You dont have javascript enabled! Please enable it!

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৫১। মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির অধিবেশনে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানে বিলম্বের সমালোচনা স্টেটসম্যান ১৮ জুন, ১৯৭১

স্বীকৃতি “প্রত্যাগমন“ ইস্যুতে কেন্দ্রের সমালোচনা
(সি পি আই – এম – রেজোল্যুশন)

কোয়েম্বাটর, ১৭ জুন -মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির পলিব্যুরো বাঙ্গলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি বিলম্বের প্রশ্নে ভারত সরকারের সমালোচনা করেছেন এবং একটি রাজনৈতিক সমাধান খুজে বের করার ব্যাপারে জোর দিয়েছেন – খবর পি টি আই।

দলের শীর্ষ নীতিনির্ধারণকারী অংশ – পলিবুরো – গতকাল অধিবেশনে বলেছে সরকার স্পষ্টতই আমেরিকা এবং অন্য কিছু মহলের চাপে আছে।

নীতি নির্ধারণী সদস্যদের আটজনের অংশগ্রহণে দীর্ঘ রুদ্ধদার বৈঠক হয়েছে। একমাত্র জনাব বি টি রান্দিভ, যিনি অসুস্থ ছিলেন বলে অনুপস্থিত ছিলেন। দলীয় বিবৃতি গত রাতে সংবাদ্ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থতা এবং বাংলাদেশকে সবরকম উপকরণ সহায়তা প্রদান না করায় বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রাম ভীষণভাবে ব্যহত হচ্ছে এবং বাংলাদেশ থেকে ভারতে ৫ মিলিয়ন উদ্বাস্তু হিসেবে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছে। এই বিশাল উদ্বাস্তুর অন্তঃপ্রবাহ ভারতে এবং বিশেষ করে পশ্চিম বঙ্গ ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয়ে বড় ধরনের সমসা তৈরি করেছে। এর জন্য ভারত সরকার দায়ী কারণ তারা বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিতে ব্যার্থ হয়েছে এবং এবং পূর্ববাংলায় পর্যাপ্ত সকল সরবরাহ সহায়তা প্রদানে ব্যার্থ হয়েছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৫২। পাকিস্তানের মার্কিন অস্ত্রের বিরুদ্ধে কোলকাতার ইয়থ ফর বাংলাদেশ এর উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড ২০ জুন ১৯৭১

পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র চালানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ

বুধবার সন্ধ্যায় ”ইয়োথ ফর বাংলাদেশ” এর উদ্যোগে কলকাতা’র USIS (United States Information Service) center এর সামনে এক ব্যাপক বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। তারা শ্লোগান দিতে থাকে যে, এ মুহূর্তে পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্রের চালান একটি গোপন কূটকৌশল। তা সত্ত্বেও মার্কিন সরকার ঘোষণা পাকিস্তানের প্রস্তাবিত অস্ত্র সরবরাহ করা হবে।

”ইয়থ ফর বাংলাদেশ” এর সম্পাদক জনাব ভজণ নাগ মিছিলে উপস্থিত ছিলেন। USIS এর কার্যালয়ে বিক্ষোভ এর দাবি-দাওয়া সংবলিত একটি কপি দেয়া হয়েছে মার্কিন সরকার বরাবর পৌঁছে দেবার জন্য।

”ইয়োথ ফর বাংলাদেশ” এর সভাপতি জনাব মিহির সেন এক বিবৃতিতে নিক্সন প্রশাসনের দু-মুখো কূটনীতি ও হৃদয়হীন পক্ষপাতদুষ্ট মতবাদ এর নিন্দা করেন।

সেন বলেন, ”একদিকে আমরা মার্কিন বিমান সি-১৩০ এর দুর্বোধ্য ব্যবহার এর সম্মুখীন হচ্ছি, যা কিনা পাকিস্তানী মিলিটারি দের অত্যাচারে পীড়িত মানুষদের জন্য ত্রাণ সরবরাহ করছে। অন্যদিকে, দ্রুত গতিতে গুপ্তভাবে পাকিস্তানে প্রবেশ করছে মিলিটারি বিমান। যা কিনা আরও অনেক বাঙালী কে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে লক্ষ মানুষকে শরণার্থী করছে।

”মার্কিন সরকারের এই বিশ্বাসঘাতকতা অবশ্যই বিশ্ব রাজনীতিতে দু-মুখো কূটনীতি ও ত্রুটিপূর্ণ সিনিক মতবাদের সবচেয়ে জঘন্য দৃষ্টান্ত হয়ে রবে। ”

”আমদের দাবী – মার্কিন সরকার ওই দুই জাহাজের সমস্ত মাল করাচী পৌঁছানোর আগেই স্থগিতাদেশ দিতে হবে এবং তাছাড়াও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পর্যন্ত কোনো প্রকার অস্ত্র বা অস্ত্রের সরঞ্জামের চালান না আসার দায়িত্ব ও নেবে।”
জনাব সেন আরও বলেন, ”মার্কিন উপকরণ সমূহ কে শরনার্থীদের সাহায্যের জন্য গ্রহন করার পূর্বে তারা যেনো আমাদের উল্লেখিত দাবী-দাওয়া গুলো মেনে নেয়, ভারত সরকার কে অবশ্যই তা নিশ্চিত করতে হবে।”

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৫৩। বাংলাদেশের ওপর দক্ষিণ_পুর্ব এশিয়ার নিরাপত্তার প্রশ্ন নির্ভর করছে বলে সিঙ্গাপুরে জয়প্রকাশ হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড ২৫ জুন ১৯৭১

তানভীর আহমেদ নোভেল
<১২, ১৫৩, ৪০৮-৪০৯>
অনুবাদ

বাংলাদেশের পরিণিতির সাথে জড়িয়ে রয়েছে এশিয়ার নিরাপত্তাঃ জয়প্রকাশ।

জুন ২৪, সিঙ্গাপুর। সূত্রমতে ভারতীয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ আজ এক বার্তায় সতর্ক করে বলেন, যদি পূর্ববাংলা’র রাজনৈতিক সমস্যার দ্রুত সমাধান না হয় তবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ_পুর্ব এশিয়ার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবেনা।

প্রেস কনফারেন্সে তিনি বলেন বড় শক্তিধর দেশগুলোর উচিৎ পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা এড়ানোর জন্য সেখানে রাজনৈতিক সমাধান করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে চাপ দেয়া।

তিনি বলেন পুর্ব পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধ ভারতের উপর অর্থণৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব ফেলবে।

জেলে থাকা শেখ মুজিবকেও মুক্তি দিতে হবে। পাকিস্তান সরকারের উচিৎ রহমান সাহেবের সাথে আলোচনায় বসা। তিনিই পূর্ব পাকিস্তানের মূল প্রতিনিধি।

আমার সন্দেহ আছে যে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা ছাড়া আর কোন শর্তে রাজি হবে কিনা। এর আগে বলা হয় পাকিস্তান এখন মৃত।

বাঙ্গালীদের আন্দোলন আর পাকিস্তানীদের নির্যাতনের কথা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন – তারা এখন এই ব্যাপারে সজাগ। তবে অনেকে জাতীয়তাবাদীতে তেমন বিশ্বাস করেন না এবং মনে করেন মিলিটারিরা তাদের দমিয়ে ফেলতে পারবে।

কিন্তু মনে রাখবেন, ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ার ৯০ ভাগ আন্দোলন বাংলাদেশ থেকেই শুরু হয়েছিল।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। পাকিস্তান এটা যত দ্রুত অনুধাবন করতে পারবে ততই মঙ্গল।

বাংলাদেশের স্ট্রাটেজিক অবস্থান সম্পর্কে দক্ষিণ এশিয়া অবগত। যদি তাদের আন্দোলন ব্যার্থ হয় তবে মাওবাদীরা তাদের এই শূন্যতা পূরণ করবে।

বাঙ্গালী সৈন্যরা বাইরে থেকে অস্ত্র পাচ্ছে কিনা জানতে চাইলে জনাব নারায়ণ বলেন, হ্যা, লন্ডনে আমি কিছু লোকের সাথে পরিচিত হয়েছি যারা অস্ত্র কেনার জন্য টাকা সংগ্রহ করছিল।

পাকিস্তানে অ্যামেরিকার অস্ত্র চালানের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি আবেদন করেন অ্যামেরিকার উচিৎ পাকিস্তানকে সকল প্রকার সামরিক সহায়তা দেয়া বন্ধ করা – যতক্ষণ মার্শাল রুল না থামে এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়।

বৈরুতে ভারতের কৃষিমন্ত্রী জনাব ফখরুদ্দিন আলী আহমেদ গতকাল পশ্চিম এশিয়ার ৪ টি দেশ সফরকালে বাংলাদেশের অবস্থা ও প্রায় ৬ মিলিয়ন শরনার্থদের জন্য ভারতে সৃষ্ট সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করতে আসেন।

শুক্রবার তিনি লেবাননের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে দেখা করবেন।

পূর্ব বার্লিনে, ভারতের ট্যুরিজম ও সিভিল এভিয়েশন মন্ত্রী ডাঃ কারান সিং বলেন ভারত শরনার্থিদের দায় নেবেনা – যারা সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে এসেছে।

ভারত এত লক্ষ লক্ষ শরনার্থিদ্র দায়িত্ব নিতে পারবেনা। ঘনবসতিপূর্ন এলাকায় তারা বন্যার স্রোতের মত ঢুকে পড়ছে – গতকাল একথাই বলেন তিনি – খবর জার্মান নিউজ এজেন্সির।

এদের পুর্ব বাংলায় ফিরে যাবার জন্য তেমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।

কারান সিং ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে সফরে এসে জানান পুর্ব জার্মানির প্রধানমন্ত্রী জনাব উইলি স্টোফন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব অট্ট উইঞ্জারের সাথে তাদের আলোচনা সফল হয়েছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৫৪। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রস্তাবঃ ‘বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও সামরিক শিক্ষা সহ সর্বপ্রকার সাহায্য দিতে হবে’। কালান্তর ২৬ জুন, ১৯৭১

Russell Rahman
<১২, ১৫৪, ৪১০-৪১১>

অস্ত্র, সামরিক শিক্ষা ও সর্বপ্রকার সাহায্য দিতে হবে
বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির দাবী

“বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও সামরিক শিক্ষা সহ সর্বপ্রকার সাহায্য করতে হবে”- ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিম বঙ্গ রাজ্য পরিষদের এক বিবৃতিতে এই দাবী করেন। বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য ভারত সরকারের সমালোচনা করা হয়েছে এবং অবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য দাবী জানানো হয়েছে। বাংলাদেশের সমস্যাকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখার জন্য এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা ও শরণার্থীদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, সমর্থক এবং জনসাধারণ কে আবেদন জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি জাতীয় সংহতিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বনের জন্য প্রধানমন্ত্রী কে মূখ্যমন্ত্রী সম্মেলন আহবানের জন্যেও পার্টি দাবী জানিয়েছেন।

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পরিষদ গত ১৬ ও ১৭ জুন তারিখে দুইদিন ব্যাপী অধিবেশনে মিলিত হন। এই অধিবেশনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক শ্রী রাজেশ্বর রাও এবং কেন্দ্রীয় সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য শ্রী ভবানী উপস্থিত ছিলেন। রাজ্য পরিষদের এই সভায় রাজ্য জুড়ে যে নৃশংস ভ্রাতৃঘাতী আন্তঃপার্টি সংঘর্ষ চলছে সে বিষয়েও আলোচনা হয় এবং এই হানাহানি বন্ধের জন্য কিছু কার্যকরী ব্যবস্থা সম্পর্কেও এই সভায় আলোচনা হয়।

অধিবেশন শেষে এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থন ও সংহতি জানানো সারা ভারতবর্ষের জনগণের এখন জরুরী কর্তব্য বলে কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিম বঙ্গের রাজ্য পরিষদ মনে করেন। প্রায় ষাট লক্ষাধিক মানুষ ইয়াহিয়া চক্রের অত্যাচারের মুখে দেশ ছেড়ে এই দেশে শরণার্থী হিসেবে এসেছেন। মুক্তিযোদ্ধারা যাতে তাদের দেশকে যথাসত্ত্বর মুক্ত করতে পারে তাঁর জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র, সামরিক শিক্ষা ও অন্যান্য সম্ভাব্য সর্বপ্রকার সাহায্য করতে হবে। এর ফলেই গৃহহীন মানুষ তাদের ঘরে ফিরে যেতে পারবে বলে পরিষদ মনে করে। এই প্রয়োজনেই বাংলাদেশ সরকারকে অবলম্বে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন বলে রাজ্য পরিষদ মনে করে। এই স্বীকৃতি দানের বিষয়ে কিছু না করার জন্য কমিউনিস্ট পার্টির রাজ্য পরিষদ ভারত সরকারের সমালোচনা করেছেন এবং পার্টি তাঁর সমস্ত শাখাকে বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য বলেছেন।

পার্টির জন্য পরিষদ তার সমস্ত শাখাকে বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরের ব্যবস্থাদি উন্নতি করার জন্য কাজ করতে বলেছেন। শরণার্থী শিবিরে যারা আছেন তাঁরা যাতে আশ্রয়, খাদ্য, ওষুধ রীতিমতো পান এবং যারা বিভিন্ন ব্যক্তির কিংবা আত্মীয়ের বাড়িতে আছেন, তাঁদের প্রয়োজনে তারাও যাতে সাহায্য পান তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে হবে। বৃদ্ধ, শিশু ও মহিলাদের যাতে যথাসম্ভব ভালোভাবে রাখা যায় যুবকদের যাতে মুক্তিবাহিনীতে যোগদানের জন্য অনুপ্রাণিত করা যায় তার জন্য পার্টির কর্মীগণ বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরগুলোতে সক্রিয়ভাবে কার্যক্রম গ্রহণ করবেন।

শরণার্থী শিবির পরিচালনায় কেবলমাত্র নেতিবাচিক স্বরুপ উদঘাটন নয় পরন্ত ব্যর্থতা ও দুর্বলতাগুলিকে কাটানোর জন্য পার্টির কর্মীদের সক্রিয় হস্তক্ষেপ করতে হবে যাতে শরণার্থীদের সুষ্ঠু ও কার্যকরী ভাবে যাহায্য করা যায়।

কমিউনিস্ট পার্টির রাজ্য পরিষদ মনে করে, বাংলাদেশের এই সমস্যাকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখতে হবে। রাজ্য পরিষদ বাংলাদেশের শরণার্থী বিষয়ে উড়িষ্যা সরকারের মনোভাব এবং মেঘালয়ে দাঙ্গার বিষয়ে গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে একটি জাতীয় সংহতিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন এবং সীমান্ত রাজ্যগুলির স্কন্দভার ভাগ করে নেওয়ার প্রয়োনীয়তা সম্পর্কে সকল রাজ্যগুলিকে সচেতন করার উদ্দেশ্যে মুখ্যমন্ত্রীর সমুহের সম্মেলন আহবানের জন্য পার্টি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছেন। এ কারণস্বরূপ বলা হয়েছে যে যদি বাংলাদেশের সংগ্রাম ব্যর্থ হয় তাহলে ভারতের গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলো সাম্প্রদায়িকতা ও প্রতিক্রিয়ার জোয়ারে ভেসে যাবে।

সাম্প্রদায়িক শক্তিসমূহের যারা গোলযোগ করার চেষ্টা করছে তাঁদের বিষয়ে হুশিয়ার থাকার জন্য কমিউনিস্ট পার্টি পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারনের কাছে আহবান জানিয়েছেন। পার্টি স্থির করেছে যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংহতি জ্ঞাপক অভিযানই বর্তমানে কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম মূল কার্যসুচী। ট্রেড ইউনিয়ন সমূহ শ্রমিকদের মধ্যে, কিষান সভা কৃষকদের মধ্যে এবং যুব, ছাত্র, মহিলাদের মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে হবে। এই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সমস্ত মানুষের সমাবেশ ঘটাতে হবে।

পশ্চিমবঙ্গে বর্তমানে আন্তঃপার্টি ভ্রাতৃঘাতী হত্যাকাণ্ড জনিত গুরুতর পরিস্থিতির জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করে রাজ্য পরিষদ এই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছে যে খুনীদের গ্রেফতার করতে এবং ব্যক্তি সন্ত্রাস রোধে পুলিশী অক্ষমতার পটভুমিকা শুধু প্রশাসনিক ব্যবস্থা নয় প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে এবং রাজনৈতিক দলগুলির সক্রিয় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এই ধরনের সন্ত্রাস বন্ধ করা সম্ভব। রাজ্য পরিষদ এবং ব্যক্তি সন্ত্রাস বিরোধী অন্যান্য পার্টির সদস্যদের সম্মেলন আহবান করে এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচী গ্রহণ করা হোক।

সর্বশেষে বাংলা কংগ্রেসের ভাঙ্গন জড়িত পরিস্থিতিও রাজ্য পরিষদে আলোচিত হয়। পার্টির বক্তব্য এই যে শ্রী সুশীল ধারাকে মন্ত্রিসভায় নেওয়া উচিত নয়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৫৫। বাংলাদেশের অনুকূলে জনমত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বিদেশ সফর শেষে সংবাদপত্রে প্রদত্ত জয়প্রকাশ নারায়নের অভিজ্ঞতা ও বলিষ্ঠ বিবৃতি বিবৃতি ২১ জুন ১৯৭১

Pallab Das
<১২, ১৫৫, ৪১২-৪১৪>

প্রেস বিবৃতি

ক। ১৬ই মে দিল্লী ত্যাগ এবং ২৭শে জুন ফিরে আসা- সব ৪৭ দিনের মধ্যে
খ। স্থান পরিদর্শনঃ কায়রো, রোম, বেলগ্রেড, মস্কো, হেলসিঙ্কি, স্টকহোম, বন, প্যারিস, লন্ডন, ওয়াশিংটন, নিউ ইয়র্ক, অটোয়া, ভ্যানকুভার, টোকিও, ব্যাংকক(বিশ্রামের জন্য- কোন ইন্টারভিউ নেই), জাকার্তা, সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুর, ব্যাংকক(দিল্লীগামী এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট ধরার জন্য)

১। সর্বসেবা, সাং ও গান্ধী শান্তি ফাউন্ডেশনের পক্ষে আমি শান্তির একজন দাস হিসেবে এই মিশন গ্রহণ করি। আমি তাদের পক্ষের সকল ধরনের সহযোগীতা, বিশেষ করে আর্থিক সহায়তার জন্য আসলেই আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।

২। সমানভাবে, আমরা যেসব স্থানে পরিদর্শন করেছি, সেসব স্থানের আমাদের দেশের প্রতিনিধিদের কাছে সকল সহযোগীতা ও আতিথেয়তার জন্য আমি আমার উষ্ণ সমাদর জানাই। আমার মিশন যতদূর সম্ভব কার্যকর করার জন্য আমরা সাধারণভাবে ভারত সরকার এবং বিশেষভাবে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।

৩। শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ সহায়তা বা মানুষের শুধুমাত্র দুঃখ-কষ্ট নিয়ে কথা বলার জন্য কিংবা জগতের নৈতিক বিবেক জাগ্রত করার জন্য আমি এই যাত্রা করি নি। লাখ লাখ মানুষ ত্রাণের জন্য ভারতে পালিয়েছে এবং একই সাথে কয়েক লাখ মানুষ বাংলাদেশে সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে এবং দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর মুখোমুখি হয়েছে –যা অবশ্যই জরুরি এবং আমি স্বাভাবিকভাবেই এ ব্যাপারে কথা বলেছি। কায়রো বাদে সকল স্থানের পত্রিকা তথা “বিশ্বের নৈতিক বিবেক বা এর যতটুকু এখন পর্যন্ত বাকি রয়েছে” হিসেবে খুব চমৎকার কাজ করছে এবং এখনও করছে।

৪। আমার বড় উদ্বেগ ছিল যে, এর সাথে রাজনৈতিক ইস্যু জড়িত ছিল যার দ্রুত সমাধান দরকার ছিল, কারণ আমি যাদের সাথে মিলিত হয়েছি তাদের কাছে আমি এটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি যে, শরণার্থী ও মানবিক সমস্যা রাজনৈতিক সমস্যার শুধুমাত্র অন্তর্নিহিত উপজাত।

৫। বিশ্ব সংবাদ মাধ্যম এবং একই সাথে তাদের নিজস্ব কূটনৈতিক চ্যানেলসহ অন্যান্য তথ্যের উৎসকে ধন্যবাদ জানাই। আমি দেখেছি যে, সরকার এই প্রশ্নের রাজনৈতিক দিক দিয়ে বেশ ভালোভাবেই অবগত ছিল। আমার মনে হয় এটি সাধারণভাবে অনুভূত হয় যে, পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক রায়কে পাশবিক শক্তি দ্বারা দমনের মাধ্যমে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে পাকিস্তানকে বিপদ্গ্রস্থ করে ফেলেছে। তা সত্ত্বেও আমি কিছু সরকারের মুখপাত্রকে দেখি পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে কিছু সংযোগ রয়েছে – এমন আশায় বুক বাঁধতে। তারা সবাই পাকিস্তানকে সামরিক সামরিক অভিযান বন্ধ করার জন্য এবং একটি রাজনৈতিক সমাধান খোঁজার জন্য চাপ দিচ্ছিল। এটা ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের নেতাদের সাথে আলোচিত ছিল যখন তাদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তারা তাঁবেদারদের সাথে সহাবস্থান করছে কিনা, তখন তারা তা জোরালোভাবে নাকচ করে দেয়। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাংলাদেশে যা করেছে, কোনো আত্মমর্যাদা সম্পন্ন বাঙালি পাকিস্তানের সাথে ‘সামান্যতম সংযোগ’ পর্যন্ত মেনে নিবে না- এমন দৃষ্টিপাতই তারা প্রকাশ করে।

৬। এই বিষয়ের বাস্তবতা হল এবং এই দেশে পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে যে, বিশ্বে ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতার ভারসাম্যের স্থিতি অবস্থা বজায় রাখার জন্য বড় বড় ক্ষমতাধররা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষমতার এই ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য বিশেষভাবে আগ্রহী। তারাই ইচ্ছাকৃত নীতির মাধ্যমে পাকিস্তানের সাথে একত্রিত হয়ে ভারতকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য এই অবস্থার সৃষ্টি করেছে।

৭। বাংলাদেশে দীর্ঘায়িত গেরিলা যুদ্ধ এ উপমহাদেশের অগ্রগতি ও স্থায়িত্বের জন্য বিরূপ ফলাফল বয়ে নিয়ে আসতে পারে, কিন্তু আশা করা যাচ্ছে যে, এই অশুভকে কোনভাবে প্রতিহত করা যেতে পারে।

৮। বিশ্বের রাজনীতির কিছু কিছু নীতিনির্ধারকরা বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ আন্দোলনের উত্থানের অনিবার্যতা প্রসঙ্গে এখনও দৃঢ় প্রত্যয়ী। যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানিদের দাবি করা “স্বাভাবিক” অবস্থা ভুল প্রমাণিত করতে পারছে না, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা পরিস্থিতির বাস্তবতা মুখোমুখি হবে বলে আশা করা সমীচীন হবে না।

৯। তারা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে তার দেশকে স্থিতিশীল রাখার জন্য “বন্ধুত্বপূর্ণ’ পরামর্শ অব্যাহত রাখবে এবং তাদের কাছ থেকে তিনি যা সাহায্য চান, সেটা প্রদান করতে অস্বীকৃতি জানাতে পারে।

১০। যেকেনো বিষয়ে ভারতকে অবিলম্বে উদ্বিগ্ন হতে হয় ও পাকিস্তানের আচরণের জন্য ভারতকে ভুক্তভুগী হতে হয় এবং ভারতকে উদ্ধার করার জন্য কেউ প্রস্তুত হয়ে আছে এমন কোনো প্রমাণ আমি কোথাও পেলাম না।

১১। শরণার্থীদের দেখাশোনার জন্য কিছু অর্থনৈতিক বোঝা শেয়ার করার জন্য তারা হয়ত প্রস্তুত আছে- তবে আমাদের অনুমিত সংখ্যা তাদের কাছে অতিরঞ্জিত মনে হতে পারে- কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, সামাজিক ও রাজনৈতিক বোঝা ভারতকে একাই বহন করতে হবে। এবং একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন এই বোঝাগুলো অর্থনৈতিক বোঝার কত বেশি ভারী।

১২। পাকিস্তান এইড কনসোর্টিয়াম গঠনের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। কিন্তু, প্রথমত এটি দ্বিপক্ষীয় সাহায্য ব্যাখ্যা করে না এবং দ্বিতীয়ত, এটা এখনও দেখার বাকি আছে যে, যদি এটি বাংলাদেশে একটি স্বদেশদ্রোহী সংগঠন না হয় এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এটিকে কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যৎ সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করেন – তাহলে কনসোর্টিয়ামের শর্ত পূরণ হিসেবে কনসোর্টিয়াম দ্বারা গৃহীত হবে।

১৩। আমার ভ্রমণের প্রভাব সম্পর্কে সংক্ষেপে বলতে চাই যে, আমরা যারা ভারতে আছি, আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, আমাদের সমস্যার সমাধান অন্য কেউ এসে দিয়ে যাবে না। এটি আমাদেরকেই করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যদি বাংলাদেশের জনগণের উপর দমন ও নিপীড়ন অব্যাহত থাকে এবং এর সঙ্গে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ফলাফল আমাদের জাতীয় স্বার্থের পক্ষে যায় কি না- এ ব্যাপারে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিভক্ত পাকিস্তান ভারতের জাতীয় স্বার্থের পক্ষে কি না- এমন প্রশ্নের সাথে এটি সমার্থক নয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও তার উপদেষ্টামণ্ডলী ইতিমধ্যে তাদের জাতিকে বিভক্ত করে ফলেছে। যেই প্রশ্নের উত্তর দরকার সেটি হচ্ছে- পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা জোরপূর্বক বাংলাদেশ দখল, এর সাথে আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিণতি, এসব কিছু সাহসী শব্দের প্রত্যাশা করে। আমার জন্য, আমার মনের মধ্যে বেশ পরিষ্কার যে, পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আরও বেশি বিলম্ব করলে তা ভারতের জাতীয় স্বার্থের জন্য অনেক বড় বিশ্বাসঘাতকতা হবে।

১৪। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কর্তৃক প্রণীত গতকালের অত্যন্ত বেদনাদায়ক বিবৃতি থেকে এটা বেশ সুস্পষ্ট যে, ইসলামাবাদ বাংলাদেশে যে সমস্যার সৃষ্টি করেছে তার সন্তোষজনক রাজনৈতিক সমাধান করার ক্ষমতা বা ইচ্ছা কোনটাই ইসলামাবাদের নেই। তারা বাংলাদেশের কোন নির্বাচিত প্রতিনিধির সাথে চুক্তি নিয়ে বসছে না এবং প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশে ঔপনিবেশিক শক্তিকে বৈধ করার জন্য একটি বিশাল সংখ্যক আসনের প্রহসনের নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার পরিকল্পনা করছে। সারা বিশ্ব ও আমাদের কাছে এই ব্যাপারটা এখনই স্পষ্ট হওয়া উচিত যে, বাংলাদেশের প্রতি পাকিস্তানের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর মৌলিক মনোভাব সংশোধন আশা করা কল্পনামাত্র। আসলে এটি পাকিস্তানে রাজনৈতিক নিষ্পত্তির আশা আগের চেয়ে অনেক বেশি অসম্ভব করে তুলেছে।

১৫। আমি বিদেশে যাদের সাথে সাক্ষাৎ করেছি, তাদের সবাই প্রধানমন্ত্রীর সংযম এবং কঠিন সংকট মোকাবেলায় রাষ্ট্রনায়কোচিত পদক্ষেপে প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল। আমিও এজন্য তাঁর প্রশংসা করি। কিন্তু তাঁকে এখনই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে যে, পদক্ষেপ গ্রহণের সময় এসেছে কি না। পাকিস্তানের সন্ত্রাস থেকে পূর্ব বাঙ্গালীদের উদ্ধার ও তাদের হারিয়ে যাওয়া গনতন্ত্রের পুনরুদ্ধারের কোন কল্যাণকর উদ্দেশ্যে নয়, বরং এই দেশে ইয়াহিয়ার খানের অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা নিয়া আসা এবং আমাদের জনগণের উপর প্রভাব এবং সব কিছুর ঊর্ধ্বে, আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা ও আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান রক্ষার উদ্দেশ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আমি স্বীকার করি যে, প্রধানমন্ত্রীকে একাই সঠিক সময়টা নির্বাচন করতে হবে কারণ একমাত্র তিনিই এ বিষয়ের অনুকূল ও প্রতিকূলতার ব্যাপারে জানার ও বিচার করার ক্ষমতা রাখেন। এমনকি ব্যক্তি নাগরিক হিসেবে আমার কাছে মৌলিক বিবেচনাগুলো স্পষ্ট এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য আমার আবেদন অগ্রসর করা হোক।

নয়া দিল্লী জয়প্রকাশ নারায়ণ
২৯জুন, ১৯৭১

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৫৬। বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টির বক্তব্য পুস্তিকা
জুলাই, ১৯৭১

Fakhruzzaman Sayam
<১২, ১৫৬, ৪১৫-৪১৮>

বাংলাদেশ সম্পর্কে বক্তব্য

প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রিরা গান্ধী ও অন্যান্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের ভাষণ ও বিবৃতি থেকে মন এহয় নয়াদিল্লীর আশা আন্তর্জাতিক চাপের ফলে বাংলাদেশের জনগণের সমস্যা আগামী ছয় মাসের মধ্যে শেষ হবে। এ মন্ত্রীদের ধারণা যে, যে ৭০ লাখ শরণার্থী পশ্চিম বাংলা, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরাতে এসেছে তারা ঐ সময়ের মধ্যে স্বেচ্ছায় তাদের জন্মভূমিতে ফিরে যাবে।

আওয়ামী লীগের নেতা যাঁরা মুজিবনগর থেকে বাংলাদেশ সরকার চালাচ্ছেন তাঁরাও এ রকমই আশাবাদী। এদের সকলেরই ধারণা ইয়াহিয়া গোষ্ঠী আজ ভীষণ চাপের তলায় আছে। শুধু যে দেশের আর্থিক সমস্যা প্রবল হয়ে তাদের দুর্বল করেছে তা নয়। রুশ ও আমেরিকা প্রমুখ শক্তিশালী দেশগুলিও মুজিবুরের সঙ্গে রাজনৈতিক বোঝাপড়া বা মীমাংসার জন্য চাপ দিচ্ছে।

কেউ কেউ একথাও বলেন ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের নরমপন্থী সহযোদ্ধাদের সঙ্গে মীমাংসা না করে পারবেন না। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক গোষ্ঠীকে বাঁচাবার এ ছাড়া আর পথ নেই। দেরী হলে বিপ্লবের নেতৃত্ব বামপন্থী বা চরমপন্থীদের হাতে চলে যাবে। তখন কোন মীমাংসাও হবে না আর এ গোষ্ঠীকেও বাঁচিয়ে রাখা চলবে না। মুক্তিফৌজের গেরিলা আক্রমণের জোর এখন আগের তুলনায় অনেক বেশী, ফৌজের শক্তিও বেড়েছে, অনেক নতুন লোক অস্ত্র শিক্ষা পেয়েছে। এ সমস্তই ঠিক কিন্তু উদ্দেশ্য হলো ইয়াহিয়া গোষ্ঠীর উপর চাপ বৃদ্ধি। গেরিলা আক্রমণের পক্ষে বর্ষাকাল খুবই উপযোগী। এক তো পাক সৈন্যের মনোবল ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। তার উপর গেরিলাদের তৎপরতা চলছে বেড়ে। ফলে পাক সেনাবাহিনী ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য। এ হলো আওয়ামী লীগের নেতাদের বিচার। ইচ্ছা পূরণ ছাড়া একে আর কি বলা যায়।

মুক্তিফৌজের যে সমস্ত নেতারা হাতে হাতিয়ার নিয়ে লড়াই করছেন তাঁরা কিন্তু এতোটা আশাবাদী নন। অল্প কিছুদিন আগে জাতীয় আওয়ামী পার্টির মৌলানা ভাসানী এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন যে অন্য বামপন্থী দলগুলি গ্রামে গ্রামে সর্বদলীয় কর্মপরিষদ গড়েছে। উদ্দেশ্য হলো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের জন্য গণপ্রস্তুতি।

তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হলে কি নতুন নেতৃত্বের উদ্ভব হবে না। উত্তরে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন, বাঘ কখনো মানুষের রক্তের স্বাদ ভুলতে পারে না। বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ১৩ লক্ষ। হাতে হাতিয়ার পেলে মানুষের চাল-চলন, ধ্যান-ধারণা ও আচার-ব্যবহার সবই বদলে যায়। অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের জাতীয় আওয়ামী পার্টি, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি(মস্কোপন্থী) ও অন্য কমিউনিস্ট গোষ্ঠী(যারা এককালে মাও নীতি ঘেঁষা ছিল) এ সমস্ত দলের নেতাদের ধারণা বিপ্লব কষ্টসাধ্য ও দীর্ঘায়িত হবে। এর জন্য প্রয়োজন সশস্ত্র মোকাবেলার উপযুক্ত রণকৌশল ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে জনগণের রাজনৈতিক প্রতিরোধের কার্যক্রম। বৈপ্লবিক দলগুলির মধ্যে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি যার নেতা মতিন আলাউদ্দিন ও কমিউনিস্ট গ্রুপ যার নেতা আব্দুল জাফর ও রাশেদ খান মেনন। তৃতীয়টি হলো পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সিলেনিনিস্ট)-এর নেতা মহম্মদ তোহা। এ দলটি পিকিংপন্থীর কাছ ঘেঁষেই চলে। কাজেই বর্তমান বিপ্লব সম্পর্কে এর নীতি দ্বিধাগ্রস্থ ও অস্পষ্ট। কিন্তু তাতেও পাকিস্তানী জঙ্গী বাহিনীর হাতে এক মার খেতে হয়েছে।

মুক্তিফৌজের নেতাদের মধ্যে কারু কারু অভিমত যে জমি ও শিল্প নিয়ন্ত্রণ জাতীয় শ্রমিক কৃষকদের নিজস্ব দাবী মেনে নিলে ভারতে শরণার্থীদের সংখ্যা কিছু কম হতো। প্রকৃত চাষীদের মধ্যে জমি বণ্টন করে দেওয়ার কথা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে এখনো ঘোষণা করা সম্ভব। শিল্প ও অন্যান্য শ্রমিক এরা অনেকেই স্বদেশ ছেড়ে এদেশে আসেনি ও মধ্যম শ্রেণীর স্বার্থ পোষণ কার্যক্রম গ্রহণ করতে রাজী নন। তাঁদের যুক্তি এ কাজ করলে মুক্তিফৌজের মধ্যে অন্তর্বিরোধ দেখা দেবে। এর অর্থ হলো জোতদার, ব্যবসায়ী, দোকানী ও সম্পদশালী ব্যক্তিরা যাঁরা এখন আওয়ামী লীগের সমর্থক তাঁরা লীগ গড়া ছেড়ে দিতে পারেন। আওয়ামী লীগের নেতারা বামপন্থীদের আরও একটি দাবী মানতে রাজী নন। বামপন্থীরা চেয়েছিলেন সমস্ত প্রতিরোধকারী শক্তিদের নিয়ে জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট হোক। দাবী প্রত্যাখ্যানের যুক্তি জনগণের সমর্থন শুধু আওয়ামী লীগেরই আছে।

বাংলাদেশ জাতীয় শ্রমিক লীগের অস্থায়ী সভাপতি মহম্মদ শাজাহান বলেন, বাংলাদেশ সংঘবদ্ধ শিল্প শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৪০ লক্ষ। এদের মধ্যে বেশীর ভাগই ইউনিয়নের সদস্য। সামরিক শাসন বাধা দিতে পারেনি। এক লাখের উপর শ্রমিক পাকিস্তানী জঙ্গী বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে। তাঁর বক্তব্য ১৯৭৬ সালে আওয়ামী লীগ নারা লাগান যার জমি তার। ১৯৭০ সালে ঢাকার মে দিবস সমাবেশে শেখ মুজিব যে বানী তাতে একথা বলা ছিল, সেদিন আর দূরে নয় যেদিন শ্রমিকরাই হবে উৎপাদন শক্তির মালিক। এর উপর সামাজিক কর্তৃত্ব স্থাপনের প্রধান ধাপ হিসেবে তিনি ব্যাংক, ইনসিওরেন্স কোম্পানি, পাট রফতানী ব্যবসায়ী, মূল শিল্পসমূহ ও জনস্বার্থ সম্পৃক্ত সেবা প্রতিষ্ঠান প্রভৃতির রাষ্ট্রীয়করণ সমর্থন করেন। আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো ন্যায়ভিত্তিক সাম্যবাদী সমাজ গঠনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে আস্থাশীল। প্রথম প্রদক্ষেপ হিসাবে কোন কোন শিল্প ব্যক্তিগত মালিকানা লোপ করা হবে তারও ফিরিস্তি আছে ম্যানিফেস্টোতে।

উপরন্তু মুজিব নাকি ৭ই মার্চ তারিখে নির্দেশ দেন যে আওয়ামী লীগের নেতারা হঠাৎ গ্রেফতার বা নিহত হলে জনগণ যে বিভিন্ন মতাবলম্বী লোকদের নিয়ে বিভিন্ন স্তরে কর্মপরিষদ গড়ে ফেলে। সর্বতোভাবে পাক সৈন্যদের সঙ্গে অসহযোগ করে রেল ও সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা বানচাল করে দিয়ে এবং প্রত্যেক গ্রামকে প্রতিরোধের দুর্গে পরিণত করে।

বিদ্রোহী জনগণ এ নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন ঘোষণার বিপ্লবের এ জাতীয় ভবিষ্যৎ পরিণতির কোনো আভাস বা ইঙ্গিত নেই বাংলাদেশের বিপ্লবী বামপন্থীদের এ খুঁত, এ ত্রুটি দূর করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে, পাক সৈন্যদের নৃশংসতা বন্ধ করতে হলে চাই জনগণের হাতে অস্ত্র। আত্মরক্ষার জন্য জনগণের হাতে তুলে দিতে হবে হাতিয়ার। সমস্ত গণবিপ্লবেই এমন একটা সময় আসে যখন জনগণের হাতে হাতিয়ার তুলে দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায়ই বিপ্লবকে বাঁচানো যায় না। বর্তমান ও পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সন্ত্রাসের জবাব দেবার এবং জনগণের মনোবল দৃঢ় করার জন্য চাই জনতাকে সশস্ত্র করা। আজ মুক্তিফৌজে আছে ৩০, ০০০ সৈনিক। আরও ৩০, ০০০-এর চলছে শিক্ষা পর্ব।

মুক্তিফৌজের নেতাদের আজ কাজ হলো গেরিলা আক্রমণের সঙ্গে স্থানীয় জনগণের প্রতিরোধের সমন্বয় ঘটানো। জনগণের সক্রিয় সহযোগ ছাড়া শুধু গেরিলা আক্রমণ মারফৎ বিপ্লবের বিস্তৃতি ঘটানো সম্ভব নয়। জনগণকে এমন কিছু দিতে হবে যার জন্য তারা লড়তে ও মরতে রাজী হয়। শুধু স্বাধীনতার নামে এ কাজ হয় না, হতে পারে না। অন্য কথায় বলতে গেলে বর্তমান বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে রূপ দেবার জন্য সচেষ্ট হতে হবে।

ভারতে ৭০ লক্ষ শরণার্থীর প্রবেশ অসুবিধা ও বিপদ নিশ্চয়ই দেখা দিয়েছে। তাতে এখানকার বুর্জোয়া সরকারের সুবিধাও হয়েছে। এ সমস্যার উপর সমস্ত গুরুত্বারোপ করতে এমন বুর্জোয়া রাজনীতিক আছেন যারা বলেন- ইয়াহিয়া সরকার যদি বাংলাদেশে গনহত্যার জন্য দিনে ১ কোটি টাকা খরচ করে আমরা দৈনিক খরচ করছি ১ কোটি টাকা ৫০ লক্ষ শরণার্থীর প্রাণ বাঁচাতে।

এ অর্থ এখন আর শুধু বাংলাদেশ পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার নয়। এটা এখন ভারতের ঘরোয়া সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শরণার্থীদের ভরন-পোষণ ও আশ্রয়ে ব্যবস্থা করতে আজ ভারতের বুর্জোয়া শাসকরা ন্যায়ত ধর্মত দায়ী ভারতের পার্লামেন্ট সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব পাস করেছিল বাংলাদেশের জনগণের মুক্তি আন্দোলনের সমর্থনেও তার সঙ্গে সংহতি জানিয়ে।

নয়াদিল্লী অবশ্য বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয় নি। বিশ্বের দরবারে শরণার্থীদের জন্য সাহায্য ভিক্ষা করাই এর প্রধান কাজ। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরা বিশেষ করে আমেরিকা ব্রিটেন যাদের পাকিস্তানের দুই অংশের প্রচুর মূলধনের বিনিয়োগ আছে তাদের বিবেককে শান্ত করার জন্য শরণার্থীদের জন্য কিছু ওষুধপত্র পাঠাচ্ছে।

এদিকে চীনের মাও আমলাতন্ত্র ইয়াহিয়া সরকারকে প্রকাশ্যে মদদ যোগাচ্ছে আর সোভিয়েত আমলাতন্ত্র তার দায় সেরেছে বাংলাদেশের জনগণকে মৌখিক সহানুভূতি জানিয়ে। পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির যে প্রতিনিধিদল সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির চতুর্বিংশতম সম্মেলনের জন্য মস্কো যায় সে দল গভীর আশাভঙ্গ নিয়ে ফিরে এসেছে। সোভিয়েত নেতাদের বাংলাদেশ সম্পর্কে কোন ঔৎসুক্য এ দল দেখেনি। সোভিয়েত নেতারা শরণার্থী পুনর্বাসনের জন্য আমেরিকার সঙ্গ সহযোগিতা ছাড়া আর কিছু করতে প্রস্তুত নন বলে এ প্রতিনিধিদলের ধারণা।

বিপ্লবের বিভিন্ন তাৎপর্য যতই পরিষ্কার হচ্ছে ভারতের রাজনীতিকদের মতামতে ততই পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। এখন আর বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামের সমর্থনে পূর্বের ঐক্যমতে নেই। বাংলাদেশের সংগ্রামের ভিতর এখন অনেক বিচ্ছেদ ও বিভেদের ভূত দেখছেন। তাদের শুধু একথা মনে করিয়ে দিলেই চলবে যে বিচ্ছেদ ও বিভেদ ইচ্ছা করলেই ঘটানো যায় না আর তা ঘটবার হলে কিছুতেই ঠেকানো যায় না। ইয়াহিয়া খানের হাতে কমপক্ষে ১০ লক্ষ লোকের প্রাণ গেছে। কিন্তু তাতে বাংলাদেশ সংগ্রাম কাবু হয়নি। আবার সিপিএম শত চেষ্টা করলেও পশ্চিমবাংলায় বাংলাদেশের গণবিদ্রোহ সৃষ্টি করতে পারবে না।

এখানে একথা অপ্রাসঙ্গিক নয় যে বাংলাদেশ সম্পর্কে এ দেশে প্রথম যে স্বস্তিবোধ দেখা দিয়েছিল তা সবটাই ন্যায্যা ও যুক্তিযুক্ত নয়। ধর্মীয় রাষ্ট্র পাকিস্তানের অবমাননায় অনেক ভারতবাসীই তাঁর উগ্র জাতীয়তাবাদের লাভ দেখেছেন। কিছু লোক হিন্দু সাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে বাংলাদেশের বিদ্রোহকে দেখেছেন। আর পুঁজিপতিরা তো তাদের উৎপন্ন মালের জন্য বাজারের প্রসার হবে এ স্বপ্নে মশগুল। বাংলাদেশের বিপ্লবের প্রকৃত অর্থ যতই পরিষ্কার হবে ততই প্রতিক্রিয়াশীল দলগুলি এ সমস্যাকে সাম্প্রদায়িক মোচড় দেবে। বাংলাদেশে সফল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পুঁজিপতিদের ভীষণ ভয়। এ বিপ্লবের ফল তাদের স্বপক্ষে হবে মারাত্মক।

এ কথা অবশ্যই স্বীকার্য যে বাইরের লোকের পক্ষে বাংলাদেশের বিপ্লবের রূপ ও তাৎপর্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া সম্ভব নয়।

ভারতের বিপ্লবী বামপন্থীরা যদি বাংলাদেশ বিপ্লবের স্বরূপ বুঝতে পারেন। বিপ্লব যে সামাজিক শক্তিগুলিকে শৃঙ্খলমুক্ত করেছে তাদের গতিপ্রকৃতি যদি তাঁরা ধরতে পারেন তবেই বাংলাদেশ বিপ্লবের হবে সর্ববৃহৎ সাহায্য। এছাড়া অবশ্য ভৌতিক ও নৈতিক সমর্থন ও সাহায্য করতেই হবে মিথ্যা ভয় ও অপপ্রচারে বামপন্থীদের কোন লাভ নেই।

এ বিপ্লব এক অভূতপূর্ব গণতান্ত্রিক বিপ্লব। চীন বিপ্লবের পর এটাই এশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। যদি এ বিপ্লবকে সফল করতে হয় তবে একে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে পরিণত করতে হবে আর সে কাজে নেতা হবে বাংলাদেশেরই শ্রমিক শ্রেণী।

বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সাফল্য চাই। ভারত, পশ্চিম পাকিস্তান ও বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী সংহতি চাই।

সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টি
(চতুর্থ কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক ভারতের সংখ্যা)

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৫৭। বাংলাদেশের সংগ্রামকে সহায়তা করার জন্য ‘সর্ব আসাম বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি’র আহবান পুস্তিকা জুলাই, ১৯৭১

দীপংকর ঘোষ দ্বীপ
<১২, ১৫৭, ৪১৯-৪২১>

বাংলাদেশের সংগ্রামকে সহায়তা করুন
সর্ব আসাম বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি

সভাপতি শ্রী শরৎ সিংহ
উপ-সভাপতি ডঃ ঘনশ্যাম দাস
-শ্রী ফনী বরা

সাধারণ সম্পাদক-
শ্রী ধীরেশ্বর কলিতা
শ্রী বিশ্ব গোস্বামী
শ্রী দেবেন্দ্র শর্মা

শ্রী বিশ্ব গোস্বামী কর্তৃক প্রকাশিত
প্রথম প্রকাশ জুলাই, ১৯৭১

বাংলাদেশের সংগ্রামকে সহায়তা করুন
সর্ব আসাম বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির আহবান

সামরিক শাসকের অত্যাচার এবং ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণ বিদ্রোহ করেছে। সারা বিশ্বের প্রগতিশীল জনগণ বাংলাদেশের জনগণের সহায়তার জন্যে সহানুভূতির সাথে এগিয়ে এসেছে। ভারত সরকার সকল রাজনৈতিক দল এবং ভারতের জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে কিন্তু এই সহায়তা ও সহানুভূতি যথেষ্ট হয়নি।

বাংলাদেশের পরিস্থিতি লাখ লাখ উদ্বাস্তুকে দেশত্যাগ করে আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, পশ্চিম বঙ্গসহ সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী রাজ্যসমূহে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে। উদ্বাস্তুর স্রোত আমাদের রাজ্য আসামকেও নাড়া দিয়েছে। সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন হিন্দু এবং মুসলমান উভয়ই বর্তমান পরিস্তিতিতে নিজেদের উদ্দেশ্য সিদ্ধিতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশের জনগণকে এ ব্যাপারে সজাগ ও সচেতন হবে। তদুপরি আরো কিছু মানুষ রয়েছে যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য এবং তার বিজয়ের সুদূরপ্রসারী গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারছে না।

এই আলোকেই আমরা এই পুস্তিকার দ্বারা আমাদের দেশের জনগণের মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন এবং তার বিজয়ের সাথে উদ্বাস্তুসহ আমাদের দেশের সমস্যা কি ভাবে জড়িত তা ব্যাখ্যার চেষ্টা করেছি।

আমরা আশা করবো যে এই পুস্তিকা বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের পক্ষে আমাদের দেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করবে বিভেদ সৃষ্টিকারী সাম্প্রদায়িক আর বিদেশী শত্রুকে উৎখাত করতে সাহায্য করবে।

বাংলাদেশের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আক্রমণ

উনিশশ একাত্তর সনের ২৫শে মার্চ বাংলাদেশের সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী অমানুষিক গণহত্যা অভিযান শুরু করে। এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছে বাংলাদেশের সকল জনবসতি, স্কুল, কলেজ, ছাত্রাবাস, অধ্যাপক, শিক্ষক, উকিল এবং ডাক্তারগনসহ বুদ্ধিজীবীরা। লক্ষ লক্ষ মানুষ হয়েছে গৃহহারা, অত্যাচারের মুখে এক বিশাল জনস্রোত প্রবেশ করেছে আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং পশ্চিম বঙ্গে।

সভ্যতার ইতিহাসে এই অত্যাচারের তুলনা নেই। চেংগিসখান আর হিচলারের বীভৎস হত্যাকাণ্ড ও ইয়াহিয়ার কাছে ম্লান হয়ে গেছে। এই বর্বরতার উদ্দেশ্য হলো পূর্ব বাংলার জাতীয়বাদী ও প্রগতিশীল শক্তিসমূহকে চিরকালের জন্য উৎখাত করা। হিন্দু মুসলমান সকল সম্প্রদায়ের ছাত্র যুবক বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করে পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের পূর্ণাঙ্গ উপনিবেশ পরিণত করাই ইয়াহিয়ার উদ্দেশ্য। পশ্চিম পাকিস্তানী জমিদার সামরিক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার সামন্তবিরোধী জাতীয়বাদী সংগ্রামকে ধ্বংস করতে পারলে পাকিস্তানের বালুচি সিন্ধি আর পাখতুনদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করাও সহজ হবে। কিন্তু ইয়াহিয়া চক্র অসাধ্য সাধনের চেষ্টা করছে, ইতিহাসের চাকাকে পেছনে ঘোরানো যায় না। পাকিস্তানী শাষক গোষ্ঠীর চব্বিশ বছরের অনুসৃত নীতির ঐতিহাসিক পরিণতিই বাংলাদেশের বর্তমান মুক্তি সংগ্রাম। পাকিস্তানের ধ্বংসের বর্তমান পর্যায়ের জন্য দায়ী ইয়াহিয়া চক্র এবং তার সাম্রাজ্যবাদী ও সামন্তবাদী মিত্ররা। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন এবং প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর ন্যায্য অধিকার স্বীকার না করে পাকিস্তান রক্ষা করা সম্ভব নয়।

মুক্তিযুদ্ধ সকলের সংগ্রাম

পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর এই অকথ্য অত্যাচারের মুখে বাংলাদেশের জনগণ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। প্রথম অবস্থা ইস্ট বেঙ্গল রাইফেল, বেঙ্গল রেজিমেন্ট আর পুলিশ বাহিনী পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করে। বর্তমানে হাজার যুবক মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করে ইতিমধ্যেই যুদ্ধ নেমে গেছে। তাদের পেছনে আছে ব্যাপক জনগণের সমর্থন। পাকিস্তানী বাহিনী জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। ভিয়েতনামে মার্কিনী এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামের সরকারী সৈন্যদের মতো তাদের অবস্থা মুক্তিবাহিনী ইতিমধ্যেই গেরিলা কৌশল অবলম্বন করে রাজধানী ঢাকার ওপর আঘাত হানা শুরু করেছে। তারা এখনো চূড়ান্ত আঘাত হানতে পারেনি এই জন্য যে মুক্তিবাহিনীর সেনারা নতুন এবং অনভিজ্ঞ, অন্যদিকে পাকিস্তানী বাহিনী আমেরিকা ও চীনের সাহায্যপুষ্ট এবং আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত। কিন্তু জনগণের সক্রিয় সমর্থনে মুক্তিবাহিনী যে চূড়ান্তভাবে বিজয়ী হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সুফল

বাংলাদেশের জনগণ আজ আধুনিক মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত এক পাশবিক শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। এই ঐক্য সম্ভব হয়েছে এ জন্য যে আওয়ামী লীগ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলসমূহ পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর হীন প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে হিন্দু মুসলীম অসাম্প্রদায়িক ঐক্য গড়ে তুলতে পেরেছে। এই সংগ্রামী ঐক্য ফাটল ধারানোর জন্য ইয়াহিয়া খান নতুন করে দালাল সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ভারতকে উস্কানি দিয়ে পৃথিবীর জনমতকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সীমান্তের সংঘর্ষ সৃষ্টি করছে।

এই পরিস্তিতিতে আমাদের ওপর গুরুদায়িত্ব এসে পড়েছে। বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্র, মানবিক অধিকার ও শোষণের কবল থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। আমাদের দেশের জনগণও গণতন্ত্র, মানবিক অধিকার ও শোষণের কবল থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। আমাদের দেশের জনগণও গণতন্ত্র রক্ষা এবং শোষনহীন সমাজের জন্যে সংগ্রাম করে আসছে। তাই বাংলাদেশের সংগ্রাম সফল হলে তা আমাদেরও সহায়তা করবে। মুক্তি সংগ্রাম জয়যুক্ত হলে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক আর প্রতিক্রিয়ার শক্তি পরাজিত হবে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে এবং ফলে আমাদের দেশেও সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়ার শক্তি দুর্বল হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সংগ্রাম পরাজিত হলে উভয় দেশেই সাম্প্রদায়িক আর প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি মাথা তুলে দাঁড়াবে এবং ফলে আমাদের দেশে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বিপন্ন হবে। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হলে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠনের অলীক কল্পনা চিরকালের জন্য বিলুপ্ত হবে।

গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের জন্ম হলে ভারতের সাথে উন্নত এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হবে। দুই দেশের মাঝে বাণিজ্যিক প্রসার ঘটবে। দেশ বিভাগের পরে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর ভারতবিরোধী মনোভাবের ফলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। আগে পূর্ব বঙ্গ থেকে আমদানীর ফলে মাছ ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য আসামে অনেক যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে সে বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আসাম ও মেঘালয় রাজ্যদ্বয় বিশেষভাবে লাভবান হবে। উদ্বাস্তুরাও সকলে ফিরে যাবে।
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম জয়যুক্ত হলে আমেরিকার যুদ্ধজোট আর চীনের চক্রান্ত ব্যর্থ হবে আমাদের সীমান্তবর্তী বাংলাদেশ হবে বন্ধুরাষ্ট্র এবং ফলে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তি আরো সফল হবে।

উদ্বাস্তু সমস্যা

পাকিস্তানী দস্যু বাহিনীর অকথ্য অত্যাচারের মুখে লক্ষ লক্ষ মানুষ বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে। আাসাম আর মেঘালয়েই এসেছে কয়েক লক্ষ। এদের মধ্যে শিশু, নারী আর বৃদ্ধের সংখ্যাই বেশী। এই ছিন্নমূল সর্বস্বান্ত মানুষদের আশ্রয় ও সকল প্রকার সহযোগিতা করা আমাদের মানবিক কর্তব্য।

এই লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু স্থায়ীভাবে থাকলে মানুষের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে আসাম ও মেঘালয়ের জনগণের মাঝে এমনিতর ধারণা বদ্ধমূল হতে চলেছে। কিন্তু ভারত সরকার ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে যে উদ্বাস্তুদের সাময়িকভাবে রাখা হবে। বাংলাদেশ হলেই তাদের ফেরত পাঠানো হবে। উদ্বাস্তু সমস্যা এক জাতীয় সমস্যা। এ কথা বুঝতে হবে যে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম জয়যুক্ত হলেই কেবল তাদের ফেরত পাঠানোর মতো পরিবেশ সৃষ্টি হবে।

পরিস্থিতি আমাদের ওপর দুটি দায়িত্ব এনে দিয়েছে। একদিকে উদ্বাস্তুদের রক্ষণাবেক্ষণ ও সাহায্য শুশ্রুষা করা এবং অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রশস্ত্র ও সমর্থন যোগানো, যাতে তারা সংগ্রামে জয়লাভ করতে পারে। ইতিমধ্যেই তারা বেশ কিছু সাফল্য অর্জন করেছে। আমাদের সক্রিয় সমর্থন পেলে তারা নিশ্চিতভাবেই বিজয়ী হবে। এ জন্যই আমাদের সকলকে এই সংগ্রামের সাফল্যের জন্য এগিয়ে আসতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন আমাদের মধ্যে ঐক্য ও শান্তি বজায় রাখা। আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হলে ইয়াহিয়া চক্রই লাভবান হবে। তাই সাম্প্রদায়িক বিভেদকামী শক্তির বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে।

আমাদের সমর্থন ও সহযোগিতায় বাংলাদেশের সংগ্রামের অগ্রতির সাথে আন্তর্জাতিক সমর্থনও এগিয়ে আসবে। ইতিমধ্যেই প্রগতিশীল বহু রাষ্ট্র বাংলাদেশের জনগণের সমর্থনে এগিয়ে এসেছে। মার্কিনীরা ইয়াহিয়া চক্রকে সামরিক সাহায্য ও সমর্থন দিয়ে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীকে ইন্ধন যোগাচ্ছে। চীন সরকারও ইয়াহিয়া চক্রকে সমর্থন দিয়ে মুক্তি সংগ্রামের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। কিন্তু আমেরিকা ও চীনের এই চক্রান্ত সত্ত্বেও মুক্তিসংগ্রামের বিজয় সুনিশ্চিত। এই সংগ্রাম পাকিস্তানের ইতিহাসের এক অবধারিত পরিণতি। আর এর জন্য সম্পূর্ণরূপে দায়ী পাকিস্তানের শাষকগোষ্ঠী।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম সমগ্র এশিয়ার জন্য এক ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এই সংগ্রাম স্বাধীনতা, গণতন্ত্র আর শোষণ মুক্তির সংগ্রাম। এর বিজয় সুনিশ্চিত। এই বিজয় যত শীঘ্র হবে ততই আমাদের উভয় দেশের জন্যই মঙ্গল। আসুন, আমরা সকলে এই সংগ্রামকে সফল করার জন্য সঠিকভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করি।

(অসমীয় ভাষায় প্রকাশিত মূল গ্রন্থ থেকে সংক্ষেপে অনূদিত)

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৫৮। ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি জয়প্রকাশ নারায়ণের আবেদন হিন্দুস্তান ষ্ট্যাণ্ডার্ড ৯, জুলাই, ১৯৭১

Pallab Das
<১২, ১৫৮, ৪২২-৪২৩>
অনুবাদ

প্রধানমন্ত্রীর এখনই সময় ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেয়ারঃ জয়প্রকাশ
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় প্রেসক্লাবে ৬৮ বছরে গরম ও আর্দ্র পরিবেশেও তাকে অসাধারণ ফিট দেখাচ্ছিল এবং চোখে অঞ্জলি উঠার কারণে কালো চশমা পড়েন। জনাব জয়প্রকাশ নারায়ণ- বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা প্রচারণার জন্য বিশ্বভ্রমণ শেষ করে ফিরে এসেছেন এবং বলেন, তিনি পূর্বে দিল্লীতে যা বলেছেন তার সাথে কিছু কথা যোগ করতে চান।

জনাব নারায়ণ বলেন, ক্ষমতাধর দেশগুলো এখনও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় আগ্রহী, তাদের মধ্যে কেউ কেউ সম্ভবত ভারতের সঙ্গে শরণার্থী বোঝা ভাগ করতে ইচ্ছুক কিন্তু কেউ বাংলাদেশ বা ভারতকে এই বিপদ থেকে মুক্ত করবে না।

তিনি বলেন, মিসেস গান্ধীর জন্য সময় এসেছে ইয়াহিয়া শাসন- যারা নিজের দেশের অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা ভারতে রপ্তানি করছে- তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়ার।

জনাব নারায়ণ যোগ করেন, তার দিল্লীর বিবৃতির পরে দুটি জিনিস ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্র যে অজুহাতেই হোক না কেন পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠিয়েছে। এবং পাকিস্তান এই অস্ত্র চালান থামানোর পরিবর্তে এটিকে সাহায্যের পুনরারম্ভ হিসেবে বিবেচনা করছে।

ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা জনাব নারায়ণের কাছে স্পষ্ট করেছিলেন যে, “তারা বাংলাদেশের প্রকৃত প্রতিনিধিদের সাথে রাজনৈতিক পুনর্বাসন দেখতে চায়, কারো হাতের পুতুলের সাথে নয়”- এমন বক্তব্য এবং জনাব স্বরণ সিং-এর আশ্বাসের বিরোধিতা করে।

এর পিছনে কার হাত রয়েছে? জনাব নারায়ণ দুইটি ব্যাখ্যা প্রদান করেন। প্রথমত, পাকিস্তানী সামরিক শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে শক্তিশালী পেন্টাগনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, দ্বিতীয়ত আইজেন- হাওয়ার প্রশাসনের সময় জনাব নিক্সন যখন ভাইস-প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন তিনি উপমহাদেশ পরিদর্শন করেন এবং পাকিস্তানে বিপুল পরিমাণে অস্ত্র সরবরাহের সমর্থনে রিপোর্ট পেশ করেন। জোট নিরপেক্ষ ভারত এটিকে ধারাবাহিক প্রক্রিয়া বলেই ধরেছে। জনাব নারায়ণ সতর্কভাবে উল্লেখ করেন যে, বরাবরের মতন স্থায়িত্বের এই মূল্যায়নের মিথ্যা বর্ণনা দেয়া হয়েছে। কিন্তু জনাব নিক্সন এখান থেকে বের হওয়ার সময় সামান্যতম বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছেন- এমন কোনো আভাস বা ইঙ্গিত পাওয়া যায় নি।

জনাব নারায়ণের মতে সোভিয়েত মনোভাব অনেক বেশি সহায়ক ছিল। রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট জনাব পডগরনি একমাত্র রাষ্ট্রপ্রধান যিনি ইয়াহিয়া খানের কাছে পাঠানো চিঠিতে তার অসমর্থন জানিয়েছেন ও পাকিস্তানী পদক্ষেপের জন্য সামান্য সমালোচনা করেছেন।

জনাব নারায়ণ আরব দেশগুলোর মধ্যে শুধু কায়রোতে ছিলেন এবং সেই সময় মিশর সহিংস রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে ছিল। তবে কায়রোতে তিনি মানুষের নামেমাত্র কৌতূহল ও অপর্যাপ্ত প্রেস কাভারেজে হতাশ হয়েছেন এবং ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াতে এর ঠিক বিপরীত অবস্থা খুঁজে পেয়েছেন।

অহিংস আন্দোলন থেকে যুদ্ধে পরিবর্তন করে মুজিব কি সাঙ্ঘাতিক ভুল করেছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে জনাব নারায়ণ বলেন, “মুজিবকে বিচার করার জন্য বিচারকের আসনে বসা আমার পক্ষে সম্ভব না”। যেকোনো ঘটনায় তিনি সামান্য অস্ত্রে-সজ্জিত আক্রমণাত্মক বাংলাদেশ বাহিনীর মধ্যে অহিংস প্রতিরোধের লক্ষণ দেখেছেন। ইয়াহিয়া পরিষ্কারভাবে হিটলারের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন এবং স্বাধীনতা আন্দোলন নিশ্চিহ্ন করার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেছিলেন। একজন সত্য গান্ধীবাদী হিসেবে জনাব নারায়ণ বলেন, একটি পরিস্থিতি যা মানুষের মর্যাদা অসম্মানজনক অবস্থায় পরিচালিত করতে পারে, এমতাবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই অস্ত্র হাতে নেয়া পরিস্থিতির দাবি হয়ে উঠে।

তারপর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে- ভারতের কি করা উচিত? জনাব নারায়ণ কোন শর্ত ছাড়াই পরিষ্কার করে বলেন যে, এমনকি আমি আগেও বলেছি বাংলাদেশ সরকার গঠন এবং আবারো বলছি ভারতকে অবশ্যই বাংলাদেশের ধারণা স্বীকার এবং যথাসম্ভব সহযোগীতা করতে হবে। এটা বোধগম্য হতে পারে যে, ইহা ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানের সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য পরিচালিত করতে পারে কিন্তু এটি একটি অনিবার্য ঝুঁকি। তিনি দ্রুত যোগ করেন যে, তিনি কোন যুদ্ধে প্ররোচিত করা ও ভারতের বিপক্ষে সামরিক উদ্যোগ চান না। ভারতের বাংলাদেশ স্বীকৃতির মাধ্যমে তিনি আশা করেন যে, আক্রান্ত এলাকাসমূহে অন্যান্য দেশের বস্তুগত সাহায্য পৌঁছাবে।

জনাব নারায়ণ নির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি উদ্বাস্তুদের নিরাপদে তাদের বাড়ি ফিরতে কতদিন সময় লাগবে। ছয় মাস, আবার এক বছরও লাগতে পারে। তবে তিনি আশা করেন যে তাদের প্রত্যাবর্তনের জন্য অনুকূল অবস্থা অবশ্যই তৈরি করা হবে। এবং তার মানে এই যে, বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার সামরিক দাসত্বের সমূলে উৎপাটনের মাধ্যমে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৫৯। জনসঙ্ঘের সভাপতি বাজপায়ি কর্তৃক অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের দাবি স্টেটসম্যান ১২ জুলাই ১৯৭১

Saiful Arefin Borshon
<১২, ১৫৯, ৪২৪>
অনুবাদ

প্রধানমন্ত্রি বাংলাদেশের কাছে করা প্রতিশ্রুতির প্রতি অবজ্ঞা করেছেনঃ বাজপেয়ী
(নিজস্ব প্রতিবেদক)

ভূপাল, ১১ই জুলাই, জনসংঘের সভাপতি অটল বিহারী বাজপেয়ী অভিযোগ করেন যে প্রধানমন্ত্রি সংসদে বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার যে অঙ্গীকার করেছিলেন, তা অনেকটা বিদ্রূপের মত।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ভারতের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ হবার সম্ভাবনাও আছে।
শক্তিশালী দেশগুলোর চাপের কারনে ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারছেন না।

মুক্তি ফৌজ ও পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের দীর্ঘ গেরিলা যুদ্ধের কারনে দেশের পূর্বাঞ্চলের অংশ বিশেষ পশ্চিম বাংলা, আসাম, নাগাল্যান্ড এবং বিহারের অবস্থাও খারাপ হতে পারে। অস্ত্র ও গোলাবারুদ নকশাল ও অন্যদের দ্বারা ভারতের পাশাপাশি রাজ্যগুলোতে পাচার হচ্ছিল।

তিনি প্রধানমন্ত্রির প্রতি জোরালো আবেদন করেন যেন প্রধানমন্ত্রি দ্রুত জাতিয় ঐক্য পরিষদের এক সভা ডাকেন এবং কমিউনিজমকে উৎখাত করতে গিয়ে যাতে বাংলাদেশের এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিকে দূরে ঠেলে না দেন।

এজেন্সি আরো যোগ করে যে, তিব্বতের মত অবস্থা দেখতে না চাইলে বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন দিতে দেরি করা উচিত নয়। স্বীকৃতি দেওয়ার পর সব ধরনের সাহায্য এবং সামরিক সাহায্য দেয়া যেতে পারে বলে যোগ করেন বাজপেয়ী।

বাজপেয়ী অভিযোগ করেন যে মিড টার্ম পোলের আগে আহামেদাবাদে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে প্রতারনার মাধ্যমে প্রায় ৪২ লক্ষ রুপি তোলা হয়েছে।
সংবাদকর্মীদের তিনি বলেন, বিশ্বস্ত সূত্রে তিনি জানতে পেরেছেন ৮০ লক্ষ রুপি তোলা হয়েছে কিন্তু গতকাল চিঠির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ওয়াই বি চ্যাবন জানান যে টাকার পরিমান ৪০ লক্ষ।

বাজপেয়ী বলেন যে, চিঠিতে চ্যাবন উল্লেখ করেছেন যে কর্মচারীসহ কিছু মানুষকে আটক করা হয়েছে এবং কিছু টাকা উদ্ধার করা হয়েছে।

যদিও বাজপেয়ী ব্যাংক এর নাম বলতে অস্বীকৃতি জানান এবং বলেন যে দিল্লির স্টেট ব্যাংক শাখার ঘটনার সাথে এই ঘটনার মিল রয়েছে।

তিনি একটি শক্তিশালী কমিশন গঠন করে এই দুই মামলার অনুসন্ধান করার দাবি জানান।

শিরোনাম সুত্র তারিখ
১৬০। “বাংলাদেশের স্বীকৃতির পক্ষে সবাই একমত, তবু সরকার নীরব কেনো? ”
মিঃ সমর গুহ, এম.পি এর প্রবন্ধ আনন্দবাজার ১২ জুলাই, ১৯৭১

Russell Rahman
<১২, ১৬০, ৪২৫-৪২৬>

বাংলাদেশের স্বীকৃতির পক্ষে সবাই একমত, তবু সরকার নীরব কেনো?

বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নে ভারতের জাতীয় জনমত প্রায় সর্বসম্মত ভাবে এক। ভারতের অধিকাংশ বিধান সভা, প্রতিটি বিরোধী দল, উচ্চ সারির আইনজিবী এবং অগণিত জনসভা বাংলাদেশের আশু স্বীকৃতি দাবী করেছে। একমাত্র মুসলিম লীগ এবং মজলিস-ই-মাসারওয়াত ছাড়া প্রতিটি মুসলিম সংগঠন এবং রাজ্য বিধান সভা ও পার্লামেন্টের মুসলিম সদস্যরাও এই দাবী সমর্থন করেছেন। বাংলাদেশকে আশু স্বীকৃতি দানের প্রস্তাব নিয়ে সম্প্রতি পার্লামেন্টে যে বিতর্ক হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে কংগ্রেস পার্লামেন্টারি দলে পরপর তিন দিন যে আলোচনা হয়েছে, তাতে সব বক্তাই শুধু যে স্বীকৃতি দাবী করেছেন তাই নয়, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আরো কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সরকারের কাছে তীব্র ভাবে অনেক দাবী জানিয়েছেন। পার্লামেন্টের দুই দিনের বিতর্কে প্রায় প্রতিটি সদস্য আশু স্বীকৃতি দানের প্রস্তাব সমর্থন করেছেন। ফ্রী ভোট হলে প্রস্তাবটি ভোটাধিক্যে গৃহীত হয়। শুধু সরকার আশ্চর্যজনক ভাবে নীরব। একটি গণতান্ত্রিক দেশে সরকার ও জাতীয় জনমতের এমন পার্থক্য অত্যন্ত অসংগত।

বাংলাদেশ ও বিশ্বজনমত

বাংলাদেশের উপরে ইয়াহিয়া শাহীর গণহত্যার বর্বর অভিযানের বিরুদ্ধে এবং বাঙ্গালীর স্বাধিকারের সমর্থনে আজ বিশ্বের সংবাদপত্র এবং জনমত সোচ্চার। এমন আন্তর্জাতীয় ঘটনা যুদ্ধোত্তর বিশ্বের ইতিহাসে খুব বেশী ঘটেনি।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন যে, ভারত ছাড়া বিশ্বের কোন রাষ্ট্রই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে রাজী নয়। কিন্তু শ্রী জয় প্রকাশ নারায়ণ ৪৮ দিনে ১৮টি বিদেশী রাষ্ট্র সফর করে বলেছেন যে, ভারত স্বীকৃতি দিলে অবিলম্বে অন্তত বিশ্বের চার-পাঁচটি রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে।

ভারতের মস্কো মিশন নয়াদিল্লী কে জানিয়েছে, “রাশিয়া বাংলাদেশের অস্তিত্ব বাস্তব ঘটনা বলে মেনে নিয়েছে”। বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রশ্নে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সোচ্চার ধ্বনি শুনেও নিশ্চিন্তে এই সিদ্ধান্ত করা যায় যে, রাশিয়া এরূপ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিরোধী নয়। বিদেশের বহু রাষ্ট্রবিদ বলেছেন যে, “বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের প্রশ্নে পথ দেখাতে হবে ভারত কে।

সরকারি আপত্তি কেনো?

নীতিগত ভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের বিরোধী নন ভারত সরকার। তবে ভারত সরকার মনে করেন যে, এখন স্বীকৃতি দিলে বাংলাদেশের পক্ষে সহায়ক হবে না, বরং ক্ষতি করা হবে। অর্থাৎ সরকারি ভাষায় “হেল্পফুল হবে না, হবে হার্মফুল হবে”। এদিকে বাংলাদেশের জাতীয় সরকার এবং সমগ্র জাতীয় দল বারবার বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের আবেদন জানাচ্ছেন। বাংলাদেশের পক্ষে কোনটা স্বার্থসম্মত এবং কোন কাজ ক্ষতিকর সেই বিচারের প্রধাণ যোগ্যতা এবং অধিকার যে বাংলাদেশের সরকারের, – এই মূল কথাটি স্বীকার করে নিয়ে ভারত সরকারের বরং স্পষ্ট করে বলা উচিত যে ভারতের স্বার্থে ভারত সরকারের পক্ষে এখন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া সম্ভব নয়, যদিও ভারত মনে করে যে বাংলাদেশকে আশু স্বীকৃতি দেওয়াই ভারতের পক্ষে স্বার্থসম্মত। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সম্বন্ধে বলেছেন, ‘রাইট টাইমে রাইট ডিসিশন নেওয়া হবে’। এই সঠিক সিদ্ধান্তের ঠিক সময়টি কখন আসবে? ঠিক সময় ও ঠিক সিদ্ধান্তের নিয়ামক বা নির্ণায়ক অথবা পারিপার্শ্বিকতার সূচকই বা কি?

সরকারি ধারণা নির্ভুল নয়

বাংলাদেশের গণভ্যূত্থানের পরে ভারত সরকার মনে করেছিলেন যে, পিন্ডি সরকার পশ্চিম পাক সীমান্ত থেকে পূর্ব বাংলায় ফৌজ পাঠাতে সাহসী হবে না। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিরোধী দলের নেতাদের বৈঠকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রী জগজীবন রমা বলেন যে, ’৩০ লক্ষের বেশী শরণার্থী ভারতে আসবেনা’। ভারত সরকারের আরো ধারণা হয়েছিলো যে সামরিক খরচ এবং পূর্ব বাংলার বিপর্যয়ের কারণে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙ্গে পড়বে। ভারত সরকারের এই তিনটি ধারণার একটি ধারণাও সঠিক প্রমাণিত হয়নি।

পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের বিকল্প

পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ পরিহারের একমাত্র রাজনৈতিক বিকল্প পন্থা হলো বাংলাদেশের আশু স্বীকৃতি দান। বাংলাদেশের সরকার স্বীকৃতি লাভ করলে যে রাজনৈতিক ও সামরিক উদ্যমের স্বাধীনতা লাভ করবে তার সুযোগে শুধু ভারতের কাছ থেকেই নয় বিশ্বের আরো কয়েকটি রাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ যে সামরিক ও রাজনৈতিক এবং আর্থিক সহযোগিতা লাভ করবে তার সংবাদ ভারত সরকারেরও অজানা নয়।

স্বীকৃতি লাভ করলে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ভারতে আগত উদ্বাস্তুদের ভিতর থেকে এক লক্ষ শক্তির গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলাও অসম্ভব হবেনা। স্বীকৃতি লাভ করলে যে প্রকাশ্য ও প্রত্যক্ষ সাহায্য লাভের সুযোগ বাংলাদেশ সরকার পাবে, সেই সুযোগ গ্রহণ করে মুক্তি ফৌজের পক্ষেই পাক ফৌজের কবল থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করে বাংলাদেশের স্বাধীন্তা সম্পূর্ণ করা সম্ভব হবে।

শিরোনাম সুত্র তারিখ
১৬১। বিহার রাজ্যে বাংলাদেশ সম্মেলন সমিতির জয়প্রকাশ নারায়ণের দাবীঃ অবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া হোক
‘কম্পাস’
১৭ জুলাই, ১৯৭১

Russell Rahman
<১২, ১৬১, ৪২৭-৪২৯>

বাংলাদেশের স্বীকৃতি সম্পর্কে জয়প্রকাশ নারায়ণ

সম্প্রতি ৬ই জুলাই পাটনায় বিহার রাজ্যে বাংলাদেশ সম্মেলন সমিতি কতৃক আয়োজিত এক জনসভায় দেশের সব রাজনৈতিক দল, শ্রমিক সংস্থা এবং স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান সমূহের উদ্দেশ্য সর্বোদয় নেতা শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণ এই মর্মে আবেদন করেন যে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর বিশেষ চাপ দেবার ব্যবস্থা করেন। বাংলাদেশ স্বীকৃতি পেলেই ঐ দেশের মুক্তিযোদ্ধের পক্ষে উপযুক্ত পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র পেয়ে ইয়াহিয়া খানের হানাদারী বাহিনীর বিরুদ্ধে মোকাবেলা করা সহজ হয়ে উঠবে।

শ্রী নারায়ণ এই অভিমত প্রকাশ করেন যে বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খানের সেনারা যে যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে তার ফলে ভারতকে এক ভীষন সংকটের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এই সংকটের মধ্যে দিয়েই ভারতকে প্রকৃত পরীক্ষা দিতে হবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। এই সংকটের মাঝেই ভারত সুদৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ হবে অথবা তাকে ভাঙ্গনের মুখে দাঁড়াতে হবে। আজ বাংলাদেশ যে যুদ্ধ চলছে তার বোঝা ভারতকে বহন করতেই হবে। বাংলাদেশ পরাজিত হলে, পরিণামে ভারতকেও পরাজয় বরণ করতে হবে। এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনগণের সঙ্গে ভারত সামিল হয়ে গেছে।

শ্রী নারায়ণ বলেন যে, পাকিস্তানের ওপর অন্যান্য রাষ্ট্রদের রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির জন্য ভারত অপেক্ষা করতে পারে না। বাংলাদেশের জনগণ যে রায় দিয়েছেন তার মর্যাদা ভারতকে দিতে হবে। পাকিস্তান বাংলাদেশে যে নিপীড়ন ও অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে তা থেকে সরে দাঁড়াবে না। আর তার নীতিরও পরিবর্তন ঘটাবে না। এমতাবস্থায় এক্ষুনিই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হবে। আর অস্ত্রশস্ত্রের যোগান দিতে হবে। ভারতের স্বার্থেই এ কাজটা করতে হবে। কারণ বাংলাদেশ থেকে যারা শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে, তাঁদের আগমনের ফলে এদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নানা রকমের জটিল সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। বর্তমানে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে বাংলাদেশে সামরিক অভিযান চালাতে গিয়ে পাকিস্তানের সামরিক চক্র যে টাকা খরচ করছেন, তার চাইতে তিন চারগুণ বেশী টাকা খরচ করতে হচ্ছে ভারতকে বিনা যুদ্ধেই। যদি কেউ মনে করেন যে যুদ্ধ চলতে থাকলে পাকিস্তানের কাঠামো ভেঙ্গে পড়বে, তাহলে তিনি ভুল করবেন। পাকিস্তানের অর্থনীতি বানচাল হয়ে যাওয়ার জন্য আরো দু’ডিভিসন সৈন্য সংগ্রহ করছে।

তিনি আরো বলেন যে, বাংলাদেশে যুদ্ধ চলছে, তাকে বাইরে থেকে মনে হবে গৃহযুদ্ধ। কিন্তু বাস্তবে এ যুদ্ধ গৃহযুদ্ধ নত। এ যুদ্ধকে সাম্রজ্যবাদী একটা জাতীয় সঙ্গে একটি মুক্তিকামী ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের জনগণের যুদ্ধ হিসেবে গণ্য করা উচিত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বার্তা বহন করে তিনি এটা উপলব্ধি করেছেন যে, বাংলাদেশের ব্যাপারে বিদেশে পাকিস্তানী সামরিক চক্রের ভারত বিরোধী প্রচারকার্য ব্যর্থ হয়েছে। পাকিস্তান বিদেশে এরকম একটা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলো যে পাকিস্তানে বাংলাদেশকে নিয়ে যে রাজনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে, তার মূলে আছে ভারত। অবশ্য পাকিস্তানের এরকম ধারণা সৃষ্টির চেষ্টা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। তবে বাংলাদেশের সমস্যাবলী নিয়ে বিশ্বের দুটি রাষ্ট্র অর্থাৎ আমেরিকা ও ফ্রান্স অদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং তাঁকে এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো যে পাকিস্তানকে আরো অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা হবে না। কিন্তু পরবর্তী দেখা গেলো, যুক্তরাষ্ট্র সরকার পাকিস্তানে আরো ছ’সাত জাহাজ বোঝাই অস্ত্রশস্ত্র পাঠিয়েছে। ফ্রান্স সরাসরি পাকিস্তানকে অস্ত্রশস্ত্র না পাঠালেও, সেখানে খোলাবাজারে পাকিস্তানের জনগণের কাছে অস্ত্রশস্ত্র বিক্রি করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক (এইড টু পাকিস্তান) কমিটি সাহায্য দেওয়া বন্ধ রাখলেও, দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বলে পাকিস্তান সাহায্য পেতে থাকবেই।

এখন ভারতের প্রায় ৭০ লক্ষ শরণার্থী এসেছে বাংলাদেশ থেকে। অদূর ভবিষ্যতে এই সংখ্যা এক কোটিতে দাঁড়াবে। পাকিস্তান এমন একটা কৌশল অবলম্বন করতে চাইছে যার ফলে এদেশে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্য্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধে। এ ব্যাপারে ভারতকে সতর্ক থাকতে হবে। যদি ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেধে যায়, তাহলে পাকিস্তানের হাত বাংলাদেশে আরও শক্ত হবে এবং পরিণামে বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রাম বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। কিছুকাল আগে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে বলেছিলেন সময় এলেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হবে। এখন প্রশ্ন হলো, সে সময় আসবে কবে? বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে গড়িমসি করা হলে, ভারতের সমস্যাবলী আরও জটিল হয়ে পড়বে। অথচ, এটা ঠিক যে একদিন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতেই হবে। বাংলাদেশকে এক্ষুনি স্বীকৃতি না দিলে আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে। আর সারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শান্তি বিঘ্নিত ও বিপন্ন হবে। এ জন্য যদি যুদ্ধ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, আমাদের অবশ্যই যুদ্ধ করতে হবে।

বিহার রাজ্য বাংলাদেশ সম্মেলন সমিতির ঐ সভায় সভাপতিত্ব করেন রাজ্যপাল শ্রী দেবকান্ত বড়ুয়া। শ্রী বড়ুয়া বলেন যে, ভারত পাকিস্তানের একনায়কতন্ত্রের বিরোধী। আজ বাংলাদেশে যে কায়দায় বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হচ্ছে, ঠিক সে কায়দায় একদিন হিটলার বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিলেন। কিন্তু ইতিহাস এই সাক্ষ্য বহন করেছে যে, পাশবিক কার্যাবলী কখনোই পরিণামে টিকে থাকে না। এর অন্যথা হলে, হিটলার অবশ্যই চুড়ান্ত পর্যায়ে সফলকাম হতেন।

তিনি আরও বলেন যে, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের ও দুর্গত শরণার্থীদের সাহায্য দেওয়ার জন্য এ পর্যন্ত বিহারের জনগণ ২৭ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করেছে। এ দেখেই বুঝা যায় বিহারের আপামর জনসাধারণ বাংলাদেশের এই মুক্তি সংগ্রাম সম্পর্কে কী সহানুভূতিশীল মনোভাব গ্রহণ করেছেন। বিহারের আধিবাসীগণ বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ৫০ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করার এক কর্মসূচী নিয়েছে।

সারা ভারত এস.এস.পি দলের সভাপতি শ্রী কর্পুরী ঠাকুরও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থনে ভাষণ দেন।

বাংলাদেশের চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ডঃ এ. কে. মল্লিক বলেন, বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনে বিহারের জনগণ যে ভূমিকা করেছেন তা কোনোদিনই বাংলাদেশের মানুষ ভুলবে না। তিনি আরও বলেন যে বাংলাদেশের মানুষ স্বায়ত্তশাসনের অধিকার চেয়েছিলেন পাকিস্তান থেকে বিছিন্ন পাকিস্তান হয়ে যেতে চায়নি। স্বায়ত্তশাসনের যে দাবী বাংলাদেশের মানুষরা করেছিলেন, সেই অপরাধে ২৫শে মার্চের মধ্য রাত্র থেকে পাকিস্তানি সামরিক চক্র নিরস্ত্র ও নিরীহ জনসাধারণের ওপর হত্যার অভিযান শুরু করে দেয় এবং এই হত্যাকাণ্ডই শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ নামে এক নতুন রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। বাংলাদেশে বাংগালী হিন্দুদের মধ্যে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে পাকিস্তানী কতৃপক্ষ যে কৌশল অবলম্বন করেছেন, তার মূল লক্ষ্য হলো ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বানচাল করে দেওয়া। এ সম্পর্কে ভারতের জনগণকে সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে।

ডঃ মল্লিক আরও বলেন যে, বাংলাদেশে বাঙ্গালি হিন্দু ও বাঙ্গালি মধ্যে কোনো শক্তিই ফাটল ধরাতে পারবে না। শেষ পর্যন্ত বাংলার মুক্তিকামী মানুষ জয়ী হবেই। এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে বাংলাদেশে এখন যে যুদ্ধ চলছে তা হলো গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার যুদ্ধ। এমতাবস্থায় গণতান্ত্রিক ভারতের জনগণ যদি বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন তাহলে বাংলাদেশের মুক্তি আরও ত্বরান্বিত হবে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৬২। ‘সেন্ট্রাল এ্যাকশন কমিটি অফ বাংলাদেশ’- এর বিবৃতি এবং খসড়া প্রস্তাব পুস্তিকা জুলাই, ১৯৭১

নীতেশ বড়ুয়া
<১২, ১৬২, ৪৩০-৪৩৪>
অনুবাদ

সেন্ট্রাল
এ্যাকশন কমিটি অব বাংলাদেশ

চেয়ারম্যান .. .. .. জয়প্রকাশ নারায়ণ
ট্রেজারার .. .. .. মিসেস সাবিত্রি নিগাম
কনভেনার .. .. .. এস.কে. দে
জয়েন্ট কনভেনার .. .. .. এস.ডি. শর্মা

সহযোগী প্রতিষ্ঠান
১। সর্ব সেবা সংঘ, গোপুরি, ওয়ার্ধা
২। দিল্লি সর্বদয়া মন্ডল, রাজঘাট, নিউ দিল্লী
৩। গান্ধী স্মারক নিধি, রাজঘাট, নিউ দিল্লী
৪। ন্যাশনাল কমিটি ফর গান্ধী মিউজিয়াম, নিউ দিল্লী
৫। গান্ধী পিস ফাউন্ডেশন, দ্বীন দয়াল উপাধ্যায় মার্গ, নিউ দিল্লী
৬। সার্ভেন্টস অফ দ্য পিপলস সোসাইটি, লাজপট ভবন, নিউ দিল্লী
৭। লোকতন্ত্র রক্ষা পরিষদ, লাজপট ভবন, নিউ দিল্লী
৮। অল ইন্ডিয়া প্রহিবিশন কাউন্সিল, ২৮ থিয়েটার কমিউনিকেশন বিল্ডিং, কনাট প্লেস, নিউ দিল্লী
৯। এ্যাসোসিয়েশন অব ভলান্টারি এজেন্সিজ ফর র‍্যুরাল ডেভেলপমেন্ট (এভিএআরডি), এ-২৩, কৈলাশ কলোনি, নিউ দিল্লী
১০। অল ইন্ডিয়া পঞ্চায়েত পরিষদ, ১-৩৩, কৈলাশ কলোনি, নিউ দিল্লী।

কাপুর প্রিন্টিং প্রেস, দিল্লী হতে মুদ্রিত এবং সেন্ট্রাল এ্যাকশন কমিটি অফ বাংলাদেশ, নিউ দিল্লীর জন্য এস.ডি. কর্তৃক প্রকাশিত

সেন্ট্রাল
এ্যাকশন কমিটি অব বাংলাদেশ
স্টেটম্যান

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ হচ্ছে বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) জনতার ইতিহাসের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিন। এই দিনে, একচেটিয়া ব্যবসায়িক স্বার্থ দ্বারা যারা পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ববঙ্গকে উপনিবেশ হিসেবে শোষন করছিল, সেই পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বাহিনী নিরস্ত্র মানুষের উপর গণহত্যার ব্যাপক পরিকল্পনা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশের মানুষের অপরাধ, ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে জনগণ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের পক্ষে জাতীয় গণপরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং রাজ্যের বিধানসভায় একচেটিয়া প্রাধান্য লাভে তাদের রায় দিয়ে আশ্বস্ত করেছিল। আওয়ামী লীগের বিজয় ছয় দফা কর্মসূচির উপর ভিত্তিতে হয়েছিলো যা বাংলাদেশের জনগণের জন্য কার্যকর স্বায়ত্তশাসনের দাবী করেছিল।

২। জবরদখল ও হস্তক্ষেপের এই সময়টাতে অগণিত নারী, পুরুষ ও শিশু প্রাণ হারিয়েছে এবং পাকিস্তানী বাহিনীর নৃশংসতা কুখ্যাত চেঙ্গিস খানকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। বস্তুত জাতিসংঘ সনদ, মানবাধিকার ঘোষণাপত্র ও বেসামরিক ব্যক্তিদের সুরক্ষা সংক্রান্ত জেনেভা কনভেনশনের লঙ্ঘনের চাইতে বৃহত্তর কিছু হতে পারে না। নির্যাতিতরা যারা ভারতে আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে তাদের সংখ্যা ইতোমধ্যেই ৭০ লক্ষ। জীবনের জন্য পলায়নরত বাঙালীদের ক্রমাগত আগমন এখনো হ্রাস পায়নি, এই অনাখাঙ্খিত বোঝা দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিকতার উপর প্রভাব বিস্তার করছে।

৩। শেখ মুজিবুর রহমানের দল এই বলপ্রয়োগের ঘটনার উপর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এবং একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করেছেন, যদিও ওয়ার্ল্ড প্রেসের মাধ্যমে বাংলাদেশে যা ঘটছে তা ব্যাপকভাবে সারা জাগিয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশের সরকারও এই নজিরবিহীন অপরাধের নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছেন। এর চাইতেও খারাপ, যা হচ্ছে, কিছু কিছু দেশ হতে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তার সাহায্য হিসেবে অস্ত্রের যোগান অব্যাহত আছে যা ভারতীয় উপমহাদেশের নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির সাম্প্রতিক বিবৃতি সামরিক জান্তা হতে রাজনৈতিক সমাধানের আশাকে আরো ধূলিসাৎ করে দিয়েছে।

৪। আমাদের সংসদে ক্ষমতাসীন দল, বিরোধী দল এবং দেশের সাধারণ মানুষ সচেতন যে বাংলাদেশের জনগণের এই জরুরী অবস্থায় যদি সাহায্য করতে না পারি তবে তা ভারতের গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। এমনতরো গুরুতর সঙ্কটে জনগণের সাংবিধানিক ইচ্ছা প্রকাশের ভিত্তিতে সর্বজনস্বীকৃতভাবে সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে যে সমাধান হিসেবে আমাদের সরকারের উচিত বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে স্বীকার করে নেওয়া। শুধুমাত্র তখনই বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের প্রতি সম্ভাব্য সকল নৈতিক ও বৈষয়িক সাহায্য বাড়ানো যাবে। ভারত প্রথমেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিলে অন্যান্য বিদেশী সরকার এই ব্যাপারে নেতৃত্ব দিবে না। এই উদ্দেশ্যে দ্রুতই যদি অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি না হয় তবে লাখ লাখ শরণার্থীদের বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার কোন আশাই থাকছে না এবং যতদিন পাকিস্তানের সামরিক জান্তার পদতলের অধীনে বাংলাদেশের লোকেদের আর্তনাদ চলতে থাকবে ততদিনেও এটা সম্ভব হবে না।

৫। সম্ভবত আমাদের সবচেয়ে বড় বাঁধা হল এই ব্যাপারে সরকারে জনসমর্থনপুস্ট আমাদের কোন পথপ্রদর্শক নাই

যিনি পুরো ব্যাপারটি বুঝে নিয়ে স্বীকৃতির ব্যাপারে যুক্তিসম্মতভাবে এগিয়ে যাবেন। এই বিষয় নিয়ে অনেকেই আলোচনা করেছে এবং সম্প্রতি একটি সংগঠন এই বিষয়ের উপর উদ্বিগ্ন প্রকাশ করেছে। এইটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে শ্রী জয়প্রকাশের সভাপতিত্বের অধীনে বাংলাদেশ নিয়ে সম্পূর্ণই নির্দলীয় ও বেসামরিক কার্যকরী একটি কমিটি গঠন করা হবে যিনি মাত্রই বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের চলমান বিষয়গুলোকে ব্যাখ্যা করার দীর্ঘ যাত্রা শেষে ফিরে এসেছেন। এই কমিটি সর্ব সেবা সংঘ, সার্ভেন্টস অব দ্য পিপলস সোসাইটি, লোকতন্ত্র পরিষদ, অল ইন্ডিয়া পঞ্চায়েত পরিষদ, এসোসিয়েশন অব ভলান্টারি ফর রুর‍্যাল ডেভেলপমেন্ট, দিল্লী সর্বোদয়া মন্ডল, গান্ধী স্মারক নিধি, গান্ধী পিস ফাউন্ডেশন এবং এই কর্মসূচীতে অন্যান্য যারাই অংশগ্রহণ করতে চায় তাদের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবে। তারা দেশব্যাপী প্রচারণা শুরু করবে এবং সকল রাজ্যের যারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি আবদ্ধ সেই সব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলোকে সচল করবে। কার্যক্রমটি প্রাথমিকভাবে যা বিবেচনা করবে তা নিম্নরূপঃ

ক) কেন্দ্রীয় রাজধানীসহ গ্রামাঞ্চলে, শহরে, নগরে এবং রাজ্যের রাজধানী ও ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত এলাকায় বাংলাদেশ নিয়ে কার্যক্রমের বিষয়ের উপর বিশেষভাবে ডাকা সভায় নির্ণিত সংকল্পগুলো ( সংযুক্ত খসড়ায় লাইনগুলোর উপর ইঙ্গিত করা আছে) পাবলিক সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের দ্বারা এবং জনতার দ্বারা নির্ধারিত হবে। এইসব সভায় নির্ধারিত নির্ণিত সংকল্পগুলো প্রধানমন্ত্রী বরাবরে তুলে ধরা হবে।
খ) বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি প্রদানে ভারত সরকারের উপর একটি বিশেষায়িত প্রচারণার সনির্বদ্ধ অনুরোধ।
গ) উপযুক্ত সময়ে বাছাইকৃত বিষয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন।

৬। আশা করা যায় যে, ভারত সরকার যখন বাংলাদেশের বিষয়ে দৃঢ় পদক্ষেপ নিবে তখন নৈতিক ও বৈষয়িক সমর্থন আদায়ে পুরো দেশজুড়ে রাজনৈতিকভাবে নির্দলীয় রেখাচিত্রের উপর প্রকাশ্যে বিতর্কের আয়োজন করা হবে। স্বাধীন সত্ত্বা হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রাক্কালে এর সম্ভাব্য পরিণাম সম্পর্কে ভারতের জনগণকে তা প্রস্তুত করবে। যদি সরকার এই পদক্ষেপ নিতে অনীহা প্রকাশ করে, তাহলে সরকারকে এই পদক্ষেপ তৈরী করতে দেশের মধ্যে যথেষ্ট রকমের চাপ সৃষ্টি করতে এই প্রচারণা তীব্রতর করা হবে। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার এই সংবেদশীল অঞ্চলে এমনতরো পরিস্থিতির গুরুত্বের প্রতি বৈশ্বিক মতামতকে সক্রিয় করতে সাহায্য করবে।

৭। ৪ঠা জুলাই রবিবারে গান্ধী পিস ফাউন্ডেশনে চেয়ারম্যান শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণ অল ইন্ডিয়া পরিষদের প্রেসিডেন্ট এস.কে. দে’র সাথে কনভেনার হিসেবে এবং সার্ভেন্টস অব দ্য পিপলস সোসাইটির লোকতন্ত্র রক্ষা পরিষদের সেক্রেটারি শ্রী এস.ডি. শর্মার সাথে জয়েন্ট কনভেনার হিসেবে অনুষ্ঠিত সভায় এই উদ্দেশ্যে যেখানে একটি কার্যকরী কমিটি গঠিত হয়। বাংলাদেশ নিয়ে এ্যাকশন কমিটির হেডকোয়ার্টার লাজপত ভবন, লাজপত নহর, ২৪ নিউ দিল্লীতে হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যেখানে অনুগ্রহ করে সকল চিঠিপত্র, টেলিগ্রাম এবং বাংলাদেশের ঘটনার জন্য চাঁদা পাঠানো যেতে পারে।

লাজপত ভবন,
লাজপত নগর, নিউ দিল্লী-২৪,
১২ই জুলাই, ১৯৭১।

নির্ণিত সংকল্প
এই সভায়………………………………………………………………………………………………………………………এতদ্বারা

অনুগ্রহ করে নথিবদ্ধ করুন, বাংলাদেশের জনতার জন্য তাদের কষ্ট ও নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণার কাছে আমাদের গভীর সমবেদনা ও সমর্থন রয়েছে;

সামরিক শাসকদের দ্বারা বাংলাদেশের নিরস্ত্র পুরুষ, নারী এবং শিশুদের উপর এই দ্ব্যর্থহীনভাবে নিন্দনীয় অমানবিক নৃশংসতা ও গণহত্যা যার ফলস্বরূপ, লাখ লাখ বাঙালীর ভারতের দিকে যাত্রা যা এই দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিকতার উপর অনাকাঙ্খিত বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে,

দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক তাড়না এবং তাদের যথাযথভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা দ্বারা অবদমন জাতিসংঘ সনদ এবং মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের চরম লঙ্ঘন;

ভারতের সরকারের কাছে আবেদন এই যে জনগণের রায় মোতাবেক গঠিত বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান এবং সম্ভাব্য সকল প্রকারের নৈতিক ও বৈষয়িক সাহায্য পর্যন্ত প্রসারিত করা যাতে শরণার্থীদের বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরী করতে পারে;

বর্তমান সংকটে দেশের জনগণের প্রতি আবেদন এই যে যেন জাতীয়ভাবে সচেতনতা এবং সংহতি বাড়িয়ে তোলা যায় এবং কোন প্ররোচনা স্বত্বেও আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্য চেতনায় সাম্প্রদায়িক শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখা; বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আবেদন যেন বাংলাদেশের মানুষের কাছে তাদের সহানুভূতি ও সহযোগীতা বাড়ানো হয় এবং সেইসব দেশের লোকদের ফেরত আনা হয় যারা এখনো পশ্চিম পাকিস্তানকে অস্ত্রের যোগান দিচ্ছে, যাতে তাদের সরকার আগুনের তেল ঢালার মতো পাকিস্তানী আগ্রাসনকে প্রতিরোধ করতে পারে; এবং

ভারত সরকারের কাছে সকল প্রকার সমর্থন এবং সহযোগীতার অঙ্গীকার পূরণের উদ্দেশ্য অনুসারে উপরোক্ত রূপরেখা বর্ণিত হয়েছে।

শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণের প্রেস স্টেটমেন্টের উদ্ধৃতাংশ

বর্তমান সঙ্কট এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে হয় তা একীভূত, ঐক্যবদ্ধভাবে শক্তিশালী এবং গ্রাহ্যনীয় অথবা মনোবলহীন হিসেবে বিভ্রান্ত এবং মেরুদন্ডহীন দূর্বল যা বিশ্বের কাছেই আর কিছুতেই গুরুত্ব রাখেনা। অতএব, এই বিষয়গুলোকে যেন আর কেউই বিভ্রান্ত না করে।

আমি যা পরামর্শ দিচ্ছিলাম তা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নয় বরং বাংলাদেশের জনতার সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক স্বীকৃত প্রদান। এটা সত্যি যে যখন সরকারের স্বীকৃতি ও প্রকাশ্যে মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করায় পাকিস্তান ভারতের সাথে যুদ্ধ করাকে প্ররোচিত না করাটা যখন প্রশ্নবিদ্ধ তখন আমি স্বীকার করছি শুরু থেকেই অবশ্যই এর ঝুঁকি আছে, কিন্তু তা গৃহীত হতেই হবে।

যদি তা ভারতকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে বলার মতো সমতুল্য হয়, তাহলে অবশ্যই আমি একজন যুদ্ধবাজ বটে। পার্থক্য বলতে আমি যতটুকু বুঝেছি, শুধুমাত্র জনতা এবং ভারত সরকারের মাঝে আমার চিন্তা করার ধরন যা হচ্ছে স্বীকৃত দেওয়া যেতে পারে এমন সঠিক মুহূর্তের জন্য পরবর্তীতে অপেক্ষা করা, আমরা বলতে চাইছি যে এখনই সঠিক সময়।

সর্বসম্মতভাবে লোকসভা কর্তৃক নির্ণিত সংকল্প গ্রহণ এই পদক্ষেপের শুরু হিসেবে চমৎকার ছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সম্প্রতি বিভেদ সৃষ্টিকারী, পক্ষালম্বী পদক্ষেপের লক্ষণ পর্যন্ত আবির্ভূত হয়েছে। এটা বোধগম্য যে কালক্রমে এমনকি বাংলাদেশের মতো নির্দলীয় বিষয়েও দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য গড়ে উঠতে পারে, বিশেষ করে সরকারী দৃষ্টিভঙ্গি যখন ক্রমাগতই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে দ্বিধান্বিত।

এই মতবাদে প্রধান বাঁধাগুলো হচ্ছে, এক- ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের দ্বারা প্রতিনিধিত্বকারীরা যা নীতিগতভাবে স্বীকৃতির বিরুদ্ধাচারী নয় কিন্তু এর জন্যে প্রধানমন্ত্রীর সঠিক সময় বিবেচনার উপর ছেড়ে দেওয়া অভ্যাস জারি রাখতে চায়, যদিও কোন সেই বিষয় যা সঠিক সময় নির্ধারণ করবে তা পরিষ্কারভাবে জানাচ্ছে না। অন্য বাঁধাটি হচ্ছে প্রায় সকল বিরোধীদল সহ অনেক নির্দলীয় সংগঠন এবং আমার মতো স্বতন্ত্র ব্যক্তি যারা মনে করে স্বীকৃতি প্রদানের এখনই উপযুক্ত সময়।

২৮শে জুলাই, ১৯৭১।

শিরোনাম সুত্র তারিখ
১৬৩। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের দাবিতে সারা পশ্চিমবংগে সফল ধর্মঘট পালিত ‘যুগান্তর’ ৪ আগষ্ট, ১৯৭১

Russell Rahman
<১২, ১৬৩, ৪৩৫>

বাংলাদেশকে স্বীকৃতির দাবিতে সফল ছাত্র ধর্মঘট
(ষ্টাফ রিপোর্টার)

কলকাতা, ৩রা আগষ্ট স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতির দাবিতে মঙ্গলবার গোটা পশ্চিমবঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র ধর্মঘট হয়েছে। আজকের এই ছাত্র ধর্মঘটের উদ্যোগ দক্ষিণ-বাম সবকটি ছাত্র সংগঠনের। এদিন রাজ্যের সর্বত্র ছাত্র ধর্মঘট হলেও পরীক্ষা যথারীতি হয়েছে। ধর্মঘটের আওতা থেকে পরীক্ষা বাদ দেওয়া হয়েছিলো।

ছাত্র ধর্মঘটের পর ছয়টি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগঠন রাজা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে একটি ছাত্র জমায়েত ডাকেন। সেখানে সভা হয়। সফিউল আলম সভাপতি ছিলেন। সভার পর ছাত্ররা মিছিল করে রাজভবনের সামনে যায়। ছাত্র প্রতিনিধিরা রাজ্যপালের উদ্দেশ্যে একটি স্বারকলিপি দিয়ে চলে আসে।

স্বারকলিপিতে বলা হয়েছে যে, পশ্চিমবঙ্গের ছাত্র-ছাত্রীদের দাবী-স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে ভারত সরকারের স্বীকৃতি দিতে হবে। এবং কেবল স্বীকৃতিই নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার মুক্তিযোদ্ধাদের হাতকে শক্ত করার জন্য মুক্তিফৌজকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতে হবে।

রাজা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারের ছাত্রসভায় বক্তৃতা দেন বাম ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শ্রী সুভাষ চক্রবর্তী, পি-এস-ইউ’র ক্ষিতি গোস্বামী, ডি-এস’ওর সঞ্জিত বিশ্বাস, ছাত্র ব্লকের ভোলা কুন্ডু প্রমুখ। এই সভাস্থল থেকে এসপ্ল্যানেড ইষ্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ স্বীকৃতির দাবিতে ছাত্রদের বিক্ষোভ ধ্বনিতে সরগরম ছিলো।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৬৪। সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল কাউল কর্তৃক বাংলাদেশ প্রশ্নে সরকারী নীতির সমালোচনা হিন্দুস্থান স্টান্ডার্ড ৩১ জুলাই ১৯৭১

Raisa Sabila
<১২, ১৬৪, ৪৩৬-৪৩৭>
অনুবাদ

বাংলাদেশ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে আমরা ভুল করেছি, বললেন জেনারেল কাউল

৩০ জুলাই- ওয়াই এন ই বলছে, সাধারন পরিষদের প্রাক্তন প্রধান এবং বিতর্কিত “দ্যা ইউনাইটেড স্টোরি” এর রচয়িতা জেনারেল কাউল বাংলাদেশ বিষয়ে সঠিক সময়ে পদক্ষেপ না নেয়ায় তার সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছেন।

তার নতুন বই, “কনফ্রন্টেশন উইথ পাকিস্তান” এ জেনারেল কাউল বলেন, আমরা একটি বিশাল সুযোগ হারিয়েছি, এমন সুযোগ ভবিষ্যতে আর নাও আসতে পারে। আমরা বাংলাদেশ পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর একটা বিরাট অংশকে ধ্বংস করে তাদের দুর্বল করে ফেলতে পারতাম, যা আমাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্যই হুমকিস্বরূপ। কিন্তু আমরা সে সুযোগ হারিয়ে ফেলেছি।

জেনারেল কাউল মনে করেন, পাকিস্তান এবং চায়নার যৌথ সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার উদ্যোগ অবশ্যই হুমকিস্বরূপ এবং ভারতের উচিত এখনি এ বিষয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং জাপানের সাথে আলোচনায় বসা।

রাজনৈতিক নেতৃত্বের সমালোচনা করে, জেনারেল কাউল বলেন- ২৫শে মার্চ এর পর প্রথম দিকে যখন নানারকম মতামত দেওয়া হচ্ছিল যে ভারতের উচিত স্বাধীনতাবিরোধী এসব শক্তির জন্য প্রেরিত সাহায্যে আঘাত হানা, তখন কিছু ব্যক্তি ঝংকার তুলে সে উদ্যোগটি থামিয়ে দেয় এবং বলে যে এতে করে আমরা চায়নাকে আমাদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলবো।

কিন্তু নেফা ক্যাম্পেইনের ভয়াবহ স্মৃতিচারণ করে জেনারেল কাউল ব্যাঙ্গ করে বলেন- ‘কিন্ত সে ভয়ে কেন আমরা লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হব, যখন আমরা জানিই যে ভারতের আর্মি একি সাথে পাকিস্তান এবং চায়নাকে হারিয়ে দিতে সক্ষম’?

১৯৬২ সালে নেফা ছত্রভঙ্গ হবার শুরুর দিকেই জেনারেল কাউল তার নান্দনিক ক্যারিয়ারের ইতি টানেন স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে। তিনি ইতিমধ্যেই তার পূর্বের বইতে উক্ত ঘটনার জন্য রাজনৈতিক ভুমিকা, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নেহরু, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মিঃ ভি কে কৃষ্ণা মেনন কে তাদের ভুল সিদ্ধান্ত আর্মি কমান্ডারদের উপর চাপিয়ে দেয়ার বিষয়ে সমালোচনা করেছেন।
তার বর্তমান বইয়ে ১৬ জুলাইয়ে দেওয়া প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নাটকীয় ঘোষণা এবং প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই এর পিকিং ভ্রমনের আহবানে সাড়া দেওয়ার সর্বশেষ খবর সংযুক্ত হয়েছে।

জেনারেল কাউল বলে- “পাকিস্তান চায়নার সাথে মিলিত হয়ে আমাদের উপর হামলা চালাতে পারে এটি ধরে নিয়েই এখন আমাদের কুটনৈতিক আলোচনা জোরদার করতে হবে এবং বন্ধুত্বভাবাপন্ন রাষ্ট্রদের সাথে বসে এধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলার প্রস্তুতি নিতে হবে।

আমরা যাই করিনা কেন, চায়না বা পাকিস্তান যেন ভবিষ্যতে আমাদের বিরুদ্ধে কখনই কোন পদক্ষেপ না নিতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। যদি পাকিস্তান আমাদের বাধ্য করে এবং আমাদের পদক্ষেপ ই হয়, তবে উপযুক্ত মিত্রের সাথে মিলে প্রথম পদক্ষেপটি আমাদেরকেই নিতে হবে।

জেনারেল কাউল আরো বলেন, যদি ২৫শে মারচের পরপরি আমাদের আর্মি মুক্তিবাহিনীর সাহায্যে এগিয়ে যেত তাহলে আমরা প্রচুর সুবিধা পেতাম। আমরা পাকিস্তানী ট্রুপের দুইটি ডিভিশনকে হাতের নাগালে পেয়ে যেতাম, যারা ঐ সময়ে গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। সেটাই হত সবচেয়ে সঠিক ক্যাম্পেনিং সিজন।

সমুদ্রে আমরা পাকিস্তানীদের জাহাজের খালাস না করেই জাহাজ থেকে নামতে বাধ্য করতে পারতাম। সাধারন মানুষ, পাকিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে ছিল এবং তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য তাড়া চেতনার দিক থেকেও আমাদের পাশেই দাড়াতো। কিন্তু এই পদক্ষেপটি নাওয়া সম্ভব হত, যদি এর পরের পদক্ষেপগুলো নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা থাকতো। আসলে আমরা কিছু প্রাতিষ্ঠানিক আলোচনা আর ফিকে সহমর্মিতা জানানো ছাড়া আর কিছুই করিনি।

জেনারেল কাউল আরো বলেন- মে, ১৯৭১ থেকে পাকিস্তান পূর্ব বাংলায় নতুন ট্রুপ পাঠাবে, যার ফলে ৪টি ডিভিশন সেখানে কাজ করবে। এই মুহূর্তে আমরা তাদের থেকে অসুবিধাজনক অবস্থায় আছি। যদি আমরা মার্চ অথবা এপ্রিলেই পাকিস্তানের উপর হামলা চালাতাম, তাহলে আমরা একটা সুবিধাজনক অবস্থান থেকে যুদ্ধ শুরু করতে পারতাম।

“এখন সে সুবিধা শত্রুর হাতে চলে গিয়েছে, এখন উল্টো তাড়া সময় এবং স্থান নির্বাচন করে আমাদের উপর হামলা করতে পারবে। যারা ভাবেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেই যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে, তাদের প্রশ্ন করা উচিত যে স্বীকৃতি না দিলে কি যুদ্ধ এড়ানো যাবে?

পাকিস্তানে উদ্ভুত বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা বিশেষ করে তরুন আর্মি অফিসারদের সাহায্যে ক্ষমতা দখন করার জন্য মিঃ ভুট্টোর চেষ্টার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন- “ যদি ক্ষমতার লড়াইয়ে ইয়াহিয়া জিতে যায়, তবে তার ফল পাকিস্তানের দুই অংশকেই ভোগ করতে হবে।

বর্তমান পরিস্থিতে, জেনারেল কাউল বলেন- ইয়াহিয়া খানের হাতে এখন শুধুমাত্র একটি উপায় আছে আর তা হল ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা। যদিও, ভারতের সাথে পাকিস্তানের যুদ্ধ হোক বা না হোক, একটি বিষয় নির্দিষ্ট করে বলা যায় যে‌ -যদি নতুন কারো কাছে পূর্ববাংলার ক্ষমতা আসে, এবং তাই হচ্ছে এখন, পূর্ব এবং পশ্চিম বাংলা মিলে চায়নার ইন্ধনে বৃহত্তর বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারে।

এই দুই অঞ্চলকে এক ব্যানারে নিয়ে আসতে চায়না পূর্বেও ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করেছে, এবং এবার তাতে সফল হলে ভারত ও পাকিস্তানকে চরম মূল্য দিতে হবে। কোন সামরিক পরিকল্পনার রূপরেখা গঠন না করে, নেফা ক্যাম্পেইনে প্রাপ্ত যুদ্ধের ক্ষতগুলো আমাদের যে শিক্ষা দেয় তা হলঃ

“সময়ের মূল্য না বিচার করে পরিস্থিতি বিচার করে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে কখনই আমাদের সরকারের ঢিলেমি দেওয়ার কোন সুযোগ নেই, কেননা তার ফলাফল ভয়াবহ হবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এর সাথে শীঘ্রই আমাদের একটা চুক্তিতে আসতে হবে, যেন এই নতুন হুমকির মোকাবেলা করা সম্ভব হয়।

শিরোনাম সুত্র তারিখ
১৬৫। শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে কোলকাতায় বিরাট সমাবেশ ‘দৈনিক আনন্দবাজার’ ৮ আগষ্ট, ১৯৭১

Russell Rahman
<১২, ১৬৫, ৪৩৮-৪৩৯>

বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবীঃ
শত-সহস্র কন্ঠ মুখরিত আকাশে বাতাসে ওঠে রণি
(ষ্টাফ রিপোর্টার)

কলকাতা, ৭ই আগষ্ট- শনিবার মুজিবর দিবসে ময়দানে শিল্পী-সাহিত্যিকদের সমাবেশে শত-সহস্র কন্ঠে বঙ্গবন্ধু মুজিবরের মুক্তি এবং মানবতাবিরোধী ইয়াহিয়া চক্রের বিচারের দাবী সোচ্চার হয়ে ওঠে। বিশাল এই জনসমাবেশের অনুষ্ঠানসূচী ছিলো ছোট্ট। মুজিবের মুক্তির দাবী সম্বলিত প্রস্তাব পাঠ করলেন তাঁরা শংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ

“৭ আগষ্টের পুণ্যদিনে সমবেত শ্রেনী-মত-ভাষা নির্বিশেষে সর্বরূপ শিল্প সাহিত্যের স্রষ্টা, কর্মী ও অনুরাগীবৃন্দের এই সমাবেশ বিশ্বের সমস্ত জনগণ আর ছোট-বড় সমস্ত শক্তির দরবারে এই ব্যগ্র উৎকণ্ঠিত দাবিটি পৌঁছে দিতে চায় যে, পাকিস্তানের নরহত্যা শাসকদের গুমঘর থেকে বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানকে অবিলম্বে মুক্ত করে না আনলে ভবিষ্যেতের কাছে আজকের জগত কখনও মুখ দেখাতে পারবেনা- তাই, আমরা চাই মুজিবর রহমানের প্রাণহননে উদ্যত পাকিস্তানী জল্লাদদের হাত বিশ্ব মানবের হস্তক্ষেপে স্তব্ধ হোক, অভিশাপে পাথর হোক, আমরা চাই অবিলম্বে নিঃশর্তে বঙ্গবন্ধু মুজিবের মুক্তি। এই বলে আমরা সারা দুনিয়াকে হুশিয়ার করতে চাই যে, বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনার ছলনা করে যে বিশ্বাসহন্তার দল সারা বাংলাদেশকে রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দিতে, লেলিহান আগুনে পুড়িয়ে দিতে কোটি কোটি মানুষকে দেশ্ছাড়া, গৃহহারা, স্বজনহারা নিঃসম্বল করতে একটুও দ্বিধা করেনি- তাঁরা মুজিবুর রহমানের প্রাণ যে কোনো মুহূর্তে, যে কোনো ছুতোয় হরণ করতে পারে। যারা পৈশাচিকতাকে বল্গাহীন করে মানুষ নামে কলঙ্ক লেপন করেছে, তাদের বিশ্বাস করা পাপ।

এই সমাবেশ মনে করে, পাকিস্তানের বর্তমান শাসকচক্র আর তার সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ঘৃণ্য রাজনৈতিক কুচক্রীর দল মানবতাকে হত্যা করার জঘন্যতম অপরাধে অপরাধী।

এই সমাবেশ মনে করে, পাকিস্তানের শাসকেরা তাদের হীন স্বার্থের যূপকাষ্ঠে শুধু বাংলাদেশকেই বলি দেয়নি, সেই সঙ্গে সমগ্র পাকিস্তানের জনগনকেও চোখ বেঁধে বধ্যভুমির দিকে নিয়ে চলেছে। আমরা আশা করি, পাকিস্তানের শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী শুভ বুদ্ধিমান সমস্ত মানুষ যেভাবেই হোক তাদের শাসকচক্রকে প্রতিরোধ করার জন্য স্বদেশবাসীর চোখ খুলে দেওয়া এবং মুক্তির সংগ্রামে উদ্ভুদ্ধ করার জন্য সাহসে বুক বেঁধে দাঁড়াবেন।

এই সমাবেশ এক বাক্যে দাবি করছে, বঙ্গবন্ধু মুজিবের মুক্তি এবং মানববিরোধী ইয়াহিয়া চক্রের বিচার। শিল্প সাহিত্য জগতের এই সমাবেশ এদেশের অন্যান্য কাজে নিয়োজিত শহরের ও গ্রামের বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, শ্রমিক-কর্মচারী, কৃষিজীবী এবং শ্রমজীবী সবাইকে আহবান জানাচ্ছে যে, বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানকে বাঁচাবার জন্যে যে যেখানে আছেন এগিয়ে আসুন। মৃত্যু আর অন্ধকারের শক্তিকে আমরা কিছুতেই কোনো খানেই জয়ী হতে দেবোনা। জীবনের আর নতুন সৃষ্টির জয় হবেই। ”

সঙ্গীত পরিবেশন করলেন দ্বিজেন মুখার্জী, অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়, উৎপলা সেন প্রমুখ শিল্পীরা। ধ্বনিত হলো মুজিবের বিনা শর্তে মুক্তি চাই, বিচার প্রহসন মানি না।

কমিউনিস্ট পার্টির বিবৃতি

পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) কমিউনিষ্ট পার্টি থেকে প্রচারিত এক বিবৃতিতে বলেছেন, চরম অত্যাচার চালিয়েও বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম দমন করতে না পেরে ইয়াহিয়া খান এখন বাঙ্গালীর প্রিয় নেতা মুজিবুর রহমানকে হত্যা করতে উদ্যত। পূঃ পাঃ কমিউনিষ্ট পার্টি এ ব্যাপারে উদ্বিগ্ন এবং শেখ মুজিবুরের মুক্তি দাবি করছে।

বিবৃতিতে বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর সকল প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহকে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে ইয়াহিয়া খাঁ কে বাধ্য করার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে অনুরোধ করা হয়েছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৬৬। মুজিবকে রক্ষার জন্যে বিশ্বের প্রতি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির আহ্বান হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড ২২শে আগষ্ট, ১৯৭১

নীতেশ বড়ুয়া
<১২, ১৬৬, ৪৪০>
অনুবাদ

মুজিবকে রক্ষা জন্যে বিশ্বের প্রতি সিপিআইয়ের আহ্বান

২১শে আগষ্ট, নয়া দিল্লী- সিপিআই গতকাল জাতীয় পরিষদের বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তিকে নিশ্চিত করতে ভারত এবং বিশ্বের দেশসমূহের সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে – ইউএন।

গতকাল জাতীয় পরিষদের দীর্ঘ বৈঠকে – সপ্তাহান্তে এই আবেদন সংকল্প হিসেবে গৃহীত হয়।

এতে বলা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও পাকিস্তান একত্রিত হয়ে উপমহাদেশের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে হুমকি প্রদান করেছে এবং এই সন্ধিক্ষণে ইন্দো-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ভারতের বিরুদ্ধে আগ্রাসী পরিকল্পনার শক্তিশালী প্রতিবন্ধক স্বরূপ।

বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি এবং মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে প্রস্তাবিত সকল প্রকারের প্রয়োজনীয় সাহায্যের জন্য জাতীয় পরিষদ বারংবার দাবী উপস্থাপন করে। এছাড়াও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণকে বাংলাদেশের জনতার পাশে দাঁড়াতে আহ্বান করা হয়েছে যারা উভয়ই অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল।

এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের নামে ও ডিভিস বন্যা নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা সম্পূর্ণ করার জন্য সরকার কর্তৃক পর্যাপ্ত তহবিল বরাদ্দের আহ্বান করা হয়।

জাতীয় কমিশন গঙ্গার মতো অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নদগুলোর বন্যা ও খরা নিয়ন্ত্রণের পর্যাপ্ত পরিমাপক উদ্ভাবন পদ্ধতির জন্য ব্রহ্মপুত্র কমিশনের রূপরেখার উপর স্থায়ী কমিশন বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।

এছাড়া, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন উচিত বলে আহ্বান করা হয়েছে।

কাউন্সিল গৃহীত সংকল্পের একটিতে গুরুত্বপূর্ণ বন্যা সুরক্ষা ও সেচ প্রকল্প কার্যকর করার জন্য রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক হতে ২০০০ কোটি টাকা বরাদ্দের দাবী জানায়।

সর্ব ভারতীয় সংবাদপত্রের কর্মচারী সংঘ এবং অন্যান্য “যাদের আন্দোলন এবং সংগ্রাম সরকারকে সংসদের পরবর্তী অধিবেশনে তদ্বসংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিল উত্থাপনে ধাবিত করেছে” সংবাদপত্রের সংশ্লিষ্টতার জন্য কেন্দ্রের প্রস্তাবকে আজ দলের কেন্দ্রীয় পরিচালকবর্গ স্বাগত জানিয়েছে।

এতে বলা হয়েছে যে, আইনে থাকা নির্দিষ্ট ফাঁকফোকরগুলোর সমাধা করা উচিত এবং পরিচালনা পর্ষদের উপর একচেটিয়া কারবারীদের অসামঞ্জস্য প্রভাব বজায় রাখার অনুমতি দেওয়া উচিত নয়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৬৭। মালাদ নাগরিক বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের প্রতিবেদন প্রচারপত্র ২২শে আগষ্ট, ১৯৭১

নীতেশ বড়ুয়া
<১২, ১৬৭, ৪৪১-৪৪৩>
অনুবাদ

মালাদ নাগরিক বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি
সাধারণ সম্পাদকের প্রতিবেদন

প্রথমত, মালাদ নাগরিক বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির পক্ষ হতে আমি বাংলাদেশের সেইসব মুক্তিযোদ্ধা এবং সেইসব জ্ঞাত ও অজ্ঞাত সকল দেশপ্রেমীদের অভিবাদন ও সম্মান জানাচ্ছি যারা মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য নিজেদের মূল্যবান জীবন বিলিয়ে দিয়েছে। এছাড়াও আমি আমাদের সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লবী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অভিবাদন ও সম্মান জানাই এবং সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার কাছে তাঁর সর্বাঙ্গীন সুস্বাস্থ্য ও সাফল্য প্রার্থনা করছি।

ভাই ও বোনেরাঃ আমাদের সমিতির পক্ষ হতে আমি আপনাদের সকলকে স্বাগত জানাই, আমি আপনাদের সামনের সেইসব কাজ পেশ করছি যা আমরা করেছি এবং আমার বিবেচনায় আপনারাই এর জন্যে সেরা বিচারক।

