You dont have javascript enabled! Please enable it!

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৯৬। ভারতে পাকিস্তানের বিপ্লবী তারিক আলীর গোপন উপস্থিতি এবং কোলকাতায় তার বক্তৃতার ওপর আলোচনা রাজ্য সভার কার্যবিবরণী ৩১শে মে, ১৯৭১

নীতেশ বড়ুয়া
<১২, ১৯৬, ৫৩৮-৫৪০>
অনুবাদ

কোলকাতায় পাকিস্তানের বিপ্লবী তারিক আলীর গোপন উপস্থিতি এবং বিবৃতির প্রতিবেদন প্রসঙ্গে

জনাব এ.জি. কুলকার্নি (মহারাষ্ট্র): মহাশয়, ১০-৫-১৯৭১ তারিখের পত্রিকায় একটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ প্রকাশ সম্পর্কে ইতিপূর্বেই আমি উল্লেখ করেছিলাম। প্রায় একই রকমের সংবাদ সীমান্তবর্তী এলাকা হতেও আসছে এবং পূর্ববঙ্গে যে বাংলাদেশ সংগ্রাম করছে তা আসাম সীমান্তের দিকে অগ্রসর হতে পারে। আসামের মুখ্যমন্ত্রী নিজেই এই বিবৃতি দিয়েছেন। মূলত আমি চাইছি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর মনোযোগ জনাব তারিক আলীর বিবৃতির প্রতি আকর্ষিত হউক যিনি গোপনে ভারতের কোলকাতায় অবস্থান করছিলেন। তিনি পাকিস্তানের একজন বিপ্লবী নেতা। তিনি গোপনে ভারতে অবস্থান করেছিলেন এবং নক্সালপন্থীদের সাথে আলাপআলোচনা চালিয়েছিলেন। তিনি কী বলেছিলেন তা আমি এখানে উদ্বৃত করতে চাই। তিনি ঐক্যবদ্ধ সমাজতান্ত্রিক বাংলা গঠনের পথ সুগম করতে পূর্ব এবং পশ্চিম উভয় বঙ্গেই বিপ্লবী ফ্রন্ট সৃষ্টির প্রস্তাব রেখেছিলেন। এটা আমাদের সরকারের নীতিনির্ধারণের জন্য খুবই ক্ষতিকারক। তাই আমি এখন জানতে চাই এই বিষয়ে সরকার কী করতে চাইছে।

শ্রী ভূপেশ গুপ্ত (পশ্চিমবঙ্গ): জনাব উপ-সভাপতি, এইটা হচ্ছে সেই বিষয় যা নিয়ে সরকারকে আপনার নির্দেশনা দেওয়া উচিৎ। হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ডে গত পরশু তারিক আলীর একটি নিবন্ধ ছাপা হয়েছে এবং শুধুমাত্র কিছু লোকের দ্বারা এই কথিত সাক্ষাৎকারের আয়োজন নিয়ে কিছু বলা ছাড়া বাকি সমস্তই কথাই সেই নিবন্ধে বলা হয়েছে। তারিক আলী ভারতের নাগরিক নয়, তাহলে সে কিভাবে ভারতে এলো? কে তাকে ভিসা দিয়েছে? সে কিভাবে এখানে প্রবেশ করেছে? এর কিছুই জানা যাচ্ছে না যদিও সরকারের উচিৎ এই সব কিছু সম্পর্কে জানা। এটা হচ্ছে একটি প্রসঙ্গ। দ্বিতীয়ত, আমি জানতে চাই যে তারিক আলী কিভাবে ফিরে গিয়েছে তা বৃটিশ সরকার হতে আমাদের সরকার জেনে নিয়েছে -সে অবশ্যই সাগরপথে অথবা আকাশপথে ফিরে গিয়েছে। সেটাও বৃটিশ সরকার হতে জেনে নেওয়া যেতে পারে। স্পষ্টতই সে সংহতিনাশক আদর্শবাণী নিয়েই তিনি এখানে এসেছিল যা হতে পারে বাংলাদেশের সংগ্রামের জন্য ক্ষতিকারক, যা সবারই ক্ষতি করতে পারে। সে বলেন, বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ সত্ত্বা, সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র এবং স্বাধীন হতে হবে। সে পশ্চিমবঙ্গকে ভারত হতে আলাদা করতে চায়। এটা অতি অবশ্যই সংহতিনাশক আদর্শনীতি এবং কেউ একজনকে এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সাথে নেওয়া উচিৎ। বর্তমানে বাংলাদেশের সংগ্রামের দৃষ্টিকোণ থেকেও এই ধরণের আদর্শনীতি খুবই ক্ষতিকারক। এই বিষয়ে সততা, স্বতঃপ্রবৃত্তের মধ্যে সরকারের অগ্রসর হওয়া উচিৎ। আমি খুবই আনন্দিত যে আমার বন্ধু বিষয়টি এখানে উত্থাপন করেছে। দাবী অনুযায়ী তারিক আলীকে এখানে পাঠানো হয়েছে যাকে ট্রয়োৎস্কাইৎস ইন্টারন্যাশনাল নামে ডাকা হয় যা যেকোন মহান সংগ্রামকে ধ্বংস করার জন্য বহুল পরিচিত। সে যা বলেছে “ আমি এখানে এই বিশেষ কাজ এবং উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছি”। সবাই জানে যে এই তরুণ প্রাণ কিছু কিছু ক্ষেত্রে খুবই সক্ষম একজন ব্যক্তি এবং নিশ্চিতভাবেই সে বেশ অনিষ্ট সাধন করতে পারে। পাকিস্তান এবং অন্যান্য আরো বিষয় নিয়ে তার বই আমি পড়েছি। আমি ঠিক জানি না কেন্দ্রীয় সরকার কি পর্যবেক্ষণ করছে। ই বিষয়টিকে তাদের অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নেওয়া উচিৎ, কেননা এর পিছনে অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে। বর্তমান সময়ে ভারত হতে বের হয়ে এসে আলাদা সত্ত্বা হিসেবে দুই বাংলাকে সমাজতান্ত্রিক বাংলা হিসেবে একত্রিত করার এই আদর্শনীতি সামান্যই ক্ষতিকারক। আমার মনে হয় এই নিয়ে রাজনৈতিকভাবে এবং আদর্শগতভাবে লড়া উচিৎ। সরকারের উচিৎ এই বিষয়কে স্মরণে রাখা এবং এর গতিবিধি অনুসরণ করা কেননা তারিক আলী ইংল্যান্ড হয়ে এখানে এসেছে। সে অবশ্যই সুযোগ সিবিধা পেয়েছে। কেউ একজন অবশ্যই তাকে এখানে আসার সুযোগ করে দিয়েছে; অন্যথায় এই ব্যক্তিকে ইংল্যান্ডেই অনুসরণ করা হতো। ফ্রান্স বা জার্মানীতে তাকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। তাহলে এটা কি করে সম্ভব যে বৃটিশ সরকার তাকে এই মুহূর্তে বিমানবন্দরে বা জাহাজে করে বের হয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে? তার অন্য সদিচ্ছা নিয়ে আমি কোন প্রশ্ন উত্থাপন করছি না। তার রাজনীতি সত্যিকার অর্থেই ভীষণ বাজে। এই প্রশ্নের মোকাবিলা সরকারের করা উচিৎ।

শ্রী কৃশান কান্ত (হরিয়ানা): মহাশয়, অতি দ্রুতই দেশের অনেক মানুষের মনে এই প্রশ্ন তৈরী হচ্ছে। আমি খুবই দুঃখের সাথে জানাচ্ছি এই পর্যন্ত তারিক আলী ভারতে এসেছিল কি আসেনি তা নিয়ে সরকারের তরফ থেকে কোন প্রকারের বিবৃতিই আসেনি। আমার মনে হয় মোহাম্মদ তোহা এবং তারিক আলীকে জড়িয়ে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ উভয়কেই দূর্বল করার জন্য এটা চাইনিজদের একটা গভীর চক্রান্ত যাতে চাইনিজরা এই এলাকার জল ঘোলা করে তাদের মাছ শিকার করে নিতে পারে। আমি জানতে আগ্রহী যে তারিক আলী এখানে কি করে এলো এবং কিভাবেই বা সে তার নিবন্ধ লিখার জন্য ফিরে যেতে পারলো।

শ্রী ভূপেশ গুপ্তঃ ফিরে যেতে পারাটা অতোটা গুরুত্বপূর্ণ নয়,

শ্রী কৃশান কান্তঃ এখানে আসা, লোকদের সাথে সাক্ষাৎ করা এবং ফিরে যাওয়ার পুরো ব্যাপারটাই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী প্রতি আমার অনুরোধ থাকবে যাতে এই বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করা হয়।

শ্রী এ.জি. কুলকার্নিঃ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এখন এখানে। তাঁর একটি বিবৃতি দেওয়া উচিৎ। অবশ্যই তাঁকে কিছু বলতে হবে।

শ্রী ভূপেশ গুপ্তঃ ট্রয়োৎস্কাইৎস তাকে এখানে পাঠিয়েছে। যখন স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল তখন ট্রয়োৎস্কাইৎস এটাকে বিনষ্ট করেছিল। যখন ফ্রান্সের যুক্ত ফ্রন্ট ফ্যাসিজম ও হিটলারে বিরুদ্ধে লড়ছিল এই ট্রয়োৎস্কাইৎস সেই যুক্ত ফ্রন্টকে বিনষ্ট করেছিল। এই ট্রয়োৎস্কাইৎস’র ইতিহাসই হচ্ছে মহান সংগ্রামের বিনষ্ট সাধন করা। তাই আমি এই ভয়টাই পাচ্ছি যে, এখানে; এই দেশেও এমনতরো প্রচেষ্টা চালাতে পারে।

শ্রী কৃশান কান্তঃ মন্ত্রীকে বিবৃতি প্রদান করতেই হবে।

শ্রী কে.সি. পান্ট- স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীঃ এই বিষয়টির উত্থান সম্পর্কে আমাদের কাছে কোন রকমের তথ্যই ছিল না। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমি কোন প্রকারের বিবৃতি দিতে পারবো না।

শ্রী এ.জি. কুলকার্নিঃ আপনি কি তদন্তের জন্য প্রতিজ্ঞা করতে পারবেন? আমি বুঝতে পারছি তাঁর কাছে কোন প্রকারের তথ্য ছিল না। কিন্তু যখনই সংসদের সদস্যরা এই বিষয়টি তাঁর গোচরে এনেছেন, তখন এই বিষয়ে তাঁর উচিৎ তদন্ত করা। এটা একটা জাতীয় দাবী।

জনাব উপ-সভাপতিঃ যে বিষয়টি এখানে উত্থাপিত হয়েছে তা নিয়ে সরকারের আচরণ কেমন হওয়া উচিৎ? আপনি কি কোন বিবৃতি দিতে চান?

শ্রী কে.সি.পান্টঃ সদস্যদের জন্য প্রশ্ন উত্থাপন, জ্ঞাতার্থে প্রজ্ঞাপন জারির ইত্যাদিতে অনেক রকমের পথই এখানে খোলা আছে। এখানেই যে এই বিষয়টি উত্থাপনের পারঙ্গম হবে তা নিয়ে আমাদের আগে থেকে কোন প্রকারের ধারণা ছিল না। আমাদের খুবই সতর্ক থাকতে হবে এবং দেখতে হবে যে আমরা এখানে যাই বলি না কেন তা সঠিকভাবেই বলা হয়েছে এবং সেই উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে আসার জন্য আমাদের পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে থাকতে হবে। বিবৃতি প্রদান করাটা উচিৎ হবে বলে আমার মনে হচ্ছে না। আমাদের কিছু মহীয়ান বন্ধুদের দ্বারা যে ভাবের সাথে তা প্রকাশ করা হয়েছে তার সাথে আমি সহমত পোষণ করছি যে, বিবাদের বিরুদ্ধে যা বাংলাদেশের আন্দোলন নিয়ে সফল হতে যা কিছুই বলা হয়েছে বা করা হয়েছে অথবা যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমাদের দেশের ঐক্যবদ্ধতায় ফাটল ধরাতে চায় যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং যা আমাদেরকে গুরুত্বের সাথে নিতে হবে এবং এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে এবং যেসব পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজনীয় তা অবশ্যই নেওয়া হবে।

সংসদ সদস্যদের উদ্দেশ্যে পত্র চালাচালির প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি প্রসঙ্গে।

শ্রী ভূপেশ গুপ্ত (পশ্চিমবঙ্গ): সংসদ সদস্য হিসেবে সমগ্র দেশের জনতা হতে যে আমরা অনেক চিঠিপত্র পাই সেই বিষটাকে আপনার বিবেচনায় আনা উচিৎ। আজ ‘প্যাট্রিয়ট’ এ একটা সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যাতে বলা হয়েছে যে অন্ধ্র প্রদেশের জেল হতে কিছু রাজনৈতিক কর্মচারী যারা উপজাতি সম্প্রদায়ের তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রেরিত স্মারকলিপির একটি অনুলিপি আমার কাছে প্রেরণ করেছে। এর আরো একটি অনুলিপি আমাদের দলের সাধারণ সচিব শ্রী রাজেশ্বর রাও বরাবর পাঠানো হয়েছে। আমি তার সাথে এ নিয়ে কথা বলেছি। না শ্রী রাজেশ্বর রাও আর না আমি, কেউই জেল হতে বন্দীদের প্রেরিত উল্লেখিত চিঠির অনুলিপিটা পেয়েছি। অবস্থানুযায়ী মনে হচ্ছে এই যোগাযোগের মাধ্যমে তারা উল্লেখ করেছে যে তারা নকশাল্পন্থী হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তারা তাদের রাজনৈতিক দর্শন বদলে ফেলেছে এবং সেই ভ্রান্ত কৌশল বর্জন করেছে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে এই যোগাযোগ ব্যবস্থায় কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলো? অতি অবশ্যই এই প্রতিবন্ধকতা কেন্দ্রীয় সরকার অথবা প্রাদেশিক সরকারের কারো দ্বারা গঠেছে। অতএব, এই মর্মে আমি আপনার মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর অনুরোধ জানাচ্ছি যে, আমাদের দলের সাধারণ সচিব ও সংসদ সদস্য হিসেবে আমার বরাবরে জেল হতে কিছু রাজনৈতিক বন্দীদের দ্বারা প্রেরিত এই যোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির পিছনে দায়ী ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে এই বিষয়ে তাঁদের হস্তক্ষেপ করা উচিৎ। আমি আশা করছি যে, এ নিয়ে তদন্ত করা হবে।

জনাব উপ-সভাপতিঃ এখন মধ্যাহ্ন ভোজের সময়।

শ্রী ভূপেশ গুপ্তঃ আমি কী চিঠিটা পেতে পারি? এটা আমার বরাবরে প্রেরণ করা হয়েছিল।

সংসদীয় বিষয়ক বিভাগের এবং শিপিং ও পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী শ্রী ওম মেহতাঃ আমি চেষ্টা করবো।

জনাব উপ-সভাপতিঃ মধ্যাহ্ন ভোজের পরে আমরা আবার শুরু করবো। রাজ্যসভা দুপুর ২:১৫ পর্যন্ত মুলতবি ঘোষণা করা হলো।

দুপুর একটা বাজার বিশ মিনিটে রাজ্য সভার তখন মুলতবি ঘোষিত হলো।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৯৭। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ থেকে বিরত থাকার ভারতীয় আহ্বান ব্রিটেন কর্তৃক প্রত্যাখ্যানের ওপর পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং এর বিবৃতি রাজ্যসভার কার্যবিবরণী ১ জুন, ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ১৯৭, ৫৪১-৫৫৬>
অনুবাদ

জরুরী জনগুরুত্বসম্পন্ন বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ
যুক্তরাজ্যের সরকার কর্তৃক পাকিস্তান এইড স্থগিত করার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান

শ্রী এন আর মুনিস্বামি (তামিলনাড়ু): স্যার, আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষন করতে চাই। যুক্তরাজ্যের সরকার সম্প্রতি পাকিস্তান এইড স্থগিত করার জন্য ভারতের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছে – সেই ব্যাপারে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রী (সরদার শরণ সিং):
জনাব চেয়ারম্যান, স্যার, পূর্ব বাংলা বিষয়ে ভারত সরকার ব্রিটিশ সরকার সহ বিদেশি সরকারগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। আমরা যে বিষয়টির উপর জোর দিয়েছি সেটা হল তারা যেন পাকিস্তান শাসককে পূর্ববাংলার নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ বন্ধ করতে বলে এবং এটাকে বল প্রয়োগ না করে রাজনৈতিকভাবে সমাধার চেষ্টা করে। আমরা তাদের আরও বলেছি যে পাকিস্তান যদি তাদের উপর নিপীড়ন চালাতে থাকে তাহলে এক সময় তাদের মাঝে ক্ষোভ আরও বাড়বে এবং সামরিক খাতে ব্যয় বাড়বে এবং এইভাবে দ্বন্দ্ব দীর্ঘায়িত হবে।

ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বলা হয়েছে যে, একটি রাজনৈতিক সমাধান করার জন্য ব্রিটিশ সরকার সম্ভাব্য সব কিছু করবেন। এবং পলিসি মোতাবেক শুধু সাহায্য নয় বরং রাজনৈতিক সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। তারা আরও মনে করে স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার হবার আগ পর্যন্ত পাকিস্তানের অর্থনীতির পুনর্গঠন সম্ভব না।

শ্রী এন আর মুনিস্বামি: বিবৃতি থেকে আমি জানলাম যে প্রস্তাব শুধুমাত্র ইউ.কে. নয় বরং অন্য বিশ্বশক্তিগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছিল।

[জনাব.ডেপুটি চেয়ারম্যান আসন গ্রহণ করলেন]
বাস্তবে এটা তাদের আমাদের প্রস্তাব অস্বীকার করার কৌশল মাত্র। আপনি এটাকে প্রত্যাখ্যান বলেন আর নাই বলেন তারা আমাদের প্রস্তাব গ্রহণ করে নাই। ভারত ও ইংল্যান্ডের এই অবস্থানে বাংলাদেশের সমস্যা বিশ্বের অন্যতম জটিল সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে এবং এটা স্থিতি অবস্থায় আসতে দির্ঘ সময় লেগে যাবে। আমি মাননীয় মন্ত্রীর কাছে জানতে চাইব এই অবস্থায় রাজনৈতিক নিষ্পত্তির বদলে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের সাথে আলোচনা করে অথবা ইউ এন ও ও অন্য কোন এজেন্সির সাথে আলোচনা করে কিছু একটা সমাধান করা যায় কিনা। আমি আরও একটি বিষয় জানতে চাই – সেটা হল অন্য দেশগুলোর সাথে আলোচনা করে শরনার্থিদের প্রবেশ ঠেকানো যায় কিনা সেটাও ভেবে দেখবেন কিনা।

শ্রী শরণ সিং: সন্মানিত সদস্য তথ্যভিত্তিক তেমন কিছু জানতে চান নাই। তিনি কিছু সাজেশন দিয়েছেন। আমরা সেগুলো সতর্কতার সাথে বিবেচনা করে দেখব যাতে সেগুলো থেকে কোনভাবে উপকৃত হওয়া যায় কিনা।

শ্রী এন আর মুনিস্বামিঃ আমি যে সব পরামর্শ দিয়েছি ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়া কী?
সরদার শরণ সিং: আমাদের প্রতিক্রিয়া যে আমরা তাঁর পরামর্শ বিবেচনা করব।

শ্রী এ জি কুলকার্নি (মহারাষ্ট্র): স্যার, মন্ত্রী যে বিবৃতি দিয়েছেন তা সবচেয়ে দুঃখজনক। এটা আসল ইস্যুকে এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া কিছু নয়। এবং তিনি ইংল্যান্ডের ভুলটি এড়িয়ে যাচ্ছেন এবং ব্যাপারটি হজম করতে চাচ্ছেন।

স্যার, আমি সরকারের কাছে জানতে চাই তারা কি বাংলাদেশ বিষয়ে আন্তর্জাতিক দেশগুলোকে যথাযথভাবে সচেতন করতে সমর্থ হচ্ছেন কিনা এবং বিশ্বশক্তিগুলোর কেউ কি ভারতকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবার মানসিকতা দেখাচ্ছে কিনা। স্যার, রোডেশিয়া বা দক্ষিণ আফ্রিকায় হত্যাকাণ্ড এবং এই ধরনের অবিচার কিন্তু চলছে তবু কোন বিশ্বশক্তি নিজস্ব জাতীয় স্বার্থে, সাহস নিয়ে তাদের সাহায্য করতে আসছেনা। তাই স্যার, আমি জানতে চাই ……

শ্রী এ ডি মানি (মধ্য প্রদেশ): স্যার, ‘.. “

শ্রী এ জি কুলকার্নি: আপনি কি চান জনাব মনি?

শ্রী এ ডি মনি: আমি শুধুমাত্র আপনার সমর্থন বাড়াতে চাচ্ছিলাম।

শ্রী এ জি কুলকার্নি: আপনার সমর্থন আমার প্রয়োজন নাই।

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: অর্ডার অর্ডার প্লিজ।
শ্রী এ জি কুল্কার্নি: আমি নিজেকে খুব ভাল সমর্থন করতে পারি। স্যার, আমি সরকারের কাছে বিশেষ করে জিজ্ঞাসা করতে চাই যে তারা আমার সাথে একমত কিনা যে বিশ্ব সম্প্রদায়কে এই বিষয়ে জাগিয়ে তুলতে বা তাদের সহানুভূতি জাগানোর চেষ্টা ব্যার্থ হয়েছে এবং বিশেষ করে যুক্তরাজ্য ভুল করছে এবং সরকার আমার প্রস্তাব সম্মত হবেন কিনা। স্যার, খুব সম্প্রতি আমি বিদেশে গিয়েছিলাম……

শাড়ি ভুপেশ গুপ্ত (পশ্চিম বঙ্গ): আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?

শ্রী এ জি কুল্কার্নি: আমি আপনাকে পরে বলব। সেখানে আমি দেখেছি, স্যার, যে ইউকে সরকার কমনওয়েলথের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে এবং এটা কমনওয়েলথ এর মাধ্যমেই আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশ যুক্তরাজ্যের প্রভাবের সাথে সাথে যুক্ত। এবং একই কারণে তারা আমেরিকানদের প্রভাবিত করছে এবং আমেরিকানরা তাদের লাইনে যাচ্ছে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্যার, তাই আমি জানতে চাই সরকার যুক্তরাজ্যকে তাদের মনোভাব পুনর্বিবেচনা করার অবেদন করবে কিনা।

স্যার, আমি জানতে চাই ভারত সরকার ইউ.কে. সরকারের প্রতি জোরালো প্রতিক্রিয়া দেখাবে কিনা। কারণ জনাব উইলসন শ্রী জে প্রকাশকে

বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে বিষয়টি অ্যাড্রেস করতে বাঁধা দিচ্ছেন। এটা খুব অপমানজনক এবং আমরা এটা হজম করতে পারি না। তারা কালপ্রিট এবং এটি যুক্তরাজ্য সরকারের সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের প্রকাশ। তাতে তারা লেবার গ্রুপ হোক অথবা কনজারভেটিভ গ্রুপ – যাই হোক না কেন। স্যার, আমার কথা হল ভারত সরকার এই বিষয়ে আমাদের মর্যাদা বজায় রাখার জন্য নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নেবে কিনা এবং পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষকে তাদের নিজস্ব একটি সরকার গঠন করতে সাহায্য করবে কিনা।

তারপর, আমার তৃতীয় বিষয়টি হল – স্যার …….

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: আমি মনে করি এই যথেষ্ট।

শ্রী এ জি কুল্কার্নি: স্যার, আমার শেষ পয়েন্টে আমি বলতে চাই সরকার সচেতন যে এখন পর্যন্ত ১২ কোটি রুপি পাওয়া গেছে। আমি মনে করি এটা খুব টলায়মান সমস্যা এবং যে টাকা আমরা পেয়েছি তা খুবই নাজুক। সুতরাং, ভারত সরকার বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের জন্য কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিবে কিনা? অন্য দেশের দরজায় কোড়া না নেড়ে – শুধুমাত্র তাদের সহানুভূতি আদায় কোনা করে নিজেরা কোন পদক্ষেপ নেবেন কিনা? কারণ তারা এই ইস্যুতে জোরালভাবে এগিয়ে আসছেন না – তারা ভারতকে সাহায্য করছেন না – — (বাঁধা)

শ্রী বাবুভাই এম ছিনাই (গুজরাট): স্যার, আমি পয়েন্ট অব অর্ডারে আছি। দৃষ্টি আকর্ষণের সময় একজন সদস্যকে শুধুমাত্র কোন কিছুর ব্যাখ্যা করার অনুমতি দেওয়া হয়। তাকে কি এত দীর্ঘ বক্তৃতা করতে দেয়া যায়? তিনি বলেন যে, তিনি সব মনোপলি (একচেটিয়া) এবং মনপলিস্ট বিরোধী। কিন্তু তিনি নিজেই একচেটিয়াভাবে হাউসের সময় নিয়ে নিচ্ছেন।
(বাধা)

শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: এটা, ঠিক মতই আছে সির।

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: অর্ডার, অর্ডার প্লিজ।

শ্রী বাবুভাই এম ছিনাই: জনাব ডেপুটি চেয়ারম্যান, স্যার, আমি জনাব ভূপেশ গুপ্তর রুলিং চাই না; আমি শুধুমাত্র আপনার রুলিং চাই।

শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: এটা এই রুলিংএর ব্যাপারেই বলেছি। আমি বলেছি সব ঠিক আছে। যদি তাকে কম বলতে দেয়া হয় এটা জাতীয় সার্থের সাথে অন্যায় করা হবে।

(বাধা)
জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: অর্ডার, অর্ডার প্লিজ। সন্মানিত সদস্যগণ দির্ঘক্ষন মোট দেবেন না বলেই আশা করি। এবং আশা করি তারা শুধুমাত্র প্রশ্ন করেই ক্ষান্ত দেবেন যাতে করে আরও বেশী সংখ্যক সদস্য অংশগ্রহণ করতে পারেন।

কিছু সদস্য: হ্যাঁ, স্যার।

সরদার শরণ সিং: স্যার, আমি সন্মানিত সদস্যের সাথে একমত। কারণ তিনি পর্যবেক্ষণ করে বলেছেন যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে সামান্য প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। কিন্তু তিনি যে বলেছেন যে ইউ.কে. কমনওয়েলথ এর প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে সেটা হয় ঠিক নাও হতে পারে।
শ্রী এ জি কুলকার্নি: কেন নয়?

সরদার শরণ সিং: আমি এটা মানতে পারছিনা। বোঝার চেষ্টা করুন। প্রথম কথা হল সন্মানিত সদস্য ইউ.কে. দ্বারা অনুমোদিত কোন ব্যাক্তি না যে তিনি যে কথাটি বলেছেন যে ইংল্যান্ড আগ্রহ হারিয়েছেন সেই কথাই সঠিক হবে। আমরা নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকেই জানি যে তাদের আগ্রহ আছে।

এরপর দ্বিতীয় যে প্রশ্নটি তিনি জিজ্ঞাসা করেছেন – যে সরকার যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে কোন শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া দেখাবে কিনা —

শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: স্যার, পয়েন্ট অব অর্ডারে উপর বলছি। মাননীয় মন্ত্রীর এই জিনিস এভাবে বলা উচিৎ হয়নি … (বিঘ্ন)। তিনি বলেছেন যে তিনি ইউ কে অনুমোদিত কোন ব্যাক্তি নন – যে বলার অধিকার রাখে যে ইউ কে আগ্রহ হারিয়েছে। তাহলে আমি বলতে পারি কেউ কি কোন অধিকার রাখেন একথা বলতে যে ইসলামাবাদ গণতন্ত্রের উপর বিশ্বাস হারিয়েছে? —

(বাধা)
জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: অর্ডার, অর্ডার প্লিজ।
শ্রী চিতা বসু (পশ্চিম বঙ্গ): উত্তর শুনুন ….
জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: দয়া করে বসুন, জনাব চিত্ত বসু।

সরদার শরণ সিং: তারপর তিনি যে বলেছেন আমি যেন দক্ষিণ ব্লক দ্বারা পরিচালিত না হই যেটা ফরেন সার্ভিস সদস্যদের জন্য অন্যায় সেখানেও আমার আপত্তি আছে। একবার এটাও ভাবুন যে কোন মন্ত্রী বা সরকার তাদের অধিনস্ত কর্মচারির কথায় বা কোন ফরেন সার্ভিসের কর্মচারির কথায় চলবে না। সরকার সম্পর্কে আমরা যে কোন ধারণা পোষণ করতেই পারি। কিন্তু ফরেন সার্ভিসের লোকদের নিয়ে সেরকম কিছু বলার সুযোগ নাই। কারণ তারা শুধুমাত্র সরকারের পলিসি অনুযায়ী কাজ করেন এবং সেই পলিসি বাস্তবায়ন করার জন্য দায়বদ্ধ।

ডঃ. ভাই মহাবীর (দিল্লি): এটা মন্ত্রীদের জন্যও খুব চাটুকার ধরনের ব্যাপার।
সরদার শরণ সিং: আমি জানি না। এটা হতে পারে, সম্ভবত, বিরোধী দলের জন্য। আমার কি সেভাবে বিষয়টি দেখা উচিৎ?

এরপর তিনি বলেছেন আমাদের কিছু দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। আমি জানি না তিনি কি বুঝিয়েছেন –

শ্রী এ জি কুলকার্নি: বাংলাদেশে …..
সরদার শরণ সিং: বাংলাদেশের সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই। আপনি ইউ.কে. সম্পর্কে আমাদের মনোভাব নিয়ে বলছিলেন। প্রশ্ন হল সমস্যা সমাধানে আমরা অন্য আর কি করতে পারতাম। অবশ্যই আমাদের এই ইস্যুতে বিশ্বকে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করার কাজ চালিয়ে যেতে হবে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ আমাদের বিশ্ব মতামত জোগাড় করতে হবে যাতে পাকিস্তান শাসকদের নিরস্ত্র মানুষের উপর সেনা শাসন ও নির্যাতন বন্ধ করা যায় এবং এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে যাতে করে যেসকল শরণার্থীরা এখানে আছে তারা দেশে ফিরে যাবার ব্যাপারে নিরাপদ বোধ করে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে হবে যাতে করে সমগ্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আমরা আদায় করতে পারি কারণ আমাদের অবস্থা দৃঢ় ও সঠিক। শরনার্থিদের জন্য বাইরে থেকে যে অর্থই আসুক না কেন আসল বিষয় হল তাদের সমর্থনের প্রকাশ।

সর্বশেষে, তিনি যে প্রশ্ন করেছেন তাঁর জবাব আমার সামর্থ্যের বাইরে। তিনি বলেছেন যে, যদি এই ব্যাপারে ইউ.কে. এর সঙ্গে বোঝাপড়া সম্পন্ন না করা যায় তাহলে বাংলাদেশের সমস্যা সমাধান করা যাবে না। আমি মনে করি বাংলাদেশ ইস্যুতে আমাদেরকে তিনি এত অসহায় না মনে করলেও চলবে। এবং সমর্থন একটি দেশের সম্পূর্ন নিজস্ব ব্যাপার। যদি কোন দেশের সমর্থন আমাদের অনুকূলে না হয় আমরা সেটাকে কারেক্ট করার চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু আমাদের নিজেদের আরও অনেক পলিসি আছে। এবং সহজ ভাবে বলতে পারি যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান যাই হোক না কেন আমাদের ব্যাবস্থা আছে। আমি সন্মানিত সদস্যের প্রতি বলতে চাই এটা সঠিক এপ্রোচ নয় —

(বাধা)
শ্রী এ জি কুলকার্নি: জনাব উইলসন একটি আন্তর্জাতিক সমাবেশে বক্তব্যকালে জনাব জয় প্রকাশকে যে বাঁধা প্রদান করেছেন সেই ব্যাপারে আমি সরকারের মনোভাব সম্পর্কে মন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করতে চাই। সেই ব্যাপারে সরকারের কি বলার আছে …..
(বাধা)
সরদার শরণ সিং: স্যার, আমরা সেই আচরণের ব্যাপারে কঠোর আপত্তি জানাই।
শ্রী লোকনাথ মিশ্র (উড়িষ্যা): তাদের অবস্থান এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি থেকে বোঝা যায় যে পাকিস্তান সফলভাবে বিদেশে মিথ্যা প্রচার করতে সক্ষম হয়েছে – অন্যদিকে ভারত সত্যতাকেও প্রচার করতে পারেনি।

আমরা বিদেশে সত্য কথা বিক্রি করতে পারিনি আর পাকিস্তান অসত্য ও মিথ্যা বিক্রি খুব সফলভাবে সেরেছে।

শ্রী এ ডি খ্রি মনি: সত্য বিক্রি করা কঠিন।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: সত্য বিক্রি করা কঠিন নয়। (বাধা) এটা জনাব মনির জন্য কঠিন হতে পারে। কিন্তু এটা একটি সরকারের জন্য কঠিন নয়।

যা আমি বলতে চাই তা হল, সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, যুক্তরাজ্য সরকারের সঙ্গে আমাদের সব ভালো সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও, আমরা যুক্তরাজ্য সরকারকে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার কথায় ইমপ্রেস করতে পারিনি। পাশাপাশি পাকিস্তানকে দেয়া যেকোন সাহায্য এখন সঙ্ঘটিত কুকর্ম আরও বাড়িয়ে তুলবে। আমরা তাদের কাছে সত্য তুলে ধরতে পারিনি। এটা হতে পারে সেখানে আমাদের হাই কমিশনারের ব্যর্থতা। এটা হতে পারে সমগ্র বিশ্বের মিডিয়াতে সরকারের প্রচারিত পাবলিসিটির ফসল। কেননা সব দেশ আমাদের অবিশ্বাস করতে শুরু করেছে যদিও আমরা সত্যের উপর আছি। অতএব স্বতন্ত্র পার্টি যাই বলছে তাই সত্য হচ্ছে। মনে হচ্ছে বিশ্বে আমাদের কোন বন্ধু নেই – আর যারা ছিল তারাও একে একে সরে যাচ্ছে।

শ্রী এ ডি মনি- স্বতন্ত্র দল ব্যাতিত।
শ্রী লোকনাথ মিশ্র: শুধু মিস্টার মনি না, স্বতন্ত্র পার্টি সরকারের বন্ধু, যারা হাউজের ফ্লোরে ভালো কথা বলে।

ডাঃ জেড এ আহমদ (উত্তরপ্রদেশ): স্বতন্ত্র পার্টি সব বন্ধু হারিয়েছে।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: স্বতন্ত্র পার্টির হয়ত সব বন্ধু হারিয়েছে কিন্তু স্বতন্ত্র পার্টি সবার সাথে বন্ধুর মত কথা বলে। আমরা ভণ্ড না।

শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: স্বতন্ত্র পার্টি টাকা এবং বন্ধু সবই হারিয়েছে।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: পরিশেষে আপনারা অনেক হারিয়েছেন এবং এখনও হারাচ্ছেন। জনাব ভূপেশ গুপ্ত খুব ইদানীং উপলব্ধি করেছেন যে তিনি মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ও তার দলকে হারাতে চলছেন। তিনি মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর দলের সঙ্গে খুব বন্ধুত্বপূর্ণ হতে চাইছেন। এখন তিনি বুঝতে পারছেন যে তিনি তার বন্ধু এবং টাকা সবই হারাচ্ছেন।

এখন আমাকে বলছেন যে সরকার সব বন্ধু হারিয়েছে। তাই আমি কাউকে বাংলাদেশের সত্য বিষয়গুলো বোঝাতে পারছিনা। মিডিয়াতে প্রচারের জন্য সরকার কি ব্যাবস্থা নিয়েছে?

শ্রী শীল ভদ্র ইয়াজি (বিহার): দয়া করে সংবাদপত্রে বিশ্বের মতামত দেখুন। তাহলে জানতে পারবেন যে আমাদেরও বন্ধু আছে।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: আপনি কি আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি বা আমাদের পররাষ্ট্র সম্পর্কে কিছু বুঝেন? দয়া করে যা বুঝেন না বা বোঝার ক্ষমতা নেই সেখানে ঢোকার চেষ্টা করবেন না।
স্যার, আমি পররাষ্ট্র মন্ত্রীর কাছে বিশেষভাবে জানতে চাই প্রচার মাধ্যমে প্রচারের জন্য তিনি কোন বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছেন কিনা? এখন তিনি বিভিন্ন দেশের রাজধানীতে যাচ্ছেন। আমি এতে খুশি এবং আশা করি সেই সব দেশের সরকার ও জনগণকে সত্যটা জানিয়ে তাদের ইমপ্রেস করতে পারবেন। কিন্তু তার প্ররোচনা দীর্ঘস্থায়ী প্ররোচনা নাও হতে পারে। আমাদের দূতাবাসগুলোকে সক্রিয় হতে হবে এবং নির্দিস্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। তার দেশ সফরে বিষয়গুলো তরান্বিত হবে। নিশ্চই তিনি যাবেন এবং ওইসব সরকারকে ইমপ্রেস করতে চেষ্টা করবেন। এবং আমাদের প্রচারের জন্য মিডিয়াতে কি ব্যাবস্থা নেয়া হয়েছে যাতে করে যেখানে আমাদের কিছু স্বার্থ আছে তারা আগে থেকে একটি ধারণা পেয়ে রাখতে পারে।

শ্রী আকবর আলি খান (অন্ধ্র প্রদেশ): আপনার প্রস্তাব কী?

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: ওইসব দেশে সরকারী প্রচার মাধ্যমগুলোকে সক্রিয় করতে হবে। এটা আমরা এখনো করতে পারিনি। তাতে সমস্যা কি? দয়া করে মাননীয় মন্ত্রী কি বিষয়টা দেখবেন? বারবার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরে তিনি কি একটু খুঁজে দেখবেন যে ফাঁকটা কোথায়? যদি আমাদের প্রচার মিডিয়া দুর্বল হয় তবে তাদের একটিভ করার জন্য কি করা যেতে পারে? তিনি কি এই ব্যাপার দয়া করে কিছু করবেন?

সরদার শরণ সিং: স্যার, মাননীয় সদস্য ব্যার্থতা সম্পর্কে যা বলেছেন তা সঠিক নয়। ব্যার্থতা বা পিছিয়ে পড়া সব সময় পাবলিসিটির দুর্বলতার জন্য হয় না। যেমন স্বতন্ত্র পার্টি প্রচার অনেক ভালো করলেও নির্বাচনে হেরেছে। অতএব পাবলিসিটি সব সময় ভালো ফল বয়ে আনেনা। সন্মানিত সদস্য বলেছেন আমরা সঠিকভাবে সত্যকে বিক্রি করতে পারছিনা। সমস্যা হল বিক্রি করতে হলে একজন ক্রেতা আর বিক্রেতা লাগে। আর যখন ক্রেতা হয় আমার একজন বন্ধু তখন বিক্রি করা একটু সমস্যা হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ আমি একটি ধারণা দেবার চেষ্টা করছি যাতে আমরা এবিষয়ে একটি জাতীয় নীতি করতে পারি কিন্তু আমি এই ধারণা আমার বন্ধুদের কাছে বিক্রি করতে পারছিনা। এতে আমার কোন ভুল নেই। দেশ এই পলিসি সমর্থন দেয়। অতএব বিক্রি শুধুমাত্র বিক্রেতার উপর নির্ভর করে না, বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কাস্টমারের উপর নির্ভর করে। তাছাড়া অন্যান্য সরকারের তাদের নিজস্ব পলিসি আছে। আমি বলতে চাই যে আমরা প্রচারে ব্যার্থ হইনি। আমার মনে হয় সন্মানিত সদস্য জানেন যে আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমগুলো নিরপেক্ষভাবে বাংলাদেশের আসল অবস্থা, মিলিটারি কর্তৃক সৃষ্ট গণহত্যা এবং রাজনৈতিক অবস্থা ফুটিয়ে তুলেছে। এটা খুব সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। মূল প্রশংসা আমাদের প্রেসের প্রতি। তাছাড়া পশ্চিম ও পূর্ব ইউরোপীয় প্রেস – বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স, জার্মানির প্রেসও প্রশংসার দাবিদার। এসব দেশে সাধারণত প্রেসের প্রচার যথেষ্ট হয়েছে। এবং তারা সঠিকভাবে পরিস্থিতি ফুটিয়ে তুলেছে। বলার প্রয়োজন নেই যে সরকারের পক্ষ থেকে সাড়া খুব শ্লথ হয়েছে। অবশ্য কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া। এক্ষেত্রে আমি সন্মানের সাথে প্রেসিডেন্ট পদ্গরনির কথা উল্লেখ করতে চাই যিনি স্পষ্টভাবে ও সঠিকভাবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে জানিয়েছেন পলিসি পরিবর্তন করতে – যেহেতু সাধারণ নিরীহ মানুষ নির্যাতিত হচ্ছে। বিশ্বনেতারা এই ব্যাপারে সতর্ক যে যদি তারা পাকিস্তানকে ওপেন স্টেটমেন্ট দেন হয়ত সেটা পাকিস্তান নাও রাখতে পারে। তারা মনে করেন পাকিস্তানের উপর তাদের প্রভাব কমে যাচ্ছে। আমরা তাদের বলেছি এটা সঠিক নয়। পাকিস্তান সরকারকে যদি খোলাখুলি নিন্দা করা হয় তাহলে চুপি চুপি সমালোচনা করার চাইতে বেশী ইফেক্ট হবে। অতএব এই বিষয়টা আরও ভালো ভাবে অনুধাবন করতে হবে। তাই আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে এবং আমরা ব্যার্থ হয়ে গেছি এসব এখনি বলা যাবেনা। এটা আমাদের দির্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতা যেখানে আমাদের ক্রমাগত আমাদের পলিসি প্রচার করতে হবে যা আমরা নির্ধারন করে রেখেছি।

শ্রী জগদীশ প্রসাদ মাথুর (রাজস্থান) ঃ মাননীয় মন্ত্রী এখন বললেন যে আমাদের প্রতি প্রথিবির অধিকাংশ দেশের প্রইক্রিয়া অনুকূল। তিনি কেবল রাশিয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানের নিন্দা করেছেন। কিন্তু রাশিয়ার পরবর্তি স্টেটমেন্ট থেকে মনে হচ্ছে সেও পাকিস্তানের প্রতি নরম সুরে কথা বলছে। এ থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে পৃথিবীর কোন দেশই – কি প্রাচ্যের – কি পাশ্চাত্যের – এ যাবত আমাদের নীতি ও প্রস্তাবের সমর্থনে কোন বক্তব্য রাখেনি। ইংল্যান্ড সম্পর্কে আপনি যতোটুকু বলেছেন শুধু পার্লামেন্টের ভেতরে যে আলোচনা হয়েছে তাঁরই রেফারেন্স দিয়ে নিজের বক্তব্য জোরালো করেছেন। কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাদের যে চিঠি লিখেছিলেন তার জবাবে কি তারা লিখিতভাবে কোন প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করেছেন? যদি করে থাকেন তাহলে তা ‘হ্যা’ বাচক সূচক না ‘না’ বাচক সূচক? মাননীয় মন্ত্রী কি অনুগ্রহ পুর্বক সে পত্র সংসদে আনবেন? শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণের সন্মানের প্রশ্নে উল্যেখ্য যে শুধু হেলসিংকিতেই নয় আরব দেশগুলিতেও তাকে অপমান করা হয়েছে। বিশেষ করে আমাদের একান্ত বন্ধুরাস্ট্র মিশরের প্রেসিডেন্ট দুদিন অপেক্ষা করার পরেও নীতিগত কারণে তার সাথে সাক্ষাতকার দিতে সম্মত হননি। এ থেকে সুস্পষ্ট হয় যে শুধু প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য নয় বরং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিও আমাদের প্রতি যে মনোভাব পোষণ করেছে সেজন্য দায়ী আমাদের নীতি। মাননীয় মন্ত্রীর কাছে আবেদন, তিনি বলুন, ২৫ মার্চ, যখন থেকে বাংলাদেশের যুদ্ধ শুরু হয়েছে পৃথিবীর কোন দেশ – রাশিয়া, ইংল্যান্ড, আমেরিকা বা চিন কেউ কি পাকিস্তানকে আর্থিক বা অন্য কোনোভাবে সহযোগিতা করে?

সর্দার শরণ সিং: আমি মাননীয় সদস্যের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত নই। রাশিয়ার কিছু নেতাদের বক্তব্য রাষ্ট্রপতি পদ্গরনির দেয়া বক্তব্য থেকে ভিন্ন হতে পারে। আমি এই দৃষ্টিভঙ্গির সত্যতা সম্পর্কে সন্দিহান। দ্বিতীয়ত আমি বলতে চাই আমাদের প্রধানমন্ত্রীর লেখা চিঠি সম্পর্কে। এই চিঠিগুলো প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সরকারপ্রধানকে লিখেছিলেন যার মধ্যে বেশ কিছুর উত্তর আমরা পেয়েছি। বাকি উত্তরগুলো অপেক্ষমাণ আছে। কিন্তু এসব চিঠি জনসম্মুখে প্রকাশ করা নিয়মবহির্ভুত – যা আমরা সবাই জানি। এবং এসংক্রান্ত কোন কপি পেশ করা হবেনা।

শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: এটা সম্মেলন হয়নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আপনি প্রকাশ করেছিলেন। এতে আমরা সন্তুষ্ট না।

সরদার শরণ সিং: এই বিশেষ ক্ষেত্রে চিঠি প্রকাশ করার কোন চিন্তা আমাদের নেই। তৃতীয় প্রশ্ন সম্পর্কে বলতে চাই – এটা ঠিক যে শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণ সংযুক্ত আরব রিপাবলিকের প্রেসিডেন্ট সাদাতের সঙ্গে এপয়েন্টমেন্ট পাননি। আমি এর জন্য দুঃখিত কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে ওই সময়ে তাদের নিজেদের অভ্যন্তরীণ সংগ্রামের প্রেক্ষাপট কি ছিল – তারা তখন তাদের সরকার গঠনের মাঝামাঝি অবস্থায় ছিল যেখানে তারা তাদের অনেক উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে একশন নিচ্ছিলেন —

সরদার শরণ সিং: সে সময়ে কঠিন ছিল আসলে। আপনি যদি ফাইল দেখেন তাহলে একমত হবেন যে, সময়জ্ঞান সঠিক ছিলোনা – কারণ কায়রোতে তখন এইসব পরিবর্তনের কাজ চলছিল যা মাঝামাঝি পর্যায়ে থাকার জন্য তারা সময় দিতে পারেনি।

শ্রী আকবর আলি খান: তারা তাদের সহানুভূতি এবং অন্তর্বেদনা প্রকাশ করতে পারতেন।

সরদার শরণ সিং: আমি আপনার সাথে একমত এবং আপনার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই তাদের সেরকম কিছু করা উচিৎ ছিল। শেষ প্রশ্ন ছিল পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু করার পড় থেকে কোনো দেশ তাদের কোনো অস্ত্র দিয়েছিল কিনা? আমাদের উৎস থেকে পাওয়া একমাত্র তথ্য হল চীন থেকে তারা অস্ত্র পেয়েছিল। আমরা এই ব্যাপারে আসলে সচেতন না যে তারা কোন কোন দেশের কাছ থেকে অস্ত্র পেয়েছে। আমি অর্থনৈতিক এইড সম্পর্কে কিছু বলতে পারব না কারণ আমি সত্যিই কোন তথ্য দিতে পারবোনা।

শ্রী আকবর আলি খান: তুরস্ক ও ইরান সম্পর্কে?

সরদার শরণ সিং: আমি বলতে পারব না যে তারা ইরান ও তুরস্ক থেকে মিলিটারি একশন শুরুর পরে কোনো অস্ত্র সাহায্য পেয়েছে কিনা।

শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: এখানে কেউ বলেনি যে বাংলাদেশ সংগ্রামের প্রতি আমাদের মনোভাব যুক্তরাজ্য সরকারের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। তবে স্যার, যুক্তরাজ্য যে মনোভাব দেখাচ্ছে তা ভারত এবং যুক্তরাজ্যের সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে। এবং সেই প্রেক্ষাপটে আমরা তাকে প্রশ্ন করছি। ব্রিটিশ সরকার যা করেছে তা নতুন কিছু নয়। ভারত-চীন সংঘাতের সময়ে আপনাদের মনে আছে জনাব ডানকান স্যান্ডি হঠাৎ দিল্লী ও করাচীতে আসেন ভারতকে ফাঁদে ফেলতে। তিনি কিছু কুখ্যাত বিবৃতিতে স্বাক্ষর করাতে এসেছিলেন যেখানে আমরা কাশ্মীর সহ আমাদের কিছু জাতীয় অবস্থানের বিষয়ে কম্প্রোমাইজ করেছিলাম। তারা ভারতের বিপক্ষে কাজ করেছিল। ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তারা আবারো আমাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তারা পশ্চিমা দেশগুলোকে আমাদের বিরুদ্ধে নেবার চেষ্টা করেছিল – যা আমাদের সবার জানা। বস্তুত আমরা ভারতের তথাকথিত কমনওয়েলথ বন্ধু দ্বারা আগ্রাসনের স্বীকার হয়েছিলাম। এখন আবার আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ব্রিটিশ সরকার প্রকাশ্যে ইয়াহিয়া খান ব্যাক আপ দিচ্ছেন এবং একটি ভারতবিরোধী প্রচারণার আভাস দিচ্ছেন। ব্রিটিশ কাগজপত্র কি লিখেছে সেটা কোন বিষয় না। এমনকি লেবার পার্টির অনেক মানুষ ইয়াহিয়া খান কর্তৃক সঙ্ঘটিত জবাই ও গণহত্যার বিরুদ্ধে তাদের সোচ্চার হয়েছে। শুধুমাত্র ব্রিটিশ সরকার কি অবস্থান নিয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ জনগণের মতের কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু আমরা সরকারের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সজাগ। ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে আমাদের কূটনীতি সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা হয়ত ভাল বিক্রেতা কিন্তু তারা সবচেয়ে আশাহীন, সবচেয়ে পঙ্কিল ক্রেতা যাদের সাথে আমাদের মোকাবেলা করতে হবে। এই সুপারিশই আমি করছি। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি খুব শক্তিশালী কিছু বলেছেন কিন্তু ইংল্যান্ডে ক্ষমতাসীন দলের একজন মন্ত্রী বা কোন ব্যক্তি ইয়াহিয়া খান বা তার অপরাধের বিরুদ্ধে কোন কথা বলেন নাই। এর বিপরীতে, তারা ইয়াহিয়া খানের কাছে আত্মসমর্পণ করে রাজনৈতিক সমাধান করার কথা বলছেন। সেটাই তাদের ধারণা। ইয়াহিয়া খানের অনুসারীরা ইংল্যান্ডের পূর্ব পাকিস্তানীদের সমর্থকদের দমনের চেষ্টা করছেন। সেটাও ঘটছে। তারা টাকা দিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যখন অন্যরা বন্ধ করে দিয়েছে তখন ব্রিটেন ইয়াহিয়া খানকে রিলিফের নামে অতিরিক্ত ফান্ড দিতে সিন্ধান্ত নিয়েছে। এই অর্থ পাকিস্তানীদের মনোবল যেমন শক্ত করবে তেমনি পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত সেনাদের পেছনে ব্যয় করা হবে। এগুলো গুরুতর বিষয় এবং সরকার তাদের প্রতি কোন নীতি গ্রহণ করছেনা। যুক্তরাজ্যের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কোথায় গিয়ে ঠেকেছে? এটাই আমরা জিজ্ঞেস করছিলাম। এখনও কেন ভারত কমনওয়েলথের মধ্যে থাকবে? প্রতিবার আমাদের নামিয়ে দেওয়া হয়েছে, লাথি মারা হয়েছে, আক্রান্ত করেছে এবং বিশ্বাসঘাতকতা করেছে কিন্তু এখনো আমরা কমনওয়েলথের সাথে সম্পর্ক অব্যাহত রেখেছি। আমরা মনোযোগ আকর্ষনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এখন আমি জানতে চাই কেন সরকার ইউ.কে. এর বিরুদ্ধে একটি নির্দিস্ত পরিকল্পনা নিচ্ছেনা? বিশেষ করে দুই দেশের সম্পর্কের ব্যাপারে। আমি মনে করি, সির, তারা যা করছেন তাতে আমাদের উচিৎ ব্রিটিশ নাগরিকদের আমাদের দেশে ভিসা ও অন্যান্য যাবতীয় সুবিধা দেয়া বন্ধ করে দেয়া উচিৎ – শুধুমাত্র যারা ভারতীয়দের জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ তারা ছাড়া। ব্রিটেন এখন আমাদের কাছ থেকে যেসকল ছাড় পায় সেগুলোও বন্ধ করে দেয়া উচিৎ।

আমাদের উচিৎ তাদের মুদ্রা আমাদের এখানে রেমিট করা বন্ধ করে দেয়া এবং অন্যান্য মুনাফা থামিয়ে দেয়া – যতক্ষণ না আমরা উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধান করতে পারি – যা আমাদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তান। এটাও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তাদের একটি চাল। আমাদের সত্যিই এখানে বসবাসরত সকল ইম্পেরিয়ালিস্ট – বিশেষ করে ব্রিটিশদের দেশ ছাড়ার কথা বলা উচিৎ। কারণ আমরা জানি তারা তারিক আলির মত লোকদেরকেও এখানে পাঠাচ্ছে যারা আমাদের ক্ষতি করতে চেয়েছিল। এসব পদক্ষেপ আমরা এখনি নিতে পারি। তাছাড়া এখানে ব্রিটিশ ইনভেস্টরদের সম্পদ জব্দ করে নিয়ে সেগুলো দিয়ে উদ্বাস্তুদের সাহায্যে কাজে লাগানো উচিৎ। প্রতি বছর তেল ও কয়লাখনি থেকে কোটি কোটি রুপি তারা নিয়ে যাচ্ছে। কেন আমরা সেগুলো দিয়ে বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের রিলিফের জন্য কাজে লাগাব না? এরকম ব্যাবস্থা আমরা নিতেই পারি। আমাদের অবশ্যই সচিবালয় থেকে তাদের প্রত্যাহার করা উচিত, কমনওয়েলথ থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করা উচিত, যুক্তরাজ্য সঙ্গে আমাদের সমগ্র সম্পর্ক নতুনভাবে পুনর্বিবেচনা করা উচিত। কমনওয়েলথ নিয়মিতভাবে আমাদের সাথে যে আচরণ করছে তা ক্রমাগত জাতীয় স্বার্থের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠছে।

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: দয়া করে শেষ করুন।

শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: অতএব, আমি বলতে চাই, সরকার শুধুমাত্র দৃঢ়ভাবে আপত্তি জানাবে তাই নয় – আমাদের জাতীয় ক্ষোভ, অনুভূতি প্রকাশ করতে হবে। ইয়াহিয়া খানের সাথে বৃটিশ সরকারের আনুকূল্যের কারণে আমাদের সাথে তাদের কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও অর্থণৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। এটাই আপনাদের কাছে দাবি করছি। এটাই হবে এই পরিস্থিতি মোকাবিলার সর্বোতকৃষ্ট পথ। এগুলো আমার কিছু প্রস্তাবনা। সরকারের উচিৎ তার অবস্থান স্পষ্ট করা।

সরদার শরণ সিং: আমি মনে করি নতুন কোন শত্রু না বাড়িয়ে এই মুহুর্তে আমাদের উচিৎ বাংলাদেশ সম্পর্কিত বর্তমান পরিস্থিতির সমাধানে আমাদের শক্তি ব্যয় করা। তিনি যা প্রস্তাব দিয়েছেন সেগুলো অবশ্যই ভালো কিন্তু এখন আমাদের বাংলাদেশ সংক্রান্ত সমস্যা ছাড়া নতুন কোন দেশের সাথে বিরোধিতা করা ঠিক হবেনা। সেটা ভিন্ন ইস্যু। সেটার সাথে এটাকে মেলানো ঠিক হবেনা।

শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: তারা এই হত্যার প্ররোচনা দিচ্ছে। ব্রিটিশ সরকার হিথ সরকার গঠন করার পড় থেকেই এই পলিসি শুরু করেছে। আপনি জানেন তারা ভারতবিরোধী মনোভাব পোষণ করে। এশিয়া বিরোধী মনোভাব পোষণ করে। এবং এখন তারা বাংলাদেশের উন্নয়নের ব্যাপারে প্রতিহিংসামূলক নীতি ব্যবহার করছেন। তারা চায় বাংলাদেশের মানুষ শোষিত হোক যা চলমান আক্রমণের জন্য হচ্ছে- অর্থাৎ এতে করে এশিয়ান জনগণ – বা ভারতের জনগণের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান প্রকাশ পায়।

সরদার শরণ সিং: যোগ করার আর কিছুই নেই।

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: জনাব গোরে।

শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: কোন উত্তর নাই? এটাই এই পার্লামেন্টের সমস্যা। যখন ব্রিটিশদের আলোচনা ওঠে আমাদের মন্ত্রীরা নীরব থাকেন। এটাই সমস্যা। গত দশ বছর ধরে আমি এটাই দেখছি। যখন ব্রিটেনের কথা ওঠে তারা পুরো চুপ থাকেন। জিনিসটাকে ইভেড করেন তারা।

সরদার শরণ সিং: আমি বলব সন্মানিত সদস্যের এই পর্যবেক্ষণ খুবই নির্দয়। গুরুত্তপূর্ন বিষয়ে আমাদের সন্দেহাতীত এবং পরিষ্কার অবস্থান রয়েছে। রোডেশিয়া ইস্যু, দক্ষিণ আফ্রিকাতে অস্ত্র সরবরাহ এবং সর্বপরি কলনিয়ালিজমে আমরা ব্রিটিশদের বিরোধিতা করেছি। আমি মনে করি এখন আমাদের মূল সমস্যার দিকে আলোকপাত করা উচিৎ। আমি আবারো বলছি – নতুন করে কোন শত্রু বাড়াতে চাইনা।
ডঃ. ভাই মানাবির: কিন্তু কি দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া হবে?

শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: আপনি বলেছেন একটি দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলা হচ্ছে। দ্বিতীয় মানে কী? আমরা কি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা বুঝিয়েছি?

শ্রী এন জি গোরে (মহারাষ্ট্র): যতক্ষণ এই ফ্রন্ট না থামে ততক্ষণ আমি প্রশ্ন করব না।
স্যার, এই প্রশ্ন খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ যেহেতু আমরা জানতে পারলাম যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মস্কো থেকে শুরু করে লন্ডন, প্যারিস ও ওয়াশিংটন সহ বিভিন্ন দেশের রাজধানীতে যাচ্ছেন। আমি তার কাছে জানতে চাই এই মিশনে তিনি মনে মনে কি আশা পুষে রেখেছেন? কারণ ২৫ মার্চ থেকে যখন ইয়াহিয়া খান সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করেছে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের নিঃশেষ করার জন্য তখন দুইটি ঘটনা ঘটেছে। প্রথমত – কোন দেশ বাংলাদেশের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেনি। তারা এলোমেলোভাবে অবস্থান নিয়েছেন। এমনকি ত্রাণ দেবার ব্যাপারেও কোন দেশ এগিয়ে আসেনি। এটা এক নাম্বার।

অপরটি হল – যখন উদ্বাস্তুরা প্রবেশ শুরু করল – যার সংখ্যা এখন চার মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে – কোন দেশ বড় কোন সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসলনা। স্যার, আমরা আমাদের প্রতিনিধিদের বাইরে পাঠিয়েছি। একজন মন্ত্রী ইতিমধ্যে বিদেশে আছেন এবং এখন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে বাইরে যাচ্ছেন। আমি জানি না এই ভিজিটের উদ্দেশ্য কি। এটা কি শরণার্থীদের জন্য আরও সাহায্য চাইতে? নাকি ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনী বাংলাদেশে যে হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে সেটা বন্ধ করতে? আমি জানতে চাই কি উদ্দেশ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাজেট অধিবেশনের মত গুরুত্তপূর্ণ সেশন রেখে সফরে যাচ্ছেন। তাছাড়া আমরা জানি, আমরা মানুষকে বোঝাতে বারবার ব্যার্থ হচ্ছি। কেউ কেউ বলেছেন যে আমাদের প্রচার মাধ্যম সঠিকভাবে কাজ করছে না। আমি এমন মনে করি না। পাবলিসিটি তার কাজ করেছে। পররাষ্ট্র সংবাদদাতারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আছে। তারা বিস্তারিত রিপোর্ট করেছেন। গোটা ব্যাপারটা হল চীন বা রাশিয়া বা ইংল্যান্ড অথবা আমেরিকা বা ফ্রান্স – তারা তাদের নিজস্ব জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করার জন্য নিযুক্ত আছে – কারণ এটা তাদের পলিসি যে তারা তাদের নিজেদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করবে। এটা সবকিছুর উর্ধে। বাংলাদেশে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে জেনেও তারা কেউ এতে জড়িত হতে প্রস্তুত নন। বাংলাদেশ কৌরব সভায় দ্রৌপদির মত অবস্থায় আছে। সবাই জানে যে যা ঘটছে তা খারাপ – কিন্তু কেউ এটা বন্ধ করার জন্য কিছু করছেনা। আমি মাননীয় মন্ত্রীর কাছে জানতে চাই – এটা কি এখন স্পষ্ট নয় যে আপনার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বিভিন্ন দেশ তাদের নিজস্ব জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করার অজুহাতে আপনার লাইনে কেউ আসছে না? তারা কোন সাহায্যে এগিয়ে আসতে যাচ্ছে না এবং আপনি যদি মনে করেন যে তারা উদ্বাস্তুদের জন্য বড় রকমের কোন সাহায্য দেবে – এটাও তারা করতে যাচ্ছেনা। এবং উদ্বাস্তুদের সমস্যা আমাদের জন্য একটি খুব দীর্ঘ মেয়াদি মাথা ব্যাথা হতে যাচ্ছে। এবং শুধুমাত্র ভারতীয়দের এই সমস্যা মোকাবেলা করতে হবে।

স্যার বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রধানদের দেয়া প্রধানমন্ত্রীর চিঠির ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন এই চিঠি প্রকাশ করা যাবেনা। আমি তার সাথে একমত। কিন্তু এটা সত্য যে, যখন চীন ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক শীতল হয়ে ছিল তখন চীনের প্রধানমন্ত্রী ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যকার সব চিঠি একটি শ্বেতপত্র আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। আমি মনে করি সেরকম সময় এসেছে। .. (বাধা)। না, না, বিরোধের অনেক আগে এটা হয়েছিল – ১৯৬২ সালে। চিঠি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৮ সালে। একটির পর একটি – মোট ৩ টা শ্বেতপত্র প্রকাশিত হয়েছিল।

স্যার, আমি সুপারিশ করব: বাংলাদেশকে নিরাপদে রাখার জন্য ভারত কি কি করছে এবং পাশাপাশি বিশ্বের অন্য দেশগুলো কি করছে সেগুলো মিলিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করবেন যাতে সমস্ত বিশ্ব তা জানতে পারে। জনাব জয়া প্রকাশ নারায়নের সাথে সঙ্ঘটিত সেই ঘটনা ও তাদের প্রতিক্রিয়াও উল্লেখ থাকতে হবে। এই দুই/ তিনটা বিষয়ের উপর আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষন করছি।

সদর শরণ সিং: স্যার এটা সত্য যে কিছু রাজধানী সফরের প্রস্তাব আছে। আমি জানি সংসদ থেকে দুরে যাওয়া কঠিন কাজ।

কিন্তু সামগ্রিক স্বার্থে আমাকে এটা করতে হবে। কিন্তু এখনো কোন চুক্তি হয় নাই। তাই আমি এই বিষয়ে বিশদ কিছু বলতে পারব না। চেষ্টা করব পাকিস্তানের ঘটনাবলি, রাজনৈতিক প্রভাব এবং সব সমস্যা তুলে ধরতে। সুতরাং এটি এখন বলা যাবেনা যে আমি একটি নির্দিষ্ট জিনিস অর্জন করে আসব। এতে এইটুকু হবে যে বিশ্ব নেতারা তাদের গুরুত্ব বুঝতে পারবেন – ঘটনার সত্য অবস্থা জানবেন – অবস্থার উন্নতি কীভাবে করা যায় এই চেষ্টা করবেন – যাতে করে মিলিটারি একশন বন্ধ করে স্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা যায়।

শ্রী এন জি গোরে: আপনি একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য অনুরোধ করবেন।
সরদার শরণ সিং: আমাকে আমি যা বলতে যাচ্ছি তার সব জিজ্ঞাসা করবেন না। সব এখনো ঠিক হয় নাই।

তারপর স্যার, তিনি খুব প্রাসঙ্গিক একটি মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন যে অন্যান্য দেশ তাদের স্বার্থ অনুযায়ী কাজ করবে যা তাদের কাছে সবচেয়ে ভালো মনে হবে। এটাই আন্তর্জাতিক জীবনের কঠিন বাস্তবতা। তবে সেখানে যথেষ্ট সুযোগ আছে। হয়ত শুধু নিজেদের স্বার্থ নির্নয় বাদেও তারা এমন কোন দরকারি জিনিস মিস করলেন যা আমাদের বা বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে। এবং এটা গুরুত্তপূর্ন যে সেরকম বিষয় তুলে ধরার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। সব শেষে আমি দুঃখ প্রকাশ করছি আমার অবস্থান পরিবর্তন না করতে পারার জন্য যা আমি আগেই বলেছি। সেটা হল আমরা প্রধানমন্ত্রী যে চিঠি লিখেছেন বা যে উত্তর পেয়েছেন সেসকল পত্র প্রকাশ করছিনা।

ডঃ. কে ম্যাথিউ কুরিয়ারন (কেরল): স্যার, মাননীয় মন্ত্রী বলেছেন, তার এই সফরের একটি উদ্দেশ্য হল বিদেশি সরকারগুলোর বাংলাদেশের সমস্যার প্রতি ইমপ্রেস করা। কিন্তু তিনি একটি বিষয় স্পষ্টভাবে বলেননি যে তিনি ভারত যে বাংলাদেশেকে স্বীকৃতি দিতে চায় সেই ব্যাপারে বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধানদেরকে ইমপ্রেস করবেন কিনা। তা না হলে তারা কীভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতির ব্যাপারটা শুরু করবে? ভারত যে বাংলাদেশের বিপ্লবীদের সব উপাদান, অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা দেবে সেই ব্যাপারে বিশ্বের অন্যান্য দেশকে ইমপ্রেস করতে চেষ্টা করবে কিনা? আমি মাননীয় মন্ত্রীর কাছে জানতে চাই ভারত কীভাবে যুক্তরাজ্যকে পাকিস্তানকে সাহায্য দিতে বন্ধ করতে অনুরোধ করবে?

ভারত সরকার ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক সাহায্য, বেসরকারী একচেটিয়া পুঁজির জন্য যুক্তরাজ্যের কাছে ঋণগ্রস্ত। আমি জানতে চাই ভারত কি ইংল্যান্ডকে পাকিস্তানকে সাহায্য না করার অনুরোধ করবে কিনা যেখানে সে নিজেই বন্দরনায়েক সরকারকে অস্ত্র সাপ্লাই দিচ্ছে যেখানকার জনগণ আমি এটা স্পষ্ট করে বলতে চাই যে সিংহল বিদ্রোহের ব্যাপারে আমি কোন পক্ষ নিচ্ছি না। সেখানকার অবস্থা যাই হোক না কেন ভারতের জন্য বাইরের দেশে অস্ত্র সাপ্লাই দেয়া লজ্জার বিষয়। আমি জানতে চাই নীতিগত কি জোর তার আছে ইংল্যান্ডকে পাকিস্তানকে সহায়তা বন্ধ করার অনুরোধ করার ব্যাপারে যেখানে ভারত নিজেই তেমন কাজ করছে।

সরদার শরণ সিং: আমি মাননীয় সদস্য যে প্রশ্ন করেছেন তার নৈতিক মানের উপর আপিল করতে চাই। এটা খুবই দু: খজনক যে মাননীয় সদস্য এভাবে চিন্তা করছেন এবং আমি অন্যদের অনুরোধ করব এভাবে ভাবতে —

ডঃ. কে ম্যাথিউ কুরিয়ান: আপনার জন্য দু: খজনক।
সরদার শরণ সিং …. এধরনের প্রকাশভঙ্গী খুব বিপজ্জনক এবং তা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। আমি তাকে এটা থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করব।

ডঃ. Kকে ম্যাথিউ কুরিয়ান: জাতীয় স্বার্থ? কার জাতীয় স্বার্থ? জনগণের জাতীয় স্বার্থ?
সরদার শরণ সিং: আমি একটা বিষয় পরিষ্কার করতে বলব যে বাংলাদেশ ও সিংহল ক্ষেত্রে আমাদের মনোভাব একই রকম কিনা? বাংলাদেশে আমরা আওয়ামী লীগকে সমর্থন করছি কারণ তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধিত্ব করছে। আমাদের অবস্থান একেবারে অভিন্ন। এভাবে চিন্তা করার সমস্যা হল .. (বাধা) উত্তেজিত হবেন না।

শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: জনাব শরণ সিং, এই একটি খুব বুদ্ধিমানের মত তর্ক নয়।
সরদার শরণ সিং: তাহলে আসুন তর্ক বন্ধ করি। আমি বলতে চাই যে এধরনের প্রশ্ন করার নৈতিক অধিকার সম্মানিত সদস্যদের নেই। আমরা পুরোপুরি আমাদের অধিকারের মধ্যে আছি – নৈতিক ও সাংবিধানিক ভাবে। আমরা যে পথ ধরেছি সেটাই আমরা চালিয়ে যাব।

জনাব ডেপুটি চেয়ারম্যান, রাজ নারায়ণ বাবু, এখন আপনি প্রশ্ন করুন।

শ্রী রাজ নারায়ণ (উত্তর প্রদেশ) : আমি জানতে চাই, ভারত সরকার বিদেশী রাষ্ট্র নায়কদের কাছে যেসব চিঠি লিখেছেন সেগুলোতে আমরা অধিকভাবে ‘পলিটিকাল সল্যুশন’ বা ‘পলিটিকাল সেটেলমেন্ট’ শব্দের প্রয়োগ হয়েছে কিনা? সমাচার পত্রিকার সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন, স্বাধীন বাংলাদেশে ‘রাজনৈতিক সমাধান’ করতে হবে। আমি জানতে চাই যে, এই রাজনৈতিক সমাধানের স্বরূপ কি? রাজনৈতিক সমাধানের অর্থ কি? এই রাজনৈতিক সমাধানে কি সন্নিবেশ করতে হবে? এর অর্থ কি এই যে আগ্রাসন অতি সত্বর বন্ধ করতে হবে? স্বাধীন বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানী বিদেশী হামলা কি এখানেই শেষ? সমস্ত সৈন্য সেখান থেকে অপসারিত হবে আর স্বাধীন বাংলাদেশ তার নিজস্ব স্বাধিনিতা নিয়ে চলবে? আমি যা বলছি ভারত সরকারের রাজনৈতিক সমাধানের অর্থ কি এটাই? আর আমি জানতে চাচ্ছি এই ‘পলিটিকাল সেটেলমেন্ট’ শব্দটি কখন থেকে এসেছে? স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশ্নে পলিটিকাল সেটেলমেন্ট শব্দটির ব্যাবহার প্রথমে ভারত সরকার করেছে, না রাশিয়া, অ্যামেরিকা বা ব্রিটেন এটি আবিষ্কার করেছে? পলিটিকাল সেটেলমেন্ট শব্দটি এরূপ অস্পষ্ট ও অনিশ্চিত যে এর একটি অর্থ বেরিয়ে আসতে পারে। একটি অর্থ আওয়ামীলীগের ৬ দফা পরিকল্পনায় পৌঁছাতে পারে। এও হতে পারে যে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক রূপে উভয়ের সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে এজন্য আমি খোলা মনে প্রথমে জানতে চাই যে ভারতের সরকারী দফতরে রাজনৈতিক সমাধানের কি ব্যাখ্যা রয়েছে? সরকারের মনোভাব ও একজন ভারতীয় নাগরিকের মনোভাব কি অভিন্ন? স্বাধীন বাংলাদেশের ব্যাপারে আমাদের পরিষ্কার মনোভাব হচ্ছে – সেখানে সম্পূর্ণভাবে বিদেশী শক্তি, আজ যারা সেখানে অবস্থান করেছে, সমস্ত শক্তি সরিয়ে নেবে এবং স্বাধীন বাংলাদেশ স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রূপে আপন অস্তিত্বে টিকে থাকবে। দুজন সোশ্যালিস্ট আছেন। একজন ইন্দিরা গান্ধী, অপরজন ব্রিটিশ লেবার পার্টি। উভয় সোশ্যালিস্ট আজ স্বাধীন বাংলাদেশের স্বতন্ত্র দাবী রাখার প্রয়াসী। আমি সর্দার শরণ সিং এর কাছে জানতে চাই আপনি কেন বিদেশে যান? কি বুঝাবার আছে তাদেরকে? ভারত সরকার অপেক্ষা কেউ কম জানেনা। পৃথিবীতে এমন কোন দেশ আছে যে, আজ স্বাধীন বাংলাদেশে যা ঘটেছে তা সম্পর্কে অবহিত নয়? স্বাধীন বাংলাদেশ সম্পর্কে সকলে খবর রাখে। জাতীয় স্বার্থেই সকল দেশ নিজেদের কথা ভাববে। তাহলে আমাদের জাতীয় স্বার্থ কি? আমি বিদেশ মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে জানতে চাই, ভারত সরকার রাষ্ট্রীয় কল্যানার্থে কী ভাবছেন? স্বাধীন বাংলাদেশ টিকে থাকা বা তার লুপ্ত হওয়া ভারতের রাষ্ট্রীয় স্বার্থের পক্ষে? আমি প্রথমে এটিই দেখতে চাই যে, ভারতের রাষ্ট্রীয় কল্যাণ ভারত সরকার কোন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন? এই সাথে আমি এও বলতে চাই, যারা কমনওয়েলথ কমনওয়েলথ বলে চিৎকার করছেন (আমি আগাগোঁড়াই যার বিরোধী ছিলাম) যতক্ষণ কমনওয়েলথের সাথে আমাদের সম্পর্ক ছিন্ন না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের স্বাধীন বিদেশ নীতি হবে না। আমার চোখের সামনে এখন এই পরিস্থিতি। এ সময় ব্রিটিশ সরকার যা কিছু করেছে সর্দার শরণ সিং হুবহু এখানে ওইসব করার জন্য প্রস্তুত রয়েছেন।

সর্দার শরণ সিং: সম্পূর্ন ভুল কথা আপনি বলেছেন।

শ্রী রাজ নারায়ণ: আমি জানতে চাই, ভারত সরকার আজও একথা মানেন কিনা যে, হিন্দুস্তান বিভক্ত হল, এবং ভারত ও পাকিস্তানের সৃষ্টি হল, এতে ব্রিটেন, রাশিয়া, অ্যামেরিকা তিন দেশেরই চক্রান্ত ছিল? এটা ভিন্ন কথা যে হিন্দু মুসলিম বিদেশের আশংকা বেড়েছিল, এটা ভিন্ন কথা যে মোঃ জিন্নাহ নাছোড় হয়েছিলেন এবং নেহেরুজি বৃদ্ধ বয়সে ক্ষমতা লাভের জন্য প্রলুব্ধ হয়েছিলেন, এতদসত্তেও রুশ, অ্যামেরিকা ও ব্রিটেন এই ত্রিরাষ্ট্রই চাইত ভারত এক বৃহৎ রাষ্ট্ররূপে যেন না থাকতে পারে এবং দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। সুতরাং তারা কীভাবে মেনে নেবে যে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হোক যা ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টে সঙ্ঘটিত অস্বাভাবিক দেশ বিভাগের বিলুপ্ত ঘটাবে। এজন্য ব্রিটেন, রুশ, অ্যামেরিকা এরা সকলে চাইবে যে পাকিস্তানের সাহায্য লাভ অব্যাহত থাকে। ব্রিটেন স্পষ্টভাবে যা বলেছে আমাদের সর্দার শরণ সিং কি তা জানেন না – পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাবস্থাকে সে ধ্বংস হতে দেবেনা? পাকিস্তানের অর্থনণৈতিক কাঠামও অটুট রাখার জন্য ব্রিটেন পূর্ন প্রচেষ্টা চালাবে একথা পরিষ্কারভাবে বলা হচ্ছে। অতএব, আমি জানতে চাই, এই সরকার, আজ স্বাধীন বাংলাদেশ সম্পর্কে কি পরিকল্পনা মনে মনে পোষণ করেছেন? সর্দার শরণ সিং কোন রূপরেখা নিয়ে বিদেশে যাবেন? বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধানদের কি কথা বলবেন? এবং স্বাধীন বাংলাদেশে কোন ধরণের সেটেলমেন্ট করানোর উদ্যোগ নেবেন?

উপ-সভাপতিঃ আপনার প্রশ্ন শেষ।
শ্রী রাজ নারায়নঃ আমি কামনা করি এবং বিদেশী মন্ত্রী মহোদয়কে জিজ্ঞেস করতে চাই যে, তিনি যখন বিদেশে যাবেন তখন কি বলবেন যে বাংলাদেশ স্বাধীন।

উপ-সভাপতিঃ মন্তব্যপূর্ন কথা যা আছে বলুন কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বলুন।
শ্রী রাজনারায়নঃ আমি বলতে চাই যে ভারত সরকার কি বিদেশে একথা অকপটে বলবে না যে বাংলাদেশ এখন স্বাধীন, পশ্চিম পাকিস্তান তার উপর চড়াও রয়েছে, পশ্চিম পাকিস্তানের হামলা মুক্ত করতে হবে, তার সৈন্য ফিরিয়ে নিতে হবে এবং স্বাধীন বাংলাদেশকে আমরা স্বীকৃতি দেব —

উপ-সভাপতিঃ ঠিক আছে বলুন। পুনরুক্তি হচ্ছে রাজ নারায়ণ বাবু।
শ্রী রাজ নারায়নঃ এখন ব্রিটেন, রুশ এবং অ্যামেরিকার মনোভাব জানার জন্য আমরা প্রস্তুত নই, আমরা জানি ভারতের এই অকপট মনোভাব রয়েছে যে স্বাধীন বাংলাদেশকে এযাবৎ স্বীকৃতি না দিয়ে ভারত সরকার ভুল করেছে। ২৫ মার্চ হতে আমরা অনাবশ্যক শব্দজাল বিছিয়ে চলছি।
উপ-সভাপতিঃ ঠিক আছে রাজ নারায়ণ বাবু, আপনি বসে যান।
শ্রী রাজ নারায়নঃ জুন ম্যাস এসে গেল। আমি চাই ভারত সরকার আন্তরিকভাবে এসব কথার জবাব দেবেন।

উপ-সভাপতিঃ জনাব শরণ সিং আপনি কি এই পয়েন্টে কিছু বলতে চান?
সর্দার শরণ সিং ঃ দোয়া করে অপেক্ষা করুন। কিছু সমালোচনা ছিল। কিন্তু মনে হয় এটা ভাল মত অবগত করা হয় নাই। মাদের অবস্থান হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সেখানে যে অপারেশন চালাচ্ছে এবং তারা যা করছে তা বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান করবে না। তাই এর একটি সমাধান বের করতে হবে। কোন সামরিক কায়দায় নয়। এটাই বিশ্বের আরও অনেক অবস্থায় প্রকাশ করা হয়েছে। ক্রমাগত সামরিক শাসনের প্রভাব ভালো নয় এবং এর বেশী ধারনা করা সন্মানিত সদস্যের জন্য ভালো হবেনা। আমরা একটি নির্দিস্ট সমাধান চাই। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে এটি বাংলাদেশের জনগণ এবং তাদের সেনা শাসকদের মধ্যকার একটি বিষয় – যাদের সাথে তারা এখন লড়াই করছে।

শ্রী রাজ নারায়নঃ যে কেউ বলতে পারে।

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: জনাব রাজনারায়ণ, তাকে শেষ করতে দিন দয়া করে।

সদর শরণ সিং: আমি সন্মানিত সদস্যের কাছে আবেদন করব বিষয়টি তাদের কাছে ছেড়ে দেবার – যাতে তারাই এর সমাধান বেড় করে- এবং তাদেরকে পথ বাতলে দেয়া আমাদের কাজ নয়। তারা ইতিমধ্যে বেশ ভাল ভাবে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, মওলানা ভাসানী ও বাংলাদেশের কয়েকজন নেতা এই ব্যাপারে তাদের মনোভাব স্পষ্ট করেছনে। এবং আমাদেরও তাদের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে বলা উচিৎ যে সেনা শাসন বন্ধ করা উচিৎ। এবং জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে – যা কিনা সম্পূর্ন বেসামরিক এবং ন্যায়সঙ্গত। আমাদের অবস্থান সঠিক এবং কৈফিয়তমূলক নয়।

শ্রী দ্বিজেন্দ্রলাল সেনগুপ্ত (পশ্চিম বঙ্গ): এটা আমাদের সমস্যা এবং এটা উপলব্ধি করা উচিত।
সরদার শরণ সিং: যতদূর আমরা উদ্বিগ্ন তাতে এটিকে আমাদের সেটেল করতে হবে। আমরা বলি নাই যে আমরা সেটেল করতে যাচ্ছিনা। বস্তুত, প্রধানমন্ত্রী, ২৪ মে তার বিবৃতিতে পরিষ্কার করেছেন –

“যদি জগতের কারো কোন চিন্তা-ভাবনা না থাকে তাহলে আমরা সব ব্যবস্থা গ্রহণ করব। আমাদের নিজস্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যা করা দরকার আমরা তা নিশ্চিত করব …”
শ্রী দ্বিজেন্দ্রলাল সেনগুপ্ত: কিভাবে?

সরদার শরণ সিং: “… এবং আমাদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক জীবন রক্ষ করব। “

শ্রী দ্বিজেন্দ্রলাল সেনগুপ্ত: কিভাবে এবং কখন …
(বাধা)

সরদার শরণ সিং: আপনি কি জিজ্ঞেস করেছেন কিভাবে এবং কখন …?

শ্রী দ্বিজেন্দ্রলাল সেনগুপ্ত: হ্যাঁ।

সরদার শরণ সিং: কিভাবে এবং কখন? এটা আমাদের জন্য রেখে দেয়া উচিত। আপনার সেটা করার কোনো ক্ষমতা নেই।

শ্রী দ্বিজেন্দ্রলাল সেনগুপ্ত: এটা আপনার একচেটিয়া বিষয়? …. (বাধা) সরকার একেবারে ব্যর্থ হয়েছে। আমি বলছি ব্যর্থ হয়েছে।

সরদার শরণ সিং: আমি দুঃখিত, আমি আপনার বিশ্লেষণের সঙ্গে একমত না। এছাড়া সন্মানিত সদস্য শুধুমাত্র একটি প্রশ্ন করেছেন। তিনি কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছেন – সরকার বাংলাদেশ ইস্যুতে দেশে বা বিদেশে কি বলতে যাচ্ছেন? এই ব্যাপারে আমাদের মনোভাব …

শ্রী মহাবীর ত্যাগী (উত্তরপ্রদেশ): সরকার কি অন্যান্য সরকারকে জানাবে যে এই বিশাল পরিমাণ শরণার্থীদের জন্য আমরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকার জায়গা চাই?

সরদার শরণ সিং: আমি বিস্তারিত আলোচনা করতে যাচ্ছি না। শ্রী রাজনারায়ণ বাংলাদেশ ইস্যুতে আমাদের মনোভাব সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। আমি মনে করি —-

শ্রী ভূপেশ গুপ্ত আছে: বাংলাদেশের জনগণের দেশ স্বাধীন করা ছাড়া তাদের ভাগ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব না। আসুন এর থেকে বিচ্যুত না হই।

সরদার শরণ সিং: সরকার বাঙলা দেশ সম্পর্ক তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, আমার বন্ধু শ্রী রাজনারায়ণ সেদিন ওয়াক আউট করেছিলেন। আমি তাকে অনুরোধ করব সেদিনকার কার্যবিবরণী পড়ে দেখার।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৯৮। বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ শরনার্থীর আগমনের উপর আলোচনার জবাবে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিবৃতি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় প্রকাশিত পুস্তিকা ১৫ জুন, ১৯৭১

Sajib Barman
<১২, ১৯৮, ৫৫৭-৫৬০>
অনুবাদ

শরনার্থীদের দায়ভার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের
রাজ্যসভায় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর বিবৃতি
১৫ জুন, ১৯৭১

বাংলাদেশ থেকে আগত লক্ষ লক্ষ শরনার্থী প্রসঙ্গে আলোচনায় হস্তক্ষেপ করে রাজ্যসভায় ১৫ জুন, ১৯৭১ প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বলেনঃ

জনাব, আমি এই আলোচনায় হস্তক্ষেপ করতে চাইনি, কারন আমরা আমাদের নীতি পরিস্কার করে ব্যক্ত করেছি। আমাদের নীতি পরিস্কার নয়, একজন সদস্যের এমন বক্তব্যে আমি খুবই অবাক হয়েছি। আমি মনে করি আমাদের বক্তব্য সম্পুর্ন পরিস্কার। আমাদের দেশে, আমাদের মানুষদের মাঝে বিশ্বাসের এই অভাব যা আমাদের সদস্যবৃন্দ নিয়মিত দেখিয়ে যাচ্ছেন তা আমাকে অবাক করেছে। আমরা কি এই মহান দেশের নাগরিক? আমরা কি এমন নাগরিক যাদের নিজেদের আত্মবিশ্বাসের এমন অভাব রয়েছে? বিতর্কের আলোচনা শুনে আমার মাঝে এই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে, বাংলাদেশ থেকে আগত শরনার্থীদের উপর কী ঘটছে এই বিষয় তার থেকে অধিক গুরুত্বপুর্ন। কারন, আমাদের যদি আত্মবিশ্বাস না থাকে তাহলে আমরা কী বলছি তা গুরুত্বপুর্ন নয়, আমারা তা প্রয়োগ করতে পারব না।

আমি এই খানে আমার নাগরিকদের এবং সরকারের উপর প্রচণ্ড বিশ্বাস রেখে কথা বলতে চাই। আমার কোনরূপ সন্দেহ নাই যে আমরা আমাদের উপর আসা এই সমস্যা সম্পুর্ন রূপে সমাধান করতে পারব। এটা তাহলে কী বুঝায়? এর মানে কী এই যে, এখানে আসা শরনার্থীদের কোন সমস্যা হবে না? এটা তা বুঝাতে পারেনা। যখন কোন দেশকে হঠাত করে আসা অসংখ্য শরনার্থীর ঢল, অনেকদিন ধরে নয় বরং খুব অল্প সময়ের মাঝে- যা ছ’ সপ্তাহের মত হবে, প্রায় ষাট লক্ষ মানুষ, তখন তা কোন কৌতুকের বিষয় নয়; এটা কোন ছোট বা সাধারন ব্যাপার না। আমি মাননীয় সদস্যবৃন্দের কাছ থেকে শুনতে চাইঃ তারা কি এমন কোন দেশের কথা জানেন যা ইতিপুর্বে এর একদশমাংশ পরিমান সমস্যার ভিতরে পরেছে? বাস্তব সমস্যা অনুধাবন না করে এই ভবনে বসে থেকে খুব সহজেই শুধুমাত্র সমালোচনা করে যাওয়া খুব সহজ। এমনকি যদি ইউরোপের কোন দেশে দশ হাজারের মত শরনার্থী প্রবেশ করত তাহলে পুরো ইউরোপ তার সংবাদপত্র, সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সবাই গর্জে উঠত। আমরা এইখানে ষাট লক্ষ শরনার্থীদের আশ্রয় দেবার চেষ্টা করছি, যারা ভয়ের রাজ্য থেকে আহত হয়ে, রোগ নিয়ে, ক্ষুধার্ত হয়ে, জীর্ন হয়ে পালিয়ে এসেছে। এবং তারা এমন এক দেশে এসেছে যারা নিজেরাই পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশ। আমাদের এই যুদ্ধের শরনার্থী বা তাদের যাই বলি না কেন তাদের প্রতি সম্পুর্ন সহানুভুতি রয়েছে।

আমারা আমাদের সর্বোচ্চ দিয়ে তাদের জন্য চেষ্টা করব। এমনকি যদি আমাদের ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, যদি ক্ষুধার্ত থাকতে হয়, আশা করব আমাদের মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়গন তাদের এক বেলার আহার পরিত্যাগ করে তা শুরু করবেন। একই সময়ে আমাদের নিজেদের জনগণকেও দেখে রাখতে হবে, তারা যেন মারা না যায়। আমাদের এক্ষেত্রে দ্বৈত দ্বায়িত্ত পালন করতে হবে, এক আমাদের নিজ জনগন ও অন্য দিকে বর্ডারের ওপার থেকে আসা শরনার্থী।

একজন সন্মানিত সদস্য আমাদের অন্যদেশ থেকে ভিক্ষার থলি নিয়ে আনা সাহায্যের কথা বলেছেন। জনাব, ভিক্ষা করার অভ্যাস আমার নেই। এবং আমার ভিক্ষার উদ্দেশ্যও নেই। যদি আমাদের দেশ থেকে কোন কূটনীতিক অন্য দেশে যান, তিনি দুর্বল স্বরে কথা বলেন না; ভিক্ষা করেন না। আমরা কূটনীতিক পাঠাই কারন এটা একটা আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি। এবং আমরা বহির্বিশ্বকে এই পরিস্থিতি পাশ কাটিয়ে চলে যেতে দিতে পারিনা। তারা তদের দায় এড়িয়ে যেতে পারেনা। তারা সাহায্য করতে পারে, আবার নাও করতে পারে। কিন্তু তাদের পৃথিবীর এপ্রান্তে যা ঘটছে তার ফল ভোগ করতে হবে। তাদের কাছে এই পরিস্থিতি সঠিক ভাবে আমাদের তুলে ধরতে হবে। আমরা অবশ্যই সাহায্য চাই, এবং যত বেশি সাহায্য পাব তত ভালভাবে আমরা শরনার্থীদের দেখভাল করতে পারব। কিন্তু এ পর্যন্ত সাহায্যের পরিমান অতি অপ্রতুল; যা প্রয়োজন তার শুধুমাত্র একদশমাংশ পাওয়া গিয়েছে। আমি আশা করি এই সাহায্যের পরিমান বাড়বে। জীবন বাচানোর দিক থেকে এটা অবশ্যই অতি গুরুত্বপুর্ন, যথাসম্ভব পুষ্টি প্রদান করা এবং কলেরা ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত লোকজনের চিকিৎসা অতি দরকারি। কিন্তু এটা শুধু সাহায্যের পরিমানের ব্যাপার নয়। ঘটনার সঠিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে আমাদের এ আবেদন আরো বেশি গুরুত্বপুর্ন। আমরা কী নিয়ে উদ্বিগ্ন? আমরা শরনার্থীদের জীবন এবং অবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন, কিন্তু আমরা আরো বেশি চিন্তিত গণতন্ত্রের এই অবস্থা নিয়ে, মানবাধিকার নিয়ে, মানুষের সন্মান নিয়ে, যা আমাদের ও বিশ্বের সামনে মর্মভেদী এবং হৃদয় বিদারক পরিস্থিতি নিয়ে এসেছে। এবং যদি আমাদের প্রতিনিধিরা যান, তা উনারা মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী বা অরাজনৈতিক বা অন্য কেউ, তা সর্বোতভাবে ঘটনার সঠিক দৃষ্টিকোন থেকে বর্ননা করে বহির্বিশ্বের সামনে নিয়ে আসতে হবে, এবং আমি মনে করি আমাদের এই প্রচেষ্টা কিছুটা হলেও সফল হয়েছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক পত্রিকাগুলিতে এই পরিস্থিতির বিবরন আসতে শুরু করেছে, এবং তা আরো অধিক পরিসরে; আমি মনে করি যে এই অবস্থার পরিবর্তনে আমাদের কিছু করনীয় ছিল। সুতরাং, আমাদের যা কিছু অর্জিত হয়েছে তাতে নাক সিটকানো উচিত নয়। যেমনটা আমি এর আগেও এখানে বলেছিলাম যে, আমি আমাদের সন্মানীয় সদস্যবৃন্দ এবং বাইরের ব্যক্তিবর্গের দুঃখ এবং আবেগের জায়গাটা বুঝতে পারি। এটা বুঝা সম্ভব এবং আমি সহমর্মিতা প্রকাশ করি। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আমাদের আরো দূর পর্যন্ত ভাবা উচিত। এটা আমাদের কানাগলিতে নিয়ে যেতে পারেনা, এমনটা ভাবতে পারিনা যে আমরা কিছুই করতে পারিনি, কিছুই করা হয়ে উঠেনি এবং আমরা কিছুই করতে পারব না। আমরা একটা প্রকান্ড ভার বহন করছি, এবং আমি বলি- আমি জানিনা এই বিশ্ব এই ভার নেবে কিনা; যদি না হয় তাহলে দয়া করে গর্জে উঠুন, মহাত্নন- যেমনটা আমি সভাগুলোতে আমার লোকদের বা যে ক্যাম্পগুলোতে আমি গিয়েছি তাদের বলছিলাম যে আমরা নরকের পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে গিয়ে হলেও এর মোকাবেলা করব। কিন্তু এ নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই যে আমরা পারব কিনা, আমরা অবশ্যই পারব। এটা আমাদের বিভিন্নভাবে আঘাত করবে, অর্থনৈতিকভাবে, এবং আরো অনেক রকমভাবে, কিন্তু আমরা অবশ্যই এর থেকে পরিত্রান পাব যদি আমরা আমাদের সাহস, একাগ্রতা এবং ধৈর্য রাখি। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি আমাদের জনগনের এই সব সামর্থ্য রয়েছে, এবং, সেহেতু আমরা এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারব। কিন্তু, এটা খুব অল্প পরিশ্রম বা স্বল্প অর্থে করা সম্ভব হবে না। এই প্রচেষ্টা আমাদের সকল স্তরের নাগরিক দের প্রভাবিত করবে। এটা এমনকি আমাদের কিছু দরকারি প্রোগ্রামারদেরও প্রভাবিত করবে। কিন্তু এটা আমরা কোনভাবেই এড়িয়ে যেতে পারিনা, কারন, আমি যেমনটা আগেই বলেছিলাম যে, বাংলাদেশে যা ঘটবে তার প্রভাব ইন্ডিয়ার উপর পড়বেই। আমরা গণতন্ত্রের সাধারন নীতি গুলো নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছি, কিন্তু আমরা এ নিয়ে বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করছি কারন বাংলাদেশের বর্ডারে যা ঘটছে তার প্রভাব এখানে অনেক বেশি পরবে যতটা না দুরের কোন দেশে ঘটলে তার প্রভাব এখানে পরত।

আমার সহকর্মী এইমাত্র পশ্চিম বঙ্গের সরকার দ্বারা পরিচালিত কয়েকটি পরিচিত অভ্যর্থনা কেন্দ্রের কথা উল্লেখ করেছেন। আমি জানিনা তারা কি করতে যাচ্ছেন। এ পর্যন্ত, অল্প কয়েকজন ছাড়া আর কেউ শরনার্থীকেন্দ্র থেকে ফিরে আসেনি, প্রায় দুই হাজার লোক- যারা বিভিন্ন কারণে উত্তর ভারত থেকে গিয়েছেন, যা অবশ্য পশ্চিম বঙ্গের শরনার্থী কেন্দ্র গুলোর সাথে সম্পর্কহীন।

এ পর্যন্ত আমি যতদুর মনে করতে পারি, তিনি শ্রী গোরায়, অথবা একজন মাননীয় সদস্য- যিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন রাজনৈতিক সেটেল্মেন্ট বলতে আমরা কী বুঝি।

আমি মনে করি তিনি আমাকে ক্ষমা করবেন; তিনি হয়ত একটা অতি অসাধারন মানে করেছেন এই শব্দটার। তিনি কি এক মুহুর্তের জন্য বিশ্বাস করেছেন যে রাজনৈতিক সেটেলমেন্ট মানে বাংলাদেশের বুঝেছেন কিনা, যা গণতন্ত্রের শবযাত্রা অথবা তাদের যারা নিজেদের অধিকারের জন্য লড়ছেন? ইন্ডিয়া কখনো এমনটা সমর্থন করে না। যখন আমরা একটা রাজনৈতিক সেটেলমেন্টের কথা বলেছি, আমরা বুঝিয়েছি এমন কিছু করা যা ঐসব মানুষদের জন্য সহায়ক, যারা নির্যাতিত। আমি এমন দৃষ্টিভঙ্গি বা মত প্রকাশ করছি না যে একটা সেটেলমেন্ট সম্ভব কিনা, কিন্তু পরিস্কার করছি যা আমরা প্রথম দিকে বলেছিলাম। যদি কোন রকমে বড় শক্তি বা যারা প্রয়োগ করছে তাদের উপর একটা আন্তর্জাতিক চাপ সম্ভবপর হত, তাহলে একটা সেটেলমেন্ট প্রথমদিকে সম্ভব হত। এখন, অবশ্যই, পার হয়ে যাওয়া প্রতিটা দিনের সাথে সাথে এই সম্ভবনা কমে যাচ্ছে।

আমরা শরনার্থীদের অস্থায়ী ভিত্তিতে সাহায্য করছি। তাদের এখানে স্থায়ী করার আমাদের কোন অভিপ্রায় নেই, অথবা তাদের ফিরে যেতে দেওয়া যেখানে তাদের হত্যা করা হবে।

একজন সন্মানিত সদস্য বলেছেন যে চীন আমাদের উপর শিথিল। আমি জানি না উনি কী বুঝাতে চেয়েছেন। আমি যতদুর জানি চীন অতটা বিদেশী জাতিগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে ছিলনা যতটা আমরা ছিলাম। তাঁরা প্রায় সর্বদাই স্বাধীন ছিল। এটা সত্য যে পুর্বে তাঁরা সমাজতন্ত্রীদের শাসনে ছিল না। কিন্তু তাঁরা সর্বদাই স্বাধীন ছিল।

সন্মানিত সদস্যবৃন্দের মনে কিছু সংশয় আছে যে শরনার্থীরা কি আসলে স্থানান্তরিত হবে না যেখানে এখন আছে সেখানেই থাকবে। এটা এই মুহুর্তে বলা সম্ভব নয় কারন এটা একটা বিশাল ব্যাপার। যদিও বা আমরা তাদের স্থানান্তর করতে চাই, এটা বাস্তবিক অর্থে সম্ভব না। প্রতিটা ট্রেন ১২০০ বা তার কিছু বেশি বহন করতে পারবে। কিন্তু, সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও আমরা হয়ত ক্ষুদ্র একটা অংশকে শুধু সড়াতে পারব। আমরা চেষ্টা করছি বিভিন্ন রাজ্য কেন্দ্র সরকারের ভুমিতে তাদের সরিয়ে নিতে, কিন্তু এটা সহজসাধ্য কোন কর্ম নয় এবং তথাপি যে রাজ্য গুলোতে তাঁরা এখন আছে সেসব রাজ্যের উপর চাপ রয়েই যাবে।

আমরা ট্রাক ব্যবহার করেছি; এখন বিমান ব্যবহার করছি; আমরা মাল গাড়িও ব্যবহার করছি। কিন্তু এতদসত্তেও, তাঁরা ষাট লক্ষ মানুষ- আপনি তাদের সহজেই সরিয়ে নিতে পারেন না।

এই দেশে, বাস্তবিক অর্থে আমাদের সবকিছুই অপ্রতুল যা উনাদের সাহায্যের জন্য দরকার। আমাদের তাবুর ঘাটতি রয়েছে; আমাদের লোহার পাতের ঘাটতি রয়েছে,; আপনি যা কিছু চিন্তা করতে পারেন তার সব কিছুই আমাদের ঘাটতি রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এইসব কিছু যোগার করার; আমরা ঐসব কেম্প গুলোতে পাঠাবার ব্যবস্থা করছি। কিন্তু আমরা যাই করিনা কেন-

আমি এটা দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে- এইসব কারনে শরনার্থীদের কোন ভাবেই নুন্যতম যত্নে রাখতে পারছি না। এবং আমি সন্তোষের সাথে জানাচ্ছি যে, আমি যেখানেই গিয়েছি, কেম্পের স্পিরিট ভাল দেখেছি। তাঁরা অতি কঠিন পরিস্থিতে আছেন, কিন্তু উনারা আমাদের সমস্যাটা বুঝেন। সুতরাং, আমরা চেষ্টা করছি যতটুকু পারি তা সর্বোচ্চ ভাল্ভাবে করতে, কিন্তু আমাদের অবশ্যই এই ঘটনার দীর্ঘমেয়াদী পরিস্থিতির দিকেও নজর রাখতে হবে, এবং আমাদের সকলের ও জনগনের উপর এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব। আমাদের সকলের নেতা হিশেবে, সংসদের বা রাজনৈতিক দলের সদস্য হিশেবে, এ দেশের নাগরিক হিশেবে অবশ্যই জনগণকে এই কঠিন পরিস্থিতির জন্য তৈরি করতে হবে, কারন এছাড়া আমরা না পারব শরনার্থীদের সাহায্য করতে, না পারব এ দীর্ঘ মেয়াদী সমস্যা মোকাবেলা করতে।

এই হাউজের সর্বদাই বোঝার সক্ষমতা আছে। আমি জান যে, সময়ে সময়ে আবেগে উদ্বলিত হবার দরকার আছে। এটা স্বাভাবিক এবং বোধগম্য, কিন্তু যখন সব কিছুই বলা হয়েছে, আমি হাউজের কাছে তার বোধগম্যতার পরিচয় দেবার জন্য এবং সহযোগী হবার জন্য আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৯৯। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্ত্রিক পাকিস্তানকে সাম্প্রতিক অস্ত্র সরবরাহের রীপোর্টের অপর আলোচনা রাজ্যসভার কার্যবিবরনি ২৪ জুন ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ১৯৯, ৫৬১-৫৯০>

জরুরী জনগুরুত্বসম্পন্ন একটি বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দেবার আহবান

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্ত্রিক পাকিস্তানকে সাম্প্রতিক অস্ত্র সরবরাহের রীপোর্টের অপর আলোচনা

শ্রী চিত্ত বসু (পশ্চিম বঙ্গ): জনাব চেয়ারম্যান স্যার আমি পাকিস্তানে সাম্প্রতিক মার্কিন অস্ত্র চালানের রিপোর্টের ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষন করছি।

পররাষ্ট্র মন্ত্রী (সর্দার শরণ সিং): জনাব চেয়ারম্যান স্যার, সরকার সম্প্রতি পাকিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সামরিক সরঞ্জামের চালান সম্পর্কে এই হাউজের সবার উদ্বেগের জন্য ধন্যবাদ জ্ঞ্যাপন করছে। ২২ জুন দ্যা নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্র থেকে সামরিক সরঞ্জামাদি সহ ‘সুন্দরবন ও পদ্মা’ নামে পাকিস্তানের পতাকা বাহী দুইটি কার্গো যথাক্রমে ৮ মে ও ২১ জুন রওনা দেবার খবরটি সম্ভবত সত্য। বিষয়টি ২৩ জুন রাষ্ট্রদূত ওয়াশিংটনে আন্ডার সেক্রেটারি সঙ্গে সন্ধ্যায় বিষয়টি নিয়ে দেখা করেন। এছাড়াও ২৩ জুন বিষয়টি নয়া দিল্লির মার্কিন দূতাবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। ইউ এস সরকারের দেয়া তথ্য মতে ২৫ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তানে কোন বিদেশী সামরিক দ্রব্য বিক্রয় করা হয়নি বা নতুন কোন অস্ত্র অনুমোদন দেয়া হয়নি, এবং কোন রপ্তানি লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি। আমেরিকান সরকার পরে আবার বিবৃতি দেয় যে নিউ ইয়র্ক টাইমস যে সংবাদ দিয়েছে তাতে ভুল আছে। তারা যানায় জাহাজে ৮ টা বিমান ছিল। কিন্তু সংবাদে আসে যে সেখানে কোন বিমান ছিলোনা। অ্যামেরিকান সরকার জানায় যে হয়ত ২৫ মার্চের আগের অনুমোদিত কিছু মিলিটারি সরঞ্জাম সম্ভবত ডকে রাখা ছিল। যারা রওনা দেবার জন্য অপেক্ষমাণ ছিল। হয়ত সেই দুই জাহাজকে নিউ ইয়র্ক টাইমস সংবাদদাতারা উল্লেখ করেছেন। তারা আরও জানান যে বাণিজ্যিকভাবে কেনা কিছু দ্রব্য যেগুলোতে এক্সপোর্ট লাইসেন্স লাগে হয়ত সেগুলো ছিল – এগুলো ২৫ মার্চের আগে অনুমোদিত। কিছু আইটেমের ক্ষেত্রে এক্সপোর্ট লাইসেন্স লাগেনা। হতে পারে যে এরকম কিছু দ্রব্য জাহাজে ছিল। তারা জানায় যে সম্ভবত জাহাজে ২৫ মার্চের আগের অর্ডারগুলোই যাচ্ছিল।

রাজ্যের আন্ডার সেক্রেটারি আমাদের উদ্বেগের প্রশংসা করেন এবং ক্ষোভের সাথে বলেন যে এই পূর্ব অনুমোদনপ্রাপ্ত দ্রব্যগুলো আমাদের নজরে আসেনি। তিনি আরও বলেন পুরো ব্যাপারটা এখনো জানা নাই – যে শিপমেন্টের আগে এক্সপোর্ট লাইসেন্স কোন কোন দ্রব্যের জন্য ইস্যু করা ছিল। তিনি আরও যুক্ত করেন যে বিষয়টি নিয়ে এখনো চূড়ান্ত তথ্য দেয়া যাচ্ছেনা কারণ এটা এখনো তদন্তাধিন আছে।

আমরা মার্কিন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছি যে এই মুহুর্তে বাংলাদেশে যে হত্যাযজ্ঞ চলছে তাতে পাকিস্তানকে কোন রকম অস্ত্র সহায়তা দিলে তা শুধু বাংলাদেশের সামরিক শাসককে উৎসাহিত করা নয় বরং সমস্ত উপমহাদেশের শান্তির জন্য হুমকি হিসেবে দাঁড়াবে। আমরা বলেছি যে এটা শুধু একটি টেকনিকাল বিষয় নয় – বরং এর সাথে সামাজিক অর্থণৈতিক, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তার বিষয় জড়িত। তাই আমরা ইউ এস গভমেন্ট কে অনরোধ করেছি যে দুইটি জাহাজ রওনা দিয়েছে সেগুলো ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে। পুরনো অথোরাজেশনের ভিত্তিতে মিলিটারি সরঞ্জাম পাঠানো যেতেই পারে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার বিষয়টি জোরালো গুরুত্বের সাথে দেখছে এবং আমরা তাদের রেসপন্সের অপেক্ষায় আছি।

আমরা আশা করি যে অ্যামেরিকা গণতন্ত্র ও স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে তারা এরকম একটি সন্ত্রাস নীতি অবলম্বন করবে না। এতে করে বাংলাদেশে সঙ্ঘটিত সন্ত্রাস আরও উৎসাহ পাবে। যতক্ষণ পাকিস্তান শাসক তাদের গণহত্যা না থামাবে ততক্ষণ পর্যন্ত এখানে শান্তিপূর্ন পরিবেশ সৃষ্টি হবেনা এবং শরনার্থিদের প্রবেশ থামবে না আর যারা এসেছে তাদের ফিরে যাবার অবস্থাও তৈরি হবেনা।

শ্রী চিতা বসু: সর্বপ্রথমে আমি কি এটা মাননীয় মন্ত্রীর কাছ থেকে জানতে পারি? তিনি শুধু বলেছেন ২২ জুন মিলিটারি অস্ত্রের চালান পাকিস্তানে এসেছে – এবং অ্যামেরিকা ভারতকে আশ্বস্ত করেছে। আমি জানতে চাই অ্যামেরিকা কি বলে ভারতকে আশ্বস্ত করেছে?

আমার দ্বিতীয় পয়েন্ট হচ্ছে এরকম – ধরুন মন্ত্রী আমারিকার ব্যাখ্যায় সন্তস্ট হয়ে গেলেন। কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের সরকারের তাদের বিবৃতিতে বিভ্রান্ত হলে চলবে না। স্যার, তিনি তাঁর বিবৃতিতে একমত হয়েছেন যে এই গুরুতর অবস্থায় পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহের ফলে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের নিরীহ মানুষের উপর যে গণহত্যা চলছে তা আরও তীব্রতর হবে। এটা পাকিস্তানে যুদ্ধের অবস্থা সৃষ্টি করবে এবং এতে আমাদের নিরাপত্তা সঙ্কটাপন্ন হবে। এই অবস্থায় সরকার কোন ভাবে অ্যামেরিকার অস্ত্র সরবরাহ মেনে নিতে পারেনা – আমারিকা যা করছে তা বন্ধুসুলভ নয় এবং ভারতের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এই অবস্থায় ভারত সরকার কি সাহস করে বলবে যে ভারতের জনগণ অ্যামেরিকার অবন্ধুসুলভ কাজ মেনে নিতে পারছেনা এবং ভারত সরকার এটা ঠেকানোর জন্য যা খুশী করবে। আমি জানতে চাই তিনি কি এমন কিছু বলবেন কিনা?

তার বক্তব্যে তিনি আরও বলেছেন যে একথা সত্য যে অ্যামেরিকা পাকিস্তানে অস্ত্র সাপ্লাই দিচ্ছে – কিন্তু দয়া করে তিনি কি বলবেন এযাবৎ কত অস্ত্র দেয়া হয়েছে? এমনকি ২৫ মার্চের পরেও – যখন অলরেডি সাপ্লাই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কারণ আমার কাছে কিছু তথ্য আছে —
জনাব চেয়ারম্যানঃ আপনি কয়েকটি প্রশ্ন করেছেন।

শ্রী চিত্তরঞ্জন বসু: … যে পাকিস্তান অ্যামেরিকার কাছ থেকে অস্ত্র অ মেরামত যন্ত্রাংশ কিনছে – মার্চ পর্যন্ত যা শিপিং করা হয়েছে তা বাদেও রিপোর্টে জানা যায় যে আমেরিকান এয়ারফোর্স পাকিস্তানের কাছে প্রায় ৪৮ মিলিয়ন সমমানের দ্রব্য কিনেছে এবং নেভিও আর্মস সাপ্লাই দিয়েছে। তিনি কি দয়া করে জানাবেন ২৫ মার্চ যখন আর্মি বাংলাদেশের ক্র্যাক ডাউন শুরু করেছে তার আগেই অ্যামেরিকা পাকিস্তানকে কত অস্ত্র দিয়েছে?

সরদার শরণ সিং: স্যার, আমি বলতে চাই যে এই হাউস সন্দিহান যে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পরের নিষেধাজ্ঞা থেকে শুরু করে অ্যামেরিকা পাকিস্তানকে কত অস্ত্র সরবরাহ করেছে এবং এর কোন ব্যাতিক্রম হয় নি। কিন্তু বাংলাদেশে মিলিটারি একশনের পর অ্যামেরিকা বলেছে যে তারা পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করেছে। কিন্তু যখন তা করা হল তা ঐ নিশ্চয়তাকে ভঙ্গ করল। তার মানে তারা যে অস্ত্র সরঞ্জাম পাঠাল তা আগে দেয়া নিশ্চয়তার বিপক্ষে যায়।

দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবে আমি বলছি আমরা তাদের উত্তরে সন্তস্ট না। আমি শুধুমাত্র তারা যা বলেছে সেটাই এই হাউজে উত্থাপন করেছি।
এবং আমরা এটাও বলে যাচ্ছিনা যে সরকার তাদের বিবৃতিতে সন্তস্ট। আমরা বরং দৃঢ়ভাবে জানাতে চাই যে তারা যে বিবৃতি দিয়েছে সেটা রক্ষা করার দায়িত্ব তাদের।

এখন আমি ধরে নিলাম যে বিবৃতি পুরোপুরি সত্য। পুরোপুরি শব্দটা এই কারণে ব্যাবহার করলাম যে নিউ ইয়র্ক টাইমসে যে খবর ছাপা হয়েছে সে ব্যাপারে আমেরিকান কর্তৃপক্ষ এখন বলছে যে জাহাজে কোন প্লেন ছিলোনা। অর্থাৎ যার কথাই সত্য হোক না কেন ওইসব মিলিটারি সরঞ্জাম পাওয়া যাচ্ছেনা। অতএব আমি পুরোপুরি শব্দটা এই কারণে ব্যাবহার করেছি যে যদিও মিলিটারি সরঞ্জাম জাহাজে পাকিস্তানের উদ্যেশ্যে পাঠানো হয়েছে তথাপি প্রেস রিপোর্ট আর সরকারী মুখপাত্রে বিবৃতিতে পার্থক্য রয়েই গেল।

শ্রী চিত্তরঞ্জন বসু: স্যার, আসল প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেলনা যে এতে আমাদের সরকার মার্কিন সরকারের প্রতি প্রতিকূল নাকি বন্ধুসুলভ অবস্থান নিল। আমাদের সরকার একথা তাদের বলবে কিনা যে আমরা এধরনের কাজের সাথে একমত নই এবং আমরা আমাদের মত করে যে কোন ব্যাবস্থা নিতে পারি। এই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু তিনি দিলেন না।

সরদার শরণ সিংঃ যেহেতু আমাদের ক্ষমতা আছে নিজেদের পছন্দমত কাজ করার তাহলে একথা কেন আমরা অযথা অ্যামেরিকা বা অন্য কোন সরকারকে জানাতে যাব? এই জটিলতা সৃষ্টির কি দরকার? কেন আমরা অন্য দেশকে জানাতে যাব যে আমরা আমাদের পছন্দ মত যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারি? এটা তো আমাদের নিজেদের ব্যাপার যে আমরা আমরা কি করতে চাইব বা চাইব না। কাজেই এধরনের কথায় আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের সম্পর্কে বিরূপ একটা মতভেদ সৃষ্টি হবে – আর তাছাড়া অ্যামেরিকা আমাদের অসন্তোষটির ব্যাপারটি নিশ্চই বুঝতে পেরেছে।

শ্রী এন জি গোরে (মহারাষ্ট্র): “স্যার, এখানে দুটি জিনিস বেরিয়ে আসল। একটি হল আমাদের অ্যামেরিকার পত্রিকার লোকজনকে ধন্যবাদ দেয়া উচিৎ কেননা তারা ধারাবাহিকভাবে তাদের নিজেদের সরকারের কার্যকলাপগুলো আমাদের প্রকাশ করছেন। স্যার সর্বশেষ খবর হল যে তারা প্রকাশ করেছে যে জাহাজগুলো করাচী যাচ্ছে। আমি জানতে চাইব আমাদের সরকারের এমন কোন সোর্স আছে কিনা যা দিয়ে আমরা জানতে পারব এধরনের কয়টি জাহাজ রওনা করেছে এবং পাকিস্তানে কি ধরণের অস্ত্র পাঠানো হচ্ছে। স্যার এই মাত্র মাননীয় মন্ত্রী জানালেন যে অ্যামেরিকার কর্তৃপক্ষ এধরনের কোন জাহাজের অস্তিত্ব পাচ্ছেন না। কিন্তু নিউ ইয়র্কের সংবাদদাতা জানিয়েছেন যে তা আছে। অতএব আমাদের এমন কোন সোর্স আছে কিনা যে আসলে বলতে পারবে যে আমেরিকান কর্তৃপক্ষ ঠিক বলছে নাকি পত্রিকার সংবাদদাতাই সঠিক। প্লেনগুলোকে যন্ত্রাংশ হিসেবে দেখানো যেতে পারে। কারণ যন্ত্রাংশগুলো করাচী আসার পরে আবার একত্রীকরণ (রিএসেম্বল) করে প্লেন তৈরি করে নেয়া যায়। এটাও সম্ভব।

আরেকটি জিনিস হল তারা তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছে – ইত্যাদি – ইত্যাদি। স্যার, মাননীয় মন্ত্রীর সফরের পরে একটি আশা ও সন্তোষটির অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু আমেরিকান সরকারের পদক্ষেপে এই আশার বেলুন চুপসে গেল।

আমরা বুঝতে পারলাম, অ্যামেরিকা আমাদের একদিকে আশ্বস্ত করছে অন্যদিকে আমাদের করছে প্রতারিত। অতএব স্যার, তারা যাই পাঠাক না কেন আমরা ‘অসন্তস্ট’ – শুধু এটুকু বলা যথেষ্ট না।

শ্রী অর্জুন অরোরা (উত্তরপ্রদেশ): আমেরিকা ভারতকে দিচ্ছে আশ্বস্ততার বানী আর পাকিস্তানকে দিচ্ছে অস্ত্র।

চেয়ারম্যান: প্লিজ, আমি আপনাকে কল করব।
শ্রী এন জি গোরে: সরকারের বলার সাহস আছে কিনা যে এসব অস্ত্র ….

চেয়ারম্যানরা: দয়া করে, আমাদের হাউসের সময় অপচয় করবেন না।
শ্রী অর্জুন অরোরা: এটাই হাউসের সময়।
শ্রী এন জি গোরে: …….. পাকিস্তান থেকে যা কিছুই বাংলাদেশের দিকে রওনা করবে আমাদের দায়িত্ব হল সেটাকে বন্ধ করা। আপনি কি দয়া করে বঙ্গোপসাগরে এবং দূরসমুদ্রে একটু দেখাশোনা করবেন যাতে করে এগুলো পৌঁছাতে না পারে? আপনি কি অ্যামেরিকাকে দেখাতে পারবেন যে ইয়াহিয়া সরকারের অস্ত্র আমরা পৌঁছাতে দেইনি?

শ্রী এস ডি মিশ্র (উত্তরপ্রদেশ): তাদের যদি সেই সাহস থাকত তাহলে অনেক আগেই তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিত। সেই ক্ষমতা তাদের নাই।
সরদার শরণ সিং: আপনি জানতে চেয়েছিলেন যে আমাদের এধরনের কোন আলাদা সোর্স আছে কিনা যারা খোঁজ নিতে পারবে যে আমেরিকান সরকারী বিবৃতি সঠিক নাকি পত্রিকার নিউজ – এর উত্তরে বলব আমাদের তেমন কোন সোর্স নাই কারণ …

শ্রী ভূপেশ গুপ্ত (পশ্চিম বঙ্গ): সেখানে আপনার দূতাবাস আছে। তারা মনে হয় কিছুই জানেনা। তাহলে আপনি কেন এসব এমব্যাসির পেছনে টাকা নষ্ট করছেন?

শ্রী উ পি চট্টোপাধ্যায় (পশ্চিম বঙ্গ): তারা শুধু জানে কীভাবে নাচতে হয়।
সরদার শরণ সিং: সসেটা আলাদা ব্যাপার। যেহেতু আলাদা কোন স্বাধীন সোর্স নাই – আমি বলতে পারিনা যে আছে। যে কোন রাষ্ট্রের জন্যই এই তথ্য বেড় করা মুশকিল যে ওইসব জাহাজে কি আছে। এটা আসলে সম্ভব না।

এখন, স্যার, অন্য প্রশ্ন সম্পর্কে, আমি তাঁর পরামর্শের সাথে একমত ….
শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: আপনার রাষ্ট্রদূত ওখানে কি করছে?
সরদার শরণ সিং: তারা স্বাধীনভাবে এই খবর বেড় করার জন্য কী করতে পারে বলে আপনার মনে হয়? এটা রাষ্ট্রদূতের কাজ নয়।

শ্রী একটি পি চট্টোপাধ্যায়: তারা শুধুমাত্র ককটেল এবং নাচে তাদের সময় ব্যয় করে।
শ্রী অর্জুন অরোরাঃ তিনি ভারত সরকারকে রুপীর মূল্যহ্রাস করতে উপদেশ দিচ্ছেন।
সরদার শরণ সিংঃ কোন গুপ্তচরবৃত্তি করা তাদের কাজ নয়।

শ্রী রাজ নারায়নঃ মহোদয়, একটা প্রশ্ন আছে। আমি শান্তভাবে বসে আছি।
সরদার শরণ সিং: শুধুমাত্র অন্য পয়েন্টে …..
শ্রী রাজ নারায়ণঃ মহোদয়, আমি বৈধতার প্রশ্ন উত্থাপন করেছি, ব্যাবস্থার প্রশ্ন আছে।
সভাপতিঃ কী ব্যাবস্থার প্রশ্ন?
শ্রী রাজনারায়ণঃ প্রথমে তিনি বসুন। যতক্ষণ মন্ত্রী বসবেন না ততক্ষণ আমি বলব না।
সর্দার শরণ সিংঃ আমি কি তাকে বসতে বলতে পারি?

শ্রী রাজ নারায়নঃ মহোদয়, দেখুন মন্ত্রী মহোদয় জবাব দিতে অর্ধেক বললেন, কেউ শুনলেন কি শুনলেন না, তিনি বললেন, অনুসন্ধান করে খবর দেয়া আমাদের বিদেশী দূতাবাসের কাজ নয়।
মহোদয়, তিনি বললেন, এটা আমাদের বিদেশী দূতাবাসের কাজ নয়। তাহলে বিদেশী দিতাবাসের কাজ কি?
জনাব চেয়ারম্যানঃ এটা পয়েন্ট অব অর্ডার নয়।
শ্রী রাজ নারায়নঃ এর চেয়ে বড় বৈধতার প্রশ্ন আর কিছু নেই। মন্ত্রী এরূপ বলতে পারেন না। তবে বিদেশী দূতাবাস কি জন্য? আপনি দয়া করে মন্ত্রীকে বলুন তিনি এই শব্দসমূহ প্রত্যাহার করুন। আমরা জানি বিদেশী দূতাবাসের কি কি কাজ করতে হয়। শুধু নিমন্ত্রণ করা, খাওয়া ও নৃত্য করা তাদের কাজ নয়।

শ্রী ভুপেশ গুপ্তঃ এটা গুরুত্তপূর্ন কারণ সেখানে আমাদের এমব্যাসির পেছনে অনেক অর্থ ব্যয় হয়। আমরা তাদের কাছ থেকে পত্র পাই যে সেখানে কি কি হচ্ছে।
শ্রী রাজ নারায়নঃ আমাদের কি শি শুনতে হবে যে এটি বিদেশী দূতাবাসের কাজ নয়? আমি জানি কোন মন্ত্রী কি কাজ করেন। ননসেন্স।

শ্রী এ জি কুল্কার্নি(মহারাষ্ট্র): পয়েন্ট অব অর্ডারে আমাদের একটি বৈধ পয়েন্ট অব অর্ডার আছে। আমাদের অবশ্যই শুনতে হবে। আপনি কিভাবে এটাকে এভাবে শেষ করলেন? বিরোধী দল যা চাচ্ছে তা অবৈধ নয়। মন্ত্রী বলেছেন যে বিদেশী দূতাবাস গোয়েন্দাগিরি করে না। তিনি বলেন, আমাদের স্বাধীন কোন সোর্স নাই। দেশের স্বার্থে দরকারি কোন একটি বিষয় খুঁজে বেড় করা কি একটি দূতাবাসের বৈধ দায়িত্ব নয়?

স্যার আপনি কিভাবে মন্ত্রীকে এধরনের একটি বিবৃতি দেবার পরে (তার কোন সোর্স নাই) চালিয়ে যেতে বলেন? এটা বিরোধী দলের ন্যায্য চাওয়া এবং আমি আরও মনে করি সরকারের উচিৎ আমাদের গোয়েন্দা বাহিনীর থেকে তথ্য বেড় করে বিবৃতি দেয়া। আপনি কীভাবে মন্ত্রীকে এমন একটি মন্তব্য করার পরে চালিয়ে যেতে বলছেন?

জনাব চেয়ারম্যান: মন্ত্রী মহোদয়, দয়া করে বসুন।
সরদার শরণ সিং: আমি মনে করি কিছু গড়বড় আছে যা আমি পরিষ্কার করতে চাই।
শ্রী আকবর আলি খান (অন্ধ্র প্রদেশ): স্যার, আমি বলতে চাই যদি কোন এমব্যাসিকে এটা করতেও বলা হয় আমার মনে হয় সেসব তথ্য এই হাউজে প্রকাশ করা ঠিক নয়।

কিছু সন্মানিত সদস্য: না, না।
(বাধা)
শ্রী জি কুলকার্নি: আমাদের সন্তস্ট করা সরকারের দায়িত্ব। আপনি কীভাবে এরকমটা বলেন? জাহাজ ভরে অস্ত্র আসছে আর আপনি বলছেন তার এই তথ্য দেয়া উচিৎ নয়?

(বাধা)
শ্রী সৈয়দ আহমদ: (মধ্য প্রদেশ): স্যার, আমি কি একটা কথা বলতে পারি?
শ্রী ভূপেশ গুপ্তঃ আমরা কোন রিপোর্ট পাচ্ছিনা কারণ জনাব এল কে ঝা, আমাদের রাষ্ট্রদূত, একজন প্রো-আমেরিকান …..
(বাধা)
শ্রী সৈয়দ আহমদ: স্যার, যদি নিউ ইয়র্ক টাইমস অস্ত্রের চালান সম্পর্কে এই তথ্য প্রকাশ না করত, মন্ত্রীর কি এটা জানার কোন উপায় ছিল?

চেয়ারম্যান: জনাব মন্ত্রী, দয়া করে বসুন।
শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: স্যার, আপনার রায় কি?
চেয়ারম্যান: দয়া করে মন্ত্রীকে বলতে দিন।
শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: স্যার, আপনি উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? আমাদের দূতাবাসের কি করছে এটি খুবই প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। (বাধা) যদি আমরা কোন তথ্য না পাই তাহলে বুঝতে হবে আমাদের এম্বাসেডর একজন অ্যামেরিকার তাবেদার। তিনি সেখানে জগাখিচুড়ি পাকাচ্ছেন।
(বাধা)
শ্রী জি কুলকার্নি: স্যার, মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করা আপনার কর্তব্য।
জনাব চেয়ারম্যান: আমি কি তাকে কথা বলতে বলছি না?
শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: রাষ্ট্রদূতকে ডাকা উচিৎ।

সরদার শরণ সিং: স্যার, আমি এই উত্তেজনার কারণ বুঝতে পারছিনা। প্রশ্নটা সহজ। আপনি যদি রেকর্ড চেক করেন তাহলে দেখবেন যে আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছে যে অস্ত্র চালানের ব্যাপারে আমেরিকান কর্তৃপক্ষ আর পত্রিকার খবরের মধ্যে কোনটা সঠিক তা জানার আমার কোন সোর্স আছে কিনা। পত্রিকার বলেছে জাহাজে প্লেন ছিল আর তাদের সরকার মুখপাত্র বলছে নাই। আর আমি বলছি জাহাজ যখন মালামাল ভর্তি করে গভীর সমুদ্রে চলমান অবস্থায়া আছে সেই অবস্থায় আমার কোন স্বাধীন সোর্স নাই যা দিয়ে আমি যাচাই করতে পারি আর জানাতে পারি যে নিউ ইয়র্ক টাইমস সত্য বলেছে …

শ্রী সি ডি পান্ডে (উত্তরপ্রদেশ): পয়েন্ট অব অর্ডারের উপর।
সরদার শরণ সিংঃ …. বা অন্য প্রতিবেদনটি সঠিক।
শ্রী অর্জুন অরোরা: পয়েন্ট অব অর্ডারের উপর।
সরদার শরণ সিং: আপনি কি আমাকে শেষ করতে দেবেন? এই অন্যায্য। আমি একমত না।
জনাব চেয়ারম্যান: জনাব অরোরা, মন্ত্রীকে শেষ করতে দিন। এর পরে যদি কিছু থাকে আমি আপনারটা শুনব।

সরদার শরণ সিং: তারপর, একটি প্রশ্ন কিরা হচ্ছে আমাদের রাষ্ট্রদূতের কি করার অধিকার আছে আর কি করার নেই সেই ব্যাপারে। কিছু আন্তর্জাতিক নিয়ম কানুন আছে। আমি আমাদের কমিউনিস্ট নেতা যে বলেছেন যে আমাদের রাষ্ট্রদূত আমেরিকার তাবেদার – এই কথাটি শক্তভাবে প্রত্যাখ্যান করছি।
শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: অবশ্যই।
সরদার শরণ সিং: একেবারে ভুল এবং অযৌক্তিক।
শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: আমরা জানি এটাই সত্য।
(বাধা)
সরদার শরণ সিং: আমাদের রাষ্ট্রদূতকে রক্ষা করা আমার কর্তব্য। মন্তব্য একেবারে অহেতুক এবং আমি তা গ্রহণ করছিনা।

শ্রী সি ডি পান্ডে: স্যার, পয়েন্ট অব অর্ডার।
জনাব চেয়ারম্যান: তাকে শেষ করতে দিন। আমি জনাব অর্জুন অরোরাকেও বসতে বলেছি।

শ্রী সি ডি পান্ডে: না, না।
সরদার শরণ সিং: আমি শেষ করিনি। আমি একমত না।
(বাধা)
শ্রী সি ডি পান্ডে: স্যার, পয়েন্ট অব অর্ডার।
জনাব চেয়ারম্যান: পয়েন্ট অব অর্ডার নিয়মের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
শ্রী. সি ডি পান্ডে: হ্যাঁ।
জনাব চেয়ারম্যান: কি পদ্ধতির সাথে জড়িত?
শ্রী সি ডি পান্ডে: স্যার, মন্ত্রী মহোদয় এমন মন্তব্য করেছেন যা গোয়েন্দা বিভাগের ভিত্তিকে দুর্বল হিসেবে প্রকাশ করে। তিনি বলেছেন, এসব জানার জন্য কোনো স্বাধীন সোর্স নেই।
জনাব চেয়ারম্যান: তিনি সেটা ব্যাখ্যা করেছেন।

(বাধা)
শ্রী সি ডি পান্ডে: আমরা দূতাবাসে কোটি কোটি টাকা খরচ করছি এবং তিনি বলছেন যে সরকারের জানার কোন সোর্স নেই…
জনাব চেয়ারম্যান এটা পয়েন্ট অব অর্ডার না। আমি এটা অগ্রাহ্য করছি।
সরদার শরণ সিং: দূতাবাসের কাজ সম্পর্কে আমাদের এই প্রশ্নটি শান্তভাবে বিবেচনা করতে হবে…..
শ্রী সি ডি পান্ডে: আমাদের গোপন সূত্র আছে। আমরা তাদের পেছনে অনেক টাকা ব্যয় করছি এবং মন্ত্রী বলছেন তার তথ্য জানার কোন সোর্স নাই।
জনাব চেয়ারম্যান: এতে পয়েন্ট অব অর্ডার নেই।
শ্রী এম কে মোহতা (রাজস্থান): স্যার, পয়েন্ট অব অর্ডারের উপর …………
সরদার দঃপঃ Aran সিং: সু- প্রতিষ্ঠিত নিয়মাবলী অনুসারে …
শ্রী সি ডি পান্ডে: স্যার, মন্ত্রীর একথা বলার কোন অধিকার নেই যে তার তথ্য জানার কোন উৎস নেই।
শ্রী এম কে মোহতা: পয়েন্ট অব অর্ডারের উপর।
জনাব চেয়ারম্যান: আমি পয়েন্ট অব অর্ডার প্রত্যাখ্যান করছি।
শ্রী এম কে মোহতা: স্যার, আমি এখনো আপনার সামনে পয়েন্ট অব অর্ডার পেশ করিনি।
জনাব চেয়ারম্যান: আমিও আপনাকে ডাকিনি। (বাধা) আপনারা সবাই যদি এই অপ্রয়োজনীয় পয়েন্ট অব অর্ডার নিয়ে কথা বলতে থাকেন তাহলে আগানো যাবেনা। দয়া করে বসুন, জনাব মোহতা।
শ্রী এম কে মোহতা: আমি এখনো জমা দেইনি। আপনি কীভাবে না বলেন?

জনাব চেয়ারম্যান: তাহলে আমাকে সবাইকে ডাকতে হবে। এসবে কোন পয়েন্ট অব অর্ডার নাই।

শ্রী এম কে মোহতা: আদেশের আমার পয়েন্ট অব অর্ডার হল –

জনাব চেয়ারম্যান: না, জনাব মোহতা, দয়া করে বসুন।
শ্রী এম কে মোহতা: স্যার, আমি কি পয়েন্ট অব অর্ডারের জন্য এনটাইটেলড না? এটা কি?
জনাব চেয়ারম্যান: দয়া করে বসুন।
শ্রী এম কে মোহতা: আদেশের আমার পয়েন্ট অব অর্ডার হল। মাননীয় মন্ত্রী এমন কিছু বলছেন যা তিনি করে থাকেন।

জনাব চেয়ারম্যান: না না জনাব মোহতা। এটা পয়েন্ট অব অর্ডার না। বসুন প্লিজ।
শ্রী এম কে মোহতা: আমাকে পেশ করতে দিন। হাউজ এটা জানতে আগ্রহী। আমরা জানতে চাই ভারত সরকারের কাছে কি তথ্য আছে।
জনাব চেয়ারম্যানঃ এটি পয়েন্ট অব অর্ডার নয়।

শ্রী এম কে মোহতা: নিউ ইয়র্ক টাইমস কি ছেপেছে তা জেনে আমাদের লাভ কি? হাউজ সেকেন্ড হ্যান্ড তথ্যের ব্যাপারে আগ্রহী নয়।
শ্রী অর্জুন অরোরা: অন্তত এই হাউসে জনাব মোহতা এবং আমি সমান সমান। এর বাইরে আমি এবং জনাব মোহতা আয়কর কর্তৃপক্ষের চোখে অসমান। স্যার, মন্ত্রী হাউসকে বিভ্রান্ত করছেন কারণ তিনি বলেছেন জাহাজ দূরসমুদ্রে আছে – অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর চার্চ উল্লেখ করেছেন যে, জাহাজকে অন্যত্র কল করা হয়েছে – বন্দর কর্তৃপক্ষ বলেছে জাহাজগুলোকে অন্য কোন বন্দরে নিয়ে অস্ত্র খালাস করা যেতে পারে – এমনকি কানাডার মন্ট্রিলে কল করা যেতে পারে। আর মন্ত্রী বলছেন জাহাজ গভীর সমুদ্রে -তাই কিছুই করা যাবেনা। তিনি কি হাউজকে বিভ্রান্ত করার জন্য নিযুক্ত?

সরদার শরণ সিং: যদি তারা অন্য কোনো পোর্টেও আসে তাদের দূরসমুদ্র পাড়ি দিয়েই আসতে হবে। আমি যা বলতে চেয়েছি যে সেগুলো গভীর যমুদ্রে আছে এবং কোন বৈদ্যুতিক বা অন্য কিছু তার সাথে যুক্ত করা যাবে না যাতে করে আমরা খুঁজে দেখতে পারি সেই জাহাজের বাক্সতে কি রাখা আছে।
শ্রী নিড়েন ঘোষ (পশ্চিমবঙ্গ)ঃ এই রিপোর্ট প্রকাশের সময় জাহাজ ঘাঁটে বাঁধা ছিল। আপনি কীভাবে বলেন যে সেগুলি গভীর সমুদ্রে আছে? সেগুলো এখনো পোতাশ্রয়ে আছে।

সরদার শরণ সিং: সেগুলো যদি তখন পোতাশ্রয়েও থাকে তবুও এখন সেগুলো গভীর সমুদ্রে থাকার কথা – কারণ পোতাশ্রয়ে ৩ দিনের বেশী রাখা হয়না। আমার মনে হয় এখানে পদ্ধতি আর যন্ত্রের বিষয় আছে। আমরা আসল বিষয় থেকে দুরে সরে যাচ্ছি। আমি হাউজের একজন সদস্য। এবং আমরা অ্যামেরিকার এই আইন লঙ্ঘনের বিষয়ে প্রতিবাদ করতে যাচ্ছি।

শ্রী এ জি কুলকার্নি: সেটা কি?
সরদার শরণ সিংঃ এটা এমরা সবাই ঐক্যবদ্ধভেব সিদ্ধান্ত নেব। এটাও এক ধরণের একশন। কিন্তু যদি আমরা আমাদের শক্তি অযথা নষ্ট করি আর কিছু শব্দ নিয়ে পরে থাকি তাহলে বলতেই হয় যে আমরা মূল বিষয় থেকে দুরে সরে যাচ্ছি। মূল বিষয় হল সবাই এক হয়ে এই কাজের বিরোধিতা প্রকাশ করতে হবে। এটাই আসল পয়েন্ট।

শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: আপনার ভীরু নেতৃত্বে।

সরদার শরণ সিং: তারপর শেষ প্রশ্ন হল যে ভারত এই জাহাজগুলোকে আটকাবে কিনা। আমি এই ব্যাপারে কিছু বলতে চাইনা।

শ্রী এন জি গোরে: আমি শুধু একটা জিনিস জানতে চাই …
জনাব চেয়ারম্যান: কোন উত্তর দেয়া কি বাকি আছে?
শ্রী এন জি গোরে: আমার মূল পয়েন্ট মিস হয়েছে। ধরুন অ্যামেরিকাকে জাহাজ পাঠানো বন্ধ করতে বলার পরিস্থিতি আপনার হলনা – কিন্তু আপনি কি অন্তত এই অধিকার সংরক্ষণ করেন যে সেগুলোকে বাংলাদেশে পৌঁছাতে দেবেন না?

সরদার শরণ সিং: আমি ইতিমধ্যে বলেছি যে আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে বলেছি জাহাজ মাঝপথে প্রত্যাহার করতে এবং পাকিস্তানে এই সরবরাহ না পাঠাতে।

শ্রী এন জি গোরে: তারা যদি তা না করে তাহলে আপনি এটা করবেন কিনা? স্যার, আপনি প্রতিবাদ করবেন নিশ্চই…
জনাব চেয়ারম্যান: শ্রী কৃষাণ কান্ত।
শ্রী কৃষাণ কান্ত: (হরিয়ানা): স্যার এটা খুবই একটা মজার পরিস্থিতি। এখানে গতকাল সেক্রেটারী অব স্টেট এর বিশেষ সহকারী এসেছিলেন। তিনি বলেছেন দুইটি জাহাজের যে খবর প্রকাশিত হয়েছে তা ভুল। এবং স্টেট ডিপার্টমেন্ট বলেছে এতে কিছু আছে। এভাবেই আমেরিকান সরকার কাজ করে। আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উপর নির্ভর করতে পারিনা কারণ সিনেটর চার্চ বলছেন এক রকম আর পরে হচ্ছে অন্য রকম। সিনেটর কেনেডি বলেছেন যে সরকার সন্দেহজনকভাবে দুই রকম কথা বলছেন। (বাধা)। স্যার, নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে যে এই সরকার আমেরিকার মানুষের বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে। আমেরিকার গণমাধ্যম এবং আমেরিকান সাংবাদিকরা পেন্টাগনের সাথে নেই। যে পেন্টাগন দু রকম কথা বলছে আর কাজ করছে তাদেরকে কি ভারতের বিশ্বাস করা উচিৎ? আপনি কি তাদের স্পষ্ট করে বলেছেন? তারা পাকিস্তানকে যে অস্ত্র দিচ্ছে তা আমাদের বিরুদ্ধে ব্যাবহার করা হচ্ছে। তারা চিনের বন্ধু। এগুলো ভারতের বিরুদ্ধে ব্যাবহার করার কথা। আপনি কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েছেন যে যদি কোনো অস্ত্র সহায়তা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অথবা CENTO এবং SEATO এর মাধ্যমে পাঠানো হয় তবে তা শুধু বাংলাদেশ পরিস্থিতি খারাপ করবে তা নয় বরং ভারতের বিরুদ্ধেও ব্যাবহ্রিত হবে। তাই এই অস্ত্র সহায়তা বন্ধ করা উচিৎ। অতএব এধরনের অস্ত্র সহায়তা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং এই ব্যাপারে আমরা যে কোন পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত। আমি এটাই জানাতে চাই।

আমেরিকান সরকার যা কাজ করেছে তা ইচ্ছাকৃত কারণ তারা এশিয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্য চায় না – এবং তারা চায় না যে ভারত এগিয়ে যাক। তারা এশিয়াতে ঘাঁটি চায়। তাই তারা এসব করছে। আমি জানতে চাই ভারত সরকার এটা স্বীকার করেন কিনা যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে যে অস্ত্র সাহায্য দিচ্ছে তা ইচ্ছাকৃতভাবে দিচ্ছে – এটা পেন্টাগনের আগ্রহে যা মোটেই গণতন্ত্র, স্বাধীনতা বা অন্য কিছুর জন্য নয়। শ্রী সদ্রুদ্দিন একই ভাষায় কথা বলেছেন। অ্যামেরিকাও একই ভাষায় কথা বলেছে। তাই, এটা পাকিস্তান, জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও সব পশ্চিমা শক্তির ষড়যন্ত্র। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমি একটি জিনিস জানতে চাই। এই অস্ত্র সহায়তা কখন বাংলাদেশ যাচ্ছে? কেন আমাদের সরকার বাংলাদেশের চারপাশে নৌ ও বিমান অবরোধ আরোপ করছেনা যাতে করে এগুলো সেখানে পৌছাতে না পারে? আমি সরকারের কাছে জানতে চাই কেন তারা এখন পর্যন্ত এটা করছেনা? মন্ত্রী বলেন, তারা এটা বিবেচনা করবেন। আমি সরকারের কাছ থেকে কি এ প্রসঙ্গে আরেকটি জিনিস জানতে পারি? ২৫ মার্চ বাংলাদেশ মাত্র দুটি ডিভিশন ছিল। এখন সেখানে পাঁচটি ডিভিশন আছে। কিভাবে তিনটি বিভাগ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে পৌছাল?

সেখানে কি কোন বড় শক্তি আছে যারা এই সৈন্য এবং অস্ত্র বহনে পাকিস্তানকে সাহায্য করেছে? তাদের কাছে কি কোন তথ্য আছে? যদি না থাকে তাহলে আমাদের জানান সেগুলো কীভাবে গেল? আরও শিপমেন্ট যাতে না হয় তার জন্য তারা কি ব্যাবস্থা নেয়া হচ্ছে?

জনাব চেয়ারম্যান: ঠিক আছে। হ্যাঁ জনাব মন্ত্রী। (বাধা)। দয়া করে অপেক্ষা করুন। আমি সবাই অনুমতি দেব।

সরদার শরণ সিং: স্যার, প্রশ্ন ছিল পাকিস্তান কে অস্ত্র সাহায্য দেয়া নিয়ে আমাদের মনোভাব স্পষ্টভাবে এবং পরিষ্কারভাবে মার্কিন সরকারের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছে কিনা। আমার উত্তর হ্যাঁ। আমরা স্পষ্টভাবে বলেছি যে পাকিস্তানে কোনো ধরণের অস্ত্র সাহায্যে তাদের সামরিক শক্তি বাড়াবে এবং পাকিস্তান নিজেই বলে যে ভারত তাদের শত্রু – তাই তাদেরকে কোন সাহায্য করা মানে সরাসরি আমাদের বিরোধিতা করা। কারণ এই অস্ত্র সরাসরি আমাদের বিরুদ্ধে ব্যাবহার করা হবে। তাই আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে কোন সন্দেহের মধ্যে রাখিনি। শুধু তাই নয় স্যার, বাংলাদেশের নৃশংসতার পরিস্থিতি এখন যে অবস্থায় আছে এসবের পরে সেখানকার মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম আরও প্রলম্বিত হবে। তাই স্যার, আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি মার্কিন সরকারকে জানিয়েছি।

শ্রী জোয়াচিম আল্ভা (মহারাষ্ট্র): স্যার, ১৯৬৫ সালে, মার্কিনরা পাকিস্তানে কোনো অস্ত্র চালান করেনি। স্যার এটা গুরুত্তপূর্ন কথা। ১৯৬৫ সালে অ্যামেরিকা পাকিস্তানে অস্ত্র চালান বন্ধ রেখেছে।

সরদার শরণ সিং: তারপর, স্যার, সন্মানিত সদস্য যে প্রশ্ন দুটি করেছেন যে আমরা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে চালান বন্ধ করার জন্য নৌ ও আকাশপথ অবরোধ করব কিনা। আমি মনে করি এর সাথে অ্যামেরিকার পাকিস্তানে অস্ত্র সাহায্য পাঠানোর কোন সমপর্ক নাই। এটা একটা সাধারণ প্রশ্ন।

(বাধা)
শ্রী কৃষাণ কান্ত: স্যার, পয়েন্ট অব অর্ডার।
(বাধা)
সরদার শরণ সিং: স্যার, এটি একটি সাধারণ প্রশ্ন … (বাধা) …. স্যার, এই সাধারণ প্রশ্নের উত্তর এখন দিতে চাই না।

শ্রী কৃষাণ কান্ত: স্যার, পয়েন্ট অব অর্ডার। “নিউ ইয়র্ক টাইমস” প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি জাহাজ ৮ মে যাত্রা শুরু করে এবং গতকাল করাচিতে পৌঁছায়। ঐ জাহাজটি অস্ত্র বোঝাই ছিল এবং বাংলাদেশ যাচ্ছে। এটি খুবই প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন।

জনাব চেয়ারম্যান: তিনি আপনার প্রশ্নে যাচ্ছিলেন যা আপনি করলেন….
(বাধা)
শ্রী কৃষাণ কান্ত: হ্যাঁ, স্যার।
জনাব চেয়ারম্যান:………… এসব সেনাসদস্যকে পরিবহন ………
সর্দার শরণ সিংঃ পশ্চিম থেকে পূর্ব পাকিস্তানে
জনাব চেয়ারম্যান: পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে নেয়া হয়েছে কি হয়নি।
(বাধা)
শ্রী কৃষাণ কান্ত: স্যার, তার আগে আমি অন্য একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছি। গতকাল যে চালান পাকিস্তান পৌঁছেছে তা বাংলাদেশ পাঠাতে যাচ্ছে। সুতরাং, স্যার, মাননীয় মন্ত্রী প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না। এর আগে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও অস্ত্র বাংলাদেশে গেছে। কীভাবে গেল? তার কাছে কি কোন তথ্য আছে যে কোন বড় শক্তি তাদের সাহায্য করেছে?

জনাব চেয়ারম্যান: না, তা আসে না।
শ্রী কৃষাণ কান্ত: স্যার, এটি খুব প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন।
(বাধা)
জনাব চেয়ারম্যান: না।
শ্রী কৃষাণ কান্ত: স্যার, পররাষ্ট্র মন্ত্রীর জানা উচিত।
(বাধা)
জনাব চেয়ারম্যান: হ্যাঁ, জনাব মন্ত্রী।
সরদার শরণ সিং: প্রশ্ন উঠেছে বড় কোন শক্তি পাকিস্তানকে বাংলাদেশের সৈন্য ও অস্ত্র বহনে সাহায্য করছে কিনা – আমার জানা মতে এরকম কেউ তা করছেনা।
(বাধা)

শ্রী শি ডি পাণ্ডে: এমনকি চীনও না?
জনাব চেয়ারম্যান: তিনি এভাবে উত্তর দিতে পারেন না। জনাব পান্ডে, আপনি আপনার সীটে বসুন।
শ্রী এ ডি মনি: স্যার, উনি এখানে বসেই আছেন।
শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: স্যার, যদি এমন হয় যে পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়ে ভারতের সাথে যুদ্ধ লাগানোর কোন পরিকল্পনা অ্যামেরিকার নেই তবে আমি জানিনা তাদের পরিকল্পনা আসলে কি।
জনাব চেয়ারম্যান: দয়া করে বসুন।
শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: এখনো তিনি বলেছেন যে কোন বিশ্বশক্তি সাহায্য করছেনা।
সরদার শরণ সিং: এটা একটা আলাদা বিষয়। যে প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করা হয়েছিল (বাধা) …. যে প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল।

জনাব চেয়ারম্যান: দয়া করে বসুন, জনাব ভূপেশ গুপ্ত।
সরদার শরণ সিং: প্রশ্নটি ছিল অস্ত্র ও লোকবল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে আনার ব্যাপারে কোন বিশ্বশক্তি সাহায্য করছে কিনা।

আমি চীন সম্পর্কে বলতে পারব না। চীনের সব রকম সহায়তায় ও সরঞ্জাম দিচ্ছে। কিন্তু পরিবহনের ক্ষেত্রে ততোটা নয়। তবে সন্দেহ নেই যে চিন সব রকমের সরঞ্জাম দিচ্ছে…….
(বাধা)
জনাব চেয়ারম্যান: জনাব পান্ডে, আপনি মন্ত্রী না। মন্ত্রীকে উত্তর দিতে দিন। ………
(বাধা)
সরদার শরণ সিং: এটা শেষ প্রশ্নের উত্তর।

শ্রী রাজ নারায়নঃ আমাকে আবার বৈধতার প্রশ্ন তুলতে হচ্ছে। আপনি এখানে রুলিং দিয়েছেন আর আমার প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার একথা মেনে নিয়েছেন যে এখন থেকে ইস্ট পাকিস্তান শব্দটি ব্যাবহার করা হবেনা শুধু বাংলাদেশ শব্দটি ব্যাবহ্রিত হবে কিন্তু মন্ত্রী মহোদয় বারবার ইস্ট পাকিস্তান ইস্ট পাকিস্তান বলছেন। একবার যখন বললেন আমি ভাবলাম অসতর্কতাবশত বলে ফেলেছেন কিন্তু আমার মনে হচ্ছে সরকার প্রথমে যে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন তা থেকে পেছনে সরে যাচ্ছেন। আপনি দয়া করে এব্যাপারে স্পষ্ট ধারনা দিন। এই সংসদে একথা অনুমোদিত হয়ে গেছে যে ‘ইস্ট পাকিস্তান’ ও ইস্ট বাংলা শব্দ দুটি আর ব্যাবহার করা হবেনা, তদস্থলে ‘বাংলাদেশ’ বলতে হবে। এর পর ও মন্ত্রী ‘ইস্ট পাকিস্তান’ শব্দটি কেন ব্যাবহার করছেন?
সর্দার শরণ সিংঃ আমার উত্তর দেবার কিছু বাকি নেই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এইটাই ব্যাবহার করছে।
(বাধা)
শ্রী রাজ নারায়নঃ মহোদয়, আমি একটি প্রশ্ন করেছিলাম। মন্ত্রী তার কি জবাব দিয়েছেন আমি শুনিনি। আমি জানতে চাই সরকারের সঠিক মনোভাব কি? তিনি বাংলাদেশে বিশ্বাসী না ইস্ট পাকিস্তানে? সরকার সোজা উত্তর দেবেন। এটা কৌতুক নাকি। আমি জিজ্ঞেস করলে তার কুকীর্তি ফাঁস করে দেব।
সভাপতিঃ এই স্টেটমেন্ট তিনি তো বাংলাদেশেই লিখেছেন।
শ্রী রাজ নারায়নঃ স্টেটমেন্টে যা লিখা আছে তাই বলুন, যা বলবেন তাই লিখবেন, যা লিখবেন তাই বলবেন।
সভাপতিঃ আপনি বসে পরুন।
শ্রী রাজনারায়ণ তাহলে আমি বুঝব যে আপনি মন্ত্রীকে আদেশ করছেন যা লিখে হয়েছে তাই বলতে। দেখুন, এসব শব্দের জটিলতায় অনেক পড়েছিলাম।

শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: স্যার আমার একটি সাবমিশন আছে। দয়া করে আপনি রুলিং দেন যে ‘ইস্ট পাকিস্তান’ শব্দটি যেখানেই ব্যাবহার করা হবে সেটাকে কেটে দিতে হবে অথবা সেই শব্দটি প্রসিডিং এ ব্যাবহার করা যাবেনা। একটি স্ট্যান্ডিং রুলিং থাকা উচিৎ। যখনি ‘ইস্ট পাকিস্তান’ বলা হবে সেটাকে ‘বাংলাদেশ’ হিসেবে ধরে নিতে হবে।

শ্রী রাজনারায়ণঃ সরকারের নির্লজ্জতা দেখুন, এটা নাকি ইন্টারন্যাশনাল এক্সপ্রেশনে বাংলাদেশ কি অন্তর্লীন হবে।
সভাপতিঃ আচ্ছা, হয়ে গেছে।
শ্রী রাজনারায়ণঃ আমি আপনাকে অনুরোধ করছি আপনি তাকে বলুন। আপনি সত্য বলেছেন যে স্টেটমেন্টে বাংলাদেশ লিখা রয়েছে। আমি মনে করেছিলাম মন্ত্রী অজ্ঞতাবশত বা অভ্যাসবশত তা বলছেন কিন্তু তিনি স্বীকার করলেন যে এটি ইন্টারন্যাশনাল এক্সপ্রেশন। আমার জানা নেই। রাশিয়া, অ্যামেরিকা, ব্রিটেন এই তিন শক্তির ষড়যন্ত্রে ভারত-পাকিস্তানের সৃষ্টি। আমাদের মগজে একথা পরিষ্কার আমি সর্দার শরণ সিংহ এর মত বিদেশে দাওয়াত খেয়ে বেড়াই না আমি আমার নীতি বদলাতে পারি না। তিনি বিদেশে গিয়ে কি কি করলেন প্রকাশ করব। আমার আবেদন এই যে, যেমন ভুপেশ গুপ্ত মহাশয় বলেছেন, আপনি আদেশ করুন, যেখানে যেখানে ‘ইস্ট পাকিস্তান’ ব্যাবহার করা হয়েছে তা কার্য বিবরণী হতে বাদ যাবে এবং তদস্থলে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি আসবে যা বিবৃতিতে লিখা আছে।

শ্রী কৃষাণ কান্ত: এটা আমার পয়েন্ট অব অর্ডার ছিল। মাননীয় মন্ত্রী তার উত্তরে বলেছেন তারা আমেরিকান সরকারকে জাহাজ যাতে পাকিস্তান পৌঁছাতে না পারে সেটা বলেছেন। ধরে নিন যে অ্যামেরিকা তাদের কথা রাখল না – তখন সরকার সেইসব অস্ত্র যাতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে না আসতে পারে সেই ব্যাপারে কোন ব্যাবস্থা নেবেন কিনা – এটাই ছিল আমার সহজ প্রশ্ন।

সরদার শরণ সিং: ঐ পরিস্থিতিতে আমরা কি করব সেটা আমি এখন বলতে চাইনা। এই মুহুর্তে আমি কিছুই বলতে চাইনা। আমি অলরেডি এর উত্তর দিয়েছি।

জনাব চেয়ারম্যান: আপনি কি “বাংলাদেশ” শব্দের ব্যবহার সম্পর্কে কিছু বলবেন?
সরদার শরণ সিং: আমি জানি না, স্যার, যদি আমার অনুপস্থিতিতে অন্য কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে কিনা। কিত্নু আমি যখন গত এক পক্ষকাল আগে সেশনে এসেছিলাম তখন পর্যন্ত আমি এসংক্রান্ত কিছুই জানিনা। এবং আমি রেকর্ড বেড় করে দেখে নেব যে এটা কত শক্তভাবে করা হয়েছে। এবং আমি একটা কথা সোজাসুজি বলতে চাই – তা হল যখন আমাকে অন্য দেশের সাথে কথা বলতে হয় তখন তাদের কাছে বোধগম্য হয় এমন ভাবেই আমাকে কথা বলতে হয়।
তাই আমাকে এটা দেখতে হবে। আমি ফাইনালি কিছু বলছিনা – আমাকে দেখতে হবে শেষ পর্যন্ত সভাপতি এই ব্যাপারে কি বলেছেন।

শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: আপনি সহজেই বলতে পারেন যে ২৫ মার্চের আগে সেটা পূর্ব পাকিস্তান ছিল এবং ২৫ মার্চ থেকে এটি বাংলাদেশ।
শ্রী এ জি কুলকার্নিঃ তার সংসদের ভাষাতেই এটা বলা উচিৎ। তিনি এটাকে শুধু বাংলাদেশ বলতে পারেন।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র (উড়িষ্যা): আপনি মন্ত্রীর অবগতির জন্য পুনরায় রিপিট করতে পারেন।
মন্ত্রী
জনাব চেয়ারম্যান: ডেপুটি চেয়ারম্যান সম্ভবত নির্দেশনা দিয়েছিলেন।
সরদার শরণ সিং: আমি আগেই বলেছি যে, আমি দেখে নেব কি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
শাড়ি রাজনারায়ণ: সেখানে পড়ার কি আছে?
সরদার শরণ সিং: আমি পরে নিতেই অভ্যস্ত।
শ্রী রাজনারায়ণ: আপনার স্টেটমেন্টেই “বাংলাদেশ” শব্দটি লেখা আছে।
শ্রী ভূপেশ গুপ্তঃ পড়ার কিছুই নেই। প্রধানমন্ত্রী এখন বারবার “বাংলাদেশ” শব্দটি ব্যাবহার করেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রীও তাই। এটাই আমাদের ভাষা। এর একটি রাজনৈতিক জাত্যর্থ হয়েছে। এর একটি নৈতিক সংজ্ঞা আছে।
সরদার শরণ সিং: একই শব্দ অন্যান্য বিভিন্ন প্রত্যুত্তরগুলিতে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমনটি আপনি বলেছেন। কিন্তু আমাকে পড়ে দেখতে হবে আমি যখন ছিলাম না তখন কি কি গৃহীত হয়েছে এবং তখন নিশ্চই আমি মেনে চলব।
চেয়ারম্যান: আমি আশা করি, জনাব মন্ত্রী, আপনি এখন মিস্টার মোহতার নোট নিতে পারেন।

শ্রী এম কে মোহতা: স্যার, মাননীয় মন্ত্রী বলেছেন, মার্কিন সরকার টেকনিক্যালি লুকাচ্ছেন যে ২৫ মার্চের পর নতুন কোন অনুমোদন দেয়া হয় নাই। স্যার আমিও মনে করি ভারত সরকার পালিয়ে আসা উদ্বাস্তুদের সাথে – যারা এখন পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও অন্যান্য বর্ডার এস্টেটে অবস্থান করছে – তাদের সাথে লুকোচুরি খেলছেন। এই হাউজ জানতে চায় কেন সরকার পাকিস্তানে অস্ত্র আসা প্রতিরোধের ব্যাপারে পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। এসব অস্ত্র বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের উপর ব্যাবহার করা হবে – ভারতের জনগণের উপর ব্যাবহার করা হবে। হাউজ জানতে চায় ভারত সরকারের মনে কি আছে? দ্বিতীয়ত আমি মন্ত্রীর কাছে জানতে চাই জাহাজে এমন কোন যন্ত্র আছে কিনা যা দিয়ে পাকিস্তান সাধারণ বিমানকে যুদ্ধবিমানে রূপান্তর করতে পারে যেগুলো বাংলাদেশের মানুষের উপর ব্যাবহার হবে? এটা হতে পারে কি পারেনা? যদি বলেন হতে পারে তাহলে প্রশ্ন কেন ভারত সরকার অ্যামেরিকার বিরোধিতা করছে না? পরিশেষে আমি জানতে চাই কোন কোন দেশ বাংলাদেশের অবস্থা খারাপ হবার পড় থেকে পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়েছে।

সরদার শরণ সিং: প্রথম প্রশ্নের বিষয়ে বলা যায় আপনি কীভাবে সমস্যাকে মোকাবেলা করবেন সেটা আপনার মানসিকতার ব্যাপার। একটি বিষয় পরিষ্কার জেনে রাখুন যে আমরা শিপমেন্ট থামাতে বলেছি। এটাও নিশ্চিত যে এতে করে দুই দেশের মধ্যে দূরত্ববৃদ্ধি তরান্বিত হবে। এটা করুন বা ওটা করুন – এসব বলার চেয়ে এই পথই ভালো হবে। একটির স্টেপের পড়ে আরেকটি স্টেপ শুরু হয় – এটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। যা খুশী তা করাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবেনা। আগে সব দিক ভেবে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দ্বিতীয় প্রশ্নে তিনি বলেছেন যে যদি সেখানে সিভিল বিমানের যন্ত্রাংশ থাকে সেগুলোকে যুদ্ধ বিমান তৈরিতেও কাজে লাগানো যায় – হ্যা – তার কথা সঠিক। অতএব একারণেই পাকিস্তানকে যে কোন ধরণের আর্থিক সাহায্য করা প্রকারান্তরে নৃশংসতাকে প্রশ্রয় দেয়া। অ্যামেরিকার ও অন্যান্য দেশের পাকিস্তানকে দেয়া বিমানের যন্ত্রাংশ অথবা কোন আর্থিক অনুদান মিলিটারি নৃশংসতাকে আরও বাড়িয়ে দেবে।

শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: ‘পোষকতা করা’ শব্দটি কি যথার্থ হয় কিনা? কেউ একজন হত্যা করছে আর আমি তাকে অস্ত্র দিচ্ছি। এটা কি হত্যায় সাহায্য করা নাকি হত্যা করা?

সরদার শরণ সিং: আমি একমত যে এই ইংরেজি শব্দটা অনেক ফোর্সফুল, অনেক এক্সপ্রেসিভ। এটাই একমাত্র অভিব্যক্তি। আমি আরও বলেছি যে এতে সামরিক শাসনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায় এবং তারা আরও বৃহত্তর হিংস্রতার দিকে ধাবিত হবে।

শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: সেটাই ব্যবহার করুন।
সরদার শরণ সিং: আমি ব্যবহার করেছি।
শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: আমি এখানে আরও ভালো শব্দ দিতে পারি।
শ্রী অর্জুন অরোরা: জনাব গুপ্ত ব্রিটেনে ছিলেন।
সরদার শরণ সিং: অতএব, আমরা সবসময় শব্দের ব্যাপারে তার সংশোধনী গ্রহণ করি। বাংলাদেশের উদ্ভূত পরিস্থিতির পরে জানা মতে পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ করেছে অ্যামেরিকা ও চিন। অর্থাৎ অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র এরাই পাকিস্তানকে মিলিটারি সহায়তা দিয়েছে।

শ্রী এ ডি মনি (মধ্য প্রদেশ): আমি মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করতে চাই যেহেতু নিউ ইয়র্ক টাইমসে ভিয়েতনাম ইস্যুতে অ্যামেরিকার বিষয়টি প্রকাশিত হয়েছিল – এতে করে স্টেট ডিপার্ট্মেন্টের গোপনীয়তা ফাঁস হয়েছে কিনা? মার্কিন সরকারের গ্রহণযোগ্যতা আমাদের কাছে কতটুকু থাকে? দেশজুড়ে যেহেতু সরকারের পলিসিতে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে এসময়ে সরকারের উচিৎ বিষয়টি ফর্মালি নিরাপত্তা পরিষদে পেশ করা – এতে করে অন্য দেশগুলোকে পাকিস্তানকে অস্ত্র সহায়তা দিতে নিষেধ করা যায় কিনা? আমরা রোডেশিয়ার ক্ষেত্রে এমনটি করেছিলাম – কিন্তু এখন আমাদের সীমান্তের বন্ধু রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে করছিনা। সরকার কেন নিরাপত্তা পরিষদে খোঁড়া যুক্তি উপস্থাপন করছেন? নিউ ইয়র্কে আমাদের এমব্যাসি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মন্ত্রী জানেন যে জেনারেল কাউন্সিলরের অফিসে আমাদের কিছু ডেলিগেট ছিল। আমি কি জানতে পারি বাংলাদেশ ইস্যু শুরু হবার পরে তিনি জেনারেল কাউন্সেলরের স্টাফদের শক্তিশালী করেছেন কিনা যাতে করে তারা সেখানকার মিলিটারি এটাচিকে কি ঘটছে তার উপর চোখ রাখতে বলতে পারেন? জেনারেল কাউন্সেলর ৩, ই-৬৪ তে আছেন – আপনি জানেন।

দুপুর ১২ টা
আমি জানতে পারি পাকিস্তানে অ্যামেরিকার অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে সেখানে আমাদের অফিসকে শক্তিশালী করা হয়েছে কিনা? কিনা এই অফিস খুঁজে বের করতে কি দেশ থেকে অস্ত্র সরবরাহ পেতে পাকিস্তান দ্বারা তৈরি প্রচেষ্টা সংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্রে ঘটছে জোরদার করা হয়েছে? তৃতীয়ত, আমি মাননীয় মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষন করছি গতকালের অল ইন্ডিয়া রেডিওতে প্রচারিত ‘স্পটলাইট’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে। সেখানে বলা হয়েছে যে কিছু কিছু লোক স্টেট ডিপার্ট্মেন্টের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধন করছেন যে তারা আঁচ করতে পেরেছিলেন যে অ্যামেরিকা এমন কাজ করতে যাচ্ছে। তাহলে কেন আমাদের সরকার কৈফিয়ত চাইবে না? আমি জানতে চাই এই অনুষ্ঠান কি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবগত ছিল নাকি আই এন্ড বি মিনিস্ট্রি ব্যাবস্থা নিয়েছিল?

সরদার শরণ সিং: আমি জানি, স্যার নিউইয়র্ক টাইমস ভিয়েতনামে অ্যামেরিকার কার্যক্রম সংক্রান্ত খবর প্রকাশ করেছে যা এখন সেখানে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। এটি রীতিমত এখন অ্যামেরিকার কোর্টে পৌঁছে গেছে। দি নিউ ইয়র্ক টাইমস চমৎকার কিছু কাজ করছে – তারা অনেক অজানা জিনিস আমাদের সামনে তুলে আনছে। এখন দ্বিতীয় প্রশ্নের ব্যাপারে আমি জানতে চাই এটিকে নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করা হবে কিনা। এই বিষয়টি খুব সাবধানে বিবেচণা করতে হবে। আমি আপনার সাথে খোলাখুলি কথা বলছি। নিরাপত্তা পরিষদের সাথে আমাদের বোঝাপড়া সুখকর না। সেখানে কিছু উত্থাপন করার আগে আমাদের ভালোভাবে চিন্তা ও আলোচনা করতে হবে – কারণ সেখানে আমাদের পক্ষে ও বিপক্ষে অনেকেই শক্ত শক্ত কথা বলতে পারেন। তাছাড়া নিরাপত্তা পরিষদের সফলতাও এখন প্রশ্নবিদ্ধ। তৃতীয় প্রশ্নের ব্যাপারে বলছি – বলা হয়েছে যে নিউ ইয়র্কের জেনারেল কন্সুলের অফিসে মিলিটারি এটাচি রাখা যেতে পারে। আমি বলতে পারছিনা আসলে এতে কোন কাজ হবে কিনা। অল ইন্ডিয়া রেডিওর প্রচার সম্পর্কে আমার কোন ধারনা নাই। আমি এটা শুনিনি। আর এটা নিয়ে মন্তব্যও করতে পারছিনা। তবে আপনারা জানেন যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্টেটমেন্ট পরিষ্কার করেনি। আমি মন্তব্য করতে পারছিনা কারণ আমি অনুষ্ঠানটি শুনিনি। এটা হতে পারে কোন প্রেসের লোক অথবা কোন রাজনৈতিক চিন্তাবিদ অথবা অন্য কারো বক্তব্য। তিনি অবশ্যই আনঅফিসিয়াল কেউ।
এখন স্যার, নিঃসন্দেহে এই হাউজ সচেতন আছে। আমাকে কল এটেশন মোশনের উত্তর দিতে হবে।

শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: পয়েন্ট অব অর্ডারের উপর ……
সন্মানিত সদস্যগণ: না না।
শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: আগে যখন লোকসভায় এ ধরনের কাজ করতাম তখন আমরা দুইটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতাম। আমার মনে হয় আমরা এটা শেষ করা পর্যন্ত লোকসভা অপেক্ষা করুক। এটার মাঝখানে চলে গেলে হবেনা। এটা খুব ভুল ও অন্যায় হবে – কারণ সেক্ষেত্রে এই হাউজকে সেকেন্ড ক্যাটাগরিতে ফেলা হবে। তাই আমি আশা করব আমার সন্মানিত লোকসভার বন্ধুগণ কিছু মনে করবেন না। যখন মন্ত্রী সেখানে ছিলেন তখন আমরা তিনি আসা পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করতাম। আপনার ইন্সট্রাকশন অনুযায়ী তিনি এখানে আমাদের আলোচনা শেষ হলেই চলে যাবেন।

জনাব চেয়ারম্যান: ঠিক আছে জনাব মুনিস্বামি।
শ্রী এন আর মুনিস্বামি(তামিলনাড়ু): স্যার, আমরা সবাই ভেবেছিলাম যে আমাদের বিদেশমন্ত্রী বিজয়ী ভাবে ভারতে অবতরণ করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি ভারতে অবতরণ করার সময়েই নিউ ইয়র্ক টাইমসের খবরে আমরা সমানভাবে মুষড়ে পড়েছি। আমি জানতে চাই তিনি অ্যামেরিকায় অবস্থানকালেই করাচীর উদ্যেশ্যে যে সেনাসরঞ্জামপূর্ন ফ্রিগেট রওনা দিয়েছে তা জানতেন কিনা। যদি তিনি ডাইরেক্টলি বা ইন্ডাইরেক্টলি না জেনে থাকেন তাহলে সেখান থেকে আসার পর এই সংবাদ জেনে এখন তিনি ভবিষ্যতে তাদের সাথে কীভাবে বোঝাপড়া করবেন বলে ঠিক করেছেন?

দ্বিতীয় প্রশ্নটি হল পাকিস্তান অন্যান্য দেশের সঙ্গে SEATO এবং CENTO এর একজন সদস্য এবং সম্ভবত ন্যাটোরও সদস্য। তারা অর্থনৈতিক এবং সামরিক – সব ধরণের সাহায্য পাচ্ছেন। কিন্তু মনে হচ্ছে আমরা অনেক অসামর্থ্যে ভুগছি। আমার মনে হয় এখনকার পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের ননএলাইন্মেন্ট পলিসি আবার রিভাইস করা দরকার।

তৃতীয় প্রশ্ন হল, তিনি যে সব দেশ গিয়েছেন যেখানে বাংলাদেশের ব্যাপারে আমাদের অবস্থান তুলে ধরতে ভালো ভাবে সফল হয়েছেন। এখন ভুট্টো সাহেব সেই সব দেশে যাওয়া শুরু করেছেন। এবং সেখানে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর করে আসা ভালো মনোভাবকে নষ্ট করে দিচ্ছেন। আমি জানতে চাই তিনি বিষয়টা তদারকি করবেন কিনা যাতে করে তিনি যে ইম্প্রেশন করে রেখে এসেছিলেন সেটা বজায় আছে কিনা তা জানা যায়।

যতদূর আমেরিকা কন্সার্ণ আছে তাতে স্টেট ডিপার্টমেন্ট গুলো পরিভাষায় পূর্ণ। এবং প্রতিরক্ষা দপ্তর নিজেদের মত মিলিটারি সরঞ্জাম সাপ্লাই দিচ্ছে আর হোয়াইট হাউজ সেটাকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এই তিনটা শাখা সমন্বিতভাবে কাজ করছেনা। আমি জানতে চাই এই তিন বিভাগের মতে কোন পার্থক্য আছে কিনা – যেখানে পেন্টাগন পাকিস্তানের পক্ষে আর হোয়াইট হাউজ সেটাকে সমর্থন দিচ্ছে। আমি জানতে চাই অ্যামেরিকা যে ভাবমুর্তি দেখিয়েছিল তা বজায় রাখবে কিনা এবং দুইটি ফ্রিগেটে করে যে সকল এয়ারক্র্যাফট আর ধ্বংসাত্মক অস্ত্র পাঠাচ্ছিলেন সেই চালান বন্ধ করবেন কিনা।

আমার শেষ ও ফাইনাল প্রশ্ন হচ্ছে আমরা যুদ্ধ যদি শুরু হয়ে যায় তাহলে তার জন্য আগে থেকে কোন প্রস্তুতি নিয়ে রাখব কিনা? আমরা এই কি আকস্মিকতার জন্য প্রস্তুত আছি?

সরদার শরণ সিং: স্যার, প্রথম প্রশ্ন সম্পর্কে আমার যোগ করার কিছুই নাই। শুধু বলব পদক্ষেপ নেয়া প্রক্রিয়াধীন আছে এবং তারা আমাদের যে আশ্বস্তিই দেন না কেন।

দ্বিতীয় প্রশ্নে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন যে আমাদের ননএলাইন্মেন্ট পুনর্বিবেচনা করা উচিত। আমি মনে করি না যে শুধুমাত্র একটি দৃষ্টি আকর্ষন বিষয়ে আলোচনা করতে যেয়ে একটি দীর্ঘ আলোচনার শুরু হোক এবং বর্তমান নীতির কার্যকারিতা সম্পর্কে গভীর আলোচনা চলুক। এটি একটি বড় ইস্যু যা এই সংক্ষিপ্ত দৃষ্টি আকর্ষন নোটিশে মোকাবিলা করা যাবে না।

তারপর তৃতীয় প্রশ্নে তিনি বলেছেন যে ভুট্টো সাহেব সফরের পরিকল্পনা করছেন। এটাকে আমি স্বাগত জানাই। আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি জানিয়েছি – তাদের যদি কিছু বলার থাকে তাহলে তারা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি জানাবার অধিকার রাখে। এটাই আন্তর্জাতিক বিশ্বে সবাইকেই করতে হয়। নিজেকে সবচেয়ে ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে হয়। হতে পারে আমি যে ভাবমূর্তি দিয়ে এসেছি তা ক্ষুণ্ণ হবে। এতে আমার হাত নেই। আমাকে যদি কেউ সুযোগ দেয় আমি দীর্ঘ দাবী করব। তবে আমার সন্দেহ নেই যে বাংলাদেশে এখন যা ঘটছে তাতে আমাদের পক্ষেই সবার মনোভাব থাকবে। এর পর তিনি জানতে চেয়েছেন যে অ্যামেরিকার বিভিন্ন দপ্তর ভিন্ন ভিন্ন ভাবে কাজ করে কিনা। সেটা তাদের বিষয়। আমরা শুধু ফলাফল দেখব। আমরা ভুল জানি – সেজন্য আমাদের কাছে মনে হচ্ছে যে এক এক দপ্তর ভিন্ন ভিন্ন ভাবে কাজ করে। আর যদি আমরা আগে থেকেই কোন কিছু ধরে বসে থাকি তাহলে আমরা সন্তস্ট হতে পারব না। এটা তাদের ব্যাপার যে যখন তারা কোন বিবৃতি দেবেন তার দায় দায়িত্ব তারা নেবেন। এর পর শেষ প্রশ্নটি একটি সাধারণ প্রশ্ন যে যদি যুদ্ধ পরিস্থিতি শুরু হয় তাহলে আমরা কী ব্যাবস্থা নেব? আমার কলিগ ডিফেন্স মিনিস্টার এখানে আছেন। তিনি এই হাউজে একাধিকবার বলেছেন যে যদি আমাদের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন হয় তাহলে আমরা যুগোপযোগী পদক্ষেপের মাধ্যমেই জবাব দেব।
শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: স্যার, মাননীয় মন্ত্রী বলেন যে তিনি আমার কাছে থেকে ভাষা গ্রহণ করবেন। কিন্তু তার ভাষার অভাব নেই। এটি তার যথেষ্ট আছে। কিন্তু তিনি আর তার সরকার আমেরিকানদের ব্যাপারে রেজল্যুশন এবং সিদ্ধান্তের অভাবে ভোগেন।

স্যার, যখন মাননীয় মন্ত্রী তার সাম্প্রতিক সফর শেষে পালাম বিমানবন্দরে পৌঁছান তখন তিনি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তারা তাকে নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার খবরটা দৃষ্টিগোচরে আনেন। তিনি বলেন – ‘আমি রিপোর্টের সত্যতা সম্পর্কে বলতে পারছিনা। আমাকে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে পাকিস্তানে কোন অস্ত্র দেয়া হবেনা। ’

আমি জানি না টাইমস অব ইন্ডিয়া সঠিকভাবে এটি উদ্ধৃত করেছে কিনা। কিন্তু তিনি মনে হয় ঘোরের মধ্যে আছেন। এত কিছু হবার পরেও হয়ত অ্যামেরিকা তাদের কথা রাখবে। আমি অবাক হই কত সহজে তিনি এইসব বিবৃতি দেন। এমনকি ভারতের সময়ে? ……….
সরদার শরণ সিং: আপনি বিবৃতির অবশিষ্ট অংশ পড়ে দেখবেন।
শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: আমি পড়ব – সেখানে মাত্র দুটি বাক্য আছে।
”আমাকে নিশ্চিত করা হয়েছে যে ইউ এস আর্মস পাকিস্তানে দেয়া হবেনা। ’
আপনি ‘নিশ্চিত’ শব্দটি ব্যাবহার করেছেন। অন্যটি হল –
”আমি রিপোর্টের শুদ্ধতা সম্পর্কে সন্দিহান। ‘

আপনার কেন মনে হয় যে এমন একটা বিষয় নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস সুদ্ধ খবর লিখবে না। এর আগেও অনেকবার তাদের রিপোর্ট সত্য প্রমাণিত হয়েছে। আমি জানতে চাই। আপনি যা ইচ্ছা বলতে পারেন।

এখন, তিনি কি জানেন যে ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় মার্কিনরা পাকিস্তানে অস্ত্র বিক্রয় ও সরবরাহের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন এবং এখনো সেটা বলবত আছে? আমরা খুঁজে পেয়েছি, ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন অনুযায়ী, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র রবার্ট McCloskey বলেছেন যে ১৯৬৬-৬৭ সাল থেকে পাকিস্তানে সামরিক আইটেম বিক্রি হয় বার্ষিক দশ মিলিয়ন ডলার। এখন নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রকাশ করেছে যে ১৯৬৭ থেকে ৩০ এপ্রিল ১৯৭০ এর মধ্যে পাকিস্তানে সামরিক সরঞ্জাম প্রবাহ হয় প্রায় ৪২ মিলিয়ন ডলার। এই সমস্ত ঘটনা আপনার জানা। আপনার রাষ্ট্রদূতেরও জানার কথা। সে কি করছে? আমি জানতে চাই। এ প্রসঙ্গে সিদ্ধান্ত সরকার কি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে? সরকার কি মনে করেনা যে অ্যামেরিকা অপরাধমূলক পৃষ্ঠপোষকতা করছে? এর ফলে ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশে যে গণহত্যা চালাচ্ছেন – সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীকে নির্যাতন করছেন – তাদের স্বপ্নকে রক্তের সমুদ্রে ভাসিয়ে দিচ্ছেন – তাকেই পৃষ্ঠপোষকতা করা হল। যদি এটা অঙ্গীকার লঙ্ঘন হয় তাহলে আমি মনে করি এটা সমস্ত বিশ্বকে জানানো উচিৎ। অন্যান্য দেশের সাথে কথা বলুন। জানান যে জাতিসঙ্ঘ চার্টার অনুযায়ী অ্যামেরিকা দোষী। জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক নিয়মাবলী অনুসারেও অ্যামেরিকা অঙ্গীকার লঙ্ঘনকারী। এটা হল এক নম্বর। তিনি কি স্বীকার করেন যে এই অস্ত্র সরবরাহ প্রকৃতপক্ষে ভারতের বিপক্ষে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়া; পাকিস্তানকে যুদ্ধের জন্য উস্কানি দেয়া। অ্যামেরিকা থেকে অস্ত্র আসার ফলে সীমান্তে উত্তেজনা বাড়ছে, পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা আরও বেশী পরিমাণে জড়ো হচ্ছে, অর্থাৎ পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। যেহেতু আমাদের জাতীয় স্বার্থ জড়িত তাই পশ্চিম পাকিস্তানে অ্যামেরিকার অস্ত্র সরবরাহ শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের জন্য হুমকি নয় বরং আমাদের বিরুদ্ধেও মিলিটারি একশন ও মিলিটারি আক্রমণ প্রস্তুতির আভাস দেয়। যদি তাই হয় আমাদের অবশ্যই বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষন করা উচিৎ। শুধু রাজনৈতিক একশন নয় অন্যান্য প্রস্তুতিও নেয়া দরকার। স্যার, এমন কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায় নাই। তিনি বলবেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী তার পাশে বসে আছেন।

জনাব চেয়ারম্যান: দয়া করে আপনার প্রশ্ন করুন।

শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: তার উত্তর হবে যে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী তার পাশে বসে আছেন – তিনিই উত্তর দেবেন। যে মুহুর্তে আমেরিকা ইয়াহিয়া শাসককে অস্ত্র দিয়ে সমৃদ্ধ করছে, বাংলাদেশ ছাড়াও আমাদের দেশের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনারা অবস্থান নিয়েছে, সে অবস্থায় আপনি কি পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছেন? আমি মনে করি আমাদের উত্তর হওয়া উচিৎ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া, মিলিটারি সহায়তা সহ বাংলাদেশকে খোলাখুলিভাবে সহায়তা দেয়া, পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য দরকারি সব রকমের অস্ত্র সরবরাহ করা এবং সমুদ্রপথে ঐ জাহাজগুলিকে ঠেকানো। বাংলাদেশে অবশ্যই তা করতে হবে। তারা অস্ত্র কোথা থেকে পাবে? এটা সিরিয়াসলি ভাবতে হবে। এই অবস্থায় আর কিছুই করার নেই। আমাদেরও ব্যাবস্থা নিতে হবে। এবং আমাদেরও আরও একশন নিতে হবে। আমাদের হাউজে ঘোষণা দিতে হবে যে অ্যামেরিকার একশন আমাদের বিরুদ্ধে, আমাদের নিরাপত্তা, স্বাধীনতা, জনগণের বিরুদ্ধে। তাদের সবই আমাদের স্বার্থের প্রতিকূলে। আমেরিকান ব্যবসায়িক স্বার্থের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন। অ্যামেরিকার তেল সঙ্ক্রান্ত বিষয় জাতীয়করণ করুন। তাদের কিছু সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করুন। তাহলেই তারা আপনার ভাষা পড়তে পারবে। এখন সর্দার শরণ সিং যেভাবে কথা বলছেন সেভাবে নয়। আপনার রাষ্ট্রদূত জনাব এল কে ঝা কে প্রত্যাহার ……….
জনাব চেয়ারম্যান: যথেষ্ট হয়েছে।

শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: আমেরিকায় ভারতীয় দূতাবাস তার কর্তব্য পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা টাকা এই দূতাবাসের জন্য প্রচুর অর্থ খরচ করছি। কর্মকর্তাদের স্ত্রীরা সেখানে কালোবাজারির এবং এরকম আরও অনেক কিছুর সাথে যুক্ত। জনাব এল কে ঝা আমেরিকানদের জন্য তার সহানুভূতির জন্য পরিচিত। আমি অতীতের সরকারের কিছু কেবিনেট মন্ত্রীর থেকে জেনেছি তিনি কীভাবে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে বা ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংক এ কাজ করেছেন। এইরকম একজন ব্যক্তি এই কাজের জন্য মাত্রাতিরিক্তভাবে বেমানান। এসব একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের জবাব, যিনি সত্যিই জাতিয় স্বার্থ নিয়ে চিন্তিত এবং যার আলাদা ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। আমি তাই জানতে চাই সরকার কী সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। আমি মনে করি সংসদীয় কমিশনে ভালো কিছু মানুষ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ঢোকা প্রয়োজন। তিনি এখনো সেখানে আমেরিকান প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেননি। যখনি আমেরিকার প্রশ্ন আসে তারা এই ধরনের ভাষা ব্যবহার করেন। তাদের সঠিক ভাষায় কথা বলা উচিত। অতএব, আমি পরিস্থিতির বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমেরিকানদের প্রতি আমাদের নীতিতে পরিবর্তনের দাবি করছি।

সরদার শরণ সিং: স্যার, এটার উত্তর দেয়া খুব কঠিন, কারণ তেমন কোন প্রশ্ন করা হয়নি। তিনি খুব শক্তিশালী পদ্ধতিতে তার নিজস্ব অবস্থান তুলে ধরেছেন যে কীভাবে আমাদের মোকাবেলা করা উচিত এবং সম্ভবত একটি কাউন্টার-স্পিচ এই হাউজে না দেয়াই ভালো। তবে আমি তিনি যেসব পয়েন্ট তুলেছেন সেগুলোর উপর সংক্ষেপে কিছু মন্তব্য করতে চাই।

প্রথমে তিনি যে পয়েন্ট উত্থাপন করেছেন তা হল তিনি পালামে প্রেস রিপোর্টে আমার বক্তব্য তুলে এনেছেন। আগমনের সময় আমাকে ঐ রিপোর্ট দেখানো হয়েছিল যা নিউ ইয়র্ক টাইমসে ছাপিয়েছে। এবং আমি স্পষ্টভাবে বলেছি আমাকে চেক করতে হবে যে রিপোর্টটি সঠিক কিনা। তারপর আমাকে যে আশ্বস্ত করা হয়েছে তা আমি জানিয়েছি। তাই ঐ সমসয়ে আমার অবস্থান স্পষ্ট করেছি। আমি আশা করেছিলাম যে জনাব ভূপেশ গুপ্ত সেই অংশটুকু পরবেন। অন্য দ্যা স্পটে আমাকে এটা দেখানো হয়। তার অপর ভিত্তি করে আমি বলতে পারিনা যে এসব সঠিক তথ্য। তাছাড়া এটা আমাকে দেয়া আশ্বাসের পরিপন্থী। আমি এখানে আমার আচরণের কোন ভুল দেখিনা।

পরবর্তীতে তিনি উল্লেখ করেছেন পাকিস্তানে আমারিকার অস্ত্র চালানের পরিণতি কি হবে সেই ব্যাপারে। আমি তার সাথে একমত যে এতে করে পাকিস্তানের সামরিক শক্তি আরও বাড়বে – তা সে যেখান থেকেই সহায়তা শুক না কেন। এবং তা সরাসরি বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় – যার ফলেই আমাদের এত এত দেশ সফর করতে হচ্ছে………

শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: না, না, এটা একটা আন্তর্জাতিক অপরাধ।
সরদার শরণ সিং: আমি শেষ করিনি।
শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: আপনি ‘ব্যবহার’ শব্দের পরিবর্তে ‘একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ও গণহত্যার পৃষ্ঠপোষকতা’ শব্দ ব্যাবহার করুন।
জনাব চেয়ারম্যান: দয়া করে বসুন। আপনি তাকে কি ভাষা ব্যাবহার করতে হবে সেই দিক নির্দেশনা দিতে পারেন না।

সরদার শরণ সিং: সেখানে যা কইছ ঘটছে তার জন্য উপযুক্ত এক্সপ্রেশন হিসেবে আমি ‘গণহত্যা’ শব্দটি একাধিক স্থানে ব্যবহার করেছি। এবং তার চেয়েও শক্তিশালী শব্দ ব্যাবহার করেছি কখনো কখনো। কিন্তু শুধু শব্দ নয় – আমার মনে হয় এই মহুর্তে দেশের ও দেশের বাইরের সবাই জানেন বাংলাদেশের পরিস্থিতি। কীভাবে নিরীহ মানুষের উপর অবর্ণনীয় দুর্দশার সৃষ্টি করেছেন সামরিক শাসকরা। তাদের জন্য আমাদের যথেষ্ট সহানুভূতি আছে।

শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: স্যার, আপনি খেয়াল করে থাকবেন তিনি এখন পর্যন্ত ‘গণহত্যা’ শব্দটি ব্যাবহার করেননি।

সরদার শরণ সিংঃ এখন আমি আমার নিজের ভাষা পছন্দ করি। আমি জনাব ভূপেশ গুপ্ত আমাকে যা বলতে বলবেন সেটাই আবার বলার জন্য প্রস্তুত নই। আমি তা গ্রহণ করব না। আমি আমার নিজের ভাষা ব্যবহার করব। এটা ত্রুটিপূর্ণ হতে পারে, অথবা হতে পারে আপনি এটা পছন্দ করছেন না। কিন্তু আমি ভাষা ব্যবহার সম্পর্কে নির্দেশনা দেয়া পছন্দ করছিনা।
শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: আমি একটা সত্য বলার চেষ্টা করছি। আমি জানতে চাই পণী এটাকে পৃষ্ঠপোষকতা হিসাবে না কি অন্য কিছু হিসেবে বিবেচনা …. (বাধা)…. কেন না? আমেরিকান ডলার আপনার গলার মধ্যে আটকে গেছে।

সরদার শরণ সিং: একথা ঠিক যে যে কোন ধরণের সহায়তা সামরিক শাসনকে শক্তিশালী করবে এবং তাদের হিংস্রতা ও নির্মমতা আরও বাড়িয়ে দেবে। এই অভিব্যক্তিগুলো পৃষ্ঠপোষকতা শব্দের চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী। আমি জানিনা কেন তিনি আমাকে আটকে রাখতে চাইছেন …. (বাধা)…. তিনি বলতে পারেন না যে তার পছন্দের শব্দই সবচেয়ে উপযুক্ত। আমি আমার নিজের ভাষা ব্যবহার করব।
শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: আপনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
সরদার শরণ সিং: আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আমার দায়িত্ব জানি এবং, আমি নির্দেশনা দেয়া রিফিউজ করছি।
শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: ভারতের উপর প্রভাব কি?
সরদার শরণ সিং: ভারত উপর প্রভাব সম্পর্কে বলতে হয়, আমরা বাংলাদেশ পরিস্থিতির সাথে সম্পর্কিত নয় সেগুলোও পর্যবেক্ষন করছি। কিন্তু এটি একটি বাস্তব সমস্যা, একটি পৃথক বিষয়। আর আমরা কখনো সন্দেহ জিইয়ে রাখছি না যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোন কোন সরকার পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ করছে। এসব সরাসরি তাদেরকে ভারতের বিপক্ষে সাহায্য করছে। পাকিস্তান বলছে না অন্য কোন দেশের সাথে তাদের সম্পর্ক শত্রুভাবাপন্ন আছে। আমি পাকিস্তান নিজে যে শব্দ ব্যাবহার করেছে সেটাই করলাম।
তাই নিশ্চিতভাবেই এই অবস্থান অত্যান্ত স্পষ্ট যে আমরা অস্ত্র যে দেশ থেকেই আসুক তার ব্যাপারে আমরা সজাগ। এরপর তিনি তার নিজস্ব মত দিয়েছেন যে এই পরিস্থিতিতে সরকারের মনোভাব কেমন থাকা উচিত। এবং তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার সুপারিশ করেছেন। আরও বড় বিষয় আছে যা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী সম্পূর্ণরূপে এই হাউজকে অবগত রেখেছেন। এবং আমার এই হাউজকে নতুন করে দেবার মত কোন তথ্য নেই। তারপর অন্যান্য পরামর্শে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তেল স্বার্থ বা অন্যান্য স্বার্থ জাতীয়করণ সম্পর্কে বলেছেন। এসব অর্থনৈতিক বিষয়। এগুলোর নির্ভর করে আমরা জাতীয়করণ সম্পর্কে কি মনোভাব পোষণ করব তার উপর। তার উপর নির্ভর করে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নেব। কিন্তু এগুলোর সাথে বর্তমান সমস্যা গুলিয়ে ফেললে হবেনা। আমি দুঃখিত আমি খুব দৃঢ়ভাবে আমাদের রাষ্ট্রদূত ঝা সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তার বিরোধিতা করছি। আমি নিজে দুবার অ্যামেরিকা সফর করেছি যখন তিনি রাষ্ট্রদূত ছিলেন। এবং আমি দেখেছি তিনি ভালো কাজ করছেন এবং ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক ও কার্যকর পদ্ধতিতে তুলে ধরছেন। এবং আমি সম্মানিত সদস্যকে অনুরোধ করব এই ধরনের সমালোচনা না করতে এবং এতে করে যেভাবে আমাদের অবস্থান বাস্তবায়ন করছি সেই প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে। একজন রাষ্ট্রদূতকে সমালোচনা করা খুবই সোজা……………
শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: আপনি কি তার বদলি হিসাবে অন্য কাউকে খুঁজে পাচ্ছেন না?
সরদার শরণ সিং: … এবং এই বিশেষ ক্ষেত্রে, যার উপর ভিত্তি করে এসব বলা হচ্ছে তা সত্য নয়। তিনি অনেক বছর আগের কথা বলেছেন আর জনাব ঝা মাত্র এক বছর আছে সেখানে গিয়েছেন। তার আগে তিনি ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন। সেই সময়ে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক উভয় দিক থেকে তিনি ভাল কাজ করেছেন এবং আমি দৃঢ়ভাবে আমাদের বিশিষ্ট রাষ্ট্রদূতের বিরুদ্ধে দেয়া সম্পূর্ণরূপে ভিত্তিহীন মন্তব্য প্রত্যাখ্যান করছি……
শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: তিনি একজন তাবেদার, একজন কুখ্যাত সাম্রাজ্যবাদী তাবেদার।
সরদার শরণ সিং: সে যদি আমাকে ঐ ভাষা ব্যাবহার করতে বলেন তা করতে আমি দ্বিধাবোধ করব। আমি বলব যে, যদি তাঁবেদারির কথাই আসে তবে আমরা জানিনা আসলে তার শেষ কোথায়।

শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: স্যার, তাকে বলতে বলুন তাবেদার কে। তার সেটা বলার সাহস আছে কিনা। আমি বললাম। আমি বললাম জনাব এল কে ঝা ব্রিটেন ও আমেরিকার তাবেদার। এবং আপনি তাকে আমেরিকায় আমাদের রাষ্ট্রদূত করেছেন।
শ্রী পিতম্বর দাস (উত্তরপ্রদেশ): এটা সবচেয়ে নির্দয় ব্যাপার।
সরদার শরণ সিং: শেষ প্রশ্নে তিনি বলেছেন যে একটি পররাষ্ট্র বিষয়ক সংসদীয় কমিশন করা উচিত। আমার মনে হয় না সংসদীয় কমিশন প্রশাসনিক ব্যাপারে কিছু করতে পারবে কিনা। তাছাড়া এগুলো বাস্তবায়ন করবার জন্য তাদেরকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের উপর নির্ভর করতে হবে যারা জাতীয় সংসদে সেগুলো উপস্থাপন করবেন।
শ্রী লাল কে আদভানি (দিল্লি):মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার যতদূর করছে, তার সব হয়ত ব্যাখ্যার সুযোগ নেই, জনাব ভূপেশ গুপ্ত এটাকে পৃষ্ঠপোষকতা বলতে পারেন এবং ঐ শব্দটির ওপর জোর দেবার জন্য পীড়াপীড়ি করে পারেন, কিন্তু অনেক অনেক শব্দ আছে যা এখানে ব্যাবহ্রিত হতে পারে। এই সময়ে পাকিস্তানকে জাহাজভর্তি অস্ত্র দিয়ে নিক্সন সরকার ইয়াহিয়া খানের সাথে বাংলাদেশে গণহত্যার সহযোগী হিসেবে দাঁড়িয়েছেন। বিষয়টি বিশ্বের কাছে অত্যন্ত নিন্দার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি সত্যিই বিস্মিত হয়েছি ওয়াশিংটনে আমাদের নিজেদের মিশনের ব্যর্থতা সম্পর্কে জেনে। বিশেষ করে একটি জাহাজ ৮ মে বন্দর ছেড়েছে অথচ আমরা ২৩ জুন পর্যন্ত তার কিছুই জানিনা। তাও আবার নিউ ইয়র্ক টাইমস তা প্রকাশ করার জন্য আমরা জেনেছি। আমার রাষ্ট্রদূত এল কে ঝাঁ কিছুই আর বলার নেই। আমি তার সম্পর্কে জানিনা এবং মন্ত্রী তার সম্পর্কে যা বলেছেন তাও জানিনা – হতে পারে তিনি তার সামর্থ্য ও ক্ষমতা সম্পর্কে যা বলেছেন তা পুরোপুরি সঠিক। কিন্তু আমি মনে করি বিদেশে মিশনের প্রাথমিক কাজ হচ্ছে আমাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সকল তথ্য সংগ্রহ করা।
এই বিশেষ ব্যাপারটিতে তথ্যটা খুব গুরুত্তপূর্ন ছিল যা নিউ ইয়র্ক টাইমস ডক রেজিস্টার থেকে নিশ্চিত হতে পারে। ের জন্য কোনো গোয়েন্দা সূত্র লাগেনা। ডক রেজিস্টার বের করে দেখা যাবে যে ৮ মে গোলাবারুদ ও অস্ত্র ভর্তি একটি জাহাজ বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। আমরা এই সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলাম। এমনকি যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াশিংটন বা নিউ ইয়র্ক পরিদর্শন করেছেন তখনো আমরা তা জানতাম না। এটা তার জানার কথা ছিল। যদি এটা জানা থাকত তাহলে আমি নিশ্চিত সফরের সমগ্র আলোচনা এবং সংলাপ অস্ত্রের এই জাহাজ কেন্দ্রিক হত এবং সম্ভবত আমরা আমাদের অবস্থান আরও জোরালোভাবে উত্থাপন করতে পারতাম এবং সম্ভবত দ্বিতীয় জাহাজটি নিউ ইয়র্ক ছাড়ত না। এই গভীর এবং অন্ধকারময় ব্যর্থতার জন্য আমি মন্ত্রীর কাছে একটি ব্যাখ্যা চাই। আমরা কি আমাদের রাষ্ট্রদূতের কাছে এর ব্যাখ্যা চেয়েছি? এখানে আমাদের রাষ্ট্রদূতের সম্পর্কে এত সার্টিফিকেট দেবার কছু নেই। এটা একটা গুরুতর ব্যর্থতা।

আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন হল এই: সন্মানিত মন্ত্রী বলেছেন, তিনি মার্কিন কর্তৃপক্ষেকে উভয় জাহাজ থামাতে এবং ফিরিয়ে আনতে বলেছেন। আমি এখানে মনে করিয়ে দিতে চাই যে ১৯৬৫ সালে ৬ টা জাহাজ আসার পথে থামিয়ে দেয়া হয়েছিল। সেগুলো আসলে ভারতে আসছিল। কিন্তু সেগুলোকে আমাদের তীর থেকে মাত্র ১৫ মাইল দুরে থামিয়ে দেয়া হয়। আমার কাছে হিন্দুস্তান টাইমসের ক্লিপিং আছে যেখানে উদ্ধৃতিতে আছে শ্রী এল এন মিশ্র এই তথ্য দিয়েছিলেন। আমি সনাম্নিত মন্ত্রীর কাছে জানতে চাই এই তথ্য সঠিক কিনা যে ছয়টি অস্ত্রবাহী জাহাজ যেগুলো ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ভারতে আসছিল সেগুলো মার্কিন কর্তৃপক্ষ দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল। সে সময়ে মার্কিন সরকার বলেছিল যে তারা উপমহাদেশের টেনশন বাড়াতে চান না – তাই তারা ভারত ও পাকিস্তান উভয়কে সহায়তার বন্ধ করে দিয়েছেন। এই অজুহাতে তারা যে অস্ত্রভর্তি ছয়টি জাহাজ ভারত আসার জন্য আমাদের তীর থেকে মাত্র ১৫ মাইল দুরে অবস্থান করছিল সেগুলোকে ফেরত নিয়ে যায়। আমি জানতে চাই এই ঘটনাটি মার্কিন কর্তৃপক্ষকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে কিনা।

সর্বশেষে, সমগ্র হাউজ আবদার করেছে যে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই দুটি জাহাজকে আটকানো উচিত। যখন শ্রী মোহতা এই সাজেশন দিয়েছেন তখন সন্মানিত মন্ত্রী বলেছেন যে এই সিদ্ধান্ত সরাসরি নেয়া যাবে না এবং তারা এটা বিবেচনা করবেন। আমার মনে হয় যেদিন থেকে বাংলাদেশে এই গণহত্যা শুরু হয়েছে তখন থেকেই ‘আমরা বিবেচনা করব’ টাইপের উত্তর বেশী শোনা যাচ্ছে। আমি একমত যে যব সিদ্ধান্তের কিছু ধারাবাহিকতা আছে। যখন আমরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে, আমরা জানি তার কিছু ধারাবাহিকতা আছে। কিন্তু আমরা মনে করি যে, এই সরকার ‘বিবেচনা’র অজুহাতে শুধুমাত্র আলস্য প্রকাশ করছেন এবং কিছুই করছেন না। এই নির্দিষ্ট বিষয়ে সরকারের অবস্থান কী? আমরা কি অস্ত্রের এই চালানের ব্যাপারে কিছুই করতে যাচ্ছি না? যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার সেগুলো ফিরিয়ে নেয় তবে তো খুব ভালো। অন্যথায়, আমরা কি অসহায়? আমরা কি কিছুই করতে পারি না? আমরা কি শুধু শান্ত থাকব এবং বসে থাকব? এটাই কি সরকারের অবস্থান?

সরদার শরণ সিং: প্রথম প্রশ্ন ছিল আমাদের অক্ষমতা নিয়ে যে শুরুতে যে জাহাজ লোড করা হচ্ছিল পাকিস্তান পাঠানোর জন্য সেটা কেন আমরা আগে জানলাম না। এটা আমি আগেই বলেছি এবং নতুন করে কিছু বলার নেই। ………

শ্রী লাল কে আদভানি: আপনি বলেন নাই …….
(বাধা)
সরদার শরণ সিং: আমি ইতিমধ্যে উত্তর দিয়েছি। আপনি জানেন আমি কি জবাব দিয়েছি ………
(বাধা)
শ্রী লাল কে আদভানিঃ এটি কোন উত্তর না।
সরদার শরণ সিং: আমি যা বলেছি তার বাইরে আমার কিছু যোগ করার নেই। আপনি অন্যরা যা বলছে তাই পুনরাবৃত্তি করছেন…………
(বাধা)
শ্রী লাল কে আদভানি: আমি বলেছি বিদেশে আমাদের মিশনসমূহের প্রাথমিক ফাংশন এটাই।
সরদার শরণ সিং: আমি জানি না। প্রাথমিক ফাংশন, সেকেন্ডারি ফাংশন এবং আরো গুরুত্বপূর্ণ ফাংশন সম্পর্কে আমরা একটি পৃথক আলোচনা করতে পারি।
শ্রী লাল কে আদভানি: আমার পয়েন্ট হল ….

