You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৭। পাশবিক হত্যা   (সম্পাদকীয়) নিউ ইয়র্ক টাইমস ৬ মে,, ১৯৭১

Prodip Mitra

<১৪, ৩৭, ৮৪>

নিউ ইয়র্ক টাইমস , ৬ মে,, ১৯৭১

পাশবিক হত্যা   (সম্পাদকীয়)

গত কয়েক বছর ধরেই ওয়াসিংটন (আমেরিকার রাজধানী) পাকিস্তান সরকারকে তাদের জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার নাম ভারী অস্ত্র, ট্যাংক, ও সামরিক বিমান সরবরাহ করে আসছে। দুঃখজনক হলেও সেই চুক্তিতে করাচির (পাকিস্তানের রাজধানী) তার নিজের দেশের জনতার নিরাপত্তা রাখা নিয়ে কিছু উল্লেখ ছিল না।  অতঃপর (আমেরিকার) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় অবশেষে মানতে বাধ্য হয় যে সেসব আগ্নেয়াস্ত্র ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা অবাধে গত মার্চ মাস হতে পাকিস্তানে সাধারণ মানুষের উপর প্রয়োগ করা হচ্ছে।  ওয়াসিংটন আরো স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে তারা সম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তানকে গোলাবারুদ ও সামরিক যন্ত্রাংশ সরবরাহ করছে। এই পটভূমিকায়, ওয়াশিংটন করাচিকে বেসরকারি পর্যায়ে সংবরণের  জন্য যেসব আবেদন করেছে, তা আদৌ কার্যকর হয়নি।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ড নিউইয়র্ক টাইম্‌স ১০ই মে, ১৯৭১

Ashik Uz Zaman

<১৪, ৩৮, ৮৫-৮৬>

দি নিউইয়র্ক টাইম্‌স, ১০ই মে, ১৯৭১

ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ড

ম্যালকম ডাব্লিউ. ব্রাউন কর্তৃক

রাজশাহী, পাকিস্তান, ১০ই মে

 

পদস্থ সরকারী কর্মচারীদের সাহচর্যে যে ছয়জন সংবাদকর্মীকে পাকিস্তানের সরকার পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে তাদের একজন কর্তৃক

বাঙালী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর পরিচালিত নিষ্পেষণ শক্তি আপাতদৃষ্টিতে পূর্ব পাকিস্তানের সকল গুরুতর সশস্ত্র বিদ্রোহ চূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছে।

এই শহরটি, যার জনসংখ্যা ১,০০,০০০ ছিল, যেটি ঘোলা পানির, ধীরে বয়ে চলা গঙ্গা নদীর পূর্ব পাড়ে অবস্থিত, যার অপর পাড়ের ৩,০০০ গজের মধ্যে ভারত । এই শহরটির মতো সীমান্তবর্তী শহরগুলো আপাত-নিষিদ্ধ বিচ্ছিন্নতাবাদী আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক শক্ত ঘাঁটি ছিল, যারা গত ৭ই ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদীয় নির্বাচনে ব্যাপক ব্যবধানে জয়লাভ করে।

জাতীয় সেনাবাহিনী, যা মূলত পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবীদের নিয়ে গঠিত; ২৫শে মার্চ পুরো পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উপর আঘাত হানে, এবং মাঝ-এপ্রিলের মধ্যে, আপাতদৃষ্টিতে, সেনাবাহিনীর সামরিক অভিযান কার্যত সম্পন্ন হয়ে গেছে।

সীমান্তবর্তী এলাকার সর্বশেষ বিদ্রোহগুলো অত্যন্ত দ্রুততার সাথে দমন করা হয়, এবং যদিও সেনাবাহিনীর টহল দলগুলো এখনো মাঝেমাঝে আক্রান্ত হয়, তবুও এই দ্বিধাবিভক্ত দেশটির পূর্ব অংশটি এখন শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রিত বলে প্রতীয়মান হয়।

সংশ্লিষ্ট সকলের জন্যই এটি বেদনাদায়ক। সাংবাদিকেরা মাটির সাথে মিশে যাওয়া বা লুঠ হওয়া হাজার হাজার দালান দেখেছেন। শহরগুলোতে, শত শত বুলেটে ঝাঁঝরা হওয়া দেয়াল দেখলে বোঝা যায় ফায়ারিং স্কোয়াড কোথায় তাদের কাজ সেরেছে। লাশগুলো পাড়ার কুয়ায় ফেলা হয়েছে, এবং সার্বজনীন জনমানবশূন্যতা ঘটনাবলীর হিংস্রতার সাক্ষ্য দেয়।

ঠিক কিভাবে এসব ঘটেছে তা আপাতদৃষ্টিতে বোঝা যাচ্ছেনা, কেননা প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য তাদের দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করে একবারেই পরস্পরবিরোধী।

সামরিক বাহিনী এবং সারা দেশ জুড়ে তাদের প্রতিষ্ঠিত বেসামরিক “শান্তি কমিটি”-এর সদস্যরা বলছে বেশিরভাগ ধ্বংসযজ্ঞ এবং গণহত্যা ঘটিয়েছে বিদ্রোহীরা, এবং সীমান্তে অনুপ্রবেশকারী ভারতীয় সৈন্যরা।

কিন্তু রাস্তাঘাটে বাঙালীরা প্রায়শই সাংবাদিকদের কাছে এসে ফিসফিসয়ে কিছু কথা বলেই দ্রুত চোখের আড়ালে চলে যায় সদা-উপস্থিত শান্তি কমিটির সদস্যরা দেখার আগেই।

শান্তি কমিটির বেশিরভাগ সদস্য, সেনাবাহিনী যাদেরকে বেসামরিক প্রশাসনের কিছু দায়িত্ব দিয়েছে, হচ্ছে বিহারি মুসলিম, যারা ১৯৪৭ সালে ভারত থেকে পাকিস্তানে চলে আসে যখন ব্রিটিশ ভারতকে ভেঙে এইদুটি রাষ্ট্র তৈরি করা হয়।

পূর্ব পাকিস্তানের বেশিরভাগ ব্যবসা এবং বাণিজ্য এই বিহারীদের হাতে, যারা স্থানীয় বাঙালীদের মাঝে সংখ্যালঘু। স্থানীয় বাঙালীরা বেশিরভাগই মুসলিম, তবে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক হিন্দু সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রয়েছে।

অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধিশালী বিহারীদের প্রতি অনেকটা দারিদ্র্যপীড়িত বাঙালীদের, অসন্তোষ, সাম্প্রতিক যুদ্ধে বাঙালীদের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের পিছনে একটি কারণ হিসেবে কাজ করেছিল। ধারণা করা হচ্ছে, শত শত সাক্ষাৎকার নেয়ার পর, কিছু কিছু এলাকায় বাঙালীরা বিহারীদের গণহারে হত্যা করেছে এবং তাদের বাড়িঘর লুঠ করেছে এবং পুড়িয়ে দিয়েছে। বাঙালীরা যারা জাতীয় সেনাবাহিনীতে ছিল তারা বিদ্রোহ করেছে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে যোগ দেয়ার জন্য। মূলত পাঞ্জাবী অধ্যুষিত পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যখন জোরপূর্বক পূর্বের অঙ্গরাজ্যে প্রবেশ করে, বিহারীদের মধ্যে তাদের মিত্ররা তৈরি ছিলই, যাদের বেশিরভাগই প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ খুঁজছিল।

এর পরবর্তীতে চালানো গণহত্যার ভয়াবহতা বেশিরভাগ প্রত্যক্ষদর্শীকেই অসুস্থ করে তুলেছে। এই সংঘাতের ফলশ্রুতিতে, এই শহরের মতো শহরগুলো থেকে বেশিরভাগ বাঙালী এবং সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রায় সবাই, পালিয়ে গেছে। এখানে যে দালানগুলো নিয়ে শহরের প্রধান বাজার এলাকা গঠিত সেগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে, আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় ১৪ই এপ্রিল যখন সেনাবাহিনী এই শহর দখল করে নেয় তখন মর্টারের গোলার আঘাতে এগুলো ধ্বংস হয়েছে।

সুন্দর কারুকার্য করা কাঠের ব্যালকনিসহ কিছু পাঁচ-তলা দালান এখনো দাঁড়িয়ে আছে এই এলাকায়,

তবে ওগুলোর মধ্যে কিছু দালানের উপরদিকের তলাগুলো গোলাবর্ষণে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

শহরের বেশিরভাগ এলাকায়, অবশ্য, গোলাবর্ষণ হয়নি, এবং সাইকেল রিক্সা এবং হকাররা আবারো রাস্তায় চলাচল শুরু করেছে। শহরে আবারো পানি, বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হয়েছে, এমনকি একটি অভিযোগ দপ্তরও আছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৯। একজন মেজরের বিদ্রোহ নিউজ উইক ১০ মে ১৯৭১

Razibul Bari Palash

<১৪, ৩৯, ৮৭>

নিউজউইক, মে ১০, ১৯৭১

মেজর হকের বিদ্রোহ

-মিলান জে কিউবিক

প্রথম দিন একটি ছোট খামারবাড়ি , পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত থেকে ২ মাইল ভিতরে , বাড়ির পিছনের দিকের উঠোনের  মধ্যে মেজর হকের সাথে সাক্ষাৎ হয়। তিনি কেডস এবং একটি কৃষকদের লুঙ্গি (একটি স্কার্ট এর উপর একটি দীর্ঘ সাদা শার্ট) পরিহিত ছিলেন। সামনের অনিবার্য সামরিক বিপর্যয় থাকা সত্ত্বেও তিনি নিরুদ্বিগ্ন। এক সপ্তাহের কম সময়ে আমি কর্দমাক্ত ট্র্যাক দিয়ে নডিং করে বাংলাদেশে আসি। ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী পালাতে পালাতে এখানে এসে পৌঁছাবে এবং পদদলিত হবে। তাদের আসতে দিন। যুদ্ধের প্রথম অংশ শেষ হবে তখন এবং তারপর ফেজ দুই আরম্ভ হবে। ‘

এলাকায় হকের একটি আহত উইলিস জীপের  মাধ্যমে আমরা যতখানি এলাকা দেখেছি ইতিমধ্যে সেগুলো মুক্ত। নারী ও শিশুদের অধিকাংশই ভারতে শরণার্থী শিবিরে চলে যায়। আর দেশের বাকি অঞ্চলে মাসব্যাপী তেল, জ্বালানি তেল ও শিল্পজাত পণ্যের  সংকট ছিল। “আমার কাছে টাইফয়েড এবং কালাজ্বর এর কোন ওষুধ নাই। ‘ এক ফার্মাসিস্ট আমাকে বলছিলেন।  “আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এস্পিরিন শেষ হয়ে যাবে। ‘

তবুও এই সব যন্ত্রণার পরেও গ্রামবাসী এখনো বাংলার  স্বাধীনতা সমর্থন করে।  উদাহরণস্বরূপ, শাহাপারে কয়েকশ কৃষক প্রচুর উদ্দীপনার সাথে হকের আবেদনে সাড়া দেয়। তিনি বলেছেন আগামী মাসে ধান কেটে আনতে। ‘ আপনারা সব যদি ভারতে পালিয়ে যান তাহলে বাংলাদেশ একটি ভয়ানক দুর্ভিক্ষে  ক্ষতিগ্রস্ত হবে।  ফসল কাতাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আপনাদের যুদ্ধ করার পরিবর্তে। তারা সাদাসিধা বাংলা পতাকা উড়িয়ে একত্রে উচ্চারণ করল “জয়বাংলা জয়বাংলা!”

আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, হক ও তার প্রধান নিয়োগকারী, ২৪ বছর বয়সী শাহ আবদুল খালেকের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধের জন্য বাংলাদেশের  স্বেচ্ছাসেবকদের বাছাই করতে কোন কষ্ট হলনা। আমার স্কুল গাইবান্ধার এক গ্রামে। আমার দেশ আর বিপদে পড়েছে। আমার  দায়িত্ব যুদ্ধ; পালান নয়। মাদিলে একটি পিতার দুই ছেলে ১৭ ০ ২৩ বছর বয়সী যুদ্ধে অংশ নেবে। আমি গর্বিত । ভেড়ার মত জবাই হয়ে মরার চেয়ে হাতে রাইফেল নিয়ে মরা অনেক সন্মাঞ্জনক।

এত উৎসাহের পরেও বাঙালি এখনও বাঁধার মুখোমুখি হচ্ছেন। অস্ত্র বলতে তাদের কাছে ৩০০০ প্রাচীন এনফিল্ড রাইফেল এবং প্রায় ১০০ ছোট মর্টার । তার উপরে, বাঙালিদের গুরুতর নেতৃত্বের সমস্যা আছে।  উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ছাড়া ভারতীয় সীমান্ত থেকে মাত্র এক মাইল দূরে বাংলাদেশের ছয় সদস্যের সরকার এখনো তেমন জোরালো ভাবে প্রকাশিত হতে পারেনি। হক নিজে আমাকে বলেছিলেন ,  “আমাকে দ্রুত ভারত যেতে হবে, কিন্তু আমি পারব না। সবচেয়ে কাছে অবস্থিত বাঙালি অফিসার ২০ মাইল দূরে এবং এই মানুষগুলো আমার মত আশা হৃদয়ে ধারণ করে।

বাঙ্গালীদের কিছু সুবিধাও আছে। নিউ দিল্লি ইতিপূর্বেই “মুক্তি বাহিনী”র জন্য স্বর্গ করে দিয়েছেন বিভিন্ন গেরিলা ট্রেনিং ক্যাম্প এবং কিছু ট্রাক ও সরঞ্জাম ও আশ্রয়স্থল প্রদান করে। অনেক কূটনীতিক, পরন্তু, অদূর ভবিষ্যতে বিদ্রোহীদের কাছে অস্ত্র চালান করার আশা প্রকাশ করেন ভারত সরকারের কাছে। বাঙালিদের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল ৭০০০০ সদস্যের ফেডারেল দখলদার বাহিনী কখনো স্থায়ীভাবে ৭৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষকে নিশ্চিনহ করে দিতে পারবেনা। “যদি আপনি এখন থেকে চার মাস পড়ে আসেন তাহলে কিছু কাজ দেখাতে পারবো – হক আমাকে জানান – আমি চলে যাচ্ছিলাম। এবং তিনি সেটাই করবেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪০। যুদ্ধ না অপমান টাইম ১০ মে ১৯৭১

Razibul Bari Palash

<১৪, ৪০, ৮৯-৯০>

টাইম ম্যাগাজিন; মে ১০, ১৯৭১

যুদ্ধ না অপমান

পূর্ব পাকিস্তানে রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ ও খাদ্যাভাব থাকলেও অন্য অংশে আছে আরেক সমস্যা। সেনা সমর্থিত প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের সরকার পূর্ব পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সম্পূর্ন বিরোধী। কিন্তু তা করতে গিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সম্পদ ক্ষয় এবং অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। এটা শাসকদের গলার মধ্যে আটকে আছে – একথা এক আমেরিকান কূটনীতিক ইসলামাবাদে বলেন। তিনি আরও বলেন  তাদের হয় এটা গিলে ফেলতে হবে না হয় উগড়ে ফেলতে হবে।

গত সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তানে সম্মুখ যুদ্ধ থেমে গেছে। তা সত্ত্বেও, পশ্চিম পাকিস্তান সুদুর ভবিষ্যতে পূর্ব পাকিস্তানে প্রচুর সেনা সমাবেশ চালিয়ে যেতে হবে।  তাছাড়া, ভারতের জন্য তার প্রতিরক্ষাকে দুই অতিরিক্ত ভাগে ভাগ করতে হচ্ছে।

পুরনো ঘৃণা

এদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্প মাত্র এক তৃতীয়াংশ হয়ে গেছে। কারণ জনবহুল পূর্ব পাকিস্তানে অর্থনৈতিক মন্দা । পশ্চিম পাকিস্তান, পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পতন দ্বারা প্রভাবিত। স্বাভাবিক সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের পাট শিল্প থেকে পুরো দেশের বৈদেশিক মুদ্রার অর্ধেক আয় হয়। এখন এটা অলস পড়ে আছে। তাছাড়া অন্যান্য শিল্প পরিবহন সুবিধা প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। পশ্চিম পাকিস্তানের সাহায্য দরকার পূর্ব পাকিস্তানকে আবার গড়ে তোলার জন্য। কিন্তু তা কঠিন হবে।  “আমরা অর্থনৈতিক ধ্বংসের কিনারে’ পশ্চিম পাকিস্তানের নিউ  টাইমসের  একটি সম্পাদকীয় গত সপ্তাহে এমনটাই লিখেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিঃশেষ হয়ে গেছে কিছুদিন আগে। এবং মে এবং জুন মাসে ইউ এস ও ইউরোপিয়ান ক্রেডিটরদের ঋণের নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করতে অসমর্থ হয়েছে।  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৮০ মিলিয়ন ডলার ঋণ সহ বৈদেশিক সাহায্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এবং এগারো জাতি যারা পাকিস্তান অর্থনৈতিক উন্নয়নের সবচেয়ে সমর্থনকারী  তারাও ইয়াহিয়ার বর্তমান সঙ্কট শেষ না হওয়া পর্যন্ত আগ্রহ দেখাচ্ছেনা।

এসব চাপের কারণে ও পূর্ব পাকিস্তানের দুরবস্থার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের ভারতের উপর পুরনো আবার উদ্দীপ্ত হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার পুর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনির নৃশংস আক্রমনের (দমনমূলক অভিযানের) উপর আসা বিদেশি সংবাদমাধ্যমের খবরাখবর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানীদেরকে সম্পুর্ন বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। পশ্চিম পাকিস্তান এটিকে ভারতীয় চক্রান্ত বলে চালানোর চেষ্টা করছেন। ভারত আপাতত নিরপেক্ষ আছে – কিন্তু এতে বাঙ্গালী বিদ্রোহীদের অনেক সুবিধা হয়েছে।

বর্ডার শুটিং

পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে কূটনৈতিক হুমকি ধারাবাহিকভাবে চলছে। কলকাতায় পাকিস্তানের প্রধান কূটনীতিক বাংলাদেশের দিকে ডিফেক্টেড হবার কারণে ইসলামাবাদ

একজন প্রতিনিধি পাঠায় যিনি কোন ভাবেই সুযোগ কড়তে পাড়েন নাই। ফলে পাকিস্তান, অফিস বন্ধ করে দাবি করেন যে ভারত ঢাকায় তার মিশন বন্ধ করেছে।

এটা কূটনৈতিক ধস্তাধস্তি আরো বিপজ্জনক।  তবে, পরিস্থিতি ইস্ট ‘পাকিস্তান ও ভারতের সীমান্ত বরাবর উন্নয়নশীল ছিল।  পশ্চিম পাকিস্তানে সেনা বিদ্রোহীদের এবং ভারতের  সরবরাহের সম্ভাব্য উৎস খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছেন এবং বাঁধা দেবার চেষ্টা করছেন। গত সপ্তাহে উভয় পক্ষের অভিযোগ যে তাদের উপর সৈন্যরা আক্রমণ করেছে। এই পরিস্থিতি বিদেশী কূটনীতিকদের শঙ্কায় ফেলেছে। তারা ভাবছেন যে আরেকটি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের শুরু হতে পারে। কোন দেশই যুদ্ধ করতে চায় না, এবং কারো সেই সামর্থ্য ও নাই। কিন্তু এটা ১৯৬৫ সালের ১৭ দিনের যুদ্ধের মতই পরিবেশ। “সেনাবাহিনীর সিদ্ধান্তের জন্য তাদের ভারত অথবা পূর্ব পাকিস্তানে নাকাল হবার সম্ভবনা আছে” এক কূটনীতিক একথা বলেন। পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা একটি ধারাবাহিক যুদ্ধবিগ্রহের পথ উন্মুক্ত করে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪১। নির্যাতিত বাঙ্গালী (সম্পাদকীয়) ওয়াশিংটন পোস্ট

(বাংলাদেশ ডকুমেন্টস)

১২ মে ১৯৭১

Razibul Bari Palash

<১৪, ৪১, ৯১>

ওয়াশিংটন পোস্ট , ১২ মে ১৯৭১

সম্পাদকীয়

নির্যাতিত বাঙ্গালী

পাকিস্তান পূর্ব অংশের সাথে যাচ্ছেতাই আচরণ করছে। তারা রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলন করছে। কিন্তু সেটাকে সেনাবাহিনী দিয়ে নির্মমভাবে দলিয়ে দেবার চেষ্টা চলছে। ইয়াহিয়া খানের মিলিটারি সরকার এখনো আন্তর্জাতিক ত্রাণ ভুক্তভোগী বাঙ্গালীদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেনা। তারা তাদের ভারতে পালিয়ে যাতে বাধ্য করছে।

 

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪২। পাকিস্তানের কথা

 

বালটিমোর মে ১৪, ১৯৭১

Ashik Uz Zaman

<১৪, ৪২, ৯২>

দি বালটিমোর সান। মে ১৪, ১৯৭১

সম্পাদকীয়

পাকিস্তানের কথা

মার্চ মাসে পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া শোকাবহ ঘটনার ব্যাপ্তি, যখন দেশটির দুইটি অংশকে পাশবিকভাবে ছিড়ে দু’টুকরো করে ফেলা হয়, একটু একটু করে জানা যাচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তানে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে অনুসন্ধানে নিয়োজিত ছয়জন বিদেশী সাংবাদিকের একটি দলের পাঠানো এ যাবতকালে প্রাপ্ত প্রকৃত তথ্য থেকে। এখন পর্যন্ত এই পর্যবেক্ষকরা সতর্ক নিরীক্ষণের মধ্যে সাবধানে লেখালেখি করেছেন, কিন্তু তাদের মধ্যে একজন, এসোসিয়েটেড প্রেস –এর মোস্ট রোসেনব্লুম, এর বিকল্প হিসেবে দেশত্যাগ করেন এবং ব্যাংকক থেকে তাঁর বার্তাগুলো পাঠান। তাঁর প্রতিবেদন এমন এক ঘৃণা ও বিভীষিকার কথা জানায়, যা কিনা এক গৃহযুদ্ধের অবিশ্বাস্য গণহত্যা, ধ্বংসের কিনারায় পৌঁছে যাওয়া জাতীয় অর্থনীতির এবং রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার।

মৃতের সংখ্যা, মিঃ রোসেনব্লুমের আনুমানিক হিসাবে, পাঁচ লক্ষ হতে পারে। যে ধ্বংসলীলা চালানো হয়েছে, তিনি জানান, তা অবিশ্বাস ধরণের। লাখ লাখ মানুষ ক্ষুধাপীড়িত, দুর্ভিক্ষ থেকে এবং ত্রাণ বিতরণ বন্ধ হয়ে যাওয়াতে, এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে। পরিস্থিতি এর চেয়ে খারাপ আর হতে পারেনা।

মিঃ রোসেনব্লুম এবং অন্যান্য সুত্রমতে এটা পরিষ্কার যে অজ্ঞাতসংখ্যক হত্যাকাণ্ড সঙ্ঘটিত হয়েছে পূর্ব বাঙালীদের দ্বারা, সেখানে বসবাসরত পশ্চিম পাকিস্তানী এবং অন্যান্য অবাঙালীদের প্রতি ঘৃণা এবং প্রতিশোধপরায়নতার প্রেক্ষিতে। কিন্তু এটাও পরিষ্কার যে জাতিটিকে পাশবিকভাবে ছিড়ে দু’টুকরো করার কৃতিত্ব প্রথমতঃ পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকেই দিতে হবে এবং তাদেরকে যারা আদেশ-নির্দেশ দিয়েছে তাদেরকেও।

এক ভাষ্যমতে সামরিক বাহিনীর অভিযানে ঢাকায়, যা কিনা পূর্ব বাংলার রাজধানী, মৃতের সংখ্যা ১৫০ এর মতো হবে যা অবশ্যই এক দানবীয় মিথ্যাচার, এবং সামরিক বাহিনী সেদিন ভোরে পূর্ব পরিকল্পিত এক সশস্ত্র বিদ্রোহ দমনের জন্য এই হামলা চালিয়েছে এমন কোনো প্রমাণও পরিবেশন করা হয়নি সামরিক বাহিনী এই অভিযান শুরু করার পরে।

 

প্রকৃত ঘটনা এখনো তাই মনে হচ্ছে, যা প্রথমেই ধারণা করা হয়েছিল, যে পাকিস্তানের সরকার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী পূর্ব বাংলার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসতে না দেয়ার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর ছিল, এবং এই দৃঢ়সংকল্প থেকেই মার্চের এই সুপরিকল্পিত গণহত্যার জন্ম হয়

যদিও এর পূর্ণ পরিণতি এখনো জানতে বাকি, তবুও এটুকু এখনই স্পষ্ট যে পাকিস্তানের স্রষ্টাদের পরিকল্পিত পাকিস্তান আর নেই, এক নড়বড়ে অর্থনৈতিক কাঠামোকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে যা থেকে পরিত্রাণের আর কোন পথ প্রায় নেই, বিদ্বেষপূর্ণ এক প্রজন্মের সৃষ্টি নিশ্চিত করা হয়েছে এবং রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এমন সব নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে যার উদ্দেশ্যের সাথে পাকিস্তানের জাতীয় সমৃদ্ধির সামান্যই সংযোগ রয়েছে

শিরোনাম সূত্র তারিখ
বিকল্প চিন্তা

 

নিউজউইক মে ১৯, ১৯৭১

Ashik Uz Zaman

<১৪, ৪৩, ৯৩৯৪>

বিকল্প চিন্তা

নিউজউইক, মে ১৯, ১৯৭১

সাত সপ্তাহ আগে যখন পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ শুরু হয়, তখন দ্বিধাবিভক্ত জাতির পশ্চিম ভাগের বেশির ভাগ মানুষ তাদের সরকারের বিছিন্নতাবিরোধী কঠোর মনোভাবকে সমর্থন করেছিল। কিন্তু রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলতে থাকলে, পশ্চিম পাকিস্তানের আরও বেশি মানুষ বিকল্প চিন্তা করা শুরু করে। করাচী থেকে গত সপ্তাহে, নিউজউইকের মিলান জে. কুবিচ তারবার্তার মাধ্যমে এই সংবাদ প্রেরণ করেছেনঃ

যুদ্ধের শুরুতে, কঠিনভাবে নিয়ন্ত্রিত করাচীর সংবাদমাধ্যম এই বিদ্রোহ এবং জাতির উপর এর প্রভাবকে অতিরঞ্জিত সরকারী মতামতের পর্দার আড়ালে ঢেকে দিতে পেরেছিল। এই ধুম্রজাল এতই কার্যকর ছিল যে মাঝে মাঝে এটা তাদেরকেও হতভম্ব করে দিত যারা এটা ছড়িয়েছে। এখন, সরকার এই পর্দার এক পাশ তুলেছে, এবং এর নিচে তারা দেখতে পাচ্ছে যে পশ্চিম পাকিস্তানিরা দ্বিধা ও বিষণ্ণতায় ভুগছে।

তাদের বিহ্বলতা আরো প্ররোচনা পায় যখন গত সপ্তাহে ঘোষণা আসে যে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মেদ ইয়াহিয়া খানের সামরিক জান্তা পাকিস্তানের ৪০০ কোটি মার্কিন ডলারের বৈদেশিক ঋণ শোধ করার জন্য আরও ছয় মাসের সময় চাইছে, এবং জ্বালানী তেলের মূল্য ৮ থেকে ১০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হবে। সরকারী হুকুমে ৪৬ ধরনের পণ্য আমদানি নিষিদ্ধকরণ এবং অন্যান্য পণ্যের উপর দিগুন-ত্রিগুন আমদানি শুল্ক আরোপের পরপরই এই ঘোষণা আসায়, মনে হচ্ছে এটা ভবিষ্যৎ ক্রমাগত মূল্যস্ফীতির পূর্বাভাস। এবং এই সম্ভাবনা, পক্ষান্তরে, অনেক পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদের সেই আশঙ্কাই প্রমান করে যে যুদ্ধের ময়দানে সরকারের জয় হলেও, পূর্ব পাকিস্তানে যে তিক্ত সংগ্রাম চলছে তা জাতীয় অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতিসাধন করছে।

এই উপসংহারে আসার পক্ষে যুক্তি খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন নয়। একদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানের পণ্য উৎপাদনকারী শিল্পগুলো বড় একটি আঘাত পেয়েছে দেশের পূর্ব অংশে তাদের পণ্যের বাজার বন্ধ হয়ে যাওয়াতে, যেখানে তারা তাদের উৎপাদিত পণ্যের একতৃতীয়াংশ বিক্রি করতো। অন্যদিকে, অসংখ্য বাঙালি শরণার্থী পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে যাওয়াতে আসন্ন চা-পাতা উত্তোলন হুমকির মুখে পরেছে, যা বিকল্প হিসেবে চা পাতা আমদানির সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিচ্ছে। সবচেয়ে ক্ষতিকর, অবশ্য, পূর্ব পাকিস্তানের পাট রপ্তানি ব্যাহত হওয়া, যা কিনা জাতির জন্য বৈদেশিক মুদ্রার সবচেয়ে বড় উৎস; মাত্র গত সপ্তাহে রপ্তানি পুনরায় শুরু হয়েছে। সব মিলিয়ে, এই যুদ্ধের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে প্রতিদিন ২০ লাখ মার্কিন ডলার যা কিনা এক বিশাল বোঝা এই জাতির জন্য যার বৈদেশিক মুদ্রার মজুত এই সংকটের শুরুতে ছিল মাত্র ৮ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার।

আরও বলতে গেলে, অদূর ভবিষ্যতে পরিস্থিতির লক্ষণীয় মাত্রায় উন্নতি হবার সম্ভাবনও খুবই ক্ষীণ। যদিও কতিপয় সরকারী কর্মকর্তা বলতে চান যে আস্তে আস্তে পূর্ব পাকিস্তানের জীবনযাত্রা “স্বাভাবিক” হয়ে আসছে, অন্যরা স্বীকার করেন যে সশস্ত্র বিদ্রোহের মাত্রা ক্রমশঃ বাড়ছে। রয়েছে ব্যাপক হারে কর ফাঁকির খবর (যা কিনা পুরো জাতির কর আদায়ের ৪০ শতাংশ)। এবং রাজনৈতিকভাবে পরিস্থিতি শান্ত করার সরকারী চেষ্টাও একইভাবে বিফল হচ্ছে। তাই, গেরিলা যোদ্ধাদের জন্য সাধারন ক্ষমা এবং সরকারি কর্মচারীরা যার যার চাকরিতে ফিরে এলে তাদের বকেয়া বেতন পরিশোধের ঘোষণা থাকলেও, শুধুমাত্র গুটিকয়েক পূর্ব পাকিস্তানিই এই প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। বাস্তবে, পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নির্বাচিত ১৬৭ জন সংসদ সদস্যর মধ্যে মাত্র দুই জনই তাদের অঞ্চলের স্বাধীনতার ঘোষণাকে অস্বীকার করেছে।

অবধারিতভাবে, ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকট এবং পূর্ব পাকিস্তানের চলমান প্রতিরোধ পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও নাড়া দিয়েছে। কিছুদিন আগেই উত্তর-পশ্চিমের সীমান্ত প্রদেশ সিন্ধ-এ বেশকিছু নাগরিককে গ্রেফতার করা হয় প্রাদেশিক বিভাজনের পক্ষে আন্দোলন করার অপরাধে। এবং জুলফিকার আলি ভুট্টো, পশ্চিম পাকিস্তানের উচ্চাকাঙ্ক্ষী নেতা যে কিনা তার অনুসারীদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে অচিরেই পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসনের অবসান হবে, নিন্দিত হয়েছে সামরিক শাসন এখনো বলবত থাকায়। কিন্তু সর্বোপরি মাথার উপর মূল্যস্ফীতির শঙ্কা এবং পূর্ব পাকিস্তানে দীর্ঘমেয়াদি গেরিলা যুদ্ধের সম্ভাবনা ইয়াহিয়া খানের জন্যেও হুমকিস্বরূপ। কেননা গত সপ্তাহে করাচীর একজন শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতা আমাকে বলেছেনঃ “অতীতের অন্য সরকারগুলো এর চেয়ে অনেক অল্পতেই ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। আমি বলবো ইয়াহিয়ার হাতে আর ছয় মাস সময় আছে সবকিছু ঠিকঠাক করার জন্য। এরপর, সামরিক বাহিনী ধরে নেবে যে তাদের প্রেসিডেন্ট যে কাজ পারবেনা সেটাতেই হাত দিয়েছে, এবং তারা হয়তো একজন নতুন নেতা খোঁজা শুরু করবে।” যদি সঠিক হয়, তাহলে এই ধারণা থেকে বলা যায় যে ইয়াহিয়ার হাতে সামান্য হলেও সময় আছে। কিন্তু পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে যে, সময় খুব দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪৪। পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা স্যাটারডে রিভিউ মে ২২, ১৯৭১

Ashik Uz Zaman

<১৪, ৪৪, ৯৫৯৭>

দা স্যাটারডে রিভিউ, মে ২২, ১৯৭১

পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা

মানুষের সকল অধিকারের মাঝে সবচেয়ে মৌলিক যে অধিকার, একজন মানুষের বিপদের সময় সাহায্যের জন্যে অন্য একজন মানুষের এগিয়ে আসার অধিকারকে এখন এমন এক মাত্রার আনুষ্ঠানিক ঔদ্ধত্যের মাধ্যমে অস্বীকার করা হচ্ছে যা কিনা সাম্প্রতিক ইতিহাসে বিরল এক দৃষ্টান্ত।

পূর্ব পাকিস্তানের যে মানুষগুলো গত বছরের বন্যার কারণে এখনো গৃহহীন এবং ক্ষুধাপীড়িত, তারাই এখন আবার মনুষ্যসৃষ্ট এক দুর্যোগের শিকার। তাদের দেশ পরিণত হয়েছে এক অনুমোদিত বধ্যভুমিতে। বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ আজ প্রায় শুন্যের কোঠায়। যারা জরুরী চিকিৎসা বা অন্যান্য সাহায্যে এগিয়ে আসতে চেয়েছিল তাদেরকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।

বর্তমান সময়ের এই অবস্থার শেকড় রয়েছে ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশকে দ্বি-জাতিতত্বের ভিত্তিতে ভেঙে দুটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তের মধ্যে। ইংরেজদের কাছ থেকে স্বাধীনতা আদায়ের সংগ্রাম ছিল জটিল এবং হিন্দু ও মুসলিম জোটের পৃথক অস্তিত্বের কারণে সংকটময়। ইংরেজরা এমনি এক দ্বিধাবিভক্ত উপমহাদেশের ধারনা প্রতিপালন করেছে যে ভারত হবে হিন্দু অধ্যুষিত এবং পাকিস্তান হবে মুসলিম অধ্যুষিত। দীর্ঘদিন ধরে গান্ধী এবং নেহরু এইধরণের দেশবিভাগের বিরোধিতা করে এসেছেন এই বিশ্বাস থেকে যে দুই ধর্মের মানুষগুলোকে একটি বিশাল জাতিতে একীভূত করা অপরিহার্য। গান্ধী এবং নেহরু অবশ্য তাদের দেশবিভাগ সংক্রান্ত এই আপত্তি উঠিয়ে নেন, যখন তারা নিশ্চিত বুঝতে পারেন যে নাহলে জাতীয় স্বাধীনতাই অনির্দিষ্টকালের জন্যে বিলম্বিত হবে।