আপনারা জানেন যে বিশ্ব ইতিহাসের ঘটনাবলীতে মানুষ কখনোই এই ধরনের গণহত্যা, নৃশংসতা ও পাশবিকতা দেখেনি যা ইয়াহিয়া কর্তৃক পূর্ব বঙ্গে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ হতে সংগঠিত হয়েছে। আপনারা অবগত আছেন যে ইসলাম ধর্ম-রক্ষকেরা বাংলা-দেশের মুসলমানদের হত্যা করছে, আমরা কি এতে নিশ্চুপ থাকতে পারি? এর একমাত্র উত্তর হচ্ছে ‘না’।

আমরা একটি গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক হওয়ায় অন্যদের তাদের দেশের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সংগ্রামকে সমর্থন দেওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব এবং মানবতার দিক হতে কর্তব্য বলে অনুধাবন করছি। অতএব, গণতন্ত্রের ঝাণ্ডা উপরে তুলে ধরে রাখতে ১৯৭১ সালের ৯ই এপ্রিল মালাদ নাগরিক বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি গঠিত হয়। এটি এমন একটি সংগঠন যেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীরা একই সাথে ট্রেড ইউনিয়ন, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা সহ মিলিত হয়েছে।

আমাদের সমিতি গঠনের পরে আমরা সেইসব শহীদ যারা স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য প্রাণ ত্যাগ করেছিল তাদের স্মরণে ১৯৭১ সালের ১৮ই এপ্রিল একটি মৌন মিছিলের আয়োজন করেছিলাম। পাঁচশোর বেশী নির্ধারিত পুরুষ ও নারীদের হাতে ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড বহনের মধ্য দিয়ে মিছিল অগ্রসর হয় এবং যেখানে সমিতির কর্মসূচী ঘোষণা করা হয় সেখানে তা গণ-মিছিলে পরিণত হয়। আমরা জনতার কাছে আবেদন করেছি যে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদেরকে শক্তিশালী করতে যে কোন প্রকারেই তারা যেন সহযোগীতা করে।

আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই যে, ১৯৭১ সালের ৬ই জুন আমরা বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং মুসলিম সংস্কার কমিটির চেয়ারম্যান শ্রী হামিদ দালওয়াই সাহাবের ‘বাংলাদেশ পরিদর্শন করা হতে পারে’ শীর্ষক একটি আলাপ-আলোচনার ব্যবস্থা করেছিলাম যাতে প্রচুর সংখ্যক জনসমাগম হয়েছিলো এবং সমিতি তদ্বানুসারে বক্তৃতা, শিক্ষা পাঠের ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সেভাবেই এই উদ্দেশ্যে সমিতির প্রায় বিশজন কর্মীর একটি দল কয়েকদিনের জন্য মালাদের সর্বত্রই ব্যানার, প্ল্যাকার্ড ও মেগাফোন নিয়ে ক্রমাগত চলাফেরা করেছে। এই সময়ে, আমরা শহরের বিভিন্ন প্রান্ত্রের প্রায় একশোর অধিক রাস্তার একপাশে সভার আয়োজন করেছিলাম যেখানে প্রায় দশ হাজারের মতো মানুষ জড়ো হয়েছিলো এবং অত্যন্ত মনোযোগ সহকারেই তা শুনেছিল।

কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে, সমাজের সকল স্তরের জনতা হতে তহবিল সংগ্রহের জন্য আমরা এক রুপি মূল্যমানের কূপন এবং খালি রসিদ বই ছাপিয়েছিলাম। এটা আমি অত্যন্ত গর্বের সাথে জানাচ্ছি যে এই অর্থ প্রধানত অবহেলিত, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সদস্য এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পরিবার, স্থানীয় গুণ্ডা হতে শুরু করে রেলওয়ের বিভাগীয় সুপারিন্টেডেন্ড, ছাত্র হতে, ক্ষুদে দোকানদার এবং ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে, পুলিশ এবং আরপিএফ ব্যক্তি হতে, বুদ্ধিজীবী হতে, সরকারী ও বেসরকারি খাতের কেরানি হতে, সবজি বিক্রেতা হতে এবং এমন আরো অনেক হতে সংগৃহীত হয়েছে। আমরা এই অর্থ এই মহান বহুজাতিক শহরের বিভিন্ন অংশে বসবাসকারী মানুষ হতে সংগ্রহ করেছি। এটা ঘোষণা করতে আমার খুব আনন্দ লাগছে যে যেখানেই আমরা তহবিল সংগ্রহের জন্য গিয়েছি সেখানেই জনতার স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া পেয়েছি। জনতা যথেষ্টই উদার ছিল এবং এই উদ্দেশ্যের জন্য উদারভাবেই দান করেছে, আমরা মনের অন্তঃস্থল হতেই তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।

এই আন্দোলন আরো শক্তিশালী করার জন্য সমিতির ব্যানারে নারী বিভাগও গঠন করা হয় এবং বাংলাদেশের জন্য তহবিল সংগ্রহ ও প্রচারে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অতএব, আমি এও অনুধাবন করছি যে সেই সব অকৃত্রিম সংগ্রাহক (নারী এবং পুরুষ) যারাই বিভিন্ন সময় তহবিল সংগ্রহের জন্যে এগিয়ে এসেছেন ও কাজ করেছেন এবং সমিতিকে প্রয়োজনীয় উপকরণাদি বিনামূল্যে যোগান দিয়েছেন তাদের সকলকে আন্তরিক অভিবাদন ও সম্মান জানানো আমার নৈতিক দায়িত্ব, এটা বলাই বাহুল্য যে, যে পরিমাণ অর্থ আমরা সংগ্রহ করেছি (যা কিছুই সংগৃহীত হয়েছে) তা বলতে গেলে প্রায়ই অসম্ভব ছিল যদি না তারা তাদের মূল্যবান সমর্থন না দিতো এবং আমাদের সাহায্য না করতো।

আমরা জানি যে সংগৃহীত অর্থ এই বিশাল মানের কার্যাবলীর কাছে কিছুই নয়, বরঞ্চ আমি এটা বলতে চাই যে। তা বিশাল সমুদ্রের সাথে তুলনা করার মতো বিন্দুমাত্র জলের সমানও নয়। এমনকি “শুধুমাত্র বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যার্থে” সংগ্রামের পক্ষে পরিবেশ সৃষ্টি ও জনসাধারণকে বর্তমান সময় পর্যন্ত তা ওয়াকিবহাল করার খাঁটি ও আন্তরিক অভিপ্রায়ের ভাবনা ছিল, আমাদের সংগ্রহ ৮, ১৫২ রুপি যার মধ্যে ৮, ১০১ রুপি প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় ত্রাণ তহবিলে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে যা পরবর্তীতে নয়া দিল্লীস্থ বাংলাদেশ সহায়তা কমিটিকে হস্তান্তর করা হবে।

আমি স্বীকার করছি যে আমাদের সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতার কারণে আমাদের পক্ষ হতে আপনাদের সবার কাছে তহবিলের জন্য যাওয়া হয়নি, কিন্তু আমি নিশ্চিত যে নিকট ভবিষ্যতে আমাদের সকলেই যখনই সাহায্যের জন্য আপনাদের দরজায় আসবো, তখন আমরা আপনাদের সকলের সহায়তা পাবো।

আমি আমার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হবো যদি না আমি আমাদের গৃহীত সংগৃহীত অর্থের সুষ্ঠু বিন্যাস পদ্ধতি সম্পর্কে আপনাদের নিকট আলোকপাত না করি। এই বিষয়ে, আমরা পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্য মন্ত্রী শ্রী অজয় মুখার্জীর নিকট চিঠি লিখেছি, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের তহবিল সংগ্রহকালীন সময়ে সেই মন্তিসভার বিলোপ হয়। তারপর ১৯৭১ সালের ২৪শে জুন আমরা নিবন্ধনকৃত এ/ডি হতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, কলকাতা-১৭ এর মিশন বরাবর চিঠি লিখি, কিন্তু যখন আমরা জানতে পারি যে মিশনের প্রধান ১৯৭১ সালের ১৮ই জুলাইয়ের আগে আমাদের প্রত্যুত্তর দেওয়ার মতো অবস্থানে নেই, তখন আবার আমরা ১৯-৭-৭১ তারিখের একটি চিঠিতে তাকে তা মনে করিয়ে দেই এবং সেই চিঠিতে আমারা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করি যে আমাদের সমিতি ১৯৭১ সালের ১৫ই আগষ্ট সংগৃহীত অর্থ হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তথাপি, বুঝা যাচ্ছিল যে মিশন তাদের দায়িত্ব নিয়ে অনেক ব্যস্ত ছিল।

অতঃপর ৪-৭-৭১ তারিখ পর্যন্ত মিশনের প্রধানের প্রত্যুত্তরের অপেক্ষার পর (যেহেতু এই বিষয়ের সেক্রেটারির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক্তিয়ার ছিল) অবশেষে ৫-৭-৭১ তারিখে নিবন্ধকৃত এ/ডি হতে নয়া দিল্লীস্থ ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বরাবর চিঠি লিখি এবং আমাদের পরামর্শ দেওয়া হয় যে নয়াদিল্লীস্থ বাংলাদেশ সহায়তা কমিটিতে এই অর্থ হস্তান্তর করা হবে।

১৯ তারিখে তৎক্ষণাৎ আমরা কলকাতাস্থ মিশনের প্রধান হতে দু’টি চিঠি পাই এবং বর্তমানে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, পরবর্তী সংগৃহীত তহবিল কলকাতা-১৭ এর মিশনের প্রধান বরাবরে পাঠানো হবে।

হিসাবের প্রতিবেদন একইভাবে নিরীক্ষার অধীনে যথাসময়ে জমা দেওয়া হবে।

শেষ করার পুর্বে, এটা একান্তই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় অখন্ডতা রক্ষায় একতা এবং সংঘবদ্ধ কর্মকান্ডের বার্তা হিসেবে বহন করার জন্য আপনাদের সকলের নিকট আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ রইলো। আমি ভীত যে, এখনো যদি আমরা বাংলাদেশ বিশয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করতে না পারি, তবে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের ত্রুটিগুলো জন্য আরো বড় ক্ষতিপূরণ দিতে হতে পারে। আমাদের ভুলের জন্য ইতিহাস কখনই আমাদের ক্ষমা করবে না। আমাদের সমিতি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে- ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ হতে সন্দেহাতীতভাবে যারা মন্ত্রণালয়ের শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, কিন্তু এটা বিশ্ব শান্তিকেও বিপন্ন করছে। ভারত ধারাবাহিকভাবে দুর্বল ও নিপীড়িতদের পক্ষাবলম্বন করে আসছে। সে ন্যায়বিচার এবং নিরপেক্ষতার সমর্থক এবং তা সেই অত্যাচারী যতোই শক্তিশালী হোক না কেন, যখনই যেখানে অত্যাচার ও নিপীড়ন হয়েছে ভারত তার বিরুদ্ধে উচ্চকিত থেকেছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৬৮। ‘ব্লীডিং বাংলাদেশ’ – কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি কর্তৃক প্রকাশিত চিত্র সংকলনে সমিতির সভাপতির বক্তব্য পুস্তিকা আগষ্ট, ১৯৭১

নীতেশ বড়ুয়া
<১২, ১৬৮, ৪৪৪>

সিনেট হাউস
কলকাতা-১২।
১৮ই আগষ্ট, ১৯৭১।

এস. এন. সেন, এম.এ., পিএইচ. ডি. (লন্ডন)

এইটি ছবিতে নিপীড়িত বাংলাদেশের গল্প বলার প্রচেষ্টা। প্রতিটি ছবিই বাংলাদেশের দুঃখী নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের মাঝে পাক বাহিনীর রেখে যাওয়া হস্তক্ষেপের চিহ্ন যা আসল এবং প্রকৃত প্রমাণ। ছবির পাতাগুলো উন্মোচন করে যে, তারা আসলে খুবই সাধারণ লোক, যাদের একমাত্র দোষ ছিল যে তারা তাদের নিজেদের দেশকে ভালবাসতো। আর্মিদের তৈরী এই ধ্বংসলীলা হতে মুক্তভাবে বেঁচে থাকার ইচ্ছাধারীদের কেউই রক্ষা পায়নি- শিশু, নারী, বৃদ্ধ জনতা- সবাই আক্ষরিক অর্থেই নির্যাতিত হয়েছে, তাদের সাধারণ ঘরবাড়ি এবং সকল ধরনের সাধারণ আমানত হয় লুন্ঠিত হয়েছে অথবা পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এই ছবিগুলো সেইসব কথা বলে এবং এইসব ছবি যেই নৃশংসতাকে উন্মোচিত করেছে তা আমরা আমাদের ক্রুদ্ধ উন্মন্ত মানসিক অবস্থাতেও আদৌ কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি কি না তা নিয়ে গুরুতর সন্দেহের উদ্রেক জাগায়। আর এই সবই ঘটেছে বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকে যখন, একজন চাঁদে হাঁটা শুরু করেছে তখন, অন্যদিকে অন্য পুরুষ সেই একই নিষ্ঠুরতম কাজগুলোর পুনরাবৃত্তি করছে যা তাদের পূর্বপুরুষেরা ২০০০ বছরেরও বেশী আগে সম্পন্ন করেছিল।

এই ছবিগুলো আসলে নিপীড়িত বাংলাদেশের বিষয়ে প্রকৃত ঘটনার শুধুমাত্র একটি ক্ষুদ্র অংশের প্রকাশ মাত্র। সেই দুঃখী দেশটিতে যা কিছু হয়েছে এবং এখনো যা ঘটে চলেছে তার সব কিছুর চিত্র ধারণ করা সম্ভব হয়নি, এমনকি যে সমস্ত ছবি ধারণ করা হয়েছে এবং সেই দেশ হতে বাইরে তা পাচার করে দেওয়া হয়েছে তার সবগুলোও সংগ্রহ ও ছাপানো সম্ভব হয়নি। কিন্তু এই অল্প সংখ্যক ছবিও পাকবাহিনীর দ্বারা বড় পরিসরে চালানো নির্বিচারে দমন পীড়নের একটি আভাস দেওয়ার জন্যই যথেষ্ট। তারা নিজেরাই প্রকাশ করছে তাদের পরিচালক কতটুকু নিকৃষ্ট এবং মুক্তি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে তার সেনাবাহিনী কত উন্মত্ত আচরণ করতে পারে।

ভাইস – চ্যান্সেলর, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।
শিরোনাম
সূত্র তারিখ
১৬৯। মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির প্রস্তাব – বাংলাদেশের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে চীনের ভূমিকার সমালোচনা দৈনিক আনন্দবাজার ২৬ আগস্ট ১৯৭১

Aparajita Neel
<১২, ১৬৯, ৪৪৫>

বাংলাদেশে জঙ্গিশাহির বর্বরতাঃ
চীনের নীরবতা বিস্ময়কর
সুন্দুরায়া

বাঙ্গালর, ২৭ আগস্ট (পি টি আই) – মার্ক্সবাদী কম্যুনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ভারত – সোভিয়েত মৈত্রীচুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি সাধনের জন্য অনুরূপ চুক্তি সম্পাদনের আহবান জানিয়েছেন। অপর এক প্রস্তাবে সব রকম দ্বিধা দ্বন্দ্ব পরিহার করে অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতেও আহবান জানিয়েছেন।

কেন্দ্রীয় কমিটির এই সব প্রস্তাব প্রকাশ করে দলের সাধারণ সম্পাদক শ্রী সুন্দরায়া আজ এক সাংবাদিক বৈঠকে বলেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেই পাকিস্তান চিনের সাহায্য নিয়ে ভারত আক্রমণ করবেন বলে তিনি মনে করেন না। পাকিস্তান অ্যামেরিকার সাহায্য নিয়ে ভারত আক্রমণ করলে চীন তা সমর্থন করবে বলে তিনি মনে করেন না। তবে চীন যে পূর্ব বঙ্গে পাক জঙ্গিশাহিদের বর্বর অত্যাচার সম্পর্কে একেবারেই নীরব হয়ে রয়েছে এটা সত্যিই একটা তাজ্জব ব্যাপার।

ভারত- সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় কমিটি বলেছেন যে, ভারত- সোভিয়েত যুক্ত বিবৃতিতে সমগ্র পাকিস্তান পরিস্থিতি রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের প্রশ্নটাকেই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কমিটির দৃঢ় অভিমত হচ্ছে স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের অনুকূলে বাংলাদেশের জনগণ যে সুস্পষ্ট রায় দিয়েছেন একমাত্র তার ভিত্তিতেই বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান সম্ভব। কেন্দ্রীয় কমিটি অপর এক প্রস্তাবে উত্তর ভিয়েতনাম, কোরিয়া, পূর্ব জার্মানি এবং প্রিন্স শিহানুকের কম্বোডিয়া সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি জানিয়েছেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৭০। বাংলাদেশের সমর্থনে পশ্চিমবঙ্গের জমিয়তে উলামার বক্তব্য কম্পাস ২৮ আগস্ট ১৯৭১

Aparajita Neel
<১২, ১৭০, ৪৪৬-৪৪৭>

বাংলাদেশ ও জমিয়ত উলামা

খিস্ত আওউয়াল চুম নেহাদ মেহ্মার কাঘ তা সুবাইয়া মীর রুয়াদ দিওঘারকাঘ, অর্থাৎ ভিত যার বাঁকা তার চুড়া আকাশচুম্বী হলেও বাঁকা থাকবেই – বলেছেন শেখ সাদি। তাই বাংলাদেশ সম্পর্কে অনুষ্ঠিত পশ্চিম বঙ্গ জমিয়তে উলামার, কনভেনশনে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি মওলানা মোহাম্মদ তাহের সাহেব বলেছেন ঃ গোঁড়ায় যার গলদ রহিয়াছে, তাহার শেষ শোধরানো সহজ নয়, সমাপ্তি তার সুন্দর হতে পারেনা। একথা মওলানা বলেছেন পাকিস্তানের জন্ম ও ইতিহাস মনে করে এবং তারই ভাষায়ঃ ‘একদা যে স্বার্থান্ধতা ও ক্ষমতা লিপ্সা সাম্প্রদায়িকতার নামে দেশ বিভাগ এবং পাকিস্তানের জন্ম দিয়েছিল, আজ সুদীর্ঘ ২৩ বৎসর যাবত পাকিস্তানের ইতিহাসে তাহা বারে বারে নগ্নভাবে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি সেই উগ্র খমতালিপ্সা এবং স্বার্থপরতারই ক্রমপরিনতি’

সোনার বাংলা শ্মশান কেন?

… ‘ধর্মের নামে, ইসলামের নামে, দেশের ঐক্য সমৃদ্ধি এবং নিরাপত্তার নামেই এই শোষণ এবং অবিচার চলিয়াছে। অথচ যে পবিত্র ইসলাম এবং ধর্মেন্র নাম নিয়ে এই শোষণ সেই পবিত্র ইসলাম ধর্মে কিন্তু ইহার অবকাশ মাত্র নাই। ….প্রিয় নবী (দঃ) স্পষ্ট ভাষায় ঘোষনা করিয়াছেনঃ যে রাষ্ট্রনায়ক কিংবা সরকার তাহার প্রজা সাধারণের কল্যাণ প্রচেষ্টা করেন না, তাহাদের সঙ্গে বিষাসঘাতকতা করেন। নরকের আগুনেই তাহার নিশ্চিত ঠাই।

তাই প্রতিবাদ

রবীন্দ্রনাথ বলেছেনঃ
অন্যায় যে করে, আর অন্যয় যে সহে
তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসমদহে।

তাহের সাহেব তাই হাদিস শরিফ উল্লেখ করে বলেনঃ অত্যাচার, অবিচার চুপ করিয়া সহ্য করিতে নাই, অত্যাচার অবিচারের ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় এবং নীরব দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করিতে নাই, ইহাতে সমগ্র সমাজের সর্বনাশ অবশ্যাম্ভাবি।

অত্যাচার অবিচারের বিরুদ্ধে মানুষ কাপুরুষতা প্রদর্শন না করিয়া যাহাতে সৎ সাহসে আগাইয়া আসে তজ্জন্য উৎসাহ দান হুজুর (দঃ) ঘোষণা করিয়াছিলেনঃ ‘জালিম রাষ্ট্রনায়কের সম্মুখে সত্য কথা ঘোঘোনা শ্রেষ্ঠতম জেহাদ”।

তাই দেখা যায়, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি হতে ১৯৬৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নানাভাবে এবং জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় এবং ঘোষিত বা অঘোষিত জেহাদ। আর শেষতঃ ২৩ বছর পড় সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ রায় দিয়েছিল ছয় দফার পড়। শেখ মুজিব নেতৃত্ব হল এই দির্ঘ সংগ্রামের প্রতীক।

ইসলামাবাদ চক্র প্রতিনিধি জেনারেল ইয়াহিয়া বাংলাদেশের ভাষাকে এবং রায়কে পদদলিত করবার প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের দলনায়কদের সঙ্গে পরামর্শমাত্র না করিয়া’ জাতীয় পরিষদের বৈঠক বাতিল করে দিলেন। তাছাড়া ইয়াহিয়া শেষ মুজিবুরকে প্রধানমন্ত্রীত্বের টোপ দিয়া ছয় দফা দাবী হতে বিচ্যুত করিতে চেষ্টা করিলেন কিন্তু, ‘জাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা না করিয়া তিনি স্পষ্ট জবাব দিলেনঃ জাতী আমাকে এবং আওয়ামীলীগকে প্রধানমন্ত্রীত্বের জন্য ভোট দেয় নাই, তাহারা ছয় দফা দাবীতেই ভোট দিয়াছে; আমি তাহা বিসর্জন দিয়া জাতির সঙ্গে বিশ্বাস ঘাতকতা করিতে পারিব না। ’

তাহের সাহেব তাই বললেনঃ ইহাতেই শোষকের আতে ঘা পড়ে; তাহারা ভাবে ব্রিটিশ সরকারকেও একদা যে অসহযোগ আন্দোলনের অস্ত্র শেষ পর্সন্ত ঘায়েল করিয়াছে, ভারতছাড়া করিয়াছে, শোষিত বাঙ্গালীরা যদি সেই অস্ত্র ব্যাবহার করে তবে আর রক্ষা নাই, ইহাতেও জোকের মুখে চুন পড়িবে…। অতএব সূচনাতেই সামাল দাও; এই শোষিত অবাধ্য বাঙ্গাল জাতিকে ডাণ্ডা মারিয়া ঠাণ্ডা করিয়া দাও। তাহাদের মেরুদণ্ড ভাঙ্গিয়া দাও। এবং বাঙ্গালী নিধনের নির্দেশ দিয়া ইয়াহিয়া ঢাকা হইতে করাচী যাত্রা করিলেন। ’

সবই চলে ধর্মের বাদে

ইসলাম ধর্ম —- রক্ষা নামেই ইয়াহিয়া সব কিছু করিতেছে। শিশু হত্যা, ধর্ষন, নিরপরাধ জনতা নিধন, বাঙ্গালী নিধনের নামেই সব চলিতেছে। ‘তাহারা মজলুমকে ঠাণ্ডা এবং জগতকে ধোঁকা দিবার জন্য একই সঙ্গে বন্দুকের গুলি এবং ধর্মের বুলি ব্যাবহার করতঃ মজলুমের শোণিত রক্তের হোলি খেলিতেছে। বাংলাদেশের সর্বত্র চলছে তাহাদের এই পৈশাচিক নৃত্য।

জেহাদ ও মুক্তিবাহিনী

প্রায় ২৩ বছর ধরে যে অব্যাক্ত জেহাদ চলে আসছিল তাই ২৫ মার্চের রাতে রূপ নিল ভিন্নভাবে।

ইয়াহিয়া খানের বিশ্বাসঘাতকতার ও বুলেটের গুলিতে পরিবেশে জন্ম নিল মুক্তিবাহিনী। বাধ্য হল মানুষ জবাব দিতে। তাহারা যে যেখানে পারল শোষক সরকারের জালেম সেনাদের প্রতিরোধে প্রয়াস পাইল — তাই তাহাদের প্রত্যুত্তরে সুসঙ্ঘবদ্ধ ছিল না। পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ ছিলোনা; ক্রমে মাস দুই পড়ে তাহারা সুপরিকল্পিতভাবে তাহাদের অভিযান চালাইতে থাকে। ’

এই মুক্তিবাহিনীর উদ্যেশ্যে তাহের সাহেব হাদিস শরিফ হতে উল্লেখ করে বলেনঃ ‘নিজেদের প্রাণ, ধন-মান রক্ষায় যে নিহত হয় তাহার মৃত্যু শহীদের মৃত্যু। ’

এই কনভেনশনে সভাপতি হিসেবে আজাদ হিন্দ বাহিনীর জেনারেল শাহ নেওয়াজ খান, সাড়া ভারত জমিয়তে উলামার সাধারণ সম্পাদক সদস্য মাওলানা আসাদ মাদানি প্রভৃতিও একটি অইস্লামিক রাষ্ট্রের স্বরূপ নিয়ে যেমন বলেছেন, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের সংগ্রামী জনসাধারণকেও অভিনন্দন জানান। আর সকলেই তাদের সাহেবের ‘অ্যামেরিকা, চিন প্রভৃতির নিজ স্বার্থে জালিম ইয়াহিয়া খান ও তার সরকারকে সাহায্য যদি দোষের না হয়, তবে নির্যাতিত মজলুম বাংলাদেশবাসির সাহায্য সহায়তায় হিন্দুস্তানের অপরাধ কি? উক্তির সমর্থনে নিজেদের কথাও বলেন।

শেষতঃ এই কনভেনশন প্রস্তাব গ্রহণ করে

১) নিশর্ত সমর্থন জানান বাংলাদেশের সংগ্রামকে; ২) ঘৃণা প্রকাশ করে ইসলামাবাদ চক্রের ফ্যাসিস্ট পদ্ধতিকে ৩) দাবী করে মুজিবের মুক্তি এবং ঐ সঙ্গে বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন করে ইসলামাবাদ সামরিক চক্রের বিচার, এবং আশা প্রকাশ করে যে ভারত সরকার সময় মত স্বীকৃতি দেবে প্রজাতন্ত্রিক বাংলাদেশকে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৭১। এ্যান এ্যাপিল টু জেসীস টু মুভ দ্য পিপল অব দেয়ার ওয়ার্ল্ড – ইন্ডিয়ান জুনিয়র চেম্বারের পুস্তিকাব পুস্তিকা আগষ্ট, ১৯৭১

নীতেশ বড়ুয়া
<১২, ১৭১, ৪৪৮-৪৫৪>
অনুবাদ

এ্যান এ্যাপিল টু জেসীস টু মুভ দ্য পিপল অব দেয়ার ওয়ার্ল্ড
ইউ এন রেজ্যুলুশন অন জেনোসাইড

ঘোষণা করে যে “আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে গণহত্যা এমন একটি অপরাধ যা সভ্য সমাজের কাছে তীব্র নিন্দনীয়। ”

১৯৪৮ সালের ৯ই ডিসেম্বরের ২৬০ III এ দ্বারা সাধারণ পরিষদ প্রস্তাব উপস্থাপন করে এবং অনুমোদন দেয়,

এই গণহত্যা যা শান্তি স্থাপন বা যুদ্ধের সময় যেভাবেই হোক না কেন তা আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে অপরাধযোগ্য যা তারা প্রতিহত করা এবং শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করে।

গণহত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞের এক ঝলক

সৃষ্টিকর্তা এবং অখন্ড পাকিস্তানের নামে ঢাকা বর্তমানে একটি চূর্ণ-বিচূর্ণ ও ভীত নগরী…

পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নির্মম ও ঠান্ডা মাথার গোলাবর্ষণের ২৪ ঘন্টা পর হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে, বিস্তীর্ণ এলাকা মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং এভাবে পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধকে নৃশংসভাবে শেষ করে ফেলা হয়েছে।

ছাত্রদের তাঁদের নিজ বিছানা মেরে ফেলা, কসাইদেরকে তাঁদের দোকানের পিছনে হত্যা করা, নারী ও শিশুদের তাঁদের ঘরেই জীবিত পুড়িয়ে মারা, পাকিস্তানী হিন্দু ধর্মালম্বীদের জোর করে ঘরের বাইরে এনে গণহারে গুলি করে হত্যা করা, বাজার এবং কেনাকাটার জায়গাগুলোতে আগুন লাগিয়ে ধ্বংস করে ফেলার চিত্রই শুধুমাত্র সামরিক বাহিনীর এমন ভয়াবহতাকে যথার্থভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারে।

২৫শে মার্চে ঢাকায় এগিয়ে আসা ট্যাংকের প্রথম লক্ষ্যই ছিল ছাত্ররা। সাইমন ড্যুরিং
ডেইলী টেলিগ্রাফ, লন্ডন
৩০শে মার্চ, ১৯৭১

এই ক্ষতি সংশ্লিষ্ট সকলের নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণায় পরিণত হয়েছে, সাংবাদিকেরা দেখেছে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হাজারো পুড়ে যাওয়া ভবনের দেয়াল। শহরের মধ্যে কংক্রিটের দেয়ালগুলোতে শতাধিক বুলেটের চিহ্ন ফুটে আছে যেখানে ফায়ারিং স্কোয়াড তাদের কাজ করেছিল। লাশগুলোকে এলাকার কুয়োতে ফেলে রাখা হয়েছে এবং ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি এই ঘটনার হিংস্রতার সাক্ষ্য দিচ্ছে।

ম্যালকম ডব্লিউ. ব্রাউনি
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস্‌, নিউ ইয়র্ক।

উ. থান্টঃ জাতিসংঘের মহাসচিবঃ যদিও এই গৃহযুদ্ধ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন ব্যাপার, কিন্তু এর জন্য কিছু সমস্যা উদ্ভব হয়েছে যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগের কারণ।

আগা হিলালীঃ মার্কিং মুলুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতঃ পূর্ব পাকিস্তানে জনসাধারণ তাঁদের হাজারও বন্ধু এবং আত্মীয়কে হারিয়েছে।

জাতিসংঘের সনদঃ
প্রস্তাবনা

“পরবর্তী প্রজন্মকে যুদ্ধের অভিশাপ হতে রক্ষা করা; যা আমাদের জীবদ্দশায় দুই দুইবার মানবজাতির উপর অবর্ণনীয় দুঃখ বয়ে এনেছে এবং মানুষের ব্যক্তি সম্মান ও মূল্যবোধ, নারী ও পুরুষের সমান অধিকার এবং বড় ও ছোট দেশগুলিতে মৌলিক মানবাধিকারে পুনর্নিশ্চয়তার আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং যে চুক্তিসমূহ ও আন্তর্জাতিক আইনের অন্যান্য মাধ্যম হতে উদ্ভূত ন্যায়বিচার ও দায়িত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের পরিস্থিতির প্রতিষ্ঠা করা এবং সামাজিক অগ্রগতি ও বৃহদতর স্বাচ্ছন্দ্যতার সাথে জীবন যাপনের মান অধিকতর উন্নততর করতে আমরা জাতিসংঘের সদস্যরা সংকল্পবদ্ধ।”

এবং এই সকল কিছুর জন্য সহনশীলতা ও ভাল প্রতিবেশী হিসেবে অন্যের সাথে শান্তিতে থাকার চর্চা করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখতে আমাদের দৃঢ়ভাবকে একত্রিত করতে হবে ও সমস্ত জাতির অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির উন্নয়নের জন্য ভারী যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু করতে হবে।

কেন এই সংঘাত?
আর্থ-সামাজিক অবস্থার পটভূমিতে

পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) মাঝে ১২০০ মাইলের অধিক ভারতীয় অঞ্চলের দূরত্ব রয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত উন্নত এবং পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬% নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান গঠিত যারা অত্যন্ত অনগ্রসর ও অনুন্নত। অধিকতর বৈষ্যম্যতার কারণে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মাঝে ভয়ংকর রকমের অস্থিরতা বিরাজ করছে। ধর্ম ভিন্ন এই দুই অঞ্চলের মধ্যে অন্য কোন মিল নেই। এমনকি এদের ভাষাও ভিন্ন; পশ্চিম পাকিস্তান উর্দু আর পূর্ব পাকিস্তান সাংস্কৃতিকভাবে তারা মেরুসম তফাতে।

১৯৪৬ সালের ১১ই ডিসেম্বরের ৯৬ (১) রেজ্যুলুশন অনুযায়ী সাধারণ পরিষদ

অর্থনৈতিক অসমতা পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) পশ্চিম পাকিস্তান
১) আয়তন (বর্গমাইল)
জনসংখ্যা (মিলিয়ন হিসেবে)
প্রতি বর্গ মাইলে জনসংখ্যা ৫৫,১১৬
৭.৫
৯২২ ৩,১০,৪০৩
৪.৩
১৩৮
২) উন্নয়ন খাতে সরকারি ব্যয়
বেসরকারি বিনিয়োগ
বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার
রপ্তানি আয়
আমদানি
মোট বৈদেশিক সাহায্য ব্যবহৃত
বৈদেশিক সাহায্য প্রাপ্তির বোঝা ৩৬%
২৫%
৪%
৫০.৭০%
২৫.৩০%
৩০%
৫৬% ৫৪%
৭৫%
৬%
৫০.৩০%
২৫.৭০%
৭০%
৪৪%
৩) কর্মসংস্থানের হারঃ
সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশ
রাষ্ট্রপতির সচিবালয়
কেন্দ্রীয় সরকারী কর্ম কমিশন
শিল্প বিভাগ
কৃষি
শিক্ষা
৮.১%
১৯%
১৪.৫%
২৬%
২১%
২৭%
৯১.৯%
৮১%
৮৫.৫%
৭৪%
৭৯%
৭৩%

প্রশাসনের সকল উর্ধ্বতন সামরিক সদস্যই পশ্চিম পাকিস্তান হতে। পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান এবং কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী, অর্থ বরাদ্দ প্রকল্পের সকল গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সব সময়ই পশ্চিম পাকিস্তানী।

জয়সীস- বাংলাদেশ

“এই সংগঠনের চার দেয়ালে মাঝে প্রাণ যেখানে চরিত্র ও ভাল নাগরিকত্বের ভিত্তি স্থাপিত করা হয় সেখান হতে আমি আশা করি যে আগামীর কোন এক সময়ের এমন একটি বার্তা আসবে যা মানুষকে একটি স্থায়ী ও চিরস্থায়ী বিশ্ব শান্তির জন্য উদ্দীপিত করবে। ”

এই কথাগুলো জুনিয়র চেম্বার মুভমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা হেনরি গিসেনবিয়েরের। এটা স্পষ্ট যে আমাদের সকল প্রচেষ্টার চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে, আমাদের আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতার মতোই স্থায়ী ও চিরস্থায়ী বিশ্ব শান্তি। “এই লক্ষ্যটি সকলের বোধগম্যের। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাঝে ১৯৫১ সালে এই জুনিয়র আন্দোলনের জন্ম হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যেই ১৯৪৪ সালে আন্তর্জাতিক জুনিয়র চেম্বার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। ” সাতাশ বছর বিদ্যমান থাকার পর, স্থায়ী ও চিরস্থায়ী বিশ্ব শান্তির এখনই প্রকৃত সময়। এই পর্যন্ত প্রতিষ্ঠাতার স্বপ্ন পূরণে আমরা কি করতে পেরেছি? স্পষ্টতই “চরিত্র ও ভাল নাগরিকত্বের ভিত্তি স্থাপন” কার্যকরী নয় যদি তা অপ্রতিরোধ্য যুদ্ধ ও সহিংসতার মাঝে বিশ্বকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করতে থাকে।

বিশ্ব বর্তমান শতকে এরই মাঝে সমগ্র মানবজাতিকে জড়িয়ে দুই দুইটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। একই সাথে বিশ্ব অভিশাপ স্বরূপ কিছু দেশকে অন্য দেশ দ্বারা দাসত্ব বরণ করে নিতে দেখছে। এটাও যুদ্ধ্বের নামান্তর। এটা অবশ্যই জয়সী মতবাদের বিরুদ্ধে, যা বিশ্বাস করে যে “ মানুষের ভ্রাতৃত্ব জাতির সার্বভৌমত্বে রূপান্তরিত হয় যার অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার সর্বোত্তোমভাবে মুক্ত মানুষের মুক্ত উদ্যোগের দ্বারা অর্জিত হতে পারে।

এই মতবাদের ব্যাখ্যা হচ্ছে, এমনটাই বজায় রাখা হয়েছে যে ‘মুক্ত উদ্যোগ’ স্বাধীনতার পবিত্রতার উপর আস্থা প্রকাশ করে, মানব জীবনের মৌলিক উৎকর্ষতার উপর বিশ্বাসকে ঘোষণা করে, প্রত্যেকের মর্যাদা ও শান্তির সাথে বেঁচে থাকার অধিকারকে রক্ষা করে, প্রত্যেককে তার নিজের সমাজের মধ্যে নুণ্যতম নিয়ন্ত্রণের প্রভাবের সাথে নিজের সর্বোচ্চ সম্ভাব্য বিকাশ সাধনের সুযোগ প্রদান করে।

জয়সী হচ্ছে তারুণ্যের আন্দোলন। এই রকমের আন্দোলনের মধ্যে বিশ্বের সর্ববৃহৎ আন্দোলন। এর লক্ষ্যই হচ্ছে ব্যক্তির দক্ষতার উন্নয়ন করা এবং একজন তরুণকে মানবজাতির একজন হিসেবে আর্থিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিকভাবে উন্নত করার উদ্দেশ্যে হিসেবে যৌথভাবে উদ্দীপ্ত করার প্রয়াস। এই উদ্দেশ্য অর্জিত হওয়ার একটি উপায় হলো অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করার মাধ্যমে।

বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ এবং যুদ্ধ সদৃশ কর্মকান্ডের কারণেই এইসব উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। শেষ বিশ্বযুদ্ধের পরের পঁচিশ বছর, আমরা এখনো দেখতে পাই যে বিশ্বের বিভিন্ন অংশ এখনো বর্বর যুদ্ধে উত্তাল। মনে হচ্ছে, শান্তি বিস্তৃতির পরিবর্তে এখন তা যেন যুদ্ধের ময়দান হিসেবে বিস্তার লাভ করছে।

প্রথমে তা ছিল কোরিয়া, এরপর এলো ভিয়েতনাম, মধ্যপ্রাচ্য-পাকিস্তান, ভারত-চায়না এবং আমরা এখন ভারত সীমান্তে বাংলাদেশের মধ্যে যুদ্ধ দেখতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে এটা যেন আমাদের সীমান্তের আরো একটি ভিয়েতনাম। এছাড়াও আয়ারল্যান্ডের মধ্যেও ঘটে চলেছে।

রাষ্ট্রের পরিস্থিতি বলতে আসলে কী বুঝায়? এটা কী অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা প্রদানের, স্বাধীনতার পবিত্রতা রক্ষা করার, মানবজীবনের শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষা করার, ব্যক্তির শান্তি ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপনের অধিকার রক্ষা করার এবং ব্যক্তির তার নিজের সমাজের মধ্যে নিজের সর্বোচ্চ সম্ভাব্য বিকাশ সাধনের সুযোগ প্রদান করার পথ!

আমরা, ভারতীয় হিসেবে কিন্তু আমাদের সীমান্তে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়ে তা অগ্রাহ্য করতে পারি না। জয়সী যেসব উদ্দেশ্য ও নীতির উপর দাড়িয়েছে তার প্রতিটি লঙ্ঘন করার মতো অনেক ঘটনাই উপস্থাপন করা যেতে পারে যেমনটি তার ইতোমধ্যেই লঙ্ঘন করেছে এবং বিশ্বের অন্যান্য অংশেও লঙ্ঘন করে চলেছে। বাংলাদেশের বিষয়টি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা সেই অস্থিরতারই একটি অংশ যা পুরো বিশ্বকে আঁকড়ে ধরেছে। পার্থক্য শুধু এইটাই যে ভারতের উপর এর নজিরবিহীন প্রভাব। এই রকম লক্ষাধিক শরণার্থীর বোঝা বহন করার মতো বিশ্বের আর কোন দেশের এমন কোন সময়ের ইতিহাস নেই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে যদিও তা রাজনৈতিক ক্রোধ প্রকাশ হিসেবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, কিন্তু তার চাইতেও অপেক্ষাকৃতভাবে এর বিশাল মানবিক দিক রয়েছে।

এই দাবীগুলোই সমগ্র বিশ্ব হতে জয়সীস দ্বারা বিবেচনা করা হয়। যুদ্ধের ফলে তারুণ্যের স্বাভাবিক জীবন ব্যহত হয়, সহিংসতায় তারুণ্য আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তারুণ্য লাঞ্চিত হয়। তরুণদের নেতৃত্ব বিকাশে সক্রিয় করার কোন প্রয়োজনীয়তাই নেই। যদি তাঁদের প্রতি কোন প্রত্যাশা উন্মুক্ত থাকে তবে তা হচ্ছে প্রতিটি নীতিকে অস্বীকার করা যা অলঙ্ঘনীয় হিসেবে ঘোষিত হয়। যে তারুণ্যকে স্বাধীনতা হতে বঞ্চিত করা হয়, শিক্ষা হতে বঞ্চিত করা হয়, খাদ্য হতে বঞ্চিত করা হয়, নিজের ভূমি হতে বঞ্চিত করা হয়, নিজের ভূমিতে উন্নতির সম্ভাবনা হতে বঞ্চিত করা হয়, সে তারুণ্যকে আদতে তার একমাত্র অস্তিত্ব হতে বঞ্চিত করা হয়।

আমরা ত্রাণ দিয়ে ও মানবেতর জীবন যাপন হতে মুক্ত করার জন্য সাহায্য করে যেতে পারি। আমারা আমাদের তরুণদের এই রকম পরিস্থিতির কর্মকান্ডের মাধ্যমের নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা অর্জনে সাহায্য করতে পারি। কিন্তু এই রকমের আচরণ কী আসলেই আমাদের প্রতিষ্ঠাতার মূল লক্ষ্যকে ফুটিয়ে তোলার মতো কাছাকাছিও নিয়ে যেতে পারে করে? বিশ্বের এমনতরো আবহ কী ভাল কিছুর জন্য পরিবর্তনের বদলে খারাপ কিছুর জন্য পরিবর্তনের মতো আমাদের উদ্দেশ্যের দিকে ধীস্থিরভাবে ধাবিত করতে পারে? আমাদের সকল প্রচেষ্টাই কি বৃথা ও ক্ষীণ আচরণের মতো নয়?

এটা হচ্ছে সেই পরিস্থিতি যা বিশ্বজুড়ে অবস্থান নেওয়ার মতো জয়সীসের প্রয়োজন। এটা সত্যি যে আমাদের মতবাদ আমাদেরকে কোন দলীয় রাজনৈতিক কর্মকান্ডে এবং একটা দেশের স্বার্থের উপর আরেকটির স্বার্থ প্রচারে অংশগ্রহণ করা থেকে নিষেধ করে। আমাদের দ্বারে এই প্রসঙ্গটি নিয়ে আসা হয়েছে যে বাংলাদেশে সৃষ্ট পরিস্থিতিকে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে অগ্রাহ্য করা যাবে না। এটা মানবিকতার বিষয়। এই প্রসঙ্গ অচিরেই আরও অনেক উন্নয়নশীল দেশের দ্বারা সম্মুখীন হতে পারে, কারণ বাংলাদেশ ফোর্ডের কাছে উপ-জাতীয়তার মধ্যে বহুজাতিক উন্নয়নশীল দেশের সম্পর্ককে নিয়ে এসেছে। যদি যুদ্ধের কোন অংশ বিভিন্ন জাতির মধ্যে চলে তবে উন্নয়নশীল দেশের মধ্যেও যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে, অচিরেই আমরা বিশৃঙ্খলতা ও বর্বরতার সীমা অতিক্রমের দিকে ধাবিত হতে যাচ্ছি। আমরা ইতোমধ্যেই বিশ্বের বিভিন্ন অংশে এমন হতে দেখে ফেলেছি। আমরা এখন তা বাংলাদেশেও হচ্ছে দেখতে পাচ্ছি। এটা এখন আর কিছুতেই রাজনৈতিক বিষয়ে নেই বরং মানবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মানবিকতার পটভূমিতে হলেও আমরা জয়সীস অবশ্যই বাংলাদেশের সমস্যার দিকে দৃষ্টিপাত করবো এবং এই প্রাসঙ্গিকে শান্তির উদ্দেশ্যে কাজ করার মতো বৈশ্বিক কার্যবিধি প্রদান করতে হবে। এর মাঝেই আমাদেরকে অবশ্যই আমাদের সকল সম্পদকে গতিশীল করে ফেলতে হবে যাতে যুদ্ধের শিকার ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দিতে পারি।

বিশ্বজুড়ে তরুণদের সর্ববৃহৎ সংগঠন হিসেবে আমাদের অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ এমনতরো মানুষ ধ্বংসের মতো কাজ দ্বারা উপেক্ষিত নয় যা বৃদ্ধের সম্মানকে অস্বীকার করে, যে কাজ মানুষের ব্যক্তিত্বকে অধঃপতিত করে। এটা যুদ্ধের বিরুদ্ধে কার্যপ্রণালী এবং যুদ্ধের কারণ আমাদের মতবাদ দ্বারা, আমাদের উদ্দেশ্য দ্বারা এবং সেই স্বপ্ন দ্বারা বিচারিত হবে যা প্রতিষ্ঠাতা হেনরী গিসেনবিয়েরকে অনুপ্রাণিত করেছে।

সেই “আগামীর কোন এক সময়” এখন নতুন বার্তার জন্য চলে এসেছে “এই সংগঠনের চার দেয়ালে মাঝে প্রাণ যেখানে চরিত্র ও ভাল নাগরিকত্বের ভিত্তি স্থাপিত করা হয় সেখান হতে আমি আশা করি যে আগামীর কোন এক সময়ের এমন একটি বার্তা আসবে যা মানুষকে একটি স্থায়ী ও চিরস্থায়ী বিশ্ব শান্তির জন্য উদ্দীপিত করবে।”

কিভাবে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে

১৯৬৯
২৫শে মার্চ : জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণ করে, দেশজুড়ে সামরিক আইন জারি করে এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ বাতিল করে।
২৭শে মার্চ : সামরিক আইন ভঙ্গকারীদের উপর সামরিক বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বিকেন্দ্রীকরণের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন।
৩১শে মার্চ :সরকারীভাবে সকল রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়।
২৮শে নভেম্বর : ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালের অক্টোবরের ৫ তারিখকে জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের দিন হিসেবে নির্ধারণ করেন।
১৯৭০
৭ই ডিসেম্বর : জাতীয় পরিষদের নির্বাচন স্থগিত করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের দল, আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয় লাভ করেন। জেড. এ. ভূট্টোর দল ২য় হয়।

১৭ই ডিসেম্বর : প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা দ্বারা অভূতপূর্ব জয় লাভ করে।

১৯৭১
১৪ই জানুয়ারি : ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উল্লেখ করেন।
১৩ই ফেব্রুয়ারি : ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চকে পরিষদের অধিবেশনের জন্য নির্ধারণ করেন।
১৬ই ফেব্রুয়ারি : : রহমান আইনগতভাবে আওয়ামী লীগ দলের নেতা হিসেবে নির্বাচিত হন, ভূট্টো ক্রমাগতই দুই অংশের জন্য আলাদা আলাদা মন্ত্রীর প্রস্তাবনা দিয়ে যাচ্ছেন।

১লা মার্চ : ইয়াহিয়া খান জাতীয় অধিবেশন স্থগিত করেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর ভাইস- এ্যাডমিরাল এস. এম. আহসানকে বরখাস্ত করেন। জাতীয় অধিবেশন স্থগিতকরণের প্রতিবাদে রহমান ঢাকায় সাধারণ হরতালের ডাক দেন।

২রা মার্চ : জন-অসন্তোষ ঢাকা সহ অন্যান্য স্থানে সহিংসতায় রূপ নেয়, সৈন্যরা এ্যাকশনে নামে এবং কারফিউ জারি করা হয়।
৩রা মার্চ : আওয়ামী লীগ শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলনে আরম্ভ করে, রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে ইয়াহিয়া খানের ১০ই মার্চের আমন্ত্রণ রহমান প্রত্যাখ্যান করেন।

৫ই মার্চ : সেনাবাহিনীর হাতে ৩০০ জন নিহত হওয়ার খবর আসে।
৮ই মার্চ : অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়।
১৯শে মার্চ
: ইয়াহিয়া খান ও রহমান সাংবিধানিক আলোচনা শুরু করেন।

২২শে মার্চ : ইয়াহিয়া খান আবারও জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী স্থগিত করেন।
২৬শে মার্চ : গণহত্যা শুরু হয়। তখন থেকেই মুজিবের হদিস পাওয়া যায় না।
১০ই এপ্রিল : স্বাধীনতার ঘোষণাঃ বাংলাদেশ নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নিজেরা গণপরিষদ গঠন করে বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী দেশে হিসেবে ঘোষণা করে।

১৭ই এপ্রিল :বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ প্রতিবেশী দেশগুলোর নিকট অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানে অস্ত্র সরবরাহের এবং খুনী সেনাবাহিনীর হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করতে একটি নবজাত দেশকে সাহায্য করার আহ্বান জানান।
মে/জুন/জুলাই/আগস্ট/
সেপ্টেম্বর/অক্টবর’৭১ : তখন থেকেই প্রায় দশ লক্ষাধিক নারী ও শিশুসহ লোক পাকিস্তানীদের দ্বারা নিহত হয়। আরো ৯০ লাখ এই গণহত্যা থেকে বাঁচতে ভারতে পালিয়ে চলে আসে।

শরণার্থী

আতংকগ্রস্থ ও দরিদ্র হাজারো বাঙ্গালী যারা ভারতে অবাধে প্রবেশ করার চেষ্টা করেছে তারা দূর্বল হয়ে গিয়েছে এবং রাস্তার পাশেই অবসন্ন হয়ে মারা গিয়েছে। কপর্দকহীন, ক্লান্ত এবং অসাড়তার মাঝে অনেকেই তাঁদের এই বিয়োগান্তক যাত্রার বর্ণনা করেছেনঃ

১)“আমরা উত্তরে ভারত সীমান্তের দিকে হাঁটা শুরু করি। যাত্রাপথেই আমরা লোকজন মারা যেতে দেখেছি। অন্যরা মাটিতেই অবসন্ন হয়ে লুটিয়ে আছে। প্রথমে মারা যেতো শিশুরা, এরপর ক্রমান্বয়ে অগ্রসর হতে হতে বৃদ্ধ ও শিশুরা দূর্বল হয়ে লুটিয়ে পড়তো এবং তারপর মহিলারা। ”

২) দুই বোন, রহিনা বেগম; যার বয়স ১৬ এবং জিনাত বেগম; বয়স ১৫, তাঁদের পায়ে এবং বাহুতে বুলেটের ক্ষত রয়েছে। রহিনা জানিয়েছে তার পুরো পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে যখন ছোট্ট নৌকায় করে নদী পার হয়ে ভারতে আসতে চেয়েছে তখনই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁদের ছোট্ট নৌকায় গুলিবর্ষণ করে।

৩) আহমেদ আলী, একজন কৃষক যার বয়স ২৫, তার ডান পায়ে এবং বাহুতে প্লাস্টার লাগানো, জানায় যে তার গ্রামে সেনাবাহিনী প্রবেশ করে এবং শক্ত সমর্থ যত জন যুবককে তারা পেয়েছে বেঁধে ফেলে। “তারা আমাদের জিজ্ঞেস করে আমরা কী বাঙ্গালী নাকি অবাঙ্গালী এবং আমাদেরকে বলে মাটিতে শুয়ে থাকতে। তারা আমাদের ঘিরে ফেলে এবং গুলি বর্ষণ শুরু করলে আমার বাহুতে গুলিতে লাগে এবং তারপরেও আমি শুয়েই থাকি। এরপরে তারা চলে, তারা আমার ঊরুসন্ধিতে বেয়োনেট দিয়ে খোঁচা মারে এবং থেঁতলে দেয় ও আমার পা ক্রমাগত আঘাতে গুড়িয়ে দিতে থাকে। ”

পিটার হেজেলহার্স্ট
দ্য টাইমস লন্ডন

বিবেক এবং বাংলাদেশ

এপ্রিলের শুরু হতে অল্প কিছু মাসের মধ্যেই পূর্ব বাংলার গৃহযুদ্ধ প্রায় আশি লক্ষ পুরুষ, নারী, এবং শিশুকে তাঁদের জন্মভূমির পরিস্থিতি হতে বাঁচতে তাঁদের নিজেদেরকে ভারতে নিয়ে আসে। অন্য আরো অগুনতি হাজারও জনকে তাঁদের দেশের মধ্যেই খন্ডযুদ্ধে খুন করে ফেলা হয়েছে অথবা ভিটে ছাড়া করা হয়েছে। পূর্ব বাংলার লাখো নারী অব্যাহত ভীতি, রোগ এবং অনাহারের সম্মুখীন, যদি না তারা অনতিবিলম্বে ত্রাণ পায়।

এই অবর্ণনীয় বিয়োগান্তক ঘটনা এখনও বিশ্ব বুঝে উঠতে পারেনি। আমি আপনাকে বলতে পারি যে, সরেজমিনে প্রত্যক্ষ না করা পর্যন্ত এর বিশালতা বুঝতে উঠতে শুরু করবেন। উদ্বাস্তুদের আর্তনাদ, তাঁদের মুখ তাঁদের গল্প ইত্যাদি শুনেছি যা এমনই চূড়ান্ত লজ্জার যা কি না বিশ্বের মানুষের নৈতিক সংবেদশীলতাকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে।

শরণার্থী শিবিরের অবস্থা বর্ণনাতীত। আপনি অস্থিচর্মসার বাচ্চাদের দেখতে পাবেন যাদের নিজেদের মাথা ধরে রাখার শক্তি পর্যন্ত নেই। আপনি দেখবেন শিশুদের পা ও পায়ের পাতা অপুষ্টিজনিত কারণে ফোলা। আপনি তাঁদের বাবা মায়ের চোখের দিকে তাকালে সন্তান থাকাতেও তাঁদের হতাশা দেখবেন। এবং, এইসবকিছুর মধ্যে সবচাইতে কঠিন হচ্ছে গতরাতে মারা যাওয়া শিশুর লাশ।

ভারত সরকার উদ্বাস্তুদের থাকা খাওয়ার জন্য যে প্রচেষ্টা করছে তা অসাধারণ কৃতিত্বের যা ইতিহাস ধারণ করবে এবং মনে রাখবে।

পূর্ব পাকিস্তানের এই ট্র্যাজেডি শুধু মাত্র পাকিস্তানের ট্র্যাজেডি নয়। এটা শুধু ভারতের ট্র্যাজেডিও নয়। এটা মূলতঃ পুরো বিশ্ব সম্প্রদায়ের ট্র্যাজেডি এবং এই সঙ্কট লাঘবে একযোগে কাজ করাটা সেই সম্প্রদায়েরই দায়িত্ব।

-এডওয়ার্ড কেনেডি

(১৯৭১ সালের ১৬শে আগষ্ট, ওয়াশিংটনে ন্যাশনাল প্রেস ক্লাবের সম্মুখে প্রদেয় ভাষণ)

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৭২। বাংলাদেশ- টাইম এন্ড লজিক রানিং আউট এ্যাকশন কমিটি বাংলাদেশের পুস্তিকা পুস্তিকা সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

নীতেশ বড়ুয়া
<১২, ১৭২, ৪৫৫-৪৬০>
অনুবাদ

বাংলাদেশ
টাইম এন্ড লজিক রানিং আউট

যখনই পাকিস্তান কোন ঝামেলায় জড়ায়, প্রায় প্রতিবারই বিশ্বের তরফ থেকে প্রথম প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভারতকেই শান্তির পথে খলনায়ক হিসেবে ধরা হয়। এই দূর্বলতা তার ব্যাপক জনসংখ্যা ও উন্মুক্ত সমাজ ব্যবস্থা হতে উদ্ভূত হয়েছে, ভারতকে এ নিয়েই থাকতে হবে যখন এই বছরের ২৫শে মার্চের সন্ধ্যা হতে বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থার উপর ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম হতে সতর্কতা বার্তা ছড়ানো সত্ত্বেও বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমের এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ হয়েছিলো মন্থগতিতে, যা মোটেও আশ্চর্যজনক ছিল না। মধ্যপ্রাচ্য তথা সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, ইয়াহিয়া খানের সামরিক জান্তা বাহিনীর দ্বারা বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া গণহত্যা যা এখনো চলছে, প্রায় সার্বজনীনভাবেই পুরো বিশ্বের মোড় সেদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। বিশ্ব সংস্থার দূর্বল অবস্থান সত্ত্বেও ইউ. এন. প্রতিনিধিদল অঘোষিতভাবেই স্বীকার করেছে যে বাংলাদেশে খুব ভয়ংকর কিছু ঘটেছে এবং এই অবস্থা আরো গুরুতর হচ্ছে। এমনতরো দৃশ্য ইউ.কে., কানাডা এবং অন্যখানের সংসদীয় প্রতিনিধিদের দ্বারা আরো বেশী স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে এবং দলীয়ভাবে বিশ্ব হতে তা আরো আসার অপেক্ষায়।

বর্তমানে অবস্থা এমন যে ভারতের কাছে বাংলাদেশ হতে আসা প্রায় ৭০ লক্ষের মতো শরণার্থী রয়েছে যাদের বাংলাদেশে থাকার অধিকার আছে, যাদেরকে ভারতে বসবাসের স্থান দেওয়া যাবে না এবং যারা অদূর ভবিষ্যতেও ফিরে যেতে পারবে না। বর্ষা মৌসুম সত্ত্বেও শরনার্থীদের অনুপ্রবেশ চলতে থাকে এবং সামরিক জান্তা, যারা সেই রাষ্ট্রকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে আছে তাদের দ্বারা স্থুল দাবী করা হচ্ছে যে বাংলাদেশে পরিস্থিতি খুবই স্বাভাবিক আছে। মুক্তি ফৌজের গেরিলা কার্যক্রম অব্যাহত আছে এবং তা বৃদ্ধি করতে দায়বদ্ধ। বাংলাদেশের অন্তবর্তীকালীন সরকার আওয়ামী লীগের ভিত্তির উপর গঠিত, যারা জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে এবং রাজ্যের আইনসভার উপর একচেটিয়া অবস্থান বজায় রেখেছে, ক্রমাগতই তারা তাঁদের গূঢ়প্রতিনিধিদের দ্বারা ‘জনগণের ক্ষমতা’র দাবী এবং ইয়াহিয়াখানের আর্মি দ্বারা নৃশংসতার প্রকৃত চিত্র বিশ্বজুড়ে সংবাদ মাধ্যমে পাঠাচ্ছে। মেইনল্যান্ড চায়না ক্রমাগতই সামরিক জান্তা জন্য সামরিক ও আর্থিক উভয়ই মূল সাহায্যের যোগান দিয়ে যাচ্ছে। এর কারণ অজানা নয়, বরং মাও-সে-তুং এর নিজস্ব যুক্তির শাসন কায়েম করতে শুধুমাত্র মধ্যবিত্ত বুর্জোয়া শ্রেনীর অবমাননার জন্য। বাংলাদেশের এই অবিরাম বিশৃঙ্খলার পরিণামস্বরূপ তারা মধ্যবিত্ত শ্রেনীর নেতৃত্বের অবসান দেখতে পায় যা তারা গণবিপ্লবের দৃষ্টিকোণ হতে হিসেবে প্রগতিবিরোধী বলে বিবেচনা করছে যা মূলত সামগ্রিকভাবেই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা বুঝতে পেরেছে পাকিস্তানের উদ্বিগ্নতার মতোই বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই অনেক দূর এগিয়েছে যে; নিকট ভবিষ্যতে চরমপন্থীরা ক্ষমতা দখল করবে এবং বিশ্বে মাওয়ের চিন্তাধারা ও মাও আধিপত্যবাদের সাথে তাদের সংযুক্ত হওয়ার পরিণাম নিয়ে চীনাদের মনে কোন প্রশ্নই নেই।

আশ্চর্জনকভাবে মেইনল্যান্ড চায়না, কোরিয়া, ভিয়েতনাম এবং লাতিন আমেরিকান উপমহাদেশ হতে আমেরিকা যে শিক্ষা পেয়েছে তার পুরোটাই তাদের উপর বিস্মৃত হয়ে গিয়েছে। আমেরিকান সরকারের পক্ষে প্রাথমিক দূরদর্শিতায় একই রকম অভিজ্ঞতাকে চিহ্নিত করতে পারতো। তাদের বোঝা উচিত ছিল যে, চীনের নেতা হিসেবে মাও-সে-তুংয়ের আবির্ভাবের জন্য এবং চরমপন্থি দল দ্বারা সেই উপমহাদেশের ক্ষমতা দখলের জন্য তারাই দায়ী। তাদের শেখা উচিত ছিল যে চিয়াং-কি-শেকের দ্বারা লুঠতরাজ ও যৌনদাসীত্বকরণ আমেরিকান অস্ত্র দ্বারা সমর্থিত হয়েছিল ও এর মূল নীতি ফলানোর জন্য অনুসৃত হতে অর্থ দেওয়া হয়েছিল এবং আমেরিকা যেখানেই তাদের উদ্বৃত্ত অস্ত্র ও তহবিলের যোগান দিয়েছিল সেই সবের প্রতিটি দেশেই একই রকম বৈশিষ্ট্য নিয়ে তার পুনরাবৃত্তি হয়েছিল এবং গালফের কম বেশী অনেকের সাথে অবনতি করতে সহজ বহির্গমন পথের ব্যবস্থা করেছিল। প্রাথমিক অস্বীকার সত্ত্বেও এটা এখন প্রকাশ্য এবং আমেরিকান সরকার যথেষ্ট নির্লজ্জের মতো প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছে যে আমেরিকার অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত আছে এবং ভারতের আতংক ও এই প্রশাসনের চলার পথকে কৌতুক করতে বিশ্বজুড়ে উপহাসের সত্ত্বেও তা অব্যাহত রাখবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন পাহারার উপর রয়েছে। কিন্তু সে কিভাবে কাজ করবে তার ভবিষ্যৎবাণী কেউ করতে পারছে না। মধ্যপ্রাচ্য দেশগুলো তা ইরান, তুর্কি বা অন্যান্য দেশ যাই হোক না কেন তারা পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে ব্যাপক অস্ত্র সরবরাহ করেই চলেছে। পশ্চিম পাকিস্তান এর সবটুকুই যে মুসলিম জনসংখ্যার প্রাধান্যপূর্ণ বাংলাদেশ যা আগে পাকিস্তান হিসেবে পরিচিত অধিকতর জনগোষ্ঠীকে ধারণ করছে তাদের স্বাভাবিক আকুতিকে দমন করতে ব্যবহার করছে এই সত্যটুকু সম্পর্কে তারা একেবারেই উদাসীন। উপসংহার হিসেবে এটাই অখন্ডনীয় মনে হয় যে, এই সমস্ত কর্মকান্ডই পাকিস্তানে সামরিক বাহিনী উপর ভিত্তি করে স্বৈরাচারী কর্তৃত্ব ও একচেটিয়া পুঁজিপতিদের লালন পালন করতেই অবাধ ক্ষমতা দ্বারা পরিচালিত হয়েছে।

এটা এখানে বিশ্লেষণ করা উপযুক্ত হবে এই জন্য যে তৎকালীন ভারতের একটি অংশে কিভাবে এবং কেন এইসব ঘটেছে যখন পাকিস্তানের চাইতেও চারগুণ জনসংখ্যার হয়েও অবিচ্ছিন্ন ভারতের অন্য অংশটি নিজের ভবিষ্যত সময়কালের গণতান্ত্রিক পদ্ধতির জন্য সংগ্রাম গঠনে এগিয়ে যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি অধঃপতিত, খন্ডিত মুঘল সাম্রাজ্য থেকে ভারতের দখল নিয়ে নেয়। বৃটিশেরা মুসলমানদের উপরে হিন্দুদের উৎকর্ষতাকে আরো মজবুত করে। পক্ষপাতমূলক পদ্ধতিতে ক্ষমতাসীনদের দ্বারা হিন্দুদের মধ্যে নবজাগরণের ও নতুন এক জীবনধারার উন্মেষ অনুসৃত হওয়া শুরু হয়। উনিশ শতকের শেষের দিক হতে হিন্দু বিদ্রোহ শুরু হয়। আকবরের শাসনামলে যারা একই জায়গার সাধারণ নাগরিক হিসেবে বসবাস করা শুরু করেছিল পরিবর্তিত সাম্রাজ্য নীতিতে হিন্দু ও মুসলমানদেরকে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে রূপান্তরিত করে। ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ধর্মযুদ্ধে গান্ধীজ্বী ভারতের সকল সম্প্রদায়কে একই পতাকাতলে জড়ো করতে সক্ষম হয়েছিলেন। দেশের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে প্ররোচিত সাম্প্রদায়িক ক্রোধ জ্বলে ওঠার পরে হিন্দু ও মুসলমান দুই আলাদা জাতির মতো কুখ্যাত তত্ত্বে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টিতে জিন্নাহকে আদর্শ হাতিয়ার হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। ফেলে রাখা নিজেদের মধ্যকার রাজনৈতিক মতপার্থক্যগুলো হয়তো যথাসময়ে সমাধান করা যেতো। কিন্তু, আন্দোলনের কর্ণধারেরা ইতোমধ্যেই শ্রান্ত হয়ে গিয়েছে। তারাও ক্ষমতার কিছুটা স্বাদ পেয়েছিলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ঔপনিবেশিক বৃটিশদের ক্ষমতা এতোটাই দূর্বল হয়ে গিয়েছিলো যে তা পুনরুদ্ধারের আশার বাইরে ছিল। বৃটিশদের ক্ষমতা হতে স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে নেতারা সেই সুযোগ বাজেয়াপ্ত করে ফেলে যা শুধুমাত্র তাদের ভবিষ্যতে ঘটতে পারে এমন কিছু হতে বের হয়ে আসার জন্য উৎসুক ছিল, কারণ তা যদি তারা না করে তবে সেটাই ঘটবে। জিন্নাহ্‌র হতবুদ্ধি অবস্থায় অবিচ্ছিন্ন ভারত পাকিস্তান এবং ভারত নামে বিভক্ত হয়ে যায়। ঐক্যের অসহায়ের মতো কান্না সত্ত্বেও মহাত্মা এর বিরুদ্ধাচারী ছিলেন। এই অস্বাভাবিকতায় মহাত্মাকে তাঁর মৌনসম্মতির জন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছিল। দেশটি মুসলিমদেরকে পাকিস্তানে এবং অমুসলিমদের ভারতে দেশান্তরের মতো মানবিকতাকে উপড়ে ফেলার বিশাল এই দ্বিপথকে দেখে ফেলেছে।

পাকিস্তানের অস্তিত্বের ২৪ বছরে অনেক রকম শিক্ষাই পেয়েছে যা জাতি হিসেবে আমাদের বিপন্ন করতে আমরা অন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করতে পারে। বিদায়ী বৃটিশ শক্তি যারা বৃটিশ শাসনের শেষ দিকে মধ্যস্তকারীর গোপন উদ্দেশ্যে ভাইদের মাঝে যুদ্ধে রত করে ভারতকে বিভক্ত করেছিল তারা ইতোমধ্যেই নিদারুণ ফল ভোগ করেছে।

বৃটিশরা ভারতে যে শূন্যতার তৈরী করেছিল তা আমেরিকা, পাকিস্তান এবং ইউএসএসআর নির্দ্বিধায় পূরণ করে ফেলে। এটা স্বীকার করতে হবে যে নিজেরা থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানের জন্মের কারণ হচ্ছে অভিজাত ও নব্য অভিজাত মুসলমানেরা পাকিস্তান দাবীর পেছনে মুসলিম জনসাধারনকে তাদের দারিদ্র ও অনুন্নয়নের উপর ভিত্তি করে তাদের উপর কর্তৃত্ব করতে সফল হয়েছিল যা এই উপমহাদেশে বৃটিশদের যুগোপযোগী প্রভাবের দ্বারা হয়েছিল। এতে অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই যে, ভারতের স্বাধীনতার জন্য জাতীয় সংগ্রামে অভিজাত ও নব্য অভিজাতদের অংশগ্রহণ খুবই সামান্য ছিল, বরং তাদের বেশীরভাগ আগ্রহ নিজেদের ও তাদের পরিবার-পরিজনের জন্য স্বাধীনতার ফল ভোগ করার মধ্যে। জিন্নাহ্‌ ও লিয়াকত আলীর মৃত্যুর পর সংকটাপূর্ণ মুহূর্তে তথাকথিত জনপ্রতিনিধিদের আড়াল করে পুঁজিবাদী ব্যবসায়ীদের সমর্থনে সেনাবাহিনী পাকিস্তানের নতুন অভিভাবক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তান হতে বঞ্চিত রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা সেনাবাহিনী কিংবা প্রশাসনের কার্যালয়ের মাছ-ভাতের উপর এবং ব্যবসায়িক স্বার্থে কৃষিতে সমৃদ্ধ অঞ্চলে উৎপাদিত ফসলের ফল ভোগের উপর কর্তৃত্ব বজায় রাখার মধ্যে নিজেদের প্রকাশের নতুন পথ খুঁজে পায়। যেখানে একজন অন্ধ ব্যক্তিও দেখতে পায় যে বর্তমানে ধর্ম কোন জাতির জন্য মাইলফলক হতে পারে না সেখানে অন্য আর কোন উপায়ে আমরা ইউরোপের খ্রিস্টান জাতি ও মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম জাতির মধ্যকার অব্যাহত যুদ্ধকে ব্যাখ্যা করতে পারি?