সরদার শরণ সিং: আপনি যদি রাষ্ট্রদূতগণ এবং মিশনের দায়িত্বরতদের সম্পর্কে খুব স্পষ্ট বিবৃতি চান, তবে আমি বলব আন্তর্জাতিক কনভেনশন দ্বারা যাকে গুপ্তচরবৃত্তি বলা হয় তা তাদের কাজ নয়…….
(বাধা)
শ্রী লাল কে আদভানিঃ এটি গুপ্তচরবৃত্তি না।
ডঃ. ভাই মহাবীর (দিল্লি): প্রধানমন্ত্রী আবার বিবৃতি রিসিপ্টিং করছেন। (বাধা) ….. তিনি এমন একটি বিবৃতি দিচ্ছেন যা আমাদের রাষ্ট্রদূতদের আরও ব্যর্থতায় পর্যবসিত করবে।
(বাধা)
সরদার শরণ সিং: সতর্কতা এবং বুদ্ধিমত্তা ভিন্ন জিনিস। সতর্কতা ও বুদ্ধিমত্তার প্রক্রিয়া প্রশ্নে কখনো আলোচনা করা হয় নাই। আমি জানি না কেন আপনারা এটা পুনরাবৃত্তি করছেন, কেন এটার উপর বারবার চাপ দিচ্ছেন।

শ্রী লাল কে আদভানি: স্যার, এটা একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন।
ডঃ. ভাই মহাবীর: স্যার, এটা একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন ……. (বিঘ্ন) ……. এ কি ব্যাপার স্যার, তার উত্তর দেওয়া বাঞ্ছনীয়।
সরদার শরণ সিংঃ দ্বিতীয় প্রশ্ন সম্পর্কে, স্যার, সন্মানিত সদস্য বলেছেন, এর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার পাকিস্তানে সরঞ্জাম বিতরণ বন্ধ করেছে।
(বাধা)
শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: না, না, এটা হল ভারত।
জনাব চেয়ারম্যান: একেবারে ঠিক। এটি শুধুমাত্র একটি জাহাজ।
সর্দার শরণ সিং: এটি থামানো হয় যখন তা দূরসমুদ্রে ছিল। অতএব, এমনকি যদি তারা এখন সিদ্ধান্ত নেন, তারা তা বন্ধ করতে পারেন এবং এতে কোন সন্দেহ নেই যেএর জন্য কোনো আগের নজির উদ্ধৃত করতে হবে। এটা সরকারের সচেতনতার একটি প্রশ্ন। যদি তারা তাদের সিদ্ধান্ত নেন যার জন্য আমরা তাদের চাপ দিচ্ছি ….. (বাধা) এটা একটা সারগর্ভ জিনিস এবং এর জন্য আগের কোন সরবরাহ করা বা সরবরাহ বন্ধ করার সম্পর্ক নাই। আমাদের তাদের প্রিসিডেন্ট না করে স্বাভাবিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে।

শ্রী লাল কে আদ্ভানিঃ আমি প্রশ্ন করেছিলাম, তাদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়ে থাকলে তার রেফারেন্স (উদাহরণ) দেয়া হয়েছে কিনা। হতে পারে তিনি তা দেননি। তাহলে বলে দিন আমরা দেইনি, পরে দিয়ে দেব।
জনাব চেয়ারম্যান: হ্যাঁ, যদি কিছু উত্তর দেয়া বাকি থাকে আমি দেখব।
সরদার শরণ সিং: স্যার, তিনি আবার জাহাজ আটকানোর ব্যাপারে বলছেন। আমি বলতে চাই যে এটি কোন সাধারণ ব্যাপার নয় যেভাবে আমরা সরকারকে চাপ দিয়ে করিয়ে ফেলব। আমরা চাপ দিয়ে কাজ করানোর কৌশলে যাচ্ছিনা। এই সিদ্ধান্তগুলি আমরা যা কিছু করি যেভাবে করি সেগুলো সব বিবেচনায় নিয়ে করতে হবে। আরেকটি প্রশ্ন করেছেন কেন সরকার আপনাদের সাজেশন গ্রহণ করছেনা – এই প্রসঙ্গে বলব আমাদের সব দিক বিবেচনায় নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে – আমরা এভাবেই সব কিছু করতে চাই – কারণ সব দায় দায়িত্ব আমাদের উপর – আশা করি আপনারা এটাকে ভালোভাবে দেখবেন।

শ্রী পিতম্বর দাশঃ স্যার ………
জনাব চেয়ারম্যান: হ্যাঁ আপনি কি চান? …….
শ্রী পিতম্বর দাসঃ স্যার, প্রশ্ন সাম্যতা নিয়ে ছিলোনা – প্রশ্ন ছিল জাহাজ থামানো নিয়ে। এর কারণই একে সাম্যতা দেয় যে কখন এটা থামানো হবে। এতে করে টেনশন বাড়বে এই অজুহাতে আগের বারে থামানো হয়েছিল। একই কারণ দেখিয়ে আপনি জাহাজ থামাতে বলতে পারেন। আমরা শুধু সাম্যতা দেখানোর জন্য থামাতে চাচ্ছিনা – আমাদের থামাতে বলার কারণ আছে।
জনাব চেয়ারম্যান: পিতম্বর দাস, বেশ স্পষ্ট বলেছেন।
সরদার শরণ সিং: আমি বলেছি, স্যার, স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছি যে এর ফলে নিরপরাধ মানুষের বিরুদ্ধে সামরিক শাসনের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি পাবে এবং নৃশংসতার চালিয়ে যেতে সামরিক শাসকরা সক্ষম হবেন এবং এছাড়াও আমাদের দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়বে এবং ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তান শক্তিশালী হবে।
জনাব চেয়ারম্যানঃ হ্যা, জনাব রাজনারায়ণ।

শ্রী রাজ নারায়নঃ মহোদয়, আমি আপনার কাছে প্রথমেই অনুরোধ জানাচ্ছি মন্ত্রী মহাশয়কে এ কথা বলে দিতে তিনি যেন না বলেন যে আমি জবাব দিয়েছি।

সভাপতিঃ আপনি প্রাসঙ্গিক কথা বলুন এবং অল্প বলুন।
শ্রী রাজনারায়ণ জাহাজ ভরে যে সামরিক সরঞ্জাম আসছে সে ব্যাপারে সরকার কি অ্যামেরিকার সরকারকে বলেছে তোমরা এটি থামিয়ে দাও, কখনোই পাঠাবে না। আরও স্পষ্টভাবে সরকার এ কথা বলেছেন কিনা যে এই সরঞ্জাম পাঠানো হলে বাংলাদেশে ব্যাবহ্রিত হবে এজন্য সমর সরঞ্জাম পাঠাবে না, থামিয়ে দাও। প্রথম প্রশ্ন।
শ্রী মহাবীর ত্যাগী (উত্তর প্রদেশ)ঃ পাকিস্তান নারাজ হয়ে যাবে ভাই।
শ্রী রাজনারায়ণঃ দ্বিতীয় কথা। মন্ত্রী মহোদয় যখন বিদেশে ভ্রমণে গিয়েছিলেন তখন তিনি কি ‘সিভিল এগ্রেসন’ শব্দটি ব্যাবহার করেছিলেন? মাননীয় মন্ত্রী কি ‘সিভিল এগ্রেসন’ শব্দ ব্যাবহার করেছিলেন আর যেহেতু এটা মিলিটারি এগ্রেসন নয়, সিভিল এগ্রেশন, তাই অ্যামেরিকা সরকারের কৌতূহল হল যে, যখন মিলিটারি এগ্রেশন এটি নয় এবং সিভিল এগ্রেশন তখন আমরা কিছু সামরিক সরঞ্জাম পাঠিয়ে দেই। এত বিতর্কের পরও কি মন্ত্রী মহোদয় একথা বিশ্বাস করবেন যে আমাদের বিদেশী দূতাবাসের কর্তব্য হচ্ছে স্বদেশের স্বার্থ রক্ষা করা এবং দেশের কল্যানার্থে দেশের স্বার্থে আঘাত আসে এমন ঘটনাবলি সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রদান করা। মাননীয় মন্ত্রী বলেছেন, সাধারণ অর্থে যা বুঝায় তা আমরা করি না। এ কথা কে বলে যে তারা স্পাই এর কাজ করবে এটা কেউ বলেনি স্পাই এর কাজ করা আর সঠিক তথ্য ও তদন্ত করে সরকারকে অবহিত করা এ দুইয়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য।

সরদার শরণ সিং: স্যার, এই প্রশ্নের উত্তর হল ‘হ্যাঁ’।
দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর হল – আমি বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে ‘বেসামরিক আগ্রাসন’ শব্দ ব্যবহার করিনি। তবে আমি কিছু অভিব্যক্তি দিয়েছি যে ভারতীয় টেরিটরির মধ্যে উদ্বাস্তুদের বৃহৎ অন্তঃপ্রবাহ আমাদের বিরুদ্ধে আগ্রাসন। কারণ এই বৃহৎ সংখ্যার প্রবেশের ফলে আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ঝুঁকির সম্মুখীন। কিছু অভিব্যক্তি আমি ব্যবহার করেছি। আমি সন্মানিত সদস্যকে বলতে চাই যে পাকিস্তানে অ্যামেরিকার অস্ত্র পাঠানোর ব্যাপারে কিছু ছিল না।

প্রথম জাহাজটা আমি সেখানে যাবার অনেক আগেই ছেড়েছে। এব্যাপারে কারো মনে কোন দ্বিধা থাকার কথা না। এবং আমি মনে করি মাননীয় মন্ত্রী কথাকে টেনে লম্বা করছেন এবং সেটাকে এখানে লাগানোর চেষ্টা করছেন। একটি বিষয় আমি মানি যে আমাদের দূতাবাসকে আমাদের নিরাপত্তা ও স্বার্থ রক্ষার জন্য সব উপায়ে কাজ করতে হবে এবং তারা তা করে যাচ্ছে। আমাদের সব সময় বেনারস এর মত বিষয়গুলো নিয়ে ভাবলে চল্বেনা। আমাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানকে ছোট করায় কোন ক্রেডিট নাই।

শ্রী রাজনারায়নঃ মহোদয়, আমার প্রশ্নের জবাব পাইনি। আমি বলেছিলাম, মে মাসের যেসব অস্ত্র সেখান থেকে এসেছিল সে সম্পর্কে ভারত সরকার তাদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন কিনা যে এসব অস্ত্র কি জন্য পাঠানো হল? মে মাসে অস্ত্র পাঠানো, এখন জুন মাস চলছে, আমি মন্ত্রী মহাশয়ের নিকট হতে একটা সুস্পষ্ট উত্তর চাই যে মে মাসে অস্ত্র পাঠানো হয়েছিল কিনা।
সভাপতিঃ এখন আপনি বসুন।
সর্দার সরণ সিংঃ আমি বলেছি যে আমরা এটা জানতে পেরেছি নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার রিপোর্ট থেকে। আমি বলেছি আমরা এটাকে গুরুতরভাবে দেখছি।
শ্রী রাজনারায়নঃ মহোদয়, আমার প্রশ্নের উত্তর এখনো আসেনি।
সভাপতিঃ তার মনে ছিলোনা।
শ্রী রাজনারায়নঃ মে মাসে অস্ত্র এলো এটাও জানা ছিলোনা। এখন আপনারা উপলব্ধি করুন এই সরকার কীভাবে আমাদের দেশ রক্ষা করতে সক্ষম হবে। …
শ্রী গোদে মুরাহারি(উত্তর প্রদেশ)ঃ এখানে কিছু সন্দেহ আছে। জনাব রাজনারায়ণ মে মাসের শিপমেন্টের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছেন – এটা মন্ত্রী নিউ ইয়র্ক যাবার অনেক আগের ঘটনা।
রাজ নারায়নঃ মহোদয়, আমি আরও জানতে চাই, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে কেন বিলম্ব করা হচ্ছে? এই সরকার এযাবৎ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেননি। মে মাসে যেখান থেকে অস্ত্র এলো, তার পর থেকে জনতার দাবী, সরকার বাংলাদেশকে সত্বর স্বীকৃতি প্রদান করুক। এই সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে ফেললে অ্যামেরিকা, ব্রিটেন ও রাশিয়া পাকিস্তানকে অস্ত্র দিতে সাহসী হত না।
সভাপতিঃ এখন আপনার মত জানা হয়ে গেছে। এর জবাব তিনি প্রথমেই দিয়ে দিয়েছেন।
শ্রী রাজনারায়নঃ স্বীকৃতির প্রশ্নে।
সভাপতিঃ মন্ত্রী বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে বলেছেন আমার আর বলার কিছুই নাই। সরকারের … সকলের জানা।
শ্রী রাজনারায়নঃ প্রধানমন্ত্রী তো পাঁচদিন পূর্বে বলেছিলেন।

শ্রী নিরেন ঘোষ: স্যার, আমি জানতে চাই ঠিক কি ধরণের আশ্বাস জনাব শরণ সিং কে U.S.A সরকার দিয়েছে? কারণ তাকে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে U.S.A থেকে পাকিস্তানে কোন অস্ত্র চালান পাঠানো হবেনা। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বলছেন, পাকিস্তানে মার্কিন সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির ওপর কোন নিষেধাজ্ঞা স্থাপন হয়েছে অথবা লাইসেন্স দেয়া বন্ধ আছে এমন কথা তারা কাউকে বলেননি। তাহলে সঠিক অবস্থান আসলে কি? আমি জানতে চাই।

এল কে ঝা কি তাকে অবহিত করেননি যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সাথে কিন্তু পেন্ডিং লাইসেন্স প্রক্রিয়াধীন ছিল – যার ফলে স্বাভাবিক শিপমেন্ট চলবে – যতক্ষণ পর্যন্ত না অস্ত্র চালানের উপর কোন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। তাই আমি জানতে চাই সঠিক অবস্থান কি? যদি এল কে ঝা মন্ত্রীকে এটা জানাতে দরকারি মনে না করেন তাহলে আমি মনে করি তার কাছে ভারতের নিরাপত্তা সুরক্ষিত নয়। তাই তার উচিৎ এই পয়েন্টটি পরিষ্কার করা।

আরেকটি জিনিস হল ভারত সরকারের মতে, পাকিস্তানে এই অস্ত্র চালানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে? এটি কি এমন যে ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তানকে এমন অবস্থায় রাখা যাতে করে উভয়ে বাংলাদেশ ইস্যু দির্ঘায়িত হয়? এতে করে উভয় দেশ নষ্ট হবে এবং তারা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে এই উভয় দেশের উপর তাদের ক্ষমতা স্থাপন করতে পারবে? ঠিক উদ্দেশ্য কী? এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে এতে বাংলাদেশ পরিস্থিতি আরও ঘনীভূত হবে। কিন্তু তার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কী? এই ব্যাপারে সরকারের মূল্যায়ন কী? এটাই আমি জানতে চাই।

তৃতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে, ভারত বাংলাদেশের উপর কোনো কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করবে না যতক্ষণ সেখানে নৃশংসতার বন্ধ করা হয়। আমি এটা জানতে চাই অ্যামেরিকা সফরকালে মার্কিন সরকার তাকে কোন আশ্বাস দেন বা না দেন, তারা কি অন্যান্য ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশ ইস্যুতে কোন কনফারেন্সের প্রস্তাব দিয়েছেন? এবং এর পর তিনি খুব খুশী মনে ফিরে আসেন এবং তাকে মিথ্যা আশ্বস্তি দেয়া হয় যে পাকিস্তানে কোন অস্ত্র চালান যাবেনা – যদিও কোন নিষেধাজ্ঞা নেই – এসবই কি চলছে? এবং প্রধানমন্ত্রী ভেবেছিলেন যে কার্ড এখন তার টেবিলে যখন তিনি বললেন যে তিনি কোন কনফারেন্সে যাবেন না যদিনা গণহত্যা বন্ধ হয় – হয়ত ভারত অ্যামেরিকার খেলার ছকে পড়ে গেছে। আমাদের এই অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছে – আমাদের এবং পশ্চিম পাকিস্তানের। আমি বলব পশ্চিম পাকিস্তান – কারণ আমি বাংলাদেশকে স্বীকার করি- সরকার করুক বা না করুক। আমি বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকার করি যা আওয়ামীলীগ নেতা তাজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে। সরকার স্বীকার করুন বা না করুন সেটা ভিন্ন বিষয়। এই অবস্থায় আমি জানতে চাই তিনি তার অবস্থান স্পষ্ট করবেন কিনা যে এই সম্মেলনে কি যায় আসে আর তাকে কি বলে আশ্বস্ত করা হয়েছে বা তারা ঠিক কি বলেছে।

জনাব চেয়ারম্যান: জনাব ঘোষ, এটা বেশ স্পষ্ট ……. (বাধা)….. আপনার প্রশ্নটি খুবই স্পষ্ট।
শ্রী নিরেন ঘোষ: এবং সর্বশেষে আমি জানতে চাই অ্যামেরিকার এই অবন্ধুসুলভ এবং প্রতিকূল আচরণে হতাশা প্রকাশের বাইরে তিনি আর কোন পদক্ষেপ নেবেন কিনা। সরকার কোন শক্তিশালী ব্যাবস্থা নেবেন কিনা যাতে করে অ্যামেরিকা এই আচরণের জবাব পায়। যদি এটাকে আপনি অনাত্মীয়সুলভ আচরণ বলে থাকেন তাহলে পররাষ্ট্র নীতিতে কাজ করতে হবে। তাই আমি জানতে চাই এই সকল বিষয় পর্যালোচনা করে সরকার তার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবেন কিনা …

জনাব চেয়ারম্যান: ঠিক আছে, জনাব ঘোষ. এখন আপনি পুনরাবৃত্তি করছেন। দিয়া করে বসুন।

সরদার শরণ সিং: মার্কিন মুখপাত্র বিবৃতি দেবার আগে দেখাবার চেষ্টা করছেন যে এই শিপমেন্ট আগে থেকেই অনুমোদিত ছিল যার জন্য অনুমোদিত লাইসেন্স আছে। কিন্তু আমাদেরকে সব সময় আশ্বস্ত করা হয়েছে যে এরকম আর কোন সাপ্লাই দেয়া হবেনা। একারণেই আমরা আমাদের যে আশ্বাস দেয়া হয়েছে তা বাস্তবায়নের উপর জোর দিচ্ছি – তাই আমরা লাইসেন্স ইস্যু এর উপর জোর দিচ্ছিনা – কারণ আমাদের মূল লক্ষ্য শিপমেন্ট থামানো। আমি মনে করি এ পর্যন্ত আমাদের এম্বাসেডরের কোন ভুল হয়নি। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দেয়া আমার জন্য সহজ নয়। কারণ তিনি জিজ্ঞেস করেছেন পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহে অ্যামেরিকার উদ্যেশ্য কি? তাদের রাজনৈতিক উদ্যেশ্য যাই হোক না কেন আমরা বরাবরই বলে এসেছি অ্যামেরিকা বা চিন থেকে পাকিস্তানকে শক্তিশালী করার জন্য যা কিছু পাঠানো হোক না কেন আমরা তার বিরুদ্ধে। আমরা এইসকল সরকারকে এগুলো বন্ধ করতে বলেছি। ইনফ্যাক্ট এই বিশেষ ক্ষেত্রে অ্যামেরিকা নিজেই বলেছিল যে তারা পাকিস্তানে অস্ত্র চালান বন্ধের প্রস্তাব দিতে যাচ্ছেন। এবং আমি বলতে পারছিনা এর রাজনৈতিক উদ্যেশ্য কি। সম্ভবত আরও কিছু দেশ সম্পর্কে এটা ভাবতে পারি। তৃতীয়ত তিনি জানতে চেয়েছেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অ আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সাথে কোন কনফারেন্সের প্রস্তাব তারা দিয়েছে কিনা। না এরকম কোন আলোচনা উঠেনি।

শ্রী নিরেন ঘোষ: প্রধানমন্ত্রী কিছু সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন যে ভারত বাংলাদেশের ওপর কোনো কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করবে না। এই অংশগ্রহণকারী কারা তিনি তা বলেননি। এজন্যই আমি জিজ্ঞাসা করলাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার কোন আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিল কিনা। হোক তা আপনার দিক থেকে বা তাদের।

সরদার শরণ সিং: জবাব নেতিবাচক। চতুর্থ প্রশ্ন সম্পর্কে বলতে চাই, আমাদের বর্তমান মনোভাব হচ্ছে এই সরবরাহ বন্ধ করতে হবে। এবং কোন আর কোন সরবরাহ যাতে না হয় তাও নিশ্চিত করতে হবে। এবং আমাদের এটা দীর্ঘায়ীত করা যাবেনা। এবং পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়গুলো একসাথে দেখতে হবে কারণ এগুলোর কিছু লক্ষ্য আছে এবং আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে অস্ত্রের চালান বন্ধ করার জন্য সব রকমের পদক্ষেপ নেয়া। সন্মানিত সদস্যের যদি চিনে কোন প্রভাব থাকে আমি তাকে অনুরোধ করব তিনি যেন চীনা সরকারকে সরবরাহ বন্ধ করতে বলেন।

শ্রী নিরেন ঘোষ: সেখানে আপনার লোক আছে আর এখানেও তাদের লোক আছে। আমাদের সাথে চিনের কোন যোগাযোগ নাই। এখন মন্ত্রীর মার্কিন সরকারের প্রতি অধস্তন মনোভাবের কারণে তা বাংলাদেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার শামিল হল …….
জনাব চেয়ারম্যান: আমি আর কোন প্রশ্নের অনুমতি দিচ্ছি না।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২০০। মস্কো, বন, প্যারিস, অটোয়া, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন এবং লন্ডন সফর শেষে প্রত্যাগত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২৫শে জুন, ১৯৭১

নীতেশ বড়ুয়া
<১২, ২০০, ৫৯১-৫৯২>
অনুবাদ

১৯৭১ সালের ২৫শে জুন লোকরাজ্য সভায় ৬ই জুন হতে ২২শে জুন পর্যন্ত মস্কো, বন, প্যারিস, অটোয়া, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন ডি. সি. এবং লন্ডন সফর শেষে প্রত্যাগত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি

১৯৭১ সালের ৬ই জুন হতে ২২শে জুনের মধ্যে আমি মস্কো, বন, প্যারিস, অটোয়া, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন এবং লন্ডন ভ্রমণ করেছে, এই সময়ে এই প্রত্যেকটি রাজধানীতে সরকার ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে আমার বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। জাতিসংঘ সদর দফতরে জাতিসংঘ মহাসচিব উ- থান্ট এবং তার সহকর্মীদের সাথে আমার আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়াও প্রতিটি রাজধানীতেই অনেক সরকারী নেতা, আইনজীবি, সম্পাদক, সমাজকর্মী এবং নেতৃস্থানীয় মতবাদীদের সাথে আমার দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে।

এইসব আলোচনার মূল মনোযোগ ছিল এবং যাতে জোর আলোচনা হয়েছে তার পুরোটাই হচ্ছে পূর্বববঙ্গ হতে ৬০ লক্ষাধিক উদ্বাস্তুর অনুপ্রবেশের ফলে ভারতের জন্য দায়জনক গুরুতর পরিস্থতির সৃষ্টি এবং আমাদের অঞ্চলে এই সঙ্কট অব্যাহত থাকার কারণ হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক যন্ত্র দ্বারা পূর্ববঙ্গে ব্যাপক হত্যাকান্ড চালানো।

আমার ভ্রমণ শেষেই আমাদের সাথে আশ্বাস স্বরূপ মস্কো, বন, প্যারিস, ওয়াশিংটন এবং লন্ডন তাদের নিজ দেশের সরকারের পক্ষে বিবৃতি দেয় এবং এতে এটাই আয়োজক দেশের সাধারণত যে প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত তাই প্রকাশ করে। অটোয়াতে পররাষ্ট্র মন্ত্রী মিচেল শার্প কানাডিয়ান হাউজ অব কমন্সে যে বিবৃতি দেন তা তাদের অবস্থানকে ইঙ্গিত করে।

এইসব বিবৃতির অনুলিপিগুলো মন্ত্রণালয়ের জন্য সংগ্রহ করা হয়েছে।

আমার দ্বারা পরিদর্শিত দেশের সরকারের সংগে আমার আলোচনার ফগলস্বরূপ চুক্তির নিম্নলিখিত বিষয়সমূহের উপর আলোকপাত করা হয়ঃ

(১) এটাই যে, এতে কোন প্রকার সামরিক সমাধান হতে পারে না এবং অবিলম্বে পূর্ববঙ্গে সমস্ত সামরিক কার্যকলাপ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।

(২) এটাই যে, অবিলম্বেই পূর্ববঙ্গ হতে উদ্বাস্তুদের ভারতে আগমণ বন্ধ করতে হবে।

(৩) এটাই যে, উদ্বাস্তুরা তাদের ঘরে শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ অবশ্যই তৈরী করতে হবে এবং এটা তখনই সম্ভব হবে যখন উদ্বাস্তুদের পূর্ববঙ্গে তাদের নিজেদের ঘরে নিরাপদ ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা দেওয়া হবে।

(৪) এটাই যে, রাজনৈতিক সমাধান পূর্ববঙ্গের লোকদের কাছে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়ার একমাত্র পথ হিসেবে গ্রহণযোগ্য।

(৫) বর্তমান পরিস্থিতি এ অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য ভয়াবহ এবং বিপদে পরিপূর্ণ।

পূর্ববঙ্গ হতে ৬০ লক্ষাধিক ব্যাপক উদ্বাস্তুর ভারতে অনুপ্রবেশ যা কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ঘটে যায় তা অসহনীয় এবং এটা যে ভারত সরকারের কাছে সম্পদের উপর বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই আর্থিক এবং সহানুভূতি উভয় প্রকারের সহযোগীতা করা জন্য সর্বসম্মতভাবেই সম্মত হয়।

প্রতিতি রাজধানীতেই আমি এটা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি যে, পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের জন্য যে কোন রকমের সহযোগীতা মূলত পাকিস্তানের প্রতি সহযোগীতা, যারা সেই দেশের জাতীয়তার জন্য তাদের দেশেরই সরকারের একটি অংশের ইচ্ছাকৃত এবং উচ্ছৃঙ্খল কর্মকান্ডের জন্য উচ্ছেদ হয়েছিল। আমি পরিষ্কার করে আরো জানিয়েছি যে যা সর্বসম্মতভাবেই গৃহীত হয় তা হচ্ছে, এই ক্রান্তিলগ্নে পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের প্রতি কোন প্রকারের সামরিক সহায়তা তাদের গণবিরোধী কার্যকলাপকে টিকিয়ে রাখতে এবং উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে এবং তাদের প্রতি কোন প্রকারের আর্থিক সহায়তা করার মানেই হচ্ছে পূর্ব বঙ্গে তাদের করা গুরুতর অন্যায় কাজগুলো না দেখার ভান করা যা এতোটাই স্পষ্ট এবং এতোটাই অখন্ডনীয় যে এই কয়েক সপ্তাহ ধরেই বিশ্বের সংবাদ মাধ্যম তা প্রকাশ করে আসছে। এছাড়াও আমি আরো বলেছি যে, আসলে কোন আর্থিক সাহায্য ব্যতীত আন্তর্জাতিক নজরদারিতে মানবিকতার বিচারে সামরিক যন্ত্র দ্বারা পূর্ব বঙ্গে নিপীড়নের শিকার সংখ্যালঘু জনতা যা বর্তমানে সেই দেশেরই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার উপর নিপীড়নে চালিয়ে যাওয়ার উপর প্রভাব ফেলবে এবং এইভাবে তা তাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার মতো অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি তৈরী করবে।

এই সমস্ত রাজধানীতে আমি ভারত সরকার এবং জনগণ কর্তৃক এই ব্যাপক উদ্বাস্তু অনুপ্রবেশের ঘটনায় প্রদর্শিত উদারতার দারুণ সমাদর দেখতে পাই, পূর্ব বঙ্গের জনগণ এবং সেই সাথে সেই দেশের জন্যেও মনুষ্য সৃষ্ট এই দুঃখজনক পরিস্থিতি যা মানব ইতিহাসে নজিরবিহীন হিসেব স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এই পরিস্থিতির গুরুত্ব এবং আমাদের কোন অপরাধ করা ছাড়াই আমাদের উপর যে বিশাল বোঝা চেপে বসেছে এবং যদি বর্তমান পরিস্থিতি দ্রুততার সাথে নিয়ন্ত্রণে আনা না হতো তবে তা এই সমগ্র অঞ্চলের মানুষ ও নিরাপত্তার জন্য যে মারাত্মক চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হতো তা সবর্ত্রই স্বীকৃত হয়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২০১। সাম্প্রতিক পরিস্থিতির উপর প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর বিবৃতি ভারতস রকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১২জুলাই, ১৯৭১

Nishat Oni
<১২, ২০১, ৫৯৩-৫৯৬>

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শ্রী জাগজীভান রামের বিবৃতি, জুলাই ১২, ১৯৭১

জুলাই ১২, ১৯৭১ এ প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের বাজেট আলোচনায় প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রী জাগজীভান রামের প্রত্যুত্তর নিন্মে বর্ণিত করা হল।

আমি বাংলাদেশের দুর্দশাময় অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করছিলাম। পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পাশবিক নির্যাতনের কারণে বাংলাদেশে যে পুনরুত্থান হয়েছে তা বর্তমানে পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক নগ্নশাসন তুলে ধরেছে। এটা আবারো প্রমান করে গণতন্ত্রের ভীত এতো গভীর আর শক্ত যে তা গত এক শতকের চতুর্থাংশ ধরে চলমান কোন সামরিক শাসক দখল করতে পারেনি। বাংলাদেশের জনতা সাহসিকতার সাথে তাদের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষার্থে পাকিস্তান সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করে আসছে। বাংলাদেশে ব্যাপক ভাবে চলা সন্ত্রাসবাদ বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছে। এই সংগ্রামে সাহসিকতা ও বিরত্বের সাথে জড়িতরা ব্যাপকভাবে প্রশংসিত ও সমাদৃত হয়েছে। দুঃসময়ে হাউস আমাদের বন্ধুদের সমর্থন ও সমবেদনা জানিয়েছে।
বাংলাদেশি জনসংখ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। এতে পরিষ্কার হয় যে পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশের জনগনের উপর নিষ্ঠুর গনহত্যা চালিয়েছে যা আমাদের অর্থনীতি, সামাজিক ও সাংবিধানিক মৌলিক কাঠামোর প্রতি হুমকি স্বরূপ। আমরা যে মূল্যবোধ লালন করি এবং আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য যে অঙ্গীকার করেছি তা বিপদের মুখোমুখি। তবু সরকার হুমকির সম্মুখীন হয়েও বেঁচে আছে শুধু তার দায়িত্বের জন্য।

পূর্ব সীমান্ত দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের অনুপ্রবেশের চেষ্টা সম্পর্কে হাউস অবগত। পশ্চিমা সীমান্ত দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের প্রস্তুতি নিয়ে সংবাদ, আরো সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে তাদের যুদ্ধ বিরতি সম্পর্কে ও হাউস অবগত আছে।

পাকিস্তানি সামরিক জান্তাদের রেজিমেন্ট গঠনের ক্ষুদ্র প্রয়াস, যুবকদের বাধ্যতামুলক ভাবে সৈন্য দলে নিযুক্ত করা, এবং তাদের পাকিস্তানি সেনাদের জন্য অন্যান্য বন্ধু দেশ থেকে বা এজেন্সির মাধ্যমে হাতিয়ার ও গোলা বারুদ আনানো সম্পর্কে হাউস অবগত। এই উপমহাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের শিখা নিভানোর জন্যেই এসব প্রস্তুতি নেয়া হয়ে ছিল। আমরা আশা রাখি, যারা এসব ব্যাপারে তাদের সাহায্য করেছিল তারা তাদের দায়ভার সম্পর্কে সচেতন, এবং এসব মরনাস্ত্র আনার উদ্দেশ্যের ব্যাপারে অবগত।

এইসব হুমকি নিয়ে হাউসে আমরা আলোচনা করেছি। শুধু বলতে পারি আমরা দিনের পরদিন এইসব ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করছি এবং আশ্বস্ত করবো পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্ত সতর্ক পাহারায় আছে এবং সবধরনের হামলা মোকাবেলার জন্য আমাদের পক্ষ থেকে সব প্রস্তুতি নেয়া আছে। আমাদের দেশে অনুপ্রবেশকারী ও অন্যান্য প্রতিকুল অবস্থা দৃঢ়ভাবে মোকাবেলার জন্য আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।

সীমান্তে অবস্থানকারী আমাদের লোকেরা, হোক তা কাশ্মীর, জুম্মু, নাগাল্যান্ড, মেঘালয় বা অন্য কোথাও, সবাই খুঁটিনাটি সম্পর্কে সচেতন। বাংলাদেশীদের উপর পাকিস্তানি সেনাদের পাশবিক নির্যাতন পদ্ধতি তাদের পাকিস্তান পরাস্ত্র করার সংকল্পকে আরো শক্তিশালী করেছে।

মুক্তি বাহিনী

সরকার কর্তৃক বাংলাদেশের প্রথম স্বীকৃতির দাবী হাউসে বিভিন্ন দিক থেকে ব্যাক্ত করা হচ্ছে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া নিয়ে দেশব্যাপী যে অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ চলছে তা আমরা জানি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ঘরে বা বাইরে যে কোন ব্যাপারেই সরকার আমাদের পাসে আছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কথার সাথে আর কিছু সংযুক্ত করার দরকার নাই। এক কথায় পরিষ্কার। স্বাধীনতা যুদ্ধের মুক্তিফৌজেদের অদম্য সাহসই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সাফল্য আনবে। বিভিন্ন সীমান্ত থেকে আসা খণ্ড খণ্ড প্রতিবেদন নির্দেশ করে কিভাবে সাহসিকতার সাথে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের নাজেহাল করছে। মুক্তি বাহিনীর এক জন গেরিলা বা একজন কমান্ডো পাকিস্তানি লুণ্ঠনবাজ সেনাসম্রাজ্ঞের চাইতে দামি। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রমাগত কার্যক্রমে এটা পরিষ্কার যে সামরিক জান্তা বাংলাদেশের জনগনের উপর বেশি দিন তাদের ধ্বংস লীলা চালাতে আর উপনিবেশিক শাসনতন্ত্র চালাতে সক্ষম হবে না। বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আমাদের সর্বাত্মক সহানুভূতি ও সমর্থন আছে।

সেনাবাহিনী
আমাদের প্রতি রক্ষা বাহিনীকে উন্নত করার অদম্য ইচ্ছা আছে। সুস্পষ্ট কারনে, আমাদের সামর্থ্য ও প্রস্তুতির চর্চা ও তা প্রকাশে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। তবে আমি নিশ্চিতভাবে বলছি, যে কোন হাতিয়ার ও ভূমিকায় আমরা প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে এগিয়ে। সশস্ত্র বাহিনীর দক্ষতার উন্নয়নের জন্য যেসব উপকরণ দেয়া হয়েছে তা হাউস এমনি এমনি জ্ঞাত হয়নি। স্থলবাহিনীর গতিশীলতার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয়েছে, পদাতিক কামান ও সাঁজোয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ট্যাংক বিরোধী মিসাইল বাহিনী দিয়ে ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। নতুন নতুন হাতিয়ার ও রণকৌশল শেখানো হচ্ছে। সব মিলিয়ে ভারতীয় সেনাদের আত্মরক্ষা ও আক্রমণাত্মক দক্ষতা প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্য গুরুতর উদ্বেগের কারন হতে পারে।

এটা সত্য যে পাকিস্তান মিরাজ-IIIE (Mirage-IIIE) যুক্ত করেছে। আমাদের বিমান বাহিনীকে পাকিস্তানের চেয়ে অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন শক্তিশালী ও দক্ষ করা হয়েছে। আমাদের যুদ্ধ বোমা স্কোয়াড্রনকে আরো আধুনিক করা হয়েছে। কমান্ড প্রস্তুতি পরিচালনায় আমরা ইতোমধ্যেই পরিচিতি পেয়েছি। ডিপো রক্ষণাবেক্ষণে ভারি মেরামত আরো বেশি আধুনিক ও উদ্দিপ্ত করা হয়েছে। সর্বদিক মিলিয়েই আমরা আশা রাখি আমাদের বিমান বাহিনীর সেবা উন্নত হবে। বিমান বাহিনীর ক্ষমতা আকর্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধির পরিমান নিশ্চিত করে স্থল ও সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে উঁচুতে কার্যক্রম পরিচালনায় তারা যথেষ্ট কার্যকর।

নৌবাহিনী

আমাদের নৌ বাহিনীর ক্ষমতা নিয়ে কিছু উদ্বেগ প্রকাশিত হয়েছে। এটা সত্য যে সাবমেরিন যুদ্ধবিগ্রহে পাকিস্তান নতুন ক্ষমতা যুক্ত করেছে। আমাদের নৌবাহিনীতে এখন সাবমেরিন আছে। আধুনিক সাবমেরিন ধ্বংস করার ক্ষমতাসম্পন্ন সাবমেরিন আমাদের আছে। নৌবাহিনী মিসাইল বহনের নৈপুণ্যও পরিচালনা করছে। বোম্বেতে ডকইয়ার্ড আধুনিক করা হচ্ছে। ভিসাখাপাতানামে নতুন একটি ডকইয়ার্ড নির্মাণাধীন। নৌ বাহিনীও তাদের প্রক্রিয়ার সুযোগ সুবিধা রক্ষনাবেক্ষনে বদ্ধপরিকর। আমি নিশ্চিত, আমাদের নৌবাহিনী ভালো প্রস্তুতিতে রয়েছে।

বেসামরিক বাহিনী

আমাদের বেসামরিক এন্টি-এয়ারক্র্যাফট বাহিনী আধুনিক এবং শক্তিশালী। প্রয়োজনীয় এলাকায় আমরা সারফেস-টু-এয়ার নির্ভর হাতিয়ার স্থাপন করেছি। বেসমরিক বাহিনী গণনা চালু করার প্রক্রিয়া হাতে নিয়েছে। এই গণনায় কেন্দ্রীয় সরকার ব্যয়ের বড় অংশ ধরবে। বেসামরিক কার্যক্রমে অধিক সংখ্যক মানুষ স্বেচ্ছায় যোগ দিয়েছে।

প্রতিরক্ষা সংগ্রহ

বিদেশী সংগ্রহ পাবার সম্ভবনা আমাদের জন্য সীমিত। কিন্তু আমি নিশ্চিত করতে চাই যে হাউস মানে আমরা এই সম্ভবনাকে অবহেলা করছিনা। আমাদের প্রধান নির্ভরতা অবশ্যই আমরা। আমাদের তোপ কারখানাগুলো এবং সামরিক অঙ্গীকার সেবার প্রয়োজন মেটানোর জন্য কাজ করছে। বিভিন্ন নতুন হাতিয়ার ও যন্ত্রপাতি উন্নত হয়েছে এবং তৈরি হচ্ছে। সামরিক গবেষণা ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান প্রশংসনীয় অবদান রেখেছে। সামরিক উন্নয়ন ও গবেষণার বৈজ্ঞানিক কাজ ও তাদের সহযোগীরা আমাদের প্রয়োজন গুলোতে আত্ম-নির্ভরশীল হতে প্রশংসনীয় অবদান রেখেছে।
যদিও কোন দেশই পুরোপুরি আত্ম-নির্ভরশীল নয়, বেশিরভাগ উন্নত দেশ টেকসই প্রযুক্তিগত ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করছে যাতে তারা অন্যান্য দেশের সাথে পারস্পরিক লাভজনক সম্পর্ক তৈরি করতে পারে। এভাবে এসব জাতি কর্ম স্বাধীনতা অর্জন করেছে অন্যান্য দেশের সাথে দেয়া ও নেয়ার অনুশীলন উন্নত করার মাধ্যমে। এই টেকসই বা অন্যভাবে বলতে গেলে বৈজ্ঞানিক, শৈল্পিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন আত্ম-নির্ভরশীলতাকে আরো বাড়িয়ে তোলে। আমরাও আমাদের বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিবিদদের কাছ থেকে এমন উন্নয়ন আশা করি, বিশেষ করে যারা সামরিক প্রতিষ্ঠা ও গবেষণাগারে কাজ করছে। আমি শুধু নিশ্চিত করতে পারি তহবিলের অভাবে হাউস তাদের কাজ কোন ভাবেই খতিগ্রস্থ করতে দেবেনা।

আমি হাউসকে মনে করিয়ে দিতে চাই যে সীমান্তের হুমকি মোকাবেলায় সশস্ত্র বাহিনীর প্রস্তুতি থেকেও জাতীয় নিরাপত্তা আগে; এটা আমাদের জাতির উদ্দেশ্যের সাথে সম্পৃক্ত, জাতির লক্ষ্য এবং আমাদের ধারন ক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত। আমি নিশ্চিত আমাদের হাউস আগস্টের মধ্যেই এসব ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এবং এগুলোর ব্যাপারে পরিপূর্ণ সমর্থন দেবে।

নিউক্লিয়ার শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার

এক্ষেত্রে আমি অনেক সতর্কতার সাথে লক্ষ্য করেছি আমাদের সামরিক বাহিনীর অনেক সম্মানীয় সদস্যদের ইচ্ছা নিউক্লিয়ার শক্তি অর্জন করা। অনেকবার হাউসে এই ব্যপারটা নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। আমাদের বর্তমান নীতি হচ্ছে নিউক্লীয় শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার। আমাদের মতে আমাদের প্রচলিত হাতিয়ার ব্যবহারের তুলনায় নিউক্লিয় হাতিয়ারের কোন বিকল্প নেই। আমি হাউসকে মনে করিয়ে দিতে চাই আমাদের মিলিটারি দক্ষতা অবশ্যই বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও শিল্পের অগ্রগতি কেন্দ্র করেই হওয়া উচিত। হাউস অবস্থান সম্পর্কে অবগত। ভারত নিউক্লীয় বিজ্ঞান দখল করেছে। অগ্রগতির অন্যান্য পরিকল্পনা ও কর্মসূচি সম্পর্কেও হাউস অবগত। এই বিষয়ে আমি আরো কিছু বলি এবং পরিপ্রেক্ষিত আচরনে ভুল করে বসি তা হাউস অবশ্যই চাইবেনা।

আন্তর্জাতিক শান্তি-রক্ষা

আমাদের সীমান্তের প্রতিরক্ষা ছাড়াও আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীর আরো কিছু দায়িত্ব আছে। বিভিন্ন উপলক্ষে জাতিসংঘের সাথে আমাদের আমাদের সামরিক বাহিনীর শান্তিরক্ষা বিষয়ক যেসব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে তা সম্পর্কে হাউস অবগত।
১৯৭১ সালের ৬ই এপ্রিল, যখন আমরা আমাদের সমস্যা নিয়ে মগ্ন ছিলাম, আমাদের বন্ধু প্রতিবেশী সিংহল সরকারের কাছ থেকে জরুরী অনুরোধ পাই। একই অনুরোধ অন্যান্য দেশের সরকারের পক্ষ থেকেও আসে। আমাদের সংস্থানের থেকে যতটা সম্ভব সহায়তা করতে একমত হয়েছিলাম। আমাদের হেলিকপ্টার সহজলভ্য। সিংহল সমুদ্রে আমাদের নৌ জাহাজ সিংহল নৌ বাহিনীকে টহলে সহযোগিতা করেছে। আমাদের কর্মীবৃন্দ সিংহলের সাথে মুক্তি বিষয়ক কোন লেনদেন করেনি এবং তাদের শুধু নজরদারি ও টহলে সহযোগিতা করেছে। তাদের কাজের সাথে তারা সিংহল সরকার থেকে তুলে নেয়া দের নিয়ে একটি ছোট বাহিনী গঠন করেছে।

সিংহল সামরিক বাহিনীকে কিছু প্রয়োজনীয় উপকরন আমরা সরবরাহ করেছি। সিংহল সরকারের অনুরোধে, তাদের অফিসারদের প্রশিক্ষণ দিতে রাজি হয়েছি। হাউস জেনে খুশি হবে, এক্ষেত্রে আমাদের সহযোগিতা পারস্পরিক ভাবে সন্তোষজনক।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২০২। পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্রের অবিরাম সরবরাহ এবং তার ফলশ্রুতির উপর আলোচনা রাজ্য সভার কার্যবিবরণী ১৯ জুলাই, ১৯৭১

Hasan Tareq Imam
<১২, ২০২, ৫৯৭-৬১৮>
অনুবাদ
জরুরী জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণী প্রস্তাব
পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্রের অবিরাম সরবরাহ এবং তার ফলশ্রুতি

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত (পশ্চিম বঙ্গ): মাননীয় চেয়ারম্যান, আলোচনা শুরূ করার আগে আমি একটি ব্যাপারে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। যখন রাজ্য সভা মুলতুবি ছিল, সেই সময় আজকের আলোচ্য বিষয়ে লোক সভায় আনুষ্ঠানিক বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজ্য সভায় শুধু একটি মনোযোগ আকর্ষণী প্রস্তাব যথেষ্ঠ নয়। তাই আমি প্রস্তাব করতে চাই যে এই মনোযোগ আকর্ষণী প্রস্তাবটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ আলোচনা প্রস্তাবে রুপান্তর করা হোক। আপনি জানেন যে মাননীয় বিদেশ মন্ত্রী সর্দার শরণ সিং এই সভায় একটি বিবৃতি পাঠ করেছিলেন, কিন্তু কোন আলোচনা হবার আগেই সভা মুলতুবি হয়ে যায়। যেহেতু এই ব্যাপারে লোক সভায় যথেষ্ঠ সময় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, সেহেতু আমাদের ভবিষ্যত করণীয় নির্ধারণ করার লক্ষে আমি চাইছি অতীতের অনেক প্রস্তাবের মত এই মনোযোগ আকর্ষণী প্রস্তাবটিকেও পূর্ণাঙ্গ আলোচনা প্রস্তাবে রুপান্তর করা হোক।

শ্রী গড়াই মুহুরী ( উত্তর প্রদেশ): মাননীয় চেয়ারম্যান, আমিও শ্রী ভূপেষ গুপ্তের প্রস্তাব সমর্থন করছি। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিগত কয়েকদিনে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে, এবং এসবের উপর রাজ্যসভায় একটি সার্বিক আলোচনা হওয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান এবং চীনের সম্পর্ক নতুন দিকে মোড় নিচ্ছে এবং এই পরিবর্তীত প্রেক্ষাপটে আমাদের উচিত মনোযোগ আকর্ষণী প্রস্তাবের পরিবর্তে এই ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করা।

চেয়ারম্যান মহোদয়: আমি আপনাদের কথা শুনছি।

শ্রী কৃষ্ণকান্ত ( হরিয়ানা): আমাদের মনোযোগ আকর্ষণী প্রস্তাব উত্থাপন এবং পূর্ণাঙ্গ আলোচনা দুই ই করা উচিত।

শ্রী ওম মেহতা ( মাননীয় সংসদ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী): প্রথমে মনোযোগ আকর্ষণী প্রস্তাবটি উত্থাপন করা হোক, তার পর আমরা একটা সময় বের করে এই ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করার চেষ্টা করব।

শ্রী নিরেণ ঘোষ (পশ্চিম বঙ্গ): একটা সময় বলতে আপনি কি বুঝাতে চাইছেন? এই বিতর্ক আজই হতে হবে।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: এটি সময় খুঁজে বের করার প্রশ্ন নয়, এ ব্যাপারে যত দ্রুত সম্ভব আলোচনা হওয়া উচিত। আজ অথবা আগামী কাল।

কিছু মাননীয় সাংসদ: না, না।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: এটি খুব সহজে আজকেই হতে পারে। যেহেতু মনোযোগ আকর্ষণী প্রস্তাব এবং আলোচনার বিষয়বস্তু একই, সেহেতু সহজেই মনোযোগ আকর্ষণী নোটিশটিকে পূর্ণাঙ্গ আলোচনায় রুপান্তর করে ফেলা যায়। আতীতে এরকম অনেক নজীর আছে। একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তির অনর্থক।

চেয়ারম্যান মহোদয়: আমি একটি প্রস্তাব নিতে চাই। আলোচ্য বিলটা নিষ্পত্তি হয়ে যাবার পর এ ব্যাপারে আজকেই একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা হতে পারে।

শ্রী শরণ সিং ( মাননীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী) : আমি এই ব্যাপারে আলোচনার জন্য সংসদের উৎসাহ অনুধাবন করতে পারছি, কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের ব্যাাপারে লোক সভায় আজ এবং আগামীকাল পূর্ব নির্ধারিত বিতর্ক আছে। সুতরাং এই দুই দিন আমি লোক সভায় ব্যাস্ত থাকব। আমি আজকের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে চাইনা, কিন্তু আজ এবং আগামীকাল আমি উপস্হিত থাকতে পারব না।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: মাননীয় মন্ত্রী উপস্হিত না থাকলে এ ব্যাপারে আলোচনার কোন অর্থ নেই। আমি যতটুকু জানি, লোকসভায় মাননীয় মন্ত্রী শুধু বিতর্ক শুনবেন, কোন আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন না। বিতর্ক শোনা যদি তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয় তাহলে ….

শ্রী নিরেণ ঘোষ: লোকসভায় আজ গুজরাট এবং পান্জাবের বিল নিয়ে আলোচনা হবে।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: আমি প্রস্তাব করছি রাজ্যসভায় আজ এ ব্যাপারে আলোচনা হবে এবং মাননীয় মন্ত্রী লোকসভায় না যেয়ে আমাদের আলোচনায় উপস্হিত থাকবেন।

শ্রী ওম মেহতা: এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার শুধুমাত্র সংসদের।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: মনোযোগ আকর্ষণী নোটিশটি উত্থাপন করা হচ্ছে। আমি পাকিস্তানে আমেরিকা এবং চীনের অস্ত্র সরবারাহ এবং এর ফলশ্রুতির ব্যাপারে মাননীয় বিদেশ মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

চেয়ারম্যান মহোদয়: শ্রী গুরুপদস্বামী এ ব্যাপারে কিছু বলতে চাইছেন।

শ্রী এম এস গুরুপদস্বামী (মাননীয় বিরোধী দলীয় নেতা) : আমি শুধু বলতে চাই যে আজকে আলোচনা না করে আমরা আরেকটি দিন ঠিক করে এ ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করতে পারি। মাননীয় সাংসদের মনোযোগ আকর্ষণী নোটিশটি উত্থাপন করা যেতে পারে, কিন্তু সাধারণ আলোচনা আজকে অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত হবেনা।

চেয়ারম্যান মহোদয়: সেটা বিবেচনা করা যাবে। ততক্ষণে মনোযোগ আকর্ষণী নোটিশটি উত্থাপন করার প্রক্রিয়া চলতে থাকুক।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: আমি ইতিমধ্যে মাননীয় বিদেশ মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি।

[ ডেপুটি চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে আলোচনা শুরু হচ্ছে ]

সর্দার শরণ সিং: আমি অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ নিয়ে এই সংসদে সর্বশেষ যে আলোচনা হয়েছিল, তারপর এই ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির কোন পরিবর্তন হয়নি। আমাদের কাছে সংবাদ আছে যে যুক্তরাষ্ট্র সরকার জনসমক্ষে যা বলছে, তার চেয়ে অনেক বেশী অস্ত্র পাকিস্তানে চালান হওয়ার অপেক্ষায় আছে। ৮ জুলাই ১৯৭১ যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের সূত্রে জানা যায় যে গত ৫ বছর ধরে পাকিস্তানের কাছে গড়ে ১০ থেকে ১৫ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করা হচ্ছে। সিনেটর চার্চ বলেন যে আনুমানিক ৩৫ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চালানের অপেক্ষায় আছে। আমাদের মতে তার হিসাবটাই বাস্তবের কাছাকাছি। শুধুমাত্র ডলার মূল্যটাই ঘটনার তাৎপর্য বোঝার জন্য যথেষ্ঠ নয়, অতীতে পাকিস্তানের কাছে অনেকবারই নাম মাত্র মূল্যে অস্ত্র বিক্রি করা হয়েছে। খুচরা যন্ত্রাংশ, যেগুলোর মূল্য অত্যন্ত কম; সেসবও পুরোনো মারণাস্ত্রকে আবার সচল করে তুলতে পারে। আমি সংসদকে আশ্বস্ত করতে চাই যে অস্ত্র সরবারের ব্যাপারে আমাদের প্রতিক্রিয়া মার্কিন সরকারকে অবহিত করা হয়েছে। আমরা তাদের বিস্তারিতভাবে জানিয়েছি যে এই অস্ত্র সরবরাহ উপমহাদেশের শান্তি এবং সমৃদ্ধির প্রতি হুমকি এবং এ ধারা অব্যাহত থাকলে তা ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলবে।

কোন দেশ যদি এখন পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করে, সেটা বাংলাদেশে গণহত্যায় প্রত্যক্ষ মদদ দেয়া হিসাবে গণ্য হবে এবং পাক সামরিক জান্তা কতৃক বাংলাদেশের মানুষের অধিকার হরণের নিয়ামক হিসাবে বিবেচিত হবে।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে মার্কিন সরকারের বক্তব্য এবং সংবাদ পত্রের খবর ছাড়া আমাদের কাছে আর কোন তথ্য ছিলনা, তাই মাননীয় মন্ত্রীর বক্তব্য আমরা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনেছি। মাননীয় মন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া দেখে আমার বলতেই হচ্ছে যে আমি অত্যন্ত হতাশ।

প্রথমত, তিনি বলেছেন যে পাকিস্তানকে অস্ত্র দেয়া মানে তাদের সহায়তা করা, কিন্তু তিনি পৃষ্ঠপোষকতা শব্দটা ব্যাবহার করছেন না। বাস্তব অর্থে পাকিস্তানকে অস্ত্র দেয়া মানে গণহত্যার সরাসরী অংশিদার হওয়া, যুক্তরাষ্ট্র সরকার ঠিক সেটাই করছে। অথচ মাননীয় মন্ত্রী শুধু সহায়তা শব্দটি ব্যাবহার করছেন। আমি অবাক হচ্ছি যে সরকার এটা বলতে পারছেনা যে পাকিস্তানকে অস্ত্র দেয়া মানে গণহত্যায় প্রতক্ষভাবে অংশগ্রহণ করা। এটা গণহত্যার আন্তর্জাতিক নীতি, জাতিসংঘের সনদ এবং মানবাধিকারের সরাসরি লঙ্ঘন এবং যুক্তরাষ্ট্র এসব লঙ্ঘনের অপরাধে অপরাধী। পাকিস্তান এবং যুক্তরাষ্ট্রের এসব পদক্ষেপ নেয়ার প্রেক্ষাপটে সরকারের রাজনৈতিক এবং সামরিক কৌশল কি? এ ব্যাপারে কোন দিক নির্দেশনা নেই। এ কথা কি সত্য নয় যে ১৯৫৪ সালে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি সাক্ষর হবার পর ফজলুল হকের সরকারকে
উচ্ছেদের লক্ষে (যে সরকারের শেখ মুজিবও মন্ত্রী ছিলেন) পাকিস্তানে প্রায় ২৫০০ মিলিয়ন ডলার, প্রায় ২০০ কোটি রুপি সমমূল্যের অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে?

এটা কি সত্য নয় যে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় তথাকথিত সামরিক নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকা সত্বেও ইরান, পশ্চিম জার্মানী, স্যান্টো এবং ন্যাটোর সহযোগী রাষ্ট্রগুলোর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করে গিয়েছে? বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা জানতে পারছি যে ৬৬ এর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে শুধু অস্ত্র সরবরাহই করেনি, বর্তমানে সেই সরবরাহের মাত্রা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।

আজকের সংবাদপত্রে আমরা জানতি পারছি যে পাকিস্তান শুধু খুচরা অস্ত্র নয়, কামানও আমদানি করছে। এমতাবস্হায় আমি সরকারের নীতি কি সে ব্যাপারে জানতে চাই। একজন সিনেটরের উদ্ধৃতি দিয়ে মাননীয় মন্ত্রী বলেছেন যে ৩৫ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সরবরাহের অপেক্ষায় আছে। এই পরিমাণ আসলে আরো বেশী, উনি সেটা উল্লেখ করেন নি। এই অস্ত্র সরবরাহ সরাসরি নিক্সনের নির্দেশে ঘটছে। ইডাহোর জনৈক সিনেটর মার্কিন সিনেটে এরকমই বলেছেন এবং তার বক্তব্যের কোন প্রতিবাদ করা হয়নি। সত্যি কথা বলতে, যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক একরকম স্বীকারই করে নিয়েছে যে নিক্সনের নির্দেশেই অস্ত্র সরবরাহ হচ্ছে। নামমাত্র মূল্যে পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছে। অনেকটা কোম্পানির পরিচালককে মাসে ১ রুপী বেতন দেয়ার মত অবস্হা। যুক্টরাষ্ট্র পাকিস্তানকে অস্ত্র উপহার দিচ্ছে। এতে কোন সন্দেহ নেই যে তারা গণহত্যার প্রত্যক্ষ অংশীদার, বরং এই প্রশ্নও তোলা যায় যে তারা কি ভারতকে যুদ্ধের জন্য উষ্কানি দিচ্ছেনা? অস্ত্র আসার সাথে সাথে পাক বাহিনীর হামলার তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমি কলকাতা থেকে এসেছি, সেখানে মানুষ বলাবলি করছে যে মার্কিন অস্ত্র পেয়ে পাক বাহিনীর হামলার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে, এমনকি তারা আমাদের সীমান্ত লঙ্ঘন করে উস্কানিমূলকভাবে গোলাবর্ষণ করে যাচ্ছে। এমতাবস্হায় মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্র বিষয়ক কিছু বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য নিম্নরুপ:

“আমি সম্প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে কিছু দেশে গিয়েছে এবং সেসব সরকারের সাথে যেসব ঐক্যমতে পৌছেছি তা হচ্ছে:”

(১) “পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার সামরিক সমাধান নেই, অবিলম্বে সেখানে সামরিক অভিযান বন্ধ করতে হবে। “

কিন্তু সংসদে এসে আমরা মাননীয় মন্ত্রী মারফত জানতে পারছি যে পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র সরবারহ বন্ধ হয়নি, বরং এর মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে।

(২) “পূর্ব বাংলা থেকে শরণার্থী আসা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। “

বাস্তবে শরণার্থী আসার সংখ্যা না কমে বরং বেড়েছে। গতকাল আমি কলকাতা থেকে জানতে পেরেছি যে এখনো প্রতিদিন ৩০, ০০০ করে নতুন শরণার্থী ভারতে ঢুকছে।

মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের ৩য় অংশ ছিল, শরণার্থীদের দেশে ফেরার নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। কসাই ইয়াহিয়াকে মারণাস্ত্র সরবরাহ করে যুক্তরাষ্ট্র কি সেই পরিবেশ তৈরি করতে সাহায্য করছে?

চতুর্থত মাননীয় মন্ত্রী রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলেছেন। সংসদে তার বক্তব্যের পর ২৯ জুন ইয়াহিয়া বিশ্ববাসীকে ভাষণ দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন যে তিনি কি ধরনের সমাধানে বিশ্বাস করেন। আমি এ ব্যাপারে আর কথা বাড়াতে চাইনা। মার্কিন সরকার বিশ্ববাসীকে জানিয়েই অস্ত্র সরবরাহ করছে। এমতাবস্হায় রাজনৈতিক সমাধান কিভাবে আসবে?

পঞ্চমত, বর্তমানে এখানকার পরিস্হিতি খুবই নাজুক। আমেরিকান অস্ত্র এসে পরিস্হিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। এখন আমাদের করণীয় কি? মাননীয় মন্ত্রী সংসদে বলেছেন যে যখন পূর্ণাঙ্গ বিতর্ক হবে, তখন তিনি তাঁর অবস্হান ব্যাক্ত করবেন। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কোন চুক্তির কথা শুনতে চাইনা, হয় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকান্ডের উপযুক্ত প্রতিবাদ করুণ অথবা স্বীকার করে নিন যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ভয়ে ভীত।

মাননীয় ডেপুটি চেয়ারম্যান, আরো দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে মাননীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ২৫শে জুন সংসদে বক্তব্য দেয়ার পর পরই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র যে বিবৃতি দিয়েছেন, তার সাথে মাননীয় মন্ত্রীর বয়ানের কোন মিল নেই। তাই আমি বলতে চাই যে, সরকার আসলে আমেরিকার ভয়ে ভীত, তারা এটা প্রকাশ্যে বলতে ভয় পায় যে মার্কিন নীতি এই অঞ্চলের শান্তি ও ভারসাম্য নষ্ট করছে। আমি জানতে চাই যে তিনি এখনো কেন যুক্তরাষ্ট্রকে বলছেন না যে এই অস্ত্র সরবরাহ শুধু বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচারণ নয়, ভারতের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষণার সামিল। মার্কিন এই কর্মকান্ড পরিষ্কারভাবেই যু্দ্ধের উষ্কানি। পাক সেনারা সীমান্তের ওপার থেকে আমাদের যু্দ্ধের জন্য উষ্কানি দিচ্ছে। তাই মাননীয় মন্ত্রীর বক্তব্য কোন সামরিক বা রাজনৈতিক নির্দেশনা বহন করেনা। আমেরিকা অস্ত্র সাহায্য দিচ্ছে …..

( সময় শেষের ঘন্টা) আমি শেষ করছি …..

সরকারের উচিত নিজের অবস্হান পরিষ্কার করা। আমি সরকারের কাছে আর্জি জানাই যে তারা যেন একটু মেরুদন্ড শক্ত করে, একটু সাহস প্রদর্শন করে। শুধু মিঃ এল কে ঝা এর বক্তব্যের উপর ভরসা করে বসে থাকলে চলবেনা, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশে আমাদের রাষ্ট্রদূত হবার অনুপযুক্ত। আমি বিশ্বাস করি যে তিনি আমাদের মাননীয় মন্ত্রীকে বিভ্রান্ত করছেন। মাননীয় মন্ত্রী মাত্র যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরেছেন, তাঁর কাছ থেকে আমি রাষ্ট্রদূতের ভূমিকা জানতে চাই। এত খরচ করে যুক্তরাষ্ট্রে দূতাবাস চালানো হচ্ছে, কিন্তু সেখান থেকে শুধু খবর আসছে যে আমেরিকা পাকিস্তানে অস্ত্র চালান করছে এবং দাবী করছে যে তারা নাকি অত্র এলাকার শান্তি রক্ষার্থেই এটা করছে। বিষয়টাকে গুরুত্বসহকারে নিতে হবে, অবিলম্বে মিঃ ঝাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে তিনি সম্পূর্ণরুপে ব্যার্থ হয়েছেন। সর্বাগ্রে এই কাজটাই করতে হবে।

দ্বিতীয়ত আমেরিকার কর্মকান্ডকে ভারতবিরোধী হিসাবে ঘোষণা করতে হবে। আমাদের কূটনীতি ব্যার্থ হয়েছে। আমেরিকার যাবতীয় কর্মকান্ড ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উষ্কানি হিসাবে বিবেচনা করতে হবে, এবং তাদের গণহত্যার সহকারী, জাতিসংদ সনদ, মানবাধিকারের সনদের লঙ্ঘনকারী এবং পাক-ভারত যুদ্ধের অনুঘটক হিসাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরতে হবে। মিন মিন না করে শক্ত হাতে পরিস্হিতি দমন করতে হবে, এটাই আমার দাবী। আমি জানিনা মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেন শরণার্থীদের সাথে দেখা করতে কলকাতায় এসেছেন। শরণার্থীদের সাথে মিঃ কিটিঙের ছবি দেখে আমি লজ্জিত হয়েছি। তাকে কে কলকাতায় আসার অনুমতি দিয়েছে? আমেরিকানরা কলকাতা বিমানবন্দর, ত্রিপুরা বিমানবন্দরের ছবি তুলছে। আমি কি জানতে পারি যারা গণহত্যার সরাসরি সহযোগী তাদের প্রতিনিধিদের কেন শরণার্থীদের সাথে দেখা করতে কলকাতায় পাঠান হচ্ছে? আমি অত্যন্ত অবাক, তাকে লাথি মেরে পশ্চিম বঙ্গ থেকে বের করে দেয়া উচিত। আমি জনতার কাছে অনুরোধ জানাব যে আমেরিকার কৃতকর্মের জন্য যেন তাদের রাষ্ট্রদূতকে লাথি মেরে কলকাতা থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়।

তার উপস্হিতি আমাদের জনগণের জন্য অপমানের। যে দেশের কারণে ভারতে লাখে লাখে শরণার্থী আসছে, আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার সেই দেশেরই রাষ্ট্রদূত কিটিঙকে শরণার্থীদের সাথে দেখা করার অনুমতি দিচ্ছেন। আর রাষ্ট্রদূত লোক দেখান ভাব করছেন যেন তিনি শরণার্থীদের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। মার্কিন সরকারের এটি এক ধরণের দ্বিমুখী নীতি। মিঃ কিটিঙকে বলুন তিনি যেন দিল্লীর বাইরে না যান। আপনারা তাকে দেশে ফেরত যেতে বলতে পারেন, কিন্তু কোন অবস্হায়ই উদ্বাস্তুদের সাথে দেখা করতে কলকাতায় পাঠাতে পারেন না। আমি কখনো এমন মেরুদন্ডহীন নীতি দেখিনি। আমেরিকা পাকিস্তানকে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহায়তা করছে, আমাদের বলা হচ্ছে যে পরিস্হিতি যেকোন দিকে মোড় নিতে পারে। অথচ তাদের রাষ্ট্রদূতের সাথে চরম রকমের বন্ধুসুলভ আচরণ করা হচ্ছে। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই, মন্ত্রীসভায় এ ব্যাপারে আলোচনার জন্য জোর দাবী জানাই। আমাদের আবার ১৯৬৫ সালের পরিস্হিতির দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে এবং যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে জোর ভূমিকা পালন করছে। তাই সাথে কূটনীতির ব্যাপারে জনগণের অনুভূতির কথাও বিবেচনা করতে হবে। আমরা যুদ্ধ চাইনা, আমরা কোনরকমের সামরিক ব্যাবস্হা নিতে চাইনা। কিন্তু আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে চাই। এবং বাংলাদেশকে অবশ্যই স্বীকৃতিদান করতে হবে। এই দুটি জিনিষ যত দ্রুত সম্ভব করতে হবে।

মাননীয় ডেপুটি চেয়ারম্যান: আপনি যথেষ্ঠ বক্তব্য দিয়েছেন।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: আমি শেষ করছি। আমি পরে আরো বলব। সরকারের তরফ থেকে কোন ধরণের শক্ত ব্যাবস্হা নেয়ার আশ্বাস পাচ্ছিনা। আমি জানতে চাই ঠিক কি কারণে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান করা হচ্ছেনা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্মক সহায়তা করা হচ্ছেনা। এ বিষয়গুলো মাননীয় মন্ত্রীর পরিষ্কার করা উচিত।

শ্রী নিরেণ ঘোষ : মাননীয় ডেপুটি চেয়ারম্যান, তারা আমাদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেন, কিন্তু আমাদের কথা শোনেন না।

সর্দার শরণ সিং : আমরা সেই দলের ভূমিকার কথাও জানি, মাননীয় সাংসদ যে দলের প্রতিনিধিত্ব করেন। মার্ক্সবাদী কমুনিষ্ট পার্টি।

মাননীয় ডেপুটি চেয়ারম্যান, রাজ্য সভার বিরতীকালে তার মনের ভেতর যত কথা-ক্ষোভ জমা হয়েছিল শ্রী গুপ্ত আজ তার পুরোটাই বলে দিয়েছেন। একটি বক্তব্যেই তিনি সব বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে দিয়েছেন, মনোযোগ আকর্ষণী প্রস্তাবের সাথে প্রাসঙ্গিক হোক বা না হোক। এবং তিনি সম্ভবত সাধারণ আলোচনার জন্য যে বক্তব্য তৈরি করেছিলেন, তার পুরোটাই এই সুযোগে দিয়ে দিয়েছেন।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: মাননীয় সভাপতি, আমি গতকাল মাঝরাতে কলকাতা থেকে এসেছি এবং আজ সকালে এই দৃষ্টি আকর্ষণী প্রস্তাবের কথা জানতে পেরেছি। আমার বক্তব্য কোন প্রস্তুতি ছাড়া তাৎক্ষণিকভাবেই দেয়া।

সর্দার শরণ সিং: আপনার কোন লিখিত বক্তব্যের প্রয়োজন নেই, আপনার মাথার ভেতরেই সব থাকে।

শ্রী নিরেণ ঘোষ : শ্রী ভূপেষ গুপ্তের বক্তব্যের সাক্ষী আমি, আমরা একই বিমানে এসেছি।

সর্দার শরণ সিং: কিন্তু আপনারা কলকাতার এক জায়গা থেকে আসেন নি।

মাননীয় ডেপুটি চেয়ারম্যান, মাননীয় সাংসদের বক্তব্যের জবাব দিতে হলে আমাকে একটি পাল্টা বক্তব্য দিতে হবে, সেটা করা থেকে আমি বিরত থাকছি। আমি বিশেষভাবে শুধু কিছু পরামর্শের জবাব দিতে চাই। তিনি আমার সাথে কোন বিষয়ে কথা বলেননি, অথচ অত্যন্ত জোরালভাবে কিছু সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা বলেছেন।

শ্রী এ জি কুলকার্নী (মহারাষ্ট্র): মিঃ এল কে ঝায়ের পরিবর্তে আপনি কেন উনাকে আমেরিকা পাঠিয়ে দিচ্ছেন না?

শ্রী লোকনাথ মিশ্র (উড়িষ্যা): উনি মন্ত্রীসভার বৈঠকের কথা বলেছেন।

সর্দার শরণ সিং : আমি তার কিছু কথার জবাব দিতে চাই। মিঃ ঝা কে ফিরিয়ে আনার যে পরামর্শ উনি দিয়েছেন, সেটি আমি প্রত্যাক্ষান করতে বাধ্য হচ্ছি। এ প্রসঙ্গে আমি আমার আগের বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করতে চাই, মিঃ ঝা সুচারুভাবেই তার দায়িত্ব পালন করছেন ….

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: আমি এই কথার প্রতিবাদ জানাচ্ছি। এরকম প্রশংসাবাক্য পাওয়ার মত কোন কাজটা মিঃ ঝা করেছেন?

মিঃ ঝায়ের একমাত্র গুন হচ্ছে তিনি নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের আস্থাভাজন হিসাবে পরিগণিত হতে পেরেছেন।

সর্দার শরণ সিং: একটি রাষ্ট্রের কর্মকান্ডের জন্য সবসময় সেই রাষ্ট্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতকে দায়ী করা যায়না। এরকম দোষারোপ করা সম্ভবত এই সংকট মোকাবেলা করার উপযুক্ত পন্হা নয়। আর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে আরো কঠোর ভাষা ব্যাবহার করতে বলেছেন। আমার মতে যথেষ্ঠ কঠোর ভাষাই ব্যাবহার করা হয়েছে, যদিও তা মিঃ গুপ্তের মত এত কঠোর নয়।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: উনি কি জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন সম্পর্কে অবহিত? যে ভাষাই ব্যাবহার করা হোক না কেন গণহত্যায় সাহায্য করার অর্থ সমগ্র বিশ্বেই অশান্তি এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা।

সর্দার শরণ সিং : আমার বক্তব্যের শেষ অংশে আমি পরিষ্কারভাবেই বলেছি যে কোন দেশ যদি এখন পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করে, সেটা বাংলাদেশে গণহত্যায় প্রত্যক্ষ মদদ দেয়া হিসাবে গণ্য হবে এবং পাক সামরিক জান্তা কতৃক বাংলাদেশের মানুষের অধিকার হরণের নিয়ামক হিসাবে বিবেচিত হবে। মিঃ গুপ্ত যদি একটু ধৈর্য নিয়ে অভিধান খুঁজে দেখেন, তাহলে দেখবেন তাঁর আর আমার শব্দ চয়নে অর্থের কোন পার্থক্য হয়নি। আমার মতে ভাবার্থ ঠিক থাকলে কোন একটি বিশেষ শব্দ চয়নে তিনি আমাকে বাধ্য করতে পারেন না, নিজের পছন্দসই শব্দ ব্যাবহারের অধিকার আমার থাকা উচিত।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: তাঁর আর আমার ব্যাবহৃত শব্দসমূহের ভাবার্থ এক নয়। প্রশ্রয় দেয়া আর প্রত্যক্ষ মদদ দেয়া
এক জিনিষ নয়, অনেক কিছুতেই প্রশ্রয় দেয়া যেতে পারে যেটা আইনের দৃষ্টিতে সরাসরি অপরাধ হিসাবে গণ্য হয়না। যে মুহূর্তে আপনি প্রত্যক্ষ মদদ শব্দটা ব্যাবহার করবেন, তখনই সেটা জাতিসংঘ সনদের আওতায় চলে আসবে।

সর্দার শরণ সিং : তাঁর তৃতীয় প্রশ্ন ছিল মিঃ কিটিঙ কেন কলকাতা বা পশ্চিম বঙ্গে গিয়েছেন …..

শ্রী চিত্ত বসু (পশ্চিম বঙ্গ): এবং তাকে কেন লাথি মেরে বের করে দেয়া হবেনা।

সর্দার শরণ সিং : আমাদের আরেকটু ভদ্রোচিত আচরণ করা উচিত। প্রশ্নটা ছিল তাকে কেন শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে করতে কলকাতায় আসার অনুমতি দেয়া হয়েছে। আমাদের সরকারের নীতিই হচ্ছে অন্যান্য দেশের প্রতিনিধি, রাষ্ট্রদূত, সংসদ সদস্য এবং সংবাদ মাধ্যম বিনা বাধায় শরণার্থী শিবিরে যেতে পারবেন এবং তাদের সাথে কথা বলতে পারবেন। আমি আপনাকে এটাও বলতে পারি যে যে ব্যাক্তিই শরণার্থী শিবিরে গিয়েছেন এবং উদ্বাস্তুদের দুঃখ-কষ্ট নিজ চোখে দেখেছেন, তারা সবাই সম্পূর্ণ নতুন একজন মানুষ হিসাবে ফেরত এসেছেন। আমাদের কোন কিছু লুকানোর নেই, কোন একজন রাষ্ট্রদূত শরণার্থী শিবিরে যাবেন, তাদের অবস্হা নিজের চোখে দেখবেন, তাদের দুঃখ-কষ্টের কাহিনী শুনবেন- এতে আমি আপত্তির কোন কারণ দেখিনা। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোন পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন নেই। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার এবং সর্বস্তরের প্রতিনিধিদের আমরা পরিষ্কারভাবে আমাদের অনুভূতির কথা জানিয়েছি, আরো জানিয়েছি যে যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানো অস্ত্র এখানে গণহত্যার কাজে ব্যাবহৃত হচ্ছে এবং পাক বাহিনীকে আরো নির্মম হয়ে উঠতে উৎসাহ যোগাচ্ছে। পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করার মানে ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানের আক্রমণাত্নক নীতিকে উৎসাহ যোগানো এবং ভারতের নিরাপত্তার উপর হুমকি সৃষ্টি করা- এই নীতি অটল রাখতে আমরা সবসময়ই দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। সম্মানিত সাংসদ হয়তো একথাই বলতে চেয়েছিলেন, আমরা কিন্তু ইতিমধ্যেই তা করে ফেলেছি। আমরা এ ব্যাপারে মন্ত্রীসভার একটি বৈঠক আয়োজনেরও প্রস্তাব করেছি। আমি শ্রী ভূপেষ গুপ্তকে আশ্বস্ত করতে চাই যে সময় সময় মন্ত্রীসভার সদস্যরা বৈঠকে মিলিত হন এবং এ ব্যাপারে সংসদের পক্ষ থেকে আলাদা করে কোন তাগাদা দেয়ার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজনে আমরা স্বল্পতম সময়ের নোটিসে বৈঠকে বসতে পারি। সাম্প্রতিক কালে আমরা এরকম অনেকগুলো বৈঠক করেছি। আজকের আলোচ্য বিষয় নিয়ে আমরা মন্ত্রীসভা এবং বিভিন্ন কমিটিতে নিয়মিত আলোচনা করে আসছি। আমি শ্রী ভূপেশ গুপ্ত এবং এই মহান সংসদকে আশ্বস্ত করতে চাই যে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন স্তরে সবসময়ই আলোচনা হচ্ছে।

আমি তাঁকে আরো আশ্বস্ত করতে চাই যে এই বিষয়টি সরকার সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে দেখছে।

তার সর্বশেষ প্রশ্নটি ছিল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়টি বর্তমান মনোযোগ আকর্ষণী নোটিশটির সাথে কোনভাবেই সম্পর্কযুক্ত নয়।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: শ্রী ভূপেশ গুপ্তের প্রস্তাবে আমি অবাক হয়েছি। তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে রাষ্ট্রদূতকে ফেরত নিয়ে আসতে চান। কেউ যদি নিজের দায়িত্ব পালনে ব্যার্থ হয়ে থাকেন, সেটা রাষ্ট্রদূত নন, তাঁর বন্ধু সর্দার শরণ সিং।

সর্দার শরণ সিং: আমি আপনারও বন্ধু।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: এখন আসল ঘটনা বোঝা যাচ্ছে। রাষ্ট্রদূতকে ফেরত আনার প্রস্তাব দিয়ে শ্রী ভূপেষ গুপ্ত প্রমাণ করছেন যে তিনি এখনো কংগ্রেসের সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তিনি কোন মন্ত্রীর পদত্যাগ চান না, প্রধাণমন্ত্রীর পদত্যাগ চান না। তিনি শুধুমাত্র রাষ্ট্রদূতকে ফেরত নিয়ে আসতে চান।

সর্দার শরণ সিং : আপনি আপনার দল থেকে এই সুবিধা পাচ্ছেন যে আপনি সম্পূর্ণ দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবে কারো পদত্যাগ দাবী করলেও আপনাকে কোন কৈফিয়ত দিতে হবেনা।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: আমার দলের পক্ষে কিছু করা সম্ভব নাও হতে পারে।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: আমার বন্ধু অত্যন্ত বুদ্ধিমান মানুষ। আমিও বোকা হতে চাইনা, আশা করি এটা কোন সমস্যা নয়।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: আমার দল ক্ষমতায় আসতেও পারে, নাও আসতে পারে। যদি কখনো ক্ষমতায় আসি তাহলে আমরা দায়িত্ব নিয়েই আসব। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আজ সর্দার শরণ সিংকে দায়িত্ব প্রদর্শন করতে হবে। এই দায়িত্ব এড়িয়ে যাবার কোন সুযোগ নেই। আমি ব্যার্থতার দায় এল কে ঝায়ের উপর চাপিয়ে দেবনা, আমি শ্রী শরণ সিংকেই দায়ী করব। উনি ৮/৯ টি দেশের রাজধানী ঘুরে এসে দিল্লী বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলনে বড় গলায় বলেছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের স্বার্থবোরোধী কিছু করবেনা। তিনি বলেছিলেন যে যুক্তরাষ্টের রাষ্ট্রপতি তাঁকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে যুক্টরাষ্ট্র কোন ভারতবিরোধী ভূমিকা নেবেনা। তিনি যদি এল কে ঝায়ের কথার উপর ভিত্তি করে তাঁর বক্তব্য দিতেন, তাহলে আমি ঝা কে প্রত্যাহার করার কথা বলতাম। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে যুক্তরাষ্ট্র সফর করে এসেছেন, নিজে ব্যাক্তিগতভাবে যুক্টরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলে এসেছেন। আমার প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে শ্রী শরণ সিং কি যুক্তরাষ্ট্র সফর থেকে এসে দেয়া তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে জাতীকে বিভ্রান্ত করেন নি? তাঁর এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া উচিত। তাঁর সাথে যদি প্রতারণা করা হয়ে থাকে, তবে তাঁর সেটাও স্বীকার করা উচিত।

(তাঁর বক্তব্যে এসময় বাঁধা পড়ে)

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত নিজে অনেক সময় নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। এখন আমার বক্তব্যে বাধা দিয়ে আমার সময় নষ্ট করছেন। আমাকে দ্বিতীয় প্রশ্নটি করতে দিন। আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে আমরা এখন মিত্রবিহীন, কাছে বা দূরে কোথাও আমাদের কোন বন্ধু নেই।

আমাদের কোথাও কেউ নেই। অথচ সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী পাকিস্তানের পৌরহিত্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে নতুন মৈত্রী রচিত হচ্ছে।

শ্রী এ পি চ্যাটার্জি ( পশ্চিম বঙ্গ) : পাকিস্তান কি হিসাবে কাজ করেছে?

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: এই মহাজোটের মহামিলনে পাকিস্তান পুরোহিত হিসাবে কাজ করেছে।

জনৈক সাংসদ: এই মিলন কি অনৈতিক?

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: হ্যাঁ, এই মিলন অনৈতিক। এই পৌরহিত্যের পুরষ্কার হিসাবেই কি পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছে?

কিন্তু আমাদের সরকারের কাছে এ ব্যাপারে কোন তথ্য ছিলনা। বিভিন্ন দেশে থাকা রাষ্ট্রদূতরাও নিজের দায়িত্ব পালন করতে পারেন নি। যার ফলে পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আমাদের করণীয় সম্পর্কে মাননীয় মন্ত্রী আমাদের অবহিত করতে পারেন নি।

এই ধরণের অদক্ষতার ফলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আমরা সবসময়ই পিছিয়ে থাকছি। আমি মাননীয় মন্ত্রীর কাছে জানতে চাই যে পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহের খবর তিনি আগে থেকে পয়েছিলেন কিনা।

তৃতীয়ত, আমি জানতে চাই সরবরাহকৃত অস্ত্রের মোট পরিমাণ কত এ ব্যাপারে তাঁর কোন ধারণা আছে কিনা। মোট অস্ত্রের পরিমাণ কত? অবস্হাদৃষ্টে মনে হচ্ছে কেউই এই ব্যাপারে কিছু জানেনা।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: আমার মনে হয় টাকার পরিমাণ দুই বিলিয়ন ডলার বা তার কাছাকাছি হবে।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: এটি আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছেনা।

মাননীয় ডেপুটি চেয়ারম্যান: শ্রী মিশ্র, আপনি বলুন।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: শ্রী শরণ সিং এর কথা আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা। “প্রাভাদা” বা “নিউ ইয়র্ক টাইমস” এ প্রকাশিত কোন সংবাদও আমার বিশ্বাস হয়না।

শ্রী এ পি চ্যাটার্জি: আপনি বলেছিলেন যে মাননীয় মন্ত্রী সমগ্র জাতীকে বিভ্রান্ত করছেন।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: তিনি যতক্ষণ পর্যন্ত বিদেশমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি এই সংসদের কাছে জবাবদিহী করতে বাধ্য। তিনি জাতীকে বিভ্রান্ত করেছেন। এখন এই মহান সংসদকে বিভ্রান্ত করলে তাঁকে এর ফল ভোগ করতে হবে।

শ্রী এ পি চ্যাটার্জি: বিভ্রান্তিকর তথ্য থেকে কি আসল তথ্য পাওয়া যেতে পারে?

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: শ্রী চ্যাটার্জি মাননীয় মন্ত্রীর ত্রাতা হিসাবে এগিয়ে এসেছেন।

শ্রী এ পি চ্যাটার্জি: আমি মাননীয় মন্ত্রীকে সাহায্য করতে আসিনি। তিনি একজন মহান ব্যাক্তি।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: শ্রী চ্যাটার্জি, আপনার যখন সময় আসবে তখন আপনি কথা বলবেন। এখন আমাকে বলতে দিন। আমার তৃতীয় প্রশ্ন হচ্ছে ….

সর্দার শরণ সিং : আপনি ইতিমধ্যে চার-পাঁচটি প্রশ্ন করে ফেলেছেন, অথচ বলছেন তৃতীয় প্রশ্নের কথা।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: আমি প্রকৃত অস্ত্রের পরিমাণ জানতে চাই, কম বা বেশী কোন অনুমানিক সংখ্যা নয়। যুক্তরাষ্ট্র দাবী করেছে যে তারা ২৪ এপ্রিলের আগের চুক্তিতে বিক্রিত অস্ত্র সরবরাহ করছে, পদ্মা বা অন্য কোন জাহাজে এই ধরণের কি পরিমাণ অস্ত্র আসছে সেটা আমাদের জানতে হবে। মাননীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী মার্কিন রাষ্ট্রদূত অথবা যুক্তরাষ্টে আমাদের রাষ্ট্রদূত মারফত সরবরাহকৃত অস্ত্রের পরিমাণ জানার চেষ্টা করতে পারেন। মাননীয় মন্ত্রীর উচিত আমাদের এই তথ্য জানানো, এবং এটাও জানানো কি পরিমাণ অস্ত্র ইতিমধ্যে সরবরাহ করা হয়েছে এবং কি পরিমাণ অস্ত্র চালানের অপেক্ষায় আছে। মাননীয় ডেপুটি চেয়ারম্যান ……

মাননীয় ডেপুটি চেয়ারম্যান: আমার মনে হয় আপনি যথেষ্ঠ বলেছেন।
শ্রী লোকনাথ মিশ্র: আপনি অনুমতি দিলে আমি শেষ একটি প্রশ্ন করতে চাই। আপনি অনুমতি না দিলেও কোন অসুবিধা নেই। শ্রী ভূপেষ গুপ্ত বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যাক্তি, আমারতো আর সেই সৌভাগ্য নেই।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: তিনি রাজকীয় সুবিধা পাবার জন্য লড়াই করছেন, আর আমাকে বলছেন আমি নাকি সুবিধাপ্রাপ্ত।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: আমি সংসদের সম্মতিতে এই কাজ করেছি, আপনি করেছেন সকলের অসম্মতিতে।

শেষ প্রশ্ন হিসাবে আমি জানতে চাই যে রাশিয়া কি দয়া করে পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করেনি?

(বিরতী)

শ্রী চিত্ত বসু, আমার মনে হয়না সম্প্রতি আপনি মস্কো গিয়েছেন অথবা রাশিয়ান রাষ্ট্রদূতের সাথে আপনার কথা হয়েছে। দয়া করে যা জানেন না, সে ব্যাপারে কোন মন্তব্য করবেন না।

আলোচনার মূল বিষয়বস্তু সচ্ছে সংবাদপত্রে প্রকাশিত সাম্প্রতিক একটা খবর।

জনৈক সাংসদ: ঠিক, ঠিক।

(বিরতী)

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: আমি চাই শ্রী শরণ সিং এটা অস্বীকার করুন। আমি প্রাভেদা বা নিউ ইয়র্ক টাইমসের খবর বিশ্বাস করিনা, সর্বোপরি শ্রী ভূপেষ গুপ্তের কথা বিশ্বাস করিনা।

(বিরতী)

এ পি চ্যাটার্জি : যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট মিঃ নিক্সন পিকিঙ যাচ্ছেন।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: নিক্সন চৌ এন লাইয়ের পেছনে দৌড়াচ্ছেন, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: মাননীয় চেয়ারম্যান, নির্বাচন ভন্ডুল হয়ে যাবার পর …..

(বিরতী)

চেয়ারম্যান মহোদয়: আপনি প্রশ্ন করুন, কেউ বাধা দেবেন না।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: আমার শেষ প্রশ্ন, পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করে যুক্তরাষ্ট্র গণহত্যার অংশীদার হয়েছে।

আমি শ্রী শরণ সিংকে জিজ্ঞাসা করতে চাই যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার ব্যাপারে তিনি কি করবেন? তিনি কোন নির্দিষ্ট উত্তর দিচ্ছেন না। মনোযোগ আকর্ষণী প্রস্তাবে হয়তো এই প্রসঙ্গটি নেই, কিন্তু মনোযোগ আকর্ষণী প্রস্তাবে অনেক কিছুই নেই। সেখানে শ্রী শরণ সিং এর নামও নেই। কিন্তু তিনি প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। সুতরাং আমি তাঁর কাছে জানতে চাই যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে সরকারের বর্তমান অবস্হান কি?

সর্দার শরণ সিং : মাননীয় চেয়ারম্যান, প্রথম প্রশ্নের ব্যাপারে আমি মাননীয় সাংসদকে বলব আমার বক্তব্য আরেকবার পড়তে।

তিনি তাঁর প্রথম প্রশ্নে পালাম বিমানবন্দরে দেয়া আমার বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কেউ আমার বক্তব্য ভুল বা অপ্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যা দিলে আমি তার জবাব দিতে বাধ্য নই। আমি কখনোই কাউকে বিভ্রান্ত করার জন্য কিছু বলিনি। এই অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং উদ্দেশ্যমূলক।

দ্বিতীয় প্রশ্নে তিনি যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে সম্পর্ক যে নতুন মোড় নিয়েছে, তার সম্বন্ধে জানতে চেয়েছেন। এই ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এবিষয়ে আমি ইতিমধ্যে একটি বিবৃতি দিয়েছি। কিন্তু আমি জানিনা যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহের সাথে এ ব্যাপারের কি সম্পর্ক আছে। এ প্রক্রিয়া শুরু হবার অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করে আসছে এবং তাদের মধ্যকার নতুন এ সম্পর্ক অস্ত্র সরবরাহ প্রক্রিয়ায় গুনগত কোন পরিবর্তন আনবে বলে আমি মনে করিনা। এই সম্পর্ক উন্নয়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু বিচ্ছিন্ন ঘটনা। পাকিস্তানের মাধ্যমে এই নতুন সম্পর্ক রচিত হওয়ায় পাকিস্তান কি বাড়তি অস্ত্র পাবে? এই প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ বা না তে দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি শুধু বলতে পারি যে এই ঘটনা ছাড়াও পাকিস্তান অস্ত্র পেয়ে আসছিল এবং খুব সম্ভবত পেতে থাকবে। তৃতীয় প্রশ্নে আমার কাছে সরবরাহকৃত অস্ত্রের পরিমাণ জানতে চাওয়া হয়েছে। আমি আমার বক্তব্যে বলেছি যে সিনেটর চার্চের দেয়া ৩৫ মিলিয়ন ডলারের অঙ্কটি আপাতদৃষ্টিতে সঠিক মনে হচ্ছে। আমি যেহেতু ভবিষ্যৎদৃষ্টা নই, সামনে কি পরিমাণ অস্ত্র আসবে সেটা অনুমান করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: চুক্তিতে মোট অস্ত্রের পরিমাণ উল্লেখ থাকার কথা। আমি জানতে চাই যে আপনি সেই পরিমাণ সম্পর্কে কিছু জানেন কিনা।

সর্দার শরণ সিং: শ্রী মিশ্র, এ ব্যাপারে একটি চুক্তি হয়নি। আপনার বুঝতে হবে যে তারা অনেকগুলো চাহিদাপত্র জমা দিয়েছে। এখানে দুটো ব্যাপার আছে। অস্ত্র চালানের কিছু অংশ মারণাস্ত্র, আবার কিছু অংশ খুচরা যন্ত্রাংশ। আমি বলেছি যে সরবরাহের অপেক্ষায় থাকা মোট অস্ত্রের মূল্য ৩৫ মিলিয়ন ডলার। সামনে কি সরবরাহ আসবে সেটা আমি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের হয়ে বলতে পারছিনা, হয়তো শ্রী মিশ্র পারবেন। তারপর তিনি জানতে চেয়েছেন রাশিয়া সরকার পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ করছে কিনা। রাশিয়া পরিষ্কার জানিয়েছে এপ্রিল ১৯৭০ এর পর থেকে তারা পাকিস্তানে কোন অস্ত্র বা খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহ করছেনা এবং আমিও এমন কোন তথ্য পাইনি যার ভিত্তিতে তাদের অবিশ্বাস করা যায়। আমাদের রাশিয়া সরকারের কথা বিশ্বাস করা উচিত, যেখানে তারা পরিষ্কারভাবে বলছে যে এপ্রিল ১৯৭০ এর পর থেকে তারা পাকিস্তানে কোন অস্ত্র বা খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহ করেনি।

শ্রী সুন্দর সিং ভান্ডারী ( রাজস্হান): তারা কি খুচরা যন্ত্রাংশের কথা বলেছে?

সর্দার শরণ সিং: হ্যাঁ।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: যুক্তরাষ্ট্রও পরিষ্কারভাবেই বলেছে।

সর্দার শরণ সিং: আমার মনে হয়না তারা খুব পরিষ্কারভাবে বলেছে। তারা যদি বলত যে তারা অস্ত্র সরবরাহ করেনি, আমি তাদের কথা মেনে নিতাম। শ্রী লোকনাথ মিশ্র: তারা বলেছে যে যেহেতু তাদের একটি চুক্তি আছে, সেই চুক্তি অনুযায়ী তারা অস্ত্র সরবরাহ করছে।

সর্দার শরণ সিং : শ্রী মিশ্র, আপনি কেন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের হয়ে কথা বলছেন।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: যুক্তরাষ্ট্র সরকার বলেছে যে তারা অস্ত্র সরবরাহ করছে …..

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: তারা কখন এটা বলেছে?

( বিরতী)

শেষ প্রশ্নে তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে আবারো জানতে চেয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আমি ইতিমধ্যে বলেছি যে এখনো উপযুক্ত সময় আসেনি এবং আমাদের জাতীয় স্বার্থ, উপমহাদেশের শান্তি এবং মুক্তিযোদ্ধাদের দিক বিবেচনা করে সঠিক সময়ে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: আমি কি এটা মনে করতে পারি যে সরকার নীতিগতভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে?

সর্দার শরণ সিং: সংবিধানের নীতিতে এই স্বীকৃতির ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়া আছে। আপনি কেন নীতি নিয়ে কথা বলছেন?

ডঃ ভাই মহাবীর ( দিল্লী): আমাদের মন্ত্রী আমেরিকা সরকারের শীর্ষ নেতাদের সাথে দেখা করে এসেছেন। আমি জানতে চাই এই অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বক্তব্য কি? কেন অস্ত্র দেয়া হচ্ছে? পাকিস্তানের উপর কোন হুমকি আছে নাকি? পাকিস্তান কি কোনভাবে সংকটাপন্ন? নাকি তার বহিরাক্রমণের ভয় আছে? আমি আমেরিকার সাম্প্রতিক বক্তব্য সংবাদপত্রে দেখেছি, যার মধ্যে ভিয়েতনাম নীতির ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে ” একটি ছোট দেশও নিজেদের অধিকার চর্চা করতে পারে, নিজেদের পথ বেছে নিতে পারে”

সেখানে আরো বলা হয়ছে, ” যুক্তরাষ্ট্র সবার বাঁচার এবং বাঁচতে দেয়ার অধিকারে বিশ্বাস করে। “যে সরকার এই দাবী করে, তাকে কি জিজ্ঞেস করা হয়েছে যে অস্ত্র সরবরাহ করা বাঁচার এবং বাঁচতে দেয়ার নীতির মধ্যে পড়ে কিনা? আমি এ ব্যাপারে মার্কিন নেতাদের বক্তব্য জানতে চাই।

আপনার বক্তৃতায় আপনি বলেছেন যে ” এটি গণহত্যায় মদদ দেয়ার শামিল”

এর মাধ্যমে আপনি বুঝিয়েছেন যে, ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশের লোকদের উপর যে আক্রমণ চালিয়েছে, আমেরিকা অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে তাতে সমর্থন জানিয়েছে। ঠিক আছে, কিন্তু আপনি একথা বলতে সম্মত কিনা যে আজকে যা ঘটেছে তা আরো গুরুতর।

ইতিমধ্যে একটি দেশের উপর আগ্রাসন চালানো হয়েছে, এবং এখনো চালানো হচ্ছে। বেসামরিক আগ্রাসন, অর্থনৈতিক আগ্রাসন, আমি বলব অনেকটা জীবাণুযুদ্ধ চালানোর মত আগ্রাসন।

সব শেষে আমি বলব, যে জাহাজটি আমাদের সর্বপ্রকার বিরোধিতা সত্বেও পাকিস্তানের অস্ত্র বহন করে আনছে, তাকে বাধা দেয়ার জন্য আমাদের সরকার কি নৌ অবরোধ করার চেষ্টা করবে? এসব অস্ত্র কি গন্তব্যে পৌছাতে বাধা দেয়া হবে, নাকি বলা হবে আন্তর্জাতিক জলসীমার জন্য কিছু করা যাবেনা।

সর্দার শরণ সিং : মাননীয় সাংসদ, পাকিস্তানে সরবরাহকৃত অস্ত্রের মোট পরিমাণ সম্পর্কে আমি আমার বক্তব্যে যে সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়েছি, এর বাইরেও আরো সূত্র থেকে আমরা তথ্য সংগ্রহ করেছি। একারণেই আমি বলেছি যে সিনেটর চার্চের উল্লেখিত ৩৫ মিলিয়ন ডলার অঙ্কটা সম্ভবত সবচেয়ে কাছাকাছি অনুমান। আমাদের কাছে যেসব গোয়েন্দা তথ্য আছে, তার ভিত্তিতেই এই আমি এই সংখ্যা উল্লেখ করেছি। তাঁর দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল যুক্তরাষ্ট্র কেন পাকিস্তানে অস্ত্রসরবরাহ করছে। ১৯৪৫ সালে পাকিস্তানে অস্ত্র বিক্রি করা শুরু করার পর থেকে অনেকবারই যুক্তরাষ্ট্রকে এই প্রশ্ন করা হয়েছে। তাদের কথা হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক শক্তিকে দমন করার কৌশল হিসাবে তারা পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ করে আসছে, যদিও এই দাবীর কোন যৌক্তিকতা নেই। আমরা শুরু থেকেই জেনে এসেছি যে ভারতকে চাপে রাখার উদ্দেশ্যেই যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে অস্ত্র দিচ্ছে।

মাননীয় সাংসদ আরো জানতে চেয়েছেন যে তারা কি চীন থেকে পাকিস্তানকে দূরে রাখাকে অস্ত্র পাঠানোর অজুহাত হিসাবে ব্যাবহার করতে চাইছে কিনা। আমার উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ, তারা এই জাতীয় অজুহাত ক্ষেত্র বিশেষে দিয়েছে, যদিও তারা ঠিক সরাসরি এই শব্দগুলো উচ্চারণ করেনি। তারা বলেছে যে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বার্থের কথা বিবেচনা করেই তারা বিভিন্ন দেশে অস্ত্র বিক্রি করে। যদিও আমি এই বক্তব্যের যৌক্তিকতা পাইনা, তারপরেও তাদের ব্যাখ্যা দেয়ার অধিকার আছে। বিশ্বাস করা না করা যার যার ব্যাপার।

তৃতীয় প্রশ্ন ছিল যে তাদের এটা বলা হয়েছে কিনা যে তাদের অস্ত্র বাংলাদেশে গণহত্যার কাজে ব্যাবহৃত হচ্ছে। একথা অবশ্যই তাদের জানানো হয়েছে। শুধু এখনই না, আগেও কয়েকবার বলা হয়েছে।

ডঃ ভাই মহাবীর: আপনার বক্তব্যে আপনি একথা উল্লেখ করেন নি।

সর্দার শরণ সিং : আমি এখন আপনার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। এছাড়াও আমি আগেও বিভিন্ন জায়গায় একথা বলেছি।

চতুর্থ প্রশ্নে তিনি পিকিঙে নিক্সনের আসন্ন সফরের ব্যাপারে আমার মন্তব্যের সাথে একমত হয়েছেন এবং বলেছেন যে এই সফর থেকে আমাদেরও শিক্ষা নেয়া উচিত যে জাতীয় স্বার্থ সবসময় সমুন্নত রাখতে হবে। আমি তাঁকে জানাতে চাই যে জাতীয় স্বার্থ সবসময়ই সরকারের অগ্রাধিকার এবং এটা বিবেচনা করেই আমরা সব ধরণের পদক্ষেপ নিয়ে থাকি।

ডঃ ভাই মহাবীর: পরিস্হিতি দেখে কিন্তু সেরকম মনে হচ্ছে না।

সর্দার শরণ সিং : উনি আরো বলেছেন যে ভারতের কঠোর হওয়া উচিত। হ্যাঁ, এই ব্যাপারে আমিও একমত যে ভারতের শক্ত হওয়া উচিত, যদিও মাননীয় সাংসদের দল ভারতকে শক্তিশালী করার লক্ষে কাজ করছে কিনা এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। তারা সবসময় বিভক্তিমূলক নীতি নিয়ে আসছেন, যার ফলে ভারত শক্তিশালী হবার বদলে দূর্বল হচ্ছে। আমি তাকে সঠিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়গুলো দেখার চেষ্টা করার আহ্বান জানাই। আমাদের সামরিক শক্তি, তিন বাহিনীর জন্য অস্ত্র তৈরি করার সক্ষমতা – এসব আমরা অর্জন করেছি আমাদের শক্তিশালী অর্থনীতি, শিল্পোন্নয় এবং সর্বোপরি আমাদের জাতীয় একতার কারণে। মাননীয় সাংসদ তাঁর বক্তব্যে এই প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেন নি। আমাদের শক্তিশালী হতে হবে, তার মানে সবগুলো সেক্টরেই শক্তিশালী হতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে দুই-একটা ইস্যু খুঁজে বের করার চেষ্টা করাটা লাভজনক কিছু হবেনা।

উনি তিনটি প্রস্তাব দিয়েছেন এবং জিজ্ঞাসা করেছেন যে পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত থাকার পরিপ্রেক্ষিতে আমি তার প্রস্তাবগুলো মেনে নিতে প্রস্তু আছি কিনা। আমি এক কথায় উত্তর দিচ্ছি যে না, আমি প্রস্তাবগুলো গ্রহণ করতে পারছিনা।

শ্রী কৃষ্ণকান্ত: আমেরিকার গত ২০ বছরের পররাষ্ট্রনীতি পর্যালোচনা করলে এটা বোঝা দায় যে এশিয়াতে শক্তির একটা ভারসাম্য চাইলে তারা সবসময়ই কেন ভারতবিরোধী নীতি নিয়ে আসছে। এমনকি এবারের এই অস্ত্র সরবরাহের সাথেও এই ক্ষমতার ভারসাম্য সম্পর্কযুক্ত। তারা কি এটাও জানেনা যে অস্ত্রের পাশাপাশি আমেরিকান জাহাজ বাংলাদেশে গণহত্যার উদ্দেশ্যে সৈন্য পরিবহণ করার কাজে ব্যাবহৃত হচ্ছে? আমেরিকা যদিও বারবার অস্বীকার করে আসছে যে তারা এটা করছেনা, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমেরিকান জাহাজ এবং কিছু ক্ষেত্রে উড়োজাহাজ সৈন্য পরিবহনের কাজে নিয়মিত ব্যাবহার করা হচ্ছে। এটাও কি সত্য নয় যে ইন্দো-চীন যুদ্ধের পর ১৯৬২ থেকে ৬৫ এর মধ্যবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করেছে এটা জানা সত্বেও যে এই অস্ত্র চীন বা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাবহার হবে না, শুধুমাত্র ভারতের বিরুদ্ধেই ব্যাবহার হবে। ১৯৬৩ সালে তাদের একটি সাবমেরিন দেয়া হয়। আরব সাগর অথবা বঙ্গোপসাগরে চীন বা রাশিয়ার কোন কার্যক্রম নেই, এই সাবমেরিন শুধু ভারতের বিরুদ্ধে ব্যাবহারের জন্যই দেয়া হয়েছে। ইন্দো-চীন যুদ্ধের সময় আমরা অস্ত্র কিনতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমাদের কাছে আমেরিকান রাইফেলও বিক্রি করা হয়নি। এটা কি ভারত বিরোধীতা নয়?

শুধুমাত্র ভারতের দিকে তাক করে পাকিস্তানে একাধিক রাডার মোতায়েন করা হয়েছে। মুলতানে একটি রাডার স্টেশন কেন তৈরি করা হয়েছে? ভারতীয় বিমানের বিরুদ্ধে ব্যাবহার করার জন্য। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী বালওয়ান্ত্রাই মেহতার বিমান ভূপাতিত করে তাকে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রী যখন ওয়াশিংটন গিয়েছেন, তখন তারা মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট তাঁর সাথে সাক্ষাত করেছেন। কিন্তু অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে তাঁকে কিছু না জানিয়ে সরবরাহ অব্যাহত রাখা হয়েছে। তারা আমাদের সাথে সম্পূর্ণরুপে অবন্ধুসুলভ, ভারতবিরোধী আচরণ করছে। তারা যে ভারতবিরোধী, এই কথাটা এখন তাদের পরিষ্কারভাবে বলে দেয়ার সময় এসেছে।

চীনা সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করতে নিক্সন চীন যাচ্ছেন না। তিনি চীনে যাচ্ছেন কারন অনেকগুলো পরীক্ষার পর চীন পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জন করেছে। এটাই বাস্তবতা।

মাননীয় ডেপুটি চেয়ারম্যান, আমেরিকার উদ্দেশ্য পরিষ্কার নয়। ৫ জুলাইতে মার্কিন মুখপাত্র বলেছেন যে তারা এখনো ইয়াহিয়া খানের বক্তব্যের লিখিত কপি হাতে পাননি। অথচ ইয়াহিয়া ২৮ জুন বক্তব্য দিয়েছেন। তাদের সবধরণের যোগাযোগ মাধ্যম ও প্রযুক্তি থাকা সত্বেও ৫ জুলাই পর্যন্ত তারা ইয়াহিয়ার বক্তব্য হাতে পান নি, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। মাননীয় ডেপুটি চেয়ারম্যান, এখনো কি নিজেদের জাতীয় স্বার্থে আমাদের আন্তর্জাতিক ভারসাম্য রক্ষার রাজনীতিতে অংশ নেয়ার সময় হয়নি? এখনো কি এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পর্ক স্হাপনে গুরুত্ব দেয়ার সময় হয়নি? বর্তমানে রাশিয়ার সাথে জাপান ও উত্তর ভিয়েতনামের মধ্যে সম্পর্ক গাঢ় হচ্ছে। আমাদেরও কি উচিত না যে পারষ্পরিক সংলাপের মাধ্যমে একই রাস্তায় হাঁটা? রাশিয়া জাপানের সাথে আলোচনায় বসেছে। আমাদেরও কি উচিত না রাশিয়া, জাপান, উত্তর ভিয়েতনাম এবং চীন- এই চার শক্তির সাথে আলোচনার টেবিলে বসার চেষ্টা করা?

আমরা জানি শুধুমাত্র ভাবাদর্শের ভিত্তিতে কোন রাষ্ট্র পরিচালিত হয়না। রাষ্ট্র পরিচালিত হয় জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে এশিয়াতে ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তন হবে, যুক্তরাষ্ট্র সেটা চায়না, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোও সেটা চায়না। সুতরাং ভারতের কি স্বাধীন বাংলাদেশ চাওয়া উচিত না, কারণ বাংলাদেশ বাস্তবায়িত হলে সেটা ভারতের অস্তিত্বের জন্যও উপকারী হবে। মিঃ কিসিন্জার এবং মিঃ নিক্সন বুঝে-শুনেই নিজেদের স্বার্থে পদক্ষেপ নিচ্ছেন। বাংলাদেশকে সাহায্য করলে আখেরে সেটা ভারতেরই উপকারে আসবে।

( সময় শেষের ঘন্টা)

মাননীয় ডেপুটি চেয়ারম্যান, এটা বলা হচ্ছে যে মিঃ এল কে ঝা সেখানে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু তিনি কি কাজ করছেন বা কেন তাঁকে সেখানে রাখা হচ্ছে সেটা আমি বুঝতে পারছিনা, কারণ কাজে আসতে পারে এমন কোন তথ্যই তিনি পাঠাতে পারছেন না। আমেরিকা নিজের নীতিতেই চলছে, মিঃ ঝা সেখানে থেকে কোন উপকারে আসবেন না। আমাদের এখন নিজেদের স্বার্থে কাজ করার সময় এসেছে। স্বাধীন বাংলাদেশ এই অঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, যুক্তরাষ্ট্র সেটা চায়না। কেউ যদি এগিয়ে এসে আমাদের পাশে না দাঁড়ায়, তবে ভারতকে একাই এই সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।

সর্দার শরণ সিং: আমি মনোযোগ দিয়ে উনার বক্তব্য শুনেছি। উনি যেহেতু কোন প্রশ্ন করেননি, আমার নতুন করে কিছু বলার নেই।

শ্রী চিত্ত বসু: আমাকে দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে মাননীয় মন্ত্রী দৃষ্টি আকর্ষণী প্রস্তাব সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করেছেন, সেগুলো সময়োপযোগী নয়। তার বক্তব্য গতানুগতিক, মেরুদন্ডহীন এবং আত্নসমর্পণের সামিল। তাঁর এধরণের বক্তব্য শুধু সাংসদদেরই রাগান্বিত করছেনা, সমগ্র দেশবাসীকেও হতাশার সাগরে নিমজ্জিত করছে।

আমেরিকা পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে, কারণ পাকিস্তান তাদের অনুগত থাকবে এবং তাদের সুবিধামত সময়ে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে, আমি মাননীয় মন্ত্রীর কাছে জানতে চাই যে তিনি আমার এই মতের সাথে একাত্নতা পোষণ করেন কিনা। যুক্তরাষ্ট্র সেই ১৯৫৪ সাল থেকেই পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করে আসছে, যার অর্থমূল্য দুই বিলিয়ন ডলারেরও বেশী। শুধু তাই নয়, ন্যাটো এবং সেন্টোর আরও কিছু সদস্যরাষ্ট্র তৃতীয়পক্ষ হিসাবে পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করে আসছে। সুতরাং এটা প্রতিষ্ঠিত যে পাকিস্তানকে ভারতের বিপক্ষে একটি শক্তি হিসাবে দাঁড় করানো মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানের যে সামরিক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছিল, তা যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে নতুন যন্ত্রাংশ দিয়ে পুষিয়ে দিয়েছে। মাননীয় মন্ত্রী কি আমার সাথে একমত যে, পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়ে যুক্তরাস্ট্র বাংলাদেশে গণহত্যার অংশীদার হচ্ছে এবং বাংলাদেশ ও ভারতের বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালাতে মদদ দিচ্ছে? আমরা দুই দেশই কি যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের শিকার নই? তাই যদি হয়, তাহলে কি সরকারের উচিত না বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের সব ধরনের সামরিক সাহায্য দেয়া? বাংলাদেশের মাটি থেকে আগ্রাসী শক্তিকে হটিয়ে দিতে পারলে সেটা দুই দেশের জন্যই লাভজনক হবে। আমাদের নিজেদের স্বার্থেই কি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া উচিত নয়? তাই যদি হয়, তাহলে এখনই কি উপযুক্ত সময় না?

মাননীয় ডেপুটি চেয়ারম্যান: মাননীয় মন্ত্রী এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন।

শ্রী চিত্ত বসু: আমরা দুই দেশই যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের শিকার এবং সেই প্রেক্ষিতে এখনই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার উপযুক্ত সময় কিনা, এই প্রশ্নের উত্তর তিনি দেন নি। বাংলাদেশের মাটি থেকে হানাদারদের হটিয়ে দেয়া আমাদের দুই দেশের জন্যই কি লাভজনক নয়? আমি আরো জানতে চাই যে চীন-আমেরিকা-পাকিস্তানের মধ্যে নতুন মহাজোট গঠিত হবার আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়াটা কি আরো জরুরী হয়ে উঠছেনা? আমি মাননীয় মন্ত্রীকে আরো জিজ্ঞেস করতে চাই যে এত কিছুর পরও কেন যুক্তরাষ্ট্রের আচরণকে ভারতের প্রতি বৈরি হিসাবে ঘোষণা করা হচ্ছেনা? কেন এই কথাটা সহজ ভাষায় বলার সাহস আমাদের সরকার পাচ্ছেনা? সরকার কি যুক্তরাষ্ট্রকে বলবে যে এ অবস্হা চলতে থাকলে সরকার চরম ব্যাবস্হা নিতে বাধ্য হবে, ঋণ পরিশোধ বন্ধ করে দেয়া হবে, সব ধরণের চুক্তি বাতিল করা হবে এবংভারতে অবস্হিত সব ধরণের মার্কিন সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হবে? যুক্তরাষ্ট্র যে ভাষা বুঝে, তাদের সাথে সেই ভাষায়ই কথা বলতে হবে। মাননীয় মন্ত্রী কি এই সব প্রশ্নের উত্তর দেবেন?

সর্দার শরণ সিং: একথা সত্য যে ১৯৫৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ শুরু করার পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র পাকিস্তানে এসেছে এবং এর উপর ভিত্তি করেই পাকিস্তান নিজেদের সেনা-নৌ-এবং বিমানবাহিনী গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে তিনি অনেক কথাই বলেছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে যা বলার আমি ইতিমধ্যে বলে দিয়েছি এবং এই ব্যাপারটিকে বারবার অন্যান্য প্রসঙ্গের সাথে জুড়ে দেয়ার ফলে সময় নষ্ট হওয়া ছাড়া অন্য কোন লাভ হচ্ছেনা। এই প্রসঙ্গটি, চীন, বা পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র চালানের সাথে কোনভাবেই সম্পর্কযুক্ত নয়। এটি একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গ এবং আমি ইতিমধ্যে এর জবাব দিয়েছি। আমার আর নতুন কিছু যোগ করার নেই। সর্বশেষে, ভারতকে ৫ মিলিয়ন ডলার দেয়া হচ্ছে এমর্মে তিনি একটি প্রশ্ন করেছেন। সংবাদপত্রে আমিও এটা পড়েছি, এর কোন সত্যতা নেই ……..

শ্রী চিত্ত বসু: আপনি কি এটা প্রত্যাখ্যান করছেন?

সর্দার শরণ সিং: এর কোন সত্যতা নেই। আমি কিসের উপর ক্ষুব্ধ হব? আমরা কারো থেকে কিছু নিচ্ছিনা।

শ্রী সুন্দর সিং ভান্ডারী: তিনি প্রত্যাখ্যান বলেছেন, ক্ষুব্ধ নয়।

সর্দার শরণ সিং: আমরা কারো থেকে কিছু নিচ্ছিনা।

শ্রী সুন্দর সিং ভান্ডারী: যদি নিতে হত?

সর্দার শরণ সিং: যদি নিতে হত মানে কি? কোন প্রকল্পিত ধারণার উপর ভিত্তি করে প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব নয়।

শ্রী চিত্ত বসু: আপনাদের মনোভাব কি?

সর্দার শরণ সিং: পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে আমাদের মনোভাব ইতিমধ্যে ব্যাক্ত করা হয়েছে, এই সুযোগে আমি সেটা আবার ব্যাক্ত করতে চাই। আমরা তাদের বিস্তারিতভাবে জানিয়েছি যে কোন দেশ যদি এখন পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করে, সেটা বাংলাদেশে গণহত্যায় প্রত্যক্ষ মদদ দেয়া হিসাবে গণ্য হবে এবং পাক সামরিক জান্তা কতৃক বাংলাদেশের মানুষের অধিকার হরণের নিয়ামক হিসাবে বিবেচিত হবে। এই অস্ত্র ভারতের বিপক্ষে ব্যাবহৃত হবে, পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহকারী প্রত্যেকটি দেশের কাছে এই বার্তা পৌছে দেয়া হয়েছে।

আমি মাননীয় ডেপুটি চেয়ারম্যানকে বলতে চাই যে অনেকগুলো মন্তব্য শোনা হয়েছে এবং একই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে বারবার জিজ্ঞেস করা হচ্ছে। আপনি মাননীয় ডেপুটি চেয়ারম্যানকে এই দিকটা একটু বিবেচনা করার অনুরোধ করছি, একই কথা বারবার জিজ্ঞেস না করে যেন নতুন প্রশ্ন থাকলে সেটা করা হয়।

মাননীয় ডেপুটি চেয়ারম্যান: অর্ডার, অর্ডার।

শ্রী এম এস গুরুপদস্বামী: মহোদয়, ইতোমধ্যে অনেক বিষয়ে আলোচনা করা হয়ে গিয়েছে। আমি খুব সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখব। আমি মাননীয় মন্ত্রীকে একটি প্রশ্ন করতে চাই। আমরা এটা বুঝতে পারছি কি পারছিনা, পাকিস্তানে আসতে থাকা এই অস্ত্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জয়-পরাজয়ের নিয়ামক হয়ে দাঁড়াতে পারে? আমরা এভাবে বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করেছি? অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে লাভ নেই, শ্রী শরণ সিং অত্যন্ত সুকৌশলে বলে দিয়েছেন যে তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার বিরোধী নন, তিনি শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা করছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই সঠিক সময়টি ইতিমধ্যে পার হয়ে যায়নি তো? আমরা কি খুব দেরী করে ফেলছিনা?

শ্রী এ ডি মানি (মধ্যপ্রদেশ): আমরা অনেক দেরী করে ফেলেছি।

শ্রী এম এস গুরুপদস্বামী: আমিও তাই মনে করি। মার্কিন অস্ত্র চালানের ব্যাপারে আমি শুধু একটি পর্যবেক্ষণের কথা বলব। আমি আশা করব শ্রী শরণ সিংও এ এ ব্যাপারে নিজের মন্তব্য জানাবেন। যুক্টরাষ্ট্রের নীতি হচ্ছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডঃ জেকিলের মত আচরণ করা, অন্যান্য ক্ষেত্রে মিঃ হাইডের মত আচরণ করা। যুক্টরাষ্ট্র সরকার দ্বি-মুখি কূটনীতির আশ্রয় নিচ্ছে, একদিকে বিশ্ববাসীর সামনে শরণার্থীদের জন্য চোখের জল ফেলছে, অন্য দিকে যে পাকিস্তানের কারণে এই শরণার্থী সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তাদের অস্ত্র দিচ্ছে, তাদের মাধ্যমে চৌ এন লাইয়ের সাথে মৈত্রি রচনা করছে।

মহোদয়, আমি এখন সুনির্দিষ্ট একটি প্রশ্ন করতে চাই। আমাদের পক্ষে হয়তো একটি চরম অবস্হান গ্রহণ করা কঠিন, এবং মাননীয় মন্ত্রী হয়তো কঠোর কোন পদক্ষেপ নিতে চাইছেন না। যুক্তরাষ্ট্রের এই দ্বি-মুখি নীতির প্রতিবাদ হিসাবে আমরা কি তাদের থেকে শরণার্থীদের জন্য সব ধরণের সাহায্য গ্রহণ বন্ধ করে দিতে পারি? আমার মতে এটি খুব ছোট একটা পদক্ষেপ হবে।

এর সাথে সাথে আমাদের কোন ধরণের কার্যকর ব্যাবস্হাও নিতে হবে, একটু ঝুঁকি নিয়ে হলেও। আমি জানি যে শরণার্থীদের জন্য সাহায্য প্রয়োজন এবং ব্যাপারে সরকারের নিজস্ব নীতি রয়েছে, কিন্তু সরকার কি একটু সাহসী হয়ে ঘোষণা দেবে যে যারা পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করছে, তাদের কাছ থেকে শরণার্থীদের জন্য কোন অর্থ সাহায্য গ্রহণ করা হবেনা?

সর্দার শরণ সিং: প্রথম প্রশ্নের ব্যাপারে আমি বলতে পারি যে এই সব অস্ত্রের চালান অবশ্যই বাংলাদেশের যুদ্ধ পরিস্হিতিতে প্রভাব ফেলবে। এটি পাক বাহিনীর শক্তি বাড়াবে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের হতোদ্যম করবে। বাংলাদেশের জনগণের জন্য ব্যাপারটা অবশ্যই উদ্বেগের। এবং এই অস্ত্র পাকিস্তানকে আমাদের বিরুদ্ধে আরো আগ্রাসী হতে সাহস যোগাবে। এই দুটি কারণে আমরা পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহের কঠোর বিরোধীতা করে আসছি। দ্বিতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র কি দ্বি-মুখি নীতি অবলম্বন করছে কিনা। এর উত্তর হচ্ছে তাদের একটি নীতি আছে এবং সেই নীতিকে আপনি আক্ষরিক অর্থে বা ভাবার্থে যা খুশি বলতে পারেন, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তারা পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ করেই যাবে। এবং পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েই যাবে।

তিনি আরো জিজ্ঞাসা করেছেন যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ত্রাণ ও অর্থনৈতিক সাহায্য প্রত্যাখ্যান করা হবে কিনা। এ ব্যাপাারে আমি স্পষ্টভাবে বলছি, উদ্বাস্তুরা আসলে পাকিস্তানের সমস্যা। এবং পাকিস্তানী নাগরিক এই উদ্বাস্তুদের দেখ-ভাল করার জন্য আমরা যেকোন ক্ষতিপূরণ চাইবার অধিকার রাখি। দ্বিতীয়ত, এব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও দায়িত্ব আছে। শরণার্থীদের সহায়তা করা সকলের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। জাতী সংঘ মহাসচিবের আহ্বানে সাড়া দিয়ে যদি কেই সাহায্য করতে এগিয়ে আসে, তাকে ফিরিয়ে দেয়া ভারতের জন্য লাভজনক হবে না। আমরা বরং পুরো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান করতে চাই এবং এটাই আমাদের নীতি। এই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর সাথে জাতীয় অহংবোধ মিশিয়ে ফেললে চলবে না। শরণার্থীদের খরচ সবাইকে মিলেই বহন করতে হবে, এ ব্যাপারে রাগের মাথায় অন্য কোন সিদ্ধান্ত নেয়া যাবেনা।

শ্রী নিরেন ঘোষ: এই মাত্র মাননীয় মন্ত্রী একটি নতুন বক্তব্য দিলেন। তিনি বলছেন যে এই আশ্রয়ার্থীরা পাকিস্তানের নাগরিক এবং আমাদের ক্ষতিপূরণ চাওয়ার অধিকার আছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হলে এরা আর পাকিস্তানের নাগরিক থাকবেনা। এরা তখন বাংলাদেশের নাগরিক হবে, যারা পাকিস্তানী আগ্রাসনে বাধ্য হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। সরকার কি শুধু এই পরিস্হিতি এড়াতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে চাইছেনা? হয়তো ঘটনাটা এরকম না, কিন্তু তাঁর বক্তব্য শুনে এই প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক, তাই আমি তার কাছে এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা চাইছি।

সর্দার শরণ সিং: আপনি এমন বক্তব্য কেন দিচ্ছেন যেটা অন্য দলকে সাহায্য করে? আপনি কি তাঁদের সাহায্য করছেন না আমাদের?

শ্রী নিরেন ঘোষ: শ্রী শরণ সিং, দূর্ভাগ্যজনকভাবে কিছু কিছু বিষয়ে সরকারের সাথে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি মেলেনা। এটা আমাদের মনে রাখা উচিত, আর এটা আমাদের দোষও নয়। এই ইস্যুতে আমরা সরকারের সাথেই থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্ত আপনারাই আমাদের এই অবস্হান গ্রহণে ব্যাধ্য করছেন। এটি অত্যন্ত দূর্ভাগ্যজনক, কিন্তু আমাদের আর কোন উপায় নেই।

দ্বিতীয়ত আমি জিজ্ঞেস করতে চাই যে অস্ত্র সরবরাহের সাথে সম্পর্কযুক্ত না হলে মাননীয় মন্ত্রী কোন প্রশ্নেরই উত্তর দেননি। এখন ২৫ শে মার্চের পর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে আমরা তাদের অস্ত্র দিতে পারতাম। স্বীকৃতি দেয়ার পর এটা আমাদের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়াত। তখন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে অস্ত্র দিলে আগরা বলতে পারতাম যে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানী আগ্রাসনকে সমর্থন করছে আর ভারত মুক্তিকামী বাংলাদেশী মানুষদের সাহায্য করছে। সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে যে মার্কিন সাহায্য ছাড়া শরণার্থীদের দেখ-ভাল করা সম্ভব নয়। পরিস্হিতি যদি তাই হয় তাহলেতো আমেরিকার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া ভারতের পক্ষে সম্ভব হবে না।

আমি আরেকটি জিনিষ জিজ্ঞেস করতে চাই। শুধুমাত্র শক্ত প্রতিউত্তর দেয়া ছাড়া আমরা বিকল্প কোন পদক্ষেপ নেয়ার কথা চিন্তা করেছি কিনা। আপনি সুনির্দিষ্ট কোন উত্তর না দিতে পারলেও আমাদের অন্তত এটুকু জানান যে আপনাদের মাথায় শুধু লিখিত জবাব দেয়া ছাড়াও বিকল্প কোন চিন্তা আাছে কিনা।

পাকিস্তান সবধরণের ঋণ পরিশোধ সাময়িকভাবে স্থগিত ঘোষণা করেছে। তারা ঘোষণা দিয়েছে : ” আমাদের অর্থনৈতিক সংকট চলছে এবং আমাদের কোন বৈদেশিক মুদ্রা নেই”। এই কারণ দেখিয়ে তারা ঋণ পরিশোধ সাময়িকভাবে স্থগিত ঘোষণা করেছে। আমাদের ক্ষেত্রে পরিস্হিতি হচ্ছে ৭০ লক্ষ লোক সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে এসেছে, আমাদের অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে আমরা উপযুক্ত সাহায্য পাইনি এবং এই ব্যায়ভার আমাদের কোষাগারকেই বহন করতে হচ্ছে। এটা নিয়ে আমি দুশ্চিন্তাগ্রস্হ নই, এটা আমাদের অবশ্যই বহন করা উচিত। আমি শরণাথী তদারকিতে অব্যাবস্হাপনার কথা এখন তুলবনা, কিন্তু যেহেতু অস্ত্র সরবরাহ এবং বিপুল সংখ্যক আশ্রয়ার্থীদের চাপে আমাদের অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে, আমরাও কি আমেরিকাকে সবধরণের ঋণ পরিশোধ সাময়িকভাবে স্থগিত ঘোষণা করতে পারিনা? আমরা মিঃ এল কে ঝা কে ডেকে পাঠিয়েও প্রতিবাদ জানাতে পারি। আপনারা ইতিমধ্যে পিকিঙ থেকে রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করেছেন। আমি কূটনীতিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করতে বলছিনা, শুধুমাত্র প্রতিবাদ হিসাবে রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করতে বলছি। দয়া করে কিছু একটা করুন।

ডেপুটি চেয়ারম্যান: শ্রী ঘোষ, যথেষ্ঠ হয়েছে।

শ্রী নিরেণ ঘোষ: সরকার কি জানে তাদের কর্মকান্ড দেশের জনগণের মনে গভীর সন্দেহ ও উৎকন্ঠার জন্ম দিচ্ছে? তারা কি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সাহায্য দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষমতা রাখে? প্রকৃত বন্ধু হিসাবে আমাদের এটুকু অন্তত করা উচিত।

সর্দার শরণ সিং: আমি বলতে চাই, যে পূর্বানুমানের উপর ভিত্তি করে তিনি প্রথম দুটি প্রশ্ন করেছেন, তা সম্পূর্ণ ভুল। বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান বা অন্য কোন ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ভয়ে ভীত হবার কোন কারণ ভারতের নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ভয়ে ভীত হয়ে ভারত সিদ্ধান্থীনতায় ভুগছে, এটা উনার উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত কল্পনা ছাড়া অন্য কিছু নয়।

পাকিস্তান সবধরণের ঋণ পরিশোধ সাময়িকভাবে স্থগিত ঘোষণা করেছে, কারণ তারা কোনভাবেই এই টাকা জোগাড় করতে পারছেনা। মাননীয় সাংসদ আমাদেরও একই কাজ করতে বলছেন। আমাদের অর্থনৈতিক অবস্হা এত খারাপ নয়। ঋণ পরিশোধ সাময়িকভাবে স্থগিত ঘোষণা করা অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত, কোন ধরণের ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ নয়।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: আমরাও প্রয়োগিক কারণে এই ব্যাবস্হা নিতে পারি।

শ্রী নিরেণ ঘোষ: আপনি এত কর্কশভাবে কথা বলছেন কেন? আপনার বক্তব্য পরষ্পরবিরোধী।

মাননীয় ডেপুটি চেয়ারম্যান: দয়া করে তাঁর কথা শুনুন।

সর্দার শরণ সিং: সৌভাগ্যক্রমে আমাদের অর্থনীতির অবস্হা এত খারাপ নয় যে আমাদের ঋণ পরিশোধ সাময়িকভাবে স্থগিত করতে হবে। আমাদের অর্থনীতির অবস্হা যথেষ্ঠ ভাল, আমরা কোন বিদেশী সাহায্য ছাড়াই আশ্রয়ার্থীদের দেখা-শোনা করতে পারব। তাদের অন্ন-বস্ত্রের ব্যাবস্হা করার জন্য আমাদের শুধু অভ্যন্তরীণ সম্পদের উপর নির্ভর করলেই চলবে। মাননীয় সাংসদ বুঝতে পারছেন না যে তিনি এরকম নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে বসে থাকলে আমি তাঁকে কোন সাহায্যই করতে পারব না। আমি জানি যে কিছু দল এবং কিছু মানুষ এমন পরিস্হিতির সৃষ্টি করতে চায়, যাতে মনে হয় ভারতের অর্থনীতিও খারাপ অবস্হায় আছে। এটা সত্য যে এই অগণিত পরিমাণ শরণার্থী আমাদের উপর বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপ সৃষ্টি করছে এবং তাদের সমস্যা সমাধানকল্পে সরকারের প্রচুর সময় ব্যায় হচ্ছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২০৩। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট কর্তৃক ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বিবৃতি রাজ্যসভার কার্য বিবরণী ২১ জুলাই, ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ২০৩, ৬১৯-৬৩৮>
অনুবাদ

জরুরী জনগুরুত্বসম্পন্ন একটি বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দেবার আহবান
খবরে প্রকাশ – পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন

শ্রী এন জি গোরে (মহারাষ্ট্র): স্যার, আপনার অনুমতি নিয়ে, আমি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট কর্তৃক ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকির ব্যাপারে প্রকাশিত সংবাদ এবং ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষন করতে চাই।

পররাষ্ট্র মন্ত্রী (সরদার শরণ সিং); জনাব চেয়ারম্যান, স্যার, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেছেন যে, ‘যদি ভারত পূর্ব পাকিস্তানের কোনো অংশ দখল করার কোন চেষ্টা করে তাহলে তিনি ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন। ’

পাকিস্তান মাঝেমাঝে বিশ্বকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি ভুল ধারণা দেবার চেষ্টা করে। তারা বলে যে বাংলাদেশের সৃষ্ট ঘটনা মূলত পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার একটি ব্যাপার কিন্তু এটি আসলে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসক ও বাংলাদেশের জনগণের মধ্যকার সমস্যা। এটা পাকিস্তানী শাসকদের নিজেদের কর্ম। বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত নৃশংসতায় সেখানে আজ ঘোলাটে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিমধ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে একটি ফলপ্রসূ সমাধানে পৌঁছানো গেলেই শুধুমাত্র পাকিস্তানের সামরিক শাসক এই ঘোলাটে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ লাভ করতে পারে।

তাই পাকিস্তান এটা স্বীকার করতে যত দেরি করবে ততোই বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের কার্যক্রম চলতে থাকবে এবং বাড়তে থাকবে। যখন মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের কোন অঞ্চল মুক্ত করতে সফল হবে এবং পাকিস্তান এটিকে আমাদের আক্রমণ করার জন্য একটি অজুহাত হিসাবে দেখাবে তখন আমিও স্পষ্ট করতে চাই যে আমরা নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য প্রস্তুত আছি।

পাকিস্তানের কোনো অংশ বাজেয়াপ্ত করার কোন ইচ্ছা আমাদের নেই। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তাঁর লোকদের এবং বিশ্ববাসীকে ভুল পথে চালিত করার চেষ্টা করছেন। অথবা এধরনের অন্যায্য ভিত্তিহীন বক্তব্য দিয়ে ভারতের বিপক্ষে একটি আগ্রাসনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
শ্রী এন জি গোরে: স্যার, আমি এই প্রশ্ন উত্থাপন করেছিকারণ আমার মনে হয় আমাদের পুরো কৌশল সম্পর্কে আবার চিন্তা করতে হবে। প্রথমেই আমি উল্লেখ করতে চাই যে জেনারেল ইয়াহিয়া খান তার বক্তব্যের কোন অযাচিত শব্দ ব্যাবহার করেন নাই কারণ তিনি সাক্ষাতকার দিয়েছেন জনাব নেভিল ম্যাক্সওয়েলের কাছে যিনি এই সংবাদের লেখক এবং যাকে আমরা খুব ভালোভাবে জানি। তিনি(ইয়াহিয়া) বলেন, যদি ভারত পূর্ব বাংলায় তার হস্তক্ষেপ জোরদার করার চেষ্টা করে, তাহলে তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করবেন এবং বিশ্ববাসীকে সে বিষয়টা নজরে রাখতে বলেন। আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জানতে চাই, তিনি এই হুমকি প্রভাব বুঝতে চেষ্টা করেছেন কিনা। মাত্র কয়েক দিন আগে আমাদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী দেশবাসীকে আশ্বস্ত করে জানিয়েছেন যে ভারতের প্রস্তুতি খুব ভাল কিন্তু এই আশ্বাস জেনারেল ইয়াহিয়া খানের উপর কোন প্রভাব বা ছাপ ফেলেছে বলে আমার মনে হচ্ছেনা। তিনি যথেষ্ট সাহসীভাবে বলেছেন। “আমি একটি সাধারণ যুদ্ধ ঘোষণা করব’ এবং তিনি আরও জানান ” আমি একা নই “।

অর্থাৎ তিনি সত্যিই শুধু আমাদের উপর নয় বরং সমগ্র বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষন করেই বলেছেন যে ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। সুতরাং গোটা ব্যাপারটা নিতান্তই পরিহাসের বিষয় যে বাংলাদেশের জনগণের সমস্যা এখন আমাদের জন্যও একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং আমাদের পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। আমি জানতে চাই সরকার কতদিন এভাবে বসে থাকবে যেখানে তারা প্রতিনিয়ত আমাদের মাথা হেঁট করার প্রয়াসে লিপ্ত। আমরা সব শরণার্থীদের গ্রহণ করছি। এবং উদ্বাস্তুদের সংখ্যা সম্পর্কে গতকালই শরণার্থীদের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী বলেছিলেন যে জানিনা কখন এই অন্তঃপ্রবাহ থামবে। শুধু তাই নয়, তিনি বলেন, এই সংখ্যা ইতিমধ্যে ৭০ লাখে পৌঁছেছে। তিনি বলেন, আশা করা যায় বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ হওয়ার সম্ভাবনা আছে যার ফলে আরও লাখ লাখ লোক আসবে। কাজেই পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে ভারতকে সবসময় এদেরকে গ্রহণ করেই যেতে হবে। তার উপর আবার ইয়াহিয়া খান যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছেন এবং তিনি এও বলছেন যে, তিনি একা নন। কিন্তু আমাদের প্রতিক্রিয়া কী? প্রতিক্রিয়ায় এটাই পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে যা লোকসভায় বলা হয়েছে – অর্থাৎ যদি আমরা আক্রান্ত হই তাহলে আমরা নিজেদেরকে রক্ষা করব। এটা কি যথেষ্ট হল? আমরা কি ইতিমধ্যে আক্রান্ত নই? ৭০ লক্ষ উদ্বাস্তুদের প্রবেশ রীতিমত একটা সিভিল অনুপ্রেবেশ। এখন যদি এই অনুপ্রবেশ চলতেই থাকে তাহলে এক সময় এই দেশের গোটা অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাবে। সাম্প্রদায়িক বিবাদ চলবে। আর এসব হলে বিশ্বের কাছে আমরা হব লাঞ্ছিত। যখন এত কিছু ঘটছে তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লোকসভায় যে উত্তর দিয়েছিলেন আজও তাই বলছেন যে যদি আমরা আক্রান্ত হই তবে আমরা নিজেদেরকে রক্ষা করব। কখন আপনি আত্মরক্ষামূলক অবস্থান ছেড়ে দেবেন? কখন আপনি খোলাখুলিভাবে বিশ্বকে এবং দ্ব্যর্থহীনভাবে বলবেন যে ভারত তার ধৈর্য্যের সীমায় পৌঁছেছে, আমরা এখন আর কোন কিছু সহ্য করতে পারব না, আমরা আর কোনও নাগরিক অনুপ্রবেশ অথবা অন্য কোন আক্রমণ সহ্য করব না এবং আমরা পূর্ববাংলার লোকদের আমাদের দেশ থেকে সরিয়ে তাদের দেশে পুনর্বাসন করতে চেষ্টা করব এবং যদি এটার মানে যুদ্ধ হয় তবে আমরা তার জন্য প্রস্তুত আছি। এসব না বলে তিনি বলছেন যে, আমরা নিজেদের রক্ষা করে যাব। এবং ইয়াহিয়া খান বলে যে, সে যুদ্ধ ঘোষণা করবে। আমি জানতে চাই ভারত কোন অবস্থান নেবে।

শ্রী গোধে মূরাহারি (উত্তরপ্রদেশ): কী ঘটছে তার নোট নিতে হবে।
সরদার শরণ সিং: আমি আশা করি তিনি আমার কাছে তার প্রশ্নের উত্তর আশা করেন না। যতদূর আমাদের অবস্থান সম্পর্কে অবগত আছেন – আমি বিবৃতিতে খুব পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছি – এবং আমি সন্মানিত সদস্যের কাছে অনুরধ করব শুধুমাত্র বাকপটুতা দিয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল করার চেষ্টা করবেন না।

শ্রী চিত্তরঞ্জন বসু: (পশ্চিম বঙ্গ): মন্ত্রীর কাছ থেকে তাহলে কোন উত্তর পেলাম না।

শ্রী চিত্তরঞ্জন বসু: আমি কি সন্মানিত মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে জিজ্ঞেস করতে পারি যে বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতির প্রশ্নটি অনেক বড় এবং জরুরী বিবেচনা করেন কিনা?
সরদার শরণ সিং: আপনি রোজই এটা জিজ্ঞেস করছেন কেন?

শ্রী চিত্ত বসু: তিনি বলেন যে প্রতিদিন আমি এই প্রশ্ন করি। আমি রোজ তা বলি তার কারণ হল যদি ভারত সরকার সত্যিই এই দেশের জনগণের কাছে এবং বাংলাদেশের মানুষের কাছে অঙ্গীকার বদ্ধ থাকে তাহলে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। তারা বলে আসছে যে, তারা সময় মত স্বীকৃতির প্রশ্ন বিবেচনা করবে। তারা সেটাকে অগ্রাহ্য করছেন না। আমি যদি ভুল না বলে থাকি তবে আমার মনে হয় এক বা দুই দিন আগেই তারা বলেছিলেন আমরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার বিপক্ষে নই। কিন্তু আমার প্রশ্ন সেটা ছিলোনা। আমার প্রশ্ন ছিল তারা আগামীকাল নয় আজ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবেন কিনা? কারণ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এটা তাদের কাছে তুলনামূলকভাবে বড় ও গুরুত্তপূর্ন জরুরী বিষয় বলে মনে হয় কিনা।

আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন হল এই। আমি এই মুহুর্তে এরকম একটা চুক্তিতে আছি যে আমাদের সরকার পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ চায়না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমরা বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের যারা নিজেদের দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে তাদের উপাদানগত ভাবেও সাহায্য করতে পারব না। ইয়াহিয়ার হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কি মুক্তিযোদ্ধাদের চাওয়া বস্তুগত সাহায্য দিতেও শৈথিল্য দেখাবে? এই মুহুর্তে এটা বিশ্ববাসীর কাছে ও বাংলাদেশের মানুষের কাছে স্পষ্ট করা উচিত যে ভারত সরকার তাদের সব বস্তুগত সাহায্য দিতে এবং বাংলাদেশে তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সম্ভাব্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে বদ্ধপরিকর।

আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন হল এই। পাকিস্তান এখন হুমকি দিয়েছে যে তারা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে। এটা কি সত্য নয় যে তারা ইতিমধ্যে ভারতীয় নাগরিকদের সম্পত্তির ক্ষতি ঘটাচ্ছে? তারা কি অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করেনি? আমি কি সরকারের কাছে জানতে পারি যে পাকিস্তান যে অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করেছে তার বিরুদ্ধে আমাদের সরকারের প্রতিক্রিয়া কি?

তার উপর আবার জনাব ইয়াহিয়া খান বলেছেন যে তিনি একা নন। এটা দিয়ে তিনি কী বুঝিয়েছিলেন? আমাদের সরকার কি পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলন দমন করার ব্যাপারে পাকিস্তানকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে আমেরিকা এবং চীনের মধ্যে কোন সংযোগ দেখতে পাচ্ছেন না? যদি তা দেখে থাকেন তাহলে আমি কি জানতে পারি যে আমাদের সরকার এই তিনটি বড় শক্তি যেভাবে একতাবদ্ধ হয়েছে তার বিপরীতে এটাকে প্রতিহত করার জন্য আন্তর্জাতিক বিশ্বের মতামত ভারতের অবস্থানের পক্ষে আনার ব্যাপারে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন?

সরদার শরণ সিং: স্যার, তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন যে আমরা আজ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি করার জন্য প্রস্তুত আছি কিনা। আমি দুঃখিত, আমার উত্তরটি ‘না’ বোধক।

শ্রী চিত্ত বসু: আগামীকাল?

সরদার শরণ সিং: আগামীকালও তাই। তাই এই প্রশ্ন আবার এবং আবার জিজ্ঞাসা করবেন না। দ্বিতীয় যে প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করা হয়েছে –

শ্রী রাজনারায়ণ: আগামীকাল যদি না হয়, তাহলে আগামী পরশু।

সরদার শরণ সিং: দ্বিতীয় যে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়েছে তার উত্তরে বলছি এই সংসদ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যথেষ্ট সমর্থন ও সহানুভূতি দেখানোর জন প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করেছে এবং আমরা সেই রেজোলিউশন বাস্তবায়ন করার জন্য সবকিছু করে যাচ্ছি।

তৃতীয় পয়েন্ট; তিনি যা উল্লেখ করেছেন যে পাকিস্তানি সামরিক শাসক ইতিমধ্যে ভারতীয় এলাকায় মানুষকে ঠেলে প্রবেশ করিয়ে একরকম বেসামরিক আগ্রাসন চালাচ্ছে যারা মূলত একটি বড় অংকের শরণার্থী হিসেবে বিবেচ্য হচ্ছে। উদ্বাস্তুদের ব্যাপারে আমি সন্দেহাতীতভাবে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছি।

এই শরণার্থীরা অস্থায়ী ভিত্তিতে আমাদের এখানে আছে। তাদের বাংলাদেশে ফিরে যেতে হবে এবং এই কারণেই আমরা অবিচলিতভাবে এই নীতি অবলম্বন করছি যে বাংলাদেশে তাদের ফিরে যাবার অনুকূল অবস্থা তৈরি করা উচিত যাতে তারা ফিরে যাবার ব্যাপারে নিরাপদ বোধ করে। আর এটি শুধুমাত্র সম্ভব যখন বাংলাদেশের ইতিমধ্যে অনুষ্ঠিত নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে। এই নীতিটি আমরা অবলম্বন করেছি এবং এই অনুযায়ী আমরা অগ্রসর হব। এটা সত্য যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তার বিবৃতিতে বলেছেন, যে তারা একা নন। এবং সন্মানিত সদস্য আমার মুখ দিয়ে এটা বলাতে চান যে তাদের সাথে আর যারা আছে তারা কারা। এই ব্যাপারটি আমরা এই পদ্ধতিতে আলোচনা করতে পারিনা। কোনো সন্দেহ নেই যে নির্দিষ্ট কিছু দেশ একদম খোলাখুলি বিবৃতি দিয়েছে যে তারা পাকিস্তানের সাথে আছে। পাকিস্তানও নির্দিষ্ট একটি জোটের সদস্য। কিন্তু এটা এখানে বলে আমাদের কোন উদ্যেশ্য হাসিল হবেনা। আপনি মূল্যায়ন করতে পারেন কিন্তু জনসম্মুখে কে কে পাকিস্তানের সাথে আছে এটা বলে আসলে কোন লাভ নেই।

জনাব. চেয়ারম্যান: জনাব কুলকার্নি

শ্রী চিত্ত বসু: এই হুমকির বিরুদ্ধে এবং পাশাপাশি আমাদের অবস্থানের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনের ব্যাপারে সরকার কি কি পদক্ষেপ নিয়েছে?

চেয়ারম্যান: দয়া করে বসুন জনাব
সরদার শরণ সিং: আমরা ইতোমধ্যে দিল্লিতে বিদেশি সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে, জাতিসংঘ তাদের প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ করার সকল চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। পাশাপাশি আমরা বিভিন্ন দেশের রাজধানীতে গিয়ে প্রতিনিধিদের সাথে কথা বলছি।
জনাব. চেয়ারম্যান: জনাব কুলকার্নি

শ্রী এ জি কুলকার্নি (মহারাষ্ট্র.): স্যার, আমি কি সরকারকে জিজ্ঞেস করতে পারি যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গুলোকে নিজেদের পক্ষে আনতে তারা কতটুকু আশাবাদী?
(জনাব ডেপুটি চেয়ারম্যান অবস্থান নিলেন)

শ্রী এ জি কুল্কার্নি: স্যার, বাংলাদেশ ইস্যু সমাধানে সহায়তার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে সরকারের কার্যক্রম প্রায় নিঃস্পৃহ হয়ে গেছে। শুনতে ভালোই লাগে যখন আমি দেখি সরকার মিলিটারি একশনে যাবে কিনা এই প্রশ্নের সোজাসুজি উত্তর দিতে পারেনা। প্রশংসার দাবিদার তিনি। কিন্তু স্যার, এটা বললে কি বাড়াবাড়ি হবে যে এটা সমস্ত ভারতীয় জনগণের মনের কথা? আমি জানতে চাই কিনা সরকার সচেতন চাই এই সব শত্রুতার মূলে আছে আমেরিকা – তারা কি সেটার ব্যাপারে সচেতন আছেন? আমি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষন করে বলতে চাই আমেরিকার আচরণের ব্যাপারে যাদের কারণে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, যিনি ১৯৬৫ সালে পরাজিত হয়েছিলেন তিনি ননসেন্সর মত আবারো ভারত আক্রমণের মত কথা বলার সাহস পান। সরকারের অবশ্যই উচিৎ সাহসের সাথে তার প্রতিক্রিয়া দেখানো এবং যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের রাষ্ট্রদূতকে যেন সেটা স্মরণ করিয়ে দিতে বলা হয়। এতে আমাদের শক্তির বাহুল্যতা প্রকাশিত হচ্ছেনা। দ্বিতীয়ত, আমি জানতে চাই সরকার এটা লক্ষ্য করেছেন কিনা যে আমেরিকার মত ইংল্যান্ড আর রাশিয়াও কিন্তু ইয়াহিয়া খানের নৃশংসতা থামাতে কোন কিছু করেনি। রাশিয়ার কাছে যে পরিমাণ প্রত্যাশা ছিল সেই অনুযায়ী তারা এগিয়ে আসেনি। অতএব স্যার, সরকারকে পুরো বাংলাদেশের সমস্যা পর্যালোচনা করে দেখতে হবে এবং সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সরকারের উচিৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের রাষ্ট্রদূতকে রিকল করা। এতে করে আমেরিকান জনগণের মনে কিছু প্রভাব পড়বে এবং কিছু ফলপ্রসূ সংলাপ শুরু হবে।

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: আমি মনে করি ইতিমধ্যে তিনি আমাদের রাষ্ট্রদূতকে রিকল সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। কাজেই একই প্রশ্ন পুনরাবৃত্তি করার দরকার নাই। মন্ত্রী ইতিমধ্যে জবাব দিয়েছেন।

শ্রী এ জি কুল্কার্নি: আমি এটা একটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটে উত্থাপন করেছিলাম।
জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: যাই হোক এটা তিনি জবাব দিয়েছেন যে রাষ্ট্রদূতকে রিকল করা হবে না।

শ্রী এ জি কুলকার্নি: প্রশ্নটা রাষ্ট্রদূত বরখাস্ত সংক্রান্ত ছিল। আমি রাষ্ট্রদূতকে সাময়িকভাবে রিকল করার জন্য বলেছি।

সরদার শরণ সিং: স্যার, আমি মনে করি না আমাদের রাষ্ট্রদূতকে রিকল করাটা কোন ভালো কাজ হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে এই পরামর্শে কাজ করলেও সাধারণত তেমন ফল হয় না এবং অভিজ্ঞতা বলে যে এতে তেমন সাহায্য হবেনা। আমরা এমনকি পাকিস্তান থেকে আমাদের এ্যাম্বাসেডর আমাদের হাই কমিশনারকে রিকল করিনি এবং পিকিং এও একটি মিশন রাখা আছে। অতএব, এটি আমাদের জিনয় সঠিক হবে না এবং আমরা একটি নির্দিস্ট সরকারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রদূত কে রিকল করার পলিসির সাথে একমত না। একটি খুব বাস্তবসম্মত পরামর্শ নয়। সেটাই তিনি দাবী করেছেন।

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: জনাব লোকনাথ মিশ্র।

শ্রী বিজু পাটনায়েক (উড়িষ্যা):মন্ত্রী মহোদয় কি আশ্বস্ত করার মত অবস্থায় আছেন?

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: আমি জনাব লোকনাথ মিশ্রকে ডেকেছি।

শ্রী বিজু পাটনায়েক: আমি শুধু একটি বিষয় পরিষ্কার করে জানতে চাচ্ছিলাম।

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: আমি আমাকে আমার সামনের তালিকা অনুসরণ করতে হবে।

শ্রী বিজু পাটনায়েক: আমি বক্তৃতা করছি না। আমি শুধু একটি বিষয় পরিষ্কার করে জানতে চাচ্ছিলাম।

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: আমি মনে করি জনাব মিশ্র শুধু একটি ক্লারিফিকেশন চাচ্ছেন।

শ্রী বিজু পাটনায়েক: আমি শুধুমাত্র মন্ত্রীর কাছ থেকে জানতে চাই।

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: না, না, দয়া করে বসুন।

শ্রী এ ডি মনি (মধ্য প্রদেশ): স্যার, সে হাউজে খুব কমই আসে। আপনি কি তাকে দয়া করে অনুমতি দিন।

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: আসলে সবার আগে আমাকে তালিকা অনুসরণ করতে হবে।

শ্রী ভি আনান্দান (তামিলনাড়ু): তিনি কোন প্রশ্ন করতে চাচ্ছেন না। তিনি শুধুমাত্র একটি ক্ল্যারিফিকেশন চাচ্ছেন এবং আপনি তাকে অনুমতি দিতে পারেন।

শ্রী বিজু পাটনায়েক: আমি মন্ত্রীর কাছে জানতে যদি তিনি দয়া করে ক্ল্যারিফাই করেন।

শ্রী এ পি চ্যাটার্জি (পশ্চিম বাঙ্গাল): পয়েন্ট অব অর্ডার। আমি আশা করি আমার বন্ধু এটাকে অন্যভাবে নেবেন না। রীতি হচ্ছে আপনি আগে লিস্ট কল করবেন এবং এক সময় হতাশ হতে হবে। যদি অন্য কেউ ক্ল্যারিফিকেশন চান তাহলে চাইতে পারেন। আমি মনে করি সম্মানিত সদস্য ব্যাখ্যা চাইতে পারেন। অবশ্যই তিনি ব্যাখ্যা চাইবার জন্য এনটাইটেলড।

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: ঠিক আছে, জনাব পাটনায়েক, দয়া করে বসুন। এখন বলবেন মিস্টার মিশ্র।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র (উড়িষ্যা); চৌ এন লাই – এর মত আগ্রাসককে ফেভার করে অ্যামেরিকা বিশ্বের গণতন্ত্রের সাথে প্রতারণা করেছেন। সে ইয়াহিয়া খানকে সমর্থন দিয়েছে, যা পাকিস্তানকে ভারতের সাথে যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সাহসী করেছে। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খুব আত্মসন্তুষ্টিতে আছেন – তিনি বলেছেন যুদ্ধ হলে আমরা সেই চ্যালেঞ্জ নেব এবং আক্রমণ থেকে নিজেদের প্রতিরোধ করব। আমি জানিনা যে লোকটি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পাশে বসেন তিনি কখনো তার সাথে একমত হন কিনা – এমনকি তা যদি পার্লামেন্টের বাইরেও হয়। তিনি সব সময় এভাবে কথা বলেন যে আমরা সব কিছুর জন্য প্রস্তুত আছি। আমরাও জনাব কৃষ্ণা মেননের কাছ থেকে ১৯৬২ এর আগে থেকে এরকমটাই শুনে আসছি। যেহেতু সভাপতির প্রশ্রয়ে মন্ত্রী মহোদয় জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে আমাদের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির বিবরণ জানাতে বাধ্য নন, তাই এসবই সংসদের সদস্যদের থেকে গোপন রাখা হয়েছে এবং কেউই সতিকার অর্থে জানে না যে প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি নামক প্যান্ডোরার বাক্সে আসলে কি আছে।

শ্রী পি সি মিত্র (বিহার): আপনি জানেন যে, ভারতর কোন প্রতিরক্ষা ক্ষমতা নাই।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: শ্রী মিত্রের অতিরিক্ত ঝকঝকে ভাব তাকে কোথাও পৌঁছে দেবেনা – না এখানে না পাকিস্তানে।

আমি নিজেই আমার প্রশ্নের জবাব চালিয়ে যেতে চাই। পাকিস্তান ইতিমধ্যে আমাদের একটি সতর্কবার্তা দিয়েছে। চিনের ক্ষেত্রেও তাই। এতসব হুমকির বিপরীতে আমরা অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাব। ভারত একটি চীনা ক্লাস রুমের ছাত্র নয় যে চীনা সরকার ভারতকে সতর্কবাণী দেবে। আমরা সেইসব হুমকি প্রত্যাখ্যান করব এবং সেগুলো বর্জ্য কাগজের মত ঝুড়ির মধ্যে নিক্ষেপ করব। এর বাইরে ইয়াহিয়া খান হুমকি দেয়ার সাহস পাচ্ছে – এমনভাবে মনে হচ্ছে যেন তিনিই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক।

শ্রী এ পি জেইন (উত্তরপ্রদেশ): এটা একেবারেই হাইপোথিটিকাল।

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: আপনি ব্যাঘাতের উত্তর দেবেন না। আপনি আপনার প্রশ্ন করুন।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: আমি শ্রী অজিত প্রসাদ জৈনের মন্তব্যে আপত্তি জানাচ্ছি। তার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল এবং এখনও তিনি দায়িত্বজ্ঞানহীন। অতএব, আমি আপত্তি জানাচ্ছি। তার মত অবস্থা সম্পন্ন মানুষের এরকম বিষয়ে আরও সহনশীল হওয়া উচিত। মিনিস্টারশিপের জন্য তার এরকমভাবে সিরিয়াস না হলেও চলে।

শ্রী এ পি জেইন: আমি আগেই বলেছি এটা হাইপোথিটিকাল।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: আমি সরদার শরণ সিং থেকে উত্তর আশা করি – শ্রী অজিত প্রসাদ জেইন এর থেকে না। কারণ তিনি মন্ত্রী হয়েছেন। তিনি আর হিসাবে নেন না।

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: আপনি আপনার প্রশ্ন করুন।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: শ্রী অজিত প্রসাদ জেইন, যতদূর ভারত সরকার অবগত আছে, তা অপর্যাপ্ত, তাতে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর জন্য সেটা যতই আনুগত্য প্রকাশ করুক না কেন।

সরদার শরণ সিং: এই ব্যাপারে আপনি ভুল করছেন।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র – তিনি কংগ্রেস পার্টির মধ্যে কেউ হবেন হয়ত।

সরদার শরণ সিং: তার অবস্থান অনেক ভালো – যতটা আপনাকে আপনার পার্টিতে গন্য করা হয়তার চাইতেও বেশী।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: কিন্তু এখন পর্যন্ত এই হাউস যতোটা অবগত তাতে মনে হয় আমি শ্রী অজিত প্রসাদ জেইন এর কোন নোটিশ গ্রহণ করিনি। .

শ্রী লোকনাথ মিশ্র; সঠিকভাবেই দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের জনগণ গেরিলা যুদ্ধ করছে এবং ধরা যাক যদি কোন অঞ্চল তারা দখল করে নেয় তখন ইয়াহিয়া খান বলবেন যে এটা হয়েছে ভারতের ইন্ধনে এবং এর পরে তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করবেন ভারতের বিরুদ্ধে। সেই সময় সরদার শরণ শিং আসলে কি বক্তব্য দেবেন? সম্ভবত এটাও শ্রী অজিত প্রসাদ সিং এর উর্বর মস্তিষ্কের হাইপোথিটিকাল প্রশ্ন।

শ্রী এ পি জেইন: ইয়স বলেছেন আপনি আমার নোটিশ নেবেন না। তাহলে আমি যা বলি তা শুনছেন কেন? ধন্যবাদ, আমাকে তার মাথায় রাখার জন্য।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র; এই ধরনের পরিস্থিতিতে ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়া কি হবে? পররাষ্ট্রমন্ত্রী সবসময় বড় বড় বিবৃতি দেন যে আমাদের পাশে আরো কিছু দেশ আছে। তিনি কি এরকম কারো নাম বলতে পারবেন? আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ হব যদি তিনি এমন কোন নাম বলতে পারেন।

সরদার শরণ সিং: প্রথম প্রশ্নের বিষয়ে আমি আমার বক্তব্যের ৩ নং প্যারা দেখতে বলছি। দ্বিতীয় প্রশ্ন এই বাইরে আসে না।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: আমাদের কাছে তার বক্তব্যের কপি নাই। আমি এই ব্যাপারে আপত্তি জানাচ্ছি।
জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: আপনি বিবৃতি শুনেছেন।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: আমি কিভাবে তৃতীয় অনুচ্ছেদ জানব? বিবৃতি তিনি পেশ করেছেন এবং তার নিজেরই টাইপ করা।

সরদার শরণ সিং : আমি এটা পড়ব।
“মুক্তিযোদ্ধারা যখন বাংলাদেশের কোন অঞ্চল সফলভাবে মুক্ত করছিল এবং পাকিস্তান সেটিকে আমাদের আক্রমণ করার জন্য একটি অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করছিল তখন আমি স্পষ্টভাবে বলেছি আমরা নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য প্রস্তুত আছি। ’

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: সেটা কি সব প্রশ্নের উত্তর দেবে?

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশটা কি? আপনি কি এমন কোন দেশের নাম বলতে পারেন যারা ভারতের সাথে আছে?

সরদার শরণ সিং: এর থেকে সেটা আসেনা।

সরদার লোকনাথ মিশ্র: ধরুন যুদ্ধ পরিস্থিতি আরম্ভ হল। পয়েন্ট অব অর্ডারে উপর বলছি।
সরদার শরণ সিং: এভাবে চলতে পারেন। আমি দুঃখিত এসবের জন্য। আমি এইসব আলোচনার মধ্যে প্রবেশ করতে চাচ্ছিনা।

স্যার, এটা অবাক ব্যাপার যে এত হাল্কা ভাবে আলোচনা হচ্ছে। এটা আমাদের জনস্বার্থে নয় ………
(বাধা)

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: স্যার, এই ভদ্রলোক বলার কে?
(বাধা)

সরদার শরণ সিং: এসব জিনিস জনসম্মুখে প্রকাশ করার জন্য নয় এবং আমি এসব প্রকাশ করব না।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: স্যার, উনি এটা বলার কে? স্যার, সে তার সীমা অতিক্রম করে ফেলছে।

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যানঃ তিনি বলছেন যে, এটা আমাদের জাতীয় স্বার্থের বিরোধী হবে যদি
ঐ সমস্ত বিষয় যা আপনি জিজ্ঞাসা করেছেন টা জনসম্মুখে প্রচারিত হয়।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: তাহলে সেগুলো যদি না জানানো হয় তাও কি জনস্বার্থে হবে?

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: তিনি তো সেটাই বলছেন।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: স্যার, আপনি কি এ বিষয়ে একমত? যদি তাই হয়, তাহলে আমরা এখানে কেন এসেছি?
(বাধা)

শ্রী পিতম্বর দাস (উত্তরপ্রদেশ): স্যার, অন্তত একটি বিষয় খুব পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে। তিনি সম্ভবত নাম বলতে পারবেন না। কিন্তু আমরা যে একা নই এটা বলার মত অবস্থাও কি আছে? তিনি কি বলবেন সেটা?

সরদার শরণ সিং: আমি ইতিমধ্যে একথা বলেছি।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: কতগুলো দেশ আমাদের দিকে আছে বলে তিনি মনে করেন?

জনাব ডেপুটি চেয়ারম্যান: তিনি বলেছেন যে ভারত একা নয়। এটাই তিনি বলেছেন।
(বাধা)

ডঃ. ভাই মহাবীর(দিল্লি) মন্ত্রী একা নন। তার পাশে অন্যান্য অনেক মন্ত্রী আছে।

সরদার শরণ সিং: হ্যাঁ, আমি একা নই। ডঃ ভাই মহাবীর আমার সঙ্গে আছেন।

জনাব ডেপুটি চেয়ারম্যান: হ্যাঁ, জনাব ভাণ্ডারী

সরদার শরণ সিং: প্রকৃতপক্ষে তিনি আমাকে কোনো প্রশ্ন না জিজ্ঞাসা করেই কল্পনাপ্রসূত ধারণা থেকে আমার সাথে তর্ক জুড়ে দিয়েছেন। যখন আপনার নিজের নিরাপত্তা হুমকির মুখে সি মুহুর্তে আপনি নিশ্চই আপনার পরিকল্পনা সবার সামনে বলে দিতে পারেন না। শুধুমাত্র বিশেষজ্ঞদের সাথে নিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কি করতে যাব।

শ্রী সুন্দর সিং ভান্ডারি- অন্তত পাকিস্তান তাদের ইন্ডিকেট করছে।

শ্রী এ পি চ্যাটার্জি: আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বিবৃতি শুনেছি। বিবৃতিতে যদি বোঝানো হয় যে প্ররোচনা সত্ত্বেও আমরা বাংলাদেশে সেনা পাঠাব না, আমাদের দেশ বাংলাদেশে সেনা পাঠানোর ব্যাপারে প্ররোচিত হবেনা তাহলে আমাদের দল প্রস্তাব এর সঙ্গে একমত। আমাদের পার্টির প্রস্তাব হচ্ছে ভারত সরকারের বাংলাদেশে কোনো সেনা পাঠানো উচিত হবে না। কিন্তু আমি সন্মানিত মন্ত্রীকে একটি প্রশ্ন করতে চাই। বাংলাদেশে গেরিলারা যে যুদ্ধ চালাচ্ছে তাতে আমাদের সরকার বলেছিল তাদেরকে সর্বভাবে সহায়তা প্রদান করা হবে – তাহলে কি ধরে নেব যে সরকার এটিকে আর চালু রাখবেন না?
আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন হল: যদি সরকার এই অবস্থান নেয় তাহলে গেরিলারা বাংলাদেশের ভিতরে গিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে যেসব সরঞ্জাম আটক করে আমাদের সীমান্তের কাছে নিয়ে আসছে তার কি নিশ্চয়তা আছে যে সেই সব অস্ত্র কমিউনিস্টদের হাতে পরবেনা? এটা কি সত্য নয়?

আমার তৃতীয় প্রশ্ন হল: এটা সত্য যে গেরিলা বাংলাদেশে যাচ্ছে, পাকিস্তানীদের সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে ফেরত আসছে যা এই সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে এবং যখন তারা আবার সেখানে যাবে এই সরকার তাদের হাতে কি শুধুমাত্র ২০৩ বুলেট ও সাধারণ অস্ত্র দিচ্ছেন? তারা কি বাজেয়াপ্ত অস্ত্র দিচ্ছেন না?

শ্রী আকবর আলি খান (অন্ধ্র প্রদেশ): আমি কি সন্মানিত সদস্যের নিকট প্রশ্নগুলো পুনর্বিবেচনা করার ব্যাপারে আপীল করিতে পারি?

শ্রী এ পি চ্যাটার্জি: আমি কি জিজ্ঞাসা করতে পারি যে এভাবেই কি সরকার গেরিলাদের বাংলাদেশের যুদ্ধে সমর্থন করছে? আমার শেষ প্রশ্ন হল সন্মানিত মন্ত্রী বলেছেন গেরিলারা যদি …

শ্রী এ জি কুলকার্নি: এই প্রশ্নের কী দরকার?

শ্রী এ পি চ্যাটার্জি: আমি প্রশ্ন করার জন্যই এনটাইটেলড। আমার শেষ প্রশ্ন গেরিলারা যখন কোন অঞ্চল মুক্ত করবে তখন যদি পাকিস্তান সেই অংশ পুনরুদ্ধার সহ ভারতের মাটিতে আক্রমণ চালায় তখন সরকার কি করবে? এগুলোই আমার প্রশ্ন।

সরদার শরণ সিং: আমি দুঃখিত, তিনি যা যা বলেছেন তার সব সত্য নয়। এগুলো সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে করা হয়নি। তাই এগুলো সঠিক না। তিনি সম্পূর্ন ভুল ধারণা থেকে এই প্রশ্ন করেছেন — (বিঘ্ন) .. আমাকে উত্তর দিতে দিন।

শ্রী এ পি চ্যাটার্জি: এটা ভারত সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ যে ভারত সরকার গেরিলাদের থেকে পাওয়া পাকিস্তানীদের অস্ত্র নিজেরা বাজেয়াপ্ত করছেন। আমি গেরিলাদের একজন সক্রিয় নেতার সাথে কথা বলেছি। আপনার বাংলাদেশের সংগ্রাম সাবোটাজ করছেন।

সরদার শরণ সিং: আমি সাধারণত ভাববাণী করতে অভ্যস্ত নই কিন্তু আমি নিশ্চিত যে মাননীয় সদস্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামেও আমাদের বিরুদ্ধে এরকম কথা বলে বেড়াতে পারেন – এবং আমি এরকম না করার অনুরধ করছি।

শ্রী এ পি চ্যাটার্জি: পয়েন্ট অব অর্ডারে উপর।

শ্রী নিরেন ঘোষ (পশ্চিম বঙ্গ): এটা ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার সময়।

সরদার শরণ সিং: এটা জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার সময়।

শ্রী এ.পি. চ্যাটার্জি: আমি চার্জ করছি: আমি চার্জ করছি যে জনাব শরণ সিং আমেরিকানদের বেতনভুক্ত একজন ব্যক্তি। তাই তিনি বাংলাদেশের বিপক্ষে যুদ্ধ করছেন।
(বাধা)

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: আপনি এই হাউসে দায়িত্বহীন বিবৃতি দিতে পারেন না। দায়িত্বজ্ঞানহীন বিবৃতি দেয়া বড় ভুল।

শ্রী এ জি কুলকার্নি: পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দেয়া যেকোন মন্তব্য এক্সপাঞ্জ করা হবে। সরঞ্জামাদি সহ অন্যান্য ব্যাপারে যা বলা হয়েছে সেটা রাজনৈতিক। সেটা প্রসিডিংসের বাইরে যাবে। এটা আন্তর্জাতিক যা আমাদের ভারত সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে।
(বাধা)

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: অর্ডার প্লিজ।

শ্রী এ জি কুলকারনি: আমি নিজের অবস্থানে আছি। আমাকে শেষ করতে দিন। জনাব চ্যাটার্জীর দৃষ্টিভঙ্গি চীনা এবং নকশালদের মত লাগছে। এগুলো সবই রেকর্ডভুক্ত আছে। এগুলো এক্সপাঞ্জ করা দরকার। জনাব শরণ সিং তাকে সঠিক উত্তর দিয়েছেন। জনাব চ্যাটার্জি যা যা বলেছেন সব রেকর্ডের বাইরে থাকা উচিৎ। রেকর্ড থেকে কেটে দেয়া উচিৎ।
জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: বসুন প্লিজ।

বিরোধী দলের নেতা (শ্রী এম এস গুরুপদস্বামী): আমি বলতে চাই আমাদের সবাই এটা নিয়ে সচেতন কিন্তু তবুও আমরা কত জটিলভাবে বিতর্ক করছি এটা নিয়ে। কেউ দলীয় মনোভাব দেখাচ্ছেনা। সবাই দলের স্বার্থ বাদ দিয়ে জাতীয় স্বার্থ নিয়ে কথা বলতে আগ্রহী। আমি দুঃখিত একথা বলে যে, আজ জনাব চ্যাটার্জি যা কিছু বললেন তা কোন নীতি প্রণয়নে সাহায্য করবে না বা আমাদের মনোভাব পালটাতে সাহায্য করবেনা – এমনকি ইস্যুটিকে নতুন ভাবে ভাবার কোন উপকরণও দেয়না। পাশাপাশি তার প্রশ্ন আমাদের কিছু বিষয় সামনে নিয়ে এসেছে। আমি নিশ্চিত সেগুলো আন্তর্জাতিক নয় কিন্তু আমার অনুরোধ থাকবে, একজন সদস্য হিসেবে, এমন একটি গুরুত্বহীন ইস্যু না তুলতে – যে মুহুর্তে আমরা খুব গুরুত্তপূর্ন একটা জাতীয় ইস্যু নিয়ে আলোচনা করছি – তাতে সরকারের সাথে আমাদের মতৈক্য থাকুক বা না থাকুক। আমাদের এমন সব কথা থেকে এই মুহুর্তে বিরত থাকা উচিৎ যাতে করে এসব কথায় আমরা ও আমাদের দেশবাসী হেয় প্রতিপন্ন না হয় এবং আমরা যাতে আমাদের মূল ইস্যু থেকে বিচ্যুত হয়ে না যাই। তাই বিরোধী দলের একজন সদস্য হিসেবে আমি জনাব চ্যাটার্জিকে অনুরোধ করছি সত্য মিথ্যা যাই হোক না কেন তিনি যা কিছু বলেছেন সেগুলো যেন তিনি আর এই হাউজে উথাপন না করেন।

শ্রী এ জি কুল্কার্নি: এটা কেটে দেয়া উচিত।

শ্রী এম এস গুরুপদস্বামি: আমি কেটে দেওয়ার জন্য বলিনা। আমাদের এই ইস্যুতে বিতর্ক না করলেই হল। আমি বলব যে, তিনি যেন এই প্রশ্ন আর না করেন এবং মন্ত্রীর পক্ষ থেকেও কোন উত্তরের দরকার নেই। যাই হোক না কেন আমাদের মধ্যে পার্থক্য হতে পারে – তবু আমরা কাঠামোর মধ্যে থেকে আমাদের মন্তব্য করব – যা বরাবর অনুসরণ করা হয়েছে – এবং আমি আশা করি এবং ভরসা করি আমার সহকর্মী, শ্রীযুক্ত চ্যাটার্জি, তার অবস্থান বুঝে নিয়ে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবেন এবং এই প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকবেন।

শ্রী নিরেন ঘোষ: স্যার, আমি বলতে পারি …….

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: দয়া করে বসুন।

শ্রী নিরেন ঘোষ: তিনি এই মাত্র যা বলেছেন সে ব্যাপারে আমার কিছু বলা দরকার।

মিস্টার ডেপুটি চেয়ারম্যান: জনাব নিরেন ঘোষ দয়া করে বসুন।

শ্রী নিরেন ঘোষ: তারপর কি? আমি বলার আছে …..

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: আমি দাঁড়িয়ে আছি, দয়া করে বসুন।

জনাব গুরুপদস্বামি যেমনটি বললেন আমরা শুধু একটি জাতীয় নীতি তে পৌঁছানোর চেষ্টা করছি। এবং আমাদের সব সময় চেষ্টা করা উচিৎ এই দৃষ্টিকোণ থেকে – যাতে করে আমাদের কোন প্রশ্ন বা বক্তব্য জাতীয় স্বার্থের বাইরে না হয়। যদি জাতীয়স্বার্থ বিরোধী কিছু হবার সম্ভবনা থাকে তাহলে আমি সন্মানিত সদস্যদের অনুরোধ করব সেগুলো থেকে বিরত থাকতে।

সন্মানিত সদস্য জনাব চ্যাটার্জি সরদার শরণ সিং সম্পর্কে কিছু খুব আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন – যে মুহুর্তে আমরা এই হাউসে আমাদের কর্তব্য পালন করতে এসেছি……..
শ্রী এ পি চ্যাটার্জি: আমি আমার বক্তব্য উঠিয়ে নেব যদি তিনি শুধু একটি শব্দ তুলে নেন – তা হল ‘জাতীয় স্বার্থ বিরোধী’।

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: ……. সন্মানিত সদস্য, হাউসে যথাযথ ভাষা ব্যবহার করা উচিত। আমাদের সবার বিবেচনা করা উচিত যে, আমরা যা কিছু করব তা যেন আমাদের জাতীয় স্বার্থের কোন ক্ষতি না করে।

এখন, শ্রীযুক্ত ভূপেশ গুপ্ত।

শ্রী এ জি কুলকার্নি: রেকর্ডের কি হবে? রেকর্ড সংশোধন করা উচিত।

মিস্টার ডেপুটি চেয়ারম্যান: আমি রেকর্ড দেখব – দেখছি কী করা যায়।

শ্রী নিরেন ঘোষ: স্যার, আমি বলতে চাই, আগে আপনি আমার কথা শুনুন – তার পরে আপনার পর্যবেক্ষণ জানান। জনাব গুরুপদস্বামির কথার পরেই আপনি আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই উঠে দাঁড়ালেন এবং চেয়ার থেকে ……

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: একজন সদস্য কিছু বললেই সবাইকেই বলতে দিতে হবে বিষয়টা এমন নয়।

শ্রী নিরেন ঘোষ: দয়া করে আমাকে শেষ করার সুযোগ দিন যেখান থেকে আপনি শেষ করতে বলেছিলেন। এটা ঠিক যে এই প্রশ্নের একটি সর্বসম্মত উত্তর হওয়া উচিৎ কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আপনি, পাশাপাশি এই হাউস, এবং সমগ্র দেশ জানে যে সরকার তা করছে না। সেটাই সমস্যা – সেটাই পার্থক্য। তারা দেশকে বিভক্ত করতে সফল। স্যার, একটি নামকরা পত্রিকা – স্টেটসম্যান – হেডলাইন করেছে যা জনাব চ্যাটার্জি উল্লেখ করেছেন এবং এখন পর্যন্ত তার কোনো হা-সূচক বা অস্বীকৃতি জানিয়ে কোন জবাব আসেনি।

জনাব ডেপুটি চেয়ারম্যান তিনি ইতিমধ্যে আজ তা অস্বীকার করছেন।
শ্রী নিরেন ঘোষ: আজ থেকে পনের দিন আগে রিপোর্ট করা হয়েছিল এবং এটি একটি রাজনৈতিক কাগজ নয়।

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: সব ঠিক আছে। তিনি এখন তা অস্বীকার করেছেন।

শ্রী নিরেন ঘোষ: আমরা অভিজ্ঞতা বলে যে আমরা বিভেদ সৃষ্টিকারী কর্মকান্ডে জড়িত। ভারত সরকার স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য বিভেদ সৃষ্টিকারী কর্মকান্ডে জড়িত এবং তাতে সংসদ সদস্যদের বলার অধিকার কি নেই? এটা কি পার্লামেন্টের সদস্য হিসাবে বিশ্বাসঘাতকতা নয়? যেহেতু আমরা তা দেশকে জানাচ্ছিনা। এটা সবসময় মনে রাখা উচিত।

সরদার শরণ সিং: আমি কখনোই তা বলিনি। আমি কি বিষয়টা ক্লিয়ার করতে পারি? আমি কখনো বলিনি যে কোন সদস্য জাতীয় স্বার্থ বিরোধী। কিন্তু আমি বলতে চাই, এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা আমাদের জাতীয় স্বার্থের মধ্যে পড়েনা।

শ্রী নিরেন ঘোষ: আপনি শব্দটি ব্যাবহার করেছেন।

সরদার শরণ সিং: যা কিছু আমাদের জাতীয় স্বার্থ বিরোধী হবে তাই এন্টিন্যাশনাল।

শ্রী নিরেন ঘোষ: রেকর্ড দেখুন।

সরদার শরণ: আমি এন্টি ন্যাশনাল কিছু বলিনি – বরং তিনি বলেছেন

শ্রী ভূপেশ (পশ্চিম বঙ্গ): ইয়াহিয়া খান – আমি তাকে আজকাল প্রেসিডেন্ট বলিনা – যেই মুহুর্তে পিকিং ও ওয়াশিংটন থেকে ঘোষণা এল যে মিস্টার নিক্সন চিন সফর করবেন ঠিক সেই মুহুর্তে ঘোষণাটি দিলেন। অর্থাৎ নিক্সন সাহেবের চিন সফর আর ইয়াহিয়ার ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার মধ্যে একটি যোগসূত্র আছে। ইয়াহিয়া খান যখন নিক্সনের সফরের প্রাক্বালে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা দিলেন সেই সময়ে আমরা ভেবেছিলাম ওয়াশিংটন পিকিং সম্পর্কের উন্নতিতে হয়ত আন্তর্জাতিক চাপ কিছুটা হলেও কমবে। আমরা খুশি যে অন্তত ভিয়েতনামে পিপলস পার্টি নেতৃত্বে আছে। “ম্যান ড্যান” এর সম্পাদকীয়তে যা বলা হয়েছিল তেমন একটি খবর গতকাল এখানকার পত্রিকায় এসেছে যেখানে বলা হয়েছে বড় শক্তিগুলো এক হচ্ছে ছোট ছোট কিছু জাতির ভাগ্যের বিনিময়ে। স্যার, তারপরেও ভিয়েতনাম নীতি থেকে সরে গিয়ে নিক্সন পলিসি এখন চিনের দিকে মন দিচ্ছে সেটাকে আমরা স্বাগত জানাই। এতে বোঝা যায় ভারতের কার্যকর বন্ধু হল —

ডঃ. ভাই বহাবীর: েসবে মধ্যে কি মনোযোগ আকর্শনের মত কিছু আছে?

শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: দয়া করে আমাকে বিরক্ত করবেন না।

জনাব ডেপুটি চেয়ারম্যান: দয়া করে তাকে বিরক্ত করবেন না।

ডঃ. ভাই মহাবীর: আপনি দৃষ্টি আকর্ষণ করার মত কিছু বলছেন না – কিন্তু …..
শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: আমি বলছি তার প্রমাণ আপনি কথা বলছেন। কীভাবে কথা বলতে হবে তা আমাকে শেখাতে হবেনা। আপনি যখন অনেক কিছু বলেন আমি কথা বলিনা। যখনি আমি বলা শুরু করি আমার বন্ধু উঠে দাঁড়ায়।
(বাধা)

ডঃ. ভাই মহাবীর : এমনকি আপনি ইউএসএসআর এর কথাও নিয়ে আসছেন।

শিরি ভূপেশ গুপ্ত- এটা আপত্তিকর। তারা কোন বন্ধু চায় না। তারা আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চায়। এটাই আমি বলতে চেয়েছি। যদি আপনি সত্যি তা অনুধাবন করতে চান তাহলে নিক্সনের চিন সফরের দিকে চোখ রাখুন।

শ্রী মহাবীর ত্যাগী (উত্তরপ্রদেশ): ইয়াহিয়া খানের সুরে কথা বলবেন না.।

শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: আমি মনে করি আপনি চেঙ্গিস খানের সুরে কথা বলেন। জনাব নিক্সন সফর করতে যাচ্ছেন। আমি একটি জিনিস বুঝতে পারছি না। কেন সরদার শরণ সিং বলে যে, তিনি চীনা কূটনীতিকে স্বাগত জানান? এর মূল রহস্যটা কি? তিনি এটাকে স্বাগত জানান কিন্তু আমরা এর ভিতরের ব্যাপারটা জানতে চাই। আমি এর ভেতরে ম্যাকিয়াভেলিজম ছাড়া আর কিছু দেখিনা। এটা বিশ্ব শান্তির জন্য ক্ষতিকর। এতে আন্তর্জাতিক চাপ কমবে না – বিশেষ করে আমাদের স্বার্থের জন্য তা চরম ক্ষতিকারক।

স্বাভাবিকভাবেই, স্যার, স্বাগত জানানোর কিছু নেই। আমি বিশ্বাস করি কিছু স্মার্ট আইসিএস অফিসার সচিবালয়ে বসে এই শব্দগুচ্ছ উদ্ভাবন করেছে – “কূটনীতির স্টাইলকে স্বাগত জানানো উচিৎ” এটায় আইসিএস এর বিশেষত্ব। সরদার শরণ সিং আরো জ্ঞ্যানি ও পরিপক্ক একজন মানুষ। তার এসব গ্রহণ করা উচিত নয় সচিবালয় থেকে এবং অন্যান্য ব্যক্তিদের কাছে এই ধরনের জিনিস পৌঁছানো উচিৎ নয়। চীনা কূটনীতির কোন সৌন্দর্য নাই। এটা খুব খারাপ। একজন কমিউনিস্ট হিসেবে আমি লজ্জিত বোধ করি যে চিনের মত একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সাথে গান বোট পলিসিতে যায় – যাদের হাত ভিয়েতনামিদের রক্তে রঞ্জিত। এবং তারাই বার পাকিস্তানী সৈন্যদের রসদ পাঠাচ্ছে। তাই আমি মনে করি ….

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: আপনি আপনার প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করুন।

শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: স্টাইল পার্ট শেষ হয়েছে। আমি এর জন্য সর্দার শরণ সিং কে দোষারোপ করিনা কারণ আমার মনে হয়েছে যে তিনি কিছু খুব স্মার্ট শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন মাত্র। তিনি এবং আপনিও – আপনারা মোটা দাগে একই কাজ করছেন।
এখন প্রশ্ন উঠছে। আমার বন্ধু এখানে তা উল্লেখ করেছেন। এটি একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য যে যদি আপনি পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান অঞ্চলের কোনো অংশ দখল নিতে চেষ্টা করেন তাহলে আমরা আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করব। এটাকে আন্তর্জাতিক আইনে বলা হয় ‘creations of casus bell’ যখন মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল দখলে নিয়ে ঢাকার কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে – তখনো পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য ও ইসলামাবাদ বলছে যে ভারত তা করছে। তাই এই ঘোষণাকে ভারতের বিপক্ষে যুদ্ধের ঘোষণা হিসেবেই নেয়া উচিৎ। এর পেছনে এটাই উদ্যেশ্য। এটাই প্রস্তুতি।

এখন স্যার, আমি মনে করি এটা তার আমাদের দেশ আক্রমণের একটি পূর্ব প্রস্তুতি। এতে আমাদের হতাশ ঝোলে চলবেনা। আমি তার সাথে একমত। তাড়া যদি তা করে তবে আমাদেরও প্রস্তুত হতে হবে। তারা এমন বিবৃতি দিচ্ছেন যে ভারত মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করছে। তারা এসব বলে ভারতকে ব্ল্যাক মেইল করার চেষ্টা করছেন। স্যার, বাংলাদেশের স্বাধীনতা তাদের মুক্তিবাহিনীই ছিনিয়ে নেবে – তাদের দেশের মানুষের প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি এখানে জড়িত আছে।

দুপুর ১ টা

আমার এতে কোন সন্দেহ নাই। আমরা পাকিস্তানের সাথে কোন যুদ্ধে লিপ্ত না। আমরা পাকিস্তানের ভিতরে সশস্ত্র হস্তক্ষেপ করছিনা। তবে একটি জাতি হিসেবে, মানুষ হিসেবে, বন্ধু হিসেবে আমরা বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীকে সম্পূর্ন সাহায্য করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এটাই আমাদের পরিষ্কার অবস্থান হওয়া উচিৎ।

স্যার, এই বিবৃতি ভারতকে ক্ষিপ্ত করার জন্যও কাজে লাগবে। তাই আমি সর্দার শরণ সিং এর সাথে একমত যে তাড়াহুড়া না করে আমাদের বুঝতে হবে জেনারেল ইয়াহিয়া খান এই ধরনের বিবৃতি তৈরীর পিছনের মূল উদ্দেশ্য কি। তিনি হয়ত ভাবছেন এই ধরণের মন্তব্য করার ফলে আমাদের জনগণ আন্দোলনে নামবে এবং আমাদের এমন কিছু করতে বলবে যা তাদের মূল উদ্যেশ্য। আমি মনে করি আমাদের কারও হাতের খেলনা হয়ে খেলা উচিৎ না।

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: যথেষ্ট হয়েছে।

শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: আমাকে শেষ করতে দিন। জনাব ইয়াহিয়া খানের এটাই উদ্যেশ্য। অতএব এখানে দুইটি বিষয় পরিষ্কার উঠে আসে। ইয়াহিয়া খানের বিবৃতি থেকে আমি মনে করি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাংলাদেশকে আমাদের স্বীকৃতি দেয়া উচিত। সম্ভব হলে আজ। কারণ জেনারেল ইয়াহিয়া খান তার কাজের জন্য ক্ষেত্র তৈরি করছেন। একটি মিথ্যা ক্ষেত্র। নিশ্চই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে আমাদের অবস্থান আরও স্পষ্ট হবে। এতে করে ভারত এখনকার চাইতে আমি সরকারের সাহায্যের ব্যাপারে উল্লেখ করছিনা। অতএব স্বীকৃতি জরুরী। ব্যাপক সহায়তা দেয়া উচিত। শুধু এপাশ থেকে নয় – ওদের পক্ষেও হাজার হাজার প্রশিক্ষিত সু- সুসজ্জিত, একটি সত্যিকারের ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট সংগঠিত করে ক্ষমতার কেন্দ্রে যেতে সহায়ক হবে। আমাদের সেই ব্যাপারে আগ্রহী হওয়া উচিত। স্যার, আমি মনে করি এই বক্তব্য থেকে আমরা এই দুটি সিদ্ধান্তে আসতে পারি……

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: যথেষ্ট হল।

শ্রী ভূপেশ গুপ্ত ………….. এবং আমাদের হতাশ বা উত্তেজিত হওয়া উচিত নয়।

অবশেষে, এখানে কোন আবেদনের প্রয়োজন নেই। আমি সম্পূর্ণভাবে একমত যে আমরা একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় পদ্ধতির মাধ্যমে পরিস্থিতি বিবেচনা করছি; সমাধান করার চেষ্টা করছি; একটি কণ্ঠে, এক ব্যক্তি হিসাবে কাজ করতে চাই যা আমাদের দেশের সমগ্র মানুষের ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করবে এবং সেভাবে বিশ্বাবাসীর কাছে প্রকাশিত হবে।

স্যার, এই ব্যাপারটি সম্পূরক হিসেবে নিষ্পত্তি করা হবে না। এই ধরনের আন্তর্জাতিক প্রশ্ন সম্পূরক প্রশ্ন হিসেবে বা মন্ত্রীবর্গের কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে বা সিদ্ধান্ত দিয়ে হবেনা। কিছু বিষয় নিয়ে সংসদে কথা বলা উচিত। আর কিছু আছে যেগুলো স্বাচ্ছন্দ্যে বলা উচিৎ না। তবে তাদের জন্য সরকার ও বিরোধী দলের বাইরেও আরও অনেক পথ আছে। এভাবেই করা উচিত ……..
জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: ঠিক আছে।

শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: হ্যাঁ, স্যার, এটা খুব সঙ্কটাবস্থা। অ্যামেরিকা, চিন এবং পাকিস্তান আমাদের বিরুদ্ধে এক হয়েছে। তাদের হালকা ভাবে দেখবেন না। আশা করি এব্যাপারে হতাশ হতে হবেনা যে বিশ্বে ভারতের পক্ষে কেউ নেই। ওইসব দেশের বাইরেও আরও দেশ আছে যারা বন্ধু হিসেবে এগিয়ে আসবে। আসুন আমরা সেই আত্মবিশ্বাস রাখি। প্রকৃত বন্ধু চেনার এখন আসল সময়। আমাদের বন্ধু আছে কারণ আমাদের অবস্থান সন্মাজনক ও সৎ। তাছাড়া আমরা জাতিসংঘের চার্টার মেনে চলি। আমি নিশ্চিত পৃথিবীর বিবেক নষ্ট হয়ে যায়নি এবং এমন শত শত জাতি আছে। আসুন আমরা সবাইকে ডাকি – দেখি কে কে আমাদের সাথে আছে আর কে নাই —

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান – দয়া করে বসুন। মনে হয় অনেক হয়েছে।

শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: সবশেষে, সরকারকে সবসময় বিরোধী দলের মতামত নেওয়া উচিত, তাদের সঙ্গে আলোচনা করা উচিৎ – কারণ তাদের অনেক ক্ষোভ ও অন্যান্য বিষয়াদি থাকে। তারা অনেক মতামত থাকে যেটাকে অনেকে অপব্যবহার করতে পারে এবং ভালো উদ্যেশ্য নস্যাৎ করে দিতে পারে। আমি মনে করি সরকারকে এ ব্যাপারে যথাযথ প্রচেষ্টা বজায় রাখা উচিত। বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা শুধুমাত্র জাতীয় বিবেক জাগিয়ে তোলার জন্য নয় বরং নিশ্চিত করা যে এটা বাস্তবায়িত হবে। একই সময়ে আমরা আমাদের প্রভাব বিস্তার বজায় রাখব ……….

জনাব ডেপুটি চেয়ারম্যান: মনে হয় যথেষ্ট হয়েছে।

শ্রী ভূপেশ গুপ্ত; দয়া করে আমাকে বিরক্ত করবেন না। আমি শেষ করছি। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সব রকমের সাহায্য দেয়া উচিৎ যাতে করে তারা একটি ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট এর মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারে। এটাই চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছানোর পূর্বশর্ত।

সরদার শরণ সিং: আমি অনেক ধন্যবাদ জানাই অনেকগুলো বিষয় সঠিক দৃষ্টিভঙ্গিতে উপস্থাপন করার জন্য। আমি তার কিছু প্রস্তাবনা যত্নের সাথে গ্রহণ করলাম।

জনাব ডেপুটি চেয়ারম্যান: জনাব পাটনায়েক।

শ্রী বিজু পাটানায়েক (উড়িষ্যা): আমি শুধুমাত্র এক একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে চাই।

শ্রী সীতারাম কেশরী (বিহার): আমি একটি প্রশ্ন করতে চাই।

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান; আমি ইতিমধ্যে আপনার দলের একজন সদস্যকে ডেকেছি।

শ্রী বিজু পাটনায়েক: আমি দুঃখিত যে মাননীয় মন্ত্রী বিবৃতি দিলেন যে তিনি আজ অথবা আগামীকাল বাংলাদেশকে স্বীকৃতির ব্যাপারে কিছু করবেন না। তিনি কি বুঝতে পারেন যে, যখন এই বিবৃতি বিশ্বের প্রেসে প্রকাশিত হবে তখন পাকিস্তান এর প্রতিক্রিয়া কি হবে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবলের অবস্থা কি হবে? প্রধানমন্ত্রী বিজ্ঞতার সাথে বলেছেন যে এই শরণার্থী অন্তঃপ্রবাহ মাত্র ছয় মাস থাকবে।

তিনি একটি সময় সীমা বেঁধে দিয়েছেন যে যদি ছয় মাসের মধ্যে এটা সমাধান না করা হয় তখন ভারত পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে। পাশাপাশি বিশ্ব বিবেকের উপর আরও প্রভাব তৈরি করতে মন্ত্রীবর্গ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করছেন। তাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী কি অন্তত এই বিবৃতিটি একটু পুনর্বিবেচনা করবেন যে তিনি বললেন, “আমি বাংলাদেশকে আজ অথবা আগামীকাল স্বীকৃতি দেবনা”? কারণ আমি মনে করি, এই কথা তিনি এখানে এখন পর্যন্ত যত কথা বলেছেন তার বিপক্ষে যায় – ভারতের সকল মন্ত্রীরা যা বলেছেন তার বিপক্ষে যায় – এমনকি পার্লামেন্টের দুইটি হাউজে যত বিবৃতি দেয়া হয়েছে সেগুলোর বিপক্ষে যায়। প্রধানমন্ত্রী ছয় মাসের কথা বলেছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রী তার বিজ্ঞতার আলোকে আরও ৩ মাস বাড়াতে পারেন। কিন্তু ‘আজ নয়, আগামী কালও নয়’ – এই কথা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ও পার্লামেন্টের রেজোল্যুশনের বিপক্ষেই চলে যায়। তাই আমি মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়কে তার বক্তব্যের এই অংশটুকু পুনর্বিবেচনার আবেদন করছি।

সরদার শরণ সিং: আমি কি একটু বিষয়টা স্পষ্ট করতে পারি? আমি সন্মানিত সদস্যেকে বলতে চাই শুধুমাত্র ঐ গুরুত্বের জন্যই আমি এই কথা আবার এবং বারবার বলব। আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই যে ‘আগামীকাল’ বলতে আমি বোঝাইনি যে ‘কোনোদিনও না’। আজ বুধবার, কাল বৃহস্পতিবার। আমি শুধু এই দুই দিনের কথা বলেছি। আর তা বলার কারণ আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন ‘আপনি কি আজ স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছেন? ’ – তখন আমি বলেছিলাম – ‘না’।

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান – তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে “আগামীকাল” দ্বারা তিনি শুধুমাত্র বৃহস্পতিবার বুঝিয়েছেন।

শ্রী গোদে মুরাহারি: আমি মনে করি জনাব শরণ সিং এর একথা বলার অধিকার নাই যে আগামীকালও স্বীকৃতি দেয়া হবেনা। এই সন্ধ্যায় মন্ত্রিপরিষদ সিদ্ধান্ত নিতে পারে যে তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে। তিনি কিভাবে বলেন যে “আগামীকাল আমি স্বীকৃতি দেব না। ’? তিনি সম্পূর্ন ভুল বলেছেন। তার এমন বলা ঠিক হয়নি। তিনি বলতে পারতেন ‘ এই মুহুর্তে আমার স্বীকৃতি দেয়ার কোন ইচ্ছা নেই। ’ কিন্তু তিনি অনুমান করেও বলতে পারেন না যে তিনি এই সন্ধ্যায় – এমনকি আগামীকালও স্বীকৃতি দেবেন না। কেবিনেট পরবর্তি ঘণ্টায় এটা বিবেচনা করতে পারে।

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: সম্ভবত মাননীয় মন্ত্রী সরকারের মনের খবর ভালো জানেন।

সরদার শরণ সিং: যদি সে রকম হয়, আমি হাউসে এসে ঘোষণা দেব।

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: জনাব রাজ নারায়ন –

শ্রী মহাবীর ত্যাগী: আমি ধরে নিচ্ছি যে তারা যথাযথ সময়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিবেন।
জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: জনাব রাজ নারায়ন –

শ্রী রাজ নারায়ণ – মহোদয় আমি বিনয়ের সাথে বিশেষভাবে আপনার কাছে নিবেদন করছি একটা প্রস্তাব পাস করার পর তার ভাষা ও ভাব বিস্মৃত হব এমন কোন কু অভ্যাস আমরা গড়ে তুলব না। আমি আপনার অনুমতি নিয়ে ঐ প্রস্তাবের একটা অংশ পড়তে চাই যাতে এই পরিষদের সন্মানিত সদস্য এবং সরকারী সদস্যগণও সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত প্রস্তাবটি হৃদয়ঙ্গম করত ভবিষ্যৎ কার্যক্রম নির্ধারন করেন।

‘ভারতের ভৌগোলিক অবস্থা ও ইতিহাস ও ঐতিহ্যের শত শত বর্ষের প্রাচীন সম্পর্কে এই উপমহাদেশের জনগণ আবদ্ধ হওয়ার কারণে এই পরিষদ তার আপন সীমান্তের এত কাছাকাছি ঘটমান ভয়াবহ ব্যাপার সম্পর্কে উদাসীন থাকতে পারেনা। ’

এই একটি মাত্র বাক্য যথার্থভাবেই দিকদর্শন করে যে আমরা এবং পূর্ব বাংলার জনগণ, বাংলাদেশের জনগণ এক। আমাদের সংস্কার ও সম্পর্ক শত শত বর্ষের পুরাতন। আমাদের ইতিহাস, আমাদের ভূগোল এই প্রমাণ করে যে, আমরা এক ছিলাম, আমি চাই সর্দার শরণ সিং একথাও হৃদয়ঙ্গম করুন। ১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ জুনে যে প্রস্তাব পাশ হবার পর ভারত পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল ঐ প্রস্তাবের ভাষাও আমি এখানে পরে শোনাতে চাই। সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটি তার জন্মলগ্ন থেকে এক অখণ্ড স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখেছে যা অর্জন করতে লক্ষ লক্ষ নরনারী কষ্ট সয়েছে। যে ভারতের স্বপ্ন আমরা দেখেছি তাকে ইতিহাস, ভূগোল সমুদ্র ও পাহাড় এক সত্তা বানিয়েছে।

আমি চাই সর্দার শরণ শিং এসব কথা স্মরণ করে জবাব দেবেন এ প্রস্তাব পাশ করার পর সরকার কি কি পদক্ষেপ নিয়েছেন।

উপ- সভাপতি- ঠিক আছে এরূপ প্রশ্ন করুন।

শ্রী রাজনারায়ণ- দ্বিতীয় প্রস্তাব শুনুন।

উপ-সভাপতি – প্রস্তাব সকলের জানা আছে।

শ্রী রাজনারায়ণ – এই সভা গণতান্ত্রিক জীবন ব্যাবস্থার জন্য পূর্ব বাংলার জনগণের সংগ্রামের প্রতি নিজের গভীর সহানুভূতি ও একাত্মতা ব্যাক্ত করছে একাত্মতা অর্থ ভারত ও স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মা এক স্বাধীন বাংলাদেশের ওপর হামলা আমরা নিজেদের ওপর হামলা মনে করি এটি ঐ প্রস্তাবের ভাষা ও তাৎপর্য। একাত্মতার অন্য কোন অর্থ নেই। একাত্ত সন্দটির মানে এই যে, আমরা ও বাংলাদেশের লোক এক। এই একাত্ত শব্দটি নেয়ার পর ও এই সরকার চার মাস পর্যন্ত নিষ্ক্রিয় রয়েছেন এর অর্থ আমি বুঝি না।

দ্বিতীয় কথা আমি বলতে চাই, প্রস্তাবের শেষাংশে রয়েছে এই সভা তাদের আশ্বাস দিচ্ছে যে তাদের সংগ্রাম ও ত্যাগ ভারতের জনগণের আন্তরিক সহানুভূতি ও সমর্থন লাভ করেছে। এতদূর সমর্থন দানের প্রস্তাব পাশ করার পর ভারত সরকার স্বীকৃতি দেয়ার প্রশ্নে পাশ কাটিয়ে চলেছেন এই সরকার কি ঐ প্রস্তাবের প্রতি বিশ্বস্ত? আমি চাই, সর্দার শরণ সিং মহাশয়, তার মধ্যে যদি ‘সেন্স অব রিস্পন্সিবিলিটি’ (দায়িত্ববোধ) অবশিষ্ট থাকে অকপটে স্বীকার করবেন যে, ভারতের বিধানসভার সদস্যদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। সর্দার শরণ সিং কি জানেন উত্তর প্রদেশ বিহার রাজস্থান যেখানে যেখানে তাদের দলের সরকার আছেন তারা প্রস্তাব পাশ করেছেন। স্বীকৃতি দেবার জন্য প্রস্তাব পাশ করেছেন উত্তর প্রদেশ, বিহার, বাংলা, রাজস্থান। সে সময় সেখানে সেখানে অধিবেশন বসেছে প্রায় জায়গাতেই প্রস্তাব পাশ হয়েছে।

উপ-সভাপতি – ঠিক আছে রাজনারায়ন বাবু এখন শেষ করুন, বসে পরুন।

শ্রী রাজনারায়ণঃ কিন্তু সরকার এযাবৎ তাদের মর্যাদা দেননি। তাই আমি বলতে চাই এসব কিছু সত্ত্বেও এই সরকার আজ অবধি স্বীকৃতি দেয়ার কথা ঘোষণা করছেন না। আজও সর্দার শরণ সিং বৃহস্পতি, শুক্র, শনিবারের কথা বলেছেন – ‘today after tomorrow’ – এরূপ বলা কি সর্দার জি’র পক্ষে বলা শোভনীয়? আমি বলি মোটেই না — আজ ইয়াহিয়া খাঁ অ্যামেরিকা ও চিনের নতুন সম্পর্কের দিকে তাকিয়ে ঘোষণা করেছেন, মুক্তি সেনারাও যদি বাংলাদেশের কোন অংশ দখল করে নেয় তাহলে আমরা তাকে হামলা মনে করব এবং সাধারণ আক্রমণ হিসাবে তার জবাব দেব। এত কিছুর পরে সর্দার শরণ সিং এর একথা বলতে কি অসুবিধা যে বাংলাদেশের ওপর পাকিস্তানের আক্রমণ ভারত তার নিজের ওপর আক্রমণ বলে মনে করে। জার্মানি পোল্যান্ডের ওপর হামলা করল। ইংল্যান্ড বলল আমরা এটা নিজেদের ওপর হামলা বলে মনে করব। আজ আমাদের প্রতিবেশী দেশ বলছে ভারতের সাথে আমাদের একাত্মতা আছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি কি বারবার চাইছেন না যে ভারত তাদেরকে স্বীকৃতি দিক?

সর্দার শরণ সিং- ইনি ত্ব সবার চেয়ে ওপরে গেলেন।

প্রতিরক্ষামন্ত্রী(শ্রী জগজিবন রাম)- চ্যাটার্জিকেও মাত করে দিলেন।

শ্রী নবল কিশোর – আমি সব সময় মাত করি।

শ্রী নবল কিশোর – আমি বলেছি যে, পাকিস্তান এরূপ করেছে।

শ্রী নবল কিশোর – আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনি আগে আগেই কোন স্ট্রং একশন নেবেন?

শ্রী ভুপেশ গুপ্ত – আমি তার সাথে সম্পূর্ন একমত স্যার।

সর্দার শরণ সিং – স্যার আমি মনে করিনা যে তিনি কোন প্রশ্ন করেছেন। তিনি শুধু মাত্র তার কিছু নির্দিস্ট দর্শন প্রকাশ করেছেন।

স্যার, আমি নির্দিস্টভাবে তার ১/২ টি প্রশ্নের উত্তর দিতে চাই। তিনি বলেছেন পাকিস্তান জম্মু কাশ্মীর অথবা আমাদের অন্য কোন অঞ্চলের উপর আক্রমণ করতে পারে। এই ব্যাপারে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইতিমধ্যে বলেছেন যে আমরা আমাদের এলাকা প্রতিরক্ষার জন্য প্রস্তুত আছি। আমরা আমাদের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত আছি। আপনি আর কোন প্রতিরক্ষা সংগঠিত করার কথা আশা করতে পারেন না।

শ্রী এন জি গোরে – তিনি একজন জেনারেলের নাম উল্লেখ করেছেন।

সরদার শরণ সিং: এক বা দুই জেনারেল – কোন বিষয় না।

সর্দার স্মরণ: না, তিনি শুধুমাত্র জানতে চান আপনারা এয়েই ব্যাপারে সচেতন কিনা।

সরদার শরণ সিং: আমরা এটা নিয়ে সচেতন এবং আমরা তার চেয়ে বেশী পরিমাণে এটা নিয়ে সচেতন।

শ্রী এন জি গোরে: স্বাভাবিকভাবেই এমনই হওয়া উচিত।

সরদার শরণ সিং: এখন, স্যার, তিনি পার্লামেন্টের রেজোলিউশন সম্পর্কে ও আমাদের গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। আমি তাকে বিনীতভাবে কলিং-দৃষ্টি আকর্ষণ নোটিশ দেখতে বলছি। এটি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের যুদ্ধের হুমকি সম্পর্কিত এবং এ সব কলিং এটেনশন নোটিশ ছাড়া উঠে আসে না। সুতরাং, আমাদের প্রাসঙ্গিকতার কিছু নিয়ম খেয়াল করতে হবে।

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: জনাব নাওয়াল কিশোর।

শ্রী নাওয়াল কিশোর: স্যার আমি কোনো প্রশ্ন করার আগে একটি ছোট্ট অনুরোধ করতে চাই। সেটি হল দয়া করে সম্ভব হলে এই কলিং-এটেনশন মোশনের সময়টা পরিবর্তন করবেন। বিশেষ করে যখন সেটা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়। এটা শুধুমাত্র আমার একটা অনুরোধ। এখন যতদূর মন্ত্রী জ্ঞ্যাত আছেন – আমি জিজ্ঞেস করছি।

শ্রী সুন্দর সিং ভাণ্ডারী: এর সংস্লিস্টতা কি? আমরা জানতে চাই, স্যার।
জনাব ডেপুটি চেয়ারম্যান – তিনি শুধুমাত্র একটি প্রস্তাবনা রেখেছেন।
শ্রী সুন্দর সিং ভান্ডারি: যখন তিনি বলেন যে এই সময়ে এটা করা উচিত হবে না, বিশেষ করে যখন তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কিছু বলেন, এর দ্বারা তিনি কি বোঝাতে চান?

শ্রী নাওয়াল কিশোর (উত্তরপ্রদেশ): আমি আপনাকে অনুরোধ করেছি মাত্র। এখানেই শেষ। পররাষ্ট্র মন্ত্রীর কাছে আমার প্রশ্ন তিনি বিশ্বের দ্রুত পরিবর্তনশীল ঘটনার ব্যাপারে তার উদাসীনতা আমাদের অকপটে বলতে রাজি কিনা এবং তার সরকার কি কোন পদক্ষেপ নেবে কিনা? কারণ এমন গল্প প্রচলিত আছে যে ভারত সরকার কখনোই কোন ক্রিয়া করেনা – শুধু প্রতিক্রিয়া দেখায়।

স্যার, প্রেসিডেন্ট নিক্সনের চিন সফরের ঘোষণার পর, পাকিস্তান তার অবস্থান আত্মরক্ষামূলক থেকে পরিবর্তিত করে আক্রমণাত্মক করেছেন এবং আমাদের যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছেন। এবং তবু এখনও আমাদের সরকারের কোন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন না। শুধুমাত্র পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন যে যখন আমরা আক্রান্ত হব তখন তা প্রতিহত করা হবে। আমি কি জানতে পারি সরকার এখন অবিলম্বে বাংলাদেশে শুধু সামরিক সরবরাহ নয় বরং সৈন্য মোতায়েন করবেন কিনা?

সরদার শরণ সিং: সরকার কেবল প্রতিক্রিয়া দেয় কিন্তু কখনো কাজ করে না – এটা বড্ড পুরনো কথা। একজন সিনিয়র সদস্য শুধু পুরনো এসব শব্দগুচ্ছগুলো উচ্চারণ করবেন এবং সেই ফ্রেমে একটি প্রশ্ন করবেন এতে করে তার জ্যেষ্ঠতা ও স্বকীয়তা বরং রক্ষিত হয় না।

দ্বিতীয় যে প্রশ্নটি তিনি জিজ্ঞাসা করেছেন – আমরা কি আত্মরক্ষামূলক অবস্থান থেকে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে নিজেদের পরিবর্তন করতে যাচ্ছি কিনা …….

সরদার শরণ সিং: আমাদের নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। সেটাই প্রতিরক্ষার সেরা পথ।

সরদার শরণ সিং: তখন সে বলবে যে কোন প্রতিক্রিয়া দেখানো হয় নাই। এটাই সেই প্রতিক্রিয়া যা আমি এই হাউজে দিচ্ছি। গতকাল আমি অন্যান্য হাউসে বিবৃতি দিয়েছি। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের একটি বিবৃতি ছিল এবং আমিও আমার বিবৃতি দিয়েছি। এটাই প্রতিক্রিয়া ……..
(বাধা)

আমি কি মাননীয় সদস্যকে আরেকবার চিন্তা করতে বলতে পারি? অন্তত যখন তিনি বাসায় ফিরেন – তিনি যা বলেছেন তার প্রায়োগিক প্রভাব তিনি কি একটু ভেবে দেখবেন? আমি নিশ্চিত যে তিনি আমার সাথে একমত হবেন যে এই প্রশ্ন অসৎ চিন্তায় করা হয়েছে। আপনার সেই প্রকৃতির কোনো ধারণা করা পোষণ করা উচিৎ নয় এবং আপনি যখন কোন ধরনের পরামর্শ দেবেন তখন তার প্রায়োগিক প্রভাব বোঝার চেষ্টা করা উচিত। আমার কোনো সন্দেহ নেই যে কোন শান্ত মুহূর্তে তিনি আমার সঙ্গে একমত হবেন যে এই ফর্মে প্রশ্ন করা উচিত নয় বা কীভাবে উত্তর দিতে হয় সেটাও। আমি শুধু তাকে আবার এই ব্যাপারে ভাবার অনুরোধ করব। এবং আমাকে কিছু বলার দরকার নেই। সেভাবে প্রশ্ন করাটাই বোকামি।

তৃতীয় প্রশ্ন সম্পর্কে, আমি কোন উত্তর দিতে চাই না।

শ্রী মহীতোষ পুরকায়স্থ (আসাম): আমি কি সন্মানিত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জানতে পারি তিনি একটি খবরের ব্যাপারে জানেন কিনা- যেটি করাচির ‘দৈনিক ডন’ পত্রিকার প্রথম পাতায় ৯ জুন ১৯৭১ তারিখে প্রকাশিত হয়েছে – সেখানে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক সহকারী ডঃ কিসিঞ্জারের একটি বিবৃতি রয়েছে। সেটি নিম্নরূপ-

“বিদেশী কূটনৈতিক সার্কেলের মতে ……..”
সরদার শরণ সিং: আমরা কেন আমাদের সংসদে পাকিস্তানের পয়েন্ট নিয়ে আলোচনা করব?

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: আপনি শুধুমাত্র প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে পারেন। আপনি এটা পরছেন কেন? পড়ার দরকার নাই। শুধু আপনার প্রশ্ন করুন।
শ্রী মহীতোষ পুরকায়স্থ: পটভূমি জানা প্রয়োজনীয়।

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: কেন আপনি এটা উদ্ধৃত করতে চান?

সরদার শরণ সিং: আপনি কেন পাকিস্তানের পয়েন্ট এখানে ফরোয়ার্ড করতে চান?

শ্রী মহীতোষ পুরকায়স্থ: ফরেন সার্কেলের মতে, মার্কিন কর্মকর্তারা, অর্থাৎ ডঃ কিসিঞ্জার এবং আরও কয়েকজন, সীমান্তে একটি জাতিসংঘ বাহিনী পাঠানোর ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করছেন – যাতে করে দুই দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জানতে চাই ডঃ কিসিঞ্জার যখন এখানে এসেছিলেন তিনি কি আমাদের সরকারের নেতাদের সঙ্গে এই বিষয়ে কোন আলোচনা করেছিলেন কিনা এবং আমি আরও জানতে চাই জাতিসংঘ বাহিনীকে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে পোস্ট করার জন্য কোন পথ প্রস্তুত করার চিন্তা তাদের আছে কিনা – যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া খান যুদ্ধের কথা বলছেন।
জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান- কীভাবে এমন এক প্রশ্নের উত্তর দেয়া যেতে পারে?