দেশবিভাগের নকশাতে মূলত দুটি রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা ছিল। বাস্তবে, উদ্ভব হয় তিনটি রাষ্ট্রের। কেননা পাকিস্তানকে তার নিজের মাঝেই দুইভাগে বিভক্ত করা হয়, পূর্বে ও পশ্চিমে। পশ্চিম অংশটি ছিল ভৌগলিকভাবে আকারে বড় এবং সেখানেই রাজধানী স্থাপিত হয়। পূর্বের অংশটি ছিল জনবহুল এবং প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। একই দেশের দুই অংশের মাঝে রয়ে যায় হাজার মাইলের ব্যবধান।

ভৌগলিক এই বৈসাদৃশ্য বুঝতে হলে, শুধু কল্পনা করতে হবে যদি মেইন এবং জর্জিয়া অঙ্গরাজ্য সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা পৃথক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে তাহলে কি ঘটতো। জর্জিয়া নামের এক রাষ্ট্র তৈরি হতো, যার দুই অংশের মধ্যিখানে বাস্তবে পুরো যুক্তরাষ্ট্র অবস্থিত। আমরা আরো ধরে নিই যে এই নতুন রাষ্ট্রের রাজধানী হতো অগাস্টা, উত্তর জর্জিয়াতে। পক্ষান্তরে বেশিরভাগ মানুষ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ রয়ে গেছে দক্ষিন জর্জিয়াতে। ফলাফলে সৃষ্টি হতো এক প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার। পাকিস্তানে যা ঘটেছে তা এই বর্ণনার সাথে মোটামুটিভাবে মিলে যায়। পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে পাঞ্জাবি (পশ্চিমের) এবং বাঙালি (পূর্বের) সমাজের মধ্যকার সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক প্রবল ব্যবধান।

শুরুর দিকে কিছুটা সময়ের জন্য পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষেরা নতুন জাতীয়তাবাদের আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক প্রফুল্লতায় একীভূত ছিল। কিন্তু মৌলিক সমস্যাগুলো আরো প্রকট হতে লাগলো যখন পূর্ব পাকিস্তান উপলব্ধি করতে শুরু করলো যে তারা আসলে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে যা কিনা ইংরেজ ঔপনিবেশিকতারই নামান্তর। তারা দাবি করেছিল যে সরকারের নীতিনির্ধারণী উচ্চপদে তাদের জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্ব নেই। তাদের অভিযোগ ছিল যে শিল্প-উৎপাদনের ক্ষেত্রে তাদের শ্রম ও সম্পদের ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও লভ্যাংশের ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করে তাদেরকে অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করা হচ্ছে। তারা পূর্ব এবং পশ্চিমের মধ্যকার মজুরি ও জীবনযাত্রার মানের সুতীক্ষ্ণ বৈষম্যকে তুলে ধরেছিল।

এই বিদ্রোহের উদ্গিরন অবধারিত ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে শুরু হওয়া রাজনৈতিক আন্দোলনের পিছনের প্রকৃত খুঁটিনাটি এখানে তুলে ধরার কোন মানে নেই। এখানে এইটুকুই বলা যথেষ্ট যে ইসলামাবাদের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব পূর্ব পাকিস্তানের সংসদে উপস্থাপনে নারাজ ছিল। যদিও সাধারণ নির্বাচনে বিপুল ভোটে স্বায়ত্তশাসনের পক্ষেই রায় এসেছিল। ইসলামাবাদের কেন্দ্রীয় সরকার জনতার এই রায়কে সম্মান দিতে শুধু ব্যর্থই হয়নি, বরং সামরিক বাহিনীকে লেলিয়ে দেয় এর বাস্তবায়নকে বানচাল করতে। ২৬ শে মার্চে শুরু হয় আনুষ্ঠানিক হত্যাযজ্ঞ।

(১) ২৬ শে মার্চ ভোরে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ও গ্রেনেড সজ্জিত সৈনিকরা সাঁজোয়া যান (ট্যাঙ্ক) নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘেরাও করে। ইকবাল হল এবং তার ডরমেটরিতে অবস্থানরত সকল ছাত্রকে হত্যা করা হয়। ট্যাঙ্কের গোলায় ধসিয়ে দেয়া হয় পুরো ভবনটি।

(২) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে অবস্থানরত একশত তিন জন হিন্দু ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ছয়জন হিন্দু ছাত্রকে অস্ত্রের মুখে বাধ্য করা হয় তাদের কবর খুঁড়তে এবং তারপর তাদেরকেও গুলি করে হত্যা করা হয়।

(৩) দর্শন বিভাগের প্রধান বরেণ্য অধ্যাপক জি. সি. দেবকে তার বাসা থেকে বের করে পার্শ্ববর্তী মাঠে নিয়ে যাওয়া হয় এবং গুলি করা হয়।

(৪) একই বিভাগের অন্য শিক্ষক যাদেরকে হত্যা বা গুরুতরভাবে জখম করা হয় তাদের নামঃ মনিরুজ্জামান, গুহঠাকুরতা, মুনিম, নাকী, হুদা, ইন্নাস আলি।

(৫) সৈনিকেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৪ নং দালানের ‘ডি’ ফ্ল্যাটে জোর করে ঢুকে অধ্যাপক মনিরুজ্জামান, তার ছেলে, তার ভাই (যিনি পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টে চাকরী করতেন) ও তার ভাইপোকে আটক করে এবং তাদেরকে দলবেঁধে দোতলার বারান্দায় নামিয়ে আনে, যেখানে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলিতে তাদের হত্যা করা হয়।

(৬) পুরানঢাকার সদরঘাট টার্মিনালের ছাদে একটি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র (মেশিনগান) স্থাপন করা হয়। মার্চের ২৮ তারিখে, এই অস্ত্রের আওতার মধ্যে থাকা সকল বেসামরিক নাগরিকদের গুলি করা হয়। এই হত্যাযজ্ঞের পর, মৃতদেহগুলোকে টেনেহিঁচড়ে কতগুলো বাসে তোলা হয়। কিছু মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়। কিছু মৃতদেহ টার্মিনালের পাশের বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দেয়া হয়।

(৭) ২৮ শে মার্চ সকালে, শাঁখারী বাজার, পুরানঢাকার একটি হিন্দু অধ্যুষিত শিল্প-এলাকা, এর দুপাশে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র (মেশিনগান) বসানো হয়। সৈনিকেরা আচমকা গুলিবর্ষণ শুরু করে ভিতরে আটকে পড়া বেসামরিক নাগরিকদের ওপর। মৃতদেহগুলো ছড়িয়েছিটিয়ে পড়ে থাকে রাস্তার ওপর।

(৮) ২৮ শে মার্চ সন্ধ্যায়, সৈন্যরা রমনা কালীবাড়ি, পুরানঢাকার এক প্রাচীন হিন্দু বসতি, তে ঢুকে পড়ে, সবাইকে (আনুমানিক ২০০ জনকে) হত্যা করে। পরেরদিন ২৯ শে মার্চে, একশোর মতো মৃতদেহ পাওয়া যায় ঐ এলাকায়।

(৯) বেসামরিক নাগরিকদের ঢাকা থেকে পালানোর সকল পথ অস্ত্রের মুখে বন্ধ হয়ে যায়।

(১০) ২রা এপ্রিল সকালে, চল্লিশজন সৈনিক বাড্ডা নামক গ্রামে ঢুকে সব (আনুমানিক ৬০০ জন) পুরুষদেরকে একত্রিত করে এবং অস্ত্রের মুখে দলবেঁধে গুলশান পার্কে নিয়ে আসে, সেখানে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ঐ দল থেকে দশ জনকে নিয়ে যাওয়া হয়, তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে তা আজো অজ্ঞাত।

এখানে বর্ণিত এই সত্যিকার ঘটনাগুলো যুবকবয়সী এবং শিক্ষিতদের উপর চালানো ব্যাপক গণহত্যার এক অতিক্ষুদ্র অংশ মাত্র। এক্ষেত্রে নিহত বা আহতদের সঠিক সংখ্যা অনুমানের চেষ্টা নিছক বাতুলতা। প্রত্যেক শহর এবং গ্রামেরই রয়েছে এমন ভয়ঙ্কর ইতিকথা। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে ইসলামাবাদ সরকার মাত্র গত সপ্তাহ পর্যন্ত, শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে সাংবাদিকদেরকে এর বাইরে রেখেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র বিভাগের কাছে শুধু উপরে বর্ণিত ঘটনাগুলেো ছাড়াও আরও অসংখ্য ঘটনার প্রামাণ্য বিবরণ রয়েছে। ঢাকাস্থ আমেরিকান রাষ্ট্রদূত এবং এপিপি-এর সাথে সম্পৃক্ত আমেরিকান চিকিৎসকরা এই বিস্তারিত বিবরণগুলো ওয়াশিংটনে প্রেরন করেন। কোন অজানা কারণবশত, স্বরাষ্ট্র বিভাগ তাদের কাছে থাকা কোন বিবরণই প্রকাশ করেনি।

পাকিস্তানে পাঠানো আমেরিকান বন্দুক গোলাবারুদ ও অন্যান্য অস্ত্রই ব্যবহার করা হয়েছে বাঙালীদের উপর আক্রমণের সময়। একই ভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চীন থেকে পাঠানো অস্ত্রও ব্যবহৃত হয়েছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ কোন সহায়ক হতে পারেনি। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার দাবী করছে যে এটা তাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়, যা কিনা জাতিসংঘের এখতিয়ারের বাইরে।

এথেকে হয়ত বুঝতে সুবিধা হতে পারে যে জাতিসংঘ এখনো পর্যন্ত আপাতদৃষ্টিতে প্রমানযোগ্য এই গণহত্যার বিরুদ্ধে কোন কার্যকর ভূমিকা নেয়নি কেন কিন্তু এর কোন ব্যাখ্যা নেই যে কেন বিবেকবান মানুষেরা জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে আকাশ বিদীর্ণ করে এই ঘৃণিত অপরাধের প্রতিবাদ করছেনা।

উপদ্রুত এলাকায় খাদ্য, ঔষধ, এবং চিকিৎসক প্রেরণের সকল প্রচেষ্টা ইসলামাবাদের কেন্দ্রীয় সরকার বানচাল করতে সক্ষম হয়েছে। এটা বোঝা খুবই দুষ্কর যে এই ধরনের একটি সিদ্ধান্তকে কিভাবে টিকে থাকতে দেয়া যায়। বাঙালীরা হয়ত তাদের রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্য জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণার অধীনে কোনদিনই পাবেনা।

যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র বিভাগ তাদের জাতীয় স্বার্থে অত্যন্ত জোরের সাথে এবং সাফল্যের সাথে কথা বলতে কখনই দ্বিধাবোধ করেনি। প্রত্যেক আমেরিকান নাগরিক এই প্রত্যাশা করতেই পারে যে যেখানে মানবাধিকারের প্রশ্ন জড়িত সেখানে যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত জোরের সাথে কথা বলবে। যুক্তরাষ্ট্র যদি পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠানোর নৈতিক উপায় বের করতে পেরে থাকে তাহলে সেখানে খাদ্য ও জরুরী চিকিৎসা সাহায্য প্রেরণের ব্যপারেও নৈতিক উপায় বের করতে পারবে।

প্রেসিডেন্ট বলেছেন যে ভিয়েতনাম হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে পৌরুষের এক পরীক্ষা। এই প্রস্তাবনাটি দ্ব্যর্থক। তবে এটুকু নিশ্চিত বলা যায় যে পাকিস্তানে যে ঘটনাগুলো ঘটছে তা যুক্তরাষ্ট্রের সহানুভূতিশীল বিবেকের কাছে এক বিশেষ পরীক্ষাসরূপ।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪৫। পাকিস্তানঃ বিনষ্ট ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার প্রয়াস টাইম ২৪ মে ১৯৭১

Razibul Bari Palash

<১৪,৪৫,৯৮-৯৯>

টাইম, ২৪ মে ১৯৭১

পাকিস্তান

বিনষ্ট ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার প্রয়াস

“আমাদের কালিমালিপ্ত করা হয়েছে,” পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর গোয়েন্দা প্রধান ঘোষণা করেন।  মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আকবর খান।  জেনারেলের কাছে করাচিতে দেড় ডজন বিদেশী সাংবাদিক পূর্ব পাকিস্তানে সাত সপ্তাহ ধরে বাঙালি বিদ্রোহ দমন করার প্রচেষ্টায় সেনা নিষ্ঠুরতার ব্যাপক রিপোর্ট উল্লেখ করে জানতে চাওয়া হলে তিনি একথা বলেন। “বানানো সংবাদ বিদেশী সংবাদ এবং রেডিও প্রচার করছে,” সরকার ধারাবাহিকভাবে আসল ঘটনার বিবরণ দিয়েছে এবং চারদিনের দ্রুত হেলিকপ্টার সফরে “সঠিক” গল্প জানানো হবে – বলে তিনি জানান।

শান্তি কমিটিঃ পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।  দমন অভিযানে মার্চ থেকে অন্তত ২০০০০০ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে – তাদের সব বাঙালি।  উপরন্তু, আরও ১৫০০০০০ জন বাঙালি ভারতে পালিয়ে যান এবং যারা এখনো আছেন তারা দুর্ভিক্ষ অভাবের মধ্যে ছেবে আছেন যা নিয়ে সরকার পক্ষের কোন উদ্বেগ আছে বলে মনে হচ্ছে না। পূর্ব পাকিস্তান ট্রাজেডি জেনারেল টিক্কা (যার মানে “লাল গরম”) খানের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে। সেনাবাহিনী বলছে তারা পূর্ব পাকিস্তানকে রক্ষা করছে ধ্বংসের হাত থেকে। তারা আরও বলেন বিদ্রোহীরা আসলে ভারতের সঙ্গে অনেক বৃহৎ ষড়যন্ত্রেে নেমেছে।  নাৎসি স্টর্ম ট্রুপারদের মত এটা একটা রণকৌশল।  পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনী রক্তগঙ্গা প্রতিরোধ করতে বাধ্য হচ্ছে মাত্র।

সাংবাদিক দের সফর সাবধানে দেখাশোনা করা হয় যাতে সরকারের অভাবনীয় কাহিনী অন্তত বিশ্বাসযোগ্য বানানো হয়। ছয়জন সংবাদমাধ্যমকর্মীর সাথে পাহারা দেয়ার জন্যে যে কয়জন সেনা পাঠানো হয়েছিল, তারা টিক্কা খানের ট্যাংক আর যুদ্ধবিমানের হামলায় পোড়া ও ধ্বংসপ্রাপ্ত বাঙ্গালীদের বাড়িঘর ও অন্যান্য ধ্বংসচিত্র না দেখানোর জন্য চেষ্টার কোন কমতি রাখেনি। পাকিস্তানীরা নৃশংসতার দৃষ্টান্ত ঢেকে রাখার সুযোগ পায়নি। নাটোরে, এটি ঢাকার  উত্তর-পশ্চিম দিকের একটি শহর, সাংবাদিকদের শান্তি কমিটির লোকেরা অভ্যর্থনা জানায়। এই দল আর্মিদের তৈরি। কমিটির লোক নিকটবর্তী গ্রামে ণয়ে যান  যেখানে, ৭০০ থেকে ১৩০০ লোককে বাঙ্গালীরা জবাই করেছিল। সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল একটি কুয়া যেটি মানুষের কঙ্কাল এবং পচা মাংস দিয়ে ভর্তি । এক শান্তি কমিটির লোক বলেছিলেন: “তোমরা যেমন নৃশংসতার কখনো দেখনি!”

সেনাবাহিনী সাংবাদিকদের তাদের নিজেদের ইচ্ছামত চারপাশে ঘুরে দেখতে দিতে চাচ্ছিলনা। টাইম পত্রিকার প্রতিবেদক লুই Kraar গত সপ্তাহে রিপোর্ট করেন , “আমি নাটোরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। একজন দাড়িওয়ালা শান্তি কমিটির লোক কেউ যখন আমার সাথে কথা বলতে আসছিল তাকেই বাঁধা দিচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত আমি সেই লোকের থেকে বিচ্ছিন্ন হলাম এবং সেখানকার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় গেলাম। জায়গাটা সম্পূর্ন ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। এক গাদা ধ্বংসস্তুপ ও ছাই পড়ে আছে। হাঁটতে হাঁটতে এক তরুণ আমার কাছে এসে বলল সে একজন ছাত্র। সে বলল ‘আমরা আর্মির ভয়ে আতংকিত থাকি। আপনি আসার আগ পর্যন্ত তারা মানুষকে মারছিল।’

পারফেক্ট অর্ডারঃ দেখতে পেলেন হত্যার ধরণ সর্বত্র একই রকম। সরকারি বাহিনী নিজেদের ইচ্ছামত যা খুশি করেছে। বাঙ্গালী অধিবাসিরা  মোট হত্যা – প্রায় ২০০০০ এর হয়ত ১০% অবাঙালির উপর  প্রতিশোধ নিতে পেরেছে। এবং তারপর সেনাবাহিনী এসে সবকিছু শেষ করে দিয়ে গেছে। ঢাকার  উত্তরে ময়মনসিংহে, পাকিস্তানি জেট বিমান দ্বারা এবং দুই টি আমেরিকান এম 34 ট্যাঙ্ক দ্বারা পাঁচ ঘন্টা গোলাবর্ষণ ও শেলিং করা হয়েছে। ময়মনসিংহ এখন শুধু ধ্বংসাবশেষ রয়েছে  এবং তার প্রাক গৃহযুদ্ধ জনসংখ্যার প্রায় ৯০%  লোক পালিয়ে গেছেন বা হত্যা করা হয়েছে। টিক্কা খান যথার্থ বলেছেন , “আমরা নিখুঁত আইন-শৃঙ্খলা চাই”।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪৬। পাকিস্তানের সাহায্য বন্ধের জন্য সিনেটরদের বিবৃতি বালটিমোর সান জুন ৯, ১৯৭১

 

Ashik Uz Zaman

<১৪, ৪৬, ১০০১০১>

দি সান বালটিমোর, জুন ৯, ১৯৭১

দুইজন সিনেটর পাকিস্তানে সাহায্য বন্ধের আবেদন জানান

অ্যাডাম ক্লাইমার

দি সানএর ওয়াশিংটন দপ্তর থেকে

ওয়াশিংটন, জুন ৮ – যতক্ষণ পর্যন্ত না পাকিস্তানের সরকার তাদের নীতি পরিবর্তন করছে যাতে করে উদ্বাস্তুরা তাদের দেশে ফিরে যেতে পারে ততক্ষণ পর্যন্ত সেখানে সবধরনের সাহায্য বন্ধ করে রাখা উচিত। সিনেটরদ্বয় উইলিয়াম বি. স্যাক্সবি (রিপাবলিকান, ওহাইও অঙ্গরাজ্য) এবং ফ্রাংক চার্চ (ডেমোক্র্যাট, আইডাহো অঙ্গরাজ্য) আজ এই জোরালো আবেদন জানান।

তাঁরা ঘোষণা করেন যে তাঁরা আগামি সপ্তাহে বৈদেশিক সাহায্য আইনের খসড়া সংশোধনের দাবী সিনেটে উত্থাপন করবেন পাকিস্তানে যেকোন সামরিক অথবা অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ রাখতে যতক্ষণ পর্যন্ত না ভারতে অবস্থানরত ৫০,০০,০০০ উদ্বাস্তু তাদের দেশে ফিরে যাচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক ত্রাণকাজ শুরু হচ্ছে।

সিনেটর চার্চ যুক্তি তুলে ধরেন যে এই সংশোধনটি একটি “গৃহযুদ্ধ”-এর এক পক্ষ – পাকিস্তানের সরকার – এর প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পরিহার করার জন্যে অতিব জরুরী। তিনি বলেন এটি একটি “নিরপেক্ষ” দাবী এবং পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে অনধিকারচর্চা এর উদ্দেশ্য নয়। তবে প্রশ্নের সম্মুখীন হলে তিনি স্বীকার করেন যে এই সংশোধন চাওয়া হচ্ছে পাকিস্তানের সরকার যাতে পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের প্রতি তাদের নীতি পরিবর্তন করতে বাধ্য হয় – যথেষ্ট উদার ধরণের নীতি পরিবর্তন প্রয়োজন যাতে করে উদ্বাস্তুরা তাদের দেশে ফিরে যাওয়াকে নিরাপদ মনে করে।

যুক্তরাষ্ট্র ১ কোটি ৫০ লক্ষ মার্কিন ডলারের সংস্থান করবে

 

ইতিমধ্যে, চার্লস ব্রেই, মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র, ঘোষণা দেন যে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে আরো ১ কোটি ৫০ লক্ষ মার্কিন ডলারের সাহায্য সংস্থান করবে যাতে করে তারা পাকিস্তানী উদ্বাস্তুদের সাহায্য করতে পারে। এটি পূর্বে ঘোষিত দুই কোটি ৫০ লক্ষ মার্কিন ডলারের সাথে যোগ হবে।

এই সংস্থানের, এক কোটি মার্কিন ডলার যাবে খাদ্য সরবরাহে, এবং বাকি অংশ যাবে চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং অন্যান্য প্রয়োজনে, মার্কিন পররাষ্ট্র সচিবের উদ্বাস্তু বিষয়ক বিশেষ সহকারী, ফ্রান্সিস এল. কেলোগ, ঘোষণা করেন।

মিঃ কেলোগ জানান সীমান্ত পার হয়ে প্রতিদিন ৫০,০০০ থেকে ১,০০,০০০ জন শরণার্থী ভারতে আসছেই, এবং যুক্তরাষ্ট্র এদের মধ্যে থেকে ১২,৫০,০০০ জনের খাদ্যের সংস্থানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তিনি বলেন ভারত সরকারের আনুমানিক হিসাবে শরণার্থীদের বর্তমান সংখ্যা ৪৭ লাখ হবে।

তিনি আরো জানান সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র চলতি সপ্তাহের শেষ নাগাদ ১০,০০,০০০ টি কলেরা-নীরোধি টিকা পাঠাবে।

সামরিক বাহিনীর বিশেষ প্রতিনিধিদলের আগমন

 

এদিকে নয়াদিল্লীতে, বিমান বাহিনীর একটি সি-১৩০ পরিবহন বিমানে করে ২৭-সদস্য বিশিষ্ট মার্কিন সামরিক বাহিনীর একটি বিশেষ প্রতিনিধিদল এসে পৌঁছেছেন। তাঁরা ত্রিপুরা রাজ্যের বিমান ঘাঁটিগুলো পরিদর্শন করবেন, যেগুলো কিনা পূর্ব পাকিস্তানের পূর্বে অবস্থিত, সম্ভাব্যতা যাচাই করার জন্যে যে আকাশপথে শরণার্থীদেরকে (যাদের সংখ্যা বর্তমানে ৫,০০,০০০ যেখানে ত্রিপুরা রাজ্যের জনসংখ্যাই হচ্ছে পনের লক্ষ) ভারতেরই অপেক্ষাকৃত লঘুবসতিপূর্ণ এলাকায় সরিয়ে নেয়া যায় কিনা। তাঁরা জানান, যদি তা সম্ভব মনে হয় তাহলে আরো তিনটি সি-১৩০ পরিবহন বিমান সেখানে পাঠানো হবে।

এই সিনেটরদ্বয় তাদের এই সংশোধনী প্রস্তাবটি আগামী সপ্তাহে পেশ করবেন যখন সিনেট-এর বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটি এই বৈদেশিক সাহায্য আইনের খসড়াটি নিয়ে আলোচনায় বসবে। উক্ত কমিটি এর আগে একটি প্রস্তাব অনুমোদন করেছে – যেটি এখনো সিনেট-এ উত্থাপিত হয়নি – যা কিনা পাকিস্তানে আরো সামরিক সাহায্য প্রেরনে বাধা দেবে। এই দক্ষিন এশীয় দেশটি মুলতঃ মার্কিন সামরিক সরঞ্জামে সজ্জিত, কিন্তু ১৯৬৫-এর পাক-ভারত যুদ্ধের পর থেকে সেখানে শুধুমাত্র খুচরা যন্ত্রাংশ এবং গোলাবারুদই পাঠানো হয়েছে।

সিনেটর চার্চ অনুমান করেন বর্তমানে মুলতবী হয়ে থাকা অর্থনৈতিক সাহায্যের পরিমান হবে ৮ কোটি মার্কিন ডলার। তিনি বলেন যে তিনি জানেন না কি পরিমান সামরিক সাহায্য প্রদানের সম্ভাবনা রয়েছে। গত অক্টোবর মাসে হওয়া বিমান এবং সৈন্যবাহী সাঁজোয়া যান-এর বিক্রয় প্রক্রিয়া এখনো সম্পন্ন হয়নি।

উভয় সিনেটর অভিযোগ করেন যে পাকিস্তানের সরকারকে সাহায্য প্রদান করাতে মার্কিন সরকারকে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়া হচ্ছে। সিনেটর স্যাক্সবি অভিযোগ করেন যে সামরিক বাহিনী শেখ মুজিবর রহমান এবং তাঁর মধ্যপন্থী, মুলতঃ পশ্চিম-ঘেঁষা দল আওয়ামী লীগ কে “নিষ্পিষ্ট করেছে”, যারা কিনা কিছুদিন আগেই জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করেছে।

সিনেটর স্যাক্সবি ডাঃ জন ই. রোড-কেও উপস্থাপন করেন, যিনি একজন চিকিৎসক হিসেবে ‘আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা’-এর সাথে পূর্ব পাকিস্তানে ছিলেন। ডাঃ রোড যুক্তি তুলে ধরেন যে ত্রাণকাজ একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমেই হতে হবে কেননা গত ডিসেম্বরের ঘূর্ণিঝড় এবং বন্যার সময় পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী দেখিয়ে দিয়েছে যে তারা সুষ্ঠুভাবে ত্রাণকাজ পরিচালনায় অক্ষম।

তিনি বলেন মার্কিন সাহায্য – যা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য অনুযায়ী গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই মুলতবি হয়ে আছে – এটাই বোঝায় যে “যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে এক পক্ষকে সাহায্য করছে”। তিনি আরো বলেন “গণহত্যা যে চালানো হয়েছে তা নথিভুক্ত আছে”।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪৭। অনিশ্চিত আশ্রয় নিউজউইক ১৪ই জুন, ১৯৭১

Ashik Uz Zaman

<১৪, ৪৭, ১০২-১০৩>

নিউজউইক, ১৪ই জুন, ১৯৭১

অনিশ্চিত আশ্রয়

লাখে লাখে, বাঙালী শরণার্থীরা স্রোতের মতো পূর্ব পাকিস্তান থেকে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে যাচ্ছে। তাদের অঞ্চলকে স্বাধীন ঘোষণা করার চেষ্টার ফলশ্রুতিতে শুরু হওয়া পাশবিক দমননীতি থেকে পালিয়ে, ব্যাধি এবং অপরিচ্ছন্নতার মাঝে তারা এক অনিশ্চিত আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে। গতসপ্তাহে, নিউজউইকের টনি ক্লিফটন কয়েকটি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন এবং এই প্রতিবেদনটি পেশ করেনঃ

ইতিমধ্যেই, ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের আকাশ ভারী এবং ধূসর হয়ে উঠে আসন্ন বর্ষাকালের পূর্বাভাস দিচ্ছে, যা কিনা যে কোনো সময়ে ফেটে পরতে পারে। সবসময়ই ধ্বংসাত্মক, এবছরের বর্ষা অবধারিত ভাবেই অতিরিক্ত প্রলয় ঘটাবে, বহুগুনে বাড়িয়ে দেবে প্রায় ৪০ লক্ষ পাকিস্তানীর আতঙ্ক এবং দুর্দশা যারা এখন গাদাগাদি করে আশ্রয় নিয়েছে জরাজীর্ণ শরণার্থী শিবিরগুলোতে তাদের প্রাক্তন স্বদেশের সীমান্তের ঠিক এপারেই। ভারতীয় সরকারী কর্মচারীরা অত্যাশ্চর্যভাবে শরণার্থীদের জন্য খাদ্য এবং বাসস্থানের ব্যবস্থা করে আসছে, কিন্তু তাদের সব প্রচেষ্টা ধুয়েমুছে যাবে যদি এমনকি বর্ষার “স্বাভাবিক” বৃষ্টিও হয়। আর যদি ভারী বর্ষণ হয়, তাহলে আসন্ন বন্যা এমন এক বিপর্যয় ঘটাতে পারে যার তুলনা করা যেতে পারে সেই প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের সাথে যেটি মাত্র গত বছরই পূর্ব পাকিস্তানে ৫ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে।

বর্ষার বৃষ্টি, অবশ্য, শরণার্থীদের দুর্দশা   শুধু কিছুটা বাড়িয়ে দেবে মাত্র যারা, বিগত সামান্য কয়েক সপ্তাহে, তাদের সম্পূর্ণ জীবনধারাকে ভেঙে পরতে দেখেছে। তারা যেন এক করুণ দৃশ্য পথে হাঁটছে দলভ্রষ্ট হয়ে, কাপড়ের পুঁটলি আঁকড়ে ধরে এবং মাঝেমধ্যে একটা কালো ছাতা প্রখর সূর্যের তাপ থেকে রক্ষা পেতে। আছে হাজার হাজার ছোট্ট শিশু এবং অসমঞ্জস্যসংখ্যক তরুণী, যারা লুটেরা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিশেষ লক্ষ্যবস্তু। দল বেঁধে লোকেরা গাছের নিচে বসে আছে অভাগার মতো তাদের দীর্ঘ পদযাত্রা এবং খাদ্যের অভাবে অবসন্ন হয়ে। “এখানকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে”, জানালেন কে. কে. নস্কর, যিনি কোলকাতা থেকে প্রায় ৬০ মাইল দুরের বনগাঁ নামক এলাকার সরকারী প্রশাসক। “ আর ১ জনকেও থাকার জায়গা বা খাবার দেবার ক্ষমতা আমার নেই, আর ওরা আসছে প্রতিদিন ১,০০,০০০ জন করে। আমি এইটুকুই করতে পারি যে ওদেরকে সামান্য কিছু খাবার দিয়ে এবং অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিতে”।

দুর্গন্ধঃ ঘিঞ্জি শিবিরগুলোর ভেতরে, দৃশ্য একইরকম বিষণ্ণ। অসংখ্য শরণার্থী – যাদের অনেকের পায়েই ফোস্কা পড়েছে, পা ফুলে গেছে, আমাশয় এবং অন্যান্য পৈটিক অসুখে আক্রান্ত – কে প্রায়শই শুধুমাত্র বাঁশের খুঁটি এবং তেরপলের ছাদের তৈরি দায়সারা আশ্রয়ের নিচে গাদাগাদি করে রাখা হচ্ছে। এই আশ্রয়গুলোর কোনো দেয়াল নেই, নেই কোনো বিছানা এবং আলোর ব্যবস্থা। যত্রতত্র আবর্জনা ফেলার কারণে এবং পুরো শিবিরের পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা খোলা হওয়ার কারণে, দুর্গন্ধ প্রায়শই অসহ্য হয়ে ওঠে, এবং মহামারী দেখা দেয়ার সম্ভাবনাও ব্যাপক। হয়তো এই অন্ধকার ছবিতে একমাত্র আলোর ছটা এই যে শরণার্থীরা তুলনামুলকভাবে ভালো খাবার পাচ্ছে – অন্তত ভারত এবং পাকিস্তানের দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টির মাত্রার তুলনায়।

তাদের বর্তমান অস্তিত্বের অপরিচ্ছন্নতা সত্ত্বেও, বাঙালীরা সহ্য করে যাচ্ছে নুন্যতম অভিযোগ নিয়ে। কিন্তু তারা একইসাথে হতবুদ্ধি এবং অপমানিত বোধ করছে যে উৎপীড়ন এবং আতঙ্ক তাদের ভোগ করতে হয়েছে দীর্ঘদিনের শত্রুর হাতে, পাকিস্তানের শাসক পাঞ্জাবীরা। আমি এক বৃদ্ধার সাথে কথা বলেছি, রসিমন বিবি নামক এক বিধবা যিনি আমাকে বলেন, “আমি এখানে এসেছি কারণ ওরা আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছে। ও তখন বীজের দোকান থেকে বাড়ি ফিরে আসছিলো যখন পাঞ্জাবীরা ওর কাছে আসে এবং ওকে গুলি করে হত্যা করে। আমি জানিনা কেন। সে তার জীবনে কখন কোনো খারাপ কাজ করেনি।” আরেকজন শরণার্থী আমাকে তার দুই ছেলেকে দেখান, যাদের বয়স ৬ এবং ৭, তাদের উভয়ের শরীরেই পাঞ্জাবী সৈন্যদের শারীরিক নির্যাতনের থেঁতলানো দাগ এখনো আছে। কয়েকজন শরণার্থী বলেন পাঞ্জাবীরা বাচ্চাদের অপহরণ করা শুরু করে এবং মুক্তিপণ আদায়ের জন্য আটকে রাখে। মেথোডিষ্ট মিশনারি জন হেসটিংস যোগ করেন, “আমি একজনের সাথে কথা বলেছি যে তার বাচ্চার মুক্তিপণের জন্য যতটুকু সম্ভব টাকা জোগাড় করে, কিন্তু ২০০ টাকা প্রায় ২৬ মার্কিন ডলার কম হয়। তখন সে বলে, বাকি টাকা উশুল করার জন্য আমাকে পেটাও। এবং তারা তখন তাকে পেটায়, তার একটা চোখ উপড়ে নেয় এবং তারপর তার বাচ্চাকে ফিরিয়ে দেয়”।

ব্যাধি. এমনকি যখন তারা পালিয়ে ভারতে চলে আসে, তখনও শরণার্থীরা নানাবিধ বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কলেরা। যখন প্রথম দলগুলো, সীমান্ত পার হয়ে আসে, চিকিৎসকেরা তাদেরকে কলেরার প্রতিষেধক দেন, কিন্তু এখন বাঙালীরা এমন সংখ্যায় ঝাঁকে ঝাঁকে ভারতে আসছে যে তাদের সবাইকে প্রতিষেধক দেয়া সম্ভব নয়। “সিরিঞ্জ ব্যবহার করতে এতো বেশি সময় লাগে”, একজন চিকিৎসক বলেন, “আর আমাদের কাছে প্রতিষেধক টীকা দেয়ার যন্ত্র কেনার মতো টাকাও নেই”। ইতিমধ্যেই কলেরার প্রকোপ মহামারীর আকার ধারন করতে যাচ্ছে। গতসপ্তাহে, প্রায় ২,০০০ শরণার্থী মারা গেছে, এবং সমানসংখ্যক মৃতপ্রায় হয়ে হাসপাতালে বা রাস্তার পাশে পড়ে আছে। ভবিষ্যতের চেহারা আরো অন্ধকারাচ্ছন্ন, কেনোনা বর্ষা মৌসুমের বন্যা অবধারিতভাবেই এই পানিবাহিত রোগটি ছড়াতে সাহায্য করবে।