বাংলাদেশের ঘটনা আলাদা, কারণ এর জনগণ জাতিতত্ত্ব, ভাষা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি বা বাস্তব্যবিদ্যা যাই কিছু আছে সবকিছুই পূর্ব পাকিস্তান হতে হাজার মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসীদের হতে সম্পূর্ণ আলাদা। সঙ্গীত ও সাহিত্যপ্রেমী বাংলাদেশের জনগণ তাদের ইচ্ছানুসারে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ার ক্ষমতায়নের জন্য বিদ্রোহের পতাকা উত্থাপন করেছিল। অন্যদিকে পাকিস্তানের ভিতরে নিজেদের মধ্যেও সেনা শাসনের বদলে স্বশাসনের দাবীর জন্য দলগত অভিব্যক্তি প্রকাশের পথ খোঁজা শুরু হয়ে গিয়েছে। ইয়াহিয়া খান ‘জনগণই ক্ষমতার উৎস’ -এর পক্ষে সংবিধান গঠনে সম্মত হয়েছেন। তাঁর উপদেষ্টাদের কাছে স্পষ্টভাবে পশ্চিম পাকিস্তান বা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনের মধ্যে কি চলছিল তা সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিলো না। শাসক দলের সকল হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়ে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সমগ্র পাকিস্তানের মধ্যে এবং প্রাদেশিক আইনসভায় একচেটিয়াভাবে প্রধান দল হিসেবে হিসেবে অক্ষুণ্ণ থাকে। শেখ তার ছয় দফা কর্মসূচীর প্রেক্ষাপটে সতিকারের অভিভাবক হিসেবে কাজ করেছিলেন এবং প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের সাথে সহাবস্থান তৈরী করেছিলেন যার ভিত্তিতে সেনাবাহিনী বা শিল্প ও বাণিজ্যে যেখানে পাকিস্তানের পশ্চিম পাঞ্জাব হতে জনগণ শাসন করছিল সেখানে তিনি জয়ী হয়েছিলেন। ইয়াহিয়া পাকিস্তানের অস্বাভাবিক অবস্থায় অবধারিত বিভক্তির গন্তব্যে হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছিলেন।

বিশ্ব বর্তমানে যেখানে দাঁড়িয়েছে তাতে এর প্রধান তিন পরাশক্তি হচ্ছে- ইউএস, ইউএসএসআর এবং মেইনল্যান্ড চায়না। এই তিন পরাশক্তি বিশ্বে চতুর্থ কোন পরাশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠুক তা চায় না। অল্প ক্ষমতাধরেরা তা ইউরোপ বা অন্য যেখানেই হোক না কেন তা চতুর্থ পরাশক্তির মত সমান ক্ষমতাধর হয়ে উঠতে পারে। ভারত তার ব্যাপক জনগোষ্ঠী, পৃথিবীতে বিদ্যমান ধন্যসম্পদের উপর অধিকারবেল তার দখল যার উপর ভিত্তি করে সে যে অবস্থানে আছে তা হতে তাকে প্রতিরোধ করার একমাত্র উপায় হচ্ছে এই সম্ভাব্য মহাশক্তি হতে শক্তিশালী পাকিস্তানকে আলাদা করে পাওয়া। বিশ্বের কাছে বিস্ময়কর হচ্ছে ইয়াহিয়া ও তার উপদেষ্টাদের দ্বারা পাকিস্তানের আসন্ন বিচ্ছেদের ঘোষণায় তা সে বড় বা মধ্যম বা ছোট যে ভাইয়েরই হোক না কেনও তাদের এই দৃষ্টিকোণ হতে দেখা উচিৎ, যেহেতু বাংলাদেশে যা ঘটছে তাতে তাদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে বড় বা মাঝারি ক্ষমতাধর বা নীরব থাকাদের ক্রমাগত অর্থনৈতিক এবং সামরিক সমর্থনের মাধ্যমে সাহায্য করা হচ্ছে।

পরবর্তীতে রাজনৈতিক ফয়সালার জন্য ইয়াহিয়া যাদের সাথে কথা বলেছিল তা সম্প্রচারিত হওয়ার জন্য পুরো বিশ্ব অপেক্ষা করছিল। ভারত রুদ্ধশ্বাসে তার উপর চেপে বসা প্রায় সত্তর লক্ষ উদ্বাস্তুর বোঝা হতে মুক্ত হওয়ার জন্য এবং এর বাইরেও এখনো প্রত্যন্ত অঞ্চল হতে পাকিস্তান নিয়ে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছিল যার হলকা সম্পূর্ণভাবেই বিধ্বংসী রূপ নিয়ে পুরো উপমহাদেশের সাথে জড়িয়ে পড়ছিল। এই বিশ্ব রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের উত্থানের উদাহরণে পরিপূর্ণ হচ্ছে যা বাদ দেওয়ার মতো নয়। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা এখন প্রকাসিত হয়েছে। সামরিক জান্তাকে পরাশক্তি দ্বারা আরো মজবুত করা হয়েছে যা দেখে মনে হচ্ছে পুরাণ মহাভারতের দূর্যোধনের মতোই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এর ফলে ডামাডোল ছড়িয়ে পড়া অত্যাবশ্যক, প্রকৃতি তার অমোঘ যুক্তিতে কাজ করে চলেছে। এরই মধ্যে আমাদের সরকারী ও বেসরকারী উভয় প্রতিনিধিরা বিশ্ব সম্পর্কে একটি জরিপ সম্পন্ন করেছে। বর্তমানে আমরা নিশ্চিত যে বিশ্ব ঘুমাচ্ছে এবং এমনকি যারা জেগেও আছে তারাও অযথা বিরক্ত হতে অনিচ্ছুক এবং নিস্প্রাণ হয়ে বা ন্যায্য কার্য হিসেবে বিনা আপত্তিতে মেনে নিবে, তা যেমনই হোক না কেন, ভারত আমাদের জন্য সুখবর দেওয়ার মতো অন্য কারো জন্য অপেক্ষা করতে পারছে না। এমনকি বর্তমানের প্রত্যক্ষ প্রতিবেশী ও গতকালের নাগরিক হিসেবে আমাদের সাথে শান্তিতে সহাবস্থানে পাকিস্তানের জনগণের প্রতি আমাদের আন্তরিক অভিলাষ রয়েছে।

উপমহাদেশের জনগণ শান্তিতে সহাবস্থানের জন্য ক্ষমতাধর ব্রিটিশরা অকপটেই ভারতকে বিভক্ত করেছে। এমনকি হুমকির মুখেও তা বিনা আপত্তিতে আমরা মেনে নিয়েছিলাম এই অনুমানের ভিত্তিতে যে, পাকিস্তানের জনগণ জনগণের ইচ্ছানুসারে তাদের জীবন গঠন করবে। এই বছরের ২৫শে মার্চে পাকিস্তানের চব্বিশ বছরের ইতিহাস আকস্মিক রূপান্তরের চরম সীমায় পৌঁছেছে যা নিশ্চিতভাবেই সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে যে এটা সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশ নয় যা সাড়ে ছয় কোটি জনসংখ্যার পাকিস্তান হতে অপসৃত হচ্ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠরা কিছুতেই এবং কোনভাবেই অপসৃত হতে পারে না। এটা সেটাই যার বেশীরভাগই অপসৃত হচ্ছে। সবচাইতে খারাপ যা হচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠদের বিজয়কে দমন করতে সামরিক জান্তা বাহিনী ব্যবহৃত হচ্ছে যা সংখ্যালঘুদের কারসাজির দ্বারা একচেটিয়া পুঁজিবাদ সমর্থিত। কম্যুনিস্ট শক্তি পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে তাদের ভাইদেরকে বিপদ হতে উদ্ধার করতে প্রস্তুত, যেমন- কিউবা। টিকে থাকার জন্য গণতন্ত্রের সেখানেই সুযোগ আছে যদিনা গণতন্ত্রের মধ্যে থাকা জনগণ সম্মিলিতভাবে নিজের অধিকার সম্পর্কে দৃঢ়ভাবে অবস্থান নিতে পারে এবং যেখানে স্বাধীনতা হুমকির মুখোমুখি সেখানে তার ভ্রাতৃত্বকে উদ্ধারে মুক্ত নির্বাচনের সুযোগ রয়েছে। এই মৌলিক বিবেচনার খাতিরে আমেরিকা প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যাওয়ার জন্য তাদের কর্মকান্ডকে উদাহরণস্বরূপ উদ্ধৃত করার জন্য যৌক্তিকতা উপস্থাপন করতে পারে। এমনও যদি হয় যে বিশ্বের অন্য আর কোন জাতি আমাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে না তবুও আমরা জনসংখ্যায় প্রয়োজনে যথেষ্ট এবং পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সহায়তায় পাশে দাঁড়ানোর নৈতিক বাধ্যবাধকতা আমাদের আছে যারা প্রাদেশিক সরকার গঠনের মাধ্যমে নিজেদের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছে, তা সেই সরকার যেখানকারই হোক না কেন এবং যতটুকু এলাকাই তাদের অধীনে হোক না কেন। অতএব, প্রথম পূর্বশর্ত হচ্ছে বাংলাদেশে জনগণের ক্ষমতার অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং যৌক্তিকভাবে অন্তর্বর্তীকালীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতির উপসিদ্ধান্ত এবং যৌক্তিকভাবে অন্তর্বর্তীকালীন বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতির উপসিদ্ধান্ত এবং এই সরকার যাতে ভারত বা অন্য যেকোন জায়গা হতেই সহায়তার মাধ্যমে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনগণের উপর ধেয়ে আসা বর্বর অত্যাচারকে পরাভূত করার পথকে সুরক্ষিত করতে পারে তা নিশ্চিত করা।

ভারত যদি এই নৈতিক পরিকল্পনানুযায়ী কাজ করতে পারে তবে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই যে এই বিশ্ব মূলত শিষ্টতায় এবং স্বাধীনতায় মানবজাতির বেঁচে থাকার অধিকারের জন্য তিমি মাছের মতো মারা যাবে। অন্যরা এতে আমাদের সাথে যুক্ত হতে বাধ্য। এমনও যদি হয় যে অন্য কেউই আমাদের সাথে যুক্ত হলো না এবং তাৎক্ষণিকভাবেও যদি পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেও ফেলে তবে এই পঞ্চান্ন কোটির বিশাল জনসংখ্যার বিশাল অংশ প্রয়োজনে এর মুখোমুখি হতে বাধ্য। এর মধ্যেই বিশ্ব জেনে যাবে যে, আমাদের প্রয়োজনের খাতিরে এই যুদ্ধ হচ্ছে না। অতএব বিশ্ব জানবে যে, বিশ্বকে জাগ্রত করতে আজ পর্যন্ত আমরা যে যন্ত্রণা গ্রহণ করেছি ও ধৈর্য্ দেখিয়েছি তা বৃথা যায়নি। শুধুমাত্র ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দেখা যায় যে ইতিহাসের মধ্যে এটি একটি বিরল সুযোগ যা জনগণের ইচ্ছার যথার্থতাকে প্রমাণ করতে, লোভীদের দমন করতে, আমাদের নিজেদের মধ্যে বিভাজন-প্রক্রিয়াকে বাড়াতে পারে করে এমন কিছুর কর্তন যা বর্তমানে আমাদের মূল শক্তিকে ক্ষয় করছে এবং যে জাতি ন্যায্যত আমাদের ছিল তা ক্রমবর্ধমান জাতি হিসেবে বেড়ে ওঠায় আমাদেরকে প্রতিরোধ করা, ইতিহাসে টিকে থাকাতে আমাদের সামর্থ্য অর্জন। ইতিহাসের শুরু থেকেই একটি জাতি গড়ে তোলার জন্য মরণশীলেরা রক্ত, ঘাম এবং অশ্রুর যোগান দিয়ে আসছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে খেলায় আমাদের ক্ষয় হয়েছে তা উল্টো রথের যাত্রা ছিল যাতে দেশের সামগ্রিক ধনসম্পদ প্রায় ধোঁয়ার মতো উবে গিয়েছে। কবে আমরা আমাদের সরকার এবং সম্প্রদায়ে সাহসী জনতার সাহসীকতার প্রতিফলন করাটা শিখতে পারবো। আমরা যে বর্বর পৃথিবীতে বসবাস করি এবং জাতিসত্তাকে উদ্বুদ্ধ করার বাস্তবতায় বিশ্বকে জেগে উঠতে হবে। এটা এমন কোন কাজ নয় যে যা সরকার বা রাজনৈতিক দল কর্তৃক গঠন করা এবং সেই লেবাস ধারণ করার দায়িত্ব নিবে যা বর্তমানে করছে। দেশের আনাচে কানাচে প্রতিটি কোণ হতে জনতার জোরালো ভূমিকা আবশ্যক। যারা দেশ বিভক্তির রাজনীতিতে মত্ত ছিল বা যা এ নিয়ে যথেষ্ট মজা নিয়ে ফেলেছে তাঁদেরকে অবশ্যই জেগে উঠতে হবে এবং জনগণের ইচ্ছাশক্তি এবং তাদের অধৈর্য্তার সাথে আমাদের বর্তমান মধুর ধৈর্য দিয়ে আমাদের সাথে তাদের দাবীর প্রতিধ্বনিকে এতোটাই জোরালো করতে হবে যেন তা বজ্রশক্তিতে পরিণত হয় যাতে ক্ষমতাধরেরা তা উপলব্ধি করতে পারে।

সহায়তা
এ্যাকশন কমিটি ‘বাংলাদেশ’

অনুগ্রহ করে এই সঙ্কল্পটি প্রথম পাতায় সংযুক্ত করবেন এবং এর একটি ভারতের প্রধানমন্ত্রী বরাবরে এবং অন্যটি এ্যাকশন কমিটি ‘বাংলাদেশ’, লাজপাট ভবন, নয়া দিল্লী-২৪ এ পাঠিয়ে দিবেন।

সংকল্প

এই বৈঠকে…………………………………………………………………………..এতদ্বারা

বাংলাদেশের জনগণের এই ক্লেশ ও অন্তর্বেদনার সময়ে তাদের প্রতি গভীর সহানুভুতি ও সমর্থনের স্থান দেওয়া হয়েছে।

সামরিক শাসকদের দ্বারা বাংলাদেশের নিরস্ত্র নারী, পুরুষ ও শিশুদের উপর সংঘটিত এই অমানবিক নৃশংসতা এবং গণহত্যা দ্ব্যর্থহীনভাবে অত্যন্ত নিন্দনীয় যার ফলশ্রুতিতে লক্ষাধিক বাঙ্গালীর ভারতের উদ্দেশ্যে দেশত্যাগের ফলে সেই দেশে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে বিশাল অনাকাঙ্খিত বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে;

পরিতাপের বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক প্রেরণা এবং যথাযথভাবে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরকে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা দ্বারা দমন ইউ.এন. সনদ ও মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের চরম লঙ্ঘন;

জনগণের রায় অনুসারে গঠিত বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে স্বীকৃতি দান এবং যত ভাবে সম্ভব তার সর্বোচ্চ সহায়তা দিয়ে উদ্বাস্তুরা বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার জন্য সুবিধাজনক অবস্থান তৈরী করা হয় তার জন্য ভারত সরকারের কাছে আবেদন জানানো হচ্ছে;

কোন প্ররোচনা ছাড়াই আমাদের অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যের বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে সংকটকালীন বর্তমানে সংহতি জ্ঞাপন এবং জাতীয় পর্যায়ের সচেতনতা প্রচারে দেশের সকল হৃদয়বান নাগরিকদের কাছে আহ্বান করা হচ্ছে;

বিশ্বের সকলের কাছে আহ্বান করা হচ্ছে যাতে তারা বাংলাদেশের জনগণের জন্য তাদের সহানুভুতি ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় এবং যারা এখনো পশ্চিম পাকিস্তানীদের অস্ত্র সরবরাহ করে যাচ্ছে তাদেরকে যেন তা বন্ধ করতে বলা হয় যাতে পাকিস্তানী আগ্রাসনে তাদের সরকার আগুনে ঘি ঢালার মতো কোন কাজ আর না করে; এবং

উপরোক্ত বর্ণিত সকল বিষয়ের আলোকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সকল সাহায্য ও সহযোগীতায় ভারত সরকার যেন অঙ্গীকারবদ্ধ হয়।

*মুদ্রন ও প্রকাশনাঃ শ্রী এস.ডি. শর্মা (যুগ্ম আহ্বায়ক, এ্যাকশন কমিটি বাংলাদেশ, লাজপাট ভবন, নয়া দিল্লী) দ্বারা এবং মুদ্রিতঃ নতুন হিন্দুস্তান প্রেস (চাঁদনী চক, দিল্লী)।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৭৩। ‘মুজিব নিহত হলে ভারত দায়ী হবে’ মিঃ রাজ নারায়ণের মন্তব্য হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড ২রা সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

নীতেশ বড়ুয়া
<১২, ১৭৩, ৪৬১>
অনুবাদ

মুজিব নিহত হলে, ভারত দায়ী হবে মিঃ রাজ নারায়ণের মন্তব্য
( আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি মারফত)

১লা সেপ্টেম্বর, নয়া দিল্লী- বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্যে কি আছে সেই সম্পর্কে তথ্য যদি থাকে তা জানাতে এম.পি. জনাব রাজ নারায়ণ গতকাল ভারতীয় সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

সাংবাদিকের সাথে কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, যদি শেখ মুজিব ইতোমধ্যেই নিহত হয়ে থাকে তবে তা নিয়ে অনেক মানুষই আতংকিত।

তিনি মনে করছেন যে যদি পাকিস্তানীদের দ্বারা যদি শেখ মুজিবকে ইতোমধ্যেই হত্যা করা হয়েই থাকে তবে তার ভারত সরকারই দায়ী। সেই সাথে তিই আরো যোগ করেন যে যদি ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি জানিয়ে দিতো তবে শেখ মুজিবের বিচার করাটা একটি আন্তর্জাতিক বিষয় হিসেবে গণ্য হতো।

ভারত ও চীনের মধ্যে সংলাপের সম্ভাবনা ছিল এমন প্রতিবেদনকে স্বাগত জানিয়ে জনাব রাজ নারায়ণ এর জন্য তিনটি পূর্বশর্ত জানিয়ে দেন।

তিনি বলেন, চায়না যেন অবশ্যই ভারত ও তিব্বতের মধ্যকার সীমান্ত হিসেবে ম্যাকমোহন লাইনকে গ্রহণ করতে হবে, তিব্বতের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে হবে এবং সেই সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিতে হবে।

তিনি আরো মনে করেছিলেন যে পররাষ্ট্র নীতি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য জনাব ডি.পি. ধরকে দায়িত্ব দেওয়ার পর পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে জনাব শরণ সিং পদত্যাগ করবেন।

জনাব রাজ নারায়াণ বলেন যে, জনাব এস.এন. দ্বিবেদী নিয়ে সিদ্ধান্তের জন্য সিদ্ধান্তটি ছিল “ তার রাজনৈতিক কর্মজীবনে প্রথমবারের মতো তার পেশা ও কর্মকান্ড পারস্পরিক সম্প্রীতির মাঝে রয়েছে”।

স্মরণ করা যেতে পারে, জনাব দ্বিবেদী নবগঠিত সমাজতন্ত্রী দল এবং ওড়িষা পিএসপি যা নিজের পৃথক পরিচয় বজার আখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা হতে জাতীয় এড হক কমিটি হিসেবে পদত্যাগ করেছেন এবং কংগ্রেসের (রেজিঃ) সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন।

তিনি জানান যে, তিনি সকল গঠিত অথবা গঠিত হবে এমন সকল সমাজতন্ত্রী দলের কমিটিতে বেশীরভাগ সদস্য অনগ্রসর সম্প্রদায়ের হতে নেওয়াটাকে পছন্দ করবেন।

সেই সাথে তিনি আরো যোগ করেন যে, যদি এমন করে অনগ্রসর সম্প্রদায়ের সদস্য নিয়ে কোন কমিটি গঠিত হয়ে তবে তাদের জন্য জায়গা তৈরী করতে কিছু সদস্যের সরে দাঁড়ানো উচিত।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৭৪। নজরুলের পুত্র কর্তৃক কবিকে দেয়া পাকিস্তান সরকারের ভাতা প্রত্যাখ্যান হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড ৪ঠা সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

নীতেশ বড়ুয়া
<১২, ১৭৪, ৪৬২>
অনুবাদ

ইয়াহিয়ার অর্থ অস্পৃশ্যঃ নজরুল পুত্র
( আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি মারফত)

৩রা সেপ্টেম্বর, নয়া দিল্লী- নজরুল পুত্র কাজী সব্যসাচী, কবির জন্য মাসোহারা নবায়নের পাকিস্তানের প্রস্তাব সম্পূর্ণই প্রত্যাখ্যান করেছেন।

তিনি বলেন, পাকিস্তানের এই রক্তমাখা টাকা তারা স্পর্শ করবেন না।

কাজী সব্যসাচী বর্তমানে তার ব্যক্তিগত ভ্রমণে এখানে আছেন, তিনি একটি বিবৃতি দেনঃ আমার বাবা যিনি বিগত বেশ ক’বছর ধরে অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী, তার মাসোহারা নবায়নের পাকিস্তানের প্রস্তাবের স্পর্ধাতে আমি বিস্মিত।

“এটা সবার জানা যে কবিতায়, গানে এবং অন্যান্য লেখনীতে নজরুল ইসলাম বাঙ্গালী সংস্কৃতি ও বিপ্লবী স্বত্বার মূর্ত প্রতীক, পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনীর দিয়ে তা আজ চূর্ণ করতে চাইছে, যত সমস্যার সম্মুখীনই হই না কেন লক্ষাধিক নির্দোষের রক্তে রাঙানো পাকিস্তানের এই টাকা আমরা স্পর্শ করবো না।

গতকালকের রেডিও পাকিস্তানের প্রতিবেদনে ইসলামাবাদের সরকারী মুখপাত্রকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে যে, কবির মাসিক ভাতা পরিশোধে “ নয়াদিল্লীস্থ পাকিস্তানের হাইকমিশনের মাধ্যমে পুনরায় শুরু করা হয়েছে। ”

যখন পাকিস্তান এই ভাতা বন্ধ করে দেয়, তখন বাংলাদেশ সরকার কবির সহায়তায় ভাতা ঘোষণা করে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার দীর্ঘ সময় হতেই কবিকে পেনশন দিয়ে আসছিল।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৭৫। গান্ধী শান্তি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের জন্য স্বাধীনতা অভিযাত্রার আয়োজন করবে হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড ৮ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

নীতেশ বড়ুয়া
<১২, ১৭৫, ৪৬৩>
অনুবাদ
বাংলাদেশ অভিমুখে ‘স্বাধীনতার অভিযাত্রা’
( এক্সপ্রেস নিউজ সার্ভিস)

৭ই সেপ্টেম্বর, কলকাতা- গান্ধী শান্তি ফাউন্ডেশন দ্বারা অক্টোবরের কোন এক সময়ে পূর্ববঙ্গের ’স্বাধীনতা অভিযাত্রা’ সংগঠিত হয়েছিল

অন্তত এক লাখ বাংলাদেশী উদ্বাস্তু যারা বিভিন্ন শিবিরে বসবাস করছে তারা দল প্রতি এক হাজারে তাদের বাড়ীতে ফিরে যাবে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে সেখানে বসবাস করবে।

তারা পাকিস্থা সরকারের সাথে সহযোগীতা করবে না এবং তাদের নিজেদের এলাকায় নিজেদের প্রশাসনকে সংগঠিত করবে।

গুপ্তচরগিরি করা লাশ হিসেবে তাদের যেভাবে ডাকা হয়, প্রধান রাস্তা দিয়েই তাদেরকে বাংলাদেশে সরানো হবে।

সেই অভিযাত্রায় বিভিন্ন দেশের শান্তিবাদী কর্মীদের অংশগ্রহণ আশা করা হচ্ছে। দুই আমেরিকান, জনাব চার্লি ওয়াকার ও জনাব অ্যালেক্সান্ডার পল যারা পাকিস্তানী জাহাজ ‘পদ্মা’তে যুদ্ধের উপকরণ বোঝাই করাকে প্রতিহত করেছিলেন তারা ইতোমধ্যেই ভারতে পৌঁছেছেন। ‘অপারেশন ওমেগা’র কর্মীদেরও এই অভিযাত্রায় যোগদানের সম্ভাবনা বেশী।

এই ফাউন্ডেশন ইতোমধ্যেই ৫০ জন তরুণকে নির্বাচিত করেছে যারা প্রতিজন ১, ০০০ জন উদ্বাস্তুর নেতৃত্বে থাকবে।

পাক বাহিনী এই অভিযাত্রার অভিমুখে বাঁধা সৃষ্টি করলে অভিযাত্রীরা কি করতে পারেন তা নিয়ে এই সম্মেলনে আলোচনা করা হয়েছে।

এছাড়াও “ওমেগা” প্রতিনিধি শান্তিবাদে বিশ্বাসী জনাব ওয়াকার তাদের সাথে যোগ দিবেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৭৬। বিশ্বশান্তি আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ কর্তৃক অবিলম্বে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান দাবি দৈনিক কালান্তর ১৬সেপ্টেম্বর ১৯৭১

Aparajita Neel
<১২, ১৭৬, ৩৬৪>

অবিলম্বে বাংলাদেশের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান চাই
জামশেদপুরের জনসভায় বিশ্বশান্তি আন্দোলনের নেত্রীবৃন্দের দাবী

জামশেদপুর, ১৫ সেপ্টেম্বর (সংবাদদাতা) – সম্প্রতি জামশেদপুরে জনসভায় বিশ্ব শান্তি সংসদের ইতালির কমিউনিস্ট নেতা ও সংসদ সদস্য শ্রী অন্টনিলা ট্রম্বোদরি এবং লেবাননের জননেতা মুহম্মদ টবেবা তাদের ভাষণে অবিলম্বে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের দাবী করেন। স্থানীয় সাকচি বেঙ্গল ক্লাবে বাংলাদেশ সংহতি কমিটির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতিত্ব করেন স্থানীয় কমিউনিস্ট ও শ্রমিক নেতা শ্রী বারিন দে।

শ্রী ট্রম্বোদরি পাকিস্তান ইয়াহিয়া খাঁর সামরিক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে সেখানকার গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে স্বাগত জানিয়ে তার ভাষণ শুরু করেন। বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে পাকিস্তান যে ব্যাপক গণহত্যা ও চন্ডিনিতি গ্রহণ করেছে তার বিরুদ্ধে তিনি ধিক্কার জানান। শ্রী ট্রম্বোদরি বলেন, যদি ইয়াহিয়া খাঁ ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করেন তবে তার বিরুদ্ধে মুসোলিনির অবস্থাই হবে। তিনি দাবী করেন, অবিলম্বেই শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দিয়ে জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্পন করতে হবে। বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম কে সহায়তা করার জন্য তিনি ভারত সরকারের প্রশংসা করেন।

মুহম্মদ টব্বো সভায় ঘোষণা করেন যে, শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার চক্রান্তকে ব্যার্থ করার জন্য তারা বিশ্বের জনমত জাগ্রত করবেন। তিনি মুক্তি সংগ্রামকে সাফল্যের জন্য যুক্তফ্রন্ট গঠনের উপর বিশেষ জোর দেন।

বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জনাব আলী আক্সাদ তার ভাষণে বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামের পটিভুমি বর্ননা করেন। মুক্তি সংগ্রামকে সাহায্য করার জন্য ভারত সহ বিশ্বের প্রগতিশীল জনগণের কাছে তিনি তার ভাষণে আহবান জানান।

উল্লেখযোগ্য ঐ সভায় জামশেদপুর ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সহায়ক সমিতির’ সভাপতি ডাঃ বিশ্নুপদ মুখার্জি জনাব আলী একসাদের হাতে এক হাজার টাকার একটি চেক মুক্তিসংগ্রামীদের সাহায্যের জন্য প্রদান করেন।

সভায় বিশ্ব শান্তি সংসদের ঐ দুই নেতার আগমন উপলক্ষে স্থানীয় স্টেশনে তাদের বিপুলভাবে সম্বর্ধনা দেয়া হয়। তারা সভাশেষে কয়েকটি আলোচনা সভায়ও যোগ দেন।
শিরোনাম
সূত্র তারিখ
১৭৭। দিল্লীর আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অবিলম্বে মুজিবকে মুক্ত করার দাবী ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

Jayanta Sen Abir
<১২, ১৭৭, ৪৬৫-৪৬৮>

ই. বি. ট্র্যাজেডি
জাতিসমূহ বিস্মিত, ক্ষুদ্ধ
মুজিবকে অবিলম্বে মুক্তিদানের আহ্বান

নয়াদিল্লী, সেপ্টেম্বর ১৮ – আজ অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ২৪টি দেশের প্রতিনিধি কর্তৃক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘তৎক্ষণাৎ ও নিঃশর্ত মুক্তি’ এর জোরালো দাবী উত্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশে ঘটমান ঘটনাবলির ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী বিরাজমান বেদনা ও ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

তিন দিন ব্যাপী এই সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনের সভাপতিত্ব করা সর্বদয়া নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ কর্তৃক উত্থাপিত এই দাবীতে সম্মেলনটিতে অংশগ্রহণকারী সকল প্রতিনিধি উঠে দাঁড়িয়ে সমর্থন প্রকাশ করেন।

শেখের গোপন বিচারের বিরুদ্ধেও এখানে নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়। এছাড়া বিশ্বের সরকারগুলোর কাছে আর্জি জানান হয় তারা যেন সকল সভ্য সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত আইন, অনুশাসন এবং মানব স্বাধীনতার লঙ্ঘন রুখতে পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের উপর চাপ প্রয়োগ করেন।

সম্মেলন এবং বাংলাদেশের জনগণের সফলতা কামনা করে রাষ্ট্রপতি ভি. ভি. গিরি, ফরাসি প্রধানমন্ত্রী মেন্ডেস-ফ্রান্স, বুদ্ধিজীবী আদ্রে মার্লো, সঙ্গীতজ্ঞ ইয়েহুদি, মেউহিন, আমেরিকান সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি এবং একটি বড় সংখ্যার ভারতীয় নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে পাওয়া বার্তা গৃহীত হয়।

সভাপতির পর প্রথম ব্যক্তি হিসেবে সম্মেলনে ভাষণ দেন বাংলাদেশের প্রতিনিধি এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য এ. আর. মল্লিক। তিনি মার্চের ২৫-২৬ এর দুঃস্বপ্নের আগে ঘটে যাওয়া মর্মভেদী ঘটনাবলির বর্ণনা দেন যার ফলে পরবর্তীতে ১০ লাখ বাঙালির বিনাশ ঘটে, ৮০ লক্ষের বেশি গৃহহীন হয়ে জীবন বাঁচাবার তাগিদে ভারতে যেয়ে আশ্রয় নেয়।

তাঁর পরে বক্তৃতা দেন শ্রীলঙ্কার সিনারাত গুনওয়ার্ধানে। এক আবেগপূর্ণ ভাষণে তিনি বলেন “বাংলাদেশের জনগণ তাদের স্বশাসনের অধিকারের প্রয়োগ যেরূপে করেছে তা পূর্বে কোনো জাতির কাছ থেকেই দেখা যায় নি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব ছিল তারা যেন তাদের আইনসিদ্ধ অধিকার লাভ করতে পারে তার নিশ্চয়তা প্রদান করা। ”

নেপালের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বি. পি. কৈরালা সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলেন “যদি বাংলাদেশের আলো নিভে যায়, তবে বিশ্বের আরো অনেক স্থানের আলোও নিভে যাবে। ”

নাৎসিদের পথ

‘ফ্রেঞ্চ লীগ অব হিউম্যান রাইটস’ এর সভাপতি মঁসিয়ে ড্যানিয়েল মেয়ার বাংলাদেশে চলমান ভয়ানক বিয়োগান্তক ঘটনাবলিকে নাৎসিদের হাতে সংঘটিত ইহুদী গণহত্যার সাথে তুলনা করেন।

ইন্দোনেশিয়ার প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ রোয়েম প্রশ্ন রাখেন “আমরা কি কারণের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে শুধুমাত্র তার ফলাফল –শরণার্থীদের উপরেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখব? ”

তাঁর নিজদেশের অবস্থানের সরাসরি বিরোধিতা করে ড. রোয়েম বলেন যে বাংলাদেশের ঘটনাটিকে একটি অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবে বিবেচনার কোনো সুযোগ নেই কারণ এটি বিশ্বশান্তির প্রতি হুমকিস্বরূপ।

তিনি জোর দিয়ে বলেন যে সর্বপ্রথম বিষয় হল শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি। তিনি বলেন, হাজারো জীবিত মুজিবের চাইতে একজন নিহত শেখ মুজিবুর রহমানে বেশি বিপদজনক। ”

নিউইয়র্কের অধ্যক্ষ স্ট্যানলি প্ল্যাস্ট্রিক আমেরিকানদের মনোভাব উল্লেখ করতে যেয়ে বলেন “ এক শতাব্দীর জন্যে একটি ভিয়েতনামই যথেষ্টের বেশি ছিল। তারা আরেকটি ভিয়েতনাম দেখতে চায় না। ”

তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন যে সর্বস্তরের আমেরিকান মতবাদ কর্তৃক বিক্ষোভ প্রদর্শন ও চাপ প্রয়োগ সত্ত্বেও প্রশাসন আমেরিকাকে এমন একটি অবস্থানে এনে দাঁড়া করিয়েছে যেখানে “পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের বাদ দিলে আমেরিকাই বাংলাদেশে চলমান ঘটনাবলির জন্যে দায়ী। ”

জনগণ উত্তর দেবে

অধ্যক্ষ প্লাস্ট্রিক বলেন যে আগামী বছরের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আমেরিকার ব্যথিত জনগণের পক্ষ থেকে বর্তমান প্রশাসনের জন্য নিশ্চিতভাবেই একটি বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে।

ব্রিটিশ হাউস অব কমন্স এর সমাজতান্ত্রিক সদস্য ফ্রেড ইভান্স তাঁর তীব্র ও শক্তিশালী ভাষণের সমাপ্তি টানেন এভাবে “জয় বাংলাঃজয় মুক্তিযোদ্ধা”।

নাইজেরিয়ান আইনজীবী সমিতির মিস্টার গ্যানি ফৌয়েহিনমি বলেন “আমরা বাংলার লাখো জনগণকে ধ্বংস হয়ে যেতে দিতে পারি না। ”

তিনি বোমা, বন্দুক এবং মৃত্যু যেন বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে দমিয়ে দিতে না পারে তার নিশ্চয়তা প্রদানের জন্য বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে অনুরোধ করেন। তিনি বলেন যে এই জনগণ ক্রমাগত শোষণের স্বীকার এবং এখন তাদের তুলে ধরা দাবী সম্পূর্ণরূপে ন্যায্য।

‘ওয়ার অন ওয়ান্ট’ এর সহসভাপতি যুক্তরাজ্যের স্যার জর্জ ক্যাটলিন বলেন যে সম্মেলনের উচিৎ হবে জাতিসংঘের উপর চাপ প্রয়োগ করা যেন বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক ইচ্ছা পূরণ এবং তাদের তুলনাহীন দুর্দশার শেষ আনয়নে জাতিসংঘ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য হয়।

জাপানের অধ্যক্ষ সুয়োওশি নারা, যিনি জাপানে অবস্থানরত পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূতের প্রতিবাদ সত্ত্বেও এই সম্মেলনে যোগদান করেন, এমন উপায় ও ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানান যাতে করে এই বাংলাদেশ সমস্যাটি বিশ্বশক্তিগুলোর নিয়ন্ত্রিত একটি বৃহত্তর এশিয়ান যুদ্ধে পরিণত না হয়।

মিশরের জনাব ক্লোভিস মাকসুদ, যিনি লিবিয়া ও সুদানেরও প্রতিনিধিত্ব করেন, বলেন যে বাংলাদেশের সমস্যাটিকে কোনোভাবেই ইন্দো-পাক দ্বন্দ্বের অংশ হতে দেয়া যাবে না।

নিজের আবেগতারিত ভাষণে তিনি বলেন যে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির বিষয়টি সকল মানবতার উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনাব মাকসুদ বলেন যে পূর্ব বাংলার জনগণকে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করার মানে হল একটি বর্ণবাদী প্রথাকে এগিয়ে যাবার সুযোগ করে দেয়া।

জনাব মাকসুদ বলেন যে আরবেরা ভেবেছিল নির্বাচনের মাধ্যমে বাঙালির সমঅধিকার ও সম্মানের যে অপলাপ তার অবসান ঘটবে।

তিনি বলেন যে আরব বিশ্বের অন্যান্য প্রতিনিধিদের সাথে তিনি এখানে এসেছিলেন প্রকৃত অবস্থা পরিদর্শন করতে। আরবেরা এ বিষয়ে “যতটা ভালভাবে উচিৎ ততটা ভালভাবে অবগত ছিল না” আর তার পেছনের কারণ হল তারা নিজ নিজ দেশে চলমান সংকটে গভীরভাবে নিমজ্জিত ছিল।

তাদের দুজন প্রতিনিধি ডেনমার্কের মিস্টার নেলিসন এবং নরওয়ের মিসেস সিগ্রিড হ্যানিসঢাল এর মাধ্যমে ‘দ্যা ওয়ার্ল্ড ফেডারেলিস্ট’ পূর্ব বাংলার জনগণের স্বশাসনের অধিকার খর্ব হবার ব্যাপারে উদ্বেগ জানায়।

আফগান সমর্থন

কাবুলের ‘ দ্যা আফগান মিলেট’ এর জনাব কিউ. হার্দাদ আফগান জনগণের সংহতির ব্যাপারে বাঙালিদের নিশ্চয়তা প্রদান করেন। তিনি বলেন শোষণের শৃংখল ছুঁড়ে ফেলতে বাঙালি জনগণের যে আকাঙ্ক্ষা তাকে আফগানেরা সম্পূর্ণরূপে সমর্থন করে।

‘ওয়ার্ল্ড কনফারেন্স অব রেলিজিয়ন্স ফর পিস’ এর সাধারণ সম্পাদক ড. হনার এ. জ্যাক অতুলনীয় বর্বরতার ভয়ানক সব কাহিনীর বর্ণনা করেন যেগুলোর খবর তিনি বাংলাদেশে তাঁর অবস্থানকালে জানতে পারেন।

মুজিবুর রহমানের আশু মুক্তি এবং পাকিস্তানকে সকল প্রকার অস্ত্র ও উপাদান সাহায্য হিসেবে পাঠানো বন্ধ করতে নিজ দেশের চারশতেরও অধিক শীর্ষ বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ ও সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের দ্বারা উত্থাপিত দাবীর পুনরাবৃত্তি করেন অস্ট্রেলিয়ার অধ্যক্ষ জন ডারহাম।

অস্ট্রেলিয়ান সরকারের ‘উটপাখির ন্যায় মনোভাব’ এর ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেন যে তাঁর দেশের বেসরকারী সংস্থাগুলো বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক সমস্যা সম্পর্কে জনমতকে প্রভাবিত করতে একটি নিয়মতান্ত্রিক প্রচারাভিযান শুরু করেছে যাতে করে জনমতের চাপ সরকারকে তাদের মনোভাব পরিবর্তনে বাধ্য করতে পারে।

‘যুগোস্লাভিয়ান লীগ ফর পিস’ এর মিস্টার পাভিই জেভারমোভিচ বলেন যে বাংলাদেশের জনগণকে স্বশাসনের অধিকার অবশ্যই দিতে হবে, যা তারা ইতিমধ্যেই প্রয়োগ করেছে।

উদ্বোধনী অধিবেশনের অনুষ্ঠানস্থল সাপ্রু হল বিশিষ্ট বিদেশী ও ভারতীয় প্রতিনিধিগণ, বিশেষভাবে আমন্ত্রিত কূটনৈতিকবর্গ, বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিক এবং অন্যান্য গণ্যমাণ্য ব্যক্তিবর্গ দ্বারা কানায় কানায় পরিপূর্ণ ছিল।

সকালের অধিবেশনে প্রায় ১৪০ জন প্রতিনিধি যোগদান করেন। তাঁদের মধ্যে প্রায় ৭০ জন আসেন ৫টি মহাদেশ জুড়ে বিস্তৃত ২৩টি বিদেশী রাষ্ট্র থেকে, যার মধ্যে সবচেয়ে বড় দলগুলো ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের।
সম্মেলনে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মধ্যে মিসেস বিজয়ালক্ষ্মী পণ্ডিত, আচার্য জে. পি. ক্রিপালানি ও মিসেস সুচেতা ক্রিপালানি, মিসেস কমলা দেবী চট্টোপাধ্যায়, মেসার্স এম. সি. চাগলা, আর. আর. দিবাকর, জে. জে. সিং ভীমসেন সাচার, এন. জি. রাঙ্গা, এম. এল. সন্ধি, সাদিও আলী, এস. এন. মিশ্র, এল. এম. সিংভি, সমর গুহ, সিব্বানলাল সাক্সেনা, শাহ নাওয়াজ খান, শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ এবং অন্যান্যেরা উপস্থিত ছিলেন।

ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সম্মেলনটিতে কংগ্রেস (আর) এবং সিপিআই এর কোনো আনুষ্ঠানিক অংশগ্রহণ ছিল না।

এই ঐতিহাসিক সম্মেলনটি শুরু হয় এর সচিব মিস্টার রাধাকৃষ্ণ এর শুভেচ্ছা বক্তৃতার মাধ্যমে।

নিজ দেশের স্বাধীনতার জন্যে জীবন বিলিয়ে দেয়া বাংলাদেশের জনগণের সম্মানে দুই মিনিটের নীরবতা পালনের মধ্যে দিয়ে সম্মেলনটির কর্মসূচি আরম্ভ হয়।

মূল আলোচ্য বিষয়

সম্মেলনের বিবেচনার নিমিত্তে মূল আলোচ্য বিষয়বস্তুগুলো ছিল ১) বাংলাদেশের পরিস্থিতি, ২) বাংলাদেশের সরকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থন এবং ৩) সরকারী-বেসরকারী উভয় ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়বদ্ধতা।

এই বিষয়গুলো সম্মেলনটির তিনটি আলাদা আলাদা আদেশপত্রে আলোচিত হবে। সম্মেলনের শেষ দিনে এই তিনটি আদেশপত্রের উপর প্রতিবেদন ও তাদের বিশ্লেষণসমূহ নিয়ে আলোচনা হবে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৭৮। দিল্লীর আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের মুক্তির জন্য সশস্ত্র বিশবাহিনি গঠনের আহবান দৈনিক যুগান্তর ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

Aparajita Neel
<১২, ১৭৮, ৪৬৯-৪৭০>

দিল্লী সম্মেলনে বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক ব্রিগেড গঠনের প্রস্তাব
(বিশেষ সংবাদদাতা)

নয়াদিল্লী, ১৮ সেপ্টেম্বর – আজ এখানে বাংলাদেশ সম্পর্কে তিন দিনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধন দিনে মুক্তিবাহিনীর হাতে হাত মিলিয়ে জঙ্গিশাহির বিরুদ্ধে লড়াই এর জন্য একটি আন্তর্জাতিক ব্রিগেড গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়। সর্বোদয় নেতা শ্রী জয় প্রকাশ নারায়ণ ও নেপালের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রী বি পি কৈরালা এ প্রস্তাব করেন।

শ্রী কৈরালা বলেন, প্রস্তাব দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসবে না। ফরাসি সাহিত্যিক আদ্রে মারলোর অভিমত সমর্পন করে তিনি বলেন যে, এই সময় বাংলাদেশের জনগণ সবচেয়েয় জরুরী যা দরকার তা হচ্ছে কার্যকর সাহায্য। শ্রী মারলো সম্প্রতি এক চিঠিতে বাংলাদেশে সামরিক কমান্ডের ভার নিতে চেয়েছেন। শ্রী কৈরালা বলেন যে, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে ব্যার্থ হলে বিশ্বের এই অংশের সমস্ত মানুষের মুক্তি সংগ্রাম ব্যার্থ হবে।

এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সমবেত বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বিশিষ্ট নাগরিকরা বাংলাদেশের ব্যাপক নরহত্যার তীব্র নিন্দা করেন এবং সেখানকার মানুষের আত্ম নিয়ন্ত্রণ অধিকার সমর্থন করেন। তারা সকলেই এক বাকয়ে স্বীকার করেন যে, আধুনিক ইতিহাসে এই হত্যাকাণ্ডের কোন তুলনা নেই।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত অন্যান্য সদস্যদের অবিলম্বে মুক্তি দেয়ার দাবী জানানো হয়।

সম্মেলনে গৃহীত এক সর্বসম্মত প্রস্তাবে মুজিবের গোপন বিচারের নিন্দা করা হয় এবং এর থেকে বিরত রাখতে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য বিশ্বের রাষ্ট্রগোষ্ঠীর কাছে আবেদন জানানো হয়। প্রতিনিধিরা সবাই দাঁড়িয়ে উঠে প্রস্তাবের প্রতি তাদের সমর্থন জানান।

বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানিবিক মূল্য রক্ষায় যারা জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, তাদের স্মৃতির উদ্যেশ্যে দুমিনিট নীরবতা পালন করে সম্মেলনের সূচনা করা হয়।

২৪ টি দেশের প্রতিনিধিরা উদ্বোধনি অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনের উদ্বোধন করেন সর্বোদয় নেতা শ্রী জয় প্রকাশ নারায়ণ।

স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় যেমন করা হয়েছিল, বাংলাদেশের মুক্তির জন্য সেরকম একটা সশস্ত্র আন্তর্জাতিক ব্রিগেড গড়ে তোলার প্রশ্ন ভেবে দেখতে সর্বোদয় নেতা জয় প্রকাশ জি আহবান জানান।

তিনি মনে করেন, প্রতিটি পাকিস্তানী সৈন্য বাংলাদেশ থেকে সরে না গেলে এবং বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত না হওয়া পর্যন্ত শরনার্থি দেশে ফিরে যাবেনা।

এই পরিপ্রেক্ষিতে শ্রী নারায়ণ বিপুল হর্ষধনীর মধ্যে বলেন, ফরাসী বুদ্ধিজীবী আদ্রে মারলো বাঙ্গালী গেরিলাদের সাহায্যে এগিয়ে আসার যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তাঁকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাতে হবে। আদ্রে মারল শুধু একজন বিশিষ্ট লেখকই নন – তিনি স্পেনের যুদ্ধে একজন গেরিলা নেতা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রান্সে বিরোধী নেতা ছিলেন।

সামরিক শাসনের অবসানের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান সোচ্চার দাবীর উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মর্মান্তিক ঘটনার জন্য যিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের চেয়ে কোন মতেই কম দামী নন, সেই ভুট্টোও আজ ঐ দাবী জোর গলায় তুলেছেন। তিনি আরও বলেন, বালুচিস্তান, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত ও সিন্ধুর মোট ছোট ছোট প্রদেশও এখন ব্যাপক অসন্তোষ।

তিনি বলেন, পূর্ব বাংলা নিছক একটি উপনিবেশে পরিণত হয়েছে। নানা কারণে পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক ও অসামরিক অফিসারের একটা ক্ষুদ্র অংশ সেখানকার রাজনৈতিক ও অর্থণৈতিক ক্ষমতা সব সময় ভোগ করে আসছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও শেখ মুজিবুর এবং তার দল কখনো পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে আসার কথা ভাবেনি। বরং মুজিব বলেছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠরা কখনোই সংখ্যালঘুদের কাছ থেকে বেরিয়ে আসেনি।

পাকিস্তানের ঘটনাবলির পটভূমিকা বিবৃতি করে শ্রী নারায়ণ বলেন, পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশের নেতারা দায়ী নন – দায়ী পাকিস্তানী জঙ্গিশাহি।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৭৯। দিল্লীসম্মেলনে বাংলাদেশের মানুষের দূর্দশা লাঘবের জন্য রাষ্ট্রসংঘের প্রচারণাআহবান হিন্দুস্তানস্ট্যান্ডার্ড ২০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

Nusrat Jahan Ima
<১২, ১৭৯, ৪৭১>
দূর্দশা লাঘবের আহবানে বিশ্ব প্রতিক্রিয়া
(হিন্দুস্তান টাইমের প্রতিবেদক)

নতুন দিল্লী, ১৯শে সেপ্টেম্বর, মানবাধিকার কমিশন এর প্রতিনিধিদের সুপারিশ কর্তৃক পরিচালিত জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক প্রচারণায়, বাংলাদেশের পরিস্থিতি দূরীকরনে বাংলাদেশকে নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন আজ।

২০ সেপ্টেম্বর, গান্ধীবাদী সংগঠন কর্তৃক আহুত এই অ-দপ্তরিক সম্মেলনের বিদেশী প্রতিনিধিরা, পূর্ব সীমান্তের শরনার্থী ক্যাম্পের পরিস্থিতি দেখতে কলকাতার উদ্দেশ্যে একটি ‘ ফিল্ড ট্রিপ’ এ যাচ্ছে।

একটি প্রস্তাবনা তৈরী হয়েছিলো যে উনারা পূর্ববাংলার ভেতর দিয়ে সীমান্ত পার হয়ে ‘স্বাধীন বাংলাদেশের জনগনের স্বীকৃতি’ দেখতে যাবেন। আন্তঃর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব বিবেচনায় এনে সম্মেলনে তিনটির মধ্যে একটি কমিশনকে নিযুক্ত এবং কাবুল থেকে রাওয়াল পিন্ডি পর্যন্ত একটি শান্তি মিছিলের আহবান করা হয়।

তিন কমিশনের একটি সাধারণ সম্মতি ছিলো, পাকিস্তানের সামরিক জান্তা কর্তৃক সৃষ্ট মানুষের এই দূর্ভোগ নিরসনের জন্য বিশ্বব্যাপী পদক্ষেপ নেবার সময় এসেছে।

অনেক প্রতিনিধির মাধ্যমে এটা উল্লেখ্য করা হয় যে, এই ব্যাপারে এই শান্তি ব্রিগেড গঠনের মাত্রা শুধুমাত্র একটি প্রতিকী সমর্থন পরিমানের হবে। পূর্ব বাংলায় মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি একটি সশস্ত্র আন্তর্জাতিক বাহিনী গঠনের পুরো প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিলো (যেমন স্পেনীয় গৃহযুদ্ধে গঠন করা হয়েছিলো)।

অন্যান্য কমিশনগুলো বাংলাদেশের জন্য এই ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে, এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশ সরকারকে বস্তুগত সাহায্যের আহবান জানিয়েছে।

আগামীকালের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের পূর্বে বিভিন্ন সুপারিশ প্রনয়ন এবং উপস্থাপনের জন্য সম্মেলনে একটি খসড়া কমিটি গঠন করা হয়েছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৮০। দিল্লীর আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রশ্ন হিন্দুস্তান স্ট্রান্ডার্ড ২০ সেপটেম্বর ১৯৭১

Pallab Das
<১২, ১৮০, ৪৭২-৪৭৪>

বাংলাদেশের স্বীকৃতির ব্যাপারে পরস্পরবিরোধী মতামত প্রকাশ
(নিজস্ব প্রতিবেদক), নয়া দিল্লী, ১৯, সেপ্টেম্বর

আজ এখানে বাংলাদেশের ব্যাপারে তিন দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে বিবাদমান মতামত উপস্থাপন করা হয়।

বাংলাদেশের প্রতি “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়”-এর বাধ্যবাধকতার ব্যাপারে একটি সেশন নির্দিষ্ট ছিল যা পরিবর্তন করা হয় এবং চেয়ারপার্সন সেনারাতা গুনাবর্ধনে বারবার অংশগ্রহণকারীদের ভদ্রতা বজায় রাখার জন্য বলছিলেন।

বাংলাদেশের স্বীকৃতি বিবেচনাধীন আছে- এ ব্যাপারে রাজি করানোর জন্য দিল্লীতে অবস্থিত কিছু বিদেশী মিশনে পরিদর্শনের প্রস্তাব করলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে। কিছু অংশগ্রহণকারীরা তালিকায় ভারত সরকারের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করেছিল।

আরেকপক্ষ এই সম্মেলন “ভারত সরকারকে যাতে অস্বস্তিতে না ফেলে” এই যুক্তিতে বিরোধিতা করেছিল। একজন অংশগ্রহণকারী প্রস্তাব করেন যে, এর বিপরীতে তাদের অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করা উচিত এবং বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য এপর্যন্ত যত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তার জন্য প্রশংসা করা উচিত।

মুজিবের মুক্তি

বিতর্ক আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠলে অ্যাবে পিয়েরে উঠে দাঁড়ান এবং তার বক্তব্য পেশ করার জন্য সভাপতির অনুমতি চান। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার নৈতিক সাহস কোনো সরকারের নেই। তিনি জিজ্ঞাসা করেন, এই প্রেক্ষাপটে শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্তি দেয়ার জন্য এবং তার ও তার দলের পক্ষে ডিসেম্বরের শেষে যে ব্যাপক নির্বাচনী অঙ্গীকার দিয়েছিল সেটাকে সম্মান জানানোর জন্য ইয়াহিয়া খানের উপর চাপ সৃষ্টি করা কি ভালো হবে না?