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২০৪। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ স্বীকৃতি প্রদানের দাবি জানিয়ে উত্থাপিত প্রস্তাব ও তার ওপর আলোচনা রাজ্যসভার কার্যবিবরণী ৩১ জুলাই, ১৯৭১

Aparajita Neel
<১২, ২০৪, ৬৩৯-৬৮৯>

স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের দাবি জানিয়ে উত্থাপিত প্রস্তাব ও তার ওপর আলোচনা

প্রণব কুমার মুখার্জি (পশ্চিম বঙ্গ):

এই হাউজ ইচ্ছা প্রকাশ করছে যে ভারত সরকার সার্বভৌম ও গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে; তার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করবে এবং সংসদের বর্তমান সেশন শেষ হবার আগেই এটি ঘোষণা করবে।

স্যার, এই রেজোলিউশন এর বিষয়বস্তু নতুন নয়। এটা নিয়ে বিভিন্ন ফর্মে সংক্ষিপ্ত আলোচনা, দৃষ্টি আকর্ষণ এই হাউসে অনেকভাবেই হয়েছে। এই বছর ৩১ শে মার্চ একটি রেজোলিউশন সর্বসম্মতিক্রমে পাস করা হয়েছিল যার শেষ অংশে প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেন-

“এই হাউজ গভীরভাবে বিশ্বাস করে যে পূর্ববাংলার ৭৫ মিলিয়ন জনগণের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান এর বিজয় হবে। হাউস তাদের আশ্বাস দিতে চায় যে তাদের সংগ্রাম ও উত্সর্গের সাথে ভারত ও তার জনগণ সহানুভূতিশীল ও ভারতের জনগণের সমর্থন তারা পাবেন এবং তাদের জন্য শুভেচ্ছা রইল।

একই রেজল্যুশন লোকসভা দ্বারা ৩১ মার্চ পাস করা হয়। তার পর চার মাস পেরিয়ে গেছে। এখন এটা আমাদের চিন্তা করার বিষয়। বাংলাদেশকে স্বীকৃতির জন্য ও আমাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করার জন্য এখনই সঠিক সময়। বিভিন্ন দেশে আমাদের বৈদেশিক মিশনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিবৃতি দিয়েছেন যা ২৫ জুন প্রস্তাবিত হয়। বিবৃতিতে তিনি বলেন –

৬ থেকে ২২ জুন, ১৯৭১ আমি মস্কো, বন, প্যারিস, অটোয়া, নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন ডি সি এবং লন্ডন সফর করি।

প্রকৃত ফল কী হয়েছিল? বিভিন্ন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও শরণ সিং এর মতবিনিময় তুলে ধরা হয়। শত সহস্র নয়, লাখ লাখ জনগণ বাংলাদেশ থেকে আমাদের দেশে প্রবেশ করছে। মন্ত্রী বলেন –

“আমি স্পষ্ট বলেছি যে পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের যেকোন সাহায্য এবং অর্থনৈতিক সহায়তা দেয়াটা তাদেরকে পূর্ব বাংলায় নির্যাতনে উৎসাহ দেয়ার নামান্তর। ’

মন্ত্রী ২৫ জুন ১৯৭১ তারিখে এগুলো বলেন। এই যৌথ ইশতেহার ১৭ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব বরাবর জারি করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানকে সাহায্য করা হলে তা প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের শাসক চক্রকে বাংলাদেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে তাদের বর্বর কার্যক্রম বা কুকর্ম করতে সাহায্য করবে। ট্রাজেডি হল পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে এই যৌথ বৈঠকের পরেই তারা পদ্মা নামক জাহাজে অস্ত্র বোঝাই একটি চালান পাঠান পাকিস্তানের জন্য। বিদেশী কূটনৈতিক মিশনের সবগুলোর মাঝে শুধুমাত্র সোভিয়েত সরকার তাদের সাথে করা যৌথ ইশতেহার অনুযায়ী ভারত সরকারকে আশ্বস্ত করে যে তারা ভারত সরকারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবে এবং এ ঘটনার উপর কড়া নজর রাখবে।

অন্য সরকারগুলো কি বলেছে? অন্যান্য পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা কি নিশ্চয়তা দিয়েছে? তারা বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য তাদের সহায়তা নিশ্চিত করেছে। তারা পরিস্থিতি রাজনৈতিকভাবে সমাধান করার ইচ্ছার কথা প্রকাশ করে এব্যাপারে মত দেন। কিন্তু বাংলাদেশের বেসামরিক নাগরিকদের উপর নির্যাতন বন্ধের জন্য তারা কি ব্যাবস্থা নিয়েছেন? তারা শুধু কথাই বলেছেন। আমি ভারত সরকারের কাছে জানতে চাই কি ইতিবাচক পদক্ষেপ নিলে বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হবে এবং এই শরনার্থিদদের অন্তঃপ্রবাহ বন্ধ হবে? আপনি ভালো ভাবে খেয়াল করলে দেখবেন ভারত সরকার এ পর্যন্ত কিছুই করেনি। জনাব চেয়ারম্যান, এটা বলা হয়েছিল যে ভারত সরকার যথাযথ সময়ে পদক্ষেপ নেবে। তারা যথাযথ সময়ে বাংলাদেশ সরকার কে স্বীকার করে নেবে। কিন্তু ‘উপযুক্ত সময়’ কখন আসবে? উপযুক্ত সময় কি তখন হবে যখন বাংলাদেশের ৭৫ কোটি মানুষ শেষ হয়ে যাবে আর সেখানকার এক কোটি হিন্দু ভারতে এসে জড়ো হবে? যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ, সচেতন যুবকরা শেষ হয়ে যাবে তখন? যখন সেখানকার সকল বুদ্ধিজীবীরা ধ্বংস হবে তখন? জনাব চেয়ারম্যান স্যার, জাতিসংঘের নীতি অনুসারে নয়, ভারত সরকারের উচিৎ সঠিক সময় ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া। এবং তা হবে প্রতিষ্ঠিত আইন অনুযায়ী। স্যার, আপনি নিজে একজন অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ এবং আপনি জানেন যে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসাবে স্বীকৃতির জন্য সব শর্ত পূরণ হয়েছে। এটা ওপেনহেম-এর মত বিশিষ্ট আইনবিদের স্বীকৃতি লাভ করেছে। জনাব চেয়ারম্যান স্যার, বাংলাদেশে এই বছরের ১০ এপ্রিল একটি পূর্ণ অস্থায়ী সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের অধীনে স্থাপন করা হয়েছে। জনাব নজরুল ইসলাম প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। এবং এই সরকার এখন সামরিক অপারেশন পরিচালনা করছে। এটা সামরিক কমান্ড্যান্ট নামে অভিহিত এবং এটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিচ্ছে। এটা শুধু ভারতীয় প্রেস না, এটা প্রায় সব বিদেশী কূটনীতিকদের এবং অনেক বিদেশী সংসদীয় প্রতিনিধি দলের নজরে আছে। এবং যেসব বিদেশী সাংবাদিক বাংলাদেশ পরিদর্শন করেছেন তারা জানিয়েছেন কার্যত বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ এলাকা বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর দখলে এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সৈন্য শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু সেনানিবাস ও নির্দিষ্ট কিছু শহরে দখল করে আছে এবং সেখানে তারা বেসামরিক নাগরিকদের উপর নৃশংসতা চালাচ্ছে। বেসামরিক প্রশাসন কার্যত বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সরকার জনাব নজরুল ইসলাম এর সভাপতিত্বে মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে।

অতএব, আমি জানিনা বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি দান থেকে ভারত সরকারের বাঁধা কোথায়। আমরা কি পাকিস্তানের অপপ্রচারে ভীত হয়ে গেছি? আমরা কি আশঙ্কা করি যে, যদি আমরা বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হুসেবে স্বীকৃতি দেই তাহলে কি সমস্ত বিশ্বের বিরুদ্ধে যাওয়া হবে? আমি কোন কারণেই ভারত সরকারের নড়বড়ে হওয়ার কোন কারণ দেখতে পাচ্ছিনা। ভারত সরকারের উচিৎ পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তার অপপ্রচারের দিকে না তাকিয়ে তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেয়া।

পাকিস্তান দেখানোর চেষ্টা করছে যে বাংলাদেশে যা ঘটছে তা ভারতের সৃষ্টি। পাকিস্তান অতীতেও এমন করেছে, বর্তমানে করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। আপনি এটা বন্ধ করতে পারবেন না। পাকিস্তানের অপপ্রচার বন্ধ করতে পারবেন না। মুজিবুর রহমান নিজে যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন, তিনি ১৯৬৫ সালে ভারতীয় আগ্রাসনের জন্য প্রথম নিন্দা প্রকাশ করেন ও একজন স্বাক্ষরকারী ছিলেন – যে ইশতেহার তৎকালীন পূর্ব বাংলার গভর্নর জারি করেছিল। অতএব, এটা বলার প্রশ্নই ওঠেনা যে বাংলাদেশে যা ঘটছে তা ভারতের সৃষ্টি। পাকিস্তানের অনেকে ও পাকিস্তানের অনুসারীদের অনেকে এমনকি বিশ্ব সম্প্রদায়ের বেশীরভাগ এটা বিশ্বাস করবে না। তারা জানে যে, মুজিবুর রহমানের লক্ষ্য নির্ধারিত এবং আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের বিশাল ম্যান্ডেট পেয়েছে। কিন্তু ভারতের লক্ষ্য নির্দিষ্ট নয়। ভারত সরকার বা তার জনগণ কোন লক্ষ্য নিয়ে কাজ করেনি। এটি মূলত একটি আন্দোলনের ফল যা বাংলাদেশেই সৃষ্টি হয়েছে। এটি মূলত একটি আন্দোলন যা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা থেকে সৃষ্টি হয়েছে। ছয়-দফা কর্মসূচি, যার দাবীতে তারা নির্বাচনে গেছে তা মানুষের কাছ থেকে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে। আমরা দেখতে পাই যে ছয় দফা কর্মসূচির কিছুই ভারতপন্থী না। ছয় দফা কর্মসূচি, যার উপর তারা বাংলাদেশের ৭৫ মিলিয়ন মানুষের কাছ থেকে ব্যাপক ম্যান্ডেট পেয়েছেন সেখানে একটি দফা নেই যা ভারতপন্থী হিসেবে মনে হতে পারে। এসব লোক ভারতের পক্ষে কিছু করছেন না। তারা ভারত দ্বারা প্ররোচিত হয়ে কিছু করছেন না। ছয় দফা কর্মসূচি সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক সমস্যার উপর ভিত্তি করে তৈরি। তারা স্বায়ত্তশাসন চান। তারা আত্মনিয়ন্ত্রণ এর অধিকার চান। তারা নিজেরাই তাদের অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তি পেতে চান। তারা বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ করতে চান। তারা তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক পুনর্বাসনের সুযোগ চান। তারা পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতাধারীদের শোষণ থেকে মুক্তি চান। তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে চান। তারা সাংস্কৃতিক মুক্তি চান। এটা কি দোষের? জাতিসঙ্ঘের সনদে ক্যাটাগরি চার্টারে আর্টিকেল ১ এ উল্লেখ আছে প্রত্যেক জাতির যাদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, জাতীয়তা আছে তাদের নিজস্ব ধারণা সঞ্চারিত করার অধিকার থাকবে। তারা গণতন্ত্রের চর্চা করবে এবং তাদের ইচ্ছা পূরণ করার অধিকার থাকবে। এটা কি জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত হয়নি? ধারা ১ (২) এ আছে –
“ভিন্ন ভিন্ন জাতির মধ্যে বন্ধুত্তপূর্ন সম্পর্ক যা সমঅধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণ এর উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে এবং সার্বজনীন শান্তি শক্তিশালী করার জন্য তা অন্যতম সহায়ক। ”

এটা কি সত্য নয় যে, জাতিসংঘের সনদে সমান অধিকার এবং আত্ম নিয়ন্ত্রণের অধিকার গৃহীত হয়েছে? জাতিসংঘের কনভেনশনে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। বাংলাদেশের ৭৫ মিলিয়ন মানুষ তাদের আত্ম নিয়ন্ত্রণের অধিকার চান। তাই তাদের স্বায়ত্তশাসন থাকতে হবে। তারা নিজের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতে চান। নিজেদের কপালের উপর নির্ভর করে দাড়াতে চান। তাহলে এই পথে বাধা কোথায়? কিভাবে এটা ভারতীয় প্রচারণা হতে পারে?

কিভাবে এটা ভারতের একটি আগ্রাসন হয়ে ওঠে? কিভাবে এটা পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াস হয়ে ওঠে? জনাব চেয়ারম্যান? আমি বুঝতে পারছি না বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে ভারত সরকার বাধা কোথায়। আন্তর্জাতিক আইনে যথেষ্ট দৃষ্টান্ত আছে। এটা কি সত্য নয় যে, ১৯০৩ সালে যখন পানামা কলাম্বিয়া থেকে আলাদা হয় তার মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের স্বীকৃত দিয়েছিল? এক সপ্তাহের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পানামা কে স্বীকৃত দেয় এবং পানামা থেকে তার নিয়ন্ত্রণকারী কলাম্বিয়াকে প্রতিরোধ করে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার পূর্বেই এর মূল অংশ যুক্তরাজ্য থেকে যে পৃথক হয়ে গিয়েছিল, সেটা কি সত্য ঘটনা নয়? তারপর ১৭৬৬ সালে আলাদা হবার ১ মাসের মধ্যে ফ্রান্স আমেরিকাকে স্বীকৃতি দেয়। এটা কি সত্য নয় যে, যখন গ্রীস ১৮২৭ সালে স্বাধীনতা ঘোষণা করে তার এক সপ্তাহের মধ্যে চার ইউরোপীয় রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিয়েছিল? এটা সত্য যে যেভাবে রুমানিয়া, বুলগেরিয়া এবং সার্বিয়া অটোমান সাম্রাজ্য থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয় তার ছয় সপ্তাহ পর ইউরোপীয় শক্তিগুলো তাদের স্বীকৃতি দেয়। আন্তর্জাতিক এমন যথেষ্ট উদাহরণ আছে। তাই আমি বুঝতে পারছি না কেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না। মানবিক কারণে আমাদের তাদের স্বীকৃতি দেয়া উচিত। এটা কি সত্য নয় যে নৃশংসতা, বর্বরতা বাংলাদেশের বেসামরিক জনগণের উপর ঘনীভূত হচ্ছে? সেখানে ভারত সরকারের মানবিক ভিত্তিতে স্বীকৃতি দেয়া উচিত। ১৮৭৬ সালে যখন রুমানিয়া, বুলগেরিয়া এবং সার্বিয়া অটোমান সাম্রাজ্য থেকে আলাদা হয় তখন কী ঘটেছিল? বেসামরিক মানুষকে জবাই করা হয়েছে, গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল। আর এর ফলে প্রায় সব ইউরোপীয় দেশ অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র গ্রহণ করে এবং তারা সেই সব দেশগুলোকে স্বীকৃতি দেয়। আমি জানিনা ভারত সরকার কেন দ্বিধাগ্রস্ত। আমি জানিনা এই সিদ্ধান্ত নিতে কত সময় লাগবে। আমরা শরণার্থী অন্তঃপ্রবাহ নিয়ে আলোচনা করেছি। সরদার শরণ সিং ভারত সরকার এর অবস্থান সম্পর্কে খুব স্পষ্ট বলা উচিৎ। প্রধানমন্ত্রীরও সরকারের অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট করা উচিৎ। জনাব চেয়ারম্যান, আমি অকপটে আমার ভুলত্রুটি স্বীকার করছি। আমি ভারত সরকারের অবস্থান বুঝতে ব্যার্থ হচ্ছি।

আর কত সময় লাগবে? কত সময় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার জন্য অপেক্ষা করতে হবে? কি শর্ত ভারত সরকারের মতে পৌঁছাতে সাহায্য করবে? পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলতে হবে। হাউসের আস্থায় সিধান্ত গ্রহণ করা উচিত, মানুষের আস্থার জন্য সেই সিদ্ধান্ত তাদের জানানো উচিত, গোপনে কোন কিছু সম্পন্ন করা উচিত না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাউসে বলবেন যে কি শর্ত পূর্ণ হলে ভারতীয় সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে পারে।

জনাব চেয়ারম্যান, আমি হস্তক্ষেপের কথা বলছি না। আমি বলছি না যে ভারত সরকারকে অস্ত্র তুলে নিয়ে পাকিস্তানের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো উচিত। আমি বলছি না, যদিও কারণ আছে তবুও ভারত সরকার অস্ত্র তুলে নিক পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। কিন্তু আমি যা বলছি তা হল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হবে। বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামে তারা যুদ্ধ করুক; তারা তাদের সামরিক শাসকদের সম্মুখীন হোক। আমাদের তাদের স্বীকৃতি দিতে হবে। তাদের আন্তর্জাতিক মর্যাদা দিতে হবে। একটি সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসাবে তাদের স্বীকার করতে হবে এবং ডিসেম্বরের নির্বাচনে যে ব্যাপক ম্যান্ডেটের মাধ্যমে সেখানে যারা নির্বাচিত হয়েছেন তাদের যোগ্য প্রাপ্য দিতে হবে। জনাব চেয়ারম্যান, স্যার, এই হাউজে কতবার পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক ভারত সীমান্তে অনুপ্রবেশের মত ঘটনা সংঘটিত হওয়ার বিষয় আলোচিত হয়েছে আপনি জানেন।

দুপুর ১২ টা-

অন্য এক দিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই হাউজে এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন পশ্চিমবঙ্গে পাক অনুপ্রবেশ ছিল ১৩ টি, আসামে ৩, ত্রিপুরায় ১৩, মোট – ২৯ টি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বারা গুলির সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় যথাক্রমে ১০৯, ২৮ এবং ১০৪ টি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নিহত ভারতীয় নাগরিকের সংখ্যা ছিল ওয়েস্ট বেঙ্গলে ১১ জন, আসাম ও মেঘালয়ে ৩১ জন, ত্রিপুরায় ৩০ জন; মোট – ৭৭ জন। আহতদের সংখ্যা ছিল ১৩৫। এই সকল অনুপ্রবেশ হয়েছে মে ১৯৭১ থেকে। এটা কি আত্মরক্ষার প্রস্তুতি নেবার জন্য যথেষ্ট অবস্থা তৈরি করেনি? তা সত্ত্বেও জনাব চেয়ারম্যান আমি এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছিনা। আমার চাহিদা খুব সামান্য। আমাদের উচিৎ বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসাবে স্বীকার করে তাদের সহায়তা দান এবং তাদের সাথে পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করা। তাদের স্বাধীনতার জন্য তাদের নিজস্ব প্রচেষ্টায় স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনা করতে দেয়া হোক। আমরা তাদের আন্তর্জাতিক মর্যাদা দিই। আমি কি খুব বেশী চাইছি? তাহলে কেন আমরা রেজোলিউশন পাস করব না? এটা কি প্রয়োজন নেই? আমাদের এই সরকার জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন করুক আমরা কি তা চাই না? আমরা কি লজ্জা পাবোনা যদি বাংলাদেশ লোক আমাদের নিন্দা করে? তারা কি বলবে না, “যখন আমরা পাকিস্তানের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি, যখন আমরা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করছি তখন আমরা কি আমাদের প্রতিবেশী দেশের কাছ থেকে সাহায্য প্রত্যাশা করতে পারিনা? — যাদের সাথে রয়েছে সাংস্কৃতিক বন্ধন, জাতীয়তার বন্ধন। জনাব চেয়ারম্যান, এখন যদি বাংলাদেশের কোন মুক্তিযোদ্ধা মনে করে যে ভারত তাদের ব্যাপারে দোটানায় আছে তাহলে কি অবাক হবেন? জনাব চেয়ারম্যান, আমি আবারো বলছি যে ভারতীয় সরকার সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। যারা ইতস্তত ভাব করে তারা ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তারা বলছে যে এই শরনার্থিরা ফিরে যাবে যদি স্বাভাবিক অবস্থা পুনরুদ্ধার করা যায় – কিন্তু আমি জানিনা কিভাবে এই স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে। কিভাবে এই মানুষ ফিরে যাবে। ভারত সরকারের কি উচিৎ না সত্তর লাখ শরণার্থীর প্রশ্ন জনতার কাছে উত্থাপন করা? আমরা বাজেট ও সম্পূরক বাজেট দাবী করি। আমরা শরণার্থীদের জন্য কি কাজ করছি? মৌলিক প্রশ্ন রয়ে যায়। এইসব মানুষ এদেশে এসে থাক, সেটা আমাদের দোষ না। তারা আমাদের দোষে এই সীমান্তের কাছে আসেনি। আমরা কি পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের সঙ্গে কথা বলতে পারিনা? আমরা কি তাদের বলতে পারিনা যে শরনার্থিদের যদি আরও বেশী করে আমাদের এখানে পাঠায় তাহলে তা আমাদের অর্থনীতিকে ক্ষতি করবে এবং এই অবস্থায় আমরা দর্শক হয়ে বসে থাকতে পারিনা। আমাদের এটি নিষ্পত্তি করা আবশ্যক। সরকারি কি কথা বলতে পারে না?

জনাব চেয়ারম্যান, স্যার আমি একজন সাধারণ মানুষ। আমি খুব সাধারণ মানুষ। আমার ভাষা ভাঙ্গা হতে পারে এবং আমার কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হতে পারে। কিন্তু কেন ভারত সরকার দুর্বল স্বরে কথা বলবে? এবং ভারত সরকারকে ভাঙা ভাষায় কেন কথা বলতে হবে? তারা কি সন্দেহাতীতভাবে কোন কথা বলতে পারে না? নেহরু-লিয়াকত আলী চুক্তি সকল আন্তর্জাতিক আইন মেনে হয়েছিল।

তারা গণহত্যার চালাচ্ছে। তারা বেসামরিক লোকদের বিরুদ্ধে নৃশংসতায় লিপ্ত। প্রথমে তারা সেখানে বসবাসকারী হিন্দু জনগোষ্ঠীর উপর করে। এখন তারা হিন্দু ও মুসলমানদের নির্বিচারে নৃশংসতা চালাচ্ছে। প্রতিটি মানুষ পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বর্বর নৃশংসতার শিকার হচ্ছে। অতএব, স্যার, আমরা হতাশ। আমরা অত্যন্ত হতাশ বোধ করছি। আমরা সন্দিহান যে তারা তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারে কিনা। বরং তারা তা পরিবর্তন করে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এটা অস্বীকার করতে পারেন। তিনি বলতে পারেন যে, সম্ভবত ভারত সরকার করবে তা না। যখন মানসিক অশান্তি শেষ হয় তখন মানুষ তা ভুলে যায়। জনাব চেয়ারম্যান যদি এটা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ধরে চলে তাহলে তা মানসিক সমস্যা তৈরি করতে বাধ্য। জনাব চেয়ারম্যান স্যার, খুব সাধারণ মানুষ হিসেবে বলছি, দেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবে বলছি – আপনারা ভুলের মধ্যে বসবাস করছেন। বাংলাদেশে যা ঘটছে তা পশ্চিমবঙ্গ ও দেশের অন্যান্য পূর্ব অংশের অর্থনীতি এবং রাজনীতির ওপর একটি গুরুতর প্রতিক্রিয়া ফেলবে। আমরা এটা হতে দিতে পারি না। আমাদের একটি অবস্থান নিতে হবে। এবং এটা সঠিকভাবে উচ্চারিত হওয়া উচিত। দ্ব্যর্থহীন হওয়া উচিৎ। জনাব চেয়ারম্যান স্যার, আমি বুঝতে পারছি না ভারত সরকার উদ্বাস্তুদের সমস্যা নিয়ে কি করবেন। ভারত সরকার প্রথমে বলছিলেন যে, তাদের তিন মাসের মধ্যে ফিরে যেতে হবে। এখন তারা ছয় মাস সময় বাড়িয়েছে। সম্ভবত তারা এক বছরের বেশি সময় আবার এক্সটেনশন করবে। এটা ছয় মাসের প্রশ্ন নয়, এটা আপনি কিভাবে মোকাবেলা করবেন তার প্রশ্ন। যতক্ষণ না সেখানে রাজনৈতিক সমাধান হয়, যতক্ষণ না সেখানে একটি অসাম্প্রদায়িক সরকার এবং জনগণের ইচ্ছার সরকার তৈরি হয় ততক্ষণ এসব শরণার্থীদের ফিরে যাবার অনুকূল পরিবেশ হবেনা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি হলে শরনার্থিরা ফিরে যাবে। কিন্তু আপনার সাহায্যের জন্য কে আসছে? আন্তর্জাতিক সংগঠন কী করছে? (ঘণ্টা বাজার শব্দ)। আমি শেষ করছি। জাতিসংঘ বলছে এটা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেকার একটি বিষয়। তারা ভারত ও পাকিস্তানে পর্যবেক্ষক পাঠাতে চেষ্টা করছে। জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক এখানে কি করবে? উ থান্ট, জাতিসংঘের মহাসচিব, যখন গণহত্যা চলছে তখন কি করেছেন? যখন বিদেশী প্রতিনিধিদল এটা রিপোর্ট করে, যখন হাউস অব কমন্সে লেবার পার্টির নেতা এটা শতাব্দীর সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হিসাবে বর্ণিত করেন, যখন কানাডিয়ান প্রতিনিধি দল বলেছে সেখানে পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন বেসামরিকদের উপর নৃশংসতার চালাচ্ছে তক্ষণ তিনি কী করেছেন? কেন তিনি ২৪ ঘন্টার মধ্যে সাধারণ পরিষদ আহ্বান করেননি? যদি সুয়েজ খাল জাতীয়করণের পর, ১৯৫৮ সালে লেবাননে উন্নয়নের পর, U.N সাধারণ পরিষদের বৈঠক ২৪ ঘন্টার মধ্যে ডাকতে পারেন তাহলে এই ক্ষেত্রে সমস্যা কী?

কেন সাধারণ সমাবেশ একটি রেজল্যুশন দেবেনা? পাকিস্তানের বর্বর নৃশংসতার পরেও? (ঘণ্টার শব্দ)। স্যার, আমি জানি আমার সময় সীমিত। আমি শেষ করতে যাচ্ছি। আমি আবার মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী কে অনুরোধ করতে চাই, যেন ভারত সরকারের নীতি সীমাবদ্ধ না হয়। যেন ভারত সরকার দেরি না করে। ভারত সরকার সন্দেহাতীতভাবে দ্ব্যর্থহীনভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বার্থে, নিজেদের জনগণের স্বার্থে এগিয়ে আসার ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়।
এই কথাগুলো বলে স্যার, আমি শেষ করছি। ধন্যবাদ।

প্রশ্ন প্রস্তাব করা হয়।

শ্রী সীতারাম কেশরী (বিহার): স্যার –

১। রেজোল্যুশনে –
কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য এবং বর্তমান অধিবেশন শেষ হবার আগে পার্লামেন্টে ‘উপযুক্ত সময়’ শব্দের ব্যাখ্যা ও প্রতিস্থাপন করা হোক।
শ্রী জে পি যাদব (বিহার); স্যার,

৩। রেজোলিউশনের –
‘কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য’ শব্দ মালার পরে ‘সামরিক ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান করতে’ শব্দমালা সন্নিবেশিত করা হোক”
প্রশ্ন প্রস্তাব করা হয়েছে।
শ্রী এম.সি. চাগলা (মহারাষ্ট্র): জনাব. চেয়ারম্যান, সন্দেহাতীতভাবে বাংলাদেশে যা ঘটছে তা শুধুমাত্র একটি অপরাধ নয় বরং একটি বিয়োগান্তক ঘটনা। ইতিহাস অনেক অন্ধকার ঘটনার সাক্ষী। ইতিহাস আমাদের রক্তে পূর্ণ। কিন্তু আমি মনে করি বাংলাদেশে যা ঘটেছে তা কার্যত নজিরবিহীন। আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে বলছি যে জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী সেখানে মানবাধিকারের প্রতিটি কনভেনশন লঙ্ঘন করা হয়েছে। আমি মনে করি দীর্ঘ সময়ের যে ইতিহাস আমাদের আছে সেখানে বাংলাদেশের ঘটনাগুলো এত ভয়ঙ্কর ও অমানবিক, যা এর আগে কখনো প্রত্যক্ষ করিনি। আমি আমার কথা যতোটুকু সম্ভব সংক্ষিপ্ত করব কারণ এটা নিয়ে অনেকেই বিতর্ক করবেন। অন্যদের তীব্র প্রতিক্রিয়া আমাকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হয়। কিন্তু আমাদের স্বার্থ এবং লক্ষ্য ভারত কিভাবে তার তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে সেটা দেখা। রিপোর্ট আসার পরে প্রধানমন্ত্রী প্রবৃত্তিগতভাবে ভয়াবহ বিতৃষ্ণার সঙ্গে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। আমি প্রায়ই দেখেছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রথম সহজাত আনুমান সঠিক হয়। কিন্তু তারপর কিছু ঘটে। পরে সেটা কঠিন চিন্তায় রূপান্তরিত হয়। তখন আমাদের ভাবতে হয় আমাদের দেশের স্বার্থ, কুসংস্কার, এবং ভারসাম্য বজায় রাখা – এইসব। আমি আমার বন্ধু, মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, যখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরামর্শ দেয় তখন এমনই ঘটে। মন্ত্রী মোটামুটি ভাল জানেন এবং আমি বলতে পারি যে, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অনুগত, সক্ষম এবং যোগ্য। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মন্ত্রণালয় আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ভুগছে। তারা ধারা খুঁজে বেড়াচ্ছেন, তারা আন্তর্জাতিক আইন খুঁজছেন – আরও অনেক কিছু। কিন্তু তারা দেখলেন না যা ঘটছে তার কোণ নজির ইতিহাসে নাই। তাহলে কিভাবে তারা ধারা খুঁজে পাবেন বাংলাদেশ ইস্যুতে? সেখানে যা ঘটেছে তা হল সরকারি ব্যালট বাক্সের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রার্থিদের সবচেয়ে সহিংস উপায়ে অবদমন করা হচ্ছে।

আপনি নোট করতে পারেন যে এটি কোণ বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কেউ যদি আলাদা করার চক্রান্ত করে তবে তা মুজিবুর রহমান নয় – ইয়াহিয়া খান। কারণ নির্বাচন অনুযায়ী মুজিবুর রহমান হবেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু ইয়াহিয়া খান এটা সহ্য করতে পারেন নি। ফলে গণহত্যা শুরু করা হয়েছিল। শুধু এই শব্দটি দিয়ে বাংলাদেশ পরিস্থিতি বর্ননা করা যাবেনা।

রেজোলিউশনে যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা অন্য হাউসে ৩১ মার্চ সরকারের মত নিয়ে সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়েছিল। আমরাও তার সাথে সহানুভূতি প্রকাশ করি। সারাদেশে এমন একটি অসাধারণ অনুভূতি কাজ করে যার প্রেক্ষিতে আমরা বাংলাদেশের জনগণের দুর্ভোগের সঙ্গে সহানুভূতি প্রকাশ করি। আমি সরকারকে ও আমার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করতে চাই বাংলাদেশকে সমর্থনের জন্য আপনারা কি করেছেন?

শ্রী আও আধেশর প্রসাদ সিনহা (বিহার): আপনি জানেন না, শ্রী ছাগলা?
জনাব. চেয়ারম্যান: দয়া করে বাধা দেবেন না

শির এম সি ছাগলা: আমি নিশ্চিত আমার সন্মানিত বন্ধু আমার চেয়ে বুদ্ধিমান।
শ্রী আধেসশর প্রসাদ সিনহা: আপনি জানেন না কি সমর্থন আমরা দিচ্ছি? আপনি সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী। আপনার আমার চেয়ে ভালো জানার কথা। পক্ষীয় কোথা বলবেন না। জনাব ছাগলা, যতদূর যম্ভব আপনার তথ্য নিরপেক্ষ হতে হবে।

শ্রী এম সি ছাগলা; আমি জানি আমাকে কেন বলতে বাঁধা দেয়া হচ্ছে। আমি কি কিছু ভুল বলছি?

শ্রী পিতম্বর দাস (কহা প্রদেশ): হাতি ঘোড়া গেল তল, ভেড়া বলে কত জল।

শ্রী এম সি ঘাঘলা: আমি যে প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করতে চাই – আশা করি মন্ত্রী বা অন্য সদস্যরা উত্তর দিবেন। আমরা কি কার্যকরভাবে বাংলাদেশকে সমর্থন করছি? বাংলাদেশকে সমর্থন করতে হলে অবিলম্বে তাদের সরকারকে স্বীকৃত দেয়া উচিৎ। আমি পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে বলতে চাই এই সময়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃত না দিলে তা হবে সর্বশ্রেষ্ঠ ভুল এবং প্রতারণা। ইতিহাস আমাদের এই জন্য কখনো ক্ষমা করবে না।

বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া এই মহুর্তে সরকারের সবচেয়ে বড় কাজ হবে। প্রতিবেশী হিসাবে যেটাকে ভারতের বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসাবে বোঝানো যেত। দ্বিতীয়ত পার্টিশনের ফলে যে ক্ষতি হয়েছিল তা অনেকটা পূর্বাবস্থায় ফেরানো যেত। তৃতীয়ত দ্বি-জাতিতত্ত্ব চিরতরে শেষ করা যেত যা সবচেয়ে খারাপ তত্ত্বগুলোর একটি যেটা পার্টিশনের আগে শুরু হয়েছিল। আমরা জানি সেটা ছিল আমাদের মাতৃভূমি ভেঙ্গে দেয়ার চক্রান্ত। কেন এই স্বীকৃতি দেওয়া হলো না? আমি কারণ ক্ষতিয়ে দেখতে চাই। প্রথমত এটা বলা হয়ে থাকে যে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহনযোগ্যভাবে আমরা স্বীকৃতি দিতে পারছিনা। আমি এর সাথে ভিন্নমত পোষণ করি জোরালোভাবে। যতদুর আমি আন্তর্জাতিক আইন জানি – যদিও আমি বিশেষজ্ঞ না – একটি দেশ কে স্বীকৃতি দেয়া না না দেয়া প্রদানকারী দেশের নিজস্ব ব্যাপার।

এটা আমাদের ব্যাপার আমরা বাংলাদেশকে স্বীকৃত দেব কি দেবনা। আমাদের জাতীয় স্বার্থ এর উপর নির্ভর করবে। দ্বিতীয়ত, এটা বলা হয়েছিল যে সেখানে কোন সঠিক সরকার গঠন হয়নি। এতেও আমি দ্বিমত পোষণ করি। যে দেশ স্বীকৃতি দেবে সে নিজেকে জিজ্ঞেস করবে ঐ দেশের বৈধতা কতটুকু। তখন সে বলতে পারে আমি ঐ দেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছি। এটি প্রদানকারী দেশটির নিজস্ব ব্যাপার।

এখন, স্যার, আমি একটি প্রশ্ন করছি – কার কাছে কে বৈধ? মুজিবের না ইয়াহিয়ার? স্যার, বাংলাদেশে যা ঘটেছে তা সেনা অভ্যুত্থান নয়। একটি বৈধ সরকারকে উৎখাত করার পায়তারা মাত্র। সরকার সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হবার আগ পর্যন্ত বৈধতা নিয়ে সংশয় ছিল। কিন্তু এখন নিঃসন্দেহে বৈধভাবে নির্বাচিত সরকার সেখানে আছে। মুজিবুর রহমানের দল গণতান্ত্রিক ভাবে ভোটে নির্বাচিত হয়েছে। সেখানে কিছু সাজানোর ছিল না। ইয়াহিয়া খান ছিলেন বিদ্রোহী। ইয়াহিয়া খানের কোনো যুক্তি বা আইনি বক্তব্য নেই যাতে তিনি এই গণতান্ত্রিক সরকারকে প্রত্যাখ্যাত করতে পারেন।

শ্রী কল্যাণ রায় (পশ্চিম বংগ ) – জেনারেল ফ্রাঙ্কো সম্পর্কে কি বলবেন?

শ্রী এম সি ছাগলা: হ্যাঁ, আমি যা বলতে চাই তা-ই। কিন্তু, এমনকি ফ্রাঙ্কোর ক্ষেত্রে, তিনি একজন বহিরাগত হিসেবে এসেছিলেন। কিন্তু এটা সত্য যে তিনি গৃহযুদ্ধের সময় স্পেনের সাংবিধানিক সরকারকে পরাভূত করার চেষ্টা করেন। স্যার, কিন্তু সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠরা সংখ্যালঘুদের চেপে রাখছিল – এখানে তেমনটা না। ইয়াহিয়া খান মূলত সংখ্যালঘুর প্রতিনিধিত্ব করছেন এবং এই সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ কে রাজনৈতিক উপায়ে পরাভূত না করতে পেরে লক্ষ লক্ষ হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছিল যাতে এরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়।

স্যার, বাংলাদেশের স্বীকৃতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারত আইনগত, বৈধভাবে এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে, আমরা বাংলাদেশে অস্ত্র সরবরাহ করতে পারতাম। এবং যদি আমরা বাংলাদেশকে অস্ত্র সরবরাহ করি বাংলাদেশ একটি অবস্থানে যেতে পারত। যদিও হয়ত পুরোপুরি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বহিষ্কার করতে পারত না কিন্তু বাংলাদেশের একটি বড় অংশ দখল করতে পারত। কিন্তু বাংলাদেশকে অস্ত্র দান না করে অথবা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিয়ে উল্টো আমাদের দেশের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনার প্রক্রিয়া করার সুযোগ তাদের করে দেয়া হয়েছে। এখন কি লাভ হল? অসহায় বাংলাদেশকে সেনাবাহিনী শেষ করে দিচ্ছে। তারা সেই এলাকা দখলে রেখেছে। এত কিছুর ভেতরেও সেখানে গেরিলা কার্যক্রম চলছে। কিন্তু তাদের দিকে কোন যত্ন নেই। আমি বলছিনা যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে আর অস্ত্র সরবরাহ করে শরনার্থি ঠেকানো যাবে।

তারা ভারতে আসছে এবং এই সরকার তা ঠেকাতে পারত। আমি বলছি ঠেকানো যেত। এই ৬ মিলিয়ন উদ্বাস্তু এখানে থাকতো না।

এখন, স্যার শরণার্থীদের ব্যাপারে আমি কিছু বলতে চাই। স্যার, আমি শরণার্থীদের জন্য কাজ করার জন্য সরকারকে অভিনন্দন জানাই। আমি মনে করি আমরা একমাত্র দেশ যারা তাদের গ্রহণ করেছি, তাদের গৃহায়ন ও তাদের খাওয়ানোর ভার গ্রহণ করেছি- এবং এজন্য আমরা গর্বিত। এটা আমাদের অর্থনীতির উপর একটি অসাধারণ বোঝা। কর ব্যবস্থা যথেষ্ট উঁচু কিন্তু আমি দেখতে পাই আমার বন্ধু, অর্থমন্ত্রী, খুব শীঘ্রই লোকসভায় সম্পূরক মঞ্জুরী জন্য অনুরোধ করতে যাচ্ছেন। কিন্তু, স্যার আমরা আর কতকাল এই বোঝা বহন করতে যাচ্ছি? আমি এই হাউজে বলতে চাই যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের সব সময় সাহায্য করবেনা। যদিও কিছু দেশ থেকে আমরা অনেক অর্থসাহায্য পেয়েছি।

শ্রী কল্যাণ রায়: খুব সামান্য পেয়েছি।
শ্রী এম সি ছাগলা: কিন্তু এটা শুধুমাত্র এই বছরের জন্য। এই শরণার্থীরা যদি বছর বছর আসা অব্যাহত রাখে তাহলে আমরা সবাইকে ম্যানেজ করতে পারবোনা। এবং এটা আমাদের অর্থনিতিকে মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন করবে। ৬ মিলিয়ন লোক কে মেনে নেয়া অনেক কঠিন।

শ্রী কল্যাণ রায়: নয় মিলিয়ন মানুষ।

শ্রী এম সি ছাগলা: ইতিমধ্যে আমাদের দেশে অনেক বেকার সম্প্রদায় আছে। আমরা তাদের ভর্তুকি দিতে পারিনা। এটা অপমানজনক।

কিন্তু এই ছয় মিলিয়ন মানুষের ব্যাপারে …
এএন সন্মানিত সদস্য: ছয় মিলিয়ন এর বেশী, । প্রায় আট মিলিয়ন উদ্বাস্তু আছে।

শ্রী এম সি ছাগলা: এই ৮ মিলিয়ন মানুষকে প্রতি মাসে খাদ্য খাওয়াতে হবে। এই বোঝা বহন করতে হবে। সবাইকে কাপড় দিতে হবে। ভারত এভাবে কতদিন পারবে? প্রধানমন্ত্রী বলেছেন এখনো দেখতে যে এইসব শরণার্থীদের কিভাবে ফেরত পাঠানো যায়। মাননীয় মন্ত্রী, স্বর্গের নামে কসম করে জিজ্ঞেস করি দয়া করে আপনি কি বলবেন এদের ফেরত পাঠানোর পথ কি? কিভাবে প্রধানমন্ত্রী দেখতে পাবেন যে শরণার্থীরা ফিরে যাচ্ছে? তিনি তো তাদের ঠেলে বের করে দিতে পারবেন না। আপনিও পারবেন না।

শ্রী কল্যা রায়: তাদের মৃত্যুর পর তারা আধ্যাত্মিকভাবে ফিরে যাবে।

শ্রী এম সি ছাগলা – কিন্তু ছয় মিলিয়ন মানুষ মরতেও অনেক সময় নেবে। এবং তাদের আবার কিছু সন্তানও হবে। কোন উপায় নেই। আমি জানি যে, আমি নিজেই শরণার্থীদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে কোন পরামর্শ দিতে যাচ্ছি না।

এখন, স্যার আমাদের শক্ত হতে হবে। আমরা ভুলে যাই যে আমরা মহান জাতি। আমাদের ক্ষমতা বড় হওয়া উচিত। কিন্তু এমন আচরণ করছি যেন আমরা দ্বিতীয় শ্রেণীর ক্ষমতাসম্পন্ন দেশ।

শ্রী কল্যাণ রায়: হ্যা।
শ্রী এম সি ছাগলা – আমি এর সাথে একমত না। আমি এমন মনে করি না। আমাদের দেশ জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম। তাহলে আমরা কেন দ্বিতীয় শ্রেণীর জাতি হয়ে থাকব? কিন্তু, স্যার, আমরা নিজেদেরকে তাই করে রেখেছি। আমি বলি কেন। আমরা কখনো উদ্যোগ নিতে পারিনা। কোন সমস্যা দেখা দিলে, আমরা প্রথম মনে করি চীন কী করবে। আমরা মনে করি পাকিস্তান কী করবে, রাশিয়া কিভাবে কাজ করবে …
এএন সন্মানিত সদস্য: …… কিভাবে মিশরের প্রতিক্রিয়া হবে।
শ্রী এম সি ছাগলা: হ্যাঁ, আমরা মনে করি কিভাবে মিশরের প্রতিক্রিয়া হবে। কিন্তু আমি জানতে চাই পাকিস্তান কি কোনোদিন মনে করে ভারতের প্রতিক্রিয়া কি হবে? এই হাউজ; সরকার পক্ষ বা আমার বন্ধু এটা বলেন আর না নাই বলেন; তারা আসলে অন্য কারো স্বীকৃতির জন্য অপেক্ষা করছেন। তারা রাশিয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। রাশিয়া এটা আমাদের জন্য কেন করবে? আমরা রাশিয়ার কাছে কি চাই? কেন আমরা কারো জন্য অপেক্ষা করব? স্যার, অতীতে, অনেক অনুষ্ঠানে, যখন শ্রী জওয়াহারলাল নেহেরু প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তিনি কোথাও অন্যায় হলে উঠে দাঁড়িয়েছেন। যা সমগ্র বিশ্ব জানে। প্রতিটি ক্ষেত্রে যখন কোথাও স্বাধীনতা বিপন্ন হয়েছে যখন যেখানে অত্যাচার ছিল, অবিচার ছিল, তিনি উঠে দাঁড়িয়েছেন – কোনোদিন অন্যের জন্য অপেক্ষা করেন নি। তার কথা সমস্ত এশিয়া শুনত।

স্যার, এটাই আমাদের করতে হবে। আমি বিশ্ববাসীর মতামত সম্পর্কে বলব। রেজল্যুশন বলছে যে সেশন শেষের আগেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হবে। আমি বলব এখনি স্বীকৃতি দিন। খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে। অন্যথায় এটা একটি বিলম্বিত জাতি হয়ে যাবে – তাই এখনই আমাদের কিছু করতে হবে। অন্তত আমরা বিশ্বকে জানাতে পারি যে আমরা এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করা শুরু করছি। বিশ্বের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানতে পারি। আমি আরো হতাশ, বিশ্ব বিবেক বাংলাদেশে কি ঘটছে তা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে না। বিশ্ব বিবেকের কি ঘটেছে? তারা নিঃশব্দ, নীরব বা মৃত হয়ে আছে। জোট নিরপেক্ষ অবস্থার কি পরিবর্তন ঘটেছে? আফ্রিকায় এবং আরব বিশ্বে যা ঘটছে – আমি পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে সবসময় পাশে দাঁড়িয়েছি। ইউ এ আর এর ব্যাপারে আমাকে কথা শুনতে হয়েছে।

আমি নাসিরের পাশে দাঁড়িয়েছি। কারণ সে সেক্যুলারিজমের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিল। এবং আমি জানি আমি তখন ঠিক করেছিলাম। কিন্তু আজ আমাকে বলতেই হচ্ছে যে তারা ধর্মান্ধ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। স্যার, আমি আপনার ধৈর্য বিচ্যুতি ঘটাতে চাই না। আমি কি এক বাক্যে উপসংহারে আসতে পারি? সরকার যা করছেন তার পরিণতি তাকে ভোগ করতে হবে। যদি জাতীয় সার্থে কিছু করা হয় সেটা যাই হোক না কেন করা উচিৎ। পাকিস্তান যদি যুদ্ধ করতে চায় তাহলে আমরা পারব। আমরা আগেও পেরেছি আবারো পারব। পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে একটি কথা মনে করিয়ে দিতে চাই – পাকিস্তান সবসময় আমাদের শত্রু থাকবে। চীন নিয়ে আমি ভিত না – তারা শুধু কিছু হাউ-কাউ করে। এর বেশী – অর্থাৎ কোন আক্রমণ আমি তাদের কাছ থেকে হবে বলে মনে করি না। সরকারের আজ যা দরকার তা হল সাহস। এবং তা জাতীয় স্বার্থে করতে হবে। আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আশ্বাস দেই যদি তিনি ভারতে আজ গণভোট নেন তাহলে ৯০% জনগণ বাংলাদেশের স্বীকৃতির পক্ষে রায় দেবে।

শ্রী বিপিনপাল দাস (আসাম):বাংলাদেশ সম্পর্কে এই হাউজে যা আলোচনা করা হয়েছে বার বার সেটাকে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ইস্যু ধরা যাবেনা। এটি একটি আন্তর্জাতিক প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এটা আমরা শুধুমাত্র বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামের ভিত্তিতে নয় বরং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ও ধরে নিয়ে আলোচনা করতে পারি।

[জনাব.ডেপুটি চেয়ারম্যান]

এটা একেবারে ভুল হবে যদি কেউ বিশ্বাস স্থাপন করে যে পাকিস্তান ইসলামের জন্য বা মুসলমানদের স্বার্থ দেখছে। চার মাসের মধ্যে বাংলাদেশে যা ঘটেছে তাতে সন্দেহ নেই যে জীবন, সম্মান এবং এমনকি -লক্ষ লক্ষ মুসলমানদের সম্পত্তি একটি মুসলিম সরকারের হাত একেবারে অনিরাপদ হয়ে আছে। তারা দাবি করে তারা ইসলামী আইন অনুযায়ী পরিচালিত। বাংলাদেশে মুসলিম জনসংখ্যার উপর মুসলিম সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার ব্যাপ্তি ২০ বছর ধরে পশ্চিম এশিয়ায় ইহুদীরা আরবদের যে দুর্ভোগ সৃষ্টি করেছিল সেটাকেও ছাড়িয়ে গেছে। সবার দেখা উচিৎ পাকিস্তান বা ভারতের মধ্যে কোন দেশ জীবন, সম্পত্তি ও মুসলমানদের সম্মান দেয়ার দিক থেকে বেশী নির্ভরযোগ্য। বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক ভুল ধারনা বহিবিশ্বে দেয়া হয়েছে।

সত্য এটাই যে পাকিস্তান কোনোদিন মুসলমানদের জন্য ভাল কিছু করেনি। এটা অ্যাংলো-আমেরিকান ষড়যন্ত্র ও পুঁজিবাদী-আমলাতান্ত্রিক সমর্থিত চক্রান্ত যার ফলে পাকিস্তানের দরিদ্র জনসাধারণ শোষিত হচ্ছে এবং অন্যদিকে ভারতের বিপক্ষে একটি সামরিক উষ্ণতা সৃষ্টি করছে। ব্রিটেন, কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আন্তরিকভাবে কেউ ভারতের সমৃদ্ধি চায় না বা ভারত শক্তিশালী হোক তা চায় না। এবং তারা সবসময় পাকিস্তানকে ব্যবহার করছে তাদের নিজস্ব স্বার্থের জন্য। ব্রিটেন এখন গ্রেট পাওয়ার নাই তাই তারা তাদের দায়িত্ব হস্তান্তর করেছে আমেরিকার কাছে। আমেরিকা ছাড়া আর কোন দেশ বাংলাদেশ ইস্যুতে এতোটা জড়িত নয়। তারা গণতন্ত্রের কথা, মানবাধিকারের মানবিক মূল্যবোধের কথা বলে কিন্তু নির্লজ্জভাবে ওঁরা পাকিস্তানকে অস্ত্র ও ত্রাণসাহায্য করছে। আর পাকিস্তান তা দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের উপর গণহত্যা অব্যাহত রাখছে। আসলে এই উপমহাদেশে পাকিস্তান আসলে আমেরিকান বেইস স্টেশন হিসাবে কাজ করছে তাদের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নিদর্শন স্বরূপ। আর পাকিস্তান পেন্টাগন এবং সিআইএ’র এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে।

স্যার, আমি বিস্মিত হবোনা যদি দেখি যে চীন পাকিস্তানের সামরিক জান্তার পক্ষে তথা বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। আমেরিকার সাথে তাদের সাম্প্রতিক কথাবার্তায় তা স্পষ্ট হয়। এই কমিউনিস্ট দেশটি স্বাধীনতা কামী একটি দেশের বিরুদ্ধে যাচ্ছে যারা সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রাম করছে। শোষণ, গণহত্যা, ধর্ষণের সাথে জড়িত একটি শাসকদের সমর্থন করছে। চীন এর আসল উদ্দেশ্য আজ উন্মুক্ত হয়েছে। তাদের সাথে আমেরিকান সম্পর্কের সম্পূর্ণরূপে অন্য মাত্রায় উন্নয়ন হচ্ছে এবং আমি মনে করি না এটার সাথে বাংলাদেশ ইস্যু সম্পর্কহীন। বিশেষত যখন পাকিস্তান দালালের ভূমিকায় অবতীর্ন এই পাওয়ার পলিটিক্সের সময়। তাই এই অবস্থায় বাংলাদেশ প্রশ্নে আমাদের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। প্রথম যে কাজটা আমি সুপারিশ করব – আমাদের পররাষ্ট্রনীতির একটি তাৎক্ষণিক রিভাইজ দরকার – এবং সেটা চিন, আমেরিকা আর পাকিস্তানের জালে আটকা পড়ার আগেই করতে হবে। আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা করার জন্য একদিকে সোভিয়েত রাশিয়া ও অন্যদিকে জাপানের সাথে আমাদের বেশী ঘনিষ্ঠ হতে হবে। একটি দেশের বৈদেশিক আদর্শ তাদের আভ্যন্তরীণ সমাজব্যবস্থার উপর নির্ভর করে না। এটা উপর ভিত্তি করে এবং জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তার বিবেচনা উপর ভিত্তি করে করা উচিত। এই কারণে যে আমি দৃঢ়ভাবে বলছি রাশিয়া ও জাপানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য। এটি শুধুমাত্র এই দেশ নয় বাংলাদেশ বিষয়েও সহায়ক হবে।

বাংলাদেশের সংগ্রাম মূলত গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য। পাকিস্তান এক দেশ হিসেবে একতাবদ্ধ থাকবে নাকি ভেঙে যাবে সেটা আমাদের বিষয় না। সেটা পাকিস্তানের জনগণ সিদ্ধান্ত নিবে। কিন্তু আমরা গণতন্ত্রের মান, মানবাধিকার মান, ধর্মনিরপেক্ষতার মূল্যবোধ এবং সমাজতন্ত্রের মূল্যবোধ নিয়ে উদ্বিগ্ন। এই কোণ থেকে বিবেচনা করে আমরা পাকিস্তান সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রাম সমর্থন করেছি এবং বাংলাদেশের জনগণের প্রতি সমবেদনা ঘোষণা করছি। প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে: আপনি কর্ম পরিকল্পনার মধ্যে কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন? আমি মনে করি না এই ব্যাপারটা এখানে জনস্বার্থে আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু আমি নিশ্চিত অধিকাংশ সন্মানিত সদস্যরা এটা জানেন। আমি বিশ্বাস করি সরকার তাদের সাধ্যমত চেষ্টা করছেন। এখন, স্যার, এক জিনিস করা উচিত …..

শ্রী লোকনাথ মিশ্র (উড়িষ্যা): তারপর আমরা আলোচনা বন্ধ করব?

শ্রী বিপিনপাল দাস: আমি আসছি সে প্রসঙ্গে। আমি জানি আপনি সব সময়ই আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদীদের জন্য কথা বলেন। যে যুদ্ধে বাইরের শক্তির কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে করা হয় তার শেষ ফল ভালো হয়না। অতএব, বাংলাদেশ এবং তার মুক্তিবাহিনীর উচিৎ নিজের যুদ্ধ নিজেরাই করা। এই হাউজে গত অধিবেশনে আমি এটা বলেছিলাম। শরণার্থীদের থেকে ১ লাখ যুবকদের বেছে নিয়ে তাদের অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্য দিয়ে পাকিস্তান সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে তাদের স্বাধীনতার নিজস্ব যুদ্ধে নিজেরাই যেতে পারে। আমি বলছি এটা আমার পরামর্শ মাত্র এবং আমি এটা বিশ্বাস করি বলেই বলেছি। আগে এটা বলার পরে কেউ আমার কোথায় কর্নপাত করেনি। আমি এখানে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করতে পারব না। আমি আগেই বলেছি, এটা জনস্বার্থে হবে না। এখন বাংলাদেশে যা ঘটছে তাতে আমি মনে করি মুক্তিফৌজ তাদের অপারেশন সফল ভাবে করতে পারছে এবং পাকিস্তান আর্মির জন্য গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। তারা সঠিক পথে যাচ্ছে। এই কারণে এখন ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকদের পোস্ট করার জন্য প্রস্তাব দিচ্ছে। এর কারণ তারা মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রম থামাতে চায়। এটা হল পাকিস্তান-বাংলাদেশ ইস্যুটিকে ইন্দো-পাকিস্তান ইস্যুতে পাল্টে দেবার পশ্চিমা চাল। এই পদক্ষেপ নিতে চাচ্ছে তার কারণ মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি শাসকদের জন্য যে অপারেশন চালাচ্ছে তা গুরুতর সমস্যা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এমদের এই বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। পাকিস্তান আগামীকাল আমাদের আক্রমণ করলে অবশ্যই আমরা রুখে দাঁড়াবো এবং আমাদের দেশকে রক্ষা করব। কিন্তু আমি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি সরাসরি সশস্ত্র সংঘাতের মুখোমুখি হবার পক্ষে নই।

অতএব আমাদের সমগ্র নীতি হবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করা এবং সফল হবার জন্য তাদের নিজস্ব যুদ্ধ করতে সাহায্য করার জন্য ঐ সমস্ত লোকদের সাহায্য করা উচিত। আমি আমার মনের মধ্যে কোন সন্দেহ নেই যে, শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জনগণের জয় হবে। আমার মনে কোন সন্দেহ নেই যে, শেষ পর্যন্ত মুক্তি ফৌজ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাত থেকে তাদের দেশ স্বাধীন করতে পারবে।

এখন স্যার, এই হাউসে যা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে তা হল স্বীকৃতি। আমি মনে করি না এই হাউজে এমন কেউ আছে যা স্বীকৃতি দেবার বিপক্ষে। যদ্দুর মনে পড়ে, এমনকি পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছিলেন সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার বিপক্ষে না। প্রশ্ন হল যখন আমরা বলেছি, দেশের মানুষ বলেছে, তখন অনেক সদস্য বলেছেন, জনাব ছাগলাও বলেছেন, ইতিমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাংলাদেশের স্বীকৃতির ব্যাপার টি সিদ্ধান্ত আর কেউ নিতে পারবেনা। শুধু সরকার এই সিদ্ধান্ত নেবে। তারা পরিস্থিতির শ্রেষ্ঠ বিচারক। কোন পরিস্থিতিতে তারা এটা করবেন তা তাদের ব্যাপার। অতএব, আমি মনে করি সরকারকে চাপ দেয়া আমাদের জন্য যুক্তিযুক্ত। আমি আবারো বলছি যে মুক্তি ফৌজ তাদের মুক্তির যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া উচিৎ। বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য তাদের বসে থাকা উচিৎ নয়।

জনাব ডেপুটি চেয়ারম্যান: আমরা একটি প্রাইভেট মেম্বার রেজোলিউশন নিয়ে আলোচনা করছি। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ রেজোলিউশন। এবং স্বাভাবিকভাবেই অনেক সদস্য এই আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে চাইবে। প্রত্যেক সদস্য পনের মিনিট কথা বলার সুযোগ পাবেন। এই আলোচনায় বৃহৎ সংখ্যায় সদস্যবৃন্দ অংশগ্রহণ করতে চান – তাই কাউকে অতিরিক্ত সময় দেয়া যাবেনা। তাই আশা করি আপনারা ১৫ মিনিটে শেষ করবেন।

জনাব বিজু পাটনায়েক,

শ্রী বিজু পাটনায়েক (উড়িষ্যা): আমরা এর আগে এই হাউজে সদস্যদের মধ্যে এটা নিয়ে অনেক আলোচনা করেছি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এটা নিয়ে বিভ্রান্তিতে থাকতে পারেন না। এটি তার একটি সুনামের বিষয়, সম্মানহানিকর কিছু নয়। বাংলাদেশের প্রতিটি জিনিস নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করা উচিৎ। এই হাউজ থেকে করা সকল বিবৃতি সময়ে সময়ে বাংলাদেশে পৌঁছাবে। ট্রেজারি বেঞ্চ এবং বিরোধীদল এর সাথে আলোচিত মতামত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় উভয়ের মতের সাথে সাদৃশ্য আছে। কিন্তু দেখা যায় সরকার মাঝে মাঝে তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করছে যা এই হাউজের অনেকের কাছে সন্দেহজনক।

আমরা সংক্ষেপে গণহত্যা, নিপীড়ন, নজিরবিহীন ধ্বংস যজ্ঞ আর নির্যাতন শব্দগুলো নিয়ে অনেক আলোচনা করেছি। এর আগে এই হাউজের কোন এক সদস্য বলেছিলেন পার্টিশনের সময় প্রায় ৬ মিলিয়ন হিন্দু এই দেশে প্রবেশ করেছিল। কিন্তু এই ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের সময় সরকারী রেকর্ড বলে এই বছরের ১ জুন পর্যন্ত পূর্ববঙ্গ থেকে ৬.৫ মিলিয়ন মানুষ এসেছে আমাদের দেশে। বাংলাদেশ প্রশ্নে দ্বি-জাতিতত্ত্বের অসাড়তা উদ্ভাসিত হয়েছে – আমি বিনীতভাবে এর সাথে অসম্মতিজ্ঞ্যাপন করছি।

পূর্ববাংলায় দেশ ভাগের সময় প্রায় ১০ মিলিয়ন হিন্দু ছিল। ধরি তা এখন আরও ২ মিলিয়ন বেড়েছে। মানে মোট ১২ মিলিয়ন হিন্দু। তখন তাদের ছয় মিলিয়ন বেরিয়ে এসেছিল এবং এখন বাকি সাড়ে ৬ মিলিয়ন। জনাব ইয়াহিয়া খান ও পাকিস্তানের শাসকরা দ্বি-জাতিতত্ত্ব বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আমরা একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। তাই আমরা চাই এমনই একটি ধর্মনিরপেক্ষ মানসিকতার সরকার প্রতিবেশী দেশে থাকুক। জনাব মুজিবুর রহমান ও তার দল আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষ মতের উপর প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের আন্দোলন ব্যর্থ হলে পাকিস্তান শেষ হবেনা। ভারত শেষ হবে। আমি আবার বলছি, পাকিস্তান একটি শতভাগ ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে থাকবে। ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সম্পৃক্ততা উভয় দিকে হতে হবে। রেকর্ড অনুযায়ী ৬৫ লাখ হিন্দু এই গণহত্যার সময় পূর্ববঙ্গ থেকে চলে গেছে এবং এর মধ্যে ১৫-২৫ বছর বয়সী নারী গোষ্ঠীর সংখ্যা অনেক কম। কারণ এই সময়ে এদেরকে হয় পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর কাছে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অথবা মধ্য প্রাচ্যে বিক্রি করা হয়েছে। এগুলো সত্য জীবন কাহিনী।

স্যার আমাদের কবুতরের মত চোখ বন্ধ্ করে রাখার অভ্যাস আছে এবং বসে বসে ভাবতে থাকব যে সমস্ত বিশ্ব ভাল আছে। আসলে আমরা নিজেদের সাথেই ভিন্ডামি করছি। পুরো বিশ্ব ভারতের ইতিহাস পড়ে। ভারতীয় ইতিহাস নিয়ে একটি গভীর গবেষণা আছে বিশ্ব বাসীর কাছে। আমরা নিজেদেরকে একটি মহান জাতি মনে করি। আমরা সবচেয়ে জনবহুল একটি দেশ হতে পারি।

শ্রী এ ডি মনি (মধ্য প্রদেশ): আমরা কখনোই বলিনি।
শ্রী বিজু পাটনায়েক: আমরা নিজেদেরকে একটি মহাণ জাতি হিসাবে দেখি। আপনি কি সেটা খেয়াল করেছেন? এটা একটা জাতি, যা অত্যন্ত জনবহুল সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলির মধ্যে অন্যতম। তার মোট স্ট্রাইকিং পাওয়ার ৪ মিলিয়ন টন ইস্পাত যার মাত্র ৯ মিলিয়ন টন ধারণ ক্ষমতা।

আমাদের জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ হয়েও জাপান ৯২ মিলিয়ন টন ইস্পাত উৎপাদন করে- কোনো লোহা বা কয়লা ছাড়াই। এই হল আমাদের মহিমা, এই হল আমাদের মহান সরকারের অবস্থা। এই হল আন্তর্জাতিক রাজনীতির সাপেক্ষে আমাদের সার্বভৌমত্বের অবস্থা। আমাদের স্বীকার করতে হবে আমরা কি। আজ আমি নিশ্চিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বীকার করবেন যে আজ আমরা এশিয়ার মধ্যেও অপ্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারিনাই। চীন আমেরিকা সরাসরি লিঙ্ক ও অর্থনৈতিক লিঙ্ক এর পাশাপাশি ভারত অবহেলিত। এমনকি নেপাল থেকেও। তুলনামূলকভাবে, আমরা একটু ইসরাইলের অবস্থা দেখি। যে দেশ একজন নারী দ্বারা শাসিত হচ্ছে। যে দেশ ডায়ান এর মত প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আছে যারা তথাকথিত আরব বাহিনী বিতাড়িত করেছে। যারা মিসরের সমগ্র বিমানবাহিনীকে পরাস্ত করেছে এবং মিশর তার মাথা উঁচু করতে পারেনি। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের সাথে আমাদের যুদ্ধের সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রী স্বীকার করবেন, আমাদের বিমানবাহিনীর ঘাঁটি কালিকুন্ড পূর্ব সেক্টর ও পাঠান কোট পশ্চিম সেক্টরে শেষ করে দেয়া হয়েছিল। তারা এসে আমাদের জঙ্গী বিমান ধ্বংস করে চলে গেছে – আমাদের কিছু করার ছিলোনা। আমরা প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বিবৃতির জন্য প্রস্তুত আছি। যদি প্রস্তুত থাকি তাহলে আমরা ভিত কেন? শুনছি একটি রেজোলিউশন হাউসে পাশ হতে পারে যে আমরা বাংলাদেশকে স্বীকার করব শুধু তাদের জিনিসপত্র দিয়ে সাহায্য করার জন্য। তারা যাতে তাদের নিজেদের যুদ্ধ করে যেতে পারে সেই ব্যাপারে। জনাব মুখার্জী বলেন, এটা এই অধিবেশনের শেষ দিকে করা হবে। জনাব ছাগলা বলেন এটা গতকাল সম্পন্ন করার কথা এবং যদি তা না করা হয় তাহলে আজ করা উচিৎ। জনাব ডেপুটি চেয়ারম্যানকে আমি রেকর্ড করতে বলছি যে এই সরকার আসলে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি কোনোদিন দেবেনা।

শ্রী শীল ভদ্র ইয়াজি(বিহার): প্রশ্ন

শ্রী বিজু পাটনায়েক: আমি আপনাকে কারণ বলব

শ্রী মাহাভির টায়গি (উত্তরপ্রদেশ): আমরা ইতিমধ্যে স্বীকার করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

শ্রী বিজু পাটনায়েক: আমরা বাংলাদেশকে কোনোদিন স্বীকৃতি দেবনা। এই সাহসী মুক্তি বাহিনীকে ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসন শুধুমাত্র শেষ করে দেবেনা বরং পরবর্তী ২০ বছর ধরে তাদের শাসন চলতে থাকবে। আমি এই কথা ঐতিহাসিক কারণে রেকর্ড করে রাখতে বলছি।

শ্রী শীল ভদ্র ইয়াজী: আপনি ভুল বলছেন।

শ্রী বিজু পাটনায়েক: আমি আপনাকে বলছি কেন। আমি আপনাকে আমার মূল্যায়ন বলব। এই সরকার পা ঠাণ্ডা করে ফেলেছে। আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর জন্য এই সরকার ১২০০ কোটি রুপি বরাদ্দ রেখেছে যেখানে পাকিস্তান রাখে ৩৫০ কোটি। তাদের কি জন্য প্রস্তুত করা হয়? আমরা কেন ভীত? আমাদের মানুষ মাটির উপর গুলি খেয়ে পড়ছে। গতকাল আমি শুনে অবাক হলাম যে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলছেন আমাদের সীমান্ত বিএসএফ এর দায়িত্বে।

বিএসএফ, বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের মর্টার নেই, আর্টিলারি নেই। তাহলে কিভাবে আমরা দূরপাল্লার ফায়ারিং করব? কে কাকে বোকা বানাচ্ছে জানি না? ৩৫০ কোটির বিপরীতে সরাসরি বাজেটে ১২০০ কোটি রুপির বাজেট। এছাড়া এর বাইরে আমরা বিএসএফ, এসএসবি, আসাম রাইফেলস, এয়ার ফোর্সের সব সীমান্ত পোস্ট এর বাহিনীকে খাওয়ানোর পিছনে, সীমান্ত সড়ক নির্মাণে ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি রুপি খরচ করি। আমাদের প্রতিরক্ষা প্রচেষ্টার সমর্থনে ৫০০ কোটি রুপি ব্যয় করি। পাকিস্তানের মত আমাদের ৯ টি ডিভিশন আছে। ৩১ মার্চ যদি আপনি স্বীকৃতি দিতেন এবং বাংলাদেশে অস্ত্র ও অন্যান্য সহায়তা পাঠাতেন – তখন সেখানে পাকসেনা ছিল মাত্র ২ ডিভিশন – সেক্ষেত্রে ২ দিনে এই সমস্যা শেষ করে ফেলা যেত।

শ্রী রাজনারায়ণ(উত্তরপ্রদেশ): ঠিক

শ্রী বিজু পাটনায়েক: অথচ আমরা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে চারটি ডিভিশন হতে দিয়েছি। আমরা তাদের গত ছয় মাসে আরো দুটি ডিভিশন বাড়ানোর সময় দিয়ে দিয়েছি। এবং আমরা এখনো বিবেচনা করিনি যে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী কতটুকু সতর্ক থাকবে। অনুপ্রবেশ, বিমান অনধিকারপ্রবেশকারী, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, এগুলো কতটুকু তারা করতে পারে। অতএব, আমি বললাম, আমাদের সরকার ভীত নয়। আমি একটি কথা রেকর্ড করে রাখতে বলি। যদি পাকিস্তানীদের ভয় করে তাহলে ৯ পায়ের চিনাদেরও ভয় করবে। আমি বলতে চাই যে ভারতের সশস্ত্র বাহিনী চীনাদের ভয়ে ভিত। আমি এটা বলে দিলাম। একদিন আমি এই হাউসে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীকে একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করব এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী উত্তর দেবেন। আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর ধীশক্তি কি? আমাদের কমান্ড বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চীফ এবং জেনারেলদের যুদ্ধ ভীতি কতটুকু? এই হাউস সে প্রশ্নের উত্তর জেনে বিস্মিত হবে।

শ্রী বিনিনপাল দাস এর: স্যার, সেনাবাহিনীর সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করা দায়িত্বশীল সদস্যের জন্য শোভনীয় নয়।
শ্রী বিজু পাটনায়েক: আমি এই দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছি। আমি আন্ডারগ্রাউন্ড মুভমেন্ট চালিয়েছি। আমি চার বছর ধরে ব্রিটিশ কারাগারে ছিলাম। আর আমার এটা বলার অধিকার আছে।

শীর বিপিন পাল দাস : আমরা এও জানি কি জনাব বিজু পাটনায়েক চীনা হামলার সময় কি করেছেন।

শ্রী বিজু পাটনায়েক: আমার রেকর্ডে জন্য নেহেরুকে জিজ্ঞাসা করুন।
শ্রী কৃষাণ কান্ত (হরিয়ানা): পয়েন্ট অব অর্ডারে এই হাউসে আমরা একটি গুরুতর ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করছি।

শ্রী রাজ নারায়ণ : হ্যাঁ।
শ্রী কৃষাণ কান্ত: আমরা কি পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে সেটা নিয়ে আলোচনা করতে পারি। কিন্তু কারো হতাশাজনক কোন মন্তব্য করা এই মুহূর্তে ঠিক নয়।

শ্রী রাজ নারায়ণ : পয়েন্ট অব অর্ডারে উপর …
ডেপুটি চেয়ারম্যান: দয়া করে বসুন।

শ্রী সুন্দর সিং ভান্ডারি (রাজস্থান): স্যার, আপনি আগে সব কিছু শুনুন।

শ্রী রাজ নারায়ণ : আমরা সবকিছু জানতে চাই।

শ্রী বিজু পাটনায়েক: জনাব কৃষাণ কান্ত, আপনি যা বলছেন তা সঠিক নয।
ডেপুটি চেয়ারম্যান: দয়া করে বসুন।

শ্রী রাজ নারায়ণ – মহোদয়, একটি বৈধতার প্রশ্ন। আমি বলতে চাই, যাদের কারণে ভারতের দাবী অংশ নস্যাৎ করা হয়েছে, নেফা হারিয়েছে, কাশ্মীর হারিয়েছে তাদের বলার অধিকার আছে। ইনি রাবিশ বলেছেন।

শ্রী কৃষাণ কান্ত: কোন সদস্য শৃঙ্খলাভঙ্গের অধিকার পাননি।
(বাধা)

শ্রী রাজ নারায়ণ – যারা দেশের স্বাধীনতা বিক্রি করেছে তারা আজ এখানে চিৎকার করছে- দালাল কোথাকার।

শ্রী কৃষাণ কান্ত: জনাব ডেপুটি চেয়ারম্যান, আপনি শুধুমাত্র এই হাউজের অভিভাবক নন, আমাদের জাতীয় স্বার্থের ও অভিভাবক।

শ্রী রাজ নারায়ণ : আপনি জাতীয় স্বার্থের কী জানেন? আপনি জাতিকে বিক্রি করেছেন।

বিরোধী নেতা (শ্রী এম এস গুরুপদস্বামী) – আমি কি কিছু বলতে পারি?

শ্রী কৃষাণ কান্ত: আমাকে আগে শেষ করতে দিন।

শ্রী রাজ নারায়ণ: না, না. আমরা পয়েন্ট অব অর্ডারে….

শ্রী বিজু পাটনায়েক: জনাব কৃষাণ কান্ত, জাতি এই হাইজের চেয়ে বড়।
শ্রী কৃষাণ কান্ত: স্যার, আমাদের সশস্ত্র বাহিনী বা আমাদের জনগণের ক্ষমতার নিন্দা করে কোন বক্তব্য দেয়া উচিৎ নয়।

শ্রী সুন্দর সিং ভান্ডারি: এটা কি?

শ্রী রাজ নারায়ণ – এই সরকার সশস্ত্র বাহিনীকে দূষিত করেছে।

কিছু সন্মাঞ্জনক ব্যাক্তি: না না

কিছু মাননীয় সদস্য: হ্যা, হ্যা।
(বাধা)

শ্রী আর টি পার্থ সারথি (তামিলনাড়ু): পয়েন্ট অব অর্ডারে উপর ….
জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: দয়া করে বসুন। আমি গুরুপদ স্বামীকে ডেকেছি।

শ্রী এ জি কুলকার্নি: স্যার, আমি চাই।

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: দয়া করে বসুন।

শ্রী উ জি কুলকার্নি: আমি বলতে বলা হয়েছে।
পয়েন্ট অব অর্ডার আছে।
(বাধা)
(বাধা)
এ ধরনের আজেবাজে কথা অবিসন্বাদিত যেতে পারে না।

শ্রী সুন্দর সিং ভান্ডারি: আপনার আজেবাজে কথা চলছেই ….

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: আপনি বসুন।

শ্রী উ জি কুলকার্নি এই দেশের সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে নয়।

শ্রী এল এন মিশ্র. (বিহার): দয়া করে একটু উদার হন।

শ্রী গুরু পদ স্বামী: আমি জানি শ্রী বিজু পাটনায়েক আমাদের সামরিক বাহিনীকে কলঙ্কিত বা ছোট করতে চাননি।

একজন সম্মানিত সদস্য: সে আর কী কী করেছেন?
শ্রী বিজু পাটনায়েক তিনি আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডারদের সম্পর্কে বলেন …..
(বাধা)
জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: অর্ডার অর্ডার। বসুন।

শ্রী উ জি কুলকার্নি: আমি বুঝতে পারি আপনি কি বলছেন।

শ্রী পাঁজ নারায়ণ : আমরা কাউলের ইতিহাস দেখেছি।

শ্রী এল এন মিশ্রের: তিনি আর নেই। চলে গেছেন

শ্রী আকবর আলি খান (অন্ধ্র প্রদেশ): তিনি একজন সিনিয়র রাজনীতিবিদ। আমি তাকে জেনারেল বা আমাদের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কিছু বলতে দিচ্ছিনা।

শ্রী গৌরি পদ স্বামী : শ্রী আকবর আলী খান আমাদের ভাইস- চেয়ারম্যান। তার অন্তত জানা উচিত যে, তার কথা বলা উচিত নয় যখন আমি দাঁড়িয়ে আছি।

এই হাউসের কেউ সেনাবাহিনীকে কলঙ্কিত করার জন্য কিছু বলেনি। একই সাথে এই হাউসের সদস্য হিসেবে, আমাদের সত্য জানা উচিত এবং নির্দিষ্ট কিছু কথা অকপটে প্রকাশ করার আছে। শ্রী বিজু পাটনায়েক সেনাবাহিনীর কমান্ড সম্পর্কে কিছু প্রকাশ করেছেন ….

একজন সম্মানিত সদস্য: আমাদের আর্মি সম্পর্কে।
শ্রী এম এস গুরুপদ স্বামী: তিনি সেনাবাহিনী সম্পর্কে উল্লেখ করেন। আমি আপনার সাথে আছি।

শ্রী এ জি কুলকার্নি: কমান্ডার তাঁর অধীনে আর্মি দের অনুপ্রাণিত করবেন। কীভাবে আপনি কমান্ডারকে অসন্মান করেন?

শ্রী কৃষাণ কান্ত; কার্যধারায় এটা করা না ….
(বাধা)

শ্রী এম এস গুরুপদ স্বামী; আমি আপনার কাছ থেকে জানতে চাই, এটা ভারতের দেশপ্রেমিক নাগরিকের কর্তব্য কিনা যে একজন সদস্য হাউজের দৃষ্টি আকর্ষন করবে? যদি সেই সদস্যের সেনাবাহিনীর সম্পর্কে ভালো ধারনা থাকে সে কি তা বলার অধিকার রাখে না? সে তো তার দায়িত্ব পালন করছে। সেবা দিচ্ছে। তার উৎসাহটা আপনারা নিচ্ছেন না কেন?

শ্রী আকবর আলি খান: এটা প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর সঙ্গে ব্যক্তিগত আলোচনায় করা যেতে পারে ….এখানে করলে তা সমস্ত বিশ্বের কাছে চলে যাবে —

(বাধা)
শ্রী সুন্দর সিং ভান্ডারি: একটি বিষয় উল্লেখ করার মানে এই নয় যে তিনি পুরো সশস্ত্র বাহিনীকে অপমান করেছেন।

শ্রী আর টি পার্থ সারথি: এই ধরণের আলাপ আলাপ এই ধরনের পরিণামে আমাদের দেশের নিরাপত্তা ক্ষতি করতে পারবে না ….
(বাধা)

সরদার শরণ সিং: শ্রী বিজু পাটনায়েক একটি ভালো পয়েন্ট উল্লেখ করেছেন। সবচেয়ে ভালো হয় এটাকে আর আর দির্ঘায়িত না করলে। তাকে পরের পয়েন্টে আসতে বলুন।

শ্রী বিজু পাটনায়েক: আমি অবশ্যই বলছি যে সন্মানিত সদস্যরা কার্যধারার মধ্য দিয়ে যাবেন এবং দেখবেন আমি আর্মড ফোর্সেস কে কলঙ্কিত করেছি কিনা। আমি যা বলেছি তা এই হাউজের জানা উচিৎ কারণ আমি বলেছি বর্তমার আর্মি কমান্ডারদের অবস্থা সম্পর্কে।

একজন সন্মানিত সদস্য: তারা বিশ্বের মধ্যে সেরা।
শ্রী বিজু পাটনায়েক: আপনার মতামতের জন্য ধন্যবাদ।

আমি আবার বলছি কমান্ডারদের দায়িত্ব এখনো প্রমাণিত হয়নি। তারা ভিয়েতনামে বা ইস্রায়েলের দায়ানের মত প্রমাণ করতে পারেনি। আমি যা বলতে চাই তা হল সরকারের উচিৎ আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর পরীক্ষা করা। তারা কি জন্য যুদ্ধ করছে? কেন তারা যুদ্ধ করছে? স্যার, আমি বলছি, রেকর্ড করতে …. (বাধা) .. আমাদের সমস্ত কর্ম, আসলে, আমাদের সব প্রতিক্রিয়া, চীনা সম্পৃক্ততার লুকোনো ভয়। আমি বলছি রেকর্ড করতে। স্যার, আমরা গত পাঁচ বছরে…. (বাধা) .. দয়া করে এখন আমার কথা শুনুন। আমরা গত পাঁচ বছরে, ৯ টি মাউন্টেইন ডিভিশন করেছি হিমালয় এর সুরক্ষার জন্য। এটা কি সত্য নয়? যদি তাই হয়, তাহলে কমপক্ষে ১৩ থেকে ১৪ টি ডিভিশন তিব্বতের কাছাকাছি এলাকা আচ্ছাদন করে আছে। আমরা চীনা এর ভয়ে ভীত না। আপনি তাদের ক্ষেপণাস্ত্র না পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে যদি ভিত হন তাহলে বলব ভারতের দিকে একটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করলে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে তা চিন জানে – তাড়া এমন ভুল করবেনা। অতএব, সেখানে নয়টি বিভাগে আছে। এবং চৌদ্দ বিভাগের নয়টি আছে – মানে ৫০%। পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের নীতি কোন ভীতি থেকে নেয়া উচিৎ নয়। এবং সেখানে যতক্ষণ না একটি নেতৃত্ব আসছে ততোক্ষণ কোন ইনভল্ভ হওয়া উচিৎ নয়। তাছাড়া এই মুহুর্তে সেখানে সেনাবাহিনীর কর্মকান্ড থামানোর জন্য কোন নেতৃত্বও নেই। এবং সেখানে জাতীয় মর্যাদাও পিষ্ট হচ্ছে। এটাই আমার পয়েন্ট।

আমি, তাই জানতে চাই কেন আমরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছিনা। এর মানে হল শুধুমাত্র অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ। আপনি যদি বলেন যে আপনি এসব দিচ্ছেন তাহলে আমি বলতে চাই, এভাবে নয়। কেন ভারত, যার এক সময়ে পুরো বিশ্বের কাছে একটি নৈতিক প্রভাব ছিল তা কমে যাচ্ছে? গোপন পদ্ধতির জন্য? এটা গান্ধীজি বা নেহেরুর শিক্ষা নয়। কেন আপনি গোপন পদ্ধতি অবলম্বন করবেন? মান্ধাতার আমলের বন্দুক দান করে আর তাদের গেরিলা শিক্ষা দিয়ে.. (বাধা) .. জনাব শরণ সিং? এটা বিশ্বের সকলের কাছে জানা। এটা একদম শিশু সুলভ। (বাধা) আমি বলছি এটা সম্পূর্ণভাবে শিশুসুলভ।

জনাব ডেপুটি চেয়ারম্যান: দয়া করে এখন শেষ করুন।

শ্রী বিজু পাটনায়েক: আমাকে শেষ করতে দিন স্যার।

বিশ্বের সব বাহিনী জানে, সব সংস্থা জানে এবং আমি যা বলতে চাই …. (বাধা) হয় …. যে হাউসের জানা উচিত, কারণ বিশ্বের সবাই জানে এবং শুধু দুর্ভাগ্যবশত এই হাউসে তা গোপন করে রাখা হয়েছে। একমাত্র গোপন বিষয় হল আমাদের কোন সাহস নেই। তারপর স্যার আমি বলতে চাই যে গেরিলারা কোণ অঞ্চল দখল করে নাই, এবং গেরিলাদের কাছে শত্রুরা পরাজিত হয়নি। সে ক্ষেত্রে, উত্তর ভিয়েতনামীরা, যারা এখন দক্ষিণ ভিয়েতনামের সবচেয়ে ভয়ানক যুদ্ধ করছে, তাদের দখল করার কথা। এটা বিশ্বের সবচেয়ে তীব্র সবচেয়ে মারাত্মক যুদ্ধরীতি যা বিশ্ব ইতোপূর্বে দেখেনি। কিন্তু তারা দখল করতে পারেনি।

কিছু সন্মানিত সদস্য: এটা অন্য বিষয়।

শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: স্যার, আমি তাকে সংশোধন করতে চাই।

শ্রী বিজু পাটনায়েক: হ্যাঁ, আমি বুঝেছি।

জনাব ডেপুটি চেয়ারম্যান: দয়া করে এখন শেষ করুন।
শ্রী বিজু পাটনায়েক: আমি মাত্র দুই মিনিট সময় নেব।

অতএব, স্যার, আমি বলতে চাই, এই সরকার চিনের ভয়ে নিজের অজান্তে নেতৃত্বের অভাবে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছেনা যার ফলে দেশ নিচের দিকে চলে যাচ্ছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের আন্দোলন কেও ধ্বংস করছে।

এবং আমি জানি এভাবেই চলতে থাকবে। এখন উদ্বাস্তু সাত মিলিয়ন। কাল সেখানে দুর্ভিক্ষ হবে – আমি চাই ভবিষ্যতের জন্য রেকর্ড করা হোক। আরও পাঁচ বা ছয় মিলিয়ন আসবে।

(বাধা)

শ্রী এ জি কুলকার্নি: ট্যাক্স ফাঁকিবাজ
(বাধা)

শ্রী বিজু পাটনায়েক; আপনার মন্ত্রীদের কাছ থেকে এমনটাই আশা করা যায় – আপনার অর্থমন্ত্রী বলে কথা।

শ্রী এ জি কুলকার্নি: হাউস অবগত।

শ্রী বিজু পাটনায়েক: এই হাউসে অনেক কিছুই প্রচারিত আছে। যখন আমি নিজেকে ডিফেন্স করছিলাম তখন কেন আপনি ট্যাক্সের কথা তোলেন নি?

অতএব, আমি বলতে চাই, এই হাউস রেজোল্যুশন পাশের বদলে, পরিস্থিতির চাহিদা থাকা সত্ত্বেও, দেরি করায় প্রতিদিন আমাদের সন্মান নিচের দিকে চলে যাচ্ছে জেনেও কিচ্ছু করছেন না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার বিশ্ব ভ্রমণে যেয়ে শুধুই সহানুভূতি পেয়েছেন। অন্যদিকে পাকিস্তান পেয়েছে যুদ্ধোপকরণ এবং সমর্থন। আমি এই কথা বলছি এবং আমি চাই একথা রেকর্ড করা হোক। আমি গর্বিত বোধ করব যদি আমার ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণ করা হয় – কিন্তু আমি বলব এই সরকার এই সেশনে এমনকি পরের সেশনেও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবেনা। কারণ সাহসের সাথে এই কথা বলছি কারণ আমি জানি তাদের মাথায় প্যাঁচ ভর্তি। যুদ্ধ আসলে সেটা চালানোর মত নেতৃত্ব তাদের নেই। ধন্যবাদ।

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: আমি মনে করি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার ব্যাপারে আপনি অনেকটা জোর করছেন।

শ্রী সুন্দর সিং ভান্ডারি: আসলেই কি তাই?
জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: হাউস ২ টা পর্যন্ত মুলতবি করছি।

(হাউস তখন ১ টা ১৭ মিনিটে লাঞ্চের জন্য বিরতিতে যায়)

হাউস ২ টার সময় আবার বসে। ভাইস চেয়ারম্যান (শ্রী আকবর আলি খান) আসন গ্রহণ করেন।

লোকসভা থেকে বার্তা
The FINANE (No.2) বিল 1971

সেক্রেটারিঃ হাউজকে আমি জানাচ্ছি যে লোকসভার সেক্রেটারি স্বাক্ষরিত নিম্নলখিত মেসেজটি আমি পেয়েছি।

“কার্যপদ্ধতি ও লোকসভায় কার্যচালন এর বিধি ৯৬ এর বিধান অনুযায়ী। আমি এতদ্বারা ফাইন্যান্স (নং ২) বিল, ১৯৭১ লোকসভায় পাস হয়েছে ঘোষণা দিচ্ছি। ৩১ শে জুলাই, ১৯৭১ তারিখে তা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

২. স্পিকার নিশ্চিত করেছেন যে এই অর্থ বিল যা ভারতের সংবিধানের ১১০ আর্টিকেল অনুসারে হয়েছে।

স্যার, আমি এটি টেবিলের উপর রাখছি।
শ্রী ব্রহ্মানন্দ পান্ডা (উড়িষ্যা)- জনাব ভাইস-চেয়ারম্যান, আমি বরং বলব যে এটা দু: খজনক যে আমরা সংসদে আলোচনা করার সময় এই রেজোলিউশন আসল। এই হাউস বা অন্য হাউসে এবং ভারতে বসবাসকারী প্রায় সকল মানুষ একমত যে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া উচিৎ। এখন প্রশ্ন হল যেমন জনাব ছাগলা বলেছেন সিদ্ধান্ত সেভাবে হবে নাকি এই অধিবেশন শেষ হওয়ার আগে করা হবে নাকি সরকারের বলা উপযুক্ত সময়ে হবে সেটা জানা দরকার।

সুতরাং এটা দুই পক্ষের ঝগড়া করার মত বিষয় না। জনাব ছাগলা এবং অন্যান্যরা শুধু না ক্লাস ফাইভ বা সিক্স গ্রেডের ছাত্ররাও জানে বাংলাদেশে কি হচ্ছে, পূর্ববাংলার দুর্বিপাক, ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার বিবরণ। তাই আমি এসব বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করতে যাচ্ছি না।

স্যার, প্রশ্ন হল সরকার স্বীকৃতি দেবে কিনা। এখন স্যার, একটা কথা প্রচলিত আছে যে আপনারা গণতান্ত্রিকভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করতে পারেন না এবং কূটনীতিক ভাবেও না। এটা খুব স্পর্শকাতর বিষয়। আপনি যদি একটি যুদ্ধ পরিচালনা করতে চান তাহলে তা সংসদে পারবেন না কারণ এখানে কোন সেনাপতিকে স্থানান্তরিত করা বা কোন ব্যাটেলিয়নকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত করা এসব কিছু সম্ভব না।

শ্রী সুন্দর সিং ভান্ডারি: এই একটি সামরিক সিদ্ধান্ত?

শ্রী ব্রহ্মানন্দ পান্ডা: আমি একটা দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। কূটনীতিতে একটি জনপ্রিয় জিনিস হতে পারে না। আপনি সবকিছু বলতে পারেন না। আপনি আপনার সব মনের কথা প্রর্দশিত করতে পারেন না। দেশের কিছু মানুষ বলছে যে অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। স্যার, আমি স্বীকৃতির জন্য বলি, কারণ আমি যখন দেখি যে মুক্তিযোদ্ধারা ভুগছে সেটা আমাকেও ভোগায়। জনাব ছাগলা বলেছেন যে তার চোখ থেকে অশ্রু আসে, আমি তার অবস্থানে থাকলে আমার অশ্রু মুছে শান্ত মন নিয়ে পুরো পরিস্থিতি দেখে একটি সিদ্ধান্তে আসতাম। সরকারকে সব সময় পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকতে হয়। বাস্তবতার মোকাবেলা করতে সরকার কল্পনা প্রসূত কোন ধারনার উপর নির্ভর করতে পারেনা। এসব বিবেচনায় আমি এটি সরকারের উপর ছেড়ে দিতে চাই যাতে উপযুক্ত সময়ে তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

শ্রী রাজনুয়াইন: একই জিনিস?
শ্রী ব্রহ্মানন্দ পান্ডা: আমি আমার বিষয় বিবেচনা করব। এমন না যে আমি ট্রেজারি বেঞ্চ থেকে বলছি বলে আমি সরকারের সমর্থন করি। এমনকি যদি আমি রাজনারায়ণের সমর্থক হই আমি একই কথা বলতাম। কারণ এটা কোন দলীয় ব্যাপার না। এটা একটি জাতীয় প্রশ্ন। এখন, স্যার, তারা বলে থাকে যে, সরকারের অবিলম্বে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং তাদের অস্ত্র সরবরাহ ও অন্যান্য জিনিস দিয়ে সাহায্য করা উচিত।
তাহলে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। আমি এই বিষয়ে একমত। স্যার, স্বীকৃতি মানে, আপনি যুদ্ধের ঘোষণা দেন বা না দেন, পাকিস্তান যুদ্ধ ঘোষণা করবে এবং আপনাকে মুজিবনগরের সমগ্র বোঝা নিতে হবে -যেখান থেকে সরকার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে – সেক্ষেত্রে আপনি কি মনে করেন যে আপনি মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কাজ করছেন? নিশ্চই না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যাই হোক না কেন যুদ্ধ কিন্তু শেষ হয়নি। এমনকি ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের কি বোঝাপড়া হয়েছে? একটা রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছেছিল যার ফলে তাসখন্দ চুক্তি হয়। আজকাল যেখানেই যুদ্ধ শুরু হয় তা আসলে শেষ হয়না। আন্তর্জাতিক রাজনীতির যে কোনো ছাত্র জানে বিশ্বের রাজনৈতিক ক্ষমতার প্যাটার্ন পরিবর্তনের একটি প্রবণতা এখন চলছে। এটা এমন না যে আমেরিকার ভালোবাসা কমে গেছে। এর কারণ আমেরিকান ডলার জাপানি ইয়েন এবং পশ্চিম জার্মান মার্ক দ্বারা প্রভাবিত। এটা তাদের নিজস্ব অর্থনীতি এবং তাদের আন্তর্জাতিক বাজার রক্ষা করার কৌশল। এখন তারা এশিয়ার বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারছেনা কারণ জাপান সেখানে সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী এবং ইউরোপীয় বাজারের পশ্চিম জার্মানি তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। যুদ্ধবাজ ও পেন্টাগন মনে করে যে, যদি কোন বিশ্বে একটি অরাজকতা বিরাজ করে তাহলে তাদের উৎপাদন ৩০০ শতাংশ বাড়বে যার ১৫০ শতাংশ প্যাসিফিক অথবা আটলান্টিক এ এবং বাকি ১৫০ শতাংশ ডাম্প হবে নিজের দেশে। সকল মৃত্যু ও ধ্বংসের এই বণিকদের সংকোচন ঘটবে কারণ আমেরিকা নিজেও বেকারত্বে ভুগছে। গত আমেরিকান বাজেটে ঘাটতি ছিল। এটা জানা যে ডলারের শাসন সর্বত্র। তবে প্যাটার্ন পরিবর্তিত হচ্ছে। আমি জানি না এটা পরিবর্তন হবে কিনা কিন্তু প্রবণতা শুরু হয়েছে। আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও ভাস্রব পরিস্থিতির আলোকে বিবেচনা করে তারপর ব্যবস্থা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেক্ষেত্রে আমি সরকারকে পরামর্শ দেব তাড়াহুড়া করে কিছু না করতে।

আমেরিকার পরবর্তী খেলা কি? এটা শুধু বিশ্ব আবিষ্কার করা নয় – যেমনটি জনাব বিজু পাটনায়েক আমাদের আন্তর্জাতিক বিষয়ক মন্ত্রী গিয়েছিলেন। তিনি ইতিমধ্যে বিশ্ব ঘুরে এসেছেন। হতে পারে যে জনাব বিজু পাটনায়েক আরো নতুন কিছু বের করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এখন কি হল? আমেরিকা ভয়ঙ্কর ভিয়েতনাম যুদ্ধে হারছে। তারা চীনা বাজার দখল করছে। দ্বিতীয়ত, তারা ঠাণ্ডা মাথায় ভিয়েতনামের সাথে তাদের সম্পৃক্ততা থেকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। তারা এটা শান্তিপূর্ণভাবে করতে চায়। কিন্তু পেন্টাগনের যুদ্ধবাজরা নিক্সন প্রশাসনকে শান্ত থাকতে দেবেনা। তারা অন্য কোথাও যুদ্ধ করতে চান। তারা বাংলাদেশে ভিয়েতনাম বানাতে চান এবং যদি আমরা একানে নিজেদের জড়াই তাঁর মানে হবে আমরাও সেই যুদ্ধে জড়িয়ে গেলাম। এই যুদ্ধ এত তাড়াতাড়ি শেষ করা যাচ্ছে না। অতএব, আমি মনে করি যে সরকার সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন এবং জোয়ারের জলের মত আমাদের ব্যক্তিগত মতামত এর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লে হবেনা। ব্যক্তিগত মতামত একটি সরকার পরিচালনায় সাহায্য করেনা। যা সত্য তা মেনে নিয়ে আমাদের জাতীয় স্বার্থ মাথায় রেখে কাজ করতে হবে। আমরা আমাদের বন্ধু, জনাব বিজু পাটনায়েক কে অনুসরণ করব না। দুর্ভাগ্যবশত, তিনি একটি সামান্য নাটক করে হাউস থেকে বেরিয়ে গেছেন। তিনি এখানে এখন নেই। তিনি বলেন, ১৯৬২ সালে তিনি জনাব নেহরু কে উপদেশ দিয়েছিলেন। আমি বরং বলব যে জনাব পাটনায়েক জনাব নেহরু কে বিপথগামী করেছিলেন এই বলে বলে যে সীমান্তের ওপারে চীনা বাহিনী পর্যাপ্ত ছিল না এবং তার কথার উপর একটি দু: সাহসিক কাজ হলেও হতে পারত। তিনি শুধু যুদ্ধ ও যুদ্ধের কথাই বলেন। কে যুদ্ধ চায়? গরীব মানুষেরা যুদ্ধ চায়না। সমাজতান্ত্রিক, জনাব রাজনারায়ণ যুদ্ধ চায় না। পুঁজিপতিরা যুদ্ধ চায়, শিল্পপতি, গ্যাংস্টার রা – যারা অর্থ বানাতে চায় তারা যুদ্ধ চায়। আমি জানি যে, জনাব বিজু পাটনায়েক এর শিল্প খুব খারাপ অবস্থায় আছে এবং যদি যুদ্ধ হয় তাহলে তিনি পারমিট ও লাইসেন্স এর জন্য সরকারের কাছে আবেদন করবেন যাতে তিনি ক্ষতি পোষাতে পারেন। এটাই জনাব ভান্ডারী বা জনাব বিজু পাটনায়েক এর আগ্রহের মূল কারণ।

শ্রী সুন্দর সিং ভান্ডারি: এভাবেই কি আপনি জনাব বিজু পাটনায়েক এর ভাষণ ব্যাখ্যা করলেন?

শ্রী ব্রহ্মানন্দ পান্ডা: যুদ্ধ, তা বাংলাদেশের জন্য বা অন্য যেখানেই হোক আসলে একটা খারাপ জিনিস। আমি দুঃখিত যে জনাব পাটনায়েক আমাদের সব জেনারেলদের অপমান করেছেন। যদিও স্যার, আমি আপনার মাধ্যমে, এই হাউসে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর গৌরবময় কাজের জন্য শ্রদ্ধা জ্ঞ্যাপন করি। আমি আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর কাছে আপীল করি যে কোন খারাপ সময় আসতে পারে এবং তার পরিণামের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। যাতে করে মানুষ যারা আমেরিকার ভাষায় কথা বলেন, যারা জনাব রাজনারায়ণের ভাষায় কথা বলেন তারা তাদের অবস্থান জানতে পারবেন। আমি আমাদের সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে গর্বিত। তারা ১৯৬৫ সালে ভাল লড়েছে, তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভাল করেছে। আমি স্বীকার করি যে আমাদের জেনারেলরা প্রস্তুত নয়। আমি জানি যখন জনাব পাটনায়েক বলেন যে তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এবং চার বছর ধরে তিনি জেলে ছিলেন। কিন্তু ছাড়া পেয়ে কিভাবে তিনি এত বড় শিল্প গড়েন এবং কোটিকোটি টাকা কিভাবে বানালেন? এছাড়াও, শোনা যায় ১৯৬৫ সালে সালে তার মালিকানাধীন একটি বিমানও ছিল। যখন পণ্য নিয়ে জওয়ানদের উপর ফেলার কথা ছিল তখন তিনি অন্যত্র ফেলেছেন। শ্রী মঙ্গেশর প্রসাদ শাহী (উত্তরপ্রদেশ)। তিনি কংগ্রেসে ছিলেন।

শ্রী ব্রহ্মানন্দ পান্ডা: তিনি সে জাতীয় স্বার্থবিরোধী কাজ করে, তাহলে আমি তাকে রেহাই দেবনা।

শ্রী রাজ নারায়ণ – কোণ কোণ মন্ত্রী কত কামিয়েছেন, কত খেয়েছেন, কত লাইসেন্স নিয়েছেন এখানে তার বিবরণ দেয়া হবে। বাংলাদেশ সম্পর্কে বলুন।

শ্রী ব্রহ্মানন্দ পান্ডা: আপনার মাধ্যমে আমি জনাব রাজনারায়ণ কে বলতে চাই আপার জীবন একটি খোলা বই এর মত। বিশ বছর ধরে আমি রাজনীতিতে আছি। যদি কেউ প্রমাণ করতে পারে যে আমি একটি পয়সা অসৎভাবে করেছি, তাহলে আমি শুধুমাত্র এই হাউজ থেকে নয় রাজনীতি থেকে পুরাপুরি অবসর নেব। আমার জীবন একটি খোলা বই। এমনকি যদি জনাব ওম মেহতা, আগামীকাল কোণ ভুল করেন এবং যদি এটা আমার নজরে আসে, আমি জনাব ওম মেহতা কে অনুরোধ করব এবং আমিও সেটা যুক্ত করব। আমরা আমাদের জীবন ও দেশের একটি পর্যায়ে এসেছি। আমরা কোণ পুরানো কৌশল নিচ্ছি না। আমরা একটি পরিষ্কার এবং ভাল এবং একটি দক্ষ সরকার চাই। যাতে আমরা আমাদের লক্ষ্যের সঙ্গে এগিয়ে যেতে পারি। জনাব বিজু পাটনায়েক আরেকটি অভিযোগ করেছেন। আমরা গেরিলা প্রশিক্ষণ দিচ্ছি।

শ্রী সুন্দর সিংহ ভাণ্ডারী – এখানে কি বিজু পাটনায়েক – এর যোগ্যতার উপর বিতর্ক চলছে?
ভাইস চেয়ারম্যান (শ্রীআকবর আলি খান): আপনি পরে সুযোগ পাবেন।

শ্রী সুন্দর সিংহ ভাণ্ডারী – আপনি যদি বিজু পাটনায়েকের উপর বিতর্ক অনুমোদন করেন তাহলে আমিও তার বিপক্ষে অনেক কথা বলতে পারি।

শ্রী ব্রমানন্দ পান্ডা: জনাব ভান্ডারী, তুমি আমার উপর আস্থা রাখুন। আমি তার পয়েন্ট এর জবাব দিচ্ছি। আমি অপ্রাসঙ্গিক কিছু বলছিনা। তিনি আরেকটি অভিযোগ করেছেন যে আমাদের সীমান্তের ভিতরে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প আছে। এখানে আমরা গেরিলাদের ট্রেনিং দেই ও দেশে পাঠাই। স্যার, এটা সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা। অমূলক। সেখানে সীমান্তে আমাদের দিকে কোন শিবির নাই কিংবা আমরা সরাসরি অথবা পরোক্ষভাবে যুদ্ধবিগ্রহের সাথে জড়িত না। এটা তাদের যুদ্ধ, তারা যুদ্ধ করছে। যদি কেহ বলে যে আমাদের সীমান্তের ভিতরে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প আছে এবং আমরা সেখানে মানুষ ট্রেনিং দিয়ে পাঠাই। আমি বিনীতভাবে বলতে পারি যে, তিনি ইয়াহিয়া খানের ভাষায় কথায় কথা বলছেন। তার কথায় ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয় না। আমি বলতে চাই যে তারা তাদের নিজেদের যুদ্ধ নিজেরাই করুক। এবং তারা তা করছেন। শুধুমাত্র আমরা অনুভব করছি যে তারা দুর্বল।

স্যার, কিছু সন্মানিত সদস্য বলেছেন যে স্বীকৃতি দিলে কিছু সমস্যা আছে। তখন চীন কি করবে? যদি আমরা স্বীকার করি তাহলে আমাদের দেশ কি করবে? আমি বলতে চাই যে, আমরা একটি জাতি। আমরা পৃথিবী থেকে আলাদা কোণ ছোট দ্বীপ না। আপনি একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হন তাহলে তা ভালোই হবে। আপনাকে বাস্তবতা বুঝতে হবে। আপনাকে জানতে হবে কোথায় কখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মনে রাখতে হবে যে আপনার বন্ধুরাই আপনার শত্রু। সিদ্ধান্তের ফলে আমাদের রাজনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক জটিলতা কি হবে? সেগুলো ভুলে গেলে চল্বেনা। এজন্যই আমি আমার ভাল বন্ধু জনাব মুখার্জিকে বলছি, অধৈর্য হবেন না। আমি বাংলাদেশের ব্যাপারে তার অনুভূতি জানি। তিনি আমার চেয়ে নিবেদিত ও আন্তরিক এবং কারণ তিনি একই সংস্কৃতি ও ভাষার মানুষ।

শ্রী চিত্তরঞ্জন বসু (পশ্চিমবঙ্গ); এটা তার নিজের কোণ বিষয় না।

শ্রী ব্রহ্মানন্দ পান্ডা: ব্যক্তিগতভাবে এবং স্বতন্ত্রভাবে, আমি বরং তাকে ধন্যবাদ দেব। কিন্তু এসব কিছু ফ্লোরে খোলাখুলিভাবে আলোচনার বিষয় না। যখন এমন একটি রেজোলিউশন আসে যেটা বিতর্ক সৃষ্টি করে তখন বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। কেউ কেউ এর পক্ষে বলবে, কেউ বিপক্ষে। এবং এতে যুদ্ধের আদর্শ কমবে না। মনোবলও কমবে না – যারা গেরিলা আক্রমণ চালাচ্ছে। সুতরাং, আমাদের এই আলোচনা করা উচিৎ যে সরকার এর কাছ থেকে কি পাওয়া যায়। আমি বলিনা যে, মন্ত্রিসভায় তারা সবসময় ভাল সিদ্ধান্ত নেন এবং জনাব রাজনারায়ণের চেয়েও জ্ঞানী মানুষ সেখানে আছে। সরকার সব সময় বাস্তবতার উপর নির্ভর করেই কাজ করবে। আমরা সংবাদপত্র থেকে নির্দিষ্ট তথ্য জানতে পারি। অন্য জায়গা থেকে কিছু জানতে পারি। আমরা এসব বিশ্লেষণ করে উপসংহার টানতে পারি। কিন্তু তারা সেই মানুষ যারা বাস্তবতার সঙ্গে লড়াই করছেন। এসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেবেন তারা যুদ্ধ চান নাকি স্বীকৃতি।

শ্রী চিত্তরঞ্জন বসু: সংসদ ওভাররুল্ড করা হল।

শ্রী ব্রহ্মমানন্দ পান্ডা: আমি বলছি না যে সংসদ ওভাররুল্ড হল। আমি আপনার মতই একজন সংসদ সদস্য।
শ্রী কল্যাণ রায়: আপনি বরং আরও ভাল।

শ্রী ব্রহ্মানন্দ পান্ডা: অনেক কিছু আছে। আমি রিপোর্ট করতে চাই না।
শ্রী জগদীশ প্রসাদ যাদব – (বিহার) যখন হতে আপনি সারেন্ডার করেছেন তখন হতে আপনার ভাষা বদলে গেছে।
শ্রী ব্রহ্মমানন্দ পাণ্ডা – ভাষা তো ঠিক ই আছে, আপনার দেখা ও শোনার ভুল।

কেউ যদি বলেন যে, আমরা মুক্তি ফৌজ দের জন্য সীমান্তে প্রশিক্ষণের ব্যাবস্থা করেছি তাহলে আমি তার কথা খণ্ডন করব।

ভাইস-চেয়ারম্যান (শ্রীআকবর আলি খান): আপনাকে ধন্যবাদ।

শ্রী ব্রহ্মানন্দ পান্ডা: কিছু বন্ধু অতীতের ইতিহাস তুলে হাউসের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। কিন্তু আমার জন্য অতীত হল ভবিষ্যতের ইতিহাস গড়ার মাধ্যম। আমার বন্ধুরা ইতিহাস থেকে অনেক কিছু উদ্ধৃত করেছেন। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা ভবিষ্যতের চেহারা বদলে দিতে পারি। আমাদের রাষ্ট্রনায়কোচিত কাজ এবং আমাদের জ্ঞান দিয়ে আমরা এই প্রাচীন গৌরব ফিরিয়ে আনতে পারি। ভারত একটি মহান দেশ। আমি কখনই বলব না যে আমরা একটি মহান দেশ না। আমি এটা নিয়ে গর্বিত। আমরা একটি মহান দেশ, এবং আমরা সবসময় ইতিহাস তৈরি করতে উন্মুখ। এবং আমরা পিছনে পরে থাকিনা। আমাদের নিজস্ব ইতিহাস আছে। আমরা আমাদের ইতিহাস তৈরি করছি। আসুন ইতিহাসের দিকে একটু ভিন্ন ভাবে তাকাই।

ভাইস-চেয়ারম্যান (শ্রী আকবর আলি খান): আপনাকে ধন্যবাদ।
শ্রী ব্রম্মানন্দ পান্ডা: আসুন জনগণ হিসেবে আমাদের ইতিহাসের দিকে তাকাই। ক্যাপিটালিস্ট, মহারাজা এবং সৌদাগর হিসাবে নয়।

অতএব, স্যার সরকার যেহেতু উভয় হাউস ও দেশের মানুষের অনুভূতির ব্যাপারে সচেতন তাই তাদের বাস্তবতা বিবেচনায় আনা উচিৎ।

আবার, শেষ করার আগে, আমি আমাদের সশস্ত্র বাহিনী কে ধন্যবাদ জানাই তাদের গৌরবময় অর্জনের জন্য। আমি তাদের যে কোনো সময়ে তৈরি হওয়া বিপদের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলি। কারণ তারা আমাদের স্বদেশ এবং সীমানা রক্ষার জন্য প্রস্তুত। তারা আমাদের দেশের আসল মানুষ।

বিরোধী দলের নেতা (শ্রী এম এস গুরুপদস্বামী): জনাব চেয়ারম্যান, স্যার, আমি বিতর্ক সাবধানে শুনেছি এবং অনেক পয়েন্ট আমার বন্ধুরা উল্লেখ করেছেন। অতীতে আমরা এ বিষয়ে অনেক দরকারী আলোচনা করেছি। আমি অবাক হচ্ছি, স্যার, গতবারের সাথে এইবারে সরকারের মনোভাবে তেমন কোণ পরিবর্তন না দেখে। যদিও এর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ভারত সরকারকে দেখছি চুপ করে বসে থাকতে। এবং তাদের মুখের ওপর আমি আলস্য দেখতে পাচ্ছি। আপনারা যদি এছাড়া অন্য কিছু দেখেন আমাকে জানাবেন।

স্যার, জাতি এক ক্লান্তি লগ্নে দাঁড়ানো। খুব বিরল মুহূর্ত যা ফিরে আসবেনা আর। আমার মতে, স্যার, এই ধরনের মুহূর্ত মার্চ মাসে এসেছিল। ২৫ মার্চ। যখন মুক্তিযোদ্ধা দের জনপ্রিয় নেতা, তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তখন ভারত সরকারের একটি দরকারী ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা হয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম যে, সরকার বাংলাদেশে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য ভূমিকা পালন করবে। আমি ভেবেছিলাম তারা হবে স্বাধীনতার স্থপতি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল আমি মনে হচ্ছে তারা বাংলাদেশের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সমাধিফলক লেখার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। স্যার, আমি আগেই বলেছি, বিরল সুযোগ খুব কমই আসে। এবং ভারত সেই সুযোগ হারাচ্ছে।

ভারত সরকার যদি সঠিকভাবে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে, প্রজ্ঞা ও সাহস ও দূরদর্শিতা দেখায় তাহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাকে ভারত সরকারের সাড়া দিতে হবে। ভারত সরকার যদি স্বীকৃতি দিট তাহলে তা স্বাধীনতা অর্জনের পথে এগিয়ে যেত। স্যার, এটা একটা সুবর্ণ সুযোগ, এবং এই বিরল সুযোগ এখন আমাদের হাত থেকে সরে যাচ্ছে। স্বীকৃতির ফলে অভাবনীয় পরিবর্তন আস্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে যে নতুন সরকার গঠন করা হয়েছে সেটি নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা, যা একটি সার্বভৌম গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করবে। এটা ঠিক যে, ভ্রাতৃপ্রতিম গোষ্ঠী ও জাতির সহানুভূতিশীল সাহায্য ছাড়া কোন স্বাধীনতা সংগ্রামের সফলতা দ্রুত আসেনা। তাই এক রকম মানসিকতার দেশগুলোর উচিৎ সেই পরিস্থিতে এগিয়ে আসা। আমি এই সরকারের কাছে বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করি তারা তাদের ভূমিকা সঠিকভাবে পালন করেছে কিনা। আমাদের দুর্লভ সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। সরকার এখনও স্বীকৃতি দিতে দেরি করছে। জনাব শরণ সিং স্বীকৃতির বিরোধিতা করেন নাই। আবার পক্ষেও নাই। এটা খুব অশ্চর্য অবস্থা। এই হাউস এমন একটি অবস্থায় আছে যেখানে কোণ ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক কিছুই বোঝা যাচ্ছেনা। সরকার যদি বলে যে আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে নাই অথবা স্বীকৃতি দেব না তাহলে বলব সরকার হ্যামলেটের চরিত্রে অবতীর্ন। স্যার, আপনি কি জানেন হ্যামলেট কি করেছিলেন? করব নাকি করব না। সরকার আজ ঠিক তেমন অবস্থায় আছে। তাদের শক্তি আছে। ক্ষমতা আছে। আমি নিশ্চিত।

শ্রী শংকাঙ্ক শেখর সান্যাল (পশ্চিম বালা): সরকার খুব ভাল করতে জানে কি করতে হবে বা হবেনা।

শ্রী এম এস গুরুপদস্বামী – তারা সুযোগ পেয়েছে কিন্তু সরকার তাদের পক্ষ থেকে কোন সচেতনতা দেখাচ্ছেনা। বাস্তবতার কোন উপলব্ধি নেই। তারা জানে না যে সুযোগ তাদের হাত থেকে সরে যাচ্ছে। তারা সত্যি বিশ্বাস করেন যে ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার সুযোগ থাকবে। এটা তাদের দ্বিধা নাকি তাদের দোদুল্যমানতা তা জানিনা। তাদের এই বিলম্বের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের বড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। সরকার বলছে যে বাংলাদেশ ইস্যু তার একার নয়। এটি একটি আন্তর্জাতিক ইস্যু। এটা তারা ভুল করেছেন। প্রাথমিকভাবে এটা আমাদের ও তাদের যৌথ সমস্যা। এই মিথ্যা অবস্থান থেকে তারা নিজেদের ন্যায্যতা যাচাই করে তাদের প্রতিনিধিদের অন্য দেশে পাঠাবে। সিদ্ধান্ত না নিয়েই তারা বিদেশে ভ্রমণ শুরু করেছেন। তারা এটাকে একটি আন্তর্জাতিক ইস্যু বানিয়েছেন। কিন্তু ফল কি? আমরা এটিকে আন্তর্জাতিক ইস্যু হিসাবে দেখিয়ে অন্যান্য ক্ষমতা প্রয়োগ করে বিশেষ করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ঘুরিয়ে দিতে পারতাম। যখন বলা হবে এটা একটা আন্তর্জাতিক সমস্যা, তখন অন্য সরকারগুলো স্বাভাবিকভাবেই খুশি হবে এবং তারা হস্তক্ষেপ করতে পারবে বলে অনুভব করত। তারা অনেক কিছু সুপারিশ করতে পারত। এখন জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে পর্যবেক্ষক দল পাকিস্তান ও ভারত এর বর্ডারে পাঠানো হবে। আমরা এটার বিরোধিতা করেছি। তারা কি বুঝতে পারেনি যে উচ্চ ক্ষমতার দেশগুলো আমাদের পাত্তা দেবেনা? সোভিয়েত ইউনিয়ন উপমহাদেশে ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তন করতে আগ্রহী নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উপমহাদেশে ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তন করতে আগ্রহী নয়, আর চীন কিংবা আরব বিশ্ব, কিংবা অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ, কিংবা জাপানও নয়। এটাই বাস্তবতা। তারা ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তন করতে চায় না। তাই তারা যায় না যে পাকিস্তান সমস্যায় পরুক। তারা স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য চেষ্টা করছে। এটা কি আমাদের আগে থেকে জানা নাই? আমাদের অনেকেই আগে বলেছেন যে আমরা অসহায় মানুষর মত দেশে দেশে সাহায্য চাইতে যাবনা। আমার ধারণা আমরা যদি আরও ৩ মাস আগে যখন বাংলাদেশ সংগ্রাম শুরু হয় তখন যদি স্বীকৃতি দিতাম তাহলে অনেক ক্ষয়ক্ষতি ঠেকানো যেত এবং এত শরনার্থি আসতো না। আমাদের নিজেদের ভুলে উদ্বাস্তুরাএসেছে। বরং তারা যোদ্ধায় পরিণত হত। এটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। উদ্বাস্তুদের দেখাশোনা করতে হবে। পুরো দেশ বিপদে আছে। তারা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভুলের জন্য আজ এমন হয়েছে। পুরো জাতী আজ ভুগছে। সরকার বোকার মত বসে আছে। তাদের রাজনিতিক কৌশল ভুল। যদি না তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবাত ব্যাপারে মানসী প্রস্তুতি নেয় নি।

কুমারী শান্তা ভাসিত(দিল্লি): আমাদের শিল্প ধ্বসে হয় যাচ্ছে। এবং অর্থনীতিও ধ্বসে যাচ্ছে। একটি যুদ্ধ কি তা পূরণ করতে পারবে?

শ্রী এম এস গুরুপদস্বামী: বাংলাদেশ সম্পর্কে আমার পূর্ববর্তী বক্তৃতায় আমি একটি কথা বলেছিলাম। আমি সেটি আবারো সন্মানিত মহিলা সদস্যের জন্য বলছি। আমি বলেছিলাম যুদ্ধ না ঘোষণা করেই পাকিস্তান আমাদের উপর বিশাল বোঝা সৃষ্টি করতে পেরেছে। এটা একটা সত্য নয়? আমার মনে হয় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা নিষ্ক্রিয় থাকার চেয়ে অনেক ভালো হতো। কারণ যুদ্ধ ছাড়াই আমরা যুদ্ধের বোঝা টানছি। এই দুঃখজনক পরিস্থিতিতে আজ আমরা আছি। এটা কি সত্য নয়? এর ফলে আমাদের দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ভয়ানক অর্থনৈতিক ধস নামতে পারে। একটি সুযোগ ছিল। কিন্তু আজ কী হচ্ছে? আগামীকাল কি ঘটবে? আমার নিজের একটি পূর্বাভাস বলি – যদিও চাই তা যেন কখনো না হয় – সেটা অল এই সম্পূর্ন এলাকা অস্থির হয়ে উঠবে এবং চরমপন্থীরা পুরো এলাকা দখল করে ফেলবে। উদ্বাস্তু দ্বারা সৃষ্ট অর্থ নৈতিক বোঝা প্রচণ্ড ভয়াবহ আকার নেবে। এটা ইতোমধ্যে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী ও ভারত সরকার তাদের নিষ্ক্রিয়তার জন্য অর্থনৈতিক পতনের প্রস্তুতি নিতে পারেন। তারা বলবে: “ওহ!” এখানে তো উদ্বাস্তু আছে তাই আমরা উন্নয়ন করতে পারিনি। প্রবৃদ্ধি হয় নি। ধরণের ছুতো দেয়া গ্রহণযোগ্য হবেনা।

আমি এই প্রশ্ন রাখি। আমাদের সামনে বিকল্প কি? আসুন এটা মোকাবিলা করি। আমাদের ৭৫ লাখ শরনার্থি আছে এবং এটা কালক্রমে আরও ১০ মিলিয়নের পৌঁছাবে। তারা কি এই উদ্বাস্তুদের ফেরত পাঠাতে চান? আপনি কি মনে করেন তারা আশু ভবিষ্যতে সক্ষম হবে? এটা কি সরকার ভাবছে যে মুক্তি বাহিনী তাদের কর্তৃত্ব পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর উপর প্রতিষ্ঠা করতে পারবে এবং দেশকে দখলমুক্ত করতে পারবে? যদি তাই বলেন তবে আমি দুঃখিত আমি এসব কথার সাথে এক মত হতে পারলাম না। ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনী মুক্তি বাহিনীর থেকে অনেক শক্তিশালী। তাদের অত্যাধুনিক সরঞ্জাম আছে। বড় বড় ক্ষমতাশালীরাও এখানে জড়িত। সরদার শরণ সিং অসম্পৃক্ততা নীতি অনুসরণ করছেন। সত্য এটাই যে এখানে বিশাল ক্ষমতাশালীরা জড়িত, যেমন সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পৃক্ততা আছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এগিয়ে আসেনি এবং বলেনি যে তাদের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সহানুভূতি আছে।

শ্রী কল্যাণ রায়: হ্যা আছে।

শ্রী এম এস গুরুপরদ স্বামী- তারা শুধুমাত্র গণহত্যার নিন্দা জানিয়েছে। আমেরিকানরা ইতিবাচক সাহায্য প্রদান করেছে। চীন অস্ত্র সরবরাহ করছে। বেশ কিছু মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সক্রিয়ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের সহযোগিতা করছে। এই অবস্থায়, আপনি কীভাবে আশা করেন যে মুক্তিযোদ্ধারা জয়লাভ করবে? আমি এমন মনে করি না। যদি কেউ তা বলে তবে তা হবে হঠকারী। আমি মন্ত্রীর সামনে এই প্রশ্ন রাখছি। আপনি কি মনে করেন যে উদ্বাস্তুরা ছয় মাস, এক বছর বা দুই বছরের মধ্যে ফিরে যাবে? তাদের যদি ফেরত পাঠানো হয় তাহলে তারা কীভাবে তা মেনে নেবে? তারা বলছে বাংলাদেশ ইন্দো-পাকিস্তানী কোন ঘটনা নয়। এটা কি সত্যি ইন্দ-পাকিস্তানী ইস্যু নয়? আপনি অস্বীকার করতে পারেন। আপনি কি পাকিস্তানের প্রভাব অস্বীকার করছেন না? পাকিস্তানের সাথে কি কোন ঝামেলাই নেই? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী জানিয়েছেন বর্ডারে সৈন্য দেয়া হয়েছে। আরও বলা হয়েছে যে ভারতী সৈন্যরা নিশ্চই জয়ী হবে আপনি কি মনে করেন পাকিস্তানীরা তাদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য উসকানি দেবে? এটা তাদের আগ্রহের বিষয় না। কেন তারা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা দেবেনা?

শ্রী ব্রহ্মানান্দা পাণ্ডা – একটু স্পষ্ট —
শ্রী এম এস গুরুপদ স্বামী –
আমি হার মানি না। আমি আমার নিজের বিশ্লেষণ দিচ্ছি। পাকিস্তান আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে যাচ্ছে না। আমাকে বিশ্বাস করুন। ছোট আকারের বিচ্ছিন্ন লড়াই এখানে সেখানে হতে পারে। কেউ কেউ সীমান্তের ভারতীয় অংশে মৃত্যুর পরিসংখ্যান দিয়েছে। কিন্তু আমি বলছি কোন সাধারণ যুদ্ধ হয়নি। পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার উদ্যোগ গ্রহণ করবেনা। কেন করবে? বাংলাদেশ তাদের জন্য সহজে অবস্থান করার মত একটা এলাকা। পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর সেখানে কোন সমস্যা নেই। জানা যায় কিছু কিছু অঞ্চলে মুক্তি বাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে হয়রান করছে। তাদের কোন খাদ্য সরবরাহ নাই। ফলে তারা অনাহারী থাকছে। এই সব কি বিশ্বাস হয়? স্যার, আর্মি কে আগে খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। এখানে ভুক্তভোগী মানুষ আছে। কতদিন এভাবে চলবে? বেশিদিন না। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল খুব বেশী।

একজন মাননীয় সদস্য: এটা অনেক বেশী।
শ্রী এম এস গুরুপদস্বামী: আমি স্বীকার করি। কিন্তু এটা কি এত উঁচু যা তাদের শেষ বিজয় অর্জন করতে সক্ষম করে? আমি এটা বিশ্বাস করি না। অতএব, স্যার, প্রশ্ন হল: কি কৌশল, কি নীতি, কি মনোভাব আমাদের গ্রহণ করা উচিত? প্রথমত, বাংলাদেশ বাহিনীর সাহায্য লাগবে এবং দ্বিতীয়ত শরণার্থীদের ফিরে যাবার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে অসহায়ত্ব ছাড়া কোন উত্তর নেই।

কিন্তু প্রশ্ন হল পাকিস্তানের সঙ্গে একটি বোঝাপড়া ছাড়া আমাদের জন্য কি আর কোন বিকল্প নেই? আমি যুদ্ধবাজ নই। কিন্তু আমাদের বিকল্প কোথায়? আপনি কি বলতে পারবেন যে সেখানে শান্তিপূর্ণভাবে কোন নিষ্পত্তি সম্ভব? আপনি বলতে পারেন যে শরণার্থীরা ফিরে যাবে? আমি বিশ্বাস করি না। তাই, স্যার, এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য খুবই স্পষ্ট। রেজল্যুশন বলছে অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে আমাদের স্বীকৃতি দেয়া উচিত। আর স্যার ইতিমধ্যে যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে এবং সময় আমাদের শত্রু। আমরা ইতিমধ্যে সুযোগ মিস করেছি। আমি জানি অন্য দিকে এক বন্ধুর একটা সংশোধনী আছে। সংশোধনী বলে যে সরকার উপযুক্ত মুহূর্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে। কিন্তু সেই উপযুক্ত সময় আসলে চলে গেছে এবং আর আসবেনা।

স্যার, সম্ভবত জনাব শরণ সিং তার মৃত্যুর পর বাংলাদেশ কে স্বীকৃতি দেবেন।
শ্রী কল্যাণ রায়: তিনি সেই কাজ করবেন যা চেকোস্লোভাকিয়া করেছিল।
শ্রী এম এস গুরুপদস্বামী: হ্যা, সম্ভবত বাংলাদেশের মৃত্যুর পর তারা স্বীকৃতি দেবে। এই অর্থে সেই স্বীকৃতি হবে যে আমরা কোন এক সময় বাংলাদেশে আন্দোলন হয়েছিল এবং বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তানি আর্মির নৃশংসতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে করেছিল এবং শেসে মারা গিয়েছিল।

শ্রী কল্যাণ রায়: বীরত্বের সাথে ….
শ্রী এম এস গুরুপদস্বামী: …………….. বীরত্বের সাথে, যেমনটি আমার বন্ধু বললেন। আমরা একটি স্মারক স্থাপন করব বা একটি সমাধিফলক লিখব বাংলাদেশের জন্য। সেটাই করতে হবে। ধন্যবাদ স্যার।

শ্রী সুন্দর সিংহ ভান্ডারী (রাজস্থান) উপসভাপতি মহোদয়, শ্রী প্রণব কুমার বাবু একটি বেসরকারী প্রস্তাবের মাধ্যমে বাংলাদেশের ব্যাপারে এই সংসদে আলোচনার অবকাশ দিয়েছেন। নতুন লোকসভা গঠন হয়েছে এবং অধিবেশন শুরু হয়েছে, তখন থেকে বাংলাদেশের প্রশ্নটি আলোচোনার বিষয়বস্তু রয়েছে। যে প্রস্তাবের উপর আমরা ৩১শে মার্চ বিতর্ক করেছিলাম এবং যেটি পাশ হয়েছে, ঐ প্রস্তাবও সরকার ও বিরোধীদলীয় সদস্যদের পারসস্পরিক আলাপ-আলোচনার ফলশ্রুতি। বাংলাদেশের প্রশ্নে বিতর্ক উত্থাপনের জন্য প্রস্তাব আনা হয়েছিল, তখন সরকারের পক্ষ হতে বলা হল যে পৃথক পৃথক প্রস্তাব আনা উচিত হবে না। আমরা কি একত্রে বসে এ প্রশ্নের একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব আনতে পারি না? এই পারসস্পরিক আলোচনার ফলেই উভয় সভায় প্রস্তাব পেশ করার জন্য সয়ং প্রধাণমন্ত্রীর ওপর ভার অর্পন করা হয় যাতে এই প্রস্তাব কোন সংশোধন ও বিতর্ক ছাড়াই অবিস্মবাদিতভাবে উভয় সভায় গৃহীত হয়। এই প্রশ্নে আমরা একটি জাতীয় সিদ্ধান্ত নিলে মিলেমিশে চলতে পারা যেত। এখন একক সিদ্ধান্তে পৌছানোর পর এই আওয়াজ উঠেছে যে এরপর সামনে চলার চূড়ান্ত ক্ষমতা শুধুমাত্র সরকারী পক্ষের ওপর ন্যস্ত করা হোক, অন্যান্যরা এতে হাত না বাড়াক। সরকার পক্ষই শুধু নয়। সমস্ত সংসদের অনেক সদস্য এব্যাপারে চূরান্ত ক্ষমতা প্রধাণমন্ত্রীকে ছেড়ে দেয়ার জন্য আগ্রহী আমি এটা বুঝি না। এমন গুরুত্বপূর্ন রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণ করা হবে না। ৩১শে মার্চে আমরা যে প্রস্তাব নিয়েছি সে মোতাবেক সামনে অগ্রসর হতে অনেক দেরী হয়ে গেছে। সরকারদলীয় একজন সদস্য প্রস্তাবে এই সংশোধন এনেছিলেন যে, স্বীকৃতিদানের প্রশ্নটি সম্পূর্ণ সরকারের ওপর ছেড় দেয়া হোক। বন্ধুবর শ্রী ব্রম্মানন্দ মহাশয় ভাষণ দানকালে বলেছেন, আমরা প্রস্তাব পাস করিয়ে নিয়েছি, স্বীকৃতি দেয়া হবে কি না এসব ব্যাপারে মীমাংসা সরকারের হাতে ছেড়ে দেয়া হোক।

শ্রী ব্রম্মানন্দ পান্ডেঃ না, আমি এমন করে কিছু বলিনি।

শ্রী সুন্দর সিং ভান্ডারীঃ রেকর্ড পুনরায় শোনার জন্য আমি আপনাকে অনুরোধ করছি।

শ্রী ব্রম্মানন্দ পান্ডেঃ আমি বলেছি, যথাযথ সময়ে স্বীকৃতির দেয়ার দায়িত্বটুকু সরকারের হাত ছেড়ে দেয়া হোক।

শ্রী সুন্দর সিং ভান্ডারীঃ স্বীকৃতি দেয়া বা না দেয়া যে শব্দই ব্যবহার করেন না কেন, তাও ভালো যে আপনি আপনার বক্তব্য ফিরিয়ে নিয়েছেন।

শ্রী সুন্দর সিংহ ভান্ডারী: আপনি হয়ত ভুলে এই শব্দটি উল্লেখ করেছেন, কিন্তু যা ভুলে বলেছেন সমগ্র দেশের মানুষের মনে আজ তাই আশঙ্কা উদ্রেক করেছে। স্বীকৃতি কখন দেয়া হব আজ এ চিন্তা মানুষের মনে তত বেশী নয় যতটা এই যে, স্বীকৃতি দেয়া হবে কিনা, যেমন জনৈক মাননীয় সদস্য তার বক্তৃতায় খুব জোরের সাথেই বলছেন যে, তার সন্দেহ হচ্ছে সরকার এখন হয়ত পিছুটান দিতে যাচ্ছেন। এ কারণেই এই প্রশ্ন আজ দেশে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি হচ্ছে। এখন এ কোথাও বলা হচ্ছে যে, এই ইস্যুতে দেশ ভাগ করার প্রয়াস চলছে। এতে কোন সন্দেহ নাই যে, বাংলাদেশ প্রশ্নে যে রাষ্ট্রীয় ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যা সবার সম্মিলিত প্রস্তাব ছিল সরকার যদি এর আলোকে অগ্রসর হতে কুন্ঠিত হন বা পদক্ষেপ নিতে বিলম্ব করেন যার ফলে ওই প্রসঙ্গ শেষ হয়ে যায়, তাহলে সারা দেশ এর ওপর প্রস্তাব পাশ করে বসে থাকবে এবং অপেক্ষা করা দেশের জন্য শোভনীয় হবে না। আমরা যদি বাংলাদেশ প্রশ্নে দেশের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ থাকতে চাই তাহলে সরকারকেও তার হঠকারিতা ত্যাগ করতে হবে, দেশের অভ্যন্তরীণ সবকিছু উপেক্ষা করে সরকার সমস্ত দেশের সমাধানের যে ঠিকা নিজের উপর নিয়েছেন এটা ছাড়তে হবে ভারতে কল্যাণে কি আসবে বাংলাদেশের কল্যাণে কি আসবে। পরিস্থিতি সম্পর্কে অধিকতর ওয়াকিফহাল আপনারা হতে পারেন, কিন্তু অবশিষ্ট সকল মানুষ অন্ধকারে আছে, তারা দেশের কল্যাণ বুঝতেই সক্ষম নয়, সবকিছু উপলব্ধি আপনারাই করতে পারেন, আমরা আপনাদের অধিকার মেনে নিতে প্রস্তুত নই। এটি একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র। এদেশের শাসন ভার আজ যদি আপনাদের বৈধ উপায়ে অর্জিত হয়ে থাকে তবে এর অর্থ এই নয় যে, দেশের অন্য সব লোক এর কল্যাণ সাধন কিংবা এর নীতি নির্ধারণ নিজের চিন্তিত অভিমত ব্যক্ত করার দায়িত্ব হারিয়ে ফেলেছে। সকল দায়িত্ব নিজ নিজ সরকারের মনে করা হোক বা ব্যক্তিবিশেষের মনে করা হোক, কিংবা নিজের দলে মনে করা হোক না সে দলের দায়িত্ব ব্যক্তিবিশেষের ওপর – এ সকল দায়িত্ব আপনাদের ঘরের হতে পারে কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রশ্নে আপনারা সকল দায়িত্ব নিজের ওপর নিয়ে অন্যদের অন্ধকারে রেখে এদেশে ঐক্য বজায় রাখতে পারবন না। এ ব্যাপারে আমার আশঙ্কা রয়েছে। আমি চাই না, এই রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নে কোনপ্রকার বিভেদ সৃষ্টি হোক বা মতদ্বৈধতা হোক। কিন্তু এ জন্যশুধু অন্যদের দোষারোপ করলে চলবে না।

এ প্রশ্নে কেন বিলম্ব হচ্ছে সরকার তার কোন কারণ দেখাতে পারছেন না। এই বিলম্ব্র দরুন যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে তা দুনিয়া দেখছে, ভারতের প্রতিটি মানুষ দেখেছেন। আমার পূর্ববর্তী বক্তাগণ একটি বিষয়ের দিকে ঈঙ্গিত করেছেন যে, অন্ততঃপক্ষে স্বীকৃতিদানের আশ্বাস না দেয়ার দরুন উদ্বাস্তুদের সংখ্যা নিরন্তর বেড় চলেছে। কোন ব্যাক্তি এজন্য আশ্বস্ত হতে পারছেন না যে স্বীকৃতি দেয়ার পরও দেশে উদ্বাস্তুদের সংখ্যা এইরুপ হতো। আমি বুঝতে পারছিনা, যদি সরকার স্বীকৃতি দিয়ে তাদের সাহায্য চাইতো, তারা সাহায্য করতে ততপর হতো, তবু এই ৮৫ লক্ষ লোক যারা উদ্বাস্তরূপে এসে পড়েছে তাদের সংখ্যা অনুরুপ হত। সরকার এখনো বলছেন, প্রতিদিন ৫০ হাজার লোক আসছে। পুনর্বাসন মন্ত্রীর বিবৃতি অনুযায়ী এই সংখ্যা কোটির কোঠা ছুঁতে পারে, এজন্য আমরা এ প্রশ্নে কোন মীমাংসায় আস্তে চাইছি না, আমরা অপেক্ষা করছি আর উদ্বাস্তুর সংখ্যা বেড়েই চলছে। আমাদের পদক্ষেপ না নেয়ায় এই সরল পরিনতি আমাদের দেশের ওপর পড়েছে। এটি এরূপ প্রত্যক্ষ যে, যে কেউ এটি দেখতে পারে। বহির্বিশ্বের মতের প্রশ্নে যতদুর বলা যায় আমরা তা অর্জনের চেষ্টা করছি। সরকারর ভাষ্য হচ্ছে, সারা বিশ্বে আমাদের প্রতিনিধি গেছে এবং বারবার এই উত্তর দেয়া হয়েছে যে, আমরা আশা করি ভারতের বিষয়টিকে তার খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন। তারা যদি বুঝতে আরম্ভ করেন তবে খুব ভালো কথা, কিন্তু তারা বহির্বিশ্বে এবং জাতিসংঘে যে কাজ করেছে তাতে এ কথার পরিপুষ্টি হয় না। জাতিসংঘে এ প্রশ্নে, জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ভারত ও পাকিস্তানে পর্যবেক্ষন পাঠানোর জন্য আলোচনা ও প্রস্তুতি চলছে। ভারতে পর্যবেক্ষক পাঠানোর প্রেরণের বিষয়টি কিভাবে সৃষ্টি হলো। আমি বলছি, আমরা কখনই মেনে নেবো না। কিন্তু এ আলোচনা শুরু হলো কিভাবে? একদিকে আমরা উপলব্ধির কথা বলছি, একদিকে আমরা বলছি যে, বহির্বিশ্ব কর্তৃক এ সমস্যা উপলব্ধির প্রয়োজন আর অন্যদিকে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতে পাঠানোর কথা চলছে। ভারত ও পাকিস্তানের নেতাদের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাধান বের করা উচিত। বিশ্বের যে সব রাষ্ট্র রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলছে, আমি সরকারের কাছে জানতে চাই, কোন আন্তর্জাতিক শক্তি এ কথা স্পষ্ট করে বলেছে যে ইয়াহিয়া খানকে রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে। তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলে থাকতে এটি তার অন্তর্গত রয়েছে, এরূপ হলে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হোক এবং সরকার এটি পরিষ্কারভাবে বলুন। আমি মনে করি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য যে আলোচনা চলছে তাতে বিশ্বের সকল রাষ্ট্র পাকিস্তান ও ভারতকে দুটি পক্ষ ভেবে আসছে। আমরা বাংলাদেশের প্রশ্নটি কিভাবে বুঝিয়েছি, আমরা কি বলতে গিয়েছি এ প্রশ্ন সাম্প্রতিক সফরের কি প্রভাব পড়েছে।

এই সফরের ফলে অবশ্যই মানুষের মধ্যে উদ্বাস্তুদের সম্পর্কে কিছুটা সহানুভুতি জেগেছে। তাদের জন্য ঔষধ ও খাদ্য এসেছে এবং বিশ্ববাসীর কাছে হয়ত আমরা কিছু সাহায্যও পেয়েছি। আর হয়ত এরূপ কিছু সাহায্য আমরা পাব কিংবা সাহায্য বন্ধ হয়ে যাবে কিছু বলা যায় না কিন্তু যেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্ন বিদ্যমান সেখানে রাজনৈতিক সমাধানের কথাবার্তা বিষয়টিকে কোনভাবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে যার দরুন বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে এখনো কোন সিদ্ধান্ত হচ্ছে না।
বাংলাদেশেকে আমরা স্বীকৃতি দিলে পাকিস্তানের যুদ্ধ বাধাবার একটি কারণ সৃষ্টি হবে এই বিতর্ক বারবার উত্থাপন করা হয়। আমি বুঝি না পাকিস্তান আমাদের স্বীকৃতির প্রশ্ন নিয়ে যুদ্ধ করার জন্য অপেক্ষা করছে। পাকিস্তান পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছে বাংলাদেশের কোনও অংশ যদি এমন হয়ে যায়, যেখানে পাকিস্তানী সৈন্যের প্রবেশ অসম্ভব হয়ে পড়ে কিংবা কোন অংশ যদি স্বাধীন হয়ে যায় তবে তার দায় দায়িত্বও ভারতের। এই ভিত্তিতে পাকিস্তান যুদ্ধ ঘোষনার অধিকারী হয়ে যাবে। এই ঘোষণা সে করে রেখেছে। সুতরাং আমরা যদি স্বীকৃতি না দেই তাহলে পাকিস্তান যুদ্ধ বাধাবে না আর যদি স্বীকৃতি দেই তাহলে যুদ্ধ বাধাবে এমন কোন কথা নেই। আমর জিজ্ঞাসা স্বীকৃতির ব্যাপারে এত বিলম্ব কেন? এটা কি এজন্য যে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী নিজেরাই স্বাধীনতা যুদ্ধ করে নিজেদের দেশ স্বাধীন করবে, কিন্তু এই স্বাধীনতার দায়-দায়িত্ব পাকিস্তান ভারতের ওপর আরোপ করতে চাচ্ছে। পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধাবার কোন ছুঁতো পাচ্ছে না। তার জন্য আপনারা কতদূর নিজের দিক রক্ষা করা চলবেন। এখন একটি পথ মাত্র খোলা আছে, মুক্তিযোদ্ধা যাতে পাকিস্তানে কোন এলাকা মুক্ত করতে না পারে, এটা এজন্য যে, ভারত তাকে সে এলাকা মুক্ত করে দিয়েছে এবং যেহেতু ভারত সে এলাকা মুক্ত করে দিয়েছে সেজন্য পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করার পূর্ন অধিকারী পাকিস্তান এই অজুহাত দেখাতে সক্ষম না হয়। আমি মনে করি এরূপ বিতর্কে নেমে আমরা নিজেদেরকেই প্রতারনা করার চেষ্টা করছি।

বাংলাদেশের প্রশ্নে আমাদের প্রতিবেশীর প্রশ্ন। বাংলাদেশের উদ্বাস্তু আজ ভারতের ভূ-খণ্ডে। তারা কেন ভারতে এসেছে? বাংলাদেশের অন্য প্রান্তে, খুব কাছাকাছি, বার্মায় কেন ঢুকে পড়লো না, ভারতে কেন এল? এটি ইতিহাসের কথা যা বাংলাদেশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, এটি পুরাতন ইতিহাস। এটি ১৯৪৭ সাল উত্তর ইতিহাস। পাকিস্তানের অত্যাচারে নিপীড়িত মানুষ ভারতে আসতো। বাংলাদেশের মানুষ অভিনব কিছু করেনি। পাকিস্তানী সৈন্যদের অত্যাচারে নির্যাতিত হয়ে মুক্তিকামী মানুষ বাঁচার সহজ উপায় মনে করে ভারতে এসেছে।

শ্রী চাগলা এখানে বলেছেন বাংলাদেশের প্রতি স্বীকৃতি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ব্যাপারে সহানুভূতির অর্থই এই যে, পাকিস্তান আর পূর্ব পাকিস্তানের অংগ নিয়ে টিকে থাকবে না, পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানের বিলোপ ঘটে তবে আমাদের ভয় কিসের। যদি আমরা একথা প্রথমেই বলতাম তাহলে আমাকে সাম্প্রদায়িক ও পাকিস্তান বিরোধী বলে অভিহিত করা হত কিন্তু এখানে এ সম্বন্ধে অনেক কথা বলা হয়েছে। এই প্রস্তাব উত্তাপনকারী শ্রী প্রণব কুমার মুখার্জী বলেছেন, বাংলাদেশের এই যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে পাকিস্তান পূর্ব বাংলা হতে প্রতিটি হিন্দুকে বের করে দেয়ার প্রয়াস নিচ্ছে। শ্রী চাগলা সরকারি হিসেবের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ৭০ লক্ষ রিফিউজীর মধ্যে ৬৫ লক্ষ হিন্দু। আজ এই সত্য কথাটি বললেও সরকারের দিক হতে বলা হবে এই প্রশ্নকে সাম্প্রদায়িকতার দিকে নিয়ে যাওয়া উচিত হবে না। সত্য ভাষণে সাম্প্রদায়িক মোড় আসে না। হয় আমরা যা ঘটছে তা থেকে নিজেদের চোখ ঢাকি, পাকিস্তানের অভিলাষ কি তা থেকেও আমরা দেশবাসীকে অন্ধকারে রাখি, নয়ত পাকিস্তান বাংলাদেশে কি করতে চায় তার উদ্ধেশ্য সম্পর্কে আমাদের কোন মাথাব্যথাই থাকা উচিত নয়। আমাদের দেশে এই প্রশ্নকে আমরা একটি জাতীয় সমস্যা মনে করি।

আজ পাকিস্তান সামরিক তৎপরতার মধ্যে বেছে বেছে প্রতিটি হিন্দুকে পূর্ব বাংলা হতে ভারতে বহিষ্কার করে দেয়ার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে কাজ করে যাচ্ছে যখন থেকে পাকিস্তান হয়েছে তখন হতে তার এই মনভাব সক্রিয়। ভারত পাকিস্তান বিভাগের শর্তসমুহ ১৯৪৭ এর ১৪ই আগস্ট হতেই মুছে ফেলা হয়েছে। পাকিস্তান কখনো তার তোয়াক্কা রাখেনি। পাকিস্তান এসব পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে এবং করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের বিপরীতে বাংলাদেশের জনসংখ্যা হ্রাস করতে হবে, ওই নীল নক্সার অন্তর্গত এই শেষোক্ত বিষয়টির বিষয়ক্রিয়া অধিকতর তীব্র। ইহা তাদের নীলনক্সা অনুযায়ী পূর্ণ হচ্ছে। আজ আমরা যদি উদ্বাস্তুদের এই বোঝা হতে আমাদের দেশকে মুক্ত করতে চাই তাহলে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। এটা তারা নিজেরাই চাচ্ছে, আমরা নিজেদের পক্ষ হতে করছি না, এটা বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের লোকেরই বলছে যারা নির্বাচনে বাংলাদেশের প্রায় ৯৮ ভাগ জনসমর্থন পেয়েছে। যে ক্ষমতাসীন দলের সরকার তাকে সে দলই নির্বাচনে নেমে জনগণের ভোট নেয় এটা আমরা দেখে আসছি কিন্তু মিলিটারী জান্তার অধীনে একটি বিরোধীদল ৯৮ ভাগ সমর্থন লাভ করে, এটি পৃথিবীতে সম্ভবতঃ নজিরবিহীন আর এই প্রবল জনসমর্থন প্রাপ্ত হয়েছে বাংলাদেশের আজকের নবগঠিত সরকার। তারা আবেদন করেছে তাদেরকে স্বীকৃতি দিতে, তাদেরকে সাহায্য করতে। আমরা তাদের স্বীকৃতি দিয়ে তাদের মিত্রতা লাভ করতে পারি, এই গনহত্যার ইতিহাস ওখানেই থামাতে পারি। গেরিলা যুদ্ধের দ্বারা তারা নিজেদের স্বাধীনতা অর্জনের একটি অন্তর্জালা একটি আকাঙ্খা প্রকট করেছেন মাত্র। গেরিলাযুদ্ধ সৈন্যদের হয়রানি করতে পারে, সৈন্যদের দ্বারা কৃত অত্যাচার ঠেকাতে পারে না। যদি আমরা বাংলাদেশের ওপর নির্যাতন রোধ করতে চাই, সৈন্যদের দ্বারা পরিচালিত গনহত্যা বন্ধ করাতে চাই স্বীকৃতি লাভের পর বাংলাদেশ সরকার আমাদের কাছে এ কাজের জন্যই সাহায্যের আবেদন রেখেছেন। অতএব, এ প্রশ্নে আমাদের আর বিলম্ব কয়া উচিত নয়।

বাবু জয়প্রকাশ নারায়ণও এটি সমর্থন করেছেন। তিনিও বিশ্বসফর করে … তিনি এতদূর বলেছেন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে পাকিস্তান যদি যুদ্ধ ঘোষণা করে, তবে পাকিস্তান যুদ্ধ ঘোষণা করবে শুধু এই ভয়ে আমাদের এটি এড়ানো উচিত হবে না। বাংলাদেশের প্রতিও আমাদের একটি কর্তব্য আছে, আমরা তা পালন করব। সরকারের এতে বিলম্ব করে আপন কর্তব্য হতে পেছনে সরে আসছে এতে আমরা ক্ষুদ্ধ এবং এ আশঙ্কা সারা দেশে বিস্তারিত হচ্ছে। এ কারণে একটা অসন্তোষ সৃষ্টি হচ্ছে, এই অসন্তোষ এখন প্রকট হবে। সরকারকে তার কর্তব্যদের প্রতি সজাগ করার জন্য, সরকারকে তার অবধারিত কর্ম সত্বার বাস্তবায়ন করানোর জন্য কাল থেকেই আমার পার্টি সতুগ্রহের ঘোষণা করেছে। আমার নেতা শ্রী পীতাম্বর দাস এই সত্যগ্রহের নেতৃত্ব করেছেন। এটি সরকারের এই কর্তব্যবোধের প্রেক্ষিতে সত্বর মীমাংসা করার জন্য। কিন্তু সরকার যদি কোন পদক্ষেপ না নেন তবে তার ফলে উদ্ভুত পরিস্থিতির কুপরিনতি সারা দেশে দেখা দিতে পারে। এমন এক বিষয় যার ওপর নীতিগত দিক থেকে আমরা সবাই একমনা, আমি চাই না, তার ওপর দেশে কোন প্রকারদ্বৈত সৃষ্টি হোক। আমরা আজ পর্যন্ত মিলেমিশে একাজ করেছি সামনেও একাজ মিলেমিশে করবার অবকাশ আছে। এজন্য এ প্রস্তাবের মাধ্যমে একটি আবেদন করা হয়েছে। ………… সংশোধনের মারফত শ্রী জগদ্মবী প্রসাদ যা এনেছেন —— যে শুধু স্বীকৃতি দিয়ে চলবে না, স্বীকৃতির সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকে সামরিক তথা অন্য সাহায্য দিতে হবে। এখন একথাও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আবশ্যক যাতে এ থেকে পেছনে সরে যাবার কোন অবকাশ না থাকে। প্রস্তাবক মহদয় বলেছেন যে, স্বীকৃতি দেয়া হোক, আমরা আরেকটি সংশোধন চাই এ, স্বীকৃতি দিয়ে তাদেরকে সামরিক সাহায্যও দেয়া হোক। এই সনশোধনীর সঙ্গে প্রস্তাবকেও মেনে নেয়া হোক, আমরা এটাই চাই।

শ্রী শীলভদ্র ইয়াজি (বিহার)- উপ-সভাপতি মহোদয় বাংলাদেশে মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হয়েছে তাকে স্বীকৃতি দেবার ব্যাপারে শ্রী প্রণব কুমার বাবুর প্রস্তাব আমি সমর্থন করছি। কিন্তু তিনি যে পার্লামেন্টের এই অধিবেশন চলাকালেই স্বীকৃতি চাচ্ছেন আমি তার বিরোধিতা করি। এই সঙ্গে আমি শ্রী পুরকায়স্থ ও শ্রী সোনারাম কেশরীর সংশোধনীর সমর্থন জানাই যাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার বিষয়টি সরকারের উপর ছেড়ে দেওয়া উচিৎ।

উপ-সভাপতি মহোদয়, ২৫ মার্চের পর উভয় পরিষদে বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রস্তাব পাস করার পর হতে বাংলাদেশে হিটলারশাহী চলছে। যখন প্রস্তাব পাস হয়েছিল তখন বাংলাদেশকে সর্বপ্রকার সাহায্য দানের আশ্বাস দেয়া হয়েছিল। এখন প্রশ্ন উঠেছে, স্বীকৃতি দিয়ে যদি সাহায্য দেয়া হয় কিংবা না দিয়েও দেয়া হয়, আমি এর গভীরতায় যেতে চাইনা, আমি সরকারের কাছে একটি কথা রাখতে চাই যে বাংলাদেশের মানুষ তাদের দেশে যে স্বাধীনতার সংগ্রাম গণতন্ত্রের সংগ্রাম করছে সেটা কি তাদেরই সংগ্রাম? না। তারা তো সারা বিশ্বের জন্য সংগ্রামরত। ভারতের জন্যও তারা সংগ্রাম করছে।

দোষী কে? মুসলিমলীগ ও কংগ্রেসের নেতারা দেশ ত্যাগ করেছে। দেশ ভাগের পর মুসলিমলীগ ও কংগ্রেসিরা গদিতে বসেছে। এব্যাপারে জনসাধারণের রায় মোটেও নেয়া হয়নি। দেশ ত্যাগের পর জনসাধারণ যদি মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ইলেকশনে আসত এবং তিনি প্রধানমন্ত্রী হতেন তাহলে তার পরে পাকিস্তানকে ভাঙবার প্রশ্ন কোথা থেকে উঠত? কিন্তু কাইয়ুম খাঁ ও ভুট্টো বলেছেন দুইজন প্রধানমন্ত্রী হবেন এবং ইয়াহিয়া খাঁ কে প্ররোচনা দিয়েছেন যে এমন কোন কিছু হওয়া উচিৎ নয়। মুজিবুর রহমান তো সমগ্র পাকিস্তানের কথাই বলতেন, তিনি শুধু বাংলাদেশের কথা বলতেন না। মুজিবুর রহমানের পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন হওয়া সত্ত্বেও তাকে শাসনের বাগডোর দেয়া হয়নি। ইয়াহিয়া খাঁ ও টিক্কা খাঁ ডাণ্ডা নিয়ে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে জনগণকে প্রহার করেছে। এজন্য আমি বলতে চাই, এযুদ্ধ শুধু বাংলাদেশরই নয় ধরে নিন, আমাদের দেশেও কোন পাগল ইয়াহিয়া খাঁ হয়ে গেল, এখনকার সরকারকে জেলে আটক করল এবং জনসাধারণকে প্রহার করা শুরু করে দিল, আমি সরকারকে জিজ্ঞেস করব তখন কি অবস্থা হবে? আজ বাংলাদেশের সংগ্রাম যারা করছে তারা গণতন্ত্রের জন্য, প্রজাতন্ত্রের জন্য এবং সমগ্র বিশ্বের জন্য লড়ছে।

আমার ক্ষোভ রয়েছে রাশিয়া ও অ্যামেরিকার ওপর। তারা জনগণের প্রতিনিধিবৃন্দের ওকালতি করেন, প্রজাতন্ত্রের দোহাই দেন কিন্তু বাংলাদেশের সাহায্যের জন্য অগ্রসর হচ্ছেন না। চিন নিজেকে জনগণের সবচেয়ে বড় ত্রাণকর্তা মনে করে, সেও আজ বাংলাদেশের জনগণকে নির্মুল করতে তাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে ইউয়াহিয়া খাঁর সরকারকে সর্বোতভাবে সাহায্য করছে এবং বলছে আমরা ইয়াহিয়া খাঁর হিটলারশাহীকে সাহায্য করব। আজ যারা গণতন্ত্রপ্রিয় লোক আছেন তারা কোথায় চলে গেছেন, বাংলাদেশে যে গণহত্যা চলছে তা থামানোর চেষ্টা কেন করা হচ্ছেনা? এবং তার বিরুদ্ধে কেন আওয়াজ তোলা হচ্ছেনা? এটি মহাভারতের মত ব্যাপার হয়ে গেছে। যখন ধ্রুপদীর শাড়ি হরণ করা হয়েছিল তখন যত বড় বড় ব্যাক্তি ছিলেন ভীষ্মপিতামহ এবং কৃষ্ণ এরা নিষ্ক্রিয়ভাবে তাকিয়ে ছিলেন এবং এরই ফলে তখন মহাভারত যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হয়েছিল। আজ বাংলাদেশ হতে আমাদের দেশে ৭০ লক্ষ লোক এসে পড়েছে এবং ইয়াহিয়া খাঁর সৈন্যরা বাংলাদেশে সাত লক্ষ লোক মেরে ফেলেছে। ধ্রুপদীর শাড়ি হরণ করা হয়েছিল। তখন মহাভারত যুদ্ধ হয়েছিল। আজ এত মানুষ নিহত হয়েছে তবু ভারতের জনগণ চুপচাপ বসে আছেন। রাবণ সীতাকে লংকা নিয়ে গিয়েছিল, যার ফলে যুদ্ধ হল এবং রামায়ণ রচিত হল। কংগ্রেস ও মুসলিমলীগ দেশকে বিভক্ত করেছিলেন, বাংলাদেশের জনগণ ভুল করেনি, ভুল করেছিলেন আপনারা যারা দেশ ভাগ করেছিলেন।

জনসাধারণের কোন ভুল ছিলোনা। আপনাদের দরুন দেশ ভাগ হয়েছে, যারা ডিক্টেটর, যারা সেনা পরিচালক, যারা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। একথা বলতে আমার লজ্জা হচ্ছে যে বাংলাদেশের নারীদের উপর কি কি অত্যাচার হয়েছে। এসব কথা আমি সংবাদপত্র পড়ে বলছিনা, আমি সেখানে যাই, তাদের লোকজনদের সাথে সাক্ষাত করি এবং এই ভিত্তিতে বলতে পারি, কোন মুর্দা লোকও যদি ওইসব কথা শোনে তবে তার মধ্যে ক্রোধের সঞ্চার হবে এবং ইচ্ছে হবে অস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশে গিয়ে তাদের হেফাজত করতে। পরিস্থিতি এরূপ কিন্তু আমরা কিছু করছিনা। এক কোটি রিফিউজি এসে যাবে, সরকার বলছেন ৭০ লক্ষ এসে পড়েছে।

শ্রী নাগেশ্বর প্রসাদ শাহীঃ ৮০ লক্ষ।
শিল ভদ্র ইয়াজিঃ যখন গণতন্ত্রের সংগ্রাম চলছে তখন শরণ সিংহ ভিষনু পিতামহের মত কি বসে থাকবেন, চ্যাবন বসে থাকবেন, ইন্দিরা গান্ধী বসে থাকবেন, রাশিয়া বসে থাকবে, চীন বসে থাকবে? অ্যামেরিকাও বলছে যে, আমরা সারা পৃথিবীর গণতন্ত্রের জন্য লড়ছি, তাহলে সে কী করছে? ওখানে গণতন্ত্রের কবর হচ্ছে এবং এর সাথে সাথে যে গণতন্ত্রপ্রিয় লোকেরা ভোট দিয়েছিল তাদেরকে বেছে বেছে মারা হচ্ছে। হিন্দু মুসলিম প্রসঙ্গ আমি তুলছিনা, হিন্দুদের মধ্যে ১০০ ভাগই তো মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন ছিল।

শ্রী যোগেন্দ্র মিত্র (উত্তরপ্রদেশ)- আপনার জানা আছে ১০০ ভাগই ছিল?

শ্রী শিলভদ্র ইয়াজিঃ আপনি এখানে বসে আছেন, আমি সেখানে যাই, মুক্তিফৌজদের সাথে দেখা করে আসি, আপনি শুধু লক্ষৌ পর্যন্ত যান, আপনি শুধু দর্শক।

আমি বলছিলাম গণতন্ত্রের যে সংগ্রাম চলছে তাতে আমাদের করনীয় কি। এখন স্বীকৃতি দেয়া হবে কিনা। আমাদের আজাদহীনদের সরকার গঠিত হয়েছিল নেতাজির নেতৃত্বে, কোন সরকার স্বীকৃতি দিলো কি দিলনা, আমরা যুদ্ধে গেছি। আমি সে বিষয়ের গভীরতায় যেতে চাইনা। স্বীকৃতি দিলে কাল যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে আমি এটাও মানিনা। পাকিস্তান আজ ভাঙছে ভুট্টোর নির্বুদ্ধিতায়, ইয়াহিয়া খানের ভুলে পাকিস্তান ভাঙ্গনের প্রান্তে। এবং চূড়ান্তভাবে ভাঙবে, কিন্তু আমাদের সরকার কি ভূমিকা পালন করবে। দ্বিজাতি তত্ত্ব চিরদিনের জনু নির্মুল করবে না কি করবে। সে যদি এখনি কোন পদক্ষেপ না নেয় তবে পূর্ববর্তি বক্তাগণ যেমন বলেছেন, তাদের সাহায্যার্থে অন্য কেউ আসবে, বাংলাদেশের লোক আপনাকে ধন্যবাদ জানাবে, (বলবে), যতখানি করেছেন ঠিক করেছেন, কিন্তু শুধু বাংলাদেশই নয়, সম্পূর্ণ ইস্টার্ণ জোন আপনার হাত থেকে বেরিয়ে যাবে, এরূপ ফোর্সেস আছে আপনাকে সাবধানী দিচ্ছি। সরকার কখন একশন নেবেন, কখন কি করবেন, আমি জানিনা। কিন্তু সরকার বাংলাদেশে যুদ্ধরত মুক্তিফৌজের সাহায্য করা উচিৎ এটা নিশ্চিত করুক। অনেকেই একথা তোলেন যে, সাহায্য কীভাবে দেয়া হবে? পাকিস্তান কীভাবে করছে, বিদ্রোহী নাগাদের ট্রেনিং ঢাকাতে হয়, মিজোদের হয় — তারা বলেনা, কিন্তু আপনি করেননি। আমাদের সরকার কি করেছে? বিজু পাটনায়ক আশ্চর্য কথা বলেন, তার বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, মুক্তিফৌজের যুদ্ধ কাগজের যুদ্ধ, তিনি নিজেকে স্ফুটনিক বলেন কিন্তু সৎ বুদ্ধি একটুও নেই। তারা কত বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করছে। ফ্রন্টে গিয়ে আপনি তাদের মনোবল দেখুন, আপনি দেখে আশ্চর্য হবেন, নেতাজির নেতৃত্বে যে আজাদহিন্দ ফৌজ যুদ্ধ করেছিল তাদের চেয়ে এদের মনোবল বেশী উঁচু। মুক্তিফৌজে যত যোদ্ধা আছেন কারও স্ত্রী নিহত হয়েছেন, কারণ কোনয়, কারও অন্য কেউ মারা গেছে। কিন্তু তাদের চেহারায় কোন ঔদাসীন্য নেই। তাদের এই হুসও নেই এ তারা খেতে পাবে কিনা। আজাদহিন্দ ফৌজ যোদ্ধাদের স্ত্রী কন্যারা তো নিরাপদ ছিল, তাদের চেয়ে এরূপ অতিরিক্ত কষ্ট সয়ে এরা লড়ছে।

এজন্য সোজা কথায় আমি সরকারকে বলতে চাই যে, সরকার বাংলাদেশের স্বীকৃতি ঘোষণা করুন বা না করুন কিন্তু তাদেরকে সাহায্য দানের ঘোষনা যেন অবশ্যই করেন। রাজ নারায়ণ বাবু বলেছেন, শুধু পার্লামেন্টের যুদ্ধ ঘোষণা করলে চলবে না। কূটনীতিও সংসারে একটি বড় জিনিস। উত্তম কূটনীতি হচ্ছে মিথ্যা কত ভালো বলা যায় তা জানা থাকা চাই। উত্তম কূটনীতি অনুসারে আপনার যা করনীয় তা করুন কিন্তু এটা বলবেন না। আমাদের চাণক্য ও কৃষ্ণের নীতি অনুসরণ করা উচিৎ। ‘আস্যুথম্না হতঃ নরো ব কুঞ্জরঃ’ নীতি গ্রহণ করে আমাদের শ্রীকৃষ্ণ ও চাণক্যের প্রদর্শিত পথে চলে কার্য সিদ্ধি করতে হবে। মুক্তিফৌজকে আমাদের সাহায্য করতে হবে এবং আমরা সাহায্যও করেছি কিন্তু আমরা কিছু বলব না। এভাবে তাদেরকে আরও রসদ দিয়ে সাহায্য করা আবশ্যক। যেভাবে চলছে সেভাবে কাজ হবেনা। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের প্রধানমন্ত্রী এই সংসদে ঘোষণা করেছেন যে, বাংলাদেশের জন্য ভারতবর্ষের লোকজন যদি জাহান্নামে যাবার প্রয়োজন হয় তাহলে সেখানে যাবার জন্যও প্রস্তুত থাকা চাই। আগেও পাকিস্তান যখন গোলমাল (গড়বর) করেছিল তখন আমরা লাহোর ও শিয়ালকোট পর্যন্ত গিয়েছিলাম। ভবিষ্যতেও যদি দরকার হয় আবার আমরা তাই করব।

শ্রী পীতাম্বর দাশঃ আপনি পরোক্ষভাবে লাহোরকে জাহান্নাম বানিয়ে দিলেন।

শ্রী শিলভদ্র ইয়াজিঃ এব্যাপারে সমাধানের প্রশ্ন যতটুকু তা আর্মিকে করতে হবে আমি তা মানিনা। সিভিলিয়ান সরকারই সমাধান করবে। আমাদেরকে অতি সত্বর সমাধানে পৌঁছাতে হবে — জেনারেল কায়োল এর কথা আমি সমর্থন করিনা। আমার বোঝা হয়ে গেছে অ্যামেরিকা কতখানি গণতন্ত্রপ্রিয়, রাশিয়া করোখানি গণতন্ত্রপ্রিয়, চীন কতখানি গণতন্ত্রপ্রিয়, সকলের মুখোশ উন্মোচন হচ্ছে। আজ বাংলাদেশে যে যুদ্ধ হচ্ছে তা গণতন্ত্র রক্ষার জন্য। ওটি শুধু মুজিবুর রহমান ও আওয়ামীলীগের লড়াই নয়, তাদের থামানোর জন্য সারা বিশ্বের মানুষ উঠে আসতে পারে।

সরকারের কাছে আমার নিবেদন, বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রশ্নে আমি রাজনারায়ণ মহাশয়ের সঙ্গে একমত। কিন্তু আমি এও চাই যে, তাদেরকে এমন সাহায্য দেওয়া উচিৎ যা দিয়ে সেখানে যত জুলুম অত্যাচার হচ্ছে সত্বর তার অবসান ঘটে। এভাবে যে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রচিত হয়েছিল সে তত্ত্বের শেষ আপনাআপনি হয়ে যাবে। এর সাথে সাথে সেখানে সমাজবাদের প্রতিষ্ঠার জন্য যে ঘোঘনা হয়েছে, সমাজবাদের নামের ওপর ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে এ কৃত্রিম প্রাচীর দাঁড়িয়ে আছে তাকে ধুলিস্ম্যাত করতে আমরা সফল হব। আজ বিশ্বে যখন কোরিয়া ও জার্মানির একত্রীকরণের কথা হচ্ছে তখন পাকিস্তানের ব্যাপারে বিশ্বশক্তিসমূহের আপন নীতির ওপরে লজ্জা হয়না। বিশ্ব শক্তিসমূহ যখন বলছে জার্মানির একত্রীকরণ হওয়া উচিৎ, ভিয়েতনামের একত্রীকরণ হওয়া উচিৎ, তাহলে তারা আজকে বাংলাদেশের ব্যাপারে নীরব কেন? সমাজবাদের নামে অতি সত্ত্বর আমাদেরকে ‘টু-নেশন থিওরি’র বিলোপ ঘটাতে হবে। এরই মধ্যে আমাদের কল্যাণ, আমাদের দেশের কল্যাণ, বাংলাদেশের কল্যাণ রয়েছে এবং সারা বিশ্বের যত গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ আছে তাদেরও কল্যাণ রয়েছে। এসব কথার সঙ্গে শ্রী মুখার্জি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের যে প্রস্তাব রেখেছেন আমি তাকেও সমর্থন জানাই। সঙ্গে সঙ্গে পুরোকায়স্থ মহাশয় ও সীতারাম মহাশয়ের সংশোধনীয়ও আমি সমর্থন করছি। পরিশেষে আমি এই বলে বসে যাচ্ছি যে, কচ্ছপ গতিতে কাজ চলবে না। আপানাকে আরও দৃঢ়তার সঙ্গে অগ্রসর হতে হবে। জয় হিন্দ। জয় বাংলাদেশ।

[জনাব.ডেপুটি চেয়ারম্যান]
শ্রী এস জি সারদেশাই(মহারাষ্ট্র): জনাব ডেপুটি চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতির দাবি এই হাউজ ও পাশাপাশি অন্যান্য হাউসের সামনে উত্থাপন করা হয়েছে। সরকার কখনোই এই দাবির বিরোধিতা করে নাই। তারা নীতিগতভাবে এটা গ্রহণ করেছে, কিন্তু যথাযথ সময়ে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু বিষয় হল এটা কোনো বিলম্ব করার বিষয় নয়। এই দাবী হাউজের বাইরে সারা দেশে ক্রমশ বাড়ছে। ক্ষমতাসীন পার্টি গোঁ ধরে আছে। এটা শুধু বিরোধী দলের প্রশ্ন না। প্রশ্ন হল এই গোঁ ধরা বাড়ছে কেন? যদি এই বিষয়টি আরও দেরী হয়, তাহলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় দুর্যোগ নেমে আসবে। সরকারের উচিৎ বিষয়টি বিবেচনায় আনা। তারা বলে যে, তারা বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের নির্দিষ্ট সহায়তা দান করছে। কিন্তু তা নয়। এটি সত্য যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিবাহিনী অনেক সংগঠিত। এবং তাদের কাজ আরো ভালো ও চমৎকার সমন্বয় হচ্ছে।

কিন্তু অন্য দিকে আমাদের উদ্বেগের বিষয় আছে। এই সব কার্যক্রম সত্ত্বেও, সপ্তাহে সপ্তাহে এবং মাসের পর মাস এই সরকার একটি আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে যাচ্ছে। এটা নিয়ে অতি বিলম্ব করা হচ্ছে এবং এর ফলে চূড়ান্ত বিজয় কঠিন হয়ে পড়বে। সাম্প্রতিক সময়ে শরণার্থী সংখ্যা বাড়ছে। আমরা যে সংখ্যা জানি তা হল ৩.৫ মিলিয়ন যা ছিল কয়েক সপ্তাহ আগের। এখন এটা ৮ মিলিয়ন। জানিনা এটা কোথায় শেষ হবে। মাত্র কয়েক মাস আগে ইয়াহিয়া খান বলেন যে, তিনি ভারতের সাথে কোন যুদ্ধ চান না এবং হয়ত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী যুদ্ধ চান না। অথচ তিনি এখন যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছেন। এমনকি যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করছিলেন তখন তাকে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে পূর্ব পাকিস্তানে তারা আর কোন অস্ত্র সরবরাহ করবেনা। কিন্তু এখন প্রকাশ্যে তারা বলেন যে তারা পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ চালিয়ে যাচ্ছে। যে ধারণা প্রথমে প্রিন্স সাদ্রুদ্দিন করেছিলেন তাই এখন জাতিসংঘের মহাসচিব করছেন। এর মানে কি? তার মানে খুব সহজ, পাশ্চাত্য ক্ষমতা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন বাংলাদেশের জনগণকে জবাই ও গণহত্যায় সাহায্য করছে। পাকিস্তানি সামরিক জান্তারা তাদের সশস্ত্র হামলা চালিয়ে যাচ্ছেন। লক্ষ লক্ষ মানুষ ভারতে পালিয়ে যাচ্ছে। এতে করে ভারতের অর্থনিতী দুর্বল হয়ে গেলে ভারত হয়ত বাংলাদেশকে আর সাহায্য করতে পারবেনা। এটা দিনের পর দিন ঘটছে। আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জানতে চাই আমাদের নীতি অনুযায়ী আসলে কি কাজ হচ্ছে? যদি তা না হয় তাহলে আমি বলব এর কোন ভালো ফল নাই। বাইবেলে আছে ভাই স্বর্গের যাওয়ার রাস্তা ভালো ইচ্ছা দ্বারা পূরন হয়। কিন্তু এই পলিসির আসল ফল কি? চার মাস পর ফল কী হল? আমাদের লক্ষ্য, ভারতকে শক্তিশালী করা মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তিশালী করা। যাতে তারা পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ করে জিততে পারে এবং বাংলাদেশে একটি স্বাধীন সরকার ব্যাবস্থা চালু করতে পারে। যার ভিত্তিতে শরণার্থীরা ফিরে যেতে চাইবে। আর যদি উত্তর এমন হয় যে আমাদের এখন এসব করার প্রস্তুতি নেই তাহলে জানতে চাই আগে কি করেছি তাহলে আমরা? এজন্যই আমাদের এখন স্বতন্ত্র্র নতুন চিন্তার প্রয়োজন। সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এবং এই পর্যায় বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। এটাকে আপনি বাইপাস করতে পারেন না।

স্যার, এই সরকার অতীতে সব সময় বলেছে এটা ইন্দো-পাক সমস্যা না। স্যার, আমি এই সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্পষ্টভাবে এটির উত্তর দিতে বলছি। বাংলাদেশের জনগণ কারা? তারা কি ভারতীয় ব্রহ্মদের মত যে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াবে? যাদের কোন আকার নেই আকৃতি নেই; নিরাকার নিগুনা? বাংলাদেশের জনগণ কর্পোরেট বাস্তবতার সম্মুখীন। এবং এর একটাই অর্থ হয়। তা হল নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে বাংলাদেশের সরকার গঠন। বাংলাদেশ সরকার মানে বাংলাদেশের এবং যদি আমরা এত পরিষ্কারভাবে না বলতে পারি তাহলে ধীরে ধীরে আমরা ডুবে যাব। স্যার যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সর্বশেষ ষড়যন্ত্র কি? সাম্প্রতিক ষড়যন্ত্র হচ্ছে হারানো, নিশ্চিত ভাবে হারানো, রাতারাতি নয়, ধাপে ধাপে। সরকারকে এমন একটা অবস্থানে আনতে বাধ্য করা যাতে এটা ভারত-পাকিস্তান ইস্যুতে মোড় নেয়। এটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা হয়েছে। এটি ইন্দোপাক ইস্যু নয়। এটা বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জনগণের মধ্যকার সমস্যা। এই মুহুর্তে সমগ্র বিশ্বের সামনে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া উচিৎ। আমরা বলতে চাই মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোন সেটেলমেন্ট গ্রহণযোগ্য নয়। যতক্ষণ না আপনি এটা একেবারে স্পষ্ট করছেন ততক্ষণ আমাদের অবস্থান দিন দিন খারাপ হচ্ছে।

স্যার আমি আপনাকে অন্য কিছু বলতে পারি। আমি আপনাকে আরও কিছু বাস্তবতা তুলে ধরছি। এই সংসদে সর্বসম্মতভাবে একটি সংগ্রামের সমর্থন পাস করেছি। এই সংসদে পরবর্তী বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা পাকিস্তানি শাসকদের সমস্যার সমাধান করার জন্য ভারতের খরচে এবং ভারতের মাটিতে তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যার মীমাংসা করার জন্য অনুমতি দিতে পারি না। পরবর্তীকালে তিনি বলেন, ভারতকে অনেক কঠিন সময় পাড় করতে হবে এই প্রশ্নের মীমাংসা করতে হলে। এটা পরে বলা হয়েছিল যে যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই ব্যাপারটা রাজনৈতিক নিষ্পত্তির বিষয় আমলে না নেন তাহলে ভারত একতরফা পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে। এই হাউস বিবৃতি দেয়া হয় ভারত একতরফা পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু এই হাউজের কেউ জানে না এই একতরফা পদক্ষেপ দ্বারা কি বোঝানো হয়েছে। আমি বলছি না ভারতের সশস্ত্র বাহিনী পাকিস্তান চলে যাবে। কিন্তু একতরফা পদক্ষেপ বলতে কি বোঝানো হয়েছে তা স্পষ্ট করা আবশ্যক। যখনই পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে বলা হয়েছে, “আপনি শক্তিশালী বার্তা কেন পাঠান না? প্রকাশ্যে বলা হয়েছিল যে, মার্কিন অস্ত্র পাকিস্তানে পরিচালিত হবে না কিন্তু সেটি যে মিথ্যা ছিল তা প্রকাশ পেয়েছে। মার্কিন সাহায্য পাকিস্তানের জন্য চলমান এবং এটি মোটেই বন্ধুসুলভ কাজ নয়। তারপর বলা হয় যে এটি কূটনৈতিক কারণ। এর কূটনৈতিক প্রয়োগ থাকতে পারে। কেন নয়? আমরা তো সেখানে সেনা ঠেলে পাঠাচ্ছি না। কেউ না। কিন্তু এটা যদি বিশ্বকে বোঝাতে হয় তাহলে শক্তিশালী বার্তা দিতে হবে। এটা আমাদের এক ধরণের অপমান। পাকিস্তানি শাসকরা ভারতে মানুষকে ঠেলে পাঠাচ্ছে এবং উল্টা পাল্টা বলছে। তাই এর জন্য শক্তিশালী বার্তা দিতে হবে।

কিন্তু আপনি শক্তিশালী বার্তা দিচ্ছেন না। এর কী কারণ থাকতে পারে? এক উপসংহার তারা টেনেছে – আর তা হল ভারত হয়ত আপাতত কিছু করতে যাচ্ছেনা। তাই এই মুহুর্তে বাংলাদেশকে স্বীকৃতির প্রশ্নটা বাস্তবসম্মত ও গুরুত্তপূর্ন। এটা শুধু নীতির প্রশ্ন না। এটা বলতে দেরি হবে না যে আমরা নীতিগতভাবে তা গ্রহণ করব। কিন্তু আমরা কখন উপযুক্ত সময় মনে করব সেটা নির্ধারন জরুরী। সময় আছে। কিন্তু এই অবস্থায় সময় খুব কম। তাই নির্দিষ্ট কিছু রেফারেন্স তৈরি করতে হবে। আমার বন্ধু, জনাব ইয়াজি বলেছেন, ‘জাতীয় স্বার্থ’ – এই শব্দ দিয়ে তিনি কি বুঝিয়েছেন আমি জানতে চাই। কিভাবে আপনি আমাদের জাতীয় স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান দেখেন? আমার বন্ধু সবসময় জাতীয় স্বার্থের কথা বলেন। সোভিয়েত সরকারের পক্ষ থেকে সুনিশ্চিতভাবে বলা হয়েছে যে ১৯৭০-৭১ সালে তারা পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করেন নাই। তারা এটা স্পষ্ট করেছেন। তারা সুনিশ্চিতভাবে শুধুমাত্র গণহত্যা থামানোর কথাই না বাংলাদেশ ও এর জনগণের স্বীকৃতির ব্যাপারেও বলেছেন। জিডিআর অবস্থান প্রকাশ করেছে। বুলগেরিয়া করেছে। অনেক সমাজতান্ত্রিক দেশ করেছে। আমি সরকারকে জিজ্ঞেস করতে পারি কিনা এমন একটি পরিস্থিতিতে তারা কি সোভিয়েত ইউনিয়নের পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য বসে থাকবেন? এটা আমাদের সমস্যা, আমরা এখানে জড়িত, আমাদের ভাইয়েরা যুদ্ধ করছে, আরেক ধাপ আগাই চলেন, তারা যতটুকু যেতে পেরেছে গিয়েছে। যা বলার বলেছে। আমরা এক ইঞ্চিও আগাই নাই। তাদের পরবর্তি পদক্ষেপের আশায় আর বসে থাকার দরকার নাই।

আমার বন্ধু, জনাব ইয়াজি, এটা সেটা বলবেন। পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ এবং আমি নিশ্চিত এই পদক্ষেপের পরে বিশ্বের অন্যান্য সহানুভূতিশীল দেশ তাদের সমর্থন প্রকাশ করবে। এটা আমাদের দায়িত্ব। আমাদের অধিকার। আমাদেরকেই করতে হবে। আপনি যদি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেন তাহলে এর মানে হল আমরা শুধুমাত্র আবেগের বশে নয় বা রাজনৈতিকভাবে নয় বরং পুরো বিশ্বের কাছে সাংবিধানিকভাবে এবং বিচারিকভাবে প্রমাণ করতে পারব যে এই দ্বন্দ্ব ভারত পাকিস্তান নয় বরং বাংলাদেশ ও তার শাসকদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব। ভারত এমন কোন সিদ্ধান্ত মেনে নেবে না যা আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এই গোটা বিশ্বকে প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হোক। যত তাড়াতাড়ি আমরা এটা করব আমাদের তত সুবিধা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা থেকে তার শরণার্থী সমস্যা পর্যন্ত – কূটনৈতিক থেকে সামরিক সমস্যা – সব কিছুর সমাধান হওয়া শুরু হবে। আমরা মুজিবের সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের সাথে শরনার্থি সমস্যার ব্যাপারে আলোচনা করব। এতে করে স্বীকৃতি আর শরণার্থী সমস্যা আলাদা করা হচ্ছেনা। এজন্যই এই সরকারকে অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে যে কোনও প্রকার বিলম্ব আরও বিপর্যয়মূলক হবে এবং এই দেশ স্পষ্টভাবে কোনো U.N. পর্যবেক্ষক গ্রহণ করতে যাচ্ছে না। এসব করলে পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হবে। তাই আমাদের এইসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এখানে আর কোন কারণ নাই। “তাদের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ” বলে কিছু নেই – এটা ‘’আমাদের স্বার্থ’। আমি জানতে পারি কি কেন দেরী হচ্ছে? এতে কি লাভ? কোনো প্রকার বিলম্ব এটিকে খারাপ অবস্থানে নেবে এবং ভারত পর্যবেক্ষক গ্রহণ করতে অবশেষে বাধ্য হবে। হয়ত তারা রাতারাতি আসবেনা, দিন মাস লেগে যাবে। আমরা হয়ত আর ঠেকাতে পারবোনা। তারা যথেষ্ট কৌশলী এই ব্যাপারে। তারা জানে কীভাবে কাজ আদায় করিয়ে নিতে হয়। ধীরে ধীরে তারা তাদের পরিকল্পনা মাফিক আগাবে আর একসময় ধাক্কা দেবে। ইতিমধ্যে পাকিস্তান এটা করছে। তারা বলে কেন আপনি পর্যবেক্ষক গ্রহণ করবেন না? আপনার কি কিছু লুকানোর আছে? “অবশ্যই, আমাদের লুকানোর কিছু নাই। অনির্দিষ্টকালের জন্য এটা সেটা বলে আমরা চলতে পারিনা। আমি এই প্রশ্ন শুধু আবেগের দিক থেকে উত্থাপন করিনি নৈতিকতার দিক থেকে করেছি। এখন সময় সবার একমত হবার।

আমি এই প্রশ্ন অত্যন্ত বাস্তবমুখী ব্যবহারিক এবং জরুরী হিসেবে উত্থাপন করছি। সবাই জানে যে ভারত সরকার তাদের সাহায্য করছে কিন্তু আপনি যদি তাদের আরো কার্যকরভাবে সাহায্য করতে চান তাহলে স্বীকৃতি দিতে হবে। চোরাগোপ্তা ফ্যাশনে চালালে হবেনা। পুরো বিশ্ব তা জানে। এটা আরো কার্যকরভাবে করতে হবে। একবার আপনি স্বীকৃতি দিলে আপনি সবাইকে বলতে পারবেন গেরিলারা যুদ্ধ করছে এবং আমরা তাদের সাহায্য করছি। তারপর ভারতীয় স্বেচ্ছাসেবকরা যেতে পারবে। উত্তর ভিয়েতনাম কি করেছিল? সবাই জানে যে উত্তর ভিয়েতনাম পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে এবং উত্তর ভিয়েতনাম তার সেনাদের ধাক্কা দেয়নি বরং তারা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছে তারা আমাদের ভাই, আমরা তাদের সাহায্য করছি। আমরা তাদের জন্য যুদ্ধ করব। তাই আমাদের এটা আগামীকাল ভারতীয় যুবকরা স্বীকার করুক এবং সরকার বলতে পারেন, আমরা তাদের সাহায্য করছি। আগে ভারতীয় সেনাবাহিনীর গোয়া যাবার সময় সত্যাগ্রহিরা সেখানে গিয়েছে সরকারের পূর্ন সহায়তায়। নেহেরু বলেছিলেন আমরা গোয়াতে আক্রমণ করছিনা। কাজেই এভাবে আপনি যদি তাদের সাহায্য করতে চান তাহলে স্বীকৃতি ছাড়া তা সম্পন্ন করা যাবে না। জনাব বিজু পট্টনায়েক বলেন যে গেরিলারা গোটা এলাকা মুক্ত করতে পারবে না – আমি তার সাথে একমত না। আসলে পুরো এলাকায় গেরিলারাই দক্ষিণ ভিয়েতনাম স্বাধীন করেছিল। উত্তর ভিয়েতনামের এ্যারোপ্লেন সেখানে যাননি। তাদের ট্যাংক সেখানে যায়নি। কেউ বলেন না যে উত্তর ভিয়েতনামের ট্যাংক ছিল। তাই সবই করা যাবে। একটা জিনিস বলতে চাই, আমরা যুদ্ধ চাই না। এটা রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত। আমরা বস্তুগত সাহায্য করতে চাই যা অবিলম্বে প্রয়োজন। আমাদের পরবর্তী ২ বা ৩ মাসের মধ্যে এই কাজ করতে হবে। এরপর আমরা আবার পরিস্থিতি বিচার করব। তাদের স্বীকৃতি দিন। গেরিলারা শক্তিশালী হোক। কূটনৈতিক বিশ্ব জানুক। মুজিবের সঙ্গে নিষ্পত্তি হোক। ভারত ইউ এস এ বা অন্য কারো সাথে দরাদরি করতে নারাজ। আমরা শুধু উদ্বাস্তু ইস্যুতে আলোচনা করতে রাজি। আপনি তাদের সহজ অবস্থান প্রকাশ করুন এবং মুজিবের সঙ্গে নিষ্পত্তির হোক। আমরা অন্য কোন বিষয়ে কথা বলব না। এতে সব ভারতীয়দের পূর্ণ সমর্থন থাকবে তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। এটা নিয়ে চিন্তিত হতে হবে না কিন্তু এই মুহূর্তে কোন দ্বিধা বা দোদুল্যমানতা কাম্য নয়। আমরা আপনার উদ্দেশ্য নিয়ে কোন জিজ্ঞাসাবাদ করছিনা। ইতিহাসে কিছু মুহূর্ত আসে যখন সিদ্ধান্ত মুহূর্তেই নেওয়া হয়। আপনি ব্যর্থ হলে, ইতিহাস এই সরকারকে ক্ষমা করবে না। তাই এই কংক্রিট পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য নির্দিষ্ট কিছু করতে হবে। জনাব ছাগলার সাথে আমি একমত যে তিনি বলেছেন কেন অধিবেশন শেষে হবে – আমরা আজই স্বীকৃতি দেব। এটা এখনই করা উচিৎ। দয়া করে আমাদের এই অবস্থা থেকে রক্ষা করুন।

শ্রী শশাঙ্কশেখর সান্যাল (পশ্চিম বঙ্গ): জনাব ডেপুটি চেয়ারম্যান, স্যার, আমার রাজ্যের সরকারি ভাষা বাংলা নয়। আমি, সেই ভাষায় বাংলাদেশ ইস্যু নিয়ে আলোচনা করতে চাই।

কিছু সন্মানিত সদস্য- তিনি আপনাকে অনুসরণ করবেনা।

শ্রীমতী টিআই পূরবী মুখোপাধ্যায় – (পশ্চিম বঙ্গ): জনাব ডেপুটি চেয়ারম্যান, স্যার, আমরা অনেক কিছু এখানে অনুসরণ করব না। এটা ইন্টারপ্রেটার এর ফাংশন। সে যে উপায়ে এখানে গৃহীত হয়েছে, তাতে আমি বিস্মিত। কিন্তু বিষয় হল আমাদের নিজের ভাষায় কথা বলার অধিকার আছে এবং এটা সরকার ও জাতীয় সংসদ কর্তৃক গৃহীত।

জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: কেউ অধিকার অস্বীকার করে নাই।

শ্রী শশাঙ্কশেখর সান্যাল: স্যার আমি আমার পুরনো বন্ধু ও বোন, শ্রীমতী পূরবী মুখোপাধ্যায়, আমাকে উদ্ধার করতে এসেছে দেখে খুশি হয়েছ। তাই আমি কাউকে ভয় পাই না।

স্যার, ৩১ মার্চ, ১৯৭১ উভয় হাউজ বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে সর্বসম্মত রেজোলিউশন পাশ করে। সে সময় ভারতের ইমেজ সমগ্র বিশ্বে উজ্জ্বল হয়েছিল। পৃথিবীর মানুষ অবাক হয়েছে কীভাবে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের জীবন উৎসর্গ করছে। পূর্ব বাংলায় তারা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনার জন্য সংগ্রাম করছে। আগে এটা ছিল অহিংস। এটা আমাদের কাছে মনে হয় যে সেই মুক্তিযোদ্ধারা গান্ধীজীর আশীর্বাদ পুষ্ট। সুতরাং এটা ছিল পূর্ববাংলায় কোন সংগ্রামে গান্ধিজীর দর্শনশাস্ত্রের ব্যবহারিক প্রয়োগ। পশ্চিমের লোকেরা, যারা অহিংস সংগ্রামের কার্যকারিতা বুঝতে পারে না, কিছু সময় পূর্ববঙ্গে এমন একটি অহিংস সংগ্রাম দেখে তারা হতচকিত ছিল।

কিন্তু চার মাস পরে আজ কি পরিস্থিতি? সর্বসম্মতভাবে রেজল্যুশন গৃহীত হল। ভারতের জনগণ সরকারকে ও পার্লামেন্টকে ডকে পাঠাল। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে অদূর ভবিষ্যতে পূর্ববাংলা পাকিস্তানের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের কবল থেকে বের হয়ে আসবে। এবং দুই বাংলার আবার সাংস্কৃতিক লিঙ্ক স্থাপন হবে। দুই বাংলা আবার বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হবে। দেশ বিভাগের পর ভারতে আসা উদ্বাস্তুরা ফিরে যাবে বলে ধারনা করা হয়েছিল। একই আশা বাংলাদেশ থেকে যারা ভারতে বর্তমানে আসছে তাদের ব্যাপারে পোষণ করা হচ্ছে। কিন্তু চার মাস পর তাদের সব আশা মাটিতে বিলীন হয়। কেন এটা হয়েছে? বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা এখন মনে করেন যে আমরা অঙ্গীকার পূর্ণ করার ব্যাপারে আন্তরিক না। পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইতিমধ্যে তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করায় আমাদের অভিযুক্ত করেছে। পাকিস্তান সরকার ইতিমধ্যে আমাদের উপর অসন্তুষ্ট। এখন আমরা খুব বিশ্রী অবস্থায় নিজেদেরকে এনেছি। যখন বাংলাদেশ প্রশ্নে আমাদের ভারতের জনগণ আমাদের ডাকে তখন উত্তর কি হওয়া উচিত?

জনাব ডেপুটি চেয়ারম্যান, স্যার, আমাদের শৈশব দিনগুলোতে আমরা রো এবং ওয়েব এর ইংরেজি ব্যাকরণ পড়েছি। আমাদের জানতে হবে যে এই স্বীকৃতি যথাযথ সময়ে দেওয়া হবে। উপযুক্ত সময় ছিল তখন যখন আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে আমাদের একাত্মতা প্রকাশ করেছিলাম। অতএব, স্বীকৃতি দেয়া এখন সরকারের আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব।

যখন সংসদ ৩১ মার্চ, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ বিষয়ক রেজোল্যুশন সর্বসম্মতভাবে পাস হয় তখন আমরা ভেবেছি ভারত সরকার হয়ত ফর্মালিটিস পালনের জন্য পনের দিন পরে বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেবে। কিন্তু অনেক মাস গেলেও সেই তারিখ পেরিয়ে গেছে। আমরা দেখি বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নে এখনো আমাদের সরকার উভয়সঙ্কটে। আমাদেরকে এর ভালো খারাপ দিক নিয়ে আলোচনা করতে হচ্ছে। আমরা বাংলাদেশ বিষয়ক সর্বসম্মত রেজল্যুশন সংসদে পাস করার পর আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের সব বস্তুগত সাহায্য দিতে সক্ষম হব। আমরা বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু অস্বীকার করতে পারতাম। উদ্বাস্তুদের যারা দেশ বিভাগের পর আমাদের দেশে এসেছিলেন, তারাও প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে সজ্জিত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে অংশ নেবে। আমরা বাংলাদেশের জনগণকে বলতে পারতাম শরণার্থী হিসেবে না আসতে কিন্তু তাদের মুক্তির জন্য লড়াই করার জন্য আসতে পারে। তারা আমাদের কথা শুনবে যদি আমরা তাদের সব ধরণের সাহায্য দেই। এই পদ্ধতিতে আমরা আমাদের দেশ থেকে শরণার্থীদের অন্তঃপ্রবাহ প্রতিরোধ করতে পারি।

স্যার, মার্চ, ১৯৭১ সালে পূর্ববাংলায় সামরিক জান্তা যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত ছিল। যদি আমরা সেই সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সব বস্তুগত সাহায্য দিতাম তাহলে পূর্ববাংলা পনের দিনের মধ্যে তার স্বাধীনতা পেত। একবার যদি তারা স্বাধীনতা অর্জন করে ফেলত তাহলে পৃথিবীর কোন শক্তি তাদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে পারতোনা। অবশ্যই কিছু দেশ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য চিৎকার করত যদি বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হত। ভারত তার সঙ্গে বন্ধুত্বের সাথে বসবাস করত। আমরা সেই সুযোগ আসার জন্য অপেক্ষা করছি।

স্যার, আসলে এই চার মাসের মধ্যে কি ঘটেছে? পাকিস্তান তার সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। সে বিদেশ থেকে অস্ত্র সাহায্য পেয়েছে। তারা দেখানোর চেষ্টা করেছে যে এটা আসলে পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে দ্বন্দ্ব নয় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বন্দ্ব। তারা কিছুটা সফল হয়েছে।

পাকিস্তান আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করতে পারে। সম্ভবত আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে বোঝাপড়া এড়ানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিচ্ছিনা। কিন্তু আমি আমার বন্ধু, সরদার শরণ সিং কে জিজ্ঞেস করতে চাই যে পাকিস্তান কি আমাদের আক্রমণ করবে না যদি আমরা বাংলাদেশের সরকার স্বীকৃতি না দেই? পাকিস্তান যখন দুর্বল ছিল তখন কি আমাদের দেশে আক্রমণ করেনি? পাকিস্তান কিন্তু এখন শক্তিশালী হয়েছে আগের চেয়ে। তাই তারা আমাদের আক্রমণ করবে। আমাদের সীমান্তে আক্রমণ করছে তারা। এই সীমানা হামলা ব্যাপক হয়ে পড়লে আমাদের তা প্রতিহত করতে হবে। কিন্তু পাকিস্তান আমাদের অভিযুক্ত করবে এবং পাকিস্তানের সেই অভিযোগ বিশ্বের অনেক বড় দেশ বিশ্বাস করবে। অতএব, স্যার, আমার কথা হল আমরা অচিরেই বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেব। যদিও আমরা দেরী করে ফেলেছি। তবু বলব না করার চেয়ে দেরিতে করা ভালো। এটা মনোবলহীন শরণার্থীদের তাদের মাতৃভূমিতে ফেরত পাঠাতে সক্ষম হবে। এটা আমাদের দেশে শরণার্থীদের আরও অন্তঃপ্রবাহ থেকে রক্ষা করতে পারবে।

পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ অনিবার্য। পাকিস্তান স্পষ্টভাবে আমাদের ওপর যুদ্ধ আরোপ করবে। পাকিস্তান তার বর্তমান সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য আমেরিকার লাইনে যাবে। আমি আমার কংগ্রেস বন্ধুদের বলব হয়ত পাকিস্তান এখন ভারতর সাথে যুদ্ধ চায় বাংলাদেশকে স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্যর্থ করার জন্য। একইভাবে গরিবি হটাও নির্বাসিত হবে। এছাড়া যুদ্ধ শুরু হলে ব্যুরক্রেটিক মেশিনারি, ক্যাপিটালিস্ট আর মনোপলিস্টরা সুবিধা পাবে। শিল বান্দ্রা ইয়াজি, আর্জুন আরোরা ও চন্দ্র শেখররা শ্রীমতী গান্ধীকে গাইড দিতে পারবেনা। তখন তাকে ব্যুরক্রেটিস্ট আর মনোপলিস্টরা গাইড দেবে।

বিশ্বশক্তিগুলো মাঝে মাঝে বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতকে এক কোনায় চাপিয়ে দেবার চক্রান্ত করেছে। ভারতের বিপক্ষে তাদের ষড়যন্ত্র মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ধ্বংসের জন্য ছিল। তাদের আর সুযোগ দেওয়া আমাদের উচিৎ হবেনা।

স্যার, আমাদের উচিৎ বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া। তাদের বিজয়ে আমাদের বিজয় হবে। তাদের পরাজয়ে আমাদের পরাজয় হবে।

ধন্যবাদ।

শ্রী সীতারাম কিশোরী (বিহার)ঃ
উপসভাপতি মহোদয় কিছুদিন পূর্বে আমার বন্ধু শ্রী রাজ নারায়ণ বাবু বাংলাদেশের অপর তার ভাষণে বলেছেন বাড়ত সরকারের কার্যাবলি দেশদ্রোহী। আমি মনে করি এধরনের কথা বলে তিনি পাকিস্তানের হাত শক্ত করেছেন। শ্রিক্রিতি সম্পক্ক্র ১৯৭১ সালের পহেলা জুনে ভাস্বানই সাহেব যে ভাষণ দিয়েছিলেন তাতে পরিষ্কারভাবে ভারত সরকার কর্তৃক প্রদর্শিত সহানুভূতির স্বাগত জানানো হয়েছে। ভারত সরকার যে এযাবত স্বীকৃতি দেন নাই এটা একথাই প্রমাণ করে যে ঐ দেশের সৃষ্ট সংকতয়ে ভারত সরকারের কোন হাত নেই। আমি বলতে চাই, আমারবন্ধু এই অবসরে যে ধরণের কোথা বার্তা বলেছেন তা ঠিক নয়। দ্বিতীয় কথা, বন্ধুবর বলেছেন, ৬৫ লক্ষ হিন্দু ও ৫ লক্ষ মুসলমান এসেছে। আমি তাকে বলব, তারা ৭০ লক্ষ হিন্দু বা ৭০ লক্ষ মুসলমান হোক আমাদের কাছে তারা পাকিস্তানী এবং পাকিস্তানের নাগরিক। এইজন্য আমি মনে করি, হিন্দু ও মুসলমানের নামে এদেশে সাম্প্রদায়িক চিন্তাধারা কখনোই প্রচার করা উচিৎ হবেনা। এর ফলে বাংলাদেশের কাজে অনেক বড় বাঁধা আসছে। আমি আরেকটা কথা বলছি, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সংকটে নির্ভিকতা ও বিশ্বস্ততার সাথে তার যে রায় প্রদান করেছেন সেইজন্য তিনি প্রশংসার পাত্র। এই জন্য রাশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানকে আমি ধন্যবাদ জানাই। অন্যদিকে অ্যামেরিকা আমাদের শত্রু রাষ্ট্র চিনের সাথে হাত মিলিয়ে নিতচা পূর্ন কাজ করেছে। সে পাকিস্তানকে তার এজেন্ট বানিয়েছে, তেলেস্মাতিরুপে কিসিঞ্জারকে চিনে পাঠিয়ে বাংলাদেশের অসহায় জনগণের ও তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের আশা আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে বিশ্বের দেশে দেশে এক বিষাক্ত আবহাওয়ার সৃষ্টি করেছে। এটা নিন্দনীয়। আমি আরেকটি কোথা বলছি, অ্যামেরিকা কি চায়? চিন কি চায়? এরা উভয়ে চাচ্ছে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হোক। তারা চায় না বাংলাদেশের মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা পূর্ন হোক। তারা চায় সমাজবাদের ভিত্তিতে প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধিশিল ভারতকে পাকিস্তানের সাথে এভাবে জরুয়ে দেয়া যায় কিনা যার মধ্যে সে হাবুডুবু খায়, এইজন্য আমি উভয়কে বলব বাংলাদের একটা ক্রান্তি চলছে আর সেই ক্রান্তির পিছনে ঐ দেশের মানুষের ভাগ্য নিহিত। এই ক্রান্তির পিছনে ঐ দেশের মানুষ অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে, পাকিস্তানের অত্যাচারের বিরুদ্দে, ইয়াহিয়া সএকারের নিপীড়নের বিরুদ্ধে একটা আন্দোলন চালাচ্ছে। এই আন্দোলনে কোন প্রকার ঘা লাগে আমাদের এমন কোন কথা বলা উচিত হবেনা। এই জন্য আমি আমার বন্ধুদের বলব …

আমি আরেকটি কথা বলছি। বাংলাদেশে যা ঘটেছে সারা বিশ্ব তা জানে। আমাদের দেশের সকল লোক বাংলাদেশের স্বীকৃতি চায়, আমিও চাই, কিন্তু স্বীকৃতির সময় হতে হবে। অনেক অবস্থা, অনেক ব্যাপার আছে যা স্বীকৃতি দেবার আগে দেখতে হয়। তাকে সমর্থন করতে প্রস্তুত এমন রাষ্ট্র ক’টি আছে, এমন কত লোক আছে। আমি আরেকটি কথা বলছি, যারা মনে করেন, ভারত বিদেশী শক্তির উপর নির্ভর করে যুদ্ধ করবে, তারা ভুল বুঝছেন। এটি বিদেশী লোক দের মন জয় করার জন্য, বিদেশীদের ভাববার জন্য, বিদেশীদের মূল্যায়নের, বিদেশীদের ধারনার একটি রীতি ও অভ্যাস। এটা কথা বলার একটি পদ্ধতি। মীমাংসা আমরা করব, পদক্ষেপ আমরাই নেব – ইস্পাতদৃঢ় পদক্ষেপ, আমরা সিদ্ধান্ত নেব যুদ্ধ কখন বাধাতে হবে আর কখন নয়। একটা কোথা আমরা জানতে চাই। আপনারা জানতে চেয়েছেন এর পরে কি আছে। প্রধানমন্ত্রী যখন বলেছেন, ভারতে আগত শরনার্থিদের ফিরে যেতে হবে। আমি বলব, আপনারা সত্য উপলব্ধির চেষ্টা করুন। এ সত্যের পেছনে কোন দুর্ভাবনা নেই। এই সুচিন্তিত কথার পেছনে কি মস্ত ইস্পাতকঠিন ধারনা আছে নীতির মানদণ্ডে তা ইন্টারপ্রেট করুন। বিচার রীতি অনুসারে এই বিবৃতির ব্যাখ্যা করুন। যদি আপনারা নিজেদের জন্য নিদের ধারনার ব্যাখ্যা করেন তাহলে সেটি সম্ভব হবেনা।

আমি জানি দেশে একটা ষড়যন্ত্র চলছে, কী সেটা? নির্বাচনে কিছু লোক হেরে গেছে, কিছু দলের বিলোপ ঘটেছে, তারা চাচ্ছে এই অবস্থার সুযোগ নিতে। কিন্তু আপনারা সুবিধা করতে পারবেন না, কেনোনা ভারতবাসী আপনাদেরকে ভালভাবে চেনে। আপনাদের এইসব প্রচার ও এই রূপ প্রোপাগান্ডার পেছনে কি অভিসন্ধি কাজ করছে। আপনি দেখেছেন তারা আন্দোলন চালাচ্ছেনা। আপনি দেখেচনে, তারা আপনার পথে চলেছে না, আপনাকে জন সাধারণ নির্বাচিত করছেনা, তাই আপনি হিন্দু মুসলমানের প্রশ্নে কথা বলতে শুরু করেছেন।

শ্রী রাজ নারায়ণ ঃ মহোদয়, বাংলাদেশকে এখন পর্যন্ত স্বীকৃতি না দেওয়া আমাদের ভুল। এব্যাপারে আমি সুনিশ্চিত। আমি আরও সুনিশ্চিত যে, বাংলাদেশেকে স্বীকৃতি দিতে যত বিলম্ব হবে ততই নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব হবে এবং ভারত প্রতিনিয়ত তার জটাজালে জড়িয়ে পড়বে। নিত্যদিন আমাদের জটিলতা বারতেই থাকবে। এখন যারা ততখানি স্বীকৃতি দেবার পক্ষপাতী নন আমি তাদের জয়ব দিচ্ছি স্বীকৃতি দিতে কেন বিলম্ব হচ্ছে। ৩১ মার্চ সংসদ সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব পাশ করেছে – ‘এ মহাদ্বিপের মানুষ বহু শতাব্দী ধরে ভারতের ভৌগলিক অবস্থান ও ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কারণে এই সভা তার আপন সীমান্তের এত কাছাকাছি ঘটমান থাকতে পারেনা। বর্তমান সময়ে তথাকার নিরপরাধ মানুষের অপর যে নজিরবিহীন উপায়ে অত্যাচার চালানো হচ্ছে আমাদের সারা দেশের জনগণ দ্ব্যার্থহীণ ভাষায় তার নিন্দা করছে।

এই সভা গণতান্ত্রিক (লোকতন্ত্রাত্মক) জীবন ব্যাবস্থার জন্য পূর্ব বাংলার জনগণের সংগ্রামের প্রতি গভীর সহানুভূতি ও একাত্মতা ব্যাক্ত করছে। এই সভা তাদের এই শ্বাস প্রদান করছে যে তাদের সংগ্রাম ও ত্যাগ ভারতের জনগণের আন্তরিক সহানুভূতি ও সমর্থন লাভ করেছে। আমি বলতে চাই যে, এই প্রস্তাবের পরে সাথে সাথে তাৎক্ষনিক স্বীকৃতি প্রদান করা কি আমাদের নৈতিক ও রাজনৈতিক কর্তব্য হয়ে দাড়ায়নি? মুজিবুর রহমা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এই ব্যাপারে সময় দেয়া উচিৎ। ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ স্থাপিত হয়েছিল। ১৫ মার্চ ইয়াহিয়া খাঁ ৩-৩০ মিনিটে ঢাকা পৌঁছেন। ১৫ মার্চে মুজিবুর রহমান শাসনক্ষমতা নিজের হাতে নেন এবং নিজেকে শাসক ঘোষনা করেন। ১৫ মার্চ তিনি একথা বলেন। ১৫ মার্চের পর আমি ২৫ মার্চের কথায় আসছি না। আমার কথা হচ্ছে ১৫ মার্চেই ভারত সরকারের মুজিব সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া উচিৎ ছিল।

আমি বন্ধুবর শ্রী শিল ভদ্র ইয়াজদিকে বলতে চাই যারা বলেন স্বীকৃতির প্রশ্নে আমরা একমত কিন্তু এটি সরকারের হাতে ছেড়ে দেয়া উচিৎ। আমি বিনয়ের সাথে বলব, তিব্বত সমস্যা কি ভারত সরকারের উপর ছেড়ে দেয়া হয়নি? তিব্বতে আমাদের ১২ টি ডাকবাংলো ছিল, তিব্বতে আমাদের তিনটি সামরিক তথ্যকেন্দ্র (জানকার) ছিল, তিব্বতে আমাদের ডাকঘর চিঠিঘর এবং টেলিফোন ঘর ছিল এবং এভাবে তিব্বত চিনের খুনি কব্জায় চলে গেছে। আমার ভয় হচ্ছে, দালাইলামার নেতৃত্বে এখানে যে ৬১ হাজার তিব্বতি শরনার্থি পরে আছে এ সরকার তাদেরকেও আমার চিন সরকারের কাছে সমর্পন না করেন। আমি এই ভয়ও পাচ্ছি যে বাংলাদেশের শরনার্থি যরা এখানে এসে পড়েছে সরকার তাদেরকে অন্য কোন রাষ্ট্রের হাতে সমর্পন না করেন। অতএব, আমি বলতে চাই এ বিষয়ে আমার কোন ব্যাক্তিগত প্রশ্ন নেই, এ প্রশ্ন সারা দেশের, সারা বিশ্বের, সমগ্র মানবের এবং সকল গণতান্ত্রিক ব্যাবস্থার, এ প্রশ্ন কোন ব্যাক্তি বিশেষের উপর আরোপ করলে চলবে না।

… সুতরাং আমি দেশের জনগণের উদ্যেশ্যে বলব, জনগণ উঠুন এবং উঠে এসে সরকারের উপর প্রচণ্ডভাবে চাপ প্রয়োগ করুন যা আজই এখনি এই অধিবেশন শেষ হতে হতে না হতেই স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের কথা এবং নৈতিক, বৈষয়িক, সামরিক সর্বপরি সাহায্যের কথা ঘোষনা করা হোক।

মহোদয়, আমি চাগ্লা সাহেবকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। চাগ্লা সাহেবের পুরো ভাষণ আমি নিজের ভাষণরূপে মেনে নিতে প্রস্তুত। চাগ্লা সাহেব বলেছেন, ইয়াহিয়া টু-নেশন মত সমর্থক। তিনি ঠিকই বলেছেন, আমিও তাই বলি, ইয়াহিয়া দুই রাষ্ট্রের তত্ত্বের পক্ষে। এইজন্য তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ হতে ঐ লোকদের বের করে দিতে চান যারা ইয়াহিয়ার মত সমর্থন করেন না। তিনি চান সকল ইয়াহিয়া সমর্থক সেখানে থাক, খাঁটি মুলসিম লিগার ও মুসলিম পূজারিরা সেখানে থাক। চাগ্লা সাহেব অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে তার বিতর্কে এ কথা প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

আমি বলব স্বীকৃতি দিলে কি লাভ হয়। স্বীকৃতি দিলে শুধু ভারতের অস্ত্রই যাবেনা, বিশ্বের এরূপ অনেক দেশ আছে যারা ভারত স্বীকৃতি দিলে, ভারতের দ্বারা স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে অস্ত্র দেবে। তাদের অস্ত্র পাঠাতে কোন অসুবিধা হবেনা। স্বীকৃতি দিলে সবচেয়ে বড় লাভ হবে এই যে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশকে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্ররূপে মেনে নিচ্ছি এবং স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের মর্যাদা পেলে তার শক্তি স্বামর্থ্য বেড়ে যাবে। তাই আমি বুঝতে পারিনা আমাদের সরকার স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে কেন স্বীকৃতি দিচ্ছেন না। মুজিবুর রহমান মহাশয় বলেছেন আমাদেরকে স্বীকৃতি দিন। তার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট বলেছেন আমাদেরকে স্বীকৃতি দিন। তাজউদ্দীন সাহেব বলেছেন আমাদের স্বীকৃতি দিন। তাদের পরিষদ সদস্য যারা এখানে এসেছেন তারা বলেছেন আমাদেরকে স্বীকৃতি দিন। তারা বলেছেন, পৃথিবীর অন্য দেশ আমাদের স্বীকৃতি দিক বা না দিক আমরা তো ভারতের ক্লের মধ্যে আছি, তিন দিক হতে আমরা ভারতের দ্বারা বেষ্টিত। এইজন্য ভারত আমাদেরকে স্বীকৃত দিক। এও তাদের বক্তব্য যে ২৩ বছর পূর্বে আমরা এক ছিলাম এবং আনাদের রক্ত এক। তাজউদ্দীন সাহেব এতদূর বলেছেন ভারত সরকার স্বীকৃতি দিতে যত দেরি করছেন তার ফলে এক এক দিনে হাজার হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটছে। তাজুদ্দিন সাহেবের একথা সত্ত্বেও ভারত সরকার বলেছেন আমরা তোমাদের স্বীকৃতি দেবনা।

শ্রী শিলা ভদ্র ইয়াজিঃ সরকার কোথায় একথা বলেছেন যে স্বীকৃতি দেবনা?

