাইরে থাকবে। কিন্তু অন্যদিকে পাঞ্জাবের কর্মকর্তাদের হত্যা করার পর মার্চের শেষ দিকে হাজার হাজার আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা বিদ্রোহ করে, তারা এই অ্যামনেস্টি দ্বারা উপকৃত হবে। এই সিদ্ধান্ত একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি গঠন করে, কিন্তু সত্য বলতে এতে কোনও ফল হয়নি।

জেনারেল টিক্কার – যিনি বাঙালির সমত্ন নীতি নিয়েছিলেন – তার বদলে একটি বেসামরিক সরকার গঠন করা হয়েছে। তবে সেনাবাহিনীর অধীনে রাখা হয়েছে। এতে করে তারা মধ্যপন্থী এবং ডানপন্থি যে চরিত্র ধারণ করুন না কেন সে সম্পর্কে মানুষের কোন বিভ্রম নেই। অন্যদিকে পশ্চিমাঞ্চলীয় কিছু কিছু রাজনীতিবিদ বলেছেন বাংলায় ক্ষমতা বদল হলেও আইন শৃঙ্খলা এখনও পর্যন্ত পুনর্বহাল হয়নি। তবুও উপনির্বাচন দুই মাসের মধ্যে হবে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শূন্য আসনগুলি পূরণ করতে হবে যেহেতু তাদের বেশিরভাগ বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। যদিও আওয়ামী লীগের মনোনীত ৮০ জন প্রতিনিধি তাদের ম্যান্ডেট রেখেছেন, তবে তাদের মধ্যে মাত্র ২০ জন সরকারি কর্মসূচি পালন করেছেন। এই নির্বাচন কি অবস্থার মধ্যে হবে তা এক আশ্চর্য ব্যাপার। স্বায়ত্তশাসনের দাবি করা দল যারা গত নির্বাচনে বিপুল বিজয় অর্জন করেছে তারাএই নতুন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না।

অবশেষে, ইসলামাবাদ কর্তৃপক্ষ শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার মুলতবি করেছে যা আগস্টের মাঝামাঝিতে অনুষ্ঠিত হয়। এখানে সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, বাঙ্গালী নেতাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে না, এমনকি যদি আদালত তাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করে। যেকোনো মামলায় তার আইনজীবী অ্যামনেস্টির জন্য আবেদন করবে। যাইহোক কোনও সন্দেহ নেই যে এই বৈদেশিক শক্তিগুলি বিশেষ করে ইউএসএ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক সমাধানের জন্য প্রদত্ত চাপের প্রতিক্রিয়ায় সরকারের এই বিভিন্ন পদক্ষেপগুলি আসে।
ফ্রান্সের প্রতিনিধিত্বকারী “ওয়াশিংটন ক্লাব” সদস্যগণ তাদের অর্থনৈতিক ও আর্থিক সহায়তা দেবার পূর্বশর্ত হিসেবে বলেছেন যে ঢাকার সিভিল প্রশাসন পুনবহাল করতে হবে। পাকিস্তানি উন্নয়ন এবং অর্থের ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে বৈদেশিক সহায়তার একটি বড় অংশ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তার সহায়তা স্থগিত করেনি এবং বঙ্গোপসাগরে সাইক্লোন এবং দমনের শিকারদের সহায়তার জন্য বছরের শুরুতে ২৪০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা প্রদান করেছে। এটা সম্ভাব্য যে তারা শীঘ্রই ইসলামাবাদ শাসনের নতুন কমিটির সদস্যদের সাথে বসবে। ইউনাইটেড নেশনস এ বাংলার ব্যাপারে প্রশ্ন উত্থাপিত হলে ইসলামাবাদ সরকার একটি ভাল ধারণা তৈরি করাতে চায়।

উপ-নির্বাচনগুলির জন্য সময়সীমা দেবার উদ্দেশ্য হল সমস্য ক্ষেপণ। কিন্তু উপনির্বাচন পর কি হবে সেই উদ্দেশ্য খুব স্পষ্ট নয়। এটি আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করা হয় যে, সরকার সর্বদা প্রদেশের স্বায়ত্তশাসন প্রদানের জন্য প্রস্তুত থাকবে, যদি এই অবস্থা বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম দেশকে বিভক্ত না করে। তবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে, তারা বাংলাদেশের সরকারকে নিয়ে সমঝোতা করতে চায় না – যা ইসলামাবাদ নাম দিয়েছে “ভারত স্টুজেস” অফিসিয়ালি তারা ঘোষণা করেছে “তারা আদালতে হাজির হতে পারে এবং নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে পারে।’’ যদি তারা না আসে, তাহলে আমরা তাদের ছাড়াই করবো। যদি ভারত অনুপ্রবেশকারীদের সাহায্য না করে তবে আমরা এক সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। এই সব সত্ত্বেও, ইসলামাবাদ পূর্ব পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা নিয়ে উদ্বিগ্ন, যেখানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মওলানা মুহাম্মদ ইসহাককে হত্যা করা হয়েছিল। পূর্ব বাংলায় সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর হস্তক্ষেপও পশ্চিমা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। মিঃ ভুট্টো, যিনি সেনাবাহিনীর পদক্ষেপকে অনুমোদন করেছিলেন, কারণ দেশটির ঐক্য রক্ষার জন্য এটি গ্রহণ করা হচ্ছিল। তিনি এখন শাসকশ্রেণীর নীতির সমালোচনা করছেন, তার যোগাযোগগুলি ভেঙে ফেলছেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২২৮। জরুরী সমস্যা মাইনিচি ডেইলি নিউজ ৩ অক্টোবর ১৯১৭

Razibul Bari Palash
<১৪, ২২৮, ৬৪১>

মাইনিচি ডেইলি নিউজ, টোকিও , ৩ অক্টোবর ১৯৭১
সম্পাদকীয়
জরুরী সমস্যা

যতক্ষণ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ স্বাভাবিক অবস্থা পুনরুদ্ধার হয়, ততক্ষণ উদ্বাস্তুদের সমস্যার কোন সমাধান হতে পারে না। যুদ্ধের সম্ভবনাও দূর করা যাবে না। ইয়াহিয়া খানের সরকার প্রশাসনে বেসামরিক নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করার কথা বলছে। কিন্তু বিভ্রান্তি এখনও আছে এবং খাদ্য সংকট আছে। সাহায্যদাতা জাতি জাপান পাকিস্তানে সহায়তা বন্ধ করে দিয়েছে যতক্ষণ পর্যন্ত স্বাভাবিক অবস্থা পুনরুদ্ধার করা না হয়। আশা করা হচ্ছে পাকিস্তানে রাজনৈতিক নিষ্পত্তির জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে যাতে সাহায্যের প্রবাহ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পুনরায় শুরু করা যায়।

এটা আন্তর্জাতিক সমাজে নিয়মের মধ্যে পড়ে যে এক দেশ অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না। কিন্তু পাকিস্তানে উদ্বাস্তুদের দুঃখজনক পরিস্থিতি ও সংকট কোন রাষ্ট্র উপেক্ষা করতে পারবেনা। এটা মানবজাতির সকলের জন্য চিন্তার বিষয়। এখন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বিষয়টি সমাধানের জন্য উত্থাপন করার একটি সঠিক ফোরাম বলে মনে হয়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২২৯। পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠী কোণঠাসা ইন্দোনেশিয়ান অব্জার্ভার ৭ অক্টোবর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২২৯, ৬৪২>

ইন্দোনেশিয়ান অবজারভার, (জাকার্তা), ৭ অক্টোবর ১৯৭১
সম্পাদকীয়
পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠী কোণঠাসা

জেনারেল ইয়াহিয়া খানের পাকিস্তানের সামরিক শাসনামল খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে। বিশ্বের সাথে দেশের অভ্যন্তরের জনগণ দ্রুত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের চাপ দিচ্ছে। দেউলিয়া অবস্থা এড়াতে ইয়াহিয়া খানের সাধারণ ক্ষমা এবং বেসামরিক লোক দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নরকে প্রতিস্থাপনের ঘোষণা ভারতে অবস্থিত ৯ মিলিয়ন শরণার্থীদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ সৃষ্টি করেনি। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মূল সমস্যাকে স্পর্শই করেননি। শরনার্থিদের ব্যাপারেও কোমল মনোভাব দেখান নি। তিনি গত ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অপ্রতিরোধ্য বিজয়ের পর পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ আইনসভা কি হবে সে সম্পর্কে কিছু উল্লেখ করেননি।

এই সমস্যা এড়িয়ে গেলে পাকিস্তানের সঙ্কট এক ইঞ্চিও সমাধান হবেনা। এদিকে, স্পষ্ট রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া পাকিস্তানের দুর্দশা আরও অসহনীয় হয়ে উঠছে। আর্থিক দেউলিয়াত্বের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান। এমনকি ইয়াহিয়া খানের শাসনামলের সবচেয়ে আশাবাদী সমর্থক ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারবেন না যে এই সমস্যা কতদিন স্থায়ী হবে।

বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের ভূমিকা নিয়ে কথা বলে বিশ্ববাসীর সহানুভূতি আদায়ের পাকিস্তানী প্রচেষ্টা ব্যার্থ হয়েছে। আজ না হোক কাল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে স্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে এবং সাধারণ নির্বাচন অনুসারে পদক্ষেপ নিতে হবে। যত দ্রুত তিনি এটা করবেন ততো দ্রুত স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসবে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৩০। স্বেচ্ছাচারিতার শিকার প্রাভদা ১২ অক্টোবর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৩০, ৬৪৩>

প্রাভদা, ১২ অক্টোবর ১৯৭১
স্বেচ্ছাচারিতার শিকার

ধারাবাহিক নির্যাতনের জন্য সব ধর্মের লক্ষ লক্ষ মানুষ আশ্রয়হীন এবং শান্তিপূর্ণ জীবন থেকে বিচ্যুত। নয় মিলিয়নের অধিক মানুষ ভারতে পালিয়ে গেছে।

এই মুহুর্তে ভারত ৯ মিলিয়ন মানুষকে খাওয়ানোর মত অত্যন্ত কঠিন সমস্যার সম্মুখীন। এই শরণার্থীদের পরিস্থিতি সহজ নয়। তারা আশা করছে ভারত তাদের আশ্রয় ও আতিথেয়তা দেবে। কিন্তু ভারত তার সীমিত সম্পদ নিয়ে তাদের কী দিতে পারে? আজ পর্যন্ত মোট যে বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া গেছে তা চাহিদার তুলনায় খুবই কম যার পরিমাণ ১৫৩ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু ৬ মাসের জন্য শরণার্থীদের খাওয়াতে হলেও এর থেকে চার গুণ বেশী অর্থের প্রয়োজন। এজন্যই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা করেন যে, সরকার শরনার্থিদের তাদের মাতৃভূমিতে ফেরত পাঠানোর জন্য ব্যবস্থা নেবে। ফেরতের ব্যাবস্থা বলতে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা বোঝানো হয়েছে যাতে করে ৯ মিলিয়ন শরনার্থি সম্মান ও মর্যাদাসহ নিরাপদে ফিরে যাবার মত আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে পারে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৩১। পরাশক্তিসমূহের দায়িত্ব লা লিব্র বেলজিক ১৮ অক্টোবর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৩১, ৬৪৪>

লা লিব্র বেলজিক (ব্রাসেলস), ১৮ অক্টোবর ১৯৭১
পরাশক্তিগুলোর দায়িত্ব
সম্পাদকীয়

বাংলার লাখ লাখ শরণার্থীদের নাটকে যুদ্ধ যোগ হচ্ছে কি? প্রতিদিন কোলকাতার রাস্তা দিয়ে পূর্ব বাংলার দারিদ্র্যপিড়ীত পুরুষ, নারী ও শিশুরা দু:স্থ অবস্থায় ভারতে প্রবেশ করছে। সেনা শাসকেরা তাদের জায়গা শূন্য করতে চায় – তাদের জনগণকে ক্ষুধা আর রোগেশোকে শেষ করতে চায়। আগামীকাল কি আমরা যুদ্ধের মাধ্যমে আরও বেশী ক্ষতিগ্রস্তদের দেখতে পাব। এই পরিস্থিতির কি শেষ আসবে?

বিশ্ব আজ মৃত্যুর সাথে লড়াই করা ১০ লক্ষ বাঙ্গালীর ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। অবস্থা দিনে দিনে বাড়ছে। এই দুর্ভাগা মানুষকে সাহায্য করতে কাউকে না কাউকে এগিয়ে আসতে হবে এবং কেউ নিশ্চুপ থাকতে পারেন না। এখানে এবং অন্য জায়গা থেকে যে অর্থসাহায্য পাওয়া গেছে তা দিয়ে শরনার্থিদের নিজেদের দেশে পুনর্বাসন ও নিজেদের স্থাপনা পুনঃমেরামতে ব্যাবহার করা যেতে পারে। এখানে মূল সমস্যা রাজনৈতিক। প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কি পাকিস্তানের মত দেশকে ক্রমাগত ভারতে লোক পাঠিয়ে চাপ সৃষ্টি করতে দিতে পারি? এটা কি গ্রহণযোগ্য যে গ্র্যান্ড আন্তর্জাতিক কৌশলের নামে মার্কিন সরকার একদিকে পাকিস্তানি নেতাদের অস্ত্র দিচ্ছেন এবং অন্যদিকে উদ্বাস্তুদের নির্বাসিত হয়ে বেঁচে থাকার জন্য সাহায্য দিচ্ছেন?

ওয়াশিংটন উত্তর দিয়েছে যে এশীয় উপ-মহাদেশের পাকিস্তানের আঞ্চলিক গুরুত্ব রয়েছে এবং পিকিং তাদের সমর্থন করে। মস্কো ভারতের সাথে ২০ বছরের বন্ধুত্ব চুক্তি করেছে। অতএব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ভূমিকা পালন করবে।

কিন্তু প্রেসিডেন্ট নিক্সন কি চীন এবং সোভিয়েতের মধ্যে সংলাপের সুযোগ সৃষ্টি করেন নাই? এবং এই আলোচনার লক্ষ্য কি বর্তমান এবসার্ড খেলা বন্ধ করার জন্য নয়? – যে খেলার জন্য বিশ্বশক্তিমানদের ক্ষমতার লড়াইয়ে লক্ষ লক্ষ শরনার্থি আজ ভোগান্তির সম্মুখীন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৩২। এশিয়া বিস্ফোরন্মুখ গ্লোব এন্ড মেইল ২০ অক্টোবর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৩২, ৬৪৫>

গ্লোব এন্ড মেইল, (টরন্টো), ২০ অক্টোবর ১৯৭১
সম্পাদকীয়
এশিয়া বিস্ফোরন্মুখ

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক এখন ফ্ল্যাশ পয়েন্টে রয়েছে, এবং দুই দেশের সীমানায় বিপজ্জনক যুদ্ধ ছড়িয়ে যেতে পারে। এ ধরনের যুদ্ধে এশিয়ায় দুটি সুপার পাওয়ারের ক্ষমতা হ্রাস করবে। রাশিয়া এবং চীন। এমনকি যদি চরম বিপদ এড়িয়ে যাওয়া হয় – তবে ভারতীয় উপমহাদেশের এই প্রাদেশিক দেশগুলির পরিণতি এবং তাদের জনগণের যুদ্ধের পরিণতিগুলি বর্ননাতিত হবে। এই বিয়োগান্ত নাটক কি কিছুতেই বন্ধ করা যাবে না?

এই পর্যায়ে উভয় দেশের মধ্যে দোষারোপের কোন বিন্দু নেই। ব্রিটিশদের বিভাজনের সময় থেকে তাদের দ্বন্দ্ব বিদ্যমান; তাদের সমস্যাগুলি শুধুমাত্র ভারত পাকিস্তানের নেতৃত্বের নৃশংসতার জন্য নয়। এটা স্পষ্ট যে বর্তমান সংকট সমাধান করা উভয় দেশের ক্ষমতার বাইরে। ভারতের জন্য এখন বড় সমস্যা পূর্ব পাকিস্তানের থেকে আসা শরণার্থীদের বন্যা। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মোট নয় মিলিয়ন হিসেব করেছেন। এমনকি পাকিস্তানের মুখপাত্ররা চার বা পাঁচ লাখেরও বেশি স্বীকার করেন। উভয় ক্ষেত্রেই তাদের রক্ষণাবেক্ষণ ভারতীয় অর্থনীতিতে অবিশ্বাস্য বোঝা চাপিয়ে দেয়, যার পরিমাণ সরকারি ব্যয়ের ৫ শতাংশেরও বেশি এবং তা ভারতের প্রাপ্ত সমস্ত বৈদেশিক অর্থনৈতিক সহায়তা থেকে অনেক বেশি।

শরণার্থীদের প্রবাহ অব্যাহত, এবং তাদের মধ্যে কেউ বর্তমান পরিস্থিতিতে পাকিস্তান ফিরে আসার চিন্তা করবে না। ভারত হতাশ হয়ে উঠছে এবং ক্রমশঃ কাছাকাছি চলে আসছে – সাধারণ বৈদেশিক নীতির কারণেই তারা পাকিস্তানের বিভক্তি এবং পূর্ববাংলাতে একটি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের দিকে তাদের অবস্থান।

পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান স্পষ্টতই তাঁর সরকারকে একটি অসম্ভব অবস্থানে নিয়ে এসেছেন যাতে দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশে স্বায়ত্তশাসিত আন্দোলনকে দমন করার জন্য সামরিক বাহিনী ব্যবহার করতে হয়। তবে এটাও সত্য যে বিপথগামীদের থামানোর জন্য কিছুটা বাহিনীর প্রয়োজন ছিল – প্রাথমিক সমস্যা দূর করার জন্য। এখন তারা আবার একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চেষ্টা করছেন। এটি সন্দেহজনক যে আসলে কোন সমাধান পাওয়া যাবে কিনা যাতে করে পূর্ব পাকিস্তানের শান্তি অ নিরাপত্তা পুনস্থাপিত হয় এবং সমসগ্র দেশে কিছুটা স্থিতি আসে। কিন্তু অবশ্যই অনেক বেশি সময় প্রয়োজন, এবং বর্তমানে একটি যুদ্ধ সকল আশা ধ্বংস হবে।

এই মুহুর্তে যা দরকার তা হল চূড়ান্ত দুর্যোগকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য ভারতকে সাহায্যের জন্য শরণার্থী ভার বহন করার কিছু উপায় বের করা। এক্ষেত্রে ১৩-জাতি বিশ্বব্যাংক কনসোর্টিয়াম (কানাডসহ) আছে যারা ভারতে অর্থনৈতিক সহায়তা দিচ্ছে তারা দায়িত্ব পালন করতে পারে। প্যারিসে ২৬ শে অক্টোবর একটি সভায়, কন্সোর্টিয়ামে ভারতের উদ্বাস্তু কর্মসূচির জন্য অর্থ প্রদানের জন্য ৭৫০ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করতে বলা হবে। দামটা অনেক বেশি তবে তার বিকল্প পথে অপচয় হবে গণনার অযোগ্য।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৩৩। পূর্ববাংলাঃ সামরিক সমাধানের ব্যার্থতা আল সাওরা ২২ অক্টোবর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৩৩, ৪৪৬>

আল সাওরা, দামস্কাস, ২২ অক্টোবর ১৯৭১
পূর্ববাংলাঃ সামরিক সমাধানের ব্যার্থতা

ঘটনা প্রবণতায় দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা আসন্ন। এ দিকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু প্রবাহ বন্ধ করতে হবে এবং সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন। বিশেষ করে সামরিক সমাধান যখন ব্যর্থ হয়েছে এবং অমানবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

এছাড়াও, লাখ লাখ শরণার্থীদের রক্ষা করতে জরুরী ব্যাবস্থা নিতে হবে এবং সাহায্য ও ত্রাণ বাড়ানোর উপায় খুঁজে বের করতে হবে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৩৪। ইন্ডিয়া-পাকিস্তান যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ফার ইস্টার্ণ ইকোনোমিক রিভিউ ৩০ অক্টোবর, ১৯৭১

Zulkar Nain
<১৪, ২৩৪, ৬৪৭-৬৪৮>

ফার ইস্টার্ন ইকোনোমিক রিভিউ, অক্টোবর ৩০, ১৯৭১
ইন্ডিয়া-পাকিস্থান যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত
এ এইচ হরিহরান

নয়াদিল্লি: ভারত ও পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী সম্পূর্ণভাবে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। গত সপ্তাহে ভারতের প্রতিরক্ষা উত্পাদন মন্ত্রী বলেন, “সতর্কবার্তা থেকে যুদ্ধ শুরু করতে দুই মিনিটের বেশি সময় নেওয়া উচিত না”। এবং সামরিক শক্তি প্রদর্শন সব সময় চলে। লাহোর, করাচী এবং পাকিস্তানের অন্যান্য শহরগুলোর যানবাহন ধর্মঘটকারীরা “ভারত গুঁড়িয়ে দাও” এবং “ভারত জয় করো” স্লোগান দিয়ে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম বলেছেন, পাকিস্তানের মাটিতে একটি নতুন যুদ্ধ হবে এবং ভারত কেবল পাঞ্জাবের লাহোর ও শিয়ালকোটের শহরগুলিই দখল নেবেনা বরং তাদের ভালোও রাখবে।

রাম স্পষ্টতই ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের কথা উল্লেখ করেন যখন ভারতীয় সেনাবাহিনী লাহোরের উপকণ্ঠে অভিযান শুরু করে, কিন্তু তাশখন্দ চুক্তির পর শহরটি দখল নেয়নি। ভারতকে এলাকা প্রত্যাহার করতে হয়েছিল এবং ত্যাগ করতে হয় কাশ্মীরের কার্গিলে ও হাজী পিরের উপর কৌশলগত আধিপত্য যা অনেক কষ্টে অর্জন করতে হয়েছিল।

১৯৬৫ সালের “২২-দিনের যুদ্ধ” সম্পর্কে দ্বিধাবিভক্ত ধারণা রয়েছে। রাজনৈতিক নেতারা বলেন, বেসামরিক জনগোষ্ঠীর ভরণপোষণে জড়িত সমস্যাগুলির কারণে ভারত লাহোর দখল করেনি। তবে, জেনারেল হারবক সিং, যিনি সেই সময় পশ্চিম সেক্টর কমান্ডার ছিলেন, তিনি বলেছিলেন যে লাহোরের লেচোগিল খাল জুড়ে একটি ব্রিজের ভিত্তি স্থাপন করার পর সেনা কমান্ডার ঠাণ্ডার কবলে পড়েন এবং তার জয়কে সুসংহত করতে ব্যর্থ হন। এটা কিছুটা সত্য হতে পারে কারন এই সেনা কমান্ডারকে পরবর্তীকালে বহিস্কার করা হয়েছিল।

এই সময়ে যুদ্ধ প্রতিরোধ করতে যেমন কঠিন সামরিক পরিস্থিতি প্রয়োজন, পাকিস্তান তার মুখোমুখি। ১৯৬৫ সালে উভয় দেশ পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেওয়া থেকে বিরত থাকে। আজ সকল বাঙালিরা এক হয়ে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে সেখানে জড়ো হয়েছে, ফলে প্রদেশের ৮০,০০০ সৈন্যকে দমন করা হবে এবং সম্ভবত যুদ্ধ শুরুর এক ঘন্টার মধ্যে ধ্বংস হয়ে যাবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পশ্চিম পাকিস্তানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য পাকিস্তান ইতোমধ্যেই পূর্বাঞ্চল থেকে এক পদাতিক বিভাগ প্রত্যাহার করেছে। এটাই কি যবনিকাপাত টানতে পারবে? পাকিস্তানি সামরিক বিমান এবং নৌ জাহাজ সিংহল ব্যবহার করতে ব্যর্থ হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানকে গুলির যুদ্ধে আটকে রাখার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে পারে।
সেনা শাসকরা পূর্ব থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করছে এবং পশ্চিমাঞ্চলে জড়ো করছে যাতে করে কাশ্মীর, রাজস্থান বা গুজরাটের কিছু ভারতীয় অঞ্চল দখল করা যায়, এটি পূর্ব পাকিস্তানে হওয়া নির্দিষ্ট ক্ষতি থেকে মুখ রক্ষা করার একমাত্র উপায় হবে।

সামরিক ভারসাম্যের ক্ষেত্রে, ১৯৬৫ সাল থেকে উভয় পক্ষই তাদের অবস্থান শক্তিশালী করেছে। পাকিস্তান সম্প্রতি সৌদি আরব থেকে ৭৫ টি সামরিক বিমান ঋণ গ্রহন করেছে। তারা বিভিন্ন পশ্চিম এশীয় দেশগুলিতে বিমান বাহিনী প্রশিক্ষণ মিশন চালিয়ে যাচ্ছে, আশা করা যায় এগুলো যুদ্ধের সময় পাকিস্তানকে সাহায্য করবে।

ভারতের সামরিক শক্তির স্বনির্ভরতা অর্জনের নীতিটি পাকিস্তান থেকে ভারতকে সুস্পষ্ট সুবিধা প্রদান করবে। ভারতীয় অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরিগুলিতে বেশ কিছু নতুন ধরনের ফিল্ম এবং গোলাবারুদ তৈরি করা হচ্ছে। বিজয়ন্ত ট্যাঙ্ক ছিল এক বিরাট সাফল্য যেটা ১৯৬৫ সালে ভারতের প্রধান অবলম্বন সেন্টুরিয়র থেকে রণকৌশলে বেশি দক্ষ বলে বিবেচিত হয়েছে। বিজয়ন্ত প্রথম বাজারে আসে ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বরে এবং তথ্যসুত্রানুযায়ী ধারণা করা হচ্ছে যে, ১০৫ মিমি বন্দুক যুক্ত প্রায় ৩৫০ থেকে ৪০০ শত মাঝারী ট্যাঙ্ক কাজে লাগানো হচ্ছে।

ভারত বিমানের পাশাপাশি জাহাজও তৈরি করে। হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স বর্তমানে জেট জঙ্গি হামলা যোদ্ধা এইচএফ-২৪, সুপারসনিক ইন্টারসেপ্টর এমআইজি-২২, জেট ফাইটার জিনাট, জেট-ট্রেনার এইচজেটি-১৬, পরিবহন বিমান, এইচএস-৭৪৮ এবং অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার তৈরি করছে। বোম্বায় মাজাগান ডকস লেইডার শ্রেণীর রণতরী তৈরি করে।

এদিকে ভারতীয় নাগরিকরা ইতিমধ্যেই বাঙালি শরণার্থী এবং যুদ্ধ প্রস্তুতির দরুন আর্থিক ঝামেলায় পড়েছে। অর্থমন্ত্রী ইয়াফ উদ্দিন চৌধুরী সংসদ এবং জনগণকে আশ্বাস দিয়েছিলেন, এই বছরে কোন সম্পূরক বাজেট প্রবর্তন করার কোনও ইচ্ছা তার না থাকলেও মিসেস গান্ধীর বিদেশ যাত্রার প্রাক্কালে তার সরকার ৭00 মিলিয়ন অর্থ তোলার জন্য অতিরিক্ত কর আরোপ করার ঘোষণা করেছিল।

রেলওয়ে ভ্রমন, ডাক সেবা, বিনিময় বিলের উপর নতুন কর আরোপ করা হচ্ছে। পত্রিকার প্রত্যেক কপিতে সরকার দুই পয়সা করে আবগারি শুল্ক ধার্য করেছে। সমস্ত নতুন আইন ১৫ই নভেম্বর থেকে কার্যকর হয়েছে। রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশের মাধ্যমে তাদের এই ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল যে এই পদ্ধতিতে প্রথমবারের মতো ট্যাক্স সংগ্রহ করা হয়েছে। নভেম্বরের মাঝামাঝি একটা সংক্ষিপ্ত শীতাকালীন অধিবেশনের জন্য সংসদ সম্মেলন ডেকেছে, এবং যেহেতু ট্যাক্স ব্যবস্থা কেবলমাত্র ১৫ই নভেম্বর থেকে কার্যকর হয় তাই অধ্যাদেশ এসেছিল আচমকাই। কেন্দ্র কর্তৃক প্রস্তাবিত ব্যবস্থাগুলি ছাড়াও, প্রদেশকে তাদের এক্তিয়ারে থাকা কিছু নির্দিষ্ট জিনিসের উপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করতে হবে।

নতুন ব্যবস্থাগুলি হলো: ১ রুপি বা তার চেয়ে বেশি দামের রেলে টিকেটে ৫% অতিরিক্ত চার্জ; ভারতের অভ্যন্তরে ভ্রমণে (মে বাজেটে টিকিটের মূল্যের উপর ১০% বিদেশী ভ্রমণের কর প্রয়োগ করা হয়েছিল) ৫% অতিরিক্ত চার্জ; পোস্টকার্ড ব্যতীত সকল ডাক নিবন্ধনের জন্য ৫ পয়সা কর; বিনিময় বিল, লেনদেনের বিল, প্রমানপত্র নোট, বীমা নীতিমালা, ক্রেডিট এবং প্রক্সি লিখিত কাগজপত্রের উপর ১০ পয়সা শুল্ক; এবং পত্রিকা ও সাময়িকীতে ২ পয়সা কর।

বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের ভরণপোষণের উঠতি ব্যায় এবং পরবর্তি অর্থ ঘাটতি পূরণের জন্য এই অতিরিক্ত কর ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে। হিসাব বলছে ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ঘাটতি ব্যয়ের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ৫৭০০ মিলিয়ন রুপি। আনুমানিক বাজেট ছিল ২৩০০ মিলিয়ন রুপি এবং বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী ১২ মাস ধরে এরূপ কর আদায় করলে সেটা ৭০০ মিলিয়ন রুপির অনেক বেশি হবে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৩৫। উপমহাদেশের বর্তমান অবস্থা সানডে পোস্ট ২২ নভেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৩৫, ৬৪৯>

সানডে পোষ্ট, নাইরোবি, ২২ নভেম্বর ১৯৭১
ভারত-পাকিস্তান উপমহাদেশ পরিস্থিতি

… যখন লক্ষ লক্ষ শরনার্থি প্রবেশ করে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক সমস্যার হুমকির সৃষ্টি করল তখন ভারত জড়িয়ে পড়ল।

কিছু অপপ্রচার করা হল যাতে বলা হচ্ছিল শরনার্থিদের আশ্রয়স্থল আসলে বন্দিদের ক্যাম্প এবং তাদের সেখান থেকে যেতে দেওয়া হচ্ছেনা। জোর করে রেখে দেয়া হচ্ছে।

এই ক্যাম্পগুলো মুক্ত ও খোলা। যে কেউ সেখানে যেতে পারেন। কোন বাঁধা বা প্রতিবন্ধকতা নেই। যে কেউ তা দেখে আসতে পারেন।

একটি শুমারিতে বলা হচ্ছে মাত্র আড়াই মিলিয়ন মানুষ পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসেছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেছেন এটা ৩ বা ৪ মিলিয়ন হতে পারে। ৮ বা ৯ কীভাবে?!

বিবিসি বলেছে একজন উদ্বাস্তুকে তিনবার চেক করা হয় যাতে সে সত্যিকারের উদ্বাস্তু নাকি ভণ্ড তা সনাক্ত করতে ভুল না হয়।

এই ব্যাখ্যায় বলা হয় ক্যাম্পে সব ধরণের রিফিউজি নেই। শুধুমাত্র যারা খুব গরিব ও অসহায় তারাই আছে। অনেক পূর্ব পাকিস্তানের লোক কলিকাতায় তাদের বন্ধু ও আত্মীয়ের বাড়ীতে উঠেছেন।

তাদের সংখ্যা কখনো নথিভুক্ত করা হয়নি। তবে তারা সবাই ফিরে যেতে চায়। তবে সন ট্রাজেডি বিশ্ববাসী দেখেছেন। একটি বিবৃতি দেখে যে কেউ অবাক হবেন – সেখানে বলা আছে – যে দেশের জনসংখ্যা বছরে ১২ মিলিয়ন বাড়ে সেই দেশের জন্য ৯ মিলিয়ন উদ্বাস্তু বোঝা হতে পারেনা।

এই নয় মিলিয়ন সরাসরি সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে।
যে শিশু জন্মগ্রহণ করে তার দায়িত্ব তার মা-বাবার উপরেই বর্তায়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৩৬। রাজাকারদের নিষ্ঠুরতা হেলসিঞ্জিন সারোমাত ২৩ নভেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৩৬, ৬৫০>

হেলসিঞ্জিন সারোমাত, ২৩ নভেম্বর, ১৯৭১
রাজাকারদের নিষ্ঠুরতা

“রাজাকার”দের নিষ্ঠুরতার কারণেই বেশিরভাগ গ্রামবাসী বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থন শুরু করে। যখন মানুষকে জিজ্ঞাসা করা হয় তারা পাকিস্তানের নাগরিক থাকতে চায় কিনা অথবা নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে চায় কিনা তখন তারা সবাই বলে তারা বাংলাদেশের পক্ষে। যদিও হয়ত তাদের ঘরের সামনে পাকিস্তানের পতাকা উড়ছে কিন্তু গোপনে তারা দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। দক্ষিণ ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকান নেতৃত্বের মত পাকিস্তানী আর্মিও এখানকার স্থানীয় জনগণের সত্যিকারের অনুভূতি অনুধাবন করতে পারেনি।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৩৭। পাকিস্তানের কার্যাবলি ভিতিপ্রসূত দে ভক্সক্রান্ত ২৪ নভেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৩৭, ৬৫১>

দে ভক্সক্রান্ত, নেদারল্যান্ড, ২৪ নভেম্বর ১৯৭১
পাকিস্তানের কার্যাবলি ভিতিপ্রসূত
-এইচ সি বেনিয়ন

পাকিস্তান রিপোর্ট করে যে পূর্ব পাকিস্তানে ভারত প্রচুর মিলিটারি একশন চালাচ্ছে। মিলিটারি রিপোর্ট যাই থাকুক পাকিস্তান মূলত ভয়, ওয়ার-সাইকোসিস, এবং পূর্ব প্রদেশ হারানোর আশংকায় ভুগছে।

ভারত আর এফোর্ড করতে পারবেনা – তাতে মিলিটারি শাসকদের কাছ থেকে যত অঞ্চলই মুক্ত করুক না কেন। তারা দির্ঘদিন গেরিলা যুদ্ধও চালিয়ে যেতে পারবেনা। কারণ উদ্বাস্তু সমস্যা তাদের জন্য একটি বড় অর্থনৈতিক বোঝা এবং পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা উচ্ছৃঙ্খল হয়ে যাবে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৩৮। অঘোষিত যুদ্ধ নেপাল টাইমস ৩০ নভেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৩৮, ৬৫২>

নেপাল টাইমস, কাঠমান্ডু, নভেম্বর ৩০, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
অঘোষিত যুদ্ধে

ভারত ও পাকিস্তানের সৈন্যদের বৈমানিক এবং ট্যাংক যুদ্ধের ভয়াবহতায় এখন ভারতীয় উপমহাদেশে যুদ্ধ আসন্ন প্রায় নিশ্চিত। বিশ্ব এখন দেখবে কিভাবে ঘনিষ্ঠ দুই দেশের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়। পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা একটি “অঘোষিত যুদ্ধ” ঘোষণা করেছেন যা দুই দেশের মধ্যে চলছে এবং সে অনুযায়ী যে সারা দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে।

একতরফা যুদ্ধ পাকিস্তান প্রথমে নিজেরাই তাদের নিজের এলাকার একটি অংশে শুরু করেছিল যা পাকিস্তানের শাসকদের দ্বারা পরিচালিত। এটি কয়েক মাস পরেই একটি প্রতিরোধের যুদ্ধে পরিণত হয়। এই যুদ্ধ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঘটছে। কিন্তু পাক শাসক এটিকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবে মনে করেন। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হিসেবে ধরে নিয়ে তারা ভারতীয় ভূখণ্ডে আক্রমণ প্লেন ও ট্যাঙ্ক দিয়ে আক্রমণ করতে পাঠায়। কিন্তু প্লেনগুলো ভূপতিত করা হয়েছে এবং বেশ কিছু ট্যাংক ধ্বংস হয়ে গেছে এবং অনেক সামরিক সরঞ্জাম ভারতীয় সৈন্যদের দ্বারা বন্দী করা হয়। তারপর, পাকিস্তানি শাসকরা শঠকারী উপায়ে একটি পুতুল শাসন ইনস্টল করার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার চেষ্টা করে তাদের দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে। পিকিং এ দেখা করে আসার মাধ্যমে ভিলেন ভুট্টোর দেয়া সার্ভিসেও সামরিক শাসকেরা পুরোপুরি সন্তুষ্ট হয় নি। তার রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী হবার ইচ্ছাও অপূর্ণ রয়ে গেছে। ভুট্টোর প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায় কিনা তাই এখন দেখার বিষয়।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিজেদের মানুষদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কিন্তু তারা আসলে শক্তিশালী কোন শক্তির কাছে হারতে রাজি কিন্তু জনগণের প্রতিরোধ আন্দোলন এর ফলস্বরূপ যে বাহিনী গঠিত হয়েছে তার কাছে মোটেই নয় – এই বাহিনীর নাম মুক্তিবাহিনী । আর সেই উচ্চতর শক্তি ভারত ছাড়া অন্য কেউ হতে পারেনা। তাছাড়া, পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা এখনও ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে তাদের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল তার প্রতিশোধ নেবার স্বপ্ন দেখে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সামরিক শাসকরা তাদের দ্বারা পরিচালতএবং সংগঠিত নির্বাচনের ফল পুরো নিশ্চিহ্ন করতে চান। তারা, ২৫ মার্চ, ১৯৭১ এর রাতে ঢাকার নাগরিকদের উপর ট্যাংক হামলা করে দশ মিলিয়ন মানুষকে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে , এবং খুন, লুটপাট ও ধর্ষণ করে এই নির্বাচনের ফলাফলের প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন। বাংলাদেশের জন্ম

ও মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রম ছিল এই নিপীড়নের রেজাল্ট। এখন সামরিক শাসকরা পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের প্রতিনিধিদের নিশ্চিনহ করতে চাইছেন। জরুরি অবস্থা জারি এবং ভারতের বিপক্ষে উত্তেজনাকর কিছু রটানোর অজুহাত খুঁজে পেতে, তারা তাদের প্রচারণা শুরু করে এবং তার ফলস্বরূপ তাদের নিজেদের লোকদের দমন করার দ্বিতীয় পর্বের পরিকল্পনা আরম্ভ করে।

পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের এই অদ্ভুত ইচ্ছা যে তারা নিজেদের লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এই ব্যাপারটা বিশ্ববাসী কীভাবে দেখেন সেটা এক প্রশ্ন। গত এক বছরে পাকিস্তানের ঘটনাবলি বিশ্ববাসী বিশ্লেষণ করবে হয়ত। পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের নিজস্ব জনগণের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধে জালেম ও নিষ্ঠুরের মত আচরণ করেছে , জনগণের অধিকার, জীবন ও সম্পত্তি ধ্বংস করে যুদ্ধের আবহ তৈরি করা হয়েছে। বিশ্ববাসীর উচিৎ পাকিস্তানের প্রতি সংযম থাকার অনুরোধ করা – এবং তা অন্য কোন তৃতীয় দেশের কাছে নয়। ভারত, যে ১ কোটি শরণার্থীর ভার বহনের ক্ষেত্রে অসম্ভব সহ্য ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে; তাকে যারা অবরোধ প্রয়োগের মাধ্যমে শিক্ষাদানে আগ্রহী তাদের আসল লক্ষ্য কী সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৩৯। ইয়াহিয়ার বোধোদয় ঘটাতে হবে বিউনেস এয়ারেস হেরাল্ড ৪ ডিসেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৩৯, ৬৫৪>

বিউনেস এয়ারেস হেরাল্ড, ৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১
ইয়াহিয়ার বোধোদয় ঘটাতে হবে

পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমাধান কোন জাদুকরী পদ্ধতিতে ঠিক হবেনা। পাকিস্তান ভারতের পশ্চিম সীমান্তে আটটি বিমান হামলা করেছে। সবাই যে যুদ্ধ সম্পর্কে ধারনা করেছিল তা অনিবার্য।

যুদ্ধ কোন কিছুর সমাধান করবেনা। এটা স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে তরান্বিত করবে। কিন্তু যুদ্ধের মূল্য হিসেবে যে সকল প্রাণ যাবে এবং ভয়ানক দুঃখকষ্ট সইতে হবে তা নৈতিকভাবে অন্যায়। যদি ভারতীয় উপ-মহাদেশে আরও একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয় তাহলে রক্তপাতের পাশাপাশি শান্তি ও প্রগতি থেমে যাবে। যুদ্ধ একটি পাগলামি। বাঙালির জাতীয় আকাঙ্খাকে পেষন করাও পশ্চিম পাকিস্তানের একটা পাগলামি। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বোধোদয় ঘটতে হবে। তাকে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে – যেমন বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবকে ছেড়ে দেয়া – এতে করে জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধের পরিস্থিতি থেমে যাবার আশংকা আছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৪০। তৃতীয় বিশ্বের জন্য শিক্ষা সানডে টাইমস অব জাম্বিয়া ৫ ডিসেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৪০, ৬৫৫>

দ্যা সানডে টাইমস অব জাম্বিয়া, ৫ ডিসেম্বর ১৯৭১
তৃতীয় বিশ্বের জন্য শিক্ষা

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার দ্বন্দ্বের সূত্রপাতে, যা খোলাখুলি যুদ্ধে জড়িয়ে পরিণত হতে পারে। কারণ বিশ্ব এতে আক্রান্ত নয়। এদিকে দশ কোটি শরণার্থীর ভারতে পালিয়ে গেছে।

এটি উল্লেখ করা আবশ্যক যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের নেতাদের উদ্বাস্তু সমস্যার ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে তার দেশের অবস্থা তুলে ধরেছেন এবং তিনি যা করেছেন তার জন্য তিনি কৃতিত্বের দাবিদার। সম্প্রতি বিশ্বের রাজধানীগুলিতে সফরে তিনি স্পষ্টতই চেষ্টা করেছেন তারা যেন রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানকে ভারত ও বাংলাদেশের আন্দোলনের প্রতি তার শত্রুতা নিয়ন্ত্রণ এবং সমস্যাটির শান্তিপূর্ণ সমাধান করার চেষ্টা করতে অনুরধ করেন।

যদি ইয়াহিয়া তাদের বিরুদ্ধে অভিযান না করেই শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়ার সামান্যতম পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তবে আমরা বিশ্বাস করি না যে, ভারত এই অবস্থায় থাকবে যার জন্য তার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হয়।

অবশ্যই, বিশ্বের নেতারা ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আগে থেকে খেলা শুরু করেছিলেন। তারা যেভাবে চেয়েছেন সবকিছুই সেভাবে যাচ্ছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই বলে চলেছে যে এটি ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের মধ্যে ঢুকে পড়ার প্রচেষ্টার প্রতিফলন করবে। সম্ভবতঃ এটি মিসেস গান্ধীর প্রচেষ্টাকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছে – যা খুব কাজে দিয়েছে – যার জন্য ইয়াহিয়া খান বাস্তবে বুঝেছেন যে শুধুমাত্র ভারতের সাথে যুদ্ধ তার অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলির মেটানোর সর্বোচ্চ চাবিকাঠি না।

এটি এখন নিশ্চিতভাবে মনে হচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত হওয়ার অনিচ্ছা মূলত স্বার্থপরতার জন্য। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চীন তাদের অবস্থানে আছেন। রাশিয়া ভারতীয়দের সমর্থন করে এবং চীনারা পাকিস্তানীদের সমর্থন করছে। সম্ভবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যে সবসময় গোপনে একটি চীন-সোভিয়েত দ্বন্দ্বের জন্য আশাবাদী, এই কারণেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে এই পরিস্থিতিতে কমিউনিস্টরা একে অপরকে ঘৃণা করতে শুরু করবে।

জাতিসংঘ – যারা যুদ্ধ লাগার আগে ব্যাবস্থা নেয় তাদের ভূমিকাও ততটা জোরালো নয়। তারা নয়াদিল্লি বা ইসলামাবাদের উপর তেমন কোন কাজ করছেনা। কিন্তু সম্ভবত যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর টুকরাগুলি তুলে নেবে জাতিসঙ্ঘই।

এই পর্যায়ে যুদ্ধ থামানো খুব কঠিন। কারণ বেশিরভাগ যুদ্ধে সাধারণত কোন একটি দল আশা ছেড়ে দেয় অথবা ছেড়ে দিতে বাধ্য করে। পাকিস্তান থেকে ভারতে বিপুল সংখ্যক সামরিক বাহিনী আছে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়াকে জানতে হবে যে তিনি কী করছেন।

যুদ্ধ নিজেই বড় ক্ষমতাগুলোর কাছে অগ্রহণযোগ্য চ্যালেঞ্জবিহীন যা সরাসরি তাদের সম্প্রসারণের সাথে সম্পৃক্ত না। এটি তৃতীয় বিশ্বের জন্য একটি শিক্ষা, যাতে করে তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে তাদের উচ্চাভিলাষী আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে “জোটনিরপেক্ষ” হওয়া সত্ত্বেও তারা এখনও বড় শক্তিগুলির খেলার উপকরণ।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৪১। ভারত-পাকিস্তান সঙ্ঘর্ষ সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৪১, ৬৫৬>

দক্ষিণ চীন মর্নিং পোস্ট, হংকং, ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
ভারত-পাকিস্তান বিরোধ

ভারতীয় উপমহাদেশের বর্তমান গুরুতর পরিস্থিতির জন্য মূলত ইসলামাবাদ দায়ী। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সম্মেলন টেবিলে মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে আলোচনার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন আলোচনা এবং তাদের পার্থক্য কমাতে চেয়েছিলেন এবং সীমান্ত এলাকা থেকে উভয়ের সশস্ত্র বাহিনী প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেছলেন।

কিন্তু তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার মূল কারণ নিয়ে কোন কথা বলেননি যার জন্য ভারতকেও ভোগান্তির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

মিসেস ইন্দিরা গান্ধী কয়েক মাস ধরে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান এবং বিশ্বের অনেক দেশকে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির সমাধান করার ব্যাপারে বলে আসছিলেন যাতে করে ৯ মিলিয়ন শরনার্থি দেশে ফিরে যেতে পারে।

শরণার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য, আশ্রয় ও চিকিৎসার ব্যাবস্থা করতে গিয়ে ভারত নিজেই বড় হুমকির সম্মুখীন।

কিন্তু বিশ্ব মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ ও অধিকার আদায়ের জন্য গত বছরের সাধারণ নির্বাচনে তাদের প্রার্থীকে জয়ী করেছে – কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান রাজনৈতিক সমাধানের আবেদন নাকচ করছেন।

প্রায় ১০ মিলিয়ন উদ্বাস্তুকে দেখাশোনা করার মত ভারী বোঝা ভারতকে ক্রমাগত তলিয়ে দিচ্ছে – ভারতের এখন যে অবস্থা তাতে এই সমস্যার সমাধান করতে হলে তাকে বাংলাদেশের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে হবে। এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে সাহায্য করতে হবে যাতে করে এই সব শরনার্থিরা তাদের বাড়িতে ফিরে যায়।

বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত হয়েছে। কিন্তু যদি কাউন্সিল হস্তক্ষেপ করে ভারতীয় উপ-মহাদেশের শান্তি ফিরিয়ে আনতে কার্যকর ব্যাবস্থা গ্রহণ করতে চায় তবে আগে তাদেরকে পূর্ব পাকিস্তানের মৌলিক সমস্যাকে বাস্তবতার আলোকে স্বীকার করতে হবে।

যুদ্ধের পরিবেশ আরও ঘনীভূত হলে সেটা ভারত উপমহাদশের শান্তি বিনষ্ট করবে এবং বিশ্বশক্তিগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়াবে – এটা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে অনুধাবন করতে হবে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৪২। যে যুদ্ধ কেউ থামাল না অস্ট্রেলিয়ান ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৪২, ৬৫৭>

দ্যা অস্ট্রেলিয়ান, সিডনি, ৬ ই ডিসেম্বর, ১৯৭১
যে যুদ্ধ কেউ থামাল না

মিসেস গান্ধী ঠিক বলেছিলেন যখন তিনি আসন্ন ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধের কথা বলেছিলেন – অথচ তখন সবাই তাঁকে নিন্দা করেছিল। নয় মাস ধরে আমরা নিশ্চুপ ছিলাম এবং এখন সেটা অনিবার্য আকার ধারণ করেছে। ভারতের নড়বড়ে অর্থনিতির পর নয় মিলিয়ন শরণার্থীদের বোঝা চাপার পরে আমরা কি কেউ কিছু করেছি? প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে চিঠির মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে পূর্ব পাকিস্তানের গণতন্ত্র রক্ষার আবেদন ছাড়া তেমন কিছুই আমরা করিনি। কিছু ধনী শিল্পোন্নত দেশ উদ্বাস্তুদের সাহায্য করার জন্য টাকা পাঠিয়েছে। তারা সবসময় তা করে। আর অস্ট্রেলিয়া, একটি জন আন্দোলন হল, জনগণকে সেজন্য ধন্যবাদ, কিছু না করার চাইতে এতে অন্তত কিছু কাজ হলেও হতে পারে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৪৩। পাকিস্তান দায়ী ইন্দোনেশিয়া রাজা ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৪৩, ৬৫৮>

ইন্দোনেশিয়া রাজা, জাকার্তা, ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১
পাকিস্তান দায়ী

চেষ্টা ব্যর্থ হল এবং বন্দুক কথা বলল। পাকিস্তান ইন্দোনেশিয়ায় একজন বিশেষ দূত পাঠাচ্ছে, কিন্তু পুরো বিশ্ব দেখেছে পূর্ব পাকিস্তানে নিজেদের দেশের মানুষের উপর কি অপচিকিতসা চালানো হয়েছে। বিজয়ী আওয়ামীলীগকে ধ্বংস করা হয়েছে, মুজিবুর রহমানকে জেলে ঢোকানো হয়েছে আর তার ফলয়ারদের আটক করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সরকারের অপকর্মের ফলে ভারতকে যে লাখ লাখ শরণার্থীর বোঝা বহন করতে হচ্ছে এমনটি প্রথিবীর ইতিহাসে অন্য কোন একক দেশকে বহন করতে হয়নি। পাকিস্তানকে বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছাকে সম্মান করতে হবে এবং তাদের ভুল সংশোধন করতে হবে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৪৪। একটি রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব ছিল স্ট্রেইটস টাইমস ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৪৪, ৬৫৯>

স্ট্রেইটস টাইমস, ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১
একটি রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব ছিল

ভারত পূর্ব পাকিস্তানের পঁচাত্তর মিলিয়ন মানুষের স্বীকৃতির জন্য উদ্বিগ্ন। প্রধান ক্ষমতাধর শক্তিগুলো পশ্চিম পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে তার দেয়া নির্বাচন-পূর্ব ওয়াদা পালন করাতে ব্যার্থ হয়েছে। পাশাপাশি জনগণের পাশবিক দমন, শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেপ্তার এবং আওয়ামী লীগকে অবৈধ ঘোষণার ফলে ভারত তার পরিবর্তিত নীতি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। শেষ পর্যন্ত অধৈর্য বিজয়ী হয়েছে এবং ভারতের জাতীয় স্বার্থ বিঘ্নিত হচ্ছে।

গতকাল পর্যন্ত, হয়ত আপসের সম্ভবনা ছিল। কিন্তু এখন কোন রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব নয় এবং যুদ্ধ অনিবার্য।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৪৫। অবিশ্বাস্য মাদারল্যান্ড ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৪৫, ৬৫৯>

মাদারল্যান্ড , কাঠমান্ডু, ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১
স্বাভাবিকভাবেই সুন্দর

এটা অনেক উল্লেখযোগ্য বিষয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতি অনেকের সন্দেহ দূর করেছে যারা ভেবেছিল যে ভারত আসলে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ফল হিসেবে “বাংলাদেশ” কে দেখছে।

ভারত তার প্রাথমিক রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করেছে। কিন্তু দির্ঘ উন্নয়নের ব্যাপারে প্রশ্ন থেকে যায় যার উত্তর কারো প্রস্তুত নেই। বাংলাদেশের নেতারা অথবা প্রধানমন্ত্রী গান্ধীও সেটা সততার সাথে বলতে পারবেন না।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটো প্রদানের ফলে ভারত বাংলাদেশের অঞ্চলের মধ্যে প্রবেশ করার সুযোগ পায় বরং মনে করে যে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেবার সময় হয়ত এসেছে – যেহেতু বিশ্ব জানে যে এই সরকার ৭৫ মিলিয়ন মানুষের স্বীকৃত প্রতিনিধিত্ব করছে।

সব বড় শক্তিগুলো জানত যে ভারত তার নিজের সিধান্ত নিতে বাধ্য হত যদি শরনার্থি সমস্যার জন্য তার অর্থনিতি ধ্বসে যেত।

সব বড় শক্তিগুলোর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশী বিরক্ত করেছে।

স্বাভাবিকভাবেই ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের কূটনৈতিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়েছে। কিন্তু তার চেয়ে বড় ঘটনা হল ভারতে অ্যামেরিকার ক্রেডিট বন্ধ করে দেয়া – বিশেষ করে এই উছিলায় যে ভারত কুচক্রী কার্যকলাপে লিপ্ত।

আমেরিকান প্রতিক্রিয়া বোধগম্য নয়। আসলে, কাউকে আমেরিকান পররাষ্ট্র নীতির নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে হলে বেশী দূরে যেতে হবে না – শুধু ভিয়েতনামের দিকে তাকালেই হবে। স্বাধীনতাকে অসম্মান জানানোর প্রচেষ্টা সত্যিই অবিশ্বাস্য।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৪৬। বাংলাদেশের মানুষের ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে হবে নিউজ ডেস্ল্যান্ড ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৪৬, ৬৬১>

নিউজ ডেস্ল্যান্ড, পুর্ব-বার্লিন, ৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১
বাংলাদেশের মানুষের ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে হবে

ভারতীয় উপমহাদেশের যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রভাবিত- যা চরম আকার ধারণ করেছে। বিশ্বের জনসাধারণ এই রক্তপাত সম্পর্কে অবগত এবং জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক এতে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। এখন, বিশ্বজুড়ে প্রগতিশীল শক্তিগুলো বাংলাদেশের সমস্যার একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তির দাবি করেছে।

সেই ভিত্তিতে ইউ এস এস আর জাতিসংঘের সামনে বক্তব্য রেখেছে এবং ইউ এস এস আর এর প্রধানমন্ত্রী ডেনমার্ক তার সফরকালে তার মতামত প্রকাশ করেছেন। তিনি বারবার বলেন “ভারতীয় উপ-মহাদেশের উত্তেজনা শিথিলকরণ করার জন্য এটা প্রয়োজনীয়।’’ প্রথমে ভেতরের রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধান করতে হবে যার ফলে সেখানকার জনগণের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের প্রতিহিংসামূলক কার্যকলাপ চলছে।

ইয়াহিয়া খানের সরকার ঠিকই জানে যে উদ্বাস্তুদের ভারতে পাঠালে সেটা ভারতের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। একারণেই পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ সশস্ত্র সংঘাতের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে এবং যুদ্ধের পরিবেশ তৈরি করছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৪৭। ইয়াহিয়া খান দায়ী নানইয়াং সিয়াংপু ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৪৭, ৬৬২>

নানইয়াং সিয়াংপু, মালয়েশিয়া. ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১
ইয়াহিয়া খান দায়ী

বাংলাদেশে বিদ্রোহীদের নির্মমভাবে দমনের চেষ্টা এবং নির্বাচনের ফলাফলের প্রতি না দেখিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সঠিক পদক্ষেপ না নিতে পারার কারণে বর্তমান ট্রাজেডি সৃষ্টি হয়েছে। এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। সঙ্কট যুদ্ধের সূত্রপাত করেছে এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এর জন্য সম্পূর্ন দায়ী।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৪৮। যুদ্ধ কেন হল ইজভেস্তিয়া ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৪৫, ৬৬৩>

ইজভেস্তিয়া, রাশিয়া ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১
যুদ্ধের কারণ কি?

পাকিস্তান সরকার পুর্ব পাকিস্তানে মৌলিক অধিকারের উপর এবং জনগণের মতামতকে অগ্রাহ্য করে রক্তক্ষয়ী দমনে সচেষ্ট। লক্ষ লক্ষ মানুষের উপর তারা অমানবিক অত্যাচার চালাচ্ছেন। এতে ইউনিভার্সাল হিউম্যান রাইটস ঘোষণাপত্রের প্রকাশ্য লঙ্ঘন হয়েছে। এসব ঘটনাগুলোর প্রেক্ষিতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি সামরিক সংঘাতের সৃষ্টি হয়েছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৪৯। দায়ী কে? ডেইলি মিরর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৪৯, ৬৬৪>

ডেইলি মিরর, ফিলিপাইন, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
দায়ী কে?

… ভারতের প্রধানমন্ত্রী যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছেন যখন তিনি বলেন, তার দেশের বল প্রয়োগ করা ছাড়া কোন উপায় ছিলোনা। পূর্ব পাকিস্তানের নিপীড়নের ফলে ভারতে প্রায় দশ মিলিয়ন উদ্বাস্তু প্রবেশ করে। এদের খাওয়াতে দিনে ৪ মিলিয়ন ডলার লাগে। এদের সবাই উদ্বাস্তু নয়। কিছু পাকিস্তানী গুপ্তচরও আছে যাদেরকে ভারত কোনো ভাবেই আশ্রয় দিতে পারেনা।

নিপীড়নের জন্য দায়ী হিসেবে পাকিস্তান সরকারের উচিৎ উদ্বাস্তুদের একটি বড় অংশের দায়িত্ব বহন করা। পাশাপাশি অন্যরাও অপরাধী। বড় ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো পাকিস্তানের ওপর অত্যাচার বন্ধ করার জন্য চাপ দিতে পারত। উদ্বাস্তুদের অন্তঃপ্রবাহ ঠেকাতে চেষ্টা করতে পারত। তারা তা করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং ভারত তার স্বার্থ রক্ষা করার জন্য কাজ করেছে।

ওয়াশিংটন যখন শান্তিপূর্ন সমাধানের ব্যাপারে অসমর্থ বা অস্বীকৃতি প্রকাশ করল তখন যুদ্ধ ছাড়া কোন উপায় ছিলোনা। মজার ব্যাপার হলো, পিকিং এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দিকে। রাজনীতির মত যুদ্ধও আশ্চর্য সম্পর্ক তৈরি করে বৈকি।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৫০। একটি নতুন জাতির জন্ম ইউটুসান মালয়েশিয়া ২০ ডিসেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৫০, ৬৬৫-৬৬৮>

ইউটুসান মালয়েশিয়া, ২০ ডিসেম্বর ১৯৭১
একটি নতুন জাতির জন্ম

শাসকদের বিরুদ্ধে তার জনগণের ঘৃণার ফলস্বরূপ পাকিস্তানের মানচিত্র থেকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ধান হল। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ইসলামাবাদ দ্বারা উপেক্ষিত হয়েছে। যদিও তারা দেশের জন্য সবচেয়ে বেশী বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে তবুও কেন্দ্রীয় সরকার তাদের শিল্প বৃদ্ধির অধিকার পশ্চিমাঞ্চলের চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে দমিয়ে রেখেছে।

একারণে পাকিস্তান থেকে নিজেদের পৃথক করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সচেষ্ট হয়। সেটি এখন পাক-ভারত যুদ্ধের ফলে অর্জিত হয়েছে। পাকিস্তানের পরাজয়ের ফলে বাংলাদেশ নামক একটি নতুন জাতি আবির্ভূত হয়েছে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থার পুনঃমেরামতের জন্য বাংলাদেশের ৭৫ মিলিয়ন মানুষের আর্থিক সাহায্য ও সহায়তা প্রয়োজন। আমরা, মুসলিম দেশগুলোর কাছে আবেদন করব বাংলাদেশে তাদের ভাইদের সাহায্য করার ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে যাতে তারা তাদের নিজেদের দেশে একটি শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ জীবন পরিচালিত করতে আশ্বস্ত হতে পারে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৫১। এক লক্ষ লোক নিহত? অমৃত বাজার পত্রিকা ২৮ মার্চ, ১৯৭১

Md Masud Hossain
<১৪, ২৫১, ৬৬৯-৬৭৩>

অমৃত বাজার পত্রিকা, কলকাতা, মার্চ ২৮, ১৯৭১
জেনারেল টিক্কা খান গুলিতে নিহত *
ঢাকা, খুলনায় বোমা হামলা
এক লাখ লোক নিহত হওয়ার আশংকা
মুক্তি যোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণ

আগরতলা। মার্চ ২৭ – হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনার দুই দিন পর, পূর্ব পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি শুধুমাত্র ঢাকা, কুমিল্লা ও যশোরের তিনটি প্রধান ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া সর্বত্রই শেখের বাংলাদেশ বাহিনীর নেতৃত্বে দানা বাঁধছে, যেখানে প্রায় ১০০,০০০ মানুষ নিহত হয়েছে বলে আশংকা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ মুক্তি সেনার প্রধান মেজর জিয়া খান আজ স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে ঘোষণা করেন যে, দুই বা তিন দিনের মধ্যেই বাংলাদেশ পাকিস্তানী সামরিক প্রশাসনের হাত থেকে মুক্তি পাবে।

জনাব রহমানকে গ্রেফতার করার বিষয়ে রেডিও পাকিস্তানের ঘোষণা (যা পরে স্বাধীন বাংলা বেতার প্রত্যাখ্যান করেছে) ঢাকাবাসীকে ক্ষিপ্ত করে তোলে, যারা লে. জে. টিক্কা খানের দাপ্তরিক বাসভবন ভাংচুর করে। সামরিক শাসন প্রশাসক এবং তাকে গুলি করে মারা হয়।

নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে বলা হয়েছে যে, প্রায় দশ লক্ষ অধিবাসীর ঢাকা সহ কুমিল্লা ও খুলনা শহর আগুন আর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন যেখানে আধিপত্য ধরে রাখতে হানাদার পশ্চিম পাকিস্তান বেপরোয়াভাবে ট্যাংক, বিমান আর হেলিকপ্টার নিযুক্ত করেছে।

সূত্র মতে, পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক শাসন প্রশাসক লে. জে. টিক্কা খানের ঢাকার বাসভবনে মুক্তি যোদ্ধারা আক্রমণ চালালে গুরুতর আহত তিনি হয়ে একটি নার্সিং হোমে S.১৫ p.-এ মারা যান।

শেখের বাহিনী অধিকাংশ সড়ক ও রেল যোগাযোগ সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনী থমকে গেছে।

আতংকের শহর ঢাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য ভয়ানক যুদ্ধ চলছে বলে জানা গেছে, যেখানে চলমান যুদ্ধে দুই হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে বলে আশংকা করা হচ্ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিধ্বস্ত বাড়িঘরের ধ্বংসস্তুপের নিচে শত শত আহত মানুষ পরে আছে ।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এবং পুরো সীমান্তের অন্যান্য উৎস কর্তৃক সরবরাহকৃত অতিরিক্ত প্রমাণ থেকে বিপদজনক এলাকার অভ্যন্তরের বিষয়ে জানা যায় যে, ঢাকা ও খুলনায় বোমা হামলা করা হয়েছে। ঢাকায় বোমা হামলার কারণে একটি বড় হাসপাতাল ধ্বংস হয়ে গেছে এবং অধিকাংশ রোগী মারা গেছে।

হতাহতের হিসেব অনুমান করার কোনো উপায় ছিল না, তবে হাজারখানেকের মতো হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে এবং এই সংখ্যা খুব দ্রুত বাড়ছে।

ট্যাংক ও বিমানের ব্যবহারের ফলে আরোপিত যুদ্ধের শুরু বলে ইঙ্গিত করছে; তবে প্রায় সকল শহরের রাস্তাঘাটে কাঠ ও ইটের সাহায্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, নদী ও খালবিলের উপর থাকা ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে এবং রেললাইন উপড়ে দিয়ে ও রেল স্টেশন ধ্বংস করার মাধ্যমে মুক্তি যোদ্ধারা সেনাবাহিনীর চলাচলে সফলভাবে অচলাবস্থা সৃষ্টি করেছে।

সেনাবাহিনী পুরো পূর্ব পাকিস্তানে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে এবং খুব দ্রুতই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, তবে তাঁরা নতুন সামরিক আইনের আদেশ জারি করে সকল বিল্ডিং-এর ধ্বংসযজ্ঞের ১(X) গজের মধ্যে সকল প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে নিতে বলার মাধ্যমে তাঁরা অজ্ঞাতসারে বাধার সম্মুখীন হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছে।

সেনা কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে যে, সদ্য জন্ম নেওয়া প্রজাতন্ত্রের পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে, যাকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গতকাল বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন, গ্রেফতার করা হয়েছে, তবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রগুলোর মধ্যে কমপক্ষে তিনটি ঐ দিন ঘোষণা করেছে যে, তিনি নিরাপদ ও মুক্ত আছেন, তাঁদের মধ্যে একজন সরাসরি সম্প্রচার করে লোকজনকে নিশ্চিত করেছেন যে, তিনি ঘটনা প্রবাহের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করছেন এবং তাঁদেরকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বলেছেন।

আজ রাতে কৃষ্ণনগরে আসা একটি প্রতিবেদনে জানানো হয় যে, গঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত একটি উপ-বিভাগীয় শহর নবাবগঞ্জে প্রায় ১,০০০ বাংলাদেশী মুক্তি যোদ্ধা অস্ত্র ও গোলাবারুদ বহনকারী একটি স্টিমার আটক করেছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আটক করার সময় স্টিমারটি অস্ত্র দিয়ে নিয়ন্ত্রিত রাজশাহী শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করছিল।

স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচারিত এক ঘোষণায় জনাব মুজিবুর রহমান প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন যে, যদি পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনী তাঁদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মুক্তি বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে তাহলে তাঁদেরকে নিরাপদে দেশে ফেরত যেতে দেওয়া হবে। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, যদি তাঁরা তা না করে, তাহলে মুক্তিযোদ্ধারা বাঙালীর রক্তের বদলা রক্তের মাধ্যমেই নেবে।

আরেকটি ঘোষণায় তিনি বলেন যে, বাংলাদেশের মধ্যে যদি কেউ ‘বিদেশী’ পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সাহায্য করে, তাহলে তাঁদের বিচার জনতার আদালতে হবে।

স্বাধীন বাংলার এক ঘোষণায় বলা হয়, গতকাল বাঙালি রেজিমেন্ট ও মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আটক এক পশ্চিম পাঞ্জাবি রেজিমেন্টের সদস্যরা আত্মসমর্পণ করতে শুরু করেছে। বাংলাদেশে মোতায়েন করা এক বেলুচি রেজিমেন্ট তাঁদের পশ্চিম পাঞ্জাবি কমান্ডারদের আদেশের বিরোধিতা করেছে বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশের ভেতর থেকে বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, মুক্তিবাহিনী বিভিন্ন ইউনিট মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, দিনাজপুর ও সিলেট শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পাকিস্তানী বাহিনীর প্রচেষ্টাকে রুখে দিয়েছে।

সেনাবাহিনী কর্তৃক চট্টগ্রামের কাছে অবস্থিত পতেঙ্গা বিমানবন্দর দখলে নেওয়ার প্রচেষ্টাকেও নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে। সেখানকার মুক্তিবাহিনীর ইউনিটের নেতৃত্ব ছিলেন ব্রিগেডিয়ার করিম।

মোংলা বন্দর দখল করাকে মুক্তিযোদ্ধারা একটি বড় সফলতা হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এই ঘটনায় খুলনায় পুরো ব্যাটালিয়ন সহ পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের প্রধান হানাদার বাহিনীকে রুখে দিয়েছেন।
তাঁরা আরও বলেন, চট্টগ্রাম ও খুলনায় নেভাল ইউনিটগুলোও মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগ দিয়েছে।

খুবই নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাতে জানানো হয়েছে যে, সামরিক বাহিনীর সাথে দিনব্যাপী যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা আজ কুমিল্লা পুলিশ অস্ত্রাগার দখল করে নেয়।

যোদ্ধারা অস্ত্র সরিয়ে নেয় ও নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে নেয়।
আখাউড়ার কাছে অবস্থিত ভৈরব ব্রিজটি মুক্তিবাহিনী উড়িয়ে দেওয়ার ফলে সিলেট জেলায় পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীর প্রধান সরবরাহ লাইনটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

বৃহস্পতিবার রাতে সেনাবাহিনী তাঁদের নৃশংস হামলা চালানো শুরু করার সময় দখলকৃত ঢাকা বেতারের নিয়ন্ত্রণ নিতে ধারাবাহিকভাবে দ্বিতীয় দিনের মতো ঢাকায় ভয়ানক যুদ্ধ হয়েছে। উভয় পক্ষে হতাহতের সংখ্যা ২,৫০০।

ভয়েস অফ অ্যামেরিকা জানিয়েছে, বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ শহর ঢাকার নিরস্ত্র জনগণের উপর ট্যাংক নিয়ে হামলা করা হয়েছে। আরও জানিয়েছে যে, যুদ্ধে আওয়ামী লিগের প্রধান কার্যালয়গুলো ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির একটি প্রমাণ হলো, আহত মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের জীবন বাঁচাতে স্বাধীন বাংলা বেতারে রক্ত দানের আহ্বান জানানো। যুবক লোকদেরকে মুক্তিবাহিনীর দখলে থাকা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ব্লাড ব্যাংকে যেতে অনুরোধ করা হয়েছে।

আজ বামপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ ভাসানি চাষিদের নিয়ে প্রতিষ্ঠিত তার সংগঠনের সদস্যদেরকে (যার সংখ্যা আনুমানিক *৫০,০০০) বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।

কলকাতায় পাওয়া বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদনের জানা গেছে, খুলনা জেলায় ইপিআর কেন্দ্রে পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমণকে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলের সদস্যরা সফলতার সাথে নস্যাৎ করে দিয়েছে।

এই প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়েছে, ইপিআর সদস্যদেরকে (যারা এখন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা) নিরস্ত্র করার লক্ষ্যে এই দিন বিকেলে হানাদার বাহিনী ঘিরে ফেলে, তবে তাঁরা তাঁদের অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে এই আক্রমণটি রুখে দেন। ব্যাপক সংঘর্ষের ফলে দুই পক্ষেই ক্ষয়ক্ষতি হয়। পরে, ঐ এলাকা থেকে হানাদার বাহিনীকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।

তবে, পদাতিক বাহিনীকে সমর্থন দেওয়ার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানী বিমান বাহিনীর বিমানগুলোকে ঐ কেন্দ্রের উপরে দীর্ঘ সময় ধরে চক্কর দিতে দেখা গেছে।

খুলনা শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত দৌলতপুরে পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনী মেশিন গান দিয়ে একটি বড় সমাবেশে আক্রমণ করে নিরস্ত্র ৯০ জন সাধারণ মানুষকে ঘটনাস্থলেই হত্যা করে। সভা না কি প্রার্থনার উদ্দেশ্যে লোকজন সমবেত হয়েছিল, তা জানা যায়নি।
পূর্ব পাকিস্তানের অনেক অঞ্চলে পিছু হটা পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনী আজ ব্যাপক স্থল আক্রমণের শিকার হয়।

পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান প্রধান শহরগুলোর রাস্তায় রাস্তায় ভয়াবহ যুদ্ধ হয় এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে আশংকা করা হচ্ছে।
আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছে বলা জানা যায়।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে অতীতের যেকোনো সময় থেকে আজ শেখের গোপন বেতার কেন্দ্রের প্রমাণ জোরালো হয়েছে।
রাস্তাঘাটে পরে থাকা পোড়া গাড়ি, পরিত্যাক্ত বুলেট, লাঠি, পাথর ও ভাঙ্গা কাঁচের টুকরো শেখের বাহিনী ও পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীর মধ্যে নৃশংস যুদ্ধের ভয়ানক গল্পের সাক্ষী বহন করছে।

সর্বশেষ প্রাপ্ত প্রতিবেদনে বলা হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানে শক্তি বৃদ্ধির জন্য পশ্চিম পাকিস্তানীরা বিমানযোগে সীমিত আকারে সৈন্য সমাবেশ করছে।

পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব শহরের রাস্তায় ভয়ানক যুদ্ধ চলছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। আওয়ামী লিগের “মুক্তিযোদ্ধারা” আখাউড়ার কাছে অবস্থিত ভৈরব ব্রিজ উড়িয়ে দিয়েছে এবং অনেক জায়গায় সড়ক ও রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। অনেক মানুষ নিহত হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।

তবে, এখানে নজরদারি করা রেডিও পাকিস্তান আজ সকালে দাবি করেছে যে, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি বেশ ভালোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে এবং ঢাকার কারফিউ “প্রত্যাহার করা হয়েছে”। রেডিওতে অব্যাহতভাবে গতকাল জারি করা সামরিক শাসনের ধারাগুলো প্রচার করা হচ্ছে এবং সেগুলো ভঙ্গ করার পরিণতি সম্পর্কে মানুষকে সাবধান করে দেওয়া হচ্ছে।

আজ স্বাধীন বাংলা বেতারে বলা হয়, পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীর গোলাগুলিতে ঢাকা ও বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে অনেক বিদেশী নাগরিক আহত হয়েছেন।

কুমিল্লায় পাকিস্তানী বাহিনী ও বাংলাদেশের মুক্তি যোদ্ধাদের মধ্যে আজ দিনের শুরুতে সংঘর্ষে কমপক্ষে ১৮০ জন্য মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, সিমান্তের কাছাকাছি থেকে খুবই নির্ভরযোগ্য প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
মুক্তি যোদ্ধারা জেলা শহরে অবস্থিত সামরিক অস্ত্রাগারে আক্রমণ চালালে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। সামরিক বাহিনী মেশিন গানের মাধ্যমে মুক্তি যোদ্ধাদের উপর গুলি চালায়, যাদের মধ্যে রয়েছে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলের সদস্য, পুলিশ, ছাত্র ও সাধারণ নাগরিক।

আমাদের শিলং সংবাদদাতা জানান, কুমিল্লা, সিলেট, ময়মনসিংহ ও ফেনী শহর আওয়ামী লিগের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

এই দিন সকালে বন্ধুকযুদ্ধের পরে গণবাহিনী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রায় প্রায় ১২,০০০ জন সেনাবাহিনীকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আলাদা হয়ে যাওয়া সেনাবাহিনী গোমতী নদী পার হয়ে গেছে। বিকেল পর্যন্ত পুরো নদী জুড়েই গুলি বিনিময় চলছিল।

মুক্তিবাহিনী কুমিল্লা জেলায় অনেক রেলওয়ে ব্রিজ উড়িয়ে দিয়েছে বা রেললাইন তুলে নিয়েছে এবং অনেক সড়কপথ কেটে দেওয়ায় যানবাহন চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বগুড়া থেকেও নিযুক্ত সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা হয়েছে এবং ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন জায়গায় নিযুক্ত সেনাবাহিনী গোলাবারুদ ও রসদের সরবরাহ সংকটে পড়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বাংলাদেশের অন্যান্য শহরে হানাদার বাহিনীর চলাচল বিঘ্নিত করার জন্য চট্টগ্রাম ও ঢাকা মহাসড়কের অনেক সড়ক সেতু মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষতিগ্রস্ত করে দিয়েছেন।

চট্টগ্রামে হতাহতের ঘটনা সবচেয়ে বেশি বলে জানানো হয়েছে। সারারাত ধরে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ রাখা আওয়ামী লিগ সমর্থকেরা আজ সকাল পর্যন্ত তা ধরে রেখেছে।

শুধুমাত্র যশোর বিমানবন্দর এলাকায় ১৫০০-এর বেশি শহুরে ও গ্রাম্য সাধারণ মানুষকে মেশিনগানের গুলিতে হত্যা করা হয়, যাদের অনেকেই “লুঙ্গি ও ধুতি” পরিহিত ছিল; তখন শেখের সমর্থকরা বল্লম, লাঠি, রাম দা ও ডেগার নিয়ে সজ্জিত হয়ে বিমানবন্দর দখল করার চেষ্টা করেছে।

হরতাল ডাকা হয়েছে
আগরতলা থেকে সম্প্রচারিত সংবাদে জানা গেছে, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, যশোর, বরিশাল ও খুলনায় বাংলাদেশী বাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীকে ঘিরে ফেলেছে।

গত দুই দিন সেনাবাহিনীর আক্রমণে শতাধিক সাধারণ মানুষের মৃত্যুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে পুরো পূর্বাঞ্চলে ‘হরতাল’-এর বিষয়ে আওয়ামী লিগের সিদ্ধান্তকে তাঁরা পুনর্ব্যক্ত করেছে।

তাঁরা ঘোষণা করেন যে, “বঙ্গবন্ধু” শেখ মুজিবুর রহমান হলেন বাংলাদেশের একমাত্র নেতা “দেশকে পশ্চিম পাকিস্তানীদের নির্মম একনায়কতন্ত্র থেকে রক্ষার জন্য যার আদেশ মানুষকে পরিপালন করা উচিত”।

আজ শেষ রাতের দিকে প্রাপ্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, রংপুর শহরে কারফিউর মধ্যেই ব্যাপক যুদ্ধ চলছে, এটি হলো সেই তিনটি স্থানের মধ্যে একটি যেখানে দুই দিন আগে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনারা বহু নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছে।

ইতোমধ্যে, আজ সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ঢাকায় কারফিউ প্রত্যাহার করা হয়েছে। প্রধান সামরিক শাসন প্রশাসক দু’টি নতুন বিধান ইস্যু করেছে, যার অধিকে সভা, সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং প্রকাশনা ও সংবাদপত্রের উপর কঠোর সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়েছে, রেডিও পাকিস্তানের প্রতিবেদন।

এই বিধিবিধানের যেকোনো লঙ্ঘন সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান সহ শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

সীমান্তের বিভিন্ন স্থান থেকে জানা গেছে, বন্দর নগরী চট্টগ্রাম মুক্ত বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা জাহাজ থেকে সেনাবাহিনী ও যন্ত্রপাতি নামাতে আওয়ামী লিগের স্বেচ্ছাসেবী ও অন্যরা প্রতিরোধ করলে ২৫ মার্চ চট্টগ্রামে রক্তের বন্যা বয়ে গেছে।

হাজারো সাধারণ মানুষের সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ঘিরে রেখেছে।

জ্বালানি সংকট
বর্তমানে পূর্ব পাকিস্তানে থাকা পাকিস্তান বিমান বাহিনী ভয়ানক জ্বালানি সংকটে পড়েছে, আজ কলকাতায় গৃহীত বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

এই প্রতিবেদনগুলো অনুযায়ী, বিমান বাহিনীর বিমানের জন্য এই অত্যাবশ্যকীয় জ্বালানি নিশ্চিত করতে পাকিস্তান সরকার অস্বাভাবিক দামে বার্মার সরকারের সাথে একটি চুক্তি করেছে এবং তাঁরা সরবরাহ করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা নদীবহুল বাংলার অনেক ব্রিজ ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস করে দিয়েছেন এবং সেনাবাহিনীর চলাচল শুধুমাত্র শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।

আজ সকালে এই পরিস্থিতিকে ভয়ানক হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে, কারণ সমগ্র জাতিই পশ্চিম পাকিস্তানী দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৫৩। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের আহবান অমৃতবাজার পত্রিকা ২৮ মার্চ ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৫৩, ৬৭৪>

অমৃত বাজার পত্রিকায়, ২৮ মার্চ ১৯৭১
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার আহ্বান
– স্টাফ রিপোর্টার

শনিবার সভায় সংযুক্ত বামফ্রন্ট সার্বভৌম স্বাধীন বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের অবিলম্বে স্বীকৃতি দিতে এবং সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তার অধিকার রক্ষার জন্য ‘সহায়তা প্রদান’ করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবি করে।

এই সিদ্ধান্তের পাশাপাশি, ULF শহীদ মিনার ময়দানে সোমবারে এক গণ সমাবেশে বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন। ULF অবিলম্বে সীমান্ত জুড়ে অবস্থিত মানুষের হাত শক্তিশালীকরণের জন্য সংগঠনের আপামর সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়।

ULF বাংলাদেশের মানুষের সমর্থনে তার ছাত্র শাখাকে মিটিং করার নির্দেশ দেয়।

এদিকে আরএসপি’র সাধারণ সম্পাদক, জনাব ত্রিদিব চৌধুরী রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব শরণ সিং কে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের অনুরোধ করেছেন এবং বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতির জন্য চাপ দিয়েছেন।

সমাজতান্ত্রিক ইউনিটি সেন্টারও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে আহ্বান জানিয়েছে। তাছাড়া, বাম ও গণতান্ত্রিক দল ও গণসংগঠনের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের হাত শক্তিশালী করার জন্য একটি গণআন্দোলন গড়ে তোলার জন্য ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি প্রণয়ন করতে বলেছেন।

অধ্যাপক হরিপদ ভারতী, রাজ্য জন সংঘের চেয়ারম্যান, এক বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা জন্য ইসলামাবাদের সামরিক স্বৈরশাসকের নিন্দা করেন এবং ভারতের সরকারের প্রতি আহ্বান জানান অলস দর্শক না হয়ে থাকতে। কেন্দ্রীয় সরকারের উচিৎ স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া। প্রফেসর ভারতী সব রাজ্যে তার দলের ইউনিটকে বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের সঙ্গে একাত্মতা প্রদর্শন করার জন্য অনুরোধ করেন।

CITU বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থন বাড়ানো এবং সীমান্ত জুড়ে মানুষের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করার জন্য শ্রমিকশ্রেণির প্রতি আহ্বান জানায়। এছাড়া তারা পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে ১৪৪ ধারা উঠিয়ে নেবার অনুরোধ করে যাতে শহরের জনগণ রাস্তায় নেমে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সহানুভূতি প্রদর্শন করতে পারে।

সম্প্রীতি সমিতি

পূর্ব ও পশ্চিম বাঙলা সম্প্রীতি সমিতির পক্ষ থেকে একটি বিবৃতিতে যারা দুই বাংলার মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য কার্যকরভাবে অবদান রাখতে চান তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়।

বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী হলেন মেসার্স তারাসংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, তুষার কান্তি ঘোষ, আনন্দ শংকর রায়, অশোক কুমার সরকার, মনোজ বসু, প্রমোদ কুমার স্যানাল, হিরময় বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিচারপতি শংকর প্রসাদ মিত্র ।

পশ্চিমবঙ্গ ছাত্র পরিষদের সভাপতি, কংগ্রেসের (ও) ছাত্রশাখার সুবীর চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীকে একটি টেলিগ্রামে বলেন এক হাজার ছাত্র পরিষদ কর্মী বাংলাদেশের মানুষকে সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত আছে। “দয়া করে আমাদের পূর্ববঙ্গে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার অনুমতি দিন।’

অধ্যাপক সমর গুহ, এমপি. এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন যে, জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নতুন সামরিক আইন জারির পর শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা ভারত উপমহাদেশের সবচেয়ে বিপ্লবী ঘটনা। সমগ্র বাংলাদেশে মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে জেগে উঠেছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৫৪। সম্পাদকীয় : বাংলাদেশের জন্য আমরা কি করতে পারি আনন্দবাজার ৩০ মার্চ, ১৯৭১

Kamol Roy
<১৪, ২৫৪, ৬৭৬-৬৭৭>

বাংলাদেশের জন্য আমরা কি করতে পারি

বুধবার পশ্চিমবঙ্গে হরতালের ডাক এই রাজ্যের মানুষের ব্যাপক সমর্থন লাভ করেছে। তার কারণে, মানুষ এই মুহূর্তে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সহানুভূতি, সহমর্মিতা ও সমর্থন প্রকাশ করার জন্য যে গভীর আকুতি বোধ করেছেন সেটা এই হরতালের ভিতর দিয়ে রূপায়িত হতে পারে। যদিও একথা বলা যেতে পারে যে এমন একটা প্রচন্ড আবেগে মথিত উপলক্ষে হরতালের উপযোগিতা নিতান্তই সীমাবদ্ধ, তাহলেও এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, এই হরতালের মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মনোভাব একটা স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যাক্তি লাভ করবে। এই হরতালের মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে যেখানে কোন বিরোধ নেই সেখানে জনসাধারণের ঐক্য যাতে অটুট থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। এই হরতাল পরিপূর্ণ শান্তির মধ্যে, সম্পূর্ণ বিনা বাধায় উদযাপিত হওয়া উচিৎ। আমরা আশা করি যে, বুধবারের হরতালের উদ্যোক্তারা এ বিষয়ে দৃষ্টি দেবেন।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, হরতালের পর কি? এটা কি আদৌ আস্বাভাবিক নয় যে, এই দেশের মানুষ প্রতিবেশী দেশের সংগ্রামীদের বাস্তব ও সুনির্দিষ্ট সাহায্য দেওয়ার জন্য বলতে গেলে অস্থির হয়ে উঠেছে। এই বাংলাদেশের মানুষগুলি কয়েক বছর আগে আমাদের স্বদেশবাসী ছিল। বিশেষ করে, পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীদের সঙ্গে তাদের নাড়ীর যোগ রয়েছে। এই জীবন মরণ পরীক্ষার দিনে তাদের প্রতি এদেশের মানুষের হৃদয়ের গভীরতম তন্ত্রীগুলি সহানুভূতির সুরে অনুরণিত হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু সে কথা ছেড়ে দিলেও সেখানে যা হচ্ছে সেটা বলতে গেলে ইতিহাসের একটা অভূতপূর্ব ঘটনা। অসামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থান আমরা দেখেছি, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে অসামরিক জনতার প্রতিরোধও আমরা দেখেছি কিন্তু একটা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে অসামরিক অভ্যুত্থান, অসামরিক জনতা কর্তৃক সামরিক শাসনের অধীনে রাষ্ট্রযন্ত্র অধিকার, এমন দৃশ্য যে কবে দেখেছে? ভারতের মানুষ ঘরের লাশে বলেই এই ঘটনার তাৎপর্যটা সঠিকভাবে উপলব্ধি করছে। সরকারী বিবৃতির মধ্য দিয়ে, লোকসভার সদস্যদের বক্তৃতার মধ্য দিয়ে, দিল্লীর জনসভার মধ্য দিয়ে, কলকাতার ময়দানে জনসভার মধ্য দিয়ে, বোম্বাইয়ে ও অন্যত্র বিক্ষোভ প্রদর্শনের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের প্রতি এদেশের মানুষের অভূতপূর্ব মমতা প্রকাশ পেয়েছে। আর সেই সঙ্গে প্রকাশ পেয়েছে ঐ সংগ্রামী মানুষগুলির পাশে এসে দাঁড়াবার জন্য, যেভাবে হোক, তাদের সাহায্য করার জন্য একটা গভীর আকুতি।

এখন পর্যন্ত এই আকুতি অসংঘটিত ও বাস্তব পরিকল্পনাহীন সকলেই বুঝছে একটা কিছু করা দরকার। কিন্তু ঠিক কি করা দরকার অথবা কতটা করা যায় সে বিষয়ে কারও স্পষ্ট কোন ধারণা নেই। সেই কারণে পরষ্পরের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষার কোন চেষ্টা না করে যিনি যেমন বুঝছেন তেমনিভাবে কথা বলছেন। কিছু তরুণ উদ্দেশ্যহীনভাবে সীমান্তে গিয়ে ভিড় করছেন, কেউ অনশন করছেন, কেউ পাকিস্তানী দূতাবাসগুলির সামনে গিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন। আসল কথা হল, মানুষের মধ্যে যে আবেগ দেখা দিয়েছে, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াবার জন্য যে গভীর আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে সেটাকে হরতালের পর একটি সুনির্দিষ্ট, একমুখী কর্মসুচীর মধ্যে সংহত করার পরিকল্পনা নেই, সেই উদ্দেশ্যে তাদের সামনে নেতৃত্বও রাখা হচ্ছে না। মানুষের আগ্রহ-উদ্দীপনাকে এভাবে বিক্ষিপ্ত হয়ে যেতে দেওয়া শুধু অপচয়কর নয়, ক্ষতিকারকও হতে পারে। এমনকি এটা পশ্চিমবঙ্গের গতানুগতিক রাজনৈতিক দলাদলির আরেকটি উপলক্ষে পরিণত হওয়াও সম্ভব। এই আগ্রহ উদ্দীপনা যাতে একটা নির্দিষ্ট খাতে প্রবাহিত হয় সেজন্য নেতৃস্থানীয় মানুষদের এগিয়ে আসতে হবে। অন্যান্য রাজ্যের তুলণায় পশ্চিমবঙ্গেই এর বেশি প্রয়োজন।

প্রতিবেশী দেশের এই ঘটনা সম্পর্কে নয়াদিল্লীতে ভারত সরকার কি নীতি গ্রহণ করবেন তা আরও কয়েকদিন না গেলে বোঝা যাবে না। সরকারকে অবশ্যই অনেক ভাবনা চিন্তা করে, চারদিক বাঁচিয়ে তাঁদের নীতি স্থির করতে হবে। তাহলেও বেসরকারী স্তরে মানুষ যদি সরকারী নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করেও কয়েক পা এগিয়ে যায় তাহলে কোন ক্ষতি নেই এবং সরকারও তাতে বাধা দিতে পারবেন না। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের আজ ঠিক কি ধরণের সাহায্য প্রয়োজন তা যাচাই করার জন্য, প্রয়োজনীয় সাহায্য সংগঠত করার জন্য, সেই সাহায্য যথাস্থানে পৌঁছে দেওয়ার জন্য রীতিমত একটা সংস্থা গড়ে তোলা দরকার। পশ্চিমবঙ্গে অবিলম্বে যদি সর্বস্তরের মানুষের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটা শক্তিশালী কমিটি তৈরি করা হয় তাহলে এমন একটা সংগঠিত কর্মসূচি নিয়ে হয়তো অগ্রসর হওয়া যাবে যাতে বাংলাদেশের মানুষকে তাদের এই বিপদের দিনে সত্যিকার সাহায্য দেওয়া যাবে। আর তা না হলে সমস্ত আবেগই একটা নিরর্থক অপচয়ে পর্যবসিত হয়ে যেতে পারে অথবা ভুল পথে চালিত হয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক না হয়ে ক্ষতিকারক হয়ে উঠতে পারে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৫৫। বাংলাদেশ সার্বভৌম সরকার ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ৩১ মার্চ ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৫৫, ৬৭৮>

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, নয়াদিল্লি, ৩১ মার্চ ১৯৭১
সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকার

কলকাতা, ৩০ মার্চ, (ইউএন আই) – শেখ মুজিবুর রহমানের অধীনে গঠিত বাংলাদেশ সরকার একটি সার্বভৌম বৈধ সরকার এবং বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশের কাছ থেকে স্বীকৃতি প্রাপ্ত হবার যোগ্য। আজ সকালে মুক্তিবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত সর্বাধিনায়ক মেজর জিয়া এই ঘোষণা করেন।

শেখের পক্ষে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে একটি সম্প্রচারে মেজর-জিয়া বলেন, “নতুন গণতান্ত্রিক সরকার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষনীতি অবলম্বন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশ সব জাতির সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক করতে চায় এবং আন্তর্জাতিক শান্তির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করবে।’’

সম্প্রচারে মেজর-জিয়া এভাবে শুরু করেন: “আমি, মেজর জিয়া, বাংলাদের মুক্তিবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার-ইন-চিফ, এতদ্দ্বারা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রচার (proclaim) করছি।” ‘আমি আরও ডিক্লেয়ার করছি যে আমরা ইতিমধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের অধীনে একটি সার্বভৌম বৈধ সরকার গঠন করেছি যা আইন ও সংবিধান অনুযায়ী কাজ করবে। তাই আমরা, বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক ও শান্তিপ্রিয় দেশের কাছে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সরকারকে স্বীকৃতি দেবার আবেদন করছি।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৫৬। সম্পাদকীয় : আবেদনে গণহত্যা বন্ধ হবে না যুগান্তর ১ এপ্রিল, ১৯৭১

Kamol Roy
<১৪, ২৫৬, ৬৭৯-৬৮০>

আবেদনে গণহত্যা বন্ধ হবে না

সংসদ প্রস্তাব নিয়েছেন। পূর্ব বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রামে তাঁরা অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন। আর নিন্দা করেছেন পশ্চিম পাকিস্তানের গণহত্যার। সংসদ সদস্যদের দৃড় বিশ্বাস সাড়ে সাত কোটি মানুষের ঐতিহাসিক সংগ্রাম শেষ পর্যন্ত জয়যুক্ত হবে। আবেগকম্পিত কন্ঠে বক্তৃতা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে প্রস্তাব। দুনিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্র এবং জনতার কাছে আবেদন জানিয়েছেন সংসদ সদস্যরা। তাঁরা যেন পূর্ববাংলার গণহত্যা বন্ধের জন্য পাকিস্তান সরকারের উপর চাপ দেন। প্রস্তাবের বয়ান সুন্দর। ভাষায় রয়েছে সরল প্রাণের আকুল ক্রন্দন। ধ্বনিত হয়েছে দিশাহারা এবং উদ্বেলিত সাধারণ মানুষের অন্তরবেদনা। সীমান্তের ঠিক ওপারে ফ্যাসিস্ট দস্যুদের নৃশংস অত্যাচারে হাহাকার করছে মানবতা। এপারে দাঁড়িয়ে দেখছেন গণতন্ত্রী ভারতের লক্ষ লক্ষ নরনারী। যাঁরা নরপশুদের উদ্দাম হত্যালীলা থেকে গণতন্ত্র বাঁচাবার কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত তাঁদের কাছে হাতিয়ার পৌঁছে দিতে পারছেন না তাঁরা। প্রতিদিন গড়ে উঠছে শবের পাহাড়। এ অবস্থায় নৈতিক সমর্থনের এবং গাঢ় সহানুভূতির বাস্তব মূল্য কতটুকু? ওপারের মুক্তিযোদ্ধাদের কাতর মিনতি- অস্ত্র নাই। দানবীয় শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই-এ শেষ পর্যন্ত আমরা জিতবই। হত্যার ব্যাপকতা এড়াবার জন্য দরকার অস্ত্র এবং সমরসম্ভার।

ইসলামাবাদের ডাকাত সর্দাররা নৈতিক উপদেশের ধার ধারেন না। তাঁরা বিশ্বাসঘাতক এবং হীনচক্রী। আপোষ আলোচনার অনিচ্ছায় সৈন্য এবং অস্ত্রশস্ত্র এনেছেন তারা পূর্ববাংলায়। তারপর অতর্কিতে হেনেছেন প্রচন্ড আঘাত। মুজিবর পাকিস্তানকে টুকরো করে ফেলতে চাননি। চেয়েছিলেন ছ’দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন। জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্যসের মধ্যে তাঁর দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাধিক্য। গণতন্ত্রের মৌলনীতি অনুযায়ী তিনিই গোটা পাকিস্তানের সত্যিকারের নেতা। লোকায়ত্ত সরকার পরিচালনা এবং সংবিধান রচনার পুরা দায়িত্ব তাঁর উপর। ভূইফোঁড় ডিক্টেটর ইয়াহিয়া তা স্বীকার করেননি। পশুবলে তিনি বাংলাকে বগলদাবা করতে চেয়েছেন। তাঁর ধৃষ্টতা সীমাহীন। মুজিবর রাষ্ট্রদোহী, আর নরাঘতী রবং বিশ্বাসঘাতক সামরিক নেতা ইয়াহিয়া দেশপ্রেমিক। ইসলামাবাদের হঠকারীর এই প্রগলভ উক্তিই পূর্ব বাংলাকে ঠেলে দিয়েছে সার্বভৌম স্বাধীনতার পথে। মুক্তিযোদ্ধারা নেমেছেন রাস্তায়। দখলকারী সৈন্যদের বাধা দিচ্ছেন জান-প্রাণ দিয়ে। হাজার হাজার শহীদের রক্তে যাদের হাত কলঙ্কিত শুধু আবেদনে বন্ধ হবে তাদের রাক্ষসী ক্ষুদা- এ কল্পনা অবাস্তব। পাকিস্তান দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একদিকে স্বাধীন এবং সার্বভৌম বাংলাদেশ, অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তানেরর সামরিক সরকার। একের হাতে জনতার সনদ এবং অপরের হাতে আসুরিক দল। একের লক্ষ্য গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা এবং অপরের লক্ষ্য তার ধ্বংস। এ দুয়ের মধ্যে কো মিলন সেতু নেই। যদি থাকত তবে মুজিবর- আয়ুব আলোচনার সময়ি তা বেড়িয়ে পড়ত বাঙালীর উপর ডাল কুত্তাদের লেলিয়ে দেবার প্রয়োজন ইয়াহিয়ার হত না। নয়াদিল্লী কি মনে করেন, বৃটেন এবং আমেরিকা ইয়াহিয়ার উপর সক্রিয় চাপ দেবে? সেন্টোর শরিক হিসেবে আপৎকালে ইসলামাবাদের শাশককুলের পাশে দাঁড়াতে ওরা কি প্রতিশ্রুত নয়? চীন পড়েছে উভয় সংকটে। এতদিন সে দহরম-মহরম করেছে ভুট্টো ইয়াহিয়ার সঙ্গে। এখন পূর্ববাংলার উত্তাল তরঙ্গে নৌকা ভাসাতে তার সরম লাগছে। দুনিয়ার সর্বত্র গণ-আন্দোলনের উদ্দাম সমর্থনে চীনের বিপ্লবী আত্মা নেচে উঠে। পূর্ব বাংলার বেলায় সে নীরব। সোবিয়েট রাশিয়ার পদক্ষেপ সতর্ক। সে মুখ খুলছে না। মার্কিন, সোভিয়েট এবং চীনা অস্ত্র নিয়ে ইয়াহিয়ার ফ্যাসিস্ট বর্বরদল চালাচ্ছে বাংলাদেশে গণহত্যা। সামরিক অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে অসামরিক জনতা ধ্বংসে। গণহত্যা প্রতিরোধে এদের সাহায্য পাওয়া দুঃসাধ্য। অথচ তাদের সমর্থন ছাড়া রাষ্ট্রসংঘে এক পাও এগুনো যাবে না।

মুজিবর এখন যে পর্যায়ে এসেছেন সেখান থেকে পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। লক্ষ শহীদের শোণিতধারার অপমান সহ্য করবেন না বিদ্রোহী বাঙ্গালী। স্বাধীনতার ঘোষণার প্রত্যাহারের পরিণতি বর্মান নেতৃত্বের আত্মহত্যা। সংগ্রামের চরম মুহুর্তে এ পথ নিতে পারেন না কোন দূরদর্শী এবং বাস্তববাদী নেতা। পদ্মার জলে নৌকা ডুবিয়ে চলে গেছেন ইয়াহিয়া খান। ডুবো নৌকা টেনে তোলা সম্ভব নয়। ইয়াহিয়ার আত্মসমর্পণের অর্থ তার গদী চ্যুতি। দুই চরম পথ এক জায়গায় মিশবার চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। তবু আপোষের অলীক স্বপ্ন দেখছেন নয়াদিল্লী। বাংলাদেশের সম্পর্কে কথা বলা কোন অধিকার নেই ইসলামাবাদের। ওদের ঔপনিবেশিক শাসন চূর্ণবিচূর্ণ। হয়তো লড়াই চলবে দীর্ঘদিন। শেষ পর্যন্ত জিতবেন গণতন্ত্রী শক্তি। সংসদ সদস্যরাও তাই মনে করেন। এই যদি হয়ে থাকে তাঁদের আন্তরিক বিশ্বাস তবে ন্যায়ের সঙ্গে অন্যায়ের বোঝাপড়ার আশা তাঁরা ছেড়ে দেন। পশ্চিম পাকিস্তানের হিংস শাসকদের বিবেকের উপর চাঁটি মারার অভ্যাস পরিত্যাগ করুন। যে জিনিসের কোন অস্তিত্ব নেই তার উপর চাপ এবং তার কাছে আর্জি অর্থহীন। স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের রীতিসম্মত আবেদন আসা মাত্রই তাকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দানের জন্য প্রস্তুত থাকুন। তাহলেই পূর্বের মুক্তিযোদ্ধারা পাবেন অফুরন্ত সংগ্রামী প্রেরণা। সম্বিত ফিরবে ফ্যাসিস্ট বর্বরদের। শবের পাহাড় হয়তো বাড়বে। কিন্তু গণতন্ত্র জয়যুক্ত হবে। বাংলাদেশ বাঁচবে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৫৭। প্রাক্তন পাক কূতনীতিকরা বলেনঃ আমরা বাংলাদেশের অনুগত আনন্দবাজার পত্রিকা ৮ এপ্রিল, ১৯৭১

Kamol Roy
<১৪, ২৫৭, ৬৮১>

আমরা বাংলাদেশের অনুগত
প্রাক্ত পাক কূতনীতিকদের বিবৃতি।

নয়াদিল্লী,৭ এপ্রিল- শ্রী কে এম সাহাবুদ্দিন ও শ্রী আমজাদ হক এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেছেন বাংলাদেশের জন সাধারণ ইসলামাবাদ সরকারকে বিদেশী ঔপনিবেশিক শাসকচক্র হিসেবেই গণ্য করেন। পূর্ববঙ্গের অধিবাসী এই দুই পাকিস্তানী কুটনীতিক গতকাল ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করেন। যুক্ত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইসলামাবাসের শাসকদের বর্বরতার নজির ইতিহাসে নেই। নিরস্ত্র জনসাধারণের উওই ব্যাপক হত্যালীলা কতদূর চালানো হয়েছে বিশ্বের জনমত তা উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন।

ওঁরা বলেন, ইসলামাবাদের ফ্যাসিবাদী সামরিক একনায়কত্বের সঙ্গে আমরা সম্পর্কচ্ছেদ করেছি। আমাদের বিবেকের নির্দেশে ইসলামাবাদের চাকুরী আমরা ত্যাগ করলাম। বাংলাদেশের পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা দখলদার বাহিনী ছাড়া কিছুই নয়।

এখন থেকে আমরা বাংলাদেশের কাছেই আমাদের আনুগত্য জানাচ্ছি। সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সুস্পষ্ট নির্দেশেই বাংলাদেশ সার্বভৌম ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। আমরা পৃথিবীর সব সভ্যমানুষের কাছে সহানুভূতি ও সুনির্দিষ্ট সাহায্যের জন্য আবেদন জানাচ্ছি। পৃথিবীর সব দেশকেই আমরা আবেদন করছি- সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন।

স্বাধীন বাংলা বেতার গত সপ্তাহে বাঙালী কূটনীতিকদের উদ্দেশ্যে এক ঘোষনায় বলা হয়েছিল, বদলির আদেশ পেলে তাঁরা যেন যে দেশে আছেন সেই দেশের আশ্রয় প্রার্থনা করেন। ওই দু’জন কূটনীতিক গত সপ্তাহে বদলির আদেশ পান।

আমাদের অনুরোধেই ভারত সরকার আমাদের নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ সার্বভৌম সরকারের নেতৃবৃন্দের নির্দেশিত পথ অনুযায়ী আমাদের দেশের কাজে আত্মনিয়োগ করতে আমরা শীগগিরই ফিরে আসছি! জয় বাংলা।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৫৮। ভারত নীরব দর্শক নয় অমৃতবাজার পত্রিকা ৮ এপ্রিল ,১৯৭১

Nahid Sajibe
<১৪, ২৫৮, ৬৮২>

অমৃতবাজার পত্রিকা। ৮ এপ্রিল ,১৯৭১
ভারত নীরব দর্শক নয়

ভারত নীরব দর্শক নয় পশ্চীম বাংলার ততকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেন; রাষ্ট্রপতি ডা: পি .সি চন্দ্র W.B.P.C.C এবং শ্রী গোবিন্দলাল ব্যানার্জি গত বুধবার নিম্নোক্ত বক্তব্য প্রদান করেছেন। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৌতিক পরিস্থিতি পরিষ্কার্।এটা সবারই জানা আছে যে, শেখ মুজিবর রহমান আইনত এবং গণতান্ত্রীকভাবে সমগ্র পূর্বপাকিস্তানের অধিকাংশ জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে স্থানীয় সরকার গঠন করেছেন। বাংলাদেশের এই বর্তমান পরিস্থিতির পরিবর্তনে ভারতের অবগত হওয়ার যথেষ্ঠ কারণ রয়েছে। অন্যান্য দেশের মত পশ্চিম পাকিস্তানও এই যুদ্ধরত বাঙ্গালীদের কান্না শুনতে পায়নি। বাংলাদেশের এই বিদ্ধস্ত অবস্থা তারা দেখেও চোখ বন্ধ করে রেখেছে,যেটা ভারত অবলোকন করেছে। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে এটা আমাদের চাক্ষুস অভিজ্ঞতা,যা কোন পত্রিকার প্রতিবেদন নয়। এটা কামানের বিরুদ্ধে কামানের কিংবা বোমার বিরুদ্ধে বোমার যুদ্ধ নয়। এট মানুষের অসহায়ত্যের সাথে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের যুদ্ধ। এটা আমাদের জন্য প্রচন্ড লজ্জার হবে যদি এসব নির্যাতিতদের কাছে আমরা নীরব দর্শক হয়ে থাকি। বাংলাদেশের জনগণকে এট জানতে এবং বিশ্বাস করতে দেয়া হোক যে,ভারত তাদের সম্মান করে এবং তাদের সাধীনতা রক্ষায় কিংবা যে কোন প্রয়োজনে পাশে দাড়াতে প্রস্তুত। এখন সময় হয়েছে সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত সিদ্ধান্ত সবাইকে জানিয়ে দেয়ার্।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৫৯। মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহী পুনর্দখল করেছে হিন্দুস্তান টাইমস ৯ এপ্রিল ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৫৯, ৬৮৩>

হিন্দুস্তান টাইমস, ৯ এপ্রিল ১৯৭১
মুজিবের লোক রাজশাহী পুনর্দখল করেছে

আগরতলা, ৮ এপ্রিল (ইউ এন আই, পিটিআই) – বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহী মুক্ত করেছে। এবং পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য অন্যত্র চলে গেছে। পাকিস্তানি প্লেন আজ উত্তর অংশে নাপাম বোমা বর্ষণ করে আরও কিছু ধ্বংস সাধন করেছে।

প্রায় সপ্তাহব্যাপী যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনী রাজশাহীতে বিজয় করে। প্রচণ্ড সংগ্রামের পর সৈয়দপুর থেকে তারা পাকিস্তানি সেনাদের তাড়িয়ে দেয়।

যশোর সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে হিমশিম খাচ্ছে। কুমিল্লায় একটি বড় যুদ্ধে পাকিস্তানীরা দুর্বল হয়ে আছে। এই খবর গতকালের।

সিলেট এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা খাদিম নগর সেনানিবাস দখল করেছে। এখানে প্রধান শহর থেকে সৈন্য আশ্রয় নিয়েছিল দুদিন আগে। পাকিস্তানিরা সালুটিকর বিমানঘাঁটি এবং শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরের চা-বাগান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়।

আওয়ামী লীগ সূত্র জানায় যে খুলনা শিল্পাঞ্চলের দখল নেবার জন্য যুদ্ধ চলছে। অনেক দিন চেষ্টার পর পরিস্থিতি এখন মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে যাচ্ছে। শারীরিক সমস্যা থাকার পরেও বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসিরুদ্দিন সেখানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

রাজশাহীর রিপোর্টে জানা যায় সেখানে পাকিস্তানীদের হার প্রায় নিশ্চিত। ১৯ জন পাকসেনা নিহত হয়েছে এবং ২০০ জন আটক হয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহী রেডিও স্টেশনের সরঞ্জাম মেরামত করছিল।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৬০। বুদ্ধিজীবী নিধন অমৃতবাজার পত্রিকা ১০ এপ্রিল ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৬০, ৬৮৪-৬৮৫>

অমৃতবাজার পত্রিকা, ১০ এপ্রিল ১৯৭১
বুদ্ধিজীবী নিধন
– নারায়ণ চৌধুরী

ইয়াহিয়া খানেরবাহিনী বাংলাদেশের ঢাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে গুড়িয়ে দিয়েছে। বলা হয় যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা একই কাজ করেছে।

ডাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসের তীব্র কাহিনী শুধু মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ভেতরে অবস্থিত দালান ধ্বংস করেই নয় বরং ক্লাস কক্ষ, ল্যাবরেটরিজ, লাইব্রেরি, ছাত্রছাত্রী হল, স্টাফ কোয়ার্টার প্রভৃতি যা কিছু ক্যাম্পাসের ভেতরে আছে সব তারা ধ্বংস করে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় পঞ্চাশ জন অধ্যাপককে জবাই করা হয় যারা এখানে পড়াতেন। এই অধ্যাপকদের মধ্যে পূর্ববাংলার কিছু শীর্ষ বুদ্ধিজীবী আছে, যারা শত্রুদের মর্টারের বর্বর আগুনে পড়ে গেছে বলে বিশ্বাস করা হয়।

যাঁরা ডাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তার আকাঙ্খিত কাঠামো এবং বিস্তৃত সবুজ লন দেখেছেন, যা বিশাল রমনা এলাকা ও তার নিকটবর্তী এলাকাগুলির মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে, তারা পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডের ধ্বংসাবশেষের দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এই ক্ষতি অপূরণীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ বিশিষ্ট শিক্ষাকর্মীর গণহত্যা এবং প্রকৃত ধ্বংসাবশেষসহ গণহত্যা সম্পর্কে আমরা যখন শুনেছি তখন আমরা মর্মাহত হয়েছি। পাকিস্তানি আর্মি দ্বারা অযৌক্তিকভাবে এই বর্বরতার জন্য আমরা শোকাহত হয়েছি।

সমান্তরাল
অদ্ভুত ট্র্যাজেডি অবশ্যই এমন কিছু যার কোন তুলনা হয়না। হত্যাকাণ্ড এবং যেসব পরিস্থিতি সংঘটিত হচ্ছে সেগুলির প্যাটার্ন হিটলারের সৈন্যদের প্রায় চল্লিশ বছর আগের হত্যাকাণ্ডের সংস্কৃতিকে মনে করিয়ে দেয়। এটা তাদের ফ্যাসিস্ট পদ্ধতি।

ইসলামাবাদ
কিন্তু চক্রের গণনা সম্পূর্ণভাবে ভুল। সকল উপায়ে জনগণকে শোষণ করার পর – তারা নিশ্চিতভাবেই ইতিহাসের শিক্ষায় পরিণত হয়েছে। ফ্যাসিস্টরা সব সময় প্রতিপক্ষকে শেষ করে দিয়ে তার লক্ষ্য অর্জন করেছে। তাদের সেট করা অত্যাচার ও নির্যাতনের ইঞ্জিনগুলি তাদের অহংকারিক অভিলাষের জোরে চলে। পশ্চিম পাকিস্তানি ফ্যাসিস্টদের দ্বারা একই ব্যাপার ঘটছে পুর্ব বাংলায়। ইতিহাসের নির্দয় বাহিনী অবশ্যই নিজের সেট করা আইন অনুযায়ী কাজ করবে। ইয়াহিয়া’র সৈন্যরা বাংলাদেশের সমভূমিতে তাদের সমাধি রচনা করবে তাদের নিজেদের কুচক্রের জন্যেই।

পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যালঘু শাসকরা এখনো বাঙালির বিশ্বাস ও জীবনধারার ও বাংলাদেশের জনগণের দৃষ্টান্তমূলক সংহতির অনুভূতি এবং গভীরতা পরিমাপ করতে সক্ষম হয় নি। বুদ্ধিবৃত্তিক, বা অ-বুদ্ধিজীবী, বাংলাদেশের সমগ্র জনগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অধীনে একতাবদ্ধ এবং এটি তাদের সব পরিস্থিতিতেই থাকাকালীন স্থির সিদ্ধান্ত। চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করা পর্যন্ত তারা তাদের দৃঢ়সংকল্পে অবিচল। রাওয়ালপিন্ডির সামরিক জান্তার নেতৃত্বে একটি স্বৈরশাসকের নিয়জিত কিছু সৈন্যবাহিনীর বিভিন্ন বিভাগের সহযোগিতায় তারা তাদের নখ দেখাচ্ছে। তারা হয়ত অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র বহন করছে একেবারে নিরস্ত্র প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তবুও এইসব জনগণের মনোবল শেষ করা খুবই কঠিন। তারা একটি নতুন মুক্ত জাতি গঠনে একতাবদ্ধ এবং যে কোন মূল্যে এক থাকবে। এখানে সেখানে কিছু বুদ্ধিজীবীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং কিছু কিছু আছে, যদিও এসব করে বাংলাদেশের পুনরুত্থানকে দমানো সম্ভব হবে না। এখন পর্যন্ত আমরা যথেষ্ট দৃঢ় বিশ্বাস দেখেছি এবং মুজিবের মুক্তিবাহিনীর মধ্যে সেই সাহস বলবত আছে যা আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে নিয়ে যাবে।

শিরনাম সূত্র তারিখ
২৬১। যুদ্ধের ঘনঘটা ফ্রন্টিয়ার ১০ এপ্রিল ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৬১, ৬৮৬-৬৮৭>

দ্যা ফ্রন্টিয়ার , ১০ এপ্রিল, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
যুদ্ধ পর্যবেক্ষক

পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় যে যুদ্ধ চলছে তার প্রবণতা এখন গত সপ্তাহের চেয়ে একটু বেশি। লুকানো সাংবাদিকদের চাক্ষুষ প্রমাণাদি এবং উদ্বাস্তুদের থেকে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে গণহত্যা, শহরে বোমা হামলা, ধর্ষণ লুটপাট এবং বেসামরিক নাগরিকদের পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা ভীতি প্রদর্শনের খবর পাওয়া যায়। পশ্চিম পাকিস্তানিরা দেশভাগে যুক্তদের দেশ থেকে তারাতে চাইছে এবং দখলদার বাহিনীর মত আচরণ করছে।

অন্যদিকে, এর আগে প্রাপ্ত স্বাধীন বাংলা রেডিও থেকে ও ভারতীয় সংবাদপত্র থেকে জানা যায় পশ্চিম পাকিস্তানি সকল সেনাকে ক্যান্টনমেন্টে পাঠানো হয়েছে যুদ্ধের পরিবর্তে। আরো সম্ভাব্য যে ৮০০০০ সৈন্যদের একটি বাহিনী যারা জালের মত বিস্তৃত নদী ও খালের জন্য সুবিশাল গ্রামাঞ্চলের সরাতে পারছে না, তাই তারা ইচ্ছাকৃতভাবে সেনানিবাসগুলোতে জমা হয়ে আছে এবং শুধু তখনি তারা শত্রুবাহিনীদের ধ্বংস করতে আসে যেখানে তাদের গোলাবারুদ ও তেল খরচ কম হয়। তাদের সরবরাহ জটিল আকার ধারণ করেছে – সম্ভবত বার্মা ও সিংহল চুক্তিপত্রে যে দৃঢ় প্রত্যাশা করা হয়েছিল তা ব্যার্থ হয়েছে।

সবচেয়ে উৎসাহজনক বিস্ময় গত একপক্ষ সময়ে মানুষের দ্বারা প্রদর্শিত অস্থিরতা। তারা সামরিক শক্তি দ্বারা আচ্ছাদিত না। জনপ্রিয় যুদ্ধবাহিনীর সাথে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্ট যুক্ত হয়েছে। সাথে আছে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও পুলিশ। বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি অফিসারদের এবং জওয়ানদের নাম আছে। অতএব বিদ্রোহী রেজিমেন্ট এর শক্তি সম্পর্কে সন্দেহ আছে। অধিকন্তু, জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও শেখ মুজিব এর আপসের সময় এইসব কর্মকর্তা এবং জওয়ানদের অজ্ঞাতে তাদের নিরস্ত্র করে ফেলা হয়েছে। তাই তাদের সাথে করে খুব বেশি অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে যাবার সম্ভবনা কম। আর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর রণসজ্জার তুলনায়, পুলিশ, মুজাহিদ ও আনসার এর অস্ত্র অনেক নিম্নমানের। তাই প্রশ্ন আসে সর্বোচ্চে কতদিন বিদ্রোহীরা সংঘর্ষ চালিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু তারা যে আক্রমণাত্মক ভঙ্গি নিয়েছে তা অনেক সাহসিক। কিছু কিছু যায়গা তারা পুরোটা দখলে নিয়েছে। যুদ্ধ চলতে থাকলে তারা অ্যামবুশের মাধ্যমে শত্রুদের থেকে হাল্কা অস্ত্র উদ্ধার করতে পারে কিন্তু আর্মিকে হারিয়ে ভারী অস্ত্র উদ্ধার করা একটা ব্যাপার বটে।

২৫ মার্চ শেখের বক্তৃতায় দেশবাসীকে আর্মির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে আহবান করা হয়েছে। কিন্তু যেভাবে তিনি তার সমর্থকদের আহবান করেছেন – যাদের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক ৭০ শতাংশ – তাতে মনে হয়না যে এটি শুধুমাত্র আওয়ামীলীগের বিষয়। দলের অনেক সদস্য আটক হয়েছেন – এতে করে বোঝা যায় তারা প্রস্তুত ছিলেন না। সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতির দরকার। অল্প সংখ্যক লোক সীমান্ত পেরিয়ে প্রতারণা করেছে। জাতীয়তাবাদ সাম্প্রদায়িকতায় রূপ নিচ্ছে। এবং সুসজ্জিত সশস্ত্র প্রতিরোধ অনুপস্থিত। অনেকে তাদের গ্রামবাসীর সাথে প্রভুর মত কথা বলেন এবং নিজেদের কমিউনিস্টদের অবিশ্বাস করে যারা একই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ছে। তারা বাংলাদেশের কেউ যারা আওয়ামীলীগের সাথে যুক্ত তারা যেন সীমান্তে কোন সহায়তা না পায় সেটি চায়।

মুক্তিযুদ্ধ চলার কারণে নির্ভরযোগ্য রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছেনা। তাই এখনো প্রতিরোধের প্যাটার্ন উপলব্ধি করা যাচ্ছে না। কে সামরিক জান্তাকে চুনকালি দিচ্ছে? পরিস্থিতি একই রকম হবার কথা নয়। এটাই কারণ হতে পারে যার জন্য বড় শক্তিগুলো দর্শকের ভুমিকায় আছে। তারা দেখার চেষ্টা করছে নিষ্পত্তিমূলক ফ্যাক্টর হিসেবে কোনটা আসবে। ভারত প্রথম থেকেই বাংলাদেশকে সমর্থন করছে কারণ পাকিস্তান ভাঙ্গার চেয়ে ভালো তার জন্য আর কিছুই হতে পারেনা। এবং বাংলাদেশ যদি আওয়ামীলীগের নিয়ন্ত্রণে থাকে তবে সেটা দ্বিগুণ সুবিধাজনক হবে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৬২। ক্ষমাহীন অপরাধ (সম্পাদকীয়) কম্পাস ১০ এপ্রিল, ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৬২, ৬৮৮-৬৯০>

ক্ষমাহীন অপরাধ

সমস্ত ভারত আজ বাংলাদেশ বা পূর্ব বঙ্গের পরিস্থিতি নিয়ে অভূতপূর্ব এক উদ্বেগের মধ্যে প্রকৃত সংবাদের জন্য উদগ্রীব। যে শয়তানি চক্র করে পূর্ব বঙ্গের নেতাদের উপর ও জনসাধারণের উপর এত অতর্কিত পৈশাচিক আক্রমণ করা হয়েছিল, তার পরিণামে কত যে নিরিস্ত্র নিরীহ জনসাধারণের প্রাণ গিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। রাজশানি ঢাকা যে একটি শ্মশানে পরিণত হয়েছে এ সংবাদ আর চারিদিন থেকে বেরিয়ে আসছে। এত বড় ঐতিহাসিক ঘটনাকে চাপা দেয়া সম্ভব না। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, যশোর প্রভৃতি শহরগুলিতে এত মরা এখনো রাস্তায় পড়ে আছে যা এখনো সরানো সম্ভব হয়নি, সরাবার লোক ও নেই। ৫/৬ লক্ষ লোককে হত্যা করা হয়েছে। কোন বড় আকারের যুদ্ধেও এত লোক মরেনা। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে এত বড় হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে। পূর্ব বঙ্গের নবজাগ্রত যুব শক্তির একটা বিরাট অংশকে ওরা হয়ত শেষ করে দিয়েছে।

এতদসত্ত্বেও জল্লাদ ইয়াহিয়া খান ব্যার্থ হয়েছে। এই পাষণ্ড জেনারেলটি মনে করেছিল যে ২/৩ দিনের এক প্রচণ্ড আঘাতেই পূর্ব বঙ্গের মেরুদণ্ড একেবারে ভেঙ্গে ফেলা সম্ভব হবে, এবং সেই প্রচণ্ড অতর্কিত আক্রমণের প্ল্যান নিখুঁতভাবে তৈরি হয়েছিল। প্রতীটি আইন সভার সদস্যদের পেছনে সামরিক গুপ্তবাহিনির চরদের ছায়ার মত অনুসরণ করার ব্যাবস্থা করে। হয়ত এমনও হতে পারে নব নির্বাচিত সদস্যদের বেশিরভাগকেই ঐ ২৫ শের রাত্রিতে ধরে ফেলে এবং হয়ত হত্যাও করে ফেলে। রাত্রির অন্ধকারেই ইউনিভার্সিটি আক্রমণ করে প্রতিটি হলের ঘুমন্ত ছেলেদের নির্বিচারে হত্যা করে এবং অধ্যাপকেরাও রেহাই পান না। আর গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগুণ ধরিয়ে দেয়। তারপরে কত কি পৈশাচিক কর্মকান্ড করে সমস্ত শহরের উপর, পড় পড় কয়েকদিন ও রাত্রি তার বীভৎস বিবরণ ক্রমশ প্রকাশ হবে।

এতদসত্ত্বেও ইয়াহিয়া খান ব্যার্থ হয়েছে। ২/৩ দিন তো দূরের কথা, ২ সপ্তাহ পার হতে চলল, পূর্ব বাংলার নরনারীদের মেরুদণ্ড ভগ্ন করা সম্ভব হয়নি। তাদের প্রাণে আতংক ও ত্রাস সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি। শহরগুলির উপরও সর্বত্র তাদের জুলুমই রাজ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়নি, ক্যান্টনমেন্টগুলিই তাদের হাতে – শহরগুলি হয় এখনো জনগণের হাতে , নয়ত পরিত্যাক্ত উভয়পক্ষে থেকেই। দিনাজপুর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, প্রভৃতি শহরগুলির উপর বোমারু বিমান থেকে বোমা ফেলাতে শত্রুপক্ষের শক্তির পরিচয় প্রকাশ পায়না। উক্ত শহরগুলি যে তাদের এখনো হাতছাড়া, এবং ধ্বংস করা ছাড়া তাদের প্রতিরোধ শক্তি নষ্ট করা সম্ভব নয়, এতে তারই প্রমাণ হয় মাত্র। জনসাধারণ যদি আর একটুও এই প্রতিরোধ বজায় রাখতে পারে, তবে এই যুদ্ধ শীঘ্রই একটা অচলাবস্থায় পরিণত হবে।

জনসাধারণের পক্ষেও কিছু ভুল ধারণা ছিল, তারাও হয়ত মনে করেছিলেন যে একমাত্র জনসমুদ্রের সাহায্যেই ইয়াহিয়া বাহিনীর ঘাটিগুলিকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন – ২/১ সপ্তাহের মধ্যেই। তাড়া লক্ষে লক্ষে প্রাণ দিতেও তাই কসুর করেনি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে প্রবলভাবে সজ্জিত আধুনিক এক বেপরোয়া নির্মম শত্রুপক্ষকে একমাত্র জনসমুদ্রের ঢেউ দিয়েই ভাসিয়ে দেওয়া যায় না, প্রত্যক্ষভাবে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এ সংগ্রামে জয় অর্জন করা সহজ নয়। জনসাধারণ তাই গ্রামদেশ ওঁ নদীনালা জঙ্গল পর্বতের উপরই ক্রমশ নির্ভরশিল হতে বাধ্য হচ্ছে। ২/১ সপ্তাহের সংগ্রাম এ নয়, ২/১ বৎসরের সংগ্রামের জন্যই তাদের প্রস্তুত হতে হবে, এই জ্ঞ্যান ইভিজ্ঞতা থেকেই সঞ্চিত হচ্ছে। যদি এই সংগ্রামকে দীর্ঘায়িত করা যায় হাজার হাজার গ্রামে মাঠে প্রান্তরে নদিতে ছড়িয়ে টেনে বিস্তৃত করা যায়, তবেই শত্রুপক্ষের সাপ্লাই লাইনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে, তাকে জ্বলে কাদাটে পাকে জঙ্গলে কবর দেওয়া সম্ভব হবে।

শত্রুপক্ষই চেয়েছিল একপক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শেষ করতে। কিন্তু যতদিন যাচ্ছে ওঁ যাবে শত্রুপক্ষের বিপদ তত বাড়তে থাকবে। বর্ষা এসে গেলে শত্রুপক্ষের ক্যান্টনমেন্ট ঘাঁটি থেকে বের হওয়াও বিপজ্জনক হবে। ততদিনে জনসাধারণের শক্তির পুনর্গঠন ওঁ পুনর্বিন্যাসের কাজ অনেকটা গুছিয়ে আনা সম্ভব হবে, কেন্দ্রীয় কমান্ড পুনর্গঠিত হবে, ভারত ওঁ পৃথিবীর সাহায্য পাওয়া সম্ভব হবে। তখন, এমনকি ক্যান্টনমেন্ট বা ঘাঁটিতে আবদ্ধ ওঁ আশ্রিত শত্রু সৈন্যদের উপর গ্রাম দেশ থেকে চারিদিক থেকে প্রতি আক্রমণ সংগঠিত করাও সম্ভব হতে পারে। মর্টার জাতীয় আগ্নেয় অস্ত্রের সাহায্যে এই ঘাঁটিগুলিকে চুর্ণ করে দেওয়া অসম্ভব হবে না। আমেরিকার মত একটা সুপার সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকেই যদি ভিয়েতনাম এমন আবদ্ধ ওঁ নাজেহাল হতে হয়, তবে এই ক্ষুদে সাম্রাজ্যবাদীরা ইয়াহিয়া- ভুট্টূ খানেরা কতদিন সে শক্তির মোকাবিলা করতে পারবে?

