শিরোনামঃ
|
সুত্রঃ | তারিখঃ |
পুর্ববংগে গণহত্যা সম্পর্কে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের শ্রমিক দলীয় সদস্য মিঃ ব্রুস ডগলাস ম্যান-এর বক্তব্য | আনন্দবাজার | ২৪ এপ্রিল, ১৯৭১
|
ভিয়েতনামে ‘মাইলাই’ একটি ব্যতিক্রম, আর গোটা পুর্ববংগই মাইলাই – ডগলাস ম্যান
(স্টাফ রিপোর্টার)
কলকাতা, ২৪ এপ্রিল-ব্রিটিশ পার্লামেন্টের শ্রমিক দলের সদস্য মিঃ ব্রুস ডগলাস ম্যান আজ এখানে বলেন যে, ভিয়েতনামে মার্কিন ফৌজ সাধারণ মানুষের উপর যে অত্যাচার চালিয়েছে, ইয়াহিয়াশাহীর বর্বতা তাকেও হার মানিয়েছে। তিনি বলেন, ভিয়েতনামে মাইলাই একটি ব্যতিক্রম, আর গোটা পুর্ববংগই মাইলাই। আজ সকালে কলকাতা প্রেসক্লাবে দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের এক বৈঠকে তিনিবলেন, পুর্ববংগে নরহত্যা অভিজান বন্ধ করবার জন্য, পাকিস্তান সরকারকে মুক্তির পথে চলতে বাধ্য করবার জন্য সারা বিশ্বকে উপযুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। ভারতবর্ষ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে বলে পাকিস্তান যে অভিযোগ করেছে, সে সম্পর্কে মন্তব্য করতে বলা হলে মিঃ ম্যান বলেন, এই ব্যাআরে ভারতবর্ষ যথেষ্ট সংযমের পরিচয় দিয়েছে। যথেচ্ছ নরহত্যাকে তিনি কোনমতেই একটি দেশের অভ্যন্তরীন ব্যাপার বলে মনে করতে পারেন না। কলকাতার পাক ডেপুটি হাইকমিশন যেভাবে আনুগত্য পরিবর্তন করেছে, ইংল্যান্ডে সেরকম কিছু হলে আপনি কি করতে বলতেন?- এই প্রশ্নের জবাবে মিঃ ম্যান বলেন, তিনি একজন আইনজীবি। আইনের কথাই তিনি ভাবতেন। কেউ বাড়ি জবরদখল হয়েছে মনে হলে ইংল্যান্ডেও আইনের আশ্রয় নেয়াই একমাত্র পথ। তিনি জানান, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ২২০জন সদস্য পুর্ব্বংগে যুদ্ধবিরতির দাবী জানিয়ে পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাবের নোটিশ দিয়েছেন। এই প্রস্তাবের পক্ষে তিনিই প্রথম স্বাক্ষরকারী। ইংল্যান্ডে বাংলাদেশের জন্য যে সর্বদলীয় কমিটি গঠিত হয়েছে মিঃ ডগলাস তার চেয়ারম্যান। তাঁর ধারণা ইংল্যান্ডের সরকারের মনোভাব পালটে গেছে, ওখানকার সংবাদপত্রগুলি খুব সুস্পষ্ট ভাষায় পাকিস্তানী বর্বরতার নিন্দা করেছে। হাজার হাজার নিরস্ত্র মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। এই হত্যা বন্ধ করবার জন্য ব্রিটিশ এবং অন্যান্য সরকারকে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রয়োগ করতে হবে। মিঃ ম্যান অনেকগুলো উদ্বাস্তু শিবির ঘুরে এসেছেন। শিবিরের ভিতরে গিয়ে তাঁরা কথা বলেছেন। ইংল্যান্ড কি বাঙ্গালীদেরকে সাময়িক সাহায্য দেবে? না। তবে কেউ দিলে বাধাও দেবে না। পরে মিঃ ম্যান কুটনৈতিক মিশনে গিয়ে হাইকমিশনার জনাব হোসেন আলীর সংগে সাক্ষাৎ করেন। উভয়ের মধ্যে আর্তত্রাণ ও আনুষঙ্গিক বিষয়ে আলোচনা হয়। তিনি বলেন, ভারতের পক্ষে একক এই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। সারা বিশ্বকে এগিয়ে আসতে হবে। মিঃ ম্যান বলেন, মিঃ স্টোনহাউস এই সাহায্য সংগঠনের জন্যই এসেছেন। মিঃ ম্যান যাদের সংগে কথা বলেছেন, তাঁরা সকলেই যশোর জেলা থেকে এসেছেন। এদের সংগে কথা বলে মনে হয়েছে, পাঞ্জাবী মিলিটারি দিয়ে পরিকল্পিতভাবে মানুষ খতম করা হচ্ছে। গ্রামকে গ্রাম লোক নেই, জল নেই। মাঠে শস্য নেই, থাকলেও পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আশংকা করা হচ্ছে। বিভিন্ন পক্ষের সংগে কথা বলে তাঁর মনে হয়েছে, যুদ্ধ পরিস্থিতি বাঙ্গালীদের পক্ষে নৈরাশ্যজনক নয়। আবার ভারতীয় সংবাদপত্রে যেমন দেখানো হচ্ছে, তেমন আশাব্যঞ্জকও নয়। অতিরিক্ত আশাবাদী চিত্র একে ভারতীয় সংবাদপত্র মুক্তিকামী বাঙ্গালীদের ক্ষতি করবেন বলে তিনি মনে করেন। বৃটিশ সরকার নতুন বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেবার প্রশ্নে নেতৃত্ব দেবে বলে তিনি মনে করেন না।
.
13.21.118-119
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
বৃটিশ শ্রমিক দলের প্রতিনিধি মিঃ ডগলাস ম্যান কর্তৃক পশ্চিম পাকিস্তানের উপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের দাবী | আনন্দবাজার | ২৪ এপ্রিল, ১৯৭১ |
আক্রমণকারী পঃ পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক আবরোধ করতে হবে বৃটিশ শ্রমিক দলের প্রতিনিধির দাবী \বিশেষ প্রতিনিধি/
.
বৃটিশ পার্লামেন্টের শ্রমিক দলের বৃটিশ পার্লামেন্টের শ্রমিক দলের প্রতিনিধি শ্ৰী বি ডগলাস ম্যান শুক্রবার প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, পশ্চিম পাকিস্তান বাংলাদেশ আক্রমণ করেছে। সেখানে জনগণকে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। ওখানে যুদ্ধবিরতি করতে পশ্চিম পাকিস্তান যাতে বাধ্য হয়, তার জন্য রাষ্ট্রসংঘ ও কমনওয়েলথের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক অবরোধ করতে হবে।
বাংলাদেশের জনগণের অবস্থা স্বচক্ষে দেখবার জন্য শ্রমিক দলের পক্ষ থেকে শ্রী ম্যান বাংলাদেশ সীমান্তে এসেছিলেন। সাংবাদিকদের কাছে তিনি অভিভূত কষ্ঠে বলেন, শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলে পাক সৈন্যদের মর্মান্তিক হিংস্রতার তিনি যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ পেয়েছেন। নির্বিচারে মানুষকে সেখানে হত্যা করা হয়েছে। চারদিকে একটা আতঙ্কের আবহাওয়া। এর পিছনে উদ্দেশ্য কি তিনি জানেন না। তবে তিনি এটা বুঝতে পারছেন, বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে আর মিলনের কোনো সম্ভাবনা নেই। যা হয়েছে তা আক্রমণ – পশ্চিম পাকিস্তানের পূর্ব পাকিস্তানের ওপর আক্রমণ। আন্তর্জাতিকভাবে একটা আক্রমণের ঘটনা হিসাবে এটিকে সকলের গ্রহণ করা উচিত। গোলাপী শংকটের সঙ্গে অক্সফোর্ড টাই পরা কেনলিংটনের এই তরুণ সুদর্শন এম-পি সাংবাদিকদের বলেন, পূর্ববঙ্গে শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য বৃটেনের সংসদ সদস্যরা উদ্যোগী হয়ে একটি কমিটি গঠন করেছেন। কমিটির তিনি একজন সদস্য।
.
সীমান্তের অভিজ্ঞতা
শ্রী ম্যান বলেন, সীমান্তের শরণার্থীরা আমাকে বলেছেন পাঞ্জাবী সৈন্যরা গ্রামে গ্রামে এসে নির্বিচার হত্যাকান্ড চালিয়েছে। বাড়ী-ঘর-দোরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। তারপর আওয়ামী লীগ নেতাদের খুঁজে বার করার চেষ্টা করেছে। অত্যাচারের সাক্ষ্য-প্রমাণগুলি খুবই স্পষ্ট। তবে এই ব্যাপক নির্বিচারে হত্যাকান্ড বাঙালীদের তাড়ানোর জন্য সুপরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে কিনা, তা তিনি বলতে পারেনা।
শ্রী ম্যান মনে করছেন, পূর্ববঙ্গে যে সব মানুষ এখনও আছেন, তাঁরা না খেয়ে মরবেন। কারণ বীজ বোনা হয়নি। চাষবাস বন্ধ। এর ফলাফল হবে মর্মম্ভদ। আরও উদ্বাস্ত্ত আসতে থাকবেন। আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে অবিলম্বে যুদ্ধপীড়িত মানুষদের উদ্ধার করা দরকার।
বায়াফ্রার সঙ্গে তুলনা হয় না
বাংলাদেশের অবস্থাকে অনেকে বায়াফ্রার সঙ্গে তুলনা করছেন, কিন্তু শ্রী ম্যানের মতে, বায়াফ্রার সঙ্গে এখানকার পরিস্থিতির তুলনাই হয় না। বায়াফ্রাতে পূর্ববাংলার মত একটা নির্বাচন হয়নি। তাছাড়া ফেডারেল সরকারের সঙ্গে বায়াফ্রা এমন ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্নও ছিল না।
তবু বায়াফ্রার কথা মনে করে অনেক রাষ্ট্র বাংলাদেশকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসছেন না। কিন্তু এটি বাজে তুলনা’। শ্রী ম্যান কদাচ মনে করেন না যে, বাংলাদেশে আজ যা হচ্ছে, তা শুধু পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ঘটনা।
শ্রী ম্যানের বিশ্বাস, পৃথিবীর লোকেরা ভাল করে জানে না, পূর্ববঙ্গে কী হচ্ছে এমনকি তাঁর নিজের দেশের সরকার ও জনগণও বিশদ খবরাখবর জানেন না। বৃটিশ সরকার এই জন্যই চুপ করে আছেন বলে শ্রী ম্যান মনে করেন।
প্রশ্নঃ আপনি কেন বৃটিশ হাইকমিশনারকে অনুরোধ করছেন না, ঘুরে সব দেখে গিয়ে সরকারকে জানাতে?
উত্তরঃ আমি ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। দেখলাম তিনি আমার চেয়েও বেশী খবর রাখেন।
প্রশ্নঃ বৃটিশ সংবাদ পত্রগুলি কি পূর্ববঙ্গের এই যুদ্ধের খবর ছেপে দিচ্ছেন?
উত্তরঃ সিরিয়াস কাগজগুলি ভাল খবরই দিচ্ছে, কিন্তু সে তুলনায় আমাদের পপুলার খবরের কাগজগুলি ভালভাবে কভারেজ দিচ্ছে না।
প্রশ্নঃ আপনি কি মনে করেন বাংলাদেশকে নিয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধবার সম্ভাবনা আছে?
উত্তরঃ দেখুন, ভারত যদি হস্তক্ষেপ করে, তাহলে চীন এগিয়ে আসবে। সেক্ষেত্রে বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেবার নয়।
প্রশ্নঃ আপনি তো সব দেখে গেলেন, আপনার কি মনে হল ভারত এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেছে?
শ্রী ম্যানের সঙ্গে সঙ্গে জবাবঃ আমি ভারতীয় পররাষ্ট্র দফতরের কর্তাদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছি যে, ভারত এমন কিছু করছে না, যেটি অভ্যন্তরীণ হস্তক্ষেপের পক্ষে সহায়ক হতে পারে।
একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেনঃ আচ্ছা মিঃ ম্যান, পাকিস্তানী ডেপুটি হাইকমিশনার মিঃ মোহাম্মদ মাসুদ কলকাতার পাক ডেপুটি হাইকমিশনের খবর নিতে এসেছেন। সরকারের বদলে আপনারা এমন একটা অবস্থায় পড়লে কি করতেন?
শ্রী ম্যানঃ আমরা ব্যাপারটা আদালতের ওপরেই ছেড়ে দিতাম। আমি একজন আইন ব্যবসায়ী। আমি বুঝি এটি সম্পূর্ণ আইনের এক্তিয়ার।
পূর্ববঙ্গে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা কমিটি
বৃটেনে পূর্ববঙ্গে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা কমিটি-জাসটিস ফর ইষ্টবেঙ্গল কমিটির অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে আছেন জন হ্যানাম (কনজারভেটিভ এম-পি), জন পারদো (লিবারেল এম-পি)। কমিটিতে আরও দুজন সদস্য আছেন, তাঁরা কেউ এমপি নন। শ্রী ম্যান এই কাটমির অবস্থায়ী চেয়ারম্যান। কমিটির ছয় দফা উদ্দেশ্যঃ (১) হত্যা ও যুদ্ধ বন্ধ করা, (২) আন্তর্জাতিক রেডক্রস ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সেবা প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়া, (৩) যতদিন পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তান ধবংসাত্মক কার্যকলাপ চালাবেন, ততদিন পাকিস্তানে উন্নয়নমূলক সাহায্য বন্ধ রাখা, (৪) পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, (৫) শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য রাষ্ট্রসংঘের হস্তক্ষেপ (৬) সিংহলে পাকিস্তানের সামরিক দ্রব্যাদি নামানোর অধিকারের অবসান।
কমিটি তাঁদের কার্যবিবরণীর এই খসড়ায় পূর্ব পাকিস্তান কথাটাই ব্যবহার করেছেন- বাংলাদেশ নয়।
.
13.22.120
শিরোনাম | সূত্রঃ | তারিখঃ
|
বাংলাদেশের ঘটনাবলীর উপর বিবিসি গৃহীত জন স্টোনহাউসের সাক্ষাতকার | বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, | ২৭ এপ্রিল, ১৯৭১ |
বি বি সি-র সাথে জন স্টোনহাউসের সাক্ষাতকার, ২৭ শে এপ্রিল ১৯৭১
জন স্টোনহাউস লন্ডনে ফিরে ২৭ শে এপ্রিল আজকের বি বি সি অনুষ্ঠানের এক সাক্ষাতকারে বলেন, পূর্ববঙ্গে যে ভয়াবহ ঘটণা ঘটছে তা গত যুদ্ধের পর আর কখনো দেখা যাইনি-তিনি আর যুক্ত করেন যে, পূর্ববঙ্গের ভয়াবহতাকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সাথে তুলনা করলে ভিয়েতনাম যুদ্ধকে একটি “টি পার্টির” মত মনে হবে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫শে মার্চ ছাত্র-কর্মকর্তা/কর্মচারীদেরকে লাইনে দাড় করিয়ে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যার ঘটনাকে বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। তিনি গভীর হতাশা ব্যক্ত করে বলেন যে, ৯৮ শতাংশ ভোটের মাধ্যমে গণতান্ত্রিকভাবে একটি নির্বাচনকে শুধু প্রত্যাখানই করেনি একে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শণপূর্বক সামরিক যানতা এদেশের জনগনের উপর এক নিষ্পেশনের নীতি গ্রহণ করে। জন স্টোনহাউস বলেন যে, আমাদের এখন হাত গুটিয়ে বসে থাকার সময় নয়, আমাদের অবশ্যই এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে।
.
13.23.121
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
পাকিস্তানে প্রেরিত বৃটিশ পণ্যসামগ্রীর বীমা সুবিধা বিলোপ | টাইমস অফ ইন্ডিয়া | ১৪ মে, ১৯৭১ |
পাকিস্তানে রপ্তানির উপর বীমা স্থগিত করেছে ব্রিটেন
জে ডি সিং
দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, বার্তা সংস্থা, লন্ডন, মে ১৪।
ব্রিটিশ রপ্তানীকারক বিভাগ ভবিষ্যতে পাকিস্তানে রপ্তানির উপর বীমা সুবিধা স্থগিত করেছে।
এটা পাকিস্তানে ব্রিটিশ রপ্তানির উপর বিদ্যমান অঙ্গীকার সম্মান করবে কিন্তু ভবিষ্যতে আর কোন বীমা সুবিধা প্রদান করবে না।
ব্রিটিশ রপ্তানীকারকদের পাকিস্তানে পণ্য সরবরাহ করার আগে নগদ অর্থ প্রদান করার জন্য চাপ দেয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। সচরাচর রপ্তানিকারক বিভাগ পণ্যের চালান দেয়া জন্য অপরিশোধ-এর বিরুদ্ধে বীমা করে।
বিভাগের একজন মুখপাত্র বলেন, “আমরা এই পদক্ষেপ নেয়ায় দুঃখপ্রকাশ করছি কিন্তু আমরা আমাদের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছি এবং এটি একটি বাণিজ্যিক সিদ্ধান্ত”।
এই সিদ্ধান্ত পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ও পাকিস্তানের ভবিষ্যত বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উপর বিভাগীর মূল্যায়ন এবং তাদের ঋণ প্রদানের সামর্থ্য দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। পূর্ব বাংলার সংকট সকল চালানকেই প্রভাবিত করছে ফলে দেশটি তার বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পাকিস্তানে ব্রিটিশ রপ্তানিমূল্য গত বছর 900 মিলিয়ন রুপির বেশি ছিল।
সম্ভবত অতীব মূলধনী পণ্য রপ্তানি করতে ব্রিটিশ পাকিস্তানে অনুমোদিত বীমা কভার স্থগিতাদেশ দিয়েছে।
সিদ্ধান্তটি এমন একটি সময়ে আসে যখন পাকিস্তান পশ্চিম ঋণদাতাদের সরকারী ঋণ পরিশোধ স্থগিত করে। স্থগিতের ব্যাপারটি বিশ্ব ব্যাংক বিবেচনা করছে।আগামী মাসে প্যারিসে অনুষ্ঠিতব্য পাকিস্তান সাহায্য সংস্থা এর সভা থেকে একটি সিধান্ত আশা করা হচ্ছে।
.
13.24.122-123
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
পাকিস্তানে বৃটিশ সাহায্য বন্ধ করার জন্য বৃটিশ এমপিদের দাবী | দি স্টেটসম্যান | ১৫ মে, ১৯৭১ |
****** পাকিস্তানে সাহায্য বন্ধ করার দাবি যুক্তরাজ্যে *****
.
লন্ডন, মে ১৪। “বাংলাদেশের পরিস্থিতি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, ব্রিটিশ সরকারের এই অবস্থান প্রত্যাখান করে, বাংলাদেশ থেকে ইসলামাবাদ যতোক্ষণ না পর্যন্ত সেনা প্রত্যাহার না করে তখন অবধি পাকিস্তানকে সহায়তা প্রদান বন্ধ রাখার দাবিকে গতোকাল ব্রিটিশ এমপি, শিক্ষাবিদ, রিপোর্টার ও ব্যবসায়ী নিয়ে গঠিত ২০০ জনের ও বেশি একটি দল আবার পুনর্জীবিত করেছে। ” পিটিআই এর বরাত দিয়ে।
.
দ্যা টাইমস পত্রিকা গতকাল এক বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে, ব্রিটিশ সরকারকে বাংলাদেশের সর্বত্র ব্যাপক হারে আন্তর্জাতিক ত্রাণসহায়তা দেওয়ার উদ্যোগে অংশগ্রহণ করার আর্জি জানিয়েছেন।
.
বিজ্ঞাপনটার শুরুতে একটি স্লোগান লেখা ছিলো ” পাকিস্তানের এই মুহূর্তের অবস্থা দেখায় যে, অভ্যন্তরীণ সমস্যার চেয়ে মানুষ বেশি গুরুত্বপূর্ণ; দশ লক্ষ মানুষের জীবন ও মৃত্যু সকলের সমস্যা” যেটা এই জাতীয় পত্রিকার ভেতরের একটি পৃষ্ঠার তিন চতুর্থাংশ জায়গা দখল করেছে। অর্ধেকটা জায়গা জুড়ে ছিলো একটি ছবি যেখানে পাকিস্তানি সেনাদের হামলার শিকার পূর্ব বাংলার কোন একটি গ্রামের এক মধ্যবয়স্ক বাঙালির শরীর দেখানো হয়েছে।
“একশন বাংলাদেশ” এর অর্থায়নে, আজকে “হাউস অফ কমন্স” এর শ্রম সংক্রান্ত সাধারণ আলোচনার প্রাক্কালে বিজ্ঞাপনটি প্রদর্শিত হয়েছে। জনাব ব্রুস ডগলাস ম্যান এর গতিময় তৎপরতা এবং শেষে বাংলাদেশ বিষয়ে ব্রিটিশ নিষ্ক্রিয়তা এবং ২০৩ টি সাক্ষর যার মধ্যে লর্ড ফেনার ব্রুকওয়ে ও আছে। সাক্ষরকারীদের মধ্যে পশ্চিম ভারতীয় লেখক জনাব, ভি এস ন্যায়পাল এর নাম ও রয়েছে।
.
বিজ্ঞাপন টি হল: “২৫ শে মার্চ , পাকিস্তানি বাহিনী নিয়মিতভাবে ও বর্বরতার সহিত পূর্ব বাংলার মানুষ হত্যা করা শুরু করেছিলো যাদের লক্ষ্য ছিলো দেশের নকশাল নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া।”
.
সেনাবাহিনীর অত্যাচার সহস্রাধিক মানুষের উপর হত্যাযজ্ঞ চালানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো না বরঞ্চ রোপন, চাষাবাদ, খাদ্য আমদানি তে বাধা দিয়ে তারা আরো দশ লক্ষের ও বেশি মানুষকে অনাহারে ভোগাচ্ছে।
.
যখন ব্রিটিশ সরকার বলছে যে, এটি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, তখন বস্তুতপক্ষে তারা বলছে, যদি দেশের জনগণ অপরপক্ষ কে ভোট দেয়, তাহলে সরকারের অধিকার আছে তার দেশের জনগণকে মেরে ফেলার কিংবা জনগণকে অনাহারে রাখার।
” আমরা নিন্মসাক্ষরকারী ব্যাক্তিরা, পূর্ব বাংলা থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত, পশ্চিম পাকিস্তানে সাহায্য পাঠানো বাতিল করার জন্য ব্রিটিশ সরকারকে আহবান জানাচ্ছি। পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর জন্য, যে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা চলছে, সেখানে অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে ব্রিটিশ সরকারকেও সে উদ্যোগে যুক্ত হওয়ার জন্য, আমার আবারো আহবান করছি। “
.
রয়টার আরো লিখেছে- ব্রিটেনের ইয়ং লিবারেলের চেয়ারম্যান – জনাব, পিটার হেইন আজ বলেছেন যে, দেশটির পূর্বাংশ হতে, সেনা প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত, ব্রিটেনের উচিত পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো সকল সাহায্য বন্ধ করা।
ত্রয়োদশ খণ্ড – ১২৩ পৃ
.
দ্যা টাইমস পত্রিকায় পাঠানো চিঠিতে তিনি লিখেছেন: ” সম্ভবত পাকিস্তান সংকট বিষয়ে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়টিকে কেন্দ্র করে, এ সপ্তাহে একটি পার্লামেন্টারি বিতর্কের মাধ্যমে, বাংলাদেশ এর মানুষের উপর চালানো পশ্চিম পাকিস্তানীদের হত্যাযজ্ঞের কারণে সৃষ্ট অপরাধবোধ থেকে ব্রিটিশ সরকারকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করবে। “
.
এপি ওয়াশিংটন থেকে যোগ করেছে : সাহায্য-সহায়তা পূর্ব বাংলার মানুষদেরও দেওয়া হবে এমন নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানে সাহায্য পাঠানো বন্ধ রাখতে, দি ওয়াশিংটন ডেইলি নিউজ রাষ্ট্রপতি নিক্সনকে পরামর্শ দিয়েছে।
.
সম্পাদকীয় কলামে পত্রিকাটি লিখেছে, পাকিস্তানী সেনা সরকারের একজন প্রতিনিধি তার দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয় প্রতিরোধ করার জন্য একশ মিলিয়ন ডলার সাহায্য চাইতে যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারকে কোন সহায়তা দেওয়ার পূর্বে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের উচিত বিষয়টি ভালোভাবে বিবেচনা করা উচিত। যতটুকু আমরা দেখতে পাই, যদিও পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালাতে ব্যবহৃত নাও হয়, ইহা পাশবিকতার কাজে ব্যবহৃত হবে।
.
13.25.124-125
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
বাংলাদেশে নির্যাতনের ওপর পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন এর পুনঃ প্রচার | একশান বাংলাদেশ; উদ্ধৃতি দি গার্ডিয়ান | ২৭ মে ১৯৭১ |
পূর্ব বাংলার নৃশংসতা
জনাব, সাংবাদিকদের মতো আমাদের সেরা কোন গল্প খোজার সময় নেই । আমরা প্রত্যেকে প্রায় ২০ বছর ধরে পশ্চিম বাংলায় বসবাস করছি এবং আমরা আমাদের ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১০০ জন শরণার্থীর সাথে কথা বলেছি । পূর্ববাংলায় আসলে কি ঘটছে তার চিত্র এখন আমাদের কাছে সন্দেহাতীত ভাবে পরিষ্কার । এখানে অনেক প্রত্যক্ষদর্শী আছেন যারা পুর্ব বাংলার ররাজনৈতিক নেতা , ডাক্তার , অধ্যাপক , শিক্ষক এবং ছাত্রদের পাকিস্তানী বাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে নির্মমভাবে নিহত হতে দেখেছেন । এখানে আরো আছেন যারা ফায়ারিং স্কোয়াড থেকে ভাগ্যক্রমে বেচে ফিরে এসেছেন ।
দিনে বা রাতে গ্রামবাসীদের ঘেরাও করা হয়েছে । গ্রামবাসীরা ভীতসন্ত্রস্ত ভাবে যেদিক পেরেছে পালিয়ে গিয়েছে আর যাদের পাকিস্তানী বাহিনী খুজে পেয়েছে ধরে জবাই করেছে অথবা গুলি করে মেরেছে । মহিলাদের ধর্ষণ করা হয়েছে এবং ব্যারাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে । নিরস্ত্র মানুষদের উপর বেয়নেট চার্জ করা হয়েছে বা নির্যাতন করা হয়েছে ।
সাত সপ্তাহ পরেও নির্যাতনের ধরন এখনো একই আছে । বিশ্বাসযোগ্য সুত্রে আরো জানা গিয়েছে যে , ছোট্ট শিশুদের বেয়নেটের উপর ছুড়ে ফেলা , মেয়েদের উপর বেয়নেট চার্জ করা, শিশুদের বেয়নেট দিয়ে টুকরো করে ফেলাসহ নানা উপায়ে তারা নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষের উপর নির্যাতন করছে । খবরগুলো বিশ্বাসযোগ্য এই কারনে নয় যে এগুলো অনেক মানুষই একই ধরনের সাক্ষ্য দিচ্ছে বরংচ এগুলো এজন্য বিশ্বাসযোগ্য যে যারা এসব ঘটনা আমাদের কাছে বলছে তারা মোটেও রাজনৈতিক সুবাধা পাবার জন্য এসব বলছে না , তারা এসব ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বা এসবের শিকার ।
আমরা একজন মা ও একটি শিশুর কাটা হাত এবং পা দেখেছি । এগুলো ছিলো বর্ডার থকে অনেক দূরে এবং বুলেটের আঘাতে তৈরি ক্ষততে পচন ধরে গিয়েছিলো । অনেকে তাদের কন্যাকে ধর্ষিত হতে দেখেছে এবং সন্তানদের মাথা দুমড়ে মুচড়ে ফেলতে দেখেছে । কেউ কেউ তাদের স্বামী সন্তান ও অভিভাবকদের কোমড়ে দড়ি বেধে একসাথে হত্যা করতে দেখেছে । পরিবারকে পুরুষশুন্য করার জন্য পুরুষদের ধরে ধরে হত্যা করা হয়েছে । বনগাঁ হাসপাতালে আমরা একটি মেয়েকে পেয়েছি যাকে কেউ শান্ত করতে পারছেনা সে বারবার পাগলের মতো প্রলাপ করেই যাচ্ছে “ তারা আমাদের সবাইকে হত্যা করবে , তারা আমাদের সবাইকে হত্যা করবে “ । আরেকটি মেয়ে রয়েছে তার পাশের বেডে যে দিনের পর দিন ক্রমাগত ধর্ষণ ও গোপনাঙ্গে বেয়নেটের আঘাতে মারাত্তকভাবে অসুস্থ হয়ে এখনো কাঁপছে ।
প্রায় ৪০০ নিরিহ মানুষকে ঝাওডাঙ্গায় হত্যা করা হয়েছে যারা ভারতে আশ্রয় নিতে ছুটে আসছিলো । তাদের দলটিকে প্রথমে ঘিরে ফেলা হয়েছে তারপর নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে । কেন তাদের এভাবে হত্যা করা হচ্ছে ? তারা ভারতে যেয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের কথা ফাঁস করে দেবে একারনে নাকি তারা শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে একটি তারা যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বেছে নিছে যা তাদের একটি নির্দিষ্ট রাষ্টে স্বাধীনভাবে বসবাসের অনুমতি দেয় সেজন্য !
আরেকটি বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে ইস্ট বেঙ্গলের শক্তিকে তারা বিনাশ করতে চেয়েছিলো । প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের অনেকেই পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে যাদের উপর গুলি করেছিলো তাদেরই রুমমেট পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা । পূর্ব বাংলায় ঘটে যাওয়া নৃশংসতার একটি আরেকটি উদাহারন ।
পূর্ব বাংলায় শোষনের মাত্রা চরমে পোঁছে গিয়েছিলো । চালের দাম ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে দ্বিগুণ । শেখ মুজিবের সমর্থকেরা গণতান্ত্রিক ভাবে ও শান্তিপূর্ণ ভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তুত ছিলো এবং তারা জনগনের অকুষ্ঠ সমর্থন পেয়েছিলো ডিসেম্বরের নির্বাচনে ১৬৯ আসনের ১৬৭ টি তে জয়ী হয়ে । কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া এর সামরিক জান্তা ও জনাব ভুট্টো তা মেনে নিতে পারেন নি ।
এই সমস্যা কি ভারতের ? এটি আক্ষরিক অর্থেই পাকিস্তানের সমস্যা । কিন্তু পশ্চিমারা কি করছে ? পূর্ব বাংলায় গণহত্যা নির্যাতন ঘটে চলেছে পাকিস্তানি শাসকদের মদদে ।আজ পূর্ব বাংলার মানুষ অসহায় , কে তাদের জন্য রিলিফের ব্যবস্থা করছে ? কারা তাদের জন্য অর্থ সংগ্রহের প্রচারণা চালাচ্ছে ? এই রাজনৈতিক জটিলতা কি মিথ্যা ? আজ কি কোন সরকার বা কোন দেশের জনসাধারণ নেই যারা পূর্ব বাংলার মানুষকে ও তাদের ন্যায়সঙ্গত দাবীকে আন্তরিকভাবে সমর্থন জানাবে ? এখানে কি কোন ঐক্যমত নেই যারা সঠিক উত্তরটি দিতে পারবে ?
রেভারেন্ড জন হ্যাস্টিং ,
রেভারেন্ড জন ক্ল্যাপহ্যাম ,
সাদ্দার স্ট্রিট মেথডিস্ট চার্চ ,কোলকাতা ।
অনুবাদকঃ মাসরুর আহমেদ মাকিব ।
১২৪-১২৫ পৃষ্ঠা
.
13.26.126-127
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
পূর্ব বাংলা ট্রাজেডির প্রত্যক্ষদর্শী বৃটেনের শ্রমিক দলের এম.পি মিঃ মাইকেল বার্নস এবং ‘ওয়ান অন ওয়ান্ট’ সভাপতি ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ-এর বিবৃতি | ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস | ২ জুন,১৯৭১ |
পূর্ব বাংলা ট্রাজেডির প্রত্যক্ষদর্শী বৃটেনের শ্রমিক দলের এম.পি মিঃ মাইকেল বার্নস এবং ‘ওয়ান অন ওয়ান্ট’ সভাপতি ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ-এর বিবৃতি
কলকাতা,জুন ১: মিঃ মাইকেল বার্নস,বৃটিশ লেবার এমপি, যিনি বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধে ভুক্তভোগীদের গতকাল দেখেতে এসেছেন, তিনি বলেছেন-“বিশ্বকে অবশ্যই এই দুঃখজনক ঘটনাটির সমাধান করার জন্য একটি সমাধান খুঁজতে হবে।”
তিনি পূর্ব বাংলায় যা ঘটছে সেটাকে শুধুমাত্র পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলাকে অর্থহীন(বোকামি) বলেছেন। তিনি এবং তাঁর সরকার এই ব্যাপারটিকে জাতিসংঘরের সামনে তুলে ধরার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
মিঃ বার্নস এবং ‘ওয়ান অন ওয়ান্ট’ সভাপতি ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ,বৃটেনের একটি দাতব্য সংস্থা, যারা সীমান্তের কিছু সংখ্যক ক্যাম্প পরিদর্শন করেছে, তাঁরা বলেছে বিশ্ববাসীকে অবশ্যই যতদ্রুত সম্ভব সাধ্যমতো সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
তাঁরা প্রস্তাব দিয়েছে যে, যুক্তরাজ্যের উচিৎ অবিলম্বে তাঁদের সাহায্যের পরিমান এক মিলিয়ন থেকে দশ মিলিয়নে উন্নীত করা। মিঃ চেসওয়ার্থের মতে, সে অর্থের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পূর্ব বাংলার সাইক্লোন আক্রান্ত এলাকার জন্য দেয়া হবে।
মিঃ চেসওয়ার্থ বলেছেন, বৃটিশ পররাষ্ট্র (বৈদেশিক) মন্ত্রীর ব্যক্তিগতভাবে এখানে পরিদর্শন করা উচিৎ কারণ এখানে সমস্যার মাত্রা এতোই বৃহৎ যে, লন্ডন, ওয়াশিংটন এবং মস্কোর পক্ষে এটা পরিমাপ করা কঠিন হবে। তিনি আরও বলেছে, “এখানে যা ঘটছে সেটা বিশ্ব শান্তির জন্য একটি সম্ভাব্য হুমকি নয়?”