শ্রী রাজ নারায়নঃ হ্যা, এটি তো বলেছেন ভারত সরকার। নিজের দেশের স্বার্থে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কি হবে তা দেখে, যখন সময় হবে, তখন স্বীকৃতি দেয়ার কথা বিবেচনা করব। যাজী মহাশয়কে বলছি আপনার সঙ্গে আছি। কিন্তু প্রশ্ন এটিই যে, আজ আপনার ৫০ টাকার দরকার হল, তিনি বলেন, এখন তোমার দরকার নেই, তোমার কখন দরকার হবে সেটা আমি বুঝব। আশানুরূপভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ বলেছে আমাদেরকে অবিলম্বে সাহায্য দিন, এখনি স্বীকৃতি দিন, কে একদিনে হাজার হাজার মানুষকে প্রাণপাত করতে হচ্ছে। কিন্তু ভারত সরকারের বক্তব্য হচ্ছে এখনো উপযুক্ত সময় আসেনি, ধৈর্যধারণ করো, যখন সময় হবে তখন স্বীকৃতি দেব। এখনো ভারত সরকার ভাবছেন যে কখন স্বীকৃতি দেবেন, কখন দেবেন না। যেখানে গ্রামের পর গ্রাম সম্পূর্ন ধ্বংস হয়ে গেছে, যেখানে কোন ফসল অবশিষ্ট নেই, যেখানে মানুষের খাবার নেই, সেখানের জন্য ভারত সরকারের বক্তব্য হচ্ছে স্বীকৃতি দেবার সময় হয়নি। … যখন পর্যন্ত সরকারের মাথায় এধরনের বুসশি থাকবে তখন পর্যন্ত ঐ সময় কখনো আসবেনা। একারণে বুদ্ধি ঠিক করার জন্য আমি ভারতের মানুষের কাছে আহবান জানাব হএ ভারতবাসী, ওঠো, ভারত সরকারকে চাপ দাও যাতে অবিলম্বে স্বাধীন বাংলাদেশ স্বীকৃতিলাভ করে এবং স্বীকৃত পেয়ে সে সর্বপ্রকার সহায়তা পায় এবং অন্যরাও তাকে সহায়তা দান করে। … আমি আজ আবার একটি পুরাতন বিষয় আপনাদের সামনে রাখতে চাই, হতে পারে সন্মানিত সদস্যগণ বিস্মৃত হয়েছেন। আমি ডঃ লোহিয়ার লেখা একটি কথা উদ্বৃত করছি। সে সময়ের চিন্তাধারা কি ছিল এবং আমাদের কাছে সময়ের চাহিদা কি আমরা সেটা জানতে পারব। ডঃ লোহীয়া মহোদয় লিখেছেন, একথা ভারতের জন্য প্রযোজ্য হয়না। কেননা ভারতের এমন কোন অংশ নেই যা তার স্বাভাবিক অঙ্গ নয় কিংবা তার থেকে আলাদা নয়। অন্যদিকে পাকিস্তানের সৃষ্টি সম্পূর্ন কৃত্রিম, তার দুই অংশের মাঝখানে এক হাজার মাইল ভারতের ভূখণ্ড। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বর্তমান সম্পর্ক টিকতে পারেনা। পূর্ব পাকিস্তান হয় পশ্চিম পাকিস্তানের দাশ হয়ে পড়বে নয়ত পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে তার সম্পর্ক শিথিল হতে থাকবে এবং তাকে ভারতের প্রতিবেশীর ভূখণ্ডের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে এমন কোন সামরিক শক্তি নেই যে, সে পূর্ব পাকিস্তানকে দাশে পরিণত করবে, … প্রভাব নিঃসন্দেহে আছে কিন্তু কতদিন পর্যন্ত টিকে থাকবে বলা যায়না। এরুন দাসত্ব অপেক্ষা স্বাধীনতার চিন্তা ভালো। ইতিহাসের পরিণতি হতে অব্যাহতি নেই। শ্রী শিল ভদ্র ইয়াজি মহাশয়, একটু শুনে রাখুন, ভারত যদি তাকে কোন সাহায্য নাও করে তথাপি পাকিস্তান সন্দেহ করবে এবং স্বাভাবিকভাবে বিকাশমান স্বাধীন বাংলাদেশের ব্যাপারটি ভারতের অপর চাপাবে। এখনি … ভাষা ও আমলাতন্ত্র (ণওকর শাহী) প্রশ্নে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে কিছুটা বিবাদ সৃষ্টি হয়েছে, আর সামনে হবে। এসকল বিবাদ বুদ্ধিমত্তার সাথে মীমাংসার পরিবর্তে পাকিস্তান হিন্দু-মুসলিম ও হিন্দুস্থান পাকিস্তানের সীমান্ত নিয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টির মারাত্মক পন্থা গ্রহণ করেছে।

শ্রী মহাবীর ত্যাগীঃ এটা কে লিখেছেন?

শ্রী রাজ নারায়নঃ ডঃ লোহিয়া।

জনৈক মাননীয় সদস্যঃ কবে লিখেছেন?

শ্রী রাজ নারায়নঃ ১৯৪৮ সালে। আপনি একটু মনোযোগ দিন, এটি ১৯৪৮ সালে লেখা হয়েছে। ১৯৪৮ সালেরই একটি ভবিষ্যতবানি আমি আবার করতে চাই।

মহোদয়, সন্মানিত সদস্যদের আমি একথাও বলব, ডঃ সকালেই সাবধানী উচ্চারণ করেছিলেন, পূর্ব বাংলা যখন স্বাধীনতা সংগ্রাম করবে তখন ভারত সরকার তটস্থ থাকতে পারে কিন্তু ভারতের জনগণ যেন এখনি এরূপ অন্যায় না করেন। ডঃ লোহিয়া ভারত সরকার ও ভারতের জনগণকে আলাদা করেছিলেন। তিনি সাবধানী দিয়েছিলেন। ভারত সরকার সরে থাকতে পারে কিন্তু হে ভারতবাসী, ভারত সরকার যদি সরে থাকেন তবে আপনারাও অনুরূপ করবে না। সেটা মহা অন্যায়, স্বাধীন বাংলার সংগ্রামে আপনারা ত্যাগ স্বীকার করবেন।

মহোদয়, এই নিবন্ধের শেষের দিকে আছে ১৯৪৮ সালে দেশ বিভাগের কমাস পরে আমি বলেছিলাম তিনটির মধ্যে কোন একটি কিংবা তিন ভাবেই পাকিস্তানের অবসান হবে? আলোচনার মাধ্যমে সঙ্ঘিয় ঐক্য, ভারতের সমাজবাদী ক্রান্তি এবং পাকিস্তানের হামলার জবাবে ভারতের আক্রমণ। এই ভাষণে পাকিস্তানের তদানীন্তন গভর্ণর জেনারেল মিস্টার জিন্নাহ চটে গিয়েছিলেন। মহাত্মা গান্ধীও সে সময় জীবিত ছিলেন। তার মৃত্যুর ফলে ঐক্যের সমস্ত ক্রম ভেঙ্গে গেছে, একারণ ছাড়া আমি এই মত পরিবর্তনের কোন প্রয়োজন বোধ করিনা। যতটুকু বিলম্ব ঘটেছে তার দায় দায়িত্ব কট্টরপন্থী হিন্দুদের অপর। এটি তার মত।

মহোদয়, এখন আমি আপনার অনুমতি নিয়ে বন্ধু শ্রী শিল ভদ্র ইয়াজি, সরদার স্মরণ সিংহ এবং দীক্ষিত মহাশয়কে বলব, ইতিহাসকে ভুলে যাবেন না। যে প্রস্তাবে দেশ বিভাগ মেনে নেয়া হয়েছিল, তার মধ্যেও কি কোন অঙ্গীকার করা হয়েছিল? ১৪-১৫ জুন, ১৯৪৭ দিল্লী। গান্ধজি এ, আই, সি, সি ছিলেন। প্রস্তাবে আছেঃ কংগ্রেস – সে কংগ্রেস তো মরে গেছে, ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারিতেই ঐ কংগ্রেসের মৃত্যু হয়েছে। যার নেতা ছিলেন গান্ধীজী – কংগ্রেস। তার জন্ম লগ্ন হতে একটি অখণ্ড স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখেছে, তাকে পেতে লক্ষ লক্ষ নরনারী কষ্ট সয়েছে। আমাদের ভারত যাকে পৃথিবী, যাকে ইতিহাস, যাকে ভূগোল, সমুদ্র, পাহাড় এক সত্তা বানিয়েছে পৃথিবীর কোন বড় শক্তি তার ভাগ্য প্রতিহত করতে পারবেনা। যে ভারতের স্বপ্ন আমরা দেখেছি তা সর্বকাল সর্বক্ষন আমাদের হৃদয়ে ও ধ্যানে জাগরূক থাকবে। আমি স্মরণ সিংহ মহাশয়কে জিজ্ঞেস করব এর অর্থ কি? এর অর্থ হল এই যে, আমাদের ভারতের স্বরূপ তাই হবে আমরা যা অঙ্গীকার করেছিলাম ১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ জুনে। …

আমি আবার আপনার মাধ্যমে একথা পুনরাবৃত্ত করতে চাই, আমাদের সংসদের কেন্দ্রীয় ভবনে রাষ্ট্রীয় সমিতির যে ৩ জন প্রতিনিধি এসেছিলেন তারা একথা বলেননি যে তাদের পক্ষে চিরদিনের জন্য পাকিস্তানের সমাধি হয়েছে? বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন কি একথা বলেন না, আর কোন শক্তি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে এক করতে পারবেনা, আগের সম্পর্ক আর পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভবপর নয়। ইয়াহিয়া খানই পাকিস্তানের সমাধি ঘটিয়েছে। ইয়াহিয়া খাঁর সামরিক শক্তি পাকিস্তানকে খতম করেছে। অতএব আপনারা কেন ভয় পান যে পাকিস্তানের বিলোপ ঘটানোর কথা বললে আমরা কোন বড় পাপ করে ফেলব। আপন মনের দুর্বলতা ঢাকার জন্য জিনের অকর্ম্যন্যতা লুকানোর জন্য একথা বলা হয় আমরা তো পাকিস্তানকে মেনে চলি। অদিকে পাকিস্তান হতে পাখতুনিস্থান চলে যাচ্ছে বেলুচিস্থান চলে যাচ্ছে। সব কিছু আপন স্থানে এসে যাবে, এভাবেই ইতিহাসের পরিণতি হতে রেহাই পাওয়া যাবেনা।

এ প্রসঙ্গে আজ মুজিবুর রহমান কে শাস্তি দেবার কথা শোনা যাচ্ছে। আমি চাই এই পরিষদ (সদন) একই কণ্ঠে আওয়াজ তুলুন, সাবধান, তোমরা যদি মুজিবকে শাস্তি দাও, ফাঁসি দাও, তবে ভারতের নাগরিক নিজের ফাঁসি মনে করে সম্মিলিত শক্তিতে সারা বিশ্বে ফাঁসির কথা ছড়িয়ে দেবে যাতে মুজিবুর রহমান আমাদের মধ্য হয়ে হারিয়ে না যায়। মহোদয়, আমি বলতে চাই স্বাধীন বাংলাদেশকে যদি স্বীকৃতি দিয়ে দেয়া হত তাহলে কি মুজিবের ফাঁসির কথা উঠত? কখনোই উঠত না।

বাংলাদেশকে এযাবৎ স্বীকৃতি না দেয়ার পরিণতি আসছে, আজ মুজিবুর রহমানের ফাঁসি দেয়ার কথা উঠেছে, মামলা চালানোর কথা হচ্ছে। এর দায় দায়িত্ব ভারত সরকারের। আমি বলতে চাই, স্বাধীন ভারতের শহীদগনের রক্তে কি ভারত সরকারের হাত রঞ্জিত হয় নি? আপনারা বলেছেন, শরনার্থি সমস্যা আছে। শরনার্থি সমস্যার উদ্ভব হয়েছে ভারত সরকার স্বীকৃতি না দেয়ার ফলে। কেননা, ২৫ মার্চের পড় ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত আমি এখনকার লোকদের সঙ্গে আলাপ করেছি – একজন শরনার্থিও আসেনি। ১৭ এপ্রিল মুজিবুর রহমানের সরকার মুজিবনগরে গঠিত হয়, সরকার গঠনের ঘোষণা হিয়এ গিয়েছিল। আমি ভারত সরকারকে বললাম এখনি স্বীকৃতি দিন, আপনারা বলতেন, সরকার কোথায়, কিন্তু সরকার তো এখন গঠিত হয়েছে। ভারত সরকার কোন জবাব দেননি। মহোদয়, দুঃখের সাথে আমাকে সয়ার চার্লস বেলস – এর মন্তব্য পুনরুল্লেখ করতে হচ্ছে, যা ১৯২৪ সালে তিনি বলেছিলেন। আমি আজ এ পরিষদের সন্মানিত সদস্যগণকে তার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যার কথা সরকার উপেক্ষা করেছেন তিনি বলেছিলেন, তিব্বত যদি চিনের কব্জায় চলে যায় তাহলে নেপাল, ভুটান ও সিকিম ভারত হতে মুখ ফিরিয়ে চিনের দিকে তাকাবে। আমি বলতে চাই, বাংলাদেশের মানুষ আজ সংসদে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতে এসেছেন। আজ যদি বাংলাদেশকে ভারত স্বীকৃতি না দেন এবং বাংলাদেশ ভারত হতে বিমুখ হয় তাহলে নেপাল ভুটান ও সিকিম কোথায় যাবে? নেপালের লোকেরা আমাদের সাথে লেখাপড়া করেছে, সেখানে যারা মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তারা সকলেই আমাদের সহপাঠী ছিলেন। আন্দোলনে জেলে তারা আমদের সঙ্গে ছিলেন। তারা সকলে আমাকে বলেন, যখন তোমরা শক্তিশালী হবে তখনই তো তোমাদের সঙ্গে থাকব। তোমাদের শক্তি নেই, আমরা কোথায় কাদের সঙ্গে থাকব। তোমাদের সঙ্গে থাকলে আমাদের স্বার্থ রক্ষা কি করে হবে? আজ স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ ও সেখানকার নেতা বলেছেন হে ভারতবাসী, আমাদের স্বার্থ রক্ষা করতে না পেরে তোমরা নিজেদের স্বার্থই ক্ষুণ্ণ করেছ। অতএব আমি বিনা দ্বিধায় বলতে চাই বাংলাদেশের উপর যে আক্রমণ হয়েছিল তা সোজাসুজি ভারতের ওপরই হয়েছে, ভারতের অকপটে বলা উচিৎ এই আক্রমণ ভারতের ওপর হয়েছে। এতে সাম্প্রিদায়িকতা কীভাবে আসে?

মহোদয়, আমি আপনাকে বলতে চাই, স্বাধীন বাংলাদেশ ভারতের সমস্ত সমস্যার সে সমাধান বেড় করেছে তাকে আর নষ্ট হয়ে দেওয়া ঠিক নয়। স্বাধীন বাংলাদেশের মুজিবুর রহমানের আওয়ামী পার্টি সবচেয়ে বড় পার্টি এবং আমাদের স্বার্থের বড় রক্ষক। বাংলাদেশের মানুষ চিৎকার করে বলছে ধর্ম রাষ্ট্রের ভিত্তি হতে পারেনা। হিন্তু ও মুলসিম একে অন্যের গলা কাঁটার জন্য সৃষ্টি হয়নি। ভ্রষ্ট ও দুষ্ট মস্তিষ্কের মুসলমান মুসলমানের গলা কাটবে এবং হিন্দুর গলা কাটবে। ভ্রষ্ট ও দুষ্ট মস্তিষ্কের হিন্দু হিন্দুর গলা কাটবে এবং মুসলমানের গলা কাটবে। এক মায়ের পেট হতে যাত দুই সহোদর ভাই একে অন্যের গলা কাটে। বিভিন্ন মায়ের সন্তান পরস্পরকে বোধ করে। এজন্য আমি পরিষদের মাধ্যমে ভারতের মুসলমানগনের কাছে আবেদন জানাচ্ছ, এখানে যে সাড়ে ৬ কোটি মুসলমান আছেন তারা কি ইসলামে বিশ্বাস রাখেন না? ইয়াহিয়া খান সাহেব কি ইসলামে বিশ্বাস রাখেন না? একজন মুলসিম মাতার সন্তান ইয়াহিয়া খাঁ, আরেক মুসলিম মাতার সন্তান মুজিবের গলা কাটছে, ওখানে তারা বলছে আমরা ইসলামে বিশ্বাসী, আর এখানে সাড়ে ৬ কোটি মুসলমান আছে। আমার বক্তব্য হল, ইয়াহিয়া খাঁর সৈন্যরা আমাদের মা, বোন, স্ত্রী ও কন্যাদের ওপর বলাৎকার করছে, দিনে দুপুরে করছে। পথে- ঘাঁটে করছে, আমি জানতে চাই এরা কি ইসলাম শেখাচ্ছে? … ইসলাম বিশ্বাসী।

যারা আজ মুজিবের ওপর আওয়ামীলীগের ওপর, বাংলাদেশের মুসলমানদের ওপর ইয়াহিয়া কর্তৃক ছড়ান এই গজবের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেনা তারা মুসলমান নয়। তাদের মুসলমান বলে দাবী করার অধিকার নেই। যদি মুসলমান থাকে তাহলে সাড়ে ৬ কোটি মুসলমানের ইজ্জত আজ বিপদ জনক হুমকির সম্মুখীন, তাদের স্ত্রী কন্যা আমাদেরই স্ত্রী কন্যা। তাদের দেশের মুসলমান আমাদেরই মুসলমান, আমি তো মনে করি তারা আমাদেরই। সম্প্রদায়বাদের স্রোতের মধ্যে থেকে তারা স্বীকৃতি দেয়ার বিরোধিতা করছে, স্বীকৃতি দিতে বিলম্ব করছে। এইজন্য আমি বলব আল্লাহর ওয়াস্তে ঈশ্বরের জন্য, মানবের জন্য, মানবতার জন্য বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন।

এব্যাপারে আমি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে, উথান্ট ও সকল বিদেশী দূতাবাসের কাছে, সকল রাজনৈতিক দলের কাছে পত্র লিখেছি।

শ্রী অর্জুন অরোরাঃ একটু পড়ে শোনান –

শ্রী রাজ নারায়নঃ অন্য কোন দিন পড়ে শোনাব। আমি লিখেছি, স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে আপনাদের সরকার এগিয়ে আসছে না কেন? আপনারা কেন অগ্রবর্তি হচ্ছেন না?

মহোদয়, ৯ আগস্ট ১৯৪২ সালে আমরা ইংরেজদের … স্বীকার নিয়েছিলাম। ইংরেজ সামাজ্যবাদের অবসান ঘটানোর জন্য আমরা চিরদিনের জন্য ‘কিতাববন্দ’ করে দিয়েছিলাম। ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট আমরা ইয়াহিয়া খাঁর … স্বীকার করে নিয়ে সক্রিয়ভাবে তার বিরোধিতায় অনশন করার ঘোষণ দিয়েছি। … ১ এপ্রিল, ২ এপ্রিল, ৩ এপ্রিল আমন কোন দেইন যায়নি যেদিন আমরা বাঙ্গালদেশের প্রশ্ন তুলিনি। ২ এপ্রিল আপনার সত্যাগ্রহ করেছি। এই সরকারকে প্রভাবিত করার জন্য আমরা যত উপায় ও সাধন ছিল সবই প্রয়োগ করেছি, এখন আপনিই বলুন আমরা কি করব। শ্রী শিলা ভদ্র ইয়াজির ভাষণে জনগণ এমন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন যে ভারত সরকারকে আর প্রভাবিত করতে পারেন না। এরূপ একটি বৃহৎ ও সঠিক কার্য করার জন্য আমাদের পূর্ন অধিকার আছে, ৯ আগস্ট আমরা অনশন শুরু করব। আমি বিনয়ের সাথে বলছি যে আমরা কারো সাথে চ্যালেঞ্জ করছিনা। আমরা কারো ওপর প্রভাব বিস্তার করার জন্য কোন কাজ করিনা। আমার পত্রে আমি লিখেছি, প্রধানমন্ত্রীকেও লিখেছি যে আমরা নিজেদের মধ্যে আত্মশক্তি সৃষ্টির জন্য, দেশের নাগরিকদের মধ্যে আত্মশক্তি সৃষ্টির জন্য, এই পুণ্য কাজ করতে যাচ্ছি। এই পরিষদের সন্মানিত সদস্যগণের মধ্যে যারা সত্যিকারভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রিদানের পক্ষপাতী সর্বতোপায়ে তাকে সহায়তা দানের পক্ষপাতি, এবং বাংলাদেশের গণহত্যা ঘটনাবলিতে উদ্বিগ্ন ও সহানুভূতি সম্পন্ন তাদের উচিৎ শুধু মৌখিক সহানুভূতি না দেখিয়ে সক্রিয়ভাবে কিছু করা। … ভারত সরকার এযাবৎ স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়ার জন্য আমি তাকে নিন্দা করি। আমি আরও বলব এই সরকার দেশ হিতের ভাবনা মুক্ত। আনন্দফুর্তির জীবন সে যাপন করছে। এই জীবন শেষ হয়ে না যায় এই তার চিন্তা। এদেশের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য আমি ভারত সরকারের নিন্দা করছি আজ এই শেষ সময়ে আমি সরদার স্মরণ সিংহ মহাশয়ের মুখ থেকে এ বানিই আশা করছি যে ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন, সাহায্য করছেন, এবং বিশ্বের সকল দেশকে স্বীকৃতি দেবার জন্য আহবান জানাচ্ছেন।

হায়াতুল্লাহ আনসারিঃ ডেপুটি চেয়ারম্যান সাহেব, এখানে একটি কথা এসে গেছে যা আমি আগে ভাবিনি। সেটি হচ্ছে রাজ নারায়ণ বাবুর মন্তব্য যে মুসলমান সহযোগিতা করবেনা।

শ্রী রাজ নারায়ণঃ আমি বলিনি।

হায়াতুল্লাহ আনসারিঃ তিনি বলেছেন মুসলমান সহযোগিতা করবেনা।
শ্রী রাজ নারায়ণঃ বৈধতার প্রশ্নে আমি বলিনি, তবুও মাননীয় সদস্য বলে যাচ্ছেন যে আমি বলেছি। আমি এই বলেছি যে যেসকল মুসলিম আজ তাদের স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত নয় এবং আজ স্বাধীন বাংলাদেশের সাড়ে ৬ কোটি মুসলমানের ওপর যে অত্যাচার চলছে সে কারণে যেসকল মুসলিমের মনে আগুন জ্বলে না তারা মুসলমান নয়।

হায়াতুল্লাহ আনসারিঃ আমি রাজ নারায়ণ বাবুকে জিজ্ঞেস করতে চাই, এমন কি উপায় বেড় করা যায় যার দ্বারা মুসলমানগন দেখতে পারবে বাংলাদেশের ব্যাপারে তাদের ইম্প্রেশন আর সকলের অনুরূপ। দেখুন, এ প্রশ্নে আমরা খুব সিরিয়াসলি চিন্তা ভাবনা করেছি। আমরা চাই মুসলমানদের একটি মহা সম্মেলন ডাকা হোক। কিন্তু আমিষ এই সাথে বলছি কনভেনশন আয়োজনের মত অর্থ আমাদের কাছে নেই। বাংলাদেশের ব্যাপারে আমরা কারো চেয়ে পেছনে নেই। এখানে এটা দেখানোর জন্য মানুষ মাদ্রাজ হতে, দক্ষিণ ভারত হতে, বাংলা হতে পায়ে হেটেও আসতে পারে। এখানে যে কথা উঠেছে তা অত্যন্ত গুরুত্তপূর্ন। কিন্তু আপনারাই বলুন, কোন রাজনৈতিক ইস্যুতে দিল্লী বা অন্য কোথাও সারা ভারতের মুসলমানদের সমাবেশ ঘটানো কি উচিৎ হবে? এ প্রশ্নে আমি সারা জীবন বিরোধিতা করে এসেছি, রাজনৈতিক ইস্যুতে মুসলমানদের ঐক্য হওয়া উচিৎ নয়। অতএব আমরা মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হতে বলতে পারিনা। …

শ্রী সুন্দর সিংহ ভাণ্ডারীঃ আপনার যদি এখন বন্ধ করে দেই তাহলে তার বক্তব্য অসম্পূর্ন রয়ে যাবে।

শ্রী পীতাম্বর দাসঃ যদি আমাদের বন্ধ করতেই হয়ে তাহলে তার বক্তব্য অসম্পূর্নই থাকুক।
মিস্টার ডেপুটি চেয়ারম্যানঃ যদি হাউজের ইচ্ছা হয় তাহলে আমার কিছু বলার নাই। এটা একজন প্রাইভেট সদস্যের রেজোল্যুশন – অতএব আমরা এটা আজকের দিনের জন্য বন্ধ করতে পারি। হাউজের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই অধিবেশন আগামী সোমবার ২ রা আগস্ট ১৯৭১ সালের সকাল ১১ টা পর্যন্ত মুলতুবি থাকবে।

পরবর্তিতে হাউজ ২ আগস্ট ১৯৭১ তারিখে সকাল ১১ টা থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত মুলতুবি থাকে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২০৫। ইয়াহিয়া খান কর্তৃক শেখ মুজিবর রহমানের বিচার এবং প্রাণদণ্ডের হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনা ও প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি
রাজ্যসভার কার্যবিবরণী ১২ আগস্ট ১৯৭১

Raisa Sabila
<১২, ২০৫, ৬৯০-৭০৭>

একটি জনগুরুত্বসম্পন্ন বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণঃ
পাকিস্তানি সামরিক আইনের আওতায় শেখ মুজিবর রহমানের বিচারঃ

মাননীয় সভাপতিঃ শ্রী আদভানিজি, এবং শ্রী ভান্ডারিজি, দয়া করে এখানে নয়।

শ্রী পিতাম্বর দাস (উত্তর প্রদেশ)ঃ আমরা পরে সুযোগ নেব। আগে দৃষ্টি আকর্ষণের বিষয়টি পেশ করা হোক।

শ্রী লোকনাথ মিশরা (উরিষ্যা)ঃ মাননীয় সভাপতি, আমি শেখ মুজিবর রহমানের সামরিক আইনের আওতায় বিচার এবং তার মৃত্যুদণ্ড সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার হুমকি প্রসঙ্গে মাননীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী (শ্রী সুরেন্দার পাল সিং)ঃ মিঃ চেয়ারম্যান স্যার…
শ্রী লোকনাথ মিশরাঃ আমি আপত্তি জানাচ্ছি। আমি পেপারে পরলাম যে পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী আজ ইন্দোনেশিয়া সফরে গেছেন, তিনি নিসচয়ি জানতেন যে আজ এবিষয়ে আলোচনা হবে।

শ্রী জোয়াকিম আল্ভা (প্রার্থী)ঃ উনি কোন ছুটি কাটাতে যাননি।

মাননীয় সভাপতিঃ উনি আমাকে জানিয়েছেন, চিঠি লিখেছেন।

শ্রী লোকনাথ মিশরাঃ উনি কি আপনার অনুমতি নিয়েছিলেন?

মাননীয় সভাপতিঃ জি।

শ্রী লোকনাথ মিশরাঃ তাহলে দয়া করে আপনি ঘোষণা দিন যে তিনি আপনার অনুমতি নিয়েছেন এবং তার অনুপস্থিতিতে…
মাননীয় সভাপতিঃ কিন্তু, মিঃ সুরেন্দার পাল সিং ও একজন মন্ত্রী।

শ্রী লোকনাথ মিশরাঃ আমি জানি, আমি মন্ত্রীদের তালিকা দেখেছি এবং আমি জানি যে তিনিও একজন মন্ত্রী। কিন্তু আমাকে অবশ্যই আমার প্রতিবাদটি অন রেকর্ড রাখতে হত কেননা পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী অনুপস্থিত আছেন।

মিঃ চেয়ারম্যানঃ আমি আরো জানাচ্ছি যে শনিবারের বিতর্ক পরিচালনা করবেন, মিঃ জগজীবন রাম। জি বলুন, মন্ত্রিসাহেব…

শ্রী সুরেন্দার পাল সিংঃ স্যার, রিপোর্ট অনুসারে গত ১১ই অগাস্ট পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করার অভিযোগে পশ্চিম পাকিস্তানে শেখ মুজিবর রহমানের ট্রায়াল কোর্ট মার্শাল শুরু হয়েছে। ট্রায়ালটি ভিডিওতে ধারন করা হচ্ছে এবং কোন বহিরাগত সহায়তা মুজিবকে দেয়া হচ্ছে না।

এর আগেও নানা বক্তব্যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান হুমকি দিয়েছেন যে তাকে শাস্তি হিসেবে মৃত্যু দণ্ড দেওয়া হতে পারে এবং তিনি এও বলেছেন যে তিনি নিশ্চিত নন যে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ভবিষ্যতে আবার একত্রিত হবার সময়ে শেখ মুজিবর রহমান জিবিত থাকবে কিনা। আমাদের সরকার এবিষয়ে যথেষ্ট বিচলিত আছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, এর আগে নিজ বক্তব্যে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে শেখ মুজিবর রহমান ই পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী যখন জাতীয় পরিশদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন জিতে নিয়ে শেখ মুজিব স্পষ্টভাবেই নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। শুধুমাত্র বাংলাদেশ নয়, গোটা পাকিস্তানেই শেখ মুজিবর রহমান একচ্ছত্রভাবে বিজয়ী হয়েছিলেন। এবছর ২৫ মার্চের পর কি হ্যেছে, তা গোটা বিশ্ব জানে। সামরিক বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের মানুষদের রাজনৈতিক মতামতকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং তাদের মৌলিক মানবাধিকারসমুহ কেড়ে নেয়া হয়েছে। শেখ মুজিবকে নির্বাচিত এবং অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে ঘোষণা না করে পাকিস্তানে গনহত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে। এহেন নজির চলমান সময়ে আমরা দেখিনি। শেখ মুজিবর রহমানকে একটি ভুয়া ট্রায়ালের মুখোমুখি করার মাধ্যমে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হচ্ছে, এবং সারা পৃথিবীর উচিত এর প্রতিবাদ করা। আমরা বারবার শেখ মুজিবর রহমান ও তার পরিবারের, গ্রেফতার থাকাকালীন তাদের নিরাপত্তা ও সুস্থতা বিষয়ে আমাদের বিচলতা প্রকাশ করেছি। আমরা আমাদের জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল এবং অন্যান্য বিদেশী সরকারের কাছে আমাদের গভীর আশংকা ও চিন্তা জানিয়েছি এবং এবিষয়ে পাকিস্তান সরকারের উপর তাদের প্রভাব খাটানর প্রস্তাব দিয়েছি। এমুহূর্তে শেখ মুজিবর রহমান বা তার পরিবারের কোন ক্ষতি হলে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা চরম আক্রমণাত্মক হয়ে পরবে এবং এর জন্য একমাত্র দায়ী থাকবে পাকিস্তান সরকার। আমরা চাই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এর এই অবস্থানের বিরুদ্ধে বিশ্বের মানবতাবাদীগণ বিবেকের তারনায় হলেও রুখে দাড়াক। আমরা চাই এ অন্যায় বিচার এখনি বন্ধ হোক এবং পাকিস্তানের সরকারকে বলে দিতে চাই যে, এর ফল ভাল হবেনা।

শ্রী লোকনাথ মিশরাঃ স্যার, অবশ্যই সরকারের এ চিন্তা যুক্তিযুক্ত। প্রধানমন্ত্রী এখন পর্যন্ত কতজন দেশের মন্ত্রিকে ইয়াহিয়া খানের শেখ মুজিবর রহমানকে সাজানো বিচারে মৃত্যুদণ্ড দাওয়ার চেষ্টার এবিষয়টি চিঠিতে জানিয়েছেন? আমি আশ করবো, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশ্চয়ই আজকের পত্রিকায় জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব উথান্ট এর অভূতপূর্ব বক্তব্য শুনেছেন। একদিকে তিনি বলছেন এই বিচারকার্য পাকিস্তানের বাইরেও অনুরিত হতে পারে, আবার একি বক্তব্যে তিনি বলছেন এ বিচার পাকিস্তানের জুডিশিয়ারির কর্মদক্ষতার মধ্যে। আমাদের সরকার এবং সকলেই জানে যে এটি শুধুমাত্র পাকিস্তানের বিচারব্যবস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর আন্তর্জাতিক একটা প্রভাব আছে, এবং উথান্ট সে সম্পর্কে অবগত, কিন্তু মনে হচ্ছে তিনি জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব হওয়া স্বত্বেও এবিষয়ে কিছু করতে পারবেন না। এখন সমস্যা হচ্ছে শেখ মুজিবের কিছু হলে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনিকে নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে পরবে। ধরে নিলাম যে ইয়াহিয়া খান তার খেয়াল খুশি মত এমন কিছুই করতে যাচ্ছেন, সেক্ষেত্রে ভারত সরকারের কি উচিত হবেনা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং উথান্টকে একটি আল্টিমেটাম দাওয়া? মুজিবকে হত্যা করলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি কখনই আর শান্ত হবেনা, আর তা নাহলে যেসকল শরণার্থী আছে বর্তমানে ভারতে, তারা কখনই আর নিজ ভুমিতে ফেরত যাবেনা, ভারত সরকার ও তাদের ফেরত পাঠাতে সক্ষম হবেনা। এমন একটি সময় ভারত সরকারের কখনই উচিত হবেনা চুপচাপ বসে থেকে কি হচ্ছে তা দেখতে থাকা। সেটা কি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এবং উথান্টকে জানানো হয়েছে, হয়ে থাকলে উথান্ট এবিষয়ে কি ব্যবস্থা নেবেন বলে জানিয়েছেন? ভারত সরকার কি এবিষয়ে উথান্ট এর কাছ থেকে কোন তথ্য পেয়েছে?

শ্রী সুরেন্দার পাল সিংঃ স্যার, আমি কি সর্বশেষ প্রশ্নটির উত্তরটি সবার আগে বিবেচনা করতে পারি? মাননীয় সদস্য তার বিবেচনা থেকে বলছেন যে ভারত এখানে নিরব অবস্থান নিয়েছে এবং তারা সবকিছুই নীরবে দেখে যাচ্ছেন। কিন্তু এটি সত্য নয়, ঘটনাবলি তা বলেনা। যখনি এবিশয়টা আমাদের নজরে এসেছে, আমরা পৃথিবীর সরবত্র আমাদের বন্ধুভাবাপন্ন দেশে এখবরটি দিয়েছি। সকল মিশনেও এখবর পৌছান হয়েছে, আমাদের যত স্পেশাল ডেলিগেশন বাইরে গেছে, তারাও এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছে। মাননীয় সদস্য ইতিমধ্যে জানেন যে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং দুইটি দেশের প্রধানের কাছে চিঠি লিখেছেন। একিভাবে আমাদের পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্টের কাছে চিঠি লিখেছেন।

শ্রী লোকনাথ মিশরাঃ ফলাফল কি হয়েছে?

শ্রী সুরেন্দার পাল সিংঃ আমি ফলাফলে আসছি। স্যার, আমাদের সকল বন্ধুভাবাপন্ন রাষ্ট্রের কাছে আমরা এই নিশ্চয়তা পেয়েছি যে তারা পাকিস্তান সরকারকে এই ভয়াবহ কাজ থেকে সরিয়ে আনতে যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। বংলাদেশ বিষয়ে তাদের রাজনৈতিক ভাবনা যাই থাকুকনা কেন, শেখ মুজিবের মুক্তি বিষয়ে তাদের কোন দ্বিমত নেই, এবং মানবতার দৃষ্টিকোণ থেকে তারা সকলেই বিশ্বাস করেন যে শেখ মুজিবকে বাচাতে হবে। তারা আমাদের বলেছে যে তারা অবশ্যই তাদের প্রভাব খাটাবে, এখন তারা কিভাবে এটা করবে, কততুকু করেছে, ৎ বলা আমাদের জন্য কঠিন। আমরা শুধু আশা করতে পারি যে তারা তাদের প্রভাবের ব্যবহার করবে এক্ষেত্রে বা করছে। এই প্রভাবের আদৌ কোন ফলাফল হবে কিনা পাকিস্তান সরকারের উপর, তা বলাও খুব কথীন, কেননা এটি নরভর করছে পাকিস্তান বিশ্ব জনমতের কতটুকু তোয়াক্কা করে তার উপর। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা যা বলে, আমি খুব একটা আশাবাদী নই, কিন্তু আমরা আশা করে যাচ্ছি।

শ্রী লোকনাথ মিস্রাঃ স্যার আমি একটি প্রশ্ন করতে চাই

মিঃ চেয়ারম্যানঃ কেবল মাত্র একটি প্রশ্ন

শ্রী লোকনাথ মিশ্রাঃ এর মধ্যে থেকেই স্যার।

মিঃ চেয়ারম্যানঃ না না, আমি নিয়ম ভংগ করতে পারি না।

শ্রী লোকনাথ মিশ্রাঃ স্যার, আপনি দৃষ্টি আকর্ষণের ক্ষেত্রে দুইটি প্রশ্ন অনুমোদন করেছেন,

মিঃ চেয়ারম্যানঃ না কখনই না, আমি নিয়মের বাইরে যেতে পারবোনা।

শ্রী লোকনাথ মিশ্রাঃ সেক্ষেত্রে আমি নিশ্চয়ই একটি বিশাল প্রশ্ন করে ফেলেছি

মিঃ চেয়ারম্যানঃ জি, আপনি বোধহয় তা করেছেন।

শ্রী এন রামা রেডি (মহিশুর)ঃ সকল জাতির মানে কি? জাতিসংঘের সকল সদস্য? আপনি কি সকল জাতি বলতে তাই বুঝেন?

মিঃ চেয়ারম্যানঃ দয়া করে…

শ্রী এন রামা রেডি: স্যার আমাকে অবশ্যই মাননীয় সদস্যের ব্যাখ্যা চাই।

মিঃ চেয়ারম্যানঃ তিনি অন্য কোন প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সময় আপনাকে ব্যাখ্যা দিয়ে দিবেন। মাননীয় মন্ত্রী, আপনি অবশ্যই তা করবেন।

শ্রী রাজনারায়ন (উত্তর প্রদেশ)ঃ আমি জানতে চাই, ভারত সরকার কি শেখ মুজিবর রহমানের জীবনের হুমকিকে ভারতের জনগনের জীবনের হুমকি বলে মনে করেন। শেখ মুজিবর রহমানের জীবনের উপর যদি কোন বিপদ আসে তবে ভারত সরকার কি বিশ্বকে এক সুস্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেবেন যে আমরা সেটা আমাদের জনগনের জীবনের উপর বিপদ মনে করবো? একে আপনার স্বত্বার উপর বিপদ মনে করে এবং অনুরুপভাবে জনসাধারনের গভীর উদবেগ প্রকাশ করে তিনি কি ইয়াহিয়া খাঁর সামরিক জঙ্গিশাহির (তানাশাহি) মোকাবেলা করবেন? ভারত সরকার কি সুনির্দিষ্ট, সুসংবদ্ধ পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?

শ্রী মহাবীর ত্যাগী (উত্তর প্রদেশ)ঃ নিয়েছে। হাউস এ বলেননি। মাফ করবেন। নিয়েছেন।

শ্রী রাজনারায়নঃ ত্যাগী মহাশয় এমন মানবতার প্রশ্নেও আপনি এরুপ বলছেন। মহোদয়, যেহেতু এই দুই রাষ্ট্রই কমনওয়েলথ সদস্যভুক্ত তাই ভারত সরকার কি কমনওয়েলথকে জানিয়েছে যে শেখ মুজিবর রহমানের জীবনের উপর কোন বিপদ নেমে আসলে ভারত কমনওয়েলথের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করবে। আমি মনে করি ভারত সরকার সময়মত পদক্ষেপ নিলে হয়ত এ যাবত শেখ মুজিবর রহমানের উপর এরুপ হামলা চলতনা। আজ সকালে মিঃ উথান্ট এর ভাষন আমরা পড়েছি। এনিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আমরা আলোচনা করছিলাম, উথান্টের এই ভাষনের পড়ে ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়া কি? উথান্ট বলেছেন যে তিনি আইনের সিমিত পরিধির মধ্যে কাজ করছেন। ভারত সরকার বলছেন যে তিনি পুরোপুরিভাবে পাকিস্তানের নেতা। তিনি সম্পুরন্তঃই পাকিস্তানের। আমি সম্পূর্ণ পাকিস্তান শব্দের তাৎপর্য নিয়ে উদ্বিগ্ন। কেননা আজ মিঃ গ্রোমিকো ও সর্দার শরন সিং তথা রুশ সরকার ও ভারত সরকার ও এর যে যুক্ত ইশ্তেহার বেরিয়েছে, সুধিবৃন্দ আপনারা তা পরে থাকবেন, তাতে এক অভিনব কথা বলা হয়েছেঃ সমগ্র পাকিস্তানের জনগনের একটি রাজনৈতিক সমাধান হোক।

মিঃ আকবর আলী খান (অন্ধ্র প্রদেশ)ঃ পূর্ব পাকিস্তান।

শ্রী রাজনারায়নঃ সম্পূর্ণ পাকিস্তান। ওতা একটু ভাল করে পরুন। আপনি নবাব সাহেব, তাই আপনি গোটা ইশ্তেহারটা পরে দেখেননি। ঐখানে লেখা হয়েছে যে সারা পাকিস্তানের জনগনের একটা রাজনৈতিক সমাধান হোক। এই সমগ্র পাকিস্তানের জন্য রাজনৈতিক সমাধানের ইশ্তেহার কি মুজিবর রহমানের জীবনের ঝুকি বৃদ্ধি করছেনা। আমি সরকারের কাছে সম্পূর্ণ পাকিস্তানের জন্য রাজনৈতিক সমাধানের অর্থ কি তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দাবী করছি এবং এও বলছি যে এই ইস্তেহারও মুজিবর রহমানের জীবনের ঝুকি বাড়িয়েছে।

মহোদয়, সংযুক্ত রাষ্ট্র থাক বা না থাক (তাতে কিছু যায় আসে না) আমি চাই ভারত সরকার তার জনগনের কন্ঠের সাথে সুর মিলিয়ে সোচ্চার হোন যে যদি মুজিবর রহমানের জীবনের উপর বিপদ এসে পরে তবে সংযুক্ত রাষ্ট্রসংঘের দুর্গতিও অনুরুপভাবেই হবে। সংযুক্ত রাষ্ট্রসংঘ থাকার আর প্রয়োজন কি, তার মানবাধিকার ঘোষণার মুল্য কি, একদিকে মানবাধিকার ঘোষণা বিদ্যমান অন্যদিকে মুজিবর রহমানের ফাঁসির মামলা চলছে।

সভাপতিঃ আপনার প্রশ্ন কি। প্রশ্ন করুন।
শ্রী রাজনারায়নঃ আমি জানতে চাই, ভারত সরকারের মনোভাব কি। একটি প্রশ্নের দ্বারা এর উত্তর মিলবে না, এটি সকল মানুষের জীবনের মুল্যের প্রশ্ন। তিনি জনগনের দ্বারা নির্বাচিত হয়েছেন খোদ সরকারই হিসেবে। সবাধিন বাংলাদেশের ১৬৯টি সিটের মধ্যে ১৬৭টী সিট লাভ করেছেন, যা শতকরা ৮৯.৮ ভাগ এবং তিনি প্রায় ৮৪ ভাগ ভোত পেয়েছেন। ঐ স্বাধীনতাকামী মানুষ এভাবে ফাঁসির দন্ড পাবে আর আমরা নিজেদের স্বাধীন বলে দাবি করবো।

মহোদয় সরকার কি অবগত আছেন, গতকালি এখানে গান্ধির মাঠের কাছে এক জনসভায় দের লক্ষ জনতার সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হচ্ছে? ভারত সরকারের কাছে আমাদের এই দাবী যে, মুজিবর রহমানের জীবন নাশের আশংকা দেখা দিলে সরকার নিজের জনগনের জীবনের উপর হুমকি মনে করে মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত হয়ে যান। সরকার এমন কোন পদক্ষেপ গ্রহন করলে আমরা তার সহযোগিতা করব, সরকার কি এ ব্যাপারে ওয়াকিবহাল?

শ্রী সুন্দর পাল সিঙ্ঘঃ সভাপতি মহোদয়, শেখ মুজিবর রহমানের জীবন বিপদাপন্ন এটা সুনিসচিত কিন্তু মাননীয় সংসদ সদস্যের মন্তব্য যে আমরা এ ব্যাপারে নিরুদবিগ্ন ও উদাসিন, তা একদমি ঠিক নয়। এব্যাপারে আমরাও অনেক চিন্তাভাবনা করছি। আম্রাও চাই যেন তিনি প্রানে বেচে যান এবং তার জন্য চেষ্টা করছি। তিনি জিজ্ঞেস করেছেন, তার জীবন বিপদাপন্ন এবং এরুপ কোন দুরঘটোনা যদি ঘটে যায় তাহলে তা আমাদের জন্য বিপদজনক হবে কিনা। এটা অত্যন্ত পরিষ্কার যে ট্রায়ালের পর যদি তার ফাঁসি হয় তাহলে তার প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত গুরুতর হবে। সর্বত্রই তার প্রভাব পরবে, আমাদের দেশেও পরবে। এজন্য আমরা চাই যে এরকম ভুল পদক্ষেপ যেন না নেওয়া হয়।

এখন, মাননীয় সভাপতি, প্রশ্ন এই যে, এই কাজ হতে পাকিস্তান সরকারকে কিভাবে বিরত রাখা যায়। আমি প্রথমে বলছি, আমরা সম্ভাব্য সরবপ্রকার চেষ্টা করেছু আমাদের দ্বারা যা সম্ভব। অন্যাব্য রাষতের সঙ্গে আমরা আলোচনা করেছি। এব্যাপারে আমাদের মতামত জানিয়েছি এবং সম্পূর্ণভাবে ওয়াকিবহাল করেছি, অতএব আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে। আমরা কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্রসমূহের কাছেও লিখেছি, তারাও একে একে বলেছেন যে আমরাও চাই এমন ট্র্যাজেডি যেন না হয়। রাজনৈতিক দিক থেকে একটি ভাল সমাধান আশা করছেন তারা। শেখ মুজিবর রহমানে জীবনের প্রশ্নে সকলেই ভাবছেন যে এই ট্রায়াল হওয়া উচিত নয়। তার জীবন রক্ষা করা প্রয়োজন। এখন এ ব্যাপারে তিনি কি করছেন একথা বলা মুশকিল।

সভাপতি মহোদয়, মাননীয় সদস্য বলেছেন, মুক্ত বিবৃতির ফলে তার জীবন নাশের আশংকা আরো বেড়ে গেছে আমি একথা মানতে প্রস্তুত নই। এব্যাপারে আমাদের যা করনীয় আমরা তা করে যাচ্ছি। আমাদের আরো কি করতে হবে এমন কোন পরামর্শ থাকলে তা শোনার জন্য প্রস্তুত আছি।

শ্রী আকবর আলি খানঃ স্যার, আমি কি এর ব্যাখ্যা দিতে পারি? মিঃ বজনারায়ন দোষারোপ করেছেন যে আমি ভুল বক্তব্য দিয়েছি। এই যে দেখুন পত্রিকা। এখানে লেখা আছে, পূর্ব পাকিস্তান, গোটা পাকিস্তানের কথা উল্লেখ করা হয়নি। সুতরাং তিনি ঠিক বলছেন।

শ্রী পিতাম্বর দাসঃ স্যার, যখন থেকে এই বক্তব্যগুলো হাউসে জমা দেয়া হয়েছে, তখন থেকেই আমরা এর সাথে দ্বিমতপোষণ করি কিনা, সেই বিষয়টি অগুরুত্বপূর্ণ হয়ে পরেছে। দ্বিমত থাকলেও, এই বক্তব্যগুলোই সংরক্ষিত হবে।

শ্রী আকবর আলি খানঃ কিন্তু, বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্ন।

শ্রী পিতাম্বর দাসঃ স্যার আমি বলছি যে, এই বক্তব্যসমুহের ব্যাখ্যার সাথে আমরা একমত নাকি না, সেটি ভিন্ন বিষয়, কোন প্রেক্ষাপটে এই বক্তব্য দেয়া হয়েছে, তাও ভিন্ন বিষয়। মুল বিষয় হচ্ছে, এই বক্তব্যগুলোই হাউসে সংরক্ষিত হবে।

মিঃ চেয়ারম্যানঃ ঠিক আছে।

শ্রী আকবর আলি খানঃ স্যার, আপনি অনুমতি দিলে আমি পরে শুনাতে পারি।

মিঃ চেয়ারম্যানঃ তার কোন প্রয়োজন নেই।

শ্রী পিতাম্বর দাসঃ যদিও ব্যাখ্যা দাওয়া হয়েছে যে “গোটা পাকিস্তানের মানুষ” বলে আর কোন কিছুর অস্তিতব নেই, তারপরো স্যার কথাগুলো রয়ে গেছে।

শ্রী রাজনারায়নঃ আমার একটা প্রশ্নের উত্তর পাইনি। মহোদয় দয়া করে শুনুন। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম ভারত সরকার কি কমনওয়েলথকে লিখেছেন যে, শেখ মুজিবর রহমানের জীবনের উপর কোন বিপদ আসলে আমরা কমনওয়েলথ ত্যাগ করবো। এর সঙ্গে আমি দ্বিতীয় প্রশ্নো করেছিলাম যে ভারত সরকার একথা বলে দিয়েছে যে শেখ মুজিবের জীবন বিপদাপন্ন হলে জাতিসংঘকেও লীগ অব নেশন্স এর পরিনতি বরন করতে হবে? এর উত্তর মেলেনি। এর সঙ্গে সঙ্গে আমি বলেছি যে, ইশ্তেহার প্রকাশিত হয়েছে- ইশ্তেহার সম্পর্কে আগামী পরশুর বিতর্কে বাকী সব কথা বলবো, এখন তার সুচনা করছি মাত্র- ঐ ইশ্তেহারে শেখ মুজিবর রহমানের নাম কেন উল্লেখ হয়নি।

শ্রী সুরেন্দ্রপাল সিঙ্ঘঃ তার কোণ প্রশ্নের উত্তর দিব মাননীয় সভাপতি? … কমনওয়েলথকে জানানো হয়েছে আমি আগেও বলেছি আর (কমনওয়েলথ থেকে) আলাদা হয়ে যাওয়ার প্রশ্ন ভিন্ন, মাননীয় সভাপতি…
শ্রী রাজনারায়নঃ দেখুন দুইটি প্রশ্ন এখনও রয়ে গেছে। যারা হৈচৈ করছে, আপনি তাদের থামাচ্ছেন না। মহোদয় যদি এখানে কেউ হৈচৈ করে আমাকে শুদ্ধ ও বৈধ প্রশ্ন করতে না দেন, তাহলে কিভাবে কাজ চলবে?

সভাপতিঃ আপনার প্রশ্ন হয়ে গেছে এবং তিনি এর উত্তর দিয়ে দিয়েছেন।

শ্রী কৃষাণ কান্ত( হরিয়ানা)ঃ স্যার পয়েন্ট অফ অর্ডারের ভিত্তিতে বলতে চাইছি যে এটি খুবি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, প্রয়োজনীয় বিষয় এবং শুধুমাত্র একটি দলের বিষয় নয়। সুতরাং স্যার, আপনি কি মাননীয় সদস্যদের অনুরোধ করবেন যেন তারা এমনভাবে প্রশ্ন তুলে যে মনে হয় এটি আসলেই একটি জাতীয় ইস্যু। এটি মোটেই একটি দলের বিষয় নয়।

মিঃ চেয়ারম্যানঃ আমিও তাই আশা করি। আমি মাননীয় সদস্যদের অনুরোধ করবো যে তারা যেন স্মরনে রাখেন যে এই বিষয়টিকে জাতীয় ইস্যু হিসেবেই গন্য করা উচিত, কেননা এটি খুবি প্রয়োজনীয় ইস্যু যা আরো বড় বড় ইস্যুতে আশংকার জন্ম দিচ্ছে। প্রশ্নগুলোও জাতীয় প্রশ্নের আঙ্গিকে করা হোক।

(শ্রী রাজনারাইন কথা বলে যাচ্ছেন)

মিঃ চেয়ারম্যানঃ মিঃ রাজনারাইন, দয়া করে বসুন। কার্যক্রমে বাধার সৃষ্টি করবেন না।

শ্রী রাজনারায়নঃ আমি বসবো না, আমি করজোরে মিনতি করছি, আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে বলুন। আমি ভারতের জনগনের প্রতি বিশ্বস্ত, আমি ভারতের সরকারের প্রতি বিশ্বস্ত নই। এটি মুজিবর রহমানের জীবনের প্রশ্ন।

মিঃ চেয়ারম্যানঃ আমি চাই আপনি হাউস থেকে চলে যান। আমি সদস্যদের বারবার বলছি বিঘ্ন সৃষ্টি করতে না, এবং তিনি তা করেই যাচ্ছেন। আমি তাকে হাউস থেকে চলে যেতে বলছি।

শ্রী এ জি কুলকারনি (মহারাষ্ট্র)ঃ এই ব্যাক্তিকে তার দল থেকেও বের করে দেয়া হয়েছে।
(আলোচনায় বিঘ্ন)

মিঃ চেয়ারম্যানঃ মিঃ রাজনারাইন, আমি আবারো আপনাকে বলছি, আপনি হাউস থেকে চলে যান কারন আপনি হাউসের কাজে বাধা সৃষ্টি করছেন।

শ্রী পিতাম্বর দাসঃ ভোট নেয়ার আগে আমি কিছু নিবেদন করতে চাই। আমি নিবেদন করবো, পরিস্থিতির নাজুকতা রাজনারায়ন বাবুর অনুমান করা উচিত। মুজিবর রহমানের ব্যাপারে সকলের ভাবনাচিন্তা অনুরুপ। কিন্তু এখন যে পরিস্থিতি উদ্ভব হয়েছে তাতে পরিশদের কোন সদস্যই রাজনারায়ন বাবুকে সমর্থন করা ভাল মনে করবেন না। সুতরাং আমি তকে অনুরোধ জানাচ্ছি যে অবস্থার নাজুকতা উপলব্ধি করে তিনি এবিষয়কে ভোটাভুটিতে নাওয়ার সুযোগ দিবেন না এবং সভাপতির আদেশ পালন করবেন।

শ্রী রাজনারায়নঃ পীতাম্বর বাবুর বিবেচনাবোধকে আমি মুল্য দেই কিন্তু একি সাথে আমি বলতে চাই যে, প্রধানমন্ত্রী মহোদয় এখানে আছে কিন্তু বাংলাদেশের স্বীকৃতির ব্যাপারে তিনি একটা কথাও বলছেন না। মুজিবর রহমানের প্রান রক্কার জন্যও কিছু বলছেন না, আমার প্রশ্নগুলোর একটিও উত্তর দিচ্ছেন না।

মিঃ চেয়ারম্যানঃ আমি মিঃ রাজনারাইনের নামে বারবার হাউসের কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করার অভিযোগ করছি।

সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী এবং পরিবহন ও শিপিং মন্ত্রী (শ্রী ওম মেহতা)ঃ স্যার, আমি অভিযোগটি পেশ করার অনুমতি চাচ্ছি- “ এই অধিবেশনে হাউসের পরবরতী সকল কার্যক্রম থেকে শ্রী রাজনারাইনকে বরখাস্ত করা হল’।

প্রশ্নটি প্রস্তাবিত হল।
(বাংলা)

মিঃ চেয়ারম্যানঃ প্রস্তাবটি হল- “এই অধিবেশনে হাউসের পরবরতী সকল কার্যক্রম থেকে শ্রী রাজনারাইনকে বরখাস্ত করা হল”
প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে।

মিঃ চেয়ারম্যানঃ এই অধিবেশনে হাউসের পরবরতী সকল কার্যক্রম থেকে এই সদস্যকে বরখাস্ত করা হল। মিঃ রাজনারাইন, এখন আপনি দয়া করে হাউস থেকে চলে যান।
(শ্রী রাজনারাইন কথা বলে যাচ্ছেন)

মিঃ চেয়ারম্যানঃ অন্যথায় আমি মার্শালকে ডেকে আপনাকে বাইরে দিয়ে আসতে বলতে বাধ্য হব। আমি আশা করি যে মার্শাল ডেকে উনাকে বের করে দেয়া উচিত, সেবিষয়ে হাউস ও একমত হবে।

(শ্রী রাজনারাইন চলে যেতে অনিচ্ছা প্রকাশ করলে, মার্শাল তাকে তুলে হাউসের বাইরে বের করে দিয়ে আসলেন)

মিঃ চেয়ারম্যানঃ আশা করি হাউস বুঝতে পারবে যে, এ সিদ্ধান্ত নেওয়া খুবি কষ্টকর ছিল, কিন্তু এ পরিস্থিতে এছারা আর কিছু করার ছিলনা।

শ্রী কে চন্দ্রশেখরন (কেরালা)ঃ গতকাল সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যে তিনি ছড়ি নিয়ে হাউসে আসবেন না, উনি আজো ছড়ি নিয়ে এসেছেন।

মিঃ চেয়ারম্যানঃ এ বিষয়ে আর কোন কথা নয়। সাংসদীয় আইন আমাকে এবিষয়ে আর কিছু করার এক্তিয়ার দেয়নি।

শ্রী এন জি গোরি (মহারাষ্ট্র)ঃ স্যার, আমি কি আমার দলের তরফ থেকে এবিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে পারি? এর সাথে আমাদের কোন সংযোগ নেই, এবং যদি আপনার মনে হয়ে থাকে যে এর জন্য কোনভাবে আমরা দায়ী, আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।

শ্রী এ জি কুলকারনিঃ স্যার আমি খুবি দুঃখিত।

মিঃ চেয়ারম্যানঃ দয়া করে এবিষয়ে আর কথা বারাবেন না।

শ্রী এ জি কুলকারনিঃ স্যার, আমি কি সরকারের কাছে জানতে পারি যে পররাষ্ট্র মন্ত্রী জাতিসংঘের মহাসচিবের সাথে কথা বলার পর তিনি কোন বক্তব্য দিয়েছেন কিনা? মিঃ উথান্ট? মনে হচ্ছে, উনাকে বিষয়টি অনুমোদন করা ও যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রচন্ড চাপের মুখে রাখা হয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও বিভিন্ন দেশের প্রধানের কাছে চিঠি লিখেছেন। সেসকল চিঠির বিষয়বস্তু কি হাউসে প্রকাশ করা হবে? যদি প্রকাশ করা যায়, তাহলে তা ইতিমধ্যে করে ফেলা উচিত।

দ্বিতীয়ত, মিঃ ইয়াহিয়া খান একজন বদ্ধ উন্মাদ। তিনি এবিষয়ে মানবতার ডাক কিংবা কুটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বক্তব্য, কিছুই শুনবেন না। প্রাদেশিক মন্ত্রী বা মাননীয় সদস্য, কেউ একজন কি বলবেন যে আজ রাশিয়ার মিঃ গ্রমিকো ও বিবৃতি দিয়েছেন যে তারা মুজিবর রহমানের প্রান বাচানোর জন্য তাদের প্রভাব ব্যবহার করবে। প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সাথে আলোচনা চলা কালীন, মিঃ গ্রমিকো কি কোথাও উল্লেখ করেছেন যে তারা আসলে এবিষয়ে কিধরনের ব্যবস্থা নিবেন। এটি খুবি গুরুত্বপূর্ণ স্যার, আমি অনুরোধ করছি যে রাশিয়া এবিষয়ে কিভাবে আমাদের সাহায্য করবে, তার বিষয়ে কোন ধারনা থেকে থাকলে তা উল্লেখ করা হোক।

শ্রী সুরেন্দার পাল সিংঃ স্যার, মিঃ গ্রমিকো তা সর্বশেষ দিল্লি ভ্রমনের সময় এবিষয়ে কথা উঠেছিল, এবং তিনি আমাদের নিশ্চয়তা দিয়েছেন যে ফিরে গিয়েই তিনি তার দেশের সরকারের সাথে কথা বলবেন, ও তার সরকার এবিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিবে।

শ্রী এ জি কুলকারনিঃ যথাযথ ব্যবস্থাটা কি?
শ্রী সুরেন্দার পাল সিংঃ এখন সেটি ব্যাখ্যা করা তো বেশ জটিল কাজ। তিনি বলেছেন যে তিনি তার সরবোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে চেষ্টা করবেন যেন পাকিস্তান একাজ থেকে বিরত হয় এবং মুজিবর রহমান প্রানে বেচে যান।

আর প্রধানমন্ত্রীর চিঠিপ্রসঙ্গে বলতে চাই, সেগুলো প্রকাশ করা আমার এক্তিয়ারে নেই। যেমনটি আমি আগেই বলেছিলাম যে, প্রধানমন্ত্রী সকল বন্ধুভাবাপন্ন রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছেই লিখেছেন, এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, এর ফলাফল কতটা ভয়াবহ হবে তা তাদের জানিয়েছেন এবং একি সাথে তাদের জানিয়েছেন যে তাদের অবশ্যই এগিয়ে আসা উচিত। তিনি আশা করেন যে তারা অত্যন্ত দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্ত করে নিয়ে আসবেন।

শ্রী ভুপেশ গুপ্ত (পশ্চিম বঙ্গ)ঃ স্যার, যখন আমি এই দৃষ্টি আকর্ষণ নোটিস দিয়েছিলাম, আমার ঘুনাক্ষরেও সরকার বা কারো সাথে ষরযন্ত্রে জরিয়ে পরার কোন উদ্দেশ্য ছিলনা। কিন্তু এই বিশয়টির সাথে আমাদের আবেগ জড়িত আছে। অনেকেই হয়ত বাংলাদেশ বিষয়ে আমাদের অবস্থান মেনে নিতে পারেন না, কিন্তু আবার অনেকেই দেশপ্রেমিক ও মহান নেতা শেখ মুজিবর রহমানের জীবন বাচানোর এই বিষয়ে আমাদের যে অনুভুতি কাজ করছে, তা বুঝতে পারবেন। যা ঘটেছে, তার জন্য আমি দুঃখিত। এখন, যেমনটি আমি বলেছিলাম যে আমি কোন ব্যাখ্যা করতে বা শুনতে চাইনা। পত্রিকার খবর এবং সরকার পরযায়ের বিভিন্ন সদস্যদের কাছে থেকে পাওয়া তথ্যর ভিত্তিতে আমি নিজের তরফ থেকে বলতে পারি যে নিঃসন্দেহে সরকার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানকে বাচাতে চেষ্টার কোন ত্রুটি করছেনা। আমি শুধুমাত্র তাদের এচেষ্টার পূর্ণ সমর্থন এবং একাত্মতা ঘোষণা করতে পারি। সবকিছু বলা এবং করার পরে, আমরা কেবলি এখানে অনানুষ্ঠানিকভাবে আমাদের মতামত প্রকাশ করতে পারব, এবং সরকারও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর কাছে তার মতামত প্রকাশ করে শেখ মুজিবর রহমানের প্রান বাচানোর জন্য যথাযথ উদ্যোগ নাওয়া হোক তা চাইতে পারবে। যদিও আমি জানিনা, যে আমরা কতদুর পর্যন্ত করতে পারবো, এবং আসলে কি করতে পারব। এবিষয়ে কাজ করার জন্য সবচাইতে উপযুক্ত ব্যাক্তি হচ্ছেন, আমাদের দেশের সরকারপ্রধান, ভারতে প্রধানমন্ত্রী, এবং তিনিই কাজ করে যাচ্ছেন। সুতরাং, তার যদি আদৌ কিছু বলার থাকে, তবে তিনি কি বলবেন এবং কাকে বলবেন, তা আমি তার উপরি ছেড়ে দিব।

কিন্তু এবিষয়ে আমার একটি বা দুইটি পর্যালোচনা আমি জানাতে চাই, যদিও বারবারই বলেছি যে এবিষয়ে সরকারই সবচেয়ে ভাল জানেন এবং আমি কোন ব্যাখ্যা চাইনা। আমি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি মেনেছি, তারাও আমারটা মেনে নিয়েছেন, এবিষয়ে কোন দ্বিমত নেই। কিন্তু, আমি কিছুতেই সেক্রেটারি জেনারেল মহোদয়ের কথার সাথে জোর করেও একমত হতে পারছিনা যে, ইয়াহিয়া তার দেশের বিচারব্যবস্থা অনুযায়ীই এই বিচারকাজ শুরু করেছেন। আপনারা জানেন, আমার বলার প্রয়োজন নেই যে আন্তর্জাতিক আইনে ও অন্যান্য আইন ছাড়াও নানবিধ কারনে এ বিচার সমর্থনযোগ্য নয়। আমার সরকার যথার্থই চিনহিত করতে পেরেছে যে, পাকিস্তান যুক্ত থাকাকালীন যেই ব্যক্তি শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী বলে ঘোষণা দিয়েছিল, সেই একি ব্যাক্তি এখন তাকে মারবার ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু আজ তাকে কার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতা বা যুদ্ধ শুরু করার অভিযোগ অভিযুক্ত করা হচ্ছে, মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি দেয়া হচ্ছে, তা আমি জানিনা। এটি কোন বিচারাধীন হত্যা নয়, বরং এটি একটি ঠান্ডা মাথার খুন, যা কোন অংশে আন্তর্জাতিক অপরাধের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। আমি আন্তর্জাতিক সকল গোষ্ঠিকে এটাই বলতে চাই যে, লিখে নিন, এটা কোন বিচারাধীন হত্যা নয়, এটি ৫ লক্ষ মানুষের গনহত্যারই ধারাবাহিকতা, যা চূড়ান্তে পৌছবে ইয়াহিয়া খান কর্তৃক এই মহান নেতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে। স্যার, আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি, এবং আশা করছি যে বিশ্ববাসী, জাতিসংঘের মহাসচিব এবং অন্যান্য সকলে মিলে যথেষ্ট সাহসের সাথেই এই মহান নেতার দিকে উদ্যত খুনির হাত রুখে দিতে সক্ষম হবে। অন্যান্য দেশের কথা বলতে গেলে বলবো যে আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি যে সরকার তাদের চিঠি দিয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ব্যাক্তিগতভাবে বিভিন্ন দেশের প্রধানদের কাছে চিঠি লিখেছেন। এটি নিঃসন্দেহে সারা পৃথিবীতে একটি জনমতামতের সৃষ্টি করবে এবং কেবন এটিই এখন শেখ মুজিবর রহমানের হত্যাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে। আমার মনে হয় আমাদের এসকল উদ্যোগ চালিয়ে যাওয়া উচিত এবং সংসদের শেষ দিনে এসে যার যার বক্তব্য পেশ করা উচিত। আমার মনে হয়না এবিষয়ে বেশি কিছু বলার আছে। সকলেই জানে যে জাতীয় এই ইস্যুতে আজ সরকার এবং জনতা এক হয়েছে, এবং আমরা আশা করি যে এই ৫৫ কোটি মানুষ ও তাদের সরকারের কথা সারাদেশে এবং সারা পৃথিবীতে আমাদের যত বন্ধু আছে, সকলের নিকট অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হবে। আমি শুধু এটূকুই বলতে চাই যে, আমাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে সোভিয়েত জনগণ বা তাদের সরকারও আমাদের সাথে একি অবস্থানে দারিয়েছে, যেখানে আমরা সকলেই এমন একটি মুল্যবান প্রান বাচানোর চেষ্টা করছি, যার উপর অধিকার আছে সমগ্র মানবজাতির। আজ মুজিবর রহমানের জীবনের উপর সমগ্র মানবজাতির অমুল্য অধিকার। সুতরাং, আজ যে আমরা এখানে আমাদের ক্ষোভ ও দুশ্চিন্তা প্রকাশ করতে এক হয়েছি, তা কেবল একটি প্রান বাচানোর জন্য নয়, বরং একটি ঐতিহ্য, মানবজাতির অধিকার বাচানোর জন্য। আজ আমাদের এই জাতীয় সমাবেশকে সমর্থন দেয়া সারা প্রিথিবীর জন্য কর্তব্য, সারা পৃথিবীতে এমনভাবে গনজাগরন সৃষ্টি করতে হবে যেন আধুনিক সভ্যতা ও মানবজাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হত্যা করার পরিকল্পনা খুনি ইয়াহিয়া খান কখনই বাস্তবায়ন করতে না পারে। আমি আশা করি এখানে উপস্থিত সকলেরি একি ধরনের অনুভুতি কাজ করছে এ বিষয়ে। এবং আমি আরো আশা করি যে আমাদের তরফ থেকে, সারা দেশের তরফ থেকে প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে দুশ্চিন্তা ও ক্ষোভ প্রকাশ করবেন এবং গোটা মানবজাতির সম্পদ, এই মহান দেশপ্রেমী ও মহৎ মানুষটিকে হত্যা করার যে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবেন।

শ্রী লোকনাথ মিশ্রাঃ আজ সর্দার শরন সিং উপস্থিত নেই তা মিঃ ভুপেশ গুপ্তর বক্তব্য শুনতে শুনতে ভুলেই গিয়েছিলাম।

শ্রী চিত্ত বসু (পশ্চিম বঙ্গ)ঃ মিঃ চেয়ারম্যান, আমি বলতে চাই যে অতিসত্বর একটি বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। এই দুঃখ শুধুমাত্র বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নয়, বরং তা আমাদের দেশের সাধারন মানুষের জন্যও বেদনাদায়ক। এটি শুধু আমাদের নয়, বরং সারা মানবজাতির জন্য একটি শোকাবহ ঘটনা হবে। একজন শ্রেষ্ঠতম যোদ্ধা ধীরপায়ে ফাসির মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর কোন মুক্তিযোদ্ধা আজ শান্তভাবে বসে থাকতে পারবে না। সুতরাং আজ এখানে অনেকেই যে অনুভুতি প্রকাশ করলেন, শুধু হাউস নয়, হাউসের বাইরেও, তার যথাযথ সম্মান দিতে হবে এবং সরকারের উচিত সামগ্রিকভাবে এদেশের জনগনের মনোভাব আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীকে অবহিত করা।

আমার অনুভুতি ব্যাক্ত করার পাশাপাশি আমি এও জানতে চাই যে, হাউসের বাইরে এবং এখানেও অনেকবারি পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে যে কোন কোন দেশ, আমি নাম উল্লেখ করবনা, মনে করেন যে শেখ মুজিবর রহমানের এ বিচার পাকিস্তানের অন্তর্বর্তী বিষয়। জংলী বর্বরদের আইন ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানে কোন আইন নেই্‌, তারকাখচিত চেম্বার ছাড়া তাদের কোন আদালত নেই। যদি কোন আদালত পশ্চিম পাকিস্তানে এ বিষয়ে থেকে থাকে তবে তা হল একটি বন্দি আদালত যার রায় বহু আগেই নির্ধারণ হয়ে গেছে। যেমনটি আমি আগেই বলেছিলাম যে খুব দ্রুতই একটি শোকাবহ ঘটনা ঘতবে। এই পরিস্থিতিতে পৃথিবীর পরাশক্তিদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে হবে। আমি কি জানতে পারি যে যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে কি বলছে? আমি যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলছি কারন আমি নিশ্চিত যে…

একজন সম্মানিত সদস্য বলছেন- চায়নাও…

শ্রী চিত্ত বসুঃ আমি সে বিষয়ে আসছি। আমি নিসচিত যে যুক্তরাশ্ত্রের ধারাবাহিক ও স্থায়ী সমর্থন, সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া পাকিস্তানের পক্ষে কখনোই এতদুর আগানো সম্ভব হত না। সুতরাং আমি বলতে চাই যে ইয়াহিয়া খান যেমন অপরাধী, প্রেসিডেন্ট নিক্সনও এবিষয়ে কোন অংশে কম অপরাধী নয়। সুতরাং আমি জানতে চাই যে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর আবেদনের উত্তরে যুক্তরাষ্ট্র কি বলেছে? এই সুত্রতায় আমি আরো জানতে চাই, এবিষয়ে চায়না সরকারকে কোন চিঠি দেয়া হয়েছে কিনা? আমরা যখন বন্ধু বা শত্রু সকল রাষ্ট্রকেই আজ মানবতার এ বিপর্যয় ঠাকাতে আহবান জানাচ্ছি তখন চায়না সরকারকেও এই মহান নেতাকে বাচানোর আবেদন জানিয়ে কোন চিঠি দেয়া হয়েছে কিনা, আমি জানতে চাই। যদি দেয়া হয়ে থাকে, তবে তারা কি প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে?

সবসেষে, যদি পুরো পৃথিবী ব্যর্থ হয়, যদি জাতিসঙ্ঘ শেখ মুজিবর রহমানের প্রান বাচাতে ব্যর্থ হয়ে যায়, তবে আমরা কি তৈরি আছি এমন উদ্যোগ নিতে যেন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়াস ব্যর্থ না হয়ে যায়, যেন মহান বীর স্বাধীনতা যোদ্ধাদের দাবি ভুলুন্ঠিত না হয়ে যায়? জাতি হিসেবে আমরাও স্বাধীনতার জন্য লড়েছি, এবং আজো সারা বিশ্বের সকল স্বাধীনতা যোদ্ধাদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি, এবং ভারতের সরকারের নেত্রিতবে ভারতের মানুষ অবশ্যই সেইসকল স্বাধীনতা যোদ্ধাদের পাশে দাঁড়াবে, যারা তাদের স্বাধীনতার জন্য লরছে, এবং তাদের এ প্রয়াস কোনভাবেই ব্যর্থ হতে দেয়া যাবেনা। এবং এর সুত্রতায় আমাদের শুধু সহমর্মিতা প্রকাশ করলে চলবে না, বরং স্বাধীনতার পক্ষে, স্বাধীনতার যোদ্ধাদের পক্ষে, তাদের রক্ষায় কঠোর কিছু উদ্যোগ নিতে হবে।

শ্রী সুরেন্দ্র পাল সিংঃ স্যার, সরকার বাংলাদেশ বিষয়ে যথেষ্ট সহযোগী মনোভাব পোষণ করে সে বিষয়ে আমাদের কোন সন্দেহই নেই। এখন পর্যন্ত কতিপয় পরিস্থিতিতেই তা প্রমানিত হয়েছে যে বাগ্লাদেশের এই আন্দোলনে আমরা তাদের পাশে আছি, তাদের অনুভুতি ও আদর্শকে সমর্থন জানাচ্ছি, এবং আমাদের পক্ষে যা করা সম্ভব হচ্ছে আমরা তাই করছি। তাদেরকে সহযোগিতায় যা যা করা সম্ভব, আমরা করে যাচ্ছি। এখন মাননীয় মন্ত্রী বলছেন যে পাকিস্তানে বর্তমানে চলমান এই বিচারের ফলাফলস্বরূপ শেখ মুজিবর রহমানের ফাসি হতে পারে বা তার মৃত্যুদণ্ড অবিসম্ভাবী, এমনটি হলে তা অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হবে।

আমিও মাননীয় মন্ত্রীর সাথে একমত যে যদি এই কাপুরুষোচিত এবং মানবতাবিরোধি কাজটি পাকিস্তানী সরকার করে, তবে তা শুধু পাকিস্তান বা বাংলাদেশের জন্য না, বরং ভারত এবং সারা পৃথিবীর গনতন্ত্র ও শান্তিকামী মানুষের জন্য অত্যন্ত দুঃখের হবে। বাংলাদেশের মানুষের সাথে নিজেদের একাত্মতা প্রকাশ করতে ভারত সরকার কয়েকবারি বলেছে, তারা বাংলাদেশের মানুষের মতই একজন হয়ে তাদের পাশে দারাচ্ছে। এও বলেছে যে আমরা তাদের প্রতি সহমরমী এবং আমরা তাদের সমর্থন করি।

তারপর সম্মানিত সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্র ও চায়নার এবিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছেন। স্যার, সদস্যরা ইতিমধ্যে জানেন যে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করছে, সুতরাং তাদের অবস্থান তাদের কাছে পরিষ্কার হওয়ার কথা। এ বিষয়ে হাউসে আগেই কথা হয়েছে।

শ্রী এন রামা রেড্ডীঃ সেটি একটি ভিন্ন বিষয় ছিল।

শ্রী সুরেন্দ্র পাল সিংঃ এই নির্দিষ্ট মানবিক বিষয়টিতে, যদি আমি সঠিক বুঝে থাকি, তারাও বলেছেন যে তারা শেখ মুজিবের বিচার বিষয়ে চিন্তিত আছেন এবং তারা তাদের সাধ্যমত চেষ্টা করবেন যেন পাকিস্তান আর বিষয়ে আর সামনে না আগায় ও শেখ মুজিব প্রানে বেচে যান।

চায়নার ক্ষেত্রে আপনারা জানেন যে এই বিষয়ে তাদের দৃষ্টিকোণ অনমনীয় ও পক্ষপাতযুক্ত, যদিও আমরা পিকিং এ আমাদের সিডিএর মাধ্যমে তাদেরকে আমাদের অবস্থান এবং নিতীমালা পাঠিয়েছি। চায়না পাকিস্তানকে সম্পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছে, সুতরাং আমার মনে হয়না কোন চিঠি দিয়ে আমরা আমাদের উদ্দ্যেশ্য বাস্তবায়ন করতে পারবো, তাদের ক্ষেত্রে। তা করার ক্ষেত্রে আমাদের জানতে হবে, আমাদের চিঠিকে কিভাবে গ্রহন করা হবে। মনে হয়না তেমন একটা কাজে আসবে, তাও আমাদের উনাদের জানাতেই হবে যে আমরা কোন ধরনের নীতি অবলম্বন করছি।

শ্রী এন রামা রেড্ডীঃ বঙ্গবন্ধুর জীবন বাচাতে একটি আপিল করা কি যথার্থ হবেনা? প্রধানমন্ত্রী কি এই বিষয়ে তাদের লেখার কথাটি বিবেচনা করবেন?

মিঃ চেয়ারম্যানঃ মিঃ নিরেন ঘোষ।
শ্রী নিরেন ঘোষঃ আমি স্বীকার করি যে এটি আসলেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এবং আমরা যখন এই দৃষ্টি আকর্ষণ অধিবেশন ডেকেছি, তখনো আমরা জানিনা যে সরকার আসলে কি করছে এবিষয়ে। আজকের পত্রিকা আমাদের কিছুটা ধারনা দিচ্ছে। আর যেহেতু ঘটনাটি আমারি পার্শ্ববর্তী এলাকায় ঘটছে, এটি অতিরিক্ত করে উল্লেখ করার কিছু নেই দেশের সকল মানুষই এবিষয়ে একত্রিত হয়েছে। এটিও এখন পরিষ্কার যে এটি কোন বিচারবিভাগীয় বিচার নয়। এটি একটি রাজনৈতিক বিচার। এবং যদি তাকে হত্যা করা হয় তবে পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় একক পার্টির নির্বাচিত নেতাকে রাজনৈতিকভাবে হত্যা করা হবে। সেক্ষেত্রে আমি বলবো, তা একজনকে হত্যা করা হবে না। পাকিস্তানের এতটুকু পর্যন্তই অস্তিত্ব ছিল। এখন তা পশ্চিম পাকিস্তান আর বাংলাদেশ হয়ে গেছে। সুতরাং পাকিস্তান বলতে কি বুঝাবে ভবিষ্যতে তা এখন নিরধারিত হয়ে গেছে আর যা ছিল তা অতিত হয়ে গেছে। এখন এখানে আছে দুইটি দেশ। পশ্চিম পাকিস্তান আর বাংলাদেশ। এখন, আমি যেই প্রশ্নটি করতে চাই তা হল যে আমরা কি ইয়াহিয়া খানের হাত রুখে দিতে নির্দিষ্ট আরো কিছু উদ্যোগ নিতে পারিনা? এমুহূর্তে শুধুমাত্র ক্ষোভ বা উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে কোন লাভ হবেনা, এমন কিছু করতে হবে যেন তা ইয়াহিয়ার হাতকে রুখে দেয়, যেন সে শেখ মুজিবের বিচার আর আগাতে না পারে, এবং এই সাথেই এই কথাটা উঠছে যে বিশ্বের অনেক দেশের মধ্যে অন্যতম যেসব শক্তিশালি দেশগুলো আছে, তাদের এবিষয়ে কিছু বলার থাকতে পারে। আর সেজন্যই আমি জানতে চাই যে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কি শুধুমাত্র উৎকণ্ঠা প্রকাশ করা যথেষ্ট? আমরা জানি যে এখন পর্যন্ত তারা যে ভুমিকা পালন করেছে, তা সকল পার্টির দ্বারা তিরস্কৃত হয়েছে, সকল রাজনৈতিক অবস্থানের কাছে, এবং ভারতের জনগন দ্বারা তিরস্কৃত হয়েছে। তারা আমাদের, এই স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন আচরন করেছে। এখন এই বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ যে যুক্তরাষ্ট্র কি শুধু উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেই পার পেয়ে যাবে, নাকি সারা পৃথিবীর সব দেশকে একত্রিত করে ইয়াহিয়া খানকে বলবে যে এই বিচার বন্ধ করতে হবেনা। এটা একটা ভুয়া বিচার। এটা একটা রাজনৈতিক বিচার। এটি কোন বিচারবিভাগীয় বিচার নয়। সুতরাং তুমি এটা করতে পারোনা। আমি এই প্রশ্নটাই করতে চাই এবং এবিষয়ে আমাদের সরকারের প্রতিক্রিয়া জানতে চাই…

শ্রী আকবর আলী খানঃ চায়নাকেও তা করতে বলা হোক।

শ্রী নিরেন ঘোষঃ অবশ্যই চায়নাকেও তা করতে বলতে হবে। আমরা এবিষয়ে চায়নার সাথে কোন চুক্তি করিনি। আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত নিব। আমার প্রস্তাব সম্পূর্ণ আলাদা, আমি জানতে চাই যে আমাদের সংসদ কি পৃথিবীর সকল দেশের সংসদের কাছে, সকল সরকারের কাছে এ বিষয়ে একটি আপিল করতে পারেনা?
একজন সম্মানিত সদস্যঃ চায়নাতে কোন সংসদ নাই।

শ্রী নিরেন ঘোষঃ উনি জানেন না, উনার ইচ্ছা না থাকলেও, চায়নাতে সংসদ আছে।

মিঃ চেয়ারম্যানঃ আপনি বিরক্ত না হয়ে আপনার প্রশ্ন পেশ করুন।

শ্রী নিরেন ঘোশঃ আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ভারতের সংসদের কি পৃথিবীর সকল দেশের সরকার ও সংসদের কাছে আপিল করা উচিত নয়? আমরা কি নির্দিষ্টভাবে যুক্তরাষ্ট্র, চায়না, ফ্রান্স ও জাপান এসব দেশের কাছে আবেদন করবোনা? এইসব দেশগুলো যদি একটি শক্ত অবস্থান নেয় এবং বলে যে ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের বিচারটি আর আগাতে পারবেনা, তাহলে, ইয়াহিয়া খানের এই বিচার আগানোর কোন শক্তি থাকবেনা, সুতরাং আমাদের অবশ্যই এই প্রশ্নটি সন্দেহাতীতভাবে করতে হবে। এবিষয়কে এড়িয়ে যাবার কোন উপায় নেই। একারনেই আমি এবিষয়ে সরকারের মতামত জানতে চাই। আমরা জানি যে আজি শেষ দিন, লোকসভা আজি মুলতুবি করা হবে। যদি কোন আপিল করা হয়, তাহলে তো আজি করতে হবে, কাল আমরা তা করতে পারবোনা।

দ্বিতীয়ত, এই বিষয়টি কি জাতিসংঘে আলোচিত হওয়া উচিত নয়? আমি সোভিয়েত ইউনিওনের উপর চাপ প্রয়োগ করার কথা বলছিনা। কিন্তু তারা কি এই বিষয়টি তুলতে পারেনা? প্রতিরক্ষা কাউন্সিলে কোনভাবে এই বিষয়টি তুলে কি আলোচনা করা যায়না, এবং সেখান থেকে তারা ইয়াহিয়া খানকে কিছু নির্দেশনা জানাতে পারেন তাদের মতামতের উপর ভিত্তি করে। সেটি কিছুটা কর্তৃত্বপূর্ণ হবে। কোন না কোন ভাবে এটি স্পষ্ট যে যদি প্রতিরক্ষা মিশন তাদের এবিষয়ে কথা বলার জন্য ডাকে, তারা এবিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারবেনা, তাদের মতামত দিতেই হবে। এমনটি করা আসলেই উচিত হবে কিনা, বা আমরা ফোরামকে এমনটি করতে রাজি করাতে পারবো কিনা, সে প্রশ্ন আমি ভারত সরকারের কাছেই রাখতে চাই এবং বলতে চাই যে সময় চলে যাচ্ছে, অন্তিম সময়ে আমরা অবস্থান করছি, এক দুইদিনের মধ্যে সব শেষ হয়ে যাবে। তারা মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দিতে পারে, আবার নাও দিতে পারে। সেটি মুল বিষয় নয়, আমরা ইয়াহিয়া খানকে মুজিবর রহমানের ভাগ্য নির্ধারণ করতে দিতে পারিনা। এটাই মুল বিষয় এবং এখন এই ইতিহাসের দোরগোড়াতেই আমরা এসে থেমে আছি। সময় খুবি অল্প। যদি আরো তাৎপর্যপূর্ণ কোন উদ্যোগ নিতে হয়, তবে তা এখনি এবং দ্রুত কোন ধরনের কালখেপন না করে করে ফেলতে হবে।

শ্রী সুরেন্দ্র পাল সিংঃ সম্মানিত সদস্যের সাথে আমিওপ একমত যে শেখ মুজিবের জীবন অত্যন্ত মুল্যবান। এবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে আমরা সবাইই একিরকমি ভাবছি। আমরা তার জীবন বাচাতে সম্ভাব্য সবকিছু করতে প্রস্তুত আছি। যেমনটা মাননীয় সদস্য বলেছেন, এটা করার একটা পন্থা হল, যদি পৃথিবীর পরাশক্তিগুলো একজোট হয়ে পাকিস্তানকে এবিষয়ে দ্বিতীয়বার ভেবে দেখতে বাধ্য করে। আম্রাও তাই আশা করে যাচ্ছি। একারনেই চায়নার সরকার বাদে সকল দেশের সরকারের কাছে আমাদের প্রধানমন্ত্রী দুইটি করে চিঠি লিখেছেন। আমরা তাদের সক্রিয় করার সকল চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, যেন তারা উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহন করে এই বীর দেশপ্রেমিকের জীবন বাচাতে উদ্যোগ নেন এবং এগিয়ে আসেন। সেটাই করা হচ্ছে। কিন্তু, সম্মানিত সদস্য নিশ্চয়ই জানেন যে পরাশক্তিরা তাদের ইচ্ছেনুযায়ী উদ্যোগ নিবেন। তারা আমাদের নিশ্চয়তা প্রদান করেছেন। তারা আসলে কি করছে বা কোন উপায়ে করছে তা বলা আমাদের জন্য খুবি কঠিন, আমরা শুধু আশা করতে পারি যে তারা তার জীবন বাচাতে কিছু করবে।

আর সংসদের আপিলের কথা বলতে গেলে বলতে হবে, আমি এক্ষেত্রে সম্পূর্ণই সংসদের উপর নিরভরশীল। যদি তারা এধরনের কোন প্রস্তাব আনে যে সকল সংসদের কাছে আপিল করতে হবে, তাহলে তা করা হবে, এবং সরকার তা সানন্দেই গ্রহন করা হবে, কেননা এটি সরকারের হাত আরও শক্ত করবে।

জাতিসংঘে এই বিষয়টি তোলা নিয়ে বলতে হয়, আমাদের সরকার এবিষয়টি নিয়ে ভাবছে এবং এখনো এটি বিবেচনাধীন আছে। আমরা কোনভাবেই এই প্রস্তাব জাতিসংঘে নেবার বিপক্ষে নেই। কিন্তু এটি বেশ জটিল একটি বিষয়। অনেক দেশের সাথে আলোচনায় বস্তে হবে এবং যখন আমরা বুঝবো যে সকলের চিন্তা আমাদের অনুকুলে আছে, তখনি কেবল আম্রা এটাকে ফোরামে নিব। এটি আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এটি বিবেচনাধীন ই রয়েছে।

বিরোধি দলিয় নেতা ( শ্রী এম এস গুরু পদস্বামী)ঃ আমি এই বিচারটিকে সাধারন কোন বিচার হিসেবে দেখছিনা, একজন নেতা, একজন ব্যাক্তি বা একজন বিপ্লবীর বিচার নয়, আমি এই বিচারকে বলব খোদ স্বাধীনতাকেই কাঠগড়ায় দাড় করানো হয়েছে। স্যার, ইতিহাসে এমন কোন বিচারের নজির নেই। এমন একটি নজির আছে, যা ঘটেছিল ১০০ বছর আগে আর তা ছিল জোয়ান ওব আরকের বিচার। একটি মহৎ উদ্দেশ্যে নিজেকে উতসরগ করার জন্য তার বিচার হয়েছিল, অরাজকতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তার বিচার হয়েছিল।

স্যার মুজিবের ট্রায়াল আমাকে সেই কথাই মনে করায় দিচ্ছে, আরেকটি বিচার যার সাথে এর কিঞ্চিত মিল আছে তা হল, রানি এনি বলেইনের বিচার, তাকেও মনগড়া অভিযোগে ফাসিয়ে তার স্বামী মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। স্যার এই বিচারের তুলনা আর কোন কিছুর সাথেই হয়না। মুজিবকে পাকিস্তানে যুদ্দ শুরু করার কিছু ভুল অভিযোগে ফাসানো হয়েছে। যেখানে এই বিষয়টি এখন পাকিস্তানীরাই পরিষ্কার নয়, সেখানে কি করে এই বিচার এখনও চলছে? এটি একটি মতামতের বিষয় হয়ে পারে। আমার বন্ধু মহদোয় শ্রী নিরেন ঘোষ বলছেন যে পাকিস্তানের কোন অধকার নেই এই বিচার করার, কিন্তু ঘটনা হল, বিচার চলছে।

স্যার আমি সরকারের উদ্যোগগুলোকে স্বাগত জানাই। আমি এও বলতে চাই যে তাকে বাচাতে যে যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তা হয়ত যথেষ্ট হবেনা, বা বাংলাদেশ ও ভারতের কাজে আসবেনা। আমি এটা বলছি কারন এই মহৎ ব্যাক্তিটির জীবনের সাথে ভারত এবং বাংলাদেশ, দুই দেশে উন্নয়নই জড়িত। এটি কখনই কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা না, কিন্তু তারপরো আমি বলব যে প্রধানমন্ত্রী যে উদ্যোগগুলো নিয়েছেন তার জন্য তাকে ধন্যবাদ, অসংখ্য ধন্যবাদ, তাও এক্ষেত্রে আরো কিছু করা প্রয়োজন। স্যার, আমি মনে করি মুলতুবি করার আগে সারা বিশ্বের কাছে আমরা সংসদ থেকে আপিল জানাই যেন তারা এবিষয়ে অতিসত্বর ব্যবস্থা নেয়।

দ্বিতীয়ত স্যার, আমাদের পৃথিবীকে বলা উচিত যে এই ব্যাক্তিকে হত্যা করা হলে তা আরো রক্তপাত ঘটাবে এবং আরো বিশালাকারের বিপ্লবের সুত্রপাত হবে। এর প্রভাব আমাদের দেশেও পরবে। আমাদের তাদের বলা উচিত যে এই মহৎ ব্যাক্তির ক্ষতিসাধন হয় এমন যেকোন কাজ পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করবে। আমাদের জানানো উচিত কি হবে। এবং স্যার, আমি বলতে চাই যে এই বিষয়টিকে জাতিসংঘে উত্থাপন করা অত্যন্ত জরুরি। আমি জানি যে জাতিসংঘের মহাসচিবের বক্তব্য মোটেও সন্তোষজনক নয়। তিনি কথাকে শুধুই এদিক অইদিক ঘিরাচ্ছেন, এর ফলাফল বা নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে তিনি সচেতন নন।

স্যার, প্রতিটি গোষ্ঠী ও প্রতিটি মানুষের স্বাধীনতার অক্ষুন্নতা রক্ষার দায় জাতিসংঘের। জাতিসঙ্ঘই এই মতবাদকে গ্রহন করেছে। যদি কোথাও স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়, তাহলে তা সবখানেই হয়। এই মতবাদ জাতিসঙ্ঘই দিয়েছে। আমার মনে হয়, দেশ হিসাবে, বিশেষত আমাদের প্রধানমন্ত্রীর উচিত অতিসত্বর মহাসচিবকে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য বিষয়ে সচেতন করা। যদি এই মহৎ নেতার জীবন হুমকির মুখে পরে, তবে জাতিসঙ্ঘকেও তাদের নীরব থাকার দায় বহন করতে হবে। জাতিসঙ্ঘ ব্যর্থ হয়েছে, এবং আমরা তাদের এবিষয়ে ব্যর্থ হবার মত আর কোন সুযোগ দিতে পারবোনা। এই পাশবিক, অশুদ্ধ, ও নিশঠুর সেচ্ছাচারিতার অন্ত যদি এই মহৎ ব্যক্তির জীবন হরনের মাধ্যমে ঘটে, তবে তা হবে সবচাইতে দুঃখজনক বিষয়। আমি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো, যে নিঃসন্দেহে উনি অনেক করেছেন, কিন্তু উনি যেন এখানেই থেমে না যান। আমি অনুরোধ করবো, শুধু চিঠি প্রেরন করেই উনি ক্ষান্ত হবেন না, প্রয়োজন পরলে উনি বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সাথে বা জাতিসংঘের মহাসচিবের সাথে নিজে কথা বলবেন। স্যার, আমি কি আশা করতে পারি যে তিনি এদেশের মানুষ ও সংসদের প্রতিনিধি হয়ে বিশ্বের সামনে দাড়াবেন এবং এই মহৎ ব্যাক্তির এহেন নির্মম পরিনতি ঠেকাবেন?

ডঃ ভাই মহাবীর (দিল্লী)ঃ মহোদয়, সরকার আছেন, যা কিছু করা সম্ভব তা করা হচ্ছে, আর এই পরিষদে সকল দলের প্রতিনিধিগন বলেছেন, এখনকার গুরুত্ব উপলব্ধি করে সরকার অধিক থেকে অধিক্তর যা কিছু পারেন যেন করেন, আমি মনে করি এখানেই প্রসঙ্গের ইতি টানা উচিত নয়। বিষয়টি আরো এগিয়ে নেয়া আবশ্যক নতুবা এখান থেকে আমরা কাজ সেরে চলে যাব আর ইয়াহিয়া খান ঐদিকে তার দুরভিসন্ধি চালিয়ে যাবেন। আমি মন্ত্রী মহোদয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই যে, দেশবাসীর প্রত্যাসা ছিল প্রকাশিত যুক্ত ইশ্তেহারের ভাষা আরো দৃঢ় হবে, শেখ মুজিবের প্রান রক্ষা ও মুক্তি প্রসঙ্গ অত্যন্ত কারযকরিভাবে উল্লেখিত হবে। মনে হয়, এ প্রসঙ্গে আমাদের সরকারের বক্তব্য আগে যা ছিল তা থেকে আরো নমনীয় হয়ে গেছে। হতে পারে, সাংবিধানিক দিক থেকে কোন অপারগতা ছিল, মহোদয়, প্রশ্নটি কোন বিশেষ সাংবিধানিক অপারগতায় আবদ্ধ থাকার মত নয়। মন্ত্রী বলেছেন, মিঃ গ্রোমিকো দেশে ফিরে গিয়ে তার সরকারের সঙ্গে এ ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ কি নেয়া যেতে পারে সে ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করার অঙ্গীকার করেছেন। দুদিন আগে সর্দার শরন সিংহকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, মুজিবর রহমান সম্পর্কে মিঃ গ্রোমিকো কি বলেছেন, আসবাসের স্বরে তিনি বললেন, গ্রোমিকো অত্যন্ত জোরালো ভাষায় তার মনোভাব ব্যক্ত করে বলেছেন যে এমনটি হতে পারেনা। যদি সত্যি সত্যি তিনি এমন্টী বলে থাকতেন তবে আজ মুক্ত ইশ্তেহারে তার প্রভাব পরত। দুর্ভাগ্য বলতে হবে যে, মিঃ গ্রোমিকো দেশে ফিরে যাবেন, তার সরকারের সঙ্গে আলোচনা করবেন, তারপর তার সরকার এবিষয়ে কি ব্যবস্থা গ্রহন করবে, তা জানা যাবে, এত বেশি সময় আমাদের হাতে নেই। মার্শাল ল পদ্ধতি সিভিল লিটিগেশন বা সিভিল কেস এর মত নয়। ইয়াহিয়া খান যখন নিজেই বিচারক সেজে বসেছেন, নিজেই সবকিছু করছেন, তখন কে আর কার কাছে কি অভিযোগ করবে। অতএব মহোদয়, আমি প্রশ্ন করতে চাই, সরকার কি যথাযথভাবে বুঝতে পেরেছেন যে, সোভিয়েত সঙ্ঘ এর বেশি কিছু করতে পারবেনা যা তার বক্তব্য থেকে পরিষ্কার ভাবে বোঝা যায়। আমি বুঝি যে তারা এর বেশি করতে পারে, বা করা উচিত।

মহোদয় আজ ইয়াহিয়া খাঁ শেখ মুজিবর রহমানকে রাশ্ত্রদ্রোহিরুপে শাস্তি দেবার চেষ্টা করছে কিন্তু প্রকৃত অবস্থা হল, শেখ মুজিব একটি দেশের রাষ্ট্র প্রধান হয়ে গেছেন। তিনি নবগঠিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, তাকে এভাবে হত্যা করার যে প্রয়াশ চলছে, তা আন্তর্জাতিক বিশ্বের জন্য কলংকজনক, কিন্তু এ ব্যাপারে আমরা আজ কোন কিছু করতে পারছিনা কেননা আমাদের সরকার এখনও মনে করেন না যে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের সময় হয়েছে। মহোদয়, আমি প্রস্তাব দিতে চাই যে, একটি সময়ের জন্য সরকার প্রতীক্ষারত, নুন্যপক্ষে এই ট্রায়াল এর ফলেই সেটী আজ সমাগত। সরকার এই সময়কে স্বীকৃতির জন্য নির্ধারণ করুন। এর চেয়ে বিলম্ব করার কোন অবকাশ সম্ভবত আর নেই।

আমার শেষ কথা যা ভুপেশ মহাশয় বলেছেন, আমার মিত্ররাও বলেছেন, বিশ্ব জনমত এ ব্যাপারে চাপ প্রয়োগ করুক অবশ্য পাকিস্তানে যে ধরনের জঙ্গীশাহি প্রতিষ্ঠিত তার উপর বিশ্বজনমত কতখানি কার্যকরী হবে আমি জানিনা, তবু আমি মনে করি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব রয়েছে এবং তারি উচিত পাকিস্তানকে বাধ্য করা ও থামানো। আমাদের সরকার তাকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিন যে, যুক্তরাশ্ত্র এ যাবত পাকিস্তানকে উপরে উঠানর জন্য এবং তাকে অস্ত্র দিয়ে যা কিছু করেছে এবং তাতে আমাদের যা ক্ষতি হয়েছে, শেখ মুজিবের বিচার করতে দিলে অনুরুপ ক্ষতি আমেরিকা আরো সংযোজিত করবে। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র কে কি বলে দেয়া হবে যে তাদের সঙ্গে আমাদের বর্তমান সম্পর্ক যেন নিয়ন্ত্রনের বাইরে না চলে যায় সেজন্য আমেরিকার উচিত তার হ্রিদয়ের বন্ধুকে থামানো। আমেরিকাই পারে থামাতে কেননা তারাই পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়েছে। তারাই পাকিস্তানের মস্তিষ্কের বিকার ঘটিয়েছে। আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে এই ভাষায় জানিয়ে দিয়ে তাকে আসন্ন দুরঘটনা থামাতে বাধ্য করি।

মিঃ চেয়ারম্যানঃ মিঃ গোরি
শ্রী জোয়াকিম আলভাঃ স্যার, আমি কেবন এক মিনিত চাই।

মিঃ চেয়ারম্যানঃ না না।

শ্রী এন জি গোরিঃ আমার বন্ধু শ্রী ভুপেশ গুপ্ত, মিঃ বসু এবং অন্যান্য সম্মানিত সদস্যরা আজ এখানে যে বক্তব্য দিয়েছেন, আমি তার সাথে সম্পূর্ণ একমত। স্যার, যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তা হল জনতার বাতিল করা সরকার সেই ব্যাক্তিকে ফাসির কাষ্ঠে পাঠাচ্ছে, যাকে জনতা সাদরে নেতার আসনে বসিয়েছে। স্যার, যদি শেখ মুজিব এর মৃত্যু হয়, তবে তিনি ঠিকই ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকবেন, কিন্তু পাকিস্তানের মৃত্যু ঘটবে। স্যার, আমি অত্যন্ত শোকার্ত যে যেই মানুষটির ত্যাগ এবং মর্যাদা আমাদের কারো পক্ষে মুখের ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব হবেনা, আজ সে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে, আশা করি তার এমন পরিনতিও মহিমান্বিত হবে।

আমি এখনও আশা করছি যে তিনি প্রানে বেচে যাবেন, এবং মিঃ নিরেন ঘোষের সাথে তাল মিলিয়ে বলতে চাই যে, যেমনটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা করেছিলাম, সেভাবে এখনও একটি প্রস্তাব গ্রহন করা হোক, এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে হাউসের একটি সদস্য এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করবেনা, কেননা, ইস্লামাবাদে যা ঘটছে তাতে প্রত্যেকেই শোকাহত এবং অপমানিত। আমার প্রথম পরামর্শ হচ্ছে এটি। প্রধানমন্ত্রীই হবেন এই প্রস্তাব আনার জন্য সবচাইতে উপযুক্ত ব্যাক্তি। তিনি অবশ্যই নিশ্চিত থাকতে পারেন যে তিনি সকলের সমর্থন পাবেন এবিষয়ে। আমি সরকারের কাছে আরেক্তি জিনিস জানতে চাই যে তারা কি কোনভাবে জাতিসংঘের প্রতিরক্ষা কাউন্সিলে একটি জরুরি অধিবেশন ডাকার জন্য প্রভাব খাটাতে পারেননা? কেননা, জাতিসঙ্ঘকেও জানতে হবে যে যা হতে চলেছে, তা এই উপমহাদেশকে প্রচণ্ড রকমের অস্থিতিশীল অবস্থায় ফেলবে, মানুষ আরো দুরদশার সম্মুখীন হবে এবং আরো রক্তপাত ঘটবে। এখানে শুধু শেখ মুজিবের প্রশ্ন নয়, বরং যে সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব তিনি করেন, তাদেরো জীবনের প্রশ্ন, এবং সেকারনেই আমি বলবো যে প্রধানমন্ত্রী কিংবা অন্য কোন বন্ধু রাষ্ট্র যেমন সোভিয়েত ইউনিওন অবিলম্বে জাতিসংঘে একটি জরুরি সভা ডাকার ব্যবস্থা করুন।

শ্রী আকবর আলি খানঃ শুধুমাত্র বাংলাদেশ নয়, পাকিস্তানের সিঙ্ঘভাগ লোক তাই চায়।

শ্রী এন জি গোরিঃ জি, এবং তৃতীয় পরামর্শ হচ্ছে, আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলবো যে তিনি ঊথান্টকে লিখে অনুরোধ করুন যেন তিনি অতিসত্বর ইসলামাবাদে যাত্রা করেন এবং কোন মৃত্যুদণ্ড প্রক্রিয়াধীন থাকলে তা অতিসত্বর বন্ধ করেন। জাতিসঙ্ঘ থেকে ইসলামাবাদ আসার ঝক্কি নেওয়াটা জরুরি কেননা, এটি সেরকমি জরুরি একটি বিষয়। উনি যদি উনার আগের মহাসচিবের উদাহরন ও দেখেন, মিঃ ড্যাগ হ্যামারশোলজ কঙ্গর পরিস্থিতি শান্ত করতে গিয়ে নিজের জীবন দিয়েছেন। এখন তারচেয়েও খারাপ অবস্থা। আমি এই পরামর্শ দিতে চাই এবং জানতে চাই যে সরকার আদৌ এমনটি করতে চায় কিনা।

প্রধানমন্ত্রী (শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী)ঃ স্যার, আজ সম্পূর্ণ হাউস একি মনোভাব পোষণ করছে, এবং আজ সবাই একটি বিষয়ে একমত হবার মতন একটি ঘটনা ঘটেছে। আমিও সম্মানিত সদস্যদের মতই উৎকণ্ঠিত এবং আমি বিরোধি দলের সদস্যদের প্রতি অভিবাদন জানাই যে তারা আজ এই বিষয়ে আমাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছে। আমরা খুবি কঠিন একটি পরিস্থিতিতে আছি। অনেক ধরনের পরামর্শ আমরা পেয়েছি, এবং এমন ধরনের পরামর্শ যা অনুযায়ী কাজ করতে আমাদের কোন আপত্তি নেই। আমরা যদি হাউসে একটি প্রস্তাব আনি বা আমি যদি বলি মিঃ উ থান্ট কে ইসলামাবাদ যেতে, তাতে কোন আপত্তি নেই, কিন্তু আমার একমাত্র প্রশ্ন হচ্ছে তাতে আদৌ কোন লাভ হবে কিনা, বা ফলাফল কি হবে? তাদের সামরিক বাহিনী যেভাবে আচরন করেছে তা আমরা সবাই দেখেছি এবং শুনেছি, এবং এহেন আচরন অব্যাহত থাকলে আমাদের অনুভুতি বা আমরা শান্তির জন্য যে প্রস্তাবই আনিনা কেন, তার শুধুই অসম্মান করা হবে। উ থান্ট এর বক্তব্য শুনে আমার মনে এ প্রশ্নও আসে যে আদৌ তিনি সেখানে যেতে রাজি আছেন কিনা।

শ্রী এন জি গোরিঃ তিনি পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেননি কখনি।

শ্রী এ ডি মনি (মধ্য প্রদেশ)ঃ অন্তত এটি একটি জনমত গড়ে তুলবে।

শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ঃ আমি আগেই বলেছি যে তাকে বলতে আমার কোন আপত্তি নেই। আমি শুধুই ভাবছি যে এতে আদৌ কোন ফল হবে কিনা, আমার চিঠি পেয়ে তিনি আসলেই যাবেন কিনা। আমাদেরকে এটাও মাথায় রাখতে হবে যে যেহেতু মুজিবের সকল আন্দোলনকে আমরা সমর্থন জানিয়েছি, আমরা এবিষয়ে কোন উদ্যোগ নিলে তা পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের আরো খেপিয়ে তুলবে। সুতরাং যেভাবে মাননীয় সদস্যরা পরামর্শ দিচ্ছেন, আমার মনে হয় ফলাফল বিবেচনা করে আমাদের উচিত হবেনা এতটা জোরালো গলায় এবিষয় কোন উদ্যোগ নেয়া বা কিছু বলা। আমরা এবিষয়ে যতই আপত্তি করবো, ততই তারা আরো জেদি হয়ে উঠবে। জেদি বলাটাও ভুল হবে, কেননা জেদ অন্যধরনের একটি বিষয়, আমার বলা উচিত যে তারা যতই শুনবে মানুষ তাদের বিরোধিতা করছে, ততই তারা একাজটি করতে আরো বেশি উৎসাহিত হবে। এটি সেরকমি একটি প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে যাচ্ছে।

আমরা কি করবো, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নাওার আগে কিছু প্রশ্ন অবশ্যই বিবেচনা করা প্রয়োজন। আমার মনে হয়, আমরা সারা পৃথিবীকে জানিয়েছি যে কি ঘটছে, এই পুরো এলাকায় তার কি ফলাফল হতে পারে, বিশেষত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমরা যা ধারনা করছি। আমরা কাউকে এবিষয়ে জানানর কোন ত্রুটি করিনি যে বাংলাদেশের সাথে যা হচ্ছে, তা অপুরনীয়। কিছু একটা ঘটতে চলেছে এবং ইতিহাসের শিক্ষা থেকে আমরা বলতে পারি যে পশ্চিম পাকিস্তান যা করেছে, তার ফল কখনই তাদের আশানুরূপ হবেনা, বরং তার বিপরীত ফল বয়ে আনবে। সম্মানিত সদস্যরা ইতিমধ্যে বলেছেন যে দেশের জন্য প্রান দেয়া মানে সবকিছুর শেষ নয়, বরং শুরু। এটি মানুষকে অমর করে দেয় এবং তার আন্দোলনকে আরো বেগবান করে দেয়। কিছু বিষয়ে আরো চিন্তার প্রয়োজন আছে, এবং যদি বিরোধী দলিয় নেতারা চান, আমরা এবিষয়ে বসে কথা বলতে পারি। আমি আগেই বলেছি যে তাদের পরামর্শ গ্রহন করতে আমার একদমি আপত্তি নেই, কিন্তু তার আগে আমি তাদেরকে আমার আশংকার বিশয়গুলি জানাতে চাই।

এখন, অনেক সদস্যি জানতে চেয়েছেন যে আমরা বিশ্বের বিভিন্ন নেতাদের কাছ থেকে আমাদের আহবানের কি জবাব পেয়েছি। বেশিরভাগ সরকারই কি করছে সে বিষয়ে কোন কথা বলতে চায়না। তারা শুধুমাত্র ইঙ্গিত দিয়েছে যে তারা এবিষয়ে কাজ করছে বা এবিষয়ে উদ্যোগ নিবে। শুধুমাত্র নিজেদের অবস্থান জানানো, বা ইয়াহিয়ার কাছে ছিটি লিখে জানানোর বদলে তারাও এমন কোন পন্থার কথা ভাবছেন যা আসলেই ফলাফল বয়ে আনবে। আমার বিশ্বাস অনেকগুলি দেশের সরকারই এখন এবিষয়ে কাজ করছেন, কিন্তু কিভাবে সেটি আমরা জানিনা। পরিস্থিতি যেধরনের চাপ সৃষ্টি করছে, তাতে মনে হচ্ছেনা খুব বেশি ফলদায়ক কিছু করা হচ্ছে। পাকিস্তানী সামরিক শাসকরা যে অবস্থানে আছে, তাতে কোন সরকার যদি তাদের উপর চাপ সৃষ্টি করেও, তাতে আদৌ তারা সাড়া দিবে কিনা, সেসব প্রশ্নও আছে, এবং আমার মনে হয় তারা সেগুলি বিবেচনা করেই মনোস্থির করবে।

আমি শুধু একটি বিষয় উত্থাপন করতে চাই আপনাদের কাছে, এটি পুরোপুরি ভাবে শেখ মুজিব বা এই বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত নয়। বিষয়টি হল, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মানুষ সবসময়ি আমাদের কাছে ভিন্নভাবে গন্য হবে। অবশ্যই পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের মানুষদের সাথে আমাদের কোন বিবাদ নেই এবং এই মিলিটারি সরকার বাংলাদেশে যেমন অরাজকতা চালিয়েছে, তেমনি তাদেরও রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে। আমি বেশি কিছু বলতে পারবোনা। আমরা জানি যে জাতিসঙ্ঘ যা করা উচিত ছিল, তা করেনি। শুধু আজকে না, আমরা তাদের অনেক দুর্বলতা আগেও নানা সময়ে নানা ঘটনায় দেখেছি, কিন্তু সবসময়ি সেগুলোকে দুর্বলতা বলে চালিয়ে দিয়েছি। কিন্তু, আমরা এটিকে একটি সঙ্ঘ হিসেবেই সমর্থন করে এসেছি, কেননা এই ফোরামের মত আর কোন ফোরাম নেই। যে মতামতগুলি এসেছে, তা সবি অনেক আগে থেকেই দেখছি আমরা। মাননীয় সদস্য শ্রী গুরুপদস্বামী জোয়ান অব আরকের কথা যথার্থই বলেছেন, যেখানে তাকেও এমন একটি সাজানো বিচারের মাধ্যমে আগুনে পুরিয়ে মারা হয়েছিল এবং পরবর্তীতে তাকে সন্ত আখ্যা দেওয়া হয় এবং সে গোটা জাতির জন্য নায়িকা বনে যায়। আমার মনে হয়না যে কোন হুমকি বা শর্তে কাজ হবে। যদি কাজ হতও, তবুও কাউকে শর্ত বা হুমকি দাওয়া নিঃসন্দেহে আমাদের এখতিয়ারের মধ্যে পরেনা। তারপরো আমরা সেটা বা অন্যান্য পন্থাগুলো অবলম্বন করব যদি হাউস এবিষয়ে একমত হয় যে যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসঙ্ঘ বা কমনওয়েলথ, যে কাউকেই যদি এহেন চুড়ান্ত শর্ত আমরা দেই, তবে তা কার্যকর হবে। আমরা যতই শক্তভাবে, নির্ভুলভাবে বা উৎকণ্ঠার সাথে বলিনা কেন, আমাদের ভাবতে হবে যে এটা আমরা কোন ধরনের ভাষা ব্যবহার করছি তার উপর নির্ভর করছেনা কেননা কেউই সাংবিধানিকভাবে বা আইনত এবিষয়ে বাধ্য নয়।

এখন একমাত্র মুখ্য বিষয় হচ্ছে একজন ব্যক্তির জীবন বাচানো, যার বিষয়ে ইতিমধ্যেই বলা হয়েছে, যে তিনি একজন নন, বরং তারচেয়েও অনেক বেশি, একজন মুক্তিযোদ্ধার বিপ্লবের চেয়েও বেশি তার তাৎপর্য। তিনি বিপ্লবের প্রতীক এবং তার বর্তমান পরিস্থিতি শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য না প্রিথিবীর সবার জন্য বিয়োগান্তক একটি ঘটনা। কিন্তু তারচেয়েও বড় এবং আসল দুঃখের বিষয় হয়ে দারায়, যখন দেখি বিশ্বের অন্যান্য জাতিসমুহ এখানে কি ঘটছে সে বিষয়ে একদমি নির্লিপ্ত। সুতরাং আমি সেইসব সদস্যদের সমর্থন জানাই যারা আজ বলেছেন যে এই বিষয়ে অবশ্যই আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে এবং আমিও একমত যে আমাদের এবিষয়টি নিয়ে আলোচনায় বসা উচিত এবং সবার মতামত নিয়ে এবিষয়ে আর কি করা যেতে পারে তা দেখা উচিত।

মিঃ চেয়ারম্যানঃ আমি শুধু একবাক্যে বলতে চাই, আমিও সকলের মতই ভারাক্রান্ত এবং চিন্তিত। সভ্য জগতে এমন বিচার যে নজিরবিহীন তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। আমার মনে হয় এটি মানবতার বিরুদ্ধে একটি অপরাধ করা হবে যদি এমন একটি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনকারী বিচার সম্পন্ন করা হয় এবং অভিযুক্তকে দন্ডিত করা হয়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২০৬। পশ্চিমা সিমান্তে পাকিস্তানের শত্রুভাবাপন্ন এবং উস্কানিমূলক আচরনে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির উপর আলোচনা রাজ্যসভার কার্যবিবরণী ১৮ নভেম্বর ১৯৭১

Raisa Sabila
<১২, ২০৬, ৭০৮-৭১৬>
অনুবাদ

একটি জরুরী এবং জনগুরুত্বসম্পন্ন বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ
পশ্চিমা সিমান্তে পাকিস্তানের শত্রুভাবাপন্ন এবং উস্কানিমূলক আচরনে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির উদ্ভব

শ্রী এ ডি মানি(মধ্যপ্রদে)ঃ স্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতি যা পাকিস্তানি বাহিনির শত্রুভাবাপন্ন এবং উস্কানিমূলক আচরনে ত্রিপুরা, মেঘালয়, আসাম এবং পশ্চিম বাংলায় তৈরি হয়েছে এবং রিপোর্ট মোতাবেক গত ১৫, নভেম্বর ১৯৭১ রাতে তাদের আগরতলা শহরে মরটার শেল চারজিং বিষয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছি।

স্টেট মিনিস্টার(প্রতিরক্ষা) এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়( শ্রী বিদ্যাচরন শুক্লা)ঃ জনাব, পাকিস্তানি আর্টিলারি গত ১৫/১৬ নভেম্বর মধ্যরাতে আগরতলা শহরের দিকে ১০ রাউন্ড শেল চার্জ করে। শেলগুলো সচিবালয় ও হাসপাতালের কাছাকাছি এলাকায় পতিত হয়। এতে তিনজন সিভিলিয়ান আহত এবং একজন নিহত হন। এর উত্তরে আমাদের সেনাবাহিনীও তাদের দিকে গুলি ছুড়ে এবং এর পর তারা থেমে যায়।

পশ্চিমা সীমান্তে পাকিস্তান যে শত্রুভাবাপন্ন এবং উস্কানিমুলক আচরন করছে, সে সম্পর্কে ভারত সরকার অবগত আছে। তারা কোন ধরনের উস্কানি ছাড়াই ত্রিপুরা, মেঘালয়, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যসমুহে শেলিং করেছে এবং আমাদের সাধারন মানুষ ও রিফিউজিদের জানমালের ক্ষতি করেছে। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয় ও আসামে তারা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা স্যাবোটাজ করার জন্য লোকও প্রেরন করেছিল যেন আমাদের জনগনের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারে। আমরা তা রোধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করেছি। আমরা আমাদের এলাকায় সীমান্তের ওপার থেকে পাকিস্তানি অস্ত্রধারীদের আগমন বন্ধ করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহন করেছি, একি সাথে সীমান্তের ওপার থেকে আমাদের উপর আক্রমন করা বন্দুকগুলিকেও থামিয়ে দেয়ার জন্যও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে। আমরা আমাদের জনগণ, যোগাযোগ ব্যবস্থাকে রক্ষা করা এবং তাদের স্যাবোটাজ রুখে দিতে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছি।
সম্মানিত সদস্যদের নিশ্চয়ই মনে আছে, গত ১৫ নভেম্বেরে আমি এই হাউসে যে বক্তব্য রেখেছিলাম, সেখানে আমাদের পশ্চিমা সীমান্তে এই উদ্ভাবিত পরিস্থিতির কথা আমি উল্লেখ করেছিলাম। আমাদের বাহিনী সিমান্তে পুরোপুরি সজাগ অবস্থায় আছে, এবং তারা যেকোন ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে প্রস্তুত।

শ্রী এ ডি মানিঃ জনাব, আমার মনে হয়, আরো দুইটি সুযোগ আছে প্রশ্ন করার। কিন্তু দ্বিতীয় সুযোগটির প্রয়োজন নেই।

চেয়ারম্যানঃ না না, শুধুমাত্র একটি প্রশ্ন করুন।

শ্রী এ ডি মানিঃ আমি তিনটি পয়েন্টে কথা বলতে চাই। পরিস্থিতি খুবি খারাপ। মন্ত্রিমশাই জানেন যে, ত্রিপুরার কামালপুর শহরে ক্রমাগত ১১ দিন শেলিং করা হয়েছে, একদিন নয়। একজন সিভিলিয়ান মারা গেছেন, এবং ৫টি ভারতীয় বিমান গুলি করে ভুপাতিত করেছে পাকিস্তানী বাহিনী। আমরা কোন দেশে হামলা চালাতে চাইনা। আমি কি মন্ত্রিমশাইর কাছে জানতে পারি যে কেন আমরা হামলা চালিয়ে এর শোধ নিচ্ছিনা এবং শত্রুকে ধংস করছিনা? এটি আমাদের প্রতিরক্ষার সাথে সম্পর্কিত একটি বিষয়।

আমার দ্বিতীয় পয়েন্টটি হচ্ছে, আসামের চিফ মিনিস্টার দিল্লীতে আসলেন, এবং আসার পর তিনি সরকারকে রক্ষীবাহিনীর সংখ্যা বাড়াতে অনুরোধ করলেন। আমি জানতে চাই, অন্তর্বর্তী প্রতিরক্ষা আইনের আওতায় পাকিস্তান থেকে ভারতে অনুপ্রবেশকারী কতজনকে আসাম থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যারা রেললাইন বিচ্যুত করার জন্য এসেছিলেন?

আমার তৃতীয় পয়েন্ট হচ্ছে, আমি জানতে চাই, পাকিস্তানী বাহিনী ২৪ পরগনার প্রবেশপথ আলিপুর পর্যন্ত চলে এসেছে। এখন তারা কলকাতার অত্যন্ত সন্নিকটে। গত মাসেই মুম্বাই সমুদ্রসীমায় পাকিস্তানী একটি সাবমেরিন গিয়েছিল, এবং সেটিকে আমাদের রণতরী ‘দ্যা কাভেরি’ তাড়া করে। আমার কাছে আসা ইনফরমেশন বলে, কলকাতা বন্দরের আশেপাশেও পাকিস্তানী সাবমেরিন বা তাদের বন্ধুভাবাপন্ন রাষ্ট্রসমূহের সাবমেরিন ঘোরাঘুরি করছে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিস্থিতিতেও কেন আমাদের সরকার প্রতিরক্ষামুলক ব্যবস্থা নিতে ইতস্তত করছে? এ পরিস্থিতিতে যুদ্ধ খুবি ন্যায়সঙ্গত।

শ্রী বিদ্যাচরন শুক্লাঃ জনাব, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে আমরা সব্ধরনের প্রতিরক্ষামুলক ব্যবস্থা গ্রহন করেছি। আমি আমার এই বক্তব্য এবং অন্যান্য বক্তব্যেও পরিষ্কার করেছি যে যখনি আমরা কোন আক্রমণাত্মক আচরন দেখেছি, হোক তা শেলিং বা অন্যকিছু, আমরা তারচেয়েও কঠোর আক্রমন করে তা রুখে দিতে পেরেছি এবং অনুপ্রবেশারিদের পিছু হটিয়েছি, এবং এভাবেই যেখানে যেখানে দরকার পরেছে, আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছি, এবং সফল হয়েছি। সুতরাং আমরা সম্পূর্ণ রক্ষণাত্মক অবস্থানে আছি, তা সঠিক না।

দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছিল, রক্ষীবাহিনী এবং আসামের চিফ মিনিস্টারের অনুরোঢ সম্পর্কে। এ বিষয়ে তার সাথে আলোচনা করা হয়েছে, এবং রাজ্যসরকারের সাথে আলোচনা করে এবিষয়ে সন্তোষজনক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। স্যার, তৃতীয় প্রশ্নটি ছিল পাকিস্তানী সাবমেরিন বিষয়ে। এটা সত্যি কথা, এই সাবমেরিনগুলো আসলেই ঘোরাঘুরি করছিল, কিন্তু আমরা তা রুখে দেয়ার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছি।

শ্রী গোদেই মুরাহারি(উত্তর প্রদেশ)ঃ জনাব, আমি মন্ত্রিসাহেবের কাছে জানতে চাই যে, আজ পাকিস্তান হাই কমিশনারের ৭৬ জন সদস্য একটি বিদেশি বিমানে করে করাচি চলে যাচ্ছেন, এ বিষয়টি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে কিনা? এটি এখন অত্যন্ত স্পষ্ট যে তাদের সরকার কোন একটি উদ্যোগ নিতে যাচ্ছেন। অন্যথায়, আমার মনে হয়না তারা তাদের হাই কমিশনের এত মানুষ সরিয়ে নিত। একি সাথে তারা শেলিং করছে, তাদের বিমানবাহিনী পাঠাচ্ছে, এবং পাকিস্তানী এজেন্ট ষড়যন্ত্রের উদ্দ্যেশ্যে সারা দেশে ছেয়ে গেছে। এক্ষেত্রে আমি জানতে চাই, সরকার কতদিন ওয়েট এন্ড সি পলিসি অবলম্বন করবে, কেননা এই পলিসির মুল্য অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে, এবং আমাদের জানমাল এবং অর্থে তা পরিশোধ করতে হচ্ছে। আমি জানতে চাই, সরকার কি মনে করছেনা। যে সরকারের এখনি এ বিষয়ে একটি উপযুক্ত উদ্যোগ নেয়া দরকার?

শ্রী বিদ্যা চরন শুক্লাঃ জনাব, আমাদের মতে আমাদের কোনভাবেই যুদ্ধ শুরু করা উচিত নয়, এবং আমরা আমাদের একতা ও শৃঙ্খলা প্রতিরক্ষার এবং সীমান্তে পাকিস্তানের এসকল উস্কানিমুলক আচরণকে বানচাল করে দেয়ার সকল ব্যবস্থা গ্রহন করেছি। সম্মানিত সদস্যগন নিশ্চয়ই জানেন যে যেভাবে আমরা প্রতিটি বাধা ও প্রতিবন্ধকতা এত সীমাবদ্ধতার মাঝেও মোকাবেলা করেছি তা অবশ্যই সন্তোষজনক। একি সাথে, পাকিস্তানী হাই কমিশনের লোকবল সরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে, আমার মন্ত্রনালয় এবিষয়ে কিছু করার কথা নয়, কিন্তু আমরা অবশ্যই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে মিলে সকল তথ্য হালনাগাদ অনুযায়ী রেখেছি।

শ্রী গোদেই মুরাহারিঃ তাদের ৭৬ জন আজ বিদেশি বিমানে করে চলে যাচ্ছেন।
শ্রী বিদ্যা চরন শুক্লাঃ আমরা জানি, আমরা এবিষয়টি নজরে রেখেছি।

শ্রীমতি পুরবি মুখোপাধ্যায় (পশ্চিম বঙ্গ)ঃ মাননীয় মন্ত্রী কি জানেন যে পাকিস্তানী বাহিনী গভির রাতে এসে মানুষজনের বাড়িঘর তল্লাসি এবং মেয়েদের সম্ভ্রমহানি করছে। অনেক কিছুই হচ্ছে সেখানে। এই নিয়মিত শেলিং এর ঘটনাকে সামনে রেখে, সরকারের কি মনে হয়না যে এইসব গুরুত্বপূর্ণ এলাকা থেকে অবিলম্বে সাধারন মানুষদের সরিয়ে নেয়া প্রয়োজন যেহেতু সেখানে নিয়মিত শেলিং হচ্ছে এবং প্রচুর ষরযন্ত্রমুলক কর্মকান্ড হচ্ছে।

শ্রী বিদ্যা চরন শুক্লাঃ জনাব, যে জনগোষ্ঠী এই মুহূর্তে সেখানে বসবাস করছেন, তারা অত্যন্ত সাহস এবং মরযাদার সাথে একটি অত্যন্ত কঠিন সময় কাটাচ্ছেন, এবং আমার মনে হয়না, এমুহূর্তে সেস্থল লোকজন সরিয়ে নেওয়াটি একটি ভালো পরিকল্পনা হবে। অত্যন্ত উচু নীতিজ্ঞানসম্পন্ন, নিয়মানুবর্তী, আজ্ঞাবহ জনগোষ্ঠী প্রতিরক্ষা বাহিনির জন্য অত্যন্ত মুল্যবান এবং সেকারনেই মাননীয় সদস্যের উপদেশটি কাজে লাগানো যাচ্ছেনা। কিন্তু, আমরা অবশ্যই যা কিছু প্রয়োজন তা করবো, এবং সাধারন মানুষের জানমালের সুরক্ষা নিশ্চিত করবো।

শ্রী কে সি পান্ডা (উরিশ্যা)ঃ আমাদের কাছে রিপোর্ট আছে, ভারত সিমান্ত এলাকায় ১২, ০০০ রাজাকার প্রবেশ করেছে। একি সাথে পশ্চিম অংশে শেরসা এর কাছের বেস ক্যাম্প এবং চণ্ডীগড়ে কিছু পাকিস্তানী চুল ও দাড়ি পড়ে সরদারের ছদ্মবেশে প্রবেশ করেছে, এমনকি তারা গ্রন্থসাহেব ও পাঠ করতে জানে।

সর্দার নারেন্দার এস আই (পাঞ্জাব) শুধু মাত্র সর্দারদের মতই নয় ( কথার মাঝখানে বলতে চাচ্ছেন)

শ্রী কে সি পান্ডাঃ দয়া করে, কথার বাকি অংশ শুনুন। ভারতের জাতীয় পত্রিকাগুলো একথাও বলছেন যে সর্দাররা সকল ষড়যন্ত্র লিপ্ত হচ্ছে। কিন্তু আমার জানামতে পাকিস্তানিরাই সরদারের ছদ্মবেশে এসকল কাজ করে যাচ্ছে। আমি জানতে চাই সরকার কি এসকল বিষয় খতিয়ে দেখছেন কি না, এবং যেসকল গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ষড়যন্ত্রের স্বীকার হতে পারে সেগুলো রক্ষা করতে আপনারা কি ব্যবস্থা গ্রহন করছেন?

শ্রী বিদ্যা চরন শুক্লাঃ পাকিস্তান যে এদেশে স্যাবোটাজ ঘটাতে চাইছে এবং সে উদ্দেশ্যে এখানে এজেন্ট পাঠাচ্ছে, সে বিষয়ে আমরা ওয়াকিবহাল এবং আমরা তাদের প্রতিহত করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমার মনে হয়না, সম্মানিত সদস্য আশা করেন যে আমরা সে বিষয়ে এখানে বিশদ বিবরন দিব। আমি শুধু এটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি যে আমরা বিপদ সম্পর্কে জানি এবং তা মোকাবেলা করার সকল প্রস্তুতি নাওয়া হয়ে গিয়েছে।

শ্রী চিত্ত বাসু (পশ্চিম বঙ্গ)ঃ স্যার, আমার মনে হয় পাকিস্তানের এই অবিরাম শেলিং কিছু কিছু এলাকার যেমনঃ পশ্চিম বঙ্গের নদিয়া এবং ২৪ পরগনা, ত্রিপুরা, মেঘালয় এবং আসামের ক্ষেত্রে একটি দৈনিক বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। এসব কিছু দেখে আমার মনে হচ্ছে, পাকিস্তান আর্মি পূর্বাঞ্চলে আসাম, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গকে পুরো দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা চালাতে বদ্ধপরিকর, কেননা এ অঞ্চলগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যেমন একটি শরীরের কাছে স্কন্ধ। এ ধারনা থেকেই আমি জানতে চাই, এইসব এলাকায় পাকিস্তান যে আগ্রাসী এবং আক্রমণাত্মক কার্যক্রম চালাচ্ছে, তার জন্য এপরযন্ত আমাদের সরকার কি করেছে?

এরপর আমি জানতে চাইব যে পশ্চিম বঙ্গের ২৪ পরগনার একটি অংশ, বয়রায় যে গত কিছুদিন ধরে ক্রমাগত শেলিং হচ্ছে এবং প্রায় ১০, ০০০ মানুষ সে এলাকা ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন, সে বিষয়ে সরকার অবগত আছে কিনা, আর যদি অবগত থেকে থাকেন, তবে সেখানকার জনগণের আস্থার জন্য এখন পর্যন্ত কি কি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, কি কি ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে যার মাধ্যমে সে এলাকার লোক পাকিস্তানের এই আক্রমণকে সাহসের সাথে মোকাবেলা করবে?

শ্রী বিদ্যা চরন শুক্লাঃ জনাব, এটি অবশ্যই সত্য যে, পাকিস্তান বেশ কিছুদিন ধরে পশ্চিমা অংশে নিয়মিত শেলিং করে যাচ্ছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে সেখানকার লোকজনের মনোবল ভেঙ্গে পরেছে এবং তাদের মনোবল ফিরিয়ে আনতে অনেক প্রচেষ্টার প্রয়োজন রয়েছে। তাদের মনোবল যথেষ্ট পরিমানেই রয়েছে এবং এই শেলিং এর বিরুদ্ধে আমরা যে উদ্যোগ নিয়েছি, তা যথেষ্টই ফলপ্রসু হয়েছে। অবস্থা সম্পর্কে আমরা ভালভাবেই অবগত আছি, এবং যেখানে যা করা প্রয়োজন আমরা তাই করছি। আমার মনে হয়না এবিষয়ে বিশদ বিবরন দাওয়া উচিত হবে।

(মিঃ ডেপুটি চেয়ারম্যান, আসন গ্রহন করছেন)

শ্রী ভুপেশ গুপ্ত (পশ্চিম বঙ্গ)ঃ আমার মনে হয়, মাননীয় মন্ত্রী তার বক্তব্যে সকল বিষয়ের উত্তর দিতে পেরেছেন। এরকম সময়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনেক লোক নেপোলিয়ন হবার স্বপ্ন দেখেন, এবং আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে মন্ত্রনালয় সেরকম কোন চেষ্টা করছেনা। আমাদের কোন যুদ্ধ শুরু করার বা কাউকে যুদ্ধে আহবান করার কোন ইচ্ছা নেই। এটি একদমি পাকিস্তানের বিবেচনা যে তারা কি করবে। আমাদের দায়িত্ব আমাদের দেশকে রক্ষা করা, এবং আমরা তাই করবো।

শ্রী রাজ নারাইন (উত্তর প্রদেশ)ঃ ষড়যন্ত্র?

শ্রী ভুপেশ গুপ্তঃ আপনি ষড়যন্ত্রের কথা বলতে পারেন, কিন্তু আপনি কি পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে যেতে চান?

ডঃ ভাই মহাবিরঃ আপনার, কি বাংলাদেশের লোকদের নিয়ে কোন চিন্তা নেই?

শ্রী ভুপেশ গুপ্তঃ অবশ্যই আমাদের চিন্তা আছে, কিন্তু যারা ভারতের সাথে পাকিস্তানের যুদ্ধ নিয়ে খুব উৎসাহী, তাদের জানা উচিত যে এতে বাংলাদেশের মানুষের বা তাদের সংগ্রামের কোন লাভ হবে না। তারা শুধুই বাংলাদেশের এই সংগ্রামকে বানচাল করতে চাইছে। আমাদেরকে সকল অবস্থায় বাংলাদেশের এই সংগ্রামের সমর্থন করে যাওয়া উচিত এবং তার স্বীকৃতি প্রদান করা উচিত, সকল সহযোগিতা প্রদান করা উচিত। এটি তাদের অধিকারের মধ্যে পড়ে এবং কাল যদি পাকিস্তান আমাদের আক্রমন করে, তবে আমাদেরো উচিত আমাদের সাধ্যের মধ্যে যা হয়, সেটা করে আমাদের অধিকার আদায় করে নেয়া। এখানেই এ বিষয়টা শেষ করা উচিত। এখন, স্যার, আমি মেঘালয় এবং আসাম সীমান্তে গিয়েছি এবং আমাকে বলতেই হবে, সে এলাকার জনগণ এবং সেনাবাহিনীর মনোবল যথেষ্ট বেশিই আছে, সাধারন মানুষের মনোবল বেশি থাকাই বেশি জরুরি ছিল। আমি প্রায় সীমান্তের কাছাকাছি গিয়েছিলাম। আমি বলবো না যে সীমান্তের ওপারে গিয়েছিলাম কিনা, কিংবা মিঃ জগজীবন রাম ও এবিষয়ে বেশি কিছু বলতে চাইবেন না। আমি সেখানে দেখছি যে আমাদের ফসলের মাঠগুলোতে চাষবাস হচ্ছে এবং আমাদের সাধারন কৃষকরা সেখানে চাষবাস করছে। এথেকে দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়, এক হচ্ছে আমাদের লোকদের মনোবল কতটা ভাল অবস্থায় আছে, আর দ্বিতীয় হচ্ছে আমাদের সেনাবাহিনী তাদের কতটুকু সহযোগিতা প্রদান করে যাচ্ছে। আমার মনে হয় এটা খুবি ভাল বিষয়। আমাদের সাধারন সম্পাদক পশ্চিমা সীমান্তে গিয়েছিলেন এবং ১৫ দিন সেখানে ছিলেন। তিনিও আমার মতই একি মতামত দিয়েছেন এবং বলেছেন যে সেখানের সেনাবাহিনী এবং লোকজনের মনোবল অটূট রয়েছে। এটিও অত্যন্ত দারুন বিষয়। একি সাথে, মাননীয় মন্ত্রী নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে বিদেশি ট্যুরিস্ট এবং হিপিতে পুর সীমান্ত ছেয়ে গেছে, এবোঞ টাড়া নিশ্চিন্তে সেখানে ঘুড়াঘুড়ি করছে, বিশে করে ফিরোজপুর জেলার হুসেইনিওয়ালা সীমান্ত এলাকায়। গত সপ্তাহ থেকেই পাকিস্তান থেকে ভারতে বিদেশিদের ও পন্য আনা নেওয়া অনেক বেশি বেড়ে গেছে। যেমন, এর আগে দিনে তিন চারটির বেশি ভ্যান যাওয়া আসা করতোনা, এখন দৈনিক ৫০টি ভ্যান যাতায়াত করছে। ভ্যান ছাড়া প্রবেশকারীদের সংখ্যাও অনেক বেড়ে গেছে। এইসকল প্রবেশকারীরা পাকিস্তানী মিলিটারি পাঠানো এস্পিওনাজ এজেন্ট হতে পারে যাদের দিয়ে ধংসাত্মক ঘটনা ঘটানো সম্ভব। এদের বেশিরভাগি আমেরিকান জনগণ এবং তারা সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য। আমি সরকারকে বলবো, অবিলম্বে এধরনের প্রবেশ বন্ধ করা প্রয়োজন। যারা এসেছেন, তাদেরকে হুসেইনিওয়ালা বর্ডার থেকে পুলিশ প্রহরায় দিল্লীতে ন্যে এসে ভালভাবে অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। এধরনের প্রবেশ অনুমোদন করা যাবেনা আর। আমার বিশ্বাস কেন্দ্রীয় সরকার এধরনের কোন নির্দেশ সেখানে পাঠায়নি, যার ফলে তারাও কোন ব্যবস্থা নেয়নি। এবিষয়ে সরকারের মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, আমি দেখছি যে সিমান্ত এলাকার কৃষকেরা কিছু আর্থিক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, এবং তারা জাতীয় প্রতিরক্ষার কথা ভেবে তা মেনেও নিচ্ছেন। মিঃ জগজিবন রাম ভালভাবেই তা জানেন, যা তিনি সেখানে করে এসেছেন। আমি অবশ্যই স্বীকার করবো যে আমাদের জনগনের মনোবল অনেক বেশি রয়েছে, কিন্তু তারা আর্থিক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, যেহেতু তারা ফসল উৎপাদন করতে পারছে না। যেসকল মানুষরা আপনাদের প্রস্তুতি নেয়ার সুবিধা দিতে গিয়ে নিজেদের আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করেছেন তাদের ক্ষতিপূরণ কিভাবে দেয়া হবে। পাঞ্জাবে মানুষ স্বেচ্ছায় ক্ষতি মেনে নিয়েছে, কিন্তু তাদের অভিযোগ বা প্রয়োজন সরকার দেখছেনা। একি বিহসয় চলছে, ত্রিপুরা এবং অন্যান্য সীমান্ত এলাকাতেও, যেখানে যেখানে শেলিং চলছে। আমি যখন সেখানে ছিলাম, শেলিং চলছিল। আমি অপেক্ষা করছিলাম যেন কোন শেল আমার উপরে পড়ে। মিঃ রাজ নারাইন ও তাই চাইবেন।

মিঃ রাজ নারাইনঃ না

শ্রী ভুপেশ গুপ্তঃ আমি একটা শেলে শেষ হয়ে যাব। কিন্তু মিঃ রাজ নারাইনের শুধু শেলে হবে না, বোমা লাগবে। সুতরাং আমার মনে হয়না, উনি সেখানে গেলে পাকিস্তানী বোমারুদেরও আহবান জানানো হবে। আমার জন্য ছোট একটি বন্দুক হলেই হবে, কিন্তু মিঃ রাজ নারাইন এর জন্য হেভি আরটিলারির প্রয়োজন হবে। সুতরাং আপনি সীমান্তে যাবেন না।

মিঃ ডেপুটি চেয়ারম্যানঃ দয়া করে শেষ করুন।

শ্রী ভুপেশ গুপ্তঃ আমাদের মনে হয়, আমাদের সরকার কোনধরনের আগ্রাসী মনোভাব দেখানোর প্রয়োজন নেই, কিন্তু যখনি কোন ধরনের আক্রমন, শেলিং চালানো হবে, তখনি তার উপযুক্ত জবাব দিবে। আমাদের কেউ আক্রমন করলে, আমরাও সঠিক লক্ষ্যে আঘাত হানবো। সময়ক্ষেপণ করা উচিত হবে না। যদি পাকিস্তান আমাদের উপর আঘাত হানে, তবে আমরা আগ্রাসী মনোভাব দেখাবোনা, কিন্তু আমাদের জনগণকে সাহস দেয়ার জন্য আমরা সাথে সাথে তার জবাব দিব। এর বেশি কিছু না। আমাদের নিজেদের বল দেখানোর জন্যই আমাদের সিমান্ত রক্ষা করতে হবে। যদিও এখন পর্যন্ত সকম ব্যবস্থাই অত্যন্ত ভালভাবে নেয়া হয়েছে। যখনি আঘাত হানবেন, তা যেন লক্ষ্য ভেদ করে, এছারা আমার আর কিছু বলার নেই।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী (শ্রী জগজীবন রাম)ঃ আমি মাননীয় সদস্যকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি যে তিনি আমাদের সাধারন জনতা ও সেনাবাহিনী, হোক সেটা পশ্চিমা অথবা পূর্বাঞ্চলের সীমান্তের, তাদের মনোবল কতটা দৃঢ়, তার একটি সঠিক চিত্র বর্ণনা করেছেন, এবং আমি মনে করি, তাদেরকে এলাকা ত্যাগ করতে বলার যে উপদেশ এসেছে, তা তাদের এই সাহস এবং মনোবলের প্রতি ন্যায়সুচক নয়।

শ্রী ভুপেশ গুপ্তঃ আমি তা করতে বলিনি।

শ্রী জগজীবন রামঃ না, আপনি তা করতে বলেননি। আপনি আমাদের জনতার মনোবল সঠিক ভাবে অনুভব করেছেন এবং এখানে তা তুলে ধরেছেন, তার জন্যই আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানিয়েছি। কিন্তু একিসাথে আমি বলেছি, যে হাউসের কোন সদস্য বা বাইরের কারো এমন সাজেশন দেয়া ঠিক হবে না। করলে সেটা হবে আমাদের জনতার মনোবলের প্রতি অবিচার। আপনি সীমান্তে গিয়েছিলেন, আমিও গিয়েছিলাম এবং আমি দেখেছি যে ঠিক সীমান্তের উপরে চাষাবাদের কাজ চলছে। আমাকে অবশ্যই আমার জনতাকে অভিনন্দন জানাতে হবে, তারা যে সাহস ও সহিষ্ণুতা দেখিয়েছে, তার জন্য আমাদের উচিত তাদের ধন্যবাদ জানানো।

আপনি ঠিকই বলেছেন যে গত কিছুদিন ধরে হুসেইনিওয়ালা এবং ফাজিল্কা পোস্টের মধ্য দিয়ে প্রচুর বিদেশীর আগমন ঘটেছে। সাধারণত, এমনকি গত বছরেও এ সময়ে প্রচুর বিদেশী এই দুই পোস্ট দিয়ে আমাদের দেশ এসেছিল। কিন্তু, এবছর লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে সংখ্যাটি মাত্রার চেয়ে সামান্য পরিমানে বেশি। আমরা এবিহসয়ে খেয়াল রাখছি এবং অনুসন্ধান করছি যে কেন এত বেশি সংখ্যক মানুষ পশ্চিমা দেশ থেকে আমাদের দেশ আসছে। এর একটা ব্যাক্যা হতে পারে যে এত বেশি সংখ্যক মানুষ ভারত এবং পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। আমি এদের মধ্যে অনেকের সাথে দেখা করেছি, এবং দেখেছি যে ইস্লামাবাদে গিয়েছে, আবার বাংলাদেশেও গিয়েছে এবং এখন ভারতে এসেছে। তারা বোঝার চেষ্টা করছে যে পাকিস্তান কি বাংলাদেশকে দখল রাখতে পারবে নাকি না। আমি এধরনের মানুষদের স্বাগত জানাই। তারা আসুক এবং দেখে যাক। তারা বাংলাদেশ ও সিমান্তে যা হচ্ছে সে বিষয়ে গবেষণা করতে পারে। কিন্তু, আমি যেমনটি আগেই বলেছি যে আমরা বিষয়টি নজরে রেখেছি এবং বূঝার চেষ্টা করছি যে আসলেই কি কারনে তারা আসছে, কেন হুসেইনিওয়ালা দিয়ে বিদেশিদের আনাগোনা বেড়ে গেছে। আমরা আমাদের সীমান্তবর্তী এলাকায় বিদেশীদের যাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু নতুন নিয়ম ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছি। কিছু সাংবাদিক এবং কিছু টিভি চ্যানেলের লোকজন আমাদের অনুরোধ জানিয়েছেন যে তাদেরকে এই নিয়মনীতির মধ্যেই কিছু বাড়তি সুবিধা দাওয়া যায় কিনা, যেন তারা সীমান্ত এলাকায় ঘুরে আসতে পারে এবং সঠিক অবস্থান বুঝতে পারে। প্রচার বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং এবিষয়ে জড়িত সকল মন্ত্রনালয় কিছু নির্দিষ্ট ব্যবস্থা নিচ্ছেন এ বিষয়ে। আপনার সাজেশন অনুযায়ী আমরা বিদেশীদের উপর আরোপিত এসকল নিয়মগুলো পুনর্বিবেচনা করে দেখবো এবং একি সাথে তা যেন আমাদের সিমান্তের নিরাপত্তায় কোন বিঘ্ন না সৃষ্টি করে সেদিকেও খেয়াল রাখব।
মিঃ ডেপুটি চেয়ারম্যানঃ আমার মনে আমরা যথেষ্ট আলোচনা করে ফেলেছি।

শ্রী এ জি কুলকারনি (মহারাশ্ত্র)ঃ এদিকে আলোচনা হয়নাই।

মিঃ ডেপুটি চেয়ারম্যানঃ প্রতি পার্টি থেকে একজন করে, ঠিক আছে মি; পার্থসারথি।

শ্রী আর টি পারথসারথি (তামিল নাড়ু)ঃ পূর্বে এবং পশ্চিমে যা হচ্ছে তাতে আমরা কি পাকিস্তানের সাথে একটি অঘোষিত যুদ্ধাবস্থায় নেই, সীমান্তে মাদের সেনাবাহিনীকে নিরন্তর চাপে রাখাকি দেশের জন্য মঙ্গলজনক? কিভাবে আমরা তার অবসান ঘটাতে পারি, আদৌ কি এর অবসান হবে?

শ্রী বিদ্যা চরন শুক্লাঃ এটি একটি অদ্ভুত প্রশ্ন। সীমান্তে আমরা একটি বিপদজনক পরিস্থিতি মোকাবেলা করছি, এবং আমাদের বাহিনী আমাদের ভুখন্ড ও স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে সেখানেই অবস্থান করবে, যতক্ষন না এই পরিস্থিতির অবসান ঘটে।

শ্রী রাজনারায়নঃ মহোদয় আমাদের দেশের সীমা সরকার কি স্পষ্ট করে বলার ক্ষমতা রাখেন?
উপমন্ত্রী (সিদ্ধেশ্বরী প্রসাদ)ঃ তা আপনিই জানেন।

শ্রী পিতাম্বর দাসঃ দক্ষিনে সমুদ্র।

শ্রী রাজনারায়নঃ আমি তা জানি। এজন্য আমি চাই যে শ্রী জগজীবন বাবু আমার প্রশ্ন ভালভাবে চিন্তা করুন। আমি চাই ভারতবর্ষের সরকার ভারতবর্ষের সীমার বিবরন দিন। আগে যা পূর্ব বাংলা ও পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিল, ১৫ই মার্চের পর যা স্বাধীন বাংলা হয়ে গেছে তার ভেতরে ভারতের উত্তর সীমান্তে পুরা ১২ মেইল এলাকা এখন মুক্তাঞ্চল বলা হচ্ছে। সেটি আমাদের সীমান্তের কোন পয়েন্ট যেখান থেকে পরিমাপ করা যাবে?

শ্রী বিদ্যা চরন শুক্লাঃ ঐ ১২ মাইল ভুখন্ড বাংলাদেশের অংশ, বাংলাদেশ সরকারের আধিপত্যে মুক্তি বাহিনীর দখলে আছে। ঐ এলাকা তাদেরি। আমরা তাদের যতটা নৈতিক ও অন্যান্য সাহায্য করে যেতে পারি, তা করে যাচ্ছি।

শ্রী এন রামা রেড্ডি (মহিশুর)ঃ স্যার, আমার সম্প্রতি সীমান্তে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। একটি নির্দিষ্ট স্থানে আমি দেখলাম সেখানে হাটবার চলছে, দুইপারের মানুষই অত্যন্ত স্বাধীনভাবে যাওয়া আসা করছে, কেনাকাটা করছে এবং টাকা পয়সার লেনদেনও চলছে। টাকার লেনদেন এর সাথে সাথে সেখানে কিছু হিপ্পিও ছিল। আমি তাদেরকে বয়ড়াতে দেখেছি। আমি জানতে চাই, যদি এখনও এই অবস্থা চলতে থাকে, তাহলে অবশ্যই ওপার থেকে আমাদের দেশে যেকোন সংখ্যায় ষরযন্ত্রকারীরা প্রবেশ করতে সক্ষম। আমি একথা জানতে চাচ্ছি, কারন ভারতের সর্বত্রই নাশকতা চলছে। কাস্মিরে একটি পোস্ট অফিস জালিয়ে দেয়া হয়েছে। বম্বেতে একটি বোমা উদ্ধার করা হয়েছে এবং রেলওয়েগুলো বিনষ্ট করা হচ্ছে। আরো অনেক কিছুই হচ্ছে সারাদেশে। এধরনের উৎকণ্ঠা বারতে থাকলে তা আমাদের দেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক। আমি জানতে চাই, এইসকল ষড়যন্ত্রকারীদের আগমন ঠেকাতে বর্ডার সম্পূর্ণভাবে সিল করা হয়েছে কিনা।

শ্রী বিদ্যা চরন শুক্লাঃ আমি ইতিমধ্যে এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। এবং আমি আবারো বলতে চাই যে আমরা সীমান্তে নজরদারি চালু রেখেছি এবং ষড়যন্ত্রকারীদের প্রবেশ ঠেকাতে সকল ব্যবস্থা নিয়েছি এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে সফল ও হয়েছি। আমরা যুদ্ধ চাইনা, কিন্তু আমরা অবশ্যই আমাদের রক্ষা করবো।

ডঃ ভাই মহাবীরঃ মহোদয়, মাননীয় মন্ত্রী সরকারের এই প্রত্যয় বারবার পুনরুচ্চার করছেন যে আমরা নিজেদের নিরাপত্তা বিধান করবো। এ উক্তির ব্যাখ্যায় আমার বন্ধু ভুপেশ গুপ্তও বরাবর বলেছেন, আমরা যুদ্ধ চাইনা, আমরা শুধু নিজদের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করবো।

শ্রী বিদ্যা চরন শুক্লাঃ আক্রমন করতে চাইনা, লড়াই করতে চাই অবশ্যই।

ডঃ ভাই মহাবীরঃ তার নিজের ভাষ্য ছিল, আমরা যুদ্ধ চাইনা, কিন্তু আমরা অবশ্যই নিজেদের রক্ষা করবো। অতঃপর বলছেন আক্রমণও করতে চাই। মহোদয় একদিকে যখন এগুলা বলা হচ্ছে, তখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর উক্তি, যদি যুদ্ধ বাধে তবে পাকিস্তানের ভুখন্ডেই হবে এবং যে পর্যন্ত আমরা অগ্রসর হব সেখান থেকে আমরা পশ্চাদাপসরন করবোনা, আমি মনে করি সারাদেশের জন্য এর চেয়ে প্রেরণাদায়ক কথা হতে পারেনা, এবং এজন্য তিনি প্রশংসিত হয়েছেন। কিন্তু, আরেকটি কথা যা বলা হচ্ছে যে আমরা নিজেদের প্রতিরক্ষা বিধান করবো এবং এর অর্থ করা হচ্ছে, আমরা আমাদের দেশ অতিক্রম করবো না, আমাদের সীমান্ত ছারিয়ে যাবনা, তারা যখন লড়তে আসবে, আমরা সেখানেই লড়ব, যখন তারা পলায়ন করবে তখন আমাদের সীমান্তের উপর দিয়ে তাদের নিরাপদে চলে যেতে দিব, এই যদি আমাদের নীতি হয়ে থাকে, তবে কিসের ভিত্তিতে পাকিস্তানের ভূখণ্ডে যুদ্ধ করার কথা ভাবছি আমরা? ১৯৬৫ সালের যুদ্ধও তো অঘোষিত ছিল। তবে কি চিরদিনের জন্য আমাদের হাত বাধা, যতক্ষন ঘোষণা হবে না, ততদিন তারা আমাদের ভুখন্ডে নির্বিঘ্নে এসে পরবে, যখন চাইবে যুদ্ধ করবে, এবং যখন পালিয়ে যাবে স্বীয় ভূখণ্ডে তখন আমরা একপাও অগ্রসর হবোনা, এই যদি পরিস্থিতি হয়, তবে এধরনের সামরিক স্ট্র্যাটেজি অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ।

সুতরাং আমি চাই সরকার তার নীতি ব্যাখ্যা করুন, আমরা কি প্রতিরক্ষা বলতে শুধু এই বুঝাই যে, তারা যখন আমাদের ভূখণ্ডে চলে আসবে, কেবল তখনি আমরা হাতিয়ার তুলে নেব, তার আগে অস্ত্র ধরতে পারিনা? …

জেনারেল হরবিন্স সিংহ এর সেই প্রবন্ধ মন্ত্রী মহোদয়ের জানা থাকতে পারে যার মধ্যে তিনি লিখেছেন, ইনিশিয়েটিভ মিলিটারি স্ট্র্যাটেজির একটি মহান তত্ত্ব। আমরা এই ইনিশিয়েটিভ তাদের হাতেই তুলে দেই, এতে দেশের কল্যান হবে না।

শেষ কথা আমি জিজ্ঞেস করব, নিজের দেশে ধ্বংসাত্মক কাজ ও স্যাবোটাজ হচ্ছে। সরকার এ সম্পর্কে অবহিত কিনা, এসবের পিছনে থাকে পাকিস্তান হাইকমিশনের কর্মচারী বি অধিকারীর চিন্তা ও পরিকল্পনা। পাকিস্তান হাইকমিশনের অভ্যন্তরে যেসব ঘটনা ঘটে তা কয়েকবার এদেশের মানুষকে বিস্মিত ও আশ্চর্যান্বিত করেছে। হাইকমিশনের বাংলাদেশি কর্মচারীদের সেখানে পেটানো হয়। এধরনের অপকর্ম রোধে সরকার কোন প্রতিবিধান করছেন কিনা?

পাকিস্তান হাইকমিশনের লোকদের কুটনৈতিক নিরাপত্তা দেয়া হয় যার ফলে আমরা তাদের অপকর্ম সমুহ বন্ধ করতে পারি না। আমি জানতে চাই, ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানস্থ আমাদের হাইকমিশনে তল্লাশি চলানো হয়েছিল আজকের সংবাদপত্রে প্রকাশিত এখবরের সত্যতা আছে কিনা। যদি থাকে তবে সরকার সে তথ্য কবে পেয়েছিলেন? এ তথ্য কি তখন পাওা গেছে যখন এ সম্পর্কে রহস্যোদঘাটন করা হয়েছে? আমি সরকারের কাছে এসব প্রশ্নের ব্যাখ্যা চাচ্ছি।

শ্রী বিদ্যা চরন শুক্লাঃ উপসভাপতি মশায়, মাননীয় সদস্যের প্রশ্নসমূহের জবাব সরকার কর্তৃক কয়েকবার সুস্পষ্টভাবে দেয়া হয়েছে। আমি এ পরিষদে সেগুলি আবার পুনরুক্তি করছি। প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী মহাশয় এবং অন্যান্য সরকারি মুখপাত্র কয়েকবার পরিষ্কারভাবে একথা বলে দিয়েছেন যে আমরা আক্রমন করবো না কিন্তু যদি আমাদের উপর আক্রমন হয়, তবে আমরা শুধু প্রতিরক্ষা বিধান করব। এমনটি অসম্ভাবি ন্য বরং সীমান্তের ওপারে যেখানেই আমাদের জন্য যথোপযোগী হবে সেখানেই ভালভাবে যুদ্ধ করবো যাতে গোটা যুদ্ধ তাদের ভুখন্ডে সংগঠিত হয়, যেন আমাদের মাটিতে আর কোন প্রকার অনুপ্রবেশ না ঘটে।
ডঃ ভাই মহাবীরঃ এখন যা হচ্ছে তা কি আক্রমন নয়?

শ্রী বিদ্যা চরন শুক্লাঃ আমাদের নীতি আপনি ভাল্ভাবে উপলব্ধি করুন, আজকে কোন যুদ্ধের ঘোষণা দেয়া হয়নি। দ্বিতীয় কথা আপনি জিজ্ঞেস করেছেন যে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ কি পাকিস্তান হাইকমিশন কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে কিনা। এ ব্যাপারে আমাদের কাছে যেসকল তথ্য প্রমান আছে তার ভিত্তিতে আমরা ঐ প্রকার কোন ঘটনা ঘটতে দেইনি, এবং এধরনের ঘটনা থেকে দেশকে মুক্ত রাখার সবরকম তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছি। এখানে আমি এসম্পরকে বিশদ কিছু বলতে চাইনা।

আপনার তৃতীয় প্রশ্ন, ১৯৬৫ সালে করাচিতে আমাদের হাইকমিশনে তল্লাশি হয়েছিল কিনা, এইটি বিদেশী মন্ত্রণালয়ের প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন, তাদের কাছেই এর যথার্থ উত্তর পাওয়া যাবে।

শ্রী মহাভির ত্যাগীঃ স্যার, সেনাবহর সাধারন মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেনা, তারা শুধু সাধারন মানুষের সহমর্মিতা আদায়ে একটা জরুরি অবস্থার পরিবেশ তৈরি করে রাখতে চায়। বর্তমানে পাকিস্তান এধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। আমার মনে হয়, বাংলাদেশ বা পশ্চিম পাকিস্তানের কোন সাধারন মানুষই ভারতের সাথে যুদ্ধ চায়না। দুই দেশের মধ্যে যে শত্রুতার সৃষ্টি হয়েছে, সে বিষয়ে সাধারতন জনগন যে একদমি সন্তুষ্ট ন্য, তা কি দুই দেশের সরকার জানে না? দুই দেশের মানুষী চায় আবার একত্র হতে। যদি কখনও মানুষ চায় যে ভারত এবং পাকিস্তান আবারো এক হয়ে যাক, তাহলে কি সরকার তাদের পক্ষ নিবে?

শ্রী বিদ্যা চরন শুক্লাঃ সম্মানিত সদস্যের প্রথম প্রশ্নের উত্তরে আমি বলব, আমার মনে হয় এর কিছু সারমর্ম আছে। কোন দেশের মানুষই যুদ্ধ চায়না, কারন কোথাও যুদ্ধ হলে সাধারন মানুষই সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়ে। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে আমি বলব, মাননীয় সদস্য একটি অনুমাননির্ভর প্রশ্ন করেছেন এবং আমি মনে করিনা এর উত্তর দাওয়ার প্রয়োজন আছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২০৭। বাংলাদেশ প্রশ্নে জাতিসঙ্ঘের তৃতীয় কমিটিতে চীন কর্তৃক পাকিস্তানের পক্ষে ভুমিকা গ্রহনের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনা রাজ্যসভার কার্যবিবরণী ২৩ নভেম্বর ১৯৭১

Raisa Sabila
<১২, ২০৭, ৭১৭-৭২৭>

বাংলাদেশ প্রশ্নে জাতিসঙ্ঘের তৃতীয় কমিটিতে চীন কর্তৃক পাকিস্তানের পক্ষে ভুমিকা গ্রহনের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনা

একটি জরুরী ও জনগুরুত্বসম্পন্ন বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ

জাতিসঙ্ঘের তৃতীয় কমিটিতে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে চীনা প্রতিনিধির পাকিস্তান কে সমর্থন প্রসঙ্গে।

শ্রী লোকনাথ মিশরা(উরিশ্যা)ঃ জনাব, জাতিসঙ্ঘের তৃতীয় কমিটিতে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে চীনা প্রতিনিধির পাকিস্তান কে সমর্থন এবং এ বিষয়ে ভারতীয় সরকারের প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র বিশয়ক মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।

পররাষ্ট্র বিশয়ক মন্ত্রী (সর্দার শরন সিং)ঃ জনাব, ভারত সরকার চিনা প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের শরণার্থী প্রসঙ্গে জাতিসঙ্ঘের তৃতীয় কমিটির বিতর্কে যে বক্তব্য রেখেছে, তা সম্পরকে অবগত আছে। বক্তব্যের এক কপি এই মুহূর্তে হাউসের টেবিলেই রয়েছে। এ বক্তব্য কোনভাবেই অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল না।

বাংলাদেশের মানুষের গনতান্ত্রিক অধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার দাবীকে দমন করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানি সেনার যে নৃশংসতা তার ফলেই এই শরণার্থী সমস্যা তৈরি হয়েছে। বহিরাগতদের কারনে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে যে দোষারোপ করা হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। সমাধান তখনি সম্ভব হবে যখন পসচিম পাকিস্তানি সেনা শাসকরা তাদের সেনাশাসন প্রত্যাহার করে নিরবাচিত গনপ্রতিনিধিদের সাথে বসে একটি রাজনৈতিক সুরাহা করবেন। এই কারনেই আমরা প্রতিনিয়ত পাকিস্তানের এই সমস্যাকে ভারত-পাকিস্তানের বিরোধ হিসেবে প্রচার করার চেষ্টাকে প্রতিহত করে আসছি। এই লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের দায়িত্ব ভারতের কাছে একটি অসহনীয় বোঝাস্বরুপ, ফলে ভারত সরকার এই শরণার্থীদের নিরাপদে সম্মানের সাথে তাদের নিজেদের ভূখণ্ডে যতদ্রুত সম্ভব ফিরিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর।

এই লক্ষ লক্ষ শরণার্থী যে ভয়াবহ ট্র্যাজেডির সম্মুখিন হয়েছে, যে কারনে তারা সারা পৃথিবীর মানুষের সমবেদনা ও সমর্থন পাচ্ছে, তা কোনভাবেই অস্বীকার বা মুছে ফেলা যাবে না। জাতিসঙ্গ নিজে তাদের জন্য ত্রান সরবরাহ করছে। অনেক রাষ্ট্র জাতিসঙ্ঘের সেক্রেতারি-জেনারেল এর সাহায্যের আবেদনে সাড়া দিয়েছেন। বিদেশিদের মন্তব্যে আমরা মুল বিষয় থেকে আমাদের মনোযোগ হারিয়ে ফেললে চলবে না। যদি মুল সমস্যার কথা ভাবা হয়, তাহলে পৃথিবীর কোন দেশ, যাদের বিন্দুমাত্র মানবতা ও ন্যায়বিচার এর প্রতি আস্থা আছে, তাদেরকে নিজেদেরকে এসব বৈদেশিক মন্তব্য ও অযথা তর্কে বিচলিত হতে দিবেনা। বাস্তবের সাথে মিল নেই, এমন ধরনের দোষারোপ করে আসলে কোন লাভ হবেনা। ভারত গর্বের সাথে বলতে পারে যে তারা কখনওই, অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলায় না এমনকি পরোক্ষভাবে এধরনের কোন দোষারোপও অনুমোদন করেনা। ভারত আশা করে যে, কোন দেশ, বা কোন পরাশক্তি এ অঞ্চলের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলবেনা।

বিবৃতিঃ

পূর্ব পাকিস্তান প্রসঙ্গে বেশ কয়েকটি দেশের প্রতিনিধিগণ কথা বলেছেন। চীনা প্রতিনিধিদলও এবিশয়ে তাদের মন্তব্য ব্যাক্ত করতে চায়। চিনা সরকার ও তার জনগণ, সবসময়ই বিশ্বাস করে যে কোন দেশের অভ্যন্তরীণ কোন্দল তারা নিজেরাই সমাধান করবে। যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, তা সম্পূর্ণই পাকিস্তানের নিজস্ব বিষয় এবং তা শুধু মাত্র পাকিস্তানের পক্ষেই সমাধান করা সম্ভব, কোন দেশেরি এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র নাক গলানো উচিত নয়। যে শরণার্থী প্রসঙ্গটি বর্তমানে এসেছে, তার কারন একটি নির্দিষ্ট দেশ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাচ্ছে এবং এই উপমহাদেশে অস্থিরতার সৃষ্টি করছে। সম্প্রতি পাকিস্তান সরকার ক্রমাগত এ পরিস্থিতি এবং শরণার্থী সমস্যার সমাধানের জন্য উদ্যোগ নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু আলোচ্য এই দেশটি সকল প্রস্তাবই বাতিল করে দিয়েছে। তারা এই শরণার্থী ইস্যু থেকে যথাসম্ভব সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর ক্ষেত্রে এবং পূর্ব পাকিস্তানিদের তাদের ঘরে ফিরে গিয়ে একটা সুরাহার ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রেও। চীনা সরকার এবং জনগন, অন্য দেশের বিষয়ে নাক গলানোর পন্থা সম্পপরকে ভালভাবে অবগত আছে। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে যে একটি নির্দিষ্ট দেশ তিব্বতে এধরনের একটি বিদ্রোহ ঘটানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু চিনা জনগন কঠোরভাবে তা দমন করেছে। তারা চিনা অধিবাসীগণকে তাদের দেশে আসার জন্য উৎসাহিত করেছিল এবং এভাবেই তিব্বতি শরণার্থীদের প্রশ্ন তুলেছিল। আমরা বলতে চাই যে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এধরনের কার্যক্রম বন্ধ করা উচিত। শুধুমাত্র এভাবেই শরনারথিদেরকে তাদের নিজ ভূখণ্ডে ফিরিয়ে নিতে সাহায্য করা হবে। চিনা সরকার সবসময়ি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং অন্য দেশের বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি মান্য করে এসেছে এবং এভাবে শরণার্থীর প্রশ্ন তুলে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টার সম্পূর্ণ বিরোধিতা করছে। পকিস্তানের রাজ্যসমুহের কলহের সমাধান পাকিস্তানেই হবে, কেননা পাক্সিতানের মানুশ দেশপ্রেমিক, যেকোন ধরনের হস্তক্ষেপের বিরোধী এবং তারা অবশয়ি তাদের নিজের সমস্যার সমাধান নিজেরাই সমাধান করতে পারবে।

শ্রী লোকনাথ মিশ্রাঃ আমি এবিষয়ে ভারতীয় সরকারের প্রতিক্রিয়া জানতে চাচ্ছিলাম। পররাষ্ট্র বিশয়ক মন্ত্রী এ বিষয়ে বক্তব্য আকারে যা বলেছেন, তাই হাউসে এবং তার বাইরে বারবার পঠিত হচ্ছে গত তিন মাস ধরে। সুতরাং চীনা সরকারের এই উল্লেখযোগ্য মণোভাব পরিবর্তনের পরেও আমরা সেই বক্তব্যে বিশেষ কোন পরিবরতন লক্ষ্য করছিনা। আমি নির্দিষ্টভাবে যা জানতে চাই, তা হচ্ছেঃ আমাদের সরকার যখন চিন সরকারের সাথে সকল উদ্যোগই অত্যন্ত নম্রতার সাথে গ্রহন করছে, সে সময় যখন সমাজতান্ত্রিক চীন সরকার এমন একটি বক্তব্য জাতিসঙ্ঘে দিচ্ছে, তার জবাব হিসেবে ভার সরকার কি প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করেছে? এখন, জনাব, আমি সেই নির্দিষ্ট প্রতিক্রিয়াটি জানতে চাই, তারপর আমি কিছু প্রশ্ন করবো…

সর্দার শরন সিংঃ আমি খুবি স্পষ্টভাবে আমার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছি যে চীনা প্রতিনিধিরা তাদের বক্তব্যে যেসব দোষারোপ করেছে, তা অন্যান্য দোষারোপগুলোর মতই ভিত্তিহীন। এটি খুবি স্পষ্ট একটি প্রতিক্রিয়া।

মিঃ চেয়ারম্যানঃ মিঃ মিশ্রা, আপনি এখন প্রশ্ন করতে পারেন…

শ্রী লোকনাথ মিশ্রাঃ আমি একটাই প্রশ্ন করবো, সেটা করতে যত সময়ি লাগুক না কেন…
মিঃ চেয়ারম্যানঃ একটি প্রশ্ন করুন।

শ্রী লোকনাথ মিশ্রাঃ স্যার, শুধুমাত্র কিছু বিষয় স্পষ্ট করে নিতে জানতে চাচ্ছি, পরিস্থিতি মোটামুটি স্বাভাবিক হলে চায়না এবং ভারতের মধ্যবর্তী কুটনৈতিক সম্পর্ক রাষ্ট্রদূতদের মাধ্যমে মজবুত করার একটি প্রস্তাব করা হয়েছে। এমন সময়ে যখন দেখা যাচ্ছে, সমাজতান্ত্রিক চীনা সরকার আমাদের সম্পর্কে এধরনের শত্রুভাবাপন্ন বক্তব্য রাখছে এবং তারা বাংলাদেশ ইস্যুটাকে সম্পূর্ণভাবে চাপা দিতে চাচ্ছে। এই কঠিন সময়ে যখন আমরা বাংলাদেশি শরনারথীদের ভারবহন করতে গিয়ে আরথিকভাবে প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তখন তারা আমাদের সাহায্য করার বদলে তারা বাংলাদেশের এই আন্দোলন চাপা দেওয়ার মনোভাব প্রকাশ করছে।

শ্রী দ্বিজেন্দ্রলাল সেনগুপ্তঃ বাংলাদেশ স্বাধীনতা আন্দোলন।

শ্রী লোকনাথ মিশ্রাঃ জি, বাংলাদেশ আন্দোলন। এই আন্দোলনের সুত্রপাত বাংলাদেশের একটি অবাধ ও বৈধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। এ নির্বাচনে শেখ মুজিবর রহমান সরবাধিক আসনে বিজয় লাভ করেন, যাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, এবং যার থেকে এই আন্দোলনের সুত্রপাত। আমি আশা করেছিলাম, ভারত সরকারের এই বিষয়ে প্রতিক্রিয়া আরো সুসংহত হবে, এবং এমন একতি দেশ হিসেবে নিজেকে সরকার প্রকাশ করবে, যা মানুষের স্বাধীনতার জন্য লরে যাচ্ছে, যখন অন্য একটি দেশ সেক্ষেত্রে অন্তরায়ের সৃষ্টি করে যাচ্ছে।

মিঃ চেয়ারম্যানঃ ঠিক আছে, এটি একটি খুবি ভাল প্রশ্ন।

শ্রী লোকনাথ মিশ্রাঃ এটিই শুধুমাত্র প্রশ্ন নয়, স্যার, একি সাথে আমি জানতে পেরেছি যে চীনা সরকার ভারত সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করছে, যেন তারা তিব্বতি শরণার্থী এবং তাদের দালাইলামাকে পাঠানো সাহায্য বন্ধ করে বা অন্তত কমিয়ে দেয়। আমাকে বলা হয়েছে…

মিঃ চেয়ারম্যানঃ আপনার প্রশ্নটি কি?

শ্রী লোকনাথ মিশ্রাঃ এই বিষয় থেকেই প্রশ্নটি আসছে।

মিঃ চেয়ারম্যানঃ না, না, আপনার প্রশ্নটি কি?

শ্রী লোকনাথ মিশ্রাঃ আমি জানতে চাই যে এটী সঠিক কিনা? (মাঝখানে কেউ একজন কথা বলছেন)

আমি ট্রেজারি বেঞ্চে আপিল করব। তাদের অধৈর্য হওার কোন কারন নেই। আমি তাদের নেতাদের সাথে কথা বলেছি, এবং মুদ্রা দুই পিঠি আমাদের পক্ষে।

এখন স্যার আমি জানতে চাই, চায়না সরকারের চাপের মুখে, এই সাহায্য কি আসলেই বন্ধ হয়ে যাবে কিনা? ভারত সরকারের প্রতি হিংসা বা মহানুভবতা, যাই হোক না কেন, তার কারনে আরো একটি দেশকে উত্যক্ত মনে হচ্ছে, যারা প্রতি বছর ৮ কোটির সমমুল্যের ওয়াগন আমদানি করত, এবং বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করত। সেই দেশটি হচ্ছে তাইওয়ান, যাদের সকল কুটনৈতিক সফর বাতিল করা হয়েছে, এমনকি তাইওয়ানিজ সিটিজেনদের ট্রাভেল ভিসা, হয়ত তারা তাজমহল দেখতে আসতো, তাও বন্ধ করে দিয়েছে। কেন, এক্টী দেশের সরকার হিংসায় সকম কুটনৈতিক মিশন বন্ধ করে দিবে, তাদের লোকদের আশা বন্ধ করে দিবে, যেখানে ভারত সরকার তাদের সাথে বানিজ্য করছে, এবং আমরা পাবলিক সেক্টরে তাদের কাছ থেকে থেকে ৮ কোটির সমমুল্যের বৈদেশিক মুদ্রা পাচ্ছে।

সর্দার শরন সিংঃ স্যার, আমাকে স্বীকার করতেই হচ্ছে যে, অনেক মনোযোগ দিয়ে উনার প্রশ্ন শুনার পরেও আমার পক্ষে বুঝা কঠিন হয়ে পরেছে, যে উনার আসল প্রশ্নটা কি। উনি উনার চিন্তা অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয়ে উনার মন্তব্য ব্যক্ত করেছেন, কিন্তু জবাব দেয়ার মত কোন নির্দিষ্ট প্রশ্ন আমাকে করেননি। উনি বেশ কিছু মন্তব্য করেছে, যার একটা বা দুইটা বিষয়ে হয়ত আমি খুবি সংক্ষেপ মন্তব্য করবো। প্রথম বিহস্য হল, সম্পরকের ক্ষেত্রে মনোভাব, অনেক সময়, সপরকের উন্নয়নের জন্য, যা সবসময়ি প্রয়োজন, আমরা নির্দিষ্ট বীষোয়ে গুরুত্ব দাওয়া প্রয়োজন হলেও, সামগ্রিক বিষয়ে আলোকপাত করি। একটি বক্তব্য, যা আমাদের পছন্দ হয়নি, তা কোনভাবেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার একটি প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে পারেনা।

শ্রী দ্বিজেন্দ্রলাল সেনগুপ্তঃ গত ছয় বছর এর পর…

মিঃ চেয়ারম্যানঃ দয়া করে, উনাকে শেষ করতে দিন।

শ্রী দ্বিজেন্দ্রলাল সেনগুপ্তঃ আমরা ছয় বছর ধরে অপেক্ষা করছি।

সর্দার শরন সিংঃ আরো একটি প্রশ্ন, যা তিনি উত্থাপন করেছেন তা হল, তাইওয়ানিজদের ট্যুরিস্ট ভিসা আমাদের বন্ধ করা উচিত হবে কি না। যদি সম্প্রতি একটি ঘটনার কথা সম্মানিত সদস্যের মনে না থেকে থাকে, আমি আবারো বিষয়টি পরিস্কার করে নিতে চাই। তাইওয়ানিজদের একটি গ্রুপ এখানে একটি কনফারেন্সে অংশ নিতে আস্তে চেয়েছিল, এই একটি আন-অফিশিয়াল কনফারেন্সে ছিল, এবং তারা আমাদের হংকং এর মিশনে ভিসা এর জন্য এপ্লাই করেছিল এবং প্রচলিত নিয়মে তাদের ভিসা বাতিল হয়েছে। তারপর এই লোকগুলোই ব্যাংককে এসে দাবী করে যে তারা ট্যুরিস্ট হিসাবে আসতে চায়, এবং তাদের ভিসা দেয়া হয়। তারা যদি কনফারেন্সে অংশ নেয়ার জন্যই এসে থাকে, তাহলে এটা তাদের ভুল হয়েছে যে তারা আমাদের মিশনকে ভুল তথ্য দিয়েছে। তারা শুধুই ট্যুরিস্ট ছিল না। সুতরাং, এটাই আমাদের পলিসি এবং আমরা তাই মেনে চলবো। গনপ্রজাতন্ত্রী চীন এসে আমাদের মনের কোথাও তাইওয়ান বিষয়ক আমাদের পলিসি নিয়ে যেন সন্দেহ তৈরি করতে না পারে। আমি এই বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট করে বলতে চাই, যে আমরা বিশ্বাস করি যে চিন একটাই, গনপ্রজাতন্ত্রী চীন হচ্ছে, দেশটির বৈধ সরকার। আমরা তাইওয়ানকে স্বীকৃতি দেইনি এবং আমরা দ্বৈত চায়নার থিওরী মেনে নিতে পারবোনা।

শ্রী লোকনাথ মিশ্রাঃ তিব্বতি শরণার্থীদের ত্রান এর কি হবে?
সর্দার শরন সিংঃ তিব্বতি শরণার্থীদের নিয়ে এখানে কোন প্রশ্নের অবকাশ নেউ। আমি শুধু মাননীয় সদস্যকে জানানোর জন্য বলতে চাই যে তাদের ত্রান সরবরাহ কমানোর কোন পদক্ষেপ আমরা নেইনি।

(মিঃ ডেপুটী চেয়ারম্যান, আসন গ্রহন করছেন)

শ্রী এন। জি, গোরাই (মহারাষ্ট্র)ঃ আমি জানিনা, তাইওয়ান ইস্যু কিভাবে আস্লো, কিন্তু এই দৃষ্টি আকর্ষণের বিষয়টিকে সঠিকদিকে নিয়ে যেতে, আমি চিনা ডেলিগেশন দলের নেতার কিছু কথা পরে শোনাতে চাই।
সর্দার শরন সিংঃ আমি তার একটি কপি টেবিলে দিয়েছি।

শ্রী এন। জি, গোরাই ঃ কিন্তু আমি কিছু বিষয়, যা সে বলেছে, তার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে চাই। তিনিও বলেছেন যে এই তথাকথিত শরণার্থী ইস্যু যা বর্তমান সময়ে তৈরি হয়েছে, তা একটি নির্দিষ্ট দেশের পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানর ফলাফল, এবং একি সাথে উপমহাদেশে অস্থিরতা তৈরির কারন। সুতরাং তিনি বেশ পরিষ্কারভাবেই ভারতকে বর্তমান পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার বিরোধের জন্য দায়ী করছেন। শুধু তাই নয়, পুরো এলাকাতেই যে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে, তার জন্য দায়ী করছেন। এই গেল এক নম্বর।

তারপর তিনি ভারতকে আরো আগ্রাসী ভাবে দোষারোপ করে গেছেন। মিঃ ফু হাও বলেছেন, তারা এই শরণার্থী ইস্যু থেকে যথাসম্ভব সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর ক্ষেত্রে এবং পূর্ব পাকিস্তানিদের তাদের ঘরে ফিরে গিয়ে একটা সুরাহার ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রেও। এটি হচ্ছে, দোষারোপ নাম্বার দুই। যে আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে শরণার্থীদের ঘরে ফিরে যাওয়া প্রতিরোধ করছি।

তৃতীয় দোষারোপ হচ্ছে, যতদুর চিনা মানুষদের কথা বিবেচনা করা যায়, এটা তাদের জন্য নতুন কিছুই নয়, যেহেতু ভারত একি পন্থায় তিব্বত ইস্যুতে নাক গলানোর চেষ্টা করেছে, এবং সে কারনে ভারত ও চায়নার মধ্যবর্তী সম্পর্কের অবনতি হয়েছে।

এই ছিল, ভারতের বিপক্ষে তাদের সুনির্দিষ্ট তিনটি অভিযোগ। স্যার, এই অভিযোগগুলোই আমরা চায়নার সাথে সম্পর্ক এর উন্নয়নের জন্য যে উদ্যোগগুলো নিয়েছি, তার তাৎপর্য ব্যক্ত করছে। আমরা আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা করছি, এবং প্রধানমন্ত্রীকেও যদি সঠিকভাবে সব জানানো হত, তিনিও বলতেন যে আসাই-চিন সমস্যা নিয়ে আলোচনায় বসা যেতে পারে। পত্র-পত্রিকায় তাই লেখা হচ্ছিল, যদিও আমি জানিনা, তাকে সঠিকভাবে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা হয়েছে কিনা। এর মানে হচ্ছে যে সেই পণ্ডিত নেহরু এর আমলে চিনের সাথে আমাদের যে ঝামেলা শুরু হয়েছিল, সেই আক্সাই চিন ইস্যু নিয়ে আমরা আলোচনার টেবিলে বসে এর সমাধান করতে আগ্রহী। এটি ছিল চিনকে দেয়া আমাদের প্রস্তাব। যেহেতু আমরা সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটানোর উদ্যোগ নিয়েছি, আমি জানতে চাই, আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রী কি এ বিষয়ে নোট রাখছেন কিনা, যে এসকল দোষারোপ এর কি ফল হতে পারে। প্রতিটা বাক্যে একটি বিষাক্ত মনোভাব রয়েছে। প্রতিটি বাক্য অত্যন্ত তীক্ষ্ণ এবং গত ৬ মাসে ভারত যে ইমেজ তৈরি করেছে, তা তারা ধংস করে দিতে চায়। আমাদের চেষ্টা ছিল, প্রতিটি দেশে যেয়ে তাদের বোঝানো যে এটি পাকিস্তান এবগ ভারতের মধ্যকার কোন বিষয় নয়, মিলিটারি জান্তার দমন-পীড়ন নিতির ফলাফল। ভারত ও চায়, যে শরণার্থীরা ফিরে যাক, কিন্তু অবশ্যই ইসলামাবাদ মিলিটারি জান্তাকে তার মনোভাব পরিবরতন করতে হবে। এখন চিনা প্রতিনিধিরা এই চেষ্টা পুরোটা গুড়িয়ে দিতে চাইছে এবং যা কিছু ঘটেছে তার সবটার জন্য ভারতকে দায়ী করেছে। আমি এইসব দেখে বলতে চাই, পররাষ্ট্র মন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই যে তারা যেন খেয়াল করে যে চিন গত কয়েকবছর ধরে একি ধরনের মনোভাব পোশন করে আসছে, এবং আজো তার কোন পরিবরতন হয়নি। এটি শুধুমাত্র ভারতকে দোষারোপ ই করেনি, তারা তিব্বতি ইস্যুর উদাহরন টেনে প্রমান করতে চাচ্ছেন যে, ভারতের পলিসিই এমন যে আমরা এধুরনের পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে নিজেদের দুরভিসন্ধি হাসিল করতে চাই। আমি জানতে চাই, এধরনের অভিযোগ, বিশেষত যখন তা জাতিসঙ্ঘের মতন একটা আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মে করা হয়েছে, তা এই সম্পর্কের উন্নয়নের উদ্যোগের ক্ষেত্রে কি ভুমিকা পালন করবে?

সর্দার শরন সিংঃ জনাব, আমি বলতে চাই যে সম্মানিত সদস্য চীনা প্রতিনিধিদের তৃতীয় জাতিসঙ্ঘের কমিটিতে প্রদান করা বক্তব্য থেকে যে তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেছেন, এই তিনটি পয়েন্ট এর ক্ষেত্রেই ভারত সরকার পরিষ্কার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। আমি প্রথমেই তা উল্লেখ করেছি, এবং আমার মনে হয়না, সুনির্দিষ্ট বাক্যগুলি পুনরায় উল্লেখের প্রয়োজন আছে।

কিন্তু, যেহেতু তিনি নির্দিষ্ট কিছু দোষারোপের কথা উল্লেখ করেছেন, তাই উল্লেখ্য যে, প্রথম অভিযোগের উত্তর হচ্ছে যে বহিরাগত হস্তক্ষেপের কারনে এই শরণার্থী সমস্যা তৈরি হয়েছে, এমন অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। দ্বিতীয়টির উত্তর হচ্ছে আমরা শরণার্থীদের ফিরে যাওয়াকে প্রতিরোধ করেছি। তৃতীয় অভিযোগের উত্তর বক্তব্যের তৃতীয় প্যারাতে আছে, যা আমি পড়ে শুনাচ্ছিঃ

এই লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের দায়িত্ব ভারতের কাছে একটি অসহনীয় বোঝাস্বরুপ, ফলে ভারত সরকার এই শরণার্থীদের নিরাপদে সম্মানের সাথে তাদের নিজেদের ভূখণ্ডে যতদ্রুত সম্ভব ফিরিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর।

এই তৃতীয় পয়েন্টের জবাব সর্বশেষ প্যারাতেও দাওয়া আছে, যেখানে বলা আছে যে, আমরা গর্বের সাথে বলতে পারি যে অন্যান্য দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যায় আমরা হস্তক্ষেপ কখনই করিনি, এবং আমরা এধরনের যেকোন পদক্ষেপকে প্রতিহত করি। সুতরাং এ বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট যে সম্মানিত সদস্য যেসক্কল পয়েন্ট উল্লেখ করেছে, তার সবগুলোর প্রতিক্রিয়া আমি ইতিমধ্যে ব্যক্ত করেছি। সম্মানিত সদস্য আরো বলছেন, যে আমি বিষয়টি গুরুতবের সাথে দেখছি কিনা, এবং আমি বলতে চাই যে আমি অবশ্যই বিষয়টি গুরুতবের সাথে দেখছি, এবং সেকারনেই সরকারের সকল প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত স্পষ্টভাবে দাওয়া হয়েছে, তা সঠিক বা ভুল যাই হোক না কেন।

শ্রী এন। জি, গোরাই ঃ এই প্রতিক্রিয়াটি অত্যন্ত বেশি তির্যক, ফলে ভারত ও চায়নার মধ্যকার সম্পর্ক স্বাভাবিক হওা সম্ববপর নয়।

সর্দার শরন সিংঃ যদি আমরা এই বিশ্বাস নিয়ে আগাই যে তির্যক বক্তব্য দিয়েই কোন দেশ আমাদের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করতে পারে, তবে আমরা আমাদের এবং পৃথিবীর সব রাষ্ট্রকেই খাটো করে দেখছি। একি সাথে এমন দেশ থাকবে, যারা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করবে, আবার এমন দেশও থাকবে যারা সমর্থন করবে না। কিন্তু, আমরা অবশ্যই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করব, এবং তাই করা হয়েছে। একি সাথে আমরা একটি উপযুক্ত বক্তব্য পেশ করবো, যদি ইতিমধ্যে আমাদের ইউ এন প্রতিনিধি তা ফোরামে না করে থাকে।

অন্যান্য পয়েন্ট এর মধ্যে তিনি উল্লেখ করেছেন, সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমাদের প্রচেষ্টা নিয়ে। আমার মনে হয় এক্ষেত্রে আমরা যথাযথ উদ্যোগই নিব, এবং চীন বিরোধিতা করার কারনে আমাদের কখনই নিজেদের নীতিমালা থেকে সরে যাওয়া উচিত হবেনা। এই বিহস্যের উপর ভিত্তি করে আমাদের আগানো কখনই সঠিক হবে না। আমার মনে হয়, তারপরো আমাদের আশা করার যথেষ্ট কারন আছে যে চীনের সাথে আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে।

শ্রী এন। জি, গোরাই ঃ আপনি কি আক্সাই চিনের উপর কোন প্রস্তাব তৈরি করেছেন?
সর্দার শরন সিংঃ না আমরা এবিষয়ে কোন প্রস্তাবনা তৈরি করিনি।

রাজ্যসভা ২৩শে নভেম্বর, ১৯৭১

শ্রী সীতারাম কেশরী (বিহার)ঃ উপ-সভাপতি মহাশয়, জাতিসঙ্ঘে চীনের প্রতিনিধি যে ভাশন দিয়েছেন যার ভিত্তিতে এই দৃষ্টি আকর্ষণী প্রস্তাব তথা আপনার বক্তব্য এসেছে, আমি কি জানতে পারি তাদের এই বক্তব্য স্বত্বেও আমরা তাদের সঙ্গে সম্পর্ক নরমালাইজ করব? চীনা প্রতিনিধি তার ভাষণে কি এ কথাও বলেছেন যে পাকিস্তান ও ভারত যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হলে তারা পাকিস্তানকে সমর্থন করবে? যদি এমন কোন বক্তব্য না দিয়ে থাকেন, তবে শুধুমাত্র জাতিসংঘে প্রদত্ত একটি বক্তব্যের দরুন, এবং নিজেদের ভুলকে আমাদের ভুল বলে অভিহিত করার অরথাত শরণার্থী সমস্যার ব্যাপারে তারা যে প্রচেষ্টা চালিয়েছে এবং বলেছে, তিব্বতে যেসব শরণার্থী এসেছিল তাদের নিয়ে ভারত তাই করেছিল, যা সে আজ করছে। এর দ্বারা আমি ধরে নেব যে, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ হলে চীন পাকিস্তানকে সমর্থন করবে আর যদি এমন আভাস না পাওয়া যায় তাহলে চীনের সঙ্গে সুসম্পরক গড়ার নীতি অব্যাহত না রাখা কি সমীচীন?

সর্দার শরন সিংঃ জনাব, আমি চিনা প্রতিনিধির বক্তব্যের আসল কপিটি হাউসের টেবিলে জমা দিয়েছি। তিনি পুরো বিশয়টির উপর তার নিজের মনোভাব ব্যক্ত করেছেন এবং তিনিই তার দৃষ্টিভঙ্গির দায় বহন করেন।

শ্রী সীতারাম কেশরী (বিহার)ঃ তাহলে কি আমি এই ধরে নিব যে, তাদের সাথে যুদ্ধের কোন সম্ভাবন নেই এবং তাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে সহযোগিতা লাভের সম্ভাবনা আছে?

সর্দার শরন সিংঃ সে বিষয়ে আমি কোন মন্তব্য করব না।

শ্রী প্রণব কুমার মুখারজীঃ জনাব, মন্ত্রিমশায় তার উত্তরের মাধ্যমে স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে জাতিসঙ্ঘে চিনা দুতের যে বক্তব্য, তা কোনভাবে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতে কোন পরিবর্তন আনবেনা। তার এ বক্তব্যের উপর ভিত্তি করেই আমি জানতে চাই যে চীনের সাথে এই সম্পর্ক উন্নয়নের যে পরিকল্পনা, সে বিষয়ে চীন সরকারের সাথে কি ভারত সরকার কোনক্ষেত্রে একমত হতে পেরেছে কিনা?

দ্বিতীয়ত, আমি জানতে চাই, ভারত সরকার এক্ষেত্রে দুতাবাসের মাধ্যমে বা কোন বন্ধুভাবাপন্ন রাষ্ট্রের মাধ্যমে চীনা সরকারকে বাংলাদেশ এবং শরণার্থীদের সত্যিকারের সমস্যাগুলো তুলে ধরবার জন্য কোন কুটনৈতিক পন্থা অবলম্বন করেছে কিনা, যেন চীন সরকার কোনভাবেই বাংলাদেশ ও তিব্বতের শরণার্থীদের একীভূত না করে ফেলেন, যেমনটা তারা এখন পর্যন্ত ভাবছে বলেই মনে হচ্ছে? সেক্ষেত্রে আমি জানতে চাইব, যে এক্ষেত্রে সরকার কি কি উদ্যোগ গ্রহন করছে?

সর্দার শরন সিংঃ আপনার প্রশ্নের শেষাংশের উত্তরের ক্ষেত্রে বলছি, আমরা বাংলাদেশ বিষয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন সরকারের রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করছি। আমরা আমাদের অবস্থান পিকিং এ এবং দিল্লীতে অবস্থানকারী তাদের রাষ্ট্রপ্রতিনিধিকেও জানিয়েছি। আমরা এই চেষ্টা চালিয়ে যাব, এবং যোগাযোগ রক্ষা করে যাব। নতুন উদ্ভুত এই পরিস্থিতেও আমরা আমাদের অবস্থান তাদের জানাবো।

শ্রী প্রণব কুমার মুখারজীঃ প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইকে কোন পত্র দিয়েছেন, যেমনটা তিনি অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধানের ক্ষেত্রে করেছেন?

সর্দার শরন সিংঃ প্রধানমন্ত্রী গণপ্রজাতন্ত্রী চীন সরকার প্রধানকেও বারতা পাঠিয়েছেন।

শ্রী প্রণব কুমার মুখারজীঃ সেটি ছিল, জাতিসঙ্ঘে অন্তর্ভুক্ত হওার জন্য অভিনন্দন বার্তা, আমি জানতে চাচ্ছি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে।

সর্দার শরন সিংঃ পুরবেই বাংলাদেশ বিষয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে, এবং এই প্রচেষ্টা ধারাবাহিকভাবে চলবে। আমরা যদি কোন দেশকে আমাদের কথা নাও বুঝাতে পারি, তারপরও আমরা বারবারই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি তাদেরকে ব্যাখ্যা করে যাব।

শ্রী এন। শ্রী রামা রেড্ডি (মহিশুর)ঃ জনাব, আমরা চীন প্রতিনিধিদলের জাতিসঙ্ঘের তৃতীয় কমিটিতে প্রদত্ত বক্তব্যের উদ্দেশ্যে ভারত সরকার যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, সে বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বক্তব্য শুনেছি। এই কমিটি এমন একটি কমিটি যেখানে মানবিক বিষয়সমুহ বিবেচিত হবে বলে বলা হয়েছিল। কমিটি সেই এক কোটি মানুষের কথা ভাবছিল যারা তাদের ভিটামাটি ছেড়ে ভারতে এসে আশ্রয় চেয়েছে। আমরাও মানবিকতার খাতিরেই বলেছি যে আমরা এই মানুশগুলোকে আশ্রয় ও সাহায্য দেব। এমন একটি ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের বিষয়ে বিবেচনার সময়ে চীন এধরনের রাজনৈতিক প্রশ্ন ও ঘোষণা দিচ্ছে যে এটি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার এবং ভারতের হস্তক্ষেপ করা উচিত হয়নি, যা অত্যন্ত গুরুতর একটি অভিযোগ। আমি এটিকে হালকাভাবে নিতে পারছিনা।

দ্বিতীয়ত, চীন আরো বলছে যে আমরা বিধ্বংসী কার্যক্রম চালাচ্ছি এবং শরণার্থীদের তাদের নিজেদের এলাকায় ফিরে যেতে প্রতিহত করছি। এ শরণার্থীদের সাহায্য করতে যেয়ে যে বিশাল অঙ্কের ব্যয় আমাদের হচ্ছে, যে ত্যাগ আমরা স্বীকার করেছি, তার কোন কিছুই তারা বিবেচনা না করে, উলটো বলছেন আমরা বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড করছি। আমার মনে হয়, এবার আমাদের ব্যবস্থা নাওয়া উচিত, এবং তা অবশ্যই বিনিত চিঠির মাধ্যমে নয়। একসময় আমরা বলতাম হিন্দী-চীনি ভাই ভাই, এবং তারপর কি হল, অক্ষয় চীন দখল করে ভারতের উপর হামলা করা হল। আমরা ভাল করেই চায়নার ব্যবহার জানি। তারা সবসময়ই বিশ্বাসঘাতকতা করে এসেছে। ভারত সরকার যতই চিনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করুক না কেন, আমি আমার মনভাব লুকাতে পারবনা। আমার মনে হয়না, আমাদের কোন চেষ্টাই প্রয়াত শ্রদ্ধেয় জওহরলাল নেহরু এর চেয়ে বেশি হবে। তিনি তার সাধ্যমত ভারন-চীনের সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করেছেন। বিনিময়ে পেয়েছেন বিশ্বাসঘাতকতা। রুটির বদলে আমাদের দিকে পাথর মারা হয়েছে। এটি আমাদের অভিজ্ঞতা, এবং তারাও কোন ব্যতিক্রম না করে জাতিসঙ্ঘে প্রবেশ করে প্রথম বক্তব্যেই এসব বলেছে। আমরা সর্বচ্চো চেষ্টা করেছি, কিন্তু তার ফলাফল হাতেনাতে পাওা শুরু হয়েছে। এরপরও কি আমাদের সরকার বিনিত কিছু চিঠি পাঠিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে? তারা কি এরপরও এ বিশয়টাকে গুরুত্বের সাথে নিবেনা? কেন একটি প্রতিবাদ পত্র পাঠানো হচ্ছেনা? যখন সারা পৃথিবী এই এক কোটি শরণার্থীদের সমস্যাকে মানবিক সমস্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের পাশে সাহায্য নিয়ে দারিয়েছে, তখন কেবল মাত্র চীন এমন একটি বক্তব্য রেখেছে। এমনকি তিউনিশিয়াও এমন কোন বক্তব্য দেয়নি। চীন তাদের প্রথম বক্তব্যে এধরনের মন্তব্য করাটা একটি সুস্পষ্ট হুমকি। আমরা হিন্দি-চিনি ভাই ভাই আমলের কথা জানি। আমার মনে হয় সেই দিনগুলো আবার ফেরত আসছে। আমি ভেবছিলাম সবকিছু স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরত আসবে এবং বন্ধুভাবপন্নতা বেড়ে যাবে। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ চিঠি আদান-প্রদান হচ্ছে। এসব কিছু আমাদের ভাবিয়েছিল যে আমরা একটি ভিন্ন পথে হাটছি এবং চিনের সাথে বন্ধুত্ব সম্ভব, কিন্তু খুব দ্রুতই সে চিন্তার অবসান ঘটল। ভারত সরকার বিশয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিত যে চীন তাদের প্রথম বক্তব্যেই এধরনের কথা বলছে, এবং তাদেরকে একটি প্রতিবাদ পত্র পাঠানো উচিত উল্লেখ করে যে ভারত কোন বিধ্বংসী কার্যক্রম করছেনা। ভারত যা করছে, তা মানবতার খাতিরে। এক কোটি মানুষ মিলিটারি জান্তার অত্যাচারে তাদের ভিটামাটি ছেরেছে। আমাদের বিষয়টি খুবি গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে। বিনয়িভাবে কাজ হবেনা, ভারতকে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

মিঃ ডেপুটি চেয়ারম্যানঃ আপনার প্রশ্নটা কি?

শ্রী এন। শ্রী রামা রেড্ডিঃ ভারত কি শুধুমাত্র চিঠি লিখেই সন্তুষ্ট থাকবে, নাকি তারা কোন প্রতিবাদ পত্র পাঠাবে?

সর্দার শরন সিংঃ প্রতিবাদ পত্র পাঠানোর কোন প্রয়োজন নেই। আমি আমাদের কথাগুলো অত্যন্ত স্পষ্টভাবে জানিয়েছি। জাতিসংঘ ফোরামে প্রতিটি দেশই তাদের বক্তব্য জানাতে পারে। আমরা সেখানেই আমাদের বক্তব্য রাখব, এবং এ বিষয়ে প্রতিবাদ পত্র পাঠানোর কোন পরিকল্পনা আমাদের নেই।

শ্রী এন। শ্রী রামা রেড্ডিঃ এধুরনের ঘটনা শুধুই সুচনা। আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রামে আছি। আমাদেরকে চীন প্রতিনিধির উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ বিবেচনা করতে হবে।

সর্দার শরন সিংঃ জি জনাব, আমরা তাইই করেছি। এবং আমি আমাদের সম্মানিত সদস্যের প্রতিটি বক্তব্যও গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছি।

শ্রী ভুপেশ গুপ্তঃ চীন আমেরিকার সাথে ভাল সম্পর্ক বজায় রাখুক, আমাদের তাতে কোন আপত্তি নেই, কিন্তু তা যেন রাশিয়ার বিরোধিতার উপর ভিত্তি করে না হয়। বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশ্বের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে এমন কারো পক্ষে বাংলাদেশের এই আন্দোলনের বিরোধিতা করা ও ইয়াহিয়া খানের সমর্থন করা সম্ভব না। এটি আমাদের সবারি দায়িত্বশীলতার একটি বিশাল পরীক্ষা। আমি দেখেছি যে বর্ডার এরিয়াতে মুক্তিবাহিনী রাজাকারদের কাছ থেকে চায়নিজ অটোমেটিক রাইফেল বাজেয়াপ্ত করছে। মাও বলেছিলেন, বন্দুকের নল শক্তির উৎস। এখন মনে হচ্ছে বন্দুকের নলের এই শক্তি ইয়াহিয়া খান তার শক্তি অক্ষত রাখার কাজে ব্যবহার করে যাচ্ছেন। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ থিওরি কাজে আসছেনা।

যদি সরকার সম্পর্ক স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে চায়, তবে তা ভাল। যদি নিতীমালা অনুযায়ী করা হয়, তবে এর মধ্যে কোন ভুল নেই। যেমনটি তিনি বলছেন, আমাদের উস্কানিতে ভুললে চলবে না। আমি এই বিষয়ে মন্ত্রিসাহেবের সাথে সম্পূর্ণ একমত যে আমাদের মনে রাখতে হবে যে ইয়াহিয়া খান তার নীলনকশার বাস্তবায়ন করার জন্যই এর ফায়দা লুটতে চাইবে। এটাও মনে রাখতে হবে যে ভুট্টোর চায়না সফরকালে তিনি আশানুরূপ ফলাফল পাননি। সারা পৃথিবীর সাংবাদিকরা সে সফরে গিয়ে বলেছেন, ভুট্টো কিছু পাননি। এমনকি কোন আশ্বস্ততাও না। আমি এটাতে বেশি গুরুত্ব দিতে চাইনা। কিন্তু আমার মনে হয় চায়না কিছু অন্তর্বর্তী সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আমরা লিন পিয়াও এবং অন্যান্য অন্তর্বর্তী শক্তিগুলোর মধ্যকার কোন্দলের কথা শুনেছি। আমাদের পলিসি নেয়ার আগে এসকল বিষয়গুলোই বিবেচনা করতে হবে। আমার বন্ধু সদস্য সরকারকে তাদের ক্ষতি বিষয়ে উদ্বিগ্ন হতে বলেছেন। আমি, সরকার এক্ষেত্রে যে অবস্থান নিয়েছে, তা সম্পূর্ণ সমর্থন করি এবং আমি আশা করবো, আমার সহকর্মীর উপদেশ না শুনে সরকার এ বিষয়ে জ্ঞান ও ধৈর্যের পরিচয় দিবে। আমি একটু অবাক হয়েছি। যখন ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তি আসলো, আমার বন্ধু তখন চীনের সাথে বন্ধুত্ব চাচ্ছিলেন। যদি রাশিয়া হয়, তবে চীন কেন নয়, এই ছিল তার মনোভাব। আজ তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলছেন। আমি জানিনা, এর মানে কি। আমি বিশ্বাস করি সর্দার শরন সিং একজন অত্যন্ত বিজ্ঞ ব্যক্তি এবং বর্তমান এই কঠিন পরিস্থিতিতে পারলামেন্ট থেকে তাকে যথাসম্ভব সমর্থন জানানো প্রয়োজন। এসময়ে আমাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার মনোভাব পরিত্যাগ করা উচিত। বাংলাদেশের মানুষ ও জাতীয় স্বার্থের কথাই মুখ্য হওা উচিত যখন আমরা বৈদেশিক পলিসি বিষয়ে বা বিশ্বব্যাপী চলমান ঘটনাসমুহ বিশ্লেষণ করবো।

শ্রী থিল্লাই ভিল্লালানঃ জনাব, আমি শুধুমাত্র একটিই প্রশ্ন করতে চাই। যে তির্যক বক্তব্য চিনা প্রতিনিধি জাতিসঙ্ঘে দিয়েছেন, তা বহুবছর ধরে আমরা যে ভাবমূর্তি তৈরি করে এসেছিলাম, তা ধংস করে দিয়েছে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, সারা বিশ্বে এ বক্তব্যের কি প্রতিক্রিয়া হয়েছে? আমি স্পষ্টভাবে জানতে চাই যে এর ফলে যেসব দেশ আমাদের সমর্থন করছিল, তাদের চিন্তায় কোন পরিবর্তন এসেছে কিনা।

সর্দার শরন সিংঃ জনাব, আমাদের জানামতে, আমাদের সমর্থন করে এমন কোন দেশের আচরনে কোন ধরনের পরিবর্তন আসেনি। কেউ বলেনি যে এই ঘটনা সম্পর্কে তাদের মুল্যায়ন বা চিন্তাধারায় কোন পরিবর্তন হয়েছে। এই বক্তব্যের সুত্র ধরে কোন পরিবর্তনের কথা কেউ আমাদের জানায়নি।

শ্রী পিতাম্বর দাসঃ মহোদয়, একটি ছোট্ট কথা আমি জিজ্ঞেস করবো। চীন আমাদের প্রতিবেশি, পাকিস্তানও আমাদের প্রতিবেশি। প্রতিবেশীর সম্পর্ক বজায় রাখা নিজের জন্য লাভজনক হয় এবং সকলেই চায় ভাল সম্পর্ক থাকুক, এটাই স্বাভাবিক। আমাদের দুর্ভাগ্য প্রতিষ্ঠাকাল হতে পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা স্বত্বেও সম্পর্ক ভাল হচ্ছেনা। পাকিস্তান আমাদেরকে এক নম্বর শত্রু বলে অভিহিত করেছে। এবং যখনি সুযোগ পেয়েছে আমাদের বিরুদ্ধে প্রচারনা চালিয়েছে। চীনের সঙ্গে আমাদের মিত্রতার সম্পর্ক ছিল, আর এমন দিন ও এল যখন সে সম্পর্ক ছিন্ন হল। ১৯৬২ সালে আমাদের উপর যখন আক্রমন করা হয় তখন এই পরামরশ দেয়া হয়েছিল যে চীনা আক্রমনকালে পাকিস্তানের সঙ্গে যেকোন ভাবে মিত্রতার সম্পর্ক গড়ে রাখা হোক কেননা দুই প্রতিবেশীর সাথে যুগপৎ ভাবে বিবাদ করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। সেটি কারো কাম্যও নয়। এতদুর পরামরশ দেয়া হয়েছিল যে যদি পাকিস্তানকে কাশ্মীর দিয়েও খুশি করা যায় তবু ভাল কেননা চীনের সঙ্গে বিবাদ আছে। অতঃপর যখন পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের বিরোধ হল, তখন এতদুর পর্যন্ত বলা হল যে আক্সায়ে চীন সম্পর্কেও আলোচনা করা হোক। আমি একথা বলছিনা যে, কেউ চিনকে আক্সায়ে চীন দিয়ে দিতে বলেছে (আমি অতদুর যাব না)। হ্যা আক্সায়ে চীন প্রশ্নে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় যদি কাজ চলে তবে সম্পর্কের পুনরুদ্ধারের জন্য সেটি অত্যন্ত ভাল কাজ হবে। এই পরামর্শ রাখা যায়।

অতএব আমি বলতে চাই, এই দুই প্রতিবেশীর মধ্যে চীনের সঙ্গে যখন আমাদের বিরোধ বাধে তখন কিছু না কিছু নিয়ে দিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে চলুন, আর যখন পাকিস্তানের সাথে বিরোধ আসন্ন তখন চীনের সঙ্গে আপোষ করে সম্পর্ক রেখে চলুন। আমরা যখন এই আবর্তে পড়ে গেছি তখন তা থেকে বের হবার জন্য আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রী কি ভাবছেন এবং তার পরামর্শ কি?