সকল ভোগান্তি সত্ত্বেও, শরণার্থীরাই শুধু খারাপ সময়ের সম্মুখীন হচ্ছে না। পাকিস্তানীদের সমাগমের প্রাচুর্যের ফলশ্রুতিতে, পশ্চিমবঙ্গের সব্জি এবং ভোজ্য তেলের দাম আকাশে উঠে গেছে। একইসাথে, স্থানীয় অধিবাসীরা দেখতে পাচ্ছে যে তাদের মজুরী প্রচলিত দরের চেয়ে কমে যাচ্ছে কেননা শরণার্থীরা কম মজুরীতে কাজ করতে রাজি হচ্ছে। “শরণার্থীরা সরকারের কাছ থেকে বিনামূল্যে খাবার পাচ্ছে তাই তারা যাদেরকে খাবার কিনতে হয় তাদের চেয়ে কম মজুরীতে কাজ করতে পারে”, মিঃ নস্কর ব্যাখ্যা করেন। “একজন ক্ষেতমজুরের দৈনিক মজুরী কমে অর্ধেক হয়ে গেছে”। অবধারিতভাবে, এই ধরণের পরিস্থিতি ক্রোধের জন্ম দেয়। “এখানকার মানুষেরা শরণার্থীদের প্রতি সহানুভূতিশীল,” মিঃ নস্কর বলেন, “কিন্তু তাদের সহানুভূতি শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে। দুই মাসের মধ্যে, পাকিস্তানীদের প্রতি অসন্তোষ ছাড়া আর কিছুই থাকবে না”।

শরণার্থীদের সমস্যা ইতোমধ্যে ভারতের রুগ্ন বাজেটের উপরও প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছে। সরকার আগামী তিন মাসে শরণার্থীদের দেখভাল করার খরচ ধরে রেখেছে নুন্যতম ৩ কোটি মার্কিন ডলার, এবং এটা অনেক বেড়ে যেতে পারে। আজ পর্যন্ত, অন্যান্য দেশের কাছ থেকে ভারত যে আর্থিক সাহায্য পেয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অল্প। যদিও যুক্তরাষ্ট্র শরণার্থীদের সাহায্যে ১ কোটি ৪০ লক্ষ মার্কিন ডলার দেয়ার পরিকল্পনা করছে যা তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, অন্যান্য দেশগুলো এখন উদাসীন রয়েছে এব্যাপারে। “একটি বিশাল বিপর্যয় এড়াতে হলে প্রচুর পরিমানে বৈদেশিক সাহায্য প্রয়োজন হবে”, মিঃ হেসটিংস সাবধান করেন, “তারপরেও কেউই নাড়াচাড়া করছে বলে মনে হচ্ছেনা”। পশ্চিম জার্মানি ১,৪০,০০০ মার্কিন ডলার দিয়েছে এবং এথেকে বলতে ইচ্ছে করবে, “অসংখ্য ধন্যবাদ। তোমরা মাত্র আধাবেলা চালিয়ে নেয়ার মতো খাবার কিনে এনেছো”। কর্নেল পি. এন. লুথরা, যিনি শরণার্থী কার্যক্রমের দায়িত্বে রয়েছেন, একইভাবে অবসাদগ্রস্তঃ “আমরা কোনোভাবে চালিয়ে নিচ্ছিলাম, কিন্তু পরিস্থিতি আরো অনেক খারাপের দিকে যাচ্ছে। আমরা আগামী দশ দিনের জন্য পরিকল্পনা করি এবং তিন দিন পর দেখতে পাই যে আমাদের আবার পরিকল্পনা করতে হচ্ছে কেননা শরণার্থীদের সংখ্যা হঠাৎ করে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আমরা আমাদের সাধ্যমতো করছি, আমাদের একার পক্ষে এটা করে যাওয়া সম্ভব নয়”।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪৮। পূর্ব-পাকিস্তানে হত্যাযজ্ঞ

 

ওয়াশিংটন ডেইলি নিউজ জুন ১৫, ১৯৭১

 

 

Ashik Uz Zaman

<১৪, ৪৮, ১০৪>

 

দি ওয়াশিংটন ডেইলি নিউজ. জুন ১৫, ১৯৭১

সম্পাদকীয়

পূর্বপাকিস্তানে হত্যাযজ্ঞ

 

প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ, যার একটার চেয়ে অন্যটা আরো ভয়ঙ্কর, যা পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রতিদিনই বের হয়ে আসছে, এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বাঙালী জনতার উপর চালানো হত্যাযজ্ঞের খবর ফাঁস করে দিচ্ছে।

স্বাভাবিকভাবেই, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সামরিক জান্তা অস্বীকার করে আসছে যে তারা বেঁছে বেঁছে গণহত্যা চালাচ্ছে। কিন্তু একের পর এক তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে তারা ঠাণ্ডামাথায় হত্যা করছে সংখ্যালঘু হিন্দু, বাঙালী বিচ্ছিন্নতাবাদী, বুদ্ধিজীবী, চিকিৎসক, শিক্ষক, ছাত্র – মোটকথা যারাই একটি স্বতন্ত্র পূর্ব পাকিস্তানকে নেতৃত্ব দিতে পারবে।

 

সবচেয়ে বড় প্রমাণ এই যে ৫০ লাখ পূর্ব পাকিস্তানী তাদের বাড়িঘর ছেড়ে আসার মতো ভয়াবহ সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং পায়ে হেঁটে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পালিয়ে এসেছে। এই ক্ষুধাপীড়িত, কলেরা-আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর সাথে প্রতিদিন আরো ১,০০,০০০ করে আতঙ্কিত শরণার্থী যোগ হচ্ছে।

 

যদি পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি এখন “স্বাভাবিক” হয়ে থাকে, যেমনটা ইয়াহিয়া খানের অধস্তন অত্যাচারী শাসক দাবী করছে, তাহলে কেন নতুন নতুন শরণার্থীরা ভারতকে প্লাবিত করছে এবং আগে যারা এসেছে তারা কেন বাড়ি ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে?

অন্যান্য দেশের পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্রও শরণার্থীদের জন্য ঔষধ এবং প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী পাঠাচ্ছে। এটাই ন্যায্য, যেহেতু ভারতের নিজেরই অনেক বড় বড় সমস্যা আছে এবং নিজের নাগরিকদের প্রতি ইয়াহিয়া খানের নিষ্ঠুরতার মাশুল তাদের দেয়ার কথা নয়।

আমাদের সরকার পূর্ব পাকিস্তানের ভেতরে জাতিসঙ্ঘ পরিচালিত একটি ত্রাণ কার্যক্রম পাঠানোরও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেনাবাহিনীর কঠোর ব্যবস্থার কারণে ধানের চাষ ব্যাহত হয়েছে, এবং লাখ লাখ বাঙালী অনাহারে পড়বে যদি বাইরে থেকে খাদ্য সরবরাহ করা না হয়। জাতিসঙ্ঘেরই এটা করতে হবে, কেননা কেউই বিশ্বাস করেনা যে পশিম পাকিস্তানীরা বাঙালীদেরকে খাদ্য সরবরাহ করবে, যেখানে তারা ওদেরকে ঔপনিবেশিক প্রজা মনে করে।

সবচেয়ে জরুরী হচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্র ইয়াহিয়া খানের জান্তা সরকারকে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে “একটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সহাবস্থান”-এ আসতে আকুল আবেদন জানিয়ে আসছে। এর মাধ্যমে ওয়াশিংটন বলতে চাইছে যে পূর্ব পাকিস্তানীদেরকে স্বায়ত্তশাসন দিতে – যার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের বেশিরভাগ মানুষ ভোট দিয়েছে।

এটা কি ওয়াশিংটনের জড়িত হওয়ার মত কোনো বিষয়? আমরা তাই মনে করি। এই দেশটি বিগত দুই দশক ধরে কোটি কোটি ডলারের অর্থনৈতিক এবং সামরিক সাহায্য পাকিস্তানে পাঠিয়েছে। (বেশিরভাগ অর্থনৈতিক সাহায্য পশ্চিম পাকিস্তান নিজের কাছেই রেখে দিয়েছে এবং সামরিক সাহায্য ব্যবহার করা হয়েছে বাঙালীদের নিষ্পেষিত করতে।)

দেউলিয়া হয়ে যাওয়া ঠেকাতে পাকিস্তানের এখন প্রতি বছর ৪৫ কোটি মার্কিন ডলার করে প্রয়োজন হবে, এবং যুক্তরাষ্ট্র একটি আন্তর্জাতিক সঙ্ঘের প্রধান যাদেরকে অনুরোধ করা হয়েছে এই অর্থের সংস্থান করতে।

ওয়াশিংটনের কি এই রকম সাহায্য চালিয়ে যাওয়া উচিত? আমরা বলি না – যতক্ষণ পর্যন্ত না ইয়াহিয়া খান তার সামরিক খুনিদের প্রত্যাহার করে নিচ্ছে এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকারের দাবী মেনে নিচ্ছে। নইলে, তার জান্তাকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে, আমরাও বাঙালী জনতার উপর চালানো গণহত্যা এবং দাসত্বের নৈতিক অংশীদার হয়ে যাব।

এই পদক্ষেপ, আমরা স্বীকার করি, আমাদের পররাষ্ট্রনীতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে কিন্তু কোনো গণহত্যার পক্ষে মৌনসম্মতি দেয়ার চেয়ে এই মূল্য কিছুই নয়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪৯। ভয়ংকর দুর্যোগ নিউইয়র্ক টাইমস ১৬ জুন ১৯৭১

Razibul Bari Palash

<১৪, ৪৯, ১০৫>

নিউইয়র্ক টাইমস, ১৬ জুন ১৯৭১

ভয়ংকর দুর্যোগ

প্যারিস থেকে সি এল লুসবার্গার

ভয়ংকর হত্যাকাণ্ডের জন্য হিরোশিমা আর নাগাসাকির কথা আমরা ভুলিনি। সংখ্যার দিকে প্রায় সমানুপাতিক হ্যাম্বার্গ আর ড্রেসডেনের কথা আরও সহজে ভুলে যাচ্ছি। সেগুলোকে গতানুগতিক ধরেছি আমরা।

তারই পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তানের দুর্যোগ দেখা যেতে পারে। এখানকার দুর্যোগ মানুষের সহানুভূতি মাপক যন্ত্রে পরিমাপযোগ্য নয়। ঠিক কত জন প্রতিদিন নিহত-আহত হচ্ছে, নিখোঁজ হচ্ছে, গৃহহীন হচ্ছে তা কারো পক্ষে গণনা করা সম্ভব নয়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৫০। ঘৃন্য হত্যাকাণ্ড নিউইয়র্ক টাইমস ২১ জুন ১৯৭১

Ashik Uz Zaman

<১৪, ৫০, ১০৬১০৭>

নিউজউইক, ২১শে জুন, ১৯৭১

বসবাসের জন্য শ্রেয়তর স্থান

 

ভারতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে স্রোতের মতো শরণার্থীদের আগমন স্তিমিত হয়ে আসতে শুরু করেছে গত সপ্তাহ থেকে, কিন্তু তাদের সাথে করে নিয়ে আসা কলেরা মহামারীর বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ চলছিলো তা এখনো চলছে। ৫,০০০-এর ও বেশি শরণার্থী ইতোমধ্যেই কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে; মহামারীর সর্বোচ্চ পর্যায়ে, কবরখোদকরা এতই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো যে তারা আর কাজ করতে পারছিলো না, এবং ঐতিহ্যবাহী হিন্দু ধর্মের প্রথানুযায়ী শবদেহ দাহ করার জন্য প্রয়োজনীয় কাঠের সরবরাহ পুরোপুরি শেষ হয়ে গিয়েছিল। যদিও ভাড়া করা বিমানে করে প্রতিদিনই খাদ্য, চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং ঔষধ আসছে, তারপরও ভারত এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ লক্ষ শরণার্থীর পরিচর্যা করার জন্য যে ২০ কোটি মার্কিন ডলারের বৈদেশিক সাহায্য প্রয়োজন তার দশ ভাগের এক ভাগ হয়তো পেয়েছে। “যে পরিস্থিতিকে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ বিষয় বলে দাবী করা হয়েছিল”, ভারতের প্রধানমন্ত্রী, ইন্দিরা গান্ধী নয়াদিল্লীতে গত সপ্তাহে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন সংসদকে বলেন, “তা এখন ভারতের আভ্যন্তরীণ সমস্যা হয়ে উঠেছে”।

সবধরণের হতাশাব্যাঞ্জক পরিসংখ্যান সত্ত্বেও, যেভাবেই হোক, ভারতের চিকিৎসা সেবা বিভাগ চমৎকারভাবে কাজ করে যাচ্ছে। “আমি এটা বলতে পারি না যে মহামারী কমে যাচ্ছে”, বলেন মিঃ আর. এন. গুপ্তা, প্রধান সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা নদীয়ায় অবস্থিত কৃষ্ণনগর হাসপাতালের, যেটি সবচে বেশি উপদ্রুত এলাকাগুলোর একটি। “আমরা এখনো প্রতিদিন প্রায় ৫০ থেকে ১০০ জন রোগী পাচ্ছি। পার্থক্য হচ্ছে, এই সপ্তাহে আমরা প্রায় সব রোগীকে হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে পেরেছি। গত সপ্তাহে, রোগীর সংখ্যা এতো বেশি ছিল যে অনেক মানুষ আমাদের কাছে এসে পৌঁছানোর আগে পথেই মারা গেছে”।

কিন্তু যদিও নদীয়ার রাস্তাঘাট এখন প্রায় কলেরা রোগীশুন্য, হাসপাতাল গুলোতে এখনো অনেক অসহায়, আক্রান্ত রোগী রয়েছে। একটি চিকিৎসা কেন্দ্র, ক্যাথোলিক সেবাদানকারীদের দ্বারা পরিচালিত, সিস্টারস অফ মেরী। ইমাকুলেট, যেটিকে কিছুদিন আগে তৈরি করা হয়েছিলো প্রসূতি হাসপাতাল হিসেবে; উদ্ভোদনের দুই সপ্তাহ আগেই এটিকে চালু করা হয় কলেরা রোগীদের জন্য এবং এখন পর্যন্ত কোনো প্রসূতি এখানে ভর্তি হননি। দালানটির সবখানে সারি সারি বিছানায় ছোট্ট শিশুরা শুয়ে আছে এবং মাথার উপর ঝোলানো বোতল থেকে সঞ্জীবনী দ্রবণ তাদের ক্ষীণ শরীরে প্রবেশ করছে। “এর ফলাফল খুবই লক্ষণীয়”, নিউজউইকের টনি ক্লিফটন গত সপ্তাহে তারবার্তায় জানান। “আক্ষরিক অর্থে জীবন, তাদের শরীরে পুনরায় প্রবেশ করিয়ে দেয়া হচ্ছে, এবং আপনি চাক্ষুষ করবেন যে বোতল যতই খালি হতে থাকে ততই তারা ধীরে ধীরে শক্তি ফিরে পেতে থাকে”। কিছু রোগী সব চিকিৎসার বাইরে চলে যায়। কিন্তু সর্বক্ষণ কাজে নিয়োজিত থেকে, হাসপাতালের দুইজন চিকিৎসক এবং আটজন সেবিকা মিলে এখন পর্যন্ত কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হওয়া প্রথম ৪২৫ জনের মধ্যে আঠারো জন বাদে সবাইকে বাঁচাতে সক্ষম হয়েছেন।

“আমরা আমাদের এ্যাম্বুলেন্সগুলোকে বাইরে পাঠাই রাস্তা থেকে রোগীদেরকে তুলে আনতে”, ব্যাখ্যা করেন সিস্টার ইমাকুলেট, হৃষ্টপুষ্ট, ত্রিশোর্ধ চিকিৎসক যিনি এই হাসপাতালটি পরিচালনা করেন। “এদের কেউ কেউ কাদা এবং বৃষ্টিতে পড়ে ছিল এবং সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত অবস্থায়। তারপরেও যদি না তারা আক্ষরিক অর্থে মৃত্যুমুখে পতিত হয় তাহলে ওদের বেশীরভাগকেই আমরা সুস্থ করে তুলতে পারি। এই মেয়েটিকে” শান্তভাবে ঘুমিয়ে থাকা এক কিশোরীকে দেখিয়ে তিনি যোগ করেন, “যখন নিয়ে আসা হয় তখন তার নাড়ীর স্পন্দন ছিল না এবং শ্বাস-প্রশ্বাস চলছিল না। আমরা ওকে স্যালাইন দিই, এবং এখন সে সুস্থ আছে। এদের কারো কারো জন্য এক গ্যালন তরল প্রয়োজন হয় সুস্থ হয়ে উঠতে, কিন্তু সঠিক যত্ন নিলে, এরা দুই বা তিন দিনের মধ্যে হাসপাতাল ছেড়ে যেতে পারে”। এই চিকিৎসায় কাজ হয় শুধুমাত্র চিকিৎসক এবং সেবিকাদের নিঃস্বার্থ সেবার কারণে। “আমরা সবসময় ওদের সাথে আছি”, সিস্টার ইমাকুলেট বলেন, “এবং আমরা তাদের প্রত্যেকের পেছনে অনেক টাকা ব্যয় করি – মাথাপিছু প্রায় ৬০ টাকা (৭ মার্কিন ডলার)করে।”

এই হাসপাতালটি একটু আলাদা, কেননা এটা নতুন এবং ব্যক্তিগত তহবিল দ্বারা পরিচালিত; নদীয়ায় খুব অল্পকয়েকটি হাসপাতালই আছে যারা প্রতিটি রোগীর জন্যে ৬০ টাকা পর্যন্ত খরচ করার সামর্থ্য রাখে। কৃষ্ণনগর হাসপাতালটি বরং অনেকটা সাধারণ মানের। এমনিতে ২৫ শয্যাবিশিষ্ট হলেও, এই মুহূর্তে এখানে ৪০০-রও বেশি রোগী আছে, যাদের অনেকেই দালানের পাশে তৈরি করা কমলা রঙের তাবুর নিচে আশ্রয় নিয়েছে তাদের পরিবারের সদস্যদের সাথে। বিছানার চাদরের সরবরাহ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে, এবং বেশীরভাগ তোষকই দূষিত হয়ে গেছে শারীরিক বর্জ্যে। রোগীরা দাগে ভরা পাতলা জালিকাপড়ে ঢাকা ৬ ফুট দীর্ঘ এবং ৩ ফুট প্রস্থের টিনের ট্রে-র উপর শুয়ে থাকে। চারিদিকে শুধু মাছি, এবং শব্দ আর দুর্গন্ধ মাত্রাধিক। শুন্য-দৃষ্টি চিকিৎসক এবং সেবিকাদের কাজের ভার এতই বেশি যে তাদের একজন গত সপ্তাহে ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ে এবং মারা যায়। এখন পর্যন্ত এতো অপরিচ্ছন্নতা সত্ত্বেও, হাসপাতালটি অত্যন্ত আশ্চর্যজনকভাবে কার্যকর রয়েছে, এবং মাত্র ৮ শতাংশের মতো রোগী মারা গেছে।

 

টাইফয়েডঃ পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধের শরণার্থীরা ভারতীয় আশ্রয় শিবিরে এসেও অনেক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। “আমরা এখন যে ভয় পাচ্ছি সেটি হচ্ছে টাইফয়েডের মহামারী”, বলেন কৃষ্ণনগর হাসপাতালের মিঃ গুপ্তা। “এখানে প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ শিবিরগুলোতে এবং এখানে আসার রাস্তার পাশে বসবাস করছে। এদের অনেকেই দূষিত পানি পান করছে, এবং ওদের অনেকেই এখানে আসার অত্যন্ত কষ্টকর যাত্রার ধকলে দুর্বল। এটা টাইফয়েডের জন্য আদর্শ পরিবেশ”।

হয়তো ভারতের এই চলমান দুর্দশার কথা চিন্তা করেই, পাকিস্তানের সরকার শরণার্থীদের তাদের ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে তাদেরকে সাধারণ ক্ষমার প্রস্তাব এবং খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা সেবা এবং তাদের আগের বসতবাড়ি পর্যন্ত পরিবহনসহ পৌঁছে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। গত সপ্তাহের এক আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী, কয়েক হাজার বাঙালী ইতোমধ্যেই সীমান্ত পার হয়ে পাকিস্তানে ফিরে গেছে এই প্রস্তাব গ্রহন করার জন্য। কিন্তু এখন পর্যন্ত, ৫ লাখ গৃহহীন মানুষের বেশীরভাগ মনে করছে বলে মনে হয় যে, এতো সমস্যা থাকার পরেও, এই মুহূর্তে ভারত বসবাসের জন্য শ্রেয়তর স্থান।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৫১। বাঙ্গালি শরণার্থীঃ দুঃখের শেষ নেই টাইম ২১ জুন, ১৯৭১

Shihab Sharar Mukit

<১৪, ৫১, ১০৮-১১০>

টাইম ম্যাগাজিন। ২১ জুন, ১৯৭১

বাঙ্গালি শরণার্থীঃ দুঃখের শেষ নেই

একটি ঘুর্ণিঝড়ে প্রায় ৫ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। একটি গৃহযুদ্ধ কেড়ে নিয়েছে প্রায় আরও ২ লাখের বেশি। দেশ ছেড়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা ৫ হাজার ছাড়িয়েছে এবং আরও বাড়ছে। কলেরা ঠিক মত শুরু হবার আগেই কেড়ে নিয়েছে প্রায় ৫ হাজার জীবন। মোসাইকের দিনগুলিতে প্লেগের আক্রমণের মত কিছু না ঘটলে এই ঘটনা বাইবেলে উল্লেখিত কষ্টের কাহিনির সাথে অনেকটাই মিলে যায়। এটা একরকম নিশ্চিতভাবেই বলা যায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিপর্যয়ের তালিকা আস্তে আস্তে আরও বড় হবে। গত সপ্তাহে নতুন করে প্রতিদিন প্রায় ১ লাখের মত উদ্বাস্তু ভারতে প্রবেশ করছে এবং তাদের মুখে মুখে মুসলিম অধ্যুষিত পাকিস্তানে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার খবর ছড়িয়ে পরছে। এছাড়াও ভারতের পাঁচটি প্রদেশের সীমান্তে ক্রমবর্ধমান শরণার্থীর চাপে শরণার্থী শিবিরগুলোতে দুর্গন্ধ এবং  দুর্ভিক্ষ ও অন্যান্য মহামারীর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

শরণার্থীদের ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হয় মার্চে যখন পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানিদের স্বাধীনতার স্বপ্নকে ধ্বংস করে দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যখনই পাকিস্তানি দুঃসাহসী পাঠান ও পাঞ্জাবি বাহিনীর সাথে বাঙ্গালি মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ শুরু হয় তখনই প্রায় ১৫ লাখ পূর্ব পাকিস্তানি- হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে দেশ ছেড়ে ভারতের পশ্চিম বঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয় ও বিহার প্রদেশে আশ্রয় নেয়। পালিয়ে যাওয়া মানুষের বেশিই হিন্দু এবং তারা অত্যাচার, ধর্ষণ ও বেপরোয়া হত্যাকাণ্ডের কাহিনী বর্ননা করছে। নতুন শরণার্থীদের মতে পাকিস্তান সরকার সদ্য অবৈধ ঘোষিত হওয়া শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে পাকিস্তানের ১ কোটি হিন্দুদের (মোট জনসংখ্যা ৭.৮ কোটি) দোষারোপ করছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানের রাজধানী করাচিতে গৃহবন্দি থাকা মুজিবকে সত্যিকার অর্থেই হিন্দুরা অন্ধসমর্থন দেয়। যা মুসলিমরাও দেয়, যার ফলেই গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬৯ আসনের ১৬৭ টি তে জয়লাভ করেছিল। কিন্তু হিন্দুরা সংখ্যালঘু হওয়ায় আক্রমনের তুলনামূলক সহজতর লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে।

আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে মেরে ফেলা হচ্ছে

একজন হিন্দু ঠিকাদার বর্ণনা করেছেন কিভাবে একটি চা বাগানে এসে জিজ্ঞেস করেছে নির্বাচনে কাদের ভোট দিয়েছিল। আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে কথা স্বীকার করায় তারা প্রায় ২০০ জনকে গুলি করেছে। ভারতের আগরতলায় এক হাসপাতালের ডাক্তার খুব বাজে ভাবে দগ্ধ রোগীদের সংখ্যা প্রকাশ করেছেন। ডাক্তার জানান, শরণার্থীদের জোরপূর্বক একটি কুঁড়েঘরে ঢুকানো হয় এবং সেনাবাহিনী সেই কুঁড়েঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। এছাড়াও হাসপাতালটিতে ৩৭০ জন গুলিবিদ্ধ পুরুষ, নারী ও শিশুকে সেবা দিয়ছে যাদের মধ্যে ১৭ জন মারা গিয়েছেন।

পশ্চিম বঙ্গ-পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তের পেট্রাপোলের শরণার্থীশিবিরে এক ষোড়শী বলছিল কিভাবে সে ও তার বাবা-মা ঘুমিয়ে ছিল, “তখনই আমরা বাইরে পায়ের শব্দ পেলাম। দরজা একরকম ভেঙে ফেলেই আমাদের ঘরের ভিতরে কয়েকজন ঢুকে পরে। তারা আমাদের গোলায় বেয়নেট তাক করে রাখে এবং আমার চোখের সামনেই আমার মা-বাবাকে রাইফেলের বাট দিয়ে পিটিয়ে নেরে ফেলে। আমাকে মেঝেতে ফেলে দেয় এবং তাদের মধ্যে তিনজন আমাকে ধর্ষণ করে।”

ত্রিপুরা ক্যাম্পে থাকা আরেক বালিকা বলছিল কিভাবে সে পালিয়ে আসার আগে ১৩ জন পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য দ্বারা পাশবিক অত্যাচারের স্বীকার হয়েছিল। পলায়নকৃত পরিবারের মেয়েদের তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং তাদের পরিবার মুক্তিপণ দিতে না পারলে সৈন্যদের কাছে পতিতা হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে।

সীমান্ত ঘুরে যাওয়া এক কর্মকর্তার দেয়া তথ্য মতে পাকবাহিনী ও তাদের হিন্দুবিরোধী সমর্থকগোষ্ঠী পূর্বপাকিস্তান ছাড়ার আগে জনপ্রতি ১৪০ ডলার করে দাবি করছে। নিজের স্ত্রীর মুক্তিপণ হিসেবে দাবীকৃত অর্থের মাত্র ২৫ ডলার কম থাকায় একজন দাবি করেন ‘বাকি টাকা আমাকে মেরে উসুল করে নিন’। মারতে মারতে একটা চোখ উপড়ে ফেলার পরেই তারা সেই লোক ও তার স্ত্রীকে যেতে দেয়।

যারা পালিয়ে গিয়েছে তারা গয়ার ‘ডিজাস্টার অব ওয়ার’ এর উদাহরণ হতে পারে। যাদের ভাগ্য ভাল ছিল তারা আগেই পরিপূর্ণ তাবু গুলোতে আশ্রয় নিয়েছে যেগুলো আগে থেকেই কস্টিক সোডা ও মানুষের মলমূত্রের গন্ধ এবং গোড়ালি সমান গত বর্ষার ময়লা পানিতে ভর্তি। ভারী বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পেতে বেশিরভাগই গাছ বা ঝোপের আড়ালে আশয় নেয়। অনেকে কোনমতে বন্ধ হয়ে যাওয়া স্কুলগুলোর বারান্দায় একটু জায়গা খুঁজে নেয়। অন্যরা যারা কলকাতার কাছাকাছি আছে তারা বড় ড্রেনের পাইপের ভিতরেই ঠাই নিয়েছে। তাদের চতুর্দিকেই এখন দুষিত পানি, রোগবালাই আর মৃত্যু।

প্রতীকী শবদাহ

দুষিত খাবার পানি, পরিচ্ছন্নতার অভাব ও লাখ লাখ শরণার্থীদের সবাইকে কর্তৃপক্ষ টীকা দিতে না পারায় কলেরা ছড়িয়ে পরছে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে। কলেরা ভারত ও পাকিস্তানে খুবই পরিচিত একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ যা মারাত্মক বমি ও ডায়রিয়া ঘটায় যার ফলে দেহে পানিশূন্যতা হয় ফলাফল প্রাণহানি। আক্রান্তদের ইনজেকশনের মাধ্যমে বা পানীয় হিসেবে প্রচুর পরিমানে লবণের দ্রবন, স্যালাইন ও গ্লুকোজ খাওয়ানো গেলে বাঁচানো সম্ভব। কিন্তু সেখানের মেডিকেল টিমের সামর্থ্যের তুলনায় শরণার্থীদের ঢল এত বেশি যে সবাইকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

শরণার্থীরা যেসব রাস্তা দিয়ে চলাচল করে সেগুলো শুধু ফেলে দেয়া কাপড় আর গৃহস্থালি পণ্যেই পূর্ণ না, এসবের সাথে যোগ হয়েছে কলেরায় মারা যাওয়া মানুষের লাশ যেগুলো তাদের পরিবার কলেরায় আক্রান্ত হবার ভয়ে সৎকার না করেই ফেলে গেছে। যদিও হিন্দুরা শবদাহ করে থাকে, কিন্তু বেশিরভাগ লাশের উপরেই মাত্র ২/৩ টা কাঠি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং বাকিটা রেখে দেয়া হয়েছে অপেক্ষায় থাকা শকুন কিংবা বন্য কুকুরে তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য। যদিও কোন লাশ দাফন করা হয়, সেই লাশ মাংসাশী প্রাণীরা তুলে বের করে আনে। শরণার্থীরা যাতে লাশ নদীতে না ফেলে সে ব্যাপারে স্থানীয় পুলিশ সতর্ক রয়েছে। জনাকীর্ণ হাসপাতালগুলোতে অসুস্থ ও মৃতপ্রায় রোগীদের একসাথে জড়ো করে রাখা হয়েছে এবং হাসপাতালের কাজের চাপে জর্জরিত স্টাফরা সময় বের করে মৃতদেহ সরিয়ে নেবার আগ পর্যন্ত মৃতদের জীবিতদের সাথে রাখা হয়।

পশ্চিমবঙ্গের একটি জনবহুল স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ৪৫ বছরের এক চাষি দেখছিলেন তার সদ্য জন্ম নেয়া বাচ্চা কিভাবে তার কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া মায়ের বুক থেকে দুধ খাবার চেষ্টা করছিল। “আমার বউ মরে গেছে” খুব ক্ষীণ স্বরে লোকটা বলছিল “আমার বাচ্চারা মরে গেছে। আর কি হতে পারে?” রোগবাহী শরণার্থীরা যেভাবে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে যাচ্ছে তাতে করে কয়েক লাখ ভারতীয় এই মহামারী রোগে যেকোনো সময় আক্রান্ত হতে পারে। একারণে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ পূর্ব পাকিস্তানিদের কলকাতায় প্রবেশে বাঁধা দিচ্ছে যেখানে আগে থেকেই লাখ লাখ মানুষ নোংরা পরিবেশে বাস করে এবং মহামারী কলেরা সেখানে একটি বার্ষিক অনুষ্ঠানের মত।

অসম বিনিময়

যদিও ভারত সাময়িক সময়ের জন্য শরণার্থীদের রাখতে আপত্তি করেনি এবং তাদের সাধ্যমত সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে তাদের সাহায্য করার  জন্য কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর সরকার এই দরিদ্র মানুষের এই ক্রমবর্ধমান ঢলকে শুধুই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্যোগ হিসেবেই দেখছে। শরণার্থী সমস্যাটা ভারতকে আগস্ট ১৯৪৭ এ উপমহাদেশ  ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান হবার পর থেকেই পীড়া দিয়ে যাচ্ছে।

উত্তর ভারতে বিনিময়টা প্রায় সামঞ্জস্যপূর্ণ, ৬০ লাখ মুসলিম পাকিস্তানে চলে যাচ্ছে এবং প্রায় ৬৫ লাখ হিন্দু শিখ ভারতে প্রবেশ করছে। দেশ ভাগের পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় ৪৩ লাখ হিন্দু ভারতে পালিয়ে গেছে, বেশিরভাগই পশ্চিমবঙ্গে। মুসলিমদের সেরকম কোন যাত্রা লক্ষ্য করা যায়নি। এই অসামঞ্জস্যের ফলে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোকে চাঙ্গা করে তোলে যার ফলে পশ্চিমবঙ্গ ও তার রাজধানী কলকাতা মানবিক বিপর্যয়ের এক আস্তানায় পরিণত হয়।

শরণার্থীদের খাবার ও আবাসের ব্যবস্থা করতে প্রতিদিন প্রায় ১.৩৩ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হচ্ছে যা শ্রীমতী গান্ধীর সরকার বহন করতে পারবে না যদি এটি গত মার্চে ‘গরীবী হটাও’ প্রচারণায় করা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে চেষ্টা করে। শরণার্থীদের রোজকার খাবারের চাহিদা বর্তমান খাদ্য মজুদে ঘাটতি সৃষ্টি করছে এবং স্বয়ং ভারতীয়দের এক দুর্ভিক্ষের হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। শরণার্থীরা ভারতীয়দের কাজও কেড়ে নিচ্ছে; স্থানীয় শ্রমিকদের যে মজুরীতে ভাড়া নেয়া হত তার এক চতুর্থাংশে বিনিময়ে শরণার্থী চাষিদের কাজে নেয়া হচ্ছে।

জায়গার অভাব

 

এসব সমস্যার মুখোমুখি হয়ে ভারত সরকার শরণার্থীদের ‘উদ্বাস্তু’ বা ‘পলায়নকারী’ হিসেবে আখ্যায়িত করছে এবং আশা করছে’নিজেরাই গরীব রাষ্ট্র হওয়ায়’ তারা একসময় তাদের নিজেদের দেশে ফিরে যাবে। পূর্ব ভারতের এক শরণার্থী শিবিরে শ্রীমতী গান্ধী বলেন, “আমরা চাইলেও আপনাদের সারাজীবন এখানে রাখতে পারব না।” পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও সম্ভাব্য গেরিলা যুদ্ধের মুখে তাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়া নিকট ভবিষ্যতে সম্ভব না। তাছাড়াও যুদ্ধ ও দেশ ত্যাগের কারণে পূর্ব পাকিস্তানে বর্ষা মৌসুমের আগে শস্য রোপণের হার খুবই কম। দুর্ভিক্ষ আঘাত হানার সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত। এবং যখন এটা হবে তখন আরও লাখ লাখ মানুষ তাদের তল্পিতল্পা গুটিয়ে পাশের দেশে আশ্রয় খুঁজতে যাবে যেখানে আগে থেকেই থাকার জন্য জায়গার খুব অভাব।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৫২। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র প্রেরণ নিউইয়র্ক টাইমস জুন ২২, ১৯৭১

 

 

Ashik Uz Zaman

<১৪, ৫২, ১১১১১৩>

দি নিউইয়র্ক টাইমস, জুন ২২, ১৯৭১.

নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র প্রেরণ

ট্যাড সুলচ

নিউইয়র্ক টাইমসের বিশেষ প্রতিনিধি

ওয়াশিংটন, জুন ২১ – পাকিস্তানের পতাকাবাহী একটি মালবাহী জাহাজ মার্কিন সমরাস্ত্র নিয়ে আজ নিউইয়র্ক থেকে করাচির উদ্দেশ্যে যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, আপাতদৃষ্টিতে এ ধরণের সরবরাহের উপর এই সরকারের আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত নিষেধাজ্ঞাকে উপেক্ষা করেই।

পররাষ্ট্র মন্ত্রলায়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা, অনুসন্ধানের প্রতিক্রিয়ায়, স্বীকার করেন যে অন্তত আরো একটি জাহাজ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাকিস্তানের পথে রয়েছে যা তাদের বর্ণনা অনুযায়ী “বৈদেশিক সামরিক বিক্রয়”-এর পণ্য বহন করছে।

এই পণ্যগুলো, তারা জানান, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্বৃত্ত সরবরাহ থেকে এসেছে এবং পাকিস্তানে এধরণের সমরাস্ত্র প্রেরণে তিন মাস আগের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা কিভাবে কার্যকর করা হবে তা নিয়ে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যকার বিভ্রান্তির ফলশ্রুতিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।

“এখানে স্পষ্টতই অসাবধানবশতঃ কোনো ধরণের বিচ্যুতি ঘটেছে,” এক কর্মকর্তা বলেন।

অগাস্ট মাসে করাচিতে

পদ্মা, যে জাহাজটি নিউইয়র্ক থেকে যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, সেটি আটটি যুদ্ধবিমান, প্যারাসুট এবং হাজার হাজার পাউন্ড ওজনের খুচরা যন্ত্রাংশ এবং যুদ্ধবিমান এবং সামরিক যানবাহনের আনুষঙ্গিক উপকরণ নিয়ে অগাস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে করাচীতে পৌঁছানোর কথা রয়েছে।

সুন্দরবন, পাকিস্তানে নিবন্ধিত আরেকটি জাহাজ, মে মাসের ৮ তারিখে নিউইয়র্ক থেকে যাত্রা শুরু করে পাকিস্তানের জন্য অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে, যার মধ্যে সৈন্যবাহী সাঁজোয়া যানের যন্ত্রাংশ রয়েছে, জাহাজের মালামালের তালিকা এবং সাথে পাঠানো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেয়া রপ্তানি অনুমোদন অনুযায়ী। এই বুধবার জাহাজটির করাচী পৌঁছানোর কথা রয়েছে।

এই সমস্ত সরঞ্জাম বৈদেশিক সামরিক বিক্রয় আইনের ধারা মোতাবেক যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী পাকিস্তানের কাছে বিক্রি করেছে।

পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর, মূলত পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদেরকে গত ২৫শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আন্দোলনকে দমন করার নির্দেশ দেয়ার পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা দেয় যে পাকিস্তানের কাছে সকল প্রকার সামরিক সরঞ্জাম বিক্রয় স্থগিত করা হলো এবং এই কার্যক্রম, যেটি ১৯৬৭ সালে শুরু করা হয় সেটি এখন “পুনঃবিবেচনা” করা হচ্ছে।

আজ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা, পদ্মা এবং সুন্দরবনের যাত্রা প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে, বলেন যে এটি এখনো এই সরকারের আনুষ্ঠানিক নীতিতে রয়েছে যে পাকিস্তানের জন্য সবধরণের সামরিক সরঞ্জাম বিক্রয় নিষিদ্ধ।

এই কর্মকর্তারা ব্যাখ্যা করেন যে মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হওয়া স্বাধীনতা আন্দোলনের নিষ্ঠুর দমন শুরু হবার পরপরই এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী এর পরবর্তী সংঘর্ষে অন্ততঃ ২,০০,০০০ পূর্ব পাকিস্তানী নাগরিক নিহত হয়েছে এবং প্রায় ষাট লক্ষ শরণার্থী ভারতে পালিয়ে গিয়েছে।

আজকের সাক্ষাৎকারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বলেন যে ২৫শে মার্চের পর পাকিস্তানের জন্য কোনো সামরিক সরঞ্জাম পাঠানোর ব্যাপারে তারা অবগত নন।

তারা স্বীকার করেন যে এরকম কিছু পাঠানো হলে তা ঘোষিত নীতির পরিপন্থী হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের জানিয়েছে যে ২৫শে মার্চের পর বৈদেশিক বিক্রয় কার্যক্রমের আওতায় কোনো ধরণের সামরিক সরঞ্জাম “পাকিস্তানের সরকার বা পাকিস্তান সরকারের কোনো প্রতিনিধি”-এর কাছে হস্তান্তর করা হয়নি।

কোনো ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি

তারা বলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে আজকের আলোচনায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এই নীতি মেনে চলার ব্যাপারে “পুনঃনিশ্চয়তা” দিয়েছে। তারা অবশ্য ব্যাখ্যা দিতে পারেননি কিভাবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই বিবৃতির সাথে প্রকৃত ঘটনাকে খাপ খাওয়ানো যায়, এখানকার পাকিস্তান দূতাবাসে পেশ করা বহন পত্র অনুযায়ী, সুন্দরবন জাহাজে যে সরঞ্জামগুলো তোলা হয় সেগুলো ২৩শে এপ্রিল এবং পদ্মা জাহাজে যে সরঞ্জামগুলো তোলা হয় সেগুলো ২১শে মে তে নিউইয়র্ক বন্দরে গ্রহন করা হয়।

রপ্তানিকারকেরা পাকিস্তান দূতাবাসের প্রতিরক্ষা ক্রয় বিভাগের লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম. আম্রাম রাজাকে ২১শে মে একটি চিঠি পাঠান যার মধ্যে এই দুটি জাহাজের জন্য বন্দর রশিদ সংক্রান্ত বিষয় ছিল।

এই সরবরাহগুলো সম্বন্ধে গত শনিবার এবং আজকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চাওয়া হলে, তারা সবধরণের অনুসন্ধানের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে যেতে বলে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে কর্মকর্তারা আনুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞার আলোকে এই সরবরাহগুলো কিভাবে হচ্ছে তার ব্যাখ্যা দিতে অপারগ।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে জানায় ২৫শে মার্চের পর পাকিস্তানের কাছে কোনো কিছু বিক্রয় বা সরবরাহের অনুমোদন দেয়া হয়নি এবং যে সরঞ্জামগুলো এই দুটি জাহাজে তোলা হয়েছে সেগুলো আনুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগে কেনা হয়েছে।

কিন্তু বন্দরে পাঠানো এবং প্রকৃত সরবরাহগুলি ২৫শে মার্চের পরে কেনো করা হলো এব্যাপারে তারা কোনো মন্তব্য করেননি।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখনো পর্যন্ত ১৭ই জুনে পাঠানো একটি চিঠির জবাব দেয়নি যেটি সিনেটর চার্চ, আইডাহো অঙ্গরাজ্যের ডেমোক্র্যাট প্রতিনিধি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব উইলিয়াম পি. রজারস কে লেখেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতিক্রমে “বিশেষ কিছু সামরিক সরঞ্জাম” পাকিস্তানে প্রেরণের ব্যাপারে তথ্য জানানোর অনুরোধ জানিয়ে।

সিনেটর চার্চ, যিনি সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির একজন সদস্য, মিঃ রজারসকে জানান যে তিনি উপলব্ধি করেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই সরঞ্জামগুলোর জন্য অনুমতিপত্র নম্বর. ১৯২৪২ প্রদান করেছে।

সুন্দরবন জাহাজে বহনকৃত মালামালের বহন পত্র নিরীক্ষণে জানা যায় এই অনুমতিপত্রের অন্তর্গত একটি সামগ্রীর বর্ণনা আছে এভাবে “২৩টি স্কিড, যন্ত্রাংশ”, ওজন ১১,৮৯৫ পাউন্ড। এই সামগ্রীগুলোর আর কোনো বর্ণনা ছিল না।

কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রদানকৃত আরেকটি অনুমতিপত্র অনুযায়ী সুন্দরবন জাহাজের মালামালের বর্ণনা আছে এভাবে “সামরিক যানবাহনের জন্য যন্ত্রাংশ এবং আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম”। সুন্দরবন জাহাজে মোট ২১ ধরণের সামগ্রী বহন করা হচ্ছে, বন্দরে সরবরাহ করার তালিকা অনুযায়ী, যেগুলো কাগজপত্রে বর্ণনা দেয়া হয়েছে শুধুমাত্র শক্ত কাগজের বা কাঠের বাক্স ভর্তি “গাড়ির যন্ত্রাংশ এবং আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম”, “স্কিড এবং যন্ত্রাংশ”, “বাক্স” এবং “যন্ত্রাংশ”।

তালিকায় রয়েছে বিমান এবং প্যারাসুট

পদ্মা জাহাজের জন্য বন্দরে সরবরাহ করার তালিকাতে দুইটি অংশে লেখা আছে “চারটি বিমান” প্রতিটিতে, ১১৩টি প্যারাসুট এবং যন্ত্রাংশ, এবং গাড়ির যন্ত্রাংশ, আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম, স্কিড

এবং “কাঠের বাক্স”।

একটি সামগ্রীর বর্ণনা আছে এভাবে “বাক্স বাণ্ডিল এবং যন্ত্রাংশ” যার ওজন লেখা আছে ১৪.১৩৩ পাউন্ড।

পাকিস্তানে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির কার্যক্রম, যেটি শুরু হয়েছিল ১৯৬৭ সালে, চলছিলো প্রতি বছরে প্রায় ১ কোটি মার্কিন ডলার করে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র, রবার্ট জে. মেক্লস্কির ভাষ্যমতে। ঐ বছর যুক্তরাষ্ট্র ভারত এবং পাকিস্তান উভয় দেশের কাছেই “অ-প্রাণঘাতী” সরঞ্জাম বিক্রি করতে রাজি হয়, ১৯৬৫ সালের ইন্দো-পাকিস্তান যুদ্ধের পর সামরিক সরবরাহের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল করার মাধ্যমে।

১৯৭০ সালের অক্টোবর মাসে, ব্যতিক্রম হিসেবে, এই সরকার রাজি হয় পাকিস্তানের কাছে অনুল্লেখিত সংখ্যক এফ-১০৪ জঙ্গিবিমান, বি-৫৭ বোমারু বিমান, এবং সৈন্যবাহী সাঁজোয়া যান বিক্রি করতে। তবে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আজ নিশ্চিত করেছে যে এই “ব্যতিক্রমী” সরঞ্জামগুলোর কোনোটিই সরবরাহ করা হয়নি।

কিন্তু এখানকার নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, যারা পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক, ১৯৬৭ সাল এবং ৩০শে এপ্রিল, ১৯৭০ সালের মধ্যে শুধুমাত্র বিমান বাহিনীর কাছ থেকে পাকিস্তানে সামরিক সরঞ্জামের প্রবাহ ৪,৭৯,৪৪,৭৮১ মার্কিন ডলার হয়েছে।

ডেনভারে অবস্থিত বিমান বাহিনীর রাজস্ব ও হিসাবরক্ষণ সদরদপ্তর থেকে ওয়াশিংটনে অবস্থিত পাকিস্তান দূতাবাসের প্রতিরক্ষা ক্রয় বিভাগের কাছে ২৮শে মে একটি চিঠি পাঠানো হয় যাতে রয়েছে “একটি প্রতিবেদন … যেখানে রয়েছে চলতি সকল বৈদেশিক সামরিক বিক্রয়ের তালিকা, প্রতিটির মূল্য, সংগৃহীত অর্থ, সরবরাহকৃত এবং যা কিছু সরবরাহ করা বাকি রয়েছে”।

এই চিঠিটি – ইলেইন বি. লোভেনথাল কর্তৃক স্বাক্ষরিত, ডেনভারে অবস্থিত সদরদপ্তরের বৈদেশিক সামরিক বিক্রয় শাখার প্রধান হিসাবাধ্যক্ষ – যিনি “যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর সামরিক বিক্রয়ের লেনদেন এবং সরবরাহের বিস্তারিত তালিকা তৈরি”-এর প্রধান ছিলেন।

এই “প্রতিবেদন”-এ উল্লেখ আছে যে পাকিস্তানের সামরিক ক্রয়ের পূর্বের হিসাব ২,৫৬,৭৯,৬৫৪.১০ মার্কিন ডলার, সরবরাহ করা হয়নি এমন সামগ্রীর মোট মূল্য ২,১৭,৩০,৭৪০.০৭ মার্কিন ডলার এবং “এখন পর্যন্ত গৃহীত নগদ অর্থ”-এর পরিমাণ ২,৪৩,৪২,৭৮২.৩৭ মার্কিন ডলার।

এই প্রতিবেদনটি ঠিক কোন সময়সীমার হিসাবকে অন্তর্ভুক্ত করেছে তা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সঠিকভাবে বলতে পারেননি।

তবে বিমান বাহিনীর প্রতিবেদনটিতে আরো বলা আছে, যে পাকিস্তান সরকারকে ১৯৭১ সালের ৩১শে মে বা তার আগেই মোট ৩৩,৭৬,২৫৩.৫১ মার্কিন ডলার পাঠাতে হবে আরো “মোট নগদ অর্থের প্রয়োজন” মেটাতে।

এই রিপোর্টের একটি টীকায় দেখানো আছে যে পাকিস্তানের কাছ থেকে “১৯৭১ সালের মে মাসে” ৫৪,০৪,১১৬.৪৯ মার্কিন ডলারের একটি চেক পাওয়া গেছে।

এখানকার নির্ভরযোগ্য সূত্র আরো জানিয়েছে যে “সমূহ সম্ভাবনা” আছে সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনীও পাকিস্তানের কাছে আরো সমরাস্ত্র বিক্রি করেছে।

ইস্ট ওয়েস্ট শিপিং এজেন্সীর মুখপাত্র, যারা কিনা পদ্মা এবং সুন্দরবন জাহাজ দুটির নিউইয়র্কের প্রতিনিধি, ইংগিত দেন যে পদ্মা জাহাজটি তার সাম্প্রতিক আরো কিছু যাত্রায় পাকিস্তানের জন্যে সামরিক সরঞ্জাম বহন করেছে, সর্বশেষ যেটি মার্চের ২২ তারিখে করাচীতে পৌঁছে দিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে সৈনিকদের অভিযান চালানোর তিনদিন আগে।

পদ্মা জাহাজটি যে যাত্রার জন্য এখন প্রস্তুতি নিচ্ছে সেটি ২৫শে মার্চের পরে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর সামরিক সরঞ্জাম বহন করে করাচীতে নিয়ে যাওয়ার প্রথম সমুদ্রযাত্রা। সুন্দরবন জাহাজটির বর্তমান সমুদ্রযাত্রাটিও নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর প্রথম যাত্রা। কিন্তু নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে যে পাকিস্তানের জন্য সামরিক সরঞ্জামাদি নিয়ে অন্য আরো জাহাজ ২৫শে মার্চের পরেও পূর্ব এবং পশ্চিম উপকূলের বন্দরগুলো থেকে যাত্রা করে থাকতে পারে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৫৩। অস্ত্র যখন ধর্মতাত্ত্বিক সমস্যা নিউইয়র্ক টাইমস ২৭শে জুন, ১৯৭১

Ashik Uz Zaman

<১৪, ৫৩, ১১৫-১১৬>

দি নিউইয়র্ক টাইমস, রবিবার, ২৭শে জুন, ১৯৭১

যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্তান

অস্ত্র যখন ধর্মতাত্ত্বিক সমস্যা

ওয়াশিংটন – নিক্সন প্রশাসন গতসপ্তাহের পত্রিকা পড়ে জানতে পেরেছে যে তারা মার্কিন সামরিক সরঞ্জাম পাকিস্তানে পাঠানোর উপর নিজেরাই যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল তা উপেক্ষা করছে দেশটির পূর্ব অংশে গৃহযুদ্ধ শুরু হবার পর থেকেই।

দেরিতে জানতে পারা যে ২৫শে মার্চে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবার পরেও সামরিক সরঞ্জাম বোঝাই অন্তত তিনটি মালবাহী জাহাজ নিউইয়র্ক বন্দর থেকে করাচীর পথে ছেড়ে গেছে, এবং ঐ দিনের পর আরো নতুন রপ্তানি আদেশ যে বেআইনি ভাবে দেয়া হচ্ছে, এতে প্রশাসন প্রকাশ্যে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে। এর সাথে আছে সংসদীয় অসন্তোষ এবং ভারতের সাথে রাজনৈতিক টানাপোড়েন।

এই ঘটনাটি পূর্ব পাকিস্তানের কার্যত বিস্ফোরক পরিস্থিতির প্রতি ওয়াশিংটনের দ্যর্থক মনোভাবকে আরো স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিতে কাজ করেছে, যেখানে বাঙালী স্বাধীনতা আন্দোলনের উপর পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর চালানো দমন-পীড়নে এখন পর্যন্ত প্রায় ২,০০,০০০ বাঙালী নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে এবং ষাট লক্ষ শরণার্থীকে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে যেতে বাধ্য করেছে।

কয়েকজন পর্যবেক্ষক বিশ্বাস করেন যে প্রশাসনের তরফ থেকে ইচ্ছাকৃত ছলচাতুরী ছিল। মোটামুটি সবাই এটা মেনে নিয়েছিল যে যারা প্রশাসনের উপরের দিকে নীতিনির্ধারণ করেন এবং যারা কার্যত সেই নীতির প্রতিফলন ঘটান তাদের মধ্যকার আভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যাহত হওয়ায় অস্ত্রের এই চালানগুলো সঙ্ঘটিত হয়েছে, যেটাকে একজন উদ্বেজিত আমলা গত সপ্তাহে বর্ণনা করেন, “হস্তীসম বৃহৎ প্রশাসনের মূল্য” হিসেবে।

অস্ত্রের এই চালানগুলোকে ঘিরে এই আমলাতান্ত্রিক বিভ্রান্তি সবদিক থেকেই পর্বতপ্রমাণ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই বেশ কয়েকজন সিনেটরকে আশ্বস্ত করেছিল (লিখিতভাবে) যে পাকিস্তানের জন্য কোনো অস্ত্রের চালান পাঠানোর কথা নেই, হতবাক হয়ে যায় যখন তারা দুটো (আরো পরে তৃতীয়) মালবাহী জাহাজ ছেড়ে যাওয়ার কথা জানতে পারে এবং ছুটে যায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের কাছে এর ব্যাখ্যা চাইতে।

পেন্টাগন তাদের কম্পিউটার ঘাঁটে এবং তথ্য পরিবেশন করে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চমকে দিয়ে, যে ২৫শে মার্চে অস্ত্রের চালানের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা মাত্র ৬ই এপ্রিলে এসে কার্যকর হয়েছে। এরপর, প্রশাসন থেকে ব্যাখ্যা দেয়া হয় যে ২৫শে মার্চের আগে পাকিস্তানী সরকারী কর্মকর্তাদের হাতে যেসব সামরিক সরঞ্জাম হস্তান্তর করা হয়েছে সেগুলো পাঠিয়ে দেয়া যেতেই পারে। কেন পাঠিয়ে দেয়া যায় সেটা আর বলা হয়নি।

প্রকৃত সত্য নিরূপণ করতে দ্রুত একটি উচ্চ-পদস্থ বিশেষ টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়, কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানার আগেই চার দিন অতিবাহিত হয়ে যায় যে পাড়িল্লা, পাকিস্তানের মালবাহী জাহাজ যেটি গত সপ্তাহান্তে নিউইয়র্ক বন্দরে মালামাল তুলছিলো, সেটি বন্দর ছেড়ে গেছে (১) ১ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার সমমূল্যের গোলাবারুদ, (২) সামরিক বিমান, সাঁজোয়া যান এবং জীপগাড়ির খুচরা যন্ত্রাংশ এবং (৩) বিমানবিধ্বংসী গোলন্দাজদের প্রশিক্ষণের জন্য বেতার-নিয়ন্ত্রিত চালক বিহীন ছোট বিমান নিয়ে।

তিন দিন ধরে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এবং সাংবাদিকরা গোলাবারুদগুলো “প্রাণঘাতী” নয় সরকারের এরূপ দাবির বিষয়ে বিতর্কে লিপ্ত হন। এর সুত্রপাত হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্ববর্তী এক স্বীকারোক্তি থেকে যে পাকিস্তানের কাছে যে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রয় করা হয়, যা কিনা “অ-প্রাণঘাতী” দ্রব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, তার মধ্যে গোলাবারুদও আছে।

তৃতীয় দিনের মাথায়, এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেনঃ “কখন গোলাবারুদ প্রাণঘাতী হয়?”। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র উত্তর দেনঃ “এটি একটি ধর্মতাত্ত্বিক প্রশ্ন”।

অস্পষ্ট থেকে যায় পূর্ব পাকিস্তানের সংকটের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নীতির মূলকথা এই স্বীকৃত পটভূমির বিপরীতে যে এখানে অত্যন্ত বাস্তব আশঙ্কা রয়েছে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবার যদি না পূর্ববাসীদের স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষার জন্য দ্রুত একটি রাজনৈতিক সমাধান পাওয়া যায়।

এই আশঙ্কা উদ্ভূত হচ্ছে ভারতের সম্পদের উপর শরণার্থীদের সংখ্যা যে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছে, ভারতের স্থানীয় অধিবাসী এবং শরণার্থীদের মধ্যেকার ক্রমবর্ধমান বিরোধ এবং পূর্ব পাকিস্তানের “মুক্তিযোদ্ধা”-দের রাজনৈতিক মৌলিকিকরণ বিষয়ক ভারতের ভয় থেকে। এই সবগুলো উপাদানকেই নয়াদিল্লী দেখছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজনৈতিক স্থিরতা এবং এই উপমহাদেশের শান্তির প্রতি সরাসরি হুমকি স্বরূপ।

ভারতীয় নীতি, যুক্তরাজ্য এবং কানাডার শক্ত সমর্থনসহ, হচ্ছে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উপর যথেষ্ট পরিমানে আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগের ব্যবস্থা করা যাতে সে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবী মেনে নিতে বাধ্য হয়। ভারতের যুক্তি হচ্ছে শরণার্থীদের পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য এটা করা জরুরী। চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার হিসেবে পাকিস্তানকে সব ধরণের বৈদেশিক সাহায্য থেকে বঞ্চিত করার দাবী তাদের।

এই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব অস্পষ্ট। প্রশাসনের সহজাত প্রবৃত্তি, বিশেষ করে পেন্টাগনের, হচ্ছে ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার সুসম্পর্কের ক্ষতিপূরণ হিসেবে যে কোন মূল্যে পাকিস্তানের সাথে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। এই মনোভাব এখনো বজায় আছে যদিও গত কয়েক বছরে পাকিস্তান আরো কাছ ঘেঁষা হয়েছে সমাজতন্ত্রী চীনের।

যদিও এই মাসের শুরুতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাকিস্তানকে প্রকাশ্যে পূর্ববাসীদের সাথে “রাজনৈতিক আপোসরফা” করার উপায় খুঁজতে বলেছে – দুই মাস ধরে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলার পর এই প্রথমবার এটা করলেও – তারা অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগের যুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছে।

তবে, গত সপ্তাহে বিশ্ব ব্যাংকের একটি বিশেষ প্রতিনিধিদল পরামর্শ দেয়, পাকিস্তানের পরিস্থিতি পর্যালোচনার পর, যে ১১০টি নতুন তহবিল পাকিস্তানের জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্য সঙ্ঘের মাধ্যমে দেয়া হবে যতক্ষণ না ইসলামাবাদ সরকার পূর্ব পাকিস্তানের সাথে “রাজনৈতিক আপোসরফা” করে।

–      ট্যাড সুলচ

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৫৪। পাকিস্তানী সৈন্যদের গ্রাম আক্রমণ শিকাগো সান টাইমস ২৮ জুন ১৯৭১

Razibul Bari Palash

<১৪, ৫৪, ১১৭-১১৮>

শিকাগো সান টাইমস

সোমবার. জুন ২৮, ১৯৭১

পাকিস্তানী সৈন্যদের গ্রাম আক্রমণ – প্রচুর লোক নিহত

বলিয়াদি , পূর্ব পাকিস্তান (এপি) – পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল রবিবার সন্ধ্যার আগে জলমগ্ন গ্রামের হিন্দু এলাকার বাসিন্দাদের হত্যা করে, ঘরবাড়ি লুণ্ঠন করে  এবং বাজার জ্বালিয়ে দেয়।

২০ মিনিট পরে ২৪ জন পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য ও ডজন খানেক সম্মুখ সেনা চলে যায়। তাদের সদর দপ্তর আমাদের পশ্চিমে । তাদের কমান্ডার  যিনি নিজে তার নাম বলেন মেজর ওমর তিনি সাংবাদিকদের জানান এটি ছিল আমাদের ‘’রুটিন টহল।’’

আরেকজন মেজর যিনি নাম বলতে চাননি – তিনি একটি নীল টুপিবিশেষ পড়া ছিলেন এবং নগ্নপদে ছিলেন। তার লোকদের কাছে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল ও ছাতা ছিল বৃষ্টি থেকে রক্ষার জন্য।

একটি পরিদর্শনে দেখা যায়  তারা তিনটি লাশ ফেলে যায় এবং গ্রামের কিছু বাড়ি এখনো জ্বলছিল।

কিছু বয়সী নারী ও শিশু মৃত্যু  শোকে বলছিল “তারা সবকিছু নিয়ে গেছে”।

একজন মুসলিম বাসিন্দা জানান এখানে প্রায় ১০০ পরিবার ছিল যারা পাটক্ষেত দিয়ে পালিয়ে চলে গেছে।

একজন সাদা দাড়ি ওয়ালা মানুষের লাশ একটি পাতির উপর শোয়ানো আছে এবং সেটা দোচালা ঘরের নিচে রাখা ছিল। তার পিঠে গুলি লেগেছিল।

গ্রামবাসীরা জানান, ৫ ঘণ্টার যুদ্ধের এই ৩ লাশের পাশাপাশি আরও ৫/৬ জন মারা গেছেন।

আক্রমণ হচ্ছিল ঢাকার উত্তরে প্রায় ১ ঘণ্টার রাস্তা পেরিয়ে যেখানে চার ব্রিটিশ সাংসদদের পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি তদন্ত করতে এসেছিলেন – তারা শেষ দিনে ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন। এছাড়া একই সময়ে আরও জাহাজ এসেছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে গোলাবারুদ এবং স্পেয়ার্স বহন করে। এটি পশ্চিম পাকিস্তানের করাচির  দিকে যাচ্ছিল।

ঘেরাও করা শহরটি বিচারপতি বি কে সিদ্দিকীর বাড়ি, যিনি বাংলার প্রধান বিচারপতি যিনি মার্চ এর শুরু থেকে আইনি কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন এবং তিনি প্রদেশের নতুন সামরিক গভর্নর হিসেবে লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানকে শপথ করানো থেকে বিরত থাকেন।

মুসলমান গ্রামবাসী ও অনেক ছাত্র যারা ২৫ মার্চ থেকে ঢাকা থেকে পালিয়ে গেছে  তারা জানায় শুক্রবার থেকে আর্মি পেট্রোল ঢাকার আশেপাশে ৬ কিলোমিটারের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে টহল দিচ্ছে – অনেক সময় তারা নৌকায় করে আসছে।

ওইসব গ্রামের দিকে তাকালে সকাল থেকে গুলির শব্দ ও ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে।

গ্রামবাসীরা বিশ্বাস করে টাঙ্গাইলের  ২৪ মাইল উত্তরএ  ব্রহ্মপুত্র নদের উপর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কার্যকলাপ এর রিপোর্ট পেয়ে পাকসেনারা এগুলো শুরু করেছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৫৫। টিক্কা খানের পৈশাচিক রক্তস্নান নিউজউইক ২৮শে জুন, ১৯৭১

Ashik Uz Zaman

<১৪, ৫৫, ১১৯-১২১>

নিউজউইক, ২৮শে জুন, ১৯৭১

টিক্কা খানের পৈশাচিক রক্তস্নান

গত মার্চ মাসে পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই, প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ ইয়াহিয়া খান আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন বাঙালির স্বাধীনতার যুদ্ধকে দমাতে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যে নৃশংস আচরণ করছে তার খবর যেন বহির্বিশ্বের কাছে কিছুতেই পৌঁছতে না পারে। বেশীরভাগ বিদেশী সাংবাদিকদের পূর্ব পাকিস্তানে যেতে দেয়া হয়নি, এবং কেবলমাত্র যেসব পশ্চিম পাকিস্তানী সাংবাদিকদের কাছ থেকে “অনুকূল প্রতিবেদন” পাওয়ার আশা আছে শুধুমাত্র তাদেরকে আমন্ত্রন জানানো হয় পূর্ব পাকিস্তানে যেতে এবং তাদের দেশবাসীকে এই বিদ্রোহ সম্বন্ধে জানাতে। অন্তত একটি ক্ষেত্রে, অবশ্য, এই নীতি বিপর্যয় ঘটায়। অ্যান্থনি ম্যাস্কারেনাস, করাচীর একজন সাংবাদিক যিনি লন্ডনের সানডে টাইমসের জন্যও লেখেন, ঘটনাবলী প্রত্যক্ষ করে এতটাই আতঙ্কিত হয়ে পরেন যে তিনি এবং তার পরিবার পালিয়ে লন্ডন চলে আসেন পুরো প্রতিবেদন প্রকাশ করার জন্য। গত সপ্তাহে, টাইম্‌স পত্রিকায়, ম্যাস্কারেনাস লেখেন যে ঢাকার পাকিস্তানী সামরিক এবং বেসামরিক কতৃপক্ষ তাকে বারবার বলেছে যে সরকার চায় “পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিনতাবাদের সমস্ত হুমকি চিরতরে নিশ্চিহ্ন করতে, এর জন্য যদি ২০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করতে হয় তবুও”। এবং ম্যাস্কারেনাস উপসংহার টানেন যে রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনী “ঠিক তাই করছে পৈশাচিক পুঙ্খানুপুঙ্খতার সাথে”।

পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের রক্তে স্নান করছে তা দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করেছেন সাংবাদিক এবং অন্যান্য যারা ৬০ লক্ষ আতঙ্কিত শরণার্থীর যুদ্ধ চাক্ষুষ করেছেন প্রতিবেশী ভারতে। নিউজউইকের টনি ক্লিফটন সম্প্রতি ভারতের শরণার্থী-ভারাক্রান্ত সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেন এবং নিম্নোক্ত প্রতিবেদনটি তারবার্তার মাধ্যমে পাঠানঃ

যে কেউ পাকিস্তানের সাথে ভারতের সীমান্তবর্তী শরণার্থী শিবির এবং হাসপাতালগুলো পরিদর্শন করলে বিশ্বাস করতে শুরু করবে যে পাঞ্জাবী সেনাবাহিনী যেকোন ধরণের নিষ্ঠুরতায় সক্ষম, আমি শিশুদের দেখেছি যাদেরকে গুলি করা হয়েছে, আমি পুরুষদের দেখেছি চাবকিয়ে যাদের পিঠের চামড়া তুলে ফেলা হয়েছে। আমি দেখেছি মানুষদের যারা আক্ষরিক অর্থে আতঙ্কে বাকশক্তি হারিয়েছে চোখের সামনে নিজের সন্তানকে খুন হতে দেখে অথবা নিজের কন্যাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে দেখে যৌন দাসী হিসেবে। আমার কোনই সন্দেহ নেই যে পূর্ব পাকিস্তানে শত শত “মেই লাই” এবং “লিডিস”-এর মতো ঘটনা ঘটেছে এবং আমি মনে করি, আরো ঘটবে।

অন্য কিছুর চেয়েও আমার ব্যক্তিগত অনুভুতি হচ্ছে বিস্ময়ের। আমি এতবেশি লাশ দেখেছি যে আর কোন কিছুই আমাকে এরচেয়ে বেশি আতঙ্কিত করতে পারবে না। কিন্তু বারবার আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ভাবি, নিজেকে জিজ্ঞেস করি কিভাবে কোনো মানুষ নিজেকে দিয়ে এরকম উন্মত্ত খুনোখুনি করতে পারে।

গণহত্যা

 

লাল এবং সবুজ ফুলের ছাপা গোলাপি রঙের ছেঁড়া জামা পড়া একটি লাজুক ছোট্ট মেয়ের কাহিনীটি এক বিশেষ আতঙ্কের। তার দ্বারা কারো কোন বিপদ হওয়ার কথা নয়। তবুও আমার, তার সাথে দেখা হয় কৃষ্ণনগরের এক হাসপাতালে, অন্যান্য রোগীদের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে ঘাবড়ানো চেহারা নিয়ে, তার হাত দিয়ে ঘাড়ের দগদগে ক্ষত ঢেকে যেখানে একজন পাকিস্তানে সৈন্য বেয়োনেট দিয়ে তার গলা কেটে দিয়েছে। “আমি ইসমত আরা, মরহুম ইসহাক আলির মেয়ে” আমাকে তার আনুষ্ঠানিক পরিচয় জানায় সে। “আমার বাবা কুষ্টিয়ার একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। আনুমানিক দুই মাস আগে তিনি আমাদের বাড়ি থেকে বের হন এবং উনার দোকানে যান এবং এরপর উনাকে আমি আর দেখিনি। ঐ একই রাতে, আমি বিছানায় যাবার পর, আমি ধমক এবং চিৎকার শুনতে পাই, এবং আমি যখন দেখতে যাই যে কি হচ্ছে, ঐখানে পাঞ্জাবী সেনারা ছিলো”।

“আমার চার বোন মরে পড়েছিল মেঝেতে, এবং আমি দেখি যে ওরা আমার মাকে মেরে ফেলেছে। আমি যখন ওখানে যাই ওরা আমার ভাইকে গুলি করে – সে বিজ্ঞানে স্নাতক ছিল। তখন এক সৈন্য আমাকে দেখে ফেলে এবং আমাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করে। আমি মেঝেতে পড়ে যাই এবং মৃতের ভান করে থাকি। সৈন্যরা যখন চলে যায় আমি পালিয়ে আসি, এবং একজন আমাকে তার সাইকেলে তুলে নেয় এবং আমাকে এখানে নিয়ে আসা হয়”।