সেনাবাহিনীর কার্যকলাপে বাংলাদেশের মানুষেরা পালিয়ে যাচ্ছে। এই ধরনের কার্যকলাপ চরম দুর্দশা এবং ভোগান্তি নিয়ে আসছে।
মিঃ বার্নস বলেছেন, কিছু মানুষ তাঁকে বলেছে, সেনাবাহিনী পূর্ব বাংলার জনগণকে তাঁদের “রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি” পরিবর্তন করতে জোর করছে যেমনটা চাইনিজরা তিব্বতিদের ক্ষেত্রে করেছিলো।
মিঃ বার্নসের মতে, বিশ্বের সকল দেশ যারা পাকিস্তানকে অস্ত্র এবং উন্নয়ন সাহায্য দিয়েছিলো সেসবই এখন পূর্ব বাংলার বর্তমান বিয়োগান্তক ঘটনার সাথে জড়িত কারণ পাকিস্তান তার নিজেদের জনগণের বিরুদ্ধেই অস্ত্রের ক্ষমতা প্রদর্শন করছে।
মিঃ বার্নস ভাবছে, দাতা দেশগুলোর এখন জাতিসংঘের মাধ্যমে কিছু শর্ত দিয়ে অস্ত্র নেয়া অথবা উন্নয়ন কাজগুলো করতে হবে যাতে পাকিস্তান সরকারের মত সরকারেরা বুঝতে পারে যে, যদি তারা নিজ দেশের মানুষের সাথে তাঁদের (দাতা দেশগুলোর) দেয়া সাহায্য ব্যবহার করে সামরিক অভিযানে জড়িয়ে পরে তাহলে তাদের প্রতি দাতা দেশগুলোর মনোভাব কি হবে।
মিঃ বার্নস বলেছেন,যদি পূর্ব বাংলার জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান পাওয়া যায় তাহলে বিশ্ব সম্প্রদায়কে অবশ্যই পাকিস্তান সরকারকে অর্থনৈতিক চাপ দিতে হবে পূর্ব বাংলা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার এবং জনগণের সাথে একটি আন্তরিক সমঝোতায় আসার জন্য।
এই প্রসঙ্গে মিঃ চেসওয়ার্থ এবং মিঃ বার্নস উভয়ই বলেছেন, এরকম কোন নজির নেই যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রয়োজনে অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগে বৃটেন সাথে ছিল না।
মিঃ বার্নস বলেছেন যদি বৃটেন ও আমেরিকা এবং পুরো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই পথ অনুসরণ করে এবং এই প্রশ্নে একত্রিত থাকে, তাহলে পূর্ব বাংলার জন্য একটি দীর্ঘ মেয়াদি আন্তরিক ও গণতান্ত্রিক সমাধান পাওয়া যাবে। তিনি আবারো বলেছেন, সে বৃটিশ সরকারকে এই ব্যপারে ঐক্যবদ্ধ থাকতে চাপ দিবেন।
যখন তাঁর মিঃ হিথের প্রতি তাঁর না-বোধক মনোযোগ ছিল, তখন তিনি মিসেস. ইন্দিরা গান্ধীর আহ্বানে পাকিস্তানে সাহায্য স্থগিত করেছিল। মিঃ বার্নাস বলেছেন, বৃটেন পাকিস্তানে বিদ্যমান অর্থনৈতিক সহযোগিতা স্থগিত করবে না। কিন্তু তারা কোন নতুন সহযোগিতার অঙ্গীকার করবে না যদি পাকিস্তান পূর্ব বাংলার সাথে একটি সমঝোতার বন্দোবস্ত করবে।
মিঃ চেসওয়ার্থ আরো ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, এই মুহূর্তে বৃটেন থেকে পাকিস্তানে কোন সহযোগিতা যাবে না। এটা এমন একটা সময় ছিল যখন সাহায্যের কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছিলো এবং কিছু প্রযুক্তিগত সহায়তা, যেমনঃ ছাত্রছাত্রীদের সাহায্য, চলমান ছিল।
মিঃ বার্নস এবং মিঃ চেসওয়ার্থ উভয়ই ব্যাখ্য করতে ব্যাথিত হচ্ছিলেন যে, আগামী বছরের জন্য কি সাহচর্য সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যখন সাহচর্য দেশগুলো কিছুদিন পূর্বে ফিরে যাবে, তারা ব্যয় পরিকল্পনা জুলাই পর্যন্ত মুলতবি করবে। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হবে এবং বৃটেন দাবি করেছে পূর্ব বাংলায় ঔপনিবেশিক শাসনের কোন অনুমেয় কারণ ছিল না।
মিঃ চেসওয়ার্থ বলেছেন, পূর্ব বাংলার বিয়োগান্তক প্রতি বৃটেনের প্রতিক্রিয়া ছিল এক প্রচণ্ড ধাক্কার মতো। যুক্তরাজ্যের মানুষের কাছে এটা বোঝা কষ্টকর ছিল যে এরকম নৃশংসতা সত্যিই ঘটতে পারে!
তিনি তাঁর সংগঠনকে বলেছিল,জনগণের সত্যিকারের প্রতিনিধি হিসেবে এবং ত্রান বিতরণ নিয়ে যুদ্ধকে স্বীকার করে নিতে বাংলাদেশ সরকারের কোন দ্বিধা ছিল না। একই সময়ে, তিনি আরো যোগ করেন যে, পাকিস্তানের সামরিক শাসনের জন্য একচেটিয়াভাবে সকল সরবরাহ বিতরণ করা ভুল হবে।
সবশেষে, মিঃ চেসওয়ার্থ পূর্ব বাংলায় একটা “গুরুতর” দুর্ভিক্ষের আশংকা করছিলেন কারণ দেশের বৃহত্তর একটা অংশে বীজ বপন করা হয় নি।
.
13.27.128-129
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১২০ জন লেবার দলীয় এম.পি.-এর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানানোর দাবি
|
দি স্টেটসম্যান | ১৭ জুন, ১৯৭১
|
১২০ জন লেবার দলীয় এম.পি.-এর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের আবেদন
এস. নিহাল সিং
লন্ডন, জুন ১৬ একশ বিশ জন লেবার দলীয় এম.পি. গতরাতে হাউস অভ কমন্স-এ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে স্বীকৃতি দানের দাবি জানিয়েছেন। দাবি উত্থাপনকারীদের মধ্যে ছিলেন লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মি. ইয়ান মিকার্ডো, এবং প্রধান দাবি উত্থাপনকারী ছিলেন মি. জন স্টোনহাউস, যিনি গত এপ্রিলে পশ্চিম বঙ্গ সফর করে এসেছেন। গত সপ্তাহে হাউস অভ কমনস-এ এ সংক্রান্ত বিতর্কের পরই এই প্রস্তাব উত্থাপন করা হলো, তবে এ ক্ষেত্রে এক ধাপ এগিয়ে সরাসরি বাংলাদেশের স্বীকৃতি দাবি করা হয়েছে।
এতে বলা হয়, ব্যাপক হারে বেসামরিক নাগরিক হত্যা এবং উচ্চ মাত্রার নৃশংসতা চালানোর মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্ব বাংলা শাসন করার সকল অধিকার হারিয়েছে। প্রস্তাবে পরিস্থিতিকে আন্তর্জাতিক শান্তির প্রতি হুমকি এবং জেনোসাইড কনভেনশনের লঙ্ঘন- উভয় বিবেচনায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সভা আহ্বান করা হয়। এতে আরও বলা হয়, পরিস্থিতি জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত পূর্ব বাংলার মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার নিদর্শন স্বরূপ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করা উচিত।
দু’টি বিষয় এই সুস্পষ্ট অবস্থানের জন্য দায়ী। সম্ভবত লেবার দলের মধ্যে মি. হ্যারল্ড উইলসন এর দাবিকৃত পাকিস্তান বিষয়ক বিতর্কের সময় শূন্য বিরোধী বেঞ্চ একটা অপরাধবোধের জন্ম দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, এটা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে সমস্যা সমাধানে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ, শরণার্থী সহায়তার প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল হওয়া সত্ত্বেও, ইয়াহিয়া সরকার পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি ধামাচাপা দেয়ার পর পাকিস্তানের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার প্রতিই অধিক মনোযোগী।
বাংলাদেশ বিষয়ে এই জোরালো পদক্ষেপ নেবার বিষয়ে লেবার দলের সিদ্ধান্ত তাদের জাতীয় নির্বাহী দ্বারা এ সংক্রান্ত দু’টি প্রস্তাব পাশের মাধ্যমেও স্পষ্ট। প্রধান প্রস্তাবটিতে ব্রিটিশ সরকারকে নিরাপত্তা পরিষদে এ সংক্রান্ত প্রশ্ন উত্থাপন, উ থান্টের ত্রাণ তহবিলে ব্রিটেনের অংশগ্রহণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি এবং শরণার্থীদের স্বার্থে ভারতকে উদার সহায়তা দেবার আহ্বান জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, পূর্ব বাংলায় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গুলো অকার্যকর হয়ে পড়ায় সেখানে সাহায্য পাঠানো অর্থপূর্ণ হতে পারে না। সুতরাং, দুর্ভোগ কমাতে সাহায্য করার জন্য সরকারের উচিত পাকিস্তানকে সাহায্য সীমিত করা এবং এই মর্মে এইড পাকিস্তান কনসোর্টিয়ামের সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। দ্বিতীয় প্রস্তাবে অবিলম্বে একটি দুর্যোগ সহায়তা কমিশন গঠনের আহবান জানানো হয়েছে।
ব্রিটিশ লেবার পার্টিতে বাংলাদেশের জনগণ অতি দ্রুত মিত্র অর্জন করে নিলেও, ব্রিটিশ সরকার কতখানি সাড়া দেবে সে বিষয়ে সন্দেহ আছে, এবং ব্রিটেনের সবাই মূলতঃ মুক্ত বাজার নিয়ে অধিক আগ্রহী।
পিটিআই adds: সুইডেন, হল্যান্ড, ইটালি, অস্ট্রিয়া এবং হাঙ্গেরি সহ ইয়োরোপীয় রাষ্ট্রসমূহ এ বিষয়ে একমত হয়েছে যে পাকিস্তান পূর্ব বাংলার উপর কোনো ‘একতরফা’ সমাধান চাপিয়ে দিতে পারে না এবং তারা অন্যান্য বন্ধুভাবাপন্ন রাষ্ট্রসমূহ সহ এ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এর উপর চাপ প্রয়োগ করবেন। প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধীর ব্যক্তিগত দূত হিসেবে সফরকালে শিল্প উন্নয়ন মন্ত্রী মি. মইনুল হক চৌধুরী এর কাছে এই রাষ্ট্রসমূহ এই মনোভাব ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশ বিষয়ে আলোচনার জন্য সফরে যাওয়া চার ক্যাবিনেট মন্ত্রীর মধ্যে তিনিই প্রথম সফর শেষ করে দেশে ফিরেছেন।
.
13.28.130
বাংলাদেশে গনহত্যাঃ ইন্ট্যারন্যাশনাল ফ্রেন্ডস অফ বাংলাদেশের গৃহীত প্রস্তাব । | সুত্রঃ ইন্ট্যারন্যাশনাল ফ্রেন্ডস অফ বাংলাদেশ , | ২৫ জুন ১৯৭১ । |
বাংলাদেশে গণহত্যা ও আমাদের প্রস্তাব
২৫শে মে লেডি গিফোর্ডের সভাপতিত্বে কনওয়ে হলে ইন্ট্যারন্যাশনাল ফ্রেন্ডস অফ বাংলাদেশ আয়োজিত সভায় জনাব জন পিটার-মিলসের নেতৃত্বে বাংলাদেশে গণহত্যা বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় । এতে সাহায্য করেন , ব্যারিস্টার অশোক সেন ( ভারতের সাবেক আঈন মন্ত্রী) ,বিচারপতি আবু এস চৌধুরী (উপাচার্য ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) , এবং বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি ব্যারিস্টার সাখাওয়াত হোসেন , ব্যারিস্টার লর্ড গিফোর্ড । নিম্নোক্ত প্রস্তাব সভায় সর্ব সম্মতিক্রমে গৃহীত হয়ঃ-
সভায় তাৎক্ষনিক ভাবে আন্তর্জাতিক গণহত্যা স্মারক বিষয়ে একটি প্রাথমিক কমিটি গঠন করতে প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নিতে বলা হয় । উক্ত কমিটি করার প্রস্তাব দেয়া হয় যেনো ঐ কমিটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে যুদ্ধাপরাধ নিয়ে একটি কমিটি করার করার জন্য চাপ দিতে পারে ইসলামাবাদের পাকিস্তান সরকারের আচরন ও ঢাকায় অবস্থানকৃত তাদের সামরিক অফিসারদের বিরুদ্ধে উত্থিত পরিকল্পিত অপরাধ ও গণহত্যার অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করার জন্য । কমিটি তাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা স্মারক লঙ্ঘনের তদন্ত করবে এবং জড়িতদের শাস্তির মুখোমুখি করবে ।
.
.
13.29.131-132
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
বাংলাদেশে ত্রাসের রাজত্ব বিরাজ করছেঃ চারজন বৃটিশ এমপির ঘটনা বর্ণনা | দ্যা স্টেটসম্যান, | ২৯ জুন ১৯৭১
|
ব্রিটিশ এমপি দের মতে, বাংলাদেশে ত্রাসের রাজত্ব বিরাজ করছে
সোমবার দুপুরের প্লেনে কোলকাতা থেকে ৪ জন ব্রিটিশ এমপি ঢাকায় অবতরন করেন। তাদের চারজনের পূর্ববাংলা পর্যবেক্ষণের রিপোর্ট থেকে এই উপসংহারে পৌছান যায় যে, সেখানে আতংকের আবহাওয়া বিরাজ করছে। পূর্ব বাংলায় আর্মির শাসন চলছে, মানুষ এখনও একটি জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে, বুলেটে আহত হয়ে হাত কেটে ফেলা হয়েছে, এমন মানুষেরও দেখা পাওয়া গেছে সেখানে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এলাকা ভারি গোলাগুলি বর্ষণের সাক্ষিবহন করছে। সব মিলিয়ে পূর্ব বাংলার চলমান পরিস্থিতিকে কোনভাবেই স্বাভাবিক বলা যায়না।
এই চারজন ঢাকায় একটি স্পেশাল আরএএফ প্লেন এ অবতরন করেন। এই চারজন হলেন, মিঃ আরথার বটমলি (এলএবি), মিঃ রেগ প্রেন্টিস (এলএবি), দুইজনই পূর্বে বৈদেশিক উন্নয়ন মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব প্রাপ্ত ছিলেন, মিঃ জেমস রামসডেন, পূর্ববর্তী কনজারভেটিভ পার্টির যুদ্ধ অবস্থা বিষয়ক সচিব এবং মিঃ টোবি জেসেল (কনজারভেটিভ)। তাদেরকে কোলকাতায় অভ্যর্থনা জানান, মিঃ অশোক রয়, যুগ্ম সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়, মিঃ এফ এস মাইলস, কোলকাতায় কর্মরত ব্রিটিশ ডেপুটি হাই কমিশনার এবং অন্যান্য সরকারি উচ্চতর পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ। তারা “রাজভবন” এ অবস্থান করছেন। এর আগে ঢাকায় একটি সংবাদ সম্মেলন এ মিঃ টোবি জেসেল বলেন যে তার কাছে সুস্পষ্ট প্রমান রয়েছে যে, পূর্ববাংলার হিন্দু জনগোষ্ঠীর চরম নিপীড়ন ও নির্যাতন চালান হয়েছে। একি সাথে তিনি বলেন যে, কোন দেশের পক্ষে সন্ত্রাসের রাজত্বের মধ্যে থেকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন করা সম্ভব নয়।
কনজারভেটিভ পার্টির এই এমপি আরো বলেন, একের পর এক গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া এবং স্থানীয় লোকদের অন্তর্হিত হয়ে যাওয়া আরও বেশি ভয়ের কারন। পাকিস্তানি আর্মিদের কে অবশ্যই অবাধে এবং বিধিবহির্ভূতভাবে গুলি চালান বন্ধ করতে হবে।
মিঃ রেগ প্রেন্টিস জানান যে উদ্বাস্তু পূর্ব বাংলার জনগনদের এখন ফিরে যাওয়া সমীচীন হবে বলে তিনি মনে করেন না, সেখানে এখনও ত্রাশের রাজত্ব বিরাজ করছে। তিনি জানান যে সেখানে এখন আর্মির শাসন চলছে এবং মানুষ তাদেরকে ভয় পাচ্ছে। পূর্ববাংলার পূর্বাংশে এখনও একটি জটিলাবস্থা ও মানুষের মধ্যে ভীতি কাজ করছে।
পূর্ববাংলায় চারদিন অবস্থানকারি এই দলটি পূর্ববাংলায় চারদিন অবস্থান করে চুয়াডাঙ্গা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, ঢাকা, ময়মনসিংহ ইত্যাদি জেলাসমুহ প্লেন এবং হেলিকপ্টার যোগে ঘুরে বেড়ান। ভ্রমনের বর্ণনা দিয়ে মিঃ আরথার বটমলি বলেন, আমরা একটি বেশ লম্বা সময় ধরে হেলিকপ্টারে যাত্রা করেছি যেন আমরা সব পর্যবেক্ষণ করতে পারি। মিঃ টোবি জেসেল বলেন, তিনি যাত্রার সময় বিধ্বস্ত মানুষজন, বাড়িঘর এবং ধংশপ্রাপ্ত গ্রাম দেখতে পান। তিনি বলেন যে তারা একটি গ্রাম পরিদর্শন করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তারা যেতে পারেননি কেননা পাকিস্তানি আর্মি গ্রামটিকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছিল এবং যাওয়ার পথটি যথাসম্ভব প্রতিবন্ধকতাপূর্ণ ছিল।
এসময় মিঃ রামসডেন কে জিজ্ঞাসা করা হয় যে তিনি আদৌ মনে করেন কিনা যে পূর্ববাংলার এই পরিস্থিতি রাজনৈতিকভাবে নিরসন করা সম্ভব? উত্তরে তিনি বলেন যে যে ধংসজজ্ঞ চালানো হয়েছে তা পুরবাবস্থায় ফিরিয়ে নাওয়া, একটি রাজনৈতিক সমাধানের চেয়ে বেশি জরুরি।
শরণার্থীদের ফিরত যাওয়া প্রসঙ্গে মিঃ জেসেল বলেন যে পূর্ববাংলায় শরণার্থীদের জন্য যে অভ্যর্থনাকেন্দ্র খোলা হয়েছে, তাতে অত্যন্ত কম শরণার্থীই সাড়া দিয়েছেন বলে পাকিস্তানি সরকার যথেষ্ট হতাশ। তিনি জানান যে পাকিস্তানি সরকার আশা করেছিল যে চুয়াডাঙ্গায় যে অভ্যর্থনাকেন্দ্র খোলা হয়েছে তাতে প্রতিদিন গড়ে ৫০০ শরণার্থী আসবেন, কিন্তু তারা সেখানে মাত্র ২০০ জন শরণার্থী দেখতে পান, যাদের মধ্যে মাত্র দুইজন হিন্দু ব্যাক্তি ছিলেন।
আরেক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে মিঃ রামসডেন বলেন, ঢাকার কিছু কিছু অংশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে বলে তার মনে হয়েছে, কিন্তু সেটি সম্পূর্ণরূপে স্বাভাবিক বলা যায়না। দেশের সামান্য কিছু অংশে রেইল এবং স্টিমার যাতায়াত অব্যাহত আছে বলে তিনি জানান।
পূর্ববাংলায় কোন ধরনের নিপীড়নের উদাহরন চোখে পড়েছে কিনা, সে বিষয়ে জানতে চাইলে মিঃ বটমলি বলেন, আমি নিপীড়ন শব্দটি ব্যাবহার করবনা। মুল কথা হচ্ছে যে এটি ঘটেছে এবং এটিকে অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। আমরা এমন মানুশজন দেখে এসেছি যাদের হাত কেটে ফেলা হয়েছে, বুলেটের আঘাতে আহত হয়েছে এবং তারা এখনও সীমাহীন যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।
এমপিগন ইংল্যান্ড এ ফিরে যাওয়ার পর নিজ নিজ পার্টির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে তাদের এই পর্যবেক্ষণ বিবরণী রিপোর্ট করবেন।
.
13.30.133
শরণার্থীদের-দুর্দশা সম্পর্কে ‘দি টাইমস’-এর সম্পাদকের কাছে লিখিত লেডি আলেকজান্দ্রা মেটকাফ-এর চিঠি | দি টাইমস |
৫ জুলাই,১৯৭১ |
পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থীরা
সম্পাদকের কাছে পত্র
লেডি আলেকজান্দ্রা মেটকাফ এর নিকট হইতে
জনাব
আমি পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থী শিবিরে কিছু সময় ব্যয় করে মাত্র ফিরলাম। পত্রিকা, টেলিভিশন ও রেডিওতে শরণার্থী শিবিরের অবস্থা সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তাকে মোটেও অতিরঞ্জিত বলা যায় না। সমস্যার তাৎপর্য বিচারে শরণার্থী শিবিরের অবস্থা সত্যি ভয়াবহ ও হৃদয়বিদারক যা আমার দেখা অনেক দুর্যোগকবলিত এলাকায় আমি প্রত্যক্ষ করিনি।
৫০ লক্ষ নিঃস্ব অসহায় মানুষের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা ও প্রতিদিন নতুন করে আগত জন-মানুষের স্রোত সামাল দেওয়া ভারত সরকারের পক্ষে প্রায় অসম্ভব যদিও তাদের প্রচেষ্ঠা প্রসংশার দাবীদার। শিশুদের মাঝে পুষ্টিহীনতা ভয়াবহ রূপ ধারন করছে। সেভ দ্য চিলড্রেন ফান্ড ‘কল্যাণী’ হাসপাতালে চিকিৎসার মাধ্যমে হাজার হাজার অপুষ্টির শিকার শিশুর জীবন রক্ষা করতে পারলেও ইতোমধ্যে অগণিত শিশুর মৃত্য হয়েছে।
আমি যে বিষয়টা জোর দিয়ে বলতে চাই তা হলো আগামী দুই থেকে তিন মাস বর্ষাকাল, এ সময়ে শরণার্থী ক্যাম্পে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিবে। খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাবে অবস্থার আরো দ্রুত অবনতি ঘটবে, রোগ-শোকের প্রার্দুভাব ছড়িয়ে পড়বে যার ফলে হাজার হাজার লোক মারা যাবে। ভয়াবহ কলেরার প্রার্দুভাবকে নিয়ন্ত্রন করা হয়েছে, বিপদ কেটে গেছে ভাবলে ভুল করা হবে কারন আরও ভয়াবহ সমস্যা সামনে অপেক্ষমান।
রিলিফের পরিমাণ বাড়াতে হবে কমানোর সুযোগ নাই।
আপনার একান্ত অনুগত
আলেকজান্দ্রা মেটকাফ, ভাইস চেয়ারম্যান, ‘সেভ দ্য চিলড্রেন ফান্ড’।
৬এস ইটন প্যালেস এসডব্লিউওয়ান।
জুলাই ৩ ।
.
13.31.134
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
বৃটিশ এম. পি. মিঃ আর্থার বটম্ লে ও টবী জেসেল-এর বক্তব্য | দি স্টেটম্যান | ৫ জুলাই, ১৯৭১ |
বৃটিশ এম. পি. মিঃ আর্থার বটম্ লে ও টবী জেসেল-এর বক্তব্য
বাংলাদেশের প্রতিনিধিগণ মিঃ টবি জেসেলকে, যিনি সদ্য ভারত ও পাকিস্তান ভ্রমণ করে দেশে ফিরে আসা তিন জন সংসদ সদস্যের মধ্যে একজন, ফুল প্রদান করেছেন।
মিঃ জেসেল (কনজারভেটিভ), যিনি চার সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধি দলের মধ্যে সবচেয়ে বেশী স্পষ্টবাদী ও সরাসরি কথা বলেন, লন্ডন বিমানবন্দরে রিপোর্টারদের/ সাংবাদিকদের জানান যে তিনি ভারতে অবস্থিত শিবিরগুলোর পাকিস্তানী উদ্বাস্তুদের তিনি দুইটি প্রশ্ন করেছিলেন। তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন: “আপনারা কি ফিরে যাবেন?” উত্তর ছিল: “সব কিছু নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত, না”।
মিঃ জেসেল এর দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল: “আপনারা কখন ফিরে যাবেন?” উত্তর ছিল: “যদি শেখ মুজিবুর রহমান ফিরে যেতে বলেন, আমরা যাব”।
মিঃ রেনাল্ড প্রেন্টিস (লেবার)কে একজন পাকিস্তানী রিপোর্টার/ সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন যে সাহায্যকে চালিকা শক্তি হিসেবে ব্যবহার করা কোন সু-নীতির মধ্যে পরে কি না। তিনি মাত্র সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের প্রসেডিংসে এরকম প্রশ্ন দেখেছেন, যেখানে ১০০ টির মধ্যে ৯৯টির ক্ষেত্রেই তিনি সাহায্যকে চালিকা শক্তি হিসেবে ব্যবহারের বিপক্ষে, কিন্তু পাকিস্তানের বর্তমান ক্ষেত্রে এটা যৌক্তিক ছিল।
গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিষয়
মিঃ বটমলে চার সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে সম্মিলিতভাবে একমত হয়ে পূর্বে একটি বক্তব্য প্রদান করেন। উদ্ভুত অবস্থার তিনটি ক্ষেত্রে তিনি প্রাধান্য প্রদান করেনঃ পূর্ব বাংলায় চলমান সংকটের ভীতি, সেখানে চলমান নৈরাজ্য এবং উদ্বাস্তুদের আরও সাহায্যের প্রয়োজনীয়তা।
মিঃ বটমলে বলেন যে তাঁর সমগ্র দায়িত্বকালীন সময়ের মধ্যে এই দায়িত্বকালীন সময়টিই ছিল সবচেয়ে হৃদয়বিদারক। তিনি রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান-কে একজন সম্মানীয় ব্যক্তি হিসেবে পেয়েছেন যিনি পূর্ব পাকিস্তানে কি ঘটছিল তা জানেন না বলে মনে হয়েছে। (italic)
কিন্তু জেনারেল টিক্কা খান, তিনি মনে করেন, ঢাকায় ভুল ব্যক্তি ছিলেন যার এই অবস্থার অর্থনৈতিক বা সামাজিক প্রভাব কি হবে তার জ্ঞান বা উদ্বেগ কোনটিই ছিল না। সেনাবাহিনী শুধুমাত্র নৈরাজ্য বপনই করেনি বরং তা অবিরতভাবে চালিয়ে যায়।
পাকিস্তানের ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হয়ে কেবলমাত্র একটি স্থান ছাড়া পূর্ব বাংলার যে স্থানে যেতে চেয়েছেন তাঁদের দলটি সেখানেই গিয়েছেন বলে তিনি জানিয়েছেন।
মিঃ বটমলে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করে জানান যে তিনি শুধু একজন প্রধানমন্ত্রীই নন বরং একজন মহা রাজনীতিবিদের মত আচরন করেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে তিনি প্রজ্ঞা ও সহানুভূতির সাথে ব্যাপক সমস্যার মোকাবেলা করছিলেন এবং তিনি সবরকমের সহায়তা প্রাপ্য।
তিনি বৃটিশ সরকার ও জনগণের নিকট উদ্বাস্তুদের জন্য ত্রান প্রদানের জন্য অনুরোধ করেন এবং ভারতীয় প্রশাসনের চমৎকার কর্মকান্ডের মাধ্যমে তাঁদের অর্থ সঠিকভাবে ব্যয় হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন।
উদ্বাস্তুদের নিজেদের বাড়ীতে ফিরতে বাধা দেয়া হচ্ছিল কি না জিজ্ঞাসা করা হলে, মিঃ বটমলে জানান যে, “এমনটি কেন হবে?” উদ্বাস্তুরা, তিনি জানান যে, ভারতের জন্য অনিবার্য সমস্যার সৃষ্টি করছিল।
.
13.32.135-136
শিরোনামঃ লেবার পার্টির আন্তর্জাতিক কমিটিতে পাকিস্তান পরিস্থিতি আলোচনা
সূত্রঃ লেবার পার্টি তথ্য বিভাগ
তারিখঃ ৮ জুলাই, ১৯৭১
.
সংবাদ বিজ্ঞপ্তি
লেবার পার্টির তথ্য বিভাগ হতে ইস্যুকৃত
পাকিস্তান
লেবার পার্টির আন্তর্জাতিক কমিটির আজকের বৈঠকে পাকিস্তানের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করা হয় এবং নিম্নলিখিত রেজুলেশন গৃহীত হয়।
১। পশ্চিম ও পূর্ব বাংলার মানুষদের বর্তমান অবস্থা নিয়ে এন ই সি (ন্যাশনাল ইকোনমিক কাউন্সিল) গভীরভাবে উদ্বিগ্ন এবং বিশ্বাস করে যে, পাকিস্তানের অধীনে বর্তমান সংঘাত আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি। পাকিস্তানের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব এবং শান্তির হুমকি বন্ধ করা একমাত্র সন্তোষজনক রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমেই সম্ভব এবং আশু প্রয়োজনীয়তা শরণার্থীদের মধ্যে মানবিক যন্ত্রণার তীব্রতা এবং যথাসময়ের পূর্বে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা ব্রিটেন থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া দাবি করছে। সুতরাং, এটি মহামান্য সরকারকে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ অবিলম্বে নেয়ার জন্য আহবান জানায়-
(ক) নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানে সংঘাতের বিষয়ে প্রশ্ন তোলা জরুরী যা অন্যের শান্তির জন্য হুমকিস্বরূপ এবং নিরাপত্তাকে বিপদসংকুল করে তুলছে।
(খ) বর্তমানে উ থান্টের ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলে প্রচুর পরিমাণে ব্রিটিশ অবদান বাড়ানো এবং ভারতের শরণার্থী সমস্যার খরচ মেটাতে তার প্রতি উদার বাড়তি সাহায্যের একটি তাৎক্ষণিক দ্বিপাক্ষিক প্রস্তাব করা।
ন্যাশনাল ইকোনোমিক কাউন্সিল আরও বিশ্বাস করে যে, এই অবস্থায় এটা ঠিক যে ব্রিটিশ মানুষের জানা উচিত আসন্ন পাকিস্তান এইড কনসোর্টিয়াম সভায় মাননীয় ব্রিটিশ সরকার কি প্রস্তাব করবে, যা পাকিস্তান যে গুরুতর অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি তা বিবেচনা করবে।
ন্যাশনাল ইকোনোমিক কাউন্সিল বিশ্বাস করে যে, এমন একটি অবস্থার অবতারণা হয়েছে যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ধস নেমেছে, তাই উন্নয়নের জন্য সাহায্য অর্থপূর্ণ হতে পারে না। সুতরাং, এটি মাননীয় সরকারকে বিনীত অনুরোধ করে কনসোর্টিয়ামের আসন্ন সভায় পূর্ব পাকিস্তানে যতদিন না পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি অর্জন করা সম্ভবপর হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রতি সাহায্য ত্রাণ এবং প্রকৃত রোগ ও পীড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখার জন্য গুরুত্ব আরোপ করা, মনে রাখতে হবে যে, যেসব মানুষের সাহায্য অতি প্রয়োজনীয় তারা বর্তমানে পাকিস্তানে নেই।
২। “ভারত ও পাকিস্তানের পর্যাপ্ত ত্রাণ না পাওয়ার সুস্পষ্ট ব্যর্থতা এবং বর্তমান সময়ে অন্যান্য অনুরূপ বিপর্যয়ে প্রযুক্তিগত সমস্যার ব্যাপারে এই কমিটি মাননীয় সরকারকে আহবান জানায় একটি আন্তর্জাতিক ত্রাণ কমিশন প্রতিষ্ঠার উত্থাপন করার জন্য। এই কমিশন অবিলম্বে গঠন করা উচিত এবং ত্রাণে, পরিবহনে এবং বড় মাপের সংগঠনের ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞ লোকজনের দ্বারা গঠন করতে হবে। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে যেমন পাকিস্তানের নতুন পরিস্থিতিতে কমিশন নিয়মিত বৈঠক করবে এবং বৈশ্বিক মাপে কী ধরনের পদক্ষেপ জাতিসংঘের দ্বারা বাস্তবায়ন করা প্রয়োজনীয়- এ ব্যাপারে রিপোর্ট করবে। কমিশন অবিলম্বে প্রাকৃতিক ও মনুষ্য সৃষ্ট বিপর্যয়ে তাৎক্ষণিক ত্রাণ পৌছানো, জীবন বাঁচানোর জন্য স্থায়ী যন্ত্রপাতি স্থাপন করবে, অপরিহার্য চিকিৎসা সরঞ্জামে সজ্জিত করবে এবং যতদিন না পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা কার্যকর করা সম্ভব নয় ততদিন প্রয়োজন মোতাবেক পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নেয়া”।
শরণার্থী
সম্মেলন সুবিস্তৃত শরণার্থী সমস্যায় বিশ্ব সম্প্রদায়ের সম্পূর্ণভাবে অপর্যাপ্ত প্রতিক্রিয়ায় তার গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ভারত সরকার এই বোঝা অনুপাতহীনভাবে বহন করছে এবং সম্মেলন শরণার্থীদের সাহায্যে পূর্ণ দায়িত্ব নেয়ার জন্য জাতিসংঘের একটি দুর্যোগ ত্রাণ সংস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য আহবান জানায়। সম্মেলন এমন একটি সংস্থার জন্য ব্রিটিশ সরকারের পূর্ণ সমর্থন অঙ্গীকার এবং একই সময়ে তাৎক্ষণিক সমস্যার সঙ্গে মানিয়ে নিতে সক্রিয় করতে ভারত সরকারের প্রতি দ্বিপাক্ষিক সহায়তা প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি করতে হবে।
সাহায্য
সন্তোষজনক রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া পাকিস্তানে দীর্ঘ-মেয়াদী সাহায্য একটি নিন্দিত সামরিক শাসনের প্রতি ভর্তুকি মনে হবে। সেই জন্য সম্মেলন সকল দেশ এবং বিশেষ করে পাকিস্তান এইড কনসোর্টিয়ামের সদস্যদের জরুরী মানবিক সাহায্য ব্যতিত সকল সাহায্য থামিয়ে রাখা উচিত যতদিন না পর্যন্ত পূর্ব বাংলার মানুষ একটি সন্তোষজনক রাজনৈতিক সমাধানে সম্মত হচ্ছে।
রাজনৈতিক সমাধান
সম্মেলন বিশ্বাস করে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর পরেই একটি রাজনৈতিক সমাধানে পৌছানো সম্ভব-
(১) পূর্ব বাংলায় সেনাবাহিনীর দমন শেষ হয় গেছে।
(২) পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দেয়া হয়েছে।
যেকেনো রাজনৈতিক সমাধান পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতাদের সাথে আলোচনা করা এবং এ অঞ্চলের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
শান্তির জন্য হুমকি
সম্মেলন বিশ্বাস করে যে, ভারতীয় উপমহাদেশে উপস্থিত অবস্থা বিশ্ব শান্তির জন্য হুমকি গঠন করে। তাই জাতিসংঘের উচিত পূর্ব বাংলার মানুষের ইচ্ছা অনুযায়ী একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য সরাসরি নিজেকে এর কাজে জড়িত করা। সম্মেলন জাতিসংঘের বর্তমান অধিবেশনে এ ব্যাপারটি তোলার জন্য ব্রিটিশ সরকারকে আহবান জানায়।
.