ততদিনে পৃথিবীর জনমতও সোচ্চার হতে বাধ্য। এত বড় হত্যাকাণ্ড – যে পৃথিবীতে কোথাও ঘটেনি – তার বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া না হয়েই পারেনা। গণতান্ত্রিক পশ্চিমিরা , স্বাধীনতাকামী আফ্রো-এশীয় দেশবাসীরা, সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির রাষ্ট্রসমূহ আজও তেমন সোচ্চার নয় দেখে অবাক না হয়ে পারা যায় না। এইসব দেশের রাষ্ট্রনায়কেরাই তাদের নিজ নিজ ক্ষুদ্র স্বার্থ বুদ্ধির খাতিরে তাদের নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে না, প্রকৃত সংবাদও তাদের নিজ নিজ দেশের লোকদের পরিবেশন করছে না। এইসব রাষ্ট্রের ভীরুতা ওঁ সুবিধাবাদী নীরবতা তদ্দেশীয় জনসাধারণ খুব বেশিদিন সহ্য করবেন, এমন মনে করার কারণ নেই।

সুখের বিষয় বা আশার কথা এই যে, ভারতের সব রাজ্যের সকল জনতা এত বড় হত্যাকাণ্ড ওঁ বিশ্বাসঘাতক তাকে আজ বসদাস্ত করতে প্রস্তুত নয়। ভারতের প্রতি কোণে কোণে তীব্য প্রতিবাদ সোচ্চার হয়ে উঠেছে। পূর্ব বঙ্গের লোকদের সাহায্য করার জন্য প্রাণ কেঁদে উঠেছে। এদেশের সরকারের পক্ষেও তা অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়। প্রাত তিন হাজার মাইল যে সীমান্ত আছে তার এপারে সর্বত্র এদেশের জনসাধারণ পূর্ব বঙ্গের লোকদের প্রাণে মারবার চক্রান্ত ব্যার্থ করবেই। যদি আমাদের কোন রাষ্ট্র বলে শক্তি থেকে থাকে সে রাষ্ট্রের যদি সামরিক কিছু শক্তি থেকে থাকে – তা যদি এত বড় হত্যাকাণ্ডের প্রতিরোধে কোন কাজে না লাগে তবে সে রাষ্ট্রের ওঁ সে সামরিক শক্তির কি প্রয়োজন, মানবতার উপর এমন বিশ্বাসঘাতকতা, গণতন্ত্রের উপড়ে এমন নির্মম আঘাত, আর এত বড় হত্যাকাণ্ড আমাদের হাতের সামনেই ঘটবে, আমাদের হাসখানাও তার প্রতিবাদে বাড়ানো হবে না – এই কি সভ্যতার দায়িত্ব? কোন একটি দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ, বড় বড় শক্তিগুলির অনুমতির জন্য প্রতীক্ষা, রাষ্ট্রসংঘ নামক একটা অপদার্থ নপুংসক প্রতিষ্ঠানের ইচ্ছা অনিচ্ছা ইত্যাদি কোন কিছুর দোহাই দিয়েই আমরা আমাদের মানবিক কর্তব্যকে এড়িয়ে যেতে পারিনা। এ দায়িত্ব এড়ালে রাষ্ট্রসংঘ যাই বলুক, বড় বড় শক্তিমান রাষ্ট্রগুলির ভোয়ে যদি আমরা আমাদের কর্তব্য পালন না করি, তবে আমাদের নিজেদের স্বাধিনিতার কোন ঐতিহাসিক অধিকার থাকেনা, থাকা উচিত নয়। আমাদের রাষ্ট্র যদি কিছু নাও করে ভারতের জনসাধারণের হাতে সে দায়িত্ব গ্রহণ করবে এবং করছে। সেদিন (গত রবিবার) পেট্রোলের সীমান্ত অতিক্রম করে লক্ষ লক্ষ (সত্যি লক্ষাধিক) নরনারী যশোরের সংগ্রামী বাঙালি ভাইদের দেখতে যেভাবে অগ্রসর হয়েছিল, এপারের সীমান্তরক্ষিরা সে জনস্রোতকে বন্ধ করতে সাহস পায়নি। সেই লক্ষাধিক নরনারীরা হাতে কিছু না কিছু সাহায্য খাদ্য বস্তু বস্ত্র তেল ইত্যাদি ছিল। প্রত্যেকে নিজের হাতে সে সামান্য সামগ্রী ওপারের যোদ্ধাদের হাতে হাতে পৌঁছে দেবার সে অপূর্ব দৃশ্য জারাই দেখেছেন তাড়া অভিভূত হয়েছেন। এতে হয়ত সীমান্তের আইন লঙ্ঘন করা হয়েছিল, কিন্তু মানবিকতার চিরন্তন আইন তাতেই রক্ষিত হয়েছিল। আর কিসের আইন? আজকে পূর্ব বঙ্গে কোন রাষ্ট্র আছে, না তার কোন আইন আছে। একদল নরঘাতক দস্যু অকাতরে নিরস্ত্র জনতার প্রাণ হননে ব্যাস্ত সেখানে এ সভ্যতার উপড়ে আক্রমণ এ কোন দেশের কথা নয়। পৃথিবীর সকল মানুষের এখানে দায়িত্ব ও অধিকার আসে।

কিন্তু এখানেও আমরা সবাইকে সতর্ক করে দিতে চাই যে প্রাণ ঢালা উদ্বেল সহানুভূতি দিয়েও ঐ নরঘাতক দস্যুদের ভাসিয়ে নেওয়া যাবে না। ভারতীয় জনসমুদ্রের উদ্বেল এই সহানুভূতি ও ভ্রাতৃত্ববোধকেও সুসংগঠিতভাবে নিয়জিত করতে হবে। বহুরকমের কাজ ও সংগঠনের মধ্য দিয়ে তাকে প্রবাহিত করতে হবে। এই তিন হাজার মাইল ব্যাপী বৃহৎ সীমান্তকে একটি সক্রিয় সুসংগঠিত শক্তি হিসেবে দাঁড় করাতে হবে। বৃহত্তর দায়িত্ব অদূর ভবিষ্যতে দেখা দেবে। পূর্ববঙ্গে দুর্ভিক্ষের অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে – সে সময় নিজেরা না খেয়ে, আধ প্যাঁটা খেয়েও অ্যাডের বাঁচিয়ে রাখতে হবে, ওদের সংগ্রামী শক্তিকে উত্তরোত্তর সক্রিয় করে তুলতে হবে, ওদের মনোবলকে আরও দৃঢ় করতে হবে, একটা দীর্ঘায়ীত সংগ্রামের প্রয়োজনে যাবতীয় জিনিস জুটিয়ে দিতে হবে। প্রকৃত তথ্য পৃথিবীর জনসাধারণের কাছে উপস্থিত করে দিতে হবে। আমরা একাজ যোই করতে পারি, তাতে ভারতও নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে, ভারত একটা শক্তি হিসেবে আবার পৃথিবীতে গ্রাহ্য হবে। যে জাত যত বড় দায়িত্ব নিতে সাহস রাখে, সে জাতই তত বড় হয়। ভারতের আপামর জনসাধারণের প্রাণে আজ সে প্রেরণা উপস্থিত। একে গ্রাহ্য করা, একে সংগঠিত রূপ দেয়াই আজ ভারতীয় নেতৃত্বের একমাত্র কাজ হওয়া উচিত।

– সম্পাদকীয়, কম্পাস, ১০ এপ্রিল ১৯৭১

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৬৩। বাংলাদেশের গণহত্যার ব্যাপক নিন্দা অমৃতবাজার পত্রিকা ১১ এপ্রিল ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৬৩, ৬৯১>

অমৃতবাজার পত্রিকা, ১১ এপ্রিল ১৯৭১
বাংলাদেশের গণহত্যার ব্যাপক নিন্দা

৩ এপ্রিল তারিখে পারুলিয়ায় অনুষ্ঠিত বার এসোসিয়েশনের সভায় সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ, নিরস্ত্র ও গণতান্ত্রিক জনগণের বিরুদ্ধে ব্যাপক আক্রমণের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অযাচিত হত্যা, বৃদ্ধ, যুবতী, নারী ও শিশুদের অমানবিকভাবে হত্যার খবর সারা বিশ্বের মানুষের মাঝে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এসোসিয়েশন পাকিস্তান সামরিক সরকারের কাজের নিন্দা করেছে।

বর্ধমান বার এসোসিয়েশন সম্প্রতি একটি সভায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে যে, ৭০ মিলিয়ন মানুষের মুক্তি আন্দোলনকে থামানোর জন্য একনায়ক সামরিক বাহিনী দ্বারা যে নির্দয় নিপীড়ন ও সন্ত্রাসের শাসন চলছে তা উদ্বেগজনক। তারা ভুক্তভোগী মানুষের প্রতি পূর্ণ আন্তরিক সহানুভূতি এবং সমর্থন প্রকাশ করেন।

বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতির জন্য এই সভায় ভারত সরকারকে আহ্বান জানানো হয়েছে।

বাঁকুড়া সমমিলনী কলেজের শিক্ষক পরিষদ সীমান্তের অন্য দিকের ঘটনার ওপর তার উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং ইয়াহিয়া খান এর সামরিক চক্রের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার নিন্দা জানায়। এটি বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের উপর – যারা কেবল তাদের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে তাদের উপর – পাক-সামরিক বাহিনীর অপরাধকে দৃঢ়ভাবে নিন্দা জানায়।

বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি সাম্প্রতিক এক বৈঠকে বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন। তারা বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় নিন্দা ও জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘনের জন্য নিন্দা জানিয়েছেন।

কৃষ্ণনগর বার এসোসিয়েশন পশ্চিম পাকিস্তানে সামরিক জান্তা কর্তৃক বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণের ওপর অসমর্থিত ও অহংকারী আক্রমণের বিষয়ে সর্বসম্মতিক্রমে গভীরতর উদ্বেগ ও নিন্দা জ্ঞাপন করে। পশ্চিমবঙ্গের সামরিক শাসকদের দ্বারা অব্যাহতভাবে নিরীহ জনসাধারণের উপর করা অন্যায়ের সর্বাত্মকভাবে নিন্দা জানান এবং বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি দিতে ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৬৪। রাজশাহী যুদ্ধের প্রত্যক্ষ বর্ণনা হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড ১২ এপ্রিল, ১৯৭১

Zulkar Nain
<১৪, ২৬৪, ৬৯২-৬৯৪>

হিন্দুস্তান স্টান্ডার্ড, এপ্রিল ১২, ১৯৭১
রাজশাহী যুদ্ধের প্রত্যক্ষ বর্ণনা
রবার্ট কেইলর

রাজশাহী, ১১ই এপ্রিল। বাইরের জগতে পৌঁছানো ইঙ্গিতগুলি থেকে বুঝা যায়, এখানে বেঁচে থাকার সংগ্রামটি পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে অন্যত্র পরিচালিত যুদ্ধগুলির একটি ভাল উদাহরণ।

শহরে, ঢাকা শহরের ১৯০ মাইল উত্তর-পশ্চিমের ১০০,০০০ জনের একটি কর্মব্যস্ত ব্যবসায়িক কেন্দ্র এখন বাংলাদেশের “মুক্তি বাহিনী”। তারা তাদের মাতৃভূমিকে মুক্ত করার সংকল্পে দৃঢ়, কিন্তু সংগঠন, অস্ত্র, যোগাযোগসহ যুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য যেগুলো লাগে তার সবকিছুতেই দুর্বল।

পশ্চিম পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর বাকি অংশটি শহরের উত্তরের প্রান্তে অবস্থিত একটি সামরিক ঘাঁটিতে অবস্থিত। তারা আধুনিক অস্ত্র এবং আকাশপথ সাহায্যসহ একটি সংগঠিত যুদ্ধের অংশ। তবে, এখন তারা প্রতিকূল জনসংখ্যা বেষ্টিত এবং সরবরাহ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পড়ে আছে।

শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগের সমর্থকদের কাছ থেকে নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তর করার জন্য সেনাবাহিনী যখন ২৫ ও ২৬শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় সব জায়গায় যুদ্ধ করেছিল তখন এটি এখানেও ছড়িয়ে পড়ে।

সেই সময় থেকে কত লোক মারা গেছে কেউ জানে না। রাজশাহীতে মুক্তিবাহিনীর নেতারা ধারণা করেন ৩,০০০ থেকে ৪,০০০ পূর্ব পাকিস্তানিদের হত্যা করা হয়েছে। বেশীর ভাগ মৃত্যু ঘটেছে আশেপাশের গ্রামে যেখানে সৈন্যরা হামলা চালিয়েছে এবং বিমান আক্রমন করছে।

অন্য দিকে, মুক্তিকামী নেতারা বলছেন যে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় ২০০ সৈন্য নিহত হয়েছে, যাদের বেশিরভাগকে কয়েকজন গ্রামবাসী ঘিরে ধরেছিল, যাদের ক্লাব, ইট ও পাথর ছাড়া কোন অস্ত্র ছিল না।

স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা তাসাদ্দেক হোসেন বলেন, “তারা অসহায় ও নির্যাতিত ছিল এবং তারা তাদের জীবনের চিন্তা না করেই সৈন্যদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং তাদের হত্যা করেছিল”।

গত বুধবার যখন শহরে থাকা সেনাদল তাদের অবস্থান সুসংহত করার জন্য শহরের এক মাইল উত্তরে অবস্থিত ক্যান্টনমেন্টে থাকা সৈন্যদের কাছে যায়, তখন মুক্তিবাহিনী রাজশাহী দখল নেয়।

এটা একটা ভুতের শহর, দোকানপাট বন্ধ ও তালাবদ্ধ। বস্তুত জনসংখ্যার সব চলে গেছে, যাদের বেশীরভাগ গ্রামে এবং প্রায় ১০,০০০ আশেপাশে ভারতীয় সীমান্তের পাড়ি দিতে গেছে।

রাস্তায় সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা বহনকারী জীপগাড়ি গুলোই একমাত্র মোটর চালিত যানবহন। কিছু দুই চাকার রিক্সা আছে কিন্তু যাত্রীর অভাবে চালকগুলো বিচ্ছিন্নভাবে রাস্তার কোণে জড়ো হয়।

অন্যত্রের মত, অনেক দোকান এবং ব্যবসা পশ্চিম পাকিস্তানিদের মালিকানাধীন ছিল, যাদের সবাই দৃষ্টিসীমা থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। এক মুক্তিকামী নেতা আমাকে বলেছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানিদের আটকে রাখা হচ্ছে, কিন্তু রাস্তার “স্বাধীনতা যোদ্ধাদের” একজন ভিন্নকথা বললো।

সে বলেছিল, “আমরা “সালামারদের” ধ্বংস করে দিয়েছি যারা সেনাবাহিনীকে সমর্থন দিয়েছিল এবং জিনিসপত্র সরবরাহ করেছিল”। যুদ্ধের শুরুতে রাজশাহীতে কতজন পশ্চিম পাকিস্তানি ছিল সেটা জানা ছিলনা।

মুক্তি নেতারা বিশ্বাস করেন যে, দুই মাইল বর্গক্ষেত্রের ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে, কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা ভবনগুলোর একটি এলাকা, প্রায় ৩০০ সৈন্যদল মোতায়েন রয়েছে। ক্যাম্পের চারপাশে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নেয়।

প্রতিরোধ

শহরে প্রতিরোধী যোদ্ধাদের দল গড়ে ওঠার দুদিন আগেই তারা ভিতরে ঢুকে পড়ার চিন্তা করে এবং ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসা সাদা পতাকাবাহী সৈন্যদের একটি দলের সাথে সামনে এগিয়ে যায়। তাদের মধ্যে কয়েকজন অস্ত্র বহন করছিলো, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা দৃশ্যত প্রত্যাশাই করেনি যে পাকিস্তানিরা তাদের ব্যবহার করবে।

তাদের পরিচয় প্রকাশ পাওয়া মাত্রই মেশিন গান চালানো হয়। মুক্তি নেতারা বলেছিল, এই ঘটনায় হতাহতদের সঠিক পরিমান পাওয়া যায়নি, কিন্তু ক্ষতির পরিমাণ অত্যধিক বলে বর্ণনা করেছেন।

মুক্তি নেতারা বলছে, সেনানিবাসে তিন ইঞ্চি মর্টার এবং অন্যান্য ভারী অস্ত্র রয়েছে। তবে তাদের উপর গুলি চালায়নি বরং মনে হচ্ছে তারা তাদের গোলাবারুদ সংরক্ষণ করছে। সৈন্যরা আশ্রয় খাদ খনন করার খবর পেয়েছে। মুক্তিবাহিনী সেনাক্যাম্পে যাওয়া জিনিসপত্র এবং পানির লাইন কেটে দিয়েছে।

যখন আমি এলাকা পরিদর্শন করেছিলাম, রাজশাহীর আকাশে কোন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর কোনও বিমান ছিল না, তবে চারপাশের এলাকায় তাদের বিমান হামলার প্রমাণ দেখা যাচ্ছিল।

শহরের দিকে যাওয়া প্রধান সড়ক জুড়ে একটি ট্রাক পড়ে আছে, এবং ৫০ ক্যালিবার কামানের গুলিতে গাড়ির টায়ার ঝাঁঝরা হয়ে ছিটকে বেরিয়ে পড়েছে। কামনটি বহন করছিলো ঢাকায় অবস্থিত সেনাঘাঁটির সামরিক বিমান এফ৮৬ যা যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি। গ্রামবাসীরা জানান, চালক পালিয়ে যায় কিন্তু রাস্তায় থাকা একজন বৃদ্ধ মহিলা হামলায় নিহত হয়।

পাশের আরেকটি গ্রামে, একটি মাটির দেয়ালের মসজিদে পেট্রোল বোমা দিয়ে হামলা করা হয়। দেয়ালগুলি দাড়িয়ে থাকলেও কালো হয়ে গেছিলো এবং কাঠের দরজা ও কুরান সহ ভিতরের সবকিছু আগুনে পুড়ে দগ্ধ হয়ে গেছিলো। মসজিদে এক ব্যক্তি নিহত এবং তিনজন আহত হয়েছিল।

বিমান হামলা

মুক্তি নেতারা বলেছিল, বিমানগুলি এক গ্রামের একটা বাজার এবং গঙ্গার তীর জুড়ে আক্রমন চালায় যেখানে বেসামরিক লোক ভারতে প্রবেশের জন্য জড়ো হয়। নদীরটার তীর কয়েক মাইল বিস্তৃত।

প্রতিরোধকারী সদস্যরা বলেছিল, দু চারটি সৈন্যদল নিয়ে বিমানগুলি প্রায়ই দিনে দুইবার আসে। তারা বলেছিল, বিমানগুলির সামনে প্রায়ই একটা হেলিকপ্টার থাকে যেটা লক্ষ্য খুজে বের করে।

সেনা বিমানগুলো শহরের ভিতরে আঘাত করেনি, কিন্তু আঘাত হানে শহরের বাইরের লক্ষ্যবস্তুতে যার বেশিরভাগ গ্রামে অবস্থিত যেগুলোর কোন সামরিক তাত্পর্য আছে বলে মনে হয়নি।

শনিবারে কোনও বিমানের চিহ্ন না থাকলেও, রাইফেল বহনকারী প্রতিরোধী সদস্য, যে আমাকে কালো পতাকাবাহী একটি সবুজ সেডানে করে শহরে নিয়ে আসে, কোন ঝুঁকি নেয়নি।

এক সপ্তাহ ধরে জন্মানো দাড়িতে তার চোয়াল আবৃত ছিল এবং তার চোখ ছিল রক্তাক্ত। আমি যখন তাকে জিজ্ঞেস করি যে কখন বিমান হামলা ঘটেছিল সে বললো, “আজ কি বার সেটাও আমি মনে করতে পারছিনা”। “দিন ও রাত উভয় সময় সে এতটাই কাজ করেছে” – ইউপিআই

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৬৫। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তিন হাজার সৈন্য নিহত হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড ১২ এপ্রিল ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৬৫, ৬৯৫>

দি হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, ১২ এপ্রিল ১৯৭১
মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তিন হাজার সৈন্য নিহত

নয়াদিল্লি, এপ্রিল – শেখ মুজিবুর রহমানের অনুগতদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান চালানোর সময় প্রায় ৩০০০ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়েছে।

তাদের আনুমানিক ৭০০০০ সৈন্যের প্রায় ৫ শতাংশ এই ধরনের ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হল।

নিহতদের পাশাপাশি পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর একটি বড় সংখ্যা মুক্তিবাহিনী কর্তৃক বন্দী হয়েছে বা নিখোঁজ রয়েছে বলে এই সূত্রটি জানিয়েছে। ছয় কর্মকর্তা সহ ১০৯ জন পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তা ভারতে আশ্রয় নিয়েছে, এই সূত্র যোগ করেছে।

সীমান্তে পাওয়া নির্ভরযোগ্য রিপোর্ট অনুযায়ী কুমিল্লার পাকিস্তান ক্যাম্পে আক্রমণ হয়েছে জানা গেছে।

পাকিস্তানের সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মোশাররফ হোসেন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কয়েকবার দেখা করতে যাচ্ছেন।

মুক্তি বাহিনী সূত্রগুলো সন্দেহ করছে যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তা ও লোকেরা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বলতে পারে যে তারা যথেষ্ট লড়াইয়ের শিকার হয়েছে।

মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা শনিবার চাঁদপুর ও কুমারের মধ্যে হজীগানের কাছে একটি বড় পাকিস্তানি বাহিনীকে ধরে নিয়ে যায়। সেখানে পিছু হটে যাওয়া পাকসেনাদের ১৩০ টি বাহন থেকে বিপুল সংখ্যক অস্ত্র ও গোলাবারুদ জব্দ করে ।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৬৬। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশঃ
নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ঃ তাজউদ্দীন প্রধানমন্ত্রী যুগান্তর ১৩ এপ্রিল, ১৯৭১

Kamol Roy
<১৪, ২৬৬, ৬৯৫>

স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ মুজিবের নেতৃত্বে নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ঃ
তাজউদ্দিন প্রধানমন্ত্রী

আগরতলা ১২ই এপ্রিল (পি টি আই)- আজ সার্বভৌম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ সাধারণত গঠিত হয়েছে। মুক্ত বাংলাদেশের কোন এক স্থান থেকে এই রাষ্ট্র গঠনের কথা ঘোষনা করা হয়। এই সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের নবগঠিত মন্ত্রিসভার সদস্যদের নামও ঘোষিত হয়েছে। বর্তমানে এই মন্ত্রিসভাই সমরকালীন মন্ত্রিসভারূপে কাজ করবেন।

বাংলাদেশের কোন এক স্থান থেকে একজন বিশিষ্ট আওয়ামী নেতা এই খবর ঘোষনা করেন। এই নবগঠিত রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমান।

জানা গেছে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শ্রী তাজউদ্দীন আহমেদ প্রধানমন্ত্রী এবং শ্রী খোন্দকার মুস্তাক আহমেদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছেন।

সীমান্তের ওপার থেকে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য সূত্রে এই স্মরণীয় সংবাদটি পাওয়া গেছে।
মন্ত্রিসভার পূর্ণ তালিকা নিম্নরূপঃ-
১। শেখ মুজিবর রহমান- রাষ্ট্রপতি,
২। সৈয়দ নজরুল ইসলাম – উপ- রাষ্ট্রপতি,
৩। তাজউদ্দীন আহমেদ- প্রধানমন্ত্রী,
৪। খোন্দকার মুস্তাক আহমেদ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী,
৫। ক্যাপ্টেন মনসুর আলি ও
৬। এই এইচ কামারুজ্জামান।

এর দ্বারা বর্তমানের অস্থায়ী সরকার বাতিল বলে গণ্য হল।

জাতীয় সভায় এবং আওয়ামী লীগের সদস্যদের এক যৌথ সভায় এই সাধারণতন্ত্র ও সরকার গঠনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বাংলাদেশের কোন এক স্থানে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

ঘোষণা করা হয়েছে, বর্তমান মন্ত্রিসভাই যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভারূপে কাজ করবেন এবং পাকিস্তানী আগ্রাসীদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করবেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৬৭। বাংলাদেশ মিশনের যাত্রা হিন্দুস্তান টাইমস ১৩ এল্রিপ ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৬৭, ৬৯৭>

হিন্দুস্তান টাইমস, ১৩ এল্রিপ ১৯৭১
দিল্লির মিশনের যাত্রা, জাতিসঙ্ঘ

আগরতলা, ১৩ ই এপ্রিল (ইউএনআই) – বাংলাদেশ সরকার একটি চূড়ান্ত সনদ প্রকাশ করেছে যা নতুন প্রজাতন্ত্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করবে – সরকারের নিকটবর্তী সূত্র থেকে আজ রিপোর্ট করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে একটি বিশেষ অভিযান নয়াদিল্লি থেকে বিশ্বের অন্যান্য রাজধানী এবং জাতিসংঘের কাছে যোগাযোগ করবে। মিশন আজ সকালে তার সদর দপ্তর শুরু করে।

স্বাধীন বাংলার রেডিও সম্প্রচারে সরকার ভারত, সিলোন এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশগুলিকে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি দিতে ও এর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করার আহ্বান জানায়।

স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ৭৫ মিলিয়ন মানুষকে প্রয়োজনীয় সহায়তার জন্য গণতান্ত্রিক দেশগুলির কাছে সম্প্রচারের একটি আপিলও ছিল।

স্বাধীনতা ঘোষণার পর বাংলাদেশ সরকার মুক্ত এলাকাগুলিতে জনগণের নির্দেশনার জন্য একটি নির্দেশনা জারি করেছে।

স্বাধীন বাংলা রেডিওতে সম্প্রচারিত নির্দেশাবলী হল:
(১) সকল আহত ব্যক্তিদেরকে ডাক্তার ও কবিরাজের কাছে নিয়ে যান যারা তাদের কাছে উপস্থিত হবে।
(২) যারা বিপ্লবকে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তাদের শাস্তি দাও।
(৩) আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের কাছ থেকে নির্দেশনা নিন।
(৪) সকল যুবককে মুক্তিবাহিনী কমান্ডের কাছে রিপোর্ট করতে হবে
প্রশিক্ষণ এবং আদেশ মানতে হবে।
(৫) সকল গ্রামপ্রধান নিকটবর্তী নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতে হবে, তাদের সবকিছু অবগত করতে হবে।
(৬) মুক্ত এলাকাগুলিতে সরকারী কর্মকর্তাদের স্থানীয়দের আওয়ামী লীগের সদর দপ্তরের কাছ থেকে আদেশ গ্রহণ করতে হবে।
(৭) নদী স্টিম ন্যাভিগেশন সেবার কর্মীদের রেডিও পাকিস্তান, ঢাকার নির্দেশনা মান্য করা উচিত নয় – তারা শুধু বাংলাদেশ সরকারের আদেশ মানবে।

(৮) আপনার এলাকার মুক্তি বাহিনীর কমান্ডের নির্দেশে বেসামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অনুসরণ করুন।
(৯) আপনার এলাকার সন্ত্রাসী চরিত্রের বিষয়ে সতর্ক থাকুন এবং সেরকম কিছু জানার সাথে সাথে আপনি আপনার এলাকার নিকটবর্তী মুক্তি বাহিনীকে রিপোর্ট করুন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৬৮। চিনা প্রতিক্রিয়া ভারতের জন্য হুমকি অমৃতবাজার পত্রিকা ১৪ এপ্রিল ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৬৮, ৬৯৮- ৬৯৯>

অমৃতবাজার পত্রিকা, ১৪ এপ্রিল ১৯৭১
চিনা প্রতিক্রিয়া ভারতের জন্য হুমকি

নয়া দিল্লি, ১৩ এপ্রিল, চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ইয়াহিয়া খানকে এক বার্তায় বলেছেন পূর্ববাংলায় পাকিস্তানের সামরিক কর্মকে তিনি সমর্থন করেন এবং চীন এর সর্বাত্মক সাহায্য বজায় থাকবে। এটি ভারতের জন্য হুমকি বলে এখানকার পর্যবেক্ষকরা মনে করেন।

সরকারি সূত্র অবশ্য জানিয়েছে ইন্দো-চীন সীমান্ত বরাবর কোন সেনা সমাবেশ দেখা যায়নি।

সরকারি সূত্র গতকাল বার্তা সম্পর্কে মন্তব্য করতে রাজি হননি কিন্তু চীন সম্পর্কিত পর্যবেক্ষকরা মনে করেন এতে করে ভারতবিরোধী ইস্যুতে ইসলামাবাদের মনোবল বাড়বে। চীনা মনোভাব একটু উগ্র হলেও পূর্ববাংলার ইস্যুতে ইন্দো-পাকিস্তান অবস্থানে চীন সরাসরি জড়িত নয়।

পর্যবেক্ষকরা হয়েছেন যে চীনের নেতৃত্ব ও প্রেস পোল্যান্ডের কমিউনিস্ট নেতৃত্বকে সমালোচনা করেছে এবং সেখানে মিস্টার গমুল্কার উৎখাতে ভূমিকে রেখেছে সেই চীন ভারতকে দায়ী করেছে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলানোর জন্য।

সরকারী সূত্র প্রত্যাখ্যান করেছে যে ভারতের পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলানোর কোন লক্ষ্য ছিলোনা। ভারত আন্তর্জাতিক আচার মেনেই তাদের সাথে সম্পর্ক রেখেছে।

পর্যবেক্ষকরা বলেন ‘জনগণের’ সরকার চীন পূর্ববাংলায় একটি সংখ্যালঘু সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে সেখানকার ‘জনগণের’ আন্দোলনের প্রতি সামান্যতম সহানুভূতি দেখাচ্ছেনা।

এদিকে, চীনা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য জনাব জেড এ ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টির একজন মুখপাত্র আজ স্বাগত জানান।

রেডিও পাকিস্তান পিপিপির তথ্য সচিব মাওলানা কাউসার নিয়াজীর বরাত দিয়ে বলেন যে তিনি লাহোরে জনাব চৌ এর বিবৃতির পরিপ্রেক্ষিতে বলেছেন – চীনের বিবৃতি ভারতের জন্য একটি সতর্কবাণী যাতে তারা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে এবং “এ অঞ্চলের শান্তি জন্য একটি গ্যারান্টি-স্বরূপ।”

তিনি দাবি করেন যে, জনাব চৌ এর বক্তব্যের সঙ্গে “ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় থাকল।”

নিরপেক্ষ

চীনা বিষয়ক ইউরোপীয় বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বিশ্বাস করেন যে চীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে “নিরপেক্ষ’ অবস্থান নিয়েছে। খবর এ এফ পি প্যারিস থেকে।

এই বিশেষজ্ঞদের মত ভারত এবং পাকিস্তানের প্রেসের থেকে ভিন্ন। এমনকি সরকারী ভাবেও দুই দেশ থেকেই বলা হয়েছে পূর্ব বাংলা ইস্যুতে চীন ইসলামাবাদের পক্ষ নিয়েছে।

কিন্তু আসলে, গতকাল রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানকে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই পাঠানো টেলিগ্রামটি আংশিক প্রকাশিত হয় যেখানে দেখা যায় তিনি বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে নয় বরং ভারতকে আক্রমণ করেই কথা বলেছেন।

চীনের বক্তব্যে ভারতের তার অবস্থান পরিবর্তনের কোন অবস্থা নেই। চৌ এর ব্যাপারটা এমন যে একজন ডাক্তার হৃদরোগীকে বলছেন, চিন্তা করবেন না, আমি আপনার লিভার ঠিক করে দেব।

পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে চুপ থাকতে গিয়ে চীন তার ভারত-বিদ্বেষ প্রকাশ করে ফেলেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে এটি শুধুমাত্র চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে ঐতিহ্যগত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে নয়। সমস্যা শুরু হয় যখন ভারত পাকিস্তান সংকটে চীনের কাছে না গিয়ে শুধুমাত্র ওয়াশিংটন ও মস্কোর কাছে গিয়েছে। (পিটিআই)

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই এর ইসলামাবাদের প্রতি দৃঢ় সমর্থন এবং ভারতের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করার অঙ্গীকার সত্ত্বেও এতে তেমন কোন বিপদ হবেনা বলে ধারনা করছেন।

শিরনাম সূত্র তারিখ
২৬৯। কুমিল্লায় মুক্তিফৌজের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ অমৃত বাজার পত্রিকা ১৫ এপ্রিল ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৬৯, ৭০০-৭০১>

অমৃত বাজার পত্রিকা
১৫ এপ্রিল ১৯৭১
কুমিল্লায় ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মুক্তিফৌজের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ
উত্তরবঙ্গে কুষ্টিয়ায় পাক আর্মির বিমান আক্রমণে প্রচুর ধ্বংসযজ্ঞ

আগরতলা, ১৪ এপ্রিল, – কুমিল্লায় মুক্তিফৌজ একটি দুর্গ ঘিরে ফেলেছে – দেরি হয়ে যাবার আগে তারা সেখানকার সাপ্লাই লাইন ধ্বংস করতে চায়। পাকসেনারা সেখানে আজ তীব্র আক্রমণ করে। তারা গোমতী নদী দিয়ে আক্রমণ চালিয়ে বাংলাদেশের পূর্ব অঞ্চলের সাথে যোগাযোগের মূল সংযোগ আখাউরা- ব্রামনবাড়িয়া সাব সেক্টর রক্ষার চেষ্টা করে। – রিপোর্ট ইউ এন আই।

তিন কোম্পানি পাকিস্তানি সেনার সাথে পাকিস্তান এয়ার ফোর্স এর চারটি বিমান যোগ দেয়। তারা কসবা সহ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তীব্র বোমাবর্ষন করে।

উত্তর সেক্টরে লিবারেশন ফোর্স দিনাজপুর শহরে শক্ত অবস্থান নিয়ে আছে। সেখানে গত রাতে তারা একটি যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের ভারী ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে।

বৈমানিক আক্রমণ মনে হচ্ছে নতুন যোগ হয়েছে। কারণ স্থলপথে জলা গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশে যুদ্ধবিগ্রহের অভিজ্ঞতা এই বাহিনীর সামান্য। তাই হয়ত এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে।

পূর্ব সেক্টরে পাকিস্তানের হামলা দেখা যায়। তারা গুরুত্তপূর্ন আখাউড়া রেলওয়ে জংশন যা মিটার গেজ দিয়ে বন্দর নগরী চট্টগ্রামের শাহে যুক্ত সেটা রক্ষা করতে চাইছে। জংশনটি যুদ্ধ শুরুর থেকে এখন পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর দখলে।

পাকিস্তানের কৌশল দৃশ্যত ঢাকা ভিত্তিক। তারা মুক্তিফৌজকে সিলেট ময়মনসিংহ অঞ্চলে নিবন্ধ রাখতে চেষ্টা করবে।

এটাকে বলা হচ্ছে “অপারেশন ঢাকা”। ঢাকা থেকে ১৮ কিলোমিটার অদূরে – সাভারে – আজ সকালে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের উপর ব্যাপকভাবে ঝাঁপিয়ে পরে।

কুষ্টিয়া জেলা শহর বাংলাদেশ বাহিনীর দখলে। ভয়েস অব এমেরিকার মতে তাদেরকেও পাকিস্তান বিমান বাহিনী ও আর্টিলারি আক্রমণ করেছে।

পাকিস্তানি সৈন্যরা ভেড়ামারা, কামার খালি এবং শিলাইহদ এলাকা থেকে বিতাড়িত হয়েছে। বিমান বাহিনীর ভারী বোমা বর্ষোন সত্ত্বেও মুক্তিবাহিনী গোয়ালন্দে তাদের দখল বজায় রেখেছে।

নগরবাড়িতে ১৫০ জন পাকিস্তানি সৈন্য মুক্তিবাহিনী ঘিরে রেখেছে বলে রিপোর্ট করা হয়।

এমনকি মুক্তিফৌজ মুক্ত এলাকায় একত্রিত হচ্ছে – সদ্য ঘোষিত বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক কাজ চালানোর জন্য তারা পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তার সমাধানে আজ সাত দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।

এইগুলি হল:
১. কোন আক্রমণ থেকে মুক্ত এলাকাকে রক্ষা করা।
২। মুক্ত অঞ্চলে সঠিক ভাবে বেসামরিক প্রশাসন চালাতে হবে – উন্নয়ন কাজ, শিল্প ও কৃষি উভয় ক্ষেত্রে উৎপাদনশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করতে হবে।

৩. স্বাভাবিক কাজ শুরু করার চেষ্টা করতে হবে। স্কুল চালাতে হবে, অফিস এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাঙ্ক পুনরায় শুরু করার চেষ্টা করতে হবে।

৪. বলিষ্ঠতার সাথে শত্রু অধিকৃত এলাকায় যুদ্ধ চালিয়ে যান।
৫. অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, সরকার কিছু প্রতিবেশী বন্ধুপ্রতিম দেশের সঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্য শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
৬. স্বর্ণমানের অভাবে কিছু বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মুক্ত বাণিজ্য চালানো হবে। ট্রেড সরকারের কিছু সংস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে যাতে মানুষ সঠিক পদ্ধতিতে সব পায়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৭০। তাজউদ্দীন কর্তৃক মুক্ত এলাকা গঠন ও কমান্ডার নিয়োগ অমৃতবাজার পত্রিকা ১৫ এপ্রিল ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৭০, ৭০২-৭০৩>

অমৃতবাজার পত্রিকা. এপ্রিল ১৫, ১৯৭১
তাজউদ্দীন কর্তৃক মুক্ত এলাকা গঠন ও কমান্ডার নিয়োগ

জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বুধবার তার দেশে মুক্ত অঞ্চল ঘোষণা করেন এবং নিজ নিজ স্থানীয় কমান্ডার যারা সেখানে অপারেশনের দায়িত্বে থাকবে তাদের মনোনীত করেন।

ফ্রী বাংলা বেতার কেন্দ্রে জনাব আহমেদ একটি সম্প্রচারে বলেন যে মেজর খালেদ মোশাররফ সিলেট ও কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের দায়িত্বে থাকবেন যিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। চট্টগ্রাম- নোয়াখালী এলাকায় EBR এর মেজর জিয়াউর রহমান দায়িত্ব পালন করবেন। চট্টগ্রামে সীমিত স্থানে প্যাকেট আকারে শত্রুদের অবস্থান।

EBR এর মেজর সাইফুল্লাহ ময়মনসিংহের টাঙ্গাইল এলাকার দায়িত্বে থাকবেন। ইপিআর এর মেজর এম এ ওসমান দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের খুলনা, কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুর, বরিশাল ও পটুয়াখালীর বিমুক্ত এলাকায় কমান্ড গ্রহণ করবেন।

জনাব আহমেদের মতে শত্রুরা এখন যশোর ক্যান্টনমেন্ট ও খুলনা শহরের কিছু অংশে সীমাবদ্ধ । উত্তরাঞ্চলে ইবিআর এবং ইপিআর একত্রিত হয়ে রংপুর ও সৈয়দপুর শত্রু অবস্থানের খারাপ একটি জায়গা দখল করে।

তিনি বলেন, একটি পূর্ণাঙ্গ অপারেশন বেস স্থাপন করা হয়েছে বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার এর পক্ষ থেকে যা সমস্ত দেশের কার্যক্রম পরিচালনা করবে। একটি অন্তর্বর্তীকালীন রাজধানী পশ্চিম জোনে অবস্থিত । পূর্ব অঞ্চলের জন্য পূর্ণ প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সিলেটের কুমিল্লা জোনের আঞ্চলিক ইউনিট দেয়া হয়েছে।

জনাব আহমেদ বাঙ্গালীদের গৌরবময় সংগ্রামে সফলতার জন্য বাংলাদেশের বীর জনগণকে অভিনন্দন জানান। যা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত।

তিনি বলেন, জনগণ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র সহ যা কিছু আছে তাই দিয়ে তারা শত্রু প্যারাট্রুপারদের, কমান্ডো এবং এজেন্ট দের মোকাবিলা করবে। তারা রাস্তা, জলপথ কেটে বুবি ট্র্যাপ সেট করবে। এমনকি অনিয়মিতরাও একটি সুশৃঙ্খল নিয়মিত বাহিনীর মত লড়াইয়ের শক্তি হিসেবে কাজ করা উচিত বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন এখন এমন একটি সময় যখন দেশের সাড়ে সাত কোটি লোকের দল মত নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সেইসাথে প্রশাসনিক ও পুনর্গঠন কাজের জন্য ঐক্য বদ্ধ হতে হবে। ভয় পেয়ে পিছু হটলে এখন আর চলবে না।

জনাব আহমেদ বলেন দৃশ্য যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থার কথা মাথায় রেখে দেশবাসীকে পরম কঠোরতার সাথে নিরীক্ষা ও মজুদ এবং কালোবাজারি এড়িয়ে চলতে হবে । অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার চর্চা করতে হবে।

জনগণের চূড়ান্ত বিজয় এর উপর আস্থা স্থাপন করে জনাব আহমেদ বলেন শত্রুদের যার সরবরাহের লাইন কার্যত বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে এবং তাদের মনোবল ধ্বংস হয়েছে ।

তিনি বলেন, “ইতিমধ্যে বিশ্ব সম্প্রদায় বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির নোট গ্রহণ করেছে। এটা এখন একটি আন্তর্জাতিক ইস্যু এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরা শীঘ্রই বিদেশী দেশ সফর করবে এবং কূটনৈতিক স্বীকৃতি ও মনোযোগ চাইবার জন্য।

বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানের ধ্বংসাবশেষের উপর নতুন জাতির পুনর্গঠন এবং পুনর্নির্মাণ কাজটি এগিয়ে নিয়ে যাবে। (পিটিআই)।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৭১। সাপ্তাহিক ফ্রন্টিয়ার পত্রিকার একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ ফ্রন্টিয়ার ১৭ এপ্রিল ১৯৭১

Masroor Ahmed Makib
<১৪, ২৭১, ৭০৪-৭০৫>

সাপ্তাহিক ফ্রন্টিয়ার পত্রিকার একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ
সুত্রঃ ফ্রন্টিয়ার
তারিখঃ ১৭ই এপ্রিল ১৯৭১ ।
সম্পাদকীয়ঃ দ্যা ফ্যামিলিয়ার প্যাটার্ন ।

মার্চে অনেক চিত্রই পাল্টে গিয়েছে । ভারতে ছিলো ইন্দিরার আকশচুম্বি জনপ্রিয়তা , যা ছিলো কিছুটা ভিন্নমাত্রার । ১৮ই মার্চ ছিলো প্যারিস প্রজাতন্ত্র খ্যাত এক বিখ্যাত বিদ্রোহের শততম বার্ষিকী । এই ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লাউস আক্রমণের পরাজয়ের একটি ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে , কিন্তু তার আগে বিশ্বের সকলেই আমেরিকান শক্তির পরাজয়ের তীব্রতা এবং তাত্পর্য অনুমান করতে সক্ষম হয়েছিল । রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান তাঁর পূর্ব পাকিস্তানে তার সৈন্যবাহিনীকে মোতায়েন করেছেন । আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ প্রচলিত উপায়ে সমস্যা সমাধানের জন্য প্রস্তুত কিন্তু রক্তপাতের জন্য নয় । বাংলাদেশীদের মধ্যে যে সাহসী ও অসম সংগ্রামের স্ফুলিঙ্গ তৈরি হয়েছিলো সেটাকে তুলনা করা যায় সিরমানভো বাঁন্দারানায়েকের নেতৃত্বে সিলন সরকারের নেয়া “সন্ত্রাসীদের” বিরুদ্ধে পদক্ষেপ যেটাতে কতগুলি নিহত হয়েছে তা এখনো জানা যায়নি।আবারও এটা স্পষ্ট যে, এই ধরনের সরকারগুলো কোন ধরণের সমাজতন্ত্রের আদর্শে প্রভাবিত হয়ে শপথ গ্রহণ করে এবং সাম্রাজ্যবাদী ও সমাজতান্ত্রিক দুনিয়াতে নিজেদের শ্রেষ্ঠ করে তোলে । বিদ্রোহী বা বিপ্লবী বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্রাজ্যবাদীদের কৌশল হলো বিখ্যাত আমেরিকান কৌশল যা তারা এই শতাব্দিতে ইন্দোচিন থেকে পাওয়া আমেরিকান অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছে যে দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম এড়িয়ে চলতে হবে। আন্দোলন যখন শুরু হতে থাকবে তখনি সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করো ।এই হল ব্লিটসচরিগ এর মতবাদ যা পূর্ববঙ্গে ইয়াহুয়ার ইয়াহিয়া যোদ্ধা এবং সিলেনিয়ান বাহিনী গ্রহণ করেছে , আর যখন ভারতবর্ষে এসব ঘটে চলেছে তখন কিছু অসাধু সংবাদপত্রের মাধ্যমে মিথ্যা সংবাদে মানুষকে ধোকা দেয়া হচ্ছে ।

শাসকগোষ্ঠীর দরকার তড়িৎ জয়লাভ । যদি একটি নিরস্ত্র ও অনভিজ্ঞ ব্যক্তিরা যুদ্ধ করে, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বিজয় ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়, এরচেয়ে বেশি স্বাগত আর কিভাবে জানানো যেতে পারে! এর ফলে হত্যাকাণ্ড এবং দারিদ্র্যতা কম হবে । কে চায় মানুষ নারী ও শিশুদের দিনের পর দিন গৃহহীন বা জবাই করা দেখতে ? কিন্তু জনগণের জন্য এই ধরনের বিজয় একটি অলৌকিক ঘটনা হবে। অলৌকিক ঘটনা সাধারনের জীবনে আসেনা ।এটা অনেক দূরের পথ যেখানে আবার পূর্ব বাংলার কবিরা গভীর রাতে লিখতে পারবেন গাছের পাতায় পরা বৃষ্টির শব্দ নিয়ে কবিতা ।

এটা কোনও বিষয় নয় যে আমাদের নেতারা এবং আমাদের সংবাদপত্র জানবে না পশ্চিমবঙ্গে কি থেকে কি হচ্ছে । পত্রিকার হেডলাইনে প্রতিদিনের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে সৈন্যরা এই বা সেই শহরে নিয়ন্ত্রন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করছে । তারপর সৈন্যরা পর মনে করে যে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ব্যর্থ হয়েছে এবং ভারতের ঐক্যবদ্ধ ঐক্যের হুমকি হ্রাস পেয়েছে । ভিয়েতনামের মতো কৌশলী চিন্তধারার একদল গ্রামবাসীর সাথে মিজো পাহাড়ে এই ধরনের যুদ্ধ প্রায় ৫ বছর চলেছিলো যাতে ব্যবহার হয়েছিলো স্টেন গান এবং হেলিকপ্টার । কাশ্মিরে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য এই কাজ আরো সহজ ছিলো । কেউ আশা করতে পারেনি যে নয়াদিল্লি জাতিসংঘে পূর্ববাংলার সমস্যা উত্থাপনের ব্যাপারে খুব উত্সাহী হবেন, যেমনটা সবাই আশা করেনি সেভাবে।

মুজিব সমর্থকদের বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের জন্য দাবী এবং স্বাধীন বাংলাদেশকে একটি আলাপচারিতায় পরিণত হতে দেখলে নয়াদিল্লীই সবচে বেশী খুশি হবে ।কিন্তু যেহেতু ব্যাপারগুলো এখন ফিরিয়ে নেবার সীমা অতিক্রম করে চলেছে, সবই একটি নিছক সমাপ্তির জন্য অপেক্ষা করছে এখন । নয়াদিল্লি, ওয়াশিংটন এবং মস্কোর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ের সাথে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে । এটা জেনে আগ্রহ বোধ করছি , যখন একজন বাঙালি বিপ্লবী (তিনি পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করেন) প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করেছেন , তখন তিনি তাকে বলেছিলেন যে জনাব পডগর্নি ও মিঃ নিক্সন উভয়ই জেনারেল ইয়াহিয়া খানে বলে গণহত্যা থামিয়েছেন।ঘটনাটি ছিলো পাডগরনির চিঠি আসার কয়েক দিন পূর্বে । সবাই জানত এটা আসছে।

নয়াদিল্লী নব্য বাংলাদেশেকে কেমন নজরে দেখবে ? চলমান নেতৃত্ব কি দ্রুত এবং তরুন মৌলবাদী নেতৃত্ব দ্বারা পুনোরাস্থাপিত হবে । কয়েকটি দেশ বাংলাদেশের নেতৃত্ব কে নিয়ন্ত্রনের জন্য বামপন্থী নেতৃত্বে চাইবে যদি একটি ডানপন্থি নেতৃত্ব ক্ষমতা গ্রহণ করে । যদি কোনও ডানপন্থি নেতৃত্ব ক্ষমতা গ্রহণ করে, তবে নতুন রাষ্ট্রের অর্থনীতি পুনর্নির্মাণের জন্য ও বৃহত্তর অর্থনৈতিক সাহায্যের জন্য এক বা উভয় সুপার পাওয়ার ক্ষমতা দেখাবে । উপমহাদেশে দুই দেশের মধ্যে মধ্যে কাজ করা দুটি সুপার পাওয়ার কে এখানেও দেখা যেতে পারে । ভারত এর নিরাপত্তার জন্য এক পাকিস্তানের চেয়ে দুই “পাকিস্তান” পার্থক্য করে তোলে । কিন্তু যদি একটি শক্তিশালী বামপন্থী আন্দোলন বাংলাদেশে বৃদ্ধি পায়, তাহলে ভারত বা সুপার পাওয়ার কারো জন্যই পরিস্থিতি এতটা ভালো থাকবেনা ।যদি স্বাধীন বাংলাদেশে বাম শক্তি বৃদ্ধি পায় তবে চীনাদের জন্য তাদের অস্ত্র সাহায্য করতে কোন সমস্যা হবেনা । ঠিক এই ভয়টাই নয়াদিল্লিতে বেশি উচ্চারিত হয়।

এর বাইরে, বাংলাদেশের বা এর সাইক্লোনের জন্য নয় দিল্লির উদ্বেগ সামান্যই রয়েছে। এটি অদ্ভুত কাকতালীয় যে “বাম সেন্টার” বা “বাম-ভিত্তিক” সিলন সরকার (কোণ ক্ষত্রে মিসেস গান্ধীর জন্য একটি আদর্শ ) “চে গেভারিস্ট” বিরুদ্ধে আরো কঠোর ব্যবস্থা ব্যবহার করেছে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন সিপিআই- এম এর সরকার নক্সালবাড়ি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে নেয়া ব্যাবস্থার চেয়েও । চে গুয়েভারারদের নিন্দা করার জন্য যখন সিলনের কমিউনিস্ট ও ট্রটস্কি (এখন একক ফ্রন্টে) সম্মিলিত হতে পারে, যখন মিসেস বন্দরনায়েকেও তার চার্জকে সমর্থন করার জন্য আহ্বান জানায় না যে সমগ্র আন্দোলনটি বিদেশী সংস্থা দ্বারা সমর্থিত। একটি সরকার যারা নিজেদের বাম দাবি করে তাআরা বাম থেকে আসা কোনও চ্যালেঞ্জ সহ্য করতে পারেনা , ডানপন্থি শক্তিই সেখানে সর্বাধিক ও সঠিক । দুই ক্ষেত্রেই , যেখানে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিগুলি সিলেনের চে গেভোরিস্টদের নিন্দা করার ক্ষেত্রে কোনও অসুবিধা দেখেনা আবার তারা বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবিতেও কোন অসুবিধা পায় না। বাংলাদেশের এবং সিলনের বিদ্রোহের মধ্যে, ভারতের দুই কমিউনিস্ট পার্টি নিজেদেরকে বিস্মিত হওয়া উচিত। বাংলাদেশ ও সিলনে চলা বিদ্রোহতে নিজেদের অবস্থান নিয়ে ভারতের কমউনিস্ট পার্টির নিজেদের বিস্মিত হওয়া উচিত । ভারতীয় কমিউনিস্টরা কোনও ক্ষেত্রে জাতীয়তার প্রশ্নকে প্রশ্নবিদ্ধ করেনি এবং এরকম পরিস্থিতি হলে তা পর্যালোচনার জন্য মস্কোতে প্রেরন করতো । যখন মন্ত্রিপরিষদ মিশন ভারত সফর করেছিল, তখন সিপিআই দেশের সংবিধানের প্রতি সম্মতি জানায়। এর আগে, তারা দুই দেশ তত্ত্বের ভিত্তিতে একটি “শিখ মাতৃভূমির” গঠন করাকে সমর্থন করে আসছিলো । যখন ভারতের জাতীয় প্রশ্ন সোভিয়েত চিন্তাধারা বদলে গেল, তখন সিপিআই নেতৃত্ব নিখুঁত বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী হয়ে ওঠে এবং প্রত্যেক বিষয়ে জাতীয় সাংস্কৃতিক অবস্থান গ্রহণ করে।
বাংলাদেশে সশস্ত্র সংগ্রাম এবং সিলেনের বিদ্রোহ নিরপেক্ষভাবে, সংসদীয় পদ্ধতিতে বিশ্বাসী কোন কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে স্বাগত জানানোর জন্য অপ্রত্যাশিত বিষয়। এর সাপেক্ষে প্রথমত অনেক কারন থাকতে পারে কিন্তু অবশ্যই এটা না যে কমিউনিস্ট পার্টি উপ মহাদেশের কোন সশস্ত্র সংগ্রামকে ভালবাসে । দ্বিতীয় কারণ হতে পারে উপমহাদেশে যে কোনও জায়গায় বিদ্রোহ সংসদীয় গনতন্ত্রে যারা বিশ্বাস করে তাদের কাছে অসন্তোষজনক ।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৭২। স্বাধীনতা সংগ্রামী বাংলাদেশের পাশে পশ্চিম বাংলা কালান্তর ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১

Kamol Roy
<১৪, ২৭২, ৭০৬-৭০৮>

স্বাধীনতা সংগ্রামী বাংলাদেশের পাশে পশ্চিম বাংলা
কমল সমাজদ্বার

বাংলাদেশের জনগণের উপর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁনের সৈন্য বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের সংবাদে পশ্চিম বাংলার মানুষ স্তম্ভিত হয়ে গেছেন। কেবলমাত্র বাংলাদেশের পাশে পশ্চিমবাংলা অবস্থিত বলেই নয় বা এই দেশের জনগণের আত্মীয়-পরিজন বাংলাদেশে আছেন বলেই নয়- এই দেশের জনগণ বিগত কয়েক বছর ধরে সানন্দ বিস্ময়ে পূর্ব বাংলার জনগণের সর্বতোমুখীন জনগণের বিকাশ লক্ষ্য করছিলেন। সে দেশের মানুষ সে দেশের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিতে ব্যাপক উজ্জীবন পশ্চিম বাংলার মানুষের নিবিড় কৌতুহলের বিষয় হয়ে উঠেছিল। তাই সে দেশের মানুষের উপর ফৌজি শাসনের মদমত্ত অত্যাচারের পশ্চিম বাংলার মানুষ স্থির থাকতে পারেনি।

পঁচিশে মার্চের সেই কাল রাতের পর প্রায় এক পক্ষকাল অতিবাহিত হয়ে গেল। এই সময়ের মধ্যে অসংখ্য শোভাযাত্রার মাধ্যমে পশ্চিম বাংলার মানুষ সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে। কয়েকটি কমিটি গঠিত হয়েছে বাংলাদেশের এই ঐতিহাসিক সংগ্রামে সর্বতোমুখী সাহায্যের জন্য।
বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার ফৌজবাহিনীর আক্রমণের সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পরই কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পরিষদের সম্পাদকমন্ডলীর পক্ষে শ্রী বিশ্বনাথ মুখার্জী এক বিবৃতি মারফত সভা সমাবেশ মিছিল করে বাংলাদেশের স্বাধিকার ও গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রামের প্রতি সৌভ্রাতৃত্ব জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে পশ্চিম বাংলার মানুষের প্রতি আহবান জানান।

বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশন, ডি এস ও, ছাত্র পরিষদ (নব কংগ্রেস) প্রভৃতি ছাত্র সংগঠনগুলির আহবানে গত ২৭ মার্চ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এক সর্বাত্মক হরতাল হয়। এদিনেই পশ্চিমবঙ্গ যুব সংঘ ও বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশন বাংলাদেশ-এর ঐতিহাসিক সংগ্রামের প্রতি আন্তরিক সংহতি জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে ষ্টুডেন্টস হলে এক যুব ছাত্র সমাবেশ আহবান করেন এবং সমাবেশের পরে এক যুব ছাত্র মিছিল কলকাতার বিভিন্ন রাজপথ প্রদক্ষিণ করে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সংগ্রামের প্রতি রক্তিম অভিবাদন জানান।
বি পি টি ইউ সি-র সম্পাদক শ্রী ভবানী রায় চৌধুরী ও টি এন সিদ্ধান্ত এক বিবৃতিতে বলেনঃ বাংলাদেশের মানুষের উপর বিনা প্ররোচনায় যে পাশব সামরিক হামলা শুরু হয়েছে বি পি টি ইউ সি তার বিরুদ্ধে তীব্র ক্রোধ প্রকাশ করেছে। এ বি টি এ কো-অর্ডিনেশন কমিটি এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণকে বিপ্লবী অভিনন্দন জানান। জীবনবীমা কর্মচারী সমিতি (পূর্বাঞ্চল) যুগ্ম সম্পাদক শ্রী সুকুমার মুখার্জী বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের সমর্থনে এক বিবৃতি দেন।
গত ২৮ মার্চ শহীদ মিনার ময়দানে এক বহুদলীয় সমাবেশে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের প্রতি পূর্ণ সংহতি জানিয়ে এই প্রত্যয় ঘোষণা করা হয় যে, সামরিক স্বৈরাচারের নৃশংস নিপীড়ন প্রতিহত করে অনতিবিলম্বেই পূর্ব বাংলার মৃত্যূঞ্জয়ী জনগণ সার্বিক স্বাধিকার অর্জন করবেন। রাজ্য বন কংগ্রেস সভাপতি সিং নাহার- এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় শ্রী অজয় মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি বক্তৃতা দেন।

শ্রী তারা শঙ্কর বন্দোপাধ্যায় প্রমুখ সাহিত্যিকবৃন্দ এক বিবৃতিতে পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছে বাংলার জনগণের উপর মিলিটারী আক্রমণের তীব্র প্রতিবাদ ঘোষনা করেন ও এই নৃশংসতার নিন্দা করে প্রতিরোধের বিষয়ে যথোচিত কর্তব্য পালনে দাবী জানান।

ভারতীয় মহিলা ফেডারেশনের পশ্চিমবঙ্গ কমিটি এক বিবৃতিতে বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের গণতান্ত্রিকতার নকল মুখোশ খুলে পড়েছে।

কলকাতা পৌরসভার গত ২৬ মার্চের সাপ্তাহিক অধিবেশনে বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষদের সমর্থনে এক সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়।

ইউনাইটেড ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া কর্মচারী সমিতির পাক সার্কাস শাখা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে এক তারবার্তা পাঠিয়ে বাংলাদেশের জনগণের আন্দোলনে সর্বপ্রকার সাহায্যের দাবি জানান।
গত ২৭ মার্চ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেটের বাৎসরিক সভায় পূর্ব বাংলায় স্বৈরাচারী অত্যাচারের প্রতি ক্রুদ্ধ প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়।

গত ৩১ মার্চ বাংলাদেশের ঐতিহাসিক গণমুক্তি সংগ্রামের প্রতি আন্তরিক সংহতি ও পাকিস্তানের সামরিক বর্বরতার বিরুদ্ধে ধিক্কার জানানোর জন্য পশ্চিমবঙ্গে অভূতপূর্ব বন্ধ পালিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের সকল রাজনৈতিক দল ও ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের ডাকে পশ্চিমবঙ্গে এই ২৪ ঘন্টাব্যাপী হরতালে রাজ্যের জনসাধারণ অভূতপূর্বভাবে সাড়া দেন।

আন্তর্জাতিক, পরিচয়, আফ্রো-এশীয় সংহতি ও পশ্চিমবঙ্গ শান্তি সংসদের উদ্যোগে গত ৩০ মার্চ স্টুডেন্টস হলে অনুষ্ঠিত এক মহতী সমাবেশে শ্রী নিরেস চক্রবর্তী সভাপতিত্ব করেন এবং এক সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের যাবতীয় সাহায্যের জন্য চাপ সৃষ্টি ও সরকার কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতির কথা বলা হয়।

ইউনিভার্সিটি ইনষ্টিটিউট হলে গত ২৯ মার্চ শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবিদের এক বিরাট সমাবেশে অন্নদাশঙ্কর রায়, বিবেকানন্দ মুখার্জী, অম্লান দত্ত, মৈত্রয়ী দেবী, ইলা মিত্র প্রমুখ ভাষণ দেন।
স্কটিশ চার্চ কলেজে ও সেন্ট পলস কলেজের ছাত্র ছাত্রী ও অধ্যাপকদের সভায় বাংলাদেশের মুক্তি যোদ্ধাদের সমর্থনে প্রস্তাব গৃহীত হয়।

দক্ষিণ কলকাতার পাঠভবন, সাউথ পয়েন্ট, সত্যভামা, জগবন্ধু প্রভৃতি স্কুলের ছাত্ররা গত ৩১ মার্চ ধর্মঘটের পর পাক হাই কমিশনের অফিসে মিছিল করে যান ও সেখানে এক স্মারকলিপি পেশ করেন।

কোন্নগর পৌরসভার গত ১৭ মার্চ অনুষ্ঠিত এক সভায় বাংলাদেশের মানুষের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের প্রতি অভিনন্দন জানান।
বঙ্গীয় স্বর্ণশীল্পী সমিতির অন্যতম সম্পাদক শ্রী নির্মল দত্ত ও মেটাল বক্স ওয়াকার্স তাদের বিবৃতি মারফৎ বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামকে অভিনন্দন জানান।

ভারতীয় গণসংস্কৃতি সংঘের সভাপতি শ্রী দিগিন বন্দোপাধ্যায় ও সম্পাদক শ্রী অন্নদাশঙ্কর ভট্টাচার্য এক বিবৃতিতে পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত শিল্পী, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের সমবেতভাবে বাংলাদেশের জঙ্গীশাহীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে আহবান করা হয়।

৩১ মার্চ বারাসতে বাংলাদেশে সংগ্রামের শেঠপুকুর ময়দানে এক বিরাট জনসভায় সর্বশ্রী সুনীল বসু (সি পি আই), অরবিন্দ দাশগুপ্ত (শাসক কংগ্রেস) ভাষণ দেন।

ভারতীয় মহিলা ফেডারেশনের পশ্চিমবঙ্গ কমিটির আহবানে ১ এপ্রিল ভারত সভা হলে অনুষ্ঠিত এক মহিলা সভায় পূর্ব বাংলার ভাই-বোনেরা আত্মত্যাগের জ্বলন্ত নিদর্শনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়। সভায় সভানেত্রি ছিলেন ডঃ রমা চৌধুরী ও ভাষণ দেন শ্রীমতি গীতা মুখার্জী, অপর্ণা ব্যানার্জী, ইলা মিত্র, অরুণা মুন্সী, কমলা মুখার্জী, মায়া দাস, এবং শ্রীমতি মীরা দত্তগুপ্তা। বাংলাদেশের একজন মুক্তি সংগ্রামীও সভায় ভাষন দেন।

পশ্চিমবঙ্গ সাব-অর্ডিনেয়াত কো-অপারেটিভ এমপ্লোয়িজ এসোসিয়েশন ও পশ্চিমবঙ্গ মৎসজীবি সমিতি বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের উপর ইয়াহিয়ার অমানুষিক অত্যাচারের তীব্র নিন্দা করেন।
ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা বাংলাদেশে জনগণের উপর পাকিস্তানের জঙ্গীশাহীর অত্যাচারের প্রতিবাদে কলকাতার পাক ডেপুটি হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ দেখান। এছাড়া আই এম এ হলে বাংলাদেশের মুক্তিফৌজের সাহায্যার্থে এক রক্তদান কেন্দ্র খোলা হয় ও গত ২ এপ্রিল এম এ সভ্য রা প্রথম কিস্তিতে রক্তদান করেন।

ট্রাম শ্রমিকদের যুক্ত কমিটি, পশ্চিমবঙ্গ সরকারী কর্মচারী সমিতিসমূহের অস্থায়ী যুক্ত কমিটি, পেট্রোলিয়াম ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন, এন্ড্রু, ইউল কোং কর্মচারী সমিতি, ইউ বি আই এমপ্লয়িজ এসোসিয়েশন, বেঙ্গল মোশান পিকচার্স এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী জনগণকে অভিনন্দন জানান।

খড়গপুর থানায় গত ৩১ মার্চ কৃষক সমাবেশে বিভিন্ন বক্তা বক্তৃতা প্রসঙ্গে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের আহবান জানান।

দমদমে ও পানিহাটীতে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সমর্থনে ৩১ মার্চ বিরাট মিছিল বের হয়।
যাদবপুর বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সমর্থনে সর্বদলীয় জনসভা ও কুলটীতে এক সর্বদলীয় যুক্ত মিছিল বের হয়।

যুবক লেখক সংস্থার উদ্যোগে স্টুডেন্টস হলের জনসভা থেকে ইয়াহিয়ার বর্বরতাকে তীব্র ধিক্কার জানানো হয়।

সাউথ সুবার্বন পৌরসভা ও সিটি কলেজের ছাত্র শিক্ষক কর্মচারীদের যুক্ত সভা তাদের নিজ নিজ প্রস্তাব মারফৎ মুক্তিকামী বাংলাদেশের মানুষদের অভিনন্দন জানান।

পথিকৃৎ ও ডি ওয়াই ও-র উদ্যোগে গত ৩ এপ্রিল এক বিক্ষোভ মিছিল পাক হাইকমিশনার দপ্তরে যায়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৭৩। বাংলাদেশ মিশন স্বীকৃতির জন্য প্রচেষ্টা চালাবে অমৃতবাজার পত্রিকা ২০ এপ্রিল ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৭৩, ৭০৯-৭১০>

অমৃতবাজার পত্রিকা, ২০ এপ্রিল ১৯৭১
বাংলাদেশ মিশন স্বীকৃতির জন্য প্রচেষ্টা চালাবে
– স্টাফ রিপোর্টার

জনাব হোসেন আলি – বর্তমানে কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনের প্রধান – – শীঘ্রই তাকে ভারতে বাংলাদেশের হাই কমিশনার হিসাবে নামকরণ করা হবে।

সোমবার কলকাতায় বাংলাদেশ মিশন কার্যালয়ে নতুন জীবন শুরু হয় এবং নতুন ফাইল খোলা হয়, এটি স্বাধীন, সার্বভৌম ও গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশ ও তার নতুন সরকার গঠনের “স্বীকৃতি”।
একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র অনুযায়ী, বিশ্বের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের প্রধানদের কাছে লেখা চিঠি এখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর স্বাক্ষরের জন্য অপেক্ষা করছে। এই মিশন থেকে একজন দূত থেকে আজ (মঙ্গলবার ) বাংলাদেশ এর পররাষ্ট্র মন্ত্রী করার সম্ভাবনা রয়েছে।

এদিকে, ভারতে কলকাতা পাকিস্তান হাইকমিশনার জাতীয় গ্রিন্ডলেস ব্যাংকের কাছে একটি টেলেক্স বার্তা পাঠিয়েছেন বলে জানা যায় যে, মিঃ হোসেন আলীকে যেন ব্যাংক থেকে কোনও অর্থ নেওয়ার অনুমতি না দেওয়া হয়। অনুরূপ উপদেশটি লন্ডনের ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানেও দেয়া হয় বলে জানা যায়। পাকিস্তান স্টার্লিং অ্যাকাউন্টগুলি ক্লিয়ারিং হাউস হিসেবে কাজ করা হতো।

অন্য টেলেক্স বার্তাতে পাক হাইকমিশনার মিঃ হোসেন আলীকে বাংলাদেশ মিশন কার্যালয় হিসেবে সার্কাস এভিনিউ ভবনকে ব্যবহার না করার কথা বলা হয়।

এখানকার সমস্ত কর্মকর্তারা এধরনের হুমকি উপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিশেষ করে পাকিস্তান সরকারের কোন রেমিটেন্স তাদের প্রয়োজন নেই – একটি উৎস একথা জানায়।

মিঃ হোসেন আলী বলেন যে তিনি “মিশনের কর্মকাণ্ড পুনর্গঠন ও পুনঃনির্ধারণ করেন” যাতে এটি “বাংলাদেশের চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষা” নিয়ে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে পারে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশিদের প্রতি তার আনুগত্য পরিবর্তন করার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে বাংলাদেশের বেশ কিছু প্রতিনিধি সোমবার মিশন সফর করেন।

কষ্টের জন্য প্রস্তুত
তিনি বলেন, সব ৬০ জন বাঙালি কর্মীরা “উত্সাহ” নিয়ে কাজ করছে এবং তারা তাদের বেতন কাটা হবে সে ব্যাপারে প্রস্তুত ছিল। “আমাদের নীরবে দেখতে হবে। আমরা বিলাসিতা করতে পারি না”, তিনি যোগ করেন।

জনাব আলী বলেন ৩০ জন পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মচারী দায়িত্বের জন্য রিপোর্ট করেননি এবং তিনি জানেননা যে তারা প্রত্যাবর্তন করতে পারছেন কিনা। মিশন একই ভবন থেকে কাজ চালিয়ে যাবে।

তিনি শীঘ্রই বাংলাদেশ সরকারের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন তাদের নির্দেশিকা নেবার জন্য।

জনাব আলী ও তার কর্মীদের শুভেচ্ছা জানানোর জন্য লোকেরা সন্ধ্যায় ফুলেল স্বাগতম জানাতে লাগল। মিশনের বিশিষ্ট পরিদর্শকদের মধ্যে ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি পি.বি. মুখার্জী।

মিশনের বাইরে প্রচুর লোক সমাগম হল। তারা বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি” দাঁড়িয়ে গাইতে লাগল ছিল।

জনাব আলী বলেন যে তার প্রথম কাজ হবে “অন্যান্য দেশ থেকে বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি নিশ্চিত করা”।

তিনি ইউএনআইকে বলেন যে শুধুমাত্র স্বীকৃতির পরই এই জাতির কাছ থেকে অস্ত্র সাহায্যের প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে।

বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনকে গতিশীল করতে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

জনাব আলী জোর দিয়ে বলেন যে নবনির্মিত সরকার ছিল একমাত্র প্রতিনিধিত্বকারী বাংলাদেশ সরকার।

মুজিব কোথায়
একটি প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তাঁর কাছে তথ্য ছিল যে ২৪ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন ছিলেন। এর পর থেকে তার খবর তিনি জানেন না।

জনাব আলী তাদের সমর্থনের জন্য পশ্চিমবঙ্গের জনগণকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানান।

রেডিও পাকিস্তানে সোমবার রাতে কাহিনীটি তুলে ধরেছিল যে, জনাব আলী বাংলাদেশের নতুন সরকারের প্রতি তার আনুগত্য প্রদর্শন করেছেন।

পাকিস্তানি পতাকা প্রতিস্থাপন করে পাকিস্তানি মিশনটির উপরে বাংলাদেশ পতাকা উড্ডয়ন করা হয়।

আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি নয়া দিল্লি থেকে লিখেছেন: এখানে বিভিন্ন স্তরের অনুসন্ধান করলে দেখা যায় যে, কলকাতাতে প্রাপ্ত পরিস্থিতি সংক্রান্ত ব্যাপারে নয়াদিল্লী বা পাকিস্তানের কোনও পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয় নি। যতদূর ভারত সরকারের সংশ্লিষ্টতা থাকুক না কেন, উভয় পক্ষের পক্ষ থেকে প্রত্যাহার বা পরিবর্তিত না হওয়া পর্যন্ত স্থিতি স্থগিত থাকবে।

আন্তর্জাতিক ইতিহাসে দেখা যায় যে এই ধরনের জিনিস নতুন নয়। কঙ্গোতে কর্মক্ষেত্রে দুটি কম্বোডিয়ান মিশন রয়েছে। ল্যাটিন আমেরিকান দেশে এই ধরনের ঘটনা প্রায় প্রতি সপ্তাহে প্রায় একবার ঘটে।

কলকাতা পূর্ব পাকিস্তানের হাইকমিশনারের অফিসে ঘটনার বিষয়ে যে কোনও পক্ষের পক্ষ থেকে এই অনুরোধ করা হলে অথবা ভারত সরকার এটিকে বিশ্বাস করে যে, পরিস্থিতিটি যথাযথভাবে বিবেচনা করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য তারা কাজ করবে।

এটি ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও বিবেচনা করবে যে কূটনৈতিক অনাক্রম্যতা উপভোগ করে এমন সকল পূর্ববর্তী কর্মচারীরা যেন একই অধিকার ভোগ করে, যদি না কোনও তথ্য চ্যালেঞ্জ বা পরিবর্তন না হয়।

জালিয়াতি প্রতিবেদন
এদিকে, দিল্লিতে সরকারি সূত্র সোমবার “পুরোপুরি কল্পনাপ্রসূত” প্রতিবেদন হিসাবে বর্ণনা করেছে যেখানে বলা হয়েছিল যে নবগঠিত প্রজাতন্ত্রের মন্ত্রিসভা এর সদর দপ্তর ভারতের কলকাতা থেকে কাজ চালাচ্ছে – পিটিআই যোগ করেছে।

এই রিপোর্টগুলি কোন ভিত্তি ছাড়াই ছিল, সূত্র জানায়।

সরকারি সূত্রগুলি বিদেশী নিউজ রিপোর্টগুলিতে যে ভুল মন্তব্য করছে তা নিয়ে বলেন – সেখানে বলা ছিল যে তারা তাদের ভারতীয় অঞ্চলে অবস্থান করছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৭৪। পাকিস্তানের ভরাডুবি (সম্পাদকীয়) আনন্দবাজার পত্রিকা ২১ এপ্রিল, ১৯৭১

Kamol Roy
<১৪, ২৭৪, ৭১১-৭১২>

পাকিস্তানের ভরাডুবি

দুর্বুদ্ধির বশে বাংলাদেশের উপর হিংস্র আক্রমণ চালাইয়া ইয়াহিয়া বাঙালীদের গোর দেওয়ার জন্য যে কবর খুঁড়িয়াছিলেন তাহাতে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানকেই না মাটি দিতে হয়। তাহাদের অঙ্গচ্ছেদ তো ইতিমধ্যেই হইয়া গিয়াছে। জঙ্গীশাহী হাজার চেষ্টা করিলেও সে কাটা শরীর আর জোড়া লাগাইতে পারিবে না। কিন্তু এ অংশটুকু তাহার একান্ত নিজস্ব সেটুকুও যে ফৌজী দাওয়াই প্রয়োগ করিয়া বাঁচাইয়া রাখিতে পারিবে, এমন ভরসাও কম। রক্ত শুধু পূর্বেই ঝরে নাই, ঝরিয়াছে পশ্চিমেও। আসলে অবশ্য সে রক্ত পূর্বেরই, নিজের দেহে তাহা সঞ্চারিত করিয়াই পশ্চিম শক্তি সঞ্চয় করিয়াছে। নিয়তির এমনই পরিহাস, পূর্ববঙ্গের বুক চিরিয়া যে রক্ত পান করিয়া পশ্চিম পাকিস্তান এত তেজ সে আর্থিক রক্তই তাহাকে ঢালিতে হইতেছে বাংলাদেশকে শায়েস্তা করিবার জন্য। অপর্যাপ্ত রক্তক্ষয় এখন তাহাকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলিয়া দিতেছে।

পাকিস্তান সমৃদ্ধির শুধু নয় প্রাণের উৎসও পূর্বে। পূর্ববঙ্গের পাট ও চা বেচিয়া যে বৈদেশিক মুদ্রা সে উপার্জন করিয়াছে সেটা ভোগে লাগিয়াছে পশ্চিমের। পূর্বাঞ্চলকে দেখাইয়া সাহায্য আদায় করিয়া কাজে লাগাইয়াছে পশ্চিম এলাকার। বাংলাদেশের নরমেধ যজ্ঞের উপাচার সংগ্রহ করিতে বাঙালীদেরই রক্ত জল করা পাট-চা বেচার টাকা লাগানো হইতেছে। লক্ষ লক্ষ প্রাণ সে যজ্ঞে আহুতি দেওয়া হইয়াছে বটে, কিন্তু খোদ পাকিস্তানই তো মরিতে বসিয়াছে। ইয়াহিয়া খাঁন তহবিলে এত অর্থ নাই যে তিনি প্রত্যহ এক কোটি টাকা খরচ করিয়া তাঁহার নিষ্ঠুর খেয়াল চরিতার্থ করেন। এক তো তাঁহাকে সঞ্চিত অর্থে হাত দিতে হইতেছে, তাহার উপর ক্ষয়ক্ষতি পূরণের উপায়ও তো তাঁহার নাই। যে রাজহাঁস সোনার ডিম পাড়িত তাহাকেই তো প্রায় শেষ করিয়া আনিয়াছেন। আর পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে সে হাঁস তো মরারই শামিল-বাঁচিয়া থাকিতে সোনার ডিম তাও আর পশ্চিম-পাকিস্তানের হাতে তুলিয়া দিবে না।

ইয়াহিয়া খাঁ যখন চোরের মতো রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়া ঢাকা ছাড়িয়া পলাইয়া যান তখন পাকিস্তানের তহবিলে মজুত ছিল মাত্র ৮ কোটি ২০ লক্ষ ডলার। এই কয় দিনেই তাহার মধ্যে দুই কোটি ডলারের উপর পদ্মার জল ঢালিয়াছে জঙ্গীশাহী। তবুও সে হালে পানি পাইতেছে না। সেন্টোর বন্ধুরা কিঞ্চিত অস্ত্রশস্ত্র অবশ্য যোগাইয়াছে, কিন্তু তাহাতে কতদিন চলিবে? বসিয়া খাইলে কুবেরের ভাণ্ডারও শুন্য হইয়া যায়- পাকিস্তানের পুঁজিতো সামান্য। নগদ টাকার অভাবে ধার যে করিবে পাকিস্তানের সে গুড়েও বালি। দেউলিয়াকে কে ধার দিতে যাইবে, কেনই বা দিবে? যাহারা এতকাল পাকিস্তানকে আদরযত্ন করিয়া এমন বাড়াইয়াছে ইচ্ছা থাকিলে তাহাদেরও তো পাকিস্তানের আবদার মেটানো কঠিন। বৃহৎ শক্তিদের মধ্যেই যে পাকিস্তানের বায়না মানিয়া লইতে চাহিবে তাহারই দেশে প্রবল আপত্তি উঠিবে। সাধ করিয়া ঝামেলা কে ডাকিয়া আনিবে?

যাহার শূন্য তহবিল তাহার পক্ষে নগদ কড়ি দিয়া সামরিক সরঞ্জাম কেনা যেমন অসম্ভব, তেমনই অসম্ভব বিদেশ হইতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল কিংবা অন্যান্য উৎপাদনের আনুষাঙ্গিক বস্তু কেবা। পূর্ব বঙ্গের সঙ্গে সহমরণে যাইতে চলিয়াছে পশ্চিম-পাকিস্তানের শিল্পও। বিদেশ হইতে কিছুই আমদানি করা যাইতেছে না, একে একে মিত্রের দলও হাত গুটাইতেছে। আরও দিন কতক এমনভাবে চলিলে পাকিস্তানের দুর্দশা চরম হইবে। বেকারি এমনিতেই তো ভয়াবহ। কলকারখানা কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশের অভাবে যদি বন্ধ হইয়া যায় তাহা হইলে পশ্চিম পাকিস্তানেও তো হাহাকার পড়িয়া যাইবে। বিদেশ হইতে পাকিস্তান যে বৈষয়িক সাহায্য আসে এক চীন হইতে যেটুকু পাওয়া যায় সেটুকু হয়তো মিলিবে, কিন্তু অন্যেরা আপাতত সাহায্যদান স্থগিত রাখিয়াছে। আমেরিকা, ব্রিটেন, জাপান সকলেই বাংলাদেশের রণাঙ্গনের দিকে তাকাইয়া আছে-সেখানে একটা ফয়সালা না হইলে দান খয়রাত আবার শুরু করিবে না, এমন একটা ভাবও তাহারা দেখাইতেছে। এমনকি আর্ত ত্রাণের জন্য যে টাকা জাপান বরাদ্দ করিয়াছিল তাহাও দিতে সে দেশ নারাজ। বিশ্ব ব্যাংকও বিশেষ প্রসন্ন নয়- পাকিস্তানকে বৈষয়িক সাহায্য যে সব দেশ দেয় তাহাদের বৈঠক প্যারিসে হইবে বটে, কিন্তু পাকিস্তানের সেখানে প্রবেশের অধিকার থাকিবে না। দেখা যাইতেছে ইয়াহিয়া নিজেও মমজিয়াছেন, দেশকেও মজাইয়াছেন।

সম্পাদকীয়ঃ আনন্দ বাজার পত্রিকা, ২১ এপ্রিল, ১৯৭১।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৭৫। পূর্ব বাংলার ঘটনাবলীর গতি-প্রকৃতি ফ্রন্টিয়ার ২৪শে এপ্রিল, ১৯৭১

Ashik Uz Zaman
<১৪, ২৭৫, ৭১৩-৭১৬>

ফ্রন্টিয়ার, ২৪শে এপ্রিল, ১৯৭১
সীমান্তের ওপারে
পূর্ব বাংলার ঘটনাবলীর গতি-প্রকৃতি
সুমন্ত ব্যানার্জী কর্তৃক

আমাদের বাঙলা সংবাদপত্রে প্রকাশিত বাংলাদেশ সম্পর্কে আতিশয্যপূর্ণ প্রতিবেদনের জগাখিচুড়ির কল্যাণে, পূর্ব বাংলায় যা ঘটছে তার রাজনৈতিক তাৎপর্য হারিয়ে যাচ্ছে।

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধের নেতৃত্ব দিচ্ছে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস-এর তরুণ সদস্যরা। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য, মুজাহিদেরা। আনসার বাহিনীর সদস্য এবং ছাত্ররা। আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ, যারা জনগণের দ্বারা কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক সংসদের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তাদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রের আশেপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছেনা। তারা আছেন কোলকাতা, দিল্লী, আগরতলা বা বনগাঁয়ে – কমিটি তৈরী বা সরকার গঠনে ব্যস্ত।

যদিও অল ইন্ডিয়া রেডিও এবং সরকারী বিবৃতিগুলো মুক্তি বাহিনীকে মুজিবের বাহিনী হিসেবে বর্ণনা করতে বদ্ধপরিকর, আমি যে যোদ্ধাদের দেখেছি যশোর, খুলনা এবং অন্যান্য এলাকায় কে তাদের নেতা তা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথাই নেই। তাদের জন্য এটা আধুনিক পৃথিবীর অন্যতম নির্দয় বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের যুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত .৩০৩ রাইফেল এবং অল্পকিছু হালকা স্বয়ংক্রিয়-অস্ত্র নিয়ে, তারা ট্যাঙ্ক, ভারী কামান এবং প্রায়শই বিমান আক্রমণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে।

দুইজন ইপিআর-এর সদস্য যাদের সাথে আমার দেখা হয় যশোর শহরের কাছে একটি জনমানবশূন্য গ্রামে আমাকে আক্ষেপের সাথে জানায় যে নেতারা গ্রামবাসীদেরকে অস্ত্রসজ্জিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন নইলে তারা হয়তো গ্রামেই থেকে যেত এবং মুক্তি বাহিনীকে সাহায্য করতো।

আমি যখন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে ভারতীয় সীমান্তের কাছে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ জায়গায় আওয়ামী লীগের সদরদপ্তরে আসি এবং একজন স্থানীয় নেতাকে জিজ্ঞেস করি যে কেন গ্রামবাসীদেরকে অস্ত্র দেয়া হয়নি, তিনি বলেন তারা দিতে পারেননি কেননা তাহলে গ্রামবাসীরা লুটপাট এবং নিজেদের মধ্যে মারামারিতে লিপ্ত হতে পারে।

গেঁয়ো লোকদের প্রতি মধ্যবিত্ত-শ্রেণীর অবিশ্বাস গ্রামের বেশীরভাগ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সবসময় দুরেই রেখেছে। আশেপাশে কোথাও পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর উপস্থিতি দেখলেই সাথে সাথে গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে দেখে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে গ্রামবাসীরা এই যুদ্ধের সাথে সম্পৃক্তই নয়।
একটি স্বাধীনতা যুদ্ধ গুটিকয়েক ইপিআর সদস্য আর স্বেচ্ছাসেবক ছাত্র নিয়ে লড়া যায় না, তারা যতই বীরত্বপূর্ণ হোক না কেন। জনগোষ্ঠীর সিংহভাগ এই গেঁয়ো লোকগুলোকে – এর মধ্যে টেনে আনতে হবে।

যেখানে আওয়ামী লীগের নেতারা এখনো বিশ্বাস করেন জনসাধারণকে দূরে রাখতে হবে, এবং যুদ্ধক্ষেত্রে গতানুগতিক ধারায় সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে এই যুদ্ধে জিততে হবে, যারা এই যুদ্ধে লড়ছে – ইপিআর সদস্য এবং স্বেচ্ছাসেবকরা, অতি দ্রুত বুঝতে পারছে গেরিলা যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা। এ থেকেই বোঝা যায় একজন নেতা এবং একজন যোদ্ধার মধ্যকার সূক্ষ্ম পার্থক্য।
আওয়ামী লীগের যতজন নেতার সাথে আমি কথা বলেছি তাদের প্রায় সবাই আশা করেন ভারত ভারী কামান, ট্যাঙ্ক এবং অন্যান্য আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে তাদেরকে সাহায্য করবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর শক্তি মোকাবেলা করার জন্য। তারা ভারত সরকারের কাছে আবেদন করছে এইধরনের সাহায্যের জন্য। এই আচরনের ঠিক বিপরীত মনোভাব দেখলাম একজন তরুণ মিস্ত্রির মধ্যে – যার বয়স খুব বেশী হলে ২৫ বছর হবে – যে দিনাজপুর থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে একদিনের জন্য ভারতে এসেছে এবং একটি ব্রিজ উড়িয়ে দেয়ার মত পর্যাপ্ত বিস্ফোরক জোগাড় করতে। নেতাদের তুলনায় বেশী বাস্তববাদী এবং প্রয়োগবাদী, সে বিস্তারিত বিবরণ দেয় কিভাবে যোদ্ধারা তাদের অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিচ্ছে এবং গেরিলা যুদ্ধের কৌশলের দিকে সরে যাচ্ছে, যেমন ফাঁদ পেতে অতর্কিতে শত্রু ট্যাঙ্ককে আক্রমণ করা।

রাজনীতি
যুদ্ধের কৌশল নিয়ে মতভেদ ছাড়াও, রাজনৈতিক মতভেদও দেখা দিচ্ছে। আওয়ামী লীগের এমপিএ এবং এমএনএ-দের প্রতি অসন্তোষ, বিশেষ করে গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে, ক্রমে বেড়েই চলেছে। তারা মনে করছে যে তাদের কথা সবাই ভুলে গেছে। যোদ্ধাদের মধ্যেও মনোভাব রয়েছে যে তাদেরকে হতাশ করা হয়েছে। তারা মনে করছে যে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য তাদেরকে পর্যাপ্ত সময় দেয়া হয়নি। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে যেভাবে সুযোগ দেয়া হয়েছে ইপিআর এবং ইআরআর-এর উচ্চপদস্থ অফিসারদেরকে সরিয়ে দেয়ার, এমনকি যখন মুজিবুর রহমান এবং ইয়াহিয়া খানের মধ্যে আলোচনা চলছিল তখনও, এই ইংগিতই দেয় যে আওয়ামী লীগের নেতারা সামরিক যুদ্ধের আঙ্গিকে চিন্তাভাবনা করেননি আন্তরিকভাবে।

সব লক্ষন দেখে এটাই মনে হচ্ছে যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব তার সামর্থ্য নিঃশেষ করে ফেলেছে। অ-হিংস অ-সহযোগ আন্দোলনের সাফল্যের মাধ্যমে তারা সৌভাগ্যের সর্বোচ্চ বিন্দুতে উঠেছিল। জনসাধারণকে অ-সহযোগ আন্দোলনের পক্ষে যোগ দেয়ার ডাক দিয়ে, তারা তাদের তেজ প্রদর্শন করে এবং যা কিনা গান্ধীর চেয়েও উৎকৃষ্ট বলে প্রতীয়মান হয়। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের সময় আমাদের অ-সহযোগ আন্দোলনে এমন বিরুদ্ধাচরণ কখনই হয়নি যেমন ভিনদেশী শক্তির চাপিয়ে দেয়া একজন গভর্নরকে শপথবাক্য পাঠ করাতে সকল বিচারপতির অস্বীকৃতি জানানোর মতো। জাতীয়তাবাদের চেতনা পরিপূর্ণ হয়ে ছিল তখন।

আওয়ামী নেতৃবৃন্দ জনসাধারণকে অ-হিংস অ-সহযোগ আন্দোলনে সামিল করতে সক্ষম হলেও, তাদেরকে সশস্ত্র প্রতিরোধে সম্পৃক্ত করার কথা নয়। তাদের মধ্যবিত্ত মানসিকতা জনসাধারণকে অস্ত্র সজ্জিত করতে বাধা দেয়। এর পরিবর্তে তারা ভরসা করেছিল ইপিআর এবং ইআরআর-এর তখনই ব্যবহারযোগ্য জীর্ন অস্ত্র যা অবশিষ্ট ছিল। গতানুগতিক যুদ্ধ ধারা এবং সম্মুখ যুদ্ধ কৌশলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, কিন্তু প্রয়োজনীয় নেতৃত্ব এবং সাজসরঞ্জাম ছাড়া, অপেক্ষাকৃত প্রকৃষ্ট পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সামনে ইপিআর এবং ইআরআর প্রায় কোন প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি।
এভাবে অ-সহযোগ আন্দোলনের শেষে এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আক্রমণের পর, পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে এক নতুন পর্যায়ের সূচনা হয় – সশস্ত্র প্রতিরোধের পর্যায় – যেটির সঠিক নেতৃত্ব দিতে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ব্যর্থ হয়েছে।

আমাদের সরকারের ইচ্ছাপ্রসুত চিন্তা এবং শেখ মুজিবের নির্বাসিত সরকারের পক্ষে প্রচারণা সত্ত্বেও, বাংলাদেশের আন্দোলনের নতুন পর্যায়ে নেতৃত্বের দ্রুত পরিবর্তন আসছে। আওয়ামী লীগের ভিতরে যেসব সমর্থকরা আন্তরিক তারা নেতাদের ব্যপারে মোহমুক্ত হচ্ছে। যশোর এলাকার একজন বিশিষ্ট নেতা, যার সাথে এক সপ্তাহ আগে কোলকাতায় আমার দেখা হয়, আমাকে জানায় কিভাবে সে দিনের পর দিন অপেক্ষা করেছে শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের সিদ্ধান্ত এবং ফলশ্রুতিতে পশ্চিম বঙ্গ সরকারের এগিয়ে আসার তার যুদ্ধরত সমর্থকদের সাহায্যার্থে, নিরর্থকভাবে, এবং অবশেষে নিজেই সিদ্ধান্ত নেয় কোলকাতায় “অন্যান্য সূত্রের” সাথে যোগাযোগ করার যশোরে ফিরে যাবার আগে।

বাংলাদেশে আর কোন রাজনৈতিক শক্তি কাজ করছে? মওলানা ভাসানির ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি যুদ্ধে যোগ দিচ্ছে না আমাদের পত্রপত্রিকায় এরকম অতিসুক্ষ প্রচারণা সত্ত্বেও, এনএপি (ন্যাপ) খুব ভালোভাবেই দৃশ্যে অবতীর্ণ আছে। এই দলের একজন বিশিষ্ট নেতা এবং সাধারণ সদস্যরা যারা দিনাজপুর এলাকায় যুদ্ধ করছে তাদের সাথে আমার দেখা হয়েছে।

এটা মনে রাখতে হবে যে মুজিবের অনেক আগেই, ভাসানিই স্বাধীন বাংলাদেশের ডাক দিয়েছেন। ন্যাপ দাবী করে যে যদিও সবাই মুজিবকেই ভোট দিয়েছে, তারা স্বায়ত্তশাসনের দাবী থেকে একধাপ এগিয়ে পরিপূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে এসেছে ন্যাপের কল্যাণেই। আলোচনার সময় তারা যে সমাবেশগুলো পরিচালনা করে তাতে মুজিবের উপর চাপ সৃষ্টি হয় এবং কোন সমঝোতায় পৌঁছানো ব্যাহত হয়, ন্যাপের নেতৃবৃন্দ দাবী করেন।

তবে ন্যাপ স্বীকার করে যে তারাও পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কাছে অপ্রস্তুত অবস্থায় ধরা পড়ে। জনগণকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত না রাখার দায় আওয়ামী লীগের পাশাপাশি তাদেরও নেয়া উচিত।

সমন্বয়
ন্যাপ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তারা একটি সমন্বয়কারী কমিটি গঠন করবে অন্যান্য বামপন্থী দলগুলোর সাথে এবং মুজিবের নির্বাসিত সরকারের সাথে যোগাযোগ রাখবে এবং দীর্ঘ-মেয়াদী যুদ্ধের প্রস্তুতি নেবে। এই দলটি বর্তমান এই সংগ্রামকে একটি জাতির স্বাধীনতার যুদ্ধ হিসেবে দেখছে এবং তারা চায় সর্বস্তরের জনগণকে এই যুদ্ধে সম্পৃক্ত করতে। আওয়ামী লীগের মতো গতানুগতিকধারার যুদ্ধের উপর নির্ভর না করে, ন্যাপ গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ন্যাপের যে নেতার সাথে আমার দেখা হয়েছিল সে পূর্ব বাংলার একমাত্র নেতা যে আমাকে সরাসরি বলেছিলঃ “আমরা তোমাদের কাছ থেকে কোন সহযোগিতা আশা করিনা। এটা আমাদের যুদ্ধ এবং আমরাই এটি লড়বো। খোদার দোহাই লাগে, তোমরা তোমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে আমাদের রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে বলো”।
ন্যাপ, মনে হচ্ছে, পূর্ব বঙ্গের তিনটি নকশালপন্থী দলের সহযোগিতা পেতে সফল হয়েছে। তোহা’র দল, যেটি অফিসিয়াল কম্যুনিস্ট পার্টি অব ইস্ট পাকিস্তান (মার্ক্সসিস্ট-লেনিনিস্ট) এর নেতৃত্ব দিচ্ছে সেটি এখনও সমন্বয় কমিটিতে যোগ দেয়নি।

পূর্ব বাংলার সিপি (এমএল) দলটি ভিন্ন ধারায় চিন্তা করছে, যদিও তারা এই স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করছে। তারা এই যুদ্ধ সম্পর্কে বলে যে এটি “সাম্রাজ্যবাদীদের সহযোগিতায় ভুয়া জাতীয়তাবাদের যুদ্ধ”। এই সংজ্ঞাটি খুব সম্ভবত আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের প্রতি উদ্দিষ্ট। এই দলটি গুরুত্ব দেয় শ্রেণীসংগ্রামকে – জমিদারদের বিনাশ এবং জোতদার ও দরিদ্র গ্রামবাসীদের মধ্যকার বিরোধ দূর করতে। তারা চায় মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের আসল রূপ উদ্ঘাটন করতে।

এই ক্ষেত্রে ন্যাপ সিপি (এমএল) এর সাথে ভিন্নমত পোষণ করে। যেখানে ন্যাপ মনে করে যে আসল বিরোধটি হচ্ছে একটি জাতি হিসেবে বাঙালী এবং আক্রমণকারী পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মধ্যে, সেখানে সিপি (এমএল) বলতে চায় গ্রামাঞ্চলে এবং মেহনতি মানুষদের মধ্যকার সামন্ততান্ত্রিক বিরোধের কথা। তারা মনে করে যে আওয়ামী লীগের দ্বারা দরিদ্র গ্রামবাসীদের প্রতি অবহেলার কারণে, গ্রামবাসীদেরকে রাজনৈতিক শিক্ষা দেয়া এবং আওয়ামী লীগের আসল রূপ দেখানো সহজ হবে।
সিপি (এমএল) এর মতে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং স্থানীয় সামন্ত জমিদারদের সাথে লড়াই একইসাথে পাশাপাশি চলবে। তারা আশা করে যে যে গ্রামবাসীরা আজকে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে তারা আগামীকাল আবার ফিরে আসবে এবং অস্ত্র হাতে তুলে নেবে, প্রয়োজন হলে কেড়ে নেবে, নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য। সশস্ত্র সংগ্রামের এই কেন্দ্রগুলোতে রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলা হবে।

এই পর্যায়ে আন্দাজ করা কঠিন বাংলাদেশে ভবিষ্যত ঘটনাবলী ঠিক কোন দিকে মোড় নেবে, বা কোন দলটি নেতৃত্বে থাকবে। কিন্তু এটুকু পরিস্কার যে পাতি বুর্জোয়া দলগুলো ধীরে ধীরে তাদের জায়গা হারাবে এবং অন্য দলগুলোকে পথ ছেড়ে দেবে, যুদ্ধরত দলগুলোর কাজ করার ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। আসন্ন বর্ষাকালের কারণে, যুদ্ধক্ষেত্র কিছুটা শান্ত থাকতে পারে। এই সময়ে, ন্যাপ এবং অন্যান্য দলগুলো হয়তো তাদের কার্যক্রম সমন্বয় করার চেষ্টা করবে এবং প্রতিরোধ দল গড়ে তুলবে এবং গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেবে। এই প্রতিরোধের ধারায় একসময়, সিপি (এমএল) এর কল্পিত এই শ্রেণী বিবাদ আরো ধারালো হবে।

ইতোমধ্যে, আমাদের পত্রিকাগুলো রোমাঞ্চকর প্রতিবেদন প্রকাশ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। আর কোন চমৎকার বিজয়ের সংবাদ থাকবে না। পরিদর্শনকারী সাংবাদিকের দৃষ্টির অনেক বাইরে চলতে থাকবে এই যুদ্ধ। মুক্তি যোদ্ধারাও বেঁচে যাবে আমাদের সাংবাদিকদের দায়িত্বজ্ঞানশুন্য প্রতিবেদন প্রকাশ করার কারণে বিপদে পড়ার হাত থেকে, এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীও আমাদের পত্রিকায় প্রকাশিত বিজয়ের ভুয়া খবর নিয়ে আনন্দ উদযাপনের হাত থেকে রক্ষা পাবে।

শিরনাম সূত্র তারিখ
২৭৬। বাংলাদেশ প্রশ্নে জাতিসঙ্ঘের প্রতারণা নিউ এজ ২৫ এপ্রিল ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৭৬, ৭১৭-৭১৮>

নিউ এজ, ২৫ এপ্রিল, ১৯৭১
বাংলাদেশ বিষয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত এর ধাপ্পাবাজি প্রকাশিত

মার্কিন রাষ্ট্রদূত এর ধাপ্পাবাজি ধরা পরেছে। কেনেথ কেটিং ঘোষণা করে যে পূর্ব বাংলায় সম্প্রতি যে রক্তাক্ত ঘটনা ঘটছে এ নিয়ে তার সরকারের মাথাব্যাথা নেই কারণ এটি পাকিস্তানের একটি অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। কোন ভিত্তি না থাকা সত্ত্বেও গ্যালারিতে খেলার এটা একটা আমেরিকান পলিসি।

তিনি বললেন – অভ্যন্তরীণ ব্যাপার শব্দটিকে খেয়াল করা হয়নি। এটি অবশ্যই অভ্যন্তরীণ ব্যাপার না। কেটিং ১৫ এপ্রিল বম্বেতে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ঘোষণা করেন।

বড়জোর চার দিন আগে এই বেলুন ফাটানো হল। স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে আসা সরকারী শব্দ কেটিং কে এই পরিস্থিতিতে আনল এবং মার্কিন অবস্থান সুপরিচিত করল আবারো। ওয়াশিংটনে ডিপার্ট্মেন্টের প্রতিনিধি রবার্ট ম্যাকক্লস্কি স্পষ্টভাবে বলেছেন কেটিং এর বোম্বেতে দেয়া বিবৃতি যা তিনি ২ এপ্রিল দিয়েছিলেন সেখানে তিনি বলতে চেয়েছেন যে, “এটি আমাদের দর্শন ছিল, পাকিস্তানে যা চলছে তা হল তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার”। এবং সেই ব্যাপারে মার্কিন সরকার উদ্বিগ্ন ছিল।

আমেরিকান ট্যাংকের অ্যাকশন

ভারতে আমেরিকান লবি চেষ্টা করছে পুর্ব পাকিস্তান ইস্যুতে মার্কিন অবস্থানের কারণে তাদের উপর যে বিরূপ অবস্থান আছে তা যেন একটু নরম করা যায়। তারা বলেন আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিকূলে নই। বাস্তব পরিস্থিতিতে একথা বিশ্বাস করার কোন মানে নেই। একই ডিপার্ট্মেন্টের প্রতিনিধি ম্যাক ক্লস্কি কিছুদন আগে বলেন যে ১৯৬৬-৬৭ থেকে পাকিস্তানে বাণিজ্যিক ও ক্রেডিট টার্মে দেয়া মিলিটারি আইটেম এর পরিমাণ বছরে গড়ে ১০ মিলিয়নের একটু নিচে আছে। এর মধ্যে ২৫% অর্থাৎ আড়াই মিলিয়ন ডলার আছে গোলাবারুদ। (ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন, ১৫ এপ্রিল, ১৯৭১)

এই কথায় আগে তারা যা বলেছিল সেটা মিথ্যা প্রমাণিত হল। তারা বলেছিল ১৯৬৬-৬৭ থেকে ইসলামাবাদকে তারা যেসব মিলিটারি পণ্য দিয়েছে সেগুলো প্রাণঘাতী নয়। আমেরিকা বলেছিল সাপ্লাই হিসেবে মিলিটারি পারসনেল ক্যারিয়ার ও যোগাযোগ রক্ষার যন্ত্রাংশ দেয়া হয়েছে। এখন তাদের স্বীকার করতে হবে যে যেসকল বুলেট ও বোমায় পুর্ব পাকিস্তানের মানুষ হত্যা করা হচ্ছে তার বেশিরভাগ আমেরিকা থেকে পাওয়া।

এবং তার সাপ্লাই এখনো চলমান। যদিও ভারত ও বাংলাদেশ সরকার বারবার আমেরিকাকে নিষেধ করে এসেছে।

এর আগে নিউ ইয়র্ক টাইমস এ খবর প্রকাশের পর ওয়াশিংটন ব্যুরো ১১ এপ্রিলের তা স্বীকার করে জানায় যে আমেরিকা পাকিস্তানে গোলাবারুদ ও খুচরা যন্ত্রাংশ যে প্রোগ্রাম অনুসারে পাঠাচ্ছে তা ১৯৬৭ সালের।

ক্রমবর্ধমান প্রমাণ আছে। কারণ পাকিস্তানি সেনারা দেশের পূর্ব অঞ্চলে বাঙ্গালি নাগরিকদের স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনে ধ্বংসপ্রাপ্ত আমেরিকান ট্যাংক, জেট বিমান এবং অন্যান্য সরঞ্জাম ব্যবহার করার প্রমাণ সেখানে মিলেছে।

“এই সরঞ্জাম ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৫ সালের সময়ের। সেই সময়ে আমেরিকা পাকিস্তানে আরও অস্ত্র পাঠিয়েছিল। পরে তাতে নিষেধাজ্ঞা হয় ১৯৬৭ সালে।(ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন, ১২ এপ্রিল , ১৯৭১)

যখন পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তার হাতে আমেরিকার অস্ত্রে পূর্ব পাকিস্তানে জবাই চলছে তখন আমেরিকা ১৯৬৬-৬৭ সালের চুক্তির ধারাবাহিকতায় পাঠানো অস্ত্র চালানের উপর নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছেনা। এবং তেমনটা মনেও হচ্ছে না। আটলান্টিকের অন্য প্রান্ত থেকে তাদের অন্য ভাইয়েরা এখন উপদেশ দিচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী যেন তাদের প্রতিরোধ বন্ধ করে এবং ভেড়ার মত জবাই হতে নিজেদের সমর্পন করে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে ২১ এপ্রিল লন্ডনের বার্তা দিয়ে বলা হয় –

“ব্রিটেনে একটি বিচক্ষণ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তারা এখানে পূর্ববাংলার রাজনৈতিক সার্কেলকে বলেছে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ পরিত্যাগ করার জন্য..”

মার্কিন ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা পূর্ববাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের চূর্ণ হতে দেখতে চায়। যাতে করে ইয়াহিয়া এবং তার পরবর্তিরা কয়েক দশক ধরে নির্বিঘ্নে শাসন করতে পারে। যখন কেটিং ভারতের মাটিতে বসে মধুমাখা শব্দাবলী উচ্চারণ করছিলেন তখন সাগরের ওপারে তার সতীর্থরা প্রতি মুহূর্তে বাংলাদেশের যোদ্ধাদের পেছন থেকে ছুরিকাঘাত চালিয়ে যাচ্ছিল।

আমেরিকা ও ব্রিটেনে গণতান্ত্রিক মতের পক্ষের লোক বাড়ছে এবং তাদের দেশের কাছে আবেদন তারা এই হত্যাকাণ্ডের সাথে যেন হাত না মেলায় এবং বাংলাদেশের দাবি মেনে নেয়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৭৭। কলকাতা ও ঢাকায় ডেপুটি হাই কমিশন অফিস বন্ধ হচ্ছে আনন্দবাজার পত্রিকা ২৫ এপ্রিল, ১৯৭১

Kamol Roy
<১৪, ২৭৭, ৭২৯-৭২০>

কলকাতা ও ঢাকায় ডেপুটি হাই কমিশন অফিস বন্ধ হচ্ছে
বিশেষ সংবাদদাতা

নয়াদিল্লী, ২৪ এপ্রিল- পাকিস্তান এবং ভারত আগামী সোমবারের মধ্যে ভারতের ডেপুটি হাইকমিশন অফিস বন্ধ করে দিচ্ছেন। গতকাল ইসলামাবাদে ভারতের অস্থায়ী হাইকমিশনারের কাছে এবং আজ পাকিস্তানী হাইকমিশনার কর্তৃক পররাষ্ট্র দফতরের সচিব শ্রী এস কে ব্যানার্জির কাছে প্রদত্ত নোটে পাকিস্তান কলকাতায় ডেপুটি হাই কমিশন অফিস বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষনা করেন।

এ নোটে ভারতকেও ঢাকায় তারা ডেপুটি হাইকমিশন অফিস বন্ধ করতে হলা হয়। ভারত তাতে রাজে, তবে পাকিস্তানের এই সিদ্ধান্তে দুঃখিত। পাকিস্তানী নোট অনুসারে সোমবারের মধ্যেই এই দুই অফিস বন্ধ হয়ে যাবে এবং উভয় অফিসের কর্মী এবং তাদের পরিবারবর্গ স্থান ত্যাগ করবেন।

ভারত পাকিস্তানের এই সিদ্ধান্তকে কূটনৈতিক মারপ্যাঁচ বলে উল্লেখ করেছে। ভারতের বৈদেশিক দফতরের একজন মুখপাত্র আজ এখানে বলেন, কলকাতায় পাক ডেপুটি হাইকমিশনার শ্রী মেহেদী মাসুদকে সম্ভাব্য সব রকমের সুবিধাই আমরা দিয়েছিলাম। বাংলাদেশের নাগরিকদের উপর অমানুষিক অত্যাচারের ফলে জনসাধারণের চরম বিক্ষোভ থাকা সত্ত্ব্বেও নিরাপত্তা রক্ষী ও পুলিশ অফিসাররা শ্রী মাসুদের ব্যক্তিগত নিরপত্তা রক্ষার প্রশংসনীয় কাজ করেছেন।

একটি নিরাপদ জায়গায় ডেপুটি হাইকমিশনারকে যথাযোগ্য স্থান করে দেওয়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। এই সুবিধার সুযোগ উপেক্ষা করে কলকাতায় অফিস বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে এবং ঢাকায় আমাদের ডেপুয়াতি হাইকমিশন অফিস বন্ধ করতে বলে পাকিস্তান যা করল তা দুঃখবহ। পাকিস্তানের পক্ষে এই পূর্ব পরিকল্পিত এবং ইচ্ছাকৃত কূটনৈতিক চাল নিন্দনীয়।

পাকিস্তানী নোটে কর্মী এবং তাঁদের পরিবারবর্গের স্বদেশযাত্রার ব্যাপারে যে পদ্ধতির কথা বলা হয়, ভারত তাতে সম্মতি জানিয়েছেঃ
ক। পাকিস্তান ইন্টারন্যাশলান এয়ারওয়েজ ভারতীয় কর্মী এবং তাদের পরিবারবর্গকে করাচি থেকে ঢাকায় আনবেন।
খ। কলকাতায় পাকিস্তান কর্মী এবং পরিবারবর্গকে আন্তর্জাতিক পরিবহনে করাচি যেতে ভারতী কর্তৃপক্ষ সুযোগ দেবেন।
গ। ইসলামাবাদের ভারতীয় হাই কমিশনের ব্যবস্থায় ভারতীয়রা করাচি থেকে দিল্লি যেতে পারবেন।
পাকিস্তান অবশ্য ভারতকে এই অনুরোধও করেছে যে, পাক হাইকমিশনারকে যেন কলকাতায় ডেপুটি হাইকমিশনের বাড়ি, সরকারী সম্পত্তি, তহবিল ও নথিপত্রের অধিকার দেওয়া হয়।

ভারতীয় অফিসের অফিসাররা কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাসও ফেলেছেন। কারণ এতে কূটনৈতিক যে বাধা সৃষ্টি হয়েছিল তার দূর হওয়ার লক্ষন রয়েছে। এখন ভারতীয় কর্মী এবং তাঁদের পরিবারবর্গ যাতে ভারতে আসতে পারেন, তা দেখার বর্তাল এখন পাকিস্তানের উপর। অবশ্য ভারতকেও অনুরূপ দায়িত্ব নিতে হবে।

বাধা রইল শুধু অস্থাবর সম্পত্তি যেমন, মোটরগাড়ি, রেফ্রিজারেটর প্রভৃতি জিনিস সম্পর্কে যা নাকি এখনই বিমানে পাঠানো যাবে না। তবে তা উভয়ের পক্ষেই প্রযোজ্য। স্থানত্যাগে পরিবহন ব্যাপারে দুই দেশের সুবিধা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে পরিকল্পনা জানিয়েছে। ভারত বলেছে, আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুযায়ী স্থির হবে। পাকিস্তানের বক্তব্য যথেষ্ট পরস্পরবিরোধী। কর্মী এবং পরিবারবর্গের স্থানত্যাগের সঙ্গে গাড়ি ইত্যাদি কথা না থাকায় আশংকা হচ্ছে এ নিয়ে কিঞ্চিত গোলমাল দেখা দেবে।

পাকিস্তান বলেছে, বাংলাদেশে সবই স্বাভাবিক। স্বাভাবিক অবস্থায় ঢাকায় ভারতীয় কর্মীরা ভারতীয় পথেই আসতে পারেন। অথচ মনে হচ্ছে, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য এই পথে আসা সম্ভব নয় বলে পাকিস্তানকে এ ব্যাপারে আগেই সবকিছু জানিয়েছে।

নতুন ওই পরিস্থিতিকে বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতিদানের পথ আরও পরিষ্কার হল। যদিও তার মানে এই নয়, অদূর ভবিষ্যতে ভারত তাই করতে যাচ্ছে। তবে এটা ঠিক, এর ফলে ভারতের কাছে পাকিস্তান বলতে রইল শুধু খন্ডিত পাকিস্তান যার নাম পশ্চিম পাকিস্তান।
আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৫ এপ্রিল, ১৯৭২

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৭৮। ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাসের কর্মচারিরা অন্তরীন স্টেটসম্যান ২৮ এপ্রিল, ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৭৮, ৭২১>

স্টেটসম্যান, ২৮ এপ্রিল, ১৯৭১
ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাসের কর্মচারিরা অন্তরীন
দিল্লি কূটনৈতিকদের ফিরিয়ে নেবার জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছে

নয়াদিল্লি – ২৭ এপ্রিল- ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্ক আরও খারাপের জন্য তার সাম্প্রতিক পদক্ষেপে ইসলামাবাদের সামরিক জান্তা কার্যত ইন্ডিয়ান হেড অব মিশন জনাব কে সি সেন গুপ্ত সহ ঢাকায় ভারতীয় উপ হাই কমিশনের কর্মীদের কার্যক্রম বন্ধ করতে বলেছেন। – ইউএনআই এবং পিটিআই রিপোর্ট।

ভারত সরকার এই পদক্ষেপটি ইসলামাবাদের প্রশাসনের সাথে দৃঢ়ভাবে তুলে ধরেছে। ইসলামাবাদ প্রশাসকের কাছে উল্লেখ করা হয়েছে যে এটি আগে দেওয়া আশ্বাসের বিপরীত এবং ভিয়েনা কনভেনশন লঙ্ঘন করছে।

পাকিস্তানি হাইকমিশনারের কাছে একটি শক্তিশালী বিক্ষোভ নোট ব্যক্তিগতভাবে জনাব সাজ্জাদ হায়দারকে পাঠানো হয়েছে – পাঠিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব জনাব এ কে রায়।

আজ রাতের বৈঠকে জনাব রায় পাকিস্তান হাইকমিশনারের কাছে ভারতীয় কর্মচারিদের দ্রুত ঢাকা থেকে ফিরিয়ে নেয়াড় ব্যাপারে কিছু প্রস্তাব দেবে। অফিসিয়াল ভাবে বলা হয়েছে যে এসব পদক্ষেপ প্রক্রিয়াকে সহজিকরন করার জন্য দেয়া হবে।

জনাব রায় জনাব হায়দারকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের সরকার থেকে এই প্রস্তাবের একটি উত্তর দিতে বলেছেন।
এখানকার কর্মকর্তারা আশা করছেন যে পাকিস্তান ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে উত্তর দেবেন।

এখানকার পর্যবেক্ষকরা মনে করেন যে কলকাতায় পাকিস্তানি ডেপুটি হাইকমিশনের কর্মীদের ব্যাপারে ভারত একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে বাধ্য হবে যদি ঢাকায় ভারতীয়দের নিয়ে আসার ব্যাপারে তাদের পদক্ষেপ না গ্রহণ করা হয়।

সরকার কর্তৃক পূর্ব অনুমতি ছাড়া ভারতে পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের বাইরে যাবার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দেবে নয়াদিল্লি দরকার। এর আগে ভারতীয় হাইকমিশনের একজন কূটনীতিক মিসেস সেন গুপ্ত এবং একজন কূটনীতিককে কুরিয়ারকে করাচী থেকে নয়া দিল্লি যাবার অনুমতি দেয়নি পাকিস্তান।

এখানে একজন বিদেশী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, সরকার ক্ষোভের সাথে শিক্ষা গ্রহণ করেছে অ তারা উদ্বিগ্ন যে ঢাকায় তাদের মিশন বন্ধ হবার সাথে সাথেই গতকাল থেকে ডেপুটি হাই কমিশনার, তার কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তাদের বাসভবনে গৃহবন্দি আছেন।

এদিকে ইসলামাবাদে একজন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র এটাকে ‘সম্পূর্ন মিথ্যা’ বলে মিসেস গুপ্তার মর্যাদাহানির অভিযোগকে অস্বীকার করেন।

রেডিও পাকিস্তানে মুখপাত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে জানায়, মিসেস সেন গুপ্ত ২১ এপ্রিল করাচী বিমান বন্দরে “ভুল পরিচয়” এর কারণে করাচী থেকে নয়াদিল্লী যেতে পারেননি। কিন্তু বিষয়টি আধা ঘণ্টার মধ্যে সমাধান করা হয়েছিল – মুখপাত্র বলেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৭৯। যুক্তরাষ্ট্রে বাঙালি কূটনীতিকদের বদলি করা হচ্ছে স্টেটসম্যান ২৮ এপ্রিল, ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৭৯, ৭২২>

স্টেটসম্যান, ২৮ এপ্রিল, ১৯৭১
যুক্তরাষ্ট্রে বাঙালি কূটনীতিকদের বদলি করা হচ্ছে

ইউ এন এইচ কিউ- ২৭ এপ্রিল- পাকিস্তানি সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রধান পদে তার বাঙালি কূটনীতিকদের বদলি করছে, খবর: গতকাল পিটিআই সূত্রটি জানিয়েছে।

তারা বলেছে পাকিস্তানের নিউইয়র্কের কনসাল জেনারেল জনাব এম এন এন চৌধুরী, ওয়াশিংটন মন্ত্রী মি এনায়েত করিম এবং তার ডেপুটি সকলকেই প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে অথবা তাদের কাজ পশ্চিম পাকিস্তান হস্তান্তর করা হয়েছে।

এই কোন পদক্ষেপই বাংলার ভাইস-কনসালের মতো নয়। তিনি জনাব এ এইচ মাহমুদ আলী, ইসলামাবাদের সাথে সমস্ত সংযোগ বাতিল করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তার আনুগত্য বজায় রাখার জন্য নিজের এবং তার স্ত্রীর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন।

ওয়াশিংটনে পাকিস্তানের দূতাবাস দাবি করেছে যে আলীকে ঘানাতে স্থানান্তর করা হয়েছে এবং ভ্রমণের জন্য সুবিধা দেয়া হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে তাকে ভিক্টিম করা হয়নি। জনাব আলী বলেন, তার মূলত অক্রেতে যাওয়ার কথা ছিল, তবে ২১ শে এপ্রিল এই আদেশ বাতিল করা হয়েছিল এবং তাকে অবিলম্বে ইসলামাবাদে পররাষ্ট্র দফতরে রিপোর্ট করতে বলা হয়েছে। জনাব আলী সংবাদদাতাদের তাকে দেওয়া সর্বশেষ আদেশ জারির কাগজ দেখান।

পাকিস্তানি দূতাবাস তাদের নেতৃস্থানীয় বাঙালি কূটনীতিকদের নতুন দায়িত্ব দেয়া বা স্থান পরিবর্তনের ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু জানায়নি। তবে, এটি জানতে পেরেছে যে নিউ ইয়র্কে কনস্যুল জেনারেলের দায়িত্ব পশ্চিম পাকিস্তানি কূটনীতিকের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। জনাব হায়াত মেহেদী, এবং যে মন্ত্রী, জনাব করিম, যিনি ওয়াশিংটনে রাজনৈতিক কাজ করছেন এদের প্রতিনিধিত্ব করছেন জনাব জাকি, তিনি ওটাওয়াতে পাকিস্তান হাই কমিশনের কাউন্সিলর।

আমেরিকার সোর্স বিশ্বাস করে যে, তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে আশ্রয় হবে কি না হবে সেটা বিষয় নয় – তবে মাহমুদ আলী ও তার স্ত্রীকে সম্ভবত থাকতে দেওয়া হবে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে চলে যেতে বাধ্য করার জন্য কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হবে না।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৮০-a। সীমান্তের ওপারের জনগণ সক্রিয় ফ্রন্টিয়ার ১মে, ১৯৭১

Nishat Oni
<১৪, ২৮০-a, ৭২৩-৭২৬>

ফ্রন্টিয়ার, ১মে, ১৯৭১
সীমান্তের ওপারের জনগণ সক্রিয়
কল্যান চৌধুরী

কিছু রাজনৈতিক চক্র বিশ্বাস করে না বাংলাদেশের গতিবিধিতে জনগণের অংশগ্রহন বলতে কি বোঝাচ্ছে। এটা সত্য, প্রধান যুদ্ধ উপকরণ হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস এবং পূর্ব বাংলা রেজিমেন্ট এর কর্মীবৃন্দ। কিন্তু তারা জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন কোন ইউনিট বা দল নয়। জনসাধারণ সক্রিয় এবং তাদের সর্বত সাহায্য করছে। এটা অনুভূতির লেভেলে কোন নিষ্ক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা নয়।

এটা কোন না কোন ভাবে সংগ্রামের এ পর্যায়ে জনসাধারণের সম্ভাব্য যুদ্ধ পারদর্শিতা ও এর অস্তিত্ব নিয়ে এক ধরণের পরস্পরবিরোধী বিশ্বাস। আমার সংগ্রামের সীমাবদ্ধ অভিজ্ঞতা (আমি বাংলাদেশে দেড় সপ্তাহ ধরে আছি, কৃষক-ভিত্তিক দিনাজপুর ও রাজশাহী দুই জেলা কাভার করছি) থেকে মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব পাহারায় থাক বা না থাক এই গতিবিধি অনিবার্য। যা আসলেই দরকার যে এই সম্প্রদায়ের উপর আওয়ামী লীগের একটা বড় কর্তৃত্ব অনস্বীকার্য যা চূড়ান্তভাবে কোনায় পৌঁছান অনিবার্য। একই সচেতনতা মাওলানা ভাসানীর জাতীয় আওয়ামী পার্টি ও অলি খানের এনএপি এর জন্য প্রযোজ্য।

কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আসন্ন বিদ্রোহের অনুমানে ইপিআর ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর ভুল করছেনা। কর্তৃপক্ষ একটি সসস্ত্র বিদ্রোহের সম্ভাবনায় সমভাবে সংবেদনশীল। একারণে জেনারেল ইয়াহিয়া খান গত ছয় মাস ধরে ইপিআর ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে অস্ত্রহীন করার পরিকল্পনা করছে, আংশিক অফিসিয়াল নির্দেশনায় এবং আংশিক জঘন্য কূটনীতির মাধ্যমে। নিরস্ত্র করার প্রোগ্রাম বিচক্ষণতার সাথে করা হয়েছে যখন ইপিআর এর বাঙালি কর্মীবৃন্দকে শহর ও ক্যান্টনমেন্টে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল ভারত সীমান্তের চলমান অবস্থার কারনে। সেনা অপভাষায় যাকে বলে “বোতলজাত করা”।
২৫শে মার্চের আগে পূর্ব পাকিস্তান প্রেস থেকে ছাপা হওয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী সেটা ছিল একটি সশস্ত্র বিদ্রোহের সূচনা। এর ৮ই মার্চের সংখ্যায় একটি ছবি ছাপা হয় যেখানে ছাত্রলীগের সদস্য, আওয়ামী লীগে সদরের ছাত্ররা, পাবনায় “মিলিটারি স্টাইলে” প্যারেডিং করছে। এর তাৎপর্য পরিস্কার যখন আওয়ামী লীগের অপরিহার্য অহিংস বেসামরিক অবাধ্য কার্যক্রম সম্পর্কে প্রাসাঙ্গিক কেউ মনে করিয়ে দেয়। এটা একধরণের নির্দেশনা যে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী ছাত্র শাখা সবসময় পার্টির পদ অনুসরণ করে অনুগত থাকবেনা। পরবর্তীতে দৈনিক পাকিস্তানের মার্চ ২২ ও পাকিস্তান অবসার্ভার এর মার্চ ২৩ এর প্রতিবেদনে দেখা যায় ছাত্রলীগ ইয়াহিয়া-মুজিব-ভুট্টোর আলাপচারিতার কার্যকারিতা বাতিল করেছে। এমনকি পরে তারা ঢাকা ও চিটাগাং এ পশ্চিম পাকিস্তান মোকাবেলার দাবিতে র্যানলি বের করে। মুজিবকে ‘আলোচনা’ বাদ দিয়ে সংগ্রামের নেতৃত্ব দেয়ার দাবি জানানো হয়।
আওয়ামী লীগের বাইরে মাওলানা ভাসানির জাতীয় আওয়ামী দলও দীর্ঘদিন ধরে একই ব্যাপার নিয়ে গোলমাল করছে। এনএপি’র সাধারণ সচিব, জনাব মশিউর রহমান আমাকে এপ্রিলের শুরুতেই বলেছিলেন তার দল স্বাধীনতা সম্পূর্ণ করার জন্য অনুরোধ করছে। ঢাকা র্যািলিতে তিনি কোন “ছয়-দফা বা একশ-দফা” অথবা “সায়ত্বশাসন” এর দাবি করেননি। তিনি স্বাধীনতার জোরালো পক্ষপাতি এবং এর কোন বিকল্প নেই যাতে বাংলাদেশের মাটি থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা আগ্রাসন উচ্ছেদ করার বৈধ দাবি জনগন করতে পারে।

পরিশেষে মুজিবর রহমানও অনিবার্যতা অনুভব করলেন। রমনা রেসকোর্স ময়দানে ঢাকার শেষ বক্তৃতায় তিনি স্বাধীনতার ডাক দিলেন, রক্ত অস্রুর বিনিময়ে হলেও। কিন্তু আওয়ামী লীগে সংগ্রামের কোন মহড়া হয়নি। এবং সকল ব্যবহারিক উদ্দেশ্যে, যে দল কখনো একটি সশস্ত্র আন্দোলনের পরিকল্পনা করেনি তারা শত্রু হিসেবে একটি প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর উপর তাদের নেতৃত্ব ধরে রাখার আশা করতে পারেনা।

তা সত্ত্বেও তিনি মুজিব, আর কেউ নয় মুজিব, যিনি বাংলাদেশে ‘আলোড়ন’ সৃষ্টি করেছেন। তিনি রাজনীতিতে বিশ্বাসী ও কর্মী সেটা আলাদা, এনএপি নেতা মশিউর রহমান বলেছেন মুজিব হয়তো কার্যক্রম সেট করাকে এড়িয়ে গিয়েছেন, কিন্তু সবশেষে যে সংগ্রাম উদ্দীপ্ত হয়েছে তাতে অনুমান করা অসম্ভব যে এই বৃহদায়তন অনুপাতের মধ্যে তিনি উৎক্রান্ত হবেন কিনা। জনাব মশিউর রহমান যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে কিছুটা ‘নেতিবাচক অবদান’।

জনাব মশিউর রহমান স্বাধীনতা শব্দটি ব্যাবহারে খুব উদ্ব্যক্ত। বর্তমান উত্থানের একটাই উদ্দেশ্য পশ্চিমা একনায়কতন্ত্র শেকল ছুঁড়ে ফেলা। বাঁধা বিপত্তি বা জানমালের ব্যাপক ক্ষতিও বাংলাদেশের জনগণের এই অভ্যুত্থানকে রুখতে পারবেনা, তিনি বলেন।

যারা মনে করছে বাংলাদেশের সংগ্রাম জনসাধারণের অংশগ্রহন উৎসাহিত করতে ব্যার্থ হয়েছে এবং উদ্বাস্তুদের প্রবাহ উল্লেখ করে যারা তাতে যুক্তি দেখাচ্ছে তাদের নোট করা দরকার যে, উদ্বাস্তুদের সংখ্যা, হোক পরিমানে বেশি, তা সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার অনুপাতে খুবই নগন্য। পাশাপাশি, উদ্বাস্তুদের বেশীরভাগই শিশু, নারী ও বৃদ্ধ লোক যেখানে সব যুবকরা তাদের ভূমিতে অবস্থান করছে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য।

জনসাধারণের অংশগ্রহণের ঘটনা বর্ণনাতীত। এপ্রিলের ২ তারিখে একটি সেনা সারি সীমান্ত ফাঁড়ি দিয়ে নবাবগঞ্জে আক্রমণের উদ্দেশ্যে রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়েছিল, যাত্রাপথে হামলার সম্মুখীন হয়। অবস্থা খুব নিদারুণ ছিল। কিন্তু যা ঘটল তা অনন্য। যখন খবর ছড়াল সৈন্যরা ট্যাঙ্ক নিয়ে আগাচ্ছে, প্রায় ৫০০০ জনতা তাদের কাছে যা ছিল- লাঠি, তীর ধনুক, বর্শা ও বন্দুক নিয়ে দল ধরে প্রতিরোধ করতে চলে এলো। এটা শুধু সাহসিকতার পরিচয় নয়। তারা ট্যাঙ্কের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ও তা কব্জা করে ফেলে, যদিও ভারী মুল্য দিতে হয়েছে। রণকৌশলগত জ্ঞান থেকে এটা দেখিয়েছে যে, রাগ-দমনের প্রকাশ হিসেবে জনগণ কোন আওয়ামী লীগ বা এনএপি নেতার নির্দেশনা ছাড়াই এটা করেছে। মুহূর্তের জন্য হলেও প্রশ্ন জাগে নেতৃত্বে পরাশ্রয়ী নির্ভরতা কি উধাও।

প্রতিরোধ বাহিনী
আমার সংক্ষিপ্ত ভ্রমনে দেখেছি এমন কোন গ্রাম নেই যেখানে প্রতিরোধ বাহিনী নেই। লাঠি, তীরের মত নগ্ন হাতিয়ার নিয়ে তারা সঙ্কল্প এবং আশার একটি পুর্নাঙ্গ ছবি। আবেগে ভরপুর, তারা পারবে! যাহোক, উচ্চতর শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তাদের যুদ্ধ কৌশল শেখা লাগবে। ইতিমধ্যেই তারা শত্রুদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধ সম্পর্কে সতর্ক এবং গেরিলা যুদ্ধের দিকে ঝুঁকছে।

আরো বেশি বাড়ি ঘুরে আমি দেখেছি যে যারা এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করছে, কিছু উল্লেখ করবো “ব্যাক্তি প্রতিনিধি”র একজন রাজশাহী জেলার রোহানপুরের মাঝি। এই গরিব লোক প্রতি রাতে তার নৌকায় করে দূরে মুক্তি বাহিনীর জন্য স্থানীয় গ্রামবাসীদের দেয়া খাবার বহন করে নিয়ে যায়। অথবা এই তরুন ছেলেটার কথাই ভাবা যায় যে তার পেট্রল-চালিত ট্রান্সমিশন সেটের জন্য ৪০ মাইল পথ সাইকেল চালিয়ে আমাদের এদিকে মাইদায় আসে জ্বালানির জন্য। এমন ‘ব্যাক্তি প্রতিনিধি’ অগনিত যারা পার্টি লাইন ক্রস করছে। পার্টি ধ্বংসের এই পর্যায়ে আওয়ামী লীগেকে প্রসারিত করে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা আন্দোলনে পশ্চিমদের নিয়ম নীতির বিপক্ষে দাড় করানোর “স্পষ্ট চাহিদা” সৃষ্টি হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ- এই সেই শব্দ। এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার পশ্চিমা রাজ্যশাসনের তথাকথিত শান্তি চুক্তিতে আর বসবেনা। আরো একটি বিষয় হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের অত্যাচারী শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আগ পর্যন্ত কোন বড় শক্তিও আর বাংলাদেশের জনগণকে কোন আলোচনায় বসাতে পারবেনা, বিশ্ব সম্রাটতন্ত্রের একজন সরাসরি প্রতিনিধি হিসেবে গৃহীত হয়েছে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধ ধারণায় ক্ষতি সাধন করে এমন কোন শর্তে বড় ক্ষমতাধর নতুন সরকার গঠিত হয়, বাংলাদেশের জনগন তা মেনে নেবেনা।

বাংলাদেশের জনগণের সাধারণ অনুভূতি বোঝানোর জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণীর কথা বলব যার কলকাতায় দেখা হয়েছিল। পঁচাশি বছর বয়স্ক একজন রাজনৈতিক নেতা ও পাকিস্তানের সাবেক মন্ত্রী যাকে তার কুমিল্লার বাড়ির সামনে হত্যা করা হয়, তার নাতি সে। ঘটনাটি তার চোখের সামনে ঘটে। ২৭শে মার্চ রাতে সৈন্যরা তাদের বাড়ি ঘেরাও করে এবং ডি এন দত্ত ও তার ছেলেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় যাকে আর্মির বায়োনেট চার্জে হত্যা করা হয়েছে বলে তদন্তে জানা যায়। মেয়েটি পালিয়ে বাঁচে। আমাকে বলল সে শরণার্থী হয়ে ভারতে থাকতে চায়না। “আমাকে বাংলাদেশে ফিরতে হবেঃ যারা আমার দাদু ও নির্দোষ চাচাকে মেরেছে সেই নরপশুর জঘন্য চেহারা আমি এক মুহূর্তের জন্য এমনকি ঘুমের মধ্যেও ভুলতে পারিনা। তাকে খুঁজে বের করে ঠিক সেইভাবেই মারবো যেভাবে তাদের মেরেছে”।

বিদেশি হস্তক্ষেপের কি মুল্য দিতে হবে সে ব্যাপারে মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী ভালভাবেই অবগত। তারা চায় না ভারত বা অন্যকোন জাতি এই দ্বন্দে সরাসরি জড়িত হোক। নেতা, সাধারন মানুষ যাকেই আমি দেখেছি তারা অস্ত্র, বোমা এই ধরণের জিনিস ছাড়া কোন বিদেশী ক্ষমতা বা সহযোগিতা চায় না। যুদ্ধের লক্ষ্য যোদ্ধাদের দ্বারাই সহজে নিষ্পন্ন হবে তারা এমন ধারণায় আচ্ছন্ন।

এটা অনস্বীকার্য যে বর্তমানের আন্দোলন কোন শ্রেণী দন্দ থেকে আসেনি। কিন্তু কঠোর শ্রেণী চেতনা পথ দেখাচ্ছে। দিনাজপুরের এসপি, একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন, তার স্ত্রী কে গ্রামের একটি ক্যাম্পে তথাকথিত নিন্ম শ্রেণীর মানুষদের সাথে রেখে এসেছেন যখন তিনি সম্মুখ অপারেশনে যুক্ত ছিলেন। তিনি বলেছিলেন শ্রেণিহীন হবার এটাই মোক্ষম সময়।

প্রশ্ন হল স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের মাটি উর্বর কিনা। আর্থ-সামাজিক বিশ্লেষণে দেখাতে পারে এটা ছিল। গত বছরের পাকিস্তানের বাজেটে ৭৫০ কোটি রুপির মধ্যে ৩৫০ কোটি নির্দিষ্ট করা হয়েছিলো সামরিক খরচের জন্য। বার্ষিক লোন পরিশোধে প্রায় ১৫০ কোটি যেখানে প্রশাসন রক্ষণাবেক্ষণ খাতে বরাদ্দ হয়েছিল প্রায় ১০০ কোটি। বাকি ১৫০ কোটি প্রধানত ব্যয় হয়েছিলো পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে যেখানে বেশীরভাগ বেসরকারি ও সরকারি সেক্টর ইউনিট গুলো অবস্থিত। অদ্ভুতভাবে, প্রতিরক্ষা খরচের ৩৫০ কোটি পূর্ব পাকিস্তান থেকে উত্তোলন করা হয়। পূর্ব পাকিস্তান বাজেট খরচের ৬৫% উঠায় চা, পাট ও তামাক বিক্রি করে এবং রাজস্বের বেশীরভাগ সেনা খাতে ব্যয় করে। ১৯৬৫ সাল থেকে পশ্চিম পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্র থেকে *** কোটি পায় সামরিক সহায়তা বাবদ। সবকিছু বিবেচনায়, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতিতে একটি জ্বলজ্বলে ভারসাম্যহীনতা বিদ্যমান। পরেরটিকে একটি উপনিবেশের চেয়ে মোটেই বেশি কিছু হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি।।

আরেকটি গোলমেলে ব্যাপার হচ্ছে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের অনেক জমি দেয়া যাদের পূর্ব পাকিস্তান থেকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। কোন সেনা কর্মকর্তা চাকরি থেকে অবসর নিলে তারা ৫০ থেকে ৩০০ বিঘা জমি পায়। অন্যদিকে এই বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত পশ্চিম পাকিস্তানি আর্মি অফিসাররা সামন্ততান্ত্রিক ভূস্বামীতে পরিণত হয় এবং শোষণের যন্ত্র হয়ে ওঠে। এসব পূর্ব পাকিস্তানিদের পশ্চিম দলের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের দুঃখের-কারন বা যা পরে পূর্ব পাকিস্তানিদের আহত করেছে যখন বিধ্বংসী সাইক্লোনের সময় কোন সেনা সদস্য তাদের সাহায্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। ঝড়ে বিধ্বস্ত এলাকার জনসাধারণের মৃতদেহ সরানোর জন্য আমেরিকান সেনাবাহিনীকে আসতে হয়েছিল। সৈন্যরা ছাড়াও পশ্চিম থেকে কোন রাজনৈতিক নেতা পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে সাইক্লোনের আঘাত হানা এলাকা পরিদর্শনে আসেনি।

………………………………

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৮০-b। রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়নের বাংলাদেশ কে স্বীকৃতি দানের আবেদন অমৃতবাজার পত্রিকা ৫ মে ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৮০-b, ৭২৭>

অমৃতবাজার পত্রিকা, ৫ মে ১৯৭১
রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়নের বাংলাদেশ কে স্বীকৃতি দানের আবেদন
– নিজস্ব সংবাদদাতা

পাণ্ডু, ৪ মে। এনএফ ৩০ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া ৪ দিন ব্যাপী আলোচনায় রেলওয়ে মজদুর ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেবার দাবি জানান।

কাউন্সিল “নির্দোষ ও স্বাধীনতার পক্ষের মানুষদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দ্বারা সেখানে গণহত্যার গভীরতা অনুভব করে।

সম্মেলনে প্রায় ২০০ প্রতিনিধি এবং অন্য সকল প্রস্তাবের প্রতিনিধিত্বকারী ১৯ টি শাখার প্রতিনিধিত্বকারী দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে, বাংলাদেশিরা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করছিল এবং পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য যুদ্ধ করছিল। ভারত ব্যতীত পৃথিবীর আর কোন দেশ তাদের নৈতিক সমর্থন প্রকাশ করেনি।

রেজুলেশনে যোগ করা হয়েছে যে যারা সেখানে সামরিক নিষ্ঠুরতা থেকে পালিয়ে গিয়েছিল এবং তারা সীমানা অতিক্রম করে শুধুমাত্র ভারতবর্ষে এসেছিল এবং এখানে সমস্যা হয়ে উঠেছিল। ভারত একা তাদের খাদ্য, বস্ত্র এবং আশ্রয়ের জন্য তাদের সম্পদ থেকে তাদের দিচ্ছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ, রেড ক্রস সংগঠন পুনর্বাসন সংস্থা, শরণার্থী সংস্থা কিছু বড় শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল – বলা হয় যে “বাংলাদেশের সংগ্রাম এখনো লকারে আছে”।

সভায় সভাপতিত্ব করেন বসন্তচন্দ্র ঘোষ, তিনি পটনার একজন সিনিয়র আইনজীবী, আরেকটি রেজুলেশনে আমেরিকান ট্রেড ইউনিয়নবাদকে বাদ দেওয়া হয়েছে “সুনির্দিষ্ট কাউন্সিলের আকারে” যা গতিশীল ও সুস্থ বাণিজ্যের অন্তরায়।

এছাড়া ৯ আগস্ট থার্ড পার্টি কমিশনের সামনে বিভিন্ন দাবির নিয়ে জেনারেল ম্যানেজারের অফিসের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৮১। ইয়াহিয়ার বায়না- বাংলাদেশ মিশনের সঙ্গে গোপন বৈঠক চাই যুগান্তর ৬ মে, ১৯৭১

Kamol Roy
<১৪, ২৮১, ৭২৮-৭২৯>

ইয়াহিয়ার বায়না- বাংলাদেশ মিশনের সঙ্গে গোপন বৈঠক চাইঃ
কূটনৈতিক বিনিময় কালও হয়নি
(বিশেষ প্রতিনিধি)

নয়াদিল্লী, ৫ মে- পাকিস্তানের একগুঁয়েমির ফলে আজও ভারতীয় এবং পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশন অফিসের কার্মচারীদের নিয়ে আসা, নিয়ে যাওয়া হয়নি। পাকিস্তান হাইকমিশনের দাবী, ডেপুটি হাইকমিশনার মিঃ মেহেদী মাসুদকে কলকাতা মিশনের সমস্ত কর্মচারীর সঙ্গে গোপনে এবং ব্যক্তিগতভাবে দেখা করতে দিতে হবে। ভারত সরকারের অভিমত, ব্যাপারটি পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার। তাঁরা কলকাতা মিশনের কাউকে এ ব্যাপারে বাধ্য করতে পারেন না। কাজেই পাকিস্তানের দাবী অবৈধ, অযৌক্তক এবং উদ্দেশ্য প্রণোদিত। এ শুধু কর্মচারী বিনিময় দেরি করার মতলাব।

পাক হাইকমিশনারের প্রেস কাউন্সিলর মিঃ এম আই বাট আজ এখানে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, ভারত সরকারের কাছে তাঁরা উপরোক্ত প্রতিশ্রুতি চেয়েছেন।

২৯শে এপ্রিলের নোটেও তাঁরা এই প্রতিশ্রুতি চেয়েছিলেন। পররাষ্ট্র দপ্তরের কাছে নোটটি পেশ করা হয়েছিল।

নোটের সারাংশ পাঠ করে শোনানোর কালে একজন সংবাদদাতা প্রশ্ন করেন, ব্যাক্তিগতভাবে দেখা করার কথা তো ওই নোটে নেই। মিঃ বাট কথাটা এড়িয়ে যান। নোটে শুধু বলা হয়েছিল ভারত সরকার যেন মিঃ মাসুদ ও শ্রী হোসেন আলিসহ (বাংলাদেশ মিশনের প্রধান) কয়েকজনের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ দেন।

মিঃ বাট বলেন, কলাকাতা মিশনের যে সব কর্মচারী পাকিস্তানে যেতে চান না- তাঁরা যে নিজেরাই স্বাধীনভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এ বিষয়ে পাকিস্তান নিশ্চিত হতে চায়। সকলের সঙ্গে একযোগে দেখা করলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে না। গতকাল মিঃ মাসুদের সঙ্গে শ্রী হোসেন আলি ও অপর কয়েকজনের দেখা হয়েছে বলে যে খবর পাওয়া গেছে সে ব্যাপারে মিঃ বাট কিছুই জানেন না। তিনি বলেন, মিঃ মাসুদ হাইকমিশনকে কিছু জানাননি।

পাকিস্তান এই সব শর্ত আরোপ করে ঢাকাস্থ ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশন অফিসের কর্মচারীদের নিয়ে আসার ব্যাপারে টালবাহানা করছেন,- এই অভিযোগ করা হলে মিঃ বাট তা অস্বীকার করেন।

প্রশ্ন করা হয়, ভারত সরকার কিভাবে কলকাতাস্থ বাংলাদেশ মিশনের কর্মচারীদের দেখা করতে বাধ্য করতে পারেন?

মিঃ বাট বলেন, তাঁরা একটা আপোষমূলক মনোভাবও দেখাতে পারেন। তিনি অভিযোগ করেন, গতকাল মিঃ মাসুদ ওদের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ভারত সরকার কোন সুযোগ সুবিধা দেননি।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৮২। এখনই ভারতের স্বীকৃতি বাংলাদেশের স্বার্থের অনুকূল হবে না আনন্দবাজার পত্রিকা ৮ মে, ১৯৭১

Aparajita Neel
<১৪, ২৮২, ৭৩০-৭৩১>

এখনই ভারতের স্বীকৃতি বাংলাদেশের স্বার্থের অনুকূল হবে না।
তবে মুক্তি আন্দোলনকে পূর্ন সমর্থন দেওয়া হবে –
শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী
বিশেষ সংবাদদাতা

নয়াদিল্লী, ৭ মে – আজ সকালে বিরোধী নেতাদের সঙ্গে বাংলাদেশ্নিয়ে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বৈঠকে বসেছিলেন। প্রায় সকলেই বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবী জানান। (ব্যতিক্রমঃ বিকানীরের মহারাজা ডঃ করণি সং এবং মুসলিম লীগ নেতা মহম্মদ ইসমাইল। দুজনের বক্তব্যে অবশ্য কিছু পার্থক্য ছিল। সকলের কথা শোনার পর প্রধানমন্ত্রী যা বলেন তার মর্ম এইরকমঃ বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের প্রতি ভারত পূর্ন সমর্থন জানাবে, কিন্তু বাংলাদেশকে এখনই কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়া এই দেশেরই স্বার্থের পরিপন্থী হবে। সারা বিশ্বে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি প্রচুর সহানুভূতি থাকলে ও স্বীকৃতির ব্যপারে ভাবনাচিন্তা চলছে। তবে তাজউদ্দিন সরারকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না এমন কথা তিনি বলেননি বা সরকার এ ব্যাপারে ঠিক কি করবেন, তার কোন আভাস দেননি। শুধু স্পষ্টভাবে তিনি বলেন যে, কোন অবস্থাতেই ভারত ভীত নয়।

ইন্দিরাজী বলেন যে, পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে নানা উস্কানিমূলক কাজ করছে। ভারতকে নানাভাবে বাংলাদেশের ব্যাপারে জড়াতে চাইছে। যা-ই হোক, ভারত যা ঠিক মনে করবে, তা করতে ভীত নয়।

দুই ব্যাতিক্রমঃ অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের দাবীর বিরোধিতা করেন বিকানীরের মহারাজা ডঃ করণি সিং। তিনি লোকসভায় কয়েকটি ছোট গোষ্ঠী ও কয়েকজন নির্দল সদস্যের নেতা। সেই গোষ্ঠী ও ব্যাক্তিরা অবশ্য আগেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার দাবী জানিয়েছেন।

ডঃ করণি সিং এর বক্তব্যঃ বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন আসলে ‘বাঙ্গালীদের বিদ্রোহ’। ভারতে এই ধরণের ব্যাপার ঘটলে সরকার কী করতেন? কাশ্মীরের কথাও ভাবা দরকার।

ইন্দিরাজি তাকে বলেনঃ কাশ্মীরে যারা হাঙ্গামা বাধাতে চায় তারা জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের পিছনে বিপুল গরিষ্ঠ সমর্থন রয়েছে। বাংলাদেশে গরিষ্ঠ অভিমত পাকিস্তান দাবীয়ে রাখতে চাইছে।

মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ ইসমাইল যা বলেন তার মর্মঃ এমন কিছু করা ঠিক হবেনা যাতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ে বা কোন সংকট সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে ঐ ধরণের সংকট দেখা দিতে পারে। তবে সরকার এব্যাপারে যেকন ব্যাবস্থাই নিন না কেন তাঁর প্রতি তাদের দলের সমর্থন থাকবে।

ইন্দিরাজি বলেন যে বাংলাদেশের ব্যাপারকে কেন্দ্র করে কিছু লোক সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করতে চাইছে। সকলকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকবে হবে।

স্বীকৃতির স্বপক্ষে জোর দাবী

অধিকাংশ বিরোধী নেতা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য জোর দাবী জানান। পরিস্থিতি সম্পর্কে ইন্দিরাজির বিশ্লেষণ তাঁরা মেনে নেননি। তাঁরা বলেন যে, বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তব সত্য। স্বীকৃতি দিয়ে সরকার শুধু সেই সত্যটিকেই মেনে নেবেন আর তাতে সেখানকার আন্দোলন জোরদার হবে। ভারত এ বিষয়ে দেরি করলে ভারতেরই ক্ষতি হতে পারে।

এ দাবী জানান – সি পি এম, সি পি আই, ডি এম কে, জনসঙ্ঘ, আদি কংগ্রেস, পি এস পি, সে এস পি, ফঃ-বঃ, আর এস পি। শ্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত (সি পি আই) তাঁর দলের পশ্চিমবঙ্গ কমিটির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে একটি স্মারক দেন। শ্রী এ কে গোপালন (সি পি এম) বলেন যে, পাকিস্তানকে ভয় না করে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সব রকমের সাহায্য দেওয়া হোক। শ্রী কে মনোহরণ (ডি এম কে) শ্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী (জঃ সঃ), শ্রী চিত্ত বসু(ফঃ বঃ), শ্রী ত্রিদিব চৌধুরী (আর এস পি), শ্রী এন জি গোরে (পি এস পি) ও শ্রী এস এন মিশ্র (আদি কং) একই দাবী তোলেন।

ত্রাণকার্য সম্পর্কে আলাদা বৈঠক বসবে
প্রধানমন্ত্রী বলনে যে, পাকিস্তানী ফৌজের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য এপর্যন্ত প্রায় ১৫ লক্ষ লোক ভারতে এসেছেন। আরও আসবেন। এজন্য ত্রাণকার্য সম্পর্কে কি করা যায় সে বিষয়ে আলোচনার জন্য তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বিরোধী নেতাদের সঙ্গে পৃথক একটি বৈঠকে বসবেন। (অর্থমন্ত্রী শ্রী চরণ নাকি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে এজন্য ৬০ কোটি টাকার দরকার।) তবে ঐ বৈঠক কবে বসবে আজ তা প্রকাশ হয়নি। ভারত চায় যে, এই ত্রাণকার্য আন্তর্জাতিক রূপ নিক।

ইন্দিরাজি আরও বলেন যে, বাংলাদেশের আগে দুই ডিভিশন পাক ফৌজ ছিল। এখন আছে চার ডিভিশন। শহরগুলি অধিকাংশ পাক ফৌজের দখলে আছে। গ্রামাঞ্চলের বহু এলাকাই এখনও মুক্তিফৌজের নিয়ন্ত্রণে। গেরিলা তৎপরতা চালিয়ে তাঁরা পাক ফৌজের তৎপরতা সাফল্যের সাথে মোকাবিলা করছেন।

কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার বৈঠক
নয়াদিল্লী, ৭ মে- প্রকাশ, বাংলাদেশ সম্পর্কে আলোচনার জন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা আজ এক বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠক পূর্ব নির্ধারিত ছিলনা।

বিরোধীদল ও নেতাদের সঙ্গে আলোচনার পরেও প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী স্বল্প সময়ের নোটিশে তাঁর সহকর্মিদের ঐ বৈঠকে আহ্বান করেন।

এক ঘণ্টা ব্যাপী বৈঠকে শ্রীমতী গান্ধী বিরোধী নেতাদের সঙ্গে তাঁর আলোচনার বিষয়ে সহকর্মিদের অবহিত করেন।

– পি টি আই

শিরনাম সূত্র তারিখ
২৮৩। পূর্ব বাংলার ঘটনা প্রবাহের ওপর ফ্রন্টিয়ার পত্রিকার একটি সমীক্ষা ফ্রন্টিয়ার ৮ মে ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৮৩, ৭৩২-৭৩৪>

ফ্রন্টিয়ার, ৮ মে কলকাতা, ১৯৭১
পরবর্তী ধাপ
পূর্ববাংলা
– কে সেন

বাংলাদেশে যুদ্ধ প্রায় এক মাস হয়ে গেল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তিনি বলেছিলেন যে তিনি ৪৮ ঘনতায় এই আন্দোলন শেষ করতে পারবেন সম্ভবত তিনিও অবাক হবেন যে তা করা যায়নি যদিও তা আর্মির বিরুদ্ধে ছিল। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার অস্বস্তি ভোগ করছে কারণ তারা মুদ্রার মূল্যহ্রাস করতে সম্মত হয়েছে। অন্যদিকে হাজার হাজার শরনার্থি ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ছে এবং এমনকি যদি তারা যা বলে তার ভগ্নাংশ সত্য হয় তবে তা আর সোনার বাংলা নাই যা তারা দেখে এসেছিল। শহরগুলি প্রায় ফাঁকা এবং সুবিশাল গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ বিধ্বস্তপ্রায়।

তারপরেও যুদ্ধ চলছে। এখনো তেমন কোন দিন নেই যে মুক্তিফৌজ তাদের বিজয় দাবি করতে পারে। এটা এখন শুধু যুদ্ধ করতে করতে মারা যাওয়া অথবা শেষ পর্যন্ত মারা যাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ। প্রথমটাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হয়। ঢাকা সাংবাদিকরা সম্প্রতি নতুন করে গ্রুপিং দেখেছেন। সেটা খুব দেখার মত বিষয় হবে।

রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া একটি দীর্ঘায়িত যুদ্ধ হতে পারে না। মুক্তিফৌজ বর্তমানে পার্লামেন্টারি ফোর্সের একটি আধাসামরিক বাহিনী। যতদূর সম্ভব তাদের প্রধান কাজ হিসেবে প্রতিরোধ করা। যদিও পত্রিকায় বাড়ীয়ে লেখা হয় – তবে বাস্তবে প্রতিরোধ তেমনটা হচ্ছে না। এটা সহজেই অনুমেয় কারণ তেমন প্রস্তুতি নেই। কিন্তু এখন আর্মি বাংলাদেশে গেড়ে বসেছে – কাজ হল এদেরকে বের করা। এবং রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে কিছু করা গেলে এই যুদ্ধ সফল হত যা ইতোমধ্যে বাংলাদেশে শুরু হয়েছে।

ডিসেম্বরের নির্বাচন আওয়ামী লীগ কে সামনে এনেছে। এবং পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের গণতন্ত্রকে উপেক্ষা তাদের (আওয়ামীলীগের) গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে। মুজিব পল্টন ময়দানে বজ্র কণ্ঠে কথা বলেছেন এবং তার দ্বাকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ একটি নতুন উচ্চতা লাভ করেছে। তারপর সেনাবাহিনী আঘাত হানে। আর সীমান্তের চারপাশে অনেক আওয়ামীলীগ নেতারা অবস্থান করছেন। এটি অনেককে হতাশ করেছে। জয় বাংলার উদ্দীপনা আগের মত নাই। এখন এই প্রশ্ন করার সময় এসেছে যে বাংলাদেশে এখন আওয়ামীলীগের প্রভাব খাটানোর মত ক্ষমতা আছে কিনা।

আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দল হিসেবে সুপরিচিত। এবং সব সময় চেষ্টা করেছে কিভাবে অবাঙ্গালি শাসকদের পরিবর্তে বাঙ্গালিদের শাসন চালু করা যায়। এই দলের লক্ষ্য ছিল অর্থণৈতিক অধিকার আদায় করা। মুজিব শেষ পর্যন্ত হলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়াবে। সে যখন এটা করেছে অনেক সময় দলের অধস্তনদের চাপ ছিল। তবে সব সময় সে চেষ্টা করেছে ইয়াহিয়ার সাথে একটি বোঝাপড়ায় আসতে। যেহেতু আলোচনা এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ তাই মুজিব বলেছে যে যদি সেনা শাসন চলে তাহলে কমিউনিস্টরা সুবিধা পাবে। তার এন্টি-কমিউনিজম সম্পর্কে সবাই জানে। একজন প্রায়ক্টিকাল রাজনীতিবিদ জানেন যে, তার দল সাংগঠনিকভাবে অথবা আদর্শগতভাবে দীর্ঘ সময়ের জন্য আন্দোলনে যাবার জন্য প্রস্তুত নয়। সম্ভবত তিনি বুঝতে পেরেছেন যে জাতীয় স্বাধীনতার আন্দোলনে তাকে কমিউনিস্টদের সাহায্যও লাগবে। এখন মনে হচ্ছে, তার কথাই সত্য হতে যাচ্ছে।

মুজিবের ভয় তিনি ভারত সরকারের সাথেও আলোচনা করেছেন। এবং মুক্তিফৌজের জন্য অস্ত্র সাহায্যের ব্যাপারেও বিব্রত হন। দিল্লি সরকার জানেন যে, আওয়ামীলীগের এই মুহুর্তে ক্ষমতা নাই অস্ত্র বাংলাদেশে নিয়ে যাবার। মিসেস গান্ধি ও তার সমর্থকরা নিশ্চই চাননা যে অযাচিত ব্যাক্তির হাতে অস্ত্র চলে যাক। এবং বর্ডারে এই পাশে কিছু একটা পথ বের করতে পারবেন। সরকার বাংলাদেশের ব্যাপারে কোন ব্যাবস্থা নিচ্ছেন না যাতে পশ্চিমবঙ্গে কোন প্রভাব পরে। অন্যদিকে দিল্লি ইসলামাবাদের সাথে নিহিত সম্পর্কের কারণে আশা করেনা যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় আসবে এবং আওয়ামীলীগ বাংলাদেশের ক্ষমতা পাবে। এটাও সন্দেহজনক যে ভারত এই অবস্থায় আরামে আছে কিনা যেখানে এমন একটি শক্তি জেগে উঠেছে। মুজিবের মত ইন্দিরাও অনড় আছেন বলে মনে হচ্ছে।

পাশাপাশি, বাংলাদেশের কম্যুনিস্টরা একটিভ আছে। আন্দারগ্রাউন্ডে। পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টী যার নেতৃত্বে আছেন আব্দুল মতিন, আলাউদ্দিন আহমেদ, টিপু বিশ্বাস ও অন্যান্যরা – তারা পশ্চিমবঙ্গের চি পি আই (এম) এর মত – এবং তারা বগুড়া, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা ও পাবনায় গেরিলা সংগ্রাম চালাচ্ছে। এদের শ্রমিক ও নিম্নশ্রেণির জনগণের সাথে প্রভাব আছে – প্রমাণ হিসেবে বলা যায় প্রায় ৪০০০০ শ্রমিক চট্টগ্রামে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। পি বি সি পি একটি ঘনিস্ট দল – সমন্বয়ে আছেন জাফর মেনন ও অন্যান্যরা যারা বিদ্রোহী ছাত্রদের মধ্যে অনেক জনপ্রিয়। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মওলানা ভাষানি ময়মনসিংহ, রংপুর, সিলেট, রাজশাহী ও অন্যান্য যায়গায় প্রায় একই রকম কাজ করছেন। কমিউনিস্টরা এখন একটা অসুবিধা অনুভব করছে যা অনেক বছর ধরেই আওয়ামীলীগ করে আসছে। ই পি আর, ইস্ট বেঙ্গল পুলিশ ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের লোকজনরাও তাদের উপড় বিরূপ। তবে বড় আন্দোলনে শেষ পর্যন্ত জনগণই আসল এবং কম্যুনিস্টদের তাদের সাপোর্ট হারাবার সম্ভবনা খুব কম।

পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) যার নেতৃত্বে আছেন প্রো-ভাসানী ন্যাপ এর সাবেক জেনারেল সেক্রেটারি মোহাম্মদ তোয়াহা -তিনি বর্তমানে মাওবাদী এবং যশোর ও খুলনায় শক্তিশালী ঘাঁটি আছে। রক্ষণশীলদের অনুমান দলের অঙ্গীকারবদ্ধ সমর্থকদের সংখ্যা ১০০০০ হবে। মাওবাদীরা এখন একটু নিচে আছে। তবে একটি জিনিসের জন্য তারা তাদের ট্রেইন্ড ফাইটারদের মাঠে নামাচ্ছেনা। তবে বাংলাদেশি বোদ্ধা রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন তাদের ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের সাথে যোগ দেবার সম্ভবনা আছে।

পি বি সি পি এবং পি পি সি পি (এমএল) এর মধ্যে পার্থক্য মূলত আদর্শিক। এবং ব্যক্তিগত ঘৃণায় তা রূপ নেয় নি। তবে এই পার্থক্য কমন শত্রুর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে তাদের একত্রিত হতে বাধা দেবেনা।

এই পরিস্থিতিতে এটা স্পষ্ট যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ভবিষ্যতে কোন দিকে যাবেন। আওয়ামী লীগ ভালর জন্য দূরে থাকবেনা। দলে বিদ্রোহীরা আছে, বিশেষ করে নিচের ক্যাডারে, সামনের আন্দোলনে যাদের যোগ দেবার সম্ভবনা প্রবল। কলকাতা ও মুজিবনগরের ভদ্র লোকদের জন্য – ব্যবহারিক উদ্দেশ্যেই তারা তাদের পক্ষে যা করার তা করবে বলে মনে হচ্ছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৮৪। চট্টগ্রামে পাক বর্বরতা অমৃতবাজার পত্রিকা ১২ মে ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৮৪, ৭৩৫>

অমৃতবাজার পত্রিকা, ১২ মে ১৯৭১
চট্টগ্রামে পাক বর্বরতা

চট্টগ্রাম, মে ১১ : গতকাল বৃহস্পতিবার পূর্ববঙ্গের এই বন্দরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক ব্যাপক শেলিং ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। সাধারণ জনগণের উপর ব্যাপক হত্যাকান্ড পরিচালিত হয়। খবর – এ.পি.