সর্দার শরন সিংঃ জনাব, সম্পর্কের উন্নয়ন করতে গিয়ে আমরা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান থেকে সরে যাব, এমন কোন পলিসি আমরা গ্রহন করিনি। অবস্থান পরিবর্তন করা একটি ভুল প্রচেষ্টা এবং এছারাও সম্পর্কের উন্নয়ন সম্ভব।

শ্রী পিতাম্বর দাসঃ সেটি মতবাদের বিষয়।

সর্দার শরন সিংঃ এটি সিদ্ধান্তের বিষয়। পার্লামেন্ট এবং সরকারের সিদ্ধান্ত। মুখ্য বিশয়গুল সবসময়ি আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করা সম্ভব। আলোচনা এভাবেই হয়। যেকোন অবস্থায় বা সময়েই এমন উপদেশ দাওয়া ভুল হবে যে কাশ্মীর বিষয়ে আমরা আমাদের অবস্থান থেকে সরে গিয়ে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটান বা তার পরিকল্পনা করবো। এটি সম্পূর্ণভাবে একটি অনৈতিক উপদেশ। আমরা কখনই এই পরিকল্পনা করবো না। আমরা সবসময় কাশ্মিরকে ভারতের অন্তর্বর্তী অংশ ভেবে এসেছি। এই বিষয়ে কোন ব্যত্যয়ের সুযোগ নেই। এমনকি এখন যখন চীনের সাথে একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিবেশির সম্পর্ক স্থাপন করতে চাচ্ছি, আমাদের সরকারের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে, এবং চাইলে সরকার তা পরিবর্তন করবে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বা উদ্দেশ্য আমাদের প্রতিবেশি বিষয়ে বেশ স্পষ্ট, যে আমাদেরকে আমাদের মধ্যকার সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। কিন্তু তা আমাদের অবস্থান বজায় রেখেই করতে হবে এবং এই উদ্ভুত সমস্যাগুলোর জন্য আমরা পলিসির এই উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হবনা। এই সমস্যাগুলো অসম্ভব বাস্তব, কখনও অসহ্য, কিন্তু বিষয় হচ্ছে কিছু ক্ষেত্রে আমাদের জন্য সম্মানজনক উপায়ে আমাদের পলিসি বাস্তবায়ন এবং লক্ষ্য অর্জন করা বেশি জরুরি হয়ে পড়ে। এবং সেটি আমাদের স্বার্থ পরিত্যাগ করা ছাড়াও করা সম্ভব।

মিঃ ডেপুটি চেয়ারম্যানঃ মিঃ পুরি, শেষ প্রশ্ন।

শ্রী দেভ দত্ত পুরী (হরিয়ানা)ঃ প্রথমত আমি সদস্যের অনুরোধ জানাবো এমন সময়ে এত স্পর্শকাতর বা এত খুদ্র মন-মানসিকতার পরিচয় না দিতে, যখন আমরা দেখছি যে চীন আমাদের সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করছে, এবং এ বিষয়ে আমরা এতই কাতর হয়ে পরেছি যে আমরা আমাদের এলাকাসমুহ বিক্রয় করা, বা এমন আরো অনেক ধরনের পরিকল্পনা করা শুরু করবো। একি সাথে আমি সরকারের কাছে থেকে পরিষ্কার, স্পষ্ট নিশ্চয়তা চাই যে তারা বাংলাদেশের করা পাকিস্তানের এই অরাজকতার দরুন, তাদের একঘরে করার প্রক্রিয়া চালিয়ে যাবে, চীন যাই বলুকনা কেন। এই নিশ্চয়তা আমি সরকারের কাছ থেকে চাই। একি সাথে আমি জানতে চাই, যে হতে পারে ঐ তাইওয়ানিজ ব্যাক্তিরা অন্যায় পন্থায় তাদের ভিসা নিয়েছে, কিন্তু কোনভাবে কি তাদের ভুল সংশোধনের সুযোগ দেওা যাবে না?

সর্দার শরন সিংঃ স্যার প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলছি, আমার মনে হয়, পাকিস্তানি সেনা শাসকদের এই অত্যাচার তাদের নিজেদের জনগণেরই গনতান্ত্রিক অধিকারকে দমন করছে, যার কারনে আজ পাকিস্তান একঘরে হয়ে পরেছে। পৃথিবী পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পেরেছে এবং পাকিস্তানি মিলিটারির পক্ষে সমর্থন খুবি নগন্য। মুলত একারনেই তারা একঘরে।

এবং আমার মনে হয় পাকিস্তানকে সমর্থন করে যে বক্তব্য দেয়া হয়েছে, আন্তর্জাতিক মহলে তা গৃহীত হবেনা, কেননা তারা নিজস্ব উপায়ে ঘটনাবিবরন প্রত্যক্ষ করে গেছে। এবং আমার মনে আন্তর্জাতিক মহল বাংলাদেশের এ পরিস্থিতিতে কি জরুরী সে বিষয়ে পরিষ্কার ধারনা রাখে।

আর তাইওয়ানিজদের বিষয়ে আমি বলবো, যে এই বিষয়ে আমরা কখনই অসহায় নই। আমরা চাইলে তাদের বের করে দিতে পারতাম, কিন্তু তাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং তারা দেশ ত্যাগ করে চলে গিয়েছে ইতিমধ্যে।

.

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২০৮। সাম্প্রতিক বিদেশ সফরের উপর আলোচনাকালে প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি দি ইয়ার্স অফ এন্ডেভার ৩০ নভেম্বর ১৯৭১

Raisa Sabila
<১২, ২০৮, ৭২৮-৭৩১>
অনুবাদ
সম্মিলিত উদ্যোগ

আমি আমার বক্তব্য নিয়ে কথা বলছিনা, যদিও সেটাই এখন মুল বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে, কেননা, আমি যখন বাইরে ছিলাম, তখন আমি দেখেছি যে যখন সম্মানিত সদস্যগন কথা বলেন, তারা এই বিশয়গুলো নিয়েই কথা বলেন, যা নিয়ে আমিও চিন্তা-ভাবনা করছি। আমার ভ্রমন বিষয়ে যা বলার ছিল, তা ইতিমধ্যে আমি আমার জবানবন্দীতে বলেছি, এবং আমার মনে হয়েছে এ বিষয়ে আর নতুন করে প্রশ্ন করার অবকাশ নেই। এখন বাড়িতে বসে আমি দেখতে পাচ্ছি, যে এবিষয়ে ধারনায় সকলেরই একটা মৌলিক একাত্মতা আছে এবং একটি সাধারন সমর্থন ও রয়েছে। আমার মনে হয়, এ বিষয়ে যেসকল সম্মানিত সদস্যগন বক্তব্য রেখেছেন্, তাদেরকে আমার ধন্যবাদ দাওয়া প্রয়োজন। আমি আমার পুরনো বন্ধু শ্রী বদুভাই চিনয় এবং শ্রী প্রনব কুমার মুখারজীকে ধন্যবাদ দিতে চাই, যারা এবিষয়ে এই মুহূর্তে কথা বলেছেন এবং পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করছেন। প্রফেসর রুথনাসোয়ামী ও এ বিষয়ে কথা বলেছেন, কিন্তু তিনি তার সতন্ত্র ধ্যানধারণা থেকেই কথা বলছেন।

ডঃ ভাই মহাভির কিছু সমালোচনা করেছে, যা একদমি অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলনা। আমি খুব সম্ভবত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে বিরক্ত করছি, এবং এখনও পর্যন্ত তার সাথে আমার কোন কথা না হলেও, যখনি তার নাম আসে, ডঃ মহাভিরের মতন আরো কিছু সম্মানিত সদস্যগন একইসাথে আমার কথাও অবিধারিতভাবে বলে থাকেন। ডঃ মহাভির আমার একটি ব্যাক্তিগত ইমেজ তৈরি করা নিয়ে কথা বলেছেন। এখন, কেউ যখন বিদেশে যায়, বিশেষত যখন কোন প্রধানমন্ত্রী বিদেশে যান, সে গনমানুষের প্রতিনিধি হয়ে যায়। তাকে কোন সম্মান প্রদর্শন করা হলে, তা ভারতকেই সম্মান প্রদর্শন করা হয়, এবং সাধারণত অন্য একটি দেশ কোন মানুষকে সম্মান প্রদরশনের মাধ্যমেই দেশকে সম্মান প্রদর্শন করে থাকেন, তা সে মানুশটি কোন সাধারন নাগরিক বা বিজ্ঞানী, যেই হোক না কেন। কাজেই আমার মনে হয়না যে যদি আমাকে কোন সম্মান প্রদর্শন করা হয়ে থাকে, বা আমি কোন ব্যাক্তিগত ইমেজ তৈরি করে থাকে, তা দেশের কোন মানুষ আলাদাভাবে নেয়ার কোন সুযোগ আছে, বরং তা অবশ্যই দেশকে সম্মান প্রদর্শন করার জন্যই এবং আমি আগেও তাই বলেছি। সুতরাং সেদিক থেকে দেখলে, আমাকে সম্মান প্রদর্শন করা মানে সরাসরি দেশকেই সম্মান প্রদর্শন করা।

ডঃ ভাই মহাভির আরো একটি বিষয়ে সমালোচনা করে বলেছেন, আমরা ভুল সময়ে পিছিয়ে এসেছি। আমার মনে হয় কিছু সম্মানিত সদস্য তার কথা যথেষ্ট মনোযোগ দিয়ে শুনেনি, যেমনটা তাদের শোনা উচিত ছিল, এবং তিনি সমালোচনা করলেন যে তাদের যখন ধৈর্য ধরা উচিত ছিল, তখন তাড়া অধৈর্য ছিলেন এবং সরকার ও তখন ধৈর্যশীল রুপধারন করলো যখন তার অধৈর্যশীল হওয়ার কথা ছিল। আমিও এবিষয়ে তার সাথে একমত যে কিছুক্ষেত্রে সম্মানিত সদস্যগন ধৈর্যশীল হতে পারতেন, কিন্তু আমার মনে হয় সরকার সবসময়ই নিয়ন্ত্রিত এবং ধৈর্যশীল হতে হবে, বিশেষত যখন কোন সরকার তার নিজের এবং তার জনগনের উপর পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করতে পারে। আমার মনে হয় না সীমান্তের ওপারের বন্ধুরা তাদের ধৈর্যের অভাব, তাদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য, হুমকি এবং উস্কানি থেকে খুব বেশি কিছু অর্জন করতে পেরেছে এবং আমার মনে হয় তাদের এহেন আচরন আমাদের জন্য ভালোই করেছে; কেননা তারা আমাদেরকে আমাদের লক্ষ্য থেকে একচুল সরাতে পারেনি, আমরা ঠান্ডামাথায় তাই করেছি যা আমাদের দেশের জন্য মঙ্গলজনক।

অবশ্যই যেকেউই রেগে যাবে, তাদের কথার জন্য নয়, বরং বাংলাদেশে যা ঘটছে সেটার জন্য। একজন মানুষ রেগে যাবে, কেননা আমাদের কাছে মনে হয় এই অনাকাঙ্খিত ট্র্যাজেডির কোন প্রয়োজন ছিলনা। লক্ষ লক্ষ মানুষ এখানে জীবন দিয়েছে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে। শুধুমাত্র যারা আমাদের শরণার্থী শিবিরে এসেছেন, তারা নন, যেসকল বিদেশি সাংবাদিক সেখানে কাজ করছেন, যারা ঢাকায় গিয়েছেন, তারাও বলছেন যে গোটা দেশই একটি শরণার্থী শিবিরে পরিনত হয়েছে। বিশালাকারে মানুষের দল শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে পাড়ি দিচ্ছেন এবং কেউ জানেনা, কে কোন গ্রামের বাসিন্দা। যখন তাদের এক এলাকায় হয়রানি করা হয়, কিংবা তারা কোন শুন্য গ্রাম দেখতে পান, কিংবা শুন্য কোন গ্রামের একাংশ, তারা সেখানে বসতি স্থাপন করেন, কিংবা তারা জানতে পান যে তাদের আর সেখানে আশ্রয় হবেনা এবং তারা সরে যেতে বাধ্য হন। সুতরাং সেখানে বেশ একটা অস্থির অবস্থাই বিরাজ করছে, কিন্তু আমি বলব জনসঙ্ঘের কাজ করার একটা নিজস্ব তরিকা আছে এবং সকলেই এই তরিকাকে স্বাগতম জানিয়েছেন। আমার মনে হয় সকলেই দেখেছেন যে অতীতে এই তরিকা আমাদের জন্য কি সম্মান বা সাফল্য বয়ে এনেছে। আমরা একটু ভিন্ন পন্থায় কাজ করি এবং আমার মনে হয় আমি এই পন্থাতেই কাজ করে যাব কেননা এটি অধিক সম্মানজনক এবং আমাদের জন্য সুফল বয়ে আনে।

এটি ছিল একটি বিষয়। আমার মনে হয়, প্রফেসর রুথনাসোয়ামী বলছিলেন যে ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তিটি প্রধানমন্ত্রীর লাগেজে প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ে আছে। আমি জানিনা, কে প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ে আছে, তবে এটি আমাকে কোন প্রতিবন্ধকতায় ফেলেনি, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। কোন বিদেশি কর্মকর্তা, বা রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার, যাদের সাথে আমার ইতিমধ্যে দেখা হয়েছে, এ বিষয়ে প্রশ্ন করেননি। সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নের সম্মুখীন করা হয়েছে, কিন্তু কাউকেই এই বিষয়ে খুব বেশি চিন্তিত মনে হয়নি। আমার মনে হয় তারা পরিস্থিতি বুঝতে পেরেছেন, কেউ কেউ এওন কথা বলে থাকতে পারেন, কিন্তু আমার মনে হয়না ভারত তার পলিসিতে কোন পরিবর্তন করেছে বা করতে যাচ্ছে। আমার ধারনা অন্যান্যরা আমাদের উপর এত বেশি বিরক্ত একারনেই হয় কারন তারা জানে যে এই একটি সরকার আছে, যারা কোন অবস্থাতেই তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেনা।

শ্রী চ্যাটারজী আমার শরণার্থীদের জন্য বিদেশী অর্থসাহায্য চাওয়ার বিষয়ে জোর দেয়ার বিষয়ে কথা বলেছেন। এই বিষয়টিও আমি সবখানে বুঝিয়ে বলেছি। আমি কখনই বিদেশী অর্থসাহায্য চাইনি। আমি এবিষয়ে একটি সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেছিলাম। আমি বলেছি যে আন্তর্জাতিক সংস্থারা এক্ষেত্রে খুবি নগন্য সাহায্য করেছেন, এবং এমন একটি সহজ প্রশ্নের উত্তর আমি অবশ্যই দিবো। কিন্তু আমি কখনই কোন বিদেশী অর্থসাহায্যের কথা বলিনি, বা কোন সরকারকে তা দিতেও বলিনি। আমরা তাদের বলেছি, তাদের জাতীয় স্বার্থ তাদেরকেই নির্ধারণ করতে হবে, আমরা তা নির্ধারণ করে দিতে পারবনা। কিন্তু আমরা অবশ্যই বলেছি যে এই উপমহাদেশে যা ঘটছে তার ফল শুধু এশিয়া নয়, সাড়া পৃথিবী ভোগ করবে। আমার মনে হয়, ভবিষ্যতে সকল দেশই এর ফল ভোগ করবে এবং এমুহূর্তে পরিস্থিতি অনুধাবন করা তাদের জন্য খুবি জরুরি, সেইসাথে আরো জরুরি হচ্ছে পরে এবিষয়ে মাথা না ঘামিয়ে এখনি এবিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া।

শ্রী চ্যাটারজী আরো কিছু বিষয়ে কথা বলেছেন, আমি জানিনা আমি তাকে ভুল বুঝেছি কিনা। তিনি কি একথা বলেছেন যে মুক্তিবাহিনী কিংবা যারা যুদ্ধ করছে, তারা পাকিস্তানের কাছ থেকে সমাধানের আশা করছে? আমার মনে হয়, শুধু মাত্র বাংলাদেশের জনগণই এবিষয়ে কথা বলার অধিকার রাখে যে তারা কি চায় এবং তারা জানে তারা কি চায়। আমার মনে হয় না, আমি তাদের হয়ে একথা বলতে পারি যে সমাধান কি। যতদুর আমার মনে হয়, আমি শুধুমাত্র আমার মতামত দিতে পারি। যেমন আমি মতামত দিয়েছি যে তাদের উচিত না স্বাধীনতার চেয়ে কম কোন সমাধানে একমত হওয়া। আমি তাদের খুব স্পষ্টভাবে বলেছি যে যদি তাদের কোন আলোচনা করতে হয়, তবে অবশ্যই তা বাংলাদেশের মানুষের নির্বাচিত গনপ্রতিনিধিদের সাথে হওয়া উচিত। আমি কোনভাবেই নতুন যেসব বিরোধিতার মুখেই ক্ষমতায় বসতে চাচ্ছেন, তাদের কথা বলিনি। সুতরাং, আমরা পুরো সময়ই মুল এবং মৌলিক বিষয়ে কথা বলে আসছি এবং মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছি। পাকিস্তান পুরো সময়ই এবিষয়টিকে একটি ভারত-পাকিস্তান ইস্যু বলে আসছে, এবং এবিষয়টিকে আন্তর্জাতিক একটি বিতর্কে রুপ দিতে চাচ্ছে। আমাকে সবখানেই এবিষয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে। সবখানেই তারা বলছেন যে যদি আপনারা বা আপনার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা কোন প্রতিনিধি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে কথা বলেন, তাহলে এবিষয়ের সমাধান হবে। আমি তাদের উত্তরে বলতে চাই যে তারা আমাদের দেশ নিয়ে কথা বলছেনা, এবং অন্য দেশের মানুষের ভাগ্যে কি ঘটবে সে বিষয়ে আমি কথা বলতে পারিনা, বা আমি তা নিয়ন্ত্রন করতে পারিনা। স্বাভাবিকভাবেই আমাকে বলতে হবে যে শেখ মুজিবর রহমান তাদের অবিসংবাদিত নেতা এবং তিনিই তাদের প্রতিনিধি হয়ে তাদের বিষয়ে কথা বলতে পারেন এবং আমি একি সাথে যোগ করতে বাধ্য হয়েছি যে গনমানুষের কথা বলতে হলে তাকে অবশ্যই মুক্তি পেতে হবে। তাকে অবশ্যই জানতে দিতে হবে যে বাংলাদেশে কি ঘটছে। কি ঘটছে বা কি ঘটে গেছে, তা জানার আগে তিনি কিছুই বলতে পারবেন না। সুতরাং পুরো বিষয়টা প্রতিরক্ষা কাউন্সিলে নিয়ে আসার এ উদ্যোগ আমার মনে হয় গোটা বিষয়টাকে একটা দ্বন্দ্বের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। কাজেই যারা এ উদ্যোগ নিচ্ছেন, তাদেরকে ভারতের জনগণ অবশ্যই সন্দেহের চোখে দেখবে।

কাশ্মির অবশ্যই ততখানিই ভারতের অংশ, যতখানি গুজরাট, মহারাষ্ট্র বা দেশের অন্য কোন অংশ, সুতরাং সেখানে কোন ধরনের কোন আক্রমনের জবাব ততখানিই নিষ্ঠার সাথে দেয়া হবে, যতখানি দেশের অন্য কোথাও আক্রমন হলে দেয়া হত। আমার আগে যেই সম্মানিত সদস্য বক্তব্য দিয়েছেন, তিনি সংক্ষেপে বলেছেন যে পূর্বের যুদ্ধের সময়, ১৯৬৪ বা ১৯৬৫তে কি ঘটেছে এবং কেন সেখানে পর্যাপ্ত সৈন্য মোতায়েন ছিলনা। গুজ্জার এর সাধারন মানুষ, কৃষকরা বা সাধারন খেটে খাওয়া মানুষ সেসময় আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তারাই আমাদেরকে প্রথম সংবাদ দেন যে মানুষ আসছে এবং আমাদের সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারনা ছরাচ্ছে। তারা আমাদেরকে সকল সংবাদই দিয়েছে। তাদের জন্যই আমরা নিয়ন্ত্রন করতে পেরেছি, এবং এই দখলদারিত্ব কে ঠেকিয়ে দিতে পেরেছি, যদিও আমি এটাকে দখল বলবনা, কেননা যারা দখল করতে এসেছিল তারা চুরি করে ঢুকেছিল। এখনও ভারতের বিপক্ষে রাগ কমেনি তাদের। যেমনটি আমি আমার আগের বক্তব্যে বলেছি যে ভারতকে এখন নতুন উপায়ে আক্রমন করা হচ্ছে। পাকিস্তানী আর্মি আমাদের ভূখণ্ডে একত্রিত হয়নি ঠিকই, কিন্তু যখন আরেক দেশের মানুষ এত বেশি পরিমানে আমাদের ভূখণ্ডে আশ্রয় নিচ্ছে, তখন আমি এটাকে বিকল্প ধরনের দখলদারিত্বই বলব। যদিও, তাদের বেশিরভাগ মানুষই ভুক্তভোগী শরণার্থী।

অবশ্যই তাদের মধ্যে যারা আসলে শরণার্থী নয়, তাদের আগমন আমার দেশের নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করে, এবং আমার দেশের স্থিতিশীলতাকে দুর্বল করে। সুতরাং সকল বিষয় বিবেচনা করে বলা যাত যে তারা আমাদের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে এবং এটি এক নতুন ধরনের আক্রমন। আমরা নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রনে রেখেছি, কিন্তু আমরা একি সাথে কিছু পাকিস্তানী বন্দুককেও থামিয়ে দিয়েছি, আমরা তাদের ট্যাংকের সাথে লড়াই করেছি, তাদের জঙ্গি বিমানগুলোকে মাটিতে ধরাশায়ী করেছি। কিন্তু আমরা কোনভাবেই তাদেরকে কোন হুমকি দেইনি। কিন্তু আমরা কোনভাবেই আমাদের প্রতিবেশীদের উপর তাদের নির্বিচারে হত্যা মেনে নিতে পারিনা। আমি বলতে চাচ্ছি যে পৃথিবীর মানুষকে এটা খুব পরিষ্কারভাবে বুঝে নিতে হবে। এখানে কোন সমান ক্ষমতাসম্পন্ন দুই বাহিনী লড়াই করছেনা, লড়াই করছে মুক্তিবাহিনি এবং পশ্চিম পাকিস্তানী আর্মি। একটি সম্পূর্ণ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত বাহিনী লড়াই করছে এমন কিছু মানুষের সাথে যাদের হয়তো প্রশিক্ষণ দাওয়া হয়েছে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস বা পূর্ব পাকিস্তান রেজিমেন্টের মাধ্যমে। এদের অনেককেই দ্রুত প্রশিক্ষন দিয়ে যুদ্ধে পাঠানো হয়েছে, যে প্রশিক্ষণ এই দুই প্যারা মিলিটারি ফোরসের নেতাগন বিভিন্ন ক্যাম্প এ দিয়ে থাকেন। কিন্ত কোনভাবেই তাদেরকে পশ্চিম পাকিস্তানী আর্মির সমকক্ষ বলা যাবেনা। এবং আমরা কোনভাবেই এবিষয়ে সমর্থন দিতে পারিনা যে শুধু মুক্তিবাহিনী নয়, বরং নিরস্ত্র সকল বাঙালি ও বাংলাদেশের মানুষকে হত্যা করা দরকার। যদিও, একথা সত্যি যে এধরনের ইছু ঘটলে, বা যা আংশিকভাবে হচ্ছে, তা কোনভাবেই আমাদের জন্য সুফল বয়ে আনবে না, বরং আমাদের জন্য একটা হুমকির কারন হয়েই দারাবে।

পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের সীমান্তের দিকে অগ্রবর্তী হওয়ার পর পশ্চিম দিকে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া আমরা আর কোন পদক্ষেপ নেইনি। যদিও যেমনটি আমি বলেছি, আমাদের স্বাধীনতায় কোন ধরনের হুমকি আসলে, আমরা তার মোকাবেলা করবো, এবং অবশ্যই আমরা বর্তমানে যা ঘটছে, তাকে একটি হুমকি হিসেবেই ধরে নিচ্ছি, এবং অবশ্যই আমরা এই হুমকিকে আমাদের জাতীয় ভিত্তির বিপক্ষে ধরে নিচ্ছি।

আমাদেরকে আমাদের বাহিনীকে সরিয়ে নেয়ার উপদেশ দেয়া হয়েছে বলে আপনারা হয়ত শুনে থাকবেন। আমি অন্যান্য ফোরামে ইতিমধ্যে বুঝিয়ে বলেছি যে কেন আমরা আমাদের বাহিনী সরিয়ে নিতে পারছিনা, আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা, ক্যান্টনমেন্ট, সকলি সেখানে অবস্থিত এবং আমরা সেখানে অসরতক অবস্থানে থাকলে, তা পাকিস্তানের জন্য কাশ্মীর দখলের ক্ষেত্রে একটি বিরাট ফায়দার ব্যাপার হবে। আমরা সেই ঝুকিটি নিতে পারবো না। কিন্তু আমার মনে হয়, অনতিবিলম্বে যে বাহিনীর সরে যাওয়া উচিত তা হল বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীর সরে যাওয়া এবং তারা সেটি করলে আমরা অবশ্যই তাদের স্বাগত জানাব। তারা তাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে আছেন, তারাও কষ্ট করছেন এবং আমার মনে হয় পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের পরিবার-পরিজনের কাছে তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া উচিত। আমার মনে হয়, এটিই হবে পশ্চিম পাকিস্তানী সরকারের একটি ইতিবাচক সাড়া যে তারা বাংলাদেশ বিষয়ে সমাধান চায়। এটি হবে শান্তি স্থাপনের অন্যতম একটি পদক্ষেপ। একি সাথে আমার এটাও মনে হয় যে পাকিস্তানি বাহিনির বাংলাদেশে মোতায়েন থাকাটা আমাদের দেশের নিরাপত্তার জন্যও একটি হুমকির বিষয়। আমার মনে হয়, আমি বেশিরভাগ বিষয়ের উত্তর দিয়েছি। বর্তমানে আপনারা জানেন যে মুক্তিবাহিনী অত্যন্ত বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করছে। এ যুদ্ধ অত্যন্ত কঠিন, কিন্তু তারা সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করছেন, এবং আমরা তাদেরকে পূর্ণ সমর্থন জানাই এবং অভিনন্দন জানাই। ভবিষ্যতে কি আছে তা কেউই বলতে পারবে না, কিন্তু আমি আগেও বলেছি যে বর্তমান পরিস্থিতি এত সহজে সমাধান হবেনা। যাই ঘটুকনা কেন, আগামী মাসে আমরা যেই পদক্ষেপই নেইনা কেন, তা আমাদের এবং বাংলাদেশের মানুষ উভয়ের জন্যই অনেক কঠিন হবে। আমাদেড় ধরে নিতে হবে যে কোন সমাধান নেই, কোন জাদুই পারে শরণার্থীদের এই কষ্ট লাঘব করতে বা তাদের বোঝা থেকে আমাদের মুক্তি দিতে। শুধুমাত্রই প্রার্থনা দ্বারা তা সম্ভব নয়। আমি আনন্দিত যে এই বিষয়ে আমরা একমত। শ্রী চ্যাটারজি তার পার্টিকে আলাদা করে ফেলা বিষয়ক কিছু একটা বলছিলেন। আমি তাকে নিশ্চয়তা দিতে চাই যে এধরনের কোন উদ্দেশ্য আমাদের নেই। কিন্তু পশ্চিম বাংলায় এধরনের কিছু ঘটনা ঘটেছে। আমি আনন্দিত যে বর্তমানে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, এবং একবার যদি শান্তি স্থাপিত হয়, তবে কারো পক্ষেই অন্যের ক্ষতি করা সম্ভব হবে না। এখন এমন একটি সময় যখন সকল পার্টিকে একত্রিত হতে হবে কেননা, ভারতের মানুষের উপর যে দায় চাপানো হয়েছে, তা বিশাল। যে চ্যালেঞ্জ এবং প্রতিবন্ধকতা আমরা মোকাবেলা করছি, তা অত্যন্ত কঠিন। এটি মোকাবেলা করতে আমাদের সকল শক্তি, সম্পদ, ঐক্য এবং আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ঝাপিয়ে পরতে হবে। আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে যে সকল পার্টিই এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সাড়া দিবে এবং আমাদের এবং বাংলাদেশের মানুষের জন্য বিদ্যমান এই ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের সময় থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারব। আমরা নিজেরাও এথেকে বের হয়ে আসতে পারব, এবং তাদেরকেও নতুন জীবন দান করতে পারব।

.

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২০৯। পাকিস্তান কর্তৃক যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বিবৃতি রাজ্যসভার কার্যবিবরণী ০৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১

Nusrat Jahan Ima
<১২, ২০৯, ৭৩২-৭৪৯>
অনুবাদ
রাজ্য সভা
শনিবার ৪ঠা ডিসেম্বর, ১৯৭১/ ১২ ই অগ্রহায়ন, ১৯৮৩

সকাল ১১ টায় কার্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়

(সভাপতি চেয়ারে বসে আছেন)
দেশের বর্তমান পরিস্থতি নিয়ে মন্ত্রীর বক্তব্য

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী (শ্রী জগজীবন রাম)-সংবাদ অনুসারে আজ সকালে পশ্চিম পাকিস্তান সরকার আমাদের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।

গতকাল সন্ধ্যায় পশ্চিম পাকিস্তানি বিমান বাহিনী উদ্দেশ্যমুলকভাবে আমাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে এবং আমাদের বেশ কিছু বিমান ঘাঁটি আক্রমণ করে। একইসাথে পশ্চিম সীমান্তে তাদের স্থল বাহিনী আমাদের পজিশনে গোলাবর্ষন করে। তাদের প্রোপাগান্ডা মিডিয়া সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন অভিযোগ এনেছে যে ভারত তাদের হামলা করেছে।

সংবাদটি আমার কাছে এবং প্রধানমন্ত্রীর নিকট পৌঁছেছে এবং প্রধানমন্ত্রী কোলকাতা থেকে ফিরে আসা মাত্র আমরা আমাদের সতীর্থ এবং বিরোধীদলীয় নেতাদের নিয়ে পরামর্শ সভা করেছি। আমরা সবাই পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে একমত হয়েছি যে, জাতির স্বাধীনতা রক্ষা করা জরুরি এবং সর্বসম্মত হয়েছি যে- আক্রমণকারীকে প্রত্যাঘাত করা হবে। আমি নিশ্চিত সামনের কঠিন দিনে আমাদের মধ্যে একই ধরনের সংহতির অনুভূতি ক্রিয়াশীল থাকবে। দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। আমরা হাউসে সমবেত হয়েছি ভারত প্রতিরক্ষা বিল গ্রহনের জন্য। আফসোস এবং দুঃখ এইজন্য যে, পাকিস্তান চুড়ান্ত মুর্খতা থেকে বিরত হতে পারেনি; যখন এই উপমহাদেশের জন্য সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো উন্নয়ন তখন ভারত ও পাকিস্তানের জনগণকে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দেয়া হলো। আমরা ভালো প্রতিবেশী হয়ে কাটাতে পারতাম কিন্তু পাকিস্তানের জনগনের হাতে কখনো তাদের ভাগ্য বদলানোর চাবি ছিলো না। এখন এই উত্তেজনার মুহুর্তে আমাদের সম্মিলিত আস্থা ও বিশ্বাস আমাদের প্রভাবশালী করে তুলবে।

আমরা যুদ্ধকালীন সংসদে সমবেত হয়েছি। যে যুদ্ধ আমরা চাইনি এবং যা এড়ানোর জন্য আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি- সেই যুদ্ধ আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। যা এড়ানো সম্ভব ছিল তা আজ বাস্তবতা। পশ্চিম পাকিস্তান বেপরোয়া বেঈমানের মতো আঘাত করেছে।

ন’মাস ধরে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নৃশংসভাবে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতা এবং মৌলিক অধিকার পদদলিত করে চলেছে। দখলদার সৈন্যবাহিনী তাদের তুলনাহীন প্রতিহিংসাপরায়ণ হিংস্রতা দিয়ে ঘৃণ্য জঘন্য অপরাধ সংঘটিত করে চলেছে। লাখ লাখ মানুষকে ভিটে-মাটি ছাড়া করা হয়েছে; ১০ মিলিয়ন মানুষকে আমাদের দেশের মধ্যে ঠেলে দেয়া হয়েছে।

আমরা বারংবার বিশ্বের দরবারে মনোযোগ আকর্ষন করেছি এবং বলেছি যে এইসব মানুষের বিপর্যয় আমাদের নিরাপত্তার উপর হুমকি স্বরূপ। ভারতের অর্থনৈতিক চাপ এবং অন্যান্য বোঝা এবং বিপদসমূহের ব্যাপারে সর্বত্র সাধারণ মানুষ সমবেদনা জানিয়েছে কিন্তু সরকারকে মনে হয়েছে নৈতিকভাবে এবং রাজনৈতিকভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত। দেরিতে হলেও (সমস্যার) স্থায়ী সমাধানের জন্য যেসব পদক্ষেপ নিতে ইসলামাবাদের শাসকগোষ্ঠীকে বলা হয়েছিল, সেসবও বৃথা গেল।

পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের রাগ বৃদ্ধির কারণ বাংলাদেশের আমজনতা মান রক্ষার্থে প্রতিবাদ করেছে এবং সংগ্রাম করেছে এবং সেটা পাকি সৈন্যরা বুঝতে অক্ষম এবং এটার কারণে পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশে দমন নিপীড়ন চলছে।

যত মুক্তিবাহিনীর কার্যকারিতা বৃদ্ধি পেয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা ততো বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আমাদের ঐতিহ্য অত্যাচারীর পাশে নয় বরং নিপীড়িতের পাশে দাঁড়ানো। তাই তাদের রাগ আমাদের উপরেও পতিত হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তান বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসন প্রবল বৃদ্ধি করেছে ভারতের বিরুদ্ধে পূর্ণ যুদ্ধ করার উদ্দ্যেশ্যে।

যুদ্ধের সময় ধৈর্য এবং আত্মসংবরণ প্রয়োজন হয় ঠিক ততখানিক যতটা শান্তির সময়েও এটা প্রয়োজন হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের মিলিটারি শাসকেরা যতখানিক সম্ভব সন্দেহ ও গুজবের বীজ ছড়াবে যাতে করে এই অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এবং অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো প্রকট হয়। আসুন আমরা যেন তাদের ফাঁদে পা না দেই। আমরা অবশ্যই আমাদের যেনো একতা ও উঁচু আদর্শের লক্ষ্য বজায় রাখতে পারি।

আমাদের দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। উচ্চ উত্পাদনশীল কৃষি ও শিল্প হচ্ছে এর ভিত্তি যার উপর বাকী প্রতিরক্ষা নির্ভর করে। কৃষক, শ্রমিক, যন্ত্রবিদের এই উৎসর্গের দ্বারা জোয়ানদের সাহস এবং লড়াইয়ের যোগ্যতা কে উৎসাহিত করতে হবে এবং ব্যাবসায়িক সম্প্রদায়ের ব্যাবসায়ীদের সামাজিক দায়িত্ব হবে সম্পদের প্রতি অথবা উচ্চ মুনাফার নির্ধারন এর লোভ থেকে বিরত থাকা। আমাদের আদর্শ রক্ষার জন্য অথবা সুউচ্চ মনোবল বজায় রাখতে, দেশের শিল্পী, লেখক এবং ছাত্ররা তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমাদের দেশের নারীদের প্রতি আমার বিশেষ আবেদন, অপচয় রোধে সম্ভাব্য প্রতিটি শষ্যদানা এবং রূপি সঞ্চয় করুন। আমাদের প্রত্যেকটি আত্নত্যাগ জাতিকে করে তুলবে শক্তিশালী এবং সহিষ্ণু ক্ষমতার। সাহসী জাপানি বৈমানিক, নাবিক এবং তাদের কঠিন ও করিত্কর্মা কর্মকর্তা তাঁরা তাদের কর্তব্য পালন করবে। এবার আমরা আমদের কাজ করি।

আমরা শান্তির পক্ষে দাঁড়িয়েছি কিন্তু এই শান্তিকে রক্ষা করতে হবে। আজ আমরা লড়ছি আমাদের আঞ্চলিক অখন্ডতা ও জাতীয় সম্মান রক্ষা করার জন্য। সর্বোপরি আমরা লড়ছি সেই আদর্শের জন্য যেটা আমরা লালন করি এবং স্বাধীনতার উদ্দেশ্যে।

সভাপতিঃ আমি বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দ কে আহ্বান করব এবং বক্তব্য সংক্ষিপ্ত করার জন্য অনুরোধ করছি। জনাব গুরুপদস্বামীকে বক্তব্য দেবার জন্য আহ্বান করছি।

বিরোধিদলীয় নেতা শ্রী এম এস গুরুপদস্বামীঃ জনাব সভাপতি, দেশের এই পরিস্থিতিতে এখন আমাদের বা তাদের বলে দ্বিধান্বিত, ইতস্তত বা আমতা আমতা করার সময় এটি নয়। পাল্টা অভিযোগ বা বিভেদ করার সময় ও এখন নয়, কিংবা আমরা দেশকে জিজ্ঞেস করার বা দেশ আমাদের কি দিয়েছে সেসব বলার সময় ও এখন নয়। নিঃসন্দেহে এটা সেই সময়, যখন আমরা আমাদের নিজেদের জিজ্ঞেস করবো দেশকে এখন আমরা কি দিতে পারি এবং এই দৃষ্টিকোণ থেকে এবং এই মানসিকতা থেকেই আমি, বর্তমান মারাত্নক পরিস্থিতির দিকেই তাকিয়ে আছি যা আমাদের মুখোমুখী করেছে।

এখন আমরা একটা ভয়ানক মুহুর্তের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি এবং অবশ্যই আমি মনে করি আমাদের দেশের এ এক ঐতিহাসিক মুহুর্ত। ২৫ বছরের ছোট্ট ইতিহাসে পাকিস্তান আমাদের তৃতীয়বারের মতো আক্রমণ করেছে এবং আমি আশা করি অন্যান্য সদস্যও আমার সাথে এক আশা পোষন করবেন যে- এটাই যেন শেষ যুদ্ধ হয়।

যদি এটা যুদ্ধ হয়, তবে এই যুদ্ধই হবে ভবিষ্যতে পাকিস্তানের সাথে সব যুদ্ধের শেষ। আমি মনে করি, এই দ্বন্দ, এই মুকাবেলা, এই যুদ্ধ আমাদের নিয়তি কে রুপদান করতে, ভাগ্য সাজাতে এবং উপমহাদেশের সকলের ভবিষ্যত একবারেই সকল সমস্যার সমাধান করবে। স্যার, এই মুহুর্তে আমি আমার ও আমার দলের পক্ষ থেকে আনুগত্য প্রকাশ করছি; পাকিস্তানের যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার ক্ষেত্রে আমাদের বন্ধুভাবাপন্নতা, আমাদের সহযোগিতা সরকারের প্রতি নিবেদিত থাকবো। স্যার এই সংসদে এই সময়ে আমরা ঠিক করতে যাচ্ছি ভবিষ্যৎ-এ উপমহাদেশে পারস্পারিক সম্পর্ক কি দাড়াবে। এই অনন্য উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে এই দেশের প্রত্যেক নর-নারী, প্রত্যেক দিনমজুর, মালিক, কর্মচারি-কর্মকর্তা সবাই আত্মত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত। আমি নিশ্চিত আমাদের দেশ শক্তিশালী এবং এদেশের মানুষ সাহসী; সেই সাথে আমি বিশ্বাস করি আমাদের মধ্যে অটুট ঐক্য বিদ্যমান। আমি নিশ্চিত এই সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সব দলের প্রতিনিধিরা আজ এই ভয়াবহ সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারকে সবরকম সহায়তা করার জন্য সর্বসম্মত। আমি শুধুমাত্র একটি সতর্ক করতে চাই- আমরা কোনো আপোষ বা সন্ধি চাই না, আমি চাই আমার দেশ আরেকটা তাসখন্দে পরিনত হোক। আমরা কোনো বহিঃ শক্তির আদেশ, উপদেশ, নির্দেশ, চাপ, প্ররোচনা শুনতে চাই না। আমরা এক জাতি হিসাবে এই যুদ্ধ টেনে নিয়ে যাব এবং লক্ষ্য হাসিল না হওয়া পর্যন্ত চালিয়ে যাব।

স্যার, পরিশেষে সংসদ সম্পর্কে একটা কথা বলতে চাই। শেষ মহাযুদ্ধের সময় চার্চিলের সেই বিখ্যাত উক্তি……

শ্রী অর্জুন অরোরা (উত্তর প্রদেশ); চার্চিল নয়, এটা চেম্বারলেইনের উক্তি।

শ্রী এম এস গুরুপদস্বামীঃ উনি বলেছিলেন যুদ্ধের সর্বোচ্চ উপকরণ হতে যাচ্ছে সংসদ। যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সব সময় বসত। তাঁরা দিনে কিংবা রাত যেকোন সময় সংসদ আহবান করত। সংসদ ছিলো ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সরকারের শক্তিশালী আত্মরক্ষার উপায়। ঠিক একইভাবে আমি সরকারের নিকট এবং এই সংসদের প্রত্যেক সহকর্মীর নিকট আবেদন করছি দিনে দিনে সংসদ যেনো আহবান করা হয় এবং সংসদকে সরকারের মিত্র হিসাবে ভূমিকা রাখে। সংসদ এবং সরকারের ভিতর কোনো তফাৎ নেই, এই দুয়ের ভেতর শুধুমাত্র ঐক্যমত্য এবং সৌহার্দ্য বিদ্যমান। চেয়্যারম্যান আপনার মাধ্যমে আমি বলতে পারি কি- প্রতিদিন কয়েক ঘন্টার জন্য হলেও আমরা কি সংসদে বসতে পারি না? সরকারকে সমালোচনা করার জন্য নয় বরং সরকারের এই অসাধারণ কাজ এবং উদ্দেশ্য- এর সাথে আরো এবং আরো সংহতির জন্য। শেষে আমি আবার বলছি পাকিস্তানের বিরূদ্ধে এই যুদ্ধের ব্যাপারে আমার দল মনপ্রাণ দিয়ে এই সরকারের সমস্ত কর্মকান্ডের সাথে সংহতি প্রকাশ করছে। আমরা আশা করি এবং বিশ্বাস করি খুব দ্রুত, এমন কি আগামী বড়দিনের আগে, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ- এর অভ্যুদয় দেখব। আমরা আরো আশা করি এবং বিশ্বাস করি আমরা এই উপমহাদেশে একটা স্থায়ী স্থিতি এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা করব।

শ্রী পীতাম্বর দাস (উত্তর প্রদেশ); মাননীয় সভাপতি মহাশয়, ভারত বর্ষের শান্তিপ্রিয়তা ও সহনশীলতা বিশ্ববিখ্যাত, এবার আমাদের সহনশীলতায় পরাকাষ্ঠা হয়ে গেছে: আমাদের দুর্ভাগ্য পাকিস্তান সব সময় উল্টা বুঝেছে।

আমাদের সৌজন্যতা তারা কাপুরুষতা ভেবেছে। আমাদের সম্পর্কে এও বলা হয়েছে “তারা পাল্টা আঘাত করতে অনেক সময় নেয় কিন্তু যখন সেটা করে তখন তারা সেটা ভীষন ক্ষিপ্রতার সাথে করে। “ এবং আমি আনন্দিত সেই সময় সমাগত।
মহোদয়, বিজয়ের প্রশ্নে আমাদের সন্দেহের কোন কারন নেই কেননা, প্রথমতঃ যে জন্য আমরা সর্বদা সংগ্রামরত ও বিবদমান তার নিজস্ব একটা দৃঢ়তা ও সাত্ত্বিকতা আছে। উপরন্ত পাকিস্তান আজ যে শক্তিসমূহের সেবা করছে তাদের অস্ত্র ১৯৬৫ এর যুদ্ধেও তার পক্ষে কাজ করতো। সে সময় পাকিস্তানের দুই বড় ভাই মিলে মিশে কাজ করত আজ পশ্চিম পাকিস্তানের এক পা বাংলাদেশে বাধা পড়েছে, আর সে যে মিত্রদের সেবা করে তাদের মধ্যে একজন রাশিয়ার সংগে জড়িয়ে পড়েছে, অন্যজন আপন রক্ষার জন্য তার প্রতিপক্ষ রাশিয়ার সাথে সমঝোতা করে চলছে। অতএব বিজয়ের ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। আমরা অবশ্যই হৃদয় দিয়ে এগিয়ে যাবো এবং উপরে ঈশ্বর আছেন।

এর সংগে সংগে আমরা অবশ্যই আমাদের ইতিহাস দেখব, প্রাচীন ও পরবর্তীকালের ইতিহাস আমরা দেখব, সংঘর্ষে ভারত কখনো হার মানেনি। সংঘর্ষে আমরা সবসময় বিজয়ী হয়েছি। আমরা হেরে থাকলে আপোষের মধ্যে হেরেছি। সুতরাং বর্তমান ইস্যুতে বৈঠকে বসে আজ আপোষের কোন অবকাশ নেই, প্রধানমন্ত্রীও এ কথাই বলেছে, “সত্যারূঢ় দলের অন্যান্য লোকেরাও একই কথা বলেছেন। আমরা আরেকটা তাসখন্দ মেনে নেবো না। আমি একে স্বাগত জানাই। এরূপ দৃঢ়তা ও সংকল্প নিয়ে আমাদের উপর আরোপিত যুদ্ধের মোকাবিলা করতে আমরা সামনে চলব।

শ্রী দয়াভাই ভি প্যাটেল (গুজরাট)ঃ মিঃ চেয়ারম্যান স্যার, আমার পুর্বের বক্তা এবং বিরোধীদলীয় নেতার মুখ নিঃসৃত বক্তব্যের সাথে একাত্ম হবার জন্য আমি কৃতজ্ঞবোধ করছি। আমরা যে আগ্রাসন মোকাবেলা করছি তার সাথে পুরো সংসদ এবং পুরো জাতি সরকারের সাথে আছে। এই যুদ্ধ আমাদের কারণে সংগঠিত হয়নি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন এটা এড়াতে এবং এমন এক সময়ে যখন দেশে তাঁর উপস্থিতি খুবই জরুরি ছিল কিন্তু তিনি বিদেশে যাবার বিপদজ্জনক পদক্ষেপ নিয়েছেন সারা বিশ্বকে বোঝাতে যে এখানে আসলে কি ঘটছে। আমাদের মতপার্থক্য থাকতে পারে। আমরা প্রায়ই এই ব্যাপারে এই সংসদে যুক্তি পাল্টা-যুক্তিসহ বিতর্ক করেছি কিন্তু এখন আর সেটা করার সময় নয়। আজ একাত্ম হবার জন্য কথা বলার সময় যাতে আমরা এই আগ্রাসনকে সঠিকভাবে মোকাবেলা করতে পারি। এবং আমার পুর্ব বক্তা সঠিকভাবে চিহ্নিত করেছেন, আসুন আমরা এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে বিজয়ী হই এবং একটা স্থায়ী শান্তি নিয়ে আসি। এবং আমরা যে পুর্বের কোনো ভুল, দুর্ঘটনা বা দুর্ভাগ্যের পুনরাবৃত্তি না করি। আসুন আমরা আমাদের কার্ডটা সঠিকভাবে খেলি। আসুন আমরা বিজ্ঞের মতো আচরণ করি এবং আমি অনেকবছর ধরে এই উপমহাদেশে শান্তি দেখতে চাই।

শ্রী ভুপেশ গুপ্ত (পশ্চিম বাংলা)ঃ আমরা আরো একবার পাকিস্তানি শাসকের নিষ্ঠুর চ্যালেঞ্জ এবং আগ্রাসনের মুখে। আমরা একটা শান্তিপ্রিয় জাতি এবং এতগুলো বছর ধরে পাকিস্তানের কাছে শান্তি ছাড়া কিছু চাইনি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী দ্বারা সমর্থিত পাকিস্তানি শাসকরা দুই দেশের জনগণের বন্ধুত্বের মধ্যে কাঁটা হয়ে দাড়িয়েছে। এমন কি এই সংকটপূর্ণ সময়ে আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ যারা নিজেরাই তাদের শাসকদের অত্যাচার এবং বিশ্বাসঘাতকতায় অতিষ্ট তাদের প্রতি কোনো বিদ্বেষ পোষণ করি না। এই যুদ্ধ আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে শুধুমাত্র আমরা বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীনতা সংগ্রামে সহায়তা করার কারণে, শুধুমাত্র আমাদের নীতি ও মুল্যবোধ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক ও তাদের সাম্রাজ্যবাদী পৃষ্টপোষকদের নিকট নতি স্বীকার না করার কারণে। এই যুদ্ধ আমাদের উপর ঠেলে দেয়া হয়েছে কারণ পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা বাংলাদেশ এর যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পশ্চাদপসরণ করছে। যত দিন যাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা অবস্থান বদল করছে এবং শক্তিশালী বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীরা দুর্বিনীতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। এই কারণে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকরা ক্ষিপ্ত হয়ে পাগলের মতো জুয়া খেলছে, অধিক বেপরোয়া হয়ে উঠছে কিন্তু আমরা জানি তারা যখন মরিয়া হয়ে উঠে তারা আইন কিংবা মানুষের প্রতি শিষ্টতা থোরাই পরোয়া করে। তাদের সব ধরনের আক্রমণ ও বিশ্বাসঘাতকতার সম্মুখীন হবার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকা জরুরি। আমাদের দেশ আক্রমণ করার মতো দুঃসাহস পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা দেখাতে পেরেছে কারণ পিছন দিক দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা তাদের অস্ত্র ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান করছে। এই সহায়তা না পেলে তারা হয়ত এরকম বিপদজ্জনক যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ত না, যা ভালো কোনো কিছু বয়ে আনে না। আমরা ও পাকিস্তানের জনগণ যে মুল্যবোধ লালন করি তা এর ফলে অত্যন্ত ক্ষতি হবে। আমাদের লক্ষ্য অত্যন্ত পরিষ্কার। এই যে যুদ্ধ যেটা আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে সেখানে আমাদের অখন্ডতা রক্ষা ছাড়া আর কোনো লক্ষ্য নেই। এবং আমাদের সকল একতা, শক্তি এবং সামর্থ্য দিয়ে আমরা আমাদের অখন্ডতা রক্ষা করব। যদি পাকিস্তানি শাসক এবং তাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রভু যদি এমন চিন্তা করে যে, এভাবে তারা বাংলাদেশ-কে দেওয়া আমাদের সহায়তাসমুহ নিরস্ত করতে পারবে তাহলে তারা মস্ত ভুল করছে। পাকিস্তানি শাসকদের এধরনের আগ্রাসন বাংলা দেশ- কে স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়ী হবার জন্য দেয়া সহায়তাসমুহ আরো জোরদার করার আমাদের সংকল্প- কে বরং আরো শক্তিশালী করবে। আমরা সম্পূর্ণ পরিষ্কারভাবে বলে দিতে চাই- বাংলা দেশ এর স্বাধীনতাকে দুনিয়ার কোনো শক্তি রুখতে পারবে না। এই প্রসঙ্গে আমি উল্লেখ করতে চাই – আমাদের দায়িত্ব প্রকাশ্যে এবং সম্পুর্ণভাবে গ্রহন করে বাংলা দেশ কে স্বীকৃতিদানে আমাদের আর আদৌ দেরী করা উচিৎ না। আমেরিকান ও অন্যরা আমাদেরকে প্রতারণা করেছে। তারা বাংলা দেশ ইস্যুকে আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত করার অপচেষ্টা করছে এবং এটাকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার বিরোধ নাম দিয়ে পার পেতে চাইছে। সেটা কক্ষনো ভারতের মাটিতে হবে না, আমরা নিশ্চয় আমাদের মাটি রক্ষা করব এবং বাংলা দেশের ব্যাপারে আমারা আমাদের সার্বিক সহায়তা প্রদান করব যাতে তারা বাংলা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম জ্বলজ্বলে বাস্তবতায় পরিণত হয়। সেটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ।

এই মুহুর্তে আমার বেশি কিছু বলার দরকার নেই। এটা দুঃখের এবং লজ্জাজনক যে চিনা সরকার পাকিস্তান এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পিছনে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আরো সমাজতান্ত্রিক দেশ আছে। আমাদের বন্ধু সোভিয়েত ইউনিয়ন রয়েছে যারা সবসময় আমাদের সমস্যা ও অসুবিধায় পাশে আছে। অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশসমুহ আছে যারা নিঃসন্দেহে পরিস্থিতি বুঝবে এবং আমাদের প্রশংসা করবে। আমরা ন্যায়যুদ্ধের সম্মুখীন। আমরা মানবিক মর্যাদা রক্ষায় যুদ্ধ করছি যা আমরা জোয়ান ও জনগণের রক্তের বিনিময়ে সমুন্নত রাখছি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং সর্বোপরি স্বাধীনতা ও শান্তিকামী মানুষের কাছ থেকে যথাযোগ্য মর্যাদা আশা করছি।

সবশেষে স্যার আমি বসার আগে আমি আমার পার্টির তরফ থেকে প্রতিরক্ষা ইস্যুতে সরকারের প্রতি সব রকম সমর্থন নিশ্চিত করছি কারণ এটা কোনো দলীয় ইস্যু নয়। এটা একটা জাতীয় ইস্যু এবং এই চ্যালেঞ্জ এবং হুমকি পুরো জাতি অভুতপূর্ব একতাবদ্ধভাবে মোকাবেলা করবে। সাম্প্রদায়িক শান্তি ও সম্প্রীতি এই মুহুর্তে আগের যে কোনো সময়ের চাইতেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সমস্ত নৈতিক শক্তি, আমাদের সমস্ত প্রচেষ্টা দিয়ে এই বিষয়টি সমুন্নত রাখবো। এটাই আমাদের আদর্শ, এটাই আমাদের বর্ম। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে একতাই আমাদের সুরক্ষার ঢাল। সাম্প্রদায়িক সন্দেহ ও অবিশ্বাস ছড়িয়ে কেও যেনো পরিস্থিতির সুযোগ না নিতে পারে সেদিকে কঠোর লক্ষ্য রাখতে হবে। এই সাধারণ সংগ্রাম এবং যুদ্ধে আমরা সবাই ভাই। সব ধর্ম, সম্প্রদায়ের সদস্য; বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অন্যান্য সমিতির সদস্যের শক্তির উৎস এই কঠিন ঐক্য। আমি মনে করি সরকার এই ঐক্যের উপর নির্ভর করতে পারে। স্যার, আমি আশা করি একই সময়ে সরকার প্রতিক্রিয়াশীল এবং স্বার্থান্বেষী গোষ্টীকে এই পরিস্থিতির কোনোরূপ সুযোগ দেবে না। এই চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি মোকাবেলায়- গণতান্ত্রিক অধিকার এবং জনগণের স্বাধীনতাকে সম্মান করা আবশ্যক এবং তাদের পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত ভূমিকা পালন করতে দেয়া উচিৎ যাতে করে আমাদের মহান জাতি তাঁর সাহস প্রমাণ করতে পারে এমনকি এই সংকটের সময় যখন একটা যুদ্ধ আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। যারা জাতীয় প্রতিরক্ষার ব্যাপারে কাজ করছেন তাদের প্রতি আবার আমরা আমাদের অঙ্গীকার এবং সংহতি প্রকাশ করছি। বাংলাদেশের বীর স্বাধীনতা যোদ্ধা এবং জনগণের প্রতি আমরা আমাদের উষ্ণ ভালোবাসা জানাচ্ছি। আমাদের হৃদয় তাদের প্রতি নিবেদিত। যতক্ষণ না পর্যন্ত শেষ পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য বাংলাদেশ ছেড়ে না যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের দুর্গ গুড়িয়ে দেয়া হবে। আমাদের পক্ষ থেকে কোনো বিরতি বা তীব্রতা কমবে না। আবার আমার শুধু এই-ই বলার আছে- আসুন আমরা এই চ্যালেঞ্জ সাহসের সাথে, একতা’র সাথে এবং বিশ্বাসের সাথে মোকাবেলা করি যে আমরা জিতব এবং সেই সাথে বাংলদেশ এর জনগণ জয়লাভ করবে।

শ্রী এন জি গারাই (মহারাষ্ট্র)ঃ যদিও আমার পার্টির সহকর্মীদের সাথে এই ব্যাপারে পরামর্শ করার মতো তেমন সময় পাইনি, তবুও আমি সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলছি যে- আমাদের মাতৃভূমির সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতা রক্ষার প্রশ্নে সব ধরণের উদ্যোগ সাথে আমার পার্টি দৃঢ়ভাবে সংহতি প্রকাশ করছে। এই মুহুর্তটা আমি ভারতের ইতিহাসের টার্নিং পয়েন্ট হিসাবে দেখছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই আগুন থেকে এক নতুন ভারতের জন্মলাভ হবে। শুধুমাত্র আমাদের মুল্যবোধ ও স্বাধীনতা রক্ষা নয় বরং আমাদের প্রতিবেশী বীর বাংগালীদের স্বাধীনতা ও মুল্যবোধ রক্ষার্থে আমাদের একই আগ্রাসী শক্তিকে প্রতিহত করা অধিকার রয়েছে।
আমি আমাদের দেশের সর্বক্ষেত্রের মানুষ এর প্রতি আবেদন করতে চাই- বিশেষ করে ছাত্র, যুবা, কৃষাণ, মজদুর এবং অতি অবশ্যই ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি তাঁরা যেন তাদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করেন।

শ্রী কে পি সুব্রামানিয়া মেনন (কেরালা) ঃ সভাপতি সাহেব, স্যার, পাকিস্তানি মিলিটারি চক্র নির্বোধ এবং ইচ্ছাকৃতভাবে আমাদের বিমানঘাঁটি গুলোর উপর হামলা চালিয়েছে এবং আমাদের সীমায় বোমাবর্ষণ করেছে যেটা একটা যুদ্ধ ডেকে নিয়ে এসেছে যেটা সর্বোতভাবে আমরা চাইনি। কিন্তু স্যার, নির্মম পাকিস্তানী সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতার জন্য যেভাবে লড়ে যাচ্ছে তাদের প্রতি আমাদের জনগণের সাহায্য, সমর্থন এবং অংশগ্রহণ এর পরিণাম হিসাবে এই যুদ্ধ আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।

আমাদের পার্টি সবসময় বলে এসেছে এবং আমি খুশি যে এই-ই সংসদেই গতকাল আমি পূনরাবৃত্তি করেছিলাম যে- যদি আমাদের জনগণের সর্বসম্মত ইচ্ছা যে তাঁরা বাংলাদেশের জনগন-কে তাদের স্বাধীনতা লাভে সাহায্য করবে তাহলে আমাদেরকে পাকিস্তানী সেনা চক্রের যুদ্ধ মোকাবেলা করতে হবে, এবং তখন সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখন্ডতা রক্ষা করার জন্য সারাদেশের মানুষ একটি একক মানুষ হিসাবে ফুঁসে উঠবে। আমি আমাদের পার্টির সেই অবস্থান এই মহান সংসদে আবার পূনরাবৃত্তি করতে চাই।

একই সময়ে আমি এই সুযোগে এই পরিস্থিতির অন্তর্নিহিত কিছু নির্দিষ্ট বিপদ সম্পর্কে বলতে চাই; সবার প্রথমে আমরা স্পষ্ট করতে চাই আমরা এই যুদ্ধটা লড়ছি বাংলাদেশের জনগণের জন্য; এবং এটাই সঠিক সময় আমাদের যুদ্ধটা বাস্তবসম্মত করতে, বোধগম্য করতে, এক্ষুনি এখানে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে। এই ব্যাপারে বিন্দুমাত্র দেরী করা ঠিক হবে না। সর্বোপরি আমরা কি কারণে যুদ্ধ করছি যদি না আমরা বাংলাদেশের জনগণের জন্য যুদ্ধ করি? এবং আমাদেরকে উগ্র দেশপ্রেমের বিপদ থেকে সতর্ক থাকতে হবে যেনো সেটা পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরিণত না হয় কারণ সেটা গোটা ব্যাপারটা ব্যর্থতায় পর্যবাসিত করে দেবে। বস্তুতঃ আমরা যে কর্মকান্ড চালাচ্ছি অর্থাৎ আমরা বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার রক্ষায় সংগ্রাম করছি সেটা যেনো এটাও দেখায় যে আমরা গোটা পাকিস্তানের জনগণের গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার রক্ষায় পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছি যারা মুলত জনগণকে অত্যাচার করছে। অতএব আমাদের উগ্র দেশপ্রেমের ফাঁদে পড়লে চলবে না বরং আমাদেরকে স্পষ্ট থাকতে হবে কে আমাদের শত্রু এবং কাদের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ।

তৃতীয়তঃ আরো একটা বিপদ আছে; নির্দিষ্ট কিছু অংশ আছে, নির্দিষ্ট কিছু প্রতিক্রিয়াশীল চক্র আছে যারা দেশের এই পরিস্থিতিতে সাম্প্রদায়িক বিবাদ উসকে দেবার চেষ্টা করবে; সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণার বিষ উসকে দেবার চেষ্টা করবে। স্যার, আমাদের যুদ্ধ বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে, তাদের প্রতি আমাদের সমর্থনের সারমর্ম হলো- গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম, ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য সংগ্রাম এবং সার্বজনীন ভারতীয় জনগণের জন্য সংগ্রাম। অতএব, স্যার, বাংলাদেশ এর প্রতি সমর্থন দানে আমরা যদি এহেন সাম্প্রদায়িক মনোভাবে জড়িয়ে পড়ি তাহলে আমাদের সংগ্রামের উদ্দেশ্য এবং উৎসর্গ বিফল হবে। তাই, আমাদের আরো সতর্ক হওয়া জরুরি যে আমরা যেনো দেশের সংখ্যালঘুদের সাথে কোনোরূপ সাম্প্রদায়িক সংঘাত এবং বিরোধে যেনো জরিয়ে না পড়ি। এবং আমি নিশ্চিত যে এই সময় সারাদেশ একতাবদ্ধ থাকবে এবং আমাদের উৎসর্গ- কে সাফল্যে রূপদান করবে।
ধন্যবাদ।

শ্রী কাঞ্চি কল্যানসুন্দারাম ( তামিল নাড়ু)ঃ সভাপতি সাহেব, এই ক্রান্তিলগ্নে, আমরা এক গুরুতর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। ভারতীয় উপমহাদেশের উপর পাকিস্তানের আক্রমন প্রথম বারের মতো নয়। এর আগেও আরো ২ বার তারা আক্রমন করেছিলো। একইভাবে, আবারো যুদ্ধবাজ পাকিস্তানীরা এখন আমাদের বিরুদ্ধে আগ্রাসন শুরু করেছে। আমরা শান্তিপূর্ন ভাবেই বাস করছিলাম। আমাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের এ আগ্রাসন নিন্দার যোগ্য। এখন আমাদের পাকিস্তান কে উচিত শিক্ষা দেয়া যেনো তারা আবার ও আক্রমন করার সাহস না হয়। যে যুদ্ধ আমরা এখন করছি, তা শুধুমাত্র আমাদের স্বাধিনতাকে কে রক্ষার জন্য নয়, একটি মহৎ উদ্দেশ্যে। পাকিস্তানের জনগনের গনতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার উদ্দেশ্যে আমরা এই যুদ্ধ করছি। আমরা শুধু আমাদের দেশের গনতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য এ যুদ্ধ করছি না, পাকিস্তানের জনগনের গনতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় আমরা যুদ্ধ করছি। যুদ্ধংদেহী এই পাকিস্তানী শাষকদেরকে শিক্ষা দিতে হবে। পাকিস্তানীদের সাথে এটাই আমাদের শেষ যুদ্ধ হওয়া উচিত। আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে যে, আবার পাকিস্তান আমাদের আক্রমন করার সাহস না পায় এবং আবারো তাদের লেজ কেটে দেয়া হবে। যতদিন আন্তর্জাতিক মানচিত্রে পাকিস্তান আছে, আমাদের বুঝিয়ে দিতে হবে যে আমাদের সাথে শান্তিমতো থাকতে হবে, এবং এই মুহুর্তেই পাকিস্তান কে এই বিষয়টি বোঝাতে হবে। আমার মনে হয় এই যুদ্ধ অবধারিত এবং এখন এই যুদ্ধ চলছে; আমরা চাই না এই যুদ্ধ আরেক “তাসখন্দ” এ পরিনত হোক। ইতিমধ্যে আমরা জানি যে, তাসখন্দ চুক্তিতে আমাদের জন্য কি করা হয়েছে। ইংরেজীতে একটি প্রবাদ আছে, “চরম শত্রুকেও তার প্রাপ্য পাওনা বুঝিয়ে দাও। এই সংকটকালে, পাকিস্তান শুধু একটাই ভাষা বুঝবে তা হলো আঘাতের জবাব আঘাত দিয়েই করতে হবে।

এই ক্রান্তিলগ্নে, D.M.K পার্টির পক্ষ হতে, আমি, ভারতের অখন্ডতা ও স্বাধীনতা বজায় রাখার জন্য আমাদের আন্তরিক ও অকুন্ঠ সহযোগিতা দিতে এবং ত্যাগ স্বীকার করতে ভারতবাসীর সাথে আছি।
ধন্যবাদ

শ্রী বি. ভি আবদুল্লা কয়া (কেরালা)ঃ জনাব সভাপতি, স্যার, যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই – আমাদের ভারতীয় সাম্রাজ্যের উপর পাকিস্তানের আগ্রাসন খুবই পরিকল্পিত ভাবে শুরু করেছে। প্রত্যেক ভারতীয় নাগরিক সে হিন্দু অথবা মুসলিম, শিখ অথবা খ্রীষ্টান তাদের পবিত্র কর্তব্য হলো, যার যা কিছু আছে সবকিছুকে উৎসর্গ করা এবং নিজের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও প্রান প্রিয় ভারত মাতা কে রক্ষার করা। যুদ্ধ ততদিন চলবে যতদিন পর্যন্ত শত্রু একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং ভবিষ্যতে ভারত সীমানা যেনো চিরতরে এ ধরনের আগ্রাসন থেকে নিরাপদে থাকতে পারে। আমি আমার পক্ষ থেকে এবং আমার পার্টি – ভারতীয় ইউনিয়ন মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে, সরকারকে আমাদের পুরো উদাত্ত হৃদয়ের সমর্থনের অঙ্গীকার করছি, এবং এই সময়ে অবিবেচক পাকিস্তানের আগ্রাসন থেকে দেশকে সুরক্ষার জন্য আমরা আমাদের সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত।

শ্রী কুম্ভ্রাম আর্য ( রাজস্থান)ঃ সভাপতি মহাদয়… এ পর্যায়ে আমাদের এই প্রতিজ্ঞা ও নিষ্ঠার সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে যে বাংলাদেশেও গনতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা হোক এবং ভারত তার অখন্ডতা নিয়ে পাকিস্তান কে এমন একটি শিক্ষা দিক যে, জীবনে সে যেন আর মাথা উঠানোর ধৃষ্ঠতা না দেখায়। এজন্য এ দেশের প্রতিটি মানুষ বিশেষ করে যাদের রক্তে তেজ আছে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাক। তারা ক্ষেতেও কাজ করে এবং যুদ্ধের ময়দানে পাকিস্তানকে শিক্ষা দেবার জন্য ও কাজ করে এবং এর সাথে তারা এও চায় যে একবার তাদের সম্মখে বিক্ষেপিত পা কারো কথায়, কারো চাপে, কোন সমঝতায় আর পেছন ফিরবে না। এ ব্যাপারে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আমাদের দেশ সবসময় শান্তি বজায় রেখে চলেছে সামনেও শান্তি বজায় রাখার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানকে শিক্ষা দেবার জন্য প্রস্তুত তার অন্য কোন ইচ্ছা নেই।

এক্ষেত্রে আমি শুধু বলবো দল, আমি এবং আমার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জনসাধারন সকলে এ দেশের জন্য শুধু সহযোগীতা নয় রক্ত দেবার জন্য প্রস্তুত কিন্তু এই রক্তের বিনিময়ে পরিষদের কাছে শুধু একটি প্রত্যাশা যে স্থানে আমাদের রক্ত বইবে ঐ মাটিতে আমাদের অধিকার যাতে স্থায়ী হয়…

*সরদার নরেন্দর সিংহ বার ( পাঞ্জাব)ঃ সভাপতি মহোদয়, আমাকে বলার সুযোগ দেয়ায় আমি আনন্দিত। দেশে সামান্য উদ্বিগ্নতা আছে কিন্তু এর মাঝে আমি কিছু প্রসন্নতাও বোধ করছি এই মনে করে যে, জাতি এবার তার শৌর্য দেখাবার এবং শত্রুর দাঁত ভেঙ্গে দেবার একটি সুযোগ পেয়েছে।

যুদ্ধ করার ব্যাপারে, মৃত্যুকে আলিংগন করার ব্যাপারে আমার জাতি আপনার সঙ্গে রয়েছে এবং সর্ব ক্ষেত্রে আপনার সহযোগিতা করবে। ( মূল ভাষন উর্দুতে)

শ্রী আই সি চাগলা (মহারাষ্ট্র)ঃ জনাব সভপতি, ১৯৪৭ সালে যখন আমরা স্বাধীন হই, পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু এর সেই সময় একটি বিখ্যাত অভিব্যাক্তি ছিলো, যে তিনি নিয়তিতে বিশ্বাস করতেন। ভাগ্যের সাথে সম্পর্ক রাখতেন। আমার কাছে মনে হয়, এটা আমদের নিয়তির সংযোগ স্থল। ১৯৪৭ সালের সেই সময়ে, আমরা নতুন ভারত গড়ার প্রচেষ্টার মাধ্যমে ভাগ্যের সাথে মোকাবেলা করেছিলাম। আমার বক্তব্য এই, এবারো আমরা ভাগ্যের সাথে সাড়া দেবো সাহস, একতা, সংহতির মাধ্যমে।

স্যার এই যুদ্ধ শুধু আমাদের দেশের ভবিষ্যতের উপরই প্রভাব ফেলবে না, পুরো দক্ষিন এশিয়ার উপর প্রভাব ফেলবে। কথায় আছে, ইশ্বর যদি কাউকে ধ্বংস করতে চায়, তো প্রথমে তাদেরকে পাগল বানিয়ে দেয়। জেনারেল ইয়াহিয়া খান হচ্ছে একজন উন্মাদ। এটা আমরা সবাই জানি। সে তার ধ্বংসের পথেই যাচ্ছে। কিন্তু আমি এই বিষয়ে আরো গুরুত্ব আরোপ করতে চাই। পাকিস্তানের সাথে এটাই আমাদের শেষ যুদ্ধ হোক। যখন আমি পাকিস্তানের ধ্বংসের কথা বলছি, আমি বলতে চাই, আমি পাকিস্তানের ধ্বংস দেখতে চাই। যখন আমি পাকিস্তান ধ্বংসের কথা বলি, তখন যে কারনগুলো আসে, তা হলো সামরিক একনায়ক্তন্ত্র, সামরিক স্বৈরশাষন, ভারতীয় দ্ব-জাতিতত্ত্ব, গনতান্ত্রিক অধিকার দমন, এবং জাতিসংঘের সনদে সন্নিবেশিত প্রতিটি মুলনীতি।

আবার অন্যদিকে, আমরা গনতন্ত্রের জন্য, স্বাধীনতার জন্য, প্রতিবেশী সুলভ মনোভাবের কারনে সোচ্চার হয়েছি কারণ এসকল বৈশিষ্ট্যগুলোকে আমরা দাম দেই। তাই, স্যার, এই যুদ্ধ শুধু সীমান্তবর্তী দুই দেশ পাকিস্তান ভারতের মধ্যে যুদ্ধ নয়, এটি দুই মতবাদের মধ্যে যুদ্ধ এবং আমি বলতে চাই যতদিন না আমরা পাকিস্তানের এই অন্যায় কে ধ্বংস করে দিতে পারবো আমরা পৃথিবীর এই অংশে কখনোই শান্তি আনতে পারবো না।

স্যার এবার আর আত্নরক্ষামূলক যুদ্ধ নিয়ে আর কোন কথা নয়। যথেষ্ট হয়েছে, পাকিস্তানের সাথে এটি এখন আক্রমনাত্নক যুদ্ধ। আমরা সব সময়ই চেয়েছি যুদ্ধ কে এড়াতে যতটুকু করা সম্ভব। কিন্তু, স্যার এখন বিবাদের সূত্রপাত হয়ে গেছে যা- বেরিয়ে আসার সব বেরিয়ে আসুক এবং এই ঝামেলা চিরতরে শেষ করে দিতে হবে।

স্যার আমি এর সাথে আরো বলতে চাই, পাকিস্তান পাপকে ধারন করে এবং এর শেষ হচ্ছে সহিংসতার মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানের একটি অংশ ইতিমধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে। বাংলাদেশ যা পাকিস্তানের একটি অংশ যা গঠিত হয়েছিলো পাকিস্তানের অধিকাংশ অংশ নিয়েই। কিন্তু যা ছিলো তার সবই ধ্বংস হয়ে গেছে ইয়াহিয়া খানের কীর্তিকলাপে। কিন্তু আমি আমার বন্ধু গুপ্তার সঙ্গে সহমত প্রকাশ করবো যে, আজ প্রথমে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হবে। আর ইশ্বরের দোহাই এটাই হবে আমাদের প্রথম উত্তর। আমি জানি আন্তর্জাতিক চাপ আমাদের উপর আছে। এক বিজ্ঞ ব্যাক্তি নিউইয়র্কে বসে থাকবেন এবং তার অন্যান্য মন্ত্রীসভাসদরা আমাদের বলবেন আমাদের কেমন ব্যাবহার করা উচিত, আমাদের কি করা করা উচিত? কিন্তু আমরা জানি আমাদের কাছে জাতীয় স্বার্থই মূখ্য। ঈশ্বর জানেন আমরা অনেক অপেক্ষা করেছি, আমরা অপমানিত হয়েছি, পাকিস্তানের আগ্রাসন দেখেছি। সে সময় চলে এসেছে যখন আমরা শপথ নিয়েছি যে, এই আগ্রাসন দূর করতে আমরা দৃঢ় সংকল্প বদ্ধ। এবং সাথে এটাও দেখতে চাই না যে ভবিষ্যতে বিশ্বের কোথাও কোন ধরনের আগ্রাসন চলুক।

স্যার, একটা বিষয়ে আমি সরকার ও প্রধানমন্ত্রী কে আশ্বস্ত করতে চাই, আমার মনে এই সময়ে আমাদের সকল ভেদাভেদ ভুলে যাওয়া উচিত। আমাদের এখন শুধু একটা জিনিসই ভাবা উচিত এবং তা হলো আমাদের দেশকে প্রতিরক্ষা করা এবং পাকিস্তানকে পরাজীত করা। স্যার, আমি প্রধানমন্ত্রী কে আশ্বস্ত করতে চাই যে, আমাদের প্রত্যেক নেতাই তার পিছনে দাঁড়াবে এবং তিনি আমাদের বিজয়োৎসবের দিকে নিয়ে যাবেন।
শ্রী গংগা শরণ সিংহ( নাম- নির্দেশিত)ঃ প্রিয় সভাপতি মহোদয়, পরস্পরাগত ভাবে আমাদের নীতি এই ছিলো যে, একবার আমরা আর পেছনে ফিরে আসি না। আমরা আক্রমন করিনি, অন্যের ভূ-খন্ড দখল করিনি কিন্তু স্বদেশের নিরাপত্তার জন্য আমরা সবসময় সংশ্লিষ্ট ছিলাম। আর আমি যখন দেশের কথা বলি তখন একটি ভূ-ভাগের ধারনা আমার অন্তরে থাকে না, কিছু ব্যাক্তির সমষ্টির মধ্যে সেটি সীমিত থাকে না। আমি আমার দেশকে মানবের উচ্চতম চিন্তাধারা, উচ্চতম দর্শন এবং উচ্চতম নীতির প্রতীক মনে করি। এ প্রতীক আমাদের আদিকাল থেকেই ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এজন্য আমরা আজ নীতিমালার জন্য ও আমরা অস্ত্র ধারন করি যেগুলোর প্রতীক হচ্ছে আমাদের দেশ।

সভাপতিঃ মি। চিত্ত বসু।

শ্রী চিত্ত বসু ( পশ্চিম বাংলা)ঃ স্যার, এটি ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন মুহুর্ত এবং জাতির জন্য এক পরীক্ষা। এবং এটি হয়েছে কারন, আমরা যুদ্ধের মধ্যে অবস্থান করছি। এবং এই যুদ্ধ আমাদের ইচ্ছায় হয় নি, এটি আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। স্যার, জাতির জন্য ডাক এসেছে, সুতরাং সীমান্ত বর্তী এলাকা জুড়ে যে আগ্রাসনের এই প্রতিযোগিতা কে মুখোমুখি করতে হবে। এই যুদ্ধ শুধু আমাদের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য না এবং আমাদের দেশের একত্রীকরনের জন্যও না, কিন্তু এই যুদ্ধ আমাদের জীবনের আদর্শ রক্ষার, যার জন্য আমরা বেচে আছি তার প্রতিরক্ষায় এবং আমরা আমদের নিজেদের ভুমিতে বেচে আছি, এটাই হলো গনতন্ত্র, স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতার জীবনাদর্শন।

সুতরাং এই যুদ্ধ আমাদের লালিত আদর্শ রক্ষার যুদ্ধ। এবং এই যুদ্ধের জন্য পূর্ন সংহতির প্রয়োজন কারন এটি একটি পূর্ন যুদ্ধ। এই যুদ্ধে শুধু সীমান্তের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাহসী জোয়ানরাই লড়াই করছে না, বরং লাংগল চালানো মানুষ থেকে শুরু করে কল কারখানার মানুষ এবং সর্বস্তরের জনগন এখানে অংশগ্রহণ করেছে। এটি একটি পূর্নাংগ যুদ্ধ এবং এর জন্য পূর্নাংগ সংহতির প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখতে হবে, এই যুদ্ধ সরাসরি পাকিস্তানের জনগনের বিরুদ্ধে নয়। কারন, এটি সম্পর্কে বহির্বিশ্ব অবহিত এবং এটি বার বার পূনরাবৃত্তি করা উচিত যে আমাদের আদর্শ রক্ষার জন্য এই যুদ্ধে অংশ নিতে আমরা বাধ্য হয়েছি। এবং আমার কোন সন্দেহ নেই যে এই সাফল্য এবং জয় নিয়ে এবং ইয়াহিয়া ও ভূট্টোর দাসত্ব থেকে পাকিস্তানের জনগনকে মুক্ত করে এবং স্বাধীনতা নিয়ে আসবো এবং অবাধ স্বাধীনতায় তাদের নিয়তিকে রুপ দিবো।

দুপুর ১২ টা

এমতাবস্থায় আমি অঙ্গীকার করতে চাই, সমস্ত কার্যকলাপে, সরকারের সকল প্রচেষ্টাতে আমার ঐকান্তিক সমর্থন থাকবে। এই ব্যাপারে, আমি মনে করি দেশের সকল রাজনৈতিক দল গুলো নিজেদের মধ্যের ভেদাভেদ ভুলে দেশের প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থাকে আরো শক্তিশালী ও নতুন করে রুপদান করবে।

বিশ্বের সকল শান্তিপ্রিয় ও স্বাধীনতা কামী মানুষের কাছে আমি যুদ্ধবাজ পাকিস্তানকে আর প্রতিপালন না করার ব্যাপারে আবেদন করতে চাই। এবং অনুরোধ করছি তারা তাদের নিজেদের নিজ নিজ সরকারকে সামলাতে অবদান রাখবেন যাতে তারা পাকিস্তানকে কোন প্রকার সাহায্য না করে – যাতে করে এই অঞ্চলে স্থায়ীত্ব ও শান্তি ফিরে আসে।

আমি আরো একবার সরকারকে আহবান করতে যাই যে, বাংলাদেশের মানুষগুলো তাদের দেশের স্বাধীনতার জন্য বীরের মত লড়াই করছে এবং গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জনগনের সরকারকেও অনতিবলম্বে স্বীকৃতি প্রদান করা হোক। কারন, বাংলাদেশের জন্য আমরা বাধ্য হয়েছি এ অবস্থান নিতে। এই পাকিস্তানী যুদ্ধবাজদের অনতিবিলম্বে উপযুক্ত জবাব হবে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারে স্বীকৃতি প্রদান করা।

স্যার, আরো একবার বলে আমি শেষ করতে চাই যে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করা হোক।

শ্রী বি ডি KHOBRAGADE ( মহারাষ্ট্র)ঃ স্যার, যেহেতু আমি এই মহান সংসদের ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হয়েছি। গত ২ বছর ধরে, এই সংসদে আলোচিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন বিষয়গুলোতে মতামত প্রকাশে আমি আমার নিজেকে বিরত রেখেছি, কিন্তু পাকিস্তান কর্তৃক ছড়িয়ে দেয়া এই আগ্রাসনের এই দৃশ্যে, আমি আমার মতামত প্রকাশ করতে বাধ্য হচ্ছি। আমি ভারতের রিপাব্লিকান দলের পক্ষ হতে দেশের সরকার ও মানুষের সাথে সংহতি প্রকাশ করছি।

স্যার, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মুখপাত্ররা তাদের নিজ নিজ মতামত প্রকাশ করেছে এই জাকজমকপূর্ন অনুষ্ঠানে। এই মহান জাতির রাজনৈতিক নেতাদের প্রদেয় মতামতের সাথে আমি আমার একাত্নতা প্রকাশ করছি।

কিছু সদস্য গন তাদের মতামত প্রকাশ করেছেন এভাবে যে, আমাদের এই সুযোগের সদ্বব্যাভার করা উচিত এবং পাকিস্তানকে উচিত শিক্ষা দেবার প্রচেষ্টা করা উচিত। আমি মনে করিয়ে দিতে চাই এই সংসদে, যে ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান আমাদের দেশের বিরুদ্ধে যে বিবাদের সূত্রপাত করেছিলো, আমরা পাকিস্তানকে উচিত শিক্ষা দিয়ে দিয়েছি। সম্ভবতঃ পাকিস্তা সে শিক্ষা ভূলে গেছে, পাকিস্তান পুনরায় আমাদের দেশের বিরুদ্ধে আবারো বিবাদ শুরু করেছে, এবং আমার মনে কোন সন্দেহ নেই যে আমাদের যে জোয়ানরা সামনে থেকে লড়াই করবে, তারা অবশ্যই এমন শিক্ষা দেবে পাকিস্তানকে যা কখনোই পাকিস্তান ভুলতে পারবে না।

স্যার, বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের দেশ চেষ্টা করেছে সাহায্য করতে এবং কাজেই পাকিস্তানী সামরিক জান্তার ক্রোধ ও উন্মত্ততা বাংলাদেশ থেকে ভারতে ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের দেশের বিরুদ্ধে এই আগ্রাসন কে আমরা অবশ্যই বীরত্বের সাথে মোকাবেলা করবো এবং আমার কোন সন্দেহ নাই যে আমাদের জোয়ানেরা যারা সম্মুখ যুদ্ধ করবে, তারা তাদের সমস্ত শক্তি ও বল দিয়ে পাকিস্তানের এই আগ্রাসী মনোভাবকে গুড়িয়ে দিবে।

আমি সংসদের আর বেশি সময় নিবো না। আমি আমার একটি মাত্র মত দিতে চাই এবং তা হলো, বাংলাদেশের জন্য আমাদেরকে এই বিবাদের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
ইতিমধ্যেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানে অনেক বিলম্ব হয়েছে, যদি বাংলাদেশের জন্যই আমাদের এই বিবাদের সম্মুখীন হতে হয়, আমি মনে করি সেই সময় চলে এসেছে যখন বাংলাদেশের স্বীকৃতি প্রদানে আর দেরী করা উচিত নয়।
এই অনুষ্ঠানে ভারতীয় রিপাব্লিকান দলের পক্ষ থেকে আমি অকুণ্ঠ ও নিঃশর্ত সমর্থন জানাচ্ছি এবং এই দেশের দূর্বল এবং পদদলিত মানুষ আমাদের দলের প্রতিনিধি। আমি সেই শ্রেনীকেই নির্দেশ করছি যাদেরকে আমরা দরিদ্র বলি, হয়তো তারা এমন অবস্থানে নেই যে তারা সোনা বা অর্থ অনুদান করতে পারবে, কিন্তু আপনাকে, এই সংসদ কে, এবং প্রধানমন্ত্রী এবং ভারত সরকারের মাদ্ধ্যমে আমি নিশ্চিত করছি যে, এই গরীব লোকেরা তাদের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও দেশের একতা রক্ষা করতে, স্বাধীনতা, অখন্ডতা রক্ষা করতে তাদের জীবন উতসর্গ করবে।

আমি ১৯৬২ এবং ১৯৬৫ এর আগ্রাসনের অভিজ্ঞতা স্মরণ করতে চাই না, যখন নিপীড়িত জনগনের সাহস ও বীরত্ব বিকশিত হয়েছিলো এবং তারা তাদের জীবন বিসর্জন দিয়েছিলো এই দেশের অখন্ডতা এবং স্বাধীনতা রক্ষায়। ১৯৬২ থেকে ১৯৬৫ সালের আগ্রাসনের অভিজ্ঞতা এক পাশে রেখে, আপনি এই দেশের ইতিহাস এর পাতায় দেখেন, শিবাজির সময় থেকে শুরু করে যখনই আমাদের দেশকে স্বাধীনতা রক্ষায় এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, এই গরীব জনগনেরাই সর্বদা নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়েছে দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় এবং স্বাধীনতা অর্জনে। তাই, এই সমারোহপূর্ন অনুষ্ঠানে, আমি আমার পক্ষ থেকে এবং সেনাদলের পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি সংহতি প্রকাশ করছি এবং নিশ্চিত করছি যে আমরা দেশের স্বাধীনতা ও অখন্ডতা বজা রাখতেযে কোন প্রকারের ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত।

জনাব সভাপতিঃ সম্মানিত সদস্যগন, এই বিচারাধীন মুহুর্তে আমি আরো একটি কথা যোগ করতে চাই। পুরো সংসদ এবং প্রকৃতপক্ষে পুরো জাতি দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ। এই যুদ্ধ; যা আমাদের উপর ঠেলে দেয়া হয়েছে, এতে কোন সন্দেহ নেই যে, বিজয় আমাদের হবে। প্রতিটি ব্যাক্তি, প্রতিটি দল, আমি নিশ্চিত তারা আপ্রান চেষ্টা করবে। এই বিজয়ের লক্ষ্য অর্জনে তারা অবদান রাখবে। আমাদের কারন এটাই আমরা লড়াই করছি নির্দিষ্ট আদর্শ এবং নির্দিষ্ট নীতির জন্য। সামরিক বাহিনী একটি মহান জাতির সামরিক শক্তি। পুরো জাতি তাদের পেছনে আছে এবং এতে কোন সন্দেহ নেই যে পরিনামে আমরা আমাদের আদর্শ ও নীতি সংরক্ষনে সফল হবো।

সংবিধানের ৩৫২ অনুচ্ছেদের অধীনে পুনরায় জরূরী অবস্থার ঘোষনা

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ( শ্রী জগজীবন রাম) ঃ স্যার আমি নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত অপসারনের জন্য আবেদন করছি,

“সংবিধানের ৩৫২ অনুচ্ছেদের দফা (১) অনুযায়ী, ৩রা ডিসেম্বর ১৯৭১ এ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জারি কৃত জরুরী অবস্থার ঘোষনা সংসদে অনুমোদন”
প্রশ্নটি প্রস্তাবিত হল।

বিরোধী দলীয় নেতা ( শ্রী এম এস গুরুপদস্বামী) ঃ আমি খুব সংক্ষেপে বলছি, সময় এসেছে সিদ্ধান্ত নেয়ার, আমাদের কি মহান দেশ হিসেবে কাজ করে যাওয়া উচিত নাকি ছোটই থেকে যাবো। আমাদের সামনে গুরুত্বপুর্ন প্রশ্ন হচ্ছে, এই দেশ কি সুবিশাল দেশ হবে নাকি এটি বামনের দেশে পরিনত হবে। জাতির ইতিহাসের সেই মুহুর্তে, যখন জাতি তার রক্ত ও শক্তির বিনিময়ে সুনাম অর্জন করেছে। বহু জাতিই দূর্ভোগ সহ্য করেছে এবং কঠোর পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছে এবং তারা সফল হয়েছে। দেশ এখন সংকটময় এবং আমাদের এর মধ্য দিয়েই যেতে হবে এবং সাফল্য অর্জন করতে হবে। স্যার, আমি পুনরাবৃতি করতে চাই না যা আগেই বলেছি। এই আয়োজনে, আমি শুধু এটাই বলতে চাই, বিভিন্ন দল ও উপদলগুলোর মধ্যে যে ছোটখাট দ্বন্দ গুলো আছে সেগুলোকে মিটিয়ে ফেলতে হবে। এই কথাটি আমি আমার সকল বন্ধুদের কাছে বলতে চাই। অতীতে এবং বর্তমানে আমাদের মধ্যে যে প্রধান বিভেদগুলো ছিল বা আছে, সেগুলো সমাধান করতে হবে এবং জাতির লক্ষ্য অর্জনে আমাদের একটি সার্বজনীন ইচ্ছাশক্তি তৈরি করতে হবে। এই দ্বন্দ কোন সাধারন দ্বন্দ নয় যা জনাব চাগলা ইতমধ্যে নির্দেশ করেছেন। এটিই গনতন্ত্র ও এক নায়কতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য। এটি সামরিক ও গনতান্ত্রিক মূল্যবোধের মধ্যে দ্বন্দ এবং এটি এমন এক দ্বন্দ যেখানে জাতির স্বার্থে আমাদের প্রত্যেককেই জড়িত হতে হয়েছে যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী। এই আয়োজনে, সরকারের প্রত্যেকটি অংগ, প্রত্যেকটি অর্থনৈতিক হাতিয়ার, প্রত্যেকটি সামাজিক মাধ্যমকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। যন্ত্রপাতি চালাতে হয়েছে, ক্ষেত গুলোতে চাষ করাতে হয়েছে, অফিসের কাজ করতে হয়েছে এবং সদা জাগ্রত থেকে তা অর্জিত হয়েছে। আমি নিশ্চিত পাকিস্তান কর্তৃক সৃষ্ট এই জরুরী অবস্থা অবলম্বে শেষ হবে। আমাদের কিছু বন্ধু আছে যারা এই ঘোষনা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে, “এই জরুরী অবস্থার কোন নির্দিষ্ট সময় সীমা নেই”- তারা এই অংশটিকে নির্দেশ করেছে। আমার খেয়াল আছে, অতীতে যখন জরূরী অবস্থা জারি হয়েছিলো, সেই জরুরী অবস্থা টানা কয়েক বছর ধরে চলেছিলো। এবং আমি আশা করি এবং বিশ্বাস করি এই জরুরী অবস্থা বেশিদিন চলবে না কারন এখন পরিস্থিতি ভিন্ন, এবং আমাদের লক্ষ্য পরিষ্কার, এবং পুরো জাতি এখন এক। এরই সাথে, শুধু মাত্র ভারতই না, যারা গনতন্ত্রে বিশ্বাস করে এবং গনতন্ত্রকে ও ন্যায় বিচারকে মূল্য দেয় তারা আমাদের সাথেই থাকবে এবং আমি খুবই নিশ্চিত যে এই জরুরী অবস্থা খুব শীঘ্রই শেষ হয়ে যাবে এবং অল্প কয়েক মাসের মধ্যে আমরা একটি নতুন উদীয়মান বাংলাদেশকে পাবো এবং এশিয়ার সামনে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে ভারত প্রকাশ পাবে। এত বছর ধরে আমরা এমন ভাবে কাজ করেছি, যা আমাদের দেশকে একটি মাধ্যমিক অবস্থানে নিয়ে এসেছে এবং, এই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে আমরা সুযোগ পেয়েছি যখন আমরা সত্যি পরিনত করতে পারবো এ দেশকে মহান করতে। এই আগুনের মধ্য দিয়েই আমাদের যেঁতে হবে, এ ছাড়া আমদের আর কোন বিকল্প নেই। এই নির্মম কষ্টের মধ্য দিয়েই যেঁতে হবে এছাড়া আমাদের আর কোন বিকল্প নেই। শুধুমাত্র এই পন্থায় বহু দেশ এভাবেই মহত্ব অর্জন করেছে। যারা ইতমধ্যে বলে গেছেন যে পাকিস্তানের জন্য সঠিক এবং কার্যকরী উত্তর হচ্ছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করা আমি তাদের সাথে একাত্নতা প্রকাশ করছি।
বাংলাদেশ, গতকাল আমি এই বিষয়টি তুলেছি এবং আমি ডেপুটি চেয়ারম্যান এর সাথে সহমত প্রকাশ করছি যিনি বলেছেন, বাংলাদেশের কারনে সেখানে দ্বন্দের সৃষ্টি হয়েছে, বাংলাদেশের জন্য সেখানে যুদ্ধ হয়েছে এবং আমরা কেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের এই তাড়নাকে বাধা দিবো। এই নিয়ন্ত্রনের পেছনে যুক্তি কি, আমি তা বুঝি না। আমি আশা করি এবং বিশ্বাস করি সরকার এই বিষয়ে পদক্ষেপ নিবে। আমি সরকারকে আশ্বস্ত করতে চাই যে পুরো জাতি তাদের পাশে এসে দাঁড়াবে এবং সংসদ ও তাদের সাথে থাকবে যদি তারা আজ ঘোষনা দেয় যে তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করবে। এটিই হবে সঠিক এবং কার্যকরী জবাব যা আমরা পাকিস্তানকে দিতে যাচ্ছি।

প্রতিরক্ষা নিয়ে একটি কথা, আমি আমার সম্মানিত বন্ধু জনাব ছাগলার সাথে একমত যখন তিনি বললেন এক্ষেত্রে প্রতিরক্ষামুলক যুদ্ধে কোন বিকল্প নেই। এই যুদ্ধে কোন প্রকারের বাধা থাকতে পারে না, এই দ্বন্দের কোন বাধা থাকতে পারে না। এই হিংস্রতার পুরষ্কার খুব ভালোভাবেই পেতে হয়েছে, যাতে আমরা খুব দ্রুত বিজয় অর্জন করতে পারি। অন্যভাবে, আমার ভয় হচ্ছে সেখানে হয়তো টানাটানি হবে, হয়তো দেরী হবে, হয়তো লক্ষ্য অর্জনে স্থগিত হতে পারে। যাইহোক, চলুন সবাই মিলে এটিকে সংক্ষিপ্ত আর ছোট করি। ইহা এই জন্যে আমি বলি যে, সরকার এবং সংসদ কে এক হয়ে কাজ করতে হবে। এবং আমাদের অবশ্যই থাকতে হবে, যাকে আমি বলি ইচ্ছাশক্তি, জাতীয় ইচ্ছা শক্তি –বাংলাদেশকে স্বাধীন করার। এবং এই কাজে যে কোন ধরনের ত্যাগ, যে কোন ক্লেশ, যে কোন দূর্ভোগ যে কোন পরিমাপের কষ্ট এবং জ্বালা জাতি হিসেবে আমাদের সহ্য করতে হবে। আমি নিশ্চিত জাতি হিসেবে আমাদের সেই শক্তি, ইচ্ছা শক্তি আছে এবং ঐক্য এবং দৃঢ়ভাবে আমরা নিশ্চিত যে এর সমাধান, ক্রিসমাসের আগেই করতে পারব এবং স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করবো এবং পাকিস্তানের সামরিক শাষনের পতন – সেটাও ক্রিসমাসের আগেই।

এরই সাথে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি।

ডঃ ভাই মহাবীর (দিল্লী)… মহোদয়, আমার শুধু এই বলার আছে, যে সংকটই আসুন না কেন আমার মনে পড়ছে, যখন ব্রিটেনের উপর এরুপ একটি যুদ্ধ পরিস্থিতি এসেছিলো তখন বলা হয়েছিল, বৃটেনের জন্য সেটি ছিল সংকটকাল, কিন্তু বাস্তবে দেখা গেলো, বৃটেনের সবচেয়ে অন্ধকার সময়ই ছিলো বৃটেনের সুন্দর সময়। এরুপ কোন পরিস্থিতি এসে থাকলে আজ সেটি আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বীরত্বপূর্ন অধ্যায়রুপে গন্য হবে, ১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট যে ভুল হয়েছিলো তা ধুয়ে মুছে সমগ্র দেশে আমরা একটি নতুন যুগের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করব।

…… মহোদয়, আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় ঐক্যের যে প্রয়াস চলছে নিজেদের মধ্যে অনৈক্যের মনোভাব কখনো কখনো তাতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় কিন্তু কোন শত্রু যদি এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দেয় যে, আমরা নিজেদের ঐক্যের কথা ভাবি, ঐক্যের মন্ত্র উচ্চারন করি, তাহলে তাদের প্ররোচনা আমাদের শোনা উচিত। ভারত আবার এক হয়ে দাঁড়িয়ে নতুন যুগ নির্মাণ করবে। আমাদেরও মতভেদ রয়েছে সত্যারূঢ় দল, প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রীকে অভিনন্দন জানাবো এবং তাদের বলব যে তারা এই দেশকে, ভারত মাতার শিরকে সাফল্যমন্ডিত করেছেন, এজন্য তারা ধন্যাবাদার্হ। এর সঙ্গে আমি অবশ্যই চাইবো, অন্যসব দল যেভাবে বিনাশর্তে সমর্থনের আশ্বাস দিচ্ছে সেভাবে সরকার ও সবকিছুর উর্ধ্বে একদলীয় সরকারের মত না ভেবে নিজেকে যেন সারা দেশের সরকার মনে করেন।

মহোদয়, আমি আরেকটি মাত্র কথা বলতে চাই, আমি মনে করি এই জরুরী অবস্থা ঘষনার সংগে সঙ্গে এই ঘোষনা আসবে যে ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এতে আর বিল্মব করা উচিত হবে না। পরিষদের এই ব্যাক্ত ইচ্ছার সঙ্গে আমি সরকারের সঙ্গে কণ্ঠ মিলাতে চাই। ধন্যবাদ।

শ্রী এম, কে মোহতা (রাজস্থান)ঃ জনাব সভাপতি, স্যার, শুরুতেই আমি পুনরাবৃতি করতে চাই, যা আমাদের পার্টির চেয়ারম্যান ইতোমধ্যে বিবৃতি দিয়েছেন, যথা, জাতীয় দূর্যোগের এই সময়ে জাতীয় প্রতিরক্ষা প্রচেষ্টায় আমাদের দল অঙ্গীকার করছে যে, আমরা পরিপূর্ন ও অকুন্ঠ সমর্থন দিবো। জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে এবং সারা পৃথিবীর দৃষ্টি এখন ভারতের জনগণের দিকে। আমরাই নির্ধারন করবো এই পরিস্থিতিতে আমরা কতটুকু উচ্চতায় উঠবো যাতে আমাদের সাহস ও সহিষ্ণুতা ও অভিপ্রায়ের সাথে একত্রে কাজ করতে পারি এবং এই সঙ্কট পুরোপুরি সফলতার সাথে মোকাবেলা করতে পারি। আমি বিশ্বাস করি একটি জরুরী অবস্থায় দলীয় মতভেদ, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ – বাদ দিতে হবে এবং একটি জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে। এটাতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব থাকবে, সকল রাজনৈতিক দলেরই এবং সকল রাজনৈতিক দলের সম্মেলনে গঠিত জাতীয় সরকারই এই যুদ্ধে এই দেশকে জয়ের দিকে এগিয়ে নেবে।

সংসদের ভুমিকার ব্যাপারে কিছু কথা বলতে চাই। যদিও সেখানে গভীর সঙ্কট বিরাজমান, তবে এটা জরুরী যে সংসদ বসবে, সরকারের কাছ থেকে সীমান্তের বিষয়ে বুঝে নেবে, কি পরিস্থিতি চলছে এবং সরকারের জন্য কি ভুমিকা কোন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে কি ব্যাবস্থা নেওয়া উচিত সে ব্যাপারে সংসদের পরামর্শ নেওয়া হবে।

শেষ করার আগে, আমি এটা বলতে চাইঃ আধুনিক যুগের যুদ্ধে একটি জাতির শক্তিমত্তার পরিমাপ শুধু সম্মুখসমরে কি পরিমাণ অস্ত্র প্রয়োগিত হচ্ছে অথবা কি পরিমাণ লোকের হাতে অস্ত্র আছে তা দিয়ে না, বরং জাতির অর্থনৈতিক শক্তির উপরও নির্ভর করে। যেকোন অর্থনৈতিক সংঘাতের ফলাফল নির্ভর করে আমরা অর্থনৈতিকভাবে কতোটা শক্তিশালী তার উপর। সেজন্য, এটা সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ যে সকল ভাবাদর্শ ভুলে যেতে হবে, সকল খুঁটিনাটি দ্বন্দ্ব ভুলে যেতে হবে। এই দেশের সামনে একমাত্র লক্ষ্য হতে হবে কিভাবে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে আরও শক্তিশালী করা যায়, সেটা মাঠে হোক, বা কারখানাগুলোতে, অধিক উৎপাদন এবং আয় করতে হবে। এটা কোন বিষয় না যে কে পণ্য উৎপাদন করছে এবং কিভাবে করছে। যেটা বিষয় সেটা হলো পণ্য অবশ্যই উৎপাদিত হতে হবে; অধিকতর পণ্য এবং সেবা উৎপাদিত হতে হবে সেটা মাঠে হোক বা কারখানায়। এবং সেজন্য আমি আপনার মাধ্যমে, জনাব, সরকারের কাছে আবেদন করবো সেসব ছোটখাটো বিষয় ভুলে যেতে যা অতীতে সরকারের চিন্তাধারাকে সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো, বরং সরকারের ও জনগণের সকল কর্মক্ষমতা সব রকমের উৎপাদন বৃদ্ধিতে নিয়োগ করতে যাতে অর্থনৈতিকভাবে আমরা শক্তিশালী হতে পারি, যাতে একটি মজবুত অর্থনীতি আমাদের সামরিক বাহিনিগুলোকে প্রয়োজনীয় ও পর্যাপ্ত সমর্থন দিতে পারে এবং এটা আমাদের বিজয়ের দিকে নিয়ে যাবে।

শেষ যে বিষয়টা আমি বলতে চাই তা হলো সীমান্তবর্তী অঞ্চলের মানুষেরা খুবই ন্যায্যত ও যথাযথভাবে আশা করছে যে সরকার অতি শীঘ্রই জরুরী ঝুঁকি বীমা ঘোষণা করবে যাতে শত্রুর যেকোনো কাযে বা নাশকতায় সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি সমগ্র ভারতের জনগণ বহন করবে এবং এর ধকল শুধুমাত্র সীমান্তবর্তী অঞ্চলে যারা বসবাস করে তারাই যাতে শুধু বহন না করে। এটা সীমান্তবর্তী অঞ্চলের মানুষদের বেশ কিছুকাল ধরেই চলে আসা সনির্বন্ধ দাবি এবং যেহেতু এখন জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে, আমি আশা করবো সরকার জরুরী ঝুঁকি বীমা ঘোষণা করতে দেরি করবে না যেমনটা কিছুকাল আগেও যখন দেশে এরকম জরুরী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিলো।
সভাপতি সাহেব ঃ শ্রী দেশাই

শ্রী দেবদত্ত পুরি (হরিয়ানা)ঃ জনাব, এই বিষয়ে ইতোমধ্যে ভোটাভুটি হয়েছে এবং একটা বা দুইটা বক্তৃতাও ……
(ব্যাঘাত)

জনাব সভাপতি ঃ দলগুলোর কয়েকজন সদস্য ইতোমধ্যে বলে ফেলেছেন।

শ্রী কে চন্দ্রশেখর(কেরালা) ঃ জনাব, যখন আপনি কয়েকজনকে আলোচনায় অংশ নেতে দেবেন, তখন আপনাকে বাকিদেরও বলার বলতে দিতে হবে। নতুবা আপনার উচিত কাউকেই অনুমতি না দেওয়া।

জনাব সভাপতি ঃ আমি এটা বলিনি, আমি ‘অনুমতি’ দিচ্ছি না। আমি আপনাকে আবেদনটি বিবেচনা করার অনুরোধ করছি; আমি বাকি সদস্যদেরকেও এই অনুরোধ জানাচ্ছি। আপনাকে অন্য সদস্যদের ইচ্ছাও বিবেচনা করতে হবে। আমি কখনোই বলিনি, ” আমি মঞ্জুর করবো না “।
শ্রী দেব দত্ত পুরি ঃ এই দিক হতে আমি সদস্যদের কাছে আবেদন করবো যে এটা একটা অনেক পবিত্র উৎসব।

শ্রী কে চন্দ্রশেখরন ঃ আমি অবশ্য আপনার উদ্দেশ্যে বলছিলাম না জনাব, বরং তার উদ্দেশ্যে
বলছিলাম। সংসদীয় বিষয়াবলী বিভাগের এবং নৌ-পরিবহন ও যাতায়াত মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী (শ্রীওম মেহতা)ঃ আমি শুধু এটাই বলবো যে এটা যেন সংক্ষিপ্ত হয়।

জনাব সভাপতি ঃ জনাব সারদেশাই, আপনি কি বলতে চান? আমি আপনাকে ডেকেছিলাম।
শ্রী এস জি শ্রীদেশাই(মহারাষ্ট্র) ঃ আমি শুনিনি। জনাব সভাপতি এই আইনসভা ইতোমধ্যে সর্বসম্মতিক্রমে সরকারকে সম্মতি জানিয়েছে যুদ্ধে লড়ার ব্যাপারে যা আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তবু আমরা চাই আমাদের উদ্দেশ্য হাসিল না হওয়া পর্যন্ত আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবো। লক্ষ্যের প্রতি অবশ্যই আমাদের সম্পূর্ণ পরিষ্কার থাকতে হবে। সেই লক্ষ্যের একটা অবশ্যই বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং দ্বিতীয়টা হলো আমাদের আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং নিরাপত্তার পুর্ণাঙ্গ প্রতিরক্ষা। এগুলোই মুল লক্ষ্য। আমি এগুলো বলছি কারণ যখন আমরা আমাদের লক্ষ্যের ব্যাপারে সাম্নের দিনগুলোতে সম্পূর্ণরূপে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকবো, কিছু ধারনা সামনে প্রকট হতে পারে এবং আজ আমাদের সম্পূর্ণরূপে সতর্ক থাকতে হবে আমাদের লক্ষ্যের বিষয়ে কারণ যুদ্ধ খুবই কঠিন হবে। আমরা নিশ্চিত যে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও আজাদি মেনে নিতে বাধ্য হবার আগ পর্যন্ত আমাদের যুদ্ধ করতে হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে, আমি সতর্কতার সাথে আরেকটা কথা বলতে চাই। আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের কোনও অংশ সম্পূর্ণরূপে দখলের জন্য যুদ্ধ করছি না।

এই বিষয়ে পরিষ্কার থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ, জনাব, এখানে উপস্থিত সবাই এটা বলেছেন এবং আমি সম্পূর্ণরূপে সম্মত যে আমাদেরকে আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে। আমাদেরএমন কোনও ধারণা পোষণ করা উচিত নয় যাতে আমাদের সম্প্রীতি বজায় রাখতে অসুবিধা সৃষ্টি হয়। এই দফাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমি এখনি এই বিষয় বিশদ ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না কারণ এই সংগ্রাম আমরা মাত্র শুরু করলাম। তথাপি শুরুর দিকে হলেও কয়েকটা বিষয় পরিষ্কার থাকা উচিত। কোন দয়া প্রদর্শন করা হবে না। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে যুদ্ধ করবো যতক্ষণ পর্যন্ত না সামরিক জান্তা হার মানতে বাধ্য হয়। আমার আমাদের ক্ষমতা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহও নেই।

আমি আরও দুই-একটা কথা বলতে চাই কারণ এই বিষয়ে কিছুই বলা হয় নাই। আমরা এই জরুরী অবস্থাকে সবাই সমর্থন করছি। যখন আমরা বলছি যে জনগণের সম্পূর্ণ ক্ষমতাই একটা মহৎউদ্দেশ্যে প্রয়োগ করা হচ্ছে, তখন এটার সঙ্গে অর্থনীতির প্রশ্ন, উৎপাদন অব্যাহত রাখার প্রশ্ন, নিত্য-ব্যবহার্য জিনিসপত্রের বণ্টনের প্রশ্নও জড়িত থাকে। তাই এটা একটা লালনপালনেরও প্রশ্ন যা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এই বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই এবং একথা বলতেও আমার কোনও দ্বিধা নেই যে ভারতীয় শ্রমিক শ্রেণীর একটা ভূমিকা আছে এবং তারা সেটা পালন করবে। এই বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে যখনি আমাদের জাতি বিপদের সম্মুখীন, যখনি আমরা সঙ্কটাপন্ন, শ্রমিক শ্রেণি কখনোই বেঈমানি করে না। দুঃখজনকভাবে, আমরা সবাই জানি যে এখানে মুনাফাভোগীরা আছে, সেইসব গুপ্তচরেরা যারা দেশের অর্থনীতিকে মুক্তিপণ বানিয়ে তার সুবিধা নেয়। এখন অবশ্যই আমি আবেদন করবো সরকারের দৃষ্টির প্রতি যাতে তারা কঠোরহস্তে শক্তভাবে সমস্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে যারা এই জাতীয় সমস্যাকে শোষণ করে নিজেদের সুবিধার্থে কাজে লাগাতে চায় তাদের বিরুদ্ধে।

আমি এই বিষয়ে আরও এক ধাপ এগোতে চাই, এবং সেটা হচ্ছে জনগণের নাগরিক অধিকারের প্রশ্ন। অনেক সময় দেখা যায় একটা সার্বজনিন পদক্ষেপ নেওয়া হয় যারা একত্রে সংগ্রহ করে বা বৈঠক ডাকে তাদের বিরুদ্ধে, কারণ জাতি বিপদের সম্মুখীন। এরকম যেন অবশ্যই না হয়। আমি এটা একদম পরিষ্কার করে বলতে চাই যে সকল প্রহসন যা আমাদের নিরাপত্তার জন্য প্রকৃতপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ এবং যারা দেশের ভেতরে সৈন্য সমাবেশ করে যেতে চায়; আমাদের দেশের নিরাপত্তাকে জোরদার করতে চায় তাদের তা করার অনুমতি দেওয়া হোক কারণ ব্যাপক পরিমানে গণশিক্ষা দরকার। এটা একটা নাগরিক অধিকারের প্রশ্ন। যদি সেখানে বিন্দুমাত্র ভয় থাকে যে কেউ বাধার সৃষ্টি করছে জনগণের ঐক্য, সাম্প্রদায়িক সম্প্রিতি ইত্যাদিতে, এগুলা যেন দমন করা হয়। কিন্তু বাকিদের জন্য, জনগণের গনতান্ত্রিক অধিকারকে সংহত করা এবং যুদ্ধের পক্ষে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ অবশ্যই সহায়ক হবে, এবং আমি আশা করবো ও আবেদন করবো সরকারের কাছে এবং আমি তাদেরকে দৃঢ়ভাবেজিজ্ঞাসা করবো যে অর্থনীতিকে চালু রাখার যে সম্পূর্ণ প্রশ্ন, নাগরিক অধিকারের যে সম্পূর্ণ প্রশ্ন তার প্রতি এমনভাবে অগ্রসর হতে হবে যেন আমাদের প্রতিরক্ষা দৃঢ়তর হয়। যারা আমাদের প্রতিরক্ষাকে দুর্বল করে, তাদের বিরুদ্ধে যেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আমাদের এই দুইটি বিষয়ে পরিষ্কার থাকতে হবে। আমি আশা করবো যে এটা খেয়ালে থাকবে।

শ্রী থিল্লাই ভিল্লালান (তামিল নাড়ু) ঃ জনাব, আমরা ইতোমধ্যে আমাদের দলের পক্ষ হতে এই সরকারের প্রতি ঐকান্তিক সমর্থন জানিয়েছি। এটা কাজের সময়, কথার সময় নয়। এটা সেই সময় যখন একতা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

আমরা কখনোই যুদ্ধে প্রবিষ্ট হই না। কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হলে আমরা ছেড়ে দিবো না। আমরা যদি সবাই মিলে ভ্রুকুটি দিয়ে তাকাই সেটা পুরো পাকিস্তানকে জ্বালিয়ে দিবে। আমরা একসাথে শ্বাস নিলে সেটা একটা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি করবে এবং সেটা পাকিস্তানকে কোন অজানা সাগরে নিক্ষেপ করবে। আমরা সবাই পাকিস্তানের বিপক্ষে একসাথে থুথু ফেললে তা অবশ্যই পাকিস্তানে এক বন্যার সৃষ্টি করবে এবং বিশ্বের মানচিত্রে পাকিস্তান বলে কিছু থাকবে না। তাই এই মুহূর্তে আমাদের দেশের জন্য প্রয়োজন কেবল একতা। তাই, আমি সকলের কাছে নিবেদন করবো যে একত্র হোন এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করুন। এই কথাগুলোর সাথে জরুরী অবস্থা ঘোষণাকে স্বাগত জানাই।

শ্রী কে চন্দ্রশেখরন ঃ জনাব সভাপতি, জনাব, এটা উদ্বেগের সময় নয়, যদিও আমরা অনেক বিপদের মাঝে আছি। স্বাধীনতার পরে এটা চতুর্থ ঘটনা – তিনবার পাকিস্তান দ্বারা ও একবার চীন দ্বারা -আমাদের দেশের স্বার্থ বিপন্ন হয়েছে। এবং পূর্বের মতই, আমার কোন সন্দেহ নেই যে এই দেশ অবশ্যই দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হবে এবং পদক্ষেপ নেবে যাতে আমরা স্বল্পতম সময়ের মধ্যে এই পরিস্থিতিমোকাবেলা করতে পারি।

স্যার এই জরুরী অবস্থার মধ্যেও সংসদ একটি চূরান্ত ভূমিকা পেয়েছে। সরকারের অবশ্যই দেখাঁ উচিত, সংসদ যে কোন পরামর্শ প্রদানে তার করনীয় দায়িত্ব পালনে সক্ষম আছে কিনা, এবং সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দায়িত্ব পালনে অস্বীকার করছে কিনা। একজন সম্মানিত সংসদ সদস্যের কাছ থেকে আমি শুনেছি যে, জাতীয় সরকার গঠনের সম্ভবত একটি চাহিদা আছে। আমি একমত নই। স্যার আমি মনে করি না যে প্রকৃতপক্ষে জাতীয় সরকার গঠন করার কোন প্রয়োজনীয়তা আছে, স্বাধীনতার পর আজ আমাদের কাছে সবচেয়ে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার আছে, এবং সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী প্রধানমন্ত্রী আছে। অতএব, সব শেষে, এখানে জাতীয় সরকার গঠন করার আসলেই কোন প্রয়োজনীয়তা নেই।
স্যার বিরোধী দলের নিশ্চতভাবেই দায়িত্ব ও কর্তব্য থাকবে। কয়েক মিনিট আগে আমরা কক্ষের প্রতিটি অংশে দেখেছি, সকল প্রতিনিধি এবং রাজনৈতিক দলের নেতারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন এবং আমাদের সামনের কঠিন সময়ে সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে তাদের সমর্থন ও অকুন্ঠ সহযোগিতা দিয়েছেন। কিন্তু স্যার বিরোধী দলকে অবশ্যি একটি গঠনগতভাবে জটিল পদ্ধতিতে এর দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হবে। আমি তাই সরকারকে সতর্ক করতে চাই যে, যদি কোন ভুল হয় তাহলে এই দেশের বিরোধী দল অকপটে সেই ভুল সরকারকে দেখিয়ে দেবে এবং সরকারকে এই ভুল স্বীকার করতে হবে ও সেগুলো সুধরাতে হবে। এমন না যে সরকার কোন ভুল বা অসাবধানতা ছাড়া কাজ করতে পারে। সংসদ এবং সংসদের বাইরে গঠনমুলক বিরোধী দল হিসেবে বিরোধী দল গুলো ভবিষ্যতে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারবে এবং যদি সরকার কোন ভুল করে তাহলে খেয়াল রাখবে যাতে সরকার সেটা সুধরায়। আমার মনে হয় সংসদে আগের চেয়ে আরো ঘন ঘন বসা উচিত। আমি আরো সুপারিশ করব যাতে বিশেষ করে প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা কমিটিকে একটি বিশিষ্ট ভুমিকা দেওয়া হয়। আমি এটাও সুপারিশ করব যে প্রতিরক্ষার সাংসদীয় উপদেষ্টা কমিটিকে উভয় সংসদীয় কক্ষের সকল দলের রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে অতিদ্রুত পুনর্গঠন করা উচিত।

মাননীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর বক্তব্যে যথার্থ ভাবে নির্দেশ করা হয়েছে যেটা তিনি আজ সকালেই বলেছেন, আমরা উৎপাদন দেখতে গিয়েছিলাম এবং এর ফলাফল বৃদ্ধি পেয়েছে এই জরুরী অবস্থার সময়ে। এই জরুরী অবস্থা চলাকালীন সময়ে আমাদের দেখতে হয়েছে, মূল্য বৃদ্ধির বদলে মূল্য স্থিতিশীলতা। এই সবের জন্য, দেশের শিল্পপতি ও ব্যাবসায়ীদের কাছ থেকে আন্তরিক সহযোগিতা প্রয়োজন। এবং সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে এবং জরুরী ব্যাবস্থা নিয়ে দেখতে হবে যাতে দাম বৃদ্ধি না পায় এবং দেশে অবিরাম উৎপাদন অক্ষুন্ন থাকে। এমনকি, যদি আমরা পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে জয়ী হই, আমরা দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হারতে পারবো না যা আমাদের দেশের ভেতরে অনবরত চলছে। পরিকল্পনা কমিশন, পরিকল্পনা মন্ত্রনালয় এবং পরিকল্পনা মন্ত্রীকে আরো ভালো করায় মনোযোগী এবং কথায় আরো বেশি আন্তরিক হতে হবে ভবিষ্যতে এই দেশের উন্নয়নে পরিকল্পনার সামগ্রিক গঠনে এবং পরিকল্পনার সাফল্যের জন্য। এর সাথে, এই জরূরী অবস্থা চলাকালীন সময়ে আমি সরকারের কাজে আমার সহযোগিতার হাত আরো প্রসারিত করবো।

জনাব চেয়ারম্যানঃ জনাব শ্যাম লাল ইয়াদেভ- আমার তালিকার সর্ব শেষ বক্তা।

শ্রী শ্যামলাল যাদব( উত্তর প্রদেশ)ঃ সভাপতি মহোদয়, আজকের সংকট কালে সকল দল সরকারের সংগে রয়েছে, আমাদের দলের সভাপতি, চৌধুরী চরন সিংহ এর আগে পরিষদের বাইরেও একথা সুষ্পষ্ট ভাবে বলেছেন যে, এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হলে আমাদের দেশের সৈন্যদের এরূপ প্রস্তুতি রয়েছে যে আমরা পাকিস্তানী আক্রমনের মোকাবেলা করতে পারব এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত করতে পারব। সকল দলের মাননীয় নেতৃবৃন্দ যেমণ বলেছেন, আমিও বলতে চাই, সরকারের আর একটি মুহুর্ত মাত্র বিলম্ব না করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া উচিত। এর ফলে যে অবস্থা বিরাজ করবে তাতে আমরা আমাদের সীমান্ত রক্ষ আকরতে পারব। আজ সকল বিরোধী দল সরকারের সহযোগীতা করতে প্রস্তুত, আমরা আশা করি, দেশের এই সংকট কালে সরকার ও সকল দলের সহযোগীতা গ্রহন করবেন।

সভাপতিঃ জনাব জগজীবন রাম, আপনি কি কিছু বলতে চান?

শ্রী জগজীবন রামঃ আমার বেশি কিছু বলার নেই। সংসদ ভালো মতই জানে কোন পরিস্থিতিতে এই জরুরী অবস্থা জারি করা হয়েছিলো। সংসদ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসমূহ, এবং তাদের নেতারা, এবং জাতি সমূহ জাতীয় নিরাপত্তা দিয়ে তাদের সংহতি প্রকাশ করেছে। আমি শুধু এটাই বলতে পারি, যে সমগ্র জাতি আজ সামরিক বাহিনীর পেছনে আছে তাদেরকে নতুন আস্থা দিয়ে, তাদের নতুন কর্মদক্ষতা দিয়ে, নতুন কার্যকরীতা দিয়ে। আমার কোন সন্দেহ নেই যে সামরিক বাহিনী জাতির প্রত্যাশা পূরন করবে এবং পাকিস্তানকে এমন শিক্ষা দিবে যা তারা সারা জীবন মনে রাখবে। সুতরাং আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই পাকিস্তানের সীমানা বৃদ্ধিতে আমাদের কোন ইচ্ছা নেই..

শ্রী এ ডি মানী (মধ্য প্রদেশ)ঃ পাকিস্তানের জনগনের সাথে কোন প্রকার ঝগড়া নয়।

শ্রী জগজীবন রামঃ অবশ্যই আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন। এটাই সংকল্প এবং বাংলাদেশের মানুষের ইচ্ছা যা তারা নির্ভূল ভাবে নির্দেশ করে দিয়েছে শেষ নির্বাচনে। এবং আমি আবারো পরিষ্কার করে বলতে চাই যে পাকিস্তানের সীমানা বৃদ্ধিতে আমাদের কোন ইচ্ছা নেই…
ডঃ ভৈমহাবীরঃ কাশ্মির যুদ্ধ।

শ্রী জগজীবন রামঃ আমরা যা চাই তা হলো, পাকিস্তানের উচিত বন্ধু পূর্ন প্রতিবেশি হিসেবে থাকা এবং মূল্যবোধের লালন করা, যা বর্তমান সময়ে ভালো মানবিক মূল্যবোধ বলে মনে করা হয়, সেই মূল্যবোধ গুলো জাতিসংঘের সনদে উল্লেখ্য আছে, যা আমরা আমাদের নিজেদের সংবিধানে সন্নিবেশিত করা হয়েছে, গনতন্ত্রের মূল্যবোধ, ধর্ম নিরপেক্ষতার মূল্যবোধ। এটাই আমরা চাই। এই যুদ্ধের উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমাদের সংবিধানে সন্নিবেশিত লালিত মূল্যবোধ রক্ষার জন্য হবে। এবং এই সংহতি আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে আরো সাহসী করবে, যা সংসদ ইতমধ্যে নির্দেশ করেছে যেমন টা আমি বলেছি, সংসদে তাই নির্দেশিত হয়েছে যে, আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে সাহসী করা হবে, এবং তাদের উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য দক্ষতা বারাতে হবে।
সভাপতিঃ প্রশ্ন হচ্ছে…

“সংবিধানের ৩৫২ অনুচ্ছেদের দফা (১) অনুযায়ী, ৩রা ডিসেম্বর ১৯৭১ এ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জারি কৃত জরুরী অবস্থার ঘোষনা সংসদে অনুমোদন”

প্রস্তাব গ্রহন করা হয়েছে
জনাব সভাপতিঃ সর্বসম্মতিক্রমে সমাধান গৃহীত হয়েছে।

শিরোনাম সুত্র তারিখ
২১০। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি রাজ্যসভার কার্যবিবরণী ৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১

Ayon Muktadir
<১২, ২১০, ৭৫০-৭৬০>

বাংলাদেশের স্বীকৃতির ব্যাপারে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি

প্রধানমন্ত্রী, আনবিক শক্তি বিষয়ক মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তথ্য ও সম্প্রচার বিষয়ক মন্ত্রী (শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী): মি: চেয়ারম্যান স্যার, অকল্পনীয় বাধার বিপরীতে বাংলাদেশের জনগনের সাহসী যুদ্ধ স্বাধীনতার আন্দোলনের ইতিহাসে সাহসিকতার একটি নতুন অধ্যায়ের সুচনা করেছে।

এর আগে তারা গনতান্ত্রিক বিজয়ের এক নমুনা রেখেছে নির্বাচনের মাধ্যমে এবং এমনকি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টও শেখ মুজিবর রহমানের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার ব্যাপারটা মেনে নিয়েছিলেন। আমরা কখনই জানতে পারব না কিভাবে এই বাস্তবসম্মত ও মহান অনুভুতি, যদি আসলেই তা থেকে থাকতো, বদলে গেল প্রতারণা ও ঘৃণার বহিঃপ্রকাশে।

আমাদের জানা ছিল যে শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দল, আওয়ামী লীগ, পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারের বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলনের পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু তারা সম্পুর্ন অপ্রস্তুত অবস্থায় ভয়ঙ্কর সামরিক আক্রমনের মুখে পরেছে। এই অবস্থায় স্বাধীনতা ঘোষণা করা ছাড়া তাদের কোন উপায় ছিল না। ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে গঠিত হয় মুক্তি ফৌজ, যা পরিণীত হয় মুক্তিবাহিনীতে, যাদের সাথে যোগ দেয় পুর্ব বাংলার হাজার হাজার মুক্তিপাগল তরুন যারা নিজেদের ভাগ্য নিজেরা গড়তে চেয়েছিল। যে একতা, একাগ্রতা ও সাহসের সাথে বাংলাদেশের জনগন লড়ে যাচ্ছে তা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমগুলো তুলে ধরেছে।

পাশের দেশের এসব ঘটনা এবং এর ফলে তৈরি সীমান্ত পার হয়ে আসা শরনার্থীদের ঢল আমাদের দেশের উপর সুদূরপ্রসারী ছাপ রাখবে নিঃসন্দেহে। এটাই স্বাভাবিক ছিল যে আমাদের সহানুভুতি থাকবে ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবীতে সংগ্রামরত বাংলাদেশের জনগনের দিকে। কিন্তু তাদের স্বীকৃতির ব্যাপারে আমরা কোন হঠকারী সিদ্ধান্ত নেইনি, আমাদের সিদ্ধান্তগুলো স্রেফ আবেগের বশে নেয়া নয়, বরং বর্তমান ও ভবিষ্যত বাস্তবতার পর্যালোচনার মাধ্যমে নেয়া।

বাংলাদেশের জনগনের একাট্টা হয়ে ফুঁসে ওঠা এবং তাদের সংগ্রামের সাফল্যই পরিস্কার ভাবে বলে দিচ্ছে যে তথাকথিত মাতৃরাস্ট্র পাকিস্তান বাংলাদেশের জনগণকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে সম্পুর্ন অক্ষম। আর বাংলাদেশের সরকারের আইনগত বৈধতার প্রসঙ্গে এখন সারা দুনিয়া জানে যে এতে সারা বাংলাদেশের জনমতের প্রতিফলন আছে, যা কিনা অনেক দেশের সরকারই দাবী করতে পারে না। গভর্নর মরিসের প্রতি জেফারসনের বিখ্যাত উক্তি মত বলতে হয়, বাংলাদেশের সরকার “জনগনের পরিপুর্নভাবে প্রকাশিত মতামত” এর মাধ্যমেই সমর্থিত। একথা ধরে নিলে, পাকিস্তানের সামরিক শাসক, যাদেরকে রক্ষা করার জন্য কিছু দেশ উদগ্রীব, কোনভাবেই তাদের জনগণকে, এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণকেও প্রতিনিধিত্ব করে না।

এখন যেহেতু পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, তাই শান্তিপুর্ন সমাধানের আশায় আমাদের ধৈর্য ধরা, যা না করলে কেউ বলতে পারে যে আমরা হস্তক্ষেপ করছি, এই ধৈর্যর কোন মানে আর নেই। বাংলাদেশের জনগন, যারা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার খাতিরে যুদ্ধ করছে এবং ভারতের জনগন যারা শত্রুর আক্রমন থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার যুদ্ধ করছে, এখন একসাথে, একই লক্ষ্যে কাজ করছে।

আমি অত্যন্ত আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে, বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে এবং বাংলাদেশের সরকারের পুনঃ পুনঃ অনুরোধের ভিত্তিতে ভারতের সরকার, সকল বিষয় ভেবে চিনতে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ কে স্বীকৃতি দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

আমাদের আশা আছে যে সময়ের সাথে সাথে আরো অনেক দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে এবং অতি শীঘ্রই বাংলাদেশ পরিপুর্ন দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে।

এই সময়ে আমরা স্মরণ করছি এই নতুন দেশের জন্মদাতা শেখ মুজিবুর রহমানকে। আমি নিশ্চিত যে এই রাজ্যসভা চাইবে যাতে আমি অবিলম্বে বাংলাদেশের মাননীয় ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে এবং তাদের সহযোগীদেরকে আমাদের উষ্ণ অভিনন্দন জানাই।

আমি এই সভাতে বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে পাওয়া তথ্য পেশ করছি। সন্মানিত সদস্যরা জেনে খুশি হবেন যে বাংলাদেশ সরকার তাদের দেশ পরিচালনার মূলমন্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে গনতন্ত্র, সমাজতন্রে, ধর্মনিরেপক্ষতা, এবং এমন একটি বৈষম্যহীন সমাজ গঠন, যেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ন বা লিঙ্গ ভেদে কোন বৈষম্য থাকবে না। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে যে নীতিগত ভাবে তাঁরা জোটনিরপেক্ষ, শান্তিপুর্ন সহাবস্থানের পক্ষে, এবং সব ধরনের ঔপনিবেশিকতা, স্বাজাতিকতা ও সাম্রাজ্যবাদ এর বিপক্ষে। ভারতএসব ব্যাপারে নীতিগতভাবে একই অবস্থানে আছে।

বাংলাদেশ সরকার বারবার তাদের দেশের যেসকল জনগন আমাদের দেশে সামায়িকভাবে আশ্রয় গ্রহন করেছে তাদের ফেরত যাবার ব্যাপারে এবং তাদের সহায়সম্পত্তি তাদের কাছে ফিরিয়ে দেবার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আমরা অবশ্যই এ ব্যাপারে তাদেরকে সর্বাত্বক সহায়তা দেব।

আমি বিশ্বাস করি যে আগামীতে বাংলাদেশ ও ভারত সরকার, যারা একই নীতি ও ত্যাগে বিশ্বাসী, একে অপরের সার্বভৌমতা, আঞ্চলিক সুরক্ষা, পারস্পরিক সহায়তা ও একে অন্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার ভিত্তিতে সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক গড়ে তুলবে। এভাবেই মুক্তি ও গনতন্ত্রের জন্য এক সাথে কাজ করে আমরা সুপ্রতিবেশী হবার ক্ষেত্রে উদাহরণ হয়ে উঠব, এবং এভাবেই শুধু এই অঞ্চলে শান্তি, স্থিতি ও প্রগতি নিশ্চিত করা সম্ভব। বাংলাদেশের প্রতি আমাদের শুভ কামনা।

সকাল ১১ টা

বিরোধীদলীয় নেতা (শ্রী এম এস গুরুপাড়াস্বামি): জনাব, আমি প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতিকে মুক্ত বাংলাদেশের জন্য ম্যাগনা কার্টা হিসেবে দেখছি। এটি এই বছরের এবং এই দশকের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন এবং ঐতিহাসিক বক্তব্য, এবং এই বিবৃতির মাঝেই আছে এই উপমহাদেশের ভবিষ্যৎ নতুন করে গঠনের অপার সম্ভাবনা। জনাব, আমার হৃদয় আজ আপ্লুত হয়েছে এবং আমি নিঃশঙ্কচিত্তে বলতে চাই যে আমার দৃষ্টিতে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এই উপমহাদেশের জীবন্ত জোয়ান অফ আর্ক হিসেবে আবির্ভুত হয়েছেন; জোয়ান অফ আর্ক মৃত্যুবরণ করেই বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বেঁচে থেকেই বিজয় অর্জন করেছেন। এই ক্ষণ শুধু আমাদের মনেই নয়, আমাদের ইতিহাসের খাতায়ও লেখা থাকবে …

শ্রী এম পি শুকলা (উত্তর প্রদেশ): সোনার অক্ষরে।

শ্রী এম এস গুরুপাড়াস্বামি: এবং এই সিদ্ধান্তটি শুধুমাত্র এই দেশের লাখো মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হবে তাই নয়, বরং এশিয়া ও আফ্রিকার লাখ লাখ মুক্তিকামী জনগনের জন্যে আশার বানী হয়ে আসবে। এটি এমন একটি সিদ্ধান্ত যাকে সমগ্র দুনিয়া স্মরণ রাখবে।

শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী দেখিয়ে দিয়েছেন, একটি গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কি করা উচিত, কি অবশ্যকর্তব্য এই ধরনের সমস্যায়। তিনি অত্র এলাকা থেকে আসা বিভিন্ন ধরনের চাপও একটি গনতান্ত্রিক দেশ হিসেবে সহ্য করেছেন।

আমার বক্তব্য দীর্ঘায়িত না করেই আমি আমি বলতে চাই, যে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শুধু আমার বা আমার দলের সকল সদস্যেরই নয়, এখানে উপস্থিত সবারই ভালো লেগেছে। আমি শুধু তার বক্তব্যের সাথে সুর মিলিয়েই তাঁকে উপদেশ দেবো যাতে তিনি পৃথিবীর সকল দেশের সরকারকে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেবার জন্য লিখিত আহ্বান জানান। আমি তাঁকে এবং ভারতের সরকার এবং জনগনকে অভিনন্দন জানাতে চাই এমন একটা মহান মুহুর্ত আমাদেরকে উপহার দেওয়ার জন্য, যখন আমরা একটি নতুন দেশ ও দেশের মানুষদেরকে স্বাগত জানাচ্ছি, যারা মুক্তি, মানবিক মূল্যবোধ ও ন্যায়বিচারের পক্ষে।

এই বক্তব্যের মাধ্যমে আমি প্রধানমন্ত্রীর নেয়া এই অসাধারন সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমার ও এখানে জড়ো হওয়া আমার সহকর্মীদের আনন্দ ব্যক্ত করছি।

শ্রী দয়াভাই ভি প্যাটেল (গুজরাট): মি: চেয়ারম্যান, আমিও আমার পুর্ববর্তী দুজন বক্তার সাথে সুর মিলিয়ে বলতে চাই। আমাদের সবার উচিত প্রধানমন্ত্রীকে তার বিজ্ঞ নেতৃত্বের জন্য অভিনন্দন জানান। আমার মনে আছে তাঁকে অনেকবার সবার কাছ থেকে বাংলাদেশকে দ্রুত স্বীকৃতি জানানোর জন্য চাপ সহ্য করতে হয়েছে। প্রতিবারই তিনি জানিয়েছিলেন যে এটা সঠিক সময় নয়, এবং তিনি সঠিক সময়েই কাজটি করবেন। তিনি তার কাজের মাধ্যমে প্রমান করে দিয়েছেন যে তিনি দরকারের সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। একই সাথে আমি এই সুযোগে আমাদের সেনাবাহিনী, সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রিকে তাঁরা যেভাবে প্রতিকুল অবস্থার মোকাবেলা করেছেন সেজন্যে অভিনন্দন জানাতে চাই। আমাদের উপর একটি ন্যাক্কারজনক হামলা করা হয়েছে, তারা ভেবেছিল আমরা অসতর্ক থাকব। আমারদের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং তার সহকর্মীরা এক ধাপ এগিয়ে ছিলেন এবং এরচেয়েও খারাপ হামলার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। ঈশ্বর এই দেশের উপর দয়াবান আছেন। চলুন আমরা এক হই তাঁর আশির্বাদের জন্য, যাতে আমরা এরকম বাঁধা বারবার পেরিয়ে যেতে পারি এবং দেশের প্রয়োজনে এক থাকতে পারি।

শ্রী ভুপেশ গুপ্ত (পশ্চিম বাংলা): জনাব আজ এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এক ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এই ঐতিহাসিক মুহুর্তে, এবং এই প্রক্রিয়ার সাথে সংযুক্ত থাকতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে হচ্ছে। গত বিশ বছর ধরে আমার সুযোগ হয়েছে প্রধানমন্ত্রী ও সরকার থেকে আসা এই হাউসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত শোনার কিন্তু আমি মনে করতে পারছিনা শেষ কবে আমাদের দেশ এবং গোটা মানবজাতির জন্য এত গুরুত্বপুর্ন সিদ্ধান্ত এর আগে নেয়া হয়েছে।এই সিদ্ধান্ত একাধারে মানুষের প্রতি গভীর সহানুভুতি, অসাধারন রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও অসামান্য রাষ্ট্রনায়কোচিকতার প্রতীক। এই সিদ্ধান্ত, দেশের সীমানা ছাড়িয়ে মানবতা ও ইতিহাসের ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রার ছাপ রাখতে চলেছে। সুতরাং, প্রধানমন্ত্রী এবং ভারত সরকার শুধুমাত্র এই সভায় উপস্থিত সবার থেকেই নয়, বরং পৃথিবীর যাদের কাছে মানবতার লঙ্ঘন অগ্রহণযোগ্য সেইসব মুক্তিকামী মানুষের কাছ থেকেই ধন্যবাদার্হ হলেন। আমি জানি এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আমরা ত্যাগ, দুঃখ ও বীরত্বের মাধ্যমে অর্জিত এই উপমহাদেশের ইতিহাসের এক স্বর্নালি অধ্যায়ের সুচনা করলাম, যা লেখা থাকবে স্বর্নাক্ষরে।এই সিদ্ধান্ত, নিশ্চিত করলো বাংলাদেশের জন্ম, আমি যেখান থেকে এসেছি, যেখানে আমার জন্ম …

শ্রী এ ডি মানি (মধ্য প্রদেশ): ময়মনসিংহ।

শ্রী ভুপেশ গুপ্ত: একটি ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক দেশই চায় বাংলাদেশের এবং এই উপমহাদেশের জনগণ। আমি এই সিদ্ধান্তের মাঝে দেখতে পাই সেই মাটির ইতিহাস যেখানে নারী পুরুষ সবাই সব বাধা ভেঙ্গে আজ তাদের আকাঙ্ক্ষিত বিজয় লক্ষ্যের দিকে সাহস ও আত্মবিশ্বাসের সাথে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি ভারতের জনগনের পক্ষ থেকে তাদেরকে অভিনন্দন জানিয়ে তাদের আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করছি। আজকের এই সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র ভারত সরকারের নয়, সমগ্র ভারতের জনগন, সকল দেশপ্রেমিক, এমনকি এই পৃথিবীর সকল স্বাধীনতা ও গনতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন। আমি আশা করছি আজকে আমরা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, খুব শীগগিরই পৃথিবীর শান্তিকামি, মুক্তিকামি ও উন্নতিকামী দেশগুলোও সেরকম সিদ্ধান্ত নেবে। আমি আবারো বাংলাদেশের জনগনের কল্যান কামনা করছি এবং আজকের এই সিদ্ধান্তের পেছনে যারা কাজ করেছেন তাদের সবাইকে অভিনন্দন জানাই। আমি ইতিহাসের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে। ইয়াহিয়া খান এখন অতীত ইতিহাস। সে ধ্বংস হবে, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, আর আমরা বাংলাদেশের ও মানবতার খাতিরে বাংলাদেশের উত্থানের আশা করছি।

শ্রী রাজ নারায়ণ (উত্তর প্রদেশ): মহোদয়, আমি সবার আগে বাংলাদেশের জনসাধারন, আওয়ামী লীগ, শেখ মুজিবুর রহমান, নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দিন, এবং মুক্তিবাহিনীকে আমার মোবারকবাদ জানাব, তাঁরা তাঁদের, নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টা ও বিরামহীন, সংগ্রামের দ্বারা আমাদের নিকট হতে স্বীকৃতি আদায় করেছেন।

মহোদয়, আমি ভারতের জনগনকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি, ভারতের জনগণ আপ্ন নিষ্ঠা এবং তাদের জীবনের সংগ্রামী ভুমিকার পরিচয় দিয়েছে। তারাও পৃথিবীর বড় বড় শক্তির মোকাবেলা করেছে, ১২ আগস্টে এই পরিষদে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার জোর দাবী জানানোর জন্য আমাকে ধাক্কিয়ে বের করে দেয়া হয়, অন্ততপক্ষে আমার সেই স্বপ্ন পুরন হয়েছে। ভারত সরকার আমার অনুসৃত পথে আসতে বাধ্য হলেন এজন্য আজ আমি সুখি ও প্রসন্ন। … সামনে আমাদের আরো কাজ রয়ে গেছে। আগে যেমন ইঙ্গিত দিয়েছিলাম আজও দিচ্ছি। আমি চাই ভারত এমন শক্তি অর্জন করুক যাতে আমেরিকা ও বৃটেনের মত সুবিধাবাদী দেশগুলো বুঝতে পারে যে, ভারত আজ ঐক্যবদ্ধ, ভারত অ পাকিস্তানের একত্রীকরণের জন্য যতদিন ভারত ও পাকিস্তান এক না হবে, যতদিন ভারত ও পাকিস্তান একীভূত না হবে, ততদিন ভারত ও পাকিস্তানের দরিদ্র ও মেহনতি মানুষের উদ্দেশ্য সফল হবে না। এ জন্য সম্পুর্ন শক্তি দিয়ে আমাদের জানিয়ে দিতে হবে, আমেরিকা হোক কিংবা বৃটেন – তোমরা যতই শক্তিধর হওনা কেন, যতই সম্পদশালী হওনা কেন, আমরাও ৫৫ কোটি মানুষের দেশ, সুতরাং ৫৫ কোটি মানুষের দেশের সাথে আর খেলা নয়, তোমরা অনেক ষড়যন্ত্র করেছ। আমার অনেক বন্ধু যথার্থই বলেছেন যে, আমেরিকা, বৃটেন ও রাশিয়ার চক্রান্তে হিন্দুস্থান ভাগ হয়েছে, ভারত ও পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছে, আমরা এক হিন্দুস্থান গড়তে চাই।

সারা বিশ্বের সেরা ভারত আমাদের, আমরা বুলবুল, এটি আমাদের কানন। আমরা সেই ভারত গড়তে চাই। বাংলাদেশের স্বাধিনতা সেই ভারত গড়ার প্রথম সোপান। এজন্য আমাদের লক্ষ্য আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে। এই লক্ষ্য অর্জনে, ভারত ও পাকিস্তানের একত্রীকরণের লক্ষ্যকে অব্যর্থ রাখতে হবে। ১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ জুন এ,আই,সি,সি (অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কনফারেন্স) দিল্লীর বৈঠকে কংগ্রেস যে প্রস্তাব গ্রহন করেছিল সেটি আবার স্মরন করুন। দ্বিজাতিতত্ব চিরতরে নির্মূল হয়ে যাবে। দ্বিজাতিতত্ব নির্মূল হতে চলেছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাথে সাথেই এই তত্বের বিলুপ্তি ঘটেছে। এর জন্য মুজিবুর রহমানকে যতই ধন্যবাদ জানানো হোক তা নগন্য হবে।

সভাপতি: হ্যাঁ, এখন সিপিএম থেকে কে বলবেন? হ্যাঁ, জনাব স্যান্যাল।

শ্রী শশাঙ্ক শেখর স্যান্যাল (পশ্চিম বঙ্গ): আমি আমার তরফ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে যে সংবর্ধনা ও অভিনন্দন জানানো হচ্ছে তাতে শামিল হচ্ছি এবং প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি তাদেরকে, যারা এটা নিয়ে লড়াই করেছেন, আমাদের দেশে এবং বাংলাদেশে, যারা ইতিমধ্যেই তাদের প্রান উতসর্গ করেছেন এবং প্রান দিতে প্রস্তুত আছেন।

জনাব, দয়া করে আমার বাচালতা ক্ষমা করবেন, ১৯৮৭ সালে, যখন প্রিয় ইন্দিরাজীর পিতা ছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী, আমি তখন কেন্দ্রীয় সংসদে কংগ্রেসের পেছনের সারির একজন সদস্য, যখন দেশবিভাগ হয়, আমি ভাঙ্গি কলোনিতে মহাত্মা গান্ধীকে দেখতে যাই, আমি আমার খদ্দর এর কাপড় সেখানে রেখে এসে, আমার খদ্দরের কোট আর চাদর ভিজিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলাম যে কংগ্রেস বিশ্বাসঘাতকতা করেছে উপরে দিল্লির সাথে, আর নীচে আমার বাংলার সাথে।

জনাব, সেদিনটি থেকে আমি অনেক কষ্টে ছিলাম। কিন্তু আজকে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি, নিজেকে অভিনন্দন জানাচ্ছি এই কারনে যে আজ আমি পাকিস্তানের মরন দেখে যেতে পারছি। যা বাকি আছে, সে হচ্ছে পাকিস্তানের প্রেতাত্মা, এবং তারা এই প্রেতাত্মার যন্ত্রণা ভোগ করবে যারা তারা ভারতও না, বাংলাদেশও না, এমন কি বাকি থাকা পাকিস্তানেরও কোন অংশ না, এই যন্ত্রণা ভোগ করবে জাতিসংঘের কিছু অর্বাচিন সদস্য। তারা ভোগ করুক সেই যন্ত্রণা বারবার। এখন মুক্তি ছড়িয়ে পরবে সবখানে, বাংলাদেশে, আমি এটাই আশা করেছিলাম প্রিয় ইন্দিরাজীর কাছ থেকে – তাঁর বাবা ছিলেন আমার সহকর্মী, তাঁর দাদা ছিলেন আমার সহকর্মী, আমরা একসাথে কাজ করেছি, যাতে তিনি সাফল্য থেকে সাফল্যে পদচারণ করতে পারেন, এবং যাতে তিনি দেখতে পান যে এই উপমহাদেশের সংগ্রামী জনগণ আজ এক নতুন পতাকার নিচে এসে হেসে উঠছে, যে পতাকা উড়ছে ইন্দিরা গান্ধীর মাথার উপরে।

শ্রী তিল্লাই ভিল্লালান (তামিল নাড়ু): আজকের এই আনন্দের দিনে, আমিও আনন্দে যোগ দিচ্ছি নানান দলের নেতাদের সাথে। আমি এই সুযোগে অভিনন্দন জানাই আমাদের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে (বাঁধা)। যেমনটি তিনি বারবার বলেছিলেন এই সভায়, ঠিক সেভাবেই সঠিক সময়ে বাংলাদেশের স্বীকৃতি দিয়ে তিনি প্রমান করেছেন যে তিনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাস্ট্রনায়ক এবং শ্রেষ্ঠ প্রশাসক।
জনাব, আমরা ধর্মীয় আলোচনায় বলে থাকি যে শক্তি সিভান(Sivan) এর চেয়ে বেশি শক্তিশালী। রাজনীতির মাঠেও তিনি (ইন্দিরা) প্রমান করেছে দিয়েছেন যে শক্তি সবার উপরে (বাঁধা)। এরপরে আমি বলতে চাই যে, যে হাত মাতৃস্নেহে দোলনা দোলায়, সেই হাত এখন বাংলাদেশের মুক্তির দোলনার দোল দিচ্ছে (বাঁধা)। এই কঠিন সিদ্ধান্ত নেবার মাধ্যমে তিনি প্রমান করেছেন যে তিনি এই পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাস্ট্রনায়ক, মহিলা রাস্ট্রনায়ক (বাঁধা) … তাই আমি তাঁকে অভিনন্দন জানাই।

একই সাথে সরকারের পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ সংক্রান্ত সমস্ত সিদ্ধান্তে আমার সর্বান্তকরণ সমর্থনের কথা আমি আমি জানিয়ে দিয়ে চাই।

আমার কথা আমি শেষ করতে চাই এই বলে, শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘজীবি হোন, বাংলাদেশ দীর্ঘজীবি হোক, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা দীর্ঘজীবি হোন!

শ্রী এ কে এ আব্দুল সামাদ (তামিল নাড়ু): আমার দল ও আমার তরফ থেকে আমি সরকারের বাংলাদেসকে স্বীকৃতি দেবার এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। আমাদের পুরো দেশের জনগণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাইছে বেশ কিছুদিন ধরেই। কিন্তু আমাদের সরকার সঠিক সময়েই সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে … (বাঁধা)। আমি প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর সরকারকে ধন্যবাদ জানাই এবং আবার জানাতে চাই যে মুসলিম লীগ পুরো দেশের সাথে এক সাথেই আছে … (বাঁধা) এই কঠিন সময়ে আমরা সরকারের এই মহৎ সিদ্ধান্তের সমর্থন করছি।

ধন্যবাদ।

শ্রী কুম্ভরাম আর্য (রাজস্থান): সভাপতি মহাশয়, আজকের ঘোষণার পর থেকে আমাদের উপর বিপদ শুরু হল এবং সর্বাধিক বিপদজনক সময় আমাদের সামনে রয়েছে। এ যাবত আমরা বাংলাদেশের সহায়তাকারী ও তার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলাম কিন্তু আজ হতে আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে হাত মিলালাম, আজ হতে তাদের সাথে আমাদের মিত্রতা, তাদের এবং আমাদের কল্যান এক হয়ে গেছে। তাদের কোন অনিষ্ট হলে আমাদের দুর্ভোগ হবে, এজন্য বাংলাদেশে যত পাকিস্তানি সৈন্য রয়েছে প্রত্যেককে অতিসত্বর বাংলাদেশ হতে পাঠিয়ে দিতে হবে, এদিকে প্রথমেই দৃষ্টি ফেরানো উচিত। সেখানে পাকিস্তানী সৈন্যের একদিনের অবস্থান আমাদের দেশ এবং বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর। পশ্চিমের ফ্রন্টে দৃঢ় অবস্থান গ্রহন করে পুর্ব ফ্রন্ট থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের বের করে দেয়াই আমাদের সর্বপ্রথম জরুরি কাজ যাতে একটি সৈন্যও আর অবশিষ্ট না থাকে। এটি হলে বাংলাদেশ ভেতর দিক থেকে তো সুরক্ষিত আছেই ফলে পাকিস্তান বুঝতে পারবে ভুল পন্থা অবলম্বনের পরিনাম কি হয়। ইঙ্গিতস্বরূপ আমি এ কথা আপনাদের সামনে উপস্থিত করছি। আমাদের দেশ এবং এই পরিষদ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আছে, সবসময় থাকবে। আমি আরেকবার প্রধানমন্ত্রী মহোদয়কে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

শ্রী গঙ্গা শরন সিংহ (নাম নির্দেশিত) মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়, আজ একটি ঐতিহাসিক দিন। আমি তো মনে করি ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর আজকের দিনটির মত কোনদিন আর আসেনি।

বাংলাদেশের সরকার একটি সাধারন সরকার নয়। এটি সাম্প্রদায়িকতার চিতা হতে উদীয়মান একটি সুর্য, একে আমরা মেনে নিয়েছি। আমি এও মনে করি যে, বাংলাদেশের সরকার গঠন, বাংলাদেশের স্বীকৃতি শুধু এশিয়ার নয়, বরং সারা বিশ্বের জন্য এক স্মরণীয় ঘটনা। কিন্তু আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে যে এটি প্রথম পদক্ষেপ মাত্র। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের পর যে দায়িত্ব আমাদের অপর আসে তা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। বাংলাদেশ আজ আমাদের সহকর্মী সাথী ও সহযোগী। তারাও সেই আদর্শ, দর্শন ও নীতিমালার ধারক হয়েছে যা আমরা বহন করছি। এই আদর্শ, দর্শন ও নীতিমালার সংগ্রামে আজ আমরা প্রতিবেশীরূপে লাভ করছি এক নতুন সঙ্গী। আমি সরকার, প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশের জনগনকে মোবারকবাদ জানাচ্ছি। আর বাংলাদেশের সরকারকেও আমি অভিনন্দন জানাব যাঁরা এ দুর্ভোগ সত্বেও অক্ষুন্ন রেখেছেন আপন জাতির মান এবং উড্ডীন রেখেছেন তাঁদের পতাকা। সেই পতাকায় আমি প্রণতি জানাই।

শ্রী এ ডি মানি: মাননীয় চেয়ারম্যান, আমি কি আমার পক্ষের এবং বিপক্ষের সহকর্মীদের সাথে প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানানোর জন্য তিনি ও তার সরকার যে মহৎ ও ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেজন্যে ধন্যবাদ জানানোতে সামিল হতে পারি? আমি এই স্বীকৃতিদানের বিশেষত্ব তুলে ধরতে চাই। এই প্রথম, আমাদের রাষ্ট্র স্থাপিত হবার পর, আমরা একটি আধুনিক পদক্ষেপ নিয়েছি এবং দেখিয়ে দিয়েছি যে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি কেবল মাত্র খাতাকলমে থাকার মত নয়, বরং এটি অত্যন্ত সক্রিয়, এবং বাংলাদেশের জনগণ ধর্মনিরেপক্ষতাকে বেছে নিয়েছে তাদের নীতি হিসেবে। অন্য ভাবে বলতে গেলে, শ্রী জওয়াহারলাল নেহেরুর মেয়ে দুই দেশ নীতিকে আজ কবর দিয়ে দিলেন আর বাংলাদেশের জনগণ এক মানবজাতির অংশ হবার পথ বেছে নিয়েছে।

জনাব, আজ আমরা দেখিয়ে দিয়েছি যে আমাদের ৫৭৪ মিলিয়ন লোকের এই দেশ, যাকে নিউ ইয়র্ক টাইমস তাদের সম্পাদকীয়তে খুব খারাপ ভাবে দুর্দশাগ্রস্থ বলে উল্লেখ করেছে, চাইলে শান্তি ও ন্যায়বিচারের জন্য অনেক কিছু করতে পারি, এমনকি জাতিসংঘ কিংবা মুক্ত দুনিয়ার মোড়ল আমেরিকার চেয়েও বেশি।

জনাব, আমরা ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছি এবং আমি মিসেস গান্ধীকে ধন্যবাদ দিতে চাই এটা নিশ্চিত করার জন্য যে আমাদের সন্তানেরা এবং তাদের সন্তানেরস অন্তত আগামী ২৫ বছর পাকিস্তান নামের দেশটির কাছ থেকে যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে না। সংবাদপত্রের সাথে যুক্ত লোক হিসাবে আমাদের উচিৎ না বড় বড় কথা বলা। আমরা সরকারের বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা করি, তবে আমি এটুকু নির্বিবাদে স্বীকার করি কে যখন এসব কথা ইতিহাসের পাতায় লেখা হবে, মিসেস গান্ধীকে এই দেশের অন্যতম মহান নেতৃবৃন্দের কাতারেই রাখা হবে।

সর্দার নরেন্দ্র সিং ব্রার (পাঞ্জাব): মাননীয় সভাপতি, আমি দলের পক্ষ থেকে এবং ব্যাক্তিগতভাবে বাংলাদেশের স্বীকৃতিদানকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। প্রথম থেকেই আমাদের বক্তব্য ছিল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া হোক। এর সঙ্গে সঙ্গে এক দেশ ও এক নেতার তত্বটি মেনে নিয়ে আমি বলতে চাই যে আমরা প্রধানমন্ত্রীর পেছনে আছি। (উর্দু)

এই সুযোগে আমি ধন্যবাদ দিতে চাই সোভিয়েত ইউনিয়নের সরকার এবং জনগনকে আমাদেরকে এই মহৎ কাজে একটানা সমর্থম দিয়ে যাবার জন্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যারা প্রান দিয়েছেন, তাদের সবার প্রতি আমার শ্রদ্ধা জানাই। বাংলাদেশের জনগণ ধন্য হোক, ভারতের জনগণ ধন্য হোক, পৃথিবীর সকল মুক্তিকামী জনতা ধন্য হোক। সাম্রাজ্যবাদ ও সামরিকতন্ত্র নিপাত যাক।

শ্রী শীলভদ্র ইয়াজী (বিহার): মাননীয় সভাপতি,আমি আমার সরকার, প্রধানমন্ত্রি এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দকে অল ইন্ডিয়া ইন্দো বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে আরো মোবারকবাদ জানাচ্ছি এবং এর সাথে সাথে এই আশা করছি যে বিশ্বের সকল গনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক দেশসমুহ আমাদের প্রধানমন্ত্রির অনুসরণে খুব সত্বর বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দান করবেন। জয় হিন্দ, জয় বাংলাদেশ।

কেন্দ্রীয় গনপুর্ত ও আবাসন মন্ত্রী (শ্রী আই কে গুজরাল): আমি সাধারণত বেশি কথা বলি না, কিন্তু আজকে আমি আমার একটি স্মৃতি আপনাদের জানাতে চাই। হয়ত আমি সেই গুটিকয়েকের একজন, হয়ত এই সভাতে আমি একমাত্র লোক যে উপস্থিত ছিল ১৯৪০ সালে লাহোরে মুসলিম লীগের সম্মেলনে যেখানে পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি যে আমি লাহোরের সেই প্রস্তাবনার শেষ দেখে যাচ্ছি।

ড: ত্রিগুণা সেন (পশ্চিম বাংলা): সম্ভবত আজকে আমি এই দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষ। আমার হৃদয় এতই অভিভুত যে আমি কথা বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। আমি আমার হৃদয় নিংড়ানো অভিবাদন জানাই আমাদের নেত্রীকে। আমি জানি যে শুরু থেকেই সব দলই প্রধানমন্ত্রীকে চাপ দিচ্ছিল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য। বাইরের থেকেই অনেক চাপ ছিল, কিন্তু তিনি জানেন যে একদম শুরু থেকেই আমি তাঁকে বলেছিলাম এই মুহুর্তে স্বীকৃতি না দিতে, কারন আমি জানতাম বাংলাদেশের তরুনরা চাচ্ছে তাদের যুদ্ধ তারা নিজেরাই লড়তে, যাতে তারা বুঝতে পারে তাদের সমস্যা গুলো এবং কখন সেই সমস্যা তাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। আমি তাঁকে বলেছি যে আমি সেই ছেলেদের দেখেছি এবং দেখেছি তারা কিভাবে যুদ্ধ করছে। আমি দেখেছি তাদের চাষাভুষোরা কিভাবে প্রশিক্ষন নিচ্ছে এবং তাদের তরুণরা কিভাবে মুক্তির জন্য যুদ্ধ করছে। তাঁদের সাহসিকতা ও একাগ্রতা নিয়ে আমি অনেক গল্পই করতে পারব। তাই আমি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছিলাম তাঁদের কে স্বীকৃতি দেবার বদলে তাঁদেরকে যুদ্ধ জয় করার জন্য সহায়তা দিতে।। আমি বলেছিলাম একটা সময় আসবে যখন আপনি অবাক হয়ে দেখবেন যে তারা নিজেদের স্বাধীনতা নিজেরাই রক্ষা করতে সক্ষম, আর সেটাই হবে তাঁদেরকে স্বীকৃতি দেবার সঠিক সময়। আমার পুর্ন আস্থা সবসময়েই ছিল প্রধানমন্ত্রির উপর। রাজনীতিবিদ হয়া খুব সহজ। সব দলের সব রাজনীতিবিদরা তাঁকে চাপ দিচ্ছিলেন স্বীকৃতির জন্য। রাজনীতিবিদ হওয়া সহজ, কিন্তু রাষ্ট্রনায়ক হওয়া কঠিন। আমি অনেক রাষ্ট্রনায়কের ইতিহাস ও জীবনী পড়েছি, কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মত রাষ্ট্রনায়ক আমি দেখিনি। আজ আমি সত্যই অনেক খুশি। আমি তাঁকে তার এই সিদ্ধান্তের জন্য অভিবাদন জানাই, কিন্তু আমি এই সভার সদস্যদের মনে করিয়ে দিতে চাই যে বাংলাদেশের ভেতরে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে, লাখ লাখ মহিলা ধর্ষিত হয়েছে, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে অনেক কিছু যা তাঁদের আবারো বানাতে অনেক সময় লাগবে। তাঁদেরকে আমাদের বন্ধুর মত দেখতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে তাঁদের সরকার গনতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি গ্রহন করবে। এটা শুধু নীতির ব্যাপার নয়, আমি আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি তারা এটা প্রয়োগ করে। আমি পাহাড়ে তাঁদের একটি গ্রামে গিয়েছিলাম। সেখানে তাঁদের একটা অনুষ্ঠান ছিল এবং তারা আমাকে সেখানে দাওয়াত দিয়েছিল কেননা আমি তাঁদের প্রশিক্ষন কেন্দ্র স্থাপনের ব্যাপারে সহায়তা দিয়েছিলাম। সেখানে কয়েকজন কোরান থেকে পাঠ করল, আর তারপর আরেকজন ভগবদ গীতা থেকে পাঠ করল।

সে যে কি সুন্দর সংস্কৃতে পাঠ করল! পরে আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তার নাম আর কোথা থেকে সে এত সুন্দর সংস্কৃত শিখল। সে বলল তার নাম নুরুল ইসলাম। আমি বললাম, তুমি মুসলিম? আর সে বলল আমি বাঙালি। সে নিজেকে হিন্দু বা মুসলিম হিসেবে ডাকার প্রতিবাদ করল! আপনারা অবাক হয়ে যাবেন তাঁদের আচার ব্যবহারে। একজন গ্রামবাসী তার ১৪ বছরের ছেলেকে নিয়ে আমার কাছে এলো। সে বলল, সেন সাহেব, আপনার নাম শুনেছি, আপনি এই ছেলেটাকে নিয়ে যান, আর প্রশিক্ষন দিন, যাতে সে ফিরে গিয়ে একজন খান সেনাকে মারতে পারে। সে নিজেও আবার ফিরে যেতে চাইছিল (বাংলাদেশে), আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম কেন সে ফিরে যেতে চাইছে। সে উত্তর দিল, আমি ফিরে যাচ্ছি যাতে আমার উপর তাদের একটা বুলেট খরচ হয়, যাতে এই বুলেটটা অন্য কারো প্রান নিতে না পারে। তারা অত্যন্ত আশাবাদী। তারা খালি গায়ে, খালি পায়ে, শুধু ভাত খেয়ে, কাঁধে রাইফেল নিয়ে যুদ্ধ করে। আমি তাঁদের অনেককে দেখেছি বুলেটের ক্ষত নিয়ে ফিরে আসতে এবং ডাক্তার খুঁজে ব্যান্ডেজ করে আবার যুদ্ধে যাবার জন্য উদগ্রীব থাকতে, অনুপ্রেরণার জন্য। আজ আমার এটা বলতে লজ্জা নেই যে, এমনকি আমাদের সৈনিকেরা যারা তাঁদের সাথে মিশেছে, তারাও এঁদেরকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছে। আমাদের সৈনিকেরা যা শিখেছে চার বছরে, এই ছেলেগুলো তা শিখছে দুই দিনে। তারা অস্ত্র বা অন্যান্য সরঞ্জাম এমন সহজভাবে চালায় যেন তা খেলনামাত্র।তাঁদের এই স্পৃহা, এই স্পৃহাকে কেউ দমাতে পারবে না। আজকে আমরা গনতন্ত্র, ধর্মনিরেপক্ষতা ইত্যাদি অনেক কিছুই বলছি, তবে আজ আমার কাছে সবচে জরুরি হচ্ছে আমাদের নেত্রীকে, প্রধানমন্ত্রীকে অভিবাদন জানানো।

আকালি বিক্ষোভকারিদের মুক্তির ব্যাপারে মন্ত্রনালয়ের বক্তব্য

স্বরাস্ট্রবিষয়ক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী (শ্রী কে সি পান্ত): আমি আকালি দলের নেতা শ্রী ব্রার এর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে কিছু কথা বলতে চাই। দিল্লির গুরুদুয়ারা চালনা নিয়ে সৃষ্ট গোলযোগের কারনে গ্রেফতারকৃত আকালিদের মামলাগুলো সরকার খতিয়ে দেখেছে। এই বিক্ষোভ আমরা আশা করিনি। সরকার খুব পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে দিল্লির গুরুদুয়ারাগুলো চালাবে দিল্লির শিখরাই, এবং বর্তমানের সাময়িক ব্যবস্থা যত তারাতারি সম্ভব বাতিল করা হবে। এ প্রসঙ্গে প্রয়োজনীয় আইন মুসাবিদা করা হচ্ছে এবং পার্লামেন্টের বর্তমান সেশনেই এটা উত্থাপন করা হবে। ইতিমধ্যে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। পাকিস্তান আমাদের বিরুদ্ধে আক্রমন করেছে। জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। দেশের এই অবস্থায় আশা করছি দেশের সব দল এখন এক হয়ে দেশের প্রতিরক্ষায় যোগ দেবে। অন্যান্য সকল দলের মত আকালিরা সময়ের প্রয়োজনে দেশকে সহায়তা করার দাবী রাখে, এবং সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাঁদের এই ইচ্ছাকে সন্মান জানানোর। এরই ভিত্তিতে সরকার এই মুহুর্তে বিক্ষোভের ফলে গ্রেফতার হওয়া সকল আকালিকে মুক্তি দিচ্ছে।

শ্রী বি ডি খোবরাগাড়ে (মহারাষ্ট্র): আজ এই খুশির মুহুর্তে আমিও আমার এই সভার সদস্যদের সাথে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে, শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশের স্বীকৃতি জানানোর নেয়া তাঁর সময়োচিত এবং ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের জন্য অভিনন্দন জানাতে চাই। এই সেদিনই আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলাম যে আমাদের দেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের নগ্ন আগ্রাসনের বিপরীতে আমাদের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানাতে আর দেরি করা উচিৎ হবে না। আমি অত্যন্ত খুশি যে এর মাত্র দুই দিনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানালেন। এই সাহসী ও ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যারা মুক্তির সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের জন্য সবসময় প্রেরনা হয়ে থাকবে।আমাদের দেশ সব সময়েই সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গেছে, এবং একারনেই এই সাহসী সিদ্ধান্ত পৃথিবীর অন্যান্য দেশের জন্য, যারা এখনও পরাধীনতার শেকলে বাধা, একটি প্রেরনা হয়ে থাকবে এবং তাদেরকে বিদেশি শাসকদের হাত থেকে মুক্তি পাবার উৎসাহ দেবে।

এই সাথে আমি বাংলাদেশের জনগণকে, যারা সাহসের সাথে তাদের মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে গেছে, আমার অভিনন্দন জানাতে চাই। আমি বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে যারা প্রান দিয়েছেন, সেইসব শহীদদের স্মরণ করছি সশ্রদ্ধচিত্তে। কয়েকজন সদস্য ইতিমধ্যেই বলেছেন যে এটা কেবল মাত্র শুরু। আমি তাঁদের সাথে একমত এবং আশা করছি শেষটা খুব বেশি দূরে না। আমি আশা করছি আর মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই বাংলাদেশ সম্পুর্নভাবে শত্রুমুক্ত হবে এবং অচিরেই সসন্মানে জাতিসংঘে নিজ আসন গ্রহন করবে। আমরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছি। আমি আবারো প্রধানমন্ত্রিকে অনুরোধ করবো যাতে তিনি অন্যান্য দেশগুলোকেও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের ব্যাপারে অনুরোধ করেন। আমি কয়েকদিন আগেই প্রধানমন্ত্রির কাছে এই যুদ্ধের ব্যাপারে তাঁর নেয়া সব সিদ্ধান্তকেই সমর্থন করার কথা বলেছি। আজ আমি আবারো সেই সমর্থনের কথা পুনর্ব্যক্ত করে জানাতে চাই যে দেশের স্বার্থে আমরা সব ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি আছি এবং আমরা সর্বান্তকরণে তাঁর সাথে আছি। ধন্যবাদ।

শ্রী আকবর আলি খান (অন্ধ্র প্রদেশ): জনাব, আমাকে যদি এক মিনিট সময় দিতেন কিছু কথা বলার জন্য। আমি শুধু একটা ব্যাপারে বলতে চাই। আমি খুব বেশি সময় নেব না। আমি জানি এই অবস্থায় আপনার কাছ থেকে সময় চাওয়া উচিত না, তবুই আমি শুধু একটা বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষন করতে চাই।

সভাপতি: ঠিক আছে, এক মিনিট।
শ্রী আকবর আলি খান: জনাব, দেশ বিভাগের ঠিক পরপরই আমি মাওলানা আবুল কালাম আজাদের সাথে কথা বলি। আমি তাঁর কাছে যাই আর বলেছিলাম … আমি এটা হিন্দুস্তানি ভাষায় বলতে চাই*

* আমাকে বলতে শুরু করলেন, ভাই, যেই হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ও সম্প্রীতির জন্য আমি আমার সারাটি জীবন নিবেদিত করেছিলাম আজ তার বিলুপ্তি হল। আপনি আবুল কালাম আজাদকে দেখেছেন, তিনি দৈহিকভাবে বেঁচে আছেন কিন্তু অন্তরে মরে গেছেন। এই কথাগুলো তিনি বলেছিলেন স্বাধীনতা লাভের পর হতে যখনই তিনি সুযোগ পেয়েছেন এ কথা তিনি নিজস্ব ভঙ্গিতে বারবার বলেছেন।সকলের বিশ্বাস, আজ মুজিবুর রহমানের সঙ্গী ও বন্ধুদের চেষ্টায় যে নতুন রাষ্ট্র জন্ম নিল অবশ্যই সেটি আমাদের নেতৃবৃন্দ ও মাননীয় বিজ্ঞজনদেরকে আন্তরিকভাবে খুশি করবে। আমি চাই আমার পশ্চিম পাকিস্তানি ভাইগণও এই নীতিসমূহ গ্রহন করবেন। আমরা তাঁদের কাজে হস্তক্ষেপ করতে চাই না। আমরা তাদের উপর আক্রমন চালাতে চাই না। কিন্তু আমার আকাঙ্ক্ষা ও আন্তরিক আবেদন, তাঁরাও এ কথা চিন্তা করুন যে মানবতা সমুন্নত হোক, গনতন্ত্র সমুন্নত হোক, সেকুলারিজম সমুন্নত হোক এবং এই আদর্শিক ভিত্তিসমূহ অনুসরন করে তারা সুখ-সমৃদ্ধি অর্জন করু। আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি এবং প্রধানমন্ত্রীকে মোবারকবাদ জানাচ্ছি। (মূল উর্দু থেকে অনূদিত)

জনাব সৈয়দ হোসাইন (কাশ্মীর): আজ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের ফলে কাশ্মীরবাসীরা অত্যন্ত খুশি হবেন এজন্য আমি প্রধানমন্ত্রীকে আমার অভিনন্দন জানাচ্ছি। কেননা সেটি একটি ব্রাউন এর মত, ‘Secular Character of India’ বানানো হয়েছে। এজন্যেই জম্মু ও কাশ্মীরের লোকেরা সবচেয়ে বেশি আনন্দিত। জম্মু-কাশ্মীরের লোকেরা ১৯৪৭ সালেই দ্বিজাতিত্বকে অস্বীকার করেছে। এখনও সাম্রাজ্যবাদী চক্রে আঘাত লেগেছিল। আজ সাম্রাজ্যবাদী চক্রকে সবচেয়ে বেশি নাড়িয়ে দিয়েছে এই বাংলাদেশের স্বীকৃতি। আজ আমি এজন্যেই মোবারকবাদ জানাচ্ছি যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী সেকুলারিজম, গণতন্ত্র, ও সমাজবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ। জম্মু ও কাশ্মীরের লোকেরা আজ অনেক শক্তিশালী হয়েছে এবং তাদের এই প্রত্যয় জন্মেছে যে আমরা সঠিক পথই বেছে নিয়েছিলাম। আজ স্বীকৃতির পরে জম্মু ও কাশ্মীরের লোকেরা যদি অনুমতি পায় তবে ভলান্টিয়ার বাহিনী এসে বাংলাদেশে যুদ্ধ করার জন্য তাদের পুর্ন শক্তি নিয়োগ করবে। তাদের অনুভুতি এরূপ। (মূল ভাষণ উর্দুতে)

সভাপতি: সংসদীয় দলের নেতা, আপনি কিছু বলবেন?

সংসদীয় দলের নেতা (শ্রী উমাশঙ্কর দীক্ষিত): জনাব, আমিও এই সভার সকলের মত প্রধানমন্ত্রীকে এই মহান ও ঐতিহাসিক ঘোষণার জন্য ধন্যবাদ জানাতে চাই। এটি আমার মতে স্বাধীন প্রজাতন্ত্রী ভারতের নেয়া অন্যতম মহৎ সিদ্ধান্ত। সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে আমি গর্বিত, এবং আমি নিশ্চিত সংসদে উপস্থিত সকল সদস্যই স্বীকার করবেন যে তারা এই মহতী সিদ্ধান্তের স্বাক্ষী হয়ে থাকার জন্য আমার মতই গর্বিত বোধ করছেন। এই সিদ্ধান্তের একটা সুদূরপ্রসারী প্রভাব থাকবে ইতিহাসে এবং মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে ভারতের সুনাম সমুন্নত রাখবে, যে ভারত তাঁদের জন্য যুদ্ধ করেছে, এবং বিপদে তাদেরকে সহায়তা দিয়েছে। এটা ভেবে ভালো লাগছে যে এই মুহুর্তে সভার সবাই, এমনকি বিরোধী দলও, শুধু জনাব রাজনারায়ন ছাড়া, জিনি নিজেকে ছাড়া আসলে অন্য কারো প্রতিনিধিত্ব করেন না, এক হতে পেরেছে এই মহতী মুহুর্তে। এই সময়ে আমি স্মরণ করছি বাংলাদেশের সাহসী জনগণকে যারা নিজেদের মুক্তির জন্য যুদ্ধ করছে, এবং আমাদের সেনা ও অফিসারদের যারা আগ্রাসন রুখে দিচ্ছে।

এটা এটা অভুতপুর্ব ব্যাপার যে বিরোধীদলের নেতাগন শুধু এই সিদ্ধান্তকে স্বাগতই জানায়নি, বরং তারা যে বুদ্ধিমত্তার সাথে এই সিদ্ধান্তের সময়টা ঠিক করা হয়েছে, সেটারও ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। আমাদের ইতিহাসে স্বর্নাক্ষরে লেখা থাকবে এই দিনটির কথা। আমি নিশ্চিত আমাদের সেনা ও অফিসাররা আগামী দিনে গর্বিত ইতিহাস রচনা করবেন। তবে আমি সবাইকে অনুরোধ করব এই বিজয়ের উদযাপন যেন আমরা পরিমিত রাখি, যদিও অভিনন্দন আমাদের সবারই প্রাপ্য। আমার মনে হয় গঙ্গা বাবু, এবং আরো ককেজন মনে করিয়ে দিয়েছেন যে যুদ্ধ এখনও চলমান এবং এই যুদ্ধ শেষ হতে হবে অশুভ এর পরাজয় এবং প্রতিবেশীর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে আমাদের দেশের সফল প্রতিরক্ষার মাধ্যমে।

এই মুহুর্তে আমি সরকারী দলের পক্ষ থেকে বিরোধীদলের সকলকে তাঁদের একতা ও সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ জানাতে চাই। ধন্যবাদ।

সভাপতি: সন্মানিত প্রধানমন্ত্রী, আমিও আপনাকে এই মুহুর্তে আপনাকে অভিবাদন জানাতে চাই এবং আপনার পক্ষ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য শুভকামনা জানাচ্ছি।

সভার কার্যক্রম আগামীকাল সকাল ১০টা পর্যন্ত মুলতবী ঘোষণা করা হল।

মঙ্গলবার, ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে বারোটা বেজে তের মিনিটে পরদিন সকাল দশটা পর্যন্ত অধিবেশন মুলতবী হল

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২১১। যুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতির উপর প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর বিবৃতি রাজ্য সভায় কার্যবিবরণী ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১

Sajib Barman
<১২, ২১১, ৭৬১-৭৬৩>

পুর্ব ও পশ্চিম সেক্টরে সর্বশেষ যুদ্ধ পরিস্থিতির উপর মন্ত্রীর বিবৃতি

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী (জগজিভান রাম) ঃ স্যার, মাননীয় সদস্যবৃন্দ ডিসেম্বরের ৪ তারিখের অপরাহ্নে এই হাউসে আমার দেওয়া বিবৃতি স্মরণ করবেন। তখন আমি বলেছিলাম যে অপূরণীয় ক্ষতিসাধনের জন্য আমাদের উপর পাকিস্তানের স্বপ্রনোদিত ও পরিকল্পিত আক্রমণ হতাশাজনক। আমাদের প্রতিরক্ষার দুর্বল জায়গা বের করতে এবং যথাসম্ভব ক্ষতি করতে পাকিস্তানি সৈন্যরা বারবার আক্রমণ করে চলেছে। পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে রুখতে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।

পাকিস্তানি বিমান বাহিনী আমাদের বিমান ঘাটির উপর দিয়ে উরে যাচ্ছে, কিন্তু যে পরিমান ক্ষতি করতে পেরেছে তা খুব নগন্য। আমরা সেই ক্ষতি মেরামত করে নিতে পেরেছি এবং আমাদের বিমানঘাঁটি এখন পুনরায় কাজ করতে সক্ষম। তিনজন পাকিস্তানি পাইলট আমাদের কাছে বন্দী।

আমাদের বিমানবাহিনী গত দুইদিন ধরে সামনের দিকের আকাশ সীমা প্রতিরক্ষায় মনযোগ দিচ্ছে এবং স্থল পথের অভিযানগুলোতে খুব কাছ থেকে সহায়তা করছে। আমরা খুব সফলভাবে পাকিস্তানি যোগাযোগ, সরঞ্জাম এবং জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙ্গে দিতে পেরেছি। সবমিলিয়ে আমরা ২২টি বিমান হারিয়েছি।

পুঞ্চে পাকিস্তানের বারংবার আক্রমণকে রুখে দেওয়া হয়েছে যাতে তাদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ছাম্ব সেক্টরের উপর খুব চাপ যাচ্ছে। আমাদের সৈন্যদের তুলে নিয়ে মোনাভার তাভি নদীর পাড়ে প্রস্তুত করা হয়েছে। সৈন্য তুলে নিয়ে এসে আমাদের পরিকল্পিত স্থানে মোতায়নের আগের যুদ্ধে পাকিস্তানের ২৫টি ট্যাঙ্ক ধ্বংস করা হয়েছে এবং ঐ যুদ্ধে তাদের প্রচুর সৈন্য হতাহত হয়েছে। আমরা আখনুর এবং শাকরগড়ে খুব প্রতিচাপ অনুভব করছি।

পাকিস্তানি সৈন্যদের ডেরা বাবা নানক ছিট্মহল থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাভি নদীর উপর যে সেতু তা এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণে। আমাদের প্রতিরক্ষা লাইন ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে যাবার পাকিস্তানি চেষ্টা প্রতিহত করা হয়েছে।

অমৃতসর সেক্টরে কিছু পাকিস্তানি পোস্ট এখন আমাদের নিয়ন্ত্রনে। ফিরোজপুর এলাকায়, পাকিস্তানি সৈন্যদের সেজরা ছিট্মহল থেকে উৎখাত করা হয়েছে।

রাজস্থান সেক্টরে, রামগড়ে একটি পাকিস্তানি সাজোয়া উপস্থিতি কিছুটা শক্ত অবস্থান তৈরি করেছিল, কিন্তু এই অবস্থান লঙ্গানাভালাতে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং কার্যকরভাবে উচ্ছেদ করা গেছে। তাদের ২০টির মত ট্যাঙ্ক নিশ্চিতভাবেই ধ্বংস করা গেছে এবং আরো ৭টির মত ট্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবমিলিয়ে পাকিস্তানিদের ৯৬টি ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয়েছে।

সিন্ধে আমরা দুইদিক থেকে কার্যকর ভাবে ঢুকতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের সৈন্যরা বিভিন্ন দিক থেকে এগুতে পেরেছে এবং আমাদের সবচেয়ে সামনের বাহিনী নয়াচর থেকে মাত্র ১০ মাইল দূরে আছে। আমরা ইসলামগড় দখল করতেও সক্ষম হয়েছি।

পুর্ব দিকের সেক্টরে, আমাদের সৈন্যবাহিনী মুক্তি বাহিনীর সাথে মিলে অগ্রসর হচ্ছে। আমাদের চাপে পাকিস্তানী সৈন্যরা পিছু হটছে। আজ সকালে আমাদের বাহিনী যশোর বিমানঘাঁটি দখল করেছে। কালীগঞ্জের পশ্চিমে সকল এলাকা পাকিস্তানী বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করা হয়েছে। মেহেরপুর থেকে ঘেনেলা হয়ে গোয়ালন্দ ফেরী ঘাট পর্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ মহাসড়ক অবরুদ্ধ করা হয়েছে। হিলি/দিনাজপুর এলাকায় আমাদের সৈন্যরা রংপুর-বগুড়া মহাসড়ক ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কুড়িগ্রাম, রংপুর এবং দিনাজপুরের উত্তরাঞ্চল এখন দখলদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত।

মাননীয় সদস্যরা দুইদিন আগের আখাওড়া দখল সম্পর্কে অবগত আছেন। মৌলভী বাজার এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কৌশলগত জায়গাগুলো এখন আমরা ঘিরে রেখেছি। গতকাল পাকবাহিনী ফেনী দখল করে নিয়েছে; আমাদের অগ্রগামী দল এখন চাঁদপুর ফেরী ঘাটের দিকে এগুচ্ছে।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরে, পাকিস্তানী বিমানবাহিনীকে বলতে গেলে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে; ঐ অঞ্চলের আকাশসীমা এখন সম্পুর্ন আমাদের নিয়ন্ত্রণে। সমুদ্র থেকে চিটাগং, চালনা, মংলা এবং খুলনার চারদিকে সামরিক স্থাপনার জন্য সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়েছে। দখলদার বাহিনী এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে সামুদ্রিক যোগাযোগ কেটে দেওয়া হয়েছে। মাননীয় সদস্যবৃন্দ ৪ ও ৫ ডিসেম্বরের রাতে আমাদের নৌবাহিনীর দুঃসাহসিক অভিযান সম্পর্কে অবগত আছেন। দুটি পাকিস্তানী যুদ্ধজাহাজ ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে এবং একটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। আমাদের নৌবাহিনী করাচী বন্দরের ১৫ মাইলের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল। তাদের গোলায় ৪ং বন্দরের স্থাপনা এবং তেলের ট্যাঙ্কের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। ভারতীয় নৌবাহিনী বঙ্গোপসাগরে পাকিস্তানের একটি সাবমেরিন ডুবিয়ে দিয়েছে। পুর্ব রণতরী এখন পাক নিয়ন্ত্রিত উপকুলে অভিযান চালাচ্ছে।

তিন বাহিনী সম্মিলিতভাবে সুপরিকল্পিত অভিযান চালাচ্ছে। এই অভিযান সমুহের কার্যকর দক্ষতা এবং যে পরিকল্পনায় এই অভিযানগুলো চালানো হয়েছে তা যথেষ্ট সন্তোষজনক।

জাতিসংঘের কিছু সদস্যের জাতিসংঘের একটি বিমানে করে স্থানান্তরের বিষয়ে একটি ব্যাপার কক্ষের সামনে উপস্থিত করার প্রয়োজন মনে করছি। জাতিসংঘের একটি বিমান C-130 তে ডিসেম্বরের ৬ তারিখ সকাল ৮টা থেকে ১০টার ভেতর স্থানান্তর সম্ভব করা হয়েছে। জাতিসংঘের পক্ষে এটা করা সম্ভব ছিল না। নয়া দিল্লীতে জাতিসংঘের একজন প্রতিনিধির অনুরোধের প্রেক্ষিতে ডিসেম্বরের ৭ তারিখ সকাল ৭টা থেক ১০টা (IST) এর ভেতর জাতিসঙ্ঘের একটা বিমানের সফল স্থানান্তর করা হয়েছে। গত রাত ১০টার পর থেকে ঢাকা এরিয়ায় আর কোন অভিযান চালানো হয়নি।

ঢাকা থেকে জানানো হয়েছে যে, জাতিসংঘের একটি বিমান ঢাকা বিমান ঘাটির উপর ধ্বংস হয়েছে। বিমান সদর দপ্তর নিশ্চিত করেছে যে ঢাকাতে কোন ভারতীয় বিমান আর অভিযান চালাচ্ছে না। জাতিসংঘকে তাদের বিমান ধ্বংসের ব্যাপারে তদন্ত করার জন্য বলা হয়েছে।

এই সভার সদস্যদের পক্ষ থেকে আমাদের দেশকে রক্ষা এবং সাহসের সাথে শত্রুদের পরাজিত করার জন্য আমি বিমান বাহিনীর বীরোচিত কর্মের প্রশংসা করছি।

ভারত
সংসদীয় দলিলপত্রঃ

ভারতীয় লোকসভায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ

শিরোনাম সুত্র তারিখ
২১২। বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে আলোচনা ভারতের লোকসভার কার্যবিবরণী ২৬ মার্চ, ১৯৭১

Ayon Muktadir
<১২, ২১২, ৭৬৫-৭৬৮>
অনুবাদ

লোকসভার কার্যক্রম দুপুরের খাবার বিরতির পর আবার দুইটা বেজে চার মিনিটে শুরু হল।

সভাপতিত্ব করছেন শ্রী আর ডি ভান্ডারী
বিষয়: পুর্ব বাংলার অবস্থা/ঘটনাবলী

শ্রী সমর গুহ(কাঁথি): জনাব, আমি অতি জরুরী একটি বিষয়ের দিকে আপনার দৃষ্টি আকর্ষন করতে চাই। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন ও বটে। এই মাত্র আমরা রেডিও এর খবর মারফত জানতে পারলাম যে বাংলাদেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৬০০০০ সৈন্য এনে সেখানে সেনাবাহিনী সব বড় বড় শহর ও গুরুত্বপুর্ন এলাকাইয় অবস্থান নিয়েছে।

ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন জারি করেছেন। তার সরকার ঢাকা সহ অন্যান্য বড় শহরে সান্ধ্য আইন জারি করেছে। তারা ঢাকা বেতার কেন্দ্রের দখল নিয়ে নিয়েছে। তারা সেখানে বাংগালীদেরকে দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ দিয়েছে। শুধু নাই নয়, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস সেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে ব্যাপক যুদ্ধ করছে।

আমার কাছে খবর আছে যে শত শত লোককে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। পথেঘাটে কাউকে দেখা মাত্রই তাকে গুলি করার একটা নির্দেশ জারি করা হয়েছে। আরেক সংবাদে জানা গিয়েছে যে করাচী বিবানবন্দরে হাজার হাজার বাঙালি পুর্ব পাকিস্তানে চলে আসার চেষ্টাইয় জড়ো হয়েছেন। সেখানেও কয়েকশত লোক নিহত হয়েছেন।

আমি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষন করে জানাতে চাই যে ধারনা করা হচ্ছে যে শেখ মুজিবর রহমান ও অন্যান্য নেতাদের হয় মেরে ফেলা হবে নয়ত তাদেরকে বন্দি করে কলম্বো বিমানবন্দরের সাহায্যে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হবে। সুতরাং আমি আপনার কাছে, এবং আপনার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জোর দাবী জানাচ্ছি যাতে ভারত সরকার শ্রীলঙ্কা সরকারের কাছে পাকিস্তানি সামরিক বা বেসামরিক কোন বিমানই যেন সামরিকবাহিনির সদস্যদেরকে শ্রীলঙ্কা হয়ে যাওয়া আসা না করতে পারে সে ব্যাপারে লিখিতভাবে অনুরোধ করে।

এছাড়াও আরেকটি ব্যাপার আছে। ঢাকা বেতার কেন্দ্র জোর করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের লোকদের এখন খবরের জন্য কেবলমাত্র অল ইন্ডিয়া রেডিওর উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। অল ইন্ডিয়া রেডিওর উচিত খবর প্রচার … (বাঁধা)। আমাকে শেষ করতে দিন। বাংলাদেশের সংগ্রাম পরিষদ এই প্রথম ভারত ও শ্রীলঙ্কার কাছে আন্তর্জাতিক জনমতকে স্বাধীনতার পক্ষে আনার জন্য সাহায্যের আবেদন জানিয়েছে। আমি সরকারকে অনুরোধ করছে এ বিষয়টি অন্যান্য এশিয় দেশের সাথে সম্মিলিতভাবে জাতিসংঘে আলোচনায় জন্য তুলতে।

আমি করাচী বিমানবন্দর জড়ো হওয়া বাঙ্গালীদেরকে সরিয়ে আনার ব্যাপারে সরকারকে সহায়তা করার অনুরোধ করছি।
সবশেষে বলছি, আমি এই ব্যাপারে ইতিমধ্যেই একটি দৃষ্টিআকর্ষনী প্রস্তাব এনেছি এবং এ ব্যাপারে একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনার প্রস্তাবও দিয়েছি। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন ও জরুরী। আমি এই (লোক)সভায় অনেকবার বলেছি যে ভারত-পাকিস্তান সমস্যা সমাধানের অন্যতম চাবিকাঠি হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন। এটা অত্যন্ত জরুরী এবং অত্যাবশ্যক বিষয়। আমরা এ নিয়ে চুপ হয়ে বসে থাকতে পারি না। আমাদের সরকারের উচিত ব্যাপারটি আমলে নেয়া এবং এ নিয়ে কিছু একটা করা।

শ্রী এস ব্যানার্জি (কানপুর): জনাব, শুধুমাত্র যে সামরিক আইন জারি হয়েছে তাই না, বরং দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এমনকি সাংবাদিকদেরকে সেনাবাহিনীর কর্নেল ও জেনারেলরা নির্দেশ দিয়েছে খবর সংগ্রহের জন্য হোটেলের বাইরে না যেতে এবং বলা হয়েছে যে বাইরে গেলে তাদেরকেও গুলি করা হবে। এই সন্ত্রাসের রাজত্ব চলছে সেখানে এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির এজেন্টরা যারা পুর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবের সফলতা চায়নি সেখানে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের জনগন যে সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে জয় লাভ করেছে এটা তাদের ভালো লাগেনি।

এই হচ্ছে আমার প্রস্তাব। ফ্যাসিবাদিরা পুর্ব পাকিস্তানে গনতন্ত্রকে হত্যা করছে। চলুন আমরা সমর্থন দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করি এবং জানাই যে আমরা অন্যান্য দেশের জনগনের অধিকার রক্ষায় ও কাজ করব। আমি আপনাকে, এবং আপনার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করছি গনতন্ত্রের ঝান্ডা সমুন্নত রাখতে ও শেখ মুজিবকে আরো সহায়তা দিতে। যদি শেখ মুজিব মারা যায়, তাহলে ইয়াহিয়ার ফ্যাশিস্ট সরকার আবার পুর্নশক্তিতে বহাল হবে। আমরা এর বিরোধিতা করছি। পাকিস্তানের জনগনকে জানিয়ে দেওয়া হোক যে ভারত মুজিবুর রহমানের সাথেই আছে এবং আমরা ইয়াহিয়ার সকল কর্মকান্ডের নিন্দা জানাচ্ছি।

শ্রী জ্যোতির্ময় বসু (ডায়মন্ড হারবার): এই ব্যাপারটাতে ভুক্তভোগী যারা তারা আমাদেরই রক্ত মাংস। সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্তের কারনেই আমাদের দেশ ভাগ হয়েছিল। সেদিক থেকে দেখলে আমরা উট পাখির মত বালিতে মাথা গুঁজে রাখতে পারি না। আজকে কি হচ্ছে পুর্ব পাকিস্তানে? যদিও আমরা বারবার চেষ্টা করেছি এই ব্যাপারে সরকারের নীতি ও মনভাব জানতে, আমরা ব্যর্থ হয়েছে উত্তর পেতে। লোকসভার সভাপতিও এ প্রসঙ্গে কোন তথ্য দেননি। এখন পর্যন্ত আমরা রেডিও এবং অন্যান্য বক্তাদের মাধ্যমে যা তথ্য পেয়েছি তার ভিত্তিতে কি আপনি দয়া করে আমাদের সরকারকে অনুরোধ করবেন যাতে সরকার তার নিজস্ব সুত্রে পাওয়া তথ্যের আলোকে আমাদেরকে জানিয়ে অবিলম্বে একটি বিবৃতি দেয় এবং আমাদেরকে জানায় যে বাংলাদেশের জনগনের উপর নির্বিচার হত্যার ব্যাপারে আমরা কি করতে যাচ্ছি?

মিনিস্টার অফ পার্লামেন্টারি অ্যাফেয়ার্স, শিপিং অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট (শ্রী রাজ বাহাদুর): সরকারও স্বাভাবিকভাবেই বিরোধিদলের সদস্যদের মতই আশঙ্কিত বাংলাদেশে কি হচ্ছে তা নিয়ে। আমরা আমাদের নিজস্ব সুত্রে সব ধরনের তথ্য জোগাড় করব …

শ্রী জ্যোতির্ময় বসু: আপনারা এখনও (তথ্য) জোগাড় করেননি?

শ্রী রাজ বাহাদুর: আমরা জোগাড় করেছি ও আরও করছি।

শ্রী জ্যোতির্ময় বসু: আমাদেরকে জানান।

শ্রী রাজ বাহাদুর: আমরা এ বিষয়ে নজর রাখছি এবং যথাসময়ে এ ব্যপারে বিবৃতি দেয়া হবে।

শ্রী জ্যোতির্ময় বসু: এক্ষনি … (বাঁধা)

শ্রী রাজ বাহাদুর: যত তারাতারি সম্ভব।

শ্রী সমর গুহ: আমরা যদি এখনই বিবৃতি না দেই তাহলে ওদের মুক্তি সংগ্রামের ব্যপারে আমাদের সংহতি … (বাঁধা)

শ্রী রাজ বাহাদুর: আমি চাপের মুখে নতি স্বীকার করবো না। আমি কথা শেষ করার আগেই আপনারা আমাকে থামিয়ে দিয়েছেন। আমরা অবশ্যই স্বল্পতম সময়ের মধ্যে একটি পরিপুর্ন বিবৃতি দেব।

শ্রী জ্যোতির্ময় বসু: আজকেই কেন নয়?

শ্রী রাজ বাহাদুর: যদি আজকে হয় তাহলে আজকেই, যদি এই মুহুর্তে হয় তাহলে এই মুহুর্তেই … (বাঁধা)। আমাদের উত্তেজিত হয়ে বা তাড়াহুড়া করে কিছু করা উচিত হবে না। আমাদের অবস্থাটা খুব সাবধানে খুঁটিয়ে দেখে বিচার করে দেখতে হবে এবং সে অনুযায়ী বিবৃতি দিতে হবে।

শ্রী ইসহাক সম্ভলী (আমরোহা): চেয়ারম্যান সাহেব, মন্ত্রি মহোদয় বলেছিলেন যে যথাসময়ে সরকার বিবৃতি প্রদান করবেন। আমি জানতে চাই সেই সময় কখন হবে।

শ্রী জ্যোতির্ময় বসু: আমরা এ ব্যাপারে আপনার রুলিং চাই।

সভাপতি: আমি আমাদের ইচ্ছার কথা মন্ত্রি মহোদয়কে জানাবো।

শ্রী ইসহাক সম্ভলী: আমার আশঙ্কা- যে কোন সময় পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা শেখ মুজিবুর রহমানকে মেরে ফেলতে পারে।

সভাপতি: আপনি চেয়ারে বসুন জনাব সম্ভলী

শ্রী ইসহাক সম্ভলী: এ সময় বাঙ্গালী নিধনের প্রশ্ন। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। এখন আর বিলম্ব করার অবকাশ নেই।

শ্রী রাজবাহাদুর: জনাব, আমি আগেও বলেছি আমাকে সব তথ্য সংগ্রহ করতে হবে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত …

শ্রী ইসহাক সম্ভলী: আমি এর আগেও বাঙ্গালী নিধন সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছি। একইভাবে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। অনতিবিলম্বে এই সমস্যা রাষ্ট্রসংঘে তোলা উচিত এবং বাংলাদেশের মানুষের সাথে একাত্মতা (প্রকাশ) করা প্রয়োজন।
সভাপতি: সন্মানিত সদস্য আপনি দয়া করে নিজের আসনে বসুন।

শ্রী সমর গূহ: আমি শুধু আরেকটি জরুরী ব্যাপারে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষন করতে চাই। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন একারনে যে শেখ মুজিবুর রহমানকে যেকোনো মুহুর্তে গুলি করে মেরে ফেলা হতে পারে। শুধু মাত্র আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এবং ভারত ও শ্রীলঙ্কার মত প্রতিবেশি দেশের প্রতিক্রিয়াই তার প্রান বাঁচাতে পারে। এই বিষয়টি অত্যন্ত জরুরী। তাকে যেকোনো মুহুর্তে মেরে ফেলা হতে পারে। আমি এই মুহুর্তে একটি প্রস্তাব আনতে চাই। সরকার কি এই ব্যাপারটিকে গুরুত্বপুর্ন ও জরুরী মনে করছে নাকি করছে না?
শ্রী জ্যোতির্ময় বসু: স্যার আপনি অন্যায্য আচরন করছেন।

সভাপতি: আমি সব সময়েই আপনাদের প্রতি ন্যায্য আচরন করেছি। আপনার শব্দচয়নে সতর্ক হোন। আমি অন্যায্য আচরন করেছি, এরকম অভিযোগ তুলবেননা।

পার্লামেন্টারী অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রি এ ব্যাপারটা আমলে নিয়েছেন এবং তিনি ব্যাপারটা পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানাবেন এবং সভায় প্রয়োজনীয় বিবৃতি দেয়া হবে আজ-কালের মধ্যেই।

শ্রী সমর গূহ: শুধু পররাষ্ট্রমন্ত্রী নন, ব্যাপারটা জানা প্রধানমন্ত্রীর জন্যও গুরুত্বপুর্ন।

সভাপতি: আপনি আপনার আসনে বসুন।

শ্রী জ্যোতির্ময় বসু: স্যার, সরকারকে দিয়ে আজকের মধ্যে একটি বিবৃতি প্রকাশ করাটা সম্পুর্ন আপনার হাতে। তাদের কাছে যদি তথ্য না থাকে তাহলে তারা ট্রেজারী বেঞ্চে বসার অযোগ্য।

শ্রী রাজ বাহাদুর: যে কোন বিবৃতি প্রকাশিত হবার আগে মন্ত্রিপরিষদের সামনে তুলতে হবে, তারপর মন্ত্রিসভা বসবে, সব তথ্য যাচাই করে দেখতে হবে, তারপরেই কেবল বিবৃতি প্রকাশ করা সম্ভব।

শ্রী জ্যোতির্ময় বসু: কিন্তু লোকসভা তো কালকে শেষ হবে।

শ্রী সমর গূহ: শুধু মনে রাখবেন যে শেখ মুজিবর রহমানের প্রান রক্ষা ক্ষমতা এখন ভারত ও শ্রীলঙ্কার জনগনের হাতে।

শ্রী রাজ বাহাদুর: আমরাও এ ব্যাপারটা নিয়ে আপনাদের সমানই উদ্বিগ্ন … (বাঁধা)

সভাপতি: কিছুই লিপিবদ্ধ করা হবে না, এখন থেকে এখানে যা বলা হবে তার কিছুই লিপিবদ্ধ করা হবে না … (বাঁধা)

মন্ত্রি মহোদয় ইতিমধ্যেই ব্যাপারটা আমলে নিয়েছেন। তিনি বারবার করে সেকথা বলেছেন।

শ্রী রাজ বাহাদুর: এই বিষয়টি একটি স্পর্শকাতর অঞ্চলে একটি স্পর্শকাতর বিষয় এবং স্বাধীনতা ও গনতন্ত্রের স্বার্থেই আমাদেরকে ভেবে চিন্তে পদক্ষেপ নিতে হবে। সবকিছু খতিয়ে দেখার পর আমরা অবশ্যই একটা বিবৃতি দেব।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২১৩। বাংলাদেশের ঘটনাবলি সম্পর্কে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি এবং বিবৃতির ওপর সদস্যদের আলোচনা ভারতের লোকসভার বিবরণী ২২ মার্চ, ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ২১৩, ৭৬৯-৭৮৬>
অনুবাদ

বিবৃতি – পূর্ববাংলার সাম্প্রতিক অগ্রগতি

জনাব স্পিকার: শ্রী শরণ সিং

শ্রী এস এম ব্যানার্জী (কানপুর): আমি পয়েন্ট অব অর্ডার তুলতে চাই

জনাব. স্পিকার: কিসের উপর?