13.34.140-141
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
বাংলাদেশে গণহত্যা প্রশ্নে দুইজন আইরিশ এম,পি’র বিবৃতি | দি স্টেটসম্যান | ১৫ জুলাই, ১৯৭১ |
বাংলাদেশে গণহত্যা
আইরিশ এম পি
স্টাফ রিপোর্টার
আইরিশ এম পি স্যার এনটনি এসমন্ড এবং মিঃ উইলিয়াম লগনান গত বুধবার কলকাতায় একটি প্রেস কনফারেন্স এ বলেন বাংলাদেশ থেকে ৭ মিলিয়ন শরণার্থীর ভারতে অনুপ্রবেশ দেশটির অর্থনীতিতে একটি ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে। ডঃ লগনান এর সাথে শরণার্থীদের কথপোকথনে জানা যায় যে শরণার্থীদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। তাঁর আহব্বানে শরণার্থীদের একটি বিশাল অংশ বাংলাদেশে ফিরে যেতে প্রস্তুত।
তাঁদের মতে শরণার্থীদের প্রভাবে বর্তমানে ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ নাজুক এবং দ্রুত রাজনৈতিক সমাধান গ্রহন না করলে তা আরও ভেংগে পড়তে পারে। সডঃ লগ্নানের মতে শরণার্থীদের বাইরে রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে নির্বাচনের ফলাফল অগনাতান্ত্রিক হবে, উপরন্তু বাংলাদেশে বসবাস্কারী জনগণের ভোটে নির্বাচিত জন প্রতিনিধিদেরও পরিত্যাগ করা সম্ভব হবেনা।
ডঃ লগনান বাংলাদেশে চলমান রত অবস্থাকে গনহত্যা বলে আখ্যায়িত করলেও মিঃ এনটনি আন্তর্জাতিক আইনের আদলে গন্নহত্যার বিষোয়টি নিয়ে সন্দিহান। তবে তাঁরা কেউই বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে নিশ্চিত কোণো রাজণৈতিক সমাধান দিতে রাজি হননি। তবে প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে তাঁরা মিঃ ভুট্টো এবং পুর্ব বাংলার নেতাদের সাথে আলোচনায় বসতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে স্যার এনটনি বলেন ইয়াহিয়া খানের সাম্প্রতিক বক্তব্য বেশ অসঙ্গগতিপুর্ণ। বাংলাদেশের ব্যাপারে হস্তক্ষেপনের বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তানি বলেন, “ কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থাই কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্থক্ষেপ করার অধিকার রাখেনা।”
তাঁরা উভয়েই ভারতের শরণার্থী ব্যবস্থাপ্নায় বিশেষ সন্তুষ্ট ছিলেন।
দমদম থেকে আমাদের সংবাদ প্রতিবেদক জানান আইরিশ এম পি দ্বয় এখান থেকে পাকিস্থানে ভ্রমণ করবেন এবং ইয়াহিয়া খানের সাথে সাক্ষাতের চেষ্টা করবেন। পুর্ব বাংলার শরণার্থীদের অবস্থা যাচাই এর পর তাঁদের দিল্লী ফিরে যাওয়ার কথা রয়েছে। আয়ারল্যান্ড ভারত ও পাকিস্তানের অবস্থা উন্নয়নের লক্ষ্যে সর্বাত্মক সহায়তা করতে প্রস্তুতু বলে তাঁরা আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে তাঁরা বলেন তাঁরা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করে জেনেছেন বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীরা ভারতের অর্থনীতিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাঁরা পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাত করে পারস্পারিক সমঝোতার ব্যাপারে আলোচনা করবেন বলে আশ্বাস দেন। তাঁদের তিন দিন ব্যাপী কলকাতায় অবস্থান কালে তাঁরা নদীয়া ও ২৪ পরগণার শরণার্থী শিবির ভ্রমণ করবেন বলে জানান।
.
13.35.142-143
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
বাংলাদেশের পরিস্থিতির ওপর অপারেশান ওমেগার প্রচারপত্র | অপারেশন ওমেগা | ৩০ জুলাই, ১৯৭১ |
.
অপারেশান ওমেগা
৩ ক্যালেডনিয়ান রোড, লন্ডন এন ১
“কষ্টে জর্জরিত জনগণ ও সাহায্য করতে সক্ষম ব্যাক্তিদের মধ্যেকার দেয়াল কখনই আইন্সিদ্ধ হতে পারেনা। মরণাপন্ন ব্যক্তিকে সাহায্য করায় কোনো বাধা ই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনা।”
প্রেস স্টেটমেন্ট ৩০-০৭-৭১
পশ্চিম পাকিস্তানের হানাদার বাহিণী বাংলাদেশের নিরীহ জনগণের উপর অবিরত নির্যাতন আর নিষ্পেষণ চালাচ্ছে। বাকি বিশ্ব এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে নিশ্চুপ রয়েছে, যা বাংলাদেশের ৭৫ মিলিয়ন জনগণকে কোণ্ঠাসা করে ফেলেছে।
এই যুদ্ধাবস্থা বাংলাদেশে খাদ্য ও ওষুধের তীব্র সংকট সৃষ্টি করেছে।
মানবিক দিক থেকে চিন্তা করলে অপারেশন ওমেগার বাংলাদেশে প্রবেশ করা ব্যাতীত অন্য কোনো উপায় নেই। কারণ প্রথমত, বাংলাদেশের জনগণরা একাকী নয় এ বিশ্বাস তাদের মধ্যে জাগ্রত করা। দ্বিতীয়ত, যাদের সাহায্য প্রয়োজন তাদের সাহায্য করা।
অপারেশন ওমেগার উদ্দেশ্য মুলত নিম্নরূপঃ
আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য বাংলাদেশে বসবাসকারী জনগণের কাছে পর্যাপ্ত খাদ্য ও চিকিৎসা সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া।
পাকিস্তান সরকারকে অপারেশন ওমেগার উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে এবং প্রয়োজনে বিশ্বের অন্যান্য দেশকেও করা হবে। তবে বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য পাকিস্তানের অনুমতি গ্রহন করা হবেনা কারণ অপারেশন ওমেগা বিশ্বাস করে, বাংলাদেশের উপর পাকিস্তানের কোনো কতৃত্ব নেই।
আমরা সাধারণ মানুষ হিসাবে বিশ্বাস করি যে বিশ্বের মানবিক সাহায্যে বরাদ্দ অনুদান কখনই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা উচিত নয়। বরং তার উপর অভাবগ্রস্থ ও সাহায্য প্রার্থী জনগণের অধিকারই সর্বাগ্রে।
অপারেশন ওমেগার পদ্ধতি নিম্নরুপঃ
ওমেগা টিম প্রথমে ভারতে সফর করবে এবং সেখানে অবস্থানরত ওমেগা টিমের অন্যান সদস্যদের সাথে মিলিত হবে। সেখান থেকে সম্পুর্ণ ওমেগা টিম বাংলাদেশের পথে পাড়ি দিবে।
ভারত থেকে ওষুধ এবং অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রী কেনা হবে এবং দুটি যানবাহনে করে তা ভারত থেকে বাংলাদেশে নেওয়া হবে। ওমেগা ১ বাহনটি দিল্লীতে পৌঁছানোর পর যথাশীঘ্র সম্ভব কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হবে এবং সেখান থেকে সবচেয়ে উপযোগী উপায়ে ব্যবহৃত হবে।
দুটি যানবাহন একসাথতে বাংলাদেশে প্রবেশ করবে। কোনো কারণে প্রথম বাহনটি নিশ্চিল হয়ে গেলে দ্বিতীয় বাহনটি সাহায্য নিয়ে জনগোনের কাছে পৌঁছুবে এবং ভারতীর সীমান্তে যোগাযোগ রক্ষা করবে। লন্ডনের সাথে জরুরি যোগাযোগ রক্ষার জন্য একজন ওমেগা স্বেচ্ছাসেবক সর্বদা সীমান্তে এবং একজন কলকাতায় অবস্থান করবে।
অপারেশন ওমেগা বাংলাদেশে তথা বিশ্ব ইতিহাসে একটি নতুন দিগন্ত সূচনা করতে পারে যখন প্রতিটি দেশের সরকারকে অবশ্যই মানবিক দিক বিবেচনা করে সকল সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে হবে, যখন কোনো দেশের সরকারই চিঠি দলিল আর রেজলুশ্যনের আড়ালে লুকিয়ে মানবিক দায়িত্ব থেকে এড়িয়ে যেতে পারবেনা।
.
13.36.144-146
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
এ্যাকশান বাংলাদেশ-এর ভূমিকা ও কর্মসূচী | এ্যাকশান বাংলাদেশ-এর প্রেস বিজ্ঞপ্তি | … জুলাই, ১৯৭১ |
এ্যাকশন বাংলাদেশ
৩৪ স্ট্র্যাটফোর্ড ভিলা
লন্ডন এন ডব্লিউ ওয়ান
এ্যাকশান বাংলাদেশ, একটি ব্রিটিশ গ্রুপ, ২০শে এপ্রিল, ১৯৭১ সালে একটি সভায় স্থাপিত হয় যেখানে উপস্থিত ছিলেন পীস নিউজের প্রতিনিধি, ইন্টারন্যাশনাল কনসান্স ইন অ্যাকশন, পীস প্লেজ ইউনিয়ন, থার্ড ওয়ার্ল্ড রিভিও, ইয়ং লিবারেলস, বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম কমিটি, বাংলাদেশ নিউজ লেটার এবং পীস কমিটির বন্ধুরা সহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
এটির উদ্দেশ্য ছিল পাবলিক, প্রেস এবং অন্যান্য সংগঠনের সদস্যদের জন্যে তথ্য সরবরাহ করা যাতে তারা ‘পূর্ব পাকিস্তান থেকে সৈন্য তাড়ানো এবং ত্রাণ পৌছানো’- এর ব্যপারে কিছু করতে পারে।
ডায়েরিঃ
এপ্রিল ২৮ঃ
ইংলিশ স্পিকিং ইউনিয়নের বাইরে সংঘটিত বিক্ষোভের কো-স্পন্সর ছিলাম, যেটি পাকিস্তান ক্রিকেট একাদশের জন্যে একটি সংবর্ধনার আয়োজন করেছিল। “খেলা শুরু কোরো না- যুদ্ধ বন্ধ কর!”
মে ১৩ঃ
দ্যা টাইমসে একটি ৩/৪ পেইজের বিজ্ঞাপন দিই (‘এই মুহূর্তে এটাই দেখানো দরকার যে মানুষ একটি ‘অভ্যন্তরীণ সমস্যা’ থেকেও বেশি কিছু’’)। এটিতে সর্বস্তরের ২০৬ জন মানুষ স্বাক্ষর এবং আর্থিক সাহায্য প্রদান করেন, এবং মে ১৪-তে হাউজ অব কমন্সে বিতর্কের আগের দিন প্রকাশিত হয়।
বার্মিংহাম রিলিফ এবং অ্যাকশন কমিটির কো-স্পন্সরে হাউজ অব কমন্সের বিপরীতে আলবার্ট বাঁধের উপরে একটি মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করা হয়ঃ “এম.পিজ শো ইউ কেয়ার” !
মে ২৫ঃ
বাংলাদেশে খাদ্য এবং ওষুধপত্র পৌঁছাতে সমর্থন পাওয়ার জন্যে ‘ব্রেক দ্যা ব্লকেড রেজোলিউশন – অবরোধ কর্মসূচী তুলে নাও’ – শীর্ষক একটি বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টার সূত্রপাত করি।
জুন ৩ঃ
কেনসিংটনের দ্যা ভেরে হোটেলে গান্ধীর বিশিষ্ট শিষ্য, জয়প্রকাশ নারায়ণের সাথে এই বিষয়ে ক্রমেই বেড়ে যাওয়া ব্রিটিশ অ্যাকশনের জন্যে আয়োজিত একটি সংবর্ধনার সংঘটন এবং স্পন্সর করি।
জুন ৭ঃ
ওয়্যার রেজিস্টরস ইন্টারন্যাশনাল, কমিউনিটি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশন গ্রুপ, ম্যানচেস্টার, এবং পিস নিউজের সহযোগিতায়ঃ অপারেশন ওমেগা চালু করা হয়। এটি ‘পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের’ ‘অনুমতি’ ছাড়াই, বাংলাদেশের মানুষের কাছে সরাসরি খাদ্য এবং চিকিৎসা সহায়তা দেয়ার জন্যে একটি প্রচেষ্টা।
জুন ১০ঃ
লন্ডন অঞ্চলের বাংলাদেশ কমিউনিটির সাথে (বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটি, বাংলাদেশ উইমেন্স এসোসিয়েশন ইন গ্রেট ব্রিটেন, বাংলাদেশ যুব সংঘ, বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি ইন স্ট্রিথাম, অ্যাকশন কমিটি ফর বাংলাদেশ (উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিম লন্ডন), বাংলাদেশ ত্রাণ তহবিল এবং পরিচালনা কমিটি) যুক্ত হয়ে “স্টপ এইড টু পাকিস্তান ক্যাম্পেইন”- চালু করেছি।
জুন ১১ঃ
অপারেশন ওমেগা -এর উপরে দ্যা গার্ডিয়ানে প্রকাশিত ১/৪ পৃষ্ঠার বিজ্ঞাপনে কো-স্পন্সর করেছি।
জুন ১৪-১৮ঃ
“স্টপ এইড টু পাকিস্তান ক্যাম্পেইন” – পাকিস্তান এইড কনসোর্টিয়ামের ১০টি দেশের লন্ডন দূতাবাসের বাইরে ৫ দিনের মধ্যে ১০টি বিক্ষোভের আয়োজন করে। “পাকিস্তানকে আর্থিক সাহায্য করা মানে বাংলাদেশের জনগণকে গণহত্যা করা !” প্রতিটি দূতাবাসের একজন প্রতিনিধির কাছে নিজ নিজ হেড অব স্টেট বরাবর একটি চিঠি হস্তান্তর করা হয়।
জুন ১৫ঃ
“স্টপ এইড পাকিস্তান ক্যাম্পেইন”-এর দুই প্রতিনিধিকে এই ইস্যুতে ফরাসিদের উদ্বেগ বাড়াতে প্যারিসে পাঠানো হয়েছে ২১শে জুন প্যারিসে সংঘটিতব্য পাকিস্তান এইড কনসোর্টিয়ামের সভার আগেই।
জুন ১৮ঃ
নিউ স্টেটসম্যান-এরঃ “অ্যাকশন বাংলাদেশ” শীর্ষক ১/৪ পৃষ্ঠার বিজ্ঞপ্তিতে স্পন্সর করেছি।
জুন ১৯ঃ
“স্টপ এইড টু পাকিস্তান”- এর আরও ৬ জন প্রতিনিধিকে প্যারিসে পাঠানো হয়েছে, যাদের মধ্যে ৩ জন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে ফিরেছে।
জুন ২১ঃ
প্যারিসঃ সকাল এগারোটা। বিশ্বব্যাংক ভবন-যেখানে পাকিস্তানে সাহায্য প্রস্তাব নিয়ে টাটকা আলোচনা চলছিল- তার বাইরে বিক্ষোভের জন্যে কো-স্পন্সর করেছি। প্রায় ১৫০ জন বাঙালি ব্রিটেন থেকে এই বিক্ষোভ সমর্থনে এসেছিল। বার্মিংহাম থেকে ২টি কোচ এবং আরেকটি লন্ডন থেকে এসেছিল। রয়টার্স এবং এ.পি. উভয়ই এই বিক্ষোভ সম্পর্কে রিপোর্ট করেছিল।
প্যারিসঃ বেলা ৪টা। ফরাসি প্রেসের কাছে এক প্রেস কনফারেন্সে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসার আগে তিন প্রত্যক্ষদর্শী- তাদের বিবরণীতে তারা কি দেখে এসেছেন তা বিবৃত করেন। ফরাসি সংবাদপত্র কমব্যাট ২২শে জুন তাদের সাক্ষ্যের পূর্ণ বিবরণী ২২শে জুন প্রকাশ করে।
জুন ২৫ঃ
দ্যা ট্রিবিউনে প্রকাশিতঃ “অ্যাকশন বাংলাদেশ” বিজ্ঞপ্তি স্পন্সর করেছি।
জুন ৩০ঃ
“পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা এবং বাংলাদেশের স্বীকৃতি”- শীর্ষক দ্যা টাইমসে প্রকাশিত সম্পূর্ণ পৃষ্ঠা(পৃষ্ঠা ৩)-এর বিজ্ঞাপন স্পন্সর করেছি। এটিতে হাউজ অব কমন্সের কাছে প্রেরিত রেজ্যুলেশনটি ছিল, যাতে ২১০ জন এম.পি স্বাক্ষর করেন, যেখানে ছিলেন ১১ জন প্রিভি কাউন্সিলর এবং ৩০ জনেরও বেশি সাবেক মন্ত্রী।
জুলাই ১ঃ
অপারেশন ওমেগা-এর প্রথম দল এবং গাড়ি- ওমেগা ওয়ান – বেলা বারোটায় বাংলাদেশ অভিমুখে ট্রাফালগার স্কয়ার থেকে যাত্রা শুরু করে।
ভবিষ্যৎ কর্মসূচীঃ
ওমেগা ২, ওমেগা ৩, ইত্যাদি ………………………….
ট্রাফালগার স্কয়ার সমাবেশ বেলা ২.০০ – সন্ধ্যা ৬.০০ টা, রোববার পহেলা অগাস্ট।
____________
.
13.37.147
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
বাংলাদেশের ঘটনাবলীর ওপর তিনজন এমপি’র বক্তব্য
|
মান্থলী কনটেম্পারারী ও হিন্দুস্তান টাইমস | ৫ও৬ আগস্ট,১৯৭১ |
লর্ড ফিনার ব্রোকওয়ে, লন্ডন, আগস্ট ৬
রাজনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে হিটলারের সময় হতে আজ পর্যন্ত গনতন্ত্রকে নির্লজ্জভাবে প্রত্যাখানের নজির হলো পাকিস্তানী সামরিক জ্যান্তা কর্তৃক পূর্ববঙ্গে সামরিক হস্তক্ষেপ । বিশ্বের ধনী রাষ্টগুলোর জন্য এটা সত্যি লজ্জাজনক যে, জনদূর্ভোগ লাঘবের জন্য তারা সঠিকসময়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। পূর্ববঙ্গের হত্যাযজ্ঞ ছিল হিরোশিমার ট্রাজেডির পর সংগঠিত পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম।
মিঃ রেগিনাল্ড প্রিনটিক, লেবার এম পি, লন্ডন, আগস্ট ৫
বৃটেন ও অন্যান্য দেশগুলোর উচিত ভারতকে নতুনভাবে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেওয়া যার মাধ্যমে ভারত শরণার্থী শিবিরে পূর্ববাংলার সত্তর লাখের ও অধিক শরণার্থীকে সামাল দিতে পারে। এটা একটা সম্ভাব্য সামরিক সমাধানকে বাঁধা দানের সাথে সাথে জনহিতকর কাজের অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে। পূর্ববাংলায় সংগঠিত ট্রাজেডির আকার ও ভয়াবহতা নিরূপন করা এতই দূরহ যে তা কল্পনা করাও অসম্ভব। প্রথম দর্শনে আমি বলতে পারি যে, এ রকম ভয়াবহ ঘটনা আমি কখনও দেখিনি এবং আশা করব যেন ভবিষ্যতে এমন নৃশংস ঘটনার সম্মুখিন না হই।
শরণার্থীদের মধ্য থেকে নির্বাচিতদের নিয়ে গঠিত মুক্তি ফৌজ গেরিলারা এসব অঞ্চলে সাফল্য লাভ করছে, আমার মনে হয় অধিকাংশ জনগনই এদের পক্ষে। পাকিস্তানের অবস্থান শান্তির জন্য হুমকি স্বরূপ যা সমগ্র মানব জাতির জন্য মর্মান্তিক ঘটনার জন্ম দিতে পারে।
মিঃ ডোনাল্ড চেজওর্থ, লেবার এম.পি,নয়া দিল্লি, আগস্ট ৬
(শ্রী পৃথিব চক্রবর্তীর সাথে সাক্ষাতকার ও ‘দি হিন্দস্তান টাইমস’ ৭ আগস্ট প্রকাশিত)
একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ অবশ্যম্ভাবী। পাকিস্তানী সামরিক জান্তাদের মধ্যে সমস্যা সমাধানের বিষয়ে সমঝোতার কোন লক্ষণ দেখা যায়নি বরং এরা এর বিরোদ্ধে কাজ করিছল। সামরিক জ্যান্তাদের নৃশংসতার একটাই পরিনতি যা গেরিলাদের যুদ্ধের প্রতিজ্ঞাকে অনড় ও মনোবলকে চাঙ্গা করছে। ফরাসীদের বিরোদ্ধে আলজেরীয় গেরিলাদের যুদ্ধ কৌশলের চেয়েও মুক্তি ফৌজ গেরিলাদের যুদ্ধ কৌশল উচুমানের ও অধিক কার্যকর ছিল বলে মনে হয়েছে। গেরিলাদের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার পুনঃস্থাপনে পাকিস্তানী সামরিক জ্যান্তাদের দক্ষতা আলজেরিয়ায় ফরাসী বাহিনীর চেয়ে নিম্নমানের ছিল। রেলওয়ে যেগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করা ছিল তার জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত।
ইসলামাবাদের সামরিক জ্যান্তা ও বাংলাদেশের নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানের সমঝোতার সম্ভাবনা অনেক আগেই শেষ হয়েছে, তাদের নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতা বাংলাদেশের জনগনের মনোবলকে আরো দৃঢ় করছে পশ্চিম পাকিস্তানের শৃংঙ্খল থেকে নিজেদের মুক্ত ও স্বাধীন করতে।
ভারতের সাথে যুদ্ধ ছাড়া আর বিশেষ কোন সুবিধা পাকিস্তানী নেতারা কিভাবে আশা করতে পারে আমার তা একেবারেই বোধগম্য নয়। আমার বিশ্বাস বিশ্ব জনমত মুক্তি ফৌজকে সহায়তার অজুহাতে পাকিস্তানী বাহিনীর ভারতের বিরোদ্ধে সামরিক হস্তক্ষপকে মেনে নেবে না। যে কেউ চাইলেই দেখতে পারে যে, মুক্তি ফৌজের অপারেশন বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমানার মধ্যে সংগঠিত হচ্ছে।
.
13.38.148
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
বাংলাদেশের ঘটনাবলীর উপর বৃটিশ এমপি মিঃ আর্থার বটম্লীর বক্তব্য | মান্থলী কনটেম্পোরারি | ২৮ আগস্ট, ১৯৭১ |
ইয়াহিয়া খানের গোঁয়ার্তুমি।
আমি চাই ভারত ও পাকিস্তান কাছাকাছি আসুক। আমি চাই এই দুটো দেশ আবার এক হয়ে যাক। তবে এ ব্যাপারে আমি শুধু আশাই করতে পারি, না হলে আবার তাদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছি বলে ভুল বোঝার সুযোগ তৈরি হতে পারে। ভারতীয় উপমহাদেশ আরও বিভক্ত হোক তা কোনভাবেই কাম্য নয়, কারণ এ অঞ্চলের রয়েছে এক সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আর গণিত ও পদার্থবিদ্যায় দক্ষ জনবল, যা আধুনিক বিশ্বে উন্নয়নের অপরিহার্য পূর্বশর্ত। আরও বিভক্তি এই জনশক্তিকে কাজে লাগানোর পথে বিশাল অন্তরায়। কিন্তু সামরিক বাহিনী যদি বর্তমান পরিস্থিতি তাদের মত করে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে তবে পাকিস্তানের ভেঙ্গে যাওয়া ঠেকানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন বেসামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের শাসনভার ছেড়ে দেয়া। পাকিস্তানে আমার সফরের সময় জেনারেল ইয়াহিয়ার সাথে আমার সাক্ষাৎ হলে আমি তাকেও একই কথা বলেছিলাম। কিন্তু আমার কথায় তার সাড়া খুব একটা আশাব্যঞ্জক ছিলো না। আমি তাকে উপমহাদেশে ব্রিটিশদের পরিনতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তা থেকে শিক্ষা নিতে বলি। আমি তাকে এই কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলাম যে আজ আমরা যাদের কারাবন্দী করি তারাই কিন্তু পরবর্তিতে জাতীয় নেতায় পরিণত হয়।
.
13.39.149
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
বাংলাদেশের ঘটনাবলীর উপর বৃটিশ এম,পি মিঃ পিটার শোর-এর বক্তব্য | মান্থলী কন্টেম্প্রারী | ৩১ আগস্ট,১৯৭১ |
“নিদারুণ যন্ত্রণার মৃত্যু এবং জন্মের নাভিশ্বাস”
বাংলাদেশের ঘটনা একটি প্রাচীন জাতির(পাকিস্তান) নির্মম মৃত্যু এবং একটি নতুন জাতির (বাংলাদেশ) জন্মের নাভিশ্বাস (আকস্মিক তীব্র যন্ত্রণা)।
বাংলাদেশ সমস্যার একমাত্র সমাধান হল অবিলম্বে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি এবং পূর্ব বাংলার মানুষের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা।
বাংলাদেশ সরকারের নেতাদের সাথে কথা বলে আমি জানতে পারি, মোটকথা স্বাধীনতাই পূর্ব বাংলায় স্বাভাবিকতা আনতে পারে।
ব্রিটেনে ফিরে গিয়ে আমি বৃটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী এবং লেবার পার্টির নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করবো যাতে তারা পাকিস্তানের বোধোদয় ফিরিয়ে আনার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সাময়িকভাবে তাদের অর্থনৈতিক সাহায্য স্থগিত করে।
যুক্তরাজ্যের উচিৎ পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের প্রতি সকল সাহায্য বন্ধ করে দেয়া যতক্ষন না পর্যন্ত তারা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাদের নৃশংস দমন বন্ধ না করবে।
মিঃ পিটার শোর, ব্রিটিশ এম,পি
আগস্ট ৩১, নয়া দিল্লী।
.
13.40.150-152
পূর্ব পাকিস্তানের বিষয়ে ব্রিটিশ এমপি জনাব বার্নার্ড ব্রেইন এর বিবৃতি
যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখনই হস্তক্ষেপ না করে তবে, রাত্রি যেমন নিশ্চিত দিন অনুসরণ করে চলে তেমনি অক্টোবর নাগাদ পূর্ব পাকিস্তানেও একটি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হতে পারে। গত সপ্তাহে টরোন্টোতে কানাডার অক্সফাম কতৃক আয়োজিত একটি বেসরকারি সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষজ্ঞগণ এরুপ অসন্তোষজনক উপসংহারে পৌঁছেছেন।
গত মাসে, বিশ্বব্যাংকের একটি মিশন পূর্ব পাকিস্তান সফর শেষে রিপোর্ট করেন যে, তারা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়ার কোন লক্ষণ দেখছেন না । মানুষ এখনো ভীত এবং অনাস্থাবাদী । অনেক কর্মী এবং সরকারি কর্মচারী দায়িত্বে রিপোর্ট করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। যোগাযোগ ব্যাবস্থা সম্পূর্ণভাবে ব্যাহত হয়েছে।
সপ্তাহ অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত রয়েছে। ভারতে এখন ৭.৫ মিলিয়ন শরণার্থী এবং তাদের সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের ভয়াবহ শারীরিক অবস্থা পিছনে ছুটে যাওয়াদের সঙ্কটাপন্ন দশার যথেষ্ট প্রমাণস্বরূপ। বিদ্রোহ অব্যাহত রয়েছে। প্রদেশের নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এখন বেসামরিক প্রশাসন থেকে দূরবর্তী, একটি গোপন সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের সম্মুখীন ।
এখন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য যে বৃহত্তর দুর্ভিক্ষ এগিয়ে আসছে সেই বিশ্বাসের ভিত্তি কী?