সেনাবাহিনী এখানে নিয়ন্ত্রণে আছে কিন্তু সৈন্যরা কক্সবাজারের গুরুত্বপূর্ণ শহরটি দখল করে নিয়েছে। মাত্র পাঁচ দিন আগে ১১০ কিলোমিটার দক্ষিণে অন্যান্য অঞ্চলে তারা মুক্তি ফৌজের মুখোমুখি হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দর তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি তবে সেখানে শ্রমিকের ওভাবে কার্গো জমে আছে যা দিয়ে আভ্যন্তরীণ পরিবহনে ব্যাবহ্রিত হয়।

চট্টগ্রামের শিল্পপতিরা বলেছেন, এখানকার অর্থনীতি ও কার্যকলাপ পুনরুদ্ধারের জন্য অনেক মাস লাগবে। ইস্পাহানি জুট মিলে ৭৫০০ শ্রমিকের মধ্যে মাত্র ২০ জন কর্মী তাদের পদে ফিরে আসেন এবং ম্যানেজার বলেন, “সবকিছুই কোথায় আছে সেটা দেখতে ছয় সপ্তাহ লাগবে”।

চট্টগ্রাম বন্দরে ডিসেম্বরে বন্দুকধারীররা একটি পাট ভর্তি ডকার জব্দ করেছে। শিপাররা অনুমান করেন যে বন্দরে ৪০০০০০ টন মালামাল বহন করা হতো, যা সাধারনত প্রতি মাসে ৩০০০০০ টন হ্যান্ডেল করতে পারে। নদীর অভ্যন্তরে এবং বাইরে পণ্য সরানোর একমাত্র উপায় হল নদী, যদিও এটি সাধারণত ট্র্যাফিকের ২৫ শতাংশ পরিচালনা করে।

অভ্যন্তরীণ জাহাজের ক্ষমতা বৃদ্ধি প্রণয়ন করার জন্য কোন পরিকল্পনা এখনো নেয়া হয়নি – বলেন শিপার।

চারপাশে পাহাড় সমৃদ্ধ সুন্দর গার্ডেন সিটিতে নির্মম যুদ্ধ সর্বত্র চলমান।

চট্টগ্রাম ছিল ছয় বিদেশী সাংবাদিকের চার দিনের সফরের সর্বশেষ স্টপ। ২৬ শে মার্চের নিষেধাজ্ঞার পর থেকে এরাই প্রথম সংবাদদাতা যাদের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এটি পূর্ববাংলায় কয়েক ডজন শহর ও শহরগুলির প্যাটার্ন প্রায় একই রকম। কুমিল্লাতেও সংবাদদাতারা দেখেছিলেন যে, ক্ষতি হয়ত কম ছিল কিন্তু পরিবেশ উত্তেজনাময় ছিল।

কুমিল্লা, যেটি ভারতীয় সীমান্ত বরাবর একটি ঘনবসতিপূর্ন এলাকা – যেখানে সৈন্যরা ব্যাপকভাবে আটমেটিক অস্ত্র সহ টহল দিচ্ছে।
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৮৫। দূতাবাস কর্মচারি বিনিময়ে সুইস মধ্যস্থতায় পাক- ভারত সম্মতি অমৃতবাজার পত্রিকা ১২ মে ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৮৫, ৭৩৬-৭৩৭>

অমৃতবাজার পত্রিকা, ১২ মে ১৯৭১
দূতাবাস কর্মচারি বিনিময়ে সুইস মধ্যস্থতায় পাক- ভারত সম্মতি
আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি

নয়া দিল্লি, মে ১১ – ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সপ্তাহ ধরে আটকে থাকা সমস্যা শেষ পর্যন্ত সুইস অফিসের মাধ্যমে মীমাংসা করা হয়েছে। ঢাকা ও কলকাতা তাদের নিজ নিজ মিশনের কর্মীদের প্রত্যাবাসন প্রশ্নে রাজি হয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অনুযায়ী, রাশিয়া এবং ইরান কর্তৃক সফল প্রচেষ্টার পর তৃতীয় পক্ষের সহায়তায় পাকিস্তান সুইস সরকারের কাছে এপ্রচ করে। তারা তাঁদের ভারত ও পাকিস্তানের ঢাকা ও কলকাতার ডেপুটি হাই কমিশন প্রত্যাবাসনের সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে এগিয়ে আসতে বলে।

নয়া দিল্লি থেকে সুইস রাষ্ট্রদূত ড ফ্রিটজ রিয়াল আজ বিকেলে পররাষ্ট্র সচিব জনাব এস কে ব্যানার্জীর সাথে দেখা করেন এবং প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেন – যা ভারত গ্রহণ করে।

এর কিছুদিন পরেই পাকিস্তান হাই কমিশনার জনাব সাজ্জাদ হায়দার, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব এস কে ব্যানার্জির সাথে দেখা করেন – যিনি সুইজারল্যান্ড কে বিষয়টা দেখতে বলেছিল।

প্রধান ঝাকি

পাকিস্তানের জোরাজুরিতে ঢাকা মিশন স্টাফকে সরানোর আবেদনের কারণ হল ডেপুটি হাই কমিশনার জনাব মাহেদি মাসুদ ভারত সরকারের থেকে সুবিধা নিয়ে তাঁদের কলিকাতা মিশনের সকলের ইচ্ছা পূরণ করবেন যারা বাংলাদেশের পক্ষে তাঁদের অবস্থান প্রকাশ করেছিলেন এবং পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন।

যেহেতু জনাব আলি হোসেন ও অন্যান্য সদস্যরা যারা কলকাতা মিশনে ছিলেন তারা জনাব মাসুদের সাথে একা বসতে একমত হচ্ছিলেন না তাই পাকিস্তান একজন মধ্যস্ততাকারির ব্যাবস্থা করে।

ভারতের অবস্থান ছিল যে এটা জনাব মাসুদ ও পাকিস্তান ডেপুটি হাই কমিশনের সদস্যদের মধ্যকার ব্যাপার। ভারত এর মধ্যে আসতে চায়নি। অথবা ভারত কাউকে জনাব মাসুদের সাথে সাক্ষাতের জন্যও চাপ দেয়নি। যদিও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জনাব হোসেন আলিকে অনুরোধ করেছে জনাব মাসুদের সাথে দেখা করার জন্য। কিন্তু যখন জনাব রসান আলি জনাব মাসুদের সাথে দেখা করতে গেলেন – কলাকাতা মিশনের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে – যারা বাংলাদেশের ব্যাপারে তাঁদের অভিযোগ করেছিল – তখন জনাব মাসুদ জোর করলেন যে তাদের সাথে আলাদা আলাদা দেখা করা উচিত। তাই জনাব হোসেন আলি ও গ্রুপের অন্যান্য সদস্যরা চলে গেল।

পদ্ধতিসমুহ
এটা জানা ছিল না যে কি পদ্ধতিতে সুইস অফিস এটা সমাধান করবেন। ইন্ডিয়া বিষয়টা নিয়ে যতটুকু অবগত আছে তাতে করে তারা মনে করে এটা সুইস ই পাকিস্তানের মধ্যেকার ব্যাপার। তারাই এটা সমাধান করবেন। ভারত এটা স্পষ্ট করেছে যে ঢাকা ও কলিকাতা মিশনের প্রত্যাবসন পারশপরিক সম্পর্কিত বিষয়। তবে তা সংখ্যার সাথে সম্পর্কিত নয়। আমাদের ঢাকা মিশনের সকল স্টাফ যারা ইচ্ছা প্রকাশ করেছে ভারতে আসার ব্যাপারে তাঁদের অনুমতি দেয়া উচিত। ভারত তাঁদের সবাইকে কলিকাতা মিশনে আসার সম্মতি দেবে যারা পাকিস্তান থেকে আসতে চায় কিন্তু কাউকে জোর করে সেখান থেকে আনবে না।

এটা দেখা যাছে যে সুইস প্রতিনিধিরা পাকিস্তান মিশনের লোকদের ইচ্ছা পূরণের জন্য তাঁদের কলিকাতায় আনার জন্য তৎপর আছেন। ঢাকায় সুইসদের কোন মিশন নাই। সুইসরা কলিকাতা মিশনের স্টাফদের সাথে একসাথে বা আলাদা কথা বলবে কিনা অথবা তারা সম্মিলিতভাবে বা আলাদা আলাদা করে কলিকাতা মিশন ও জনাব মাসুদের সাথে আলোচনা করবে কিনা – এগুলো সব নির্ভর করে সুইস অফিসের কার্যকারিতার উপর।

ভারত মূলত ঢাকা থেকে সকল স্টাফ এর প্রত্যাবসনের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন এবং পাকিস্তান মিশনের স্টাফদের কেউ যদি ইচ্ছা প্রকাশ করে তবে তারা তাকে কোন বাধা দেবেন না।

সুইস চেষ্টায় সমস্যাটা সমাধানের চেষ্টা চলছে। এবং সূক্ষ্ম আশা নিয়ে তারা অপেক্ষা করবে। গত ১৬ এপ্রিল ঢাকা ও কলিকাতা মিশন বন্ধ করা হয়েছে কারণ পাকিস্তান একচেটিয়াভাবে তাঁদের ডেপুটি হাই কমিশন বন্ধ করে দেয় এবং ভারতকে বলে ঢাকায় তাঁদের মিশন বন্ধ করে দিতে।

বন্ধ করে দেয়া মিশনের সদস্যদের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি কারণ পাকিস্তান ভারতকে জড়াতে চাইছে যদিও এটা সম্পূর্নভাবে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার।

শিরনাম সূত্র তারিখ
২৮৬। শরণার্থী শিবিরে শ্রীমতী গান্ধী আনন্দবাজার পত্রিকা ১৪ মে, ১৯৭১

Kamol Roy
<১৪, ২৮৬, ৭৩৮-৭৩৯>

শরণার্থী শিবিরে শ্রীমতি গান্ধী

পূর্বাঞ্চলের শরণার্থী শিবিরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখবেন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। রবিবার আসবেন তিনি বনগাঁয়। এই শিবিরগুলোতে ইতিমধ্যেই তিরিশ লক্ষ আতংকিত মানুষ মানুষ জড়ো হয়েছেন। আরও আসছেন হাজারে হাজারে। জলের মত টাকা খরচ হচ্ছে। বাইরের সাহায্য বড় একটা পাওয়া যাচ্ছে না। এপারে এসে দূর্ভাগাদের সোয়াস্তি নেই। মাঝে মাঝে তাদের উপর পড়ছে পাক-কামানের গোলা। এই পর্বত প্রমাণ বোঝা বহনের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না কেন্দ্রীয় সরকার। অথচ এর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল অনেক আগেই। প্রশাসকদের অদূরদর্শীতা জটিল করে তুলেছে গোটা পরিস্থিতি। শরণার্থীর ভারে নুইয়ে পড়ছে পশ্চিম বাংলা। নয়াদিল্লী ধীরে ধীরে বুঝতে পারছেন বাস্তব অবস্থা। পাল্টাচ্ছে তাদের ত্রাণ পরিকল্পনা। আত্মবঞ্চনা করে লাভ নেই। ইয়াহিয়ার চালের হারে হেরে গেছে ভারত। গণহত্যা এবং মানুষ-খেদার অভিযান সম্পূর্ণ হলে বহাল তবিয়তে ঘর গুছাবেন ইয়াহিয়া খান। আর তার দুষ্কার্যের ভারবাহী হয়ে থাকবে ভারত। মুক্তিযোদ্ধারা লড়বেন। তাঁদের সর্বাত্মক বিজয় কবে সম্ভব হবে তা জানবেন না কেউ। অন্তত এইটুকু সত্য আজ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য শরণার্থীরা থাকবেন ভারতে। অনেকে হয়তো আর ফিরে যেতেই চাইবেন না। ইসলামাবাদের ফাঁদে পা দিয়েছেন নয়াদিল্লী। এ ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসার পথ একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

শরণার্থী শিবিরগুলোতে দেশী-বিদেশী অনেক মহামান্যের পদধূলি পড়েছে। তাতে হতভাগ্যদের ভাগ্যের কোন পরিবর্রতন ঘটেনি। বাংলাদেশের পাক-অত্যাচার বন্ধ হয়নি। শ্রীমতি গান্ধীর আগমনে লক্ষ লক্ষ মানুষের দীর্ঘশ্বাসের গরম হাওয়া ঠান্ডা হবার নয়। ওরা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। স্বদেশে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হলেই অধিকাংশই হয়ত ফিরে যাবেন। এই পরিবেশ সৃষ্টিতে যত দেরী হবে অনেকের ফিরে যাবার পথও তত কন্টকিত হয়ে উঠবে। শেষ পর্যন্ত ক’লক্ষ নরনারীর হয়তো ফিরে যাওয়াই হবে না। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ছাড়া আর কেউ শরনার্থীমুক্ত করতে পারবেন না ভারতকে। তার জন্য দরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক অগ্রগতি এবং মুক্ত অঞ্চলের পরিধির বিস্তার। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার পাননি কারও কূটনৈতিক স্বীকৃতি। তাদের ভাগ্যে জুটছে না প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র। ইয়াহিয়ার সুসজ্জিত বাহিনীর সঙ্গে তাঁরা লড়াই করবেন কিসের জোরে? বাংলাদেশে সাহায্য পাঠাবার অনুমতির জন্য ইসলামাবাদের কাছে আর্তি জানাচ্ছেন রাষ্ট্রসঙ্ঘ। আমেরিকা পিছন থেকে ঠেকা দিচ্ছে ভারতকে। ইয়াহিয়া শুধু বলছেন- এখনও সময় আসেনি। বাংলাদেশকে একেবারে পর্যুদস্ত না করা পর্যন্ত ইসলামাবাদের বাঞ্চিত সময় আসবে না। দুর্ভিক্ষের কবলে পড়বেন বাঙ্গালী জনতা। এপারে শরণার্থীদের ঘিরে দানা বাঁধবে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা। কৃতজ্ঞতার বদলে দেখা দেবে ভারতের প্রতি বিতৃষ্ণা। ঠিক এই মুহূর্তেই আসবে ইয়াহিয়ার অনুকূল সময়। রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাহায্য তিনি নিতে চাইবেন নিজের হাতে। তাতে হয়ত আপত্তি করবেন না বিশ্বসভার মানবদরদীরা। পাক-ঘাতকেরা নামবে আর্ত-ত্রাণে। লাভের ব্যবসা ফাঁদবেন ইসলামাবাদ। বৈদেশিক সাহায্যের ছিটেফোঁটা যাবে বাংলাদেশে। পরের ধনে দল ভারী করবে কুচক্রী দল। ক্ষুধার অন্ন যে তুলে দেবে আর্তের মুখে জনতা তাদেরই জানাবেন সেলাম। ভুলে যাবেন অতীতের নারকীয় ঘটনা। দুনিয়ার এই সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটবে না বাংলাদেশে। মুক্তিযোদ্ধারা সহজে ছাড়বেন না। ভারত সীমান্ত থেকে ওঁরা চালাবেন গেরিলা তৎপরতা। অসহায় নয়াদিল্লী চেয়ে চেয়ে দেখবেন। পাক-বেতার শুরু করবে উলটো প্রচার। পূর্ববাংলা শান্ত। তাকে অশান্ত করছে ভারতাশ্রিত গেরিলারা। আর্ত ত্রাণে ব্যঘাত ঘটাচ্ছে পদে পদে। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞের দল তখন বলবেন- কথাটি ফেলনা নয়।

শরনার্থী শিবিরগুলো দেখতে এসে শ্রীমতি গান্ধী ভালই করবেন। তিনি বুঝতে পারবেন ‘দেখি কি হয় নীতির পরিণাম’। সাড়ে সাত কোটি মানুষের একটা বিরাট অঞ্চলকে ছাড়খার করছে প্রায় দেড় হাজার মাইল দূরের একটা হানাদার বাহিনী। বিশ্ববিবেকের মাথায় দিনের পর দিন লাথি মারছেন ইয়াহিয়া খান। বৃহৎ রাষ্ট্রগুলো অত্যাচারিতের সেবার জন্য লোক দেখানো কলরব তুলছে। ঘাতকের বিরুদ্ধে যারা লড়াই করছেন তাঁদের জন্য কারও মাথা ব্যাথা নেই। ওঁদের সরকার পাচ্ছেন না কূটনৈতিক স্বীকৃতি। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আসছে না অস্ত্রশস্ত্র। এই রাষ্ট্রগুলোর মুখ চেয়ে বসে আছেন নয়াদিল্লী। ঘরের পাশে একটা পশু শক্তির বিরুদ্ধে সক্রিয় ব্যবস্থা নিতে পারল না ভারত। তার এই দুর্বলতার জের চলবে দীর্ঘদিন। বাইরের ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর কোন আস্থা থাকবে না নয়াদিল্লীর উপর। তাদের শক্তির আড়ম্বর দাগ কাটবে না কারও মনে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের মর্যাদাহানির পরিপূরণ করতে পারবে না নিষ্ক্রিয় নৈতিক বাক্যবিন্যাসে। শ্রীমতি গান্ধীর জন্য অপেক্ষা করছে শরনার্থীদের বুক ফাটা কান্না। চোখের সামনে যারা নিহত হতে দেখেছেন প্রিয়জনদের, কি দিয়ে তিনি তাঁদের দেবেন সান্ত্বনা। প্রতিশোধের জন্য বাংলাদেশের সাচ্চা তরুণ-তরুণী পাগল। তাদের সামনে কি দৃষ্টান্ত রেখেছেন নয়াদিল্লী? ভারতীয় অঞ্চলে পড়ছে পাক-কামানের গোলা। মরছেন ভারতীয় নাগরিক। সীমান্ত রক্ষীদের অপহরণ করছে পাক-হানাদাররা। শুধুমাত্র কড়া নোটে পাঠিয়েই কর্তব্য বোধ করছেন কেন্দ্রীয় সরকার। শক্তিমানের শক্তির আস্ফলনের বাস্তব প্রয়োগ নেই যেখানে, সেখানে সে হতে পারে না অন্যের শক্তির প্রেরণা। এই বাস্তব অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের প্রয়োজন ছিল শ্রীমতি গান্ধীর। হয়ত তিনি পারবেন তা শরনার্থী শিবিরগুলিতে।

নয়াদিল্লীর হাতে আছে বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর সার্টিফিকেট। অমানুষিক সংযমের পরিচয় দিয়েছেন তাঁরা। শত শত জনপদ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বাংলাদেশে। দশ লক্ষ নরনারীর রক্তে ভেসে গেছে পথঘাট। এবং কুকুরের দল গলিত শব নিয়ে করছে টানাটানি। কোটি টাকা এবং রাশি রাশি সোনা রূপা পাচার হয়েছে পাকিস্তানে। হাজার হাজার নারী ধর্ষিতা। তিরিশ লক্ষ শরনার্থী বোঝা নিয়ে ধুঁকছে পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো। ভারতের আকাশসীমা এবং সীমান্তরেখা লঙ্ঘিত হচ্ছে বার বার। ঢাকায় রয়েছেন ভারতীয় কূটনৈতিক কর্মীরা আটক। তা স্বত্ত্বেও ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গেনি নয়াদিল্লীর। ধরিত্রীর মত এই সর্বসংহা আচরণের অসংখ্য সাধুবাদ দিয়েছে বৃটেন, সোভিয়েট রাশিয়া এবং আমেরিকা। নিজেদের ঘাড়ে যখন এসে পড়ে নিরাপত্তার সমস্যা তখন তাদের মধ্যে দেখা যায় না বহু প্রশংসিত এই সংযম। তার প্রমাণ, কিউবায় মার্কিন অবরোধ, হাঙ্গেরী এবং চেকোশ্লোভাকিয়ায় সোভিয়েট প্রতিরোধ এবং ১৯৫৬ সালে বৃটেনের সুয়েজ অভিযান। বাংলাদেশের ঘটনাবলীর সঙ্গে এগুলোর তুলনা চলে না। এ অঞ্চলের সংগ্রাম গণতন্ত্রের সংগ্রাম এবং সংখ্যালঘু ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠদের লড়াই। ভারতের উপর চলছে তার প্রত্যক্ষ জের। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধী ভেবে দেখুন- তিনি বৃহৎ শক্তিগুলোর দেওয়া সার্টিফিকেট সোনার ফ্রেমে বাধিয়ে রাখবেন, না তা ছুড়ে ফেলে দিয়ে আত্মশক্তিতে বাস্তব অবস্থার মোকাবিলা করবেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৮৭। দূতাবাস কর্মচারি বিনিময়ে সুইস প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত দি স্টেটসম্যান ১৫ মে ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৮৭, ৭৪০-৭৪১>

দি স্টেটসম্যান
১৫ মে ১৯৭১
দূতাবাস কর্মচারি বিনিময়ে সুইস প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত
– আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি

নয়া দিল্লি, ১৪ মে – পাকিস্তান সরকারকের সুইস সরকার তাদের দূতাবাস কর্মচারি ঢাকা, কলকাতা থেকে ইসলামাবাদে বিনিময়ের প্রস্তাব দিয়েছিল যাতে ভারতের সাথে তাদের দ্বন্দ্ব উপশম হয় – কিন্তু পাকিস্তান তা প্রত্যাখ্যান করেছে। এটা আশ্চর্যজনক। গতকাল শেষরাতে এই খবর আসে।

একদিন আগে পাকিস্তান সরকার প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল যেখানে কলিকাতার সাবেক ডেপুটি হাই কমিশনার জনাব মেহেদি মাসুদ, জনাব হোসেন আলি ও পূর্ব বাংলার সুইস স্টাফ ছিলেন। এখন বিষয়টা দেশটির (পাকিস্তান) বন্ধ বা খোলা কূটনীতিতে দোলায়মান।

পাকিস্তান সরকারের দুইজন মুখপাত্র, যারা একবার সুইস প্রতিনিধি জনাব মাসুদ এবং পূর্ব বাংলার অন্য কর্মচারিকে গ্রহণ করে নিয়েছেন আরেকবার তাদের প্রত্যাখ্যান করেছেন – এই দুইটি বিষয় এখন স্পষ্ট করা দরকার।

পাকিস্তানের কাছে আশ্চর্য হচ্ছে সুইস হস্তক্ষেপ খুব দ্রুত সরে গিয়েছিল। নিশ্চিত ভাবে তাদের উদ্যেশ্য ছিল কূটনৈতিক চাপ বজায় রাখা যাতে করে আন্তর্জাতিক মনোযোগ বাংলাদেশে পাকিস্তানি আর্মিদের কর্মকান্ড থেকে দূরে থাকে এবং একই সাথে শরণার্থীদের ভারতে চলে যাবার ব্যাপারটাও বিশ্ববাসীর নজরের বাইরে থাকে।

সর্বশেষ এখানে সরকারি সূত্রকে এই ব্যাপারে কথা বলতে অনিচ্ছুক মনে হল। সুইসকে তারা এই বিষয়ে জড়িয়েছিল তাদের নিজেদের লাভের আশায় কিন্তু এখন তা না হওয়ায় তারা সেটাকে প্রত্যাখ্যান করছে। ভারত তার পক্ষে থেকে যে কোন গঠনমূলক পদক্ষেপে সহায়তার কথা বলেছে – যা সুইস দূত পাকিস্তানের সাথে আলাপ করে তাদের জানাবেন বলে জানিয়েছেন।

এতে করে এই বিষয়ে ভারত যে আলোচনায় আগ্রহী তাই প্রমাণ হয় – একথা আজ সুইস এম্বাসেডর জনাব ফ্রিজ রিয়েল সেক্রেটারি এস এ ব্যানার্জি (পূর্ব) এর সাথে বৈদেশিক অফিসে আলাপকালে বলছিলেন। মিটিঙটা শুরু হয়েছিল পাকিস্তান সরকারের প্রত্যাখ্যানের পরে।

স্পর্শকাতর ইস্যু

উদ্বেগের বিষয় হল পাকিস্তান এমন একটা স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। প্রথমে পাকিস্তান ঢাকা ও কলিকাতার রাশিয়ান দূতদের প্রত্যাখ্যান করেছে। এরপর ইরান আসে যখন ভারত ইরানকে অনুমতি দিয়েছিল তাদের বিমানকে কলিকাতায় নামতে দেবার ব্যাপারে। সবশেষে পাকিস্তান সুইসদের সাথে এই সিদ্ধান্ত নিল। এখন সুইস দূত এবং সুইস সরকার প্রতিনিধি বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন – তারা বলেন পাকিস্তান পুরো বিষয়টাকে পেছনের দিকে নিয়ে গেল।

পাকিস্তানকে সুইস দূতাবাস জনাব মাসুদ ও বাংলাদেশ থেকে জনাব হোসেন আলির সাথে যে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল তা আজ ইসলামাবাদে একজন সরকারি মুখপাত্র প্রত্যাখ্যান করেছেন।

এক বিবৃতিতে মুখপাত্র অভিযোগ করেন যে এখানে ভারত আসলে সুইসদের কলকাতার মিশনকে অন্যদিকে পরিচালিত করতে চেষ্টা করছে।

মুখপাত্র বলেছেন, ভারত আসলে জনাব মাসুদ আর প্রাক্তন হাইকমিশনার জনাব হোসেন আলী মধ্যে একটি বৈঠকের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছিল – যা আসলে জনাব আলির ইচ্ছা ছিল।

অদ্ভুতভাবে, মুখপাত্র এ বিষয়ে তার পূর্ববর্তী বিবৃতি প্রত্যাখ্যান করেন – তিনি বলেন যে এই সভায় সুইজারল্যান্ডের বা অন্য কোন তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা করার কোন প্রয়োজন নেই।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৮৮। ইয়াহিয়া’র সীমাহীন বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অবেদন কালান্তর ১৫ মে, ১৯৭১

Kamol Roy
<১৪, ২৮৮, ৭৪২-৭৪৩>

ইয়াহিয়া’র সীমাহীন বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আবেদনঃ
পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের উদ্দেশ্যে ডাঃ গণির বেতার ভাষণ

সম্প্রতি কমিউনিষ্ট নেতা ডাঃ এ, এম, ও, গণি উর্দু ভাষাভাষি জনগণের কাছে বাংলাদেশের ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করে বর্তমানে পাকিস্তান সরকারের “সীমাহীন বর্বরতার”-র চিত্র তুলে ধরে উর্দু ভাষায় একটি বেতার ভাষণ দিয়েছেছেন এবং সেটি “আকাশবানী” থেকে প্রচারিত হয়েছে। এই ভাষণে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণকে এই বর্বরতা অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য সচেষ্ট হওয়ার আন্তরিক আবেদন জানানো হয়েছে।

ডাঃ গণি বলেছেন, “ওদেশে যে ঘটনা ঘটছে তা যে-কোন জাতি এবং যে কোন দেশের লজ্জার বিষয়। রটনার সামান্যতম অংশকে সত্য বলে মেনে নিলেও দেখা যায় পাকিস্তানের বর্তমান নীতি মানবতাবিরোধী। এমন প্রশ্ন থেকে যায় এতে পাকিস্তান সরকারের লাভ কি? অফুরন্ত প্রাণ সম্পদ হানির পর এবং পরষ্পরের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষের পাহাড়ের পর বসেও কি পাকিস্তানের অখন্ডতা বজায় থাকবে? আমরা জানি, কোন জাতি বা দেশকে সামরিক শাসনের দাপটে দাবিয়ে রাখার দিন আজ বিগত। যদি তাই-ই সম্ভব হত, তাহলে কেন শক্তিধর আমেরিকা গত দশ বছর ধরে ভিয়েতনামকে দাবিয়ে রাখতে পারছে না অথচ এ সব সত্ত্বেও পাকিস্তান তার ক্ষুদ্র শক্তির ভিত্তিতে এই হত্যালীলা চালিয়ে যাচ্ছে।

“একথা প্রায়ই শোনা যায়- যা ঘটছে তা নাকি পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার এবং এর উপর অপরের হস্তক্ষেপের অধিকার নেই- এই ভিত্তিতেই ভারতকে হুমকি দেওয়া হয়েছে। জার্মানীতে ইহুদীদের উপর হিটলারের অত্যাচারও তো অভ্যন্তরীণ ব্যাপার তবু কেন সারা বিশ্ব এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ঘটনাবলী আরও সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান, এখানে হত্যা ও ধ্বংসলীলা খোলাখুলিভাবে ঘটছে। পশ্চিম পাকিস্তান, একটি সম্পূর্ণ পৃথক জাতি অপর এক ভিন্ন জাতি বাংলাদেশের জনগণের উপর শোষণ ও অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে এবং পাইকারী হারে নরহত্যা করছে। অর্থনীতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা যায়, ঐ দুই খন্ডের মধ্যে কোন সামঞ্জস্য নেই। পশ্চিম পাকিস্তানের দিকে তাকালে চোখে পড়ে প্রাচুর্য ও ঐশ্বররয এবং বাংলাদেশের জনগণ যদি অমানুষিকতাকে “ঔপনিবেশিক” আখ্যা দিয়ে তা থেকে মুক্ত হতে চায় তবে দোষ কোথায়।

“ওখানে সকলে একমত হয়ে বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চাইছেন। ওঁদের বাইরে থেকে বাধা দিয়ে ওঁদের অধিকার না মানাকে নিছক আভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে গ্রহণ করা যায়? অস্ত্রবলে কোন একটা জাতিকে নিজের অধীনস্থ করা এবং অস্ত্রের অপপ্রয়োগ করে নরনারী ও শিশু হত্যাকে কি সমর্থন করা যায়? বিশ্ব-বিবেক কি আজ সুপ্ত। এই নিপীড়ন থেকে নির্লিপ্তভাবে দূরে থাকা এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করা কোন দেশের ন্যায় বিচার”

“যে কোন রাষ্ট্র কর্তৃক অপর এক রাষ্ট্রকে স্বীকৃতিদানের অধিকার আন্তর্জাতিক নিয়মের আওতায় পড়ে। চীন তো বিগত বাইশ বছর হল একটি স্বাধীন সরকার গঠন করেছে কিন্তু বহু দেশের স্বীকৃতি না পাওয়ার দরুন কি চীনের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়েছে? যারা স্বীকৃতি দেয়নি তাদের স্পর্ধা ও অন্ধকার মূর্ত প্রমাণস্বরূপ আজও চীন বিরাজমান। বাংলাদেশের আমাদের স্বীকৃতি দিতে হবে কারণ এটাই আপামর জনসাধারণের অভিমত এবং বারবার একথা প্রকাশিত হয়েছে। কোন সত্যানুসন্ধানী ব্যক্তি এটা অস্বীকার করতে পারেন না। এই স্বীকৃতি দানে যতই বিলম্ব ততই লক্ষ লক্ষ লোকের প্রাণ বিনষ্ট হবে, তাই বিশ্ববাসীকে এ ব্যাপারে অগ্রণী হতে হবে যাতে, ঐ পরিণতি রোধ করা যায়।

“আজ বাংলাদেশের দিকে তাকালে দেখবেন ইসলাম ধর্ম ও মানবতাবোধ রক্তাক্তভাবে নিষ্পেষিত। তা’ না হলে কেন ওখানে লক্ষ লক্ষ দরিদ্র, নির্দোষ, নিরস্ত্র মুসলমানের উপর অপর মুসলমানেরা নির্মম হত্যালীলা চালাচ্ছে?”

ডাঃ গণি বাংলাদেশের দুর্দশাগ্রস্ত জনসাধারণের সহায়তয়ায় প্রেরিত আন্তর্জাতিক রেডক্রস সোসাইট’র বিমানটিকে পাক সরকার যেভাবে করাচী থেকে ফেরত পাঠিয়েছেন তার প্রতি তীব্র ধিক্কার জানিয়ে বলেছেন “ব্যাপারটি সন্দেহজনক এবং নিশ্চয়ই এমন কিছু আছে যার ফলে বিদেশী সাংবাদিকদের তাড়াহুড়ো করে প্রথম দিনেই বিতাড়িত করা হল। পাক সরকার জানেন না, যে রক্ত ঝরেছে সে রক্তই একদিন তারস্বরে চীৎকার করে উঠবে। পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের নিকট আমার আন্তরিক আবেদন পাক সরকারের সীমাহীন বর্বরতা বন্ধ করুন যা আপনাদের বিশ্বের নিকট নিন্দনীয় করে তুলেছে”।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৮৯। স্বীকৃতির সময় এখনো আসে নিঃ প্রধানমন্ত্রী
স্টেটসম্যান ১৭মে, ১৯৭১

Pallab Das
<১৪, ২৮৯, ৭৪৪- ৭৪৭>

দি স্টেটসম্যান
স্বীকৃতির সময় এখনো আসে নিঃ শরণার্থী ত্রাণ সমস্যায় চাপে প্রধানমন্ত্রী
বিশেষ প্রতিনিধি ১৭মে, ১৯৭১

প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী রবিবার দম দম বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সাথে একটি সংক্ষিপ্ত সাক্ষাতে বলেন যে, বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া একজনের কাছে কেন্দ্রীয় সরকারের তাৎক্ষণিক সমস্যা মনে হলেও বাস্তবতা তার বিপরীতে।

তিনি বলেন, এখানে প্রধান বিবেচ্য বিষয় হলে কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক উক্ত স্বীকৃতি বাংলাদেশের মানুষকে সাহায্য করবে কিনা। তিনি যোগ করেন “আমি মনে করি এটা তাদের খুব বেশি একটা সাহায্য করবে না এবং ভুল সময়ে স্বীকৃতি দেয়া যাবে না”।

যখন একজন রিপোর্টার তাঁকে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতির ব্যাপারে অন্য কোন দেশের অপেক্ষায় আছেন কিনা- এমন প্রশ্ন করলেন তখন প্রধানমন্ত্রী দৃশ্যত বিরক্ত হন। তিনি বলেন এমন প্রশ্ন তাঁকে এর আগে বহুবার করা হয়েছে। তিনি সবসময় বলে এসেছেন যে, ভারতের একটি স্বতন্ত্র নীতি রয়েছে এবং বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর অবস্থানের জন্য অন্যদের উপর তিনি নির্ভর করেন না। তিনি বলেন, “স্বাধীন নীতি নিয়ে গঠিত আমরা একটি স্বাধীন দেশ, বিভিন্ন লক্ষণীয় বিষয়ে কঠোর মনোভাব পোষণ করি এবং অন্যরা কি করলো বা কি বললো এর উপর নির্ভর করি না”।
বনগাঁর দুইটি শরণার্থী শিবির ও একটি হাসপাতাল পরিদর্শন শেষে বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টারে করে বিমানবন্দরে পৌঁছার পরে অতি দ্রুত, প্রধানমন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জনাব অজয় মুখোপাধ্যায় ও উপ-মুখ্যমন্ত্রী জনাব বিজয় সিং নাহারের সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী জনাব সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় যিনি প্রধানমন্ত্রীর ভ্রমণসঙ্গী ছিলেন, তিনিও আধা ঘন্টার অধিক সময়ের এই মিটিং এ উপস্থিত ছিলেন।

মিসেস গান্ধী সকালে আসাম থেকে হলদিবাড়িতে যান এবং দুপুর সোয়া দুইটার দিকে দমদম বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন জনাব রায় এবং বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির প্রধান মিস পদ্মাজা নাইডু। দমদম থেকে প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর সফরসঙ্গীরা হেলিকপ্টারযোগে বনগাঁ যান। আরেকটি হেলিকপ্টারে পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রীরা যান। তারা দমদম বিমানবন্দরে সাড়ে পাঁচটার কিছুক্ষণ পরে দমদম বিমানবন্দরে ফিরে আসেন।

প্রধানমন্ত্রী পূর্ণ হাতা ব্লাউজসহ নীল শাড়ি পড়ে ছিলেন এবং তাঁকে ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। যখনই তিনি বিমানবন্দরের নতুন লাউঞ্জে আসেন তখনই তাঁর এটেন্ড্যান্টকে জনাব অজয় মুখোপাধ্যায় এ জনাব নাহারের সাথে তাৎক্ষণিক সম্মেলনের জন্য নিচতলার একটি রুমের ব্যবস্থা করতে বলেন। প্রেস সাংবাদিকদের প্রথম তলার লাউঞ্জেই অপেক্ষা করতে বলা হয়। ত্রাণ সমস্যার আলোচনার জন্য মিস পদ্মাজাকে আলোচনায় ডেকে পাঠানো হয়।

প্রধানমন্ত্রীর জনাব অজয় মুখোপাধ্যায় ও জনাব নাহারের সাথে আলোচনায়, যেখানে জনাব সিদ্ধার্থ রায় উপস্থিত ছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ সংক্রান্ত সমস্যা আলোচনায় এসেছে। পরে যোগাযোগ করা হলে জনাব নাহার বলেন, কিছু গুরুতর সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে তবে সভায় কি ঘটেছে তা প্রকাশ করতে অসম্মতি জানান।

অনেক বড় সমস্যা

শরণার্থী সমস্যা সংক্রান্ত গভীর আবেগ সম্পর্কে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “ এটি একটি বড় সমস্যা এবং এটি মোকাবেলা করতে অনেক বেগ পেতে হচ্ছে। আমাদের পণ্যদ্রব্যের ঘাটতি রয়েছে এবং এই অবস্থায় সরকার অনেক ভালো কাজ করেছে”।
অনেকে আশ্রয়হীন অবস্থায় আছেন – এ ব্যাপারে তিনি অবগত আছেন এবং যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয় বিদেশ থেকে তিনি কোন সাহায্য আশা করছেন কিনা এর প্রত্যুত্তরে তিনি বলেন, “নিবন্ধ পত্রিকায় আসতে অনেক সময় লাগে”, আমরা এর জন্য শুধু আশাই করতে পারি। তিনি যোগ করেন, “অন্যান্য দেশ থেকে এই পর্যন্ত কিছুই আসে নি”। তিনি মনে করেন, যদি ত্রাণ সামগ্রীর মাধ্যমে বাইরে কোন সাহায্য আসে তাহলে, ভারত ভালো করেই জানবে কোন সংস্থা থেকে কি এসেছে।

একটি প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন যে শরণার্থীদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যেতে হবেম কিন্তু “এটি কত তাড়াতাড়ি সম্ভব, এটি আমি জানি না”। তিনি মনে করেন শরণার্থীদের তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যাবার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কিছু নির্দিষ্ট অবস্থার তৈরি করতে পারেন।

পাকিস্তান সরকার যতদূর অবগত আছে, বাংলাদেশে স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছে –পাকিস্তানের এমন দাবিতে মিসেস গান্ধী বলেন যে, সাধারণ মানুষকে সরিয়ে স্বাভাবিকতার অর্জনের একটি খুব সুবিধাজনক উপায় এবং আমার কাছে এটি স্বাভাবিকতা নয়।

কেন্দ্রীয় সরকার সীমান্ত এলাকা থেকে শরণার্থীদের ছড়িয়ে দেয়ার প্রস্তাব বিবেচনা করেছিল। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই ধরনের মানুষ ছড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগ ত্রিপুরার মতন ছোট প্রদেশকে বড় সমস্যার সম্মুখীন করতে পারে। তিনি বলেন দেশের অন্যান্য প্রান্তে শরণার্থীদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা বিবেচনা করা হচ্ছিল। তিনি যদিও নিশ্চিত ছিলেন না এটি সম্ভব কিনা।

বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের এবং অনেক রাজনৈতিক দলের বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সহায়তার দাবির ব্যাপারে মন্তব্য করতে বলা হয়। মিসেস গান্ধী বলেন, তাঁর কোন “কমেন্ট নেই, রিয়েকশান নেই ”।

ঢাকা থেকে ভারতীয় কূটনীতিকদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে তিনি এই পরামর্শের সাথে একমত হন যে, এই বিষয়টি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক যেকোনো প্রস্তাব গ্রহণের অস্বীকৃতে একটি অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

তিনি বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক ভারত সীমান্ত বরাবর গুলিবর্ষণ করার ঘটনা ঘটে। এই রকম ব্যাপারে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী যোগ করেন, “তবে সবসময় ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়ে উঠে না”।

বনগাঁ
আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক যোগ করেছেন, এর আগে বনগাঁতে বাংলাদেশী শরণার্থীদের উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটি খুবই দুঃখজনক যে পূর্ব বঙ্গে নির্দিষ্ট কিছু দল এখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সাম্প্রদায়িক রূপ দেয়ার চেষ্টা করছে। তিনি যোগ করেন, এরকম প্রচেষ্টা দেশ তৈরির উৎসাহকে শুধুমাত্র নমনীয় করতে পারে।

বিকেলে মিসেস গান্ধী পেট্রাপোল ও ইটখোলার দুটি শরণার্থী ত্রাণ কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। তিনি বনগাঁর উপ-বিভাগীয় হাসপাতাল পরিদর্শন করেন এবং পাকিস্তানী বাহিনী কর্তৃক গুলিবিদ্ধ বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের সাথে কথা বলেন।

তিনি শরণার্থীদের বলেন যে পূর্ববঙ্গের মুক্তিযুদ্ধ “সকল প্রকার দমন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। মনে রাখবেন আপনাদের যুদ্ধই আমাদের যুদ্ধ”।

তিনি বলেন, অবিচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু হয়, তখন বাংলাদেশের জনগণকে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য করা হয়। “আমাদের সব শুভেচ্ছা থাকা সত্বেও আপনাদের এখানে সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে কারণ আমরা ধনী দেশ নই”।

মিসেস গান্ধী আশা করেন যে, শরণার্থীদের দীর্ঘদিন ভুগতে হবে না এবং তারা অতি শীঘ্রই তাদের বাড়িতে ফিরে যেতে পারবেন। তিনি বলেন, ভারত একটি গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন খারাপ মনোভাব ছিল না। তিনি আশাবাদী যে,পূর্ব বাংলার জনগণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখবে এবং যৌথভাবে মুক্তিযুদ্ধে লড়াই করবে। পেট্রাপোল ক্যাম্প যেখানে আট হাজারের বেশি শরণার্থী বসবাস করছে, সেখানে মিসেস গান্ধী একটি ছোট্ট মেয়ের হাতে খাবার তুলে দেন। সে তার অনেক আত্মীয়কে হারিয়েছে বলে রিপোর্ট করা হয়েছে। দশ বছরে একজন বালক যে কাঁধে তার ছোট বোনকে বহন করছিল, তার কাহিনী বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। তিনি একজন নারীর সাথে কথা বলেন যার স্বামী পাকিস্তানী সেনাদের গুলিতে নিহত হয়েছেন।

ভারত সেবাশ্রমের মুখপাত্র বলেন, পেট্রাপোল ক্যাম্পের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ মুসলমান। আট বছরের নিচে ছেলে-মেয়ের সংখ্যা ২,২০০ জন। মিসেস গান্ধী কলকাতা বিমানবন্দরে অবতরণ করার সময় অবিলম্বে বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবিতে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংগঠন এবং গণতান্ত্রিক যুব সংগঠন – এর সমর্থকরা একটি বিক্ষোভ সংগঠিত করে। বিক্ষোভকারীরা বাংলাদেশের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের মনোভাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে।

ভারতীয় রেড ক্রস সোসাইটির পশ্চিমবঙ্গ শাখার সভাপতি জনাব জে.সি. দে প্রধানমন্ত্রীকে ব্যাখ্যা করেন এবং ভারতীয় রেড ক্রস সোসাইটির চেয়ারম্যান মিস পদ্মাজা নাইডু রেড ক্রস সোসাইটির রাজ্য অংশ পেট্রাপোল এবং অনেক কেন্দ্রে কি কাজ করতেছে তার ব্যাখ্যা করছিলেন।
হলদীবাড়ি

হলদীবাড়িতে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক যোগ করেনঃ ভারতীয় সীমানার মধ্যে পাকিস্তানের বারংবার অনুপ্রবেশের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সীমান্তবর্তী এলাকায় বসবাসকারী মানুষ “কিছু ঝুঁকির সম্মুখীন হবে”। তিনি বলেন, যারা পাঞ্জাব এবং জম্মু-কাস্মীর সীমান্তে বসবাসকারী মানুষকে শান্তিপূর্ণ সময়েও অনুরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে।

মিসেস গান্ধী হলদিবাড়ি গার্লস স্কুল ও দেওয়ানগঞ্জের দুটি উদ্বাস্তু ক্যাম্পে বক্তৃতা রাখেন। তিনি বলেন, পাকিস্তান ইচ্ছাকৃতভাবে পূর্ববঙ্গে জনসংখ্যা কমাচ্ছে যারা গত নির্বাচনে জনাব মুজিবুর রহমানকে ভোট দিয়েছিল তাদের বহিষ্কারের মাধ্যমে। এস ইউ সি ও ফরোয়ার্ড ব্লকের স্থানীয় ইউনিট এবং অন্য একটি সংস্থা অবিলম্বে বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবিতে মিসেস গান্ধীর কাছে স্মারকলিপি পেশ করে।

এস ইউ সি’র সমর্থকরা হেলিপ্যাডের কাছে এবং গণপূর্ত বিভাগের বাংলো যেখানে তিনি দলের প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাৎ করেন সেখানে বিক্ষোভ করে।

মিসেস গান্ধী নয়াদিল্লিতে দুই পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রীর সাথে ত্রাণ ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তিনি এমন আলোচনার জন্য রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জনাব জয়নাল আবেদিন ও গণপূর্ত মন্ত্রী সন্তোষ রায়ের প্রতি ইঙ্গিত দেন। তারা বৃহস্পতিবার নয়া দিল্লি ছেড়ে যাবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৯০। শরনার্থীদের সাহায্য দিতে লাগবে ২০০ কোটি টাকা আনন্দবাজার পত্রিকা ১৮ মে, ১৯৭১

Kamol Roy
<১৪, ২৯০,৭৪৮>

শরণার্থীদের ৬ মাস সাহায্য দিতে লাগবে ২০০ কোটি টাকা
রাষ্ট্রপুঞ্জ দল সমীপে ভারত
বিশেষ সংবাদদাতা

নয়াদিল্লী, ১৭ মে- শ্রী চারলস মেস এর নেতৃত্বে রাষ্ট্রপুঞ্জ দলটি পূর্বাঞ্চলে “ব্যাপক সফর” করে বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থী সমস্যা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করে এসেছেন। আগামীকাল তাঁরা ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন। বুধবার তাঁরা জেনিভার উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন এবং সেখানে পৌঁছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যথাস্থানে তাঁদের রিপোর্ট পেশ করবেন।

আজ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে শ্রী মেস জানান যে, ভারত সরকার জানিয়েছেন, বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের (সংখ্যা আপাতত তিরিশ লক্ষ ধরে নিয়ে) ছয় মাস ধরে সাহায্য দিয়ে খরচ পড়বে দু’শ কোটি টাকা। ভারত সরকার মনে করেন যে, এ সমস্যা “অস্থায়ী”। ছয় মাসের মধ্যে বাংলাদেশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে এবং এই শরণার্থীরা সকলেই স্বস্থানে প্রত্যাবর্তন করতে পারবেন।

শ্রী মেস বলেন, “শরণার্থীরা নিজের নিজের বাড়িতে ফরে যাবেন- ভারত প্রধানমন্ত্রী এই আশার আমরাও অংশীদার।”

দলের অন্যতম সদস্য শ্রী টমাস জামিসন বলেন যে, ভারত সরকার ঠিক ছ’মাসের জন্য সাহায্য চেয়েছেন। ওই মেয়াদের বাইরে কোন আলোচনায় যেতেই ভারত অনাগ্রহী। ভারত সরকার বিশ্বাস করেন যে, ছ’মাসের মধ্যে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে যাতে শরণার্থীরা নিজেদের দেশে দিরে যেতে চাইবেন। “আমরা এই আশাবাদ সমর্থন করি।”

দলের সদস্যরা “বাংলাদেশ” বা পূর্ব পাকিস্তান” দুটি শব্দই এড়য়ে চলেন বেশ সতর্কতার সঙ্গেই। শরণার্থীদের প্রসঙ্গে তাঁরা “বাড়ি”, “দেশ”, “নিজেদের জায়গা” প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করেন। ফিরে গিয়ে কি সুপারিশ তাঁরা করবেন তার কোন আভাস দলটি দেননি। তবে শ্রী মেস বলেন যে, সমস্যাটি “বিরাট” এবং ভারত সরকার “মানবিক কারণেই” শরণার্থীদের সাহায্য করছেন এবং এটা প্রসংশনীয়।

কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী শ্রী আর কে খাদিলকর এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন যে, সরকার ছ’মাসের জন্য সাহায্য চেয়েছেন। তবে কেন ছ’মাসের ভিত্তিতে সমস্যাটি মোকাবিলার কথা ভাবা হচ্ছে তা তিনি ব্যাখ্যা করেন নি।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৯১। সীমান্ত দেখতে প্রতিরক্ষামন্ত্রী, উদ্বাস্তু মন্ত্রী আসছেন আনন্দবাজার পত্রিকা ২০ মে ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৯১, ৭৪৯>

সীমান্ত দেখতে প্রতিরক্ষামন্ত্রী, উদ্বাস্তু মন্ত্রী আসছেন
স্টাফ রিপোর্টার

বাংলাদেশে দখলদার পাক ফৌজ ইদানীং পশ্চিমবঙ্গ ওঁ পূর্বাঞ্চলের অপর কয়েকটি রাজ্যের সীমান্ত লঙ্ঘন করে গুলো চালানোয় ভারত সরকার বিশেষ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের মনোভাব এ ব্যাপারে কঠোরতর হচ্ছে। ঐ সীমান্ত এলাকার প্রকৃত অবস্থা পরিদর্শনের জন্য ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রী জগজিবন রাম তাই নিজে আগামী শনিবার দুই দিনের জন্য পশ্চিমবঙ্গে আসছেন। তিনি আসামের কয়েকটি সীমান্ত অঞ্চলও পরিদর্শন করতে চান।

শ্রী রাম ছাড়া কেন্দ্রীয় পুনর্বাসন মন্ত্রী শ্রী আর কে খালিদকরও শনিবার রাত্রে কলকাতায় আসছেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা সংক্রান্ত অতিরিক্ত সচিব শ্রী আর এন চোপড়া বুধবার কলকাতায় এসেছেন।

প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধির আসাম ওঁ পশ্চিমবঙ্গ পরিদর্শনের এক সপ্তাহের মধ্যেই কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওঁ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন মন্ত্রী সীমান্ত সফর বিশেষ তাতপর্যপূর্ন বলে রাজনৈতিক মহল মনে করছেন। হানাদার ফৌজের বারবার ভারত সীমান্তে হানা প্রতিরোধ ভারত সরকার কতদূর অগ্রসর হবেন এবং শররনার্থিদের সম্পর্কেই বা কি ধরনের ব্যাবস্থা অবলম্বন করবেন শ্রী রাম ওঁ শ্রী খাদিলকরের সফরের পর তা চূড়ান্ত নির্ধারিত হতে পারে বলেও তথ্যাভিজ্ঞমহলে মনে করা হচ্ছে।

এই সম্পর্কে আলোচনাকালে একজন সরকারী মুখপাত্র বুধবারও পাকফৌজ কর্ত্রিক পেট্রাপোল সীমান্তে এবং সুন্দরবন এলাকার খোজডাঙ্গায় গোলাগুলি বর্ষনের উল্লেখ করেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ওঁ প্রতিরক্ষামন্ত্রী এর আগে পাক ফৌজের সীমান্ত লঙ্ঘন ভারত সরকার করবেন না বলে যে মন্তব্য করেছেন তিনি তারও উল্লেখ করেছেন।

বুধবার কোলকাতায় রাজ্য সরকারের সূত্রে এই দুজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর আসার খবর পাওয়া গেছে।

জানা গেছে শনিবার সকালে প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রী রাম সরাসরি বাগডোগরায় আসছেন। সেখান থেকে তিনি কোচবিহারে হলদিবাড়ি ওঁ সুরতি এলাকায় যাবেন। এরপর আসাম সীমান্ত ঘুরে সন্ধ্যায় কলকাতায় আসবেন ওঁ রাত্রে এখানে থাকবেন। পরদিন রবিবার সকালে তিনি চাকুলিয়া ওঁ বনগাঁয় যাবেন। কয়েকটি শরনার্থি শিবির পরিদর্শন করবেন। অপরাহ্নে দমদম বিমান ঘাঁটিতে ফিরে এসে দিল্লি প্রত্যাবর্তন করবেন।

কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শ্রী খালিদকর শনিবার রাত্রে এখানে আসবেন এবং রবিবার বনগাঁ সীমান্ত এলাকা ওঁ শিবির পরিদর্শন করবেন।

রাজ্যমন্ত্রিদের দিল্লি যাত্রা
এদিকে বাংলাদেশের শরনার্থিদের ত্রাণ ব্যাবস্থা নিয়ে আলোচনার জন্য বুধবার সন্ধ্যায় তিনজন মন্ত্রী শ্রী সন্তোষ রায়, ডাঃ জয়নাল আবেদিন এবং শ্রী তরুণ কান্তি ঘোষ দিল্লি গিয়েছেন। উপ-মুখ্যমন্ত্রি শ্রী বিজয় সিংহে নাহার এদিন সকালেই দিল্লি রওনা হন।

শরনার্থিদের ত্রাণ বাবদ ২৪০ কোটির একটি কর্মসূচি এদিন রাজ্য মন্ত্রীসভায় অনুমোদন করা হয়। এই কর্মসূচি অনুযায়ীই ঐ চারজন মন্ত্রী কেন্দ্রের কাছে ২৪০ কোটি টাকা চাইবেন। রাজ্য মন্ত্রিবৃন্দ প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধি, স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং পুনর্বাসন মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করবেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৯২। ক্ষমতার ভারসাম্য স্টেটসম্যান ২২ মে ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৯২, ৭৫০-৭৫১>

দ্যা স্টেটসম্যান, ২২ মে ১৯৭১
সম্পাদকীয়
ক্ষমতার ভারসাম্য

পূর্ববাংলার ঘটনাসমূহের বিশ্ব রাজনৈতিক প্রভাবগুলি ভারত তার কূটনৈতিক কর্মকান্ডে এখনো সফলভাবে বিশ্বকে উপলব্ধি করাতে পারেনি। শরণার্থীদের ব্যাপক আন্দোলন এটিকে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছে যে একটি সংকীর্ণ অর্থেও পূর্ব পাবংলার ঘটনা পাকিস্তানের সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে বিবেচিত হতে পারে না। তবুও, কয়েক দিন আগেই ভারত শরণার্থী সমস্যার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছে ও আন্তর্জাতিক মহলের মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছে। সম্প্রতি রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে ও কিছুটা সরাসরি ভারতের নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করার কথা বলছে। কিন্তু অন্য ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলি মনে করে সমস্যাটি মানুষের ভোগান্তি সংক্রান্ত এবং তারা মনে করে কেবলমাত্র পাকিস্তান সরকারের সহযোগিতায় এটি সমাধান করা যেতে পারে। ওয়াশিংটন লন্ডনে ইসলামাবাদের দূত রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলছে; এবং এটা ভাবার কোন কারণ নেই যে পাকিস্তানী কূটনৈতিক সম্পূর্ণভাবে অবিশ্বাসযোগ্য। প্রকৃতপক্ষে, ওয়াশিংটন ও লন্ডন উভয়ই সাহায্যের জন্য ইসলামাবাদের অনুরোধে কিছুটা বিবেচনা করেছে, এটি কেবলমাত্র পাকিস্তানের অর্থনীতিকে পুনর্বাসন করার জন্য নয় বরং পূর্ববাংলার কোটি কোটি মানুষের জন্য তাত্ক্ষণিক ত্রাণও তারা প্রদান করবে।

পাকিস্তানের বিষয়টি বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পারে। তারা এটাকে বড় মানবিকতার দিক থেকে দেখতে পারে। তবে নয়াদিল্লিকে প্রথম থেকে উদ্দিপনাময় মনে হয়েছে। তারা এর রাজনৈতিক প্রভাবগুলির উপর জোর দিচ্ছে। তারা এখন এটা নিয়ে আলোচনাও করছে। যদিও পূর্ব বাংলার সমস্যার মোকাবিলায় তাদের অবস্থান প্রশংসিত হয়েছে। এটা ভাবার কারণ নেই যে কোন স্পষ্ট কারণ বা চিন্তাভাবনা ছাড়াই এরকম করছে তারা। সম্ভবত কিছু ইচ্ছাকৃত চিন্তাভাবনা ছিল যে পূর্ববাংলার জনগণ দ্রুত বিজয় লাভ করবে, অথবা খারাপ হলে আরও খারাপ হতে পারে – মিলিটারি প্রশাসন দ্রুত শাসন কায়েম করবে সেক্ষেত্রে। যাই হোক না কেন এমন কোন দির্ঘ মেয়াদি সমস্যা তৈরি হবেনা যা তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। আন্দোলনের ধারাবাহিকতা যত বিস্তৃত হোক বা প্রভাবিত করুক না কেন – একটি ভয়ঙ্কর বাস্তবতা না সৃষ্টি হওয়া পর্যন্ত অনুমান করা যাবে বলে মনে হয় না। এমনকি যখন শরণার্থী প্রবাহ শুরু হল তখন ভারতীয় কর্তৃপক্ষ প্রাথমিকভাবে অস্থায়ী ত্রাণ সমস্যা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল: গত কয়েক দিন হল যে তারা দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে শুরু করেছে। কিন্তু এটি এখনও স্পষ্ট নয় যে নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে কিনা।

কোন পদক্ষেপ নেয়া খুব সহজ হবে বলে মনে হয়না। ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চলে নির্দিষ্ট স্বার্থ রক্ষায় নেয়া যে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ বড় ধরনের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে পারে। অন্য শক্তি গুলোও তাতে জড়িত হতে পারে। অন্তত পরোক্ষ ভাবে। কিন্তু কঠিন সিদ্ধান্ত এড়ানো যাবে যদি বড় শক্তিগুলো পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে তাদের নিজেদের ভাগ্য নিজেদের মত গড়ে নিতে বলার ব্যাপারে ইসলামাবাদকে বলে। কিন্তু সত্য হচ্ছে গত দুই সপ্তাহ ধরে পূর্ব বাংলায় যা ঘটেছে তাতে সেখানে কোন রাজনৈতিক সমঝোতা সম্ভব নয়। কারণ তারা কোন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা গ্রহণ করতে মানসিকভাবে প্রস্তুত নয়। তারা এই ব্যাপারে ভিত যে পশ্চিম পাকিস্তান চিনের সাথে আতাত করবে যেহেতু পশ্চিমা দেশ অ রাশিয়া ইসলামাবাদকে এমন মুভমেন্টে অনুৎসাহিত করেছে।

দৃশ্যত এটিও যুক্তিযুক্ত যে পূর্ব পাকিস্তান ভেঙ্গে গেলে উপমহাদেশের ক্ষমতার ভারসাম্য এলোমেলো হবে এবং পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হবে। ক্ষমতার কৃত্রিম ভারসাম্য বজায় রাখার নামে অনেক অপকর্ম করা হয়েছে; পশ্চিম পাকিস্তান এই ব্যালেন্স রক্ষা করতে যেয়ে গত কয়েক বছরে পূর্ব বাংলায় অনেক ক্ষতি হয়েছে। এবং তর্ক হয়েছে যে পশ্চিমবঙ্গে বিশাল এলাকা জুড়ে একটি দুর্বল আন্দোলন হতে পারে। তাদের কাজের গতি অনেক বেড়ে যাবে যদি পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধ অনির্দিস্টকালের জন্য আন্ডারগ্রাউন্ড গেরিলা আক্রমণে রূপ নেয়। এমনকি যদি পশ্চিম পাকিস্তানের সরকার পূর্ববাংলার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পারে তবুও বিছিন্নভাবে গেরিলা আক্রমণ চলতেই থাকবে। এতে তাদের নেতৃত্ব অ লক্ষ্যের ব্যাপক পরিবর্তন হবে। যদি তা হয় তবে চায়না তেমন উদ্বিগ্ন হবেনা যেহেতু পাকিস্তানের স্বার্বভৌমত্ত বজায় থাকবে যা এখন আছে। জেতাই হোক না কেন পিকিং তার দীর্ঘমেয়াদী বিকল্প পরিকল্পনা বন্ধ করেনি।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৯৩। করিমগঞ্জ সীমান্তে পাকিস্তানী সৈন্য সমাবেশ হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড ২২ মে ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৯৩, ৭৫২>

হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, ২২ মে ১৯৭১
করিমগঞ্জ সীমান্তে পাকিস্তানী সৈন্য সমাবেশ

শিলং, ২১ মে -আসামের মুখ্যমন্ত্রী জনাব মাচন্দ্র মোহন চৌধুরী ইউনিয়নের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জনাব জগজিবন রামের সঙ্গে করিমগঞ্জে আগামীকাল আসাম-পূর্ববাংলা সীমান্তে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান সাপেক্ষে সামগ্রিক নিরাপত্তার প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করার সম্ভাবনা রয়েছে। রিপোর্ট পিটিআই।

মুখ্যমন্ত্রী আজ বিধানসভায় বলেন যে পাকিস্তানি সেনারা আসাম সীমান্তে খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে।

এবিষয়ে আলোচনায় একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হাউসে বলেন যে এই সরকার করিমগঞ্জের উল্টোপাশে পাকিস্তানি সেনাদের জড়ো হওয়ার ব্যাপারে অবগত আছে – সেখানে তারা কাসুরিয়া নদীর পাড়ে বাংকার তৈরী করেছে।

মুখ্যমন্ত্রী বলেন, তিনি করিমগঞ্জ সীমান্ত জুড়ে পাকিস্তানের প্রস্তুতি সংক্রান্ত ব্যাপারে হাউজের সদস্যদের অনুভূতি প্রতিরক্ষা মন্ত্রীকে অবহিত করবেন।

এর আগে হাউসের সদস্যরা আসামের করিমগঞ্জ সীমান্ত শহরে জুড়ে পূর্ববাংলার জাকিগঞ্জে পাকিস্তানি সৈন্যদের জড়ো হওয়ার খবর নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

ইউ এন আই যোগ করেছে: পার্ভা অফিসিয়াল রিপোর্টে জানা গেছে বুধবারে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ৭০০০ এর বেশী শরণার্থী আসাম এর মিজো পাহাড় জেলায় এসেছে। ২৫ মার্চ যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে মিজো পাহাড় অঞ্চলে এটাই বড় আকারের শরনার্থি অন্তঃপ্রবাহ। তাদেরকে পাচাং ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হয়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৯৪। জঙ্গিশাহির হাতে অন্তত দশ লাখ নিহত আনন্দবাজার পত্রিকা ২৩ মে ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৯৪, ৭৫৩>

জঙ্গিশাহির হাতে অন্তত দশ লাখ নিহত
বাংলাদেশের ভ্রাম্যমাণ দ্যূতের বিবৃতি
বিশেষ সংবাদদাতা

নয়াদিল্লী, ২২ মে, বাংলাদেশের ভ্রাম্যমাণ রাষ্ট্রদূত ডঃ মোখলেসুর রহমান কাল রাতে দিল্লিতে এক বিবৃতিতে বলেন যে, জেনারেল ইয়াহিয়া খানের আদেশে গত ২৫ মার্চ বাংলাদেশ জঙ্গি আক্রমণ শুরুর পর নারী ০ শিশুসমেত অন্তত দশ লাখ নিরস্ত্র ও অসহায় বাঙালি নিহত হয়েছে।

তিনি বলেন, জেনারেল ইয়াহিয়া খানের অনুগত সঙ্গী প্রশাসক লে জে টিক্কা খান এখনো বাংলাদেশের সর্বত্র ব্যাপক হারে নরহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। আমেরিকা, রাশিয়া ও চিনের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংলাদেশের সমস্ত অসহায় মানুষের বিরুদ্ধে পুরোদস্তুর যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। অগ্নিবর্ষী ট্যাংক , কামান, মর্টার ও মেশিনগানের গোলায় তাদের নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। গ্রাম ও শহরগুলির ওপর ব্যাপকভাবে বোমা ফেলা হচ্ছে।

কেম্ব্রিজের ইতিহাসের পি এইচ ডি ডঃ রহমান ২ মে বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। প্রত্ত্যক্ষদর্শীর করুন বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন রাজশাহীর কয়েকজন গ্রামবাসী আমাকে একটি গ্রামে নিয়ে যান। সেই গ্রামের ১২০০ থেকে ১৪০০ লোককে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে।

বাংলাদেশে যে উৎপীড়নের কথা প্রচারিত হয়েছে, তা অতিরঞ্জিত – এই মিথ্যা প্রচারের জন্য ইয়াহিয়া খান সরকার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দ্যূত পাঠিয়েছেন। শ্রী রহমান জিজ্ঞাসা করেন, তাই যদি হয় তাহলে কেন বিদেশী সাংবাদিকদের সেখানে যা ঘটেছে তা দেখতে দেয়া হচ্ছেনা?

শ্রী রহমান বলেন যে, মানবতার নামে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটী মানুষের পক্ষে আমরা দাবি করছি যে, বাংলাদেশে এই ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের জন্য আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের উচিত অবিলম্বে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও টিক্কা খানের বিচারে উদ্যোগী হওয়া।

তিনি বিদেশী বন্ধুদের এই কথা মনে রাখতে বলেন যে, জঙ্গিশাহিকে কোন রকম অর্থনৈতিক সাহায্য দেওয়া হলে তা বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধেই কাজে লাগানো হবে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৯৫। একটি নির্ভিক কণ্ঠ কালান্তর ২৪ মে, ১৯৭১

Aparajita Neel
<১৪, ২৯৫, ৭৫৪-৭৫৫>

একটি নির্ভিক কণ্ঠ

এবার একটি নির্ভিক কণ্ঠ সোচ্চার। শেখ মুজিবরই পাকিস্তানের অখণ্ডতার শত্র – ইয়াহিয়া খান ও তাঁর জঙ্গী চক্রের এই অপপ্রচার ধূলিসাৎ করে দিয়েছেন স্পষ্টবক্তা বাদশা খান। তিনি বলেছেন, মুজিব সাহেব পাকিস্তান ধ্বংস করতে চান নি, পাকিস্তান যদি ধ্বংস হয়ে থাকে তবে তাঁর জন্য দায়ী পাকিস্তানের পিপলস পার্টির নেতা ভুট্টো ও মুসলিম লীগ নেতা কাইয়ুম। বাঙালীরা খাঁটি মুসলমান নয় – এমন প্রচার করতেও শয়তানরা ছাড়েনি। তাঁর জবাবে বাদশা খান বলেছেন, বাঙালীরা খাঁটি মুসলমান এবং পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য অন্য যে কারো চাইতে তাদের বেশী। দেশ ভাগের আগে একমাত্র বাংলাদেশেই মুসলীম লীগ সরকারের অস্তিত্ব ছিল, বেলুচিস্তান, সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু বা পাঞ্জাবে তা ছিল না। বাঙালীদের চেষ্টায়ই পাকিস্তানের জন্ম হয়েছে। অতএব, পাকিস্তানের প্রতি বাঙালীদের আনুগত্য ছিল না, একথা অবিশ্বাস্য।

বাদশা খানও সেই একই প্রশ্ন তুলেছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাইবে কেন? বাঙালীরা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে দাবিয়ে রাখার জন্যই সামরিক আইন জারি করে বাংলাদেশে ট্যাঙ্ক, মেশিনগান ও বোমা চালিয়ে সন্ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করা হয়েছে। এটা পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার পথ নয়। আসলে পাঞ্জাবের পুঁজিপাতি গোষ্ঠী ও সামরিক প্রভুদের ক্ষমতা কায়েম রাখার জন্যই সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের উপর এই বলপ্রয়োগ। বাদশা খান তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভাষায় বলেছেন, হতভাগ্য বাঙালীদের একমাত্র অপরাধ যে, তাঁরা নির্বাচনের মাধ্যমে গোটা পাকিস্তানের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। আওয়ামী লীগের ছয় দফা দাবিকেই যদি ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের সর্বনাশের কারণ বলে মনে করেন, তবে সেই ছয় দফা দাবীর বিরোধিতা গোড়া থেকেই তিনি করলেন না কেন? প্রায় এক বছর ধরে এই ছয় দফা দাবীতে আওয়ামী লীগ প্রচার এবং সেই দাবীর ভিত্তিতেই সে নির্বাচনে জয়ী হয়। বাদশা খান প্রশ্ন করেন, তখন তা বন্ধ করে দেবার কথা সামরিক রাষ্ট্রপতির মাথায় ঢোকেনি কেন? বাংলাদেশে গিয়ে তিনি কেনই বা বললেন যে, শেখ মুজিবুর রহমানই পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী? মুসলীম লীগ নেতা কাইয়ুম সাহেবও তো বলেছিলেন, ছয় দফা দাবি পূর্ন পাকিস্তানের পক্ষে প্রযোজ্য। ভুট্টো সাহেবও তো আওয়ামী লীগের ছয় দফার মধ্যে পাঁচ দফা দাবি মেনে নিয়েছিলেন।

তথাপি সব কেঁচে গন্ডুষ হয়ে গেল কেন? বাদশা খান নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এর উত্তর দিয়েছেন।
জিন্নার আমলে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে অনুরুপ জুলুম হয়েছিল। পাকিস্তানের সবে জন্ম হয়েছে। সীমান্ত প্রদেশের বিধানসভায় তখন ছিল বাদশা খানের দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা। পঞ্চাশ জন সদস্যদের মধ্যে তেত্রিশ জনই ছিলেন তাঁর দলের। জিন্না সাহেব জোর করে সেই দলের মন্ত্রীসভা ভেঙে দিয়ে সংখ্যালঘু দলকে মন্ত্রীসভা গঠন করতে ডাকলেন। কেবল তাই নয়, বান্নু যাবার পথে বাদশা খানকে গ্রেপ্তার করা হল। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ইপির ফকিরকে দেবার জন্য পাঁচ লক্ষ টাকা সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিলেন। আরো রটিয়ে দেওয়া হল, পাকিস্তানকে তিনি বালির ঢিপি এবং এক লাথিতে তিনি তা উড়িয়ে দেবেন। প্রচার চলল, বাদশা খান বিশ্বাসঘাতক ও হিন্দুদের দালাল। সঙ্গে সঙ্গে বহু লোককে গ্রেপ্তার করা হল। এই গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ করতে ও নামাজ পড়তে জুম্মাবারে যারা বারবারায় এসে জামায়েত হল তাদের উপর চলল বোমা ও মেশিনগান। শত শত নরনারী ও শিশু প্রাণ হারাল। তারপর সারা প্রদেশে চলল লুণ্ঠন, মারপিট ও নানাবিধ লাঞ্ছনা। হাজার হাজার খোদাই খিদমৎগারকে আন্দোলন ও তাঁর মুখপাত্র ‘’পুশতুন’’ নিষিদ্ধ করে দিল।

বাদশা খান বলেছেন, সেদিন সংখ্যাগুরুদের উপর সংখ্যালঘু কর্তৃক চাপিয়ে দেবার জন্য পাকিস্তানের জনক খোদ জিন্না সাহেব যে পন্থা অবলম্বন করেছিলেন, আজ সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগকে দাবিয়ে ভুট্টোর সংখ্যালঘিষ্ঠ পিপলস পার্টিকে পাকিস্তানের ক্ষমতায় বসবার জন্য সেই একই বলপ্রয়োগের নীতি গ্রহণ করেছেন সামরিক রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহিয়া খান। বাদশা খান চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন যে গুরু যে পথ নিয়েছিলেন, শিস্যও সেই পথ ধরেই চলেছেন।

তিনি স্পষ্টতই বলেছেন, বলপ্রয়োগের দ্বারা পাকিস্তানের জনসাধারণকে আর ভুলিয়ে রাখা সম্ভব নয়। যদি একসাথে থাকতে হয় তবে ভাই ভাই হয়ে থাকতে হবে। সমমর্যাদা ও সমান অধিকার স্বীকার না হয় তবে পশ্চিম পাকিস্তানের অঙ্গ রাজ্যগুলোর সংখ্যালঘুরা আমরিক শাসকের কাছে কী-ই বা প্রত্যাশা করতে পারে? পশ্চিম পাকিস্তানের অঙ্গ রাজ্যগুলোকে মিলিয়ে আবার যদি একটি প্রদেশে পরিণত করা হয়, তা শাসন ক্ষমতায় যদি ভুট্টোর দল এসে বসে, তবে পাশতুনরা তা কিছুতেই বরদাস্ত করবে না বলে বাদশা খান হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। কারণ, তাঁর মতে তা হবে দাসত্ব ও শোষণকে বরণ করে নেওয়া।

বাদশা খান পাকিস্তানের কল্যাণকামী বলেই একটি প্রস্তাব দিয়েছেন। বর্ত্মান পাক সরকার যদি প্রয়োজন বোধ করেন, তাঁকে মধ্যস্ত মানতে পারেন। সম্মতি পেলে তিনি সিন্ধু, বেলুচিস্তান, সীমান্ত প্রদেশ ও পাঞ্জাব থেকে কয়েকজন প্রতিনিধি নিয়ে বাংলাদেশ যাবেন। তাঁর আগে পাক সরকারকে কথা দিতে হবে যে, তাঁরা শান্তি চান। মুজিব ও তাঁর সমর্থকরা বাদশা খানের প্রস্তাবে সম্মত হবেন কি-না সেটা বড় কথা নয়, শান্তিপূর্ন পথে সমাধান সম্ভব কি-না তাঁর চেষ্টা করে দেখবেন তিনি। তাঁর প্রস্তাবে পাক সরকারের কোন সাড়া পাওা যায়নি এখনো পর্যন্ত। সাড়া পাওয়া যাবে বলেও মনে হয় না। সদিচ্ছা থাকলে আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক অধিকারকে এভাবে পিষ্ট করে ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিতেন না।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৯৬। ১১ জুন দেশের শ্রমিক শ্রেণী “বাংলাদেশ” দিবস পালন করবে কালান্তর ২৫ মে, ১৯৭১

Aadrita Mahzabeen
<১৪, ২৯৬, ৭৫৬>

১১ জুন দেশের শ্রমিক শ্রেণী “বাংলাদেশ” দিবস পালন করবে

নয়াদিল্লী, ২৩ মে(ইউএনআই)–আগামী ১১ জুন ভারতের শ্রমিক শ্রেণী সারা দেশব্যাপী “বাংলাদেশ” দিবস প্রতিপালন করবে।

বাংলাদেশের সঙ্গে সংহতি রক্ষার জন্য গঠিত ভারতের জাতীয় ট্রেড ইউনিয়ন কমিটি উপরোক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে।

সম্প্রতি, আইএনটিইউসি, সিটু, এইচএমএস, এইচএমপি এবং ইউটিইউসি (উভয় গ্রুপ)-র প্রতিনিধিদের নিয়ে এই মিলিত জাতীয় ট্রেড ইউনিয়ন কমিটি গঠিত হয়েছে। কমিটির প্রেসিডেন্ট ড. মৈত্রেয়ী বসু আজ এখানে সংবাদিকদের জানান, যে শেখ মুজিবুরের বিনা শর্তে মুক্তির এবং ভারত কর্তৃক “বাংলাদেশ” স্বীকৃতির দাবীকে জয়যুক্ত করাই হবে এই কমিটির মূল লক্ষ্য।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৯৭। নির্যাতনের চিত্র ন্যাশনাল হেরাল্ড ২৬ মে, ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৯৭, ৭৫৭>

ন্যাশনাল হেরাল্ড, ২৬ মে, ১৯৭১
নির্যাতনের চিত্র

করিমগঞ্জ, ২৫ শে মে – পূর্ব বাংলার দুই অধ্যাপক গতকাল সংবাদিকদের বলেন বাংলাদেশের প্রচুর সংখ্যক যুবতী মেয়েকে সিলেট জেলার বিভিন্ন ক্যাম্পে ইয়াহিয়া’র কুকুরদের কল গার্ল হিসেবে বন্দি করে রাখা হয়েছে।

পাকিস্তানী সেনাদের এই “ভয়ানক অত্যাচারের” একটি ছবি তুলে তারা বলেন, “এই যুবতী নারীদের কোনও শাড়ি ছাড়াই রাখা হয় এবং তাদের সৈন্যদের ইচ্ছার অধীনে পরিচালিত করা হয় যখন তারা তাদের খায়েশ মেটাতে চান।’’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই দুজন শিক্ষাবিদ বলেন, “সহিংসতা ও নিপীড়নের অহংকারে দখলদার বাহিনী বাংলাদেশের জনগণকে শেষ করার জন্য এবং স্বাধীনতা আন্দোলনকে ধ্বংস করার জন্য নতুন পন্থা অবলম্বন করেছে। তারা বাঙালিদের দিয়ে জোর করে তাদের ঘরবাড়ি এবং বাজারের লুণ্ঠন করে এবং ফটোগ্রাফ গ্রহণ করে। এই ছবিগুলি তারা বিদেশে পাঠায় যাতে সেগুলো সেখানকার টেলিভিশনে প্রচার করা হয় এই বলে যে ‘বাঙালিরা অবাঙ্গালিদের ঘর লুট করছে’ অথবা ‘’হিন্দুরা মুসলমানদের ঘরে লুট করছে’’।

এছাড়াও তারা রেডিও পাকিস্তানে “জঘন্য এবং বানোয়াট প্রচারণা” প্রচার করছে, যাতে তারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিঘ্ন ঘটাতে পারে। “বিশ্বকে বোকা যাবেনা”, তারা বলে। পিটিআই।
————

শিরনাম সূত্র তারিখ
২৯৮। মেঘালয় সীমান্তে গোলাবর্ষণ হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড ২৬ মে ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৯৮, ৭৫৮- ৭৬০>

হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, ২৬ মে, ১৯৭১
মেঘালয়ের সীমান্তে গোলাবর্ষণ
৯ জন বিএসএফ নিহত

শিলং, ২৫ মে – যদিও অফিসিয়াল সূত্র মতে আজ মেঘালয় গারো হিল জেলার দালু সেক্টরে পাকিস্তানিদের আক্রমণে ২২ জন মারা গেছে যাদের ভারতীয় সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর ৯ জন আছে। আসামের প্রধানমন্ত্রী জনাব মহেন্দ্রমহন চৌধুরী আজ সন্ধ্যায় এসেম্বলিতে বলেছেন বি এস এফ সফলভাবে পাকিস্তানের আগ্রাসন আসামের বাংলাদেশ বর্ডারের তিনটি সেক্টর থেকে প্রতিহত করেছে – খবর এজেন্সির।

প্রধানমন্ত্রী যিনি ভারতীয় ভূখন্ডএর আসামে পাকিস্তানি হামলার উপর বিবৃতি দিচ্ছিলেন। তিনি বলেন, আসাম সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আমাদের অঞ্চলের পবিত্রতা রক্ষা করতে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেছিলেন যাতে আমাদের এলাকা থেকে পাকিস্তানি আর্মি দূর হয়।

জনাব চৌধুরী বলেন চারটি গ্রাম থেকে সাধারণ জনগণকে নিরাপদে সরানো হয়েছে – কারণ পাকিস্তানিরা ভারতের অনেক ভেতরে গারো পাহাড় আর করিমগঞ্জ সেক্টরে আক্রমণ করেছিল।

গ্রামগুলো হল মেঘালয়ের গারো পাহাড়ের ডালু, এবং সুতারকান্দি আর করিমগঞ্জ সেক্টরের জেরাপাত্তা ও গোবিন্দপুর।

ডালু সেক্টরে ২২ জন মারা যাবার পাশাপাশি আরও ১১ জন আহত হয় পাকিস্তানিদের শেলিং এর জন্য। তারা ভারতের বর্ডারের আউটপোস্টে মেশিনগান ও শেলিং করছিল জঙ্গলের গভীর থেকে – অফিসিয়াল সূত্র একথা জানায়।

প্রতিবেদন অনুযায়ী এক জন বিএসএফ জুনিয়র কমিশন্ড অফিসারকে পাক-সৈন্যরা অপহরণ করে।

রিপোর্ট জানায় যে, ভারতীয় অংশে সাধারণ জনগণের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে কারণ এখনো জঙ্গলের ভেতর লাশ খোজা হচ্ছে।
প্রায় ২০০ পাকিস্তানি সৈন্য ভারতীয় ভূখন্ডের ভিতরে কিলাপারায় টহল দিচ্ছে বলে রিপোর্ট করা হয়েছিল। কিন্তু এলাকাটি সন্ধ্যায় ভারত সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে।

আমাদের তুরা প্রতিবেদক বলেছেন: পাকিস্তানী সৈন্যের সাথে রাইফেল, মেশিনগান ও মর্টার আছে। তারা আজ সকাল প্রায় ৭ টার সময় মেঘালয়ের গারো পাহাড়ের সীমান্তে দালুবাজার প্রবেশ করে। সংখ্যায় ১০০ ছিল। ১ ঘণ্টা এলোমেলো গুলো চালাতে থাকে।

একটি অসমর্থিত নন-অফিশিয়াল প্রতিবেদন অনুযায়ী মৃতদের মধ্যে এক নারী ও একটি চার বছরের শিশু ছিল। কেউ কেউ গুরুতর আহত হয়েছে – টাদের সাধারণ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আনা হয়েছে। আহতদের মধ্যে অ-গারো, গারো সহ স্থানীয় বাসিন্দা এবং বাংলাদেশী শরনার্থি ছিল যারা দালুবাজার ও টার পার্শবর্তি এলাকায় ক্যাম্পে ছিল।

একটি মুলতবি প্রস্তাব যা দিয়েছেন কমিউনিস্ট দলের বড় নেতা জনাব ফনি – তার জবাবে জনাব চৌধুরী বলেন, আক্রমণকারি পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রাথমিক কিছু লাভ আছে। কিন্তু চূড়ান্ত বিজয় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর।জনাব চৌধুরী উভয় হাউজে আসাম-পূর্ববাংলার সীমান্তে পাকিস্তানের আগ্রাসনের ব্যাপারে বলেন। তিনি বলেন। ” পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নিবে তা এত দ্রুত বলা সম্ভব না।’

মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য হাউসকে নিশ্চিত করেন যে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত ছিল যে কোন পরিণামের জন্য।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর “বিনা উস্কানিতে আক্রমনাত্মক কার্যক্রম” এর বিবরণ দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, হামলা তিনটি ভিন্ন সেক্টরে হয়েছে – দক্ষিন আসামের করিমগঞ্জ সাব ডিভিশনের সুতারকান্দি থেকে মেঘালয় পর্যন্ত।

মুখ্যমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তানি সেনারা গতকাল বিকালে সুতারকান্দিতে ভারতের সীমান্ত ফাঁড়ি এবং করিমগঞ্জের জরাপাতার গ্রামের ফাঁড়ি দখল করে।

ভারতীয় সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর পরে একটি পাল্টা আক্রমণ করে এবং দুটি স্থান পুনরুদ্ধার করেন।

মেঘালয়ের গারো পাহাড়ের সেক্টরে পাকিস্তানি আর্মি ডালু টালিপারা ও ছাইপানি এলাকায় গুলি করে ত্রাস সৃষ্টি করার চেষ্টা করে।

প্রায় ২০০ পাকিস্তানি আর্মি আজ সকালে ভারতীয় এলাকা টালিপারায় টহল দিচ্ছে। গুলি বিনিময়ের পড় টাদের গ্রাম ছাড়া করা হয়। এতে উভয় পক্ষের অনেকে হতাহত হয়। যানা যায় যে, পাকিস্তানী সৈন্যরা প্রচন্ডভাবে করিমগঞ্জ সেক্টরের লাটু গ্রামে ও মেঘালয়-গারো পাহাড় জেলার উল্টা দিকে ডালু ফাঁড়ির মধ্যে শেলিং করে।

সৈন্যরা ভারতীয় অনেক গ্রামে অনেক ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় ও বেসামরিক লোক হত্যা করে এবং অপহরণ করে। জনাব চৌধুরী বলেন, যদিও এখন ভারতের মাটিতে কোন পাকিস্তানী সৈন্য নাই, রাজ্য সরকার পাক সরকারের আক্রমনাত্মক ভঙ্গি সম্পর্কে উদ্বিগ্ন আছে।

মুখ্যমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তানি আর্মি ২৩ মে সন্ধ্যায় সুতারকান্দিতে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর ফাঁড়ির দিকে গুলি করে।

সাম্প্রতিক সরকারের কাছে আসা তথ্য অনুযায়ী যানা যায় পাকিস্তানি আর্মি এবং বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সাথে পূর্ব বঙ্গের কাছাকাছি ভারতীয় গ্রাম লাটু এবং করিমগঞ্জের মহিশাশন গ্রামে ভারী যুদ্ধ হয়।

মুখ্যমন্ত্রী বলেন পূর্ব বাংলা সীমান্তের মেঘালয়ের ময়মনসিংহ সেক্টরের গারো-হিলস বরাবর দাতু, তাল্লিপারা ও ছাইপানি এলাকায় পাকিস্তানি সেনারা ভারী গোলা বর্ষণ করে একটি ছাপ সৃষ্টি করেছে।

গত সন্ধ্যায় ডালুতে পাকিস্তানের গোলা বর্ষণের কারণে একজন ভারতীয় গ্রামবাসী নিহত হয়েছে এবং ছয় জন আহত হয়েছে। এছাড়া সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীরও কিছু হতাহত হয়েছে।

আজ সকালে তালিপারা ও ছাইপানি এলাকা থেকে পাকিস্তানি সেনারা কিছু ভারতীয়দের অপহরণ করেছে।

আমাদের শিকারপুর প্রতিবেদক যোগ করেছেন: প্যাট সৈন্য সকাল ৮ টার পর থেকে শিকারপুর সীমান্তে গুলি চালাচ্ছে। সম্ভবত ২২ মে তারিখে তাদের তিনজন গুলিতে নিহত হয় সেই প্রতিশোধ নিতে এগুলো করছে। তারা ভারতে প্রবেশ করে জোরপূর্বক ১১ টি ছাগল নিয়ে যেতে এসেছিল। কুষ্টিয়া সীমান্তে পাক সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। শিকারপুর সীমান্ত থেকে বিএসএফ সরানো হয়েছে। বিস্তারিত আরও পরে জানানো হবে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৯৯। শরনার্থী শিবিরে বাঙ্গালী নিধন হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড ২৭ মে ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ২৯৯, ৭৬১>

হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, ২৭ মে ১৯৭১
শরনার্থী শিবিরে বাঙ্গালী নিধন

২৫ শে মে – পূর্ব বাংলার একজন প্রকৌশলী, সম্প্রতি সুইডেন যাওয়ার পথে ঢাকা থেকে এখানে এসেছেন। তিনি সামরিক প্রশাসন কর্তৃক জঘন্য কাজকর্মের কথা প্রকাশ করে বলেন এটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিতে নাৎসিদের দ্বারা সঙ্ঘটিত নিপীড়নের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল।

প্রকৌশলীর কাছের আত্মীয়রা যারা পদ্মা নদীর অন্য পার্শ্বে থাকেন তারা বন্দি ক্যাম্পে যেখানে বাঙালিদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ও রাতের অন্ধকারে জবাই করা হচ্ছে সেসব কাহিনী বলেন। সামরিক কর্তৃপক্ষ, যারা পূর্ববঙ্গে “স্বাভাবিক জীবন” আছে বলার চেষ্টা করছেন – তারা আসলে দিনের বেলায় গোলাগুলির চাইতে ছুরি দিয়ে তাদের পেট কাটার পন্থা অবলম্বন করেছেন – এর কারণ হল গুলির আওয়াজে সবাই ভোয় পেয়ে যায় যাতে করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার পরিবেশ বিনষ্ট হয়।

প্রকৌশলীর জানা মতে, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গোদনাই ও টঙ্গিতে এরকম কমপক্ষে চারটি ক্যাম্প আছে।

তিনি বলেন যে যদিও ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের প্রায় বেশিরভাগ কারখানাই কাজ করে না, তবুও সৈন্যরা সাধারণ মানুষকে দিয়ে সেখানে বয়লারে ধোঁয়া উৎপন্ন করতে বলেছেন যাতে মনে হয় এগুলো স্বাভাবিকভাবে চলছে।

বিভিন্ন সরকারি অফিস এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি খুব কম। এমন দৃষ্টান্ত আছে যে সরকারি কর্মকর্তাদের তাদের বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং কখনও আর তাদের দেখা যায়নি বা তাদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

অনেক সেনা কর্মকর্তাকে তাদের মৃত সৈন্যদের জন্য কফিন বানানোর আহ্বান জানানো হয় এবং যখন তারা সেটা করতে ব্যার্থ হয় তখন সৈন্যরা কোনও সামর্থ্যবান লোককে সেখানে নিয়ে আসে এবং তাদেরকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩০০। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের প্রশ্নে ভারত সরকারের দ্বিধা কাটেনি কালান্তর ২৭ মে, ১৯৭১

সমীরণ বর্মন
<১৪, ৩০০, ৭৬২-৭৬৩>

বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের প্রশ্নে ভারত সরকারের দ্বিধা কাটেনি
লোক্সভায় শ্রীমতি গান্ধীর বক্তব্যের মর্মার্থ

নয়াদিল্লি, ২৬মে-বাংলাদেশ সম্পর্কে আট ঘন্টার লোকসভা বিতর্কের জবাব্দাঙ্কালে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আজও তিনি বলেছেন, “আমরা ঝুঁকি নিতে ভয় পাই না। দরকার হলেই ঝুঁকি নেব”। অথচ তাঁর দলের বিশিষ্ট সদস্য শ্রী দীনেশ সিং বলেছেন, ইতিমধ্যেই ভারত অনেকটা দেরী করে ফেলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে একটা জিনিস খুব সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলি কি করে সেদিকে ভারত তাকিয়ে আছে।

ইউএনআই-এর সংবাদে প্রকাশ, প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা লোকসভায় বলেছেন, বাংলাদেশে যে সঙ্কটজনক অধ্যায় সূচিত হয়েছে সে ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সমাজকে হস্তক্ষপ করতে হবে। এই অঞ্চলের শান্তি অ নিরাপত্তা যাতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় ও বজায় থাকে তা দেখা বিদেশী দেশগুলোর কর্তব্য। আর তা করতে ব্যররথ হলে তাঁর পরিণতি খুব বিপজ্জনক।

শ্রীমতি গান্ধী বলেন, বাংলাদেশে যা ঘটেছে তা রাজনৈতিক বা অর্থনীতিক সমস্যা নয়। এ হচ্ছে সমগ্র অঞ্চলের মানুষের জীবনমরণ লড়াইই। তন বলেন, একটি গোটা জাতিকে ধ্বংস করার সুপরিকল্পিত প্রয়াস থেকে আজকে বাংলাদেশের এই পরিস্থিতির উদ্ভব হচ্ছে। আর সেই গণহত্যার কার্যকরণ পরিণতিস্বরূপ হাজার পুরুষ নারী শিশুকে হত্যা করা হচ্ছে বা লাখো মানুষকে শরণারররহী করে, ভারতে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে।

শ্রীমতি আজ পুনর্বার বলেন, আমরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের প্রশ্নটি প্রতিনিয়ত ভেবে দেখছি। এ ব্যপারে বা অন্য ব্যাপারে আমরা যে সিদ্ধান্তই গ্রহণ করি না কেন তা স্বাধীনভাবে বিচারবিবেচনা করে গ্রহণ করব। আমাদের বৃহত্তর স্বার্থের কথা মাথায় রেখে সিদ্দধান্ত করব।
প্রধানমন্ত্রী আজ সদস্যদের প্রতিশ্রুতিদেন, বাংলাদেশের প্রশ্নে সব বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা ক্করে চলবেন।

তিনি সদস্যদের বলেন, পাকিস্তানের নির্বাচনে যে রায় প্রকাশিত হয়েছে গণতন্ত্রের এর চেয়ে কোন সুস্পষ্ট প্রকাশ হওয়া কি সম্ভব? তিনি বলেন, গণতন্ত্রের অনেক গালভরা ঝুলি শুনেছি। মিত্র দেশগুলি দাবি করেন, গণতন্ত্র বাঁচাবার জন্য নাকি তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নেমেছিলেন কিন্তু এখন তারা কোথায়?
তিনি বলেন, কোন কোন দেশ বাংলাদেশের মানুষকে বিছিন্নতাকামী আখ্যা দিয়েছেন। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন যে, পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষ পূর্বাঞ্চলে বাস করে। কিন্তু গণতান্ত্রিকের ব্যাবস্থায় সংখ্যাধিক্যের কতকগুলি অধিকার আছে। আর পূর্বাঞ্চলের মানূষ যদি সেই অধিকারগুলো বুঝে নিতে চান তবে তাদের বিছিন্নতাকামী আখ্যা দেওয়া কি সমীচীন হয়েছে?
তিনি বলেন সাড়ে সাত কোটি মানুষধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এ কারণেই ভারতের মনোভাব প্রকাশিত হয়নি, বাংলাদেশের মর্মান্তিক ঘটনার ছাপ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অ সামাজিকজীবনে এসে পড়েছে। এই হচ্ছে অবস্থার বাস্তব রূপায়ন। এ কোন প্রচার নয়।

পূর্বাহ্নে প্রাক্তন মন্ত্রী শ্রী দীনেশ সিং বলেন, ভারত কোন ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করলে তবে বিদেশী রাষ্ট্রগুলি বাংলাদেশের ঘটনার সঙ্গে নিজেদেরকে জড়িত করবে। তিনি বলেন, অনেক দেরী হয়েছে। আর কালবিলম্ব না করে ভারত সরকারের ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করা উচিত।

তিনি বলেন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার পেছনে অনেকগুলি সাংবিধানিক অবৈধ যুক্তি আছে।
পিএসপি শ্রী সমর গুহ বলেন, বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারত সরকার ইতিমধ্যেই অনেকখানি জড়িয়ে পড়েছে। এখন সে দেশকে স্বীকৃতি দিলে অবস্থার গুণগত পরিবর্তন হবে।

নির্দল সদস্য শ্রী কৃষ্ণমেনন বলেন, একদিন করে স্বীকৃতি দিতে দেরী হচ্ছে বাংলাদেশের পরিস্থিতিও জটিলতর হচ্ছে। শ্রী মেনন মনে করেন বাংলাদেশকে উপদ্রুপ অবস্থা পিছনে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি লুকিয়ে আছে তাদের রুখবার জন্যও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন।

তিনি বলেন, পাকিস্তানের পুরোপুরি অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার জন্য ভারত সরকার বৃটেন অ আমেরিকার ওপর চাপ সৃষ্টি করুন।

তিনি মনে করেন, সক্ষম শরণার্থীদের বাংলাদেশের ফিরে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নৈতিক সাহায্যদান করা উচিত।

কালান্তর, ২৭ মা, ১৯৭১

____________________________

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩০১। অবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতির দাবিতে পৌরসভার প্রস্তাব কালান্তর ২৮ মে,১৯৭১

Kamol Roy
<১৪, ৩০১, ৭৬৪>

অবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতির দাবিতে পৌরসভার প্রস্তাব

কলকাতা, ২৬ মে- বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামের সমর্থনে আজ কলকাতা পৌরসভার বিশেষ অধিবেশনে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। প্রস্তাবে “অনতিবিলম্বে বাংলাদেশের সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ও তার সরকারকে স্বীকৃতি এবং অস্ত্রশস্ত্রসহ সর্বপ্রকার কার্যকরী সাহায্য” দেবার জন্য ভারত সরকারের কাছে দাবি জানানো হয় এবং “পশ্চিমবাংলার বিধানসভায় বাংলাদেশের স্বীকৃতিদান সম্বন্ধে সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হওয়া সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত ভারত সরকার তাহা কার্যে রূপান্তরিত না করায় এই প্রস্তাবে গভীর ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করা হয়। “প্রস্তাবকে কার্যকরী করার জন্য ভারত সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে” পশ্চিম বাংলার জনগণকে প্রস্তাবে আহবান জানানো হয়েছে।

প্রস্তাবে “বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীগণকে যথার্থ সাহায্য ও সেবা করার উদ্দেশ্যে মেয়রের নেতৃত্বে একটি সাহায্য ভান্ডার খোলার” কথা বলা হয়।

প্রস্তাবের পক্ষে একমাত্র আরএসসি ছাড়া আর সমস্ত দলের সদস্য ভোট দেন।

সভার শুরুতে বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের বিবরণসহ মেয়র শ্রী শ্যামসুন্দর গুপ্ত একটি বিবৃতি দেন। পরে মেয়রের অনুপস্থিতিতে ডেপুটি মেয়র শ্রী পান্না লাল দাস সভার কাজ পরিচালনা ও মেয়রের আসন থেকে মূল প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন।

প্রস্তাবটি সমর্থন করে অল্ডারম্যান শ্রী কমলাপতি রায় (সিপিআই) বলেন, যে বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির প্রশ্নটি হল প্রধান বিষয়; এবং বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে ভারতের ভাগ্য জড়িত থাকা স্বত্বেও বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি না দেওয়ার পক্ষে পার্লামেন্ট যে সমস্ত যুক্তি দেখান হয়েছে তা মেনে নেওয়া যায় না। সিপিএম সদস্যরা তাঁদের বক্তৃতায় মূল প্রস্তাবকে সমর্থন করলেও বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যেকার সীমান্ত বেড়া তুলে নেবার জন্য দাবি করেন। এসইউসি এবং কংগ্রেস সদস্যরা তাদের বক্তৃতায় মূল প্রস্তাবকে সমর্থন করেন। প্রস্তাবের সমর্থনে সবশ্রী শিবকুমার খান্ন, ডাঃ কে পি ঘোষ, শ্যামল দত্ত প্রমুখ পৌরপিতাগণ বক্তৃতা দেন।

প্রস্তাবের তিনটি ধারাই আর এসপি সংশোধনী দেয়। অপর একটি ধারায় সমস্ত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। এদের এইসব সংশোধনীর পক্ষে শুধু নিজেদের ৮ জন সদস্য ভোট দেন। সংশোধনী পরাজিত হলে দলের সদস্যরা মূল প্রস্তাবে ভোট দানে বিরত থাকেন।

সংশোধনীগুলোতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতির জন্য ১৫ দিন সময়সীমা বেঁধে দিতে চাওয়া হয় ও স্বীকৃতি না দিলে ১৫ দিন পরে গণ আন্দোলন করার কথা বলা হয়। সংশোধনী উত্থাপন করে আরএসপি সদস্য অন্য সব রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধেই বিষোদগার করেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩০২। পাকিস্তানে গোপন তথ্য পাচারঃ রাজ্যসভায় সরকারী বিবৃতির দাবী কালান্তর ২৮ মে, ১৯৭১
Kamol Roy
<১৪, ৩০২, ৭৬৫>

পাকিস্তানে গোপন তথ্য পাচার
রাজ্যসভায় সরকারী বিবৃতির দাবী

নয়াদিল্লী, ২৭ মে, (ইউ এন) – দু’জন মন্ত্রী এবং একজন সংসদ সদস্য সরকারের গোপন তথ্য সরবরাহ করছে বলে কলকাতার দৈনিক সংবাদপত্রে যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, কয়েকজন সদস্য আজ রাজ্যসভায় উক্ত বিষয়টি উত্থাপন করেন। কোন কোন সদস্য সংবাদপত্রের সংবাদও উদ্ধৃত করেন।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র (স্বতন্ত্র) সভায় সংবাদপত্রের রিপোর্টের কিয়দাংশ পাঠ করেন।

উক্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রী সভার জনৈক মন্ত্রী খুব গোপনীয় ফাইলপত্র পাকিস্তান সরকারকে সরবরাহ করছেন। এই রাজ্যের জনৈক সুপরিচিত সংসদ সদস্য পাকিস্তানের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করে পাকিস্তান থেকে টাকাও পেয়েছেন। শ্রী মিশ্র উক্ত মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের নাম প্রকাশের ও অবিলম্বে তাদের গ্রেফতারের দাবি জানান।

এই বিষয়টি খুবই গুরুতর বলে তিনি সরকারকে একটি বিবৃতি দিতে অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, এতে দেশে নিরাপত্তাই শুধু বিপন্ন হয়নি পার্লামেন্টের মর্যাদা হানি ঘটেছে।

শ্রী ভূপেশ গুপ্তও অনুরূপ রিপোর্ট পশ্চিমবঙ্গের কোন কোম বাংলা দৈনিক সংবাদপত্রেও প্রকাশিত হয়েছে বলে বলেন, এবং তিনি রিপোর্টের কোন সত্যতা আছে, না রিপোর্টটি জাল, সে সম্পর্কে সরকারকে একটি বিবৃতি দিতে অনুরোধ জানান।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩০৩। বাংলাদেশ হস্তক্ষেপ ও সুদৃঢ় নীতির দাবীতে- কম্পাস ২৯ মে, ১৯৭১

Kamol Roy
<১৪,৩০৩, ৭৬৬-৭৭০>

বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ ও সুদৃঢ় নীতির দাবীতে-
সম্পাদকীয়

বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চাপ আসতে পারে, এজন্যই ভারত সরকার ইতস্তত করছেন। সাধারণভাবে এরকম একটা ধারণাই এখন জনসাধারণে দেখা যাচ্ছে। ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেও বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলি হয়তো ভারত সরকারকে অনুসরণ করে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেবে না। এটাই নাকি ভারতের পক্ষে স্বাধীনভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার পথে যথেষ্ট বাধার কারণ।

কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে বিদেশী রাষ্ট্রগুলির মনোভাব কি দাঁড়াতে পারে, তা পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।

চীন সুস্পষ্ট ভাষায় ভারতকে এই মর্মে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে যে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারত যেন আর নাক না গলায়। সর্ব প্রথম চীনের হুমকির বিষয়ে আলোচনা দরকার।

পূর্ব বাংলার ঘটনাবলীতের উদ্বেগ প্রকাশ করে ১৯৭১ সালের ৩রা এপ্রিল সোভিয়েট রাশিয়া পাকিস্তানের কাছে এক নোট পাঠিয়েছিল। এরপরেই আসে ১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল চীনের তরফে ভারতের প্রতি হুঁশিয়ার বাণী। চীনের এই হুঁশিয়ারীর পরেই এদেশে অনেকেই বলতে শুরু করলেন “আর কিছু করার প্রয়োজন নেই”, বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারত যেন আর জড়িয়ে না পড়ে।

অবশ্য চীনের ঐ নোটের তাৎপর্য খুব সতর্কতার সঙ্গে অনুধাবন করলে দেখা যায়-
(ক) সম্ভবতঃ রাশিয়ার নোটের প্রত্যুত্তরে পাকিস্তানের অনুরোধ বা চাপে চীন ভারতের প্রতি ঐ ধরনের হুঁশিয়ারী দিয়ে থাকতে পারে। যদি চীন সত্যিই তার হুঁশিয়ারী সম্পর্কে সিরিয়াস হয়ে থেকে, তাহলে তাকে অবশ্যই ভারত আর রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই হবে। আর এরকম ব্যবস্থা নেওয়ার অর্থই হল বিশ্বযুদ্ধকে ডেকে আনা। কিন্তু এই মুহুর্তেই যে চীন বিশ্বযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত, তা কারুর মত নয়। শুধু হুমকি দিয়েই চীন পাকিস্তানের সঙ্গে তার বন্ধুত্বকে বজায় রাখতে চেয়েছে-তার বেশী কিছু নয়।

(খ) চীন যে হুঁশিয়ারী দিয়েছে, তাতে কোথাও পূর্ব বাংলার আন্দোলন ও দাবীর ন্যায্যতা সম্পর্কে যেমন কিছু বলেনি, তেমনি ঐ আন্দোলন ও দাবীর সম্পর্কে অন্যভাবে কোন বক্তব্য রাখেনি। চীন শুধু ভারতের হস্তক্ষেপেরই নিন্দা করেছে। এর অর্থ জলো পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটি সম্পর্কে বিবেচনার পথ সে খোলাই রেখেছে। এ প্রশ্ন নক্যে তখনই সে বিবেচনা করবে, যখন তার স্বার্থের প্রশ্ন দেখা দিবে।
(গ) যদি পাকিস্তান চূড়ান্ত পরিণতিতে সম্পূর্ণরূপে শত্রুভাবাপন্ন দুটি ইউনিট ভেঙ্গে পড়ে আর ঐ ইউনিট দু’টি একে অপরের থেকে স্বাধীন হয়ে যায় তাহলে চীন এবং অন্যান্য শক্তিগুলিকে (যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েট রাশিয়া ও বৃটেন) একটিকে ছেড়ে আর একটি বেছে নিতে হবে। অবশ্য উপরোক্ত রাষ্ট্রগুলির প্রত্যেকেই পাকিস্তানের ঐক্যাবস্থা বজায় রাখতে আগ্রহী। কারণ, সাধারণভাবে এশিয়ায় এবং বিশেষভাবে ভারত উপমহাদেশে নিজেদের আন্তর্জাতিক রণকৌশল স্বার্থ বজায় রাখার জন্য তারা প্রত্যেকেই ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানকে ব্যবহার করার সুযোগ পাবে। এতে তাদের দুটি উদ্দেশ্যই সিদ্ধ হবে- ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানকে দাঁড় করিয়ে সাম্য সৃষ্টি করা এবং নিজ নিজ রাজনৈতিক স্বার্থে পাকিস্তানকে সামরিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা। কিন্তু পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পশ্চিম পাকিস্তানকেই বেছে নেবে- পুর্ব বাংলাকে নয়। পশ্চিম পাকিস্তানই সত্যিকারের পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলা ত’ ‘পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ। ভারত এবং রাশিয়ার মধ্যে যাতে সামরিক দিক দিয়ে সংযোগ না ঘটতে পারে, সে উদ্দ্যেশ্যে এ দুটি দেশের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানকে গোঁজ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। চীনকে পশ্চিম পাকিস্তান তার প্রথম শ্রেণীর বিপক্ষে বন্দর করাচীকে ব্যবহার করার জন্য দেবে। চীন আজ রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম এশিয়া এবং উত্তর অফ্রিকায় ঘাঁটি গড়তে পারেনি। পশ্চিম পাকিস্তানের মাধ্যমে চী সহজেই ঐ দুটি অঞ্চলে প্রবেশে সুযোগ পাবে।

(ঘ) অবশ্য চীন যে তার ভৌগলিক রাজনৈতিক হিসাবের খাতা থেকে পূর্ব বাংলাকে একেবারে খারিজ করে দেবে, তা নয়। সে পূর্ববাংলার প্রশ্নটিও খোলা রেখেছে। যাতে আওয়ামী লীগেই নেতৃত্ব একই সাথে ভারতের সঙ্গে কলংকিত হয় এটা দেখবার জন্যই চীন অপেক্ষা করছে। মুজিবর রহমান ও তার দল সুস্পষ্টরূপে ভারতের সমর্থক। এবং বাংলাদেশের জনসাধারণও মুখ্যত ভারতের সমর্থক। ইয়াহিয়া খানের নির্মম নিপীড়নে ভারতে প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব যদি পরাজিত ও কলংকিত হয়, সেক্ষেত্রে পূর্ব বাংলায় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হতাশা ও শূন্যতা দেখা দেবে। তা পূরণের জন্য সেখানে চীনপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো এগিয়ে আসবে। আর তখন চীন পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে প্রবেশ করতে ইতস্তত করবে না। সে অবস্থায় চীন শুধু পূর্ব বাংলার প্রশ্নেই আবদ্ধ থাকবে না। সম্ভবতঃ সিকিম, ভূটান, নেপাল ও ব্রহ্ম সমেত আসাম, নেফা, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা মণিপুর এবং পশ্চিম বঙ্গকে নিয়ে সারা পূর্ব ভারতে সাধারণভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার জন্য পূর্ব বাংলাকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হবে। ভারত কি এই অবস্থা ঘটতে দেবে? এটা কি ভারতের পক্ষে আত্মহত্যার শামিল নয়?

(ঙ) ১৯৬২ সালে নেফায় যেদিন চীন তার সৈন্য সামন্ত নিয়ে ঢুকেছিল তখন ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিচারে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সে সময় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বলতে সত্যিকারের যা বোঝায়, তা ভারতের ছিল না। তাতেও সে সময়ে “থাগলা”; থেকে “ফুট হিলস” আসতে একমাস লেগেছিল। এখন উত্তরাঞ্চলে শত্রুকে রুখবার জন্য পাহাড়ী পরিবেশে যুদ্ধক্ষম আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত নয় ডিভিশন সৈন্যকে ভারত উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলে নিযুক্ত করেছে। চীন ভুটানকে আক্রমণ করতে পারবে না। ভুটান রাষ্ট্রসংঘের সদস্য। এক্ষেত্রে ভুটান আক্রান্ত হলে বিশ্বের অন্যান্য শক্তিগুলিও জড়িয়ে পড়বে। বাংলাদেশের মুক্তিফৌজকে বিপুল সাহায্য দেওয়ার উদ্দেশ্য যদি ভারত হস্তক্ষেপ করে, তাহলে অনিতিবলম্বে বাংলাদেশ পাক-বাহিনীকে নির্মূল করে দিতে পারবে। এরকম অবস্থায় পূর্ব বাংলায় অবস্থিত পাকিস্তান বাহিনীকে চীন সত্যিকারের কোন সাহায্যই দিতে পারবে না। চীনের পক্ষে ভারতের নয় ডিভিশন সৈন্যের বেড়াজাল ছিন্ন করে পাকিস্তানী বাহিনীকে সাহায্য দেওয়া সহজ হবে না। তাছাড়া, যত বড় শক্তিই হোক না কেন হিমালয় ডিঙ্গিয়ে ভারতীয় উপত্যকায় প্রবেশ করে কোন শক্তির পক্ষেই যুদ্ধ করা সম্ভব হবে না- যুদ্ধের সরবরাহ পথ এতই বিপদ সঙ্কুল ও অনিশ্চিত যে সমর কৌশল প্রশ্নটি অসম্ভব হয়ে উঠবে। আর তাছাড়া সাধারণত চীনকে যুদ্ধের জন্য অন্য দেশে ঢুকে পড়তে দেখা যায় না। কেবলমাত্র কোরিয়াতে এর ব্যতিক্রম ঘটেছিল। তবে সেখানেও নিজের প্রতিরক্ষার স্বার্থেই চীন ব্যতিক্রম ঘটিয়েছিল। এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে, এখনও পর্যন্ত চীন ভিয়েতনামে কোন সশস্ত্র বাহিনী পাঠায়নি।

(চ) এখন চীন এবং রাশিয়ার মধ্যে যে সম্পর্ক বর্তিমান, তা হলো প্রকাশ্য বৈরিতার। কিন্তু ১৯৬২ সালে দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে সে রকম সম্পর্ক ছিল না। তাছাড়া সে সময় কিউবায় পারমাণবিক বোমারু বিমানের ঘাঁটি স্থাপনের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার বিরোধ আসন্ন হয়ে উঠেছিল, আর সে জন্য রাশিয়া অনেকাংশে প্রতিহতও হয়েছিল। চীনও সে সময় রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে বিপজ্জনক পরিণতির উদ্ভব হয়েছিল, তার সুযোগ নিয়েছিল। এখন সিংকিয়াং থেকে শুরু করে মাংগোলিয়া পর্যন্ত দু’দেশের মধ্যে বিরাজমান সুবিস্তৃত সীমান্ত জুড়ে চীনকে বিপুল সৈন্যবাহিনী নিয়োগ করতে হয়েছে। এটা মনে রাখা দরকার যে, সোভিয়েট-চীন সীমান্ত অঞ্চল পৃথিবীর মধ্যে দীর্ঘতম।

উপরোক্ত বিষয়গুলি বিবেচনা করে বলা যায় যে চীন যে হুঁশিয়ারী দিয়েছে তা ধর্তব্যের মধ্যে না আনাই উচিত হবে। তাই আমরা পাকিস্তানকে তার ইচ্ছামত বাংলাদেশ ও তার সংগ্রামী নেতৃত্বকে ধ্বংস করতে দিতে পারি না।

ভৌগলিক- রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণেই রাশিয়া ও পাকিস্তান সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহী। চীন এবিং যুক্তরাষ্ট্রের খপ্পর থেকে পাকিস্তানকে ছিনিয়ে আনতে রাশিয়া চায়। নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এখন রাশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি রক্ষণশীল। রাশিয়াও স্থীরাবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে চলতে চায়। প্রতিরক্ষা এবং অন্যান্য কারণের জন্য ভারত যুক্তরাষ্ট্রের চাইতে সোভিয়েট রাশিয়ার ওপরই বেশী নির্ভরশীল। কিন্তু রাশিয়ার উদ্বেগ নিয়ে ভারতের পক্ষে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। কারণ, ভারত দৃঢ়তার সঙ্গে তার নীতি অনুযায়ী এগিয়ে গেলে, রাশিয়া কোন অবস্থাতেই ভারতকে করতে পারবে না। কেননা, তাহলে তাকে সমগ্র এশিয়াতেই তার (রাশিয়ার) বর্তমান আত্মরক্ষার ব্যবস্থা পরিত্যাগ করতে হবে।

বর্তমানে আমেরিকায় বাংলাদেশ বিরোধীদের চাইতে সমর্থকদের সংখ্যাই বেশী। এখন সেখানকার প্রভাবশালী মহল পশ্চিম পাকিস্তানকে বাংলাদেশের অবস্থার জন্য নিন্দা করছে। অবশ্য মার্কিন সরকার ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে সমর্থন করে এখনও সেই পুরোনো খেলাই খেলছে।

স্বাধীন সত্তা নিয়ে পূর্ব বাংলায় নব অভ্যুদয় ঘটেছে তাকে এখন ইংল্যান্ডের শ্রমিকদল সাহায্য সমর্থন করতে প্রায় অঙ্গিকারাবদ্ধ। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী যে নারকীয়তা ও নির্মমতার মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলায় হত্যাকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে, তা সেখানকার ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল দলও সমর্থন করতে পারছে না।

ব্রহ্মদেশ, সিংহল, নেপাল, সিকিম প্রভৃতি ভারতের চতুর্দিকস্থ ছোট ছোট রাষ্ট্র পূর্ব বাংলার পরিস্থিতিতে ভারতে কী রকম আচরণ করে এটা দেখার জন্যই অপেক্ষা করছে। যদি ভারত তার কর্তব্য সম্পাদনে ব্যর্থ হয়, তাহলে ভারতের প্রতি এখনও তাদের যেটুকু আস্থার ভাব আছে, সেই ভাবটুকু একেবারেই কেটে যাবে এবং তারা আত্নরক্ষার জন্য অন্যান্য বৃহৎ শক্তির জন্য ঝুঁকে পড়বে।
অবশ্য ভারত সরকারও এসব বিষয়ে অবহিত। আন্তর্জাতিক শক্তিগুলির তথাকথিত চাপেই যে ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের পক্ষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে ইতস্তত করছে তা-ও বলা যায় না। এ ব্যাপারে অন্যান্য শক্তির ওপর ভারত সত্যিই কোন দোষারোপ করতে পারে না। এক্ষেত্রে সিদ্ধান্তটা নেবার ভার ভারতকেই নিতে হবে- ঐ সব রাষ্ট্রকে নয়।

বাংলাদেশের ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ার মত শক্ত নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সংখ্যা গরিষ্ঠতা নেই তা বলা যায় না। তাছাড়া, আজ কি একটি মাত্র ব্যক্তির হুকুমে, তাঁর নিজের শাসনেই, ভারত সরকার চলছে না? কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় অন্যান্য মন্ত্রীদের অস্তিত্বটা তাঁর মর্জির উপরই নির্ভর করে। নিজেরই ইচ্ছামত প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীসভা গঠন করতে পারেন-ভাঙ্গতেও পারেন।

ভারতের ঐক্যবদ্ধ জনমত হিল, বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হোক- আর খোলাখুলিভাবে উপযুক্ত পরিমাণ সাহায্য দেওয়া হোক।

এ প্রশ্ন নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ বাধলে আমাদের সমর বিভাগের সেনাপতিরা যে বিরোধিতা করবে তা সত্য নয়। অবশ্য তাদের মধ্যে সকলেই খুব উৎসাহী নাও হতে পারেন। কিন্তু যুদ্ধি অথবা শান্তি যাই হোক না কেন, এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ, সমর বিভাগ নয়। রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মান্য করাই ও আদেশ পালন করাই সামরিক বিভাগের কাজ। সমর বিভাগের ওপর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার অর্পণ করলে, তারা সব সময় উপযুক্ত প্রস্তুতির অভাবের ছুতো দেখিয়ে যুদ্ধকে পরিহার করতে চাইবে। আর প্রস্তুতি কথাটা সবসময়ই আপেক্ষিক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে; প্রস্তুতি বলতে প্রকৃতপক্ষে যা বুঝায়, সে অর্থে এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে, সোভিয়েট রাশিয়া এবং চীনের মত শক্তিও প্রস্তুত নয়। প্রস্তুতি পর্বের সীমা থাকে না; উপরন্তু যদি আমরা দেখি যে কোন ন্যায্য কারণের জন্য এবং ভারতের প্রতিরক্ষার জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে আমরা অপ্রস্তুত অবস্থায় আছি, তাহলে কেন বছর বছর আমাদের বাজেটে সমর বিভাগের জন্য ১১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করি? আর বাস্তবিকই আমাদের সামরিক বিভাগ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পালনে অস্বীকৃত হয়নি।

এই ব্যাপারে কোন কিছু না করতে গেলে যে খরচ হবে তার পরিমাণ প্রত্যক্ষভাবে কিছু করতে গেলে, এমনকি একখন্ড সম্ভাব্য যুদ্ধ করতে হলেও তার চেয়ে বেশী হবে। বাংলাদেশ থেকে কমপক্ষে এক কোটির মত উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য এখনই ভারতকে প্রস্তুত থাকতে হবে। এই উদ্বাস্তুদের মধ্যে বাঙ্গালী হিন্দুদের সংখ্যাই দাঁড়াবে ৯০ লক্ষের মত। বাংলাদেশে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরেপক্ষ রাষ্ট্র স্থাপিত না হলে বাঙ্গালী হিন্দু উদ্বাস্তুরা কখনও দেশে ফিরে যাবে না। বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের জন্য মাথাপিছু ব্যয় দৈনিক দু’টাকা ধরা হলে, ভারতকে তাদের জন্য দৈনিক দু কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে। ঐ উদ্বাস্তুদের ভরণ পোষন ও পুনর্বাসনের বোঝা রাষ্ট্রসংঘ বহন করবে না এবং বহন করতে পারবে না। একমাত্র প্যালেস্টাইনের উদ্বাস্তুদের ক্ষেত্রেই এর ব্যতিক্রম ঘটেছে। অবশ্য সেই ব্যতিক্রমও ঘটেছে, যুদ্ধের পর সন্ধির শর্ত পালনের বাধ্যবাধকতা হিসবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সরকারীভাবে কোন যুদ্ধ ঘোষিত হয়নি- তাই সন্ধির শর্তের কোন প্রশ্নই এখানে নেই। কিছুকালের জন্য বিশ্ব সংস্থাগুলি কিছু সাহায্য দিতে পারে কিন্তু তারা নিশ্চয়ই উদ্বাস্তুদের জন্য দায়দায়িত্বের ভারগ্রহণ করবে না।

এসব উদ্বাস্তুর ভারে ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙ্গে পড়বে। যদি ভারতে পূর্ব বাংলার সব বাঙ্গালী হিন্দুরাই চলে আসতে বাধ্য হয়, তাহলে সারা দেশে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির মধ্যে বিরাট ওলট-পালট ঘটবে এবং পরিণামে ভারতেও ভীষণ সাম্প্রদায়িক রক্তবন্যা বইতে পারে। এর ফলে এ দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্যও বিপর্যস্ত হবে- শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রে বর্তমান মন্ত্রীসভার এবং ভারতের পুর্ব অঞ্চলের রাজ্যসমূহের মন্ত্রীসভাগুলির পতন ঘটবে। সে অবস্থায় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কাজ শিকেয় তুলে রাখতে হবে এবং উন্নয়নমূলক কাজগুলিকে বন্ধ রাখতে হবে। জনগণের নৈতিক মেরুদন্ড দ্রুত ভেঙ্গে পড়বে। তখন ভারতের ভেতরেই গড়ে উঠবে বিচ্ছিনতাবাদী মনোভাব। আর, চুড়ান্ত পর্যায়ে ভারত যুদ্ধকেও এড়িয়ে যেতে পারবে না। আর যদি যুদ্ধ হয়ই, তাহলে এ যুদ্ধের যে খরচা পড়বে তার দশগুন বেশী খরচা পড়বে ভবিষ্যতের যুদ্ধে- যে যুদ্ধ ঘটবে পাকিস্তানের ইচ্ছায় ও পাকিস্তানের সুবিধামত।

আমাদের এই উপমহাদেশের অগ্রগতির যাত্রা পথে বাংলাদেশ হল হারানো সূত্র। সাম্প্রদায়িকতার জগদ্দল পাথরে ধাক্কা খেয়ে ভারতকে তার আদর্শ থেকে সরে আসতে হয়েছে। পাকিস্তানবাদ এবং দ্বিজাতিতত্ত্বের সত্যিকারের জবাব হিসেবেই বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক এবং প্রগতিশীল ও ভারতের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অবির্ভাব ঘটলে, এই উপমহাদেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণভেদ এবং সঙ্কীর্ণতাবাদের মত সব শক্তিগুলোই বিলীন হয়ে যাবে। বাংলাদেশে আমাদের সামনে এক বিরাট সুযোগ এনে দিয়েছে- যা হয়তো আগামী আর এক শতাব্দীর মধ্যে আবার আমরা পাব না।

ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে যদি পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে, তাহলে পাকিস্তান যে পূর্ব বাংলায় কয়েক দিনের বেশী টিকে থাকতে পারবে না, তা সে ভালভাবেই জানে। কিন্তু এই ভীষণ সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা ছাড়া আর কোন পথ নেই। কারণ, পাকিস্তানের জঙ্গী শাসকরা নিজেদের জনগণের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ভারতের কাছে পরাজয় বরণকেই শ্রেয় মনে করবে। পশ্চিমাঞ্চলেই চূড়ান্তভাবে যুদ্ধের নিষ্পত্তি হবে। এজন্য উত্তরাঞ্চল থেকে সৈন্যদের সরিয়া আনার প্রয়োজন হবে না। পূর্বাঞ্চলে পাকবাহীনিকে উচ্ছেদ করা হলে,- যা কয়েকদিনের ব্যাপার মাত্র- আমরা স্বচ্ছন্দেই পূর্বাঞ্চল থেকে পশ্চিমফ্রন্টে শক্তি বৃদ্ধি করতে পারব। সম্ভবত এক মাসেরও অধিক কাল পশ্চিম পাকিস্তান যুদ্ধে টিকে থাকতে পারবে না। এ অবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তানের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে ধসে যাবে। অথবা এমনও হতে পারে যে, ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান যুদ্ধ ঘোষণা নাও করতে পারে। বর্তমানে পশ্চিম পাকিস্তানে যে উন্মোদনা দেখা দিয়েছে, তাতে বলা যায় যে, রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের জন্য গণতান্ত্রিক নির্বাচিত জনগণের প্রতিনিধিদের হাতেই পূর্ব বাংলাকে সমর্পণ করে যুদ্ধে পরাজয় বরণের মত দূরদর্শিতা বিজ্ঞতা পশ্চিম পাকিস্তানের জঙ্গী শাসক গোষ্ঠির মধ্যে নাও থাকতে পারে।।

শত্রুপক্ষকে পিছন থেকে ব্যতিব্যস্ত করে শেষ করে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের জনগণকে গেরিলা দল সংগঠন করতে বলা হয়েছে। এ অনেকটা লম্বা চওড়া নির্দেশ দেওয়ার মত ব্যাপার। এমনকি যদি তারা শেষ পর্যন্ত এরকম স্থায়ী শক্তি সংগঠন করতেও পারেন। তবুও ঐ শক্তিকে নির্দিষ্টরূপে দিতে কয়েক বছর কেটে যাবে। আর চীন ও রাশিয়া কারুর মতামতের অপেক্ষা না করে ভিয়েতনামকে যেমনভাবে বিপুল পরিমাণ সাহায্য দিয়েছিল আজও দিচ্ছে, ঠিক তেমনভাবে যে কোন অবস্থার সম্মুখীন হওয়ার জন্য প্রস্তুত থেকে যদি ভারত বিপুল পরিমাণ সাহায্য দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ না হয়, তাহলে এ ধরণের গেরিলা শক্তির নেতৃত্ব ভারতের পক্ষে খুব সহায়ক হবে না। তাছাড়া, মুক্তিফৌজকে অত গোপনে ঐভাবে বিপুল পরিমাণ সাহায্য দেওয়া যাবে না। মুক্তিফৌজকে বিপুল পরিমাণ সাহায্য দেওয়ার জন্যও ভারতকে অবশ্যই সর্বপ্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হবে।

উপরন্তু ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের জনসাধারণের মধ্যে নিজেদের সম্পর্কে এবং বাংলাদেশ সরকার সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসের ভাব বজায় থাকবে না। বাংলাদেশের জনগণকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সুসজ্জিত করার আগে তাদের নৈতিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে শক্তিমান করে দিতে হবে নৈতিক মানদণ্ডহীন জাতিকে যতই অস্ত্র দেওয়া হোক না কেন, কোনদিনই ওই জাতি অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে না।

ভারতের মতো উপমহাদেশে নেতা হবেন সুমহান, আর তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার মধ্যে থাকবে যুগপৎ দূরদৃষ্টি ও শক্তি। এই দেশকে শাসনের ভার ক্ষুদে শ্রেণীর রাজনৈতিক হাতে দেওয়া যায় না। মহান দেশরূপে যদি ভারত পরিগণিত হয়, তাহলে তাকে বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী দায়িত্বভার বহন করতেই হবে। এ বিষয়ে ইতস্তত করলে চলবে না। এই জাতিকে তার লক্ষ্যে পৌঁছিয়ে দেওয়ার জন্য সুমহান কাজও সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞার প্রয়োজন। কেবলমাত্র সুমহান কাজ ও সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞাই সমগ্র জাতিকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। তাহলেই এ দেশ এক বিরাট শক্তিতে পরিণত হবে এবং সকলের সম্মানের পাত্র ও শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে দাঁড়াবে। ভারতের সামনে যে দায়িত্ব উপস্থিত, তা যদি সে এড়িয়ে যেতে চায় তাহলে তার ধ্বংস অনিবার্য ও নিশ্চিত।
সম্পাদকীয়, কম্পাস : ২৯শে মে, ১৯৭১

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩০৪। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের ভূমিকা কম্পাস ২৯ মে, ১৯৭১

Kamol Roy
<১৪, ৩০৪, ৭৭১-৭৭৩>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের ভূমিকা
সুদিন ভট্টাচার্য

আপাতঃ দৃষ্টিতে মনে হয় ইয়াহিয়া খাঁ বোধ হয় যা চেয়েছিলেন তাই হতে চলেছে। পূর্ব বাংলার প্রায় এক কোটি হিন্দু এবং কয়েক লক্ষ শিক্ষিত সংস্কৃবান মুসলমান সে দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে ভারতের আশ্রয় নেওয়ার পথে। এর দলে সুচতুর রাজনীতিবিদ ভূট্টোর আশা পূর্ণ হবে- বাঙ্গালীরা পাকিস্তানে সংখ্যা লঘু সম্প্রদায়ে পরিণত হবে। তার প্রতিক্রিয়া হবে সুদূরপ্রসারী। পূর্ব বাংলায় গণবিপ্লবের সময় পাকিস্তান সরকার যেমন মাসাধিককাল ধরে গড়ে দৈনিক ১ কোটি টাকা সামরিক ব্যয় করতে বাধ্য হয়েছেন এবং প্রায় ৭০ কোটি টাকার মত বৈদেশিক মুদ্রা রোজগার করতে অক্ষম হয়েছেন তেমনি ভারতকেও প্রতিদিন আশ্রয়প্রার্থীদের ভরণপোষনের জন্য একই প্রকার অর্থ ব্যয় করতে হবে তা ছাড়া সামাজিক এবং রাজনৈতিক কুফল তো আছেই।

কিন্তু কেন এমন হতে চলেছে? আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের ব্যর্থতা? পাকিস্তানী সৈন্যদের অসাধারণ উন্নতমানের অস্ত্রাদি এবং দক্ষতা? না ভারতের ব্যর্থতা? এই তিনটি বিষয় একে একে আলোচনা করা যাক-

(১) আওয়ামীলীগ খুব বেশী দিনের দল নয়। নেতৃত্বও তরুণ। এর সুবিধা অসুবিধা দুইই আছে। অহিংস সংগ্রামের অভ্যস্ত নেতৃত্ব হিংস সংগ্রামের প্রস্তুতি চালাতে স্বভাবতঃই অক্ষম হয়েছিলেন। দ্বিতীয়তঃ এঁদের সমর্থকদের একাংশ, ছাত্ররা আদর্শনিষ্ঠ এবং সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে থাকলেও দূর গ্রামাঞ্চলে তাদের প্রভাবটা ততটা কার্যকর হয় নি। সেখানে এখনও লীগ যুগের ধর্মান্ধতার রেশ কম বেশি রয়ে গিয়েছে। ইয়াহিয়া চক্র এই সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন। তৃতীয়তঃ শেখ মুজিবের ব্যক্তিত এবং নেতৃত্ব ছিল এই দলের সবচেয়ে বড় ভরসা। ২৫শে মার্চ রাত্রে মুজিবর রহমান পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে গ্রেফতার হওয়ায় তার দল অনেক পরিমাণে দিশাহারা হয়ে পড়ে। সশস্ত্র সংগ্রাম সম্পর্কে লীগের নেতৃবৃন্দের বিন্দুমাত্র ধারণা থাকলে তারা বিদ্রোহ করার জন্য ২৫ মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন না এবং সৈন্যদের হতো পুলিশ ও ইপিআরকে নিরস্ত্র এবং প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে দিতেন না এবং প্রথম দিনেই তারা ঢাকা বিমানঘাঁটি দখল করবার চেষ্টা করতেন।

(২) পাকিস্তান মোটামুটি শক্তিশালী দেশ। ‘টাইম’ পত্রিকার তথ্য যদি ঠিক হয় তাহকে বুঝতে হবে যে দেশের ঐ সৈন্যদলে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে মাত্র একজন পূর্ববাংলার মানুষ। মাত্র ৫/৬ ব্যাটেলিয়ন সৈন্য পূর্ব বাংলার তার মধ্যেও বহু অবাঙ্গালী সৈন্য ও অফিসার ছিল। এর মধ্যেও অর্ধেক ছিল পশ্চিম অংসে। সুতরাং বিদ্রোহের দিনে মাত্র হাজারখানেক সামরিক শিক্ষিত বাঙ্গালী পূর্ব বাংলায় উপস্থিত ছিলেন ইপিআর প্রকৃতপক্ষে সীমান্ত পুলিশ। এদের অল্প সংখ্যক স্টেন, এলএমজি ২” ও ৩” মর্টার ছিল। কিন্তু সামরিক শিক্ষার মানের দিক দিয়ে এরা খুব পশ্চাৎপদ। আনসারদের অস্ত্রশস্ত্র খুব কমই ছিল, সামরিক শিক্ষার মানও ছিল শোচনীয়। শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্য ও স্বদেশ প্রেমের দ্বারাতো যুদ্ধ করা যায় না- বিশেষতঃ পূর্ব বাংলার খোলামাঠে এবং গ্রীষ্মকালের ফসলহীন ক্ষেতের উপর যুদ্ধ হলে জিতবার কোন আশাই থাকে না আধুনিক সৈন্য বাহিনীর বিরুদ্ধে।

পাকিস্তানের সামরিক শক্তি “স্টেটসম্যান” এর হিরন্ময় কার্লেকার মহাশয় যা দিয়েছেন ততটা নয়- ” ইনষ্টিটিউট অব ষ্ট্রাটেজিক স্টাডিজ”- এর মতে তার চেয়ে অনেক কম। নিয়মিত সৈন্য প্রায় ২ লক্ষ ৭০ হাজার,

কাশ্মীরের আধাসৈন্য প্রায় ৩০ হাজার। এছাড়া আছে স্কাউট, রেঞ্জার ইত্যাদি অনিয়মিত কিন্তু মোটামুটি দক্ষ সৈন্য আর ৪০/৫০ হাজারের মত। অস্ত্রশস্ত্রে ঐ ২৭০০০০ সৈন্য বেশ আধুনিক, বাকীরা সেকেলে। মার্কিন বদান্যতায় পাওয়া এবং ১৯৬৫’র ক্ষয়ক্ষতি থেকে রেহাই পাওয়া ৪০৯ মাঝারি ট্যাঙ্ক এবং রাশিয়া ও চীন থেকে পাওয়া ৩০০- এর মত মাঝারি ট্যাঙ্ক আছে। হাল্কা ট্যাংক (মার্কিন ও চীনা) এবং উভচর ট্যাঙ্ক (রাশিয়ান পিটি ৭৬) মিলেও আরও ২০০ এর মত হতে পারে। কামান বেশির ভাগই পুরানো ২৫ পাউন্ডের হলেও অল্পসংখ্যক মার্কিন ও রুশ খুব ভারী কামান ও ভালোজাতের চীনা মর্টার ও রকেটও আছে। পূর্ব বাংলায় কিন্তু এই বাহিনীর সাত ভাগের এক ভাগও ছিলনা ২৫শে মার্চ। এবং তার পরের এক মাসে- বিদেশীদের মতে স্যাবর জেট বিমান। অল্প সংখ্যক হেলিকপ্টার, ‘গানশিপ’ ও ছিল পূর্ব বাংলায়।

আওয়ামীলীগের “রেগ-টেগ সার্কাস”- এর তুলনায় ৩০/৪০ হাজার নিয়মিত সৈন্য এবং তাছাড়া ৪০ শতাংশ লেজুড় যথেষ্ট শক্তিশালী এক কথা বলাই বাহুল্য ইপিআর-এর কোন রণসম্ভাই এই বাহিনীর বা স্যাবর জেটগুলির মোকাবিলা করবার পক্ষে উপযুক্ত নয়। সুতরাং ফল যা হওয়ার হয়েছে।

(৩) ভারতের শোচনীয় ব্যর্থতার ইতিহাস বড়ই করুণ। এমন সূবর্ণ সুযোগ যে দেশ গ্রহণ করতে না পারে সে দেশের নেতৃত্ব ক্ষমার অযোগ্য। পাকিস্তান ভারতের শত্রুদেশ। ১৯৬৫ সালের পর থেকেই দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা বানিজ্য বন্ধ, কোন প্রকার কূটনৈতিক সৌজন্য প্রদর্শনও হয় না। পাকিস্তানের এক মাত্র কাম্য হল ভারতের সর্বনাশ হোক। যেন তেন প্রকারে ভারত সামরিক ও আর্থিক দিক দিয়ে দুর্বল হোক। নাগা মিজো তামিলরা বলুক যে আমরা ভারতের মধ্যে থাকবো না। চীন ও ভারত এশিয়ার এই দুইটি প্রধান শক্তি পরস্পর শত্রুতার মধ্যে কালযাপন করুক- পাকিস্তান এই চায়। তার বিনিময়ে ভারত ক্রমাগত চাইছে যে, পাকিস্তান আমাদের সঙ্গে ব্যবসা বানিজ্য করুক। ভদ্র আচরণ করুক ইত্যাদি। এর চেয়ে হাস্যকর মূর্খ্যতা আর কি হতে পারে। জার্মানীর মদগর্বী পার্শিয়ান জাঙ্কারদের মত সৌর্যবীর্যগর্বী পাঞ্জাবী আফ্রিদি বেলুচরাও ভাবে যে ভারত আমাদের কি ক্ষতি করবে? আমাদের সহায় চীন, তুরস্ক, ইরান, সৌদি আরব এবং লিবিয়া- এই শেষোক্ত দেশ দু’টি তেল বিক্রির টাকার একটা বড় অংশ যেমন ইসরাইলীদের বিরোধী আরবরা পাচ্ছে তেমন একটা উল্লেখযোগ্য অংশ পাচ্ছে হিন্দু বিরোধীর ভূমিকায় পাকিস্তান। সামরিক শক্তি এ দিক থেকে একমাত্র চীন শক্তিমান। তুরস্ক ও ইরানের কিছু আধুনিক রণসম্ভার আছে কিন্তু সাহায্য দেওয়ার মত কিছু না। স্টেইটম্যান (১২মে) এ কূলদীপ নায়ার লিখেছেন যে ইরান ও তুরস্ক পাকিস্তানকে এফ-৫ এবং এফ-৮২ বিমান দিয়েছে। অদ্ভুদ কথা। ঐ এফ-৫ মার্কিনরা ১৯৬২ সালে ভারতকে দিতে চেয়েছিল। ভারত নিতে রাজী হয়নি। মান্ধাতার আমলের এফ-৮২ (না ছাপার ভুল-এফ৮৬?) কি করবে। ভারতে প্রায় ৩/৪ শত মিগ-২১ ও এস-২২২ যাদের গতিবেগ উপরোক্ত বিমান্দ্বয়ের গতিবেগের দ্বিগুন- তাদের সামনে ২০/২৫ খান ঐ বিমান কি করবে? ইরানে খান কয়েক ফ্যান্টম (এফ-৪ এফ) আছে কিন্তু ঐ কখনোই বা কি হবে। কিন্তু ভবিষ্যতে ভারতের এই বর্তমান সুবিধা নাও থাকতে পারে। সুতারাং এমন সুবর্ণ সুযোগ ভারতের হারানো উচিত নয় এবং শেষ পর্যন্ত কূলদীপ নায়ারও অবশ্য বলেছেন- “ইন্ডিয়া কেন স্টিল ইসু এন আলটিমেটম টু পাকিস্তান টু স্টপ দি ইনফ্লাক্স রিফিউজীস অব ফেচ দি কন্সকুইনসেস”।

নীচে এশিয়ার কয়েকটি দেশের সৈন্য ও বিমানের সংখ্যা দেওয়া গল- চীন (১) নিয়মিত সৈন্য ২৫ লক্ষ, ৬টি আর্মার্ড ডিভিশন, ৪০০০ ট্যাংক (২) ২৫০০ যুদ্ধবিমান- অধিকাংশ মীগ- ১৭ ও ১৯, সামান্য সংখ্যক ২১ এবং ৩০০ ইলিউসিন-২৮ (ক্যানবেরার চেয়ে মন্থরগতি এবং কম উচ্চে উড়তে পারে)।

ভারত (১) নিয়মিত সৈন্য ১০ লক্ষ, ৩ আর্মার্ড ডিভিশন, ৭০০ মাঝারি, ১০০ হালকা ট্যাঙ্ক (২) প্রায় ৩০০ যুদ্ধ বিমান- মাত্র ৩০ টি শব্দের দ্বিগুণ গতিবেগ সম্পন্ন (মিরাজ) ১০০০ কামান।

তুরস্কের শক্তি পাকিস্তানের চেয়ে একটু বেশি এবং ইরানের শক্তি বহুগুণ কম। সৌদি আরবের ২৫ খানা শব্দের দ্বিগুণ অধিক গতিবেগ সম্পন্ন লাইটনিং বিমান আছে। যেহেতু চীন সম্ভবত কোন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বার কোন সম্ভাবনাই নেই বলা চলে, কারণ তাকে রাশিয়া ও আমেরিকার মোকাবিলা করতে হয় এবং ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করা তার নীতিও নয়। তখন পাকিস্তানে কোন সাহসে ভারতের সঙ্গে লড়তে চায়? পাঞ্জাবী মিলিটারী আভিজাত্যের দর্প চূর্ণ করার এবং তথাকথিত আজাদ কাশ্মীর পুনরুদ্ধার করবার, চিরকালের মত নাগা-মিজো সমস্যার সমাধান করবার মত এমন সুযোগ আর কখনো আসবে না। কারণ এখন পাকিস্তানের মাত্র ৮ ডিভিশন সৈন্য পশ্চিমে আর চার ডিভিশন পূর্ব দিকে। সুবর্ণ সুযোগ।

আর ভারত আজ যদি ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায়- বস্তুতঃ ভয় পেয়ে অকারণে ভারত পিছিয়েই গেছে- তবে ইতিহাস তার জন্য ক্ষমা করবে না। প্রায় এক কোটি নবাগতের ভরণ পোষণের ব্যবস্থা করতে তাকে দেউলিয়া হতে হবে এবং কেউ তাকে এ বিষয়ে সাহায্য করতে আসবে না। কারণ মার্কিনরা জানে রুশরাও জানে ভারতকে এখন সাহায্য করার অর্থ হক এশিয়াতে আর একটি “চীনের” সৃষ্টি করা। তার চেয়ে সামরিক ভারসাম্যের নিস্ফল ধোঁকাবাজী চলতে থাকুক। মরুক ভারত আশ্রয় প্রার্থী সমুদ্রে হাবুডুবু খেয়ে।

বলতে বাধা নেই যে সাম্প্রতিক সাধারণ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাদিক্যে জয়লাভ করায় ইন্দিরাজীর প্রতি অনেক বিরূপ জনেরও একটু শ্রদ্ধার ভাব উদয় হচ্ছিল। পূর্ব বাংলার প্রতি আচরণের অপ্রতুলতায়, ব্যর্থতায় আজ তারা সকলেই ক্ষুদ্ব হয়েছেন এ কথা বলাই বাহুল্য। এর ফলে ভারতের রাজনীতি এই কষ্টার্জিত স্থিতিশীলতা আর বেশিদিন স্থায়ী হবে বলে মনে হয় না। কার্যাকালে যার বল কার্যকর নয় এমন মানুষ কখনো কারো শ্রদ্ধার পাত্র হতে পারে না। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণে ভারতের ব্যর্থতা সত্যিই বেদনাদায়ক। পাকিস্তানী জঙ্গীবাদের জয় হলে এশিয়া ভূখন্ডে গুরুতর বিপর্যয় ঘটতে পারে। এবং তার জন্য ভারতের দায়িত্ব পাকিস্তানের চেয়ে কম নয়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩০৫। লোকসভায় কমিউনিষ্ট সদস্যদের পাক ডেপুটি হাইকমিশনার সম্পর্কে ভারতের আচরণের নিন্দা কালান্তর ১ জুন ১৯৭১

Kamol Roy
<১৪, ৩০৬, ৭৭৪-৭৭৫>

লোকসভায় কমিউনিষ্ট সদস্যদের পাক ডেপুটি হাইকমিশনার সম্পর্কে ভারতের আচরণের নিন্দা।
(বিশেষ প্রতিনিধি)

নয়াদিল্লী, ৩১ মে- আজ লোকসভায় কমিউনিষ্ট সদস্য এস কে ভেলায়ুধন কলকাতায় পাক ডেপুটি হাই কমিশনার মেহেদী মাসুদের প্রতি ভারত সরকারের আচরণের তীব্র নিন্দা করলে বৈদেশিক দপ্তরের মন্ত্রী শরণ সিং- এর পক্ষে সভাকে শান্ত করা মুস্কিল হয়ে পড়ে।

ক্ষুদ্ধ ভেলায়ুধন জানতে চান পাকিস্তান সরকার যখন ঢাকার ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তাদের অভ্যন্তরীণ করে তখন তার প্রতিশোধাত্মক ব্যবস্থা হিসেবে ভারত সরকার কলকাতার পাক ডেপুটি হাই কমিশনারকে কেন অন্তরীন করেন নি?

সরকারকে এই আচরণকে কাপুরুষোচিত আখ্যা দিয়ে তিনি বাংলাদেশ মিশনের সদস্যদের সঙ্গে পাক ডেপুটি হাই কমিশনারের সাক্ষাতের অনুমতি দানের তীব্র নিন্দা করেন।

জবাবে বৈদেশিক দপ্তরের মন্ত্রী স্বীকার করেন যে মেহেদি মাসুদ কলকাতার পাক ডেপুটি হাইকমিশন দপ্তরের প্রাক্তন কর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ লাভের দাবি করেছিলেন। কিন্তু তিনি জানেন না যে মেহেদী ঐ সব কর্মী যারা বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতি তাদের আনুগত্য পরিবর্তন করেছেন তাদের বাড়ি বাড়ি দেখা করার জন্য গেছেন।

পাক ডেপুটি কমিশনারের প্রতি সদয় ব্যবহার করার কারণ স্বরূপ শ্রী শরণ সিং বলেন ভারত সরকারের প্রধান লক্ষ ছিল ঢাকা থেকে ভারতীয় দূতাবাসের কর্মীদের বের করে আনা।

অনুরূপ কারণেই ইন্দিরা কংগ্রেস সদস্য এল কে দাশ চৌধুরী মাসুদকে বহিস্কার করার দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি যুক্তি হিসেবে আর বলেন, যদিও মাসুদ পাক ডেপুটি হাইকমিশনের কূটনৈতিক সদস্য নন কেননা কলকাতায় ঐ দপ্তরের বর্তমান অস্তিত্ব নেই তবুও ভারত সরকার জেনেভা কনভেনশিন অনুযায়ী কিছু সুযোগ সুবিধা দিতে বাধ্য।

ভেরায়ুধনের আর এক প্রশ্নের জবাবে শ্রী শরন সিং জানান যে, ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাসের কর্মীদের ফিরিয়ে আনার জন্য ভারত সরকার পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে অনবরত যোগাযোগ করছেন। এই বিষয়ে ভারত সরকার উভয় দেশে বহু স্থানীয় রাষ্ট্রের দিল্লীস্থ দূতাবাসের সঙ্গেও যোগাযোগ করছেন।
লোকসভায় কমিউনিস্ট দলের নেতা ইন্দ্রজিত গুপ্ত বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের সম্পর্কে প্রকৃত সংবাদ বিদেশের সরকারগুলিকে কি রকম ওয়াকিবহাল রাখছেন তার নির্দিষ্ট জবাব দাবি করেন।

জবাবে বৈদেশিক দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী সুরেন্দ্র পাল সিং জানান ভারতে প্রতিনিধিরা সংশ্লিষ্ট সরকারগুলিকে বাংলাদেশের খবারখবর দিয়েছেন। তাছাড়া এ দেশে যে সব বিদেশী দূতাবাস আছে তাদের কাছেও বিভিন্ন সময়ে এ বিষয়ে জানিয়েছেন।

বিদেশী রাষ্ট্রগুলির এবং জাতিসংঘ সম্পাদকের দৃষ্টি বাংলাদেশ সম্পর্কে সংসদের প্রস্তাব এবং প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার প্রতি আকর্ষণ করা হয়েছে।

এই কূতনৈতিক কার্যকলাপের ফলে বেশ কয়েকটি সরকার মানবতার খাতিরে বাংলাদেশের জনসাধারণের জন্য সেবামূলক কাজের প্রতি উৎসাহ প্রকাশ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন সম্পর্রকে অধিকাংশ সরকারই কোন নির্দিষ্ট নীতি গ্রহণ করেনি।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩০৬। বাংলাদেশে পাক ফৌজী বর্বরতা অবিশ্বাস্য কিন্তু সন্দেহাতীত কালান্তর ১ জুন, ১৯৭১

Kamol Roy
<১৪, ৩০৬, ৭৭৬>

বাংলাদেশ পাক ফৌজী বর্বরতা অবিশ্বাস্য কিন্তু সন্দেহাতীত
স্টাফ রিপোর্টার

কলকাতা ৩০শে মে, ‘ওয়ার অন ওয়ান্ট’- এর সভাপতি মিঃ ডোনাল্ড চেসওঅর্থ এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য মি: এম বার্নেস বাংলাদেশ থেকে আগত শরনার্থীদের শিবির পরিদর্শনের পর আজ এখানে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানী ফৌজের বর্বরতা ও হত্যাকান্ড সম্পর্কে সন্দেহের কোনও কারণ নেই এবং পাকিস্তানকে যেসব দেশ অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্য দিয়েছে, তাঁদের দায়িত্ব রয়েছে পাকিস্তানের উপর প্রয়োজনীয় চাপ সৃষ্টি করার- যাতে পূর্ব বাংলা থেকে সৈন্য প্রত্যাহৃত হয় এবং সেখানকার প্রশ্নের একটা প্রকৃত গণতান্ত্রিক মীমাংসা সম্ভব হয়।
মিঃ বার্নেস বলেন, যদি ধরা যাক ৬ মাস পরেও এই সমস্যা অসমাধিত থাকে, মুক্তিফৌজের সঙ্গে পাকফৌজের সংঘর্ষ এবং শরণার্থীদের আগমণ অব্যাহত থাকে, তাহলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বাড়বে এবং তাতে একটা গুরুতর পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। বাংলাদেশের বর্তমান ট্রাজেডির সমাধানের একটা উপায় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলিকে অবশ্যই বার করতে হবে।

যে সব দেশ পাকিস্তানকে অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্য দিয়েছে এ ব্যাপারে তাদের দায়িত্বের কথা উল্লেখ করে মি: বার্নেস বলেন, পাকিস্তানের সমস্ত নাগরিকের উন্নয়ন ও প্রতিরক্ষার জন্য যে সাহায্য ও অস্ত্র দেওয়া হয়েছিল, পাকিস্তান যাতে সাহায্যের এহেন অপব্যবহার না করতে পারে, তার জন্য পাকিস্তানকে উন্নয়নমূলক সাহায্য ও অস্ত্র সাহায্য দানকারী দেশগুলির এক্ষেত্রে বসে একটা উপায় বার করা উচিত। তিনি জানেন।

“এইড কনসোর্টিয়াম” (সাহায্যদানকারী রাষ্ট্রপুঞ্জ) আগামী জুলাই মাসে বৈঠকে মিলিত হয়ে এ বিষয়ে তাদের ইতিকর্তব্য স্থির করবে।

মিঃ ডোনাল্ড চেসওঅর্থ জানান যে, গত বছর পূর্ববঙ্গে ঘুর্ণিঝড়ে দুর্গত মানুষের সাহায্যের জন্য তাদের বেসরকারী সাহায্য সংস্থা ১৫ লক্ষ পাউন্ড সংগ্রহ করে যার অধিকাংশই ব্যয়িত হয়নি। তারা এখন মনে করেন, ঐ টাকার একটা অংশ পূর্ববঙ্গ থেকে ভারতে আগত শরনার্থীদের জন্য ব্যয়িত হওয়া উচিৎ। কিন্তু ঐ টাকা যেহেতু ঘূর্ণিঝড়ে সাহায্যার্থে সংগৃহীত হয়েছিল, সেহেতু শরনার্থীদের জন্য এ টাকা ব্যয় করায় আইনগত জটিলতা আছে। তাঁদের এখানে আসবার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, শরণার্থীদের মধ্যে পূর্ব বাংলার ঘূর্ণিঝড়ে দুর্গত মানুষ আছে কিনা তা নির্ধারণ করা। তারা পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় শরণার্থীদের তিনি বলেন পূর্ব বাংলায় যা হচ্ছে তা এমনি অবিশ্বাস্য ও অবর্ণনীয় যে, দেশে ফিরে গিয়ে ইংল্যান্ডের মানুষকে একথা বুঝানো তাঁর পক্ষে কঠিন হবে যে, তিনি বাংলাদেশের ঘটনা সম্পর্কে যা বলছেন তা অতিরঞ্জিত নয়।
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, ওপার বাংলায় এক ব্যাপক দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে, যা হয়তো আকারে ১৩৫০ সালের দুর্ভিক্ষের মতোই ভয়াবহ হবে। ওখানে আ ঘটেছে তা যে শান্তির পক্ষে বিপজ্জনক তাই নয়, সমস্যার আকার এত বড় যে, বাইরে থেকে তা অনুমান করা কঠিন। সমস্যার এই ব্যাপ্তি সঠিকভাবে উপলব্ধি করবেন বলে জানান।

তিনি বলেন, ব্রিটেন বাংলাদেশের ব্যাপারে ১০ লক্ষ পাউন্ড সাহায্য দেবার কথা ঘোষনা করেছে। কিন্তু সমস্যার ব্যাপ্তি এবং বৃটেনের মতো একটি শিল্পোন্নত দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই সাহায্য কমপক্ষে এক কোটি পাউন্ড হওয়া উচিত।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩০৭। ভাসানী রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভবনা নাকচ করেছেন অমৃতবাজার পত্রিকা ১৫ জুন ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ৩০৭, ৭৭৭-৭৭৮>

স্টেটসম্যান, জুন 1, 1971
ভাসানী রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভবনা নাকচ করেছেন
বিশেষ প্রতিনিধি

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা মওলানা ভাসানী, সোমবার বাংলাদেশ বিষয়ে রাজনৈতিক নিষ্পত্তির সম্ভাবনা নাকচ করেছেন। তিনি কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগ নেতারা যে পথ নিয়েছিলেন সেই পথ অবলম্বন করলেন। এতে বিপত্তি হতে পারে। কিন্তু পাকিস্তানের বিপক্ষে আমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে, যদি প্রয়োজন হয় তাহলে একশ বছর। হয় আমরা মরব নয় জিতব।

সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মাওলানা ভাসানী বলেন রাজনৈতিক নিষ্পত্তির জন্য যদি কেউ বাংলাদেশে বা দেশের বাইরে চেষ্টা করেন তাহলে বাংলাদেশের ৭৫ কোটি মানুষ তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করবে। কারণ মানুষ পাকিস্তান সরকারের উপর তাদের বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। তাদের সাম্প্রতিক নৃশংসতা মানব ইতিহাসের পূর্বের সব ঘটনাকে হার মানিয়েছে।

যদি একটি গণভোট U.N. পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠিত হয় যা বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন করবে তাহলে তিনি কিছু মনে করবেন না। তিনি নিশ্চিত যে একটি মানুষও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ভোট দেবে না। এর ফলে পাকিস্তানি রা যে প্রচারণা চালাচ্ছিলেন যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ভারতের স্পন্সরকৃত তা মিথ্যা প্রমাণিত হবে। কেন আমেরিকা , সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন বা চীন যারা পাকিস্তানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল তারা সেনাবাহিনীর নৃশংসতার ব্যাপারে একটি স্বাধীন খোঁজখবর নিতে তাদের সাংবাদিকদের পাঠাচ্ছেন?