হঠাৎ করে, যেন সে আর তার অগ্নিপরীক্ষার অভিজ্ঞতার কথা আর ভাবতে পারছিল না, মেয়েটি ঘর ছেড়ে বের হয়ে যায়। হাসপাতালের চিকিৎসক আমাকে ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন যে যখন মেয়েটিকে হাসপাতালে আনা হয় তখন সে নিজের রক্তেই গোসল হয়ে ছিল, যখন সে অন্য রোগীদের ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসে এবং সরাসরি আমার সামনে এসে দাড়ায়। “আমি এখন কি করবো?” সে জানতে চায়। “একসময় আমার পাঁচ বোন এবং এক ভাই এবং বাবা এবং মা ছিল। এখন আমার কেউ নেই। আমি এতিম। আমি কোথায় যেতে পারি? আমার কি হবে এখন?”।

ঘটনার শিকার

“তোমার কিছু হবে না” আমি বলি, বোকার মতো। “এখানে তুমি নিরাপদ”। কিন্তু ওর এবং ওর মতো হাজার হাজার বালক এবং বালিকা এবং পুরুষ এবং নারীর ভাগ্যে কি আছে যারা তাদের প্রজ্জলিত গ্রাম থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে যে আগুনের শিখায় প্রতি রাতে পূর্ব পাকিস্তানের আকাশ আমি আলোকিত হয়ে উঠতে দেখি? ত্রিপুরার রাজধানী, আগরতলার হাসপাতাল, সীমান্ত থেকে মাত্র আধা মাইল দূরে, এবং সেটি ইতোমধ্যেই উপচে পড়ছে হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর শিকার দিয়ে। এখানে ৪ বছর বয়সী এক বালক আছে যে পেটের ভেতর বুলেট নিয়েও বেঁচে গেছে এবং এক নারী আছেন যিনি আনমনে বর্ণনা করেন কিভাবে সৈন্যরা তার চোখের সামনে তার দুই বাচ্চাকে হত্যা করে, এবং এরপর তাকে গুলি করে যখন সে তার সবচেয়ে ছোট শিশুটিকে কোলে নিয়ে ছিলো। “গুলিগুলো বাচ্চার পেছন দিয়ে ঢোকে এবং এরপর তাঁর বাম বাহু ভেদ করে যায়”, ডাঃ আর. দত্ত, হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক, ব্যাখ্যা করেন “কিন্তু পরে তাঁর জ্ঞ্যান ফিরে আসে এবং তিনি এবং তাঁর বাচ্চাকে নিয়ে সীমান্তে চলে আসেন”। অন্য এক নারী, যার পায়ের উপরের দিকের হাড় গুলিতে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, এক নবজাত শিশুকে কোলে নিয়ে আছেন। গুলিতে আহত হওয়ার পর তিনি এক ধান ক্ষেতে প্রসব করেন সময়ের আগেই। তারপরেও, একহাতে নবজাতক শিশুটিকে আঁকড়ে ধরে এবং অন্যহাতে নিজেকে টেনেহিঁচড়ে, শেষপর্যন্ত তিনি সীমান্তে এসে পৌঁছান। “যদিও আমি এই মানুষগুলোকে চিনি, তারপরেও আমি অবিরতভাবে হতবাক হয়ে ভাবি এরা কতটা কষ্টসহিষ্ণু”, মিঃ দত্ত বলেন। তারপরেও, কেউ কেউ আছে যারা পেরে ওঠে না। আমি মাড়িয়ে এসেছি দুটি, ছোট বালকের উপর দিয়ে যারা মেঝেতে শুয়ে ছিল, বানরের মতো একে অপরকে আঁকড়ে ধরে; “শরণার্থীরা বলে আনুমানিক এক সপ্তাহ আগে ওদের গ্রামটি পুড়িয়ে দেয়া হয় এবং এই দুইজন ছাড়া আর সবাই মারা যায়”, চিকিৎসকরা জানান। “তিনদিন ধরে ওরা এখানে আছে এবং আমরা ওদের পরিচয় জানিনা। ওরা এতই আতঙ্কিত হয়েছে ঐ দৃশ্য দেখে যে ওরা বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। ওরা একে অপরকে আঁকড়ে ধরে ওখানে শুয়ে থাকে। ওদেরকে খাওয়ানোর জন্য কিছু সময়ের জন্যও আলাদা করা প্রায় অসম্ভব। এটা বলা খুবই কঠিন যে কখন ওরা বাকশক্তি ফিরে পাবে কিংবা স্বাভাবিক জীবনে আবার ফিরে যেতে পারবে”।

নিউ জার্সির কংগ্রেসম্যান কর্নেলিয়াস গ্যালাহার, যিনি আগরতলা হাসপাতাল পরিদর্শন করেন, বলেন যে তিনি ভারতে এসেছিলেন এই ভেবে যে নিষ্ঠুরতার কাহিনীগুলো অতিরঞ্জিত। কিন্তু তিনি যখন সত্যি সত্যি আহতদের দেখেন তখন বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে, আর যাইহোক, প্রতিবেদনগুলো অনেক হালকাভাবে করা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জেনারেল প্যাটনের সাথে ইউরোপে অনেক পদকপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী, গ্যালাহার আমাকে বলেনঃ “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, আমি ফ্রান্সের নিকৃষ্টতম এলাকা দেখেছি, নরম্যান্ডির বধ্যভূমি দেখেছি, কিন্তু আমি কখনই এরকম কিছু দেখিনি। আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে আমাকে চেষ্টা করতে হয়েছে কান্নায় ভেঙে পড়া থেকে বিরত থাকতে”।

ধর্ষণ

অন্য বিদেশিরাও, প্রথমে এইসব নিষ্ঠুরতার কথায় সন্দেহ পোষণ করতেন, কিন্তু বিভিন্ন উৎস থেকে একই কাহিনীর অন্তহীন পুনরাবৃত্তি তাদেরকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করে। “আমি নিশ্চিত যে সৈনিকেরা বাচ্চাদের বাতাসে ছুঁড়ে দেয় এবং বেয়োনেট দিয়ে গেঁথে নেয়”, যুক্তরাজ্যের নাগরিক জন হেসটিংস বলেন, যিনি একজন মেথোডিষ্ট মিশনারি হিসেবে বিশ বছর বাঙলায় ছিলেন। “আমি নিশ্চিত যে সৈনিকেরা মেয়েদেরকে বারংবার ধর্ষণ করেছে, এরপর দুই পায়ের ফাঁকে বেয়োনেট ঢুকিয়ে তাদেরকে হত্যা করেছে”।

এইসব নিষ্ঠুরতা এই ইংগিত দেয় যে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী হয় রক্ত-লিপ্সায় উন্মাদ হয়ে গেছে অথবা, এর সম্ভাব্যতাই বেশি, যে পুরো বাঙালী জনগোষ্ঠীর উপর পূর্ব পরিকল্পিত সন্ত্রাসের নীতি কার্যকর করছে যা কিনা গণহত্যায় রূপ নিচ্ছে। এর স্থপতি বলে মনে হচ্ছে লেঃ জেনারেল টিক্কা খান কে, পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক। অনুমান করা হয়, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট কিছুটা জানেন কি ঘটছে, কিন্তু তিনি হয়তো ধারণাও করতে পারেন না যে বাচ্চাদেরকে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, মেয়েদেরকে কার্যত দাসী হিসেবে বিক্রি করা হচ্ছে এবং পুরো পরিবারকে একসাথে হত্যা করা হচ্ছে। তিনি সামরিক বাহিনীকে বলেন বিদ্রোহ দমন করতে, এবং টিক্কা খান সেটা করেছে, কার্যকর এবং দয়ামায়াহীন ভাবে। ফলশ্রুতিতে, পূর্ব পাকিস্তান এখনও পাকিস্তানের একটি নামমাত্র অংশ। কিন্তু গত তিন মাসে পশ্চিম অংশ পূর্ব অংশের উপর যে পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছে তাতে এটাই নিশ্চিত হয়েছে যে পাকিস্তান ভেঙে দুটি আলাদা দেশ হওয়া এখন সময়ের ব্যপার মাত্র। এবং এই দেশ দুটি অমোঘভাবে বিচ্ছিন্ন থাকবে – অন্তত ততদিন পর্যন্ত যতদিন না আজকের বিকলাঙ্গ এবং নির্যাতিত শিশুরা বুড়ো হবে এবং মারা যাবে তাদের স্মৃতিসমেত যে কি ঘটেছিল যখন ইয়াহিয়া খান তাদের দেশরক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৫৬। মার্কিন সরকার পাকিস্তানে সাহায্যদান অব্যাহত রাখবে নিউইয়র্ক টাইমস ২৯ জুন, ১৯৭১

Zulkar Nain

<১৪, ৫৬, ১২২১২৩>

নিউইয়র্ক টাইমস, মঙ্গলবার, ২৯ জুন, ১৯৭১

অন্যান্য জাতি কতৃক আহ্বান জানানো সত্ত্বেও মার্কিন সরকার পাকিস্তানে সাহায্যদান অব্যাহত রাখবে

টেড শ্যুল (নিউইয়র্ক টাইমসের বিশেষ বার্তা)

ওয়াশিংটন, জুন ২৮ – নিক্সন প্রশাসন আজ পুনর্ব্যক্ত করেন, বিদেশী সহায়তা বন্ধে আন্তর্জাতিক চাপ থাকা সত্ত্বেও যতদিন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় না পৌঁছাবে ততদিন পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদান করা হবে।

এগারোটি জাতি নিয়ে গঠিত পাকিস্তান সাহায্য সংঘের অধিকাংশই মনে করেন সহায়তা (যা প্রায় বছরে ৫00 মিলিয়ন ডলার) বন্ধ করলে যে সংকটের কারণে আনুমানিক ২০০,০০০ পূর্ব পাকিস্তানিদের মৃত্যু হয় এবং প্রায় ছয় মিলিয়ন উদ্বাস্তু ভারতে পালিয়ে যায় সেই সংকটের একটা রাজনৈতিক সুরাহা হবে।

পাকিস্তানকে সহায়তায় সমন্বয়কারী বিশ্বব্যাংক পরবর্তি সাহায্যের বিরুদ্ধে সুপারিশ করেছে। সংঘের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে ব্রিটেন. কানাডা এবং বেলজিয়াম অনুরূপ অবস্থান নিয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের পাকিস্তান সফরের প্রতিবেদন গ্রহন করার জন্য গত সোমবারে প্যারিসে সহয়তা সংঘের এক অনানুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, সেখানেই তাদের অবস্থান পরিষ্কার হয়। গত বৃহস্পতিবার ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট এস ম্যাকান্মারাকে এই নীতি অনুমোদন করতে বলা হয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্র প্যারিসে যা বলেছিল, প্রশাসনের কর্মকর্তারা আজ সিনেট শুনানিতে সেটা জানিয়েছেন, আর সেটা হলো একটি রাজনৈতিক চাপের হাতিয়ার হিসেবে পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্যের নীতিতে যুক্তরাষ্ট্র অসমর্থন জানিয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি আজ এখানে পুনর্ব্যক্ত হলো।

সিনেট বিচারপতিগণের উপকমিটির সামনে উদ্বাস্তুদের ব্যাপারে আজ সাক্ষ্য দেওয়ার সময়, পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক উপসহকারী রাষ্ট্রসচিব ক্রিস্টোফার ভ্যান হোলেন বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কতৃক পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহয়তা প্রদানের উদ্দেশ্য হলো স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে “রাজনৈতিক সমঝোতা” তৈরি করা এবং শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন করার মত পরিবেশ সৃষ্টি করা।

যাহোক, চুক্তিতে স্বীকার করা হয়েছে, এধরনের উদ্দেশ্য তখন পর্যন্ত পরিমাপযোগ্য ছিল না এবং কিছু শরনার্থী দেশে ফিরে এসেছে।

এছাড়াও মিঃ ভ্যান হোলেন ঘোষণা করেন যে, পাকিস্তানে সামরিক সরঞ্জাম চালানে একটি পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা স্থাপনের ব্যাপারে প্রশাসনের কোন পরিকল্পনা ছিল না।

ম্যাসাচুসেটস ডেমোক্র্যাট সিনেটর এডওয়ার্ড এম কেনেডির নেতৃত্বে তিনি উপকমিটিকে বলেন যে, ” পাকিস্তানে সম্ভবত অতিরিক্ত সামরিক সরঞ্জাম পাঠানো হবে”

তিনি বুঝিয়ে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধবিগ্রহ প্রাদুর্ভাবের পর গত ২৪শে মার্চ প্রশাসন তার চার বছর মেয়াদী ঋণ ও নগদ বিক্রয় কর্মসূচির আওতাধীন সামরিক সরঞ্জামের রপ্তানি লাইসেন্স মঞ্জুর স্থগিত করেছিল, সেই তারিখের আগে দেওয়া অনুমতি প্রত্যাহার করা হবে না।

যাহোক, অন্যান্য প্রশাসন সূত্র প্রতিবেদন করেছিল, রাষ্ট্রবিভাগ সকল চালানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা সত্ত্বেও কমপক্ষে তিনটি পাকিস্তানী জাহাজে নিউইয়র্ক থেকে করাচীতে সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে যাওয়ার ঘটনা খবরের কাগজ প্রকাশ হাওয়ার পর গত সপ্তাহে এই সিদ্ধান্ত জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ কতৃক প্রণীত হয়।

কেনেডি প্রতিবাদ

পরবর্তীতে রাষ্ট্রবিভাগ একটি সংশোধন জারি করে জানায়, মার্চের পূর্বে পাকিস্তান কতৃক ক্রয়কৃত সরঞ্জাম চালানের উপর এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি। সিনেটর কেনেডির জিজ্ঞাসাবাদে মিঃ ভ্যান হোলেন স্বীকার করেন যে, এবিষয়ে পররাষ্ট্র দপ্তরের পূর্বের প্রকাশ্য বিবৃতি “গোলমেলে” এবং “বিভ্রান্তিকর”।

দিনের শেষে, রাষ্ট্রবিভাগের কর্মকর্তারা প্রতিবেদনে নিশ্চিত করেন, আজ নিউইয়র্কে থাকা পাকিস্তানি জাহাজ কাপ্তাই ২রা জুলাই করাচীর উদ্দেশ্যে গমন করবে, “সম্ভবত যুদ্ধোপকরণ নিয়ন্ত্রণ তালিকায় থাকা সরঞ্জাম সঙ্গে নিয়ে”, এবং অন্য চার-পাঁচটা জাহাজ অনুরূপ পন্য নিয়ে আগস্ট মাসের মাঝামাঝি রওনা হবে।

শেষ বিকেলের দিকে এই তথ্য সিনেটর কেনেডিকে নতুন চালানের প্রতিবাদে পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোসেফ জে সিস্কোকে টেলিফোন করতে প্ররোচিত করে।

তারপর এক বিবৃতিতে জনাব কেনেডি অভিযোগ করেন, আজ সকালে তার উপকমিটির সামনে শুনানিতে পাকিস্তানে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করার ক্ষেত্রে প্রশাসনের নীতি “বিভ্রান্তিকর এবং পরস্পরবিরোধী” হিসাবে ইঙ্গিত করা হয়।

তিনি বলেন, “আমার এবং কংগ্রেসের অন্যদের মধ্যকার বোঝাপড়া অমান্য করতে, আমাদের সরকার অবাধে পাকিস্তানে গত দুই মাস ধরে অন্ততপক্ষে তিনটি সামরিক সরঞ্জাম চালান সহ্য করেছে”।

“আজ, শুনানির পর, আমরা জানতে পারি যে, এখনো কাপ্তাই নামে অন্য একটি জাহাজ পাকিস্তানের জন্য অধিক সামরিক দ্রব্যাদি দিয়ে বোঝাই হওয়ার জন্য নিউইয়র্কে ভিড়েছে এবং ধারণা করা হচ্ছে আগামী সপ্তাহের মধ্যে আরো চার-পাঁচটা জাহাজ সেখানে বোঝাই হবে।

“আমি প্রশাসনকে পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠানো নীতি বন্ধ করতে বলেছি”।

উপকমিটির শুনানিতে, জনাব ভন হোলেন পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদান চালিয়ে যাওয়া এবং সামরিকক্ষেত্রে রপ্তানি লাইসেন্সের বৈধতা বজায় রাখার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন, সেটা এইজন্যে যে এর অন্যথা করা হয়তো পূর্ব পাকিস্তানের “আত্মবিরোধ” সময়কালে “এটাকে অনুমোদন এবং অভ্যন্তরীণ সমস্যায় অনুপ্রবেশ হিসাবে দেখা হবে”।

তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে “প্রাণঘাতী নয় এমন” সামরিক জিনিস বিক্রি করা অব্যাহত রাখছে যাতে করে প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান কমিউনিস্ট চীনের মত অন্যকোন উৎসের দিকে ফিরে না তাকায়।

তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন, যে চীন এযাবতকাল ধরে পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ করে আসছিল।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৫৭। পাকিস্তানকে সাহায্য দেওয়া কেন? নিউইয়র্ক টাইমস ৩০ জুন, ১৯৭১

Zulkar Nain

<১৪, ৫৭, ১২৪-১২৫>

নিউইয়র্ক টাইমস, বুধবার, ৩০ জুন, ১৯৭১

পাকিস্তানকে সাহায্য দেওয়া কেন?”

মাসব্যাপী বাকচাতুরী ও ছলাকলা শেষে, রাষ্ট্রবিভাগ পরিশেষে এটা স্পষ্ট করে, পূর্ব পাকিস্তানে নিপীড়ন চালিয়ে বিশ্বকে মর্মাহত করা সত্ত্বেও প্রশাসন পাকিস্তান সরকারকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা চালিয়ে যেতে ইচ্ছুক। এই অবিশ্বাস্য নীতিগত সিদ্ধান্ত বোধশক্তিকে উপেক্ষা করে।

পূর্বের ন্যায় (পাকিস্তানকে) সাহায্য প্রদান অব্যাহত রাখার ব্যাপারে স্বীকারোক্তি দেশে-বিদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করছে। জনগন, কংগ্রেসের সদস্যবৃন্দ এবং অন্ততপক্ষে একটি আগ্রহী বিদেশী সরকার (ভারত) বিশ্বাস করে (অবশ্য সবসময় চতুরতার সাথে) যে সকল প্রকার সামরিক সহায়তা এবং পাকিস্তানের জন্য কোনো নতুন উন্নয়ন সহায়তা স্থগিত রাখা উচিত যতক্ষন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধানের দিকে প্রগতি না আসে। এই প্রতারণার প্রকাশ বিশেষ করে ভারতের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্থ করবে, এছাড়াও কিছুদিন আগে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াশিংটন ত্যাগ করার পূর্বে পাকিস্তানের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নিয়ে তার যে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল সেটা এখন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নিন্দিত হয়েছে।

অর্থনৈতিক সাহায্য চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বব্যাংক ও এগারো জাতির সমন্বয়ে গঠিত পাকিস্তান সাহায্য সংঘের প্রকাশ্য অবাধ্যতায় ফেলে দিয়েছে, যা বর্তমানে ইসলামাবাদে নতুন সাহায্য প্রদানের অঙ্গীকার করা থেকে বিরত থাকার জন্য অনানুষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিক্সন প্রশাসন অতীতে বারবার নির্দেশ দিয়েছে, পাকিস্তানের সম্মানার্থে একতরফা কোন সিদ্ধান্ত এড়িয়ে চলার জন্য তার নীতি হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কতৃক বেশি বেশি সাহায্য আন্তর্জাতিক বরাত দিয়ে পাঠানো।

প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন তাঁদের সাহচর্য সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার কারণ এটাকে একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার শামিল।  কিন্তু একই সময়ে তারা যুক্তি দেখান যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কতৃক পূর্বাঞ্চলে একটা রাজনৈতিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য চালিয়ে যেতে হবে। দুইভাবে এটা তারা করতে পারবে না।

আমেরিকা কতৃক চিরস্থায়ী সাহায্য সত্যিকার অর্থে পাকিস্তানে সামরিক শাসন প্ররোচিত প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে কোন কাজে আসবেনা যেমনটা এথেন্স জান্তার জন্য আমেরিকার অবিরাম সমর্থন গ্রীসের জনগনকে গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে সাহায্য করেছিল। তবে এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নিপীড়ন করার স্বাক্ষরিত নীতির অসমর্থনযোগ্য অবস্থানে ফেলে দিবে যার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের হাজার হাজার বাঙালি নির্মম ও অবিরাম গণহত্যার শিকার হয়েছে। ইতোমধ্যে এই নীতিগুলো ছয় মিলিয়ন পূর্ব পাকিস্তানিদের ভারতে নির্বাসিত করেছে যেখানে তাদের উপস্থিতি মারাত্মক রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও গার্হস্থ্য এবং এমনকি আন্তর্জাতিক সংঘাতের একটি ক্রমবর্ধমান হুমকি সৃষ্টি করছে।

রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়ার বেসামরিক শাসন পুনরুদ্ধারের সাম্প্রতিক প্রস্তাব উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের জন্য সামান্য আশা জাগাচ্ছে, যেহেতু তারা নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামীলীগ দলকে বহিষ্কার করছে, যে দল অতীতে পাকিস্তানে অপ্রতিরোধ্য সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয় লাভ করেছে এবং গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে অপরিবর্তিত জাতীয় বৈঠকে চরম সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে। এরকম পরিস্থিতিতে, কেউ এটা পারতেন? পাকিস্তানকে অতিরিক্ত সামরিক বা উন্নয়নমূলক সাহায্য ভারতীয় উপমহাদেশে শান্তিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক উন্নয়নে তার দেশের রাষ্ট্রীয় স্বার্থে নৈতিকভাবে কিভাবে সমর্থনযোগ্য হতে পারে সেটা ওয়াশিংটন ব্যাখ্যা করেছে?

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৫৮। বাঙালী নিধনে সাহায্য ওয়াশিংটন ডেইলী নিউজ ৩০ জুন, ১৯৭১

 

Zulkar Nain

<১৪, ৫৮, ১২৬>

ওয়াশিংটন ডেইলী নিউজ, বুধবার, ৩০ জুন, ১৯৭১

বাঙালী নিধনে সাহায্য

প্রশাসন কতৃক পাকিস্তানের নৃশংস ও নিপীড়ক শাসকদের আরো অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত যেমন অদূরদর্শী তেমনি এটা অমানবিকও।

কংগ্রেসের সামনে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় রাষ্ট্রবিভাগ তার ভয় স্বীকার করে যে পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করা “অনুমোদন এবং অনুপ্রবেশ” হিসাবে ক্ষতিকর হবে।

আমরা জানতে চাই, গণহত্যা ও গণহত্যা বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা কতটা খারাপ? সঠিকভাবে বললে, পশ্চিম পাকিস্তান অধ্যুষিত সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের অসহায় বাঙালিদের বিরুদ্ধে যা করছে সে জন্য।

২৫শে মার্চে প্রতারণাপূর্ন আক্রমণের শুরুতেই, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ২00,000 বাঙালি হত্যা করে এবং ছয় মিলিয়ন উদ্বাস্তুকে জীবন বাঁচাতে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। এমন একটি শাসনব্যবস্থায় অস্ত্র পাঠানো নৈতিকভাবে অসমর্থনযোগ্য।

অসমর্থনীয়কে সমর্থনযোগ্য করার প্রতিভা দিয়ে রাষ্ট্রবিভাগ ব্যাখ্যা করে কিভাবে অর্থনৈতিক সাহায্যে বিঘ্নতি পাকিস্তানে আমাদের উদ্দেশ্যসাধন বাধাগ্রস্থ করবে – যদিও বলতে গেলে এখন আমাদের কোন উদ্দেশ্য নেই।

এছাড়া, আমাদের অস্ত্র চালান বন্ধ করলে পাকিস্তান কমিউনিস্ট চীনের মত অন্যান্য সরবরাহকারীদের মুখাপেক্ষী হবে। তবে (রাষ্ট্র) বিভাগ স্বীকার করে যে, চীন পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করা কখনো বন্ধ করেনি।

ম্যাসাচুসেটসের সিনেটর এডওয়ার্ড এম কেনেডি এগুলোকে “অস্পষ্ট, অযোগ্যতা অথবা উভয়ই” বলে আখ্যায়িত করেছেন – এবং সে ঠিকই বলেছে।

পাকিস্তানের অর্থনীতি ধ্বস প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টায় আমাদের অংশীদাররা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত ভীতু নয়। বিশ্বব্যাংক, ব্রিটেন, কানাডা।

পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক শাসকদের একটা রাজনৈতিক মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত বেলজিয়াম এবং অন্যান্যরা অর্থনৈতিক সাহায্য স্থগিত রাখবার পক্ষে।

কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (এর পক্ষে) নয়।

পাকিস্তান অবশ্যই নিদারুণভাবে দরিদ্র এবং পাওয়া সাহায্যের সবটুকু তারা ব্যবহার করতে পারে কিন্তু এখন সাহায্য করার সমস্যা হলো, এটি সরকার কতৃক সৈন্যবাহিনীকে পূর্ব পাকিস্তানের দখলে নিয়োজিত রাখতে সাহায্য করে।

পাকিস্তানের ইতিহাসে, পূর্বাঞ্চলের বাঙালিরা মুক্ত নির্বাচনে শুধুমাত্র স্বায়ত্তশাসনের জন্য সিংহভাগ ভোট দিয়েছে। পরিবর্তে তারা পশ্চিমা সেনাবাহিনী কতৃক গণহত্যার লাঞ্ছনা পোহাচ্ছে, লজ্জাজনকভাবে যা এখনো চলছে।

ইতিহাস বলে, ১000 মাইল দূরে থাকা পশ্চিম পাকিস্তানিরা চিরকাল বাঙালিদের পদানত করতে পারবে না। পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠিয়ে আমরা যা করছি তাতে বাঙালি নিশ্চিতভাবেই মনে রাখবে, তাদের প্রিয় বাংলাদেশের (বাঙালি জাতি) প্রসববেদনাকালীন সময়ে আমেরিকার অস্ত্র দিয়ে তাদেরকে হত্যা করা হয়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৫৯। পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি নিউইয়র্ক টাইমস ৩০শে জুন, ১৯৭১

 

Zulkar Nain

<১৪, ৫৯, ১২৭-১২৯>

দ্যা নিউইয়র্ক টাইমস, বুধবার, ৩০শে জুন, ১৯৭১

পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি বিপুল ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত

সিডনী এইচ. শনবার্গ

ঢাকা, পাকিস্তান, ২৬শে জুন – পুর্ব পাকিস্তান অংশে খাদ্য ঘাটতি প্রকট আকার ধারণ করেছে, গ্রামাঞ্চলে নগদ টাকার পরিমাণ কমে গেছে, পাটকল বিকল হয়ে গেছে, এবং গেরিলারা প্রতিনিয়ত প্রধান রাস্তা এবং রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করছে।

তা সত্ত্বেও, অধিকাংশ বিদেশী অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন, বাঙালি স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন দমন করার সময় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া পূর্বাঞ্চল দখলে সেনাবাহিনীকে সমর্থন দেওয়ার জন্য নিদারুণ অর্থনৈতিক মূল্য দিতে সরকার ইচ্ছুক, অন্ততপক্ষে তাৎক্ষণিক ভবিষ্যতের জন্য হলেও।

জ্ঞাত বিদেশী সূত্র রিপোর্ট দেয় যে তাদের ভ্রমণে কিছু এলাকায় খাদ্য ঘাটতি উঠে এসেছে যা মারাত্মক অবস্থায় পৌঁছাতে পারে যদি না বিঘ্নিত পরিবহন ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধিত হয়।

একটা সমস্যাঘটিত এলাকা হলো উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল, সাধারণত এটা একটি চাল উদ্বৃত্ত অঞ্চল যেখান থেকে প্রতিবেশী জেলায় সরবরাহ করা হয়।

বিদেশী অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, কিছু কৃষক ছাড়া উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল নির্জন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যারা ২৫শে মার্চ থেকে বাঙালিদের দমন করার চেষ্টা করছে, বেশিরভাগ তাদের হাত থেকে বাচতে ভারতে পালিয়েছে।

ধ্বংস, লুটপাট, অপসারণ

বৈদেশিক সূত্র জানায়, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে মজুদ খাদ্য লুটপাট, ধ্বংস করা হয়েছে, অথবা দেশের বাইরে পাচার করা হয়েছে। পরিস্থিতি অনাহার পর্যায়ে পৌঁছায়নি, তারা আরও বলেন, কিন্তু মানুষের খাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত খাবার নেই, এবং দুই বা তিন মাসের মধ্যে খাদ্য সমস্যা দেখা দিবে।

একজন অর্থনীতিবিদ বলেন, এই মুহূর্তে সেখানে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা সবথেকে বেশি তারপর মৃত মানুষের সংখ্যা।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, সমগ্র পুর্ব পাকিস্তানের জন্য দুই মাসের খাদ্যশস্য মজুত ছিল এবং সমস্যা হলো খাদ্য ঘাটতি অঞ্চলগুলোতে এগুলো বিতরণ করা।

চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা রেলপথ, যেটা পুর্ব পাকিস্তানের প্রধান বন্দর, এখনো বিচ্ছিন্ন এবং জানা যাচ্ছে এসব অঞ্চলে গেলিরা তাণ্ডব এখনো চলমান। স্বাভাবিক অবস্থায় এই পথে পূর্ব পাকিস্তানের আমাদানিকৃত খাদ্যশস্যের ৭০ শতাংশ আসে। রাস্তার প্রধান সেতুগুলো উড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

অঞ্চলের স্বাভাবিক চাল ঘাটতি বছরে প্রায় দুই লাখ টন: এই বছর এটা সম্ভবত প্রায় তিন মিলিয়ন হবে।

ঘাটের শ্রমিকরা আবদ্ধ

পরিবহণ বিশৃঙ্খলা ছাড়াও, শ্রম স্বল্পতা এবং গুদামঘরে জায়গার অভাবে বিভিন্ন বন্দর, যেমন চট্টগ্রাম এবং চালনা, ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কারণ বেশিরভাগ শ্রমিক দেশের অভ্যন্তরে অথবা ভারতে পালিয়েছে।

বন্দরে অত্যধিক ভিড়ের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাময়িকভাবে তাদের চালান স্থগিত করেছে যারা সাধারণত প্রতিবছর পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় এক মিলিয়ন টনের মত খাদ্য সরবরাহ করে।

অন্য প্রধান খাদ্য-দুষ্প্রাপ্য এলাকা হলো বঙ্গোপসাগরের বদ্বীপ অঞ্চল যেটা গত নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত হয়েছিল যাতে কয়েকশত হাজার লোক নিহত হয় এবং অধিকাংশ ধানের ফসল ধ্বংস হয়। দ্বীপ ও উপকূলবর্তী অঞ্চলে খাদ্যমজুদ কম হলেও অবস্থা যতটা ভাবা হচ্ছিল ততটা আশঙ্কা মূলক নয় কারণ কিছু ত্রাণ খাদ্য বিতরণ করা হয়েছে।

যাহোক, বৈদেশিক সূত্র জানায়, যদি বিতরণ ব্যবস্থার উন্নতি নাহয় তাহলে এই অঞ্চল একটি দুর্ভিক্ষ এলাকায় পরিণত হতে পারে।

সূত্র জানায়, গাঙ্গেয় বদ্বীপের খুলনা জেলাতেও একটা খাদ্য সমস্যা দেখা দিয়েছে কারণ অনেক হিন্দু কৃষক ও খামার শ্রমিক পালিয়ে গেছে। হিন্দু সংখ্যালঘুরা সেনাবাহিনীর প্রধান লক্ষ্য যাদেরকে তারা ভারতের এজেন্ট এবং এই মোসলেম জাতির শক্তি মনে করে।

ছয়লক্ষ বাঙালি যারা ভারতে পালিয়ে গেছে তাদের দেশ ত্যাগের দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব আরেকটি অজানা বিষয়। তাদের প্রস্থান খাদ্য ও কলকারখানার উৎপাদন কমিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি খরচও কমিয়ে দিয়েছে।

এমনকি এলাকায় যেখানে কারণবশত ধানের সরবরাহ ভালো, সেখানে নগদ অর্থ স্বল্প এবং অনেক গ্রামবাসীর কেনার যথেষ্ট সামর্থ্য নেই, এমনকি পলাতক হিন্দু কৃষকরা কম দামে বিক্রি করলেও না।

এই অর্থ অভাবের প্রধান কারণ সরকারের গ্রামীণ গণপূর্ত কর্মসূচি প্রায় স্থগিত করা হয়েছে। শ্রমিকরা যারা সড়ক নির্মাণ, সেচ খাল ও খানা খনন করে প্রতিদিন ৬০ সেন্ট করে আয় করত তারা এখন বেকার।

সকল উন্নয়ন কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারি কৃষি প্রযুক্তিবিদরা এবং বেসরকারি সেচ-খাল ঠিকাদাররা অভ্যন্তরে ঢুকতে ভয় পাচ্ছে। ঢাকা অফিসে বিদেশী পরামর্শদাতারা এবং প্রকৌশলীরা তাদের সময় নষ্ট করছে। সরকারি অফিসগুলো খোলা থাকলেও কর্মকর্তা নাই এবং কোন কর্ম-পরিকল্পনা করছেনা তারা।

পাট কারখানাগুলো পূর্বের তুলনায় খুব কম চলছে। পূর্বাঞ্চলের পাট জাতীয় অর্থনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন এবং পাকিস্তানের সবথেকে বড় রপ্তানি এবং বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী শিল্প।

সম্প্রতি পূর্ব পাকিস্তান ঘুরতে এসে এরকম অর্থনৈতিক চিত্র দেখতে পেয়েছে বিশ্ব ব্যাংকের দল যারা পূর্ণমাত্রায় সাহায্য করার পূর্ব শর্ত হিসাবে শান্তি ও স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা সম্পর্কে জানতে এসেছিল।

বিদেশী অর্থনীতিবিদরা মর্মাহত এবং ম্রিয়মাণ হয়ে বর্ণনা করেছেন যে, দলটিকে সুপারিশ করা হয়েছিল যাতে একটা বৈধ রাজনৈতিক সমাধান এবং মার্শাল-ল সরকার দ্বারা একটি বাস্তবসম্মত উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত যেন সাহায্য বন্ধ রাখা হয়।

এগারোটি জাতির সাথে বিশ্ব ব্যাংকের যোগসূত্র আছে যারা প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার সরবরাহ করে প্রতিবছর যার উপর পাকিস্তান ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। এই সাহচর্যের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই সাহায্যের অধিকাংশ তথা প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলারের ব্যবস্থা করে।

বিদেশী সাহায্য ছাড়া কতক্ষণ পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনী কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে সেটা এখানে বিদেশী সম্প্রদায়ের কাছে ব্যাপক আলোচনার বিষয়।

বিদেশী মুদ্রার সঞ্চয় কম হলেও অবস্থা যতটা খারাপ ভাবা হয়েছিল ততটা খারাপ না। বিশাল আন্তর্জাতিক ঋণ প্রদান স্থগিত রাখার ব্যাপারে পাকিস্তানের একতরফা ঘোষণা এর একটি কারণ। আরেকটি দিক হচ্ছে, যুদ্ধ শুরু হওয়াতে কোন আমদানিই পুর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করেনি, তাই সরকার বৈদেশিক মুদ্রা জমিয়েছেন। সর্বশেষ কারণ, সমস্যা শুরু হওয়ার আগেই কাকতালীয়ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানে উৎপাদনের জন্য কাঁচামালের উদ্ভাবন প্রচুর বেড়েছে।

সংক্ষেপে, বিদেশী অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থান একেবারে শেষ পর্যায়ে হলেও এটা মোটেই পুর্ব দখল অগত্যা শেষ হওয়ার পূর্বলক্ষণ নয়।

————————————————————————

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৬০। একটি বিদেশি সৈন্য বাহিনীর কতৃক আরাপ

 

নিউইয়র্ক টাইমস জুলাই ৪, ১৯৭১

 

 

Zulkar Nain

<১৪, ৬০, ১৩০১৩২>

 

নিউইয়র্ক টাইমস, সোমবার, জুলাই ৪, ১৯৭১

একটি বিদেশি সৈন্য বাহিনীর কতৃক আরাপ

সিডনি এইচ. শনবার্গ

ঢাকা – বহুবছর ধরে পূর্ব পাকিস্তানে আছেন এমন একজন বিদেশি জিজ্ঞেস করলেন “বিশ্ববাসী কি এখনো বুঝতে পারছেনা যে তারা (পশ্চিম পাকিস্তানিরা) কসাই ছাড়া কিছু নয়? তারা বাঙালিদের হত্যা করেছে এবং করেই চলেছে শুধুমাত্র ভয় দেখিয়ে তাদের দাস বানিয়ে রাখার জন্য? সূর্য উদয় থেকে শুরু করে ক্লান্ত না হওয়া অব্দি তারা গুলি চালিয়েই যাচ্ছে, পুরো গ্রাম নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে”?