প্রথমত, এটা স্বীকৃতি দিতে হবে যে, প্রচুর বৃষ্টিপাত এবং সমৃদ্ধ মাটি থাকা সত্ত্বেও এই প্রদেশে ক্ষুধা ও অপুষ্টি একটি সার্বজনিন রোগ। এখানে মৌলিক খাদ্য ভাত এবং সবজি, মাছ ও ডাল সম্পুরক খাদ্য। মাংস ও দুগ্ধজাত পণ্য বিরল বিলাসদ্রব্য। বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিগত বছর গড় মাথাপিছু খাদ্যশস্য ভোগ ছিল ১৬.১ আউন্স। যা উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের ২৭০০ ক্যালোরির তুলনায় শুধুমাত্র ১৭০০ ক্যালোরির যোগান দেয়। বস্তুতপক্ষে, পাকিস্তান সরকার কতৃক ১৯৬৪ সালে পরিচালিত পুষ্টি জরিপের তথ্যানুযায়ী,পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামীণ জনসংখ্যার গড় প্রোটিনযুক্ত খাবার গ্রহণ শতকরা ৮৫ ভাগ পর্যন্ত অপর্যাপ্ত ছিল এবং অর্ধেক ছেলেমেয়েরা অপুষ্টির সীমান্তরেখার উপর ছিল। শিশু মৃত্যুর হার তাদের পঞ্চম জন্মবার্ষিকী পর্যন্ত ২৬ শতাংশ ছিল যা ইউরোপে গড় ২.৪ শতাংশ।
এসবের প্রভাব টরন্টো সম্মেলনে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের ডঃ জন রোড দ্বারা বর্নিত হয়, যিনি সম্প্রতি পূর্ব পাকিস্তান থেকে ফিরে এসেছেন। তাঁর মূল বিষয়টা ছিল যে একটি মানুষ, যার খাদ্য এবং কল্যাণ স্বাভাবিক অবস্থাতেই অত্যন্ত প্রান্তীয়, সেখানে যদি শুধুমাত্র একটি চিরাচরিত খাবার সরবরাহে প্রান্তিক ঘাটতি হয় তবে তা বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।তা সত্ত্বেও, যদি একটা বড় ঘাটতি হয় তবে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ অনিবার্য এবং লক্ষ লক্ষ মৃত্যু নিশ্চিত।
ঘাটতি সম্পর্কে তথ্য কি কি? ১৯৬৬ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান বছরে গড়ে ১০.৮ মিলিয়ন টন শস্য উৎপাদন করে, কিন্তু এখনো চলমান ঘাটতি মেটাতে বছরে ১.২ মিলিয়ন টন আমদানি করতে হয়। চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক কার্যসূচী দেশীয় উৎপাদনে ১৯৭৫ সাল নাগাদ একটি বৃহৎ বৃদ্ধি পরিকল্পনা করে । কিন্তু তা যদি অর্জন করাও যায়, দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে আমদানি এখনও প্রয়োজনীয় হবে।
দুর্ভাগ্যবশত, আদৌ বৃদ্ধি না পেয়ে, উৎপাদন মারাত্নক ভাবে ব্যাহত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন কতৃক আন্তর্জাতিক উন্নয়নের জন্য তৈরি করা সাম্প্রতিক হিসাবের উপর ভিত্তি করে ডঃ রোড কতৃক উদ্ধৃত পরিসংখ্যান অনুযায়ী,আগামী বছরের দেশীয় উৎপাদন বর্তমান সমস্যার পুর্বের অনুমেয় হিসেবের চেয়ে ২.২৮ মিলিয়ন টন কম হতে পারে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, পূর্ব পাকিস্তান বাংলার ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের পর বৃহত্তম খাদ্য ঘাটতির মুখোমুখি। দুর্ভিক্ষে যে তিন মিলিয়ন মানুষের ক্ষতি হয় তা স্মরণ করে এই বিষয়ে জড়িত বিষয়গুলোর ব্যাপারে ধারণা উপলব্ধি করা যাবে।
এরুপ ভীতিকর পরিস্থিতির কারণসমূহ গণনা কঠিন নয়।শত হাজার কৃষক ভারতে পালিয়ে গেছেন এবং এখনও পালাচ্ছেন। কৃষিঋণ ব্যাবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। গণপূর্ত কার্যক্রম ও বেসরকারি ব্যবসায়িক কার্যক্রম বস্তুত স্থগিত আছে, এবং প্রদেশের সর্বত্র নগদ অর্থের তীব্র ঘাটতি বিরাজমান। গোপন মজুত বাড়ছে এবং চালের দাম আচমকা বেড়ে গেছে।
ডঃ রোড মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুমেয় ত্রাণ উদ্ধৃত করে বলেন যে, দেশীয় উৎপাদনের সম্পূরক হিসেবে ২.৯ মিলিয়ন টন শস্য আমদানি প্রয়োজন হবে, গড় মাথাপিছু দৈনিক ভোগ ১৫ আউন্স (১৬০০ ক্যালোরি) নিশ্চিত করার জন্য। এটি একটি সর্বনিম্ন ধারণা, যেহেতু একজন প্রাপ্তবয়স্কর ১৬০০ থেকে ১৯০০ ক্যালোরি প্রয়োজন সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ১৯৭০ সাল নাগাদ, কোন স্বাভাবিক বছরে খাদ্যশস্যের সর্বাধিক আমদানি ছিল ১.৫ লাখ টন, তাই প্রায় দ্বিগুণ পরিমান আমদানি ও তার সুষম বন্টনের সম্ভাবনা বর্তমান পরিস্থিতিতে ঘাটতিপূর্ণ।
এমনকি যদিও প্রয়োজনীয় পরিমাণ খাদ্য জাহাজে যেতে পারে এবং খালাস হতে পারে, তাদের ঘাটতিপুর্ন এলাকায় স্থানান্তর করা ক্ষমতা মারাত্মকভাবে সীমাবদ্ধ।চট্টগ্রাম ও অন্যান্য বন্দর ধারণক্ষমতার নিচে পরিচালিত হচ্ছে। কারণ প্রচুর বন্দর শ্রমিক পালিয়ে গেছে। সামরিক সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহীদের অন্তর্ঘাত ক্রিয়াকলাপ দ্বারা সড়কএবং রেল যোগাযোগ গুরুতরভাবে ব্যাহত হয়েছে।
প্রায় ৯০ শতাংশ জনগণ গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে, এবং এই অনুপাত এখন সম্ভবত আরও বেশি কারণ শহুরে জনসংখ্যার অর্ধেক পালিয়ে গেছেন। কিন্তু এখানে, যেখানে প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দখল সেখানে সবচেয়ে বেশি ভঙ্গুর। বাস্তবে ভয় যে, যদি খাদ্য বিতরণ শুধুমাত্র সামরিক বাহিনীর হাতে ছেড়ে দেওয়া হয় তবে তারা প্রথমে আদেশের পুন ইকেপ্রতিষ্ঠাঅগ্রাধিকার দেবে এবং খাদ্যকে একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে দ্বিধাবোধ করবে না । যদি সেটা হয়, বিদ্রোহীরা এই প্রক্রিয়া ব্যাহত করাবে সে আশা করা যেতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে ডঃ রোড টরন্টো সম্মেলনে তিনটি জরুরী প্রয়োজনের কথা বলেন। প্রথমত, আন্তর্জাতিক মতামতকে দাবী জানাতে হবে যে পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিপক্ষ দলকে খাদ্য আক্রান্ত এলাকায় পৌঁছানোর অনুমতি দিতে হবে যা সেনা বা বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে। দ্বিতীয়ত, খাদ্য সরাসরি প্রয়োজনগ্রস্থ মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য একমাত্র নিশ্চিত পথ হল, পাকিস্তান সরকারকে এটা মেনে নিতে হবে যে খাদ্য বিতরণ জাতিসংঘের কর্মীদের তত্ত্বাবধানে এবং অধীনে হওয়া উচিত। তৃতীয়ত, একটি বিশেষজ্ঞদের আন্তর্জাতিক দলকে বিলম্ব ছাড়াই পূর্ব পাকিস্তানের প্রবেশ করার অনুমতি দেওয়া হবে। ইহার কাজ হবে সর্বাধিক প্রয়োজনগ্রস্থ এলাকাসমূহ নির্ধারণ করা, বর্তমান খাদ্য মজুদ মূল্যায়ন করা, ত্রাণসামগ্রীর ধরণ এবং পরিমাণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং প্রয়োজনীয় ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা এবং বেসামরিক উদ্দেশ্যে যোগাযোগ ও পরিবহন সুবিধাসমূহ মেরামতের তদারকি করা, আকাশ এবং জলপথে সহজগম্য খাদ্য বিতরণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা এবং বিতরণের জন্য যুক্তিসঙ্গত ও ন্যায়সঙ্গত পদ্ধতি প্রণয়ন।
এরুপ প্রয়োজনীয়তায়, এবং তাদের দ্রুত মেটানোর ক্ষেত্রে, কার্যকর ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালিত করার যুক্তিসঙ্গত একটি সুযোগ রয়েছে। তাৎক্ষণিক চাহিদা পুরণে, জরুরী খাদ্য সরবরাহ করা উচিত। বন্দরে যানজট এড়াতে, এবং সড়কের ভাঙ্গন এড়াতে এবং রেল যোগাযোগে উপকূলে জাহাজ ব্যবহার করা উচিত। আঞ্চলিক কেন্দ্রসমূহে পৌঁছাতে বিস্তৃত জলপথে একটি ছোট নৌবহর-ব্যাবস্থা ব্যবহার করা যেতে পারে।
কিন্তু সময় গুরুতরভাবে সংক্ষিপ্ত। বিশ্ব সম্প্রদায়কে এখনই কাজ করতে হবে অথবা একটি অকল্পনীয় মানবিক দুর্যোগ প্রত্যক্ষ করতে প্রস্তুত থাকতে হবে।
.
13.41.153
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃপক্ষকে আর্থিক সাহায্য দেয়া উচিত নয়ঃ বৃটিশ এমপি মিঃ পিটার শোর-এর বক্তব্য | সানডে টাইমস | ৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ |
.
ব্রিটিশ এমপি, মিঃ পিটার শোর-এর বক্তব্য
২রা সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
বক্তব্যের উপর একটি রিপোর্ট নিম্নরূপঃ
স্টেপনি-এর লেবার দলের এমপি মিঃ পিটার শোরের দৃষ্টিতে পশ্চিম পাকিস্তানে ব্রিটিশ সরকারের উচিত হবে না বাণিজ্যিক অথবা আর্থিক সাহায্য আবার শুরু করা।
মিঃ শোর, যিনি মাত্রই স্টেপনির বিশপ, রাইট রেভারেন্ড ট্রেভর হাডলস্টোন-এর সাথে দিল্লী এবং পশ্চিম পাকিস্তানে এক সপ্তাহের পরিদর্শন শেষে ফিরেছেন, তারা পররাষ্ট্র সচিব, স্যার ডগলাস-হোমের নিকট এই প্রস্তাব প্রেরণ করেন, পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারকে বুঝতে হবে যে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে এবং সেখানে ক্ষমতা থেকে সরে আসতে শুরু করতে হবে।
গতকাল (২রা সেপ্টেম্বর), মিঃ শোর বলেন, “এখন পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার একটি সন্তোষজনক সীমারেখা গ্রহণ করেছে, কিন্তু অক্টোবরে বাণ্যিজ্য সুবিধা পুনরায় শুরু করা উচিত হবে কি না তা নিয়ে সিদ্ধান্ত গৃহিত হবে।”
“পশ্চিম পাকিস্তান সরকার, সাহায্য পুনরায় শুরু করার জন্যে, পূর্ব বাংলায় একটি বিশদ উইন্ডো ড্রেসিং অপারেশন*(*অর্থনৈতিক বিবরণী দেয়ার আগে অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করার নামই হচ্ছে উইন্ডো ড্রেসিং অপারেশন) –এর কেস দাঁড়া করানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমাদের এটা নিশ্চিত করতে হবে যে কেউই এটা দ্বারা ক্ষুব্ধ না হয়।”
“আমাদেরকে অবশ্যই আমেরিকান সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে যার পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। আমেরিকান সরকারের নীতি অনিশ্চিত, যদিও তারা তাদের নিজস্ব কংগ্রেস থেকেও চাপে আছে।”
“সিনেটর কেনেডির ভারত সফর থেকেই এটি বেড়ে চলেছে, এবং আমি আশা করি যে ব্রিটেনে যেভাবে ধারণার পরিবর্তনের শুরু হয়েছে একইভাবে আমেরিকান ধারণাও পরিবর্তিত হতে থাকবে।”
মিঃ শোর বলেন, “এটা পুরোদস্তুর সত্য যে, পাকিস্তান ভেঙ্গে গেছে।” তিনি বলেন, “শুরু থেকেই তারা ভৌগলিকভাবে ১,০০০ মাইল দ্বারা পৃথক ছিল।”। তিনি বলেন, “এখন তারা রাজনৈতিক এবং সার্বজনীন লক্ষ্যের অর্থে ঠিক একই দূরত্বে পৃথক হয়েছে। তাদের সম্পর্ক ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে।”
“পূর্ব পাকিস্তানের আপামর উৎসুক জনতার ইচ্ছার প্রেক্ষাপটে, যেটি এখনও প্রতি মাসে এক মিলিয়নেরও বেশি হারে বেড়ে চলেছে, আমি দেখতে পাই না যে, ভয়াবহ কোন চাপের ভিত্তিতে, যা বস্তুত স্বৈরশাসন; পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারের পক্ষে এই দুই অসম পাকিস্তানকে একত্রে এনে একটি অবিভক্ত রাজনৈতিক সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।”
মিঃ শোর, যিনি সফরকালে “বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী” তাজউদ্দিন আহমেদের সাথে একটি আলোচনায় বলেন যে, “যদি পশ্চিম পাকিস্তান সরকার এখনই পূর্ব বাংলা থেকে ক্ষমতা ফিরিয়ে নিতে শুরু না করে, আরেকটি তিক্ত এবং অনিয়ন্ত্রিত গৃহযুদ্ধ নিশ্চিত শুরু হবে যেখানে অন্যান্য জাতি জড়িত হতে পারে।”
.
13.42.154
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
লন্ডনের দি টাইমস পত্রিকায় লিখিত অক্সফামের পরিচালক মিঃ কার্কলের বিবৃতি | দি টাইমস, লন্ডন | ৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ |
মিঃ এইচ.এল. কার্কলে, ডিরেক্টর, অক্সফাম-এর চিঠি
দি টাইমস, লন্ডন
৩রা সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
স্যার, আমি বার্নার্ড ব্রেইনি-এর অবেদনের(প্রবন্ধ, ১লা সেপ্টেম্বর) পক্ষে জোরালোভাবে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক দুর্ভিক্ষ এড়াতে এখনই ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ’ আবশ্যক।
পরিষ্কারভাবে এই অবস্থা ব্যক্তি ও বেসরকারি সংস্থার নিয়ন্ত্রণের বাইরে, কিন্তু এখন সেখানে ছোটখাট গ্রুপগুলো দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধে সরকারি এবং আন্তর্জাতিক সাহায্যের জন্যে চাপ অব্যাহত রাখতে পারে।
মানুষের অবশ্যই যথেষ্ট পরিমানে সাহায্যের জন্যে ইচ্ছা থাকতে হবে যাতে তাদের সরকার জনগণের অর্থ জনস্বার্থে দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে ব্যয় করে, যে দেশেই দুর্ভিক্ষের এই ভয়াল থাবা বিস্তার করুক না কেন।
ইতিমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্য পরিস্থিতি অনিশ্চিত। একজন অক্সফাম প্রতিনিধি পরিদর্শনকালে, জানতে পারেন একটি পরিবার, ৮১ জন বাস্তুচ্যুত ব্যক্তির আশ্রয়স্থল ছিল- স্পষ্ট করা যাক, এটি পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যেই অন্তর্গত ছিল।
বিপদ আরও বেড়েছে বন্যা, জলোচ্ছাস এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্ট যে অধিবেশনে নাই সে ঘটনার জন্যে। কারন গণসচেতনতা এবং সর্বোচ্চ স্তরে কার্যকলাপ বজায় রাখার জন্যে এই ফোরামের ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।
প্রকৃতপক্ষে, খাদ্যবস্তু ঘাটতি সবচেয়ে বড় সমস্যা নয়, যেটা এই প্রযুক্তিমনস্ক প্রজন্ম সহজেই লড়াই করতে পারবে, কিন্তু একদিকে আন্তর্জাতিক সহানুভূতির জগদ্দল চাপের শুরু এবং আরেকদিকে জনগণ ও সরকারের ইচ্ছা পূরণের দ্বিমুখী সমস্যা। জনগণের প্রতিক্রিয়া এক স্বতঃস্ফূর্ত দান-এর আকারে পরিচালিত হয় এবং তারপরে ভুলে যাওয়া হয়।
২৬শে জুলাই থেকে, ব্রিটিশ দাতব্য সংস্থার মূল চালিকাশক্তি, খ্রিস্টান এইড, অক্সফাম এবং ওয়্যার অন ওয়ান্ট- পূর্ব পাকিস্তানে পূর্ণ সাহায্য প্রদানে জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এটা কি বেশি আশা করা হয়ে যাবে যে, এই শেষ সময়ে, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়” হয়তোবা “আমরা কতটুকু খরচ করতে সমর্থ?”-এই নীতিবাক্য না মেনে ইতিবাচক “কি পরিমান লাগবে”- নীতিতে এগিয়ে আসবে?
আজকের এই সংকীর্ণমনা বিশ্বে, পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষুধা নিপীড়িত অনাহারী শিশু এবং বুড়ো মানুষের দুঃখ-দুর্দশা থেকে কেউই রেহাই পাবেন না, সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের মতামত যাই হোক না কেন। এবং এ কাজে বিশ্বের হাতে মাত্র এক বা দুই সপ্তাহ সময় আছে।
ইতি, আপনারই;
এইচ.এল.কার্কলে, ডিরেক্টর, অক্সফাম,
২৭৪, বানব্যুরি রোড, অক্সফোর্ড,
২রা সেপ্টেম্বর।
.
13.43.155
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
কুয়ালালামপুর কমনওয়েলথ সংসদীয় সম্মেলনে মিঃ আর্থার বটম্লের বক্তৃতা | বাংলাদেশ ডকুমেন্টস | ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ |
.
কুয়ালালামপুর, কমনওয়েলথ সংসদীয় সম্মেলনে মিঃ আর্থার বটম্লে(ব্রিটেন)-এর বক্তৃতা
১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
…. কিন্তু আমি মনে করি, আবারও যেসব ভুল-ত্রুটি হয়েছে তা খুব সাধারণ কারণে হয়েছে। যখন সেনাবাহিনী আসলো, তখন প্রথমেই তারা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় প্রবেশ করেছিল, এবং থানার অভিমুখে রওনা হয়েছিল। এখন, সরকারী সূত্রমতে, যখন থানার কাছাকাছি এসেছিল, তখন পুলিশেরা সৈন্যদের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। কিন্তু আমি একটি দ্বিতীয় গল্প শুনেছি যেটিতে ছিল যে, এই সামরিক নেতাদের মধ্যে এক অহংকারী, আত্মরম্ভী নেতা পুলিশদের অস্ত্র সমর্পণের দাবি জানান, এবং পুলিশ প্রধান বলেন, “কার নির্দেশে?”। এরপরই আবারও আরেকটি দাবি ওঠে, “অবিলম্বে অস্ত্র ফেরত পাঠাতে হবে, যদি তা না করা হয়, তাহলে আমরা গুলিবর্ষণ করবো।” এবং গুলিবৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানীর পুলিশ সদস্যরা ও সৈন্যবাহিনীর পশ্চিম পাকিস্তানিরা মনে করলো যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত সৈন্যবাহিনী তাদের সবাইকে কচুকাটা করবে। এবং এই কারনে, আমরা এই পরিস্থিতিতে উপনীত হয়েছি যেখানে এসব লোক দেশের রাষ্ট্রপতির ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। এবং এখানে সন্দেহের কোনই অবকাশ নেই যে তারা এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যেখানে আইন-শৃংখলা ভেঙ্গে পড়েছে। কিন্তু একজন বেসামরিক প্রশাসক যিনি কিনা এই কঠিন রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যা উত্তরণে ব্যবস্থা নিতে পারতেন, তার বদলে একজন সামরিক কমান্ডার, জেনারেল টিক্কা খান-কে বসানো হল, যাকে সরানো হয়েছে বলে আমি খুবই আনন্দিত। যখন আমি জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করেছিলাম, তিনি বলেছিলেন যে, যদি এই সৈন্যবাহিনীকে যে কেউ কোনরকম বিপর্যয়ে ফেলার জন্যে চেষ্টা করে, তাহলে তৎক্ষনাৎ তাদেরকে গুলি করে মারার নির্দেশ প্রযোজ্য হবে। এই নীতি অনুসরণ না করার জন্যে আমি তাকে অনুরোধ করেছিলাম। আর ঠিক এই নীতির কারনেই, শহর ও গ্রামে যেসব সৈন্যবাহিনী ছিল, যারা এমন ধরণের নেতৃত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল, তারা বন্য পশুর মত আচরণ শুরু করলো এবং এর ফলে হাজার হাজার ভীত-সন্ত্রস্ত গ্রামবাসী দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। মুসলিমরা প্রথমে গেল, তারপরেই হিন্দুরা। হিন্দুদের ব্যপারটা বোঝাই যাচ্ছিল কারন তারা এ ধরণের পরিস্থিতির সাথে আগে থেকেই পরিচিত ছিল। এবং এই কারনে আপনি এমন এক পরিস্থিতির শিকার যেখানে লাখ লাখ শরণার্থী পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে এসে আশ্রয় নিয়েছে। ভারত তার নিজের কোনো কারণ ছাড়াই সম্ভবত একটি দেশের পক্ষে সবথেকে বড় একটি সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। আমি শরণার্থী শিবির দেখেছি, এখানে ভারতীয় প্রশাসনের অসাধারণ সব কাজ আমি দেখেছি। তারা খাদ্য ও সরঞ্জামে অপ্রতুল। এটি সত্যি যে বৈশ্বিক সাহায্য আসছে, কিন্তু অপর্যাপ্ত। উদাহরণস্বরূপ, আমার নিজের দেশ, ৮ মিলিয়ন পাউন্ড-এর সমপরিমাণ সাহায্য ভারতকে এবং ১ মিলিয়ন পাউন্ড পাকিস্তানকে দিয়েছে, এবং আমি আস্থার সঙ্গে বলতে পারি, আমরা আরও সাহায্য দিতে যাচ্ছি। ভারতের এই সমস্যা এমন একটি সমস্যা যেটা সব কমনওয়েলথভুক্ত দেশের মাঝে ভাগ করে নেয়া উচিত ছিল এবং পালাক্রমে সকল কমনওয়েলথভুক্ত দেশের উচিত ছিল জাতিসংঘের ওপর সামগ্রিকভাবে চাপ অব্যাহত রাখা…..।
…. সবশেষে আমি এটা বলতে চাই যে, মিঃ প্রেসিডেন্ট, বিশ্বের এই অংশে আমরা শান্তি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব শুধুমাত্র যদি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, পূর্ব পাকিস্তানে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধি, যিনি তার জনগণের হয়ে কথা বলতে সক্ষম, শেখ মুজিব-কে, স্বীকৃতি প্রদান করে। আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রেসিডেন্টকে বলেছি এবং আমি এখানে আবারও বলি, একজনের উচিত ব্রিটিশ ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা। আমরা একদিন একজনকে জেলখানায় বন্দি করি এবং তার পরের দিন সে জাতির নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়।
.
13.44.156
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
বৃটিশ ওভারসীস সোশ্যালিস্ট ফেলোশীপ সমিতি আয়োজিত সভায় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বাংলাদেশ প্রশ্নে বক্তৃতাদানের আমন্ত্রণপত্র | লেবার পার্টি | ২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ |
লেবার পার্টি
২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
বিচারপতি জনার চৌধুরী
বাংলাদেশ অফিস
১১ গোরিং স্ট্রিট,
লন্ডন, ইস্টার্ন সেন্ট্রাল ৩।
জনাব,
বৃটিশ ওভারসীস সোশ্যালিস্ট ফেলোশীপ
আমি আপনার কাছে নিশ্চিত করার জন্যে লিখছি যে, আপনার সাথে এই প্রতিষ্ঠানের ভাইস চেয়ারম্যান, জনাব ডালজিৎ শিবাই এর সাথে টেলিফোনে কথা হয়েছিল যেন তিনি ব্রিটিশ ওভারসিজ সোশ্যালিস্ট ফেলোশিপ এবং বাংলাদেশের এমপি মিঃ পিটার শোর-এর যৌথ প্রচেষ্টায় ৫ই অক্টোবর, রোজ মঙ্গলবার, বিকাল ৫:১৫ মিনিটে, ব্রাইটনের লিউস রোড; ব্রাইটন লেবার ক্লাবে আয়োজিত একটি মিটিংয়ে বক্তব্য প্রদান করেন। আমি বুঝতে পারছি যে, আপনি লেবার পার্টির সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে চান এবং আপনার থাকার জন্যে ব্রাইটন, কিংস রোডের বেডফোর্ড হোটেলে ৩রা অক্টোবর থেকে ৫ম অক্টোবর পর্যন্ত বুকিং দেয়া হয়েছে ।
লেবার পার্টির সদস্য এবং ব্রিটেনের অভিবাসী সম্প্রদায়ের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখার মূল উদ্দেশ্য নিয়ে ব্রিটিশ ওভারসিজ সোশ্যালিস্ট ফেলোশিপ প্রতিষ্ঠানটি লেবার পার্টির ন্যাশনাল এক্সিকিউটিভ কমিটি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং সাম্প্রতিক সময়ে, এই প্রতিষ্ঠানটি লেবার পার্টির সদস্যদের মাঝে পররাষ্ট্র বিষয়ের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জানানোর জন্যে জোর দিয়েছে। এই ফেলোশিপের চেয়ারম্যান, এমপি মিস জোয়ান লেস্টর, যিনি ন্যাশনাল এক্সিকিউটিভ কমিটি এবং লেবার গভর্ণমেন্ট-এর একজন সদস্য।
আমি ব্রাইটনে মঙ্গলবার উপস্থিত থাকবো এবং আপনার সাথে সাক্ষাতের জন্যে অপেক্ষা করবো।
আপনার অনুগত,
টিম রিডৌট
সেক্রেটারি।
_________________
.
13.45.157-158
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
লেবার পার্টি কতৃক পশ্চিম পাকিস্তানের ভুমিকার সমালোচনা | টাইমস অফ ইন্ডিয়া
|
৪ অক্টোবর, ১৯৭১।
|
লেবার প্রতিনিধির পাকিস্তানের প্রতি ইঙ্গিত
পশ্চিম পাকিস্তানে সাহায্য পাঠানো প্রতিরোধ করতে আহব্বান
ব্রাইটন, ৪ অক্টোবর, পিটিআই এর এক রিপোর্টে জানা যায় আজ লেবার পার্টির নির্বাহী কমিটি তাদের জাতীয় সম্মেলনে পাকিস্তানকে নিয়ে এক বিবৃতি প্রদান করে যেখানে পূর্ব বাংলায় চলমান ঘটনাসমূহের উল্লেখ ছিলো । বিবৃতিটি বিবেচনার জন্য উত্থাপন করা হয়েছিলো এবং তা বৃহস্পতিবারের সম্মেলনে গৃহীত হয় ।
বিবৃতিটিতে পূর্ব বাংলায় চলমান পরস্থিতিতে সরাসরি যুক্ত হয়ে উদ্ভূত সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে কাজ করতে জাতিসংঘের প্রতি অনুরোধ জানানো হয় । এখানে আরো উল্লেখ করা হয় সমাধানটি যেনো জনগনের মঙ্গলের দিক বিবেচনা করে করা হয় এবং তা যেনো তাদের জন্য গ্রহণযোগ্য হয় ।আরো উল্লেখ করা হয় , একটি সমাধান হতে পারে যদি পূর্ব বাংলার বর্তমানে নিপীড়িত হতে থাকা ও জেলে বন্দী থাকা রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মুক্তি প্রদানের মাধ্যমে এবং বিশেষভাবে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি প্রদান এবং তাদের সাথে আলোচনা করার মাধ্যমে ।
বিবৃতিতে তারা এইড-পাকিস্তান তথা পশ্চিম পাকিস্তানে সাহায্য পাঠানোর সাথে যেসব দেশ বা প্রতিষ্ঠান জড়িত তাদের পূর্ব বাংলার চলমান পরিস্থিতির সন্তোষজনক রাজনৈতিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কোন ধরনের সাহায্য বিশেষ করে যেকোন ধরনের মানবিক সাহায্য পাঠানো থেকে বিরত থাকতে আহব্বান জানান । দীর্ঘ মেয়াদে সাহায্য পাঠালে তা হবে একটি নিন্দিত সামরিক শাসনকে ভর্তুকি প্রদান করা ।
বিবৃতিতে শরণার্থীদের সাহায্য পাঠানোর ব্যাপারে বিশ্ব সম্প্রদায়ের ভুকিকা অপর্যাপ্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে ।ভারতে শরণার্থীদের যে পরিমাণ সাহায্য করছে তা ভারতের একার প্রতি বৈষম্যমুলক ও বোঝা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে । দলটি এই ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারকে আরো অধিক হারে সাহায্য পাঠাতে অনুরোধ জানিয়েছে ।
আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি আরো উল্লেখ করেনঃ বাংলাদেশের স্বেচ্ছাসেবকেরা প্রতিনিধিদের কাছে একটি আবেদন প্রদান করার জন্য সকালে কনফারেন্স হলের বাইরে উপস্থিত হয়েছিলেন । তারা তাদের আবেদনে পাঁচটি বিষয় তুলে ধরেন। এগুলো হচ্ছে , বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি আর্মির অপসারন ,জাতিসংঘে ব্রিটেন সহ অন্যান্য দেশের গণহত্যা সনদের উপর বাংলাদেশের পরিস্থিতি উত্থাপন করা , পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি আর্মি অপসারন করা না পর্যন্ত ব্রিটেনের পশ্চিম পাকিস্তানে সাহায্য পাঠানো বন্ধ রাখা , আমেরিকা সহ অন্যান্য দেশকে পশ্চিম পাকিস্তানে সামরিক সাহায্য না পাঠাতে প্ররোচিত করা এবং সর্বশেষ ব্রিটেন সহ অন্যান্য “ সভ্য দেশ ” কে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে আহব্বান করা ।
রেন্টার ও এএফপি থেকে প্রাপ্তঃ একজন ডমিনিকান যাজক ফাদার জেন উভস জলিপ আট দিন ইন্ডিয়া ও পূর্ব বাংলা সফর করে আজকে প্যারিসে বলেছেন পূর্ব বাংলায় উদ্ভূত সমস্যর সমাধান একমাত্র সামরিকভাবেই সম্ভব । তিনি উল্লেখ করেন, ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার্থে পূর্ব বাংলার নেতার সাথে আলোচনার রাস্তা পরিত্যাগ করে এই সমস্যা সামরিকভাবেই সামাধান করতে চাইছেন । ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর পিস মুভমেন্ট নামক সংগঠনের অধীনে এই সফর শেষে তিনি আরো বলেন , “ পূর্ব বাংলার অধিকাংশ মানুষ বাংলাদেশ এর স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করে । বাংলাদেশ সরকার সেনাবাহিনী গঠন করছে এবং সেনা নিয়োগের জন্য সকল শরণার্থী ক্যাম্পে অফিস স্থাপন করেছে । সেখানে তরুনরা সামরিক পোষাক পরে রয়েছে এং পশ্চিম পাকিস্তান আর্মির কাছ থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে করে আনা হয়েছে ।“ তিনি আরো যোগ করেন ,মুক্তিবাহিনী উত্তরে ভারত আয়তাধিন ১৩৬০ বর্গ কলোমিটার সীমান্ত এলাকায় অবস্থান নিয়েছে এবং এই দলে সৈন্য সংখ্যা ৮৫০০০ । ৬৫ কিলোমিটার পশ্চিমেও সমান আকারের আরেকটি বিভাগ মোতায়েন রয়েছে ।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক দূত প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান জেনেভাতে বলেছেন , পূর্ব বাংলার শরণার্থীদের এই বৃহৎ এবং অমানবিক সমস্যা মোকাবিলায় জরুরি সাহায্য প্রয়োজন । জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক নির্বাহী কমিটির ১০ দিন ব্যাপী সভায় উপস্থিত ৩১ টি দেশের প্রতিনিধিদের তিনি বলেন ,এই বছরে বৈশ্বিক শরণার্থী সমস্যা আরো ভয়াবহ এবং ক্রমবর্ধমান বিস্ফোরক হয়ে উঠেছে । তিনি আরো উল্লেখ করেন বাংলাদেশী শরণার্থী সমস্যায় বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছ থেকে আশাব্যাঞ্জক মাত্রায় সাহায্য পাওয়া গিয়েছে যার পরিমাণ ১১৫ মিলিওন ডলার এবং এই ব্যাপারে এখনো আরো সাহায্য প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন । বর্তমানে সেখানে যেসব জিনিস প্রয়োজন সেগুলো জরুরিভাবে পাঠানোর জন্য তিনি লিস্ট আকারে বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছে পাঠাবেন বলে আরো উল্লেখ করেন ।
এই পরিস্থিতি উত্তরনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরো বেশি সাহায্য সহযোগীতা ও প্রচেষ্টা প্রয়োজন এবং এই ব্যাপারে সবার আরো অধিক মনযোগী হওয়া প্রয়োজন । সাম্প্রতিক বন্যা শরণার্থী ক্যাম্পের মারাত্তক ক্ষয়ক্ষতি করেছে এবং ত্রাণ কার্যক্রম ব্যাহত হবার ফলে সমস্যা আরো ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে । দুর্বল বৃদ্ধ এবং শিশুদের স্বাস্থ্যের উপর এর প্রভাব আরো মারাত্বক আকারে পড়বে বলে প্রিন্স আগা খান উল্লেখ করেন ।
.
13.46.159
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
বাংলাদেশের অবস্থান পরিপ্রেক্ষিতে ন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ স্টুডেন্টস-এর প্রস্তাব এবং একটি আবেদন, | সূত্রঃ ন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ স্টুডেন্টস | তারিখঃ ১১ অক্টোবর, ১৯৭১
|
ন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ স্টুডেন্টস
যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সংগঠন
৩ এন্ড স্লীং স্টীট, লন্ডন, তারিখঃ ১১ অক্টোবর, ১৯৭১
ন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ স্টুডেন্টস’র ১০ ই অক্টোবর এর নির্বাহি কমিটির বৈঠকে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ঃ
জাতীয় নির্বাহী কমিটি গৃহীত নোট সমূহ
১. লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালী শরণার্থী,যারা অনাহার ও নানা রোগে আক্রান্ত পাকিস্তান থেকে ভারতে অনুপ্রবেশ করেছে, তাদের অবস্থা সত্যি অবর্ণনীয়।
২. পূর্ব পাকিস্তানে ভয়াবহ খাদ্য ঘাটতির পূর্বাভাস
৩. পূর্ব পাকিস্তানে রিলিফ বিতরণে কর্মরত বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানসমূহ অর্থ ও অন্যান্য সাহায্যের জন্য অনেক আবেদন করেছে।
৪. জরুরী অবস্থা বিবেচনায় কোন সম্মেলন ডাকা হয়নি;
সিদ্ধান্তসমূহঃ
১. সাহায্যের জন্য প্রাপ্ত আবেদনগুলো ন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ স্টুডেন্টস এর
সংশ্লিষ্ট দেশের আগ্রহী অথবা প্রত্যক্ষভাবে পূর্ববঙ্গে রিলিফের কাজে জড়িত, তাদের নিকট প্রেরণ করা;
২. মেইন মেইলের মাধ্যমে ঐসব দেশসমূহকে বৈদেশিক শাখার সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ করা;
৩. ন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ স্টুডেন্টস-এর বেঙ্গল ডিজাস্টার ফান্ডে সাহায্য প্রদানের জন্য প্রচারণা চালিয়ে যাওয়া;
৪. আসন্ন ১২ই ডিসেম্বরে নির্বাহী কমিটির সভায় গঠিত আইপিজি-‘র অনুরোধের ভিত্তিতে
আলোচ্য ফান্ডে প্রাপ্ত অর্থ বিতরণের পদক্ষেপ গ্রহন করা হবে;
৫. ন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ স্টুডেন্টস-এর মাধ্যমে প্রাপ্ত সাহায্যের আবেদন বৈদেশিক শাখায় প্রেরণ করা;
৬. এই রেজুলেশন স্টুডেন্ট প্রেস সার্ভিস ও মেইন মেইলের মাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থা করা।
আবেদন
সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী আজ পাকিস্তানী শাসক সামরিক জান্তার পরিকল্পিত গণহত্যার শিকার। শত সহস্র মানুষকে সম্পূর্ণরুপে ধ্বংস করা হয়েছে। ৬০ লাখের অধিক লোককে বাড়ি থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত করে ভারতে শরণার্থী হতে বাধ্য করা হয়েছে। বেঁচে থাকা অধিকাংশই আবার স্বজনহারা।
কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর একটি নতুন দিগন্ত সুচনা হওয়ার আশা করা হয়েছিল । বৃহৎ স্বায়ত্বসাশনের লক্ষে পূর্ব বাংলার আপামর জনতা আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়। কিন্তু জনতার রায়কে প্রত্যাখান করা হয়েছে। পাকিস্তান পার্লামেন্টে অধিকাংশ আসনে বিজয়ী নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠ একটি রাজনৈতিক দলকে অস্বীকার করার সাথে সাথে পার্লামেন্টকেও নিগৃহীত করা হয়েছে। যারা মানবাধিকারের কথা বলে তাদের দিকে বন্দুকের নল তাক করা হয়েছে। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী লেখক,ছাত্র শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতাদের উপর সামরিক একনায়কত্বের মাধ্যমে অত্যাচার ও আগ্রাসন চালায়। পূর্ব বাংলায় যে ঘটনা ঘটছে তা কেবল পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়, এটা একটি আর্ন্তজাতিক ঘটনাও বটে। বিশ্ব সম্প্রদায় কি এই গণহত্যার নীরব সাক্ষী হয়ে থাকবে?
অতএব, আমরা সারা বিশ্বের বিবেকবান নর-নারীর সমর্থন ও সরকারসমূহকে তাদের প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে আমাদের দাবীর সাথে একাত্ত্বতা প্রকাশের অনুরোধ জানাচ্ছি
দ্রুত সামরিক আগ্রাসন বন্ধ করা
পূর্ব বাংলার জনগনের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি রাজনৈতিক সমাধান উপস্থাপন করা
এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা যার মাধ্যমে শরণার্থীরা তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে গিয়ে নিরাপদ ও সম্মানজনকভাবে বসবাস করতে পারে।
সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানকে প্রলম্বিত করতে পারে এমন সকল সাহা্য্য/সহায়তা প্রত্যাহার করা।
আমরা সারা বিশ্বের সকল জনগন ও সরকারের প্রতি শরণার্থীদের কল্যানে আর্ন্তজাতিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি বিবেচনাপূর্বক ভারতের দিকে দ্রুত তাদের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়ার অনুরোধ করছি, যাতে শরণার্থীদের ক্ষুধা, রোগের হাত থেকে রক্ষা করতে ও তীব্র বর্ষায় তাদের মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করতে পারে।
.