চীন ও রাশিয়ার বন্ধু হিসেবে পরিচিত মাওলানা কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল সে স্বীকৃতির জন্য সেখানে যাবেন কিনা। তার উত্তর স্পষ্ট এবং নির্দিষ্ট ছিল যদি তারা এখনো বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের নৈতিক দায়িত্ব পালন করার ব্যাপারে আগ্রহী থাকে তবে তার ভিজিট সাফল্য অর্জন করবে। তিনি হতাশার সাথে বলেন যে ভারত ছাড়া অন্য কোন দেশের – হোক তা সমাজতান্ত্রিক অথবা সাম্রাজ্যবাদী – কেউ আমাদের দুর্দশার ব্যাপারটি আমলে নিচ্ছেনা।

দলের লোকদের উপদেশ

মাওলানা বলেন যে তিনি বাংলাদেশে তার দলের লোকদের এবং সব বামপন্থী শক্তির সাথে পরামর্শ করে একত্রে গ্রামে গ্রামে সর্বদলীয় “একশন কমিটি” গঠন করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের জন্য জনগণকে প্রস্তুত করার নির্দেশ দেন। এই কমিটির একটি অন্যতম কাজ হল জনগণকে পাকিস্তান সরকারকে খাজনা দিতে বাধা দেয়া। দ্বিতীয় কাজ পাকিস্তানী আর্মি যে ভারতবিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছে সেটা বানচাল করে দেবে।

যাইহোক, দেশ ভাগের সময় বহুদলীয় জোটের বা প্লাটফর্মের তিক্ত অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে তিনি বলেন সেরকম কোন ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট বা এই পর্যায়ের কিছু হলে তিনি তা সমর্থন করবেন না। তাছাড়া নেতৃত্বের কোন্দলের সম্ভাবনার ব্যাপারেও তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

কিন্তু তার চেয়ে উদ্বেগের বিষয় হল বাংলাদেশের মানুষের বিশ্বাস যেন কোনোভাবেই দুর্বল না হয়। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল। বাংলাদেশের জনগণকে দুইভাগ করে শাসন করার কোন সুযোগ আমরা দিতে চাইনা।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য একটি দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের পথে দলীয় কোন্দলের সুযোগে কোন চরমপন্থী দল নেতৃত্ব দখলের সুযোগ পাবার সম্ভবনা আছে কিনা জিজ্ঞেস করা হলে মাওলানা সরাসরি কোন উত্তর দেন নাই। তিনি উত্তর দেন ‘ বাঘ কখনো মানুষের রক্তের স্বাদ ভোলেনা”। এদেশে দেড় কোটি শিক্ষিত বেকার আছে। এবং হাতে অস্ত্র পেলে মানুষের মনোভাব ও আচরণ পাল্টে যায়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩০৮। বাংলাদেশ প্রশ্নে বিশ্বের হস্তক্ষেপ চাই অমৃতবাজার পত্রিকা ২ জুন ১৯৭১

MD Ahsan Ullah
<১৪, ৩০৮, ৭৭৯-৭৮১>

অমৃতবাজার পত্রিকা, ২ জুন ১৯৭১
বাংলাদেশ প্রশ্নে বিশ্বের হস্তক্ষেপ চাই
দিনেশ সিং – এম পি
(সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী)

ভারতীয় উপমহাদেশের উন্নয়ন প্রসংগে বাংলাদেশের মানুষের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম পরিলক্ষিত হয়েছে। ভারত,পাকিস্তান এবং সিলনের নির্বাচনের পরেও জনগণের নির্বাচিত নেতৃত্ব সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র,বদলানোর চেষ্টা এবং স্থায়ীত্বকে সমর্থন করে কিনা এই ব্যাপারে সন্দেহ থেকে গিয়েছে। তাদের নেতা এবং দল নির্বাচনের ক্ষেত্রে দেশের মানুষ অবিভ্রান্তচিত্তে সেনাশাসনের সামনেও জনগণের দ্বারা শাসন পরিচালনার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। একইভাবে তারা দ্রুত সমাজের সঠিক পরিবর্তন করে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের সহায়তা দিয়েছে যারা জনগণের চেতনাকে উপলব্ধি করতে পারে। এটা এই অতীতের সাক্ষী ছিল যে, ভারত সিলন সরকারের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে সাহায্য নিয়েছিল যা তখনকার সময় মানুষের বিভিন্ন ইচ্ছার কিছুটা বিরুদ্ধে ছিল।তখনকার প্রেক্ষাপটে একই ঘটনা যখন পাকিস্তানেও হলো তখন ভারতকেও একই ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। এই বিবেচনার উপরই ভিত্তি করে তখন আমাদের পার্লামেন্ট বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল। যেটা সকল জনগণকে মানতে হত। কারণ একটি গণতান্ত্রিক সমাজ হিসেবে তাদের কাছে আর কোনো পছন্দ ছিল নাহ। ১৯৭১ সালের ২৪শে মে লোকসভায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশের প্রতি সাহায্য করার ব্যাপারে সুস্পষ্ট বক্তব্যকে সকলের স্বাগত জানানো উচিত ছিল। বাংলাদেশে বিচ্ছিন্নতা কোনো চর্চার বিষয় ছিল নাহ কিন্তু পৃথিবীর এই অংশের মানুষের শ্বাসমূলে যেন তা উদ্ভাসিত হচ্ছিল। এখানে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে এদেশের মানুষের চেষ্টা প্রতিফলিত হচ্ছিল। এটি ছিল গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ও মানুষের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিতকরণের আন্দোলন। এটা খুব সহজেই প্রতীয়মান হচ্ছিল যে পাকিস্তানে নির্বাচনের ফলাফল আর বেশিদিন সেনা শাসনের অধীনে থাকবে নাহ। জাতীয় সংসদে ৩১৩টি আসনের মধ্যে শেখ মুজিবর রহমানের আওয়ামীলীগ এবং এর অনুসারীরা সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিজয়ী হয়ায় ৭০২ জন সদস্য মিলিত হয়ে দেশের শাসনকর্তা নির্বাচিত হবেন এমনটায় আশানুরূপ ছিল। এখানে ৬ দফা দাবি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কেনই বাঁ সংখ্যাগরিষ্ঠরা সংখ্যালঘুদের আনুগত্য স্বীকার করবে? এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বুঝতে পেরেছিলেন শেখ মুজিবর রহমানই পাকিস্তানের ভবিষ্যত প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। এছাড়াও শেখ মুজিবর রহমানের ৬ দফা ছিল বাংলাদেশিদের মুক্তির দলিল।তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের হঠাতই সশস্ত্র আক্রমন একদমই সংকেতবিহীন এবং হঠাতই হয়েছিল যা পরবর্তীতে পাকিস্তানকে বিভক্ত করেছে। তথাপি

এটি পাকিস্তানী সেনা উপনিবেশের অভ্যুত্থান ছিল। আমাদের সাহায্য আসুক বাঁ না আসুক পাকিস্তানি উপনিবেশের বিরুদ্ধে সেদেশের মানুষের অভ্যুত্থান হয় যেন তারা একটি গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এটি পররাষ্ট্র বিষয়ক নিষ্পত্তিতে আমাদের স্বাভাবিক এবং নিত্য সাহায্যের মতই ছিল।তারা আমাদের পাশের অঞ্চলেই এভাবে সীমান্ত নিয়ে লড়াই করবে এবং আমরা যেহেতু বৈশ্বিক শান্তি চুক্তিতে অংশগ্রহণ করেছি তাই তাদের সাহায্য করা কি আমাদের উচিত ছিল না? যেখানে আমরা দক্ষিন আফ্রিকার জন্যও আমাদের হাত উঁচু করেছিলাম। যেখানে আমরা দক্ষিণ রোডেশিয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠদের শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র হস্পক্ষেপ করেছিলাম। যেখানে আমরা পর্তুগীজদের স্বাধীনতা যুদ্ধেও হস্তক্ষেপ করেছি সেখানে আমরা কি করে আমাদের সীমান্তে দুটি দেশের যুদ্ধে চুপ থাকি? আমরা কি বাংলাদেশের মানুষের উপর নির্মম অত্যাচার এবং গণহত্যা দেখেও চোখ বুজে থাকব? নিজেদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে তাদের এই আকাঙ্ক্ষা কি ভুল ছিল? বাংলাদেশে যদি এই যুদ্ধ দ্রুত রোখা না যেত তাহলে আরো হাজারো রিফিউজি কি ভারতে আশ্রয় নিতে আসত না? আমাদের কি তাদের সাহায্য করা উচিত ছিল না? আমাদের স্বাধীনতার প্রেক্ষাপত , আমাদের জাতীয় চাহিদা এবং আমাদের নীতি যেন তাদের সাথে একই বিন্দুতে মিলিত হয়েছিল। আমাদের এখন অনেক রিফিউজি রয়েছে। আজকে প্রায় চল্লিশ লক্ষ। সাত লক্ষ আগামীকাল এবং আরো দশ লক্ষ আসবেন তার পরের দিন। কেও জানেনা আরো কতজন আসবে, আমরা তাদের কতটুকু দিব এবং কতদিন দিতে থাকব। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার কিভাবে হতে পারে। যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজের দেশের সীমান্ত পেরিয়ে অন্যদেশের সীমান্তে এসে পরছে সুতরাং এটি আর শুধু অভ্যন্তরীন ব্যাপার নেই। এটি সেদেশের মানুষের উপর হয়া অত্যাচারের প্রতিফলন মাত্র। যখন একটি দেশের মানুষকে জোরপূর্বক সেদেশ থেকে বের করে দিয়ে আরেকটি দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে যা দেশের অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক ব্যাপারে প্রভাব ফেলছে তবে আমরা যুদ্ধে কেন যাবো না? পাকিস্থান এই ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করে কখনোই পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্থানের ভেতর সামঞ্জস্যতা আনতে পারে নাহ। বাংলাদেশ এখন একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। এটি ছিল একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রে গণহত্যা , অধীকার এবং সীমান্ত লঙ্ঘনের ঘটনা। কিন্তু আমি সময় হারাচ্ছি। আমরা ইতোমধ্যে দুর্যোগপূর্ণ সময়ের তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গিয়েছি। নতুবা খুব শীঘ্রই পাকিস্তানি নিপীড়িত রিফিউজিদের বন্যা বয়ে যাবে। আমরা যদি শিঘ্রই মুক্তিফৌজ প্রেরণ করি তাহলে বিভিন্ন এলাকা স্বাধীন হতে থাকবে এবং সেখান থেকে রিফিউজিদের আগমন আসা কমতে থাকবে। বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক সহায়তা চাইতে পারত যেন চাপের মুখে পরে পাকিস্তান বিষয়টার দফারফা করতে উন্মুখ হয়। এখন সেই চাপ আমাদের উপর রয়েছে কেননা পশ্চিম পাকিস্তান বাঁ মূল পাকিস্তানে তো কোনো রিফিউজি নেই। স্বীকারোক্তি বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বীকারোক্তির ব্যাপারে কখন তা তারা সম্পন্ন করবে সে প্রশ্নটা সেখানকার সরকারের উপর ছেড়ে দেওয়া হোক। অবশ্যই একটা স্বীকারোক্তি মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস যোগাবে এবং তখন আর কোনো রকম বাধ্যবাধকতা থাকবে নাহ। এই প্রশ্নটাই এখন আগামীর কর্মপন্থা নিশ্চিত করবে। যদি মুক্তিফৌজ পাকিস্তানি বাহিণীদের কাছ থেকে দখলকৃত এলাকা সমূহয় মানুষকে নিরাপত্তা দিতে পারে তাহলে ভারত থেকে রিফিউজিদের বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। রিফিউজিদের তাদের এলাকায় ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে আমাদের খুব সাবধানে ভেবে চিন্তে একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তারা ততক্ষণ পর্যন্ত যাবে না যতক্ষণ আমরা পাকিস্তানি বাহিণীর কাছ থেকে তাদের পরিপূর্ণ নিরাপত্তার ব্যাপারে নিশ্চয়তা না দেই। আমরা এখন সাহায্যের খাতিরে আরো বিভিন্নভাবে তহবিলের আবেদন করতে পারি কিন্তু এই ব্যাপারে জাতিসংঘের উত্তর খুবই নিরাশাজনক ছিল। হয়তবা আমরা আরো কিছু অর্থায়ন পেতে পারি। কিন্তা সেটা এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে নাহ। পকিস্তানকে অবশ্যই জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সেই অর্থ পরিশোধন করতে হবে যা আমরা এখানে রিফিউজিদের পেছনে ব্যয় করেছি এবং তাদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে রিফিউজি ক্যাম্প তৈরি করা উচিত যারা এখন ভারতে রয়েছে।পাকিস্তানি বাহিণী এসব কিছুই রাখঢাক করার ষড়যন্ত্র করছে। যা আমরা হতে দিতে পারি না। তাই এই সমস্যার নিষ্পত্তি আন্তর্জাতিক কর্মকর্তাদের দ্বারা পাকিস্তান সরকার এবং বাংলাদেশ সরকারের মধ্যবর্তী চুক্তির মাধ্যমে হতে হবে। আমাদেরকে এই ব্যপারে বাংলাদেশ সরকারকে পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা করতে হবে। এখানে এই ধরনের বিচ্ছেদের রিফিউজিদের অবস্থান নিশ্চিত করতে খুবই সমস্যা হবে যা তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ আর তাই যত দ্রুত সম্ভব জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে রিফিউজিদের পূর্ব পাকিস্তানে রিফিউজি ক্যাম্পে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করতে হবে। এটা কোনো ব্যাপার না যে তাদের কতদিন লাগছে কত সপ্তাহ লাগছে বাঁ কত বছর লাগছে নিজেদের অধিকার আদায় করে নিতে এবং স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি পেতে কিন্তু আমরা সর্বদা সকল ক্ষেত্রে সকল সিদ্ধান্তে তাদের পাশে রয়েছি। আমরা অবশ্যই সকল ক্ষেত্রে তাদের সাফল্য কামনা করি ।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩০৯। আশা ও বিভ্রান্তির মাঝখানে হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড ৪ জুন, ১৯৭১

Ayon Muktadir
<১৪, ৩০৯, ৭৮২-৭৮৪>

হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, ৪ জুন, ১৯৭১
আশা ও বিভ্রান্তির মাঝে
লেখক: প্রান চোপড়া

যখন লু হাওয়া বয়ে যায় তখন যেমন মানুষের অপেক্ষা না করে উপায় থাকে না, তেমনি বাংলাদেশের শরনার্থীদেরও মিসেস গান্ধীর বক্তব্য অনুযায়ী মাস ছয়েক অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু লু হাওয়া বয়ে যাবার পর আসে শান্তির বারিধারা। এই ছয় মাস অপেক্ষার শেষে কি অপেক্ষা করছে?

মিসেস গান্ধী ২৪ মে তারিখে লোক সভায় যে ভাষন দিয়েছিলেন তা তাঁর আগের বক্তব্য থেকে কিছুটা অগ্রসর বলে ধরা যায়। তিনি যে পুর্ব বাংলা না বলে বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলেছেন, সেটা দিয়ে হয়ত এমন বড় কিছু বোঝা যায় না। কিন্তু তাঁর বক্তব্যে কড়া ভাব সুস্পষ্ট, যেখানে তিনি বাংলাদেশের দুঃখ দুর্দশার দিকে কেউ মনযোগ না দিলে তার পরিণতি এবং পাকিস্তান ভারতকে যে সমস্যায় ফেলেছে তা নিয়ে কথা বলেছেন। কিন্তু তাঁর বক্তব্য শুনে বুঝার উপায় নেই যে তিনি কার কাছ থেকে এ ব্যাপারে কতটুকু মনোযোগ আশা করছেন। তাঁর ভয় জাগানো এই বক্তব্যর দুটো ব্যাখ্যা করা যায়, এক হচ্ছে যে ইয়াহিয়া খান চাপের মুখে পরে নরম হতে বাধ্য হচ্ছেন, এবং তাঁর ঝাঁঝালো বক্তব্য ভারতকে কিছু ক্রেডিট এনে দেবে, যা হয়ত এমনিতেই হবে, অথবা আসলেই গোটা দুনিয়া অস্বাভাবিক সময় নিচ্ছে বাস্তবতার প্রেক্ষিতে জেগে উঠতে এবং তাঁকে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য ভারতকে প্রস্তুত করতে হবে। কিন্তু সবচেয়ে সম্ভাব্য যে ব্যাখ্যটা, সেটাই তিনটির সবচেয়ে অপছন্দের, সেটা হচ্ছে যে যদিও সরকারের মধ্যে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত আলংকারিক বক্তব্য ছাড়া আমরা তেমন কোন জবাব পাইনি। এখনও পর্যন্ত আমরা সেই সম্ভাবনার সম্মুখীন হইনি, যেখানে ইসলামাবাদের ভদ্রলোকটি আভ্যন্তরীণ অথবা আন্তর্জাতিক চাপের মুখে থাকবেন, এবং ভারতের সুরক্ষার দাবীতে মিসেস গান্ধীর কথিত সে ‘যে কোন উপায়’ অবলম্বন করতে বাধ্য হতে হবে।

ভারত পাকিস্তানের উপর আন্তর্জাতিক জাতিগোষ্ঠীর কাছ থেকে যে ধরনের চাপ দেখতে চায়, তা মূলত অর্থনৈতিক। নয়া দিল্লী এটা গভীরভাবে বিশ্বাস করে যে পাকিস্তান পুর্ব বাংলায় একটি রাজনৈতিক সমাধানে আসতে, অথবা ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে, যদি তাদেরকে আন্তর্জাতিক পাওনা পরিশোধের ব্যাপারে কোন ধরনের ছাড় না দেওয়া হয়, এবং মার্চের শেষ পর্যন্ত যা দেওয়া হয়েছে, এর বাইরে যদি তাদেরকে কোন ধরনের সহায়তা না দেয়া হয় আগামি ছয় মাস। এর ফলে, বিশ্বাস করা হচ্ছে যে পশ্চিম পাকিস্তান মুক্তি ফৌজের বর্তমান যুদ্ধ সক্ষমতার বিপরিতে যে নুন্যতম যুদ্ধ চালাতে হবে সেটাও করতে পারবে না। বাকিটা ছেড়ে দিতে হবে ইসলামাবাদের সামরিক জান্তা, সেনাবাহিনী এবং উচ্চাভিলাষী রাজনীতিবিদদের মত পার্থক্যের উপর, যারা যুদ্ধক্লান্ত সেনা নায়করা ক্ষমতার নাটাই যতটুকু তাদের কাছে ছাড়তে রাজী, তারচেয়ে বেশি দাবী করবে।
এই দাওয়াই খাতাকলমে ঠিকই আছে। কিন্তু কোন দাওয়াখানা এই ওষুধ দেবে সেটা পরিস্কার না। ভারত যতটুকু অফিশিয়ালি জানে এবং দাতাগোষ্ঠীরাও যা নিয়ে একমত, সেটা হচ্ছে পুর্ব বাংলায় সব ধরনের সহায়তা দেয়া এখন বন্ধ আছে এবং আগামি কয়েক মাস, হয়তবা দুই বা তিন বছরেও সেসব চালু হবার সম্ভাবনা কম। কিন্তু এটাকে পশ্চিম পাকিস্তানের উপর দাতাগোষ্ঠীর বিরূপ ভাব প্রকাশের চেয়ে হয়ত পুর্ব বাংলায় চলমান গন্ডগোলেরই ফলাফল হিসাবে দেখা উচিত। আওয়ামী লীগের সাথে সেনাবাহিনীর শুরু হবার সাথে সাথে বিদেশি সরকারগুলো তাদের এখানে বিভিন্ন প্রকল্পে কর্মরত নাগরিকদের এখানে থাকা নিরাপদ নয় বলে ধরে নেয়।এর ফলে আসতে আসতে বিদেশি কর্মচারিরা দেশ ত্যাগ করতে থাকে এবং তারা আগামী বেশ কিছুদের মধ্যে ফিরে আসবে বলে মনে হচ্ছে না। এর ফলে এই প্রকল্পগুলোর অর্থ সাহায্য স্থগিত হয়ে গেল। এর বাইরে, ভারতীয় কান বিদেশি অর্থসাহায্য বন্ধ হবার যতই গুজব শুনতে পাক না কেন, এখন পর্যন্ত কোন দেশের অর্থ সাহায্য দেবার অস্বীকৃতির নিশ্চিত খবর এখনও পাওয়া যায়নি, বরং যুদ্ধ শুরুর পরপরই রাশিয়ানরা জানিয়ে দিয়েছে যে তারা করাচীর কাছে একটা ষ্টীল মিল তৈরির কাজ থেকে সরে আসছে না।

ছবিটা হয়ত আরেকটু পরিস্কার হয়ে আসবে আগামি আগস্টে যখন পাকিস্তান এইড কনসোর্টিয়াম আলোচনার বসবে; তার আগে হয়ত কি হতে যাচ্ছে তার একটা আভাস পাওয়া যেতে পারে যখন জুলাই মাসে এই একই দেশগুলো আলোচনায় বসবে ভারতকে নিয়ে। কিন্তু একটা ব্যাপার প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়, এই কনসোর্টিয়ামের সদস্যরা এসব ব্যাপারে মূলত আমেরিকা আর ব্রিটেনের কাছ থেকেই নির্দেশনা নেবে, এবং এই দুটি দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থানকে দিয়ে যদি তাদের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক নীতি আন্দাজ করা যায়, তাহলে ভারতের উচিত হবে না এখানে বিশেষ কিছু আশা করা। এই দুই দেশেরই সাধারন জনগন এবং সরকার খুব ভালো করে জানে পুর্ব বাংলায় কি ন্যাক্কারজনক কাজ হয়েছে। ব্রিটিশ এবং আমেরিকান সংবাদমাধ্যম খুবই অকপটভাবে তুলে ধরেছে পরিস্থিতি, এমনকি যাদেরকে লোক দেখানো নিয়ন্ত্রিত ভ্রমনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল প্রমান দেয়ার জন্য যে সেখানে বর্বর আক্রমন হয়নি। তাদের এই অকপটতা নয়াদিল্লীর প্রশংসা কুড়িয়েছে, যেখানে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমকে সাধারণত সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা হয়। কিন্তু এত কিছুর পরেও লন্ডন কিংবা ওয়াশিংটনের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য এমনভাবে দেয়া হয় যাতে ইসলামাবাদ আহত না হয়, যাতে পরিস্কার বোঝা যায় তাদের নিজেদের স্বার্থে পাকিস্তানের সাথে, তাদের কাছে মূলত পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে, ভালো সম্পর্ক রাখা তাদের জন্য কত প্রয়োজনীয়।

বর্তমান অ্যাংলো-আমেরিকান মনভাবের সবচেয়ে ভালো উদাহরন ব্রিটিশ সরকার দিয়েছিল মে মাসের ২৫ তারিখে, যেদিন হাইজ অফ কমনসে তারা ঘোশনা দিয়েছিল যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিশেষ প্রতিনিধিদলকে ‘পুর্ব বাংলার ঘটনাবলী’ (এখানে ঘটনাবলী বলতে কি দলে দলে শরনার্থীদের দেশ ত্যাগ নাকি সামরিক সন্ত্রাস, নাকি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগনের আকাঙ্ক্ষাকে দমনের কথা বলা হচ্ছে, সেটা সুকৌশলে উহ্য রাখা হয়েছে) সম্পর্কে ব্রিটেনের শঙ্কার কথা অবহিত করা হয়েছে, এবং সেই সাথে এটাও উল্লেখ করা হয়েছে যে প্রতিনিধিদল যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের “পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যার দ্রুত রাজনৈতিক সমাধানের আনয়নের দৃঢ় ইচ্ছার উপর” জোর দিয়েছে সেটাকে ব্রিটেন স্বাগত জানিয়েছে। অন্য কথায় বলতে গেলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান নিজেই নির্ধারন করতে পারেন সেই সমস্যার “সমাধান” কিভাবে হবে, যাকে তার দূতরা জোরগলায় “আভ্যন্তরীণ সমস্যা” হিসাবে উল্লেখ করেছেন।

মাত্র কয়েকদিন আগেই ইয়াহিয়া খান স্বয়ং নিশ্চিত করেছেন যে তার “সমাধানে” আওয়ামী লীগের কোন স্থান হবে না, যদিও আওয়ামী লীগ আর পুর্ব বাংলার জনগণ যে সমার্থক, সেটা প্রমানিত। ইয়াহিয়া খানের একটি দৃঢ় বক্তব্য হচ্ছে যে তারা “শেখ মুজিবুর রহমানকে সামাল দিবে তাদের নিজেদের মত করে”, এবং আরেকটি হচ্ছে যে আওয়ামী লীগের সাথে কোন ধরনের আলাপ-আলোচনা নয়, এবং আরো একটি বক্তব্য হচ্ছে যে তিনি আওয়ামী লীগ নেতাদের বড় ধরনের শাস্তি দিতে প্রস্তুত, যারা তার দৃষ্টিতে “অপরাধ করেছে” এবং তিনি যেহেতু বলেছেন যে শেখ মুজিব তাঁকে, দেশের প্রেসিদেন্টকে, গ্রেফতার করার ছক করেছে, তিনি নির্ঘাত শেখ মুজিবকে একজন অপরাধী হিসাবেই দেখবেন এবং সেভাবেই ব্যবস্থা নেবেন। তিনি অবশ্য আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সদস্যদের সামনে একটি মুলা ঝুলিয়ে রেকেছেন, তিনি বলেছেন যে বিজয়িদেরকে ব্যক্তিগত ভাবে বিজয়ী ধরা হবে, আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসাবে নয়, এবং এর ফলে আওয়ামী লীগের উপর দেয়া নিষেধাজ্ঞা তাদের উপর প্রযোজ্য হবে না, এবং যারা ২৫ মার্চের ঘটনাবলীর পর নিজেদেরকে যথেষ্ট পরিমানে সংশোধন করে নিতে পারবেন, তাদেরকে এই রাজনৈতিক সমাধানে জায়গা দেয়া হতে পারে। কিন্তু অন্যান্য পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারাও ব্যাখ্যা করেছেন কিভাবে তাদেরকে জায়গা দেয়া যেতে পারে, সেটা হতে পারে “পুর্ব পাকিস্থানের পরিবর্তিত রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে” নতুন করে নির্বাচন করা, যেখানে সংখ্যালঘুর দায়িত্ব দেয়া হবে সংখ্যাগুরুদের হাতে। এদের সাথে ইয়াহিয়া খানের এত মিল, এবং ইয়াহিয়া খানের সাথে যুদ্ধংদেহি জেনারেলদের, যারা সামরিক জান্তাকে চালাচ্ছে, মতের এত মিল যে, পশ্চিম পাকিস্তানের হর্তাকর্তাদের মধ্যে মতানৈক্য আশা করা অনুচিত, যদি না এই বর্বর শাসক গোষ্ঠীর উপর বিদেশি অর্থ সাহায্য দেয়া বন্ধ করে চাপ না দেয়া হয়।

বিদেশি সরকারগুলো ভারতীয় দিকের শরনার্থি সমস্যা সম্পর্কে সীমান্তের ওপারের রাজনৈতিক সমস্যার চেয়ে বেশি সমঝদার হয়েছে। তারা প্রধানত সহানুভূতিশীল মনোভাবই দেখিয়েছেন। এতই সহানুভূতি তারা দেখিয়েছেন যে যেই সাড়ে তিন মিলিয়ন শরনার্থী ইতিমধ্যেই এসেছে, অথবা যে পাঁচ মিলিয়ন এখনও আসার অপেক্ষায় আছে, তাদের হিসাবে নিলেও ভারতের জন্য অর্থনৈতিক বোঝার ব্যাপারটি এখন প্রায় অবাস্তব মনে হচ্ছে। আমরা প্রতিবছর আমাদের জনসংখ্যার সাথে পনের মিলিয়ন মানুষ যোগ করি, এবং তাদেরকে বাচিয়ে রাখার জন্য কোন বিশেষ সহায়তার আশায় থাকি না। যদি আমরা রিলিফ ম্যানেজমেন্টে মাঝারি মানের দক্ষতাও দেখাতে পারি, তাহলেও আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি যে আমরা এই শরনার্থীদের কেবল মাস ছয়েক না, হয়ত কয়েক বছরও রাখতে পারবো। কিন্তু তারা শরনার্থি অবস্থা থেকে কবে মুক্তি পাবে সেটা অনিশ্চিত। শরনার্থী অবস্থা থেকে তাদেরকে হয় পুনর্বাসিত করতে হবে নয়ত তাদেরকে তাদের দেশে ফিরে যাবার ব্যবস্থা করে দিতে হবে, কিন্তু এই দুই পন্থার কোনটিই নিশ্চিত নয়, এবং অনিশ্চিতই থাকবে যতক্ষন না পর্যন্ত বৃহৎ শক্তিগুলো পাকিস্তানের ব্যাপারে তাদের নীতি পরিবর্তন করে, অথবা ভারত স্বাধীনভাবে তাদের পক্ষে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। আসলে সবাই ভারতীয় অংশের সমস্যাগুলো নিয়ে কথা না বলে পুর্ব বঙ্গের দিকের সমস্যা নিয়ে যতদিন সোচ্চার না হবে, ততদিন পর্যন্ত শরনার্থীরা তাদের দেশে ফিরে যাবার মত অবস্থা তৈরি হবে না।

ভারত যতই চেষ্টা করুন না কেন শরনার্থীদের “বিশ্বাসযোগ্য নিশ্চয়তা” দিতে তাদেরকে ফিরে যাবার জন্য, তাদের কাছে সেটা কখনই গ্রহণযোগ্য হবে না যদি সে নিশ্চয়তার দায়িত্বে থাকে ইয়াহিয়া খান, অথবা ঢাকায় তার জোগাড় করা কোন পুতুল শাসক।এটা বিশেষত দুই মিলিয়ন হিন্দুদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যারা দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছে বা হচ্ছে, যাদের জীবিকার অবলম্বন বিশেষত স্থাবর সম্পত্তি কেড়ে নেয়া হয়েছে এবং মুসলিম লীগের সদস্যদের ভাগাভাগি করে দেয়া হয়ে গেছে, সেসব কোনভাবেই আওয়ামী লীগ বিরোধী কোন সরকার এসে ফিরিয়ে দেবে না। অবশ্য সেসব কথা তখনই আসবে যদি কখনো তারা ফিরে যেতে আদৌ পারে। এক লম্বা এবং কষ্টদায়ক পদ্ধতিতে ইয়াহিয়া খান বেছে নেবে কোন কোন শরনার্থিদের তারা ফিরিয়ে নেবে, ততদিনে পৃথিবী এ ব্যাপারে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে, এবং খুবই সীমিত সংখ্যক লোকই আসলে সীমান্ত পেরিয়ে ফেরত যেতে পারবে। কিন্তু যা হচ্ছে তা হল যে রাজনৈতিক সমস্যাটা প্রতিদিনই শরনার্থিদের মানবিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার চাপে পেছনে পরে যাচ্ছে; সিনেটর কেনেডির সর্বশেষ বক্তব্য যা তিনি সেক্রেটারি অফ স্টেট রজার্সের কাছে লেখা চিঠিতে দিয়েছেন, এবং তার আগের বক্তব্যের মধ্যকার পার্থক্য খুবই আশংকাজনক। সেদিকে যদি দৃষ্টিপাত না করা হয়, তাহলে রাজনৈতিক সমস্যাটা থেকেই যাবে এবং সেকারনেই থেকে যাবে মানবিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যাটাও। এটা একটা বিশাল ভুল হবে যদি ধরে নেয়া হয় যে শেষের সমস্যাটার সমাধান হয়ে যাবে আগের সমস্যাটার সমাধান না করেই। হয় ভারতকে এই রাজনৈতিক সমস্যার প্রেক্ষিতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, অথবা দাতা দেশগুলোকে তারা বর্তমানে যতটুকু সচেতনতা এবং উদ্দেশ্যপুর্নভাব দেখাচ্ছে তার চেয়ে আরো বেশি দেখাতে হবে, যদিনা তারা চায় এটা বাংলাদেশ ও ভারতের জন্য চিরস্থায়ী সমস্যায় পরিনত হোক।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩১০। পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতার কোন অবকাশ নাই – তাজউদ্দীন হিন্দুস্তান স্টান্ডার্ড ৪ জুন ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ৩১০, ৭৮৫- ৭৮৬>

হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, ৪ জুন ১৯৭১
পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতার কোন অবকাশ নাই – তাজউদ্দীন

নয়া দিল্লি, ৩ জুন – বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, গতকাল মুজিবনগরএ সুনিশ্চিতভাবে ঘোষণা করেন যে, “পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে তাদের সাথে সমঝোতার কোন সুযোগ নাই।’ – খবর ইউ এন আই।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম ও স্বাধীন দেশ এবং আমরা যে কোনো মূল্যে এটা রক্ষা করব।’

অল ইন্ডিয়া রেডিওতে এক সাক্ষাৎকারে জনাব আহমেদ পুনর্ব্যক্ত করেন আমরা সবার সাথে আমাদের প্রতিশ্রুতিমত বন্ধুত্তপূর্ন সমপর্ক রাখব – বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশের প্রতি। আমাদের দুর্যোগে বিভিন্ন বিশ্বশক্তিগুলো যে ভিন্নমত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন তা আমাদের বন্ধুত্তপূর্ন সমপর্ক গঠনে প্রভাব ফেল্বেনা।

একটি প্রশ্নের উত্তরে তাজউদ্দীন বলেন – ‘২ মাস বয়সী একটি দেশ হিসেবে আমরা বিদেশী নীতিতে বেশী কঠোর হতে চাইনা।’

তিনি আরো বলেন: “উত্সাহব্যাঞ্জক উন্নয়ন চলছে এবং দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের উপর কোন চূড়ান্ত মন্তব্য করার প্রয়োজন নেই।”

পাকিস্তান সরকার দাবি করে যে, শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং তিনি মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করতে – এই সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে জনাব আহমেদ বলেন, “আমরা জানিনা শেখ সাহেবকে পাকিস্তান সরকার কোথায় আটক করে রেখেছে। কিন্তু যে দাবী করা হয়েছে যে তিনি নাকি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়েছেন – একথা পরম অবমাননার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করা উচিত’। এই দাবী অযৌক্তিক।

জনাব আহমেদ বলেন, আমরা জানিনা পাকিস্তান সরকার রাজনৈতিক নিষ্পত্তির জন্য মধ্যস্থতা করার জন্য এবং আওয়ামী লীগের ছয় দফা মেনে নেওয়ার ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বলেছে কিনা।

বড় ক্ষমতাশালী দেশগুলো, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশ সম্পর্কে নীরবতা বা দোটানায় থাকা সম্পর্কে তার সরকারের অনুভূতি কি জানতে চাইলে তিনি বলেন: “বর্তমান অবস্থা নিয়ে বিশ্বশক্তিগুলোর প্রতিক্রিয়ায় যে বৈচিত্র থাকুক না কেন নির্বিশেষে আমাদের পররাষ্ট্রনীতির কৌশল অব্যাহত থাকবে।’

তিনি বলেন, তার সরকার কর্তৃক প্রেরিত প্রতিনিধিদের বিদেশে কাজ হবে এ অঞ্চলের পক্ষে লবিং করা এবং বাংলাদেশের পক্ষে জনমত তৈরি করা।

সরকারের বর্তমান কার্যকরী অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে জনাব তাজউদ্দিন বলেন, বাংলাদেশের সুবিশাল গ্রামাঞ্চলের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে। এবং “আমরা আমাদের স্থানীয় নেতৃস্থানীয় কর্মীদের মাধ্যমে অধিকৃত এলাকার শহর ও শহরগুলির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি।’

“আমরা আমাদের নিয়ন্ত্রণনাধিন এলাকায় প্রশাসনিক যন্ত্র চালু রেখেছি এবং শত্রু দমনের জন্য কেন্দ্রীয় কমান্ড অপারেশন পরিচালনা করছে।’

বাংলাদেশে বামপন্থী বাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করলে জনাব আহমেদ বলেন যতদূর জানি বামপন্থী বাহিনী কোনো সমস্যা করছেনা। দেশব্যাপী নির্বাচনে দেশের মানুষ এক হয়ে তাদের মতামত প্রকাশ করেছে। এখনো সেভাবেই দল মত নির্বিশেষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

তিনি বলেন, “ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মওলানা ভাসানী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক নেতারা ইতিমধ্যে সংগ্রামরত মানুষদের সমর্থন করছেন এবং বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি দাবি করেছেন।’

পিটিআই যোগ করেছে: মার্শাল ল প্রশাসন যদি একটি পাপেট সরকার ঢাকায় গঠন করে তাহলে কি করবেন জানতে চাইলে তাজউদ্দীন বলেন – খুনিদের সাথে যে কোন সহযোগিতা প্রত্যাখ্যান করা হবে এবং দেশের মানুষ নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যে লড়াই করছে তার বিরুদ্ধে কোন চক্রান্ত বরদাশত করা হবেনা।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩১১। স্টেটসম্যান পত্রিকার একটি সম্পাদকীয় দি স্টেটসম্যান ৫ জুন ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ৩১১, ৭৮৭-৭৮৮>

দি স্টেটসম্যান, ৫ জুন ১৯৭১
শান্ত রাখা

যখন নতুন দিল্লি সিদ্ধান্ত নেয় যে বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তুদের আসার জন্য ভারত সীমান্ত খুলে দেয়া ছাড়া তাদের আর কোন বিকল্প নেই অন্তত মানবিক কারণে। এই একটি নীতি যার সঙ্গে কোন দ্বন্দ্ব হতে পারে না। যেহেতু পরিস্থিতির শিকার। তবুও রাজনৈতিক উদারতার এটিকে সমাধান করবে না। সরকারের সাথে আলোচনার মাধ্যমে সম্ভাব্য পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। শরণার্থী প্রবাহের পরিমাণ, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার ঝুঁকি, রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বারা এই দুর্ভাগ্যের শোষণ, পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসনের সীমিত ক্ষমতা, স্থানীয় ও জাতীয় উভয় অর্থনীতির উপর চাপ, সাম্প্রদায়িক চাপের ঝুঁকি এবং ” শরনার্থী কলকাতা শহরে আক্রমণ – এই সমস্ত বিষয়গুলি এক রাত্রিকালে আবির্ভূত হয়নি, তারা সীমান্ত খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তে ছিল এবং এটা প্রত্যাশিত হতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে কি উদ্বাস্তুদের বাইরে বাইরে ছড়িয়ে দেওয়া উচিত? সীমান্ত রাজ্যগুলির মধ্যে বেশ কিছু সমীকরণ এবং মোট অনুপস্থিতি রয়েছে, কেন্দ্র ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে। সব পরিস্থিতিতেই নির্দেশ করে যে এটি বিচ্ছিন্ন করার কোন বিকল্প নেই তবে এখানে স্পষ্ট নীতি গ্রহণের কোন প্রমাণ নেই এবং এটি বাস্তবায়নের জন্য একটি স্পষ্ট সম্মতি নেই। সব বিষয় বিবেচনায় নিলে দেখা যায় এখন ডিস্পারসাল অনুমোদন ছাড়া কোন উপায় নেই। তবে এখানে আপাত ইচ্ছার কোন পরিষ্কার পলিসি নেই। ডিস্পার্সালের ব্যাপারে নয়াদিল্লীর অনিচ্ছার কারণে রাজ্য দরকারি সেবা দিতে ব্যর্থ হয়েছে – এটিই প্রধান কারণ। এভাবে সীমান্ত এলাকায় বিস্ফোরক পরিস্থিতি বিরাজমান।পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসন প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে।

আজ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার প্রধান থিম হতে পারে অপর্যাপ্ততার নিয়ে; এবং এ যুক্তিতে কয়েকজন আগ্রহী হবে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে সঙ্কটগুলি সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারা নয়াদিল্লীর উদ্বেগ। শরণার্থীদের অব্যাহতির উন্নতির তেমন সম্ভবনা নেই। সমস্যা প্রতিদিন আরো জটিল হয়ে উঠছে এবং তীব্রতা বেড়ে যেতে পারে বলে আশা করা যায়। সরাসরি সেন্ট্রাল তত্ত্বাবধানে এই পরিস্থিতির জন্য একটি নীতি করা বাধ্যতামূলক এবং যা না হলে তাত্ক্ষণিক সমাধান পাওয়া যায় না। প্রাথমিক লক্ষ্য হল এই প্রতিরোধ্য অবস্থার পরিণতির কি হবে সেটা। ছয় মাসে এ অঞ্চলে একটি প্রাথমিক সমঝোতায় পৌঁছান গেলে সেখানে সবচাইতে খারাপটা মাথায় রেখে ভালো সময়ে তা প্রতিরোধ করতে হবে। সব কিছুর উপড়ে শুধু ত্রাণ দেয়া সম্ভব – তাও সামর্থের উপর নির্ভরশীল।এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক লেভেলে হতাশা জন্ম নিয়েছে – নয়াদিল্লীর সামনে নতুন বিপদ – তাদের সামনে যে চাপ তাতে করে জনপ্রিয়তা ধরে রাখার জন্য অথবা আবেগের সন্তুষ্টির জন্য – অথবা কোন দলে নৌকার পালে হাওয়া লাগালে – তা জাতীয় স্বার্থের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।

প্রেশার যাই হোক না কেন – শরণার্থী প্রবাহ দ্বারা উত্পাদিত চাপ এবং উত্তেজনা নয়াদিল্লি এখন পর্যন্ত প্রশংসনীয়ভাবে ঠান্ডা রেখেছে। ইসলামাবাদের নিজস্ব চাপ বাড়ছে যদিও এইগুলি প্রথম দিকে ফলপ্রসূ হবে না, তবে শেষ পর্যন্ত তারা ভারতের তুলনায় আরো বেশি সুবিধা পেতে পারে।

রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের উক্তি যে পাকিস্তানের অর্থনীতি “এত খারাপ যে আমি তোমাকে বলতে পারব না” – এটাই মিথ্যাবাদ ও বিকৃতির বাঁধের মধ্যে এক নিখুঁত নিরবচ্ছিন্ন সত্য। জনাব স্বরান সিংয়ের মিশন সম্ভবত অর্থনৈতিক চাপ বৃদ্ধির জন্য বিশ্ব মতামতকে জানানো। রাজ্যসভায় তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন পূর্ববাংলার সঙ্কটটি “মূলত” বাংলাদেশের জনগণ ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে। মুল বিষয় হল বড় শক্তিগুলোকে বুঝাতে হবে যে এই পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করার কোন ইচ্ছা ভারত সরকারের নেই। কারণ ইতোমধ্যেই এটি অনেক জটিল আকার ধারণ করেছে। তা এতটাই জটিল যে যদি কেউ এটাকে আরও মাখাতে যায় তাহলে উল্টো তার নিজেরই সমস্যা হবে – বৃহত্তর স্বার্থে। এবং তা বাংলাদেশের স্বার্থের বাইরেও যাবে। ইতোমধ্যে ভারত যতোটুকু জড়িয়েছে তার মূল্য তাকে শোধ করতে হচ্ছে। পাকিস্তানের ভারতকে প্রধান উশকানিদাতা প্রমাণ করার চেষ্টা ব্যার্থ হয়েছে এবং একথাও ভুল প্রমাণিত হয়েযে যখন তারা বলে পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। ইসলামাবাদের দাবি ও বিবৃতিগুলিতে আন্তর্জাতিকভাবে সংশয়বাদীরা এখন এমন চাপের সম্মুখীন হতে পারে যা রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়াকে অপ্রতিরোধ্য হিসেবে প্রকাশ করছে। সমাধানের কোন শর্টকাট পথ নেই। এবং সেইসাথে নিয়াদিল্লির উদ্বেগকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে। দায়িত্বজ্ঞানহীন দাবির প্রতি আত্মসমর্পণ না করে সীমান্ত এলাকায় কীভাবে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা যায় সে ব্যাপারে “দৃঢ় পদক্ষেপ” নিতে হবে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩১২। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভি সি কর্তৃক যুব শিবির উদ্বোধন অমৃতবাজার পত্রিকা ৫ জুন ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ৩১২, ৭৮৯>

অমৃতবাজার পত্রিকা, ৫ জুন ১৯৭১
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভি সি কর্তৃক যুব শিবির উদ্বোধন

গত বুধবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ডঃ আজিজুর রহমান মল্লিক কোলকাতায় দুই সপ্তাহ ব্যাপী বাংলাদেশ ছাত্র ও যুব ক্যাম্পের উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চল থেকে আসা ৬২ জন তরুণ ছেলেমেয়েদের ২ সপ্তাহে গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ জীবনের উপর মতাদর্শিক ও ব্যবহারিক কোর্সের উপরে ট্রেনিং দেয়া হবে। জনাব বিচারপতি এস পি মিত্র ক্যাম্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন। গান্ধী পিস ফাউন্ডেশন এর আয়োজন করেছে।

প্রথমে ক্যাম্পের যুবকদের কাছে বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসন দ্বারা নিপীড়ন এবং নির্দয় শোষণের চিত্র উপস্থাপন করা হয়। ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ক্ষিতীশ রায় চৌধুরী, পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সভাপতি সবাইকে উষ্ণ স্বাগত জানান। অনুষ্ঠানের আহবায়ক জনাব শিশির সান্যাল প্রশিক্ষণের উদ্যেশ্য জানান যা যুবকদের একটি মুক্ত সমাজ গঠনে মনোবল, পটভূমি এবং ব্যবহারিক জ্ঞান বৃদ্ধি করবে।

একটি কৃতিত্ব

এর আগে তাদের প্রথম ওরিয়েন্টেশন কোর্সে প্রতিষ্ঠানের সভাপতি জনাব আর আর দিবাকর ক্যাম্পারবৃন্দকে বলেন বাংলাদেশী তরুণদের তাদের সংগ্রামের মূল্যায়ন এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থা পুনর্গঠন করার লক্ষ্যে এই কর্মসূচি।

জনাব মল্লিক পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের দ্বারা বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের সমালোচনা করেন। আমরা মহাত্মা গান্ধীকে অনুসরণ করি কিন্তু ইয়াহিয়া খান আমাদের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিচ্ছেন। এই অসভ্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে আমাদের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে। আমাদের লক্ষ্য সত্য ও ন্যায়। তাই আমাদের জয় অপ্রতিরোধ্য। জনাব মিত্র ক্যাম্পারদের শরনার্থিদের মাঝে কাজ করতে বলেন যাতে তারা উপযুক্ত সময়ে তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যাওয়ার প্রয়োজনীয় নৈতিক মনোবল পান।

সভা বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের সাথে শেষ করা হয়। – খবর এস পি এস।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩১৩। স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন যুগান্তর ৫ জুন, ১৯৭১

Kamol Roy
<১৪, ৩১৩, ৭৯০- ৭৯১>

স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন

আজ শনিবার পাঁচই জুন। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আসবেন কলকাতায়। কি দেখবেন তিনি? সীমান্তে নেই তিল ধারণের স্থান। উপকন্ঠে এসে পৌঁছেছে শরণার্থীর ঢেউ। পাক লুটেরা রাস্তায় কেড়ে নিয়েছে তাদের সর্বস্ব। প্রাণে মরেছে অনেকে। নিখোঁজ হয়েছে স্ত্রী-কন্যা। এপারে এসেও স্বস্তি নেই। মহামারীরূপে দেখা দিয়েছে কলেরা। রাজ্য সরকার দিশেহারা। শরণার্থীর সংখ্যা চার লক্ষ ছাপিয়ে উঠেছে। অন্যান্য রাজ্যে না পাঠালে বাঁচবে না এই হতভাগ্যের দল। দু’মাস অপেক্ষা করেছেন কেন্দ্রীয় সরকার। কি পেয়েছেন তাঁরা। বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির চরম ঔদাসীন্য এবং রাষ্ট্রসঙ্ঘের অসহনীয় নীরবতা। ইয়াহিয়া আগের চেয়ে বেশী বেপরোয়া। বাংলাদেশে জ্বালাচ্ছেন তিনি সাম্প্রদায়িকতার আগুন। পুড়ছে অনেকে। যারা কোনমতে বেঁচেছে তারা আশ্রয় নিচ্ছে ভারতে। যত দিন যাবে শরণার্থীর সংখ্যা তত বাড়বে। ওদের ফেরার পথ বন্ধ। বন্দুক উঁচিয়ে আছে ইয়াহিয়ার বাহিনী। তাদের ইন্ধন জোগাচ্ছে স্থানীয় ধর্মান্ধের দল। গোড়ার দিকে বাংলাদেশ সরকারকে যদি স্বীকৃতি দিতেন নয়াদিল্লী তবে ঘটত না অবস্থার এমনিতর অবনতি। মুক্তিযোদ্ধারা পেতেন দ্বিগুন মানসিক বল। বাড়ত সংগ্রামের তীব্রতা গ্রামাঞ্চলে গড়ে উঠতো প্রতিরোধ ব্যুহ। সাম্প্রদায়িক নেতাদের মধ্যে দেখা দিত সন্ত্রাস। কমত লুটপাটের ব্যাপকতা। বিপুল সংখ্যায় সংখ্যায় শরণার্থীরা হয়তো ভীড় করত না ভারতের সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে। কেন্দ্রীয় সরকারের “দেখি কি হয় নীতি” এনেছে নৈরাশ্য। বাড়িয়েছে ইয়াহিয়ার স্পর্ধা এবিং ভারতকে নিয়েছে আর্থিক সঙ্কটের মুখে।

বন্ধ হবে না শরণার্থীর স্রোত। পূর্ব বাংলায় থাকতে পারবে না অসাম্প্রদায়িক সাধারণ মানুষ। কিসের আশায় দিন গুনছেন প্রধানমন্ত্রী? বৃহৎ শক্তিগুলো কি লক্ষ লক্ষ শরনার্থীর হাত ধরে তাদের নিজেদের বাড়ীঘরে বসিয়ে দিয়ে আসবে? তারা কি এদের নিরাপত্তার গ্যারেন্টি দেবে? আর্থিক চাপে ইয়াহিয়ার নাকে খত আদায় করবে? গত দুমাসের আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি কি বুঝতে পারেননি জল কোথায় গড়াচ্ছে? জিইয়ে রাখবে তারা ইসলামাবাদকে। শক্তিসাম্য ভাঙতে দেবে না এশিয়ার এ অঞ্চলে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশ ছাড়া শরণার্থী ফিরতে পারবে না নিজেদের বাড়ী ঘরে। এই সহজ সত্য মেনে নিতে কর্তৃপক্ষের দ্বিধাগ্রস্থ মনোভাবই সৃষ্টি করছে যত জটিলতা। শ্রীমতি গান্ধী আশায় আশায় অনর্থক সময় কাটাচ্ছেন। এখন যে অবস্থা চলছে তার ব্যতিক্রম না ঘটলে ছ মাস কেন ছ বছরেও শরণার্থী ছাড়বে না ভারতের মাটি। পূর্ব বাংলায় শক্তি সংহত করবেন ইসলামাবাদ। মুক্তি সংগ্রামীরা পাবেন প্রচন্ড বাধা। আর ক্রমবর্ধমান শরণার্থীর বোঝা নিয়ে ভারত খাবে হাবুডুবু। সমূহ বিপদ সামনে দেখেও মন স্থির করতে পারছেন না কেন্দ্রীয় সরকার। গোটা জাতিকে কোন অন্ধকার গুহায় টেনে নিচ্ছেন তারা?

বিভিন্ন রাজ্যে শরণার্থীদের অবিলম্বে সরিয়ে দেওয়া খুবই দরকার-সন্দেহ নেই। এ ব্যবস্থা অবশ্যই সাময়িক। তাতে পাওয়া যাবে না সমস্যার স্থায়ী সমাধান। গোঁজামিল দিয়ে সময় কাটাবার পালা শেষ হয়েছে। দেশবাসীর ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। জবাব দিন নয়াদিল্লী- শরণার্থীদের নিয়ে তাঁরা কি করবেন? কি করে থামাবেন বন্যার স্রোত? কিভাবে পাঠাবেন তাঁদের বাংলাদেশে? বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির কাছে নয়াদিল্লীর আকুতি-মিনতি ব্যর্থ। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত পত্রে এবং কূটনৈতিক তৎপরতায় যাদের টনক নড়েনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বরণ সিংয়ের সম্ভাব্য সফরে তাদের ঘুমের নেশা কাটবে না। লক্ষ লক্ষ শরণার্থীকে বুকে ধরে অনন্তকাল বসে থাকতে পারে না ভারত। নিরাপত্তার এবং বাঁচার তাগিদেই কেন্দ্রীয় সরকারকে নিতে হবে নিজস্ব পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনার প্রাথমিক অঙ্গ- স্বাধীন বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দান। বাড়ান দরকার তাদের সংগ্রামী শক্তি। ওঁদের জয় ত্বরান্বিত হলেই স্বদেশে ফিরবেন শরণার্থীরা। নইলে তাঁরা থাকবেন ভারতে। এ কথ সত্য, কোন শান্তিবাদী রাষ্ট্র সহজে বলপ্রয়োগ করতে চাননা। ইয়াহিয়া খান নয়াদিল্লীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভর করছেন না। বাংলাদেশের সমস্যার সঙ্গে ভারতকে তিনি জড়িয়ে ফেলেছেন। চারিদিকে দেখা যাচ্ছে অশান্তির দুর্লক্ষণ। মুখ বুঁজে থাকলেই বিপদ এড়ান যাবে না। বাস্তব অবস্থার মোকাবিলা করুন কর্তৃপক্ষ। অবিলম্বে স্বীকৃতি দিন স্বাধীন বাংলাদেশকে। প্রশস্ত করুন ইয়াহিয়ার চরম পরাজয়ের পথ। এতেই আসবে পূর্ব বাংলার ভবিষ্যৎ শান্তি। শরণার্থীরা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন প্রেরণা।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩১৪। মেহদী মাসুদের ওপর বিধিনিষেধ আরোপঃ ভারত সরকারের কড়া ব্যবস্থা। কালান্তর ৬ জুন, ১৯৭১

Kamol Roy
<১৪, ৩১৪, ৭৯২>

মেহদী মাসুদের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ
ভারত সরকারের কড়া ব্যবস্থা

নয়দিল্লী, ৫ জুন (ইউএনআই)- কলকাতার পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশনার মেহদী মাসুদ ও হাইকমিশনের অন্যান্য পশ্চিম পাকিস্তানী কর্মচারীর গতিবিধির উলর ভারত সরকার বিধিনিষেধ আরোপ করেছেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য, ১ মদ থেকে ঢাকার ভারতীয় কূটনৈতিক কর্মচারীদের ওপর পাকিস্তান সরকার অনুরূপ বিধিনেষেধ চাপিয়েছেলন।

ভারতীয় সরকারী সূত্র থেকে বলা হয়েছে ভিয়েনা সনদে প্রতিষ্ঠিত কূটনৈতিক সম্পর্কের রীতিনীতি ও মর্মবস্তু অগ্রাহ্য করে পাকিস্তান সরকার ঢাকায় অবস্থানকারী ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার শ্রী কিরণ চন্দ্র সেনগুপ্তকে অন্তরীণ করে এক অভূতপূর্ব নজির সৃষ্টি করেছেন। পাকিস্তানী কূটনৈতিক কর্মীদের ক্ষেত্রেও অনুরূপ ব্যবস্থা অবলম্বন করবেন।

পাকিস্তান সরকার ঢাকার ভারতীয় কূটনৈতিক কর্মীদের বিনা অনুমতিতে নিজেদের মধ্যে বা বাইরের কারোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে দেয়নি। শুধুমাত্র একটি ব্যতিক্রমঃ শ্রী সেনগুপ্ত দিনে এক বা দুবার ইসলামাবাদে ভারতীয় হাইকমিশনারকে টেলিফোন যোগাযোগ করতে পারেন

ঢাকার প্রত্যেক ভারতীয় কূটনৈতিক কর্মীর বাসভবনের বাইরে সশস্ত্র মিলিটারী প্রহরা মোতায়েন আছে।

বিধিনিষেধ জারি হবার পর দু’দেশের মধ্যে দূত বিনিময় করার জন্য কয়েকটি বন্ধু রাষ্ট্র প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান সরকার কোন পরমর্শতেই কান দেননি। ভারতীয় সরকারী মহল থেকে বলা হয়েছে, এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারত কলকাতায় অবস্থানকারী পাক কূটনৈতিক কর্মীদের গমনাগমনের ওপর বিধিনিষেধ চাপাতে বাধ্য হল।

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য লোকসভায় ও রাজ্যসভায় কমিউনিষ্ট সদস্যরা বলেছিলেন, যেখানে ঢাকায় ভারতীয় কূটনৈতিক কর্মীদের অসম্মান ও অপমানের বোঝা মাথায় নিয়ে অন্তরীণ থাকতে হয়েছে সেখানে কলকাতার পাক কূটনৈতিক কর্মীদের ‘রাজার হালে’ কোন যুক্তি নেই।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩১৫। বার্মিংহামে পাক ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে বৃহত্তম বিক্ষোভ সমাবেশ কালান্তর ৬ জুন, ১৯৭১

Kamol Roy
<১৪, ৩১৫, ৭৯৩>

বার্মিংহামে পাক ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে বৃহত্তম বিক্ষোভ সমাবেশ
বার্মিংহাম (ইংল্যান্ড), ৫ জুন (এপি)- ইংল্যান্ড- পাকিস্তান প্রথম টেস্টের ৩য় দিনে আজ ৩০০০ বাংলাদেশ সমর্থক বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
পাকিস্তানী ক্রিকেট দলকে চলতি সফরে এত বড়ো বিক্ষোভ মিছিলের সম্মুখীন হতে হয়নি। মিছিলে ৫০ জন পঙ্গু মহিলা পেরাম্বুলেটরে চড়ে যোগ দেন।
মিছিলকারীর এজবাস্টন মাঠের প্রধান প্রবেশ পথে রক্তাক্ত কুশপুত্তলিকা ও পূর্ববঙ্গে ইয়াহিয়া বাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপন পোষ্টার নিয়ে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দেখান। বার্মিংহাম বাংলাদেশ সংগ্রাম সহায়ক কমিটির সভাপত জগলাল পাশা বলেন, পাকিস্তানী ক্রিকেট দলের বর্তমান সফর বাতিল করাই মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের দাবি।
উল্লেখযোগ্য, পাঁচ সপ্তাহ পূর্বে পাক-ক্রিকেট দল ইংল্যান্ড সফরে এলে প্রায় সমস্ত জায়গাতেই তাদের বাংলাদেশ সমর্থকদের বিক্ষোভের সম্মুখীন হতে হয়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩১৬। দায়িত্ব পালনে কেন্দ্রের গড়িমসি কালান্তর ৬ জুন, ১৯৭১

Kamol Roy
<১৪, ৩১৬, ৭৯৪-৭৯৫>

দায়িত্ব পালনে কেন্দ্রের গড়িমসি

লোকসভায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শ্রী জগজীবন রাম বলেছেন যে বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের পূর্ণ দায়িত্ব কেন্দ্রের এবং সে দায়িত্ব তারা অস্বীকার করছে না। কিন্তু দায়িত্ব স্বীকার ও দায়িত্ব পালন এক কথা নয়। শরণার্থীদের যে প্রবল চাপ পশ্চিমবঙ্গের উপর পড়েছে তাত গুরুত্ব উপলব্ধি এ যাবত কেন্দ্রীয় সরকার করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। যদি উপলব্ধি করতেন তাবে তাঁরা সমস্যাটা জরুরী বিবেচনায় সমাধানের পথে আরো দ্রুত অগ্রসর হতেন। আসলে গোড়ায় গলদ। কেন্দ্রীয় সরকারের চূড়ামণিরা হয়তো ভেবেছিলেন দু’চার দশ লক্ষ শরণার্থী আসবে এবং তাদের সীমান্তবর্তী এলাকায় রেখে দিয়েই আবার স্বল্পকালের মধ্যে বাংলাদেশে ফিরিয়ে দেয়া যাবে। সমস্যাটা যে তার চেয়ে অনেক বেশী গুরুতর এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়ে উঠতে পারে এমন দূরদৃষ্টি তাদের ছিলনা বলেই মনে হয়।

কিন্তু অবিরাম শরণার্থীর স্রোতে পশ্চিমবঙ্গ প্লাবিত হতে চলেছে। বন্যার জল বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। যে কোন সময় বাঁধ ভেঙ্গে প্লাবনের মত এই জলস্রোত পশ্চিমবঙ্গের চরম বিপর্যয় ঘটাতে পারে। তাই রাজ্য সরকার বিষম উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। চল্লিশ লক্ষ শরণার্থীর মধ্যে অনুমান উনিশ লক্ষ ছাদের তলায় কোন রকমে মাথা গুঁজবার ঠাঁই পেয়েছে আর পাঁচ লক্ষাধিক শরণার্থী তাড়াহুড়ো করে তোলা চালায় আশ্রয় নিয়েছে। বাকি সব উন্মুক্ত আকাশ বা গাছের তলায়। প্রতিদিন জনস্রোতের মত শরণার্থীর দল চলে আসছে এপারে। নিচে জল-কাদা, উপরে বর্ষার ধারা। এই ছত্রহীন লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর কি দশা হবে এখন? মাথা গুঁজবার জন্যে তারা কোথায় যাবে? নাম তালিকাভূক্ত হবার পর চার দিনের মতো রেশন পায় তারা। বাকি ক’দিন কি দিয়ে উদরের জ্বালা নিবৃত্তি হবে তাদের?

তার উপর মহামারীর আকারে কলেরার প্রাদুর্ভাব। সর্বস্বান্ত হয়ে সুদূর পথ অতিক্রম করে যারা আসছে পথেই তারা প্রায় অর্ধ্মৃত হয়ে পড়ে। কোন প্রকারে মুমূর্ষ অবস্থায় এসে পৌঁছাবার পরেও যদি আবার তাদের চরম প্রতিকূল অবস্থারই মধ্যে পড়তে হয় তবে অবশিষ্ট প্রাণ শক্তিটুকুও নিঃশেষ হতে দেরি হয় না। হচ্ছেও তাই। কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়েই অনেকে আসছে এপারে; প্রয়োজনের তুলনায় চিকিৎসা ব্যবস্থা এতই অপ্রতুল যে তাদের মধ্যে অনেকেই প্রাথমিক চিকিৎসা পাবার আগেই চোখ বুঁজে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। উপযুক্তসংখ্যক চিকিৎসক এবং শুশ্রূষাকারীরাও যেমন নেই তেমনি প্রয়োজনীয় ঔষধপত্রেরও অভাব।

এমন একটা গুরুতর পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকারের তৎপরতার নমুনা দেখে অবাক হতে হয়। এ যাবত ত্রাণ কার্যের জন্য কেন্দ্রের কাছ থেকে এসেছে মাত্র ৩ কোটি ৫৭ লক্ষ টাকা। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বাবদ চাওয়া হয়েছে ২ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা; কিন্তু তা এখনো পর্যন্ত পৌঁছায়নি। আশ্রয়স্থল নির্মাণের জন্য ৩ কোটি টাকা চেয়ে পাওয়া গেছে মাত্র কোটি টাকা। কলেরা মহামারী আকারে দেখা দেওয়ায় কলেরা ইঞ্জেকশান ও স্যালাইন বোতল চেয়ে পাওয়া গেছে তা সমুদ্রে বারি বিন্দুবৎ। সুতরাং দায়িত্ব পালনে কেন্দ্রীয় সরকার এ যাবত যে কৃতিত্ব দেখিয়েছে তাতে কৃতার্থ না হয়ে পারা যায় না।

মুখে শরনার্থীদের জন্য দরদের অন্ত নেই। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের অমার্জনীয় ঔদাসীন্যের ফলে হতভাগ্য শরণার্থী ও পশ্চিমবঙ্গের নিরুপায় মানুষ উভয় কুলই যে ডুবতে বসেছে সে দিকে নজর আছে কার? কানে জল ঢুকলে টাকা হয়তো তারা কিছু দেবেন। কিন্তু টাকা দিলেই জিনিস মিলবে এমন নিশ্চয়তা কোথায়? রেশন দিলেও তো তা রেঁধে খেতে হবে। শরণার্থীরা জ্বালানীর জন্য কার কাছে যাবে? সীমান্তবর্তী এলাকার যে সব শিক্ষায়তনে শরণার্থীদের ঠাঁই দেয়া হয়েছে দু’তিন সপ্তাহ বাদে গ্রীষ্মের ছুটি অন্তে যখন বিদ্যালয় খুলবে তখন এরা যাবে কোথায়? অন্যত্র না সরালে জেলার বহু ছাত্র-ছাত্রীর পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যাব। সুতরাং তাদের জন্যও নতুন আশ্রয় শিবির নির্মাণ করা দরকার। তাছাড়া যে বহু লক্ষ শরণার্তী বাতাবরণহীন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে অবিলম্বে তাদের তাঁবুর ছাউনী না করলে দারুণ বর্ষায় কি করে বাঁচবে তারা? সুতরাং আশ্রয় শিবির নির্মাণের জন্য চাই তাঁবু, করোগেটের শীট, অ্যাসবেস্টেস শীট, খুঁটি, নাটবল্টু, দড়িদড়া ইত্যাদি।

আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ঢিলেঢালাভাবে করার করার কাজ নয় এটা। জরুরী প্রয়োজন বোধে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় অতি দ্রুত সারতে হবে এসব কাজ। তার জন্যে চাই একটি সার্বিক পরিকল্পনা ও সেই পরিকল্পনা ত্বরিতগতিতে রূপায়ণের জন্য চাই একটা উপযুক্ত পরিচালনাযন্ত্র। বর্তমান অবস্থায় ত্রাণকার্যে সামরিক ব্যাপৃত রাখ হয়তো সঙ্গত হবে না, কিন্তু সে ধরনের দক্ষতাসম্পন্ন একটা বিশেষ ‘কোর’ গঠন করা এই জরুরী কাজ দ্রুত নিষ্পন্ন না করলে রাজ্য সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয় এত বড় দায়িত্ব বহন করা। অতএব কেবল অর্থ দিয়ে সাহায্য করলেই চলবে না, প্রয়োজনীয় সামগ্রীও কেন্দ্রীয় সরকারকেই সরবরাহ করতে হবে এবং শরণার্থীদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও মূলত তাকেই নিতে হবে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩১৭। বাংলাদেশের ব্যাপারে শুধু বিশ্ববিবেক নয়, দেশের বিবেকও জাগাতে হবে যুগান্তর ৬ জুন, ১৯৭১

Kamol Roy
<১৪, ৩১৭, ৭৯৬-৭৯৮>

বাংলাদেশের ব্যাপারে শুধু বিশ্ববিবেক নয়,
দেশের বিবেকও জাগাতে হবে

গত সোমবার কল্যাণসুন্দরম লোকসভায় মন্তব্য করেন- ভারত সরকার পাকিস্তানকে তুষ্ট করে চলেছে। এ কথায় শ্রীমতি গান্ধী খুবই মর্মাহত হয়েছেন। এখন সিপিআই নেতা চেমবারলিনের কুখ্যাত মিউনিখ নীতির সঙ্গে ভারত সরকারের পাকিস্তান নীতির তুলনা টানবেন এমন কথা প্রধানমন্ত্রী বোধহয় কল্পনাও করেননি। তিনি খুব জোরের সঙ্গে এই মারত্মক অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তবে, “আমরা বাংলাদেশের ঘটনাবলী সম্পর্কে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণে তৎপর রয়েছি”- এর চেয়ে বড় কোন আশ্বাসও প্রধানমন্ত্রী সেদিন দিতে পারেন নি।

মে মাসের মাঝামাঝি প্রধানমন্ত্রী ঘোষনা করেছিলেন- নীতি সংক্রান্ত ব্যাপারে ভারত অন্যান্য দেশের মনোভাবের উপর নির্ভরশীল নয়; সে নিজেই নিজের নীতি স্থির করে থাকে। কিন্তু তবু বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার বর্বর অত্যাচার শুরু হওয়ার পর থেকে আমাদের সরকার যে কূটনীতিক স্তরে খুবই তৎপর হয়ে ওঠেনি- এমন কথা কেউ বলতে পারবেন না। বিভিন্ন দেশের রাজধানীর সঙ্গে নয়াদিল্লী নিয়ত সংযোগ রক্ষা করে চলেছে। অন্যান্য দেশের সরকারের সঙ্গে ‘নোট’ বিনিময় করাও হয়েছে। ইয়াহিয়া ভারতের উপর কী বিপুল সমস্য চাপিয়ে দিয়েছেন তার ফল কী দারুণ বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াতে পারে- আমরা ঐসব দেশকে সে কথা বোঝাবার চেষ্টা করেছি।

আমরা আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বিদেশে পাঠিয়েছি। তিনি কয়েকটি দেশে গিয়ে বাংলাদেশের সমস্যা বুঝিয়ে বলবেন। শিল্পোন্নয়ন মন্ত্রী শ্রী মঈনুল হক চৌধুরী ইতিপূর্বেই ঐ কাজ কিছুটা সেরে এসেছেন। একই কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন শ্রম ও পুনর্বাসন মন্ত্রী শ্রী খাদিল কর। কূটনীতিক কাজে তিনি এত ব্যস্ত যে শরণার্থীদের দেখাশোনার কাজটা তিনি তার অধিনস্তদের হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশের বিষয়ে নয়াদিল্লীর বক্তব্য দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিকে বুঝিয়ে দিয়ে তাদের আমাদের পক্ষে নিয়ে আসার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী শ্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়।

বাংলাদেশ নিয়ে আমরা যে প্রবল কূটনীতিক অভিযান শুরু করেছি, তা আগে আর কখনো দেখা যায়নি। যে সব দেশে আমাদের প্রতিনিধিরা যাচ্ছেন, তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই পাকিস্তান কূটনীতিক সম্পর্ক আছে। তাদের নিজস্ব গোয়েন্দা বিভাগও আছে; এবং আছে, তাদের নিজস্ব অর্থ। আড়াই মাস ওদের লোকেরাও ইয়াহিয়ার রক্ত ক্ষুধার তান্ডব স্বচক্ষে দেখেছেন। তবু আমাদের সরকার অতি আশায় বোধ হয় ভাবছেন- ভারত গিয়ে ওদের ব্যাপারটা ঠিকমত বুঝিয়ে দিলেই ওদের বিবেক একেবারে পরিস্কার হয়ে যাবে এবং ওরা ভারতের পক্ষে চলে আসবে।
ফল যা-ই দাঁড়াক বিশ্ব-বিবেক জাগ্রত করার এই প্রয়াসের জন্য ভারত সরকারের সাধুবাদ অবশ্য প্রাপ্য। কিন্তু ভারতের যে সব রাজ্য সরাসরি শরণার্থী সমস্যা দ্বারা পীড়িত হচ্ছে না, তাদের বিবেক জাগানোর চেষ্টা যথেষ্ট রকম হয়েছে কি? শ্রীমতি গান্ধী তার সহযোগী মন্ত্রীদের কিংবা সর্বশক্তিমান রাজনীতি বিষয়ক কমিটির বিবেকই কি জাগাতে পেরেছিলেন?

শরণার্থীদের ঠাঁই দেওয়ার ব্যাপারে অধিকাংশ রাজ্যের যা মনোভাব তাতে মনে হয় বিদেশে দূত না পাঠিয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের বিবেক জাগ্র করা এবং পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয় রাজ্যে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর সমাবেশ ভারতের পক্ষে কী সংকট ডেকে এনেছে তা বুঝিয়ে বলার জন্য বিভিন্ন রাজ্যে দূত পাঠালেই ভাল হতো।

এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে নয়াদিল্লী যখন সিদ্ধান্ত নেয় যে শরণার্থীদের সীমান্তের কাছাকাছিই রেখে দেওয়া হবে, তখন তাছাড়া অন্য তেমন কিছু করারো ছিলনা। পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের যত্ন-আত্তি করার জন্য গড়ে তোলা কেন্দ্রীয় পুনর্বাসন দফতর পূর্বাঞ্চলের উদ্বাস্তু সমস্যার প্রকৃত অবস্থা পরিমাপ করে তদানুযায়ী পরিকল্পনা তৈরি করবে- এমন আশাও দুরাশা। সীমান্তের দূরবর্তী কোন রাজ্যকে একজন শরণার্থীকে ঠাঁই দেওয়ার জন্যও রাজী করানো যায়নি। শরণার্থীদের অন্য নিয়ে যাওয়া সম্পর্কে কলকাতায় বসে প্রধানমন্ত্রীর দ্বিধাগ্রস্ত ঘোষনা থেকেই বোঝা যায় যে, তিনি অন্যান্য রাজ্যের মনোভাব পাল্টাতে সক্ষম হননি।

পশ্চিমবঙ্গের প্রাণান্তকর সমস্যা সম্পর্কে ভারত সরকার কী করতে চান- গত সপ্তাহে রাজনীতি বিষয়ক কমিটির একজন সদস্যকে এ প্রশ্ন করেছিলাম। উনি বললেন কিসের সমস্যা? ভারত সরকারতো উস্বাস্তুদের সব ব্যয় বহন করছে, সুতরাং পশ্চিমবঙ্গের কোন অভিযোগ থাকার কথা নয়। মোট শরণার্থীর মাত্র এক-তৃতীয়াংশ সরকারী সাহায্য নিচ্ছে অন্যেরা পশ্চিমবঙ্গের মানুষের গলগ্রহ হতে বাধ্য হয়েছে- একথা তিনি মানতে নারাজ। উনি বললেন- পশ্চিমবঙ্গ যদি মনে করে যে বোঝা খুব ভারী হয়ে পড়ছে, তাহলে সীমান্ত পুনরায় বন্ধ করে দেয়া যেতে পারে; কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ কি তা মেনে নেবে? ওঁর কথায় মনে হয়, সমস্যা যেন পশ্চিমবঙ্গেরই। ওঁর বক্তব্যের সঙ্গে ভারত সরকার যে ‘স্টান্ড’ নিয়েছেন তার সঙ্গতি আছে কিনা সেটা তিনি তলিয়ে দেখনি। রাজনীতি বিষয়ক কমিটিতে এ বিষয়ে শুধু ওঁর একারই মনোভাব নয়।

এই উপমহাদেশে রাজনীতিক মন্থনের ফলে অমৃত এবং বিষ দুইই উঠছে; পশ্চিমবঙ্গের ভাগ্যে শুধু বিষটাই জুটছে। সামাজিক ও আর্থিক বিপর্যয়েও রাজ্য ক্ষয়ের মুখে; হাঁড় পাঁজরা যে কখানা আছে তা বোধ হয় মহামারীর জন্য রেখে দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ একেবারে নিঃশেষ হয়ে গিয়ে বিদেশে চা-পাট পাঠানো বন্ধ করে দেশের জন্য বিদেশী মুদ্রা নিয়ে আসা বন্ধ না করা পর্যন্ত বোধ হয় কেন্দ্র বা স্বচ্ছল রাজ্যগুলির হুঁস হবে না।

শরণার্থী সমস্যা নিয়ে যেসব রাজ্যের গায়ে আঁচড় লাগছে না তাদের বড় চিন্তা পশ্চিমবঙ্গের ভড়াডুবির নয়; তাদের চিন্তা শরণার্থীদের জন্য অনেক টাকা খরচ করতে হলে চতুর্থ যোজনার কাজ বানচাল হবে এবং তার ফলে তাদের উন্নতি শ্লথ হয়ে পড়বে। আন্তর্জাতিক সমস্যাদির ব্যাপারে প্রত্যেক রাষ্ট্রই নিজস্ব স্বার্থের দিকটি বজার রেখে অগ্রসর হয়ঃ তেমনি বাংলাদেশের সমস্যার মত অবস্থায় ভারতের রাজ্যগুলিও নিজেদের স্বার্থের কথাটাই আগে ভাবছে। শ্রী সিদ্ধার্থশংকর রায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধি। তিনি বোধ হয় বাংলাদেশের ব্যাপারে বিদেশে না গিয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজধানীতে একবার ঘুরে এলে ভালো করতেন। তিনি মন্ত্রিসভায় তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনায়ও তাঁর সময়টা কাজে লাগাতে পারতেন। স্বদেশে অনেকের মত পাল্টাবার প্রয়োজন রয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনীতি সমস্যার ব্যাপারেও আমরা বোধ হয় উলটপুরাণ গাইছি। শ্রীমতি গান্ধী কলকাতায় বলেছেন, পাকিস্তান ভেঙ্গে যায় ভারত চায় না। ২৫ মার্চের আগ পর্যন্ত এটাই ছিল ভারতের মনোভাব। কারণ বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন হলে ভারতের ছদ্মসামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় গভীর প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়ে পারে বলে ভারত ভীত ছিল। যাই হোক, ইয়াহিয়া আক্রমণ শুরু করার পর ভারতের মনোভাবে মৌলিক পরিবর্তন এসেছে বলে মনে হয়েছিল। বাংলাদেশের সংগ্রামের যথার্থতা অন্যদের বুঝিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে যাদের উপর আমরা নির্ভর করে চলি আমরা কি তাদেরই চিন্তাভঙ্গি গ্রহণ করে বসে আছি?

ভারত সরকারের বিশ্বাস আর মাস তিনেকের মধ্যে পাকিস্তান আপনা থেকে ধসে পড়বে। এক দিকে যুদ্ধের বিপুল ব্যয়, অন্যদিকে বাংলাদেশের পাট চা বিক্রি করে বিদেশী মুদ্রা ঘরে আনা বন্ধ- এই দুইয়ে মিলেই পাকিস্তানের ধ্বংস আনিবার্য করে তুলবে বলে বলা হচ্ছে। তা যদি হয়, তাহলে ভারতকেও শুধু দেখতে হবে যে পাকিস্তান যেন বিদেশী সাহায্যের দ্বারা আর্থিক সংকট কাটিয়ে উঠতে না পারে। ভারতের দূরদেশ বিদেশ পরিক্রমার সেটাও অন্যতম লক্ষ্য।

নিরাপদের শরণার্থীদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবার ব্যাপারে ভারত কী করতে পারবে তা বোঝা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের মুখপাত্রদের বক্তব্যঃ আগামী মাস তিনেকের মধ্যে পাকিস্থানী সৈন্যদের বাংলাদেশ থেকে হটিয়ে দিতে না পারলে ওদের বোধ হয় আর কখনোই হটানো যাবে না। তার অর্থ শরণার্থীদেরও ঘরে ফেরা হবে না।

এটা হয়তো মুক্তি ফৌজের অনেকের সাময়িক আশাভঙ্গ জনিত বক্তব্য; কিন্তু তবু এ বক্তব্যের দিকে ভারতকে কান দিতেই হবে।

তাছাড়া নয়াদিল্লীকে হয়তো পশ্চিমবঙ্গের ধ্বংস দেখতে হবে। তা যদি হয়, তাহলে দেশের অর্থনীতিতে তার ধাক্কা পড়বে প্রচন্ড ভাবেই। শ্রী অজয় মুখোপাধ্যায় ওয়ারনিং দিয়েছেন যে, তিনি হয়ত পদত্যাগ করতে বাধ্য হবেন। তিনি যাতে তাড়াহুড়ো করে কিছু না করে বসেন সে ব্যাপারে ভারত সরকার কি করেন বা না করেন, তার উপর এই পশ্চিমবঙ্গ সরকার শেষ পর্যন্ত কি করবেন বা না করবেন তা নির্ভর করবে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩১৮। সোয়েলের কাছে বাংলাদেশের স্বীকৃতি প্রশ্নটি ভাবাবেগজাতঃ সংখালঘুদের জাতীয় কনভেনশনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। কালান্তর ৬ জুন, ১৯৭১

Kamol Roy
<১৪, ৩১৮, ৭৯৯>

সোয়েলের কাছে বাংলাদেশের স্বীকৃতি প্রশ্নটি ভাবাবেগজাতঃ সংখালঘুদের জাতীয় কনভেনশনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ।

লক্ষৌ, ৬ জুন (ইউএনআই)- কাওয়াস বাগ বারাদরীতে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলির জাতীয় কনভেনশনের আজ সকালে উদ্বোধন হয়। লোকসভার সহকারী অধ্যক্ষ জি এস সয়েল বলেন, বাঙ্গালদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়াটাই শেষ কথা নয়। যদিও সম্মেলনের উদ্যোক্তাদের অন্যতম দাবি হলো অবিলম্বে স্বীকৃতি দান।

কনভেনশনের কাছে যারা শুভেচ্ছা বানী পাঠিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী তাদের অন্যতম। তিনি ঐ প্রশ্নের সরাসরি জবাব এড়িয়ে বাংলাদেশের সম্পর্কে ভারত সরকারের সিদ্ধান্তগুলি সমর্থন করে সরকারের হাত শক্ত করার আহবান জানিয়েছেন।

সহকারী অধক্য শ্রী সোয়েল অবশ্য এরকম একটা আভাস দিয়েছেন যে পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী শরণ সিং এর প্রত্যাবর্তনের পর বাংলাদেশের স্বীকৃতি দান সম্পর্কে একটা সিদ্ধান্ত হতে পারে। শ্রী সিং বিশ্বের বিভিন্ন রাজধানীতে ভারতের অভিমত জানাতে ও জানতে গেছেন।

বক্তৃতা প্রসঙ্গে সোয়েল বলেছেন বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতির প্রশ্নটি একটি ভাবাবেগজাত। তার ধারণা এর দ্বারা ভারত পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তার ফাঁদে পা দেবে। কারণ পশ্চিম পাকিস্তান সমগ্র বিষয়টি সাম্প্রদায়িক রূপ দিতে চায়। সে জন্য শ্রী সোয়েলের পরামর্শ হলো “বাংলাদেশের স্বীকৃতি” যা আদৌ শেষ কথা নয় তার জন্য উন্মুখ হয়ে না থেকে চরম লক্ষত সার্বভৌমতা, শান্তি ও সমৃদ্ধি কিভাবে অর্জন করা যায় সে জন্য কাজ করা।

কনভেনশনের উদ্বোধন করে কেন্দ্রীয় খাদ্য ও কৃষিমন্ত্রী ফখরুদ্দিন আলী আহমেদ বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারত সরকারের নীতি ব্যাখ্যা করে বলেন, এ লড়াই অবাঙ্গালী বা অমুসলমানদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম নয়। একটা সামরিক রাজত্বের বিরুদ্ধে সমগ্র জনতার সংগ্রাম।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩১৯। রাজনৈতিক সমাধানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধানের চার দফা পূর্বশর্ত কালান্তর ৬ জুন, ১৯৭১

Kamol Roy
<১৪, ৩১৯, ৮০০-৮০১>

রাজনৈতিক সমাধানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধানের চার দফা পূর্বশর্ত

কলকাতা, ৬ জুন- আজ স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্র প্রধান নজরুল ইসলাম চার দফা নূন্যতম পূর্বশর্ত উপস্থাপিত করে জানিয়েছেন, ইয়াহিয়া সরকার ঐ শর্তাবলী মেনে নিলে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব।

এই শর্তগুলি হলঃ (১) বাংলাদেশ অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবর রহমান এবং কারান্তরালে নির্বাসিত অপরাপর গণপ্রতিনিধিদের বিনাশর্তে মুক্তিদান; (২) অবিলম্বে পাক হানাদের বাহিনীর বাংলাদেশ ত্যাগ; (৩) বাংলাদেশের স্বাধীন, গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারের স্বীকৃতি; (৪) বাংলাদেশে সামরিক তান্ডবের ফলে লুন্ঠিত সম্পদ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কোন আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক নিরুপণ করে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দান।

আজ “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র” কর্তৃক প্রচারিত সৈয়দ নজরুল ইসলামের দেশবাসীর উদ্দেশ্যে এক বেতার ভাষণে ঐ শর্তগুলি তুলে ধরা হয়েছে।

সৈয়দ ইসলাম পুনরায় ঘোষনা করেন, যদি কেউ রাজনৈতিক সমাধান বলতে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের পুনর্জীবনের কথা মনে করেন তাহলে তিনি মূর্খের স্বর্গে বাস করেন। “লাখো শহীদের রক্তে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান মরে গেছে, তাকে আর বাঁচানো যাবে না। সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী কোন গোঁজামিলের সমস্যা সমাধান মেনে নেবে না।”

সাম্প্রদায়ীকতা আর মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না

তিনি বাংলাদেশের জনগনকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, “যে অস্ত্রকে সম্বল করে পশ্চিমা শাসকরা পাওনাদের ২৩ বছর ধরে শোষণ করেছে, সেই সাম্প্রদায়িকতার অস্ত্র তারা আবার শানাচ্ছে।”

তিনি দৃপ্তকন্ঠে ঘোষণা করেন, “বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা আর মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না।”

তিনি জানান ২৩ বছর ধরে আমরা বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলমান-খৃষ্টান-বৌদ্ধ এক সঙ্গে শোষিত হয়েছি আবার এখন একসঙ্গে লড়ায় করছি। “জঙ্গীশাহী মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডা ধ্বংস করেছে, খুন করেছে ডঃ গোবিন্দ চন্দ্র দেবকে, ডাঃ ফজলুর রহমানকে, ক্যাথলিক ফাদার তিনজনকে, বৌদ্ধ ভুক্ষুদের।
‘একশ্রেণীর ভাড়াটিয়া দালাল’ বাংলাদেশে যে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াচ্ছে তার উল্লেখ করে তিনি দৃঢ় ভাবে জানান, “কোন দুস্কৃতকারী যদি মানুষে মানুষে বিভেদ ও শান্তিপ্রিয় জনগণের প্রাণ বিপন্ন করে তাহলে তখনই খবর দেবেন- আমাদের মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেবেন, ঐ সকল দুস্কৃতকারীদের দেখামাত্র কঠোর সাজা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”

ভারত ও ব্রহ্মদেশ সরকারকে অভিনন্দন
বাংলাদেশের ৪০ লক্ষ শরণার্থীকে ভারতে এবং ৫০ হাজার শরনার্থীকে ব্রহ্মদেশে আশ্রয়দানের জন্য তিন ভারতের “জনগণ, রাজনৈতিক জনগণ ও সরকারকে” এবং ব্রহ্মদেশ সরকারকে অভিনন্দন জানান।
তিনি বাস্তুচ্যুত শরণার্থীদের প্রতি ঐকান্তিক সমবেদনা জানিয়ে বলেন, হানাদারদের হটিয়ে দিয়ে বাংলাদেশ সরকার সসম্মানে দেশত্যাগী বাস্তুহারাদের ফিরিয়ে আনতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। “আপনারা বাংলাদেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে আপনাদের বাড়ি-ঘর সম্পত্তি ফিরে পাবেন।”

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩২০। অনাহারে পথশ্রমে অবসন্ন মৃতপ্রায় শরণার্থী দল আনন্দবাজার পত্রিকা ৮ জুন, ১৯৭১

Kamol Roy
<১৪, ৩২০, ৮০২-৮০৩>

অনাহারে পথশ্রমে অবসন্ন মৃতপ্রায় শরণার্থী দল
বিশেষ প্রতিনিধি

– স্যার, একবার বলে দিন, এই স্লিপ কোথায় গেলে রেশন পাব?

কলকাতা থেকে টাকি, টাকি থেকে হাসনাবাদ, হাসনাবাদ থেকে বসিরহাট, বসিরহাট থেকে বারাসাত, বারাসাত থেকে দমদম, তারপর লবণ হ্রদ, তারপর-? শত শত লোক, বৃদ্ধ বৃদ্ধা, যুবক যুবতী, কিশোর কিশোরী এবং শিশু এই একটি প্রশ্ন মুখে নিয়ে পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিভিন্ন শিবিরে এরা যাচ্ছে, প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে, আবার হাঁটছে, হাঁটছে মাইলের পর মাইল, হাঁটছে দিন রাত। তারপর অনাহারে পথশ্রম, যারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল, অবসন্ন তারা বসে পড়ছে পথের ধারে। মরছে।

কলকাতার প্রবেশদ্বারেই, সাহারা আশ্রয় শিবিরের সামনে অস্থিচর্মসার এক বৃদ্ধ একটি ভাঙ্গা বাড়ির হাড় পাঁজর বের করা দেওয়ালে হেলান দিয়ে নিষ্পলক চেয়ে আছেন আশ্রয় শিবিরের দিকে। না, এখন তার কোনও চাহিদা নেই, কারণ তিনি মৃত।

রবিবার কলকাতার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের কয়েকজন চিকিৎসক ডেকে আমাকে দৃশ্যটা দেখালেন। জানা গেল, ওই বৃদ্ধার পদযাত্রা শুরু হয়েছিল খুলনার এক গ্রাম থেকে, আর যাত্রা শেষ হল এই সাহারায়, কলকাতার দ্বারপ্রান্তে।

এ দৃশ্য আজ পশ্চিমবঙ্গের কোথায় নয়? এর, এই আর্ত, ক্ষুদিত, সাজানো সংসার উন্মুলিত লোকগুলো এইরকম দিশাহীন ঘুরছে কেন? মাড়োয়ারি রিলিফ সোসাইটির একজন মুখপাত্র বললেন, কী করব? আমাদের শিবিরগুলোর আর কাউকে আশ্রয় দেবার সামর্থ্য নেই। আমরা তাই নতুন লোককে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছি। আবার ঠিক কোথায় পাঠালে যে ওরা আশ্রয় পাবে, তাও জানিনে। তাই আমরা কোথাও পাঠাতেও পারছিনে।

মাড়োয়ারি রিলিফ সোসাইটি বসিরহাট মহকুমার দশটা আশ্রয় শিবির পরিচালনা করেছেন। রবিবার এই দশটা শিবিরে আশ্রয়প্রার্থীর মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লক্ষ ৮৮ হাজার ৭৩ জন।

ওঁরা যা হিসেব দিলেন তাতে জানা গেল, হাসনাবাদ শিবিরে ৩৫ হাজার, টাকু সৈন্যের বাগানে ৩০ হাজার, গোলপুকুরে ২৫ হাজার, বসিরহাট মেলাখোলায় ১৫ হাজার, মৈত্র বাগানে ৩৫ হাজার, মোগলপাড়ায় ১৫ হাজার, স্বরূপ নগরে ৫০ হাজার, নির্মানে ১৬ হাজার, তেঁতুলিয়া ১০ হাজার, কাটিয়াহাটে ১৫ হাজার। একুনে আড়াই লক্ষ। এর উপর আরও ৩৮ হাজার আশ্রয়প্রার্থীর ভার এদের নিতে হয়েছে সরকারের অনুরোধে।
ওঁরা জানালেন, ওঁদের উপর এত চাপ পড়েছে যে, ওদের ব্যবস্থা চাপের চোটে ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে। ওরা বেশ চিন্তিত। মাড়োয়ারি রিলিফ সোসাইটি কয়েকটা নির্ধারিত কেন্দ্র থেকে আশ্রয়প্রার্থীদের মধ্যে সরকারী বরাদ্ধ অনুসারে রেশন বিলি করেন। সরকারের বরাদ্দ দৈনিক মাথাপিছু ৪০০ গ্রাম চাল, ১০০ গ্রাম ডাল, ১৫০ গ্রাম আলু, ১৫০ গ্রাম পিয়াজ, ১৫০ গ্রাম লবণ। আশ্রয়প্রার্থীদের সপ্তাহে ছয়দিনের রেশন দেওয়া হয়। বিতরণের সুবিধার জন্য সোসাইটি নিয়ম করেছেন সপ্তাহে একদিন নির্দিষ্ট এলাকার আশ্রয়প্রার্থীর মধ্যে রেশন দেওয়া হবে। এতে বিশৃঙখলা কমেছে কিন্তু মানুষের দুর্দশা কমানো যায়নি। টাকির এক রেশন বিতরণ কেন্দ্রে বিকালের মুখে গিয়ে দেখি হাজার হাজার লোক রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছেন।

মাড়োয়ারি রিলিফ সোসাইটির পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত ৫ হাজার পরিবারকে বাসনপত্র দেওয়া হয়েছে এবং এছাড়া অনেককে কাপড় জামা ইত্যাদি। এছাড়া ওরা সীমান্ত অঞ্চলে ৫০ বেডের একটা হাসপাতালও খুলবেন।

বর্ষা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনটি সমস্যা প্রকট হয়েছে। যথাঃ (১) জ্বালানী, (২) শৌচাগার এবং (৩) পানীয় জল।

সরকার রেশন দেবার মালিক, জ্বালানী দেবার কেউ নয়। ফলে এতদিন আশ্রয়প্রার্থীরা নিজেরাই এপাশ ওপাশ থেকে তা সংগ্রহ করে নিচ্ছিলেন। এদিকে জঙ্গল নেই। ফলে এতদিন স্থানীয় গৃহস্থদের জিনিসেই হাত পড়েছিল। এবং পশ্চিমবঙ্গের লোক শত অসুবিধা সহ্য করেও শরণার্থীদের সাহায্য করে অতিথিবৎসলতার প্রশংসনী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কিন্তু এখন, এই বর্ষায় কি হবে? গৃহস্থরা নিজেরাই তো জ্বালানীর অভিযোগে ভুগবেন। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের উচিৎ অবিলম্বে শরণার্থীদের জন্য জ্বালানীর ব্যবস্থা করা। নাহলে ক্রমে জ্বালানীর অভাবে শরণার্থীদের হাঁড়িই যে চড়বে না, তাই নয়, আইন-শৃঙখলাগত শোচনীয় অবস্থার সৃষ্টি হবে।

রবিবার শিবিরের পর শিবিরে গিয়ে দেখেছি, নুন্যতম স্বাস্থ্য রক্ষার ব্যবস্থাই নেই। একে এইসব শিবিরে লোক সংখ্যার তুলনায় পায়খানার সংখ্যা শোচনীয়ভাবে কম, (আব্রু রক্ষার প্রশ্ন তুলছিই না) তার উপর বৃষ্টির জলে সেগুলো এখন থৈ থৈ, একেবারে অব্যবহার্য হয়ে উঠেছে। মাঠগুলোও ভেসে উঠেছে, জেগে আছে শুধু পাকা সড়ক। অতএব কিছুদিন পরে কি অবস্থা দাঁড়াবে, তা সহজেই অনুমেয়। এরপরে দুর্গন্ধে ওদিকে তিষ্ঠানো যাবে না।

এরই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পানীয় জল সরবারহের সংকট। এমন শিবিরও আছে যার লোক সংখ্যা ১৫ হাজারের উপর, কিন্তু মাত্র একটি টিউবওয়েল কাজ করছে। বাকিগুলো বিকল। পরিশ্রুত পানীয় জলের অভাব, শিবিরে সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি রক্ষার অবস্থান মারাত্মক সব রোগের সৃষ্টি করতে এবং সকলের জীবন বিপন্ন করে তুলবে।

ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের কয়েকজন চিকিৎসক গত কয়েকদিন ধরে যাহারা শিবিরে দল। বেঁধে আসছেন এবং প্রাণপণে চেষ্টা করছেন। সেবা করতে দেখে ভাল লাগল। ওদের মধ্যে দু’জন, ডঃ বিমল বসু এবং ডঃ নন্দ সরকার জানালেন, সাহারা শিবিরে (কাশী বিশ্বনাথ সেবা সমিতি শিবির পরিচালনা করছেন) গত সপ্তাহ থেকে তারা মহামারীর আকারে যে উদরাময়, চোখের রোগ, ব্রংকাইটিস, বসন্ত, হাম, এমনকি যক্ষ্মা রোগ দেখা দিয়েছে তার চিকিৎসা করছেন। তারা রেডক্রস, ক্যালকাটা কেমিক্যালস, হাওড়া লায়ন্স ক্লাব, দেজ মেডিক্যাল, স্ট্যাডমেড, ইস্ট ইন্ডিয়া ফারমাসিউটিক্যালস প্রভৃতি সংস্থার কাছ থেকে কিছু ওষুধপত্র পেয়েছেন তাতে প্রয়োজন মিটছে না। সরকারের কাছে আবেদন নিবেদন করেও এ পর্যন্ত তারা কোনও সাহায্য পাননি। সময়মত সাহায্য পেলে তারা অনেক জীবন বাঁচাতে পারতেন।

বর্ষা শুরু হতে না হতেই সমস্যার তীব্রতা এবং ব্যাপকতা এইভাবে বেড়ে চলেছে। যার পরিণতি লক্ষ লক্ষ ঘরছাড়া শরণার্থীদের ঠেলে নিয়ে চলেছে একটি মার লক্ষে মৃত্যুর দুয়ারে।

এর বিকল্প কি? বিভিন্ন শরণার্থীকে সারাদিন ধরে জিজ্ঞাসা করেছি। ওরা বলেছে দেশে ফিরে যাওয়া। ওরা বলেছে আমরা ঘরে ফিরতে প্রস্তুত। আপনারা আমাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে দিন।

নিরাপত্তার ব্যবস্থা বলতে কি বোঝাতে চান? কী চান আপনারা? রামপালের ছাত্র কালিদাস রায়, শিক্ষক বিকাশ চন্দ্র সরদার, গ্রামের মাতব্বর বিজয়কৃষ্ণ মন্ডল- সারাদিন তারা রেশিন নেয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন, সারাদিন ধরে বৃষ্টিতে ভিজছেন, ক্লান্ত তারা, অবসন্ন একবাক্যে বললেন, মুজিবের সরকার, একমাত্র মুজিবের সরকার হলেই বাংলাদেশ স্বাধীন হলেই আমরা নিরাপদ হব। ঘরে ফিরে যাব।”

এজন্য প্রয়োজনে তারা অস্ত্র ধরবেন। যদি তাদের এ কাজে লাগানো হয়, তবে এই দন্ডেই তারা রেশনের লাইন ছেড়ে চলে যাবেন। প্রাণ বলি দিতে তারা প্রস্তুত।

প্রশ্ন এই, এ ব্যবস্থা কে করবেন? আগে করা হবে কি? হলে এই তো সময়, কেননা জীবনীশক্তি কিছু এখনো অবশিষ্ট আছে। যত দেরি হবে, মৃতের স্তুপে ভারত ততই ভরে যাবে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩২১। চিকিৎসা সামগ্রী প্রেরণের জন্য জরুরী বিমান হিন্দুস্তান স্ট্যান্দার্ড ৮ জুন ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ৩২১, ৮০৪- ৮০৫>

“হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, জুন ৮, ১৯৭১
চিকিৎসা সামগ্রী প্রেরণের জন্য জরুরী বিমান

জেনেভা: জুন ৭ – বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) আজকে ঘোষণা করে জরুরি ঔষধ সরবরাহ বিমানযোগে ভারতে পাঠানো হবে সেখানকার পূর্ব বাংলার শরনার্থিদের কলেরার মহামারির জন্য। বিদেশী এবং ভারতীয় সংবাদ সংস্থা থেকে প্রাপ্ত রিপোর্ট।

WHO সপ্তাহ শেষে জানায় মত ২ টন ভ্যাকসিন প্রাথমিক ভাবে গেনেভা ত্যাগ করেছে। বিমানযোগে আগামী ৮ থেকে ১০ সপ্তাহের মধ্যে মোট ৩০ থেকে ৪০ টন সাপ্লাই করা হবে বলে তিনি জানান।

বিবিসি, WHO এর বরাত দিয়ে জানায় ইতোমধ্যে ৩০০০ ইস্ট পাকিস্তানের উদ্বাস্তু কলেরা এবং gastroenteritis এ মারা গেছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয় যে আরও প্রায় ১০০০০ শরণার্থী আক্রান্ত হয়েছ।

U.N. খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মহাপরিচালক বলেছেন, ১২১ -জাতির সংগঠন সম্পূর্ণরূপে পাকিস্তান ও ভারতের জন্য জরুরি খাদ্য সাহায্যের জন্য যে চাহিদা তা পূরণ করতে পারবেনা। জনাব Addeke এইচ নেদারল্যান্ড Boerma বলেন যে পরিমাণ চাহিদা সেখানে আছে তা এফএও এর সামর্থ্যের বাইরে।

ব্রিটেন, আজ ভারতে পূর্ব বাংলার কলেরা ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ওষুধ ও খাদ্য দ্রব্যের একটি বড় বিমান পাঠিয়েছে। আরএএফ বিমান খুব শীঘ্র কলেরা টিকার সিরিঞ্জ এবং অন্যান্য উপাদানের বিনামূল্যের সরবরাহ অবিলম্বে নিয়ে যাবে ।

ফরেন অফিস গতকাল জানায় এর বাইরেও এক মিলিয়ন ডলারের ইতিমধ্যে U.N. আপীল তহবিলে জমা পড়েছে এবং ৭৫০০০০ খাদ্য সহায়তা জমা পড়েছে।

প্রথম চারটি আরএএফ বিমান অক্সফাম থেকে 6 টন চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে মঙ্গলবার কলকাতা পৌঁছাবে। মঙ্গলবার ভোরে একটি মোবাইল হাসপাতাল পৌঁছাবে। দাতব্য কর্মচারীবৃন্দ এবং ডাক্তার ও নার্স বুধবার পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

জাপানি সরকার আজ রাতে পূর্ববাংলার উদ্বাস্তু দের জন্য ভারতে 3 মিলিয়ন ডলার ত্রাণ সহায়তার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই টাকায় জাপান থেকে চাল কেনার জন্য ব্যবহার করা হবে। জাপানি প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর উত্তরের অপেক্ষায় আছেন।
প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস বলেছেন ফিলিপাইনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতের লাখ লাখ শরণার্থী সমস্যার উপর মিসেস গান্ধীর কাছ থেকে পাওয়া একটি চিঠি মনোযোগে নিচ্ছে।

পশ্চিম জার্মান রেড ক্রস আজ বলেছেন তারা ১০০০ তাঁবু, ১৫ টন বেবি ফুড, চিকিৎসা সরঞ্জাম এর ত্রাণ চালান এবং ১৩০০০ মার্ক (প্রায় £ 35,630) এর খাদ্যদ্রব্য পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের জন্য কলকাতায় পাঠাচ্ছেন আগামীকাল।

এয়ার ইন্ডিয়া আজ ২৩৬ প্যাকেট ত্রাণ কলকাতায় আনে। এগুলোর মধ্যে কলেরা ভ্যাকসিন, সিরিঞ্জ , ওষুধ ও গুঁড়োদুধ আছে বাংলাদেশএর শরনার্থিদের জন্য। জানা যায় গুড়োদুধ অস্ট্রেলিয়া এসেছে এবং বাকি জিনিসগুলো আমেরিকা থেকে।

কোপেনহেগেন থেকে ইউনিসেফ চার্টার্ড বোয়িং 707 ফ্লাইট পূর্ববাংলার শরণার্থীদের জন্য জরুরী চিকিৎসা সরবরাহের প্রায় ৩২ টন নিয়ে কলকাতা বিমানবন্দরে আগামীকাল বিকেলে পৌঁছাবে। এর মধ্যে চিকিৎসা সরঞ্জাম ওষুধ, আঠালো প্লাস্টার, গজ ব্যান্ডেজ, সিরিঞ্জ এবং সূঁচ অন্তর্ভুক্ত।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩২২। আই পি আই বৈঠকে বাংলাদেশ প্রশ্ন উঠতে পারে হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড ৮ জুন ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ৩২২, ৮০৬>

হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, ৮ জুন ১৯৭১
আই পি আই বৈঠকে বাংলাদেশ প্রশ্ন উঠতে পারে
– তারাপদ বাসিল

হেলসিংকী, ৭ জুন – যদিও মনে হচ্ছে যে সিঙ্গাপুরের প্রেসের অনুষ্ঠান- ২০ তম আন্তর্জাতিক প্রেস ইনস্টিটিউটের সাধারণ পরিষদ- যা আজ সকালে শুরু হয়েছে, সেখানে কোন সন্দেহ নেই যে পূর্ববাংলার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কও এখানে আসবে। তারা স্বেচ্ছাসেবকদের দ্বারা গতকাল সানডে টাইমসে সম্প্রচারিত ছবিগুলির নিয়ে দীর্ঘ বিতর্কের পর প্রতিনিধিদল এবং অন্যান্যদের দ্বারা অনানুষ্ঠানিকভাবে ভারতীয় ও পাকিস্তানি প্রতিনিধিদল আলোচনা করেছে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রকাশক এবং অন্যান্যদের এই বার্ষিক সমাবেশের তাত্পর্যপূর্ণ উল্লেখ করে শুভেচ্ছা জানানো হয়, কমিউনিস্ট দেশগুলির বাইরে গণমাধ্যমের বর্তমান পরিস্থিতির উপর মতামত বিনিময় এবং নোট গ্রহণ করা হয়। ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী, জনাব আলী কারজালানিনিন, যিনি দেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতিও ছিলেন – তিনি অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী ভাষণ দেন।

সিঙ্গাপুরে প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ ৯ জুন “বিশ্ব নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিতে গণমাধ্যম” বিষয়ে বক্তৃতা দেবেন এবং প্রতিনিধিদের একটি বড় অংশের সাথে তার আলোচনা হবে বলে আশা করা হচ্ছে যেহেতু অনেক প্রতিনিধিরা তার কাজের সমালোচনা করেছেন।

জনাব অশোক কুমার সরকার ও অন্যান্য ভারতীয় প্রতিনিধিদের বার বার ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক এবং বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় জিজ্ঞেস করা হয়েছে।

আইপিআই চক্র সাধারণত দুটি পয়েন্ট বিশ্বাসী বলে মনে হয়; (১) পূর্ব বাংলায় সন্ত্রাসের কারণে শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়, এবং (২) তারা পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যাবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তা পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

কিছু পাকিস্তানী প্রতিনিধি ভারতের প্রেসকে দায়ী করার চেষ্টা করে বলার চেষ্টা করছে যে তারা পূর্ব বাংলার বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী। এই ধরনের প্রচেষ্টা শুধু ভারতীয় প্রেস প্রতিনিধিদের দ্বারাই নয়, বরং অন্যদের দ্বারাও প্রতিবাদ করা হবে – যেমন সানডে টাইমস এর সাংবাদিকদের কোন সন্দেহ নেই যে সামরিক শাসক যা করছে তার জন্য শুধুমাত্র ইয়াহিয়া খান দায়ী।

মস্কোতে গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রী সরণ শিং এর সফর এবং বন, প্যারিস, ওটাওয়া, ওয়াশিংটন ও লন্ডন সফরের খবর এবং হেলসিংকি ও অন্যান্য স্ক্যান্ডিনেভিয়ান রাজধানীতে টেলিভিশন অনুষ্ঠানের কথা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। পূর্ববাংলার পরিস্থিতি গুরুতরভাবে ধীরে ধীরে বিদেশে উপলব্ধ হচ্ছে। তাই আইপিআই সাধারণ পরিষদে কিছু পাকিস্তানি প্রেস প্রতিনিধিদের বিশ্বপ্রেসকে ভুল দিকে পরিচালিত করার প্রচেষ্টা করবে এবং পূর্ব বাংলা থেকে তাদের দৃষ্টি অন্য দিকে সরানোর চেষ্টা করবে। পাকিস্তানি প্রচারণা থেকে কিছু প্রতিনিধি ইতিমধ্যেই ভুল ধারণা নিয়ে ফেলেছেন – পাকিস্তানি প্রেসের কয়েকজন সদস্যও ব্যক্তিগতভাবে স্বীকার করেছেন যে তাদের প্রচেষ্টা এখানে ব্যর্থ হতে পারে। যদি ব্যক্তিগত আলোচনা পাকিস্তানিদেরকে অনুধাবন করাতে ব্যার্থ হয় যে তাদের এসবে কাজ হচ্ছেনা তাহলে জেনারেল এসেম্বলিতে তার পরিণতি হিসেবে যা ঘটবে তার জন্য তারাই দায়ী থাকবে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩২৩। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সামাধান কালান্তর ৮ জুন, ১৯৭১

Kamol Roy
<১৪, ৩২৩, ৮০৭-৮০৮>

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধান
সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধান হোক এ ইচ্ছা পৃথিবীর কোন কোন রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্র নায়করা প্রকাশ করেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীও বিভিন্ন বক্তৃতায় এর একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানের কামনা ব্যক্ত করেছেন। সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গফফার খান মীমাংসায় পৌঁছানোর জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের জঙ্গীশাহী ও বাংলাদেশের নেতাদের মধ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাবও করেছিলেন। পাকিস্তানের জঙ্গীশাহী মেনে না নেওয়ার ঐ প্রস্তাবের অপমৃত্যু ঘটেছে। তা সত্ত্বেও পাকিস্তানের নজীরবিহীন ঘটনার কোন রাজনীতিক সমাধান সম্ভব কিনা এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে আজও গবেষণার শেষ নেই। রবিবার স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক বেতার ভাষণে এই সমাধানের ভিত্তি সম্পর্কে ঐ সরকারের মনোভাব ব্যক্ত করেছেন।

এ পর্যন্ত যারা রাজনীতিক সমাধানের কথা ভেবেছেন তারা প্রত্যেকেই পাকিস্তানের ঐক্য অক্ষুন্ন রেখে সমাধানের কথা হয়তো চিন্তা করছিলেন। বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান তাদের এই চিন্তাকে অবান্তর এবং ভ্রান্ত বলে উল্লেখ করেছেন। “লাখো শহীদের রক্তে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান মরে গেছে , তাকে আর বাঁচানো যাবে না”। সৈয়দ নজরুল ইস্লামের এই মর্মান্তিক উক্তির মধ্যে থেকে ভাবপ্রবণতার প্রাবল্য থাকতে পারে কিন্তু এটা আজ বাংলাদেশের কাছে বাস্তব ঘটনা। একই রাষ্ট্রের মধ্যে থেকে যে পূর্ব বাংলা ভৌগোলিক দিক থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল জঙ্গী রাষ্ট্র নায়করা শহীদের রক্তের নদী সৃষ্টি করে সবদিক থেকে তাকেই আজ সম্পূর্ণ পৃথক করে দিয়েছে। একে গোঁজামিল দিয়ে ঐক্যবদ্ধ রাখার কোন প্রয়াসই আর সফল হতে পারে না। অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান অত্যান্ত দৃঢ়তার সঙ্গে এবং সুস্পষ্ট ভাষায় সেই ঘোষণা করেছেন।

স্বাধীন বাংলাদেশকে ভিত্তি করে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সমস্যার সমাধানের যে চারটি পূর্ব শর্ত দিয়েছেন তার কোন একটিকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান করা যায় না। মুজিবুর রহমান সমেত অন্যান্য গণপ্রতিনিধিদের মুক্তি, হানাদার বাহিণির বাংলাদেশ ত্যাগ, স্বাধীন, গনপ্রজাতন্ত্রী সরকারের স্বীকৃতি এবং বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতির ক্ষতিপূরণ ছাড়া বাংলাদেশে কোন শান্তি প্রতিষ্ঠার চিন্তা প্রকৃতই অবাস্তব।

এই উপমহাদেশে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা এবং সংগ্রামী জনসাধারণ স্বাধিকারও স্বায়ত্ত্বশাশনের জন্যে যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের একচেটিয়া পুঁজি, সামন্ততান্ত্রিক স্বার্থ এবং সামরিক জুন্টার মিলিত আক্রমণ তাকের তাকে রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দিতে চেয়েছিল। বর্ষার প্রবল জলরাশিকে শুধু বাঁধ দিয়ে ঠেকানো যায় না। তার অবাধ প্রাবাহের পথ করে না দিলে সে বাঁধ ভাঙ্গে। ইয়াহিয়ার বর্বর সৈন্যদের নিষ্ঠুরতা সেই বাঁধ আজ বাংলাদেশের জনতা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে এগিয়ে চলেছে। স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা, স্বায়ত্ত শাসন থেকে সার্বভৌমত্ব, পশ্চিমী পুঁজিরে নাগ পাশের বাঁধন শিথিল নয়; একেবারে ছিন্ন করার শপথে বাংলাদেশের জনতা আজ সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। জনতার সেই দুরন্ত আবেগকেই সমাধানের শর্তরূপে বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কদের কাছে হাজির করেছেন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান।

বাংলাদেশের সমস্যা অনেকদিন আগেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের “অভ্যন্তরীণ বিষয়”- এর গন্ডী ছাড়িয়েছে। একটা সামরিক চক্রকে সামনে রেখে বাঙালী জাতিকে (ধর্মের ভিত্তিতে নয়) এবং বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তানের ঐ এক চেটিয়া পুঁজির ঔপনিবেশিক শোষণের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করার নীতি যেদিন থেকে গ্রহণ করা হয়েছে সেদিন থেকেই বাঙ্গালী জাতির স্বাধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রাম ঘরোয়া আন্দোলনের সীমা অতিক্রম করেছে।

আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামের সঙ্গে পরাধীন জাতিগুলির মুক্তির আন্দোলন প্রায় একাকার হয়ে গেছে। বাংলাদেশের কোন সমাধানের কথা যারা চিন্তা করছেন তাদের দৃষ্টি যেন বাঙ্গালী জাতির মুক্তি আন্দোলনের এই দিকটা থেকে সরে না যায়- সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেই জন্যই তাঁর সরকারের পক্ষ থেকে ঐ পূর্ব শর্তগুলি আরোপ করেছেন।

একটা স্থায়ী রাজনীতিক সমাধানের জন্য বাংলাদেশের বাঙালীরাতো প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি দাম দিয়েছেন। চার পাঁচ লক্ষ বাঙ্গালী রক্ত ঢেলেছেন, অর্ধ কোটি নর-নারী-শিশু সর্বস্ব ত্যাগ করে দেশের মাটির বাইরে দাঁড়িয়ে শত্রুকে ধিক্কার দিচ্ছেন- যদি প্রয়োজন হয় আরও মূল্য দিতে তাঁরা প্রস্তুত কিন্তু বিনিময়ে তাঁরা চান মুক্তি স্বাধীনতা। বাংলাদেশের স্থায়ী রাজনীতিক সমাধান মাত্র ঐ একটিই। বাংলাদেশ সরকার অবিচল নিষ্ঠার সঙ্গে একমাত্র শর্তই আরোপ করেছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩২৪। কলকাতার দূতাবাসগুলিতে বদলী ও নতুন নিয়োগের হিড়িকঃ কারণ রাজনৈতিক? দর্পন ১১ জুন, ১৯৭১

কলকাতার দূতাবাসগুলিতে বদলী ও নতুন নিয়োগের হিড়িকঃ
কারণ রাজনৈতিক?
(দর্পণ সংবাদদাতা)

হঠাৎ কি যেন একটা ঘটেছে বা ঘটতে যাচ্ছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছুটে কলকাতা এলেন। দূতাবাসে দূতাবাসে গুঞ্জন, ফিসফিসানী। বাংলাদেশ? ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ? পঞ্চাশ লক্ষ নবাগত শরণার্থীর চাপ? পশ্চিমবঙ্গে ধূমায়িত অসন্তোষ?

এলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। “যুদ্ধ না শান্তী- প্রধান প্রশ্ন প্রধানমন্ত্রীকে?

খবর নয়, খবর তৈরী করার চেষ্টাও আনন্দবাজারের কল্যাণে খবর হয়ে উঠলো। খবরের কাগজ পুরোপুরি “দাবীদিবসের” হ্যান্ডবিল হয়ে উঠেছে।

তাই বোধ হয় দূতাবাসের অফিসগুলোতে বদলীর পালা চলছে। সোভিয়েত, মার্কিন, পশ্চিম জার্মানী, পূর্ব জার্মানী, উত্তর কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফ্রান্স এবং মধ্য এশিয়ার কয়েকটি দেশ নিয়ে প্রায় সবকটি দেশের কলকাতা দূতাবাসে নতুন নতুন লোকের আমদানী হচ্ছে।

সবাই জানেন (সেলার ও কানের সোভিয়েতবিরোধী চক্রান্তের ইতিহাস, রবিন্স, সিডনী রিলিদের পরিচয় আজ অনেকেরই অজানা নেই) যে বৈদেশিক দূতাবাসে সংস্কৃতি, বার্তা বিভাগ, সাহায্য বিনিময় বিভাগ ও রেডক্রস জাতীয় প্রতিষ্টানের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীদের অনেকেই স্ব স্ব দেশের রাজনৈতিক গুপ্তচরের কাজ নিয়ে আসেন।

সুতরাং হঠাৎ কলকাতার দূতাবাসগুলির এই সব বিভাগের প্রধানদের পাইকারী বদলী এবং নতুন লোকের আগমন ওয়াকিবহাল মহলে বিস্ময় ও ঔৎসুক্যের সৃষ্টি করেছে।

পশ্চিমবঙ্গে হত্যা খুনোখুনির রাজনীতি আমদানী এবং তা অবলীলাক্রমে বিনা বাধায় চালিয়ে যাওয়ার পিছনে বৈদেশিক যে গুপ্তচর সক্রিয় তার মধ্যে পৃথিবীর দুটি বৃহত্তম শক্তি নাকি অবতীর্ণ। আটষট্টি সাল মার্কিন গুপ্তচর বিভাগের বড় কর্তারা লালবাজারে পর্যন্ত ঘুরে গিয়েছেন।

তাই এবার ছোট ছোট রাজনৈতিক দল এবং বিছিন্ন, হতাশাগ্রস্থ রাজনৈতিক সম্পর্কযুক্ত লোক দিয়ে ঘটনাগুলোর নতুন আবরণ সৃষ্টি করা দরকার। আমরা দেখেছি উনিশশো আঠারো-তেইশ সালের সোভিয়েত দেশেও বিভিন্ন বিপ্লব বিরোধী ও প্রতিবিপ্লবী ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলিকে বৃটিশ, ফ্রান্স, মার্কিন গোয়েন্দা চক্র শিশু সোভিয়েত রাষ্ট্র ও প্রায় অনভিজ্ঞ বলশেভিক পার্টির ধ্বংস করার চক্রান্তে নিযুক্ত করতে পেরছিল।
ভারতবর্ষের ওপর সোভিয়েত এবং মার্কিন খবরদারী প্রায় সমান। বর্তমানে সোভিয়েত রাষ্ট্রও পুরোপুরি রেনিনের স্তালিনের আদর্শ মেনে চলে না। বরং দুনিয়ার ভাগবাটোয়ারায় তারা মার্কিনীদের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং বোঝাপড়ায় আগ্রহী মিত্রও বটে।

ইন্দিরা সরকারের প্রতি সোভিয়েত মার্কিন যতখানি অনাগ্রহশীল, পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খানের প্রতিও তাঁরা অন্ততঃ ততখানিই সদয়। বৃটেন, ফ্রান্স পশ্চিম ও পূর্ব জার্মানী, কোরিয়া প্রভৃতি কমবেশি এই দুটী বৃহত্তম শক্তিরই অনুসরণকারী মাত্র যদিও তাদের নিজ নিজ দেশের বিশেষ স্বার্থও তারা দেখেন।

পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক তৎপরতা বড় বেশি রকম দৃষ্টিকটু ভাবে শুরু হয়েছে। এই কলকাতা শহরে আনাগোনা, ব্যস্ততা, সংবাদ চ্যানেল নানা অলিগলিতে ভীড় জমে উঠেছে। ছোট ছোট রাজনৈতিকদের, দলছুট রাজনৈতিক ব্যাক্তি ও খবরের কাগজের লোকদের দিকে নজর রাখলেই ডালহৌসী আর লালবাজার থেকে উড ষ্ট্রি হ্যারিংটন ষ্ট্রিটের আনাগোনা ব্যস্তাত চোখে পড়বে। চোখ কান খোলা রাখলে সুতারকিনী মার্কিনী এবং বাগবাজারের দু’চারটে বৈষ্ণব বাবাজীর দেখাও এখানে মিলে যাবে।

তাতেই আপনার মনে হবে কি যেন ঘটছে বা ঘটতে যাচ্ছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩২৫। সাহায্য দাতাদের প্রতি বাংলাদেশের আবেদন টাইমস অফ ইন্ডিয়া ১২ জুন ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ৩২৫, ৮১১>

টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ১২ জুন ১৯৭১
সাহায্য দাতাদের প্রতি বাংলাদেশের আবেদন
টাইমস অফ ইন্ডিয়া নিউজ সার্ভিস

নয়াদিল্লি, ১১ জুন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ এম.এ. সামাদ আজ বিশ্ব সম্প্রদায়কে এ বিষয়ে নিশ্চিত করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন যে, বাংলাদেশের নিপীড়িত জনগণের জন্য দেয়া ত্রাণসামগ্রী যারা তারা দিচ্ছে তা যেন পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধ যন্ত্রের কাছে না গিয়ে জনগণের কাছে পৌঁছেছে। একটি বিবৃতিতে তিনি বলেন যে এটি করার একমাত্র কার্যকর উপায় হল বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে ত্রাণ সরবরাহ চালানো, যাতে জনগণের পূর্ণ আস্থা আছে ও তারা এই সরকারের আনুগত্যকে স্বীকার করে।

যদি এই ধরণের পদক্ষেপ ত্রাণ সরবরাহের জন্য গ্রহণযোগ্য না হয় তবে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি বা নিরপেক্ষ দেশগুলি দ্বারা বিতরণ করা উচিত। জনাব সামাদ ইউএন এর সচিব ইউ থান্টের কাছে আবেদন করেছিলেন, যে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলকে ইউএনএ, বিশেষ করে নিরাপত্তা পরিষদের সামনে তাদের ব্যাপারটি উপস্থাপনা করার অনুমতি দেয়া উচিত।

তিনি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বসবাসকারী জনগণের জন্য বিশেষ কিছু করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যর্থতা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। কারণ জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক নিষ্ঠুরভাবে তাদের উপর গণহত্যা, লাঞ্ছনা ও তাদের অপহরণ করা হচ্ছিল এবং তাদের বাড়ি থেকে উৎখাত করা হয়েছিল। “বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে শৃঙ্খলিত ও হতাশ করা হলে বিশ্বকে নিষ্ক্রিয়ভাবে বসে থাকলে চলবে না।”

সকল সরকার ও ইউএন এর উচিত ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণকে গণহত্যা এবং পরিকল্পিতভাবে খাদ্যাভাবে রাখার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করা, তাদের উচিত বাংলাদেশ থেকে পেশাগত বাহিনী দ্রুত প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির বিষয়টিও আনতে হবে।

জনাব সামাদ যিনি সম্প্রতি বুদাপেস্ট শান্তি কনফারেন্সে যোগ দেন এবং অনেক ইউরোপীয় রাজধানী পরিদর্শন করেন, তিনি বলেন যে, বাংলাদেশ সরকারের দেয়া তথ্য অনুযায়ী সেখানে দুর্ভিক্ষ এবং মহামারী প্রকট আকার ধারণ করেছে যাতে প্রচুর লোক মারা যাচ্ছে। একদিকে বর্ষার কারণে জনসাধারণ দুর্ভোগ আছে অন্যদিকে দখলদার সেনাবাহিনী তাদের ঘর ছাড়া করছে। গত নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড়ের শিকারদের জন্য যে রিলিফ পাওয়া গেছে তা ইসলামাবাদ সরকার পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে দিয়ে বাংলাদেশের নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষকে গণহত্যার জন্য ব্যবহার করছে।”

ত্রাণ সামগ্রীর কার্যকরী বণ্টন নিশ্চিত করতে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের সেনানিবাস থেকে প্রত্যাহার করা উচিত।

জনাব সামাদ বিশ্বাস করেন যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যারা ইসলামাবাদের প্রতারণা সম্পর্কে সচেতন ছিল, তারা জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে ত্রাণ যথাযথ বণ্টনের কথা বলবেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩২৬। ভারত ডুবতে বসেছে কম্পাস ১২ জুন, ১৯৭১

Kamol Roy
<১৪, ৩২৬, ৮১২-৮১৪>

ভারত ডুবতে বসেছে
সম্পাদকীয়

কত দ্রুত গতিতে ভারতের অর্থনীতি সমাজ ও রাজনীতি গভীর সঙ্কটের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে, তা আজও কূপমন্ডুক ভারতীয়দের চেতনাতে আসেনি। ভারত সরকারের সত্যিই কোন নীতি আছে কি না সন্দেহ। অবস্থার চাপে পড়ে ব্যবস্থা করা যাবে, এর চেয়ে পরিষ্কার কোন দৃষ্টি তাদের ছিল না। কিন্তু যা ঘনিয়ে উঠেছে তাদের এখন এই নেতৃত্ব হাবুডুবু খাবে মাত্র। নেতৃত্ব হাবুডুবু খাক বা যাক সবচেয়ে বড় কথা নয়, সবচেয়ে ভাবনার বিষয় হলো এই যে এবারে বুঝি ভারতেই (এঁদেরই হাতে অবশ্য) ডুবতে বসেছে।

বাংলাদেশে অনতিবিলম্বে ইয়াহিয়া বর্ষার জলকাদায় ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে ডুবে যাবে, এ জাতীয় অতি সরল হিসেবে মূর্খতার সাফল্য থেকেই অমন সহজাত স্ট্রাটেজী রূপে এদেশে চালু হয়েছে। দিতে পাকিস্তানের এক কোটি করে নাকি টাকা খরচ হচ্ছে, কিন্তু এক শরণার্থীদের ভাত কাপড় দিতেই কি ভারতের দৈনিক দুই কোটি টাকার ব্যবস্থা করতে হবে না? এখন স্বীকার করা হচ্ছে যে ইতিমধ্যেই শরণার্থীর সংখ্যা পঞ্চাশ লক্ষে দাঁড়িয়েছে। আর শরণার্থী আগমনী স্রোত সহিসা দ্বিগুন বেগে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাঝখানে কয়েকদিনের জন্য এই স্রোতটা কম ছিল। অমনি কর্তৃপক্ষ একটু আশ্বস্ত বোধ করছিল। কিন্তু হায় আজ কয়েকদিন ধরে এই দৈনিক গড়ের হার লক্ষাধিক হয়েছে। কেউ বলছেন এক লক্ষ, কেউ বলেছেন এক লক্ষ বিশ হাজার করে দৈনিক এই আমদানী।

আসলে এই জনস্রোতের বৃদ্ধিটা বুঝতে হবে বাংলাদেশের ভিতরকার অবস্থা থেকে। পাকবাহিনীর আক্রমণের মুখে শহর বন্দর ছেড়ে বহু লোক প্রথমেই ভারতের সিকে ছুটে আসেনি। তারা দূর দূর গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এদিকে মুক্তিফৌজ পাকসামরিক বাহিনীর আক্রমণের উত্তরোত্তর বৃদ্ধির সাথে সাথে ভারতের সীমান্তের দিকে চলে আসতে বাধ্য হয়, ভিতরকার প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে, জনসাধারণের উপর নির্মম অত্যাচার ও হত্যার বিভীষিকা ও তান্ডব সৃষ্টি করা হয়, রাস্তের ধারে ধারে গ্রামগুলি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সীমান্ত বরাবর পাক বাহিনীর অগ্রগতির ফলে প্রথমটায় সীমান্ত বরাবর জেলাগুলি থেকেই ভারতে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী প্রাণ ভয়ে এক বস্ত্রে চলে আসতে থাকে- রাত্রির অন্ধকারে সীমান্ত পার হতে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের ভিতরকার জেলাগুলি থেকে প্রথমে অত শরণার্থীর স্রোত সৃষ্টি হয়নি। তারা অপেক্ষা করছিল দেখতে শেষ পর্যন্ত কি হয়। শেষ পর্যন্ত কিছুই হলো না, ভারত প্রত্যক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করলোই না, বলে মৌখিক আশ্বাস দিতে ছাড়ে না। এদিকে পাক নির্যাতন উৎপীড়ন ও নিধন যন্ত্রের নিষ্পেষন পূর্ববাংলার দূরতম পল্লীতেও গুন্ডাশ্রেণীর লোকদের সহায়তায় বিস্তৃত হতে লাগলো। এখনতো আর থাকা যায় না, এই প্রত্যয় ও ভয় দৃঢ় হবার সাথে যে যেখান থেকে পারে যত দূরেই হোক সীমান্তের দিকে চলতে শুরু করল। গোটা বাংলাদেশ দেশত্যাগ করতে শুরু করেছে এবার।

এবার বরিশাল, ফরিদপুর, ঢাকা প্রভৃতি দূরবর্তী জেলার গ্রাম থেকে লক্ষ লক্ষ নরনারী, শিশু ভারতের ক্রমবর্ধমান স্রোত ধারায় আসছে। দৈনিক গড় তাই লক্ষাদিক হয়েছে।

প্রথমে যারা নিকটবর্তী অঞ্চল থেকে এসেছিল, তারা অন্তত শক্ত সামর্থ দেহগুলি হেঁটে হোক, ট্রাকে, গাড়িতে, নৌকাতে, রিক্সাতে এসে পৌঁছাতে পেরেছিল, এবং যতটা আশ্রয় শিবির তৈরি ছিল তাতে এসে মাথা গুঁজতে পেরেছিল। আজ যারা আসছে, বহু দূর দূর প্রান্ত থেকে ২/৩ সপ্তাহ ধরে পায়ে হেঁটে অর্ধভূক্ত অভক্ষ্যদ্রব্য খেতে খেতে, ক্লান্তি শ্রান্ত অবসন্ন দেহে এসে পড়েছে। তাদের ক্লিন্ন, অবসন্ন, শূণ্যদৃষ্টি চেহারাগুলি দেখতে পারা যায় না, মন বিষন্ন হয়ে যায়। তাদের পশুবৎ জীবন অবর্ণনীয় দুঃখে শোকে ভয়ে ক্লান্তিতে একদম ভেঙ্গে পড়েছে। কে তাদের আজ মনে বল দেয়, কে তাদের আজ বোঝাতে পারে যে তাদের ভবিষ্যৎ আছে, দেশ আছে কোথাও? ‘বাংলাদেশ’ সে আজ কোথায় কতদূরে? বুঝি মৃত্যুর অপর পারে।

এদিকে কলেরা মহামারীরূপে উপস্থিত! হাজার কয়েক প্রাণ ইতিমধ্যেই তার শিকার হয়েছে। হু হু করে এর সংক্রমণ আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ছে। সমস্ত শরণার্থী ও পার্শ্ববর্তী গ্রাম ও জনপদবাসীরা ভয়ানক এক আতঙ্কগ্রস্ত- এই শীতল মৃত্যু গুলিগোলার মৃত্যুর চেয়ে অনেক বেশী ভয়াবহ ত্রাস সৃষ্টি করছে। কলেরা নিয়েই অনেক শরণার্থী ঢুকেছে, কেননা অভুক্ত অবস্থায় যা তা খেয়েছে, বিষাক্ত জল পান করেছে, নদী নালা বিলে মৃত দেহগুলি পচছে, ভাসছে- সেই জলই খেতে হয়েছে। আর এপারেও যে স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থাপনা, বিশুদ্ধ পানীয় ও খাদ্য মিলছে, তাওতো খুবই কম ছিল। এখানেও কলেরা মহামারী, বসন্ত প্রভৃতি রোগের ক্ষেত্র তৈরি ছিল। আজ মৃতদেহ এখানেও সৎকারের কোন ব্যবস্থা নেই। এমনকি মাটিতে কবর দেবার জন্য যথেষ্ট কোদাল পর্যন্ত নেই। জীবিতদের দায়িত্বই কেউ নিতে নেই, মৃতদেহের দায়িত্ব নিবে কে, বিশেষ করে সংক্রামক রোগে মৃত ব্যাক্তিদের? ফলে এখানেও নদীতে মৃতদেহ নিক্ষেপ করা ছাড়া উপায় নেই।

সীমান্ত- বিশেষ করে ২৪ পরগণা, নদীয়া, মুর্শিদাবাদে যে যব শিবির করা হয়েছিল সেগুলির স্থান নির্ণয়ে কোন দূরদৃষ্টি ছিল না, মনে করা হয়েছিল দুদিনের তো ব্যাপার, বাংলাদেশ শীঘ্রই মুক্ত হয়ে যাচ্ছে, ভারত সরকার নিশ্চয়ই শেষ পর্যন্ত হাত লাগাবে (নইলে এত সৈন্য সামন্ত এধার ওধার করছে কেন! আসলে সৈন্যরা নিস্ক্রিয় নয়, এমনি একটু ভয় দেখাতে ভাণ করেছিল মাত্র কিন্তু ইয়াহিয়া খান আমাদের এই ভাণটা ধরে ফেলে- তারা যা করার তা করেই যাচ্ছে। কোন দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে)। তাই যেখানে সেখানে শিবির করা হয়, যার প্রায় সবগুলিই খোলা মাঠের নীচু জমিতে। এদিকে বর্ষা এসে গেছে। ক্যাম্পগুলির অধিকাংশই জলে ডুবে যাবে শিঘ্রই! কী বীভৎস নোংরা অমানুষিক অবস্থায় পড়বে এই হতভাগ্য মানুষগুলি! মহামারী ও মৃত্যুর মহাভোজ উপস্থিত।
এদিকে নতুন করে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী আসতে শুরু করেছে। সীমান্তের শিবিরে মাথা গুঁজবার কোন ঠাঁই নেই। তাদের সংখ্যা গুনবার জন্যও কোন লোক নেই। পশ্চিম বঙ্গের পুনর্বাসন ব্যবস্থা শক্তির বাইরে চলে গেছে। সমগ্র প্রশাসন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। ডাক্তার নেই, সেবক নেই, নার্স নেই, এত স্বেচ্ছাসেবক নেই কোন স্বেচ্ছাসেবক সংস্থার এর কোন কূল কিনারা করতে পারে। শরণার্থীরা ক্ষুদায়, অনাহারে, মহামারীর ভয়ে হাজারে হাজারে কলকাতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এ এক অদ্ভুত মার্চ, পৃথিবীতে যা কেউ কোথাও দেখেনি। প্রাণ ভয়ে ভীত লক্ষ পশুবৎ মানুষের মার্চ। কলকাতাবাসীরা এবার আতঙ্কিত, তাদের সুখের নীড় (যদি কিছু সেখানে আজও থেকে থাকে) বুঝি এই আর্ত মানুষদের বন্যায় ও সামাজিক ঝড়ে ভেঙ্গেচুরে যায়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও অন্য কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করছেন বুঝি তা তাদের মন্ত্রীত্ব খতম করার জন্য কোন রাজনৈতিক মতলববাজ দল শরনার্থীদের কলকাতায় আসতে পথ দেখিয়েছে। কী অদ্ভুত আত্মপ্রতারণা। তাদের মন্ত্রীত্ব তারা এমনিতে রাখতে পারবেন আর কত দিন সে সন্দেহ তাদের নিজেদেরই আছে। কেন আবার একটা মিথ্যা অভিসন্ধি আরোপ করা! অন্যরা এই শরণার্থীদের ক্রমবর্ধমান স্রোতকে নিজেদের রাজনীতির স্বার্থে লাগাচ্ছে, না এঁরাই লাগাতে চাইছে! কিন্তু হায়, এতে কোন দলেরই রাজনীতি হবে না, কোন লাভ হবে না- গোটা দেশের সব রাজনীতিই এই আর্তজনপ্লাবনে ডুবে যাবে, যাচ্ছেও।

পাকিস্তানের সঙ্গে গোপণ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত সন্দেহে কতিপয় নেতৃস্থানীয় লোকদের ধরা হয়েছে। জানি না এই অভিযোগ কতটা সত্য। পাকিস্তানী চর গুপ্তাভাবে নানাদিকে কাজ করেছে, করবে এতে আর আশ্চর্য কি, তার জন্য যাকে পাও, দোষী বলে জানো ধরো, বিচার করো। কিন্তু আজ তো পাকিস্তান শুধু গোপন ষড়যন্ত্র করছে না, খোলা ষড়যন্ত্র করে কোটিখানেক লোক ভারতের ঘাড়ে ফেলে দিচ্ছি- এই অঘোষিত যুদ্ধের জন্য ভারত সরকার অথবা রাজ্যসরকারগুলি কি করেছেন? পাকিস্তানের গায়ে হাত দিয়ে ভয় লাগছে, তাই নয়?

আজ ভারত সরকারকে পৃথিবীর কাছে এসওএস বা রক্ষ কর রক্ষা কর বলে আর্তনাদ করতে বাকী। বাংলাদেশকে রক্ষা করো এই আবেদন আজ তার কাছ থেকে শোনার কোন তাৎপর্য নেই। বাংলাদেশের জন্য আর উকিল মোক্তার রাষ্ট্রদূত পৃথীবীর দুয়ারে পাঠাতে হবে না, নিজেকে রক্ষা কেমন করে করবে সে কথাই ভাবুক!