একটি সেশনে বিদেশী প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে বাংলাদেশ অভিমুখে স্বাধীনতা মিছিলের নেতৃত্ব দেয়ার প্রস্তাবনা বিবেচনা করার সময় জনাব পিয়েরে দ্বিতীয়বারের মতন ভারত সরকারের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি বলেন, এই মার্চ ভারত সরকারকে অসমর্থনীয় অবস্থান ফেলতে পারে যেটার শুরু এর নিজস্ব অঞ্চল থেকে হতে পারে।

কিছু অন্যান্য অংশগ্রহণকারী এর প্রস্তাবনা সম্পর্কে তাদের সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। আরেকজন মনে করেন যে, এই পদক্ষেপে অবশ্যই বাংলাদেশ সরকারের আশীর্বাদ থাকা উচিত না হলে এটা তার উদ্দেশ্য অর্জনে ব্যর্থ হবে।

আন্তর্জাতিক ব্রিগেড গঠনের পরামর্শে বলা হয়, আমাদের নিজেদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করলে এটি স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের মতন শুভের চেয়ে অশুভ ও জটিলতাই বেশি ডেকে আনবে।
অধিবেশনটি একমত হয় যে, শেখ মুজিবরের মুক্তির জিজ্ঞাসার জন্য নয়াদিল্লীতে পাকিস্তান হাই কমিশনের কাছে তাদের সমাধানের একটি কপি প্রেরণ করবে। তারা মঙ্গলবার এটি করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

ইসলামাবাদ অভিমুখে যাত্রা

অধিবেশনটি নয়া দিল্লী বা কাবুল থেকে ইসলামাবাদ অভিমুখে পশ্চিম পাকিস্তানকে তাদের দেশের পূর্ব ভাগে প্রকৃত পক্ষে কি ঘটছে সে ব্যাপারে অবহিত করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক শোভাযাত্রার আয়োজন করার ব্যাপারে বিবেচনা করছে। একজন অংশগ্রহণকারীর মতে, যাত্রা শুরু করার সম্ভাব্য স্থান হিসেবে তেহরানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

একটি প্রস্তাবনায় বলা হয় যে, ইয়াহিয়া শাসনের বিরুদ্ধে যখন একটি শক্ত বিরোধী দল দাঁড়িয়ে যায়, তার পরিণতি কী হয় সেটার প্রতীকী রূপ হিসেবে অংশগ্রহণকারীরা বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে দেখেছেন।

“বাংলাদেশের জন্য সাহায্য”- কমিশন পূর্ব বাংলার মানুষকে সাহায্য করার বিভিন্ন ধাপের ব্যাপারে বিতর্ক করেছে। ইনস্যাশিয়েট(insatiate) ফর ডিফেন্স স্টাডিজ এন্ড এনালাইসিস – এর পরিচালক জনাব কে সুব্রমানাম বলেন যে, ভারতের উচিত ইয়াহিয়া ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের দৃষ্টি বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে সরানোর জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তে সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ তৈরির অবস্থা সৃষ্টি করার ব্যাপারটি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা।

আরও সৈন্য

তিনি বলেন, বৃষ্টির মৌসুমের পরে পাকিস্তানী জেনারেল বাংলাদেশী মুক্তিযোদ্ধাদের উপর আরও কঠিন ও আক্রমণাত্মকভাবে আক্রমণ করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে আরও সৈন্য ও মারণাস্ত্র আনবে।

এতদসত্বেও মুক্তিযোদ্ধাদের উল্লেখযোগ্য সফলতার মাঝেও বাংলাদেশে আরও শত্রু বাহিনীর সৈন্য বৃদ্ধি তাদের সংগ্রামের শেষ পরিণতিতে একটি বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। আর তাই ভারতের উচিত সৈন্য সংখ্যার দিক দিয়ে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে ভারসাম্য হারনোর আগেই কিছু করা।

বাংলাদেশের জনগণকে অবাধে হত্যা সত্বেও পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য বৃদ্ধিতে আমেরিকার উদ্দেশ্যের ব্যাখ্যায় জনাব সুব্রিমানাম বলেন, পাকিস্তানকে ভারতের বিপক্ষে সমশক্তির দেশ ও আমেরিকার পৃষ্ঠপোষকতায় সামরিক চুক্তির সদস্য দেশ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পাকিস্তানকে অন্যান্য মুসলিম দেশের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হত এবং এখন যুক্তরাষ্ট্র একে চীনের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে।

ব্রিটিশ এম পি জনাব উইলিয়াম মলয়ের সভাপতিত্বে অধিবেশনে অন্যান্য বক্তারা অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উত্থানের প্রচারের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন। তারা বলেন, যোগাযোগের ব্যর্থতার কারণে বিশ্বের অনেক অঞ্চলে বাংলাদেশের ব্যাপারে বিশাল অজ্ঞতা তৈরি হয়েছে।

স্বীকৃতির জন্য আবেদন

বাংলাদেশের এবং আরও অন্যান্য দেশের বক্তারা তাদের দেশের সরকারের প্রতি বাংলাদেশের স্বীকৃতির ব্যাপারে আকুল আবেদন জানিয়েছেন। তারা বলেন, বাংলাদেশ হল একটি জীবন্ত বাস্তবতা যার সীমানা দিন দিন আগুয়ান হচ্ছে। আধুনিক রাষ্ট্রের মতন এর অঞ্চল, সার্বভৌমত্ব ও অন্যান্য সব রয়েছে, আমাদের সরকারের স্বীকৃতির মাধ্যমে এর পররাষ্ট্র শক্তি আরও ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে।

অস্ট্রেলিয়ার মিসেস স্যালি রায় বলেন, যদিও পূর্ব বাংলায় অবিশ্বাস্য রকমের জীবন ও সম্পদের অবাধ ধ্বংসযজ্ঞ সংঘঠিত হয়েছে, তবুও বাংলাদেশ এরকম প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে ভিয়েতনাম ও বায়াফ্রা এর মতন অস্ট্রেলিয়ার কাছে আসে নি। এর কারণে অস্ট্রেলিয়ার জনগণ এই সমস্যার ব্যাপারে কিছুই জানে না। প্রতিনিধি দলকে অবশ্যই সেখানে পাঠানো দরকার।

অস্ট্রেলিয়ার আরেক প্রতিনিধি বলেন যে, আমাদের অনেক লজ্জাজনক গোপনীয়তা রয়েছে। যেমন- আমাদের আদিবাসীদের উন্নতির পরিকল্পনার ব্যাপারে আমরা উদাসীন বলে অভিযোগ করা হয়। নিউ গিনির স্বাধীনতার অস্বীকৃতির জন্যও আমরা অভিযুক্ত। তবে আমি আপনাদের সবাইকে আশ্বাস দিতে চাই, বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি ও সমর্থনের ব্যাপারে আপনারা আমাদের কোন উদাসীনতা খুঁজে পাবেন না। যারা বাংলাদেশের ব্যাপারে জানে তারা অনেক মর্মাহত।

জনশ্রুতি আছে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, ইরান, তুর্কি এবং অন্যান্য আরব রাষ্ট্রসমুহ প্রচুর পরিমাণে পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য প্রদানের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব সবচেয়ে বেশি অসমর্থনীয় ছিল। যেই দেশ স্বাধীনতার বাতিঘরকে শূন্যে উঠিয়ে রেখেছে এবং বিশ্বকে “আমাকে স্বাধীনতা না হয় মৃত্যু দাও” এরূপ স্লোগান দিয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মানবাধিকার জঘন্য পর্যায়ে চলে এসেছে- এর অস্বীকৃতিকারীর দলে আমার নাম এখনই লেখা উচিত।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৮১। বিশ্বের প্রতি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য দিল্লী আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আহ্বান হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

Ashik Uz Zaman
<১২, ১৮১, ৪৭৮-৪৭৯>

বিশ্বের প্রতি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের আহ্বান
(আমাদের বিশেষ প্রতিনিধির বরাত দিয়ে)

নয়াদিল্লী সেপ্টেম্বর ২০.- বাংলাদেশকে নিয়ে করা আন্তর্জাতিক সম্মেলনের পক্ষ থেকে বিশ্বের সব দেশের সরকারকে আজ আহ্বান জানানো হয়েছে বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি দিতে এবং পশ্চিম পাকিস্তানী জান্তার প্রতি সব ধরনের সামরিক সাহায্য বন্ধ করতে।

এই সম্মেলনের এক প্রস্তাবে ঘোষণা করা হয় যে বাংলাদেশের মানুষের এই রাজনৈতিক আন্দোলন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখতে হবে একটি জাতির মুক্তির আন্দোলন হিসেবে।

বিশ্বের সকল সরকার ও জনগনের কাছে উদাত্ত আহ্বান জানানো হয় বাংলাদেশ তাৎক্ষনিক এবং কার্যকরী সহায়তা প্রদানের জন্য।

উক্ত প্রস্তাবে বর্ণিত এই সাহায্য বলতে কোনো রাষ্ট্র বা ব্যক্তির জন্য এটা সামরিক সাহায্য হতে পারে আবার কারো জন্য হতে পারে অর্থনৈতিক এবং অহিংস সাহায্য।

প্রস্তাবে আরো বলা হয়, একটি সার্বভৌম জাতির সকল বৈশিষ্ট্যই বাংলাদেশের আছে এবং জনগনের ইচ্ছায় প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারই তাদের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে।

জাতিসঙ্ঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে অনুরোধ করা হয় বাংলাদেশের সমস্যাটি যেন এই আন্তর্জাতিক সংস্থার সকল পরিসরে উত্থাপন করা হয় মানবাধিকারের লঙ্ঘন এবং বিশ্বশান্তির প্রতি হুমকিস্বরুপ হিসেবে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনের স্বপক্ষে করা প্রথম এই সম্মেলনে সব মহাদেশের ২৪টি দেশ থেকে ১৫০ জনেরও বেশি প্রতিনিধি অংশ নেন।

প্রতিনিধিদের মধ্যে ৬৫ জন এসেছেন প্রায় ২৩টি বিদেশী রাষ্ট্র থেকে। তাঁদের মধ্যে শান্তিকামী সাধারণ নারী ও পুরুষ ছাড়াও আছেন বিভিন্ন দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী, কয়েকটি দেশের সংসদ সদস্য, নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবী এবং স্বনামধন্য প্রকাশক।

এই মুক্তির আন্দোলনের স্বপক্ষে কি ধরণের সহায়তা দেয়া যেতে পারে সে ব্যপারে তাদের মধ্যে সামান্য মতানৈক্য থাকা সত্ত্বেও সম্মেলনের শেষ দিকে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে প্রতিনিধিরা সমস্যাটি সম্বন্ধে আরও ভালো ধারণা পেয়েছেন।

নিজ নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার পর এই প্রতিনিধিদের অনেকেই বাংলাদেশের মানুষ ও পাকিস্তানী শাসন থেকে তাদের মুক্তির আন্দোলনের স্বপক্ষে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ার কাজে ঝাপিয়ে পড়বেন।

কি ধরণের সাহায্য-সহযোগিতা করা হবে তা নিয়ে প্রতিনিধিদের মধ্যকার মতানৈক্য সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনে বের হয়ে আসে।

খসড়া প্রস্তাবে বিশ্বের সরকারগুলোকে আহ্বান করা হয় “বাংলাদেশের সরকারকে তাৎক্ষনিক ও কার্যকরীভাবে সামরিক এবং অর্থনৈতিক সহায়তা” প্রদান করতে।

কতিপয় প্রতিনিধি মতপ্রকাশ করেন যে এই সম্মেলনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দেশের সরকারকে আহ্বান জানানো হোক তারা যেন “অবিলম্বে পাকিস্তান সরকারের প্রতি সব ধরণের অস্ত্র, গোলাবারুদ, খুচরা যন্ত্রাংশ এবং সামরিক সাহায্য সরবরাহ করা বন্ধ করে দেয়”।

অবশেষে, যারা বাংলাদেশের জন্য সামরিক সহায়তার পক্ষে এবং যারা সহায়তার ধরনটি উন্মুক্ত রাখার পক্ষে ছিলেন তারা উভয় পক্ষই একটি সমঝোতায় আসেন। সংশোধিত প্রস্তাবে সরকার এবং জনগনের জন্য এই সিদ্ধান্ত উন্মুক্ত রাখা হয় যে তারাই ঠিক করবে যে তারা সামরিক নাকি অর্থনৈতিক এবং অহিংস সহায়তা করবে।

এই প্রস্তাবে জাতিসঙ্ঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোকে আহ্বান জানানো হয় তারা যেন বাংলাদেশের সরকারের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের দুর্দশা লাঘবের উদ্দেশ্যে এমন ভাবে ত্রাণকাজ পরিচালনা করে যাতে করে সঠিক মানুষের কাছে সেই ত্রাণ গিয়ে পৌঁছায়।

বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্রদের সদস্য করে একটি আন্তর্জাতিক কমিটি গঠন করার কথাও এই প্রস্তাবে তোলা হয় যেটি নির্ভরযোগ্য সুত্র থেকে পাওয়া সংবাদ প্রচার করবে সরকারী ও বেসরকারী সংস্থা গুলোর কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনের স্বপক্ষে জনমত তৈরির কাজে সাহায্য করার জন্য।
এই সম্মেলনে সন্তোষ প্রকাশ করা হয় “বাংলাদেশের শরণার্থীদের মাঝে ত্রাণ বিতরনের ভারত সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগ” গ্রহন করার জন্য। আন্তর্জাতিক রেডক্রস সংস্থাকে আহ্বান জানানো হয় বাংলাদেশে ত্রাণকাজ পরিচালনা এবং বিতরনের সরাসরি দায়িত্ব গ্রহন করার জন্য।

“কোনো অবস্থতেই”, এই প্রস্তাবে বলা হয় “এই দায়িত্ব পাকিস্তানী সামরিক শাসকদের হাতে দেয়া যাবে না। ১৯১৯ সালের চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের তৃতীয় ধারা মোতাবেক বাংলাদেশের সরকারের অংশগ্রহন এখানে নিশ্চিত এবং প্রয়োজনীয়”।

ব্যক্তি এবং বেসরকারী সংস্থাগুলোর কাজ হিসেবে এই সম্মেলন থেকে বলা হয় যে তারা বিভিন্ন দেশের অংশগ্রহনকারীদের নিয়ে একটি ‘মুক্তির মিছিল’-এর আয়োজন করতে পারে যেটি অহিংসভাবে ভারত থেকে বাংলাদেশে ঢুকবে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৮২। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ সংস্থা গঠনের সিদ্ধান্ত দৈনিক স্টেটসম্যান ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

Ashik Uz Zaman
<১২, ১৮২, ৪৭৭>

বাংলাদেশের বন্ধুরাঃ বিশ্বসংঘ প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে
(আমাদের বিশেষ প্রতিনিধির বরাত দিয়ে)

নয়াদিল্লী, সেপ্টেম্বর ২১.- বাংলাদেশকে নিয়ে করা আজকের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে থেকে কয়েকজন প্রতিনিধি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে তারা বাংলাদেশের বন্ধুদের সমন্নয়ে একটি আন্তর্জাতিক কমিটি তৈরি করবেন যার সদরদপ্তর হবে লন্ডনে।

মিঃ জয়প্রকাশ নারায়ণ, যিনি গতকালের সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন, তাকে কমিটির গঠন চূড়ান্ত করার অনুমোদন দেয়া হয়েছে।

মিঃ ডোনালড চেসওয়ারথ, সম্মেলনের ইংরেজ প্রতিনিধিদের একজন, যাকে আহ্বায়ক করা হয়েছে কমিটি প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক কাজগুলো করার জন্য।

এই কমিটি বাংলাদেশ সাহায্য সংস্থাগুলোর সাথে নিবিড় যোগাযোগ রাখবে, বাংলাদেশের উপর তথ্য সংগ্রহ ও প্রচার করবে এবং জাতীয় কমিটি ও জাতীয় সংস্থাগুলোর কাজের সমন্নয় করবে।

আজকের সভায় আরো আলোচনা হয়েছে জাতিসংঘে কিছু করার সম্ভাবনা নিয়ে এবং বাংলাদেশ সরকারের আবেদনের স্বপক্ষে আন্তর্জাতিক রেড-ক্রসকে আহ্বান জানানো হয় বাংলাদেশে ত্রাণকাজ পরিচালনা এবং বিতরনের সরাসরি দায়িত্ব গ্রহন করার জন্য।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৮৩। দিল্লী আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রতিনিধিদলের কর্তৃক বাংলাদেশে প্রবেশের সিদ্ধান্ত বাতিল হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

Ashik Uz Zaman
<১২, ১৮৩, ৪৭৮-৪৭৯>

প্রতিনিধিদলের সীমান্ত অতিক্রমের সিদ্ধান্ত বাতিল
(নিজস্ব প্রতিবেদকের বরাত দিয়ে)

দিল্লীতে বাংলাদেশকে নিয়ে করা সদ্য-সমাপ্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে থেকে যে প্রতিনিধিদল বুধবার সকাল ১১টা ৩৫ মিনিটে দমদম এসে পৌঁছেছেন তারা তাদের সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত বাতিল করেছেন।

এর আগে দিল্লীতে ঘোষণা দেয়া হয় যে এই প্রতিনিধিদল সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করবেন এটাই দেখাতে যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পাকিস্তানের এই দখলদারিত্বকে স্বীকৃতি দেয়নি।

২৪টি দেশের প্রতিনিধিত্বকারী ৩৫ জনের এই প্রতিনিধিদল, যাদের মধ্যে ৩ জন ভদ্রমহিলাও রয়েছেন, এখানে পৌঁছানোর পরপরই তাদের সীমান্ত অতিক্রমের সিদ্ধান্ত বিষয়ক এক রুদ্ধদার বৈঠকে বসেন।

বৈঠকের শেষে মিঃ লী জনসন, একজন অস্ট্রেলীয় সংসদ সদস্য, ঘোষণা দেন যে পেত্রাপোল দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়েছে যাতে “বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান ছাড়া অন্য আর কোনো দেশ এই সমস্যার সাথে জড়িত আছে এমনটা মনে না হয়”।

সিদ্ধান্ত বাতিলের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে, মিঃ জনসন বলেন যে প্রতিনিধিরা ভারত সরকারের অতিথি হিসেবে একটি ভাড়া করা বিমানে করে কোলকাতা এসেছেন। তাই প্রস্তাবনা অনুযায়ী সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করলে তা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করতে পারে। তিনি আরো বলেন, “যদিও বাংলাদেশের জনগণের সার্বভৌমিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হওয়াতে আমরা আমাদের অকৃত্রিম ও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি তবুও আমরা মনে করি যে এই মুহূর্তে সীমানা অতিক্রম করা অনুচিত হবে”।

জানা যায় যে বিমানযাত্রা পথে প্রতিনিধিদের মধ্যে এ বিষয়ে তুমুল আলোচনা হয়। কয়েকজন সীমান্ত অতিক্রমের পক্ষে ছিলেন।
এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে প্রতিনিধিদলের কোনো কোনো সদস্য ব্যক্তিগতভাবে সীমান্ত অতিক্রম করতে পারেন। ওমেগা পিস মিশনের কয়েকজন সদস্য খোলাখুলি জানিয়ে দেন যে তাদের কয়েকজন প্রতিনিধি কিছু দিনের মধ্যেই নিজস্ব ব্যবস্থায় সীমান্ত অতিক্রম করবেন।

পরবর্তীতে এই প্রতিনিধিদল সল্ট লেক শিবির পরিদর্শন করেন যেখানে ২৩২, ০০০ জন শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। দুটি স্টেশন-ওয়াগন গাড়িতে করে তাদেরকে ঐ এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয় বেলা ১টার দিকে। তারা শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশা দেখেন এবং তাদের সাথে কথা বলেন। যখন প্রতিনিধিদলের সদস্যরা শিবির ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন, তখন শরণার্থীরা মুজিবের মুক্তি, অন্যান্য দেশের কাছ থেকে বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার শাস্তি, ইত্যাদি চেয়ে স্লোগান দিতে থাকে।

প্রতিনিধিদলের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন নরওয়ের অধিবাসী মিঃ এবং মিসেস হানিসদ্যাব। মিসেস হানিসদ্যাব বলেন শরণার্থীদের দুর্দশা তাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। বিগত বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি নিজেও একজন শরণার্থী ছিলেন। তাই তিনি খুব ভালোভাবেই জানেন শরণার্থী হবার কষ্ট কাকে বলে।

তিনি বলেন এটা অন্যান্য রাষ্ট্রের দায়িত্ব যে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানীদেরকে বিতাড়িত করা যাতে করে শরণার্থীরা নির্বিঘ্নে তাদের দেশে ফিরে যেতে পারে।

মিসেস ভিভিয়ান গুনোবর্ধন বলেন যে তিনি শ্রীলংকায় ফিরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মিসেস বন্দরনায়েকের উপর চাপ সৃষ্টি করবেন, যাতে সেখান থেকে পাকিস্তানী বিমানগুলোর তেল নেয়া বন্ধ করা হয়।

ভারতের প্রশংসা করে তিনি বলেন সমস্যার গুরুত্ব বিবেচনা করলে ভারতের ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। বাংলাদেশের সমস্যার একমাত্র সমাধান হচ্ছে তার স্বাধীনতা লাভ করা।

সুদানের প্রতিনিধি মিঃ মোহাম্মেদ আলি সালিয়াহ বলেন যে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেয়ে এর স্বায়ত্ত্বশাসন লাভ করাকে বেশি সুবিধাজনক মনে করেন।

যখন তার কাছে জানতে চাওয়া হয় যে কেন তিনি সম্পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষপাতী নন তখন তিনি বলেনঃ “আমরা পাকিস্তান বা অন্য কোনো দেশেরই বিভাজন চাই না”।

ডঃ এ সুরিয়ান মালায়শিয়ান, মালয়শিয়ার একজন সংসদ সদস্য, বলেন যে, “বিশ্বের দেশগুলোর উচিত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া এবং এক্ষেত্রে ভারতের উচিত স্বীকৃতিপ্রদানে নেতৃত্ব দেয়া”।
সল্ট লেক শিবির পরিদর্শনের পর প্রতিনিধিদল হোটেল হিন্দুস্তান ইন্টারন্যাশনাল-এ আসেন মধ্যাহ্নভোজনের জন্য। তারা এরপর বিকাল ৫টায়, কোলকাতায় বাংলাদেশ দুতাবাসের প্রধান, মিঃ হুসাইন আলির সাথে সাক্ষাত করেন এবং তার সাথে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৮৪। বাংলাদেশ সরকারের ওপর ভারত সরকারের প্রভাবের প্রশ্নে স্বতন্ত্র পার্টির বক্তব্য যুগান্তর ১০ অক্টোবর ১৯৭১

Aparajita Neel
<১২, ১৮৪, ৪৮০>

স্বতন্ত্র পার্টি জানতে চায় ভারত কি বাংলাদেশ সরকারকে মস্কোমুখি করছে?
(নিজস্ব সংবাদদাতা)

বোম্বাই, ৯ অক্টোবর – বাংলাদেশ মুক্তি ফ্রন্টের বিভিন্ন কমিটিকে ‘সোভিয়েতের অনুকূল’ করে গড়ে তোলার জন্য ভারত সরকার কি বাংলাদেশ সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করছেন?

স্বতন্ত্র পার্টির সেক্রটারি শ্রী মধু মেহতা প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর কাছ থেকে এ প্রশ্নের সরাসরি জবাব চেয়েছেন। লন্ডন টাইমস এর নিয়াদিল্লিস্থ সংবাদদাতা এ সমপর্কে যে চাঞ্চল্যকর রিপোর্ট পাঠিয়েছেন শ্রী মেহতার প্রশ্ন সেই রিপোর্ট কেন্দ্র করেই।

টাইমসের সংবাদ দাতা পিটার হেজেল হার্স্ট বাংলাদেশ সরকারের খুব একজন উচ্চপদস্থ ব্যাক্তির বক্তব্য উধ্রিত করে বলেছেন, ভারত সরকার সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে পূর্ব বঙ্গের স্বাধীনতা আন্দোলনকে এমন একটি সংস্থায় পরিণত করতে চেষ্টা করছেন যে শেষ পর্যন্র মস্কোর সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে বাধ্য হবে।

বাংলাদেশ সরকারের এই সদস্যের মতে, ভারত সরকারের মস্কোমুখি ব্যাক্তি বা মুক্তি ফ্রন্টের বিভিন্ন কমিটিকে মস্কোর পক্ষে সুবিধাজনক সংস্থায় পরিণত করার জন্য দু দুবার বাংলাদেশ সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করেছেন।

টাইমসের সংবাদদাতা প্রেরিত রিপোর্টে প্রধানত সোভিয়েতপন্থি বাঙ্গালী কমিউনিস্টদের নিয়ে আওয়ামীলীগ সদস্যদের উপদেষ্টা কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে, রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তরের দুজন বিশিষ্ট প্রবীণ কর্মকর্তা সর্বপ্রকার রাজনৈতিক মতামতের ব্যাক্তিদের নিয়ে উপদেষ্টা কমিটি গঠনের নাম করে মস্কো পন্থিঅধ্যাপক মুজাফর আহমেদ সমেত তিনজন কমিউনিস্ট নেতাকে ঐ কমটির অন্তর্ভুক্ত করতে সমর্থ হন। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে প্রফেসর আহমদ গত ডিসেম্বর নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন।

স্বতন্ত্র পার্টি কেন্দ্রীয় সরকারকে এসব ব্যাপার সম্পর্কে পূর্ন সত্য জনসম্মুখে উপস্থিত করার দাবী জানিয়েছেন।

মিঃ হেজেল হার্স্ট বলেছেন, রাষ্ট্র সঙ্ঘে সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে যে প্রতিনিধিদল যান প্রধানত শ্রী ডি পি ধরের হস্তক্ষেপেই সে দল থেকে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোস্তাক আহমেদকে বাদ দেওয়া হয়।
শিরোনাম
সূত্র তারিখ
১৮৫। বাংলাদেশ প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা নমনীয় বলে জাতিসঙ্ঘের কেন্দ্রীয় কমিটির অভিযোগ দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়া ১১ অক্টোবর ১৯৭১

Saiful Arefin Borshon
<১২, ১৮৫, ৪৮১-৪৮২>
অনুবাদ

সরকার বাংলাদেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকা করতে যাচ্ছে, জনসংঘের অভিযোগ
(দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়া)

মাদ্রাজ, ১০ই অক্টোবর- জনসংঘের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটি আজ কেন্দ্রীয় সরকারকে অভিযুক্ত করে বলে, “বাংলাদেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা” এবং সিমলায় জনাব শরণ সিং এর বিবৃতিতে “পাকিস্তান কাঠামোর মধ্যে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা” আহ্বান ছিল “একটি লজ্জাজনক ঘটনা।”

একটি রেজল্যুশনে বাংলাদেশ বিষয়ক কমিটি থেকে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের সমস্যা সমাধানে সাহায্য করতে জাদুর পরশ নিয়ে আসা ভারত-সোভিয়েত চুক্তি অকেজো প্রমাণিত হয়েছে’।

আজকের আলোচনায় সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে জনাব এল কে আদভানি, কর্মপরিষদের সদস্য ও জনসংঘ পার্লামেন্টারি দলের সম্পাদক, বলেন- এই প্রথমবার একজন সিনিয়র সরকারি কর্মকর্তা, জনাব শরণ সিং, পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে বাংলাদেশের সমস্যা সমাধান সম্পর্কে বক্তব্য দিয়েছেন।

জনাব আদভানি বলেন, প্রায় সকল দলই বাংলাদেশের স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে যেখানে ভারত সরকারও অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু তারা সময়ক্ষেপণ করছে বলে মনেহয়।
শরণ সিং এর বিবৃতি তাদের কমিটির কাছে বিস্ময় হয়ে এসেছে বলে তিনি জানান। তিনি আরও বলেন, ‘এই বিবৃতি থেকে বোঝা যাচ্ছে যে বাংলাদেশের সাথে বিস্বাসঘাতকতা করতে তারা প্রস্তুত হয়েছে’।

ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তি

তার ধারনামতে, বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারত সরকারের অবস্থা পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। তাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, এমনকি ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তি হওয়ার পর সরকারের কিছু নেতা সোভিয়েতকে ভারত সরকারের সাথে একই রকম চিন্তা করানোর ব্যাপারে আশাবাদী ছিল। কিন্তু মস্কোতে ইন্দিরা গান্ধী যাওয়ার পর বুঝতে পারেন, রাশিয়া তার অবস্থান থেকে নড়তে প্রস্তুত না।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী যৌথ বিবৃতিতে সাক্ষর করার পরই সোভিয়েত চাপের কাছে ‘আত্মসমর্পণ’ করেন যেখানের কিছু বাক্যাংশ হচ্ছে ‘সমগ্র পাকিস্তান’ এবং ‘পাকিস্তানের কাঠামোর ভিতরে থেকে’। আদভানি দাবী করেন, এই বাক্যাংশগুলো থেকে বুঝতে পারা যায় যে সোভিয়েত এবং আমেরিকা অখন্ড পাকিস্তানে বিশ্বাসী।

বিশ্লেষণ থেকে জানা যায় যে প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, অভিবাসীরা ৬ মাসের ভেতর তাদের নিজেদের দেশে ফিরে যাবে কিন্তু তা না হয়ে এখনো স্রোতের মতো মানুষ ভারতে প্রবেশ করছে। আরো বলা হয়, ‘বর্ষার পরপরই ইয়াহিয়ার ট্যাঙ্ক তাজা রক্তের নৃশংসতা শুরু করবে যা এইদেশে গুরুতর প্রভাব ফেলবে’।

স্বীকৃতির আবেদন

আদভানি বলেন, মুক্তিবাহিনীর কোনভাবেই সেনাবাহিনীকে ধংস বা হটিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। যদি বাংলাদেশকে স্বাধীন হতে হয় তবে সরকারের সাথে সরকারের সমঝোতার মাধ্যমে ভারতের উচিত প্রথমেই স্বীকৃতি দেওয়া এবং প্রয়োজনীয় সাহায্য এমনকি অস্ত্র, ট্যাঙ্ক, বিমান ও জাহাজ দেয়া।

রেজুলুশন থেকে অক্টোবরের ৯ তারিখের সোভিয়েত-আলজেরিয়ার একটি যৌথ বিবৃতি তুলে ধরা হয় যেখানে বলা হয়, ‘জাতিয় সংহতি এবং পাকিস্তানের অখন্ডতার প্রতি শ্রদ্ধা’ এবং ভারত-পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানানো হয় ‘তাসখন্দ বৈঠকের চেতনা থেকে সমস্যা সমাধানে দুই দেশের উচিত শান্তিপূর্ণ সমাধানের দিকে হাঁটা’।

‘তাসখন্দ এর আবেদন শুধুমাত্র বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা এবং মারা যাওয়া লক্ষ লক্ষ মানুষের সাথেই বিশ্বাসঘাকতা করা না, ভারতের জাতিয় স্বার্থের সাথেও বিশ্বাসঘাতকতা করা।

আদভানি জানান, কার্যকরী কমিটি বাংলাদেশ ইস্যু এবং সাধারন জিনিসের দামের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে জাতিয় আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং জনসংঘের সভাপতি এ.বি. বাজপেয়ী মঙ্গলবার এ ব্যাপারে বক্তব্য রাখবেন।

শিরোনাম
সূত্র তারিখ
১৮৬। পাকিস্তানের যুদ্ধ প্রস্তুতির মোকাবিলার প্রশ্নে আসাম প্রাদেশিক কংগ্রেস (বার্ষিক) কমিটির প্রস্তাব দৈনিক হিন্দিস্তান স্ট্যান্ডার্ড ২৪ অক্টোবর ১৯৭১

Saiful Arefin Borshon
<১২, ১৮৬, ৪৮৩-৪৮৪>
অনুবাদ

পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধকে APCC(R) গুরুত্ত্বের সাথে নিয়েছে
(গোয়াহাটি অফিস থেকে)

অক্টোবর, ২২- গতকাল দীর্ঘ বৈঠকের পর আসাম প্রদেশ কংগ্রেস ‘পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর প্রস্তুতি’ কে গুরুত্ত্বসহকারে নিয়েছে এবং সরকার ও জনগণকে আহ্বান জানায় যেন ‘সতর্ক হয় এবং সাহস ও দৃঢ়তার সাথে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ’ নিতে পারে।

সেখানে বলা হয়, এই সংকটময় মুহূর্তে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে, বিশেষ করে আসাম কে সতর্কতার সাথে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কমিটির সভাপতি জনাব বি.সি ভাগাওয়াত সবাইকে এক হয়ে, দল-মত নির্বিশেষে ঐক্য বজায় রাখতে এবং জাতীয় নিরাপত্তার খাতিরে সরকারের সাথে কাজ করার জন্য সকলের কাছে আবেদন করেন।

সমাধানের জন্য আলোচনা চলার পাশাপাশি পাশের কক্ষে কমিটির সহ-সভাপতি ও ৩ জন AICC সদস্য নির্বাচন চলছিল।

আলোচনার অন্যতম বক্তা অর্থমন্ত্রী কে.পি ত্রিপাঠী বলেন, জেনারেল ইয়াহিয়ার নেতৃত্বের কারনে পাকিস্তানে যে বৃহৎ ‘ভারতে যুদ্ধ’ বিরোধী অংশ ছিল, তারা সবাই ধুয়ে-মুছে গেছে। কমিটি এখান থেকে এতোটুকুই বলতে পারে যে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং মূল বিষয় হচ্ছে যে, প্রতিটি নাগরিককেই সতর্ক হতে হবে।

কমিটি এখনো আশা করে যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করে বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে এবং ১০ লক্ষ উদ্বাস্তুকে দেশে ফিরিয়ে নিতে সাহায্য করবে।

কমিটি এটাও আশংকা করছে যে ‘পাকিস্তানি সামরিক নায়কের একগুয়েমির কারনে’ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হস্তক্ষেপ নাও করতে পারে। কমিটি সরকার এবং জনগণকে আহ্বান জানায় বেসামরিক প্রতিরক্ষার জন্য যেন বিমান হামলা চালানো হয় এবং শত্রু পক্ষের এজেন্ট থেকে যেন সতর্ক হয়, বিশেষ করে গুপ্তচরদের নাশকতা থেকে।

কমিটি মনে করে যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা, দেশরক্ষী বাহিনী, অগ্নি নির্বাপণ বাহিনী, শান্তিবাহিনী এবং ইমারজেন্সি রিলিফ কমিটিকে যত দ্রুত সম্ভব শক্তিশালী করতে হবে।

সরকারের উচিত এখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের যথেষ্ট সরবরাহ নিশ্চিত করা, যথেষ্ট মজুদ গড়ে তোলা এবং প্রয়োজন মত বন্টন করা।

সবাইকে যে কোন সংকট মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকতে হবে এমং উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে।
আজকে কোন আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব গ্রহন করা ছাড়াই NEC এর সংশোধন APCC এর দ্বারা সর্বসম্মতভাবে গ্রহন করা হয়েছে।

তিনজন প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে ধরিন্ধর বসুমাতারায় (এমপি)সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। অন্যদিকে বাকি তিনটি পদের জন্য আটজন প্রার্থী থেকে রবিন কাকতি(এমপি), ডাঃ ভুমিধর বর্মন এবং প্রদেশ কুমার চৌধুরী নির্বাচিত হয়েছেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৮৭। পাকিস্তানের হুমকি মোকাবিলার ব্যাপারে সরকারের সাথে তিনটি বিরোধী দলের সহযোগিতা দৈনিক স্টেটসম্যান ২৫ অক্টোবর ১৯৭১

Saiful Arefin Borshon
<১২, ১৮৭, ৪৮৫-৪৮৬>
অনুবাদ

পাকিস্তানের হুমকি মোকাবেলায় সরকাররের সাথে তিন বিরোধীদলের বৈঠক

২৪ অক্টোবর, দিল্লী- প্রধানমন্ত্রি ইন্দিরা গান্ধী গতকাল রাতে বিরোধীদলের কয়েকজন নেতাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে চলেছে এবং সম্ভাব্য সকল কিছু মোকাবেলাতেই দেশকে প্রস্তুত থাকতে হবে।

ইন্দিরা গান্ধী আলাদাভাবে ভূপেশ গুপ্তা (সিপিআই), এস.এন.মিশরা (Cong. O)এবং ডি. প্যাটেল (স্বতন্ত্র) কে আলাদাভাবে ডেকে নিয়ে দেখা করেন এবং আত্মতুষ্টিতে না ভুগে যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক হতে বলেছেন।

প্রধানমন্ত্রি আশ্বাস দিয়েছেন যে প্রতিরক্ষা বাহিনী সতর্ক অবস্থায় রয়েছে এবং পাকিস্তানের যেকোন প্ররোচনার উপুযুক্ত জবাব দেয়া হবে। তিনি পুরো পরিস্থিতি নিয়ে জ্যেষ্ঠ সহকর্মীদের সাথে আলোচনা করেছেন এবং তার অনুপস্থিতিতে তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবেন। প্রয়োজনে তিনি তার ভ্রমন সংক্ষিপ্ত করবেন।

দৃঢ় সমর্থন

ইন্দিরা গান্ধী বলেন যে তার বিদেশ সফরকে বাঁধাগ্রস্ত করতেই পাকিস্তান সীমান্তে উস্কানিমূলকভাবে সৈন্য মোতায়ন করেছে।

তিনি আশংকা করেন যে ইয়াহিয়া শাসকগোষ্ঠী তার আমেরিকা ভ্রমন নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল এবং আশংকা করছিল তিনি আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নিক্সন এবং অন্যান্য নেতাদের সাথে বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করবেন। এই প্রেক্ষাপটে তিনি তার আমেরিকা ভ্রমনে অবিচল ছিলেন।

পাকিস্তানের সাথে যে কোন চ্যালেঞ্জে তিন নেতাই সরকারের সাথে থাকার অঙ্গীকার করেছেন।

গুপ্তা (সিপিআই) কে বোঝানো হয়েছে যে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে হবে যুদ্ধ এড়িয়ে যাবার। যদিও দেখা যাচ্ছে পাকিস্তান যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যেতেই বেশি আগ্রহী। কিন্তু বাংলাদেশকে সমর্থন করা থেকে পিছুহটা চলবে না।

নতুন করের কথা উল্লেখ করে গুপ্তা বলেন, সাধারন মানুষের উপর অতিরিক্ত কর আরোপ না করে ধনী ভারতীয় এবং বিদেশীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ নেয়া উচিত।

এস.এন.মিশরা বলেন, তার দল যেকোন প্রয়োজনে সরকারের পাশে দাঁড়াতে প্রস্তুত।

বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের দোলাচাল নীতির সমালোচনা করেন প্যাটেল। পাকিস্তানের বিপক্ষে সরকারের যে কোন পদক্ষেপে সরকারের পাশে থাকার কথা জানান তিনি। পাকিস্তান যাতে সাম্প্রদ্রায়িক দাঙ্গা লাগাতে না পারে সেই দিকে সরকারকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তিনি।

স্বতন্ত্র দলের সভাপতি সর্বভারতীয় সম্মেলনে ১৯৬৪ সালে পূর্ব বাংলার সংখ্যালঘুদের উপর এক রিপোর্টের অনুলিপি ইন্দিরা গান্ধীর কাছে পেশ করেন। প্যাটেল বলেন, দেশ বিভাগের পর সরকারকে উদ্বাস্তু সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। তিনি রিপোর্টে পূর্ব বাংলার এই সমস্যার এক দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের জন্য অনুরোধ করেন।

ইন্দিরা গান্ধী বলেন, সকল বিরোধীদলীয় নেতাদের নিয়ে একসাথে আলোচনা করা যায়নি জনসংঘ পার্টির নেতা বাজপায়ী অসুস্থ থাকায়, তাই সবার সাথে আলাদা আলাদা করে সাক্ষাত করতে হচ্ছে। বাজপায়ীর সাথে তিনি শুক্রবার দেখা করে এসেছেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৮৮। বাংলাদেশ প্রশ্নে জয়প্রকাশ নারায়ণের বিবৃতিসমূহ সংকলন কোয়েস্ট সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, ১৯৭১

Rafiqul Islam Shawon
<১২, ১৮৮, ৪৮৭-৪৯২>
অনুবাদ

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে
জয়প্রকাশ নারায়ন

কয়েকটি কারন জয়প্রকাশ নারায়ণকে গভীরভাবে আন্দোলিত করেছে এবং তাকে বাংলাদেশ সমস্যায় প্রগাঢ়ভাবে জড়িয়ে ফেলেছে। মুক্তিযোদ্ধা, ইন্ডিয়ান কংগ্রেস সমাজতান্ত্রিক পার্টির প্রতিষ্ঠাতা-সচিব, সার্বোযায়া নেতা, ইন্ডিয়ান সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা কমিটির প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য, জে.পি। একজন প্রদীপ্ত গান্ধী একজন অনুসারী বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খানের দলের দ্বারা সংগঠিত গনহত্যার স্পষ্টাস্পষ্টি নিন্দা জানান। তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিকেও সমর্থন দিয়ে আসছেন। অন্যান্যদের থেকেও বেশি, জে.পি. দেশে এবং বিদেশ উভয়খানেই বাংলাদেশের পক্ষে জনগণের মতামত উত্থিত করতে, সক্ষম হোন।

আমরা নিম্নে জে.পি. এর বাংলাদেশ বিষয়ক সংবাদ সম্মেলনের প্রতিলিপি বর্ণনা দিলাম (জোর দিয়ে)।

নয়া-দিল্লী, মার্চ ১৬, ১৯৭১

ভুল বোঝাবুঝির ভয় থেকেই আমি পূর্ব পাকিস্তানের অগ্রগতি নিয়ে মন্তব্য করতে দ্বিধাবোধ করছিলাম, কিন্তু আজ মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা আপীল পড়ে আমি প্রতিক্রিয়ায় কিছু কথা বলতে তাড়িত হই।

প্রথমতই, যে অসাধারণ নেতৃত্ব বাংলাদেশের মানুষকে দিয়েছে তার জন্য শেখের আমি আমার গভীর প্রশংসা করতে চাই।

ইতিহাসে এমন অন্যকোন নেতার উদাহরণ পাওয়া খুব কঠিন হয়ে যাবে যিনি তার পিছনে তার সকল মানুষকে মুষ্টিবদ্ধভাবে একত্রিত করতে সফল হয়েছেন যা শেখ মুজিবর রহমান করতে পেরেছেন।

ইতিহাসে এখনো এমন উদাহরণ খুজে পাওয়া কঠিন হবে যেখানে অপ্রতিরোধ্য সমর্থন প্রবল উত্তেজনার মুখেও ধৈর্য ও জ্ঞান দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছে।

যেহেতু গান্ধিজী অসহিংস আন্দোলনের সুবিশাল ক্ষমতার দাড়িপাল্লা শেখ মুজিবর রহমানের নিকট বর্নণা দিয়ে ছিলেন।

আমাকে ইহা পরিষ্কার করতে দিন যে যেমন আমি আমার দেশের রাষ্ট্রীয় ন্যায়পরায়ন্তায় বিশ্বাস করি, আমি পাকিস্তান ভঙ্গ দেখার ইচ্ছা পোষণ করি না। শেখ মুজিবর রহমান নিজে তার রাষ্ট্রের জন্য পুর্ণ স্বায়ত্তশাসন ব্যতিত বেশি কিছু চাচ্ছেন না তা সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তান শাসনের গণহত্যা অংশ হলেও, তিনি বিচ্ছিন্নতার শেষ পদক্ষেপ নেয়া হতে নিবৃত্ত হয়েছেন। এটাই তার রাষ্ট্রপরিচালনা দক্ষতার পরিমাপ। তাকে তার স্ব-আরোপিত সীমানার বাহিরে ঠেলে দেয়া দায়ভার সম্পুর্ন পাশ্চিম পাকিস্তানের বেসামরিক এবং সামরিক শক্তির। আমরা মনে করি যে তাকে খুব বেশিদূর জোর করা তাদের বুদ্ধিমানের কাজ হবে না

সীতাবদিয়ারা, মার্চ ২৭, ১৯৭১

সাম্প্রতিক এক বিবৃতিতে আমি ধারণা করেছিলাম যে পাকিস্তান বিশ্বের সামরিক এবং আমলাতান্ত্রিক নেতাদের শেখ মুজিবর রহমান এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সহ্যের সীমানার বাহিরে ধাক্কা না দেয়ার পর্যাপ্ত জ্ঞান রয়েছে। ঘটনাগুলো প্রত্যাশাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে এবং যাকে মোলায়েমভাবে বলা যে ইয়াহিয়া খান কঠোর সেনাশাসনের হুকুম দেন কিন্তু যা বাস্তবে তা গোটা জনগণের উপর একটি সামরিক হুমকি।

পরিস্থিতির কিছু দিক গণতান্ত্রিক জনগণের সাথে এবং বিশ্বের সরকারদের সাথে বিশেষভাবে আলোচনা করা উচিত, যথা যে শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় সমাবেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন এবং পূর্ব অঞ্চলে শতকরা ৯৮.৮ ভাগ আসন জয় করেন, গণতন্ত্রের সকল অনুশাসন দ্বারা পাকিস্তানের ন্যায়সঙ্গত শাসক এবং আরো যেহেতু বাংলাদেশ পাকিস্তান জনসংখ্যার শতকরা ৫৮ ভাগ সেহেতু ইহা বাস্তব যে যুক্ত পাকিস্তানে সংখ্যালঘুরাই সংখ্যাগরিষঠদের দমন করার চেষ্টা করতেছে।

বাস্তবে সংখ্যালঘুরা অবশ্যই খুব অল্প কারন বাতুলতাগ্রস্থ পশ্চিম পাঞ্জাবি মুসলিমরা ব্যতিত, সিন্ধুর জনগণ, পূর্ব-পশ্চিমের সীমান্ত এবং বেলুচিস্তানকে সামরিক সৈরতন্ত্রের পিছনে তাদের একত্র হতে দেখা যাচ্ছে না এবং তারা সবাই স্বায়ত্তশাসনের বিভিন্ন মাত্রার দাবি জানাচ্ছে।

এপ্রিল ২, ১৯৭১

যাহোক, সময় এসে পড়েছে, এখন এটা অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে যে খুব নিছক সমাধানের অভিব্যক্তি এবং সহানুভূতির অঙ্গিকার দিয়ে বেশি কার্যকরি উদ্দেশ্য সাধন করা যাবে না। অঙ্গীকারগুলো অবিলম্বে বাস্তবায়ন করার জন্য উপলক্ষ্য কি? বস্তুগত সমর্থনে সব ধরণের ত্রাণ এবং সীমান্ত খুলে দেয়ার ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে যারা পাড়ি দিতে চায়…… কিন্তু এটাও নিশ্চিত করা প্রয়োজন যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যে সংগ্রাম চলছে তা যেন পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর পদপিষ্ট না হয়। এই উদ্দেশ্যের জন্য আর বিলম্ব না করে প্রয়োজনীয় সবরকমের সাহায্য করা উচিত। সর্বোত্তম সিদ্ধান্ত নেয়া এখন সরকারের উপর বর্তায়। আমি এটাই বলতে পারি যে আমাদের ইতিহাস জ্ঞান ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীর বোধ বলে যে বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিলে আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গতি ভঙ্গ হবে না। জনাব চাগলা এবং জনাব কৃষ্ণ মেননের মতপ্রসিদ্ধ আন্তর্জাতিক আইনজীবীও একই রকম অভিপ্রায় নিয়েছেন।

শেখ মুজিবর রহমান সরকারের সত্যতা বৈধতা প্রমাণে আরেকটি গুনক হিসাবে আনতে হবে। সাম্যবাদি কোন দেশে অবাধ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনে শেখের আওয়ামিলীগের মত এই ধরনের বা তার কাছাকাছি বিজয় খুঁজে পাওয়া মুশকিল। গণতান্ত্রিক দৃষ্টিকোন থেকে শেখ মুজিবর রহমান সরকার ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসন থেকে প্রশ্নাতীতভাবেই বেশি বৈধ। অতএব, যারা একতা এবং সাংবিধানিকতার নামে পশ্চিম পাকিস্তানকে সমর্থন করছে তা আসলে উপনিবৈশিক এবং সামরিকতন্ত্রকে সমর্থন করছে। নিঃশেষ করে যারা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো, যেমন- আফ্রিকা এবং এশিয়া, যারা বিপ্লব ও মানুষ নিয়ে অনেক আলোচনা করেন। এটা কি ইতিহাসের গুরুতর দুঃখজনক ঘটনা হবে না যদি এই গণঅভ্যুথ্যান সেনাবাহিনী, জনগণ বিরোধী শক্তি দ্বারা পদপিষ্ট হয়?

জে.পি. মে-জুন ১৯৭১, বাংলাদেশ ইস্যুতে বিদেশে জনগণের মতামত তৈরী করতে কয়েকটি দেশে ভ্রমণে যান। তিনি কায়রো, রোম, বেলগ্রেড, মস্কো, হেলসিঙ্কি, স্টকহোম, বন, প্যারিস, লন্ডন, ওয়াশিংটন, নিউ ইয়র্ক, ওতায়া, ভ্যানকিউবার, টোকিও, জাকার্তা, সিঙ্গাপুর এবং কুয়ালালামপুর ভ্রমণ করেন। ফেরার পর, তিনি শান্তি জারি করেন। “আমরা নিচে বিবৃতির সারাংস দিয়ে দিলাম।

আমি শান্তির জন্য সর্ব সেবা সংঘ এবং গান্ধি শান্তি ফাউন্ডশনের অনুকূলে এই মিশনের দায়িত্ব নিলাম। আমি প্রকৃতপক্ষে, সবার নিকট, তাদের থেকে আর্থিক এবং অন্যান্য পরামর্শমূলক সহায়তা পাওয়ার জন্য অনেক কৃতজ্ঞ।

সমানভাবেই, আমাকে অবশ্যই সফর করা সকল রাজধানীগুলোয় আমাদের দেশের প্রতিনিধিদের নিকট হতে পাওয়া সকল প্রকার সাহায্য এবং আতিথেয়তার জন্য উষ্ণ প্রশংসা প্রকাশ করতে হবে। বিশেষ করে তাদের এবং ইন্ডিয়ার সরকারকে যারা আমাদের মিশন যতটা সম্ভব কার্যকরী করতে সহায়তা করেছেন।

ইহা শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য ভিক্ষা অথবা শুধুই মানবিক ভোগান্তির সম্পর্কিত আলোচনা ছিল না এবং আমি যে শ্রমসাধ্য সফরের দায়িত্ব নিয়েছিলাম তা বিশ্বের নৈতিক বিবেকবোধ জাগানোর জন্য ছিল। ইন্ডিয়ায় পালিয়ে আসা লক্ষাধিক শরণার্থীদের ত্রানের জন্য, বাংলাদেশে ভয়ের বশীভূত হয়ে চলে আসা এমন আরো লক্ষাধিকের এবং যারা সেখানে দুর্ভিক্ষ এবং মহামারির মুখোমুখি তাদের জন্য ত্রাণ অবশ্যই জরুরী, এবং স্বাভাবিকভাবেই আমি এই সম্পর্কে কথা বলেছি। বিশ্ব নৈতিক বিবেকের যা অবশিষ্ট আছে, কায়রো ব্যতিত, সব জায়গায় প্রেস করা হয়ে গিয়েছে, এবং আমি মনে করি, একটি দারুন কাজ হয়েছে।

আমার বড় চিন্তা ছিল রাজনৈতিক সমস্যার জড়ানোর সাথে এবং তাদের জরুরী সমাধানের প্রয়োজনীয়তা, কারণ আমি যাদের সাথেই সাক্ষাত করেছি তাদের কাছেই দেখিয়েছি, শরণার্থী সমস্যা এবং মানবিক সমস্যা শুধু মাত্র রাজনৈতিক সমস্যার দ্বারাই তৈরী হচ্ছিল।

ওয়ার্ল্ড প্রেস ছাড়াও অন্যান্য তথ্য উৎসসহ তাদের নিজস্ব কূটনৈতিক চ্যানেলের জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি দেখেছি যে রাজনৈতিক দিক বিবেচনা থেকে সরকার মোটামোটি ভাল মতামত দিয়েছেন। আমি মনে করি, এটা সাধারণত অনুভূত হয় যে পাকিস্তানের সরকার বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক রায় দমন করতে তাদের পাশবিক সামর্থ্য ব্যবহার করছে যা একতাবদ্ধ জাতি হিসেবে পাকিস্তানের টিকে থাকার অবস্থাকে ঝুকিতে ফেলেছে। এখনো, আমি দেখেছি; কিছু সরকারের মুখপাত্ররা খড়কুটো চেপে ধরে আছেন এই আশায় যে দুই পক্ষের মধ্যে এখনো কিছু সংযোগ সংরক্ষিত আছে। অতএব, তাদের সবাই পাকিস্তানের মিলিটারি অভিযান বন্ধ করার জন্য জোর করছেন এবং রাজনৈতিক সমঝোতা চাচ্ছেন -এ টা বাংলাদেশের নেতৃত্বের সাথে ওয়াশিংটনের জনপ্রিয় শর্ত ছিল। কিন্তু যখন প্রশ্ন করা হয় তারা তা অস্বীকার করে। বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনারা যে কাজ করেছে তারপরেও কোন আত্নসম্মানবোধ সম্পন্ন বাঙালী পশ্চিম পাকিস্তানের শুভ কামনা করবে না।

বিষয়টা এই যে, এবং এই দেশে এটা পরিষ্কারভাবে বুঝতে দেওয়া উচিত যে, বর্তমানে পরাশক্তিদের সবাই বিশ্বে স্থাপিত শক্তির সাম্যর স্থিতিবস্থা সংরক্ষন করার জন্য উদ্ধিগ্ন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বিশেষ করে দক্ষিন এশিয়ার মধ্যে সাম্যতা সংরক্ষন করতে উতসাহী যা তাদের তৈরী করা সুচিন্তিত নীতি দ্বারা পাকিস্তানকে জোরদার করে ইন্ডিয়াকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলা।

যেকোন ঘটনায় ভারত তাৎক্ষনিকভাবে চিন্তিত হয়ে পড়ে এবং পাকিস্তান যুদ্ধের কর্মফল ভোগ করতে পারে, এবং আমি কোথাও প্রমাণ পেলাম না যে কেউ আমাদের জন্য বিপদ থেকে বাচার সমাধান বের করতে প্রস্তুত হয়েছে।

শরণার্থীদের দেখাশুনা করার কিছু অর্থনৈতিক বোঝার জন্য তারা হয়ত আমাদের প্রস্তাবিত পরিমাণ সাহায্যের অংশীদার হবে যদিও আমাদের প্রস্তাবিত পরিমাণ তাদের কাছে অতিরঞ্জিত হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে কিন্তু এটা নিশ্চত যে সামাজিক এবং রাজনৈতিক বোঝা ইন্ডিয়াকে একাই টানতে হবে। এবং শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন এইসব বোঝা অর্থনৈতিক বোঝার চাইতেও কতটা ভারী।

সব মিলিয়ে আমার এই সফরটিকে বলা যায়, ইন্ডিয়ানদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে আমরা আমাদের্ সমস্যা সমাধানে অন্যের সাহায্য আশা করতে পারি না। তা আমাদের নিজেরকেই করতে হবে। দ্বিতীয়ত, আমাদের এই সিদ্ধান্তে আসতে হবে যে যদি বাংলাদেশের মানুষের উপর দমন অব্যাহত থাকে, ্তাহলে তার সকল প্রভাব অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে আমাদের উপর পড়বে। তাই স্বভাবতই এটা আমাদের জাতীয় আগ্রহে পরিণত হবে। পাকিস্তান ভাঙলে ইন্ডিয়ার জাতীয় স্বার্থ কিনা এটা সেই প্রশ্ন না। ইতোমধ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং তার উপদেষ্টাগণ তাদের পাকিস্তান জাতীয়তা ভেঙ্গে ফেলেছেন। এই প্রশ্নেরও উত্তর দিতে হবে যে পশ্চিম পাকিস্তান জোড়পূর্বক বাংলাদেশ দখল করবে কিনা, তার সকল বর্তমান এবং ভবিষ্যত প্রভাব আমাদের উপর পড়বে। আমার দৃষ্টিকোন থেকে আমার মনে এটা বেশ পরিষ্কার যে এইটা ভারতের স্বার্থের জন্য বিরাট একটা বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দাঁড়াবে যার পরিণতি খুব বেশি ভাল হবে না।

বিদেশে সফরকালীন সময়ে আমি দেখতে পেলাম বেশিভাগ মানুষই প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন সমস্যা সামলানো এবং তার রাষ্ট্রপরিচালনার জন্য বাহবা দিচ্ছে। আমিও এর জন্য তার প্রশংসা করি। কিন্তু তাকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যদি সময় এখনই না আসে। পূর্ব-বঙ্গকে পাকিস্তানের ত্রাস থেকে বাচানো এবং তাদের হারানো গণতন্ত্র বাচানোর জন্য কোন কল্যানময় অভিপ্রায়মূলক কাজ দেখা যায় না, কিন্তু ইয়াহিয়া খানকে তার অভ্যন্তরীন বিশৃঙ্খলা এদেশে রপ্তানি করা থেকে রোধ করা এবং তাদের জনসংখ্যার পূনর্গঠন, আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক সংস্কারের পথে আমাদের বাঁধা দিচ্ছে। তাই প্রধানমন্ত্রীকে অবশ্যই তার সময় বলতে হবে। কারন তিনি তার জায়গা থেকে সব খুটিনাটি ব্যাপার জানেন। আমার মৌলিক বিবেচনা পরিষ্কার এবং এটাও মাথায় রাখার আবেদন রাখলাম।

আমরা নিচে জে.পির জুলাই ২৭, ১৯৭১-এ নয়া দিল্লী থেকে প্রকাশ পাওয়া সংবাদ সংলাপ নিচে উল্লেখ করলাম। এই বিবৃতি মনে হয় যেমন প্রচার বিস্তৃতি হওয়ার কথা ছিল তা পায় নি। (জোর দিয়ে)।

“একটি ঘুঘু পাখি বাজপাখিতে পরিণত হল”, “একজন ভাড়াটে নৈকি”- এভাবেই আমি পত্রিকার অংশে বর্ণনা করেছি। অন্যরা আমাকে বিব্রতর অবস্থায় ফেলার এবং প্রধানমন্ত্রীকে কলংকিত করে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছে; এবং অন্তত একটি বোম্বের মিথ্যাচারী সাপ্তাহিক সুপারিশ করেছে যে আমার বাংলাদেশ ভঙ্গিমা দ্বারা ইন্দিরাজীকে চাপে ফেলে ভারতের পরবর্তি প্রেসিডেন্ট বানানোর আশা করছি। বিশেষ করে মুসলিম প্রেস, কিছু ব্যতিক্রম ব্যতিত, আমার বিরুদ্ধে আক্রমনাত্বক অবস্থান নিচ্ছে, আমি যখনই সুযোগ পাবো, আমি আশা করি বাংলাদেশ প্রশ্নে আরো পূর্নাঙ্গ লিখবো। এখানে, আমি শুধু আমার অবস্থান পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে এবং সত্য আবেদন তুলে ধরার ইচ্ছা করেছি।

আমি নিশ্চিতভাবে অস্বীকার করছি যে আমি কখনই পাকিস্তান যুদ্ধের পক্ষপাতি ছিলাম না। প্রকৃতপক্ষে যখন থেকে প্রথমবারের মত আমি সংবাদ সম্মেলনে হাজির হয়েছি তখন থেকেই আমি এর বিরোধীতা করে আসছি, কিন্তু যেহেতু এমনটা হয়েছে, শিরোনামে কাদা ছোড়াছুড়ি শুরু হয়েছে। এইটাই শুধু আমার কাছে প্রবলভাবে অন্যায় না সাথে জনগণের মনে গভীরভাবে বিভ্রান্তি ছড়ানো এবং যা এই সংকটপূর্ন ও অসম্ভাবী মুহূর্তে খুব প্রয়োজনীয় জাতীয় প্রচেষ্টা নাজুক করে। বর্তমান সংকট খুবই গুরুতর যে হয়ত্ এই জাতিকে এই থেকে কঠিন, ঐক্যবদ্ধ, শক্তিশালী এবং সম্মানিত ক্ষমতাশীলভাবে অভ্যুদিত হতে হবে অথবা নীতিনষ্ট, বিভ্রান্ত এবং মেরুদন্ডহীন দূর্বলের মত বিশ্ব দ্বারা আর কখনো গুরূত্বের সাথে গ্রহনযোগ্য হবে না। অতএব, কাউকে এই সমস্যায় কাউকে বিভ্রান্ত করা চেষ্টা করতে দেয়া যাবে না।

আমি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বিরুদ্ধে কিন্তু আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিকভাবে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতির পক্ষপাত করতেছি। এইটা সত্য যে যখন প্রশ্ন করা হয় যদি সরকারের স্বীকৃতি এবং মুক্তিবাহিনীর জন্য উম্মুক সহায়তা হয়ত ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে যুদ্ধে প্ররোচিত করবে না, আমি স্বীকার করতেছি যে সেখানে নিশ্চিত পরিত্রাণ নাই, কিন্তু এইটা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য হতে হবে।

যদি এই বলি যে ইন্ডিয়ার উচিত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ইন্ডিয়ার যুদ্ধ ঘোষনা দেয়া তাহলে আমি নিশ্চিতভাবেই ভাড়াটেনৈকির মত সমান হবে। কিন্তু এমনকি নিয়তিও জানে এদেশের কেউই ভাড়াটেনৈকি নয়। একমাত্র পার্থক্য, আমি এখন পর্যন্ত বুঝতে সক্ষম হয়েছি যে, আমারমত সমমনা জনগণ এবং ইন্ডিয়ার সরকার সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করতেছে যখন থেকে হয়ত স্বীকৃতি দেয়া যাবে, আমরা বলতেছি যে সঠিক সময় এখনই।

আমি প্রধানমন্ত্রীকে বিব্রত অথবা সুনামহানী অথবা আমাকে চাকুরি দেওয়ার জন্য জোর করা চাই না, এই ধরনের নীচ পরামর্শ হিসেবে নেওয়া যাবে না। কিন্তু যেহেতু তাদের পত্রিকায় দেখা গিয়েছে এবং দলছুট পাঠকদের বিভ্রান্ত করতে চায় তাই আমাকে ইহা পরিষ্কার করতে দেন যে রাজনৈতিক কুড়াল নেই পেষাই করার, না আমি কোন অফিসের জন্য প্রার্থী, এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে না আমার ব্যক্তিগত স্নেহ ও কদর রয়েছে। আসলে, “বাংলাদেশ প্রশ্নে, আমার অনুভূতি তা যা আমাদের মধ্যে সম্পূর্ন বোধগম্য, এবং আমি যে জনগণের চাপ আমি তাতক্ষনিক অথবা যথাসময়ে স্বীকৃতি দেয়ার অনুকূলে তৈরী করতে সহায়তা করতেছি তা কোনভাবেই বিব্রত করবে না।

এই আকুতি করি যে আমি বাংলাদেশ ইস্যূ থেকে দলীয় রাজনীতি আলাদা রাখার ইচ্ছা রাখি। লোক সভার চলতি অধিবেশনের খুব শুরুতেই সে তার এই বিষয়ের বিবৃতিতে, প্রধানমন্ত্রী জোর দিয়েছেন যে “এই অবস্থা পক্ষপাতভুক্ত মনন অথবা দলীয় রাজনীতির শর্তাবলী দিয়ে ঠেকানো যাবে না”। লোক সভা দ্বারা পাস করানো সর্বসম্মত সমাধান ছিল এই অভিগমনের দারুন শুরু। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত সম্প্রতি বিভেদ সৃষ্টিকর উপসর্গ দেখা গিয়েছে, এমনকি পক্ষপাতভুক্ত অগ্রসরও। ইহা অত্যন্ত বোধগম্য যে, বাংলাদেশের মত নির্দলীয় এমনকি দলীয় ইস্যূর পার্থক্যও, সময়ের পরম্পরায় উদিত হতে পারে, বিশেষত সরকারের দৃষ্টিকোনও কার্যকরী প্রক্রিয়া গ্রহণ করতেও দ্বিধা করতে শুরু করেছে। এখানে প্রধান দুই সারির মত রয়েছে। এক হচ্ছে ক্ষমতাশীন দল কংগ্রেস যারা নীতিগত ভাবে স্বীকৃতি দেয়ার বিরোধী নয় কিন্তু বাস্তবে তা প্রধানমন্ত্রীর উপরেই সময় নির্ধারনে কোন কোন বিষয় আসবে তা পরিষ্কারভাবে উপযুক্ত চিন্তা করায় ন্যস্ত। অন্য সারির গঠন প্রায় এর ঘোর বিপরীত।

এর সাথে অনেক নির্দলীয় সংস্থা এবং আমার মত ব্যক্তিত্বরা আছেন যারা অনুভব করেন যে স্বীকৃতির সময় এখন এবং এখনই। যদিও জাতির মনে এই দুঃখজনক বিভাগ ঘটতে সুযোগ দিয়েছে, মতপার্থক্য খুব ভালো নয়।

যখন কনগ্রেস(আর) জনগনের মতামত তাদের নিজস্ব দিকে সচল করবে, অন্যের অধিকার যেন একই রকম হয় এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। পরবর্তীকালে, যাইহোক, যদি তারা গুরুত্বের সাথে গ্রহণ হতে চায় তাদের অবশ্যই যুক্তফ্রন্টে উপস্থিত হতে হবে। ভারতীয় জনসংঘের সভাপতি শ্রী অটল বিহারী বাজপাই, খুশিমনেই তার দলের কার্যক্রমের ১২ই আগস্টের সময়সূচী সর্বদলীয় অথবা নির্দলীয় ব্যাপারে রুপান্তর করেন। আমি সকল দলের এবং ব্যক্তিত্বদের নিকট গঠনমূলক আহবানের আবেদন করছি।

প্রথমত প্যান-আরব্যের রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল অটোমান সম্রাজ্য থেকে স্বাধীন হওয়া, এবং এটা সাধিত হয়েছে সম্রাজ্যের কেন্দ্র, তুরস্কের মধ্যকার একমাত্র ক্রমবর্ধমান বিপ্লবী আন্দোলনের জন্য। আরব জাতীয়তাবাদী এবং তুরষ্কের সংস্কারবাদী সমবায়ের সিক্রেট সংঘ এবং উন্নতি কমিটি সিক্রেট এসোসিয়েশনের দ্বারা যারা তরুন তুর্কীদের ১৯০৮-৯ এ লিবারেল কার্যক্রমের ক্ষমতায় নিয়ে বিভিন্ন জাতিগত, ধর্মগত এবং জাতীয় দলগুলোর সমতার অঙ্গীকার করেন। কিন্তু তরুন তুর্কিদের উগ্র জাতীয়তাবাদ আরবদের মোহমুক্ত করে, তারা তখন স্বায়ত্তশাসনকে তাদের লক্ষ্য হিসেবে গৃহীত করেন। খ্রিষ্টানদের নেতৃত্ব আন্দোলন মুসলিমদের সাথে সম্পৃক্ত করা উচিত যারা কিনা নতুন ভাবাদর্শগুলো দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। পরন্তু, তরুনদের সংকীর্ণ পালা আরব মুসলিমদের বিচ্ছিন্ন করে এবং যতটুক খ্রিষ্টানদের করেছিল। অটোমাইজেশন পলিসি অর্থ হলো আরবী ভাষা এবং সাহিত্যকে এবং তুর্কির প্রশাসন এবং শিক্ষাকে অনুতসাহিত করা। এই উন্নয়ন অটোমান প্রচেষ্টার ব্যর্থতার পথ সুগম করে, নিজেকে সংঘবদ্ধ শক্তি হতে রক্ষা করতে ১৯১৪ সালের যুদ্ধ স্থিত করে।

মরোরে বার্জার, দ্যা আরব ওয়ার্ল্ড টুডে, ডাবলডে এন্ড কোম্পানি
নিউ ইয়র্ক ১৯৬২, পৃঃ ৩৩৮

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৮৯। ‘এ ক্রাই ফর হেল্প-মহারাষ্ট্র বাংলাদেশ এইড কমিটি আয়োজিত শরনার্থীদের সাহায্যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা’
(রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বানী) ‘এ ক্রাই ফর হেল্প’- পুস্তিকার ২৪ নভেম্বর, ১৯৭১

Sajib Barman
<১২, ১৮৯, ৪৯৩-৩৯৪>
অনুবাদ

প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশে এই সন্ত্রাসী আক্রমণ শুধুমাত্র কোন ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠিকে নিশিহ্ন করার জন্য নয়, বরং বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের উপর- যারা গনতান্ত্রিকভাবে তাদের সাংবিধানিক অধিকারের ভিত্তিতে ভোট প্রদান করেছিলেন। সংখ্যায় ব্যাপকহারে উর্দ্ধমুখী এই বিশাল সংখ্যক উদ্বাস্থুদের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণ সরবরাহ এখন সময়ের দাবী।

অদূর ভবিষ্যতে বিশ্ববাসীর এই মানুষদের তাদের নিজ গৃহে পুনর্বাসন করা আবশ্যক। এই অন্তরীন সময়ে ভারত সরকার এবং তার জনগনের একতাবদ্ধ হয়ে তাদের যা সম্ভব তা দিয়ে সাহায্য করা প্রয়োজন। নিজ দেশ থেকে নির্যাতিত হয়ে পালিয়ে আসা মানুষদের আমাদের দেশ এখন পর্যন্ত আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে আসছে।

মহারাষ্ট্রের বাংলাদেশ এইড কমিটির জন্য আমার মঙ্গল কামনা রইল।
বন, পশ্চিম জার্মানি
১১ নভেম্বর, ১৯৭১
Sd/-
(ইন্দিরা গান্ধী)

রাষ্ট্রপতি ভবন
নয়া দিল্লী-৪
৩০ অক্টোবর, ১৯৭১

আমি জেনে খুশী হয়েছি যে মহারাষ্ট্রের বাংলাদেশ এইড কমিটি ২৪ নভেম্বর, ১৯৭১ একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। আমি এই প্রচেষ্ঠার সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা করি।

Sd/- ভি ভি গিরি

বন্ধুগণঃ
বাংলাদেশ থেকে আগত শরনার্থীদের সাহায্যকল্পে বাংলাদেশ এইড কমিটি, মহারাষ্ট্রের পক্ষে এই আয়োজন এবং “STRINGS & STARS” কে উপস্থাপন করতে পেরে আমি নিশ্চিত ভাবেই অত্যন্ত সন্মানিত বোধ করছি। বাংলাদেশ এইড কমিটি (মহারাষ্ট্র) বাংলাদেশ থেকে আগত লক্ষ লক্ষ শরনার্থীদের সাহায্য করতে নিজস্ব দ্বায়িত্ববোধ থেকে ব্যাপক মাত্রায় কাজ করে আসছে। অর্থ সংগ্রহের এই সাফল্য অতি অবশ্যই আপনাদের সহযোগিতা, দয়া এবং এই মহান কাজে আপনাদের অংশগ্রহনের আগ্রহের উপর নির্ভরশীল, যা আপনাদের ব্যতিরেকে কোন ভাবেই সম্ভবপর ছিলনা।

আমি আমার সহকর্মী বিশেষ করে ওয়াহিদা রহমান, আর সি চৌধুরী এবং রাম কামলানী এর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, যারা কোন ভাবেই “STRINGS & STARS” এর অনুষ্ঠানের সাফল্যের কিছু কম ভাগীদার নয়।

আমি কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই মাননীয় নওয়াব আলী যাভের জুং, গভর্নর মহারাষ্ট্র, যিনি উনার ষ্টেটের সকল কাজের ব্যস্ততার মাঝেও আগ্রহ করে শুরু থেকে শেষ অবধি সময় দিয়ে বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করেছেন।

এই মহান কর্মের সবকিছুই নিবেদিতপ্রাণ, পরিশমী সদস্যদের স্বেচ্ছা ও নিরন্তর শ্রমে সম্ভব হয়েছে।

আমি আজকে আপনাদের সকলের আন্তরিক উপস্থিতির জন্য কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

Sd/- …………………..