13.47.161
হাউজ অফ কমন্স
১১ অক্টোবর ১৯৭১
জনাব আলি,
২৯ সেপ্টেম্বর এর চিঠির জন্য জনাব উইলসনের পক্ষ থেকে আপনার আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
আপনি অবশ্যই অবহিত আছেন যে জনাব উইলসন পুর্বপাকিস্থানের করুণ পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত। তিনি আপনার চিঠির জবাবে আমাকে এই বিলম্বের জন্য ক্ষমা চাইতে অনুরোধ করেছেন। কিন্তু আমি আশাবাদী যে আপনি কাজের চাপ অনুধাবন করতে পারবেন।
বিগত জুন মাসে যখন স্যার অ্যালেক ডগ্লাস হোম পুর্বপাকিস্থানে সাহায্যের বিষয়ে তার বক্তব্য তুলে ধরেন, বিরোধীদলীয় বক্তা সম্মানিত (দা রাইট হনার) ডেনিস হিলি ইউ থান্টের আবেদনে ভারত সরকার কে দেওয়া ১০ লক্ষ ইউরোর সহায়তা সীমার উর্ধ্বে দেওয়া ৫০ লাখ ইউরো অতিরিক্ত সহায়তা দেওয়া কে স্বাগত জানান। তিনি রাজনৈতিক নিষ্পত্তির সুনিশ্চিত অগ্রগতি না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানকে কোন সহায়তা না দিতে দৃঢ় ঐকমত্য প্রকাশ করেন।
আপনি হয়তো জেনে থাকবেন যে জনাব উইলসনের অনুরোধে ৯ জুন হাউস অব কমন্সে পুর্ব পাকিস্তান নিয়ে একটি বিশেষ বিতর্ক হয় এবং তিনি বিষয় টির উপর জোর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি না করায় সঅরকার কে তিরস্কার করেন। এ বিতর্কে বিরোধী দলীয় অবস্থানে সম্মানিত (দা রাইট হনার) জর্জ থমসনও রাজনৈতিক নিষ্পত্তির জন্য এবং সে প্রয়োজনে শেখ মুজিব কে অন্তর্ভুক্ত করতে আহ্বান জানান। আমাদের মতে একটি নিষ্পত্তি পূর্বপাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষের কাছেই গ্রহনযোগ্য হবে। আমি জুন মাসে লেবার পার্টির আন্তর্জাতিক কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত একটি অনুবন্ধ, এবং লেবার পার্টির গত সপ্তাহে প্রকাশিত অনুবন্ধ সংযুক্ত করছি।
যখন স্যার এলেক. ডগ্লাস হোম বিরোধিদলীয় অনুরোধে এ বিষয়ে অতিরিক্ত বক্তব্য প্রদান করেন। সম্মানিত (দা রাইট হনার) ডেনিস হিলি জাতিসংঘ যাতে নিজ দায়িত্বে পাকিস্তানে ত্রান এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ন্ত্রনের জন্যে পররাষ্ট্র সচিব কে বিশেষভাবে উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানান।
আমি আশা করি আপনি একমত হবেন যে, লেবার পার্টি তার অবস্থান পরিষ্কার করেছেন.
চিঠির জন্য আপনাকে আবারও ধন্যবাদ।
.
13.48.162
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
স্বাধীন বাংলার সংগ্রামে লেবার পার্টির সমর্থনের আভাস দিয়ে বৃটিশ এমপি মিঃ মিকার্ডোর চিঠি | ব্যক্তিগত চিঠি | ১৩ অক্টোবর, ১৯৭১ |
হাউজ অফ কমনস
প্যালেস চেম্বারস
ব্রিজ স্ট্রিট লন্ডন, এসডব্লিউ ১এ ২জেএক্স
জনাব এম এ এইচ মিয়া বি.কম
৩৭ বিসকট হাউজ
ডেভাস স্ট্রিট
লন্ডন
ই৩ ৩এলজেড
১৩ অক্টোবর, ১৯৭১
সুপ্রিয় জনাব মিয়া, লেবার পার্টির কনফারেন্স থেকে ফেরার পর অবশেষে আমি ধন্যবাদ দেবার সুযোগ পেলাম আপনার ৩ তারিখে পাঠানো চিঠির জন্য। আমি নিশ্চিত আপনি এই কনফারেন্সে ন্যাশনাল এক্সিকিউটিভ কমিটি উত্থাপিত এবং সর্বসম্মতিতে গৃহীত রেজোল্যুশনটি এবং এই কনফারেন্সে এবং কনফারেন্সের বাইরে সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত অন্যান্য সভায় যেসব বক্তব্য রাখা হয়েছে সেসব ব্যাপারেও জেনেছেন। লেবার পার্টির বিশাল একটা অংশ আপনাদের প্রতি সহানুভূতিশীল।
বিনীত
স্বাক্ষরিত
জনাব মিকাডো কর্তৃক নির্দেশিত
এবং তাঁর পক্ষে স্বাক্ষরিত
হতেঃ জনাব ইয়ান মিকাডো
এম,পি
.
49.49.163-195
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
বাংলাদেশের পরিস্থিতির উপর
ষাট ব্যক্তির প্রতিবেদন |
অক্সফোম রিপোর্ট | ২১ অক্টোবর,১৯৭১ |
বাংলার সংকট নিয়ে ষাট ব্যক্তির সাক্ষ্য
(২১শে অক্টোবর, ১৯৭১ সালে, এইচ. লেজলী কির্কলে, ডিরেক্ট, সি. বি. ই. অক্সফোম, অক্সফোর্ড, কর্তৃক প্রণীত)
ষাট জন নারী এবং পুরুষ এমন এক পরিস্থিতি দেখেছে এবং এর মধ্য দিয়ে বসবাস করেছে যাকে বলা যায় “বর্ণনাতীত” । এটি হল তাদের তা ব্যখ্যা করার চেষ্ঠা। এটি হল একটি ট্র্যাজিডির তাদের রেকর্ড ,তাদের কন্ঠ, তাদের সাক্ষ্য ।
সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি এবং মাদার তেরেসা সম্পর্কে পুরো পৃথিবী জানে।অন্যরা যারা আন্তর্জাতিক সাংবাদিক বিশেষত এই ডকুমেন্টে সাক্ষ্য দিয়েছেন হলেন মাইকেল ব্রুনোসন (আইটিএন), ক্লারে হলিংওয়ার্থ (টরোন্টো টেলিগ্রাম), জন পিলগার (ডেইলি মিরর) ,নিকোলাস টমালিন (সানডে টাইমস)। সাথে অন্যরা হলেন ব্রিটিশ, ইউরোপীয়ান অভিজ্ঞ রিলিফ কর্মী। সকলেই অসংকোচে এবং বিনালাভে তাদের সময় এবং কর্মশক্তি দিয়েছেন ।
তারা হলেন প্রত্যক্ষদর্শী, এবং তারা যে গল্প বলেন তা ভয়ানক।এই গল্প হল লক্ষাধিক, ভীত, গৃহহীন, মৃত্যুগামীদের।এটি একই সাথে বিশ্ব সম্প্রদায় সাম্প্রদায়িক উটপাখির মতো আচরণে জোটবদ্ধ হবার গল্প।
হয়তবা এটি এমন যে পৃথিবীবাসী জানে না।তবে সত্যকে বলতে দেওয়া হোক।হয়তবা এটি এমন যে আমরা কোনভাবেই এই দুর্যোগের ব্যাপ্তিকে বুঝতে পারব না।ইতোমধ্যে একত্রে সুইডেন এবং নিউজিল্যান্ডের সমান জনসংখ্যা তাদের মাতৃভূমি হতে পালিয়েছে। আরো লক্ষাধিক যারা রয়ে গিইয়েছে এখন দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়েছে।এটি চিন্তা করতে বাধ্য করতে করে না।তবে আমাদের করতে হবে।যদি একটি ছোট মেয়ে অক্সফোমকে লিখতে পারে এবং বলতে পারে যে “আমরা সাহায্যের সিদ্বান্ত নিয়েছি।আমরা একত্রে ৫৬.১৫ ইউরো সংগ্রহ করেছি।আমরা সকলেই ৯’/২”, তবে ঈশ্বরের দোহাই এ বিশ্ব সরকারসমূহ এই বিষয়ে জরুরী চিন্তা করতে পারে।শত হাজার যারা অক্সফোমের মধ্য দিয়ে দিয়েছেন এবং দিয়ে যাবেন এবং সমসাময়িক পৃথিবীর অন্যান্য সংস্থার নামে আমি আমার সম্পূর্ণ হৃদয়ের সাথে নিম্নের আবেদনসমূহকে সামনে আনছিঃ
ব্রিটিশ সরকারের প্রতি – আমি অতিস্বত্বর নতুন করে ২৫ মিলিয়ন ইউরো শরনার্থী ত্রাণ চাইছি।ব্রিটেন দিয়েছে, তবে তা কোনোভাবেই পরিস্থিতির পর্যাপ্তের কাছাকাছি না।আরো ২৫ মিলিয়ন ইউরো এর মানে হল ব্রিটেন এক মাসের ত্রাণ খরচ মিটিয়ে দিয়েছে।অন্তত জাতি হিসেবে আমরা এইটুকু করতে পারি।
বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি- আমি চাইছি যে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ এখন সভা ডেকে, সেক্রেটারি জেনারেলের ব্যক্তিগত চেয়ারম্যানশীপের অধীনে, কর্তৃত্বের সাথে অতিস্বত্বর পাঁচ জনের একটি কার্যবাহী দল নিয়োগ করা হোক যাতে ভারত এবং পূর্ব পাকিস্তানের ত্রাণ কার্যক্রমের জরুরী তহবিল এবং বাস্তবায়ন নিশ্চিত করে।আমি আরো মিনতি করছি যে প্রত্যেক সরকার এই অত্যাবশ্যক মানবিক কার্যক্রমের অবদানে মুক্তভাবে সকল যথাযথ সম্পদ ব্যয় করি।
পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ এবং মুক্তিবাহিনীর প্রতি – আমি চাইছি বিস্তীর্ণ ইউএন দুর্ভিক্ষ-ত্রাণ কার্যক্রমে তাদের পূর্ণ সমর্থ এবং উৎসাহ, এবং শরনার্থীদের তাদের ঘরবাড়িতে ফিরে যেতে সাধারণ ভাবে সংগতিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করা হোক।
মানুষ – সাধারণ মানুষের প্রতি – আমি চাই যে তারা তারা তাদের যত্ন এবং দেয়া অব্যাহৎ রাখে।আমি চাই যে তারা এমনকি একটি জীবনকেও পরিহার্য মানতে অস্বীকার করে।
এটি, আমার কাছে অকল্পনীয় যে, আমাদের কম করা উচিত।
সংকটের সংক্ষিপ্ত পটভূমি- ১৯৪৭ সালে, স্বাধীনতাকালে , “ব্রিটিশ ভারত” চার ভাগে বিভক্ত হয়েছিলঃ ভারত, বার্মা, এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান; পরবর্তীতে ইসলামবাদ এর ভিত্তিতে একটি দেশে মিলিত হয় কিন্তু হাজার মাইলে আলাদা থাকে, আলাদা ভাষা ও এমনকি আলাদা হাতে লেখা। এটি এমন যে খ্রিষ্টবাদের ভিত্তিতে, গ্রীস আর ব্রিটেন একদা একটি দেশ হিসেবে মিলিত হয়েছিল।
অনেক বছর ধরে, পাকিস্তানে পূর্বের বাঙালীদের ,পাঠানদের, পশ্চিমের বেলুচ্চিদের মধ্যে একটি শক্তিশালী সামরিক স্বৈরশাসনের মাধ্যমে আঞ্চলিক সংঘর্ষ সংঘটিত হয়ে আসছিল। ক্ষমতা কিছু মানুষের হাতে কুক্ষগিত করে রাখা হয়েছিল।বাইশটি পরিবার দেশের অর্ধেক শিল্প সম্পদের মালিক ছিল।
কয়েক বছর ধরে, পূর্বে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ যাচ্ছিল। ১৯৫৮ সালে ৫৫% রপ্তানী পূর্ব হতে এসেছিল; তারপরও ৭০% আমদানী গিয়েছে পশ্চিমে। পাট, যা দেশের রপ্তানীর ৪০% বহন করে, পুরোটা আসে পূর্ব হতে।তৃতীয় পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনায় (১৯৬৬-৭০), ৫২% রাজস্ব পূর্বে বরাদ্দ করা হয়েছিল ;শুধুমাত্র ৩৬% সেখানে ব্যয় করা হয়েছিল।
১৯৬৯ এর মার্চে আইয়ুব খান পদত্যাগ করে্ন এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক অনুসৃত হন, যিনি সিভিলিয়ান্দের ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য নির্ধারিত হয়েছিল।দুঃখজনক ভাবে ,এটি ছিল গণতন্ত্রের পথে প্রথম ধাপ – ১৯৭০ এর ডিসেম্বর এর সাধারণ নির্বাচন – যার কারণে সংকট শুরু হইয়।এই নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান ভিত্তিক আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবর রহমান পূর্ব পরিষদে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৫৭টি আসন অর্জন করে এবং একইসাথে জাতীয় পরিষদে ৩১৩টি আসনে নিয়ন্ত্রণ নেয়।তার কার্যক্রম বন্ধ হয় শুধুমাত্র পূর্বের অল্প বিচ্ছিন্নবাদের কারণে।
পূর্বে জে আ ভূট্টো জিতে সে সাধারণ পরিষদের ৩রা মার্চ ১৯৭১ এর প্রথম সভা বয়কট করে।ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য পরিষদ স্থগিত করে।পূর্বের স্বাধীনতার ঘোষণার সাথে সাথে হত্যা এবং লুন্ঠন ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা শহরে।
২৫শে মার্চ ,পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য পূর্বে আনা হয় ঢাকা এবং চট্টগ্রাম এ তড়িত নিয়ন্ত্রণ আনতে।
একটি রক্তবন্যা বয়ে যায় ভয়ানক অনুপাতে।নারী এবং শিশুরা মেশিন গান বিদ্ব এবং ধর্ষিত হইয়।মে এর শুরুতে শরনার্থীর একটি বড় অংশ যাদের ৬৫% হিন্দু ,ভারতের সীমানায় ঢল পড়ে; তাদের পিছনে একটি গণহত্যা সাক্ষী রেখে।জুনের মাঝামাঝিতে পঞ্চাশ লক্ষাধিক জড় হয়েছিলঃ যেটি এসএস কর্তৃক ইউরোপে হামলার ধরুণ মানুষের প্রস্থান পরবর্তী সবচেয়ে বড়।ভারত সরকার খাদ্যের জন্য ক্যাম্প তৈরী করে,কিন্তু সেখানে পয়ঃনিষ্কাশনের, বিশুদ্ব পানির, ভীষণ অভাব ছিল।কলেরা ছড়িয়ে পড়ে।তখনি বর্ষা চলে আসেন।এবং সেখানে সব সময় আরো শরনার্থী আসতে থাকে যতক্ষণ না এর সংখ্যা বর্তমান অনুসারে নব্বই লক্ষে পোছায়, ১৫-৪০০০০ প্রতিদিন।
পোপ পল কর্তৃক পাকিস্তানের জন্য সাহায্যের আহবান-“লক্ষাধিক মানুষ, অমানুষিক অভাবের পরিস্থিতিতে আছে ।একের পর এক দুর্যোগ এই মানুষগুলোকে আঘাত হানছে যারা নিতান্তই গরীব।
এখানে ভয়ানক খবর এবং ঘটনার কমতি নেই, যাতে প্রকাশ পায় ভয়াবহ অসামঞ্জস্যতা যা সাহায্য প্রয়োজন আর যা আসলে লভ্য এর মধ্যে।অসংখ্য জীবন বাচাতে মানুষকে সাহায্যের ব্যপারে জেগে উঠতে হবে।সরকারি এবং বেসরকারি সাহায্য ,সাথে আমাদের নিজেদের সহযোগীতাও জড়িত কিন্তু এটি নিতান্তই অপর্যাপ্ত।এটি আশা করা অতিরিক্ত নয় যে পুরো পৃথিবী এই মানুষগুলো এই মানুষগুলোর অঙ্গীকার দ্বারা আবেগতাড়িত হবে এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপাতি খাদ্য, বস্ত্র, ওষুধ, ও অর্থ পাঠাবে।
এই শরনার্থী কার্যকরম এর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ এই শতাব্দীতে দেখা সবচেয়ে বড়।এই কার্যক্রম বর্তমানে ছয় মাস ধরে ৩৫০ মিলিয়ন ডলারে চলছে, প্রতিদিন ১ মিলিয়ন ডলারেরও উপরে।
যুক্তরাষ্ট্র হাই কমিশন ভারতের বোঝা মেটাতে শরনার্থীদের জন্য তহবিলের ডাক দিয়েছেঃ এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র ১১৪ মিলিয়ন এসেছে একটি দেশ হতেঃ আমেরিকা
ভারতে ব্রিটিশ সরকারের সহযোগীতা হল ৮ মিলিয়ন এবং পাকিস্তানের জন্য ১ মিলিয়ন।এর সাথে সাথে ব্রিটিশ দাতব্য তাদের কর্মসূচিতে ১ মিলিয়ন ব্যয় করে।
ব্রিটিশ সরকারের কাছে লেসলি কির্ক মোট অনুপাতের হিসেব পেতে চাইছে,যেখানে দুটো বিষয় মাথায় রাখা প্রয়োজন।
১৯৫০ হতে ১৯৬৯ পর্যন্ত পাকিস্তানে আসা আন্তর্জাতিক সাহায্য হিসেব করা হয় ৬,০৩৩ মিলিয়ন এর উপর।বর্তমানে অবস্থার দরুণ পাকিস্তানে বড় দাতব্য দেশগুলো কর্তৃক নতুন সাহায্য স্থগিত করা হয়েছে ব্রিটিশ সরকারের সাথে গ্রহণযোগ্য সঞ্চয়ের সাথে।(গত বছর ,পাকিস্তানে ব্রিটেনের সাহায্য ছিল ৯’/২ মিলিয়ন)
২ প্রেসিডেন্ট নিক্সন বর্তমানে কংগ্রেসের কাছে অতিরিক্ত ২৫০ মিলিয়ন চাইছে।
(অক্সফোম স্বীকারোক্তি তাদেরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে যারা এই ষাট এর সাক্ষ্য সম্ভব করেছে; অবগশগ্রহণকারীদের তাদের সাক্ষ্য তৈরি করেছে নিজেদের মুখের, ছবিতে অথবা স্কেচে।তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অক্সফোমের সাথে এক হওয়া জরুরী নয়; তাদের বক্তব্য দ্বারা বাধ্যও অক্সফোমের নীতির কাছে।আমরা ধন্যবাদ জানাচ্ছি ক্লারে হোলিং ওয়ার্থ, নিকোলাস টমালিন এবং মার্টিন উলকটকে যারা মূল প্রবন্ধের জন্য সময় দিয়েছেন; দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, দ্য সানডে টাইমস এবং দ্য গার্ডিয়ানকে যারা সেগুলো প্রচার করেছে; রোমানগো ক্যাগোগনি, এলান লিথার, এবং ডোনাল্ড ম্যাককুলিনকে তাদের ফটোগ্রাফের জন্য, দ্য অবসারভার এর ডেনিস ও’ডায়েরকে তার ডিজাইনের জন্য; সকল প্রতক্ষ্যদর্শীদের যারা বক্তব্য সময়মতো পাবলিকশনের জন্য দুর্ভোগ ও ব্যয় বহন করেছে; সর্বশেষ জেলার্ড স্কারফে যাকে আমরা প্রতক্ষ্যদর্শীর বক্তব্যের জন্য রিং করেছি , কিন্তু তিনি বলেছেন “আমি কথা বলার মানুষ নই” এবং আমাদের এই ছবিগুলো দিয়েছেন)
সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি
দুঃখের বিচিত্রতা
সম্পূর্ণ কৌশন এখন সারা বিশ্ব কর্তৃক বোঝা হয়নি। আমি আপনাদের এটি বলতে পারি যে যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি নিজ চোখ দেখবেন না আমরা এর তীব্রতা বুঝতে পারবেন না।শুধুমাত্র এইখানে অবস্থান করে আপনি মানুষগুলোর অনুভূতি এবং অঙ্গীকার উপলব্ধি করতে পারবেন, এবং সহিংসতার তীব্রতা যা শরনার্থী তৈরিতে এবং বেসামরিকের হতাহতের সংখ্যা বাড়াতে বলবৎ রয়েছে।
ভারতে আমি শরনার্থী এলাকা পরিদর্শন করেছি কলকাতা হতে পূর্ব বাংলা সীমানা জুড়ে এবং পশ্চিমে পশ্চিম বাংলা থেকে জলপাইগুড়ি এবং দার্জিলিং শহরে উত্তর হতে পশ্চিমের ত্রিপুরা রাজ্যের আগারতলা পর্যন্ত।
ঢাকার দক্ষিণে অবস্থিত বরিশাল এবং খুলনা জেলার হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নেমে আসে বীভৎস বর্বরচিত অত্যাচার।
আবালবৃদ্ধবনিতা দিনের পর দিন, রাতের পর রাত অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পায়নি,তাদেরকে অনিশ্চিত ভাগ্যের বিড়ম্বনায় রাস্তার ধারে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে বিচরণ করতে দেখা গেছে।পাকিস্তানের সৈন্য ও তাদের দোসর বা সহযোগী দালালদের অবর্ণনীয় অত্যাচার যেমন অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ,লুটপাট,নিপীড়ন,হত্যা’র মতো বীভৎস ঘটনা এদের মুখে বলতে শোনা গেছে।রাস্তার ধারে অনেক শিশুকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে এবং তাদের পিতামাতাকে সাহায্যের জন্য রাস্তায় হাতবাড়াতে দেখা গেছে।মৌসুমী বৃষ্টিপাত ও প্রাকৃতিক আনুষঙ্গিক দুর্যোগ থেকেও তারা রেহাই পায়নি।যারা এ অবস্থা দেখেছে তারা ভেবেছে আরও কতদিন,আরও কত রাত বিশ্রামহীন,আশ্রয়হীন,খাদ্যহীন অবস্থায় এদের পাড়ি দিতে হবে।
একটি পঙ্গু শিশু যে নাকি জীবনে আর হাঁটতে পারবেনা তার অসহায় চাওনি এবং ছোট তাঁবুর নিচে মাদুরে শুয়ে থাকা ভীতসন্ত্রস্ত শিশুটি দেখছে তার মা বাবা ভাই বোনের করুণ মৃত্যু- এমন দৃশ্য কখনো মন থেকে মুছে ফেলা যাবেনা।আমরা পৌঁছার কয়েক মুহুর্ত পূর্বে কলেরায় মৃত ছোট শিশুটির গায়ে ঢাকবার মতো একখন্ড কাপড়েরও ব্যবস্থা করতে পাচ্ছেনা তার দশবছর বয়সী বোনটি।যখন আমি শরণার্থী শিবিরের একজন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করি তার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন কিসের,তখন তিনি জবাব দিলেন তার প্রধান জরুরী প্রয়োজন হলো মৃতদেহ সৎকারের ব্যবস্থা করা।তিনি ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ একটি শরণার্থী শিবিরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। এই স্থানটি মূলত নিম্ন এবং মধ্য আয়ের লোকদের আবাসস্থল হওয়ার কথা ছিলো।এখন তা এক লক্ষ সত্তর হাজার শরণার্থীদের আশ্রয়স্থল।
পূর্ববাংলার এই করুণচিত্র শুধুমাত্র পাকিস্তানের বা ভারতের ছিলোনা,এই করুণচিত্রটি ছিলো সারা বিশ্বের। এই সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন সমস্ত বিশ্বের মানবসম্প্রদায়ের যৌথ উদ্যোগ।
সাধারণ মানবতার দাবি আমেরিকা এবং সম্মিলিত জাতিসংঘের।এ সত্য মেনে নেওয়া উচিৎ যে এ সমস্যাটা শুধু ভারতের নয়,এটা সমগ্র মানবসম্প্রদায়ের একটি দায়িত্ব।
মাদার তেরেসা
( “দি মিশনারিজ অফ চ্যারিটি” এর প্রতিষ্ঠাতা মাদার তেরেসা।গত বছর তিনি পোপের পুরস্কার গ্রহণ করেন।তিনি ১৯৪৮ সাল থেকে কলকাতার মুমুর্ষ এবং দুস্থদের নিয়ে কাজ করেছেন।তাঁর আদেশ অতি অল্প সংখ্যক ক্যাথলিকদের মতোই ছিলো।তাঁর সাতশত পরিচারিকা ও সন্ন্যাসিনী ছিলো।তারা বস্তিতে বসবাস করতো এবং তারা দরিদ্রের মতো খাবার গ্রহণ করতো।)
ভারতীয়দের এই সমস্যাকে সারা বিশ্বের সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য আমরা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
এই লক্ষ লক্ষ পাকিস্তানী শরণার্থীদের সার্বিক দায়িত্ব ভারত ইতোমধ্যে নিয়েছে এবং ভবিষ্যতে নেবে।তাদের এ সমস্যা বহির্বিশ্বে তুলে ধরার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী চমৎকার একটি উদ্যোগ নিয়েছেন। চলো আমরা স্মরণ করি :
পাকিস্তানের জনগণ,ভারতীয় জনগণ, ভিয়েতনামের জনগণ এবং পৃথিবীর যে যেখানেই থাকুকনা কেনো সবাই ঈশ্বরের সন্তান।সবাই এক সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি।আজকে পাকিস্তানের জনগণ আমাদের নিকট আলাদা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হলেও তারাও কিন্তু এ বিশ্বে ঈশ্বরের পরিবারেরই সদস্য।
এটা শুধু ভারতের সমস্যা নয়।এটা সারাবিশ্বের সমস্যা।সমস্যাটা বিশ্বকে বহন করতে হবে এবং বিশ্বকেই এর সমাধান দিতে হবে।
আমাদের ভারতবাসীর জন্য এ সমস্যাটা ভাল কিছু নিয়ে এসেছে।কারণ আমাদের দেশের জনগন এটার জন্য যথেষ্ট ত্যাগ স্বীকার করেছে এবং করবে।
কিন্তু সারাবিশ্ব এ বিষয়ে আন্দোলিত হবে।আমরা যা হই না কেন,আমাদের অনুধাবন করতে হবে যে,আমাদের লক্ষ লক্ষ শিশু ক্ষুধা,অপুষ্টি এবং আরও অন্যান্য সমস্যায় ভুগছে যার সমাধানে আমাদের জনগন প্রশংসা পাবার যোগ্য।যদি খাদ্য,আমিষ এবং আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্র নিয়ে বিশ্ব এগিয়ে না আসে তবে এ শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগবে এবং মারা যাবে।এ কারণে বিশ্বকে এর জবাবদিহি করতে হবে।
আমি শরণার্থীদের নিয়ে ৫/৬ মাস যাবৎ কাজ করছি।আমি শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মারা যেতে দেখেছি।সেকারণে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে,পরিস্থিতিটা কত নাজুক এবং এদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসা কত প্রয়োজন।
বিশ্বের কাছে এটা একটা আবেদন,এবং বিশ্বকে এর জবাবদিহি করতে হবে।
নিকোলাস টমালিন
(আমাদের মধ্যে যারা এটা দেখেছে তারা বুঝতে পেরেছে ব্যাপারটা একার পক্ষে সমাধান করা কতখানি অসম্ভব।’সানডে টাইমস’এর নিকোলাস টমালিন ইন্ডিয়ায় অবস্থানরত শরণার্থীদের সম্পর্কে এক অনবদ্য প্রবন্ধ লিখেছেন।)
বিগত ত্রিশ বছরের মধ্যে পাকিস্তানের এই ভয়াবহ দুর্যোগটি বিশ্বকে মোকাবেলা করতে হয়েছে।গত ২৫শে মার্চ-এ পাকিস্তানি জেনারেলরা সেনাবাহিনীকে নিজদেশের মানুষের উপর আক্রমণের জন্য লেলিয়ে দেওয়ার হুকুম হিটলারের যুদ্ধের পরিস্থিতির চেয়েও ভয়াবহ ছিল।
৯০ লক্ষ ভুক্তভোগী শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নেয় এবং সাড়ে ছয় কোটি নিষ্পাপ বাঙালি পূর্বপাকিস্তানে থেকে যায়,যাদের দুঃখ-দুর্দশা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।যুদ্ধসহ,দুর্ভিক্ষ, মহামারী, ঘূর্ণিঝড়,অবিচারসহ বিভিন্ন ধরণের সরকারি অত্যাচার দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে যা বিগত ১৫ বছরের ভিয়েতনাম, বিয়াফ্রা এবং আফ্রিকার রক্তাক্ত সংঘাতের চেয়েও মারাত্মক ছিলো।
প্রতি সপ্তাহে যেখানে দুই থেকে তিন হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করছিল এবং আমরা যারা এগুলো দেখছিলাম তাদের সহায়তা করার মতো কোনো উপায় ছিলোনা।কারণ আমরা নিরুপায় ছিলাম।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের জন্য এবং দুস্থদের সাহায্যের জন্য বিশ্বের দূর-দূরান্তের বিভিন্ন শহর-নগরের জননগন এবং বিভিন্ন সংস্থা আবেগ তাড়িত হয়ে কনসার্টের আয়োজন,সভা-সমাবেশের আয়োজন প্রভৃতির মাধ্যমে নগদ টাকা এবং তহবিল গঠন করতে উদ্যোগ নেয়।ওই সংস্থার কিছু সদস্য শরণার্থীদের সেবা করার মানসে ভারতে চলে আসে।
অক্সফামের মতো দাতব্য ত্রাণ বিতরণকারী সংস্থা যারা নাকি দুস্থ মানুষের দুর্দশা লাঘবে সক্ষম তারাও লোকবল,অর্থবল এবং অক্ষমতার কারণে প্রকৃত সমস্যা সমাধানে সক্ষম হয়নি।
তাদের অবশ্যই ইয়াহিয়া খান এবং তার পাকিস্তান সরকারকে বল প্রয়োগ করার জন্য একটি কঠিন এবং দক্ষ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দরকার যাতে তারা স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে তাদের বর্তমান কর্মকাণ্ড বেআইনি এবং নির্বোধের এবং তা অচিরেই বন্ধ করা উচিত। এরপর তাকে এবং তার অনুসারীদের বাধ্য করতে হবে যাতে তারা পূর্ব পাকিস্তান হতে তাদের সৈন্য সরিয়ে নেয় এবং যেসব শরণার্থী ফিরে আসতে চায় যেন তাদের সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেয়। এরপর তাদের ইন্দিরা গান্ধী এবং ভারত সরকারকে রাজি করাতে হবে সেসব শরণার্থী গ্রহণ এবং সাহায্য করার জন্য যারা আর ফিরে আসতে চায় না। সর্বোপরি মানুষকে অনাহার, অসুস্থতা এবং অভাব থেকে বাঁচানোর জন্য তাদের কয়েক শত লক্ষ পাউন্ড পরিশোধ করতে হবে।
যদি এই সকল প্রক্রিয়া খুব দ্রুত সম্পন্ন করা যায় তবে বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব। পূর্ব পাকিস্তান সাধারণভাবে বলতে গেলে বাংলা, এখনও একটি দুর্যোগ পূর্ণ এলাকা। কিন্তু তারপরও এখানে একটি সুখি অবস্থা বিরাজ করছে।
গত সপ্তাহে কলকাতায় কিছু শরণার্থী শিবির ঘুরে আসার পর থেকে এই বিপর্যয় নিয়ে লেখার কথা ভাবছিলাম। আমি শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত গ্রান্ড হোটেলের বড় সুইমিং পুলের পাশে একটি নরম গদিতে শুয়ে শুয়ে ঠান্ডা বিয়ার পান করছি, সাথে আছে চিনাবাদাম এবং মাঝে মাঝে কুঁচকানো কাগজে ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি (আই লাভ ইউ)’ নামের একটি কমিক পড়ছি যেখানে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে পাহাড় থেকে স্কিইং করে নেমে আসছিল, তখন মেয়েটি বললো, “আমি স্টিভ কে ভালোবাসি, কিন্তু যখন সে আমার অতীত জানবে তখন সে কি করবে? সে কি আমার অতীত ভুলতে পারবে?”