আহা পৃথিবীর বিবেক! পৃথিবীর বিবেকের রক্ষাকর্ত্তা যারা তাদের একটি হলো আমেরিকা- জাপানে হিরোসিমা ও নাগাসাকীতে পারমানবিক বোমা অকারনেই নিক্ষেপ করে লক্ষ লক্ষ প্রাণ যারা মুহুর্তে ধ্বংস করেছিল। ভিয়েতনামে তার কীর্তিতো ঐতিহাসিক। ব্রিটেন আর এক ঐতিহাসিক বিবেকের মুর্ত্তি আহা কী তার ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এসব বৃহৎ শক্তির ঘরের খবর কি; ইতিহাস কি? আজ উ থান্ট বলেছেন পৃথিবীর ইতিহাসে পূর্ববঙ্গে যা হয়েছে সে জাতীয় ট্রাজেডি নাকি বিরল! আহা কত দেরীতে এই পরপদলেঈ মোটা বেতনভুক্ত কর্মচারীটির ঐতিহাসিক বিবেকজ্ঞান উপস্থিত হলো। কয়েক কোটি টাকার আশ্বাস পাওয়া গেছে পৃথিবীর রাজ দরবারগুলো থেকে- ভারত তাই আকাশবাণী মারফৎ এদেশ ও বাংলাদেশের লোককে শুনাচ্ছে। এই কয়েক কোটি টাকার সাহায্য, আসলে ভস্মে ঘি ঢাকার মতও হবে না, উপরন্তু এর বিনিময়ে সাহায্যদাতারা ভারত যাতে কোন কারণেই পাকিস্তানের “অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে” হস্তক্ষেপ না করে সে মুচলেকা বা বাধ্যবাধকথা আদায় করে নিচ্ছে।

এদিকে ভারতের প্রতিরক্ষা দফতরের ভণিতার অন্ত নেই। ভি.সি. শুক্লা জানাচ্ছেন, ভারত শীঘ্রই চার দফায় ক্রিয় ক্ষেপণাস্ত্র (ফোর স্টেজ রকেট) তৈরী করতে যাচ্ছে- ভারতের আকাশের উপর দিয়ে ভারত মহাসাগরে! এই সময়ে এই তথ্যটি পরিবেশন করার একটা মতলব আছে। পাছে ভারতবাসীরা বাংলাদেশের জন্য পাকিস্তানী বর্বরতার বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ করতে বলে, দরকার মত যুদ্ধের দায়িত্ব নেবার দাবী করে- যে দাবী উত্তোরত্তর বৃদ্ধি পেতে বাধ্য। সেই জন্যই আমাদের ভোলাবার চেষ্টা করা হচ্ছে এই বলে যে আসল শত্রুতো চীন তার সঙ্গে যুদ্ধের কথাটা না ভেবে কি পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাবো? পাকিস্তান থেকে দেশের দৃষ্টি অন্যত্র ঘুরিয়ে দেবার জন্যই পার্লামেন্টে এই বীরত্যব্যঞ্জক ঘোষনা রকেট বানাবার (পারমানবিক বোমার রকেট নয়- সাধারন বোমাই) ইচ্ছা প্রকাশ করা হয়। ভারত সরকার আমাদের সত্যিই আহাম্মক মনে করেন।

এদিকে প্রতিরক্ষা বাজেটের বরাদ্দ ১১৫০ কোটি টাকা থেকে ১২৫০ কোটিতে টেনে আনা হলো। এত টাকা খরচ করা হচ্ছে কেন, যদি আজ পাকিস্তানের এমন বর্বর আক্রমনের জবাব দিতেও না যাই? আমাদের নাকি বহু অস্ত্রসস্ত্র ও বহু সৈন্যসামন্ত হয়েছে, এমনকি একসঙ্গে ২/৩ দেশের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করতে পারি বলে মাঝে মাঝে বলা হতো। এখন আর ওসব উচ্চারণও হয় না। ভারতের আজ সত্যিই নার্ভাস। যদি এমন দিনেও আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কোন কাজে না আসে, তবে এত খরচ করা কেন? সৈন্যবাহিনীকে দিয়ে যখন যুদ্ধ করানো হচ্ছে না, তখন শরণার্থীদের রক্ষণাবেক্ষণের ভারটাই তাদের দেওয়া হোক না কেন? তারপর ভারতকে একটা “খোলাদেশ” বা “ওপেন কান্ট্রি” বলেই ঘোষণা করা হক না কেন? ভারতের চতুর্দিকে যে সব বৃহৎ শক্তি আছে- রুশ, চীন, আমেরিকা প্রভৃতি তারা আমাদের ডিফেন্সের ভার নিন, তারা ভাগাভাগি করে নিজেদের শক্তি সাম্যের খাতিরেই হয়তো ভারতকে রক্ষা করা যাবে- যদিও ভারতের তাতে কোন স্বাধীনতা থাকবে না ইজ্জতও থাকবে না, বৃহৎ শক্তিগুলির দাস হয়ে বেশ “সুখের সংসার” নিরাপদে চালাতে থাকবে। হায় জয় হিন্দু, হায় জয় ভারত।

কিন্তু আমরা এভাবে পরিপূর্ণ স্বাধীনতার বদলে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের পথও বোধ হয় গ্রহণ করতে পারবো না। ছোট বড় নানা অহঙ্কারও তো আছে। আপাতত আমরা অর্থনৈতিক সামাজিক সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সব রকমের এক নারকীয় দুর্গতির মধ্যে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। এত বড়ো দেশের মালিক হতে চাই, অথচ এক ফোঁটা সাহস আমাদের নেই। এই নির্লজ্জ ভীরুতাকে ঐতিহাসিক বিজ্ঞতা বলে দার্শনিক আত্মপ্রতারণায় নিমগ্ন আছি। ভারতের ইতিহাসে এতবড় লজ্জা ও এত বড় ট্রাজেডি পূর্বে কখনো ঘটেনি। আমরা ডুবে যাচ্ছি।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩২৭। শরনার্থীদের চিকিৎসায় সরকারী ও বেসরকারি সংস্থার সমন্বয় দরকার কালান্তর ১৩ জুন, ১৯৭১

Aparajita Neel
<১৪, ৩২৭, ৮১৫>

শরনার্থীদের চিকিৎসায় সরকারী ও বেসরকারি সংস্থার সমন্বয় দরকার

কলকাতা ১২ জুন – বাংলাদেশ থেকে আগত শরনার্থীদের মধ্যে চিকিৎসা সংক্রান্ত ত্রাণের কাজে অবিলম্বে সমন্বয় দরকার।

বিশেষভাবে বেসরকারি সংস্থাগুলির সঙ্গে ৮১৩ সরকারি কাজের সমন্বয়ের অভাবে ও বেসরকারি সংস্থাগুলির ওষুধপত্রের অভাবে শরনার্থীদের চিকিৎসা ভীষণভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

আজ এক সাংবাদিক সম্মেলনে আইএমএ-এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক ডাঃ দেবেন ঘোষ এ কথা বলেন। এই সাংবাদিক সম্মেলনে সর্বশ্রী এ কে রায়, শিশির সেনগুপ্ত, নরেশ ব্যানার্জী, মৃনাল নন্দী ও সমর রায় চৌধুরী প্রমুখ বেঙ্গল মেডিকেল রিলিফ কমিটির ডাক্তারগণ উপস্থিত ছিলেন।

আইএমএ-এর কাজে সরকারি সহযোগিতা সম্পর্কে তাঁরা বলেন-আইএমএ চেষ্টা করেও রাজ্য সরকারের কাছ থেকে কোন প্রকার সাহায্য বা সহযোগিতা পায়নি। পক্ষান্তরে নদীয়া জেলা শাসকের অনুরোধে শাসকের দল নদীয়ায় গিয়ে সহযোগিতার অভাবে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন।

গত ৮ জুন রাজ্য স্বাস্থমন্ত্রী আইএমএ-এর সহযোগিতা চেয়ে চিঠি দিয়েছেন। আইএমএ মনে করে রাজ্য সরকার চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রশ্নে আমিএম-এর আগের প্রস্তাব মত কাজে সমন্বয় ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সরকারি বেসরকারি সংস্থার দায়িত্ব বন্টনের নীতি গ্রহণ না করলে সহযোগিতা হতে পারে না।

আই এম এ নিজেদের সদস্য ও শাখাগুলি ছাড়াও বহুসংখ্যক সংস্থার কাছ থেকে ছোট বড় দান পেয়েছে। কিন্তু তা প্র্যোজনের তুলনায় নিতান্তই কম। বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সহায়ক সমতির (সভাপতি অজয় কুমার মুখার্জী) কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা সাহায্য পেয়েছে। ডাঃ ত্রিগুনা সেনের সভাপতিত্বে গঠিত কমিটির সাহায্য করেছে। শ্রী জ্যোতি বসুর সভাপতিত্বে গঠিত কমটি কোন সাহায্য করেছে কিনা জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, সংবাদপত্রের সাধারণ আবেদন ছাড়া বিষেশভাবে কোন সাহায্য করিনি। ঐ সংস্থার কাছে সাহায্য করার জন্য আবেদন করা হবে কি না তা এখনও সিদ্ধান্ত করা হয়নি।

ডাক্তারগণ কলেরার প্রোকোপের সঙ্গে সঙ্গে ডিপ্তহেরিয়া আক্রমণের আশঙ্কা প্রকাশ করেন। মহামারী প্রোতিরোধে সামরিক বাহিনীর সাহায্য গ্রগণ করার জন্যও তারা দাবি করেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
বাংলাদেশ মুক্তি আন্দোলনকে সমর্থন করুন। ভারতীয় মুসলমান ভাইদের প্রতি বাংলাদেশ সংসদীয় প্রতিনিধিদের আবেদন কালান্তর ১৫ জুন ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ৩২৮, ৮১৬>

বাংলাদেশ মুক্তি আন্দোলনকে সমর্থন করুন। ভারতীয় মুসলমান ভাইদের প্রতি বাংলাদেশ সংসদীয় প্রতিনিধিদের আবেদন

বোম্বাই ১৪ জুন (ইউ এন আই) – শ্রী ফনি মজুমদারের নেতৃত্বে ৪ জন সদস্যবিশিস্ট বাংলাদেশ সংসদীয় প্রতিনিধিদল আজ এখানে ভারতের মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনকে সমর্থন ডানের আহবান জানান।

বোম্বাই প্রদেশ ইন্দিরা কংগ্রেস কমিটির আয়োজিত এক সংবর্ধনা সভায় তারা বলেন যে, পাক ফৌজ মসজিদগুলি ধ্বংস করে এবং পবিত্র কোরান পুরীয়ে ইয়াহিয়া সরকার বিশ্বের সমস্ত মুসলমানদের কাছে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে।

প্রতিনিধিদলের সদস্য শ্রী ও রেহমান বলেন যে, তিনি ইয়াহিয়া সরকারের গণহত্যা ও বর্বরতার প্রমাণ দেওয়ার জন্য যে কোন ভারতীয় মুসলমান ভাইকে পাকিস্তানে নিয়ে যেতে প্রস্তুত আছেন।

অন্যান্য সদস্যরা শ্রী ফনি মজুমদার, শ্রী শাহ ময়াজ্জেম হোসেন ও শ্রীমতী নূরজাহান মুরশেদ প্রমুখ সভায় ভাষণ দেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩২৯। ভারত সরকারের অনুরোধে বাংলাদেশের সরনার্থীদের জন্য সোভিয়েত বিমানের আগমন কালান্তর ১৫ জুন ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ৩২৯, ৮১৭>

ভারত সরকারের অনুরোধে বাংলাদেশের সরনার্থীদের জন্য সোভিয়েত বিমানের আগমন
(স্টাফ রিপোর্টার)

কলকাতা- ১৪ জুন – সোভিয়েত সরকার বাংলাদেশের শরনার্থিদের স্থানন্তর করার কাজে সাহায্যের জন্য ভারত সরকারের অনুরোধে আজ দুটি বৃহদাকার এ এন ১২ পরিবহন বিমান পাঠিয়ে দিয়েছেন।

বিমান দুটি আজ বিকালে মস্কো থেকে দিল্লি হয়ে দমদম বিমান বন্দরে পৌঁছায়। মঙ্গলবার সকালে ঐ বিমান শরনার্থিদের নিয়ে নানা শিবিরে রওনা হবে।

স্মরণযোগ্য যে, পাক জঙ্গিচক্রের বর্বরতম ফৌজি আক্রমণের ফলে লক্ষ লক্ষ শরনার্থি বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত পেরিয়ে নিরাপত্তা ও আশ্রয়ের জন্য পশ্চিমবঙ্গ ও সংলগ্ন ভারতের রাজ্য সমূহে চলে আসেন। সীমান্ত রাজ্যগুলি থেকে অত্যাধিক শরনার্থি চাপ সরাতে তাদের অধিকতর সুষ্ঠু আশ্রয় ব্যাবস্থার জন্য ভারতের অন্যত্র উদ্বাস্তু শিবিরে স্থানান্তরিত করার পরিকল্পনা নিয়ে ভারত সরকার এই কাজে সাহায্যের জন্য সোভিয়েত সরকারকে অনুরোধ জানান। সেই অনুরোধে সাড়া দিয়ে সোভিয়েত সরকার প্রথম দফায় এই দুইটি বৃহৎ পরিবহন বিমান পাঠালেন।

এ এন ১২ প্রথম বিমানটির বৈমানিক দলটিকে বিমান বন্দরে অভ্যর্থনা করেন সোভিয়েত দূতস্থানের কূটনীতিবিদ এবং পশ্চিম বঙ্গ ও ভারত সরকারের উদ্বাস্তু ত্রাণ বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মচারিরা। দিল্লি থেকে বিমানে তাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের ত্রাণ বিভাগের অফিসার শ্রী ভি পি বাইদাকোভ কলকাতায় আসেন।

বিমানবন্দরে স্বাগত জ্ঞ্যাপনকারীদের মধ্যে ছিলেন কলাতাস্থ সোভুয়েত কনসুলেটর শ্রী ভি দিউলিন সহ কন্সাল শ্রী ভি গুর্গেনভ, সোভিয়েত এয়ারোফ্ল্যাতেস্ক ক্যাপ্টেন সেজকুলভ এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন দফতরের জয়েন্ট সেক্রেটারি শ্রী এস শি রায় ও অন্যান্য কর্মকর্তারা।

সোভিয়েত ঔষধ ও অন্যান্য সাহায্য নিয়ে আরও বিমান দু এক দিনের মধ্যে এসে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
ইসলামি দেশ বিপন্ন বলে বাংলাদেশ জাতি হত্যা চাপা দেয়া যাবেনা
কালান্তর ১৬ জুন ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ৩৩০, ৮১৮>

ইসলামি দেশ বিপন্ন বলে বাংলাদেশ জাতি হত্যা চাপা দেয়া যাবেনা
ইয়াহিয়া সামরিক সরকারের ঘৃণ্য অপরাধের প্রতিবাদে
আরবের ৫ টি যুব সংস্থার বিবৃতি
(বিশেষ বিবৃতি)

বার্লিন, ১৫ জুন – পাক সামরিক চক্র বাংলাদেশ জাতই হত্যার ঘৃণ্য অপরাধ চাপা দেওয়ার জন্য ইসলামিক দেশ বিপন্ন বলে যে ধুয়া তুলেছে তা আরব দেশের জনগণকে প্রতারিত করতে পারবে না বলে এখানে আরব দেশের ৫ টি যুব সংস্থা এক যুক্ত বিবৃতি প্রচার করেছে।

আরব দুনিয়া থেকে বাংলাদেশের জনগণের ওপর ইয়াহিয়া আক্রমণের প্রতিবাদে এই প্রথম বিবৃতি।
নির্বাচনে আওয়ামী লিগের চমকপ্রদ জয় বর্ননা করে বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে প্রশাসনিক দায়িত্ব তুলে দেবার এবং জনগণের রায়ের প্রতি সন্মান প্রদর্শনের পরিবর্তে পশ্চিম পাকিস্তানের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের অনুরোধে ইয়াহিয়া বাংলাদেশের ওপর জাতি হত্যা শুরু করেছে। বাংলাদেশের জনগণের ওপর গণহত্যা এবং ইয়াহিয়া ফৌজের সামরিক বর্বরতা দেশের ঐক্যের ওপর প্রচণ্ড আঘাত হেনেছে।

বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তানের সংগ্রামরত যুবকদের প্রতি সমর্থন জানানোর জন্য সংহতিমূলক প্রচার সংগঠিত করার এবং সামরিক শাসকের জাতি হত্যার মুখোশ খুলে ডেইয়ার উদ্যেশ্যে আরব দেশের যুবকদের প্রতি আহবান জানানো হয়েছে। পূর্ববঙ্গের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে প্রশাসনিক দায়িত্ব অর্পন করার জন্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চাপ সৃষ্টি করতে হবে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

bবিবৃতিতে সিরিয়ার ডেমোক্রেটিক ইয়ুথ ইউনিয়ন, ইরাকের ডেমোক্রেটিক ইয়ুথ ইউনিয়ন, ইয়েমেনের গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের আসসালাফি যুব আন্দোলন, সুদানের যুব ইউনিয়ন, লেবানন ডেমোক্রেটিক ইয়ুথ ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ স্বাক্ষর করেছেন। জানা গেছে যে জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের যুব সংস্থার সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কংগ্রেসে যোগদানের উদ্যেশ্যে আগত উপরোক্ত আরব যুব সংস্থার নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ভারতীয় যুব ফেডারেশন ওঁ যুব কংগ্রেসের সর্বশ্রি যোগীন্দ্র সিং দয়াল ওঁ জনার্দন সিং আলোচনার ফলশ্রুতি হিসেবেই বাংলাদেশ সম্পর্কে আরব দেশের যুব সমাজের পক্ষ থেকে ঐ মর্মে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৩১। হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার একটি সম্পাদকীয় হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড ১৬ জুন ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ৩৩১, ৮১৯>

হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, ১৬ জুন ১৯৭১
সম্পাদকীয়
সমস্ত ট্রাজেডি

দিন যায়, সপ্তাহ যায়। সময় সঙ্গে সঙ্গে শান্তি এবং স্বাধীনতাকামী বাংলার মানুষের মাঝে আশা জমা হয়। জেনারেল ইয়াহিয়া খান এর আক্রমণ থেকে বাঁচতে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে যারা তাদের দুর্দশা অবর্ননীয়। তবুও, বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী, তাজউদ্দীন আহমেদ, বিশ্বের বড় শক্তিগুলোকে শরণার্থীদের দুঃখজনক সত্য উপলব্ধি করে এগিয়ে আসার আহবান করেছেন। তার সাম্প্রতিক বিশ্ববাসীকে দেয়া ভাষণে তিনি সমস্যার মূল দিকে আলোকপাত করেছেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন বিশ্বের সচেতন সমাজ সম্ভবত ছুটি উদযাপন করছে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারতকে ধন্যবাদ জানান তার প্রতিকূল অবস্থার মাঝে এগিয়ে আসার কারণে। ভারত এটা অবশ্যই করেছে – বন্ধুত্ব ও বোঝাপড়া থাকায় তাদের কাছ থেকে এটা কাম্য ছিল। কোন সন্দেহ নেই যে শরণার্থীদের বিপুল প্রবাহ ভারতের উপর অসাধারণ চাপ সৃষ্টি করেছে যাদের সীমিত সম্পদ রয়েছে। এখনও সীমান্তের অন্য পাশ থেকে আসা লোকদেরকে গেস্ট হিসাবে রিসিভ করা হচ্ছে। এখানে কোন প্রতিশ্রুতি দেয়া নেই যে যে রাষ্ট্র থেকে আসছে তারা এর খরচ যোগাবে – এমনই শরনার্থিরা কবে ফিরে যাবে সেই ব্যাপারও অনিশ্চিত। এটা সত্যিই দুঃখের ব্যাপার যে – যে আরব দেশগুলির জন্য ভারত সবসময়ই কথা বলেছিল, তারা নিন্দা করে একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি। তাদের এই নীরবতা ইসলামাবাদকে উপকৃত করেছে সন্দেহ নেই।

আরও বেদনাদায়ক হচ্ছে বিশ্বের বড় শক্তিগুলি মোটামুটি নিশ্চুপ আছে। ইসলামাবাদের দ্বারা নির্দয়ভাবে সংগঠিত ঘটনা, ঘরবাড়ি ও জীবন ধ্বংসের ঘটনায় তারা খোলাখুলিভাবে নিশ্চুপ আছে। তারা এখনো ইয়াহিয়াকে বলেনি যে তারা তাকে কোনও অস্ত্র বা আর্থিক সহায়তা দেবে না। খুব সহজ কারণেই তারা নিপীড়নের যন্ত্রের বিরুদ্ধে তা বলতে পারে। জনাব আহমেদ অভিজ্ঞতা থেকে জানেন এটা ক নিষ্ঠুর হতে পারে। এটা স্পষ্ট যে যে কোন দেশ যারা এখন ইয়াহিয়া খান শাসনের সহায়তায় আসবে তারা ধর্মের নামে গণতন্ত্র, শান্তি, মানবাধিকার ও অনুরূপ পবিত্র চেতনার অধিকার ক্ষুণ্ন করবে। যারা ইসলামাবাদ এর সামরিক চক্রের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে, তারা নিজেরাই মূলত গণহত্যার অস্ত্র।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৯ জুন ‘বাংলাদেশ দিবস’ পালন করুন কালান্তর ১৭ জুন ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ৩৩২, ৮২০>

১৯ জুন ‘বাংলাদেশ দিবস’ পালন করুন
(স্টাফ রিপোর্টার)

কলকাতা, ১৬ জুন – পশ্চিম পাকিস্তানের একনায়কতন্ত্র ও সামরিক বর্বরতার বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্তের জন্য যারা লড়াই করছে সেই ‘বাংলাদেশের’ জনগণের প্রতি সংহতি জানানোর জন্য ১৯ জুন এই রাজ্যের শ্রমজীবী মানুষ ‘বাংলাদেশ ‘ দিবস পালন করবেন। আজ শ্রী শিশির কুমার গাঙ্গুলি (আই এন ইউ শি) , শ্রী মাখন চ্যাটার্জি (এইচ এম এস) , শ্রী যতিন চক্রবর্তি (ইউ টি এউ শি) এবং শ্রী ফটিক ঘোষ (ইউ টি ঈউ শি) আজ এক বিবৃতিতে বলেছেন, বাংলাদেশের সংহতির জন্য ভারতীয় ট্রেড ইউনিয়নসমূহের জাতিয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯ জুন ‘বাংলাদেশের’ জন্য সর্বত্র সভা সমাবেশ হবে।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিনিধিদের নিয়ে ১৯ জুন কেন্দ্রিয়ভাবে ভারত সভা হলে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে বনগাঁও সুবৃহৎ সমাবেশ কালান্তর ১৭ জুন ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ৩৩৩, ৮২১>

মহিলা ফেডারেশন ও মহিলা সমিতির উদ্যোগে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে বনগাঁও সুবৃহৎ সমাবেশ

বনগাঁ, ১৬ জুন (সংবাদদাতা) – বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে ভারতীয় মহিলা ফেডারেশন ও পশ্চিমবঙ্গ মহিলা সমিতির আহবানে বনগাঁর রেল স্কুল ময়দানে গত ১৪ জুন দশ হাজার মানুষের একটি সভা অনুষ্ঠিত হোয়। উল্লেখযোগ্য, বনগাঁয় আশ্রিত বাংলাদেশ শরনার্থিদের একাংশ এই সভায় যোগদান করেন।

সভায় সভাপতিত্ব করেন শ্রীমতী রেণু চক্রবর্তি, সর্বভারতিয় বিশিষ্ট মহিলা নেত্রীরা ভাষণ দেন। স্থানীয় জননেতা শ্রী অজিত গাঙ্গুলি এম এল এ মহিলা নেত্রীদের স্বাগত জানিয়ে ভাষণ দেন। শ্রী গাঙ্গুলি বলেন, সমস্যা জর্জরিত সীমান্ত শহর বনগাঁ লক্ষাধিক শরনার্থিকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছে এবং এগিয়েই থাকবে।

বিশিষ্ট মহিলা নেত্রী শ্রীমতী বিমলা ফারুকি বলেন, জঙ্গিনায়ক ইয়াহিয়া বাংলাদেশের মানুষের উপর নিষ্ঠুরতম সন্ত্রাস চাপিয়ে দিয়েছে। যার ফলে লাখো লাখো মানুষ এ দেশে চলে আসতে বাধ্য হয়েছে।
তিনি বলেন শুধুমাত্র মানবিক কর্তব্য সম্পাদনের জন্যেই আমরা তাদের আশ্রয় দিচ্ছিনা, তাদের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সংগ্রামকে সাহায্য করাও আমাদের উদ্যেশ্য, কারণ আমরাও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী।
তিনি জানান যে, বাংলাদেশ থেকে আগত ভাই বোনদের সাহায্য এবং মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে জনমত সৃষ্টির জন্য জাতিয় ফেডারেশন ভারতজুড়ে প্রচারাভিযান চালাবার সিদ্ধান্ত করেছে।

bangবাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নেত্রী মালেকা বেগম এপার বাংলার মানুষের কাছে বক্তব্য রাখার সুযোগ দেবার জন্য অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, অনেক কষ্টে ও দুর্ভোগে আমরা এদেশে আশ্রয় নিয়েছি। অন্য দেশে চিরকাল আমরা থাকব না। আমরা এখানে নিজেদের সংগঠিত করে সংগ্রামে তীব্রতর করার প্রস্তুতি নিচ্ছি।

শ্রীমতী বেগম বলেন, ২৩ বছরেও বাংলার মানুষ স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের স্বাদ পায়নি। শেষত তিনি ঘোষণা করেন, জঙ্গিশাহির অত্যাচারে আর নিষ্ঠুরতায় আমাদের চোখের পানি শুকিয়েছে, কিন্ত মনের আগুণ নেভেনি। এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে হিন্দু- মুসলমানকে এক হয়ে লড়তে হবে।

জননেত্রি শ্রীমতী অরুণা আসফ আলি বলেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশও এখন বুঝতে পারছে, এটা গৃহযুদ্ধ নয়। ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধের পাশে আমরা দাঁড়িয়েছি, বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াতে হবে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশকে স্বাধীন করার দায়িত্ব শরনার্থিদেরও আছে, আমরা তাদের সাহায্য করব।
পশ্চিম বাংলার জননেত্রি শ্রীমতী গীতা মুখার্জি ইয়াহিয়ার চক্রান্তের স্বরূপ বিশ্লেষণ করেন তিনি বলেন, ইয়াহিয়া এক বেয়নেট দিয়ে মুক্তিকামী বাঙালি তরুণদের হত্যা করেছে আরেক বেয়নেট দিয়ে হিন্দুদের এবাংলায় তারিয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশের সব সম্প্রদায়ের মিলিত সংগ্রাম এই চক্রান্তকে ব্যার্থ করাতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

সভাপতি শ্রীমতী রেণু চক্রবর্তি বলেন তিন মাস চেষ্টা করেও ইয়াহিয়া বাংলাদেশে একটা কাঠের পুতুল সরকারকে দাড় করাতে পারেনি। পশ্চিম পাকিস্তানের জঙ্গি চক্রের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতিকে এক হয়ে স্বাধীনতার লড়াই চালাচ্ছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের জন্য হিন্দু মুসলমান শরনার্থিদেরও হাতিয়ার তুলে নিতে হবে।

সভায় সঙ্গীত পরিবেশন করেন শ্রী দেবনাথ চক্রবর্তি ও ওপার বাংলার শিল্পীরা।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৩৪। মুক্তির দূত মুক্তি ফৌজ কালান্তর ১৭ জুন ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ৩৩৪, ৮২২>

মুক্তির দূত মুক্তিফৌজ

বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ শরনার্থি ভারতে এসেছেন, আজও আসছেন। তারা পীড়িত, আর্ত, অসহায়, আশ্রয়প্রার্থী। অতিশয় স্পষ্ট ও অত্যান্ত প্রকাশ্য এই ঘটনা, ফলে সাদা চোখেই মানুষ তা দেখেন। কিন্তু সাধারণের দৃষ্টির অগোচরে বাংলাদেশের যৌবন। বিভিন্ন শিক্ষা শিবিরে স্বদেশের পীড়া, দুঃসময় ও অসহায়তার সঙ্গে মোকাবিলার জন্য যে মুক্তিফৌজের অঙ্কুরের মধ্যে জমেছে এবং ইয়াহিয়ার ফৌজের সঙ্গে লড়াই করে ঐ অংকুর যে চড়াগাছ হয়ে উঠেছে তা কজনে দেখছেন? এই পত্রিকার বুধবারের সংখ্যায় কমিউনিস্ট নেতা শ্রী বর্ধনের দেখা ঐরূপ কয়েকটি শিবিরের বর্ননা রয়েছে। হিন্দু ও মুসলমান ছেলেরা একত্রে হাতেনাতে লড়াইয়ের শিক্ষা নিচ্ছেন। শিক্ষার্থিদের মধ্যে রয়েছে ১৩ বছরের কিশোর। শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন ফৌজি ক্রিয়াকর্মে অভিজ্ঞ ৫০ বছরের প্রৌড় শত্রুকে ঘায়েল করার বহু সাফল্যে মুক্তিফৌজের রেকর্ডও তাতপর্যপূর্ন।

এই মুক্তিফৌজই হল বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। ভারতে আগত অসহায় শরনার্থি এবং বাংলাদেশের ভিতরেও অসহায় কোটি কোটি মানুষের মধ্যে যোগসূত্র হল এই মুক্তিফৌক। ভারতে আগত ছিন্নমূল যারা, শুধু তারাই ছিন্ন মূল নয়, বাংলাদেশের ভিতরে যারা আছেন তারাও ছিন্নমূল। বাংলাদেশের ভিতরে কোন একটি কল কিংবা কারখানায় আজ ধোঁয়া ওড়ে না। ৪০ লক্ষ শ্রমিক একটানা ধর্মঘটে লিপ্ত। সেখানেও সমাজের চাকা স্তব্ধ। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের – তাড়া ভারতে রয়েছেন কিংবা বাংলাদেশে আছেন, সকলেই পুনর্বাসন চাই। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সমাজ ওঁ সভ্যতাকে ইয়াহিয়া খাঁ চুরমার করেছে। তাদের এক সপ্তমাংশ যদি ভারতে উৎক্ষিপ্ত, তবে ছয় সপ্তমাংশ বাংলাদেশেই আছেন। মুক্তিফৌজ হল কারিগর, যারা এই ভাঙা মানুষকে জোড়া দেবে। ভাঙা দেশকে পুনরায় গড়বে।

বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর এই খবরই বিশ্ব বিবেককে চাঙ্গা করে তুলেছে এবং তুলবে। পাঁচটি আরম রাজ্যের যুবসংস্থাগুলির একটি যৌথ ঘোষণা হল তারই চিহ্ন। ইসরায়েলের দস্যু আক্রমণে প্যালেস্টাইনের ছিন্নমূল শরনার্থিদের জন্য বিশ্ব সমাজতন্ত্র ওঁ গণতন্ত্রের সাহায্যের মানে যারা বোঝেন, কতদিন তারা বাংলাদেশের ছিন্নমূলদের প্রতি নিজেদের আন্তর্জাতিক দায়িত্বের কথা ভুলে থাকতে পারেন? বয়োবৃদ্ধ রাজনিতিক ও রাষ্ট্রনিতিকদের দৃষ্টির ঘোর কাটার জন্য কিছু বেশি সময় লাগতে পারে। কিন্তু আরব দেশগুলির যুব সংস্থাগুলির যৌথ ঘোষণাই হল প্রমাণ যে, অংকুর ওখানেও ডালপালা মেলতে শুরু করেছে।

ভারতে আগন্তুক শরনার্থিদের কাছে, বিশেষ করে শরনার্থি শিবিরের যুবকদের কাছে আজ মাত্র একটি ডাক- তোমরা মুক্তিফৌজে যোগ দাও। স্বদেশের মুক্তির জন্য তোমাদের সংগ্রাম বিশ্ব মানবতাকে তোমাদের পাশে দাড় করিয়ে দিচ্ছে এবং দেবে। তোমাদের সংগ্রামই বাংলাদেশ থেকে ভারতে আগমনকারী ছিন্নমূলদের যেমন একমাত্র ভরসা, তেমনই বাংলাদেশের ভিতরে অবস্থানকারী ছিন্নমূলদেরও পুনর্বাসন ওঁ পুনর্জিবনের একমাত্র সহায়। বাংলাদেশের মুক্তি অর্জন এবং স্বাধীনতাই হল একমাত্র ধ্রুব লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করার জন্য এদেশেরও কোন কোন দল ও ব্যাক্তি , যারা ভারতেই শরনার্থিদের পুনর্বাসন চাই বলে প্রচার করছে, তারা জ্ঞ্যাতসারে কিংবা অজ্ঞ্যাতসারে ইয়াহিয়ার চর।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৩৫। বাংলাদেশ শরণার্থীদের জন্য মাস্টারপ্ল্যান চাই
কম্পাস ১৭ জুন ১৯৭১

মোঃ কাওছার আহমদ
<১৪, ৩৩৫, ৮২৩-৮২৫>

বাংলাদেশ শরণার্থীদের জন্য মাস্টারপ্ল্যান চাই

বাংলাদেশ থেকে আগত লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের মধ্যে শুধু ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিলেই আমাদের কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না,দায়িত্ব লাঘবও হয় না।এদের সুসংগঠিত একটি ফলপ্রসূ শক্তিতে পরিণত করার জন্য আমাদের একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রয়োজন এবং অনতিবিলম্বে সে পরিকল্পনাকে বাস্তবে পরিণত করাও অত্যন্ত আবশ্যক। বাংলাদেশ থেকে আগত তরুণ ছাত্র,বুদ্ধিজীবী, আইন ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার প্রত্যেকেই এই অবশ্য কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং এই বাংলার মানুষের উদ্যোগী হতে হবে।এই পরিকল্পনা রুপায়নে পশ্চিম বাংলা সরকার ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ দায়িত্ব রয়েছে।তাদের পক্ষ থেকে কতগুলি বাধ্যতামূলক নির্দেশ জারী করতে হবে। গেরিলা যুদ্ধের জন্য ভারত সরকারের সহযোগিতায় বাংলাদেশের তরুণদের বিশেষ ট্রেনিং দান করা এবং এই রণকৌশল তাদের সুদক্ষ ও সুশিক্ষিত করে তোলা বাংলাদেশ সরকারের কর্মসূচিরর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।কিন্তু এখন পর্যন্ত স্বেচ্ছাসেবকদের সংখ্যাগত এবং গুণগত পরিস্থিতি কিছুমাত্র সন্তোষজনক নয়।গেরিলা যুদ্ধের প্রাথমিক কর্মপন্থার জন্যই এখন পর্যন্ত সম্ভবত সাত থেকে আট হাজারের বেশী তরুণ তালিকাভুক্ত হননি।প্রকৃত ট্রেনিং কতটা দেওয়া হচ্ছে সে সম্পর্কে অবশ্য আমরা কিছু জানিনা,কারণ স্বাভাবিক ভাবেই তা গোপন সামরিক দপ্তরের বিষয়।কত সংখ্যক তরুণকে এ কাজে পাওয়া যেতে পারে সে সম্পর্কে বহু পরস্পর বিরোধী রিপোর্ট আসছে।তবে প্রায় ষাট লক্ষ উদ্ধাস্তদের মধ্যে থেকে ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সের অন্তত পাঁচ ছয় লক্ষ তরুণের নাম রেজিস্টারে থাকা উচিৎ। ভারত সরকার এবং অনান্য স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা শরণার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা এই যুবকদেরও অন্নবস্ত্রদান এবং রক্ষণাবেক্ষণের দিকে লক্ষ্য রাখছেন।কিন্তু কেন এই পাঁচ ছয় লক্ষ তরুণকে বাধ্যতামূলকভাবে প্রাথমিক সামরিক শিক্ষার জন্য তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে না?এনসিসি পদ্ধতির ট্রেনিং (পিটি, প্যারেড, বন্ধুক চালনা,ফাস্টএইড, সমাজ কল্যাণ ও রাজনীতি সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান ক্যাম্পের শরণার্থী সেবার মধ্যদিয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা সবই শিক্ষণ সূচীর মধ্য পড়বে)দেওয়াটা তো বিপজ্জনক কিছু নয় ভারতীয়। ছাত্রদের জন্য এনসিসি বাধ্যতামূলক, কিন্তু তার সঙ্গে ছাত্রদের রাজনৈতিক মতপথ জড়িয়ে তো কেউ দুশ্চিতা করেনা। কোন শত্রু পক্ষীয় লোক যাতে এই বিশেষ ট্রেনিং -এর সময় শিক্ষণকারী তরুণদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে আত্নগোপনে করে থাকতে না পারে তার জন্য স্কুটিনী ও স্ক্রীনিং করার পরে এই সুশিক্ষিত ও সুসংহত বিশাল যুব বাহীনি থেকে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী এবং কম্যান্ডো ও গেরিলা গ্রুপের জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে দীর্ঘদিন সৈন্য জোগানে সম্ভব।সমস্ত তরুণদের যদি আলাদাভাবে একটি সুশৃঙ্খল সংগঠনের মধ্যে সতর্ক বিধিনিষেধের নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় তাহলে স্ক্রুটিনী ও স্ক্রীনিং -এর কাজ অনেকটা সহজ হয়ে যাবে। এই অজস্র শরণার্থীদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করা একটি বিরাট দায়িত্ব এবং প্রচন্ড সমস্যা। পশ্চিমবাংলার আইন শঙখৃলা ব্যবস্থাটাই এতে দিশেহারা হয়ে পড়তে পারে।উপরন্তু এই হত দরিদ্র, শৃঙ্খলাহীন ভারতে এই দেশত্যাগী হৃতসর্বস্ব মানুষের স্রোত যে অঅর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট সৃষ্টি করবে সেই পরিস্থিতিতে শত্রুপক্ষের ষড়যন্ত্রকারীরা ধূমায়িত সাম্প্রদায়িক সুযোগ নিতে চেষ্টা করবে।কিন্তু বাংলাদেশের সমস্ত শরণার্থী যুবকদেরই

যদি নিয়ম শৃঙ্খলার আওতায় আনা যায় তবে তার প্রভাবে সমগ্র শরণার্থী স্রোতই নিয়ন্ত্রিত হবে।এই তরুণেরা শরণার্থীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থের দিকে লক্ষ্য রাখবেন।অতত্রব, সর্বাগ্রে বাংলাদেশ থেকে আগত যুবশক্তিকে পূর্ণত শৃঙ্খলাবদ্ধ করার মধ্যেই রয়েছে এই বিপর্যস্ত পরিস্থিতিকে সুনিয়ন্ত্রিত করার চাবিকাঠি। প্রত্যেক কর্মী ও সংগঠক কে ট্রেনিং দিয়ে শরণার্থী যুবশক্তিকে সুসংগঠিত করা ও সুনিপুণভাবে যুবশিবিরগুলি পরিচালনা করা নিঃসন্দেহে একটি অত্যন্ত কঠিন কাজ তবে অজস্র কর্মী পাওয়া সম্ভব। বহু শিক্ষিত ব্যক্তি, নানাবিধ কাজে যুক্ত মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষ, যথা অধ্যাপক, শিক্ষক, আইন ব্যবসায়ী সাহিত্যিক, ডাক্তার, ও ইঞ্জিনিয়াররা আজ বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম বাংলায় আশ্রয় গ্রহণ করেছেন।তাদের সকলকে এই উদ্দেশ্য সংঘবদ্ধ করা প্রয়োজন। চাকুরীর সন্ধানে,আশ্রয়ের সন্ধানে, উদ্দেশহীন ভাবে বৃথাঘুরে তাদের লাভ নেই।স্বদেশীয় মানুষ ও যুবকদের পক্ষথেকে এ সম্পর্কে আদেশ জারি করা উচিৎ। আমরা আশা রাখি যে, যদি জাতীয় স্বার্থে একটি বিরাট ফলশ্রুতিপূর্ণ পরিকল্পনার আয়ত্তে এঁদের নিয়ে আসা যায় তাহলে এঁদের অধিকাংশই জীবনের বিভ্রান্ত লক্ষ্যকে পুনরায় ফিরে পাবেন।ইতিহাস, জনস্বাস্থ্য, ভুগোল,অক্ষর পরিচয়, ব্যবস্থাপনা, রাজনীতি জ্ঞান,সহায়হীন শরণার্থী সেবায় আত্ননিয়োগ সমস্তই এই পরিকল্পনার বিষয়ীভূত হবে।যদি টেকনিক্যাল ট্রেনিংয়ের জন্য যথেষ্ট লোক পাওয়া যায় তাহলে ভারতীয়দের মধ্য থেকে কর্মী সংগ্রহ করে শুন্যস্থান পূর্ণ করা যাবে।এটা স্বাভাবিক যে মুসলমান শরণার্থীরা সংখ্যায় বেশী হবেন।এই হিন্দু শরণার্থীদের মনোবলই সবচেয়ে বেশি বিধ্বস্ত দেখা যাবে এবং বেশীর ভাগ হিন্দু যুবকেরা বাংলাদেশে আর ফিরে যাবার ইচ্ছা পোষণ করবে না।কিন্তু যদি বাংলাদেশ এবং ভারতের সর্বস্তরের নেতারা একযোগে এদের মধ্যে ব্যাপক, গভীর এবং সুশৃঙ্খলভাবে রাজনৈতিক কাজ করে যান তাহলে বাংলাদেশের প্রতি তাদের আস্থা ও বিশ্বাস আবার ফিরে আসবে।শরণার্থীদের মধ্যে বহু হিন্দু তরুণ সবকিছু সত্ত্বেও এখনো মুক্তিসংগ্রামে যোগ দিতে ইচ্ছুক। ট্রেনিং, অস্ত্রশস্ত্র, পরিকল্পনা ইত্যাদিসহযোগে এদের সুশিক্ষিত করে তুললে বাংলাদেশ পশ্চিম পাকিস্থানী সামরিক চক্রকে সার্বিকভাবে প্রত্যাঘাত করার মুহূর্তে এঁরা এগিয়ে যাবেন।এ কাজে প্রচুর টাকা দরকার এতে কোন সন্দেহ নেই।কিন্তু শরণার্থীদের ভরণপোষণের জন্য টাকা আমাদের যোগার করতেই হবে।বিক্ষিপ্ত বা আধাখেঁচড়াভাবে নয়, এতে বড় একটা যুব শক্তিকে প্রকৃত টেনিং দিতে হলে যে আরো কিছু বেশী টাকা দরকার তা সত্য।কিন্তু এই অর্থব্যয় পরিণামে উভয়ত লাভজনক হবে।শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনা এবং বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামের জন্য এক বিরাট শক্তিকে গড়েতোলা দুটি কাজই এতে সার্থক হবে।তবে পরিচ্ছন্ন শৌচাগার, পানীয়জল, পোষাক-পরিচ্ছদ, বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা,গ্রন্থাগার চিকিৎসা ব্যবস্থা এই সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া যুব-শক্তিগুলোর কাজ আরম্ভ করা ঠিক নয়।যাতে অতি প্রয়োজনীয় সাধারণ জিনিসগুলোর অভাবে তাদের মধ্যে অসন্তোষ ও বিরুক্তি দেখা না দেয় সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতেই হবে। যদি ভারত আজ এ দায়িত্ব যোগ্যভাবে গ্রহণ ও পালন করতে পারে তবে একদিন স্বাধীন বাংলাদেশ এজন্য ভারতকে আন্তরিক প্রীতি ও সৌহার্দ্য জ্ঞাপন করবে-আর অদূরভবিষ্যতে বাংলাদেশ কে পুনর্গঠিত করার কাজে স্বাধীন বাঙ্গালিরা এই লক্ষ লক্ষ সুশিক্ষিত সুনিয়ন্ত্রিত যুবকদের নিয়োগ করতে পারবেন।আজ যা অসহনীয় বোঝা মনে হচ্ছে, ভবিষ্যতে তাই এক বিশাল সজীব সোনার খনি বলে পরিগণিত হবে।চূড়ান্ত দুঃখজনক পরিস্থিতিকেও পরম মঙ্গলের প্রতি পরিচালিত করার এটাই এক মাত্র পথ। কিন্তু কে এই বিরাট পরিকল্পনার দায়িত্ব নেবেন এবং তা কার্যকরী করবেন?আজ অত্যান্ত তীক্ষ্ণ এবং দ্ব্যর্থহীন পদ্ধতিতে প্রত্যেকের দায়িত্ব প্রত্যেকের সামনে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে হবে।বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি, এবং ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের সামরিক কর্মচারীদের নিয়ে একটি উচ্চ ক্ষমতাশালী সংস্থা গঠন।

করতে হবে।প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, সমাজতত্ত্ববিদ,মনস্তত্ত্ববিদ ও সমাজ কর্মীদের উপদেষ্টা হিসেবে নিতে হবে। দুটি দেশের যৌথ ভবিষ্যতের পরিপ্রেক্ষিতে সকলকে আমরা প্রস্তাবটি ভেবে দেখতে অনুরোধ করছি।ক্ষিপ্র সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করলে পরিস্তিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে।মনে রাখা দরকার শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা কুরতে হবে’বিশ্বের দরবারে এটা কাতরকণ্ঠে বলে বেড়ালেও দায়িত্বটা বিশ্ববিবেক বা বিশ্বমানবতার নয়, তাদের দোষারুপ করার চেয়ে নিজেদের কতগুলি কমিটমেন্ট এ আসা বেশী প্রয়োজন। এক্ষুণি শরণার্থীরা ফিরতে পারবেন না।সম্মুখে দীর্ঘদিন এবং দীর্ঘপথ। উভয় দেশকেই এই মহান দুঃখ বহন করার শক্তি অন্তর থেকে অর্জন করতে হবে।বলহীনের কাছে কিছুই লভ্য নয়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৩৬। ফুলবাড়ি সীমান্তে পাকবাহিনীর গোলাবর্ষণঃ ৩ জন ভারতীয় আহত
দ্যা স্টেটসম্যান ১৯ জুন, ১৯৭১

Raisa Sabila
<১৪, ৩৩৬, ৮২৬-৮২৭>

ফুলবাড়ি সীমান্তে পাকবাহিনীর গোলাবর্ষণঃ ৩ জন ভারতীয় আহত
সুত্রঃ দ্যা স্টেটসম্যান
তাঃ ১৯ জুন, ১৯৭১

কৃষ্ণনগর, ১৮ই জুনঃ
উক্ত বার্তা অফিস থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরের ফুলবাড়িতে অবস্থিত ভারতীয় সীমান্ত ঘাটিতে আজ পাকিস্তানি বাহিনী লম্বা সময় ধরে শেলিং আক্রমন চালিয়েছে, যা এযাবতকালে তাদের চালানো সবচাইতে বড় হামলা ছিল এবং এ হামলায় তিনজন ভারতীয় গ্রামবাসী ও একজন বাঙালি পলাতক শরণার্থী আহত হন।

আজ ভোর ৪টা থেকে পাকিস্তানিরা আক্রমন শুরু করে এবং প্রায় ৭ ঘণ্টা যাবত তারা গোলাবর্ষণ অব্যাহত রাখে। তারা আক্রমনে হালকা মেশিনগান, মরটার ও ২৫ পাউন্ডার ব্যবহার করে। যদিও ভারতীয় সীমান্তে এর ফলে কোন ধরনের হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। আহতদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গেদে, দাহকুলা ও শিকারপুর অঞ্চলেও পাকিস্তানিদের নিক্ষেপ করা শেল পতিত হয়। প্রতিটি স্থানেই ভারতীয় সীমান্ত প্রতিরক্ষা বাহিনী এই গোলাবর্ষণের উপর্যুপরি জবাব দিয়েছে, এবং এই গুলি বিনিময় আজ রাত পর্যন্ত চলছে।

কুষ্টিয়া অঞ্চলে একটি পাকিস্তানি বিমান সীমান্তের কাছাকাছি এলাকাগুলো ঘুরে পরিদর্শন করতে দেখা গেলেও, তারা ভারতীয় আকাশসীমায় প্রবেশ করেনি।

এর মধ্যে, আজ বাংলাদেশের দক্ষিন পশ্চিম অঞ্চলে অবস্থিত কুষ্টিয়া জেলার করাইপারা সীমান্তের দখলে থাকা বাংলাদেশী মুক্তিযোদ্ধাদের বাহিনী তাদের ঘাতি ত্যাগ করে তেতুলবাড়িয়াতে অবস্থান নিয়েছে। উক্ত সীমান্ত ঘাটিটি গত ১৬ই জুন তারা দখল করলেও আজ এ অঞ্চলে পাকিস্তানিরা তাদের শক্তিবৃদ্ধির জন্য নতুন অস্ত্র ও লোকবল আমদানি করাতে তারা হঠে যেতে বাধ্য হল। তেতুলবাড়িয়াতে এখন তারা নতুন করে প্রতিরক্ষা ঘাটি গড়ে তুলেছে।

ফুলবাড়ি সীমান্তের ঠিক এপাশের অঞ্চলের নাম কাদিপারা (যা পশ্চিম বাংলার নদীয়া জেলায় অবস্থিত)। আমাদের করিমগঞ্জের বার্তাবাহক বলেনঃ করিমগঞ্জের সীমান্ত থেকে বাংলাদেশী মুক্তিযোদ্ধারা ওপাড়ে প্রবেশ করে ধীরে ধীরে আগাচ্ছে এবং করিমগঞ্জের মানুষ গত বুধবার সকালেও মর্টার ও লাইট মেশিনগানের শব্দ পেয়েছে বলে জানিয়েছে।

লাটু ও বড়লেখা এলাকার মধ্যবর্তী যে দোলনী ব্রিজ, তা মুক্তিবাহিনীরা উরিয়ে দিয়েছে। শিলুয়া চা বাগানের লোকেরা পাকিস্তানিদের চর হিসেবে কাজ করছিল বলে, মুক্তিযোদ্ধারা বাগানে অবস্থিত চা ফ্যাক্টরিটি উরিয়ে দিয়েছে। এই তথ্যটি পৌছে দিতে দুইজন মুসলিম লীগ নেতা একটি গাড়িতে করে পাকিস্তানি আর্মিদের ক্যাম্পের দিকে যেতে থাকলে, মুক্তিযোদ্ধারা সেই গাড়িটিও উড়িয়ে দেয়ে এবং এই দুই নেতাকে হত্যা করে। করিমগঞ্জ সীমান্তের অপারে সুতারকান্দি এলাকা থেকেও মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনের খবর আসছে। গত ১৫ জুন পাকিস্তানি আর্মিরা করিমগঞ্জ শহরের কাছেই বাংলাদেশে অবস্থিত বালট অঞ্চলে তিনজন হিন্দুকে হত্যা করে ও দুইজন নারীকে ধর্ষণ করে।

আমাদের রাজগঞ্জ এলাকার বারতাবাহক বলেন, তেতুলিয়া এখন সম্পূর্ণভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে এবং দিনাজপুরের পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও এলাকাতেও তারা পাকিস্তানি বাহিনীর উপর কঠিন হামলা চালাচ্ছে এবং এর ফলে প্রচুর পাকসেনা হতাহত হচ্ছে। পশ্চিম দিনাজপুর অঞ্চলের টাঙ্গন থেকে বংশিহারি পর্যন্ত নদীতে গুলিবিদ্ধ পাকসেনাদের মৃতদেহ ভাসতে দেখা যাচ্ছে।

আমাদের আগরতলা অফিস বলছেঃ সীমান্তের ওপার থেকে কিছুটা বিলম্বে হলেও খবর এসেছে যে রামগর এলাকার কেরেরহাটে গত ৯ জুন থেকে প্রায় ৩ দিন ধরে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকবাহিনীর মধ্যে এক ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং এতে প্রায় ২০০ পাকসেনা হতাহত হয়। ১১ জুন কেরেরহাটে প্রায় ১৫০ জন পাকসেনার মৃতদেহ প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়। যদিও, ১২ই জুন পাকিস্তানি সেনারা নয়া শক্তিবলে বলীয়ান হয়ে পুনরায় হামলা চালালে মুক্তিযোদ্ধারা সেখান থেকে সরে যায়।
মোহনপুর সীমান্ত এলাকার ওপাড়ে অবস্থিত সিলেট অঞ্চলের দক্ষিনাংশে অবস্থিত সিধন এলাকায় প্রায় ২০ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে গত মঙ্গলবার সারারাত ধরে পাকবাহিনী নির্বিচারে শেলিং করার গলে মোহনপুর সীমান্ত এলাকায় প্রায় ২০,০০০ শরণার্থী বুধবার প্রবেশ করে, যাদের মধ্যে নারী, পুরুষ শিশু সকলেই আছে, এবং তারা প্রায় সবাইই মুসলিম। সিধন থেকে মোহনপুর এলাকার মধ্যবর্তী পুরো ৮ মাইল রাস্তা জুরেই শরণার্থীদের প্রবাহ দেখা গেছে, এবং তারা পায়ে হেটে আগরতলার দিকে যাত্রা করছেন। শরণার্থীরা বলছেন যে পাকিস্তানিরা এতই বেশি শেলিং হামলা চালিয়েছে যে প্রায় ৩০টির বেশি গ্রাম আগুনে পুড়ে ভস্ম হয়ে গিয়েছে, প্রায় ৫০০০০ মানুষ ঘরছাড়া হয়েছেন এবং হতাহত ও হয়েছেন প্রচুর সংখ্যক মানুষ।

গতকাল ত্রিপুরায় অবস্থিত বাংলাদেশী শরণার্থীদের জন্য পাঠানো প্রথম বিদেশী ত্রাণ সরবরাহটি এসে পৌঁছেছে। আজ আগরতলায় কানাডিয়ান বিমান বাহিনীর মাধ্যমে প্রায় ৪৯০০০ পাউন্ড ত্রাণ সহযোগিতা আগরতলায় এসে পৌছায়। এই ত্রাণ সরবরাহে শরণার্থীদের ছাউনি তইরির জন্য পলিথিন শিট, তেরপল, এন্টিবায়োটিক ঔষধ এবং প্রায় ৮ লক্ষ টাকা সমমূল্যের খাদ্যসামগ্রী অন্তর্গত ছিল। ভারত ও নেপালে ত্রাণ পাঠানোর জন্য এই বিমানটি অস্ট্রেলিয়ান সরকার ভাড়া করেছে। অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিশনের সেকেন্ড সেক্রেটারি ও কনসাল, মিঃ গ্রায়েম কে ই নুনান, যিনি আজ ত্রিপুরা সরকারের কাছে এই ত্রাণ হস্তান্তর করেন, তিনি হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন যে ১৯ জুন থেকে আশ্রয়ী শরণার্থীদের ত্রাণ সরবরাহ করার জন্য পুরো এক সপ্তাহ জুড়ে প্রতিদিন একটি করে বিমান অস্ট্রেলিয়া থেকে আগরতলায় পাঠানো হবে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
মার্কিন অস্ত্রে বাংলাদেশে রক্ত ঝরানো চলবে না কালান্তর ২৫ জুন ১৯৭১

Bashneen Faham
<১৪, ৩৩৭, ৮২৮>

মার্কিন অস্ত্রে বাংলাদেশে রক্ত ঝরানো চলবে না
৮ টি শরণার্থী শিবিরে কেলোগের সামনে মার্কিন বিরোধী বিক্ষোভ
বনগাঁ, ২৪ জন- মার্কিন সরকারের শরনার্থী দপ্তরের প্রতিনিধি শ্রী ফ্রাঙ্ক কেলোগ আজ সীমান্ত অঞ্চলের শরনার্থী শিবিরগুলি পরিদর্শন করতে এলে কমপক্ষে ৮ টি স্থানে মার্কিন অস্ত্র সাহায্যের প্রতিবাদে এক বিরাট সংখ্যক জনতার বিক্ষোভের সম্মুখীন হন।

বিক্ষোভকারীরা তাঁর সামনে ‘খুনী ইয়াহিয়াকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ কর’, ‘দ্বি-মুখী নীতি বন্ধ কর’ ও ‘মার্কিন অস্ত্রে বাংলাদেশে রক্ত ঝরানো চলবে না’ প্রভৃতি শ্লোগানসহ বিক্ষোভ প্রকাশ করেন বলে ইউএনআই জানিয়েছেন।

যশোহর রোড ও বাগদা রোডের বিভিন্ন স্থানে, বনগাঁ সদর হাসপাতালে ও মালঞ্চ শরনার্থী শিবিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রচন্ড বিক্ষোভ দেখানো হয়।

মালঞ্চ শিবিরে শ্রী কেলোগ উপস্থিত হওয়া মাত্র শরনার্থী্রা তাঁকে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নে জর্জরিত করে তোলেন। দু’জন শরণার্থী তাঁকে সরাসরি প্রশ্ন করে জানতে চান,-তাঁর এখানে আসার উদ্দেশ্য কি। শরনার্থী দু’জন বলেন, যখন তোমার দেশ পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ করেছে তখন তুমি এখানে কোন উদ্দেশ্যে এসেছো?

প্রশ্নের জবাবে শ্রী কলোগের সহযোগী মার্কিন কনসাল জেনারেল হার্বার্ট বলেন যে, তাঁরা শরনার্থীদের জন্য আরও বেশী পরিমাণ সাহায্য দানের উদ্দেশ্যেই এখানে এসেছে।
শ্রী কেলোগ বনগাঁ সদর হাসপাতালে পৌছুলে সেখানেও তাঁকে সৈন্যদের গুলিতে আহত শরনার্থীরা রয়েছেন।

প্রসঙ্গতৎ উল্লেখযোগ্য যে, এই হাসপাতালে ইয়াহিয়ার সৈন্যদের গুলিতে আহত শরনার্থীরা রয়েছেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে তাঁর কাছে এক স্মারকলিপি পেশ করেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জেন ডঃ টি হোসেন শ্রী কেলোগের সামনে ৪ টি অল্পবয়স্ক ছেলে মেয়ে হাজির করিয়ে তাদের অবস্থা দেখান।

এই ছেলেমেয়েদের চোখগুলি ইয়াহিয়ার সৈন্যের আক্রমণে নষ্ট হয়ে গেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
পরিশেষে শ্রী কেলোগের স্বীকার করতে হয়েছে যে, পূর্ববঙ্গের অভ্যন্তরে সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটে গেছে।
শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৩৮। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অপকৌশল ও বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম কালান্তর ২৫ জুন ১৯৭১

Bashneen Faham
<১৪, ৩৩৮, ৮২৯>

(সম্পাদকীয়)
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অপকৌশল ও বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম

জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদের বিশেষতঃ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ সামরিক অভিযান ও পরোক্ষ সাহায্য আজ আর গোপন নয়। বিশ্বে এমন কোন দেশ নেই যেখানে স্বাধীনতার সংগ্রামকে দমন করার জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সামরিক সাহায্য করছে না। এটাই হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের ধর্ম। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

এতদিন যাবৎ মার্কিন সরকার বাংলাদেশে পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কুন্তিরাশ্র বিসর্জন করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে বিভ্রান্তির সৃষ্টির কৌশল গ্রহণ করেছিল। এখন তারা প্রতারকের মুখোশ ফেলে দিয়ে সরাসরি পাকিস্তানী জাহাজ বোঝাই করে অস্ত্র প্রেরণ করেছে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে ধ্বংস করার জন্য। পেন্টাগন থেকে স্বীকার করা হয়েছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া অস্ত্র বোঝাই জাহাজ করাচী অভিমুখে রওনা হয়েছে। সারা বিশ্বের মানুষ যখন ইয়াহিয়া খানের জাতিহত্যার বিরুদ্ধে নিন্দা ও প্রতিবাদে সোচ্চার, যখন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন ক্রমেই ব্যাপক হয়ে উঠেছে, তখনই মার্কিন সরকার তার ভেক পরিবর্তন করে পাকিস্তানকে সরাসরি সামরিক সাহায্য দানে অগ্রসর হয়েছে। তারা চায় পাক-ভারত উপমহাদেশের দ্বিতীয় ভিয়েতনাম সৃষ্টি করতে। সাড়ে সাত কোটি মানুষের বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে ধ্বংস করাই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বেরণনীতির অংশ। পাকিস্তানের সামরিক শাসনের পেছনে যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দৃঢ় সমর্থন রয়েছে এবং মার্কিন সাহায্যপুষ্ট হয়েই যে বাংলার মানুষের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়ার জাতিহত্যা অভিযান চলেছে তা আজ দিবালোকের মতো পরিস্কার। অতএব, এই সত্যের সম্যক উপলব্ধি না হলে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে সর্বপ্রকার প্রত্যাশা পরিত্যাগ না করলে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের শক্তিসমূহ ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না। এটা যেমন সার্বজনীন সত্য, তেমনই বাংলাদেশের পক্ষেও সত্য এবং বাস্তব। রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষকে এ সত্য উপলব্ধির পরীক্ষা দিতে হচ্ছে।

বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ নেতাদের একাংশ পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ থেকে রাজনৈতিক ও নৈতিক সমর্থন প্রত্যাশা করছেন বলেই এখনও বাংলার জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে সংহতি বা ঐক্য সৃষ্ট হয়নি। বাংলাদেশের মুক্তি-সংগ্রামের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকারকে মার্কিনী সামরিক সাহায্যদান নিশ্চয় আওয়ামী লীগ নেতাদের মোহমুক্ত করবে। বাংলাদেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তাদেরই ভৃত্য ইয়াইয়ার বিরুদ্ধে সার্বিক জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন যে অপরিহার্য এই সত্যটিকে আর অস্বীকার করার উপায় নেই। দলমত নির্বিশেষে যাঁরাই মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেছে তাঁদের ঐক্যের মধ্যেই সংগ্রামের দুর্বার শক্তি নিহিত রয়েছে। এটাই হল এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের মুক্তিসংগ্রামের অভিজ্ঞতা। এই মূল্যবান অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামীদের জন্য অমূল্য সম্পদ। আধুনিক মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত শত্রুর বিরুদ্ধে সার্বিক জাতীয় ঐক্য ব্যতীত অপর কোন পথ নেই। একমাত্র এই পথেই বাংলার শ্রমিক, কৃষক মধ্যবিত্ত এবং জাতীয় বুর্জোয়ার ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। একমাত্র এই পথেই বাংলাদেশের মানুষ ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে।

সার্বিক জাতীয় মুক্তি ফ্রন্টের যে সশস্ত্র বাহিনী সৃষ্টি হবে সেই বাহিনী সাধারণ মানুষের সাহায্যপুষ্ট হয়ে বাংলার স্বাধীনতার পথ উন্মুক্ত করবে, শত্রম্নকে নিধন করে মুক্ত অঞ্চল গঠনের মাধ্যমেই স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠিত করবে। এই সার্বিক ঐক্যের পথ হল গণতন্ত্র বিকাশের ঐতিহাসিক পথ। এই ঐক্যের বিনাশ নেই, পরাজয় নেই। একমাত্র এই পথেই বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম জয়যুক্ত হতে পারে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৩৯। মার্কিন সরকারকে সাফ জবাব দেওয়ার সাহস ভারত সরকারের নেই কালান্তর ২৫ জুন ১৯৭১

Bashneen Faham
<১৪, ৩৩৯, ৮৩০৮৩১>

রাজ্য সভায় ভূপেশ গুপ্তর অভিযোগ
মার্কিন সরকারকে সাফ জবাব দেওয়ার সাহস ভারত সরকারের নেই
পাকিস্তানকে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহ নিয়ে তীব্র উত্তেজনা

নয়াদিল্লী, ২৪ জন-মার্কিন সমরাস্ত্র বোঝাই দুই পাকিস্তানী জাহাজকে কেন্দ্র করে আজ রাজ্যসভায় এক দৃষ্টি আকর্ষণী প্রস্তাবে আলোচনাকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিং অত্যন্ত বেকায়দায় পড়েন।
ইউএনআই জানাচ্ছে, এক সময়ে কামিউনিস্ট সদস্য শ্রী ভুপেশ গুপ্তর সঙ্গে শরণ সিং এর তীব্র কথা কাটাকাটি হয়। শ্রী গুপ্ত অভিযোগ করেন, মার্কিন সরকারকে স্পষ্ট ভাষায় নিন্দা করার সাহস, ইচ্ছা এবং সিদ্ধান্ত এই সরকারের নেই।

দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি দাবী করেন, পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ না করার প্রতিশ্রুতি যে মার্কিন সরকার ভঙ্গ করেছে তার উপযুক্ত জবাব দেওয়ার জন্য ভারত আমেরিকার তেল এবং অন্যান্য ব্যবসায়িক স্বার্থ বজেয়াপ্ত করা হোক।

শ্রী গুপ্ত বলেন, মার্কিন সরকার এই ভাষাই বোঝে।

শ্রী শরণ সিং সদস্যদের কাছে মার্কিন সরকারের যে অভিমত ভারত সরকার জেনেছে তার এক বিস্তৃত বিবরণ দেন।

দৃষ্টি আকর্ষণীয় প্রস্তাবটি ছিল, ফরোয়ার্ড ব্লক সদস্য চিত্ত বসুর।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং সদস্যদের কাছে এক বিবৃতিতে বলেন যে, দু’টি জাহাজ মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানের পথে রওয়ানা হয়েছে সেই সমরাস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার জন্যে মার্কিন সরাকারের কাছে দাবী করা হয়েছে। এবং সঙ্গে সঙ্গে অতীত চুক্তির দোহাই দিয়ে আর নতুন কোন অস্ত্র সরবারাহ করা হবে না এই প্রতিশ্রুতি চাওয়া হয়েছে। শ্রী সিং এও জানান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই বিষয়ে জরুরী দৃষ্টি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ‘আমরা ওদের কাছে থেকে জবাবের প্রতীক্ষায় আছি’।

শ্রী সিং সদস্যদের উদ্বেগকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, ২২ জুন, নিউইয়র্ক টাইমস যে সংবাদ দিয়েছে তা সঠিক। গত ৮ মে এবং সর্বশেষ ১১ জুন ‘সুন্দর বন’ আর ‘পদ্মা’ পাকিস্তানী পতাকা উড়িয়ে নিউইয়র্ক থেকে রওনা হয়েছে এবং তাতে মার্কিন সমরাস্ত্র আছে।

তিনি জানান, ২২ জুন সন্ধ্যায় ওয়াশিংটনে ভারতের রাষ্ট্রদূত মার্কিন স্বরাষ্ট্র দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারির সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। নয়াদিল্লীর মার্কিন দূতাবাসেও বিষয়টি জানানো হয়।

শ্রী সিং বলেন, মার্কিন সরকারের বক্তব্য হলো ২৫ মার্চ এর পর পাকিস্তানকে কোন সমরাস্ত্র সরবরাহের অনুমতি বা রপ্তানি লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। ঐ জাহাজের মালগুলি আগের অর্ডার অনুযায়ী সরবরাহ হয়ে থাকতে পারে এবং এতে হয়ত এমন কিছু আছে যার জন্য রপ্তানি লাইসেন্সের প্রয়োজন হয় না। জাহাজে ৮টি বিমান থাকার কথা মার্কিন সরকার অস্বীকার করেছে। আর কোন নতুন জাহাজ যাবে কি-না সে সম্পর্কে সরকারের কাছে কোন তথ্য নেই বলে জানিয়েছেন তবে খোঁজ করে দেখেছেন। মার্কিন স্বররাষ্ট্র দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটরী জানিয়েছেন এতে কিছু সমরাস্ত্র থাকতে পারে। শ্রী সিং এর জবাবে অসন্তষ্ট সদস্যদের কেউ কেউ দাবি করেন ভারতের উচিত মাঝ দরিয়ায় জাহাজ দু’টির পথ আটকানো। জবাবে শ্রী সিং বলেন ঐ কর্মধারা হবে একটি সুচিন্তিত পরিকল্পনার ফলে। সাধারনতঃ সংঘর্ষে লিপ্ত দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ সম্প্রসারণের সময়ে ঐ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। অতএব সেকথা চিন্তা করেই এই কাজে হাত দেওয়া উচিত।
অন্য কয়েকজন সদস্য দাবি করেন এই কাজকে ভারত সরকার ‘অবন্ধু জনোচিত শত্রুতামূলক কাজ’ বলে ঘোষণা করুক এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের অধিকার সরকারের আছে এ কথা জানিয়ে দেওয়া হোক।

জবাবে শ্রী সিং বলেন, সভার সঙ্গে সরকারও উদ্বিগ্ন এবং দৃঢ় ভাবে মনে করে আরও সরবরাহ বন্ধ করা মার্কিন সরকারের কর্তব্য। সেক্ষেত্রে মার্কিন সরকার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা সম্পূর্ণ নাকচ করা হবে এবং বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খান যে বর্বতার অপরাধ করেছে তা মার্জনা করা হবে। তাছাড়া ‘অবন্ধু জনোচিত এবং শত্রুতামূলক কাজ’ এই কথাটা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অন্য অর্হত বহন করে।

কমিউনিস্ট নেতা ভূপেশ গুপ্ত অভিযোগ করেন ভারত সরকারের সাহস, সমাধান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের অভাব রয়েছে। পালাম বিমান ঘাঁটিতে শরণ সিং-এর মন্তব্য প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করেন যে, নিউইয়র্ক টাইমস-এর সংবাদ ভুল হতে পারে শ্রী সিং-এর এ কথা চিন্তা করার কারণ কি হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে ইয়াহিয়া বাহিনীর গণহত্যা ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করছে এ কথা মার্কিন সরকারকে ভারতের জানিয়ে দেওয়া উচিত।

এছাড়াও শ্রী গুপ্ত দাবি করেন যে, তেল ব্যবসা সহ সমস্ত মার্কিনী ব্যবসায়িক স্বার্থের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এই ভাষাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বোঝে, ‘আপনাদের ভাষা’ নয়।
তিনি আরও অভিযোগ করেন, নিউইয়র্কস্থিত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এল কে ঝা ভারতের মনোভাব সঠিকভাবে পাদপ্রদীপের আলোকে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৪০। বিক্ষুব্ধ ভারতের দাবি :
মার্কিন অস্ত্র বোঝাই পাক জাহাজ আর যেন না এগোয় যুগান্তর ২৫ জুন ১৯৭১

Bashneen Faham
<১৪, ৩৪০, ৮৩২-৮৩৩>

বিক্ষুব্ধ ভারতের দাবি :
মার্কিন অস্ত্র বোঝাই পাক জাহাজ আর যেন না এগোয়
(দিল্লী অফিস থেকে)

২৪ শে জুন-মার্কিন অস্ত্রশস্ত্রসহ যে দু’টি পাকিস্তানী জাহাজ নিউইয়র্ক থেকে করাচী পথে রওনা হয়ে গেছে তাদের মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে পাকিস্তানকে এই অস্ত্রশস্ত্র না দিবার জন্য ভারত মার্কিন সরকারকে আহবান জানিয়েছেন। পাকিস্তানকে মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র দেওয়া সম্পর্কে এক দৃষ্টি আকর্ষণী নোটিশের জবাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রী সর্দার স্বরণ সিং আজ সংসদে বলেন যে, মার্কিন সরকার জানিয়েছে যে, এই মাসে দু’টি পাকিস্তানী জাহাজ সামরিক সাজ-সরঞ্জাম পাকিস্তানকে দেওয়া হয়েছে।

এই অস্ত্রশস্ত্র পাকিস্তান যাতে না পায় সে জন্য মার্কিন সরকারকে চেষ্টা করতে বলা হয়েছে।
সর্দার স্বরণ সিং রাজ্যসভার সদস্যদের জানান যে, পূর্বে অনুমতি অনুসারেও পাকিস্তানকে যাতে আর কোন অস্ত্রশস্ত্র এখন না দেওয়া হয় সেজন্য ভারত সরকার মার্কিন কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে আশ্বাস চেয়েছেন।

মার্কিন সরকার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখছেন এবং আমরাও ওয়াশিংটন থেকে ঊত্তরের জন্য অপেক্ষা করছি।

পররাষ্ট্র মন্ত্রী আরও বলেন যে, ভারত সরকার মার্কিন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন যে, বর্তমানে যখন পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের নিরীহ নিরস্ত্র জনতার ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে তখন পাকিস্তানের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে শুধু এই উপমহাদেশেরই নয়, সমগ্র অঞ্চলের শান্তি বিঘ্নিত হবে।
তাছাড়াও এতে শুধু পাকিস্তানের প্রতি ক্ষমা দেখানো হবে না, আরও নির্যাতন চালিয়ে যাওয়ার উৎসাহ দান করা হবে।

তিনি বলেন, আমরা জানিয়েছি যে, এটা নিছক টেকনিক্যাল ব্যাপার নয়। একটি বিরাট অঞ্চলের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তার প্রশ্নও এটির সঙ্গে জরিত।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ওপর যে বলাৎকার চলছে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী মার্কিন সরকার পাক কর্তৃপক্ষের কোন প্রকার অস্ত্রশস্ত্র সামরিক সাজ-সরঞ্জাম দিয়ে তাতে সাহায্য করবেন না বলে ভারত অশা করে। যতদিন না ইসলামাবাদ কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে শরনার্থীদের আগমন রোধ করে ভারত থেকে শরণার্থীদের দেশে ফেরার ব্যবস্থা করেন ততোদিন যেন মার্কিন সরকার ইসলামাবাদকে সাহায্য দানে বিরত থাকেন।
সভার সকল শ্রেনীর সদস্যদের উদ্বেগে সম-অংশীদার হয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন যে, গত ৮ই ও ২১শে মে পদ্মা ও সুন্দরবন নামক দু’টি পাক জাহাজ মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে করাচীর পথে রওনা হয়ে গেছে বলে নিউইয়র্ক টাইমসে যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তা মোটামোটি ঠিক। চিত্র বসু এবং ২০ জন সদস্য দৃষ্টি আকর্ষনী প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও জানান যে, ওয়াশিংটনস্থ ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সংবাদ পাবার সঙ্গে সঙ্গেই ২২শে জুন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সহাকারী সচিবের সঙ্গে বিষটি নিয়ে আলোচনা করেন। ২৩শে জুন নয়াদিল্লীতে মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে বিষয়টি আলোচিত হয়।

মার্কিন সরকার জানিয়েছেন ২৫শে মার্চের পর পাকিস্তানকে অস্ত্রশস্ত্র প্রদানের কোন অনুমতি দেওয়া হয়নি বা ব্যবসায়িক ভিত্তিতে অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় সংক্রান্ত কোন চুক্তি অনুমোদন করা হয়নি, অথবা এই দিনের পর পুরনো কোন লাইসেন্সের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়নি।

ভারতের অনুরোধে বিবেচনা করা হচ্ছে

নয়াদিল্লী, ২৪শে জুন (ইউএনআই)- ভয়েস অব আমেরিকার এক রিপোর্টে জানা গিয়েছে যে, সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে দু’টি পাকিস্তানী জাহাজ করাচীর পথে রওনা হয়েছে তাদের যাত্রা বন্ধ করার জন্য ভারতের অনুরোধ মার্কিন সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৪১। ধরা পরেছে মার্কিন ফাঁকি
আনন্দবাজার ২৫ জুন ১৯৭১

Bashneen Faham
<১৪, ৩৪১, ৮৩৪-৮৩৫>

সম্পাদকীয়
ধরা পরেছে মার্কিন ফাঁকি

মার্কিন সমর সম্ভার নিয়ে পাক-জাহাজগুলো করাচীর দিকে এগুচ্ছে। সংসদে উত্তেজনা বাড়ছে। সবাই জানে বাংলাদেশের কপালে দুঃখ অনেক। যারা গণতন্ত্র রক্ষায় উৎসর্গিত প্রাণ বলে কথিত তাঁরাই সেজেছেন ভক্ষক। তাঁদের অস্ত্র ব্যবহৃত হবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনে। ভারতের জনসাধারণ ক্ষুদ্ধ এবং রাগে ফেটে পড়েছেন বাংলাদেশের জনতা। শরণার্থীরা প্রতিবাদমুখর। ওরা ঘেরাও করছেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের পরিদর্শনে। দুর্গত মানুষগুলো বুঝতে পারছে না মার্কিন কর্তৃপক্ষের দ্বৈতনীতি। এদিকে তাঁরা শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশায় চোখের জল ফেলছেন, অপরদিকে বাংলাদেশের দুষমনদের হাতে তুলে দিচ্চেন মরণাস্ত্র। মানুষ মরার ব্যবসা এবং মানবতার উচ্চগ্রামী নিনাদের মধ্যে সামঞ্জস্য রাকা কঠিন কাজ। ওয়াশিংটনের যুক্তি দুর্বল। তাঁরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের আগে কোন মার্কিন অস্ত্র যাবে না পাকিস্তানে। দুনিয়ার সামনে নতুন করে প্রমাণিত হয়েছে, মার্কিন প্রতিশ্রুতি ভূয়া। তার নেই কোন বাস্তব মূল্য। ওঁদের কথায় এবং কাজে ধরা পড়েছে লজ্জাজনক অসংগতি। সংসদ সদস্যদের উত্তেজনা খুবই স্বাভাবিক। তাঁদের প্রশ্নবাণে নাজেহাল কেন্দ্রীয় সরকার। সাঝদরিয়া থেকে পাক-জাহাজের মার্কিন সম্ভার তুলে নেবার দাবি জানাচ্ছেন নয়াদিল্লী। অবাস্তব পাঁয়তারা। জ্ঞানপাপীকে জ্ঞানদান অসম্ভব।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বরণ সিং বিব্রত। কত আশা নিয়ে তিনি গিয়েছিলেন আমেরিকায়। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে তিনি করেছিলেন আলাপ-আলোচনা। অখন্ড বিশ্বাস নিয়ে ফিরেছেন তিনি দেশে। লিখিত বিবৃতিতে স্বরণ সিং বলেছেন, গণতন্ত্রের একনিষ্ঠ সেবক মার্কিন সরকার সত্যভ্রষ্ট হবেন না। তারপরই হাতেনাতে ধরা পরেছে গণতন্ত্রের মহামান্য সেবকদের কান্ডকারখানা। স্বরণ সিং-এর সার্টিফিকেট প্রকৃতপক্ষে সত্যের আপলাপ। এই লাইন ক’টি বাদ দেবার জন্য সংসদে উঠেছিল দাবি। কেটে দিলে হয়ত খুশি হতেন মাননীয় সদস্যরা। কিন্তু তাতে মার্কিন সরকারের টনক নড়ত না। ভারতের দেওয়া সুনাম কিংবা বদনামে তাঁরা থোড়াই কেয়ার করেন। পাক-ভারত শক্তিসাম্য বজায় রাখা তাঁদের নীতি। চীনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মার্কিন কর্তার করবেন পাক-তোষণ। তাতে যদি গণতন্ত্র কিংবা বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ জাহান্নামে যায়, যাক। এ নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় নেই আমেরিকার। বলদর্পিত ধনীদের চিন্তাধারা আলাদা। উন্নয়নশীল দেশগুলোর হাত-পা তাদের লেজের সঙ্গে বাঁধা। ওরা জানে কিছুক্ষণ ছটফটনির পর গরীবেররা ধর্না দেবে তাদের দরজায়। টাকা পেলেই সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক শালীনতার মাপকাঠি বানাবে তারাই। অবশিষ্ট দুনিয়া মেনে নেবে ওদের নিরূপিত সভ্যতার নিত্যনতুন সংজ্ঞা। বেশি দিন আগের কথা নয়, ১৯৬৫ সালে মার্কিন অস্ত্র নিয়ে আয়ুব খান লাড়াই-এ নেমেছিলেন ভারতের বিরুদ্ধে। তখনও মার্কিন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এসেছিল প্রতিশ্রুতি খেলাপের অভিযোগ। তাতে কান দেবার দরকার বোধ করেনি আমেরিকা। মার্কিন অস্ত্র ইসরাইলে গেলে ক্ষেপে ওঠে আরব দুনিয়া। ওরা বলে এসব অস্ত্র ব্যবহৃত হবে ইসরাইলী নির্যাতিত আরব হননে। এসব অস্ত্র যখন পাকিস্তানে যায় তখন তারা নীরব। অনেকে নীরব। অনেকে মনে মনে খুশী। একথা তাদের ধারণায় আসে না যে, মার্কিন মারণাস্ত্র প্রযোজ্য হবে বাংলাদেশের বাঙালি হননে। এগুলো ব্যবহার করবেন নরঘাতক ইয়াহিয়া খান। ওরা ভাবে, মুসলমান ইয়াহিয়া নির্বিচারে বাঙালি হিন্দু-মুসলমান খুন করলে দোষ নেই। যত দোষ ইসরাইল যদি আরব নিধনযজ্ঞ চালায়। বর্তমান দুনিয়ায় একমাত্র আমেরিকাই বিবেক বর্জিত সুবিধাবাদী নয়, অন্যেরাও বড় কম যায় না।

দুর্ভাগ্য ভারতের। এই স্বার্থদুষ্ট দুনিয়ার মুখের দিকে চেয়ে আছে নয়াদিল্লী। লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর ভারে নুইয়ে পড়ছে তাঁদের অর্থনৈতিক কাঠামো। আকাশে জমা হচ্ছে সামাজিক অর্থনৈতিক বিপ্লবের কালমেঘ। শরনার্থীদের স্বদেশে ফেরত না পাঠালে নয়। যাঁকে পর্যুদস্ত করলে এদের প্রত্যাবর্তনের পথ হবে। সুগম, তাঁর হাতই জোরদার করছেন মার্কিন সরকার। বারবার হুমকি দিচ্ছেন নয়াদিল্লী-বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে দুনিয়া এগিয়ে না এলে ভারত নেবে তার নিজস্ব ব্যবস্থা। এ নিজস্ব ব্যবস্থাটা যে কি তা হয়ত নিজেই যানে না প্রধানমন্ত্রী। নয়াদিল্লীর তর্জন গর্জনে পাত্তা দিচ্ছে না কেউ। সবাই ভাবছে, ভারত সরকার যত গর্জায় তত বর্ষান না। সেভিয়েত রাশিয়ার কূটনৈতিক তৎপরতা নাকি গত কয়েকদিনে বেশ বেড়ে গেছে। বৃটিশ সরকার শূন্যে ফানুস ফাটিয়েছেন- পূর্ব বাংলার গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধান দরকার। তা না হলে কোন বৃটিশ সাহায্য নাকি যাবে না পাকিস্তানে। ফরাসীরা আদর্শের চেয়ে অস্ত্রের ব্যবসাটা ভাল বুঝেন। আদর্শের কচকচানীতে ওঠে বুদবুদ। আর অস্ত্রের ব্যবসায়ে আসে টাকা। বুদবুদের চেয়ে টাকার দাম বেশি। ইয়াহিয়াকে নিস্ক্রিয় করার জন্য দুনিয়া কি করেছে, জানেন না ভারতের জনসাধারণ। নয়াদিল্লীর কথায় অনেকেরই নেই কোন আস্থা। ওঁদের মূল্যায়ন মিলছে না বাস্তব অবস্থার সঙ্গে। বিশ্বজনমতের একটা দাম অবশ্যই আছে। কিন্তু সবার উপরে বাহুবল। এই বলের সার্থক প্রয়োগ করতে পারলে বিশ্বজনমতের মোড় ঘুরতে বেশি সময় লাগে না। নয়াদিল্লী আত্মস্থ হোন। বৃহৎ রাষ্ট্রগুলো তাদের ফাঁকি দিচ্ছে। ভারতের জনমতঈ বিগড়ে যাচ্ছে। নয়াদিল্লীর শক্তির উৎস নিম্নগামী। আর দেরী নয়। স্বাধীন বাংলাদেশকে বাস্তব করে তুলুন। তা না হলে ভারতের ভরাডুবি অনিবার্য।

সম্পাদকীয়-আনন্দ বাজার পত্রিকা, ২৫ জুন, ১৯৭১।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৪২। কোন সামাধান না হলে ভারত যে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করতে বাধ্য : উর্দু পত্রিকার সম্পাদকের সভায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আভিমত কালান্তর ২৮ জুন ১৯৭১

Bashneen Faham
<১৪, ৩৪২, ৮৩৬>

কোন সামাধান না হলে ভারত যে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করতে বাধ্য :
উর্দু পত্রিকার সম্পাদকের সভায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আভিমত

নয়াদিল্লী, ২৭ জুন- ‘বিশ্বের রাষ্ট্রগুলিকে বিশেষ করে বৃহৎ শক্তিবর্গকে এখন এ কথা পরিস্কারভাবে জানিয়ে দেওয়ার সময় হয়েছে যে যথাশীঘ্রই বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান না হলে ভারত একান্ত আনিচ্ছার সঙ্গেই তার গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থগুলি রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় যে কোন ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য হবে।

ইউ এন আই জানাচ্ছে, আজ উর্দু পত্রিকার সম্পাদকদের তিন দিনের আলোচনার শেষে সাধারণতভাবে এই অভিমত ব্যক্ত হয়। সম্পাদকরা বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারত সরকারের নীতির প্রতি পুর্ন সমুর্থন ঘোষনা করেন।

তিন দিনব্যপী এই আলোচনা চক্রে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে উর্দু পত্রিকার প্রায় পাঁচশ’ জন সম্পাদক অংসগ্রহন করেন।

সেমিনার ইয়াহিয়া খানের সামরিক প্রশাসনকে এখনও সমরাস্ত্র যোগান দেওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য কয়েকটি দেশের আচরণের তীব্র নিন্দা করেন।

বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ শরনারথীর প্রতি আন্তরিক সহানুভুতি জানিয়ে সম্পাদকরা বলেন, সমস্যাটি কেবল মানবিক নয়। পাকিস্তানের সামরিক জুন্টার সীমাহীন নৃশংসতা ও নিষ্ঠুরতার নিরীহ শিকারদের কেবল খাদ্য এবং আশ্রয় দিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।

তাঁরা বলেন, ‘মুক্তি এবং ঔপনিবেশিকতাবাদী শক্তির মধ্যে এই সংঘর্ষের সমাধান কেবল বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্খার স্বীকৃতির ভিত্তিতেই সম্ভব’।

দেশে এবং বিদেশে উর্দু পত্রিকার বিরুদ্ধে কায়েমী স্বার্থ যে কুৎসা করছে এঁরা তার প্রতিবাদ করেন। এঁরা দাবি করেন উর্দু সংবাদপত্রগুলি ‘আমাদের জাতীয় নীতি’ রূপায়িত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

এ দেশে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম এবং পাক-ফৌজের দ্বারা অনুষ্ঠিত নৃশংসতাকে ভারতে এবং বিদেশের কোন মহল সাম্প্রদায়িক বলে চালানোর যে চেষ্টা করেছে সম্পাদকরা তার তীব্র প্রতিবাদ করেন।
শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৪৩। একটি রাজনৈতিক সমাধান (সম্পাদকীয়) দি স্টেটসম্যান ৩০ জুন ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ৩৪৩, ৮৩৭>

সম্পাদকীয়
দি স্টেটসম্যান, ৩০ জুন ১৯৭১
মিলিটারি সমাধান

পূর্ববাংলার শরণার্থী যাতে তাদের বাড়িগুলিতে ফিরে আসতে পারে এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে সরাসরি পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য দিল্লি যথেষ্ট রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত দেখিয়েছে; ভারত পরিস্থিতিকে আরও জটিল করতে পারে, তার নিজেও জন্য এবং অন্যের জন্যও – যদি তারা পূর্ব পাকিস্তানে একটি মিলিটারি সমাধানের জন্য চেষ্টা করে। এটা দুর্ভাগ্যজনক হবে যদি সোমবারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সম্প্রচারে যা বলা হয়েছে – অর্থাৎ সরাসরি হস্তক্ষেপের কোন বিকল্প নেই বলে যে যুক্তি দেখানো হয়েছে সেটি যদি বিবেচিত হয়। যদিও খোলাখুলিভাবে বা প্ররোচনা দ্বারা প্রস্তাবিত হয়েছে যে একটি যুক্তিসঙ্গত রাজনৈতিক নিষ্পত্তি এখনও সম্ভব হতে পারে। জেনারেল ইয়াহিয়া এখন স্পষ্ট করেছেন যে তিনি পূর্ব বাংলায় যা চান তা কেবল সামরিক সমাধান ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি দাবি করেন যে পূর্ববাংলার অবস্থা স্বাভাবিকের দিকে ফিরে এসেছে; যদিও সামরিক আইন অব্যাহত থাকবে। জাতীয় পরিষদ আহ্বান করা হবে, কিন্তু সেখানে একটি সংবিধান প্রণয়নের অনুমতি দেওয়া হবে না এবং যে দলটি অধিবেশনে বেশিরভাগ আসনে জিতেছে, তাদের সংসদে বসতে দেয়া হবে না। প্রকৃতপক্ষে যদি আওয়ামী লীগের কোন সদস্য এসেম্বলিতে বসে তবে তাকে তার দলের আনুগত্য অস্বীকার করতে হবে, অন্যরা অযোগ্য হয়ে যাবে এবং তাদের আসন নির্বাচনের মাধ্যমেই ইসলামাবাদের মনোনীত প্রার্থীদের দ্বারা পূর্ন করা হবে।

সাধারণ শব্দে পূর্ববাংলার উপর পশ্চিম পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আধিপত্য সামরিক শক্তির দ্বারা বহাল থাকবে, কিন্তু এই দমনমূলক আইনকে বৈধতা দেয়ার জন্য প্রতীক হিসাবে উপস্থাপন করার জন্য এখন পুতুল অসামরিক সরকার গঠন করা হবে। এটি একটি নগ্ন সামরিক একনায়কত্বের চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক হতে পারে। কিছু সময় পরে পূর্ববাংলার অসহায় লোকেরা নিজেদেরকে এই ভয়ানক প্রতারণার থেকে ইস্তফা দিতে পারে এবং বাইরের দেশগুলো এটাকে জনপ্রিয় স্বীকৃতির কিছু প্রমাণ হিসেবে দেখতে পারে। বিশ্বকে অবশ্যই এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, তারা ইয়াহিয়া শাসনের এই নিষ্ঠুর কৌশলের সাথে থাকবেন কিনা – যা প্রত্যেক গণতান্ত্রিক নীতির চূড়ান্ত বরখেলাপ। নিক্সন প্রশাসন পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করে নিজের সন্মান ঢেকে রাখতে পারেনি, কিন্তু সে এখনও রাজনৈতিক নিষ্পত্তির ধারণা দেবার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং এখনও ইসলামাবাদকে স্থায়ী সামরিক সমাধানের পথ ত্যাগ করার কথা বলতে পারে। অন্য দেশগুলো, যারা বিশেষ করে পাকিস্তান সরকারকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একটি নিষ্পত্তি করার আহ্বান জানিয়েছেন তাদের চাপকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের সামরিক সমাধানের চেষ্টা অন্যদেরকে একই উপসংহারে পৌঁছাতে বাধ্য করবে না। তথাকথিত শক্তিশালী পদক্ষেপ কেবল পূর্ব বাংলায় রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধানেই নিহিত রয়েছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৪৪। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে নিহত সাড়ে তিন হাজার পাক আফিসারের মৃতদেহ করাচীতে কবরস্থ কালান্তর ৩ জুলাই, ১৯৭১

Bashneen Faham
<১৪, ৩৪৪, ৮৩৮-৮৩৯>

মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে নিহত সাড়ে তিন হাজার পাক আফিসারের মৃতদেহ
করাচীতে কবরস্থা। দড়ি বেঁধে বাংলাদেশ থেকে জাহাজ বোঝাই মেয়ে চালান :
করাচী প্রত্যাগত প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ

কলকাতা, ২ জুলাই-গত ২৫ মার্চ থেকে ২ মাসের ভেতর পাক বাহিনীর সাড়ে তিন হাজার উচ্চপদস্থ কর্মী ও মৃতদেহ ঢাকা থেকে করাচী পেশোয়ারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং সেখানে কবর দেওয়া হয়েছে। খান সৈন্যদের দৃষ্টি এড়িয়ে করাচী থেকে সীমান্ত পার হয়ে আসা প্রত্যেক্ষদর্শী জনৈক পাক বিমান বাহিনীর কর্মী আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এ কথা জানান। পাক বিমান বাহিনীর কমিটি আজ কলকাতা এসে পৌছেছেন।

২৫ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত কমীটি নজরবন্দী আবস্থায় ছিলেন। তিনি জানান, ২৬ মার্চ ভোরে বিমান বাহিনীর কর্মীদের শিবিরে এসে খান সৈন্যবাহিনীর অফিসারেরা বাঙালী কর্মীদের আলাদা করে এবং তাঁদের নিরস্ত্র করে দেয়। খান সৈন্যবাহিনী বাঙালি কর্মীদের এমনকি সংরক্ষণ বিভাগের কাজ থেকে এবং মেনটেনেন্স বিভাগের কাজ থেকেও সরিয়ে এনেছে।

এই প্রত্যক্ষদর্শী জানান, বাংলাদেশে খান সৈন্যবাহিনীর বহু সৈনিক ও অফিসার যে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মার খেয়েছে, তাঁরা করাচীতে বসেই টের পেয়েছেন।

খান সৈন্য বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মী ও অফিসার যাদের মৃতদেহ করাচী এবং পেশোয়ারে বিমানযোগে বিমানবন্দরে বহন করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এমন সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন হাজার। তিনি জানান, করাচীতে ড্রাইডেন সিনেমা হলের পাশে সরকারী কবরস্থানে এবং প্রতিরক্ষা বিভাগের কবরস্থান ও পেশোয়ারের কবরস্থানে এইসব মৃতদেহ কবর দেওয়া হয়েছে। এই মৃত ব্যক্তিদের নাম করাচীর ‘বি আর অর্ডারে’ লিপিবদ্ধ আছে। প্রত্যক্ষদর্শী এই বিমান বাহিনীর কমীটি আরও জানান যে, বাঙালি সৈনিকদের নিরস্ত্র করে রাখার পর তাদেরকে নজরবন্দী আবস্থায় দিন কাটাতে হয়েছে। এবং সেই সময় বর্তমান শসকগোষ্ঠী বাংলাদেশের কত উন্নতি করেছে এবং বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থা যে কত শান্ত তা প্রচার করে প্রদর্শিত সিনেমা এই নজরবন্দী বাঙালিদের দেখতে হয়েছে।

মেয়েদের দড়ি দিয়ে বেঁধে করাচী নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

এই প্রত্যক্ষদর্শী আরো জানান যে, চট্টগ্রাম বন্দরে এফ এন এস ঢাকা, বাবর এবং এফ এন এস খাইবার নামে যে তিনটি জাহাজ ছিল, সেই জাহাজ তিনটি করাচী ফিরে যাওয়ার পথে বহু বাঙালি মেয়েকে করাচীতে নিয়ে গিয়েছে। তিনি জানান এই সমস্ত মহিলাদের যখন করাচী বন্দরে নামানো হয় তখন এঁদের হাতে পরস্পর দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল এবং প্রত্যেকেরই কোমরেও দড়ি বাঁধা ছিল। এই সমস্ত মহিলাদের এখন বিত্তশালী লোকের ক্রীতদাসী কিংবা রক্ষিতা হিসেবে রাখা হয়েছে।
করাচী থেকে বাংলাদেশে এখন কেউ করাচীতে আসছে না।

এই প্রত্যক্ষদর্শী আরো জানান যে, খান সৈন্যবাহিনীর যে সমস্ত কর্মী করাচীতে ৮০ টাকা বেতন পেতেন তাদের বর্তমানে ইয়াহিয়া চক্র চারশত টাকা বেতন দিয়ে বাংলাদেশে পাঠাতে চায় কিন্তু এতদসত্ত্বেও কেউ বাংলাদেশে আসতে ইচ্ছুক নয়। বেলুচীস্তানে ব্যাপক অত্যাচার

এই প্রত্যক্ষদর্শী আরো জানান যে , বেলুচীস্তানে ইয়াহিয়া চক্রের বিরুদ্ধে ব্যপক বিক্ষোভ হচ্ছে। তিনি বলেন খান সৈন্যবাহিনী বিক্ষুব্ধ মানুষকে দমনের জন্য ব্যাপক অত্যাচার চালাচ্ছে। তারা গ্রামে গ্রামে ভ্রম্যমাণ জঙ্গী আদালত বসিয়েছে এবং খান সৈন্য-বিরোধী মানুষের সম্পত্তি কেড়ে নিচ্ছে।

বিমান বাহিনীর এই কমিটি জানান যে, তিনি এখন তাঁর পিতা-মাতার সঙ্গে মিলিত হবেন এরপর মুক্তি যুদ্ধের সৈনিক হিসেবে যোগ দেবেন। তিনি জানান করাচীতে এখনো বিমান বাহিনীর বহু বাঙালি কর্মী নিরস্ত্র এবং নজরবন্দী অবস্থায় আছেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৪৫। পাকিস্তানকে অস্ত্র দেওয়া না দেওয়া যুগান্তর ৩ জুলাই ১৯৭১

Aparajita Neel
<১৪, ৩৪৫, ৮৪০-৮৪১>

সম্পাদকীয়
খোদ আসামি নিক্সন

আমেরিকা আরও অস্ত্র পাঠাচ্ছে পাকিস্তানে। এগুলো ব্যাবহ্রিত হবে বাংলাদেশের মরনযজ্ঞে। বিবেক বলে কোন যন্ত্র নেই মার্কিন কর্তাদের। মিথ্যার প্রলেপ দিয়ে ঢাকতে চেয়েছিলেন তারা নিজেদের অপরাধ। গত কদিন ধরে প্রচার চলছিল যত নষ্টের গোরা আমলাতন্ত্র। ওরাই অনাসৃষ্টির জন্য দায়ী। মার্কিন নীতিনির্ধারকরা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠানোর ওপর। তার ফাঁক ফোকর দিয়ে অস্ত্র যাচ্ছে পাকিস্তানে। এই ছেঁদা প্রলেপ একেবারে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। আসল রহস্য বেরিয়ে পড়েছে। খোদ আসামি আমলাতন্ত্র নন, প্রেসিডেন্ট নিক্সন নিজে। তিনিই খারিজ করেছেন আমালতন্ত্রের পরামর্শ। ব্যাক্তিগত দায়িত্বে অস্ত্র যোগাচ্ছেন ইয়াহিয়া খানকে। অজুহাত পুরনো, পাকিস্তানকে অস্ত্র না দিলে দেশটা চলে যাবে চিনের খপ্পরে। চিনের খপ্পর থেকে পাক জঙ্গিশাহিকে বাঁচানোর জন্য প্রেসিডেন্ট নিক্সন ডেকে আনছেন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটী মানুষের সর্বনাশ। হাতে হাঁড়ি ভাঙছেন শ্রী জয় প্রকাশ নারায়ণ। ওয়াশিংটনে তিনি দেখা করেছিলেন মার্কিন কররাদের সাথে। তারা বলেছিলেন বাংলাদেশের সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে ইসলামাবাদের একটা বোঝাপড়া দরকার। কাজের বেলায় দেখা যাচ্ছে অন্যরকম। বোঝাপড়ার বদলে বাংলাদেশকে সাবাড় করার মদদ দিচ্ছে আমেরিকা। প্রেসিডেন্ট আইনেজ হাওয়ারের আমলে নিক্সন ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। তিনি তখন রিপোর্ট দিয়েছিলেন, জোট নিরপেক্ষ ভারতকে বিশ্বাস নেই। পাকিস্তানই সত্যিকারের বন্ধু। তাকেই দেওয়া উচিত বিপুল পরিমাণ অস্ত্র সাহায্য। তারপর দুনিয়া চেহারা অনেক বদলিয়েছে। পদে পদে ধরা পড়েছে মার্কিন মূল্যায়নের ভুল ভ্রান্তি। প্রেসিডেন্ট নিক্সন শিখেন নি কিছু। সাবেকি মন দিয়ে তিনি ধরে আছেন মার্কিন প্রশাসন তরীর হাল।

নয়াদিল্লী রাগে ফেটে পড়েছে। ভারতীয় জনমত উত্তাল। কিসিঞ্জারের স্বস্তিবচনে জনতার উষ্মা বাড়ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং দিশেহারা। বড় আশা নিয়ে তিনি গিয়েছিলেন আমেরিকায়। অগাধ বিশ্বাস ছিল তার মার্কিন রাষ্ট্রনায়কদের উপর। শেষ পর্যন্ত তার কপালে জুটল বিশ্বাসঘাতকটা। যা বলছিল তা করল না আমেরিকা। ভারতে আগত শরনার্থিদের জন্য ওয়াশিংটন দেবেন টাকা। আর ইয়াহিয়ার শরনার্থি তৈরির যন্ত্রে তারা ঢালবেন অঢেল তেল। এই মার্কিন দ্বৈত নীতি বর্তমান দুনিয়ার নিদারুণ অভিশাপ। ইসলামাবাদে নরপশুদের অকৃত্রিম দোস্ত প্রেসিডেন্ট নিক্সনই নাকি স্বাধীন বিশ্বের জিম্মাদার এবং গণতন্ত্রর অতন্দ্র প্রহরী। দক্ষিণ ভিয়েতনামের জন্য তিনি চান স্বায়ত্তশাসন এবং বাচার অধিকার। আর বাংলাদেশের সম্পর্কে তার বিধান – ইসলামাবাদের জঙ্গি শাহীর ক্রীতদাসত্ব কিংবা সর্বাত্তক সংহার। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধি হৈ চৈ করে বেড়াচ্ছেন। মাঝে মাঝে ওয়াশিংটনের উপর কড়া বাক্যবাণ ছাড়ছেন। তাতে লাভ নেই কিছু। পাকিস্তানের সঙ্গে মার্কিন কর্তাদের গোপন আঁতাত দীর্ঘ দিনের। ওঁরা কিছুদেই ছাড়বেন না আশ্রিত খুনিদের। এমন আশ্রিত বাৎসল্যের কাছে বিবেকের বিলাস প্রত্যাশা অর্থহীণ।

এখন কী করবেন নয়াদিল্লী? ইয়াহিয়ার উপর ছাড়বেন না সত্যিকারের কোন আন্তর্জাতিক চাপ। বেঁকে দাঁড়িয়েছে আমেরিকা। মার্কিন জনমত তাকে সিধা করতে পারবে কিনা সন্দেহ। সোভিয়েত রাশিয়ার অবস্থা ধরি মাছ না ছুঁই পানি। অন্য যারা চেঁচামেচি করছেন তাদের প্রভাব সীমিত। আরব দুনিয়ার ধর্মবোধ বড় বেশি জাগ্রত। তাদের দৃষ্টিতে ইসলামিক ঐক্যের ধ্বজাধারী। বাংলাদেশের হিন্দুরা কাফের এবং মুসলমানেরা ধর্মচ্যুত। পাইকারি হারে তাদের নিধন কিংবা বিতাড়নে কোন দোষ নেই। ইয়াহিয়া যদি মুসলমান না হয়ে ইহুদি, খ্রিস্টান কিংবা হিন্দু হতেন তবে হয় আরব নেতাদের টনক নড়ত। আগুনে তাতান বালির উপর ধান দিলে এগুলো যেমন ফট ফট করে ফুটে তেমনি তারা ফুটতেন। নাসেরের মিশর ছিল প্রগতিবাদী বলে পরিচিত। এখন সেখানে কায়েম হয়েছেন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদত। তিনি দোস্তি করেছেন পাক সুহৃদ সৌদি আরবের সঙ্গে। ১৯৬৭ সালে খার্তুম চুক্তি অনুযায়ী মিশর পাচ্ছে সৌদির খয়রাতি টাকা। এখন আরও এগিয়ে গিয়েছে প্রেসিডেন্ট সাদত। নাসের বলতেন, আরব দুনিয়ার ঐক্যের ভিত্তি সাধারণতন্ত্র ও সমাজবাদ। আর সাদতের মতে আরবের শক্তির উৎস ধর্ম। সৌদি আরবের বাদশা ফয়সল মহা খুশি। তিনি মিশরকে দেবেন ইজরাইল বিরোধী মদদ। বিনিমিয়ে সাদত জোরদার করবেন ফয়সালের ঐস্লামিকঐক্য অভিযান। কিসের আশায় সময় কাটাচ্ছে নয়াদিল্লী? দুনিয়ায় বিবেক বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। যা আছে তা শুধু সংকীর্ণ আত্মস্বার্থ। ভালো কথার যুগ শেষ হয়েছে। বর্তমান যুগটা শক্তির যুগ। যার বাহুতে আছে বল এবং মনে আছে সংকল্পের দৃঢ়তা তাকেই সেলাম জানাবে দুনিয়া। নিজের পায়ে দাঁড়ান নয়াদিল্লী। স্বীকৃতি দিন স্বাধীন বাংলাদেশকে। দুর্বার করে তুলুন মুক্তিফৌজের সংগ্রাম। এপথেই আসবে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান। এবং শরনার্থিদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন।

সম্পাদকীয়, যুগান্তর, ৩ জুলাই ১৯৭১।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৪৬। পাকিস্তানী প্রচারণার বিরুদ্ধে হুশিয়ারি দ্যা স্টেটসম্যান ৪ জুলাই, ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ৩৪৬, ৮৪২>

দ্যা স্টেটসম্যান, ৪ জুলাই, ১৯৭১
পাকিস্তানী প্রচারণার বিরুদ্ধে মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতি হুশিয়ারি
আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি

নয়াদিল্লি, ৩ জুলাই- বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র আজ মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন পাকিস্তানি প্রচারণা থেকে ভুল বোঝা যাবে না। তিনি বলেন পাকিস্তানী সৈনিকদের দাঁড়া মুসলিম মেয়েদের ধর্ষণ করা কি ইসলামিক? মুসলিম ডাক্তার ও বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা কি ইসলামিক? মুসলিম গ্রামবাসীদের সম্পত্তি পুড়িয়ে ফেলা এবং মুসলমান নারী ও শিশুকে গণহত্যা কি ইসলামিক?

তিনি বলেন, মুসলিম দেশগুলির এই প্রশ্নগুলো নিজেদেরকে করা উচিত এবং তারপর শুধুমাত্র বাংলাদেশে দমন চালানো ও সন্ত্রাসের শাসন পরিচালনা করা ইসলামাবাদের সামরিক শাসকদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।

এখানে বাংলাদেশ মিশনের মুখপাত্র জনাব আমজাদুল হক একটি প্রেস কনফারেন্সে বলেছেন, তাঁর সরকারের প্রতি মুসলিম দেশগুলোর অবস্থান দুঃখজনক। তিনি এইসব দেশের বর্তমান মনোভাবকে “পাকিস্তানি সামরিক যোদ্ধাদের দ্বারা ইসলামের নামে জঘন্য প্রচারণার” ফল হিসাবে উল্লেখ করেছেন।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ একটি যৌক্তিক ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল এবং শুধুমাত্র ইসলামের ভিত্তে একতরফাভাবে পাকিস্তানের ব্যাপারে সমঝোতা হতে পারে না। পাকিস্তানিরা দুষ্কর্মের মাধ্যমে একটি মহান ধর্মের নাম ব্যবহার করছে এবং মুসলিম বিশ্বকে বিভ্রান্তিতে ফেলছে। তারা শ্লোগান উত্থাপন করেছে যে বৃহত্তম ইসলামী দেশটির অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে – এসব বলে সামরিক শাসকরা বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ শান্তিপূর্ণ ও নিরস্ত্র মুসলিম নাগরিককে জবাই করছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহের পুনরাবৃত্তি এই প্রেক্ষাপটে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বড় শক এবং হতাশা হিসাবে দেখা দিয়েছে। “আমরা মার্কিন সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি যে, পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া উচিত এবং এও নিশ্চিত করতে হবে যে সামরিক শক্তির আরও শিপমেন্ট পাকিস্তানের জন্য পাঠানো হবে না। এতে করে কেবলমাত্র সামরিক নিপীড়ন চিরস্থায়ী হবে এবং হত্যা অভিযানের গতি আরও বেড়ে যাবে।’

জনাব হক বিস্মিত হন যে হিউম্যান রাইটস কমিশনের মত আন্তর্জাতিক সংস্থা কেন বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অবস্থান করছে না। “যখন বাংলাদেশের ৭৫ মিলিয়ন মানুষ স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার, গণতান্ত্রিক অধিকার ও শান্তির জন্য যুদ্ধ করছে তখন এইসব আন্তর্জাতিক সংগঠনের অবস্থান কি?”

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৪৭। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র দাবী দি স্টেটসম্যান ৫ জুলাই ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ৩৪৭, ৮৪৩-৮৪৪>

‘দি স্টেটসম্যান ৫ জুলাই ১৯৭১
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র দাবী
আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি থেকে প্রাপ্ত খবর

উদয়পুর. জুলাই 4 – জনসঙ্ঘ ১ আগস্ট থেকে নয়া দিল্লিতে সত্যাগ্রহ আরম্ভ করবে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার ব্যাপারে সরকারকে চাপ দেয়ার জন্য এটা করা হবে। শুধু তাই নয়, তাদের দাবী এটি সক্রিয় করতে সকল প্রকার সামরিক সহায়তা সহ সব নৈতিক ও বৈষয়িক সমর্থন দিতে হবে তাদেরকে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক শাসনের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত করতে।

আজ সকালে দলের সভাপতি জনাব অটল বিহারী বাজপেয়ী সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে এটা ঘোষণা করেন।

জনাব বাজপেয়ী ঘোষণা করেন যে সত্যাগ্রহ ১১ আগস্ট পর্যন্ত ১১ দিনের জন্য অব্যাহত থাকবে এবং সংসদ-আগস্টের বর্তমান অধিবেশন শেষ দিনে ১২ আগস্টের মধ্যে প্রায় ২০০০০০ জন সংঘ স্বেচ্ছাসেবক সংসদের সামনে বাংলাদেশ বিষয়ে সরকারের আলস্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রকাশ করবে। তবে তিনি বলেন, যদি ১ আগস্ট এর আগে সংঘ এর দাবী সরকার মেনে নিতে রাজি হয় তাহলে আন্দোলন পরিকল্পনা ছেড়ে দেয়া হবে এবং কেন্দ্রকে সব রকমের সহায়তা প্রদান করতে হবে।

বাংলাদেশ রেজল্যুশনের উপর বিতর্ক চলাকালীন সময়ে অনেক প্রতিনিধি বলেন যে নেতৃত্ব শুধুমাত্র চাচ্ছে সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপ। কারণ মনে হচ্ছিল পার্টির বাংলাদেশ ইস্যুতে কোন দায়িত্ব নেই। তাদের জবাবে জনাব বাজপেয়ি বলেন জান সংঘের প্রতিষ্ঠাতা ডঃ শ্যামাপ্রসাদ প্রসাদ মুখার্জী, পূর্ব বাংলার শরণার্থী ইস্যুতে কেন্দ্রীয় সরকার থেকে পদত্যাগ করেছেন। এছাড়া গোয়া আগ্রাসনের সময়ে জম্মু ও কাশ্মীর-এর জন্য একটি গণআন্দোলন শুরু হয়েছিল। অতএব, যখন হাজার হাজার মানুষ বাংলাদেশে জবাই করা হচ্ছে তখন পার্টি শান্ত থাকতে পারেনা।

জনাব বাজপেয়ীর বক্তব্যের পর বাংলাদেশ রেজল্যুশন এর উপড়ে নির্দিষ্ট সংশোধনী গৃহীত হয়, UNI যোগ করে। শেখ মুজিবুর রহমান ও উদ্বাস্তু দের সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবস্থা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যাতে তারা তাদের মুক্তির জন্য আরও সক্ষম হতে পারে এবং তাদের বাছাই প্রক্রিয়া শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

এই রেজল্যুশন দেশের সবার সামনে একটি ছয় দফা কর্মসূচি হিসাবে পেশ করা হবে এবং দেশের বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করতে সরকারকে বাধ্য করার জন্য জনমত সংগঠিত করতে তার পার্টির সব ইউনিট পরিচালিত হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়।

তারা উদ্বাস্তু দের ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন এলাকায় বিতরণ করার বিরোধিতা করেন। এটা দাবি করেন যে শরণার্থী শিবির হবে বাংলাদেশ সীমান্তে যাতে যত তাড়াতাড়ি পাকিস্তান হানাদার বাহিনী নতুন প্রজাতন্ত্রের থেকে সরে যাবার সাথে সাথে তাদের প্রত্যাবর্তন সহজতর হয়। তারা ভারতীয় সীমান্তে পাকিস্তানি আগ্রাসন প্রতিহত করার জন্য কার্যকর সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলেন।

রেজল্যুশনে শেখ আব্দুল্লাহ এবং অন্যান্য যারা ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের সামরিক জান্তার নিন্দা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন তাদের বিচারের দাবি করেন।
আরও বলা হয়, সকল দেশপ্রেমী সংগঠনকে এক হয়ে কাজ করতে হবে। তাহলে বাংলাদেশের পাকিস্তানি আগ্রাসন বন্ধ তরান্বিত হবে এবং ভারতের অখণ্ডতা এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি মুক্ত হবে।

রেজল্যুশনে ভারতের পররাষ্ট্র-নীতি সমালোচনা করা হয়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৪৮। ব্রিটিশ সংসদীয় দলের বিবৃতি প্রচার করা যাবে না – পাক জঙ্গী সরকারের ফরমান
যুগান্তর ৩ জুলাই ১৯৭১

Bashneen Faham
<১৪, ৩৪৮, ৮৪৫>

ব্রিটিশ সংসদীয় দলের বিবৃতি প্রচার করা যাবে না :
পাক জঙ্গী সরকারের ফরমান
বিশেষ সংবাদদাতা

নাদিল্লী, ৫ জুলাই- চারজনের যে ব্রিটিশ পারলামেন্টারি প্রতিনিধি দলটি বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভের জন্য ভারত ও পাকিস্তান ঘুরে গিয়েছেন তাঁদের কোন সাক্ষাৎকার বা বিবৃতি প্রকাশ বা বেতার প্রচার পাকিস্তান সরকার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছেন।

ঐ প্রতিনিধি দলের কার্যকলাপের ছবি তোলাও পাক সরকার নিষিদ্ধ করেছেন। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রতিনিধি দলের মূল্যায়ন ও তাঁদের বিবৃতিতে পাক বাহিনীর নৃশংসতার বিবরণ প্রকাশ পাওয়ায় জঙ্গী সরকার বিরক্তি বোধ করেছেন। পাক সরকার পাকিরতানীদের বাংলাদেশ সম্পর্কে যে মিথ্যা সংবাদ দিয়ে আসছিলেন, ব্রিটিশ প্রতিনিধি দলের বিবৃতি ও মন্তব্য থেকে তাঁদের সে ভুল ধারণা ভেঙ্গে যাক জঙ্গী মহল তা আদৌ চান না।

চারজনের ঐ প্রতিনিধি দলের রক্ষণশীল ও শ্রমিক উভয় দলেরই সদস্য ছিলেন ব্রিটিশ সরকার ঐ প্রতিনিধি দলকে পাঠিয়েছিলেন। প্রাক্তন কমনওয়েলথ রিলেসন্স মন্ত্রী শ্রী আরথার বটমালি ছিলেন ঐ প্রতিনিধি দলের নেতা।

আটক ব্যক্তিদের সম্পর্কে খোঁজ খবর

ইউ এন আই জানাচ্ছেন, যেসব পশ্চিম পাকিস্তানী পূর্ববঙ্গ থেকে চলে এসে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন পাকিস্তানের অনুরোধ ও মানবতার খাতিরে ভারত পাকিস্তানকে তাঁদের খবরাখবর জানাতে সম্মত আছে। তবে আন্তর্জাতিক আইনের বিধান ও আইন অনুযায়ী পাকিস্তানকেও তাদের জেলে আটক ২৫০ জনেরও বেশি ভারতীয়ের খবরাখবর জানাতে হব।

আজ সরকারী মহল থেকে ঐ তথ্য পাওয়া গিয়েছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৪৯। পাকিস্তানের মিথ্যা কূটনৈতিক প্রচার যুগান্তর ৬ জুলাই ১৯৭১

Bashneen Faham
<১৪, ৩৪৯, ৮৪৬>

ভারতে আটক রাখা সম্পর্কে পাকিস্তানের মিথ্যা কূটনৈতিক প্রচার

৬ই জুলাই- পাকিস্তান সরকার এবার এক নতুন মিথ্যা কূটনৈতিক প্রচার শুরু করেছেন। পাক সরকার রাষ্ট্রসঙ্ঘের সেক্রেটারী জেনারেল উত্থান্ট, রাষ্ট্রসঙ্ঘের শরণার্থী দপ্তরের হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দীন ও কয়েকটি বিদেশী মিত্র রাষ্ট্রের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন যে, ভারতীয় জেলে যেসব পাকিস্তানী রয়েছে তাদের প্রত্যাবর্তনে তাঁরা যেন সাহায্য করেন।

পাক বৈদেশিক দপ্তর থেকে অভিযোগ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশ হাঙ্গামার জন্য চা-বাগান, ব্যাংক, বানিজ্যিক সংস্থা ও সরকারী কিছু সংখ্যক কর্মচারী ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে এবং ভারত সরকার নাকি তাদের গ্রেফতার করে জেলে পুরেছেন।

পাকিস্তান সংবাদপত্র, রেডিও ও টেনিভিশনেও ভারতের বিরুদ্ধে এই মিথ্যা প্রচার চলছে।
পাক সরকার আরও অভিযোগ করেছেন যে, ধৃত ব্যক্তিদের খবরাখবরের জন্য কয়েকটা চিঠি লিখেও তাঁরা কোন জবাব পাননি।

ভারত সরকার জানিয়েছেন যে, বাংলাদেশ থেকে যেসব পশ্চিম পাকিস্তানী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছে তাদের সংবাদের জন্য পাকিস্তান সরকারের অনুরোধ ভারত সরকার ‘মানবতার ভিত্তিতে’ বিবেচনা করে দেখতে প্রস্তুত আছেন। তবে পাকিস্তানের জেলে যে ২৫০ জনেরও বেশি ভারতীয় এখন কষ্টভোগ করছেন আন্তর্জাতিক আইন ও বিধি অনুযায়ী তাঁদের কথাও পাকিস্তানকে বিবেচনা করতে হবে। পাক জেলে আটক এই ভারতীয়দের অপরাধ কি, তাঁরা কেমন এবং কোথায় আছেন সে সম্পর্কে পাকিস্তানের কাছে চিঠি লিখে ভারত কোন জবাব পায়নি।

বাংলাদেশের যেসব লোককে ভারতে আটক করে রাখা হয়েছে বলে পাকিস্তান মিথ্যা প্রচার চালাচ্ছে এবং যাদের নামের তালিকা পাক সরকার দিয়েছে তারা সংখ্যায় মাত্র ৩১ জন এবং সকলেই পশ্চিম পাকিস্তানী, তারা পূর্ব বঙ্গের লোক বলে পাক সরকার যে দাবি করেছেন তা মিথ্যা। জনৈক সরকারী মুখপাত্র বলেন যে, বাংলাদেশ থেকে ৭০ লক্ষ লোক ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন কিন্তু তাদের জন্য পাক সরকারের কোন মাথাব্যথা নেই। মাত্র ৩১ জন পশ্চিম পাকিস্তানির জন্যই পাক সরকার চিন্তিত।

পাকিস্তানের জেলে আটক ভারতীয়দের মধ্যে সাংবাদিকরাও আছেন। ভারতীয় সীমান্ত এলাকা থেকে এপ্রিলের গোড়ার দিকে তাঁদের অপহরণ করা হয়েছে। তাঁদের খবরাখবরের জন্য পাক সরকারের কাছে চিঠি লিখেও কোন জবাব পাওয়া যায়নি।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৫০। পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র সাহায্য বন্ধের জন্য ভারতের দাবি ডি স্টেটসম্যান ৮ জুলাই, ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ৩৫০, ৮৪৭-৮৪৮>

স্টেটসম্যান, জুলাই ৮, ১৯৭১
পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র সাহায্য বন্ধের জন্য ভারতের দাবি
আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি

নয়া দিল্লি, জুলাই ৭ – প্রেসিডেন্ট নিক্সনের বিশেষ দূত ও নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা ডঃ হেনরি কিসিঞ্জার কে ভারতীয় নেতারা জানা মার্কিন সরকারের পাকিস্তানে অস্ত্র ক্রমাগত সরবরাহে উপ-মহাদেশে ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে ।

প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী উভয়েই জোরালো ভাবে জানান যে তারা এটা মেনে নেবেন না। আমেরিকা ব্যাখ্যা দিয়েছিল যে তারা শুধুমাত্র অপ্রাণঘাতী অস্ত্র সরবরাহ করছে এবং তা শুধুমাত্র আমলাতান্ত্রিক বন্ধনের কারণে। তারা বলেন যে এই কথা সত্য নয়।

ড কিসিঞ্জার কে সামরিক অর্থের বাইরে থেকেই এর প্রভাব সহজ ভাষায় তুলে ধরা হয়। কিসিঞ্জার স্পষ্টত বলতে চেয়েছেন এটা শুধুমাত্র প্রান্তিক-রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বাইরে কিছু নয়।

জনাব শরণ সিং পাকিস্তানে “অব্যাহত এবং ক্রমাগত” অস্ত্র সাহায্যের প্রতিকূল প্রভাব সম্পর্কে ড কিসিঞ্জারের মনোযোগ আকর্ষণ করেন। তিনি বলে তথাকথিত অপ্রাণঘাতী অস্ত্র দিয়েও চরম মারাত্মক অস্ত্রের ইঞ্জিন সক্রিয় করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। তিনি বলেন পাকিস্তানে অস্ত্র সাহায্যের ফলে দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন এবং উপমহাদেশের নিরাপত্তাও ঝুঁকির মুখে পড়বে। ১৯৫৪এবং ১৯৬৫ সালের মধ্যে পাকিস্তানে ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের অস্ত্র সাহায্য আসে।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে কিসিঞ্জারকে বলা হয় ভারত বাংলাদেশের ব্যাপারটি দেখছে এটা আইনসিদ্ধ নয়। এর সাথে সাড়ে সাত মিলিয়ন মানুষের মানবাধিকার জড়িত। এবং সেটা বন্ধ করার জন্য পাকিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা দরকার।

আমেরিকান সাহায্যের কোন সুনির্দিষ্ট কারণ নেই উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কিসিঞ্জারকে আরও বলেন ২৯ জুন জেনারেল ইয়াহিয়ার ভাষণে যে রূপরেখা বলা হয় তা নেতিবাচক ছিল এবং তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার পক্ষে বাস্তবসম্মত ছিলনা। প্রকৃতপক্ষে, পূর্ববাংলার নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

এই প্রেক্ষাপটে ভারতীয় নেতারা আমেরিকা সহ বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে দাবি করেন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের যেন সব ধরনের সামরিক ও রাজনৈতিক এইড বন্ধ করা হয়। এমন পরিস্থিতি তৈরি করা উচিৎ যাতে এই ৭ মিলিয়ন উদ্বাস্তু নিরাপদ মনে করে ও সম্মানজনক ভাবে ফিরে আসে – অন্যথায় পরিস্থিতি আরও ভয়ানক হবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রেসিডেন্সিয়াল এইড কে ভারত জানায় দীর্ঘদিন ধরে শরণার্থী সমস্যা নিয়ে ভারত টিকতে পারবেনা। এবং এই পরিস্থিতিতে ভারত অনির্দিষ্টকাল চুপ করেও বসে থাকবেনা। এটা আন্তর্জাতিক মহলের দায়িত্ব যে তারা পাকিস্তানকে বাধ্য করবে একটি সঠিক রাজনৈতিক সমাধান করার ব্যাপারে।

কিসিঞ্জার সাহেবের সাথে উপস্থিত ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জনাব কেনেথ বি কিটিং। তারা একটি রাজনৈতিক সমাধানের ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু তারা এটি সমাধানকল্পে কোন সুনর্দিস্ট পদক্ষেপ দেন নাই। প্রকৃতপক্ষে ডঃ কিসিঞ্জার কোন ধরনের নিশ্চয়তা দেন নাই। তিনি শুধু বললেন তিনি ভারতের প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির কাছে পৌঁছে দেবেন ।

ওয়াকিবহাল মহল আশাবাদী যে কিসিঞ্জার ভারতীয় অবস্থানের ব্যাপারে ধারণা পেয়েছেন। এটা সুপরিচিত যে তিনি কোন প্রস্তাবই আসলে নেন নাই তিনি শুধুমাত্র প্রেসিডেন্ট নিক্সনের একটি ব্যাক্তিগত চিঠি মিসেস গান্ধির কাছে দেন। সম্প্রচারে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের রূপরেখা সঠিক পথ হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি। এটাই ছিল তার ফিরিয়ে দেবার ব্যাপারে উদাসীনতার কারণ।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৫১। বাংলাদেশের হৃদয় হতে যুগান্তর ৯ জুলাই, ১৯৭১

Bashneen Faham
<১৪, ৩৫১, ৮৪৯-৮৫০>

বাংলাদেশের হৃদয় হতে

রবীন্দ্র-সদনের মঞ্চে পাশাপাশি দুই কন্ঠশিল্প- মাহমুদুর রহমান, শাহীন আখতার। দু’জনেই বাংলাদেশ থেকে সদ্য আগত; সদ্য বিবাহিত। গাইছেন অতুল প্রসাদের একটি রাগপ্রধান গান-‘এসো হে সজল শ্যাম ঘন দোয়া’। ছোট ছোট ক্ষিপ্রতান ও সরগম-সহ, অনবদ্য সুরেলা, দরাজ গলায়। বাইরে তখন অবিশ্রান্ত ধারায় বৃষ্টি পড়ছে।

বাংলাদেশ সহায়ক শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমিতি আয়োজিত অনুষ্ঠানের (৩ ও ৪ জুলাই) বিবরণ দিতে গিয়ে প্রথমেই মনে এল ঐ দৃশ্যটি যা আমাদের স্মৃতিতে পাকা রঙের ছবি হয়ে গিয়েছে। সেদিন ওদের গান শুনাতে শুনাতে সমিতির অন্যতম সম্পাদক শ্রী দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ণিত বাংলাদেশের তরুণ প্রাণের প্রতীক নবদম্পতিকে সনাক্ত করে নিতেও আমাদের ভুল হয়নি। আমরা জেনে গিয়েছি : এই সেই প্রণয়ীযুগল, মুক্তিযুদ্ধ যাদের বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। আবার যুদ্ধের আগুনের মধ্যেই অকুতোভয়, যারা মিলিত; পরিণীত। আজ ঘটনার আবর্তে দু’জনেই কলকাতায়। একজন পুনর্বার রণাঙ্গনে যাবার জন্য প্রস্তুত। তিনি সেখানে গেলে অপরজন কি করবেন? শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায়, ‘গান গাইবেন, এবং গান গাইবেন, এবং গান গাইবেন’।– স্বামীর মঙ্গল-আকাঙ্খায়, দেসের মুক্তির কামনায়।

সমিতির দুই দিনব্যাপী ঐ অনুষ্ঠানের দু’টি প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। এক, বাংলাদেশের নানা শহর থেকে যেসব গায়ক-গায়িকা, যন্ত্রশিল্পী কলকাতায় এসেছেন অথবা আসতে বাধ্য হয়েছেন, সমিতির উদ্যোগে যাঁরা পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন, তাঁদের একটি শিল্পীদল হিসাবে কলকাতার দর্শক-শ্রোতাদের সামনে উপস্থিত করা। দুই, ওই বাংলার শিল্পীদের সঙ্গে এই বাংলার শিল্পীদের অন্তরঙ্গ, ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সূচনা করা। অনুষ্ঠানসূচী সেইভাবে গঠিত। দুই আসরের সভানেত্রী রূপে আমরা পেলাম শ্রীমতি সুচিত্রা মিত্রকে। দ্বিতীয় অধিবেশনে প্রধান অতিথির আসনে ছিলেন বাংলাদেশের কূটনৈতিক দূতাবাসের শ্রী হোসেন আলী।

ভিন্নধর্মী এই অনুষ্ঠানে সভানেত্রী শ্রীমতি মিত্র বক্তৃতা দিতে চাননি, দেননি। তিনি আসরে প্রাণ সঞ্চারিত করে দিলেন গান গেয়ে- রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’, বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। শুভারন্ত।

প্রথম দিন অর্থাৎ শনিবারের অধিবেশনটি প্রধানত বাংলাদেশের শিল্পীদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। একে একে তাঁরা আত্মপ্রকাশ করলেন। প্রথমে শ্রীমতি সানজিদা খাতুন। তাঁর ‘আনন্দধ্বনি জাগাও গগনে’ রবীন্দ্র সংগীতে হামবীর রাগের আকুতি-একটি প্রার্থনার দ্যোতনা। সম্মেলক কন্ঠে (প্রবাল চৌধুরী, তপন বৈদ্য, আবু নওসেদ, অনিল বডুয়া) আনন্দেরই বার্তা ঘোষিত হল: ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি এই অপরূপ রুপে বাহির হলে জননী’ ক্রমে ফ্রোরা আহম্মদ শোনালেন, ‘না গো এই যে ধুলা আমার না এ’ (রবীন্দ্র সংগীত); ডালিয়া নৌশিন ‘ঝরা ফুলদলে’ (নজরুল); কল্যাণী ঘোষ ‘গানে গানে ঢাকা আমার গভীর অভিমান’ (নজরূল); রফিকুল আলম ‘তুমি গাও ওগো গাও মম জীবনে’ (অতুলপ্রসাদ); মাহমুদুর রহমান, শাহীন ‘এসো হে সজল শ্যামঘন’(অতুলপ্রযাদ)।শেষোক্ত দ্বৈত-সঙ্গীতটি অপূর্ব, যার উল্লেখ আগেই করেছি।
লোকসঙ্গীতের আসরে গান গাইলেন মন্মথ বিশ্বাস, মাধবী আচার্য, রথীন রায়।শ্রী রায়ের ভাওউয়াইয়া গান দু’টি এক কথায় অসাধারণ। কলকাতায় এমন লোকগীতি শোনবার অবকাশ বহুকাল আমাদের হয়নি। দোতরা (মন্মথ বিশ্বাস) আর বাঁশির (স্বপন দাস) দ্বৈত-যন্ত্রসংগীতের অনুষ্ঠানটিও আকর্ষক।

প্রথম দিনের শেষ অনুষ্ঠান; রূপান্তরের গান। ১৯৪৭ সন থেকে দেশপ্রেমের যে গানগুলি পূর্ব পাকিস্তানকে ধীরে ধীরে এই’৭১ সনে বাংলাদেশে পরিণত করল, সেই সব উদ্দীপক গানেরই একটি অলেখ্য ঐ অনুষ্ঠানে পরিবেশিত। এর মধ্যে আছে কিছু পরিচিত সংগীত, নজরুল সংগীত। অন্যান্য গীত-রচয়িতার মধ্যে আছেন : গুরুসদয় দত্ত, সলিল চৌধরী, সিকান্দার আবু জাফর, নাজিম মাহমুদ, সারওয়ার জাহান। গানগুলি শৃংখলার সঙ্গে উপস্থাপিত; কখনও একক কন্ঠে; কখনও সম্মেলকভাবে। সম্মেলক গীতাংশই বেশি। বত্রিশ জন কন্ঠশিল্পী এই অনুষ্ঠানে যোগ দেন; যন্ত্রসংগীতে ছিলেন দশজন।এই বাংলাদেশের ঐ শিল্পীরা যে একটি দলে পরিনত, তার নির্ভুল প্রমান পাওয়া গেল এই ‘রুপান্তরের গান’ অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন সানজিদা খাতুন ও ওয়াহিদুল হক।

শ্রী দেবব্রত বিশ্বাস এই দিন আমাদের তিনটি রবীন্দ্র-সংগীত শুনিয়েছিলেন : ‘কে এসে যায়’, ‘রুদ্রবেশে কেমন খেলা’, ‘কে দিল আমায় আঘাত’। দরদ দিয়ে গাওয়া তিনটি গানই চমৎকার। কিন্তু মনে হয়, তাঁর গান রবিবারের আসরের জন্য রাখলেই ভাল হত, কারণ ঐ আসরটি ছিল এই বাংলার শিল্পীদের জন্য চিহ্নিত।

রবিবার সকাল ন’টায় দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু। আগের দিন রাত্রে সাড়ে ন’টায় প্রথম অধিবেশন সমাপ্ত হয়। ইতিমধ্যে, বলা বাহুল্য, রবীন্দ্র সদন আর কোনও গোষ্ঠীর দখলে আসেনি। উদ্যোক্তাদের কারও কারও বেশবাসে সামান্য কিছু পরিবর্তন চোখে পড়লেও মনে হল, সমিতির অনুষ্ঠান একটানা চলছে। বিচিত্রানুষ্ঠানের এই আসরের শিল্পীরা সকলেই সুখ্যাত এবং জনপ্রিয়, আবহাওয়াও ছিল অনুকূল, প্রেক্ষাগৃহ তাই ভরে উঠতে দেরী হয়নি।

রবীন্দ্র-সংগীত আর মঝে মাঝে আবৃত্তির বৈচিত্র-এইভাবে পরো তিন ঘন্টা কেমন করে কেটে গেল আমরা জানতেও পারলাম না। শ্রীমতি তৃপ্তি মিত্র ও শ্রী শান্তিদেব ঘোষ রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করলেন; শ্রী শম্ভু মিত্র শোনালেন জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের ‘মধুবংশীর গলি’; শ্রীমতি অপর্ণা সেন ইরানের কবি নাজিম হিকমতের একটি কবিতার বাংলা রূপান্তর (সুভাষ মুখোপাধ্যায়-কৃত), শ্রীদেব দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশের কবিদের রচনা। ‘ব্লাড ব্যাংক’ কবিতার (এটি আগেও একবার শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায় শুনিয়েছিলেন) ‘মাটি অভিমুখে রক্তের চিত্রকল্পটি কি আমাদের রক্ত মুহূর্তের জন্য হিম করে দিয়েছিল, মনে করিয়ে দিচ্ছিল বাংলাদেশের কোনও ডকুমেন্টারি ছবির কথা’।

রবীন্দ্র-সংগীত শুনলাম প্রায় কুড়িখানি। পূজা, দেশপ্রেম, প্রেম, আত্মনিবেদন এবং একান্ত কিছু অনুভূতির গান। মনে হয়, বেশির ভাগ শিল্পীদের স্বনির্বাচিত। বিচিত্র অনুষ্ঠান যখন, তখন বিষয় বৈচিত্র্যই কাম্য। শুরু করলেন সুচিত্রা মিত্র, শেষ একক শিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। মাঝে ছিলেন শান্তিদেব ঘোষ, নীলিমা সেন, অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সাগর সেন। প্রত্যেকেই তিনটি করে গান গেয়েছিলেন, পরম আন্তরিকতার সঙ্গে। বিশেষ করে ভাল লাগল : ‘না বাঁচবে আমায় যদি’(সূচিত্রা মিত্র), ‘মম মন-উপবনে’(শান্তিদেব ঘোষ), ‘আজ যেমন করে গাইছে আকাশ’ (নীলিমা সেন), ‘একবার তোরা মা বলিয়া ডাক’(অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়), ‘তোমারি তরে মা সঁপিনু এ দেহ’ (কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়)।

দুই বাংলার অর্ধশতাধিক শিল্পীর গান আমরা শুনলাম দুই আসরে। গানের সংকখ্যাও অর্ধশতাধিক। তার মধ্যে রবীন্দ্রস্নাথের গান অন্তত ত্রিশ। তিনিই যে নব বাংলাদেশের প্রাণপুরুষ।
-সংগীতপ্রিয়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৫২। মার্কিন কনস্যুলেট ভবনের সম্মুখে বিক্ষোভ হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড ১০ জুলাই ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ৩৫২, ৮৫১>

হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, ১০ জুলাই ১৯৭১
মার্কিন কনস্যুলেট ভবনের সামনে বিক্ষোভ
– স্টাফ রিপোর্টার

পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র চালানের প্রতিবাদে বাংলাদেশের ছাত্র এবং নারী শিল্পীদের একটি গ্রুপ শুক্রবার কলকাতায় মার্কিন কনস্যুলেট ভবনের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশে করে।

২৪পরগনা ডিসিসির(ও) সামনে যুব ও ছাত্রদের আন্দোলন অপ্রত্যাশিতভাবে রাশিয়ান কনস্যুলেটের সামনে পড়ে যায়। তারা ইউএসএসআর কনস্যুলেটের কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন।

তারা কনস্যুলেট প্রবেশদ্বারের সামনে থামেন। একজন কর্মকর্তা স্মারকলিপি গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। বিক্ষোভকারীরা ভবনের দেয়ালে ঝুলিয়ে আসে।

যখন তারা মার্কিন কনস্যুলেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন একটি পুলিশের গাড়ির আসে। পশ্চিমবঙ্গ ছাত্র পরিষদের সহ-সভাপতি জনাব অসীম চ্যাটার্জী (কংগ্রেস-ও)অভিযোগ করেন যে কিছু পুলিশ গাড়ি থেকে লাফিয়ে তাদেরকে কোন বিরক্ত না করা সত্ত্বেও লাঠিচার্জ করতে শুরু করেন।

পুলিশের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভকারীরা রাস্তা আটকে বসে পড়েন। কংগ্রেস (ও) নেতা ডাঃ প্রতাপ চন্দ্র সুন্দর এবং জনাব অশোক কৃষ্ণ দত্ত, কংগ্রেস (ও) নেতা যাকে একদিন আগে হাওড়াতে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল তার প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ হতে বলেন। তখন বিক্ষোভকারীরা স্থান ত্যাগ করে।

এর আগে সকালে বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসা কিছু চলচ্চিত্র শিল্পী ও প্রযুক্তিবিদরা মার্কিন কনস্যুলেটের সামনে প্রতিবাদ মিছিল করে। তারা কনস্যুলেট কর্মকর্তারা কাছে একটি স্মারকলিপি হস্তান্তর করে। তাতে পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করতে অনুরোধ করা হয় এবং বাংলাদেশে গণহত্যায় সাহায্য না করার আহবান জানানো হয়।

সন্ধ্যায় মিসেস পূরবী মুখার্জি এমপি (কংগ্রেস আর), মিসেস গীতা মুখার্জি (সিপিআই), মিসেস রেনুকা রায় (কংগ্রেস আর) এর নেতৃত্বে কয়েকশ নারী মার্কিন কনস্যুলেটের সামনে পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করে।

বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সহায়ক সমিতির বিক্ষোভের আয়োজন করে। একটি স্মারকলিপি মার্কিন কনস্যুলেট জেনারেল হার্বার্ট গর্ডনের কাছে হস্তান্তর করেন যেখানে পাকিস্তানকে আর কোন অস্ত্র সহায়তা না দিতে বলা হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা দিয়ে একটি রাজনৈতিক সমাধানে সাহায্য করার আবেদন জানানো হয়। এছাড়াও স্মারকলিপিতে যেসকল অস্ত্র পাকিস্তানের পথে আছে সেগুলোকে ফিরিয়ে নেবার আবেদন করা হয়।

চেয়ারম্যান মিসেস রেনুকা রায় ও আহবায়ক মিসেস মিরা দত্ত গুপ্ত, মার্কিন কন্স্যুলেটর জেনারেল গর্ডনের কাছে স্মারকলিপি হস্তান্তর করেন। জনাব গর্ডন প্রতিনিধিদের জানান যে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টকে বিষয়টি অবগত করবেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৫৩। কূটনৈতিক বিনিময়ের প্রস্তুতি দি স্টেটসম্যান ১০ জুলাই, ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ৩৫৩,৮৫২>

দি স্টেটসম্যান, ১০ জুলাই, ১৯৭১
কূটনৈতিক বিনিময়ের প্রস্তুতি
সুইস অফিসিয়ালের ইন্টারভিউ প্রস্তুতি
আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি

নয়াদিল্লি, জুলাই ৯ – ভারত ও পাকিস্তানি কূটনীতিকদের ভারত ও পাকিস্তান থেকে ফেরত পাঠানোর জন্য ডেকে পাঠানো হয়েছে – শেষ পর্যন্ত ৭০ জন পূর্ব বাংলার কূটনীতিকদের ইচ্ছার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারে অনুমোদন করা করেছে যারা তাদের বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে।

সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত জনাব ফ্রিটস রিয়্যাল, আজকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব )কে ইসলামাবাদের সুসমাচার জানানোর জন্য বৈদেশিক কার্যালয়ে ডেকে এনেছেন। মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের জানান, সুইস সরকার প্রস্তুতি পর্ব শেষ হওয়া পর্যন্ত দায়িত্বে থাকবে যেখানে সাবেক পাকিস্তানের ডিপ্লম্যাটদের ইন্টার্ভিউ হয়।

সাক্ষাত্কারের প্রয়োজন ছিল কারণ পাকিস্তানি কূটনীতিকরা হলেন কলকাতার সাবেক পাকিস্তানি ডেপুটি হাইকমিশনার মিঃ হোসেন আলীর নেতৃত্বে।

ভারত তার অংশ থেকে আলোচনা চালিয়েছে যে এটা ছিল পাকিস্তানী হাই কমিশনের পদক্ষেপ যারা কূটনীতিকদের ইচ্ছাকে বাস্তবায়ন করবেন। জনাব হোসেন আলি তিনি প্রথমে প্রশ্ন তুলেছিলেন যে তাকে কোন পাকিস্তানী না তৃতীয় পক্ষ প্রশ্ন করতে পারে – তবে শেষ পর্যন্ত তিনি রাজি হয়েছেন – “যদি কেবল তার উপর দোষারোপের ব্যাপারে পাকিস্তানি মিথ্যা অভিযোগ করে “। একজন বাংলাদেশী মুখপাত্র এটি বলেন।

সম্মতিপত্রের আওতায়, একজন সুইস প্রতিনিধি প্রাক-নির্ধারিত কিছু প্রশ্নের একটি দল গঠন করবে – ভারতীয় কূটনীতিবিদ এবং পাকিস্তানি প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে প্রশ্নগুলির বিষয়বস্তু নিয়ে উভয়ে ইতিমধ্যেই সম্মত হয়েছে।

কূটনীতিকদের ইচ্ছার ব্যাপারে নিশ্চিত হবার পরেই শুধুমাত্র তাদের সরিয়ে নেবার কাজ শুরু হবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ইরান ইতোমধ্যেই কূটনীতিকদের সরানোর করার প্রস্তাব দিয়েছে।

পাকিস্তানি ডেপুটি হাই কমিশনার জনাব মাহদী মাসুদ, যিনি হোসেন আলী এর উত্তরাধিকারী নামে পরিচিত ছিলেন, সেখানে বেশ কিছু পাকিস্তানি কূটনীতিক সদস্য রয়েছে (৭০এর বেশি) যারা বাঙালি কূটনীতিক এবং বর্তমানে কলকাতায় বাংলাদেশ সরকারের সাথে কাজ করার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন – তাদেরকে করাচি থেকে পুনর্বাসিত করা হবে।

ইসলামাবাদে সামরিক শাসনের পর থেকে ঢাকায় ভারতীয় মিশন বন্ধ করা হয় এবং তখন থেকে জনাব কে সি সেন গুপ্তের নেতৃত্বে ১৩০ জন স্টাফ মূলত গৃহবন্দি ছিলেন।

তার পড় থেকেই জনাব কে সি সেন গুপ্তকে আদ্দিস আবাবাতে ভারতের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৫৪। মুক্তিসংগ্রাম কমিটি গঠিত দি টাইমস অফ ইন্ডিয়া ১৬ জুলাই ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ৩৫৪, ৮৫৩- ৮৫৪>

দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়ার, জুলাই ১৬, ১৯৭১
মুক্তিসংগ্রাম কমিটি গঠিত

মুজিবনগরে, ১৫ জুলাই, একটি নয় দলীয় “বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি” গঠন করা হয়। সম্প্রতি দেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রতিটি গ্রামে এরা গেরিলা স্কোয়াড করেছে।

কমিটি মওলানা ভাসানী এর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতৃত্বে গঠিত হয় ও পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (সিকদার গ্রুপ) এর সাথে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

এটি “স্বাধীনতা এবং মুক্তির জন্য পরিবেশ তৈরি’’ করবে এবং যারা দেশ থেকে সেনাবাহিনীর নৃশংসতার জন্য পালিয়ে যাচ্ছে তাদের পুনর্বাসনের জন্য কাজ করবে। তারা বাংলাদেশের মানুষকে সাহায্য করার জন্য ভারতকে ধন্যবাদ জানান।

কমিটি আশু উদ্দেশ্য হলে স্বাধীনতা তরান্বিত করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত সব বাহিনীর সাথে সমন্বয় করে নির্দিষ্ট প্রোগ্রাম এবং কর্মধারা তৈরি করা।

তার বাংলাদেশের ভেতরে কোন একটি জায়গায় একটি মিটিং করে কমিটির ১৫ দফা প্রোগ্রাম গ্রহণ করেন এবং সকল দলকে এটা বাস্তবায়নে সহযোগিতা করতে অনুরোধ করে।

কমিটির অন্য সাতটি দল হল কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ববাংলা কো-অর্ডিনেশন কমিটি, শ্রমিক কৃষক কর্মিসংঘ, বাংলাদেশ (হাতিয়ায় গ্রুপ) কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ব বাংলা কৃষক সমিতির পূর্ব বাংলা শ্রমিক ফেডারেশনের পূর্ববাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশন।

মাধ্যমে তারা স্বাধীনতা পাবেনা এবং তা করতে হলে নিরলসভাবে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।

কমিটি প্রতিটি গ্রামে একটি সর্বদলীয় পিপলস লিবারেশন কাউন্সিল গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় । এর মাধ্যমে প্রতিটি গ্রামে রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ও অন্যান্য দায়িত্ব নেয়া হবে এবং গ্রাম সুরক্ষা বাহিনী সংগঠিত করে জনগণের আদালতের মাধ্যমে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

এই কাউন্সিল সুদ সিস্টেম বন্ধ করার পক্ষে কাজ করবে। এবং যারা পাকসেনাদের সঙ্গে পৃষ্ঠপোষকতা করবে বা পাকিস্তানের চলমান চক্রের এজেন্ট হিসাবে কাজ করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেবে।

এছাড়া তারা বাংলাদেশের যেসব নাগরিক দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে তাদের সম্পদ দেখাশোনা করবে।

ছোট গেরিলা স্কোয়াড করা হবে স্থানীয় কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র ও অন্যান্য যুবকদের নিয়ে যারা গ্রামের মধ্যে সংগঠিত হবে এবং বিচ্ছিন্নভাবে শত্রুদের ধ্বংস করবে তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া অস্ত্র দিয়ে।

যারা স্বেচ্ছায় পাকিস্তান সরকার ও পাকিস্তানের বাহিনী বা তাদের এজেন্টদের সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামরিক সহযোগিতা করবে তাদের জাতীয় শত্রু হিসেবে বিবেচনা করা হবে এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের পর তাদের বিরুদ্ধে শাস্তির সিদ্ধান্ত যৌথ ভাবে আলোচনার মাধ্যমে নেয়া হবে।

প্রোগ্রামে বর্তমানে প্রচলিত “শিক্ষা নীতি এবং দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্কৃতির প্রভাব” কে প্রতিস্থাপন করার প্রস্তাব গৃহীত হয়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৫৫। পূর্বাঞ্চলে পাক বাহিনীর আত্ম রক্ষামূলক তৎপরতা দি স্টেটসম্যান ১৯ জুলাই ১৯৭১

Maruf Kabir
<১৪, ৩৫৫, ৮৫৫-৮৫৬>

দি স্টেটসম্যান, ১৯ জুলাই ১৯৭১
পূর্বাঞ্চলে পাক বাহিনীর আত্ম রক্ষামূলক তৎপরতা
– এস চক্রবর্তি

আগরতলা, জুলাই ১৭ – সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া ভিবিন্ন তথ্য অন্যযায়ি আভাস পাওয়া যাচ্ছে যে পাকসেনারা সম্ভ্যাব্য গেরিলা আক্রমণ থেকে রাজধানী ঢাকা, ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট ও চট্টগ্রাম বন্দর রক্ষা করার চেষ্টা করছে। এসমস্ত সূত্র মোতাবেক, সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সেনা পূর্বাঞ্চলে মোতায়েন করা হয়েছে এবং শুধুমাত্র চট্টগ্রাম – সিলেট সেক্টরে এ সংখ্যা ৭০ হাজারের মত। পশ্চিমাঞ্চলে নিয়োজিত সেনাশক্তি এর চাইতে কম বলে মনে করা হয়।

পাকবাহিনীর, ঢাকা ময়নামতি ও চট্টগ্রামের মধ্যে স্থল গমন পথ সচল রাখার প্রচেষ্টা এপর্যন্ত ব্যার্থ হয়েছে। তিন মাস চেষ্টার পরেও তারা প্রত্যন্ত অঞ্চল ও সীমান্ত এলাকার সেনাবাহিনীর জন্য জরুরী ও কৌশলগত কেন্দ্রগুলির মধ্যে টেলিফোন যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেনি।

গত মাসে মুক্তিবাহিনী পূর্বাঞ্চলের প্রায় ৯০ টি সফল গেরিলা ও কমান্ডো আক্রমণ পরিচালনা করে। যাতে বহু পাকসেনা হতাহত হয়। বিশ্বাসযোগ্য হিসাব মতে এসব অপারেশনে ১৭০০ জন পাকসেনা নিহত বা গুরুতর আহত হয় যেখানে মুক্তিবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি ছিল অনেক কম।

ঢাকায় গেরিলা বাহিনী ও পাকসেনাদের মধ্যে প্রায়ই খণ্ডযুদ্ধ হয়। এসময়ে আতংকিত ও বাহ্যত নীরব শহর উত্তাল যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। ২৮ জুন ইয়াহিয়া খানের ঘোষণার পর পরই ঢাকা শহরের অনেক গুরুত্তপূর্ন স্থানেই ধারাবাহিক ভাবে গেরিলা আক্রমণ করা হয়। এরই অংশ হিসেবে ৩ জুলাই নারায়ণগঞ্জের ‘পাক বে কোম্পানি’ গেরিলা আক্রমণে ধ্বংস হয়। এখান থেকে অনেক দূরে বসবাসকারী মানুষেরা সারা রাত এখানকার জ্বলন্ত আগুণ দেখতে পেয়েছিল।

মুক্তিযোদ্ধারা এখন কৌশলগত সেনা অবস্থান গুরুত্তপূর্ন শহর, শিল্পাঞ্চল ও যোগাযোগ ব্যাবস্থার দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে বলে মনে করা হয়।

ইতিমধ্যে পূর্বাঞ্চলে পাকসেনাদের কৌশলগত পরিবর্তন বেশ লক্ষণীয়। paপাকসেনারা এখন তাদের গ্রামাঞ্চলে ঘাঁটি এবং স্থল ও জলপথের যোগাযোগ রক্ষায় বেশি তৎপর। এর ফলে সিলেট ও চট্টগ্রামের মধ্যে কয়েকশত মাইল সীমান্ত এলাকা অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। অসংখ্য ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহত এড়ানোর জন্য কিছু কিছু সুরক্ষিত এলাকার দিকে তারা মনোযোগ দিচ্ছে। আভ্যন্তরীণ এলাকায় শক্তিশালী দ্বিতীয় স্তরের প্রতিরক্ষাব্যাবস্থা গড়ে তুলছে। সীমান্ত এলাকায় নিয়জিত ছোট ছোট ঘাঁটিতে অবস্থানরত সেনাদের প্রত্যাহার করে তাদের ভেতরের দিকের সুরক্ষিত ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

সিমান্তবর্তি যেসব এলাকা থেকে পাকসেনা সরিয়ে নেয়া হয়েছে তার কিছু এলাকায় রাজাকার নামের এক নতুন বেসামরিক বাহিনী নিয়োগ করা হয়। তারা ছিল অবাঙ্গালি ও স্থানীয় চিনহিত সমাজবিরোধী লোকজন। এসব রাজাকাররা মুক্তিবাহিনী কর্তৃক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও তাদের ভয়ে থাকে। এরা মূলত শরনার্থিদের জিনিসপত্র হরণ ওঁ তাদের মেরে ফেলার সাথে জড়িত। তাদের হাতে এপর্যন্ত ৩০০ জন শরনার্থির মৃত্যু হয়েছে।

পূর্বাঞ্চলের মুক্তিসেনারা এখন পাকসেনাদের হাত থেকে কেড়ে নেয়া উন্নতমানের চাইনিজ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যাবহার করছে। susojসুসজ্জিত পাকসেনারা যারা একমাস আগেও গ্রামাঞ্চলে আক্রমণ চালিয়ে ভীতির সঞ্চার করত এখন তারা গেরিলা আক্রমণ ও তাদের সম্ভ্যাব্য ক্ষয়ক্ষতির ভয়ে আতংকিত।

সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া এক বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন অনুযায়ী ৭ জন পাকসেনা কুমিল্লার নবীনগর গ্রামের এক মুসলিম লিগ নেতাকে গেরিলা বাহিনীর হাত থেকে জীবন রক্ষার জন্য এক মাস আগে নিয়জিত ছিল। গভীর রাতে গেরিলারা এখানে আসে এবং তাদের সবাইকে বাইরে আসতে বলে; এর পর বিনা বাঁধায় তাদের সবাইকে হত্যা করা হয়। আমি যখন এখান থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে দেবীপুর সীমান্ত এলাকায় ছিলাম তখন আমাকে আরেকটি কাহিনী বলা হয়। গত শনিবার বিকেল ৩ টায়গেরিলা বাহিনী কুমিল্লা সিমান্তবর্তি সালদা নদীতে একটি সেনা স্পিড বোটে অকস্ম্যাত হামলা চালায় যেখানে দুইজন মেজর , দুইজন ক্যাপ্টেন ও ৪ জন সেনা সহ মোট ৮ জন নিহত হয়। এরা সবাই সালদা নদীর ঘাঁটি পরিদর্শনে এসেছিল। এলাকা ত্যাগ করার জন্য তাড়াহুড়ায় ছিল ও অকস্ম্যাত আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিলোনা। অভিযানের সময় গেরিলারা কিছু চাইনিজ আগ্নেয়াস্ত্র, ওয়ারলেস সেট ও স্পিড বোট দখল করে। একই সাথে আরেকটি স্পিড বোট ধ্বংস হয়ে যায়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
পাকিস্তানে ফিরে যেতে বাংলাদেশ মিশন কর্মচারিদের অস্বীকৃতি প্রকাশ দি স্টেটসম্যান ১৯ জুলাই ১৯৭১

Maruf Kabir
<১৪, ৩৫৬, ৮৫৭-৮৫৯>

বাংলাদেশ মিশনের ব্যাক্তিবর্গের যাওয়ার অনিচ্ছা
(সুইস প্রতিনিধির সাক্ষাৎকার)

বাংলাদেশ মিশন প্রধান মি হোসেন আলি সহ ৬৪ জন প্রতিনিধি পাকিস্তান সরকারের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য প্রকাশ করেন। সুইস সরকারের প্রতিনিধি ড বোনার্ড এর কলকাতায় তদন্তের মাধ্যমে বিষয়টি স্পষ্ট হয় তারা পাকিস্তানে ফেরত যেতে চান না।

ডঃ বোনার্ড ছিলেন দিল্লিতে নিযুক্ত সুইস রাষ্ট্রদূতের একজন সদস্য যিনি ৬৫ জন বাঙালি মিশন স্টাফ যারা ইতোপূর্বে কলকাতায় নিযুক্ত পাকিস্তানী ডেপুটি হাই কমিশনে কর্মরত ছিলেন যাদেরকে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য প্রকাশ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। বিষয়টি কূটনৈতিকভাবে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়েছিল কারণ ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার মি কে সি সেন গুপ্ত ও হাই কমিশনের ১৩০ জন সদস্য এবং তাঁদের পরিবার বর্গ গৃহবন্দি অবস্থায় ছিল। মি মেহেদী মাসুদকে পাকিস্তানের নতুন ডেপুটি হাই কমিশনার হিসেবে কলকাতায় নিযুক্ত করা হয় এবং তার স্টাফরা তার সাথে একই রকম আচরণ করেন। অচলাবস্থা কাটানোর জন্য সুইস মধ্যস্থতায় ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় ঢাকা ও কলকাতায় নিযুক্ত মিশনের সদস্যের পারস্পরিক বিনিময়ের চুক্তি করা হয়।

চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ মিশনের স্টাফ মেম্বারদের মতামত পরীক্ষার জন্য ড বোনার্ড নিরপেক্ষ স্থান হিসেবে কমকাতার হিন্দি হাই স্কুলকে বেছে নেন। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মি এ কে রায় ও মি মাসুদ এর উপস্থিতিতে সুইস কূটনৈতিক ড বোনার্ড মিশনের প্রত্যেক সদস্যকে আলাদাভাবে প্রশ্ন করেন। পূর্ব নির্ধারিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রত্যেক স্টাফ মেম্বারকে ড বোনার্ড শুধু একটি প্রশ্ন করেন। প্রশ্নটি ছিল ‘আপনি কি পাকিস্তানে ফিরে যেতে চান নাকি চাননা?যদি আপনি ফিরে যেতে চান তাহলে ভারত সরকার আপনাকে জেনেভা কনভেনশন অনুসারে সমস্ত নিরাপত্তার ব্যাবস্থা করবে। দোয়া করে আপনার ইচ্ছার কথা জানান।’

বাংলাদেশ মিশনের ৬২ জন সদস্য তাঁদের সিদ্ধান্ত ড বোনার্ডকে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে জানিয়ে ছিল ‘তারা যেতে চান না।’ পাকিস্তানে ফিরে ড বোনার্ড যে পরীক্ষার ব্যাবস্থা করেছিলেন তা মি হোসাইন আলি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে ড বোনার্ড মি মাসুদ এবং মি রায়ের উপস্থিতিতে তার নির্বাচিত স্থানে স্বাক্ষাতকার দিতে রাজি আছেন। বাংলাদেশ মিশন অফিসে আসলে তিনি তাদেরকে আনন্দের সাথে স্বাগত জানাবেন। কিন্তু তিনি বাংলাদেশ মিশন অফিসে মি মাসুদের উপস্থিতি পছন্দ করবেন না।

আচরণবিধি মানাঃ

মি হোসাইন আলি তখন তার দখলে থাকা একটা খালি আবাসিক ফ্ল্যাট এর প্রস্তাব করেছিলেন যেখানে উল্লেখিত টিম তার স্বাক্ষাতকার নিতে পারে; যদিও এটা ছিল মি হোসাইন আলির জন্য নিয়ম রক্ষার বিষয় কারণ তিনি ইতোমধ্যে স্পষ্টভাবে পত্রিকা ও টেলিভিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন।

বাংলাদেশ মিশনের প্রেস সচিব মি ম্যাকসুদ আলি সে সময়ে জলবসন্তে আক্রান্ত ছিলেন এবং তিনি স্বাক্ষাতকার দেবার উপযুক্ত ছিলেন না। ড বোনার্ড এবং তার লোকজন মি ম্যাকসুদের কাছ থেকে ‘নিরাপদ দূরত্ব বজায়’ রেখে তার স্বাক্ষাতকার নিয়েছিলেন। মি আলি যে উত্তর দিয়েছিলেন তা অন্যদের থেকে আলাদা ছিলোনা। শুধু একজন মিশনের সদস্য কলকাতার বাইরে ছিলেন যিনি যে কোন সময় ফিরে আসবেন বলে আশা করা হচ্ছিল।

পরে সন্ধ্যায় মি হোসাইন আলি তার অফিসে একটা সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন এবং ঘোষণা দেন যে তিনি এবং তার মিশন সদস্যরা মি মাসুদ এর উপস্থিতিতে স্বাক্ষাতকার দিতে সম্মত আছেন; কারণ ঢাকাতে ভারতীয় মিশন অফিসে গৃহবন্দির কারণে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তারা সবাই তার দ্রুত অবসান চান।

মি আলি বলেছিলেন যে কলকাতায় নিযুক্ত পাকিস্তানী হাই কমিশন অফিসের বাঙালি সদস্যদের বল প্রয়োগ করে পাকিস্তান পক্ষ ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে যে অভিযোগ সত্য নয়। প্রত্যেক সদস্য বাংলায় লিখিতভাবে উত্তর দিয়েছিলেন তারা পাকিস্তানে ফিরে যেতে চান না। মি হোসাইন আলি বলেছিলেন এটা এখন স্পষ্ট যে পূর্ব পাকিস্তান হাই কমিশনের বাঙালি সদস্যরা স্বেচ্ছায়, আনন্দের সাথে ও মনেপ্রাণে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন।

এখানে পাকিস্তান সরকারের দাবি তারা তাঁদের প্রতি বল প্রয়োগের কোন বিষয় নেই। মি আলি বলেছিলেন যে বাঙালিরা যে কারণে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছিল তা হল পাকিস্তান সরকারের বাংলাদেশ দুর্বিষহ অবস্থা সৃষ্টি। তিনি বলেছিলেন, আমরা সবাই পাকিস্তান সরকারের প্রতি বাধ্য ও বিশ্বাসী ছিলাম, কিন্তু যদি আমাদের বিশ্বস্ততা পরিবর্তন হয়ে থাকে তবে তা বাংলাদেশে পাকিস্তানী সেনাদের কার্যক্রমের কারণেই হয়েছে।

মি আলি বলেছিলেন যে, তিনি বাংলাদেশ মিশন প্রধান ও তার পদবী রাষ্ট্রদূত বা হাই কমিশনার পদমর্যাদার সমান। এমতাবস্থায়, তার চেয়ে নিচের পদমর্যাদা সম্পন্ন একজন বিদেশী প্রতিনিধি এবং পাকিস্তানী ডেপুটি হাই কমিশনার পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যাক্তির সামনে পরীক্ষা দিতে ইচ্ছুক নন। তাই তিনি তার নিজের পছন্দমত একটি স্থানের প্রস্তাব করেছেন যেখানে তারা আসতে পারেন। তখন তারা আসতে রাজি হন। যেখানে মি আলি তার আনুগত্যের বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রদান করেন।

মাথা নেড়ে আভিবাদনঃ
মি মাসুদ পররাষ্ট্র বিষয়ক কর্মকর্তা হিসেবে মি আলি এর কনিষ্ঠ সহকর্মি ছিলেন। তিনি মি আলিকে বন্ধুভাবাপন্ন মাথা নেড়ে তাকে অভিবাদন জানান। মি আলি বলেছিলেন, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাংলাদেশে নারকীয় ধ্বংস চালানোর কারণে পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধিকে অভিবাদন জানানোর মত মানসিকতা তার ছিলোনা। তিনি শুধু মৃদু হেসেছিলেন। মি আলি বলেন, ড বোনার্ড যে পরীক্ষা নিয়েছেন তা তিনটি স্থানে সম্পন্ন হয়েছিল।
১। কলকাতার হিন্দি হাই স্কুল ভবন
২। মি আলির প্রস্তাবিত আবাসিক ভবন এবং
৩। মি ম্যাকসুদের বাসভবন।

সকাল ১০-১৫ থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত এই স্বাক্ষাতকারপর্ব স্থায়ী হয়।

বাংলাদেশ মিশনের যে সদস্য আগরতলাতে অবস্থান করছিলেন তার ফিরে এসে স্বাক্ষাতকার দেয়া পর্যন্ত ড বোনার্ড কলকাতায় অবস্থান করেন। মি আলি আশা করছিলেন যেকোন সময় তিনি ফিরে আসবেন।

প্রাথমিকভাবে স্বাক্ষাতকারটি সুইস রাষ্ট্রদূত মি ফিতজ রিয়েল এর তত্ত্বাবধানে হবার কথা ছিল। তিনি অসুস্থ থাকায় ড বোনার্ড সব বাঙালির অনুগত্যের বিষয়ে লিখিত উত্তর সংযুক্ত করে প্রতিবেদন প্রদান করবেন বলে আশা করা যায়। যেহেতু, চুক্তির বিষয়ে আগে থেকেই সবাই অবগত ছিলেন সেজন্য ঢাকায় ভারতীয় মিশনের সদস্যদের ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে বিলম্বের কোন সুযোগ ছিলোনা।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৫৭। পাক বাহিনীর দলিলে লুট ও ধর্ষনের প্রমাণ দি স্টেটসম্যান ২০ জুলাই ৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ৩৫৭, ৮৬০-৮৬১>

দি স্টেটসম্যান, জুলাই ২০, ১৯৭১
পাক সামরিক ডকুমেন্টসে লুটপাট ও ধর্ষণের প্রমাণ
আমাদের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট থেকে প্রাপ্ত

নয়া দিল্লি, জুন ১৯ – ভারত সরকার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছ থেকে দখল করা সামরিক নথিতে বাংলাদেশে ঘটা দুইটি বিশেষ কাজের প্রমাণ পেয়েছে। () বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিবাহিনীর অব্যাহত কর্ম এবং (2) সম্পত্তি লুটপাট , লাঞ্ছনা এবং পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নারী ধর্ষণ।

নথিগুলো পাক সেনারা ভারতের হাতে আত্মসমর্পণ করার সময় জমা দিয়ে তাদেরকে বিনিময়ে মুক্তি ফৌজের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাবার অনুরোধ করে।

লুটপাট, হামলা ও ধর্ষণ এত বিশাল মাপের হয়েছে যে পাক-সামরিক কর্তৃপক্ষ কে এই উদ্দেশ্যে বিচার আদালত স্থাপনের আদেশ জারী করতে বাধ্য করা হয়েছে ।
নথির কিছু বিশদ বিবরণ:

(1) লেঃ কর্নেল যহির সারওয়ার্দী, হেড কোয়ার্টার স্টাফ অফিসার এর একটি গোপন চিঠি., ৯ বিভাগ নং ১৬৬০৪/৪, তারিখ – ১০/৫/৭১, ৩০ পি বি , হেড কোয়ার্টার ফ্রন্টিয়ার কর্পস ঠিকানায়।
(2) এটা পরিষ্কারভাবে স্বীকার করেন যে মুক্তি ফৌজ গেরিলারা রেলপথ ও সড়ক সেতু উড়িয়ে দিচ্ছে এবং রাস্তায় মাইন পুতে রাখছে ও সামরিক যানবাহনের উপর লুকিয়ে অ্যামবুশ আক্রমণ করছে । এতে তারা হ্যান্ড গ্রেনেড ব্যাবহার করছে ও স্নাইপিং করছে।

একই নথিতে অভিযোগ তারা ব্যাংক ও সরকারের কোষাগার থেকে অর্থ লুট করে নিচ্ছে ও পুলিশ ও আর্মির কাছে থেকে আগ্নেয়াস্ত্র ছিনিয়ে নিচ্ছে।