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের কতৃক বাঙালী স্বাধীনতা আন্দোলনকে বরবাদ করতে পূর্ব পাকিস্তানে সৃষ্ট রক্তগঙ্গার বিষয়ে যে বিদেশি বলছিলেন তিনি আদতে একজন শান্ত স্বভাবের মানুষ।

এই লোকটির মত বেশিরভাগ বিদেশি কূটনীতিক, ধর্মপ্রচারক ও ব্যবসায়ীরাও ঠিক একই কথা বলছে। তারা গত তিন মাসের চাপা রাগ এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ছে। এবং তারা এসব ব্যাপারে সেইসব বিদেশি সাংবাদিকদের জানাতে খুব আগ্রহী যারা ২৫শে মার্চের আগের রাত থেকে (অর্থাৎ যখন পাকবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে নিপীড়ন অভিযান চালায়) পাকিস্তানে প্রবেশের অনুমতি পেয়েছিল এবং প্রথমবারের মত একাকি চারিদিক ঘুরে দেখার সুযোগ পেয়েছিল।

পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের কাছে বিদেশি সংবাদমাধ্যম অপ্রতিরোধ্য ও প্রতিকূল হয়ে উঠছে, কিন্তু তারা বিশ্বের কাছে তাদের দাবি প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে যে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণে আছে এবং পূর্ব পাকিস্তানে দ্রুত স্বাভাবিকতা ফিরে আসছে।

ভারতের সাহায্য পেয়ে বোনিয়ারের কাছাকাছি কিছু অঞ্চলে মুক্তিফৌজ বা স্বাধীনতা বাহিনীরা বেশ সক্রিয় এবং ক্রমবর্ধমান হয়ে উঠছে। প্রকৃতপক্ষে, এই অঞ্চলগুলো বাদে বাকি সব পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দখলে। তা সত্ত্বেও, পূর্ব পাকিস্তানের সবকিছুই স্বাভাবিক। সহজ ও নিশ্চিতভাবেই এটি একটি বহিঃ সেনাবাহিনীর কতৃক সামরিক দখলদারিত্ব।

বাঙালি পুলিশদের বদলে ১০০০ মাইল দুরের (ভারতকে মাঝে রেখে) পশ্চিম পাকিস্তানের পুলিশদের চাকরি দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানিরা সরকারি কর্মকর্তাদেরও বদলাতে চেয়েছিলো- এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে টাইপিস্ট পর্যন্ত।

নিহত ও গ্রামে পলাতক বাঙালিদের ঘর-বাড়ি এবং দোকানপাটগুলো পূর্বপাকিস্তানের মুসলিম অবাঙালিরা দখল করেছে, এরা পাকবাহিনীদের সহযোগীতা করছে। সেনাবাহিনীর প্রধান লক্ষ্য সংখ্যালঘু হিন্দুদের মন্দির, যেগুলো বিনাকারনে ধ্বংস করা হচ্ছে শুধু এটা বোঝানোর জন্য যে সেনাবাহিনীর নকশা অনুযায়ী যারা ‘বিশুদ্ধ ইসলামের’ অংশ নয় তারা প্রকৃত পাকিস্তানি নয় এবং তাদেরকে সহ্য করা হবেনা।

বাঙালি যুবকদের মধ্যে কিছুদিন আগেও যারা প্রকাশ্যে উল্লাস করে কুচকাওয়াজ করে পাকিস্তানিদের প্রতি প্রকাশ্য অবাধ্যতার স্লোগান দিত, এখন তারা ফিসফিস করে কথা বলছে, বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে গনহত্যা, স্বজন হত্যা বা গ্রাম ধ্বংস করার কথা অস্ফুট স্বরে বলতেও ব্যর্থ হচ্ছে। হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে অবস্থানরত সাংবাদিকদের ডাকবাক্সে প্রতিদিন বিস্তারিত বিবরণসহ বেনামী চিঠি আসছে।

ভয়ের বহিঃপ্রকাশ এখন বাড়াবাড়ির পর্যায়ে কিন্তু একটা নতুন উদ্দীপনাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সরল এবং আবেগপ্রবন অনেক বাঙালিও এখন বুঝতে পারছে যে অন্য কোন দেশ তাদের রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে না, যা করার নিজেদেরকেই করতে হবে এবং এর জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন।

তরুনদের একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যা বের হয়ে পড়েছে মুক্তিবাহিনীতে যোগদানের জন্য, যা সীমান্ত এলাকা এবং অভয়াশ্রম থেকে শুধু ভারত সীমান্ত জুড়ে পরিচালনা করা হচ্ছে। বাঙালি গেরিলা আক্রমন বাড়ছে। ঢাকায় প্রচুর ককটেল বিস্ফোরিত হচ্ছে এবং বেশকিছু সেনাবাহিনী সহচরদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে। প্রতিরোধ এখনো সীমান্তবর্তী, বিক্ষিপ্ত এবং বিশৃঙ্খল, কিন্তু এটা বাড়ছে।

প্রতিটি আক্রমনের প্রতিশোধ নিতে সেনাবাহিনীরা নিকটবর্তী বাঙালি নাগরিকদের উপর অত্যাচার করছে। এক প্রতিবেদনে জানা যায়, নোয়াখালী জেলায় মুক্তিফৌজরা সেনাবাহিনী সৃষ্ট “শান্তি কমিটির” একজন সদস্য, তার স্ত্রী এবং সন্তানকে মেরে ফেলার পরপরই সেনাবাহিনীরা কয়েকশ নাগরিককে গ্রেপ্তার করে এবং কুপিয়ে মেরে ফেলে।

একসময় একটা তত্ত্ব ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে ভোগদখলের খরচ পাকিস্তানকে সেনাবাহিনী ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করবে কিন্তু এই তত্ত্ব খুব দ্রুতই বাতিল হয়ে গেল। নিপীড়নের তিরষ্কারে বিশ্ব ব্যাংকের সহযোগীরা বাৎসরিক অনুদান বন্ধ করলেও, ইসলামাবাদ সরকার পূর্ব পাকিস্তানে তাদের প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ধারনা করা হয়েছিল, গত সোমবারে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষনে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে তার দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বেসামরিক শাসনের পরিকল্পনা ব্যক্ত করবেন। দেখা গেলো সম্পুর্ন বিপরীত ঘোষনা দিলেন যাতে বলা হয় সামরিক একনায়কতন্ত্র অব্যাহত থাকবে; চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য একটি বেসামরিক সরকার গঠন করা হয়।

রাষ্ট্রপতি, যিনি সেনাবাহিনী প্রধানও, তার বক্তৃতায় আল্লাহর রহমতে দেশকে বিভেদের কিনারা থেকে উদ্ধার করছে দাবি করে সেনাবাহিনীর ভূয়সী প্রশংসা করেন যেটাকে পশ্চিমা কূটনীতিকরা একটি “বিপর্যয়” হিসাবে বর্ণনা করেন। পাশাপাশি তিনি ৬০ লক্ষ বাঙালির (যাদের অধিকাংশই সংখ্যালঘু হিন্দু) প্রতি ‘গভীর সমবেদনা’ জ্ঞাপন করেন, যারা বিদ্রোহীদের মিথ্যা প্রচারনার কারনে ভারতে পলায়ন করেছে। “দ্রুত পুনর্বাসন” এর লক্ষ্যে তিনি তাদের নিজের দেশে ফিরে আসার আহ্বান জানান।

রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়ার ভাষণের আগেরদিন, এক পল্টন সেনা ঢাকা থেকে ৩০ মাইল দুরবর্তী কিছু হিন্দু প্রধান গ্রামে হামলা চালিয়ে পুরুষদের হত্যা করে, ঘরবাড়ি লুট করে এবং জ্বালিয়ে দেয়। একই ধরনের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার রিপোর্ট আসে এই প্রদেশের (পুর্ব পাকিস্তান) অন্যান্য অংশ থেকেও। কেউ জানেনা ঠিক কতজন বাঙালিকে সেনাবাহিনী হত্যা করেছে, কিন্তু বিদেশি কিছু নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে এর সংখ্যা এক লক্ষাধিক এবং সম্ভবত তার থেকেও বেশি।

পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি, জাতীয় কোষাগারকে শুধু অর্ধেক রপ্তানি মুল্য এবং বৈদেশিক মুদ্রাই প্রদান করেনি বরং পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পজাত পণ্যের জন্য বড় বাজার তৈরি করেছিল, এই ধ্বংসযজ্ঞে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে জনগন যতই বিরূপ বা অপ্রতিরোধ্য হোক না কেনো, চরম অর্থনৈতিক মুল্য দিয়ে হলেও পূর্ব পাকিস্তানকে একটি উপনিবেশ হিসাবে রাখতে সামরিক শাসকদের যথেষ্ট আগ্রহী মনে হচ্ছে, অন্ততপক্ষে বর্তমানের জন্য।

একজন পশ্চিমা বলেন, “এটা যেন ভূমিদাসদের বিরুদ্ধে পরিচালিত এক মধ্যযুগীয় সেনা। এরা যেকোন উপায়ে পূর্ব পাকিস্তান দখল নিতে এবং শোষণ করতে চায়। এমনকি, বাঙালিরা প্রতিরোধের ব্যাপারে গুরুত্ব দিলেও তাদেরকে ঘায়েল করতে ৫ থেকে ১০ বছর লেগে যাবে”।

—– সিডনি এইচ. শনবার্গ

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৬১। দক্ষিণ এশিয়া – দুর্যোগের পদধ্বনি

 

নিউইয়র্ক টাইমস জুলাই ৫, ১৯৭১

 

Zulkar Nain

<১৪,৬১, ১৩৩১৩৪>

নিউইয়র্ক টাইমস, সোমবার, জুলাই ৫, ১৯৭১

দক্ষিণ এশিয়া দুর্যোগের পদধ্বনি

চেস্টার বোয়েলস

এসেক্স, কানেটিকাট – দুইটি অসম্ভাব্য উন্নয়ন সংঘঠিত নাহলে, দক্ষিন এশিয়া একটি দুঃখজনক ও অনাবশ্যক যুদ্ধের আসন্ন বিপদের সম্মুখীন। এগুলো হচ্ছেঃ প্রথমত, ক্ষমতাসীন পশ্চিম পাকিস্তান সরকার কতৃক (পূর্ব পাকিস্তানে) নিজস্ব প্রজাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্য্যক্রম পরিহার করা এবং এমন একটি সিদ্ধান্তে সম্মত হওয়া যাতে ভীত ও গৃহহীন শরনার্থীদের ভারতে না যেতে হয়। দ্বিতীয়ত, ইতোমধ্যে ভারতে আশ্রিত প্রায় ছয় মিলিয়ন শরনার্থীকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বিশ্ব সম্প্রদায়ের ব্যাপক প্রচারনা চালানো।

ভারতীয় সরকার এইসব নিঃস্ব এবং ভীত মানুষদের খাদ্য, চিকিৎসা সহায়তা এবং আশ্রয় প্রদানে দৃঢ় প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। প্রতি সপ্তাহে ভারত সরকারকে ১০ মিলিয়নের বেশি খরচ করতে হচ্ছে এসব শরনার্থীদের পেছনে এমন একটা সময়ে যখন কিনা ভারত বিশ্বব্যাংক ও এর সহযোগীদের (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান ও কানাডা) কতৃক আর্থিক সহায়তা অনেক কম পাচ্ছে, উপরন্তু এ বছরই ভারতকে পূর্ববর্তী ৫০০ মিলিয়নের ও বেশি ঋণ সুদসহ পরিশোধ করতে বলা হয়েছে।

এসব অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা রাজনৈতিক কর্মকান্ড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। প্রধানমন্ত্রী গান্ধী জোর দিয়ে বলেন, “শরনার্থীদের মধ্যে মুসলমান, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, হিন্দুসহ সকল রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ আছে”। কিন্তু রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী সমগ্র পুর্ব পাকিস্তান জুড়ে হিন্দু সংখ্যালঘুদের উপর বেশি নির্যাতন করছে। যদি এটা সত্য হয় তাহলে ভারতের ৬৫ মিলিয়ন মুসলিম সংখ্যালঘু নিয়ে একটা চাপা উত্তেজনার সৃষ্টি হবে। ফলশ্রুতিতে, ভারত ভয় পাচ্ছে স্বাধীন পুর্ব বাংলা যদি পশ্চিমবঙ্গ, যেখানে কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদীরা বৃহত্তম একক উপাদান, এর সাথে মিলে একটি একক বাঙ্গালী জাতি গঠন করে তাহলে তা চীনা চক্রান্ত ও পরাভাবের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠবে।

সাম্প্রতিককালে, ভারতীয় পার্লামেন্টের এক বক্তৃতায় মিসেস গান্ধী দাবি করেন, “এটা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যা নয় – যেমনটা অনেকেই ভাবছেন। এটা পুরো দক্ষিন এশিয়ার শান্তির জন্য হুমকি স্বরূপ। শত শত নয়, হাজার হাজার নয় – এতো লক্ষ লক্ষ মানুষকে অস্ত্রের মুখে জোর জবরদস্তি করে দেশ ছাড়া করার অধিকার কি পাকিস্তানের আছে? এটা একটা চরম অসহনীয় পরিস্থিতি। আমাদের সরকারের ভুল থাকতে পারে কিন্তু ভীত নয়। সরকার এমন ঝুঁকি নিতে ভয় পাবে না যে ঝুঁকি প্রয়োজনীয়”।

শীঘ্রই সম্ভাব্য যেসব ঘটনা আমাদের সম্মুখীন হতে পারে সেগুলো বেশ আতঙ্কজনকঃ (১) ভারত শরনার্থী ঠেকাতে দৃঢ় প্রচেষ্টা চালাবে, বর্তমান শরনার্থীদের তাদের নিজের দেশে ফেরত পাঠাবে এবং পুর্ব পাকিস্তানে দুর্বল চরম বামপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠা ব্যাহত করে সৈন্যদের হয়তো পূর্ব পাকিস্তানের দিকে ধাবিত করবেঃ (২) আশা করা যাচ্ছে তখন কাশ্মির ও ভারতের পাঞ্জাব আক্রমন করে পাকিস্তান হয়তো এর বদলা নিবে; (৩) চীন ভারতকে চূড়ান্ত শর্ত দিতে পারে (যেমনটা ১৯৬৫ সালের অক্টোবর মাসে পুর্ব পাকিস্তান যুদ্ধের শেষের দিকে দিয়েছিল); (৪) তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতীয় অবস্থানের সমর্থনে চীনকে বাধা প্রদান করবে এবং উদ্দীপনা বাড়তে থাকবে।

বিছানায় শুয়ে স্বপ্ন দেখছি ভেবে অনেকেই হয়তো এসব দৃশ্যকল্পকে উড়িয়ে দিতে পারেন। আমার মতে এটা খুব বাস্তব একটা সম্ভাবনা এবং এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে এটা সম্ভাব্যতায় রুপ নেবে। মিসেস গান্ধীর সরকার ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তের সঙ্কট নিরসনে দায়িত্ব পালন করছে, কিন্তু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ দ্রুত ভারতকে সহনসীমার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

বিশ্বসম্প্রদায়কে জাতিসংঘের সরাসরি উদ্যোগে বা অন্য যেকোন উপায়েই হোক এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে সেটা অবশ্যই অনৈতিক এবং অমানবিক, এর বিরুদ্ধে নিন্দা জানানো এবং বন্ধে বিশ্ব সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি ছয় মিলিয়ন শরনার্থীর দায়-দায়িত্ব থেকে ভারতকে অব্যাহতি দিতে হবে। একটা গণতান্ত্রিক দেশ যা কয়েক মাস আগেও অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের কাছাকাছি পৌঁছেছিল- এই দীর্ঘ দুর্ভোগ আর সংগ্রামে সেটা নষ্ট হতে দেওয়া যায় না; কেননা এই পরিস্থিতির জন্য তারা দায়ী নয়।

একটি সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়, যতক্ষন না পর্যন্ত (পশ্চিম) পাকিস্তান পুর্ব পাকিস্তানের সাথে একটা রাজনৈতিক বোঝাপড়া এবং তাদের নায্য পাওনার নিশ্চয়তা না দিবে ততদিন পাকিস্তানে আর্থিক সহয়তা বন্ধে বিশ্ব ব্যাংক ও সহযোগীরা সবাই (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যতীত) সম্মত হয়েছে।

মার্চের শেষের দিকে পূর্ব পাকিস্তানে সংগ্রামের শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্র (পশ্চিম) পাকিস্তানে সামরিক সরঞ্জামসহ কার্গো জাহাজে পাঠিয়েছে – যা কেবল পূর্ব পাকিস্তানে তার নিজের লোকদের প্রতি কিংবা ভারতের বিপক্ষে ব্যবহার করতে পারে পাকিস্তান। পাকিস্তানে কোনোরকম যুদ্ধাস্ত্র পাঠানো হবে না- এই মর্মে কংগ্রেসকে পুরোপুরি আশ্বস্ত করার সত্ত্বেও এই পদক্ষেপ নিলো যুক্তরাষ্ট্র। প্রথমদিকে এটাকে শুধু ‘যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি আমলাতান্ত্রিক ভুল হিসাবে মেনে নেওয়া হয় যা আমেরিকার নীতির সাথে যায় না। যাহোক, কয়েকদিন আগে প্রমাণ পাওয়া যায় যে এটা কোনো দুর্ঘটনাবশত ভূল ছিলো না বরং এটি একটি ইচ্ছাকৃত সিদ্ধান্ত।

যদি প্রকৃতপক্ষে এটা সত্য হয়, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আবারো এশিয়াতে ভয়ঙ্কর একটা ভুল করলো। যুক্তরাষ্ট্রের এই ভূল সিদ্ধান্তকে ক্ষমা বা সমর্থনে অজুহাত খুঁজে পেতে ইতিহাসবিদদেরও হয়তো (এমনকি ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকেও) বেগ পেতে হবে।

*** চেস্টার বোয়েলস, “প্রতিশ্রুতি রাখুনবইয়ের লেখক, ১৯৬৩৬৯ ভারতে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ছিলেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৬২। পাকিস্তানের জন্য মার্কিন অস্ত্র – একটি গ্লানির ইতিহাস ওয়াশিংটিন পোস্ট ৫ জুলাই ১৯৭১

Razibul Bari Palash

<১৪, ৬২, ১৩৫-১৩৬>

দ্যা ওয়াশিংটিন পোস্ট, ৫ জুলাই ১৯৭১

পাকিস্তানের জন্য মার্কিন অস্ত্র – একটি গ্লানির ইতিহাস

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ২৫ শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনকে চূর্ণবিচূর্ণ করতে নেমেছিল। সেনাবাহিনীর অত্যাচার ও স্বতঃস্ফূর্ত হত্যাকাণ্ড শুরু হওয়ার পর থেকেই ওয়াশিংটনে প্রশ্ন করা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে কোন অস্ত্র বিক্রি বা দেওয়া হচ্ছে কিনা। এবং, আরও অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত আছে কিনা। এখানে ওয়াশিংটনের দেওয়া উত্তর লিপিবদ্ধ হল।

২ এপ্রিল: যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট বলেছে যে আমেরিকান সরঞ্জাম ব্যবহার করা হচ্ছে এমন রিপোর্ট তারা প্রত্যাখ্যান বা নিশ্চিত করতে পারে না।

২০ শে এপ্রিল, এটা কোন ভাবেই অগ্রাহ্য করা যায় না – সেনেটর কেনেডি জানান যে, “পূর্ব পাকিস্তানে আমেরিকান অস্ত্র ব্যবহারের উপর আমাদের উদ্বেগ প্রকাশ করছি”; তিনি আরও বলেন যে “চীন, ইউএসএসআর এবং ইউ কে সহ অনেক দেশ থেকে প্রয়োজনীয় অস্ত্রগুলি ব্যবহার করা হয়েছে।”

তিন দিন পরে: বিভাগটি সরকারিভাবে তা স্বীকার করে। সেনেটর ফুলব্রাইটকে বলেন যে “কিছু এম -৪ ট্যাংক এবং এফ-৮৬ বিমান সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে পূর্ব পাকিস্তান ব্যবহার করতে দেখেছে”। তবে তিনি এটা স্বীকার করে না যে এই ট্যাংক এবং প্লেনগুলি নিপীড়িত মানুষদের বিরুদ্ধে ব্যাবহার করা হচ্ছে কণা যাদের কাছে হয়ত রাইফেলের মত কিছু থাকতে পরে।

৬ এপ্রিল: জনাব ফুলব্রাইট সচিব স্টিল রজার্সকে “বর্তমান জাহাজের চালানের অবস্থা” সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে এগুলোর কোনটিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য সামরিক সরঞ্জাম আছে কিনা। পরের সপ্তাহে বিভাগের একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানের সঙ্গে একটি বৃহৎ সামরিক সহায়তা কর্মসূচী রয়েছে” এবং ঘোষণা করে, “পাইপলাইনে কোনও পুনরাবৃত্তি নেই- কোনও সরঞ্জাম নেই এবং এগুলোর কোনটি এখনো ডেলিভারি দেয়া হয়নি।’ এটা অক্টোবর, ১৯৭০ এর  অস্ত্র চুক্তি অনুযায়ী মানা হচ্ছে। তিনি কিছু হাল্কা “অ-প্রাণঘাতী সামরিক সরঞ্জামএবং কিছু গোলাবারুদ ও সরঞ্জামের জন্য খুচরা যন্ত্রাংশ” -এর কথা বলেন যা ১৯৬৭ সাল থেকে চলে আসছে। এগুলোর বেশিরভাগ এখন পাকিস্তানীদের হাতে আছে। তিনি বলেন: “এই চুক্তির অধীনে যেসব চালান রয়েছে সেগুলো আবার বিবেচনা করা হচ্ছে।’

১৪ ই এপ্রিল: ওয়াশিংটন পোস্টে একটি বেসরকারি সূত্র থেকে পাওয়া প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয় যে অস্ত্র সরবরাহ চলছে কিন্তু সর্বনিম্ন প্রচারের সাথে। পরের দিন, বিভাগের মুখপাত্র এই বিষয়ে একটি পর্যালোচনা প্রকাশ করেছেন: “সংক্ষেপে বলা যায়, এই সঙ্কটের শুরু থেকেই পাকিস্তান সরকারকে কোন অস্ত্র সরবরাহ করা হয়নি এবং ডেলিভারির প্রশ্নটি পর্যালোচনায় রাখা হবে।’’

এপ্রিল ২০: সিনেটর কেনেডি বলেছিলেন: “পূর্ব পাকিস্তানে মার্চ মাসে ২৫-২৬ তারিখে যুদ্ধের প্রাদুর্ভাবের পর থেকে পাকিস্তান সরকার বা তার এজেন্টদের কাছে এই আইটেমগুলির (গোয়েন্দা সহ ১৯৬৭ ‘অ-প্রাণঘাতী’ তালিকায়) কোনটিই দেওয়া হয়নি। আর কোন চালান শিডিউলে নেই।

৬ মে: সেনেটর ফুলব্রাইট বলেন: “সংক্ষেপে, সঙ্কটের শুরুর দিক থেকে কোনও অস্ত্র সরবরাহ করা হয়নি এবং বিতরণের বিষয়গুলো পর্যালোচনা করা হয়েছে।”

৮ মে: সুন্দরবন নামে পাকিস্তানে অস্ত্র বহনকারী একটি পাকিস্তানী জাহাজ নিউইয়র্ক থেকে যাত্রা করে যা জনসাধারণের ঘোষণা বা জনসাধারণের জ্ঞ্যাতের বাইরে ছিল।

১৭ জুন: পররাষ্ট্র দপ্তর সাংবাদিকদের বলেন যা পরের দিন এই সংবাদপত্রে এসেছে- তিনি বলেন যে, “যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ২৫ মার্চের থেকে কোনও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়নি।”

২২ জুন: নিউইয়র্ক টাইমসের একটি রিপোর্টেত প্রতিক্রিয়া জানাতে বিভাগটি স্বীকার করেছে যে অস্ত্রের দুটি শিপমেন্ট পাকিস্তানে চলে যাচ্ছে এবং ব্যাখ্যা করে যে তাদের লাইসেন্স ২৫ মার্চের আগে করা হয়েছে। একই দিনে দ্বিতীয় জাহাজ পদ্মা রওনা করে।

ছয় দিন পরে: প্রশাসন বলেছে যে ২৫ মার্চের আগে যদি আরও কোন লাইসেন্স করা শিপমেন্ট থাকে তাহলে সেগুলো সরবরাহ করা হবে। কারণ হিসেবে বলা হয়  (১) পাকিস্তান সরকারকে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য “লিভারেজ” প্রদান করতে হবে (এটি এখনো আছে) এবং (২) ছয় মিলিয়ন শরণার্থী যারা ভারতে পালিয়ে গিয়েছে (প্রতিবেদনের মতে যা চলমান আছে এবং প্রতিদিন ৪০০০০ মানুষ চলে যাচ্ছে বলে যানা যায়) তাদের ফিরে আসার জন্য। দ্বিতীয় কারণের সাথে প্রশাসন যে আগে বলেছিল যে আমেরিকার পাশাপাশি সোভিয়েত, চীন ও ব্রিটিশ অস্ত্র সেখানে ব্যাবহ্রিত হয়েছে – এটি বলা হিয়েছে পাকিস্তানকে অন্যদের থেকে অস্ত্র কিনতে নিরুৎসাহিত করার উদ্যেশ্যে।

২৯ শে জুনঃ এটি প্রকাশ করা হয়েছিল যে চার বা পাঁচটি অস্ত্র জাহাজের চালান নির্ধারিত ছিল। কাপ্তাই নামক জাহাজ ২ জুলাই যাত্রা শুরু করে।

আমরা এই একটি বিস্ময়কর এবং লজ্জাজনক রেকর্ড প্রকাশ করলাম যার দুইটি অর্থ আছে। প্রথমটি হলো, রাজনৈতিক উদাসীনতার কারণে ইউনাইটেড স্টেট একটি নৃশংস শাসককে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করছে যা প্রায় ২ লাখ নাগরিককে হত্যা করেছে এবং তাদের ছয় লাখেরও বেশি লোককে তাদের দেশ থেকে বের করে দিয়েছে। দ্বিতীয় কারণটি বুঝতে হলে পেন্টাগনের কাগজপত্র নিয়ে বর্তমান বিতর্কের প্রেক্ষিতে দেখতে হবে –  যা জানার অধিকার জনসাধারণের আছে এবং গোপন করার অধিকার সরকারের ওপর বর্তায়। এখানে আমরা একটি ক্লাসিক সিস্টেম দেখালাম যা সত্যিই কাজ করে; সরকারি তদন্ত থেকে গোপন রেখে, প্রশাসন কর্মকর্তারা পাকিস্তানে অস্ত্র

সরবরাহ করছেন, এবং স্পষ্ট ও দৃঢ়ভাবে জনসাধারণকে বলছে যে এই ধরণের সরবরাহগুলি বন্ধ করে ফেলা হয়েছে। আমরা অনুমান করি যে এই প্রতারণা সাংগঠনিক বিভ্রান্তি এবং আমলাতান্ত্রিক বিচ্ছিন্নতার সংমিশ্রণ এবং ঘটনাকে আড়াল করার প্রয়াসমাত্র। আসল বিষয় হল: অস্ত্রের জাহাজ এখনো চলছে। এটা রাষ্ট্রপতির ব্যাপার যে তিনি তার সরকার ঘোষিত নীতিমালা অনুসারে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে তা থামাবেন কিনা।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৬৩। পাকিস্তান নিউজ উইক ১২ই জুলাই, ১৯৭১

 

 

নীতেশ বড়ুয়া

<১৪, ৬৩, ১৩৭-১৩৮>

নিউজ উইক- ১২ই জুলাই, ১৯৭১

পাকিস্তান

 

গত সপ্তাহেই প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যে এই প্রতিবন্ধীতাকে হালকা ভাবে নেওয়ার অবকাশ নেই। এটা সত্য যে পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ থাকা সত্ত্বেও বিদ্রোহ দমন হতে তা এখনও অনেক দূরেই আছে। সাম্প্রতিক সময়ে এক সময়কার অসংগঠিত মুক্তিফৌজের মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা যুদ্ধে তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতি প্রদর্শন করেছে। গুরুত্বপূর্ণ রেললাইন ও মহাসড়ক কেটে দিয়ে তারা ডজনের উপর ব্রীজ উড়িয়ে দিয়েছে, তারা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ধ্বংস করেছে এবং স্থানীয় সরকার প্রচলনে সেনাবাহিনী দ্বারা নিযুক্ত অবাঙালী সদস্যদের তারা গোপনে হত্যা করেছে। ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীতে স্নায়ু উত্তেজনা বাড়ছে এবং পূর্বাঞ্চলে চার ডিভিশনের সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করতে আরও দুই ডিভিশন সৈন্য পাঠাতে অনুরোধ করা হয়েছে।  গত সপ্তাহে পূর্ব বঙ্গের রাজধানী ঢাকাতে নিউজ উইকের লরেন্স জেনকিন্সকে একজন বিদেশী রাষ্ট্রদূত বলেছেন যে, “এইভাবেই ভিয়েতনামে শুরু হয়েছিল।” সেনাবাহিনী যতদিন ইচ্ছে এর মূল্য দিতে এখানে অবস্থান করতে পারে। কিন্তু সরকার গেরিলা যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করার মতো অবস্থায় নেই।

একই রকম উপসংহারে পৌঁছে গত সপ্তাহে এগারটি দেশের সমন্বয়ে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের একটি দল পাকিস্তানের সাহায্যার্থে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের সরবরাহ নিয়ে পাকিস্তানের পৌঁছেছে। দলটি বিধ্বস্ত পূর্বাঞ্চল পরিদর্শনের পর ইয়াহিয়াকে এই শত্রুতার রাজনৈতিক সমাধান খুঁজতে বাধ্য করার জন্য এই সহায়তাকে ফিরিয়ে নিতে সুপারিশ করে। একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রই এর বিরোধীতা করে যা ঘোষণা করে যে নিজের প্রভাব ইয়াহিয়ার উপর জারি রাখতে ইসলামাবাদের প্রতি তার সহায়তা অবিরত রাখবে এবং সম্ভবত শান্তির পথে নিয়ে যেতে তাকে উদ্বুদ্ধ করবে। অবশ্য এই ধরণের ভ্রান্ত চিন্তাভাবনা  সংঘাতের মধ্যস্থতা করার জন্য কোন প্রকার প্রবৃত্তি প্রদর্শন করেনি। প্রকৃতপক্ষে এটাই সত্য যা ঢাকাস্থ এক কূটনৈতিক গত সপ্তাহেই পূনর্মিলনের কোন সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়ে দিয়েছেন। “ যেদিন থেকে পূর্বাঞ্চলে সেনাবাহিনী প্রবেশ করেছে সেদিনই পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে।”

 

 

 

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৬৪। ভারত টাইম ১২ই জুলাই, ১৯৭১

 

 

নীতেশ বড়ুয়া

<১৪, ৬৪, ১৩৯-১৪০>

 

টাইম ম্যাগাজিন- ১২ই জুলাই, ১৯৭১

ভারত

গত মার্চে যখন প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর নতুন কংগ্রেস পার্টি নিয়ে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসেন তখন তিনি উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন কর্মসূচীর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যাতে ভারতের প্রায় ৬০০ মিলিয়ন জনতার জীবন-গতি বদলে যাবে। যাই হোক, গত সপ্তাহে এইটা পরিষ্কার হয়েছিল যে দেশের অর্থনীতি কিছুতেই শক্তিশালী হচ্ছিল না এবং এই বাঁধার কারণগুলো কিছুতেই শ্রীমতি গান্ধীর দ্বারা তৈরী হয়নি। গত মার্চ মাস হতেই পশ্চিম পাকিস্তানস্থ পাকিস্থান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের উপর তাদের নিপীড়ন ও সন্ত্রাসের বর্বর আগ্রাসন শুরু করার পর ৬০,০০,০০০ এরও অধিক শরণার্থী ভারতে পালিয়ে এসেছিল। শরণার্থীদের আশ্রয় ও খাদ্যের যোগান এবং হাজারো কলেরায় আক্রান্তদের চিকিৎসায় প্রথম ছয়মাসেই কমপক্ষে ৪০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে।