আমি প্রচুর সাঁতার কাটি, অদ্ভুদ স্বাদের জুস খাই এবং চেষ্টা করি বাঙালি বেয়াড়া ছেলেটার উপর বিরক্ত না হতে যে আমাকে ভালো বখশিশের আশায় রাজা-মহারাজাদের মত খাতিরদারী করছে।
আমি এই সব কিছুই করেছি কেননা শরণার্থী শিবিরে যা ঘটছে তার আতঙ্ক কাটানোর জন্য আমার একটি লম্বা সময় দরকার। আমার সংবাদপত্রের সহকর্মীর অবস্থাও আমার মতই। আমি এসব উল্লেখ করছি কেননা অন্যান্য সকল পরিস্থিতিতে তারা এসব অতি আতঙ্কজনক ঘটনা এবং মানব দুর্বিপাকের অসহনীয় অভিজ্ঞতা দেখতে সক্ষম হয়েছিল এবং তা তাদের ভেতরে কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি।
আমি তাদেরকে বায়াফ্রা থেকে ভিয়েতনামে অথবা বাংলার ঘূর্ণিঝড় থেকে ফেরার পর দেখেছি। তারা উদ্বিগ্ন ছিল, সমব্যথী ছিল কিন্তু তারা আবেগের সাথে মানিয়ে নিয়ে জানত। কিন্তু এবার তারা মানতে পারছে না।
একজন সহকর্মী যার আগে একবার গলার ক্যান্সারের অপারেশন হয়েছিল সে আবার ইতিমধ্যে দিনে সত্তরটি সিগারেট খাওয়া শুরু করেছে। একত্রিত হওয়া পত্রিকার লোকজন আত্মরক্ষার জন্য সশস্ত্র হয়ে যায়।
একজন জীর্ণশীর্ণ ছোট বাঙালি বালিকার আয়নার টুকরাতে নিজেকে দেখার ছবির দিকে তাকিয়ে কেউ একজন বললো, “অক্সফাম পোস্টারের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে” এবং তা শুনে সবাই হাসলো।
একজন আলোকচিত্রকর বললেন, “আমি আজ একটি অসাধারণ ছবি তুলেছি।” দুইটি শিশু একত্রে মাটিতে মৃত্যুবরণ করছে।”
“আমি এর চেয়েও ভালো কিছু পেয়েছি”, অন্য একজন বললো। “আমি তাদেরকে হাত ধরাধরি করা অবস্থায় পেয়েছি।”
কলকাতায় বাকিরাও সবাই সমান আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছে। একজন স্থানীয় কূটনৈতিক, যিনি এই দ্বিতীয় দফার পরেও স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছেন, এবং প্রচন্ড আবেগ নিয়ে যুদ্ধের ব্যাপারে কথা বলছেন। তার মতে হয়ত এই নভেম্বরে, অথবা পরবর্তী নভেম্বরের ভেতরেই ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে শুধুমাত্র যে কোন একটি দেশই টিকে থাকবে। তার মতে, ভারত সরকারের পক্ষে এই নব্বই লক্ষ কর্মহীন নতুন অভুক্ত বাসিন্দাদের অর্থনৈতিক ভার বহন অসম্ভব হয়ে পড়বে।
ইতিমধ্যে আসামে বিদ্রোহ চলছে যেখানে পাহাড়ি লোকজন সমতলের বাঙালি যারা তাদের পাহাড় থেকে তাড়িয়ে দেয় তাদের অপছন্দ করে। এখনই তাদের ওখানে, এমনকি কলকাতার শিবিরগুলোর আশেপাশে লড়াই ও সংঘর্ষ চলছে। সর্বপ্রথমে ভারতীয় কৃষকেরাই তাদের দুঃখের সাথীদের স্বাগত জানায়। এখন যদি তারা কোন অপরিচিতকে অনাহারের কারণে তাদের কাজ ছিনিয়ে নিতে, তাদের জমি দখল করতে এবং তাদের মালামাল অথবা নারীদের হরণ করতে দেখে,তখনই তাদের লড়াই শুরু হয়।
সুতরাং, এই কূটনৈতিকের যুক্তি অনুসারে, ভারত (স্থানীয় বাঙালিদের সঙ্গে নিয়ে) খুব দ্রুতই পূর্ব পাকিস্তানে ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনীকে এক সপ্তাহের মধ্যে নিষ্কাশনের জন্য তাদের উপর সেনা আক্রমণ চালাবে। এরপর তিনি পূর্ব পাকিস্তানকে ভারতের প্রদেশ বানাবেন কি বানাবেন তার
বাংলায় কোন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থাকতো না, মোদ্দাকথা, এমন আজগুবি রকমে পাকিস্তানকে প্রদেশে ভাগ করতে হয় না, ভৌগলিক ভাবে এ অঞ্চল ভারতের অন্তর্ভুক্ত হবার কথা ছিল যা অর্থনৈতিক দিক দিয়েও সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সাম্প্রতিক ইতিহাস খুবই বেদনাদায়ক। দুর্ভাগ্য থেকে দারিদ্র্য, সেই দারিদ্র্য আরো বেশি দুর্ভাগ্য বয়ে নিয়ে এসেছে যা আরো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শোষণ, অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি, ধর্মান্ধতা আর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় টিকে থাকতে পারে নি। এমন অসহায় এবং বিশৃঙ্খলাপূর্ণ জায়গায় কিভাবে পাকিস্তানের জন্মদাতা সুশৃঙ্খল পাঞ্জাবী শাসকরা নিয়ম এবং সমৃদ্ধি নিয়ে আসবে? তারা কিভাবে তাঁদের উৎসাহী ব্যবসায়ীদের এখান থেকে লুটপাট করা থেকে বিরত রাখবে? তারা কিভাবে ইসলামের নীতি বিরোধী হবে এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা কমাতে কেমন করে সুষ্ঠু জন্ম নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থা গ্রহণ করবে?
এটা বোধগম্য হয়েছে যে পূর্ব পাকিস্তান এক রকম ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের একটি উপনিবেশে পরিণত হয়েছে যেখানে লম্বা, বাদামি, আবেগহীন পশ্চিমা এবং খাট, কৃষ্ণকায়, উত্তেজিত, মেধাবি প্রাচ্যের মাঝে জাতিগত বিরোধ রয়েছে। পাঞ্জাবী এবং বিহারীরা বাঙ্গালীদেরকে অনিয়ন্ত্রণযোগ্য দুস্থ হাভাতে বানরের থেকে খুব বেশি কিছু মনে করত না। এবং তাঁদের দিক থেকে অবস্থাদৃষ্টে এই বিশ্বাসটিই আরো ভালভাবে প্রমাণিত হয়।
বাঙ্গালীরা পশ্চিমা ধাঁচের সামরিক শাসক, বণিক সম্প্রদায়, ইংরেজ পুঁজিপতি থেকে কোন অংশে কম না এমন মহাজন দেখে এসেছে। যারা ছিল আরো কম উদার, তাঁদের বিশেষ আবেগ অনুভূতির প্রতি কম সংবেদনশীল এবং আরো কম মত প্রকাশের সুযোগদানকারী। বৈরিতা এতটাই বেড়ে গেছে যে বিস্ফোরিত হওয়ার আগে বিগত মার্চ মাস থেকে বাঙ্গালীরা যেভাবে আগ্রাসী প্রদর্শন শুরু করেছে এবং তাঁদের মাটিতে সকল পশ্চিমা ‘বিদেশী’দের হত্যা করা শুরু করেছে তা মোটেও অবাক করার মতো নয়। কারণ, তারা এতই বেশি দিন ধ্বংসপ্রায় জীবন কাটিয়ে এসেছে যে এমন আক্রোশ (যা কিনা পুরো উপমহাদেশ জুড়েই সংঘাতপূর্ণ ঐতিহ্যের একটি অংশ) পুরোপুরিভাবেই বোধগম্য। এবং সবশেষে যখন লাখ লাখ পূর্ব পাকিস্তানী গত বছরের ঘূর্ণিঝড়ে ডুবে গেছে বা মারা গেছে তখন তারা কেন ইসলামাবাদের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে তাঁদের নিজেদের আওয়ামী লীগ কে ভোট দিয়েছে তাও অবাক করার মত নয়।
এ অবস্থায় যে কাজটা সবচেয়ে পাপের এবং মূর্খের মত হয়েছে তা হল জেনারেল ইয়াহিয়ার একমাত্র সামরিক সমাধানই একমাত্র সমাধান বলে ধরে নেয়ার সিদ্ধান্ত। তার এটা বুঝা উচিৎ ছিল যে এমন শত্রুভাবাপন্নতার সামনে কোন সামরিক সমাধানই ফলপ্রসূ হবে না। তার এই সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র অনৈতিক এবং অবৈধই নয় বরং নিশ্চিতভাবে বিফল।
মার্চের আক্রমণগুলোর পরের মাসগুলোতে যা হয়েছে তা ইয়াহিয়ার আগে থেকেই বুঝা উচিৎ ছিল। দেশটি আগের চেয়ে কম নয় বরং আরো বেশি শত্রুভাবাপন্ন হয়েছে। বাংলার গেরিলারা সকল যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। এবং যেখানে তারা ব্যর্থ হয়েছে সেখানে সেনাবাহিনীর প্রতি আক্রমন সফল হয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে উর্বর এই অঞ্চলে খাদ্য মজুদ করা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৈরিতা আর হত্যা আরো ধর্মীয় এবং জাতিগত হওয়া শুরু করেছে। পূর্ব পাকিস্তানে মুসলমানদের সাথে ১ কোটি হিন্দু বসবাস করছে। যখনই বুঝা গেল পাকিস্তানী সেনারা নির্বিচারে হিন্দু হত্যা করছে তারা প্রায় সবাই ভারতে পালিয়ে গেল। তাঁদের সাথে এল মুসলিম বাঙ্গালী জাতিয়তাবাদী। আওয়ামী লীগের সমর্থক এবং জনগণ লড়াই করা থেকে পিছপা হল না। সংঘাত আর লড়াই যত বাড়তে থাকল ততই তা অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়ল। ভারতের সীমানার ওপাড় থেকে সেনাবাহিনী গেরিলা দ্বারা আক্রান্ত হল এবং এর প্রতিশোধ স্থানীয় জনগণের উপর নেয়া শুরু করল। এরপর বাঙ্গালীদের দমন করতে অনিয়মিতভাবে কিছু মুসলিম স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগ দেয়া হল। এবং এই নিয়োগপ্রাপ্তরাই হল রাজাকার, যারা মুসলিম ধর্মান্ধ, দস্যু, কারাভোগ করা আসামী। এরাই এখন বেশির ভাগ হত্যা সংঘটিত করছে।
ওদের জন্যই এখন মৌসুমী বৃষ্টির সময়েও সীমান্তের ওপাড়ে শরণার্থীদের সংখ্যা বেড়ে চলছে।
বৃষ্টি থেমে গেলেই অবস্থার পরিবর্তন হয়ে যাবে। গ্রামাঞ্চল কিছুটা শান্ত হতে পারে কেননা সেনাবাহিনী মূলত রাস্তা এবং সীমানা ভাল নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যদি আরো বেশি মানুষ চলাচল শুরু করে এবং একে অপরকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয় তবে পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে। কতিপয় ভারতীয় কর্তাব্যক্তি আরেকটি শরণার্থীদের জোয়ারের আশংকা করছেন, খুব সম্ভবত আরো ৪০ লাখ। অন্যদের ধারণামতে, বর্তমান শরণার্থীদের অর্ধেকের এক চতুর্থাংশ হয়তো ভারত থেকে পাকিস্তানের দিকে ধাবিত হবে।
তাছাড়া, এখন ভারতে অবস্থানকারী শরণার্থীরা গাদাগাদি করে বেঁচে আছে। সেখানে না আছে পর্যাপ্ত খাদ্য, না আছে সুষ্ঠু বাসস্থান আর না আছে কোন কাজ। পাকিস্তানী শরণার্থীদের দৈন্যদশা সাম্প্রতিক সময়ে এসে যে কারো কাছেই পরিচিত যদি সে পড়তে পারে অথবা এমনকি সে যদি চোখে দেখতে পারে। সকল সংবাদপত্র, টেলিভিশন এবং বিজ্ঞাপন বার্তা থেকে এসব আমাদের জোরপূর্বক দৃষ্টিগোচর করা হয়।
এমন বোমাবর্ষণের পর তাঁদের সত্যিকার মোটেও আশানুরূপ নয়। একজনের উৎসবের মনোভাব অন্য কারোর মহানুভবতার সাথে তাল নাও মিলাতে পারে। দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে থাকার পর যেমন ক্যাথেড্রাল আর প্রাচীন গীর্জাগুলো প্রত্যাশিত ছবির মতো হয় না, ঠিক তেমনি কলকাতার নিকটবর্তী ক্যাম্পগুলোতে শরণার্থীদের আশ্চর্যজনকভাবে স্বাভাবিক লাগে।
তাঁদের কয়েকজন বেশ উৎফুল্ল। কয়েকজন তো আবার প্রায় মোটাই। কয়েকজনের আবার কিছু কাজ করার থাকে। কয়েকজন আবার পূর্ব পাকিস্তানে তাঁদের গ্রামের চেয়ে এখানে উন্নততর জীবন যাপন করছে। কয়েকজন শুধু এমন। বেশির ভাগই প্রায় লক্ষাধিকই এমন নয়। এবং যখন কেউ সীমানা ধরে রাস্তা দিয়ে অতিক্রম করে তখন চোখে পড়ে তাঁবুর পড়ে তাঁবু, শত শত তাঁবু রাস্তার ধারে গাছে টাঙানো অথবা ইটের স্তূপের উপর এই জনবহুল এলাকায় যেখানে সম্ভব সেখানেই শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে। এখানে সবচেয়ে আশংকার বিষয় হল তাঁদের সংখ্যা।
কিছুকাল পরে, মানুষের এত দুঃখ দুর্দশা থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে তাঁদের অবস্থা এতটাই করুণ যে তা ধারণার অতীত। আমি মাত্র দুইদিন শরণার্থী শিবিরের পাশ দিয়ে গিয়েচি আর এক রাত মোটামুটি ভাল দশার এক শিবিরে থেকেছি। প্রথমে, আমি যেমনটা বলেছি, তাদেরকে দেখে সীমান্তবর্তী হাসনাবাদের রাস্তা থেকে খুব একটা দূরবর্তী মনে হয় না। কলকাতার এক শহরতলী সল্ট লেক সিটিতে আড়াই লাখ মানুষ মোটামুটি অবস্থাপন্ন বসবাস করে। সেখানে খাদ্য বেশ পর্যাপ্তই ছিল। বিদেশী ত্রাণ সংস্থা থেকে এখানে তিন-চারটা হাসপাতাল স্থাপিত হয়েছে। সেখানে বেশ কিছু আইন শৃঙ্খলা বাহিনীও রয়েছে যার জন্য কলকাতার নিকটবর্তিতা ধন্যবাদ প্রাপ্য। কিন্তু এমনকি এখানেও শিশুদেরকেই সবচেয়ে বাজে অবস্থায় দেখা যায়।
তাঁদের দুরবস্থা বুঝতে গেলে পুষ্টি সম্পর্কিত কিছু জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। একটি শিশুর প্রচুর পরিমাণ আমিষ দরকার যখন সে মাইলের মাইল হেঁটে এসেছে। এবং এখন সে চিরস্থায়ীভাবে অসুস্থ কারণ এখন তার খাদ্যাভ্যাস আগে যেমন ছিল তেমনটা নেই। তার বিশেষত অনেক বেশি পরিমানে পুষ্টি দরকার। কিন্তু বর্তমানে ভারতে কর্তৃপক্ষ জনপ্রতি মাত্র ৪০০ গ্রাম চাল এবং সাথে কিছু শাকসবজি, রান্নার তৈল এবং শস্য রেশন হিসেবে দিচ্ছে। বরাদ্দ জনিত জটিলতার জন্য এ পরিমাণ অনেক ক্ষেত্রেই জনপ্রতি ২০০ গ্রাম চাল এবং শিশুদের জন্য তা অর্ধেক মানে প্রতিদিন ১০০ গ্রাম করে দেয়া হচ্ছে। এই পরিমাণ আসলে এক মুঠোর সমান।
ভারতীয় এবং বিদেশী বিশেষজ্ঞদের মতে এই শিশুদের অনেকেই মারা যাবে যদি তাদেরকে অতিরিক্ত আমিষ দেয়া না হয়। নয় মাসের মধ্যে তাঁদের তিন চতুর্থাংশ মারা যাবে। প্রায় ১০ লাখ শিশু।
তাই, ধীরে ধীরে অনেক শ্রম দিয়ে শিশুদের খাবারের জন্য বিশেষ কেন্দ্র খোলা হয়েছে যেখানে তারা দুধ এবং বালাহার নামে উচ্চ আমিষযুক্ত খাবার পাবে। এখনও পর্যন্ত এসব খাদ্য কর্মসূচির অধিকাংশ
ক্ষেত্রেই যে খাবার শিশুদের হাতে দেয়া হয় তা তারা আদি প্রথামতে তাদের পরিবারকে দিয়ে দেয় এবং সবাই সেটা ভাগাভাগি করে খায়। তাই সেই শিশুটি এই অনুচ্ছেদটি প্রকাশিত হওয়ার আগেই মারা যাবে।
আবার লাখ লাখ শিশু মারা নাও যেতে পারে। তারা বেঁচে থাকবে, স্রেফ বাঁচার জন্য। আরও সাত কোটি প্রাপ্তবয়স্কদের সাথে তারাও বেঁচে থাকবে। আশাহীন, শিক্ষাহীন, কোন উদ্দেশ্যহীন। হিংস্র বাগাড়ম্বরে পরিপূর্ণ বাংলাদেশের বিদ্রোহীরা তাঁদের আয়ত্ব করে নিবে। আর তাঁদের মনে থাকবে পাকিস্তানী ট্যাংক গুলো হটিয়ে তাঁদের জন্মভূমি দখল করে নেয়ার মিছে আশা।
এটি একটি ভয়াবহ এবং বিপদজনক দৃশ্য। সবাই কোন সমাধান না করেই ভীতসন্ত্রস্ত এবং এমন উচ্ছন্ন কেন হয়েছে তা সহজেই অনুমেয়।
এর সাথে শিবিরের আশেপাশের মূর্ত স্মৃতি। বৃদ্ধা মহিলা বন্যার মাঝে দুই ঘড়া চাল নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। পানি তার কাঁধ সমান। ঘড়াটা কাঁধের ঠিক উপরেই সে ধরে আছে। বেশির ভাগ সময়েই কিছু শিবিরের যে কয়টা তাঁবু অবশিষ্ট আছে ওখানে যেতে হলে বাঁশের তৈরি সরু সাঁকো পার হতে হয়। পুরো পরিবার কাদায় মাখা মাখি হয়ে যায় এবং তার চেয়েও বড় কথা স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত এ মানুষগুলোর মনের দাগও যায় না যখন বন্যার পানি ভেঙ্গে তারা খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রে পৌঁছাতে সংগ্রাম করে যায়।
একটা শিবির ছিল দিয়ারা, প্রায় ৩০০০০ শরনার্থী তাঁদের শুষ্ক তাঁবুতে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল। সবাই যথাযথভাবে তাঁদের মাথা গোঁজার ঠাই পেয়েছিল। কিন্তু সেই শিবিরও রাতারাতি বন্যার পানিতে তলিয়ে গেল। তাঁদের যাবতীয় সহায় সম্পত্তি হারিয়ে যায় এবং পাশেরই এক উঁচু জায়গায় তারা আশ্রয় নেয়। তৃতীয় বা চতুর্থ বারের মতো তারা আবার তাঁদের জীবন সংগ্রামে নতুন করে লেগে পড়ে।
হাসনাবাদ রেল ষ্টেশন এ একটি অভ্যর্থনা কেন্দ্র ছিল। খাদ্যের রেশনের জন্য কাতর জনতার ভিড় সেখানে দুঃস্বপ্নের মত। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা এতই ক্লান্ত যে আর তারা দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। তরুণ যুবারা ফোলা চোখে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁদের প্রত্যেকের ত্বকে খুশকির আস্তরন পড়ে গেছে পুষ্টির অভাবে। মৃত বাচ্চাদের দাঁত অস্বাভাবিকভাবে বেরিয়ে আছে তাঁদের শুকিয়ে যাওয়া মুখ থেকে। শক্তিসম্পন্ন লোকেরা তাঁবুতে বেকার বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করার পায় না। অথবা স্থানীয় গৃহস্থালি হতে বিশেষ খাবার পাওয়ার আশায় দরাদরি করে তাঁদের রুপির মজুদটা শেষ করে দিচ্ছে।
এই দৃশ্য সবখানে; যে কেউ একের পর এক তালিকা দিয়ে যেতে পারবে। এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা হল বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর কি হবে সেটা চিন্তা করা। শরণার্থী এবং আবাসনচ্যুত ভারতীয় কৃষকদের মাঝে রাজনৈতিক গণ্ডগোল এসময়ে সবচেয়ে বাজে অবস্থা হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ তারাও বাংলায় শীতের কারণে খাদ্যাভাবে আছে। এদিকে একটু গরম থাকাতে এখানে এটা খুব বড় বিষয় নয়। কিন্তু সিলেটের দক্ষিণ দিয়ে আসামে এখনই ঠাণ্ডা বেশ পড়ে গেছে। দুই মাসের মধ্যে ওখানে বরফ জমে যাবে, তুষার পড়বে এবং টানা ঠাণ্ডা লেগেই থাকবে।
বাঙ্গালী শরণার্থীদের কোন কাপড় নেই, কম্বল নেই। তাঁবুও খুব বেশি নেই। ৩০ লাখ কম্বল, কাপড় আর সুষ্ঠু তাঁবু এসব মানুষদের জন্য এখনই দরকার।
তো এই ৯০ লাখ শরণার্থী ইতোমধ্যে রাজনৈতিক কুশাসন সয়ে এসেছে, এরপর ঘূর্ণিঝড় পারি দিয়ে এসেছে, এরপর একটি যুদ্ধ দেখেছে, এরপর গৃহহারা হয়েছে, ক্ষুধা, রোগ-শোক এবং শরনার্থী হবার আরো যা যা প্রাপ্য আছে তা সবই তাঁদের ধারন করতে অক্ষম এক দেশে তারা পেয়েছে। এরপর তারা বন্যাদুর্গত হয়েছে। আর এখন তাদেরকে এই তীব্র শীত সহ্য করতে হচ্ছে।
যেমনটা আমি বলেছিলাম, বিগত ৩০ বছরের ইতিহাসে পুরো পৃথিবীতে এমন দুর্যোগ আর কেউ দেখে নি। এবং আমি যেটা বুঝাতে চেষ্টা করেছি, এই দুর্যোগ এতই ভয়াবহ যে সুষ্ঠু কোন ব্যবস্থা
কোলকাতার সকল সাংবাদিকরা জানে সেই সাথে অক্সফাম ও অন্যান্য রিলিফ কর্মীরা যে আমরা অনেক বড় সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। এখন শুধু দান কিংবা সমবেদনার মত অবস্থা নয়। সর্বোপরি, গোটা বিশ্ব দানশীলতার পরিচয় দিয়েছে। গত মে মাসে যখন কলেরা মহামারী আকারে দেখা দিয়েছিলো তখন আমরা আমার সব টাকা পয়সা ঢেলে দিয়েছিলাম, তাই গোটা বিশ্ব এখন বস্তুত পক্ষে কার্যকর দানের ব্যাপারে ক্লান্ত। তদুপরি, আসল দান দেখানো উচিৎ আমাদের নির্মম রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যেখানে স্পষ্টতই পাকিস্তানী সরকার এর জন্য বরাদ্দ, যেটা টিকে আছে বিদেশী অর্থ আর মিলিটারি সহযোগিতা নিয়ে, এটা আরও খারাপ পথে যাবে যদি না বর্তমান নীতি পরিবর্তন করা না হয়। রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রবাহিত হচ্ছে সেনাবাহিনীর অফিসার দ্বারা যারা ইয়াহিয়া খান কে মদত দিচ্ছে।
যদি তাদেরকে ইয়াহিয়া খান কে পরিত্যাগ করতে পারা যায় আর তাকে তার পূর্বের ভুলের জন্য বলির পাঁঠা করা যায় তাহলে নতুন নীতির সমন্বয়সাধনের একটা সুযোগ পাওয়া যেতে পারে । এটাই প্রথম অপরিহার্য কাজ। তারপর কি হবে সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। হয়তো স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হতে পারে কিন্তু সেটা অনেক গুলো সমস্যার ও তৈরি করবে। হয়তো পাকিস্তানের একটি নতুন সংবিধান হবে যেখানে পূর্ব অংশ কেন্দ্রীয় ভাবে পশ্চিমের সাথে যুক্ত হবে অথবা শেষমেশ একটি নতুন জাতিগত বাংলা রাষ্ট্র তৈরি হবে যাতে অর্ধেক মুসলিম, অর্ধেক হিন্দু আর ভারত ও পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে যাবে। সব সম্ভাবনাই এখন বিপদজনক। কিন্তু কোন কিছুই এতোটা বিপদজনক হবেনা এখনকার অবস্থা চলতে দেবার মত।
বড় শক্তিগুলোকে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক ভাবে বুঝাতে হবে যে পরিবর্তন দরকার আর সেটা খুব জলদি ই করতে হবে। তাদেরকে অর্থ, খাদ্য, সব কিছু দিয়ে ঐ সব পূর্ব পাকিস্তানী শরণার্থী যারা কিনা ভারতে অবস্থান করছে তাদের অনেক ব্যাপক পরিসরে সাহায্য করতে হবে।
যদি তারা থাকতে চায় তাহলে শত সহস্র পাউন্ড ও চ্যানেল বয়ে যাবে জাতিসংঘের এজেন্সি গুলোর মাধ্যমে। এটা নাহলে গ্র্যান্ড হোটেলের বিলাসবহুল সুইমিং পুল ভীতিগ্রস্ত, বাতুল, বিষণ্ণ হয়ে যাবে। স্থানীয় কূটনীতিকরা এভাবেই রহস্য করে কথা বলবে আর রাতে ঘুমাবেনা। সহস্র সহস্র বাচ্চারা মারা যাবে। সাথে হাজার হাজার বয়স্করাও। এর ফলশ্রুতিতে হাজার হাজার জীবিত মানুষের জীবন এই নির্মম পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাবে।
ক্লারি হলিংঅরথ
ইন্ডিয়ার যাবার লম্বা রাস্তা
(ডেইলি টেলেগ্রাফ থেকে ক্লারি হলিংঅরথ। পূর্ব পাকিস্তানের দুর্ভিক্ষ। ৮০ লক্ষ মানুষ তাদের নিজেদের দেশেই শরণার্থী, অসহায় ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর ভারতের দিকে চেয়ে আছে )
পূর্ব পাকিস্তানে আজ পর্যন্ত ৮০ লক্ষ মানুষ, স্ত্রী লোক, শিশুরা তাদের নিজেদের দেশে গৃহহীন , “শরণার্থী”।
গ্রামবাসীরা এদিক ওদিক অসহায়ের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে আর ভারতের পানে চেয়ে আছে, কখনো কখনো হতবম্ব হয়েই ভুল পথে পা বাড়াচ্ছে। কিন্তু এদের মধ্যে ক্ষীণ সন্দেহ হয় যে এই বিশাল ভুক্তভুগি জনগোষ্ঠী সীমানা পারি দিচ্ছে শরণার্থী শিবিরের খাবার আর থাকার আশায়।
একটা বড় অংশ ভয়ে তাদের ঘর বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে, যখন তারা গুলির শব্দ শুনছে অথবা দেখছে যে তাদের পাশের বাড়ি অথবা পাশের গ্রাম পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা পুড়িয়ে দিচ্ছে মুক্তি বাহিনী – স্বাধীন বাংলার সৈন্য দের আগ্রাসনের প্রতিশোধ নেবার উদ্দেশ্যে
কিছুকিছু নারীরা স্বভাববসতই কিছু থালা বাসন আর কিছু চাল নিয়ে কোন জলাভূমির দিকে দৌড় দিচ্ছে। সৌভাগ্য বসত কিছু লোকের কাছে কিছু টাকা করি ছিল তাদের পকেটে, যা খুব তাড়াতাড়ি ই শেষ হয়ে যাবে। এই সব লোকদের চলার পথ গুলো খুব ভালো ভাবেই পাকিস্তানী আর্মি দের সচরাচর চলার পথ থেকে আলাদা। কোন আর্মি জীপের শব্দ শুনলেই সবাই কাছাকাছি কোন জঙ্গলায় গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে। কেউ কেউ বসতদিন গ্রাম গুলোতে আশ্রয় নিচ্ছে কিন্তু তারা স্থানীয় ভাবে কোন খাবার জোগাড় করতে পারছেনা। তারা এখন মনে প্রাণে বিশ্বাস করে যে কোথাও সাহায্যর জন্য বের হলে আর্মিরা তাদের যুবক ছেলে আর মেয়েদের ধরে নিয়ে যাবে।
খরা মৌসুমের দরুন, নৌকার কমতির কারণে, আর মুক্তি বাহিনীর রেলওয়ে, রাস্তা ঘাট ভেঙ্গে ফেলার কারণে এই সব করুন লোকদের কোথাও যাবার ঠাই নেই, এমন কি সেই সব জায়গাও যেখানে খিস্টান মিশন আর ইয়উরপিয়ান রা সাহায্য করছে।
এটা বলা কঠিন যে এই সব লোকদের কতজন ভারতে যাবার পথেই মারা যাচ্ছে, ডাক্তার দের মতে পাঁচ ভাগের ১ ভাগ অন্তত। আমি এই লোকগুলোর মধ্যে খুব বড় ধরনের অপুষ্টির লক্ষণ দেখতে পারছি।
এই সব শরণার্থী আর ভবঘুরে লোকদের মধ্যে জরুরী ভিত্তিতে খাবার, পোশাক আর চিকিৎসা সেবা দেয়া দরকার কিন্তু এটাই সবচেয়ে কঠিন যে কিভাবে তাদের এই সেবা গুলো পৌঁছে দেয়া যাবে যতক্ষণ না পর্যন্ত তারা ভারতের সীমানায় না আসে অথবা জাতিসংঘের উচিৎ পাকিস্থান সরকার কে চাপের মুখে রেখে কিছু সংখ্যক রিলিফ কর্মী বাড়াতে যারা কিনা এই সব খাবার বণ্টনে সহায়তা করবে। এখন পাকিস্তান সরকার পর্যবেক্ষক দল গুলোকে এটা দেখাতে রাজি হয়েছে যে তাদের উপহারক্রিত খাবার গুলো ঠিক ঠিক লোকের মুখে যাচ্ছে। খাবার একটি রাজনৈতিক অস্ত্র আর এটা খুবই দুর্লভ, “ভালো মানুষেরা” যারা কিনা পাকিস্তান আর্মি দ্বারা তৈরি শান্তি কমিটির সদস্য, তারা এগুলো রাজনৈতিক কর্মীদের খাওয়াচ্ছে।
আর “ খারাপ মানুষেরা” যারা পাকিস্তানের পক্ষে নয়, যাদের কিনা বাংলাদেশের প্রতি সহমর্মিতা আছে, তাদের প্রতি পাকিস্তানী আর্মি প্রশাসনের আচরণ খুবই খারাপ।
হাজার হাজার মানুষ না খেতে পেরে নাভিশ্বাস হয়ে উঠেছে তাদের নিজেদের বাসায় যদিও তাদের পার্শ্ববর্তী বাজারে প্রচুর চালের মজুদ আছে , কিন্তু তাদের সেটা কেনার মত ক্ষমতা নেই, অর্থনৈতিক অবকাঠামো ভেঙ্গে গেছে। এই যুদ্ধের কারণে চাষিরা ফসল ফলাচ্ছে না , লোকজনেরা তাদের কাজ থেকে “কর্ম বিরতি” নিয়েছে। আবারো, নিরপেক্ষ ভাবে এই রিলিফের খাবার বণ্টন হওয়া জরুরী কেননা এটা নাহলে হাজার হাজার মানুষ তাদের নিজেদের পরিচিত বসত ভিটে ছেড়ে ভারতের পথে পা বাড়াবে।
এই হাজার হাজার, হয়তো লাখ পেরিয়ে যাবে এই সব লোকদের বেঁচে থাকার জন্য একটাই মাত্র পথ খোলা আছে সেটা হচ্ছে, রিলিফ কার্যক্রম অতি শীঘ্রই চালু করা। এই দুর্ভিক্ষ এড়ানো যাবেনা কারণ শরতে যখন নতুন শস্য উঠবে তখন এখনকার চেয়ে আরও ২০ লক্ষ টন ধান প্রয়োজন হবে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর গুলো থেকে খাদ্য গুলো প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিয়ে যেতে কোন ট্রেন, লরি অথবা খুব কম নৌকা আছে। যে জিনিসটা এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ সেটা হচ্ছে কিছু স্পিড বোট আর ট্রাক যাতে করে কর্তিপক্ষ সেই শস্য গুলো পরিচিত জায়গা ছাড়াও অন্যান্য পথে রাজধানী থেকে নিয়ে যেতে পারে।
বার্নার্ড ব্রেইন, সংসদ সদস্য
বাংলার এই দূর্দশাজনক পরিস্থিতিতে যেটা ক্ষমার অযোগ্য তা হলো, মাসের পর মাস আমরা দেখছি এটি বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু এটি বন্ধের জন্য কেউ কিছুই করছে না। এটা প্রকাশ্য সুস্পস্ট যে, বৃহৎ ও ক্রমবর্ধমান শরণার্থীদের বোঝাক্রান্ত ভারত বা দূর্ভিক্ষের সম্ভবনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা পাকিস্তান কেউই বাইরের সহায়ত ছাড়া নিজেদের সামলে উঠতে পারবে না। তবুও এখন পর্যন্ত উ থান্টের সাহায্যের আহ্বানের বিপরীতে সাড়ার পরিমান দুঃখজনকভাবে অপর্যাপ্ত। বিশ্ববাসীর এখনই কিছু করা উচিত, অথবা অকল্পনীয় মাত্রার মানবিক বিপর্যয়ের সাক্ষী হতে প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।
মার্ক এডওয়ার্ডস, কিস্টোন প্রেস এজেন্সি
পরিণত বয়সী শরণার্থীদের মাঝে চূড়ান্তরকমের ক্লান্তি ছড়িয়ে গেছে। রাজনৈতিক আন্দোলনকারীরা কোনো আন্দোদোলনে নামার আগে, যা এমনকি সহিংস আন্দোলনও হতে পারে, তারা কতদিন টিকে থাকবে তা শুধু কেউ কেউ কল্পনাই করতে পারে।
টাইগার স্ট্যাক, অক্সফাম
শরনার্থী শিবিরে চূড়ান্ত মানবিক অবক্ষয় ও দূর্ভোগের মাঝে বেঁচে থাকার পরে দেশে ফিরলে জনগনের প্রত্যেকেরই একটি বিষয়ই মনে পড়বে… তাদের ঘর-গৃহস্থালি বিষয়ক দূর্ভাবনা।
আর্নেষ্ট হিলেন, উইকেন্ড ম্যাগাজিন
পূর্ব পাকিস্তানে চলমান বিপর্যয় বিষয়ে এখন পর্যন্ত সরকার ও কানাডার জনগনসহ অন্যদের মনোভাব মূলত নিস্পৃহ। এবং এটা বিশ্বাস করা শক্ত। পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তের শখানেক মানবেতর শরণার্থী শিবিরের একটিতে বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে থেকে এটি বুঝতে পারা কঠিন। এতো সংখ্যাক মানুষ ভুগছে ও মারা যাচ্ছে যা নজিরবিহীন এবং এই সংখ্যা বাড়ছে। এখানে ব্যাপক দূর্ভিক্ষ চলছে এবং যুদ্ধের সমূহ আশঙ্কা আছে।
ডাঃ টিম লাস্টি, স্বেচ্ছাসেবক ডাক্তার
কলকাতার ৭০০ মাইল উত্তরের কুচবিহারের এক শরণার্থী শিবিরে এক দুপুরে হেঁটে বেড়ানোর কথা আমি মনে করতে পারি। পথে চটের উপর পড়ে থাকা অসুস্থ ও মুমুর্ষু শিশুদের জন্য আমরা কয়েক দফা থমকে দাঁড়িয়েছিলাম। নরওয়েজিয়ান শিবির পরিচালককে আমি জিগ্যেস করেছিলাম অপুষ্টির কি উন্নতি হচ্ছে না কি আরও অবনতি হচ্ছে। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘অবনতি হচ্ছে।’
দিনের মাঝেই অক্সফাম সে এলাকায় কার্যরত ভারতীয় চিকিৎসক দলকে নিয়ে আসে, কিন্তু ব্যক্তিগত দাতব্য কাজের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। সৌভাগ্যবান মানুষদের উদ্বিগ্নতার মাত্রা দিয়ে এই সীমা নির্ধারিত হয়।
ডেভিড হার্ট, এসসিএফ স্বেচ্ছাসেবক
চা-উৎপাদনকারী হিশেবে আমি পূর্বস্থানীয় অঞ্চলে ১৪ বছর কাটিয়েছি তাই সেখানকার অবস্থা সম্পর্কে আমি জানি। গত নভেম্বরে সাইক্লোনের পরে আমি পূর্ব পাকিস্তানীদের সঙ্কটাপন্ন অবস্থা এবং পরবর্তীতে তাদের দূর্ভোগ ও দূর্দশা দেখেছিলাম। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে ভারতের শরণার্থী শিবিরে আমি যে দুঃখজনক পরিস্থিতি দেখেছি তার সাথে তুলনা চলে এমন কিছু আমি কখনও দেখিনি।
.