শ্রী এস এম ব্যানার্জী: আপনি জানেন যে নিয়ম অনুযায়ী একজন মন্ত্রী তাঁর কাছে মনে হওয়া কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে শুয়ো মোটো দেবার অধিকার রয়েছে। আমার পয়েন্ট হচ্ছে দৃষ্টি আকর্ষণ নোটিশ আমরা পেশ করেছিলাম………

শ্রী সমর গুহ (কাঁথি): সকালে বিরোধী দলের নেতার সাথে একটি মিটিং ছিল এবং আমরা সব একমত যে একটি বিবৃতি তৈরি করা উচিত।

শ্রী এস এম ব্যানার্জী: এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, অনেক সূক্ষ্ম ব্যাপার, আমি এটা জানি। এর উপর আলোচনা হওয়া উচিত; অন্যথায় এটা একটি একমুখী অবস্থা সৃষ্টি করবে। সরকার একতা বিবৃতি দেবে এবং আমরা কেবল তা হৃদয়ঙ্গম করব। তাই, আমি অনুরোধ করব আপনি দৃষ্টি আকর্ষণ নোটিশ দিন। এর উপর কিছু বলার অনুমতি দিন।

শ্রী সমর গুহ: আমি এই প্রস্তাব দিতে চাই। প্রধানমন্ত্রী, আমায় বলতেই হবে, বিরোধী দলের নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে তাঁর প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। আমরা সকালে এক ঘণ্টা আলোচনা করেছি। আমরা সকলেই একমত যে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি তৈরি করা উচিত। সেখানে তার দলের নেতারাও ছিল। এই একটি জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে আমাদের দৃঢ় সংকল্প, সমর্থন ব্যাক্ত করা হয়। ভুক্তভোগীদের জন্য সহানুভূতি প্রকাশ করা হয়। সে আলোকে আমাদের এই বিবৃতি গ্রহণ করা উচিত।

মিস্টার স্পিকার: পদ্ধতি আপনারা সবাই জানেন। যখন একজন মন্ত্রী এক বিবৃতি দেন তখন তাকে প্রশ্ন করা যাবেনা।

শ্রী পিলু মোদী (গোধরা) ……… কিন্তু আলোচনার জন্য —

জনাব. স্পিকার: আপনি রাষ্ট্রপতির ঠিকানার উপর একটি সাধারণ আলোচনা করতে যাচ্ছেন। কাজেই যথেষ্ট সুযোগ পাবেন।
জনাব. স্পিকার: আমি জানিনা তা কতদূর যুক্তিযুক্ত হবে।

প্রধানমন্ত্রী, আণবিক শক্তি মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, পরিকল্পনা মন্ত্রী ও তথ্য মন্ত্রী (শ্রী মতি ইন্দিরা গান্ধি )-

আমি কি বলতে পারি যে, যেহেতু এই ব্যাপারটি নিয়ে পুরো হাউস জোরালোভাবে মত দিতে আগ্রহী কাজেই এর ক্ষেত্রে আমরা একটু ব্যতিক্রম হতে পারি কিনা যাতে সদস্যরা তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারবে।

জনাব. স্পিকার: আমি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ কে সাধুবাদ জানাই। আমি একটি ব্যতিক্রম করতে প্রস্তুত আছি। আমি আশা করি আপনি এটা আর পুনরাবৃত্তি করবেন না। এটি একটি ব্যতিক্রমী ব্যতিক্রম।

পররাষ্ট্র মন্ত্রী (শ্রী শরণ সিং): ভারত সরকার আমাদের সীমানায় ঘটে যাওয়া ঘটনা গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করছে। তাই আমাদের গভীর আবেগ এই হাউসএ প্রকাশিত হচ্ছে এবং যা সমগ্র দেশে জেগে উঠেছে।

মাননীয় সদস্যরা, আমি নিশ্চিত ২৮ নভেম্বর, ১৯৬৯ সাল থেকে পাকিস্তানের রাজনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কে আপনারা সম্যক অবগত যখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট একটি নব্য গণতান্ত্রিক সংবিধানের জন্য এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য তার পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছিলেন।

সরকার ও ভারতের জনগণ সবসময় পাকিস্তানের জনগণের জন্য সহানুভূতি ও বন্ধুত্তপূর্ন আচরণ করেছে। অতএব, আমরা আশা প্রকাশ করেছিলাম যে পাকিস্তান একটি গণতান্ত্রিক বিবর্তন অনুসরণ করবে। স্বাভাবিকভাবেই এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিরা একটি সংবিধান অনুযায়ী জনগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মত অনুধ্যায়ী অভিব্যক্ত হবে – যা গত বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা দেখেছি।

তবে ঘটনা একটি ভিন্ন এবং বিয়োগান্তক দিকে মোড় নিয়েছে। শান্তিপূর্ণ বিবর্তনের পরিবর্তে সেখানে এখন চলছে রক্তারক্তি।

প্রতিবেদন মতে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও প্রাদেশিক পুলিশ জনগণের বিরুদ্ধে ২৫ এবং ২৬ মার্চ মধ্যরাতে নির্মম ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু করে। প্রচুর হতাহতের খবর পাওয়া গেছে। মার্চ ২৬ সকালে ঢাকায় রেডিও স্টেশন সেনাবাহিনী দ্বারা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। অতঃপর রেডিও স্টেশন এর মাধ্যমে ১৫ টি নতুন মার্শাল ল এর ঘোষণা দেয়া হয়। রেগুলেশন নিষিদ্ধ, অন্য কিছু, সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, মিছিল, সভা, বক্তৃতা ও স্লোগান নিষিদ্ধ করা হয়। বেতার ও টেলিভিশন প্রোগ্রাম ও সব খবরের উপর সম্পূর্ণ সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আরো দুই নিয়মিত বিভাগ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে দমন করার জন্য নিয়োগ করা হয়। আমাদের হৃদয় সেই সব মানুষদের জন্য যারা অভাবনীয় দুঃখকষ্ট ভোগ করছেন তাদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করছে।

আমরা স্বাভাবিকভাবেই কামনা করছি এবং আশা করি যে, দেরী করে হলেও এটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু হবে যেখানে মানুষ গরিষ্ঠাতার ভিত্তিতে নেতৃত্ব নির্বাচন করতে পারবে। এটা সত্য যে যেখানে এত বড় একটা সেগমেন্ট এর দ্বন্দ্ব চলছে এবং মানুষ চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।

সম্প্রতি যখন পূর্ব পাকিস্তানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হল, সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে ভারতের জনগণ সেখানে দুর্ভোগ মেটাতে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল।

আমরা আবারো তাদের জন্য করতে চাই। আন্তর্জাতিক কমিউনিটি বা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এর সাথে মিলে আমরা নিষ্পাপ ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাড়াতে চাই।

শ্রী এ.কে. গোপালান (পালঘাট): বাংলাদেশে, পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে, প্রকৃত অর্থে গৃহযুদ্ধ নয়। এটা একদিকে সামরিক একনায়কতন্ত্র এবং অন্য দিকে বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্খার ব্যর্থটায় সৃষ্ট একটি যুদ্ধ। নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার নেতা শেখ মুজিবুর রহমান শুধু কেন্দ্রের দুই টি বিষয় – পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র নয় বরং পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করেন। নির্বাচন ও জনগনের ইচ্ছাকে মেনে নেওয়ার পরিবর্তে জনাব ইয়াহিয়া খান স্লোগান পর্যন্ত নিষিদ্ধ করে দেন এবং মানুষকে গুলি করে হত্যা করা শুরু করেন।

তারা বলে যে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এবং জনগণকে পশ্চিম পাকিস্তান এর হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আহবান জানান।

আরেকটি সমস্যা আছে যা আমাদের সম্মুখীন হওয়া লাগতে পারে। মানুষ বাংলাদেশ-পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসতে পারে – হিন্দু বা মুসলমান, তখন তাদের আশ্রয় দিতে সমস্যা হতে পারে। এবং আমি আশা করি একটি সংগঠন তৈরি করে দেয়া হবে তাদের দেখাশোনা করার জন্য।

আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর নিষ্ঠুর আক্রমণ ও সামরিক গণহত্যার নিন্দা করি ও বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামকে মন থেকে সমর্থন করি। এবং ভারত সরকার এবং ভারতের মানুষ বাংলাদেশের মানুষের জন্য সব রকমের সমর্থন ও সাহায্যের হাত প্রসারিত করবে।

শেখ মুজিবুর রহমান তাদের সংগ্রাম বা স্বাধীনতার জন্য এশিয়-আফ্রিকান দেশগুলোর কাছে সহায়তা চেয়েছেন এবং যদি এটা অব্যাহত থাকে তাহলে আমাদেরও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সমর্থন করতে হবে এবং চেষ্টা করতে হবে যে কোন সাহায্য দেয়ার।
শ্রী এইচ এন মুখার্জি (কলকাতা উত্তর পূর্ব): জনাব স্পিকার, স্যার, আপনি যেমনটি বলেছেন, এই ব্যতিক্রমী আলোচনায় আপনি নিশ্চই আমাদের জনগণের পক্ষ থেকে আপনার আবেগ প্রকাশ করবেন বাংলাদেশে ঘটতে থাকা অমানবিক ঘটনার জন্যে।

বাংলাদেশ, যেখানকার আদি বাসিন্দা এই হাউজেও আছেন। আমরা জানি হাজার হাজার রক্তপাত সেখানে হচ্ছে যার উদাহরণ ইতিহাসে নজির ছাড়া এবং তারা এমন এক বিপ্লবে নেমেছে যার কোন তুলনা হয়না। এমন একটি দল তাদের উপর অত্যাচার করছে যারা জঙ্গলের আইন ছাড়া কিছুই জানেনা।

স্যার, পূর্ববাংলায় সরকার যা হয়েছে বলে প্রচার করছে, বাস্তব অবস্থা তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে। এই দেশে যেই সরকার ই কাজ করে থাকুক, তাদের সতর্ক মূল্যায়ন এই দেশ নিয়ে খুবই নিষ্প্রাণ ধরণের, বিশেষত এই অঞ্চলে যখন এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যা আগে কখনোই ঘটেনি।

এটা ছিল সম্মতিক্রমে শুরু করা একটি বিপ্লব। ব্যালটের মাধ্যমে জনগণ নিজেদের প্রাদেশিক স্বশাসিত অধিকারের পক্ষে মতামত প্রকাশ করে ছিল। ইতিহাসে এমনটা আগে দেখা যায়নি। এটার দর্শক এমন একটি দেশের মানুষ যারা গান্ধির নামে পরিশ্রম করে – তাদের এই মুহুর্তে এগিয়ে আসা উচিৎ।

আপনারা কি জানেন যখন ঢাকায় হরতাল ডাকা হয় তখন গভর্নর থেকে সরকারী কুক পর্যন্ত দৈনন্দিন কাজ বন্ধ রাখেন। যাকে সামরিক প্রশাসক নিয়োগ করা হয় বা তেমন একটা পদে তার শপথ নেওয়া হয় নাই কারণ প্রধান বিচারপতি তা প্রত্যাখ্যান করেন। আমরা ইতিহাসে এতটা একতাবদ্ধ জাতী আর দেখিনি। তারা তাদের অবস্থার পরিবর্তন আনার জন্য একটি শান্তিপূর্ণ ও সত্যিকারের গণতান্ত্রিক পথে এগিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের দাস্ত থেকে মুক্তি পেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

আমি বিষয়টি যথার্থতায় প্রবেশ করছি না, কিন্তু আমাদের সবার পূর্ববঙ্গের জনগণের অন্তর্বেদনা ক্রন্দন মনে করা উচিৎ। এটা দুর্বল এবং অপমানজনক নয়। শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, বাঙালির জানে কিভাবে মানুষের মত মরতে হয়। আর, সে কারণেই তারা যুদ্ধ করছে। ৭০০০০ সৈন্য এখন পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতিরোধের জন্য নিযুক্ত আছে। যখন পূর্ব বাংলায় সাংবিধানিক ভাবে একজন প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হতে যাচ্ছেন -আপনি এবং ডেপুটি স্পিকার নতুন সংসদ সম্পর্কে কথা বলছিলেন। আমার মনে হয় আপনি এবং আমি ইস্ট বেঙ্গল থেকে কিছু শিক্ষা পেয়েছি। কাদের অঙ্গুলিনির্দেশে কি হচ্ছে তা আমরা খুব ভালোভাবে জানি। আমাদের দেশের স্বার্থ অস্থির করে অনেকে ঘোলা জ্বলে মাছ স্বীকার করতে চাচ্ছেন। পূর্ববঙ্গ স্বায়ত্তশাসন চায়। পশ্চিম পাকিস্তান একটি নির্দিষ্ট স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য তাদের উপর নির্যাতন করেছে। ৭০ লাখ মানুষের স্বপ্ন চূর্ন করা হচ্ছে। আমরা এখানে শুধুমাত্র প্রতিবেশী দেশে বলে এসব অনুধাবন করছি। সরকারের পক্ষ থেকে এখনো আমরা একটি শব্দ উচ্চারণ করছিনা। আমি নিজে ভাষা পূর্ববাংলার ভাষায় কথা বলি, শুধু আমি একা না, এখানে আমাদের অনেকে এই ভাষায় কথা বলেন। তাই আমার লজ্জা লাগে যখন দেখি আমরা এখনো কিছু করতে পারিনি যাতে দুই দেশের মাঝে বন্ধুত্ব প্রমাণিত হয়। আমি চাই সরকার এমনভাবে এগিয়ে যাবে যেমনটা আমাদের দেশের উত্তর-পূর্ব অংশে করা হচ্ছে। অন্য রকম ইতিহাস তৈরি হলেও হতে পারে।

অতএব, আমি আশা করি সরকার পরিস্থিতির আরো মনোযোগ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করবে। আমি চাই সরকার বলুক ৭ কোটি মানুষের উপর এই গণহত্যার অনুমতি দেওয়া হবে না। আমি চাই সরকার এই জন্য জাতিসংঘ বা যেকন সংগঠনের কাছে যাবে এই ব্যাপারে যতোটা সংবিধান সমর্থন করে। তারা বলুক যে তারা পূর্ব বাংলার জনগণের বিষয়টি নিয়ে সকল ফোরামের কাছে যাবেন। আমরা তা করব কারণ তারা আর আমরা আসলে এক। এক সম্প্রদায়। মুজিবুর রহমান ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বন্ধুত্ব পুনঃস্থাপনের ব্যাপারে অনেক বলেছেন। তিনি পাকিস্তানের শৃঙ্খলাভঙ্গ চাননি। তিনি শুধুমাত্র আমাদের দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক পুনরায় শুরু করা উচিত বলেছেন। অথচ পেছনে কিছু বিশ্বাসহীন মানুষ কোন আচার আলোচনা না করে করাচির নিরাপত্তা থেকে সামরিক আইন ঘোষণা করেন – এবং তারা যা করতে যাচ্ছেন তার সবই মানবতার বিরুদ্ধে যায়।

আমি প্রস্তুত ছিলাম না যে নির্বাচনে তারা অনেক উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনা পেয়েছেন তার পরে এত শীঘ্র তারা এই দেশের মানুষের প্রতি সহানুভূতি দেখাননি বা নূন্যতম যুক্তিযুক্ত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পূর্ববাংলার জনগণকে শুভেচ্ছা জ্ঞ্যাপন করেন নাই। আমি বিবৃতি দিয়ে খুব হতাশ। আমি বলছিলাম আমি বিবৃতি দিয়ে খুব হতাশ। শ্রী স্বরন সিং শেষ কথাটি বলেছেন এই সরকার একটি ভয়ানক ভুল করছে। আমি আশা করি প্রধানমন্ত্রী আমাদের সবার আলোচনা শেষে সর্দার শরণ সিং এর কথার চেয়ে আরো কংক্রিট কিছু বলে শেষ করবেন – যদিও আমি তা জানিনা ভারত কি করতে যাচ্ছে এই গণহত্যা এবং রক্তাক্ত ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে। যা কিছু ঘটছে তেমন ইতিহাস উপমহাদেশে বিরল।

শ্রী চিন্তামণি পানিগ্রাহি (ভুবনেশ্বর): স্যার, এটি ভারত ও পাকিস্তানের ইতিহাসে এবং দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলের জন্য সবচেয়ে গুরুতর মুহূর্ত। সংবাদপত্রে ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি থেকে বর্ণিত হয়েছে বাংলাদেশের মানুষের অপরিমেয় কষ্ট। এবং আমরা আমাদের হৃদয়ে গভীর যন্ত্রণা অনুভব করেছি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী, আমাদের সরকার ও এখানে উপস্থিত সব দল ও এই দেশের সমগ্র জনগণের হৃদয়ে তা স্পর্শ করেছে। আমার মনে হয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতির পরে প্রধানমন্ত্রী তার নিজের একটু অভিব্যক্তি দেবেন, যাতে বাংলাদেশের যে সাহসী যোদ্ধারা ঔপনিবেশিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, যারা এশিয়ার মানবাধিকার ও স্বাধীনতা সমুন্নত রাখার জন্য সবচেয়ে বড় যুদ্ধ, তাদের জন্য আমাদের প্রধানমন্ত্রী আবেগঘন কিছু কথা বলবেন।

আমি পররাষ্ট্র মন্ত্রীর কাছে জানতে চাইব মুজিবুর রহমান অথবা মুক্তিযোদ্ধারা কেউ এশিয়ার দেশগুলোর থেকে কোন সাহায্যের জন্য আপিল করেছে কিনা। দ্বিতীয়ত, এটা সত্য যে, মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে যথেষ্ট প্রভাব রাখেন এবং তাকে যদি কোন ভাবে সাহায্য করা না হয় তাহলে চরমপন্থীরা সুযোগ নিয়ে নেবে যা ভারতের স্বার্থের জন্য ভালো হবেনা। আমি আশা করি মন্ত্রী এটা স্পষ্ট করবেন। তৃতীয়ত, সরকারকে দেখতে হবে অতিরিক্ত অস্ত্র ভারত মহাসাগর এবং ভারতীয় নৌবাহিনীর চোখ এড়িয়ে যেন না যেতে পারে। আকাশপথেও তা খেয়াল করা দরকার। সরকার তাদের অবস্থান স্পষ্ট করবেন বলে আশা করি। ভারতের জনগণের জানতে চায় বাংলাদেশের এই সংকটাপন্ন মুহূর্তে বাংলাদেশের সাহসী যোদ্ধাদের কোনো প্রকার সহায়তা আমাদের সরকার দিচ্ছে কিনা। কমপক্ষে একটু সহানুভূতি যাতে তারা করে তারা পশ্চিম পাকিস্তানের একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে এই অসম যুদ্ধ চালিয়ে যাবার মনবল পায়।

ডঃ ভি কে আর ভারাদারাজা রাও (বেল্লারী): স্যার, ক্ষমতাসীন দলের একজন সদস্য হিসেবে, আমি বাংলাদেশে গণতন্ত্র অবদমনের যে কঠিন ঝড় চলছে তার জন্য আমার বিষাদময় অনুভূতি প্রকাশ করছি।

ভারতীয় ইতিহাসে বা এই উপমহাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের জন্য একটি অহিংস আন্দোলন সব প্রত্যাশা অতিক্রম করে সফল হয়েছে। আমি এটা বলতে চাই আমাদের প্রাণপ্রিয় দেশ ভারত তার সাধ্যের চেয়েও সফলভাবে তা পেরিয়ে এসেছে। সেসব অহিংস আন্দোলনের নেতারা শান্তিপূর্ণ ভাবে সমঝোতা করেছিলেন। স্বাধীনতার দাবিতে ছিল না; স্বায়ত্তশাসন এবং দীর্ঘকালস্থায়ী দাবিদাওয়াগুলি তারা দাবি করেছিলেন। আমার জানা মোঃতে ইতিহাস কোনোদিন দেখেনি যে একজন সামরিক আইন প্রশাসক কে শপথ পাঠ করানো থেকে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। আমি দেখিনি একটি রেডিও স্টেশন তার নিজের ইচ্ছায় পূর্ববাংলায় আবেগপূর্নভাবে জনগণের নেতার কাছে সমর্পিত হয়েছে। এই ধরনের জিনিস গান্ধীর সময়েও আমাদের নিজের দেশে ঘটেনি। পূর্ববাংলার জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এমন একটি অহিংস আন্দোলন সফলতা লাভ করার পর্যায়ে আসার মাত্র সাত দিনের মধ্যে ট্যাংক এবং সশস্ত্র বাহিনীর দ্বারা দমন পীড়ন শুরু করা হল যা অনুমানের বাইরে।

১২ টা –
তারা আমাদের প্রতিবেশী কিনা সেটা কোন বিষয় না। ইস্ট বেঙ্গল বিশ্বের একটি অংশ এবং আমরা ঘোষণা করেছি, আমাদের প্রেসিডেন্ট বলতে আনন্দিত হবেন যে, ভারতের কণ্ঠ যেখানেই অন্যায় সেখানেই জাগ্রত হবে। আমি মনে করি, পূর্ব বাংলায় অবিচার ও নিপীড়নের যে উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে তা অদ্বিতীয়।

আমি আমার দলের নেতা কে মনে করিয়ে দিতে চাই যে ১৯৪৭ সালে, যখন আমরা একটি সরকার গঠন করে উঠিনি এবং তার বিশিষ্ট পিতা ভারতের তথাকথিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতা ছিলেন, তিনি তখন একটি এশিয়ান পিপলস কনফারেন্স ডাকেন। আমি তখন ছিলাম। সেখানে ভারতীয় ৪৮ জন সদস্যে সমস্ত বিশ্বে ঘটে চলা নিপীড়ন এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাদের সমর্থন জ্ঞ্যাপন করেন। নিপীড়ন এবং অত্যাচারের সেসব ঘটনা পশ্চিমবঙ্গে আমাদের সীমানা জুড়ে চলছে। আমি জানি আমার দলের নেতা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী বেশী না হলেও অন্তত তার বাবার মতো সাহস পেয়েছেন।

আমি অবশ্যই বলব, এই সুযোগে, যে আমি আমার সাবেক সহকর্মি মাননীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বিবৃতিতে হতাশ। কারণ তার ঘূর্ণিঝড় দুর্গতদের জন্য যারা আসলে ট্যাঙ্কের নিচে নিষ্পেষিত হচ্ছেন তাদের ত্রাণ দেয়ার ব্যাপারে তার প্রয়াস সন্তোষজনক নয়। তিনি কাদেরকে রিলিফ দিতে যাচ্ছেন? পূর্ব পাকিস্তানে মৃত মানুষের জন্য? আমি জানি না, আমি আমার দলের মাননীয় নেতাকে অনুরোধ করতে চাই উপনিবেশবাদের শেষ চিনহ এশিয়া মহাদেশের থেকে মুছে ফেলতে হবে এবং মানুষকে অবাধ ও আত্ম সন্মানের সাথে জীবনযাপন করতে এবং তাদের নিজস্ব গণতান্ত্রিক পথে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়তে হবে।

শ্রী কৃষ্ণ মেনন (ত্রিভানদ্রাম): জনাব স্পিকার, স্যার, আমি এই হাউসে অনেক দর্শকদের দেখতে পাচ্ছি যা আমি সবসময় দেখিনা। এব্যাপারে সন্দেহ নাই যে পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটেছে তা একটি জাতীয় বিপ্লব এবং তা হচ্ছে ঔপনিবেশিক শাসন এর বিরুদ্ধে যা বেশ কয়েক বছর ধরে চলছে।

আমি বিস্তারিত বলতে চাইনা। আমি বলতে চাই পূর্ববাংলার নিপীড়িত মানুষের সাহায্যের জন্য আমাদের সর্বাত্তক চেষ্টা করা উচিৎ। তাদেরকে আপনি শরনার্থি বা অন্য যাই বলুন না কেন। আমাদের শুধুমাত্র আমাদের আকাশ সীমায় তাদের উড্ডয়ন এবং আক্রান্ত হলে বদলা নিয়েই সন্তষ্ট থাকলেই চলবে না। আমি আশা করি, সরকার জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী অবিলম্বে পদক্ষেপ নেবে। যা কিছু ঘটছে তার বিরুদ্ধে কনভেনশন অনুযায়ী দায়িত্বশীল হতে হবে পদক্ষেপ নিতে হবে।

যতদিন আমাদের কূটনৈতিক প্রতিনিধিরা ইসলামাবাদে থাকবে, আমরা সঠিক তথ্য পাব, যার উপর ভিত্তি করে আমরা জাতিসংঘের সাথে বোঝাপড়া করতে পারব।

এই সময়ে নৈরাশ্যবাদী হলে এবং যদি বলি আমরা জাতিসংঘ ও সংসদে কিছুই করতে পারবোনা সেটা হবে চরম ভুল। আমরা বিশ্বের প্রতিটি ফোরাম ব্যবহার করব। যখন এই দেশের জনমতের একটি বড় অংশ মোজাম্বিক এবং এ্যাঙ্গোলা অথবা আফ্রিকাতে দমন ও নিপীড়নের বিপক্ষে প্রতিবাদ প্রকাশ করেছে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের জনগণের সংগ্রাম সমর্থন করছে,, আরবের লোকদের আরেকটি সামাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সমর্থন করেছে, তখন তাদের ব্যাপারে আমরা কিভাবে চুপ করে থাকি যারা একদম ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে? আমি কোন ভাবেই বলছিনা যে আমরা আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে তা করতে চাই। আপনার পাকিস্তান কাশ্মীরে যা করছে তা করতে চাচ্ছিনা। এটা একটা স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন যা শুরু হয়েছে শাসক সরকারের নিজেদের দেয়া নির্বাচনের ফলাফলের পরে। এটি একটি ন্যায্য আন্দোলন। যা জনগণের ভোট দ্বারা পবিত্রীকৃত হয়েছে এবং সেখানে একটি এই সম্পর্কে কোন দ্বিমত নাই। এবং আমি আশা করি যে, প্রধানমন্ত্রী তার পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন ইন্ডিয়ান রেড ক্রসের মত সংগঠনগুলোকে নিযুক্ত করে। তারপর অন্যান্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।

আফ্রো-এশীয় মতামত যা ঔপনিবেশিক শাসনের সময় প্রয়োগ করা হয় যেখানে শাসন করার সুযোগ নাই, অব্যাহত আন্দোলনে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে নয়, এটা নির্বাহী বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ মত সংস্কারের জন্য নয়। এটা শুধুমাত্র বিপ্লবী মানুষদের স্বাধীনতার দাবি। আমি আশা যতক্ষণ সরকার নতুন সরকার জনগণের দ্বারা বাস্তবায়িত না হয় ততদিন আন্দোলন চলবে। এবং যেন উত্তর ভিয়েতনাম ও পূর্ব জার্মানির মত না করে। (বাধা) কারণ এই বিষয়ে বিলম্ব যত হবে এটা তত কঠিন হবে। যখন একটি সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, যুক্তিসঙ্গতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং মানুষ তার কমান্ড মানে এবং তখন তা আমেরিকার আইনেও বাধ্যবাধকতা সঞ্চালন করতে সক্ষম হয় এবং তা অবিলম্বে স্বীকৃত হওয়া উচিত। সুতরাং, যদি একটি আবেদন নতুন সরকার কর্তৃক প্রণীত হয় তাহলে এটাকে স্বীকৃতি দেয়া উচিৎ, নাম যাই হোক – যেহেতু আরেকটা বংগ এখানে আছে।

অবশেষে, আমি বলতে চাই, জনাব স্পিকার, যে এই ঘোলা পানিতে সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ আমাদের প্রতিরোধ করতে হবে। ব্রিটিশ সরকার যারা এই অংশ থেকে প্রস্থান করেছিল, তারা প্রথম ভারত ও পরে সিংহল কে বেইজ হিসেবে নেবে। জানিনা খবর সঠিক কিনা। বিশ্বের অন্যান্য ক্ষমতাধর দেশও এমনটাই করছে। সাম্রাজ্যবাদ ঘোলা পানিতে মাছ ধরতে পছন্দ করে। এবং আমাদের সময়মত হস্তক্ষেপ করতে হবে – কারণ বিপদ একদম আমাদের সীমানা পাসে চলে এসেছে।

আমি আপনাকে ধন্যবাদ, জনাব মাননীয় স্পিকার, আমাকে কিছু কথা বলার সুযোগ দেওয়ার জন্য।

শ্রী সমর গুহঃ স্যার, আজ আমি এই উপমহাদেশের সবচেয়ে সুখী মানুষ। কারণ আমার পূর্ববাংলায় মুজিবুর রহমানের সাথে পাঁচ বছরের জন্য কাজ করতে হয়েছিল। এবং আমাকে পাগল বলে খেতাব দেয়া হয়েছিল যখন ১৯৫২ সালে আমার নিজের লেখা একটি বইতে আমি উল্লেখ করেছিলাম যে স্বাধীন পূর্ববাংলা পাকিস্তানের দুই অংশের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে সৃষ্টি হবে। এরপর আমি বিভিন্ন নিবন্ধ ও গ্রন্থে অনেক বার এটা লিখেছি এবং সব সময় আমাকে মানুষ পাগল হিসেবে অভিহিত করেছে। কিন্তু, স্যার, আজ একটি পাগলের কথা সত্য হচ্ছে এবং একারণে আমি খুব খুশি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্তির পর সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা। সম্ভবত এটা আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান। আমি মনে করি এটা দেশ ভাগের পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে একটি ঐতিহাসিক সুযোগ দেবে। এটা পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের এক ঐতিহাসিক বিপ্লব।

মুজিবুর রহমানের এক বিস্ময়কর বিপ্লবী নেতৃত্বের উদাহরণ দিয়েছেন সমস্ত বিশ্ব তার সাক্ষী হয়ে থাকবে। সকলে জানি ন্যাশনাল আওয়ামী লীগের নেতা জনাব ভাসানী চীনা সাহায্যে সব রকমের অসুবিধা তৈরি করছেন। কিন্তু এখন সব দল; ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ, কনভেনশন মুসলিম লীগ, পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ ও জামাত – উল উলেমা, সব দল সম্পূর্ণভাবে মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ।

এটা মহান পরিতৃপ্তির একটা ব্যাপার যে এখন পূর্ব বাংলার সব বেসামরিক প্রশাসন আওয়ামী লীগ ও তাদের সংগ্রাম পরিষদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। শুধু সেনানিবাস এলাকায় এবং কিছু অন্যান্য শহরাঞ্চলে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ৮০০০০ মানুষ নিয়ন্ত্রণে আছে। ট্যাংকের সাহায্যে এবং মেশিনগানের সাহায্যে তারা কসাইখানা করে রেখেছে; তারা পূর্ববাংলায় বিপ্লবীদের হাজারে হাজারে গণহত্যার করছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা নত হবে এবং তাদের আত্মসমর্পণ করতে হবে। কারণ, সেনাবাহিনীর এই ৮০০০০ মানুষকে চাপে রাখবে সাড়ে সাত কোটি মানুষ।

যারা বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থা জানেন তারা এটা বুঝতে পারবেন। সেখানে অনেক নদী আছে। লজিস্টিক কারণেই সেখানে সকল জনসংখ্যার উপর দমন চালানো সহজ নয়।

আমি প্রধানমন্ত্রীকে মনে করিয়ে দিতে চাই একটি জাতির জীবনে এমন আন্দোলন এমন সুযোগ সব সময় আসে না। এটা নিষ্পত্তি করার সময়। এটা ভারত সরকারের নেতাদের দ্বারা নিষ্পত্তিমূলক কিছু করার সময়। আমি অনেক বার বলেছি যে ভারত-পাকিস্তান সমস্যার বাস্তব সমাধান কাশ্মীরে নয়, বরং তা পূর্ব বাংলায়। যদি পূর্ববাংলায় বিপ্লবী আন্দোলন সফল হয়, যা আসলে হবেই, তখন সেখানে সমগ্র উপমহাদেশে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন হবে ও ভারত ও পাকিস্তান মধ্যকার পারস্পরিক রাজনৈতিক সম্পর্ক ভালো হবে।
আমি বলতে চাই, অবিলম্বে সরকারের উচিৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে তাদেরকে একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া। আমাদের দেখতে হবে কি অবস্থায় একটি জাতি তাদের সম্পূর্ণ সার্বভৌমত্ব অর্জন করে। দেখা যায় আওয়ামী লীগ ১৬২ টি সদস্য পদ সুরক্ষিত করে যা সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য যা প্রয়োজন তার চেয়েও বেশী।

অতএব, যদি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গণতান্ত্রিক নীতির কোন অর্থ থাকে তাহলে বাংলাদেশর জনগণের অধিকার আছে তাদেরকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেবার।

তারা সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের ভুঅঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের বেসামরিক প্রশাসনও চলছে এবং সেখানকার জনগণ তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেছে। তাদের নিজস্ব সরকার ও নিজস্ব পতাকা আছে। সার্বভৌমত্ব পূরণের সকল শর্ত সেখানে উপস্থিত। অতএব, তারা নিজেদের একটি স্বাধীন দেশ ঘোষণা করতে পারে এবং বাস্তব গণতান্ত্রিক অর্থে তাদের সে অধিকার আছে এবং ভারতেরও অধিকার রয়েছে আন্তর্জাতিক নীতি অনুসারে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার।

এটি একটি প্রমাণিত সত্য। আমি বলছি না ভারত তার সামরিক শক্তি নিয়ে পূর্ববাংলায় ঝাঁপিয়ে পরুক। সামরিক হস্তক্ষেপ, আন্তর্জাতিক কোড মানা এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক বহাল রেখেই ভারত পূর্ববাংলার জনগণ ও বিপ্লবীদের সম্ভাব্য সকল সহায়তা দিতে পারে।

আমি কিছু জিনিস সুপারিশ করবে। ভারতের উচিৎ অবিলম্বে বিশ্ব জনমত গঠন করা। আমি এই সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীকে মনে করিয়ে দিতে চাই। এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের নেতারা তাঁদের সাহায্যের জন্য হাত প্রসারিত করতে ভারত, সিংহল এবং অন্যান্য এশীয় ও বিশ্বের দেশগুলোর কাছে অনুরোধ করেছে। তারা এটা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছে। অতএব এই বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু নয়। স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে তাদের স্বীকৃত হবার অধিকার আছে।

আমিও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষন করছি বেসামরিক মানুষ যারা গণহত্যার স্বীকার হচ্ছে তাদের জন্য অবিলম্বে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনে ব্যাবস্থা নিতে।
আমিও প্রধানমন্ত্রীর কাছে আরও দাবি জানাচ্ছি তিনি যেন ব্রিটেন সরকার, কলম্বো বন্দর এবং মালদ্বীপকে পশ্চিম পাকিস্তানকে পূর্ব লাকিস্তানে অস্ত্র ও গোলাবারুদ আনা নেয়ার জন্য বন্দর হসেবে ব্যাবহার করার অনুমতি না দেয় এই ব্যাপারে অনুরোধ করতে। নৌবাহিনীকে বঙ্গোপসাগরে এবং ভারত মহাসাগরে পাহারা দিতে হবে যাতে এইসব নরঘাতক, খুনী রা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে যেতে না পারে।

আমি আরও একটি নিবেদন করি। আমি জানি যে, বাংলাদেশের হাজার হাজার লোক করাচি বিমানবন্দরে আশ্রয় নিয়েছে। তারা জানে না তাদের কি ঘটবে। তাদের জবাই করা হচ্ছে। অতএব, আমি তাদের ভারতের ভিতর দিয়ে একটি নিরাপদ ট্রেন বা অন্য কোন মাধ্যমে তাদের নিজের দেশে ফিরে যাবার পথ সহজ করে দিতে অনুমতি প্রদানে সরকারকে অনুরোধ জানাচ্ছি।

উপসংহারে আমি বলব এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়। আমাদের এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত নষ্ট করা যাবেনা। আশা করব ভারতীয় একজন সাহসী কন্যা হিসেবে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ রক্ষার বিপ্লবের হাত বাড়িয়ে দেবেন এবং ভবিষ্যতে ভারতকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবেন।

বাংলাদেশকে আমার স্যালুট! জয় বাংলা জয় হিন্দ! মুজিবুর রহমান জিন্দাবাদ, নেতাজি জিন্দাবাদ! নেতাজি মুজিবুর রহমানের অনুপ্রেরণা। আমি ব্যক্তিগতভাবে তা জানি।

শ্রী এ.কে. সেন (কলকাতা উত্তর পূর্ব): এই কোন খারাপ মুহুর্ত নয় বরং গর্ব করার মুহূর্ত। এবং আমরা খুশি যে একটি জাতি বিপ্লবের মাধ্যমে জেগে উঠছে। তাদের বিরুদ্ধে যারা তাদের বছরের পর বছর শোষণ নির্যাতন করে যাচ্ছে। এখানকার অনেক রক্তাক্ত স্থান ব্যক্তিগতভাবে আমাদের কাছে পরিচিত। সেখানে আমাদের হাজার হাজার শহীদদেরও রক্ত ঝরেছে যারা ব্রিটিশদের বুলেটের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিল। সেই দৃশ্য আবার যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানের বুলেটে ফিরে এসেছে কিছু নিরীহ লোকদের বিরুদ্ধে যারা শুধুমাত্র সাধারন নাগরিকদের মত বাঁচতে চেয়েছে এবং তাদের নাগরিক অধিকারটুকু চেয়েছে। তারা কি করেছে?

তারা শুধু তাদের নেতাকে ভট দিয়েছে। তারা স্বেচ্ছায় তাদের নেতাকে সব কিছু করার অনুমতি দিয়েছে। তিনি আইয়ুব খানের বা ইয়াহিয়া খানের মতো সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে জোরপূর্বকভাবে কিছু করেন নাই। মানুষ স্বেচ্ছায় তাকে সব ক্ষমতা দিয়েছে। যখন সামরিক নেতা পূর্ব পাকিস্তানে ছিলেন তারা তাদের নিজস্ব চোখে দেখেন বাংলাদেশের পতাকা ঘরে ঘরে উড়ছে এবং গভর্নমেন্ট হাউজ ও সামরিক সদর দপ্তরেও একই অবস্থা। এবং শাস্তি হিসেবে সামরিক জান্তা ৭০ মিলিয়ন নির্দোষ মানুষের উপর যুদ্ধ ঘোষণা করেন। লাখ লাখ নারী রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে এবং আমরা তাদের জন্য গর্বিত। তারা আমাদের মত রক্ত মাংসের মানুষ। তারা এখনও আমাদের ভাষার বলে। তারা রেডিওতে যে গান গায় যুগ যুগ ধরে তা আমাদের মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। আর সেখানে সমুদ্রপথ বিদেশী অস্ত্র সহ কিছু মিথ্যুক ঢুকে পড়ছে আর নির্বিচারে হত্যা করছে সেই সব নিরীহ নির্দোষ নারী, পুরুষ ও শিশুদের।
আমার মনে আছে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মহান পিতা ডাচদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন যখন তারা সমুদ্র পথে তাদের সৈন্য ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা দমন করার জন্য যাচ্ছিল। তিনি তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে বলেছিলেন। সেই মুহূর্ত আবার এসেছে। আমি আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে আবেদন করছি একই ভাবে নেতৃত্ব দিতে।

এটা শুধু বাংলাদেশের একার কণ্ঠস্বর নয়। বা শুধু পশ্চিমবঙ্গের কণ্ঠ নয়। এটা সমস্ত এশিয়ার কণ্ঠ, যা মানবতার কথা বলছে এবং তাদের দুর্দশা এবং দাসত্বের নির্মম কাহিনী জানান দিচ্ছে।

অতএব, প্রধানমন্ত্রী যে নেতৃত্ব দেবেন, যা দেশবাসী তাকে দিয়েছে। সাহসের হাত নিয়ে তিনি সমগ্র এশিয়াতে এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে এবং শোষণের বিরুদ্ধে এগিয়ে যাবেন এটাই আশা।

এটা শুরু ভারত-এর জন্য একটি মুহূর্ত নয় – একা সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি মুহূর্ত। এবং যদি আমরা কাজ শুরু করি তাহলে সবাই দেখতে পাবে – বিশেষ করে যারা সাধারণত নিরীহদের সাহায্যের জন্য কথা বলেনা। অতএব শুধু দুখ প্রদর্শন না এখন কিছু করার সময় এসেছে। তারা আমাদের সাথে ঘনিস্টভাবে সম্পর্কিত, তারা আমাদের বন্ধু, তাদের আমাদের সাহায্যের প্রয়োজন এবং যদি আমরা সাহায্য কততে অস্বীকার করি তাহলে ভবিষ্যতে এই মুক্ত মানুষগুলো তা ভুলে যাবেনা।

আসুন নিজেদেরকে সংগঠিত করি এবং সব সাহায্য দেই। চলুন আগে প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকারি শুরু করুন। পাকিস্তানে সব অস্ত্র সরবরাহ ব্যাহত করুন। দরকার হলে সেইসব বন্দর এবং দোকান দখলে নিন যারা নিরপরাধ মানুষদের জবাই করার উদ্দেশ্যে প্রাণঘাতী অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছিল। আমরা জাতিসংঘকে দাবি জানাই- সেখানে আমাদের পুর্ব অবস্থান ও জেনোসাইড কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী হিসেবে আমাদের এই গণহত্যা বন্ধে এগিয়ে আসতেই হবে – বিশেষ করে যারা আমাদের একদমই কাছের মানুষ।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী যদিও খুব উৎসাহব্যঞ্জক ও সহানুভূতি পূর্ণ কথা বলেছেন যদিও তা অকপটে আমাদের অনেককে হতাশ করেছে। আমি প্রফেসর মুখার্জির অনুভূতির সাথে যোগ করে বলি, আমাদের অবস্থান আরও শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন, আরও অনেক শক্ত হওয়া দরকার যা পৃথিবীর ইতিহাসে লেখা থাকবে।

আমার মনে আছে যখন ফরাসি বিপ্লব শুরু হয় এবং প্যারিস থেকে বিক্ষুব্ধরা ভার্সাই আসে রাজা বলেছিলেন – ‘মানুষ কি বিদ্রোহে করছে? তাঁর মন্ত্রী বলেন, “না, স্যার, এটা একটি বিপ্লব! ‘ প্রফেসর মুখার্জীকে তা মনে রাখতে হবে।

অতএব, এই শুধু নির্যাতিত কিছু মানুষের বছরের পর বছর ধরে শোষিত হবার যন্ত্রণা নয়। এটা নিছক সাহায্য ও সহানুভূতির কথা নয়। এটি কিছু করার জন্য চিৎকার করা বিপ্লবী কণ্ঠ যাতে বিশ্বের বিবেক জেগে উঠে এবং সেই মানুষগুলো যারা বিদেশী অস্ত্র নিয়ে নিরপরাধ মানুষের উপর সশস্ত্র যুদ্ধের অবতীর্ণ হয়েছে তাদের ধ্বংস করে দেয়।

শ্রী কে মনোহরণ (মাদ্রাজ উত্তর): পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিবৃতি না শুধুমাত্র নির্ভরযোগ্য তো নয়ই বরং আমি দুঃখিত বলার জন্য যে তা ভয়ঙ্কর হতাশাজনক। আমার মত উদ্বেগ এই হাউসএর অনেকের কথায় ফুটে উঠেছে। শ্রী এ.কে. সেন যিনি আমার আগে বক্তব্য রাখলেন তিনি বলেছেন, শক্তিশালী ভাষা ব্যবহার করা প্রয়োজন। যতদূর আমি বুঝি যে শক্তিশালী ভাষা বলতে তিনি আরও জোড়াল পদক্ষেপ বুঝিয়েছেন; যা এখনো দৃশ্যমান নয়।

ব্যালট – যা পূর্ববাংলার জনগণের মর্যাদা, স্বীকৃতি, অবস্থান এবং স্বাধীনতা দিয়েছে তা ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে এবং ইসলামাবাদ থেকে আনা অসংখ্য বুলেট দিয়ে তাদের উপর চালানো হচ্ছে। পূর্ব বাঙলায় যা হচ্ছে তা শুধু কিছু লোকের যুদ্ধ নয় – বরং তা ইয়াহিয়ার সাজানো মিলিটারি গুন্ডাদের বিরুদ্ধ যুদ্ধ।

এই প্রেক্ষাপটে, ভারত সরকারের কি করতে হবে? এটাই এখন এই হাউজদের সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠের মূল জানার বিষয়। আমি খুব স্পষ্টভাবে বলতে চাই ইতোমধ্যে ভারত সরকারকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে প্ররোচনা দেবার অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাই একটি খোলা ঘোষণা দেয়া উচিৎ যে আমরা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সাথে আছি। কিন্তু গোপনে বা অন্যথায় কোন ভাবে সরকার তা করবে তা আটদের ব্যাপার। আমরা সরকারকে সে ব্যাপারে বিব্রত করতে চাইনা।

জানামতে এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো উদ্বিগ্ন। আমি মনে করি পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যার বিপক্ষে যথেষ্ট জনমত গঠন হয়েছে। তাই একটি সর্বদলীয় কনভেনশন বা সর্বদলীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে পারে এবং তার মাধ্যমে আমরা জনমত সংগঠিত করতে পারি। আমরা সমগ্র উপমহাদেশের মানুষের মনোযোগ আকর্ষন করতে পারি। এবং আমরা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে আমাদের নৈতিক সহানুভূতি দেখাতে পারি। যদি তার চেয়ে বেশী কিছু দেয়া হয় তাহলে সেটা কিছু গোপন সংস্থা বা আন্তর্জাতিক সংস্থা কে জানানো যথার্থ।

তার মানে আবার এই নয় যে, সরকার চুপ থাকবে। সরকার কূটনৈতিক ভাবে এটা নিয়ে আগাবে। সরকার মানবাধিকার কমিশন, জাতিসংঘ বা অন্য কোন ফোরামে পূর্ব পাকিস্তানের উপর যা হচ্ছে সেটার ব্যাপারে মনোযোগ আকর্ষন উত্থাপন করতে পারেন।
আমরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সকালে বৈঠক করি। প্রধানমন্ত্রী এটা সম্পর্কে অনেকটা চিন্তিত, এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী এটা সম্পর্কে সমানভাবে উদ্বিগ্ন, কিন্তু তা সত্বেও, তার বিবৃতি আমাদের ভয়ঙ্কর হতাশ করেছে। তাই আমি অনুরোধ করব ভারত সরকারকে আরো একটু বিবেচনা করতে এবং তা সমস্ত জনগণ, দায়িত্বশীল সংস্থা, দেশ – বিশেষ করে এশিয়ান-আফ্রিকান দেশগুলোর কাছে পৌঁছাতে হবে এবং বিশ্বের মতামত নিতে হবে।

আমি যখন এই কথা বলছি এর মানে এই নয় যে আমি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছি। এটা এখন শুধু পাকিস্তানের বিষয় নয়। মেশিনগানের গুলিতে লাখ লাখ শিশুদের ও নারীদের হত্যা, ধর্ষন করা হচ্ছে – এটা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হতে পারেনা। আমরা মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখব। আমি মনে করি সরকার পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জন্য অনেক কিছু করতে পারেন। আমরা মঙ্গলকামনা করি এবং পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জন্য সহানুভূতি প্রদর্শন করতে পারি।

শ্রী সমর গুহ: কোন পূর্ব পাকিস্তান নয়, বাংলাদেশ।

শ্রী কে মনোহরণ: জনাব সমর গুহ রহমানের যোগাযোগ রাখেন। আমার একে বাংলাদেশ বলতে কোন আপত্তি নাই।

কিছু সদস্য উঠে দাঁড়ালেন —

জনাব. স্পিকার: মাত্র অল্প কয়েক সদস্য প্রশ্ন বা ব্যাখ্যা করতে চাওয়ার অনুমতি চান, কিন্তু এটা কি নিয়মিত বিতর্কে পরিণত হল? এটা কঠিন যে কোনটা ব্যাতিক্রম আর কোনটা বিতর্ক।

শ্রী পি কে দেও (কালাহান্ডি): এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, এবং প্রত্যেক দলকে অংশহ্রহন করতে দেওয়া উচিত।

ডঃ. হরি প্রসাদ শর্মা (আলওয়ার): এই হাউসের প্রতিক্রিয়া একটু তীব্র হয়েছে, আমরা একটু বেশি আবেগ প্রকাশ করছি। আমার মনে হয় না এত ব্যাখ্যার প্রয়োজন। আমাদের প্রতিক্রিয়া আমাদের মৌলিক মূল্যবোধের উপর আক্রমণ তীব্র হয়েছে। মৌলিক কিছুতে আমাদের আক্রমন করা হচ্ছে। এটা না শুধুমাত্র দেশের অন্যান্য অংশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার দ্বারা আক্রমন নয় বরং মূল্যবোধের উপরে আক্রমণ। আমরা বরাবর বিশ্বজুড়ে মানুষের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলাম। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ দেশের অন্যান্য অংশ নিপীড়নের বিরুদ্ধে একটি অহিংস সুশৃঙ্খল সংগ্রাম করছে এবং আমি মনে করি এর ইতিবাচক দিক আছে।
সেখানে অন্যান্য সমস্যা খুব শীঘ্রই শুরু হবে। যদি আমরা সঠিক আন্দোলন এর সিদ্ধান্ত না নিতে পারি। সরকারকে মনে করিয়ে দিতে একটি প্রবাদ – দেরিতে বিচার আসলে বিচার না করার নামান্তর। কাজেই কোন প্রকার বিলম্ব পূর্ব বাংলার জন্য হতাশাজনক হতে পারে।

আরেকটি সমস্যা যা খুব শীঘ্রই আসবে – তা হল পূর্ব বাংলার স্বীকৃতি। আমি মনে করি সরকারএর প্রস্তুত থাকা উচিত। আমরা স্বীকৃতির উপর তাত্ত্বিক আলোচনায় যেতে চাইনা। একটা পুরো জাতির স্বীকৃতির দরকার আছে। চারটি মৌলিক নিয়ম স্বীকৃতির জন্য পূর্ণ করা হয়েছে সেখানে। পূর্ব পাকিস্তানের একটি নির্দিস্ট অঞ্চল আছে; সেখানে নির্দিষ্ট জনসংখ্যা আছে; তাদের একটি নির্দিষ্ট জাতিগত পরিচয় আছে এবং কার্যত নিয়ন্ত্রণ আছে সরকার কর্তৃক – যার চালক মুজিবুর রহমান। কাজেই যদি আমরা সঠিক সময়ে পদক্ষেপ গ্রহণ না করি তাহলে আমাদের প্রতিবেশীর উপর অবিচার করা হবে যা আমাদের নিজস্ব মৌলিক নীতি বিরোধী। এটিই প্রথম দৃষ্টান্ত নয়। ইন্দোনেশিয়াতেও এমন হয়েছিল। আমরা ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলাম। আমরা সেখানে কোনো সশস্ত্র বাহিনী পাঠাই নাই। সেখানে সবসময় আরেকটি কর্মপন্থা ছিল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে নয়া দিল্লিতেএকটি সম্মেলনে আহূত হয়েছিল। আমি মনে করি অন্তত আমরা সেরকম কিছু করতে পারি কিনা। আমি শুধুমাত্র সুপারিশ করতে পারি – তবে সরকার যা করবেন তা যেন সমস্ত জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটায়। এবং যাতে ভবিষ্যতে আমাদের কোনোদিন লজ্জা না পেতে হয়।

শ্রী শ্যাম নন্দন মিশ্র (বেগুসারাই): জনাব স্পিকার, স্যার, আমার বলতে দ্বিধা নেই যে সরকার যে বিবৃতি দিয়েছে তা ফ্যাকাশে এবং ম্রিয়মাণ। আমি বলব যে এটা নির্জীব। এবং এটি বিশেষভাবে আশ্চর্যজনক অন্তত যে দেশের পেছনে এত শক্তি রয়েছে।

আমিও কয়েকটি শব্দ এখানে বলতে চাই। এখানে হয়ত আমাকে একটু সাবধান হয়ে বলা উচিৎ। আমরা কখনো পাকিস্তানের নামে কুৎসা রটাইনি। তাই এখন যদি কিছু বলি সেটা শুধুমাত্র এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য বলা হতে পারে। কিন্তু তাই বলে আমরা সম্ভ্রান্ত ফরাসির মত বলতে চাইনা যাকে তিনি আক্রান্ত হলে তা অবহিত করা হলে তাকে বলা হল যে একটি বিপ্লব শুরু হয়েছে। তখন তিনি উপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এমনটা আমরা চাইনা। আমরা আমাদের চোখ রাখতে পারিনা। অন্যান্য মাননীয় সদস্যরা বলেছেন যে আমাদের বর্ডারে কীভাবে গণহত্যা হচ্ছে, নিষ্পেষিত হচ্ছে মানবতা, মানব স্বাধীনতা ও গণতান্ত্র যেখানে মুখ থুবড়ে পরে আছে যারা আমাদের পরিবারের কাছের সদস্য ছিলেন।

আমরা আমাদের চোখ বন্ধ রাখতে পারিনা। সেখানে সম্প্রতি যে নির্বাচন হয়েছে – এমন কি বর্ডারে যা হচ্ছে তাও নজরে রাখতে হবে। আমি আশা করি যে সরকার আমাদের পূর্ব সীমান্তে এমনকি আমাদের পশ্চিম সীমান্তেওচোখ রাখবেন। কারণ উভয়দিকেই বিভিন্ন আয়োজন চলছে। তারা সেটাকে আরও বাড়াতে পারে ও শাখাপ্রশাখা ছড়াতে পারে।

আমি আশা করি যে সরকার এমন পদক্ষেপ নেবে যে Cento বা SEATO এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করেন এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার মাটিতে কি হচ্ছে এই অজুহাতে এখানে ঢোকার চেষ্টা না করে। এটা সরকারকে মাথায় রাখতে হবে।
বিষয়টা এমন না যে আমরা সবসময় পাকিস্তানকে একটি স্থায়ী শত্রু হিসেবে দেখি। আর যদি তাই হয় তবে তাদের সঠিক ভাবে বুঝতে আমাদের সমস্যা হবে।

সর্বশেষে, আমার দল সন্তুষ্ট থাকবে সরকার যে সিদ্ধান্তই নিক। এবং আমরা সন্তস্ট হব যে সরকার বাংলাদেশ পরিস্থিতি সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পেরেছে। কারণ আমাদের বিশ্বাস সরকার যদি বুঝতে পারে তাহলে তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করবেনা।
পরিশেষে, আমরা অতি দ্রুত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মানুষের স্বাধীনতা ও যেভাবে নির্মমভাবে দমন করা হচ্ছে সেই সত্য তুলে ধরার জন্য সরকারকে কাজ করতে হবে। আমার কোন সন্দেহ নেই, যে কূটনৈতিক ভাবে সরকার তার সব প্রচেষ্টা বলবত রাখবেন। আমি আমার পার্টির পক্ষ থেকে বলতে চাই আমার এই হাউজের উপর ভরসা আছে। শুধু তাই নয় হাউজের বাইরে সেই সব সাহসী মানুষ আত্ম বিশ্বাসী মানুষ যারা জনগণের সার্বভৌমত্বের মত প্রকাশের জন্য আন্দোলন করছেন। আন্দোলন এত শক্তিশালী এবং আত্মনির্ভরশীল যে পাকিস্তান সরকার বলছে যে এটা বাইরের শক্তিগুলোর দ্বারা সমর্থিত হচ্ছে। বরং আমি ভীত পাকিস্তান সরকার তাদের দমন করার জন্য বাইরের দেশ থেকে অস্ত্র এনে কিছু একটা করে কিনা। আন্দোলনশতস্ফুর্ত যে শেষ পর্যন্ত আমার আশা যে আন্দোলন সফল হবে।

শহর এস এ শামীম (শ্রীনগর): জনাব স্পিকার, আমার হৃদয়ে পূর্ব পাকিস্তানে আমার ভাইদের জন্য রক্তক্ষরণ হচ্ছে এবং আমি পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত ঘটনাবলির ব্যাপারে অন্তর্বেদনা অনুভব করছি এবং এই হাউসে উদ্বেগ ভাগ করে নিচ্ছি। কিন্তু আমি অবশ্যই বলবো যে আমি আবেগ দ্বারা তাড়িত নই। পূর্ব পাকিস্তানের লাখ লাখ মানুষ এক বিশাল সংকটের মুখোমুখি। আমাদের মাথা গরম করলে চলবে না। আমরা আবেগ দ্বারা চলব না। এই হাউজে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ পূর্ব পাকিস্তানীদের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য। সেই জুলফিকার আলি ভুট্টর বিরুদ্ধে যে ইন্দো-পাক সম্পর্ক নিয়ে, ফক্কার- বন্ধুত্ব নিয়ে, প্রতারিত করেছে। মুজিবুর রহমান কে ভারতের দালাল বানিয়েছে। ১৯৬৯ এর অভ্যুত্থানের একমাত্র তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার চার্জ দেয়া হয়েছিল যাতে বলা হয়েছিল সে আমাদের গুপ্তচর। আমাদের হাত ভুট্টোর হাতকে শক্তিশালী করার জন্য নয়। তবে আমরা যে স্বীকৃতি দেবার জন্য তাড়াহুড়া না করি। এই ব্যাপারে আমি কিছু বলতে চাই —

(বাধা)—-
শ্রী সমর গুহ: এটি একটি বিচ্ছিন্ন কথা।

শ্রী S.A. শামীম: হতে পারে। নিবন্ধিত হোক্। আমি আমার গণতান্ত্রিক ভিন্নমত বলার অধিকার রাখি। একই ভাবে আপনি আপনার মতামত প্রকাশ করতে পারেন।

প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে যে ক্ষেত্রে এই বিষয়টা জাতিসংঘের সাপ্নে পেশ করা হবে। আমি একজন কাশ্মীরি হিসাবে, জানতে চাই তাদের আসলে কি করার আছে? তারা গোটা ব্যাপারটাই তালগোল পাকিয়ে ফেলবে। তারা কাশ্মীরে কি করেছে? আপনি জাতিসংঘে গিয়েছিলেন এবং আপনি আট দিনের মধ্যে একটি সমাধান আশা করেন। এখন ২৪ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে এবং এখনও আপনি কোন সমাধান পান নাই।

পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ আগ্রাসনের মুখোমুখি। তারা সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করছে। গ্রহণ করব বা করবোনা – এভাবে আমরা আগাতে চাইনা। এই পর্যায়ে আমাদের অন্তর্বেদনা এবং রাগ সংযত করতে হবে। আমি সরকারের সঙ্গে পুরোপুরি একমত এবং আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে মিলিয়ে বলতে চাই যে তার বিবৃতি সময়োচিত।

মুজিবুর রহমান, যিনি আন্দোলন শুরু করেছেন, আমাদের সকলের সহানুভূতি তার দরকার। সে ভারতীয় সংসদ, ভারত সরকার বা ভারতীয় জনগণের অস্ত্র দিয়ে তার এই আন্দোলন শুরু করেন নাই। তিনি একজন সাহসী ব্যক্তি। আমি তাঁকে যতটুকু জানি তিনি যথেষ্ট সাহসী পাকিস্তানী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম নিয়ন্ত্রণের জন্য। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। আমাদের সহানুভূতি তার সাথে আছে এবং এটা রেকর্ডেড। আমি নিশ্চিত তিনি এই যে ভারতের পার্লামেন্টে ভারতের প্রতিনিধিরা তাদের সহানুভূতি এবং পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে তার উপর তাদের অন্তর্বেদনা প্রকাশ করবে।

সংকটের এই অবস্থায় ভুলে যাবেন না যে এখন পূর্ব বাঙলায় যে পরিস্থিতি তা দেশের অন্যান্য অংশে ঘটতে পারে। আপনি নিশ্চই ডান পন্থিদের প্রভাব সম্পর্কে অবগত? আমি তা সমর্থন করিনা এবং আমি একমত না যে এটা …….. করা উচিত (বিঘ্ন).
শ্রী সমর গুহ: সাড়ে সাত কোটি মানুষ তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। আপনি যা বলেছেন তা বলার অধিকার আপনার নেই — …… (বাধা)

শ্রী এস এ শামীম – এই সরকার ইয়াহিয়া সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই সরকার আজ পর্যন্ত ইয়াহিয়া সরকারের স্বীকৃতি প্রত্যাহার করেননি। আমি সচেতনভাবে কথা বলছি এবং আমি দায়িত্ব নিয়ে একটি পূর্ণ ধারনা সঙ্গে কথা বলছি। এক জন্য আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে ডান সমর্থন করিনা। আমাদের আরও ভাবতে হবে, আইনি এবং রাজনৈতিক প্রভাব বুঝতে হবে। আমার হৃদয় বাংলার মানুষের জন্য থাকবে এবং আমি পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটছে তার জন্য অনুতপ্ত অবস্থায় আছি। কিন্তু আমাদের মত প্রকাশের প্রতি মর্যাদাশীল হওয়া উচিত। আমাদের অভিব্যক্তি একটি সংযত হতে হবে। আমি আমার মত বলতে চাই, পাকিস্তানি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে ভারতীয় জনগণ বিশেষ করে কাশ্মীরের জনগণকে মুজিবুর রহমানের সাথে থাকবে – সেই মহান বীর, মহান মুক্তিযোদ্ধা।
কিছু মাননীয় সদস্য. জেগে উঠলেন ……..

জনাব. স্পিকার: এটা অনির্দিষ্টকালের জন্য চলতে পারে না।

শ্রী পি কে দেও – আমি হাউসের সামনে আমার দলের মতামত স্থাপন করতে চাই।

জনাব. স্পিকার: ভুলে যাচ্ছেন, আমি সব প্রধান দল এবং কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের অনুমতি দিয়েছি।

শ্রী পি কে দেও: আমাদের একটি জাতীয় দল এবং আমরা আমাদের মতামত এখানে লিপিবদ্ধ করাতে চাই।

জনাব. স্পিকার: আমি ডঃ মেলকোট এবং শ্রী দেও কে দু’মিনিট সময় দিতে পারি। এরপর প্রধানমন্ত্রী কে দেয়া হবে।

ডঃ. মেলকোট (হায়দ্রাবাদ): আমাদের সঠিক দৃষ্টিকোণ থেকে বুঝতে হবে যে পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে তা আমরা অনুধাবন করেছি। যখন আমরা সেখানকার কথা বিবেচনা করি তখন আমাদের পিছনে ফিরে তাকাতে হয়। যখন আমরা ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল্মা – ব্রিটিশরা আমাদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করেছে এবং আমাদের ওপর তারা এমন বল করত যে তারা মনে করত তা করা ঠিক আছে। সে সময়ে আমরা সব বিশ্বজুড়ে সরকারের সমর্থন প্রত্যাশা করেছিলাম এবং যখনই আমরা কাগজে যা পড়েছি ১৯৩০ এবং ১৯৪২ সালে কিছু বিদেশী সরকার আমাদের পক্ষে ছিল যার জন্য আমরা খুশি ছিলাম। কাজেই এই সন্ধিক্ষণে আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করব – আমরা আমাদের সহানুভূতি, অনুভূতি প্রকাশ করব এবং তাদের সমর্থন করব। গণতান্ত্রিকভাবে দেখানো হয়েছে যে, তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন এবং তারা একটি অহিংস পদ্ধতিতে একটি যুদ্ধ যুদ্ধ করেছেন। এখানে আমি আপনাদের দৃষ্টি আবদ্ধ করতে চাই। এটা ভারতের জনগণ ও ভারত সরকারের দায়িত্ব পূর্ববাংলার নিপীড়িত মানুষ যে যুদ্ধ করছে তাতে সাহায্য করা। সরকার পর্যাপ্তরূপে অনুভূতি ব্যক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই মুহুর্তে প্রত্যেক সম্ভাব্য পদ্ধতিতে সমর্থন পূর্ববাংলার জনগণের জন্য খুব মর্যাদাপূর্ণ।

আমি সব সদস্য যারা এরকম বলেছেন তাদের সমর্থন করলাম। কিন্তু আমি অবশ্যই বলবো যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কর্তৃক প্রণীত বিবৃতি অপর্যাপ্ত এবং অপর্যাপ্ত।

জনাব. স্পিকার: আমি পি টি আই থেকে খবর পেয়েছি। আমার মনে হয়; এটা আমাদের নিজস্ব টেলিপ্রোম্পটার থেকে আসছে। এটি বলছে যে পূর্ব বাংলার নেতা মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রেডিও পাকিস্তান আজ (বাধা) ঘোষণা করেন।

কিছু মাননীয় সদস্য: লজ্জা লজ্জা!

জনাব স্পীকার: গ্রেপ্তারের গত রাতে মধ্য রাতের পর করা হয়েছিল. শ্রী পি কে দেও।

শ্রী পি কে দেও: জনাব স্পিকার, স্যার, স্বাতন্ত্র্য পার্টির পক্ষ থেকে আমি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত এবং জনপ্রিয় অভ্যুত্থানের সঙ্গে একমত প্রকাশ করছি এবং স্বায়ত্তশাসনের জন্য তারা ডিসেম্বরের নির্বাচনে যে স্পষ্ট ম্যান্ডেট পেয়েছেন তার জন্য তাদের আকাঙ্খার প্রতি সমর্থন জানাচ্ছি।

আমি যখন বাংলাদেশের কথা বলি, তখন আমি পাকিস্তানে ভৌগোলিক অর্থহীনতা এবং ধর্মের ভিত্তিতে কংগ্রেসে দ্বারা গৃহীত হয়েছে বলে মনে করেছি। কিন্তু আমরা সবকিছু সমর্পন করে দিয়েছি। আমাদের পূর্বসুরিরা যা করে গেছেন আমরা সেই একই কাজ করতে চাইনা।

এই মুহূর্তে আমি ফলিস থেকে শিক্ষা নিতে পারি। তারা যা করেছিলেন যখন চিনের তিব্বত আগ্রাসন করেছিল। অথবা চেকোস্লোভাকিয়ার আগ্রাসন। সেই ভুল গুলো আমাদে মনে রাখতে হবে। আমাদের সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্খার সমর্থন করা উচিত।

এই মুহূর্তে, আমি স্বতন্ত্র পার্টির পক্ষ থেকে সরকারের কাছে অনুরোধ জানাই জাতিসংঘে এবং আফ্রো-এশীয় সম্মেলন এবং অন্যান্য সব আন্তর্জাতিক ফোরামে মানবাধিকার কমিশনের প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ নিতে, এবং একই সময় সেখানে মানুষ ত্রাণ ও চিকিত্সার আবেদন পাঠাতে।

সর্বশেষে, আমি সেই সাহসী শহীদের যারা তাদের মাতৃভূমির জন্য নিজেদের জীবন দিয়েছেন তাদের শুভেচ্ছা জানাই। আমি তাদের সঙ্গে পূর্ণ সহানুভূতি প্রকাশ করছি।

প্রধানমন্ত্রী, আণবিক শক্তি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, তথ্য মন্ত্রী ও সম্প্রচার মন্ত্রী (শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী): জনাব স্পিকার, স্যার, কিছু খবর আমরা পেয়েছি. . . . .

জনাব. স্পিকার: আমি ভেবেছিলাম অফিস আমাকে পাঠিয়েছে তা ঘোষণা করতে। আমি জানি না।

শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী: এই সংবাদ রেডিও পাকিস্তান থেকে এসেছে তবে আমি বলতে পারব না তা সত্য না মিথ্যা। আমরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে এটাকে সত্য বলে মেনে নেয়া ঠিক হবেনা কারণ এটা অপপ্রচারও হতে পারে।

স্যার, শক্তি কথার মসয়ে নিহিত থাকেনা। আমার সহকর্মী সরদার সাহিব আবেগের সঙ্গে উচ্চারিত করেন নাই। এর কারণ তার পক্ষ থেকে বা সরকারের পক্ষ থেকে সেই অনুভূতির অভাব। কিন্তু এটা সত্য যে আমরা এই আন্দোলন এবং এর ঐতিহাসিক গুরুত্বের ব্যাপারে গভীরভাবে সচেতন।

পূর্ববঙ্গে নতুন কিছু হয়েছে। সেখানে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হতে যাচ্ছিল যেখানে সকল মানুষ প্রায় এক কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিলেন। আমরা এটাকে স্বাগত জানিয়েছি, এমন নয় যে আমরা অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে চেয়েছি। কিন্তু, ঘটনার মূল্যের জন্য তা করেছি। যেমনটা আমার এক বন্ধু বলেছেন – যার জন্য আমরা সবসময় একত্রে দাঁড়াই এবং যার জন্য আমরা সবসময় সোচ্চার হয়েছি। এবং আমরা আশা করেছিলাম যে একটি নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ আমাদের আরও কাছাকাছি আসবে। যা আমাদের নিজেদের মানুষদের ভাল পরিবেশ দেবে এবং এই উপমহাদেশে একটি সম্পূর্ণ নতুন পরিস্থিতি তৈরি করতে সাহায্য করবে। কিন্তু তা হয়নি। পাকিস্তান এমন একটি সুদৃঢ় করার জন্যে চমৎকার সুযোগ নষ্ট হয়েছে এবং যা দুঃখজনক, পীড়াদায়ক। তাই এই সম্পর্কে আমরা শক্তিশালী কোন কথা খুঁজে পাচ্ছি না। এটিও আবার একটি নতুন পরিস্থিতি কিন্তু ভিন্ন রূপে। এটা নিছক একটি দমন আন্দোলন নয়, । এখানে ট্যাংক দিয়ে নিরস্ত্র মানুষের উপর চালানো হচ্ছে। আমরা সমস্ত ঘটনার খবর নিচ্ছি।

আমি নিশ্চিত মাননীয় সদস্যরা তা বুঝতে পারছেন। আমি মাননীয় সদস্যদেরনিশ্চিত করতে চাই যে আমরা অবশ্যই দ্রুত গুরুত্তপূর্ন সিদ্ধান্ত নেব। সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় শেষ হয়ে যায়নি। আমরা সম্পূর্ণরূপে সজাগ আছি। এবং আমরা কি ঘটছে এবং কি আমরা করা প্রয়োজন সে সম্পর্কে ক্রমাগত দায়িত্ব পালন করব। আমি তার সাথেও একমত যে বলেছেন আমরা নিছক একটি তাত্ত্বিকভাবে যেন এগুলোকে না দেখি। একই সময়ে আমাদের সঠিক আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসরণ করতে হবে। গণহত্যা সম্পর্কে আমরা পুরোপুরি সচেতন এবং যা আমরা বিরোধীদলীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। এই মুহূর্তে আমি শুধু বলতে পারি যে, আমরা সম্পূর্ণরূপে হাউসের সবার অন্তর্বেদনা, আবেগ দেখেছি এবং এই বিষয়ের উপর তাদের গভীর উদ্বেগ ভাগ করে নেব। আমার সবসময় বিশ্বাস আছে যে স্বাধীনতা অবিভাজ্য নয়। আমরা সবসময় নির্যাতিতদের সাথে ছিলাম। কিন্তু এই রকম গুরুতর অবস্থায় আমরা, সরকার হিসেবে, মনে করি আমরা ভালো অবস্থায় আছি। আমি হাউসকে আশ্বস্ত করতে চাই যে আমরা পরিস্থিতি সম্পর্কে সজাগ আছি এবং আমরা বিরোধী দলীয় নেতাদের সাথে যোগাযোগ রাখব যাতে তারা আমাদের তাদের পরামর্শ দিতে পারেন এবং আমরা তাদেরকে আমরা যতটুকু জানব তা জানাতে পারি।

শিরোনাম সুত্র তারিখ
২১৪। বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রস্তাব গ্রহণ প্রসঙ্গে আলোচনা ভারতের লোকসভার কার্যবিবরণী ২৯ মার্চ, ১৯৭১

Sajib Barman
<১২, ২১৪, ৭৮৭-৭৮৯>

শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী (গোয়ালিকর)ঃ আমাকে আরেকটি কথা বলতে হচ্ছে। সারাদেশ এবং এই সংসদ বাংলাদেশের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। প্রধানমন্ত্রী সংসদে উপস্থিত আছেন। এই সভা কি বাংলাদেশের জনগণের সংগে নিজের সংহতির কথা ব্যক্ত করে একটি প্রস্তাব পাশ করতে পারে না? প্রধানমন্ত্রী এবং বিদেশমন্ত্রী যা কিছু বললেন বিপক্ষ দলের অন্যান্যরাও সেই কথাই বলছেন। ভারতের পার্লামেন্ট একটি প্রস্তাবের মাধ্যমে বাংলার জনগণের প্রতি তার দৃঢ় সমর্থন ঘোষণা করছে এটা আমাদের রেকর্ডে থাকা দরকার। আমি মনে করি, এটা কোন দলীয় ব্যাপার নয়। এখানে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা যায় এবং আমরা ওই প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারি।

স্পীকারঃ প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতির উপর এখানে পর্যাপ্ত বক্তৃতা হয়েছে। বক্তৃতার রূপ ছিল বিতর্কের মতই। এসব বক্তৃতায় যা কিছু বলা হয়েছে, আমি মনে করি, তাতে হাউসের সম্মতি ছিল এবং তাকে প্রস্তাবের সমরূপ মনে করা চলে।

শ্রী সমর গুহ(কন্টাই)ঃ এটা বিতর্কের ব্যাপার নয়। ট্যাঙ্ক ও মেশিনগানের গুলিতে ঢাকায়, চট্টগ্রামে ও অন্যান্য জায়গায় হাজার হাজার মানুষ মরেছে। এই গনহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে শ্রীমতি ইন্ধিরা গান্ধী কী করেছেন?

উনারা কী করেছেন? যখন হাজারে হাজারে মানুষ মরছে তখন এটা বতর্কের বিষয় নয়। এটা কোন বিশেষ শুভ ইচ্ছা পোষণের ব্যাপার নয়। এই কশাইগিরি(নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড), বিশৃঙ্খলা এবং গনহত্যার প্রতিবাদ সরূপ আমাদের সরকার কী করেছে?

এখানে আরেকটি বিষয় আছে। পশ্চিমবঙ্গের পত্রিকাসমূহে প্রকাশ হয়েছে যে গুয়াহাটি থেকে কলকাতা গামী ভারতীয় যাত্রীবাহী একটি ডাকোটা পাকিস্তান আর্মি গুলি করে ভূপাতিত করেছে এবং তা ধ্বংস হয়ে পাকিস্তানের ভিতর গিয়ে পরেছে।
স্পীকারঃ আপনি কি দয়া করে বসবেন? আমি আপনাকে অনুমতি দিচ্ছিনা।

শ্রী সমর গুহঃ এটা খুবই প্রাসঙ্গিক। আমি এই ব্যাপারে মনোযোগ দিতে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করতে বলেছি। বেসামরিক বিমান মন্ত্রীর এই সভায় ডাকোটাটি এখনো নিখোঁজ কিনা এই ব্যাপারে একটি বিবৃতি দেয়া উচিত।

স্পীকারঃ আমি আপনাকে অনুমতি দেইনি।

শ্রী সমর গুহঃ আমাদের সম্পর্ক রয়েছে। তাদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হচ্ছে। এমনকি ভারতীয় নাগরিকদেরও পাকিস্তানি আর্মি নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করছে। আমরা কি এমন চুপচাপ বসে থাকব যখন হাজারো মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে অকারণে নিষ্ঠুরভাবে এবং যখন অকারণ বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে? স্যার, এটা শুধুমাত্র সহানুভূতি জানানো নয়। সত্যিকার কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে …

স্পীকারঃ শ্রী সমর গুহ, আমাকে অতি রুঢ় হতে হবে যদি আপনি এরকম করে যেতে থাকেন?

শ্রী সমর গুহঃ গণহত্যা থামানোর জন্য? আমি তাই জানতে চাই। আমি দৃঢ়ভাবে সমর্থন করি যে, এই সভার উচিত পুর্ববঙ্গের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে সম্পুর্নভাবে সংহতি প্রকাশ করা। এটা একটা চরম প্যাঁচ, শুধু …

স্পীকারঃ শ্রী গোপলান।

শ্রী সমর গুহ, আপনি দয়া করে বসুন।

শ্রী সমর গুহঃ আমি বসছি না। সীমানার ঐপারে আমার ভাইয়েরা নিহত হচ্ছেন। আমি ঢাকা থেকে এসেছি, আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আমি জানি ঢাকার রাস্তায় হাজারো মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। আপনি কি চান যে আমি চুপচাপ বসে থাকি, যখন আমার ভাইয়েরা অকারণে নিষ্ঠুরভাবে নিহত হচ্ছেন, তাদের হত্যা করা হচ্ছে?

স্পীকারঃ আপনি দয়া করে রাশ টানুন।

শ্রী সমর গুহঃ মা, মহিলা এবং বাচ্চাদের হত্যা করা হচ্ছে, এবং আমরা চুপচাপ বসে আছি।

স্পীকারঃ আপনি যদি এইরকম করতে থাকেন, তাহলে কিছুই রেকর্ড হবে না, আপনি দয়া করে বসুন। একই বিষয় আরো ভালোভাবে বলা যায়।

শ্রী সমর গুহঃ আপনি যদি শুধু ঢাকা হতে আসতেন! আপনার প্রতিক্রিয়া অন্যরকম হত।

শ্রী এস এম ব্যানার্জি(কানপুর)ঃ আমরা প্রত্যেকেই ঢাকা হতে আসা। আপনি শুধু একা নন। (বাধা দিয়ে)

স্পীকারঃ এটা কি হচ্ছে? অন্যদের উপস্থিতিতে আপনাকে উল্লেখ করা আমার জন্য ভাল দেখায় না। শ্রী গোপলান।

শ্রী এ কে গোপলান(পালঘাট)ঃ স্যার, এটা সত্য যে, একটা বিবৃতি দুই দিন আগে দেয়া হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে। কিন্তু আজকের পরিস্থিতি কিছুদিন আগের অবস্থা থেকে সম্পুর্ন ভিন্ন। ওখানে একটা অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়েছে এবং যেখানে যুদ্ধ পরিস্থিতি চলেছে, সে ব্যাপারে বলা যায় যে ওখানকার অবস্থা খুব ভয়াবহ। সুতরাং, এখানে সরকারেরও কিছু বলার থাকতে পারে এবং প্রধানমন্ত্রীও দুইদিন পর ঐদিন বলেছেন, যখন প্রতিবার একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তখন প্রধানমন্ত্রী কিছু বলতে পারতেন। সুতরাং এখন এটা সময় যে আমরা বালাদেশ-পুর্ব পাকিস্তান এর পরাক্রমশালী জনগণের প্রতি আমাদের সংহতি প্রকাশ করি। এটা সত্য যে আজকের অবস্থা দুইদিন আগের অবস্থা থেকে ভিন্ন। সুতরাং, আমরা অনুরোধ করি যে প্রধানমন্ত্রী পুর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধরত মানুষের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে একটা বিবৃতি দিবেন।

শ্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত(আলিপুর)ঃ মাননীয় স্পিকার, আমি কি একটা মতামত দিতে পারি?

যেমনটা শ্রী গোপলান এরমধ্যে বলেছেন যে, ঘটনাপ্রবাহ এখন খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। যেহেতু আপনি এই সভায় ঘোষণা দিয়েছেন যা এর মধ্যে সভা দ্বারা অনুমোদিতও হয়েছে, যে লোকসভা আগামী ২রা এপ্রিল মুলতবি করা হবে এবং যা আর মাত্র চার-পাঁচ দিনের ব্যাপার, আমি আপনার এবং এই সভার বিবেচনার জন্য দুটো প্রস্তাবনা করতে চাই।

প্রথমত, আমি আমার সহকর্মী শ্রী বাজপেয়ীর ধারণার সাথে সহমত পোষণ করি যে এই সভার কার্যক্রম মুলতবি হওয়ার পুর্বে- আমি অন্তত মনে করি সর্বসম্মতিক্রমে যদি এটা আমরা গ্রহণ করি তাহলে এতে ক্ষতির কিছু নেই। এটা এই পক্ষ কিবা ওই পক্ষ বা অন্য কোন পক্ষের সাথে বিতর্ক বা বিরোধের বিষয় নয়- এই সভার সবার সাথে আলোচনা করে সর্বসম্মতিক্রমে একটা খসড়া তৈরি করা যেতে পারে এবং শুধুমাত্র সকলের মতের সাথে মিল রেখে তৈরি করা একটা খসড়া এই সভায় উপস্থাপন করা যেতে পারে, যা দুইদিন আগের এই সভায় প্রস্তাবিত সকলের মতামতের প্রতিফলন ঘটাবে, আমি মনে করি এটা করা উচিত হবে।

আমি মনে করি এই সংসদ মে মাস শেষ হবার আগে আর বসবে না। সুতরাং, এই মধ্যকালীন সময়ে সীমান্ত এলাকায় কী ঘটতে পারে তা ভেবে ভয়ে প্রকম্পিত হচ্ছি। এই বিষয়গুলোর উপর পর্দা পরে যাবার আগেই বাংলাদেশের মানুষদের অন্তত জানতে দেওয়া হোক যে ভারতের পার্লামেন্টে সর্বসম্মতিক্রমে একটি বিষয়ে একাত্মতা ঘোষণা করা হয়েছে যে, আমরা আমাদের হৃদয় দিয়ে তাদের সংগ্রামের প্রতি সমর্থন ও সংহতি পোষন করছি। আমি মনে করি এটা কঠিন কিছু নয়।

দ্বিতীয়ত, আমি আবেদন করছি যে আগামী ৩-৪ দিন ঘটনাবলীর উপর নজর রাখা হোক যেন প্রয়োজন পরলে সংসদ মুলতবী হবার আগে আরেকদিন আপনি দয়া করে আমাদের এই বিষয়ে বসার সুযোগ দিন, যদি আগামী ৩-৪ দিনে বিশেষ ভিন্ন কিছু ঘটে যায়। আমি কিছুই জানি না। আমি ঘটনাবলী নিয়ে আগাম কিছু অনুমান করতে চাচ্ছিনা। কোন খবরগুলো শুধুই গুজব আর কোন প্রতিবেদন গুলো সঠিক বা বেঠিক তা এই মুহুর্তে অনুমান করা খুব দুঃসাধ্য। সুতরাং, আগামী তিন চার দিনে একদম ভিন্ন চিত্র বের হয়ে আসতে পারে। তাই আমি আপনার কাছে নজর রাখতে অনুরোধ করব এবং সংসদ মুলতবীর পুর্বে আরেকদিন আলোচনা করার সুযোগ রাখার যেন আমরা আমাদের বিশ্লেষণ প্রকাশ করতে পারি। এবং, এই মধ্যবর্তী সময়ে, আমাদের সিদ্ধান্ত বিবেচনা করা হোক। আমার মনে হয়, সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করা যায় এমন একটা খসড়া তৈরি করা খুব কঠিন হবে যা এই সংসদের মাধ্যমে আমাদের কথা বা অনুভূতি প্রকাশের জন্য যথাযথ হবে।

প্রধানমন্ত্রী, আণবিক শক্তি মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী এবং তথ্য ও প্রচার মন্ত্রী মহোদয় ( শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী) ঃ আমার একটি আবেদন আছে। আমি শুধু বলছিলাম যে, সভার নিকট আমার যা প্রতিশ্রুতি ছিল যে আমি আরেকটি বিবৃতি দিবনা কিন্তু বিপক্ষ দলগুলোর নেতাদের সাথে কথা বলব এবং আমি মনে করি আমরা উনাদের ঐ প্রস্তাবনা নিয়ে একসাথে বসতে পারব। রেজুলেশন নিয়ে আমার কোন আপত্তি নেই, কিন্তু একসাথে বসে কী করা যেতে পারে তা চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।

শ্রী শ্যামানন্দন মিস্রঃ মাননীয় স্পিকার, আমি কি একটি আবেদন করতে পারি? আমি এই তর্কের ভিতর বলতে চাই যে, যেহেতু আপনি ২রা মে সংসদ মুলতবীর বিষইয়ে আলোচনা শেষ করতে চাইছেন আমি মত দিতে চাই এটা একটি দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি। এই দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির জন্য যদি আমাদের মে মাসের শেষের দিকে আবার সংসদে বসার প্রয়োজন পরে আপনি কি সংসদ অধিবেশন ডাকার বিষয়টি দয়া করে ভেবে দেখবেন? আরেকটি আলোচনা সভা ডাকার ক্ষেত্রে কি সমস্যা হতে পারে?

মাননীয় স্পিকারঃ আমরা নেতাদের সভা ডাকছি। এই বিষয়গুলো সেখানে আলোচনা করা যেতে পারে।

শ্রী শ্যামানন্দন মিস্রঃ আমাদের বিগত কিছুদিন ধরে ডাকা হচ্ছে না। দুই তিন পার হয়ে গিয়েছে।

একজন মাননীয় সদস্যঃ প্রতিদিন সভা ডাকার কোন প্রয়োজন নেই।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২১৫। বাংলাদেশ ঘটনাবলির ওপর প্রধানমন্ত্রীর উত্থাপিত প্রস্তাব ভারতের লোকসভার কার্যবিবরণী। ৩১ মার্চ, ১৯৭১।

Masroor Ahmed Makib
<১২, ২১৫, ৭৯০-৭৯২>
অনুবাদ

রেজুল্যুশনঃ পূর্ব বাংলায় পুনঃসাম্প্রতিক উন্নয়ন।

স্পিকারঃ আমরা দৃষ্টি আকর্ষণে গতি আনার আগেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের উপর একটি রেজুল্যিশন উপস্থাপন করবেন। এটির উপর আর কোন আলোচনা হবেনা এবং এটি গ্রহন করা হবে।

প্রধানমন্ত্রী, আণবিক শক্তি মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, পরিকল্পনা মন্ত্রী এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী (শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী)ঃ নির্বাচনে বিজয় লাভ করার পর পরই আমাদের প্রতিবেশী পূর্ব বাংলায় উপর যে বিয়োগান্তর ঘটনা ঘটেছে তাদের দুঃখ কষ্ট, তাদের সুন্দর দেশ দেশকে ধ্বংস করার চেষ্টার উদ্বেগ ও তাদের ভবিষ্যতের জন্য উদ্বেগ . আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। আমি একটি রেজোলিউশন নিয়ে অগ্রসর হতে ইচ্ছুক যা বিরোধীদলীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে এবং এটি সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয়েছে বলে আমি আনন্দিত।

আমি নিম্নোক্ত সিদ্ধান্তগুলো পেশ করতে চাইঃ(১)এই হাউস পূর্ববাংলায় সাম্প্রতিক উন্নয়ন তার গভীর যন্ত্রণা ও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রেষিত সশস্ত্র বাহিনী দ্বারা পূর্ব বাংলার সমগ্র জনগণের বিরুদ্ধে ব্যাপক হামলা চালানো হয়েছে এবং এই হামলা তাদের আশা ও আকাংখা দমনের জন্যই চালানো হয়েছে বলে প্রতিয়মান হয়।

২) জনগনের আকাংখা যা নিশ্চিতভাবে পাকিস্তানে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে ১৯৭০ সালে, পাকিস্তান সরকার তার প্রতি সম্মান না দেখিয়ে জনগনের ম্যান্ডেট কে বিদ্রুপ করার পথ বেছে নিয়েছে।

৩)পাকিস্তান সরকার শুধুমাত্র নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাবই ফিরিয়ে দেয়নি এর সাথে ইচ্ছামত তার ন্যায়সঙ্গত এবং সার্বভৌম ভূমিকা ক্ষমতা গ্রহণের থেকে জাতীয় পরিষদকে প্রতিরোধ করেছে।

৪) ভারত সরকার ও ভারতের জনগণ সবসময় আশা করেছে ও কাজ করেছে পাকিস্তানের সঙ্গে, শান্তিপূর্ণ স্বাভাবিক এবং ভ্রাতৃসুলভ সম্পর্কের জন্য। যাইহোক, উপমহাদেশের জনগন শতাব্দীপ্রাচীন ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য পুরনো বন্ধন দ্বারা আবদ্ধ, এই হাউজ আমাদের সীমান্তে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর ট্রাজেডি নিয়ে উদাসীন থাকতে পারেনা। আমাদের দেশের প্রতিটি আনাচে কানাচে থেকে মানুষ এই ঘটনার প্রতি নিন্দা জানিয়েছে, একজন নিরস্ত্র এবং নিরীহ লোকদের ওপর নজিরবিহীন মাত্রায় নৃশংসতা চালানো হচ্ছে।

৫) এই হাউস পূর্ববাংলার জনগণের গণতান্ত্রিকজীবনের জন্য জন্য তাদের সংগ্রাম সাথে গভীর সমবেদনা ও সংহতি প্রকাশ করছে।

৬) ভারতের আছে শান্তির প্রতি চিরস্থায়ী স্বার্থ এবং মানবাধিকার সম্মুনত ও রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি। এই হাউস বলপ্রয়োগের মাধ্যমে আরক্ষিত মানুষদের উপর চালানো গণহত্যার অবিলম্বে অবসানের জন্য দাবি জানাচ্ছে। এই হাউজ সাধারন মানুষের উপর পাকিস্তান সরকারের চালানো ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম যা গনহত্যার শামিল তা থেকে তাদের বিরত রাখতে দ্রুত ও গঠনমুলক পদক্ষেপ নেয়ার জন্য বিশ্বের প্রতিটি নাগরিক ও প্রতিটি দেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে।

৭) এই হাউস দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, পূর্ব বাংলার ৭৫ কোটি মানুষের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান বিজয়ী হবে। হাউস তাদের আশ্বাস দেয় যে তাদের সংগ্রাম ও উত্সর্গ ভারতের জনগণের সর্বাত্মক সমর্থন, সহানুভূতি ও শুভেচ্ছা পাবে।

শ্রী কে মনোহরন ( মাদ্রাজ / উত্তর )ঃ যদিও কোন আলোচনার অনুমতি দেওয়া হয়, সেখানে বিরোধী দলের সদস্য হিসেবে ক্ষমতাসীন দলের দ্বারা উপচয় এর জন্য কি কোন সুযোগ নেই?

স্পিকারঃ না।

শ্রী সি সি দেশাই ( সাবারকান্থা )ঃ পররাষ্ট্রমন্ত্রী কেন এখানে উপস্থিত নেই? এর মানে কি এই যে তিনি রেজল্যুশনের সঙ্গে একমত নন?

জনাব স্পিকারঃ সংসদে প্রশ্ন হচ্ছে, (১) এই হাউস পূর্ববাংলায় সাম্প্রতিক উন্নয়ন তার গভীর যন্ত্রণা ও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রেষিত সশস্ত্র বাহিনী দ্বারা পূর্ব বাংলার সমগ্র জনগণের বিরুদ্ধে ব্যাপক হামলা চালানো হয়েছে এবং এই হামলা তাদের আশা ও আকাংখা দমনের জন্যই চালানো হয়েছে বলে প্রতিয়মান হয়।

২) জনগনের আকাংখা যা নিশ্চিতভাবে পাকিস্তানে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে ১৯৭০ সালে, পাকিস্তান সরকার তার প্রতি সম্মান না দেখিয়ে জনগনের ম্যান্ডেট কে বিদ্রুপ করার পথ বেছে নিয়েছে।

৩)পাকিস্তান সরকার শুধুমাত্র নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাবই ফিরিয়ে দেয়নি এর সাথে ইচ্ছামত তার ন্যায়সঙ্গত এবং সার্বভৌম ভূমিকা ক্ষমতা গ্রহণের থেকে জাতীয় পরিষদকে প্রতিরোধ করেছে।

৪) ভারত সরকার ও ভারতের জনগণ সবসময় আশা করেছে ও কাজ করেছে পাকিস্তানের সঙ্গে, শান্তিপূর্ণ স্বাভাবিক এবং ভ্রাতৃসুলভ সম্পর্কের জন্য। যাইহোক, উপমহাদেশের জনগন শতাব্দীপ্রাচীন ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য পুরনো বন্ধন দ্বারা আবদ্ধ, এই হাউজ আমাদের সীমান্তে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর ট্রাজেডি নিয়ে উদাসীন থাকতে পারেনা। আমাদের দেশের প্রতিটি আনাচে কানাচে থেকে মানুষ এই ঘটনার প্রতি নিন্দা জানিয়েছে, একজন নিরস্ত্র এবং নিরীহ লোকদের ওপর নজিরবিহীন মাত্রায় নৃশংসতা চালানো হচ্ছে।

৫) এই হাউস পূর্ববাংলার জনগণের গণতান্ত্রিকজীবনের জন্য জন্য তাদের সংগ্রাম সাথে গভীর সমবেদনা ও সংহতি প্রকাশ করছে।

৬) ভারতের আছে শান্তির প্রতি চিরস্থায়ী স্বার্থ এবং মানবাধিকার সম্মুনত ও রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি। এই হাউস বলপ্রয়োগের মাধ্যমে আরক্ষিত মানুষদের উপর চালানো গণহত্যার অবিলম্বে অবসানের জন্য দাবি জানাচ্ছে। এই হাউজ সাধারন মানুষের উপর পাকিস্তান সরকারের চালানো ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম যা গনহত্যার শামিল তা থেকে তাদের বিরত রাখতে দ্রুত ও গঠনমুলক পদক্ষেপ নেয়ার জন্য বিশ্বের প্রতিটি নাগরিক ও প্রতিটি দেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে।

৭) এই হাউস দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, পূর্ব বাংলার ৭৫ কোটি মানুষের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান বিজয়ী হবে। হাউস তাদের আশ্বাস দেয় যে তাদের সংগ্রাম ও উত্সর্গ ভারতের জনগণের সর্বাত্মক সমর্থন, সহানুভূতি ও শুভেচ্ছা পাবে।

স্পিকারঃ একটি একবারও ‘ না ‘ উচ্চারিত হয়নি। সুতরাং, রেজল্যুশনটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হলো।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২১৬। সীমান্তে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর আক্রমণাত্মক তৎপরতা সম্পর্কে বিতর্ক ভারতের লোকসভার কার্যবিবরণী ২৪ মে, ১৯৭১

<১২, ২১৬, ৭৯৩-৮০৪>
Tashrik Mohammad Sikder <৭৯৩-৭৯৬>
Zulkar Nain <৭৯৭-৮০৪>

মৌখিক প্রশ্ন-উত্তর

ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের উপর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ভারী-সৈন্য চলাফেরা এবং মোতায়েন প্রসঙ্গে।

১. শ্রী আর. এস. পান্ডেঃ
শ্রী এস. এম. কৃষ্ণাঃ

রক্ষামন্ত্রী কি উল্লেখ করবেনঃ

(ক) সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের বিভিন্ন সেক্টরে পাকিস্তানি বাহিনীর ভারী-সৈন্য চলাফেরা ও মোতায়েন করা হয়েছে কিনা;

(খ) পাকিস্তানি বাহিনী উস্কানিমূলক কর্ম চরিতার্থ করতে এবং ভারতীয় অঞ্চলের মধ্যে অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে কিনা; এবং

(গ) যদি তাই হয়ে থাকে, তার বিবরণ এবং সীমান্তে পাকিস্তান দ্বারা সৃষ্ট অবস্থা মোকাবেলা করতে সরকার কর্তৃক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে কিনা?

রক্ষামন্ত্রী (শ্রী জগজীবন রাম): (ক) হইতে (গ): কোন অস্বাভাবিক চলাফেরা বা পাকিস্তানি সেনার মোতায়েন ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে পরিলক্ষিত হয়নি। তবে পূর্ববাংলার সীমান্ত সংলগ্ন কিছু সেক্টর বরাবর পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের দ্বারা যেকোন ভাবেই হউক, কিছু অস্বাভাবিক কার্যকলাপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ২৫শে মার্চ হতে ৭টি ভিন্ন সময়ে পূর্ব সেক্টরের ভারতীয় অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনী অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে। সেখানে সীমান্ত এলাকাজুড়ে গুলীবর্ষণের ৪৩টি ঘটনা এবং ৩টি অপহরণের ঘটনা হয়েছে। এছাড়া পাকিস্তানি বিমান দ্বারা ১৬বার আকাশ-সীমা লঙ্ঘনের ঘটনা হয়েছে। এইসব ঘটনায় পাকিস্তান সরকারের কাছে ১৯টি প্রতিবাদ দায়ের করা হয়েছ। আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীকে সীমান্তে সর্বদা সতর্কটহল বজায় রাখার এবং পাকিস্তানি অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য তাদের প্রতি নির্দেশ রয়েছে।

শ্রী রাম সহায় পান্ডেঃ মাননীয় স্পীকার, প্রতিরক্ষামন্ত্রী মহাশয় তাঁর জবাবে পাকিস্তানের দ্বারা সংঘঠিত আক্রমনের কথা উল্লেখ করেছেন। আমি জানতে চাই, পাকিস্তানের নিয়মিত সেনাবাহিনী আমাদের পূর্বক্ষেত্রে সাতবার আক্রমণ চালিয়েছে আমরা তাঁর কি জবাব দিয়েছি? এটা কি আন্তর্জাতিক রীতিনীতির বরখেলার নয়? এটা কি ভারতীয় সার্বভৌম সত্তার অবমাননা নয়? এসব যদি সত্যি হয় তাহলে আমরা সামরিক ব্যবস্থা কি নিয়েছি? আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কি অভিযোগ করেছহি এবং আমি এও জানতে চাই যদি এ রকম আক্রমন অব্যাহত থাকে তবে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স) পরিস্থিতির মুকাবেলা করতে সক্ষম হবে কি? যদি নাহয় তাহলে…পাকিস্তানের নিয়মিত বাহিনীর বিপরীতে আমরা নিজেদের নিয়মিত বাহিনী সমাবেশ করব না? না করলে তা কি কারণে?

শ্রী জগজীবন রামঃ সদস্য মহোদয়ের প্রশ্নের প্রথমাংশের উত্তর মূল জবাবের মধ্যেই সন্নিহিত রয়েছে। একথা আমি অবশ্যই বলব যে, আমাদের পূর্ব সীমান্তে যা কিছু ঘটছে তাকে পূর্ব বাংলা কিংবা বাংলাদেশে যা কিছু ঘটছে সেই পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে চাই, তা থেকে বিচ্ছিন্ন করে আমরা ওই প্রশ্নকে দেখতে পারিনা। বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের স্বাধীনতার জন্য পণ করেছে সংসদ তা জ্ঞাত আছে। এ কথাও সংসদের জানা আছে যে, যখন সেখানকার জনগণ নিজেদের সংকল্প বাস্তবায়িত করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হল তখন পাকিস্তানী হামলা চলল এবং সেখানে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল, ইস্ত বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক জনগণ পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরোধীতা করল, মোকাবেলা করল, সংঘর্ষ হলো, যুদ্ধ হলো। এ কথাও সত্যি যে পাকিস্তানী শক্তি বহুদিন যাবত এদেরকে দাবিয়ে রাখার ফলে এরা সফল হতে পারেনি। তারা কিছুটা পিছিয়ে পড়ে এবং সৈন্যদের দ্বারা যখন তাদের উপর বর্বরতাপূর্ণ হামলা হল তখন আমাদের দেশে আরও শরনার্থী আশ্রয় নিল। এরূপ অবস্থাতেও তাদের ওপর গুলি চলল। কিছু লোক পালিয়ে এসে পড়ল এখানে। আমি বলেছি আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী এর প্রতিবাদ পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছে। সংসদকে আমি প্রত্যায়িত করতে চাই সীমান্তে আমাদের যে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী রয়েছে তারা আমাদের সীমান্ত রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত এবং যখনই প্রয়োজন হবে তারা অনুপ্রবেশ রুখবার জন্য পদক্ষেপ নেবে।

শ্রী রাম সহায় পান্ডেঃ আমি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মহাশয়ের কাছের জানতে চাই, আসামের মুখ্যমন্ত্রী বিধান সভায় যে বিবৃতি দিয়েছিলেন তা তাঁর দৃষ্টি কি-না, বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, করিমগঞ্জে সেক্টরে পাকিস্তানী সৈন্যের বিরাট সমাবেশ হচ্ছে। সৈন্য সমাবেশের ফলে সেখানে যে বিপদের সম্ভবনা দেখা দিয়েছে সেদিকেও তিনি ইঙ্গিত করেছিলেন। এসব যদি সত্য হয় তবে ওই প্রশ্নই আমি দ্বিতীয়বার উচ্চারন করতে চাই যে রক্ষী বাহিনীর স্থলে আপনি কি নিয়মিত বাহিনী পাঠানোর ব্যবস্থা নেবেন?

শ্রী জগজীবন রামঃ আমি বলেছি গত পরশু আমি নিজে করিমগঞ্জে ছিলাম সেখানে আগত শরনার্থীদের অবস্থা দেখবার জন্য আমি সেখানে গিয়েছিলাম। …পাকিস্তান বাহিনী সীমান্ত ফাঁড়িতে কিছু সৈন্য রাখছে। সীমান্ত ফাঁড়িতে সৈন্য রাখতে হলে অল্প সৈন্য রাখা যায় না। কমপক্ষে হলেও তাদেরকে এক কোম্পানী কিংবা তাঁর কাছাকছি সংখ্যায় রাখতে হবে কেননা, আগাগোড়াই তাদের সামনে এই বিপদ লেগে রয়েছে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক লোকেরা তাদের প্রতিরোধ করতে থাকবে। এজন্য পাকিস্তান সীমান্ত ফাঁড়িতে সৈন্য রাখতে গেলেই পর্যাপ্ত সংখ্যায় রাখে। তার সার্বক্ষনিক আশঙ্কা হচ্ছে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক জনগণ যারা নিজেদের স্বাধীনতার জন্য অকুতোভয় তারা চুপ মেরে বসে থাকবেনা। আমি বলেছি, আমাদের সীমান্তের অপর দিকের কয়েকটি বিরোধী দেশের সৈন্যদের তৎপরতা চলছে সেদিকে সর্বক্ষন আমার দৃষ্টি রয়েছে আর আমাদের সীমান্তের এদিকে আমি জরুরী ব্যবস্থা নিচ্ছি।

শ্রী এস এম কৃষ্ণঃ স্যার, মাননীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী অসন্তোষ জানিয়ে বলেন যে, সীমান্তের ওপর ঘটে চলা বিপক্ষীয় এসব অত্যুত্তেজিত কার্যকলাপগুলো আমাদের একটি যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিচ্ছে। আমি মাননীয় মন্ত্রীর কাছে জানতে চাইছি, সীমান্তের দায়িত্বে নিয়োজিত পাকিস্তানি সৈন্যরা নিয়মিত পাক-সেনা কর্তৃক প্রতিস্থাপিত হয়েছে এমন কোন কিছু মন্ত্রণালয়ের নজরে পরেছে কিনা।

দ্বিতীয়ত, পরিখা খনন এবং বাংকার নির্মাণ করে পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টরের উপর একটি যুদ্ধাবস্থার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এবং তিনি আরো যোগ করেন, সামরিক আইন প্রয়োগের সাম্প্রতিক ঘোষণা, সীমান্তের পাঁচ মাইল ব্যাপী এলাকাজুড়ে রাতে কারফিউ জারী করা, বেসামরিক এলাকাবাসীদের খালি করতে বাধ্য করা, যাতে সেনা-সদস্যরা ওই এলাকায় নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে পারে। সুতরাং, এই সব কার্যক্রম পরিলক্ষে, আমি দেশের মাননীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী থেকে একটি নিশ্চয়তা চাই, যে সীমান্তের পর্যাপ্ত রূপে যত্ন নেওয়া হবে এবং শত্রু পক্ষের এই সব উস্কানিমূলক কার্যকলাপের বিপরীতে আমাদের সশস্ত্রবাহিনীর তরফ হতে যথোপযুক্ত প্রতিউত্তর দেয়া হবে।

শ্রী জগজীবন রামঃ আমার নতুন কিছু যোগ করে বলার নেই। পাকিস্তানের পশ্চিম সেক্টর প্রসঙ্গে, আমি আগেই বলেছি যে, সেখানে কোনদিকে অস্বাভাবিক সৈন্য সমাগম হয়নি। যখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সীমান্তের কাছাকাছি পোস্ট করা হয়, তখন সেখানে স্বাভাবিক নিয়মেই নির্দিষ্ট আনাগোনা হয়; সেখানে সীমান্তের পার্শ্বে তাদের নির্দিষ্ট বাংকার বা রাস্তা মেরামত হয়। এটা নিয়ে তেমন উৎকণ্ঠিত হবার কিছু নেই। পূর্ব সীমান্ত প্রসঙ্গে, সেখানে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী পূর্ব সীমান্তে সমাবৃত হয়েছে, যেমনটি সংসদ অবগত আছে যে, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ভারত ও পূর্ববাংলার সীমান্ত পাহারায় নিয়োজিত ছিলো।

স্বভাবতই যখন সেখানে স্বাধীনতার জন্য লড়াই শুরু হয়, তখন সেই মুক্তিযুদ্ধের অগ্রভাগে ছিলো ইষ্টপাকিস্তান রাইফেলস এবং ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট। স্বাভাবিক ভাবেই, পাকিস্তান কে ইষ্টপাকিস্তান রাইফেলস কে প্রতিস্থাপন করেছে নিয়মিত সেনাবাহিনী দ্বারা। সে তথ্য আমাদের জানা রয়েছে, এবং আমি আগেই বলেছি যে, সেই দেশের সৈন্যদের সীমান্ত জুড়ে তদতিরিক্ত গতিবিধির প্রত্যক্ষ করা হচ্ছে এবং প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ সক্ষমতা সৃষ্টি করা হচ্ছে সীমান্তের এপারে।

কিছু সম্মানিত সদস্যগণ উঠে দাঁড়ালে –

জনাব স্পিকারঃ অর্ডার, অর্ডার.

শ্রী কে বালাকৃষ্ণানঃ স্যার, আমি একটা পয়েন্ট অব অর্ডার উত্থাপন করছি। বিশ্বের কোথাও এমন কোন সংসদ কি রয়েছে, যেখানে প্রতিরক্ষার বিষয়াবলী নিয়ে এই রকম আলোচনা করা হয়েছে? (বিরাম)

জনাব স্পিকারঃ আমি অনেক সংসদ দেখেছি; আমি একজন সদস্যকে এই রকম একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে দেখিনি।

ডঃ রনেন সেনঃ স্যার, আমি মাননীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী থেকে জানতে পারে কিনা যে, এটা কি এটা সত্য যে, আমাদের অঞ্চল অবিরত আক্রমণ এবং সীমানা লঙ্ঘন করে ভারত সীমানার ভিতরের স্থান দখল করা হচ্ছে? এটা স্মরণ করা উচিত যে পাকিস্তানী বাহিনী আক্রমণ করে বয়রা এলাকায় ভারতের সীমানার ভিতরে এসে আমার নির্বাচনী আসনের এলাকায় আসে, এবং পাঁচজন লোককে হত্যা করে।

জনাব স্পীকারঃ অর্ডার, অর্ডার।

ডঃ রনেন সেনঃ শুধুমাত্র এক মিনিট। ১৯শে মে, তারা বনগাঁ-পেট্রাপোল এর চেকপোস্ট এলাকায় বোমাবর্ষণ করে, আমি কি এই সব সত্ত্বেও জানতে পারি যে, এইসব ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর প্রতি সরকারের নির্দেশনা কি – এই আক্রমণের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা বা এই আক্রমণ প্রতিহত করা নাকি শুধু নয়াদিল্লি শহর থেকে নোট পাঠানো? আমি মাননীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী থেকে এর উত্তর জানতে চাই।

শ্রী জাগজীবন রামঃ যদি মাননীয় সদস্য মূল উত্তর শুনে থাকেন, তাহলে সেটা তিনি আমার শেষতম বাক্যটিতে পাবেন যেখানে আমি বলেছি যে আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর অনুপ্রবেশকারীদের সঙ্গে মোকাবেলা করতে নির্দেশাবলী দেয়া আছে। (বিরাম)

শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী………

শ্রী জগজীবন রাম: আমি আমার জবাবে এটাই পড়েছিলাম।

“পাকিস্তানের অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য নির্দেশাবলী দেয়া আছে”।

এটা পরিষ্কার অর্থ হচ্ছে যে, যদি একটিও অনুপ্রবেশ হয়, অনুপ্রবেশকারীদের আমাদের সীমানার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হবে। তাহলে সেখানে বিমান অনুপ্রবেশের হয় এবং যদি তারা সাড়া না দেয় এবং ফেরৎ না যায়, তাদের গুলি করে ভূপাতিত করা হবে। যেটা বেশ সুস্পষ্ট।

বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি

৩। শ্রী সারীউ পান্ডেঃ
শ্রী কে লাক্কাপ্পাঃ
শ্রী মুখতিয়ার সিং মালিকঃ

বিদেশমন্ত্রী কি উল্লেখ করবেনঃ

(ক) সরকার বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি দিতে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে; এবং
(খ) যদি না হয়ে থাকে, বিষয়টি নিয়ে প্রস্তাবিত পদক্ষেপে যাওয়া হবে?

বিদেশমন্ত্রী (শ্রী শরণ সিং): (ক) ও (খ). বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের স্বীকৃতি প্রশ্নে ভারত সরকার ক্রমাগত পর্যালোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।

ভারতীয় পূর্ববাংলার সীমান্ত এলাকাজুড়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দ্বারা অনুপ্রবেশ তথা জরুরী জনগুরুত্বসম্পন্ন কাজের কথায় মনোযোগ আকর্ষণ করছি।

শ্রী পি কে দেও (কালাহান্ডি): স্যার, আমি জরুরী জনগুরুত্বসম্পন্ন বিষয়ে গৃহমন্ত্রী মনোযোগ আকর্ষণ করছি এবং আমি অনুরোধ করছি এই ব্যাপারে তিনি একটি বিবৃতি দেবেনঃ

“প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয় পূর্ববাংলার সীমান্তবর্তী ভারতীয় অঞ্চলে পাকিস্তানি সৈন্যরা অনুপ্রবেশ করে, ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর সদস্যসহ বেশকিছু নাগরিককে হত্যা করা, বহুসংখ্যক সম্পত্তির ধ্বংস সাধন এবং এই অঞ্চলে পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান দ্বারা ভারতীয় আকাশ-সীমা লঙ্ঘণ।”

শ্রী রাম নিবাস মির্ধাঃ জনাব স্পিকার স্যার, এই সংসদ গত অধিবেশনে সর্বসম্মত রেজল্যুশন পাস করে আমাদের জনমানুষের পূর্ববাংলার জনগণের প্রতি পূর্ণ সহানুভূতি ও সমর্থন প্রকাশ করেছিল। সংসদ গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পূর্ববাংলায় ঘটেচলা হৃদয় বিদারক ঘটনা সম্পর্কে অবগত। পাকিস্তানের যুদ্ধ মেশিন তার বোধহীন প্রচারণা জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমন করার জন্য নিরপরাধ নারী, পুরুষ ও শিশুদের পদদলিত করছে। যথাযথভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নির্মম নিপীড়ন বিশ্বকে মর্মাহত করেছে, যারা জনপ্রিয় এবং জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা এবং আকার দিতে চেষ্টা করছেন।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তার সামরিক সম্প্রসারণের নিমিত্তে ইন্দো পূর্ববাংলার সীমান্তবর্তী ভারতীয় এলাকায় ৭ বার অনুপ্রবেশ ঘটায় এবং ৪৩টি ঘটনায় আমাদের সীমান্তের দিকে গুলীবর্ষণের পুনরারম্ভ করে। সীমান্তে বিএসএফ এর টহলের উপর আক্রমণ হয় এবং যাদের ভেতর ৪ জন সদস্য নিহত হয়, ২১ জন সদস্য বিভিন্নরকম জখম, এবং ৫ জন সদস্য অপহৃত হয়; ১৬ জন সাধারণ মানুষ নিহত এবং ১০৫ জন আহত হয় এই সব ঘটনায়। ভারতীয় এলাকাস্থিত বেশকিছু সংখ্যক কুঁড়েঘর, বসতবাড়ী অগ্নিসংযোগকৃত অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিএসএফ এর ২টা পোষ্ট এবং ১টা রেলস্টেশন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যান্য সহায়সম্পত্তি এবং গবাদিপশুও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। এমন কি শরণার্থীরা, যাদের পূর্ববাংলায় ঘটে চলা নিপীড়ন চালিয়ে শরণাগত হতে বাধ্য করা হয়েছে, তারাও এর থেকে রেহাই পায়নি। তাদের ভেতর ১৪ জন নিহত হয় এবং ৬৭ জনের মতো আহত হয় এই সব ঘটনায়। কঠোর প্রতিবাদ দায়ের করা হয়েছে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের কাছে এবং আমাদের ক্ষতিপূরণ পাবার অধিকারের দাবী করা হয়েছে।

৩০-৩-১৯৭১ হতে সেখানে পাকিস্তানি বিমান দ্বারা পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টরের ভারতীয় আকাশ-সীমা এগারোবার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় সাতবার প্রতিবাদ ইতিমধ্যেই দায়ের করা হয়েছে এবং অন্যান্য ঘটনাগুলোর প্রতিবাদ খুব শীঘ্রই দায়ের করা হচ্ছে।

আমাদের নিরাপত্তাবাহিনী পূর্ববাংলার সঙ্গে ভারতের আন্তর্জাতিক সীমানা শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত হয়ে দৃঢ়চিত্তে ও দৃঢ়তার সঙ্গে সব ধরনের পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন এবং তাৎক্ষণিক ভাবে অনুপ্রবেশকারীদের বহিষ্কারে নিয়োজিত রয়েছেন। যদিও এ ধরনের অবিরাম আক্রমণাত্মক হামলা ও ভারতীয় অঞ্চলে অনুপ্রবেশ এবং আমাদের বায়ুসীমা লঙ্ঘনের মধ্যে দিয়ে অবশ্যই এই অঞ্চলের শান্তিরক্ষার জন্য একটি গুরুতর হুমকি। এমনকি আমাদের এলাকাজুড়ে পূর্ববাংলা হতে শরণার্থীদের ক্রমাগত বিরাট আন্তঃপ্রবাহ, যা আমরা মানবিকতার ভিত্তিতে মোকাবেলা করছি, সরাসরিভাবেই যেটা পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানিদের নৃশংসতার ফল, এবং এই অঞ্চলের জায়গা ও নিরাপত্তা বিপন্ন করে পাশাপাশি আমাদের সম্পদ ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ভয়ঙ্কর চাপে ফেলে দিয়ে আমাদের জন্যেও গুরুত্বর অবস্থার সৃষ্টি করেছে। এই সকল শরনার্থীদের নিরাপদে তাদের নিজের দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য আমরা সম্ভাব্য সকল পথে হাটছি। এসব গুরুত্বর ঘটনার মুখে পাকিস্তান কতৃক স্বাভাবিক অবস্থার দাবি অর্থহীন।

আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী সম্পূর্ণরূপে তাদের দায়িত্বে নিবেদিত এবং সীমান্তজুড়ে সবসময় সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে। আমি সংসদকে আশ্বস্ত করতে চাই যে, আমরা সতর্কভাবে এসব উন্নয়ন দেখছি এবং আমাদের দেশ ও আমাদের জনগণের স্বার্থের অখণ্ডতা রক্ষার্থে আমরা যেকোন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দ্বিধা করবো না।

শ্রী পি কে দেওঃ স্যার, ৩১শে মার্চে এই সংসদ থেকে স্বীকৃত পাওয়া একটি সর্বসম্মত রেজল্যুশনের মাধ্যমে পূর্ব বাংলায় ঘটে যাওয়া গণহত্যা সম্পর্কে আমরা আমাদের যন্ত্রণা ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছি, একই সময়ে, পূর্ব বাংলায় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং জনগনের প্রকৃত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য আমরা বিশ্বের সকল সরকারকে একটা গঠনমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছি, পঞ্চান্ন দিন অতিক্রান্ত হয়েছে। প্রসন্নতার এই পঞ্চান্ন দিনে, মুখ্যমন্ত্রী এবং অন্যান্য কিছু মন্ত্রীর সামরিক আস্ফালন ছাড়া তেমন কিছুই করা হয়নি। এই মধ্যবর্তী সময় ভারতীয় কূটনীতির দেউলিয়াত্ব উন্মুক্ত করে দিয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন বা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক ফোরামে এই প্রশ্ন উত্থাপন করার কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। অন্যদিকে আমরা দেখতে পাই, পাকিস্তান একটি দেশের শোকসঙ্গীত চুরি করেছে এবং চীন, তুরস্ক, ইরান ও সৌদি আরবের সমর্থন সুনিশ্চিত করেছে। এমনকি আমাদের বন্ধু জয়া প্রকাশ নারায়ণকে ইউনাইটেড আরব রিপাবলিক একটা সাক্ষাৎকার প্রদান করেননি যখন তিনি এই উদ্দেশ্যেই সেখানে সফর করেন।

এই সময়ের মধ্যে তিন মিলিয়নের বেশি উদ্বাস্তু এখানে এসেছে। যা এই দেশের অর্থনীতিতে একটি খুব গুরুত্বর সমস্যা তৈরি করেছে। এটা অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং উত্তেজনা প্রণোদিত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি পাঠ বেশ বেদনাদায়ক হয়েছিল।

পূর্ববাংলার গণ অভ্যুত্থান দমনে ব্যর্থ হয়ে, এই দুই অঞ্চলকে ঐক্যবদ্ধ করতে পাকিস্তান এসব বিদ্বেষকে অবলম্বন করে এই দেশে সামরিক মহড়ার উস্কানি দিচ্ছে যেমন ভারতের প্রতি বিদ্বেষ থেকে ব্যর্থ পাকিস্তানের জন্ম। এটা একটা কারণে হতে পারে। আমাদের এই ধরণের সামরিক মহড়ার ফাঁদে পড়া ঠিক হবে না কারণ এখানে আমরা ও এদেশের ক্ষমতা দুটোই শোষিত হবে এবং এই দেশ দ্বিতীয় ভিয়েতনামে পরিণত করার সম্ভাবনা রয়েছে।

এসব বিষয়গুলি বিবেচনায় রেখে, যখন দলত্যাগী বাংলাদেশ একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে জন্ম যন্ত্রণা ফেলে উদ্ভূত হয়, আমাদের বিধিসম্মত স্বীকৃতি এর প্রধান অংশ না হতে পারে, কিন্তু এই দেশের নিরাপত্তা বিবেচনায় মাত্র তিনটি বিকল্প পথ আছে যা আমাদের জন্য উন্মুক্ত। প্রথমত, সীমান্ত সংঘর্ষ স্থানীয়করণ এবং কঠোর হস্তে দমন। দ্বিতীয়ত, সরকারকে ব্যাপক সামরিক সংঘাতের জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত যদি তারা এই অনুপ্রবেশ ও আকাশ-সীমা লঙ্ঘন বন্ধ করতে না পারে। যে সময়ে আমরা আমাদের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির বিবেচনায় আছি। সেসময়য়ে একই সাজানো ভাববিলাসী বিবৃতি দেওয়া উচিত হবেনা, যেমনটি করেছিলেন পণ্ডিত জওয়াহারলাল নেহেরু সিংহল যাওয়ার সময় যে চীনাদের বাইরে নিক্ষেপ করা হবে। সেই লাঞ্ছনার ক্ষত এখনো আমাদের মুখ থেকে মুছে যায়নি। আমরা সেটার পুনরাবৃত্তি চাই না। তৃতীয় বিকল্প হিসাবে বিশ্ব বিবেক জাগ্রত করা যেতে পারে যাতে কিছু প্রভাব পড়ে এবং পাকিস্তানের ওপর চাপ দেওয়া যায়। অথবা কেন তারা এই বিষয়টা নিয়ে গড়িমসি করবে, আমি সরকারের কাছ থেকে দ্ব্যর্থহীন উত্তর পেতে চাই। এটা সমগ্র দেশের জন্য উদ্বেগের ব্যাপার।

শ্রী রাম নিয়াজ মির্ধাঃ সরকার এই ব্যাপারে আত্মসন্তুষ্টিতে রয়েছে এটা বলা ঠিক নয়। বিশ্বের সরকারদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব শরণার্থী নিয়ে সৃষ্টি হওয়া সমস্যার মোকাবেলা করতে সহায়তা পাঠানোর জন্য আপীল জারি করেছে। উদ্বাস্তুদের জন্য জাতিসংঘ কমিশনের প্রতিনিধি একটি অন-স্পট জরিপ করার জন্য এখানে ছিল। সব বিশ্বশক্তির সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে এবং আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি তাদের জানাচ্ছি। সুতরাং, এই ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রসন্নতার প্রশ্নই ওঠে না।

পাকিস্তান যেকোন রকম উস্কানি প্রদান করতে পারে। আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে পারি যে, আমরা কোনো প্রান্ত থেকে আসা কোনো প্রকার উস্কানির কাছে নতিস্বীকার করবো না বরং দৃঢ়চিত্তে ও দৃঢ়তার সঙ্গে পরিস্থিতির মোকাবিলা করবো যেমনটা আমরা এখন পর্যন্ত করে আসছি। সেখানে ঘটা এসব অবৈধ অনুপ্রবেশ ও অনুরূপ ঘটনার সঙ্গে দৃঢ়ভাবে মোকাবেলা করতে সীমান্তে আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে পরিষ্কার নির্দেশনা দেয়া আছে। যখন কিছু ঘটবে, পরিস্থিতি অনুযায়ী সম্ভাব্য এব্যাপারে যেকেউ নিশ্চিত থাকতে পারে।

শ্রী পি কে দেওঃ এটি খুব অসন্তোষজনক উত্তর।

শ্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্তঃ স্যার, সরকারের কাছে আমার প্রশ্ন হল, পাকিস্তান সরকারের দ্বারা আমাদের নাগরিকদের হত্যা বা সামরিক বা কূটনৈতিক উস্কানিসহ আমাদের সীমানার মধ্যে অনুপ্রবেশ, আকাশ-সীমা লঙ্ঘনের ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে ভারত সরকার কি এখনও পারস্পরিক নীতি মেনে চলছে নাকি এই নীতি বাদ দেওয়া হয়েছে? আমি শুধু এটুকুই জানতে চাই।

উদাহরণস্বরূপ, সেখানে স্থল নিয়ম আছে। আমি তাদের যতদূর জানি, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে স্বাভাবিক শান্ত সময়ে স্থলনীতি অনুযায়ী উভয় পক্ষের নিয়মিত সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে পাঁচ কিমি দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক সীমানা অনুযায়ী, পারস্পরিক চুক্তি মাধ্যমে নো ম্যান্স ল্যান্ড থাকবে যেখানে শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট এলাকার দায়িত্বে থাকা সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীরা টহল দিতে পারবে। নিয়মিত সেনাবাহিনীরা দুই পাশের আন্তর্জাতিক সীমানার সেই পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে যাওয়ার কথা নয়।

এখন, এই বিষয়ে আমার প্রথম প্রশ্ন, যেমনটা একটু আগে মাননীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বললেন, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এসব স্থলনীতি লঙ্ঘন করছে, এবং সীমান্তের অনেক জায়গায় তারা একেবারে আন্তর্জাতিক সীমান্তপ্রদেশে মধ্যে এসে সেখানে তাদের পদ প্রতিষ্ঠা করেছে। এই ক্ষেত্রে সরকারের কাছে আমার প্রশ্ন, ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নীতি বাতিল করা হয়েছে নাকি তারা একতরফাভাবে এটা মেনে চলার চেষ্টা করছে যখন পাক-বাহিনী আন্তর্জাতিক সীমান্তে আসছে, সেখানে শুধুমাত্র সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীরা থাকতে পারবে আমাদের এই নীতি বেশকিছু বিপজ্জনক পরিণতি ডেকে আনতে পারে যা ইতোমধ্যে ঘটেছে।

এ ব্যাপারে আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন, পারস্পরিক নীতির আলোকে আমি জানতে চাই আমাদের ডেপুটি হাই কমিশনারকে ঢাকায় পদে বহাল রাখার কারণ কি? এর কারণ কি? ঢাকায় তিনি গ্রহণযোগ্য নন। তারা তাকে বের করে দিয়েছে। অবশ্যই, আপনি তাকে ফিরিয়ে আনতে পারেন না। সেটা অন্য ব্যাপার। সে সেখানে অন্তরায়িত। আপনি এখনো তাকে ঢাকাতে রেখছেন। যেখানে পশ্চিম বাংলায় পাকিস্তানের ডেপুটি হাই কমিশনার বাংলাদেশের প্রতি তার আনুগত্য প্রকাশ করেছে। সে আর পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধিত্ব করছেনা। কিন্তু জনাব মাসুদ যাকে ইসলামাবাদ থেকে কলকাতায় জনাব হুসাইন আলির পরিবর্তে নতুন ডেপুটি হাই কমিশনার হিসাবে পাঠানো হয়েছিল, তাকে ভিয়াইপি হিসাবে দেখা হচ্ছে অথচ তাকে কলকাতার কেউ চায়না। তাকে একটা হোটেলে দেখা গেছে যেখানে তিনি অবস্থান করছিলেন। ওয়েটার তাকে পরিবেশন করতে অস্বীকার করে। সে আত্মগোপনকারীর মত কলকাতায় এখান থেকে ওখানে ঘুরতো। কিন্তু এই সরকার তাকে ভিআইপির গুরুত্ব দিচ্ছে। মাসুদ এখানে ভিআইপির মর্যাদা পাচ্ছে। তিনি কলকাতার বিভিন্ন স্থানে একজন আত্মগোপনকারীর মত দৌড়ে থাকতো। কিন্তু তিনি এই সরকার কর্তৃক ভিআইপি মর্যাদা দেওয়া হয়। মাসুদকে এখানে একটি ভিআইপি হিসেবে গণ্য করা হয়। অথচ এটা পশ্চিমবঙ্গে ইসলামাবাদের ডেপুটি হাইকমিশনার পদ যেখানে আমাদের ঢাকায় আমাদের ডেপুটি হাই কমিশনার কে “আমরা আপনাকে এখানে চাইনা” বলে বের করে দেওয়া হয়েছে যেটা ঢাকায় অবস্থিত। আমরা উনাকে পুনরায় স্মরণ করতে বলছিনা। তাঁর জায়গায় কি আমরা নতুন ডেপুটি হাইকমিশনার নিয়োগ দিচ্ছি? পশ্চিমবঙ্গের পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার তাদের প্রতি তার অ-আনুগত্য ঘোষণা করেছে এবং বাংলাদেশের প্রতি তার আনুগত্য ঘোষণা করেছে। আমি জানি না কি ধরনের নীতি এই সব বিষয়ে অনুসৃত হচ্ছে। সেখানে কি এরূপ কোন পারস্পরিক নীতি আছে? সরকার কেন ঢাকা থেকে ডেপুটি হাইকমিশনার প্রত্যাহারের কথা বলছেনা? আমি জানি না কেন সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী যথাসময়ে কাজ করতে পারেনি। আমি জানিনা তাদের কি ধরণের নির্দেশ দেওয়া ছিল। এটা ঘটেছে বেনাপোল ও পেট্রাপোলে এবং এটা সকল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তারা বলেন, পাকিস্তানি সেনারা কাস্টমস ফাড়ি সংলগ্ন রেল লাইনের উপরে আসলেও সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীরা তাদের গুলি করেনি।

সুতরাং আমি জানতে চাই, কি ধরণের পারস্পরিক নীতি আপনি অনুসরণ করতে চাচ্ছেন? পাকিস্তান কতৃক এসব স্থলনীতির লঙ্ঘন সম্পর্কে আপনি কি করতে যাচ্ছেন? আপনি কি একতরফা ভাবে এসব নীতি মেনে চলবেন।

শ্রী রাম নিয়াজ মির্ধাঃ স্থলনীতি প্রসঙ্গে বলতে হয়, এসব নিয়ম সীমান্তের উভয় পক্ষের বাহিনীর নিরাপত্তা আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করে। স্থলনীতি নিজেদের বিরোধ মীমাংসা বা দ্বন্দ্ব বা যুদ্ধ সংঘটিত হলে তা থেকে উত্তরণের পথ তৈরি করে। এসব স্থলনীতির প্রচুর লঙ্ঘন ইতোমধ্যে হয়েছে। আমরা প্রতিবাদ করেছি। আমরা বিরোধ মীমাংসা করতে আলোচনা সভা করেছি। কিন্তু, আমি বলতে পারি, আসলে এটা স্থলনীতি লঙ্ঘনের বাইরে অনেক চলে গেছে।

প্রকৃতপক্ষে, এসব স্থলনীতি শুধুমাত্র সীমান্তে স্বাভাবিক টহল দেওয়ার সময়ে ঘটা বিভিন্ন ঘটনার জন্য। কিন্তু সীমান্তে এখন যে পরিস্থিতি তা এসব স্থলনীতির অধীনে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়।

শ্রী ইন্দারাজ আইটি গুপ্তঃ আমরা কি এখনো একতরফাভাবে এসব স্থলনীতি মেনে চলবো। সে হ্যা বা না বলতে পারে। উত্তর যদি “না” হয় তাইলে কেন?

শ্রী রাম নিয়াজ মৃধাঃ আমি এব্যাপারে ইতোমধ্যে বলেছি……

শ্রী রাম নিয়াজ মৃধাঃ একতরফাভাবে নিয়ম লঙ্ঘন বা এসব স্থলনীতি মেনে নেওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। স্থলনীতিগুলো স্বাভাবিক সময়ের পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য ব্যবহার করা হয়। স্বাভাবিক স্থলনিয়ম যেক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, পরিস্থিতি তার থেকে অনেক খারাপ। লঙ্ঘন প্রসঙ্গে পরিস্থিতি অনুযায়ী নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে পরিষ্কার নির্দেশনা দেয়া আছে।

বিদেশ মন্ত্রী (শ্রী শরণ সিং): ঢাকায় আমাদের উদ্দেশ্য ও কলকাতায় পাকিস্তানের ডেপুটি হাই কমিশনের উদ্দেশ্য, আমি আশা করি কোন সন্দেহ নাই যে সংসদ এই দুটো মিশন বন্ধ করার সিন্ধান্ত নিয়েছে, আমরা আমাদের ঢাকা মিশন স্থগিত করেছি। পাকিস্তানকে কলকাতায় তাদের মিশন বন্ধ করতে বলা হয়েছে। বস্তুত, এই কর্মকর্তারা এবং ঢাকা ও কলকাতায় তাদের কর্মীরা তাদের প্রত্যাবর্তন ও নিজ নিজ দেশে ফেরত নেওয়ার চুক্তির জন্য অপেক্ষা করছে।

আমরা যখন এই সীমান্ত অনুপ্রবেশ ও আমাদের জায়গাতে বায়ু লঙ্ঘনের ব্যাপারে শুনেছি তখন আমাদের চোখ দিয়ে ফোটায় ফোটায় রক্ত ঝরেছিল। আমি নিশ্চিত যে মাননীয় মন্ত্রীর উত্তরে সংসদের কোন সদস্য সন্তুষ্ট হননি। সেখানে প্রায় ৪৩টি অনুপ্রবেশ এবং ১৬টি আকাশ-সীমা লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। মাননীয় মন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন, সব বায়ু লঙ্ঘনের ঘটনা আমাদের বাংলার সীমান্তগুলোতেই ঘটেছে। তিনি আরো বলেন যে, তিনি এই দেশের অখন্ডতা অক্ষত রক্ষার্থে যেকোন প্রকার দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করবেন না। কিন্তু আমি বলছি, মাননীয় মন্ত্রী যাই বলে থাকুন না কেন মূল ব্যাপার এটা নয়। আমার পয়েন্ট প্রতিপন্ন করার জন্য, আপনাকে ১২ই এপ্রিলে পাকিস্তান টাইমস প্রকাশিত খবরে মনোযোগ আকর্ষন করছি।

তারা বলছে;

“দুই ভারতীয় বিএসএফ কোম্পানি যশোর জেলায় নিশ্চিহ্ন হয়েছে…

বন্দী সিপাহীরা তথ্য প্রকাশ করেছে।

ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর দুটি কোম্পানী যারা পাকিস্তান সীমানার মধ্যে ভাল কার্য্যক্রম চালাচ্ছিল তারা গতকাল যশোর জেলার বেনাপোল এলাকায় যুদ্ধ করার সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী কতৃক নিশ্চিহ্ন হয়েছে।

শ্রী এস এম ব্যানার্জীঃ এটা মিথ্যা।

শ্রী এন কে সঙ্গীঃ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়ঃ

“…. ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর দুই জোয়ানকে জীবিত বন্দী করা হয়েছে।

এবং তারা আটক করা দুইজন সিপাহীর নাম বলেছে মোহন লাল এবং পঞ্চ।

পার্লামেন্টারী এফেয়ার্স এবং শিপিং ও পরিবহন মন্ত্রী (শ্রী রাজ বাহাদুর): বিদেশের প্রতি কারো আস্থা নাই, অন্য দেশে কেউ এটা বিশ্বাস করেনা, কেউ এখানে বিশ্বাস রাখেনা। তাই এটা এখানে উল্লেখের দরকার কি? এটা শুধুমাত্র তাদের অপপ্রচার। এবং মাননীয় মন্ত্রী কেন এসব অপ্প্রচার বিশ্বাস করবে? (বিরাম)

শ্রী এন কে সঙ্গীঃ তারা এসব জনগনের ছবি তাদের পত্রিকায় ছেপেছে। আমি শুধু বলবো, এসব নিয়ে উত্তেজিত হওয়ার প্রয়োজন নাই। এটা শুধুমাত্র তাদের পত্রিকায় যা দেখা যাচ্ছে কিন্তু তারা যা বলেছে আমি এক মুহুর্তের জন্যেও সেটা মেনে নেবোনা। আমরা বড় ধরনের ধোকার শিকার হচ্ছি, তাই আমরা তাদের সেখানে নিয়ে যাবো। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই যেহেতু আমাদের সিমান্তরক্ষী বাহিনী সম্পর্কে সন্দেহ তৈরি হয়েছে, তাই মাননীয় মন্ত্রীর কাছ থেকে আমাদের কিছু জবাব পাওয়া উচিত কারণ আমি এই ব্যাপারটা নিয়েই আলোচনা করছি।

শ্রী রাজ বাহাদুরঃ এটা কেন এখানে উল্লেখ করতে হবে?

শ্রী এন কে সঙ্গীঃ আমি জানতে চাই এটা কি সত্য যে, এই মানুষগুলোকে বন্দী করা হয়েছে……

জনাব স্পীকারঃ মাননীয় সদস্য আপনি বসতে পারেন। আমি তাকে অনুমতি দিচ্ছি……
শ্রী কে এন তিওয়ারি (বেতিয়াহ): পুরো ব্যাপারটা মুছে ফেলা দরকার।

শ্রী এন কে সঙ্গীঃ মাননীয় মন্ত্রী যদি চান যে আমি এখান থেকে কিছু না বলি, আমি কিছু মনে করবোনা। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক অনুপ্রবেশের ব্যাপারে আমি মাননীয় মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষন করতে চাই কারণ এটা অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এটা এই কারণে নয় যে তারা আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর চারজন সদস্যকে হত্যা করেছে…

শ্রী কে এন তিওয়ারিঃ আমি বলবো এই ধরনের বিষয়গুলো নথি থেকে মুছে ফেলা উচিত।

শ্রী এন কে সঙ্গীঃ আমি শুধুমাত্র আমার প্রশ্নে আসছি।

মি স্পীকারঃ এসব বিষয়ে কথা বলতে গেলে মাননীয় সদস্যের আমার অনুমতি নেওয়া উচিত।

শ্রী এন কে সঙ্গীঃ যদি কোন অভিযোগ থাকে, তাহলে আমি এটা নিয়ে কোন কথা বলবো না। কিন্তু মূল বিষয় হলো পাকিস্তানী বাহিনী কতৃক অনুপ্রবেশ এবং আমাদের দেশের আইন লঙ্ঘন নিয়ে সদস্যদের মন অনেক উত্তেজিত, এবং সেখানে এসব নিয়ম লঙ্ঘন হচ্ছে মাননীয় মন্ত্রী সেটা স্বীকার করেছেন, অথচ সেটা নিয়ে কোন কার্যকারী পদক্ষেপের ব্যাপারে আমরা কথা বলতে পারছিনা, আমরা তাদের গুলি করে মেরে ফেলতে পারছিনা, আমরা কোন পাকিস্তানী বাহিনীর লোককে ধরতে পারছিনা, যদিও তারা আমাদের এলাকায় প্রবেশ করেছে। এটা সত্যিই অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আমরা অবশ্যই তাদের এলাকায় যেতে চাইনা, কিন্তু যখন তারা আমাদের এলাকায় আসছে, আমি মনে করি আমাদের সিমান্তরক্ষী বাহিনীর উচিত তাদের থেকে কৈফিয়ত নেওয়া। এটা এমন একটা বিষয় যেটা জনগনের মনে উত্তেজনা ছড়াচ্ছে। যদি আমরা তাদের থেকে কৈফিয়ত না নিতে পারি তাহলে সিমান্তরক্ষী বাহিনী রাখার কোন প্রয়োজন দেখিনা। আমি কি মাননীয় মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করতে পারি যে তিনি পূর্ব বাংলা সীমান্তে আমাদের সেনাবাহিনী রেখে তাদের ব্যবস্থা নেওয়া যায় কিনা যখন তারা অনুপ্রবেশ করবে কারণ আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী তাদের কৈফিয়ত নিতে ব্যর্থ হয়েছে? আমরা জেনেছি যে ৩০শে এপ্রিলে কুচবিহারের সব জনগণ এসব আক্রমণের জন্যে চলে গেছে। আমি কি জানতে পারি, এর জন্য সরকার ভারতীয় নাগরিক যারা সীমান্তে আছে এবং তাদের বাড়িঘর, পরিবারের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়েছে তাদেরকে কোন ক্ষতিপূরণ দেবে কিনা! আমি কি এটা জানতে পারি যে শীঘ্রই সরকার সীমান্তরক্ষী বাহিনী সরিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন করবে কিনা! আমি পৃথক পৃথক উত্তর চাই।

শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী (গোয়ালিয়র): মাননীয় স্পীকার, মন্ত্রী মহোদয় যে জবাব দিয়েছেন তা শুধু নৈরাশ্যজনক নয় লজ্জাজনকও বটে। এই অধিবেশন সর্বসম্মতিক্রমে একটি সংকল্প ব্যক্ত করেছিল সেটি ছিল এই যে, আমরা নিজেদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধরত পূর্ব বাংলার বীর জনতার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করব, তাদের সমর্থন দেব, কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের সহায়তা করা তো দুরের কথা আমরা নিজেদের সীমান্ত রক্ষা করতে পারছিনা। আমরা পাকিস্তানের অনুপ্রবেশ রুখতে পারছিনা। আমরা নিজেদের আকাশ সীমা লঙ্ঘনের নিষেধাজ্ঞা বলবত করতে পারছিনা। বহুলোক আমাদের সীমান্তে ঢুকে পড়ে আমাদের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর লোকজনদের ধরে নিয়ে গেছে, তারা আমাদের দুজন পত্রবাহককে বন্দী করে রেখেছে, তারা ৪৭বার সীমান্ত অতিক্রম করেছে। এ অবস্থায় সরকার বলুন, যখন পাকিস্তানী সৈন্য আমাদের সীমান্ত অতিক্রম করতে এসেছিল আমরা কি তাদের মধ্যে একজনকেও গ্রেফতার করেছি?……সৈন্যকেও গ্রেফতার করতে পারিনি, আমরা একটি পাকিস্তানী বিমানকে ভুপাতিত করতে পারিনি। সীমান্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পর্যাপ্ত এ কথা যথেষ্ট নয়। ব্যবস্থা পর্যাপ্ত হলে তা দেখানোও চাই।

আমার প্রশ্ন এই যে, সরকার কি মনে করেন সীমান্ত রক্ষীবাহিনী এসব পাকিস্তানী হামলার জবাব দিতে সমর্থ! সীমান্ত রক্ষীবাহিনী ভাল কাজ করেছে, আমি সীমান্তে দেখে এসেছি, কিন্তু যখন পাকিস্তান তার নিজ সৈন্যবাহিনী সীমান্তে নিয়ে এসেছে তখন সৈন্যের সঙ্গে কেবল সৈন্যই ত বুঝতে পারে। সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর পক্ষে সৈন্যের মোকাবিলা করা কঠিন হবে। সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর কাছে আমরা এটা আশা করতে পারি না যে তারা পাকিস্তানী বিমান ভূপাতিত করবে, তাদের কাছে ANTI-AIRCRAFT GN নেই। যখন পাকিস্তান নিজ সৈন্য আমাদের মাটির উপর নিয়ে এসেছে তখন সীমান্ত অতিক্রম করার জবাব দেবার জন্য আমাদেরকেও কি সৈন্য সীমান্তে নিয়ে যেতে হবে না? সেনাবাহিনীকে পাকিস্তানের আক্রমণাত্মক তৎপরতার দাঁতভাঙ্গা জবাব দেবার জন্য কি সুস্পষ্ট আদেশ দেয়া হয়নি? প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশে যে অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে বিশ্ব রাষ্ট্রসমূহকে সে ব্যাপারে কিছু করতে হবে। আমি জিজ্ঞাসা করতে চাই, আমাদের দেশ নিজে কি করছে যা আমাওরা অন্য দেশসমূহের নিকট হতে আশা করছি। বাংলাদেশের প্রশ্নে আমরা যদি এগিয়ে না আসি তথা বিশ্ব রাষ্ট্রসমূহের প্রতিক্ষায় চেয়ে থাকি তাহলে বাংলাদেশের জনগনের প্রতি আমরা কর্তব্য সম্পাদন করতে পারবো না।

আমার প্রশ্ন ছিল স্বীকৃতিদানের ব্যাপারে, কিন্তু তা দেয়া হয়নি। আমি কর্মবিরতির প্রস্তাবসমূহের তথ্য জানিয়েছি…

শ্রী এস এন ব্যনার্জীঃ আমরাও জানিয়েছি।

স্পীকারঃ সেটা আমরা পরে দেখব।

শ্রী রাম নিবাস মির্ধাঃ সীমান্তে সৈন্য পাঠানোর প্রশ্নে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মহাশয় কিছু পূর্বেই সংসদকে অবহিত করেছেন। পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য সীমান্ত রক্ষী বাহিনী সক্ষম কিনা এ ব্যাপারে আমি আগেও বলেছি যে তারা সর্বতোভাবে সক্ষম। আজও সীমান্তের যে অবস্থা, তারা তা মোকাবিলা করতে পারবে, যদি দরকার হয় তাহলে সেখানে সৈন্যও পাঠানো যেতে পারে তথা অধিকতর কার্যব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। কিন্তু সীমান্ত রক্ষীবাহিনীকে বর্তমানে যে কাজ অর্পন করা হয়েছে তা করতে সক্ষম নয় একথা বলা অনুচিত হবে।

আরডিঃ মূলতবী প্রস্তাব

১২.৪০

জনাব স্পীকারঃ শ্রী হনুমান্থিয়া

শ্রী জ্যোতির্ময় বসু (ডায়মন্ড হার্বার): আমাদের একটি মূলতবী প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।

জনাব স্পীকারঃ আপনি কি দয়া করে বসবেন?

শ্রী সমর গুহ (কোণটাই) আমাকেও একটি মূলতবী প্রস্তাবের নোটিশ দেয়া হয়েছে।

শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীঃ এখন আপনার কাছে আবেদন করা সুযোগ এসে গেছে। আমি জানতে পেরেছি যে আপনি বাংলাদেশের স্বীকৃতির ব্যাপারে আমাদের মূলতবী প্রস্তাব অনুমোদন করা সংগত মনে করেননি। আমি আবেদন জানাচ্ছি আপনি নিজ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করুন। এটি খুব গুরুত্বর প্রশ্ন। অধিবেশন একটি সংকল্প ব্যক্ত করেছিল। সরকার তদানুযায়ী আচরন প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের ৩৩ লক্ষ অধিবাসী আমাদের দেশে এসে পড়েছে। পাকিস্তান বিনা উস্কানীতে হামলা শুরু করে দিয়েছে। আমি চাই আপনি আমার কর্মবিরতি প্রস্তাব মেনে নিন এবং আমাকে সরকারের নিন্দা করার সুযোগ দিন।

জনাব স্পিকারঃ আমি কি আপনাকে পুনরায় আসন গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করতে পারি। একটি মূলতবী প্রস্তাব অনেক গুরুত্বপূর্ন হয়ে যায় যখন সংবিধান এবং আইন দ্বারা নির্দিষ্ট দায়িত্ব ও কর্ম ব্যর্থতায় পরিণত হয়। এখানে এক্ষেত্রে, কোন স্বীকৃতি কর্তব্যের কোন অংশ নয়। এটা তাদের বিবেচনার অংশ, অবশ্যই, যখন আপনার সাথে আমার দেখা হবে, (বিরাম)

আমি আপনাকে পুরো অবস্থা ব্যাখ্যা করেছি যে আমি নিজেও কিছু আলোচনার ইচ্ছে পোষণ করি, এবং আমি, আজ বা আগামীকাল আপনার পছন্দের যে কোনো আলোচনা করার জন্য প্রস্তুত আছি, কিন্তু মুলতবি প্রস্তাবের মাধ্যমে নয় কারণ একটি মূলতবী প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা তখনই হতে পারে যখন সরকার ব্যার্থ হয়। (বিরাম) দায়িত্ব পালনে সরকারের ব্যর্থতা। (বিরাম) আপনি কি দয়া করে বসবেন? সংবিধান ও আইন কতৃক প্রণীত দায়িত্ব পালনে সরকারের ব্যার্থতা। এখানে এটা ব্যার্থতা নয়, কারণ স্বীকৃতি সংবিধান প্রণীত দায়িত্বের অংশ নয়, (বিরাম) আমি আলোচনা করার অনুমতি দিতে প্রস্তুত। (বিরাম)

একজন সম্মানিত সদস্যঃ মূলতবী প্রস্তাব।

জনাব স্পীকারঃ আমি প্রস্তুত নই।

শ্রী জ্যোতির্ময় বসুঃ আমি আরো একবার আপনাকে অনুরোধ করছি মূলতবী প্রস্তাব স্বীকার করে নেয়ার জন্য, আজ নাহলেও অন্য দিন।

জনাব স্পীকারঃ না, না, এটা বিবেচনার যোগ্য নয়, আইন অনুযায়ী এটা স্বীকার্য নয়, (বিরাম) যদি আপনি চান তাহলে আপনার পছন্দমত যেকোন একটি সময় নির্ধারন করে এই বিষয়ে আলোচনা করা যাবে। (বিরাম)

সংসদীয় দরিয়া তথা নৌবহন ও পরিবহণ মন্ত্রী (শ্রী রাজ বাহাদুর): আজ বিকাল ৩টায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে একটা বিবৃতি দিবেন। আমরা এই ব্যাপারে আলোচনায় একমত (বিরাম) যেটা পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে ঘটছে (বিরাম) কারণ এটা আমাদের প্রভাবিত করছে।

শ্রী জ্যোতির্ময় বসুঃ এটা এক ধরণের প্রতারনা।

শ্রী রাজ বাহাদুরঃ এখানে প্রতারনার কোন প্রশ্নই আসেনা।

শ্রী জ্যোতির্ময় বসুঃ এটা তর্কের বিষয় নয়।

শ্রী রাজ বাহাদুরঃ এ বিষয়ে উনারাও একমত ছিলেন, জনাব (বিরাম)।

জনাব স্পীকারঃ অনুগ্রহ করে তাকে থামাবেন না।

শ্রী রাজ বাহাদুরঃ আমরা একমত; এই বিষয়ে আলোচনা জন্য আমরা শ্রী জ্যোতির্ময় বসুর চ্যালেঞ্জ গ্রহন করলাম এই সংসদে আজ অথবা আগামীকাল।

শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীঃ আমার একটি আবেদন আছে। এই প্রশ্নেও আপনি এমন কোন রুলিং দেবেন না যা আমাদের মূলতবী প্রস্তাব আনার অধিকারকে খর্ব করবে। আপনি আমাদের মূলতবী প্রস্তাব শুনুন। তার ভাষা এই যে “৩১শে মার্চ লোকসভায় প্রণীত রেজ্যুলেশনের বাস্তবায়ন”। যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তার উপর আলোচনা করতে চাই, স্বীকৃতি না দেয়ার যে অবস্থা উদ্ভব হয়েছে তার উপর আলোচনা করতে চাই। মূলতবী প্রস্তাব এখানে না আসলে আর কোথায় আসবে?

শ্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত (আলীপুর) ১ আমি আইনের দিকে আপনার দৃষ্টি আকর্ষন করছি।

জনাব স্পীকারঃ আমি যা দিয়েছি, সেটা নিয়ে কোনো পুনর্বিবেচনায় যাচ্ছি না।

শ্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্তঃ আপনি কি বলছেন, “আপনি যদি চান”, কারণ নিয়ম বলে।

জনাব স্পীকার ২ আপনি যদি চান তাহলে, আজ অথবা কাল আপনার পছন্দের যেকোন সময় আমি আলোচনা করতে পারি কিন্তু মুলতবি প্রস্তাবের সাহায্যে নয়। একটি মূলতবি প্রস্তাব এ ব্যাপারে অনুমোদনযোগ্য।

শ্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত ১ ৫৬ ধারার অধীনে।

জনাব স্পীকারঃ ৫৬ ধারা আমি দেখেছি।

শ্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত ১ এটা জনগুরুত্বসম্পন্ন একটি জরুরী ব্যাপার। এই বিষয় নিয়ে আলোচনা সংবিধানে বাধ্যবাধকতা নাও হতে পারে।

……জনগুরুত্বসম্পন্ন একটি নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনার উদ্দেশ্যে সংসদ কার্যক্রম মূলতবীর একটি প্রস্তাব করা যেতে পারে।

জনাব স্পীকারঃ সেখানে অনেক বিধি-বিধান আছে যা আমি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করেছি, এবং আমি তাতে সম্মতি দেইনি।

শ্রী জ্যোতির্ময় বসুঃ ৫৬ ধারা অনুযায়ী, আমাদের আপনার সম্মতি পাওয়ার অধিকার আছে।

জনাব স্পীকারঃ আমি এ ব্যাপারে একটি আলোচনা করার অনুমতি দিতে প্রস্তুত, আজ, কাল অথবা যেকোন সময়।

শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীঃ মূলতবী প্রস্তাব অন্য জিনিস। আমরা সরকারের নিন্দা করতে চাই।

স্পীকারঃ সেখানেও করতে পারেন।

শ্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্তঃ (মুলতবী) প্রস্তাবে পর্যাপ্ত সমর্থন থাকার পরেও, আমি এটা স্বীকার না করার জন্য কোনো কারণ দেখিনা।

জনাব স্পিকারঃ আমি আগেই বলছি, যেকোন সময় আলোচনা করতে আমার কোন আপত্তি নাই (বিরাম)।

শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীঃ মূলতবী প্রস্তাব আনা আমাদের অধিকার। আমরা আপনার সঙ্গে একমত নই। নিজেদের বিরোধিতা প্রকাশ করার জন্য আমরা ধর্মঘট করতে চাই।

শ্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্তঃ প্রতিবাদে আমরাও ধর্মঘট করছি।

এরপর, শ্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী, শ্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত ও অন্যান্য কিছু সম্মানিত সদস্য বাসা ত্যাগ করলেন।

শ্রী জে, বি, ধৌতে (নাগপুর):…………………

জনাব স্পিকারঃ মাত্র দুই ঘণ্টা আগে সদস্য শপথ গ্রহণ করেছেন আর তিনি আমাকে উপদেশ দিচ্ছেন! দয়া করে বসুন। আমি এতে সম্মতি দেইনি।

শিরোনাম সুত্র তারিখ
২১৭। বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি ভারতের লোকসভার কার্যবিবরণী ২৪ মে, ১৯৭১

Rafiqul Islam Shawon
<১২, ২১৭, ৮০৫-৮০৭>
অনুবাদ

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাপনের বিবৃতি

প্রধানমন্ত্রী, পরমানু মন্ত্রী, গৃহমন্ত্রী তথ্য সূচনা ও প্রসারণ মন্ত্রী(শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী)ঃ জনাব ডেপুটি স্পিকার, জনাব, সংসদ স্থগিত হওয়ার সপ্তম সপ্তাহের মধ্যে, গোটা রাষ্ট্রের মনোযোগ বাংলাদেশের চলমান সংকটের দিকে স্থবির হয়ে আছে। সম্মানিত সদস্যরা আশার পরিবেশ ফিরিয়ে আনবেন, যা আমরা মার্চে দেখেছিলাম। আমরা সবাই অনুভব করেছি যে আমাদের দেশ দেশ দ্রুততার সাথে সুস্থির করা হয়েছে, অর্থনৈতিক সুবিধা এবং আমাদের জনগণের উপর অধিক উদ্বেগপূর্ণ দারিদ্রতার আক্রমণ। এমনকি আমরাও এই নতুন কাজের প্রতিস্থাপন করছিলাম, আমরা নতুন এবং দানবিক সমস্যা দ্বারা গ্রাস হয়ে যাই, যা আমাদের দ্বারা তৈরী ছিল না।

১৫ এবং ১৬ মে-তে, আমি আসাম, ত্রিপুরা এবং পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ হতে আসা শরণার্থীদের ভোগান্তির অংশীদার হতে, এই বাড়ি এবং ইন্ডিয়ার জনগণের সৌহার্দ্য এবং সহায়তা তাদের নিকট পৌছে দেওয়া এবং তাদের দেখভাল করার জন্য কি ধরণের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা নিজের চোখে দেখার জন্য সফর করি। আমি দুঃখিত এই সময়ে অন্যান্য ক্যাম্প পরিদর্শন করা সম্ভব ছিল না। সকল সহজলভ্য স্কুল, প্রশিক্ষন কেন্দ্রসহ ভবন ব্যাবহার করা হয়। হাজারো তাবু টানানো হয়েছে এবং ৩৩৫টি ক্যাম্পে যত দ্রুত সম্ভব অস্থায়ী আশ্রয় স্থাপন করা হয়েছে, আমাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টার পরেও, যারা এখানে এসেছেন তাদের সবাইকে আশ্রয় দেয়া সম্ভব হয় নি, এবং সবাই এখনো আশ্রয়হীণ। জেলা প্রশাসন কঠিন ধকলে আছে। এখানে যারা আছে তাদের সাথে তাল মিলানোর আগেই, আরো ৬০০০০ আরো বেশি আসছে প্রতিদিন।

এই স্বল্প সময়ের মধ্যে, এত বিশাল পরিযাণ, লিখিত ইতিহাসে অভূতপূর্ব। গত সপ্তাহ থেকে বাংলাদেশ থেকে ইন্ডিয়ায় প্রতিদিন সাড়ে ত্রিশ লক্ষ মানুষ আসতেছে। তারা হিন্দু, মুসলিম্, বৌদ্ধ এবং খ্রিষ্টান প্রত্যেকটা ধর্মীয় বিশ্বাসের অনুসারী। তারা প্রত্যেক সামাজিক শ্রেনী এবং বয়সের। ্পার্টিশনের পর থেকে আমরা এই শব্দ বুঝতে পারি যে তারা শরনার্থীরা নয়। তারা যুদ্ধে শিকার যারা আমাদের সীমান্তে মিলিটারির ভয়ে পালিয়ে এসেছে।

অনেক শরণার্থী আহত এবং গুরুতর মেডিকেল চিকিতসা প্রয়োজন দরকার। ত্রিপুরা এবং পশ্চিম বঙ্গে সফরকালে আমি তাদের অনেককে মেডিকেলে দেখেছিলাম। আমাদের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর মেডিকেল সুবিধা ক্ষমতার ভিতরে, প্রসারিত করা হয়েছে। রাজেস্তানে সরকারের উদারভাবে দান করা, ১১০০ নতুন হাসপাতালের সরঞ্জামাদী দ্রূততার সাথে, ৪০০ শয্যার ভ্রাম্যমান হাসপাতালসহ, সে সকল এলাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে। বড় ক্যাম্পগুলোয় বিশেষ দল, ফিজিসিয়ান, নার্স এবং গণ-স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের নিয়োজিত করা হয়েছে। সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে বিশেষ পানি সরবারহ পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে `এবং প্রতিষেধক স্বাস্থ্য পরিমাপ বিশাল পরিসরে হাতে নেয়া হয়েছে।

আমাদের সংবেদনশীল সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোয়, যারা ধকলের সম্মুখীন হচ্ছে, স্থানীয় প্রশাসনের স্বাভাবিক এবং উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের মনোযোগ চ্যুতি হয়ে ক্যাম্প প্রশাসন, বেসামরিক সরবারহ এবং নিরাপত্তা সমস্যার দিকে চলে গিয়েছে। কিন্তু আমাদের লোকজন শরণার্থীদের কষ্ট তারা নিজেরাই গ্রহণ করে নিয়েছে, এবং পাকিস্তান চরদের সাম্প্রদায়িক শত্রুতা সৃষ্টিতে উস্কানির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। আমি নিশ্চিত যে এই সুন্দর চেতনা বজায় থাকবে।

বর্তমানে প্রস্তাবিত, কেন্দ্রীয় কোষাগারের ব্যয় শুধু ছয়মাসের সময়ে ত্রানই ১৮০ কোটি রুপি ছাড়িয়ে যাবে। সব কিছু, সম্মানিত সদস্যরা গ্রহণ করবে, যে অপ্রত্যাশিত বোঝা আমাদের উপর আরোপিত হয়েছে।

আমি দেয়াল-ঘেরা বাংলাদেশের জনগণের জন্ম দুর্দশা এবং ভবিষ্যতে তাদের আশা আছে কিনা সে ব্যাপারে নিরুতসাহিত হয়েছিলাম। এটা প্রস্তাব করা ক্ষতিকর যে ইন্ডিয়াকে বাংলাদেশের জন্য যেকোন কিছু করতে হবে। এটা বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্খা এবং স্বতঃস্ফূর্ত আত্নদানের জন্য অপমানজনক হবে, এবং পাকিস্তান শাসকেরা পরিকল্পিতভাবে ইন্ডিয়াকে তাদের অপকর্মের বলির পাঠা বানানোর প্রচেষ্টায় সফল হবে। এটা বিশ্ব সমাজকে ধোকা দেওয়ার মতও অমার্জিত প্রচেষ্টা হবে। বিশ্ব প্রেসও পাকিস্তানি প্রতারণা দেখেছে। তথা-কথিত ইন্ডিয়ান অনুপ্রবেশকারীর বেশিরভাগই মহিলা, শিশু এবং বয়স্ক।

এই আইন-সভা আমাদের দেশের অনেক প্রয়োজনীয় জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সমস্যা বিবেচনা করেছে। কিন্তু কোন ঘটনাই আমাদের বাংলাদেশের মত গভীরভাবে স্পর্শ করতে পারে নি। যখনই আমরা এরকম গাম্ভীর্যপূর্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি, এই আইন-সভায় প্রতিটা শব্দ বিবেচনায় এটা বিশেষভাবে জরুরি, এবং আমাদের সকল জনগণের সাথে এই সমস্যা জড়িত এবং এর দায়িত্ব এখন আমাদের উপর দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে।

এই তেইশ বছরেরও বেশি সময়ে, আমরা পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিনি। এমনকি যদিও তারা একই রকমের সংযত আচরণ করে নি। এবং এখনো আমরা কোনভাবেই এমন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার আকাঙ্খা করি না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কি হয়েছিল? যা আমরা দাবি করেছিলাম পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন সমস্যা ইন্ডিয়ার জন্যও এখন অভ্যন্তরীন সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে। যদিও, আমাদের পাকিস্তানকে তাতক্ষনিকভাবে এর কার্যকলাপ থেকে ক্ষান্ত হওয়ার জন্য অভিহিত করতে হবে যা তারা অভ্যন্তরীন অধিকারের নামে করছে, এবং যা ভয়ানক ভাবে আমাদের লক্ষ লক্ষ নিজস্ব নাগরিকদের শান্তি এবং সুবোধকে প্রভাবিত করছে। পাকিস্তানকে তার নিজস্ব রাজনৈতিক অথবা অন্যান্য সমস্যা ইন্ডিয়ার ব্যয়ে এবং ইন্ডিয়ার মাটিতে সমাধানের সুযোগ ভারত দেবে না।

শতাধিক নয়, হাজার নয় লক্ষাধিক মানুষকে বেয়নেটের মুখে ফেলে তাদের নাগরিকদের তাদের নিজস্ব আশ্রয় থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করার অধিকার কি পাকিস্তানের আছে? আমাদের জন্য এটা অসহনীয় পরিস্থিতি। বাস্তবতা হচ্ছে যে আমরা এই লক্ষাধিক অভাগা মানুষদের আশ্রয় এবং ত্রাণ দিতে বাধ্য এবং আরো মানুষদের আমাদের সীমান্ত থেকে তাদের ধাক্কা দেওয়ার জন্য কোন অজুহাত দিতে পারি না।

আমরা আমাদের সহনশীলতার সংস্কৃতিতে গর্বিত। আমরা সবসময়ই অনুতপ্ত এবং লজ্জা অনুভব করেছি আমাদের অসহনীয় মুহুর্তের জন্য। আমাদের জাতি, আমাদের জনগণ শান্তির জন্য মরিয়া এবং যুদ্ধের ব্যাপারে কথা বলতে তারা আত্ননিবেদিত। কিন্তু আমার উচিত হবে আমাদের জনগণকে হুশিয়ার করা যে তাতে করে আমরা হয়ত শরনার্থিদের বহন করার থেকেও ভারী বোঝা ডেকে আনতে পারি।

যে সমস্যা আমাদের মুখোমুখি তা কেবল আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং পশ্চিম-বঙ্গেই সীমাবদ্ধ নয়। এইগুলো জাতীয় সমস্যা। নিঃসন্দেহে মৌলিক ও আন্তর্জাতিক সমস্যাও বটে।

আমরা আমাদের বিদেশের প্রতিনিধি এবং ইন্ডিয়ায় বিদেশী সরকারের প্রতিনিধি দ্বারা বিশ্বের বিবেক জাগ্রত করার জন্য চেষ্টা করেছি। আমরা জাতিসংঘের কাছে আবেদন করেছি, এবং, অবশেষে মনে হচ্ছে বিশ্বের অন্যান্য দেশের কাছে আমরা সমস্যার প্রকৃত মাত্রা ও সংবেদনশীলতা অনুভূতি তৈরি করতে পেরেছি। যদিও, আমি দুঃখের সাথে স্মরণ করছি এটা বুঝতে আন্তর্জাতিক বিশ্বের লম্বার সময় ক্ষেপণের কারণে।

শুধু ইন্ডিয়াই না প্রতিটা দেশ এটার গুরুত্ব বিবেচনা করেছে। আমার মনে হয় আমি এই আইন-সভার এবং আমাদের মানুষদের অনুভূতি প্রকাশ করেছি যখনই আমি এই শান্তির বিনাশকারীর অসচ্চরিত্রের বিরুদ্ধে আমার আওয়াজ তুলেছি। ভাল প্রতিবেশিসুলভ সুহৃদয়তা এবং মানবিকতার মৌলিক নীতি পাকিস্তানের সামরিক শাসনের অচৈতন্যমুলক কর্মকান্ড দ্বারা প্রত্যাখ্যাত। তারা ইন্ডিয়ার বিশাল মানবিকতা ও শান্তির স্থিতিশীল অবস্থাকে হুমকি দিচ্ছে।

আমরা সেক্রেটারি জেনারেল. উ থান্ট-এর সাধারণের প্রতি করা আবেদনকে স্বাগত জানাই। আমরা আনন্দিত যে কয়েকটি রাষ্ট্র এই বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। কেউ কেউ বিবেচনা করছেন। কিন্তু এখানে সময়ের ব্যাপারটা গুরুত্তপূর্ন। এই লাখ লাখ মানুষের ত্রান দেয়াও বিশাল সমস্যা। ত্রানকেও চিরস্থায়ী করা যাবে না; আমরা এমন করার ইচ্ছা করি না। আরো শরণার্থীদের অন্তঃপ্রবাহ থামাতে শর্ত অবশ্যই তৈরী করতে হবে এবং তাদের ভবিষ্যত নিরাপত্তা এবং সুস্থতার জন্য গোড়ার দিকেই বিশ্বাসযোগ্য নিশ্চয়তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে ফেরত পাঠাতে হবে। আমি সকল দায়িত্বের সাথে বলি যে যদি এটা না ঘটে, তবে এই উপমহাদেশে কোন স্থায়ী স্থিতিশীলতা ও শান্তি থাকবে না। আমরা অন্যান্য শক্তিকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য মিনতী করেছি। যদি বিশ্ব আমলে না নেয় তাহলে আমরা আমাদের নিজস্ব নিরাপত্তা এবং আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের উন্নতির কাঠামো সংরক্ষনে যাবতীয় দমনমূলক ব্যাবস্থা গ্রহন করব।

আমরা অনুধাবন করেছি যে পূর্ব-বঙ্গ সমস্যার কোন সামরিক সমাধান সেখানে নেই। একটি রাজনৈতিক সমাধান অবশ্যই আনতে হবে। বিশ্ব শক্তিগুলোর রাজনৈতিক সমাধানের সামর্থ্য যাদের আছে তাদের এগিয়ে আসতে হবে। পরাশক্তিদের একটি বিশেষ দায়িত্ত্ব রয়েছে। যদি তারা তাদের শক্তি সঠিক এবং দ্রুত ভাবে চর্চা করে তাহলেই আমরা কেবল উপমহাদেশে টেকসই শান্তির দিকে তাকাতে পারি। কিনুত যদি তারা ব্যর্থ হয় এবং আমি মন থেকে আশা করি যে তারা ব্যর্থ হবে না; তাহলে মানবাধিকারের লঙ্ঘন এবং চলমান বিশাল সংখ্যক বাস্তুহারা মানুষেরা শান্তির হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

এই অবস্থা পক্ষীয়-নীতিতে অথবা দলীয় রাজনিতীর শর্ততে সামলানো যাবে না। এই সমস্যা প্রতিটা নাগরিকের উদ্বেগকে জড়িত করেছে। আমি আশা করি যে এই সংসদ, আমাদের দেশ এবং আমাদের জনগণ প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা গ্রহন করতে প্রস্তুত আছে যাতে করে আমরা আমাদের জনগণ ও লক্ষ লক্ষ মানুষ যারা সন্ত্রাসের রাজত্ব থেকে পালিয়ে এখানে সাময়িক শরণার্থী হয়েছে তাদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালন করতে পারি।

এই সকল বোঝা আমাদের উপর ভারী দায়িত্ব আরোপ করেছে এবং কঠোর আন্তর্জাতিক শৃংখলার প্রয়োজন। আমাদেরকে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। আমাদের কারখানা এবং খামারগুলোকে অবশ্যই বেশি বেশি উতপাদন করেতে হবে। আমাদের রেলপথ এবং আমাদের যাবতীয় যোগাযোগ ও আঞ্চলিক সহায়তা বাড়াতে হবে। আমাদের অর্থনীতি বাচাতে, সামাজিক ও রাজনৈতিক গঠন এবং জাতীয় সংহতি শক্তিশালী রাখতে সবকিছু অধস্তনবর্তী করতে হবে। আমি প্রত্যেক নাগরিক, প্রত্যেক পুরুষ, নারী এবং শিশুর নিকট আবেদন জানাই সেবার মূলনীতি মেনে চলতে এবং ত্যাগ স্বীকারে অনুপ্রানিত করি – যা এই জাতি করতে সক্ষম।

শ্রী সমর গুহা (কনতাই)ঃ সকল বিরোধী নেতারা সকালে স্পিকারের সাথে সাক্ষাত করেছে যখন আমরা সমন্বয়ের ব্যাপারে চাপ দিয়েছি। স্পিকার আমাদের বলেছেন যে তিনি বাংলাদেশ সমস্যায় কিছু আলোচনার অনুমতি দিবেন। তারপর আমরা জানাই যে প্রধানমন্ত্রী বিবৃতি দিবেন। আমি জানতে চাই যে সেখানে বিবৃতির উপর ভিত্তি করে কোন আলোচনা হবে কিনা।

এনআইআর. ডেপুটি স্পিকারঃ আপনারা নিয়ম জানেন। যদি আপনারা আলোচনা করতে চান এবং স্পিকার একমত হন্, তাহলে আপনারা নোটিশ পাঠান।

শ্রী এস.এম. ব্যানার্জী(কানপুর)ঃ তিনি বলেছেন আজ নয়ত কাল।

শ্রী পি.কে. দেও (কালাহান্দি)ঃ বিবৃতি হয়ত প্রচারিত হবে।
শিরোনাম
সূত্র তারিখ
২১৮। বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি ভারতের লোকসভার কার্যবিবরণী ২৪ মে ১৯৭১

হোসাইন মুহাম্মদ মুরাদ
<১২, ২১৮, ৮০৮-৮১১>
অনুবাদ

জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ
পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পূর্ব সীমান্তে গোলা বর্ষণ করছে

শ্রী মুখতিয়ার সিংহ মালিক (রহটাক)ঃজনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এবং আশা করছি যে তিনি এই ব্যাপারে একটি বিবৃতি দিবেন।

২৫.০৫.১৯৭১ তারিখে মেঘালয়ের গারো পাহাড় জেলার ডুলু সেক্টরে পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা ভারী গোলা বর্ষণের খবর পাওয়া গেছে যাতে ৯ জন ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী সহ ২২ জন নিহত হয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ও আভ্যন্তরীণ বিষয়ক মন্ত্রী স্পীকার মহোদয়,
১৯৭১ এর ২৫ মে তারিখে পাকিস্তানী সেনারা ভারী মর্টারের গোলাবর্ষণের ছত্রছায়ায় ডুলু এলাকার ৫০০ গজ দূরে অবস্থিত কিলাপাড়া বিএসএফ চেকপোস্টে হামলা করে। বিএসএফ এর ডিটার্সমেন্টটি বীরত্বের সাথে প্রতিআক্রমণ করে কিন্তু সংখ্যায় কম হও্য়ার কারণে হেরে যায় এবং ঘাঁটিটি হাতছাড়া হয়।

আমি অত্যন্ত দুঃখের সাথে পার্লামেন্টকে জানাচ্ছি যে এই আক্রমণের ফলে ৯ জন বিএসএফ সদস্য নিহত হয়েছে এবং দুইজন নিখোঁজ আছে। আসাম সরকার হতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এই আক্রমণে ১৩ জন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত এবং ১১ জন আহত হয়েছেন।
যদিও ডুলুতে অবস্থিত বিএসএফ কন্টিজেন্ট পাকিস্তানী অগ্রগতি রুখে দেয় এবং তাদের ভারতীয় সীমান্ত হতে তাড়িয়ে দেয়।

শ্রী মুখতিয়ার সিংহ মালিকঃ স্পীকার মহোদয়, আমাদের ১৩ জন লোক অব্যাহতভাবে ৪ ঘন্টা ধরে যুদ্ধ করতে থাকে। তাদের মধ্যে একজন নিহত হয় এবং ৬/৭ জন আহত হয়। যুদ্ধের সময় তারা অতিরিক্ত সাহায্য চেয়েছিল কিন্তু পরিতাপের বিষয়, তাদের সাহায্যকারী পাঠানো হয়নি। এই দুর্বলতার পরিণামে বেসামরিক লোকজনও মারা গেছে এবং রক্ষী বাহিনীর ৯ জন সদস্যও নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে ২ জন নিখোঁজ রয়েছে।

স্পীকার মহোদয়, এই দুর্বলতা না দেখানো হলে এবং আমাদের সরকার এইরূপ নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে না থাকলে এই পরিণতি হত না। আমাদের সীমান্তে আজ যেসব ঘটনা ঘটেছে তার বর্ণনা এই সংসদে নিত্যদিন হচ্ছে, কিন্তু সমুচিত ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত এই সরকার গ্রহণ করেননি।

আমাদের সরকারী মুখপাত্র বলেছেন পাকিস্তানীরা গ্রাউন্ড রুলসের কোনো তোয়াক্কা করে না যখন আমরা তা কড়াকড়িভাবে অনুসরণ করতে চাই। এমতাবস্থায় আমাদের সরকার কি এরুপ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন যে, আগামীতে বিএসএফ-এর সাহায্যের জন্য নিজেদের সৈন্যও সামাবেশ করা হবে এবং যখনই দরকার হবে আমাদের সৈন্য তাদের মুকাবেলা করবে, পাকিস্তানের ভূ-খন্ডে গিয়ে তাদের ধাওয়া করে তাদেরকে সেভাবেই জবাব দেবে যেভাবে আজ তারা আমাদের সঙ্গে আচরণ করছে।

শ্রী কৃষ্ণচন্দ্র পনতঃ স্পীকার মহোদয়, আমি প্রশ্ন করিনি, আমি জবাব দেব। মাননীয় সদস্য একটু আগে বললেন, সৈন্যসাহায্য সেখানে পৌঁছেনি। আমি বলতে চাই সূত্রখংডীতে সৈন্যসাহায্য পৌছেছিল, ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ক যিনি ছিলেন তিনি স্বয়ং সৈন্য সাহায্যে সমভিব্যাহারে সেখানে পৌঁছে উদ্ভূত পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে সক্ষম হন। তারপর তাদের প্রতি পালটা আক্রমণ আরম্ভ হয়। ফলে রক্ষীবাহিনী ওই সীমান্ত ফাঁড়ি পুনর্দখল করে নেয়। পাকিস্তান আর্মির একজন কনস্টেবলকেও গ্রেফতার করে। সুতারাং এতে দুর্বলতার বা প্রসন্নতার কোন কিছু নেই।

শ্রী সমরগুহ: আমি জানি না, পাকিস্তানের ক্রম আগ্রাসনের বিপরীতে ভারত সরকারের বর্তমান ভীরু আচারণ কখন শেষ হবে। কারণ আমি বুঝতে পারছিনা কখন পাকিস্তানী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সহিষ্ণুতা, ধৈয্য ও শান্তির বাণী আওড়ানো বন্ধ হবে। এটা রীতিমত দেখতে অসুস্থকর যে ৫৫ কোটি জনসংখ্যাবিশিষ্ট একটি জাতি শুধুই গোছাগোছা প্রতিবাদ পত্র পাঠাচ্ছে এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কতৃক পাকিস্তানকে দেওয়া অতিরঞ্জিত হুমকির অনুষ্ঠান দেখছে……..

স্পীকার মহোদয়: মনে হচ্ছে তিনি একটা বক্তব্য দেবেন। আমি তাকে প্রশ্ন সুনির্দিষ্ট এবং সংক্ষিপ্ত করতে অনুরোধ করছি।

শ্রী সমরগুহ: দয়া করে আমার ব্যাপারে একটু ধৈর্য করুন। আমি জানি না আমার ব্যাপারে আপনার এলার্জি আছে কিনা?

স্পীকার মহোদয়: প্রতিদিন না। কখনো কখনো।

শ্রী সমরগুহ: পঞ্চান্নকোটি জনসংখ্যার একটি জাতীর পক্ষে এটা দেখা সত্যি অসুস্থকর হয়ে গিয়েছে যে, পাকিস্তানকে গোছাগোছা প্রতিবাদ পত্র পাঠানো প্রায় একটি অনুষ্টানে পরিণত হয়েছে। সেই সাথে এটা দেখাও অসুস্থকর হয়ে গিয়েছে যে আমাদের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এই বলে পাকিস্তানকে অতিরঞ্জিত হুমকি দিছেন যে তারা (পাকিস্তান) আগ্রাসী মনোভাব এবং অনুপ্রবেশ বজায় রাখে, তবে পরিণতি খারাপ হবে। এইসব অতিরঞ্জিত হুমকির জবাব পাকিস্তান নিয়মিত পুনঃপুনঃ নতুন আগ্রাসনের মাধ্যমে দিয়ে যাচ্ছে।

এই সীমান্তের এই ঘটনা গুলোকে বিচ্ছিন্ন হিসেবে না দেখে বরং বাংলাদেশ এবং ভারতের বিরুদ্ধে চক্রান্তের অংশ হিসেবে দেখা উচিত। আমি জানি না গতকাল প্রেস ব্রিফিং এর দায়িত্বে কে ছিলেন। যিনি সীমান্তের বহিরাক্রমণ বিষয়ে বলতে গিয়ে বলেছেন যে, শরণার্থীদের প্রবাহ দৈনিক ষাট হাজার থেকে নেমে পঞ্চাশ হাজারে পৌছেছে। এই ভদ্রলোক পাকিস্তানীদের নির্মমতার ধরণ সম্পর্কে জানেন না। তারা নিয়মিত মানুষ হত্যা করছে, যাতে লক্ষ লক্ষ লোক-সংখ্যালঘু এবং আওয়ামীলীগ সমর্থক পালানোর উপর আছে। পাকিস্তানীরা এই লোক গুলোকে সীমান্ত অতিক্রম করতে দিচ্ছে না। কিন্তু যখনই তারা সুযোগ পাবে আবারো তারা লক্ষে লক্ষ্র ভারতে প্রবেশ করবে।

এই সমস্ত বিষয় গুলো বিবেচনা করে সরকার কী আমাদের সীমান্তে পাকিস্তান আগ্রাসন ও অনুপ্রবেশের সমগ্রতা অনুভব করবে এবং এই চক্রান্তকে আমাদের নিরাপত্তার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের দেওয়া হুমকি বলে মেনে নিবে? যদি তাই হয়, তবে পাকিস্তানী বাহিনীর দ্বারা সীমান্ত নীতির ইচ্ছাকৃত লঙ্ঘন আমাদের সেনারা কেন বসে বসে দেখছে আর একতরফা ভাবে রীতি মেনে চলছে?

দ্বিতীয়ত, অস্ত্র শস্ত্র এবং জনগণের দিক থেকে দূর্বল বিএসএফ এর হাতে অস্ত্র ও লোকবল উভয়ই দিক থেকেই শক্তিশালী পাকিস্তানি বাহিনী মোকাবেলার দায়িত্ব না দিয়ে সেনাবাহিনীকে কী পাকিস্তানী আগ্রাসন মোকাবেলা করার জন্য ডাকা হবে? যদি না হয় তবে কেন?

সর্বশেষে যেমনটা ১৯৫০ সালে প্রয়াত পন্ডিত নেহরু করেছিলেন এর চেয়ে কম বিপদের সময়ে তেমনি সরকার কী পাকিস্তান সরকারকে একটি সময় বেঁধে দিবে যেন বাংলাদেশে ভারতীয়দের হত্যা, বাংলাদেশী মানুষদের উপর নৃশংস উত্পাটন সহ তাদের ভারতের দিকে যেতে বাধ্য করা বন্ধ করবে। এবং বর্বর গণহত্যা বন্ধ করবে? যদি তা বন্ধ না করে তবে কী ভারত সরকার সরাসরি পাকিস্তান আর্মির বিপক্ষে যুদ্ধে উদ্দ্যেগ হবে, যেন ভারতের জাতীয় নিরপত্তা এবং বাংলাদেশে বাঙালীদের জীবন, সম্মান এবং সম্পদ রক্ষা করতে পারবে। যদি তা না হয়, তবে ভারতের জাতীয় নিরপত্তা সহ বাংলাদেশের মানুষের সহায়-সম্পত্তি রক্ষা করতে বিকল্প পন্থা কী?

শ্রী ক. চ. পানতঃ শ্রদ্ধেয় সদস্য দ্বারা দুইটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। একটি হল, সেখানে শুধু বিএসএফ কেন ছিল এবং কেন তাদের কাছে শুধুমাত্র হালকা অস্ত্র ছিল। বিএসএফ ঐখানে ছিল কারন এই ব্যবস্থাপনা কয়েক বছর ধরে চলে আসছে যেখানে বিএসএফ বর্ডারে এবং আর্মি বর্ডারের কিছু দূরে থাকবে। আমার শ্রদ্ধেয় বন্ধু এই ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানেন।

শ্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত(আলিপুর)ঃ যা কী একতরফাভাবে শুধু আমরাই পালন করব?

শ্রী ক. চ. পনতঃ এই ক্ষেত্রে তারা গোলাবারুদ এবং মর্টারের সাথে সশস্ত্র থাকে। সুতরাং তারা যে পর্যাপ্ত অস্ত্র ছাড়া ছিল তা সঠিক নয়, এবং আমার তথ্য অনুযায়ী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর শক্তি বিএসএফ এর তুলনায় অনেক বেশী। বিএসএফ তাদেরকে প্রতিহত এবং বিতাড়িত করে পিছু হাঠাতে সক্ষম ছিল। আমি তাকে অনুরোধ করব এইরকম প্রশ্ন না করতে এবং ফল থেকে তার উপসংহার টানতে।

দ্বিতীয়ত তিনি জিজ্ঞাসা করেছেন, আমাদের নিরাপত্তার দরকারে আমরা সেনাবাহিনীর ব্যবহার করতে প্রস্তুত আছি কিনা। স্বাভাবিকভাবে তা নির্ভ্র করে আমরা সীমান্তে পাকিস্তানী আর্মি দ্বারা কীরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছি তার উপর।

শ্রী সমর গুহঃ আমি গ্রাউন্ড রুলস সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম। কেন আমাদের সীমান্ত বাহিনী একতরফাভাবে গ্রাউন্ড রুলস মেনে চলছে যেখানে পাকিস্তানী আর্মি দ্বারা তা বারংবার লঙ্ঘন হচ্ছে।

স্পীকারঃ আপনি তাকে নিয়ন্ত্রণ কক্ষে নিয়ে যেয়েন মাঝে মাঝে।

শ্রী সমর গুহঃ এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন কেননা আমাদের এবং তাদের নিরপত্তা বাহিনীর মধ্যে দশ মাইল ফাঁক প্রতিপালিত হচ্ছে এবং তারা বারংবার গ্রাউন্ড রূলস লঙ্ঘণ করছে। আমি জানতে চাচ্ছি কেন আমাদের সরকার দ্বারা কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হল না, এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এবং এর উত্ত্র দেওয়া উচিত।

স্পীকারঃ এই প্রশ্ন গতকালও জিজ্ঞেস করা হয়েছিল।

শ্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্তঃ এই প্রশ্ন গতকালও করা হয়েছেল এবং তিনি এর উত্তর এড়িয়ে গিয়েছিলেন।

শ্রী ক. চ. পানতঃ যদি আমার সম্মানিত বন্ধু এই ব্যাপারে কিছু চিন্তা করেন তবে তিনি অনিধাবন করতে পারবেন তার প্রশ্ন

শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীঃ সংরক্ষিত লোকসভার কার্যবিবরণী জারিকৃত কপি অস্পষ্ট। সেটি পড়া সম্ভব হয়নি বলে এখানে তার অনুবাদ সন্নিবেশ করা গেল না।

শ্রী কৃষ্ণচন্দ্র পনতঃ মাননীয় সদস্য বলেছেন, আমার বিবৃতিতে একথা বলা হয়েছে যে, পাকিস্তান আর্মি এই চেকপোস্ট অতিক্রম করেছে। আমি আবার উল্লেখ করতে চাই, এই ফাঁড়ির চেকপোস্টে মাত্র ১১ জন লোক ছিল এবং যে সব শরণার্থী আসছে তাদের জন্য ওই চেকপোস্ট খোলা রাখা হয়েছিল। সেখান থেকে ৫০০ গজ দূরে ঢালুতে আমাদের বড় চেকপোস্ট ছিল। আক্রমণকারীরা ৫০০ গজ দূরত্বের কাছাকাছিও পৌঁছুতে পারে নি। ওই চেকপোস্টে যেখানে মাত্র ১১ জন লোক ছিল পাকিস্তানী সৈন্য তাদের ওপর আক্রমন চালায় এবং তাদের ছাড়িয়ে যায়। যেহেতু হামলাকারীদের সংখ্যা অনেক বেশী ছিল তাই চেকপোস্টের ১১ জনের পক্ষে তাদেরকে ঠেকানো সম্ভব ছিল না। আমি মনে করি, তারা সৈন্য কিংবা সীমান্ত রক্ষীবাহিনী যাই হত না কেন, মাত্র ১১ জন এত বেশী সংখ্যার হামলাকারীদের বাধা দিতে পারত না। তা সত্ত্বেও যে বীরত্বের সংগে তারা যুদ্ধ করেছে সেজন্য আমি তাদের প্রশংসা করি ও অভিনন্দন জানাই। তাদের পেছনে ঢালুতে অবস্থানরত সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর কন্টিজেন্ট হামলাকারীদের ৫০০ গজের মধ্যেও আসতে দেয়নি এবং পাকিস্তানী সৈন্যদের ভারতীয় সীমান্তের বাইরে তাড়িয়ে দিয়েছে।

গ্রাউন্ড রুলস-এর প্রশ্নে- আজ যে পরিস্থিতি, এমতাবস্থায় যদি আমাদের ওপর আক্রমণ হয় এবং কোথাও আমাদের সৈন্য পাঠানো জরুরি মনে করা হয় তবে সেখানে কোন পদ্ধতিগত বাধা হবে না। পরিস্থিতি যে রূপই নিক না কেন আমাদের তা এভাবেই মুকাবিলা করতে হবে। ভারতের এক এক ইঞ্চি জমির প্রতি আমাদের বাজপেয়ী মহাশয়ের যদি ভালবাসা থাকে তবে আমি এ কথা পরিষ্কারভাবে বলে দিতে চাই যে, আমরাও নিজেদের দেশের প্রত্যেকটি ইঞ্চি জমির প্রতি ভালবাসা তাঁর চেয়ে কম নয়, ….হৈ-চৈ…

শ্রী প. ভেনকোটাসুখভাই ( নান্দায়াল ) : সরকার কী এইটা বুঝতে পারছে যে, পাকিস্তান সম্পূর্ণ বাংলাদেশ দখল করে বিশ্বের মতামত ভ্রান্ত করতে সীমান্তে সংঘর্ষ ও নতুন রণকৌশল গ্রহণ করেছে বা, এটি কী আমাদের আন্তর্জাতিক সীমানা লঙ্ঘণের বড় প্রচেষ্ঠা? যদি তাই হয়, তবে সরকার এই তথ্য অবগত যে, পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশ ও আমাদের দেশের ৬২০ মাইলের সিমান্তে সৈন্য ভীর করে তালগোল পাকাচ্ছে। সরকার কী এই বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবে এবং আমাদের সৈন্যদের আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরার সীমান্তে সড়াবে?

শ্রী ক. চ. পনতঃ পাকিস্তানী সৈন্য বর্ডারে বিশৃখলা তৈরী করছে তা আমি স্পষ্ট বলতে পারছি না। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এই ব্যাপারে আমার চেয়ে ভাল তথ্য দিতে পারবে। কিন্তু সাধারণভাবে বলতে গেলে, বাংলাদেশের অব্যন্তরে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের জন্য পাকিস্তানী আর্মি তার সৈন্যদের ক্ষুদ্র দলে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে পাঠানো সহজ হবে। তারা যখনই কোথাও। তাই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে সমস্ত বর্ডারে ছড়ানো খুবই কঠিন হবে, এটিই সাধারণ অবস্থা। এই সুনির্দিষ্ঠ প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারব না
শিরোনাম
সূত্র তারিখ
২১৯। বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান প্রসঙ্গে বিরোধী সদস্যদের প্রস্তাব বিতর্ক ভারতের লোকসভার কার্যবিবরণী ১৮ জুন ১৯৭১

Hasan Tareq Imam
<১২, ২১৯, ৮১২-৮২৬>
অনুবাদ

১৬:৪৯ ঘটিকা

সিদ্ধান্ত: বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান

শ্রী সমর গুহ (কোন্টাই): আমি মাননীয় স্পিকারের অনুমতি নিয়ে আমার প্রস্তাব পেশ করছি।

১৬:৪৯
এই মহান সংসদ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে আমাদের পবিত্র সংবিধানের মূলনীতি স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র সমুন্নত রাখতে, বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহনী পরিচালিত গণহত্যার সমাপ্তি টানতে; লক্ষ লক্ষ গৃহহারা উদ্বাস্তুকে নিজের দেশে ফিরিয়ে দিতে এবং উপমহাদেশে শান্তি, উন্নতি এবং প্রগতির একটি নবযুগের সূচনা করতে ভারতীয় সরকারের উচিত অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া এবং তাদের জাতীয় মুক্তি অর্জনের লক্ষে প্রাথমিক সবধরণের সহায়তা করা।

১৭:০০ ঘটিকা
এই মহান সংসদে এমন একটি ঐতিহাসিক প্রস্তাব উত্থাপন করতে পেরে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। কাকতলীয়ভাবে ঠিক এই সময়েই লেবার পার্টির নেতা বৃটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান করার প্রস্তাব তুলে ধরেছেন এবং ১২২ জন সাংসদ ইতিমধ্যে ঐ প্রস্তাব সমর্থন করেছেন। প্রয়াত মার্কিন রাষ্ট্রপতি জন.এফ.কেনেডির ছোট ভাই সিনেটর টেড কেনেডিও যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে একই দাবী জানিয়ে একটি প্রস্তাব পেশ করেছেন।

আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে বাংলাদেশের বিপ্লবের প্রেক্ষাপট ইতিহাসের কোন দূর্ঘটনা নয়, বরং পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ দ্বন্ধের একটি যৌক্তিক পরিসমাপ্তি। ১৯৩৩ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ ছাত্র রহমতুল্লাহ রক্ষণশীল আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পাকিস্তান গঠনের ধারণা প্রস্তাব করেন। এই প্রস্তাব যখন তৎকালীন বৃটিশ অফিসার জনাব জাফরুল্লাহর কাছে তুলে ধরা হয়, তিনি একে অবাস্তব একটি রাজনৈতিক কল্পনা বলে উড়িয়ে দেন। এই রাজনৈতিক কল্পনা ১৯৪৭ সালের ১৪ই অগাস্ট মধ্যরাতে বাস্তবায়িত হয় এবং তখন থেকেই পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ দ্বন্ধের সূচনা।

তখন আমি ঢাকায় ছিলাম। ১৯৪৭ সালে আমি ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় চলে আসি।

আমি আশা করি আপনি আমাকে কিছু কথা বলার সুযোগ দেবেন। যুগবাণী নামে কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিকে আমি ২০ এর অধিক প্রবন্ধ লিখেছি। প্রবন্ধগুলোতে আমার মূল বক্তব্য ছিল যে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা অবধারিত এবং এই স্বাধীনতা শুধু সংখ্যালঘুদের সমস্যার সমাধান করবেনা বরং পাকিস্তান-ভারতের মধ্যে যত সমস্যা আছে সেগুলোর সমাধানেরও চাবিকাঠি হয়ে উঠবে। সেসময় আমার অনেক সম্মানিত সহকর্মী আমার লেখা নিয়ে হাসি মষ্করা করেছিলেন। কিন্তু তারপরেও আমি পূর্ব বাংলা নিয়ে লেখালেখি চালিয়ে গিয়েছি এবং একটার পর একটা বই লিখে গিয়েছি। ১৯৬৪ সালে ঢাকা গণহত্যার পর অনেকে এটিকে সাম্প্রদায়িক হামলা বলে উল্লেখ করেছিলেন। সেই সময় আমি শাস্ত্রিজীর সাথে দেখা করি। তখন আমি সাংসদ ছিলামনা। তিনি আমাকে অল্প কয়েকদিনের মধ্যে আমার বক্তব্য লিখিত আকারে তাঁকে দিতে বলেন। আমার বক্তব্য নিয়ে আমি একটি বই লিখে ফেলি এবং সেই বইটি শাস্ত্রিজীকে উপহার দেই। সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধান হিসাবে আমার প্রস্তাবের প্রথম দফা ছিল, “পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে সব রকমের সহযোগিতা করতে হবে। “

তারপরে ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর “ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইস্ট বেঙ্গল” নামে আমি আরেকটি বই লেখি। বইটি পূর্ব বাংলার ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় এবং পাকিস্তান সরকার বইটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ৬৫ এর যুদ্ধের পর পূর্ব বাংলার মানুষের রাজনৈতিক চেতনায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। ১৯৬৭ সালে আওয়ামী লীগ ছয় দফা দাবী পেশ করার পর আমি আরেকটি বই লিখি, বইটি প্রকাশের সময় আমার বন্ধুরা নিজ নামের পরিবর্তে ছদ্মনাম ব্যাবহার করার পরামর্শ দেন এবং আমি তাদের কথা মেনে নেই। আমার এত কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট যে কোন রাজনৈতিক দূর্ঘটনা নয় সেটি তুলে ধরা। এটি অবধারিত ছিল। এই বিস্ফোরণ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের অনিবার্য পরিণতি। এই কারণে আমি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই যে বাংলাদেশী শরণার্থী সমস্যা যদিও এই বিপ্লবের সাথে সম্পর্কযুক্ত, কিন্তু এটি মূল আলোচ্য বিষয় নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা জটিল একটি সমস্যার সমাধান। বাংলাদেশে যা ঘটছে সেটি ঐতিহাসিক একটি বিপ্লব এবং এর ভেতর লুকিয়ে থাকা অমিত সম্ভাবনা সমগ্র উপমহাদেশের রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে দেবার ক্ষমতা রাখে।

মাননীয় স্পীকার, স্বাধীন বাংলাদেশ বাস্তবায়িত হলে সেটি উপমহাদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন নিয়ে আসবে। আপনি যদি বাংলাদেশের সমস্যার মূলে যান, তাহলে আপনি তার স্বাধীনতার বৈপ্লবিক গুরুত্ব এবং এই লাখো শহীদের আত্নদান ভারত এবং সমগ্র মানবতাকে কি দিয়েছে সেটা অনুধাবন করতে পারবেন। সেই কারণে আমি জানতে চাই যে, এই বিপ্লবের অফুরন্ত সম্ভাবনার ব্যাপারে আমাদের সরকার অবহিত আছেন কিনা।

কিছুদিন আগে মাননীয়া প্রধাণমন্ত্রী রাজ্যসভায় উল্লেখ করেছেন, ” বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আমাদের নরকতুল্য অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হবে। যদি আমাদের সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার সাহস দেখায়, তবে ভারতীয় জনগণ খুশি মনেই নরকের ভেতর দিয়ে যাবে এবং সব ধরণের ভোগান্তি সহ্য করবে। আমি নিশ্চিত যে সরকার এই ইতিবাচক পদক্ষেপটি নিলে সমগ্র ভারতবাসী সরকারের পেছনে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াবে এবং সব কষ্ট হাসি মুখে সহ্য করে নেবে।

যুদ্ধ শুরু হবার আড়াই মাস হয়ে গেল, সরকারের আচরণ কি? জনমনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে যে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকার নানা রকমের টাল-বাহানা করছে। আমাদের সরকার, প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য মন্ত্রীরা একাধিকবার বলেছেন যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের বিষয়টি সরকার সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে। তাদের বক্তব্য থেকে এটি প্রতীয়মান হয় যে সার্বভৌম বাংলাদেশের যৌক্তিকতা সরকারও অস্বীকার করতে পারছেনা। তবে কখন এই স্বীকৃতি দেয়ার যৌক্তিক ও উপযুক্ত সময়, এই ব্যাপারে তারা দ্বিধাগ্রস্হ।

কিছুদিন পূর্বে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন যে স্বীকৃতি দেয়া হবে। এবং সঠিক সময়ে স্বীকৃতি দান করার সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তাদের কাছে প্রশ্ন হচ্ছে পরিস্থিতি কতটুকু জটিল হলে স্বীকৃতি দান করার সঠিক সময় আসবে? এই ব্যাপারে সরকার কঠোর রকমের নীরবতা পালন করছে। এমনকি কি পরিস্থিতি, বা কি কি বিষয় সমূহের উপর ভিত্তি করে তারা স্বীকৃতি দেবার সঠিক সময় নির্ধারণ করবে সে ব্যাপারে সংসদকেও কিছু জানাচ্ছেনা।

কিন্তু জনগণ কি চায়? বেশীরভাগ রাজ্য সরকার সর্বসম্মতভাবে বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেবার প্রস্তাব করেছে। কোন কোন মন্ত্রী এবং কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা প্রকাশ্যে বলেছেন যে বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেয়া উচিত। মুসলিম লীগ বাদে সংসদের প্রতিটি বিরোধীদল একমত যে এখনই স্বীকৃতি দেবার উপযুক্ত সময়। মিঃ চাগলা, মিঃ সেটালভাডের মত আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন আইনজ্ঞেরা একবাক্যে বলেছেন যে সরকারের উচিত এখনই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া। অসংখ্য জনসভায় ভারতীয় জনগণ একই দাবী তুলেছে। কিছুদিন আগে যখন সেন্ট্রাল হলে লোক সভা এবং রাজ্যসভার সদস্যদের সামনে বাংলাদেশী সংসদীয় দল নিজেদের বক্তব তুলে ধরে স্বীকৃতি চান, তখন দুই সভার সদস্যরাই একযোগে বজ্র কন্ঠে তাদের সমর্থন জানান। এসব ঘটনা থেকে কি প্রতীয়মান হয়? এখান থেকে বোঝা যায় যে প্রায় পুরো দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত। কিন্তু হয় সরকার জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন, অথবা সরকার জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন। সরকার মনে করে সঠিক সময় নির্ধারন করার মত প্রাজ্ঞতা শুধু তাদেরই আছে, কিন্তু জনগণ মনে করে সময় ইতিমধ্যে পার হয়ে গিয়েছে এবং আর দেরী করা সরকারের উচিত হচ্ছেনা।

সরকার সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে চায়। স্বাভাবিক ভাবেই এর মানে দাড়ায় যে সরকার পাকিস্তানকেও সময় দিতে চায়। পাকিস্তান সরকারের কল্পনার চেয়ে অনেক বেশী চতুর ও চক্রান্তকারী। তারা কতটুকু নীচে নামতে পারে সেটা চিন্তাও করা যায়না। সরকারের সময়ক্ষেপণের সুযোগে তারা সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করবে এবং বিপ্লব গুড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশে নিজেদের পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা করবে। সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টি করে হিন্দুদের দেশ ছাড়া করবে, যার ফলে ভারতেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রিতী বিনষ্ট হবে এবং আন্তর্জাতিক সমস্যা দেখা দেবে। সরকার সময় চায়। তারা কি মনে করে যে এই লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু এক ধরনের জড়বস্তু? তারাও মানুষ, তাদেরও রাগ, উদ্বেগ ও অন্যান্য অনুভূতি আছে। নয়াদিল্লী থেকে চাপিয়ে দেয়া নির্দেশের মাধ্যমে তাদের সবসময় নিয়ন্ত্রণ করা যাবেনা। ইতিমধ্যেই অনেক ধরণের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়েছে। অনেক জায়গায় এলাকাবাসী এবং শরণার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিচ্ছে। এধরণের ঘটনা ঘটতেই থাকবে এবং আমাদের জন্য একটা বিশাল সমস্যার সৃষ্টি করবে। সুতরাং এই সময়ক্ষেপণ পাকিস্তানের নয়, আমাদের জন্য ক্ষতির কারণ হবে। এই সময়ক্ষেপণ পাকিস্তানকে আরো ষড়যন্ত্র করার এবং আমাদের জন্য আরো সমস্যা সৃষ্টি করার সুযোগ করে দেবে।

পদক্ষেপ নেবার কথা আর কি বলব, গণহত্যা থেকে শুরু করে সাম্প্রদায়িক সংঘাত, পাকিস্তানের নেয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক পদক্ষেপের উপযুক্ত প্রতিক্রিয়া পর্যন্ত আমাদের সরকার দেখায়নি। আমি বলতে চাই যে পাকিস্তান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম বিনষ্ট করার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে এবং কিছু করা দূরে থাক, আপনারা এ ব্যাপারে কোন প্রতিক্রিয়া পর্যন্ত দেখাতে চান নি।

সরকার শুধু মাত্র একটা পদক্ষেপ নিয়েছে। বিশ্ব বিবেক জাগ্রত করার লক্ষে শ্রী শরণ সিং এবং আরো কয়েকজন মন্ত্রীকে বিভিন্ন দেশে পাঠিয়েছে। নিজেরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে তারপর বিভিন্ন দেশে দূত পাঠিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার জন্য জনমত গড়ে তোলাটাই কি সঠিক পদক্ষেপ হত না? সেটা বিশ্বের অনেক দেশকে নিজের নীতি নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবতে বাধ্য করত। আমাদের সরকার ভাল করেই জানে যে পাকিস্তান ধ্বংস হয়ে যাক, এটা বিশ্বের কোন পরাশক্তিই চায়না। তারা বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করে পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে চায়। যুক্তরাষ্ট্র কি চায়? আজকের সংবাদপত্রেও আছে যে তারা ভারতকেই সংযম প্রদর্শন করতে বলছে। পাকিস্তানের মত খুনি, কসাই একটি রাষ্ট্র, যারা বাংলাদেশে গণহত্যা চালাচ্ছে, মা-বোনদের অপহরণ করে নিয়ে নির্যাতন করছে- সেই পাকিস্তানের সাথে তারা ভারতকে এক পাল্লায় মাপতে চায়।

যেহেতু আপনারা স্বীকৃতি দেননি, শ্রী শরণ সিং দেশে দেশে যেয়ে স্বীকৃতি চাইতে পারছেন না। তিনি শুধু উদ্বাস্তু সমস্যা তুলে ধরতে পারছেন, কিন্তু মূল সমস্যাটা বিশ্ব জনমতের কাছে উপযুক্তভাবে উপস্হাপন করা যাচ্ছেনা। আপনারা বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের ব্যাপারেও বিশ্বের কাছে কোন দাবী জানাতে পারছেন না। আপনারা শুধু বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, আর ইতিমধ্যে আমাদের দেশ উদ্বাস্তুদের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে।

আপনারা ভুল পথে অগ্রসর হচ্ছেন। বিশ্বের কাছে দৃঢ়তার মূল্য আছে। সময়ক্ষেপণ না করে আত্নবিশ্বাসের সাথে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে দিলে অন্তত যুগোস্লাভিয়ার মত কিছু দেশ আমাদের অনুসরণ করে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করে নিত।

আরেকটি ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। শ্রী শরণ সিং শুধু বাংলদেশকে স্বীকৃতি দেবার বিরোধিতাই করেন নি, বরং এই ব্যাপারে কোন ইতিবাচক ভূমিকা নিতেই অসম্মত ছিলেন। এই ভদ্রলোক যখন সরকারী মুখপাত্র হিসাবে অন্য একটি দেশের রাষ্ট্র প্রধানের সাথে আলোচনা করবেন, তার নিজের চিন্তাধারা কি সেখানে প্রভাব ফেলবে না? আর তিনি কি নিয়ে কথা বলবেন? মুক্তিফৌজ আর আওয়ামী লীগ যেখানে বলছে যে দুনিয়ার কোন শক্তিই পাকিস্তান আর বাংলাদেশকে আবার একত্রিকরণ করতে পারবেনা, সেখানে কি তার পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে আর কোন রাজনৈতিক সমাধান খোঁজার সুযোগ আছে? আমি কোন কঠিন ভাষা ব্যাবহার করতে চাইছিনা, কিন্তু সরকারী মুখপাত্ররা আযৌক্তিকভাবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামো বহাল রেখে সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছেন।

আমাদের মাননীয়া প্রধাণমন্ত্রী সেদিন সংসদে বলেছেন যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৃত্যু আমাদের সরকার মেনে নেবে না। কিন্তু আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে তাঁর সরকার আন্তর্জাতিক রাজনীতির কূটচালের শিকার হয়ে বিভিন্ন রকম চাপের মুখে এই সংকটের রাজনৈতিক সমাধান খুঁজতে বাধ্য হচ্ছে। প্রধাণমন্ত্রী বাংলাদেশের মৃত্যু চান না, কিন্তু অন্তর্জাতিক রাজনীতির বলি হয়ে শ্রী শরণ সিং বাংলাদেশের মৃত্যু পরোয়ানায় সাক্ষর করতে বাধ্য হচ্ছেন।

মুক্তিফৌজ ও আওয়ামী লীগ বার বার বলছে যে সমস্যার একমাত্র রাজনৈতিক সমাধান বাংলাদেশ থেকে অবিলম্বে পাকিস্তানী সেনা প্রত্যাহার করা এবং নির্বাচিত সরকারকে নিজের দেশে একটি সার্বভৌম সংসদ গঠন এবং সংবিধান প্রণয়ন করতে দেয়া। এটিই একমাত্র সমাধান, এর কোন বিকল্প নেই। পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামো বহাল রেখে কোন সমাধান হতে পারেনা। ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমি আপনাকে সাবধান করে দিতে চাই। আমি অনেক মুক্তিযোদ্ধার সাথে কথা বলেছি। আপনাকে মনে রাখতে হবে, এই মুক্তিযোদ্ধারা আওয়ামী লীগ বা আন্য কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য নয়। তারা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, সাবেক পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস, আনসার এবং পুলিশ থেকে নিযুক্ত। আপনাকে আরো মনে রাখতে হবে যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৫০% সদস্যকে ২৫ মার্চের রাতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। আপনারা কেউই সীমান্ত এলাকায় জাননি এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মনে পাকিবাহিনীর প্রতি জমে থাকা ঘৃণা অনুভব করতে পারেন নি। বাংলাদেশী কিছু অফিসার, যারা যুদ্ধে বাবা-মা-নিকটজন হারিয়েছেন, বলছেন যে সরকার যদি পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে থেকে কোন সমঝোতা করে, তবে সেই সরকারকে উৎখাত করা হবে। পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠমোর মধ্যে থেকে কোন সমাধান মুক্তিফৌজ ও জনগণ মেনে নেবে না। পাকিস্তান এখন মৃত, বাংলাদেশই তাদের দেশ। স্বাধীন বাংলাদেশ এখন বাস্তবতা।

আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি যে শুরুতে বাংলাদেশের ব্যাপারে উৎসাহী থাকলেও এখন কোন বিচিত্র একটা কারণে আমাদের সরকার দ্বিধাগ্রস্ত এবং বিভ্রান্ত। আমাদের সরকারের অবস্হা এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়- দ্বিধাগ্রস্ত থেকে বিভ্রান্ত, বিভ্রান্ত থেকে কৌশলী, কৌশলী থেকে হতবুদ্ধি এবং পরিশেষে কোন রকমে পলায়নের চেষ্টা। আমার মনে হয় শুধুমাত্র দেশবাসী এবং বাংলাদেশের জনগণকে শান্ত রাখার জন্য তারা মুখে কিছু সাহসী এবং ইতিবাচক কথা বলছেন।

এই অবস্থা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমি কিছু বলার ভাষা পাচ্ছিনা। হয়তো তারা কোন বিশেষ জায়গা থেকে সবুজ সঙ্কেত পাচ্ছেন না, যদিও তারা দাবী করেন যে তাদের সব নীতি সম্পূর্নরুপে স্বাধীন।

এর মধ্যে আরো বিপজ্জনক ঘটনা ঘটছে, আমি জানিনা সংসদে এই ব্যাপারটা তুলে ধরব কিনা। মানুষের মধ্যে নানা রকমের আলোচনা হচ্ছে, বিভিন্ন রকম গুজব ছড়াচ্ছে।

আমি সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে ১৯৫০ সালে আমিই প্রথম ব্যাক্তি যে ঢাকা থেকে পালিয়ে সোজা এখানে এসে পন্ডিতজীর সাথে দেখা করি…..