মুসলিম প্রধান পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের প্রায় ৮০% হিন্দু যারা পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতের পূর্বাঞ্চলে যেখানে তাদের সহ-সম্প্রদায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে সেখানে তাদের আশ্রয়স্থল খুঁজছিল। মূলত ভারতকে যা দুশ্চিন্তায় ফেলছিল তা হচ্ছে তাদের নিজেদের ভিটে-বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে আসছিল। গত সপ্তাহে নয়াদিল্লী হতে বলা হয়েছিল যে পাকিস্তানীরা পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুদের ভিটে-বাড়ী ও সহায় সম্পত্তি ধ্বংস করে ফেলছিল। আর তাই ভারতকে পাকিস্তানী শরণার্থীদের যা ক্রমাণ্বয়ে ১০ লক্ষাধিক হতে পারে তাদেরকে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য মেনে নিতে হতে পারে।

ক্ষুদ্র সাফল্য

পূর্ব বা পশ্চিম উভয় দিক হতেই শরণার্থী সমস্যার জন্য এতোই স্বল্প সহায়তা এসেছে যে যার জন্য ভারতীয়রা ক্রুদ্ধ হয়ে আছে। দুই সপ্তাহে আগেই শ্রীমতী গান্ধী ঘোষণা করেছেন যে “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এর দায় হতে পালিয়ে যেতে পারে না।” “এর পরিণতি যাই হোক না কেন তা বিশ্বের এই অংশকেও সহ্য করতে হতে পারে।”

সবচাইতে ভয়ংকর পরিণতি হতে পারে যুদ্ধ, ফলাফল সম্পর্কে চিন্তাভাবনাহীন হয়ে  দেখা যাচ্ছে যে অনেক ভারতীয়ই এই শরণার্থী সমস্যার সমাধান হিসেবে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে পূর্ব পাকিস্তান হতে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে তাড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে তর্ক করে যাচ্ছে যাতে শরণার্থীরা তাদের ঘরে ফিরে যেতে পারে। শ্রীমতি গান্ধী এই ধরণের আলোচনাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, যদিও এই আলোচনার ক্ষেত্র বাড়ছে, এমনকি তা সংসদ সদস্যদের মাঝেও আলোচিত হচ্ছে।

জরুরী সহায়তা প্রদান ও পূর্ব পাকিস্তানে দমন প্রশমনে অন্যান্য দেশসমূহকে রাজী করানোর চেষ্টায়, ভারতের পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে প্রধানমন্ত্রী তাঁর বিভিন্ন সহকর্মীদেরকে বিদেশে পাঠিয়েছেন এবং এই পর্যন্ত এতে ক্ষুদ্র সাফল্য মাত্র অর্জিত হয়েছে।

ভারত যা চায় তা হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতা। আর তা গত ডিসেম্বরে শেখ মুজিবর রহমান ও তাঁর দল আওয়ামী লীগের দ্বারা অপ্রতিরোধ্য বিজয়কেই মূল্যায়ন করা হবে। সাংবিধানিক কংগ্রেসের জন্য ভোটে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনেই শেখ মুজিব জয় লাভ করে। যেহেতু দেখা যাচ্ছে যে গণপরিষদের ৩১৩টি আসনের মধ্যে শেখ মুজিব নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে,  যা তাকে সমগ্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত  করতে পারতো। যেহেতু তিনি ভারতের

সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ছিলেন তাই ভারত শেখ মুজিবের এই বিজয়ে দারুণভাবে আনন্দিত হয়েছিল। যার ফলশ্রুতিতে ভারত পাকিস্তানের সাথে সীমান্ত রক্ষা ব্যয়ের মতো মোটা দাগের ব্যয় কমিয়ে ফেলতে পারতো।

কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান কেন্দ্রীয় সরকারের ভিতরে শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষমতা অর্জনে রাজী ছিলেন না, এমনকি তিনি পূর্ব পাকিস্থানে বৃহদার্থে স্বায়ত্তশাসন প্রদানেও অতোটা আগ্রহী ছিলেন না। পরবর্তীতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দ্বারা কঠোর দমন নীতির ফলে শত হতে হাজারে হাজারে পূর্ব পাকিস্তানীদের হত্যাকে রাজনৈতিক সমঝোতা হতে অনেক দূরে ঠেলে দেয়।

আদর্শিকতার আত্মীয়তা

দীর্ঘ মেয়াদে চলতে থাকলে ভারতীয়দের ভয় যে তারা তাদের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর চাইতেও ভয়াবহ হুমকির মুখোমুখি হতে হবে। সত্যিকারের বিপদ হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের গেরিলা আন্দোলন ভঙ্গূর আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব হতে নকশালপন্থীদের হাতে চলে যেতে পারে যারা মাওবাদী চরমপন্থীদের সাথে আদর্শিকভাবে আত্মীয় এবং যারা কলকাতা ও পাকিস্তান-ভারতের অন্যান্য অঞ্চলকে আতংকিত করে তুলেছে। ভারতীয়দের যে ভয় সেটা হচ্ছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাথে পাকিস্তানের পূর্ববাংলার একত্রীকরণের প্রয়াস যেখানে সংস্কৃতি ও ভাষার মিল আছে যা কোন এক সময় ধর্মীয় অমিলকে পরিবর্তন করে ফেলতে পারে।

অস্ত্রের জোর

এক নাছোড়বান্দা পূর্ব পাকিস্তানী যে নিজেকে নকশালবাদী বলে পরিচয় দেয় সে টাইম ম্যাগাজিনের সংবাদদাতা লেমস্‌ শেফার্ডকে বলেছে যে “এই মুহূর্তে আমাদের অভিন্ন শত্রু (আওয়ামী লীগ এবং পূর্ববঙ্গের নকশালপন্থী উভয়ের) হচ্ছে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। ভারত যে অস্ত্র আওয়ামী লীগকে দিচ্ছে তাই নকশালপন্থীদের কাছে পৌঁছে যাবে এবং আমরা যে শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করবো তা নয় বরং বুর্জোয়াদের এবং সামন্ততান্ত্রিক উপাদানের সাথে এবং ঘৃণিত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সাথে যুদ্ধ করবো।” নকশালবাদী ঘৃণার সাথে বলেছেঃ “ বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতারা রাজনৈতিক ক্ষমতা যে বন্দুকের নল হতে বের হয়ে আসে সেই প্রবাদের সত্যতা দেখতে পাচ্ছে।”

সমস্যা হচ্ছে, অনেক ভারতীয়রাও এই অস্ত্রের ক্ষমতার কথা ভাবছে। এমনকি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী বাস্তবমুখী শিখ শরণ সিং পর্যন্ত গত সপ্তাহান্তের সভায়  ক্ষমতাসীন নতুন কংগ্রেস পার্টির সংসদ সদস্যদের সতর্ক থাকার কথা বলতে বাধ্য হয়েছেন “রাজনৈতিক সমঝোতা না হওয়া পর্যন্ত ভারত তার নিজের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হবে।”

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৬৫। পশ্চিম পাকিস্তানীদের বাঙালী দমন অব্যাহত নিউইয়র্ক টাইমস ৪ জুলাই, ১৯৭১

 

Ashik Uz Zaman

<১৪, ৬৫, ১৪১-১৪৫>

 

দি নিউইয়র্ক টাইমস। জুলাই ১৪, ১৯৭১

পশ্চিম পাকিস্তানীদের বাঙালী দমন অব্যাহত

নিচের প্রতিবেদনটি লিখেছেন নিউ ইয়র্ক টাইম্‌সের নয়াদিল্লী প্রতিনিধি, যাকে জুনের ৩০ তারিখে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বহিষ্কার করা হয়।

ইদানীং সামরিক বাহিনীর ট্রাকগুলোকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানীর প্রায়-জনমানবশুন্য রাস্তায় চলতে দেখা যায়, “রাষ্ট্র-দ্রোহী” বন্দিদের তাদের কাজের জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে হাড়ভাঙা খাটুনী খাটানোর জন্য। তাদের মাথা কামানো এবং তাদের পায়ে কোনো জুতা নেই এবং হাফপ্যান্ট ছাড়া তাদের গায়ে আর কোনো কাপড় নেই – সবই পালানোর পথ কঠিনতর করার জন্যে।

রাজধানী ঢাকার বিমানবন্দরে প্রতিদিন উড়োজাহাজ এসে নামে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে, ভারতের উপর দিয়ে এক হাজার মাইলেরও বেশি দূরত্ব পেরিয়ে, গোষ্ঠীগত বিশেষ পোশাক ঢোলা পায়জামা পড়া সৈনিকদের উগরে দিতে যাতে দেখে সন্দেহজনক কিছু মনে না হয়।

বাঙালী সংস্কৃতির ছাপ মুছে দেয়ার অভিযানের অংশ হিসেবে সড়কের নাম থেকে সকল হিন্দু নামের পাশাপাশি বাঙালী মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের নামও সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। ঢাকার শাঁখারী বাজার সড়ক এখন টিক্কা খান সড়ক, পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক পদাধিকারী লেফটেন্যান্ট জেনারেলের নামে এবং যাকে বেশিরভাগ বাঙালীরা “কসাই” ডাকে।

এগুলো অসংখ্য প্রমাণের গুটিকয়েক মাত্র, যা এই প্রতিবেদক তার সাম্প্রতিক পূর্ব প্রদেশে সফরের সময় দেখেছেন, যে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা তাদের এই দখলদারিত্ব বজায় এবং এই অঞ্চলের সাড়ে সাত কোটি মানুষের উপর দমন-পীড়ন অব্যাহত রাখতে বদ্ধপরিকর। পঙ্গু অর্থনীতি, ভেঙে পড়া সরকারি প্রশাসন, বাঙালী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ব্যাপক গেরিলা আক্রমণ, ক্রমবর্ধমান সামরিক ক্ষয়ক্ষতি এবং চাপা ক্রোধে বিমুখ জনগোষ্ঠী থাকা সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানিরা এটা করছে।

পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শক্তি নিশ্চিত করতে, আয়ারল্যান্ডের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান, ওয়ার্ল্ড এয়ারওয়েজ-এর কাছ থেকে সরকার দুটি বোয়িং ৭০৭ বিমান ভাড়া করেছে, ৭০,০০০ থেকে ৮০,০০০ সৈন্যর সামরিক বাহিনীর শক্তিবৃদ্ধি এবং আহত-নিহতদের প্রতিস্থাপক সেনা পরিবহনের জন্য।

প্রতিদিনকার সৈন্য পরিবহনের পাশাপাশি, সরকার স্রোতের মতো পশ্চিম পাকিস্তানিদের নিয়ে আসছে সরকারি পদে পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রতিস্থাপন করতে। কোনো বাঙালীকেই বিশ্বাস করে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বা স্পর্শকাতর পদে রাখা হচ্ছেনা; এমনকি যে লোকটি ঢাকা বিমানবন্দরের ঘাস কাটে সেও অবাঙালী।

গুটিকয়েক বাঙালী ট্যাক্সিচালক এখনো আছে। তাদের কাজটি দেয়া হয়েছে ভারত থেকে অভিবাসী হয়ে আসা অবাঙালী মুসলমান যেমন বিহারীদেরকে, যারা পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারের পক্ষ নিয়েছে এবং সেনাবাহিনীর বেসামরিক শাখা হিসেবে গুপ্তচরবৃত্তি করছে।

পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাংলা ভাষার ব্যবহার নিরুৎসাহিত করছে এবং চেষ্টা করছে তাদের নিজের ভাষা, উর্দু, দিয়ে একে প্রতিস্থাপিত করতে। সৈনিকেরা ঘৃণাভরে বাঙালীদের বলে যে, তাদের ভাষা কোনো সভ্য ভাষা নয় এবং তাদের উচিত তাদের শিশুদেরকে উর্দু ভাষা শেখানো যদি তারা টিকে থাকতে চায়। ব্যবসায়ীরা, ভীত হয়ে, তাদের প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড ইংরেজিতে লিখছে কেননা তারা উর্দু জানেনা।

‘শান্তি কমিটি’ প্রতিষ্ঠা

পুরো পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে সেনাবাহিনী এক নতুন আধাসামরিক ‘রাজাকার’ বাহিনীকে প্রশিক্ষন দিচ্ছে বা শুধুমাত্র তাদের ‘অনুগত’ বেসামরিক নাগরিকদের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে, যাদের মধ্য থেকে কিছু লোক নিয়ে গঠন করা হচ্ছে শান্তি কমিটি। বিহারি এবং অন্যান্য অবাঙালী ছাড়াও, কিছু উর্দুভাষী সংখ্যালঘু বাঙালী মুসলমানদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে যারা সবসময়ই মুসলিম লীগ এবং জামাত-ই-ইসলামি এর মতো ডান-পন্থী সাম্প্রদায়িক দলগুলোর সেনাবাহিনী-ঘেঁষা মতবাদকে সমর্থন করে এসেছে।

এই দলগুলো বিগত ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের একটি আসনও জিততে পারেনি।

একভাবে চিন্তা করলে এই নির্বাচনই এই সংকটের জন্ম দিয়েছে, কেননা আওয়ামী লীগ, পূর্ব পাকিস্তানের একটি রাজনৈতিক দল যেটি এই প্রদেশের স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে আন্দোলন করছিল, অপ্রত্যাশিতভাবে জাতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। অতীতের নিপীড়িত বাঙালীরা একটি শক্তিশালী জাতীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে যাচ্ছে দেখে, পশ্চিম পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক দল, পাকিস্তান পিপলস পার্টি, আসন্ন জাতীয় সংসদ অধিবেশনে উপস্থিত হতে অস্বীকৃতি জানায়, যে অধিবেশনে এক নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে বেসামরিক শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার কথা ছিল। এর জবাবে প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মাদ ইয়াহিয়া খান অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করেন, ৩রা মার্চ পর্যন্ত।

আলোচনা এবং আক্রমন

প্রতিবাদে ও বিক্ষোভে ফেটে পড়ে পূর্ব পাকিস্তান, এবং বাঙালীরা আওয়ামী লীগের ডাকে সাড়া দিয়ে সামরিক বাহিনীকে অগ্রাহ্য করে এক অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে।

প্রেসিডেন্ট ঢাকায় আসেন আওয়ামী লীগের নেতা, শেখ মুজিবর রহমান, এর সাথে আলোচনায় বসতে। তাদের আলোচনা চলাকালীন, ২৫ শে মার্চ রাতে, সামরিক বাহিনী নিরস্ত্র বেসামরিক জনগনের উপর আকস্মিক আক্রমন চালায় তাদের স্বাধিকার আন্দোলনকে ধূলিসাৎ করার চেষ্টায়। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এবং শেখ মুজিবকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে জেলখানায় পাঠানো হয়।

পুলিশ এবং জাতীয় সেনাবাহিনী থেকে আনুগত্য পরিবর্তনকারী সৈনিকদের নেতৃত্বে গড়া – বাঙালীদের প্রাথমিক প্রতিরোধ – খুব তাড়াতাড়িই প্রশমিত করা হয়, কিন্তু তারা এখন আবার ফিরে আসছে ভারতের সীমান্তবর্তী আশ্রয়স্থল থেকে, সাথে নতুন সৈন্য ও রসদপত্র নিয়ে, ভিয়েতনামের মতো গেরিলা যুদ্ধ শুরু করতে এবং সেনাবাহিনীকে ক্রমবর্ধমানহারে উৎপীড়ন করতে।

আক্রমনের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সৈন্যরা অসংখ্য বাঙালিকে হত্যা করেছে – বিদেশী কূটনীতিকরা অনুমান করেন সংখ্যাটি নুন্যতম ২০০,০০০ থেকে ২৫০,০০০ – যার বেশিরভাগই গণহত্যা। যদিও শুরুতে বাঙালী মুসলমান এবং এক কোটি হিন্দুদের প্রতি লক্ষ্যস্থির করা হয়, সেনাবাহিনী এখন হিন্দুদের প্রতি মনোনিবেশ করছে যাকে বিদেশী পর্যবেক্ষকরা ধর্মযুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করেন।

পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা সবসময়ই মনে করতো হিন্দুরা হচ্ছে ইসলামের শত্রু। তারা এখন এদেরকে হিন্দু ভারতের চর হিসেবে দেখে, যেখানে ভারতকে দোষারোপ করা হয় স্বাধিকার আন্দোলনের মদদদাতা হিসেবে জোরপূর্বক পাকিস্তানের বিভাজন ঘটানোর উসকানি দেয়ার জন্য।

সামরিক বাহিনীর অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে যে ষাট লাখেরও বেশি বাঙালী পালিয়ে ভারতে চলে এসেছে, তার মধ্যে নুন্যতম চল্লিশ লাখ হচ্ছে হিন্দু। এর পরও সৈনিকেরা হিন্দুদের হত্যা করছে এবং তাদের গ্রামগুলো লুট করছে।

পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারি কর্মকর্তারা, অবশ্য, দাবী করেন যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে এবং তারা হিন্দুদেরকে “তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে আসার” আহ্বান জানিয়েছে, তাদের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে যে তাদের ভয় পাবার কিছু নেই। শুধুমাত্র গুটিকয়েক উদ্বাস্তুই এভাবে ফিরে এসেছে এবং বিদেশী পরিদর্শকদের দেখানর জন্য সরকার যে অভ্যর্থনা কেন্দ্রগুলো দাঁড়া করিয়েছে সেগুলো খালিই থাকে।

সাহায্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা

সাম্প্রতিককালে সেনাপতিরা প্রচার করেছে যে নিম্ন-বর্ণের হিন্দুরা তাদের বাড়িতে ফিরে আসতে পারবে। পরিদর্শকেরা এই পদক্ষেপকে বিদ্বেষের সাথে দেখছেন, তারা দেখিয়ে দিচ্ছেন যে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের শ্রমিক, ঝাড়ুদার এবং ধোপা ছাড়া সেনাবাহিনীর নোংরা পরিষ্কারের কাজ করার আর কেউ নেই।

ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থী ছাড়া, পূর্ব পাকিস্তানেও লাখ লাখ বাস্তুচ্যুত বাঙালী রয়েছে যারা সেনাবাহিনীর ভয়ে তাদের বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিল এবং এখনো ফিরে যেতে ভয় পাচ্ছে।

সাম্প্রতিককালে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে যে সৈনিকদেরকে তাদের কার্যক্রম আরো সূক্ষ্মভাবে এবং জনসমক্ষের আড়ালে পরিচালনার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই নির্দেশ, বিদেশী কূটনীতিকদের মতে, অনুপ্রাণিত হয়েছে পাকিস্তানের সেই আশা থেকে যে এটা ১১-রাষ্ট্রের সংঘকে প্ররোচিত করবে অর্থনৈতিক সাহায্য পুনরায় শুরু করতে, যা কিনা সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায় সামরিক শাসনের নিন্দা শুরু হলে।

[আন্তর্জাতিক পুনর্গঠন ও উন্নয়ন ব্যাংক (ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক ফর রিকন্সট্রাকশন এন্ড ডেভেলপমেনট), যেটি এই সাহায্য কার্যক্রম সমন্নয় করে, এর একটি বিশেষ প্রতিনিধি দল, এইমর্মে প্রতিবেদন দিয়েছে যে সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে তাতে এই উন্নয়ন কার্যক্রম কমপক্ষে এক বছরের জন্য স্থগিত রাখতে হবে। এই প্রতিনিধি দল মে এবং জুন মাসে এই প্রদেশে ব্যাপক জরিপ চালায়।]

ঢাকায় অবস্থানরত কূটনীতিকেরা মনে করেন বিদেশীদের বিনাবাধায় পূর্ব পাকিস্তানে ঘুরে বেড়াতে দেয়ার পাকিস্তানের সিদ্ধান্ত এবং বিদেশী সাংবাদিকদের পুনঃপ্রবেশের সুযোগ দেয়া – যাদেরকে আক্রমন শুরু হবার পর থেকে ঢুকতে দেয়া হয়নি সরকার-নিয়ন্ত্রিত সফরে সঙ্গী হওয়া ছাড়া – এই সাহায্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা অভিযানেরই অংশবিশেষ।

তবে চলমান হত্যাকাণ্ড যদিও বেছে বেছে এবং ততটা গণহারে হচ্ছে না, তাই বলে থেমে যায়নি, এবং বাইরে থেকে দেখে, বেশিরভাগ পরিদর্শক বিশ্বাস করেন, এটা একটা দীর্ঘ এবং রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হতে যাচ্ছে।

বাঙালীদের প্রচার

বিদেশী ধর্মযাজক যারা এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের প্রত্যন্ত এলাকগুলোতে নিয়োজিত আছেন তারাও প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন গণহত্যার তথ্য দিচ্ছেন। দক্ষিনে, একজন ধর্মযাজক জানান যে সেনাবাহিনী ১,০০০ এরও বেশি হিন্দুকে হত্যা করেছে বরিশাল জেলার এক এলাকায়। আরেকজন জানিয়েছেন যে সিলেট জেলাতে, উত্তরপূর্বে, শান্তি কমিটি এক এলাকার সবাইকে এক সভায় ডেকে নিয়ে আসে, আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে যে তারা ব্যাপারটা মীমাংসা করতে চায়। যখন সবাই একত্রীত হয় সৈন্যরা এসে হাজির হয়, সেখান থেকে ৩০০ হিন্দুকে বেছে বের করে, সরিয়ে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মারা হয়।

যখনি কোনো বাঙালী প্রকাশ্যে কোনো বিদেশীর সাথে কথা বলবে তাকে ঝুঁকি নিয়েই তা করতে হবে। ফেরীতে পারাপারের সময় বাঙালীরা এই প্রতিবেদকের গাড়ির কাছে এসে ফিসফিসিয়ে সেনাবাহিনীর অত্যাচারের অথবা, মৃদু হাসির সাথে, মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণের ছিটেফোঁটা তথ্য দেয়ার চেষ্টা করে।

যখনি ছয় অথবা সাত জন একত্রিত হয় একজন পশ্চিম পাকিস্তানি সৈনিক বা পুলিশ সদস্য এসে উপস্থিত হয়, কড়াচোখে বাঙালীদের দিকে তাকায়, এবং তখন তারা আবার সরে যায়।

সেনাবাহিনী এবং তাদের বেসামরিক গুপ্তচরদের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও, বাঙালীরা কোনো না কোনো ভাবে একটা উপায় বের করে ফেলে তাদের কথা বিদেশী, পরিদর্শকদেরকে বলার – গাড়ির মধ্যে চিরকুট ঢুকিয়ে দিয়ে বা গোপন সভার আয়োজন করে।

ঢাকার অদূরে এক ছোট শহরে এরকমই এক সভায়, এক ব্যবসায়ী জানায় যে একজন সৈন্য তাকে বিনাকারনে গ্রেফতার করে, তার কাছ থেকে সব টাকাপয়সা ও হাতঘড়ি কেড়ে নেয় এবং তাকে নিকটস্থ থানায় নিয়ে যায়, যেখানে তাকে একরাত জেলে আটকে রাখা হয় দৈবক্রমে তাকে পরেরদিন ছেড়ে দেয়ার আগ পর্যন্ত।

সেই ব্যবসায়ী জানান যে পুরো রাত তিনি প্রার্থনা করে এবং জেলখানার দেয়ালে লেখা পূর্ববর্তী বন্দীদের বার্তাগুলো পড়ে কাটিয়ে দেন। বার্তা গুলো, তিনি বলেন, সবগুলো প্রায় একইরকম বন্দীদের নাম ও ঠিকানা এবং তাদের গ্রেফতার হবার তারিখ এবং লেখাঃ “আমি হয়তো বাঁচবোনা। দয়া করে আমার পরিবারকে জানাবেন আমার কি ঘটেছিল।”

তাদের কাউকেই এরপর আর খুঁজে পাওয়া যায়নি, সেই ব্যবসায়ী আরো জানান।

সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি

সেনাবাহিনী সব জায়গাতেই হত্যার পাশাপাশি সম্পত্তিরও ক্ষতিসাধন করেছে। শহরের বাইরে, মাইলের পর মাইল রাস্তার দুই পাশের সব গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়া হয়েছে, বড় এবং ছোট সব শহরের বিশাল এলাকা ভারী গোলাবর্ষণে একেবারে ধ্বসে গেছে।

বাঙালীরা জানায় সৈন্যরা তাদের খেয়ালখুশি মতো ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। যদিও সেনাবাহিনী বলে যে আক্রান্ত না হলে তারা কখনই গুলি চালায়নি, কিন্তু বেশিরভাগ সেনা অধিনায়ক গর্বভরে জানায় যে অধিকাংশ শহরই সামান্য বা কোনোরকম বাঁধা ছাড়াই তারা দখল করে নেয়।

তাহলে কেনো এতো ধ্বংসলীলা? তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হয়। তাদের গৎবাঁধা উত্তর, “দুষ্কৃতিকারীরা” এটা করেছে।

যদিও কিছু কিছু বাঙালীরা জনবহুল কেন্দ্রীয় শহর গুলোতে ফিরে আসছে, অধিকাংশ ছোট শহরগুলোতে এখনো আসল জনগোষ্ঠীর অর্ধেক বা তারও কম মানুষ রয়েছে, এবং কিছু কিছু এলাকায়, যেমন উত্তরপশ্চিমে, শহরগুলো প্রায় জনমানবশূন্য।

ধানের ক্ষেতে অজত্নে আগাছা ধরে গেছে। পাট ক্ষেতে যেখানে ডজন ডজন খেতমজুর একসময় কাজ করতো সেখানে দুই একজনকেই দেখা যায়। পূর্ব পাকিস্তানের পাট, বস্তা তৈরি করার শক্ত আঁশ, হচ্ছে জাতীয় অর্থনীতির প্রধান খাত, এককভাবে সবচেয়ে বড় রপ্তানি পণ্য এবং বৈদেশিক মুদ্রার আনয়নকারী। লক্ষন দেখে এটাই বোঝা যাচ্ছে যে আসন্ন ফসল – এবার খারাপ হতে যাচ্ছে।

যদিও বা এবারের ফলন ভালো হতো, পাটের কারখানাগুলো, তাদের বেশিরভাগ দক্ষ শ্রমিক না থাকায়, তা সামাল দিতে পারতো না। তারা তাদের উৎপাদন ক্ষমতার অনেক নিচে চলছে।

নদীপথে চলাচল বিঘ্নিত

বিদ্রোহীরা নদীপথে সামরিক চলাচল এবং উত্তোলিত পাটের ফসল কারখানায় পৌঁছানয় বিঘ্ন ঘটানোর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তারা ইতিমধ্যেই বেশকয়েকটি পাটবাহী নৌকা ডুবিয়ে দিয়েছে যশোর-খুলনা এলাকায়, যেটি ধান-পাটের এলাকা।

পূর্ব পাকিস্তানের চা শিল্প আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, এবং জনশ্রুতি আছে যে সরকার বিদেশী উৎস থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি ভোক্তাদের জন্য বিশ লাখ পাউন্ড চা নিয়ে আসার নির্দেশ দিতে বাধ্য হয়েছে।

পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের অন্যতম মূল কারণ। অন্য কারণটি হচ্ছে পশ্চিম অংশে আধিপত্য বিস্তারকারী ফর্সা, মধ্যপ্রাচ্যীয় পাঞ্জাবী এবং পূর্ব অংশের শ্যামলা বর্ণের, দক্ষিণপূর্ব এশীয় বাঙালীর মধ্যকার জাতিগত বিশাল বিভেদ। শুধুমাত্র ধর্ম, ইসলাম, ছাড়া এই দুই জাতির মধ্যে আর কোনো কিছুরই মিল নেই।

২৪ বছর আগে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের সময় থেকেই, পশ্চিমের বর্ধিষ্ণু সংখ্যালঘু (সাড়ে পাঁচ কোটি) জনগোষ্ঠী, পূর্বের সংখ্যাগুরু বাঙালীদের শাসন ও শোষণ করে এসেছে। বাঙালীরা ত্যাক্তবিরক্ত হয়ে ওঠে যখন তারা দেখতে পায় যে পূর্বের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং সেখানে কলকারখানা তৈরি ও উন্নয়ন প্রকল্পের পিছনে।

এমনকি যে কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্প পূর্ব পাকিস্তানে চলছিল সেগুলোও এখন বন্ধ হয়ে আছে আতংকে, অনিশ্চয়তায় এবং গ্রামাঞ্চলে বেসামরিক প্রশাসনের অপ্রতুলতায়।

প্রতিরোধ ক্রমবর্ধমান

তবুও, সেনাবাহিনী, শ্রমিকদের একত্রিত করে, শেষপর্যন্ত চট্টগ্রাম ও চালনার সমুদ্রবন্দর গুলোকে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় চালু করতে সক্ষম হয়েছে, কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকে যে পণ্যগুলো গুদামে ছিল সেগুলো ছাড়া আর কোনো পণ্য নেই বহির্গামী জাহাজে তোলার মতো।

খাদ্যসংকট ক্রমেই আরো জটিল আকার ধারণ করছে কিছু এলাকায় এবং বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন যে পরিস্থিতি দুর্ভিক্ষে রূপান্তরিত হতে পারে যদি না সামরিক বাহিনী বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং হাতে থাকা খাদ্য বিতরন শুরু করে।

সেরকম হবার সম্ভাবনা খুব একটা নেই বললেই চলে কারণ বাঙালীদের প্রতিরোধ, যদিও এখনো বিশৃঙ্খল, মনে হচ্ছে ক্রমেই ত্বরান্বিত হচ্ছে – ভারতের কাছ থেকে ক্রমবর্ধমান সাহায্য এবং আশ্রয়, এবং মাঝে মাঝে সাহায্যকারী গোলাবর্ষণ পেয়ে।

হাজার হাজার বাঙালী যুবককে গেরিলা যুদ্ধ এবং বিস্ফোরক ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে – প্রায়শই সীমান্তের ওপারে ভারতে, যেখানে ভারত জোগান দিচ্ছে প্রশিক্ষকের। নতুন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলারা পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যেতে শুরু করেছে।

আরো বেশি বেশি সড়ক ও রেল সেতু বিধ্বস্ত হচ্ছে এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিস্ফোরকের ব্যবহার করা হয়েছে অতি দক্ষতার সাথে। রাস্তার পাশে মাইন বিস্ফোরণ অতি সাধারন ঘটনা। প্রায়শই সেনাবাহিনী, যা কিনা যুদ্ধকালীন সতর্কাবস্থায় রয়েছে, স্থানীয় ঠিকাদারদের পায় না ক্ষতিগ্রস্থ রাস্তা মেরামতের জন্য, তাই তারা জোরপূর্বক ধরে আনা শ্রমিকদের কাজে লাগায়, যার ফলাফল খুব একটা ভালো হয় না।

খুব বেশি দিন আগের কথা নয় কুমিল্লা শহরের বাইরে গেরিলারা একটি রেল সেতু উড়িয়ে দেয়। সেনাবাহিনীর পাহারায় সেতু মেরামতের জন্য একটি ট্রেন পাঠানো হয়। গেরিলারা দিনেদুপুরে সেই ট্রেন আক্রমণ করে, চালকের সহকারীকে হত্যা এবং একজনকে বন্দী করে। ট্রেনটি দ্রুত পালিয়ে শহরে ফিরে যায়।

–      সিডনি এইচ. শ্যানবার্গ

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৬৬। পাকিস্তানের নিন্দা নিউইয়র্ক টাইমস ১৪ জুলাই, ১৯৭১

 

Razibul Bari Palash

<১৪, ৬৬, ১৪৬>

নিউ ইয়র্ক টাইমস, বুধবার। ১৪ জুলাই ১৯৭১

পাকিস্তানের নিন্দা

গত মাসে পূর্ব পাকিস্তানে বিশ্বব্যাংকের এলতি মিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তানের বিধ্বংসী সামরিক অভিযান চলছে। এতে করে ইসলামাবাদে ইয়াহিয়া খানের সরকারকে দেয়া সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা অব্যাহত রাখার বিষয়টি পুনির্বিবেচনার কথা বলা হয়েছে।

গতকাল এই কাগজে প্রকাশিত প্রতিবেদনের উদ্ধৃতাংশ থেকে জানা যায় উক্ত অঞ্চল জুড়ে মৃত্যু ও ধ্বংসলীলা চলছে।  একটি মিশনের সদস্য জানান কুষ্টিয়ার শহর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বোমাবর্ষনের ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত শহরের মত দেখাচ্ছিল। এখানে পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনী বারো দিন ধরে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। সেনাবাহিনী জনসাধারণের মধ্যে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করছে  বিশেষ করে হিন্দু ও আওয়ামী লীগের সন্দেহভাজন সদস্যদের জন্য।

এর আগে প্রকাশিত রিপোর্টে পূর্ব পাকিস্তানের বর্বর কর্মকাণ্ডের জন্য পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীকে কোন প্রকার আমেরিকান সামরিক সরঞ্জামের চালান পাঠানো ঠিক হবেনা। যেগুলো রওনা দিয়েছে সেগুলো থামাতে হবে যেমন করে যুদ্ধ শুরু হবার কারণে খাদ্য চালান চট্টগ্রাম পোর্টে আসা থামানো হয়েছিল। বিদেশী আক্রমণ বন্ধ হবার আগ পর্যন্ত খাদ্য সহায়তা ছাড়া আর কোন অস্ত্র সহায়তা না দেওয়াই উচিৎ। এবং নির্বাচিত প্রতিনিধি যারা পলাতক বা কারাগারে আছেন তাদের কাছে ক্ষমতা বুঝিয়ে দেয়া উচিৎ।

বিশ্বব্যাংক উন্নয়ন সহায়তা স্থগিত রাখার জন্য শক্তিশালী যৌক্তিক অবস্থান নিয়েছে। পক্ষান্তরে পাকিস্তানের সরকারি দাবি মিশন জানায়, ‘পরিস্থিতি খুবই স্বাভাবিক আছে। এমনকি খারাপ দিকে যাবার কোন লক্ষণ নেই।’রিপোর্টে বলা হয় জনগণের মধ্যে ভীতি ও নিরাপত্তা হীনতা তৈরি হয়েছে এবং যোগাযোগ ব্যাবস্থা পুরো ধ্বংস হয়েছে। পরিশেষে রিপর্টে বলা হয় নতুন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন প্রচেষ্টা অন্তত আগামী বছর বা ৬ মাসের জন্য বন্ধ রাখা উচিৎ।

প্যারিসে গত মাসে পাকিস্তানের সাহচর্যে থাকা এগারো-জাতির সম্মেলনে দশ টি সদস্য দেশে এই মতের সঙ্গে একমত। শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অপ্রত্যাশিতভাবে একমত পোষণ করেনি। পাকিস্তানে আমেরিকান উন্নয়ন সহায়তার ধারাবাহিকতা আন্তর্জাতিক ঐক্যমত্যের মুখে প্রশ্নবিদ্ধ এবং বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে তা প্রমাণিত।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৬৭। পাকিস্তানের উদ্যেশ্যে প্রেরিত অস্ত্রভর্তি জাহাজ প্রতিরোধের কয়েকটি সংবাদ বাল্টিমোর সান, ওয়াশিংটন সটার, ফিলাডেলফিয়া বুলেটিন ১৬ জুলাই, ১৯৭১

Lenin Ghazi

<১৪, ৬৭, ১৪৭-১৫৪>

দি বাল্টিমোর সান, জুলাই ১৬, ১৯৭১

পাকিস্তানে অস্ত্র বহনকারী শিপিং এজেন্ট প্রতিবাদের সম্মুখীন

তেরো জন প্রতিবাদকারী- তার মধ্যে এক জন মাত্র পাকিস্তান থেকে- শহরের একটি অফিস বিল্ডিংয়ের সামনে মিছিল করে প্রতিবাদ জানায়, কথিত এক মিলিটারি কার্গো পাকিস্তানে পাঠানোর ব্যাপারে এই প্রতিবাদ।

৪৫ মিনিটের এই শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে প্রতিটি মিছিলকারির হাতেই ছিল বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড যেগুলো নিয়ে তারা কালভার্ট ও রেডউড স্ট্রিটের কেইসার বিল্ডিংয়ের সামনে অবস্থান করে।

তাদের থেকে দুজন নেতা পরে ইস্ট ওয়েস্ট শিপিং এজেন্সির একজন প্রতিনিধির সাথে আলাপ করে, এই বিল্ডিংয়ে প্রতিষ্ঠানটি অফিস রয়েছে। এই এজেন্সিটি আগামীকাল বিকেলে ম্যাককোমাস স্ট্রিটের পোর্ট কোভিংটন টারমিনালে পদ্মা নামে পাকিস্তানি একটি মালবাহী জাহাজ আসার ব্যাপারে প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

গন্তব্য করাচি

পাকিস্তানি জাহাজটি, যার গন্তব্যস্থল করাচি, বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরেই বিতর্কের বিষয় ছিল। রিপোর্টে জানা গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহের লাইসেন্সের অনুমোদন দেবে না, তবে আগের নির্ধারিত শিপমেন্টগুলো হতে দেবে। পাকিস্তানি সরকার পূর্ব পাকিস্তানি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের একটি বিদ্রোহ দমন করেছে তবে গেরিলা আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে।

প্রতিবাদকারিদের মুখপাত্র বিন ময়ের দাবী করেন পদ্মা জাহাজটিতে আটটি সেবার জেট, বিমান যন্ত্রাংশ ও খুঁটিনাটি, গাড়ির যন্ত্রাংশ এবং ২০০০ রাউন্ড অ্যামিনিশন ভরা রয়েছে।

ম্যানেজারের সাথে আলোচনা

আমেরিকান ফ্রেন্ডস সার্ভিস কমিটিস এর জ্যাক প্যাটারসন এবং ডায়ানা স্ক্রাম মিছিল থেকে এগিয়ে যান ইস্ট-ওয়েস্ট শিপিং এজেন্সিস এর ম্যানেজার ওয়াল্টার স্পাইকার এর সাথে পদ্মা’র ব্যাপারে আলাপ করতে।

মিসেস স্ক্রাম মি. স্পাইকারকে জানান তার সংগঠন, ফ্রেন্ডস অফ ইস্ট বেঙ্গল এই জাহাজটির অবস্থান এবং বহনকৃত মালামাল সম্পর্কে বেশকিছু পরস্পর বিরোধী রিপোর্ট পেয়েছে।

মি. স্পাইকার বলেন, ‘আমাদেরকে কেউ কল করেনি’ এবং সঙ্গে সঙ্গেই জানিয়ে দেন আগামীকাল জাহাজটি এসে পৌঁছাবার কথা। “পদ্মা এখন সাগরে রয়েছে, মন্ট্রিল (যা কানাডার শেষ বন্দর) এবং বাল্টিমোর এর কোনো এক জায়গায়”, মি. স্পাইকার আরও জানান। “আমি যতটা জানি ডকে শেষ তক যা ঘটেছে সে অনুযায়ী কোনো সামরিক মালামাল পদ্মায় উঠাবার কথা নয়”

.