13.50.196
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
অধিকৃত বাংলাদেশে ত্রাণকর্মরত অপারেশন ওমেগা কর্মীর কারাবরণ | বাংলাদেশ নিউজলেটার | ১০ নভেম্বর, ১৯৭১ |
“অপারেশন ওমেগা”র (একটি আন্তর্জাতিক রিলিফ মিশন,যাদের সদর দপ্তর ইংল্যান্ডে অবস্থিত)দুজন কর্মীকে দখলকৃত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবৈধভাবে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের আর্মিরা গ্রেফতার করেছে।তাদের ওপর চোরাচালানের অভিযোগ আনা হয় এবং মিলিটারি আদালত তাদের দুই বছর কারাভোগের দণ্ড প্রদান করে।
৪ঠা অক্টোবর,ডানমট,নিউ জার্সির ২৭ বছর বয়সি এলেন ল্যাঙ্গল কনেট এবং ব্রিটিশ নাগরিক গরডন স্লেভেন কে যখন আটক করা হয়, তখন তারা দখলকৃত বাংলাদেশের ১০ মাইল অভ্যন্তরে কাপড় এবং ঔষধ বিতরন করছিলেন।
মিসেস কনেট ছিলেন দ্বিতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় ত্রানবিতরনকারী স্বেচ্ছাসেবী যাকে বাংলাদেশে অবৈধভাবে ত্রানসামগ্রী বিতরনের জন্য বিচার করা হয়।প্রথম জন জাকে কারাভোগের দণ্ড প্রদান করা হয়েছিল,তিনিও ছিলেন অপারেশন ওমেগার একজন; সানফ্রান্সিস্কোর ডানিওল ডিউ,যাকে গত সেপ্টেম্বরে বিচারাধীন করা হয় এবং বিতাড়িত করা হয়।
অপারেশন ওমেগার কর্মকর্তাদের মতে,এই দুইজন বন্দীর সঙ্গে কে “তৃতীয় শ্রেনি”র বন্দীদের মত আচরণ করা হচ্ছে যা সাধারনত সাধারন বন্দীদের সাথে করা হয়ে থাকে এবং বিষয়টি একজন আমেরিকান আইনজীবী অস্বীকার করেছেন।
১৭ই অক্টোবর একটি ব্রিটিশ দৈনিক “ডেইলি অবসারভার” এর একটি সম্পাদকীয়তে “Monstrous Punishment” শিরোনামে লেখা হয়-
“দুজন যুবক ত্রানকর্মীকে পাকিস্তান আদালত দুই বছরের কারাদণ্ড প্রদান করেছে।তাদের কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল দুর্গতদের সহযোগিতা রাষ্ট্রের সকল রাজনৈতিক অবস্থার চেয়ে অগ্রাধিকারযোগ্য তা প্রচার করা।তাই তারা রোগশোক ও ক্ষুধায় কাতর অসহায়দের সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য অবৈধভাবে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করে।
“পাকিস্তান সরকার ব্যবস্থা গ্রহন করে তাদের কারাবন্দী করেছে।সমগ্রবিশ্বে বিষয়টি আলোড়ন তুলেছে এবং সারা পৃথিবীর মানুষ তাদের উদ্দেশ্য কে সমর্থন জানিয়েছে।দুই বছরের কারাদণ্ড ভয়াবহ এবং যা বর্তমান সরকারের জন্য কলঙ্ক বয়ে আনবে।
.
13.51.197
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ত্রান তহবিলের যুক্তরাজ্য কমিটির আবেদন। | বাংলাদেশ একুমেন্টস | ৩০ নভেম্বর ১৯৭১ |
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় ত্রান তহবিলের জন্য যুক্তরাজ্য (শরণার্থী) কমিটির আবেদন।
নভেম্বর ৩০, ১৯৭১ ইং
নীচের চিঠিটি লন্ডনের ’দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকার সম্পাদক বরাবর লিখিত হয়েছিলো। এটি নভেম্বর ৩০, ১৯৭১-এ ঐ পত্রিকায় ছাপা হয়।
জনাব,
সংবাপত্রগুলো এখন যুদ্ধ বিধ্বস্ত খবরাখবরে সয়লাব। এটি উৎসারিত হয়েছিলো পূর্ব বাংলার দুঃস্বপ্নের মতো অবস্থা থেকে। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, প্রায় ১ কোটি শরনাথী এখনো ভারতেই অবস্থান করছেন। এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে, এই বিপুল সংখ্যক শরনাথীদের খাওয়া, পরা ও আশ্রয়দানের গুরু দায়িত্ব এখনো ভারত সরকারের কাধেঁই ন্যাস্ত রয়েছে।
ভারত যদি পৃথিবীর সবচাইতে ধনী দেশও হতো, তবু এই কাজটি হতো যথেষ্ট বড় একটি মানবিক দায়িত্ব। কিন্তু যে দেশ নিজেই দারিদ্র্যের সাথে সংগ্রাম করে টিকে আছে, সেই দেশের জন্য এটি সত্যিই একটি শ্বাসরূদ্ধকর প্রচেষ্টা। আর ভারতীয় জনগণও তাদের সরকারের সাথে এই কৃতিত্বের অংশীদার। কারন ভারত একটি স্বাধীন দেশ, যেখানে শাসকগন ভোট দ্বারা নির্বাচিত হন এবং জনগনের প্রতি দায়বদ্ধ। ভারতীয় জনগনের সক্রিয় সমর্থন ছাড়া মিসেস গান্ধীর পক্ষে কখনো এই বিশাল সংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়া সম্ভব হতো না। আর সেখানে এত দিন পর্যন্ত বিশাল খরচ করে ভারতের মাটিতে রাখার কথা না হয় বাদই দিলাম।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় ত্রান তহবিলের যুক্তরাজ্য কমিটি মিসেস গান্ধীর নিকট সরাসরি হস্তান্তর করার জন্য বেশ কিছু অর্থ সংগ্রহ করেছে। তাঁর সামগ্রিক পৃষ্ঠপোষকতায় সে সময়ে এই নগদ অর্থ উক্ত শরনার্থীদের সেবায় (শীত ও গ্রীষ্মের কাপড়, ঔষুধপত্র, চিকিৎসা সরঞ্জামাদি, কম্বল ও বিছানা, তাবু ও লন্ঠন, শিশুখাদ্য, তৈজসপত্র ও অন্যান্য আনুষাংগিক জিনিসপত্রাদি) ব্যয় করা হয়েছে।
আইএনআর (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল রিলিফ) এর নামে ইস্যুকৃত ব্যাংক চেকের মাধ্যমে যে কেউ সরাসরি আমার কাছে বা ফান্ড একাউন্ট নম্বর ১৫৬১১৪৬, লয়েডস ব্যাংক লিমিটেড, ৬ পল মল লন্ডন, এস ডব্লিউ ১-এ পাঠিয়ে অনুদান দিতে পারবেন । আমি সবাইকে সবিনয়ে অনুরোধ করছি, আপনারা যে যা পারেন, তা এই মহান জনহিতকর ও জরুরী কাজে ব্যয় করুন।
বিনীত নিবেদক,
সিবীল থ্রনডাউক ক্যাজন
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় ত্রান তহবিলের জন্য যুক্তরাজ্য (শরনাথী) কমিটি।
.
13.52.201
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দপ্তর মুখপাত্রের বাংলাদেশ সংক্রান্ত বিবৃতি (সংকলিত) | পররাষ্ট্র দপ্তর | মার্চ-এপ্রিল, ১৯৭১ |
>১৩>৫২>২০১
পূর্ব পাকিস্তান সংকট
যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দপ্তর মুখপাত্রের বিবৃতি
মার্চ ২৬
“অত্যন্ত নিবিড়ভাবে আমরা এ বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি”।
মার্চ ৩১
“ইসলামাবাদ দূতাবাসের একজন পদস্থ কর্মকর্তা প্রবাসী সম্পর্ক মন্ত্রনালয়ের একজন পদস্থ কর্মকর্তার নিকট এ বিষয়ে আমাদের উদ্বেগের কথা প্রকাশ করেন। ফলে আমরা অবগত হলাম যে যা ঘটছে অর্থাৎ প্রকৃত ঘটনা কাটাছেড়া করা হচ্ছে। আমরা অনুধাবন করলাম যে আমেরিকান সাংবাদিকেরা যে সব বৈধ এবং বাস্তব খবর সংগ্রহ করছে সেগুলোর উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে”।
এপ্রিল ২
“পাকিস্তানের অধিবাসীদের বর্নিত জীবন নাশ, ক্ষয়-ক্ষতি এবং দূঃখ-কষ্ট জনিত ভোগান্তিতে আমরা স্বভাবতই উদ্বিগ্ন”।
“এ পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ মহাসচিবের গতকালের দেয়া বিবৃতি আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছি।
জাতিসংঘ মহাসচিবের বিবৃতির প্রেক্ষিতে পাকিস্তান সরকারের অনুরোধক্রমে আমরা আন্তর্জাতিকভাবে গৃহিত মানব সেবার যে কোন উদ্যোগকে স্বাগত জানাবো”।
“আমরা মনে করি যা ঘটছে তা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়”।
এপ্রিল ৫
“এটি আমাদের আশা যে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ পূনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে”।
“পাকিস্তানের অধিবাসীদের বর্নিত জীবন নাশ, ক্ষয়-ক্ষতি এবং দূঃখ-কষ্ট জনিত ভোগান্তিতে আমরা স্বভাবতই উদ্বিগ্ন।
আমরা ঊ থান্ট এর ৩১ মার্চের বিবৃতি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিয়েছি এবং জাতিসংঘ মহাসচিবের সাথে পাকিস্তান সরকারের অনুরোধক্রমে অবশ্যই আমরা বলছি যে আন্তর্জাতিকভাবে গৃহিত মানব সেবার যে কোন উদ্যোগকে আমরা সহমর্মিতার সাথে বিবেচনা করব”।
এপ্রিল ৬
“স্বভাবতই এই সব পরিস্থিতিতে আমেরিকান অস্ত্র প্রয়োগের যে কোন সাধারন প্রস্তাবের বিষয়ে আমরা যথেষ্ট উদ্বিগ্ন”।
প্রধান বিভাগীয় বিবৃতি (MAIN DEPARTMENT STATEMENT)
এপ্রিল ৭
“বর্তমান পরিস্থিতির শুরু হতেই , পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত হওয়া প্রাণহানি এবং ক্ষয়-ক্ষতি বিষয়ে বিভিন্নভাবে আমরা আমাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছি এবং আমরা আশা প্রকাশ করছি যে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ পুনঃপ্রতিষ্টিত হবে”।
>13>52>202
“এই পরিস্থিতির উপর নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রাপ্তির অসুবিধা সত্বেও যখন, এটি ক্রমবর্ধমান স্পষ্ট হয়ে উঠে যে এখানে উল্লেখযোগ্য পরিমানে হতাহত ও ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে, হতাহত এবং ক্ষয়-ক্ষতির পরিমান নির্ধারন করার যথাযথ কোন উপায় যদিও আমাদের ছিলনা।
যারা সাম্প্রতিক ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত তাদের জন্য আমাদের সহানুভূতি। পূর্ব পাকিস্তানের স্বাভাবিক জীবন গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের অবিরত বিশ্বাস সংঘাত নিরসনের জন্য সাধ্যের মধ্যে নেয়া যে কোন পদক্ষেপ এবং একটি শান্তিপূর্ণ উপযোজন অর্জন গুরুত্বপুর্ণ।
শীঘ্রই সাম্প্রতিক ঘটনা দ্বারা সৃষ্ট দুর্ভোগ লাঘব করা সম্ভব হবে বলে আমরা আশা করি। এ প্রসঙ্গে আমরা আশা করি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দেয়া সাহায্য প্রস্তাব পাকিস্তান সরকারের নিজের জন্যই হিতকর হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই ধরনের যে কোন আন্তর্জাতিক মানবিক প্রচেষ্টায় সহায়তা করার জন্য প্রস্তুত আছে। আমরা পাকিস্তান সরকারের সাথে এই বিষয়ে আলচনা করেছি এবং আমাদের আলোচনা অব্যাহত থাকবে”।
“পাকিস্তান সরকারের থেকে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহায়তার কোন অনুরোধ আছে বলে আমি মনে করিনা, আমরা আশা অব্যাহত রাখছি যে, যে সকল প্রস্তাব আছে এবং যেগুলো আসন্ন সে সকল প্রস্তাব পাকিস্তান সকারের জন্য হিতকর হবে”।
“সাংবাদিকদের বের করে দেয়া হয়েছে, তাদের বৈধ সংবাদ সংগ্রহ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং তাদের ক্যামেরা নোট ইত্যাদি তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে , আমরা এই ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি। আমরা এই সকল ব্যক্তিগত সম্পদ ফেরত দিতে বলেছি”।
এপ্রিল ১২
“কিছু প্রস্তাবনা অনুযায়ী পাকিস্তানের সাথে চলমান বৃহৎ কোন সামরিক সহায়তা কার্যক্রম আমাদের নেই। ১৯৬৫ সাল থেকেই এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। গত অক্টোবরের একমাত্র ব্যতিক্রমী ঘোষনা অনুযায়ী বিবরন ও দামের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি এখনো আলোচনাধীন।
সরবরাহ লাইনে সরবরাহের মতো কোন সরঞ্জাম নেই, আবারও বলছি কোন সরঞ্জাম নেইএবং উদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে কোন সরঞ্জাম সরবরাহ করাও হয়নি। বাস্তবে ছয় সপ্তাহ ধরে এ বিষয়ে কৌশলগত কোন আলোচনাই হচ্ছেনা।
পাকিস্তানের জন্য, নগদ প্রাধান্য সম্পন্ন, আমাদের একটি শিষ্ট বিক্রয় কার্যক্রম ছিল, প্রাণঘাতী নয় এ রকম সামরিক সরঞ্জাম , সরঞ্জামের খুচরা যন্ত্রাংশ এবং কিছু গোলা-বারুদ ইতিমধ্যে পাকিস্তানীদের হাঁতে পৌঁছেছে। যেই চুক্তির ভিত্তিতে এই কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে এটি সম্পন্ন হয়েছিল বর্তমান সংকট শুরু হওয়ার পূর্বে এবং এই সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে পাকিস্তান সরকারের সাথে নতুন কোন কার্যক্রমের বিষয়ে আমি জ্ঞাত নই। এই চুক্তির অধীনে সম্পন্ন হওয়া চালান নিয়ে উদ্বেগের বিষয়টিও আমাদের পর্যালোচনায় রয়েছে।
সংক্ষেপে বলা যায়, জাতি হিসেবে পাকিস্তানের সাথে আমাদের যে সারগর্ভ সামরিক সহায়তা কার্যক্রম রয়েছে তা ভ্রান্ত”।
>১৩>৫২>২০৩
এপ্রিল ১৩
“সর্বসমেতভাবে পাকিস্তানে খাদ্য সরবরাহ এখন পর্যাপ্ত বলে মনে হচ্ছে। এ কথাও ঠিক যে, স্থানীয়ভাবে কোন সংকট রয়েছে কিনা সে ব্যাপারে কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেনা। কিন্তু একটি সাধারণ প্রস্তাব হিসেবে এটি বলার অপেক্ষা রাখেনা যে ব্যাপক ভিত্তিতে কোন দূর্ভিক্ষ নেই এবং এটি ভেবেই আমরা স্বস্তি বোধ করছি।বর্তমানে ৭ লক্ষ টন খাদ্য মজুদ রয়েছে অর্থাৎ চার মাসের স্বাভাবিক যোগান মজুদ আছে। উপরন্তু আরো ২ লক্ষ টন রয়েছে জলের উপরে যার অধিকাংশই রয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের বন্দর সমুহে। যুক্তরাষ্ট্রের আরো ৩ লক্ষ টন শস্যের অনুমোদন দেয়া হয়েছে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিতরনের জন্য সরবরাহ করা হবে। যদি প্রমাণিত হয় ভবিষ্যত চাহিদা এর চেয়েও অনেক বেশি, তাহলে আমরা অবশ্যই, অতিরিক্ত পিএল-৪৮০ চালানের বিষয় ও বিবেচনা করবো। যদি প্রয়োজনীয় মনে হয় তাহলে আমরা অবিলম্বে এটি সরবরাহের মত অবস্থায় রয়েছি।
এখন, কৃষি বিভাগ গতকাল জানিয়েছে যে , যতটা সম্ভব স্বল্প সময়ের মধ্যে চালান শুরু করার ব্যাপারে আমরা উদ্বিগ্ন পূর্ব পাকিস্তানের বন্দরের জরাজীর্নতা দূর করা এবং পন্য খালাস ও বন্টন ব্যবস্থা শিথিল করার জন্য পাকিস্তান সরকারের নিকট আমরা নির্দেষনা পাঠিয়েছি। বলা হচ্ছে এই সমস্ত সমস্যা যোগান ব্যবস্থা নিয়ে নয় বরং পূর্ব পাকিস্তানে পন্য খালাস ও বন্টন ব্যবস্থা নিয়ে কারন রেল, নৌ এবং সড়ক যোগাযোগ ব্যাহত হচ্ছে এবং ডকে তীব্র খালাসী সংকট রয়েছে।
এখন, আমরা পাকিস্তান সরকারের প্রতি বন্টন সমস্যা সমাধানে জোর গুরুত্ব দিচ্ছি, পূর্ব পাকিস্তানে সহায়তা প্রদান করার যে কোন আন্তর্জাতিক মানবিক প্রচেষ্টাকে সমর্থন করার জন্য আমরা প্রস্তুত আছি এবং আমরা জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখছি”।
এপ্রিল ১৫
পাকিস্তানের উপর প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদনে প্রাপ্ত তথ্যে দাবি করা হচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র পাকিস্তানে সরবরাহ করা হচ্ছে এবং খাদ্য সহায়তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এতে আমরা মর্মাহত। এই দাবিগুলো সত্য নয়।
প্রথমত, আমাদের কাছে থাকা সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্যের উপর ভিত্তি করে বলতে পারি , পূর্ব পাকিস্তানে কোন ব্যাপক দূর্ভিক্ষের অস্তিত্ব নেই, যদিও স্থানীয় ঘাটতি থাকতে পারে। যোগান কোন সমস্যা নয় এটি বন্টন ও বন্দরের জরাজীর্নতার কারনে ।জরুরী ভিত্তিতে এই সমস্যার সমাধানে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আমরা উল্লেখযোগ্য সময় ধরে কাজ করছি। প্রচুর পরিমানে ইউ এস পিএল-৪৮০ গম সহ ৯ লক্ষ টন শস্য সরকারের নিকট হয় পূর্ব পাকিস্তানে অথবা তার বন্দরে অথবা গভীর সমুদ্রে মজুদ আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত ৩ লক্ষ টন শস্যের অনুমোদন রয়েছে এবং যতটা সম্ভব স্বল্প সময়ের মধ্যে বিলি করার জন্য সরবরাহ করা হবে এবং যদি আরো প্রয়োজন পড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবিলম্বে এটি নিয়ে কাজ করবে। আমরা বলেছি এবং আমাদের সদিচ্ছার কথা পুনঃব্যক্ত করছি যে কোন অতিরিক্ত আন্তর্জাতিক মানবিক ত্রাণ প্রচেষ্টায় আমাদের সমর্থনের কথা। পাকিস্তান সরকার এ বিষয়ে আমাদের প্রস্তুতি সম্পর্কে সম্যক অবগত আছে।
মার্কিন অস্ত্রের প্রশ্নে , ১৯৬৫ সাল হতেই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর রয়েছে। গত অক্টোবরের সাময়িক ব্যতিক্রমী ঘোষনা অনুযায়ী কোন অস্ত্র বিতরন করা হয়নি এবং সরবরাহ লাইনেও কোন অস্ত্র নেই। ১৯৬৬-৬৭ সাল হতেই , পাকিস্তানের সঙ্গে বিদেশী সামরিক সরঞ্জাম বিক্রয় চুক্তির অধীনে , খুব স্বল্প পরিমানে কিছু জিনিস যেমন- যোগাযোগের, চিকিৎসার , পরিবহন সরঞ্জাম হিসেবে খুচরা যন্ত্রাংশ ও অস্ত্রের গোলা-বারুদ প্রদান করা হয়েছে ১৯৬৫ সালের নিষেধাজ্ঞা আরোপের পূর্বেই পাকিস্তানে চলে গেছে। গোলা-বারুদ প্রশ্নে সম্মানের সাথেই জানাচ্ছি যে, মোট উপাদানের ১০ থেকে ১৫ শতাংশের বেশি গোলা-বারুদ নেই, আমরা প্রতিরক্ষা দপ্তর থেকে অবগত হয়েছি পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধির নিকট সরবরাহ করা হয়নি এবং এই ধরনের সরবরাহের কোন কিছুই এখন নির্ধারিত হয়নি। সংক্ষেপে বলতে গেলে, এই সংকটের শুরু থেকে কোন অস্ত্রই পাকিস্তান সরকারকে প্রদান করা হয়নি এবং বিতরনের বিষয়টি উন্নয়নের আলোকেই পর্যালোচনার জন্য রাখা হবে।
>১৩>৫২>২০৪
শরনার্থী সমস্যা
এপ্রিল ২৭
এখানে (নিউইয়র্ক) এবং নতুন দিল্লী উভয় স্থানেই ভারত সরকারের সাথে আমরা এ বিষয়ে আলাপ করেছি এবং এ বিষয় নিয়ে আমরা আমাদের সাধ্যমত তৎপর রয়েছি সম্ভবত জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে অথবা আন্তর্জাতিক রেড ক্রস সংস্থার তত্ত্বাবধানে একটি নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে থেকে কিছু আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার উপরে। তবে এখনো বিস্তারিত কিছুই ঠিক হয়নি।
আমি বিশ্বাস করি, তিনটি বা তার অধিক সেচ্ছাসেবী সংস্থা থাকতে পারে, কিন্তু আমার জানামতে তিনটি সেচ্ছাসেবী সংস্থা – ক্যাথলিক রিলিফ সার্ভিস; চার্চ ওয়ার্ল্ড সার্ভিস; এবং কেয়ার (CARE) আমাদের সম্মতিক্রমে যাদের ভারতে মানব সেবার কার্যক্রম রয়েছে তারা তাদের কিছু মালপত্র যা তারা তাদের স্বাভাবিক প্রকল্পসমূহে ব্যবহার করত তা দিয়ে পশ্চিম বাংলায় শরনার্থীদের জন্য ত্রাণ প্রকল্প চালিয়ে যাচ্ছে, যা গত কয়েক সপ্তাহ ধরে পশ্চিম বাংলায় আশ্রয় নেয়া ১৫০০০০(দেড় লাখ) শরনার্থীর কাজে লাগছে।
“ভারতীয় একটি উৎস থেকে আমি একটি হিসাব পেয়েছি যাতে দেখা যায় পশ্চিম বাংলা ও আসাম রাজ্যে ৫ লক্ষেরও অধিক শরনার্থী আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু আমি দৃঢ়ভাবেই জানাচ্ছি যে, এ বিষয়ে আমাদের নিজেদের কোন স্বাধীন/বিশ্বাসযোগ্য পরিসংখ্যান/হিসাব নেই”।
.
13.53.205-206
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
সিনেটর রবার্ট সি বায়ার্ডকে লিখিত পররাষ্ট্র দপ্তর কর্মকর্তার চিঠি | পররাষ্ট্র দপ্তর | ২১ এপ্রিল, ১৯৭১ |
স্ট্যাট ডিপার্টমেন্ট
ওয়াশিংটন ডি.সি.২ ১
২১ এপ্রিল, ১৯৭১
সম্মানিত রবার্ট সি.বায়ার্ড
যুক্তরাষ্ট্র সিনেট
ওয়াশিংটন ডি.সি. ২০৫২০
জনাব সিনেট বায়ার্ড :
পূর্ব পাকিস্তানের উপর জনাব এবং জনাবা ফ্রেড স্টটলমায়ারের অভিমতের ভিত্তিতে গত ৩০ মার্চ আপনার তদন্ত হাতে পেয়েছি।
পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক শান্তি স্বেচ্ছাসেবক সৈন্য হিসেবে,এখানকার দুঃখজনক অগ্রগতিতে স্টটলমায়ারের উদ্বেগ,এবং বিশেষত ইউ.এস-এর সরবরাহকৃত অস্ত্রর ব্যবহার বোধগম্য। প্রকৃত অবস্থা হলো, স্ট্যট ডিপার্টমেন্ট মুখপাত্র বারংবার এই বিষয়গুলোকে গত বিভিন্ন সপ্তাহে দাপ্তরিক বিজ্ঞপ্তিতে উদ্দেশ্য করেছেন।এই বিজ্ঞপ্তি সমূহ, যাই হোক না কেন, সব রকম জনপ্রিয়তা পায়নি যা আমরা প্রাপ্য মনে করি।
পূর্ব পাকিস্তানে সংগঠিত জীবন নাশ ও ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে আমরা উদ্বেগ জানিয়েছি,এবং আশা হলো শান্তিপূর্ণ অবস্থা সেখানে পূনঃস্থাপিত হবেই।এসব ঘটনার ভুক্তভোগীদের প্রতি আমাদের সহমর্মিতা সম্প্রসারণ করেছি।আমরা আমাদের বিশ্বাস বিবৃত করেছি যে এটা গুরুত্বপূর্ণ যে সাধ্যমতো সব উদ্যোগ নেয়া হবে এই দ্বন্দ্ব শেষ করতে এবং একটি শান্তিপূর্ণ বাসস্থান অর্জন করতে। এসব ঘটনার কারণে যেকোনো মানবিক মুক্তি উপশম প্রচেষ্টার আগ্রহে সমর্থন দিতে আমরা জোর দিয়েছি।আমরা এসব বিষয়ে পাকিস্তান সরকারের সাথেও আলোচনা করেছি এবং তা চালিয়ে যাবো।
জনাবা এবং জনাবা স্টটলমায়ারের উত্থাপিত বিষয়ের জন্য,আমি নিশ্চিত করতে চাই যে,এমন অভিমত গুরুত্বসহকারে ডিপার্টমেন্ট এ বিবেচনা করা হয়েছে। আমাদের মুখপাত্র বিশেষভাবে আমাদের উদ্বেগ বিবৃত করেছেন যখন এমন অবস্থায় আমেরিকান অস্ত্রাদি ব্যবহার হয়েছে। ডিপার্টমেন্ট ঘোষণা করেছে যে, এই সঙ্কট শুরু হওয়া থেকে পাকিস্তান সরকারকে কোনো অস্ত্র সরবরাহ করা হয়নি এবং পাকিস্তানে সামরিক ক্রয়ের চালানের প্রশ্নে পর্যালোচনা চলছে। পূর্ব পাকিস্তানে একটু স্বাধীন সরকার চিহ্নিতকরণে যুক্তরাষ্ট্রের এমন অনুরোধ পাওয়া থেকে উদিত হয়নি।
প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানে আসন্ন কোনো দুর্ভিক্ষের হুমকি নেই যদিও স্থানীয় খাবারের স্বল্পতা বিদ্যমান থাকতে পারে।আমরা বুঝেছি যে প্রায় ৯০০,০০০ টন খাদ্যশস্য, বড় অঙ্কের ইউএস পিএল-৪০০ গম সমেত, পূর্ব পাকিস্তান সরকারের তহবিলে,বন্দরে অথবা পথে আছে। একটি অতিরিক্ত ৩০০,০০০ টন ইউএস খাদ্যশস্য অনুমোদিত হয়েছে এবং পূর্ব পাকিস্তানের দিকে অগ্রসর হবে, যত দ্রুত সম্ভব প্রেরণ করা যায়।
|দলিল, খণ্ড ১৩, ২০৬ পৃষ্ঠা|
জরুরি প্রয়োজনে বন্দরের বর্তমান অত্যধিক ভীড় এবং পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে খাদ্য বিতরণ সমস্যা সমাধানে আমরা পাকিস্তান সরকার পর্যন্ত নিয়েছি এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমরা এই সমস্যা তুলে ধরব নিয়মিত।
‘গত তিন সপ্তাহে’ পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থার উপর ডিপার্টমেন্ট এর মুখপাত্রের করা বিবৃতির একটি সংকলনের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমি আপনার উপর বদ্ধ।জনাব এবং জনাবা স্টটলমায়ারকে উত্তর দিতে আশা করি এই তথ্য আপনাকে সাহায্য করবে। যখনই আপনি মনে করেন আমরা সাহায্য পেতে পারি অনুগ্রহ করে আমাকে স্মরণ করবেন।
বিনীত
এস ডি/
ডেভিড এম. এবশায়ার
মহাসভা সম্পর্কিত
সহকারী সচিব
পরিবেষ্টন :
১. বিবৃতির সংকলন
২. ফেরত চিঠিপত্র
.