স্পীকার মহোদয় : শ্রী সমর গুহ, আপনি অনেক সত্য কথা তুলে ধরছেন। । কিন্তু আপনার একটু সতর্ক হওয়া উচিত।

শ্রী সমর গুহ: সেজন্যই আমি সব খুলাখুলি বলছিনা। আমি বলছি যে বাজারে নানা রকমের গুজব ছড়াচ্ছে, সরকারের উচিত পরিষ্কার করে কথা বলা।

শ্রী এস.এম.ব্যানার্জী (কানপুর): মাননীয় স্পিকার, আমি কি একটা কথা বলতে পারি? আমি শ্রী সমর গুহের বক্তব্যের মর্ম উপলব্ধি করতে পারছি। তিনি আবেগের বশবর্তী হয়ে অনেক কথা বলেছেন। আমার মতে তাঁর সব কথা সংবাদপত্রে যাওয়া উচিত না, বিশেষ করে সেনাপ্রধাণ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য।

শ্রী ইন্দ্রজিত গুপ্ত( আলীপুর): আমি আরেকটু বড়িয়ে বলতে চাই যে এই বক্তব্যের কোন রেকর্ডই থাকা উচিত না। এগুলোর কিছুই আমার জানা ছিলনা।

শ্রী সমর গুহ: এগুলো কারোই জানা ছিলনা।

শ্রী ইন্দ্রজিত গুপ্ত: এগুলো আসলেই ঐতিহাসিক সত্য কিনা সেটাই আমার জানা নেই।

শ্রী সমর গুহ: কোন প্রটোকলের অপেক্ষা না করে লিয়াকত আলীকে করাচী থেকে দিল্লীতে উড়িয়ে আনা হয়েছিল। আমার এটা জানা আছে।

শ্রী এস.এম.ব্যানার্জী (কানপুর): ১৯৫০ সালে পন্ডিতজী পাকিস্তানের সাথে সুসম্পর্কে বিশ্বাসী ছিলেন। সারা পৃথিবীরই এটা জানা আছে। এই বক্তব্য রেকর্ডে থাকা উচিত না।

স্পীকার মহোদয় : শ্রী সমর গুহ, আমরা এই ব্যাপারে একমত যে আমরা বাংলাদেশকে সমর্থন করি এবং এর কোন ক্ষতি চাইনা। কিন্তু আমি যদি এই বক্তব্য রেকর্ডে রাখি, আমি জানিনা এটি কিভাবে ব্যাবহৃত হবে। আমার মনে হয় আমি এটি রেকর্ড থেকে মুছে ফেললে আপনি আপত্তি করবেন না।

শ্রী সমর গুহ: আমি চাইনা আমার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান অন্য সবার মতের উর্ধে থাকুক। সংসদ যদি মনে করে এটি রেকর্ডে থাকা উচিত না, তবে তাতে আমার আপত্তি নেই। আমি শুধু বলব, আমাদের নেতৃবৃন্দের ব্যাখ্যা দেয়া উচিত যে কেন তারা কোন ব্যাবস্হা নিচ্ছেন না। কি পরিস্থিতি, বা কি কি বিষয় সমূহের উপর ভিত্তি করে তারা স্বীকৃতি দেবার সঠিক সময় নির্ধারণ করবেন, সেটা পরিষ্কার করে সংসদকে জানানো উচিত।

আমার মনে হয় সরকার কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত কারণ তারা মনে করছে যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে সেটা পাকিস্তানের সাথে সশস্ত্র যুদ্ধের কারণ হবে। কিন্তু পৃথিবীতে অনেক দেশই এরকম পরিস্থিতিতে প্রতিবেশী দেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে, কিন্তু তার কারণে তাদের যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হয়নি। যদি তাও হয়, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়, এর মুখোমুখি হওয়া ছাড়া অন্য কোন সম্মানজনক রাস্তা আছে কিনা সেটি আমার জানা নেই। পাকিস্তান ইতিমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ২১/২ ডিভিশন সৈন্য বাংলাদেশে নিয়ে এসেছে। ফলে এই অঞ্চলের সামরিক ভারসাম্য বিনষ্ট হয়েছে। আপনারা জানেন যে পাকিস্তানের উপর অর্থনৈতিক চাপ বাড়ছে, বিশ্বশক্তিরাও তাদের উপর কূটনীতিক চাপ বৃদ্ধি করছে। এসময় তাদের সাথে একটি সামগ্রিক যুদ্ধ বাধার সম্ভাবনা খুবই কম। আর যুদ্ধ লাগলেও সেটা ভারতের তুলনায় পাকিস্তানের জন্য অনেক বেশী ক্ষতির কারণ হবে।

আরেকটি আশঙ্কার কথা বলতে হচ্ছে। দেশে এমন একটি প্রপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে যে অর্থনৈতিক চাপ সহ্য করতে না পেরে পাকিস্তান ভেতর থেকে নিজেই ধ্বংস হয়ে যাবে। এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।

শ্রী এস.এম.ব্যানার্জী : যতক্ষণ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র তাদের সাহায্য করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এটা হবে না।

শ্রী সমর গুহ: শুধু যুক্তরাষ্ট্র না, যুক্তরাজ্য সহ আরো দেশ আছে, যারা মনে করে পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থায়ই থাকা উচিত। তারা পাকিস্তানের অর্থনীতিকে ভেঙে পড়তে দেবেনা।

সরকারের আরেকটি আশঙ্কা আছে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার কারণে কোন যু্দ্ধ লাগলে চীনও তাতে জড়িয়ে পড়তে পারে। আমি বলতে চাই যে সরকার খুব বড় ভুল করছে। সরকার পৃথিবীর ছোট-বড় প্রায় সব দেশে দূত পাঠিয়েছে, আমি জানিনা তারা বাংলাদেশের ব্যাপারে কেন চীনের সাথে আলোচনা করছেনা। চীনের সাথে একটি নীতিগত অস্ত্র আমাদের সাথে আছে, কারণ গত ২৫ বছর ধরে চীন একটি প্রপাগান্ডা ছড়ানোর চেষ্টা করছে যে তারা বিশ্বের সব মুক্তিকামী মানুষের প্রতিই তাদের সমর্থন আছে। তাদের এই বক্তব্যের সুযোগ নিয়ে সরকারের উচিত বাংলাদেশ বিষয়ে তাদের সাথে আলোচনার চেষ্টা করা। আরেকটা ব্যাপার লক্ষ করা যায় যে চীন সরাসরি বাংলাদেশের ব্যাপারে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে একটি কথাও বলেনি। পাকিস্তানের সমর্থনে তারা কিছু কথা বলেছে, কিন্তু বাংলাদেশ বিষয়ে তারা মুখ বন্ধ রেখেছে।

শ্রী এম.রাম গোপাল রেড্ডি (নিজামাবাদ) : তারা বলেছে যে তারা পাকিস্তানের আখন্ডতা রক্ষা করতে চায়।

শ্রী সমর গুহ: এ ব্যাপারে তাদের কোন সরকারী বক্তব্য অন্তত আমার চোখে পড়েনি। যখন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের সাথে সাক্ষাত করতে চীনে গিয়েছিলেন, তখন চীনের তরফ থেকে বলা হয়েছিল যে চীন কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানের সাথে থাকবে। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপারে তারা একটি কথাও বলেনি।

শ্রী পি.কে.দেও (কালাহাঁড়ি ): তারা পাকিস্তানকে গান বোট দিয়েছে।

শ্রী সমর গুহ: সেটা তারা করবে। আমেরিকা থেকে শুরু করে রাশিয়া, সবাই এটা করছে। রাশিয়া পর্যন্ত চট্টগ্রামে একটি কারখানা স্হাপনের জন্য তাদের ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি দিয়েছে। আর পাকিস্তান বাংলাদেশে যেসব গানবোট ব্যাবহার করছে, সেগুলো আমেরিকা, ফ্রান্স ও অন্যান্য আরো দেশ থেকেও এসেছে, শুধু চীন থেকে নয়। চীনের ২য় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী রাজনীতির ব্যাপারে আমি সংসদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। ১৯৫০ সালের পর আমেরিকা চীনের প্রধান সাম্রাজ্যবাদী শত্রু ছিল। কিন্তু এখন চীন আমেরিকার মাধ্যমে জাতিসংঘের সদস্য হতে চাইছে।

শ্রী এস.এম.ব্যানার্জী : পিং পং কূটনীতি।

শ্রী সমর গুহ: স্পীকার মহোদয়, কূটনীতির দিক দিয়ে চীন অত্যন্ত অভিজ্ঞ এবং রক্ষণশীল। তারা খুব সহজে তাদের নীতি পরিবর্তন করেনা। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের এই নীতির পরিবর্তন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে খুবই গুরত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য তারা এখন যুক্তরাষ্ট্রের নৈকট্য লাভ করতে চাইছে। কিন্তু তারা আবার ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়াতেও সরাসরিভাবে যুক্ত। এসব দেশকে তারা সাহায্যও করছে। সুতরাং তারা পাকিস্তানকেও সাহায্য করবে, কিন্তু নিজেদের স্বার্থ বাদ দিয়ে নয়। নিজেদের জাতীয় স্বার্থ বাদ দিয়ে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নতুন পাওয়া বন্ধুত্ব ভুলে গিয়ে শুধু পাকিস্তানকে সাহায্য করার জন্য তারা পূর্ব বাংলার যুদ্ধে নিজেদের জড়াবে, এটি খুবই ভুল ধারণা। কূটনৈতিক কারণে হলেও আমাদের উচিত চীনের সাথে আলোচনার চেষ্টা করা।

বাংলাদেশকে এই মুহূর্তে স্বীকৃতি দেয়া উচিত। শুধুমাত্র এই একটা উপায়েই তাদের সাহায্য করা যায়। তাদের অস্ত্রের দরকার নেই, কিন্তু তারা এই সাহায্যটা চায়, স্বীকৃতি চায়। আপনারা যদি সীমান্ত এলাকায় যান, তাহলে দেখবেন দেশের স্বাধীনতার জন্য হাজার-হাজার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত। মুক্তিবাহিনী বীরত্বের সাথে পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করছে। খুব অল্প পরিমাণ রসদ সম্বল করে তারা একটি প্রশিক্ষিত বাহিনীর সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের স্বীকৃতি তাদের মনে নতুন আশা জাগাবে, মনোবল অনেক গুণে চাঙা করে তুলবে। মুক্তিবাহিনী পাক সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে দিয়েছে। সংবাদপত্রে এসেছে যে তারা ঢাকাতে পর্যন্ত ঢুকে পড়েছে। তারা ঢাকা বিমানবন্দরে হামলা চালিয়েছে, একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র উড়িয়ে দিয়েছে।

আমাদের প্রধাণমন্ত্রী জনগণের সামনে নিজের একটি ভাবমূর্তি দাঁড় করিয়েছেন, অত্যন্ত শক্তিশালী, অকুতোভয় একটি ভাবমূর্তি। সর্বশক্তিমান ভাবমূর্তি।

শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ি ( গোয়ালিয়র): এখন সেই ভাবমূর্তির কি অবস্হা?

শ্রী সমর গুহ: আমি তাঁকে ক্ষুব্ধ করতে চাইনা। বিরোধী দলে থেকে আমরা জনমত গড়ে তুলতে পারি, সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা শুধু মাত্র মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীরই আছে। আমি শুধু সরকারী দলের সাংসদদের বলতে চাই, আপনারা জনগন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন। দিনে দিনে প্রধাণমন্ত্রীর ভাবমূর্তি ভীরু এবং কাপুরষতায় বদলে যাচ্ছে।
জনৈক সাংসদ : শ্রী বাজপেয়ি উনাকে প্ররোচিত করেছেন।

মাননীয় স্পীকার : এই প্রস্তাবে কিছু সংশোধনী আছে। যারা সংশোধনী উত্থাপন করতে চান, তারা সেটা করতে পারেন।

শ্রী এস.এম.ব্যানার্জী : আমি একটি সংশোধনী উত্থাপন করতে চাই।

” প্রস্তাবে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেয়া হোক এবং স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সব ধরণের সহায়তা করা হোক’

এর পরিবর্তে ‘ ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে ৩০-০৬-১৯৭১ এর পূর্বে স্বীকৃতি দেয়া হোক এবং স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সব ধরণের সহায়তা করা হোক’ ব্যাবহার করা উচিত।

শ্রী সমর গুহের প্রস্তাবে আবিলম্বে স্বীকৃতি দেয়া হোক, এই কথাটি বলা হয়েছে। অবিলম্বে বলতে আজকের দিনও বোঝা যেতে পারে, আবার তিন মাস পরের একটি দিনও বোঝা যেতে পারে। আমি একটি নির্দিষ্ট তারিখ ব্যাবহার করতে চাই, যাতে করে ১ জুলাই থেকে তারা সব ধরণের সাহায পেতে শুরু করে। আমি আশা করি আমার মাননীয় সহকর্মী সংশোধনীটি গ্রহণ করবেন, কারণ তিনি অবিলম্বে বাংলাদেশের স্বীকৃতি চান।

শ্রী বিভূতি মিশ্র ( মোতিহারী): সিদ্ধান্তের শেষে এটি জুড়ে দেবার জন্য আমি প্রস্তাব করছি:
” এবং বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আন্তরিক সহানুভূতি প্রকাশ করছে এবং এই কামনা করছে যে তারা যেন শীঘ্রই নিজেদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাফল্য লাভ করে। তাদের ত্যাগ ও নিষ্ঠার প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছে এবং আশা করছে যে বিশ্বরাষ্ট্রসমূহ তাদের পূর্ণ মর্যাদা দেবে। তারা সরকারকে অনুরোধ জানাচ্ছে যে বর্তামান পরিস্হিতি পর্যবেক্ষণ করে সে যেন প্রয়োজনীয় এবং উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করে। “

স্পীকার মহোদয়: এই সংশোধনীগুলো এখন সংসদের সামনে পেশ করা হল।
শ্রী কৃষ্ন হালদার ( অশুগ্রাম) : মাননীয় স্পীকার, আমি আমার মাতৃভাষা বাংলায় কিছু কথা বলতে চাই। এটি ভারতীয় সরকার এবং জনগণের জন্য অত্যন্ত লজ্জার ব্যাপার যে বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কোন প্রস্তাব না আসায় বিরোধী দলের পক্ষ থেকে স্বীকৃতি প্রস্তাব উত্থাপন করতে হচ্ছে। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে বাংলাদেশে কি হচ্ছিল এটা সমগ্র বিশ্ববাসী জানে। বর্তমান বাংলাদেশে- যেটি আগে পূর্ব পাকিস্তান নামে পরচিত ছিল, পাকিস্তানের জনসখ্যার শতকরা ৬০ ভাগ মানুষ বাস করত এবং তারাই পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। এটিও সবাই জানেন যে সংখ্যাগুরু মানুষের ভাষা হওয়া সত্বেও নিজেদের মাতৃভাষার সরকারী স্বীকৃতি আদায়ের জন্য বাংলাদেশের মানুষকে আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছিল। তারা চেয়েছিল তাদের ভাষার সরকারী স্বীকৃতি দেয়া হোক এবং অফিস-আদালতে বাংলা ভাষার ব্যাবহার চালু করা হোক।
পূর্ব বাংলার পাট বিক্রি করে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা কোটি কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে আসছে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলার মানুষ পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী কতৃক অর্থনৈতিক শোষণের শিকার হয়ে আসছে। বাংলার মানুষ তাদের সাংবিধানিক এবং গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলার মানুষ প্রথমবারের মত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শোষনের প্রতিবাদে ঐক্যবদ্ধ হয়, কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সেই আন্দোলন দমনের জন্য শক্তিপ্রয়োগের পথ বেছে নেয় এবং শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাঙালীকে দাবী আদায় করে নিতে হয়।

আইয়ুব খানের পতনের পর সামরিক শাসকেরা আবার বাংলার মানুষকে তাদের সাংবিধানিক এবং গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা চালায়। এমনকি তাদের সামান্যতম নাগরিক অধিকার পাওয়া থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা হয়; সুতরাং নিজেদের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষায় বাঙালীকে আবার সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পথ বেছে নিতে হয়। নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পর বাংলাদেশের মানুষ যখন নিজেদের হারানো অধিকার ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন দেখছিল, ঠিক সেই সময় পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী তাদের উপর সেনাবাহিনী লেলিয়ে দেয়। স্পীকার মহোদয়, এটাও সবাই জানেন যে সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কাল্পনিক অভিযোগে গ্রেফতার করে কোন বিচার ছাড়াই আটকে রাখা হয়েছে।
স্পীকার মহোদয়, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে বাঙালী অনেক রক্ত দিয়েছে। অনেক মানুষ ইতিমধ্যে শহীদ হয়েছেন। সমগ্র বিশ্ববাসী দেখছে যে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে বাংলাদেশের জনগণ নিজেদের দাবী আদায় করে নিচ্ছে। তারা বিশ্ববাসিকে দেখিয়ে দিচ্ছে যে সামরিক আগ্রাসন সবসময় জয়ী হতে পারেনা। যে জাতী রক্তের বিনিময়ে হলেও নিজেদের অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ, পৃথিবীর কোন শক্তিই তাদের হারাতে পারেনা। আইয়ুব খানের দমননীতির বিরুদ্ধে দাড়িয়ে নিজেদের অধিকার আদায়ে বাঙালীকে কত রক্ত দিতে হয়েছে সেটা সবাই জানে।

ভোটের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ গণতন্ত্রের পক্ষে রায় দিয়েছে। নজিরবিহীন এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ শুধু পূর্ব বাংলায়ই নয়, সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ছয় দফার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী প্রচার চালায়। তারা পাকিস্তান থেকে আলাদা হতে চায়নি, তারা স্বায়ত্তশাসন চাইছিল। তারা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অর্থনৈতিক বঞ্চনার অবসান চাইছিল। বাংলার মেহনতি মানুষের কষ্টের সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হয়ে যাচ্ছিল। নিজেদের কষ্টে অর্জিত সম্পদে পূর্ব বাংলার মানুষ নায্য হিস্যা পাচ্ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকেরা পূর্ব বাংলাকে মূলত নিজেদের উপনিবেশ হিসাবে বিবেচনা করছিল। একারণেই বাংলার মানুষ এই অর্থনৈতিক শোষনের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ায়। তাদের দাবী ছিল শুধুমাত্র পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষা ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলাকে স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। কিন্তু তাদের এই নায্য দাবী না মেনে তাদের বিরুদ্ধে যেভাবে আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত একটি সামরিক বাহিনী নামিয়ে গনহত্যা চালানো হচ্ছে, তার নজির ইতিহাসে বিরল। ইতিমধ্যে ৫ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছে। মানব সভ্যতার সাথে এরকম বিশ্বাসঘাতকতার নজির সম্ভবত ভিয়েতনাম ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও পাওয়া যাবেনা।

স্পীকার মহোদয়, আমার দল সি.পি.এম বিশ্বাস করে সংসদীয় গণতন্ত্রের উপর হুমকি কখনো জনসাধারণ থেকে আসেনা, আসে সরকারী দলের তরফ থেকে। সরকারী দল যখন দেখে সংসদীয় গণতন্ত্রে তাদের স্বার্থ সিদ্ধির হাতিয়ার হিসাবে ব্যাবহার করা যাচ্ছেনা, তারা সেটা ধ্বসংস করে দেয়ার চেষ্টা চালায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঠিক এই ব্যাপারটা ঘটেছে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বুঝতে পেরেছে যে গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত একটি সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করলে তারা আর পূর্ব বাংলায় শোষণ চালিয়ে যেতে পারবেনা, একারণে তারা পাকিস্তানের সংসদীয় গণতন্ত্রকে জন্মের আগেই গলা টিপে মেরে ফেলতে চাইছে।

আমাদের পার্লামেন্টে যে প্রস্তাবটা পাশ হয়েছে, সেটি মূলত সরকারের উপর বিরোধী দলের চাপের কারণ। সবগুলো বিরোধীদলের ঐক্যবদ্ধ দাবীর সামনে সরকারকে নতি স্বীকার করতে হয়েছে। সংসদে যখন প্রস্তাবটা উঠে, তখন সব বিরোধী দল একযোগে বাংলাদেশকে সব ধরণের সাহায্য-সহযোগীতা করার দাবী জানায়। কিন্তু সেসময় সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আংশিক সাহায্য দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। আমরা আশা করছিলাম যে খুব তাড়াতাড়ি সরকার সর্বাত্তক সহায়তা করার ঘোষণা দেবে, কিন্তু ২৫ মার্চের পর আড়াই মাস হয়ে গেলেও এ ব্যাপারে সরকার কোন পদক্ষেপই নেয়নি। আমাদের সবধরণের সমর্থন থাকা সত্বেও নিজে স্বীকৃতি না দিয়ে সরকার বরং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার অনুরোধ জানাচ্ছে। উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানের আশায় আমরা প্রতিটি দেশের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছি। সরকার যদি উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান আসলেই চায়, তাহলে তাদের অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হবে। এই স্বীকৃতি দেয়া হলে শরণার্থীরা দেশে ফিরে যাবার ব্যাপারে আস্হাশীল হবে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম নতুন দিকে মোড় নেবে এবং আরো বেশী মানুষ সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া ছাড়া এই উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধানের আর কোন রাস্তা নেই। সরকার অন্য উপায়ে এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু ইতিমধ্যে ৫৫ থেকে ৬৫ লক্ষ উদ্বাস্তু ভারতে ঢুকে পড়েছে এবং আমার মতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে স্বীকৃতি দেয়াই এই সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায়। বাংলাদেশের মানুষের সাথে আমাদের রক্তের সম্পর্ক। আমি শুধু একজন বাঙালী বলে একথা বলছিনা, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমাদের দুই দেশের লোক কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে। দুঃখের ব্যাপার এই যে জাতীয়তাবাদী শক্তির দূর্বলতার সুযোগে ভারত-পাকিস্তান আলাদা হয়ে গিয়েছে। সাম্রাজ্যবাদি শক্তিরা সবসময়ই চেয়েছে যে ভারত-পাকিস্তান নিজেদের মধ্যে লড়াই করতে থাকুক। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতেই ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করে গিয়েছে। ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের লক্ষ মানুষ জীবন দিয়েছে, তাদের সেই মুক্তি সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি। তারা এখনো সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে।

১৮:০০ ঘটিকা

স্পীকার মহোদয়। পশ্চিম বাংলায় ও একই ধরণের সংগ্রাম চলছে। পশ্চিম বঙ্গের মানুষও নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য লড়াই করছে। কেন্দ্রীয় সরকার সেখানে অত্যন্ত বিপজ্জনক নীতি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। তারা সেখানে জনগণের সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে। সমগ্র রাজ্যে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে এবং বিনা কারণে অনেক মানুষকে গ্রেফতার-হয়রানি করা হচ্ছে। এলাকায় সিআরপি এবং সেনা মোতায়েন করা হয়েছেএবং সিআরপি সদস্যরা বারবার মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হচ্ছে। সরকার যদি আসলেই বাংলাদেশকে সমর্থন করতে চায়, তাহলে পশ্চিম বঙ্গের মানুষের অধিকারও ফিরিয়ে দিতে হবে এবং সিআরপি ও সেনাদের অত্যাচার থেকে তাদের রক্ষা করতে হবে। কিন্তু সরকার অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা বিল পাস করাতে চায়, যে বিল পাশ হলে সমগ্র পশ্চিম বঙ্গ পুলিশী রাজ্যে পরিণত হবে। এই প্রস্তাবের আগে সংসদে কেন্দ্র-রাজ্যের সম্পর্ক সংক্রান্ত আরেকটি গুরুত্বপূর্ন প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। আমাদের দল চায় যে প্রত্যেকটা রাজ্য আরো বেশী করে স্বায়ত্বশাসনের ক্ষমতা লাভ করুক। শুধু তাই নয়, রাজ্য সরকারগুলোকে আরো বেশী অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকার এই দাবী না মেনে নিলে ভারতের ভবিষ্যতে কি আছে তা কেউ বলতে পারবেনা।

সবশেষে আমি বলব, বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেয়া হোক। আমি সমাজতান্ত্রিক এবং এশিয়া-আফ্রিকার দেশগুলোকে অনুরোধ করব তারাও যেন কাল বিলম্ব না করে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। সেইসাথে আমি বিশ্বের প্রগতিশীল শক্তিগুলোকে অনুরোধ করব, তারা যেন বাংলাদেশী মুক্তিযোদ্ধাদের সব ধরণের সমর্থন দেন এবং স্পেনে ফ্যাসিবাদি শক্তির সাথে লড়াই করার সময় যে অন্তর্জাতিক মৈত্রি গড়ে উঠেছিল, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও যেন তাই হয়।

স্পীকার মহোদয়, শরণার্থী শিবিরে থাকা অসংখ্য মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অন্য দেশগুলো কি ভুমিকা রাখছে সেটা আমাদের বিবেচ্য বিষয় নয়, বাংলাদশের স্বাধীনতা সংগ্রাম আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কারণ তাদের সাথে আমাদের রক্তের সম্পর্ক। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আমরা একসাথে লড়াই করেছি।

স্পীকার মহোদয়, ভারত দাবী করে তারা বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ। এই দাবী সমুন্নত রাখার জন্য হলেও আমাদের উচিত বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমে সারা বিশ্বের জন্য একটি উদাহরণের সৃষ্টি করা। আমি জানি, মার্কিন চাপের কারণে আমাদের সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্থীনতায় ভুগছে। অথচ ভারতের কোটি কোটি মানুষ এই একই দাবী করছে। আমার দাবী মেনে নেয়া মানে লক্ষ-কোটি জনতার দাবী মেনে নেয়া। মাননীয় স্পিকার, এই বলে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি।

শ্রী বিভূতি মিশ্র : আমাদের সরকার, আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ গ্রহণ করুন, এইটা আমি চাই। আমাদের আইন প্রণেতারা যে প্রস্তাব পাশ করেছেন তাতে তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করেছেন, তাদের প্রশংসা করেছেন- কিন্তু আসল সিদ্ধান্ত নেবে কেন্দ্রীয় সরকার। এই ব্যাপারে দায়-দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। কারো প্ররোচনায় বা কারো প্রভাবে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত নয়।
আমি সরকারের কাছে বিনীতভাবে আবেদন করছি, সরকার ভেবে-চিন্তে অগ্রসর হোন, কেননা এ ব্যাপারে জবাবদিহী করতে হবে আমাদেরকেই। যাঁরা সামনে বসে আছেন, তাঁরা যদি আজ ক্ষমতায় চলে আসেন তবে তাঁদের কথাও বদলে যাবে। তাঁরা যদি ক্ষমতায় থাকতেন তবে অন্য কথা বলতেন। যেহেতু বিরোধী দলে আছেন তাই এরুপ ভাষা ব্যাবহার করছেন। কংগ্রেস সমর্থকেরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে লড়েছেন, এজন্য আমরা স্বাধীনতার মূল্য জানি এবং অন্যের স্বাধীনতার মূল্য বুঝি। সুতরাং, ভেবে-চিন্তে অগ্রসর হওয়া চাই, রাজা-মহারাজাদের খপ্পরে পড়া উচিত নয়।

শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী : আমি শ্রী সমর গুহকে ধন্যবাদ জানাই, তিনি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে প্রস্তাব এনে এই সংসদকে বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্হিতি সম্পর্কে ভাববার সুযোগ করে দিয়েছেন। এই প্রস্তাব সরকারকেও নতুন পরিস্হিতির উপর তার নীতি ব্যাক্ত করার সুযোগ করে দিয়েছে।

স্পীকার মহাশয়, যখন থেকে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এ্যান্হনি মাসকোরেনহাস-এর বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবেদন ছাপিয়েছে, একটি অদ্ভূত অস্হিরতায় সারা দেশ ছেয়ে গেছে। আমি এ্যান্হনি মাসকোরেনহাসকে ধন্যবাদ জানাই। মাসকোরেনহাস-এর মূল বক্তব্য ছিল, বাংলাদেশের ব্যাপারে পাকিস্তানে দুটি বিকল্প রয়েছে: এক, গণহত্যা দুই উপনিবেশিকীকরণ। আমি তার লেখা হতে অংশবিশেষ উদ্ধৃত করতে চাই।

” পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে সরকারী নীতি ঢাকাস্হ ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টারে বসে আমাকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। এর মূল জিনিষগুলো হচ্ছে:

(১) বাঙালীরা নিজেদের অবিশ্বস্ত প্রমাণ করেছে এবং তাদের অবশ্যই পশ্চিম পাকিস্তানী শাসনের অধীনে রাখতে হবে;
(২) বাঙালীদের সঠিক পথে নিয়ে আসতে হবে। গণ হারে ইসলামীকরণের মাধ্যমে বিচ্ছিন্নতাবাদ রোধ করতে হবে এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে শক্তিশালী ধর্মীয় বন্ধন গড়ে তুলতে হবে।
(৩) যুদ্ধ এবং হত্যার মাধ্যমে হিন্দুদের নিচিহ্ন করে দেবার পর তাদের সম্পদ সুবিধাবঞ্চিত মুসলিম মধ্যবিত্তদের মধ্যে বন্টন করে দেয়া হবে। এটা ভবিষ্যতে প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার ভিত্তিপ্রস্তর হিসাবে বিবেচিত হবে।

” বাঙালীরা সব কোথায়? ” ঢাকার জনশূণ্য রাস্তা দেখে আমি আমার সাথে থাকা পথপ্রদর্শককে

জিজ্ঞেস করলাম। উত্তর আসল, ” তারা সব গ্রামে চলে গিয়েছে। ” গ্রামের আশে-পাশে যেয়েও কোন বাঙালী চোখে পড়লনা। ঢাকার মত কুমিল্লা শহরও ছিল নীরব। কুমিল্লা থেকে লাকসাম যাবার পথে ১০ মাইল রাস্তায় যে কয় জন মানুষ দেখা গেল, তাদের বাস্তবিকই হাতের আঙুলে গুনে ফেলা যায়।

কৃষি উন্নয়ন ব্যাঙ্কের চেয়রম্যান মিঃ কুর্নির সাথে তার করাচীস্হ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিস কক্ষে বসে কথা হচ্ছিল। দুর্ভিক্ষ প্রসঙ্গ আসলে তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, ” এই দুর্ভিক্ষ বাঙালীদের অন্তর্ঘাতের ফল। তারা মরুক। এতে যদি তাদের হুঁশ ফেরে। “

আমরা পূর্ব বাংলায় সহায়তা করতে চাই। তার পক্ষে আমরা সর্বসম্মতভাবে প্রস্তাব গ্রহণ করেছি। রাজ্যসমূহের বিধানসভাগুলোও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার আহ্বান জানিয়েছে। প্রধাণমন্ত্রীর ভাষণ আজ দেশকে কোন দিকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে সেটা স্পষ্ট নয়। যে রাজনৈতিক সমাধানের কথা আমরা আলোচনা করছি সেজন্য কি সময় পাওয়া যাবে? পাকিস্তানি শাসকেরা কি তা মেনে নেবে? আমার বন্ধু শ্রী সমর গুহ বলেছেন যে আওয়ামী লীগ সেটা মানবে না। এত অত্যাচারের পর আবার পাকিস্তানের অংশ হওয়া বাংলাদেশের জন্য কঠিন হবে। আমি সে বিষয়ে বলছিনা। পাকিস্তানী শাসকদের কি পথে আনা গেছে? বিশ্বজনমত কি পাকিস্তানি শাসকদের প্রভাবিত করতে পেরেছে? আমি জানতে চাই নয়াদিল্লী হতে যে মন্ত্রী প্রতিনিধিদল বাইরে গিয়েছিলেন, তাঁরা কি নিয়ে ফিরেছেন? বিশ্ব রাজধানীসমূহের প্রতিক্রিয়া কি? বড়জোর তারা শরণার্থীদের সহায়তার জন্য অর্থ দিতে প্রস্তুত আছে কিম্বা মৌখিক সহানুভূতি জাহির করতে তৈরি আছে। যে রাজনৈতিক সমাধানের কথা আমরা আলোচনা করছি- তার অর্থ এই যে, বাংলাদেশে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হবে, বাংলাদেশ উপনিবেশ থাকবেনা, বাংলাদেশ হতে যত শরণার্থী এসেছে সকলে ফিরে যেতে পারবে, তাদের জান-মাল ও সম্মান নিরাপদ থাকবে; এই সমাধানের জন্য কি বিশ্বরাষ্ট্রসমূহ আমাদের সাহায্য করবে? আমিতো কোন সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছিনা। মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্য কি আমি তাই শুনব।

হত্যাযজ্ঞ চলছে এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবেনা। গণহত্যার বিষয়টি কি জাতিসংঘে উপস্হাপন করা যেতনা? ভারত সরকার তা উত্থাপন করে দেখতে পারে। বিশ্বের সমর্থন পেতেই হবে এমন কোন কথা নেই কিন্তু তা করা হলে আমাদের ভূমিকায় আত্নতৃপ্তি থাকত। দ্বিতীয়ত পৃথিবীর কোন দেশ কত গভীর পানিতে অবস্হান করছে তা পরিষ্কার হত। আমাদের নীতি নির্ধারণ করতে সুবিধা হত। নীতি একটিই হতে পারে এবং সেটি হচ্ছে একটি প্রতিজ্ঞা-আজকের বাস্তব অবস্হার সঙ্গে কোন আপোষ নেই। বাংলাদেশে সেই পরিস্হিতির সৃষ্টি করতে হবে যাতে উদ্বাস্তুরা ফিরে যেতে পারে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। সেজন্য যুদ্ধ ছাড়া যদি কোন উপায় না থাকে তবে ভারতের যুদ্ধ করার জন্যও তৈরি থাকতে হবে।

প্রথমেই আমরা দেরী করে ফেলেছি। সরকারের যদি কোন পরিষ্কার ধারণা থাকত এবং ২৫শে মার্চ যখন পাকিস্তানি সৈন্যরা অত্যাচার শুরু করেছিল তখনই যদি আমরা নিজেদের নীতি নির্ধারণ করতাম তাহলে বাংলাদেশের পরিস্হিতি হয়ত অন্যরুপ হত।

আমরা ভুল করেছি। কিন্তু যেটুকু বিলম্ব হয়েছে আমরা তা এখনো শোধরাতে পারি। আমি বিশ্বজনমত জাগ্রত করার বিরোধী নই, সেকাজ চলতে থাকুক কিন্তু নয়াদিল্লীর ধারণা পরিষ্কার থাকা দরকার। বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ থেকে আগত উদ্বাস্তুদের ভাগ্য বিধান ওয়াশিংটন, লন্ডন, বন বা মস্কোতে হবে না, নয়াদিল্লীতে হবে এবং নয়াদিল্লী সাহসের সঙ্গে চললে এক নতুন ইতিহাস লেখা যেতে পারে। আজ আমাদের দেখতে হবে সরকার নতুন ইতিহাস রচনার যোগ্যতা রাখে কিনা।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২২০। পাকিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র প্রেরণ সম্পর্কে পররাষ্ট্র বিবৃতির উপর বিতর্ক ভারতের লোকসভার কার্য বিবরণী ২৪ জুন, ১৯৭১

Hasan Tareq Imam
<১২, ২২০, ৮২৭-৮৩৪>
অনুবাদ

১৬:১৫ ঘটিকা
জরুরী জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ

জাহাজযোগে পাকিস্তানে আমেরিকান অস্ত্র আমদানি সম্পর্কিত সংবাদ

শ্রী আর.বি.বড়ে(খরগোন): স্পীকার মহোদয়, আমি নিম্নলিখিত জনগুরুত্ব সম্পন্ন বিষয়ের প্রতি মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এবং প্রার্থণা করছি যে, এই বিষয়ে তিনি একটি বিবৃতি দেবেন:

গত মার্চ মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কতৃক আরোপিত পাকিস্তানে অস্ত্র বিক্রয়ের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে সুন্দরবন এবং পদ্মা নামের দুটি পাকিস্তানি সমুদ্র জাহাজ যেগুলি যথাক্রমে ৮ মে এবং ২১শে জুন, ১৯৭১ তারিখে আমেরিকা হতে অস্ত্র নিয়ে রওয়ানা হয় সে সম্পর্কিত সংবাদ।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী (শ্রী শরণ সিং): মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাকিস্তানে সামরিক সরঞ্জাম আসা সম্পর্কিত প্রকাশিত সংবাদে সংসদের বাকি সবার মত সরকারও উদ্বিগ্ন। সুন্দরবন এবং পদ্মা নামের দুটি পাকিস্তানি পতাকাবাহী জাহাজ যথাক্রমে ৮ মে এবং ২১শে জুন, ১৯৭১ তারিখে আমেরিকা হতে অস্ত্র নিয়ে রওয়ানা হয়েছে এই মর্মে নিউ ইয়র্ক টাইমসে ২২ জুন তারিখে প্রকাশিত সংবাদ আপাতদৃষ্টিতে সঠিক বলে মনে হচ্ছে।

‘এসময় কিছু সাংসদ সমস্বরে “শেইম, শেইম!” বলে নিন্দা জ্ঞাপন করেন ‘
সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথেই আমাদের রাষ্ট্রদূত যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারী অফ স্টেটের কাছে ২২ জুন সন্ধায় বিষয়টি তুলে ধরেন। ২৩ জুন নয়াদিল্লীতে অবস্হিত মার্কিন দূতাবাসকেও বিষয়টি অবহিত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বক্তব্য অনুযায়ী ২৫শে মার্চের পর থেকে পাকিস্তানি সরকারের কাছে কোন অস্ত্র বিক্রির অনুমোদন দেয়া হয়নি; ২৫ শে মার্চের পর থেকে পাকিস্তানীদের বানিজ্যিকভাবে কোন এক্সপোর্ট লাইসেন্স দেয়া হয়নি এবং কোন লাইসেন্স নবায়নও করা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র সরকার আরো জানিয়েছো অস্ত্রের চালানে ৮ টি জঙ্গীবিমান থাকা সংক্রান্ত নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদটি সঠিক নয়। জাহাজদুটিতে কোন জঙ্গীবিমান ছিলনা। তবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার স্বীকার করেছে যে ২৫ শে মার্চের পূর্বে অনুমোদিত কোন চালান নিউইয়র্ক টাইমসে উল্লেখিত ঐ দুটি জাহাজে উঠানো হয়ে থাকতে পারে। তারা আরো জানিয়েছে যে ২৫শে মার্চের আগে ইস্যুকৃত কোন এক্সপোর্ট লাইসেন্সের ভিত্তিতে বানিজ্যিকভাবে ক্রয়কৃত কোন জিনিষ ঐ জাহাজে থাকতে পারে। আবার কিছু কিছু সরঞ্জাম কেনার জন্য এক্সপোর্ট লাইসেন্সেরও প্রয়োজন পড়েনা। উল্লেখিত দুটি জাহাজে এধরনের জিনিষও থাকার সম্ভাবনা আছে। এসবের উপর ভিত্তি করে যুক্তরাষ্ট্র সরকার জানিয়েছে যে ২৫শে মার্চের পূর্বে অনুমোদিত কাগজপত্রের ভিত্তিতে সংগ্রহিত কোন ধরনের অস্ত্র জাহাজদুটিতে থাকার সম্ভাবনা আছে। যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারী অফ স্টেট আমাদের উদ্বেগকে গুরুত্বের সাথে নিয়েছেন এবং তাদের বানিজ্য ব্যাবস্হার এই ত্রুটির ব্যাপারে দুঃখপ্রকাশ করেছেন। পূর্বে অনুমোদিত এক্সপোর্ট লাইসেন্সের আওতায় কি কি করা যায়, সেই ব্যাপারে তিনি আমাদের বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন। আগের অনুমোদনের উপর ভিত্তি করে এধরনের আরো অস্ত্রের চালান ছাড় করানো সম্ভব হবে কিনা সেটা এখনো জানা যায়নি। আন্ডার সেক্রেটারী মহোদয় জানিয়েছেন যে বিষয়টি তারা পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে দেখছেন এবং এব্যাপারে এই মুহূর্তে মন্তব্য করা সম্ভব নয়।

যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে আমরা জানিয়েছি যে বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণের উপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হত্যা-নির্যাতন চলা অবস্হায় তাদের কোন ধরনের সামরিক শক্তিবর্ধন শুধু উপমহাদেশ নয়, সমগ্র এলাকারই শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত করবে। এই মুহূর্তে পাকবাহিনীকে কোন ধরনের অস্ত্র সাহায্য করার অর্থ হচ্ছে তাদের নির্মমতার অনুমোদেন দেওয়া এবং আরো বেশী নৃশংস হতে তাদের উৎসাহিত করা।

শ্রী এস.এম.ব্যানার্জি (কানপুর): আমরা আপনার থেকে আরো বেশী কিছু আশা করি। গতকাল আমেরিকান দূতাবাস থেকে আমরা আরো কিছু তথ্য পেয়েছি। জাহাজদুটির এখন কি অবস্হা?

এই সময় মন্ত্রীর বক্তব্যে বাঁধা পড়ে

শ্রী শরণ সিং: আপনি ভুল সময়ে আমাকে বাঁধা দিচ্ছেন, আমার বক্তব্য শেষ হয়নি। আমার পরের কথাগুলো শুনুন।

শ্রী এস.এম.ব্যানার্জি: ভবিষ্যতে কি হচ্ছে? সেই ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কি?

শ্রী শরণ সিং: আমি আমার অবস্হান ব্যাখ্যা করছি। আপনি ধৈর্য্য ধরছেননা কেন?

যুদ্ধাস্ত্রবাহী দুটি জাহাজকে থামানোর চেষ্টা করতে এবং পূর্ব অনুমোদনের উপর ভিত্তি করে আর নতুন কোন অস্ত্রের চালান ছাড় দেয়া হবেনা এই ব্যাপারে আমাদের নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে আমরা আহ্বান জানিয়েছি।

আমরা আশা করি যুক্তরাষ্ট্র সরকার, যারা …….এসময় কিছু সাংসদ সমস্বরে “শেইম, শেইম বলে চিৎকার করতে থাকেন।

শ্রী এস.এম.ব্যানার্জি: আপনার লজ্জিত হওয়া উচিত। তারা নির্মভাবে মানুষকে হ্ত্যা করছে আর আপনি শুধু আশা নিয়ে আছেন। আমরা আপনার কাছ থেকে অনেক বেশী কিছু আশা করি। (এই সময় মন্ত্রীর বক্তব্যে আবারও বাঁধা পড়ে)

শ্রী শরণ সিং: আপনি আমাকে বক্তব্য দেয়া থেকে বিরত রাখতে পারেননা। আমি কি বক্তব্য দেব সেটা আপনি ঠিক করে দেয়ার অধিকার রাখেন বলে আমি মনে করিনা। আপনি চিৎকার করে যেতে পারেন, কিন্তু আমার বক্তব্য আপনি নির্ধারন করতে পারেননা। এটা আমার বক্তৃতা, আপনার নয়। আপনি ইচ্ছা করলে যেকোন প্রশ্ন করতে পারেন।

শ্রী শরণ সিং: আমরা আশা করি যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার চেতনা লালন করে, এ দুটি জিনিষ ব্যাহত হয় এরকম কোন কিছু তারা অনুমোদন করবেনা। আজকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা নির্লজ্জভাবে ব্যাহত হচ্ছে, আমরা আশা করি যুক্তরাষ্ট্র সরকার এতে কোন ধরনের সমর্থন দেবেনা। আমাদের প্রত্যাশা এই যে যতদিন পর্যন্ত পাকিস্তানী সামরিকজান্তা বাংলাদেশের নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেনা, ভারতের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে শরণার্থী আসা বন্ধ হবেনা এবং ভারতে অবস্হানরত শরণার্থীরা নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারবেনা; ততদিন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র সরকার পাকিস্তানের কাছে কোন ধরনের সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করবেনা।

শ্রী আর. বি. বড়ে: মাননীয় স্পীকার মহাশয়, মাননীয় মন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে বলেছেন-

“যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে আমরা জানিয়েছি যে বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণের উপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হত্যা-নির্যাতন চলা অবস্হায় তাদের কোন ধরনের সামরিক শক্তিবর্ধন ….”

– আমি জানতে চাই আপনি ‘জেনোসাইড’ শব্দটি কেন ব্যাবহার করেননি? ‘জেনোসাইড’ শব্দের পরিবর্তে আপনি ‘এ্যাট্রোসিটিস’ শব্দটি ব্যাবহার করেছেন, এতে বাইরের দেশ সমূহের উপর কোন ভাল প্রভাব পড়েনি। পার্লামেন্টের বিবৃতিতে জেনোসাইড শব্দটি থাকা উচিত ছিল।

দ্বিতীয় কথা- পাকিস্তানী জাহাজগুলি চলে গেল, আমেরিকা তাদের কেন থামালো না? আপনি আপনার বিবৃতিতে পাকিস্তানী জাহাজগুলোকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য আমেরিকার সাথে কথা বলেছেন কিনা সেটা উল্লেখ করেননি।

তৃতীয় কথা- ঐ জাহাজগুলোতে কি ধরনের মালপত্র ছিল সে ব্যাপারে আমেরিকান দূতাবাস থেকে একটি বিবৃতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমি আপনার কাছে জানতে চাই ঐ জাহাজসমূহে কি কি মাল ছিল, আপনার বিবৃতিতে একথা বলা হয়নি।

চতুর্থ কথা- আপনি বলেছেন তাদের সামরিক সরঞ্জাম দেয়া উচিত নয়, কিন্তু আপনি কি তাদের উপর আর্থিক সাহায্য না দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেছেন? নিউইয়র্ক টাইমস খবর ছেপেছে পাকিস্তানের ঐ জাহাজগুলোতে সামরিক সরঞ্জাম পাঠানো হয়েছে। তারা আমেরিকার অর্থ সাহায্যও পাচ্ছে। এরুপ অগণতান্ত্রিক দেশকে কোন ধরনের আর্থিক সাহায্য দেয়া উচিত নয়- এ বিষয়ে কি আপনি আমেরিকাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন?

পঞ্চম কথা- যখন আপনি পালাম বিমানবন্দরে নামলেন, তখন একবারেই বলে দিলেন
” রিপোর্টটি সঠিক কিনা এ নিয়ে আমি মন্তব্য করতে পারছিনা”

এর অর্থ কি?

শ্রী শরণ সিং: আপনি আমার পুরো বিবৃতি পড়েননি, শুধু এই ছত্রটি উদ্ধৃত করছেন।

শ্রী আর. বি. বড়ে: আমার মনে হয় আমাদের দুতাবাস নিজের কাজে ক্ষিপ্র নয় অথবা যা কিছু সেখানে প্রকাশিত হয় যেমন নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদ, সেসব তথ্য আমাদের রাষ্ট্রদূত পাননা। একারনেই আপনি যখন বিমান বন্দরে আসলেন এবং নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদ আপনার সামনে রাখা হল, তখন আপনি বললেন,
” রিপোর্টটি সঠিক কিনা এ নিয়ে আমি মন্তব্য করতে পারছিনা”

আমি একথাও বলতে চাই যে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে গোপনে লেন-দেন করছে, যার সুস্পষ্ট প্রমাণ সিনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চ-এর বক্তৃতা। ১৭ জুন তিনি অভিযোগ করেছেন যে পাকিস্তানে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করা হচ্ছে, যার উত্তর নিক্সন সরকার এ যাবত দেননি। আপনি যখন আমেরিকা গিয়েছিলেন তখন আমাদের দূতাবাস আপনাকে এই তথ্য কি দিয়েছিল?

শ্রী শরণ সিং: আমি সংক্ষেপে আমার উত্তর দেয়ার চেষ্টা করছি। ‘জেনোসাইড’ শব্দটি ব্যাবহারে আমি প্রস্তুত আছি, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে আমরা ইতিমধ্যে শব্দটি ব্যাবহার করেছি। ‘জেনোসাইড’ শব্দের ব্যাবহার যদি আমার সম্মানিত বন্ধুদের খুশি করে, তবে আমি তাই করব কিন্তু আমি এটাও বলতে চাই যে আমার বক্তৃতায় ব্যাবহৃত শব্দাবলী কোন অংশেই বাংলাদেশের অবস্হাকে খাটো করে দেখাচ্ছেনা।

দ্বিতীয় প্রশ্নে উনি জিজ্ঞেস করেছেন যে যুক্তরাষ্ট্র সরকার কেন জাহাজদুটিকে আটকায় নাই। এর উত্তরে আমি বলতে চাই, আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে ঠিক এই কাজটাই করতে বলছি। আমাদের দাবী হচ্ছে তারা জাহাজগুলো আটক করুক এবং অস্ত্রের চালান যেন পাকিস্তানে না পৌছাতে পারে সেটা নিশ্চিত করুক।

শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ি: তাদের সিদ্ধান্ত কি?

শ্রী শরণ সিং: আমি ইতিমধ্যে আমার বক্তব্যে বলেছি যে তারা এখনো তাদের সিদ্ধান্ত জানায়নি।

উনার তৃতীয় প্রশ্নে উনি জাহাজে সরঞ্জামের একটি তালিকা চেয়েছেন। আমি দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে এই মুহূর্তে সেটি দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা।

শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ি: স্পীকার মহোদয়। বক্তাদের তালিকায় আমার নাম নেই, আমি জোর করে বলতে চাইনা। মন্ত্রী মহাশয়ের হয়তো মনে আছে, ১৯৬৫ সালে আমেরিকার কয়েকটি জাহাজ অস্ত্র নিয়ে আসছিল। সেগুলো ভারতীয় সীমান্তের ১৫ মাইলের মধ্যে থেমেছিল, তাদের থামান হয়েছিল। আমেরিকা যদি চায় তাহলে জাহাজ থামিয়ে দিতে পারে।

শ্রী শরণ সিং: আমি একমত যে আমেরিকা চাইলে এটা করতে পারে। জাহাজ থামানোর সিদ্ধান্ত নিলে তারা সেটা থামাতে পারে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। আমরা তাদের অসম্ভব কিছু করতে বলছিনা। তাদের যেটা করা উচিত আমরা ঠিক সেটিই করতে বলছি।

শ্রী শ্যামানন্দন মিশ্র (বেগুসরাই): তারা কি পাকিস্তানী জাহাজ থামাতে পারে?

শ্রী শরণ সিং: আমি জানিনা তিনি কিভাবে এতটা দ্বিধাগ্রস্ত হতে পারেন।

শ্রী শ্যামানন্দন মিশ্র: তাকে অন্য কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে চাপ দেয়া হোক।

শ্রী শরণ সিং: তালিকার ব্যাপারে দুঃখের সাথে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে পাকিস্তানি জাহাজে কি কি জিনিষ থাকতে সে ব্যাপারে আমাদের কোন ধারনা নেই।

উনার চতুর্থ আলোচ্য বিষযয়ের উত্তর হচ্ছে, পাকিস্তানের অনেকগুলো দাতা রাষ্ট্রের কাছে পাকিস্তান কতৃক বাংলাদেশে অত্যাচার বন্ধ, নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায়ন এবং শরণার্থীদের নিরাপদে ফিরিয়ে না নেয়া পর্যন্ত অর্থ সাহায্য না করতে আমরা জোর আহ্বান জানিয়েছি।

পঞ্চমত, উনি পালাম বিমানবন্দরে দেয়া আমার বিবৃতির সমালোচনা করেছেন। ব্যাপারটা আমি ব্যাখ্যা করতে চাই। আমাকে শুধু একটা ছাপা টেলিগ্রাম দেখিয়ে বলা হয়েছিল যে আমেরিকা থেকে আসা এই টেলিগ্রামে অস্ত্রসরবরাহের খবরটি এসেছে। খবরটি সঠিক কিনা আমাকে জিজ্ঞেস করা হয় এবং আমার প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হয়। আমার উত্তর ছিল আমি এখনো জানিনা খবরটি সঠিক কিনা, আমাকে বিস্তারিত দেখতে হবে। খবরটা যদি সঠিক হয়, তাহলে এটি হবে আমাদের দেয়া সবধরনের আশ্বাসের বরখেলাপ। আমরা সম্পূর্নরুপে এর বিরুদ্ধাচারণ করি। এটি ছিল আমার বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশ, যেটা মাননীয় সাংসদ পড়ে শোনান নি।

ষষ্ঠত উনি বলেছেন যে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে পাকিস্তান এবং আমেরিকার মধ্যে কোন গোপন আঁতাত চলছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের তরফ থেকে আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে যে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের উপর পাকবাহিনীর নির্যাতন, নিপীড়নের কারনে তাদের কোন ধরনের অস্ত্রসরবরাহ করা হবেনা। এর কোন বরখেলাপ হলে আমরা তার নিন্দা জানাই।

শেষ প্রশ্নটি এতই হাস্যকর যে আমি এর উত্তর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করছিনা। আমি শুধু উনার সমালোচনাকে মরা ইঁদুরের সাথেই তুলনা করতে পারি।

শ্রী আর.ভি.বাদে: আপনি কি জেনেছিলেন যে একজন আমেরিকান সিনেটর পাকিস্তান এবং আমেরিকার গোপন আঁতাতের ব্যাপারে সরকারের কাছে চিঠি লিখেছেন?

শ্রী শরণ সিং: আমার এই তথ্য জানা ছিল। যেসব আমেরিকান সিনেটর এবং সংবাদকর্মী এই আঁতাতের ব্যাপারে তথ্যপ্রকাশ করছেন, আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।

শ্রী কমল মিশ্র মাধুকর(কেসরিয়া): স্পীকার মহোদয়, এই বিবৃতি শুনে মনে হয় যে, এটি কোন আত্নসম্মান সম্পন্ন দেশের বিদেশমন্ত্রীর বিবৃতি নয়। মনে হয় এটি একটি অধীন সরকারের বিবৃতি যা আমেরিকা মহাপ্রভুর সামনে বলার সাহস রাখেনা কিমবা তার এই উপলব্ধি নেই যে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ভিয়েতনাম, ইসরাইল, আরব রাষ্ট্র অথবা দক্ষিণ আমেরিকা বিশ্বের সর্বত্রই গণহত্যা চাপিয়েছে এবং গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে। সেই সরকার সম্পর্কে আপনি নিজ বিবৃতিতে বলেছেন যে, আমাদের প্রত্যাশা, গণতন্ত্র এবং আত্ননিয়ত্রণাধিকারে বিশ্বাসী যুক্তরাষ্ট্র সরকার….আমি মনে করি বিদেশমন্ত্রীর এই বিবৃতি মার্কিন সরকারের সঠিক চিত্র প্রতিফলিত করেনা। আপনি এলেন এবং বিমান বন্দরে বিবৃতি দিলেন, তারপরেও সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় যে, আমেরিকা হতে পাকিস্তানের জন্য অস্ত্র বোঝাই জাহাজ আসছে। এর অর্থ এই যে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃবৃন্দের সম্পর্কে আপনার ধারনা ভুল কিমবা স্পষ্টভাষায় বলার সাহস আপনার নেই। এই বিবৃতিতে কোথাও আপনি তাদের নিন্দা করেননি। কোন কঠিন শব্দ প্রয়োগও তাতে করা হয়নি…..এতদিন পরে আপনার বক্তব্যে এসেছে ২৫শে মার্চের পরে সেখানে পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের নতুন কোন সমঝোতা হয়নি, পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহের কোন লাইসেন্স দেয়া হয়নি, কিন্তু তা সত্বেও পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছে এবং সেখান থেকে জাহাজ রওয়ানা হয়ে গেছে। তাহলে আপনার দূতাবাসের কর্মকর্তারা কি কানে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছিল বা আমেরিকান নাইটক্লাব সমূহে ঘুমিয়ে ছিল? তারা কোথায় ছিল যে আপনাকে খবর দিতে পারেনি? যদি না দিতে পারে তাহলে দূতাবাস রেখে কি লাভ?

দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, এভাবে যে অস্ত্র আসছে তা রুখবার জন্য আপনি কি ব্যাবস্হা নিয়েছেন সেকথা পরিষ্কারভাবে বলেননি। আপনি প্রতিবাদ নোট পাঠিয়েছেন, কিন্তু অস্ত্র সরবরাহ না করা নিশ্চিত করতে কি করেছেন?

একদিকে আপনার বিরুদ্ধে অস্ত্র দেয়া হচ্ছে, আপনাকে হুমকি দেয়া হচ্ছে, অন্য দিকে আপনাকে আর্থিক সহায়তা দেয়ার প্রলোভন দেখান হচ্ছে। এই দু-মুখো নীতির ব্যাপারে আপনার বলা উচিত, এরুপ অপমানজনক সহায়তা আমরা নিতে চাইনা। এই দেশের শান্তি এবং বিশ্ব শান্তির জন্য বিপদ ডেকে আনে, এরকম সাহায্যের আমরা ঘোর বিরোধী- একথা দৃঢ়তার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে বলা উচিত।

আপনাকে বলতে হবে, যে পত্র আপনি নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে দিয়েছেন তার প্রতি ঐ সরকারের আচরণ কি।

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিবৃতিতে সত্যতা থাকেনা। ১৯৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বলেছিল যে, পাকিস্তানে যে অস্ত্র দেয়া হচ্ছে তা সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য দেয়া হচ্ছে কিন্তু তা ভারতের বিরুদ্ধে ব্যাবহৃত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যদি বাংলাদেশে কোন রাজনৈতিক সমাধান চায় তাহলে তার ভূমিকা কি এই হবে যে সে পাকিস্তানকে অস্ত্র দেবে? এতে সুস্হ পরিবেশের সৃষ্টি হবেনা।

বাংলাদেশ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি? একদিকে আপনি বলছেন যে তাকেই সাহায্য করবেন, অন্য দিকে তার সমস্যাবলীর অপেক্ষা আমাদের দেশের জন্যই মাথাব্যাথা বেড়ে গেছে, এই পরিস্হিতিতে শেষ পর্যন্ত আপনার সিদ্ধান্ত কি, কিভাবে তাদের সাহায্য করতে চান তা স্পষ্ট করে কেন বলছেন না? আমার মতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে পৃথক ভাবে তাকে সাহায্য দেয়াই বেশী ভাল।

এসব বিষয়ে আমি সরকারের ব্যাখ্যা চাইছি।

শ্রী শরণ সিং: আমি মাননীয় সাংসদকে আশ্বস্হ করতে চাই যে আমরা যুক্তরাষ্ট্র অথবা অন্য কোন দেশের ভয়ে ভীত নই। প্রত্যেক ব্যাপারেই আমাদের নিজস্ব নীতি আছে এবং কোন রাষ্ট্রের আচরণের ব্যাপারে আমাদের মত আমরা পরিষ্কারভাবেই বলি। আমরা অবশ্যই কোন দেশের নির্দেশ মেনে চলব না, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের আচরণের প্রতিবাদে আমাদের বিরোধী দলীয় সাংসদ যেসব শব্দ ব্যাবহার করছেন তা আমি সমর্থন করিনা।

তার কিছু প্রশ্ন শুধুমাত্র তার বক্তব্যের অংশ, সেখান থেকে আমি সতর্কতার সাথে যে সব ক্ষেত্রে আমার কাছে তথ্য চাওয়া হয়েছে তার উত্তর দেয়ার চেষ্টা করব।

উনি জানতে চেয়েছেন মার্কিন সংবাদপত্রে আসার আগে আমাদের দূতাবাস কেন অস্ত্র সরবরাহের তথ্য পেতে ব্যার্থ হল। আমাদের এটা বুঝতে হবে যে যুক্তরাষ্ট্রের মত এত বড় একটা দেশের কোথা থেকে কি পণ্য কোথায় সরবরাহ করা হচ্ছে তার সব কিছু জানা কোন দূতাবাসের পক্ষেই সম্ভব নয়।

শ্রী জ্যোতির্ময় বসু: তারা আমাদের দেশে এই তথ্য সাফল্যের সাথেই সংগ্রহ করে।

শ্রী শরণ সিং: আপনার হয়তো গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের ভাল কোন উপায় আছে।

শ্রী জ্যোতির্ময় বসু: আমি বলেছি “তারা”। আমাদের দেশে আমেরিকানদের শক্তিশালী গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক আছে।

শ্রী শরণ সিং: আপনি হয়তো ঠিক, হয়তো অন্য দেশেরও এরকম শক্তিশালী নেটওয়ার্ক আছে। আমরাও যতটুকু সম্ভব তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করি।

এবং আমরা নিজেদের ব্যাপারে যতটুকু সম্ভব সতর্ক থাকার চেষ্টা করি।

একজন মাননীয় সাংসদ: কিন্তু আপনারা কোন তথ্যই পান না।

শ্রী শরণ সিং: অনেক তথ্যই আমরা মাননীয় সাংসদদের দেইনা। আমাদের হাতে অনেক তথ্য থাকে, যা হয়তো আমরা সবসময় ব্যাবহার করিনা।

উনি আরো জানতে চেয়েছেন যে আমেরিকা জাহাজ না থামালে আমরা কি করতে পারি। আমরা তাদের জাহাজ থামানোর অনুরোধ করেছি, সুতরাং এই মুহূর্তে এই হাইপোথিটিক্যাল প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব নয়। তার পরবর্তী প্রশ্ন ছিল আমাদের দাবীর ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের জবাব কি? আমি ইতিমধ্যে বলেছি যে মাত্র দুই দিন হয় দাবী জানানো হয়েছে, আমরা এখনো উত্তরের অপেক্ষা করছি।

শেষ প্রশ্ন ছিল বাংলাদেশের ব্যাপারে আমাদের নীতি সম্পর্কে। আমার মনে হয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনেকবারই বাংলাদেশের মানুষের প্রতি আমাদের সহানুভূতি এবং সমর্থন ব্যাক্ত করেছেন। আমরা এখন যে দৃষ্টি আকর্ষণী প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করছি, তার সাথে এই প্রসঙ্গের কোন সম্পর্ক নেই।

শ্রী এন.কে.সাঙ্গী (লালোর): এস.এস.পদ্মা এবং এস.এস.সুন্দরবনের মাধ্যমে অস্ত্র সরবরাহ করাটা ভারতের লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়ার মত। আমাদের মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী লম্বা বিদেশ সফরে অনেকগুলো দেশে গিয়েছেন এবং বাংলাদেশের বাস্তবতা, সেখানকার গণহত্যা এবং আমাদের সমস্যাগুলোর ব্যাপারে বিশ্ব নেতৃত্বকে অবহিত করেছেন। এজন্য আমরা তাকে অভিনন্দন জানাই, কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁর দেশে ফেরার ১৮ ঘন্টার মধ্যে নিউইয়র্ক টাইমস মারফত আমরা এই অস্ত্র সরবরাহের খবর পাই। এই মাত্র মাননীয় মন্ত্রী নিশ্চিত করলেন যে টেলিগ্রাম মারফত তিনিও নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত খবরটি জেনেছেন। এটা অন্ত্যন্ত দুঃখজনক যে এখন পর্যন্ত আমেরিকা থেকে আমাদের দূতাবাস এই ব্যাপারে কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য পাঠায়নি। আমেরিকার ভারতনীতিতে এটা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি পরিষ্কারভাবে বোঝার জন্য আমাদের একটু পিছনে ফিরে যেতে হবে। প্রয়াত স্টেট সেক্রেটারী জন ফস্টার ডালাস একটি নীতি প্রবর্তন করেছিলেন, ‘যারা আমেরিকার মিত্র নয় তারা সবাই আমেরিকার শত্রু’। এই কারনে ভারতকে সবসময় হুমকির মুখে রাখার জন্য তিনি পাকিস্তানের মত দেশে সমরাস্ত্র বিক্রি করা শুরু করেন।

২৫শে মার্চ পরবর্তী বাংলাদেশের ঘটনাবলীর দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। গন্ডগোল শুরু হবার পরপর যুক্তরাষ্ট্র আমাদের আশ্বস্ত করেছিল যে পাকিস্তানে কোন গোলা-বারুদ পাঠানো হবেনা। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের রবার্ট ম্যাকলাস্কি ১৬ই এপ্রিল জানিয়েছিলেন যে পাকিস্তানে কোন অস্ত্র পাঠানো হবেনা এবং পাইপলাইনেও কোন অস্ত্রের চালান নেই। তিনি বলেছিলেন জেটিতে পড়ে থাকলেও পাকিস্তানে কোন অস্ত্র যাবেনা। কিন্তু এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি জাহাজ ভর্তি গোলা-বারুদ পাকিস্তানে পাঠানো হচ্ছে। ইস্ট পাকিস্তান শিপিং এজেন্সি অফ আমেরিকা পরিষ্কারভাবে জানিয়েছে যে অস্ত্র ও গুলির চালান নিয়ে জাহাজ দুটি একাধিকবার আমেরিকা-পাকিস্তানে আসা-যাওয়া করেছে। ২৫শে মার্চের পরে আরো অনেকগুলি অস্ত্রবাহী জাহাজ পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে আমেরিকা ছেড়েছে। যুদ্ধের শুরুতে লজিস্টিক বিশেষজ্ঞরা আমাদের বলেছিলেন আরো ১০ দিন যুদ্ধ চললে পাকিস্তানীদের গোলা-বারুদ ফুরিয়ে যাবে। অথচ এখন তিন মাসের বেশী হয়ে গেল এবং পাকিস্তান বাংলাদেশে চার ডিভিশন সৈন্য মোতায়েন করে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। চীন, পাকিস্তান এবং অন্যান্য দেশ থেকে তারা যুদ্ধ চালানোর রসদ পাচ্ছে। আমাদের কূটনীতিক মিশনগুলোর তুলনায় পাকিস্তানের বিদেশী লবি অনেক বেশী শক্তিশালী, সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসনের সাম্প্রতিক একটি উক্তি থেকে যেটা পরিষ্কার বোঝা যায়। উইলসন বলেছেন যে পাক-ভারত যুদ্ধের ব্যাপারে তাঁকে ভুল বোঝানো হয়েছিল। এখন যুক্তরাষ্ট্র সরকার আমাদের দেয়া প্রতিশ্রুতি ও আশ্বাস বার বার ভঙ্গ করছে, এ ব্যাপারে আমাদের কি করা উচিত? ১৯৬৫ সালের পর তারা বলেছিল যে পাকিস্তানকে চীনের সঙ্গছাড়া করার জন্য তারা পাকিস্তানকে সাহায্য করছে। পরে আবার একই ঘটনা ঘটানোর পর তারা বলেছিল এটি শুধু একবারের জন্যই তারা করছে, এর পুনরাবৃত্তি হবেনা। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি বার বার আমাদের আশ্বাস দেত্তয়া সত্বেও তারা পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করেই যাচ্ছে। তাদের আমরা কতটুকু বিশ্বাস করতে পারি? এখন আমি এই বিষয়ে দুটি সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন করতে চাই। ভারতীয় সরকার কি জাতিসংঘকে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবার জন্য ১৫ দিনের সময়সীমা বেঁধে দেবে? এর ভেতর তারা কোন পদক্ষেপ না নিলে ভারত জাতীয় স্বার্থে তাদের অনুমতি ব্যাতিরেকে যেকোন পদক্ষেপ নেবার ক্ষমতা রাখবে। দ্বিতীয়ত বর্তমান অবস্হার প্রেক্ষিতে ভারত কি সকল ধরনের মার্কিন প্রতিষ্ঠান থেকে আসা ত্রান সাহায্য প্রত্যাখ্যান করবে? এত কিছু পরেও মার্কিন সাহায্য নেয়া সমগ্র জাতীর জন্য অপমান।

শ্রী শরণ সিং: সাংসদ মহোদয়ের সমালোচনা এবং বক্তব্যের প্রথম অংশের সাথে আমি মোটা দাগে একমত। তার বক্তব্যের সাথে কিছু প্রশ্ন সংযোজিত ছিল এবং তার বিশ্লেষনের সাথে আমি সম্পূর্ণরূপে একমত। তবে তার দেয়া পরামর্শগুলি গ্রহণ করতে পারছিনা, এই মুহূর্তে কোন সময়সীমা বেঁধে দেয়া অথবা ত্রানসাহায্য প্রত্যাখ্যান করা বুদ্ধিমানের কাজ হবেনা।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২২১। কয়েকটি দেশে সফর প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি ও তার উপর আলোচনা
ভারতের লোক সভার কার্যবিবরণী
২৫ জুন, ১৯৭১

Raisa Sabila
<১২, ২২১, ৮৩৫-৮৪০>

মিঃ স্পিকারঃ এখন বক্তব্য রাখবেন, শ্রী শরন সিং।

শ্রী এস এম ব্যানারজি (কানপুর)ঃ স্যার, উনি বক্তব্য রাখার আগেই আমি অনুরোধ জানাচ্ছি যেন উনি পূর্বনির্ধারিত বক্তব্যের সাথে পাকিস্তানে তৃতীয় একটি জাহাজ প্রেরনের সত্যতা সম্পর্কেও বক্তব্য রাখেন। আমরা সকলেই এবিষয়ে চিন্তিত আছি। আমরা আপনার কাছেও লিখেছি (আলোচনায় বিঘ্ন)

পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী (শ্রী শরন সিং)ঃ ৫ থেকে ২২ জুন, ১৯৭১, এই সময়ের মধ্যে আমি মস্কো, বন, প্যারিস, অটোয়া, নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন এবং লন্ডন ভ্রমন করেছি। এই প্রতিটি রাজধানীতে আমি তাদের সরকার প্রধান এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীদ্বয়ের সাথে বিশদ আলোচনায় বসেছি। জাতিসঙ্ঘের হেডকোয়ার্টারে গিয়ে আমি জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্ট এবং তার সহকর্মীদের সাথেও আলোচনা করেছি। এই প্রতিটি রাজধানীতেই আমি সরকার প্রধান বা পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ছাড়াও প্রচুর সংখ্যক সরকারি দলের অন্যান্য নেতাসমুহ, সাংবাদিক, সমাজ কর্মী এবং জনপ্রিয় নেতাদের সাথে দেখা করেছি।

কোন একজন সংসদ সদস্যঃ বাংলাদেশ

এসকল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এবং মনযোগ পুরোটাই ছিল পূর্ব বাংলা থেকে আগত ৬ মিলিয়ন শরণার্থীর প্রবাহে ভারতে যে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে, এবং পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের গনহত্যায় পূর্ব বাংলায় যে ধারাবাহিক বিপর্যয় চলছে, সে বিষয়ে। আমার ভ্রমন শেষে মস্কো, বন, প্যারিস, ওয়াশিংটন এবং লন্ডনে এবিষয়ে বিবৃতি দেয়া হয়েছে এবং এই বিবৃতিই তাদের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে ধরে নেয়া যায়। অটোয়ায় পররাষ্ট্র মন্ত্রী মিচেল শার্প হাউক অব কমন্সে একটি বিবৃতি দিয়েছেন, যা থেকে তাদের প্রতিক্রিয়াও প্রতিফলিত হচ্ছে।

(এসকল বিবৃতির কপি হাউসের টেবিলে জমা দেয়া হয়েছে, গ্রন্থাগার- এলটি-৫৩৮/৭১)

আমার আলোচনা এবং ভ্রমনের ফলস্বরূপ যেসকল চুক্তিতে আমরা পৌছাতে পেরেছি তা হলঃ

১) পূর্ব বাংলায় সকল সামরিক অভিযান অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। এ সমস্যার কোন সামরিক সময়াধান নেই।
২) পূর্ব বাংলা থেকে ভারতে শরণার্থীদের আগমন বন্ধ করতে হবে।
৩) শরণার্থীরা যেন নিজভুমিতে নিরাপদ ও শান্তিতে ফিরে যেতে পারে তার উপযুক্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে। এটি শুধুমাত্র তখনি সম্ভব হবে যদি শরণার্থীরা পূর্ব বাংলায় একটি নিরাপদ ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা পায়।
৪) পূর্ব বাংলার গনমানুষের অনুমোদিত রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার আর কোন বিকল্প উপায় নেই।
৫) বর্তমান পরিস্থিতি অত্যন্ত সংকটপূর্ণ এবং আমাদেরকে এ উপমহাদেশের শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখতে কঠিন বিপদের সাথে লড়াই করতে হবে।

এটি সর্বসম্মতিক্রমে স্বীকৃত যে মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পূর্ব বাংলা থেকে প্রায় ৬ মিলিয়ন শরণার্থীর যে ঢল ভারতে এসেছে তা এদেশের সরকারের জন্য একটি অসহনীয় বোঝা হয়ে দারিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক সমাজকে অবশ্যই এর সমাধানে আর্থিক সহযোগিতাসহ সকল ধরনের সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসতে হবে। যাত্রাপথের প্রতিটি শহরে আমি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে তাদের ব্যাখ্যা করেছি যে, এই শরণার্থীরা পাকিস্তানেরি নাগরিক, যারা তাদের প্রদেশে সরকারের নিপীড়ন এবং অত্যাচারী আচরনের কারনে নিজ দেশ থেকে উৎখাত হয়েছে এবং তাদেরকে সহযোগিতা করা মানে পরোক্ষভাবে পাকিস্তানেরি সহযোগিতা করা। আমি এটাও পরিষ্কার করে বলেছি এবং তা সর্বজনগৃহীতও হয়েছে যে এই মুহূর্তে পাকিস্তানকে সেনা সহায়তা দাওয়ার মানে হবে তাদের গনবিরোধী কার্যকলাপকে আরো উস্কে দেয়া। তাদেরকে অর্থনৈতিক সহায়তা দাওয়ার মানে হল তাদের এসকল শোচনীয় কার্যকলাপ দেখে না দেখার ভান করা।

কোন একজন সংসদ সদস্যঃ বাংলাদেশ (আলোচনায় বিঘ্ন)

শ্রী সমর গুহা (কাঠি)ঃ রাজ্যসভার সভাপতি একটি রুলিং জারি করেছেন যে পূর্ব বাংলাকে বাংলাদেশ বলে সংবোধন করতে হবে।

শ্রী শরন সিংঃ এই কয়েকদিনে আমি কি কি করেছি তার সবটাই চাক্ষুষ সাক্ষীবৃন্দ নিখুতভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন এবং তা পুরো সপ্তাহ জুড়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। আমি এবিষয়েও নির্দিষ্ট করে জানিয়েছি যে এমুহূর্তে শুধুমাত্র আন্তরজাতিক তৎপরতায় মানবিক সাহায্য ছাড়া পাকিস্তানকে অন্য কোন আর্থিক সাহায্য দিলে তা সেদেশের ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী মিলিটারি শক্তি ব্যবহার করে সংখ্যাগরিষ্ঠদের উপর যে অত্যাচার করছে তা বহাল রাখতে সাহায্য করবে, এবং তাদের অন্তর্বর্তী বিষয়ে দুঃখজনকভাবে হস্তক্ষেপ করা হবে।

প্রতিটি শহরেই তারা আমাদের দেশ এবং সরকারকে প্রশংসা করেছে। পূর্ব বাংলা এবং আমাদের দেশ, দুই স্থানেই আজ মানবসৃষ্ট দুর্যোগের সৃষ্টি হয়েছে। এমতাবস্থায় এই ব্রিহদাকারের শরণার্থী শিবিরকে দেখভাল করা ও আস্রয় দাওয়ার যে উদ্যোগ তা ইতিহাসে নজিরবিহিন। এহেন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সকলেই স্বীকার করেছেন যে, সম্পূর্ণ রুপে নির্দোষ হওা সত্ত্বেও আমাদের উপর বোঝা বহন করতে হচ্ছে, এবং খুব দ্রুত এ সমস্যার সমাধান না হলে তা গোটা উপমহাদেশের নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

শ্রী এস এম ব্যানারজিঃ আমার নেতা যে প্রশ্ন করবে, তা আমি করছিনা। কিন্তু আমি একটা বিষয় জানতে চাই। গতকাল তারা বিবৃতি দিয়েছে, আর আজকের পত্রিকায় এসেছে যে পাকিস্তানি সেনাদের জন্য সেনা সরঞ্জাম নিয়ে আমেরিকা থেকে তৃতীয় জাহাজটি রওনা হয়েছে। আগামিকাল আমাদের সভা নেই এবং তারপর দিনেও……

মিঃ স্পিকারঃ প্লিজ, না…

শ্রী এস এম ব্যানারজিঃ স্যার এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ (আলোচনায় বিঘ্ন)

শ্রী প্রিয়া রনন দাস মুন্সি (সাউথ কলকাতা)ঃ স্যার, এ বিষয়ে অবশ্যই আমাদের আলোচনা হওা অত্যন্ত জরুরি। (আলোচনায় বিঘ্ন)

মিঃ স্পিকারঃ আপনারা প্রতিদিন যা করছেন, তারি পুনরাবৃত্তি দেখার জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতি আজ আমার নেই। আপনারা যদি না চান, তাহলে অন্য কোন দিন করতে পারেন … (আলোচনায় বিঘ্ন)

শ্রী এস এম ব্যানারজিঃদয়া করে আমার কথা এক মিনিটের জন্য শুনুন।

মিঃ স্পিকারঃ আপনার সাম্নেই বিবৃতিটি রাখা আছে।

শ্রী এস এম ব্যানারজিঃ আমি স্টেটমেন্ট বিষয়ে কথা বলছিনা।

মিঃ স্পিকারঃ দুঃখিত, আমি আপনাকে কথা বলতে দিতে পারছিনা।

কিছু সম্মানিত সদস্য দাড়িয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছেন।

মিঃ স্পিকারঃ এর কোন কিছুই রেকর্ডে যাবেনা। আমি কাউকেই কথা বলতে দিবনা, যদি আপনারা না বসেন। যতদুর বোঝা যাচ্ছে, বর্তমান বিষয়ে মন্ত্রিমশাই তার বক্তব্য প্রদান করে ফেলেছেন। গতকালকেই বলা হয়েছে যে পার্টীর লিডাররা প্রশ্ন তুলবে, যদি সেবিষয়ে আলোচনা করতে হয়, তাৎক্ষনিক তা করা হবে, কিন্তু তখন না যখন মন্ত্রিমশাই তার বক্তব্য পেশ করছেন, এবং তা হাউসের বিবেচনার আওতাধীন রয়েছে।

সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী এবং পরিবহন মন্ত্রী ঃ জনাব স্পিকার, আপনার অনুমতিক্রমে, প্রথম হাউসের সকল অধদপ্তরকেই জানাচ্ছি যে, এবিষয়ে আলোচনা জিইয়ে রাখার কোন ইচ্ছেই নেই। (আলোচনায় বিঘ্ন) আমি বলতে চাই, মন্ত্রীসাহেব একটি বক্তব্য দিয়েছেন। আপনি গতকাল বিরোধিদলের সাথে এবিষয়ে কিছু নির্দিষ্ট নিয়মনীতি নির্ধারণ করেছেন। আপনি মাত্রই আমাদের বলেছেন যে আপনি সে অনুযায়ীই আগাতে চান। তারা যদি কোন আলোচনা চায়, তবে তা আলাদাভাবে বিবেচিত হবে।

শ্রী এস এম ব্যানারজিঃ তৃতীয় জাহাজের কি হবে?

শ্রী ভগত ঝা আজাদ (ভাগলপুর)ঃ আমরা সরকারের মতামত জানতে চাই।

শ্রী রাজ বাহাদুরঃ যেমনটি আমি বলেছিলাম, আমরা এবিষয়ে আর কোন আলোচনা রাখতে চাইনা।

শ্রী ভগত ঝা আজাদঃ যেহেতু সরকারও এ আলোচনায় একমত হয়েছে, সুতরাং, এখানে নতুন করে প্রশ্ন করার কোন দরকার নেই।
শ্রী পি কে দেও (কালাহান্দি) ঃ সকলের চাহিদার বিষয়টি বিবেচনা করে, আমাদের এখনি এবিষয়ে আলোচনা সেরে ফেলা উচিত। (আলোচনায় বিঘ্ন)

মিঃ স্পিকারঃ আমি কাউকেই অনুমতি দেইনি। কিন্তু যদি সদস্যরা এভাবে নিজে থেকেই কথা বলতে থাকেন, তাহলে আমরা আগাতে পারবোনা। যদি সবাই একসাথে কথা বলেন, আমি কিভাবে সবার কথা শুনবো?

শ্রী এস এম ব্যানারজিঃ পয়েন্ট অব অর্ডারের ভিত্তিতে……

মিঃ স্পিকারঃ আমি কথা বলছি, সুতরাং এখন কোন পয়েন্ট অফ অরডার নেই।

শ্রী দিনেন ভট্টাচার্য (সেরামপুর)ঃ আমেরিকা তৃতীয় একটি জাহাজ পাঠিয়েছে।

মিঃ স্পিকারঃ আমরা আবারো একবার মনে করি, গত পরশু, সকল সংসদীয় নেতাগন, সকল বিরোধীদলীয় নেতাগন এবং ট্রেজারি বেঞ্চের সদস্যগনসহ সকলে মিলে এবিষয়ে একমত হয়েছেন যে মাননীয় মন্ত্রী শুক্রবার এবিষয়ে বক্তব্য প্রদান করবেন, এবং প্রতিটি পার্টীর নেতারা এবিষয়ে প্রশ্ন করবেন। (আলোচনায় বিঘ্ন) আমি জানিনা, যে সদস্যরা এখন পর্যন্ত যেসকল আলোচনা হয়েছে তার উপর বিতর্কে অংশ নিতে ইচ্ছুক।

শ্রী শরন সিংঃ তারা এমন কোন চাপ সৃষ্টি করছেনা, আসুন এবিষয়টা বাদ দেই। তারা প্রশ্ন করতে আগ্রহী নন, সুতরাং বাদ দিন, আমাদের একটা আলাদা আলোচনা হওয়া দরকার, সেবিশয়ে আমারো কোন আপত্তি নেই। আমাকে হাউস এবং আপনার ইচ্ছানুসারে বরত্মান পরিস্থিতি পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করার সুযোগ দিন। মিঃ স্পিকার, এই বক্তব্য আমার ভ্রমন বিষয়ে দেয়া হয়েছিল। মনে হছে, সকলেই, এমনকি আমিও, অস্ত্র সরবরাহ করার বিষয়টিতে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছি। সুতরাং যদি তারা এবিষয়ে প্রশ্ন করতে না চায়, তাহলে বাদ দাওয়াই ভাল। আমরা এবিষয়ে আলাদা আলোচনা করাই ভাল।

শ্রী ভগত ঝা আজাদঃ আমরা অবশ্যই একটি আলাদা আলোচনা চাই, তবে তা এই বক্তব্যের উপরে নয়, বরং পাকিস্তানে আমেরিকা যে অস্ত্র সরবরাহ করছে, সে বিষয়ে। আমরা সেই বিষয়ে আলোচনা করতে চি, যা বক্তব্যে উল্লেখিত হয়নি।

শ্রী শরন সিংঃ এবিষয়ে আমরা সোমবার বা অন্য কোন্দিন আলোচনা করবো, তার মধ্যে আমরা প্রয়োজনীয় তথ্য যোগার করে ফেলতে পারবো বলে আশা করছি।

শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়িঃ আমরা বাংলাদেশ বিষয়েও আলোচনা করতে চাই। আলোচনা শুধুমাত্র অস্ত্র সরবরাহের মধ্যে আটকে না থেকে, বাংলাদেশ বিষয়েও হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। এবিষয়ে সরকারের মনোভাব জানা খুবি প্রয়োজন।

শ্রী এইচ এন মুখারজি (কোলকাতা- উত্তরপূর্ব)ঃ আমি বলতে চাই যে যখন মন্ত্রিসাহেব কোন বক্তব্য দেন, সেটি হাউসের বক্তব্য হয়ে দারায়। একজন সদস্য হিসেবে আমি খুবি অন্যরকম একটি মন্তব্য করতে চাই এবিষয়ে। এর আগে বাংলাদেশ বিষয়ে যেসকল পররাষ্ট্র বিষয়ক বক্তব্য এসংসদে দেয়া হয়েছে, এ বক্তব্য কি সেগুলো থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যাচ্ছেনা? বক্তব্যটা শুধুমাত্রই তার ভ্রমনের একটা সারসংক্ষেপ বিষয়ে আমাদের ধারনা দিচ্ছে। এ বিষয়ে একটি সরাসরি আলোচনা হওয়া খুবি প্রয়োজন। এমতাবস্থায়, একেকজন ব্যক্তির প্রশ্নের উত্তর দেয়ার যে ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তার আর প্রয়োজন নেই, কেননা, সরকার বাংলাদেশ এবং তাদের পলিসি সম্পর্কে যেসকল বক্তব্য দিয়েছিলেন, তা থেকে অনেকখানি সরে এসেছেন। তারপরো একটা বড় আলোচনার প্রয়োজন আছে, এবং তা অতি সত্বর হওয়া প্রয়োজন, কেননা, যেমনটি আমি বলেছিলাম যে বাহিরেও এমন একটি ধারনার সৃষ্টি হয়েছে যে সরকার তাদের প্রাক্তন অবস্থান থেকে সরে আসছেন।

শ্রী এস এম ব্যানারজিঃ ৩৬৭(২) ধারা অনুসারে, “হাউসের একটি বিষয়ে আমি এই মুহূর্তে একটি পয়েন্ট অফ অর্ডার উত্থাপন করছি”

এই বিষয়টি হল, মন্ত্রীর পেশ করা বক্তব্য। যার ভিত্তিতে আপনি আমাদের প্রশ্ন করার অনুমোদন দিচ্ছেন। আমি যে প্রস্তাব উত্তাপন করতে যাচ্ছি, ৩৪০ ধারা অনুসারে, “কোন সদস্য যদি কোন প্রস্তাব উত্থাপন করেন, তবে যেকোন সময়ে তার উপর ভিত্তি করে চলমান বিতর্ক স্থগিতও করতে পারেন। “

শ্রী শরন সিং তার প্রস্তাব পেশ করেছেন।

শ্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী (গোয়ালিয়র) ঃ হাউসের সামনে কোন প্রস্তাব ই ছিলনা।

শ্রী এস এম ব্যানারজিঃ প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে, এবং এখন আমাদের প্রশ্ন করতে হবে।

আমি প্রস্তাব পেশ করছি যে এই বিতর্ক এখনি স্থগিত করা হোক, এবং একটি পুরনাঙ্গ আলোচনা পেশ করা হোক।
মিঃ স্পিকারঃ কোন প্রস্তাব নেই, কোন বিতর্কও নেই।

শ্রী এস এম ব্যানারজিঃ আমেরিকা পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করছে। এখন তৃতীয় একটি জাহাজ ও আসছে। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, গতকালের বক্তব্যে, মাননীয় মন্ত্রীসাহেব এই সাম্রাজ্যবাদীদের এহেন নিষ্ঠুর ও দুর্বৃত্তজনক আচরনের সমালোচনা না করে, উল্টো তাদের মানবতার সনদ দিয়ে দিয়েছেন। তা উনি করছেন, করুক; কিন্তু আমরা এই হাউসের পক্ষ থেকে আমার বাংলাদেশের ভাইদের জন্য হলেও তাদের এখনি অভিযুক্ত করতে চাই, এবং এই মুহূর্তে।

জনৈক সম্মানিত সদস্যঃ এ বিষয় সরকার নির্ণয় করুক।

শ্রী সমর বাহাদুরঃ আমার জ্যেষ্ঠ সহকর্মী মাননীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী ইতিমধ্যে তার অবস্থান পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছেন। তিনি অস্ত্র সরবরাহ বিষয়ে গতকাল একটি বক্তব্য দেন। এখন, খবর এসেছে যে তৃতীয় জাহাজটিও যাত্রা শুরু করেছে। আজকের বক্তব্যে উনার বিভিন্ন দেশের রাজধানীগুলো ভ্রমনের বর্ণনা এসেছে। সকলি এখানে পেশ করা হয়েছে। হাউস কোন আলোচনায় বস্তে চাইলে, আমরা অবশ্যই তা করতে রাজি আছি। আপনি সময় নির্ধারণ করে দিন, আমরা অবশ্যই তাতে সম্মত হব।

(শ্রী সাবিয়ার গুহ দাঁড়ালেন)

মিঃ স্পিকারঃ এই ভদ্রলোককে নিয়ে কি করা যায়, প্রতিবার উনি দাড়িয়ে যাচ্ছেন। (আলোচনায় বিঘ্ন)

শ্রী সমর গুইলাঃ পয়েন্ট অব অর্ডারের ভিত্তিতে।

মিঃ স্পিকারঃ যতক্ষন পর্যন্ত আমি পয়েন্ট অফ অর্ডার ঘোষণা না দিচ্ছি, ততক্ষন পর্যন্ত তা সে অনুযায়ী লিপিবদ্ধ হবে না। (আলোচনায় বিঘ্ন) আমার মনে হচ্ছে আমি অনেক লোকের ভিড়ের মধ্যে বসে আছি। আপনারা আলোচনা করতে চান। সে বিষয়ে মন্ত্রিমশাইর কোন আপত্তি নেই। কিন্তু, কি বিষয়ে আসলে আপনারা আলোচনা করবেন, বা তার উপযোগিতা কি? (আলোচনায় বিঘ্ন)

শ্রী অটল বিহারি বাজপেয়ীঃ দয়া করে, আলোচনার বিষয়বস্তুকে সংক্ষিপ্ত করবেন না। কেননা, যে বক্তব্য পেশ করা হয়েছে, তাতে সবি উল্লেখিত হয়েছে। অস্ত্র সরবরাহ, সরকারের বাংলাদেশ বিষয়ক মনোভাব, সবি এখানে বলা হয়েছে।

মিঃ স্পিকারঃ আলোচনার বিশয়বস্তু অনেক বিশদ।

শ্রী ভগত ঝা আযাদঃ ১৮৪ নং ধারার ভিত্তিতে…

মিঃ স্পিকারঃ যাই ধারা থাকুক না কেন। ।

শ্রী ভগত ঝা আযাদঃ ১৮৪ নং ধারা অনুসারে আমি বলতে চাই, আমাদেরকে এই বিষয়ে আলোচনা করতে দাওয়া হোক।

মিঃ স্পিকারঃ আমি তা নির্ধারণ করছি, দয়া করে বসুন।

শ্রী ভগত ঝা আজাদঃ আপনি আমাদের সাথে আপত্তিকর ব্যবহার করছেন। আপনি প্রস্তাবনা চেয়েছিলেন, আমি প্রস্তাব করছি যে ১৮৪ নং ধারা অনুসারে আমরা এ বক্তব্যের উপর আলোচনা করতে চাই।

মিঃ স্পিকারঃ তাহলে আর আপনার সরকারী পক্ষে বা বিরোধি পক্ষে থাকার মধ্যে পার্থক্য কি থাকল?

শ্রী ভগত ঝা আজাদঃ গতবারের লোকসভা আর এবারের লোকসভায় আপনার অবস্থানের কি পরিবর্তন! প্রতি মুহূর্তে আপনি আমাদের রুদ্ধ করে দিচ্ছেন। আমি এই লোকসভায় আছি সেই ১৯৫২ থেকে, যে আওলে আপনিও ছিলেন না।

মিঃ স্পিকারঃ আপনি জানেন যে আমরা হাউসে আলোচনার সময় নির্ধারণ করছি।

শ্রী ভগত ঝা আজাদঃ আপনি প্রস্তাবনা চেয়েছিলেন, এখন শুনতে না চাইলে কিভাবে সাজেশন দিব? আমি ১৮৪ ধারা অনুযায়ী আপনাকে প্রস্তাবনা দিচ্ছি, আপনি তা অন্যভাবে নিচ্ছেন। আমি খুবি অবাক হচ্ছি।

মিঃ স্পিকারঃ আমরা আলোচনা করব। কিন্তু কত সময় ধরে?

শ্রী রাজ বাহাদুরঃ দুই ঘন্টা সময়ই যথেষ্ট, নতুবা গোটা অনুষ্ঠানসূচী পুনরায় ঢেলে সাজাতে হবে।

শ্রী জ্যোতির্ময় বসু (ডায়মন্ড হারবার)ঃ ছয় ঘন্টা।

মিঃ স্পিকারঃ আজ কার্যদিবস নয়। আমরা কোন একটি কার্যদিবসে এ আলোচনাটি সম্পন্ন করতে চাই। আমরা এই আলোচনাটি সোমবারে করব। সারাদিন ধরে।

শ্রী সমর গুহঃ তাতে মুল প্রভাবটা কেটে যাবে। এটি খুবি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

শ্রী জ্যোতির্ময় বসুঃ আমরা আজ ৩.৩০ এ আলোচনা শুরু করে, সোমবারেও তা চালিয়ে যেতে পারি। কেননা, বিষয়টি খুবি জরুরি, আমরা এটিকে হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে পারিনা।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২২২। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য উত্থাপিত প্রস্তাবের ওপর আলোচনা ভারতের লোকসভার কার্যবিবরনি ২ জুলাই ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ২২২, ৮৪১-৮৬৯>
অনুবাদ

পুনঃরেজোলিউশন – বাংলাদেশকে স্বীকৃতি

জনাব ডেপুটি স্পিকার: এখন আমরা শ্রী সমর গুহর রেজল্যুশন নিয়ে আগাব। এর জন্য দুই ঘন্টা বরাদ্দ। এক ঘন্টা ত্রিশ মিনিট ইতিমধ্যেই নেওয়া হয়েছে। সুতরাং, শুধুমাত্র ৩০ মিনিট বাকি।

শ্রী এস এম বানেরি (কানপুর): আমার একটি আনুষ্ঠানিক সংশোধনী আছে। আমি ৩০ জুন তারিখ দিয়েছিলাম এই ভেবে যে সেদিন আলোচনা শেষ হবে। কিন্তু হয়নি। তাই আমার সংশোধনী ৩০ জুন ১৯৭১ কে ১৫ জুলাই ১৯৭১ দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা হোক। এটা প্রচার করা হোক।

জনাব. ডেপুটি স্পিকার: আমি মনে করি যে এটা কারণিক বিষয়। আপনার কি কোন ফ্রেশ সংশোধনী আছে?

শ্রী এস এম ব্যানার্জী: আমি আমার সংশোধনী বিকাল ৩ টায় জমা দিয়েছি।

জনাব. ডেপুটি স্পিকার: আপনার আরেকটি সংশোধনী আছে, নং ৫। আপনি কি এটা মুভ করবেন?

শ্রী এস এম ব্যানার্জী: হ্যাঁ।

আমি আবেদন জানাচ্ছি।

শ্রী এস এম ব্যানার্জীর স্থানান্তরিত সংশোধনী, প্রিন্ট করা আছে ২, তালিকা নং ১-

“৩০-৬-১৯৭১” এর জন্য
বিকল্প “১৫-০৭-১৯৭১”

শ্রী এইচ এম প্যাটেল (ধান্দুকা): প্রথমে আমরা নিজেদের জিজ্ঞেস করতে চাই যখন সরকারি মুখপাত্র বলে যে যেসব উদ্বাস্তু ভারতে ঢুকেছিল তাদের ফেরত পাঠানো হবে, তারা নিশ্চই ফিরে যাবে – ইত্যাদি কথা দিয়ে সরকার কী বোঝাতে চান? এটা অর্জন করার জন্য তাদের প্রস্তাবনা কি? তাদের কি কোন রাজনৈতিক নিষ্পত্তির পরিকল্পনা আছে? এর মানে হতে পারে মুজিবুর রহমান ও তাঁর অনুসারীদের সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের মধ্যে বোঝাপড়া। যতক্ষণ না এই দুইএর মধ্যে সরকার ও প্রশাসনের কিছু ফর্ম প্রতিষ্ঠা করা যায় ততক্ষণ উদ্বাস্তুদের সেখানে ফিরে যাবার সম্ভবনা নেই। কিন্তু একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তির সম্ভাবনা কি আছে? কেউ এই নিষ্পত্তির কথা বলছে? বিশ্বশক্তিগুলো এটা নিয়ে কথা বলছে? তাদের বিবৃতিতে উল্লেখিত হয়েছে যে, তারা একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তি চান। আমরা কেন এই ধরনের একটি প্রস্তাবে আমাদের সমর্থন দেব? আমরা কি সন্তুষ্ট যে, এই ধরনের সমাধানের সম্ভবনা আছে?

আমাদের দুটি বিকল্প আছে। তাদের রেফার করা পদ্ধতিতে আমরা সমাধানের দিকে আগালাম – এতে করে উদ্বাস্তুরা কিছুটা আশা হয়ত পাবে। অথবা আমরা আমাদের নিজেদের মত করে আগালাম। এখন কোন পথটি দীর্ঘ মেয়াদে ভালো। আমরা জানিনা। কেন এটা পরিষ্কার নয়? এটা কি মিলিটারি একশনের জন্য? যদি তা না হয় তবে সরকারের মনে কী আছে?

আমি আশঙ্কায় আছি যে আমাদের সামনে একটা পথ আছে – সেটা হল আমরা যা বলছি সেটাকে একটা কাঠামোতে দাঁড় করানো। বলতে গেলে আমরা একাই এটা করব। সমস্ত বিশ্বকে বুঝিয়ে দেয়া উচিৎ যে আমরা কাজের কাজই করছি। এবং বিশ্বাস করতে শুরু করি যে পয়েন্ট আসবে, খুব দ্রুতই আসবে, যখন আমরা সামরিক কায়দায় আগাব, এমন না যে আমরা তেমনটা চাই। কারণ কেউ যুদ্ধ নিয়ে চিন্তিত না – আর আমাদের অন্য কোন পথ নেই। এটা উভয় ফ্রন্টের জন্য অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু আমাদের কি আর কোন বিকল্প আছে?

যদি এখানে বাংলাদেশর স্বীকৃতি প্রস্তাব করা হয় এটা শুধুমাত্র একটি প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে। এটা শুধুমাত্র একটি পদক্ষেপ যে আমরা বলতে পারি যে, আমরা একটি সরকারকে স্বীকার করে নিচ্ছি। যদিও এটা কোন অঞ্চলের দায়িত্বে নেই কিন্তু এটা ঐ অঞ্চলের মানুষের দ্বারা স্বীকৃত। তাদেরকে তাদের অঞ্চল থেকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। স্বীকৃতি আমাদেরকে কাজ করার জন্য একটা সুবিধাজনক পরিবেশ তৈরি করবে। কিন্তু এটি শুধুমাত্র একটি প্রস্তাবনা। প্রাথমিক পদক্ষেপ হবে সামরিক একশন। আমাদের মনে রাখতে হবে এই একশন ছাড়া স্বীকৃতি দিয়ে কোন লাভ হবেনা।

যখন প্রধানমন্ত্রী হাউসের মধ্যে একটি রেজল্যুশন দিয়েছিলেন সেটা সর্বসম্মতিক্রমে পাস করেছি। কেন আমরা সবাই সেটা মেনে নিয়েছি? কারণটা হল আমরা জানি কিছু উদার মানুষকে নির্দয়ভাবে শোষণ করা হচ্ছে। কারণ তারা একটি অবাধ নির্বাচনে তাদের মতামত দিয়েছিল এবং আমরা মনে করি যেকোন গণতান্ত্রিক বিচারে তারা সরকার গঠন করার অধিকার রাখে। কিন্তু তাদের জোর পূর্বক দমন করা হচ্ছে এবং আমাদের মনে হয়েছে যে, আমাদের তাদের পাশে থাকা উচিৎ। আমরা কীভাবে সেটা করতে পারি? এই অবস্থায় হয়ত আমরা ভেবেছি একটু সহানুভূতিই যথেষ্ট হবে। কিন্তু যখন উদ্বাস্তুরা আমাদের বর্ডারে আসতে লাগল তখন সবাই বুঝতে পারল এটা শুধুমাত্র পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। এমনকি কেউ যদি খুব বেশী আইনের কথাও বলেন। এটা একটা আন্তর্জাতিক সমস্যা এবং ভারত এতে আক্রান্ত এবং ভারতকেই কাজ করতে হবে।

অনেকে সুপারিশ করেন যে আমাদের উচিৎ আমাদের বর্ডার বন্ধ করে দেয়া। কীভাবে আমরা তা করব? আমরা কীভাবে পাকিস্তানের মত নির্দয় হতে পারি? তাই ঐ প্রস্তাব না মেনে আমরা তাদের প্রবেশ করতে দিলাম। কিন্তু প্রবেশ করতে দেবার পরেই আমাদের দায়িত্ব আসল আমরা শুধু তাদের দেখাশোনা করলেই হচ্ছেনা – কারণ তাদেরকে তো আর চিরদিন এভাবে রাখা যাবেনা – তাদের নিরাপদে দেশে ফিরে যাবার ব্যাবস্থাও করতে হবে। আর তা করার একমাত্র পথ হল শেখ মুজিবুর ও তার সমর্থকদের নেতৃত্বের সরকারকে প্রতিষ্ঠিত করা অথবা মিলিটারি একশন। এর মধ্যে কোনটা বাস্তবসম্মত? সেই পথে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রথম স্টেপ হতে পারে। কিন্তু এটাও মানতে হবে যে মিলিটারি একশন অনিবার্য – অতএব আমাদের খুব দ্রুত স্বীকৃতি দিতে হবে।

জনাব ডেপুটি স্পিকার: এখনও প্রায় ১২ জন এই বিতর্কে অংশগ্রহণ করতে চান। এবং মাননীয় মন্ত্রী ও যিনি প্রস্তাবকারী তাদেরকে জবাবও দিতে হবে। এত কিছু ২০ মিনিটে সম্ভব না। তাই আমি বিষয়টি সম্পর্কে হাউজের মত চাই।

আমরা ৫ টা ২৫ মিনিট পর্যন্ত সময় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দেখি কি হয়।
সংসদ বিষয়ক এবং শিপিং ও পরিবহন বিষয়ক মন্ত্রী(শ্রী রাজ বাহাদুর): আমরা প্রস্তাবক এবং মন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করতে চাই জবাব দিতে তাদের কত সময় প্রয়োজন হবে। অবশিষ্ট সময় আলোচনা করতে দেওয়া যাবে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রী (শ্রী শরণ সিং): আমার ১৫ মিনিট সময় লাগতে পারে।

শ্রী এস এম বানেরি: আমরা ৫ টা ২৫ মিনিটের ব্যাপারে সম্মত। তিনি মাত্র ১৫ মিনিট সময় নিতে চান। তিনি এটা সম্পর্কে কিছুই বলতে চাচ্ছেন না। তাকে অন্তত ইয়াহিয়া খানের সাম্প্রতিক বিবৃতি সম্পর্কে কিছু বলতে দেয়া যাক। তিনি সে বিষয়ে নীরব থাকতে চান।

শ্রী সমর গুহ: আমার ২৫ মিনিট প্রয়োজন হবে।

জনাব ডেপুটি স্পিকার: মন্ত্রী এবং প্রস্তাবক মোট ৪০ মিনিট সময় লাগবে বলেছেন। এর আলোকে বাকি বিতর্ক আমাদের এডজাস্ট করতে হবে।

শ্রী দীনেশচন্দ্র গোস্বামী (গৌহাটি): বাংলাদেশ বিষয়টি দেশের প্রতিটি নাগরিকের মনে আছে। এমনকি এই হাউজে আমরা আশা, রাগ, হতাশা, হতাশা, ক্ষোভ এবং নানা রকম অভিব্যক্তি পেয়েছি। এছাড়া এই হাউজে একটি অনুভূতি কাজ করছে – আমি এটা সঠিকভাবে টের পাচ্ছি – তা হল বিশ্বশক্তিগুলো প্রত্যাশিত পদ্ধতিতে এগিয়ে আসিনি – তাই আমাদের নিজেদেরই কিছু সিদ্ধান্তে যেতে হবে। আমি অনুভব করতে পারছি এতে করে যার জন্য আমরা যুদ্ধ করছি সেটা একটু পরাভূত হবে।

১৯৫৩ সাল থেকে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শক্তি ও সর্বগ্রাসী বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। এই বাহিনী সমানভাবে সুষম। পশ্চিমা শক্তির সাহায্যে সর্বগ্রাসী বাহিনী সবসময় গণতান্ত্রিক শক্তিকে চূর্ণ করেছে। এই জন্য ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে একটি প্রস্তাব পাস করে। যতদূর জানা যায় তা জোটনিরপেক্ষ নীতি ছিল। পশ্চিমা শক্তিগুলো উপলব্ধি করেছে যে, যদি বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের মুক্তির উপায় পেয়ে যায় তাহলে এই অংশে পশ্চিমাদের আধিপত্য শেষ হয়ে যাবে। অতএব, তাদের নিজস্ব স্বার্থে তারা একটি নীতি অবলম্বন করছে যা আমাদের পছন্দ না। এই কারণে এমনকি ব্রিটিশ সরকারও বলছে যে, এটি বাংলাদেশের একটি অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।

পশ্চিমা শক্তির এই প্রতিক্রিয়ার কারণে তাদের সাথে আলোচনায় গেলে সেটা আমাদের জন্য ভুল সিদ্ধান্ত হবে।

বিভিন্ন মুড এবং অনুভূতির কারণে কিছু ভুল পন্থা ইতোমধ্যে জায়গা নিয়েছে। ‘বাংলাদেশ ইস্যু’ তে আমাদের কেউ কেউ অনুভব করে যে অর্থনৈতিক বিষয়টি সমাধান করাই মূল সমস্যা – সেটি সমাধান হলে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হবে। দ্বিতীয়ত, আরেকটি অনুভূতি হচ্ছে বাংলাদেশ সমস্যার বিষয়ে আমরা আমাদের নিজস্ব যা করার তা করব তাতে করে সেটা মুজিবুর রহমান গ্রহণ করুন বা না করুন। যদি আমরা মনে করি যে, শরণার্থী সমস্যা বাংলাদেশের নিজেদের সমস্যা তাহলে তা হবে চরম ভুল। এই জন্য আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রত্যেক বার বলেছেন যে আমরা বাংলাদেশের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চেষ্টা করব।

রাজনৈতিক সমাধান দ্বারা কি বোঝানো হয়? এমন সমাধান যা মুজিব ও তার অনুসারীদের কাছে গ্রহণযোগ্য। তৃতীয় প্রশ্ন হল, এই বিতর্কের কোন অংশ নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন? প্রশ্ন হল আমরা বাংলাদেশের নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দান করব কিনা? আমি যতদূর জানি যে স্বীকৃতি একটি আইন দ্বারা পরিচালিত ব্যাপার নয়, এটা একটা পলিসি। তাছাড়া স্বীকৃতি শুধু সিদ্ধান্ত নেবার বিষয়, আইনি কর্তব্য সম্পাদনের পর অর্জিত কোন ফল নয়। কিন্তু জাতীয় স্বার্থ অনুসারে হতে হবে। যদিও এটা নীতির ব্যাপার, তবে এটা অস্বীকার করা যাবে না যে আন্তর্জাতিক কিছু নির্দিষ্ট শর্ত এর উপর প্রযোজ্য। সেগুলো হল – প্রথমত; একটি স্বাধীন সরকার ব্যাবস্থা থাকা, দ্বিতীয়ত, সেই সরকারের কার্যকর কর্তৃত্ব জনসংখ্যার বেশিরভাগ অংশ মেনে চলবে, তৃতীয়ত, নির্দিষ্ট অঞ্চল থাকা। সংক্ষেপে বাহ্যিক স্বাধীনতা এবং একটি যুক্তিসঙ্গতভাবে সংজ্ঞায়িত অঞ্চল ও সরকার ব্যাবস্থা অপরিহার্য।

যতক্ষণ এগুলো উপস্থিত থাকে – অথবা বলা যায় – যদি কোন জাতি স্থায়িত্ব ও রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতার এই শর্ত পূরণ করতে ব্যর্থ হয়, তবে এটা সাধারণত আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত এমন কাউকে স্বীকৃতি দেয়া বন্ধুসুলভ কাজ নয়। বলতে গেলে এটা এক রকমের হস্তক্ষেপ এবং আন্তর্জাতিক কর্তব্যে অবহেলা স্বরূপ।

অতএব, যখন আমরা স্বীকৃতি দেব তখন দেখব প্রাথমিক বিষয়গুলি উপস্থিত আছে কিনা। অকাল স্বীকৃতি শুধুমাত্র পাকিস্তানকে সমস্যার গুরুত্ব অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিতে সাহায্য করবে এবং মুক্তিকামী যোদ্ধাদের অপ্রত্যাশিত দিকে ধাবিত করবে। এর মানে এই নয় যে আমি স্বীকৃতির বিরোধিতা করছি। আমি মনে করি, যদি আমরা স্বীকৃতি দান করতে যাই তবে আমাদের তিনটি সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য আছে কিনা তা দেখতে হবে। প্রথমত, আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থে মুজিবুর রহমান ও তাঁর দলকে বৈধতার টিকিট দেব যাতে অগণতান্ত্রিক শক্তি, আভ্যন্তরীণ ও বহিস্থিতভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত আমরা সচেতন যে স্বীকৃতির প্রশ্নে স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধি পাবে। এছাড়াও, এটি সরাসরি এবং পরোক্ষভাবে, ইয়াহিয়া খানের বাংলাদেশে ইচ্ছাকৃত অগণতান্ত্রিক নকশা প্রণয়নের প্ল্যান স্থবির করে দেবে।

তাই স্বীকৃতি দেবার আগে শর্তগুলো আছে কিনা দেখতে হবে। যদি আমরা দেখি যে সবগুলো বিষয় নেই তবে আমি মনে করি এখনো স্বীকৃতি দেবার সময় হয়নি। তবে আমাদের এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যাতে এগুলো পূরণ হয়।

এই কথাগুলো বলে আমি এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করছি।
শ্রী ইন্দ্রজিত গুপ্ত (আলিপুর): জনাব ডেপুটি স্পিকার, স্যার।

সর্ব প্রথম আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে মনে করিয়ে দিতে চাই এতে আমাদের কোন উপকার হবে কিনা। অবশ্যই, এই ধরনের কথা তাঁর দলের এক সদস্য বলেছেন যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গৃহীত হবার মত বিষয়গুলো উপস্থিত আছে কিনা – একটি বিশেষ সরকার স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য কিনা সেগুলো দেখতে হবে- অন্যথায় আমরা এমন কিছু করতে চাইনা যা বিরক্তিকরভাবে প্রকাশিত হয়। আমি এটা বলার জন্য দুঃখিত। কিন্তু কেউ যদি এটিকে মানদণ্ড ধরে যুক্তিতর্ক করতে চায় এবং আন্তর্জাতিক আচরণের নীতি মানে সেক্ষেত্রে মাননীয় মন্ত্রী খুব ভালভাবেই জানেন যে প্রকৃতপক্ষে আন্তর্জাতিক বিশ্ব সেভাবে তা মেনে নেবেনা। ইসরায়েল, যা পাকিস্তানের চেয়ে ছোট, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সর্বসম্মত একটি প্রস্তাবে তাকে বলা হয়েছিল ঐ অঞ্চলের সামরিক দখল ছেড়ে দিতে। কিন্তু ইসরাইল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সেই সিদ্ধান্তকে সামান্যতম ভ্রুক্ষেপ করেনি। বিশ্ব কি এটা সম্পর্কে কিছু করতে সক্ষম হয়েছে?

জাতিসংঘ একাধিকবার সুপারিশ করেছে যে, কেউ দক্ষিণ আফ্রিকায় অস্ত্র বিক্রয় করবেন না। অথচ যুক্তরাজ্য সরকার দক্ষিণ আফ্রিকায় অস্ত্র বিক্রি করে যাচ্ছে। আপনি এটি সম্পর্কে কিছু করতে পারেন? সুতরাং, আমাদের বাস্তববাদী হতে হবে এবং দেখুন আমরা কেমন বিশ্বে বাস করছি। শুধু কাল্পনিক এবং তাত্ত্বিক নীতির কথা বলে লাভ নাই। বরং স্বীকৃতি দেবার আগে সাধারণ শর্তগুলো পূরণ করা জরুরী। বিশ্ব তেমন কোন স্থান না। আপনাকে নিজের জাতীয় স্বার্থ অনুযায়ী কাজ করতে হবে। এটা বাংলাদেশের মানুষের প্রতি উদারতা দেখানোর বিষয় নয়। আমি চাইনা আপনি বিষয়টা সেভাবে দেখুন। আমি চাই আপনি এটা আমাদের নিজের জাতীয় স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখুন। শুধুমাত্র এটাই নির্ণায়ক এবং আমাদের সরকারের মুখপাত্রদের এটাই বলতে বলা হয়। যখন তারা বলে যে তারা চাপে পড়ে কাজ করছে – তারা আসলে ক্রুদ্ধ হয়ে বলে। “আমরা কখনোই চাপে ছিলাম না। আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থ অনুযায়ী কাজ করব”। এখন এটা পরীক্ষা করার সময়। আমরা দেখতে চাই তারা এখন কি করে।

গত সোমবার থেকে পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়েছে। দুটি জিনিস তৈরি হয়েছে যার জন্য সরকার অনেক দিন অপেক্ষা করেছেন। একটি হল ইয়াহিয়া খানের ঘোষনা। এর বিস্তারিত আমি বলার দরকার মনে করছিনা। চিন্তার ধারা এখন পাল্টে যাবে। আমাদের এখন রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য চেষ্টা করতে হবে। আন্তর্জাতিক জনমত তৈরি করতে হবে ও অন্যান্য সরকারকে চাপ দিতে হবে যাতে করে ইয়াহিয়া খান একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় আসতে বাধ্য হয়। এখন তিনি তার সম্প্রচারে বলেছেন অনির্দিষ্টকালের জন্য সামরিক শাসন অব্যাহত থাকবে। মার্শাল ল অব্যাহত থাকবে। পূর্ব পাকিস্তান উপনিবেশ হবে। এতে কোনো ধরনের রাজনৈতিক মীমাংসার সম্ভবনা দেখা যাচ্ছেনা। সাধারণ নির্বাচন কার্যত বাতিল করা হয়েছে। সকল আওয়ামী লীগ সদস্য যারা নির্বাচিত হয়েছেন তাদের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। এবং উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগেকে নিষিদ্ধ করা হবে। আমি ক্ষোভের সাথে জানাচ্ছি সরদার শরণ সিং গত শুক্রবারের বিবৃতিতে মুজিবুর রহমানের মুক্তির সম্পর্কে একটি শব্দও বলেননি। রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সকল স্লোগান এখন মৃত। দয়া করে এটি আবার বলবেন না। ইয়াহিয়া খান স্পষ্টভাবে তার কথায় বলে দিয়েছেন তিনি কোন পথে যাচ্ছেন।

দ্বিতীয়ত, অল্প কিছুদিন আগে আমাদের মন্ত্রী দেশের মাটিতে পা ফেললেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার প্রকাশ্যে গত কয়েকদিনে বলেছে যে তারা পাকিস্তানে অর্থনৈতিক, সামরিক বা অন্য কোন এইড বন্ধ করবে না। ইয়াহিয়া খান কেন এই অবস্থা নেবেনা? চীন তাকে সমর্থন করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাঁকে সমর্থন করছে। স্যার, সময় আর নেই। আমি শুধু আর এক বা দুটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে চাই। আমাদের সীমান্তে প্রতিদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনী আক্রমণ করছে এবং আমাদের সীমানা লঙ্ঘন করছে। এটাও এক ধরণের আগ্রাসন। কারণ পাকিস্তানি সেনারা বন্দুক আর বেয়নেটের মুখে লক্ষ লক্ষ মানুষকে আমাদের দেশে পাঠাচ্ছে। এটা খুব শীঘ্রই থামবে না। তারা এব্যাপারে কি করবেন? আমরা কীভাবে আমাদের বর্ডার পাহারা দেব? এটা আমার প্রথম প্রশ্ন। মন্ত্রী বিশ্বকে জানিয়েছেন যে তারা যদি কেউ এগিয়ে না আসেন তাহলে আমরা নিজেদের মত কাজ করতে বাধ্য হব। এখন আমি তার কাছে জানতে চাই সেই সময় এসেছে কিনা। পুরো সময়ে আমরা নিজেদের পিঠ চাপড়িয়েছি – কারণ অনেক দেশ আমাদের পলিসিকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে।

আমি বলতে চাই, স্যার, এখন ইয়াহিয়া খানের ব্রডকাস্টের পর বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম সত্তা হিসেবে স্বীকৃতি পেলনা। আপনিও স্বীকৃতি ছাড়া বাংলাদেশ বলে চালিয়ে যেতে পারেন, কিন্তু এর অর্থ হল, বিশ্ব জানবে যে আপনি পূর্ব পাকিস্তানে ইসলামাবাদের কর্তৃত্বকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন। আপনি কি তা করতে ইচ্ছুক? আমি সব সময় বলে এসেছি নিজেদের এলাকা না হলেও তাদের শাসন চলছে এবং চলতে থাকবে।

এখানে একটি সরকার আছে যেখানে বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা প্রতিনিধিত্ব করে। এটাই আমাদের নৈতিক শক্তি যে আমরা নিজেদের নীতির পক্ষেই আছি। তারা নির্বাচনে ৯৮% আসন পেয়ে জিতেছে। তথাপি তাদের এক বর্গফুট জায়গাও নেই যার উপরে তাদের স্থায়ী নিয়ন্ত্রণ আছে। কিন্তু আপনি মিলিটারি শাসককে স্বীকার করে যান যাদের পেছনে কোন অনুমোদন নেই। এখন এটা পুরো বিশ্বের কাছে উন্মুক্ত। ২ দিন আগে গার্ডিয়ান পত্রিকা সম্পাদকীয়তে সুচারুরূপে একটি প্রশ্ন করেছে যার উত্তর দিতে আমাদের সরকার রাজি হয়নি।

আমি উদ্ধৃতি করছি:
“ইয়াহিয়ার মহাপরিকল্পনার মাঝে আসল প্রশ্নটা কি কখনো করা হয়েছে? পাকিস্তান কি আর বিদ্যমান? ঐক্যের কি আর কোন মূল্য আছে? পাঞ্জাবি সৈন্যদল কি অর্জন করেছেন? মুজিব নিখোঁজ হবার পর পাকিস্তানকে জাদুর কাঠি দিয়ে এক করার জন্য অনেক রক্ত ঝরেছে, অনেক উদ্বাস্তু হয়েছে”।

পাকিস্তান এক করার গল্প এবং এটা তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার – এসব অনেক দেশে বলে বেরানো হচ্ছে। তাই হয়ত আমাদের এই সামরিক শাসনকে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং বাংলাদেশে তাদের কর্তৃত্ব চালিয়ে যেতে দিতে হবে যদিও তা এখন হজম করা যাবে না। আমি মনে করি ইয়াহিয়া খানের সম্প্রচারে অন্যান্য কিছু দেশের চিন্তায় কিছু বদল আসবে, যারা সম্ভবত রাজনৈতিক নিষ্পত্তির পক্ষে ছিলেন – আমি জানি না যদিও।

আমি পত্রিকায় জেনেছি যে ডঃ শরণ সিং বুলগেরিয়ার প্রধানমন্ত্রী সোফিয়ার সঙ্গে কথা বলেছেন। আমি জানিনা সঠিকভাবে রিপোর্ট করা হয়েছে কিনা। রিপোর্টে বলা হয়েছে এটা কোন ভাবেই আর পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়। যদি তাই হয় তবে আমি মনে করি এটা বাতাসে খড়ের মত ব্যাপার। তবে এটা ঠিক একজন ডুবন্ত মানুষ খড় ধরে হলেও বাঁচতে চায়। আমার মনে হয় আমাদের সরকার এখন এমন একটি পরিস্থিতির মধ্যে এসেছে যে আমাদের নিজস্ব সীমানা রক্ষা করতেও পারছেনা। উদ্বাস্তু প্রবাহ বন্ধ করতে পারছে না। আমেরিকান অস্ত্র পাকিস্তান যাওয়া বন্ধ করতে পারছে না এবং এমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছেন না যার মাধ্যমে আমরা আমাদের অঞ্চল, সীমানা ও অর্থনিতি রক্ষা করতে সক্ষম। এখন আবার ভাবতে হবে। স্যার, অনেক মানুষ তাদের বলেছে যে সময় হয়েছে। অতএব আমি অনুরোধ করি দয়া করে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিন যারা তাদের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে – যারা নৈতিকভাবে সমগ্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে স্বীকৃত। এবং আপনি জানিয়ে দিন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক শাসনকে আমরা স্বীকৃতি দেই না। এর পর আমরা পরবর্তি পদক্ষেপে এগিয়ে যাব।

জনাব ডেপুটি স্পিকারঃ এটা এমন একটি বিষয় যেখানে সব সদস্য ইনভল্ভড থাকতে চান। যদি সবাই ৫ মিনিটে বলে শেষ করে সহযোগিতা কোনে তাহলে আজকে নির্ধারিত সময়ে শেষ করা যাবে। তাই আমি সদস্যদের অনুরোধ করছি সংক্ষেপে বলতে।

শ্রী নিম্বাল্কার(কোলহাপুর): জনাব ডেপুটি স্পিকার, স্যার, আজকের বিতর্কে আমি টাইমস অব ইন্ডিয়ার গোল্ডস্মিথ থেকে কোট করছি –

‘সত্যিকারের উদারতা মানে মানবতার সকল নিয়ম মেনে চলা নয়। জীবনের অন্তিম ইচ্ছাকে ফলো করতে এবং বর্তমানের সুবিধাগুলোকে দমিয়ে রেখে ভবিষ্যতের ভালো ফল থেকে বঞ্চিত করাও উদারতা।
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার বিষয়টি খুব দ্রুত সমাধান করা সম্ভব না। শুধুমাত্র সরকার জানেন কখন সেই সঠিক সময় আসবে – কারণ তাদের কাছেই সঠিক তথ্য আছে।

শ্রী এস এম ব্যানার্জী: সঠিক সময় কখন?

শ্রী নিম্বাল্কার: এটা সরকারের সিদ্ধান্ত। আমি বলতে চাই আমাদের মন্ত্রী বিভিন্ন রাজধানীতে যে সফর করেছেন এর ফলে ঐ সময়ে পৌঁছাতে আমরা দ্রুত সক্ষম হব।

এখানে আমি দুই জন সংসদ সদস্যের কথা বলতে চাই যারা একসময় ট্রেজারি বেঞ্চে ছিলেন। একজন সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী শ্রী দীনেশ সিং – তিনি বলেছেন সরকার একটি সুযোগ হারাল; আমি মনে করি সরকারের ২৫ মার্চই ব্যাবস্থা নেয়া উচিৎ ছিল। আমি এর সাথে একমত না। প্রথমতঃ যদি আমরা শ্রী দীনেশ সিং এর পথে যেতাম তাহলে একটি দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হত। সেটা পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশের মধ্যে না – বরং পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে। এবং সেটাই আমরা এড়াতে চেয়েছি। আমরা যদি শুধুমাত্র সেটা করতাম এবং পাকিস্তান ভারতকে আগ্রাসক হিসাবে ব্র্যান্ডেড করে নিরাপত্তা পরিষদের কাছে যেত। এটা পাকিস্তানের জন্য কঠিন কোন কাজ ছিলোনা। আমি বুঝিনা মন্ত্রী কতটা দায়িত্ব নিয়ে অফিস করেন। মন্ত্রণালয় যে মুহুর্তে তাদের কাছ থেকে নিয়ে যাওয়া হল তখন থেকেই এমন আচরণ শুরু।

দ্বিতীয় প্রাক্তন মন্ত্রী যার কথা আমি বলতে চাই তিনি হলেন শ্রী ক্রিস্টিনা মেনন। যে কোন ব্যক্তি যিনি ভারতের স্বাধীনতার আগে অথবা ঠিক তার পরপর লন্ডনে ছিলেন; তিনি নিশ্চই শ্রী কৃষ্ণ মেননের প্রতি শ্রদ্ধা থামাতে পারেন না। তিনি মাঝে মাঝে খুব তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্তে আসতেন। খুব সক্ষম আইনজীবী হওয়ায় তার কথার পক্ষে যুক্তি তর্ক ও ন্যায্যতা খুঁজে বের করে ফেলতেন।

শ্রী সমর গুহ: আমরা একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করছি যা নিয়ে গোটা জাতি উদ্বিগ্ন। যদি ট্রেজারি বেঞ্চের সদস্যরা বিরোধীদলীয় সদস্যদের ও তাদের মতামতকে আক্রমণ করা শুরু করে তবে আমি মনে করি তারা শুধু সরকারের না এমনকি দেশের অপকার করছেন।

জনাব ডেপুটি স্পিকার: আমি মনে করি যুক্তি খুব বৈধ। এটা এমন একটি প্রশ্ন যা নিয়ে আমরা সবাই উদ্বিগ্ন। এখানে পারস্পরিক সমালোচনা করা উচিত হবে না।

শ্রী নিম্বল্কর: আমাদের মন্ত্রীরা যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তা ধীরে ধীরে আমাদের জন্য সাফল্য বয়ে আনছে।

[শ্রী কে এন তাওয়ারি আসন গ্রহণ করলেন]

প্রফেসর ড. মাদি-টু ডান্ডেভাতে(রাজাপুর): জনাব ডেপুটি স্পিকার স্যার, একটা জাতির জীবনে কিছু মুহূর্ত আসে যখন সার্বভৌম সংসদে দল ও দলীয় রাজনীতি উপরে উঠতে হয়। চীনা আগ্রাসনের সময় আমরা এরকম করেছিলাম। এবং পাকিস্তান আগ্রাসনের সময়ও একই পুনরাবৃত্তি করেছিলাম। আজও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করতে হবে। বাংলাদেশের ইস্যু শুধুমাত্র দলীয় রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে হবেনা – বরং জাতীয় স্বার্থের দিকে তাকিয়ে দেখতে হবে। ট্রেজারি বা বিরোধী দলের বেঞ্চ থেকে মিসলিডিং করলে হবেনা। এটা স্পষ্টভাবে পরিষ্কার করা যাক, যে বাংলাদেশের স্বীকৃতির বিষয়টি আরো শাণিত হয়ে গেছে এবং বিশেষ করে সাম্প্রতিক পাকিস্তানে অ্যামেরিকার অস্ত্র সাহায্যে এটি খুব বড় পরিমাণে দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে। এমন একটি সময়ে যখন বাংলাদেশ পাকিস্তানের বিপক্ষে একটি ভয়ানক সংগ্রামে জড়িত। এটিও আবার কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় এবং আমি হাউজে বলতে চাই এটা বিশ্বশক্তিগুলোর রাজনীতির পরিণতি। এশিয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখা দরকার। এটাই তাদের ‘এশিয়ান কৌশল’। এ কারণে আমেরিকা চায় যে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ নয় বরং একটা টানা উত্তেজনা বজায় থাকুক।

এ কারণে আমেরিকা চায়না যে বাংলাদেশের মত গতিশীল ও উদীয়মান জাতি সামনে আসুক। বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ এবং ভারতের মিত্র এবং যদি বাংলাদেশ ও ধর্মনিরপেক্ষ ভারত জোট বজায় থাকে তাহলে দক্ষিণ এশীয় রাজনীতিতে ক্ষমতার ভারসাম্য সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হবে। ক্ষমতার ভারসাম্য তারা পুনরুদ্ধার করতে চায়।

আর এটা নিছক আমেরিকার কৌশল নয়। একটা সময় ছিল যখন সোভিয়েত রাশিয়া কাশ্মীর সমস্যাকে কেন্দ্র করে ভারতকে শক্তিশালী সমর্থন দিয়েছিল। অনন্তর যখন তারা উপলব্ধি করেন যে পাকিস্তান আমেরিকার একচেটিয়া সহানুভূতি পাচ্ছে তখন তারা ধীরে ধীরে কাশ্মীর ইস্যুতে জোট নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করে। এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে পাকিস্তানের জন্য অর্থনৈতিক সাহায্যের হাত প্রসারিত করে। এভাবেই রাশিয়ার পলিসি নতুন আকার ধারণ করে।

বিশ্বশক্তিগুলোর রাজনীতির সাধারণ প্যাটার্ন দেখে মনে হচ্ছে যে, তারা বাংলাদেশের স্বীকৃতির ইস্যুতে সমবেদনার মনোভাব গ্রহণ করবে। এশীয় রাজনীতির কৌশল থেকে মনে হয় বাংলাদেশের ব্যাপারটি বিশ্ব শক্তিগুলোর কাছে প্রজেক্টেড আছে। যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের নীতি ও সম্পর্ক শুরু থেকেই স্পষ্ট আছে।

দুর্ভাগ্যবশত, এটা সত্য যে, আমাদের দেশ বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের দূতাবাস ব্যর্থ হয়েছে। একজন ব্যক্তি যাকে বিশাল কাজে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তিনি হলেন জয় প্রকাশ নারায়ণ। তিনি শুধু ভারত সরকারের রাষ্ট্রদূত না বরং আমাদের জনগণের রাষ্ট্রদূত – কারণ একমাত্র তিনি বাংলাদেশের স্বীকৃতির পক্ষে আছেন। অসাধারণ প্রচেষ্টা নিচ্ছেন তিনি। আমরা তার কাজের প্রশংসা করছি।

যতদূর বিশ্বশক্তিগুলো উদ্বিগ্ন আছে, তাতে আমাদের এমন কাজ করা ঠিক হবেনা যে অন্য দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে তারপরে আমরা দেব। আমি আমাদের সরকারের অবস্থান বুঝতে পারি। সম্ভবত সরকার ভীত যে যদি কোন বিশ্বশক্তি বাংলাদেশের স্বীকৃতির ব্যাপারে এগিয়ে না আসে এবং শুধুমাত্র ভারত তা একতরফাভাবে করে এবং আরও যদি চীন পাকিস্তানের দিকে ঝোঁকে তাহলে পাকিস্তানের সাথে সরকারের সরাসরি একটি দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়ে যায় – সাথে অন্যান্য দেশের সাথেও। আমেরিকা সহ পাকিস্তান ও চীনের সমন্বয় হলে সেটা হবে একটি বিশাল দুর্যোগ। সম্ভবত সেই ভয় সরকারের মনের মধ্যে লুকোনোর আছে।

আমি এই বলে শেষ করছি যে যখন ইয়াহিয়া খান হুমকি দিয়েছেন যে তিনি তার পুতুল শাসন চাপিয়ে দিবেন সেই বিশেষ সন্ধিক্ষণে আমরা অবশ্যই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেব। আমাদের ঝুঁকি নিতে হবে। কোনো সন্দেহ নেই যে, ঝুঁকি আছে কিন্তু আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীর ধারালো ইমেজ আছে। আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ইমেজ একজন ‘সফল রাজনৈতিক’ হিসেবে। আমি চাই তিনি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও সেই ইমেজ ধরে রাখবেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতির সঙ্গে জুয়া; কিছু ঝুঁকিপূর্ন সূক্ষ্ম হিসাব নিকাশ; বাংলাদেশকে স্বীকৃতি; বাংলাদেশ বিষয়ে নতুন বাহিনী তৈরী করা এবং ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার একটি নতুন পরিবেশ সৃষ্টি করা – এভাবেই আগাতে হবে। বাংলাদেশ ও ভারতের এই সমন্বয় এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য ধ্বংস করে দেবে এবং সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের আন্তর্জাতিক সংঘাত ও ক্ষমতার রাজনীতির জন্য একটি গুটি হিসেবে এশিয়ার জমি ব্যবহার করতে পারবে না। এই পদ্ধতিতেই আগাতে হবে এবং এই ঝুঁকি নিতে হবে। আমি আশা করি এই মনোভাব গ্রহণ করা হবে এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হবে।

শ্রী বি কে দাশ চৌধুরী (কোচবিহার): জনাব চেয়ারম্যান, স্যার ভারতের অতীত ঐতিহ্য বিবেচনায় বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য স্বতঃস্ফূর্ত, ব্যাপক এবং দেশব্যাপী যে চাহিদা তৈরি হয়েছে তার নিজস্ব যুক্তি আছে।

ব্যাপারটি হাউসের সামনে স্থাপন করা হয়েছে এবং আর্গুমেন্ট চলছে যে স্বীকৃতি দিতে হলে নির্দিষ্ট কিছু মৌলিক মানদণ্ড লাগে। শুধু লজিস্টিক ভিউ এবং তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিলেই হয় না। হাউসের একজন মাননীয় সদস্য পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে একটি দেশকে স্বীকৃতি দেবার নির্দিষ্ট কিছু পূর্বশর্ত আছে।

আমি প্রথমে ওইসব পয়েন্টের জবাব দিতে চাই। তিনি বলেছেন, সেখানে একটি অঞ্চল থাকতে হবে এবং কার্যকর সরকার থাকতে হবে এবং স্থায়িত্ব থাকতে হবে। আমি মাননীয় সদস্যকে অনুরোধ করব এগুলো সত্য ও সঠিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা হবে। একটি সার্বভৌম স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছে এটি সত্য এবং এটি স্পষ্টভাবে এবং নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ইতিহাসে একটি গুণগত পরিবর্তন এনেছে। আর এতে বোঝা যায় যে এটি পাকিস্তানকে একটি বড় ধাক্কা দিয়েছে তাদের দ্বিজাতি তত্ত্বে। দেখা যায় যে পাকিস্তানের দ্বিজাতি তত্ত্বের মৃত্যু ঘটেছে পূর্ব পাকিস্তানে যার নাম এখন বাংলাদেশ।

এই তিনটি শর্তের সবগুলোই বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আছে। সেখানে একটি সরকার আছে, আর এই সরকার বাংলাদেশের ৯০% মানুষের সমর্থনপুষ্ট। এরপর কেউ কীভাবে বলে যে বাংলাদেশ স্বীকৃতি পাবার যোগ্য না? এরপর আসে এলাকার প্রশ্ন। এটা বিশ্বের সবার জানা যে অন্তত কিছু এলাকা মুক্তিফৌজের নিয়ন্ত্রণাধীন।

অন্যান্য বিষয়গুলোর কি অবস্থা? অন্য বিষয় হল এটা টেকসই কিনা। এটা সত্য যে যদি বাংলাদেশ স্বীকৃতি পায় তাহলে ভারত ও বাংলাদেশ মিলে এমন একটি অবস্থান তৈরি করবে যা একদিন বিশ্বের ক্ষমতার রাজনীতিকে সামঞ্জস্যপূর্ন করবে।

এই সব কথা বিবেচনা করে, আমি বুঝতে পারি না কেন এই ধরণের বিতর্ক করা হচ্ছে।
আরেকটি মাননীয় সদস্য বললেন এখনি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমি তাকে সব কিছু বিবেচনা করতে বলব। আমরা একটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান কাঠামোতে কাজ করি। আমি তাকে জিজ্ঞেস করতে চাই এটা সরকারের জন্য একচেটিয়া হয়ে যাবে কিনা? সরকারের কি সংসদের সদস্যদের ঐক্যমত্য নিয়ে গনতান্ত্রিকভাবে কাজ করা উচিৎ নয়? সরকারকে সদস্যদের মতামত বিবেচনা করতে হবে, ভারতীয় জনগণের মতামত বিবেচনা করতে হবে।

আন্তর্জাতিক আইনের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনাটা আরও বিস্তর। আমি সন্মানিত সদস্যকে সেগুলোও মাথায় রাখতে বলব।

আন্তর্জাতিক আইনের কি কোন বেসিক কাঠামো আছে? এমন কোন বেসিক নিয়ম আছে যা সবসময় স্থির?

আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে আমরা দেখি জরুরী পরিস্থিতিতে, নির্দিষ্ট মতামত এবং নির্দিষ্ট উন্নয়নের কথা বিবেচনা করে, নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ক্ষমতাধর রাষ্ট্র সেগুলো গ্রহণ করে। বিপরীতভাবে, কিছু আইন এবং নিয়মাবলী আছে যা পালন করার বাধ্যবাধকতা আছে। তাই, সে ক্ষেত্রে, আমি সরকারের নিকট আপীল করব, আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে, লজিস্টিক ভিউ বা তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে কোন বাঁধা নেই।

শুধু তাই নয়, অতিতে ১৯০৩ সালে অ্যামেরিকা পানামাকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। তার আগে পানামার এক ইঞ্চি জায়গা তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। অ্যামেরিকা তাদের স্বীকৃতি দেয়। এমনকি প্রথম যুদ্ধের পরে এরকম অনেক রাষ্ট্রকে অ্যামেরিকা স্বীকৃতি দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আরও কিছু রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়। ইন্দোনেশিয়াতে নরডমের নেতৃত্বের সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি কি ছিল? এটা খুব পরিষ্কার।

সুতরাং, এই সব দিক বিবেচনা করে, পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক সরকার বাংলাদেশকে কয়েক বছরের জন্য একটি উপনিবেশ করে রাখতে চায়। তাই এটা সরকারের জন্য দায়িত্ব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া। এবং মনে রাখবেন যখন আপনি বাংলাদেশকে সকল সহায়তা দেবেন তখন স্বীকৃতি দেয়া থাকলে আপনি ভারমুক্ত অনুভব করবেন। তবে তা হবে স্বাধীনতা আন্দোলনের মাধ্যমে। আমি সরকারের কাছে অনুরোধ করতে চাই এখনি স্বীকৃতি দেবার আসল সময়। এখনো যদি আমরা এই পথ না নেই তাহলে সামনে আর কি করতে পারব? তাই এই পদক্ষেপ পরের স্টেপে যেতে সহায়তা করবে।

জনাব. চেয়ারম্যান: জনাব কৃষ্ণ মেনন,
শ্রী বি কে দাশ চৌধুরিঃ যদি সরকার সময় মত তা করতে ব্যার্থ হয় তবে এটা ভণ্ডামি হবে যা পরবর্তিতে ব্যার্থতায় পর্যবসিত হবে …

শ্রী কৃষ্ণ মেনন (ত্রিভানদ্রাম): আমি স্বল্প সময়ে আমার দৃষ্টিভঙ্গি জানাতে চাই। তাই আমার প্রশ্ন সংক্ষিপ্ত করে শুধু বাংলাদেশকে স্বীকৃতির প্রশ্নে থাকতে চাই। এবং অনেকেই বলেছে যে এটা কোন দলীয় প্রশ্ন নয়।

আমিও তাই বলি। এমনকি যদি সেটাও হয় আমি বলব কিছু দিন আগে ট্রেজারি বেঞ্চ থেকে বলা হয়েছিল যে স্বীকৃতি এখন উল্লেখযোগ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে – সেটা মিথ্যা ছিলোনা। যুদ্ধ শুরু হয়েছে ৮০ বা ৯০ দিন হল। এখনো যদি সরকার মনে করে যে সময় আছে তবে তা ভুল হবে।

আজ বিকেলে এবং আগে আলোচনায় বৈদেশিক নীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমি সেগুলোর উপর আলোচনা করতে চাইনা। পরেও সুযোগ থাকতে পারে। আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে এখন বলছি, যে আমি এখন পররাষ্ট্র বিতর্কে যেতে চাই যদি স্পিকার আমাকে অনুমতি দেন। এটা হয়ত ফরেন পলিসি নিয়ে বলার সময়। অন্যান্য বিষয় এখন আমার অবস্থানে আসে না।

এটা আবশ্যক যে বাংলাদেশকে স্বীকার করা উচিত। বিশেষ করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের সাম্প্রতিক বক্তব্যে যখন তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যাকে পছন্দ করব তাদের একসঙ্গে ডাকব – গণপরিষদ বা অন্যত্র’। কমান্ড পারফরম্যান্স। যখন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের লেবার পার্টির আই এস ও মেম্বাররা স্বীকৃতির আবেদন করতে পারে, তখন এটা বেমানান নয় যে সমাজতান্ত্রিক দল বাংলাদেশকে স্বীকৃতির দাবী করবে। আর এখন স্বীকৃতি মানে রাষ্ট্রদূত পাঠানো নয়। সেই আলোচনা এখানে আসেনা। এটা দূত পাঠানোর বিষয় নয়। এটা একটি জাতির অস্তিত্ব স্বীকারের প্রশ্ন। পূর্ব বাংলার দশ ভাগের এক ভাগ লোক এখন আমাদের দেশে অবস্থান করছে। আমরা তাদের সক্রিয় করার জন্য কী করছি? আমরা তঁদের কি সহায়তা দিচ্ছি? যাতে তারা ফিরে গিয়ে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে পারে? আমি বলছি না যে আমরা বাংলাদেশে অস্ত্র পাচার করব। কিন্তু আমাদের সাহায্য করতে হবে বাংলাদেশের শরণার্থীদের সক্রিয় করার ব্যাপারে যাতে তারা পাকিস্তানী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে। আমি বলছিনা যে আমি আমাদের পাকিস্তান বা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উস্কানি দিতে হবে।

আমি ট্রেজারি বেঞ্চ থেকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে অনেক শুনেছি। আমি শুনেছি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এরকম অনেক বার বলেছেন। এখন যদি বলি পাকিস্তানের একশন ‘আভ্যন্তরীণ বিষয়’ নয় তাহলে স্বীকৃতি দেয়া কেন আভ্যন্তরীণ হবে? কোন বহিরাগত কর্তৃপক্ষ বলে কি কিছু আছে যারা আমাদের বলে দেবে? আমাদের কি অন্য কোন দেশের বলার অপেক্ষায় থাকতে হবে? আমি বলছি জনাব চেয়ারম্যান, এটা আমাদের সিদ্ধান্ত, শধুই আমাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। অন্য কোন দেশের হুমকি দেবার কিছু নেই। সময় চলে যায়নি। কারণ পরিস্থিতি নতুন মোড় নিয়েছে। সেখানে আলাদা ‘সরকার’ গঠন করতে হবে। আমি ইচ্ছাকৃতভাবে বলতে চাই, মানুষ আমার বক্তব্য সম্পর্কে যাই ভাবুন না কেন, আমাদের সরকারের উচিৎ পূর্র বাংলায় ভিয়েতনামের মত আরেকটি ভিত্তি গড়ে দেয়া। যখন আমি বাংলাদেশের কথা প্রথমে বলেছিলাম, যখন প্রথম এটা চেম্বারে উঠেছিল, অনেকেই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়েছিলেন। আমি স্পষ্টভাবে বলি, অ্যামেরিকা শুধু যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেখানে সফর করছিলেন তখনি পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠায়নি বরং যখন তিনি ফিরে এসেছেন তখনো পাঠিয়েছে। এবং এটা ধারাবাহিকভাবে চলমান আছে।

একটি মাননীয় সদস্য: আপনি কি চিনের সম্পর্কেও তা মনে করেন না?

জনাব চেয়ারম্যান: দয়া করে কোন হস্তক্ষেপ করবেন না।

শ্রী কৃষ্ণ মেনন: যদি তাদের সামরিক শক্তির কাছে কোন অস্ত্র না থাকে তবে। যখন তাদেরকে কোন জাতিকে দমিয়ে রাখার জন্য অস্ত্র দেয়া হয় তখন সেটা ইন্দো-চায়না পরিস্থিতির মত হয়। আমরা ধীরে ধীরে সেদিকেই ধাবিত হচ্ছি। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, এই দেশে এখন এবং গত কয়েক বছর ধরে বলার মত কোন পররাষ্ট্র নীতি নাই। আমরা ধীরে ধীরে অস্ত্রহীন ও দুর্বল হয়ে পড়ছি। আমাদের খুঁজে বের করতে হবে এই পরিস্থিতে আমাদের অবস্থান আসলে কোথায়। আমরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছি না কিংবা স্প্যানিশ সিভিল ওয়ারে ব্রিটেনের মত হস্তক্ষেপ, অথবা সীমালঙ্ঘনকারীর জন্য রিং ধরেও বসে নাই। কিন্তু আমাদের বর্তমান পলিসি এগ্রেসরকে (সীমালঙ্ঘঙ্কারী) পুষে রাখছে। কারণ তারা বারবার বলেছে তারা পুনর্গঠন করবেনা। তারা বলছেনা যে তারা স্বীকৃতি দেবে; শুধু বলছে ‘সময় আসেনি বা এখনো যথাযথ হবেনা’। সরকারের কাছে সময় ঘড়ি ধরে আসেনা, কোন অনুষ্ঠানের মাধ্যমেও আসেনা, তাহলে কীভাবে আসে? এটা শুধুই ঘটনার গতি দেখে নির্নয় করতে হয় যাকে আমরা বলি পলিসি।

১৬.00 ঘন্টা

যেমনটি শ্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত বলেছেন যে বাংলাদেশের জনসংখ্যার এক-দশমাংশ পাকিস্তান থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হয়েছে। এটা একধরনের পরোক্ষ আগ্রাসন। যখন একটি দেশ জনগণকে তার নিজের বাড়িতে ভূখণ্ডে বাস করার অনুমতি দেয় না এবং অন্য দেশে পুশ করে – যেমনটা পাকিস্তান করছে – এটা কি? যদি পূর্ববাংলার জনগণ সেখানে কোন অসুবিধা ছাড়াই এখানে আসত তাহলে আমরা তাদের ফিরিয়ে দিতাম অথবা জেলে রাখতাম অথবা সেই অবস্থায় যা করার তা করতে পারতাম। কিন্তু আমরা তা করিনি বা করতে পারিনা কারণ তাদের দেশের আভ্যন্তরীণ অবস্থা এমন যে সেখানকার মানুষ সন্ত্রাসের ভয়ে পালিয়ে এখানে আসছে।

জনাব চেয়ারম্যান, আমি বসে পড়ার আগে একটি কথা বলতে চাই। এখানে যে বিপুল সংখ্যক মানুষ এসেছে তাদেরকে আমরা কোন নার্সিং হোম বা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের সদস্য হিসেবে দেখছিনা। তাদেরকে রাজনৈতিকভাবে, শারীরিকভাবে এবং অন্যান্যভাবে সমর্থ করতে হবে যাতে তারা দেশে ফিরে গিয়ে বহিঃশত্রুর মোকাবিলা করতে পারে। উদ্বাস্তু শিবির (এবং কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে)র ভিতরে প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। সেখানে যেসব সমর্থ শরীরের মানুষ আছে, যাদের কর্মক্ষমতা আছে, বুদ্ধি আছে এবং যারা সাবেক সৈনিক তাদেরকে এসব ফোর্সের দায়িত্ব দিতে হবে। ফলে যখন তারা ফিরে যাবে তারা একটি মুক্তিবাহিনীর মত কাজ করতে পারে।

আমরা ক্রমাগত কিছু শব্দ এবং এক্সপ্রেশন শুনি যে ‘তাদের ফিরে যাওয়ার মত অবস্থা তৈরি করতে হবে। ‘ কে সেই পরিবেশ করে দেবে? তারা কি পাকিস্তান বা বিশ্বের বা জাতিসংঘের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সরকার, যারা কঙ্গোতে একটি জগাখিচুড়ি পাকিয়াছিল? আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হল, আন্তর্জাতিক কোন সহযোগিতার আমরা ব্যবহার করতে চাইনা। পূর্ব বাংলা থেকে যারা এসেছে তাদেরকে এভাবে তৈরি করতে হবে যাতে করে তারা রাজনৈতিকভাবে, মানসিক ও শারীরিক শক্তি দিয়ে সেখানে ফিরে যায় এবং প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তোলে। আমি মনে করি এই সময়ে এটাই আমাদের করতে হবে। আমি এটাকে আর দীর্ঘায়ীত করতে চাইনা।

আর, যদি এই কাজ করা হয়, তাহলে স্বাধীনতাকামী বাহিনীর বিজয়ে কিছু অবদান হয়ত রাখা হবে।

আমি আরও বলতে চাই যে, আমরা বেসরকারী সদস্যদের গতিতে আলোচনা চালাচ্ছি। কেউ ভাবেনি আমরা আজ বিস্ময়কর বা নতুন কিছু বলতে যাচ্ছি। কারণ হল ৩/৪ দিন আগে যখন আমরা এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছিলাম তখন নতুন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। আমাদের কিছু ভিজিটরও সেদিন এখানে ছিল যারা সম্প্রতি পূর্ব বাংলা থেকে ঘুরে এসেছেন। আমি বিশ্বাস করি প্রধানমন্ত্রী নিজেই সরাসরি, বা পরোক্ষভাবে, বলেছেন যে পূর্ববঙ্গে পাকিস্তান ফিরে আসতে পারবেনা। পাকিস্তান সরকার সেখানে থাকবেনা, তাহলে আপত্তি বা স্বীকৃতি দেবার কে আছে সেখানে? পাকিস্তান থেকে আমাদের কূটনীতিকদের সরিয়ে ফেলায় একটি শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে যারা আছে তাদের সঠিক অস্তিত্ব নেই। স্বীকৃতিই পারে তাদের অস্তিত্বকে বাস্তব রূপ দিতে।

এটা দুঃখজনক ব্রিটিশ, আমেরিকান বা ফরাসি কাগজপত্রে আমাদের চেয়ে বেশী তথ্য আছে। সরকার এসব সংবাদপত্রের উপর নির্ভর করে। এবং যখন তারা রিপোর্টের প্রভাব অনুধাবন করতে না চান তখন তারা পুরো বিষয়টি একটি রহস্যে ঘিরে রাখে – তখন তারা বলে এখানে সরকার কি করছে তা বলা নাই … প্রভৃতি।

অবশেষে, আমি আবারো বলছি এই বিতর্ক বেসরকারী সদস্যের গতিতে হচ্ছে। আমি আশা করি সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী যিনি ক্ষমতাসীন দলের চিফ হুইপ তিনি মুখ খুলবেন। বর্তমান ইস্যু নিয়ে সদস্যরা তাদের চিন্তা চেতনা অনুযায়ী ভোট দেবেন। এটা দলীয় সিদ্ধন্তের চেয়ে অনেক বড় কিছু। আমরা কিছুই হারাইনি, কারণ আমরা যদি এই গতিতেও আগাই সরকারের পতন হবেনা। একটি ফ্রি ভোট দেয়া যেতে পারে যাতে বিশ্ব জানতে পারে ভারতের জনগণের মনের ইচ্ছা কি।

আমাদের বিরোধী দলের বন্ধুদের সম্পর্কে সপ্তদশ শতাব্দীর এক দার্শনিকের একটি কথা উল্লেখ করছি,
“অজ্ঞতা মানুষকে দল গঠন করায়।
লজ্জা তাকে দল পরিত্যাগে বাঁধা দেয়। ’

তেমন পরিস্থিতি যেন না আসে।

শ্রী ইন্দ্রজিত গুপ্ত: শুধুমাত্র অজ্ঞতা নয়।
শ্রী কৃষ্ণ মেনন: অতএব, আমি আশা করি, এই সংসদে, ঐতিহ্যের সঙ্গে, এই অবস্থায় এই ধরনের একটি ভোটের ব্যাবস্থা করা যেতে পারে – যাতে করে এই ব্যাপারে আমাদের অবস্থান জানা যেতে পারে – হুইপের কার্যক্রমকে ব্যাহত না করে। আমি মনে করি ফ্রি ভোটের অনুমতি দেয়া যেতে পারে। এতে আমাদের গণতন্ত্রের প্রতি সমর্থন দেখানো হবে।

শ্রী প্রিয় রঞ্জন দাস মুন্সী (দক্ষিণ কলকাতা): বাংলাদেশ সম্পর্কিত রেজল্যুশন উপর আলোচনায় ইতিমধ্যে হাউসের অনেক সদস্য মতামত দিয়েছেন এবং এটি একটি পরিপক্ক পর্যায়ে পৌঁছেছে। আমাদের দলের এবং অন্য দলের অনেকের থেকে অনেক অদ্ভুত ধারণা পাওয়া গেছে। কিন্তু আমি সেসবের বিস্তারিত আলাপে যেতে চাইনা।

আমি দুটি প্রধান দিকে আমার মতামত প্রকাশ করতে চাই। ভারত সরকার ইতিমধ্যে ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বের সামরিক সরকারকে নিন্দা করেছেন। যার ফলে আমরা যথেষ্ট সাহস দেখিয়েছি এবং সারা বিশ্ব জেনেছে যে আমরা কোন পারমাণবিক শক্তি বা সামরিক শক্তির উপর নির্ভর করতে রাজি না। আমরা শুধুমাত্র মানবতার শক্তির উপর নির্ভর করতে চাই। যেহেতু আমরা বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক মানুষের উপর ইয়াহিয়া খানের সামরিক জান্তার নিন্দা করার সাহস দেখিয়েছি যেহেতু নিক্সন সরকারের পাকিস্তানে অস্ত্র চালান পাঠানোর ব্যাপারেও আমাদের নিন্দা করার ক্ষমতা আছে। মানবতার উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের জনগণের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি দেবার সাহস আমাদের রয়েছে।

অনেক সদস্য সমস্যাটিকে কিছুটা জট পাকিয়ে ফেলার চেষ্টা করেছেন। আমি এটা দীর্ঘ সময়ের জন্য দেখেছি। অনেক সদস্য আন্তর্জাতিক আইনের মানদণ্ড যাচাই করার আহ্বান জানিয়েছেন যাতে করে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি এখন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার সঠিক সময় কিনা। আমি জানি না কেন আমাদের সেই মানদণ্ড ধরে যেতে হবে। যতদূর আমি জানি তাতে গণতন্ত্র শুধুমাত্র জনগণের রায়ের উপর অথবা জনগণের দ্বারা জনগণের প্রতিনিধিদের পছন্দের উপর নির্ভর করে। বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধিদের ৯৮ শতাংশ নির্বাচিত হয়েছে – এটি ইয়াহিয়া খান অথবা আন্তর্জাতিক কোনো উৎসের সুবিধা নিয়ে হয়নি। এটা হয়েছে জনগণের ইচ্ছার মাধ্যমে। তাই অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে ক্ষতি কি? আমাদের উচিৎ অবিলম্বে তাদের স্বীকৃতি দেয়া।

যদি ভারতের জনগণের শক্তির উপর দাঁড়ানোর সাহস থাকে তাহলে বিশ্বের কে কি প্রশ্ন করল সেই চিন্তা না করে আমাদের উচিৎ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া। এবং এই সিদ্ধান্তের জন্য ভারতের সমস্ত জনগণ দায়ী থাকবে। যদি সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয় তবে তাদের ধারাবাহিকভাবে সামনে এগিয়ে আসতে হবে এবং বিশ্বকে জানাতে হবে যে, না তারা এমন কিছু করতে যাচ্ছেনা। কিন্তু এত সময় ধরে বিষয়টাকে দীর্ঘায়ীত করার মানে কি? তাহলে যারা কষ্ট করছে তাদেরকে সহানুভূতি দেখান, শরনার্থিদের প্রতি সহানুভূতি দেখান অথবা বিশ্ব শক্তিগুলোর সাথে এত আলোচনার মানে কি? বিশ্বের কাছে আমাদের জন্য যা দরকার তা তো আগে থেকেই ছিল। অ্যামেরিকা থেকে আমাদের মন্ত্রীর ফিরে আসার পর অ্যামেরিকার আচরণ কি ছিল? পরিস্থিতির গুরুত্ব ও বাস্তবতা অনুধাবন না করেই অ্যামেরিকা পাকিস্তানে জাহাজভর্তি অস্ত্রের চালান পাঠাল। এদিকে, কমিউনাল শক্তিধর যুক্তরাজ্য কি ব্যাবস্থা নিল? তারা কি এই সমস্যা নিয়ে একটি মন্তব্যও করেছে? পার্লামেন্টের একজন সদস্যকে প্রতিনিধি হিসেবে পাঠানো ছাড়া তারা কি আর কিছু করেছে? তারা কি এটি নিয়ে কোন রাজনৈতিক অবস্থা প্রকাশ করেছে? আবার ধরুন রাশিয়ার কথা। নিশ্চই তারা কিছু সাহায্য ও আরও কিছু জিনিস পাঠাচ্ছে। কিন্তু তারা কি কোন সিরিয়াস রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছে? দুঃখের সাথেই বলছি সোভিয়েত ইউনিয়নের মত একটি প্রগতিশীল রাষ্ট্র এখনো কোন রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেয় নাই। সোভিয়েত ইউনিয়নের ২৪ তম কংগ্রেসের বক্তব্যে আমি বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে একটি কথাও কোথাও খুঁজে পাইনি। সবাই শুধু দেখতে চায় ভারত কীভাবে আগায়। যদি ভারত কাশ্মীরের দিকে আগায় তারা বলবে সেখানে অ্যামেরিকার ভয় আছে। ভারত যদি NEFA এর দিকে যায় তারা বলবে সেখানে চিন এর ভয় আছে। কিন্তু আমি দেখেছি যে এটা ভারতের নিজস্ব সমস্যা হওয়া উচিত এবং এটা আমাদের সমাধান করতে হবে। যদি ইতিহাসে আমাদের জন্য বিপদ আসে – তবে ভারত সরকার এবং হাউজের সদস্যদের সেভাবে সমর্পন করতে হবে। চিন বাংলাদেশ সমস্যায় অলরেডি একটি ফাঁদ তৈরি করেছে। আমাদের হয় জনগণের শক্তিতে নির্ভর করে অবস্থান নিতে হবে এবং তাদের স্বীকৃতি দিতে হবে অথবা বলে দিতে হবে আমরা এসবের মধ্যে নেই কারণ আমরা অ্যামেরিকা বা রাশিয়ার সাথে জোটনিরপেক্ষ অবস্থানে আছি।

সুতরাং, আমি রেজল্যুশনকে সমর্থন করি কারণ এখন স্বীকৃতি দেবার সময় এসেছে। আমরা যদি তা করতে বাধ্য হই বাংলাদেশের যুব সমাজ যারা ক্যাম্পে বসে তাদের সময় ব্যয় করছে তারা তাদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করার জন্য আমাদের অভিশাপ দেবে। তারা এটা সহ্য করার জন্য প্রস্তুত না, তারা ভারতের মহিমান্বিত ইতিহাসের সাথে, ভারতের মানুষ তাদের সে আশ্বাস দিয়েছে তার সাথে এটাকে মেনে নিতে প্রস্তুত নয়।

শ্রী জাম্বুবেন্ত ঘোটে (নাগাপুর)ঃ স্পিকার মহোদয়, বাংলাদেশের সমস্যা আজ শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্বের নয়, আমাদের দেশের একটি গুরুত্তপূর্ন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানবিকতার কারণে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া উচিৎ। মানবিকতার কারণে পাকিস্তানী আক্রমণ প্রতিহত করা উচিৎ, এটাই আমাদের দেশের ভূমিকা ছিল। এই ভূমিকায় বাংলাদেশের প্রশ্নে দেশ ঐক্যবদ্ধ আছে। এমতাবস্থায় আমাদের এটাই পর্যবেক্ষন করা জরুরী যে, আমাদের বিদেশ নীতি কি এবং আজ আমাদের বিদেশ নীতি কোন দিকে যাচ্ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, আমাদের বিদেশ নীতি দেউলিয়াত্তে পৌঁছে গেছে। দুর্ভাগ্যবশত আমাদেরকে বলতে হচ্ছে, বিশ্বে আজ আমাদের কোন বন্ধু নেই। দূরের কথা থাক, নেপালও আজ আমাদের বন্ধু নয়। বার্মাও আমাদের কাছে মিত্র নয়। শুধু এই নয়, বরং আমাদের দেশেও এমন কতগুলো শক্তি আছে যারা আমাদের পক্ষে নেই। এ অবস্থায় আমাদের বিদেশ নীতি কোনদিকে যাচ্ছে, কোন গর্তে আমরা নিপতিত হচ্ছি, এটাও আমাদের দেখা উচিৎ। পাকিস্তানের সঙ্গে আমরা আজ অবধি কথা বলে আসছি, চিনের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ হয়েছে এবং এতে কোন সন্দেহ নেই যে শতাব্দী কাল ধরে চিন ও ভারত দুটি বন্ধু ও ভ্রাতৃত্বপ্রতিম দেশ ছিল, কিন্তু আজ এমন অবস্থা এসেছে যে আবার আমাদেরকে বাংলাদেশ প্রশ্নে চিনের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। বিশ্বের বহু দেশেই তো আমাদের প্রতিনিধি গেছেন, আজ চিনের সঙ্গে আলোচনার জন্যও আমাদেরকে অবশ্যই তৈরি থাকতে হবে, যাতে বাংলাদেশ প্রশ্নে চিন আমাদের সঙ্গে একমত হতে পারে। আজ বাংলাদেশে যে বর্বরতাপূর্ন হামলা হচ্ছে যেখানে মানবতাকে পদদলিত করা হয়েছে, শিশুদের পিষে মেরে ফেলা হচ্ছে, এমতাবস্থায় আমরা বাংলাদেশের পিছনে দাঁড়িয়েছি, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর পিছনে সারা দেশ এক হয়ে দাঁড়িয়েছে, তিনি মশাল হাতে সামনে এগুচ্ছেন – এরূপ দৃশ্যকল্প আমরা সামনে রেখেছি, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে এখন কোন দ্বিধা থাকা উচিৎ নয়, সামান্য সময় অপচয় করাও সমীচীন নয়, কেননা এখন আমাদের ওপর সময় এসে পড়েছে যে, পরে আমাদের আর কিছু করার থাকবে না, বাকি থাকবে শুধু পরিতাপ।

শ্রী শশীভূষণ( দক্ষিণ দিল্লী)ঃ স্পিকার মহোদয়, যে পরিস্থিতি আমাদের দেশ অতিবাহিত করছে তাতে আমাদের সদস্যগণের খুব সংযত ভাষায় বক্তব্য উপস্থাপিত করা উচিৎ। কিছু লোক আছেন, দিনের আলোতেও তারা অন্ধকার দেখেন, চারিদিকে শুধু নিরাশাই চোখে পড়ে, বিশ্বে তাদের কেউ নেই, তারা একেবারে তলিয়ে যান, কিন্তু আমি মনে করি যে, যখন আমরা কোন ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য তৎপর হই তখন এরকম হতাশার কথা বলা দেশকে পেছনে ঠেলে দেবার নামান্তর। বিশ্বে আমাদের সহযোগী নেই একথা আমার কাছে দুর্বোধ্য। পৃথিবীর যেখানেই প্রগতিশীল শক্তি আছে যারা সমাজবাদের জন্য যুদ্ধ করছে, তারা আমাদের সঙ্গে আছে, বাংলাদেশের সংসদ সদস্যের সঙ্গে কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক দেশে আমার যাবার সুযোগ হয়েছে। সেখানকার জনগণ সহযোগীতা করেছে এবং সেখানকার সরকারও সমর্থন দিয়েছে। দু’তিন মাসের মধ্যে কোন পরিবর্তনকে সারা বিশ্ব স্বীকৃতি দিয়ে দেবে এটা কখনো হয় না। আমরাও স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছিলাম কিন্তু বিশ্ব কতদিন পরে স্বীকৃতি দিয়েছে? ভিয়েতনামের স্বীকৃতি মিলেছে তিন বছরে। সুতরাং বিশ্ব আমাদের সাথে নেই একথা মানিনা। আমি আরেকটি কথা বলতে চাই, যদি আমরা বাংলাদেশের সরকারকে সহায়তা না করতাম তারা দশটি দিনও টিকতে পারত না। কারও ওপর যদি বিশ্বাস থাকে তবে সেটিও হচ্ছে এই মহান দেশ কেননা এদেশের ৫০ কোটি জনসাধারণ আন্তরিকভাবে তাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। বিশ্বের কোন দেশ এত বড় আন্তরিক স্বীকৃতি কখনো পায়নি। এখন সরকারের স্বীকৃতি দেয়া উচিৎ। আমি একথার পক্ষপাতী যে, বাংলাদেশের জনগণ যারা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছেন, তাদেরও নিজ শক্তিতে সামনে চলা উচিৎ এবং আমাদের উচিৎ তাদেরকে সাহায্য করা। আমি সরকারের কাছে আবেদন করছি ৯ আগস্ট সামনে আসছে, তখন পর্যন্ত যদি আমরা কোন সিদ্ধন্তে পৌছতে না পারি তবে সংসদকে আমি জানিয়ে দিতে চাই যে, আমাকে আমরণ অনশন করতে হবে, সেদিন সমগ্র দেশের যুবকরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ব্রত গ্রহণ করবে। ব্যাস, আমি এটুকুই বলতে চাই।

শ্রী ফুলচন্দ্র বর্মা(উজ্জয়ন)ঃ বাংলাদেশে আজ যে ধ্বংসযজ্ঞ চলছে সেটি শতাব্দীর সর্ববৃহৎ গণহত্যা। সত্তুর-আশি লাখের মত লোক আমাদের এখানে এসে পড়েছে। তাদের আগমনের ফলে আমাদের অর্থনিতি ধ্বংস হচ্ছে, আমাদের সমাজে ভাঙ্গন ধরছে, একই সঙ্গে তারা আমাদের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে কেননা বাংলাদেশ হতে আগত লোকদের সঙ্গে অনেক চরও ঢুকে পড়েছে। কিছুক্ষণ আগে কয়েকজন মাননীয় সদস্য বলেছে যে, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ২১৬ জন সন্মানিত সদস্য বাংলাদেশেক স্বীকৃতি দেবার প্রস্তাব উথাপন করেছেন। আমার দুঃখ হয়, আমাদের সরকার কেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে অগ্রসর হচ্ছেনা। আমি মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে এই আবেদন করছি যে, সময় এসে গেছে, মোটেই বিলম্ব না করে আমাদের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার জন্য অগ্রসর হওয়া উচিৎ।

শ্রী মুরাসলি মাড়ান(মাদ্রাজ দক্ষিণ): জনাব চেয়ারম্যান, স্যার, আমি ধরে নিচ্ছি আমরা যে যুদ্ধ করিনি তাতে আমরা হেরে গেছি। এটা এমন যুদ্ধ যেখানে যুদ্ধ না করেই আমরা পাকিস্তানের কাছে হেরে গেছি। তা না হলে কীভাবে আমরা ৮ মিলিয়ন লোকের বোঝা মেনে নিচ্ছি? জনাব কৃষ্ণা মেনন বলেছেন বাংলাদেশের এক দশমাংশ লোক আমাদের ভেতর ঢুকে পড়েছে। এখন আমরা একটি বাচ্চাকে ধরে বসে আছি – অথচ সে কোথা থেকে আসল তা যেন আমরা জানিনা। আমরা এটা কখনো আশা করিনি যেখানে সংসদে রেজোল্যুশন পাশ হয়েছে। আমরা তখন উৎফুল্ল মেজাজে ছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম বাংলাদেশ আজ অথবা কাল দাঁড়িয়ে যাবে। কিন্তু আমরা জানতে ব্যার্থ হয়েছি যে বাংলাদেশে আসলে কি ঘটছে। আমরা সময় মত আমাদের বন্ধুদের পরামর্শ দিতে ব্যর্থ হয়েছি। এমনকি আমরা ইন্ডিয়ান সংবাদপত্রকে গাইড দিতে ব্যার্থ হয়েছি, ও ভারতীয় জনমত গঠন কৌশলে ব্যর্থ হয়েছি – কারণ তারা সব সময় উচ্চাশামিশ্রিত সংবাদ পরিবেশন করছিল।

গণহত্যা শুরুর ছয় দিন পর, আমাদের সংসদ বাংলাদেশের ৭৫ মিলিয়ন মানুষের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান সমর্থনে একটি প্রস্তাব সর্বসম্মত ভাবে পাস করে। কিন্তু এখনও আমরা তাদের স্বীকৃতি দেই নাই। যখন তা হবে তখন উপমহাদেশের ইতিহাস পরিবর্তিত হয়ে যাবে। আমরা লক্ষ লক্ষ জীবন ও বাড়িঘর রক্ষা করতে পারতাম। যা করার কথা ছিল তা আমরা করিনি। “সুনিপুণ নিষ্ক্রিয়তা” শব্দটি আমাদের অবস্থানকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলে বলে আমার ধারনা।

পরিশেষে, আমরা টের পেলাম যখন উদ্বাস্তুরা আসতে শুরু করল। যখন আমরা বুঝলাম আমাদের অর্থিনিতে টান পড়ছে, আমরা একের পর এক নানান দেশের রাজধানীতে যেতে থাকলাম। একটা সময় ছিল যখন পুরো বিশ্ব ভারতের নেতৃত্বের অপেক্ষা করত। পরে আমরা হলাম জোটনিরপেক্ষ গ্রুপের নেতা। এখন আমরা সেই উদ্যোগ, উদ্দীপনা ও নেতৃত্বও হারিয়েছি। জনাব মেনন যেমন বলেছেন, এখন যা দরকার তা হল ফরেন পলিসি। আমাদের কর্মঠ পররাষ্ট্রনীতি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মত মৃত। একটি স্পর্শ পাথর পররাষ্ট্রনীতি খুঁজে বের করতে হইবে যা আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় সাহায্য করবে।

আমরা কীভাবে শরণার্থী সমস্যা সমাধান করতে যাচ্ছি? ফিলিস্তিনের শরণার্থীদের কী ঘটেছিল? এখনও সেই সমস্যা সমাধান হয়নাই। রাস্তায় সাধারণ মানুষের প্রশ্ন আপনি কিভাবে শরণার্থী সমস্যা সমাধান করতে যাচ্ছেন? সাধারণ মানুষ আমাদেরকে বলে, “যদি বাংলাদেশ না থাকে, যদি তাদের ভৌগোলিক অঞ্চল না থাকে, তবে এটা ভারতের দায়িত্ব সেটা তৈরি করা। ’ ইজরায়েল সেনা মরুভূমি পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিল। চীন এখনও আমাদের অঞ্চলের হাজার বর্গ মাইল দখল করে রেখেছে। ক্ষমতাশালীরা আমাদের কথা বুঝবে শুধুমাত্র যদি আমরা তাদের ভাষায় বোঝাতে পারি। প্রেসিডেন্ট নিক্সন এবং জনাব রজার্স ‘হত্যা’ শব্দটিকে যথাযথ শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপন করার জন্য প্রস্তুত নন। তাজউদ্দীন আহমদ যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, তখন তিনি বলেছিলেনঃ
“প্রতিদিন এই স্বীকৃতি ও সহায়তা বিলম্বিত হচ্ছে এবং সহস্র মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে এবং বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। “

শুধু বাংলাদেশ স্বার্থ নয় বরং ভারতের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা যুদ্ধ চাই না। কিন্তু পরিস্থিতি আমাদের তা করতে বাধ্য করতে পারে। এটাই শ্রী জয় প্রকাশ নারায়ণ অ্যামেরিকাতে বলেছেন। সময় ও স্থান নির্বাচন আমাদের শত্রুর হাতে থাকবে। আজকের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের খবর বলছে যে মুজিবুর রহমান রাওয়ালপিন্ডিতে একটি হাসপাতালে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় আছেন। কাল হয়ত সংবাদ আসবে যে পাকিস্তানের সেনা সদর দপ্তর বলছে যে মুজিবুর রহমানের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। তার পরের দিন হয়ত খবর আসবে তিনি হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। কঙ্গোর লুমুম্বাতে এরকম ঘটেছিল। একই জিনিস বার বার হতে পারে এবং মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হতে পারে। সরকারের উচিৎ তার জীবন রক্ষা করতে সম্ভাব্য সব কিছু করা। জনাব রজার্স আসছেন। এর আগে সরকারের কিছু করা উচিত। শুধুমাত্র স্বীকৃতি এই সমস্যার সমাধান করবে না। আমি আশা করব সরকার আজ তার প্রোগ্রাম তৈরি করবেন।

শ্রী রাম নারায়ণ শর্মা(ধন্যবাদ)ঃ স্পকার মহাশয়, বাংলাদেশের সমস্যা আজ আমাদের সামনে একটা জীবন মরণ প্রশ্ন। জীবন মরণ প্রশ্ন এজন্য বলছি যে এই সমস্যার প্রথম পর্যায়ে আমরা ঐ দেশের শতকরা দশ ভাগ লোককে আমন্ত্রণ জানিয়েছি, জানিনা আরও কত পারসেন্ট লোক আসবে। এমতাবস্থায় আমরা যা ব্যয় করছি অন্য দেশের প্রতিও এই আশা রাখছি যে তারাও আমাদের সাহায্য করবে। তবে যেভাবে সাহায্য আসছে তা একেবারে না আসার মত। কিন্তু আমাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আমি দেখছি যে আমাদের দেশে আগত এই ৭০ লক্ষ লোকের জন্য মাথাপিছু চার/পাচ টাকা করে ব্যয় করলেও দৈনিক ৩ কোটি টাকা খরচ হয়। যদি বছরের হিসাব ধরা হয় তাহলে তা সহস্র কোটি টাকায় পৌঁছে। এভাবে আরও আসতে থাকলে আমাদের ব্যয় আরও বাড়বে। আমাদের দেশের সমস্ত প্রচেষ্টা সে দিকেই নিবদ্ধ। সকল নেতার মনোযোগ সেদিকেই বাঁধা, সারা দেশের দৃষ্টি সেদিকেই আকৃষ্ট। এই সমস্যা আরও কত প্রকট হতে পারে তার কোন পরিমাপ নেই।

আমার তুচ্ছ অভিমতে এর সমাধান একটিই রয়েছে। এখন আপনার অন্য দেশের দিকে তাকানোর প্রয়োজন নেই। এখন আপনাকে একাই চলার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমার বক্তব্য হচ্ছে তাড়া যদি এগিয়ে আসে তবে ভালো কথা। যদি না আসে তবে আপনার সিদ্ধান্ত আপনাকে নিজেই নিতে হবে। ঐ সিদ্ধান্ত শুধু স্বীকৃতি দেয়াই নয় বরং বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতা যেন বাংলাদেশবাসীর হাতে আসে, বাইরের আধিপত্য যেন শেষ হয়ে যায়। এজন্য আপনাকে সেখান থেকে আগত লোকদের শুধু ট্রেনিং দিয়েই নয়, যদি দরকার হয়, নিজ দেশের সৈন্য পাঠিয়েও বাংলাদেশের লোকদের মুক্ত করতে হবে। স্পকার মহাশয়, আমার পরামর্শ, সরকার বর্ডার সিল করে দিন। আজও যেভাবে হাজার হাজার লোক আসছে তাদেরকে আসতে না দিয়ে আমরা অস্ত্র দিয়ে তাদেরকে ফিরিয়ে দেব। শুধু অস্ত্রই নয়, যদি দরকার হয় তবে রসদপত্র দিয়েও তাদেরকে সাহায্য করব।
সুতরাং, মাননীয় স্পিকার, আমি বলব, আমার মতে এই সমস্যার সমাধান একটিই। যদি এরূপ ডিমে তেতলা নীতি নিয়ে আমরা চলি তাহলে আমাদের ব্যয় আরও বাড়বে, আমরা আমাদের ওপর বিপদ ডেকে আনব, এবং সমগ্র বিশ্বের কাছে আমাদের যে অবস্থান, তা হারাব। এ জন্য আমি সরকারকে এ বিষয়ে খুব সত্বর সিদ্ধান্ত নেয়ার অনুরোধ করছি।

প্রফেসর ড. এস এল সাক্সিনা(মহারাজগঞ্জ): স্যার, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা আছে। তিনি তার বীরত্ব ও দ্রুত সিদ্ধান্তের জন্য পরিচিত। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তার সংকল্পের অভাব এবং আলস্য আমাকে ব্যাপকভাবে ব্যথিত করেছে। তিনি ১ এপ্রিলের বাস মিস করেছেন। ২৫ মার্চ থেকে ১ লা এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংবাদ সম্প্রদায়কে ঢাকা থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। তখন তাড়া হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করেছে। যদি আমরা তখন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতাম এবং আমাদের সৈন্য পাঠাতাম তাহলে হয়ত এত কিছু হতনা। তখন পাকিস্তানি সেনারা সংখ্যায় অল্প ছিল এবং আমরা সহজেই তাদের পরাজিত করতে পারতাম। সেক্ষেত্রে আজ বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে আবির্ভুত হত। এবং কোন সমস্যা থাকত না। কিন্তু আমরা তখন বাস মিস করেছি।

এখন আমরা বিশ্ব বিবেককে নাড়ানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। কিন্তু আমরা সফল হইনি। সবাই স্বার্থপর। ইয়াহিয়া খানের সম্প্রচারের পর, আমি আশা করি আমাদের প্রধানমন্ত্রী তা মেনে নেবেন না – তাতে করে চীন, পাকিস্তান বা অন্য যে কোন শক্তি হোক না কেন। আমরা আগে পাকিস্তানের সাথে সংঘাতে আমাদেরর শক্তি দেখিয়েছি। আমি আশা করি আমাদের সরকার অবিলম্বে বাংলাদেশের গণহত্যা থামাতে আমাদের সৈন্য পাঠাবে। আমাদের চীন এবং পাকিস্তান কে ভয় করলে চলবে না যাদের আমরা ১৯৬৫ সালে হারিয়েছি। বাংলাদেশ থেকে আগতদের মধ্যে অনেক সাহসী যুবক আছে। আমরা এসব যুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং তাদের অস্ত্র দিয়ে তাদের দেশে যুদ্ধ করতে পাঠাতে পারি। আমি নিশ্চিত বিজয় আমাদের হব এবং তারপর সবাই আমাদের সমর্থন দেবে। কারণ কেউ কাপুরুষ জাতিকে সমর্থন করেনা। কাজ করার সময় এসেছে এবং এখন আর কোন উপায় নেই। কংগ্রেসের সদস্যরাও এর পক্ষে মত দিয়েছেন। আমি আশা করি, পুরো জাতি এই মতামতের পক্ষে। অতএব, আমি আশা করি প্রধানমন্ত্রী সাহসের সাথে ঘোষণা করবে যে আমরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছি।

শ্রী এম সত্যনারায়ণ রাও (করিমনগর): আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে এই সরকার শোচনীয়ভাবে তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। ৩১ মার্চ এই হাউস একটি সর্বসম্মত রেজোলিউশন দ্রুত কার্যকর করার জন্য পাশ করেছিল। কিন্তু এটা ব্যর্থ হয়েছ। তাদের এই দেশ শাসন করার অধিকার নেই। এক সদস্য বললেন, যেহেতু তাদের কোন অঞ্চল বা জনসংখ্যা নেই তাই আমরা স্বীকৃতি দিতে পারিনা। তাই যদি হবে তাহলে কেন এই সরকার পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে বাংলাদেশ উল্লেখ করছেন? এই সরকার বাংলাদেশ বলার কোন অধিকার রাখেনা। যদি বলে তাহলে তার আগে উচিৎ তাকে স্বীকৃতি দেয়া। স্যার, শুধুমাত্র সেটা করলেই আমরা শক্তিশালীভাবে কাজ করতে পারব। আমরা কি দ্রুত কাজ করছি? সামরিক সহায়তা অথবা সৈন্য পাঠালে সমস্ত বিশ্ব হয়ত স্বীকৃতি দিতে এগিয়ে আসত। একটি উক্তি আছে: সফলতার মত কোন সাফল্য নেই। এটা সবচেয়ে দু: খজনক। পররাষ্ট্রমন্ত্রী একজন সর্দার হয়ত। তাকে যথেষ্ট সাহসী হতে হবে। সর্দারের মত সিদ্ধান্ত তিনি নিতে পারতেন। আমরা এখানে সিদ্ধান্ত নিতে পারি এবং এখন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে পারি। অন্যথায় সমস্ত বিরোধী দল একত্রে জনগণকে বলবে এই সরকারকে স্বীকৃতি না দিতে। আমি সর্দার শরণ সিংএর কাছে অনুরোধ করছি বাংলাদেশকে অবলম্বে স্বীকৃতি দিন অন্যথায় এটি আমাদের জন্য বিপদ ডেকে আনবে। যখন আমাদের নিজেদের লোকদের খাওয়ানোর ক্ষমতা নেই সেই মুহুর্তে আমরা এই লোকদের পেছনে কোটি কোটি রুপি খরচ করছি। দয়া করে অন্তত এটাকে কন্সিডার করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন। শুধু স্বীকৃতি নয় আমাদের সেনাবাহিনী পাঠিয়ে সেখানকার ভিক্টিমদের পুনর্বাসনের ব্যাবস্থা করুন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রী (শ্রী শরণ সিং): জনাব চেয়ারম্যান, স্যার, এই ইস্যুতে, বিরোধী দল থেকে এমন মন্তব্য আমি আশা করিনি। কি কারণে এমতাবস্থায় আমি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছিনা সেটা নিয়ে কোন বিতর্কে আমি যেতে চাইনা। আমরা আমাদের অবস্থান স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছি এবং সন্মানিত সদস্যের কাছে অনুরোধ তারাও যেন ব্যাপারটি সামলান।

আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি নিয়ে আমরা যতটা উদ্বিগ্ন সেটি ভিন্ন বিষয়। কিন্তু এটা আভ্যন্তরীণ বিষয় এবং এটা নিয়ে কোন বৃহত্তর জটিলতা সৃষ্টি করা উচিত নয়। আপনি যদি সংযম করতে না চান তাহলে আমি বলব এটা শুধু আমাদের জাতীয় স্বার্থের কোন বিষয় নয়। এটাই আমি পুরোপুরি বিশ্বাস করি।

শ্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত: আপনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সম্প্রচারের পর পরিবর্তিত কিছু বলেননি।

শ্রী শরণ সিং: আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিবৃতির উপর আমার মতামত দিব এবং অন্যান্য দিকগুলোও আলোচনা করব।
শ্রী এস এম ব্যানার্জী: তাকে কেন জ্ঞান দিচ্ছেন?

শ্রী শরণ সিং: আমি জ্ঞ্যান দিচ্ছি না। কিন্তু আমি কি নম্রতা ও আন্তরিকতা সাথে জিজ্ঞাসা করতে পারি যে কেন তিনি আমাকে এটা জিজ্ঞাসা করছেন? আমি জ্ঞান দিতে চাই না; এটা আমার পথ নয়। কিন্তু আমি সন্মানিত সদস্যকে গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তা করতে বলি যে আমরা যে ধরণের জনমত তৈরি করার চেষ্টা করছি তাতে আমাদের জাতীয় স্বার্থ যেন লঙ্ঘিত না হয় – আমরা সবাই যেন এক থাকতে পারি। আপনারা যদি এই ধরণের তর্ক চালিয়ে যেতে থাকেন আর কি করব কি করব না সেটা বলতে থাকেন তবে আমি নিশ্চিত এতে মনোযোগ বিঘ্নিত হবে এবং আমরা মূল সমস্যা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ব। আমাদের সবাইকে আমাদের মূল উদ্যেশ্য অনুধাবন করতে হবে এবং আমরা তা না করে আশেপাশের অপ্রয়োজনীয় বিষয়ের পেছনে শক্তি ক্ষেপণ করছি।

আমাদের মুল উদ্যেশ্য রেজোলিউশন সম্পর্কিত যা আমরা সব সর্বসম্মতিক্রমে পাশ করিয়েছিলাম। এতে বলা আছে আমরা বাংলাদেশের মানুষের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সমর্থন দিচ্ছি এবং তাদের প্রতি আমাদের সহানুভূতি প্রকাশ করছি। আমরা সর্বসম্মতিক্রমে সেই সমর্থন বাস্তবায়ন করার অঙ্গীকার করেছি। এই রেজোলিউশন অনুসারে কাজ করার জন্য আমরা কীভাবে আগাব সেই ব্যাপারে আলোচনা চলছে। সেখানে মতভেদ হতে পারে। কিন্তু সেটা সমাধান করতে চেষ্টা করা উচিত এবং মুল উদ্দেশ্য বোঝা উচিৎ। শুধু একটি বিশেষ পদক্ষেপ এই সমস্যার একমাত্র সমাধান নয়। এটাই সমগ্র বিষয়ের মূল কথা।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিবৃতি সম্পর্কে বলা যায় সেখানে এমন কিছু তিনি বলেছেন যা আগে থেকেই আশা করেছিলাম। কিন্তু আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিবৃতির কারণে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে এখন বাংলাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার দায়িত্ব এখন শুধুমাত্র তার নিজের উপর বর্তায় – যেখানে তারা চাচ্ছে মুক্তি এবং সামরিক শাসন থেকে পরিত্রাণ।

প্রফেসর ড. এস এল সাক্সেনা: আপনার সাহায্য ছাড়া?
শ্রী শরণ সিং: আপনি যদি বিবৃতিটি দেখেন তাহলে দেখবেন সেখানে গণতান্ত্রিক পথে আসার কোন সম্ভবনা নেই। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে জাতীয় পরিষদের সংবিধান প্রণয়ন না করে তিনি হয়ত এক্সপার্ট কাউকে দিয়ে সেটা তৈরি করাবেন। সেখানে আরও কিছু আপত্তিকর কথা আছে যা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে তারা সামরিক শাসন চিরস্থায়ী করতে চাচ্ছে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের আওয়ামীলীগের নিরঙ্কুশ বিজয় ও গণতন্ত্রের পথে যাত্রাকে সম্পূর্নভাবে অবদমিত করা হয়েছে।

গণপরিষদ নির্বাচনের পিছনে যে দর্শন ছিল যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের তাদের শাসনতন্ত্র রচনা করার অধিকার থাকবে – এখন, তা তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হল। আরও বিস্ময়কর ব্যাপার হল সামরিক শাসন সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচিত পদে কারা হেরেছে। অবাক ব্যাপার হল প্রশাসন এমন কিছু করতে যাচ্ছে যাতে করে একটি দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে এবং এতে করে তারা ওইসব নির্বাচিত আসন হারাবে। গণতন্ত্রের পথে এর চাইতে নিষ্ঠুর কৌতুক আর হয় না। তারা বলছে যদি কোন দল বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপে যুক্ত থাকে তবে তাদের দোষী করা হবে তারপর তারা বিবেচনা করবে তাদের জাতীয় পরিষদের সদস্য হওয়ার অধিকার থাকে কিনা।

এটাকে বলা যায় গণতান্ত্রিক ধারণার প্রতি সম্পূর্ণ অস্বীকৃতি প্রকাশ। সেখানে আরেকটি অত্যন্ত অসন্তোষজনক বিষয় রয়েছে। বলা হয়েছে যে আঞ্চলিক দলগুলো সংবিধান প্রণয়নে অংশ নিতে পারবেনা এবং কোন জাতীয় অনুষ্ঠানেও তাদের ডাকা হবেনা যতক্ষণ না তাদের সমস্ত দেশেই দলীয় শাখা থাকে। আমি মনে করি এটাই একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মুল কেটে দেবার জন্য যথেষ্ট। এতে করে শুধু বাংলাদেশ নয় পশ্চিম পাকিস্তানেও এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব আছে। উদাহরণস্বরূপ, বেলুচিস্তানের দল শুধু বেলুচদের কথা বলে, উত্তর পশ্চিম ফ্রন্টের প্রদেশের দলগুলো শুধু সেখানেই সীমাবদ্ধ – এতে করে তারা আঞ্চলিক দল হিসেবে বিবেচিত হবে – জাতীয় কোন দল হিসেবে নয় – এবং জাতীয় নির্বাচনে অংশ সুযোগ না পাবার কারণে তাদের ক্ষমতা খর্বিত হবে।

এই হচ্ছে কিছু বৈশিষ্ট্য যা গণতান্ত্রিক আদর্শের পথে সুস্পষ্টভাবে আপত্তিকর। এতে করে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রশাসনিক ক্ষমতা না দিয়ে গণতন্ত্রের সম্মান্য সম্ভবনাও মাটিয়ে মিশিয়ে দেয়া হল।

শ্রী এস এম ব্যানার্জী: আপনি এখন কি করতে যাচ্ছেন?

শ্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত: এখন কি তাহলে আপনার সব আশা শেষ হয়ে গেছে? আপনি কি এখনও একটি রাজনৈতিক সমাধানের আশা করছেন?

শ্রী শরণ সিং: আমি তেমন কোন আশা পোষণ করিনা যা তিনি আমাকে বলতে বলছেন।

শ্রী ইন্দ্রজিত গুপ্ত: আপনি আমাদেরকে বলুন আপনার আশা কি।

শ্রী শরণ সিং: আমাদের এর প্রয়োগ বুঝতে হবে। এতে বোঝা যায় বাংলাদেশের জনগণকে দীর্ঘ আন্দলন চালাতে হবে।

স্বীকৃতির প্রশ্নে আমি বলতে চাই আমরা এটাকে নেগেটিভলি দেখছিনা, আমরা এর বিপক্ষে নই। এটা আমাদের ধারাবাহিক বিবেচনায় আছে।

ডঃ. রনেন সেন (বারাসত): কত দিন?

শ্রী শরণ সিং: এবং আমি বলতে চাই যে সঠিক সময়ে আমরা স্বীকৃতি দেব। এই অবস্থায় আমি সন্মানিত সদস্যদের জানাতে চাই যে কিছু নতুন বিষয় উঠে এসেছে এবং ইয়াহিয়া খানের সম্পূর্ন নেগেটিভ বিবৃতিতে আমাদের আচরণ পুনঃনির্নয় করতে হবে। (বাঁধা)
আমাদের তাড়াহুড়া করলে হবেনা। যখন আমরা বলি যে আমরা স্বীকৃতির বিপক্ষে না তখন অনেকেই ভাবতে পারেন না যে আমরা কীভাবে সামনে আগাব। এখানেই আমাদের স্বীকৃতির উপর তাড়া দেয়া হয়। এটাই একমাত্র বিষয় যেটা নিয়ে আমাদের তাড়াহুড়া করা ঠিক নয়। এর উপর আমাদের নেগেটিভ ধারনা পোষণ করলে হবেনা। আমরা এটাকে বারবার পরীক্ষা করে দেখতে পারি। যেহেতু চেষ্টা করব যারা সংগ্রাম করছে তাদের পাশে থাকার – রেজোল্যুশনে সেরকম অঙ্গীকারই আমরা করেছি যা এই হাউজে সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয়েছে।

শ্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত: অর্থাৎ বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খানের শাসনের উপর আপনার স্বীকৃতি বহাল আছে। বাংলাদেশ বলা মানে আপনি সেটাকে স্বীকার করছেন। তারা সেখানে যা কিছু করছে তাকেই আপনি সমর্থন দিচ্ছেন

শ্রী শরণ সিং: এভাবে শ্রেণীগত বিবৃতি না দেয়াই ভালো – তাতে কোন লাভ নাও হতে পারে . . .

শ্রী ইন্দ্রজিত গুপ্ত: কেন নয়?

শ্রী এস এম ব্যানার্জী: এই দেশের জনগণ জানুক আপনি কি।

জনাব. চেয়ারম্যান: কওয়া করে কোন ব্যক্তি আক্রমণ করবেন না. . . . . ..(বাধা)

শ্রী এস এম ব্যানার্জী: আমার তার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগতভাবে কিছুই নাই স্যার. . . . .
(বাধা).

শ্রী শরণ সিং: আমি শুধুমাত্র বলতে চাই এসব কথায় আমার কিছু হয় না – আমি টলি না। আমি এসব চিৎকারের সাথে একমত না।

শ্রী এস এম ব্যানার্জি: আমরা আপনার কেয়ার করিনা। আপনি ভুট্টোর বন্ধু। আপনি ইয়াহিয়া খানের বন্ধু. . .

জনাব চেয়ারম্যান: জনাব ব্যানার্জি আপনি যা বলছেন সব রেকর্ড হচ্ছে। আমি আবেদন করছি আপনি হস্তক্ষেপ করবেন না . . .
আপনি একজন প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান .. আপনার প্রায়শ এমন করা উচিত নয়।
শ্রী শরণ সিং: স্যার, আমি বিতর্ক বাড়াতে চাইনা। আমি বলতে চাই এই মুহুর্তে এটি সরকারের অবস্থান – আমার ব্যাক্তিগত অবস্থান নয়।

আমরা এটা পর্যালোচনা করছি এবং আমরা যথাযথ সময়ে সিদ্ধান্ত নেব। এটা আমাদের অবস্থান এবং আমি আশা করি এটা প্রশংসা করা হবে এবং জনাব সমর গুহের কাছে অনুরোধ করছি এই ইস্যুতে দেশ ও হাউজকে বিভক্ত না করতে। কারণ এখানে কোন দ্বিমত নেই। এবং আমি চাইনা স্লোগানে স্লোগানে মূল বিষয় হারিয়ে যাক। এটা ছোঁড়াছুড়ির ম্যাচ না। মাননীয় সদস্য এর সাথে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও ঝুঁকি জড়িত। . . . .(বাধা). তাই আমাদের দায়িত্ব. . . .

শ্রী এস এম ব্যানার্জী: আমেরিকা সম্পর্কে কিছু বলুন। আপনি কেন আপনার কর্তার বিরুদ্ধে কথা বলছেন না?

শ্রী শরণ সিং; একটির সাথে আরেকটি গুলিয়ে ফেলার দরকার নেই।

সেটি অস্ত্র সরবরাহের প্রশ্নের সাথে সমর্কিত। (বাধা)। আমি ইতিমধ্যে আমার শক্তিশালী প্রতিবাদ জানিয়েছি।
(বাধা).

জনাব চেয়ারম্যান: আমি কাউকে ইচ্ছামত দাঁড়াতে দেবনা। আমি মাননীয় জনাব ইন্দ্রজিৎ গুপ্তকে প্রশ্ন না করার অনুরোধ করছি। জনাব বড়ে. আমি আপনাকেও অনুমতি দিচ্ছিনা। এভাবে হাউজ চলেনা।

শ্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত: মাননীয় মন্ত্রী বসে পড়ার আগে আমি জানতে চাই তিনি সে উত্তর দিচ্ছেন সেটা কি প্রেসিডেন্ট নিক্সনের দূত হিসেবে কিনা। বিশেষ দূত। জনাব কিসিঞ্জারের পদ আপনার হওয়া উচিৎ। তার সফরে আমাদের প্রভাবিত হওয়া উচিৎ না। আমাদের উচিৎ আমাদের সমস্যা বলা, দেশের স্বার্থের কথা বলা।

শ্রী কৃষ্ণ মেনন: মন্ত্রী তার উত্তর শেষ করার আগে এটা বলবেন কি? তিনি বলেছেন, তাকে স্লোগান দ্বারা বিভক্ত করা উচিত নয়। স্বীকৃতির বিষয়টা কি স্লোগানের মত হাল্কা বিষয়? আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি স্লোগানের মত বিষয় নয়।

শ্রী মুরাসলি মরণ: আমরা জেনেছি যে শ্রী মুজিবুর রহমান গুরুতর অসুস্থ। . . .

জনাব. চেয়ারম্যান: আর কোন প্রশ্ন নয়।

শ্রী সেজিয়ান (কুম্বাকোনাম): শ্রী মুজিবুর রহমান গুরুতর অসুস্থ। এটা তাদের স্বাভাবিক চালাকি। যখনি তারা কারো জীবন নিয়ে কিছু করতে চায় তখন তারা এসব বলেন। আজ বলা হয়েছে, মুজিবুর রহমান অসুস্থ। আগামীকল্যই তারা বলতে পারেন, তিনি এখনো শঙ্কামুক্ত নন। আগামী পরশু এটা রিপোর্ট করা হতে পারে যে তার মৃত্যু হয়েছে। আমি জানতে চাই সরকার এ ব্যাপারে কি করছে?

শ্রী শরণ সিং: আমি বলতে চাই যে, এই নীতিই আমরা ফলো করার চেষ্টা করছি এবং আমরা বরাবর হাউস এবং হাউজের বাইরে বিরোধীদলীয় নেতাদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় তা অবহিত রেখেছি। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ভারত সফরের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। আমি মাননীয় সদস্যকে বলব কোন সম্পর্কই নেই এমন কিছুর সাথে কোন কিছু মিলিয়ে ফেলবেন না। আমি জানিনা জনাব কৃষ্ণ মেনন স্লোগানের সাথে বিষয়টি আলাদা কীভাবে করলেন।

শ্রী কৃষ্ণ মেনন: আমি বলেছি স্বীকৃতিকে আপনি স্লোগানের সাথে তুলনা করেছেন।

শ্রী শরণ সিং: সে ব্যাপারে আমি অবস্থান স্পষ্ট করেছি। এবং সেটা সরকারেরও অবস্থান। বিষয় হল কখন এটা করা উচিত। স্বীকৃতির সাথে স্লোগানের কোন সম্পর্ক নেই। আমি বলতে চেয়েছি যে স্লিঙ্গিং ম্যাচ আপনারা শুরু করেছিলেন সেই ব্যাপারে। পার্থক্য হচ্ছে সময়জ্ঞ্যানে – যে কখন স্বীকৃতি দিতে হবে। এটা একটা বাস্তব প্রশ্ন। তাই আমি বলেছি যেহেতু হাউজে মূল বিষয়ে তেমন কোন পার্থক্য নেই তাই অন্য কোন ক্ষুদ্র ইস্যু নিয়ে সেখানে বিভক্তি সৃষ্টি করা ঠিক হবেনা। আমি এটাই বলতে চেয়েছি।

শেষ প্রশ্ন সম্পর্কে, আমি সম্পূর্ণরূপে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাস্থ্য সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করছি। বস্তুত, এই বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী নিজেই এবং আমাদের সবাইকে পাকিস্তানের সঙ্গে খুব জোরালোভাবে দেখতে বলেছেন। শেখ মুজিবুর রহমান একটি অসামান্য নেতা যিনি এমন অসামান্য বিজয় অর্জন করেছেন এবং যারা আনুগত্য ও কমান্ডের উপর পাকিস্তানের সুবিশাল সংখ্যার জনগণ আস্থা রেখেছে। বস্তুত তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ জয় লাভ করেছেন যদি আমরা সম্পূর্ণ পাকিস্তানকে হিসাবে ধরি। তিনি একজন অসামান্য নেতা। আমরা বলেছি সরকারিভাবে ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্বারা সব রকমের চেষ্টা করা হবে। আজ সকালে বলা হয় যে, তিনি গুরুতর অসুস্থ। কিছু দিন আগে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় যে তার স্বাস্থ্য একটু ভিন্নরকম আছে। এই গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট আমরা সব সরকারকে বিশেষভাবে তাড়া দিয়েছি যাতে করে তারা পাকিস্তানের সামরিক শাসককে শেখ মুজিবুর রহমান এর মতন একজন অবিসংবাদিত নেতার সুস্থতা নিশ্চিত করতে বলে। কিছু সন্মানিত সদস্য বলেছেন আমরা বলিনি যে তাকে যেন ছেড়ে দেয়া হয়। আমি প্রকৃতপক্ষে আরও বেশী কিছু করেছি। আমরা বলেছি শেখ মুজিবুর রহমানকে ছেড়ে দিলে উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান হবে – কারণ তিনি তাদের অবিসংবাদিত নেতা। তাকে ছেড়ে দিলে এমন পরিবেশ সৃষ্টি হবে যে তাতে উদ্বাস্তুরা ফিরে যাবে। আমরা সব সময় তার মুক্তির পক্ষে এবং আমরা সকল সরকারকে অনুরোধ করেছি।

১৭-০০ টা

শ্রী ইন্দ্রজিত গুপ্ত: তিনি কি জানেন তাকে আসলে কোথায় রাখা হয়েছে?

শ্রী শরণ সিং: আমাদের তথ্য অনুযায়ী তিনি এখনো পশ্চিম পাকিস্তানে।

শ্রী ইন্দ্রজিত গুপ্ত: কারাগারে?