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৯০। বাংলাদেশ ও ভারতের ভবিষ্যৎ জয়া প্রকাশ নারায়ণ লিখিত নিবন্ধ কম্পাস ২৭ নভেম্বর ও ৪ ডিসেম্বর ১৯৭১

রানা আমজাদ
<১২, ১৯০, ৪৯৫-৫০০>

বর্ষার অবসান হতেই ক্ষমতাসীন নেতৃবর্গ সোচ্চার হয়ে উঠেছেন এবং রীতিমত কলরব শুরু করেছেন। সবচেয়ে সামরিক ঢং- এর কলরব করেছেন আমাদের সুযোগ্য প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এর দ্বারা তিনি এদেশের জনসাধারণের বুদ্ধির অবমাননা করেছেন আর নিজেকেও পৃথিবীর লোকের কাছে হাস্যসম্পদ করে তুলেছেন। জলন্ধরে তিনি নাকি বলেছেন- ‘পাকিস্তানের প্রায় অর্ধেক তো খতম হয়ে গেছে। ভারতের আর লড়াই করবার দরকার নাও হতে পারে। জেনারেল ইয়াহিয়া খান উপলব্দি করতে শুরু করেছেন বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী তাদের প্রাধন্য স্থাপন করে চলেছে আর বিশ্বের মতামতও ক্রমে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সবচেয়ে বিচিত্র উক্তি হল- ‘মুক্তি বাহিনী আর একটী মুষ্ঠাঘাত করলেই বাংলাদেশের মুক্তি হয়ে যাবে’।

প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে শ্রী জগজীবন রাম নিশ্চয়ই অন্যের চাইতেও ভাল জানেন। তিনি জানেন বাংলাদেশে গেরিলার কত সামান্য হাতিয়ার নিয়ে লড়ছে- তাদের নিয়মিত সংগ্রাম করার বাহিনীকত ছোট, অগ্নেয়াস্ত্রে তদের কি শোচনীয় স্বল্পতা রয়েছে, আধুনিক আস্ত্রশস্ত্র এবং ভাড়ী সামরিক সরঞ্জাম তাদের প্রায় কিছুই নেই এত সামান্য আস্ত্রশক্তি এবং অর্ধশিক্ষা নিয়ে তারা বাংলাদেশে পাকিস্তানের পাঁচ ডিভিসন সৈন্যকে ঘায়েল করতে পারবে এ রকম আশা করা মানে অতিবড় মূর্খের স্বর্গে বাস করা। আরও খারাপ কথা হল- এ দেশের জনসাধারণ যাদের ভাগ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের ভাগ্য অবিচ্ছদ্যরূপে বাঁধা হয়ে গেছে, এ ধরণের উক্তি তাদের শোচনীয়রূপে বিভ্রান্ত করবে। আজ যখন জনগণের মধ্যে এরূপ মানসিকতা সৃষ্টি করা জরুরি প্রয়োজন যাতে সংগ্রামী চেতনায় তারা শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে পারে, নিজেদের মধ্যকার সবরকম ভেদাভেদ ভুলে যেতে পারে, কর্মের প্রতিক্ষেত্রে সর্বদিক উদ্যম নিয়ে আত্ননিয়োগ করতে হবে, তখন কেউ নয় স্বয়ং প্রতিরক্ষামন্ত্রী এই মারাত্নক আত্ন-সন্তুষ্টির মধ্যে জগৎকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে চাইছেন, যে বিনা সাহায্যে বাংলাদেশের সৈন্যরাই কাজ খতম করে দিতে পারেবে।

একথা অবশ্যই সত্য বাংলাদেশের লোকদেরই লড়াই করতে হবে। কিন্তু যেহেতু বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা সাহসী, সংকল্পব্ধ এবং অনন্যনিষ্ঠ, সেইহেতু তারা নিজেরাই পাকিস্তানী বাহিনীকে পরাজিত করতে পারবে এ ধরণের কথা বলে আমাদের নিজেদেরকে এবং বিশ্ববাসীকে প্রতারণা করা নিরর্থক। তাদের সাহায্য কাউকে আসতে হবে। ভারত ছাড়া সে ক্ষমতা এবং উদ্বেগ আর কার আছে? এটা যদি কেবল আর্ত প্রতিবেশীকে সাহায্য করার প্রশ্ন হত তাহলে এ যুগের জাতি-রাষ্ট্রের অনৈতিক নৈরাশ্যক ও হৃদয়হীন রীতি অনুসরন করে নিজের দোরগোড়ার বাইরেই লুটতরাজ, নারীধর্ষণ ও বিধ্বংসী কার্যকলাপ সম্পর্কে চোখ বুজে থকলেও হয়ত ভারতের পক্ষে তা যুক্তিযুক্ত হত। আমাদের বিবেককে বাঁচাবার জন্য আমরা কানে তুলো দিয়েও থাকতে পারতাম যাতে বাংলাদেশে পাকিস্থনী সৈন্যদের পাপালয়ে বন্ধী হতভাগিনী বাঙলি তরুণীদের হৃদয়ভেদী নৈশ আর্তনাদ আমাদের শুনতে না হয়। বাংলাদেশের লোকেদের ‘হিন্দুপ্রবণ’ সংস্কৃতি ধ্বংস করে, কি করে খাঁটি মুসলমান হতে হয় তা তাদের শিক্ষা দিয়ে বাংলাদেশে একটি জারজ জাতি সৃষ্টি করার স্পর্ধিত পাকিস্থনী উক্তি সম্পর্কেও আমরা বাধিত থাকতে পারতাম। তাদের পূর্বাংশের উপনিবেশটিকে অমুসলমান বিশেষ করে হিন্দু শূন্য করা, যথেষ্ট সংখ্যায় বাঙালি মুসলমানকে খুন করে বা বিতাড়িত করে তাদের জায়গায় যথেষ্ঠ ‘অনুগত’ পাকিস্তানী আমদানী করে বাঙলি সংখ্যালঘুতে পর্যাবসিত করা এবং তার দ্বারা বাঙলি জাতীয়তাবাদকে নিস্ক্রিয় করে তোলা, মুসলিম জগতের সর্বোত্তম সাংস্কৃতি উজ্জীবনকে ব্যর্থ করে দেখা, বাঙলি দেশপ্রেমিকদের কবরে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে চাপা দেওয়া সর্বশেষ দ্বিজাতিতত্ত্বকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার পৈশাচিক ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আমরা আমাদের মনের দরজায় খিল রাখতেও পারতাম। কিন্তু দূর্ভাগ্যের কথা হল বাংলাদেশ ভারতের পক্ষেই এক জীবন-মরণের প্রশ্ন। শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় কোটিতে পৌঁছেছে এবং সেই যে অন্যায়জনক পৌনঃপুনিক উক্তি- ‘বাংলাদেশে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যাতে শরনার্থীরা নিরাপদে ফিরে যেতে পারে’ তা সত্য করে তুলবার জন্য বিশ্বের দুই রাশিয়া ও আমেরিকা যদি পাকিস্তানকে সম্মত করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে কালক্রমে শরণার্থী সংখ্যা কোটি কিম্বা বেশি হতে পারে। কিন্তু এ শুধু শরণার্থী বহনের প্রশ্ন নয়। লোকস্ফিত ও দারিদ্র্যপীড়িতে আমাদের দেশের উপর ক্রমাগত এত বেশী শরণার্থীর চাপ সামাজিক, রাজনৈতিক, ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত কি পরিণাম অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে তা অতিবড় নির্বোধও উপলব্দি করতে পারে।

সোজাসুজি সমস্যাটির মুখোমুখি হয়ে বুঝতে হবে পৃথিবীর অন্তত মুখ রক্ষার মত সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে ভারত টিকে থাকবে কিনা, বাংলাদেশ প্রশ্নটি তার চাইতে কিছু কম নয়। নিক্সন এবং পদগার্নি যদি না-ও জানেন নয়াদিল্লীর এখন জানা উচিত বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম জাতিতে পরিণত না হলে একজন শরণার্থীও, অন্তত একজন অমুসলমান কিম্বা রাজনীতি সচেতন মুসলমানও ফিরে যাবে না। তথাকথিত বিশ্ব সমাজ যতই বুঝান বা চাপ দিন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তিতে কোন ‘রাজনৈতিক সমাধান’ ইয়াহিয়া খান মেনে নিবেন কখনও তার সম্ভাবনা নাই। এ ধরনের বুঝানো পড়ানো ও পীড়াপীড়ির ফল কি হয়েছে তা ইয়াহিয়া খান নিজেই তার বহু প্রতীক্ষিত ১২ই অক্টোবরের বিবৃতিতে বিশ্ববাসীকে শুনিয়ে দিয়েছেন। অনুমান রাশিয়া এবং আমেরিকা উভইয়েই ‘রাজনৈতিক সমাধানের প্রথম ধাপ হিসেবে শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্তি দেবার জন্য পাক প্রেসিডেন্ট এর ওপর চাপ দিচ্ছেন। তার উত্তরও ইয়াহিয়া খান দিয়েছেন। তিনি বলেছেন সামরিক ট্রাইব্যুনালের যে প্রশ্নটি তিনি খাঁড়া করেছেন তা যদি শেখ মজিবকে নির্দোষ না করে তাহলে তিনি একজন দেশদ্রোহীর সাথে কথা বলতেও প্রস্তুত নন। এ মানুষটি অতি সস্প্রতি পাকিস্তানের নির্বাচন এক বিস্ময়কর জয়ের গৌরব অর্জন করেছেন এবং সমগ্র পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে তার দলকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এনে দিয়েছেন, জনমত যাচাই করে তার ভাগ্য নির্ণয় করা হবে- এ কথা বলতেও ইয়াহিয়া খানের মুখে আটকায়নি। ‘রাজনৈতিক সমাধানের জন্য বৃহৎ শক্তিবর্গের এবং আমাদের প্রধানমন্ত্রীরও চেষ্টা চরিত্রের নীট ফল। এই ‘রাজনৈতিক সমাধান’ বস্তুটিকেও ইচ্ছা করেই অস্পষ্ট রাখা হয়েছে- অবশ্য তার একটি বক্তব্য খুবই স্পষ্ট, সেটি হল অখন্ড পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে থেকে সমাধান।

ওপনিবেশিক শাসন মুক্তিলাভের জন্য আমেরিকা সংগ্রাম করেছে, কিন্তু সে অনেক দিনের কথা, নিউইয়র্ক বন্দরে ‘স্ট্যাচু অফ লিবার্টি’ (স্বাধীনতার মর্মরমূর্তি) ছাড়া সেই উপনিবেশবাদ বিরোধী আদর্শের আজ আর অবশিষ্ট নেই। প্রকৃতপক্ষে আজ আমেরিকা নিজেই একটি বৃহৎ উপনিবেশিক শক্তি। অন্যদিকে রাশিয়া বারাবর ওপনিবেশিকতা বিরোধী সমস্ত মুক্তি সংগ্রাম উচ্চকন্ঠে তার পরিপূর্ণ সমর্থন জানিয়ে আসছে বটে কিন্তু তার তাঁবেদার রাষ্ট্রগুলোর ওপর তার দখল শিথিল করবার কোন ইচ্ছাই দেখাচ্ছে না। নিতান্ত ভদ্র ভাষাতেই এগুলো তাঁবেদার, আসলে এই রাষ্ট্রগুলোর সেই পুরাতন ওপনিবেশিকরই মতন। এই দুই মহাশক্তি নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে বিশ্বের ভবিষ্যৎ এর মুঠি ধরে রয়েছে। এবং তা কোন নৈতিক ক্ষমতায় নয়, সংহারের ভীষণতম হাতিয়ার হাতে থাকার জোরে। বাংলাদেশের পক্ষে নিদারুণ বেদনায় যে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা’ সম্পর্ক এই দুই শক্তির দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যে-রুশ ভারত চুক্তি সত্ত্বেও কোন মৌলিক তফাৎ নেই। নিজ নিজ জাতীয় স্বার্থ অনুসারে এই দুই দেশেই পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি রক্ষার জন্য উদ্বিগ্ন-

পাকিস্থনের দুই অংশের মধ্যে বন্ধন যতই ডিলে হোক না কেন। কিন্তু বাংলাদেশের বিপর্যয়ের মধ্যে কী কী প্রশ্ন নিহিত রয়েছে অন্তত ভারতের সে বিষয়ে কোন ভ্রান্ত ধারনা থাকা উচিত ছিল না। ভারত তো কোন ওপনিবেশিক উচ্চাশা নেই, আর ভারত সরকারের আজও কিছু সদস্য আছেন যারা নিজেরা এক সময় স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছেন। গোড়া থেকে এটাই পরিষ্কার যে, ‘পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রে’ যা ঘটেছে তা কোন জাতির বিচ্ছিন্নতা নয়। তা হচ্ছে স্বাধীনতার জন্য ঔপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম। অত্যন্ত বেদনার কথা, অনেক বেশী অস্ত্রশক্তি সম্পন্ন একটা বাহিনীর বিরুদ্ধে সাত মাসের নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রামের পরও, সার্বভৌম স্বাধীনতার কম কোন কিছু তাদের এবং তাদের জনগণের কাছে কদাচ গ্রহণীয় হবেনা। বাংলাদেশের ন্যায্য সরকার স্বয়ং বারংবার এই ঘোষনার পরও, ভারতের নেতৃবৃন্দ আলোচনার ভিত্তিতে বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের গ্রহনযোগ্য রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলে চলেছেন। এর চেয়ে অন্তঃসারশূন্য আর কিছু কল্পনা করা কঠিন। গত সাত মাসের অভিজ্ঞতার পরও তারা কি করে আশা করতে পারেন যে, পাকিস্তানী সামরিক শাসকগোষ্ঠিকে তাদের পূর্বাংশের কলোনী হাতছাড়া হওয়ার ক্ষতি স্বীকার চাপ দিয়ে রাজী করানো যেতে পারে- বিষেশ করে যখন তার কিছু শক্তিশালী বন্ধু জুটেছে? নাকি আমাদের শাসকরা নিজেরাই পাকিস্তানকে অখন্ড রাখার প্রচ্ছন্ন ইচ্ছা পোষণ করেন, তা-ই যদি হয়, ঈশ্বর এই দেশকে রক্ষা করুন।

সমস্যাটি যদি শুধু বাংলাদেশের ভাগ্য নিয়েই হত তাহলে আমরাও বাস্তবতাবর্জিত অপ্রাসঙ্গিক অনেক বুলি আওড়াতে পারতাম। কিন্তু আমাদের মৌলিক জাতীয় স্বার্থ যে কতখানি বিপন্ন তা আমি আমার কথা দিয়ে হয়ত আমাদের শাসকদের বুঝাতে পারবো না, তাই প্রধানমন্ত্রীর কিছু উক্তিই উদ্বৃত করেছি (উক্তিগুলো ২৪শে মে ১৯৭১ লোক সভায় প্রদত্ত এবং সরকারীভাবে মুদ্রিত প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ থেকে)ঃ শরনার্থী স্রোতের কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বলেছিলেন, “এত অল্প সময়ের মধ্যে এত বিপুল দেশত্যাগ মানুষের লিখিত ইতিহাস অভূতপূর্ব। গত আট সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশ হতে প্রায় ৩৫ লক্ষ লোক ভারতে এসেছে। দেশভাগের পর থেকে উদ্ধার বলতে আমরা যা বুঝে এসেছি এরা তা নন। এরা যুদ্ধের কবলে পড়েছেন, সীমান্তের ওপারে সামরিক সন্ত্রাস হতে আশ্রয়প্রার্থী হয়ে এখানে এসেছে। “এরপর প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন করেন, শত নয় সহস্র নয় লক্ষ লক্ষ নাগুরিককে বেয়েনটের মুখে তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য করার অধিকার কি পাকিস্তানের আছে। আমাদের কাছে এ এক অসহ্য অবস্থা। ”

তা ছিল মে মাসের চতুর্থ সপ্তাহ, এখন হচ্ছে অক্টোবরের চতুর্থ সপ্তাহ। তখন শরণার্থীর সংখ্যা ছিল ৩৫ লক্ষ, ৯৫ লক্ষ। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর মতে তখনই যদি অবস্থা ‘অসহনীয়’ হয়ে থাকে তারপর গত পাঁচ মাসে যে ক্রমাগত শরনার্থীদের স্রোত বেড়েই চলেছে তা আমরা কি করে সহ্য করতে পারলাম? সম্ভবতঃ আমাদের প্রিয় আন্তজার্জাতিক উপকারীদের বন্ধুসুলভ আমাদের সহ্যের স্তর উন্নীত করতে সাহায্য করেছে। জানি না কোনদিনই আমাদের সহ্যের সীমায় আমরা পৌঁছিব কিনা।

একই বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, “ভারতের ঘারে বন্দুক রেখে এবং ভারতেরই মাটিতে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানকে তার রাজনৈতিক বা অন্যান্য সমস্যার সমাধান করতে দেয়া যায় না। পাকিস্তান কিন্তু ঠিক তাই করে চলেছে, তথাপি তা থামাবার জন্য প্রধানমন্ত্রী এই মাত্রই তিনি করেছেন তার দূতদের অন্যান্য রাষ্ট্রে পাঠিয়ে তাদের অনুরোধ উপরোধ করেছেন যে কাজ পাকিস্তানে করতে দেয়া যায় না বলে তিনি গম্ভিরভাবে ঘোষনা করেছেন তা থেকে তারা যেন পাকিস্তানকে বিরত রাখেন। পাকিস্তান অন্যান্য রাষ্ট্রের ক্ষতি করে এবং তাদের মাটির উপর দাঁড়িয়ে তো তার সমস্যা সমাধান করতে চায়নি, তাহলে ভারত তার নিজের জাতীয় স্বার্থে করতে প্রস্তুত নয় তা তাদের কেউ করবে- খুন কম করে বললেও তা আত্নবঞ্চনা নয় কি? অন্য কোন রাষ্ট্র যে আমাদের কল্যাণে ভারতকে আর ‘অসহ্য’ বিড়ম্ভনা থেকে উদ্ধার করার জন্য বীর পুঙ্গরবে ভূমিকা নেয়নি তাতে অন্তত আমি তো তাদের দোষ দিতে পারি নাঃ বীর্যবত্তার যুগ যদি কখনও থেকেও থাকে, বহুকাল তা অতিক্রান্ত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেনঃ ‘শুধু ভারত নয় প্রত্যেক দেশকেই তার নিজের স্বার্থ দেখাতে হয়। ওরা (অর্থাৎ পাকিস্তানীরা) বিশ্ব মানবতার একটি বিরাট ভূখন্ড এই যে ভারত তার শক্তি ও স্থায়িত্ব বিপন্ন করেছে। “তারপর ঝঙ্কৃত শব্দে তাঁর বক্তৃতার উপসংহার টেনে প্রধানমন্ত্রী বললেন- বিশ্ব যদি এ অবস্থায় বসে থাকে তাহলে আমরা আমাদের নিরাপত্তার জন্য এবং আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন কাঠামো বাঁচানো এবং পরিপুষ্ট করার জন্য বাধ্য হয়েই প্রয়োজনমত সমস্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করব। বাংলাদেশ প্রশ্নে দেশের মৌলিক স্বার্থ কিভাবে জড়িয়ে আছে এর চেয়ে স্পষ্টতার ভাষ্য এবং যে কোন অবস্থায় দেশ রক্ষা ও দেশের স্বার্থ রক্ষার তাগিদে সর্বাধিক ব্যবস্থা অবলম্বন সম্পর্কে পৃথিবীকে এর চেয়ে পরিষ্কার ও শক্ত হুঁশিয়ারী আর কিছু হতে পারে না।

আজ পাঁচ মাস পরে এই কথাগুলো কত আসার মনে হয়। এই পাঁচ মাসে আমাদের অবস্থা তো কেবলই ঘোরালো হয়েছে। কাজ করার যখন কোন ইচ্ছাই ছিল না তখন এ ধরনের বীরত্বব্যঞ্জক উক্তি করার কি প্রয়োজন ছিল। কথা এবং কাজের এই ব্যবধানই পৃথিবীতে এই দেশের মর্যাদা মারাত্নকরূপে ক্ষুন্ন করেছে, দেশের নেতাদের সম্পর্কে লোকে আস্থাহীন হয়ে পড়েছে। কথা-কথা-কথা কিন্তু কোন কাজ নয়, এর একটি মারাত্নক পরিণাম হল দেশের মধ্যে দিব্বি নিশ্চিন্তার ভাব ছড়িয়ে পড়েছে, সম্ভাব্য পাকিস্তানী দুষ্কর্মের মোকাবেলা করার মত কোন মানসিক প্রস্তাব নেই। স্বাধীন ভারতের এই সংঘাতিক সংকটে জাতীয় নেতৃত্বের এর চেয়ে চূড়ান্ত ব্যর্থতা কল্পনা করা কঠিন।

তাঁর সংযম ও ‘রাষ্ট্রিক বিচক্ষণতার’ জন্য আমাদের প্রধানমন্ত্রী অবশ্য রাশি রাশি সুপারিশপত্র পাচ্ছেন, কিন্তু তাতে এই দেশ যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বোঝার চাপে আর্তনাদ করেছে তা বিন্দুমাত্র হাল্কা হয়নি এবং জাতির অস্তিত্ব যেভাবে বিপন্ন হয়েছে তাকেও ঠকানো যায়নি। মাসের পর মাস আন্তর্জাতিক স্তরে রাজনৈতিক সমাধানের খোঁজ চলছে, কিন্তু তাঁর এই মাত্র ফল হয়েছে ইয়াহিয়া খান বন্ধু-বান্ধব সবাইকে বৃদ্ধাঙ্গষ্ঠ দেখিয়ে বেড়াচ্ছেন এবং তাঁর পথ হতে সরে দাঁড়াতে অস্বীকার করেছেন। তা তিনি করতেই পারেন, তাঁর একাধিক শক্তিশালী বন্ধু আছে।

আসলে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের চাবিকাঠি কেবল ভারতের হতেই আছে। আমি এর আগেও বলেছি স্বাধীনতা ছাড়া কোন রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব নয়। সতরাং যার জীবন-মরণের প্রশ্ন বাংলাদেশের প্রশ্নের সাঙ্গে জড়িত সেই ভারতকেই রাজনৈতিক সমাধানের এই নিষ্ফল সন্ধান বন্ধ করতে হবে এবং সাহস করে বাংলাদেশ ও তাঁর ন্যায়সঙ্গত সরকারকে স্বীকার করে শক্ত হাতে প্রশ্নটিকে চিরদিনের মত মোকাবেলা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীন তাঁর সঙ্গেই উপযুক্ত কথাটি বারবার বলে চলেছেন। ইতিহাস প্রমান করবে তিনি ইতিমধ্যেই এ রকম কয়েকটি উপযুক্ত মুহূর্ত হারিয়েছেন।

সবচেয়ে উপযুক্ত সময় ছিল এপ্রিলের প্রথম পক্ষে, যখন বাংলাদেশ নেতৃবর্গ ও মুক্তিযোদ্ধাগণ সাহায্যের জন্য চীৎকার করেছিলেন, যখন তাঁরা তাঁদের সরকারও প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছিলেন এবং তাঁদের বক্তব্য পেশ করার জন্য সাহায্যের আশায় দিল্লী ছুটে যাচ্ছিলেন। তখন আমরা যেতাম বন্ধুদের পৃথিবীতে যা কিছু শোভন, নীতিসম্মত ও মানসিক তা আমাদের দিকে আসত। তখন আমরা যেতাম বন্ধুদের এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যকারী ভূমিকা নিয়ে, আক্রমনকারীর ভূমিকা নিয়ে নয়- আর এই সাহায্যের বারবার অনুরোধ আসছিল বাংলাদেশ সঙ্গত ও সংবিধানিক সরকারের কাছ থেকে, যে সরকারকে জন কয়েক মীরজাফর বাদে সকলেই পূর্ণ সমর্থন করেন। অথচ সেই সুযোগ আমরা বৃথায় যেতে দিয়েছি যে সুযোগ কোন জাতির জীবনে একশ বছরে একবার আসে। তখনকার এই নিষ্ক্রিয়তার জন্য ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর বদনাম দেওয়া হচ্ছে। আমাদের বীর জোয়ান ও তাঁদের সুযোগ্য অফিসারদের সম্পর্কে এর চেয়ে অধিক অশোভন আর কিছু হতে পারে না। সৈন্যবাহিনীর অপ্রস্ততি নয়। রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতাই এই জন্য দায়ী-আপাতকালের জন্য বিকল্প পরিকল্পনা তাঁরা দিতে পারেননি।

গোপন হলেও এখন একথা প্রায় সকলেই জানে ঢাকাস্থিত আমাদের ডেপুটি হাইকমিশন বারবার সরকারকে সমাধান করেছিলেন যে মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনায় আলেয়া ছাড়া কিছু নেয়, পাকিস্তান পূর্ব সীমান্তে সৈন্যসংখ্যা বাড়াচ্ছে এবং আজ হউক কাল হউক সে ঝাপিয়ে পড়বে। অন্যদিকে একথাও জানা ইসলামাদস্থিত আমাদের হাইকমিশন বরাবর অনেক আশার কথা বলেছেন। দু’জনেই সমান যোগ্য প্রতিনিধি, তাঁদের ওপর দোষারোপ করে লাভ নেই। যখন দুটি সম্ভাবনাই ছিল, রাজনৈতিক নেতৃত্বের কর্তব্য ছিল, যে কোন একটি সম্ভাবনার জন্যই প্রস্তুত থাকা। আমাদের সুদক্ষ প্রধান সেনাপতিকে যদি অত্যন্ত খারাপ সম্ভাবনার জন্য প্রস্তুত থাকতেই পরামর্শ দেওয়া হত, তাহলে আমি নিশ্চিত জানতাম আমাদের সৈন্যবাহিনীকে দোষ দেবার কোন কারণই থাকত না।

কোন কোন মহলে অনেক করে বলা হয়েছে যে, তেমন কিছু করতে গেলে বাংলাদেশ ব্যাপারটা পাক- ভারত যুদ্ধে গিয়ে দাঁড়াত। আজ হউক কাল হউক সে ঝুঁকি নিতেই হবে, কেননা আর কোন বিকল্প নেই। কিন্তু এপ্রিলের সেই গোড়ার দিকে অবস্থা খুবই অনুকূল ছিল এবং বিশ্বের লোক জেগে উঠবার ও চলতি ধরনে শোরগোল তুলবার আগেই প্রশ্নটির মীমাংস হতে পারত। এই অনৈতিক দোষদর্শী ও হৃদয়হীন পৃথিবীতে কাজ করে ফেললে তবে লোক তা হিসাবের মধ্যে আনে। আমি এইকথা বলছি না ভারতের উচিত ছিল বাংলাদেশ দখল করে নেওয়া- কিন্তু তাঁদের সাহায্যে আমাদের ছুটে যাওয়া উচিত ছিল, মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মিলে দশ- পনের দিনের মধ্যে কাজ শেষ করা উচিত ছিল। তারপর আমরা বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরও করতে এবং বাংলাদেশ থেকে সরে আসতে পারতাম যদি না বাংলাদেশ সরকার চাইতেন কোন না কোন ধরনের আমাদের সামরিক সাহায্য বাংলাদেশ আরও কিছুদিন থাকুক, আমাদের আধুনিক সমরাস্ত্র এবং অফিসারগন বাংলাদেশের নিজেস্ব বাহিনী গঠনে কিছুদিন সাহায্য করুক।

মাত্র এই একটি সুযোগই হাতছাড়া হয়নি। কিন্তু সেসব কথা বলতে গেলে তা ক্লান্তিকর হবে। কাজের কথা হলঃ যথেষ্ঠ বিলম্ব ঘটে গেলেও এখন পুরোপুরি সাহস করে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া উচিত এবং তাঁদের স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে সর্বতোভাবে সাহায্য করা উচিত। তাতে হয়ত পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ লেগে যেতে পারে, কিন্তু তেমন পরিস্থিতির জন্য যে কোন অস্থাতেই আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। শ্রীমতি গান্ধী বারবার জোর দিয়ে বলেছেন বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দিয়েও স্বাধীনতা সংগ্রামে সম্ভবত সমস্ত সাহায্য দেওয়া যেতে পারে। এ কথা শুধু এ দেশের লোকের চোখে ধুলো দেওয়া হচ্ছে। কোন সন্দেহ নেই আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রচ্ছন্নভাবে কিছু সাহায্য দিচ্ছি। তা আমরা যতই অস্বীকার করি, গত কয়েক মাসে ধরেই পৃথিবীর সংবাদপত্র তা নিয়ে লিখেছে এবং পৃথিবীর কোন বৈদেশিক দূতাবাসের কাছেই তা গোপন নয়।

আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা আরও ক্ষুন্ন করা ছাড়া এ ধরনের নিরর্থক দোমুখো কাজে কী ফল হচ্ছে? কোন কোন দেশ যদি অভিযোগ করে যে আমরা গোপন সাহায্যের দ্বারা বাংলাদেশে সংঘাত জিইয়ে রাখছি তাহলে সত্যি কি আমরা তাঁদের দোষ দিতে পারি? অতএব এখন আর বীরত্বব্যঞ্জক উক্তি নয় বীরত্বপূর্ন কাজের প্রয়োজন। আমি আগেই বলেছি বাংলাদেশ প্রশ্নের রাজনৈতিক সমাধান শুধু ভারতের হাতেই আছে। ভারত যদি এগিয়ে যায়, নিশ্চিতরূপে অন্যারাও তা অনুসরণ করবে। ভারত এত বন্ধুহীন নয়। অন্যদের সাহায্যে যদি ভারতের প্রয়োজন, ভারতের সাহায্যও অন্যদের কম প্রয়োজন নয়।

শুরুতে ভারতীয় সংসদ পরিষ্কার ভাষায় ও একমত হয়ে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে যে প্রস্তাব নিয়েছিলেন তাতে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সমগ্র জাতি এই প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু তারপর থেকে তাঁর দ্বিধাগ্রস্থতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে অক্ষমতা একই সময়ে গরম ও নরম উক্তি জাতির মানসিকতা বিভক্ত ও হীনবল করে দিয়েছে। দূর্ভাগ্যের কথা, এত বড় সংকটে- যখন জাতীয় ঐক্য অত্যন্ত জরুরী প্রয়োজন- তখনও তিনি তাঁর ভাগ করার রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছেন, কয়েকটি পার্টির বিরুদ্ধে এই অশোভন অভিযোগ করেছেন যে, তাঁর শুধু দলের স্বার্থ নয় সাম্প্রদায়িক স্বার্থেও বর্তমান অবস্থানকে কাজে লাগাচ্ছে। কিন্তু কোন পার্টি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ জাগাবার উদ্দেশ্যে বর্তমান পরিস্থিতিকে কাজে লাগাচ্ছে একথা অসত্য।

প্রধানমন্ত্রীর একজন শুভাকাঙ্ক্ষীরূপে আমাদের ইতিহাসের এই সংকট মূহুর্তে তাঁকে আমার বিনম্র পরামর্শঃ তিনি দলীয় রাজনৈতির ঊর্ধ্বে উঠুন, তার নেতৃত্বে সারাদেশ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করুন, জনগনকে পরিষ্কারভাবে পথ দেখান এবং তাদের খোলাখুলি বলুন জাতিকে টিকিয়ে রাখতে হলে ত্যাগ ও দুঃখবরণ করতে হবে। তা যদি তিনি করেন এবং এই জরুরি মুহূর্তে উপযুক্ত কর্মে প্রবৃত্ত হন তাহলে তাঁর যে ব্যক্তিগত আকর্ষণ আছে, যোগ্যতা আছে, তা দিয়ে জনগণের মহত্তম শক্তিকে তাঁর পশ্চাতে দূর্ভেদ্য ব্যূহের মত সত্য করতে সমর্থ হবেন।

প্রধানমন্ত্রীর প্রতি গভীর প্রীতিবশতই আমি বলছি তিনি আমার এই কথাগুলো গুরুত্ব দিয়ে শুনুন। আমি যে সমালোচনা করেছি তা তাকে সাহায্য করার জন্য, হেয় করার জন্য নয়। যে রাজনৈতিক আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়েছে তাতে কারুর সততাই প্রশ্নাতীত নয়। কিন্তু আমার কোন রাজনীতি নেই, যা কিছু আমি বলেছি অন্তরের অন্তরস্থল থেকে সরাসরি বলেছি, আমার সাধ্যমত সততা ও দেশপ্রেম অন্তরে রেখেই আমি কথাগুলো বলেছি।

(মূল ইংরেজি। অনুবাদ- মনকুমার সেন। )

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৯১।কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির রিপোর্ট (১৯৭১ সনের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত) পুস্তিকা ডিসেম্বর ১৯৭১

মোহিব নীরব <১৯১-১৯৬>
Raisa Sabila <১৯৭ – ৫২৬>
<১২, ১৯১, ৫০১-৫২৬>

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি

প্রেসিডেন্ট
প্রফেসর এস এন সেন

ভাইস-চ্যান্সেলর , কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
ওয়ার্কিং প্রেসিডেন্ট
প্রফেসর পি কে বোস

প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (একাডেমিক)
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

কোষাধ্যক্ষ
প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (ফিন্যান্স)
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

সেক্রেটারি
প্রফেসর ডি কে চক্রবর্তী

জয়েন্ট সেক্রেটারি
প্রফেসর ইলা মিত্র
প্রফেসর এস এন ভট্যাচার্য
প্রফেসর এস কে মিত্র
প্রফেসর এস গুপ্ত

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
সিনেট হাউজ, কলিকাতা
পশিমবঙ্গ, ভারত
১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতিঃ একটি আবেদন

আমরা আশা করছি আপনি অবগত আছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র, বিশ্ববিদ্যালয় এবং সংশ্লিষ্ট কলেজের অন্যান্য ব্যক্তিদের নিয়ে ১৯৭১ সালের এপ্রিলের শুরুর দিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি গঠিত হয়, যা ইতিমধ্যে দেশপ্রেমীক বাংলাদেশীদের সমর্থনে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সত্য ঘটনা নিয়ে বেশ কিছু পুস্তিকা ও ভাঁজপত্র প্রকাশ এবং বিশ্বব্যাপী প্রচার করেছে। যে সকল প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশী শিক্ষকদের সাহায্য করতে আগ্রহী তাদের জন্য সমিতি কয়েক হাজার বাংলাদেশী শিক্ষকের বায়োডাটা সংগ্রহ করে দিয়েছে। এছাড়া শরণার্থী বাংলদেশী শিক্ষকদের অস্তিত্ব রক্ষায় এখনই আর্থিক সাহায্য প্রয়োজন।

আমরা ইতিমধ্যে বাংলাদেশের বাস্তুহারা শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবীদের মাঝে একলাখের বেশি রুপী এবং মুক্তিবাহিনীর তরুণদের এক লাখের বেশি মূল্যের অন্যান্য সহায়তা প্রদান করেছি। আমরা ভারতে আশ্রয় নেয়া বাংলাদেশীদের মাঝে আমাদের কাছে আসা অন্যান্য সাহায্যসহ ৮০ হাজার রূপীর বেশি মূল্যের ওষুধ বিতরণ করেছি।

আমরা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছি তৎকালীন বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডঃ পিবি গজেন্দ্রগাদকর এবং অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অতিন মজুমদার এবং অন্যান্যদের যাঁদের মাধ্যমে বিশাল আর্থিক সাহায্য আমরা গ্রহণ করেছি।

আপনি কি মনে করেন, ভারত সরকার কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের মত সাহায্যের আর প্রয়োজন নেই? আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, আশা করা হয়েছিল অনেক আগেই শরণার্থীরা বিশেষ করে বাস্তুহারা শিক্ষকগণের নিজ দেশে ফিরে স্বাভাবিক কাজ খুঁজে পাবে। যুদ্ধে অনেকেই তাদের বসতবাড়ি, আত্মীয় স্বজনদের হারিয়েছেন, অনেকের স্কুল-কলেজের ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমি এই আবেদন সকলের কাছে পৌঁছে দিতে চাই যেন তাঁরা আর্থিক সাহায্য বা যে কোন ভাবে অবদান রাখেন। শতবছর বয়সী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্ররা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে আছেন। আমি নিশ্চিত যে, দুর্দশাগ্রস্ত মানবতার সাহাযার্থে মানুষ এগিয়ে আসবে।

ভারত সরকার দান বাড়ানোর জন্য দাতাদের আয়কর প্রদান থেকে অব্যহতি দেয়ার সদয় সম্মতি প্রদান করেছেন।

সমিতির কেন্দ্রীয় কার্যালয় দাঁড়ভাঙা ভবন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা-১২, ভারতে অবস্থিত।

এস এন সেন,
উপাচার্য,
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
এবং
প্রেসিডেন্ট
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি

“*কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির নামে চেক ইস্যু করার জন্য সাহায্যদাতাদের অনুরোধ করা হচ্ছে”।

এপ্রিল, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র, কর্মকার্তা-কর্মচারী, সংশ্লিষ্ট কলেজের শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কমিটির সদস্যদের নিয়ে এক সভায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি গঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সতেন্দ্রনাথ সেন সমিতির প্রেসিডেন্ট, অধ্যাপক পিকে বসু, উপ উপাচার্য (শিক্ষা কার্যক্রম) সমিতির কার্যকরি প্রেসিডেন্ট, শ্রী হিরেন্দ্রমোহন মজুমদার, উপ উপচার্য (অর্থ এবং বাণিজ্য) সমিতির ট্রেজারার হিসেবে নিযুক্ত হন।

প্রাথমিকভাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক দানকৃত ৫ হাজার রুপী সমিতির তহবিল গঠন করে এবং সমিতি তখন থেকেই কাজ করা শুরু করে।

সূচনালগ্ন থেকেই সমিতি যুদ্ধের শরণার্থীদের উল্লেখযোগ্য সহায়তা দিয়ে আসছে। খাবারের প্যাকেট ছাড়াও, প্রয়োজনীয় ওষুধ, প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জাম পাঠানো হয়েছে। ইতিমধ্যে আমাদের কয়েক হাজার রুপী এবং যথেষ্ট পরিমাণ পরিশ্রম করতে হয়েছে কারণ শরণার্থীদের ঢল নেমেছে যাদের সংখ্যা ইতিমধ্যে ৫০ লক্ষ অতিক্রম করেছে। শ্রমতি বিনা ভৌমিক(বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী) এবং তাঁর একটি ছোট দল, শ্রীমতি কমলা বোস, শ্রীমতি মৃন্ময়ী সেন এবং অন্যান্যরা আমাদের বেশ সহায়তা করেছেন। স্কুল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাও সদা তৎপর ছিল।

১৯৭১ এর ৫ এপ্রিল আমাদের প্রেসিডেন্ট অন্যান্যদের সাথে ভারতের প্রধানমন্ত্রী, ইউনেস্কোর ডিরেক্টর জেনারেলের কাছে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন। আমাদের প্রেসিডেন্ট তাঁর টেলিগ্রামে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। বাংলাদেশের উপর পাকিস্তান সেনবাহিনীর কাপুরুষোচিত আক্রমণ, ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম সহ সারা দেশে ধ্বংসযজ্ঞ এবং শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের গণহত্যা সম্পর্কে ইউনেস্কোর ডিরেক্টর জেনারেলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। ডিরেক্টর জেনারেল টেলিগ্রামের মাধ্যমে গণহত্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জাতির প্রতি তাঁর সহমর্মিতা জ্ঞাপন করেছেন। প্রধানমন্ত্রীও টেলিগ্রামের প্রাপ্তি স্বীকার করেছেন।

আমাদের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল যে সকল বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেছেন তাঁদের সাহায্য করা। আমরা তাঁদের কে আর্থিক সাহায্য দিয়ে যাচ্ছি এবং তাঁদের কে তালিকাভুক্ত করেছি। ডঃ অনিরুদ্ধ রায়, ইসলামি ইতিহাস এবং সংস্কৃতি বিভাগে স্নাতকোত্তর এবং তাঁর সহযোগী হিসেবে শ্রী অনিল সরকার বাণিজ্য বিভাগের স্নাতকোত্তর, শ্রী পীযূষ দাশ, শ্রী আংশুমান মল্লিক, শ্রী অনিল বসু এ বিভাগের দায়িত্বে আছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিণ্ডিকেট বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রনালয়, ভারতের সম্মতি অনুযায়ী বাংলাদেশের স্কলারদের অতিথি অধ্যাপক বা প্রভাষক হিসেবে সাময়িক নিয়োগ দেয়ার পরিকল্পনা করছে, যা সমগ্র ভারতে বিস্তৃত হতে পারে। রাজ্য সরকারের অনুমতি পাওয়া গেলে এই পরিকল্পনা স্কুল পর্যায়েও বাস্তবায়িত হতে পারে। আমরা ইতিমধ্যে বিভিন্ন রাজ্যসরকারের কাছে চিঠি দিয়ে যোগাযোগ করেছি।

আমরা আশা করছি এ সকল প্রচেষ্টা থেকে ইতিবাচক কোন ফল পাওয়া যাবে।

বর্তমান ভাঁজপত্র ছাড়াও আমরা শেখ মুজিবের ছয় দফা কেন্দ্রীক আরেকটি প্রকাশনাকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছি। শ্রী অজিত মোহন গুপ্ত(বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র), ভারত ফটোটাইপের কর্ণধার কর্তৃক এটি করা হয়েছিল। শ্রী স্বরাজ ভট্ট্রাচার্য, চিত্রগঙ্গাদার স্টাফ চিত্রগ্রাহক আমাদের বেশ কিছু মূল্যবান ফটোগ্রাফ দিয়ে সাহায্য করেন।

আমাদের প্রেসিডেন্ট সাধারণ মানুষের কাছে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের কাছে সমিতির তহবিলে মুক্তহস্তে দান করার জন্য আবেদন করেন(বাংলা এবং ইংরেজি উভয় ভাষায় প্রকাশিত)। তাঁর আবেদনের সাড়া অত্যন্ত উৎসাহজনক। আমাদের জাতীয় অধ্যাপক সতেন্দ্রনাথ বোস প্রথম ব্যক্তি হিসেবে দান করেন। এরপর স্বল্প সময়ে দানকারীদের মাঝে কৃষ্ণনগর মহিলা কলেজ, সরোজিনী নাইডু কলেজ, মহিলা কলেজ, কলকাতা লেডি ব্রাহোর্ন কলেজ, বেথুন কলেজ, ডাঃ বিসি রায় ইন্সটিটিউট অফ বেসিক মেডিসিনের শিক্ষক এবং কর্মচারী, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর বিভাগগুলোর ৬১ জন শিক্ষক, অর্থনীতি, পলিটিক্যাল সায়েন্স, ইসলামি ইতিহাস, আধুনিক ইতিহাস ও ইংরেজি বভাগের শিক্ষার্থীরা, জনাব এন এল টোদীর মাধ্যমে ভারত চ্যারিটি ট্রাস্ট, মেসার্স প্রেস এজেন্টস প্রাইভেট লিমিটেড, মেসার্স এলাইড এজেন্সি, পাস্তুর ল্যাবরেটরিসের কর্মীবৃন্দ, সিদ্ধেশ্বর হিসিয়ারি ফ্যাক্টরি, গোখালে মেমোরিয়াল গার্লস কলেজ, উমেশ চন্দ্র কলেজ, বাংলাদেশ এইড কমিটি বম্বে, শ্রী এইচপি লোহিয়া, এংলো ইন্ডিয়া জুট মিল (কর্মকর্তা ও কর্মচারী), শ্রি অজিত কুমার দত্ত-সাবেক এডভোকেট জেনারেল-পশ্চিম বঙ্গ সরকার, ফাদার পি ফ্যালোন, শ্রী অমিতেশ ব্যানার্জি, প্রিন্সিপাল নিরোদ কুমার ভট্ট্রাচার্য, প্রিন্সিপাল মমতা অধিকারী এবং বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ। বিনামূল্যের উপহারকৃত ওষুধ সংগ্রহ করেন শ্রী উৎপল চৌধুরী ও শ্রীমতি সোমা চ্যটার্জি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল বিভাগের শিক্ষার্থীরা সমিতির পক্ষ থেকে অর্থ সংগ্রহ করেন। আমরা আশা করছি দানকারদের সংখ্যা এবং দান অনেক বৃদ্ধি ভাবে আগামী দিনগুলোতে যেন আমরা এই সুবিশাল কর্মকাণ্ড সম্পাদন করতে পারি।

অধ্যাপক জুয়ানেস পত্রনবিস, যতীন চ্যটার্জি, দীপক হাজরা এবং পি সেন শর্মা সমিতি কার্যালয়ের সকল দায়িত্ব পালন করছেন। সমিতির কার্যালয়ে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে দাঁড়ভাংগা ভবনের দ্বিতীয় তলায় সকাল ১১টা থেকে বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত এবং ১৪, বিধান সরণির প্রথম তলায় সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৮টা।

আমাদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্যে অর্থ প্রয়োজন। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, কর্মচারী এবং শিক্ষকগণ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের তহবিলে নিয়মিত মাসিক অর্থ সাহায্য দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। আমরা সকলের প্রতি সাহায্য প্রদানের জন্য আবেদন জানাই। ট্রেজারার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির বরাবর চেক পাঠানো যেতে পারে।

মে ১৯৭১

কলকাতা বিশবিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি বাংলাদেশের সমর্থনে কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। আলোচ্য সময়ে সমিতির পরিচালিত কার্যক্রম সমূহঃ ১ মুক্তিফৌজকে বিভিন্ন বেসরকারি সরবরাহে সহায়তা, বিভিন্ন সময়ে একই উদ্দেশ্যে কার্যরত সমধর্মী সমিতির সাথে যৌথভাবে পরিচালিত, ২ বাংলাদেশি শিক্ষক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য কর্মচারীদের প্রতি সহায়তা, ৩ বাংলাদেশের সরকারি বিভিন্ন এজেন্সিকে তাঁদের কার্যক্রমে সমন্বয় সাধনে এবং তাঁরা যেভাবে যে মাধ্যমে সহযোগিতা চেয়েছেন সেভাবে সহায়তা করা। ১৯৭১ সালের ৯মে, রবীন্দ্রনাথের জন্ম বার্ষিকীতে সমিতির প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা “বাংলাদেশ-দ্যা ট্রুথ” সমিতির প্রেসিডেন্ট ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এস এন সেনের লিখিত মুখবন্ধে প্রকাশিত হয়। প্রকাশনাটি পৃথিবীর সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে, গণ্যমান্য সকল ব্যক্তি, সংসদ সদস্য, সংবাদপত্রের কাছে পাঠানো হয়েছিল। আমাদের জানা মতে এই প্রকাশনাটি বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মাঝে বাংলাদেশে চলমান ঘটনাবলীর ব্যাপারে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি করে।

সমসাময়িক আরো দুটি প্রকাশনার মাঝে অধ্যাপক আসাফ-উজ-জামান কর্তৃক “মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ” কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির মাধ্যমে প্রকাশিত হয় যেখানে রেডিয়েন্ট প্রসেসের শ্রী সুধীর চন্দ্র মুখোপাধ্যায় সহযোগিতা করেন। দি রেডিয়েটন্ট প্রসেস বিনামূল্যে কাজটি করে। শ্রী অজিত মোহন গুপ্ত কর্তৃক বাংলা ভাষায় অপর প্রকাশনাটিও সমিতির আংশিক আর্থিক সহায়তায় যেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঢাকায় দেয়া ঐতিহাসিক ভাষণ প্রকাশিত হয়।

বর্তমানে আরো দুটি প্রকাশনার কাজ চলমান, ১ দুই ভলিউমের একটি ছবির এ্যালবাম, একটি ভারত ফটোটাইপ স্টুডিও এবং অপরটি রেডিয়েন্ট প্রসেস কর্তৃক প্রকাশিত হবে। দুটি প্রকাশনাই ভারতে বাংলাদেশ মিশন, কলকাতার প্রধান জনাব এম হোসেন আলীর মুখবন্ধে প্রকাশিত হবে। ২ বাংলাদেশ সম্পর্কে মিঃ ডর্ফম্যান এবং আরো দুজন আমেরিকান স্কলার কর্তৃক প্রস্তুতকৃত কিছু দলিল পত্রের পুনঃমুদ্রণ।

“প্রাথমিক যুদ্ধবিদ্যা” নামক সামরিক প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত বাংলা পাঠ্য বইয়ের বেশ কিছু কপি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির মাধ্যমে বিভিন্ন বাংলাদেশী ট্রেনিং ক্যাম্পে পৌঁছে দেয়া হয়। অনেক দিন ধরে এধরনের একটি বইয়ের চাহিদা ছিল। প্রকাশক মেসার্স নয়া প্রকাশ এবং লেখক কর্তৃক বিনামূল্যে সমিতির কাছে বইগুলো দেয়া হয়।

আমাদের ছাত্রকর্মীরা কয়েকটি চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন করেছে। চিত্রকর্ম প্রদর্শনীর স্থান এবং তারিখ নিচে দেয়া হলোঃ

মে ৯ – সার্কাস এভিনিউ, আনুমানিক ২০০০ দর্শক
মে ২১, ২২, এবং ২৩ – নবীন চন্দ্র বড়াল এভিনিউ, আনুমানিক ৪০০০ দর্শক
মে ২৫, ২৬, এবং ২৭ – গোবরদাঙ্গা, আনুমানিক ৫০০০ দর্শক

মাসজুড়ে দলগুলোকে মুক্তিফৌজের বিভিন্ন ক্যাম্পে পাঠানো হয়। শ্রীমতি ইপ্সিতা এবং একদল কর্মী বেহরামপুরে(মুর্শিদাবাদ) অনেক ভালো কাজ করছেন। আমরা ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় গিয়েছি। অধ্যাপক পিকে বসু, আমাদের কার্যকরী প্রেসিডেন্ট এসকল ক্ষেত্রে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আমরা ত্রিপুরা রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীর সাথে দেখা করে আমাদের অভিজ্ঞতার কথা তাঁকে জানিয়েছি।

আমাদের প্রেসিডেন্ট, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সহায়তায় একটি পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে নয়াদিল্লীতে অবস্থান করছিলেন, এবং ভারত সরকার যেন অধিক সংখ্যক বাংলাদেশী শিক্ষককে ভিজিটিং ফেলো হিসেবে কাজে লাগায়। তাঁর উদ্যোগেই পশ্চিম বঙ্গের সকল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপচার্যদের সমন্বয়ে একটি উপাচার্য কমিটি গঠিত হয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার শ্রী অরুন রায় এই কমিটির সচিব হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। বাংলাদেশী শিক্ষকদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিরিক্ত ও সাময়িক ভিত্তিতে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে এ কমিটি কাজ করতে থাকে।

শরণার্থী ক্যাম্পে কলেজ এবং এর সাথে স্কুল সংযুক্তির একটি পরিকল্পনাও চূড়ান্ত করা হয়। আমাদের অন্যতম যুগ্ম সচিব অধ্যাপক সৌরিন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য এ ব্যাপারে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সাথে দিল্লীতে আলোচনা করেন। আমাদের প্রেসিডেন্ট আবারো দিল্লীতে এসকল পরিকল্পনা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন এবং ভারত সরকারের সাথে আলোচনা করতে যাবেন।

১৯৭১ সালের ২১ মে, আমাদের উদ্যোগে বাংলাদেশী শিক্ষকদের সভা অনুষ্ঠিত হয় যেখানে ডঃ এ আর মল্লিক, জনাব কামরুজ্জামান, ডঃ আনিসুজ্জামানকে যথাক্রমে প্রেসিডেন্ট, এক্সেকিউটিভ প্রেসিডেন্ট এবং জেনারেল সেক্রেটারি করে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি গঠিত হয়।

২১ মে ব্রিটিশ-ভারতীয় একটি যৌথ দল এ এলাকা ভ্রমণ করে। ৩১ মে মিস্টার উইলিয়াম বার্ন্স, এমপি(কে), মিস্টার ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ, সদস্য লন্ডন কাউন্টি কাউন্সিল, এবং চেয়ারম্যান, “ওয়্যার অন ওয়ান্ট” বাংলাদেশে অতি সংক্ষিপ্ত সফর শেষে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আমাদের প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করেন। একই দিনে তাঁরা কলকাতা প্রেসক্লাবে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। শ্রীমতি মৃন্ময়ী বোস কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়তা সমিতির পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানটির কিছু অংশ আয়োজন করেন।