(2) ব্রিগেডিয়ার মেজর এইচ জি . ১৩১ থেকে প্রাপ্ত একটি গোপন চিঠি- সিলেট নং ১০৯০৭০ / জি এস (ও পি এস) তারিখ – ৭ -৫-৭১
এই ডকুমেন্ট এ সম্পত্তি লুট এবং লাঞ্ছনা ও মেয়েদের ধর্ষণ এর প্রমাণ ছিল । কমান্ড্যান্ট এটি গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেছে। কমান্ড্যান্টের নির্দেশ ছিল ভবিষ্যতে যদি কাউকে এই ধরনের অপরাধে দোষী পাওয়া যায় তাহলে তার শাস্তি হবে।
(নোট গ্রহণ করা যেতে পারে যে অতীতের গুলোর কোন বিচার হবেনা। শুধুমাত্র ভবিষ্যতে যারা এসবের সঙ্গে সংযুক্ত হবে তাদের বিচার করা হবে!)
(3) এইচ জি ৩১৩ এর ব্রিগেড মেজর জি আর ভাট্টি থেকে প্রাপ্ত একটা চিঠি, নং ২০০১/২০/এ (ও পি এস) তারিখ – ২-৫-৭১

দ্যার্থহিনভাবে প্রমাণিত এসব (হেডকোয়ার্টার ইস্টার্ন কমান্ড থেকে গৃহীত) লুট করা জিনিসপত্র ঢাকা ও করাচীতে নিয়ে আসা হয়। পূর্ব কমান্ডের সামরিক অফিসারদের এসবের সাথে সম্পৃক্ততার প্রমাণ রিপোর্টে আছে। জিওসি-ইন-সি, ইস্টার্ন কমান্ড, এবং জিওসি 9 নং বিভাগ এই ঘটনা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে।

(4) সদর দপ্তর, ফ্রন্টিয়ার কর্প্সের একটি সংকেত বার্তা, তারিখ ৭-৫-৭১ ৩১৩ ব্রিগেড , নং জি ১২০, মেজর আমজাদ হোসেন ২ নং উইং বলেন যে ৩১৩ ব্রিগেড রিপোর্ট করে যে সেখানে র্যাঙ্কের গুরুতর অনিয়ম বিরাজ করছে।

শিরোনামঃ সূত্রঃ তারিখঃ
পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহের প্রতিবাদে ছাত্রদের দ্বারা মার্কিন পতাকার অসম্মান হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড
২১ জুলাই, ১৯৭১

Nobel Himura
অনুবাদঃ মোঃ রাশেদ হাসান
<১৪,৩৫৮,৮৬২>
হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, জুলাই ২১, ১৯৭১
ছাত্ররা আমেরিকান পতাকা নামিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছেন
লিখেছেনঃ একজন স্টাফ রিপোর্টার
.
কলকাতার চৌরঙ্গীতে গত মঙ্গলবার বিকেলে বামপন্থী ছয়টি ছাত্রসংগঠন USIS লাইব্রেরীর সামনে একসাথে এক বিশাল বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করে। ভমনের উপর থেকে তারা আমেরিকার পতাকা নামিয়ে এনে আগুণ লাগিয়ে দেয় এবং বিক্ষোভ করতে থাকে। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের একটি তুঁষপুত্তলিকাও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
.
বিক্ষুব্ধ জনতা USIS ভবনে আমেরিকার পতাকার স্থলে দক্ষিণ ভিয়েতনামের অস্থায়ী সরকারের পতাকা উড়িয়ে দেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজয়ের পক্ষে এবং পাকিস্তান আর্মিকে দেওয়া আমেরিকান সরকারের অস্ত্র সাহায্যের বিপরীতে তারা স্লোগান দিচ্ছিলেন।
বিক্ষোভ চলাকালীন পুরোটা সময় জুড়ে বিপুল সংখ্যক দাঙ্গা পুলিশ ভবনের সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। গোটা সময় জুড়ে বিক্ষোভটি শান্তিপূর্ন ছিল।

এরআগে ছাত্ররা রাজা সুবোধ মল্লিক স্কয়ারে এসে জড় হন। এই সমাবেশ থেকে আমেরিকান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে একটি প্রস্তাবনা গৃহীত হয়। জনাব বিমান বসুর সভাপতিত্তে আরও বক্তব্য রাখেন জনাব দেবাশিষ ব্যানার্জি, জনাব কিশ্তি গোস্বামী এবং জনাব গৌতম ঘোষ।

এরপর আমেরিকান কনস্যুলেট অভিমুখে একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একজন দূতাবাস কর্মকর্তা ছাত্রদের কাছথেকে একটি স্মারকলিপি গ্রহণ করেন। স্মারকলিপিতে দক্ষিণ ভিয়েতনাম থেকে আমেরিকান সৈন্য প্রত্যাহারের দাবী জানানো হয়। তারপর ছাত্ররা রাজ ভবনে যান। সেখানে গভর্নরের সেক্রেটারি ছাত্রদের কাছ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেওয়া একটি স্বারকলিপি গ্রহণ করেন। স্বারকলিপিতে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশ্যে ভিয়েতনামের PRG(The Provisional Revolutionary Government of the Republic of South Vietnam) কে স্বীকৃতি দিতে এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামে আগ্রাসনের জন্য আমেরিকান সরকারের প্রতি নিন্দা জানানোর দাবী করা হয়।

AISF [All Indian Students Federation], SFI [Students Federation of India], DSO[All Indian Democratic Students Organisation], প্রোগ্রেসিভ স্টুডেন্টস ইউনিয়ন, স্টুডেন্টস ব্লক এবং ফেডারেশন অফ রিভলিউশনারি স্টুডেন্টস এই বিক্ষোভের আয়োজন করেন।

UNI[United News of India] সংযুক্তিঃ এই সংগঠন গুলোর ডাকে রাজ্যের বেশীরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এইদিনে ভিয়েতনাম দিবস পালনে বন্ধ ছিল।
শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৫৯। পূর্ব বাংলার বিপন্ন বৌদ্ধরা আনন্দবাজার পত্রিকা ২২ জুলাই, ১৯৭১

Bashneen Faham
<১৪, ৩৫৯, ৮৬৩>

সম্পাদকীয়
পূর্ব বাংলার বিপন্ন বৌদ্ধরা

পূর্ববাংলার নানাস্থানে, বিশেষ করে চট্টগ্রামে যে সংখ্যালঘু বৌদ্ধেরা ছিলেন, পাকিস্তানী ফৌজের গুন্ডামি ও বর্বরতায় তাঁরাও অন্যদের মতই নিরাশ্রয় হয়েছেন। তাঁদের মঠ মন্দির ভেঙে, ঘর বাড়ী জ্বালিয়ে, কুলনারীদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়ে পাকিস্তানী দুষমনরা যে নরকের আবহাওয়া সৃষ্টি করেছে তার মধ্যে বেঁচে থাকা অসম্ভব। নিছক প্রাণের দায়েই তাই ২০ হাজার বৌদ্ধ ব্রক্ষ্মদেশের আরাকান অঞ্চলে জঙ্গলে পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছেন। ব্রক্ষ্মদেশবাসী এক বাঙালি বৌদ্ধই এ সংবাদ জানিয়েছেন আসামের বৌদ্ধপ্রধান শ্রীজিনরতন মহাস্থবিরকে। আসামের মিজো পাহাড় আঞ্চলেও নাকি এসেছেন প্রায় ১৫ হাজার বৌদ্ধ এবং তাঁরাও এসেছেন একইভাবে বর্বরতার শিকার হয়ে।

আর্ত ও বিপন্ন মানুষেরা যে ধর্ম বা মতানলম্বীই হন, তাঁদের দিকে আমাদের তাকাতে হবে একই উদার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। সে হিসাবে পূর্ব বাংলার মৃত্তিকা থেকে উন্মুলিত লক্ষ লক্ষ হিন্দু মুসলমান নরনারীর সমস্যা থেকে বৌদ্ধদের সমস্যাকে হয়ত তফাৎ করে দেখা চলে না। তবু বঙ্গ ভাষাভাষী বৌদ্ধদের সমস্যার একটি নিজস্ব দিক আছে। তাঁরা শুধু বাংলায় নয় গোটা ভারতই সংখ্যায় নিতান্তই কম। তাঁদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক রীতিপদ্ধতির বৈশিষ্ট্য অব্যাহত রেখে তাঁরা এতদিন যেভাবে জীবন কাটিয়েছেন, তার ভিত্তি হঠাৎ গুঁড়িয়ে যাওয়ার জন্য তারা অনিবার্যভাবে আজ অকূলে পড়েছেন। এই সংকটে তাঁদের জন্যে হাত এগিয়ে দেবার জন্যে তাঁদের স্বগোষ্ঠীর মানুষ আরো অধিক সংখ্যায় থাকলে ভালো হত।

ধর্মের আনুষ্ঠানিক অংশ আমরা মানি বা না মানি, তার অন্তর্লগ্ন ঐক্যের বন্ধনটি যে আদৃশ্যভাবেই কাজ করে তা বোঝা যায়, যখন চরম বিপদের মুহূর্তে ত্রাণের আশায় মানুষ স্বশ্রেণী ও স্বভাষীর আশ্রয়েই ছুটে আসে। পূর্ববাংলার হিন্দু মুসলমান ভারতে রিক্ত হাতে এলেও এসেছেন এখানকার হিন্দু মুসলমান্দের পোষকতার ভরসায়। এই ভরসা নিশ্চয়ই অন্তরে আছে বৌদ্ধদেরও, কারণ বৌদ্ধধর্ম যেহেতু হিন্দুধর্মেরই সম্প্রসারিত একটি শাখা এবং ভারতবর্ষ যেহেতু ‘সেকুলার’ বা ধর্মের গোঁড়ামি বিমুক্ত রাষ্ট্র, সেই হেতু তাঁরাও এখানে আশ্রয় ও সহায়তা পাবেন। তবু কতকটা নিরূপায়তা বোধ হবেই তাঁদের এবং তার কারণ আমরা গোঁড়াতেই বলেছি। এদিক থেকে ব্রক্ষ্মদেশের পরিবেশ তাঁদের হয়ত খানিকটা অনুকূল হবে।

অবশ্য রাজনীতিক শরণার্থীদের সম্বন্ধে সরকারী নীতি সেখানে কি হবে, তার ওপরই নির্ভর করছে সব কিছু। আসামে ও পশ্চিম বাংলায় যে বৌদ্ধ শরণার্থীরা এসেছেন, তাঁদের ত্রাণ এবং সেবার কাজে যে আমাদের সতর্ক মনোযোগ আকৃষ্ট হবে, এতে অবশ্য কোনই সন্দেহ নেই। একদিন আমরা হিটলারের জার্মানী থেকে ইহুদীদের দলে দলে উৎখাত ও বিতারিত হয়ে পৃথিবীর দিকে দিকে পিছিয়ে পড়তে দেখেছি। অদম্য প্রাণশক্তি ও বলিষ্ঠ সাংস্কৃতিক আত্মপ্রত্যয়ের জোরে তাঁরা চরম দুর্যোগের মধ্যেও টিকে থেকেছেন। এবং তা থেকেছেন বলেই শেষ পর্যন্ত উঠে দাঁড়িয়েছেন। স্বৈরাচারী হিটলারই পরাজয়ের ভস্ম মুখে বিদায় নিয়েছেন ইতিহাসের বঙ্গমঞ্চ থেকে। বাঙালি বৌদ্ধরাও এইভাবে জয়ের অধিকারী হবেন একদিন, স্বধর্মদ্রোহী, মানবদ্রোহী আজ জঙ্গী সর্দারদের ক্ষণিকের খেলা শেষ হলে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৬০। মুজিবের নয়, ইয়াহিয়ার বিচার চাই
(সম্পাদকীয়) যুগান্তর ২৪ জুলাই, ১৯৭১

Bashneen Faham
<১৪, ৩৬০, ৮৬৪-৮৬৫>

সম্পাদকীয়
মুজিবের নয়, ইয়াহিয়ার বিচার চাই

জেনারেল ইয়াহিয়া খাঁর হাতে বন্দী শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্য সম্পর্কে অস্থায়ী বাংলাদেশি সরকারের

পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক আহম্মদ যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, সে উদ্বেগ তাঁর একার নয়, পৃথিবীর সকল সভ্য মানুষেরই এই বিষয়ে উদ্বেগ বোধ করার কথা। শাসক হিসাবে যাঁর বন্দুকের জোর ছাড়া আর কোন জোরই নেই সেঁই ইয়াহিয়া খাঁ বিচারের নামে হত্যা করতে চাইছেন শেখ মুজিবুর রহমানকে- যিনি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নির্বাচিত নেতা। জঙ্গি শাসককে এই জিঘাংসাপরায়ণতা থেকে নিবৃত্ত করার দায়িত্ব সারা পৃথিবীর, সমগ্র মনুষ্যজাতির।

বিদেশী সাংবাদিকের কাছে দম্ভভরে বাংলাদেশের কসাই ইয়াহিয়া খাঁ বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে
সামরিক আদালতে গোপন ‘বিচারের’ সম্মুখীন করা হবে এবং তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হবে তাতে তাঁর মৃত্যুদন্ড হতে পারে। দশ লক্ষ মানুষের হত্যা, অসংখ্য নারীর নির্যাতন, লুন্ঠন ও ধ্বংসের জন্য যিনি দায়ী তিনি কি করে অন্যের বিচার করবেন? জল্লাদ যেখানে হাকিম সেখানে বিচার কিভাবে হবে? আর শেখ মুজিবুর রহমান এমন কি করেছে যার জন্য তাঁকে ইয়াহিয়ার কাছে প্রাণ বলি দিতে হবে? দেশদ্রোহীতা? মুজিব যদি দেশদ্রোহী তাহলে ইয়াহিয়া ঢাকায় এসে তাঁর সঙ্গে বৈঠক করছিলেন কেন? এই ‘বিচার’ গোপনেই বা অনুষ্ঠিত হবে কেন? যাকে ইয়াহিয়া খাঁ নিজে একদা ‘ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী’ বলে অখ্যায়িত করেছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে আজ কি অভিযোগ, কি সাক্ষ্যপ্রমাণ, এসব কথা দেশের লোককে ও পৃথিবীর মানুষকে জানতে দেওয়া হবে না কেন? ঘৃণিত ইহুদী হত্যাকারী আইকম্যানের বিচারও তো প্রকাশ্যেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এমনকি ন্যুরেনবার্গের বিচারও গোপনে হয়নি।একজন নিরস্ত্র, নিঃসঙ্গ মানুষ তাঁর হাতের মুঠোয়, আদালত তাঁর নিজেরই তৈরি। তবু সেই মানুষকেই তাঁর এত ভয় যে, সকলের চোখের সামনে সেই মানুষটিকে তিনি কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারছেন না? শুধু যে প্রকাশ্য বিচার হবে না, তাই নয়, পিন্ডির মিলিটারী ডীকটেটরা বলেছেন, কোন বিদেশী উকিলের সাহায্যও পাবেন না শেখ সাহেব।
অর্থাৎ যে মামলা তিনি সাজাবেন সেই মামলা যাতে ফেঁসে না যায়, তার জন্য তিনি খুব হুঁশিয়ার। বিচারের নামে প্রহসনে দন্ডটা আগেই দিয়ে রাখা হয়েছে, বাকি সবটা মিথ্যা চাল।
এটা লক্ষ্য করার বিষয় যে, বঙ্গবন্ধু মুজিবকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলাবার হুমকি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইয়াহিয়া এ কথাও গেয়ে রেখেছেন যে, মৃত্যুদন্ডের আদেশ মকুব করার ক্ষমতা তাঁর রয়েছে। তাঁর এই কথার ইঙ্গিত সম্ভবত এই যে, মুজিবের প্রাণকে বাজি করে তিনি রাজনৈতিক জুয়াখেলায় নামবেন। মুজিবের অনুগামীদের সম্ভবত প্রাচ্ছন্নভাবে তিনি এটাই জানিয়ে দিতে চান যে, তাঁরা যদি তাঁদের নেতাকে প্রাণে বাঁচাতে চান তাহলে তাঁর সঙ্গে একটা আপোষে আসতে হবে। কিন্তু তার এই শয়তানি চাল ব্যর্থ হতে বাধ্য। কেননা, বাংলাদেশের মানুষ ইসলামাবাদের পশুশক্তির বিরুদ্ধে যে লড়াইয়ে নেমেছে সেটা মরপণ লড়াই। কোন ভয় দেখিয়ে বা চাল দিয়ে তাদের সঙ্কল্প থেকে বিচ্যুত করা যাবে না। সে কথা না বুঝে ইয়াহিয়া যদি শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসির দড়ি পরাতে যান, তাহলে নয়াদিল্লীতে বাংলাদেশ প্রতিনিধি জনাব কে,এম, সাহবুদ্দিনের ভাষায়,’বাংলাদেশ তাঁকে কোন দিন ক্ষমা করবে না। তখন জবাব হবে-রক্তের বদলে রক্ত, প্রাণের বদলে প্রাণ’

কিন্তু রক্তপিপাসু ইয়াহিয়া খাঁকে এই চরম নির্বুদ্ধিতার পথ থেকে নিবৃত্ত করবে কে? বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক আহম্মদ এই বিচারের প্রহসন বন্ধ করে শেখের প্রাণ বাঁচাবার জন্য রাষ্ট্রসঙ্ঘের সেক্রেটারি জেনারেল উথান্টের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। সেক্রাটারি জেনারেলের নিশ্চই এই বিষয়ে একটা কর্তব্য রয়েছে। মানবিকতার নামে, ন্যায্যবিচারের নামে তাঁর নিশ্চয়ই এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা উচিত। পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রের তরফ থেকেও ইসলামাবাদের শাসকদের উপর চাপ আসা উচিত যাতে বন্দী অবস্থায় মুজিবের কোন রকম শারীরিক ক্ষতি না হয় বিশেষ করে মার্কিন যুক্ত্রাষ্ট্রের মতো যারা মনে করে যে ইয়াহিয়াকে ক্ষেপিয়ে না দিয়ে তাঁকে দিয়ে বুঝিয়ে-সুজিয়ে কাজ করান উচিত সেসব রাষ্ট্র এবার প্রমাণ দিক যে, পিন্ডির নায়করা তাদের কথার বিন্দুমাত্র দাম দেননা। মুজিবের বিচার প্রহসন বন্ধ করার দাবীতে সারা পৃথিবীর জনমত সোচ্চার হয়ে ওঠা উচিত। আর ভারতবর্ষের দিক থেকে আসা উচিত সবচেয়ে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। নয়াদিল্লী পরিষ্কার জানিয়ে দিক যে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার জন্য বিচারের মধ্যে ভাঁওতা দেওয়া হলেও ভারত বুঝে নেবে, পাকিস্তান বাংলাদেশ সমস্যার কোন চায় না এবং তখন আশ্রয়প্রার্থীদের ফিরে যাওয়ার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে ভারত যে কোন ব্যবস্থা অবলম্বন করবে।

শিরনাম সূত্র তারিখ
৩৬১। বাংলাদেশ ও জাতিসঙ্ঘ
(সম্পাদকীয়) দি স্টেটসম্যান ৩০ জুলাই, ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ৩৬১, ৮৬৬-৮৬৭>

স্টেটসম্যান , ৩০ জুলাই ১৯৭১
সম্পাদকীয়
বাংলাদেশ এবং জাতিসঙ্ঘ

নিয়া দিল্লি একটি বিষয়ে খুবই সজাগ – আর টা হল বাংলাদেশ বিষয়টি যেন কোনভাবে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার একটি বিষয় না হয়। ভারতের দুঃখিত বোধ করার কিছু নাই। জাতিসঙ্ঘের কাজ সম্পর্কে দেয়া মতামত ঘোলাটে। এর মূল কারণ মনোভাব ও আচরণ। যখন ইসলামাবাদ দাবি করেছিল যে বাংলাদেশের সংগ্রাম পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার তখন আসলে সমস্ত মানবতার উচিত ছিল জবাই, লুন্ঠন ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু যখন ভারত আসছিল তখন এটা আর পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ বিষয় থাকে না। এবং ভারতের যথেষ্ট কারণ থাকে যে তখন তারা এটাকে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে মেনে নিতে নারাজ। এটা ওই সময়ে আশা করা হয়েছিল যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সাথে সাথে একশন নেবে। এবং পাকিস্তানকে থামাতে চেষ্টা করবে। এটা শুধু মানবতার দিক থেকেই নয় পার্শবর্তি দেশের জন্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ের প্রতি হুমকি। কিন্তু কোন ব্যাবস্থা নেয়া হয়নি। কিছু দেশ চেষ্টা করেছে তবে তেমন জোরালো নয়।

স্পষ্টরূপে, নয়া দিল্লি হয় এটা আগে থেকে অনুমান করেনি বা এটা নিয়ে তেমন চিন্তা করেনাই যে নেগেটিভলি ঘটনাগুলো ঘটলে কি করবে তারা। পাকিস্তান ও তার বন্ধু দেশগুলো এখন বাংলাদেশ বিষয়কে তাদের পক্ষে নেবার জন্য আন্তর্জাতিক প্রভাব ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন। পূর্ববাংলার জনসংখ্যার সত্তর লক্ষেরও বেশি কমেছে এবং অনেক মানুষ সামরিক প্রশাসনের স্পর্ধা সম্পর্কে স্বীকার করবে। এবং এটাও ঠিক যে পাকিস্তানের লক্ষ্য তাদের ভারতের পূর্ব সীমান্তের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। এটা করা যাবে যদি সীমান্তের উভয় পাশে জাতিসঙ্ঘ অবস্থান করে। এতে করে শরনার্থিদের প্রবেশের ব্যাপারে ও পাশাপাশী বাংলাদেশি মুক্তিবাহিনীর ঐ এলাকায় কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। শরনার্থিরা শুধু অপেক্ষা করছে বিদেশি কেউ এসে তাদের ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ীঘরে ফিরে যাবার ব্যাবস্থা করবে – যা স্বপ্নের মত আসলে – যা জাতসঙ্ঘের সবচাইতে অজ্ঞ সদস্য ধারণা করতে সক্ষম না যে এই ধারনা কতটা কঠিন এবং ভারতের তা যথারীতি প্রত্যাখ্যান করেছে।

কিন্তু তারা জাতিসঙ্ঘের যে কোন অবস্থানকে অস্বীকার করতে পারেনা। যা তার নিজের সঠিক চিন্তাধারার বাইরে যায় – আর তা হল এটা পাকিস্তানের সম্পূর্ন আভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়। ভারত এটাও মানতে নারাজ যে – পাকিস্তান আর পূর্ব বাংলার মধ্যে একটি সমঝোতার ব্যাবস্থা হবে – আর ভারত তাতে ইনভল্ভ হবেনা। এটা ভারতের স্বার্থের বিপরীত হবে। যেহেতু তারা শরনার্থিদের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। যদি এটা নিরাপত্তা পরিষদে উঠে তখন ভারত মোটেই লজ্জা পাবেনা তার অবস্থানের পক্ষে যৌক্তিক কারণ প্রমাণ করতে। শরণ সিং বিরোধিতা করেন যে উ থান্ট নিরাপত্তা পরিষদের মিটিং ডেকেছেন আর সেখানে বাংলাদেশ ইস্যু উঠবে না। ভারতের এই আলোচনা এড়িয়ে যাবার কোন কারণ নেই। বরং তারা এতে সক্রিয়ভাবে আলোচনা করবে যাতে আলোচনা সঠিক দিকে যায়। স্বআরোপিত বিচ্ছিন্নতায় থেকে তেমন কোন লাভ হবেনা।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৬২। কলকাতায় বাংলাদেশের প্রথম ফুটবল খেলা যুগান্তর ৭ আগস্ট, ১৯৭১

Bashneen Faham
<১৪, ৩৬২, ৮৬৮>

কলকাতায় বাংলাদেশের প্রথম ফুটবল খেলা
(স্টাফ রিপোর্টার)
শ্রীগোষ্ঠ পালের একাদশ ৪ : বাংলাদেশ ২।

মোহনবাগানের খেলোয়াড় নিয়ে গড়া শ্রীগোষ্ঠ পালের একাদশ ৪-২ গোল বাংলাদেশের টিমকে হারিয়ে দেওয়া এমন কিছু নয়, এক সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে বাদল-আপরাহ্নে দুই বাংলার খেলোয়াড় ও হাজার হাজার দর্শকের প্রীতি শুভেচ্ছা বিনিময়ই কলকাতা ময়দানের এক স্মরণীয় ঘটনা। ঘেরামাঠের কর্মীরাও এদিন কোন পারিশ্রমিক নেননি।

প্রদর্শনী ফুটবলে কোন দল ভাল খেলল, কোন দল খেলল না; কে গোল করল, কে গোল করল না; এ সব আলোচনা হয়নি। পরিমল-চুনী জীবনে সর্বপ্রথম এক টিমে খেলছে, এই বয়সে চুনী কি রকম খেলছে, বাংলাদেশের ১০ নম্বর খেলোয়াড় তুর্যর ‘ফিটনেস’, ওদের গোলরক্ষকের বল ধরার কায়দার কথাই সবার মুখে মুখে। ফুটবল ছেড়ে দিবে আবার ফুটবল মাঠে এসে চুনী যে বল কনট্রোল, মাপা পাস, ড্রিবলিং দেখিয়ে গেল তা এখানকার খেলোয়াড়দের কাছ থেকে লীগের খেলায় খুব কম দেখতে পাই। বুটের ডগা ও সাইড দিয়ে ছোট্ট জায়গায় বল ধরে দু’তিন জনকে কাটানো এখনও চুনীর পক্ষে অসম্ভব নয়। বলে, বলে চুনী পায়ের কাজ দেখিয়েছে, ছোট জায়গায় চার পাঁচজনকে সহজেই ড্রিবল করে নিজের খেলোয়াড়দের মাপা ‘প্রু’ দিয়েছে। এখনকার ফুটবলে এসব লুপ্তপ্রায়। পাশে প্রণব, সুকু, পরিমলও খেলেছে, তার মধ্যে সবাই দেখেছে একটি উজ্জ্বল তারকা চুনী গোস্বামীকে। মনে হয়নি সে খেলা থেকে অবসর নিয়েছে।

বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের মধ্যে তুর্য হাজার, যে প্রথম গোল করে নিজের দলকে এগিয়ে দিয়েছিল, তার ‘ফিটনেস’ ও খেলার ধারা উন্নত ধরনের। কিন্তু সতীর্থদের কাছ থেকে সে সাহায্য পায়নি। গোলরক্ষক অনিরুদ্ধ দৃঢ়তা দেখিয়েছে। ৪ টি গোল হলেও কোনটিরও জন্য তাকে দায়ী করা যায় না।

কাদাভরা মাঠে খেলা উঁচু দরের না হলেও প্রাণহীন হয়নি। প্রায় অনুশিলন বিহীন বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের কাছে মাঠের অবস্থা সাবলীল ক্রীড়াধারার অন্তরায় ছিল। অনুশীলন করলে এই দল আরো অনেক ভাল খেলবে।

১৩ মিনিটে তসলিমের ব্যাক সেনটারে তুর্য হেড করলে গোলরক্ষক বলাই দে’র হাতে লেগে বলটি গোললাইন ‘ক্রস’ করে ১-০। ২৫ মিনিটে গোষ্ঠ পালের দল গোল শোধ করে। চুনীর পাস থেকে প্রণব ডান পায়ের কমজোরী নিচু শটে গোলরক্ষককে পরাজিত করেন ১-১। বিরতির এক মিনিট আগে চুনীর পাস থেকে সুকল্যাণ গোল করে গোষ্ঠ পালের দলকে এগিয়ে দেন ২-১।

৫৫ মিনিট প্রণব বাঁ পায়ের বিদ্যুৎ গতির শটে গোল করে সকলের চোখ ধাঁধিয়ে দেন ৩-১। ৬২ মিনিটে সুকু পালটা জবাব দেয়। চুনীকে পাস করলে চুনী প্লেসিং-এ গোল করে ৪-১। ৬৬ মিনিটে বাংলাদেশের বদলি খেলোয়াড় নৌশের একটি গোল শোধ করে ৪-২।

শ্রীগোষ্ঠ পালের একাদশ : বলাই, কাজল, কল্যাণ, নিমাই, ভবানী : প্রবীর, প্রিয়লাল: সুকল্যাণ, পরিমল, চুনী, প্রণব।
বাংলাদেশ : অনিরুদ্ধ, আইনুল, জাকির, পিনটো, ইমান, খোকন, কাইকোবাদ প্রতাপ, বিমল, সাগর, এনায়েৎ, সুভাষ, তুর্য হাজরা, তসলিম, নৌশের ও আমিনুল।
রেফারী : শ্রী সুধীন চ্যাটার্জি।

শিরোনাম ˆসুত্র তারিখ
৩৬৩। মুজিবের বিচার শুরুঃ
রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রতি ভারতের আবেদন দি স্টেটসম্যান, ১১ই অগাস্ট, ১৯৭১

Ashik Uz Zaman
<১৪, ৩৬৩, ৮৬৯-৮৭২>

দি স্টেটসম্যান, ১১ই অগাস্ট, ১৯৭১
মুজিবের বিচার শুরুঃ
রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রতি ভারতের আবেদন

রাওয়ালপিন্ডি, ১১ই অগাস্ট, ওয়াকিবহাল সরকারী সূত্রে জানা গেছে যে আওয়ামী লীগ নেতা, শেখ মুজিবুর রহমান এর প্রাণরক্ষার বিচারকাজ আজ শুরু হয়েছে তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন এই অপরাধে। এপি-র প্রতিবেদন।

বিচারকাজ গোপনে পরিচালনা করা হয়।

মামলার বিচারকাজ শুরু হয়েছে তা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করতে সরকার অস্বীকৃতি জানিয়েছে। সরকার সামরিক আদালতের অবস্থান, বিচারকদের নাম বা বিবাদী পক্ষের আইনজীবীর নাম প্রকাশ করতেও অস্বীকৃতি জানায়।

তিনটি বিদেশী রেডিও ষ্টেশন – রেডিও আক্রা, রেডিও কোলন এবং রেডিও অস্ট্রেলিয়া প্রচার করেছে – আজ শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারকাজ শুরু হয়েছে কিন্তু তারা কোন সূত্র উল্লেখ করেনি।

মিসেস গান্ধী ২৪টি দেশের কাছে আবেদন জানিয়েছেন মিঃ রহমানের জীবনরক্ষার জন্য, নয়া দিল্লী থেকে আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি লিখেছেন।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকেও একই আবেদন জানানোর সম্ভাবনা রয়েছে এই বিষয়ে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী, মিঃ সরন সিং একই বিষয়ে একটি তারবার্তা পাঠিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে।

যুক্তরাষ্ট্র আজ পাকিস্তান সরকারের প্রতি দ্বিতীয়বারের মতো তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যে শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচারে যেকোনো “সংক্ষিপ্ত বিচার” করা হলে তা পূর্ববাংলার সঙ্কটের রাজনৈতিক মীমাংসার জন্য সব ধরণের সম্ভাবনা নষ্ট করে দেবে। ওয়াশিংটন থেকে জানিয়েছে এপি।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব মিঃ রজার্স, পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত মিঃ আগা হিলালির কাছে ১১ জন সিনেটরের পক্ষ থেকে একটি টেলিগ্রাম এবং ৫৮ জন কংগ্রেস সদস্যের সাক্ষরিত একটি চিঠি হস্তান্তর করেন যেগুলোতে তাঁরা সবাই শেখ মুজিবের প্রতি করুণা প্রদর্শনের জন্য পাকিস্তানের প্রতি আবেদন জানান।

একই সময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র ডেমোক্র্যাট সিনেটর মিঃ কেনেডিকে ইসলামাবাদ এবং ঢাকা সফরের জন্য পাকিস্তান সরকারের অনুমতি দিতে প্রত্যাখ্যান করার সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করেন।

আজ মুজিবনগরে এক নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে পাওয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা গেছে যে শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী যিনি ঢাকায় গৃহবন্দী ছিলেন তাঁকে কয়েকদিন আগে বিমানযোগে করাচী নিয়ে আসা হয়, লিখেছে ইউএনআই।

তাঁকে সামরিক প্রহরায় ধানমন্ডির বাসা থেকে বিমানবন্দরে নিয়ে আসা হয় এবং করাচীগামী একটি বিমানে তুলে দেয়া হয়।

তাঁকে করাচী বা পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য কোথাও আটকে রাখা হয়েছে কিনা তা জানা যায়নি।

রেডিও অস্ট্রেলিয়া জানায় যে বিচারের ফলাফল পূর্বনির্ধারিত ছিল। “একমাত্র রায়ঃ দোষী”।
২৬শে মার্চ রাতে, শেখ মুজিব গ্রেফতার হবার ১৮ ঘণ্টা পর, জেনারেল ইয়াহিয়া খান তাঁকে বিশ্বাসঘাতক এবং পাকিস্তানের শত্রু হিসেবে ঘোষণা করেন। “পাকিস্তানের কেউই, বিশেষ করে কোন সামরিক আদালত, কখনই ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে যেতে সাহস পাবে না”, রেডিও অস্ট্রেলিয়াতে প্রচার করা হয়।

রেডিও অস্ট্রেলিয়া আরো প্রচার করে যে জেনারেল ইয়াহিয়া খান একান্তে “শেখ মুজিবকে মরতেই হবে” এরকম মন্তব্য করেছেন বলে জানা গেছে।

সকল পরাশক্তি, পশ্চিমা দেশগুলো এবং আফ্রিকার বিশেষ কিছু দেশ, এশিয়া ও পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলির প্রতি প্রেরিত প্রধানমন্ত্রীর তারবার্তা সংশ্লিষ্ট সরকার প্রধানদের প্রতি উদ্দেশ্য করে এবং সেইসব দেশে ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে।

তিনি এই তারবার্তায় বলেন “ভারতের সরকার ও জনগণ সেইসাথে আমাদের সংবাদমাধ্যম এবং সংসদ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উল্লিখিত বিবৃতিতে অত্যন্ত বিচলিত হয়েছে যে, তাঁকে কোনধরণের বৈদেশিক আইনি সহায়তা নেয়ার সুযোগ না দিয়েই তিনি জনাব মুজিবুর রহমানের গোপন সামরিক বিচার শুরু করতে যাচ্ছেন। আমরা বুঝতে পেরেছি যে এই তথাকথিত বিচার শুধুমাত্র শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ড আড়াল করার কাজেই ব্যবহার করা হবে। এতে করে পূর্ববঙ্গের পরিস্থিতির আরো অবনতি হবে এবং ভারতেও গুরুতর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে কেননা এব্যপারে আমাদের জনগণ এবং সবগুলো রাজনৈতিক দলের গভীর অনুভূতি রয়েছে। একারণেই আমাদের গভীর উদ্বেগ। আমরা আপনাদের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি এই অঞ্চলে শান্তি এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখার বৃহত্তর স্বার্থে একটি বাস্তবসম্মত মনোভাব গ্রহণ করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে আপনাদের প্রভাব খাটাতে”।
মিসেস গান্ধীর এই বার্তা, অবশ্য, চীন এবং ইউএআর ও ইরাক ছাড়া পশ্চিম এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোকে উদ্দেশ্য করে পাঠানো হয়নি। এই বাছাই করা তালিকায় রয়েছেঃ ইউএআর, সিলন, তাঞ্জানিয়া, ইন্দোনেশিয়া, আফগানিস্তান, নেপাল, মালয়শিয়া, জাম্বিয়া, ইউএসএসআর, কানাডা, ফ্রান্স, ইটালি, সিঙ্গাপুর, সুইডেন, হল্যান্ড, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, পশ্চিম জার্মানি, ঘানা এবং যুগোস্লাভিয়া।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ সরন সিং, ইউ থান্ট-এর কাছে তাঁর পাঠানো তারবার্তায় বলেন “তারা আগামীকাল থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার আরম্ভ করার প্রস্তাব করেছে রাওয়ালপিন্ডি থেকে এই ঘোষণা আসায় আমরা ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত। এই ঘোষণা ইদানীং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান হতে উদ্ভূত কয়েকটি চরম বিবৃতির প্রাক্কালে এসেছে যেখানে তিনি শেখ মুজিবের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার এবং রাষ্ট্রদ্রোহমূলক কার্যক্রমে লিপ্ত থাকার সামর্থ্য সম্পর্কে বলেছেন”।

“শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জনগণের অবিসংবাদিত নেতা, যাকে সবাই ভালবাসে এবং শ্রদ্ধা করে। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসের নির্বাচনে তাঁর বিজয় সম্ভবত সাম্প্রতিক সময়ের পৃথিবীর যেকোনো স্থানের অনুরুপ নির্বাচনের মধ্যে সবচেয়ে চমকপ্রদ ছিল। আমাদের জনগণ, সংবাদমাধ্যম, সংসদ এবং সরকার সবাই নিশ্চিত যে পূর্ব বঙ্গে পাকিস্তানী কর্মকাণ্ডের কারণে আমাদের জন্য যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে পাকিস্তানের সরকার যদি শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও কল্যাণের প্রেক্ষাপটে কোন হঠকারী এবং চরম সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে সেগুলো আরো দশ-গুণ বেড়ে যাবে”।

“আমরা আপনার কাছে সনির্বন্ধ আবেদন করতে চাই যাতে করে আপনি জরুরী পদক্ষেপ নেন পাকিস্তান সরকারকে অনুরোধ করার জন্য যেন তারা এমন কোন কাজ না করে যা তাদের এবং আমাদের সমস্যাগুলোকে আরো অনেক বেশী জটিল করে তোলে। তারা শেখ মুজিবের সাথে এখন যাই করুক না কেন তার পরিণাম অত্যন্ত গুরুতর এবং বিপজ্জনক হবে”।

সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে তিনি এবিষয়ে আলোচনা করেছেন কিনা এই প্রশ্নের জবাবে মিঃ সিং আজ রাজ্যসভায় বলেন যে মিঃ গ্রোমিকো দৃঢ়ভাবে পাকিস্তানকে প্ররোচিত করার পক্ষে যাতে করে তারা “এধরণের লজ্জাজনক বিচারকাজ” নিয়ে আর অগ্রসর না হয়।

তিনি সভাকে আরো জানান যে সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট যে হুমকির সৃষ্টি করেছেন তা নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।

মিঃ এ. ডি. মানি বাংলাদেশে পাকিস্তানী সামরিক শাসকদের দ্বারা যেসব যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে তার তদন্তের জন্য আন্তর্জাতিক আইনজ্ঞদের দিয়ে একটি কমিশন গঠন করার ব্যপারে সরকার কোন পদক্ষেপ নেবে কিনা জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন এধরণের একটি প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। তবে তাঁর মতে, যদি আন্তর্জাতিক আইনজ্ঞ কমিশনের ভারতীয় সদস্যরা এই পদক্ষেপ নেন তাহলে তা আরো কার্যকর হবে।

জাতিসংঘের মহাসচিব, ইউ থান্ট গতকাল বলেন যে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্যে যা ঘটবে পাকিস্তানের বাইরে তার প্রতিক্রিয়া হতে বাধ্য, জাতিসংঘ থেকে রয়টার জানিয়েছে।

কিন্তু মহাসচিব বলেন, সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের আসন্ন বিচার “একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং নাজুক বিষয় যেটি একটি সদস্য রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থার যোগ্যতার মধ্যে পরে”।

একটি সংবাদ বিবৃতিতে, ইউ থান্ট বলেন, তিনি জাতিসংঘে অনেক দেশের প্রতিনিধির সাথে একই অনুভুতির অংশীদার “যে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্য নির্ধারণ সংক্রান্ত বিষয়ে যেকোনো পরিবর্তনে পাকিস্তানের সীমান্তের বাইরে অবধারিতভাবে তার প্রতিক্রিয়া হবে”।

তিনি বলেন এই বিচারকার্যটি “অনেকের কাছেই মানবিক সেইসাথে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত কৌতূহল এবং উদ্বেগের বিষয়”।

তিনি বলেন, পূর্ব বঙ্গের পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা প্রায় প্রতিদিনই তার কাছে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং এখনো করে যাচ্ছেন।

জেনেভাতে, আন্তর্জাতিক আইনজ্ঞ কমিশন গতকাল শেখ মুজিবুর রহমানের নির্ধারিত বিচারকার্যের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছে।

কমিশনের মহাসচিব মিঃ এলান নীল ম্যাকডেরমট কর্তৃক স্বাক্ষরিত এক তারবার্তায় বলা হয় “আন্তর্জাতিক আইনজ্ঞ কমিশন শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন সামরিক বিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে লুকানোর মতো কিছু থাকে না”।

লন্ডন থেকে এক প্রতিবেদনে বলা হয় লন্ডনে অবস্থানরত শেখ মুজিবুর রহমানের আইনজীবীরা দাবী করেন যে তাঁকে সবধরনের আইনগত সাহায্য গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখা হয়েছে। রয়টার জানিয়েছে।

আইনজ্ঞ বার্নার্ড শেরিডান অ্যান্ড কোম্পানি এই মামলার ব্যপারে টাইম্‌স পত্রিকার কাছে একটি চিঠি লেখার মতো অস্বাভাবিক পদক্ষেপ নেয়। তারা এটা করেছে, চিঠিতে বলা হয়, যাতে করে পাঠকরা আরো সঠিকভাবে জানতে পারে তাঁর জন্য একটি পক্ষপাতবিহীন বিচার নিশ্চিত করতে আইনজ্ঞরা কি কি প্রচেষ্টা চালিয়েছে।

“যদিও শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হয়েছেন এই বছরের মার্চ মাসের শেষ দিকে নির্বাচনে তাঁর জয়লাভের অব্যবহিত পরেই তাঁকে সবধরনের আইনী পরামর্শ গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখা হয়েছে”।

এই চিঠিতে আরো বলা হয় যে তারা গত জুন মাসে লন্ডনের পাকিস্তান দূতাবাসে গিয়েছিলেন এবং তাঁর সাথে দেখা করার অনুমতি চেয়ে লিখিত আবেদন করেছিলেন কিন্তু এই আবদনের প্রতিউত্তর বা প্রাপ্তিস্বীকার পাননি।

এই প্রতিষ্ঠানের একজন সদস্য মিঃ শন ম্যাকব্রাইড (জ্যেষ্ঠ আইনজ্ঞ) পাকিস্তানে সশরীরে উপস্থিত হয়ে আরেকটি আবেদন করেন যেটির প্রাপ্তিস্বীকারও পাওয়া যায়নি বলে এই চিঠিতে বলা হয়।
কায়রো থেকে এক প্রতিবেদনে জানা যায় ইউএআর-এর শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা আল আহরাম, সামরিক আদালতে পূর্ব বঙ্গের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার হতে যাচ্ছে এই ঘোষণায় গতকাল উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

এই পত্রিকায় বলা হয় “সামরিক বা গোপন বিচার করে জাতীয় ঐক্য নিশ্চিত করা যাবে না এবং জনসংখ্যার বেশীরভাগ মানুষকে লৌহকঠিন শাসনে রেখে একে রক্ষা করা যাবে না”।

পত্রিকাটি জানায় শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্যে কি ঘটতে যাচ্ছে সে ব্যপারে আগ্রহ দেখানো মানে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা কিংবা জাতীয় ভূমি থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদের ডাকের নিশ্চিতকরণ নয় হস্তক্ষেপ ও বিচ্ছেদ উভয় নীতি সুনিশ্চিত এবং দ্ব্যর্থহীনভাবে বাতিল করা হয়েছে।

“এই আগ্রহ বরং অনেকটা প্রথমত এই বিশ্বাস থেকে যে পাকিস্তানের পূর্ব এবং পশ্চিম অঙ্গরাজ্যের জাতীয় ঐক্য বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এই জাতীয় ঐক্য জনসাধারণের আকাঙ্খার একটি যুক্তিসম্মত অভিব্যক্তি এবং উভয় প্রদেশে তাদের নেতৃত্বের জন্যই”, এই পত্রিকায় বলা হয়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৬৪। বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে গুরুত্ব আরোপ – ভারত – সোভিয়েত যুক্ত বিবৃতি আনন্দবাজার পত্রিকা ১০ আগস্ট, ১৯৭১

Bashneen Faham
<১৪, ৩৬৪, ৮৭৩-৮৭৪>

ভারত- সোভিয়েট যুক্ত বিবৃতি
বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে গুরুত্ব আরোপ
(দিল্লী অফিস)

নয়াদিল্লী, ১১ই আগস্ট-ভারত ও সোভিয়েট ইউনিয়ন আজ এক যুক্ত বিবৃতিতে পূর্ববঙ্গ সমস্যার ‘রাজনৈতিক সমাধানের’ জন্য জরুরী ব্যবস্থাবলম্বনের দাবি জানান। এই সমস্যার কোন ‘সামরিক সমাধান’ হতে পারে না বলে ভারত ও সোভিয়েট সরকারদ্বয় সুস্পষ্ট অভিমত প্রকাশ করেছেন।

বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কে ভারত ও সোভিয়েট ইউনিয়নের মতামত প্রায় অনুরূপ বলে সরকার সূত্রে প্রকাশ। সদ্য সম্পাদিত চুক্তির নবম অনুচ্ছেদে উপমহাদেশে যুদ্ধ আশঙ্কা আলোচনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ পরিস্থিতিকে বিবেচনা করা হয়।

শরণার্থীরা যাতে নিরাপদে তাঁদের ঘরবাড়ীতে ফিরে যেতে পারেন সেরকম অবস্থা সৃষ্টির জন্য দাবি জানিয়ে যুক্ত-বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে, ‘একমাত্র ঐ অবস্থায় পাকিস্তানের সমগ্র জনগণের স্বার্থ এবং ঐ এলাকায় শান্তি রক্ষিত হতে পারে। একমাত্র রাজনৈতিক সমাধানই পাকিস্তানের সমগ্র জনগণের চাহিদা পূরণ করতে পারে এবং তা না হলে শুধু পূর্ববঙ্গের নয়, সমগ্র পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ বিপদাপন্ন হতে পারে।

মতানৈক্য?

যুক্ত-বিবৃতিতে পূর্ববঙ্গ অথবা বাংলাদেশের পরিবর্তে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। কোন ধরনের রাজনৈতিক সমাধান হবে সে সম্পর্কে যুক্ত-বিবৃতিতে কোন ব্যাখ্যা করা হয়নি। বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক সমাধান চাপিয়ে দেবার কোন প্রশ্নই আসে না বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে কোন ধরনের রাজনৈতিক সমাধান বাঞ্ছনীয় সে সম্পর্কে ভারত ও সোভিয়েট ইউনিয়নের মতামত ঠিক অনুরূপ নয় বলে প্রকাশ। পাকিস্তান একা থাকবে না পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ পৃথক হয়ে যাবে এই প্রশ্নে মতানৈক্য থাকতে পারে বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারত সরকার যে নীতি ঘোষনা করেছেন তা থেকে সরকার বিচ্যুত হননি বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।

রাজনৈতিক সমাধান চাপিয়ে দেওয়া হবে না এবং তা বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দের পক্ষে গ্রহণযোগ্য হতে হবে এই মূল প্রশ্নে ভারত ও সোভিইয়েট সরকারদ্বয় সহমত পোষণ করেন বলে প্রকাশ।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার স্মরণ সিং এবং ভারত সরকারের আমন্ত্রণে আগত সোভিয়েট পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ গ্রোমিকোর কয়েক দফা আলোচনা শেষে এই যুক্ত বিবৃতি প্রচারিত হয়।

বাংলাদেশ সম্পর্কে বিবৃতির ব্যাখ্যা

যুক্ত-বিবৃতিতে পাকিস্তানের ‘সমগ্র জনগণের’ কথা বলা হলেও বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারত সরকার পিছিয়ে যাননি বলে সরকারী মহল সূত্রে প্রকাশ। বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে পাকিস্তানকে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে উপনীত হতে হবে এ রকম কোন উল্লেখ না থাকায় অর্থ এই নয় যে, ভারত ও সোভিয়েট ইউনিয়ন পূর্ববঙ্গের ওপর কোন সমাধান চাপিয়ে দেবার পক্ষপাতী। পূর্ববঙ্গের বর্তমান অবস্থার কারণ বিশ্লেষণে ভারত ও সোভিয়েট ইউনিয়নের মতামত প্রায় অনুরূপ বলে সরকারী মহল মন্তব্য করেছেন।

পূর্ববঙ্গের জনগণের পক্ষে গ্রহণযোগ্য সমাধানেই ভারত রাজী হবেন। বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে এই ব্যাপারে পাকিস্তান সরকার আলোচনা করুন সেটাই ঐ এলাকার জনগণের দাবি। সমাধান হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশ হোক অথবা অন্য কিছু হোক- বাংলাদেশের জনগণের গ্রহণযোগ্য সমাধানেই ভারত রাজী হবে।

মার্কিন আঁতাত সম্পর্কে নীরবতা

যুক্ত বিবৃতিতে কোন স্থানে চীন, মার্কিন-চীন আঁতাতের উদ্যোগ অথবা পাকিস্তান সম্পর্কে কোন কথা বলা হয়নি। তবে সীমান্ত বিরোধসহ সকল আন্তর্জাতিক সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের কথা বলা হয়েছে। বলপ্রয়োগ অথবা বলপ্রয়োগের হুমকিকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে।

শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতার ভারত-সোভিয়েট চুক্তিকে উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক ঘটনা বলে বিবৃতিতে মন্তব্য করা হয়েছে। এশিয়া তথা বিশ্বে শান্তি বজায় রাখার সংগ্রামকে জোরদার করাই ভারত-সোভিয়েট শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতার চুক্তির লক্ষ্য বলে বিবৃতিতে মন্তব্য করা হয়েছে। এশিয়া তথা বিশ্বে শান্তিরক্ষায় যাঁরা আগ্রহী এই চুক্তি তাঁদের সমর্থন লাভ করবে বলে বিবৃতিতে আশা প্রকাশ করা হয়েছে।

নয়াদিল্লীতে সোভিয়েট পররাষ্ট্র মন্ত্রী মিঃ গ্রোমিকো রাষ্ট্রপতি শ্রী ভি, ভি, গিরি ও প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি খাদ্য ও কৃষিমন্ত্রী শ্রী ফখরুদ্দিন আলি আহমেদ, অর্থমন্ত্রী শ্রী ওয়াই বি চ্যাবন ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শ্রী জগজীবন রামের সঙ্গেওও আলোচলা করেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৬৫। পাক বাহিনীর কৌশলগত পশ্চাৎপসরন দি স্টেটসম্যান ১২ আগস্ট, ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ৩৬৫, ৮৭৫-৮৭৬>

দি স্টেটসম্যান, ১২ আগস্ট, ১৯৭১
পাক বাহিনীর কৌশলগত পশ্চাৎপসরন
– আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি

মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার সময় সম্প্রতি বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মি সেক্টর কমান্ডারদের কয়েকজন মনে করেন মুক্তি বাহিনীর কমান্ডো ও গেরিলারা অপারেশনে মুখোমুখি অবস্থানে বেশ কয়েকটি এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনী যুদ্ধে তেমন যুক্ত হয়নি। কমান্ডাররা মনে করেন যে এটি কৌশলগত কারণে হতে পারে।

এটা এখন স্পষ্ট যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যা মূলত পশ্চিম পাকিস্তানীদের দ্বারা গঠিত এবং তারা পূর্ববাংলার কাদা এবং কাঁটাঝোপে সম্পূর্ণ হতাশ হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে এখন যে প্রবল বর্ষণ পরিস্থিতি চলছে যা যুদ্ধের জন্য ভালো পরিবেশ না। সেনাবাহিনীর বর্তমান কৌশল হতে পারে বর্ষা পরবর্তি মৌসুমের জন্য তারা অস্ত্র ও শক্তি সংরক্ষণ করছে। বর্ষার পরে হয়ত তারা কঠোর আক্রমণ শুরু করবে।

মুক্তিবাহিনী সদর দপ্তরের একটি নোটে কমান্ডাররা বলছেন যে মুক্তি বাহিনীর বর্ষায় আক্রমণের তীব্রতা আরও বাড়াতে হবে যাতে পাকিস্তানি বাহিনীর পশ্চাদপসরণের ফলে “মুক্ত অঞ্চল” বিস্তৃত হতে পারে। কমান্ডাররা বলেন যে বন্যার সময় পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর জাল বজায় রাখার লক্ষ্যে লিবারেশন আর্মি অবকাঠামো অনুযায়ী বুদ্ধিমান পদক্ষেপ নেবে।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ইউনিটগুলি থেকে চলে আসা বাঙালি গানার , সৈন্যরা যোগ দেয়ার ফলে মুক্তি বাহিনী আরও শক্তিশালী হয়েছে। তারা পশ্চিম থেকে এসে লিবারেশন আর্মি হেডকোয়ার্টারে যোগ দিয়েছেন। কমান্ডাররা বলছেন যে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এখন একটি সম্পূর্ণ গানার রেজিমেন্ট আছে এবং এটিকে যথাযথভাবে ব্যবহার করা উচিত।

কিন্তু কমান্ডাররা আশঙ্কা করছেন যে, যদি অক্টোবরের মাঝামাঝি বর্ষা শেষ হয়ে যায়, তাহলে বাংলাদেশের যুদ্ধ দীর্ঘদিনের হবে। পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের ভোগান্তি আরও বাড়বে। সেনা কর্মকর্তারা মনে করেন যে বর্ষার তিন মাসে যত বেশি সম্ভব অস্ত্র মজুদ করতে হবে এবং সফল অপারেশন শেষ করতে হবে।

মুক্তিবাহিনীর সব কমান্ডার পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের প্রচলিত ও বিশেষ যুদ্ধ কৌশল ট্রেনিং করেছে যা আমেরিকায় ওঁ কিছু ন্যাটো দেশে হয়েছিল। বহু বছর ধরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে তাদের কাজ করার কারণে তারা মুক্তিযুদ্ধের আক্রমনের ঘটনায় সেনাবাহিনী যা যা করতে পারে সে ব্যাপারে তাদের আগে থেকে ধারণা আছে।

কমান্ডারদের মতে পাকিস্তানি আর্মির প্রতি ইউনিটের অগ্নি শক্তি লিবারেশন আর্মি বা এমনকি ভারতীয় সেনাবাহিনীর থেকেও বেশি।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমেরিকা ও চীনা কর্তৃক প্রদত্ত সমস্ত স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে সজ্জিত। তাদের অস্ত্র স্টক ক্রমাগত চীনা এবং কিছু অন্যান্য পশ্চিমা শক্তি দ্বারা পূরণ হচ্ছে।

কমান্ডাররা স্পষ্ট শর্তাবলী দিয়ে কেস রেডি করেন। গেরিলাদের জন্য এবং কমান্ডারদের জন্য আরো অস্ত্র প্রয়োজন। সমগ্র বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ক্যাম্পে গেরিলাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা চালু আছে। অস্ত্র সরবরাহের ঘাটতির জন্য এই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বেশিরভাগকে সম্পূর্ণরূপে কাজে লাগানো যাচ্ছেনা।

কিছু গেরিলা ইউনিট বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে প্রবেশ করেছে এবং সেখানে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এই কেন্দ্রগুলিতে প্রশিক্ষণের সুবিধার্থে স্থানীয় জনগণের প্রতিক্রিয়া অসাধারণ হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রশিক্ষণ কিছু সময়ের জন্য অব্যাহত রয়েছে এবং সারা দেশ জুড়ে শক্তিশালী ইউনিট গড়ে উঠেছে, – একটি রিপোর্ট অনুযায়ী এ খবর পাওয়া যায়।
বর্ষা মৌসুমে লিবারেশন আর্মি কে মূলত অগ্রগামী এলাকায় যেতে হবে এবং বাস্তব ক্ষেত্রে সব ইউনিটগুলিকে তাত্ক্ষণিক একশন দরকার। কমান্ডাররা মনে করেন যে সকল সম্ভাব্য উৎস থেকে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য প্রচেষ্টা করা উচিত। সম্প্রতি, কমান্ডাররা বাংলাদেশ ক্যাবিনেটের সাথে বৈঠক করেছেন এবং যুদ্ধের পরিস্থিতি ও আরও অস্ত্রের প্রয়োজনের উপর জোর দিয়েছেন। প্রচলিত হার্ডওয়্যারগুলির জন্য অত্যাধুনিক অস্ত্রের প্রয়োজন ছিল না। তারা বলেছিল যে গেরিলারা লাঠি ও ড্যাগার নিয়ে সুসজ্জিত সশস্ত্র শত্রুদের মুখোমুখি হোক এটা আশা করে না।

বাংলাদেশের গেরিলা যুদ্ধকে অন্যত্র অনুরূপ সংগ্রামের সমতুল্য করা উচিত নয়, কারণ প্রথমবারের মত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে। সমগ্র জনগণ সংগ্রামের সাথে ছিল এবং দ্বিতীয়ত, একটি সম্পূর্ণ প্রশিক্ষিত বাহিনী মুক্তি বাহিনীর সাথে অংশ গ্রহণ করেছে। সেনাবাহিনীতে পদাতিক, বন্দুকবাজ এবং সংকেত ইউনিট এবং বিভিন্ন ধরণের যুদ্ধ, সরবরাহ ও চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য নানা গ্রুপ থাকে।

কিছু কমান্ডার এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন যে তারা তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম। তারা আশা করেছিল যে বাংলাদেশ সরকার অস্ত্র সংগ্রহের জন্য যথাসাধ্য করবে এবং বর্ষা মৌসুমে আরও ভাল ব্যবহার করা হবে। যেহেতু যত অস্ত্র পাওয়া যাবে ততই মুক্তিবাহিনীর কৃতিত্ব তাদের গর্বিত করবে যেভাবে অন্য কোন সেনাবাহিনী গর্বিত হয়।

শিরোনাম
সূত্র তারিখ
৩৬৬। বিদেশি সত্যাগ্রহী দল বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন আনন্দবাজার পত্রিকা ১৫ আগস্ট ১৯৭১

Bashneen Faham
<১৪, ৩৬৬, ৮৭৭>

মঙ্গলবার বিদেশী সত্যাগ্রহী দল
বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন
(নিজস্ব প্রতিনিধি)

বাংলাদেশে পাকিস্তানী নির্যাতন এবং বিদেশ থেকে অবাধ সাহায্য দানের পথে সীমান্ত বাহিনীর অবরোধ সৃষ্টির প্রতিবাদ ‘অপারেশন ওমেগা’ নামীয় বৃটিশ ও আমেরিকান সত্যাগ্রাহীদের একটি দল আগামী মঙ্গলবার বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন। শুক্রবার কলকাতায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁরা বলেন, পশ্চিম বাংলা থেকে তাঁরা ‘সীমান্তের বেড়া ভেঙে’ ভেতরে ঢুকবেন এবং পাক বাহিনীর মোকাবেলা করবেন। তাঁরা সম্পূর্ণ নিরস্ত্র এবং নিরস্ত্রই থাকবেন। বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য অবশ্যই তাঁরা ইয়াহিয়া সরকারের অনুমতি চাননি-কারণ তেমন অনুমতির প্রয়োজন আছে বলে তাঁরা মনে করেন না। তাঁদের সুস্পষ্ট অভিমত : কোন দেশের অভ্যন্তরে মানুষের ওপর অত্যাচার, লাঞ্ছনা, গণহত্যা ঘটলে, অভাব-অনটন ঘটলে, এই দুর্গত মানুষদের পাশে ছুটে যাবার সম্পূর্ণ মানবিক অধিকার অন্য দেশের মানুষদের আছে- এই অধিকারকে রাজনৈতিক ও ভৌগলিক বেষ্টনী দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা যায় না। অবশ্য, অহিংস সৈনিকের নীতি অনুসারে তাঁরা তাঁদের এই সত্যাগ্রহ পরিচালনার কথা পাক সরকারকে জানিয়ে রেখেছেন- তাঁরা প্রকাশ্যেই সীমান্তের বেআইনী আইন লঙ্ঘন করবে এবং যে কোন ঝুঁকির সম্মুখীন হবেন।

৪ জন মহিলাসহ এই সত্যাগ্রহী দলে মোট আছেন ১১ জন। এঁদের মধ্যে ৮ জন দু’টি ল্যান্ডরোভার গাড়ীতে ত্রাণসামগ্রী বোঝাই করে বাংলাদেশে প্রবেশ করবেন।

সত্যাগ্রহী দলের মুখপাত্রের লন্ডনের বিখ্যাত সাপ্তাহিক ‘পীস নিউজ পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক মিঃ রজার মুডী (বৃটিশ) এবং মিঃ ড্যানিয়েল গ্রটেন (আমেরিকা) সাংবাদিকদের বলেন, আমরা আশা করব আমাদের কাজের দ্বারা এমন একটি নজীর স্থাপিত হবে যা শুধু পাক-ভারত পরিস্থিতিতেই নয়, বিশ্বের যে কোন স্থানে সংঘাতের ক্ষেত্রে কর্যকর করা যাবে। তাঁরা বলেন, রাষ্ট্রসঙ্ঘের সনদে যা-ই লেখা থাকুক, বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরে মানুষের ওপর অত্যাচার চলছে, গণহত্যাও সংঘটিত হচ্ছে। এ ধরনের মানবতাবিরোধী কান্ডকে কোন দেশের ‘অভ্যন্তরীণ ব্যাপার’ বলে কিছুতেই গন্য করা যায় না। একটি প্রশ্নের উত্তর তাঁরা জানান, ভেতরে ঢুকে সরাসরি জনসংযোগ এবং সসাহায্য বন্টনই তাঁদের অভিপ্রায়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৬৭। চুক্তির পর দি স্টেটসম্যান ২০শে অগাস্ট, ১৯৭১

Ashik Uz Zaman
<১৪, ৩৬৭, ৮৭৮-৮৭৯>

দি স্টেটসম্যান, ২০শে অগাস্ট, ১৯৭১
চুক্তির পর

যারা আশা করেছিলেন যে ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তি নয়া দিল্লিকে পূর্ব বাংলার ঘটনাবলী এবং তার পরিণতির প্রেক্ষাপটে ভারতের স্বার্থ রক্ষায় আরো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করবে তাদেরকে এখন দারুণভাবে হতাশ হতে হয়েছে। যারা বলিষ্ঠতাকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সদগুন বলে মনে করে তাদের হতাশাকে গুরুত্বসহকারে নেয়ার কিছু নেই, কিন্তু আরো অনেকে আছে যারা মনে করেছিল এই চুক্তি ভারতকে বাংলাদেশ বিষয়ক সমস্যা তাৎক্ষনিকভাবে সমাধানে আগের চেয়ে আরো অনেক দৃঢ়ভাবে দাবী তুলতে সাহায্য করবে এবং সত্যিকার অর্থে সমাধানের একমাত্র উপায় হবে এটি। সমস্যা সমাধানে ভারতের দাবী তোলার অধিকার প্রশ্নাতীত, কেননা আর কোনোকিছুই এই দেশটিকে শরণার্থীদের অসহনীয় বোঝা থেকে মুক্তি দিতে পারবে না। এটিও কখনো যুক্তি দিয়ে বলা যাবে না যে পূর্ব বঙ্গের মানুষের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ছাড়া এই সমস্যার সমাধান করা যাবে। বিভিন্ন সময়ে নয়া দিল্লী থেকে এই দুটি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। যদি ৯ই অগাস্ট পর্যন্ত পাকিস্তান এই বিষয়গুলোকে তেমন গুরুত্ব না দিয়ে থাকে, তাহলে মনে করার কারণ রয়েছে যে নয়া দিল্লী থেকে তোলা দাবীগুলোর পেছনে তেমন শক্তি ছিল না। ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তি স্বাক্ষরের সাথে সাথেই এই শক্তির অভাব দূর হয়েছে বলে অনেকেই এমন মনে করতে শুরু করেছে। তাদের মধ্যে এমন মানুষও আছে যাদের মনে এই চুক্তির দীর্ঘ-মেয়াদি প্রভাব নিয়ে সংশয় রয়েছে কিন্তু তারপরও তারা একে কিছুটা স্বাগত জানিয়েছে এই আশায় যে এই চুক্তি পূর্ব বঙ্গে একটি রাজনৈতিক সমাধান নিশ্চিত করতে ভারতের হাতকে আরো শক্তিশালী করবে। এখন পর্যন্ত কোন প্রমান নেই যে নয়া দিল্লীর হাত আরো শক্তিশালী হয়েছে। বরং, সমাধানের দাবী কিছুটা প্রয়োজনীয়তা হারিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

এই চুক্তি এই যুদ্ধ সংক্রান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন আলাপচারিতা বন্ধ করে দিয়েছে যা একটি ভালো পরিণতি, যদিও এটি আশ্চর্যজনক বলে মনে হয় যে সম্ভাব্য সামরিক সহায়তার আশ্বাস আন্তরিকতাবিহীন আচরণকে বশীভূত করতে পারে। পাকিস্তানের প্রতি রাশিয়ার প্রকাশিত হুমকি হয়তো ইসলামাবাদে কিছুটা সংযম সঞ্চারিত করেছে, এতে করে ভারতের দিক থেকে আর পাল্টা হুঁশিয়ারি প্রদানের প্রয়োজনীয়তা নেই। সবদিক থেকে, এই চুক্তি হয়তো ইতিমধ্যেই তার একটি প্রয়োজনীয় উদ্দেশ্য সফল করেছে ক্রমবর্ধমান সমস্যাগুলোকে হালকা করে দিয়ে। তবে উৎসাহী সমর্থকদের কাছে তারা যেমনটা ভেবেছিল এটি এই চুক্তির সেই উদ্দেশ্য নয়। নিশ্চয়ই, এই চুক্তি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের পরও মানা হচ্ছে না যদিও অনেকেই মনে করেছিল যে তা হবার সম্ভাবনাই বেশী ছিল এবং যুদ্ধরত দলগুলোর মধ্যে সবচে কম অনুপ্রেরণা দেয়ার কথা। সম্ভাব্য বহিঃশক্তির সহায়তার উপর নির্ভর করে তাড়াহুড়ো বা দৃঢ়তার সাথে কোন পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থেকে ভারত ততটা পরিপক্কতার পরিচয় দিয়েছে যতটা হয়তো তাকে কেউ কৃতিত্ব দেয় না, কিন্তু এখন এটি ব্যাপকভাবে সন্দেহ করা হচ্ছে যে এই সংযম প্রদর্শন সোভিয়েত সহায়তার প্রতিশ্রুতির পূর্বশর্ত ছিল।

এই চুক্তির ফলে ভারতের পদক্ষেপ নেয়ার স্বাধীনতা ঠিক কতটা খর্ব হয়েছে বা আদৌ হয়েছে কিনা তা কেবলমাত্র অনুমানের বিষয়। কিন্তু এটাও বিবেচনা করতে হবে যে যদিও সংযম কাম্য এমনকি বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়া হলেও তারপরও পাকিস্তানের সাথে ভারত কেবলমাত্র একটি যুদ্ধ এড়িয়ে গিয়ে বাংলাদেশ বিষয়ে একটি সমাধানে আসতে পারবে এমনটা আশা করতে পারে না। তার এমন কোন আশা করারও সুযোগ নেই যে দায়সারা চাপের মুখে আন্তর্জাতিক প্ররোচনায় বা আভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য সমস্যার কারণে ইসলামাবাদের সামরিক জান্তা তাদের হুঁশ ফিরে পাবে। তার সীমিত উপায়ের মধ্যে হয়তো সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক হচ্ছে যে দলগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে তাদের সবাইকে সম্ভাব্য সব উপায়ে সাহায্য করা, যেটির মাধ্যমে জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে কিছুটা শিক্ষা দেয়া যাবে। দুঃখজনকভাবে, মুক্তি বাহিনী এখনো অনেকটা অক্ষম রয়ে গেছে পর্যাপ্ত অস্ত্র ও গোলাবারুদের অভাবে; এবং বর্ষাকাল, যে সময়টায় গেরিলারা সবচেয়ে বেশী কার্যকর, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। আশা করতে হবে যে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে শান্তি ও বন্ধুত্ব চুক্তি স্বাক্ষর করাটা মুক্তি যোদ্ধাদের সাহায্যে পুরোপুরিভাবে এগিয়ে আসার আপাত ব্যর্থতার কারণ হয়ে না দাড়ায়।
শিরোনাম সুত্র তারিখ
৩৬৮। ইউরোপে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড ৯ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

Nusrat Jahan Ima
<১৪, ৩৬৮, ৮৮০-৮৮২>

হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, ৯ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
ইউরোপে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি

আগামী মাসে মিসেস গান্ধীর, উল্লেখ্যযোগ্য পশ্চিম ইউরোপ ও আমেরিকা পরিদর্শন হবে, বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের ভুমিকার যথাযথ প্রেক্ষাপট। জনগনকে দমন করতে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী পুর্ব বাংলায় যাওয়ার ৫ মাসেরও বেশি সময় পরে কূটনৈতিক কার্যক্রমের এক অদ্ভুত চিত্র উপস্থাপন করেছে। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডল থেকে দূরে নির্বাসিত হওয়া, জেনারেল ইয়াহিয়া খান তার বিজয়ী হবার পথে গ্রহনযোগ্যতা বেশ ভালোই।

সামান্য কৌশল
বাংলাদেশ সম্পর্কে পশ্চিমা মনোভাব বোঝার জন্য, এ কথা অনস্বীকার্য যে, পাকিস্তান বহুলাংশে ইন্দো-পাকিস্তান সমস্যাকে কে একটা বড় ইস্যু করে উপস্থাপন করার ব্যাপারে সক্ষম হয়েছিলো। আর এটা সম্ভব হয়েছে খুব সামান্য কৌশলের মাধ্যমে, এই দুই দেশের মধ্যকার অস্থিরতা চরম মাত্রায় বৃদ্ধির মাধ্যমে, পশ্চিমা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ট্রাজেডি খুব দ্রুতই নিমজ্জিত হয়ে যায় ইন্দো-পাকিস্তান সমস্যার পিছনে যার ফলে পশ্চিমাদের কাছে বাংলাদেশের সংগ্রাম এর তুলনায় ইন্দো পাকিস্তান সমস্যা আরো প্রকট ভাবে প্রতীয়মান হয়।

পুর্ব বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তানী আর্মীদের বর্বরতা ও দমনের মাত্রা সম্পর্কে পশ্চিমা বিশ্ব জানতে পারে সপ্তাহ খানেক , মাস খানেক পর কিন্ত যখন সংঠিত হচ্ছিল তখন নয়। এটা তখনই জানতে পারে যখন লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর ঢল নামে ইন্ডিয়াতে, ভয়াবহ একটা সম্ভাবনা দেখা দেয় মহামারী আকারে কলেরা ছড়িয়ে পড়ার, এবং এসব কিছুর পরেই পশ্চিমা বিশ্বের দুয়ারে পাকিস্তানী আর্মির ভয়াবহ আগ্রাসনের খবর গিয়ে পৌছায়। শরনার্থীদের নিয়ে কিছু সময় পর্যন্ত সংবাদ শিরোনাম হলেও পরে এই ব্যাপারে আগ্রহ কমে যেতে থাকে, একে পূনর্জ্জীবিত করতে পশ্চিম পাকিস্তানের কূটনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ববাংলার জনগন বিদ্রোহ করে। পূর্ব বাংলার মানুষদের এই দূর্ভোগের জন্য অনেক সহানুভুতি, উদ্বাস্তুদের এই অব্যাহত প্রবাহের সাথে মোকাবেলা করতে ভারতের বারতি চাপের জন্য কিছু সহানুভুতি। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের মাত্র অর্ধেক লোকই বিশ্বাস করে যে পাকিস্তানের ভাংগন অপরিহার্য, এমনকি যারা মনে করে যে, পুর্ব বাংলা একদিন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে অস্তিত্ব লাভ করবে, কিন্তু তা কত সময়ের মধ্যে সে সম্পর্কেও তারা পরিষ্কার নয়। এদিকে এখনো পর্যন্ত পাকিস্তানের ২ অংশেরই রাস্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহিয়া এবং তাদেরকে এর সাথে ব্যাবসা করতে হবে।
যাইহোক, হোয়াইট হলের বাংলাদেশের সমস্যার ব্যাপারে মনোভাবে এক ধরনের পরিবর্তন এসেছে। এক ধরনের পরিবর্তনের আভাস পাওয়া গেছে, যা বলা হয়েছে ঠিক তার মাধ্যমে নয় বরং যা বলা হয়নি তার মাধ্যমে। নতুন কাজের ধরনে, এই পরিবর্তন গুলো প্রতিফলিত হচ্ছে, ইসলামাবাদ কে নিন্দা করার চাইতে বরং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কে তার সীমানা রক্ষা করার ব্যাপারে তারা অনেক বেশি এগিয়ে। অপ্রিয় সত্য কথা বলতে এবং পুর্ব পাকিস্তানের ভয়াবহ দূর্ভিক্ষের দরুন সৃষ্ট নতুন বিপদকে ব্রিটিশ জনগনের সামনে নিয়ে আসতে, এসব রেখে দেয়া হয়েছিল পিটার শো –এর মত শ্রম মন্ত্রী এবং গীর্জার নেতাদের উপর এবং উত্তেজিত সম্পাদকীয় লেখকদের উপর।
পশ্চিমাদের এই নিষেধ, এবং এই নিষেধের মূল বিষয় হচ্ছে যে, ইন্দো-সোভিয়েত সম্পর্কের কারনে কখনোই তারা পাকিস্তানের ভাঙ্গন চায় না।
এমনকি যখন চুক্তি সম্পাদিত হয় বিশ্বের সামনে, বেশির ভাগ পশ্চিমা ইউরোপীয়ানদের ধারনা হয়েছিলো যে, ভারত সোভিয়েত শিবিরে পরিনত হচ্ছে। কিন্তু এই চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল তাদের মন থেকে লম্বা সময় ধরে থাকা সন্দেহ মুছে দিতে যে ভারত অশ্রেনীভুক্ত একটি কাঠামো। সেই সাথে চায়না এবং মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্র উভয়েই আছে ইসলামাবাদের পাশে। পশ্চিমা ইউরোপের চ্যান্সেলর রা ক্রমাগত এর মডেল হয়ে উঠেছিলেন।

এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে, পশ্চিম পরিদর্শন কালে মিসেস গান্ধী কে তারা, শরনার্থী ইস্যুতে সামান্য সাহায্য করার বদলে তাশুধু চা আর সহমর্মিতা দিবে। পূর্ব বাংলায় ভারতীয় সেনাদের হস্তক্ষেপ এর প্রলোভনের মুখে, ব্রিটিশ ও ফ্রেঞ্চ কর্মকর্তারা একে অন্যের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রশংসা করছিলেন মিসেস গান্ধীর সংযত রুপকে, কিন্তু এই প্রশংসা শুধুই ছিল তার জন্য স্বান্তনা। পশ্চিমা ইউরোপের রাজধানী গুলোতে তার এই সফর কেবল একটি বিষয় নিশ্চিত করে যে ভারত কে এই শরনার্থী সমস্যা একাই বহন করতে হবে এবং নয়া দিল্লী সমস্যা উত্তরনের জন্য বহির বিশ্ব থেকে খুব সামান্যই সাহায্য পাবে।

কুটনৈতিক ভাবে মিসেস গান্ধীর এই উদ্দেশ্যপূর্ন সফর সফল হতে ও পারে আবার না ও হতে পারে। পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানী মিলিটারীদের শাষকদের কার্যকলাপ সত্ত্বেও বিশ্বের রাষ্ট্র তাদের নৈতিকতার মানদন্ডে তাদের বিচার করবে বরং করবে তাদের জাতীয় স্বার্থ দ্বারা। এবং পাকিস্তান এই কূটনৈতিক বিজয় কে একটি অসমর্থিত অবস্থানে পরিনত করতে প্রায় সক্ষম হয়েছে।
উদ্বেগের ভান করা

পূর্ব বাংলার সীমান্তের উভয় পাশে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক স্টেশনের ব্যাপারে প্রস্তাবিত পাকিস্তান সরকারের উত্সাহী সমর্থন, ভারত থেকে উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য ইসলামাবাদের উদ্বেগজনক অবস্থানের কথা প্রকাশ করেছে। পূর্ব বাংলায় ইচ্ছাকৃত ভাবে যে রক্তপাত হয়েছে তার জন্য ইয়াহিয়া খান চালাকী করে লেফট্যানেন্ট জেনারেল টিক্কা খান কে বলির পাঠা করেছেন। এমনেস্টির ঘোষনার সাথে তিনি এখন একজন প্রতীকী বেসামরিক গভর্নর হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন।

এ সমস্ত কাজ ছিল একটি কূটনৈতিক উদ্দেশ্যে সাধনে। জাতিসংঘের সাধারন পরিষদের উদ্বোধনের পূর্বেই তারা দুই ধরনের উদ্দেশ্য অর্জন করতে চেয়েছিলো, একবার পুনরায় কল ছেড়ে দিয়ে পাকিস্তান কনসোর্টিয়ামকে সাহায্য করা এবং পুর্ব বাংলার সকল পাপ ধুয়ে পরিষ্কার করা। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাম্প্রতিক পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়া বিবেচনা করে পশ্চিম পাকিস্তানের এই লক্ষ অর্জনের জন্য আরেকটি সুযোগ তৈরী হয়েছে।

আংশিক ভাবে, পাকিস্তানের এই কৌশল সম্ভবত পশ্চিমাদের বিশ্বাস করাতে সক্ষম হবে যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শেষ পর্যন্ত সঠিক পথ বেছে নিয়েছে। পশ্চিমাদের অনেকেই তখন প্রশ্ন করা থামিয়ে দিবে, বেসামরিকের পার্থক্য কি? গভর্নর পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির সাথে সামরিক কর্তৃপক্ষের সাথে মিলিত করে তাদের কঠোর নিয়ন্ত্রনের মধ্যে রাখবে। অনেকেই এই বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাবে না, যে পুর্ব বাংলায় থাকা অবস্থায় শরনার্থীরা শুধু মাত্র শর্ত প্রযোজ্য অঙীকার নামার জোড়ে বাড়ি ফিরে যাবে না। ভারতের সীমান্তে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক থাকার দরুন পশ্চিমা স্বার্থে প্রাথমিক ভাবে ভারতকে বাংলাদেশী গেরিলা দের সাহায্য করার ব্যাপারে নিরুৎসাহী করা হয়। এই সাহায্য গেরিলাদের ভারসাম্যের জন্য যথেষ্ট ছিল না, কিন্তু সব শেষে ভারত কে দোষারোপ করার জন্য যথেষ্ট ছিলো।
আরো বিশ্বাসযোগ্যতা
মিসেস গান্ধী ইউরোপে তাঁর সাময়িক বসবাসের সময় আবিষ্কার করবেন যে, যদিও ভারত পরিস্থিতির স্বীকার তবুও তাকে পুনয়ায় যুদ্ধের জন্য লড়াই করতে হচ্ছে। এই সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশের কারনে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে কোন সুসংহত পন্থা অবলম্বন না করার জন্য নয়াদিল্লির অ্যাড-হক নীতিকে আংশিকভাবে দোষারোপ করা যায়।

মিসেস গান্ধী সেজন্য তাঁর উপর আরোপিত কাজের চাপ কমিয়েছেন। তিনি শুধুমাত্র তখনই প্রভাব ফেলতে পারবেন যদি তিনি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেখাতে পারেন। সীমান্তবর্তী বিষয় যেগুলো মূল বিষয়টিকে ঘোলাটে করতে পারে সেগুলোর উপর নয় বরং অপরিহার্য বিষয়গুলোর ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। এটা ভারতের ভাবমুর্তি উজ্জ্বল করতে সাহায্য করবে যদি নয়াদিল্লি তাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত কি হবে সেটা বুঝতে পারে। ভারত-সোভিয়েত চুক্তি ভারতের জোট নিরপেক্ষতাকে পরিবর্তন করেনি এই ঘোষণায় খুব কম উদ্দেশ্যই সফল হবে। পশ্চিম পাকিস্তান তার নিজের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং কথার জোরে তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবে না। অবশ্যই ভারতের অবস্থান পশ্চিমের কাছে আরো বিশ্বাসযোগ্য হবে যদি মিসেস গান্ধী বলতেন যে, একটা বিশেষ সময়ে ভারতের জনগণের মনে একটা মনস্তাত্বিক উন্নতিসাধনের জন্য বাধ্যতামূলক অভ্যন্তরীন কারনে তাকে রাশিয়ার সাথে একটি শান্তিচুক্তি করতে হয়েছে।

দ্বিতীয়ত আইনি যুক্তিতর্ক ভারতকে সাহায্য করতে পারবে না। বাংলাদেশ সংকটের অপরিহার্য বিষয়গুলো সকল নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকগণ দেখতে পাচ্ছেন এবং সেগুলোর ওপর জোর দাওয়াই উপযুক্ত হবে। সেগুলো হলো, ভারতের পূর্ব সীমান্তে পাকিস্তানী সামরিক শাসকগনের কর্মকান্ডে একটি ব্যাপক হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে এবং একটি সংকট যার সাথে ভারতের কোন সম্পর্ক নেই, লক্ষ্য লক্ষ্য উদ্বাস্তুর রূপে দেশটির উপরে বর্তেছে।

যদি পশ্চিম আশা করে যে এই পরিস্থিতিতে ভারত কিছুই করবে না, তাহলে তারা খুবই অদূরদর্শি। পশ্চিমের মত ভারত সমস্যা থেকে তার দৃষ্টি এড়াতে পারে না। এটা খুবই কাছে এবং ভীষনভাবে অনুভূত। যদি মিসেস গান্ধী পশ্চিমের নেতাদের সাথে কথা বলেন তো তিনি এমন শর্তে দেখা করবেন যাতে তিনি তাদের সম্মতি না পেলেও শ্রদ্ধা পান। আসুন আমরা এটা মেনে নেই যে ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তান একই অবস্থান থেকে বাংলাদেশকে দেখে না এবং দেখবেও না।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৬৯। বাংলাদেশের সরকারের জন্য ওয়ার কাউন্সিল গঠিত দি স্টেটসম্যান ১০ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

Ashik Uz Zaman
<১৪, ৩৬৯, ৮৮৩-৮৮৪>

দি স্টেটসম্যান, ১০ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
বাংলাদেশের সরকারের জন্য ওয়ার কাউন্সিল গঠিত
এন. সি. মেটিঅন, হিন্দুস্তান টাইম্‌স এর প্রতিনিধি

মুজিবনগর, ৯ই সেপ্টেম্বর – আওয়ামী লীগ এবং অন্য আরো চারটি দলের প্রতিনিধিদের মধ্যে দুই-দিনব্যাপী বৈঠক শেষে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা করার জন্য আট-সদস্য বিশিষ্ট একটি যুদ্ধকালীন পরিষদ (ওয়ার কাউন্সিল) গঠন করা হয়েছে।

এই পরিষদের উপদেশ এবং সাহায্য স্বাধীনতা যুদ্ধ সংক্রান্ত যেকোনো বিষয়ে পরামর্শের প্রয়োজনে বাংলাদেশ সরকারের জন্য সহজলভ্য থাকবে।

এই পরিষদের সদস্যরা হচ্ছেনঃ মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানী (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি – ভাষানী গ্রুপ), মিঃ মনি সিংহ (কম্যুনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ), মিঃ মনোরঞ্জন ধর (বাংলাদেশ ন্যাশনাল কংগ্রেস), মিঃ মুযাফফর আহমেদ (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, মুযাফফর গ্রুপ), মিঃ তাজউদ্দীন আহমেদ, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, মিঃ খন্দকার মোস্তাক আহমেদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, এবং আওয়ামী লীগের আরো দুইজন সদস্য যাদের নাম পরে জানানো হবে।

বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্রের ভাষ্য অনুযায়ী এই পরিষদ গঠন করার উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বাধীনতা যুদ্ধে সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণের অনুভূতি নিশ্চিত করা এবং বাংলাদেশে যারা ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শোষকদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করছে তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া।
এই মুখপাত্র আরো বলেন, এই পরিষদ গঠন শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব, আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রতি বাংলাদেশের সর্বস্তরের মুক্তিকামী জনগণের দৃঢ় বিশ্বাসের প্রকাশ যা একাই বাংলাদেশে এই পরিষদের আইনগত বৈধতা প্রদান করার জন্য যথেষ্ট।

জনশ্রুতি রয়েছে মওলানা ভাষানীর উদ্যোগে প্রায় ছয় সপ্তাহ আগে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য একটি নয়-দলীয় সমন্বয়কারী কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটিতে অংশগ্রহণকারী হিসেবে যে দলগুলোর নাম উল্লেখ করা হয়েছিল তাদের বেশীরভাগই এই যুদ্ধকালীন পরিষদের সদস্যদের তুলনায় অনেকবেশি বামপন্থী ছিলেন। মওলানা ভাষানী পরবর্তীতে এর সাথে জড়িত থাকার কথা বা এই কমিটি তাঁর উদ্যোগে গঠিত হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন।

এই তথাকথিত সমন্বয়কারী কমিটির কয়েকজন সদস্য চরম বামপন্থী ছিলেন বলে শেখ মুজিবের প্রতি তাদের আনুগত্য সন্দিগ্ধ ছিল। সমন্বয়কারী কমিটিতে যেসব দলের নাম উল্লেখ করা হয়েছিল তাদের কাউকেই যুদ্ধকালীন পরিষদে রাখা হয়নি।
গতকাল শেষ হওয়া এই পাঁচ-দলীয় বৈঠকে অনেকগুলো সিধান্ত গৃহীত হয়। তার মধ্যে একটি হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা কর্তৃক শেখ মুজিবকে বেআইনিভাবে বিনা বিচারে বন্দী করে রাখার বিষয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ এবং শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে “হাস্যকর ও জঘন্য” মামলা পরিচালনা করার “লজ্জাজনক প্রচেষ্টার” তীব্র নিন্দা জানানো।

এই বৈঠকে বিশ্বের সকল পরাশক্তি এবং জাতিসংঘের প্রতি আবেদন জানানো হয় তাৎক্ষনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য যাতে করে এই “জঘন্য মামলা” বন্ধ এবং শেখ মুজিবের মুক্তি নিশ্চিত হয়।
এই বৈঠকে ভারত এবং অন্যান্য দেশগুলোর প্রতি আবেদন জানানো হয় বাংলাদেশ সরকারকে তাৎক্ষনিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করতে এবং সেইসাথে স্বাধীনতা যুদ্ধের বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিতে যার সাথে বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি শান্তি-কামী গণতান্ত্রিক জনগণ জড়িত।

নেতারা ভারতের সরকার এবং জনগণের প্রতি তাঁদের “গভীর কৃতজ্ঞতা” প্রকাশ করেন বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের প্রতি তাদের “সহৃদয় সহায়তা”-র হাত বাড়িয়ে দেয়া এবং ভারতের সরকার বাংলাদেশের সংগ্রামরত জনগণের জন্য যে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তার জন্য।
নেতারা পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের প্রতি বাংলাদেশে তাদের ভ্রাতৃবর্গের স্বাধীনতা যুদ্ধে “পূর্ণ সহযোগিতা” প্রদান করার আবেদন জানান একইসময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের সাথে সংহতি প্রকাশ করেন যারা নিজেরাই শোষকের শৃঙ্খল থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করার সংগ্রামে লিপ্ত।

নেতারা সিধান্ত নেন যে পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া বাংলাদেশ বিষয়ে আর কোনো রাজনৈতিক প্রস্তাব তাদের কাছে কখনই গ্রহণযোগ্য হবে না। বাংলাদেশের জনগণ সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য এবং স্বাধীনতার দাম যদি রক্ত দিয়েই পরিশোধ করতে হয় তাহলে বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণ প্রতি ঘণ্টায়ই তা করছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৭০। প্রথমত সেনাবাহিনীকে যেতে হবে, বলেছেন বাংলাদেশের মন্ত্রী দি স্টেটসম্যান, ১০ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

Ashik Uz Zaman
<১৪, ৩৭০, ৮৮৫>

দি স্টেটসম্যান, ১০ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
প্রথমত সেনাবাহিনীকে যেতে হবে, বলেছেন বাংলাদেশের মন্ত্রী

নয়া দিল্লী, ৯ই সেপ্টেম্বর – মিঃ খন্দকার মুশতাক আহমেদ, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন যে পাকিস্তানের সাথে আপোসরফার জন্য যেকোনো রাজনৈতিক নিষ্পত্তি করার আগে বাংলাদেশ থেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনীকে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

সম্প্রতি গৃহীত এক বিশেষ টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন আপোসরফার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার ক্ষেত্রে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।

“আপোসরফার সুযোগ সবসময়ই রয়েছে, কিন্তু আপোসরফার মাধ্যমে নিষ্পত্তির খাতিরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিকিয়ে দেয়ার কোন সুযোগ নেই”, তিনি বলেন।

এই টিভি সাক্ষাৎকারটি আজ রাতে “সংবাদ পরিপ্রেক্ষিত” নামক একটি পাক্ষিক অনুষ্ঠানে প্রচারিত হয়। এই অনুষ্ঠানে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের পাকিস্তান বিষয়ক শিক্ষার সহযোগী অধ্যাপক, ডঃ মোহাম্মেদ আইয়ুব কর্তৃক গৃহীত নয়া দিল্লীতে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রধান, মিঃ কে. এম. শিহাবউদ্দিনের একটি সাক্ষাৎকারও প্রচার করা হয়।

এক প্রশ্নের জবাবে মিঃ শিহাবউদ্দিন বলেন আসন্ন জাতিসংঘ সাধারণ সভার অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল পাঠানোর ব্যপারে কোন সিধান্ত নেয়া হয়নি। তিনি বলেন বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ একইসাথে কূটনৈতিক এবং সামরিক ক্ষেত্রে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। পূর্ব বাংলার বেসামরিক প্রশাসক হিসেবে ডঃ এ. এম. মালিক-এর নিয়োগ ছিল “বাগাড়ম্বর শুধুমাত্র বিশ্ব জনমতকে ধোঁকা দেয়ার জন্য”। তিনি ডঃ মালিককে “বিশ্বাসঘাতক” হিসেবে অভিহিত করেন।

মিঃ শিহাবউদ্দিন বলেন বিশ্ব ব্যাংক গঠিত সঙ্ঘ থেকে কোন সাহায্য না পাওয়াতে ইসলামাবাদ অর্থনৈতিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছে। “আমি নিশ্চিত বিশ্ববাসী পাকিস্তানী প্রেসিডেন্টের কুকর্ম সম্পর্কে অবগত আছে”।

মিঃ শিহাবউদ্দিন ধারণা করেন যে পিপলস পার্টির সভাপতি মিঃ জেড. এ. ভূট্টো এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যকার জ্ঞাপিত মতবিরোধ পরিণামে পাকিস্তানের ধ্বংস ডেকে আনবে। তাঁর মতে, এই দুই জনের মধ্যকার দ্বন্দ্ব আসলে “দুইজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী পুরুষের”।
তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে পরিচালিত বিচারের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং সকল রাষ্ট্রপ্রধান ও জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রতি শেখ মুজিব এবং তাঁর পরিবারের নিঃশর্ত মুক্তি নিশ্চিত করতে হস্তক্ষেপ করার জন্য আহ্বান জানান।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৭১। আজ বাংলাদেশের উপর আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধন টাইমস অব ইন্ডিয়া ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ৩৭১, ৮৮৬-৮৮৭>

দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া, ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
আজ বাংলাদেশের উপর আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধন
স্টাফ রিপোর্টার

নয়া দিল্লি, ১৭ সেপ্টেম্বর: আগামীকাল বাংলাদেশের উপর আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অনেক রাষ্ট্রনায়ক, প্যাসিফিস্ট, সমাজকর্মী, শিক্ষাবিদ, আইনজীবী ও সাংবাদিকরা যোগ দেবেন।

গান্ধী পিস ফাউন্ডেশন আয়োজিত তিন দিনব্যাপী সম্মেলনে বাংলাদেশ ইস্যু নিয়ে আলোচনা করা হবে। বাংলাদেশ নিয়ে আয়োজিত এটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান। গত ২৫ মার্চ থেকে বাংলাদেশের ঘটনাবলী সমস্ত পৃথিবীর খবরের শিরোনাম হয়ে আছে।

যারা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করছেন তারা সবাই দেশে ও দেশের বাইরে যথেষ্ট প্রভাবশালী।

উদাহরণস্বরূপ, অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কিছু আরব দেশের প্রতিনিধি রয়েছেন যারা এই ব্যাপারে বরফশীতল নিস্তব্ধতা অবলম্বন করছেন – যদিও আড়াল থেকে তাদের সরকারী মুখপাত্ররা বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাদের সমবেদনা জানিয়েছেন।

এমনকি ভারত সরকারী পর্যায়ে সম্মেলনে অংশগ্রহণ করবে না। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার, সংসদ সদস্য, এবং কংগ্রেস পার্টির প্রভাবশালী নেতা সদস্যরা তাদের ব্যক্তিগত ক্ষমতায় সম্মেলনে যোগ দিবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

২৩ টি দেশ থেকে ২ জন নারী সহ ৫০ জন এবং বিভিন্ন সংগঠন থেকে আরও ১০০ জন এখানে যোগ দিবেন বলে আশা করা হচ্ছে। সর্বদয়ার নেতা জনাব জয়প্রকাশ নারায়ণ এর সভাপতিত্ব করবেন।

বিদেশী প্রতিনিধিদের মধ্যে জনাব বেয়ার্ড রাস্টিন, আমেরিকান ব্ল্যাক মুভমেন্ট নেতা, জনাব মাইকেল হ্যারিংটন, চেয়ারম্যান সমাজতন্ত্রী দল, নিউ ইয়র্ক, জনাব পেভ জেভারমোভিক, যুগোস্লাভ লীগ ফর পিসের কার্যনির্বাহী সদস্য, জনাব ড্যানিয়েল মেয়ার, মানবাধিকার ফরাসি লীগের সভাপতি, মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের জনাব জন ডানহাম, জনাব এল ওয়ালিদ ইব্রাহিম, সুদান থেকে একজন সাংবাদিক, লিবিয়ার জনাব ফরিদ সায়লা, ডঃ মোহাম্মদ রোয়েম, ইন্দোনেশিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী, এবং জনাব কিউ হারদাদ, সম্পাদক, “আফগান মিল্লাত,” কাবুল উলেখযোগ্য।

খসড়া বিষয়সূচি
বেসরকারিভাবে যেসব গুরুত্বপূর্ণ দেশ অংশ নিচ্ছে তাদের মধ্যে আছে জাপান, মালয়েশিয়া, নেপাল, সিংহল, গিয়ানা, নাইজেরিয়া, ইউ এ আর, অ্যামেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে, সুইডেন, চেকোস্লোভাকিয়া, আর্জেন্টিনা, কানাডা, বেলজিয়াম ও যুক্তরাজ্য।

সম্মেলনের খসড়া বিষয়সূচিতে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য একটি সম্মিলিত আন্তর্জাতিক ব্রিগেড গঠনের মতো বিষয় অন্তর্ভুক্ত আছে। প্রয়োজনে বাংলাদেশ সরকারকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা দেবার ব্যাপারে আলোচনা হবে এবং মানবাধিকার কমিশনের একটি বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করা হয়েছে।

সম্মেলনে সাপ্রু হাউসে উদ্বোধন করা হবে এবং ভারত আন্তর্জাতিক কেন্দ্রে আলোচনা হবে। আজ রাত পর্যন্ত, প্রায় ২০ জন বিদেশী প্রতিনিধি চলে এসেছেন। অন্যরা ভোরের ফ্লাইটে চলে আসবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৭২। মুজিবকে বিনাশর্তে মুক্তি দিন
২৪-জাতি সম্মেলনের আহ্বান
দি স্টেটসম্যান ১৯শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

Ashik Uz Zaman
<১৪, ৩৭২, ৮৮৮-৮৯১>

দি স্টেটসম্যান, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
মুজিবকে বিনাশর্তে মুক্তি দিন
২৪-জাতি সম্মেলনের আহ্বান
বাংলাদেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন থেকে
জানাচ্ছেন আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি

নয়া দিল্লী, ১৮ই সেপ্টেম্বর – বাংলাদেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদানকারী ২৪টি দেশের প্রতিনিধিরা আজ এখানে সর্বসম্মতিক্রমে আহ্বান জানান শেখ মুজিবুর রহমানের নিঃশর্ত মুক্তি প্রদানের জন্য যাকে তারা বর্ণনা করেন বাংলাদেশের জনগণের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে।

এই তিন-দিনব্যাপী সম্মেলন, যার আলোচনা শুরু হয় বাংলাদেশে যারা নিহত হয়েছে তাদের স্মরণে দুই মিনিট নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে, বিশ্ববাসী এবং তাদের সরকারদের প্রতি আহ্বান জানায় পাকিস্তানের সামরিক সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করার জন্য যাতে করে তারা সভ্য সমাজে স্বীকৃত নাগরিক সুবিধা ও মানবিক স্বাধীনতা পরিচালনাকারী সবধরনের আইনের ধারা গভীরভাবে ভঙ্গ করা থেকে বিরত হয়।

এই সম্মেলনের সভাপতি মিঃ জয়প্রকাশ নারায়ণ কর্তৃক উত্থাপিত এই প্রস্তাব, সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় যখন সম্মেলনে উপস্থিত সবাই দাঁড়িয়ে এই প্রস্তাবের প্রতি তাদের সমর্থন জানান।

মিঃ নারায়ণ, তাঁর বক্তব্যে ইঙ্গিত দেন “সোভিয়েত রাশিয়া ছাড়া, ভারতের বাইরের পৃথিবী”, পাকিস্তানের শাসকদেরকে তাদের অপরাধের জন্য নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। এই সম্মেলনের সবাইকে দ্ব্যর্থহীনভাবে এই শাসকদেরকে নিন্দা জানানোর জন্য আহ্বান জানিয়ে তিনি আরো বলেন, “অবশ্য শুধুমাত্র নিন্দা জানানোতে কাজ হবে না”। তিনি এতদূর পর্যন্ত বিশ্বাস করেন যে শরণার্থীরা ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের দেশে ফিরে যাবেনা যতক্ষণ পর্যন্ত না শেষ পাকিস্তানী সৈন্যটি বাংলাদেশ ত্যাগ করছে এবং বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে।

ভিন্ন ঘটনা
তিনি আরো বলেন, তিনি জানেন যে তাঁর বক্তব্য তাৎক্ষনিকভাবে প্রতিষ্ঠিত জাতি-রাষ্ট্র বিভাজনের প্রত্যাশিত দুর্দশার আতঙ্ক উত্থাপন করবে, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর প্রতিনিধিদের মনে। কোন বিচক্ষণ ব্যক্তিই তা কখনো চাইবে না, তিনি বলেন, “কিন্তু এক্ষেত্রে এ বিষয়টি সার্বজনীন মনে করা ভুল হবে”। সাম্প্রতিক ইতিহাসে ঘটে যাওয়া অন্য সব ঘটনার চেয়ে বাংলাদেশের ঘটনাটি বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ভিন্ন।
প্রথমত, পৃথিবীতে পাকিস্তানের মতো অন্য আর কোনো জাতি-রাষ্ট্র নেই যার দুই অংশ ১,০০০ মাইল দূরত্বে বিভক্ত, সমুদ্র দ্বারা নয় – প্রায় ৭০০ মাইল – যেমন মালয়শিয়ার ক্ষেত্রে, বরং ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা। দ্বিতীয়ত, ধর্ম ছাড়া পাকিস্তানের পূর্ব এবং পশ্চিম অংশের মধ্যে কোন মিলই নেই। তৃতীয়ত, পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার অধিকাংশ প্রায় ৬০%, পূর্ব অংশে বসবাস করে। চথুর্তত, বেশ কিছু পরিস্থিতির কারণে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতা সবসময়ই কতিপয় রাজ্যশাসক পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক অফিসারের হাতে ছিল যার ফলশ্রুতিতে পূর্ব পাকিস্তান একটি উপনিবেশে পরিণত হয়।

তারপরেও শেখ মুজিবুর রহমান কখনই আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করেননি। বরং, শেখ মুজিব প্রকাশ্যে বলেছেন যে, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় কখনই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে আলাদা হয়ে যায় না। ফলে, যে ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে তিনি গত সাধারণ নির্বাচনে লড়েছেন তা পুর্ন আভ্যন্তরীণ স্বায়ত্তশাসনের দাবীর চেয়ে বেশী কিছু ছিল না। তাঁর জয়লাভ অবশ্য, পাকিস্তানের শাসকদেরকে আতঙ্কিত করে তোলে, কেননা এর মানে দাঁড়ায় রাষ্ট্র-ক্ষমতার মধ্যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার ক্ষেত্রে দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন, যেখানে সামরিক-বেসামরিক রাজ্যশাসন ক্ষমতা জনতার হাতে হস্তান্তর এবং ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু পশ্চিম থেকে পূর্বে সরে যাওয়া। বাকি সবকিছু সাম্প্রতিক ইতিহাসের অংশ এবং মিঃ নারায়ণ বিস্ময় প্রকাশ করেন পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অবাধ নজিরবিহীন অত্যাচারের মুখে বাঙালীদের স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার জন্য তাদেরকে কেউ কিভাবে দোষারোপ করতে পারে।

তিনি আরো বলেন, পাকিস্তানীরা মার্চের ২৫-২৬ তারিখের মধ্যরাত থেকে তাদের উপর যা করেছে তারপর বাঙালীদের সামনে আর অন্য কোনো উপায় ছিলনা। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার কোনো দ্বিধা নেই বলতে যে ওদের জায়গায় থাকলে আমিও ঠিক একই কাজ করতাম। বরং, আমার সন্দেহ আছে যে আত্ম-সম্মানজ্ঞান সম্পন্ন যেকোনো ব্যক্তি বা জনগণ পৃথিবীর যেকোনো স্থানে এই ধরণের পরিস্থিতিতে ভিন্ন আচরণ করতো।

“পাকিস্তান আর নেই”
কাজেই, মিঃ নারায়ণ আরো বলেন, এটা পরিস্কারভাবে বুঝতে হবে যে বিশ্ববাসী যে পাকিস্তানকে চিনতো সেই পাকিস্তান আর নেই। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মিঃ তাজউদ্দিন আহমেদকে উদ্ধৃত করে, তিনি বলেন, লাশের পর্বতের নিচে সেই দেশ চাপা পড়ে গেছে।

মানবিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য স্বাগত জানিয়ে মিঃ নারায়ণ প্রতিনিধিদেরকে স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় গঠিত সশস্ত্র আন্তর্জাতিক ব্রিগেডের আদলে একটি বাহিনী গঠন করার প্রতি আকর্ষণ করেন। এই বিষয়ে মিঃ আন্দ্রে ম্যালরো, যিনি একজন স্বনামধন্য লেখক হবার পাশাপাশি স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময়কার একজন গেরিলা নেতা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রান্সে একজন মাকুই নেতাও ছিলেন বলে, তাঁর কাছ থেকে আসা বাঙালী গেরিলাদের সাহায্যে এগিয়ে আসার প্রস্তাব উষ্ণভাবে স্বাগত জানানো এবং আরো বিশ্লেষণ করে দেখা উচিত বলে মনে করেন।

মিঃ নারায়ণ আরো প্রস্তাব করেন যে এই সম্মেলনের বিবেচনা করা দরকার “বিশ্বের সরকার গুলোর জন্য কিছু বাস্তব পরিকল্পনা” তৈরী করা, বা এমন কিছু করা যা থেকে আমরা আশা করতে পারি যে তারা কোন না কোন ভাবে বাংলাদেশের সরকার এবং তার মুক্তিযুদ্ধের প্রতি নৈতিক, রাজনৈতিক এবং বাস্তব সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশ যার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে তা হচ্ছে “ইসলামাবাদে ক্ষমতায় আসীন হিটলারের সমতুল্য জান্তা যে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণকে বাংলাদেশের জনগণের চেয়ে কোনো অংশে কম অধীন করে রাখেনি”, তিনি বলেন।

সিলনের (শ্রীলংকা) মিঃ গুনাবর্ধনে, যিনি এক দশকেরও বেশী সময় ধরে জাতিসংঘে তাঁর দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন, বলেনঃ “বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান হবে নৈতিকতার জয়, সত্যের জয়”, ইউএনআই আরো জানায়।

তিনি বলেন বাংলাদেশের এই দুঃখজনক ঘটনা সিলনবাসীদেরকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে এবং তারা ওখানে যা ঘটছে তাকে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে দেখছে না। বাংলাদেশের জনগণ তাদের আত্ম নির্ধারনের অধিকার অনুশীলন করেছে এবং তারা যাতে তাদের ন্যায্য অধিকার আদায় করতে পারে এটা নিশ্চিত করা বিশ্ববাসীর দ্বায়িত্ব।

মিঃ গুনাবর্ধনে, অন্য আর প্রায় সকল বক্তার মতো বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য এবং “দখলদার বাহিনী”-এর একজন সৈন্যও যেন পূর্ব বঙ্গে না থাকে তা নিশ্চিত করতে এবং তাদের অতিপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানান।

তিনি বলেনঃ “এই সমস্যা সমাধানের জন্য কোনধরনের সামরিক সমাধান কোনভাবেই থাকতে পারে না এবং এমনকি রাজনৈতিক সমাধানের জন্যও এখন দেরি হয়ে গেছে। এর একমাত্র সমাধান হচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান”।

“মানুষের মর্যাদা”
নেপালের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মিঃ বি. পি. কৈরালা, হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন “যদি বাংলাদেশের বাতি নিভে যায় তাহলে বাকি পৃথিবীরও আরো অনেক বাতি নিভে যাবে তা নিশ্চিত”। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা শুধুমাত্র তাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে তা নয় বরং তারা তাদের “মানুষের মর্যাদা” বজায় রাখার জন্যও যুদ্ধ করছে।

মিঃ গানি ফাওয়েহিন্মি, নাইজেরিয়ান লইয়ার্স এসোসিয়েশনের প্রতিনিধি, বলেন “বাংলার লাখ লাখ মানুষকে আমরা নিষ্পেষিত হতে দেব না”। তিনি বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানান এটা নিশ্চিত করতে যে বোমা ও গুলি যেন ধ্বংস করতে সক্ষম না হয় বাংলাদেশের জনগণের এই আকাঙ্ক্ষা কেননা তাঁর ভাষ্যমতে এরা অব্যাহত শোষণের স্বীকার এবং এখন তারা তাদের ন্যায্য দাবীর জন্য লড়ছে।

ওয়ার অন ওয়ান্ট এর সহ-সভাপতি, স্যার জর্জ ক্যাটলিন (যুক্তরাজ্য) বলেন, এই সম্মেলনের উচিত জাতিসংঘের উপর কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করা যাতে করে বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাগুলো পূর্ন হয় এবং তাদের অবর্ননীয় দুর্দশার পরিসমাপ্তি ঘটে।

প্রফেসর ৎসুয়োশি নারা (জাপান), যিনি জাপানে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের প্রতিবাদ সত্ত্বেও এই সম্মেলনে এসেছেন, তিনি বাংলাদেশের এই সমস্যা যাতে করে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর মদদে একটি বৃহত্তর এশীয় যুদ্ধে রূপান্তরিত না হয় তা নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আহ্বান জানান।

মিঃ ক্লোভিস মাকসুদ (মিশর), যিনি লিবিয়া এবং সুদানেরও প্রতিনিধিত্ব করছেন, বলেন যে বাংলাদেশের এই সমস্যাকে কোনভাবেই পাক-ভারত বিরোধের অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না।

এক আবেগপূর্ন বক্তব্যে তিনি বলেন শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি একটি মানবিক উদ্বেগের বিষয়। পূর্ব বঙ্গের জনগণকে ন্যায়বিচার দিতে অস্বীকার করার মানে হচ্ছে একটি বর্নবাদী নীতি রচনা করা।

মিঃ মাকসুদ পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণকে উদ্দেশ্য করে বলেন বাঙালীদের এই মর্যাদা রক্ষার যুদ্ধ পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের পাশাপাশি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্যও উদ্বেগের বিষয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণকে এটা উপলব্ধি করতেই হবে যে পূর্ব বঙ্গের জনগণকে ন্যায়বিচার দিতে যেকোনভাবে অস্বীকৃতি জানানোর মানে হবে বর্নবাদী ঔপনিবেশকতার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা।

তিনি বলেন, ঘটনার প্রকৃত স্বরূপ সচক্ষে দেখার জন্য তিনি আরব বিশ্বের অন্যান্য প্রতিনিধিদের সাথে এখানে এসেছেন। আরব দেশগুলো পরিস্থিতি সম্বন্ধে যতটা জ্ঞাত থাকার কথা ততটা ছিল না কেননা তারা তাদের নিজেদের মাতৃভূমি সংক্রান্ত সমস্যাদি নিয়ে গভীরভাবে জড়িত ছিল।
ওয়ার্ল্ড ফেডারেলিস্ট নামের প্রতিষ্ঠানটি তাদের দুইজন প্রতিনিধি ডেনমার্কের মিঃ নিলসন এবং নরওয়ের মিসেস সিগরিড হাননিসদাল-এর মাধ্যমে, সম্মেলনে উপস্থিত প্রতিনিধিদের সাথে একাত্ম হয়ে পূর্ব বঙ্গের জনগণকে তাদের আত্ম নির্ধারনের অধিকার অনুশীলন করা থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়া নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে।

আফগানিস্তানের মিল্লাত অব কাবুল-এর প্রতিনিধি মিঃ হেরদাদ বাঙালীদের আশ্বস্ত করেন যে আফগানিস্তানের জনগণ তাদের সাথে সংহতি প্রকাশ করেছে। তিনি বলেন পূর্ব বঙ্গের বাঙালীদের শোষণের শিকল ছিঁড়ে ফেলার আকাঙ্ক্ষার প্রতি আফগানিস্তানের জনগণের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।

ডাঃ হোমার এ. জ্যাক, ওয়ার্ল্ড কনফারেন্স অফ রিলিজিয়ন্স ফর পীস-এর সাধারণ সম্পাদক, তুলনাহীন নিষ্ঠুরতার বর্ননা দেন যে ঘটনাগুলো সম্বন্ধে তিনি জানতে পারেন বাংলাদেশে তাঁর অবস্থানের সময়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৭৩। বাংলাদেশ এখন একটি আন্তর্জাতিক প্রশ্ন হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড ২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

Aabir M. Ahmed
<১৪, ৩৬৮, ৮৯২-৮৯৪>

হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড,২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
বাংলাদেশ এখন একটি আন্তর্জাতিক প্রশ্ন
– নীতিশ চক্রবর্তী

বাংলাদেশ বিষয়ে নয়াদিল্লীতে সাম্প্রতিককালে হয়ে যাওয়া আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তেমন কোনো নাটকীয় ফলাফল আসেনি। এটা তাদের কোনো অর্জন কিংবা তাদের কোনো ঘাটতির পরিচায়ক নয়। বরং বাংলাদেশে সম্পর্কে সাধারনভাবে উদ্বিগ্ন কিছু মানুষের আলোচনায় বসা থেকে কোনো লক্ষণীয় ফলাফল আসবে তা আশা করাই বাতুলতা। এই সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিলো বিশ্ব সম্প্রদায়ের বিবেককে নাড়া দেওয়া। পরবর্তীতে এর ফলাফলের উপর এটির সফলতা নির্ধারিত হবে।

বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ বিভীষিকার ব্যাপারে বিশ্বজুড়ে সব সরকারই শুধু একই রকম আচরন করছে তা নয়, ইসলামাবাদের শাসক জান্তাকে নিয়ন্ত্রন করতে অনানুষ্ঠানিক পর্যায় থেকেও তেমন কিছুই করা হয়নি। পাকিস্তানিদের এমন বর্বরতার বিরুদ্ধে নানা শ্রেণীর নারীপুরুষকে একই কাতারে নিয়ে আসার মাধ্যমে এই সম্মেলন খুব তাৎপর্যপূর্ণ একটি কাজ করেছে। এটি প্রমান করেছে যে বিভিন্ন সরকারের একই আচরন সত্ত্বেও বিভিন্ন দেশের অসংখ্য মানুষ বাংলাদেশের হয়ে যাওয়া ঘটনায় গভীরভাবে ব্যথিত।

আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর সংলাপের মাধ্যমে এই সম্মেলন থেকে হয়ত এমন ফলাফল আসবে যা কার্যকরী পদক্ষেপে রূপ নেবে এমন আশার উদ্রেক হয়েছে। বন্ধুর কাছে লেখা ফরাসি লেখক জনাব আন্দ্রে মালরাউক্স এর একটি চিঠি প্রকাশ পেয়েছে যার ফলে এমন সম্ভবনার সৃষ্টি হয়েছে। জনাব মালরাউক্স , যিনি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে শোষকদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে লড়াই করেছেন, মনে করেন বিভিন্ন প্রস্তাবনার মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসকদলকে প্রত্যাহত করার চেষ্টাই ফলপ্রসু হবে।

এমন কি জনাব জয়প্রকাশ নারায়ণ এর মত শান্তিবাদী মানুষও বিশ্বাস করেন যে শুধুমাত্র মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করলেই বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে সাহায্য করতে পারে। সম্মেলনে দেওয়া রাষ্ট্রপতির ভাষণে তিনি ১৯৩০ সালে স্প্যানিশ ফ্যাসিবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলো এমন একটি শক্তির ব্যাপারে পরামর্শ দেন। এই পরামর্শ জনাব বিপি কৈরালা তাৎক্ষনিকভাবে সমর্থন দেন যিনি নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং নিজদেশে গণতান্ত্রিক শাসনের জন্য আজীবন যুদ্ধ করে গিয়েছেন ।

এটা খুব অবাক হবার মতো বিষয় নয় যে এই ধারনার খুব বেশী সাড়া পাওয়া যায়নি। এটার একটা কারন এই সম্মেলনের প্রস্তুতিকালিন সময়ে কোনো সশস্ত্র আন্তর্জাতিক যুদ্ধের সম্ভবনার ব্যাপারে সাবধানতার সাথে কোনো নিরীক্ষণ করা হয়নি। এটা সম্ভবত আশা করা উচিত নয় যে বিভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে আসা মানুষেরা এমন আলোচনার মাত্র ৭২ ঘন্টার ব্যবধানে এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবেন।

অংশগ্রহণকারীরা শুধু মাত্র সশস্ত্র যুদ্ধ শুরুর সিদ্ধান্তের প্রজ্ঞার ব্যাপারেই ভিন্নমত পোষন করেননি, এমনও কিছু মানুষ ছিলেন যাদের মতে যে কোনো কারনে অস্ত্রের ব্যবহার সম্পূর্ণ অগ্রহনযোগ্য। আরও সমস্যাজনক ব্যাপার হলো যে, অংশগ্রহণকারীদের অনেকেই পাকিস্তানের হস্তক্ষেপের বাইরে একটি স্বাধীন বাংলাদেশের ধারনার বিরুদ্ধে রয়েছেন। যদি ব্যক্তিগতভাবে না হয়ে থাকে তাহলেও জাতিগতভাবে প্রতিটি গোষ্ঠীই বাংলাদেশের সঙ্কটসমাধানে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করছেন।

এমন একটি সম্মেলনে এরকম ত্রুটি সম্ভবত স্বাভাবিক যা খুব সংক্ষিপ্ততম সময়ের মাঝে আয়োজন করা হয়েছিলো একটি অলাভজনক প্রস্তুতি কমিটির মাধ্যমে যার আমন্ত্রিত ব্যক্তিবর্গদের বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তিবিশেষের সহানুভূতি ব্যতিত আর কিছুই ছিলো না। বহু দেশেই জাতীয়গোষ্ঠী বাংলাদেশের সমর্থনে এখন পর্যন্ত কিছুই বলেনি, তাই প্রস্তুতি কমিটিকে আমন্ত্রনের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ব্যক্তিবিশেষের উপর নির্ভর করতে হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় শস্য থেকে খড়কুটো সর্বক্ষেত্রে পৃথক করা যায় না।

ভারত সরকারের নিরুত্তাপ আচরন সম্ভবত বহির্বিশ্বে এই সম্মেলনের ব্যাপারে ভুল ধারনা দিয়েছে। তাদের সাথে কনগ্রেস(ডান) এর বাহ্যত অসহযোগিতার কারনে সেই ভুল ধারনা আরও জোরালো হচ্ছে। তারা যদি সন্দেহ করে থাকে এই সম্মেলন সরকারবিরোধী ফোরামে রূপ নিতে পারে, তাহলে এটাই সেই কারন যার জন্য আলোচনার মাধ্যমে সেটা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এমন কি বাংলা দেশইস্যুতেও কনগ্রেস (ডান) এবং সিপিআই এর জনসংঘের সাথে একই কাতারে না আসবার ব্যাপারে উদ্বেগ সম্ভবত ভারতের শত্রু পক্ষের এই দ্বিধাকে আরও জোরালো করবে। তা সত্ত্বেও, আয়োজকদের কাজ কঠিন করে তুলতে পারে এমন কিছুই ভারত সরকার করেনি এবং বস্তুত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জনাব শাহ নেওয়াজ খান প্রথম সারিতেই বসে ছিলেন।

অংশগ্রহনকারীদের সংখ্যার ভিত্তিতে এই সম্মেলন কিছুটা পার্থক্যের দাবী করতে পারে। প্রায় ৬০শতাংশ মানুষ ২৩ টি দেশ থেকে নয়া দিল্লীতে এসেছেন এই সম্মেলনে অংশগ্রহন করার জন্য। সংখ্যগত দিক থেকে পিছিয়ে থাকলেও কিছু উচ্চ পর্যায়ের অংশগ্রহনকারীদের জন্য সে ই ক্ষতি পুষিয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন থেকে আসা লক্ষনীয় মাত্রার অংশগ্রহনকারী এটাই প্রমান করে যে নিক্সন প্রশাসন কিংবা টরি সরকারের প্রতি সমগ্র জনগনের সমর্থন নেই।

প্রায় দ্বিতীয় ভিয়েতনামের মত অবস্থায় তৈরী হতে যাওয়া পরিস্থিতির সাথে নিজেদের জড়াতে তাদের দ্বিধা থাকলেও বাংলাদেশ সহিংসতায় বহু সংখ্যক আমেরিকান গভীরভাবে নাড়া খেয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন, দুই দেশেরই প্রতিনিধিদল চাচ্ছেন তাদের সরকার ইতিবাচক মনোভাব ধারন করুক যার ফলে ইসলামাবাদ কর্তৃপক্ষ তাদের ভুল শুধরে নিতে পারে। যদিও ফরাসি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে সর্বাত্মক সহায়তার আবেদনের জন্য খুব উদারতার পরিচয় দেয়নি।

সম্মেলনের ছয়টি মহাদেশের প্রতিনিধিই ছিলেন কিন্তু তুলনামূলকভাবে এশিয়ার প্রতিনিধিত্ব ছিলো খুবই করুন। ভারত এবং বাংলাদেশ বাদে মাত্র ৭টি এশীয় দেশের প্রতিনিধি এসেছিলেন। অনেক এশীয় প্রতিনিধির ক্ষেত্রে সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো বিষয় এটাই ছিলো যে বাংলাদেশের জন্য তাদের অকুন্ঠ সমর্থন রয়েছে। প্রত্যাশিতভাবে নেপালের উচ্চপর্যায়ের একজন প্রতিনিধি বাংলাদেশের সার্বভৌম রাষ্ট্র হিশেবে বাংলাদেশের অধিকারের পক্ষে কথা বলেছেন। সিলনের প্রতিনিধিদলও সমান ভাবেই পাকিস্তানের শাসনের নিন্দা করেছেন।

এমন কি মালয়শিয়ায় প্রতিনিধিও স্বাধীন রাষ্ট্র হিশেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পক্ষে মতো দেন। ইন্দোনেশিয়ার দুজন মানুষের দলতির মতামত কিছুটা ভিন্ন ছিলো। একজন সাবেক ইন্দোনেশীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডঃ মোহম্মদ রোয়েম এবং জাতিসংঘে ইন্দোনেশীয় প্রতিনিধিদলের একজন পূর্ববর্তী নেতা ডঃ আবু হানিফার মতে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের জন্য বাংলাদেশ যথেষ্ট উপযুক্ত। কিন্তু একটি সার্বভৌম জাতির হিসাবে এর অস্তিত্বের অধিকার প্রশ্নে তারা সমর্থন করবে না।
সম্ভবত সবচেয়ে হতাশাজনক হলেও অপ্রত্যাশিত ছিলো না আরব বিশ্ব থেকে অংশগ্রহনকারীদের অবস্থান। সংখ্যাগত এবং অবস্থানের ভিত্তিতে কম সংখ্যক আরব অংশগ্রহনকারীরা নিজেদের পর্যবেক্ষক হিশেবে উপস্থাপন করেছে , প্রতিনিধি নয়। তাদের মুখপাত্র ডঃ ক্লভিস মাকসুদ খুব গুরুত্ত্বের সাথে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং মানুষের মর্যাদার বিষয়ে কথা বললেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে ঐক্যমত পোষণ করে এমন কোনো কিছু বলা থেকে কৌশলে বিরত থেকেছেন। আরবদের পরামর্শমতে যে কোনো সমাধানই অখন্ড পাকিস্তান কাঠামোর ভেতর রাখতে হবে।

বাংলাদেশ ইস্যুতে ঐক্যমত্যের অভাব হওয়া সত্ত্বেও, এই নিদারুন বিপর্যয়ের উপর বিশ্বের মনযোগ নিয়ে আসতে সম্মেলনটি সফল হয়েছে। বাংলাদেশের গনহত্যার ব্যাপারে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের নিন্দাজ্ঞাপন সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের বিবেককে নাড়া দেবে। এটা নিঃস্পৃহ থাকা সরকারগুলোকে কোনো উদ্যোগ নিতে অনুপ্রাণিত করবে কি না তা ভিন্ন ব্যাপার।

পাকিস্তানের শোষকগোষ্ঠী এই ব্যাপারটিতে স্বস্তিতে থাকবে না যে ২৪টি দেশের নাগরিকেরা কোনো বিরোধীতা ছাড়াই শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবী জানিয়েছে যাকে তারা (পাকিস্তানের শোষকগোষ্ঠী) দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়েছে। এর অসাড়তা প্রমাণিত হয় নয়া দিল্লীর সম্মেলনে অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে জনগণকে চাপ দেয়ার জন্য বিভিন্ন দেশে পাকিস্তানি কূটনৈতিকদের চেষ্টার মাধ্যমে। বাংলাদেশের মিত্রদের দ্বারা একটি আন্তর্জাতিক পরিষদ এর গোড়াপত্তন স্বাধীনতার আশার আলোকে আরও উজ্জ্বল করবে। যদিও প্রক্রিয়াটি শ্লথগতির এবং আন্তর্জাতিক জনমত তৈরীতে জোরপ্রচেস্টা বাংলাদেশ এর উদ্দেশ্যকে সহায়তা করবে।
শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৭৪। জাতিসংঘে বিতর্ক শুরু
শরণ সিং কর্তৃক বাংলাদেশ সমস্যা রাজনৈতিক সমাধান দাবী দি স্টেটসম্যান ২৮শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

Ashik Uz Zaman
<১৪, ৩৭৪, ৮৯৫-৮৯৭>

দি স্টেটসম্যান, ২৮শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
জাতিসংঘে বিতর্ক শুরু
শরণ সিং কর্তৃক বাংলাদেশ সমস্যার
রাজনৈতিক সমাধান দাবী

জাতিসংঘ সদরদপ্তর, ২৭শে সেপ্টেম্বর – ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ শরণ সিং আজ জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতি আহ্বান জানান “ইসলামাবাদের সামরিক জান্তার উপর চাপ প্রয়োগ করে বুঝিয়ে দিতে যে শক্তি প্রয়োগ করে সফল হওয়া যাবে না এবং সামরিক জান্তা ও ইতিমধ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তি হওয়া জরুরী”, পিটিআই জানায় “আরো খারাপ পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার জন্য অপেক্ষা করাকে আমরা অত্যন্ত অদূরদর্শী চিন্তা বলে মনে করি” তিনি বলেন।

“দ্বিপক্ষীয়ভাবে সকল সরকার তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে পারে তাদেরকে নিশ্চিত করতে যে সামরিক জান্তা এই দমনপীড়ন বন্ধ করবে এবং নির্বাচিত নেতাদের সাথে আলোচনায় বসবে তাদের সম্মতির মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তি অর্জন করতে এবং সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে”। মিঃ সিং বলেন শুধুমাত্র এই পদক্ষেপগুলো নেয়ার মাধ্যমেই শরণার্থীদের ঢল থামানো যাবে এবং ইতিমধ্যেই যারা ভারতে চলে এসেছে তারা তাদের ঘরে ফিরে যেতে পারবে।

মিঃ শরণ সিং আজ জাতিসংঘে শুরু হওয়া সাধারণ আলোচনা সভায় এই বক্তব্য দিচ্ছিলেন। ভারত এই বিতর্কের দ্বিতীয় বক্তা যেটি আরো কয়েকদিন ধরে চলবে বলে আশা করা যাচ্ছে। ব্রাজিল ছিল প্রথম বক্তা। পাকিস্তান অক্টোবর মাসের শুরুতে বক্তব্য রাখবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

একটি বিস্তারিত বক্তব্যে যেটিতে তিনি বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্বন্ধে বলেন যার মধ্যে চীনকে জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রদান, ভিয়েতনাম ও মধ্যপ্রাচ্যে নিরস্ত্রীকরণ এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সঙ্কট ছিল। মিঃ সিং বাংলাদেশের সমস্যা মোকাবেলা বিষয়ে কথা বলেন এবং সেখানে যে এখনো ত্রাসের রাজত্ব বলবত রয়েছে তা জানান।

তিনি সাধারণ সভার নতুন সভাপতি মিঃ আদম মালিক এবং প্রাক্তন সভাপতি নরওয়ের রাষ্ট্রদূত এডওয়ার্ড হ্যামব্রোকেও ভারতের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন।

চীনের সদস্যপদ প্রাপ্তির বিষয়ে মিঃ সিং ভারতের মনোভাব দৃঢ়তার সাথে ব্যক্ত করেন যে চীনদেশ একটিই আছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে এই বিষয়টি চলমান সভায়ই নিষ্পত্তি হবে। “এখানে একটিই চীনা আসন রয়েছে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চীন সরকার জাতিসংঘের এই আসন দখলে রাখার অধিকারী”, তিনি বলেন। “আমরা সবসময়ই নিশ্চিত ছিলাম যে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের উপস্থিতি এই সংস্থাটিকে আরো কার্যকর করে তুলবে”। মিঃ সিং বলেনঃ “এই বিষয়ে একটি বাস্তবধর্মী সিদ্ধান্ত নেয়া আমরা অনেকদিন থেকে স্থগিত করে রেখেছি, আমরা আর গড়িমসি না করি”।

ভিয়েতনাম বিষয়ে মিঃ শরণ সিং আক্ষেপ করে বলেন যে উত্তর ভিয়েতনামের কিছু অংশে পুনরায় বোমাবর্ষণ শুরু হয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে প্যারিস এবং অন্যান্যস্থানে আলোচনার ভিত্তিতে “অবিলম্বে ভিয়েতনামের এই নিদারুণ যন্ত্রণার পরিসমাপ্তি ঘটবে যাতে করে মার্কিন ও অন্যান্য বিদেশী সৈন্যরা অবশেষে একটি নির্দিস্ট তারিখের মধ্যে অপসারিত হবে এবং অবশেষে ভিয়েতনামের জনগণ বহিঃশক্তির কোনধরনের হস্তক্ষেপ ছাড়াই তাদের নিজস্ব ইচ্ছানুযায়ী তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারন করতে পারবে”। তিনি বলেন প্যারিসে প্রদত্ত সাত-দফা প্রস্তাব আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার জন্য একটি যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি প্রদান করেছে বলে মনে হয়।

মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে মিঃ শরণ সিং আক্ষেপ করে বলেন সাময়িক পদক্ষেপ হিসেবে যে যুদ্ধবিরতি মেনে নেয়া হয়েছিল যাতে করে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো জাতিসংঘের দূত মিঃ গুননার জারিং এর মধ্যস্ততায় আলোচনার মাধ্যমে একটি সমঝোতায় আসতে পারে তা আগ্রাসীপক্ষের পক্ষে গিয়ে পরিস্থিতি অচল করে দিয়েছে।

মিঃ সিং তাঁর বক্তব্যের বেশীরভাগ সময় উৎসর্গ করেন বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে আলোচনায় ধারাবাহিকভাবে ঘটনাবলী বিবেচনা করে যার মধ্যে নির্বাচনের ফলাফলও ছিল।

৬-দফা কর্মসূচী
মিঃ শরণ সিং স্মরণ করেন ছয়-দফা কর্মসূচীর কথা, যেটি পূর্ব বঙ্গের জন্য আরো বৃহত্তর মাত্রায় স্বায়ত্তশাসন বিবেচনা করেছিল এই উদ্দেশ্যে যে বৈষম্য এবং শোষণের পরিসমাপ্তি ঘটবে। “আপাতদৃষ্টিতে এই নির্বাচনের ফলাফল পাকিস্তানের শাসকদেরকে এতটাই চমকে দেয় যে তারা পুর্ব অংশের উপর তাদের অর্থনৈতিক, সামরিক এবং রাজনৈতিক প্রভাবের প্রতি একে হুমকিস্বরূপ মনে করতে থাকে। এথেকেই তাদের তড়িৎ পদক্ষেপ নেয়া এবং সামরিক শাসন চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা পরিস্কার বোঝা যায়”।

মিঃ সিং বলেন যে সেনাবাহিনী পুর্ব বঙ্গে বেসামরিক জনগণের উপর যা করেছে এবং এর বৃহদায়তন আক্রমণে যা এখনো করে যাচ্ছে তা সবাই খুব ভালো করেই জানে। ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছিল এবং এখনো তা বলবত রয়েছে।

হত্যা, জ্বালাওপোড়াও, ধর্ষন এবং লুটপাট ব্যাপক আকার ধারন করেছে এবং এর অবধারিত পরিণতিই ঘটেছে। মানুষ সন্ত্রাস ও সহিংসতা এড়াতে তাদের যাকিছু ছিল তা ফেলে রেখেই ভারতে পালিয়ে এসেছে। “তাদের সংখ্যা নব্বুই লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে এবং এই যাত্রা এখনো অব্যাহত রয়েছে। মানবজাতির ইতিহাসে যেকোনো আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেড়িয়ে শরণার্থীদের এই যাত্রা নজিরবিহীন”।

মিঃ শরণ সিং বলেন, “নিজেদের সবচেয়ে অপরিণামদর্শী এবং প্রাণঘাতী কার্যকলাপের জন্য অন্যদেরকে দোষারোপ করা ছাড়া পাকিস্তানের শাসকেরা আরো বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে যেগুলো আসলে বাগাড়ম্বর ছাড়া আর কিছুই নয়। তাদের এই পদক্ষেপগুলো আসলে ঠিক কতটা অকার্যকর তা বোঝা যাবে শরণার্থীদের স্রোতের উপর এগুলোর প্রভাব বিবেচনা করলেই। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট সময়ে সময়ে শরণার্থীদেরকে আহ্বান জানিয়েছেন ফিরে যাওয়ার জন্য, কিন্তু ভারতের দিকে স্রোতের মতো শরণার্থীদের সংখ্যা কেবল বেড়েই চলেছে”।

বেসামরিক বিন্যাস
মিঃ শরণ সিং বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে একটি তথাকথিত বেসামরিক সরকার গঠন করা হয়েছে এমন সব ব্যক্তিদের নিয়ে যাদের প্রতিনিধিত্বমুলক খ্যাতি বলতে প্রায় কিছুই নেই এবং তারা নিছক পুতুল-সম যারা তাদের সামরিক নেতাদের নির্দেশ মানতে বাধিত। একটি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরকে একইসময়ে দেশদ্রোহী হিসেবে বিবেচনা এবং বিচার করা হচ্ছে। আমরা অত্যন্ত আশ্চর্যের সাথে লক্ষ্য করছি যে পাকিস্তানের সরকার গঠন করা যে দলটির অধিকার ছিল সেটিকে নিষিদ্ধ এবং সবধরনের রাজনৈতিক কার্যকলাপ থেকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অর্ধেককে জাতীয় সংসদে আসন গ্রহণ করতে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের মতে ততক্ষণ পর্যন্ত শরণার্থীদের স্রোত থামবে না বা যারা ইতিমধ্যেই ভারতে রয়েছে তারা ফিরে যাবে না যতক্ষন পর্যন্ত না জনগণ দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।

মিঃ শরণ সিং বলেন, “মাননীয় মহাসচিব, ইউ থান্ট এবং অন্য অনেক বিশিষ্ট কূটনীতিক, রাজনীতিক এবং জনগণের নেতা সবসময়ই বলে এসেছেন যে সমস্যাটি আসলে রাজনৈতিক”।

তিনি বলেন যে রাজনৈতিক সমাধানের দিকে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে অবিলম্বে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে হবে এবং তাঁর সাথে আলোচনা শুরু করতে হবে।

মিঃ শরণ সিং আরো বলেন, “এই পদক্ষেপগুলো ছাড়া, যা পাকিস্তানীরা নিজেরাই নিতে পারে, ঠিক এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আর কিই বা করতে পারে? সর্বপ্রথম যে পদক্ষেপ এই সভা এবং জাতিসংঘের ভিতরের বা বাইরের অন্যসব আন্তর্জাতিক সংস্থা নিতে পারে তা হচ্ছে ইসলামাবাদের সামরিক জান্তার উপর চাপ প্রয়োগ করে বুঝিয়ে দিতে যে শক্তি প্রয়োগ করে সফল হওয়া যাবে না এবং একারণেই, সামরিক জান্তা ও ইতিমধ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তি হওয়া জরুরী। আমরা আরো খারাপ পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার জন্য অপেক্ষা করাকে অত্যন্ত অদূরদর্শী চিন্তা বলে মনে করি”।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৭৫। সোভিয়েত মনোভাবে মুজিব নগরে আশার সঞ্চার হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড অক্টোবর ১৯৭১

Ashik Uz Zaman
<১৪, ৩৭৫, ৮৯৮>

হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, অক্টোবর মাস, ১৯৭১
সোভিয়েত মনোভাবে মুজিব নগরে আশার সঞ্চার

মুজিবনগর, ৪ঠা অক্টোবর। মস্কোতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী এবং সোভিয়েত নেতৃবৃন্দের মধ্যে আলোচনায় বাংলাদেশ প্রশ্নে সোভিয়েত মনোভাব এখানকার সরকার ও রাজনৈতিক মহল উভয় ক্ষেত্রেই এক সতর্ক আশার সঞ্চার করেছে।

এই আশার ভিত্তি বলে মনে হচ্ছে আলোচনা শেষে প্রকাশিত ইন্দো-সোভিয়েত যুক্ত বিবৃতি এবং এ বিষয়ে নয়া দিল্লীতে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব মিঃ টি. এন. কৌল এবং অন্যান্য কর্মকর্তাদের সাথে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মিঃ এম. আলমের কথোপকথনের পর তৈরী এক পরিপত্রকে।

বাংলাদেশের সরকার নিশ্চিত যে ইন্দো-সোভিয়েত যুক্ত বিবৃতি ক্রেমলিনে বাংলাদেশ বিষয়ে গভীর উপলব্ধিরই প্রতিফলন।

বাংলাদেশের সরকারের মতে সোভিয়েত সরকার কর্তৃক রাজনৈতিক মীমাংসার পরামর্শ দেয়া হয়েছে “পূর্ব বঙ্গের মানুষের আকাঙ্ক্ষা, অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং আইনানুগ স্বার্থ” বিবেচনায় নিয়ে যা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অপরিহার্য শর্ত হিসেবে স্বীকার করে নেয়ার আরো কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। বাংলাদেশের সরকার এটা পরিস্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আর অন্য কোন সমাধান জনগণ মেনে নেবে না। অতএব এ থেকে বোঝা যায় যে রাজনৈতিক মীমাংসার জন্য ইন্দো-সোভিয়েত বিবৃতিতে বর্নিত তিনটি মৌলিক নীতি অবধারিতভাবে জনগণের অপরিহার্য দাবিকেই নিশ্চিত করে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি খুবই পরিস্কার। বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে যতক্ষণ পর্যন্ত না বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জিত হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা ক্ষান্ত হবে না। এবং এই সিদ্ধান্তটি বদলাবে না। তাই এই বিষয়ের রাজনৈতিক মীমাংসার ব্যপারে জল্পনা-কল্পনা করার কোন সুযোগ নেই। বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা, গত শনিবার এখানে এক বৈঠকে মিলিত হন মস্কোতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং সোভিয়েত নেতৃবৃন্দের মধ্যকার আলোচনা মুক্তিযুদ্ধের উপর কি প্রভাব ফেলতে পারে তা বিবেচনা করতে, এই উপসংহারে উপনীত হন যে “সম্মান ও মর্যাদার সাথে শরণার্থীদের নিজ নিজ ঘরে ফিরে যাওয়ার” প্রশ্নে পর্যাপ্ত জোর দেয়া হয়েছে।

তবে মন্ত্রিসভা মনে করে যে শুধুমাত্র বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত হবার পরই শরণার্থীদেরকে ফিরে যাবার জন্য উৎসাহিত করা যেতে পারে।

মন্ত্রিসভার আলোচনা শেষে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে অবশ্য পরিস্কারভাবে বলা হয়েছে যে কূটনৈতিক কার্যক্রমের ফলাফল যাই হোক না কেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোন প্রকার অবহেলা করা হবে না। “পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনই আমাদের লক্ষ্য” বিবৃতিতে বলা হয়।

এই প্রসঙ্গে, এই বিবৃতিতে তুলে ধরা হয় যে বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত হয় না এমন কোন মীমাংসার প্রস্তাব বাংলাদেশ সরকার এমনকি বিবেচনা করতেও প্রস্তুত নয়। যে দেশ এবং যে সরকার মীমাংসার জন্য হয়তো বিকল্প প্রস্তাব দেয়ার চিন্তাভাবনা করছিল তাদেরকে বিরত রাখার জন্য এই বিবৃতিতে এই বিষয়টি বিশেষভাবে সবার দৃষ্টিগোচর করা হয়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৭৬। ভারত – রুশ চুক্তির প্রতি আকুন্ঠ সমর্থন – চ্যাবনের প্রস্তাবে সভায় ঐক্যমত্য আনন্দবাজার পত্রিকা ৯ অক্টোবর ১৯৭১

Bashneen Faham
<১৪, ৩৭৬, ৮৯৯-৯০০>

ভারত-রুশ চুক্তির প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন
চ্যাবনের প্রস্তাবে সভায় ঐকমত্য

কৈলাশনগর, সিমলা, ৮ই অক্টোবর (পি টি আই)- আজ বিকেলে নিখিল ভারত কংগ্রেস (শো) কমিটির উদ্বোধনী অধিবেশনে ভারত-রুশ চুক্তির সমর্থনসূচক প্রস্তাবটি সর্বসম্মত ভোটে গৃহীত হয়েছে।

তিন ঘন্টাব্যাপী এই বিতর্কে প্রস্তাব উত্থাপক শ্রী যশোবন্তরাও চ্যাবনের ভাষণের পর সমস্ত সংশোধনী প্রস্তাব প্রত্যাহার করা হয়। শ্রী চ্যাবন বলেন, সংশোধনী প্রস্তাবে বড় রকমের কোন হেরফেরের কথা ছিল না; সদস্যরা বিপুলভাবে মূল প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানান।

উদ্বোধনী অধীবেশনে ভারত-রুশ চুক্তির সমর্থনসূচক প্রস্তাব পেশ করার সময় অর্থমন্ত্রী শ্রী যশোবন্তরাও চ্যাবন বলেন, এই চুক্তি হল দুই সার্বভৌম, সমান ও বন্ধু রাষ্ট্রের মধ্যে চুক্তির দ্বারা বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের স্বাধীন নীতি অনুসরণের পথে কোন বাধার সৃষ্টি হবে না।

শ্রী চ্যাবন বলেন, এ চুক্তি কোন দেশের বিরুদ্ধে নয়; তবে ভারতের বিরুদ্ধে যে দেশ কোন অভিসন্ধি পোষণ করে তার এত ভয়ের কারণ আছে।

এই চুক্তি দ্বারা এও প্রমাণ হয়েছে যে, ভারত মিত্রবাহিনী নয়।

চুক্তির যে অনুচ্ছেদে আছে,-‘কোন তৃতীয় রাষ্ট্র দ্বারা চুক্তিবদ্ধ পক্ষদ্বয়ের একের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবার আশঙ্কা দেখা দিলে উভয়েই তার মোকাবেলায় এগিয়ে যাবে,’শ্রী চ্যাবন সেইটি পাঠ করে শোনান। এই চুক্তিকে শ্রী চ্যাবন ভারত-রুশ সম্পর্কের ইতিহাসে ‘এক যুগান্তকারী’ ঘটনা বলে আখ্যা দেন। তিনি বলেন, এটা কোন আকস্মিক ঘটনা নয়, পরন্ত দুই রাষ্ট্রের দীর্ঘ সম্পর্ক ও ক্রমবর্ধমান বন্ধুত্বেরই চূড়ান্ত ফল। রাষ্ট্রদ্বয় বিভিন্ন রাজনৈতিক পদ্ধতির অনুসারী হলেও বিশ্বশান্তি, স্বাধীনতা এবং নব জাগ্রত রাষ্ট্রগুলির আর্থিক প্রগতির প্রশ্নে ভারত ও রাশিয়ার লক্ষ্য এক এবং অভিন্ন।

শ্রী চ্যাবন বলেন, সমগ্র দেশ এই চুক্তিকে অভিনন্দন জানিয়েছে, সংসদে বিপুল সংখ্যক সদস্য সমর্থন জানিয়েছেন। কিছু লোক এই চুক্তির বিরূপ সমালোচনা ও করেছেন। তবে এসব ব্যক্তি সরকারের সমস্ত প্রচেষ্টারই সমালোচনা করতে অভ্যস্ত। বিদেশেও দু-একটি ছাড়া (এরা হয়ত ভারতের প্রতি বেরীভাবাপন্ন) প্রধান প্রধান রাষ্ট্র সমেত সবাই এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে। সর্বশেষ সংবাদ অনুযায়ী চীন ও এই চুক্তি ‘কল্যাণকর’ দিক অনুধাবন করতে রাজি বলে শ্রী চ্যাবন উল্লেখ করেন।
অর্থমন্ত্রী বলেন, এ চুক্তি কেবল ভারতের সুবিধার জন্যই নয়, এতে অন্য দেশের অধিবাসীরাও উপকৃত হবেন। ভারতের মত রাশিয়ার জনগণও এই চুক্তিকে বিপুল ভাবে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এই চুক্তির ফলে ভারতের গোষ্ঠীনিরপেক্ষ নীতির কোনই তারতম্য হবে না। অথচ বিরূপ সমালোচকরা বলেছেন এই চুক্তি ভারতের গোষ্ঠী-নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির অবসান ঘটাবে।
ঐতিহ্য অনুসারে বন্দেমাতরম সঙ্গীত সহযোগে আজ বিকেলে নিখিল ভার কংগ্রেস (শো) কমিটির তিনদিনব্যাপী অধিবেশনের উদ্বোধ্ন হয়।

সুসজ্জিত মঞ্চের ওপর কংগ্রেস সভাপতি শ্রী ডি সঞ্জীবায়া, প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, শ্রী জীবন রাম, উমাশঙ্কর দীক্ষিত, যশোবন্তরা ও চ্যাবন, ব্রক্ষ্মনান্দ রেডডি এবং মোহনলাল সুখাড়িয়া সমেত ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যরা উপবিষ্ট ছিলেন।

মঞ্চের পিছন দিকের প্রাচীরে পুষ্পশোভিত মহাত্মা গান্ধীর ছবির দুপাশে দুই প্রাক্তন নেতা পরলোকগত প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও লালবাহাদুর শাস্ত্রীর ছবি রাখা হয়।

সাগরতল থেকে ছ হাজার ফুট উঁচুতে সবুজ বনানীতে ঘেরা এই পার্বত্য অধিত্যকায় প্রায় দু হাজার দর্শকের উপযোগী প্যান্ডাল অধিবেশনের উদ্বোধনকালে পরিপূর্ণ ছিল। বহু দর্শক বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে অধিবেশনের গতিপ্রগতি স্থির মনোযোগে লক্ষ্য করেন।

বালিকার দল জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার জন্য মাইকের সামনে আসার সময়ও একদল সাধারণ ও মুভিক্যামেরাম্যান মঞ্চে সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী প্রমুখের চাবি নিতে থাকেন।

উদ্বোধনী সঙ্গীতের পর একটি দল চিরাচরিত পোষাক পরা হিমাচল প্রদেশের একদল যুবক ও যুবতী এই রাজ্যের সুখসৌন্দর্য বর্ণনাগীতি গেয়ে শোনান।

স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা,
ইউ এন আই জানাচ্ছেন, অধিবেশনের শুরুতে পরলোকগত স্বাধীনতা সংগ্রামী ডঃ সৈয়দ মাহমুদ ও বিনোদানন্দ ঝারের উদ্দেশ্যে শোক প্রকাশ করা হয়।

সাধারণ সচিব ডঃ শঙ্করদয়াল শর্মা শোক প্রস্তাব আনার পর প্রতিনিধিরা দু মিনিট শোকস্তবদ্ধতা পালন করেন।

পরলোকগত সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিহারের কংগ্রেস নেতা এম পি সিংহের স্মৃতির প্রতিও শ্রদ্ধা জানান হয়।

সভাপতির ভাষণ,
অধিবেশনের উদ্বোধন করে সভাপতি শ্রী সঞ্জীবায়াও ভারত-রুশ চুক্তির কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এই চুক্তি সত্ত্বেও আমরা আমাদের গোষ্ঠী নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করে যাব। আমরা অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গেও এই ধরনের চুক্তিতে আবদ্ধ হতে চাই শ্রীমতি গান্ধী যে গত মাসে নানা কাজে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও রাশিয়া সফর করতে পেরেছেন তাতে সুফল ফলেছে।

বাংলাদেশ সম্পর্কে রূশ প্রধানমন্ত্রী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় রাজনৈতিক সমাধানের দাবী ঘোষণা করেছেন। বর্তমানে ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে খুব ঘনিষ্ঠ প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। দেশের সমস্যা সম্পর্কে শ্রী সঞ্জীবায়া বলেন, বন্যা নিরোধের জন্য সরকারকে স্থায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। জনগণের সমস্যার প্রতি কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে সজাগ করার দায়িত্ব নেবার জন্য তিনি কংগ্রেস কর্মীদের প্রতি আহবান জানান।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৭৭। ইয়াহিয়ার শিখণ্ডীরা পূর্ব বাঙলার নির্বাচন সম্পর্কে নিশ্চিত নয় পেট্রিয়ট ৫ অক্টোবর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ৩৭৭, ৯০১-৯০২>

পেট্রিয়ট, ৫ অক্টোবর ১৯৭১
ইয়াহিয়ার শিখণ্ডীরা পূর্ব বাঙলার নির্বাচন সম্পর্কে নিশ্চিত নয়

ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি পরিকল্পনা ঘোষণা করে জেনারেল ইয়াহিয়া খান এখন তার উপর বসে আছেন। তিনি বলেছেন যে পূর্ববাংলার জাতীয় পরিষদের ৭৯ টি আসনের নির্বাচন ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হবে।

মনোনয়নপত্র দাখিল এবং নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার দুই মাসের মধ্যে এই ফাঁকির কারণ হিসেবে বলা হয়েছে এটি নতুন নির্বাচনী আইন তৈরির জন্য প্রয়োজন। জনাব ভুট্টো ইতোমধ্যে অভিযোগ করেছেন যে নতুন ভোটার তালিকার প্রস্তুতির প্রেক্ষিতে “প্রগতিশীল ও দেশপ্রেমিক ভোটার তালিকা থেকে বাদ যেতে পারে”। যে কোনো ক্ষেত্রে, তালিকা শুধুমাত্র একটি একাডেমিক আগ্রহের ব্যাআপ্র হতে পারে।

জান্তা শুধুমাত্র নিশ্চিত হতে চায় যে তার নিজের লোকেরা “নির্বাচিত” হয়েছে। নির্বাচনের বলবিজ্ঞানের বিষয়ে বা তাদের ন্যায্যতা বা স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বা এগুলোর উপর কোন আলোচনা বর্তমান পরিস্থিতিতে অনুপস্থিত। জামাত-ই-ইসলামির মতো একটি স্টুডিও পার্টিও মনে করে না যে, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।

অসম্ভব
পূর্ববাংলার জামাত-ই-ইসলামির প্রধান গোলাম আযম বলে যে, আগামী ছয় মাসের মধ্যে কোন নির্বাচনী ইঞ্জিনিয়ারিং বা রাজনৈতিক কার্যক্রম করা অসম্ভব হতে পারে।