তোমরা নিয়ে নিতে পারো

মি. স্পাইকার এর জানামতে সেই জাহাজে আছে কেবলই ১,৮০০ টন ওজনের সাধারণ কার্গো যার মধ্যে রয়েছে স্টিল, ময়দা এবং কাঁচের জিনিষপত্র। “আপনারা এসে আমাদের মালামাল লোড করা দেখতে পারেন”, তিনি সমাপ্তি টানেন, “যদি আপনারা সেখানে কোনো প্রকারের সামরিক মালামাল লোড করতে দেখেন, তবে সেগুলো সব আপনাদের”

এই তথ্য নিয়ে মি. প্যাটারসন এবং মিসেস স্ক্রাম প্রতিবাদকারিদের কাছে ফিরে যান, যারা তখনও পিকেটিং করছিল। প্রতিবাদকারিরা তাদের এই প্রতিনিধিদের ঘিরে দাঁড়িয়ে ঘোষণা শোনেন, এর সাথেই সেদিনকার প্রতিবাদ এর সমাপ্তি ঘটে।

মি. ময়ের জানান তার সংগঠন জেনেছে যে আগামীকাল অস্ত্র উঠানো করা হবে, যদিও মি. স্পাইকার জোর দিয়ে বলেছিলেন বাল্টিমোর এ কোনো সামরিক কার্গো উঠবে না।

চার্লস জোনস, যিনি লোকাল ৮২৯, ইন্টারন্যাশনাল লংশোরম্যান’স অ্যাসোসিয়েশন এর ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট, জানান তিনি পদ্মা’র শিপমেন্ট এর সাথে জড়িত এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করেছেন। তিনি বলেন তাকে জানানো হয়েছে বাল্টিমোর এ কোনো গোলাবারুদ, কোনো সামরিক মালামাল অথবা সামরিক সংশ্লিষ্ট কোনো সরঞ্জাম উঠানো হয়নি। প্রতিবাদকারিরা জানায় তারা আজ বেলা ১২টায় কেইসার বিল্ডিং এর সামনে সমবেত হবে। সেখান থেকে তারা ১০০ নং ব্লক-এর সাউথ গে স্ট্রিট এর অবস্থিত ইউনাইটেড স্টেটস কাস্টমস অফিস এর দিকে মিছিল করে এগিয়ে যাবে এবং কর্মকর্তাদের সাথে পদ্মা’র ব্যাপারে কথা বলবে।আগামীকাল কোভিংটন টারমিনাল বন্দরে ‘নন-ভায়োলেন্ট নেভি’’দের একটি অবরোধ ধার্য রয়েছে।

জাহাজ অবরোধকারি ৭ যুবককে পুলিশ আটক করেছে ১৫১১তে

–      অ্যান্টেরো পাইটিলা

পানিতে নেমে পাকিস্তানি জাহাজ পদ্মাকে ডকে অনুপ্রবেশে বাধাদানকারী সাত যুবককে গত রাতে বাল্টিমোর পুলিশ দুটি বোট সহযোগে গ্রেপ্তার করেছে। ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। পুলিশ তাদেরকে পদ্মা জাহাজটির খুব কাছে অবস্থানকালে দুটি ক্যানো এবং একটি কায়াক থেকে উদ্ধার করেছে। এই পদ্মা জাহাজটি করাচির যেটি সম্পর্কে কথিত রয়েছে যে সামরিক সরঞ্জাম বহন করে পাকিস্তান নিয়ে যাচ্ছে যদিও তেমন শিপমেন্টের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়োছে।

যাদেরকে নৌযান চলাচলে বাধাদানকারি এবং পুলিশের আদেশ অমান্যকারী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছে তারা হলেন, ওয়েইন লসার, স্যালি উইলোবি, রিচার্ড টেইলর, মাই স্কট, স্টেফানি হলিম্যান এবং চার্লস গুডউইন। সকলকেই ফিলাডেলফিয়া’র অধিবাসি বলে জানা গেছে। প্রাথমিক শুনানি সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে বেলা ৯টায় অনুষ্ঠিত হবার কথা।

.

পাশে দাঁড়াল আরও ২ জন

আরও দু’টি ক্যানোতে করে ৫ জন প্রতিবাদকারি জাহাজটির পাশে অবস্থান করার অনুমতি পেয়েছে। আটটার কিছু আগে পাইয়ার ৮এ জাহাজটি নোঙর করেছে।

এর আগে গতকাল, ইন্টারন্যাশনাল লংশোরমেন অ্যাসোসিয়েশন তাদের বাল্টিমোর এর এক অধিবাসীকে পদ্মায় কাজ করতে নিষেধ করে, কারণ হিসেবে তারা পূর্ব পাকিস্তানকে দুর্দশাগ্রস্ত করছে এমন গৃহযুদ্ধের ব্যাপারে ‘নিরপেক্ষ’ থাকতে চায়। এদিকে নিউ ইয়র্কে জাহাজটির মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্ট অ্যালান এলিয়া, যিনি ইস্ট ওয়েস্ট শিপিং এজেন্সির ভাইস প্রেসিডেন্ট, জানিয়েছেন জাহাজে কোনো সামরিক মাল-সরঞ্জাম ছিল না। তিনি জানিয়েছেন, তার কোম্পানি লংশোরমেন’স ইউনিয়ন এবং ফেডেরেল মেরিটাইম কমিশন বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আনয়নের চিন্তা করবে যদি লংশোরমেন সকালে কাজ করতে না আসে।

মি. এলিয়ার বরাতে জানা যায় লংশোরমেন এর তিনটি দল আজ সকাল ৭টা থেকে কাজ শুরুর কথা। তিনি আরও জানান বাল্টিমোর নির্ধারিত যে মাল-সরঞ্জাম জাহাজে তোলার কথা রয়েছে তার মধ্যে কোনো প্রকার সামরিক মালামাল নেই।

“পুরো ব্যাপারটাই হাস্যকর”, এক টেলিফোন সাক্ষাৎকারে এজেন্টটি বলেন। তিনি উল্লেখ করেন তিনি জাহাজের মালামাল পরিদর্শনের ব্যবস্থা করতেও রাজি আছেন যদি কোনো প্রকার সামরিক মালামাল না পেলে পরিদর্শক এই আয়োজনের খরচাদি বহন করেন। লোকাল ৮২৯ মায়ামি থেকে একটি বয়কট আদেশ পায়, যেখানে এর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাগণ একটি সম্মেলনে যোগ দেবার কথা।

ইউনিয়নের ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট চার্লস (বাক) জোনস জানান টেলিফোনে এই নির্দেশের পেছনে কোনো ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। “উইলিয়াম হিয়ালে যিনি আমাদের আন্তর্জাতিক ভাইস প্রেসিডেন্ট তিনি জানান যে, আমাদের ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট টমাস জি. গ্লিসন বলেছেন এই কার্গোতে কেউ কাজ করবে না। তিনি কোনো ব্যাখ্যা দিতে বলেননি।”

একটি বিপ্লব চলছে

তিনি এরপর যোগ করেন, “সেখানে [পাকিস্তান] একটি বিপ্লব বিদ্যমান, তাই না? আমরা কোনোভাবে তাতে জড়িত থাকতে চাইনা।”

বিকেল জুড়ে, যখন পদ্মা চেসাপিক আর ডেলাওয়ার ক্যানেলে ছিল, পোর্ট কোভিংটন এর কাছে তিনটি ক্যানো, দুটি কায়াক আর একটি রো-বোট এর একটি বহর ঘোরাফেরা করছিল।

নৌকাগুলোতে ছিলেন ফ্রেন্ডস অফ ইস্ট বেঙ্গল এর সদস্য ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা। ফিলাডেলফিয়া ভিত্তিক এই সংগঠনটি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার রয়েছে। খবর রয়েছে যে দ্য আমেরিকান ফ্রেন্ডস সার্ভিস কমিটি, দ্য কোয়েকার অর্গানাইজেশন এবং গত কালকের প্রতিবাদীদের সাথে এই সংগঠনের দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে। তারা গত গ্রীষ্মে এজউড আর্সেনাল এ বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার এর বিরুদ্ধেও সোচ্চার ছিলেন।

গ্রুপটির পরিকল্পনা

প্রায় ৩৫ সদস্যের এই গ্রুপটির প্রতিনিধি চার্লস ওয়াকার বলেন, তাদের বিক্ষোভকারীরা পদ্মাকে পোর্ট কোভিংটনে নোঙর করতে বাধা দেবার চেষ্টা করবে।

তিনি আরও জানান, যদি তাদের নোঙরে বাধা প্রদান বিফল হয়, তবে তারা সেটিকে বন্দরে অবরুদ্ধ রাখবেন। এই পদ্মাকে নিয়ে যত দ্বন্দ্বের সূচনা ২২শে জুন থেকে, যখন ওয়াশিংটন থেকে নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয় জাহাজটি নিউ ইয়র্ক থেকে ছাড়বে। আগস্টের মাঝামাঝি করাচিতে পৌঁছবার কথা রয়েছে জাহাজটির, বয়ে নিয়ে যাবে আটটি এয়ারক্রাফট, প্যারাশুট এবং “হাজার হাজার পাউন্ড ওজনের সামরিক বিমান ও গাড়ির যন্ত্রাংশ ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম”, টাইমস এ লেখা হয়েছে।

সমরাস্ত্র বিক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা

পাকিস্তানে সমরাস্ত্র বিক্রি’র উপর ২৫শে মার্চে স্টেট ডিপার্টমেন্টের এক নিষেধাজ্ঞার বরাত দিয়ে পেপারটি বলে, “অজ্ঞাতনামা এক কর্মকর্তা বলেছেন ‘কিছু গলদ আছে বলেই প্রমাণ পাওয়া গেছে।’”

নিউ ইয়র্ক ছাড়ার পর পদ্মা জাহাজটি কানাডার উদ্দেশ্য পাড়ি জমায়, যেখানে কর্মকর্তারা আর কোনো প্রকার শিপমেন্টের উপর নিষেধাজ্ঞা অর্পণ করেন।

.

প্রতিবেদন অগ্রাহ্য

তিনি বলেন যে, কানাডিয় কর্মকর্তাবৃন্দ একটি কার্গো উঠাতে বাধা দিয়েছে যেটিতে, “৪৬ বাক্স যন্ত্রাংশ এবং সরঞ্জাম” ছিল।

তিনি টাইমস’এর প্রতিবেদনটিকে অগ্রাহ্য করে বলেন, “এটা হাস্যকর। কেউ ভুল তথ্য পেয়েছিল। আমাদের কোনো সামরিক কার্গো ওঠানো হয়নি, কোনোটিতেই নয়। আমাদের ১০ বাক্স স্মোক সিগন্যাল আছে। এখন এটাকে যদি গোলাবারুদ বলেন…” এজেন্ট বলেন। কার্গোতে এয়ারক্রাফট থাকার ব্যাপারটিকেও তিনি উড়িয়ে দেন এবং বলেন বিমান সংক্রান্ত যা ছিল সেগুলো হচ্ছে, অল্টিমিটার, “বিমানের যন্ত্রাংশ, নাট এবং বল্টু।”

তবে প্রতিবাদকারিরা – যাদের মধ্যে প্রায় দশজন পাকিস্তানি এবং ভারতীয় ছিলেন – অটলভাবেই দাবী করতে থাকেন কার্গোতে সামরিক জিনিসপত্রই ছিল। তারা গতকাল প্ল্যাকার্ড বহন করেছেন যেগুলোতে লেখা ছিল, ‘পাকিস্তানকে থামাও – গণহত্যা হচ্ছে – অস্ত্র পাঠিও না।”

গ্রুপটি লংশোরমেন এর পদ্মায় কাজ না করবার ব্যাপারে গৃহীত সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানান যদিও এটির বাল্টিমোর এর কার্গো সামরিক মালামালের ছিল না।

দ্য বাল্টিমোর সান, শুক্রবার, জুলাই ১৬, ১৯৭১

পাকিস্তানি অস্ত্রবাহী জাহাজে মালামাল উঠাতে ডক ইউনিয়নের অস্বীকৃতি

আমেরা পাইটিলা কর্তৃক

লংশোরমেন মালামাল উঠাতে অস্বীকার করায় পাকিস্তানি জাহাজ পদ্মা আজ বাল্টিমোর ছেড়ে মোবাইল, আলা-এর উদ্দেশ্যে রওনা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। লোকাল ৮২৯ এর সদস্যরা ইন্টারন্যাশনাল লংশোরমেন’স অ্যাসোসিয়েশন এর টমাস জি. গ্লিসন (ইউনিয়নটির প্রেসিডেন্ট) কর্তৃক আদেশপ্রাপ্ত হয়েছিলেন পোর্ট কোভিংটনে অবস্থানকৃত জাহাজটিতে কাজ না করার জন্য। তার মতে, তার ইউনিয়ন পাকিস্তানী গৃহযুদ্ধে ‘নিরপেক্ষ’ থাকতে চায়।

এই যুদ্ধে, স্টেট ডিপার্টমেন্টের হিসাবমতে কমপক্ষে ২০০,০০০ লোকের প্রাণহানী ঘটেছে এবং ষাট লাখ লোক ভারতে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অবস্থিত ন্যাশনাল শিপিং কোম্পানী অফ করাচি, পাকিস্তান এর এজেন্ট দ্য ইস্ট ওয়েস্ট শিপিং কোম্পানী একটি টেলিগ্রাম পাঠিয়েছে ফেডেরেল মেরিটাইম কমিশনকে, তাতে অভিযোগ করেছে যে লংশোরম্যানের এই কর্মকাণ্ড যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের বাণিজ্যে সরাসরি বিঘ্নের সামিল।

এই টেলিগ্রামে কমিশনের চেয়ারম্যান মিসেস হেলেন ডেলিচ বেন্টেলিকে এই বিবদমান পরিস্থিতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করার অনুরোধ করা হয়েছে। তবে একজন মুখপাত্র বলেছেন, কমিশন এখনই কোনো হস্তক্ষেপে যাবে না বরং পরিস্থিতিটির নিরিখ করবে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার সাথে যোগাযোগে এই শিপিং এজেন্সি জানিয়েছে যে, পদ্মার কার্গো হিসেবে এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এর থেকে যাচ্ছে: ফার্মাসিউটিক্যাল সাপ্লাই, কীটনাশক, অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম এবং বৈদ্যুতিক জেনারেটর।

তবে স্টেট ডিপার্টমেন্ট নিশ্চিত করেছে যে, এর কার্গোতে অস্ত্রশস্ত্র ছিল যার রপ্তানী লাইসেন্স ২৫শে মার্চের আগে দেয়া হয়েছিল, পাকিস্তানে এমন ধরণের মালামাল পাঠানোর প্রতি নিষেধাজ্ঞা কার্যকর রয়েছে।

পদ্মা’র কার্গোতে থাকা সামরিক সরঞ্জাম এর পরিসংখ্যান এবং আর্থিক মূল্যমান দেয়া হলো: বিমানের যন্ত্রাংশ ৯২৪,৩২৯ মার্কিন ডলার, সামরিক যানবাহনের যন্ত্রাংশ ১৮৪,১৮৭ মার্কিন ডলার, বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ ২৫,৪১৭ মার্কিন ডলার, জাহাজের যন্ত্রাংশ ৪৫,১১৭ মার্কিন ডলার এবং যুদ্ধাস্ত্র বা আর্টিলারি এর যন্ত্রাংশ ২,৮৩০ মার্কিন ডলার।

সামরিক সরঞ্জাম হিসেবে আছে ২২ ক্যালিবার এর ২,২০০ রাউন্ড গোলাবারুদ যা যুদ্ধাস্ত্র বা আর্টিলারি এর সাথে। এগুলো সবই গত মাসে নিউ ইয়র্ক থেকে পদ্মা জাহাজটিতে ওঠানো হয়েছে বলে স্টেট ডিপার্টমেন্ট জানিয়েছে।

জাহাজটি এর পরে মন্ট্রিলের উদ্দেশ্যে রওনা হয়, যেখানে এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক সরবরাহকৃত সেবার জেট এর যন্ত্রাংশের ৪৬টি ক্রেট নেবে। ক্রেটগুলো ওঠানোর ক্ষেত্রে কানিডিয় সরকার বাধা দিয়েছে। শিপিং এজেন্ট বলেন, বাল্টিমোরে পদ্মা জাহাজটি পানিতে বেশি ভাসছিল যাতে তা অর্ধেক খালি বলেই বোঝা যায়, এতে বেসামরিক জিনিসপত্র ওঠাবার কথা।

এই মালামালের মধ্যে অজ্ঞাত পরিমাণের ইলেক্ট্রোলাইটিক টিনের পাত আছে, যা এখন জাহাজঘাটাটির একটি ওয়্যারহাউসে আছে এর প্যাকেজের গায়ে পরিচিত এআইডি চিহ্ন আড়াআড়ি রাখা হাত দেখা যায়।

এদিকে মোবাইল এ জাহাজটিতে আরও ইস্পাতের পন্য ওঠাবার জন্য অপেক্ষায় আছে। উপকূলীয় বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় ফিলাডেলফিয়া ভিত্তিক ফ্রেন্ডস অফ ইস্ট বেঙ্গল এর ৩০ জন সদস্য এবং সহানুভূতিশীলগণ পোর্ট কোভিংটনের গেটে ইট-পাটকেল ছুঁড়েছে এবং জাহাজের কাছে ক্যানোতে করে নিজেদের প্ল্যাকার্ডে প্রতিবাদ প্রদর্শন করেছে।

কয়েদে রাত্রিযাপন

বুধবার রাতে যখন পদ্মা জাহাজটি পোর্ট কোভিংটনে পৌঁছায়, দুটি নৌকায় করে সিটি পুলিশ তিনটি ক্যানোভর্তি বিক্ষোভকারিদের গ্রেফতার করে।

সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্ট লকআপ-এ পুরো রাত আটক থাকার পর ফিলাডেলফিয়ার ৬ জনের প্রত্যেকে রায় ছাড়াই নিরীক্ষাকাল (প্রোবেশন) লাভ করে, নৌযান চলাচলে বাধাসৃষ্টি এবং এক পুলিশের আদেশ অগ্রাহ্য করাই তাদের অপরাধ। একজন প্রতিবাদি অভিযোগ থেকে রেহাই পায়।

পোর্ট কোভিংন এর গেট এর কাছে এক সাংবাদিক সম্মেলনে প্রতিবাদকারিরা জানায় তারা তাদের প্রতিবাদকে আরও বিস্তৃত করার পরিকল্পনা নিয়েছে।

ওয়াশিংটন স্টার, শুক্রবার, জুলাই ১৬, ১৯৭১

বাল্টিমোর-এ অস্ত্রবাহী জাহাজ নিয়ে প্রতিবাদ

বাল্টিমোর (এপি) পদ্মা আজ বাল্টিমোর এ নোঙর করতে বাধা দেবার কর্মসূচী চলমান থাকার কথা। কথিত রিপোর্টে জানা গেছে পাকিস্তানি এই জাহাজটি এর যুদ্ধবিধ্বস্ত প্রদেশে অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে যাবে।

একজন অফিসার জানান সবাইকে নৌযানকে মুক্তভাবে যাতায়াতে বাধাপ্রদানের অভিযোগে আটক করা হয়েছিল। তিনি আরও জানান, “তাদেরকে নিজেদের নিরাপত্তার জন্যই বরং আটক করা হয়েছিল।”

ইতোমধ্যে বিতর্ক চলমান রয়েছে যে পদ্মায় নির্ধারিত মালামাল তোলা হবে কিনা।

তবে, বাল্টিমোর এর স্থানীয়দেরকে ইন্টারন্যাশনাল লংশোরমেন’স অ্যাসোসিয়েশন নির্দেশ দিয়েছে জাহাজটিতে মালামাল না উঠাতে। বিক্ষোভকারিদের মতে এই জাহাজে করে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সরঞ্জাম পাকিস্তানে নেয়া হচ্ছে, যদিও এমন মালামাল পরিবহনের উপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে, জাহাজটির যুক্তরাষ্ট্রীয় এজেন্ট ইস্ট-ওয়েস্ট শিপিং এর দাবী এমন কোনো সামরিক মালামাল জাহাজটি বহন করছে না।

সান্ধ্য বুলেটিন

ফিলাডেলফিয়া, শুক্রবার জুলাই ১৬ ১৯৭১

পাকিস্তানগামী জাহাজ অবরোধকারী ৬ জনের মুক্তি

বাল্টিমোর – ছয় জন ফিলাডেলফিয়ান, যারা পাকিস্তানগামী একটি জাহাজে মালামাল ওঠাতে বাধা প্রদানের জন্য ক্যানো এবং কায়াক ব্যবহার করে পথ রোধ করায় গ্রেফতার হয়েছিল, গতকাল তারা একটি সতর্কতা প্রদর্শনপূর্বক মুক্তি পেয়েছেন।

ড. চার্লস কান, যিনি ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভেনিয়ার একজন শিক্ষক এবং এই গ্রুপের নেতা, জানিয়েছেন তার অনুসারীরা আবারও পদ্মা নামক জাহাজটিতে মাল ওঠানোতে বাধা দেবে পেনসিলভেনিয়াতে এলে।

ড. কান এর সঙ্গে আটক হওয়া আরেক ফিলাডেলফিয়ান হলেন রিচার্ড টেইলর, গ্রিন এর কাছে সেজউইস্ক স্ট্রিট থেকে, ম্যালকম স্কট, পেলহাম এর কাছে হর্লটার স্ট্রিট থেকে, স্যালি উইলোবি আর স্টেফানি হলিম্যান ৪৪তম এর কাছে পাইন স্ট্রিট থেকে, চার্লস গুডউইন, ৫০তম এর কাছে উইলো অ্যাভিনিউ থেকে এবং মিডিয়ার থেকে ওয়েইন লসার। তারা সারা রাত কয়েদে আটক ছিলেন।

 

 

 

শিরোনাম সূত্র তারিখ
বাঙালীরা রুখে দাঁড়িয়েছে নিউজ উইক ১৯ জুলাই, ১৯৭১

 

নীতেশ বড়ুয়া

<১৪, ৬৮, ১৫৫-১৫৬>

 

নিউজ উইক- ১৯শে জুলাই, ১৯৭১

বাঙালীরা রুখে দাঁড়িয়েছে

“আমি আনন্দের সাথে আপনাদেরকে জানাচ্ছি” এইভাবে জাতির উদ্দেশ্যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন যে “ পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির উপর সেনাবাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে। এরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী দুর্বৃত্ত, অন্তর্ঘাতী, অনুপ্রবেশকারীদের বিনাশ করেছে।” ইয়াহিয়ার প্রতি আফসোস , বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন কথা বলছে। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে দেখা যাচ্ছে যুদ্ধরত বাঙালীদের প্রতিরোধ আন্দোলন আগের যেকোন কিছুর চাইতে আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এইটা প্রমাণ করতে যে এই আন্দোলন এখনও ভাল মতোই চলছে এবং ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পরা ভারী অস্ত্রে সজ্জিত দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জীবনকে আরও জটিল করে তোলার ক্ষমতা রাখে।

পাকিস্তানের বিধ্বস্ত সমগ্র পূর্বাঞ্চল জুড়ে পুনুরুজ্জীবিত বিদ্রোহী দল নিঃশর্ত ভাবে তাদের অস্তিত্বকে জানান দিয়েছে। ভারতের দেয়া প্রচন্ড সংঘর্ষের অনুশীলন কার্যক্রম এবং অস্ত্র ও গোলাবারুদের সুযোগ তারা নিচ্ছে। মুক্তিবাহিনী (লিবারেশন আর্মি)  আক্রমণাত্মক রূপ ধারণ করেছে। শিল্প-কারখানাতে অন্তর্ঘাত করা হয়েছে, প্রধান সেতুগুলো কার্যকরী বিস্ফোরণের মাধ্যমে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ রণযান চলাচলের পথে গোপনে রাখা ম্যাশিনগান আক্রমণের শিকার হয়েছে এবং অপেক্ষাকৃত কম রেল-ইঞ্জিন কার্যক্রম চালাচ্ছে এমন রেলপথগুলো মাইন দ্বারা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

হুমকি

যদিও ভারত সীমান্তের  কাছাকাছি ভারী আক্রমণ চলছিল, তবুও ৯০ মাইল দূরে থাকা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা প্রতিরোধকারী বাহিনীর আক্রমণের আওতায় চলে আসে।  পাল্টাপাল্টি গোলাবর্ষণ ও মাঝে মাঝে মধ্যে বিস্ফোরণের শব্দে শহরের রাস্তাঘাট প্রকম্পিত হচ্ছিল। এবং এই মাসের শুরুতে এমনই এক রাতের আক্রমণে বাঙালী বিদ্রোহীরা ঢাকা  বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান ট্রান্সফরমারকে উড়িয়ে দিয়ে রাজধানীকে প্রায় ছয় ঘন্টার মতো সপর্ণই অন্ধকারে নিমজ্জিত করে দেয়। গত সপ্তাহে এক পশ্চিমা কূটনৈতিক বলেছেন যে “এটা হয়তো খুব আগবাড়িয়ে দেখা হবে যে মুক্তিবাহিনী সেনাবাহিনীর জন্য গুরুতর হুমকি স্বরূপ।” “কিন্তু এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আমরা রক্তাক্ত, দীর্ঘকালীন গেরিলা যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ের সাক্ষী হচ্ছি।”

এই পাহাড়ুসম সংগ্রামে তাদের অভ্যুত্থানের সাথে যুঝতে গিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অব্যাহত নির্বিচার নির্যাতন বাঙ্গালী বিদ্রোহীদের ক্ষোভের রসদ যোগাচ্ছিল। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে বিদ্রোহীরা তাদের নিজস্ব এলোমেলো ত্রাসের ভীতিকে অন্তর্ভুক্ত করতে নিজেদের  গেরিলা আক্রমণ আরও ছড়িয়ে দিয়েছে। যেখানে রাজ্যের কর সংগৃহীত হয় সেখানে কার্যক্রম না চালানোর জন্য জনগোষ্ঠীকে সতর্কবার্তা হিসেবে ঢাকাস্থ গুলিস্তান সিনেমা হলে ব্রিদ্রোহীদের গ্রেন্ড ছোঁড়া হয় এবং এতে এক ব্যক্তি নিহত ও আরও চৌদ্দ ব্যক্তি আহত হয়। একইভাবে পাকিস্তান সরকারের উদ্দেশ্যে আমেরিকার অস্ত্রের চালান ও সরবরাহের প্রতিবাদে উপকন্ঠের বাইরে ধানমন্ডিতে বসবাসরত আমেরিকান দূতের বাড়িতে একটি ছোটোখাটো বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।

“গ্রামাঞ্চলে” নিউজউইকের লরেন জেঙ্কিন্স যিনি গত সপ্তাহে পূর্বাঞ্চল পরিদর্শন করেছিলেন তিনি তারবার্তা পাঠান এই বলে যে “ পরিস্থিতি আরও বহু দূর গড়িয়েছে। সম্প্রতি গাঙ্গেয় ব্ব-দ্বীপের শহর খুলনাতে অভিবাসিত দুই সেনা কর্মকর্তা- গোলাম সরোয়ার ও আব্দুল হামিদ খান

বিদ্রোহী দল হতে একটি ‘চরম পত্র’ পায় যেখানে বলা হয়েছে তাদেরকে গোপনে হত্যার জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে। যদিও ব্যক্তিদ্বয় নিজেদেরকে রাজাকার(অভিবাসিত-সরকারের আইনরক্ষাকারী) দেহরক্ষী দ্বারা ঘিরে রেখেছে, তবুও এক সপ্তাহের মধ্যেই সেই দুইজনের মৃত্যু হয়। এবং কাল মুখোশধারী ভয়ংকর গেরিলা আক্রমণে সারোয়ারের বাড়ির রাজাকার দলটি পরাজিত করা হয়, পরবর্তীতে তারা স্বারোয়ারের মাথটি শরীর হতে বিচ্ছিন্ন করে তাদের সাথে নিয়ে যায়।”

 

বার্তা

পূর্ব পাকিস্তানের মিলিটারী গভর্ণর লেঃ জেঃ টিক্কা খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীও একই রকমের প্রতিক্রিয়া দেখায়। গেরিলারা উত্তর ঢাকার একটি সেতু উড়িয়ে দেওয়ার পর পাঞ্জাবী সৈন্যরা পার্শ্ববর্তী বেশ কিছু গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়, গেয়াম্বাসীদের পর্যায়ক্রমে হত্যা করে এবং অন্যদেরকে তাদের হেফাজতে রেখে দেয়। জেঙ্কিন্স জানায় যে খুলনার গুপ্তহত্যার ব্যাপারে পাকিস্তানি আর্মিদের প্রতিক্রিয়া আরও অনেক ভয়ংকর ছিল। “ সারোয়ারের মস্তক ছিন্নের পরের দিন সকালে খুলনা জুটমিলের উদ্দেশ্যে থাকা শ্রমিকেরা রেলস্টেশনের সামনে সারিবদ্ধভাবে সাজানো সতেরটি মৃতদেহ দেখতে পায় যাদের হাত পিছমোড়া করে বাঁধা এবং প্রতিজনকে গুল করে হত্যা করা হয়েছে। সেনাবাহিনী মৃতদেহগুলোকে ২৪ ঘন্টার মতো জনসম্মুখে ফেলে রাখে যাতে জনতার এর অর্থ বুঝে নিতে পারে।”

কিন্তু এই আনুমানিক ৩০,০০০ গেরিলা যোদ্ধার উপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই কৌশল কিভাবে সফল হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় বিদ্যমান। এটা সত্য যে, টিক্কা খান যেখানেই তার সৈন্যদল নিয়ে একাগ্রতা দেখিয়েছে সেখানেই তারা এগিয়ে থাকার লক্ষণ দেখা গিয়েছে। কিন্তু অন্যত্র ব্যর্থ চেহারা। মুক্তিবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের ৭ কোটীরও বেশী জনসংখ্যাকে নিজেদের দিকে টেনে নিতে পারে। এবং সেনাবাহিনীর প্রতিটি নতুন করে করা হত্যাযজ্ঞ ভীত বাংলার জনতার দৃঢ় সংকল্পকে আরো শক্তিশালী করে তোলে। পশ্চিমা কূটনৈতিক ব্যক্তি জেঙ্কিন্স গত সপ্তাহেই বলেছেন যে “ইয়াহিয়া খান এবং সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতনেরা মনে করেছিল যে বাঙ্গালীদেরকে তারা ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলতে পারবে।” “সত্যই যে বাঙ্গালীরা ভয় পেয়েছে কিন্তু এর ফলাফল পুরোই উল্টো। যদিও তিনি আগে কোনদিন তা করেননি কিন্তু তিনি তা টেনে নিয়ে গিয়েছেন এবং তিনি বুঝেছেন যে তার নিজেকে মুক্ত করার একমাত্র উপায় হচ্ছে- শুধুমাত্র সহিংসতা।”

 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!