এ মাসে আমরা অসংখ্য বন্ধু বান্ধব শুভানুধ্যায়ীর সহযোগিতা পেয়েছি। মাসের শুরু হয়েছিল পুরো মাসের বেতন সাহায্য হিসেবে দান করার মত প্রশংসনীয় প্রতিজ্ঞা করার মাধ্যমে, যা পরবর্তীতে অধ্যাপক ডঃ আসিমা চ্যাটার্জী(ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ) এর মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। এছাড়াও আমরা বিভিন্ন সংগঠন থেকে অনুদান গ্রহণ করেছি যথা বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সহায়ক সমিতি, বাংলাদেশ এইড কমিটি-বোম্বে, আগ্রা বিশ্ববিদ্যালয়, সুপারভাইজরি স্টাফ এ্যাসোসিয়েশন-সিডি, এগ্রা সারদা শশিভূষণ কলেজ, প্রেসিডেন্সি কলেজ, সেট সুরাজমাল জালান গার্লস কলেজ, বিদ্যাসাগর কলেজ ফর ওমেন, বিবেকানন্দ শতবার্ষিকী মহাবিদালয়, বাগনান কলেজ, যোগামায়া দেবী কলেজ, এর কে এন কলেজ অফ কমার্স-বেরহামপুর, জঙ্গীপুর কলেজ, কর্মচারী সমিতি, ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট স্টুডেন্টস অফ পিজি, পলিটিক্যাল সায়েন্স ডিপার্টমেন্ট, পিজি টিচার্স অফ জুলজি, সিওনারায়ান রামশ্বর ফতেপুরিয়া কলেজ, প্রফেসর তরুণ রায়, শ্রী এইচ পি লোহিয়া, পিজি স্টুডেন্টস অফ ডিপার্টমেন্ট অফ ইংলিশ এবং আরো অনেকে। শ্রী নিরোদ কুমার সেন মুক্তিফৌজ সদস্যদের জন্য পানির বোতল দান করেন এবং সেগুলো সংশ্লিষ্ট কোয়ার্টারে পৌঁছে দেয়া হয়। একই উদ্দেশ্যে মেসার্স দে মেডিকেল স্টোর এবং সিবা ওষুধ দান করে।

আমাদের সকল কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য অর্থ প্রয়োজন। আমরা আশা করছি, আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ পাওয়া যাবে।

জুন, ১৯৭১

জুন মাসে আমাদের প্রোগ্রামের অন্তর্ভুক্ত চার রকমের কার্যক্রম সম্পন্ন করতে গিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় কাটাতে হয়েছে, যে কার্যক্রমের মধ্যে ছিলঃ
১। মুক্তিবাহিনীর সহায়তা করা।
২। শিক্ষকদের সহায়তা করা।
৩। প্রকাশনা
৪। চিত্র প্রদর্শনী।

এই পর্যায়ে, আমরা মুক্তিফৌজের কর্মকর্তাদের বাড়তি সহায়তা প্রদান কার্যক্রম চালিয়ে গিয়েছি, যেমনঃ ঔষধপত্র, কৃষ্ণনগরের রেডক্রস সেণ্টারে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সহায়তা দেয়া এবং অন্যান্য রকম কার্যক্রম।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি থেকে শিক্ষকদের একটি দল, ডঃ এ মল্লিক, ভাইস চ্যান্সেলর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, এর নেতৃত্বে উত্তর প্রদেশ এবং দিল্লীতে অবস্থিত আমাদের কিছু বিশ্ববিদ্যালয় প্রদর্শন করেন। D: এ আর মলিক ছাড়াও এই দলে আরো ছিলেন ডঃ আনিসুজ্জামান, জনাব সুবিদ আলি, ডঃ অনিরুদ্ধ রয়, প্রফেসর সৌরিন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রী এবং অনিলকুমার সরকার প্রমুখ। বাংলাদেশ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর যৌথ একটি দল, বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি থেকে এলাহাবাদ, আলীগড়, দিল্লী, আগ্রা এবং লখনৌ প্রদর্শন করেন। এর সমস্ত খরচ সমিতি থেকে বহন করা হয়। দলটি যেখানেই গিয়েছে সেখানেই যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছে, এবং বাংলাদেশের শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের বর্তমান সমস্যাগুলো উপলব্ধি করার মত একটি অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।

আমাদের ভাইস চ্যান্সেলর, প্রফেসর, এস এন সেন, এবং সি ইউ বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের শিক্ষকদের ভারতীয় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি নিয়ে ইউজিসি ও ভারত সরকারের সাথে আলোচনা করার জন্য দিল্লী গমন করেন। যেহেতু শিক্ষামন্ত্রী দেশে ছিলেন না, তাই এখনও পর্যন্ত একাজে তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি এবং এ সমস্যা সমাধানও করা সম্ভব হয়নি। গত ১৭ জুন বঙ্গভবনে একটি প্রেস কনফারেন্সে প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের শিক্ষকদের অস্থায়ী নিয়োগ দেয়ার প্রয়োজনীয়তার উপর বিশেষ গুরুত্ব প্রয়োগ করেন, এছাড়াও আমাদের ক্যাম্প-স্কুল স্কিম এবং গবেষণা কার্যক্রমগুলো কিভাবে শিক্ষার্থীদের চারদেয়ালে আটক রেখে শিক্ষাপ্রদানের চিরাচরিত নিয়ম থেকে বের করে আনবে এবং শিক্ষকদের জন্য কিছু দারুন কর্মের সুযোগ সৃষ্টি করবে সে বিষয়ে কথা বলেন।

প্রফেসর, এস এন সেন, এবং সি ইউ বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির প্রেসিডেন্ট, উপস্থিত অন্যান্য অতিথি যেমন আলহাজ লুতফুল হক, শ্রী চিত্ত বসু, এবং শ্রী ডি এল সেনগুপ্ত, সকল এমপিদের সম্মুখেই দিল্লির এ প্রেস কনফারেন্সে ঘোষণা দেন যে আমাদের একজন শিক্ষক, এস। জে এর ইউরোপিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ শিক্ষা ডিপার্টমেন্ট প্রধান ফাদার পি ফ্যালনকে ভ্যাটিকানে শ্রদ্ধেয় পোপের সাথে দেখা করার জন্য প্রেরন করা যেতে পারে। ফাদার পি ফ্যালনের ভ্রমনসংক্রান্ত সকল খরচ কোলকাতার লর্ড বিশপ বহন করবেন।

রেডিয়েন্ট প্রসেসের কর্মকর্তা শ্রী এন বি মুখারজী ফাদার পি ফ্যালনকে তার যাত্রার পূর্বে একটি সংক্ষিপ্ত সংবর্ধনা প্রদান করেন। অল ইন্ডিয়া রেডিও এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে ফাদার ফ্যালন ইতিমধ্যেই পোপ মহোদয়ের সঙ্গে সাক্ষাত করেছে এবং ইয়াহিয়ার বাহিনী দ্বারা বাংলাদেশে যে গনহত্যা চালানো হয়েছে সে বিষয়ে তাকে অবহিত করেছেন।

মিঃ ভি এন থিয়াগারাজান, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি সার্ভিস, ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কমিটি এর নির্বাহী সচিবকে আমাদের কার্যালয়ে আহবান জানানো হয় এবং তিনি আমাদের বর্তমান প্রকাশনা ও ভবিশ্যতে প্রকাশিতব্য কার্যক্রমগুলোর দারুন প্রশংসা করেন। তিনি আমাদের ক্যাম্প স্কুল স্কিমের প্রতিও আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, এবং আমাদের সকল কাজে সহায়তা করার নিশ্চয়তা দিয়েছেন।

এম্ব্যাসেডর এঞ্জিয়ার বিডল ডিউক, মিঃ মরটন হ্যাম্বারগ (জেনারেল কাউন্সেল-আই আর সি), মিসেস লি থ (পরিচালক,আই আর সি), ডঃ ড্যানিয়েল এল ওয়াডনার (প্রফেসর অব সার্জারি, এলবারট সিন্সট কলেজ অব মেডিসিন, নিউ ইয়র্ক) এবং মিঃ থমাস ডব্লিউ ফিপ্স (একজন লেখক)এর সমন্বয়ে ইন্টারন্যাশনাল রেস্কিউ কমিটির একটি দল আমাদের অফিস পরিদরশনে আসেন এবং আমাদের বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পর্কে আলোচনা করেন এবং আমাদের ক্যাম্পস্কুল কার্যক্রম তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বেশ কয়েকবার আলোচনার পর তারা মৌখিকভাবে আমাদের প্রতিমাসে ১০,০০০ ডলার আর্থিক সাহায্য দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, এবং ইতিমধ্যেই আমাদের পরামর্শ অনুযায়ী তারা বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতিতে ১০০০ ডলার প্রদান করেছে। এর সাহায্যে, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিটি ইতিমধ্যে ৭টি ক্যাম্পস্কুল শুরু করেছে। আই আর সি এর সাথে আলোচনায় সমিতির প্রফেসর সৌরিন্দ্রনাথ, জুনিয়র সেক্রেটারি এবং প্রফেসর পি সেন শর্মা প্রতিনিধিত্ব করেন এবং এখনও কার্যক্রমসমুহ নিয়ে আলোচনা চলছে।

বিভিন্ন দেশের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আমাদের সাথে কাজ করছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইউনিভার্সিটি হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়ায় অবস্থিত দ্যা ইন্সটিটিউট সিলনিজ স্টাডিস, কলম্বো, ঢাকা ইউনিভার্সিটির মিত্র প্রতিষ্ঠানসমুহ, লন্ডনের এ সোসাইটি অব এমিনেন্ট স্কলারস এন্ড টিচারস অব ইউকে, দ্যা বাংলাদেশ স্টুডেন্ট একশন কাউন্সিল, লন্ডন ইত্যাদি। দ্যা স্টুডেন্ট, টিচার্স এন্ড স্টাফ অব মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ইতিমধ্যে আমাদের ১৩, ২৬৫ রুপি প্রদান করেছে, অনুদানের প্রথম কিস্তি হিসাবে। এক্ষেত্রে আমরা অবশ্যই উক্ত ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত প্রফেসর অতিন্দ্র মজুমদারকে ধন্যবাদ দেব, আমাদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য। উক্ত ইউনিভার্সিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং স্টুডেন্ট কাউন্সিলের ভাইস প্রেসিডেন্টও বাংলাদেশ বিষয়ে কাজ করার যথেষ্ট আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

কলম্বো এর দ্যা ইন্সটিটিউট সিলনিজ স্টাডিস থেকে শ্রীমতী নিমল পেরেরা আমাদের জানিয়েছেন যে তারা একটি কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন যার নাম ‘আউট টু দ্যা পিপল” এবং তারা বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বুদ্ধিস্ট সন্যাসীদের নিয়ে পূজনীয় মহানায়ক (দ্যা হাই প্রিস্ট) এর উপস্থিতিতে একটি সমাবেশ আয়োজন করতে পারেন বলে জানিয়েছেন।

প্রফেসর এসরা বেননাথান, ডিরেক্টর, ফ্রেন্ডস অব ঢাকা ইউনিভার্সিটি, ব্রিস্টল, আমাদের পাঠানো তথ্যাবলীর প্রশংসা করেছেন এবং তিনি বাংলাদেশের শিক্ষকদের পুনর্বাসনে আমাদের সহায়তা করবেন বলে জানিয়েছেন।

এসকল প্রতিষ্ঠান ছাড়া কিছু ব্যাক্তিগত উদ্যোগ যেমন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া এর মিঃ এ এইচ সাদউদ্দিন, ওটাগো ইউনিভার্সিটি, নিউজিল্যান্ড থেকে প্রফেসর প্রিয়তোষ মৈত্র এবং লন্ডন থেকে প্রফেসর নরেশ নন্দ প্রমুখ আমাদের সহায়তা করে যাচ্ছেন।

ভারতের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠান আমাদের সরবরাহকৃত বায়োডাটার ভিত্তিতে বাংলাদেশের শিক্ষকদের অস্থায়ী চাকুরির ব্যবস্থা করতে এগিয়ে এসেছেন। এক্ষেত্রে আমরা অবশ্যই সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানাই ওয়েস্ট বেঙ্গল কলেজ এন্ড ইউনিভার্সিটি টিচার’স এসোসিয়েশনকে। এবছর রবীন্দ্র বিষয়ক লেকচারের জন্য বাংলাদেশী কিছু শিক্ষককে আহবান জানানোর কথা ভাবছে ইউনিভার্সিটি অব কেরালা।

ওয়েস্ট বেঙ্গল কলেজ এন্ড ইউনিভার্সিটি টিচার’স এসোসিয়েশন আমাদেরকে একটি টাইপ রাইটারও ধার দিয়েছে, যার জন্য আমরা তাদের ধন্যবাদ জানাই।

মেসার্স রেডিয়েন্ট প্রসেসকে ধন্যবাদ জানানো প্রয়োজন, কেননা তারা “কনফ্লিক্ট ইন ইস্ট পাকিস্তান-ব্যাকগ্রাউন্ড এন্ড প্রস্পেক্টস” নামক প্রকাশনাটি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে মুদ্রন করেছে এবং প্রয়োজনীয় ও সম্পৃক্ত বিষয়সমুহ এতে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

শ্রী সুধির মুখারজী, একজন রোটারিয়ানকেও আমরা আমাদের কাজে সহায়তা করার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

শ্রী নিরোদ মুখারজী, প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ সংগ্রাম সহায়ক সমিতি, লেক গার্ডেন, আমাদের মুক্তিফৌজকে কম্বল ও পানিনিরোধক সরবরাহে সহায়তা করার জন্য, আমরা তার কাছে কৃতজ্ঞ।

সমিতি তিনজন ইমিসারিকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠিয়েছেন বাংলাদেশের সর্বশেষ ঘটনাবলী সম্পর্কে ইউরোপের সম্ভ্রান্ত শ্রেনীকে অবহিত করার লক্ষ্যে। এ লখ্যে আমরা প্রয়োজনীয় সকল দলিল ও ছবি সরবরাহ করেছি ও তাদের খরচ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় সম্পুরনভাবে সমিতি থেকে বহন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রথম গিয়েছেন, ফাদার পি ফ্যালন এস।জে, যার কথা ইতিমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে।

কলকাতা হাই কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারক, জাস্টিস মিঃ অরুন কে দাস লন্ডনে গমন করেছেন এবং তিনি ইউরোপের অন্যান্য শহরেও যাবেন। যদিও তিনি নিজেই তার সকল খরচ বহন করবেন, কিন্তু তিনিও একজন দুত হিসাবেই দায়িত্ব পালন করবেন।

মিসেস ইলা মিত্র, আমাদের একজন নির্বাহী সচিব, যিনি মস্কো গমন করেছেন এবং তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন এর আরো কেন্দ্রসমূহেও যাবেন।

জুন মাসের মধ্যে, সমিতি নিম্নোক্ত প্রকাশনাসমুহ সম্পন্ন করেছেঃ

১। কনফ্লিক্ট ইন ইস্ট পাকিস্তান-ব্যাকগ্রাউন্ড এন্ড প্রস্পেক্টসঃ প্রফেসর এডোয়ারড এস মেসন, রবার্ট ডরফম্যান এবং স্টিফেন এ ম্যাগ্লিন এটি লিখেছেন। অবশ্য, আমরা বাংলাদেশ প্রচারনা ও তথ্য অধিদপ্তরের সহায়তায় এটিকে বুকলেট আকারেও পুনর্মুদ্রণ করেছি। আমরা এই বুকলেটগুলো মুলত মিডল ইস্ট এবং আফ্রিকাতে বিতরন করেছি।

২। বাংলাদেশ- থ্রু লেন্সঃ প্রথম প্রকাশিত ছবির এ্যালবাম। এই বইটি এখনও প্রেসে আছে, এবং শীঘ্রই প্রকাশিত হবে।
৩। বাংলাদেশ- দ্যা হিরোস অব নিউ লাইফঃ ডঃ বি গাঙ্গুলি ও মিসেস মিরা গাঙ্গুলি সম্পাদিত এবং এর ভুমিকা লিখেছেন শ্রী চপলকান্ত ভট্টাচার্য।
৪। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাঃ প্রফেসর যতিন্দ্রনাথ চট্টোপধ্যায় সম্পাদিত, এবং এর ভুমিকা লিখেছেন শ্রী আনন্দ শঙ্কর রয়।
৫। দ্বিতীয় প্রকাশিত ছবির এ্যালবাম।

বাংলাদেশ এর শিক্ষকদের এই দলটি কোলকাতা ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর সাথেও সাক্ষাত করে তাদের সমস্যার কথা বলেন এবং এই দলে তাদের সাথে আরো যোগ দেন শান্তিনিকেতন আস্রমিক সঙ্ঘের শ্রীমতী ম্রিন্ময়ী বোস। কোলকাতা ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন চ্যান্সেলর, শ্রীমতী পদ্মজা নাইডু এর সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেবার জন্য আমরা ধন্যবাদ জানাই ন্যাশনাল কোঅরডিনেশন কমিটি ফর বাংলাদেশ এর কনভেনার, প্রফেসর সমর গুহ, এমপিকে।তিনি আমাদেরকে শিশুখাদ্য ও ঔষধ সরবরাহে সাহায্য করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

১৭ জুনে দিল্লীতে একটি প্রেস কনফারেন্সের আয়োজন করা হয়েছে যার কথা ইতিমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। দিল্লীতে স্বল্পসময় থাকা হলেও ইউজিসি এবং অনেক সরকারি কর্মকর্তাগণের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। যোধপুর পার্ক গার্লস স্কুলের শ্রীমতী ম্রিন্ময়ী বোশ সহ দুইজনের একটি দল বোম্বে গমন করেন এবং সেখানে সকল শ্রেনির মানুষের সাথে সাক্ষাত করেন।
নবাব আলী জাভের জং, মহারাষ্ট্রের গভর্নর এবং প্যাট্রন, বাংলাদেশ এইড কমিটি এর সাথে ২৯ তারিখ যোগাযোগ করা হয়, এবং তিনি আমাদের ক্যাম্প স্কুল স্কিম বাস্তবায়নে সম্পূর্ণ সহায়তা করবেন বলে আশ্বস্ত করেন। মিঃ হরিশ মহিন্দ্র, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ এইড কমিটী, উক্ত মিটিঙটি বোম্বের রাজ ভবনে আয়োজন করেন।

শ্রী সলিল চৌধুরী, এস এম সবিতা চৌধুরী এবং শ্রী মান্না দে তাদের এ্যালবাম, ‘বাংলা আমার বাংলা” সকল রয়ালিটি দান করেছেন।

বোম্বে ফার্টিলাইজার কর্পোরেশন এর সকল অফিসার ও কর্মীরা আমাদের একটি ভাল অংকের ডোনেশন দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

শ্রী হৃষীকেশ মুখারজী এবং শ্রী হিতেন চৌধুরী তাদের নিয়মিত সাহায্যের প্রবাহ চালিয়ে যাবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন।

শ্রী সি এল ঘিওয়ালা, সেক্রেটারি, ঈন্দিয়ান মারচ্যান্টস চেম্বার, বোম্বে, আমাদের বিভিন্ন মানুষজনের সাথে যোগাযোগ করতে সাহায্য করছেন এবং আমাদের কমিটিতেও সাহায্য করবেন বলে জানিয়েছেন।

বোম্বেতে এত মানুষের সাথে এক্সযোগাযোগ করা সম্ভব হয়েছে, প্রয়াত বিমল রয় এর স্ত্রী শ্রীমতি মনোবিনা রয়, ডঃ অশোক মজুমদার এবং বোম্বে হাই কোর্টের এডভোকেট শ্রী গিরিশ মুন্সী এর সাহায্যে। মিঃ বংশিভাই মেহরা ও তার স্ত্রী শ্রীমতি সুশিলা মেহতা আমাদেরকে বোম্বে থাকাকালীন সময়ে সব ধরনের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। মিঃ আর সি জাভেরি ও সব ধরনের সাহায্য করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

বোম্বে ইউনিভার্সিটি এর জাস্টিস গজেন্দ্রগরকার, ভাইস চ্যান্সেলর, বোম্বে ইউনিভার্সিটি, আমাদের একটি কমিটি করবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যার মাধ্যমে তারা ফাণ্ড সংগ্রহ করবেন এবং কোলকাতা ইউনিভার্সিটিতে আমাদের শিক্ষক সহায়ক সমিতির সকল কার্যক্রম চালাতে সাহায্য করবেন। প্রফেসর দন্তওয়ালা, প্রফেসর মিস আলো দস্তুর, ডঃ ঊষা মেহতা এবং বোম্বে ইউনিভার্সিটির আরো অনেকজঙ্কে আমরা মনের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ জানাই, বোম্বেতে অবস্থাঙ্কালীন সময়ে নানা ধরনের প্রোগ্রাম আয়োজন করার জন্য।
আমাদের পিকচার এ্যালবামে কিছু দারুন ছবি দিয়ে সাহায্য করার জন্য আমরা ধন্যবাদ জানাই, বোম্বের ফিল্ম ডিভিশনকে। ফিল্ম ডিভিশনের শ্রী অরুন চৌধুরী এবং শ্রী পি পতি এই ছবিগুলো পেতে সাহায্য করেছেন। শান্তিনিকেতন আশ্রমিক সঙ্ঘের শ্রী ডাব্লিউ এম ভান্ডারি তাদের অক্টবর মাসের ৪ দিনের চ্যারিটি ফাংশনের পুরোটা জুড়ে এই প্রকাশনাগুলো বিক্রির জন্য প্রচারনা চালাবেন বলে জানিয়েছেন। এজন্য আমরা আরো কৃতজ্ঞতা জানাই, কোলকাতার শ্রী কাশ মেন সেন কে, যিনি শ্রী ভান্ডারির সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষার জন্য আমাদেরকে একটি রোভিং টিম সরবরাহ করেছেন। AIFUCTO এর ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রফেসর কে এম দেওধরের কথাও না বলে পারছিনা,একি সাথে শ্রী প্রবির সান্ডেল, শ্রী বসন্ত ব্যানারজি, মিসেস বীনা ব্যানারজি, শ্রীমতী চিত্র বড়ুয়া, মিঃ মিনু মাসানি এবং আরো অনেকে যারা অসাধারন অবদান রেখেছেন এবং ভবিষ্যতেও রাখবেন।

ভারতীয় বিদ্যা ভবনের সেক্রেটারি, শ্রী এস রামকৃষ্ণন, আমাদের সমিতির সহায়তায় বোম্বেতে কিছু পারফর্মেন্স আয়োজন করবেন।

শ্রী শিক্ষায়তন, সিউনারাইন ও রমেশ্বর ফতেপুরিয়া কলেজ এর শিক্ষক প্রাক্তন ছাত্র ও বর্তমান ছাত্রদের একটি প্রতিষ্ঠান, দ্যা রেডিয়েন্ট প্রসেস, রাজা পেয়ারি মোহন কলেজের শিক্ষক মহোদয়গন, অমতা বালিকা বিদ্যালয়, উদ্বোধন ট্রাস্ট, সচিব টিসি মুঘেরিয়া গঙ্গাধর মহাবিদ্যালয় প্রভিতি আমাদের শ্রী সংঘ চলাকালীন সময়ে সাহায্য করেছেন।

আমাদের অর্থ সাহায্য প্রয়োজন এবং তার নিয়মিত প্রবাহেরও দরকার আছে। আমরা দেশের এবং দেশের বাইরের সকলকে আবেদন জানাই যেন তারা আমাদের সমিতির কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য নিশ্চিত করেন।

আমাদের ছাত্র সঙ্ঘের ফটোগ্রাফিক এক্সিবিশনের পোস্টারগুলো তৈরি করে সাহায্য করার জন্য আমরা শ্রী দেবব্রত মুখোপধ্যায় এবং এসএম সিপ্রা আদিত্যকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।

সমিতির জন্য শ্রী মানস হালদার, শ্রী অনিল বসু, শ্রী অংশুমান মল্লিক এবং আরো অনেকে বাংলাদেশ থেকে আমাদের সমিতিতে যেভাবে সাহায্য করছেন, তার জন্য ধন্যবাদ না জানালেই নয়। একি সাথে কলকাতা ইউনিভার্সিটি এর সুপারভাইসর এবং অন্যান্য কর্মকর্তাদের কথাও উল্লেখযোগ্য।

আমাদের প্রকাশনাসমুহঃ

১। ছয় দফা দাবী
২। মুজিবরের ঐতিহাসিক ভাষন
৩। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ, Re. ১.00
৪। বাংলাদেশ, দ্যা ট্রুথ, Re. ১.00
৫। কনফ্লিক্ট ইন ইস্ট পাকিস্তান
৬। বাংলাদেশ থ্রু দ্যা লেন্স
৭। বাংলাদেশ, দ্যা হিরোস অব এ নিউ লাইফ
৮। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ
৯। পাকিস্তানিসম এন্ড বেঙ্গলি কালচার বাই উসমান জামাল, Rs. ৩.00
১০। ব্লিডিং বাংলাদেশ (এ পিকচার এ্যালবাম) Rs. ১0.00
পাওয়া যাচ্ছেঃ
* সি ইউ সেলস কাউন্টারস, কলেজ স্ট্রিট
* ফরোয়ারড পাব্লিকেশন্স, কলেজ মার্কেট

জুলাই ১৯৭১ঃ
জুলাই মাসে আমাদের কার্যক্রম মুলত ৪ টি বিভাগে বিভক্ত ছিলঃ
১) মুক্তি ফৌজকে সাহায্য করা
২) শিক্ষকদের সাহায্য করা
৩) প্রকাশনা
৪) ছবি প্রদর্শনী।
আমরা আমাদের করমকান্ডের মাধ্যমে শিক্ষকদের ক্যাম্পস্কুলে বিভিন্ন সরঞ্জামাদি সরবরাহ করতে পেরেছি। ক্যাম্পস্কুলগুলো ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির পরিচালনায় ও ইন্টারন্যাশনাল রেস্কিউ কমিটির আর্থিক সাহায্যে চালু হয়েছে।

এসময়ের মধ্যে আমরা তরুণদের ক্যাম্পগুলোতে সহায়তার কার্যক্রম যেমন ওউশধ, খাদ্যদ্রব্য সাহায্য, এবং আরো নানা উপকরন সরবরাহ চালিয়ে গিয়েছি। চিফ মিনিস্টারের কমিটি বিলুপ্ত হওায় একটি ফান্ড স্বল্পতার সৃষ্টি হয়েছে যা একটি শূন্যস্থানের সৃষ্টি করছে, এবং আমাদের জন্য তা পরিপূর্ণ করা খুবি কঠিন হয়ে দাড়িয়েছে।

আমাদের বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির প্রেসিডেন্ট, ভাইস চ্যান্সেলর, প্রফেসর এস এন সেন, দিল্লী গমন করেছিলেন, কিন্তু দুরভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশী শিক্ষকদের অস্থায়ী নিয়োগের বিষয়টি চুড়ান্ত হয়নি। বর্তমানে কমিটির সচিব দিল্লীতে অবস্থান করছেন যেন ইউজিসি এবং সরকারের সাথে আলোচনা করে এসকল স্কিম যা দিল্লীতে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে, তা দ্রুত বাস্তবায়িত হয়।

এম পি শ্রী ডি এল সেন গুপ্ত এর সাহায্য তিনি, জুলাই এর ২২ তারিখে প্রধানমন্ত্রী এবং একি সাথে ইউনিয়ন মন্ত্রীদ্বয় শ্রী চয়ন ও শ্রী সিদ্ধার্থ সংকর এর সাথেও দেখা করেছে্ন। প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশ থেকে যারা আসতে বাধ্য হয়েছে তাদের বিষয়ে অবগত করা হয়, বিশেষত শিক্ষকদের বিষয়ে। আমাদের কাজ দেখে প্রধানমন্ত্রী খুশি হয়েছে, বিশেষত আমাদের প্রকাশনার প্রশংসা করেছেন। তিনি আমাদের পশ্চিম বঙ্গ সম্পরকিত ইউনিয়ন মন্ত্রী শ্রী রয় এর সাথে দেখা করার পরামর্শ দেন। ইউনিয়ন মিনিস্টার আমাদের সচিবকে দিল্লীতে পরামর্শ দেন যেন তিনি কলকাতায় তার সাথে দেখা করেন এবং আমাদের সকল সমস্যাগুলো নিয়ে সেখানে বিস্তারিত আলোচনা করেন। আমাদের শত চেষ্টা স্বত্বেও তিনি আমাদের সময় দিতে পারেননি, শুধু মাত্র আমরা ২৯ তারিখে একটি লিখিত নোট তাকে রাইটারস বিল্ডিঙ্গে হস্তান্তরিত করতে পেরেছি। আমরা এই নোট এর কপি প্রধানমন্ত্রীকেও পাঠিয়েছি।

প্রকাশনাঃ
এসময়ের মধ্যে বেশকিছু বই প্রকাশিত হয়েছে এবং বিভিন্ন ওয়ার্ল্ড সেন্টারে তা প্রেরন করা হয়েছেঃ

১) বাংলাদেশ দ্যা হিরোস অফ এ নিউ লাইফ- ডঃ বঙ্গেন্দু গাঙ্গুলি ও ডঃ মিসেস মিরা গাঙ্গুলি সম্পাদিত।
২) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ- প্রফেসর যতিন্দ্র চট্টোপধ্যায় সম্পাদিত।
এই বইটি মুলত বাংলাদেশের শিক্ষকদের অভিজ্ঞতার একটি বিবরন, যারা ছিলেন ইয়াহিয়ার প্রথম টার্গেট।
এছারাও আমরা এখন পর্যন্ত কলকাতা ইউনিভার্সিটি এর পলিটিকাল সাইন্স ডিপার্টমেন্ট এর হেড ডঃ এস কে মুখারজি সম্পাদিত, বাংলাদেশ এন্ড ইন্টারন্যাশনাল ল” বইটির ৫০০ কপি হাতে পেয়েছি। বইটি পশ্চিম বঙ্গের পলিতিক্যাল সাইন্স এসোসিয়েশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে। আমরা আমাদের মেইলিং লিস্টে অন্তর্ভুক্ত প্রথিবীর বিভিন্ন সংস্থায় বইটি প্রেরন করেছি।

আমাদের দ্বিতীয় পিকচার এলবামটি শিঘ্রই প্রকাশিত হবে। আমাদের সম্পাদক বোর্ড আরো কিছু পাণ্ডুলিপি দেখছেন।

ক্যাম্প স্কুল প্রোগ্রামঃ

এই প্রোগ্রামটি যথেষ্ট সহায়তা পাচ্ছে। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে মোট ৩১টি স্কুল চালু হয়েছে (শুধু মাত্র পশ্চিম বঙ্গেই রয়েছে ৬০৪টি ক্যাম্প)। ক্যাম্পস্কুলগুলো বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির পরিচালনায় ও ইন্টারন্যাশনাল রেস্কিউ কমিটির আর্থিক সাহায্য এবং স্থানিয় লোকজন, ক্যাম্প পরিচালকদের সহায়তায় চলছে। আমরা মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির সহায়তার মাধ্যমে ইতিমধ্যে সেখানে স্লেট, বইখাতা ও অন্যান্য জিনিস্পত্র ছাত্রদের মধ্যে বিতরন করেছি। এক্ষেত্রে আমরা অবশ্যই শ্যামচরন স্ট্রিটের মেসার্স ভারত স্টেশনারিকে ধন্যবাদ জানাই, যারা বিনা লাভে সকল সরঞ্জাম আমাদের সরবরাহ করেছেন।

স্কুলের সকল শিক্ষারথিকে বিনামূল্যে বা বিনা লাভে বই সরবরাহ করবে বলে জানিয়েছে কোলকাতার দ্যা পাবলিশার্স এন্ড বুক সেলারস এসোসিয়েশন। তারা এমুহূর্তে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি এর পরিচালকদের সাথে এই বইগুলো কিভাবে বিতরন করা হবে তা নিয়ে আলোচনা করছেন। আমরা একি সাথে তাদের ধন্যবাদ জানাই একারনে যে তারা ক্যাম্প স্কুলের ডিরেক্টরেটের জন্য বিনামূল্যে তাদের হল ব্যবহার করতে দিয়েছে। মেসার্স নয়া প্রকাশ ও তাদের একটি অফিসে ক্যাম্প স্কুল ডিরেক্টরেটদের ব্যাবহার করতে দিচ্ছে, যাতে সকল আসবাব ও টেলিফোন সংযোগ মজুদ রয়েছে।

কলকাতার রাজ ভবনে, মহারাষ্ট্রের গভর্নর নবাব আলি জাভের জং এর সাথে সমিতির একটি দল সাক্ষাত করে যাতে উপস্থিত ছিলেন ডি কে চক্রবরতী, এস এন ভট্টাচার্য, জানেশ পত্রনবিশ ও প্রিয়দর্শন সেন শর্মা এবং হিজ এক্সেলেন্সি ক্যাম্প স্কুলের কাজে বেশ আগ্রহ দেখিয়েছেন। তার ইচ্ছে অনুযায়ী রেসিডেন্সিয়াল স্কুলের একটি স্কিমও প্রফেসর পি সেন শর্মা তৈরি করেছেন এবং সেটি তাকে প্রেরন করা হয়েছে। পি ডাব্লিউ ডি এর সহকারী ইঞ্জিনিয়ার শ্রী এ কে রয় আমাদেরকে স্কুল ও হোস্টেল বিল্ডিং এর ডিজাইনটি তৈরি করে দিয়েছেন। তিনি একি সাথে খরচের একটি আগাম হিসাবো নির্ধারণ করেছেন। সমিতি তার এই সাহায্যের জন্য তাকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছে।

আমরা একি সাথে সিএএসএর সাথেও যোগাযোগ করছি, যাদের পরিকল্পনার সাথে ক্যাম্প স্কুল প্রোগ্রামটির মিল রয়েছে। প্রফেসর অমিয় চৌধুরী তাদের আমন্ত্রনে দিল্লীতে বাংলাদেশের উপর একটি সেমিনারে যোগ দিয়েছেন।

বাংলাদেশ অবস্থা অনুসন্ধান কমিটিঃ
আমাদের সমিটি বাংলাদেশ অবস্থা অনুসন্ধান কমিটিকে সহায়তা করছে এবং আমরা তাদের কিছু কোসচেনেয়ার মুদ্রন করে দিয়েছি।

পুনার বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সহায়ক সমিতির আমন্ত্রনে আমরা চিত্র প্রদরশনীর সরঞ্জামসহ আমরা দুইজন ছাত্র প্রতিনিধিকে পুনায় পাঠিয়েছি- শ্রী মানস হালদার ও গৌতম ঘোষ । পুনার সমিতি আমাদের প্রদরশনীটি পছন্দ করেছে এবং তারা অনুরোধ করেছে যে এই প্রদর্শনীটি যেন আমরা বোম্বে ও মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানেও করি। আমরা প্রস্তাবগুলো বিবেচনায় রেখেছি।

বোম্বে ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর ডঃ পি বি গজেন্দ্রগরকার এর আমন্ত্রনে আমরা বাংলাদেশী শিক্ষক ও আমাদের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি দল বোম্বে ইউনিভার্সিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছি। সমিতি একিভাবে প্রসিদ্ধ সঙ্গীত শিল্পীদের একটি দল সিলনে পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছে এবং শ্রীমতী কনিকা বন্দ্যোপাধ্যায় এই দলটির নেতৃত্ব দেবেন বলে জানিয়েছেন।

শেখ মুজিবর রহমানের প্রহসনের বিচারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি যে র্যা লি করেছে তাতেও সমিটি অংশগ্রহন করে।

ত্রাণ কর্মকাণ্ডঃ

আমরা আন্ধ্রা ইউনিভার্সিটি ও সাধারন ব্রাক্ষ্ম সমাজ এর মহিলা সমিতি থেকে পোশাক ও অন্যান্য দ্রব্যাদি পেয়েছি যা আমরা সাধারন শরণার্থীদের মধ্যে বিতরন করেছি। সাধারন ব্রাক্ষ্ম সমাজ আমাদের আরো সাহায্য করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আমরা সাধারন ব্রাক্ষ্ম সমাজ এর রেক্টর অরুন কুমার সেনকে এজন্য ধন্যবাদ জানাই। ডঃ পিকে চ্যাটারজী-একাডেমিক কাউন্সিল মেম্বার ও সিনেট সদস্য, নিয়মিত আমাদের ঔষধ সরবরাহ করে সাহায্য করছেন। সিন্ডিকেট মেম্বার, ডঃ বিবেক সেঙ্গুপ্ত, ডঃ পিকে চ্যাটারজি ও ডঃ প্রবোধ রয় আমাদের জানিয়েছেন যে গুরুতর রোগীদের চিকিতসায় তারা সাহায্য করবেন। মিঃ কল্যান মুখারজি ও তার স্ত্রী মিসেস মুখারজি তাদের খরচে কিছু আহত মুক্তিযোদ্ধার চিকিতসার ভার নিয়েছেন। আমরা তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।

ফাদার পি ফ্যালন তার ইউরোপ ট্যুর থেকে ফিরে এসেছেন এবং আমাদেরকে একটি বিস্তারিত রিপোরট জমা দিয়েছেন। ১৯শে জুলাই তিনি ইউনিভার্সিটিতে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজনও করেন।/ জুলাই এর ২২ তারিখে তার রিপোর্টটি প্রধানমন্ত্রীর হাতে দেয়া হয়। রিপোর্ট এর কপি শ্রী শরন সিং এবং শ্রী সিদ্ধারথ শংকর রয় কেও দাওয়া হয়েছে। কোলকাতা হাই কোর্ট এর রিটায়ার্ড বিচারক, জাস্টিস একে দাস ও তার ইউরোপ ভ্রমন শেষে ফিরেছেন।

ইন্সটিটিউট অফ সিলনিস স্টাডিজঃ

ইন্সটিটিউট অফ সিলনিস স্টাদিজ বাংলাদেশের শিক্ষক এবং আমাদেরকে আমন্ত্রন জানিয়েছেন। আমাদের তরফ থেকে প্রফেসর পিকে বোস, একাডেমিক ভাইস চ্যান্সেলর এ দলের নেতৃত্ব দেবেন।

অতিথিগনঃ

জাপানিজ পারলামেন্টারি গ্রুপ ফর ওয়ার্ল্ড গভারন্মেন্ট এর জেনারেল সেক্রেটারি, ওয়ার্ল্ড এসোসিয়েশন অফ ওয়ার্ল্ড ফেডারালিস্টস এর চেয়ারম্যান এবং জাপানিজ পার্লামেন্ট এর এম পি, মিঃ কান ইচি নিশিমুরা, হনেফস, অস্ল থেকে ফেরার পথে কোলকাতায় আসেন। প্রফেসর সেন শর্মা তাকে দমদম এয়ারপোর্টে অভ্যর্থনা জানান এবং সমিতির প্রকাশনাগুলোর এক সেট ইংরেজি ভারসন তাকে উপহার দেন। আমাদের বইগুলো মিঃ নিশিমুরাকে বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে। ২৬শে জুলাই আমাদের তরফ থেকে প্রফেসর অমিয় চৌধুরী ও পি সেন শর্মা তাকে বিদায়ও জানান। আমাদের অফিসে জাপানের বাংলাদেশ সলিডারিটি ফ্রন্ট এর সেক্রেটারি জেনারেল মিঃ সেতসুরি সুরুশিমা, জাপা বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ এসোসিএশন এর একজন এক্সিকিউটিভ কমিটি মেম্বার মিঃ টি সুসুকি ও জাপানের একজন টিভি ক্যামেরাম্যান, মিঃ তেমিসুকাকে আমন্ত্রন জানানো হয়। তাদেরকে আমাদের প্রকাশনাগুলো উপহার দেয়া হয়, যা তারা জাপানি ভাষায় অনুবাদ করবেন এবং বাংলাদেশের জন্য প্রচারণাগুলোতে প্রচার করবেন। তারা আমাদের সমিতির সাথে আরো কাজ করবেন বলে জানিয়েছেন।

পুনার বাংলাদেশ মুক্তি-সংগ্রাম সহায়ক সমিতি এর সেক্রেটারি ও মহারাষ্ট্রের সংসদের একজন এমএলএ শ্রী শ্যামকান্ত ডি মুরকেও কুয়ালালামপুরে ইন্টারন্যাশনাল পারলামেন্টারি কনফারেন্সে গমনের পূর্বে আমরা বাংলাদেশ বিষয়ে তথ্যাবলী দিয়েছি।

ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি সারভিসঃ

ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি সারভিস এর মিঃ থাইয়াগরজন আমাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে যাচ্ছেন এবং আমরা আশা করছি যে আমাদের বিভিন্ন করমকান্ডে আমরা তাদের পাশে পাবো। অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এর প্রসিদ্ধ ইতিহাসবিদ প্রফেসর এ এল ব্যাশাম, আমাদের অফিসে এসেছিলেন। তিনি আমাদের কর্মকাণ্ডের প্রশংসা করেন এবং আমাদের জন্য ফান্ড সংরক্ষনের প্রতিশ্রুতি দেন।

মুক্তি বাহিনিঃ

এই মাসে আমরা নিম্নোক্ত দ্রব্যাদি মুক্তি বাহিনিকে পাঠিয়েছিঃ

১। ট্রাঞ্জিস্টার রেডিও।
২। কম্বল
৩। ঔষধ
৪। চিড়া।

আর্থিক সাহায্যঃ

আমরা এসময়ের মধ্যে মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির ছাত্র ও শিক্ষকদের কাছে থেকে আর্থিক সাহায্য পেয়েছি, যাদের মধ্যে ছিলেনঃ প্রফেসর অতিন্দ্র মজুমদার, নিউজিল্যান্ড এর ওএলিংটন থেকে ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটির ডঃ এ মজিদ খান, নিউজিল্যান্ডের ডুনেডীন এর অবস্থিত ওটাগো ইউনিভার্সিটির ইকোনমিকস বিভাগের প্রফেসর প্রিয়তোষ মৈত্র। অন্ধ্র ইউনিভার্সিটি এর ছাত্র ও শিক্ষকরাও সাহায্য করেছেন, আরো আছেন জওহরলাল নেহ্রু ইউনিভার্সিটি এর সাপোর্ট বাংলাদেশ কমিটি, ফারটিলাইজার করপোরেশন অব ইন্ডিয়া থেকে শ্রী স্বপন ভদ্র, শ্রী প্রবির সান্ডেল এর মাধ্যমে বোম্বের ইন্টার স্টেত কালচারাল ইন্টিগ্রেশন এর চেম্বুর টম্ব্রে, ইন্ডিয়ান প্লাস্টিক ফাউন্ডেশন থেকে মিঃ রুজ আন্সারি। এম/এস গুড কম্পানির শ্রী বারিন মিত্র, উলুবেড়িয়া কলেজ থেকে প্রফেসর অরুন দাসগুপ্ত, সি ইউ এর শিক্ষা ডিপার্টমেন্টের ও পালপাড়া ওয়াই এস কলেজের ছাত্র ও শিক্ষকগন, বগুলা (নদিয়া) শ্রীকৃষ্ণ কলেজের টিচার্স কাউন্সিল ও আর্থিক সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন।

সৃজনশীল শিল্পীদের সহায়তাঃ

শ্রীমতী মৃন্ময়ী বোসের অব্যাহত চেষ্টার ফলস্বরূপ, আমাদের সমিতির একজন প্রতিনিধি বাংলাদেশী কিছু সঙ্গিতশিল্পীসহ এয়ার কোলকাতা স্টেশনে অভিষিক্ত হয়েছেন। আমরা সেখানকার শ্রী বিমান ঘোষকেও এর জন্য ধন্যবাদ জানাই।

আমাদের দাতার জন্য আয়কর মওকুফঃ

আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই ভারত সরকারকে যারা আমাদের দাতার কর মওকুফ করে দিয়েছেন, যেন দাতার সংখ্যা বাড়ে।

আমাদের দুতঃ

শ্রী বংশিভাই মেহতা এবং শ্রীমতি সুশীলা মেহতা, এই দুইজনের দলটি এমুহূর্তে আমাদের আরো কিছু প্রতিনিধির সাথে ইউরোপে ভ্রমন করছেন।

আমরা আবারো সবাইকে আবেদন জানাতে চাই যে আমাদের কোলকাতা ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ সহায়ক সমিতিতে যে অর্থ সহায়তা আপনারা প্রেরন করছেন, তা যেন অব্যাহত থাকে, যেন আমরা আমাদের উদ্যোগগুলোকে বাস্তবায়িত করতে পারি এবং বাংলাদেশে গনহত্যার ফলে বিপদগ্রস্থ মানুষগুলোর পাশে দাড়াতে পারি ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করতে পারি।

অগাস্ট ১৯৭১ঃ

কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি ৪ভাবে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেঃ

(১) মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা (২) প্রকাশনা, (৩) শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের সহায়তা (৪) চিত্র প্রদর্শনী, এবং এছাড়াও আমরা এডভারটাইজিং কাউন্সিলের সাথে একটি নিউজ ব্যাঙ্ক স্থাপন করেছি, যাতে বড় বড় সংবাদদাতা সংস্থাগুলো সংযুক্ত আছে। এই প্রজেক্টটি বাংলাদেশী কিছু তরুন ছেলেমেয়েরা চালিয়ে যাচ্ছে।

বরাবরের মতই আমরা বিভিন্ন তরুণদের ক্যাম্পের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে যাচ্ছি এবং আমাদের ক্ষমতা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করে যাচ্ছি। এমাসে আমরা খুবি কম সংখ্যক মশারি, বুটজুতো ইত্যাদি বিতরন করেছি তাদের মধ্যে। তারা আমাদের কাছে আরো জিনিসপত্র চেয়ে পাঠিয়েছে এবং অন্যান্য কমিটি থেকে তা সংগ্রহ করার চেষ্টা আমরা করে যাচ্ছি।পসছিম বঙ্গ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এসোসিয়েশন এবং অন্যান্য গনকমিটিগুলোও একি লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। মিঃ কল্যান মুখারজি ও মিসেস বানি মুখারজির বদান্যতায় আমরা কিছু চিড়া ও চিনি পেয়েছি যা আমরা তাদের অনুপস্থিতিতেই তিনটি ক্যাম্পে বিতরন করেছি। আমরা দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে এ মাসে আমাদের কোন প্রকাশনা হয়নি, কিন্তু আমরা ইতিমধ্যে প্রকাশিত পুস্তকগুলি বিভিন্নস্থানে ডাকযোগে প্রেরন করে যাচ্ছি। আমরা আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে আমাদের দ্বিতীয় আলোকচিত্র এ্যালবামটি, যা সময়ের ধারানুযায়ী সন্নিবেশিত করা হয়েছে, তা ইতিমধ্যে মুদ্রনের জন্য প্রেসে দাওয়া হয়েছে এবং বোম্বের ভারতীয় বিদ্যাভবনের ডঃ অশোক মজুমদার লিখিত আরো একটি প্রকাশনা অতিশীঘ্রই প্রেসে দেয়া হবে।

ক্যাম্প স্কুল স্কিমঃ

এখন পর্যন্ত ৩১টি ক্যাম্পস্কুল চালু হয়েছে, যার মধ্যে ২১টি পশ্চিম বঙ্গে ও ১০টি আগরতলায়। এখানে বাংলাদেশের ৪০০ জনেরো বেশি শিক্ষক কাজ করছেন। গত মিটিং রিপোর্টেই বলা হয়েছিল যে মহারাষ্ট্রের গভর্নর নবাব আলী জাভের জং আমাদের ক্যাম্প স্কুল স্কিমে বেশ আগ্রহ দেখিয়েছেন। তিনি বোম্বে ফিরে গিয়েই টেলিগ্রাফের মাধ্যমে আমাদের স্কিমে কিছু পরিবর্তন আনার পরামর্শ দিয়েছেন। আমরা সে অনুযায়ী পরিবর্তন করে তার বিবেচনার জন্য পাঠিয়েছি। আমরা দ্রুতই কিছু ভাল ফলাফল আশা করছি এব্যাপারে।

শিক্ষকদের সহায়তা প্রদানঃ

শুরু থেকেই আমাদের সমিতির প্রেসিডেন্ট ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর এস এন সেন, বাংলাদেশের শিক্ষকদের অতিরিক্তভাবে অস্থায়ীকিছু পদে নিয়োগ দেবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। উনি ইউজিসি ও ইউনিয়ন এডুকেশন মিনিস্টারের সাথে এবিষয়ে আলাপ করে যাচ্ছেন মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে। একিসাথে একথা জুনে এবং জুলাই মাসের শেষদিকে প্রধান্মন্ত্রীকেও জানানো হয়েছে। বরতমাঙ্কালে শিক্ষকদের অবস্থা ক্রমশ আরো সঙ্গীন হচ্ছে সে বিষয়ে ইউনিয়ন মিনিস্টারকে অবহিত করা হচ্ছে। বাংলাদেশের শিক্ষকদের ভিজিটিং ফেলো হিসেবে নিয়োগের ব্যাপারে বেশ কিছু স্কিম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি প্রস্তুত করেছে এবং তা সরকারের কাছে জমাও দিয়েছে। দুরভাগ্যবশত এখনও এ বিষয়ে আশানুরুরপ কোন ফল পাওয়া যায়নি। আমাদের দেশের পলিসি প্রনয়ঙ্কারী ব্যাক্তিরা যদি সহায়ক সমিতির বাংলাদেশী শিক্ষকদের অস্থায়ী নিয়োগের এ প্রস্তাব অনুমোদন করতেন, সেটি খুবি দারুন একটি ফলাফল বয়ে আনতো।

যদিও আনন্দের সাথে বলা যায় যে, যোধপুর, মুজাফফরপুরে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অফ পাটিয়ালা, বোম্বের দ্যা ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি, কলকাতার দ্যা ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন অফ সাইন্স, কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউট ও যাদবপুর ইউনিভার্সিটি কিছু শিক্ষকদের নিয়োগ দিয়েছে। দিল্লী ইউনিভার্সিটি ও জওহরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।

এমতাবস্থায়, আমাদের শিক্ষকদের আর্থিক সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখতে হবে। এই বিষয়ে আমাদের অব্যাহত ফান্ড সহায়তা প্রয়োজন।

তথ্য ব্যাংকঃ

আমরা এডভারটাইজিং কাউসিলের সহায়তা ও দিকনির্দেশনায় একটি তথ্য ব্যাংক স্থাপন করেছি। হিন্দুস্তান থম্পসন এসসিয়েটস লিমিটেড এর শ্রী রাম রয় শীর্ষ সংবাদ মাধ্যমগুলোর মুখপাত্র হিসেবে এ প্রজেক্টটি দেখভাল করছেন। এর জন্য নেতাজি ভবন, কলকাতায় এর ওয়ারক সেন্টার স্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার সারভস করপস এর কাজে সারবিক সহায়তা এবং লোকবল দিচ্ছে।

আলোকচিত্র প্রদরশনীঃ

পুনার বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সমিতির আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে শ্রী মানস হালদার আমাদের চিত্র প্রদর্শনী সমেত মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেরাচ্ছেন। এটি দারুন প্রশংসিত হচ্ছে। আমাদের কাছে এস।পি কলেজ, পুনা ও অন্যান্য স্থান থেকে অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি এসেছে।

বিদেশী সংস্থার সাথে যোগাযোগঃ

আমরা বাংলাদেশ বিষয়ে কাজ করার লক্ষ্যে প্রায় ২০০ বিদেশী প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করেছি।

মেডিকেল যন্ত্রপাতি ও ঔষধঃ

আমরা বাংলাদেশ-গ্রিন ক্রস হতে অতি সম্প্রতি একটি বার্তা পেয়েছি, যাতে তারা আমাদের বলেছে একটি বড় ঔষধপত্র ও মেডিকেল যন্ত্রপাতির পারসেল খুব শিঘ্রই তারা পাঠাচ্ছে, এবং আমরা যেন সেগুলো গ্রহন করার জন্য তৈরি থাকি।

উলের পোশাকের আবেদনঃ শীত আসছে। ইতিমধ্যেই কিছু কিছু ক্যাম্পে ঠান্ডা অনুভুত হয়। আমরা সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বৃদ্ধ, শিশু ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য শীতের কাপড়ের সাহায্যের আবেদন চেয়ে পাঠিয়েছি। মেয়েদের স্কুল্গুলোতে বিশেষভাবে আবেদন করা হচ্ছে।

মিস মেরি স্যাটনঃ

বাংলাদেশের সকল রেজিস্টার্ড শিক্ষকদের একটি পুরনাঙ্গ তালিকা মিস ম্যারি স্যাটন এর কাছে পাঠানো হয়েছে। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশের জন্য যে ত্রান তহবিল তার তদারকিতে আছেন।

কেরালা পরিদরশনঃ

বাংলাদেশের রাজশাহি ইউনিভার্সিটির বাংলা ডিপার্টমেন্ট এর প্রধান, ডঃ মাজহারুল ইসলাম, এ মুহূর্তে কেরালায় সেখানকার একটি ইউনিভার্সিটির আমন্ত্রনে গিয়েছেন। তিনি সেখানে রবীন্দ্রনাথের উপর লেকচার দেবেন ও কিছু সম্মানীও পাবেন। তার সকল খরচ আমরা বহন করছি।

সমিতি রেজিস্ট্রেশন ও দাতাদের আয়কর মওকুফঃ

আমরা রেজিস্ট্রেশন অব সোসাইটিস এক্ট এর আওতায় এই সময়ের মধ্যে সমিতি রেজিস্ট্রেশন করিয়েছি এবং দাতাদের আয়কর মওকুফ এর মাধ্যমে সহায়তার অংক বৃদ্ধি করেছি।

রবীন্দ্র সদনে চ্যারিটি পারফরমেন্সঃ

গত ২৩ ও ২৪শে অগাস্টে দুইটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছে। ২৩ তারিখের শোটি উদ্বোধন করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর এস এন সেন ও প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর এবং বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির প্রেসিডেন্ট ডঃ আজিজুর রহমান মল্লিক। ২৪শে আগস্ট উদ্বোধন করেন আমাদের কার্যকরী প্রেসিডেন্ট এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর পিকে বসু এবং প্রধান অতিথি ছিলেন জনাব আমিরুল ইসলাম এমএনএ (বাংলাদেশ)। আমরা নবনালন্দা গ্রুপ ও শান্তিনিকেতন আশ্রমিক সংঘকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই যে তারা বিনা পারিশ্রমিকে দুইটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। আমরা রবীন্দ্রসদনের কর্তৃপক্ষ এর শ্রী সুকুমার দাস, শিমান বি চক্রবর্তী, ডঃ শুরবা লাহিরি ও প্রফেসর সোমেন বোসকে ধন্যবাদ জানাতে চাই প্রচারনা চালানো ও সহায়তার জন্য।

ভ্রমন কারযক্রমঃ

আমরা দুইটি ভ্রমন কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। এক্টিতে বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রন রক্ষা করতে বোম্বে যাওয়ার কার্যক্রম ও অপরটি সিলন বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রন রক্ষা করতে যাওয়ার সিলনে যাওয়ার কার্যক্রম।

দিল্লী সেমিনারঃ

বাংলাদেশের উপর নিউ দিল্লীতে যে সেমিনার হয়ে গেল তাতে সমিতির প্রতিনিধি হিসেবে ডঃ অমিয় চৌধুরী অংশ নিয়েছেন।

আর্থিক সহায়তাঃ

আমরা এই সময়ের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভারসিটী অফ মেলবোর্নের ছাত্রগন ও প্রফেসর এ। মজুমদারের নিকট থেকে, ফ্রান্স প্রবাসী মিস কোলেট দুটিলার নিকট থেকে (শ্রী কে এল মুখারজীর মাধ্যমে), ইমপ্লয়ী অব কোলকাতা ইউনিভারসিটি্, লন্ডন থেকে, অন্ধ্র ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর মহোদয় থেকে। কোলকাতা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হরিকিন্তর নন্দী ও পরিসংখ্যান বিভাগের অন্যান্য শিক্ষক, বেঙ্গলি সোশ্যাল এন্ড কালচারাল এসোসিয়েশন এর পক্ষে, ওয়েস্টারন-অস্ট্রেলিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি এর প্রফেসর প্রদিপ মিত্র, পাঞ্জাব উনিভারসিটি টিচার্স এসোসিয়েশন এর প্রেসিডেন্ট মিঃ কে এল জাওরা, ও কলকাতার এডুকেশন সোসাইট কলেজ এর টিসি ভাওয়ানিপোর এর কাছ হতে আর্থিক সাহায্য পেয়েছি।

সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর, ১৯৭১ঃ

গত দুই মাসেও কোলকাতা শিক্ষক সমিতি চারভাগে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে গিয়েছেঃ

১) মুক্তি ফৌজকে সাহায্য করা
২) শিক্ষকদের সাহায্য করা
৩) প্রকাশনা
৪) ছবি প্রদর্শনী।

এই সময়ে আমরা একি সাথে বর্ডারে অবস্থিত যুবক্যাম্পগুলোকে সহায়তা করেছি। বাস্তবে বাকি সকল পাবলিক কমিটিগুলোই বিলুপ্ত হচ্ছে এবং তাদের করমকান্ডের ভার আমাদের উপর ন্যাস্ত হচ্ছে। আমাদের উপর চাপ অনেক বেড়ে যাচ্ছে। আমরা কোলকাতার এক্স শেরিফ শ্রী এস সি রয় এর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে যাচ্ছি, মুলত তিনিই বাংলাদেশ এইড কমিটির মুল দায়িত্বগুলো পালন করেন। এই কমিটির সঙ্গঠক শ্রীমতী পদ্মজা নাইডু ও শ্রী এমসি চাগ্লা এর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল কোঅরডিনেশন কমিটি ফর বাংলাদেশ, এবং এর হেডকোয়ারটার নেতাজি ভবনে অবস্থিত।

সেপ্টেম্বরের ২ তারিখে আমরা পশ্চিম বঙ্গ বিষয়ক ইউনিয়ন মিনিস্টার শ্রী সিদ্ধারথ শংকর রয় এর সঙ্গে কোলকাতায় দেখা করি এবং একটি নোট প্রদান করি যা ইতিপূর্বে প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া হয়েছে। নোটে এখন পরযন্ত আমাদের সমিতির প্রেসিডেন্টের উদ্যোগে বাংলাদেশের শিক্ষকদের সহায়তায় যা যা করা হয়েছে তার একটি বিবরনী সম্বিলিত হয়েছে। এখন পর্যন্ত এবিষয়ে আমরা সরকার থেকে কোন জবাব পাইনি।

ক্যাম্প স্কুলঃ

এখন পর্যন্ত ক্যাম্প স্কুলের মোট সংখ্যা ১৫টি যার মধ্যে ১০টিই ত্রিপুরায়। এখন পর্যন্ত ৭১৪ জন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ও ইন্টারন্যাশনাল রেস্কিউ কমিটির আর্থিক সহায়তায় এ ক্যাম্প স্কুলগুলো চলছে। ফান্ড বাড়লে এই কারযক্রমকে আরো বর্ধিত করা যায়।

শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের সহায়তা প্রদানঃ

বোম্বে ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর এর দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহনের পূর্বে ডঃ পি বি গজেন্দ্রগ্ররকার আমাদেরকে বোম্বে ইউনিভার্সিটির টিচার ও ছাত্রদের কাছে থেকে সংগ্রহকৃত মোট ৬৭,০০০ রুপি প্রদান করেন। এখন পরযন্ট একটি মাত্র ইউনিভার্সিটি থেকে প্রাপ্ত এটিই ছিল সরবোচ্চ অংকের সাহায্য। এখন পর্যন্ত দ্বিতীয় অবস্থানে আছে অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি যারা কয়েকটি কিস্তিতে আমাদের প্রায় ৪১,০০০ রুপি প্রদান করেছেন। আমরা প্রফেসর টপ, বোম্বে ইউনিভার্সিটির বরতমান ভাইস চ্যান্সেলর এর সাথেও যোগাযোগ রক্ষা করে যাচ্ছি এবং আশা করি তিনি বাংল্লাদেশের শিক্ষকদের জন্য সাহায্য অব্যাহত রাখবেন।

শরণার্থী শিক্ষকদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের লক্ষে শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ন গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রদুত মিঃ এম হুসেনের মাধ্যমে আমাদের ২ লাখ রুপি প্রদান করেছেন। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির উদ্যোগে একটি অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে এবং অচিরেই এটি বাস্তবায়িত হবে

তথ্য ব্যাঙ্কঃ

তথ্য ব্যাঙ্ক এর কাজ ধিরেধীরে এবং সুষ্ঠভাবেই আগাচ্ছে। কোলকাতার ব্রিটিশ ইনফরমেশন সার্ভিস আমাদেরকে তিনটি পত্রিকার গত তিন মাসের প্রকাশিত প্রতিটি কপি দান করেছে। অন্যান্য বিদেশি জার্নাল ও ভিডিও ক্লিপের কপিও জমা হচ্ছে। এখন চাইলে স্কলারগন বা ইতিহাসবিদগণ এই ব্যাংককে রিসার্চের সময় কাজে লাগাতে পারবেন। এ বিষয়ে আমাদের অবশ্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনাব জামিল চৌধুরীকে ধন্যবাদ জানানো দরকার যার পরযবেক্ষন ও দিকনির্দেশনার মাধ্যমে বাংলাদেশের ১৪ জন ছাত্র সেখানে আমাদের জন্য কাজ করছে। বাংলাদেশ সরকারের প্রেস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্টকেও আমরা ধন্যবাদ জানাই তাদের সাহায্যের জন্য। আমরা বরাবরের মতই এ প্রজেক্টেও অর্থ বিনিয়োগ করছি। এবিষয়ে আমাদের সহায়তা করছে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি।

আলোকচিত্র প্রদরশনীঃ

পুজার ছুটিতে প্রদর্শনী হাওড়াতে, মুর্শিদাবাদ এবং পশ্চিম বাংলার অন্যান্য স্থানেও অনুষ্ঠিত হয়।

বিদেশী সংস্থার সাথে যোগাযোগঃ

বিভিন্ন সমমনা বিদেশী সংস্থাগুলোর সাথে আমাদের যোগাযোগ প্রতিদিন কেবল বাড়ছেই, এবং এখন এ যোগাযোগ রক্ষা করা দুরুহ হয়ে পরেছে কেননা যোগাযোগ বাড়ার সাথে সাথে ডাকখরচ ও বেড়ে গেছে।

প্রবাসে ভ্রমনঃ

অক্টোবর মাসে, আমাদের দুত হিসেবে শ্রী শিবনাথ ব্যানারজি আফগানিস্তান গমন করেন। তিনি ছিলেন ১৯২২ সালে স্থাপিত কাবুলের মক্তব-এ-হাবিবিয়ার প্রাক্তন শিক্ষক। সেখানে অবস্থানকালে তিনি খান আব্দুল গাফফার খান ও অন্যান্য আফগানি নেতাদের সাথেও দেখা করেন। শ্রী ব্যানারজি তাদেরকে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত করেন এবং একি সাথে শরণার্থী শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের বিপদাপন্ন অবস্থার কথাও ব্যক্ত করেন।