দৃশ্যত শাসকগোষ্ঠী এই অসুবিধা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন বলে মনে হয়। তাই পুতুল গভর্নর ড এ এম মালিকের কথা উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে যে, “সময়সূচী অনুযায়ী নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য সরকার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে সে সম্পর্কে কেউ নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারে না যে এটা সময়ের মধ্যেই হবে। “

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের দ্বারা লক্ষ্য করা যায় এমন আরেকটি সঙ্কটও এখানে রয়েছে। এই বক্তব্যের অর্থ এই যে, খুব শীঘ্রই বাংলাদেশে আরো অনেক বেশি উপনির্বাচন প্রয়োজন হতে পারে। পাকিস্তান টাইমস, লাহোর এবং পাকিস্তান অবজারভার, ঢাকার, মত কাগজপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির ৮৮ জন সদস্যের মধ্যে খুব কম সংখ্যক লোক সরকার কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছে এবং তারা এই শাসকের প্রতি তাদের আনুগত্য ঘোষণা করতে ইচ্ছুক।

পাকিস্তান টাইমসের একজন কলামিস্টের মতে, “পূর্ববাংলার সমগ্র অঞ্চলে নতুন নির্বাচন” প্রয়োজন। তবে, সরকারী যন্ত্র শুধুমাত্র ৭৯ টি আসনের জন্য উপনির্বাচনের জন্য নির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারণ করেছে, যা ইতিমধ্যেই খালি ঘোষণা করা হয়েছে। এর মানে হচ্ছে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি বা মার্চ নির্বাচনের প্রক্রিয়া প্রসারিত করা হবে।

জেনারেল ইয়াহিয়া খান ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছেন যে, যদি নির্বাচন শেষ না হয় তবে জাতীয় পরিষদের আসন পূরণ হবে না এবং ক্ষমতার হস্তান্তরের প্রশ্ন উঠবে না।

পাকিস্তানি পত্রিকা নওয়াবদ নাস্রুল্লাহ খানকে উদ্ধৃত করে বলেছে যে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি সহানুভূতি ও সমর্থন পূর্ববাংলাতে চলমান সংকটের প্রধান কারণ। তাঁর মতে পূর্ববাংলাতে সমস্যা ঠেকাতে যদি একটি যৌক্তিক প্রচেষ্ট করা হতো তাহলে এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যেত।

অনুগত অভিযোগ
“কিন্তু জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রায়শই শক্তিশালী কিছু কাজ করে। বাংলাদেশে স্বাধীনতাকামী বাহিনীকে চূর্ণবিচূর্ণ করার চেষ্টা এখনও পর্যন্ত সফল হয়নি।”

পূর্ব বাংলার মৌলভি ফরিদ আহমেদ আরও একটি পদক্ষেপ এগিয়ে গেছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন যে “পশ্চিম পাকিস্তানের শক্তিশালী দলগুলো পূর্ববাংলার আওয়ামী লীগের বিদ্রোহকে সহায়তা করছে।” মৌলভী ফরিদ আহমেদ যাকে পাকিস্তানের সামরিক শাসক পাকিস্তান শান্তি ও কল্যাণ বিষয়ক কাউন্সিলের সভাপতি করেছে। এটি পাকিস্তানের প্রো-মিলিটারি পত্রিকা লাহোর ইমরোজ এবং জাং অব করাচির মত পত্রিকায় এসেছে। তিনি বলেছেন যে পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটেছে তা নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে তীব্র উত্তেজনা দেখা দিতে পারে।

পূর্ববঙ্গে নিজাম-ই-ইসলাম পার্টির সভাপতিত্বকারী মৌলভি ফরিদ আহমেদ দাবি করেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানে বেশ কয়েকটি শক্তি আওয়ামী লীগকে আর্থিকভাবে, বস্তুগতভাবে অ নৈতিকভাবে সাহায্য সহায়তা করছে – সরকারের কাছে সত্যিকারের তথ্য রয়েছে। সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নেয়নি কারণ সে মনে করে তাতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যেতে পারে।

বাংলাদেশের অবস্থা সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে মৌলভি ফরিদ আহমেদ বলেন যে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। আওয়ামী লীগের প্রভাবের অধীন মুক্তিবাহিনীর হামলা বেড়েছে – সৈন্যবাহিনী বীরত্বপূর্ণ কাজ করা সত্ত্বেও প্রতিটি পদক্ষেপে জীবন ও সম্পত্তি বিপদের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

মৌলভি ফরিদ আহমেদ আরও বলেন যে গত কয়েক মাস ধরে শত শত প্রো-পাকিস্তানী “দেশপ্রেমিক “কে আওয়ামী লীগের গেরিলাদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে।

মৌলভী ফরিদ আহমেদ এর বিবৃতি দুটি কারণে কারণে তাত্পর্য বলে অনুমান করা যায়। প্রথমত, এটি বাংলাদেশের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের মহান সহানুভূতি প্রকাশ করে। এটি সরকারের শাসনের দাবি মিথ্যা বলে দেয় যে বাংলাদেশের সমস্যাটি “দুষ্কৃতিকারীদের” দ্বারা হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, মৌলভি ফরিদ আহমেদ পরিষ্কারভাবে স্বীকার করেছেন যে পূর্ববাংলার প্রতিরোধ আন্দোলন অনেক বেশি শক্তিশালী হচ্ছে এবং মুক্তিযোদ্ধারা শত শত সহযোগীকে (রাজাকার) টার্গেট করে তাদের নিষ্ঠুরতার লক্ষ্যে পরিণত করছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৭৮। রাশিয়া – আলজিরিয়া ও বাংলাদেশ (সম্পাদকীয়) আনন্দবাজার পত্রিকা ১৩ অক্টোবর ১৯৭১

Bashneen Faham
<১৪, ৩৭৮, ৯০৩-৯০৪>

সম্পাদকীয়
রাশিয়া-আলজিরিয়া ও বাংলাদেশ

প্রচলিত প্রবাদ-যখন রোমে থাকিবে তখন রোমদের মত আচরণ করিবে। সোভিয়েট প্রধানমন্ত্রী শ্রী কোসিগিনও কি অবশেষে সেই পরামর্শ গ্রহন করিলেন? আলজিরিয়া সফরের পর প্রেসিডেন্ট বুমেদিনের সঙ্গে তাঁহার যে যৌথ বিবৃতি প্রকাশিত হইয়াছে তাহা পড়িয়া সকলে হতবাক। এমন কি মস্কোর বেসরকারী মুখেও নাকি বিস্ময়ের চিহ্ন। যুক্তবিবৃতিতে বিশ্বরূপ দর্শন উপলক্ষে বাংলাদেশও উল্লিখিত। তবে “বাংলাদেশ” হিসাবে নয়। সেখানকার সাড়ে সাত কোটী মানুষেড় ন্যায্য লড়াই কিংবা ভারতে আগত নব্বই লক্ষ শরণার্থীর কথাও অনুল্লিখিত। বিবৃতি বয়ান অনুযায়ী বাংলাদেশ কার্যত ভারত আর পাকিস্তানের ব্যাপার! দুই রাষ্ট্রনেতার পরামর্শ- ভারত পাকিস্তানের উচিত তাসখন্দ আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া সমস্যার ফয়সালা করিয়া লওয়া। স্বাক্ষরকারীরা এমন কি “রাজনৈতিক সমাধানের” প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করা দরকার মনে করেন নাই। মাত্র কয় সপ্তাহ আগে প্রচারিত শ্রীমতি গান্ধী ও কোসিগিনের যুক্তবিবৃতি “প্রাভদার” ক্রুদ্ধ লেখালেখি, সমগ্র রাশিয়া-ব্যাপী গণ-আন্দোলন-এ সবের তবে অর্থ কি? সবই কি মায়া? কয় দিন আগে প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তসংসদীয় সম্মেলনে রূশপ্রতিনিধি নাকি অপ্রত্যাশিতভাবে সম্পূর্ণ বেসুরো গাহিয়াছিলেন। সিমলায় শ্রীচ্যবন ঘোষণা করিয়াছেন-এসব অপপ্রচার। রুশ-ভারত যুক্ত বিবৃতির পর অবান্তর কথায় কান না দেওয়াই ভাল। আলজিয়ার্স হইতে প্রচারিত বিবৃতিতে যিনি সহি করিয়াছেন তিনি কোনও সাধারণ রুশ-প্রতিনিধি নহে স্বয়ং কোসিগিন। এক দলিলে স্বাক্ষরের কালি শুকাইতে না-শুকাইতে সম্পূর্ণ অন্য ধরনের ঘোষণাপত্রে একই হাতে আবার স্বাক্ষর, ব্যাপারটা একটু বেসদৃশ বইকি। মস্কোস্থ ভারতীয় দূত নাকি রহস্যর কিনারা করার কাজে লাগিয়েছেন।

আলজিরিয়া বাংলাদেশ সম্পর্কে উদাসীন হইলে আমাদের কিছু বলার নাই। এমনকি বুমেদিনের সমাজতন্ত্রী সরকার পাকিস্তানের জঙ্গীশাহীর প্রতি দূর্বলতে দেখাইলেও সেটা আজ আর কাহারও কাছে বিস্ময়কর ঠেকে না। সত্য, আলজিরিয়ার মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা আছে, এবং একথাও সর্বজনবিদিত সেই লড়াইয়ে ভারত ছিল আগাগোড়া আন্তরিক সমর্থক। কিন্তু তাহাতে বিশেষ কিছু আসে যায় না আলজিরিয়া সমেত অন্যান্য আরব রাষ্ট্রের মতিগতি ইতিমধ্যেই বোধ হয় তাহা জানাইয়া দিয়াছে। সনাতনপন্থী গোঁড়া ঐশ্লোমিক ভ্রাতৃত্বে বিশ্বাসী রাষ্ট্রগুলির কথা বাদই দেওয়া যাক। রাষ্ট্রপুঞ্জে পাকিস্তানের পক্ষে সওয়ালকারী যদি মরক্কো, প্যারিস সম্মেলনে তবে-টিউনিসিয়। পাকিস্তানের প্রতি সৌদি আরব বা ইরানের ভালবাসা আরও গভীর। কিন্তু অন্যদিকে তথাকথিত প্রগতিশিল আরব রাষ্ট্রগুলিই বা কোন ভূমিকায়? উদ্বাস্তু সমস্যা সম্পর্কে তাঁহারা ওয়াকিবহাল, প্যালেস্টাইনের শরণার্থীরা এখনও নানা দেশের শিরঃপীড়া। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল বলিয়া বর্ণিত রাষ্ট্রগুলিও যে এখনও মৌন অথবা নিস্পৃহ তাহার পিছনে একাধিক কারণ থাকা সম্ভব। সমাজতন্ত্রী অথবা রাজতন্ত্রী, কোন মুসলিম রাষ্ট্রই নাকি চায় না বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান দ্বিখন্ডিত হোক, এবং তাহার ফলে একটি “অমুসলিম রাষ্ট্র” ভারতের কোনও রাজনৈতিক সুবিধা হোক। দ্বিতীয়ত, গণতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র ইত্যাদির মধ্যে যে বিপুল ফারাক বর্তমান, আরব দুনিয়ার রাজনৈতিক ঐতিহ্যের পটভূমিতে সেটা এখনও সকলের কাছে যথেষ্ট স্পষ্ট নয়। তৃতীয়ত, অনেকেরই চোখের সামনে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমস্যা রহিয়াছে, ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তাঁদের কাহারও কাহারও চোখে সে চেহারা লইয়াই ফুটিয়া উঠিয়াছে। চতুর্থত, বাংলাদেশ বহু দূর! সুতরাং বুমেদিন বা কোনও আরব নেতা যদি একটি ঐতিহাসিক স্বাধীনতা সংগ্রামকে অন্যভাবে গ্রহণ করতে চাহেন তবে আমাদের বলার কিছু নাই। কিন্তু রাশীয়ার পক্ষে, তাঁহার অভিমতে সায় দেওয়া সম্ভব হইল কী করিয়া? বিশেষত, শ্রীমতী গান্ধীর মস্কো সফরের পরে। মস্কো দলিল কিন্তু “রাজনৈতিক মীমাংসা”, শরণার্থী সমস্যা সবই উল্লিখিত আলোচিত।

হইতে পারে রুশ প্রধানমন্ত্রী আলজিরিয়ার চাপে এই বিবৃতিতে সম্মত হইয়াছেন। হইতে পারে আফ্রিকার ঐ খন্ডে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষার চেয়ে অন্য স্বার্থ তাঁহারর কাছে মূল্যবান ঠেকিয়াছে। কিন্তু এ ধরনের কুটনীতি নীতি হিসাবে কি শ্রেয়? এখন টীকাভাষ্যযোগে হয়তো প্রমাণ করা হইবে-ভারত-রুশ চুক্তি বা ইন্দিরা-কোসিগিন যুক্তবিবৃতির ধারাবাহিকতা ইহাতে ক্ষুন্ন হয় নাই, এই উপমহাদেশকে যুদ্ধের বিপদ হইতে মুক্ত রাখিবার জন্যই দুই বন্ধু রাষ্ট্র কোদালকে কোদাল না বলিয়া অন্য কথা পাড়িয়াছেন। তাহাতে রুশ-ভারত বন্ধুত্বে প্রশ্নবোধক চিহ্নটি হয়তো লুপ্ত হইবে, কিন্তু ইত্যবসরে ইয়াহিয়া খানের যে বিস্তার সুবিধা হইয়া গেল তাহাতে সন্দেহ না-রাখাই ভাল। শোনা যাইতেছে, তিনি মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসন মিটাইয়া আনিয়াছেন। তিনিই আইন প্রণেতা, তিনিই বিচারক। তা ছাড়া আগেভাগেই তিনি জানাইয়া রাখিয়াছেন-মুজিবুর দেশদ্রোহী এবং মৃত্যুদন্ডই তাঁহার প্রাপ্য। ইয়াহিয়া হয়তো এই মুহূর্তে সে দন্ড মিটাইয়া দিবেন না, আপাতত করুণাময়ের ভূমিকা গ্রহণ করিবেন। তাঁহার এবং জনাব ভুট্টোর চালচলন ইঙ্গিতে বলিতেছে পাকিস্তান বাংলাদেশকে হাতে রাখিবার জন্য চূড়ান্ত চেষ্টা চালাইবে। সে-কাজে তাঁহাদের সমর্থক প্রয়োজন। খানসাহেব নাকি প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে গোপনে চিঠি লিখিয়াছেন। আলজিয়ার্স বিবৃতির পর এবার তিনি ইচ্ছা করিলে প্রকাশ্যেই রুশ প্রধানমন্ত্রীকেও চিঠি লিখিতে পারেন। কেননা, বিবৃতিতে পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার জন্যও উদ্বেগ প্রকাশ করা হইয়াছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৭৯। স্বীকৃতির দাবিতে চাই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন (সম্পাদকীয়) বাংলাদেশ ১৫ অক্টোবর ১৯৭১

Bashneen Faham
<১৪, ৩৭৯, ৯০৫-৯০৬>

সম্পাদকীয়
স্বীকৃতির দাবীতে চাই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন

বাংলাদেশের স্বীকৃতির পরিবর্তে শাসক কংগ্রেসের নেতারা তথাকথিত রাজনৈতিক সমাধানের দিকে ঝুঁকিতেছে, এ সংবাদ আমরাই বাংলাদেশে প্রথম করিয়াছিলাম। কিন্তু এক্ষণে সিমলায় নব কংগ্রেসের সদ্য অনুষ্ঠিত অধিবেশনে বহিবিষকমন্ত্রী শ্রী শরণ সিং যে বিবৃতি দিয়াছেন তাকে এককথায় বলা যায় বাংলাদেশের মুক্তি-সংগ্রামের প্রতি বেঈমানী। আজকের পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যেই বাংলাদেশ সমস্যার মীমাংসার কথা উচ্চারণ করাটাই অন্যায় এবং পাপ। যে পাকিস্তান বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটী মানুষের বিরুদ্ধে ইতিহাসের জঘণ্যতম গণহত্যার অভিযান শুরু করিয়াছে এবং এক্ষণে যে পাকিস্তানী শাসকচক্র সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ ও সীমান্ত আক্রমণের প্ররোচনার দ্বারা ভারতের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধের হুংকার দিতেছে, সেই বর্বর পাকিস্তানের হিংস্র নেকড়েদের হাতে বাংলাদেশের ভাগ্যকে সাঁপিয়া দেওয়ার কথা আজ চিন্তাও করা যায় না। তাই আজ ইয়াহিয়ার ফ্যাসিষ্ট শাসন ও শোষোণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামকে সব রকমের সাহায্য এবং সহযোগিতার দ্বারা সফল করিয়া তোলাই প্রতিটি ভারতবাসীর একমাত্র পবিত্র কর্তব্য। বাংলাদেশের মুক্তি-সংগ্রামে ভারতীয় জনগণের এই ইচ্ছা এবং আকাঙ্খাকে ভারত সরকার বাস্তবক্ষেত্রে কার্যকরী রূপদান করিবেন, এইটাই সকলে প্রত্যাশা করে। তাছাড়াও লোকসভা থেকে শুরু করিয়া পশ্চিমবঙ্গের ভেঙ্গে দেওয়া বিধানসভাতেও বাংলাদেশের সংগ্রামের প্রতি সর্বাত্মক সাহায্যদানের জন্য দলমত নির্বিশেষে যে কনসেনসাস বা ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, ভারত সরকার এখনও জনমতের সেই ঐতিহাসিক অভিব্যক্তিকে কেন এবং কার স্বার্থে রূপায়িত করিতেছেন না, চারিদিকে আজ এই প্রশ্নই আলোচিত এবং আলোড়িত হইতেছে। দেখিয়া শুনিয়া অনেকের মনে হইবে, ভারত সরকার যেন তার আগের অবস্থান থেকে অনেকটা পিছাইয়া আসিয়াছে এবং বাংলাদেশ সমস্যা মানেই হইতেছে উদ্বাস্তু সমস্যা এবং এই উদ্বাস্তুর বোঝা ভারতবর্ষের ঘাড় থেকে নামিয়া গেলেই নাকি ল্যাঠা চুকিয়া যাইবে, প্রধানমন্ত্রী তো এমন কথা খোলাখুলিই বলিতেছেন। অবশ্য এ ব্যাপারে বৃহৎ শক্তিগুলির মনোভাবও অত্যন্ত সুবিধাবাদী এবং তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই যে যারা নিজের স্বার্থকেই বড় করিয়া দেখিতেছেন। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের গণতান্ত্রিক এবং মানবিক অধিকারের প্রশ্নটা তাঁদের কাছে গৌণ।

তাছাড়া যেসব দেশ বাংলাদেশের মুক্তি-সংগ্রামকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখিতেছেন তাঁরাও অনেকেই পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতবর্ষ কি করে তাই লক্ষ্য করিতেছেন। কারণ ভারত যেখানে এই ব্যাপারে প্রত্যক্ষ শিকার, অর্থাৎ যখন ভারতে প্রায় এক কোটি উদ্বাস্তুর বোঝা আসিয়া পড়িয়াছে তখন ভারতই সর্বপ্রথম বাংলাদেশের সংগ্রামকে স্বীকৃতি দিবে ইহাই তো স্বাভাবিক।। তাই ভারতকে স্বীকৃতি দিতে ইতস্তত করিতে দেখিয়া অন্যান্য সহানুভূতিশীল দেশগুলিও একটু থমকাইয়া দাঁড়াইয়াছেন এবং হয়ত ভাবিতেছেন, তা হইলে ব্যাপারটা কি? ভারত নিজেই গড়িমসি করিতেছেন কেন?
স্বয়ং শ্রী শরণ সিং সর্বশেষ যে বক্তৃতা দিয়াছেন এবং নব কংগ্রেস নেতারা ক্রমেই বাংলাদেশ প্রশ্নে যেভাবে ডিগবাজী খাইতেছেন, তাতে আমাদেরও সন্দেহ হইতেছে যে, শেষ পর্যন্ত ভারত সরকারের ভূমিকা এ-ব্যাপারে হয়ত চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতায় পর্যবসিত হইবে। বিশেষত পূর্ব বাংলার মুক্তি সংগ্রাম যখন আগের চেয়েও আরও অনেক দানা বাঁধিয়া উঠিতেছে, তখন ভারত সরকারের স্বীকৃতিদানে ক্রমেই পশ্চাদপসরণ মুক্তি-যোদ্ধাদের মনোবলকে দুর্বল করিয়া দিতে উদ্যত হইয়াছে। সুতরাং এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গে দলমত নির্বিশেষে ভারতের সমস্ত গণতান্ত্রিক মানুষের আশু কর্তব্য, ভারত সরকারের উপর জোরালো আন্দোলনের চাপ সৃষ্টি করিয়া বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য করা। কারণ, নব কংগ্রেসের নেতাদের হাবভাব এবং কথাবার্তার ধরন-ধারণ দেখিয়া আমাদের আরও সন্দেহ হইতেছে যে,’বাংলাদেশ’ ইস্যুটাকে এখন তাঁরা ভারতবর্ষের অভ্যন্তরেই নিজেদের সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগাইবার মতলবে আছেন। যেমন, একদিকে উদ্বাস্তুদের জন্য সারা বিশ্বের সম্মুখে কাসুনি গাহিয়া রিলিফ সংগ্রহ করা হইবে আর অন্যদিকে উদ্বাস্তুদের শিখন্ডী করিয়া পশ্চিমবঙ্গে গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে পন্ড করিয়া দেওয়া হইবে। শুধু তাই নয়, গরিবী হটাওর ব্যর্থতা, মূল্যবোধ বা অন্য যে-কোন অর্থনৈতিক সমস্যার জন্য যখন বিরোধী দলগুলী, ইন্দীরা গান্ধীর সমালোচনা করিবেন তখনই ভারতবাসীর যা কিছু দুঃখ কষ্ট সব অনর্থের মূল হিসাবে উদ্বাস্তুদের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখাইয়া দাওয়া হইবে। তা না হইলে শরণ সিংয়ের মুখে ‘রাজনৈতিক সমাধানের’ গীত শোনা যায় কেন? কারন যে কোন মূর্খও জানে যে, বাংলাদেশের মুক্তি বা স্বাধিনতা না আসিলে একজন শরণার্থীরাও পাকিস্তানের ফ্যাসিস্ট খাঁচায় বা কাঠামোর মধ্যে ফিরিয়া যাইবে না। সুতরাং উদ্বাস্তুদের দেশে ফেরৎ পাঠানোটাও যদি ভারত সরকারের গরজ হইত, তবে, তাঁরা সর্বাগ্রে সেই পরিবেশ সৃষ্টির দিকেই ঝুঁকিতেন অর্থাৎ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতেন। কিন্তু এখনও তেমন কোন পদক্ষেপের নমুনাই তো আমরা দেখিতাছি না। অতএব উদ্বাস্তুদের দেশে ফেরত যাওয়া সম্বন্ধে ভারত সরকারের উদ্বেগও যে কতখানি আন্তরিক, সে বিষয়ে গভীর সন্দেহ সৃষ্টি হইতেছে না কি? বিশেষত যখন শোনা যাইতেছে যে, বাংলাদেশে উদ্বাস্তুদের শিখন্ডী করিয়া ‘গরিবী হটাও’ এর প্রধানমন্ত্রী আগামী বাজেটে আরও ৫০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত ট্যাক্সের বোঝা চাপাইতে উদ্যত হইতেছেন তখন বাংলাদেশের উদ্বাস্তুরাই শুধু নন, ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষেরও যে প্রাণান্তকর অবস্থা সৃষ্টি হইবে তাতে আর সন্দেহ কি?

সুতরাং এই পরিস্থিতিতে আমরা ভারতবর্ষের, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত বামপন্থী এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলির উদ্দেশ্যে পুনরায় সনির্বন্ধভাবে এই অনুরোধ জানাইতেছি, যে অবিলম্বে বাংলাদেশের স্বীকৃতির সমর্থনে আপনারা ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়িয়া তুলুন, কারণ, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে আমাদের স্বার্থও (যেখানে অধিকাংশ উদ্বাস্তুই পশ্চিমবঙ্গের ঘাড়ের উপর) আঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় যদি আজ কোনরকমে বিনষ্ট হয়, তবে শুধু বাংলাদেশ নয়, প্রতিবেশী দেশরূপে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিও তার সমস্ত জনজীবনের ভবিষ্যতও বঙ্গোপসাগরের অতল জলে তলাইয়া যাইবে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৮০। পূর্ব পাকিস্তানে উপনির্বাচন দি হিন্দু ২৭ অক্টোবর ১৯৭১

Hasan Mahmud
<১৪, ৩৮০, ৯০৭>

দি হিন্দু
২৭ অক্টোবর ১৯৭১
পূর্ব পাকিস্তানে উপনির্বাচন
সম্পাদকীয়

সম্প্রতি ঢাকা থেকে ঘুরে এসে এক বৃটিশ সাংবাদিক তাঁর নিবন্ধে লিখেছেন, “দেশের ৯০% এর বেশী জায়গায় নিরাপত্তা এতই অনিশ্চিত যে নির্বাচনের কথা চিন্তাও করা যায় না”। তিনি এও বলেছেন, দু’মাস আগেও রাতে ঢাকার বাইরে ড্রাইভ করে যাওয়া যেত কিন্তু এখন সেটা অত্যন্ত বিপদজনক এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনী থাকা সত্তেও ঢাকায় নির্বাচনী প্রচারনা চালানো অসম্ভব। কিভাবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কেন্দ্রে ৭৮টি এবং পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৪ টি আসনে নির্বাচনের প্রস্তাব করেছেন? জানা গেছে যে হতে যাওয়া ওই দুই নির্বাচনে প্রচুর প্রার্থী দাঁড়িয়েছেন। এর মধ্যে পাকিস্তানী রেডিও বলেছে যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ১৫ জন প্রার্থী আপাত:দৃষ্টিতে কেন্দ্রীয় আসনে নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে আছেন পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির ৫ জন, জামাতে ইসলামির ৫ জন, কনভেনশন মুসলিম লীগ থেকে ২ জন, নিজামে ইসলাম থেকে ২ জন ও পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাইয়ূম দল) থেকে ১ জন।

এ তথ্য যদি সত্যি হয় তবে ধরে নিতে হবে যে, গত নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে পরাজিত দলের প্রার্থীরা এবারে তাঁদের অঞ্চলে নির্বাচনী প্রচারের কষ্ট না করে ও বিরোধী প্রার্থী ছাড়াই নির্বাচিত হবেন।

ঢাকায় আওয়ামী লীগের মধ্যপন্থী নেতাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা যায় কিনা সে ব্যাপারে মি. ভুট্টোর পিপলস পার্টি প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলো, সে বিষয়ে আর কোন খবর পাওয়া যায়নি। কেন্দ্র ও প্রাদেশিক পরিষদের খালি হয়ে যাওয়া আসনগুলো পূর্ণ করতে জেনারেল ইয়াহিয়া হয়তো এই সুবিধাজনক পথ অবলম্বন করবেন; কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোকে মানিয়ে নিতে অনেক সমস্যা হবে। মুসলিম লীগের ভেঙ্গে যাওয়া তিন দলকে একত্রিত হতে হবে, ভুট্টোর পিপলস পার্টির “বিপ্লবী” কর্ম-পরিকল্পনা এখনো জামাতের মতো রক্ষণশীল দলকে ক্রুদ্ধ করছে, এবং কেন্দ্রীয় পরিষদের অধিবেশন করাটা পশ্চিম পাকিস্তানে নিরাপদ হলেও ঢাকায় প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন সহজ হবেনা। পাকিস্তান সরকার নিঃসন্দেহে ধরে নিয়েছে যে আজ বা কাল পূর্ব পাকিস্তানের বিরোধী শক্তি স্তিমিত হয়ে আসবে এবং জনগন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন মেনে নেবে যা তারা এতোগুলো বছর করেছে।

কিন্তু আসলে মুক্তি বাহিনীর আঘাত করার শক্তি বাড়ছে বই কমছে না। কিছু বিশ্লেষকের মতে বর্ষা শেষ হবার সাথে সাথে এক নূতন পরিস্থিতি হয়েছে যেখানে বড়ো শহরগুলো ও বিমান-বন্দরে যুদ্ধ হবার সম্ভাবনাই বেশী। সামরিক এই যুদ্ধের পরিস্থিতিতে গঠনতন্ত্র বানানোর পরিকল্পনা অপরিপক্ক ও নিরর্থক। এটা কিছুটা অর্থবহ হতে পারে যদি জেনারেল ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানের বন্দী নেতার সাথে কথা বলেন।
সম্পাদকীয়
দি হিন্দু মাদ্রাজ

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৮১। পাক হাই কমিশনের অধিকাংশ বাঙ্গালী কর্মচারির পলায়ন হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড
০৩ নভেম্বর ১৯৭১

Hasan Mahmud
<১৪, ৩৮১, ৯০৮-৯০৯>

হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড
নয়াদিল্লী ০৩ নভেম্বর ১৯৭১
পাক হাইকমিশনের বেশির ভাগ কর্মচারী স্বাধীনতার জন্য পলায়ন
বিশেষ সংবাদদাতা
নয়াদিল্লী – ০২ নভেম্বর।

১১ জন বাঙ্গালী কর্মচারীর ১০ জন পরিবার সহ বেরিয়ে এসেছেন এখানকার পাকিস্তানী হাই কমিশন থেকে, যেটাকে বাংলাদেশী মিশনের প্রধান “কশাইখানা” বলে থাকেন। যিনি বেরিয়ে আসতে পারেন নি তিনি হলেন মি. হোসেন আলী যিনি ভারতে পাকিস্তানী গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান মি. আব্দুল গনির ব্যক্তিগত সহকারী। যখন তিনি বেরিয়ে যাবার জন্য প্রধান ফটকের কাছে পৌঁছেছিলেন তখন তাকে পশ্চিম পাকিস্তানীরা নিষ্ঠুর ভাবে প্রহার করে ও টেনে হিঁচড়ে ভেতরে নিয়ে যায়। মি. হোসেন আলী অচেতন হয়ে পড়ে ছিলেন পাকিস্তানী হাই কমিশনের ভেতরে, তার পাশে ছিলেন তার স্ত্রী ও তিন কন্যা, তাঁর দুটি তরুণ পুত্র অন্যদের সাথে বেরিয়ে এসেছিল। ভেতরে আরো আটকে ছিলেন পাকিস্তানী এয়ার এডভাইজারের ব্যাক্তিগত সহকারী মি. খলিলুদ্দিনের স্ত্রী তাঁর দুই কন্যা ও একটি শিশুপুত্র সহ। প্রায় দুই ঘণ্টা পরে অনুমতি পেয়ে তিনি বেরিয়ে এসে স্বামী ও দুই পুত্রের সাথে মিলিত হন যারা আগেই বেরিয়ে এসেছিলেন।

যখন বাঙ্গালী কর্মচারীরা সামান্য যা কিছু আনতে পেরেছিলেন তাই নিয়ে পাকিস্তানী হাই কমিশনের বাইরে রাস্তায় বসে ছিলেন এ খবর পেয়ে বাংলাদেশ মিশনের প্রধান এইচ. আর. চৌধুরী তাঁর দুই সহকর্মী মি. কে এম সাহাবুদ্দিন ও মি. আমজাদুল হক-কে সাথে নিয়ে ছুটে এসেছিলেন, তখন পাকিস্তানী হাই কমিশনের ভেতর থেকে পাকিস্তানীরা ইঁট-পাটকেল ছোঁড়া শুরু করে। দেশি-বিদেশী সাংবাদিক ও পুলিশের সাহায্যে মি. চৌধুরী সেই ইঁট -পাটকেল বর্ষণ থেকে নারী ও শিশুদেরকে নিরাপদ জায়গায় পাঠিয়ে দেন। তাঁরা ফটকের কাছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তাঁদের জিনিসপত্র তুলে নিয়ে যান।

পুরো নাটকের শুরু হয় ভোর বেলায় যখন কমিশনের বাঙ্গালী কর্মচারীরা পরিবার পরিজন সহ ফটকের কাছে জড়ো হন। নীচু দেয়াল পেরুনোর আগেই পাকিস্তানী গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান মি. আব্দুল গনির উপদেষ্টা ক্যাপ্টেন আজিম দাউদপতা এবং কাশ্মিরে পাকিস্তানী সন্ত্রাসের দায়িত্বে থাকা ফার্স্ট সেক্রেটারী মি. আহমেদ জাবিদ শাহ তাঁদের নিষ্ঠুর ভাবে প্রহার করতে শুরু করে। কিছু কিছু বাঙ্গালী দেয়াল টপকে বেরিয়ে এসে “জয় বাংলা” বলে চিৎকার করতে থাকেন। অন্যরা তাঁদের সন্তানদেরকে দেয়ালের এপারে ছুঁড়ে দেন। এর মধ্যে চিৎকারে আকৃষ্ট হয়ে কিছু পুলিশ ফটকের কাছে জড়ো হন। তখন পাকিস্তানীরা ফটক খুলে বাঙ্গালীদেকে বাইরে আসতে দেয়। কিন্তু মি. হোসেন আলীকে এতই প্রহার করা হয়েছিলো যে তিনি বাইরে আসতে পারেন নি। অন্য বাঙ্গালীরা অভিযোগ করে যে মি. হোসেন আলীকে টেনে হিঁচড়ে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয় ও একটি কক্ষে অচেতন অবস্থায় ফেলে রাখা হয়। লোক-গননা শেষ হলে দেখা যায় যে মি. হোসেন আলীর পরিবারের সাথে দুই কন্যা ও এক পুত্র সহ মি. খলিলুদ্দিনের স্ত্রীও বেরিয়ে আসতে পারেন নি।

মি. এইচ আর চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন যে পাকিস্তানী হাইকমিশনের সমস্ত বাঙ্গালী কর্মচারীরা গত কয়েক মাস থেকেই বাংলাদেশ সরকারে যোগ দিতে চাইছিলেন। কিন্তু তাঁদের জোর করে পাকিস্তানী হাইকমিশনের ভিতরে ধরে রাখা হয়। কিছু বাঙ্গালী কর্মচারীরা বেরিয়ে গেলে হাইকমিশনার সমস্ত নিষেধ তুলে নেন ও যাঁরা ইচ্ছে করে তাঁদেরকে পরিবার সহ বেরিয়ে যাবার অনুমতি দেন। মি. চৌধুরী বলেন, এই সিদ্ধান্ত তাঁর উপস্থিতিতেই নেয়া হয়েছিলো যখন তিনি হাই কমিশনের সাথে বোঝাপড়া করেছিলেন, ওই আদেশে তাঁর দস্তখত দেয়া হয়েছিলো। মি. চৌধুরী বলেন ভারত-সরকারকেও পাকিস্তানী হাইকমিশন এই ধারণাই দিয়েছে।

মনে হয় বাঙ্গালিরা এই আদেশ আক্ষরিক অর্থে নিক সেটা পাকিস্তানের হাইকমিশন চায় নি। যখন বাঙ্গালী কর্মচারীরা বলেছে তারা বাংলাদেশ সরকারে যোগ দিতে যাচ্ছে তখন পশ্চিম পাকিস্তানীরা তাদেরকে নির্মমভাবে প্রহার করতে শুরু করে। কিছু কর্মচারীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। মি. হোসেন আলী তখনো হাই কমিশনের ভেতরে ছিলেন, তার দুই পুত্র ও অন্যান্য বাঙ্গালী যাঁরা বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন, তাঁরা হাইকমিশনের সামনে রাস্তায় সর্বক্ষণ অবস্থান ধর্মঘট করে হোসেন আলী ও তাঁর পরিবারের মুক্তি দাবী করতে থাকেন।

বাংলাদেশ মিশনের প্রধান পাকিস্তানীদেরকে এই মর্মে হুঁশিয়ারী দেন যে, যদি ৪৮ ঘন্টার মধ্যে মি. হোসেন আলীকে মুক্তি দেয়া না হয় তবে বাংলাদেশে একজন পশ্চিম পাকিস্তানীও মুক্তি বাহিনীর হাত থেকে নিরাপদ থাকবে না। বাঙ্গালী কর্মচারীরা চাণক্যপুর পুলিশ স্টেশনে হাই কমিশনের অ-কুটনীতিক কর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রহার করার অভিযোগ দাখিল করেন। আন্তর্জাতিক আইনে যে কোন হাই কমিশনের অ–কুটনীতিক কর্মচারীরা দেশের আইন মানতে বাধ্য থাকেন।

হাইকমিশন, যাকে বাঙ্গালীরা বলছেন পাকিস্তানী কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প, সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পর তাঁরা প্রথমেই জনগনের নির্বাচিত আইনসিদ্ধ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। তাঁদের ভাষায়, পাকিস্তান মৃত ও তার কবর হয়ে গিয়েছে। তাঁদের প্রায় সবাই নিশ্চিত করেছেন যে বাংলাদেশ মুক্তি বাহিনীর বর্তমান সাফল্যে হাই কমিশনের পশ্চিম পাকিস্তানী কর্মচারীদের মনোবল ভেঙ্গে পড়েছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৮২। পূর্ব বাঙলার শিশুদের বিক্ষোভ প্রদর্শন টাইমস অফ ইন্ডিয়া
০৪ নভেম্বর ১৯৭১

Hasan Mahmud
<১৪, ৩৮২, ৯১০-৯১১>

টাইমস অফ ইন্ডিয়া
০৪ নভেম্বর ১৯৭১
পূর্ব বাংলার ছেলেরা মানব বন্ধন করেছে
নয়াদিল্লী – নভেম্বর ৩
নিজস্ব প্রতিনিধি

ভারতে পাকিস্তান গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান মি. আব্দুল গনির ব্যাক্তিগত সহকারী মি. হোসেন আলীর দুই ছেলে আট বছরের মুরাদ ও ছয় বছরের মোর্শেদ পূর্ব বাংলার অন্যান্য ছেলেমেয়েদের সাথে পাকিস্তান হাইকমিশনের ফটকের সামনে মানব বন্ধন করে হাইকমিশনে বন্দী তাদের পিতা মাতার মুক্তি দাবী করেছে। গতকাল মি. হোসেন আলী বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন এবং হাইকমিশনের কর্মচারীরা তাকে প্রহার করে; তিনি এখনো অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন বলে জানা গেছে। ছোট্ট মোর্শেদের হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিলো – “আমাদের পিতা ও বোনকে মুক্তি দাও”। গতকাল যেসব কর্মচারী বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য দেখিয়েছেন তাঁদেরকে আজ হুমকি দিয়েছে পাকিস্তান আর্মি উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার গুলাম হাসান খান যখন সে সেখানে মুরাদ ও মোর্শেদের সাথে কথা বলতে এসেছিল। ব্রিগেডিয়ার গাড়ী চালিয়ে প্রধান ফটকের কাছে এসেছিল হাইকমিশনের পূর্বের কর্মচারীদের সাথে কথা বলতে। জানা গেছে, সে জিজ্ঞেস করেছিল- কমিশনের ফটকের বাইরে কি করছেন যখন মাত্র একদিন আগেই তাঁরা পাকিস্তানে যাবে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন।

পূর্বের কর্মচারীরা ব্রিগেডিয়ারকে বলেছেন তাঁরা তার সাথে কথা বলতে চান না; সে যেন নিজের কাজে ফিরে যায়। এর মধ্যে হাই কমিশনের আরো চারজন কর্মচারী ফটকের কাছে গিয়ে তাকে সাহায্য করার জন্য তার সাথে যোগ দেয়। পুলিশ অফিসারেরা তাদেরকে কোন ঘটনা না ঘটাতে এবং হাইকমিশনের ভেতরে থাকতে অনুরোধ
করলে তারা পুলিশের সাথে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। যখন তারা পুলিশকে গালাগালি শুরু করে তখন তাদেরকে ফিরে যেতে বলা হয়। জানা গেছে, ব্রিগেডিয়ার হাসান বাঙ্গালীদেরকে হুমকি দিয়ে বলেছেন যে তাঁরা যদি চলে না যান তাহলে “আমি তোমাদেরকে গুলি করে ফেলে দেবো – আমি একজন পাঠান”। এই ব্রিগেডিয়ার তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় মি. মুজিবুর রহমানকে ক্রস-একজামিন করেছিল।

বালিকাকে টানা-হ্যাঁচড়া
মি. হোসেন আলীর স্ত্রী ও তিন কন্যা হাই কমিশনের একটি কক্ষে বন্দী আছেন। তাঁর দুই ছেলে গতকাল হাই কমিশনের কিছু বাঙ্গালী কর্মচারিদের সাথে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়। বাঙ্গালীরা আশংকা করছেন যে কমিশনের ভেতরে পাকিস্তানী গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা হোসেন আলীকে খুন করতে পারে।

তাঁরা বলেছেন গতকাল মি. হোসেনের ১৫ বছরের কন্যা মায়া পালাবার চেষ্টা করলে হাইকমিশনের পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার মি. বাট তার চুল ধরে টেনে নিয়ে যায়। নয়াদিল্লীতে বাংলাদেশ মিশনের মুখপাত্র বলেছেন, মি. হোসেন আলী ও তার পরিবারকে মুক্তি দেবার যে আলটিমেটাম পাকিস্তানী হাইকমিশনার মি. সাজিদ হায়দারকে দেয়া হয়েছিল তার মেয়াদ আগামিকাল বেলা ১২টায় শেষ হবে। তার আগে যদি তিনি মুক্তি না পান তাহলে সমুচিত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৮৩। নিক্সনের সঙ্গে প্রধান মন্ত্রীর নাজুক আলোচনা শুরু হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড
০৫ নভেম্বর ১৯৭১

Hasan Mahmud
<১৪, ৩৮৩, ৯১২-৯১৩>

হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড
০৫ নভেম্বর ১৯৭১
নিক্সনের সাথে প্রধানমন্ত্রী গুরুত্বপূর্ন আলোচনা শুরু করেছেন

ওয়াশিংটন নভেম্বর ৪। ইউনাইটেড নিউজ অফ ইন্ডিয়া এবং প্রেস ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া জানিয়েছে, পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গণহত্যা সত্বেও ইসলামাবাদের সেনা-সরকারের প্রতি আমেরিকার সমর্থনের কারনে বিগত সময়ে ভারত-আমেরিকার মেঘাচ্ছন্ন সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে মিসেস গান্ধী আজ প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সাথে ভারত-আমেরিকার পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেন। হোয়াইট হাউসে স্বাগত: অনুষ্ঠানে দুই দেশের বন্ধুত্ব ও সাধারণ আদর্শ আবারো নিশ্চিত করে এই নেতা-নেত্রী তাদের গুরুত্বপূর্ন আলোচনা শুরু করেন।

মিসেস গান্ধী বলেন তিনি এসেছিলেন উপমহাদেশের বর্তমান সংকটকে গভীরতর ভাবে বুঝে নিতে; ইন্দো-রাশিয়া চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে মি. নিক্সন মনে করেন না যে ভারত ও আমেরিকার মধ্যে বিশেষ কোন চুক্তি বা অঙ্গীকার প্রয়োজন আছে। আলাপ শুরু হবার প্রথম দিকে মিসেস.গান্ধী ও মি. নিক্সন কিছুক্ষন একাই ছিলেন, পরে তাঁদের সাথে আমেরিকা ও ভারতের কিছু অফিসার যোগ দেন। তাদের মধ্যে ছিলেন মি.নিক্সনের বিশেষ উপদেষ্টা ডক্টর হেনরি কিসিঞ্জার, ভারতের রাষ্ট্রদুত মি. এল কে ঝা, পররাস্ট্র সচিব মি. টি. এন. কাউল এবং প্রধান মন্ত্রীর সচিব মি. পি. এন. হাকসার।

জানা গেছে, প্রেসিডেন্ট নিক্সন মিসেস গান্ধীকে বলেছেন পাকিস্তানকে আমেরিকার অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে ভারতকে অযথাই উদ্বিগ্ন হতে হবে না কারন সেগুলোর পরিমাণ নিতান্তই কম এবং সেই সরবরাহ মোটামুটি শেষ হয়ে এসেছে। সরকার ইয়াহিয়ার উপরে যতটা সম্ভব চাপ প্রয়োগ করে চলেছেন প্রথমতঃ শেখ মুজিবুর রহমানকে মৃত্যুদণ্ড না দিতে এবং দ্বিতিয়তঃ রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য বাংলাদেশ নেতার সাথে কথা বলতে। জানা গেছে তিনি এটাও বলেছেন, পাকিস্তান ও ভারতের উচিত হবে সীমান্তের দুই ধারে জাতিসংঘের কোন ধরনের উপস্থিতি মেনে নেয়া। এতে অন্যান্য দেশের সামনে এ ধরনের পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের কার্যকারিতা শক্তিশালী হবারও একটা উদাহরণ তৈরী হবে। নিক্সন বিশেষ করে বলেন, কোন রকমেই পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ হওয়া ঠিক হবে না। জানা গেছে তিনি মিসেস. গান্ধীকে এটাও বলেছেন যে, তাঁর সরকার পাকিস্তানকে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চাপ দেবে, ভারতকেও রাজী হতে হবে সীমান্ত থেকে উভয় পক্ষের সৈন্য সরিয়ে নিতে যাতে উদ্বেগ কমে যায়।

পাকিস্তানকে আমেরিকার অস্ত্র সরবরাহ ও তা দিয়ে বাঙ্গালীর উপরে ত্রাস ও গণহত্যার ব্যাপারে মিসেস গান্ধী ভারতের উদ্বেগ ব্যাখ্যা করেন। মনে করা হচ্ছে তিনি এটাও বলেছেন আমেরিকার উচিত শেখ মুজিবের মুক্তি ও তার সাথে সংলাপের জন্য পাকিস্তানের উপরে চাপ প্রয়োগ করা। আমেরিকার উচিত হবে এটা বুঝতে পারা যে, পূর্ব বাংলায় যা ঘটছে তা পাকিস্তান-ভারতের সমস্যা নয় বরং পূর্ব পাকিস্তান ও ইসলামাবাদের মধ্যে বিরোধ। কাজেই তাদের মধ্যে সমঝোতা হতে হবে যদি উদ্বাস্তুদের নিরাপদে ফিরে যেতে হয়।

মিসেস গান্ধী পরিষ্কার করে নিক্সনকে বলেন যে ভারত কখনোই পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ চায়নি। সেই সাথে পাকিস্তানের যুদ্ধংদেহী ভাবভঙ্গি ও সামরিক শাসকদের উস্কানিমূলক বক্তব্যকেও ভারত উপেক্ষা করতে পারে না। তিনি মি. নিক্সনকে মনে করিয়ে দেন, পাকিস্তান এর মধ্যে ধোঁকাবাজী করে ভারতের উপর তিন বার আগ্রাসন করেছে। যতদিন উত্তেজনা বিরাজ করবে ততদিন ভারত তার সৈন্য সরিয়ে নিতে পারে না। জানা গেছে তিনি মি. নিক্সনের কাছে জানতে চেয়েছেন তাঁর আসন্ন চীন-ভ্রমণ থেকে কি অর্জন করতে চান।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৮৪। পশ্চিম পাকিস্তানী বুদ্ধিজীবীগণ কর্তৃক মুজিবের মুক্তি দাবি হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড
নভেম্বর ৬, ১৯৭১

Hasan Mahmud
<১৪, ৩৮৪, ৯১৪>

হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড
নভেম্বর ৬, ১৯৭১
পশ্চিম পাকিস্তানের সুশীল সমাজ মুজিবের মুক্তি চান

লাহোর, নভেম্বর ৫। রয়টার জানাচ্ছে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে ৪২ জনের স্বাক্ষরিত এক আবেদনপত্র দেয়া হয়েছে যাতে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি ও গত ডিসেম্বরে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ীদের দ্বারা সরকার গঠনের আবেদন করা হয়েছে।

স্বাক্ষরদাতাদের মধ্যে আছেন ইস্তিকলাল পার্টির নেতা সাবেক এয়ার মার্শাল আসগর খান এবং লেলিন শান্তি পুরস্কার বিজয়ী কবি ফয়েজ আহমেদ। তাঁরা বলেন, পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্হিতিশীলতার ওপরে হুমকি দূর করতে গণতান্ত্রিক সরকার গঠনই শ্রেষ্ঠ উপায়।

বিভিন্ন নেতারা যেমন রাজনীতি, ট্রেড ইউনিয়ন, আইনজীবী, সাংবাদিক, লেখক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্রনেতা, এইসব স্বাক্ষরকারীরা বলেছেন:- “শেখ মুজিবের মুক্তিই ন্যায়বিচারের ভিত্তি”। আবেদনপত্রটিতে আছে তাঁর মুক্তি যদি সম্ভব না হয় তবে দেশদ্রোহীতার যে অভিযোগে মুজিবের বিচার সামরিক আদালতে চলছে সেটা সঠিক বিচারের জন্য সাধারণ উন্মুক্ত আদালতে আনা উচিত।

আবেদনপত্রটি দিবার সময় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তিন দিনের সফরে রাওয়ালপিন্ডি থেকে এখানে এসেছেন।

স্বাক্ষরকারীরা বলেন, সম্প্রতি আমেরিকান নিউজউইক-এ দেয়া সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট বলেছেন জাতি যদি চায় তবে তিনি শেখ মুজিবকে মুক্তি দেবেন, এই প্রেক্ষাপটে আবেদনপত্রটি দেয়া হয়েছে। সে পত্রে বলা হয়েছে যে, পাকিস্তানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্হিতিশীলতার ওপরে যে গুরুতর রাজনৈতিক হুমকি সৃষ্টি হয়েছে তা দূর করতে গণতান্ত্রিক সরকার গঠনই শ্রেষ্ঠ উপায়। গত ডিসেম্বরে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করা যেতে পারে।

স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে প্রথম হলেন ইস্তিকলাল পার্টির নেতা সাবেক এয়ার মার্শাল আসগর খান। অন্যদের মধ্যে আছেন ইংরেজী দৈনিক পাকিস্তান টাইমস-এর প্রাক্তন সম্পাদক সোস্যালিস্ট পার্টির চৌধুরী আসলাম খান, পাকিস্তান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট মির্জা মুহম্মদ ইব্রাহীম এবং লেলিন শান্তি পুরস্কার বিজয়ী কবি ফয়েজ আহমেদ। বেশীরভাগ স্বাক্ষরকারী বামপন্থী এবং লাহোরে, যে জায়গাটা পাকিস্তানে সবচেয়ে শক্তিশালী মুজিব-বিরোধী কেন্দ্র সেখানে প্রেসিডেন্টের প্রতি এই ধরণের আবেদনপত্র এই প্রথম।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৮৫। দিলির ছাত্রদের সমাবেশ , আলির মুক্তি দাবি হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড
নভেম্বর ৯, ১৯৭১

Hasan Mahmud
<১৪, ৩৮৫, ৯১৫-৯১৬>

হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড
নভেম্বর ৯, ১৯৭১
আলীর মুক্তির দাবীতে দিল্লীতে ছাত্র মিছিল
নিজস্ব প্রতিবেদক
নয়াদিল্লী, নভেম্বর ৮. ৮ বছরের মুরাদ ও ৬ বছরের মোর্শেদ, যাদের পিতামাতা ও বোনেরা পাকিস্তান হাইকমিশনে বলপ্রয়োগে বন্দী, তাদের সমর্থনে হাজার হাজার স্কুল ছাত্ররা কমিশনের সামনে জড়ো হয়েছে। তারা দাবী করেছে, বন্দীদেরকে অনতিবিলম্বে মুক্তি দেয়া হোক।

বাচ্চারা পাকিস্তানের অত্যাচারকে নিন্দা করে শুধু প্ল্যাকার্ডই বহন করেনি, তারা মুরাদ ও মোর্শেদকে মিষ্টি খাইয়ে ও ফুলের মালা পরিয়ে কাঁধের ওপর বহন করেছে। তিন ঘণ্টার এই মানব-বন্ধনে তারা মুরাদ ও মোর্শেদের ওপর গোলাপ পাপড়ী বর্ষণ করেছে।

ছাত্রেরা পাকিস্তানী হাইকমিশনার মিস্টার সাজ্জাদ হায়দারের সাথে দেখা করতে চাইলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। দূতাবাসের কোনো প্রতিনিধিও তাদের সাথে কথা বলতে রাজী হয়নি। ছাত্রেরা দূতাবাসের প্রবেশ-পথে একটি স্মারকলিপি সেঁটে দেয়। তাতে দূতাবাসের বাঙালী কর্মচারীদের ওপর দুর্ব্যবহারের প্রতি গভীর বিতৃষ্ণা প্রকাশ করা হয় এবং আলী পরিবারের মুক্তি দাবী করা হয়।

স্মারকলিপিতে আরো বলা হয়, বাংলাদেশের শিশু-কিশোর ও জনগণের মুক্তির লড়াইয়ে দিল্লী ও ভারতের শিশু-কিশোরেরা দৃঢ়ভাবে তাদের সাথে আছে। ইতোমধ্যে মুজিবনগর থেকে ইউনাইটেড নিউজ অফ ইন্ডিয়া জানাচ্ছে, বাংলাদেশ যুব সমিতির চেয়ারম্যান মিস্টার এ. এইচ. বাদশা ও সাধারণ সম্পাদক মুহম্মদ নজরুল ইসলাম পাকিস্তানী হাই কমিশনারকে এই বলে হুঁশিয়ার করে দেন যে তিনি যদি বাংলাদেশী কর্মচারীদেরকে মুক্তি না দেন তবে যেসব বাঙালীরা বাইরে আছেন তাঁরা হাইকমিশন দখল করে তাঁদের সহকর্মীদেরকে মুক্ত করবেন।

তাঁরা এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, একবার ঢুকলে তাঁরা চিরদিনের জন্য হাইকমিশনের দালান দখল করে নেবেন কারণ সেটা – “বাংলাদেশের জনগণের ঘাম ও রক্তে অর্জিত টাকা দিয়ে বানানো হয়েছে”। আমাদের বিশেষ সংবাদদাতা জানাচ্ছেন এখানকার বাংলাদেশ মিশনও এই সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না। বাংলাদেশ মিশনের প্রেস এটাচি মিস্টার আমজাদুল হক বলেন, মিস্টার আলীর জীবন বাঁচানোর জন্য রেডক্রস সোসাইটি লীগ ও জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেলের কাছে তাঁদের পাঠানো আবেদনের প্রেক্ষিতে কি ঘটে সেই অপেক্ষায় আছেন তাঁরা।

মিস্টার আলীকে মুক্তি না দেয়া হলে দিল্লীর পাকিস্তান হাইকমিশনে মার্চ করার সম্ভাবনার ব্যাপারে মতামত চাইলে তিনি বলেন:- “সে সম্ভাবনা আমরা উড়িয়ে দিতে পারিনা। যত যাই হোক, আমাদের এক ভাই, তার স্ত্রী ও কন্যাকে যখন পাকিস্তানীরা অবৈধভাবে বন্দী করে অত্যাচার করছে, তখন আমরা জনগণকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবো? অপরাধীরা পার পাবেনা। দাঁতের বদলে দাঁত, নখের বদলে নখ আমাদের দৃঢ় নীতি।”

এ পর্যন্ত মিস্টার আলীর কোনো খবর পাওয়া যায়নি যাঁকে পাকিস্তানী হাইকমিশনের কর্মচারীরা নিষ্ঠুরভাবে প্রহার করেছে। হাইকমিশনের নিযুক্ত ডক্টর মিসেস সুন্দেরসন গুজরাল আজ জানিয়েছেন তিনি মিস্টার আলীর ব্যাপারে কিছুই জানেন না, তিনি তাঁকে দেখেনও নি।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৮৬। সামরিক সরবরাহের অসুবিধায় পাক বাহিনী ক্ষতির সম্মুখীন হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড ১৮ই নভেম্বর, ১৯৭১

Ashik Uz Zaman
<১৪, ৩৮৬, ৯১৭-৯১৮>

হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, ১৮ই নভেম্বর, ১৯৭১
সামরিক সরবরাহের অসুবিধায় পাক বাহিনী ক্ষতির সম্মুখীন
লেঃ. জেনারেল এল. পি. সেন, ডি. এস. ও.
আমাদের সামরিক প্রতিবেদক

প্রতিটি অভিযানে, কৌশলগত পরিকল্পনার আরোপিত প্রচেষ্টা অর্জনে সমমানের প্রশাসনিক সুব্যবস্থা থাকতেই হবে। এটি নিশ্চিত করতে যদি যত্নসহকারে ব্যবস্থা না নেয়া হয় তাহলে রণাঙ্গনে অধিনায়ক নিজেকে জয়লাভের সমান সুযোগ থেকে বঞ্চিত বলে আবিস্কার করবেন এবং এমনকি পরাজয়ের সম্মুখীনও হতে পারেন। এটা মনে রাখতে হবে, যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পশ্চিম মরুভূমিতে জার্মানির চৌকস বাহিনী আফ্রিকা কোরের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা হয়েছিল। এমনকি এই বাহিনীর সুদক্ষ অধিনায়ক ফিল্ড মার্শাল আরউইন রোমেলও, একে রক্ষা করতে পারেননি। বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কি দীর্ঘ সময় ধরে টিকে থাকার সক্ষমতা সহ প্রশাসনিক সুব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে? মুক্তি বাহিনী যেখানে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে।

অনেক জায়গাতেই এই অনুভূতি রয়েছে যে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর জন্য সরবরাহ ব্যবস্থা যতটা স্বাস্থ্যকর হওয়া দরকার ছিল ততটা নেই এবং অদুর ভবিষ্যতে পরিস্থিতি তাদের জন্য আরো গুরুতর হয়ে উঠতে পারে। এরকম মনোভাব এই বাস্তবতার উপর নির্ভর করে তৈরী যে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা যখন বাংলাদেশের জনগণকে দমন করার সিধান্ত নেয় তখন একটি দীর্ঘ-মেয়াদী অভিযান পরিচালনার পরিপ্রেক্ষিত থেকে তারা চিন্তা করেনি। এটি একটি স্বল্পমেয়াদের ঝটিকা অভিযান হবার কথা ছিল।

এই পরিপ্রেক্ষিতে, যে তিনটি ডিভিশনকে আকাশ এবং সমুদ্রপথে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আশা হয় তারা তাদের শান্তি-কালীন সরবরাহ ব্যবস্থা সাথে নিয়ে আসে যুদ্ধকালীন ব্যবস্থা নয়।

গত আট মাস ধরে মুক্তি বাহিনী যে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে তাতে পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের সীমিত সরবরাহের প্রায় সবটুকু ব্যবহার করতে অবশ্যই বাধ্য হয়েছে। মুক্তি বাহিনীর সাথে তাদের এই সংঘর্ষ যেহেতু আরো লম্বা সময় ধরে চলবে তাই তাদের সরবরাহের মজুত নিশ্চিত করতে পুনঃসরবরাহ প্রয়োজন হবে। এর জন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে একটি দীর্ঘ উত্তোলন প্রক্রিয়া প্রয়োজন হবে কিন্তু তাতে কোন সমস্যা হবার কথা নয় যদি ধরে নেয়া হয় যে এ প্রক্রিয়ায় কোনধরণের প্রতিবন্ধকতা নেই। কিন্তু এই ক্ষেত্রে মুক্তি বাহিনীর গেরিলারা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে খুব ভালোভাবেই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতে পেরেছে।
ব্যাপকহারে সড়ক ও রেল ব্রিজ, কালভার্ট এবং ছোটখাটো ব্রিজগুলো ধ্বংস এবং নড়বড়ে করে দেয়ার মাধ্যমে গেরিলারা পাকিস্তানী বাহিনীর জন্য গুরুতর মাথাব্যথার কারণ সৃষ্টি করেছে। মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় স্থানীয় শ্রমিকের সঙ্কট থাকার কারণে এটি উপদ্রবের চেয়েও বেশী বিরক্তিকর হয়ে উঠেছে।

তবে সড়ক ও রেল ব্রিজ ধ্বংস হয়ে যাওয়াটা সবচেয়ে বেশী ক্ষতির কারণ নয়। চট্টগ্রাম, চালনা, মংলা এবং চাঁদপুরের মত বন্দর এলাকায় সমুদ্রগামী জাহাজ এবং আভ্যন্তরীণ নদীতে চলমান জলযানগুলো আক্রান্ত হওয়াতে পাকিস্তানীদের উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়েছে। খাদ্যশস্য এবং গোলাবারুদ বহনকারী কয়েকটি জাহাজ এবং একটি তেলবাহী জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানের অরক্ষিত বাহিনীর পক্ষে স্থানীয়ভাবে কিনে খাদ্যশস্যের এই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া এখন আর সম্ভব নয়।

উদাহরণস্বরূপ যশোরের ঘটনাটিই নেয়া যাক। এই সেনানিবাসটি ঢাকা থেকে তার প্রয়োজনীয় সামগ্রীগুলোর সরবরাহ পেত, প্রধানত গোয়ালন্দ ঘাট হয়ে এবং আকাশ পথে। সাতক্ষীরায় এই পথের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ সড়ক অবশ্য, পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে পরিত্যাগ করতে হয়েছে এবং এই পথের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে কুষ্টিয়া জেলার কিছু স্থান যেমন ঝিনাইদহ এবং চুয়াডাঙ্গায় কয়েকটি নিশ্চিত পদক্ষেপ নিতে হয়েছে।

তারপরেও, চালনা বন্দর ব্যবহার করে একটি জরুরী সরবরাহের পথ ছিল। মুক্তি বাহিনীর ডুবুরীরা, অবশ্য এই সপ্তাহের শুরুতে বন্দরের নৌচালনার পথে গ্রীসের একটি জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে এই পথ পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে। এইদিক দিয়ে যশোরে সরবরাহের পথ তাই, প্রভাবিত হয়েছে এবং এখন হয়তো শুধুমাত্র আকাশপথে বা বিমান থেকে সরবরাহ করার পন্থায় সীমিত থাকতে হবে। এটি একটি খরচান্ত ধরণের রক্ষনাবেক্ষন ব্যবস্থা, বিশেষ করে যখন বিমানের সংখ্যা সীমিত এবং সেগুলোও ভূমি থেকে নিক্ষেপিত গুলির আঘাতে হারানোর সম্ভাবনা সবসময়ই রয়েছে।

আপাতদৃষ্টিতে চট্টগ্রামের অবস্থাও খুব ভালো নয়। বন্দরের কার্যক্রম পুনরায় শুরু হওয়ার পর থেকেই মুক্তি বাহিনীর কম্যান্ডোরা এই এলাকায় খুবই সক্রিয় রয়েছে। দুটি ছাড়া জাহাজ নোঙ্গর করার আর সবকয়টি স্থানই তারা অচল করে দিয়েছে। একারণে এই বন্দরে ভারী সামরিক সরঞ্জাম নাড়াচাড়া করার সক্ষমতা অনেক কমে গেছে এবং এখানে সবসময়ই এই আশঙ্কা থাকে যে নোঙ্গর করা জাহাজগুলো ডুবুরীদের আক্রমণের শিকার হতে পারে যেকোনো সময়েই।

বিদেশী পতাকাবাহী অনেক জাহাজই ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে এবং ঐ জাহাজগুলোর মালিকেরা অত্যন্ত পরিস্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে তাদের জাহাজ আর চট্টগ্রাম বন্দরে যাবেনা। তবে এটা হয়তো অপূরণীয় ক্ষতির কারণ নয় কেননা চট্টগ্রামের সাথে চাঁদপুর বা ঢাকার যোগাযোগ রক্ষাকারী আভ্যন্তরীণ সড়কপথ আগে থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে।

এই ক্ষতবিক্ষত একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যমটি মেরামতের জন্য পাকিস্তান তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে চাঁদপুর পর্যন্ত একটি আভ্যন্তরীণ নদীপথ চালু করার। এটি অবশ্য, খুব একটা সফল হয়নি কেননা কম্যান্ডোরা চাঁদপুরেও সক্রিয় ছিল। চীন থেকে সাম্প্রতিককালে সংগৃহীত একটি সহ সামরিক বাহিনীর জন্য খাদ্য এবং অন্যান্য সরবরাহ বহনকারী মোট চারটি জলযান কিছুদিন আগেই এখানে ডুবিয়ে দেয়া হয়।

মরিয়া হয়ে, পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ তাদের গানবোটগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে চালনা এবং সাতক্ষীরা এলাকায় চলাচলকারী সব দেশী নৌকাকে গুলি করে ধ্বংস করে দেয়ার। এতে করে সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া হতে পারে, কেননা এই বদ্বীপ এলাকার মানুষ সবসময়ই ভ্রমন এবং মালামাল পরিবহণের জন্য জলপথ ব্যবহার করে আসছে। এতে করে পরবর্তীতে স্থানীয়রা দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হতে পারে।

পাকিস্তান কি তার সরবরাহ ব্যবস্থার অব্যবস্থা সংশোধন এবং পরিস্থিতির উন্নতি সাধন করতে পারবে? বর্তমান পরিস্থিতি এবং মুক্তি বাহিনীর ক্রমবর্ধমান কার্যক্রমের মধ্যেও এটি করা সম্ভব তবে কাজটি সহজ হবে না। এজন্য পশ্চিম পাকিস্তানের মূল ঘাঁটি থেকে যে দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার যে ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থা তা এই কাজটিকে আরো কঠিন করে তুলবে।

তাহলে, পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে? এরকম হতে পারে যে মরুযুদ্ধে রোমেলের সৈন্যদের যে পরিণতি হয়েছিল বাংলাদেশে তারই পুনরাবৃত্তি হবে। মুক্তি বাহিনী ইতিমধ্যেই বালিঘড়ি উল্টে দিয়েছে এবং যদি তারা অতীতের মতো তাদের চাপ বজায় রাখতে পারে তাহলে পাকিস্তানী বাহিনীর সময়ের বালি শেষ হয়ে যাওয়াটা এখন সময়ের ব্যপার মাত্র।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৮৭। পাক বাহিনীর গুলির আওয়াজ স্তব্ধ করতে সেনাবাহিনীর হিলই, বালির ঘাঁট সীমান্ত অতিক্রম হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড নভেম্বর ৩০, ১৯৭১

Ark Prince
<১৪, ৩৮৭, ৯১৯-৯২১>

হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, নভেম্বর ৩০, ১৯৭১
পাক সেনাদের গোলাবর্ষণ বন্ধ করার জন্য সেনাবাহিনীর হিলি, বালুরঘাট
সীমান্ত অতিক্রম
বার্তা নির্বাহক রিপোর্ট

ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ সীমান্তের ২ মাইল এর মধ্যে প্রবেশ করে সোমবার এবং পাকিস্তানী গোলাবর্ষণ বন্ধ করে দেয়। শনিবার থেকে পাকসেনারা গোলাবর্ষণ করছিল হিলি আর বালুরঘাট এলাকায়।

প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ এর কারনেই সীমান্ত শহর হিলি আর বালুরঘাট শহরে সোমবারে পাক বাহিনীর গোলাবর্ষণ বন্ধ ছিল।

যুদ্ধে ট্যাংক আর গোলন্দাজ বাহিনী ব্যবহারিত হয়, কিন্তু এ পর্যন্ত কোন যুদ্ধ বিমান যুদ্ধে অংশগ্রহন করে নাই। পাকিস্তানীরা ১৪টা ট্যাংক এর বহর ব্যবহার করেছিল যুদ্ধে, কিন্তু তিনটা হাড়ায় শনিবার আর একটা হাড়ায় রবিবার। একটি ভারতীয় ট্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন এর আঘাতে।

যুদ্ধে কমপক্ষে ১৬০ পাক সেনা হতাহত হয়।সরকারী হিসেব অনুযায়ী বলা হয়েছে যে ভারতীয় পক্ষে মারা যায় ৩৫ জন।

বালুরঘাট এর কাছে পাতিরাম থেকে তরুন গাঙ্গুলি জানাচ্ছেন যে এই ঘটনা শহরের বাসিন্দাদের
সুযোগ করে দেয় জিনিশপত্র সহ তাদের পাক বাহিনী থেকে নিরাপদ দুরত্বে সরে যাবার জন্য।

পুরুষ,মহিলা এবং বাচ্চাদের দেখা যায় সরে যেতে পশ্চিম দিনাজপুর এবং মাইদা জেলার নিরাপদ এলাকাতে যা পাক সেনাদের আয়ত্তের বাহিরে । নির্ভরযোগ্য সুত্রে জানা যায় শহরের প্রায় শতকরা ২৫ ভাগ মানুষ নিরাপদ দুরত্বে সরে যায়। সরে যেতে ইচ্ছুক মানুষদেরকে যানবাহন সহায়তা দেয়া হয় সরকারী ভাবে, কিন্তু বড়ো পরিসরে মানুষ সরিয়ে নেবার কোন সরকারী পরিকল্পনা ছিল না।

বালুরঘাট এর স্কুল এবং কলেজ বন্ধ রাখা হয় নিরাপত্তার জন্য। হিলিতে বেশ কিছু বসতবাড়ি বুলেট এবং
কামান এর গোলা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় সীমান্ত এলাকার গোলাবর্ষণের জন্য।

নয়া দিল্লীর সরকারী মুখপাত্র জানায় যুদ্ধ চলমান শনিবার সকাল থেকে বাংলাদেশ এর সীমানায় হিলি সীমান্ত থেকে ২ মাইল অভ্যন্তরে এবং পশ্চিমবঙ্গের বালূড়ঘাট এলাকায়।

“ সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী” সোমবার সন্ধ্যায় সরকারী লিখিত বিবৃতিতে বলা হয় “পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পালটা হামলা চালায় রবিবার ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুধ্যে যখন ভারতীয় বাহিনী প্রতীরক্ষামুলক ব্যাবস্থা নিতে বাধ্য হয় শনিবার পাকসেনাদের সাধারন মানুষদের উপর বড় আকারের গোলবর্ষণের ঘটনার পর। যুদ্ধ এখনো চলছে।“

ফেনিতে তীব্র যুদ্ধ

মুখপাত্র জানিয়েছেন যে ভারত স্থল বাহিনীকে বিমান সহায়তা দেয়নি বালুরঘাট যুদ্ধে, “সাধারনত
আমরা স্থল বাহিনীকে বিমান সহায়তা দেই না কিন্তু পাকিস্তান যদি যুদ্ধ বিমান ব্যবহার করে তবে ভারত ও তাদের যুদ্ধ বিমান ব্যবহার করবে।“

পাকিস্তান যখন তাদের স্থল বাহিনীকে সহায়তার জন্য যুদ্ধ বিমান ব্যবহার করেছে বয়রা সেক্টরে ভারত ব্যবহার করে তার বিমান শক্তি যা পাকিস্তানের ৩ টি সেবর জেট কে ভুপাতিত করে।

ইতিমধ্যে মুজিবনগরে সংবাদ আসে যে মুক্তিবাহিনী ত্রিমুখী আক্রমন অব্যাহত রেখেছে যশোর সেনাসদরে। এদিকে যদিও তুলনামুলকভাবে সুরক্ষা ছিল, মুক্তিবাহিনী এবং পাকসেনা বিচ্ছিন্ন ভাবে যুদ্ধে লিপ্ত হয় অত্র এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ চ্যানেল নিয়ন্ত্রণ এর জন্য।

তীব্র যুদ্ধের খবর পাওয়া যায় মুক্তিযোদ্ধা আর পাকবাহিনীর মধ্যে ফেনীতে ভারতের ত্রিপুরায় সীমান্ত মুখি শহর বেলনিয়া বরাবর। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায় যে পাকিস্তানি সেনা বড় চাপে পরে যায় ফেনী শহর দখল করতে এসে মুক্তিবাহিনীর সাঁড়াশী আক্রমনে ।

প্রসঙ্গ ক্রমে, আগরতলার প্রাদেশিক পুলিশ সদর দপ্তরের এক রিপোর্টে যানা যায় সুন্নার কাছে সীমান্তবর্তী গ্রাম কনারঘাটে পাক বাহিনী কর্তৃক অপহৃত চার ভারতীয় সেনা কে উদ্ধার করে সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনী।
উদ্ধারকাজ সম্পন্ন হয় পাকবাহিনী এবং সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনীর মধ্যে এক ঘন্টা ব্যাপি প্রচন্ড গুলি বিনিময়ের পর।

যুদ্ধে ১০ জন পাকিস্তানী সেনা মৃত্যুবরণ করে।

নভেম্বর ২৭ এবং ২৮ তারিখে রাতে, পাকিস্তানী বাহিনী গোলা ছুঁড়ে আমাদের স্থাপনায় পশ্চিম বঙ্গের গঙ্গারাম এবং পাতিরাম এর উত্তরে । বিএসএফ পাল্টা গুলিবর্ষণ করে। আমাদের পক্ষে কোন হতাহত হয়নি। পাকিস্তান পক্ষের হতাহতের সংখ্যা অজানা।

নভেম্বর ২৬ এ, পাকিস্তানী বাহিনী গুলিবর্ষণ করে বিএসএফ টহল বাহিনীর উপর উত্তর-পূর্ব বসিরহাটে।
শেষ খবর পর্যন্ত কোন হতাহতের খবর পাওয়া জায়নি। ত্রিপুরায়, পাকিস্তানী এবং বি এস এফ টহল বাহিনী গুলি বিনিময় করে সনামুরার পশ্ছিমে নভেম্বরের ২৭ তারিখে। কিছু পাকিস্তানী সেনার হতাহতের খবর পাওয়া যায়। ভারতীয় পক্ষে কোন হতাহত হয়নি।

নভেম্বর ২৬ এ, রাধাকিশরপুরের পশ্চিমে গুলি বিনিময় হয়। ভারতীয় পক্ষে কেউ মারা যায়নি। একই দিনে পাকিস্তানী বাহিনী গুলি ছুঁড়ে ছোট অস্ত্র এবং মাঝারি মেশিন গান দিয়ে কামাল্পুরের উত্তর পুর্বে ভারতীয় স্থাপনায়। কোন হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশী পতাকা উত্তোলন করেছে দিনাজপুর জেলার পঞ্চগড় রেল স্টেশনে এবং এম এন এ সুত্রে জানা যায় বাংলাদেশ সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে এই এলাকায় বেসামরিক প্রশাসন
প্রতিষ্ঠার জন্য ।

সিলেট জেলায় মুক্তিবাহিনী দক্ষিন-পশ্চিম জইন্তাপুরের ছোটাখেল স্বাধীন করেছে গতকাল তীব্র যুদ্ধের পর যেখানে “দখলদার” সেনাবাহিনীর অনেক হতাহত হয়। সর্বশেষ সংবাদ অনুযায়ী সিলেট শহর থেকে মাত্র ১৯ কিলোমিটার দূরে এক যায়গায় তীব্র যুদ্ধ চলছে।

গতকাল মুক্তিযোদ্ধারা তাহেরপুর থানা পুনর্দখল করে এবং সুচনা ফাঁড়ি ঘিরে রাখে। তারা তাদের চাপ অব্যাহত রাখে কম্পানিগঞ্জ এবং সালুতিকার এলাকায় এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের বাধ্য করে সিলেট শহরে উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নিতে। সিলেট এবং সুনামগঞ্জের মধ্যে সকল যোগাযোগ ইতিপূর্বেই বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল।

ময়মনসিংহ জেলার কমলাপুর ফাঁড়ির চারিদিকে এখন তীব্র যুদ্ধ চলছে। বাংলাদেশি কমান্ডোরা ইতিমদ্ধেই ফাঁড়ি ঘিরে ফেলেছে এবং “ শত্রুপক্ষের ” শক্তিবৃদ্ধির প্রচেষ্টা বিনষ্ট করে দেয়।

মুক্তিবাহিনী গেরিলারা সরকারি মালিকানার পাটকল পুড়িয়ে দেয় ময়মনসিংহের নান্দিনায়, ইউ পি আই
রিপোর্ট করে ঢাকার সামরিক আইন কতৃপক্ষের বয়ান থেকে।

এই ঘটনা থেকে ১৪,০০০ ইউ এস ডলার মুল্যমানের পাট সম্পদ বিনস্ট হয়। বিগত সপ্তাহে ৩ টি পাট কল পুড়ানো হয়।

মুক্তিযদ্ধারা অবিচলিত অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখে টাঙ্গাইল এলাকায় এবং তাদের দখল আরও মজবুত করে এই জেলার ৪ টি চেক পোস্টে ।

ঢাকা থেকে বিলম্বিত সংবাদ অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা কোডালিয়ায় একটি কৌশলগত সেতু উড়িয়ে দেয়,যেটা একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ রাস্তা যা ঢাকা এবং টাঙ্গাইল এর মধ্যে একটি যোগাযোগ বিচ্ছিন্য করে দেয়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৮৮। পাকিস্তান যুদ্ধ পরিস্থিতি ঘনীভূত করেছে দ্যা স্টেটসম্যান ডিসেম্বর ২, ১৯৭১

Ark Prince
<১৪, ৩৮৮, ৯২২-৯২৩>

দ্যা স্টেটসম্যান , ডিসেম্বর ২, ১৯৭১
পাকিস্তান যুদ্ধ পরিস্থিতি ঘনীভূত করেছে
আগরতলায় তিনটি সেবর জেট এর হামলাঃ
স্থল কামানের গোলার আঘাতপ্রাপ্ত একটি
আমাদের বিশেষ প্রতিনিধির রিপোর্ট

নয়া দিল্লি, ২রা ডিসেম্বার। — পাকিস্তান যুদ্ধ পরিস্থিতিকে আরও ঘনিভুত করে আজকে পুর্ব সীমান্তে যখন তাদের বাহিনী ভারি গোলাবর্ষণ করে আগরতলায় এবং তারপরে বিমান আক্রমন করে বিমানবন্দরে এবং কাছের বেসামরিক স্থাপনার উপর।

পাকিস্তানিরা ব্যাপক গোলাবর্ষণ করে আগরতলা শহরে সকাল বেলা। মধ্যাহ্নের পর স্বল্প বিরতি ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায় ১২:৩০ টায় যখন ৩ টি সেবর বিমান আক্রমন চালায় বিমান বন্দরে। সরকারি মুখপাত্র জানমালের ক্ষয় ক্ষতির প্রতিবেদন পেশ করে।

সেবর বিমান গুলি উড়ে যাইয় ভুমি থেকে নিক্ষেপিত প্রবল গোলাবর্ষণ এর মধ্যে দিয়ে। এর মধ্যে একটা স্পষ্টতই আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ধুঁয়ার গতিপথ রেখে যায় এবং সেটা গতিপথ পরিবর্তন করে বাংলাদেশ এর সীমানার দিকে চলে যায়।

পাকিস্তানী বিমান হামলা হয় যখন আরেকটা বিমান হামলা প্রচেস্টা ব্যার্থ হয় বয়রার কাছে যেখানে তারা ৩ টি বিমান হারায় যা নিশ্চিত ভাবেই ছোট মাত্রার সীমান্ত দাঙ্গার চরিত্র হারায় এবং বড় মাত্রার যুদ্ধের
ইঙ্গিত দেয়। যার প্রমান পাওয়া যায় পাকিস্তানি হামলা কার্য্যক্রমে বালুরঘাটে এবং আগরতলার দক্ষিন পশ্চিমে এবং পাঞ্জাব,জম্মু,কাশ্মীর এর পশ্চিম সীমান্তে ।

সরকার আগরতলার এই বিমান হামলা গুরুত্বের সাথে নেয় এবং স্থানীয় কমান্ডাররা নির্দেশিত হয় যথাযথ
আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য । ভারতের পাল্টা আক্রমনের বিস্তারিত যানা যায়নি খবর ছাপাখানায় যাওয়ার আগে পর্যন্ত কিন্তু আজ রাতের প্রাথমিক খবর অনুযায়ী কিছু পাকিস্তানী যুদ্ধ স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে। সরকারী মুখপাত্রের বরাতে বলা হয় যে কম্যান্ডাররা স্বাধীন সীমান্ত অতিক্রম করার জন্য যদি তারা এটা জরুরী মনে করে এই অঞ্চলের সুরক্ষার প্রয়োজনে ।

প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরন অনুযায়ী যা স্থানীয় সংবাদপত্রে গৃহীত হয়েছে আগরতলা সংবাদ কর্মীর মাধ্যমে
পাকিস্থানী গোলাবর্ষণ সকালে ছিল বাছবিচারহীন এবং নিরবচ্ছিন্ন । ২ বার গোলা ফাটার বিকট শব্দ পরিস্কার শুনা যায় যখন আগরতলার সাথে ফোনে কথা চলছিলো ।

পাকিস্থানী কামান একসাথে গোলাবর্ষণ করে বালুরঘাট শহরে যাতে ৬ জন বেসামরিক ব্যাক্তি নিহত হয়।
ভারতীয় কামান গোলা ছুঁড়ে পালটা আক্রমনে। একই দিনে পাকিস্থানী সেনাবাহিনী গুলি ছুঁড়ে ছোট বন্দুক এবং কামান দিয়ে ভারতীয় বালুরঘাটের উত্তর-পশ্চিমে এবং বালুরঘাটের উত্তরে । সীমান্তরক্ষি
জওয়ানরা পাল্টা গুলি করে। একই দিনে পাকিস্থানী সেনাবাহিনী গুলি ছুঁড়ে স্বয়ংক্রিয় ছোট অস্ত্র এবং কামান দিয়ে হিলির ভারতীয় অবস্থানে।

পশ্চীম সীমান্তে একটি পাকিস্থান টহল বাহিনীর ৪ জন ভারতীয় সীমানার ১৫০ গজের ভিতরে অনুপ্রবেশ করে ফিরোজপুর এর উত্তরে। ভারতীয় টহলবাহিনী অনুপ্রবেশকারীদের দিকে গুলি ছুঁড়ে । এতে সেনাদল পালিয়ে যায় তাদের একজন আহত সেনাকে নিয়ে। মঙ্গলবারে পাকিস্থানীরা গুলি ছুঁড়ে ৩০ বার মাঝারি
মেশিন গান দিয়ে যুদ্ধবিরতি সীমানা পেরিয়ে মেন্ধার দক্ষিন পশ্চিমে । ভাররপক্ষের কনও হতাহত হয়নি।
সোমবারও পাকিস্থানী বাহিনী গুলি ছুঁড়ে হালকা মেশিন গান দিয়ে একই যায়গায় যতে কেউ হতাহত হয়নি।

আগরতলা সংবাদদাতার ভাষ্য অনুযায়ী পাকিস্তানী বিমান কনও ক্ষতি করতে পারেনি আগরতলা বিমান বন্দরের আজকের বিমান হামলায়।

এদিকে পাকিস্থানী বাহিনী ভারি গোলাবর্ষণ করে আগারতলা শহর এবং সংলগ্ন এলাকায় বিনা উস্কানিতে যা শুরু হয় গতকাল রাত ৮ টায় যা আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত অব্যাহত আছে । একটা বড় সংখ্যার ভারি কামান এবং মর্টারের গোলা আঘাত করে কুঞ্জবন এবং শহরের আভায়নগর এলাকায় এবং শহরের বাহিরে ঈন্দরনাগার, জগতপুর উশাবাজার,নারসিঙ্গার এবং ছয়ঘর এলাকায় ।

কমপক্ষে ৫ জন ভারতীয় মারা যায় এবং আরও ৪৫ জন আহত হয় গোলাবর্ষণে। মৃতদের মধ্যে ছিল ৩ বছরের বালক এবং ১৫ বছরের বালিকা।

————————————-

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৮৯। পাকিস্তান ভারতের উপর পুর্নাংগ যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে – প্রধানমন্ত্রী দি স্টেটসম্যান ৪ ডিসেম্বর ১৯৭১

Abdul Malek
<১৪, ৩৮৯, ৯২৪- ৯২৭>

কূটনীতিজ্ঞ, ৪ঠা ডিসেম্বর;১৯৭১
পকিস্তান ভারতের উপর পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে !
“আমাদেরকে দীর্ঘ মেয়াদী ত্যাগ স্বীকার করতঃ প্রস্তুতি নিতেই হবে “:মিসেস গান্ধী ।

নয়া দিল্লী, ৩রা ডিসেম্বর : মধ্যরাতের খানিকটা পরের এক খবরে উল্লিখিত হয় যে ,প্রধান মন্ত্রী মিসেস ইন্দিরাগান্ধী বলেছেন ; আজ বিকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে পাকিস্তান, ভারতের উপর এক পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে – রিপোর্ট পি.টি.আই. ।

তিনি আরও বলেন যে , এখন যুদ্ধ ছাড়া আমাদের আর অন্য কোনই বিকল্প নাই । সমস্ত দেশব্যাপী জরুরী অবস্থা ঘোষণা করতঃ সকল প্রকার প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে ।
আমাদেরকে দীর্ঘ কালীন কষ্ট স্বীকার ও সকল প্রকার আত্ন বলিদানের জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে !
প্রধান মন্ত্রী তীব্র কণ্ঠে বলেন , পাকিস্তানের অনর্থক উচ্ছৃঙ্খল আচরণের আক্রমণকে সময় মত সংকল্পিতভাবে প্রতিহত করা হবে ।

ভারত শৃঙ্খলা বজায় রেখে বীরত্বের সাথে নজিরবিহীনভাবে একতাবদ্ধ হয়ে এই আগ্রাসনের উপযুক্ত জবাব দিবে। বাংলাদেশের যুদ্ধ এখন ভারতের নিজস্ব যুদ্ধে মোড় নিয়েছে বলে তিনি বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন – “আমাদের জীবনযাত্রার ধরন , স্বাধীনতা আর গণতন্ত্র রক্ষা না করতে পারলে শান্তি রক্ষিত হবে না । তাই আমরা শুধু আমাদের একমাত্র অবস্থানিক অখণ্ডতার জন্যই যুদ্ধ করছি না । আমাদের মৌলিক নীতিমালা যা এই দেশকে শক্তিশালী করে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে , সেই জন্যই এই যুদ্ধ ।

প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষনে আরও বলেন যে -“আমি আমাদের দেশ ও জাতির সংকটময় মুহূর্তে আপনাদেরকে অবগত করিয়ে দিচ্ছি যে , শুক্রবার , মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে, সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটা নাগাদ পকিস্তান পুরোদ্দমে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে ! পাকিস্তানের বিমানবাহিনী আমাদের অমৃতাশ্বর , পাঠানকোট , শ্রীনগর , আভন্তীপুর , উত্তরলাই , যৌধপুর , আম্বালা ও আগ্রার বিমানঘাঁটিতে অতর্কিত আক্রমণ করেছে । সোলেমানকী , খেমকরন , পূঞ্চ এবং অন্যান্য ঘাঁটিতে আমাদের প্রতিরক্ষাকারী অবস্থানের উপর তারা গুলি চালায়” ।

এর পূর্বে কোলকাতার প্যারেড গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত লাখ লাখ লোকের সমবেত সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন , কিছু কিছু বিদেশী শক্তি ভারত-পাকিস্তানের এই দ্বন্দকে আরও বিষাক্ত করে তুলেছে । ভারত সংকল্পের সাথে , দেশের স্বার্থে এই দ্বন্দ প্রতিহত করবে বলে তিনি পুনঃ ব্যক্ত করেন; বলেও সাংবাদিকরা জনান ।
যে পরাশক্তিরা গোপনে পাকিস্তানকে ভারতের বিরুদ্ধে সহানুভূতি দেখিয়েছে , তাদেরকে তিনি স্মরণ করিয়ে দেন যে , স্বাধীনতার পূর্বে , এমনকি আজ হতে পাঁচ বছর আগের ভারতও আজ সেই ভারত নেই ।

আজ দেশ ও জাতি তার সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য যত ঘর্ম ও রক্ত দেবার প্রয়োজন তজ্জন্য সার্বিকভাবে প্রস্তুত” ।

প্রধানমন্ত্রীর আগমনে চারিদিকে জয়জয়কার পড়ে ও তাঁকে ভীষণ বড় রকমের সাদর সম্ভাষণ দেয়া হয় ।

দিল্লী যাত্রার প্রাক্কালে পশ্চিম বঙ্গের রাজ্যপাল , মুখ্যসচিব , লেখক , শিল্পী , কলাকুশলী ও গুরত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সাথেও তিনি পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ আলোচনা করেন ।

জনাব আবদুস সাত্তারের সভাপতিত্বে , অধুনা বছরগুলির সবচাইতে বড় এই সভার আয়োজন করে পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কংগ্রেস(ডানপন্হী ) । দুইশতেরও বেশী দেশী বিদেশী সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে , বার ফুট উঁচু বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়িয়ে ছাপার শাড়ী পরিহিতা প্রধানমন্ত্রী বিপুল জনতাকে উদ্দেশ্য করে তাঁর বক্তব্য রাখেন ।

মিসেস গান্ধী মঞ্চে উঠতেই উপস্থিত জনতা আন্তরিক হর্ষধ্বনি করে উঠে । ডানপন্হী কংগ্রেস সম্পৃক্ত দলগুলো তাঁকে অঝোরে ফুল মাল্যে ভূষিত করে । এই সময় হেমন্ত মুখার্জী ও নামীদামী শিল্পীরা জাতীয় সংগীত পরিবেশন করে সভাটিকে সময়োপযোগী করে তোলে ।

একঘন্টা কালীন হিন্দী বক্তব্যে তিনি বলেন , এই দুর্যোগের সময়ে সকলে ভুক্তভোগী হলেও তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস , জনগণ তাদের সহজাত শক্তি দিয়ে এই সকল অসুবিধা ও কষ্ট সহ্য করে তা নিরসন করার ক্ষমতা রাখবে ।

প্রধানমন্ত্রী বলেন , তিনি জানেন এই যুদ্ধ সকলকে, বিশেষ করে গরীবদের জন্য অপরিমেয় দুর্ভোগ বয়ে আনবে । কিন্তু যদি কোন যুদ্ধ, দেশের অখণ্ডতার উপর হুমকি বয়ে আনে, তবে তার মোকাবিলা সাহসিকতার সাথেই করতে হবে । ইংল্যান্ডের বিগত যুদ্ধে পঁয়তাল্লিশ বছরের নীচের সকলকে ডাকা হলে নারীদেরকেও এই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় ।

শরণার্থীদের আন্তঃপ্রবাহ চাপে প্রশাসনে বর্ধিত অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপ বয়ে আনবে বৈকি ! কিন্তু দেশের সার্বিক নিরাপত্তার উপরই আমাদের সর্বোচ্চ নজর দিতে হবে ।শুরুতে ভারতের সীমান্তরক্ষী বি এস এফ নিজেদের সীমান্তে বহাল থাকা অবস্থায় পাকিস্তান, পূর্ববাংলার সীমান্তে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্ (ইপিআর) এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট(ইবিআর) আনা শুরু করলেই ভারতের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় ।

যখন দেখা গেল ইপিআর ও ইবিআর জওয়ানরা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিচ্ছে, তখনই পাকিস্তান পূর্ববাংলার সীমান্তে ও পশ্চিমের ঘাঁটি গুলিতে তার নিজস্ব সৈন্য মোতায়েন আরও জোরদার করা শুরু করে । এ কথা ইউ এন পর্যবেক্ষকদের গোচরে আনা হলে বলা হয় , পাকিস্তান সৈন্য সরিয়েছে তাদের মহড়া ও প্রশিক্ষণের নিমিত্তে ।

এ কথা কে বিশ্বাস করবে ? পকিস্তান যেখানে আমাদেরকে তিন তিনবার আক্রমণ করেছে, এহেন বিশ্বাস অসম্ভব ! যাই হোক, দশ দিন অপেক্ষা করার পর আমাদের সৈন্য সীমান্তে পাঠানো হয়েছে – বলেন প্রধানমন্ত্রী !

এটা কি আশ্চর্য্য যে , পাকিস্তান সৈন্য পাঠানো শুরু করলে বৃহৎ শক্তিগুলো মনেই করলো না এটা ভারতের জন্য হুমকি ! কিন্তু যখন আমরা সৈন্য পাঠালাম , তখন তারাই হৈচৈ , কান্নাকাটি করে বলা শুরু করলো এটা উপমহাদেশের জন্য বিরাট হুমকি ! কোন দায়িত্বশীল সরকার এহেন সংকটময় মুহূর্তে তার সীমান্তকে সুরক্ষিত না করে পারে না ।

যেহেতু আমাদের সেনানিবাস সীমান্ত হতে অনেক দূরে অবস্থিত ,তাই চাইলেই কম সময়ে সেখানে সৈন্য সরানো যায় না ।

পাকিস্তানের পক্ষে এই কাজটি অধিকতর সহজ । কারন সীমান্ত তাদের সেনানিবাস হতে অতি কাছে । আক্রমণ করে পাকিস্তান যদি আমাদের ভূমি দখল করে, তবে তাহা ফেরত পাবার নিশ্চয়তা আমাদেরকে কে দিবে ? তিনি প্রশ্ন রাখেন ।

তিনি পুনরায় বলেন , পাকিস্তান পূর্ববাংলা হতে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করার অর্থই হবে, কোন যুদ্ধের সম্ভাবনা নাই । ঐখানে
সৈন্য মোতায়েনই হলো এই সমস্যার প্রধান কারন ।

ত্রৈমাসিক এক আলোচনায় পরামর্শ দেয়া হয়েছে যে , পূর্ববাংলায় শীঘ্রই ইউ.এন. পর্যবেক্ষক মোতায়েন করা হচ্ছে ।তাতে লাভ কি ? তারা কি বাংলাদেশে শরণার্থীদেরকে নির্ভয়ে দেশে ফিরে যেতে দিতে সমর্থ হবে ? তিনি আবারও প্রশ্ন করেন । শরণার্থীরা বলে যে , তারা তখনই সেখানে ফিরে যাবে যখন বাংলাদেশ স্বাধীন ও শান্তিপূর্ণ হবে ।

প্রধানমন্ত্রী মনে করেন যে , ঐ শত্রুতার খণ্ড, টুকরো ভূমিতে শান্তি ফিরিয়ে আনাই হবে আমাদের প্রথম পদক্ষেপ । এখনও সেখানে মানুষ খুন ও নারীধর্ষণ চলছে । ভারত দরিদ্র । ভারতের উপর এত বড় একটা বোঝা থাকা সত্ত্বেও আমরা এহেন অবস্থায় তাদেরকে দেশে চলে যেতে বলতে পারিনা।

তিনি বিদেশে সফরকালে তাঁর অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন যে , পূর্ববাংলার সমস্যা নিরশনে রাজনৈতিক সমাধান আনা সম্ভব । বৃহত্তর শক্তিগুলো তা’র উদ্যোগ নিলেও তার কোন প্রভাব এখনও পরিলক্ষিত হয় নি ।”পাকিস্তান ভারতকে হুমকি দেবার অনেক মাস পর পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করলেও , তার কোন সুরাহা পাইনি ।

শক্তিশালী কিছু দেশের শাসনের উদ্ধৃতি দিয়ে মিসেস গান্ধী বলেন , এশীয় দেশগুলিকে তারা এখনও তাদের “ক্রীতদাস” বলে মনে করে । কিন্তু ভারত স্বাধীনতার পূর্বে , এমনকি পাঁচবছর আগেও যা ছিল, এখন আর তা নয় । পাঁচ বছর আগেও প্রশ্ন জাগতো , ভারতবর্ষ কি ঐক্যবদ্ধ হয়ে অবিভক্ত থাকতে পারবে ? এ দেশের গণতন্ত্র কি বেঁচে থাকবে ? কিন্তু এহেন সন্দিহান আজ অপগত ।
এ দেশের আরেকটি নতুন আত্ন প্রত্যয় এই যে , ভারত তার জতীয় স্বার্থে তৎপর হতে “অসমর্থ”এ কথা কেউ মনে করলে চরম ভুল করবে ।

বৃহত্তর শক্তিগুলো আমাদেরকে সাহায্য করলে খুবই ভাল । আমরা তা কৃতজ্ঞতার সাথে গ্রহণ করবো । যদি না করে তবে আমি স্পষ্ট করে জানাতে চাই যে , ভারত তার নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছে । অন্যের সাহায্য ভিক্ষার আশায় চেয়ে থাকবে না ।

মিসেস গান্ধী বলেন , এই ব্যপারে আমাকে “জেদী” বলা হয়েছে।
বাংলাদেশের ধংসযজ্ঞ থামানো মানে আমার জেদ নয় । বংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে ধংসের কবল থেকে বাঁচানো ভারতের জাতীয় স্বার্থ । এবং এটা অবশ্যই বাংলাদেশের স্বার্থও বটে ।

কিছু দেশ পাকিস্তানকে সমরাস্ত্র সরবরাহ করে ইন্ধন যুগিয়েছে। ইহা ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের যুদ্ধের পায়তারা বর্ধিত করেছে।

তিনি মনে করেন, পাক নেতারা সুষ্ঠু নীতিমালা অনুসরণ করছে না। কারন তারা এমন সকল কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে যা তাদের দেশের জাতীয় স্বার্থ সম্বলিত না।

প্রধানমন্ত্রী বলেন , প্রতিবারই কলকাতায় সভা করতে আসার আগে মনে হয় তেমন কোন লোকজন হয়তো হবে না । কিন্তু প্রতিবারই পূর্বাধিক বিশাল জনসমাবেশ দেখে আমি আশ্চর্য্য
হই ।

তিনি উল্লেখ করেন যে, এই বিশাল সমাবেশের উষ্ণ সাদর সম্ভাষণ , আমার একার জন্য নয় ; বরং আমাদের নতুন মহৎ কর্মসূচীর জন্য ।

মধ্যবর্তী কালীন নির্বাচনের পর আমরা , মনে করেছিলাম সামাজিক কাঠামো উন্নয়নের দিকে নজর দিব । কিন্তু সীমান্তে পাকিস্তানী জান্তাদের কবল হতে রক্ষা পেতে, অগণিত নিরীহ জনতার আন্তঃ প্রবাহ একটা নতুন সমস্যার সৃষ্টি । শুরুতে ভেবেছিলাম সমস্যা সাময়িক এবং বিদেশী দেশগুলির সহযোগিতায় তা অল্প সময়ে নিরসন সম্ভব । কিন্তু তা হয়নি । প্রথমতঃ পর্যাপ্ত সাহায্যের অপ্রাপ্তি ।

দ্বিতীয়তঃ যে দেশগুলি সাহায্য দিয়েছে তারা , এই বিশাল শরণার্থী নিজের দেশ ছেড়ে আমাদের দেশে কেন আসলো তার মূল কারণ তলিয়ে দেখেনি ।

প্রধানমন্ত্রী বলেন , রোগ নিরসনে রোগের প্রধান কারণ খুঁজে বেড় করতে হয়।
ডানপন্থী কংগ্রেস ও নির্বাচনী অঙ্গীকারের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন , দল যা করতে চাচ্ছে তা নতুন কিছুই নয় । এগুলি দলের মূল কর্মসূচী । দলের কিছু সংখ্যক সদস্যদের বিরোধিতার কারণে তা করা সম্ভব হয়ে উঠছে না।

ডানপন্হী কংগ্রেস, মহারাজা আর কোটিপতিদের বিরুদ্ধে নয়।বরং সেই পদ্ধতির বিরুদ্ধে, যেখানে কিছু সংখ্যক লোক ধনকুবের বনে যাবে আর সিংহভাগ জনতা দারিদ্রে হিমসিম খাবে । পশ্চিমবঙ্গে দারিদ্রতা এবং চাকুরী হীনতা সব চাইতে বেশী । এর মূল কারন ক্রমাগত বয়কট ও বাধকতা । যে সমস্ত দলগুলি তাদেরকে বিপ্লবী মনে করে , এ সকল নিরসনে তাদের কোন উদ্যোগই নাই । এরা গরীব কৃষকদের ভূমি পেতে প্রলোভন দেখিয়েছে, কিন্তু ভূমি দস্যুদের ভূমির ক্ষুধা সমস্যার কোন সমাধান দেয় নাই ।

দীর্ঘ মেয়াদী ফায়দার জন্য দরকার ২৫তম সংশোধনী কার্যকরী করে ধন সম্পদ জাতীয়করণ করা । মিসেস গান্ধী বলেন, এই জাতীয়করণে স্বতন্ত্র দলের সর্বদাই বিরুদ্ধাচরণ । প্রমাণ হিসেবে মিল কারখানা জাতীয়করণের অপারগতার কথা উল্লেখ করে এরা বলেন – “এতে কোন ফায়দাই আসবে না” । আহমেদাবাদের টেক্সটাইল মিল উল্লেখ করে তিনি বলেন , এটা অনেক সময়
সত্য । কিন্তু এটা তো মিল মালিকদের পূনঃ উৎপাদন ফিরিয়ে এনে মুনাফা বাড়ানোর অপারগতা ! সে পশ্চিম বঙ্গের যুব কংগ্রেস ও ছাত্রদলের খুনাখুনি, মারামারির রাজনীতি খতমের ভূয়সী প্রশংসা করেন । কিন্তু তারপরও তিনি মনে করেন এইক্ষেত্রে আরও অনেক কাজ বাকি । সীমান্ত হুমকির কারনে পশ্চিমবঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা অনিশ্চিত । তিনি মজুতদার আর মুনাফাখোরদের সম্পত্তি বা দোকানপাটে আক্রমণ না করে শান্তিপূর্ণভাবে স্বাভাবিক জীবনযাপন করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জনান । কোলকাতা নোংরা বলে যথেষ্ট নাম আছে । হয়তো এটা কোলকাতা কর্পোরেশনের দোষ ! কিন্তু জনতারও যথেষ্ট ভূমিকা ও দায়িত্ব থাকা উচিৎ । এই দুর্যোগের সময় মহামারীর প্রাদুর্ভাব যাতে না হয় সেই দিকে নজর রেখে শহরের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে ।
**************

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৯০। পাক-ভারত-বাংলাদেশ যুদ্ধের খবর আনন্দবাজার পত্রিকা ৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১

Fakhruzzaman Sayam
<১৪, ৩৯০, ৯২৮-৯৩০>

করাচী ও ঢাকায় বোমাবর্ষণঃ
বাংলাদেশের ১১টি বিমান বন্দরে ভারতীয় বিমানের হানা
চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ভারতীয় নৌ-আক্রমণ

৪ঠা ডিসেম্বর- আজ রাত্রে একজন সরকারী মুখপাত্র বলেন যে, গত ১৮ ঘণ্টায় তিনটি মিরাজ এবং দুটি এফ-১০৪ স্টার ফাইটারসহ ৩৩টি পাকিস্তানী বিমান ভূপাতিত অথবা ধ্বংস করা হয়েছে। গত রাত্রে ভারতীয় বিমান ঘাঁটিগুলির ওপর বিনা প্ররোচনায় পাকিস্তানের নির্লজ্জ আকস্মিক আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতীয় বিমান বাহিনী গতকাল মধ্য রাত্র থেকে আক্রমণ শুরু করেছে। বাংলাদেশে পাকিস্তানী বিমান বাহিনী প্রায় খতম হয়েছে, আর দুই-তিনটি বিমান সম্ভবত অক্ষত আছে। ভারতীয় বিমান বাহিনী ১১টি বিমান ধ্বংস হয়েছে-৬টি পশ্চিম পাকিস্তানে, ৫টি বাংলাদেশে।

পূর্ব সীমান্তে ময়মনসিংহ জেলার কমলপুর ঘাঁটির পতন ঘটেছে। এই ঘাঁটির ৩১তম বালুচ বাহিনী ও ভেজার্ট রেঞ্জাররা ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। শনিবার চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বন্দর শহরের ওপর ভারতীয় নৌবহন প্রচণ্ড আক্রমণ চালায় এবং বাংলাদেশের পাক দখলকৃত এলাকার বন্দরগুলোকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। আজ অপরাহ্ণে দ্বিতীয়বার চট্টগ্রাম পোতাশ্রয় আক্রমণ করে এবং প্রভূত ক্ষতিসাধন করে।

ভারতীয় বিমান বাহিনী ঢাকা-যশোর খণ্ডে ১৭০ বার ঝাঁক বেঁধে গিয়ে আক্রমণ করে ১৪টি বিমান ভূপাতিত করেছে এবং সামরিক লক্ষ্যবস্তুর উপর আঘাত হেনেছে।

পশ্চিম সীমান্তে ভারতীয় সৈন্য বাহিনী শত্রু এলাকার ৭ কিলোমিটার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে খেরি ও নুনিসহ পাকিস্তানের ৯টি গ্রাম দখল করেছে। মেন্ধার খণ্ডের বিপরীত দিকে একটি পাকিস্তানী ঘাঁটি দখল করেছে- এখানে বহু পাকিস্তানী সৈন্য হতাহত হয়েছে। ভারতীয় বাহিনী ছাম্ব-জোরিয়ান খণ্ডের বিপরিতে মাতোয়ালী শহরটি দখল করেছে।

ভারতীয় বিমান বাহিনী করাচী বন্দর ও নৌবন্দর সারগোধা, পোরকোট প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোর ওপর বোমা ফেলে এসছে। এই সীমান্তে ১৯টি পাক বিমান ধ্বংস করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে ৮০ জন পাক সৈন্য ভারতীয়দের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। হুসেনীওয়ালাতে ১২টি পাকিস্তানী ট্যাঙ্ক ধ্বংস করা হয়েছে। হুদিয়ারা নালায় এক কন্টিনজেন্ট পাক সৈন্য অবরুদ্ধ হয়ে আছে।

ঢাকা চট্টগ্রাম করাচি-শত্রুর ঘাঁটিতে বোমাবর্ষণ
বাংলাদেশে চতুর্দিক থেকে জওয়ানেরা আগুয়ান
বরুণ সেন গুপ্ত
যুদ্ধের প্রথম দিনই ভারতীয় সেনা নৌ এবং বিমানবাহিনী বাংলাদেশের দখলদার পাক বাহিনীর ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়েছি। চতুর্দিক থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী এগোচ্ছে। চূড়ান্ত লক্ষ্য ঢাকা দখল এবং পাক বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা। প্রথম দিনের প্রাথমিক ধাক্কাতেই বিভিন্ন সেক্টরে পাক বাহিনী বিপর্যস্ত, বাংলাদেশে পাক বিমান বাহিনীর অর্ধেকের বেশী বিধ্বস্ত এবং জলপথে তারা সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ। সর্বত্র ভারতীয় বাহিনীর সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন বীর মুক্তিবাহিনী।

এই খবর যখন আপনি পড়ছেন ততক্ষণে পূর্ব বাংলার বহু শত বর্গমাইল এলাকা থেকে পাক সেনাবাহিনী বিতাড়িত। শনিবার সন্ধ্যায়ই সরকারী হিসাবমত ২০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ভারতীয় বাহিনীর দখলে। কিন্তু এই হিসাব এতক্ষণে অনেক পালটে গিয়েছে। ভারতীয় বাহিনী আরও বহুদূর এগিয়েছেন। শনিবার সকালে যশোর সীমান্তে গিয়েছিলাম। ভারতীয় বাহিনীর অধিনায়ক বললেনঃ আজ আমরা যশোর থেকে মাত্র সাত আট মাইল দূরে। কাল সকালে যদি আসেন দেখবেন আমরা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছি।

তিনটি ভারতীয় বাহিনী তিনভাবে আক্রমণ করেছে। একই সঙ্গে বিমানবাহিনী ভোরেই সমগ্র বাংলাদেশে সবকটি পাক বিমানঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালায়। এই আঘাতে এই দিন তাদের ১৪টি বিমান ধ্বংস হয়ে গিয়েছে তার মধ্যে ৭টি স্যাবর জেট। এছাড়া আমাদের বিমানগুলি ঢাকা, যশোর, হিলি, লালমনিরহাট, আখাউড়া, কক্সবাজার, মালাপুর প্রভৃতি ১১টি বিমানবন্দরের ওপর আক্রমণ চালিয়ে ওগুলিকে অনেকটা অকেজো করে দিয়ে এসেছে।

আমাদের বিমান বাহিনীর আক্রমণে এইদিন সৈয়দপুরে কয়েকটি পাক সেনা বোঝাই ট্রেন এবং যমুনায় ছ’টি স্টিমারও ধ্বংস হয়েছে।

চট্টগ্রাম এবং নারায়ণগঞ্জে তৈল ডিপোর ওপরও প্রচণ্ড আক্রমণ চালায় ভারতীয় বিমান বাহিনী। দুটো এলাকায়ই এখনও আগুন জ্বলছে। বিমান আক্রমণ চলছে খুলনা স্টিমারঘাটের ওপরও। চট্টগ্রামে দুটি পাক জাহাজও বিধ্বস্ত।

অবশ্য এই ধ্বংসলীলা ছাড়াও পূর্ব বাংলার সমুদ্রপথ পাক বাহিনীর কাছে সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ। কারণ, নৌবাহিনী গোটা বঙ্গোপসাগরে অবরোধ সৃষ্টি করেছেন। সমুদ্রপথে বাংলাদেশের দিকে এগোনো পাক বাহিনীর পক্ষে অসম্ভব। স্বয়ং আই এন এস বিক্রান্ত চট্টগ্রাম বন্দরের মুখে। বিক্রান্ত বিমানবাহী জাহাজ। বিক্রান্ত থেকে বার বার বিমান উড়ে গিয়ে চট্টগ্রাম এবং নারায়ণগঞ্জ আক্রমণ করেছে। একটি পাক বাণিজ্য জাহাজ কলম্বো থেকে সামরিক উপকরণ নিয়ে বাংলাদেশের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। ভারতীয় নৌবাহিনী তাকে আটক করেছে।

বিমান ও নৌবাহিনী যখন গোটা পূর্ব খণ্ডে আক্রমণে পাক দখলদারদের বিধ্বস্ত করছে ঠিক তখনই ভারতীয় সেনাবাহিনী খুব দ্রুত আঘাত হেনে স্থলপথে অগ্রসর হচ্ছে। ভারতীয় বিমান ও নৌবাহিনী গোটা পূর্ব বাংলায় পাক ঘাঁটিগুলির ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। আর সেনাবাহিনী এগোচ্ছে কতকগুলি নির্দিষ্ট সেক্টর দিয়ে। মূল লক্ষ্য ঢাকা। কতকগুলি এলাকায় পাক বাহিনী শেষ পর্যন্ত লড়াই করেছে। কতকগুলি অঞ্চলে আবার সামান্য যুদ্ধের পরই তারা আত্মসমর্পণ করেছে। ভারতীয় বিমান ও নৌবাহিনী এইদিন প্রচণ্ডভাবে রকেট ব্যবহার করেছে।

এই সার্বিক বিমান আক্রমণের ফলে একদিকে যেমন গোটা বাংলাদেশে পাক সেনাবাহিনী প্রচণ্ড অসুবিধায় পড়েছে, তেমনি সুবিধা হয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর। অগ্রবর্তী ভারতীয় পদাতিক সেনাবাহিনীর ওপর বিমান আক্রমণ চালাবার তেমন ক্ষমতা আর পাক প্রতিরক্ষা বাহিনীর নেই। এবং পাক ক্যান্টনমেন্ট ও গ্যারিসনগুলির ওপর যখন ভারতীয় বিমানবাহিনী আক্রমণ চালাবে তখন তা প্রতিরোধের ক্ষমতাও পূর্ব বাংলায় পাক বিমান বাহিনীর থাকবে না। এখন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আর বিমান আনাও তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর অগ্রগতি আসলে শুরু হয়েছে শনিবার বেশি রাত থেকে। শনিবার গোটা দিনে তাঁরা প্রধানত আক্রমণের প্রস্তুতি গড়েছেন। এবার চতুর্দিক থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী অগ্রসর হতে থাকবেন।

দর্শনা স্টেশন, ঠাকুরগাঁও, চরখাই, কমলপুর, কুলাউড়া, গাজিপুর এবং চৌদ্দগ্রামের পতন ঘটেছে। এখন ওগুলি ভারতীয় সেনাবাহিনীর দখলে। সাতক্ষীরা এবং আখাউড়ায় শনিবার বিকেলবেলা প্রচণ্ড লড়াই চলছিল।

আজ যশোর, সিলেট, কুমিল্লা, রাজশাহী, রংপুর প্রভৃতি শহরের ওপর আক্রমণ বাড়বে। শনিবার রাত্রে ভারতীয় সেনাবাহিনী ওই শহরগুলির দিকে এগিয়েছেল।

এছাড়া বাংলাদেশের ভেতরের কতকগুলি শহর থেকেও পাক সেনাবাহিনী দ্রুতগতিতে ক্যান্টনমেন্টগুলির দিকে চলে আসছে। ফলে বরিশাল, ফরিদপুর এবং পটুয়াখালি এখন সম্পূর্ণ মুক্ত। ওই সব জেলায় আর কোন পাক কর্তৃত্ব নেই।

এই স্থল ও বিমানযুদ্ধে এইদিন বিকাল পর্যন্ত বিভিন্ন সেক্টরে অন্তত তিনশত পাকসেনা নিহত হয়েছে। আর প্রায় একশত আত্মসমর্পণ করেছে। এই চরখাইতেই দু’জন অফিসারসহ ৫০ জন পাকসেনা আত্মসমর্পণ করেছে।

আসল স্থলযুদ্ধ অবশ্য হবে আজ রবিবার থেকে।
ভারতীয় প্রতিরক্ষা দফতরের এক মুখপাত্র জানান, এই দিনের যুদ্ধে ভারত চারটি জঙ্গী বিমান হরিয়েছে এবং কিছু সৈন্য মারা গিয়েছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৯১। পূর্ববঙ্গে পাক বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা আমার লক্ষ্য- লেঃ জেঃ অরোরা আনন্দবাজার পত্রিকা ৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১

Fakhruzzaman Sayam
<১৪, ৩৯১, ৯৩১-৯৩২>

পূর্ববঙ্গে পাক বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা
আমার লক্ষ্য- লেঃ জেঃ অরোরা
(স্টাফ রিপোর্টার)

কলকাতা, ৪ঠা ডিসেম্বর- বাংলাদেশের ব্যপারে ভারতীয় বাহিনীর উদ্দেশ্য সম্বন্ধে পূর্বাঞ্চলের অধিনায়ক লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আজ সাংবাদিকদের বলেছেন, পূর্ববঙ্গ দখল করা ভারতীয় বাহিনীর উদ্দেশ্য নয়। এ সম্পর্কে আমার সরকারের নীতি খুবই পরিষ্কার। আমার সরকার চান, বাংলাদেশে যথার্থ জনপ্রতিনিধিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠিত হোক।

পাকিস্তানের যুদ্ধ ঘোষণার অব্যবহিত পরেই পূর্ব খণ্ডে ভারতীয় জোওয়ানরা দুর্বারগতিতে পাকিস্তানী সেনাদের আঘাত দিয়ে চলেছে। আজ সকাল থেকে সন্ধ্যের মধ্যে ভারতীয় জোওয়ানরা স্থলে, জলে ও অন্তরীক্ষে একের পর এক সাফল্য অর্জন করে চলেছে বলে প্রতিরক্ষা বাহিনীর একজন জানান।
ইস্টার্ন কম্যান্ডের জি ও সি লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আজ কলকাতায় ভারতীয় ও বিদেশী সাংবাদিকদের এক সম্মেলনে বলেন যে, ভারতীয় বিমানবাহিনী প্রধানতঃ সামরিক ঘাঁটি, লক্ষবস্তু এবং বিশেষ করে বিমানঘাঁটির উপর আক্রমণ চালিয়েছে।

ভারতের সামরিক অভিপ্রায় সম্পর্কে তিনি বলেন যে, বাংলাদেশে মোতায়েন পাক সৈন্য বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করাই আমার লক্ষ্য। বাংলাদেশে সংগ্রামরত পাকবাহিনী যুদ্ধ থেকে বিরত এবং আত্মসমর্পণ না করা পর্যন্ত আমাদের সামরিক অভিযান চলবে।

বাংলাদেশে ৮০ হাজার পাকসৈন্য
লেঃ জেঃ অরোরার অনুমান বাংলাদেশে চার ডিভিশন অর্থাৎ ৭০ থেকে ৮০ হাজার পাকিস্তানী সৈন্য আছে। এর মধ্যে দুই ডিভিশন যশোর থেকে বাংলাদেশের পশ্চিম খণ্ডে এবং নাটোর অথবা বগুড়ায় আক্রমণ চালাচ্ছে আর তৃতীয় ডিভিশনটি রয়েছে ঢাকার সামরিক সদরঘাঁটিতে।

তিনটা দিন সময় দিন
যশোরে আক্রমণাত্মক অভিযান সম্পর্কে তাঁর পরিকল্পনা সম্বন্ধে বিদেশী সাংবাদিকরা বার বার প্রশ্ন করতে থাকলে তিনি বলে, আমাকে দয়া করে তিনটা দিন সময় দিন।

লেঃ জেনারেল অরোরা বলেন যে, বয়রার অদূরে ভারতীয় ঘাঁটিগুলির সৈন্যশক্তি গতকাল রাত্রে বৃদ্ধি করা হয়েছে।

বাংলাদেশে পাক বিমান বাহিনীর শক্তি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে লেঃ জেঃ অরোরা বলেন যে, গত মাসে বয়রায় সংঘর্ষের সময় পাকিস্তানের তিনখানি স্যাবর জেট খতম হয়েছে। তাঁর বিশ্বাস ভারতীয় বিমানবাহিনী আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বাংলাদেশে জঙ্গীশাহীর আর যে কয়খানি বিমান আছে তা খতমের কাজ শেষ করতে পারবে। বাংলাদেশে পাক বিমানবহরকে নির্মূল করতে পারলে আমাদের স্থলসৈন্যদের কাজে খুবই সুবিধা হবে।

তিনি বলেন, কিছুদিন যাবৎই বাংলাদেশের অবস্থা উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে আছে। আমরা কোনো কোনো অঞ্চলে আক্রমণাত্মক ও প্রতিরক্ষামূলক তৎপরতার জন্য সৈন্য পাঠিয়েছে।

লেঃ জেঃ অরোরা বলেন যে, তাঁর কিছু আক্রমণাত্মক পরিকল্পনাও আছে। তবে তিনি এখন ফাঁস করবেন না। তবে আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে আক্রমণ করেই পূর্ববঙ্গ রণাঙ্গনের সমস্যার মোকাবিলা করা এবং যত শিঘ্রই সম্ভব পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীকে ‘টিট’ করার চেষ্টা করবেন। এর অর্থ হলো পাক-বাহিনীর মোকাবিলা করার জন্যে ভারতীয় জোওয়ানরা বাংলাদেশে ঢুকবে।

প্রতিরোধ অতীতের বস্তু
পাকিস্তানী বাহিনীর প্রতিরোধ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে লেঃ জেঃ অরোরা বলেন যে, বাংলাদেশে মোতায়েন পাক বাহিনীর প্রতিরোধ এখন অতীতের বস্তু। তিনি বলেন, আগরতলা এলাকায় সব চেয়ে জোর লড়াই চলছে। অন্যান্য এলাকাতেও মোটের ওপর তাই। পূর্ব রণাঙ্গনে কোথাও পাকিস্তানী বাহিনী সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতীয় এলাকায় প্রবেশ করেছে কিনা- এই প্রশ্ন করা হলে লেঃ জেঃ অরোরা বলেন, এই ধরনের কোন খবর আমার জানা নেই। তবে পশ্চিম রণাঙ্গনে কোথাও কোথাও তারা সীমান্ত অতিক্রম করেছে।

তিনি বলেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক আইনসভার মুজিবর রহমান ও তাঁর দলকে বিপুল ভোটাধিক্যে জিতিয়ে বাংলাদেশের জনগণ চেয়েছিলেন মুজিবরের নেত্রিত্বে গঠিত সরকার। ভারত সরকারও চান বাংলাদেশে এই সরকার প্রতিষ্ঠিত হোক।
মূলত মার্কিন ও চীনা অস্ত্র

পূর্ববঙ্গে অবস্থিত পাক বাহিনীর অস্ত্রসম্ভার সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে লেঃ জেঃ অরোরা বলেন যে, পাক বাহিনী মূলত মার্কিন ও চীনা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে লড়ছে। এছাড়া তাদের কাছে কিছু ১০৫ মিলিমিটারের ইতালীয় কামানও পাওয়া গেছে।

তেজগাঁ কুর্মিটোলায় আক্রমণ

ভারতীয় বিমান বাহিনী আজ সকালে যে আক্রমণ চালায় তার সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে লেঃ জেঃ অরোরা বলেন যে, ভারতীয় বাহিনীর আক্রমণ একান্তভাবেই সামরিক লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ভারতীয় বাহিনী আজ ঢাকার তেজগাঁও ও কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটি এবং অন্যান্য স্থানের বিমানঘাঁটির উপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণের উদ্দেশ্যে হচ্ছে পূর্ব রণাঙ্গনে পাক বিমান বাহিনীকে খতম করা। তিনি বলেন যে, আমরা রানওয়ে নষ্ট করছি না এবং পূর্ববঙ্গের অর্থনৈতিক কাঠামো বজায় রাখার দিক থেকে প্রয়োজনীয় অসামরিক লক্ষ্যবস্তুও আমরা নষ্ট করছি না।
হতাহতের সংখ্যা জানা যায়নি

তিনি বলেন যে, ভারতীয় বাহিনীর হতাহতের সংখ্যা এখনও জানা যায় নি। তবে কোন কোন অঞ্চলে ভাল যুদ্ধ হয়েছে। পাকিস্তানী সৈন্যরা ভালই লড়েছে। তবে আমি আমার জওয়ানদের কৃতিত্বে গর্বিত।

মুক্তিবাহিনীর উচ্ছ্বাসিত প্রশংসা করে অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন যে, গত দু’মাসে তারা যে কৃতিত্ব দেখিয়েছে তা তারিফ করার মতো।

ভারতীয় বাহিনী মুক্তি ফৌজকে কোন রকম সাহায্য দিয়েছে কিনা এই প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমরা তাদের কোন সাহায্যই দিইনি। তবে আমি এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ যে আমার সরকার শীঘ্রই মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিশে একই কম্যান্ডের অধীনে থেকে কাজ করা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৯২। নিরাপত্তা পরিষদে সোভিয়েট ভেটোঃ বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান দাবী যুগান্তর ৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১

Fakhruzzaman Sayam
<১৪, ৩৯২, ৯৩৩-৯৩৪>

নিরাপত্তা পরিষদে সোভিয়েট ভেটো
বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান দাবী

রাষ্ট্রসংঘ, ৫ ডিসেম্বর (ইউ পি আই, এ পি)- আজ নিরাপত্তা পরিষদে আমেরিকা, ভারত ও পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে অস্ত্রসংবরণ ও সৈন্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে যে প্রস্তাব তুলেছিল, রাশিয়া তাতে ভেটো প্রয়োগ করেছেন। পক্ষান্তরে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান এবং বাংলাদেশে পাক সেনাদের হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হোক। কারণ এইটাই মূল বিরোধের উৎস এবং এগুলি বন্ধ হলেই বর্তমান সংঘর্ষের অবসান ঘটবে।

সোভিয়েত প্রস্তাব উত্থাপন করেন সহকারী পররাষ্ট্র মন্ত্রী জ্যাকব এ মালিক। তিনি দৃঢ়টার সঙ্গে জানান, আমেরিকা যে প্রস্তাব উত্থাপন করেছে, তা পক্ষাপাতিত্বপূর্ণ এবং গ্রহণযোগ্য নয়। আমেরিকার প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় এগার জন প্রতিনিধি। তবে ব্রিটেন ও ফ্রান্স ভোট দানে বিরত থাকে। সোভিয়েত ও পোল্যান্ড বিপক্ষে ভোট দেয়।

মিঃ জ্যাকব বলেন, আমেরিকার প্রস্তাবে এই সংঘর্ষের দায়িত্ব প্রকৃত দোষীর ওপর না চাপিয়ে অন্য পক্ষের ওপর চাপানো হচ্ছে। তাছাড়া পাকিস্তান, তার বড় বড় রক্ষাকর্তারা এবং তাদের ব্লকের সদস্য রাষ্ট্রগুলি ভারত ও পাকিস্তানকে একই পর্যায়ে চেষ্টা করছে। এটা ভীষণ ভুল কাজ। কারণ যদি পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বৈধ প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় অসম্মত না হতেন তবে আজকের এই পরিস্থিতির উদ্ভব হতোই না। গত ডিসেম্বর মাসের নির্বাচনে এই সব প্রতিনিধি যথারীতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।

ভারতের ওপর অকথ্য অত্যাচার ঘটছে
মিঃ মালিক বলেন, ভারতের ওপর অকথ্য অত্যাচার ঘটছে। এক কোটি শরণার্থী ভারতে এসেছে। তাদের দুঃখ কষ্ট অবর্ণনীয়। এই অবস্থায় নিরাপত্তা পরিষদ যদি বাংলাদেশের কোন প্রতিনধির মুখ থেকে সেখানকার পরিস্থিতির কথা শোনেন তবে ভালো হয়। তা থেকে বিরোধের মূল উৎসভূমি কোথায় তা জানা যাবে।

বেলজিয়াম, ইটালি, জাপানের প্রস্তাবে হয়েছিল, ভারত ও পাকিস্তানকে মীমাংসার প্রথম পদক্ষেপরূপে অস্ত্র সংবরণ ও সামরিক তৎপরতা বন্ধ করতে বলা হোক।

আরও বলা হয়,লক্ষ লক্ষ শরণার্থী যাঁরা ভারতে এসেছেন তাঁরা স্বেচ্ছায় যাতে স্বদেশে ফিরে যেতে পারেন তার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। সেক্রেটারী জেনারেল উ থান্টের সঙ্গেও যেন বিভিন্ন রাষ্ট্র ত্রাণকার্যের ব্যপারে সহযোগিতা করেন।

জরুরী অধিবেশন

ভারতীয় সময় রবিবার সকাল। নিরাপত্তা পরিষদের জরুরী অধিবেশন বসল। বিবেচ্য বিষয়ঃ ভারত ও পাকিস্তানের কাছে অবিলম্বে অস্ত্রসংবরণ ও সৈন্য প্রত্যাহার আহ্বান জানানো হতে পারে কিনা।

সোভিয়েত প্রস্তাব

সোভিয়েত প্রতিনিধি প্রস্তাব দিলেনঃ (১) বাংলাদশের রাজনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানানো হোক। এর দ্বারা এক্ষুনি শত্রুতার অবসান ঘটবে। (২) পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানানো হোক, বাংলাদেশ পাকবাহিনীর সর্বপ্রকার হত্যা ও হিংসাত্মক কাজ বন্ধ করতে হবে। কারণ এই হত্যা ও হিংসাত্মক কাজ থেকে পরিস্থিতি অবনতি ঘটেছে।

আমেরিকা গ্রুপের

আমেরিকার প্রতিনিধি মিঃ জর্জ এইচ বুশ তাঁর প্রস্তাবে বলেন, নিরাপত্তা পরিষদ অবিলম্বে অস্ত্রসংবরণের জন্য ভারত ও পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে আহ্বান জানাক। দুটি দেশ যেন এই উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করে। উভয় সরকার ও সংশ্লিষ্ট অন্য সকল পক্ষ, শরণার্থীদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য যেন সর্বতোভাবে চেষ্টা করে। সেক্রেটারী জেনারেল এই উপমহাদেশে শান্তি স্থাপনের জন্য যে প্রস্তাব দিয়েছেন তাতে উভয় দেশেরই সাড়া দেওয়া উচিৎ। এজন্য সীমান্ত বরাবর রাষ্ট্রসংঘের পর্যবেক্ষক নিয়োগ, অস্ত্রসংবরণ ও সৈন্য প্রত্যাহার হওয়া উচিৎ।

তিনি বলেন, পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ। এই অবস্থায় সমস্যা সমাধানের জন্য নিরাপত্তা পরিষদের পক্ষে বলপ্রয়োগের পথ গ্রহণ করা উচিৎ হবে না।

সমর সেনের ভাষণ

রাষ্ট্রসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রথিনিধি শ্রী সমর সেন নিরাপত্তা পরিষদে বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। এ ঘটনা সুনিশ্চিতই এবং ভারতও বাংলাদেশের মানুষকে সাহায্য করে যাবে, সে সব মানুষের মনোবল কোনভাবেই ধ্বংস করা যাবে না।

তিনি বলেন, পাকিস্তানী কামান যখন ভারতের গ্রামের ওপর অবিরত গোলাবর্ষণ করে চলল, তখন ভারতের পক্ষে তার জবাব দেওয়া ছাড়া অন্য কোন পথ ছিল না। পাকিস্তান নিজের দেশবাসীকে জবাই করতে লাগল। তারপর তারা কামানের মুখ ভারতের দিকে ফেরাল। তখন আমাদের কাছে ঐ কামানগুলিকে স্তব্ধ করে দেওয়া ছাড়া অন্য পথ ছিল না। এবং আমাদের বেসামরিক লোকদের রক্ষা করার উদ্দেশ্যে আমরা তা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

আগেই সৈন্য সমাবেশ

শ্রী সেন বলেন, ভারতের বহু আগেই পাকিস্তান সীমান্ত বরাবর সৈন্য সমাবেশ করেছে। বাঙ্গালী বিদ্রোহীদের কোন ভাবে শায়েস্তা করতে না পেরে পাকিস্তান তাদের এই বিশেষ ধরনের সঙ্কটের যথার্থতা প্রমাণের জন্য অন্য একটা পথ খুঁজছিল। বর্তমান সংঘর্ষ সেই খোঁজার পরিণতি।

অধিবেশন স্থগিত

সোভিয়েত ভেটোর পরে নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন বিকেল আরাইটা পর্যন্ত স্থগিত রাখা হয়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৯৩। পাক-ভারত-বাংলাদেশ যুদ্ধের খবর যুগান্তর ৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১

Fakhruzzaman Sayam
<১৪, ৩৯৩, ৯৩৫-৯৩৭>

লাকসামের পতন, লক্ষ্য ঢাকা
(স্টাফ রিপোর্টার)

কলকাতা, ৫ই ডিসেম্বর- বাংলাদেশে ভারতীয় বাহিনীর অভিযানের লক্ষ্য ঢাকা। আজ কলকাতায় ইস্টার্ণ কম্যান্ডের জনৈক মুখপাত্র ভারতীয় ও বিদেশী সাংবাদিকদের বলেছেন যে, বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে ভারতীয় সৈন্যবাহিনী মুক্তিবাহিনী ও সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর সহযোগিতায় বাংলাদেশের রণাঙ্গনে কয়েকটা উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করেছে।

বাংলাদেশে আজকের জয়লাভের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল লাকসাম, আখাউড়া, বকসিগঞ্জ (ময়মনসিংহ), মিয়াবাজার, পারিকোট, লালবাগ (কুমিল্লা) ও যশোরের কোটচাঁদপুর।

যশোর শহর ও ক্যান্টনমেন্ট ভারতীয় বাহিনীর সাফল্য সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে ঐ মুখপাত্র বলেন যে, যশোরকে সম্পূর্ণভাবে অবরুদ্ধ করা হয়েছে। ক্যান্টনমেন্টের পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের ভারতীয় বাহিনীর পক্ষ থেকে মাইকে বলা হচ্ছে “আত্মসমর্পণ অথবা মৃত্যু, এর একটি বেছে নাও।” এদিকে ভারতীয় বাহিনী আজ সন্ধ্যায় দিনাজপুর শহর থেকে প্রায় ৬ মাইল দূরে।

ইস্টার্ণ কম্যান্ডের সামরিক মুখপাত্র আজ বলেছেন, বাংলাদেশে আমাদের অভিযানের সাফল্যের একটা বড় সুবিধা হল যে মুক্তিবাহিনী আগেই বহু এলাকা মুক্ত করে রেখেছেন।

ঐ মুখপাত্র বলেন যে, চট্টগ্রামের দরিয়া এখন ভারতীয় নৌবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। ভারতীয় বিমানবাহী রণতরী ‘বিক্রান্ত’ কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম বন্দরের পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের ঘাঁটিগুলি ধ্বংস করে দিয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে বাংলাদেশে এখন চারটির বেশী নেই।

ইস্টার্ণ এয়ার কম্যান্ডের অধিনায়ক এয়ার মার্শাল দেওয়ান শিলংয়ে বলেছেন যে, বাংলাদেশের আকাশে এখন ভারতীয় বিমান বাহিনীর পূর্ণ আধিপত্য। আজ ভারতীয় বিমান বাহিনী ময়মনসিংহের জামালপুরে পাকিস্তানী কলামের উপর আক্রমণ চালিয়ে ৯০টি সামরিক গাড়ী ও কয়েকশ’ পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যকে নিহত করেছে।

রেল সংযোগ বিচ্ছিন্ন
আখাউড়া ও লাকসামের পতনের ফলে চট্টগ্রাম, ফেনী, চাঁদপুর, কুমিল্লা, শ্রীহট্ট ও ঢাকার মধ্যে রেল সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে।

কলকাতায় ইস্টার্ণ কম্যান্ডের মুখপাত্র বলেছেন যে, ১২ নম্বর ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রাইফেলসের একটি ব্যাটেলিয়ান আখাউড়ায় যুদ্ধ করছিল। তাদের সঙ্গে ট্যাংক ছিল। সকাল সাড়ে ছটায় ভারতীয় বাহিনী চূড়ান্ত আঘাত দিলে আখাউড়ার প্রতিরক্ষা ভেঙ্গে পড়ে। বহু পশ্চিম পাকিস্তানীকে বন্দী করা ছাড়াও ২টি ট্যাংক ও কয়েকটি ফিল্ডগান ভারতীয় সৈন্যদের কাছে ধরা পড়েছে।

কুমিল্লা সেক্টরের মিয়াবাজারে ভারতীয় বাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের ২৫ নম্বর ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রাইফেলসের অধিনায়ক লেঃ কর্নেল বেগকে আটক করেছে। তিনি তাঁর সকল সৈন্য ও অস্ত্রশত্র নিয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন। লেঃ কর্নেল তাঁর ২৩৫ জন লোক নিয়ে ভারতের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে হাত তুলে আত্মসমর্পণ করেছেন।

খুলনা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমায় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানীদের তুমুল লড়াই চলছে।
ময়মনসিংহ সেক্টরের মিয়াবাজারে ৩১ নম্বর বালুচ ও ৭১ নম্বর উইং রেঞ্জার্সের ১৬০ জন লোক তাদের অস্ত্রশস্ত্র সহ আত্মসমর্পণ করেছে। শ্রীহট্ট সেক্টরের মুন্সিবাজার ভারতীয় বাহিনী দখল করেছে। মুন্সিবাজারে ৩০ জন পাকিস্তানী সৈনিককে বন্দী করা হয়েছে। ভারতীয় বাহিনী পশ্চিমে হাতিকান্দা ও পুবে নাগেশ্বরী থেকে রংপুরের গুরুত্বপূর্ণ রেল জংশন লালমণিরহাটের দিকে অভিযান করেছে।

হিলি সেক্টরে পাকিস্তানী সৈন্যরা চারখাই, ফুলবাড়ী দখল করে পার্বতীপুরের রেল জংশনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

নৌবাহিনীর সাফল্য
ভারতীয় নৌবাহিনীর গোলায় চট্টগ্রামের তৈল শোধনাগারের ক্ষতি হয়েছে। ভারতের প্রতিরক্ষা দপ্তর চট্টগ্রাম বন্দরের ধারে কাছে নিরপেক্ষ জাহাজগুলিকে না যাবার নির্দেশ দিয়েছেন।

বিমান বাহিনীর কৃতিত্ব
শিলং-এ ভারতীয় বিমান বাহিনীর মুখপাত্র জানিয়েছেন যে, বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটিগুলির উপর ভারতীয় বিমানগুলি ২৩০ বার আক্রমণ চালিয়ে বিপুল ক্ষতি করেছে। বাংলাদেশে কোন ভারতীয় বিমানের ক্ষতি হয় নি। সবগুলি বিমান নিরাপদে ঘাঁটিতে ফিরে এসেছে। তিনি বলে যে, ভারতীয় বিমানগুলি ঢাকা শিল্পাঞ্চলে ও বিমান ঘাঁটির রানওয়েতে ৩৪ বার বোমা ও গুলী মেরে ক্ষতি করেছে। কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টের বিমান ঘাঁটি ও তেজগাঁও বিমান ঘাঁটিতে আজ পাকিস্তানীদের কোন বিমান ওঠানামা করতে পারে নি। কুর্মিটোলা বিমান ঘাঁটিতে ভারতীয় বিমানের গোলা দশ ফুট গভীর ও ৩০ বর্গ ফুট পরিমিত এলাকায় গর্ত করেছে। গতকালের হানায় ১৪টি পাকিস্তানী বিমান ধ্বংস হয়েছে। ভারতের ৫টি বিমানের ক্ষতি হয়েছে।

মুক্তিবাহিনীর সাফল্য
মুক্তিবাহিনী ঢাকা থেকে ৩১ কিলোমিটার উত্তরের রেল জংশন টঙ্গী দখল করেছে। ফলে ঢাকা ও ভৈরববাজারের মধ্যে রেল সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। ঢাকার উত্তর-পশ্চিমে মনোহরদি ও নরসিংদী থানাগুলি মুক্তিবাহিনী দখলে এনেছেন। এছাড়া মুন্সীগঞ্জ ও মানিকগঞ্জের পুরা মহকুমায় মুক্তি বাহিনী আধিপত্য বিস্তার করেছে। এর ফলে ঢাকার পশ্চিম পাকিস্তানীরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশের রণাঙ্গন থেকে পশ্চিম পাকিস্তানীরা রাওয়ালপিন্ডিতে এই এস-ও-এস পাঠাচ্ছে যে তাদের অস্ত্র ও গোলা বারুদ ফুরিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত সমরসম্ভার পাঠানো হোক। কিন্তু বাংলাদেশের পশ্চিম পাকিস্তানীদের কাছে যাতে কোন রসদ না পৌঁছায় সেজন্য ভারত আকাশ ও নৌপথে অবরোধ ব্যূহ রচনা করেছে।
বাংলাদেশে পাক বাহিনী বিচ্ছিন্ন
(দিল্লী অফিস)

৫ই ডিসেম্বর- বাংলাদেশে পাক বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে পড়েছে। ক্রমশ, জল আর স্থলপথে পশ্চিমের সঙ্গে এখন আর কোন যোগাযোগ নেই। এরা এখন সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এখন এদের চাঙ্গা করে তোলার জন্য ইসলামাবাদে তৈরী করা কাহিনী শোনানো হচ্ছে। এদের বলা হচ্ছে অমৃতসর, পুঞ্চ, ছাম্ব আর ফিরোজপুর এখন পাকিস্তানের দখলে। অতএব মুজাহিদের দল ভয় পেওনা, জেগে ওঠো।
শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৯৪। পাক-ভারত-বাংলাদেশ যুদ্ধের খবর যুগান্তর ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১

Fakhruzzaman Sayam
<১৪, ৩৯৪, ৯৩৮-৯৪১>

ফেনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া কসবা দখল, খানের প্রায় অবরুদ্ধ
(স্টাফ রিপোর্টার)

কলকাতা, ৬ই ডিসেম্বর- বাংলাদেশে ভারতীয় বাহিনীর আজকের সাফল্যগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কসবা। সন্ধ্যায় ভারত বাহিনী লালমনিরহাট রেলশহরের উপকণ্ঠে পোঁছেছে।

ভারতীয় বিমান বাহিনী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনে আজ যশোর ক্যান্টনমেন্ট ও ঝিনাইদহের পশ্চিম পাকিস্তানীদের সামরিক ঘাঁটি ও লক্ষ্যবস্তুগুলির উপর আক্রমণ চালিয়েছে। স্থলবাহিনী ঝিনাইদহ-যশোর রোড ধরে এগিয়ে কালিগঞ্জ দখল করেছে।

ইস্টার্ণ কম্যান্ডের জনৈক মুখপাত্র কলকাতার রাত্রে সাংবাদিকদের বলেন যে, যশোরে অসামরিক লোকদের ক্ষয়ক্ষতি যাতে না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে যশোর ভারতীয় বাহিনী তাদের আক্রমণ সীমাবদ্ধ রেখেছে। তবে তিনি পরিষ্কারভাবে জানান যে, বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের পালিয়ে যাবার কোন পথ নেই। তাদের সরবরাহেরও কোন ব্যবস্থা নেই। ফলে সেখানে তাদের অবস্থা খুবই সংকটজনক।

সকালে ইস্টার্ণ কম্যান্ডের চীফ অফ স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকব এক সাংবাদিক সম্মেলনে জানান যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশে দখলদারী পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের যোগাযোগের সকল সূত্র স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

ভারতীয় নৌবাহিনীর বিমানবাহী তরী বিক্রান্ত থেকে উড়ে গিয়ে বিমান বহর আজ খুব ভোরে খুলনার মংলা বন্দরের কাছে পদ্মা নদীতে দু’টি গানবোট উড়িয়ে দিয়েছে।

সাতক্ষীরা সেক্টরে মুক্তিবাহিনী আজ তুমুল লড়াইয়ের পর সাতক্ষীরা শহরে প্রবেশ করেছে। সাতক্ষীরা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানীরা এখন খুলনা রোড ধরে পিছিয়ে যাচ্ছে।

মুক্তিবাহিনীর বৈমানিকেরা আজ প্রথম বিমান নিয়ে শ্রীহট্ট জেলার পাকিস্তানী ঘাঁটিগুলিতে বোমাবর্ষণ করে নির্বিঘ্নে নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরে এসেছে।

ইস্টার্ণ কম্যান্ডের মুখপাত্র জানান যে, লাকসাম থেকে ভারতীয় বাহিনী ঢাকার পথ ধরেছে। লাকসাম থেকে ঢাকার দূরত্ব সড়ক পথে প্রায় ৭০ মাইল।

ভারতীয় বাহিনী আজ পশ্চিম পাকিস্তানীদের হাতে যে সকল জায়গা মুক্ত করেছে, তা হল ময়মনসিংহ সেক্টরে জয়ন্তীয়াপুর ও গোঁয়াইঘাট, শ্রীহট্ট সেক্টরে লাটু, জুড়ি, কুলাউরা ও মুন্সীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কসবা ও কুটি। এখানে তিতাস নদীর উপর উজানীসার ব্রিজটি ভারতীয় বাহিনী অক্ষত অবস্থায় দখল করেছে।

পঞ্চমুখী অভিযান
বাংলাদেশের ভেতরে পঞ্চমুখী অভিযান চালিয়ে সৈন্যবাহিনী যে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে, আজ সকালে ফেনী, কুলাউড়া ও লাটু দখলের মধ্যে দিয়ে তা প্রমাণিত হয়েছে।পূর্বাঞ্চল কম্যান্ডের চীফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব এদিকে/এদিন সকাল এগারটায় এক সাংবাদিক বৈঠকে ঘোষণা করেনঃ একদিকে যশোর শহরের থেকে প্রায় চার মাইল দূরে প্রচণ্ড লড়াই চলেছে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর অগ্রগতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মেজর জেনারেল জানানঃ ভৌগোলিক দিক থেকে এবং মাটি ও নদী নালার জন্য আমাদের স্থলবাহিনী বাংলাদেশের ভেতরে অগ্রসর হতে অসুবিধে অবশ্যই দেখা দিচ্ছে। বিশেষ করে যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত খারাপ।

সামরিক বাহিনীর জনৈক মুখপাত্র আরো বলেনঃ প্রথম সেক্টরে অর্থাৎ গঙ্গা ও সমুদ্রের ধারা ঘেরা এলাকায় ভারতীয় সেনাবাহিনী আপাততঃ এগিয়ে গিয়ে যশোর শহরের সীমান্তে পৌঁছে গেছে। প্রায় তিন মাইল দূরে প্রচণ্ড লড়াই চলেছে। দর্শনা, জীবননগর দখল করেছে। আর সেনাবাহিনী

চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরের ওপর প্রবল চাপ দিয়ে চলেছে। তাছাড়া মুখপাত্র বলেন, ব্রহ্মপুত্রের কাছে উত্তর সেক্টরে পার্বত্য অঞ্চলে প্রবল লড়াই চলেছে। নবাবগঞ্জের সামনে যুদ্ধ হচ্ছে। বোদা, ঠাকুরগাঁও দখল করে ভারতীয় জওয়ানরা আরো নিচের দিকে নেমে চলেছে।

কালিগঞ্জের দিকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অগ্রগতির উল্লেখ করে মুখপাত্র জানান, কালিগঞ্জ, কমলপুর আত্মসমর্পণ করেছে। বকসিগঞ্জ শহরও দখল হয়েছে। কানারিঘাটের দিকে ভারতীয় সেনাবাহিনী দুর্বারগতিতে এগিয়ে চলছে। শমশেরনগর বিমান ঘাঁটি সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত। মৌলভীবাজার দখলে এসেছে। পাক বাহিনীর ১২ নম্বর ফ্রনটিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে। লাকসাম দখলের পর তারা মুকাদ্দরগঞ্জের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

মেজর জেনারেল জানিয়েছেনঃ বেলোনিয়া পকেট সম্পূর্ণভাবে ভারতীয় সেনার হাতে এসে গেছে।
বিদেশী সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মেজর জেনারেল বলেন, পাক সৈন্যদের হতাহতের তুলনায় ভারতীয়দের কমসংখ্যক সৈন্য আহত বা নিহত হয়েছে। তবে পাকিস্তানী সেনারা প্রবলভাবে লড়ছে। তিনি আরো বলেন এখন পর্যন্ত ৩১৭ জন পাক সৈন্য নিহত হয়েছে। ১৯৯ জন আহত এবং ৪২৬ জনকে আজ পর্যন্ত আটক করা হয়েছে। একজন মুখপাত্র একথাও বলেন, কিন্টনের সাতটি লরী ভর্তি পাক সেনা ধৃত হয়েছে। পাক সেনাবাহিনী সবচেয়ে যে কয়টি জায়গায় ভারতীয় সেনাকে বাধা দিয়েছিল ও দিচ্ছে, তার মধ্যে আখাউড়া, লাকসাম যশোর আছে।

অপর এক প্রশ্নের উত্তরে সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র বলেন, ধৃত পাক সেনাদের সঙ্গে জেনেভা চুক্তি অনুযায়ী সৌজন্যমূলক ব্যবহার করা হচ্ছে। শত্রুসেনাদের আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে। তারা যদি আত্মসমর্পণ করে, তবে রক্তক্ষয় কম হবে। তিনি আরো জানান, ধৃত পাক সেনারা বলেছে, তাদের কাছে সর্বশেষ যে বার্তা এসেছে, তাতে বলা হয়েছে, ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আটকে রাখ। আমরা সাহায্য পাঠাচ্ছি। ইতিমধ্যে পশ্চিমাঞ্চলে আমরা অমৃতশহর, শ্রীনগর দখল করে নিয়েছি। তিনি একথাও বলেন, এসব মিথ্যা বলা হচ্ছে। পাক সেনাদের মধ্যে নিহতের সংখ্যা তিন-চার শয়ের মত হবে।

পাকিস্তানের পনেরোটি স্যাবার জেট এই ভূখণ্ডে ভূপাতিত করা সম্ভব হয়েছে। তাদের ২২টি মার্কিনী ট্যাংক বিধ্বস্ত হয়েছে। তারা বিভিন্ন স্থানে পোড়া মাটি নীতি অনুসরণ করে চলেছে।

মেজর জেনারেল বলেন, ভারতীয় সেনাবাহিনী তীব্রবেগে এগিয়ে চলেছে। আমাদের নৌবাহিনী সমুদ্রপথে বাঁধা দিচ্ছে এবং আমাদের বিমান বাংলাদেশের আকাশের ওপর প্রভুত্ব করছে।

ইস্টার্ণ কম্যান্ডের মুখপাত্র বলেন যে, কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার কাজিপুর পাক সৈন্য মুক্ত হয়েছে। ঝিনাইদহে পাক সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় ভারতীয় সৈন্যরা গুরুত্বপূর্ণ খালিসপুর সেতুটি দখল করেছে।

মুখপাত্রটি বলেন, হাতিবান্ধা থেকে অগ্রসরমান ভারতীয় সৈন্যরা রংপুর জেলার উত্তরে লালমনিরহাটের দিকে অনেক দূর এগিয়ে গেছে।

কুমিল্লাখণ্ডে আমাদের সৈন্যরা বরচাঁদ ও একতাবপুর মুক্ত করার পর গোমতী নদী পার হয়ে গেছে।

মেঘালয়খণ্ডে ভারতীয় সৈন্যরা কমলপুরের ৪০ কিঃ মিঃ দক্ষিণে জামালপুর ও চরবাংলি দখল করার পর ময়মনসিংহ জেলার দিকে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গখণ্ডে ভারতীয় সৈন্যরা ঠাকুরগাঁও-এর ২৭ কিঃ মিঃ দক্ষিণ-পূর্বে বীরগঞ্জ এবং রংপুরের ২৫ কিঃ মিঃ উত্তরে কালিগঞ্জ আজ সকালে দখল করেছে।