13.54.207-211
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
সিনেটর জে ডাবলু ফুলব্রাইট কে লেখা লিখিত পররাষ্ট্র দপ্তর কর্মকর্তার পত্রগুচ্ছ | সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির রিপোর্টের পরিশিষ্ট | মে ১৩, ১৯৭১ |
(সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির রিপোর্টের পরিশিষ্ট- মে ১৩, ১৯৭১। পাকিস্থানে মিলিটারি সাহায্য প্রদান বন্ধ করার ব্যাপারে)
পররাষ্ট্র দপ্তর
ওয়াশিংটন ডিসি, এপ্রিল ২৩, ১৯৭১।
সন্মানিত জে ডাবলু ফুলব্রাইট
সভাপতি, বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটি
ইউ এস সিনেট
প্রিয় সভাপতি, মাননিয় মন্ত্রী আমাকে আপনার এপ্রিল ৬, ১৯৭১ এর চিঠির উত্তর দিতে বলেছেন যে চিঠিতে আপনি পূর্ব পাকিস্থানের অবস্থা সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আপনি আপনার চিঠিতে পূর্ব পাকিস্থানে দেয়া আমেরিকার মিলিটারি সাপ্লাইয়ের ব্যবহার সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। আপনি আরও জানতে চেয়েছেন পাকিস্থান সরকারের সাথে মিলিটারি সরঞ্জাম বিক্রির ব্যাপারে আলাপ-আলোচনার অবস্থা। যদি বর্তমানে কোন চালান থাকে সেটার সম্পর্কেও আপনি জানতে চেয়েছেন।
আমরাও আপনার সাথে উদ্বিগ্ন যে আমেরিকার দেয়া অস্ত্র পূর্ব পাকিস্থানে ব্যবহার করা হয়েছে এবং আমরা এই ব্যাপারে নিশ্চুপ নই। ২৫ শে মার্চ মিলিটারি একশন শুরু হবার পর থেকেই আমাদের মুখপাত্র সেখানে আমেরিকান অস্ত্রের ব্যবহারের ব্যাপারে আমাদের উদ্বেগ জানিয়েছে , এবং যে উদ্বেগ গোপনে আমরা পাকিস্থানকেও জানিয়েছি। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দেখা যায় যে সাম্প্রতিক সময়ে পূর্ব পাকিস্থানে কিছু M-24 ট্যাংক এবং F-86 বিমানের ব্যবহার হয়েছে। এমনও মনে হয় যে পাকিস্থানে দেয়া চীন, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পশ্চিম ইউরোপের কিছু দেশের অস্ত্রপাতিও পূর্ব পাকিস্থানে ব্যবহার করা হচ্ছে। আমাদের এসব তথ্য সরাসরি ঢাকা এবং চট্রগ্রাম থেকে প্রাপ্ত।
আমেরিকার তৈরি এই অস্ত্রগুলো সম্ভবত ১৯৫০ এর দশকের শেষের দিকে পাকিস্থানের সাথে আমাদের ‘সামরিক সহযোগিতা প্রোগ্রামের’ অধীনে দেয়া হয়েছে। আপনি জানেন হয়তো, ওই প্রোগ্রামে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষার জন্য পাকিস্থানকে সেসব অস্ত্র ব্যবহার করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। তাছাড়া ১৯৫৯-এর চুক্তি অনুযায়ী জাতীয় সার্বভৌম এবং বাইরের আক্রমন থেকে রক্ষার জন্যেও সেসব অস্ত্র পাকিস্থান ব্যবহার করতে পারবে। আমরা শুধুমাত্র পশ্চিম পাকিস্থান অংশের জন্য অস্ত্র সরবারহ করেছি, কারন প্রদেশটির উত্তর-পশ্চিম অংশেই নিরাপত্তা ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি বলে মনে হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্থান আর্মির জন্য কোন অস্ত্র দেয়া হয়নি। যায়হোক, পাকিস্থান কর্তৃপক্ষ পশ্চিম পাকিস্থান থেকে পূর্ব পাকিস্থানে অস্ত্র নিয়ে যাবার ব্যাপারে আমাদের সাথে আলোচনা করতে বাধ্য নয়। যদিও আমাদের বলা হয়নি, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আমেরিকার দেয়া কিছু অস্ত্র পশ্চিম থেকে পূর্ব পাকিস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিশেষত M-24 ট্যাংকের মত কিছু পুরনো অস্ত্র।
MAP সহযোগিতা শেষ হবার পর থেকে এবং ১৯৬৫ সালে ভারত ও পাকিস্থানে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করার পর থেকে আমরা পাকিস্থানে আর কোন মারণাস্ত্র পাঠায় নি। ১৯৬৬-৬৭ তে খুবই সীমিত আকারে দেশ দুটিতে অস্ত্র বিক্রি শুরু করার পর থেকে পাকিস্থানে নামসর্বস্ব কিছু অস্ত্র আমরা নগদ টাকার বিনিময়ে সাপ্লাই দিয়েছি যা আগে দেয়া অস্ত্রের গোলাবারুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাছাড়া যোগাযোগের জন্য কিছু জীপ, ট্রাক এবং ডাক্তারি কিছু যন্ত্রপাতি আমরা সেখানে পাঠিয়েছি। আমরা পাকিস্থানে গোলাবারুদ এখনো বিক্রি করছি যাতে করে আমেরিকার দেয়া অস্ত্রপাতিগুলো সচল থাকে এবং যাতে করে পাকিস্থান আরও টাকা-পয়সা খরচ করে আধুনিক অস্ত্র কিনতে বাধ্য না হয় যে টাকা পয়সা তারা তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ব্যবহার করতে পারত ।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আমাদের জানিয়েছে যে ২৫শে মার্চ পূর্ব পাকিস্থানে যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে পাকিস্থান সরকার বা তার কোন প্রতিনিধিকে কোন মিলিটারি জিনিসপত্র দেয়া হয়নি এবং এমন কোন চালান যাবার জন্য প্রস্তুতও নেই। আমরা দ্রুততার সাথে আমাদের মিলিটারি বিক্রয় প্রোগ্রাম পর্যালোচনা করছি।
আপনি জানেন যে, গত অক্টোবরে আমরা আমদের মিলিটারি সরবারহ পলিসিতে একবারের জন্য ব্যতিক্রম আনার ঘোষণা দিয়েছিলাম যাতে করে পাকিস্থানে আমরা সশস্ত্র জনবল বহনের গাড়ি, বোমারু বিমান এবং কিছু সামুদ্রিক টহল বিমান বিক্রি করতে পারি। এখনো এর কিছুই সরবারহ করা হয়নি, এবং এটা সরবারহ করার ব্যাপারে কোন কথাও গত ছয় সপ্তাহে হয়নি। এই ব্যাপারটাও পর্যালোচনাধীন রাখা হয়েছে।
সিনেটের কিছু সদস্য যে পাকিস্থানে আমাদের মিলিটারি সরবরাহ পলিসির ব্যাপারে উদ্বিগ্ন সে ব্যাপারে আমরা পূর্ণ সচেতন আছি। মন্ত্রনালয়ের অফিসাররা এ ব্যপারে আপনাকে এবং সিনেটের বাকি সদস্যদের যে কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রস্তুত আছে।
পূর্ব পাকিস্থানের অবস্থা নিয়ে মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের বিবৃতির একটি সংকলন আমি দিয়ে দিচ্ছি, যে সংকলনে মিলিটারি সাপ্লাই, পাকিস্থানে জীবনহানি এবং ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে অফিসিয়াল বিবৃতি , এইসব ঘটনার শিকার মানুষগুলোর প্রতি সমবেদনা, খাদ্য পরিস্থিতির তথ্য, শান্তিপূর্ণ অবস্থার পুনস্থাপনের ব্যাপারে তথ্য ইত্যাদি দেয়া আছে।
আপনার একান্ত
ডেভিড এম এবশায়ার
সহকারী সচিব, কঙগ্রেশনাল রিলেশনশিপ
পররাষ্ট্র দপ্তর
ওয়াশিংটন ডিসি, এপ্রিল ২৯, ১৯৭১।
সন্মানিত জে ডাবলু ফুলব্রাইট
সভাপতি, বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটি
ইউ এস সিনেট
প্রিয় সভাপতি, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি আমাকে আপনার ২৩শে এপ্রিল ১৯৭১ এর চিঠিটার জবাব দিতে বলেছেন, যে চিঠিতে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্থানের বর্তমান সংকট সম্পর্কে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। আমরা আপনার চিঠিটি খুবই যত্নের সাথে বিবেচনা করেছি। আমি আশা করি আপনি বুঝবেন যে মন্ত্রণালয় প্রচলিত নিয়মের ব্যাত্যয় ঘটিয়ে আপনার অনুরোধ রাখতে পারবেনা যা আমি আপনাকে ১৯৭০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বরের চিঠিতে উল্ল্যেখ করেছি। উপ-সহকারি সেক্রেটারি আগামীকালের সেশনে পাকিস্থানের ব্যাপারে কথা বলবেন। আমার তখন কমিটির সবাই সবকিছু জানতে পারবেন।
আপনার একান্ত
ডেভিড এম এবশায়ার
সহকারী সচিব, কঙগ্রেশনাল রিলেশনশিপ
পররাষ্ট্র দপ্তর
ওয়াশিংটন ডিসি, এপ্রিল ২৯, ১৯৭১।
সন্মানিত জে ডাবলু ফুলব্রাইট
সভাপতি, বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটি
ইউ এস সিনেট
প্রিয় সভাপতি, মাননীয় সেক্রেটারি আমাকে আপনার ১৯শে এপ্রিলের চিঠির উত্তর দিতে বলেছেন যেখানে কার্যনির্বাহী কমিটির বক্তব্যের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়েছে যেটাতে পাকিস্থানে সমস্ত আমারিকান মিলিটারি সহযোগিতা প্রত্যাহার করতে বলা হয়েছে, এমনকি পাকিস্থানে অস্ত্র বিক্রির সব লাইসেন্সও বাতিল করতে বলা হয়েছে ততক্ষণ পর্যন্ত “যতক্ষন পর্যন্ত পাকিস্থানের সংঘাত শেষ না হয়”।
আমি প্রথমেই বলতে চাই যে কমিটির মতই আমরাও পূর্ব পাকিস্থানের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ নিয়ে ব্যথিত, যে দেশটির সাথে আমরা দীর্ঘদিন ধরে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে চলেছি। যেমনটা আমি আপনাকে আমার ২২শে এপ্রিলের চিঠিতে লিখেছিলাম, মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আমেরিকার অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে জনসম্মুখে আমাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন । এবং একই উদ্বেগ গোপনে আমরা পাকিস্থান সরকারকেও জানিয়েছি।
এপ্রিল ২২এর চিঠিতে আপনাকে যেমনটা বলেছিলাম, আমাদের মিলিটারি সহযোগিতা প্রোগ্রাম পাকিস্থানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও বাইরে থেকে প্রতিরক্ষার জন্য অস্ত্রের ব্যবহারের ব্যাপারটি স্বীকৃতি দেয়।
যায়হোক, চলমান ঘটনাই প্রকাশ করা উদ্বেগের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ অনেক কিছুই ইতিমধ্যে করা হয়ে গেছে। আপনি জানেন, ১৯৬৫ সালের ইন্ডিয়া-পাকিস্থান যুদ্ধের পর দেশ দুটির সাথে আমরা সমস্ত সামরিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেছি। তারপর থেকেই দেশ দুটিতে আমরা কোন অস্ত্র সরবারহ করিনি। আমরা ১৯৬৫ সাল থেকে শুধুমাত্র সামান্য কিছু মিলিটারি ট্রেইনিং চালু রেখেছি যা দেশ দুইটিতে দুই লক্ষ ডলারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ । আমরা বিশ্বাস করি যে এই প্রোগ্রাম পাকিস্থান এবং আমেরিকার সামরিক বাহিনীর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করতে গঠনমূলক ভূমিকা রাখবে। আমরা আশা করি যে এই প্রোগ্রামটা চালু থাকবে এবং আমরা এটার বিরতি বা শেষ চাইনা।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আমাদের জানিয়েছে যে ২৫শে মার্চ পূর্ব পাকিস্থানে যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে পাকিস্থান সরকার বা তার কোন প্রতিনিধিকে কোন মিলিটারি জিনিসপত্র দেয়া হয়নি এবং এ ধরনের সরবরাহের বিষয়টি পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
তাই চলমান ঘটনা প্রবাহে মিলিটারি প্রোগ্রাম পুরোপুরি প্রত্যাহার করলে পূর্ব পাকিস্থানে সামরিক অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হবেনা এবং এটা পাকিস্থানের সাথে আমাদের রাজনৈতিক সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটাতে পারে। তাই আমাদের মনে হয় পাকিস্থানের সাথে সামরিক সরবারহ প্রোগ্রাম চালু রাখার ব্যাপারে আমাদের কিছুটা নমনীয় হওয়া উচিত যাতে করে আমরা পাকিস্থানের সাথে একটা টেকসই সম্পর্ক চালু রাখতে পারি, যে সম্পর্ক সাম্প্রতিক যুদ্ধে বিপন্ন মানুষ গুলোকে সহযোগিতা করতে এবং তাদের স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে।
তাই আমাদের মনে হয় পাকিস্থান কে সীমিত পরিমাণে মিলিটারি সরঞ্জাম দেওয়া চালু রাখা উচিত যাতে করে আমাদের দ্বীপাক্ষীয় সম্পর্ক গঠনমূলক ভাবে চালু থাকে এবং পাকিস্থান অন্য দেশের উপর নির্ভর হতে বাধ্য না হয়।
তাই আমাদের মনে হয় “পূর্ব পাকিস্থানের সমস্যা যতদিন শেষ না হয়” নামে যে শব্দ গুচ্ছ ব্যবহার করা হচ্ছে তা অযৌক্তিক এবং তা বাস্তবায়ন অসম্ভব। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে পূর্ব পাকিস্থানের সংঘর্ষ এখন অনেকটাই প্রশমিত হয়ে গেছে এবং পূর্ব পাকিস্থানের বেশিরভাগ অংশ এবং বেশিরভাগ মানুষের উপর পাকিস্থান সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পাকিস্থান সরকারের অফিশিয়াল বক্তব্য হচ্ছে পূর্ব পাকিস্থানের সশস্ত্র সংঘর্ষ শেষ হয়ে গেছে এবং সেখানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনার কাজ করা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জনগনের নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ইচ্ছা পূনর্ব্যক্ত করেছেন। এই পরিস্থিতিতে সব চেয়ে কঠিন সমস্যা হচ্ছে পাকিস্থানের অবস্থা সত্যিকার অর্থেই কবে ঠিক হবে তা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব না।
আমি আশা করি নির্বাহী বিভাগের এই বক্তব্য আপনার উপকারে আসবে। এই রিপোর্টটি জমা দেবার ব্যাপারেও আমাদের কোন আপত্তি নেই।
আপনার একান্ত
ডেভিড এম এবশায়ার
সহকারী সচিব, কঙগ্রেশনাল রিলেশনশিপ
.
13.55.212-213
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
মার্কিন সরকারের শরণার্থী ত্রাণ কার্যক্রম সংক্রান্ত বিবৃতি | পররাষ্ট্র দপ্তর | ১৮ মে, ১৯৭১ |
পূর্ব পাকিস্তানের মানবিক এবং উদ্বাস্তু পরিত্রাণ প্রচেষ্টার উপর ভারতের একটি বিবৃতি।
১৮ মে,১৯৭১
যুক্তরাষ্ট্রের সরকার দূর্ভোগ এবং অসচ্ছলতা নিয়ে গুরুত্বের সাথে উদ্বিগ্ন হয়ে পরেছেন যেটি পূর্ব পাকিস্তানে বেসামরিক বিশৃঙ্খলার উদয় ঘটিয়েছিল।
এই সমস্যার দুইটি দৃষ্টিকোণ থেকে জড়িত অামাদের নির্দিষ্ট মনোযোগের প্রথমটি হলো চুক্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠা যেটিতে নির্বাসনের পুনরুদ্ধারে প্রশাসন এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক কার্যকলাপে অনুমতি দেওয়া হবে যাতে খাদ্য বন্টন এবং অন্যান্য অপরিহার্য সেবা পুনরায় শুরু করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, উদ্বাস্তু যারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে গেছে তাদের তদারক করতে হবে।যত দ্রুত সম্ভব অামরা অামাদের উদ্বেগ সর্বসমক্ষে এবং গোপনে প্রকাশ করেছিলাম শান্তিপূর্ণ বাসস্থানের যেটি পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক জীবন ধারনের অনুমতি মিলবে এবং উদ্বাস্তুরা নিজেদের ঘরে ফিরবে।
পরিত্রাণ প্রচেষ্টার মত লোকহিতকর কাজে পাকিস্তান ও ইন্ডিয়ার সাথে অামরা অালোচনা করেছি এবং অান্তর্জাতিক সংস্থা ও অন্যান্য অাগ্রহী দেশসমূর্হকে অাকস্মিক ঘটনার পরিকল্পনায় যথাযথ দায়িত্ব গ্রহনে অাহবান জানিয়েছি। এই একটি সমস্যা মূলত সরকারের প্রধান সমস্যা হিসেবে অামরা স্বীকৃতি দিয়েছি এবং জনগন অবিলম্বে তা সমাধানে উদ্বিগ্ন। তাদের প্রচেষ্টা অপরিহার্য কিন্তু অান্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের প্রচেষ্টায় এবং তাদের সম্পদ প্রতিস্থাপনে মহান সহায়ক হতে পারে।
পূর্ব পাকিস্তানের জন্য অান্তর্জাতিক মানবিক মুক্তির পহেলা এপ্রিলের উৎসর্গে জাতিসংঘ মহাসচিব উ-থান্টস এর সাথে অামরা নিজেদেরকে সর্বসমক্ষে এবং গোপনে যুক্ত করেছি।পাকিস্তানের সরকারের সাথে অামরা বারবার অালোচনা করেছি।
সচিব রজার বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ২৭ শে এপ্রিল একটি বার্তায় সাধারন সভায় যোগদান করেন। মানবিক সহায়তায় তার প্রস্তাব তিনি পুনঃঅারম্ভ করার পরামর্শ দিয়েছেন।
বন্টনের ৭.৫ মিলিয়নের উপর এবং ১০০ মিলিয়নের বেশী মার্কিন মালিকানাধীন পাকিস্তানি মুদ্রা পুনর্বাসন প্রকল্পের জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুত করেছিলেন। ঘূর্নিঝড়ে দুর্যোগপূর্ন এলাকায় পুনর্বাসনের জন্য চুক্তির সাথে দ্রুত খাদ্য শস্যের ১৫০০০০ টন প্রদানের জন্য অামরা সামনের দিকে এগুতে পারি। অামরা অারো দ্রুত ১৭০০০০ টন গম দখলের জন্য মোটামুটি পূর্ব পাকিস্তানের পূর্বের চুক্তির ভারসাম্যে রাখতে প্রস্তুতি নিয়েছি। যত দ্রুত সম্ভব বন্দরে প্রেরণ করতে এবং বিতরন সুবিধার জন্য অনুমতি নিতে হবে।
পূর্ব পাকিস্তান থেকে বহু সংখ্যক উদ্বাস্তু ইন্ডিয়ায় চলে গেছে। ইন্ডিয়ার সরকার ইতিমধ্যেই অান্তর্জাতিক সহায়তার জন্য অনুরোধ করেছিলেন এবং তিনি উদ্বাস্তুদের সাহায্য করতে ক্রোড়পত্রে এটি নিজেদের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা হিসেবে তিনি বিভিন্ন দেশ থেকে দ্বিপার্শ্বিক সহায়তা চেয়েছিলেন। উদ্বাস্তুদের অান্তর্জাতিক মুক্তি প্রচেষ্টার সমর্থনে অামরা নেতৃত্ব দিয়েছি যেটি জাতিসংঘের হাই কমিশনার দ্বারা সংগঠিত হয়েছিল। অামরা খুব অান্তরিকভাবে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচীর সাথে কাজ করছি যেটি মুক্তি প্রচেষ্টায় জাতিসংঘের হাই কমিশনারের সাথে অারো সহযোগী হবে।
যত দ্রুত সম্ভব ইন্ডিয়ার মার্কিন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মধ্যে ক্রমবর্ধমান উদ্বাস্তুর স্রোতের সংখ্যা অটলভাবে বলিষ্ঠ করতে অামরা একটি কর্মসূচী শুরু করেছি।এই সপ্তাহের সবশেষে অামরা একটি ক্যাথলিক ত্রান সেবা “কেয়ার” বিশ্বের গির্জা সেবার জন্য অপেক্ষা করেছি। এবং লুথেরান বিশ্ব সংঘ যত বেশী সম্ভব ৩০০০০০ উদ্বাস্তুদের “পি এল- ৪৮০ খেতাব খাদ্য অাইটি” ব্যাবহার করে প্রতিপালন করবে।এই জন্য এবং অন্যান্য মুক্তির উদ্দেশ্যে অামাদের অাছে অনুমোদিত ২.৫ মিলিয়নের বেশী খাদ্য এবং অন্যান্য সহায়তা অামাদের প্রাথমিক অবদান হিসেবে জরুরী মুক্তি কার্যকলাপকে সচল করতে পথ খুঁজে পেয়েছি। যখন অান্তর্জাতিক মুক্তি প্রচেষ্টা সংগঠিত হচ্ছে একটি “ইউ এন এইচ সি অার ” দল হিসেবে সম্প্রতি ভারতে মুক্তির প্রয়োজনে পরিমাপন দরকার। অামরা বিবেচনা করব কি ধরনের অতিরিক্ত অবদান অামাদের গ্রহন করতে হবে যখন এই দল এটির অাবিষ্কারকে রিপোর্ট করেছে।
.
13.56.214-216
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
ড: গ্রীনোর উদ্দেশে পররাষ্ট্র দপ্তর কর্মকর্তার চিঠি | পররাষ্ট্র দপ্তর | ২৬শে মে, ১৯৭১
|
ষ্টেট ডিপার্টমেন্ট
ওয়াশিংটন ডিসি, ২০৫২০
২৬শে মে, ১৯৭১ ড:উইলিয়াম বি. গ্রীনো- ৩য় প্রধাণ, সংক্রামক ব্যাধি বিভাগ
স্কুল অব মেডিসিন দ্যা জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি হসপিটাল
বাল্টিমোর, মেরিল্যান্ড ২১২০৫
প্রিয়ড:গ্রীনো,
গত ৬ই মে আপনি সেক্রেটারি রজার্স বরাবর ড: মিল্টন আইজেনহাওয়ার মারফত প্রেরিত পত্রে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির নানা দিক সম্পর্কে আপনার যেসব মতামত ব্যক্ত করেছেন সেই প্রসঙ্গে সেক্রেটারি সাহেব আমাকে তার জবাব দিতে বলেছেন।
সর্ব প্রথম আমাকে বলতে দিন যে, চিঠিতে লেখা আপনার চিন্তাকর্ষক ও বিশ্লেষণধর্মী ভাবনাগুলো আমরা অত্যন্ত আগ্রহ আর আন্তরিকতার সাথে পাঠ করেছি, এটা সত্যিই প্রশংসনীয়। আমাদের বৈদেশিক সম্পর্ক সংক্রান্ত এধরণের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সুশীল আমেরিকান নাগরিক মতামতকে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিয়ে থাকি।
পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক অবনতিশীল সংঘাতময় পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনি যে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তা নিশ্চিতভাবেই বোধগম্য, বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঢাকা ও কলকাতায় স্বাস্থ্য গবেষণা ও মাঠ প্রশিক্ষণে নিয়োজিত আপনার সহকর্মীদের কাছ থেকে যেসব তথ্য আপনি সরাসরি পেয়েছেন তার আলোকে তো বটেই। আমাদের ষ্টেট ডিপার্টমেন্টও আপনার সাথে সমভাবে উদ্বিগ্ন এবং পূর্ব পাকিস্তানে বিগত মার্চ থেকে শুরু হওয়া গৃহদ্বন্দের পর থেকে আমরা নিষ্ক্রিয় বা নিশ্চুপ থাকিনি। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমাদের মুখপাত্র এই বিষয়টির নানা দিক তুলে ধরে বহুবার অফিশিয়াল ষ্টেটমেন্ট দিয়েছেন। যেহেতু এই বক্তব্যগুলোর সবকটিই প্রচার পায়নি যেটা পাওয়ার যোগ্য ছিল বলে আমরা মনে করি, ফলে আপনার জন্য এসব বক্তব্যের কিছু সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরা আমার পক্ষে সহায়ক হবে বলে মনে করছি।
পূর্ব পাকিস্তানে গৃহদ্বন্দ ছড়িয়ে পড়ার পর সেখানে সংঘটিত প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে আমরা আমাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছি এবং সেখানে শান্তিপূর্ণ অবস্থা পূনরায় ফিরে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছি। এসব ঘটনার শিকার সকলের প্রতি বমরা আমাদের সহানুভূতি বাড়িয়ে দিয়েছি। আমরা আমাদের বিশ্বাসকে জোরালো করে বলেছি যে, সংঘাতের অবসান ঘটাতে এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান অর্জনে পাকিস্তান সরকারের সকল সম্ভাব্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ। এসব ঘটনার কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের দুর্ভোগ লাঘবে যে কোন আন্তর্জাতিক মানবিক ত্রাণ তৎপরতায় আমাদের সহায়তা দেওয়ার ইচ্ছার কথা আমরা ঘোষণা করেছি। ইতোমধ্যেই আমরা পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে পাড়ি জমানো অসংখ্য উদ্বাস্তুর নুকট উল্লেখযোগ্য ত্রাণ সহায়তা বাড়িয়ে দিচ্ছি এবং অনুরোধ পাওয়া মাত্র পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছে জরুরী সহায়তা পৌঁছে দিতে প্রস্তুত আছি। এছাড়াও আমরা এই বিষয়গুলো নিয়ে পাকিস্তান সরকারের সাথে বিস্তারিত আলোচনা করেছি এবং তা বাস্তবায়নের জন্য চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।
আপনার চিঠিতে তুলে ধরা কিছু সুনির্দিষ্ট প্রসঙ্গের প্রেক্ষিতে আমি আপনাকে আস্বস্ত করে বলতে চাই যে, ডিপার্টমেন্ট এই ধরণের যৌক্তিক চিন্তা ভাবনাগুলোকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিয়েছে। আমি বিশ্বাস করি সবচেয়ে সহায়ক যে পথে আমি এই প্রত্যুত্তর দিতে পারি তা হলো আমাদের বৈদেশিক সম্পর্কের এই কঠিন ও জটিল সমস্যার বিভিন্ন দিকের প্রেক্ষাপটে কোন কোন অবস্থান নেয়াকে আমরা যথাযথ মনে করছি তা আপনার কাছে ব্যাখ্যা করা এবং এটাকে মোকাবেলা করতে যেসব পদক্ষেপগুলো আমরা নিচ্ছি তার কিছু উল্লেখ করা।
এই পরিস্থিতিতে উদ্ভূত রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক যেসব জটিলতার প্রতি আপনি ইঙ্গিত করেছেনন আমরা অবশ্যই সেসব বিষয়ে পুরোপুরি অবগত আছি। তবে একটি সরকার হিশেবে অন্যদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা এড়িয়ে চলার জন্য আমাদেরকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়, ঠিক যেরকমভাবে আমরা চাই না যে তারাও আমাদের কোন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করুক। আপনি জানেন যে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার পাকিস্তান সরকারের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করে চলে যারা দেশটির উভয় অংশেই বিচারিক ও নির্বাহিক নিয়ন্ত্রণ পরিচালনা করছে। সেজন্য আমরা পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোকে আবশ্যিকভাবেই তাদের একান্ত আভ্যন্তরিক বিষয় হিশেবে দেখছি এবং এগুলো নিয়ে পাকিস্তানীরা নিজেরাই তাদের করণীয় ঠিক করবেন। এটয় আমাদের একান্ত আশা যে, স্বাভাবিক কূটনৈতিক চর্চার পরিমণ্ডলে থেকে আমাদের নীতিমালা ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মানবিক দুর্ভোগ সম্ভাব্য অনেকটা কমিয়ে আনা ও একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরীতে ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সকলের কাছেই আমরা সহায়ক হয়ে উঠতে পারবো। সংঘাতের দুই পক্ষেই মানুষের প্রাণহানি ও ধংসের মতো বিয়োগাত্মক ঘটনাগুলো ঘটছে, আমি আপনার সাথে একমত যে এই অবস্থার উত্তরণে করণীয় কি কি হতে পারে সামনে তার উপায় আমাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে।
অর্থনৈতিক সহায়তার প্রসঙ্গে আমি বলতে চাই যে, দানগ্রাহী দেশগুলোর জনগণের সুবিধার্থে নির্দিষ্ট কিছু উন্নয়ন লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্যই আমাদের কর্মসূচীগুলো প্রণয়ন করা হয়েছে। অন্যান্য সরকারগুলোর উপর রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের উদ্দেশ্যে এগুলো যেমন সম্প্রসারণ করা যায় না, তেমনি প্রত্যাহারও করা যায় না। আমাকে অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাতে হচ্ছে যে, পূর্ব পাকিস্তানেরর পরিস্থিতির কারণে সেখান থেকে আমাদের অনেক সহায়তা কর্মসূচী কাটছাঁট করতে হয়েছে এবং আমরা আশা করি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বা পরিস্থিতি অনুকূল হলে আবারও সেগুলোকে আমরা শুরু করতে পারবো। পাকিস্তানেরর সম্ভাব্য স্থলগুলোতে আমরা একদিকে যেমন বিদ্যমান কর্মসূচীগুলো চালিয়ে নিচ্ছি, পাশাপাশি এসবের প্রতিষ্ঠিত উন্নয়ন মানদণ্ড পূরণ নিশ্চিত করতে পর্যবেক্ষণ যাচাই-বাছাই অব্যাহত রেখেছি। আমাদের জানা মতে পূর্ব পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধের কোন পক্ষের সামরিক কর্মকাণ্ডে সহায়তার জন্য আমাদের আর্থিক সহায়তা ব্যবহৃত হচ্ছে না।
আমি আপনার সাথে একমত যে, আমাদের সবার এখন যেই বিষয়টির উপর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে তা হলো পূর্ব পাকিস্তানের মানবিক দুর্যোগ লাঘবে ত্রাণ তৎপরতা শুরু এবং সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের আগমন প্রতিরোধসহ শান্তিপূর্ণ অবস্থা ফিরে আসার সহায়ক একটি আবহ তৈরি করে একটি রাজনৈতিক সমাধানের দিকে অগ্রগতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আমি আপনাকে আস্বস্ত করতে চাই যে, এরকম একটি ত্রাণ কর্মসূচী এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে মার্কিন সরকার সক্রিয় রয়েছে। গত মাসে জাতিসংঘের মহাসচিব কর্তৃক প্রণীত আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা প্রচেষ্টায় আমরা অত্যন্ত দ্রুততার সাথে নিজেদেরকে সংগঠিত করে নিয়েছি। আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী থেকে সহায়তা কর্মসূচী গ্রহণ করার জন্য পাকিস্তান সরকারকে আমরা চাপ দিয়েছি। আমরা খুব উদ্বেলিত হয়েছি যখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া মহাসচিব উথান্ট অবহিত করে বলেছেন যে তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে আসা সাহায্যকে স্বাগত জানাবেন এবং বর্তমানে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে চাহিদার পরিমাণ নিরুপন করছেন। আমরা এই বিষয়গুলো অত্যন্ত নিবিড়ভাবে অনুসরণ করছি এবং এরুপ একটি আন্তর্জাতিক ত্রাণ তৎপরতায় যেসব সামগ্রী আমাদের দেয়া লাগতে পারে সেসব জিনিস আমরা এখন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সংগ্রহ করছি।
সবচাইতে ভালো প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানের কয়েক মাসের কাঙ্ক্ষিত চাহিদা মেটানোর মতো পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ রয়েছে এবং সেখানকার বন্দর ও অভ্যন্তরীণ পরিবেশন ব্যবস্থাগুলো অনুমোদন করলেই সেখানে অতিরিক্ত সরবরাহ পাঠানো হবে। খাদ্যের প্রতীক্ষায় থাকা মানুষের কাছে যেন খাবার পৌঁছে দেয়া যায় সেজন্য বন্দর ও বিতরণ সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা যা করতে পারি তা করার জন্য অন্যান্য আগ্রহী দেশগুলোকে সাথে নিয়ে আমরা এখন তৈরি হচ্ছি।
ভারতীয় অঞ্চল অতিক্রম করা অসংখ্য উদ্বাস্তুর সহায়তার জন্য আমীা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি। সেখানে প্রায় ৩,০০,০০০ উদ্বাস্তুর খাদ্য যোগান দিতে তাৎক্ষণিক চাহিদা মোকাবেলায় সেখানে পিএল-৪৮০ শীর্ষক ২য় ষ্টক থেকে খাদ্য সংগ্রহ করার জন্য আমরা তিনটি আমেরিকান স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে ভারতে নিযুক্ত করেছি। উদ্বাস্তুদের জন্য জাতিসংঘ দূত কর্তৃক আয়োজিত একটি আন্তর্জাতিক ত্রাণ প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণের জন্যও আমরা তৈরী হচ্ছি।
আপনি যেমনটা উল্লেখ করেছেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলীয় অঞ্চল যেগুলো গত নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ে বিলীন হয়ে গেছে সেখানে ত্রাণ ও পুনর্বাসন শুরুর ক্ষেত্রে আমাদের ধারাবাহিক বিশেষ আগ্রহ আছে।আমাদের ব্যাপক পিএল-৪৮০ খাদ্যশস্য সহায়তার অনেক অংশই এখনও দেয়ার বাকি রয়ে গেছে, এর বাহিরেও এইড এবং বেশ কিছু সংখ্যক আমেরিকান স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় পুনর্বাসনের জন্য বিভিন্ন প্রকার সাহায্য সহযোগিতা বাড়িয়ে দিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে গৃহদ্বন্দ ছড়িয়ে পড়ার পূর্বে এরকম অনেক পরিকল্পিত কর্মসূচীই সেখানে চালু হওয়ার প্রস্তুতি নিতে সক্ষম হয়নি । এসব অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ করতে পারা মাত্র ইতোমধ্যে শুরু হওয়া ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মসূচীগুলো পুনরায় চালু করা যাবে বলে আমরা আশা করি। এছাড়াও আমরা যেসব অঞ্চলে অতিরিক্ত কর্মসূচী চালুর লক্ষ্যে গঠিত ডলার ও রুপী তহবিল থেকে অর্থ সংগ্রহের আশা করি, যার উপর সরকারের সাথে আমাদের আলোচনা এখনও শেষ হয়নি। ইতোমধ্যে আমরা পূর্ব পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক ত্রাণ তৎপরতা চালু হওয়া মাত্র ঘূর্ণি দুর্গত অঞ্চলে খাদ্য সামগ্রী পৌছানোর দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিচ্ছি।
সামরিক সরবরাহ প্রসঙ্গে বলতে চাই, পূর্ব পাকিস্তানে আমেরিকান কিছু কিছু অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে এবং পাকিস্তানের সাথে খুব গোপনে কাজ করেছি বলে যে খবর বেরিয়েছে সে বিষয়ে আমাদের মুখপাত্ররা যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের কথা প্রকাশ করেছেন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের সাথে আমাদের সামরিক সহায়তা কর্মসূচী বাতিল হওয়ার পর থেকে আমরা পাকিস্তানে এরুপ অস্ত্র সরবরাহের জন্য কোন অর্থ বরাদ্দ করিনি এবং এর পর থেকে আমরা পাকিস্তানে কোন ধরণের অস্ত্র বিক্রি করিনি। ১৯৬৭ সাল থেকে আমরা পাকিস্তানের সাথে একটি সীমিত সামরিক বিক্রয় কর্মসূচী পরিচালনা করছি যার আওতায় পাকিস্তানকে আমরা কিছু আক্রমণাত্মক যন্ত্রপাতি, গোলাবারুদ ও পূর্বে সরবরাহ করা যন্ত্রপাতির খুচরা যন্ত্রাংশ দিয়ে আসছি। প্রতিরক্ষা দপ্তর আমাদেরকে অবহিত করেছে যে, সংকট শুরুর পর থেকে এই বিক্রয় কর্মসূচীভূক্ত কোন জিনিসই পাকিস্তানকে দেয়া হয়নি এবং পাকিস্তানের কাছে সমরাস্ত্র বিক্রির প্রশ্নটি তাদের পর্যালোচনায় রয়েছে।
পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতির উপর আমাদের মুখপাত্ররা গত দু’মাস ধরে যেসব অফিশিয়াল বিবৃতি দিয়েছেন তার একটি সংকলন আপনার তথ্যসূত্রের জন্য এতদসঙ্গে সংযুক্ত করা হলো। এছাড়াও পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে পাড়ি দেয়া উদ্বাস্তুদের সহ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জন্য আমরা যেসব মানবিক ত্রাণ প্রচেষ্টা নিচ্ছি এবং নেয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি, সে সংক্রান্ত একটি বিবৃতিও সংযুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আমি আশা করি এসব তথ্য পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতির বিষয়ে আমাদের অবস্থান সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা পেতে এবং এ বিষয়ে আমরা যেসব পদক্ষেপ নিয়েছি ও নেয়ার পরিকল্পনা করছি, তা বুঝতে আপনার জন্য সহায়ক হবে।
বিনীত,
ক্রিস্টোফার ভ্যান হলেন
উপ-সহকারী সচিব
নিকট পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়া
বিষয়ক ব্যুরো।
সংযুক্তি:
১। বিবৃতির সংকলন
২। মানবিক ত্রাণ প্রচেষ্টা সংক্রান্ত বিবরণী
.