আমাদের আরেকজন দুত, শ্রী পুরনেন্দ নারায়ন রায়, এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশ ভ্রমন করাতে শ্রী রয় এর মাধ্যমে অনেকগুলো নতুন স্থানে যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হয়েছে। এমুহূর্তে ডঃ আলির নেতৃত্বে একটি নরওয়েজিয়ান টিম শ্রী রয় এর রেফারেন্সে কোলকাতায় অবস্থান করছে। তারা কম মুল্যে প্রোটিনজাত খাদ্য সরবরাহ করার জন্য ভারতে একটি উচ্চমাত্রার প্রোটিনজাত খাদ্য তৈরির ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। টীমটি ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ে গিয়েছে এবং আমরাও এবিষয়ে সরকারের সাথে যোগাযোগ করছি।

বিদেশী দরশনারথীঃ

ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অফ ওয়ার্ল্ড ফেডারালিস্ট এসোসিয়েশন এর চেয়ারম্যান প্রফেসর নুড নিলসন কোলকাতা আসলে তাকে আমাদের পক্ষ থেকে প্রফেসর পি সেন শর্মা অভ্যর্থনা জানান। তাকে কিছু শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রফেসর নিলসন আমাদের অফিসেও এসেছিলেন এবং এখানেই তিনি বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের সাথে তাদের সমস্যা নিয়ে কথা বলেন। জেনেভার ডাব্লিউএসসিএফ এর মিঃ জ্যাক ল্যাকশারকও আমাদের অফিস পরিদর্শন করেন এবং বাংলাদেশী শিক্ষকদের সাথে তাদের সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করেন। তাকেও আমাদের প্রকাশনাগুলো দেয়া হয় এবং তিনিও অন্যান্যদের মত আমাদের একাজের জন্য আমাদের প্রশংসা করেন। এছাড়াও, নিম্নে বর্ণিত সাংবাদিক মহোদয় আমাদের অফিসে এসেছেন এবং বাংলাদেশ বিষয়ক খবরাখবরগুলো যাচাই করতে আমাদের সাহায্য চেয়েছেন।

(১) এস এ নিলসন (স্টকহোম)
(২) এ এম স্কিপার (ডেনমার্ক)
(৩) ভি এস বি ব্যাকারট (ডেনমার্ক)
(৪) এম আই ওঝা (সুইডেন)

মেডিকেল ইউনিটঃ

মেডিকেল ইউনিটের দায়িত্ব শ্রীমতি ম্রিন্ময়ী বোসকে দেয়া হয়েছে। শ্রীমতি পদ্মজা নাইডু নির্দেশ দাওয়ার পর আমরা ঔষধ সরবরাহ পাবার নিয়মিত ঔষধ সরবরাহ পাচ্ছি। স্থানীয় রেড ক্রস কর্মীরাও আমাদের সর্বাত্মক সহায়তা করে যাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের কাছে যা মজুদ আছে, তাতে শীতের সময়ে টানাটানি পরতে পারে। সেকারনেই এই বিষয়ে আরো কিছু নতুন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

শীতের কাপড় প্রদান করার আবেদনঃ

আমরা শীতের কাপড়ের জন্য সেপ্টেম্বর মাসে সকলের সাহায্য আহবান করেছিলাম এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা সাড়াও পাচ্ছি, কিন্তু আমাদের কাছে যা মজুদ আছে, তা দিয়ে শীতের সময় যথেষ্ট যোগান দেয়া সম্ভব হবেনা। সেকারনেই এই বিষয়ে আরো কিছু নতুন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

প্রকাশনাঃ

আমরা নিম্নে বর্ণিত প্রকাশনাগুলো বাজারে বিক্রির জন্য প্রকাশ করেছিঃ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওসমান জামাল রচিত পাকিস্তানিসম এন্ড বেঙ্গলি কালচার বইটি বিনামূল্যে মুদ্রন করে দিয়েছেন গুড কম্পানির বারীন মিত্র।

বাংলাদেশের উপর জাতীয় সেমিনারঃ

আমরা ইউইভারসিটি গ্র্যান্টস কমিশনের আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশের উপর একটি জাতীয় সেমিনার এর আয়োজন করছি। ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বুদ্ধিজিবীগন এই সেমিনারে অংসগ্রহন করবেন। বাংলাদেশের কিছু প্রখ্যাত বুদ্ধিজিবীও এতে অংশ নিবেন বলে আমরা আশা করছি। এই সেমিনার সাব কমিটি এর কনভেনারের দায়িত্ব পালন করছেন প্রফেসর যতীন্দ্র নাথ চট্টোপাধ্যায়।

কলকাতা ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির বোম্বে ইউনিট গঠনঃ

আমরা ফান্ড সংগ্রহ এবং বোম্বের বন্ধুদের মাধ্যমে তা আমাদের কাছে পৌছে দেবার জন্য একটি বোম্বে ইউনিট গঠন করেছি। এই ইউনিটের কনভেনার ট্রেজারার হলেন শ্রী নাভিন টি খান্ডওয়ালা এবং অত্যন্ত মহানুভবতার সাথে এ ইউনিটের চিফ প্যাট্রনের দায়িত্ব নিয়েছে মহারাষ্ট্রের গভর্নর হিজ এক্সেলেন্সি নবাব আলি জাভের জং। এ মুহূর্তে বোম্বে ইউনিট ফান্ড সংগ্রহের জন্য কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। সম্মানিত মহারাষ্ট্রের গভর্নরসাহেব এই অনুষ্ঠানগুলোর উদ্বোধন করবেন।

আর্থিক সাহায্যঃ

এ সময়ের মধ্যে আমরা যাদের কাছ থেকে অর্থসহায়তা পেয়েছি তারা হলেন, পাঞ্জাব ইউনিভারসিটি টিচার্স এসোসিয়েশন এর প্রেসিডেন্ট প্রফেসর কে এল জাউরা, নর্থ বেঙ্গল ইউনিভারসিটি এর যুগ্ম সম্পাদক ও ট্রেজারার প্রফেসর এস কে বিষ্ণু, ওয়েস্ট বেঙ্গল গভর্নমেন্ট কলেজ টিচার্স এসোসিয়েশন এর কৃষ্ণনগর ইউনিট, মেসার্স গুড কম্পানি এর স্টাফসমুহ, লন্ডন থেকে শ্রী আর এন ভট্টাচার্য, অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অফ মেলবোর্ন থেকে প্রফেসর অতীন মজুমদার ও বোম্বে ইউনিভারিস্টির কথা পুরবেই বলা হয়েছে। এছাড়াও আমরা দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে কোলকাতা ইউনিভার্সিটি সুপারভাইসরি স্টাফস গত রিপোর্টকালীন সময়ে আমাদের অর্থসহায়তা করলেও তা গত রিপোর্টে উল্লেখিত হয়নি।

আমাদের এই স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রমগুলোকে এগিয়ে নিতে আমাদের আরো ফান্ড প্রয়োজন এবং আমরা বিষয়ে সকলের সাহায্য কামনা করি।

নভেম্বর ও ডিসেম্বর, ১৯৭১ঃ

সমিতি শেষ দুইমাসেও একিধারায় তার কার্যক্রম চালিয়ে গিয়েছেঃ

১) মুক্তি ফৌজকে সাহায্য করা
২) শিক্ষকদের সাহায্য করা
৩) প্রকাশনা
৪) তথ্য ব্যাঙ্ক ও
৫) ক্যাম্প স্কুল

মুক্তি ফৌজকে সাহায্য করাঃ

যেমনটি সবাই জানেনে যে মুক্তিবাহিনীর তরুন সদস্যদের মৃত্যু স্বাধীনতা আন্দোলনকে আরো জোরদার করে তুলেছিল, তেমনি তাদের বিভিন্ন জিনিসের প্রয়োজনিয়তাও বেড়ে গিয়েছিল। আমরা আমাদের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তাদেরকে কম্বল, শীতের কাপড়, ট্রানজিস্টার, বই এবং ঔষধ সরবরাহ করেছি। এগুলো মুলত পাঠানো হয় রাজশাহি, খুলনা, যশোর ও কুষ্টিয়ার নিকটবর্তী মুর্শিদাবাদ, নদীয়া ও ২৪-পরগনা অঞ্চলে। এছারাও আমরা বই সরবরাহ করেছি, গেরিলা অপারেশনে আহত যোদ্ধারা আমাদের মাধ্যমে কোলকাতার বিভিন্ন হাস্পাতালে চিকিৎসা পেয়েছে। ইন্সটিটিউট অব বেসিক মেডিসিন এর শিক্ষক এবং বোর্ড অব হেলথ এর সচিব ডঃ প্রবোধ রয় এবিষয়ে আমাদের সকল সাহায্য প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

শিক্ষক ও বুদ্ধীজীবিদের সহায়তাঃ

এ পরযায়েও আমরা শরণার্থী শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান অব্যাহত রেখেছি। আমরা ভারতে বাংলাদেশের হাই কমিশনার মিঃ এম হোসেন আলির মাধ্যমে শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ন এর নিকট থেকে ১,৯৯, ৯০০ রুপি সাহায্য পেয়েছি। চট্টগ্রাম বিসব্বিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ও বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির প্রেসিডেন্ট ডঃ এ আর মল্লিক এবং মুজিবনগরে কর্মরত পরিকল্পনা অধিদপ্তর এ অর্থ ব্যয় এর পরিকল্পনা করছে। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির নিরবিচ্ছিন্ন সহায়তায় শরণার্থী শিক্ষকদের মাঝে এ অর্থ বিতরন করা হচ্ছে। এর জন্য আমরা ধন্যবাদ জানাই বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সচিব ডঃ অজয়কুমার রয়, সহকারি সচিব জনাব আনোয়ারুজ্জামান ও একি সমিতির শ্রী নিত্যগোপাল সাহাকে।

প্রকাশনাঃ

আমরা এই সময়ের মধ্যে একটি চিত্র সম্বলিত বই প্রকাশ করেছি যাতে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত চলমান আন্দোলনগুলোর একটি ধারাবাহিক বিবরন রয়েছে, যার ফলসবরুপ আজ বাংলাদেশ সবাধীন একটি দেশে পরিনত হয়েছে। বইটির মুখবন্ধ লিখেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির প্রেসিডেন্ট প্রফেসর এস এন সেন ও সারসংক্ষেপ লিখেছেন জনাব এম হোসেন আলি। বইটির শিরোনাম রক্তাক্ত বাংলাদেশ। রেডিয়েন্ট প্রসেসের শ্রী এন বি মুখারজি বইটি প্রকাশনার সকল খরচ বহন করেছেন। এই বইটির সম্পাদনার দায়িত্বেও ছিলেন এস এম শিপ্রা অদিত্য এবং প্রসিদ্ধ শিল্পী বইটির প্রচ্ছদের জন্য এক্ট দারুন স্কেচ করেছেন। আমরা ‘মুক্তিযোদ্ধার প্রতি” শিরোনামে একটি ছোট পুস্তিকা প্রকাশ করেছি, যেখানে বিভিন্ন পরযায়ের নেতাদের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পাঠানো বারতাগুলো সংবলিত হয়েছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির প্রফেসর যতীন্দ্রনাথ চ্যাটারজি ও বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির প্রফেসর সুকুমার বিশ্বাস যৌথভাবে এই বইটির সম্পাদনা করেন।

যদিও আমরা এই দুইমাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ বা স্বাধীন এলাকাগুলো থেকে সংরক্ষিত ছবিগুলো নিয়ে কোন প্রদরশণী এখনও করতে পারিনি।

তথ্য ব্যাংকঃ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্স বিভাগের ডঃ এ মজুমদারের নজরদারিতে এই সময়ের মধ্যে তথ্যব্যাঙ্কের কাজ ভালভাবেই এগিয়েছে। কোলকাতার প্রথম সারির কিছু খবরমাধ্যম এ ব্যাঙ্কের সফলতা নিয়ে নিউজ করেছে। শ্রী দুরগাদাস তরফদার এবিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন এবং এই কাজের পরিসর আরো বড় করার জন্য কিছু দারুন পরামর্শ দিয়েছেন। মিঃ রাম রায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিউজ ফতোকপি করে রাখার দায়িত্ব নিয়েছেন। আমরা ইতিমধ্যে তাকে একাজ করার জন্য ২০০০ রুপি দিয়েছি। ব্যাকের কিছু ভলান্টিয়ার ব্যাঙ্কটিকে ঢাকা স্থানান্তরিত করে সেখানেই কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সচিব ডঃ এ কে রয়, বাংলাদেশ ভলান্টারি সার্ভিস করপস এর চেয়ারম্যান জনাব আমিরুল ইসলাম এমএনএ, মিঃ রাম রায় ও আমাএর কিছু প্রতিনিধির একটি মিটিঙে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যে ব্যাঙ্কটি একসময় ঢাকাতেই স্থানান্তরিত হবে এবং এর দায়িত্বে থাকবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বাংলাদেশ ভলান্টারি সার্ভিস করপস।

ক্যাম্প স্কুলঃ

গত রিপোরটে উল্লেখিত ক্যাম্প স্কুলগুলো এমাসে ভালভাবেই চলেছে। শুধুমাত্র গত ডিসেম্বরে যখন শরনারথীরা বাংলাদেশে ফিরে যেতে শুরু করেছেন, তখন কিছু ক্যাম্প স্কুলেরো বিলুপ্তি ঘটেছে। এই স্কুলের বাচ্চাদের বই কিনার জন্য ইন্টারন্যাশনাল রেস্কিউ কমিটি একটি বেশ বড় আকারের অরথব্যায় করেছে। এই বই এর তালিকা আমাদের প্রতিনিধিগণ এবং ক্যাম্প স্কুলের পরিচালকদের একত্রে প্রস্তুত করেছেন। এক্ষেত্রে আমরা বলতে চাই, সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি এর কথা যারা আমাদের কাজের জন্য চিঠি দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন।

ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি সার্ভিস, ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কাউন্সিলের নির্বাহী সচিব, মিঃ ভি এন থিয়াগরজন আমাদের কিছু ক্যাম্পস্কুল পরিদর্শন করে এর প্রক্রিয়া নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। তিনি বাংলাদেশের মানুষের শিক্ষা বিষয়ক কার্যক্রম এর জন্য একটি বড় অংকের আর্থিক সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

আন্তর্জাতিক যোগাযোগঃ

আমাদের নয় মাসের প্রচেষ্টা মধ্যপ্রাচ্যে অবশেষে কিছুটা হলেও সচেতনতা তৈরি করেছে। কুয়েত ও আফগানিস্তান থেকে বাংলাদেশ বিষয়ে তথ্য চেয়ে চিঠি এসেছে। যদি আমরা বাংলাদেশের বাস্তবতা ও তাদের স্বাধীনতা আন্দোলন বিষয়ে তাদের ভালভাবে জানাই, তবে হয়ত ভবিষ্যতে আমরা এ বিষয়ে ভালো সাড়া পাবো। আমাদের সিলনিজ বন্ধু, সান নিমাল পেরেরা, যখন সিলন গমন করেছিলেন, তখন তিনি ইয়াহিয়ার সিলন প্রতিনিধির কাছে চট্টগ্রাম পারবত্য জেলার শ্রী ত্রিদিব রয়ের দারুন ভুমিকার কথা জানিয়েছেন। এসএম পেরেরা, বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে বাংলাদেশের উন্নতি কামনায় আমাদের মাধ্যমে চৌদ্দশ শতকের বুদ্ধিস্ট প্রার্থনা সংগীত পাঠিয়েছেন। আমরা ইতিমধ্যে তা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়েছি।

নিউজিল্যান্ডের ইউথ ইন্টারন্যাশনাল কমিটির সেক্রেটারি ও ভাইস চেয়ারম্যান, মিসেস আল্ভিন এফ আরনোল্ড এবং মিঃ ত্রেভন জে ওয়াল্টন ও নভেম্বর এর ৩০ তারিখে আমাদের অফিস পরিদরশন করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়, শিকাগো থেকে বাংলাদেশ আন্দোলন এর একজন মিত্র মিঃ এভেলিন চ্যাটকিন আমাদের কিছু ক্যাম্প স্কুলে গিয়েছেন। তিনি আমাদের প্রোজেক্টগুলো চালাতে আমাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা করবেন বলে জানিয়েছেন। আমরা এছারাও বাংলাদেশ ভলান্টার সার্ভিস করপ্স এর এমএনএ ও চেয়ারম্যান মিঃ আমিরুল ইসলাম, ব্রিটিশ ওয়ার ওন ওয়ান্ট এর এম পি মিঃ জন স্টরহাউসের সাথে কোলকাতায় দেখা করেছি। আমরা বাংলাদেশকে সাহায্য করার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে তাদের সাথে আলোচনা করেছি এবং তারা আমাদের পরিকল্পনা নিয়ে বেশ আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

পূর্ব রিপোর্টের অপ্রকাশিত তথ্যঃ
আমরা ভুল্বশত গত রিপোর্টে উল্লেখ করিনি যে বাংলাদেশ ও কলকাতা ইউনিভার্সিটির শিক্ষকদের একটি যৌথ দল সেপ্টেম্বর মাসে বোম্বে ও আশেপাশের এলাকায় পরিদরশনের জন্য গমন করেছিল, যাতে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন চট্টগ্রাম বিসব্বিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ও বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির প্রেসিডেন্ট ডঃ এ আর মল্লিক, প্রফেসর আলি আহসান, প্রফেসর সুবিমল মুখারজি ও ডঃ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। আমরা ভুলে এটিও উল্লেখ করিনি যে দিল্লীতে শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ন বাংলাদেশের উপর যে আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করেন তাতে ডঃ বুদ্ধদেব ভট্টাচারয কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন। ভ্রমনের সকল খরচ সমিতি থেকে বহন করা হয়।

মুজিবনগর ভ্রমনঃ

বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দাওয়া উপলক্ষে আমরা জনাব এম হোসেন আলির মাধ্যমে বাংলাদেশী নেতাদের শুভেচ্ছা জানিয়েছি। মুজিবনগরেও একিভাবে আমরা শুভেচ্ছা জানিয়েছি, বাংলাদেশ পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা অর্জনের পরে। একারনেই খুব সম্ভবত আমাদেরকে খুবি দ্রুত মুজিবনগরে বাংলাদেশের নেতাদের সাথে সাক্ষাত করার আহবান জানানো হয়। আমরা তরিঘরি ভাবে একটি দল গঠন করি, যাতে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন স্যার এন বোস, ডেপুটি রেজিস্টার স্যার জি সি ব্যানারজি, ডেপুটি কন্ট্রোলার অফ এক্সামিনেশন্স, এস এম এম বোস, প্রফেসর পি সেন শর্মা, শ্রী মানস হালদার, শ্রী এস মুখারজী, এবং সংশ্লিষ্টরা, যারা অভিনন্দন জানাতে গমন করেন। বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ তাদেরকে অভ্যর্থনা জানান এবং আমাদের সকল সহায়তার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার অনুভুতি কলকাতা ইউনিভারসিটির ভাইস চ্যান্সেলর ও সমিতির অন্যান্য সদস্যদের কাছে ব্যাক্ত করার অনুরোধ করেন। তিনি বলেন যে ইচ্ছে থাকা স্বতঃতেও কাজের চাপে তিনি ইউনিভারসিটি পরিদর্শন করতে যেতে পারেননি। তিনি এরপরে কলকাতা গেলে অবশ্যই পরিদর্শনে যাবেন বলে জানান। একি সাথে বলেন, তিনি নিজেও শিক্ষক হবার কারনে শিক্ষকদের সাথে তিনি বিশেষ আত্মিয়তাসুত্রে আবদ্ধ বলে মনে করেন।

আর্থিক ও অন্যান্য সাহায্যঃ

এসময়ের মধ্যে আমরা মহারাষ্ট্রের ইস্তারি সাত সং সভা থেকে, মিঃ আজিজুর রহমান, মিঃ এস আর পরশ রমন, মিঃ এস উল্লাহ, মিঃ স প্রকাশ খান্না, মি; মুনির আলি, মিঃ ঈশ্বর লাল পাটেল, মিঃ এন সি দে, মিঃ আলাউদ্দিন, মিল এম এ চৌধুরী, নরেশ চন্দ্র নন্দ ও লন্ডনের মোজাদ্দের আলি, বেলজিয়াম এর ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি ফ্যাকাল্টি মিসেস নীপা ব্যানারজী, ব্যাঙ্কক থেকে ডঃ নিহার সরকার, মিঃ রিক রজারস, ফ্রান্সের প্রফেসর এডগার লেডেরার এবং শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ন এর সাহায্য পেয়েছি। বাংলাদেশের সরকারের একটি নতুন সামাজিক গনতন্ত্র পুনঃনিরমানের যে বিশাল দায়িত্ব, তাতে সাহায্য করতে আমাদের এখনও প্রচুর ও নিয়মিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সাহায্যের প্রয়োজন।

বিদেশ ভ্রমনঃ

আমাদের একজন প্রতিনিধি, শ্রী পি এন রয়, মাত্রই ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে তার লম্বা সফর শেষ করে ফিরেছেন এবং আমরা তার রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছি।

সমিতির বোম্বে ইউনিটঃ

কোলকাতা ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি এর বোম্বে ইউনিট ফেব্রুয়ারি এর ১২ তারিখ থেকে বোম্বেতে তিনটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করবেন। এই শোগুলোতে পারফর্ম করার জন্য, শান্তিনিকেতন আশ্রমিক সঙ্ঘ, কোলকাতা সেন্টারের শিল্পীরা বোম্বে যাচ্ছেন। মহারাষ্ট্রের অরগানাইজারদের বোম্বেতে কাজ করতে সমিতি সাহায্য করবে।

যৌথবাহিনীর কাছে পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনীর আত্মসমরপনঃ

বাঙ্গালদেশ স্বাধীন হবার সাথে সাথে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা সম্পরকিত কিছু তথ্যও প্রকাশিত হয়েছে। এসব তথ্য আমাদের সমিতির উপর কিছু গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছে। একথা বলাই যায় যে, আমাদের সমিতি বাংলাদেশের মানুষের আস্থা অর্জন করতে পেরেছে। যার কারনে স্বাধীন অঞ্চলসমূহের অসহায় মানুশগুলোকে বাড়তি সাহায্য করার আবেদন ইতিমধ্যেই আসতে শুরু করেছে। এ কারনে আমাদের সমিতির ডঃ ডি লাহিরি, শ্রী ম্রিন্ময়ী বোস, প্রফেসর এ চৌধুরী, শ্রী জে চট্টোপাধ্যায়, শ্রী মানস হালদার, এবং শ্রী অনিত বোস এবং বাংলাদেশের শিক্ষক সমিতির ডঃ এ কে রয়, জনাব আনোয়ারুজ্জামান, শ্রী নিত্যগোপাল সাহা, ডঃ আনিসুজ্জামান এবং আরো অনেকজনের একটি দল যশোর, কুষ্টিয়া এবং খুলনার বিভিন্ন জেলা ভ্রমন করছেন। এসব অঞ্চলে আমরা ঔষধ, কম্বল, শিশুখাদ্য এবং কিছু ক্ষেত্রে আর্থিক সাহায্যও প্রদান করছি। কুষ্টিয়ায় জরুরি ভিত্তিতে নির্মাণকৃত সারকিট হাউসে আমরা প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ করেছি। আমাদের তরফ থেকে মিঃ এন বি মুখারজি এর সকল খরচ বহন করেছেন। আমরা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় গঠনকৃত শহিদ ফান্ডেও আর্থিক সাহায্য প্রদান করেছি। জনাব শফিউদ্দিন (বাবু) সরোয়ার এর কাছে থেকে আমরা স্বাধীনতার ঠিক পূর্বে হত্যাক্রিত বুদ্ধিজীবীদের একটি প্রাথমিক লিস্ট সংগ্রহ করেছি, যা আমরা আমাদের প্রেসেও সরবরাহ করেছি। আমাদের একজন প্রতিনিধি, প্রফেসর ভি কে শাস্ত্রিকে আমরা ঢাকায় পাঠিয়েছি এবং তার অভিজ্ঞতার একটি রিপোর্ট তিনি আমাদের জমা দিয়েছেন।

বাংলাদেশ বিষয়ে সেমিনারঃ

জরুরি কারনে ডিসেম্বরের ২১ তারিখে বাংলাদেশ বিষয়ে কোলকাতায় যে জাতীয় সেমিনার হবার কথা ছিল, তা পিছিয়ে গিয়েছে। আমরা প্রস্তাব করেছি যেন সেমিনারটি ১৯৭২ এর এপ্রিলের ১৪ তারিখ অনুষ্ঠিত হয়। আমরা আশা করছি যে ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্ট কমিশনের চেয়ারম্যান, প্রফেসর ডি এস কোঠারি এ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করবেন এবং ভারতীয় স্কলারদের সাথে বাংলাদেশী কিছু স্বনামধন্য শিক্ষক ও বুদ্ধিজিবীরাও এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর, ডঃ এ আর মল্লিক, ইতিমধ্যেই আমাদের আমন্ত্রনে সাড়া দিয়েছেন।

বাংলাদেশ পুনর্গঠন লক্ষে সহায়তা কার্যক্রমসমুহঃ পশ্চিমবঙ্গের গভর্নর, শ্রী এ এল ডায়াস এর পরামর্শ অনুযায়ী, আমরা বেশ কিছু কার্যক্রম এর পরিকল্পনা করেছি, যার ফলে বাংলাদেশের পুনর্নির্মাণে আমরা উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারব। আমরা প্রচন্ডভাবে অনুভব করি যে, অন্তত একটি একাডেমিক সেশন পর্যন্ত বাংলাদেশে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পুননির্মাণে সম্পূর্ণ সহায়তা প্রদান করা দরকার। একি সাথে আমরা নিম্নে বর্ণিত প্রতিষ্ঠানের সাথে বাংলাদেশে পরিবার কল্যানের লক্ষে কাজ করবোঃ

(১) জনাব আমিরুল ইসলাম, এম এ্ন এ, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার সার্ভিস, করপ্সঃ বাংলাদেশের সশস্ত্র তরুণদের সমস্যা, ত্রাণ এবং পুনর্বাসন প্রসঙ্গে।
(২) বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা অধিদপ্তর
(ক) সমবায় কৃষি বিষয়ে
(খ) শিক্ষা বিষয়ে
এসডি/…………………………
সচিব।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৯২। রাজ্যসভায় বিতর্ককালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যবর্তী ভাষণ ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২৭ মার্চ, ১৯৭১

Shuvadittya Saha
<১২, ১৯২, ৫২৭-৫২৮>
অনুবাদ

২৭ মার্চ এর উপরে রাজ্য সভায় বিতর্কে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পারমানবিক শক্তি বিষয়ক মন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী, এবং তথ্যমন্ত্রী (শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী):

ডেপুটি চেয়ারম্যান সাহেব, পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আমরা মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করছি। আমি পূর্ব বাংলার নির্বাচনের কথা বলছি, আশা করেছিলাম যা তাদেরকে একটি সম্ভাবনাময়, একতাবদ্ধ এবং শক্তিশালী জাতি হিসেবে সামনের দিকে নিয়ে যাবে। কিন্তু আমার কলিগ সরদার সাহেব যা বললেন, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বদলে তারা একটি অন্ধকারাছন্ন, বেদনাদায়ক পথের দিকে এগুচ্ছে, যেখানে আছে অনেক দুঃখ কষ্ট, সত্যি কথা বলতে গোটা জনগোষ্ঠির জন্য দুঃখ কষ্ট একটি লঘু শব্দ। আমি নিশ্চিত, রাজ্যসভার সম্মানিত সদস্যগন এটা অনুধাবন করবেন, আমাদের হৃদয় যতই দুঃখ ভারাক্রান্ত হোক না কেন, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের দুঃখ কষ্টের কথা আমরা যতই অনুধাবন করি না কেন, রাজ্যসভার সম্মানিত সদস্যগন যে ভাষায় সেটা বলছে, সেটা আমরা সরকারি ভাবে বলতে পারি না। সত্যি কথা বলতে, এর কারন হলো, আমরা বর্তমান সময়ের ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে সচেতন, আবার এটাও মাথায় রাখা জরুরি, এই মুহূর্তে একটা ভুল শব্দ, ভুল পদক্ষেপ এর মাসুল আমাদের অনেক চড়া দিতে হতে পারে, যা আমাদের আমাদের লক্ষ্য অর্জন কে সদূরপরাহত করে ফেলতে পারে।

রাজ্যসভা অবগত যে আমাদের আন্তর্জাতিক নিয়মনীতির মধ্যে থেকেই কাজ করে যেতে হবে। এটা দেখে ভালো লাগছে যে সব দল গুরুত্বপূর্ণ কিছু পয়েন্ট তুলে ধরেছে। যেমন ধরা যাক, স্বতন্ত্র পার্টি শ্রী মুজিবর রহমান এর সামাজতন্ত্রপন্থী কার্য্ক্রম এর প্রশংসা করেছে। জনসঙ্ঘ তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ নীতিকে সমর্থন দিয়েছে এবং বলেছে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ আমাদের ভাই। আমি আশা রাখব, তারা সেই একটি সমর্থন এবং সহানুভূতি আমাদের দেশের জনগনের জন্য ও রাখবে। আমি আগেই বলেছি, পূর্ব পাকিস্তানে কি ঘটছে, সে বিষয়ে আমরা সম্পূর্ণ অবগত। এর অর্থ, সেখানকার জনগনের উপর যা ঘটছে, তাদের দুঃখ দুর্দশা এবং আমাদের দেশের জন্য তা কি বিপদের কারন হতে পারে, সে বিষয়ে ও আমরা অবগত। তাই বিভিন্ন কারনে এই বিষয়ে আমরা আগ্রহী, প্রথমত, আমাদের একজন রাজ্য সভার সদস্য যা বললেন, শ্রী মুজিবুর রহমান যেই মূল্যবোধগুলো ধারণ করেন যেমন, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা আমরা সেই একই মূল্যবোধের জন্য লড়াই করি, সেই একই মূল্যবোধ ধারণ করি। এর সাথে সেখানকার জনগণ যেভাবে মুজিবর রহমানের পিছনে এই মূল্যবোধগুলো নিয়ে দাঁড়িয়েছে, তার স্বাতন্ত্রতা আমাদের মুগ্ধ্য করেছে এবং তা নিয়ে আমরা সচেতন। সেখানে যা ঘটছে, তা নিয়ে আমরা গভীরভাবে ব্যথিত এবং রাগান্বিত কিন্তু আমি রাজ্যসভার সদস্যদের কাছে আবেদন করতে চাই, এই মুহূর্তে সরকারের এর চেয়ে বেশি কিছু করার নেই এবং এটা যদি সাধারণ জনগনের বিতর্কের বিষয় হয়ে যায়, তা কোনভাবেই ভাল হবে না। আমার মনে হয় না, রাজ্যসভার সম্মানিত সদস্যগন এই মুহূর্তে সব প্রশ্নের উত্তর আশা করছেন। আমার মনে হয়, এই আলোচনার মূল উদ্দেশ্য হলো আমরা যাতে এই বিষয়ে তাদের মনোভাব এবং পরামর্শ জানতে এবং শুনতে পারি। সম্মানিত সদস্যবৃন্দ অবশ্যই অবগত আছেন, আমি বিরোধী দলের নেতাদের সাথে সকালে এই বিষয়ে আলোচনা করেছি এবং তা চালিয়ে যাব। পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবল আমরা যতটা গভীরভাবে সম্ভব পর্যবেক্ষন করছি এবং একই সাথে আমরা বিরোধী দলের নেতা এবং রাজ্যসভার সম্মানিত সদস্যদের সাথে এই বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি এবং এই বিষয়ে তাদের মনোভাব বুঝার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমার স্বীকার করতে কোন অসুবিধা নেই, সব সময় আমরা যা চাই, সে অনুসারে হয়তো আমরা কাজ করতে পারি না নানা প্রতিকূলতা এবং পরিস্থিতির চাপে কিন্তু এই মুহর্তে সম্ভবপর সবকিছুই আমরা তাদের জন্য করব এবং তাদের পরামর্শ দিব।

শ্রী মহাবীর ত্যাগী: প্রধানমন্ত্রী আমাদের নিশ্চিত করতে পারেন যে, আমাদের ভারতের আকাশসীমা পাকিস্তান ব্যবহার করতে পারবে না?

শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী: আমি রাজ্যসভাকে এবং মাননীয় সদস্যকে আশ্বস্ত করতে চাই যে, আমাদের আকাশসীমা পাকিস্তানের জন্য খুলে দেবার কোন ইচ্ছা আমাদের নেই।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৯৩। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী কতৃক উত্থাপিত প্রস্তাব রাজ্য সভার কার্য বিবরণী ৩১ মার্চ, ১৯৭১

Shuvadittya Saha
<১২, ১৯৩, ৫২৯-৫৩০>
অনুবাদ

নং ৮ মার্চ ৩১, ১৯৭১

সিদ্ধান্ত: পূর্ব বাংলার সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পারমানবিক শক্তি বিষয়ক মন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী, এবং তথ্যমন্ত্রী (শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী):

চেয়ারম্যান মহোদয়, আমাদের প্রতিবেশী পূর্ব বাংলার সাহসী জনগনের জীবনে নির্বাচনে জয় লাভের পর থেকে যেই শোকাবহ রাত নেমে এসেছে, সেখানে তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এর প্রতি আমাদের উদ্বেগ এবং তাদের প্রতি আমাদের ভ্রাতৃত্ববোধ, সমবেদনা আমাদেরকে আজ ঐক্যবদ্ধ করেছে। আমি এখানে লোকসভা থেকে একটি সিদ্ধান্ত পাশ করতে চাই, যা আমরা বিরোধীদলের নেতাদের সাথে ইতিমধ্যেই আলোচনা করেছি এবং আমি আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে আমরা সবাই এব্যাপারে একমতে পৌঁছেছি।

মহোদয়, আমি নিম্ন লিখিত সিদ্ধান্ত এই মহান লোকসভাতে পাশ করতে উত্থাপন করছি:

“এই পার্লামেন্ট পূর্ব বাংলার সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর জন্য গভীর উদ্বেগ এবং শোক প্রকাশ করছে। পূর্ব বাংলার মানুষের আশা আকাঙ্খাকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেবার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী সেখানে নির্মমভাবে আক্রমণ চালিয়েছে। পাকিস্তানের সরকার ১৯৭০ এর ডিসেম্বরে সেখানকার মানুষ যেই রায় দিয়েছে তার প্রতি কোন শ্রদ্ধা না করে বরং সেখানকার জনগনের ম্যান্ডেটকে বিদ্রুপ করার পথ বেছে নিয়েছে।

পাকিস্তানের সরকার শুধু যে নিয়মতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে তাই নয়, বরং জাতীয় পরিষদ (ন্যাশনাল এসেম্বলী) কে তার নিয়মতান্ত্রিক এবং সার্বভৌম ভূমিকা পালনের পথও রুদ্ধ করে দিয়েছে। বেয়নেট, মেশিনগান, ট্যাংক, আর্টিলারি এবং যুদ্ধবিমান দিয়ে নির্লজ্জ্বভাবে পূর্ব বাংলার মানুষকে দমন করা হচ্ছে।

ভারতের সরকার ও জনগণ সবসময় পাকিস্তানের সাথে শান্তিপূর্ণ, ভ্রাতৃত্বপূর্ণ এবং স্বাভাবিক সম্পর্ক চেয়েছে। কিন্তু এই উপমহাদেশের মানুষের মধ্যে শত শত বছরের যে ইতিহাস, সংস্কৃতির এবং ঐতিহ্যের বন্ধন আছে, সেখানে ভারতের দায় আছে এবং এহেন পরিস্থিতিতে আমাদের সীমানার ওপর পাশে যে নির্মম অত্যাচার এবং ধংসযজ্ঞ চলছে, তা দেখে ও এই পার্লামেন্ট চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, নিরীহ এবং নিরস্ত্র জনগনের উপরে যেই মাত্রায় অত্যাচার এবং ধংসযজ্ঞ চলছে, তার নজির সদূর অতীতে পাওয়া মুশকিল।

শান্তি এবং মানবাধিকারের প্রতি ভারতের স্থায়ী অঙ্গীকার থেকে এই সংসদ পূর্ব বাংলার জনগনের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের এই সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সংহতি এবং সহানুভূতি জানাচ্ছে এবং এই সংসদ পূর্ব বাংলার নিরস্ত্র জনগনের উপরে যে হত্যাযোগ্য এবং বলপ্রয়োগ চলছে, তা অনতিবিলম্বে বন্ধের দাবি জানাচ্ছে। এই সংসদ একই সাথে সমগ্র পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সরকার এবং জনগনের কাছে আবেদন জানাচ্ছে যেন তারা পাকিস্তানের সরকারের উপরে এই ধংসযোগ্য ও গণহত্যা বন্ধ করতে সকল সম্ভব চাপ প্রয়োগ করে।

এই সংসদ সুদৃঢ় প্রত্যয় রাখে যে পূর্ব বাংলার ৭৫ মিলিয়ন মানুষের ঐতিহাসিক জয় হবেই। এই সংসদ তাদের আশ্বস্ত করছে যে, তাদের এই সংগ্রাম এবং আত্বত্যাগের পথে তারা ভারতের জনগনের পূর্ণ সমর্থন এবং আন্তরিক সহযোগিতা পাবে।

প্রশ্ন উত্থাপন করা হলো এবং সংসদের প্রতিক্রিয়া গৃহীত হলো।
চেয়ারম্যান মহোদয়: এই সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে পাশ করা হলো।
শ্রী মহাবীর ত্যাগী (উত্তর প্রদেশ): আন্তরিক অভিনন্দন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৯৪। বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর আগমনের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে শ্রম ও পুনর্বাসন মন্ত্রীর বিবৃতি ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২৪ মে, ১৯৭১

Sajib Barman
<১২, ১৯৪, ৫৩১-৫৩২>

২৪ মে, ১৯৭১ তারিখে রাজ্যসভায় কল এটেনশন নোটিশ এবং বাংলাদেশ থেকে ভারতে বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর আগমনের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে শ্রম ও পুনর্বাসন মন্ত্রী শ্রী ডি ডি পুরির বিবৃতি।

পুর্ব বাংলার অভ্যন্তরীণ গোলযোগ এবং তৎ পরবর্তি ১৯৭১ এর মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে পাকিস্তানি আর্মির নির্মম অত্যাচারের পরিপ্রেক্ষিতে বিপুল সংখ্যক শরনার্থী পশ্চিম বঙ্গ, আসাম, মেঘালয় এবং ত্রিপুরার বর্ডার দিয়ে প্রবেশ করছে। শরনার্থী সংখ্যা এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত স্বল্প ছিল, যা এর পর থেকে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। শরনার্থী অনুপ্রবেশের হার কী হারে বাড়ছে তা নিচের পরিসংখ্যান থেকে সহজেই অনুমেয়ঃ

(১) সপ্তাহান্ত …………… ১৭-০৪-১৯৭১ ১, ১৯, ৫৬৬ জন
(২) সপ্তাহান্ত …………… ২৪-০৪-১৯৭১ ৫, ৩৬, ৩০৮ জন
(৩) সপ্তাহান্ত …………… ০১-০৫-১৯৭১ ১২, ৫১, ৫৪৪ জন
(৪) সপ্তাহান্ত …………… ০৭-০৫-১৯৭১ ১৫, ৭২, ২২০ জন
(৫) সপ্তাহান্ত …………… ১৪-০৫-১৯৭১ ২৬, ৬৯, ২২৬ জন
(৬) সপ্তাহান্ত …………… ২১-০৫-১৯৭১ ৩৪, ৩৫, ২৪৩ জন

২১-০৫-১৯৭১ পর্যন্ত প্রায় ৩৪.৩৫ লক্ষ শরনার্থী পুর্ব বাংলা থেকে আমাদের দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। এর প্রায় অর্ধেক রিলিফ ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে, আর বাকি অর্ধেক তাদের বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয় স্বজনের বাসায় উঠেছে।

ভারত সরকার মানবাধিকার প্রেক্ষাপট স্মরণে নিয়ে শরনার্থীদের আশ্রয় এবং খাদ্যের যোগান দেবার জন্য রিলিফ কার্যক্রম প্রসারিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাশাপাশি, চিকিৎসা সেবা প্রদান এবং মহামারি নিয়ন্ত্রনের বন্দোবস্ত করেছে। শিশু, নারী, গর্ভবতী এবং অসুস্থদের জন্য গুড়ো দুধ বিতরনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আরো প্রয়োজনীয় দ্রব্য যেমন বস্র ও বাসন-কোসন বিতরনেরও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এই রিলিফ কার্যক্রমের জন্য যে ভীষণ ব্যয় নির্বাহের দরকার হয়ে পড়েছে, যেখানে শরনার্থী ও তার নিমিত্তে প্রয়োজনীয় রিলিফের পরিমান প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে তা ভারতের অর্থনীতির উপর ব্যপক চাপ প্রয়োগ করছে। তাই, ভারত সরকার তার দূতাবাস সমুহের মাধ্যমে জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিকট সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে, যেন এই বিপুল সংখ্যক শরনার্থীর দায়ভার গ্রহন করে।

ভারত সরকার মনে করে এই শরনার্থীরা তাদের নিজ মাতৃভূমিতে ৬ মাসের ভেতর ফিরে যেতে পারবে, ততদিনে পুর্ব বাংলার অভ্যন্তরীণ সমস্যা মিটে যাবে। সেই হিসেবে, ভারত সরকার ১৩২ কোটি রুপি এই ৬ মাসের রিলিফ কার্যক্রমের জন্য বরাদ্দ করেছে। এই হিসাব UNHRC এর প্রতিনিধিদলের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে, যারা পশ্চিম বাংলা, আসাম এবং ত্রিপুরা দিয়ে আগত শরনার্থীদের রিলিফ ক্যাম্পগুলো সম্প্রতি বর্ডারে গিয়ে পর্যবেক্ষন করে গিয়েছে। তাদের পর্যবেক্ষন এবং হিসাব অনুযায়ী এর মধ্যে তারা জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর প্রতি সদয় হয়ে পুর্ব বাংলার শরনার্থীদের জন্য এই রিলিফ কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য আহবান জানিয়েছে। আশা করছি আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে এবং অন্যান্য দেশগুলো শীঘ্রই মানুষের এই বিয়োগান্ত ঘটনায় ভারত সরকারের সহায়তা কার্যক্রমের পাশে এসে দাঁড়াবে।

এই বিশাল রিলিফ কার্যক্রমের সমস্যাবলী মোকাবেলা করার জন্য এর মধ্যে পশ্চিম বাংলার কলকাতায় একজন অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে পুনর্বাসন অধিদপ্তরের একটি শাখা সচিবালয় খোলা হয়েছে। এই শাখা সচিবালয় বর্ডার স্টেট গুলোর সরকারের সাথে কাজের সমন্বয় করে রিলফ কার্যক্রম এগিয়ে নিচ্ছে। পশ্চিম বঙ্গ, আসাম, মেঘালয় এবং ত্রিপুরার সরকার এই কঠিন পরিস্থিতিতে যথাসাধ্য কাজ করছে এবং ত্রাণ সরবরাহ করছে, যার প্রতি ভারত সরকারের পূর্ন সমর্থন রয়েছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৯৫। বাংলাদেশকে স্বীকৃতির দাবীর প্রশ্নে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জবাব ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২৫ মে, ১৯৭১

Nishat Oni
<১২, ১৯৫, ৫৩৩-৫৩৭>
অনুবাদ

রাজ্য সভায় ২৫মে, ১৯৭১ এ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার প্রশ্নে সংক্ষিপ্ত আলোচনায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জবাব

জনাব ডেপুটি চেয়ারম্যান, স্যার, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্যদের যেসব বক্তৃতা দেয়া হয়েছে তাতে দেশের সাধারন অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে। এই আবেগ তাদের জন্য স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। বাংলাদেশে যারা সেনা শাসনতন্ত্র দ্বারা শোচনীয় ভাবে নির্দয় নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার স্বীকার হয়েছে তাদের জন্য এই আবেগের প্রকাশ। এই বিতর্কে উপস্থিত সব সদস্যদের নিয়ে ঐতিহাসিকভাবে পুরো ঘটনার বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগের ব্যপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এতে মনে হচ্ছে বাংলাদেশের জনগনের সমর্থন ও নির্বাচনী ফলাফল আওয়ামী লীগের ভুল এবং সেনাশাসন এতে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। যদিও রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান কিছু কথাবার্তা শুরু করেছেন।

আমি আমার সম্মানীয় বন্ধু শ্রী জাইন এর দেয়া বিশ্লেষণের সাথে একমত যে, পশ্চাতের দৃশ্য বিশ্লেষণে এটা মনে হয়, যখন এসব আলোচনা চলছিল তখন সেনা শক্তিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে আনা হয় এবং হঠাত করেই আলোচনা বন্ধ হয়ে যায় ও পাকিস্তানি সামরিক শক্তি বাংলাদেশি নিরস্ত্র জনগনের উপর এর আধুনিক নির্দয়তার প্রকাশ ঘটায়। যে বর্বরতা সংগঠিত হয়েছে তার সাক্ষী শুধু ভারতে আশ্রয় নেয়া শত শত হাজার দুর্ভাগা মানুষই নয়, সারা পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের সব স্বাধীন পর্যবেক্ষকেরা। সেনারা যখন নিরস্ত্র মানুষের উপর হামলা শুরু করে তখন বাংলাদেশে অবস্থানকারী লোকের দল, সামরিক শাসক বাংলাদেশীদের উপর যে হামলা করেছিল সেই বর্বরতার সাক্ষী দিয়েছে। এছাড়াও তখন ঢাকায় অবস্থানকারী বিদেশি সাংবাদিকদের যত দ্রুত সম্ভব ঢাকা ও বাংলাদেশ ছাড়তে বলে ও হামলার দিনগুলোতে বিদেশি সাংবাদিকদের লেখায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নিষ্ঠুরতার পর্দা উন্মোচনের যে কাহিনি বর্ণনা করা হয়েছে তা পুরো বিশ্বকে নাড়িয়ে দেয় এবং আমি বলবো এই পরিস্থিতে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাধারন জনগনের অভিমত আরো বেশি জীবন্ত ও প্রতিক্রিয়াশীল।

আমি সেইসব স্বাধীন সাংবাদিক ও বিদেশিদের শ্রদ্ধা জানাই যারা বাংলাদেশের দুঃসময়ে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন। ব্রিটিশ, আমেরিকা, ইউরোপ এমনকি এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সংবাদ মাধ্যমের কারণে আস্তে আস্তে সত্য বেরিয়ে আসে এবং তথ্য প্রচারের জন্য তাদের প্রতি সম্মান জানাই। এটা সত্য যে অনেক সরকার রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসন বাংলাদেশে যে হামলা করেছে তার সরাসরি সমালোচনা করেনি তবে বিশ্ব নেতারা আমাদের নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশের ঘটনা সম্পর্কে তারা অবগত এবং আরো বলেছে পাকিস্তানি সরকারকে বাংলাদেশে নিরর্থক চাপ থেকে বিরত থাকার জন্য তাদের পক্ষে যতটা সম্ভব তারা চেষ্টা করবেন।

কারনবশত তাদের কেউ কেউ ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনের ভূমিকাকে দায়ী করেছে। বাংলাদেশী জনগনের ভোগান্তির জন্য পাকিস্তান শাসকদের সিদ্ধান্ত দায়ী এবং সামরিক শাসন ও পাকিস্তান সরকারের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান যদি চিন্তা করে থাকে তারা বাংলাদেশী বীর যোদ্ধাদের স্বাধীনতার চেতনাকে নিরোধ ও দমন করবে তাহলে তারা দুঃখজনক ভাবে ভুল করছে। স্বাধীনতার এই আগুন, এই শিখা একবার তীব্র হলে তা কম হতে পারে কিন্তু নিভে যায়না। এটাই বিশ্বের ইতিহাস। এবং সামরিক শাসনের নিপীড়ন ও নির্যাতন মুক্তিবাহিনী ও বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী বাহিনীকে নিবৃত করতে পারবেনা। এই পরিস্থিতিতে আমরা একটি দুঃখজনক অবস্থার মুখোমুখি, যেখানে প্রধানমন্ত্রী গতকাল হাউজে তার বিবৃতিতে নির্দেশ করেছেন, যে সমস্যাকে পাকিস্তান সব সময় বলে এসেছে তাদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার এখন তা আমাদের আভ্যন্তরীণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং একথা অনস্বীকার্য যে বাংলাদেশ ও ভারত যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে তা পাকিস্তানের কারণে। এই পরিস্থিতিতে যখন লাখো মানুষ নিরাপত্তা ও আশ্রয়ের জন্য পূর্ব বাংলা থেকে ভারতে পালিয়ে গিয়েছে তখনো অনেকে বলেছেন এটা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার। প্রধানমন্ত্রী তার বিবৃতিতে পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে এমন কথা মেনে নেয়া হবেনা। যেখানে প্রচুর পরিমানে শরণার্থী বা আশ্রয়প্রার্থী ভারতে অবস্থান করছে তখন আমরা পাকিস্তানের প্রতি অনেক দেশের নীরবতা মেনে নেব না – যেহেতু তারা বোঝাতে চাইছেন এটা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ বিষয়। এটা আমাদের জন্য সম্পূর্ণভাবে অপ্রত্যাশিত।

এই পটভূমিতে আমরা অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে এই ব্যাপারটা সুষ্ঠুভাবে নিষ্পত্তি করেছি যে তাদের এমনভাবে আচরণ করা উচিত যাতে পাকিস্তান তার সৃষ্ট পরিস্থিতিতে প্রয়োজনীয় চাপে থাকে যাতে প্রথমেই জনগন এই পরিস্থিতি থেকে সরাসরি বেরিয়ে আসে। দ্বিতীয়ত, এমন অবস্থার সৃষ্টি করা উচিত যেখানে পাকিস্তান ছেড়ে আসা জনগন ফিরে যেতে নিরাপদ বোধ করে এবং বাস করতে পারে। কারন তারা সেখানকার অধিবাসী। তৃতীয়ত, আমরা সম্পূর্ণ ভাবে স্পষ্ট করেছি যে এটা শুধু আমাদের স্থায়ী দায়িত্ব নয় বা হতে পারেনা। এটা বিশ্ব সম্প্রদায়েরও দায়িত্ব এবং এটা সম্পূর্ণভাবে সত্য যে ভারত তার সহিষ্ণু ঐতিহ্য অনুযায়ী এসব মানুষদের অস্থায়ী ত্রান ও সহায়তা দিতে তৈরি আছে। এই দায়ভারের ভাগ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও নেয়া উচিত কারন এটা একটা আন্তর্জাতিক সমস্যা, ভারতের জাতীয় সমস্যা নয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে সম্পূর্ণ অবস্থা দেখা দরকার।

প্রথমত যখন আমরা এতো বড় সমস্যা সামাল দিচ্ছি তখন কে আমাদের সাথে এগিয়ে আসল আর কে আসলো না সেটা নিয়ে পড়ে থাকা ঠিক নয়। এটা কোন বুদ্ধিমানের কাজ নয় বা ব্যবহারিকও দিক থেকে ভালো কিছু নয়। প্রথমেই যদি বলেন এটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাজ কিন্তু তারা করেনি – আমি বলব – আমাদের কি করার ছিল যেখানে আমাদের প্রধানমন্ত্রী স্পষ্টভাবে তার বিবৃতিতে বলেছিলেন যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আবেদন করছি পরিস্থিতির বাস্তবতা দেখুন যে এই শরণার্থীর বোঝা একটি আন্তর্জাতিক উদ্বেগ; এই বিপদের ইতি টানা উচিত এবং এমন অবস্থার সৃষ্টি করা উচিত যাতে এসব লোকেরা নিরাপদে ফিরে যেতে পারে। শুধুমাত্র তখনই আমরা সঠিক কাজটি করার ক্ষমতা রাখি, এবং এটাই ছিল প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হয়ত এটা জিজ্ঞেস করে খুব মজা লাগতে পারে যে যদি আমরা বা আমাদের দেশ ব্যার্থ হয় তাহলে কি করব? এসব ব্যাপার খোলাখুলি আলোচনা করা হয়না এবং আমরা পাকিস্তান খুবই একরোখা এর উপর ভিত্তি করে আগাতে পারিনা। বা যদি আমি এই অভিব্যক্তি প্রকাশ করি যে পাকিস্তান খুব সহজে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সবকিছু অস্বীকার করবে – হয়ত তখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই সমস্যার গুরুত্ব বুঝতে ব্যার্থ হবে – তখন আমাদের নিজেদেরকেই তার সমাধানের দিকে মনযোগী হতে হবে।

জনাব ভারমান তার সরকারি কার্যক্রম ও সংসদীয় কার্যক্রমের অভিজ্ঞতায় ভাল ভাবে জানেন যে মন্ত্রীসভায় কি ঘটছে তা নিয়ে কেউ কিছু বলতে পারেনা এবং মন্ত্রীসভায় গৃহীত মতামত আমার কাছ থেকে জেনে কোন লাভ নেই। মন্ত্রীসভার আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে সংসদের আগ্রহ থাকা উচিত নয় কারন এটা সরকারের ব্যাপার এবং প্রত্যেক সদস্যদের আলাদা আলাদা মতামত থাকতে পারে যার সাথে এগুলো সম্পৃক্ত হওয়া না হওয়া একই সাথে আমি এটা বলার সুযোগ নিতে চাই যে শ্রী রাজনারাইন ও জনাব ভার্মার উল্লিখিত পরামর্শ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

সরকারের সব সদস্যদের এই ব্যাপারে শ্রদ্ধা জানাই কারন সবাই একই মানসিকতার এবং সবার মতামত এক। ছোটবেলায় বন্ধুদের সাথে অনেক সময় কোন ব্যাপারে আমরা একমত হয়েছি বা কখনো তির্যক সমালোচনা শুনেছি – এমনটা হতেই পারে। আমরা সেই ফাঁদে পড়িনা। কারন কেউ কিছু বলবে আর তা সমর্থন বা প্রতিবাদের দায়ভার যাবে আমার উপর, যা সরকারের যে কোন সদস্যের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত। যতক্ষণ সরকারি সিদ্ধান্ত আছে ততক্ষন আলোচনার ব্যাপারে সংসদের উদ্বেগের কোন কারন নেই যা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তকে অগ্রবর্তী করে বা সিদ্ধান্ত তৈরি করে। এটাকে সরকারি নীতি হিসেবে গ্রহন করা উচিত।

সম্মানিত সদস্যদের জাহির করা সসম্যা গুলো নিয়ে আমি ভালো ভাবে চিন্তা করেছি। আসলে সেটা হবে জাতির প্রতিফলন যা মার্চ সেশনে অবিসংবাদিতভাবে সংসদের মিলিত ফলাফল এবং পরবর্তীতে অবস্থার বর্ণনা, জনগনের কাছে আমাদের অঙ্গীকার যে আমাদের পরিপূর্ণ সমর্থন ও সমবেদনা তাদের সাথে আছে (শ্রী চিত্ত বসুর বাঁধা দেয়া)। জনাব চিত্ত বসু, আমাদের এই ব্যাপারটাকে আরও গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিত।

দয়া করে নাক গলাবেন না। ধৈর্য ধরুন।

এখন সিদ্ধান্ত কি? আমি আবারো সিদ্ধান্ত জানতে চাচ্ছি কারণ স্মৃতি সাধারণত ক্ষণস্থায়ী হয় এবং অনেকসময় আমরা নিজেদের মীমাংসা ভুলে বসি। অন্যান্য ব্যাপারগুলো বর্ণনার পরে আমরা বলি-

“যেহেতু আমরা মানবাধিকার রক্ষা ও সমর্থন করি তাই ভারতে শান্তি বজায়ে থাকে এই স্বার্থ স্থায়ীভাবে মনে রাখতে হবে, হাউস চায় নিরস্ত্র মানুষের উপরে এই নৃশংস যজ্ঞ যত দ্রুত সম্ভব নিবৃত হোক”।

এটা ছিল হাউসের সর্বসম্মত চাওয়া-
“বিশ্বের সব মানুষ ও রাষ্ট্রেকে হাউস পাকিস্তানকে অবিলম্বে গণহত্যায় রুপ নেয়া ধ্বংসযজ্ঞের নিয়মানুগ ইতি টানতে বোঝানোর জন্য জরুরী ও গঠনমূলক ধাপ গ্রহণ করতে আহ্বান করেছে”।
যেহেতু আমরা বল প্রয়োগে নিবৃত্ত থাকার জন্য বলেছি এবং পৃথিবীর সব রাষ্ট্র ও মানুষের কাছে আবেদন করেছি, এটাকে আমরা দায়িত্তের সাথে পরিচালনা করব কারণ এটাকে আমরা অনেক রাষ্ট্রের কাছে নিয়েছি। এটাকে আমরা ইউনাইটেড নেশনস ও ECOSOC সোশ্যাল কমিটির কাছে নিয়েছি; মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারটা তাদের সাথে দেখা হবে।

“পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি লোকের জয় অভ্যুত্থানে এই হাউস তার গভীর প্রত্যয় রাখবে”।
আমরা এখনো অবিরত এই দৃশ্যে বিদ্ধ যে এই বিজয় আসবেই।

“হাউস তাদের আশ্বস্ত করতে চায় যে, তাদের সংগ্রাম ও ত্যাগ ভারতবাসীদের একান্ত সমবেদনা ও সমর্থন গ্রহণ করবে”।

তার নির্দ্বিধায় ভারতবাসীর সমবেদনা ও সমর্থন গ্রহণ করেছে। সুতরাং কারোর মনে কোন দ্বিধা থাকা উচিত নয়, ভারতে কারোর মনে বা সরকারের কোন পক্ষে যদি এই ব্যাপারে কোন স্খলন থেকে থাকে তাহলে সমধান করে এই সিদ্ধান্তে একমত হবে।

বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার প্রশ্ন অনেক বিতর্কিত এবং আবেগজড়িত এবং কিছু সম্মানিত সদস্যদের শান্তিরক্ষা ব্যাপার আছে। এই প্রশ্নের ব্যাপারে আমাদের কোন বিশুদ্ধ বিতার্কিক ভাব গ্রহনের অভিপ্রায় নেই। বিভিন্ন বিতর্কের জবাব দেবার ইচ্ছা সরকারের নেই। তার মানে এই না যে, সম্মানিত সদস্যরা যেসব যুক্তি দেখিয়েছেন তার কিছু পয়েন্টে কোন বিপরীত যুক্তি নেই। কিন্তু আমাদেরকে এই সমস্যার অভিগমন বড় পরিসরে নিতে হবে এবং লোক সভায় উত্থাপিত প্রশ্নের জবাবে ইতিমধ্যেই আমরা আমাদের অবস্থান ঠিক করে ফেলেছি এবং এই একই ধরনের প্রশ্ন কাল হাউসে হবে। আমাদের অবস্থান পরিষ্কার করছি। এই পরিস্থিতিতে আমাদের অবস্থান বাদামের খোসার মত যা অবিরত তরল হচ্ছে। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে আমাদের চিন্তা ভাবনা সময়ের সাথে সাথে প্রকাশিত হতে থাকবে। আমরা পরিস্থিতির সাথে প্রতিনিয়ত আছি এবং এই ব্যাপারে কোন নির্দিষ্ট অবস্থান নেই। এবং যে কোন মুহূর্তে যদি আমাদের মনে হয় যে এতে শান্তি রক্ষা হবে, আমাদের জাতীয় স্বার্থ আছে এবং স্বাধীনতার জন্য যারা লড়ছে তাদের সাহায্য হয়, আমরা যে কোন পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করবোনা হতে পারে সেটা স্বীকৃতি। এটা এমন একটা ব্যাপার যেখানে আমাদের সব দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায় আনতে হবে এবং যখনই সরকার বুঝতে পারবে যে আনুষ্ঠানিক ভাবে সরকারকে স্বীকৃতি দেবার সময় হয়েছে, আমরা তা করতে দ্বিধা করবোনা। নির্দিষ্ট নিয়ম আছে যা সতর্কভাবে বিবেচনা করতে হয় সেই সাথে আন্তর্জাতিক মানের ধরাবাঁধা নিয়ম রয়েছে। কিন্তু রাজ্য সম্প্রসারণের মত ব্যাপারগুলো এর নিয়ন্ত্রনাধিন, সমর্থনের বিস্তার, আদেশ পত্রের পরিমান, প্রকৃতপক্ষে যা বোঝায় এই উপাদান গুলি সব সতর্কভাবে বিবেচনা করতে হবে, আমাদের সম্পর্কের প্রতিক্রিয়া এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানের সাথেও কারণ তাদের সাথে আমাদের বিশাল সীমান্ত রয়েছে, এবং যদি আমরা অন্য একটি দেশের অংশ হিসেবে পরিচিতি পাই যা ইউনাইটেড নেশন্স একটি দেশ হিসেবে গ্রহণ করে। এটা নিশ্চিত যে, যে দেশের অংশ সার্বভৌম ভাবে পরিচিত এবং স্বাধীন দেশ প্রতিক্রিয়া জানাবে। এটা আমাদের জন্য পুরোপুরি নিশ্চিত এবং আমার আর বলার প্রয়োজন নেই। এইসব বিবেচ্য বিষয় সমূহকে হাল্কা ভাবে নেয়া যাবেনা এবং যে কেউ আবেগ দিয়ে ব্যাপারটিকে শক্তভাবে অনুভব করতে পারে। আমাদের চিন্তায় কি আছে সে ব্যাপারে যাবনা এবং যে কোন পর্যায়ে যদি মনে হয় আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতির প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, আমরা সেই পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করবোনা। এরই সাথে জনাব ডেপুটি চেয়ারম্যান, আমি ইতি টানছি। আমি হাউসকে বেশিক্ষন আটকে রাখতে চাইনা।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!