হিলির ১৫ কিঃ মিঃ উত্তর-পূর্বে নবাবগঞ্জ এবং যশোরের ৩০ কিঃ মিঃ উত্তর-পশ্চিমে কোটচাঁদপুরও ভারতীয় বাহিনীর দখলে এসেছে। ভারতীয় সৈন্যবাহিনী মুক্তিবাহিনীর সহযোগিতায় সমস্ত খণ্ডেই পাক সৈন্যদের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে চলেছে।

বিমান বাহিনীর ভূমিকা
শিলং-এ ইস্টার্ণ এয়ার কম্যান্ডের এয়ার মার্শাল দেওয়ান সাংবাদিকদের বলেছেন যে, কুমিল্লার উপর ভারতীয় বিমান আর একটি পাকিস্তানী স্যাবর জেট বিমানকে গুলিবিদ্ধ করে ভূপাতিত করেছে। এই নিয়ে বাংলাদেশে ১৫টি পাকিস্তানী বিমান ধ্বংস হলো। এখন পর্যন্ত এই খণ্ডে ভারতের ৫টি বিমানের ক্ষতি হয়েছে।

১৮৬ বার হানা
তিনি বলেন যে, ভারতীয় বিমান বাহিনী ১৮৬ বার আক্রমণাত্মক হানা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সামরিক লক্ষ্যবস্তু ও ঘাঁটিগুলির ব্যাপক ক্ষতি করেছে। ভারতীয় বিমান আজ কুর্মিটোলা ও তেজগাঁও বিমান ঘাঁটিতে ২৪ পাউন্ডের বোমা ফেলে বিমান ঘাঁটি দুটিকে সম্পূর্ণ অকেজো করে তুলেছে।

নয়াদিল্লী, ৬ই ডিসেম্বর (ইউ এন আই)- ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশে আখাউড়ার ট্রাঙ্ক টেলিফোন অফিস চালু হয়েছে বলে আজ এখানে সরকারীভাবে জানান হয়েছে। জনসাধারণ এই টেলিফোনে যোগাযোগ করতে পারেন বলেও জানান হয়েছে।

২টি পাক ট্যাঙ্কার আটক
দিল্লীতে সরকারী মুখপাত্র জানিয়েছেন যে, পাকিস্তানের জন্য সম্ভারবাহী ২টি বড় ট্যাংকারকে আজ ভারতীয় নৌ বাহিনী মেঘনা নদীর উপকূলে আটক করেছে। বিমানবাহী নৌবহন খুলনার চালনা ও মঙ্গলা বন্দরের লক্ষ্যবস্তুগুলির উপর আক্রমণ চালিয়েছে। খুলনার উপকূলে একটি পাক বাণিজ্য জাহাজ ভারতীয় বিমানকে লক্ষ্য করে গোলা ছুড়লে বিমান বাহিনী জাহাজটিকে আক্রমণ করে।

আগরতলা বিপদমুক্ত
আগরতলা অফিস থেকে অনিল ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন, মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী এখন আখাউড়া এবং কুমিল্লা জেলায় আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পাকিস্তানী ঘাঁটি অধিকার করায় আগরতলা এখন বিপদমুক্ত বলা যেতে পারে।

ভারতীয় বাহিনী এখন আগরতলার সর্ব উত্তরে অবস্থিত ধর্মনগর থেকে জুড়ি রেল স্টেশন পর্যন্ত(ধর্মনগর থেকে ১২ মাইল) এলাকা দখল করে নিয়েছে।

শ্রীহট্টের শালুটিকর বিমান ক্ষেত্রের তিন মাইলের মধ্যে ভারতীয় বাহিনী পৌঁছে গেছে। শ্রীহট্টের কোটাক ও লালখন্ড চা-বাগান ভারতীয় বাহিনী দখল করেছে এবং শ্রীমঙ্গল ও শায়েস্তাগঞ্জের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।

বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে পাক বাহিনীর সেরা দুর্গ ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পাক বাহিনীর একাংশ চাঁদপুর চলে গিয়েছিল। এখন চাঁদপুর ও ময়মানতির মধ্যে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। পাকবাহিনী এখন ক্রমশঃ পিছু হটে যাচ্ছে।

কুমিল্লা-ফেনী খণ্ডে ৭০০ জন পাক সৈন্য নিহত হয়েছে।
শ্রীহট্টের কয়েকটি থানা এলাকা মুক্তিবাহিনী দখল করেছে এবং সেখানে বাংলাদেশ সরকার চালু হয়েছে। ৩রা ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনী যখন চট্টগ্রাম আক্রমণ করে তখন স্থানীয় অধিবাসীরা ‘জয় বাংলা’ ও বিভিন্ন ধ্বনি দিয়ে অভিনন্দন জানায়। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের নাট্যরূপ লেখককে মুক্তিবাহিনী গুলি করে খতম করেছে।

আগরতলা থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল আখাউড়াতে আজ এক বিরাট সমাবেশের মাঝে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। মুক্তিপরিষদের সশস্ত্র বাহিনীর সহযোগিতায় অসামরিক প্রশাসন দেখার জন্য ঐ এলাকায় প্রশাসনিক কাঠামো স্থাপিত হয়েছে।

বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলের মুক্তি পরিষদের চেয়ারম্যান শ্রী জহুর আহমদ চৌধুরী পতাকা উত্তোলন করে বলেন, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরিত করার দিন আর দূরে নেই।

বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি এবং বাংলাদেশের জনগণকে সাহায্যদানের জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর, তাঁর সরকার ও ভারতের জনগণের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

ই বি আর-এর বিশেষ ভূমিকা
কলকাতায় ইস্টার্ণ কম্যান্ডের মুখপাত্র জানিয়েছেন যে, লাকসাম সেক্টরে ভারতীয় বাহিনীকে সক্রিয়ভাবে সাবেক ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের লোকেরা সাহায্য করেছে এবং ফেনী দখলে ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছে।

হিলির উত্তর পশ্চিমে রংপুরের হাতীবান্দা ভারতীয় বাহিনী দখল করেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে সুলতানপুরে ভারতীয় বাহিনী এক কোম্পানী ইঞ্জিনিয়ার, ৭টি গাড়ী ও সামরিক সাজ-সরঞ্জাম, আটক করেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া দখলের পর ভারতীয় বাহিনীকে ভৈরববাজারের দিকে রওনা হতে হবে। ভৈরববাজার ঢাকার উত্তরে টঙ্গী যাবার পথে।

প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ
ঢাকা, ৬ই ডিসেম্বর- ভারতীয় বিমান বাহিনীর বিমানগুলি পশ্চিম দিক থেকে আঘাত হেনে আজ ঢাকা শহরকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।

ভারতীয় বিমান বাহিনীর মিগ ২১ ওয়াই এবং সুহই-৭ এস গত শনিবার ভোরে শহরের ওপর বোমা বর্ষণ শুরু করে এবং আধ ঘণ্টা পর বিকেল পর্যন্ত বোমা বর্ষণ চলে। পরে রাতের অন্ধকারে আবার শুরু হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণীতে প্রকাশ, বিমান হানার ফলে সম্ভবতঃ ১২ জন পাকিস্তানী মারা গেছে। ভারতের দুটি বিমান খোয়া গেছে। উইং কম্যান্ডার বলে চিহ্নিত জনৈক বিমান চালককে বন্দী করা হয়েছে।

বিমানগুলোর মূল লক্ষ্য ছিল ঢাকা বিমান বন্দর। পূর্বাঞ্চলে এখানেই পাকিস্তান বিমান বাহিনীর প্রধান ঘাঁটি এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের ইহাই একমাত্র প্রাণকেন্দ্র।

রাষ্ট্রসংঘ বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থা এবং বিভিন্ন দূতাবাসের ইউরোপীয়দের পরিবারবর্গকে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা সেখানে দেশ ত্যাগের অপেক্ষায় আছে।
শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৯৫। বাংলাদেশ স্বীকৃতি পেল – ‘জয় বাঙলা’ ধ্বনির মধ্যে লোকসভায় ঘোষণা যুগান্তর ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১

Aparajita Neel
<১৪, ৩৯৫, ৯৪২>

বাংলাদেশ স্বীকৃতি পেলঃ
‘জয় বাঙলা’ ধ্বনির মধ্যে লোকসভায় ঘোষণা
(দিল্লী অফিস)

৬ই ডিসেম্বর-ভারত সরকার আজ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এই স্বীকৃতির ফলে এই উপ-মহাদেশে একটি স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের অভ্যুদয় আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা হলো।

প্রধাণমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী আজ সকালে সংসদের যুক্ত অধিবেশনে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের গুরুত্বপূর্ন ঘোষণাটি করেন এবং উভয় সভার সদস্যগণই দাঁড়িয়ে এই ঘোষণাকে স্বাগত জানান। সেই সঙ্গে সংসদ কক্ষে প্রবল হর্ষধ্বনি উত্থিত হয় এবং সদস্যবর্গ উৎসাহ আবেগে মিলিত ধ্বনি তুলেন- ‘জয় বাংলা’, ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের নতুন সরকার ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামে অভিহিত হবে। এই সভা নিশ্চই চান যে, আমি বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, ও অন্যান্য সহকর্মীদের কাছে আমাদের ঐকান্তিক সম্বর্ধণা ও আন্তরিক অভিনন্দন পৌঁছে দিই।

সংসদের অধিবেশন আরম্ভ হওয়ার অব্যবহিত পরেই শ্রীমতী গান্ধী একতি বিবৃতি দিয়ে বলেন, বাংলাদেশের জনগণ বিরাট বাধার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে ‘স্বাধীনতা আন্দোলনের’ ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছেন।

শ্রীমতী গান্ধী বলেন যে, বাংলাদেশ ও ভারতের সরকার ও জনগণ স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য যে একসাথে কাজ করেছেন, তাঁর ভাল প্রতিবেশীর দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।

শ্রীমতী গান্ধী বলেন, একমাত্র এরুপ একটি নীতিই এই অঞ্চলে শান্তি, স্থায়িত্ব ও প্রগতির দৃঢ় প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন যে, বাংলাদেশ সরকার ভারতে আগত শরনার্থীদের দ্রুত প্রত্যাবর্তনের এবং তাঁদের জমিজিমা ও জিনিসপত্র ফিরিয়ে দেবার ব্যাবস্থা করার জন্য পুনরায় উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। ভারত স্বাভাবিকভাবেই এই প্রচেষ্টা কার্যকারী করার ব্যাপারে সর্বতোভাবে সাহায্য করবে।

বেলা সাড়ে দশটার সময় শ্রীমতী গান্ধী এই নাটকীয় বিবৃতি প্রদানের জন্য উঠে দাঁড়ান এবং বিবৃতি পাঠের সঙ্গে সঙ্গে হর্ষধ্বনি ওঠে।

শ্রীমতী গান্ধী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতিদানের প্রসঙ্গ এলে লোকসভায় অভূতপূর্ব উৎসাহ পরিলক্ষিত হয়; সদস্যগণ দাঁড়িয়ে উঠে বিপুল হর্ষধ্বনি সহকারে ঐতিহাসিক ঘোষণাকে অভিনন্দন জানান।

শিরনাম সূত্র তারিখ
৩৯৬। স্বাগত বাংলাদেশঃ বাংলাদেশের স্বীকৃতির ওপর একটি সম্পাদকীয় যুগান্তর ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১

Aparajita Neel
<১৪, ৩৯৬, ৯৪৩-৯৪৪>

স্বাগত বাংলাদেশ

সোমবার, ৬ ই ডিসেম্বর, ইতিহাসের এক যুগান্তকারী দিন। অধীর আগ্রহের বাঞ্ছিত অবসান। বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিয়েছে নয়াদিল্লী। প্রায় ৮ মাস আগে স্বার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে যার প্রথম আবির্ভাব, আজ তার পূর্ন অভিষেক সমাপ্ত। নবজাতকের মাথায় কল্যাণ বারি বর্ষন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধি। ভারতের ৫৫ কোটী নর নারীর অন্তরের শুভেচ্ছা মেশান রয়েছে তার সঙ্গে। লোকসভায় প্রধানমন্ত্রী যখন ঘোষণা করছিলেন ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত তখন আনন্দমুখর হয়ে উঠেছিল পরিষদ কক্ষ। দল মত নির্বিশেষে সবার কণ্ঠ গিয়েছিল মিশে। স্বাগ জানাচ্ছেন তারা বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ রাষ্ট্রটিকে। উচ্ছল হৃদয়ের এই সাদর অভিবাদন গোটা ভারতের তৃপ্ত বাসনার প্রতিধ্বনি। হয়ত চমক লেগেছে ইসলামাবাদের জঙ্গি শাহির। সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালিকে ধ্বংস করার জন্য তারা ছুড়েছিলেন কামানের গোলা। তাদের সি নিক্ষিপ্ত গোলা থেকে জন্ম নিয়েছে নতুন রাষ্ট্র। ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির সম্ভবনায় সে প্রাণবন্ত। তাকে দাবিয়ে রাখতে পারেনা দুনিয়ার কোন স্বৈরাচারী শক্তি।

বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা আপোষে পায়নি, লড়াই করে ছিনিয়ে নিয়েছে। দিতে হয়েছে তাকে রক্তমূল্য। যা সে পেয়েছে তা রাখার জন্য দরকার আরও রক্তের। পূর্বের বাঙ্গালি তার জন্য তৈরি। বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারত। গত ৮ মাস ধরে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করেছে সে। সীমান্তের ওপার থেকে প্রতিদিন ভেসে আস্তও আর্ত মানুষের বুক ফাটা কান্না, ধর্ষীতা নারীর রক্ষার মিনতি এবং মায়ের কোল জড়িয়ে ধরা অসহায় শিশুর ভয়ার্ত চিৎকার। আবার পরক্ষণেই পাক পশুদের উন্মুক্ত উল্লাসের মধ্যেই মিলিয়ে যেত সব। সীমান্তের বাধ ভেঙ্গে ঘাতকের খাঁড়া কেড়ে নিতে পারেনি ভারত। তাঁদের চোখের জল মুছতে ত্রুটি করেনি এদেশের ৫০ কোটী নর নারী। সাময়িক সান্ত্বনায় ভরেছে ওদের মন। কিন্তু প্রাণে আসেনি শান্তি। স্বদেশ যাদের শত্রু কবলিত তারা কি করে পাথর চাপা দিতে পারেন জীবনের সমস্ত অনুভূতি? আহত সিংহের মত গর্জে উঠেছিল বাঙ্গালি। করেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। মুক্তিবাহিনী ধরেছিল অস্ত্র। আঘাতে আঘতে জরজর করে তুলেছিল দখলদার পাক বাহিনীকে। ইয়াহিয়ার অত্যাচারে নিরিস্ত্র জনতার রূপান্তর ঘটেছে জাতীয় সেনাবাহিনীতে। তাঁদের ভরসাস্থল ভারত, ৫৫ কোটি নর নারীর আশির্বাদ তাঁদের পাথেয় এবং স্বাধীনতার উদগ্র আকাঙ্ক্ষা তাঁদের প্রেরণা। আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত একটি দস্যু দলের সঙ্গে ক্ষীণকায় বাঙ্গালির দীর্ঘস্থায়ী লড়াই সাম্প্রতিক ইতিহাসের এক অনন্য সাধারণ ঘটনা। ওরা গোটা দুনিয়ার বিস্ময় এবং ভবিষ্যৎ মুক্তি সেনাদের স্বার্থ পথিকৃৎ। এদের ভাগ্যের সঙ্গে নিজের ভাগ্য মিশিয়ে দিয়েছে ভারত। ইয়াহিয়া দিয়েছে তার জঙ্গি উত্তর। ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন তিনি। জলে, স্থলে এবং অন্তরিক্ষে চলেছে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। পশ্চিম রনাজ্ঞন জ্বলছে। জঙ্গি শাহির শোষণ দুর্গ পুড়ে একেবারে ছাই হবার আগে তা নিভবে না। কোনমতেই ভারত এ আগুণ নিভাবে দেবেনা। গত ২৩ বছরের পাক আবর্জনার সে রাখবে না – বর্ত্মান সংগ্রাম – সামন্ততন্ত্রী পাক দস্যুদের নিঃশেষ করার শেষ সংগ্রাম।

ইচ্ছা করে নয়াদিল্লী নেননি এ রক্ত পিছল বন্ধুর পথ। ইসলামাবাদের উন্মাদের দল তাঁদের ঠেলে দিয়েছে এই পথে। আজ ভারত এবং স্বাধীন বাংলাদেশ সহযাত্রী। মুক্তিযোদ্ধাদের খুন মিশে যাচ্ছে ভারতীয় জওয়ানদের রক্তের সঙ্গে। ওদের সম্মিলিত আঘাত পড়ছে নরপশুদের ওপর। কিসের বন্ধনে বাধা পরেছে অসম সাহসী ভারতীয় জওয়ান এবং দুর্বার মুক্তিসেনা। কোথায় পেয়েছে তারা উল্কার গতি। কেন একসঙ্গে মিশে যাচ্ছে তাঁদের প্রানেত স্পন্দন? ধর্ম নিরপেক্ষ এবং গণতন্ত্রী ভারত আদর্শের মূল্য দিতে যানে। পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক বদ্ধ জলার মধ্যে বাংলাদেশ ফুটন্ত পদ্ম। তার সারা অঙ্গে রয়েছে গণতন্ত্র। এবং ধর্ম নিরপেক্ষতার ছাপ। আদর্শের এই ঐক্য চেতনা ভারত এবং বাংলাদেশকে টেনে এনেছে কাছাকাছি। তাই নবীন মাথায় প্রবীণ ঢেলেছে প্রথম অভিষেকের কল্যাণ বারি। তার হাতে পুঁছে দিয়েছে সৌভ্রাতৃত্বের রাখি। আন্তর্জাতিক সমাজের পাদপ্রদীপের সামনে আসার আগেই নব জাতককে গলা টিপে মারতে চেয়েছিল কায়েমি স্বার্থবাদীর দল। দুহাতে তাকে আড়াল করে রেখেছে ভারত। ইয়াহিয়ার অস্ত্র পরেছে তার পিঠে। ভ্রুক্ষেপ করেনি সে। জমির লোভ তার নেই। আদর্শের জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকারে সে প্রস্তুত। বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দানে সঙ্গে সঙ্গে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে পশ্চিম পাকিস্তান। এটা প্রত্যাশিত নয়। একসঙ্গে থাকতে পারেন কল্যাণব্রতী ও মানবদ্রোহী দুটি রাষ্ট্র। বাংলাদেশে যারা গণহত্যার নায়ক, যারা লক্ষ লক্ষ নর নারীকে ভিটে ছাড়া করার নিপীড়ক যন্ত্র এবং যারা নারীর ইজ্জত অপহারক তারা নিঃসন্দেহে সভ্য সমাজের অপাংতেয়। পূর্বের নতুন সূর্যকে অভিনন্দন জানাতে ভারত যখন ব্যাস্ত তখন অন্ধকারের জিব গুলি খুঁজে বেড়াচ্ছে বিবরাশ্রয়। রেহাই পাবেনা ওরা। ভারতের স্বার্বভৌম মর্যাদার উপরে আঘাত হেনেছে বর্বরের দল। চরম শাস্তি ওদের পাওনা। কোথায় আছে পাক দোস্তদের শয়তানি চক্র? একসঙ্গে গাঁট ছাড়া বেধে তারা করেছে উন্মত্ত নর্তন। ঠেকাতে পেরেছে কি স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রগতি? থামাতে পেরেছে কি তারা জওয়ানদের প্রচণ্ড প্রত্যাঘাত। নির্বোধ ইয়াহিয়া এবং নির্বোধ তার পরিষদ দল। ওদের ধ্বংস অনিবার্য। বাংলাদেশে খুঁড়েছে অত্যাচারী স্বৈরতন্ত্রীর কবর। তাতে ইসলামাবাদের সব নামাবে ভারত। আর এই কবরে মাটি দেবে ভারত এবং বাংলাদেশের সাড়ে ৬২ কোটী নর নারী। এই দুটি রাষ্ট্রের বন্ধুত্বের বুনিয়াদ পরস্পরের বুকের পাঁজরে গড়া এবং শহিদের তাজা রক্তে সিঞ্চিত। এ বন্ধন অক্ষয় এবং ভবিষ্যতের অপরূপ আলোকে ভাস্মর। স্বাগত সার্বভৌম বাংলাদেশ, স্বাগত তার রাহুমুক্ত জনতা, এবং স্বাগত তার সরকার। জয় বাংলা।
শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৯৭। পাক – ভারত- বাংলাদেশ যুদ্ধের খবর হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড ডিসেম্বর ০৮, ১৯৭১

Biplob Momin Jhinuk TIpu
<১৪, ৩৯৭, ৯৪৫- ৯৪৮>

হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড ডিসেম্বর ০৮, ১৯৭১
জাওয়ানদের যশোর ও সিলেট মুক্ত করা
অমিতাভ দাস গুপ্ত

ভারতীয় সেনাদের দ্বারা মঙ্গলবারে সিলেট ও যশোর মুক্ত হবার পর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একটা চরম পর্যায়ে পৌঁছে। দুইটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের মুক্ত হওয়া বাংলাদেশে নির্বাচনের প্রথম জয়ন্তী নির্দেশ করেছিল যেটা স্বাধীনতার পথে একটা গুরুত্বপূর্ণ মোড় ছিল।

যশোরে অগ্রগামী ভারতীয় সৈন্যদের পাকিস্তানী আর্মির রক্ষণাত্মক অবস্থানের ধ্বংস সাধন ছিল উল্লেখযোগ্য এই মর্মে যে শত্রুরা আরও কঠোর যুদ্ধের জন্য ক্যান্টনমেন্টের এই বিভাগীয় সদর দপ্তরে(পাকিস্তানী বাহিনীর আর দুইটি বিভাগীয় সদরদপ্তর ছিল নাটোর ও ঢাকাতে) ঘাঁটি গেড়েছিল। পাকিস্তানী বাহিনীর এই অবস্থানের বিচ্ছিন্নকরণ একটা বিশাল এলাকা খুলে দিয়েছিল খুলনা সেক্টরে ভারতীয় মিত্রদের নিরবচ্ছিন্ন অগ্রসরের জন্য। আসলে, পাকিস্তানীরা ইতোমধ্যেই মঙ্গলা বন্দর পরিত্যাগ করেছিল এবং খুলনা ছেড়েছিল।

যশোর ও সিলেটের, বাংলাদেশের সুরমা ভ্যালির একটি গুরুত্বপূর্ণ চা শহর মুক্তি নিঃসন্দেহে নির্দেশ করে ভারতীয় সেনা পাকিস্তানী বাহিনীর উপরে পূর্ব সেক্টরের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে পুরোপুরি প্রভাব বিস্তার করেছে। ভারতীয় বাহিনীর আগ্রাসনে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য পাকিস্তানী সেনাদের কাছে ঢাকা ছাড়া আর কোন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা বাকী ছিল না।

এ পর্যন্ত যশোর সেক্টরের সংঘর্ষের সময় জুড়ে পাকিস্তানী বাহিনী ক্যান্টনমেন্টে গভীরভাবে আবদ্ধ হয়েও চেষ্টা করে যাচ্ছিল গত ৩৬ ঘণ্টা ধরে ভারতীয় সেনাদের প্রতিরোধ করতে। আসলে, যশোর ক্যান্টনমেন্টে সোমবার সকালে যখন ভারতীয় আর পাকিস্তানী সেনাদের মুখোমুখি সংঘর্ষ হল তুমুল যুদ্ধ হল। আন্দাজ করা হয় ব্রিগেডের পাকিস্তানী সেনারা প্রতিরক্ষী অবস্থান থেকে প্রতিরোধ করতে থাকে। মঙ্গলবার সকালে, যেকোনোভাবে, যখন ভারতীয় সেনারা ক্যান্টনমেন্টের দিকে সুনির্দিষ্ট আক্রমণ করতে থাকল তখন পাকিস্তানী প্রতিরক্ষার মেরুদণ্ড ভাঙ্গা শুরু হয়েছিল। এটা নির্দেশিত হয়েছিল এই বিষয়ের দ্বারা যে ভারতীয় সেনারা বিমানঘাঁটিগুলো দখল করেছিল মঙ্গলবার সকালে। এটা সম্ভব ছিল ক্যান্টনমেন্ট এবং প্রতিরক্ষা অবস্থানগুলোতে ভারতীয় বাহিনীর সুপরিকল্পিত আক্রমণের জন্য।

এরপরেই ক্যান্টনমেন্ট ভূমিতে ভারতীয় সেনারা আবারও একটি আক্রমণ চালায় এবং এতে পাকিস্তানী প্রতিরক্ষা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে। এরপরে তুমুল যুদ্ধ হয় এবং মঙ্গলবার বিকেলের মধ্যেই ক্যান্টনমেন্ট সফলভাবে দখল করে। পাকিস্তানীরা আসলে যশোর শহরে নিজেরাই চলে গিয়েছিল কিন্তু এটাও ভারতীয়দের চলমান চাপের মুখে তাদের অকর্মণ্যতা প্রমাণ করে। রাত শেষ না হতেই পাকিস্তানী বাহিনী নদীর পূর্ব দিক থেকে যশোর শহরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় যাতে তারা কিছু সময় পায় পুনপ্রস্তুতির জন্য। এই প্রক্রিয়ায় যশোর শহর পুরোপুরি পাকিস্তানী মুক্ত হল।

যশোরের এই যুদ্ধের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল যে ভারতীয় সেনারা শহর এবং ক্যান্টনমেন্ট মুক্ত করার পরে আর কোন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সম্মুখীন হয়নি। এটা আসলে পাকিস্তানীদের তড়িঘড়ি করে ঢাকার আশেপাশের প্রতিরক্ষা অবস্থান পুনরুদ্ধার করার প্রচেষ্টা থেকেই বোঝা যায়। এই পুনরুদ্ধার দুই দিন এক রাতে শত্রুপক্ষ থেকে ভারতীয় সেনাদের প্রতিরোধ দ্বারা সহায়তা পেয়েছিল। যে কোন মূল্যে রিপোর্ট করা হয়েছিল যে পাকিস্তানী বাহিনিরা মাগুরার দিকে চলে যাচ্ছে।

একই চিত্র পাওয়া গিয়েছিল সিলেট শহরের যুদ্ধ থেকেও। আটটি আইএএফ হেলিকপ্টার ভারতীয় সেনাদের নামিয়ে দিয়েছিল শহরে যা পাকিস্তানীদের আকস্মিকভাবে পরাস্ত করেছিল।

যদিও এই যুদ্ধের বিস্তারিত তাৎক্ষণিক জানা যায়নি, এটা দৃশ্যমান ছিল যে পাকিস্তানী সৈন্যরা সম্পূর্ণ অবস্থানের হতাশার কথা বিবেচনা করে হাল ছেড়ে দিচ্ছিল। যদি এই সেক্টরের পাকিস্তানী সৈন্যদের ঢাকার দিকে ফেরত নেওয়া হয়ে থাকে তাহলে একই প্রক্রিয়া ছিল ফরিদপুর এবং কুষ্টিয়াতে। এই রকম ফেরত নেওয়ার যাই উদ্দেশ্য থাকুক এই অবস্থা হয়েছিল যে ভারতীয় সেনারা যথাক্রমে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট থেকে কুমিল্লাকে বিচ্ছিন্নকরণে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল এবং কুমিল্লাকে বাইপাস করা হয়েছিল এবং ভারতীয়রা কুমিল্লা ও দাউদকান্দির একটা গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ সড়কের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল সম্ভবত মেঘনার নিকটতম স্থানে পৌঁছানোর জন্য। অন্যদিকে ভারতীয় সেনারা মৌলভীবাজার মুক্ত করেছিল সমশেরনগরের দিক থেকে অগ্রসর হয়ে এবং ঢাকা ও সিলেটের একটি গুরুত্বপূর্ণ নৌঘাঁটি চাঁদপুরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল।

একজন সেনা মুখপাত্র বর্ণনা করেছিল গুরুত্বপূর্ণ এবং দ্রুত আক্রমণগুলো পূর্ব সেক্টরের সমস্ত অঞ্চল জুড়ে পরিচালিত হচ্ছিল যাতে শত্রুরা আন্দাজের উপরেই থাকে। যশোর সেক্টরে একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ কেন্দ্র ঝিনাইদহ মুক্ত হল। যশোরের ২৫ মাইল উত্তরের এই জায়গাটা পাকিস্তানের এই অঞ্চলের প্রতিরক্ষার ভিত্তিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেনা মুখপাত্র এটা পরিষ্কারভাবে সংবাদকর্মীকে জানিয়েছিল যে পুরো অভিযানেই ভারতীয় সেনারা চমৎকার সহযোগিতা পেয়েছে মুক্তি বাহিনীর। তিনি এটাও পরিষ্কার করেছিলেন যে গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর মুক্তি সেনাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ভারতীয় সেনারা শুধু তাদের প্রতিরক্ষা ভেঙ্গে দিতে চাচ্ছিল যেখানেই সম্ভব হয়।

মাধ্যম যুক্ত করেছিলঃ “পাকিস্তানীরা দৌড়ের উপর আছে এবং পুনরুদ্ধারের গতি গত রাত থেকে অনেক দ্রুত”, একজন অফিশিয়াল মুখপাত্র দিল্লিতে বলেছেন।

পাকিস্তানীরা ভার্চুয়ালি স্বীকারোক্তি দিয়েছে তাদের নড়বড়ে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে যখন অফিশিয়াল রেডিওতে বলা হয়েছিল তারা যশোর খালি করেছে। একই রিপোর্ট পাওয়া গিয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকেও।

বিশাখাপত্তনমে পূর্ব নৌ কমান্ড সদরদপ্তরে পাওয়া রিপোর্ট অনুযায়ী পাকিস্তানীরা মঙ্গলা পরিত্যাগ করেছে এবং খুলনা খালি করেছে।

পূর্ব দিকে নৌ সেনাদের এয়ারক্র্যাফট এবং ইউনিটের নৌ আক্রমণের কারনে পাকিস্তানী নৌ ক্র্যাফট এবং সেনা দল এই দুই জায়গা ছেড়ে যাচ্ছে।

সিলেট মুক্ত হয়েছিল ভারতীয় সেনাদের দ্বারা সকাল ১১টা ৩০মিনিটে মঙ্গলবারে।
এর আগে, ভারতীয় সেনারা সিলেটের শালুতিকর বিমানঘাঁটি মুক্ত করেছিল।

সিলেট শহর এবং বিমানবন্দর দখল হয়েছিল ভারতীয় স্থল ও নৌ সেনাদের দ্বিমুখী আক্রমণের দ্বারা।

এয়ার মার্শাল এইচ, সি, দেওয়ান এটা উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিল যে আটটি হেলিকপ্টার ১০০ সেনা সম্বলিত বাহিনী দ্বারা সিলেট শহর এবং বিমানবন্দর দখলের জন্য প্রথমবারের মত অভিযানে পাঠানো হয়েছিল।

একজন সেনা মুখপাত্র বলেছিলেন, গোমতী নদি পার হবার সময় অগ্রগামী সৈন্যরা সুরক্ষিত ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টকে পশ্চিম থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকের রাস্তা বিচ্ছিন্ন করে।

মেহেরপুর, কালীগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, ছাতক সহ গত অন্য পাকিস্তানী ঘাঁটিগুলো গত ২৪ ঘণ্টায় মুক্ত হয়েছিল। পাকিস্তানী বাহিনী ফরিদপুর ও কুষ্টিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল পদ্মার গোয়ালন্দ ঘাঁট দিয়ে রাজধানী ঢাকার দিকে যাওয়ার রাস্তা খুঁজতে।

এরপর দিনাজপুরের হিলিতে যুদ্ধ চলছিল পাকিস্তানী সুসজ্জিত অবস্থানের বিরুদ্ধে। ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানী ব্রিগেডের বিরুদ্ধে নতুন আক্রমণ পরিচালনা করেছিল হিলিতে থেকে ফুলবাড়ি পর্যন্ত পেছন থেকে পূর্ব এবং উত্তর দিক থেকে শত্রুপক্ষকে ঘায়েলের জন্য।

ময়মনসিংহ সেক্টরে ভারতীয় বাহিনী পৌঁছে গেছিল জামাল্পুরের কাছে এবং যমুনার জগন্নাথগঞ্জ ঘাঁট এর দিকে এই শহর মুক্ত করার জন্য অগ্রগামী অভিযান পরিচালনা করছিল যা পশ্চিম তীরে বগুড়াকে একটি ব্রিজহেড প্রদান করেছিল।

গত ২৪ ঘণ্টার অভিযানগুলো নিয়ে বর্ণনায় মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব, চিফ অফ জেনারেল স্টাফ, পূর্ব কমান্ড সংবাদকর্মীকে কলকাতায় বলেছিল যে অন্য উল্লেখযোগ্য অর্জন ছিল উত্তরে রংপুর জেলার লালমনিরহাট বিমানঘাঁটি মুক্ত করা এবং কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টকে এবং দক্ষিণপূর্ব সেক্টরে শহর সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নকরণ।

আখাউরা দিয়ে ঢাকা আক্রমণ নিয়ে জেনারেল বলেছিল ভারতীয় সেনা শত্রুপক্ষের প্রতিরক্ষাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ভৈরব বাজারের এবং টঙ্গী জংশনের দিকে সরাসরি সংঘর্ষ করেছে যেটা রাজধানী শহরের দক্ষিণে ছিল।
অভিযানের অগ্রগতি নিয়ে জেনারেল জ্যাকব বলেছিল যে একবার পাকিস্তানী প্রতিরক্ষার বহির্ভাগ ভেঙ্গে গেলে অগ্রসর আরও ত্বরান্বিত হবে বর্তমানের চেয়ে। তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন পাকিস্তানীরা কিছু শহরে এবং কেন্দ্রে সুসজ্জিত হয়েছিল বাঙ্কার মাইনফিল্ড এবং আর্টিলারি অবস্থান নিয়ে ভারতীয় অগ্রসরকে রুখে দিতে।

বর্তমান অভিযানের দিকে গুরুত্ব দিয়ে জেনারেল জ্যাকব বলেছিল আমরা শহরগুলোকে বিবেচনা করিনি “আমরা জনগণকে আক্রমণ করতে চাইনা, এটা আমাদের নীতি বহির্ভূত”
মেঘালয় সেক্টরে সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ মুক্ত হয়েছিল ভারতীয় সেনাদের দ্বারা।

একটি উপ-বিভাগীয় সদরদপ্তর হিসেবে অন্য জায়গায় ভারতীয় বাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর কাছে পতনের ফলে রিপোর্ট ছিল যে ঢাকা জেলার বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে পাকিস্তানীরা সৈন্য বৃদ্ধি করছিল।
সাবেক পূর্ব বাংলা রাইফেলসের সদস্যরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভারতীয় মুক্তি বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে করতে ময়মনসিংহ জেলার অনেক থানা মুক্ত করেছিল।

আসলে তারা লালমনিরহাটের স্বাধীনতায় নেতৃত্ব দিয়েছিল এবং পাকিস্তানীদের বিমানঘাঁটি থাকা শহরে প্রথম পৌঁছেছিল। বাংলাদেশী স্বাধীনতা যোদ্ধারা এখন শত্রুদের যোগাযোগের সমস্ত মাধ্যম এবং সবরকম চালান বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছিল।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৯৮। পাক-ভারত-বাংলাদেশ যুদ্ধের খবর যুগান্তর ৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১

Fakhruzzaman Sayam
<১৪, ৩৯৮, ৯৪৯-৯৫০>
কুমিল্লা দখল, ময়নামতীতে প্রচণ্ড লড়াই
(স্টাফ রিপোর্টার)

কলকাতা, ৮ই ডিসেম্বর-ভারতীয় বাহিনী এবং বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী আজ বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কুমিল্লা শহর, কুমিল্লা বিমানক্ষেত্র এবং কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর দখল করেছে। তারপর কুমিল্লা শহরের অদূরে ময়নামতী ক্যান্টনমেন্টের ওপর প্রচণ্ড চাপ দিয়ে চলেছে। তারা ময়নামতী ক্যান্টনমেন্টকে সম্পূর্ণ ঘিরে ফেলেছে।

যশোর খণ্ডে ভারতীয় বাহিনী আজ ঝিনাইদহ থেকে এগিয়ে গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ কেন্দ্র মাগুরা দখল করেছে। খুলনার দিকে রূপদিয়া দখল করেছে এবং খুলনার দিকে এগিয়ে চলেছে।

বিমানবাহী রণতরী থেকে বিমানবাহিনী চট্টগ্রাম বিমান ক্ষেত্র, মিলিটারী ব্যারাক এবং কক্সবাজারে বোমা ফেলেছে। চালনা ও মঙ্গলা বন্দরের ওপরও আক্রমণ চালাচ্ছে। গতকাল অধিকৃত রংপুর-দিনাজপুর খণ্ডের পীরগঞ্জে আজ পাক বাহিনীর প্রচণ্ড প্রতি-আক্রমণ রোধ করা হয়েছে। এখানে পাক বাহিনীর প্রচুর ক্ষতি হয়েছে।

মুক্তিবাহিনী চট্টগ্রাম জেলার রামগড় এলাকা মুক্ত করেছে।

ভারতীয় বাহিনীর ইস্টার্ন কম্যান্ডের সর্বাধিনায়ক লেঃ জেঃ অরোরা আজ দুপুরে দখলীকৃত কুমিল্লা বিমানঘাঁটি পরিদর্শন করেন। তিনি যখন বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করেন, তখন স্থানীয় লোকেরা তাঁকে বিপুলভাবে সম্বর্ধনা জানান।

শ্রীহট্ট খণ্ডে ভারতীয় বাহিনী শ্রীমঙ্গল অধিকার করেছে।
ভারতীয় নৌবাহিনী বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সমস্ত বন্দরগুলি অবরোধ করে সাগরে পূর্ন কর্তৃত্ব স্থাপন করেছে।

ভারতীয় বাহিনী অগ্রবর্তী সৈন্যদলগুলি এখন রাজধানী ঢাকা দখল করার জন্য জোর কদমে এগিয়ে চলেছে।

যে সৈন্যদল দু’দিন আগে ফেনী দখল করেছিল, তারা গতকাল রাত্রে চাঁদপুর নদী বন্দরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছে। বিস্তারিত বিবরণ জানা যায়নি। যে দলটি আখাউরা মুক্ত করেছে তারাও গতকাল রাত্রে কুমিল্লার ৩২ কিলোমিটার পশ্চিমে এলিয়টগঞ্জ মুক্ত করেছে এবং আজ ঢাকা ৩৫ কিলোমিটার পূর্বে দাউদকান্দির সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।

পাকিস্তানী বাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্যান্টনমেন্ট সৈয়দপুরের ওপর মুক্তিবাহিনী প্রচণ্ড আক্রমণ চালাচ্ছে। খবর পাওয়া গেছে যে উত্তর দিক থেকে সৈয়দপুরে যাবার রাস্তায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় মুক্তিবাহিনী দখল করেছে।
জানা গেছে যে, ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী দিনাজপুর জেলা শহরের ওপর তিনদিক থেকে আক্রমণ চালাচ্ছে।

বীরগঞ্জ-দিনাজপুর খণ্ডে কান্তনগরে একটি সেতু উরিয়ে পাকিস্তানী বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর অগ্রগতি রোধ করার চেষ্টা করেছে। এখানে প্রচণ্ড লড়াই চলছে।

ময়মনসিংহ খণ্ডে ভারতীয় বাহিনী জামালপুর মহকুমা শহরের দক্ষিণে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। জামালপুর শহর দখলের জন্য জোর লড়াই চলছে।

ময়মনসিংহ সদর শহর দখলের জন্য সৈন্য বাহিনী এগিয়ে চলেছে।
পদ্মার পশ্চিম তীরে কুষ্টিয়া শহর ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী একযোগে ঘিরে গেলেছে তারা পদ্মার উত্তরে রাজশাহী ও পাবনার সঙ্গে দক্ষিণ তীরে গোয়ালনন্দ ঘাঁটের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।

ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী একযোগে খুলনার ওপর গোলাবর্ষণ করছে। আশেপাশে থেকে পাকিস্তানী সৈন্যরা এখানে এসে জড়ো হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা শহরের ওপরও প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করা হচ্ছে।

শ্রীহট্ট খণ্ডে শ্রীহট্ট শহর এবং খাদিমনগরসহ শহরের উপকণ্ঠ এলাকা পাকসৈন্য মুক্ত করা হচ্ছে। কুষ্টিয়া জেলার বৈদ্যকুটচৌরা টেম্পলহীল এবং হাজিগঞ্জ রেল স্টেশনগুলি ভারতীয় বাহিনীর দখলে এসেছে।

ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী সম্মিলিতভাবে অভিযান চালিয়ে খুলনা জেলার সাতক্ষীরা শত্রুকবল মুক্ত করেছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৯৯। পাক-ভারত-বাংলাদেশ যুদ্ধের খবর আনন্দবাজার পত্রিকা ১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১

Fakhruzzaman Sayam
<১৪, ৩৯৯, ৯৫১-৯৫৩>

চাঁদপুর মুক্ত, চুয়াডাঙ্গা মুক্ত, জওয়ানরা কুষ্টিয়ার উপকণ্ঠে
সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত

মুক্তির নিশান উড়ছে চুয়াডাঙ্গায়। উড়ছে চাঁদপুরে। এদিকে ঝিনাইদহ থেকে এড়িয়ে একটি ভারতীয় বাহিনী কুষ্টিয়ার উপকণ্ঠেও পৌঁছে গিয়েছে।

বৃহস্পতিবার সংসদে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শ্রী জগজীবন রাম বলেন, রংপুর আর দিনাজপুরের পতন আসন্ন।

এই অঞ্চলে ভারতীয় বাহিনী নতুন করে ঝড় হয়ে নতুন উদ্যমে রংপুরের দিকে এগিয়ে চলছে। আর দিনাজপুর শহরে দশ মাইল ভিতরে কাউঠানগর সেতুর ওপর তীব্র লড়াই চলছে।

কুমিল্লার সন্নিহিত ময়নামতি এখন খান সেনার হাতে। তবে তাদের পালাবার সব রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ময়নামতি ছাউনির আশেপাশের পাহাড়ে আর শত্রু সৈন্য নেই। ঢাকার ২২ মাইল উত্তর-পূর্বে আশুগঞ্জ ফেরীঘাট মিত্রসেনার দখলে।

যশোহর এলাকায় ভারতীয় সেনা এক হাজার টন গোলাগুলি ফোকটে পেয়ে যায়। পালানোর তাড়ায়, দখলদারেরা এসব ফেলে গিয়েছে। যশোহরের দক্ষিণে রূপদিয়ায় একজন মেজর এবং ৪০ জন সৈন্য নিহত।

ভারতীয় বাহিনী ক্রমে ক্রমে খুলনার দিকে এগোচ্ছে।

ময়মনসিংহ অঞ্চলে মিত্র সেনা জামালপুর সম্পূর্ণভাবে ঘিরে ফেলেছে। যে কোন মুহূর্তে এর পতন হতে পারে।

প্রতিরক্ষা বাহিনীর এক প্রেসনোটে বলা হয় : কোন শত্রু যাতে জল পথে পালাতে না পারে সেজন্য নৌবাহিনী বঙ্গোপসাগরে নজর রেখেছে।

ভারতীয় বাহিনী এখন মেঘনার তীরে, চাঁদপুরের পূর্বদিকে। সেখান থেকে নদীর উপর নজর রেখে চলেছে। প্রায় ৫০০ পাক সেনাসহ একটি বড় জাহাজকে প্রথমে ট্যাংক থেকে তারপর বিমান থেকে বোমা ফেলে আক্রমণ করা হয়। জাহাজটিতে আগুন জ্বলতে দেখা যায়।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে শত্রু সৈন্য নিশ্চিহ্ন করার জন্য রাত্রে আমাদের জওয়ানেরা বিমান পথে আঘাত হানছে।
পাক বাহিনী নদী পথে পলায়নের জন্য বরিশাল, খুলনা ও চট্টগ্রামের আশেপাশের নদী হয়ে সমুদ্র পথে বঙ্গোপসাগরের দিকে ছুটছে। ভারতীয় বাহিনী এদিন সন্ধ্যার মধ্যে অন্তত সৈন্য বোঝাই তিনটি জাহাজ আটক করে। একটি জাহাজের সৈন্যরা সাদা পতাকা উড়িয়ে ভারতীয় জওয়ানদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।

ভারতীয় বাহিনী উত্তরে পলাশবাড়ি, দক্ষিণে চাঁদপুর এবং পশ্চিমে আশুগঞ্জ দিয়ে ঢাকা এলাকায় পাক বাহিনীকে ঘিরে রেখেছে।

পূর্বাঞ্চলের জিওসি লেঃ জেঃ জগজিৎ সিং অরোরা বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জানান, বাংলাদেশের ভিতরে এবং যশোহর ও খুলনার মধ্যে আটকে পড়া পাক বাহিনী মেঘনা ও পদ্মা দিয়ে পালাবার চেষ্টা করছে। তাদের উপর ভারতীয় বিমান বাহিনী ক্রমাগত বিমান থেকে বোমা ফেলেছে।

জেনারেল বলেন, এখন পাকিস্তানী বাহিনী দু’দিকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। একটি অংশ রয়েছে হিলির উত্তরে আর অন্যটি বাংলাদেশের দক্ষিণ দিকে। উত্তরে যে বাহিনী আছে তার সংখ্যা এক ব্রিগেড। তিনি বলেন, ভারতীয় বাহিনী পাক বাহিনীকে যশোহর থেকে দক্ষিণ দিকে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে।

জেনারেল আরও বলেন, ব্রহ্মপুত্রের তীর ঘেঁষে উত্তর দিক থেকে যে ভারতীয় বাহিনী অগ্রসর হচ্ছে-তারা ময়মনসিংহ সদর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে জামালপুর ঘিরে রেখেছে। মেঘালয় সীমান্তের হাদুয়াঘাটের দিক থেকে আর একটি সৈন্যদল ময়মনসিংহ এর দিকে এগোচ্ছে। শ্রীহট্ট এলাকায় লড়াই চলছে।

জনৈক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ময়নামতি দুর্গে পাকবাহিনীকে ভারতীয় বাহিনী ঘিরে রেখেছে। সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টেও লড়াই চলছে।

একজন বিদেশী সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে জেনারেল দৃঢ়তার সঙ্গে জানান, শরণার্থীদের জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জ যেসব যানবাহন দিয়েছিলেন, তার একটিকেও বাংলাদেশের এই অভিযানে নামানো হয়নি।
তিনি বলেন, মুক্তিবাহিনী ভারত বাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করছে। এছাড়া যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা, আগে থেকে খবরাখবর সংগ্রহ করা ইত্যাদি ব্যাপারে মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের কার্যকলাপ যুদ্ধরত ভারতীয় সেনাবাহিনীকে যথেষ্ট সাহায্য করছে।

জেনারেল অরোরা আরো বলেন, মুক্তিবাহিনীর লোকজনেরা কয়েকটি থানার ভার হাতে নিয়েছেন এবং স্থানীয় লোকদের দেখাশোনা করছেন।

তিতাস নদী পেরিয়ে অমীয় দেবরায়

আগরতলা, ৯ ডিসেম্বর-তিতাস নদী সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যেতে যেতে দেখলাম পথের দু’ধারে পাক সেনারা পরিত্যক্ত শত শত বাংকার পড়ে রয়েছে। সারা শহর আনন্দ উৎসবে মেতে উঠেছে। মাইকে মুজিবের গলা শুনে চমকে উঠলাম। মুজিব কি ফিরে এসেছে? না-মুজিব নয়, এ মুজিবের কণ্ঠস্বর রেকর্ড করা। ঢাকার মাঠে তার ঐতিহাসিক বক্তৃতার রেকর্ডটি চালিয়ে লোকে বারবার তার কণ্ঠস্বর শুনছে।
এখান থেকে আখাউড়া প্রায় ১৩/১৪ মাইল। আখাউড়ার দিকে এগোচ্ছি। দেখি বহু লোক যারা বাড়িঘর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন তারা ফিরে আসছেন। তারা বলেন, গত চার মাসের মধ্যে এই প্রথম গ্রামে ফেরার সুযোগ হচ্ছে। এর আগে পাক সেনাদের ভয়ে তারা আসতে পারেননি।

উত্তর খণ্ডে

শিলিগুড়ি থেকে দীনেন চক্রবর্তী জানান, ভারতীয় সেনাবাহিনী আজ উত্তর রণাঙ্গণে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সড়কঘাঁটি রংপুর জেলার পলাশবাড়ি ও শাদুল্লাপুর দখল করে নিয়েছেন। সামরিক দিক থেকে এই দুইটি ঘাঁটি দখলের তাৎপর্য বাংলাদেশের উত্তর খণ্ডে রংপুর-দিনাজপুর ও বগুড়া জেলার পাকবাহিনী এখন সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন এবং অবরুদ্ধ।

কোনদিক থেকে আর পালানোর রাস্তা নেই। যমুনা পেরিয়ে ঢাকা-তাও না। ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন পদস্থ অফিসার সাংবাদিকদের বলেন, রংপুর জেলার গাইবান্ধার উত্তরে রেলপথটিও তারা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করে দিয়েছেন। ফলে রংপুর ও গাইবান্ধার মধ্যে রেল সংযোগ বিচ্ছিন্ন।

পীরগঞ্জের এগার মাইল দক্ষিণে পলাশবাড়ি এবং পলাশবাড়ির প্রায় ২৫ মাইল দক্ষিণ-পূর্ব শাদুল্লাপুর। ওই দুইটি ঘাঁটি দখল করার পর আজ মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় জওয়ানরা এখন রংপুর ও দিনাজপুর শহরের দিকে এগোচ্ছে।

অল্পের জন্য

পাকবাহিনীর মেজর জেনারেল নাজির হোসেন ও তার দু’জন বিগ্রেডিয়ার এবং একজন লেঃ কর্নেল গত মঙ্গলবার ভারতীয় জওয়ানদের তোপের মুখ থেকে বেঁচে গিয়েছেন। মেজর জেনারেল হোসেন বগুড়া থেকে রংপুর গিয়েছিলেন শলাপরামর্শের জন্য। পীরগঞ্জ যে ভারতীয় বাহিনী দখল করেছে সে খবর তারা রাখতেন না। তাই পীরগঞ্জ দিয়ে যখন মেজর জেনারেল বগুড়ার দিকে যাচ্ছিলেন তখন ভারতীয় বাহিনী গুলিবর্ষণ করে। নাজির হোসেনের গাড়িটি দ্রুতগতিতে বাঁদিকে ঘুরে চলে যায়। কিন্তু পাক বাহিনীর একজন লেঃ কর্নেল মারা যায়।
শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪০০। মুক্তিসংগ্রাম ঢাকার দ্বারপ্রান্তে আনন্দবাজার পত্রিকা ১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১

Fakhruzzaman Sayam
<১৪, ৪০০, ৯৫৪-৯৫৫>

রাজনৈতিক সংবাদদাতা
মুক্তি সংগ্রাম ঢাকার দ্বারপ্রান্তে

বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াই এখন বাংলার রাজধানীর দ্বারপ্রান্তে চতুর্দিক থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং মুক্তিসেনারা ঢাকার দিকে এগোচ্ছে। মাঝে কয়েকটা নদী, পদ্মা আর মেঘনার শাখা-প্রশাখা। তারপরই ঢাকা। এবং এরপরই ঢাকার লড়াই-বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত লড়াই।

এই চূড়ান্ত লড়াই-ই কি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় লড়াই হবে, পাক সেনাবাহিনী কি ঢাকায় দখল বজায় রাখার জন্য মাটি কামড়ে যুদ্ধ করবে? কেউ জানে না। তবে ভারতীয় বাহিনী সেই বড় লড়াইর জন্য প্রস্তুত হয়েই ঢাকার দিকে এগোচ্ছে। বৃহস্পতিবার বিকেলে পূর্বাঞ্চলীয় সেনাধ্যক্ষ লেঃ জেঃ জগজিৎ অরোরা সাংবাদিকদের সেই কথাই জানালেন।

বললেনঃ ওরা কী করবে জানি না। তবে আমরা সেজন্য প্রস্তুত হয়েই এগোচ্ছি।

মুক্তিসংগ্রামীরা এগোচ্ছেন সব দিক থেকে। আশুগঞ্জ এখন মুক্ত। কিন্তু ওখানে মেঘনার ওপাড়ের বিরাট পুলটা পাক সেনাবাহিনী ভেঙ্গে দিয়েছে। আর একটা বাহিনী এগোচ্ছেন দাউদকান্দির দিক দিয়ে। দাউদকান্দি থেকে পাক বাহিনী পালিয়েছে। উত্তর দিক থেকে মুক্তিসংগ্রামীরা এগোচ্ছেন জামালপুর হয়ে। ওদিক থেকে অবশ্যই পথ এখনও অনেকটা। তবে পথে কোনও বড় নদী নেই। এদিকে অর্থাৎ পদ্মার দিকে আমাদের সেনাবাহিনী মধুমতীর তীরে। মধুমতী পাড় হলেই পদ্মা তারপরই ঢাকা। কুষ্টিয়া মুক্ত করে আর একটা বাহিনী এগোতে চলেছে গোয়ালন্দ ঘাটের দিকে। গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর চাঁদপুর থেকেও আমাদের বাহিনী ঢাকার দিকে এগোবার জন্য প্রস্তুত।

ঢাকা মুক্ত করার চূড়ান্ত লড়াইয়ে পুরোদমে যোগ দেবেন সব কটা বাহিনী-সেনা, বিমান এবং নৌ। বিমান বাহিনী লড়াইর প্রথম দিন থেকেই ঢাকা আক্রমণ শুরু করে দিয়েছেন। ঢাকার সামরিক এবং অসামরিক দুই বিমানবন্দরই এখন অকেজো। নৌবাহিনীও এগিয়ে আসছেন দুই নদীতে-পদ্মা এবং মেঘনায়। ঢাকা দখলের চূড়ান্ত লড়াইয়ে নৌবাহিনীর গানবোটগুলিও পুরোদমে যোগ দেবেন।

জেনারেল অরোরাকে সাংবাদিকরা জিজ্ঞাস করেছিলেন, ঢাকাকে মুক্ত করার পথে আপনার সামনে সবচেয়ে বড় বাধা কি? জেনারেল একটা কথায় জবাব দিলেনঃ নদী। এবং তারপরই বললেন, নদী অতিক্রমের ব্যবস্থা আমরা করে ফেলেছি।

আমাদের পদাতিক বাহিনী ও রসদ পারাপারের জন্য ব্যবস্থা চাই, কিন্তু আমাদের পিটি-৬৭ ট্যাংকগুলি নিজে থেকেই নদী সাঁতরে যেতে পারবে। তার জন্য স্টিমার বা লবির প্রয়োজন নেই।
বাইরে থেকে বা গোটা বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে ঢাকা রক্ষার জন্য সৈন্য আনাও পাক বাহিনীর পক্ষে এখন আর সম্ভব নয়। এর দুটি কারণ, আমাদের সেনাবাহিনী তাদের পালাবার পথ আটকে দিয়েছেন। সিলেট সেক্টরে তারা অবরুদ্ধ। উত্তরখণ্ডে দিনাজপুর-রংপুর অঞ্চলেও আটকে গিয়েছে। দ্বিতীয় কারণ, বাংলাদেশের আকাশে ঢাকার সব পথের ওপর নজর রাখছেন। পাকসৈন্যবাহী স্টিমার বা বোট দেখলেই আক্রমণ চালাচ্ছেন।

ঢাকার পাক বাহিনীর কত সেনা আছে? সে হিসাবও কেউই জানেন না। জেনারেল অরোরা এইদিনও বলেন, গোটা বাংলাদেশে ওদের চারটা ডিভিশন ছিল। এবং আমাদের সামরিক বাহিনী আগে বলেছিলেন, ঢাকায় রয়েছে একটা ডিভিশন। যদি তাই হয় এবং যশোর সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চল থেকে কিছু পাকসৈন্য গিয়ে সত্যিই ঢাকায় আশ্রয় নিয়ে থাকে তাহলে ঢাকায় অন্তত দেড় ডিভিশন সৈন্য রয়েছে। কিন্তু সত্যিই কি ওদের অত সৈন্য ঢাকায় আছে? ঢাকার লড়াই শেষ হলেই তা জানা যাবে-তার আগে নয়।

ঢাকায় ওদের দূরপাল্লার ভারী কামানই বা কত রয়েছে? বাংলাদেশে এখন পাক বিমান বাহিনীর কোনও অস্তিত্ব নেই। তাই ঢাকার লড়াইয়ে ওদের মূলত নির্ভর করতে হবে দূরপাল্লার ভারী কামানের উপর। গোটা বাংলা যুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোথাও পাক বাহিনী ভারী দূরপাল্লার কামান ফেলে যায়নি। যদি ওরা আগেভাগেই ভারী দূরপাল্লার কামানগুলি পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সরিয়ে না নিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে ঢাকার চূড়ান্ত লড়াইয়ে সে সব কামান দেখা যাবেই। হিলির যুদ্ধে নভেম্বর মাসেই ওরা ৩৫ মাইল পাল্লার কামান ব্যবহার করেছিল। ৩৫ মাইল পাল্লার দু’চারটি কামান শুধু সীমান্তের লড়াইয়ে ব্যবহার করে ওরা ভারতীয় বাহিনীকে ধাপ্পা দিতে চেয়েছিল, না সত্যিই ওই ধরনের কামান ওরা বাংলাদেশে আরও অনেক রেখেছিল ঢাকার লড়াইয়ে তাও বোঝা যাবে।

ঢাকা থেকে ইউপিআই এক খবরে জানিয়েছেন, আজ ভারতীয় সৈন্যরা অগ্রসর হওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলি থেকে নগরীর মধ্যে পশ্চাদপসরন করেছে।

ভারতীয় সৈন্যরা অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গোলার আওয়াজও শোনা যাচ্ছে।
আমাদের লন্ডন অফিসের খবরে বলা হয়েছে, ঢাকা থেকে সেখানে টেলিফোনে প্রাপ্ত সংবাদে জানা গিয়েছে, অগ্রসরমান ভারতীয় বাহিনীর গোলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। অবস্থা খুবই সংকটজনক। ঢাকা শহর প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪০১। পাক-ভারত-বাংলাদেশ যুদ্ধের খবর যুগান্তর ১১ ও ১২ ডিসেম্বর, ১৯৭১

Fakhruzzaman Sayam
<১৪, ৪০১, ৯৫৬-৯৫৭>

দুর্বার গতিতে ঢাকার পথে
হেলিকপ্টার ও স্টিমারে মেঘনা অতিক্রমঃ নোয়াখালী মুক্ত
চালনা ও মঙ্গলা বন্দরে ভারতীয় নৌ-বহর
(সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত)

কলকাতা, ১০ই ডিসেম্বর-ঢাকার পথে ভারতীয় সৈন্যবাহিনী আজ দুরন্ত মেঘনা অতিক্রম করেছে। মেঘনার পূর্ব পাড়ে আশুগঞ্জ থেকে বিদ্যুৎগতিতে স্টিমার ও হেলিকপ্টারে ভারতীয় বাহিনী পশ্চিম পাড়ে ভৈরব বাজারে অবতরন করেছে।

এখানে মেঘনা উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত এবং নদীর প্রস্থ দু’মাইলেরও বেশী। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা এখানে ভৈরববাজারের গুরুত্বপূর্ণ সেতু ভেঙ্গে দিয়েছে।

মুক্তিবাহিনীর কলাম ভারতীয় সাহায্যে আজ নোয়াখালী মুক্ত করেছে। চট্টগ্রাম বন্দরের উত্তরে নোয়াখালীর মুক্তি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। নোয়াখালীর মুক্তির বিশাদ বিবরণ জানা যায়নি।

চালনা-মঙ্গলা দখল
খুলনার কাছে চালনা ও মঙ্গলা বন্দর আজ মুক্তি বাহিনী ও ভারতীয় সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী মুক্ত করেছে। ভারতীয় নৌবাহিনী এদের সাহায্য করেছে। ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজগুলি আজ সকাল সাতটায় বন্দরে প্রবেশ করে।

ইস্টার্ন কম্যান্ডের একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের জানান যে, চাঁদপুর থেকে পলায়নের চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর প্রায় ৯০ জন পাকিস্তানী সৈন্যকে আটক করা হয়েছে।

যশোর সেক্টরে ভারতীয় বাহিনী খুলনার পথে রূপদিয়া, চেঙ্গুটিয়া, হরিশংকরা, ডাঙ্গামারা দখল করে ফুলতলার কাছাকাছি পৌঁছেছে। ভারতীয় বাহিনী সড়কের উপর একটি অতিকায় ব্যারিকেড বানিয়ে খুলনার উত্তরে পশ্চিম পাকিস্তানীদের একটি কলামকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এই অভিযানে ৩০টি গাড়ী, ৬টি রিকয়েললেস গান ও ৪টি ভারী মর্টার দখল করা হয়েছে।

দিনহাটা থেকে আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা জানাচ্ছেন যে, রংপুর জেলার গুরুত্বপূর্ণ শহর লালমনিরহাট এবং একটি থানা সদর দপ্তরও পাকিস্তানীদের হাত থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। এই অঞ্চল থেকে পাক সেনাদের এত তাড়াতাড়ি চলে যেতে হয়েছে যে, পাক চমুদের অর্ধভুক্ত পাত্র এবং কাগজের ওপর খাপ খোলা ফাউন্টেনপেনও সেখানে পাওয়া গিয়েছে।

রংপুর সেক্টরে ভারতীয় বাহিনী দুরা, বরচাংগ্রাম মুক্ত করে বীরগঞ্জকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। রংপুর এলাকায় পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের একটি ব্রিগেড রয়েছে এবং এই ব্রিগেডের সৈন্যরা ভারতীয় বাহিনীর অগ্রগতিকে কোন কোন জায়গায় অল্প বাধা দিচ্ছে। ভারতীয় বিমান বাহিনী রংপুর, বিসপাড়া গাইবান্ধা ও সৈয়দপুরের ওপর আক্রমণ চালিয়ে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে দিয়েছে।

ময়মনসিংহ সেক্টরে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সৈন্য ছাউনিগুলিকে ভারতীয় বাহিনী সম্পূর্ণভাবে অবরুদ্ধ করেছে এবং শত্রুদের পলায়নের কোন পথ নেই।

ইস্টার্ন কম্যান্ডের মুখপাত্র বলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংলাদেশের তেরশ মাইল সীমান্ত সৈন্য সমাবেশ করেছিল। এখন বিভিন্ন দিক তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় কোন স্থানে পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিশেষ কোন জমায়েত নেই।

যশোর সেক্টরে কুষ্টিয়া, ভেরামারা ও নবাবপাড়ায় ভারতীয় সৈন্যদের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের তুমুল লড়াই চলছে।

বাংলাদেশের পূর্বাংশে লাকসামে পশ্চিম পাকিস্তানীরা তুমুল লড়াইর পর পরাস্ত হয়েছে। ২৩ নম্বর পাঞ্জাব ব্যাটেলিয়ানের দু’জন অফিসার ও ৪১৫ জন সৈন্যকে বন্দী করা হয়েছে।

কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের অবরুদ্ধ পাকিস্তানী সৈন্যরা গতকাল সম্ভবত পালিয়ে যাবার পথ খুঁজবার জন্য ভারতীয় বাহিনীর উপর গুলিবর্ষণ করে। ভারতীয় সৈন্যদের পাল্টা গুলিবর্ষণে ৩০ জন পাক সৈন্য নিহত হয়েছে। ভারতের দু’জন মারা গেছে। এখানে পাকিস্তানীরা ট্যাংক ব্যবহার করেছিল।

ময়মনসিংহ, হিলি, কুষ্টিয়া শত্রুমুক্ত
(সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত)
কলকাতা, ১১ই ডিসেম্বর-ভারতীয় ও মুক্তি বাহিনীর সম্মিলিত সেনাদলের অভিযানের মুখে আজ কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ, জামালপুর, হিলির পতন হয়েছে।

মেঘনার পশ্চিম পাড়ে ভৈরব বাজার থেকে ভারতীয় বাহিনীর যথেষ্ট অগ্রগমন হয়েছে। কিন্তু এখানে ভারতীয় বাহিনী ঢাকার পথে কতটা এগিয়েছে তা নির্দিষ্টভাবে বলতে ইস্টার্ন কম্যান্ডের মুখপাত্র অস্বীকার করেন। তবে তিনি বলেন যে, ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী মেঘনার পূর্বপাড়ে বিভিন্ন দিক থেকে ঢাকার পথে অগ্রসরমান।

খুলনার পথে ভারতীয় বাহিনী নোয়াপাড়া দখল করার পর এখন দৌলতপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার দূরে।

ভারতীয় বাহিনী আজকের অভিযানে ছোট বড় ১২টি শহর দখল করেছে এবং ১ জন ব্যাটেলিয়ন কম্যান্ডার, ১৬ জন জেসিও সহ ২ হাজারের বেশী পাকিস্তানী সৈন্যকে বন্দী করেছে।

হিলি শহর মুক্ত
সামরিক বাহিনীর ঐ মুখপাত্র আরও জানান যে, দিনাজপুর-রংপুর খণ্ডে ভারতীয় বাহিনী পাক-বাহিনীকে ঘেরাও করে রেখেছে। ওখানে আনুমানিক চার হাজার পাকসেনা আছে। তাদের আর বেরিয়ে যাবার কোন পথ নেই।

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে পাক-বাহিনীর বড় ঘাঁটি বগুড়ায় প্রায় ২০ মাইলের মধ্যে ভারতীয় বাহিনী আজ দুপুরে পৌঁছে গেছে।

দিনাজপুর ও রংপুর শহর দু’টির যে কোন সময়ে পতন ঘটতে পারে
পাক বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি হিলি থেকে স্টাফ রিপোর্টার শ্রীকল্যাণ বসু আরও জানিয়েছেনঃ হিলির নিকটবর্তী বাহাদুনিয়া ও গোবিন্দগঞ্জে যুদ্ধে ১২০ জন পাক সেনা ও একজন অফিসার নিহত হয়েছে। বিধ্বস্ত অবস্থায় ৪টি পাকিস্তানী ট্যাঙ্ক কামানসহ দখল করা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার যুদ্ধের পরিণতিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষে হিলি, গোবিন্দগঞ্জ, বাহাদুরিয়া, ফুলঝুরি সম্পূর্ণভাবে শত্রুমুক্ত হয়েছে।
হতাবশিষ্ট পাকসেনারা সিরাজগঞ্জ হয়ে ঢাকায় পালাবার জন্য মরিয়া হয়ে পথ খুঁজছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪০২। পালাতে দেব না, হুঁশিয়ার-মানেকশ আনন্দবাজার পত্রিকা ১২ ডিসেম্বর, ১৯৭১

Fakhruzzaman Sayam
<১৪, ৪০২, ৯৫৮-৯৫৯>

পালাতে দেব না, হুঁশিয়ার- মানেকশ
বিশেষ সংবাদদাতা

নয়াদিল্লী, ১২ ডিসেম্বর- বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানী সৈন্যদের পালাতে দেওয়া হবে না। তাদের পালাবার পথ বন্ধ করার জন্য ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্থল বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল মানেকশ আজ বেতারে বাংলাদেশে দখলদার বাহিনীর সেনাপতিদের উদ্দেশ্যে এই হুঁশিয়ারি প্রচার করেছেন।

জেনারেল মানেকশ বলেন, পাকিস্তানীরা যে পাঁচটি বাণিজ্যিক জাহাজে করে পালাতে মতলব করেছে তা তিনি জানতে পেরেছেন। তিনি হুঁশিয়ার করে দেন- “খবরদার এরকম চেষ্টা করবেন না। যদি করেন আপনাদের বাণিজ্যিক জাহাজগুলি তো ধ্বংস হবেই-সেই সঙ্গে আপনাদের সৈন্যরাও মারা যাবে।”

মেজর জেনারেল রাও ফারমান আলির উদ্দেশ্যে এই বেতারবার্তা। রাও ফারমান আলি হচ্ছেন বাংলাদেশের অসামরিক পুতুল সরকারের সামরিক উপদেষ্টা এবং চট্টগ্রামে পাকিস্তানী নৌবাহিনীর ফ্লাগ অফিসার কম্যান্ডিং।

জেনারেল মানেকশর এটিই শেষ হুঁশিয়ারী। জেনারেল বলেন, “আমি সৈন্যদের জীবন বাঁচাতে চাই। এজন্যই আমার হুঁশিয়ার।”

এই বেতার বার্তার আগে জেনারেল মানেকশ বিশেষভাবে জেনারেল ফরমান আলির নিকট আর একটি হুঁশিয়ারি প্রচার করেছিলেন। এতে তিনি পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনীগুলিকে বাংলাদেশে অগ্রসরমান ভারতীয় বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণের পরামর্শ দেন। পাকিস্তানী সেনাপতিকে তিনি বলেন, “অন্যথায় আপনার অধীনস্থ সৈনিক ও নাগরিকদের জীবনহানির জন্য একমাত্র আপনিই দায়ী হবেন।”

জেনারেল মানেকশ অধিকৃত বাংলাদেশে পাকিস্তানী সেনপতির উদ্দেশ্যে আবার বলেন, “আমার সৈন্যবাহিনী চার দিক থেকে আপনাদের ঘিরে ধরেছে। আমি আপনার সৈন্যদের এখনই আমার সেনাবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করার জন্য বারবার পরামর্শ দিয়ে আসছি। সমুদ্রপথে কিংবা আকাশ পথে কোন দিকেই তাদের আর পালাবার জো নেই। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যে আপনাদের নিকট কোন সাহায্য আসবে সে আশাও নেই। প্রতিরোধ নিরর্থক। প্রতিরোধ করা মানেই আপনার অধীনস্থ বহু নির্দোষ সৈনিকের মৃত্যু।”

তিনি বলেন, “আপনার যেসব সামরিক ও আধাসামরিক লোক ইতিমধ্যে আমার বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করেছেন তাদের জন্য আমি পূর্ণ নিরাপত্তা ও জেনেভা চুক্তি অনুযায়ী সদ্ব্যবহারের ব্যবস্থা করেছি। আপনারা যদি আত্মসমর্পণ করে আমার রক্ষণাবেক্ষণে না আসেন তবে পশ্চিম পাকিস্তানী নারী-পুরুষ ও শিশুদেরও জীবন খুবই বিপন্ন। আমি আপনার সেনা ছাউনিগুলির বিরুদ্ধে যথেষ্ট কম বল প্রয়োগ করেছি যাতে লোকক্ষয় বেশী না হয়, কিন্তু আমি আর সময় দিতে অক্ষম। আমি আবার বলছি, আপনারা আমার পরামর্শে কান দিন। অন্যথায় সৈন্য ও অন্যান্য নাগরিকদের মৃত্যুর পুরা দায়িত্ব আপনার উপরই বর্তাবে।”

জেনারেল মানেকশ’র বেতার বার্তা আজ প্রথমে বেলা দেড়টায় এবং আবার বিকল তিনটায় জেনারেল ফারমান আলির উদ্দেশ্যে আকাশবাণী থেকে প্রচারিত হয়।

জাহাজঘাঁটায় জাহাজ তৈরি

জেনারেল ফারমান আলির উদ্দেশ্যে প্রচারিত হুঁশিয়ারিতে জেনারেল মানেকশ বলেন, “আমি জানতে পেরেছি গুপ্তা খেয়ায়(চট্টগ্রাম) দু’টি উপকূল জাহাজ তৈরি হয়ে আছে। আপনাদের রানওয়ে অক্ষত এবং আপনাদের বিমান প্রতিরক্ষা জোরদার করেছেন। আমি আরও জানি আপনাদের পাঁচটি বাণিজ্য জাহাজ আত্মগোপন করে আছে এবং পাইলট আর কে ৬২৩ সন্ধ্যা ছ’টা নাগাদ স্পীড বোটে রওয়ানা হবার জন্য তৈরি। এই অবস্থায় মোকাবিলার জন্য আমি আমার বাহিনীগুলিকে নির্দেশ দিয়েছি।”

জেনারেল মানেকশ বলেন, “আপনাদের যদি এরকম কোন চেষ্টা করেন আপনাদের বাণিজ্য জাহাজগুলি তো ধ্বংস হবেই আপনার সৈন্যরাও মারা যাবে। সৈনিকদের জীবন বাঁচাতে চাই বলেই আমার হুঁশিয়ারী।”

জেনারেল ফারমান আলি পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য ও বেসামরিক লোকজনদের বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে সরিয়ে নেবার জন্য ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রপুঞ্জের সাহায্য চান বলে জানা গিয়েছে।

নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা তার অনুরোধ বিবেচনা করতেও নাকি বলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান জেনারেল ফারমান আলির অনুরোধ অগ্রাহ্য করতে বলেন। পাকিস্তান রেডিও নাকি বলেছে, ফারমান আলির আবেদন অনুমোদিত।
শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪০৩। পাক – ভারত- বাংলাদেশ যুদ্ধের খবর হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড ১৩ই ডিসেম্বর, ১৯৭১

Ashik Uz Zaman
<১৪, ৪০৩, ৯৬০-৯৬২>

হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, ১৩ই ডিসেম্বর, ১৯৭১
ঢাকার অদূরে ভারতীয় ছত্রীসেনাদের অবতরণ
অমিতাভ দাস গুপ্ত কর্তৃক

শনিবার বিকেল ৪টায় ঢাকার অদূরে নির্দিষ্ট কিছু স্থানে ভারতীয় ছত্রীসেনারা অবতরণ করেছে। একইসময়ে, ভারতীয় স্থলবাহিনী বিভিন্ন দিক থেকে রাজধানীর দিকে এগিয়ে আসছে।

শুক্রবারে মেঘনার পশ্চিম পাড়ের অবস্থান থেকে যাত্রা শুরু করা অগ্রসরমান বাহিনী রবিবারে নরসিংদী মুক্ত করে এবং ঢাকার দিকে তাদের যাত্রা অব্যাহত রাখে। রবিবার রাতের মধ্যে এই বাহিনী শহরের ৩০ মাইলের মধ্যে পৌঁছে যায়।

এ থেকে বলা যায় যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ তার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ঢাকার উদ্দেশ্যে অভিযান খুবই চমৎকার ভাবে এবং পরিকল্পনামাফিক চলছে।

যে ছত্রীসেনারা বিপুল সংখ্যায় অবতরণ করেছে তাদের সাথে শত্রুপক্ষের সংঘর্ষ হয়েছে এবং তারা শত্রুপক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চলছিল। পূর্ব রণাঙ্গনের একজন মুখপাত্রের বরাত দিয়ে জানা যায়, একজন পাকিস্তানী অফিসার ও অন্যান্য পদমর্যাদার ২২ জন নিহত হয়েছে এবং ১২ জনকে বন্দী করা হয়েছে। জানা গেছে যে, ঢাকায় পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কারফিউ জারি করা হয়েছে।

ঐ এলাকায় চলমান যুদ্ধ এবং পাকিস্তানীদের একটি পাল্টা আক্রমণের বিবরণ দিয়ে, এই মুখপাত্র বলেন, “ঢাকার দিকে আমাদের অগ্রগতি নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট”।

ভৈরববাজার-ঢাকা অক্ষে, নরসিংদী থেকে ভারতীয় বাহিনী দ্রুত এগিয়ে আসছে অবতরণকারী ভারতীয় ছত্রীসেনা এবং দক্ষিণের ময়মনসিংহ শহর থেকে এগিয়ে আসা বাহিনীর সাথে মিলিত হতে, তিনি বলেন।

মেজর জেনারেল জ্যাকব, চীফ অব স্টাফ, পূর্ব রণাঙ্গন, রবিবারে সাংবাদিকদের বলেন ঢাকার চারপাশে বাংলাদেশের বেশীরভাগ এলাকা মুক্ত করা হয়েছে।

এতে করে ভারতীয় সৈন্যরা হয়তো একটু বাড়তি সুবিধা পেয়েছে। তবে অপারেশন ঢাকা পরিচালনার ক্ষেত্রে ঢাকার চারপাশের ভৌগলিক অবস্থানগত সীমাবদ্ধতার মধ্যেই তাদেরকে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। এক্ষেত্রে নদী এবং জলাভূমির উপস্থিতির কারণে সৈন্য পরিচালনা করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। তবে এসবকিছু বিবেচনা করেও বলা যায় যে তারা অত্যন্ত ভালো কাজ করছে।

অপারেশন ঢাকায় নিয়োজিত ভারতীয় সৈন্যদেরকে অতিরিক্ত সহায়তা দেয়ার জন্য মুক্তি বাহিনীর গেরিলারা ঢাকার অভ্যন্তরে হয়রানিমূলক কৌশল প্রয়োগ করা শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই তারা বেশ কয়েকটি জায়গায় শত্রুপক্ষের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে এবং তাদেরকে ভালো আঘাত হেনেছে।

এই মুহূর্তে অপারেশন ঢাকা মূলত দুই দিক থেকে অগ্রসর হচ্ছে যার একটি ময়মনসিংহ থেকে টাঙ্গাইল হয়ে এবং অন্যটি মেঘনা নদী পার হয়ে ভৈরববাজারের দক্ষিন থেকে আসছে। ভৈরববাজার থেকে দক্ষিন দিকে অগ্রসরমান বাহিনীটির অগ্রগতি সন্তোষজনক যেখানে উত্তরদিকে ভারতীয় সৈন্যরা ময়মনসিংহ থেকে বেশ দ্রুত গতিতে টাঙ্গাইলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

মেজর জেনারেল জ্যাকব সাংবাদিকদের বলেন ঢাকার দিকে আসলে কয়েকটি বাহিনী অগ্রসর হচ্ছে। ভৌগলিক অবস্থান বিবেচনা করলে, নদী ও জলাভূমি এবং পাকিস্তানীদের দ্বারা বিপুল সংখ্যক ব্রিজ ধ্বংস প্রাপ্ত হওয়ার কারণে সৈন্য পরিবহনে কিছু সমস্যা দেখা দিতে বাধ্য। তারপরেও ভারতীয় সৈন্যরা অত্যন্ত দ্রুত গতিতে অগ্রসর হতে পারছে কেননা পাকিস্তানীরা বেশ মরিয়া হয়ে লড়াই করছে। যুদ্ধের গতি বেশ তীব্র তিনি বলেন।

অপারেশন ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে ভারতীয় সৈন্যরা মেঘনা নদী অতিক্রম করেছে, যেটি প্রায় ১,২০০ গজ চওড়া এবং তারা সবাই এখন ঢাকার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। অতিরিক্ত শক্তি যোগানোর জন্য স্থানীয় অভিজ্ঞতা, ষ্টীমার, ইত্যাদি সবই কাজে লাগানোর সকল চেষ্টাই করা হচ্ছে। ভারতীয় কৌশলের কোন কিছু ফাঁস না করেই এটা বলা যায় যে ষ্টীমার, হেলিকপ্টার এবং অন্যান্য জলযান ব্যবহার করে বাহিনী গঠন চলমান রয়েছে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় অবস্থানরত গুরুত্বপূর্ণ পাকিস্তানী কর্মকর্তাদের বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করার পেছনে হয়তো একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তারা চুপিসারে বিমানে করে বা অন্যান্য উপায়ে এই চেষ্টা চালিয়েছে, কিন্তু অনুমান করা হচ্ছে যে তারা এখনো পর্যন্ত সফল হতে পারেনি।

বিভিন্ন রণাঙ্গনে এখন পর্যন্ত ভারতীয় সৈন্যরা যে অগ্রগতি দেখিয়েছে তার বিশদ বিবরণ দিয়ে মেজর জেনারেল জ্যাকব বলেন যে ভারতীয় সৈন্যরা এই মুহূর্তে খুলনার উপর একটি বড়সড় আক্রমণ চালাতে যাচ্ছে এবং “আমরা আশা করি অচিরেই আমরা সেখানে পৌঁছবো”।

শনিবারে কুষ্টিয়া মুক্ত হয় যেটি কঠিনভাবে রক্ষিত ছিল। সেখানে তীব্র যুদ্ধ হয়। শত্রুপক্ষ ভারতীয় ট্যাঙ্কগুলোকে আক্রমণ করে এবং অসংখ্য বাঙ্কার তৈরী করে রেখেছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে শত্রুপক্ষকে পরাজিত করার পর ভারতীয় সৈন্যরা এখন পদ্মা নদীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

আরো পূর্ব দিকে, ময়মনসিংহ দখল করে নেয়ার পর ভারতীয় সৈন্যরা টাঙ্গাইলের দিকে এগিয়ে আসছে। এই মুহূর্তে তারা মধুপুরের ঘন জঙ্গলের কাছে রয়েছে। একইভাবে ভারতীয় সৈন্যরা জামালপুর থেকে দক্ষিন দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সিলেট সেক্টরে ঝাড়ামোছার অভিযান চলছে এবং পাকিস্তানী সৈন্যরা বিচ্ছিন্নভাবে চলাচল করছে এবং মাঝে মাঝে ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে তাদেরকে সঙ্কেত দেয়া হচ্ছে ভারতীয় সৈন্যদের অবস্থান জানিয়ে আত্মসমর্পণের সুযোগ দেয়ার জন্য।

ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ দিতে গিয়ে মেজর জেনারেল জ্যাকব বলেন যে পাকিস্তানী বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। একটি যুদ্ধে ভারতীয় ক্ষয়ক্ষতিও অনেক বেশী হয়েছে কিন্তু বেশীরভাগ যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ স্বল্প থেকে মাঝারী ধরণের। পাকিস্তানীরা এখনো ময়নামতি সেনানিবাস দখল করে রেখেছে। অপ্রয়োজনীয় হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে সাধ মেটানো ভারতীয় সৈন্যদের অভিপ্রায় নয়। তাই তাদেরকে আত্মসমর্পণ করার জন্য আরেকবার সুযোগ দেয়া হবে। যদি তারা তা না করে তাহলে তাদের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সংস্থাগুলো যোগ করেঃ রবিবারে ভারতীয় সৈন্যরা খুলনা সেনানিবাস (দৌলতপুর) পৌঁছে গেছে এবং শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সেখানে তুমুল যুদ্ধ চলছে।

এক প্রশ্নের জবাবে সামরিক মুখপাত্র বলেন পাকিস্তানীরা খুলনা এলাকায় আত্মসমর্পণ করার আগে “একটি মরিয়া শেষ চেষ্টা” করছে বলে মনে হচ্ছে। যেহেতু চালনা এবং মংলা উভয় বন্দরই নৌবাহিনীর আক্রমণে বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের পালানোর আর কোন পথ নেই, তিনি যোগ করেন।

বাংলাদেশের আরো উত্তর পশ্চিমে, ভারতীয় সৈন্যরা শত্রুপক্ষের উপর চাপ বজায় রেখেছে হিলি ও গাইবান্ধা এবং ঘোড়াঘাট ও গোবিন্দগঞ্জ এর দিক থেকে দ্বি-মুখী আক্রমণ চালিয়ে। গোবিন্দগঞ্জের যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনী চারটি শ্যাফি ট্যাঙ্ক, সাতটি কামান এবং দুটি আরসিএল আটক করে। আরও দুটি শ্যাফি ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয় এবং ৬০ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। চল্লিশজন শত্রুসেনাকে বন্দী করা হয়।

ভারতীয় বিমান বাহিনী শনিবারে কুষ্টিয়া সেনানিবাসে গুলি বর্ষণ করে ১০ টি রেল ওয়াগন এবং ১৫ টি যানবাহন ধ্বংস করে দেয়। তারা সিরাজগঞ্জ এবং ফুলছড়িঘাটে পিছু হটতে থাকা শত্রু সেনাদেরকেও আক্রমণ করে।

সকল মুক্ত এলাকায় পাকিস্তানের নিয়মিত বাহিনীর সদস্য এবং রাজাকাররা যারা বাংলাদেশ থেকে সাদা পোশাকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে তাদের ধরার জন্য পুর্নউদ্যমে অভিযান চলছে।

আমাদের সৈন্যরা হিলি এবং দিনাজপুরে শেষ প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দিয়েছে সাঁজোয়া বহর ধ্বংস এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করার মাধ্যমে। পলাশবাড়ীর দক্ষিন পশ্চিমে অবস্থিত ঘোড়াঘাট যেটি বেশ কয়েকদিন টিকে ছিল রবিবারে মুক্তি বাহিনীর কাছে তার পতন হয়। মুক্তি বাহিনী পলাশবাড়ী থেকে ১৭ কিমি দক্ষিণে অবস্থিত গোবিন্দগঞ্জ মুক্ত করে।

ঘোড়াঘাট এবং গোবিন্দগঞ্জ মুক্ত হওয়ার মাধ্যমে হিলি থেকে গাইবান্ধা পর্যন্ত ১২০ কিমি সড়ক এখন সম্পূর্ণরূপে পাকিস্তানী সৈন্যমুক্ত।
শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪০৪। পাক-ভারত-বাংলাদেশ যুদ্ধের খবর যুগান্তর ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১

Fakhruzzaman Sayam
<১৪, ৪০৪, ৯৬৩-৯৬৪>

ভারতীয় গোলার আওতায় ঢাকা
জওয়ানেরা শহরের উপকণ্ঠে
পরিমল ভট্টাচার্য

যুদ্ধ এখন ঢাকা, দখলদারেরা ভারতীয় কামানের পাল্লার আওতায়। খানসেনা তিনদিক থেকে বেষ্টিত হয় পড়ছে। তাদের স্বরচিত এবং স্বনির্ভাচিত মৃত্যুফাঁদ ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে।

ভারতের ছত্রী বাহিনী সংগটিত, মুক্তিবাহিনী সক্রিয়। ভৈরববাজার থেকে আগুয়ান একদল জওয়ান নরসিংদী পেরিয়ে রাজধানীর উপকণ্ঠে। আর একদল ধেয়ে আসছে। জেলাসদর টাঙ্গাইল, মির্জাপুর সোমবারই মুক্ত করে জয়দেবপুর।

এটি একটি বিখ্যাত অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরির আস্তানা। শীতলক্ষ্যা নদী পাড় হওয়ারও চেষ্টা চলছে। যমুনার বাধাও অতিক্রান্ত। চাঁদপুর বিজয়ী বাহিনী মেঘনা পাড় হয়েছেন দাউদকান্দিতে। মুক্তিবাহিনীরা আছে মিত্রবাহিনীর পাশে।

তিন দিক থেকে তিনটি ইউনিট ঢাকার গায়ে গায়ে।

অবরুদ্ধ ঢাকা শহর থেকে ভয়েস অব আমেরিকার সংবাদদাতা জানিয়েছেন, ভারতীয় সৈন্য ঢাকার কেন্দ্র থেকে মাত্র ১১/১২ মাইল দূরে। লড়াই এখন প্রায় শহর এলাকাতেই।

দিল্লীতে একজন সরকারি মুখপাত্র বলেছেন, আর একটি দিন কি দুটি দিন মাত্র, তার মধ্যেই ঢাকা এলাকায় আমরা বেশ জোরালো হয়ে এঁটে বসবো।

কিন্তু মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা এবং এখানেই জওয়ানদের দ্রুত অগ্রগতির খবরে দখলদার বাহিনী দিশেহারা। ফিল্ড কম্যান্ডাররা পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ রাখতে পারছেন না। বিমান নেই। গোলন্দাজরাও প্রায় সাবাড়। ট্যাঙ্কই বা কোথায়? সেনাপতিদের মধ্যে আছেন ছয়জন মেজর জেনারেল। বারো তের দিনের লড়াইয়ে বাংলাদেশে দখলদার বাহিনী ছন্নছাড়া। অথচ যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন দখলদারদের কম করেও ষাট হাজার সেনা ছিল।

পাকিস্তানী দখলদাররা একদিকে ঢাকা মুক্তির লড়াইয়ের বাধা দেওয়ার জন্য ফন্দি আঁটছে। শহরে কারফিউ সমানে চলছে, রাতে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বেসরকারি বাড়িতেও দখলদার সেনারা ঢুকে পড়েছে। ঘন ঘন গোলা ফাটিয়ে তাদের চাঙ্গা রাখার চেষ্টা হচ্ছে। নির্দেশ জারি হয়েছে, এই সেনাদের কেউ বিন্দুমাত্র এদিক ওদিক করলে তাকে গুলি করা হবে। অন্যদিকে ভারতীয় জওয়ানদের কাছে পাক সেনাদের আত্মসমর্পণের পালা সমানে চলছে। সোমবার লাকসাম ও কুমিল্লায় আরও এক হাজার একশ’ চৌত্রিশজন আত্মসমর্পণ করেছে। তাদের মধ্যে চৌদ্দজন অফিসার ও পঁচিশজন জেসিও আছেন তারা ৫৩ ব্রিগেড, ২৩ পাঞ্জাব, ১৫ বালুচ, ৫২ ফিল্ড রেজিমেন্ট, ৪৭ ফিল্ড কোম্পানী ইঞ্জিনিয়ার ও ২১ আজাদ কাশ্মীরি রেজিমেন্টের।

ঢাকা ছাড়া খুলনা, বগুড়া ও চট্টগ্রাম সেক্টরে তুমুল লড়াই হচ্ছে। খুলনার কাছে তিন দিন ধরে লড়াই চলছে। এখানে ওরা মরিয়া, কারণ শত্রুবাহিনীর পালাবার পথ নেই। ভারতের জওয়ানরা তাদের চেপে ধরেছেন। শত্রু সেনারা যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে সেখানে আশ্রয় নিয়েছে। খুলনা যাওয়ার পথ জলাভূমি। এই সুযোগে তারা ভারতের জওয়ানদের বাধা দিয়ে যেতে চেষ্টা করছে। আর ভারতের জওয়ানরা যতটা সম্ভব কম প্রাণনাশ করে তাদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দিচ্ছেন।

হিলির দিক থেকে ভারতের জওয়ানরা পাঁচবিবি মুক্ত করেছেন। তাদের আর একদল লক্ষ্মীপুর মুক্ত করার পর বগুড়ার শহরতলিতে পৌঁছে গিয়েছেন। বগুড়ায় উত্তরাঞ্চলে পাক বাহিনীর সদর দফতর। লক্ষ্মীপুরে ৩২ বালুচ রেজিমেন্টের চারজন অফিসারকে বন্দী করা হয়েছে।

ভারতীয় জওয়ানরা চট্টগ্রামের পথে সীতাকুণ্ডুর চট্টগ্রামের উত্তর-পশ্চিমে ছত্রিশ কিলোমিটার। চালনা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত শত্রুপক্ষের কোন চিহ্ন নেই।

ভারতের জওয়ান ও মুক্তিবাহিনীর লোকজন ঈশ্বরদীর কাছে পদ্মা নদীর উপরে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ বা সারা সেতুর দখল নিয়েছেন। পূর্বে পাবনার দিকে পালিয়ে যাওয়ার সময় পাক সেনারা ব্রিজটির তিনটি খিলান ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। পালাবার সময় তারা কিছু অস্ত্রশস্ত্র ও গাড়িও ফেলে যায়।

সোমবার ভারতের বিমান সেনারা ভেড়ামারা, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, রংপুর, ময়নামতি, নরসিংদী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের কাছে শত্রু ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালান। গোয়ালন্দঘাটেও শত্রুদের কিছু মোটরবোট ও সেনাবাহিনী বহনের যান ধ্বংস করে। ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট এখনও শত্রুদের দখলে। লড়াই চলছে।

সোমবার সন্ধ্যায় নয়াদিল্লীতে প্রতিরক্ষা দফতরের এক মুখপাত্র বলেন, পরিকল্পনা অনুসারে ঢাকা মুক্তির লড়াই ঠিকঠিক চলছে। এদিন কলকাতায় পূর্বাঞ্চলীয় কম্যান্ডের এক মুখপাত্র সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘আমাদের বাহিনী ভালভাবে এগোচ্ছেন।’ তিনি ঢাকা অপারেশন সম্বন্ধে বিস্তারিত জানাতে চান না। প্রতিরক্ষা দফতরের মুখপাত্রও নয়। একজন আমেরিকান সাংবাদিক পূর্বাঞ্চলীয় কম্যান্ডের মুখপাত্রকে প্রশ্ন করেন-তা হলে কি ঢাকার খবর ব্ল্যাকআউট করা হচ্ছে?
মুখপাত্র কর্নেল হেসে জবাব দেন, না মশায়। পরিকল্পনা অনুসারে লড়াই হচ্ছে। আগে থেকে সবকিছু বলা সম্ভব নয়।
শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪০৫। সপ্তম নৌবহর সিঙ্গাপুরের পথে টাইমস অব ইন্ডিয়া ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ৪০৫, ৯৬৫-৯৬৬>

“টাইমস অফ ইন্ডিয়া”, ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১
সপ্তম নৌবহর সিঙ্গাপুরের পথে
নিউজ সার্ভিস, নিউ দিল্লি, ১৩ ডিসেম্বর

যে মুহুর্তে জাতিসঙ্ঘ অ্যামেরিকার ‘ভারতকে পাকিস্তান আক্রমণ না করার’ প্রস্তাব বিবেচনা করছিল সেই মুহুর্তে উত্তর ভিয়েতনাম থেকে পরমাণু শক্তিসম্পন্ন এয়ারক্র্যাফট ক্রুজার সিঙ্গাপুরের দিকে রওনা দিচ্ছিল।

একটি স্থানে চীনের চলাচলের খবর পাওয়া গেছে। এটা হতে পারে পিকিং এর সাথে ইসলামাবাদের সংহতির নিদর্শন।

সাইগণের রিপোর্ট থেকে জানা যায় সপ্তম নৌবহর টাস্কফোর্সে বিভিন্ন ডেস্ট্রয়ার আছে এবং এটিকে সিঙ্গাপুর অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে। টাস্কফোর্সের জানায় ঢাকায় আটকে পড়া ইউ এস নাগরিকদের উদ্ধার করার জন্য এটিকে আনা হয়েছে।

একজন সরকারী মুখপাত্র আজ সন্ধ্যায় একটি ব্রিফিংএ প্রশ্নের জবাবে সপ্তম নৌবহর এর চলাচল সম্পর্কে জবাব দিতে গিয়ে বলেন – তারা আজ Vassil Kuznetsov, সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম উপ-প্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী ও তার মুখ্য সচিব, জনাব পি এন হাসকারের সাথে কথা বলেছনে।

মানসিক চাপ
সরকারি মুখপাত্র বলেন যে টাস্কফোর্স হয়ত ভারতের উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তিনি সরাসরি কোন সমালোচনা না করে শুধু বলেছেন ঢাকায় আটকে পড়া সামান্য কজন নাগরিকের জন্য নৌবাহিনীর এত বড় আয়োজনের হয়ত কোন দরকার ছিলোনা।

মুখপাত্র উল্লেখ করেন যে, সিঙ্গাপুরে অবস্থিত ব্রিটিশ ঘাঁটি থেকে ৩ টি আর এ এফ এয়ারক্র্যাফট ও কানাডীয় সি -১৩০ বিমান দিয়ে গতকাল ভারতীয় সরকারি ব্যবস্থার অধীনে ঢাকা থেকে কয়েকশ বিদেশীদের সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ভারত সরকার একই রকম সুবিধা অ্যামেরিকাকে দিতে পারলে খুশী হবে।

এর পাশিপাশি সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারত মহাসাগরে তার নৌ শক্তি পুনর্বহাল করছে।
এক রিপোর্টে সপ্তম নৌবহর কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে যে তারা বলেছেন যদি অন্য কোন ভাবে ঢাকায় আটকে পড়া আমেরিকানদের উদ্ধার করা যায় তাহলে হয়ত আমরা আমাদের বঙ্গোপসাগর মিশন বাতিল করতে পারি।

আকজের ব্রিফিংএ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন ইউ এস এবং চীনা উদ্দেশ্য উপমহাদেশে অস্থির পরিবেশ সৃষ্টি করবে। তিনি বলেন, ‘আমি আশা করছি যে অ্যামেরিকা বা চীনের পরিস্থিতি জটিল করার কোন ইচ্ছা নাই।’

তিনি বলেন, সপ্তম নৌবহর দূরসমুদ্রে তার স্বাধীন ভ্রমণ চালাতে পারেন কিন্তু বন্দিদের উদ্ধারের কারণ ছাড়া অন্য কোন কারণ দেখাতে না পারলে তাদের সিঙ্গাপুরে অবস্থান করাটা যুক্তিযুক্ত হবেনা।

তার একটি টাস্ক ফোর্স পাঠানোর সিঙ্গাপুর বন্ধ দাঁড়াতে যদি না একটি নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা এই একইভাবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে চীনের এই পরিকল্পনা পরিকল্পিতভাবে ভারতকে ভয় দেখানোর জন্য। এর প্রয়োজনীয়তার কারণ আরও ভালো করে খুঁজে দেখা উচিৎ।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪০৬। ঢাকা দখলের লড়াই আনন্দবাজার পত্রিকা ১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১

Fakhruzzaman Sayam
<১৪, ৪০৬, ৯৬৭-৯৭১>

বগুড়া মুক্ত। চট্টগ্রাম ও ঢাকার গভর্নরের প্রাসাদ জ্বলছে
ঢাকা দখলের লড়াই
খান শাহীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে মন্ত্রিসভাসহ
ডঃ মালিকের পদত্যাগঃ নিরপেক্ষ একালায় আশ্রয়

নয়াদিল্লী, ১৪ই ডিসেম্বর (ইউএনআই)- ঢাকায় ‘গভর্নরের’ বাড়ি ও অন্যান্য কয়েকটি লক্ষ্যস্থলে এখন আগুন জ্বলছে। গভর্নর ডঃ এ মালিক, তার মন্ত্রী পরিষদ ও ঊর্ধ্বতন অসামরিক কর্মচারীরা ইতিমধ্যে তাদের নিজ নিজ পদে ইস্তফা দিয়ে নিরপেক্ষ এলাকা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে পালিয়ে গিয়েছেন।

এই খবরে আরও জানা যায় যে, ভারতীয় সৈন্য ও মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠে প্রবেশ করেছে এবং সেখানে এখন যুদ্ধ চলছে।

বাংলাদেশের জনসাধারণের যুগান্তকারী স্বাধীনতা সংগ্রাম এখন শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। ঢাকায় পাকিস্তানীদের চূড়ান্তভাবে উচ্ছেদ করে একটি প্রতিনিধি স্থানীয় সরকার গঠনের জন্য ভারতীয় সৈন্যদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

পূর্ব পাকিস্তান সরকার আজ বিকেলে সদলবলে পদত্যাগ করেছেন এবং ইসলামাবাদে ইয়াহিয়া সরকারের কেন্দ্রীয় প্রশাসন থেকে নিজেদের সরিয়ে এনেছেন।

ঢাকার শহরতলীতে প্রচণ্ড হাতাহাতি লড়াই চলছে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় জোয়ানরা তীব্রবেগে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন। একটি শক্তিশালী পাকবাহিনীর মোকাবেলা করে তাঁরা তাদের সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত করেছেন। ঢাকা শহরের সেনাবাহিনীর ছাউনির ওপর ভারতীয় গোলান্দাজ বাহিনী গোলা নিক্ষেপ করে চলেছে।

এদিন রংপুর সেক্টরে শত্রু সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ডিভিশনাল হেডকোয়ার্টার বগুড়ার পতনের মধ্যদিয়ে ঐ সেক্টর মোটামুটিভাবে শত্রুমুক্ত হয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে।

গভীর রাতে ঢাকা সেক্টরের আরো যে সংবাদ এসেছে, তাতে দেখা যায়, ভারতীয় জওয়ানরা শুধু জয়দেবপুর, টঙ্গী কালিক্টর দখল করেই ক্ষান্ত হন নি, তাঁরা আরো দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছেন। শহরতলীতে পাক সেনাবাহিনীর পুরো একটা ব্রিগেড আটক পড়েছে। ঐ বাহিনীর অধ্যক্ষ একজন ব্রিগেডিয়ার ও ময়মনসিংহ এর মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটারসহ কমপক্ষে ১২ জন জাঁদরেল পাক সেনাবাহিনীর এই ব্রিগেড জয়দেবপুর-টঙ্গীর নিকটে গিয়ে জমায়েত হয়েছিল। কিন্তু অতর্কিতে ভারতীয় সেনাবাহিনী উপস্থিত হওয়ায় তারা আটক পড়েন।
চট্টগ্রাম সেক্টরে কুমিরার দক্ষিণে ভারতীয় জওয়ানরা বেশ জোরের সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর জ্বলছে। তাছাড়া শ্রীহট্টের নিকটে একটি পেট্রোলিয়ামের পরিশোধনাগারও দখলে এসেছে।

দখলদার বাহিনীর প্রধান অধিনায়ক জেনারেল এ এ কে নিয়াজী অনিচ্ছা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বাধ্য হওয়ায় ভারতীয় সৈন্যরা ও মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা ঢাকার অভ্যন্তরে সামরিক লক্ষ্যস্থলগুলির উপর প্রচন্ড বোমা বর্ষণ করেন এবং তারা এখন শহরের মধ্যে এগিয়ে চলেছেন। ঢাকায় এবার তাদের রক্তাক্ত সংগ্রাম শুরু হয়েছে।

ভারতীয় সৈন্যদের একটি দল ঢাকা নগরীর ১১ কিলোমিটারের মধ্যে এগিয়ে গিয়েছিল। আর একটি মাত্র নদী অতিক্রম করলেই তারা শহরের অভ্যন্তরে যেয়ে পৌঁছবেন।

আজ দুপুরের দিকে একটি পাক পরিবহন বিমান থেকে পুস্তিকা ফেলে বলা হয়েছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা যে সব অবাংগালীদের হাতে অস্ত্র দিয়েছে তারা যেন নিজ নিজ এলাকা থেকে দ্রুত সরে যায়।

প্রকাশ, বাঙ্গালী পুলিশের মধ্যে বিদ্রোহ দেখা দিতে পারে, এই সম্ভাবনায় পাক কর্তৃপক্ষ তাদের হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়েছে।

উর্ধ্বতন অফিসারদের পদত্যাগের হিড়িক
বাংলাদেশে পাক সরকারের অধীনস্থ উচ্চপদস্থ অসামরিক অফিসাররা পদত্যাগ করেছেন বলে নয়াদিল্লীর এক সরকারী মুখপাত্র জানিয়েছেন। মুখপাত্র বলেন, সরকারের কাছে খবর এসেছে যে, এই অফিসাররা ঢাকার রেডক্রসের নিরপেক্ষ অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের সংখ্যা প্রায় ৬৫ জন। এই সংবাদটি ঢাকা থেকে আন্তর্জাতিক রেডক্রসের প্রতিনিধি মিঃ রেনার্ড জেনিভায় রেডক্রসকে পাঠিয়েছেন। ভারতীয় রেডক্রস আজ বেলা আড়াইটায় সংবাদটি পান। রেনার্ডের বার্তায় ছিলঃ পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সর্বোচ্চ শ্রেণীর অফিসাররা পদত্যাগ করছেন এবং রেডক্রসের নিরপেক্ষ এলাকায় আশ্রয় চেয়েছেন। অবিলম্বে ভারতীয় ও বাংলাদেশ সরকারকে খবরটি জানান। আমরা এখানে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেওয়া হয়নি।

ভারত সরকার নয়াদিল্লীর আন্তর্জাতিক রেডক্রস প্রতিনিধির উপরোক্ত অনুরোধে সম্মত হয়ে ঢাকার হোলিফ্যামিলি হাসপাতাল এবং ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলকে নিরপেক্ষ এলাকা বলে ঘোষণা করেছেন।

এছাড়া ভারত বর্ষের মধ্যে রেডক্রসের আন্তর্জাতিক কমিটিকে কাজ করবার সুযোগ ভারত সরকার দিয়েছেন। মুখপাত্র আরো বলেন, নিরপেক্ষ এলাকা এবং ঢাকা সম্পর্কে ভারত জেনিভা চুক্তি অনুসরণ করছেন। এর অর্থ হচ্ছে আহত এবং অসুস্থ সৈন্য এবং অসামরিক নাগরিকদের আশ্রয়দান, রাষ্ট্রসংঘ এবং বিদেশীদের যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া থেকে রক্ষা করা। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কও এই মর্মে ভারতীয় কমান্ডারদের নির্দেশ দিয়েছেন। তবে মুখপাত্র বলেন, ব্যবস্থাগুলি কার্যকরী করতে হলে ঢাকার পাক দখলদার বাহিনীর সহযোগিতা প্রয়োজন। তাঁরা যেন নিরপেক্ষ এলাকা সামরিক প্রয়োজনে ব্যবহার না করেন। পিটিআই ইউএনআই।

ঢাকা থেকে রয়টারের অপর এক খবরে জানা যায় যে, পূর্ববঙ্গে অসামরিক সরকারের সমস্ত কাজকারবার সব বন্ধ হয়েছে।

পুলিশ ইন্সপেক্টর জেনারেল মিঃ এম এ চৌধুরীসহ প্রায় ১৬ জন পদস্থ সিনিয়র অসামরিক অফিসার আজ সকালে এখানে রেডক্রসের নিরপেক্ষ এলাকা বলে ঘোষিত ইন্টারকন্টিনেন্টালে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন।

‘গভর্নর’ মিঃ এ এম মালিকের বর্তমান মতলব জানা যায়নি। যারা হোটেল ইন্টারকন্টিনেটালে আশ্রয় নিয়েছেন, তাঁরা মিঃ মালিকের লিখিত আদেশেই তা করেছেন। মিঃ মালিক তাঁদের নির্দেশ দিয়েছেন তাঁরা যেন কাজকর্ম বন্ধ করে নিরপেক্ষ এলাকায় পালিয়ে যান।

খুলনাকে সবদিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। পাক সেনাবাহিনী সেখানে ‘শেষ যুদ্ধ’ লড়ে চলেছে।
রংপুর সেক্টরে এদিন আরো যে কয়েকটি শহর ও অঞ্চল দখল করা হয়েছে, তার মধ্যে আছে খেতলাল, জয়পুরহাট ও খানসামা।

ভারতীয় বিমান এদিনও খুলনা, দৌলতপুর, গোকুল, খাসনামা, জয়দেবপুর ও ময়নামতির ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়েছে। খুলনা, গোয়ালন্দঘাট, আড়িয়াঘাট ও সিরাজগঞ্জে শত্রুসেনারা লঞ্চে, নৌকাযোগে আক্রমণ করতে উদ্যোগী হয়েছিল। তবে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছে। ভারতীয় বিমান বাহিনীর
সাফল্যজনক আক্রমনের ফলে স্থল বাহিনীর অগ্রগতি অব্যাহত আছে বলে এখানে মনে করা হচ্ছে।

ঢাকার দিকে

পুর্বাঞ্চল কম্যান্ডের একজন মুখপাত্র কলকাতায় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বলেছেনঃ ভৈরব বাজারের দিক থেকে ভারতীয় জোয়ানের নির্দিষ্ট পথে ঢাকার দিকে এগিয়ে চলছেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে খবর হচ্ছে ঢাকায় পাক সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশেষ বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। তাদের প্রধান জেনারেল নিয়াজি ও ফরমান আলির মধ্যে বিশেষ মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। একজন এই প্রচণ্ড চাপের মধ্যে আত্মসমর্পণ করতে বলছেন। অপরজন তা অস্বীকার করছেন।

তিন দিক থেকেই ভারতীয় সেনারা যে এগিয়ে চলেছেন, তা ঐ মুখপাত্র এদিন স্বীকার করেছেন। বিমান থেকে যে সকল ছত্রী ভারতীয় সৈন্যকে গত দু’দিনে ঢাকার উপকণ্ঠে নামানো হয়েছিল, তারাও আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা ঢাকা শহরের মধ্যে প্রবেশ করেছেন বলে জানা গেছে।

শত্রুসেনা রক্ষাব্যূহ

উক্ত মুখপাত্র মনে করেন, পাক সেনারা ঢাকার রক্ষাব্যূহ আরো সুদৃঢ় করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে, ভারতীয় জোয়ানরা সব অবস্থায় মোকাবিলা করতে প্রস্তুত।

আরো জানা গেছে, পাক সেনাদের হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশী। ইতোমধ্যে ৪১০২ জন পাক সেনাকে বন্দী করা হয়েছে এবং ৪০৬৬ জন তাদের প্যারা মিলিটারি সৈন্যও ধরা পড়েছে।

বন্দী শত্রুসেনাপতি
কালিয়াকৈরে যে নয়জন পাক সেনাপতিকে বন্দী করা হয়েছে, তার মধ্যে আছেনঃ ৯৩নং ব্রিগেডের কম্যান্ডার খাদির খান, সিভিল আর্মড ফোর্সের সেক্টর কম্যান্ডার লেঃ কর্নেল মোহাম্মদ আকবর, ময়মনসিংহ-এর মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর লেঃ কর্নেল আমির মোহাম্মদ খান, ৯৩নং ব্রিগেডের মোহাম্মদ আকবর, রেঞ্জার্সের উইং কম্যান্ডার মেজর আসগর, মেজর আলধর, মেজর মসজিদ, বসির আহমেদ এবং ৯৩নং ব্রিগেডের ৩ নম্বর গ্রেডের জি এস এ ক্যাপ্টেন আনজাম।

ঢাকার দিকে ময়মনসিংহের পথ ধরে ভারতীয় জোয়ানদের যে দলটি এগিয়ে যাচ্ছে, তাদের চলার পথে বিশেষ বড় কোন নদীর বাধা নেই বলে সামরিক বাহিনীর একজন অফিসার জানান। আর নরসিংদীর দিক থেকে যে দলটি রয়েছেন তা ঢাকা শহর থেকে প্রায় এগার মাইল দূরে। উত্তর ও পূর্বদিক থেকে বাংলাদেশের রাজধানী অভিমুখে ধাবিত ভারতীয় বাহিনী আশাব্যঞ্জক গতিতে এগুচ্ছে বলে ধরা হয়েছে। কারণ টাঙ্গাইল-এ ভারতীয় জোয়ান ও মুক্তিবাহিনীর সমবেত শক্তি কুর্মীটোলার ক্যান্টনমেন্টের চার পাঁচ মাইলের মধ্যে পৌঁছেছে।

আরো নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, পাক জঙ্গী শাসকদের প্রধানরা তাদের কর্মস্থল ত্যাগ করে রেডক্রসের কাছে নিরপেক্ষ অঞ্চলে আশ্রয় চেয়েছেন; লেঃ জেনারেল নিয়াজি ঢাকা ধ্বংস হয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চাইছেন। প্রকাশ, শুধু গোলান্দাজ বাহিনী নয়, ভারতীয় বিমান বাহিনী পর্যন্ত ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের উপর বিকেলের দিকে বোমা বর্ষণ করেছেন।

ভারতীয় সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র আরো জানিয়েছেনঃ স্থল বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল মানেকশা’র বাণী সম্বলিত প্রচারপত্র বিমান থেকে গতকাল রাতে ঢাকা শহরে ফেলা হয়েছে। উক্ত মুখপাত্র আশঙ্খা প্রকাশ করেছেনঃ অসামরিক লোকজনদের এলাকায় যাতে সংঘর্ষ না হয়, তার জন্য বিশেষ নজর রাখা হচ্ছে। তবে, ঢাকা মিলিটারী গ্যারিসন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখল করেছে। অবশ্য তাতে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের তিক্ততা বৃদ্ধি পাবে। আজ পুনরায় সামরিক মুখপাত্র বলেন, ভারতীয় গোলান্দাজরা অসামরিক লোকজনের ওপর গোলাবর্ষণ করছে না।

বগুড়ার পতন

বগুড়ার পতনের পর চারজন পাক অফিসার বন্দী হয়েছে। তবে একজন পলায়ন করতে সক্ষম হয়। পাক সেনারা রংপুর সেক্টরে ক্যান্টনমেন্টকে ঘিরে এখনও যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।

চট্টগ্রামের বন্দর জ্বলছে

ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চল কম্যান্ডের যুদ্ধ জাহাজ এদিন পুনরায় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বন্দরের ওপর বোমা ও রকেট নিক্ষেপ করায় বন্দরটি জ্বলতে দেখা গেছে বলে খবর এসেছে। এই দুই বন্দরের ওপর চাপ অব্যাহত রাখার জন্যই এই আক্রমণ চালানো হয়েছে বলে জানা গেছে।

এছাড়া শত্রুদের অনেক ব্যারাক, হেড কোয়ার্টার ও ট্রানজিট ক্যাম্পের ওপর আক্রমণ করা হয়েছিল। ভারতীয় নৌবাহিনীর দপ্তরখানা জানিয়েছেনঃ এই আক্রমণের ঘটনার পরে একটি জাহাজও বন্দর ছাড়তে পারেনি। চট্টগ্রাম বন্দর এখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর চলার পথে মাত্র চার-পাঁচ মাইলের মধ্যে।
চট্টগ্রামের দিকে সাঁড়াশী অভিযান চালানো হয়েছে। তাছাড়া নৌবাহিনী শত্রুসেনাদের সব জলপথে যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দিয়েছিল। পূর্বাঞ্চলের নৌবাহিনী যখন এই যুদ্ধ চালাচ্ছিল, তখন ফ্ল্যাগসীপ বিমানের সাহায্যে আক্রমণের পুরোভাগে ছিল। তারা ‘অপূর্ব’ কাজ করেছে বলে দাবী হয়েছে। নৌবাহিনীর কোন ক্ষতি হয়নি।

শ্রীহট্টের অগ্রগতি

শ্রীহট্ট শহর থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে এক গ্রামে অবস্থিত বাংলাদেশের পেট্রোলিয়াম পরিশোধনাগারটি অক্ষত অবস্থায় ভারতীয় সেনাবাহিনীরা দখল করেছেন। গতকাল বিকেলে যখন এটি দখল করা হয়, সামরিক বাহিনীর একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, তখন সেখানে বারো হাজার গ্যালন পেট্রোলিয়াম ও পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্যাস ছিল। এই পরিশোধনাগার থেকে কুশিয়ারা নদীর তীরে অবস্থিত সার কারখানায়ও গ্যাস পাঠানো হতো। উক্ত মুখপাত্র আরো বলেন, পাক সেনাদের তিনটি বাহিনী ঐ পরিশোধনাগারটি রক্ষা করেছিল। কিন্তু ভারতীয় জোয়ান ও মুক্তিবাহিনী সমবেতভাবে তা আক্রমণ করেন; শত্রুপক্ষের অনেক লোক হতাহত হয়।

১৮ জন পাক সেনার মৃতদেহ এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে। শত্রুরা দুটি চীনের ভারী মেশিনগান, চারটি ভারী গাড়ি, কিছুসংখ্যক গোলা ও অন্যান্য অস্ত্র রসদ ফেলে গেছে। তিনজন আহত শত্রুসেনাকে বন্দী করা হয়েছে। শত্রুরা এই কারখানাটি ভেঙ্গে দেবার চেষ্টা করেছিল; কিন্তু সার্থক হয়নি।

খুলনা রনাঙ্গন
এই রনাঙ্গনের শত্রুসেনাদের হতাহতের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। কারণ, তারা মরণপণ করে লড়ছে। পদ্মার ওপরের হার্ডিঞ্জ ব্রীজের নিকটে ভারতীয় জওয়ানরা শত্রুদের পাঁচটি বন্দুক, একটি ট্যাঙ্ক, ৮৫টি গাড়ী এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র পেয়েছেন।

১৭৫টি পাক ট্যাঙ্ক
সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র জানিয়েছেনঃ গতকাল পর্যন্ত বিভিন্ন রনাঙ্গনে ১৭৫টি পাক ট্যাঙ্ক ও ৮৩টি বিমান ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এর মধ্যে ১৮টি ট্যাঙ্ক অক্ষত আছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর একদিনের যুদ্ধে নৌবাহিনীর একটি বিমান সমেত ৪১টি বিমান ও ৬১টি ট্যাঙ্ক খোয়া গেছে।
দৌলতনগরে (খুলনা ক্যান্টনমেন্ট) এদিক প্রচণ্ড লড়াই চলছে বলে খবর পাওয়া গেছে। শত্রুসেনাদের সঙ্গে তাদের গোলান্দাজ বাহিনী আছে। তবে, ভারতীয় জোয়ানরা তাদের কাছ থেকে দু’টি ট্যাঙ্ক কেড়ে নিয়েছে।

কুমিল্লা সেক্টরে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের দিকেও ভারতীয় সেনারা এগিয়ে চলেছে। ঐ ক্যান্টনমেন্টে এক হাজার পাক সৈন্য আছে বলে মনে করা হচ্ছে।

যশোর সেক্টরের দিক থেকে খুলনার দিকে যখন ভারতীয় জোয়ানরা এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তারা শত্রুদের ছ’টি ট্যাঙ্কের ক্ষতি করতে সক্ষম হন।

সর্বশেষ সংবাদে জানা গেছে, বগুড়ার নিকটে ইউনিসেফ-এর গাড়ীতে করে পাক সেনাবাহিনী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যাচ্ছিল। সেনাবাহিনী গাড়ীগুলি আটক করেছেন।
মালদা থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা শ্রী ধীরেন ঠাকুর জানাচ্ছেনঃ সীমান্তের ওপর থেকে পাওয়া খবরে প্রকাশ যে মুক্তিবাহিনী চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সেখানে জোর লড়াই হয়েছে। শিবগঞ্জ থানা এলাকা মুক্তিবাহিনী দখল করেছে। পাক বাহিনী এখন রাজশাহী সদরে জমা হচ্ছে। মুক্তিবাহিনী সূত্রে প্রকাশ যে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ শ্রীঘ্রই মুক্ত হবে।
শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪০৭। রাশিয়ার তৃতীয় ভেটো দি স্টেটসম্যান ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ৪০৭, ৯৭২>

দি স্টেটসম্যান, ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১
মার্কিন একগুঁয়েমিতে রাশিয়ার ভেটো
– জে কে ব্যানার্জি
জাতিসংঘ, ১৪ ডিসেম্বর, – আজ রাশিয়া ৯ দিনব্যাপী নিরাপত্তা পরিষদের মিটিংএ নিক্সন প্রশাসন এর একগুঁয়ে প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে তৃতীয় ভেটো দিয়েছে। এখানে কিছুটা চীনের সমর্থন রয়েছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার উপকারের জন্য ভারতীয় উপমহাদেশে সামরিক পরিস্থিতি আপাতত বন্ধ রাখার বিরুদ্ধে এই ভেটো দেয়া হয়।

মার্কিন প্রস্তাবের পর ইতালি ও জাপান ৯ দফার একটি প্রস্তাব পেশ করে এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব শরণ সিং জানান এগুলো ভারত পরীক্ষা করে দেখবে। পাকিস্তানি প্রতিনিধি জনাব আগা শাহি বলেন, এই প্রস্তাব অগ্রহণযোগ্য।
প্রস্তাবে ভারত ও পাকিস্তানকে তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি এবং সৈন্য সরিয়ে নেবার জন্য সব ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য বলা হয় এবং ” আলোচনার মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক সমঝোতার কথা বলা হয়।’

জনাব সিং পরে বলেছিলেন, “পাকিস্তান প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে বলে আমরা গ্রহণ করব এমনটা নয়।” ভারতীয় প্রতিনিধিদল বিশদভাবে এটা পরীক্ষা করে দেখবে।

মার্কিন প্রস্তাবে ছিল সামরিক সংঘর্ষ স্থগিত করার ব্যাপারে। কিন্তু সেখানে বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি রাজনৈতিক সমাধানে আসার কথা ছিলোনা।

কাউন্সিলের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ একটি স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অস্তিত্বের বাস্তবতা স্বীকার করেছিলেন। গ্রহণযোগ্য নিষ্পত্তির ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষে বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তা ছাড়া যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্তে যাওয়া যাবেনা।

জনাব শরণ সিং এবং জনাব ভুট্টো উভয়ের নিজস্ব সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। তবে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশ্চিত করেন তারা পূর্ব বা পশ্চিমে কোন সৈন্য জড়ো করবেন না এবং বাংলাদেশে সৈন্য জড়ো করবেন তাঁর একটি পূর্বশর্ত ছিল যে অত্র অঞ্চলে যুদ্ধবিরতি বা শান্তি ও স্থিতিশীলতা মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশ সরকারকেও একটি দল হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪০৮। বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌ বহর পৌঁছেছে, কুড়িটি রুশ রণ তরী ও আসছে আনন্দবাজার পত্রিকা ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ৪০৮, ৯৭৩-৯৭৪>

বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌ বহর পৌঁছেছে, কুড়িটি রুশ রণ তরীও আসছে

মার্কিন সপ্তম নৌবহর বুধবারই বঙ্গোপসাগরে এসে হাজির হয়েছে। এই বহরে আছে পরমাণু শক্তিচালিত বিমানবাহিনী জাহাজ ‘এন্টারপ্রাইজ’। সঙ্গে এসেছে আরও সাতটি রণতরী। এদিন সিঙ্গাপুর থেকে পাঠানো ইউ পি আই এর এই খবরের পাশাপাশি টোকিও থেকে এপি জানিয়েছে কুড়িটি সোভিয়েত রণতরীও ভার মহাসাগরে এসো জড়ো হয়েছে। ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে পারে এমন জাহাজও এর ভেতরে আছে। জাপানী প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের মুখপাত্ররা বলেছেন, গত ৯ ডিসেম্বর জাপানের দক্ষিণতম প্রান্ত ও কোরিয়া উপদ্বীপের মধ্যবর্তি সুসিমা প্রণালির ভিতর দিয়ে ক্ষেপণাস্ত্রবাহি একটি সোভিয়েত ফ্রিগেট এবং ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে পারে এমন একটি সোভিয়েত ডুবোজাহাজও বঙ্গোপসাগরের দিকে পাড়ি দিয়েছে।

বুধবার রাতেই নয়াদিল্লীতে কর্তৃপক্ষ মহল বলেছেন, খবর পেয়েছি মার্কিন সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে ঢুকেছে। বাংলাদেশ থেকে দখলদার পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীকে সরিয়ে নেওয়ার কোন রকম এক্তিয়ারই এই নৌবহরের নেই। সপ্তম নৌবহর বা বাইরের যে কোন শক্তিই হোক- পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীর উপর এখন কারো কোন রকম এক্তিয়ার নেই। কারণ, পশ্চিম পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে এখন ভারতীয় ও মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ হচ্ছে।

নয়াদিল্লীতে একজন সরকারী মুখপাত্র আজ বলেছেন, মার্কিন নৌবহরের কয়েকটি জাহাজ মালাক্কা প্রণালির পশ্চিম দিয়ে এগিয়ে গিয়েছে। জাহাজগুলো কোথায়, কোনদিকে যাবে এবং কেনই বা এসেছে তা এখনো যানা যায়নি। আমেরিকায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূত মার্কিন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এব্যাপারে এখনো পর্যন্ত সুস্পষ্ট কোন ব্যাখ্যা পাননি। গোঁড়ায় বলা হচ্ছিল, মার্কিন নাগরিকদের উদ্ধার করতেই মার্কিন নৌবহর আসছে। কিন্তু বিগত ৩৬ ঘণ্টা ধরে বলা হচ্ছে, ‘রক্তপাতের সম্ভবনা’ দেখা দেওয়ায় পাকবাহিনী ও বিহারি মুসলমানদের অপসারণের জন্যই ঐ নৌবহর এসেছে।

আমেরিকায় ভারতের রাষ্ট্রদূত শ্রী এল কে ঝাঁ গত মঙ্গলবার ওয়াশিংটনে সাংবাদিকদের বৈঠকে বলেছেন, পাক সৈন্য ও অসামরিক লোকজন সরিয়ে নিতে বঙ্গোপসাগরে ঐ বোম্বেটে মার্কিন নৌ বহর যদি বাংলাদেশে জাহাজ ভেড়াতে চায় তাহলে এই একতরফা ব্যাবস্থার দরুন পরিস্থিতি দুর্বহ হইয়ে উঠবে এবং সমগ্র ব্যাপারটি অনেক বিপদজনক হয়ে উঠবে। শ্রী ঝাঁ আরও বলেছেন, পশ্চিম খণ্ডে পাক সৈন্যের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ থেকে যদি সৈন্য সরিয়ে নেওয়া হয় – তাহলে এই কাজকে আমরা শত্রুতা বলেই গণ্য করব।

সপ্তম নৌবহর অধিনায়ক এডমিরাল জর্জ ম্যাকেন ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্সকে বলেছেন, ভারত ও পাকিস্তানকে এই নৌবহরের আওতায় আনার উদ্যেশ্যে তাঁর বহরের কর্মক্ষেত্র ভারতের পশ্চিম দরিয়া অবধি প্রসারিত করা হয়েছে। এ এফ পি এই খবর দিয়ে জানিয়েছে, গত সোমবার ম্যানিলায় মার্কিন- ফিলিপিনো যৌথ প্রতিরক্ষা পর্যদের বৈঠকে এডমিরাল ম্যাকেন প্রেসিডেন্ট মার্কসকে একথা জানিয়েছেন। মার্কিন সপ্তম নৌবহরের জাহাজগুলি দুই ভাগে ভাগ হয়ে সোমবার ও মঙ্গলবার গোপনে সিঙ্গাপুর অতিক্রম করে।

কূটনৈতিক সূত্র থেকে বলা হয় যে, আটটি জাহাজ এখন বঙ্গোপসাগরে রয়েছে।

বেসরকারি জাহাজই মহল ও এন্টারপ্রাইজ এবং অন্য জাহাজগুলির চলাচলের খবরের সত্যতা সমর্থন করেছেন।

উল্লিখিত সূত্র থেকে আরও জানানো হয়, এন্টারপ্রাইজ এর সঙ্গে রয়েছে আক্রমণক্ষম জাহাজ ‘ত্রিপলি’। হেলিকপ্টারবাহী জাহাজ ‘ত্রিপল’ তে ২৩ টি হেলিকপ্টার আছে। অন্যান্য জাহাজের মধ্যে আছে ডেস্ট্রয়ার বা ডেস্ট্রয়াল রক্ষী জাহাজ ও টেন্ডার জাতীয় জাহাজ। একটি মহল থেকে বলা হয় – উপকুলে অবতরণের উপযোগী জলযানও এই সঙ্গে রয়েছে।

নয়াদিল্লীর ওয়াকিবহাল মহল থেকে বলা হয়েছে – সপ্তম নৌবহরের চলাচলের সংবাদে বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামের কোন হেরফের হবেনা।

বোবা নীতি
ওয়াশিংটন খবরঃ সপ্তম নৌবহরের চলাচলের যে কোন খবর সম্পর্কে মার্কিন পররাষ্ট্র এখনো যথারীতি সম্পূর্ন নীরব নীতি বজায় রেখেছে।

আমেরিকায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূত শ্রী ঝাঁ আরও বলেন, তিনি নির্ভরযোগ্য সূত্রে সংবাদ পেয়েছেন যে, গত শুক্রবার একটি মার্কিন ‘টাস্ক ফোর্স’ (বিশেষ কাজের জন্য প্রেরিত মার্কিন বাহিনী) ভিয়েতনাম থেকে যাত্রা করেছে। এই বাহিনীটি বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানী সৈন্য, অসামরিক ব্যাক্তি এবং ঐ অঞ্চলে এখনো যেসব মার্কিন নাগরিক রয়েছে তাদের সরিয়ে আনার চেষ্টা করতে পারে।

ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বলেন, বিদেশীদের ঢাকা থেকে সরিয়ে নেয়ার জন্য ভারত সরকার বিদেশী বিমান ব্যাবহারে আপত্তি করেনি।

আমেরিকা বোম্বেটেসুলভ কূটনীতি (গানবোট ডিপ্লিমেসি) অনুসরণ করছে অভিযোগ করে শ্রী ঝাঁ বলেন – এইভাবে জাহাজ পাঠিয়ে দেওয়ায় ভারসাম্যের অভাব এবং মাত্রাজ্ঞ্যানের অভাব দেখা যাচ্ছে,

শ্রী ঝাঁ এই নৌবহরের অগ্রগতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন পূর্ব ইউরোপ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভারপ্রাপ্ত মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্র সচিব শ্রী জোসেফ সিস্কোকে ঐ সংবাদ জানানো হয়। শ্রী সিস্কো সংবাদের সত্যতা অস্বীকার করেন নি।

সংসদে ক্ষোভ

বুধবার নয়াদিল্লীতে সংসদের উভয় কক্ষে সদস্যরা বঙ্গোপসাগরে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের প্রবেশ সম্পর্কে সরকারের কাছ থেকে বিবৃতি দাবি করেন। অবশ্য সে ব্যাপারে কোন বিবৃতি দেন নি।
শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪০৯। আত্মসর্মপনের জন্য নিয়াজিকে কয়েক ঘণ্টা সময় বেধে দেওয়া হয়েছে হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১

Goutam Chandra Sarker
<১৪, ৪০৯, ৯৭৫-৯৭৬>

হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড , ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
আত্মসর্মপনের জন্য নিয়াজিকে কয়েক ঘণ্টা সময় বেধে দেওয়া হয়েছে
(আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি)

নিউ দিল্লি, ১৫ ডিসেম্বর – বাংলাদেশে নিযুক্ত পশ্চিম পাকিস্তান সেনাপ্রধান লেঃ জেনারেল নিয়াজি ভারতকে যুদ্ধবিরিতর জন্য অনুরোধ করে। ভারতীয় আর্মি প্রধান জেনারেল মানিকশাহ পুনরায় আত্মসমর্পণ এর জন্য নিয়াজি কে ১৬ ই ডিসেম্বর সকাল ৯ টা পর্যন্ত সময় বেধে দেন।

শুদ্ধমতির নিদর্শন হিসেবে জেনারেল মানিকশাহ নিয়াজিকে জানান যে আজ বিকাল ৫ টা থেকে আগামীকাল সকাল ৯টা পর্যন্ত আকাশ পথে আক্রমন স্থগিত থাকবে,তবে স্থল পথে ভারতীয় বাহিনীর এবং মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ চলবে।

নিয়াজির বাংলাদেশে যুদ্ধবিরতির অনুরোধ নয়াদিল্লী র আমেরিকার দূতাবাসের মাধ্যমে জেনারেল মানিকশাহের কাছে পৌছানো হয় দুপুর ১২ টায়।বার্তাটির প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন সেনা সরকারের গভর্নরের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল ফরমান আলী।জেনারেল মানিকশাহর উত্তর ও আমেরিকার দূতাবাসের মাধ্যমে গিয়েছিল। ভা

রতের মুখপাএ বলেছিল আজ বিকালে জেনারেল মানিকশাহ এবং জেনারেল নিয়াজির মধ্যে যে র্বাতা বিনিময় হয়েছে তা পূর্বের র্বাতার সাথে সামঞ্জস্যহীন। কিন্তু জেনারেল মানিকশাহর র্বাতা যার পুরোটা প্রকাশ করা হয়েছিল তা পশ্চিম পাকিস্তান আর্মির বার্তাকেই ইংগিত করে।

জেনারেল মানিকশাহ জেনারেল নিয়াজিকে বলেছিল ‘আমি নিউ দেল্লির আমেরিকার দূতাবাসের মাধ্যমে বাংলাদেশর যুদ্ধবিরতি নিয়ে আপনার বার্তা পেয়েছি আজ বেলা ২ঃ৩০ এ আমি পূর্বে দুইটি র্বাতায় জেনারেল ফরমান আলীকে জানিয়েছি যে (ক)আপনার সকল মিলিটারী এবং প্যারামিলিটারী বাহিনী যারা আমার নিকট বাংলাদেশে আত্মসমর্পণ করবে তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিব।

(খ) বিদেশী জনগন, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী এবং পশ্চিম পাকিস্তানী জনগন,তারা যেই হোক তাদের নিরাপত্তা প্রদান করব।যেহেতু আপনি যুদ্ধবিরতির ইংগিত দিয়েছেন আমি আশা করব আপনি অতিসত্বর বাংলাদেশে থাকা আপনার অধিনস্ত বাহিনীকে যুদ্ধবিরতির এবং আমার বাহিনীর নিকট আত্মসর্মপন করার আদেশ দিবেন। নিয়মের প্রতি অনুগত থাকব।

তদুপ আমি আপনাকে আশস্ত করছি যেসব সৈন্য আত্মসমর্পণ করবে তাদেরকে যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদা দেয়া হবে এবং আমি জেনেভা কনভেনশনের রি, আপনার আহত সৈন্যদের পরিচর্যা এবং যারা মৃত্যুবরন করেছে তাদের দাফণের ব্যবস্থা করব।এমনকি তারা যেখান থেকেই আসুক কারো নিরাপত্তার ব্যপারে ভয় পাবার কোন প্রয়োজন নেই অথবা আমার বাহিনী দ্বারা প্রতিহিংসার শিকার হবার কোন ভয় নেই।

এইমাত্র আমি একটি ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি -জেনারেল অরোরার আদেশে ভারতীয় এবং বাংলাদেশের সেনারা পূর্বমুখীর রনাঙ্গনে আকাশ এবং স্থলপথের আক্রমন থেকে বিরত থাকবে।আপনার উপর আমার বিশ্বাসে ঢাকায় আজ বিকাল ৫ টা থেকে আকাশ পথে অভিযান বন্ধ করেছি।

আমি আপনাকে আশস্ত করছি আপনার সেনাদের উপর অহেতুক আক্রমণ করার কোন ইচ্ছা আমার নেই যেহেতু আমি মানুষের মৃত্যুকে আমি পরিহার করি।যাইহোক আমার সাথে আপনি ভিন্নমত পোষন করছেন যার কারনে আগামীকাল সকাল ৯ টায় সর্বাঙ্গ শক্তি দিয়ে আক্রমন করতে বাধ্য থাকব।

আমি আলোচনা করে দ্রুততম সময়ে সমাধানে আসার জন্য একটি রেডিও লিংকের ব্যবস্থা করেছি যার ফ্রিকোয়েন্সি দিনের বেলা ৬৬.০৫ এবং রাতে ৩২.১৬ আমি আপনাকে অনুরোধ করব দ্রুত মাইক্রোওয়েভে যোগাযোগ ঠিক করে নিতে।বার্তা শেষ।

ভয়েস অব আমেরিকা আজ শেষ রাতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের বরাত দিয়ে ঢাকা থেকে একটি রিপোর্ট এ বলছে-তিনি নিয়াজিকে বলেছে দরকার হলে যুদ্ধ বন্ধ করতে।

আজ রাতে আবার বিবিসি রিপোর্ট করেছেr যে -রাওয়ালপিন্ডিতে একজন অফিসিয়াল মুখপাত্র ব্যপারটি অস্বীকৃতি জাণিয়ে বলেছে যে -ঢাকায় পাকিস্তানী মিলিটারী এবং ভারতীয় অথরিটির মধ্যে কোনো সমঝোতা হয়নি।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪১০। ঢাকার ভিতরে ভারতীয় কামান আনন্দবাজার পত্রিকা ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১৪, ৪১০, ৯৭৭-৯৭৮>

‘নিরাপদ এলাকা’ ওঁ খালি বাড়ীতে পাক সৈন্যের ঘাঁটি
ঢাকার ভিতরে ভারতীয় কামান গোলা দাগছে

ভারতীয় পদাতিক সৈন্যরা ঢাকার দুই কিলোমিটারের মধ্যে এসে পৌঁছেছেন। শহরের মহল্লায় মহল্লায় তাঁরা বিভিন্ন সামরিক লক্ষ্যবস্তুর উপর কামান দেগে চলছেন। ওদিকে মিত্রবাহিনী চট্টগ্রাম থেকে আসছেন মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে।

মেঘনার দক্ষিণ তীরে দাউদকান্দি থেকে যেসব পদাতিক বাহিনী আসছিলেন তাঁরা পথের সমস্ত নদীর বাধাই অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছেন। এখন চতুর্দিক থেকেই পদাতিক সৈন্যরা নগরীকে নাগপাশের মত এঁটে ধরেছেন।

বুধবার কলকাতায় একজন সামরিক মুখপাত্র আরও জানান পাকিস্তানী সৈন্যরা আমাদের গোলন্দাজ বাহিনীর মর্টারের গোলার জবাব দিচ্ছে।

খবর পাওয়া গিয়েছে, ঢাকার যে সব অসামরিক লোকজন বাড়িঘর ফেলে অন্যত্র চলে গিয়েছেন, শত্রু সৈন্যরা তাঁদের পরিত্যাক্ত বাড়িঘরে ঢুকে ঘাঁটি গেড়েছে।

একজন বিদেশী সংবাদ দাতার প্রশ্নের জবাবে মুখপাত্র বলেন, ‘আমাদের সেনাবাহিনী এসব বাড়ীকে সামরিক লক্ষ্য বলে গণ্য করেছেন।

নয়াদিল্লীতে জনৈক সরকারী মুখপাত্র বলেছেন, ঢাকায় দখলদার বাহিনী আত্মরক্ষার এক অভিনব কৌশল অবলম্বন করেছে। পাক জঙ্গিশাহি তাঁদের সেনাদের ঢাকার নিরপেক্ষ অঞ্চল ওঁ অসামরিক এলাকায় জড়ো করেছে। খান সেনাদের সদর দফতর হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিমান বাহিনীর সদর দফতর করা হয়েছে যক্ষ্মা হাসপাতালে। আর সামরিক পর্যবেক্ষনস্তম্ভের জন্য বেছে নেয়া হয়েছে ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল। প্রসঙ্গত উল্যেখ্য, এইসব স্থানগুলি রাষ্ট্রপুঞ্জের কর্মি এবং রেডক্রসের নিরাপত্তার জন্য নিরাপদ এলাকা বলে ঘোষিত হয়েছে।

আমাদের বিমান বাহিনীর কাছ থেকে পাওয়া এক নির্ভর যোগ্য সংবাদে জানা যায় খান সেনারা ঢাকার উত্তরাঞ্চলে পাঁচটি বাঙ্কারের উপরে অসামরিক লোকদের আটক করে রেখেছে। এর উদ্যেশ্য, ভারতীয় আক্রমণের হাত থেকে আত্মরক্ষা।

কলকাতায় সামরিক মুখপাত্র বলেন, দলে দলে ছাত্রী সৈন্যরা উত্তর পশ্চিম দিক থেকে ঢাকার ১৮ কিলোমিটার দুরবর্তি জয়দেবপুরের দিকে দ্রুত এগিয়ে আসছেন। অন্যদিকে নরসিংদীর উত্তর পূর্ব দিক থেকে ভারতীয় সেনা ওঁ মুক্তিবাহিনীর আরেকটি দলও দ্রুতগতিতে ঢাকার দিকে আগুয়ান।

মুখপাত্র ঢাকার কাছাকাছি ভারতীয় বাহিনীর অবস্থান স্থলের বিস্তৃত বিবরণ দিতে অস্বীকার করেন।

ময়নামতির প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়েছে

কুমিল্লা খণ্ডে ভারতীয় বাহিনীর প্রবল চাপে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে শত্রুর প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়েছে। এখন ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় অর্ধেক ভারতীয় নিয়ন্ত্রণে।

ভারতীয় বাহিনী খুলনা শহরের শিরোমণি অঞ্চল মুক্ত করেছেন। বিচ্ছিন্ন পাকিস্তানী সৈন্যরা গত ৫ দিন ধরে এখানে জোর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় সৈন্যরা খুলনার পথে ইতোমধ্যে নদী ওঁ জলাভূমির বাঁধা অতিক্রম করে ফেলেছেন।

মুখপাত্র বলেন, ভারতীয় সৈন্যরা যশোরের উত্তরে মধুমতী নদী পার হয়ে অপর পাড়ে ঘাঁটি স্থাপন করেছেন। এখান থেকে ফরিদপুর শহর ওঁ ঢাকার পথ উন্মুক্ত।

শ্রীহট্ট খণ্ডে পাকিস্তানী সৈন্যরা কোণঠাসা। এখানে বালুচ রেজিমেন্টের এক কোম্পানি পাক সৈন্য বুধবার ভারতীয় বাহিনীর নিকট আত্তসমর্পন করেছে।

বুধবার ফরিদপুর খণ্ডে কুমারখালি ঘাঁটে প্রচণ্ড লড়াই শুরু হয়েছে। মধুমতী নদী পাড় হয়ে ভারতীয় বাহিনী এখানে দ্বিমুখী আক্রমণ চালিয়েছে।

যশোর জেলার যোগাযোগ কেন্দ্র মাগুরা থেকেও ভারতীয় বাহিনী ওঁ মুক্তিবাহিনীর একটি সম্মিলিত দল মধুমতী নদী পাড় হয়ে গোয়ালন্দের দিকে এগিয়ে চলেছে। গোয়ালন্দ মুক্ত হয়ে গেলে যেসব পাক সৈন্য এখনো মরিয়া হয়ে জলপথে পালাবার চেষ্টা করছে, তাঁদের পথ একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে।

যমুনা নদীর এপারে সিরাজগঞ্জ ওঁ ওপারে জগন্নাথগঞ্জে ঘাটের দিকেও ভারতীয় বাহিনী ওঁ মুক্তিবাহিনীর সৈন্যরা অগ্রসরমান। এই অভিযানেরও উদ্যেশ্য ছত্রভঙ্গ পাকসেনাদের পালাবার পথ রোধ করা।

দিনাজপুর, রংপুর ওঁ সৈয়দপুরের পাক ফৌজরা এখনো বাঁধা দিচ্ছে।

রামগড় মুক্ত
দুদিন যুদ্ধের পর ভারতীয় বাহিনী ওঁ মুক্তিবাহিনী গত ১০ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামের মহকুমা শহর রামগড় মুক্ত করেছেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪১১। পাকিস্তান হার মানল আনন্দবাজার পত্রিকা বিশেষ সংখ্যা ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১

Aparajita Neel
<১৪, ৪১১, ৯৭৯>

পাকিস্তান হার মানল
নিয়াজির বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ

বাংলাদেশ দখলদার পাক ফৌজ বৃহস্পতিবার আত্মসমর্পণ করেছে। এবং আত্মসমর্পণ করেছে বিনাশর্তে। ঐ ফৌজের সর্বাধিনায়ক লে জে নিয়াজি আত্মসমর্পণের শর্তাদি নিয়ে আলোচনার জন্য ইস্টার্ন কমান্ডের অধ্যক্ষ মে জে জেকবকে ঢাকায় যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। জে জেকব তদানুযায়ী বৃহস্পতিবার সকালেই হেলিকপ্টারে ঢাকা রওনা হয়ে যান।

এই সম্পর্কে নয়াদিল্লী থেকে এক সরকারী ঘোষণায় বলা হয়েছেঃ জেনারেল মানেকশ আত্মসমর্পণের যে আহ্বান জানিয়েছিলেন আজ সকালে লে জে নিয়াজি তাতে সাড়া দেন। ঢাকা থেকে মাইক্রয়েভ মারফত তিনি আত্মসমর্পণে রাজি হওয়ার কথা জানান।

জেনারেল মানেকশ আত্মসমর্পণের সময় সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন বৃহস্পতিবার সকাল ৯ টা। কিন্তু তখন পর্যন্ত জে নিয়াজির কাছ থেকে কোন সাড়া শব্দ না পাওয়ায় ভারতীয় বিমান বহর ঢাকার সামরিক লক্ষ্যবস্তুগুলির উপর বোমাবর্ষন শুরু করে। এর কিছু পরেই পাওয়া যায় আত্মসমর্পণের খবর।

জেনারেল নিয়াজির কাছ থেকে সর্বশেষ যে বার্তা পাওয়া গিয়েছে তাতে তিনি আরোও ৬ ঘণ্টা বোমাবর্ষন বন্ধের জন্য আর্জি জানিয়েছেন। সেই আর্জিতে সায় দিয়ে বেলা তিনটা পর্যন্ত বোমাবর্ষন মুলতুবি রাখা হয়েছে।

সকাল পর্যন্ত চুপচাপ

জেনারেল ম্যানকশ আত্মসমার্পণের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন বৃহস্পতিবার সকাল নয়টা। কিন্তু জেনারেল নিয়াজি তখন পর্যন্ত কোন উচ্চবাচ্চ করেননি। ফলে ভারতীয় ফৌজ নয়টার পর ফের গোলাগুলি বর্ষণ শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে বিমান থেকে গোলাবর্ষণ। পাক সেনাপতির তখন চৈতন্যোদয় হয়। আত্মসমর্পণে তিনি রাজি হন, মানকেশ’র কাছে বার্তা পাঠান এবং আত্মসমর্পণের শর্তাদি নিয়ে আলোচনার জন্য জেনারেল জেকবকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানান।
শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪১২। নিয়াজির নিশর্ত আত্মসমর্পন যুগান্তর ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১

Aparajita Neel
<১৪, ৪২০, ৯৮০>

নিয়াজির নিশর্ত আত্মসমর্পন
বৃহস্পতিবার ঢাকায় দলিল স্বাক্ষর

নয়াদিল্লী, ১৬ ডিসেম্বর (ইউ এন আই) – পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী আজ বিনাশর্তে মুক্তিবাহিনীর সহযোগী ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ পূর্ন মুক্তি লাভ করল। আত্মসমর্পনের নথিপত্র স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশে পাক বাহিনীর প্রধান লে জে নিয়াজি এবং ভারতীয় ইস্টার্ণ কমান্ডের জি ও সি ইন সি লে জে জগজিৎ সিং আরোরা। লে জে আরোরা এই উদ্যেশ্যে আর দুপুরে বিমানযোগে বাংলাদেশের রাজধানীতে গিয়েছিলেন। বিকাল ৪ টা ৩১ মিনিটে এই নথি স্বাক্ষর হয়।

পাক দখলদার বাহিনীরা বিনাশর্তে আত্মসমর্পনের কথা প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধি লোকসভায় ঘোষণা করেন এবং রাজ্যসভায় এই কথা ঘোষণা করেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রী জগজীবন রাম। বিকাল সাড়ে পাঁচটার সময় উভয় কক্ষে একই ঘোষণা করা হয়।

এই ঘোষণার সংগে সংগে উভয় কক্ষ উল্লাসে ফেতে পরে এবং নির্দিস্ট সময়সূচীর বাইরেও তারা অধিবেশন চালিয়ে যান।

আত্মসমর্পনের ব্যাপারে সমস্ত ব্যাবস্থা করেন ইস্টার্ণ কমান্ডের চিফ অফ স্টাফ মেজর জেনারেল জে এফ আর জেকব। আমাদের সৈন্যাধক্ষ জেনারেল মানেকশের চরমপত্র অনুযায়ী আজ সকাল ন’টার পরেই জেনারেল নিয়াজি বিনাশর্তে আত্মসমর্পনের কথা জানান।

সকাল ন’টার দশ মিনিট পূর্বে জেনারেল নিয়াজির বার্তা এসে পৌঁছায়।

আত্মসমর্পনের শর্ত

পাকিস্তানী বাহিনীর লে জে নিয়াজি ভারতীয় বাহিনীর লে জে আরোরার কাছে প্রদত্ত যে আত্মসমর্পনপত্রে স্বাক্ষর করেন তাঁতে আছে, এতোদ্বারা পূর্বাঞ্চলের ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর জি ও সি ইন সি লে জে আরোরার কাছে পাক বাহিনীর ইস্টার্ণ কমান্ড বাংলাদেশস্থিত সমস্ত পাকিস্তানী সশস্ত্র সৈন্যের আত্মসমর্পনের কথা স্বীকার করেছে। আত্মসমর্পন যারা করেছে তাদের মধ্যে আছে পাকিস্তানী স্থল, বিমান নৌবাহিনীসহ প্যারামিলিটারি বাহিনী ও অসামরিক সশস্ত্রবাহিনীর সমস্ত সৈনিক।

এই সমস্ত বাহিনীর সৈনিকেরা যে যেখানে আছে সেখানকার লে জেনারেল আরোরার অধিনস্ত সৈন্যবাহিনীর কাছে অস্ত্র ও আত্মসমর্পন করবে। এই নথি স্বাক্ষরের সংগে সংগেই পাকিস্তানী ইস্টার্ন কমান্ড লে জে আরোরার অধীন হয়ে যাবে।

এই আদেশ যে অবজ্ঞা করবে তাকে আত্মসমর্পন শর্তের পরিপন্থী বলে মনে করা হবে এবং যুদ্ধের প্রচলিত নিয়মানুযায়ী তাঁর বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হবে। আত্মসমর্পন শর্তাবলি সম্পর্কে কোন সন্দেহ দেখা দিলে লে জে আরোরা সে বিষয়ে যে ব্যাখ্যা দেবেন তাই চূড়ান্ত বলে বিবেচনা করা হবে।

লে জে আরোরা এই প্রতিশ্রুতি দেন যে, যেসব সৈন্য আত্মসমর্পন করবে তাদের প্রত্যেকের সঞে জেনেভা চুক্তির শর্তানুযায়ী সন্মান ও মর্যাদাপূর্ন ব্যাবহার করা হবে এবং তাদের নিরাপত্তার জন্য ব্যাবস্থা অবলম্বন করা হবে।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!