শ্রী এস এম ব্যানার্জী: কোন জেলে? পশ্চিম পশ্চিম পাকিস্তান অনেক বড়। আমি জানি। তাকে কোন জেলে রাখা হয়েছে।

শ্রী সমর গুহ: এই পর্যায়ে এটা বলা সঠিক নয়।

শ্রী শরণ সিং: অতএব, শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তা প্রশ্নে এবং সামরিক শাসক তাকে ভালো রাখার ব্যাপারে এবং তাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছেড়ে দেবার ব্যাপারে এবং একটি গণতান্ত্রিক কাঠামোর শুরু হবার ব্যাপারে আমাদের পক্ষ থেকে আহবান জানানো হয়েছে। এবং আমি সন্মানিত সদস্যকে অনুরোধ জানাচ্ছি এটিকে ভোটের জন্য রেজল্যুশন দেবেন না। কারণ আমাদের এখন এই বিষয় নিয়ে বিভক্ত করা উচিত হবেনা।

ডঃ. রনেন সেন: একেবারে নিরাশ বিবৃতি।
শ্রী শরণ সিং: আমি জানি আমি তাকে সন্তুষ্ট করতে পারি নাই।

শ্রী এস ব্যানার্জিঃ তিনি ভারতের কাউকে সন্তুষ্ট করতে পারেন না।

শ্রী সমর গুহ: এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রী বলেছেন যে, সরকার বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতির ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেনা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তারা এখনও ইতিবাচক কি করেছেন তা বলেননি। সম্ভবত সরকার এত তাড়াতাড়ি দিতে হতে পারে তা ভাবেননি এবং তাই একটি রাজনৈতিক সমাধানের উপর জোর চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তাদের আশা ইয়াহিয়া খান কর্তৃক বিস্ফোরিত হল। আমি জানি না আমাদের সরকার এখনও কোন নরম বিছানায় শুয়ে চরম-আলস্যে শীতনিদ্রা দেবেন কিনা। আমি জানি না তারা কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ নেবেন কিনা। কিন্তু আমি সত্যিই অবাক হয়েছি যে আমাদের সরকার বাংলাদেশের প্রশ্নে বাংলাদেশের স্বার্থের উপর আরো বুদ্ধিমান ও বিশেষজ্ঞ হয়েছেন – কারণ তারা বুঝতে পেরেছেন কোনটা ভালো কোনটা খারাপ – কখন স্বীকৃতি দিলে ভালো হবেনা ইত্যাদি। যখন বাংলাদেশের সব মানুষ, তাদের নেতা, তাদের সরকার, এবং তাদের মুক্তি বাহিনী এবং তাদের সব রাজনৈতিক নেতারা একবার নয় – বারবার শুধু ভারতকে নয় – এখন সারা পৃথিবীর মানুষকে বলছে তাদের সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দিতে – তখন আমাদের সরকার কীভাবে বলেন যে এখন স্বীকৃতি দিলে তা ভালো হবে না খারাপ হবে। আমি জানিনা হয়ত আমাদের সরকার তাদের চাইতেও ভালো জানেন যে তাদের আগ্রহ কিসে।

আমি জানি না আমাদের এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রীর জন্য কোন বিশেষণ ব্যবহার করা উচিত। যদি তিনি কিছু মনে না করেন, তাহলে আমি বলতে চাই তিনি সত্যিই একজন বিভ্রান্তিকর পররাষ্ট্রমন্ত্রী, কারণ তিনি অনেকবার আমাদের বিভ্রান্ত করেছেন এই বলে যে যদি ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, তাহলে অন্য কোন দেশ আমাদের অনুসরণ করবে না। কিন্তু শ্রী জয় প্রকাশ নারায়ণ তার ৪৮ দিনের সফরে কূটনৈতিক বাঁধা উপেক্ষা করে বিশ্বের ২০ টি দেশ এর গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে খোলামেলাভাবে আলাপ করেছেন এবং তাদের অনেকে একটি প্রকাশ্যে স্পষ্ট বিবৃতি দিয়েছেন যে যদি ভারত সাহস নিয়ে স্বীকৃতি দেয় তবে বিভিন্ন দেশ সেটা অনুসরণ করবে। অন্তত চার বা পাঁচটি দেশ অবিলম্বে স্বীকৃতি দেবে।

কিছু দিন আগেই আমরা দেখেছি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একটি স্টেটমেন্ট ইস্যু করা হয়েছে যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া উচিৎ।

আমি জানি না কি সরকার বিশ্বের মতামতের সংহতি সম্পর্কে আরও কি আশা করেন। সম্ভবত এর আগে কোন সময়, কোন নির্দিষ্ট বিষয়, পুরো বিশ্বের মতামত, পত্রপত্রিকা ও জনমত ইহাহিয়া খানকে নিন্দার ব্যাপারে এবং পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সমর্থনের ব্যাপারে এতোটা সর্বসম্মত ছিলোনা।

একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে স্বীকৃতি ইস্যুতে আমাদের বন্ধু সোভিয়েত রাশিয়ার আচরণ। যদি মস্কোর চাপ মাপার জন্য আমাদের ব্যারমিটার থাকত তাহলে দেখতাম সেটা আমাদের ভারতীয় সি পি আই এর ব্যারোমিটারের সমান। আমরা তাদেরকে বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য উচ্চকণ্ঠ পেতাম। বাংলাদেশকে স্বীকৃতির ব্যাপারে আমরা সব সময় তাদের অতি উচ্চস্বরে চিৎকার করতে দেখি। রাশিয়া যদি বলত যে তারা স্বীকৃতি দেবে। আমি সরকারের কাছে জানতে চাই মস্কো বাংলাদেশের ব্যাপারে তাদের অবস্থান দিল্লীকে জানিয়েছে কিনা। যদি জানায় তাহলে তার রাজনৈতিক ইমপ্লিকেশন কি? সেটা হল সরকারের উচিৎ অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া। রাশিয়া তাতে দ্বিমত করবেনা। তারা ১/২ মাসের মধ্যে ভারতকে সাপোর্ট দেবে এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে।

আমি সরকারকে সতর্ক করে দিতে চাই সময় হচ্ছে সবচেয়ে সিদ্ধান্তকারি বিষয়। এটাই বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য নির্ধারন করবে – ৭ মিলিয়ন উদ্বাস্তু আর ভারতের ভাগ্য নির্ধারন করবে। আমি সরকারকে সতর্ক করে বলতে চাই আমাদের শত্রু এখন সময়। আর পাকিস্তান হল সবচেয়ে ভালো বন্ধু। আমরা ইতিমধ্যে খুব মূল্যবান প্রারম্ভিক সময় ব্যয় করেছি। ২৫ মার্চ পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে তার এক ব্যাটেলিয়ান সেনাবাহিনী নিয়ে যেয়ে কুণ্ঠাবোধ করেনি। তারা বাংলাদেশের আন্দোলনকে পিষে ফেলতে চেয়েছিল – কারণ তারা ভীত ছিল – তারা ভেবেছিল যদি তারা পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য নিয়ে যায় তাহলে পশ্চিম পাকিস্তান দুর্বল হয়ে পড়বে। ২ সপ্তাহ পর যখন তারা বুঝতে পারল যে ভারত কিছু করতে যাচ্ছেনা তখন তারা আড়াই ডিভিশন সৈন্য পাঠাল যা দিয়ে তারা বাংলাদেশের অভ্যুত্থান দমিয়ে দিল এবং প্রায় ১০ লাখ দেশপ্রেমিকে হত্যা করল।

আমি আরও মনোযোগ আকর্ষন করে বলতে চাই যে চিন ১২ এপ্রিল পর্যন্ত একটি শব্দও করেনি। তারা ভারত কি করে তা দেখছিল। রাশিয়াও প্রথমে খুব কঠোর মনোভাব গ্রহণ করেছিল কারণ রাষ্ট্রপতি পোদ্গোর্নি ইয়াহিয়া খানকে একটি শক্তিশালী চিঠি লিখেছিলেন। সেটা ফলো আপ করেন নি কেন? উত্তর মস্কোতে নয় – দিল্লীতে আছে। দিল্লী সঠিকভাবে পর্যাপ্তরূপে এবং কার্যকরভাবে রিএক্ট করেনি।

আমি আরও দৃষ্টি আকর্ষন করতে চাই যে ২৫ মার্চের পর থেকে প্রায় ২ সপ্তাহের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং অন্যান্য সব বিশ্বশক্তিগুলোর সম্পূর্ণরূপে নীরব ছিল। কারন কি? তারা সাবধানে ভারতের প্রতিক্রিয়া দেখছিল। ভারত কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। কূটনৈতিক অনুশীলন অনুযায়ী, তারা অকারণে পাকিস্তানকে জ্বালাতে পারেনি।
সময় পাকিস্তানের পক্ষে এবং আমাদের বিপক্ষে। আমরা অনেক অনুমান করেছি। আমাদের প্রথম ভাবনাটি ছিল যে পাকিস্তান পশ্চিম থেকে পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টরে তাদের সেনা নামানোর সাহস করবে না। এটা ভাবনার কারণ হলো এই যে আমরা ভেবেছিলাম যে বাংলাদেশের বিপ্লব তারা নিজেরাই অর্জন করতে সক্ষম হবে। যা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আমাদের দ্বিতীয় ভুল ধারনা ছিল ছিল যে অনধিক দুই মিলিয়ন উদ্বাস্তু ভারতে পার হয়ে যাবে। একটি সভায় যেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন সেখানে প্রধানমন্ত্রী আমাদের বলেছেন যে প্রায় ১৫ লাখ উদ্বাস্তু এসেছেন। জনাব চৌহান এ সময় উপস্থিত ছিলেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আমার পাশে বসা ছিলেন এবং তখন আমি বললাম যে, ভারতের অস্থায়ী গতিশক্তিহীনতা লাভ করছে। এটা স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ যিনি তা থেকে ভারতকে তুলে আনছেন। আমি জানি না, এখানে কোন কৃষ্ণ আছেন কিনা যিনি মন্ত্রীকে কাজ করতে বলবেন। আপনাকে কাজ করতেই হবে।

সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী, এবং শিপিং ও পরিবহন মন্ত্রী (শ্রী রাজ বাহাদুর): তিনি শেষ করার আগে আমি একটি কথা বলতে চাই। যথেষ্ট সময় দেয়া হয়েছে এবং যথেষ্ট বিতর্ক হয়েছে। আমার শ্রদ্ধেয় সহকর্মী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন যে বিষয়টি পরখ করা হচ্ছে। অতএব, কার্যপ্রণালী বিধি নিয়ম ৩৪০ এর অধীনে, আমি মনে করি প্রশ্ন বিতর্ক এখন স্থগিত করা হতে পারে।

শ্রী এস এম বানেরি; ৩(১) পড়ুন যদি আপনি নিয়ম অপব্যাবহার চান।

শ্রী রাজ বাহাদুর: আমি নিয়ম অপব্যবহার করছি না। আমি দুইটি অনুরোধ করেছি। বহিঃবিষয়ক মন্ত্রী ইতিমধ্যে অবস্থান বিবৃত করেছেন। এটি একটি উন্নয়নশীল পরিস্থিতি। আমরা হঠাৎ করে একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। অর্থাৎ যে কোন একটি স্ন্যাপ ডিসিশন। যেহেতু অবস্থা উন্নয়নশীল তাই একে পর্যালোচনার অধীনে রাখা হয়েছে। আমাদের এর প্রয়োগ এবং প্রতিক্রিয়া বুঝতে হবে অথবা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এর ঘোষণার প্রতক্রিয়া দেখতে হবে। তাই আমি অনুরোধ জানাচ্ছি যে বিতর্ক অনির্দিষ্টকাল স্থগিত করা হতে পারে।

জনাব চেয়ারম্যান: নিয়ম অপব্যবহার বলে কিছু নাই। (বিঘ্ন) বিতর্ক অনির্দিষ্টকাল স্থগিত করা হল। শ্রী এ কে গোপালন।

শ্রী সমর গুহঃ স্যার, যেহেতু বিতর্ক অনির্দিষ্টকাল স্থগিত করা হয়েছে রেজল্যুশন বেঁচে আছে। আমি হাউসকে ভাগ করতে চাই না। যদি সরকারের পক্ষ থেকে কোন বাধা না থাকে তাহলে কোন সন্দেহ নেই যে এই রেজল্যুশন সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের দ্বারা গৃহীত হবে। কিন্তু আমি হাউসকে ভাগ করতে চাই না। আমি একটি জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি করতে চাই এবং হাউস ভাগ চাইনা। আমি তাই আমার রেজল্যুশন এর উপর এই বিতর্কের স্থগিতকরণে সম্মত আছি।

জনাব. চেয়ারম্যান: প্রশ্ন হল: “বিতর্ক অনির্দিষ্টকাল স্থগিত করা হল”।
প্রস্তাব গ্রহণ করা হল।

শ্রী এস এম বানেরি: পয়েন্ট অব অর্ডারে, স্যার, হাউসে ভোট চাওয়ার আগে, আপনি বিতর্ক অনির্দিষ্টকাল স্থগিত করে দিলেন।
জনাব চেয়ারম্যান: পরে আমি হাউসে ভোট গ্রহণ করেছি।

সর্বশেষে, পাকিস্তান সময় ক্ষেপণ করছে মধ্যপ্রাচ্যের তেল সমৃদ্ধ দেশ এবং অন্যান্য দেশ থেকে টাকা পাবার জন্য।

তাই আমি বলেছি সময় এখন পাকিস্তানের সবচেয়ে ভালো বন্ধু এবং ভারতের সবচেয়ে বড় শত্রু। আমি দুঃখিত যে, সরকার জানেন না যে একটি বিপ্লবী জাতীয় আন্দোলনের গতিশীল পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবেলা করতে হয়। আমি প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে বলব রাশিয়ান বিপ্লবের ইতিহাস পড়ে নিতে। ট্রটস্কি, যিনি সেই বিপ্লবের স্থপতি ছিলেন, একটি বিপ্লবের সাফল্য নির্ভর করে তার মেজাজ ও জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততা নির্ধারণের উপর। আপনি ভুলে গেলে চলবে না যে, বাংলাদেশের মানুষ এক মাস আগে যুদ্ধ শুরু করেছে। এক মাস ধরে সেখানে অসহযোগ আন্দোলন চলেছে। এবং তারপর থেকে তিন মাস ধরে তারা যুদ্ধ করছে। এটা চতুর্থ মাস। এটা কি সম্ভব তাদের জাতীয় অভ্যুত্থান আকাঙ্ক্ষা, শক্তি ও মানুষের মেজাজ আগের মতোই আছে? তাই আমি বলতে চাই, এই আন্দোলনের স্বীকৃতি অত্যাবশ্যক। এটা তাদের বাহুতে একটি শট হিসেবে কাজ করবে; এটা তাদের পুরো দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে দেবে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে তাদের বিশ্বাস পুনস্থাপন করবে এবং নতুন কর্মউদ্দীপনা যোগাবে; উজ্জ্বল কর্মউদ্দীপনা।

আপনি সত্যিই দেখতে চান তাহলে, আপনি দেখতে পাবেন যে, বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধারা সিংহের মত যুদ্ধ করছে। যেখানেই আমি চলে গেছি সেখানেই আমি তাদের অপারেশন বেস দেখেছি। প্রথম যে প্রশ্ন তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে তা হল “আপনারা কখন আমাদের স্বীকৃতি দেবেন? ” স্বীকৃতি মানে তারা তাদের নিজস্ব সংগ্রামের রাজনৈতিক স্বীকৃতি চায়। স্বীকৃতি মানে হল আমরা যে তাদের স্বাধীনভাবে সাহায্য করতে চাই তার স্বীকৃতি; এখানে কোন কূটনৈতিক বাঁধা থাকবেনা।

আমি সরকারকে সতর্ক করতে চাই, যারা পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধের কথা বলেন আমি তাদের পক্ষে নই। আমি মনে করি স্বীকৃতি হচ্ছে এই মুহুর্তে যুদ্ধের একমাত্র বিকল্প। অন্যথায় ইতিমধ্যে যুদ্ধকালীন পরিবেশ তৈরি হয়ে গেছে এবং এই হাউসের অনেক সদস্য বাংলাদেশের সংগ্রাম সম্পর্কে কথা বলা শুরু করেছেন। বাংলাদেশকে মুক্ত করার কথা বলছেন। এর মানে কী? এটার মানে যুদ্ধ। ভারতীয় সেনাবাহিনীর যুদ্ধ করার জন্য কোন প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশের নিজস্ব মুক্তিবাহিনী আছে। তাদের গেরিলা যোদ্ধা আছে; তারা তাদের পুরো উদ্দেশ্য অর্জন করতে সক্ষম হবে। আপনি যদি তাদের অস্ত্র ও অন্যন্য সরঞ্জাম দেন তা তাদেরকে শক্তিশালী করবে এবং বিশ্বের সঙ্গে কূটনৈতিক স্বাধীনতা চালিয়ে যাবার সুযোগ দেবে। সেটা তাদেরকে শক্তিশালী করবে। এটাই পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ এড়াতে একমাত্র বিকল্প। অর্থাৎ, তাদের অবিলম্বে স্বীকৃতি দিতে হবে। এরপর স্বাধীন জাতির ভিত্তিতে পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে আপনি তাদের অস্ত্র দিতে পারেন; তাদের প্রশিক্ষণ দিতে পারেন এবং তারা যা কিছু চায় তার সবকিছু দিতে পারেন – এমনকি তারা বিশ্ব ঘুরে আসার স্বাধীনতা পাবে। এটাই আমি বলতে চাই। এটাই বাংলাদেশকে সাহায্য করার একমাত্র উপায়।

আমি শেষ করার আগে শুধু একটা শব্দ বলতে চাই। কুরুক্ষেত্রের খারাপ সময়ে কি ঘটেছে? মহাভারতে কি লেখা আছে? অর্জুন ৮০ লাখ গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত ছিল, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আমাকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেন যে আমি শিশুসুলভ কথা বলছি। তিনি বলেন, অনধিক ২০ লাখ আসবে। এখন অবস্থা কি? আপনার দ্বিতীয় ধারনা বিলকুল ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

তৃতীয় ভাবনাটি এখনো চলছে। তারা ভাবছেন যে পাকিস্তান ভেতর থেকে অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে ভেঙ্গে যাবে। আজকাল কোন দেশ অর্থনৈতিক অসুবিধার কারণে পতন হয়না। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো আছে, তেল-সমৃদ্ধ দেশ আছে। এমনকি সঙ্গী দেশগুলো ভয় করে যে, তাদের ঋণ শোধ না করা হতে পারে; রাজনৈতিক কারণে পাকিস্তানকে সহায়তা দিতে অস্বীকার করতে পারে এবং যদি তারা আরও ঋণ দেয় তাও হয়ত পরিশোধ করতে পারবেনা। সুতরাং শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ভিত্তিতে তারা পাকিস্তানকে আটকাতে পারবেনা। সম্ভবত পাকিস্তান আরো এইড পেতে বিদেশী শক্তির সঙ্গে একতরফা আলোচনার সময় পাবে।

আপনি যদি পাকিস্তানকে সময় দেন তাহলে এর মানে কী? আমি এর ফলাফল বলতে পারি। প্রথমত সে দুইটা নতুন ডিভিশন আর্মিকে অস্ত্রসাঁজে সজ্জিত করার সময় পাবে – সাথে থাকবে চাইনিজ মিলিটারি হার্ডওয়্যার। এটাকে দ্রুততম সময়ে করার জন্য পাকিস্তান ডিভিশনগুলোকে এক তৃতীয়াংশ ট্রেইন্ড সৈন্য আর এক তৃতীয়াংশ নতুন সৈন্য দিয়ে মিশিয়ে ফেলেছে। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তান সম্ভাব্য সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে ফ্রান্স থেকে দুই স্কোয়াড্রন ফাইটার বোমারু বিমান পাচ্ছে। তৃতীয়ত, পাকিস্তান শিগগিরই তার চতুর্থ সাবমেরিন পাচ্ছে। চতুর্থত, পাকিস্তান আগামী দুই মাসের মধ্যে ন্যাটো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইরান ও তুরস্ক থেকে অস্ত্রের খুচরা যন্ত্রাংশের শপিং সম্পন্ন করার সুযোগ পাচ্ছে। পঞ্চমত, পাকিস্তান তার বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর বাংলাদেশী অফিসার ও কর্মিদের প্রতিস্থাপন করার সময় পাচ্ছে। এদের সংখ্যা বাহিনীর প্রায় ২০ শতাংশ। এবং তাদের অধিকাংশই প্রযুক্তি কর্মি। নৌবাহিনীতে যারা আছেন তারা খুব গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত। তারা এখন বাঙালিদের জায়গায় পশ্চিম পাকিস্তানীদের নিয়োগের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে একটি বিজ্ঞাপন দিয়েছে। আপনি তাদেরকে আসব করার সময় দিচ্ছেন। এখন তাদের বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীতে প্রশিক্ষিত কর্মী ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কম আছে। এবং তাদের সময় দিয়ে আপনি তাদের এই শূন্যতা দূর করার সুযোগ দিচ্ছেন।

ষষ্ঠত, পাকিস্তান বাংলাদেশে অবাঙালিদের মধ্যে থেকে সশস্ত্র মিলিশিয়া, প্যারা মিলিশিয়া, পুলিশ বাহিনী এবং পাল্টা গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলার জন্য সময় কাজে লাগাচ্ছে। সপ্তমত, বর্তমানে নৌপথ বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান সরবরাহ এবং যোগাযোগ লাইন; তারা রেল ও সড়ক যোগাযোগ পুনরূদ্ধারের জন্য ক্ষিপ্ত প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এবং যদি আপনি তাদেরকে সময় দেন তাহলে তারা এটা করে ফেলবে। অষ্টমত, পাকিস্তান চীন থেকে চীনা গানবোট এবং কয়লা পাচ্ছে। নবমত, পাকিস্তান এই সময়কে রাজনৈতিকভাবে ব্যাবহার করছে – তারা মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলামী ও অন্যান্য পুতুল দল এবং বিভীষণ তৈরি করছে যারা বাংলাদেশে তাদের সমর্থন দেবে। দশমতঃ তারা খাদ্য ঘাটতি বৃদ্ধি এবং দুর্ভিক্ষের অবস্থা তৈরি করে আরও মানুষকে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাঠাবার সুযোগ পাচ্ছেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২২৩। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনা ভারতের লোকসভার কার্যবিবরণী ১২ জুলাই, ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ২২৩, ৮৭০-৮৭৬>

১৭ টা ০২ মিনিট

জনগুরুত্তপূর্ন বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে

শ্রী জ্ঞ্যানেসশর প্রসাদ যাদব (কাটিহার)ঃ স্পিকার মহোদয়, আমি নিম্নলিখিত জরুরী জনগুরুত্তসম্পন্ন বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষন করছি এবং বিদেশ মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষন করছি এ সম্পর্কে তার বিবৃতি প্রদানের জন্যঃ

‘প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ব্যাক্তিগত আদেশে পাকিস্তানকে সাড়ে তিন কোটি ডলার মূল্যের অস্ত্রশস্ত্র প্রদানে যুক্তরাষ্ট্রের কথিত সিদ্ধান্ত’

পররাষ্ট্র মন্ত্রী (শ্রী শরণ সিং): সরকার সেনেটর চার্চের বিবৃতিটি ৭ জুলাই, ১৯৭১ দেখেছেন। আনুমানিক ৩৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের সামরিক সরঞ্জাম পাকিস্তান আসার জন্য পাইপলাইনে আছে। ৮ জুলাই, ১৯৭১, পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বলেছেন, “গত পাঁচ অর্থবছরে বছরে গড় আনুমানিক ৫ থেকে ১০ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র পাঠানো হয়েছে। ’

সিনেটর চার্চ একজন ভাল অবগতিসম্পন্ন সিনেটর এবং বিভিন্ন দেশে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে ভালো জানেন। এটা সম্ভব যে তার তথ্য সঠিক চিত্রের কাছাকছি। ডলারের পরিমাণ থেকে অস্ত্রের প্রকৃতি সম্পর্কে ধারনা করা যায়না। সরকারি উত্স থেকে ক্রয় করলে অনেক সময় স্বাভাবিক বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক কমে পাওয়া যায়। অনেক খুচরা যন্ত্রাংশ আছে যার দাম হয়ত সামান্য কিন্তু প্রাণঘাতী অস্ত্র হিসেবে অনেক বেশী সক্রিয়।

পাকিস্তানে মার্কিন সামরিক সরঞ্জামের অব্যাহত সরবরাহের সম্পর্কে হাউসের সব বিভাগ অবগত আছে। আমি আশ্বাস দিতে চাই যে আমাদের মতামত মার্কিন সরকারের কাছে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ করা হয়েছে।

সরকার মনে করে এই মুহুর্তে কোনো দেশের দ্বারা পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ করা সেখানকার সামরিক শাসকদের দ্বারা বাংলাদেশে সঙ্ঘটিত নৃশংসতার ও গণহত্যার ধারাবাহিকতায় উৎসাহ দেয়ার শামিল। এটি বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের হস্তক্ষেপের শামিল। আমরা বাংলাদেশের শান্তি ও উপমহাদেশের স্থিতিশীলতা এবং সামগ্রিকভাবে এ অঞ্চলের পরিস্থিতিতে এ ধরনের নীতির প্রভাব সম্পর্কে মার্কিন সরকারকে জানিয়েছি।

শ্রী জ্ঞ্যানেসশর প্রসাদ যাদবঃ স্পিকার মহোদয়, সাম্রাজ্যবাদী অ্যামেরিকা ভিয়েতনাম ও কোরিয়ায় সৈন্য পাঠিয়ে হস্তক্ষেপ করার পেছনে সব সময় এই অজুহাত দেখিয়েছে যে, গণতন্ত্র রক্ষার জন্য মানবিক মূল্যবোধ সংরক্ষণের জন্য এবং সম্প্রসারনবাদি চীনের দুরভিসন্ধি নস্যাৎ করার জন্যই তারা তা করছে কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে বলতে হচ্ছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই তিনটি ফ্যাক্টরই বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও অ্যামেরিকা সেখানে কিছু করছে না। সেখানে গণহত্যা চলছে, পাকিস্তানের আধিপত্যবাদি মনোভাবের দরুন তাদের অত্যাধিক শোষণে অর্থণৈতিক বৈষম্যের পাহাড় রচিত হয়েছে এবং সেখানকার সাত কোটি জনতা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এরূপ অবস্থায় অ্যামেরিকা আমাদেরকে প্রতিরক্ষা লাঘব করার উপদেশ দিচ্ছে, অন্যদিকে সে পাকিস্তানকে সর্বাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত করার প্রয়াস পাচ্ছে। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি আমাদের বিদেশ মন্ত্রী অ্যামেরিকা গিয়ে ভারতের মনোভাব, ভারত সরকারের নীতি তাদেরকে অবহিত করানোর চেষ্টা করেছে। এতে কোন লাভ হয়েছে কিনা জানিনা, তবে মার্কিন সিনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চ এ কথার রহস্য উদ্ঘাটন করেছেন যে, প্রেসিডেন্ট নিক্সনের আদেশের ৩ কোটি ৫৫ লক্ষ ডলার মূল্যের সমরাস্ত্র পাকিস্তানে পাঠানো হচ্ছে। এখানেই শেষ নয়, ১৯৭২ অর্থ বছরে অ্যামেরিকা অন্যান্য দেশে অস্ত্র সহায়তা কিংবা এ জাতীয় সহায়তাদানের যে পরিকল্পনা তৈরি করেছে তার মধ্যে বেশীর ভাগ, প্রায় ৫২ কোটি ডলারের সমরোপকরন পাকিস্তানকে দেয়া হবে। এমতাবস্থায় আমি জানতে চাই মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত হেনরি কিসিঞ্জার ভারতে এসে প্রধানমন্ত্রী, বিদেশমন্ত্রী, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে কি আলোচনা করেছেন? মার্কিন দূতের আলোচনার বিষয় বস্তু সম্পর্কে সংসদে এবং সমগ্র দেশকে অন্ধকারে রাখা হয়েছে – তিনি কি ভারত সরকারকে কোন প্রকার আশ্বাস দিয়েছেন যে ভবিষ্যতে এরূপ কিছু করা হবেনা? কিংবা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অনুকূলে পাকিস্তানের উপর প্রভাব বিস্তার করা হবে? এরূপ কোন কথা কি তিনি বলেছেন?

শ্রী শরণ সিং: আমি তার বক্তব্যের প্রথম অংশের সাথে একমত যেখানে তিনি পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছেন এবং দেশের কথা বলেছেন এবং পাকিস্তানে মার্কিন সরকার কর্তৃক অব্যাহত অস্ত্র সরবরাহের ওপর উদ্বেগ এই হাউসে প্রকাশ করেছেন। শেষে তিনি দুই বা তিনটি নির্দিষ্ট প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছেন যার জবাব আমি দেব।

প্রথমত, পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ করবে না এমন কোন নিশ্চয়তা কিসিঞ্জার দিয়েছে কিনা – যখন সে দিল্লীতে ছিল। আমি বলতে চাই তিনি আসলে পরিস্থিতি দেখতে এসেছিলেন – কোন প্রতিশ্রুতি দিতে নয়।

শ্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত (আলিপুর): তিনি কি কোন ধরনের নিশ্চয়তা চেয়েছিলেন?

শ্রী শরণ সিং: ড কিসিঞ্জারকে নিশ্চয়তার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করা হয়নি।

শ্রী ইন্দ্রজিত গুপ্ত: কি ধরনের জিনিস তিনি খুঁজেছেন?

শ্রী শরণ সিং: এটা তিনি বলতে পারবেন, আমি না।

শ্রী সমর গুহ (কাঁথি):সংলাপ নিয়ে মন্ত্রী কি হাউসকে অবহিত করেছিলেন?

শ্রী শরণ সিং: দ্বিতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে কিসিঞ্জারকে বাংলাদেশে সামরিক কর্ম বন্ধ করার জন্য পাকিস্তানকে চাপ দিতে অনুরোধ করা হয়েছিল কিনা।

শ্রী পি কে দেও (কালাহান্ডি):মন্ত্রী কি সন্তুষ্ট আছেন?

শ্রী শরণ সিং; মোটেই না।

এই বিষয়টি ওয়াশিংটনে মার্কিন সরকারের কাছে আমরা খুব জোরালোভাবে তুলে ধরেছিলাম। তারা পাকিস্তানের সঙ্গে বিষয়টি দেখবে – কিন্তু যতক্ষণ আমরা কোন ফল পাচ্ছিনা ততক্ষণ আমরা তা মানিনা। তাছাড়া বাংলাদেশে নৃশংসতা অবিরত চলছে এবং আমি
শ্রী পি কে দেও কে বলেছি, আমি বুঝতে পারছিনা মার্কিন সরকার কি ব্যাবস্থা নিয়েছে এব্যাপারে।

শ্রী সমর গুহ: আপনি কি আপনার নিজের কাজে সন্তস্ট? বাংলাদেশ সম্পর্কে যা নিচ্ছেণ?

জনাব স্পিকার: আমি এই ধরনের ব্যাঘাত পছন্দ করি না।

শ্রী শরণ সিং: আমরা এটা থামাতে পারি। আমরা আজ অন্য কিছু আলোচনা করি।

জনাব স্পিকার: সন্মানিত মন্ত্রী আপনার তার দিকে মনোযোগ দেবার দরকার নেই।

শ্রী শরণ সিং: আমি একমত যে ১৯৫৪ সাল থেকে মার্কিন সরকার পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়ে যাচ্ছে। ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত তারা ১৭০০ থেকে ২০০০ কোটি ডলার মূল্যের অস্ত্র সরঞ্জাম পাঠিয়েছে। এভাবে পাকিস্তান তার সামরিক সক্ষমতা অর্জন করেছে। এবং বর্তমান সরবরাহ, বিশেষ করে বাংলাদেশে সামরিক কর্ম শুরুর পরে এটা আমাদের জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে বাংলাদেশের ঘটনার পর কিছু দেশ সাপ্লাই বন্ধ করেছে।

আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ থামানোর জন্য ধারাবাহিকভাবে অনুরোধ করে যাচ্ছি এমন কি যদি ২৫ মার্চের আগেও সেগুলো ইস্যু করা হয়ে থাকে – কিন্তু তারা তা শুনছে না।

সিনেটর টনি যার সম্পর্কে সন্মানিত সদস্য বলেছেন এবং আমরাও আজ ইউ এস এমব্যাসি থেকে জেনেছি – তা হল আমেরিকান পতাকাবাহী জাহাজে পাকিস্তানী সেনা বহন করা হচ্ছে। এটাই তিনি আমাদের আজ বলেছেন।

একজন সন্মানিত সদস্য: তারা আগামীকাল তা অস্বীকার করতে পারে।

শ্রী শরণ সিং: যদি তারা এটা আগামীকাল অস্বীকার করে আমি আগামীকাল তা জানাব যে তারা আজ এটা বলেছিল।

শ্রী জগন্নাথ রাও জোশী( শাজাপুর) ঃ স্পিকার মহোদয়, মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্য শুনে রবীন্দ্রনাথের একটি মন্তব্য আমার মনে পরে গেল।

আমরা বিশ্বকে ভুল চোখে দেখি আর বলি যে আমরা প্রতারিত হয়েছি।

বস্তুত অ্যামেরিকা হোক, রাশিয়া হোক বা অন্য বৃহৎ শক্তি হোক, নিজ দেশের ব্যাপারে তাদের কৌশল কারও অজানা নয়। অ্যামেরিকায় গণতন্ত্র আছে বলে সিনেটররা বলতে পারেন। রাশিয়ার মোট সমাজতান্ত্রিক দেশে গণতন্ত্র থাকার কারণে লুকিয়ে ছাপিয়ে কি হয় তা জানা যায়না। ১৯৫৪ সনে যখন অ্যামেরিকা SEATO & SENTO এর সদস্য হিসেবে পাকিস্তানকে অস্ত্র দেবার সিদ্ধান্ত নেয় তখন অন্তত একটা অজুহাত ছিল।

এটা আসলে কমিউনিজমের বিরোধিতা করার একটা পদক্ষেপ ছিল।

১৯৫৪ সনে অন্তত এই কথা বলা যেতে পারে কিন্তু ১৯৬৫ সালের পর থেকে কম্যুনিস্ট রাষ্ট্র চীন রাশিয়া পাকিস্তানকে সাহায্য দিচ্ছে এবং অ্যামেরিকার অস্ত্র ভারতের বিরুদ্ধে ব্যাবহ্রিত হয়েছে। সকল দেশ পাকিস্তানকে অস্ত্র দিচ্ছে এবং মন্ত্রী মহোদয় ও জয় প্রকাশ নারায়ণ যারা বিদেশ ঘুরে এসেছেন – উভয়ের সারকথা হল – ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, অ্যামেরিকা, রাশিয়া, চীন ইত্যাদি কোন দেশই বাংলাদেশের ব্যাপারে পাকিস্তানকে প্রভাবিত করে ভারতে আগত শরনার্থিদের ফিরে যাবার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি করায় সহায়তা দান তো দূরের কথা সেই পরিস্থিতি তৈরির জন্য কোন মতামতও প্রকাশ করছে না।

এটা স্বয়ং মার্কিন সিনেটরের কথা। এই পুরো বিবৃতির সার কথা হল – আমরা বাংলাদেশ পরিস্থিতে অ্যামেরিকার পলিসিকে বিপদজনক মনে করছি। তবে মন্ত্রীর এই ব্যাপারে সন্দেহ আছে।

অর্থাৎ শরনার্থিদের ফিরে যাবার ব্যাপারে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান ও সাহায্যদানের জন্য আমাদের পরামর্শ আপনার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, একথা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে, কিন্তু বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহকে চাপ সৃষ্টি করে শরনার্থিদের ফিরে যাবার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি করার ইচ্ছা তাদের নেই। শুধু তাই নয়, দশ দিন পুর্বে আমার কাছে চিঠি এসেছে। ঐ চিঠিতে বলা হয়েছে ৮/৯ বছরের শিশু কিশোরীরা ভুখা মিছিলে অংশ নিচ্ছে এবং স্থানে স্থানে গিয়ে চাঁদা সংগ্রহ করছে। সেই চাঁদার সমস্ত অর্থ এই বলে লাহোরে পাঠানো হয়েছে যে, বাংলাদেশে আওয়ামীলীগ যে পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়েছে তাতে পশ্চিম পাকিস্তানের লোকেরাই শরনার্থি হয়েছে। তাদের জন্য অ্যামেরিকায় অর্থ সংগ্রহ হচ্ছে এবং সেই অর্থ সেখানে যাচ্ছে। আমি জানতে চাই, এ তথ্য কি সরকারের কাছে আছে?
অ্যামেরিকার কৌশল প্রত্যক্ষ করার পর আমি আমাদের মত প্রকাশ করতে চাই।

এসব কিছু ঘটার পর আমরা কি করব? পাকিস্তানের পরিস্থিতি কীভাবে স্বাভাবিক হবে যাতে শরনার্থীরা ফিরে যেতে পারবে। এ ব্যাপারে আমাদের পরামর্শ যদি গ্রহণযোগ্য না হয় তাহলে এ আলোকে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ কি হবে।

শ্রী শরণ সিং: স্যার, মননীয় সদস্য তার উদ্বোধনী বক্তব্যের প্রথম অংশে অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে সমার্থক করার চেষ্টা করেছেন। আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই তিনি তা করতে পারেন না। যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে, তারা বাংলাদেশের ঘটনার পরেও পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ করবে কিন্তু অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকার এবং তাদের মুখপাত্র স্পষ্ট বিবৃতি দিয়েছেন যে তারা বিশেষ করে এপ্রিল, ১৯৭০ এর পরে কোনো অস্ত্র পাকিস্তানে সরবরাহ করেননি।

শ্রী জগন্নাথ রাও যোশঃ তারা ভারত ও পাকিস্তানকে একইভাবে মাপেন। এটা আজকের কাগজেও আছে।

শ্রী শরণ সিং: কীভাবে অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে এরা একই হয়? (বাধা)।

তাঁর দ্বিতীয় প্রশ্নটিও কিছুটা অনুরূপ জটিল। কারণ তিনি বলেছেন ১৯৫৪ সালে সম্ভবত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিছু অজুহাত দেখিয়েছিল পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ করার জন্য যে এটা কমিউনিজমকে ঠেকানোর জন্য একটা চেষ্টা। কিন্তু তিনি ভালোভাবেই জানেন ওইসব ট্যাংক ও সরঞ্জাম কমিউনিজমের বিরুদ্ধে কখনোই ব্যবহার করা যেতে পারে না। আমরা জানতাম যে একমাত্র ভারতের বিপক্ষে সম্ভবত সিন্ধু-গাঙ্গেয় সমভূমিতে তারা এগুলো ব্যবহার করতে পারত। তাই আমি বুঝলাম না কেন সন্মানিত সদস্য এটা বললেন। আমরা জানতাম যে ১৯৫৪ সালে এই অস্ত্র আমাদের বিরুদ্ধে ব্যাবহার করার জন্য পাকিস্তানে সরবরাহ করা হয়েছে, এবং সেই একই নীতি অব্যাহত আছে। সুতরাং, ১৯৫৪ সালে অস্ত্র পাঠানোর আর কোন অজুহাত নেই।

তিনি জিজ্ঞেস করেছেন বাংলাদেশ সম্পর্কে আমাদের পরিকল্পনা কি। এই প্রশ্ন অস্ত্র সরবরাহের সাথে সম্পর্কিত। আমরা একটি পুরো দিন এই বিতর্ক করেছি এবং আমি আমার বক্তৃতায় তা আর পুনরাবৃত্তি করতে চাই না।

শ্রী অটল বিহারি বাজপেয়ীঃ স্পিকার মহোদয়, আমাদের বিদেশ মন্ত্রী ওয়াশিংটন থেকে ফিরে আসার পর থেকে প্রতিদিন মার্কিন সরকারের নীতি সম্পর্কে এমন সব তথ্য উদ্ঘাটিত হচ্ছে যা ভারতের জন্য হুমকিস্বরূপ। আমি একথা বলব না যে, এটি বিদেশ মন্ত্রীর সফরের ফল কিন্তু একথা অবশ্যই বলব যে তিনি ওয়াশিংটনকে প্রভাবিত করতে ব্যার্থ হয়েছেন। ওয়াশিংটন থেকে ফিরে এসে পালাম বিমান বন্দরে তাঁকে খুশী দেখাচ্ছিল। তিনি আশ্বাস দিলেন যে, মার্কিন নীতির পরিবর্তন হয়েছে। তারপরে জানা গেল যে জাহাজ যাচ্ছে। প্রথমে দুটি জাহাজ, আবার তিন জাহাজ তারপরে ৫ জাহাজ। এখন বলা হচ্ছে পাইপলাইনের সকল সাহায্য পৌঁছানো হবে। পাইপলাইন কত দীর্ঘ কে জানে। এও জানা সম্ভব হচ্ছে না যে তার ভেতরে কত অস্ত্র রয়েছে, কত যন্ত্রাংশ রয়েছে। মার্কিন সিনেটরদের কথাবার্তায় এসব জানা যাচ্ছে এবং এজন্য তাদেরকে ধন্যবাদ জানানো উচিৎ। তবে এর সঙ্গে সঙ্গে নিজ দূতাবাসকেও আমাদের অধিক সক্রিয় করে তোলা আবশ্যক। সিনেটর চার্চ যা বলেছেন, ‘ নিউ ইয়র্ক টাইমস/ সেটি সমর্থন করেছে। আমি বিদেশমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেছি, একথা কি সত্য যে, অ্যামেরিকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এ সময়ে পাকিস্তানকে কোন অস্ত্র না দিতে প্রেসিডেন্টকে সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট নিক্সন নিজ ক্ষমতা বলেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, অ্যামেরিকার অস্ত্র যাবে। আমি জানতে চাই এব্যাপারে ভারত সরকারের বক্তব্য কি? আমি জানতে চাই মার্কিন সরকারের কৌশল ও মনোভাব সম্পর্কে তাদের অভিমত কি? বিদেশ মন্ত্রী মহোদয় বলছেন, এই অস্ত্র বাংলাদেশে গণহত্যা আরও বৃদ্ধি করবে। এতে আমি একমত। তবে আমি আরেক পা এগিয়ে গিয়ে বলতে চাই, বাংলাদেশে গণহত্যা চালানোর মত পর্যাপ্ত অস্ত্র পাকিস্তানের আগে থেকেই রয়েছে। এসব অস্ত্র আসছে যে কোন সময় ভারতের ওপর পাকিস্তানের আক্রমণের উদ্যেশ্য নিয়ে। এ আক্রমণ যে কোন স্থানে হতে পারে। জম্মু কাশ্মীরে, রাজস্থানে, গুজরাটেও হতে পারে। নচেৎ এসময় অস্ত্র প্রেরণের উদ্যেশ্য কি? অ্যামেরিকার মনোভাব কি? বিদেশমন্ত্রী মহোদয় বলছিলেন, রাশিয়া ও অ্যামেরিকাকে আমাদের এক সারিতে দেখার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আজকের সংবাদপত্রে ইজভেস্তিয়ার খবর ছাপা হয়েছে – রাশিয়ার নেতা আমাদেরকেও বলেছেন, ধৈর্য ধর, পাকিস্তানকেও বলেছেন ধৈর্য ধর। এটা কি ভারত ও পাকিস্তানকে একই সারিতে রাখা হচ্ছেনা? এখন আমি দু তিনটি প্রশ্ন করতে চাই।

প্রথম প্রশ্ন এই যে, সরকার কি অ্যামেরিকাকে এযাবৎ কোন প্রতিবাদ লিপি পাঠিয়েছেন? কূটনৈতিক পর্যায়ে লিখিত প্রতিবাদের গুরুত্ব ভিন্নতরই হয়।

ডঃ কিসিঞ্জার এখানে এসেছিলেন। তার কাজ পরামর্শ দেয়া। ভুল পরামর্শও তিনি দিতে পারেন। তিনি পরামর্শ দেবেন সেখানে আর এখানে তথ্য উদ্ধার করবেন। আমি জানতে চাই আমরা কি তাঁকে শরনার্থী শিবিরে গিয়ে একটু পরিদর্শন করে আসবার আমন্ত্রণ জানিয়েছি? এটা করা হলেই তো তিনি তথ্য পেয়ে যেতেন? আগত লোকদের চেহারায় ভয় ও আতংকের যে সব কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে তিনি তা পড়ে নিতে পারতেন আর মন্ত্রী মহোদয়ের প্রয়োজন হতনা তাঁকে বুঝবার। আমরা তাঁকে কোন শরনার্থি শিবিরে না পাঠালে কি কারণে পাঠাইনি?

অ্যামেরিকা শরনার্থিদের জন্য আমাদেরকে সাহায্য দিচ্ছে আর পাকিস্তানকে দিচ্ছে অস্ত্র। এক অ্যামেরিকার দুই রূপ। আমি জানতে চাই, অ্যামেরিকার কৌশলের বিরুদ্ধে নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশের জন্য বিদেশমন্ত্রী কি কোন ব্যাবস্থা গ্রহণ করেছেন? বিদেশ মন্ত্রী কি এই ঘোষনা দিতে প্রস্তুত আছেন যে, অ্যামেরিকা পাকিস্তানকে অস্ত্র দেয়া বন্ধ না করলে উদ্বাস্তুদের জন্য সে যত সাহায্য দিতে তৈরি থাক না কেন আমরা তা গ্রহণ করব না, আমরা তা ফেরত দেব? হামাগুড়ি দিয়ে টেনে হিঁচড়ে চলার চেয়ে নিজ পায়ের ওপর ভর করে লড়তে লড়তে মরে যাওয়াই বেশী ভালো।

শ্রী শরণ সিং: প্রথম প্রশ্নের উত্তর ‘হ্যাঁ। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর ‘হ্যাঁ। কিসিঞ্জার বলেছিলেন যে, তিনি খুব ব্যস্ত ছিলেন এবং তিনি শরণার্থী শিবির দেখতে যেতে পারবেন না। তার তৃতীয় প্রশ্ন, পরামর্শ সংক্রান্ত যে যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে তাই আমি ডিক্লেয়ার করব কিনা যে আমি উদ্বাস্তুদের জন্য কোনো সাহায্য তাদের থেকে গ্রহণ করব না। আমি দুঃখিত, আমি এটা করতে পারব না।

শ্রী অটল বিহারি বাজপেয়ীঃ অ্যামেরিকাকে লিখিত প্রতিবাদপত্র দেয়া হলে তার প্রকৃতি কি এবং কবে দেয়া হয়েছে?

শ্রী শরণ সিংঃ ২৭ জুন ১৯৭১ তারিখে।

শ্রী ফুলচন্দ্র বর্মাঃ এটি অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ন বিষয়। এর ওপর কমপক্ষে দুই ঘণ্টা ধরে আলোচনা হওয়া দরকার। এটি আমাদের দেশের জীবন মরণ সমস্যা। সংসদের সকলে চায় এর ওপর দুই ঘণ্টা ধরে আলোচনা হোক।

জনাব স্পিকারঃ যদি নিয়ম থাকে আমার অনুমতি দিতে বাঁধা নেই।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২২৪। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা কর্তৃক শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার হুমকি প্রসঙ্গে আলোচনা ভারতের লোকসভার কার্যবিবরণী ৪, ৯ ও ১২ আগষ্ট, ১৯৭১

Hasan Tareq Imam
<12, ২২৪, ৮৭৬-৮৮৮>
অনুবাদ

১২.১০ ঘটিকা

পাকিস্তানের সামরিক জান্তা কর্তৃক শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার হুমকি

মাননীয় স্পীকার: জ্বনাব এফ.এ.আহমেদ।

শ্রী সমর গুহ (কোন্টাই): আমি অত্যন্ত জরুরী এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।

মাননীয় স্পীকার: আমি আপনাকে অনুমতি দিতে পারছিনা। আপনি আগে থেকেই বক্তব্য দেবার ব্যাপারে প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন। আমি দুঃখিত, কিন্তু আমি আপনাকে ফ্লোর দিচ্ছিনা।

শ্রী সমর গুহ: আপনি যতক্ষন পর্যন্ত না আমাকে সংসদ থেকে বের করে দিচ্ছেন, আমি বাংলাদেশের ব্যাপারে কথা বলতে থাকব। আমি সংসদ এবং সংসদের মাধ্যমে এই বিষয়ে দেশবাসীর মনোযোগ আকর্ষণ করেই যাব, বিশেষত যেখানে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে।

মাননীয় স্পীকার: উনি বলছেন যে উনাকে সংসদ থেকে বের করে না দেয়া পর্যন্ত উনি থামবেন না।

(এই সময় স্পীকারের বক্তব্যে বাধা পড়ে। )

শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ি (গোয়ালিয়র): স্পীকার মহোদয়, আমার নিবেদন এই যে, শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে সংসদের মনোভাব এরকমই এবং আমাদের বন্ধু শ্রী সমর গুহ বাংলাদেশের সমস্যা না তুলে থাকতেই পারেন না। আপনি তাঁকে বলতে পারেন যে, আপনি এই সমস্যা নিয়ে ভাবছেন এবং এভাবে এই সমস্যা এড়াতে পারেন।

স্পীকার মহোদয়: এরুপ দু’তিন দিন তো আমি চিন্তা-ভাবনার কথা বলে কাটিয়েছি। আর কত দিন এভাবে চলবে।

শ্রী এস.এ.শামীম (শ্রীনগর): এই অবস্হান শ্রী সমর গুহের একার নয়। আমি নিশ্চিত যে পুরো সংসদই তাঁর সাথে সহমত পোষন করে। সুতরাং প্রশ্নটি শুধু শ্রী সমর গুহের নয়, প্রশ্নটি সমগ্র সংসদের তরফ থেকে উথাপিত। আমি জানিনা যে সরকারী দল কেন এ ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করছেন।

শ্রী এইচ.এন.মুখ্যার্জি (কলকাতা উত্তর-পূর্ব): মাননীয় সাংসদ যে প্রশ্নটি উত্থাপন করেছেন তা পুরো সংসদের জন্যই উদ্বেগজনক। সনসদে কিছু মন্ত্রী সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন, আমি জানিনা তারা নির্বোধ কিনা; কিন্তু তাঁরা কোন প্রশ্নের উত্তর দেন না। সাংসদদের দায়িত্ব যে কোন গুরুত্বপূর্ন ইস্যু সংসদের দৃষ্টিগোচর করা এবং সরকারের দায়িত্ব এর প্রত্যুত্তর দেয়া। আমি লক্ষ করছি যে মাননীয় স্পীকার সব সময় সরকারকে সমস্যাগুলোর দিকে দৃষ্টি দিতে অনুরোধ করছেন এবং এবং নিজেদের পর্যবেক্ষন সংসদকে অবহিত করতে অনুরোধ করছেন। আমি চাইনা যে মাননীয় স্পীকার কোন ব্যাপারে পক্ষ অবলম্বন করবেন বা নিজের রায় জানাবেন, কিন্তু সরকার কিছুই বলছেনা। সংসদ নেত্রী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আজ উপস্হিত নেই। আমি জানিনা অন্য মন্ত্রীরা কি করছেন, কিন্তু এই প্রশ্নের জবাব দেয়া তাঁদের অবশ্য কর্তব্য।

স্পীকার মহোদয়: আলোচ্যসূচিতে যেহেতু কিছুই অন্তর্ভুক্ত ছিলনা, মাননীয় মন্ত্রীরা কেন এখানে থাকবেন? এখন রাজ্যসভার অধিবেশনও চলছে, মন্ত্রীরা পালাক্রমে দুই সভার কার্যক্রমেই অংশগ্রহণ করছেন। কেউ কেউ রাজ্যসভার অধিবেশনে অংশ নিচ্ছেন, কেউ কেউ এই সভার অধিবেশনে আসছেন।

শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ি : স্পীকার মহোদয়, আমি যা বলেছি, তার অর্থ এই নয় যে শ্রী সমর গুহের প্রশ্ন হেসে উড়িয়ে দিতে হবে। আমি আপনার এবং তার মধ্যকার দ্বন্দ্ব এড়াতে চেয়েছি মাত্র। আপনি এটা গ্রহণ করতে পারেন।

স্পীকার মহোদয়: কিভাবে নিতে পারি?

শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ি : স্পীকার মহোদয়, দৃষ্টি আকর্ষণ (CALL ATTENTION)- এর মধ্যে আপনি এটি নিতে পারেন।

স্পীকার মহোদয়: আমি আপনাকে শুধু এটুকু বলতে পারি যে আমাকে জোর করে বা ভয় দেখিয়ে কাজ হবেনা। সংসদে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে প্রশ্ন উত্থাপন করতে হয়। একজন সাংসদ স্পীকারের চেয়ারকে অপমান করছেন আর আপনি বলছেন আমার তা মেনে নেয়া উচিত। আমি এটা মেনে নিতে পারিনা।

শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ি : স্পীকার মহোদয়, আমি এর উপর দৃষ্টি আকর্ষণ (CALL ATTENTION) দিয়েছি।

শ্রী এস.এম.ব্যানার্জি (কানপুর): আমার মনে আছে যে প্রশ্নটি যখন তোলা হয়েছিল, আপনি শ্রী শরণ সিংকে এ ব্যাপারে কিছু বলতে অনুরোধ করেছিলেন। এটি সংবাদপত্রেও প্রকাশিত হয়েছে, আমাকে এ ব্যাপারে বক্তব্য দিতে দিন।

মাননীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ( শ্রী জগজীবন রাম): বাংলাদেশের জনগনের মুকুটহীন নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার দেয়া বক্তব্যে সংসদের অন্য সবার মত সরকারও উদ্বিগ্ন। সংসদ কে ইতিমধ্যে অবহিত করা হয়েছে যে শেখ মুজিবুর রহমানের কোন ক্ষতি না করতে পাকিস্তান সরকারকে চাপ দেয়ার জন্য আমরা অনেকগুলো দেশের নেতৃবৃন্দকে অনুরোধ জানিয়েছি।

শ্রী এস.এম.ব্যানার্জি: চলুন শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দাবী করে আমরা সংসদের পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাব পাশ করি।

শ্রী জগজীবন রাম: আমাদের মাননীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী ইতিমধ্যে সংসদকে জানিয়েছেন যে সরকার কূটনৈতিক পর্যায়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছে। সরকারের চাওয়া এ বিষয়ে একটি রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে বাংলাদেশে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর।

জরুরী জন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ
শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার বিষয়ে ইয়াহিয়া খানের বক্তব্য

শ্রী সমর গুহ: আমি নিম্নলিখিত জরুরী জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মাননীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এবং উনার বক্তব্য আশা করছি:
সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান একটি বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন যে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হতে পারে।

মাননীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী ( শ্রী শরণ সিং): সামরিক আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার হতে পারে এবং পাকিস্তানে তথাকথিত সংসদ বসার সময় শেখ মুজিব জীবিত নাও থাকতে পারেন এই মর্মে সংবাদপত্রে প্রকাশিত ইয়াহিয়া খানের বক্তব্যে আমাদের সরকার অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। অথচ ইয়াহিয়া খান তার আগের একটি বক্তব্যে শেখ মুজিবুর রহমানকে “পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী” হিসাবে ” উল্লেখ করেছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতা হিসাবে শেখ মুজিব বাংলাদেশে ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি তে জয়লাভ করেছেন এবং এর মাধ্যমে সমগ্র পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছেন। শেখ মুজিবুর রহমান শুধু পূর্ব পাকিস্তান নয়, সমগ্র পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা। ২৫শে মার্চের পর কি ঘটেছে সেটা সারা পৃথিবী জানে। জনরায় উপেক্ষা করে বাংলাদেশের সাধারনগনের উপর সামরিক বাহিনী লেলিয়ে দেয়ার মাধ্যমে যে মানবাধিকারের লঙ্ঘন করা হচ্ছে, তার নিন্দা জানানোর ভাষা নেই। ভোটের ফলাফলকে সম্মান জানিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার পরিবর্তে পাকিস্তানি সরকার নিরীহ মানুষের উপর যে অত্যাচার-নির্যাতন চালাচ্ছে এবং গণহত্যা করছে, তার উদাহরন সাম্প্রতিক কালের ইতিহাসে পাওয়া যায়না। শেখ মুজিবুর রহমানের এই হাস্যকর বিচার মানবাধিকার পরিপন্হি এবং সমগ্র বিশ্বের উচিত এর নিন্দা জানানো। কারাগারে এবং গৃহবন্দী শেক মুজিব এবং তাঁর পরিবারের নিরাপত্তার ব্যাপারে আমরা বার বার উদ্বেগ প্রকাশ করেছি। আমাদের উদ্বেগের কথা আমরা বিদেশী সরকারগুলোকে জানিয়েছি এবং পাকিস্তানের উপর এ ব্যাপারে প্রভাব খাটাতে অনুরোধ করেছি। শেখ মুজিব, তাঁর সহযোগী এবং পরিবারের কারো যদি কোন ক্ষতি হয়, তাহলে বাংলাদেশের পরিস্হিতি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাবে এবং এই পরিনামের জন্য পাকিস্তানী সামরিক জান্তা একক ভাবে দায়ী থাকবে। আমরা বিশ্ববিবেকের কাছে অনুরোধ জানাই যে তারা যেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। আমরা পাকিস্তান সরকারের এই প্রস্তাবের নিন্দা জানাই এবং তাদের সতর্ক করে দিতে চাই যে এপথে অগ্রসর হলে এর পরিনাম অত্যন্ত ভয়াবহ হবে।

শ্রী সমর গুহ: লোক সভা এবং রাজ্যসভার সদস্যরা তাঁদের গভীর উদ্বেগ এবং আশঙ্কার কথা জানিয়ে আপনার কাছে একটি স্মারকলিপি দিয়েছেন। শেখ মুজিবের বিচার বন্ধ এবং অবিলম্বে তাঁর নিঃশর্ত মুক্তির লক্ষে বিশ্ব নেতাদের প্রভাবিত করার জন্য আপনি যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন, তার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। এখন সরকারের পালা। শেখ মুজিবের আশু মুক্তি এবং তাঁর ব্যাক্তিগত নিরাপত্তার জন্য কি কি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা আমাদের জানা দরকার। বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষার জন্য শুধু বিশ্ব দরবারে ধর্না দেওয়াই যথেষ্ঠ হবেনা। আমার মতে সবচেয়ে কার্যকর পন্হা হচ্ছে বাংলাদেশেকে অবিলম্বে রাষ্ট্র হিসাবে এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে সামরিক আদালতে দাঁড় করানোর আগে রাওয়াল পিন্ডির সামরিক জান্তাকে অনেক চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। অবিলম্বে শেখ মুজিবের মুক্তির ব্যাবস্হা করা যদি সম্ভব না হয়, তাহলে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়াটা আমাদের প্রথম এবং প্রধান ইস্যু হওয়া উচিত এবং এ ব্যাপারে সরকারকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নেতা নন, তিনি শুধু বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট নন, তিনি তার থেকে অনেক বড় কিছু। তিনি আজ সারা বিশ্বে গণতন্ত্রের প্রতীক। আমি আবার “বঙ্গবন্ধু” শব্দটি ব্যাবহার করি, তিনি আসলেই গনতান্ত্রিক মূল্যবোধের বন্ধু- প্রজাতন্ত্রের আদর্শ। আমি সংসদকে স্মরন করিয়ে দিতে চাই, একটি সমগ্র জাতী একজন নেতার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে, শেখ মুজিব ছাড়া এরকম উদাহরণ ইতিহাসে আর নেই। পৃথিবীর কোথাও আর কোন বহুদলীয় নির্বাচনে তাঁর মত ৯৮.৯% ভোট পেয়ে নির্বাচিত হওয়ার নজীর নেই।

কোন সামরিক, ফ্যাসিবাদি অথবা অন্যধরনের স্বৈরাচারী সরকার জনগনের সার্বভৌম ইচ্ছার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সক্ষম হয়নি। এটাও মনে রাখতে হবে যে নির্বাচনটি সামরিক জান্তার অধীনেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই অবস্হায় তাঁর এরকম বিপুল ভোটে নির্বাচিত হওয়া বিশাল একটা ঘটনা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ গনতান্ত্রিক এই দেশের সংসদকে স্বীকার করতে হবে যে বিশ্বের অন্য কোন দেশের কোন গনতান্ত্রিক নেতা শেখ মুজিবের মত গনতন্ত্রের পতাকা তুলে ধরতে পারেননি।

আমরা নিজেদের গান্ধীর উত্তরাধিকার হিসাবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করি। মহাত্না গান্ধী অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের পিতা। আমি বিনয়ের সাথে বলতে চাই যে জাতীয় মুক্তির জন্য এই কৌশল খাটাতে শেখ মুজিব গান্ধীজি থেকে অনেক বেশী সফল। সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ তাঁকে সম্পূর্ণরুপে বিশ্বাস করে এবং ২৫ শে মার্চের পূর্বে বাংলাদেশের জনজীবন বা প্রশাসনের উপর ইয়াহিয়ার বিন্দুমাত্র কতৃত্ব ছিলনা। এখানে উল্লেখ্য যে প্রধান বিচারপতি গভর্নর টিক্কা খানের শপথগ্রহণ পরিচালনা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন, বিশ্বের কোথাও এমন নজির খুঁজে পাওয়া যাবেনা।

ইয়াহিয়া খান দাবী করেন যে তিনি নাদির শাহের বংশধর। তিনি নাদির শাহের মতই শাসক হতে চান, গনতান্ত্রিক আন্দোলনের সবচেয়ে বড় আইকন শেখ মুজিবকে প্রহসনের বিচারের মুখোমুখি করতে চান। আদালতে বিচার হওয়ার আগেই তিনি বিচার করে ফেলছেন, বলে দিচ্ছেন যে অক্টোবরে পুতুল সংসদ বসার পূর্বেই মুজিবকে হত্যা করা হবে।

আমি পাকিস্তানকে সাবধান করতে চাই যে তারা যদি চেষ্টা করে…..
( এসময় তাঁর বক্তব্যে বাধা পড়ে)
তাদের জন্য সতর্কবানী রইল, এর পরিনাম খারাপ, ভয়াবহ রকমের খারাপ হবে। ইয়াহিয়া খানের জানা উচিত যে তিনি যদি শেখ মুজিবের কোন ক্ষতি করেন, তাহলে বাংলাদেশে বসবাসরত ৪০ লক্ষ পশ্চিম পাকিস্তানী এবং ৫১/২ ডিভিশন সৈন্যের জীবন সংশয়ের মুখে পড়বে। শেখ মুজিবকে যদি হত্যা করা হয়, একজন পাকিস্তানী সৈন্য অথবা পশ্চিম পাকিস্তানী কোন কিছু বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে পাকিস্তানে ফিরতে পারবেনা। সুতরাং বাংলাদেশে জিম্মি তার নিজেদের মানুষের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ইয়াহিয়া খান কোন ধরনের হটকারী পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থাকবেন বলে আশা করা যায়। এরকম কোন কিছু হওয়া অবশ্যই উচিত নয়, কিন্তু আমি সত্য বর্ণনা করছি মাত্র। তারা যদি শেখ মুজিবের কোন ক্ষতি করে, তাহলে ভয়াবহ রকমের পরিনতি নেমে আসবে। ইয়াহিয়ার এটা মনে রাখা উচিত যে বাংলাদেশের মানুষের প্রতিক্রিয়া ভয়ঙ্কর হতে পারে, এবং এর ফলে পশ্চিম পাকিস্তানী নিরপরাধ মানুষের জীবন সংশয় হতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী আজ এখানে নেই। আমি তাঁকে কঙ্গোর নেতা লুমুব্বার জীবন রক্ষার্থে পন্ডিত জহর লাল নেহেরুর নেয়া পদক্ষেপগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। আমি পন্ডিত নেহেরুর কন্যা, মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর কাছে শেখ মুজিবের নিরাপত্তা এবং মুক্তির জন্য সম্ভাব্য সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার আবেদন জানাই।

আমি সরকারের কাছে জানতে চাই অবিলম্বে বাংলাদেশকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকার করে নেয়ার মাধ্যমে শেখ মুজিবকে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হবে কিনা। আমি আগেই বলেছি যে আমার মতে শেখ মুজিবের মুক্তি এবং নিরাপত্তার জন্য এটিই হবে সর্বোত্তম পদক্ষেপ।

দ্বিতীয়ত আমি জানতে চাই শেখ মুজিবের মুক্তি ও নিরাপত্তা চেয়ে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষন করে এই মহান সংসদ সর্বসম্মতভাবে একটি প্রস্তাব পাশ করবে কিনা। আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি হলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবের ক্ষতি করার সাহস পাবেনা।

তৃতীয়ত, আমি স্পীকারের কাছে অনুরোধ জানাই যে ইন্ডিয়ান পার্লামেন্টারী ইউনিয়নের সভাপতি হিসাবে আপনি শুধুমাত্র বিরোধীদলীয় সাংসদদের নিয়ে একটি প্রতিনিধিদল নির্বাচন করবেন। এই প্রতিনিধিদল বিভিন্ন দেশে গিয়ে শেখ মুজিবের পক্ষে আন্তর্জাতিক মত তৈরির চেষ্টা করবেন।
চতুর্থত, আমি সরকারের কাছে জানতে চাই তারা রাশিয়ার সাথে সামরিক জোট গঠনের ব্যাপারে সংসদে কোন বক্তব্য দেবেন কিনা। আমি সরকারের কাছে জানতে চাই আমাদের বন্ধু গ্রোমিকো…..
(এসময় তাঁর বক্তব্যে বাধা পড়ে)
হ্যাঁ আমি তাঁকে বন্ধুই বলি কারন বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু। আমি জানতে চাই শেখ মুজিবের ব্যাক্তিগত নিরাপত্তা এবং মুক্তির ব্যাপারে তাঁরা গ্রোমিকোর সাথে আলোচনা করেছেন কিনা। সর্বশেষে, আমি জানতে চাই প্রয়োজনে এই ব্যাপারটা সরকার জাতিসংঘ তুলে ধরবে কিনা।

শ্রী শরণ সিং: মাননীয় সাংসদ, শেখ মুজিবের প্রতি আপনার মত আমিও অত্যন্ত শ্রধ্ধাশীল। তিনি শুধু নির্বাচনে বিপুল বিজয় বা সমগ্র দেশের মানুষের নিরঙ্কুশ ভালবাসা পাননি, তিনি সমগ্র বিশ্বের স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে সম্মান অর্জন করেছেন। একারনেই তাঁর ব্যাপারে আমরা উদ্বিগ্ন এবং ইয়াহিয়া খানের নেয়া বিচারের উদ্দোগের আমরা তীব্র নিন্দা জানাই। কিন্তু মাননীয় সাংসদ এমন কিছু পদক্ষেপের কথা বলেছেন, যেগুলো আসলে এই প্রশ্নের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়। যেমন স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারটা।

শ্রী সমর গুহ: স্বীকৃতি দিলে আমরা বাংলাদেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্হাপন করতে পারব এবং তিনি একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের রাষ্ট্রপতি হবেন। আইনগতভাবে এটি তাঁকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেবে।

শ্রী শরণ সিং: এটি একটি আলাদা বিষয়। এখন এটি নিয়ে আলোচনা করে শেখ মুজিবের মুক্তির ব্যাপারে আমাদের অবস্হান দূর্বল করতে চাইনা। পরিস্হিতি যাই হোকনা কেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত ইয়াহিয়ার প্রস্তাবিত অবৈধ বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ নেয়া।

তারপর উনি এই সংসদ থেকে একটি বিবৃতি চেয়েছেন। এ ব্যাপারে আমি উনার সাথে সহমত পোষন করি। আমার মতে সর্বসম্মতিক্রমে পুরো সংসদের পক্ষ থেকে এরকম একটি বিবৃতি দেয়া হলে সেটি শেখ মুজিবের প্রতি আমাদের সম্পূর্ন সমর্থন বোঝাবে এবং পাকিস্তানি সামরিক জান্তার উপর শেখ মুজিবের মুক্তি এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য চাপ সৃষ্টি করবে।

মাননীয় স্পিকারের কাছে উনি যে আবেদন করেছেন, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত মাননীয় স্পীকারই নেবেন।

স্পীকার মহোদয়: আপনি আমাকে কি করতে উপদেশ দেন? আমার কি করা উচিত?

শ্রী শরণ সিং: এ ব্যাপারে আমি বলতে চাই যে, ভারতীয় সরকার ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে রাশিয়া সহ বন্ধুপ্রতীম দেশগুলোর সাথে আলোচনা করেছে। আমরা তাঁদের অনুরোধ করছি যে তাঁরা যেন পাকিস্তানের সামরিক সরকারের উপর প্রভাব খাটিয়ে বাংলাদেশে পাকিস্তানের সামরিক কর্মকান্ড বন্ধ এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য কার্যকর আলোচনা শুরুর পরিবেশ সৃষ্টি করার ব্যাবস্হা করেন।

শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ি (গোয়ালিয়র): তাদের প্রতিক্রিয়া কি?

শ্রী শরণ সিং: বেশিরভাগ সরকারই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে তারা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে এব্যাপারে কথা বলবেন।

মাননীয় সাংসদের শেষ প্রশ্নের ব্যাপারে বলতে চাই জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে ইতিমধ্যে একটি স্মারকলিপি পাঠানো হয়েছে এবং আমি নিশ্চিত যে এই স্মারকলিপি জাতিসংঘের ভেতর এবং বাইরে যথেষ্ঠ প্রভাব ফেলবে। জাতিসংঘে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা হবে কিনা সেই ব্যাপারে আরো চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন আছে।

স্পীকার মহোদয়: এই প্রথম বারের মত স্পীকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে একটি প্রশ্ন করা হয়েছে। প্রসঙ্গটি আমি বিবেচনা করছি। ডঃ করণ সিং যদি আমাকে দুইটি জাম্বো জেট বিমান ধার দেন, তাহলে আমি পুরো সংসদকেই বিদেশে পাঠিয়ে দিতে পারি।

মাননীয় বিমান এবং পর্যটন মন্ত্রী (ডঃ করণ সিং): আপনার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা মাননীয় স্পীকার।

স্পীকার মহোদয়: ঠিক আছে। আমার ইচ্ছাই উনার ইচ্ছা। আমি চেষ্টা করে দেখব আপনাদের জন্য একটি বিদেশ সফরের আয়োজন করা যায় কিনা। কিন্তু বিদেশ যেয়ে আপনাদের এক জিনিষ নিয়ে বসে থাকলে চলবেনা। আপনাদের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে আগামী কনফারেন্স অফ ইন্টার পার্লামেন্টারী ইউনিটের সবগুলো সভা এবং কমিটিতে আমাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে ইতিমধ্যে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে।

শ্রী পি. ভেঙ্কটাসুব্বাইয়া ( নান্দিয়াল): মাননীয় স্পীকার। এই ব্যাপারে আমার ছোট্ট একটি কথা বলার আছে। এই গুরুত্বপূর্ন ব্যাপারে হাস্যরস করা ঠিক নয়।

স্পীকার মহোদয়: সমস্ত বিস্তারিত সহ আই.পি.আই এর কাছে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। আশা করি ভবিষ্যৎে স্পীকারের উদ্দেশ্যে আর কোন প্রশ্ন করা হবেনা।

শ্রী এস.এম.ব্যানার্জি (কানপুর): স্পীকার মহোদয়, আমি মাননীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বক্তব্যের শেষ বাক্যটি পড়তে চাই। তিনি বলেছেন:

” আমরা পাকিস্তান সরকারের এই প্রস্তাবের নিন্দা জানাই এবং তাদের সতর্ক করে দিতে চাই যে এপথে অগ্রসর হলে এর পরিনাম অত্যন্ত ভয়াবহ হবে। “

এই প্রথম বারের মত আমরা শুধু পাকিস্তানী সরকারের কর্মকান্ডে বিষ্ময় বা নিন্দা জ্ঞাপনই করিনি, ইয়াহিয়া খানের উদ্দেশ্যে সতর্কবাণীও উচ্চারন করেছি। আমরা সামরিক স্বৈরাচার এবং তার সাম্রাজ্যবাদী প্রভু আমেরিকার চরিত্র সম্পর্কে জানি এবং এটাও জানি যে ইয়াহিয়া সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার হাতের পুতুল ছাড়া কিছু নন। অতীতের করুন অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি যে পৃথিবীর অনেকগুলো সংগঠন রোসেনবার্গের মৃত্যুদন্ড বন্ধ করার দাবী জানিয়েছিল। কিন্তু তাতে কি হল? তার মৃত্যুদন্ড বন্ধ করা যায়নি। আমি জানি প্যাট্রিক লুমুম্বার কি হয়েছিল। তাঁকে কিভাবে হত্যা করা হয়েছিল। আমরা এও জানি মার্টিন লুথার কিংকে হত্যা করার পর কি করা হয়েছিল। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে যেয়ে কেউ যখন শহীদ হয়, আমি তখন অবাক হইনা। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শহীদদের আমরা সম্মান দেই। কিন্তু আমার একমাত্র চিন্তা হচ্ছে শেখ মুজিবের প্রহসনের বিচারের পর তাঁকে যদি হত্যা করা হয়, তা হবে একই সাথে মানবতা, সংসদীয় গনতন্ত্র এবং বাংলাদেশে অসাম্প্রয়দায়িকতাকে ক্রুশবিদ্ধ করা।

আমি জানি যে যতক্ষন পর্যন্ত বাংলাদেশে একটি শিশুও বেঁচে আছে, ততক্ষন পর্যন্ত সামরিক সরকার শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারবেনা। যেসব মানুষ যুদ্ধ করছেন, তাঁদের শক্তির উপর আমার আস্হা আছে। সামরিক বাহিনীর গুলিতে এখন পর্তন্ত ৬ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছেন। কিন্তু তারা এখনো যুদ্ধ করে যাচ্ছে। মুক্তিফৌজ নতুন নতুন এলাকা দখল করছে এবং তাদের শক্তি দিনে দিনে বাড়ছে।

এই ঘটনার নিন্দা জ্ঞাপন, পাকিস্তানকে হুঁশিয়ারী উচ্চারন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যোগাযোগ করা ছাড়াও আমাদের সরকারে উচিত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার মত গুরুত্বপূর্ন একটা বিষয় নিষ্পত্তি করা।

ভারতের মানুষ এ ব্যাপারে কি প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে? গতকাল একটি রবীন্দ্র সঙ্গীতের অনুষ্ঠান অংশগ্রহনের সময় আমার একটি চমৎকার অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেই অনুষ্ঠানে এম.এন.কুমার মুখ্যার্জি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত গাইছিলেন।

আমরা সবাই, এমনকি আমাদের মন্ত্রীরাও জানেন যে অন্তরের অন্তঃস্হল থেকে আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাই। আজ ৯ ই অগাস্ট একটি ঐতিহাসিক দিন, এই দিনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তির লক্ষে সবচেয়ে বড় যুদ্ধটা সংগঠিত হয়েছিল। আজকের এই মহান দিনে আমি মাননীয় মন্ত্রীকে অনুরোধ করব গণতন্ত্র এবং অসাম্প্রদায়িকতা রক্ষার্থে বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি দিতে।

মাননীয় মন্ত্রী সাথে সাথেই বলবেন যে এই প্রস্তাব প্রশ্নের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়। কিন্তু শুধু এদিক-ওদিক আবেদন করে কিভাবে আপনি একটি দেশকে রক্ষা করতে পারবেন? স্বৈরাচারী ইয়াহিয়া খান মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কলের পুতুল, তারা ইয়াহিয়ার কিছুই হতে দেবেনা। ইয়াহিয়া শেখ মুজিবকে শেষ করে দিতে চাইবে কারন স্বৈরাচার সবসময়ই মনে করে ব্যাক্তিকে দমন করেই মতবাদকে ধ্বংস করে দেয়া যায়। আমি জানি যে তারা সফল হবেনা, কিন্তু চেষ্টা তারা অবশ্যই করবে।

মাননীয় মন্ত্রীর কাছে আমার প্রশ্ন, বর্তমান অবস্হার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার বিষয়টি তিনি পুনর্বিবেচনা করা করবেন কিনা।

যদিও আমি চুক্তির পুরোটা এখনো জানিনা, কিন্তু পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র-চীন জোটের বিপক্ষে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী মিঃ গ্রোমিকোর সাথে আমাদের সরকারের যে জোট গঠিত হয়েছে সেটা জেনে আমি অত্যন্ত খুশি। এই ঐতিহাসিক দিনে চুক্তির সাথে জড়িত সকলকে অভিনন্দন। কিন্তু আমি জানতে চাই যে এই জোট গঠনের পরে পাকিস্তান এবং চীনের আক্রমণের ভয় না পেয়ে ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে কিনা। আমি নিশ্চিত যে আমাদের আক্রমণ করার সাহস কারো হবেনা। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হলে আমরা শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং অসাম্প্রদায়িকতা সবই রক্ষা করতে পারব।

মাননীয় স্পীকার, আপনার মাধ্যমে আমি মাননীয় মন্ত্রীকে এই বিষয়ে আরেকটু বিশদ আলোচনা করার আহ্বান জানাই। আমি খুশি যে তিনি পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে হুঁশিয়ারি উচ্চারন করেছেন। কিন্তু পাকিস্তান মুজিবকে হত্যা করলে ঠিক কি পদক্ষেপ নেয়া হবে সেটা পরিষ্কার করা বলতে হবে। এটা পাকিস্তান এবং দুনিয়ার মতের উপর ছেড়ে দেয়া যাবেনা। আমাদেরও অনেক বন্ধুরাষ্ট্র আছে। সমাজতান্ত্রিক শক্তি রাশিয়া আমাদের সাথে আছে। এটা প্রমাণিত যে আমাদের সাম্রাজ্যবাদী বন্ধুরা আমাদের গম পাঠায়, পাকিস্তানকে পাঠায় অস্ত্র। কিন্তু রাশিয়া আমাদের প্রকৃত বন্ধু। সেই বন্ধুত্ব আজ আরো শক্তিশালী হল। আমাদের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার ব্যাপারে সাহসী হওয়া উচিত। শেখ মুজিবুর রহমানের দ্রুত মুক্তির ব্যাবস্হা করার জন্য আমি সরকার এবং বিশ্বনেতৃত্বের প্রতি আহ্বান জানাই।

শ্রী শরণ সিং: বাংলাদেশকে স্বীকৃতী দেয়ার ব্যাপারে সরকারের অবস্হান অনেকবার ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং এই মুহূর্তে এ নিয়ে আবার আলোচনা করা অপ্রয়োজনীয়। আমি এ ব্যাপারে কোন বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতে চাইনা। দ্বিতীয় প্রশ্নে উনি পাকিস্তান শেখ মুজিবকে হত্যা করলে কি কি পদক্ষেপ নেয়া হবে সেটা পরিষ্কার করে বলতে বলছেন। আমি মনে করি এই ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা বুদ্ধিমানের কাজ হবেনা।

শ্রী এস.এম.ব্যানার্জি : আমার প্রশ্নের পুরো উত্তর দেয়া হয়নি। চুক্তির ব্যাপারে কি হল?
( তাঁর বক্তব্যে বাধা পড়ে)। আমরা রাশিয়ার সাথে একটা চুক্তিতে এসেছি
(বক্তব্যে আবার বাধা পড়ে)

শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ি : চুক্তির ব্যাপারে আমরা কিছুই জানিনা।

শ্রী এস.এম.ব্যানার্জি: আমি জানতে চাই কোন চুক্তি হয়েছে কিনা এবং চুক্তি হয়ে থাকলে সেই ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য চাই।

স্পীকার মহোদয়: মাননীয় মন্ত্রী চুক্তির ব্যাপারে এখনো কোন বক্তব্য দেননি।

শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ি : এ ব্যাপারে আমরা কিছুই জানিনা।

স্পীকার মহোদয়: তিনি এ ব্যাপারে পরে বক্তব্য রাখবেন।
( তাঁর বক্তব্যে বাঁধা পড়ে)

শ্রী এস.এম.ব্যানার্জি : বাংলাদেশকে নিয়ে বাইরে অসংখ্য সভা-সমাবেশ হচ্ছে। আশ্চর্যের বিষয় যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতির ব্যাপারে আমরা তাদের কিছুই বলতে পারছিনা।
( বক্তব্যে বাঁধা পড়ে)

স্পীকার মহোদয়: অর্ডার, অর্ডার। শ্রী এইচ.এম.প্যাটেল।

শ্রী এইচ.এম.প্যাটেল( ধানদুকা): মাননীয় মন্ত্রীর বক্তব্য এবং শ্রী সমর গুহের প্রশ্নের উত্তরে তাঁর দেয়া ব্যাখ্যার পর আমি আর বিস্তারিত কিছু বলার প্রয়োজন দেখিনা। এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে এই মুহুর্তে সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত নয়, যদিও আমাদের অনেকেই মনে করছেন যে এখনই স্বীকৃতি দেয়াটা জরুরী। মাননীয় মন্ত্রীর কাছে আমার প্রশ্ন, এ ব্যাপারে সমগ্র সংসদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে তিনি কি একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেবেন কিনা। এরকম একটি বিবৃতি দেয়া হলে সেটা কিছুটা হলেও গুরুত্ব বহন করবে। যদিও এই গুরুত্বের পরিমাণ কতটুকু হবে সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ। পাকিস্তান এবং ইয়াহিয়া খান সবসময়ই যুক্তিবোধের বাইরে আচরণ করে আসছে। তারপরেও এই ব্যাপারে একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি মন্দের ভাল হিসাবে কাজ করবে।

শ্রী শরণ সিং: এই মহান সংসদে আমার বক্তব্যের পর বিভিন্ন দলীয় সাংসদদের প্রতিক্রিয়া শোনার পর আমার মনে হয়েছে যে সার্বিক ভাবে সবাই আমার বক্তব্য সমর্থন করছেন। আমি ইতিমধ্যে বলেছি এই অবস্হান সমর্থন করে সংসদ যদি একটি প্রস্তাব পাশ করে, তাতে আমার আপত্তি নেই।

শ্রী এস.এম.ব্যানার্জি: তাহলে সেটাই করুন। আপনি প্রস্তাবটা উত্থাপন করতে পারেন না?
(তাঁর বক্তব্যে বাঁধা পড়ে)

শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ি : আমরা সবাই মিলে ইতিমধ্যে একটা বিবৃতি দিয়েছি। সেটার কি হল? আরেকটা বিবৃতি দিয়ে কি হবে?
(বক্তব্যে বাঁধা পড়ে)

স্পীকার মহোদয়: মিঃ ব্যানার্জি, সব সময় ফ্লোর কেড়ে নেবেন না। এটা খুবই খারাপ। শ্রী পি.আর.দাস মুন্সি।

শ্রী পি.আর.দাস মুন্সি (কলকাতা দক্ষিণ): মাননীয় মন্ত্রীর বক্তব্যের উপর আমি বলতে চাই যে এটা অত্যন্ত খুশির ব্যাপার যে সরকার একদম সঠিক সময়ে নিজেদের উদ্বেগের কথা আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলে ধরেছে।

এই ব্যাপারে এখন আমি আমাদের গৌরবময় ইতিহাস স্মরণ করতে চাই। ১৯২৪ সালে আমাদের এক মহান নেতা নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসু যখন গ্রেফতার হন, তখন আরেক মহান নেতা সি.আর.দাস বলেছিলেন যে দেশের জন্য স্বাধীনতা চাওয়া যদি অপরাধ হয়, তাহলে তিনি অপরাধী।

ভারতীয় জনগন এবং সারা বিশ্বের অগণিতগনতন্ত্রকামী মানুষদের জন্য এখনই সময় শেখ মুজিবুর রহমানের সমর্থনে সি.আর.দাসের কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করার। আমরা যে সত্যের পথে আছি এবং আমাদের হৃদয়কে অনুসরন করছি এ ব্যাপারে কোনই সন্দেহ নেই।

আমরা জেনেছি যে সরকার এ ব্যাপারে আমাদের উদ্বেগের কথা অন্যান্য দেশগুলোকে জানিয়েছে এবং পাকিস্তান সরকারের উপর নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে সমাধানের ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে বলেছে। এই আলোচ্য বিষয়ে আমি মাননীয় মন্ত্রিকে একটি প্রশ্ন করতে চাই।

সম্প্রতি আমরা দুটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র মঞ্চস্হ হবার ঘটনা দেখতে পাচ্ছি। তার একটির পেছনে আছেন পিকিং এ কিসিন্জার এবং চৌ এন লাই, অন্যটি রচনা করছেন ইসলামাবাদে ইয়াহিয়া এবং কিসিন্জার। আমি জানতে চাই সরকার কি এই ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে অবহিত আছে কিনা। কিসিন্জার এবং চৌ এন লাই বৈঠকের পরে নিক্সন প্রশাসন এই অঞ্চলে তাদের অশুভ প্রভাব বিস্তার করছে এবং ইয়াহিয়া শেখ মুজিবকে হত্যা করার হুমকি দিচ্ছেন। যদিও ইয়াহিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের জনগনের সমর্থনে বলীয়ান হয়ে হুমকি দিচ্ছেন, কিন্তু তিনি আদপে নিক্সনের পালকপুত্র ছাড়া আর কিছু নন। এই অঞ্চলের ব্যাপারে নিক্সন ইয়াহিয়ার পরামর্শ মেনে চলেন বলে আমি বিশ্বাস করি।

এরপর আমি একটি সুনির্দিষ্ট বিষয় উত্থাপন করতে চাই। আমরা ইতিমধ্যে এই ঘটনার নিন্দা জানিয়েছি এবং সম্ভবত পাকিস্তান সরকারের উদ্দেশ্যে হুঁশিয়ারি উচ্চারন করেছি। আমি বিশ্বাস করি শেখ মুজিবকে হত্যার হুমকি দেয়ার মাধ্যমে ইয়াহিয়া শুধু বাংলাদেশের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষনা করেননি, ভারতের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষনা করেছেন। কারণ ভারতের জনগন এ ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের সাথে সম্পূর্ণরুপে একাত্নতা প্রকাশ করে।

ইয়াহিয়া খান যদি মুজিবুর রহমানের কোন ক্ষতি করার চেষ্টা করেন, তাহলে কি আমাদের সরকার বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর নগ্ন আগ্রাসনের প্রতিবাদে সমগ্র ভারতের মানুষকে, বিশেষ করে তরুণসমাজকে মুক্তিফৌজে যোগ দেয়ার আহবান জানাবে?

আমি মাননীয় মন্ত্রীর কাছে এই দুটি সুনির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তর চাই।

শ্রী শরণ সিং: পাকিস্তান সরকারকে অস্ত্র সরবরাহ করা এবং তাদের সমর্থন দেয়ার ব্যাপারে মার্কিন সরকারের সার্বিক অবস্হানের বিরোধিতা করে আমরা জাতিসংঘের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করেছি এবং আমাদের তীব্র প্রতিবাদ ব্যাক্ত করেছি। ইতিপূর্বে এ ব্যাপারে আমি সংসদকেও অবহিত করেছি।

জনগনকে মুক্তিফৌজে অংশ নেয়ার আহবান জানানোর ব্যাপারে উনার প্রশ্নের উত্তরে আমি বলতে চাই যে এটি মূলত রাজনৈতিক উদ্দোগের ব্যাপার, সরকারী নয়।

শ্রী পি. ভেঙ্কটাসুব্বাইয়া: মাননীয় সাংসদদের দ্বারা পেশকৃত স্মারকলিপিতে সমগ্র ভারতবাসীর পক্ষ থেকে আধুনিক যুগের নাদির শাহ ইয়াহিয়া খান কতৃক বাংলাদেশের জনগনের উপর চালানো অত্যাচার এবং বর্বর নির্যাতনের প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। নিপীড়ন বন্ধ করতে ইয়াহিয়াকে চাপ দেয়ার জন্য আমাদের সরকার বিভিন্ন বিদেশী শক্তিকে অনুরোধ করেছেন। আমি মাননীয় মন্ত্রীর কাছে জানতে চাই, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন যে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তারা হস্তক্ষেপ করবেন না। মালয়শিয়ার টুংকু আব্দুর রহমান, যিনি কিছুদিন আগেও আমাদের অতিথি হয়েছিলেন, সম্প্রতি কুয়ালালামপুরে তার দেয়া বক্তব্যে শুনে মনে হয়েছে গনহত্যা বন্ধে ইয়াহিয়াকে চাপ দিতে তিনি অনিচ্ছুক। এই সন্ধিক্ষণে ইয়াহিয়া খান পিকিং এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দালাল হিসাবে কাজ করছেন এবং এই সাহসেই তিনি শেখ মুজিবকে হত্যা করার হুমকি দিতে পেরেছেন। যুক্টরাষ্ট্র দাবী করে তারা সমতা এবং ভাতৃত্বে বিশ্বাসী, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তারা এডওয়ার্ড কেনেডির মত বিশিষ্ট সিনেটরের প্রতিবাদ উপেক্ষা করে এই নির্মম নিপীড়ন চালাতে পাকিস্তানকে সাহায্য করে যাচ্ছে। এমতাবস্হায় আমি জানতে চাই যে মাননীয় মন্ত্রী পরাশক্তিগুলোর মাধ্যমে পাকিস্তানকে চাপ প্রয়োগের ব্যাপারে এখনো আশাবাদি কিনা। ঘটনাবলী এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করছে যে পরাশক্তিগুলো শুধু মাত্র নিজেদের স্বার্থ নিয়ে চিন্তিত, মানবতার ব্যাপারে তাদের বিন্দুমাত্র মাথা ব্যাথা নেই। আমাদের সাথে এখন রাশিয়া আছে, যারা সবরকম প্রয়োজনের সময় আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি জানতে চাই রাশিয়া ও অন্যান্য দেশের সহায়তায় মাননীয় মন্ত্রী ইয়াহিয়া খানের কর্মকান্ড জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশনের সামনে উপস্হাপন করবেন কিনা।

শ্রী শরণ সিং: কিছু দেশের আচরনের ব্যাপারে মাননীয় সাংসদ যে মন্তব্য করেছেন, তা সঠিক। আমি খোলাখুলিভাবে বলতে চাই যে, আমার ধারনা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট মিঃ পোডগোরনি এবং আর অল্প কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রতিনিধিরা আমাদের প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে এ ব্যাপারে আদৌ কোন পদক্ষেপ নেবেন না।

শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ি: কোন কোন দেশ ব্যাতিক্রম?

শ্রী পিল্লু মোদি (গোধরা): আর তারা কতটুকি সম্মানিত?

শ্রী শরণ সিং: কিছু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কিন্তু আমাদের চেষ্টা করে যেতে হবে যেন এই রাষ্ট্রগুলো নিজেদের যতটুকু প্রভাব আছে সেটা খাটিয়ে ইয়াহিয়াকে আরো ধ্বংসযজ্ঞ চালানো থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করে।

কার্যকরনের ব্যাপারে মাননীয় সাংসদ জানতে চেয়েছেন যে ব্যাপারটা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্হা এবং জাতিসংঘে তোলা হবে কিনা। অবশ্যই ব্যাপারটা সেখানে উত্থাপন করা যায়, উপযুক্ত সময়ে এটি উল্লেখিত সংস্হাগুলোতে তুলে ধরার ইচ্ছা আমাদের আছে।

১২ আগষ্ট, ১৯৭১

জবাব:পাকিস্তানের সামরিক জান্তা কর্তৃক শেখ মুজিবুর রহমানের কতিথ বিচার

শ্রী এস.এম.ব্যানার্জি (কানপুর): মাননীয় স্পীকার। আজ সকালে আপনার মাধ্যমে আমি মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীকে শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তার ব্যাপারে বক্তব্য দিতে অনুরোধ করেছিলাম। আমি জানি অধিবেশন প্রায় শেষের দিকে এবং এখন ব্যাপারে একটি সমাধানে আসা সম্ভব নয়। তবে যেহেতু মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী এখানে উপস্হিত আছেন এবং শেখ মুজিবের মুক্তির ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সকল রাষ্ট্রকে অনুরোধ জানিয়ে তিনি ইতিমধ্যে একটি বিবৃতি দিয়েছেন, সেহেতু তিনি যদি সংসদের উদ্দেশ্যে একটি বক্তব্য দিলে সারা পৃথিবী জানবে যে এই সংসদ শেখ মুজিবের ব্যাপারে আর সকলের মতই উদ্বিগ্ন এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সহায়তায় সহায়তায় শেখ মুজিবকে হত্যা প্রচেষ্টা রুখে দিতে চায়। শেখ মুজিবের মৃত্যুর সাথে সাথে বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র এবং অসাম্প্রদায়িকতার মৃত্যু ঘটতে পারে। এ ব্যাপারে একটি বক্তব্য দিতে আমি মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করছি।

প্রধানমন্ত্রী, আনবিক শক্তি বিষয়ক মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী: মাননীয় স্পীকার, আমি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা সংবাদের ব্যাপারে মাননীয় সাংসদদের গভীর উদ্বেগ এবং দুশ্চিন্তা সম্পূর্নরুপে উপলব্ধি করতে পারছি।

আমি শুধু এতটুকু বলতে পারি যে তাদের মত সরকারও উদ্বিগ্ন ও দুশ্চিন্তাগ্রস্হ। মাননীয় সাংসদের শেষ বাক্যটির সাথে আমি একমত নই, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম বন্ধ হবার নয়। কারন আমরা জানি যে শহীদের মৃত্যু মানুষকে অমরত্ব দেয়। এধরনের ঘটনা আন্দোলনকে দূর্বল করার পরিবর্তে শক্তিশালী করে। বিশ্বের ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি, কতৃপক্ষ যত বেশী দমন-পীড়ন চালায়, আন্দোলন-সংগ্রাম তত দূর্বার হয়ে ওঠে।

আমরা সবসময়ই খবর সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছি। এই খবরটি ইউনাটেড প্রেস থেকে পাওয়া, মাননীয় সাংসদরা চাইলে এটি বিশ্বাস করতে পারেন, আবার নাও পারেন।

” গতকাল নির্ধারিত দিনে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে মন্তব্য করতে পাকিস্তানী কর্মকর্তারা অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। “

এ ব্যাপারে আমরা আর কোন খবর পাইনি, পাকিস্তানী রেডিওতেও কোন ঘোষণা নেই। এই মাত্র আমরা বন্যা-খরার মত প্রাকৃতিক দূর্যোগ নিয়ে আলোচনা করছিলাম, যা বছরের পর বছর মানুষের কষ্টের কারন হয়ে আসছে। কিন্তু এটি মনুষ্যসৃষ্ট দূর্যোগ, প্রাকৃতিক নয়। আমি আগেই বলেছি, আমি শুধু স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার হরণের ব্যাপারে চিন্তিত নই, এই ঘটনা ভারতের উপর যে প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলছে সেটিও আমার চিন্তার কারণ।

আমি বুঝতে পারছি যে মাননীয় সাংসদরা সরকার থেকে আরো বেশী কিছু চাইছেন। অনেক সাংসদ বিভিন্ন বিদেশী সংসদ এবং সংস্হাকে চিঠি লিখে বিভিন্ন বিষয় অবহিত করেছেন। সরকারী পর্যায়েও আমরা জাতিসংঘ মহাসচিব মিঃ ইউ থ্যান্টের সাথে কথা বলেছি। আমি ব্যাক্তিগতভাবে শেখ মুজিবের জীবন বাঁচানোর উদ্দোগ নেয়ার জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধান এবং প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছি। আমি জানি অনেক সাংসদ মনে করেন যে সমগ্র সংসদের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি আসা উচিত। এরকম একটি বিবৃতির ব্যাপারে আমার কোন আপত্তি নেই, কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের অনুভূতির পুনঃপ্রকাশ করা ছাড়া এই বিবৃতি আর কোন কাজে আসবেনা। আমরা জানি যে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা আমাদের বিবৃতি অথবা বিশ্বের অন্যান্য দেশ কি বলল তার তোয়াক্কা করেনা। শুধুমাত্র বিশেষ কিছু দেশের সরকারের চাপে কাজ হতে পারে এবং আমাদের সেই লক্ষেই চেষ্টা করে যেতে হবে।

আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে আমরা কিছু করলে সেটা ক্ষতির কারণও হতে পারে। পাকিস্তানি জান্তা প্রমাণ করার চেষ্টা করছে যে শেখ মুজিব ভারতের স্বার্থ সংরক্ষণ করছেন এবং ভারত তাকে মদদ দিচ্ছে। ভিত্তিহীন নানা রকমের অভিযোগ তোলা হচ্ছে। আসলে….

শ্রী এস.এম.ব্যানার্জি : এগুলো সব মিথ্যা কথা।

শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী: সবই মিথ্যা কথা। কিন্তু আমাদের এমন কিছু করা উচিত হবেনা যাতে করে এই প্রোপাগান্ডা বিশ্বাসযোগ্য হয় এবং শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে যায়।

আমি মাননীয় সাংসদদের আরেকটি কথা বলতে চাই। আমরা মাঝে মাঝে বক্তব্যে পশ্চিম পাকিস্তান শব্দটি ব্যাবহার করি। আমাদের সবসময় পশ্চিম পাকিস্তানি জনগনকে আলাদা রাখা উচিত, তাদের সাথে আমাদের কোন বিরোধ নেই
( তাঁর বক্তব্যে এসময় বাধা পড়ে)।
আমাদের বিবাদ পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক সরকারের সাথে যারা নিরীহ মানুষের উপর অত্যাচার করছে, তাদের ন্যায়সঙ্গত রাজনৈতিক অধিকার দিচ্ছেনা। একই কাজ তারা পাকিস্তানের অন্যান্য অঙ্গরাজ্যের সাথেও করছে। এখন আমরা অধিবেশনের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। অধিবেশন শেষ করার আগে আমরা শেখ মুজিব এবং বাংলাদেশের দূর্ভাগা মানুষদের সাথে সংহতি প্রকাশ করতে চাই। বাংলাদেশ সম্ভবত উপমহাদেশের যেকোন অঞ্চলের তুলনায় সবচেয়ে বেশী বিপ্লবীর জন্ম দিয়েছে। সেই মানুষেরাই আজ অত্যন্ত কষ্টে আছে।

আমি আগেই বলেছি শেখ মুজিব শুধু একজন ব্যাক্তি নন। আমাদের প্রত্যেকটা ব্যাক্তির অধিকার এবং স্বাধীনতার ব্যাপারে সচেতন হওয়া উচিত, কিন্তু আজ শেখ মুজিব
( তাঁর বক্তব্যে এসময় বাঁধা পড়ে) পুরো বাংলাদেশের আশা-আকাঙ্খার, ত্যাগ-তিতিক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছেন।

এই বক্তব্যের সাথে সাথে আমি সংসদ অধিবেশন শেষ করতে চাই। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক, কিন্ত এটি সময়ের চাহিদা।

শ্রী শ্যামনন্দন মিশ্র (বেগমসরাঁই): শেখ মুজিবের বিচারের ব্যাপারে আপনি যেসব বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে যোগাযোগ করেছেন, তাদের প্রতিক্রিয়া কি?

শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী: কিছু রাষ্ট্র বলেছে তারা বিষয়টি বিবেচনা করবে এবং কিছু রাষ্ট্র ইতিমধ্যে বিষয়টি বিবেচনা করেছে।

শ্রী শ্যামনন্দন মিশ্র: ইউ থ্যান্ট এ বিষয়ে এখনো কোন উদ্দোগ নেননি?

শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী: মাননীয় সাংসদ অবশ্যই ইউ থান্টের বিবৃতিটি পড়েছেন। এটি আজ সকালের সংবাদপত্রে এসেছে। আমি জানিনা এটি সম্পূর্ন বিবৃতি কিনা, কিন্তু এটি মাননীয় সাংসদদের পরিস্হিতির জটিলতা সম্পর্কে ধারনা পেতে সাহায্য করবে। অন্যান্য বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে জাতিসংঘের দূর্বল দিকগুলো সম্পর্কে আমাদের ধারনা হয়েছে।

শ্রী পি. ভেঙ্কটাসুব্বাইয়া ( নান্দিয়াল): অন্তর্গ্রথিত দূর্বলতা।

শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী: আরেকটি প্রশ্ন হচ্ছে এই মুহূর্তে ঠিক কি করলে তা শেখ মুজিবের সাহায্যে আসবে। এই দুর্যোগমুহূর্তে পুরো সংসদ যেভাবে একাত্নতা এবং সংহতি প্রকাশ করেছে, আমি তাতে গর্ববোধ করছি। আমরা শুধু শেখ মুজিবের মুক্তির ব্যাপারেই আগ্রহী নই, আমরা মনে করি পাকিস্তানী সামরিক জান্তার কর্মকান্ড শুধু বাংলাদেশ এবং ভারতের মানুষের জীবনেই নয় বরং সমগ্র পৃথিবীতে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। যেসব সরকার পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে সাহায্য করছে, পরবর্তীকালে এ ঘটনার প্রভাব তাদের উপরেও পড়বে। এই হত্যাযজ্ঞ তাদেরও কোন উপকারে আসবেনা।

স্পীকার মহোদয়: সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতুবি ঘোষণা করা হল। সবাই শান্তিতে ছুটি কাটান, নভেম্বরের কোন সময় আবার সংসদ অধিবেশন বসবে।

১৯:২১ ঘটিকা
সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতুবি হল।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২২৫। ভারতের সীমান্তে পাকিস্তানের সৈন্য সমাবেশ সম্পর্কে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বিবৃতি এবং আলোচনা ভারতের লোকসভার কার্যবিবরণী ১৫ নভেম্বর, ১৯৭১

Hasan Tareq Imam
<১২, ২২৫, ৮৮৯-৮৯৭>

[মাননীয় ডেপুটি স্পীকার সভা পরিচালনা করছেন]

জরুরী জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ
ভারতের সীমান্তে পাকিস্তানের সৈন্য সমাবেশ সম্পর্কিত সংবাদ

শ্রী এস.এম.ব্যানার্জি (কানপুর): আমি অত্যন্ত জরুরী এবং জনগুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে মাননীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই এবং তাঁকে এই ব্যাপারে একটি বিবৃতি দেয়ার অনুরোধ করতে চাই।

” ভারতের সীমান্তে পাকিস্তানের সৈন্য সমাবেশ, পাকিস্তানের বোমাবর্ষণের ফলে ভারতীয় জান-মালের ক্ষয়ক্ষতি এবং পাকিস্তানী যুদ্ধবিমান কর্তৃক বারবার ভারতের আকাশসীমা লঙ্ঘন করা সম্পর্কে প্রকাশিত সংবাদ”

মাননীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ( শ্রী জগজীবন রাম): মাননীয় স্পীকার, মহোদয়, পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সীমান্তে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টির মূল কারন হচ্ছে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার সাথে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বিরোধ।

২৫/২৬ মার্চের কালরাত্রে বাংলাদেশের মানুষের উপর পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর নির্মম হামলা সম্পর্কে সকল সাংসদ অবহিত আছেন। এই ঘটনার আগে পাকিস্তানে কয়েক দশকের মধ্যে প্রথমবার সাধারন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং স্বায়ত্তশাসনের ছয় দফা সমর্থন করে বাংলাদেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে দেশ পরিচালনার জন্য নির্বাচন করে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা নির্বাচনের এই ফলাফল মেনে না নিয়ে ২৫/২৬ মার্চের কালরাত্রে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের উপর নির্মমভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

এর ফলে বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তানী সেনাবাহীনীর অভূতপূর্ব নৃশংসতার শিকার হয়েছে; লক্ষ লক্ষ মানুষকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে; গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে; নারীরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং শিশুরা বিকলাঙ্গ হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আক্রমনের বিশেষ লক্ষ্যবস্তু হিসাবে নির্বাচন করা হয়েছে এবং পাক সেনারা মূলত বুদ্ধিজীবি, তরুণ এবং সংখ্যালঘু নিধনের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছে। ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া গাড়ি এমনকি কামান এবং যুদ্ধবিমানের মত আধুনিক সমরাস্ত্র ব্যাবহার করা হচ্ছে। এই সংসদ ইতিমধ্যে এই অব্যাহত সন্ত্রাসে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেছে।

বাংলাদেশের মানুষও বসে নেই, তারা এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেছে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে এবং পুলিশ বাহিনীর অনেক সশস্ত্র সদস্য তাদের সাথে যোগ দিয়েছে। সামরিক জান্তা বাহ্যিকভাবে আওয়ামী লীগের সাথে আলোচনা করতে থাকলেও পিছন দিয়ে প্রায় দুই ডিভিশন সৈন্য বাংলাদেশে নিয়ে আসে। বাংলাদেশে প্রতিরোধের মুখে পড়ার পর তারা সমুদ্র এবং আকাশ পথে আরো বিপুল সংখ্যক সৈন্য নিয়ে আসে। পরবর্তীকালে তারা ইস্ট পাকিস্তান সিভিল ফোর্স এবং রাজাকার নামের বিশাল আধাসামরিক বাহিনী গঠন করে এবং এরা গ্রামাঞ্চলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।

নারী-পুরুষ-শিশু, মুসলমান-হিন্দু-খৃষ্ঠান-বৌদ্ধ; ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নির্মমতার শিকার অসংখ্য মানুষ আশ্রয়ের উদ্দ্যেশ্যে ভারতে উদ্বাস্তু হয়ে এসেছে। পাক বাহিনীর অত্যাচার অব্যাহত আছে; অব্যাহত আছে শরণার্থীস্রোত। এই শরণার্থীর সংখ্যা বিস্ময়করভাবে প্রায় এক কোটিতে পৌছেছে।

পাকবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত গণহত্যা এবং বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতি ধ্বংস করার নিষ্ঠুর প্রয়াসের কারণে সমগ্র বিশ্বের মানুষ বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছে। আমাদের জানামতে ধর্ম-বর্ণ-বয়স নির্বিশেষে লক্ষ লক্ষ মানুষকে গৃহহীন এবং অসহায় অবস্থায় ঠেলে দেবার প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। তাদের আশ্রয় এবং ত্রাণ দেয়া ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় ছিলনা। এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার ফলে আমাদের উপর ব্যাপক চাপের সৃষ্টি হয়েছে; আমাদের অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়েছে, অনেক সামাজিক মূল্যবোধ এবং সাংবিধানিক অধিকার ব্যাহত হচ্ছে এবং সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অন্যান্য অনেক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের ঐকন্তিক ইচ্ছা যে সন্ত্রাসের শিকার এই উদ্বাস্তুরা যেন সম্মান এবং সম্পূর্ণ নিরাপত্তার সাথে নিজের দেশে ফেরত যেতে পারে। পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা এখন পর্যন্ত সন্ত্রাস বন্ধ অথবা এই উদ্বাস্তুদের দেশে ফেরার মত নিরাপদ অবস্থা তৈরি করতে কোন উদ্যোগ নেয়নি। বিশ্ববিবেক, সংবাদপত্র এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া সকল পদক্ষেপই বিফলে গিয়েছে।

পাক বাহিনীর বাংলাদেশে অবস্থান অসম্ভব করে তোলার জন্য বাংলাদেশের মানুষ আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসকে সামনে রেখে একটি কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে। দেশপ্রেমিক বিপুল সংখ্যক তরুণ এই প্রতিরোধে যোগ দিয়েছে। তাদের এই প্রতিরোধ পাক বাহিনীর জন্য ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রতিরোধের সাফল্য বাংলাদেশে দ্রুত শত্রুমুক্তির ব্যাপারে আশা জাগিয়েছে।

সামরিক শাসকেরা বিগত কয়েক মাস ধরে নিজেদের দুষ্কর্ম থেকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি অন্য দিকে সরানোর জন্য ভারতের উপর দোষারোপ করার চেষ্টা করে আসছে। আমরা শুধু আক্রান্ত মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন এবং তাদের সাহায্য করার অপরাধে অপরাধী। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আমাদের উপর প্রতিশোধ নেবার হুমকি দিয়েছেন। বাংলাদেশে পাক বাহিনী বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহতম ধর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মুক্তি বাহিনী বাংলাদেশকে মুক্ত করার চেষ্টা করছে। ৩০শে জুলাই, ১৯৭১ তারিখে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের তরফ থেকে আমাদের বিরুদ্ধে সার্বিক যুদ্ধ ঘোষনার হুমকি আসে। ১২ই অক্টোবর জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে তিনি আবার এই হুমকির কথা পুনব্যাক্ত করেন। ইতিমধ্যে পাকিস্তানের সামরিক শক্তি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। পাকিস্তানিদের যুদ্ধ উন্মাদনার পালে বাতাস দেয়া হচ্ছে। “ভারতকে চূর্ণ কর”, “ভারত দখল কর” ইত্যাদি লেখা সম্বলিত পোস্টার প্রদর্শনীর আয়োজন করা হচ্ছে। পাকিস্তানীদের জিহাদের জন্য আহবান করা হচ্ছে।

ভারতের বিরুদ্ধে সার্বিক যুদ্ধের হুমকি দেয়ার পর ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে ভারত-পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্তে সৈন্য সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। রাজস্থান, গুজরাট এবং পূর্ব পাঞ্জাব সীমান্তের খুব কাছে পাকিস্তানি সেনা বাহিনী অবস্থান নিয়েছে। করাচী চুক্তির বরখেলাপ করে যুদ্ধবিরতি রেখা লঙ্ঘন করা হয়েছে। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মিরে অতিরিক্ত সৈন্য পাঠান হয়েছে, আধা সামরিক ফ্রন্টিয়ার কর্পস গ্রুপকে তলব করা হয়েছে, বিপুল সংখ্যক মুজাহিদদের সক্রিয় করা হয়েছে এবং কারাকোরাম স্কাউটদের নিয়ে একটি অতিরিক্ত বাহিনী সংগঠিত করা হয়েছে। পশ্চিম সীমান্ত এবং যুদ্ধবিরতী রেখা বরাবর বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলা-বারুদ মজুত করা হয়েছে। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে পাকিস্তানের প্রায় পুরো সামরিক বাহিনীকে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে এনে সম্পূর্ণ যুদ্ধ প্রস্তুতিসহ আমাদের সীমান্তে মোতায়েন করা হয়েছে। এরপর থেকেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সীমান্ত এলাকায় একের পর এক উষ্কানীমূলক ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। স্থল এবং আকাশপথে সীমান্তরেখা লঙ্ঘনের অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে। আমাদের পূর্বসীমান্তে ব্যাপক গোলাবর্ষণ করা হয়েছে, যার ফলে সম্পদের বিপুল ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে এবং অনেক ভারতীয় নাগরিক এবং বাংলাদেশী আশ্রয়ার্থী মৃত্যুবরণ করেছে। যুদ্ধবিরতি রেখার কাছে গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটেছে এবং পূর্ব সীমান্তে আমাদের যোগাযোগ ব্যাবস্থা নষ্ট করার জন্য অনেকগুলো নাশকতার ঘটনা ঘটেছে।

আমি অত্যুক্তি করতে চাইনা, কিন্তু আমাদের সীমান্তের অববস্থা খুবই সংকটজনক। অন্তরেখার কাছে পাকবাহিনী সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। তারা পুরোদমে আক্রমনের জন্য সম্পূর্ণরুপে প্রস্তুত। আমাদের কাছে আসা খবর অনুযায়ী তারা আমাদের বিমানঘাঁটিগুলোতে স্বতপ্রণোদিত আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছে।

এই অববস্থায় পশ্চিম সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করা ছাড়া আমাদের হাতে আর কোন বিকল্প নেই। আজকে আমাদের সেনাবাহিনীকে সবরকমের পরিস্থিতি মোকাবেলার পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে মোতায়েন করা হয়েছে। আমাদের জওয়ানেরা মানসিকভাবে অত্যন্ত চাঙা অবস্থায় আছে। সীমান্তবর্তী অঞ্চলের জনগনের মনোবলও অটুট আছে, তারা যুদ্ধপ্রস্তুতিতে সেনাবাহিনীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহে নাশকতা প্রতিরোধ এবং বিমান আক্রমন মোকাবেলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। আমাদের দেশের বিরুদ্ধে যেকোন আগ্রাসন প্রতিরোধে আমরা বদ্ধ পরিকর এবং প্রয়োজন হলে আক্রমণকারীর মাটিতে যেয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করা হবে।

আমি বিশ্বাস করি যে আমাদের প্রস্তুতি দেখে পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা তৃতীয় বারের মত আমাদের উপর একটি যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া থেকে নিরস্ত হবে। বাংলাদেশের পরিস্থিতির একটা সন্তোষজনক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এবং শরণার্থীরা নিজেদের মাতৃভূমিতে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত আমরা আমাদের সতর্কতা শিথিল বা সীমান্ত থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করব না। আমি আশা করি ইসলামাবাদের নেতারা ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করবেন এবং ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের উপর সামরিক আগ্রাসন চালানোর নিরর্থকতা উপলব্ধি করতে পারবেন। আমি আশা করতে চাই যা পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এই আত্নঘাতি পথ পরিহার করবেন, আমাদের দোষারোপ করা বন্ধ করে এমন একটি রাজনৈতিক সমাধান খোঁজার চেষ্টা করবেন যেটা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নির্বাচিত বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের কাছে গ্রহনযোগ্য হয়। শুধুমাত্র এই পদক্ষেপই উপমহাদেশের সব মানুষের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে এবং তাদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়নের লক্ষে নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাবার সুযোগ করে দেবে।

শ্রী এস.এম.ব্যানার্জি : পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সীমান্তে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টির মূল কারন হচ্ছে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার সাথে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বিরোধ, মন্ত্রী মহোদয়ের এই বক্তব্যের সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত। আমি জানি যে দুঃসাহসিক, অদম্য মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধের মুখে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা নিজেদের মানসিক ভারসাম্য সম্পূর্ণরুপে হারিয়ে ফেলেছে। এখন তারা আমাদের প্ররোচিত করে একটি যুদ্ধে জড়াতে চায়, যাতে করে তারা সমস্যার একটা আন্তর্জাতিক রুপ দিয়ে জাতিসংঘের কাছে নিয়ে যেতে পারে, এবং জাতীসংঘ থেকে একটি পর্তবেক্ষক দল পাঠিয়ে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম বন্ধ করে দিতে পারে। আমার বক্তব্যে আমি মুক্তিবাহিনীর ভাই-বোনদের অভিনন্দন জানাতে চাই, যারা নিরলসভাবে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন এবং বেশ কিছু অঞ্চল ইতিমধ্যে ইয়াহিয়ার দখলমুক্ত করে এনেছেন। আমি আশা করেছিলাম যে অধিবেশনের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান করার ঘোষণা দেবেন। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে এখনো কোন বক্তব্য দেননি।

আমি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে পাকিস্তান নিয়মিত আমাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করছে। প্যাট্রিয়ট নামক খবরের কাগজে আমি জানতে পরেছি যে ১৪ই নভেম্বর চাম্ব অঞ্চলে পাক যুদ্ধবিমান তিনবার আমাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে, এবং দুপুর ১:২৫ মিনিটে একটি মিরাজ যুদ্ধবিমান আমাদের সীমায় অনুপ্রবেশ করেছে।

আমি সুস্পষ্টভাবে ১৯৬২ এবং ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে আমাদের জওয়ানদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা স্মরণ করতে চাই এবং আমি জানি ভবিষ্যতেও তারা যেকোন ধরনের আগ্রাসনের জবাব দেবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের আকাশসীমায় অনুপ্রবেশ করার পরও আমরা তাদের বিমান গুলি করে ভূপাতিত করিনি। যশোর থেকে একটি জেট যুদ্ধবিমান মাত্র তিন মিনিটে দম দম বিমানবন্দরে এসে বোমা ফেলে যেতে পারে। আমি জানতে চাই যে কোন বিমান আকাশসীমা লঙ্ঘন করলে তাকে গুলি করার জন্য আমাদের জওয়ানদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে কিনা এবং দেয়া হলে তারা কেন সেটা পালন করেনি। আমরা কেন যুদ্ধবিমানগুলোকে নির্বিঘ্নে ফিরে যেতে দিচ্ছি? তাদের আমাদের সীমানায় অনুপ্রবেশের উদ্দেশ্যতো মাননীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর অজানা নয়। আমি এই প্রশ্নের উত্তর চাই। আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই যে আমি বা আমার দল যুদ্ধের পক্ষে না। আমরা যুদ্ধবাজ নই এবং আমরা যুদ্ধে জড়াতে চাইনা। আমাদের জওয়ানদের সীমান্ত অতিক্রম না করার যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, আমি সেটা সমর্থন করি। কিন্তু আমাদের সীমান্ত রক্ষায় এবং তাদের সেনারা যেন আমাদের সীমান্ত অতিক্রম না করতে পারে সেটা নিশ্চিত করতে কি ব্যাবস্থা নেয়া হয়েছে আমি সেটা জানতে চাই। আমি চাইনা মাননীয় মন্ত্রী কোন গোপন তথ্য ফাঁস করে দিন এবং আমি জানি আমাদের জওয়ানেরা নিজেদের দায়িত্ব পালন করছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, কাশ্মীর এবং অন্যান্য সীমান্তবর্তী এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ক্রমাগত গোলাবর্ষণ করছে এবং সেখানকার মানুষ প্রতিনিয়ত মৃত্যুভয়ে দিনপাত করছে। কুমিল্লা থেকে আগত অভিবাসিরা আগরতলাতে অবস্থান করছে এবং মুক্তিবাহিনীর জয় নিশ্চিত করতে তারা যোকোন ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত। মাননীয় মন্ত্রী বলেছেন যে পরিস্থিতিঅত্যন্ত গুরুতর এবং এবং এই উত্তেজনাকয় পরিস্থিতি মোকাবেলায় যেকোন পদক্ষেপ নিতে আমরা প্রস্তুত আছি। আমি জানতে চাই যে সীমান্তের মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা বিধান করা এবং পাকবাহিনী যেন সীমান্ত অতিক্রম করে আমাদের এলাকায় এসে গুলি করে মানুষ হত্যা করতে পারে সেটা নিশ্চিত করার জন্য কোন ব্যাবস্থা নেয়া হবে কিনা। আমি মাননীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর কাছে এই দুইটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের উত্তর চাই।

আমি মাননীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সম্পূর্ণ বক্তব্য পড়েছি এবং আমি তাঁকে ধন্যবাদ দেই। মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশে যুদ্ধ করে যাচ্ছে, আমাদের দিক থেকে আমাদের সীমান্তের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সর্বশেষে আমি মাননীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর কাছে একটা জিনিষ জানতে চাই। তিনি যদি এই প্রশ্নের উত্তর না জানেন, তবে মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীর কাছে উত্তর চাই। যখন আমরা মুক্তিবাহিনীর সাফল্য চাই, ইয়াহিয়া সরকারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সাফল্য চাই, বাংলাদেশের নির্যাতিত মানুষের পক্ষে বিশ্ববিবেকের সমর্থন চাই, তখন আমরা কি করব? আমরা কি নীরব দর্শক হয়ে থাকব, নাকি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেব?

শ্রী জগজীবন রাম: এই দুটি সম্পূরক প্রশ্নের উত্তর আমার বক্তব্যেই দেয়া হয়েছে। আমাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করা হয়েছে এব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই এবং এটা আমি আমার বক্তব্যে উল্লেখ করেছি। আমার সম্মানিত বন্ধুরা যদি খবরের কাগজ পড়ে থাকেন, তবে দেখবেন যে আমাদের যুদ্ধবিমান শত্রুপক্ষের বিমানকে তাড়া করেছে।

শ্রী এস.এম.ব্যানার্জি: কিন্তু সংবাদপত্রে এটাও ছিল যে তারা ব্যার্থ হয়েছে।

শ্রী জগজীবন রাম: আপনার অনুমান আপনি করতে পারেন। কিন্তু প্রশ্নে জানতে চাওয়া হয়েছিল যে জওয়ানদের কি নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। আমাদের সেনাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে সীমানায় অনুপ্রবেশকারীকে তাড়া করতে …… ( তাঁর বক্তব্যে এ সময় বাঁধা দেওয়া হয়)

শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী ( গোয়ালিওর): নাকি গুলি করে নামানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে?

শ্রী জগজীবন রাম: আমাদের পূর্বসীমান্তে গোলাবর্ষনের ব্যাপারে আমি আমার বক্তব্যে বলেছি যে ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, কাশ্মীর এবং অন্যান্য সীমান্তবর্তী এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ক্রমাগত গোলাবর্ষণ করছে, কিন্তু আমি নিশ্চিত করছি কোন পাক সেনার সীমানা অতিক্রম করে ভারতে ঢোকার সাহস হয়নি। তারা যদি সীমান্ত অতিক্রম করে, তাদের পাকিস্তানে ছুঁড়ে ফেরত পাঠানো হবে …… ( তাঁর বক্তব্যে এ সময় বাঁধা দেওয়া হয়)। আমাদের জওয়ানদের এই নির্দেশই দেয়া হয়েছে। গোলাগুলি করতে আমাদের জওয়ানদের বারণ করা হয়েছে, আমি নিশ্চিত তারা এটা করছে এবং করবে। এখনো পর্যন্ত, আমি আবারও বলছি এখনো পর্যন্ত নির্দেশ হচ্ছে আমাদের সেনারা সীমান্ত অতিক্রম করবেনা। আমার বক্তব্যে আমিই মাত্রই বলেছি যে যদি শত্রুপক্ষের তরফ থেকে আগ্রাসন হয়, তাহলে পাকিস্তানের মাটিতেই যুদ্ধ হবে।

স্বীকৃতির ব্যাপারে আমার বক্তব্য হচ্ছে উপযুক্ত সময়ে সেটা দেয়া হবে।

শ্রী দশরথ দেব (উত্তর ত্রিপুরা): মাননীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বলেছেন শত্রুপক্ষ সীমানা অতিক্রম করলে আমাদের সেনারা তাদের পিছু হটিয়ে দিয়ে তাদের এলাকায় যেয়ে যুদ্ধ করবে। কিন্তু আমি কিছু বিষয়ে মাননীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।

ত্রিপুরা সীমান্তজুড়ে মর্টার এবং অন্যান্য অস্ত্র দিয়ে পাকবাহিনী গোলাবর্ষন করে চলেছে। এমন কোন রাত নেই যে গোলাবর্ষন হচ্ছেনা, বিশেষ করে বেলোনিয়া, সোনমপুর, আগরতলা এবং কামালপুর শহরে। এর মধ্যে তিনটি শহর থেকে সব মানুষ পালিয়ে গিয়েছে। শুধুমাত্র সরকারী কর্মকর্তারা, যাদের এলাকা না ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তারা সেখানে আছেন। প্রতিদিন গোলাবর্ষণের কারনে সাধারন মানুষ এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। অতি সম্প্রতি আগরতলা শহরে একটি মর্টার বিস্ফোরনে ৬ জন নিহত এবং ২০ জন গুরুতর আহত হয়েছেন। তারা এখনো হাসপাতালে আছেন।

শুধুমাত্র এই চারটি প্রধান শহর নয়, পুরো ত্রিপুরা সীমান্ত জুড়েই প্রতিদিন মানুষ গুলিতে আহত এবং নিহত হচ্ছে। এই মাসে শুধু কামালপুর শহরে ৫০ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। সীমান্তবর্তী এলাকা কমলনগর, সিমনা-সিধাই এ ৫০ জন নিহত এবং অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছে। পাকিস্তানী গোলাবর্ষনের কারনে সীমান্ত অঞ্চলে ফসল, বাড়ি-ঘর এবং গবাদিপশুর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং মানুষ এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে।

সুতরাং, যখন মাননীয় মন্ত্রী বলেন যে আমাদের জওয়ানের সীমান্ত সুরক্ষিত রাখতে প্রস্তুত, তখন আমি তাঁর কাছে জানতে চাই সীমান্ত এলাকার ভারতীয় নাগরিকদের নিজ ভূমে শরণার্থী হওয়া প্রতিরোধ করতে সরকার কি পদক্ষেপ নিচ্ছে? ঘর-বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হওয়া এসব মানুষের ত্রান এবং অন্যান্য সাহায্য পৌছে দিতে সরকার কি করছে? এই সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এসব মানুষের পক্ষে বাড়ি ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়।

দ্বিতীয়ত, মাননীয় মন্ত্রী বলছেন যে উপযুক্ত সময়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হবে। আমি জানিনা সেই উপযুক্ত সময় কখন আসবে। পাকিস্তান আমাদের সীমান্তে সামরিক শক্তি কেন্দ্রীভূত করেছে এবং তাদের আক্রমণে প্রতিদিন ভারতীয় নাগরিকদের প্রাণহানি ঘটছে। যদি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হয় এবং মুক্তিবাহিনীকে জিনিষ-পত্র দিয়ে সাহায্য করা হয়, তবে তারা শুধু ভারতীয় সীমান্ত থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে তাড়িয়ে দেবেনা, বাংলাদেশের ভেতরেই তাদের ধ্বংস করে দেবে।

আমি সরকারের কাছে জানতে চাই যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে তারা আর কতদিন সিদ্ধান্তহীনতার বেড়াজালে বন্দী থাকবে। আমাদের সরকার কখন বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেবে?

শ্রী জগজীবন রাম: ত্রিপুরা সীমান্তে গোলাবর্ষনের ব্যাপারে মাননীয় সংসদ বিশেষভাবে কামালপুর এবং বেলোনিয়ার নাম উল্লেখ করেছেন। আমি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি কারণ তিনি ঐ এলাকা থেকে এসেছেন, সুতরাং ঐ অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর সাহসী যোদ্ধাদের সাফল্যের কথা তিনি নিশ্চই ভুলে যাননি। কামালপুর-বেলোনিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে পাকবাহিনীকে হটিয়ে দিয়ে ঐ এলাকা দখল করেছে। আমি জানি যে সীমান্তবর্তী শহর ও গ্রামগুলিতে ঝুঁকি আছে। এলাকাবাসীর দূর্দশা লাঘব করতে সরকারী প্রশাসন সব ধরনের ব্যাবস্থা নেবে।

বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার ব্যাপারে কোন ধরনের সিদ্ধান্তহীনতা নেই, এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত
নেয়া হয়েছে এবং সেই সিদ্ধান্ত হচ্ছে উপযুক্ত সময়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হবে। কখন সেই উপযুক্ত সময় আসবে সেটা অনেকগুলো বিষয়ের উপর নির্ভরশীল।

মুক্তিবাহিনীর ব্যাপারে আমার বক্তব্য হচ্ছে, মাননীয় সাংসদেরা জানেন যে মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশের মাটিতে, সমুদ্রে এবং কিছু ক্ষেত্রে আকাশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং ইউরোপ, আমেরিকা ও অন্যান্য দেশে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশীদের থেকে সবধরনের সাহায্য পাচ্ছে। প্রবাসী বাংলাদেশী নাগরিকেরা মুক্তিবাহিনীর জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেছেন এবং সমরাস্ত্র সংগ্রহে তাদের সহায়তা করছেন।

শ্রীমতি মুকুল ব্যানার্জি ( নয়াদিল্লী): সর্বাগ্রে আমি ভারতের নিরাপত্তার জন্য সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহন এবং সীমান্ত অঞ্চলে কার্যকর ব্যাবস্থা নেয়ার জন্য মাননীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার জন্য মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীকেও অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমাদের নেতৃবৃন্দের কূটনৈতিক দক্ষতার কারনে এমন কিছু দেশ এবার আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, যারা অতীতে পাকিস্তান ইস্যুতে কখনোই আমাদের পক্ষাবলম্বন করেনি। এই প্রথমবারের মত আমাদের পররাষ্ট্রনীতি বিশ্বজুড়ে সফল হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। কিন্তু এর পরেও আমাদের সীমান্তে ক্রমাগত ভাবে অনুপ্রবেশ ঘটছে এবং ব্যাপক গোলাবর্ষন চলছে। পাকিস্তানের ক্রমাগত প্ররোচনা সত্বেও আমাদের সরকার এবং জনগণ সংযত আচরণ করছে, কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে আর কতদিন মানুষ ধৈর্য ধরে রাখতে পারবে?

আমি মাননীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর কাছে আরো জানতে চাই যে উনি রাধিকাপুরের ব্যাপারে অবহিত আছেন কিনা। রাধিকাপুর পশ্চিম দিনাজপুরের সর্বশেষ স্টেশন, খুব ছোট একটি জায়গা। পাকবাহিনীর ক্রমাগত গোলাবর্ষণে সেখানকার জনজীবন বিপর্যস্থ। আমি মাননীয় মন্ত্রীর কাছে আরো জানতে চাই যে চাঁচার সহ আসামের আন্যান্য কিছু জেলায় বেশ কিছু অন্তর্ঘাতমূলক ঘটনা ঘটেছে এবং কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতা নাশকতাকারীদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন। সীমান্ত এলাকায় এধরনের নাশকতা প্রতিহত করতে কি ব্যাবস্থা নেয়া হয়েছে?

শ্রী জগজীবন রাম: আমি ইতিমধ্যে বলেছি যে সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে মাঝে মাঝে গোলাবর্ষণের ঘটনা ঘটছে এবং শত প্ররোচনার মুখেও আমাদের সেনারা সহিষ্ণুতার পরিচয় দিচ্ছে। আমরা সংযত আচরনই করে যেতে থাকব, আমরা অযথা যুদ্ধে জড়াতে চাইনা। আর যদি যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠে, তখন আমাদের সেনাবাহিনী বীরের মতই পরিস্থিতির মোকাবেলা করবে।

নাশকতাকারী এবং গুপ্তচরদের বিরুদ্ধে আমরা ইতিমধ্যে ব্যাবস্থা নিয়েছি। এধরনের পরিস্থিতিতে শত্রুপক্ষ বিপুল সংখ্যক নাশকতাকারী এবং গুপ্তচর পাঠিয়ে থাকে। এধরনের অন্তর্ঘাত প্রতিহত করা আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এব্যাপারে সচেতন আছে এবং অনেক নাশকতাকারী এবং গুপ্তচরকে ইতিমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে।

শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী: মাননীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাঁর ভাষনে যা বলেছেন, তার পরেও অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি। তাঁর বক্তব্য পড়ার পর কখনো কখনো মনে হয় সরকার পরষ্পরবিরোধী কথা বলছে। তিনি একথা স্বীকার করেছেন যে পাকিস্তান প্রায় এক কোটি লোককে আমাদের দেশে ঠেলে দিয়ে এক নতুন ধরনের আক্রমন পন্থা অবলম্বন করেছে। তিনি একথাও মেনে নিয়েছেন, আমি তাঁরই বক্টব্য উদ্ধৃত করছি,

“আমাদের কাছে আসা খবর অনুযায়ী তারা আমাদের বিমানঘাঁটিগুলোতে স্বতপ্রণোদিত আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছে। “

পাকিস্তান হঠাৎ আক্রমণ চালিয়ে আমাদের এয়ার ফোর্সকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করতে পারে। একই সাথে তিনি স্বীকার করেছেন যে, পাকিস্তান অব্যাহতভাবে সীমান্তে গুলিবর্ষণ করছে, আমাদের জওয়ানেরা নিহত হচ্ছে। বেসামরিক লোকেরা মৃত্যুবরণ করছে। আমাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করা হচ্ছে। এরপরও তিনি বলেন, পাকিস্তান হামলা করলে আমাদের জওয়ানেরা দাঁতভাঙা জবাব দেবে এবং যুদ্ধকে আমরা শত্রুর মাটিতে নিয়ে যাব। এর অর্থ কি এই যে, আমরা নতুন কোন আক্রমণের জন্য প্রতীক্ষারত? এক কোটি লোককে ভারতে ঠেলে দেয়া- যার ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক সংকট, সামাজিক বিদ্বেষ সৃষ্টি হচ্ছে-এটা কি আক্রমণ নয়? একদিকে বলা হচ্ছে আমরা যুদ্ধকে শত্রু ভূ-খন্ডে নিয়ে যাব, অন্য দিকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী মহোদয় একথাও সমর্থন করেন যে, আমি জওয়ানদের বলে দিয়েছি, তারা যেন নিজ সীমান্ত অতিক্রম না করে। আমি জানতে চাই, আপনি কোনটা হামলা মনে করেন? শরনার্থী ঠেলে দেয়া হামলা নয়? প্রতিদিন আকাশসীমা লঙ্ঘন করা হামলা নয়? প্রতিদিন গুলিবর্ষণ করা হামলা নয়? যে ভূ-খন্ড হতে বোমা বা গুলিবর্ষণ করে তারা আমাদের নাগরিক হতাহত করছে, আমাদের সম্পদ বিনষ্ট করছে, যে শরনার্থী মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্য আমাদের আশ্রয়ে এসেছে তাদেরও মৃত্যুর দুয়ারে পৌছে দিচ্ছে- তাদের দেশে ঢুকে পড়ে তাদের আড্ডা ভেঙে দেয়ার অধিকার আমাদের সৈন্যরা পাবে না কেন? সেরুপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে কবে? প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মহোদয় কোন সময়ের প্রতীক্ষায় আছেন? এ যাবত যা হয়েছে, তা যদি হামলা হয় তবে কোন নতুন হামলার প্রতীক্ষা করার প্রয়োজন নেই।

আগে বলা হয়েছিল, পাকিস্তানি বিমান ফেলে দেয়া হবে। এখন বলা হচ্ছে পাকিস্তানি বিমান তাড়িয়ে দেয়া হবে। আমরা এ যাবত তাদের একটি বিমানও ফেলতে পারিনি। তারা ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমান ধাওয়া করেছে। গুজরাটের ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বলবন্ত রায় মেহতা কি পরিস্থিতিতে নিহত হয়েছিলেন তা এই সংসদ এবং এই দেশ ভুলতে পারেনা। আমরা কতদিন পর্যন্ত আমাদের আকাশসীমার অবিরাম লঙ্ঘন বরদাশত করব? পাকিস্তানের একটি বিমান ফেলে দেবার ক্ষমতাও আমাদের নেই, আমি এটা মানতে রাজি নই। সম্ভবত বিমান বাহিনীকে বিমান নামানোর আদেশ দেয়া হয়নি। তিনি আমাদের স্থল বাহিনীর সৈন্যদের শত্রু ভূ-খন্ডে প্রবেশের যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন, তাও ফিরিয়ে নেয়ার আবশ্যকতা রয়েছে। শত্রু নিজ ভূ-খন্ড থেকে অবিরাম গুলিবর্ষণ করতে থাকলে আমাদের সেনা বাহিনীর হাতে তাদের সীমায় ঢুকে আক্রমণ চালিয়ে তাদের স্তব্ধ করে দেয়ার অধিকার থাকতে হবে। আমি যখন আক্রমণের কথা বলি, আত্নরক্ষার জন্য বলি। আত্নরক্ষার জন্য আমাদের আক্রমণ চালাতে হতে পারে।

আরেকটা প্রশ্ন আছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মহোদয় বলেন যে, আমাদের সেনাবাহিনী সীমান্ত থেকে তখনই চলে যাবে যখন কোন সমাধান বের হবে। বাংলাদেশ সমস্যার এরুপ সমাধান হতে হবে যেটা পূর্বের নির্বাচিত লোকেরা মেনে নেবেন। যাঁরা প্রথমে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে কেউ কারারুদ্ধ আছেন, কেউ আত্নগোপন করে আছেন। তাঁদের জায়গায় জেনারেল ইয়াহিয়া খান নতুন লোক নির্বাচন করেছেন। আওয়ামী লীগের সাথে যারা নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন, তারা এখন পূর্ব বাংলার জনপ্রতিনিধি হিসাবে আছেন। সেখানে একটি পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এমতাবস্থায় যারা আগে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তারা নির্ভিকভাবে, নিঃসঙ্কোচে নিজেদের কথা বলতে পারবেন কি? বিশ্ব মতের চেষ্টায়, বিশ্বের সহানুভূতির আশায় আমরা কি নিজ রাষ্ট্রের স্বার্থ বলি দিতে যাচ্ছি? আমি জানিনা শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে আছেন কি না। আগামীতে ইয়াহিয়া খান তাঁকে ছেড়ে দেবার নাটক রচনা করতে পারেন। দীর্ঘ আলোচনা চলতে পারে। যে এক কোটি লোক এখানে এসেছে, এখন তাদের কি দশা হবে?

ভারত সরকারের কোন মুখপাত্র কি একথা বলতে রাজি আছেন- আমি প্রতিরক্ষা প্রশ্ন করছি-যখন পর্যন্ত বাংলাদেশ স্বাধীন না হবে, এবং স্বাধীন বাংলাদেশে একটি অসাম্প্রদায়িক সেক্যুলার সরকার প্রতিষ্ঠা না হবে,, তখন পর্যন্ত শরনার্থীদের ফিরে যাবার কোন আশা কি করা যায় না?

রাজনৈতিক সমাধানের ডাক উঠেছে। বিশ্বরাষ্ট্রসমূহ চাইবেনা পাকিস্তান ভেঙে যাক। কিন্তু পাকিস্তানের সৈন্য যদি বাংলাদেশে থাকে তাহলে শরণার্থীরা কিভাবে ফিরে যাবে? বিগত ২৪ বছরে যারা এসেছে, তাদের মধ্যে কি কেউ ফিরে গিয়েছে? শরণার্থীদের মাঝে আমারও যাবার সুযোগ হয়েছে। বাংলাদেশ যদি পাকিস্তানের অংশ থাকে, শরণার্থীদের উপর নির্মম নির্যাতন চালান পাক সেনারা যদি সেখানে থাকে, তবে শরণার্থীরা ফিরে যাবেনা। তখন আমরা এমন একটি রাজনৈতিক সমাধান কিভাবে করব যার ফলে শরণার্থীরা ফিরে যেতে পারে?

মন্ত্রী মহোদয় বলেছেন সরকার সিদ্ধান্থীনতায় ভুগছে না। আমি জানতে চাই, ভারত সরকার কি পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে এই আল্টিমেটাম দিতে রাজি আছে যে, সাত দিনের মধ্যে আক্রমণাত্নক তৎপরতা বন্ধ করতে হবে, অন্যথায় ভারতের জন্য এখন রাস্তা খোলা আছে। এটি পাকিস্তানের উপর আক্রমণ চালানোর প্রশ্ন নয়, বরং যে হামলা ইতিমধ্যে হয়েছে তার জবাব দেবার প্রশ্ন। এবং এই সরকার জবাব দিতে প্রস্তুত আছে কিনা আমি এটাই জানতে চাই।

শ্রী জগজীবন রাম: শ্রী বাজপেয়ী বিমান দ্বারা আমাদের আকাশসীমা অতিক্রমের প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি সংবাদপত্রে নিশ্চই দেখে থাকবেন যে, পাকিস্তানী বিমান প্রবেশের পর আমাদের পক্ষ থেকে এন্টি এয়ারক্রাফট গান চালানো হয়েছে। আমি সংসদের অন্য কক্ষে বলেছিলাম আর এখানেও তা পুনরায় বলতে চাই যে, কোন পাকিস্তানী বিমান প্রবেশ করলেই তাকে ভূপাতিত করা হবে এই মর্মে আমাদের স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে।

আমাদের সীমান্তে বিক্ষিপ্ত গোলাবর্ষণ হচ্ছে একথা স্বয়ং আমি বলেছি। আমি এও বলেছি যে এক কোটি শরণার্থী এ দেশে পাঠিয়ে দেয়া এক জঘন্য আক্রমণ। আমি আরও বলেছি যে আমাদের উষ্কানি দেয়ার জন্য যত গোলাবর্ষণ করা হচ্ছে আমরা তা নীরবে সহ্য করছি, কেননা পরিস্থিতি যুদ্ধে রুপ নিক সেটা আমরা চাই না। আমি আগে বলেছি এবং দৃঢ়তার সাথে আবার বলতে চাই যে, পাকিস্তানের একটি সৈন্যও যদি আমাদের সীমান্তের কাছে আসে, তবে আমাদের সৈন্যরা তাকে তাড়িয়ে সীমান্তের ওপারে পৌছে দেবে। কিন্তু পাকিস্তানের এ আচরণ আমি এভাবে নিতে চাইনা আমাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার, লক্ষও সুস্পষ্ট এবং এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তও পরিচ্ছন্ন। এমনিতে পাকিস্তানের একটি বিমানও যদি চলে আসে, তবে তাকে আমরা হস্তক্ষেপ বা অনুপ্রবেশ বলে উল্লেখ করে আক্রমণ বলতে পারি। আমাদের সীমান্ত লক্ষ করে একটি গুলি ছোড়া হলেও আমরা তাকে আক্রমণ বলতে পারি, আমরা তা বলেছিও। কিন্তু আমরা যে অর্থে আক্রমণের কথা বলেছি সেটা হল এই যে, পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সৈন্য যদি আমাদের সীমান্তের নিকটবর্তী হয় তাহলে আমাদের জওয়ানরা তাদের সীমান্তের ওপারে ছুঁড়ে দেবে।

আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে চাই যে এ ব্যাপারে কোন অনিশ্চয়তা নেই। আমরা সিদ্ধান্থীনভাবে কাজ করছি না বরং একটি সিদ্ধান্ত নিয়েই কাজ করছি।

আমাদের আরও দৃঢ় বিশ্বাস, শরণার্থীদের সম্মান ও নিরাপ্তার সাথে দেশে ফিরে যাবার মত পরিস্থিতি তৈরি করা যাবে। সেই অবস্থা কখন তৈরি হবে সেটাও আমি স্পষ্ট করে বলে দিয়েছি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধান শুধু তাই হতে পারে যা বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে গ্রহনযোগ্য। তাঁদের কাছে কোনটা গ্রহনযোগ্য তা তাঁরা দ্যর্থহীন ভাষায় বলে দিয়েছেন এবং আমি আশা করি শ্রী বাজপেয়ী সেটা পড়েছেন। তাঁরা বলেছেন সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থেকে কম কোন রাজনৈতিক সমাধান তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবেনা। তাঁরা একথারও পুনরুক্তি করেছেন যে, তাঁরা বাংলাদেশে একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যাবস্থা প্রতিষ্ঠা করেই লোকদের ফিরিয়ে নিতে চান। বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নিজেদের এই প্রতিজ্ঞা ঘোষণা করেছেন।

শ্রী বাজপেয়ী উল্লেখ করেছেন যে, পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা সেখানে আবার নির্বাচন করিয়েছে। এটি বিশ্ব ইতিহাসের কোন নতুন ব্যাপার নয়। যখনই কোন সামরিক শাসনের শক্তি কমে আসে, যখন তাদের চেতনা হয় যে তাদের পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে, তখন তারা এই প্রকার শিখন্ডিদের আশ্রয় নিতে দ্বিধা করেন। এরুপ পরিস্থিতিতে বংশবদ মন্ত্রীসভা গঠন করা হয়, বিশ্ব ইতিহাসে এরকম অনেক নজীর মেলে। ইতিহাসে এরকম বংশবদ মন্ত্রীসভার যেরকম পরিনতি হয়ে এসেছে, বাংলাদেশেও সেরকম পরনতিই হবে সে ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই।

এ ব্যাপারেও আমার কোন সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশের তরুণরা যারা নিজেদের মাতা-ভগ্নিদের অপমানিত হতে দেখেছেন, যারা নিকট আত্নীয়দের নির্মমভাবে নিহত হতে দেখেছেন, বাংলাদেশের পূর্ন স্বাধীনতার কোন বিকল্প যে নেই, একথা তারা কখনো বিস্মৃত হতে পারবেন না। সংসদকে আমার বলার এই-ই আছে। এর বেশী বলার দরকার আছে বলে আমি মনে করি না।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২২৬। পাশ্চাত্যের কয়েকটি দেশ সফর শেষে প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি ভারতের লোকসভার কার্যবিবরণী ১৫ নভেম্বর, ১৯৭১

Fahmida Bristy
<১২, ২২৬, ৮৯৮-৯০০>
অনুবাদ
বিবৃতিঃ প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফর

প্রধানমন্ত্রী, পারমাণবিক শক্তি মন্ত্রী, বিদ্যুৎ সংক্রান্ত মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী (শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী) : আমি সবেমাত্র বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, যুক্তরাজ্য, আমেরিকা যুক্ররাষ্ট্র, ফ্রান্স, এবং গণপ্রজাতন্ত্রী জার্মান সফর থেকে এসেছি।

বারবার পাঠানো আমন্ত্রণের সাড়ায় এই দেশগুলোতে রাষ্ট্রীয় সফরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত আরো আগেই নেওয়া হয়েছিলো এবং তা নেওয়া হয়েছিলো পারস্পারিকতার চর্চার সাথে সংগতি রেখে। সভার সকলের মনে থাকবে যে প্রেসিডেন্ট নিক্সন, প্রধানমন্ত্রী হীথ ১৯৭০ সালে আমাদের দেশ ভ্রমণ করেছিলেন। চ্যান্সেলর কেসিঞ্জার ১৯৬৯ সালে এবং প্রেসিডেন্ট পম্পিডো যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন আমাদের দেশ সফর করেছিলেন। কিন্তু আমাদের সাধারণ নির্বাচনের কারণে আমার সফর স্থগিত ছিলো।

বাংলাদেশে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের দিকে আমাদের সীমান্তে মারাত্মক পরিস্থিতি সত্ত্বেও আমি এই সফরে উদ্যোগী হয়েছিলাম, যাতে আমাদের উপর আরোপকৃত বোঝার সহজীকরণের করা যায় এবং যারা আমাদের নিরাপত্তাকে হুমকি দিচ্ছে তাদের অনুৎসাহিত করার ব্যাপারে সর্বাত্তক প্রচেষ্টা হিসেবে। এমন জাতীয় বিপর্যয়ের সময় আমাদের জনগণের আশ্বাস এবং আমাদের সকল দলের একতা সফরটিকে গুরুত্ববহ করেছে।

আমার সফর সরকার প্রধানদের সাথে ও জনপ্রতিনিধিদের সাথে আমার চিন্তা-ভাবনা বিনিময় করতে সক্ষম করেছিলো – এমন একটি সময়ে যখন বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটছিলো এবং বিশ্বস্বার্থ, দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক, এবং বিশেষ করে বাংলাদেশ পরিস্থিতি ও এটি আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোতে ও এই প্রদেশের শান্তিতে যে হুমকি সৃষ্টি করেছিল – এই সফর এইসব ব্যাপারে তাদের কাছে আমাদের দৃষ্টিকোণ তুলে ধরতে সক্ষম করেছিলো।

আমাদের আলোচনা কিছু আশঙ্কা দূর করতে ও সমস্যাটির মূল কারণে মনযোগ দিতে করতে সাহায্য করে, সেটি হলো পাকিস্তান সামরিক সরকার তাদের নিজেদের জনগণের রায়কে প্রত্যাখ্যান করেছে, বাংলাদেশে তারা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে এবং ভারতে শরণার্থীদের স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। আমি মনে করি যে এই দেশ ও অন্যান্য দেশগুলো উপলব্ধি করতে পারবে যে ইতোমধ্যে পূর্ব বাংলার জনগণের নির্বাচিত নেতার সাথে এবং তাদের আইনসঙ্গত ইচ্ছানুযায়ী সমঝোতার মাধ্যমে বাংলাদেশে বিদ্যমান পরিস্থিতির একটি রাজনৈতিক সমাধান অনুসন্ধান ছাড়া সীমান্তবর্তী সমস্যাসমূহের দূরীকরণ ফলপ্রসূ হবেনা। অধিকাংশ দেশ আরো মনে করে যে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি অপরিহার্য এবং পাকিস্তানের সামরিক সরকারকে এটি বুঝাতে তারা মনস্থ করে।

দীর্ঘদিন এটিকে পাকিস্তানের একটি অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মর্মান্তিক উদাসীনতা দেখানো হয়েছে – যা এখন একটি সমাধান খোঁজার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে।

মূল ঘটনাটিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার ও মেঘাচ্ছন্ন করার জন্য জাতিসংঘকে জড়িত করতে সচেষ্ট হওয়া এবং বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামকে পাকিস্তান বিরোধিতা এবং দ্বন্দ্বে রূপান্তরিত করতে পাকিস্তানের প্রচেষ্টা প্রকাশ হয়ে গেছে। এটি এখন খুব ভালো বুঝা হয়েছে যে ভারত পাকিস্তানের পদক্ষেপে পথভ্রষ্ট হবেনা এবং যে জনগণের সাথে এমন অবিচার ও হিংস্রতার সাথে আচরণ করেছে তাদের সাথে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার অবশ্যই বোঝাপড়ায় আসতে হবে। এটিও বিশ্বজুড়ে সমাদৃত হয়েছে যে পূর্ব বাংলার জনগণের উপর একটি সমাধান চাপিয়ে দেওয়ার কোন অধিকার কোন দেশেরই নেই এবং স্বাধীনতা ও জাতীয়তাবাদের যে স্পৃহার দ্বারা তারা উদ্বুদ্ধ হয়েছে তা কোন শক্তিই দমিয়ে রাখতে পারবেনা।

আমার যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় আমি জানতে পেরেছিলাম যে পাকিস্তানে আরও অস্ত্রবাহী জাহাজ পাঠানো বন্ধের বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরে একটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়েছিলো। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং গণপ্রজাতন্ত্রী জার্মানি থেকে আর কোন অস্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছেনা।

এটি আমার ব্যগ্র আশা যে যেসব রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিবর্গের সাথে সাক্ষাৎ করেছি তাদের সম্মিলিত বা পৃথক উদ্যোগ পাকিস্তানি সামরিক সরকারকে বুঝতে সাহায্য করবে যে ভারতে সামরিক শক্তি প্রদর্শন কিংবা একটি সামরিক সংঘাত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে কোন লাভ হবেনা। আমি মনে করি যে উপদেষ্টারা এটা বুঝানোর জন্য খুব দেরি করে ফেলেননি যে কেউ কঠিন সত্য অবজ্ঞা করে চলতে পারেনা। বাংলাদেশের জনগণের ন্যায্য ও আইনসঙ্গত আকাঙ্ক্ষাকে অবজ্ঞা বা পদদলিত করা যাবেনা।

আমরা যেভাবে নব্বই লক্ষেরও বেশি শরণার্থীদের দেখাশোনা করার গুরুভার বহন করছি, তার জন্য সহানুভূতি ছিলো। শরণার্থীদের ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার জন্য তহবিলে সংযোজনের ব্যাপারে ইঙ্গিত এসেছে। এসকল দেশ সম্মত হয়েছে যে শরণার্থীদের আরো আগমন থামাতে এবং যারা ভারতে অবস্থান করছে নিরাপত্তা ও মানবীয় মর্যাদার সাথে তাদের স্বদেশে ফেরা সহজতর করতে পূর্ব বাঙলায় অবশ্যই যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।

এটা বলার পরে আমি অবশ্যই এটা পরিষ্কার করতে চাই যে আমরা আমাদের সমস্যার সমাধান করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উপর নির্ভর করতে পারিনা, এমনকি সেসব দেশের উপরও নয় যেসব দেশ আমি সফর করেছি। আমরা তাদের সমবেদনা, তাদের নৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থনকে মূল্যায়ন করি, কিন্তু এই বোঝা আমাদের এবং বাংলাদেশের জনগণ যাদের সাথে আমাদের পূর্ণ সমবেদনা ও সমর্থন আছে, তাদেরকেই বহন করতে হবে।

যেহেতু আমাদের নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন, তাই আমাদেরকে প্রস্তুত থাকতে হবে এবং আমাদের স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা রক্ষা করতে শেষ নারী-পুরুষটিও প্রস্তুত আছে। বলাবাহুল্য, যদি বাংলাদেশে সন্তোষজনকভাবে পরিস্থিতির সমাধান না হয়, আমরা সীমান্ত থেকে আমাদের বাহিনী সরিয়ে নেওয়ার মতো ঝুঁকি নিতে পারিনা। কারণ এটি আমাদের নিরাপত্তার উপর মারত্মক হুমকি আরোপ করে।

বিজ্ঞ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের প্রাজ্ঞ তাড়নার মাধ্যমে আপাতদৃষ্টিতে সমাধানের অতীত সমস্যারও সমাধান পাওয়া গিয়েছে বা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যেমন: ইউরোপে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও চায়নার মধ্যকার সমস্যার ক্ষেত্রে। কিন্তু এসব অগ্রগতিতে আমাদের প্রসন্ন হলে চলবে না।

ইউরোপে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে বৈরিতার অবসানের একটি উদ্দীপনা আছে। যেটি, আমরা আশা করি যে, শীঘ্রই ঐ মহাদেশে স্থিতিশীল নিরাপত্তার দিকে পরিচালনা করবে। এটি এশিয়াতে ও পৃথিবীর অন্যান্য অংশে একটি স্থিরকারী প্রভাব রাখবে। সেখানে একটা উপলব্ধি ছিলো যে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে রাজনৈতিক বৈরিতার অবসানের ব্যাপারটির সাথে বাহ্যিক দৃষ্টিগত অর্থনৈতিক নীতির সাথে সংযুক্ত করা উচিৎ, বিশেষত উন্নয়নশীল বিশ্বের চাহিদার ব্যাপারে।

দেশগুলোর সাথে দ্বি-পাক্ষীয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক নিয়েও আলোচনা হয়েছে। সেখানে ভালো সাড়া মিলেছে। বেলজিয়াম, ফ্রান্স এবং গণপ্রজাতন্ত্রী জার্মানি উপলব্ধি করেছে যে ভারত এবং ইউরোপীয় অর্থনৈতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্কের অগ্রগতির ক্ষেত্রে একটি সুবিশাল প্রশস্ত দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে।

সংক্ষেপে, এগুলোই হচ্ছে আমার মনের কথা যা আমি সম্মানিত সদস্যদের জানাতে চেয়েছিলাম। আমি নির্দিষ্ট করে কোন নির্দিষ্ট দেশের নেতাদের নাম উল্লেখ করছি না কারণ তারা সকলেই ভারতের প্রতি সমবেদী ও বন্ধুত্বপূর্ণ ছিলো।

আমি মনে করি আমার এই সফর ব্রিটেনের সাথে আমাদের সম্পর্ক পুনরধিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেছে যা ১৯৬৫ সালে একটি খারাপ অবস্থার মধ্যে ছিলো।

যেসব দেশ আমি সফর করেছি তাদের সরকার ও জনগণ যে উষ্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ অভ্যর্থনার সাথে আমাকে সর্বত্র গ্রহণ করেছে তার জন্য আমি ভারত সরকার ও জনগণের পক্ষ থেকে তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাতে চাই। আমি সবশেষে আরো তারিফ করতে চাই বিশ্ব সংবাদ মাধ্যমকে যারা বাংলাদেশে ঘটনাসমূহের নিরপেক্ষ প্রচার, জনগণের উপর অবাধ অবর্ণনীয় নির্যাতন, তাদের বীরোচিত সংগ্রামের কথা জানানোর জন্য – যা সেখানকার মানুষ তাদের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য চালিয়ে যাচ্ছে।

আমি আমার জনগণ ও সকল রাজনৈতিক দল যারা কোন বহিরাগত হুমকির বিরুদ্ধে প্রজ্ঞা ও সংযম দেখিয়েছে এবং জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছে তাদেরকে ধন্যবাদ জানাতে চাই।

মাননীয় ডেপুটি স্পীকার, আমি আমার এই বিবৃতি একটি অনুস্মারকের সাথে শেষ করছি যে জাতিগত সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে আমাদের দেশ শান্তি, স্বাধীনতা ও সুবিচারের প্রেরণা প্রতীকায়িত করে। এমন একটা সময় ছিলো যখন স্নায়ুবিক যুদ্ধের খপ্পরে থাকা বিশ্বে আমাদের আওয়াজ ছিলো একাকী। এমনকি পাকিস্তানি সামরিক সরকারের আমাদের জন্য তৈরি করা মারাত্মক সমস্যার মাঝেও আমাদের জনগণ, আমাদের দেশ, এবং বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের এই মহান দেশ শান্তি এবং আত্মসংযমের স্পৃহা বজায় রেখেছে। আমরা আমাদের সীমান্তের ওপার থেকে আসা হুমকি ও প্ররোচনার দ্বারা সৃষ্টি হওয়া উত্তেজনা প্রত্যাখ্যান করেছি। তাহলে চলুন আমরা আমাদের মধ্যে পুরো আস্থা নিয়ে নিজেদের পরিচালিত করি যেন বিশ্ব দেখতে ও জানতে পারে যে ভারতের একসাথে থাকার শক্তিমত্তা আছে। ভারত শান্ত এবং আমরা আমাদের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম।

শ্রী সমর মুখার্জী (হাওড়া) : মহোদয়, এই ব্যাপারে আমরা একটি আলোচনা চাই।

ডেপুটি স্পীকার মহোদয় : তিনি এইজন্য একটি মোশন নোটিশ দিতে পারেন।

শ্রী এস. এম. ব্যানার্জী : এটাকে সার্কুলেট করতে হবে।

শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী: সকালে দলের নেতাদের সাথে আমার একটি সাক্ষাৎকার ছিলো। তারা এতে সম্মত হয়েছিলো যে আমরা আলোচনা করবো। এর তারিখ আপনি এবং ব্যবসায়ী উপদেষ্টা কমিটি নির্ধারন করবেন।

ডেপুটি স্পীকার মহোদয়: এটি শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২২৭। পাক-ভারত সীমান্ত পরিস্থিতি এবং তিনিটি অনুপ্রবেশকারী পাকিস্তানী স্যাবর জেট বিমান সম্পর্কে আলোচনা ভারতের লোকসভার কার্যবিবরণী ২৩ নভেম্বর, ১৯৭১

Fahmida Bristy
<১২, ২২৭, ৯০১-৯০৩>
অনুবাদ
সূত্রঃ পাক-ভারত সীমান্তে অগ্রগতি এবং বিবৃত

সূত্রঃ তিনটি অনুপ্রবেশকারী পাকিস্তানী স্যাবরকে কলকাতার উত্তর-পূর্বে বয়রার কাছে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

শ্রী অটল বিহার বাজপেয়ী (গোয়ালিয়র): স্পীকার মহোদয়, আমি আপনার অনুমতি নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আপনার ও সংসদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। পার্লামেন্ট অধিবেশন ১৫ তারিখে আরম্ভ হয়েছে। সেদিন একটি দৃষ্টি আকর্ষন মোশন ছিলো। জবাবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সীমান্ত পরিস্থিতির উপর একটি বিবৃতি প্রদান করেছিলেন। আজ ২৩ তারিখ এসে গেছে। সীমান্তে অবিরাম পাকিস্তানের আক্রমণাত্মক গতিবিধি চলছে। আমাদের আকাশ সীমা অতিক্রম করা হচ্ছে। কাল তো পাকিস্তান বিমান বাহিনীর জাহাজ ভারতীয় সীমান্তের ৬৫ মাইল ভেতরে ঢুকে পড়েছে এবং আমাদের জেট বিমানগুলো তাকে ধাওয়া করেছে। আমাদের জওয়ান মারা যাচ্ছে, নিরপরাধ নাগরিক মৃত্যুর দুয়ারে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। দেশে একটা অঘোষিত যুদ্ধ পরিস্থিত রয়েছে। খুব আশ্চর্যের কথা, এই পরিস্থিতি সম্পর্কে সংসদকে বিশ্বাস করা হয়নি। আমরা যা কিছু জানি তা কেবল সংবাদপত্রের মাধ্যমে। যে কথা সংবাদপত্রগুলোকে জানানো যায় সে ব্যাপারে এই সংসদকে বিশ্বাস করা যায় না? সংসদকে অন্ধকারে রেখে কি যুদ্ধ করা যাবে? আপনার কাছে আমার আবেদন, আপনি মন্ত্রী মহোদয়কে, প্রধানমন্ত্রীকে বা প্রতিরক্ষা মন্ত্রীকে সীমান্তের নতুন পরিস্থিতি সম্পর্কে সংসদকে অবহিত করার জন্য নির্দেশ দিন। যদি তিনি দৃষ্টি আকর্ষণীয় প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য প্রস্তুত না থাকেন, আমাদের প্রশ্নমালা হতে সরে থাকতে চান, তাহলে স্বয়ং এসে তিনি বিবৃতি দিতে পারেন, এবং আমরা আপনার অনুমতি নিয়ে তাঁর ব্যাখ্যা চাইতে পারি, কিন্তু সংসদের সঙ্গে এরূপ আচরণ করা না সংসদের মর্যাদার অনুকূল, না এই সংকটের সময়ে দেশের মনোবল অটুট রাখার সহায়ক। সংসদকে আমাদের সমানে রাখতে হবে। যেসব ঘটনা ঘটেছে সেগুলি সম্পর্কে আমাদের মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে যোগাযোগ থাকা চাই, সংবাদপত্রসমূহের সঙ্গে নয়।

শ্রী এস. এম. ব্যানার্জী (কানপুর): আমরা এই বিষয়ে একটি দৃষ্টি আকর্ষন মোশন পেশ করেছিলাম।

শ্রী সমর গুহ (কোন্তাই): জনাব, আমি একই বিষয়ে আপনার কাছে লিখেছি এবং আমি আশা করি, আপনি আমাকেও এই বিষয়ে কিছু বলার অনুমতি দিবেন। আমি এই বিষয়ে শুধুমাত্র একটি বিষয় যোগ করতে চাই।

ভারত মৈত্রী বেতার বলেছে যে গতকাল নদীর কোন এক জায়গায় একটি বড় সমর যুদ্ধ হয়েছিলো এবং পাঁচটি মধ্যমাকৃতির পাকিস্তানী যুদ্ধ জাহাজ ধ্বংস করা হয়েছিলো। প্রায় প্রতিদিনই আমরা পাকিস্তান বেতার থেকে জানতে পারছি যে যশোর সেক্টরে একটি সমর যুদ্ধ হয়েছিলো এবং কিছু সংখ্যক ভারতীয় বন্দী হয়েছে। পাকিস্তান বেতার শুধুমাত্র বন্দী অফিসারদের নামই প্রচার করছে না, তারা কিছু বন্দী অফিসারদের ধারণকৃত কণ্ঠস্বরও তৎক্ষণাৎ সরাসরি প্রচার করছে। আমিও কয়েকটি দৃষ্টি আকর্ষন মোশন দিয়েছি। একশর বেশি শরণার্থী হত্যা করা হয়েছে।

স্পীকার মহোদয়: প্রতিটি বিষয় নয়, শুধুমাত্র একটি বিষয়ের কথা আপনি উল্লেখ করেছেন। আমি শুধুমাত্র ঐ একটি বিষয়ই অনুমতি দিচ্ছি – সব নয়।

শ্রী সমর গুহ: প্রতিদিনই গোলাবর্ষণ চলছে যার ফলে সীমান্ত এলাকার কাছে ১০০ শরণার্থী খুন হয়েছে এবং এক হাজারের কাছাকাছি আহত হয়েছে। বাংলাদেশ সীমান্ত রেখার পাঁচ মাইলের মধ্যে ৯০ লাখ শরণার্থী রয়েছে। আমি অনুরোধ করবো যে, এই আইনসভাকে এ ব্যাপারে আস্থায় আনা উচিৎ যে কী হচ্ছে এবং আমাদের অবস্থান কী। সরকারের উচিৎ কোন বিবৃতি দেওয়া অথবা এই আইনসভায় কোন আলোচনা তৈরি করার অনুমতি দেওয়া।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের রাজ্য মন্ত্রী (প্রতিরক্ষা বিষয়ক), শ্রী বিদ্যা চরণ শুক্লা: এটা বলা ঠিক নয় যে আমরা পাকিস্তানের সাথে কোন অঘোষিত যুদ্ধে আছি কিংবা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কোন শত্রুতার সম্পর্ক বিরাজ করছে (বাধা)। পাকিস্তান বিভিন্ন বিশ্ব রাজধানীসমূহে এবং জাতিসংঘে এটাই বলার চেষ্টা করছে যে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এক ধরনের যুদ্ধ চলছে এবং ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এক ধরনের বৈরী সম্পর্ক বিরাজ করছে, যা কিনা একেবারেই ভুল। এখানে কোন অঘোষিত যুদ্ধ কিংবা এরকম কোন বিষয় নেই। যা কিছু যুদ্ধ চলছে তা পশ্চিম পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে রাজ্যশাসন নিয়ে চলছে।

সেটাই হচ্ছে সঠিক বিষয়। পাকিস্তান বিশ্ব রাজধানীসমূহকে ও অন্যান্যদের প্রভাবিত করার জন্য ঐ বিগ্রহকে আন্তর্জাতিক করার চেষ্টায় বলছে যে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি অঘোষিত যুদ্ধ চলছে, এবং এই জন্য জাতিসংঘসহ অন্যান্য সংস্থাগুলোর এই ব্যাপারে সস্তক্ষেপ করতে আসা উচিত। আমি সকল সম্মানিত সদস্যদের অনুরোধ করবো যেন এধরনের পাকিস্তানী অপপ্রচারের শিকার না হন। এটি পাকিস্তানের চালিয়ে যাওয়া একটি অপপ্রচার ও মিথ্যা গুঁজব। (বাধা)

শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী: আমি এই বক্তব্যের বিরোধিতা জানাই। আমরা কোন পাকিস্তানী অপপ্রচারের শিকার হয়নি। এ ধরনের অভিসন্ধীর অভিযোগ খোঁজার তার কোন এখতিয়ার নেই।

শ্রী বিদ্যা চরণ শুক্লা: আমি কোন অভিসন্ধী খুঁজছি না। আমি সতর্ক করছি যে কারোরই এ ধরনের অপপ্রচারের ফাঁদে পা দেওয়া উচিৎ নয়। আমি এটি জোরালোভাবে প্রত্যাখান করছি যে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে কোন অঘোষিত যুদ্ধ আছে। এটি বলা সম্পূর্ণরূপে ভুল। কারোরই কখনো এ ধরনের কথা বলা উচিৎ নয় কারণ সম্পূর্ণ বিষয়টি আন্তর্জাতিক করার জন্য এটি পাকিস্তানের একটি প্রচেষ্টা।

তথ্য দেওয়ার বিষয়ে, সীমান্তে যা কিছুই হয়েছে আমরা সময়ে সময়ে সংবাদ মাধ্যমগুলোকে ব্রিফিং করে জানিয়েছি। আমাদের বাহিনীগুলো সেখেনে রয়েছে। যখনই পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনীর মাধ্যমে কোন বহিরাক্রমণ হয়, আমরা তাদেরকে পশ্চাদপসরণ করি। যদি তারা কামান দাগে, তাহলে আমরা জবাব দেই এবং তাদের কামান থামিয়ে দেই। এ ধরনের বিষয়গুলো ঘটছে। মাঝে মাঝে আমরা সংবাদ মাধ্যমগুলোকে ব্রিফিং করে জানাই যাতে করে জনগণ এবং জাতি এইসব বিষয়ে তথ্য জানতে পারে।

শ্রী ইন্দ্রজিৎ গৌতম (আলীপুর): আপনি কেন সংসদকে ব্রিফিং করছেন না?

শ্রী বিদ্যা চরণ শুক্লা: আমি এই বিষয়ে আসছি। বাংলাদেশের ভেতরে অনেক বিষয়ই ঘটছে। বাংলাদেশে প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে মাঝে মাঝে আমরা এই বিষয়ে তথ্য পাই। আমাদের নিজেদেরও তথ্যের উৎস রয়েছে। আমরা সংসদের সামনে আসতে ও জানাতে এক মুহূর্তও দ্বিধা করবো না যখন গুরুত্বপূর্ণ কিছু অথবা এমন কিছু যা সংসদের মনযোগ দাবি করার মতো কিছু আমাদের সীমান্তে ঘটে। যেসব বিষয় ঘটছে তা নিয়ে একটি সরকারি ব্রিফিং আছে, এখানে গোলাবর্ষণ কিংবা সেখানে একটি বহিরাক্রমণ, যা কর্যকরীভাবে জবাব দেওয়া হয়েছে। যদি আমরা প্রতিদিনই আসি এবং কী হচ্ছে এই বিষয়ে বিবৃতি দেই, আমি মনে করি না যে আমরা কোন ভালো নজির রাখতে যাচ্ছি। যদি এখানে গুরুত্বপূর্ণ কোনকিছু থাকে অথবা এমনকিছু যা সত্যিই সংসদের মনযোগের দাবিদার, যত শীঘ্রই আমাদের নজরে আসবে, আমরা অবশ্যই তা সম্পর্কে সংসদকে জানাবো। এখন, আপনার অনুমতি নিয়ে, মহোদয়, আমি একটি বিবৃতি দিতে চাই।

সম্মানিত সদস্যগণ অবৈধ বিমান অনুপ্রবেশ সম্পর্কে অবগত আছেন যেটি গতকাল বিকালে কলকাতা থেকে ত্রিশ মাইল উত্তর-পূর্বে বয়রায় ঘটেছিলো।

এখানে, সম্মানিত সদস্য উল্লেখ করেছেন যে বিমানগুলো ত্রিশ মাইল ভেতরে প্রবেশ করেছিলো। এটি ত্রিশ মাইল নয়, তারা আমাদের রাজ্যের ত্রিশ মাইল ভেতরে অনুপ্রবেশ করেনি। তারা কয়েক কিলোমিটার এসেছিলো। এই ঘটনাটি ঘটেছিলো কলকাতা থেকে ত্রিশ মাইল দূরে।

আমাদের বিমান বাহিনীর গৃহীত প্রতিরোধ কার্যের বিস্তারিত এখন আমাদের হাতে আছে। আনুমানিক ১৪:৪৯ ঘটিকার দিকে চারটি পাকিস্তানী স্যাবরকে আমাদের সীমান্তের দিকে আসতে দেখা যায়। চার সদস্যের একটি মিশনকে আদেশ দেওয়া হয়েছিলো তাদেরকে প্রতিরোধ করতে। পাকিস্তানী বিমানপোত ভারতীয় আকাশ সীমার প্রায় পাঁচ কিলোমিটার ভেতরে অনুপ্রবেশ করেছিলো। তাদেরকে ১৪:৫৯ ঘটিকায় সফলভাবে প্রতিরোধ ও হটিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। এই ঘটনার সাথে জড়িত চারটি স্যাবরের মধ্যে তিনটি উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানী বিমান চালকদের গাঁটবন্দী করা হয়েছিলো। তাদের মধ্যে দুজন, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পারভেজ মেহদী এবং ফ্লায়িং অফিসার খলিল আহমেদ আমাদের হেফাজতে আছে। আমাদের বাহিনীর কোন ক্ষতি হয়নি এবং তারা নিরাপদে তাদের ঘাঁটিতে ফিরে এসেছিলো।

ভারতীয় বিমান বাহিনীর বিমান চালকগণ, যারা এই স্যাবরগুলোকে উড়িয়ে দিয়েছিলো, তারা হলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ম্যাসি, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম. এ. গানপতী এবং ফ্লায়িং অফিসার লাজারাস।

শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী: এরপরেও পাকিস্তানের সাথে শত্রুতা নেই একথা বলা হাস্যস্পদ। আমি বিমান বাহিনীকে ধন্যবাদ দিতে চাই এজন্য যে তারা একটা কিছু করেছে। (বাধা)

স্পীকার মহোদয়: আমি এই লিখিত বিবরণীর একটি অভিমত চাই……

শ্রী এস. এম. ব্যানার্জী: মহোদয়, আমি এই সংসদের কাছে আবেদন করতে চাই যে এখানে আমাদের এমন কিছু বলা উচিৎ হবেনা, এমনকি কোন আভাসের মাধ্যমেও নয়, যা পাকিস্তানের অপপ্রচারের সমর্থন করতে পারে। আমাদেরকে এই বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। এই অনুরোধটি আমি সংসদে করতে চাই।

স্পীকার মহোদয়: এখন, মধ্যাহ্ন খাবারের পরে আমরা উড়িষ্যার ঘূর্ণিঝড় ধ্বস নিয়ে আলোচনা শুরু করবো। আমি কিছু সংখ্যক নাম পেয়েছি এবং আমি তাদের নিশ্চিত করছি যে তারা সবাই তাদের কথা বলার জন্য কয়েক মিনিট করে সময় পাবে এবং আমাদের এই বাগ্বিতণ্ডা শেষ করা উচিৎ হবেনা যতক্ষণ না তালিকা শেষ হচ্ছে। আমি আশা করবো আপনার সকলেই তাদেরকে উপযুক্ত সময় দিতে সহায়তা করবেন।

শ্রী এস. এম. ব্যানার্জী: মনে হচ্ছে কোন দল থেকেই উড়িষ্যার কোন প্রতিনিধি নেই, অন্যদেরকে সময় দেওয়া উচিৎ হবে।

স্পীকার মহোদয়: আমরা এখন মুলতবি করলাম এবং ২:৩০ মিনিটে পুনরায় মিলিত হবো।

শ্রী এস. এম. ব্যানার্জী: মহোদয়, আজকে মাননীয় মন্ত্রী সত্যিই এমন একটি বিবৃতি দিয়েছেন যা আমরা সকলেই বাহবা জানাই। কিন্তু সরকারের উচিৎ হবে এটা তার নিজ উদ্যোগে নেওয়া।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২২৮। পাকিস্তানে জরুরী অবস্থা ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি ভারতের লোকসভার কার্যবিবরণী ১৪ নভেম্বর, ১৯৭১

Fahmida Bristy
<১২, ২২৮, ৯০৪-৯০৫>
অনুবাদ

বিবৃতি
প্রসঙ্গঃ পাকিস্তানে জরুরী অবস্থার ঘোষণা এবং ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত পরিস্থিতি

প্রধানমন্ত্রী, পারমাণবিক শক্তি মন্ত্রী, বিদ্যুৎ সংক্রান্ত মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী (শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী) : পাকিস্তান জুড়ে জরুরী অবস্থা জারি করে গতকাল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা সম্পর্কে লোকসভা অবহিত আছে। এই ঘোষণা বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের মনযোগ সরিয়ে নেওয়ার জন্য এবং যে পরিস্থিতি সে নিজেই তৈরি করেছে তার দোষ আমাদের উপর চাপানোর জন্য তার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা। একটি সামরিক সরকার, যে সরকার বাংলাদেশের জনগণের উপর গত আট মাস ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে এবং গত তিন চার মাস যাবৎ সামগ্রিক যুদ্ধের জন্য আমাদেরকে হুমকি প্রদর্শন করে আসছে, সম্পূর্ণরূপে তার নিজের জনগণ এবং বিশ্বকে প্রতারিত করা ছাড়া সেই সরকারের এমন ঘোষণার কোন অর্থ নেই।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের স্বতন্ত্র বক্তব্য এই প্রভাব তৈরি করেছিলো যে সে অন্ততপক্ষে সামরিক অভ্যাগমন পরিত্যাগ করতে ও একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজতে কিছু বিশ্বনেতাদের উপদেশ চিন্তাভাবনা করছেন। আমরা মনে করি যে জরুরী অবস্থার ঘোষণা একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজবার চাপ থেকে বের হওয়ার একটি উপায়।

বর্ষাকালে মুক্তিবাহিনীর সফলতা স্পষ্টতই সামরিক বাহিনীর পরিকল্পনাকে বিপর্যস্ত করেছে। তাদের সকল জনগণের পূর্ণ সমর্থনের সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী বাহিনী পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনীর জান-মালের ব্যাপক ক্ষতি করেছে এবং তাদের স্বদেশের বৃহৎ অংশ মুক্ত করেছে।

আমাদের নিজস্ব বিশাল ব্যয়ে আমরা প্রায় এক কোটির মত ভীত-সন্ত্রস্ত নারী, পুরুষ, শিশুর অসহনীয় বোঝা দেখাশোনা করা কাঁধে নিয়ে আসছি, যারা কিনা পাকিস্তানি নির্যাতনের হাত থেকে পালিয়ে এসেছে। নিরাপত্তা এবং মানবিক মর্যাদার প্রত্যয়যোগ্য নিশ্চয়তা নিয়ে শরণার্থীরা তাদের দেশে ফিরতে চায়। আমরা এটা নিশ্চিত করতে দৃঢ় যে তারা যত শীঘ্রই সম্ভব দেশে ফিরে যেতে সক্ষম হবে।

পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী আমাদের সীমান্ত এলাকাগুলোতে জান-মালের উপর হানা দিয়ে গোলাবর্ষণ করে যাচ্ছে। তাদের বিমান বাহিনী শুধুমাত্র কয়েকবার আমাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেনি, একবার শ্রীনগর পর্যন্ত চলে এসেছিলো। গুপ্তচর ও অন্তর্ঘাতকরা রেল ও সেতু উড়িয়ে দিচ্ছে। ১৯৭১ এর মার্চ থেকে ৮৯০ টি ছোটখাটো ঘটনা রোধসহ সীমান্ত আইন অমান্য করার কারণে আমরা ৬৬ টি প্রতিরক্ষা পয়েন্ট স্থাপন করেছি। আকাশ আইন লঙ্ঘনের জন্য ৫০ টি ঘটনা রোধসহ আমরা ১৭ টি প্রতিরোধ গড়েছি। কিন্তু এইসব প্রতিরোধ কোন কাজেই আসেনি এবং তাদের এই অবিরাম উৎক্রমণ ঢাকতে পাকিস্তানি অপপ্রচার মাধ্যম এই গল্প প্রচার করে যাচ্ছে যে আমরা একটি অঘোষিত যুদ্ধে লিপ্ত এবং ট্যাংক ও সৈন্যবাহিনীসহ বিশাল এক আক্রমণ নিয়ে সওয়ার হয়েছি। এটি পুরোপুরি মিথ্যা। প্রকৃতপক্ষে, এটা হল পাকিস্তান, যে সামগ্রিক যুদ্ধের হুমকি দিয়েছিলো এবং তার সকল সশস্ত্র শক্তি আমাদের সীমান্তে যুদ্ধ অবস্থানে পাঠিয়েছিলো এবং “ভারত জয় করো” শ্লোগানসহ একটি বড় ভারত-বিদ্বেষী প্রচারণা চালিয়েছিলো। এইজন্য আমাদের দেশের অখণ্ডতা রক্ষা করার উদ্দেশ্যে ও আমাদের দেশের নাগরিকদের জান-মাল রক্ষা করতে আমাদের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হয়েছিলো এবং আমাদের বাহিনীকে আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে পাঠাতে হয়েছিলো। পরিস্থিতি ধাপে ধাপে বৃদ্ধি করার বা একটা সংঘাত শুরু করার অভিপ্রায় আমাদের কখনোই ছিলো না। এরপরে, আমরা আমাদের বাহিনীকে নির্দেশনা দিয়েছি যেন আত্মরক্ষার প্রয়োজন ছাড়া সীমান্ত অতিক্রম না করে। আমরা ১৯৪৭-৪৮ সালের, ১৯৬৫র জানুয়ারির এবং আগস্ট- সেপ্টেম্বরের অভিজ্ঞতার কথা অবজ্ঞা করতে পারিনা।

নভেম্বর ২১ তারিখে, মুক্তিবাহিনীর উপর, যারা কিনা বয়রার আশেপাশে স্বাধীন এলাকা দখল করেছিলো, তাদের উপর পাকিস্তানী পদাতিক সৈন্যবাহিনী যুদ্ধজাহাজ ও গোলাবারুদসহ আক্রমণাত্মকভাবে চড়াও হয়েছিলো। আমাদের পূর্ব সীমান্ত থেকে পাঁচ মাইল দূরে, পাকিস্তানী সাঁজোয়া ভারী গোলাবারুদ নিয়ে আমাদের আত্মরক্ষামূলক অবস্থানকে হুমকি দিয়ে আমাদের সীমান্তের দিকে অগ্রসর হয়েছিলো। আমাদের রাজ্যে তাদের গোলাবর্ষণ হয় যা আমাদের কিছু সংখ্যক মানুষকে আহত করে। স্থানীয় ভারতীয় সামরিক কমান্ডার পাকিস্তানী আক্রমণকে দমন করতে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছিলো। এই যুদ্ধে ১৩ টি পাকিস্তানী চ্যাফি যুদ্ধজাহাজ নিশ্চিহ্ন করা হয়েছিলো।

নভেম্বরের ২২ তারিখে পাকিস্তানী বাহিনী আমাদের অবস্থানের উপর চারটি স্যাবর জেট নিয়ে আকাশপথে হামলা করেছিল। ভারতীয় রাজ্যের ভেতরে এগুলো আমাদের ন্যাটস দ্বারা প্রতিহত করা হয়েছিলো যারা তিনটি স্যাবর জেটকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলো। পাকিস্তানী বিমানচালক যারা তাড়া করেছিলো, তাদের মধ্যে দুই জন আমাদের রাজ্যে ধৃত হয়েছিলো। আমরা এটিকে পুরোপুরি একটি স্থানীয় প্রক্রিয়া মনে করি।

যদিও পাকিস্তান একটি জরুরী অবস্থার ঘোষণা দিয়েছে, আমরাও একই ধরণের পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকবো যদি না পাকিস্তানের আর কোন আক্রমণাত্মক কাজ আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এই ধরণের পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করে। একইসাথে আমাদের দেশের উচিৎ হবে অবিচল থাকা। আমাদের সাহসী সশস্ত্র সামরিক বাহিনী এবং আমাদের জনগণ নিশ্চিত করবে যে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর কোন রাজনৈতিক হঠকারিতা উপযুক্ত জবাব পাচ্ছে। পাকিস্তানের শাসকদের অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে যে শান্তিপূর্ণ সমঝোতাই শান্তির পথ – যুদ্ধ, স্বাধীনতা হরণ এবং গণতন্ত্রের দমন শান্তির পথ নয়।

শিরোনামঃ সূত্র তারিখ
২২৯। পাকিস্তান কতৃক ভারতের উপর আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি এবং তার উপর আলোচনা ভারতের লোকসভার কার্যবিবরণী
৪ নভেম্বর, ১৯৭১

Tanvir Tanz Hedayet
<১২, ২২৯, ৯০৬-৯২০>
অনুবাদ

বেলা ১১ টায় লোকসভার অধিবেশন শুরু হয়
(মাননীয় স্পীকারের উপস্থিতিতে)

পাকিস্তান কতৃক আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে বিবৃতি

শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ( মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আণবিক শক্তি মন্ত্রী, ইলেকট্রনিক্স মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী )– মাননীয় স্পীকার, আজকের সকালের সংবাদ অনুসারে পশ্চিম পাকিস্তান সরকার আমাদের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। গতকাল বিকেলে, পশ্চিম পাকিস্তান বিমান বহর আমাদের আকাশ সীমা লঙ্ঘন করে এবং যথেচ্ছাপূর্বক বিপুল সংখ্যক বিমান ঘাটিতে আক্রমণ চালায়। একই সাথে তাদের স্থল বাহিনী সীমান্তের পশ্চিমাঞ্চলে আমাদের সেনা অবস্থানের উপর গোলা বর্ষণ করে। তাদের প্রচার মাধ্যম ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলেছে যে, ভারত আক্রমণ ও হামলা চালিয়েছে।

কলকাতা ত্যাগের প্রাক্কালে এই খবর আমার কাছে এসে পৌছায়। ফেরত আসার পর অনতিবিলম্বে আমি আমার সহকর্মী এবং বিরোধী দলীয় নেতাদের সাথে এ বিষয়ে পরামর্শ করি। জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষায় আমরা সর্বসম্মতভাবে একমত হয়েছি যে, আক্রমণকারীকে অবশ্যই প্রত্যাহত করা হবে। আমি নিশ্চিত আমাদের এই সংহতি ভবিষ্যতের কঠোর দিনগুলোতে আমাদের কাজে প্রভাব ফেলবে। দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হল।

আমি ৩রা ডিসেম্বর, ১৯৭১ এ প্রকাশিত ভারতীয় গেজেটেরে বিজ্ঞপ্তি নম্বর জি.এস.আর. ১৭৮৯ এর একটি অনুলিপি পেশ করছি, যাতে সংবিধানের ৩৫২ নম্বর অনুচ্ছেদের “২” নং ধারার উপ-ধারা “বি” অনুসারে ৩রা ডিসেম্বর, ১৯৭১ এ রাষ্ট্রপতি কতৃক জরুরী ধারা ঘোষণার কথা প্রকাশিত আছে, যা একই অনুচ্ছেদের “১” নং ধারায় উল্লেখ করা আছে।

আমরা সংসদে ভারতীয় সুরক্ষা বিধান পাশের প্রস্তাব রাখছি।

আমরা দুঃখ অনুভব করছি, যে সময়ে উপমহাদেশের উন্নতি সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন তখন পাকিস্তান তাদের চূড়ান্ত বোকামি আর ব্যর্থতার কারণে ভারত ও পাকিস্তানের জনগণকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ যাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কখনোই কোন বক্তব্য ছিল না, তাদের সাথে আমরা ভাল প্রতিবেশী হিসেবেই থাকতে পারতাম। এই অন্তিম মুহূর্তে আমাদের কতৃত্তপূর্ণ আবেগ অন্যতম আস্থা ও বিশ্বাস।

প্রায় নয় মাসেরও অধিক সময় ধরে পাকিস্তান সামরিক সরকার বর্বরতার সাথে বাংলাদেশের মানুষের সাধারণ মানবাধিকার এবং স্বাধীনতা পদদলিত করে আসছে। কর্মরত সেনা বাহিনী জঘন্যতম অপরাধ ঘটিয়েছে যার হিংস্রতার পরিমান কঠোর শাস্তিরও অপ্রতুল্য। কয়েক লক্ষ লোককে হত্যা করা হয়েছে এবং দশ লক্ষ লোক আমাদের দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।

আমাদের নিরাপত্তা ভীতি সত্ত্বেও, একটি পুরো জাতীর ধ্বংসের বিষয়ে ক্রমাগত সমগ্র বিশ্বের মনযোগ আকর্ষণ করেছি। সর্বত্রই জনগণ সহানুভূতি প্রকাশ করেছে এবং ভারতের অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য চাপ ও সংকটের বিষয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছে। কিন্তু সরকার নৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে পক্ষঘাতগ্রস্তদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের জন্য ইসলামাবাদ সরকারকে কিছু পদক্ষেপ নেবার বিলম্বিত প্ররোচনা ব্যর্থ হয়েছে।

পশ্চিম পাকিস্তান সেনাদের ক্রোধের মাত্রা বেড়েছে কারণ বাংলাদেশের জনগণ তাদের মূল্যবোধ রক্ষার জন্য সংগ্রাম করছে এবং সেনাবাহিনীর কাছে এটা গ্রহণযোগ্য নয়, এবং পাকিস্তানের সব কটি প্রদেশে এটি দমন করা হয়েছে।

মুক্তিবাহিনীর কার্যকারিতা বৃদ্ধির সাথে সাথে পশ্চিম পাকিস্তান সেনা বাহিনী মরিয়া হয়ে পড়েছে। অত্যাচারীর পক্ষ নেয়া নয় বরং নিপীড়িতদের সাথে থাকাই আমাদের ঐতিহ্য এবং এই কারনেই তাদের ক্রোধ এখন আমাদের উপর এসে পড়েছে।

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ধাপে ধাপে বৃদ্ধি পাওয়া ও সম্প্রসারিত হওয়া পশ্চিম পাকিস্তানের আক্রমণ ভারতের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। শান্তির মত যুদ্ধেরও ধৈর্য ও সংযম এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। পাকিস্তানের সামরিক সরকার সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও অভ্যন্তরীণ সমস্যা জারি রাখতে, সন্দেহ ও গুজব ছড়ানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। আমাদের তাদের পরিকল্পনার ফাঁদে পরা উচিৎ নয়। আমাদের অবশ্যই লক্ষ স্থির রেখে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।

আমাদের দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। কৃষি এবং শিল্প ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি হচ্ছে মুল ভিত্তি যার উপর প্রতিরক্ষা নির্ভর করে। কৃষক, শ্রমিক, শিল্পবিদ ও ব্যবসায়ীদের আত্মোৎসর্গের সাহায্যে জওয়ানদের সাহসী ও যুদ্ধোপজোগী করে তুলতে হবে। ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের বিশেষ দায়িত্ব হচ্ছে দ্রব্যাদি মজুদ এ অধিক মুনাফার লোভ থেকে নিজেদের সংবরণ করা। শিল্পী, লেখক, শিক্ষক ও ছাত্রদের প্রতি জাতি আশা করে তারা আমাদের আদর্শকে রক্ষা করবে এবং নৈতিকতাকে উচ্চস্তরে রাখবে। আমাদের দেশের প্রতিটি নারীর প্রতি আমার বিশেষ আবেদন থাকবে যাতে তারা যতটা সম্ভব শস্য এবং রুপি সঞ্চয় করে এবং অপচয় রোধ করে। আমাদের সকলের আত্মত্যাগে গড়ে উঠবে জাতির শক্তি ও স্থায়ী ক্ষমতা।

আমরা শান্তির পক্ষে কিন্তু শান্তিরক্ষা করাটাও আবশ্যক। আজকে আমরা আমাদের প্রাদেশিক সংহতি ও জাতীয় সম্মান রক্ষার জন্য যুদ্ধ করছি। সর্বোপরি, আমরা যে আদর্শকে লালন করি তার জন্য এবং শান্তির জন্য যুদ্ধ করছি।

১১:০৬ ঘটিকা

জরুরী অবস্থা ঘোষণা বিষয়ক বিশ্লেষণ

শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ( মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আণবিক শক্তি মন্ত্রী, ইলেকট্রনিক্স মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী )– আমি জরুরী অবস্থা ঘোষণা বিষয়ক বিশ্লেষণ উত্থাপনের অনুরোধ জানাচ্ছি –

“রাষ্ট্রপতি কতৃক ৩রা ডিসেম্বর, ১৯৭১ এ স্বাক্ষরিত সংবিধানের ৩৫২ নং ধারা অনুযায়ী জরুরী অবস্থা ঘোষণাকে সংসদে মঞ্জুর করা হোল।”

মাননীয় স্পীকারঃ- বিশ্লেষণ উত্থাপন করা হোল –

“রাষ্ট্রপতি কতৃক ৩রা ডিসেম্বর, ১৯৭১ এ স্বাক্ষরিত সংবিধানের ৩৫২ নং ধারা অনুযায়ী জরুরী অবস্থা ঘোষণাকে সংসদে মঞ্জুর করা হোল। “

শ্রী এ. কে. গোপালান (পালাঘাট) — গতকাল বিভিন্ন স্থানে বিপুল পরিমাণে বিমানযোগে আক্রমণ ও গোলা বর্ষণের মাধ্যমে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা এদেশকে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের মুখোমুখি করেছে। ভারত বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামে সহায়তা করার জন্য এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, আমাদের দল সবসময়ই বলে এসেছে যে এই ধরণের পরিস্থিতিতে সমগ্র জাতি একীভূত হয়ে সামরিক জান্তার আক্রমণকে প্রতিহত করবে, কারণ উপমহাদেশে সাম্রাজ্যবাদের পতন ঘটিয়ে শুধুমাত্র বাংলাদেশ নয় পশ্চিম পাকিস্তানেও গনতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে বাংলাদেশের এই স্বাধীনতা সংগ্রামে বিজয়ী হওয়া অত্যন্ত জরুরী। আমরা আমাদের দলের এই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করছি। আমরা ভারতীয় সরকারের প্রতি আবেদন জানাচ্ছি যাতে সকল সংশয়ের অবসান ঘটিয়ে, সব ধরণের চাপ প্রতিহত করে শীঘ্রই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হয় কারণ আমরা বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করছি, এবং আজকে অবশ্যই আমাদের বাংলাদেশকে আনুস্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে।

আমরা আরও সতর্ক করতে চাই যে, দেশে প্রগতিবিমুখ শক্তি উগ্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সৃষ্টি করতে পারে। এই ধরণের সকল প্রগতিবিমুখ শক্তি প্রতিহত করে আমাদের দেশের জনতাকে জানাতে হবে আমরা বাংলাদেশের জনগণের বিজয়ের জন্য এই যুদ্ধে অংশ নিচ্ছি। আমাদের আরও জানাতে হবে তারা যেন কোন প্রকার পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনে জড়িত না হয়।

জরুরী অবস্থা ঘোষণা বিষয়ে আমাদের অভিমত এই যে, যেহেতু সমগ্র দেশ সরকারের পক্ষে রয়েছে তাই এই মুহূর্তে জরুরী অবস্থা ঘোষণার প্রয়োজনীয়তা নেই কিন্তু ইতোমধ্যে তা ঘোষিত হয়ে গেছে। এই বিষয়ে আমরা কোন মন্তব্য করবো না। আমরা নিশ্চিত করছি যে আমরা মনেপ্রাণে বাংলাদেশের সংগ্রামের পক্ষে এবং পাকিস্তানের বিপক্ষে আমাদের সমর্থন জানাবো।

শ্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত (আলিপুর ) — এই সংকটলগ্নে দেশের অখণ্ডতা রক্ষার এই গুরু দায়িত্বের প্রতি আমাদের দলের পক্ষ থেকে আমরা সম্পূর্ণ সমর্থন জানাই।

গতকাল রাত থেকে আমাদের সেনাবাহিনীর ওপর এক বিশাল ও ঐতিহাসিক দায়িত্ব এসে পড়েছে। শুধুমাত্র দেশের অখণ্ডতা রক্ষা করার মধ্যেই এই দায়িত্ব সীমাবদ্ধ না। বাংলাদেশের অত্যাচারিত ও দাসত্বের শিকার হওয়া অসহায় মানুষগুলো গত রাত থেকে আমাদের ভরসায় রয়েছে যাতে তাদের পক্ষে আমাদের ন্যায় বিচারের তলোয়ার শাণিত হয়। এই ন্যায়ের তলোয়ার সাহস ও স্থির সংকল্পের সাথে শাণিত হওয়া উচিৎ। একই সাথে আমি সরকারের কাছে অনুরোধ জানাবো, সকল সন্দেহের উর্ধে থেকে এই বিষয়ে খোলাসা করতে যে, আমাদের পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ক্ষুণ্ণ করার কোন দুরভিসন্ধি নেই। পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ যাদের সাথে আমাদের কোন কলহ নেই, আমরা সবসময় চেয়েছি এবং আশা করি একদিন অবশ্যই আমরা শান্তি ও সৌহার্দপূর্ণ প্রতিবেশী হিসেবে তাদের সাথে বসবাস করতে পারব।

আমাদের সংগ্রাম ইসলামাবাদের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে, যাদের অবর্ণনীয় অত্যাচার ও ভোগান্তির শিকার বাংলাদেশের জনগণ। তাই, আমি সরকারের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি যাতে সারা বিশ্বের কাছে এই যুদ্ধে আমাদের মূল লক্ষের বিষয়ে খোলাসা করা হয়, যাতে সম্রাজ্যবাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তি এই পরিস্থিতির ফয়দা লুটতে না পারে। এবং এখন সময় এসেছে, বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের জনগণের সরকারকে আমাদের দৃঢ় স্বীকৃতি জানানোর।

খুব শীঘ্রই আমরা ভারতের প্রতিরক্ষা আইন পাশ করতে যাচ্ছি এবং এর নিয়ম কাঠামো এতে উল্লেখ করা থাকবে। এই আইন বাস্তবে সরকারকে অসীম ক্ষ্মতাসম্পন্ন করবে। প্রধানমন্ত্রী দেশ এবং প্রতিরক্ষার স্বার্থে উৎপাদন বৃদ্ধির কথা বলেছেন। আমরা তার সাথে একমত। কর্মজীবী শ্রেণী এই বিষয়ে ভুমিকা রাখবে। এখন আপনার অধীনে এই ক্ষমতা আসার পর আপনি অবশ্যই খেয়াল রাখবেন যাতে কারখানার মালিক ও কর্মজীবীরা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য উৎপাদন বন্ধ এবং শ্রমিক ছাঁটাই না করে। আপনি আরও লক্ষ্য রাখবেন যেন এই মুহূর্তে বন্ধ থাকা ৩০০০ এরও অধিক কারখানা অবিলম্বে চালু করে উৎপাদন শুরু করা হয়, যাতে করে আমাদের সম্পদের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা যায়।

আমরা যেভাবে দেশকে প্রতিপক্ষের আক্রমণের হাত থেকে রক্ষায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, তেমনি সরকারের উচিৎ দেশের জনগণকে এই অস্বাভাবিক অবস্থার ফয়দা নিতে চেষ্টা করা অসাধু মুনাফাখোর, মজুতদার এবং গুপ্তচরের হাত থেকে রক্ষা করা।

আমি এই মুহূর্তে আর বেশী সময় নিতে চাই না। আজকে আমাদের প্রাথমিক ভাবনায় আমাদের বীর সেনা সদস্যগণ এবং আমার মতে বীর মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা যাদের আট মাস ব্যাপী প্রবল প্রতিরোধ ছাড়া বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষা করা সম্ভব হত না। তারা নতি স্বীকার করলে, আত্মসমর্পণ করলে এবং হার মেনে নিলে আজকে আমাদের সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হত। কিন্তু আশাই একমাত্র অবলম্বন এবং বাংলাদেশের জনগণ ও মুক্তিবাহিনীর আত্মত্যাগের ফলে তারা বিদ্রোহ চরমে রেখে স্বাধীনতা রক্ষা করতে পেরেছে। আজকে আমাদের গর্ব করা উচিৎ কারণ, যখন ইসলামাবাদের সামরিক জান্তা মরিয়া হয়ে রক্তের বিনিময়ে বাংলার জনগণকে দমন করতে চাচ্ছে তখন আমরা বাংলাদেশের জনগণের জাতীয় নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা রক্ষার ইতিহাসে অবিচ্ছেদ্যভাবে এই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করছি। আমরা সাহস, সংকল্প ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ভাবে সামনে এগিয়ে যাব। কিন্তু আমাদের দেশীয় ঐতিহ্যকে মাথায় রেখে আমাদের ঘোষণা করতে হবে যে, আমরা সর্বদাই শান্তি প্রিয় রাষ্ট্র। আমরা শুধু তখনই যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে যখন আমাদের বাধ্য করা হয়েছে। আমরা অন্য কোন রাষ্ট্রকে জোরপূর্বক আমাদের অন্তর্ভুক্ত করতে চাই না। আমরা আমাদের মাতৃভুমির প্রতিরক্ষা করতে চাই, এবং বাংলাদেশের জনগণকে তাদের স্বাধীনতা রক্ষায় সাহায্য করতে চাই যাতে তারা স্বাধীনভাবে নিজেদের ইচ্ছেমত এবং পছন্দের সরকারের অধীনে থাকতে পারে।

শ্রী শেঝহাইয়ু আন ( কুম্বাকোনাম ) — মাননীয় স্পীকার, আমি ডি.এম.কে. র পক্ষ থেকে জরুরী অবস্থা ঘোষণার সমর্থন জানাচ্ছি এবং সরকারের প্রতি আমাদের সংহতি প্রকাশ করছি। আমরা যুদ্ধ চাই নি কিন্তু আমাদের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে এবং আমরা আমাদের গণতন্ত্র রক্ষায় এবং রাষ্ট্রীয় অধিকার সংরক্ষণে এই যুদ্ধ আহবান গ্রহণ করছি। যদি পাকিস্তানী সামরিক সরকার মনে করে অস্ত্র দেখিয়ে আমাদের সরকারকে অচল করা সম্ভব তবে এখানে আমরা এবং বাংলাদেশের জনগণ যারা তাদের সকল বিশ্বাস ও জীবন গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় নিয়োজিত করেছে, এই যুদ্ধের আহবান গ্রহণ করবে। একতাবদ্ধভাবে আমরা লড়াই করবো এবং একতাবদ্ধভাবে আমরা অবশ্যই জিতবো।

শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী — স্পীকার মহাশয়, একটি জাতীয় সংকটের মধ্যে আমরা একত্রিত হয়েছি। পাকিস্তান আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীর অব্যাহত সাফল্যে বিশ্বের দৃষ্টি অন্যত্র সরানোর জন্য এবং এই ভূখণ্ডে আন্তর্জাতিক চাপ ডেকে আনার জন্য পাকিস্তান আমাদের নিরাপত্তা, অখণ্ডতা এবং আমাদের স্বাধীনতার প্রতি চ্যালেঞ্জ প্রদান করেছে।

আজ আমি দলীয় প্লাটফর্ম থেকে বলতে আসিনি। এখন সমগ্র দেশই একটি দল। রাজনৈতিক মতানৈক্য বিস্মৃত হয়ে, ছোটখাটো ব্যাপারসমুহ শিকেয় তুলে রেখে, সমগ্র দেশকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, পায়ে পা মিলিয়ে বিজয়ের জন্য সামনে অগ্রসর হতে হবে। এই যুদ্ধ যত ত্যাগ চাইবে, তা প্রদান করা হবে। এরুপ পরিস্থিতিতে যে জাতীয় সংকল্প অপরিহার্য হয়ে ওঠে, এই সংকটকালে আমরা সেই সংকল্পের পরাকাষ্ঠা দেখাব না এমন ভাববার কোন কারণ নেই।

স্পীকার মহোদয়, মায়েরা যে দিনের জন্য সন্তান ভূমিষ্ঠ করে আজ সেদিন সমাগত। বোনেরা যেদিনের জন্য ভাইদের হাতে রাখী বেঁধে দেয় সেদিন এসে গেছে। পাকিস্তান যদি এই ভেবে থাকে যে সে প্রতারণা করে আক্রমণ চালিয়ে অসতর্কভাবে আমাদের কাবু করে ফেলবে তবে সেটি তার ভুল হবে। বিশ্ব দেখেছে আক্রমণকারী কে এবং আক্রমণকারীকে আমাদের সেনাবাহিনী দাঁতভাঙ্গা জবাব দিচ্ছে।

আমরা আশা করব, ইতিহাস পরিবর্তনের জন্য মুহূর্তের দায়িত্ব যাদের হাতে ন্যাস্ত, এবং প্রধানমন্ত্রী, যিনি এই সংকটকালে দেশের নেতৃত্ব দেবার জন্য এগিয়ে আসছে, আমাদের কামনা, এই দেশ জয়যুক্ত হোক এবং প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরা একটি নতুন ইতিহাসের জন্ম দেই।

স্পীকার মহাশয়, আমি চাই এই আক্রমণের সময়ে এই সংসদকে ইয়াহিয়া খাঁর বিরুদ্ধে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। পাকিস্তানে পার্লামেন্ট নেই। পাকিস্তান সরকারের জনসমর্থন নাই। এখানে জনপ্রতিনিধিরা উপবিষ্ট আছেন। বিশ্বরাষ্ট্রসমুহ দেখছে, এবং ভবিষ্যতেও দেখবে, সংকটের সময় এক হয়ে প্রত্যুত্তর দেবার সামর্থ্য এই দেশের আছে।

আমি এও প্রত্যাশা করব যে, যুদ্ধ তৎপরতায় সকলকে সহগামী করে তোলার জন্য পরিকল্পনা তৈরী করা হোক, পৃথকভাবে কাজ ভাগ করে দেয়া হোক, এবং দেশে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা হোক যাতে এই যুদ্ধে আমরা বিজয়ী হতে পারব।

আজ জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে, আমি এটা সমর্থন করি একথা বলাই বাহুল্য। এ ব্যাপারে আমি বন্ধু, গোপালনের সঙ্গে একমত নই যে, এর কোন প্রয়োজন ছিল না। পাকিস্তান যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, পাকিস্তান হঠাৎ আক্রমণ করেছে। এ সময়ে আমরা কোনরূপ শীথল নীতি দেখাব সে প্রশ্নই উঠতে পারে না। জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে, সংসদ তাকে পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছে, এবং ভবিষ্যতেও দেশের নিরাপত্তার ব্যাপারে যে সব পদক্ষেপ নেয়া হবে, এই সংসদ তা সমর্থন করবে। সমগ্র দেশ এক ব্যক্তি রূপে এই চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে সক্ষম হবে।

শ্রী শ্যামনন্দন মিশ্র ( বেগমসরাই ) — জনাব মাননীয় স্পীকার, আজকে আমি আমার দলের পক্ষ থেকে বলতে চাই, আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে আমরা জাতি হিসেবে দুর্বার ও একতাবদ্ধ। আজকে আমরা আমাদের মাঝে কোন পার্থক্য খুঁজে পাই না, পার্থক্য শুধুমাত্র আক্রমণকারী আর তাদের মিত্রদের সাথে। অতীতে আমাদের মধ্যে কিছু মতভেদ থেকে থাকতে পারে কিন্তু আজকে সেসব শুধু বিবর্ণই হয়নি, সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

আজকে আমার মতে জাতির সামনে শুধু একটাই কর্তব্য, সাফল্যের সাথে আক্রমণকারীকে প্রতিহত করা। এবং কেবলমাত্র দ্বিধাহীন ও পূর্ণ একতার সাথে একক নেতৃত্বে এই কাজ করা সম্ভব। আর সকল সংকীর্ণতা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে এই পন্থা অর্জন ও বজায় রাখা সম্ভব।

জনাব, আক্রমণকারীর বিবেচনায় এই যুদ্ধ অত্যন্ত স্থির ও হিসেবী হবে। আক্রমণকারীরা আমাদেরকে দশ দিনের সময় দিয়েছিল। আমার মতে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান তার কথা রেখেছেন।

তিনি তার দেশের জনতাকে জানিয়েছিলেন যে দশ দিনের মধ্যে তিনি যুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন। এখন আমি এই দেশের পক্ষ থেকে বলতে চাই আজকে সমগ্র জাতি আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রয়েছে।

যদি রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান ভেবে থাকেন তিনি একজন জেনারেল ছিলেন এবং আমাদের প্রধানমন্ত্রী জেনারেল ছিলেন না, তবে আমি জানিয়ে দিতে চাই, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শুধুমাত্র এই জাতির কোমলতার প্রতীক নন, ইস্পাত ও গ্রানাইট পাথরের মত দৃঢ় ও মজবুত সত্তারও প্রতীক এবং আমাদের পক্ষ থেকে তিনি দুর্গা মায়ের মত ক্ষমতাবান।

আমরা মহাত্মা গান্ধীর উত্তরসূরি হিসেবে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বেড়ে উঠেছি। আমরা কখনোই নিজেদের আক্রমণকারী হিসেবে ভাবতে পারি না। আমরা কখনোই নিজেদের আক্রমণকারী রূপে মানাতে পারব না বরং আমরা চতুর্থ বারের মত পাকিস্তানের আক্রমণের শিকার হলাম। অতীতের সকল আক্রমণ ভারত প্রত্যাহত করেছে, আশা করি এবারের আক্রমণ এমন নিশ্চিতভাবে প্রত্যাহত করা হবে যাতে আক্রমণকারী ভবিষ্যতে পুনরায় আক্রমণের সাহস না পায়।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যাতে সব ধরণের পদক্ষেপের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত থাকে সেই বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। বিভিন্ন উন্নত দেশগুলো বিভিন্ন রকম কূটনৈতিক সাহায্যের জন্য প্রস্তুত থাকতে পারে। ৭এ০ই সকল বিষয়ের ধারণায় আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি, আমাদের দেশ সম্পূর্ণ একাগ্রতার সাথে যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত আছে, এবং আমাদের সরকার বিশ্বাস, ভরসা এবং সহিষ্ণুতার সাথে এই কর্ম সম্পন্ন করতে পারবে, যেমনটা গত রাতে প্রধানমন্ত্রী তার সম্প্রচারে ব্যক্ত করেছেন।

আমি নিশ্চিত অন্য যেকোন কারনেই আমাদের সমাজের মধ্যে বিভেদ থেকে থাকুক না কেন, আজকে আমরা একটি জাতি হিসেবে উঠে দাঁড়াবো এবং যেকোন দায়িত্ব আমাদের উপর এসে বর্তাক আমরা তা পরিপূর্ণতার সাথে সম্পন্ন করতে পারবো। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের পরিপূর্ণতা ছাড়া সন্তুষ্ট হওয়া উচিৎ নয়।

জনাব স্পীকার, এই বক্তব্যের সাথে আমি আমার দলের পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাতে চাই। এটা অত্যন্ত মামুলি শোনালেও আমরা গুরুত্বের সাথে জানাতে চাই যে, সম্ভাব্য সকল উপায়ে আমরা এই আক্রমণকারীদের বিপক্ষে দেশকে সচল রাখার চেষ্টা করবো।

শ্রী ফ্রাঙ্ক অ্যান্থনি ( নির্বাচিত অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ) — মাননীয় স্পীকার, আমার ইউনাইটেড ইন্ডিপেন্ডেন্ট গ্রুপের সদস্যদের সাথে সেইরকম সহানুভূতি নিয়ে সহযোগিতা করার সুযোগ হয়েছিল যা অন্যান্য দলের মুখপাত্রের মধ্যেও ছিল।

এই তো সেদিন মদ্ধাহ্নভোজের সময় আমেরিকার সিনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চের সাথে আমি বলেছিলাম, আমি কিছুদিনের মধ্যে পাকিস্তান জান্তার তরফ থেকে আক্রমণ আশা করছি। উনি আমার কাছে এর কারণ জানতে চাইলে আমি ইসলামাবাদের অবর্ণনীয় নৃশংসতার কথা জানাই্, এবং এই সামরিক জান্তা বুঝতে পেরেছে যে তারা বেশীদিন বাংলাদেশকে দখলে রাখতে পারবে না তাই অন্যান্য স্বৈরাচারী শাষকের মত নিজেদের মুখ বাঁচাতে আমাদের উপর আক্রমণ করবে এবং তাই ঘটেছে।

সভায় উপস্থিত সকল দলের মুখপাত্র এবং প্রতিনিধিগণ এই জাতীয় সংকটলগ্নে অকুণ্ঠভাবে প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের প্রতি অটল সমর্থন জানিয়েছেন। কিন্তু আমি মনে করি আমরা এই বিষয়েও একমত যাতে এই সময় আরেকটি তাশকেন্ট ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

নিরাপত্তা পরিষদ এবং অগ্রগামী দেশের সরকারগণ অত্যন্ত কঠোর ও অমানবিকভাবে নিশ্চুপ ছিল যখন ইসলামাবাদের কসাই ও তার ভাড়াটে সৈন্যরা লক্ষাধিক অসহায় পুরুষ, মহিলা ও শিশুর হত্যা করে এবং দশ লক্ষাধিক লোককে আমাদের সীমান্তে ঠেলে দিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করে।

বাস্তবিকপক্ষে, কিছু সরকার আমাদের নিজেদের সীমান্ত রক্ষা না করার এবং আমাদের সৈন্য ফিরিয়ে নেবার মত হঠকারী উক্তিও করেছে, যখন তারা ইতিহাসের বৃহৎ এই গণহত্যা নিয়ে কথায় ও কাগজে ফুলঝুরি ফোটাচ্ছিলেন। আমি বিশ্বাস করি, এই গণহত্যায় উৎসাহের জন্য হলেও ইসলামাবাদের কসাইয়ের পূর্ণ মাত্রায় ভারত আক্রমণের সাহস হত না যেমনটা সে করেছে। সারা বিশ্ব জানে ভারত কিভাবে সংযমের পরিচয় দিয়েছে। বিশ্ব জানে ক্রমবর্ধমান আক্রমণ সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীর শক্তি ও ক্ষমতা রয়েছে ভারতকে বিবেচনাযোগ্য সময়ের জন্য শৃঙ্খলাবদ্ধ রাখার।

জাতির জন্য বিশেষত প্রত্যেকটি ভারতীয়র জন্য এই যুদ্ধ তাদের চারিত্রিক পরীক্ষা স্বরূপ। এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হতে পারে, সব যুদ্ধের মত এখানেও বিসর্জন ও ভোগান্তি বৃহৎ আকারের। কিন্তু আমরা এটা জেনে উৎকর্ষ বোধ করতে পারি যে আমরা এমন এক অশুভ সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি যার হাত অসহায় মানুষের রক্তে রাঙ্গা, সর্বোপরি আমরা এটা জেনে উৎকর্ষ বোধ করতে পারি যে, আমরা শুধু আমাদের দেশের জন্যই যুদ্ধ করছি না, আমরা যুদ্ধ করছি গণতন্ত্রের জন্য এবং যে যুদ্ধে বর্ণ, গোত্র, সম্প্রদায় নির্বিশেষে আমরা শুধুমাত্র ভারতীয় হিসেবে উল্লেখিত হব এবং একত্রে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইসলামাবাদের রক্ত পিপাসু যুদ্ধবাদী উন্মাদকে পরাজিত করতে পারবো।

শ্রী পি.কে. দেও ( কালাহান্ডি ) — জনাব মাননীয় স্পীকার, ভারতের এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে বক্তব্য দেবার সুযোগ পেয়ে আমি গর্ব বোধ করছি। আমি জরুরী অবস্থা ঘোষণার সমর্থন জানাচ্ছি এবং পাকিস্তান কতৃক ভারতীয় জনগণের উপর অনর্থক, স্থূল এবং উন্মুক্ত আক্রমণ ও বোমা বর্ষণের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।

এটি শান্তিপ্রিয় লোকের বিরুদ্ধে ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য আক্রমণ হিসেবে লিখিত থাকবে। পাকিস্তানের এহেন কর্ম পার্ল হারবারে জাপানীদের অপ্ররোচিত আক্রমণকেও তুচ্ছ প্রমাণ করেছে।

পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের সাথে আমাদের কোন বিবাদ নেই। এটা ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বাধীন সামরিক দলের কর্ম, যারা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বোঝে না এবং নিজেদের লোকদের উপর গণহত্যা চালিয়ে ভারতের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।

ভারত যদি কিছু করে থাকে তবে তা হল, মানবিক ও সহানুভূতির কারণে দশ লক্ষাধিক বাংলাদেশী শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে।

এই উপলক্ষে সারা দেশ একতাবদ্ধভাবে প্রধানমন্ত্রীর স্বপক্ষে জেগে উঠবে। স্বতন্ত্র দল সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছে এবং জনগণের প্রতি আবেদন জানাচ্ছে যাতে তাদের মনোবল ইস্পাতের মত মজবুত করে এবং দেশের স্বাধীনতা ও জাতীয় সম্মান রক্ষায় রক্ত দিতে ও সর্বচ্চো বিসর্জনের জন্য প্রস্তুত থাকে।

আমি সরকারের কাছে আবেদন জানাই যাতে ১৯৪৯ এবং ১৯৬৫ সালের যুদ্ধবিরতির মত বোকামি না করে এবং সবধরণের চাপ প্রয়োগ করে এই দন্দের সমাপ্তি ঘটায় এবং জয়ই হতে পারে একমাত্র যৌক্তিক সমাপ্তি।

জনাব, সত্য ও ন্যায় আমাদের পক্ষে। সৃষ্টিকর্তা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে। আমাদের উৎকৃষ্ট সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম রয়েছে যা নিয়ে যেকোনো দেশ গর্ব করতে পারবে। তাই জয় আমাদের হবেই।

শ্রী সমর গুহ ( কন্তাই ) — পাকিস্তানের উন্মাদ সামরিক একনায়ক আমাদের জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এই যুদ্ধ আমাদের জাতীয় সম্মান রক্ষার, আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার এবং সেসব সকল মূল্যবোধ রক্ষার যার ভিত্তিতে আজকে আমরা স্বাধীন।

জনাব, এই বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নাই যে সমগ্র জাতি আজকে এই যুদ্ধকে মেনে নিবে বরং তারা এই যুদ্ধকে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সরবাধিক মূল্যবোধ রক্ষার জেহাদ হিসেবে গ্রহণ করবে যা থেকে পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ বঞ্চিত।

জনাব, আমি ভারতীয় সোশালিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে আমার দল ও নিজেকে দেশের জাতীয় সম্মান ও নিরাপত্তা রক্ষার গুরু দায়িত্ব পালনে সমরপন করছি।

ইয়াহিয়া খানের এই বিশ্বাসঘাতি আক্রমণ ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে, যা একদিক থেকে ভারতীয় প্রেরণাকে এক উচ্চ মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। এটা আমাদের ভারত, মহাত্মা গান্ধীর ভারত, পণ্ডিত জওহারলাল নেহেরুর ভারত, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের ভারত, যে ভারত সমগ্র জাতির জন্য ঝুকি নিতে পারে, বিশাল বিসর্জনের জন্য ঝুকি নিতে পারে, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য চরম ভোগান্তি ও ক্ষতির মুখোমুখি হতে পারে, যার ঐতিহাসিক বন্ধন ও ঐতিহ্য তিন হাজার বছরের পুরনো ভারতীয় সভ্যতা এবং আমাদের জাতির অংশ, আজ তা হুমকির সম্মুখীন। তাই যদি ঝুকি নিতে হয় আমরা আমাদের সর্বস্ব দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষার ঝুকি নিতে প্রস্তুত। আজকে যখন বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শক্তি তাদের পুরাতন রাজনৈতিক শক্তি ও সংকীর্ণতায় নিমজ্জিত, তখন বিশ্বের ভবিষ্যৎ ইতিহাস এবং মানবতার ভবিষ্যৎ ইতিহাস স্বাক্ষী থাকবে যে একটি জাতি একটি অংশের জনগণের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য যুদ্ধ করেছিল, যেখানে সামরিক স্বৈরশাসক এমন হত্যা ও জঘন্য অপরাধ ঘটাতে চেয়েছে যা বিশ্ব আগে কখনও দেখেনি।

আজকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে পরিণত হয়েছে। আজকে আমাদের বাংলাদেশী বন্ধুদের জানাতে চাই, এই স্বাধীনতা সংগ্রাম শুধুমাত্র সাড়ে ৭ কোটি বাঙ্গালীর স্বাধীনতা সংগ্রাম নয়, ৫৫ কোটি ভারতীয়রও সংগ্রাম। ইয়াহিয়া সরকারের জানা উচিৎ, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সর্বাধিক মূল্যবোধ রক্ষার এই সংগ্রাম ৬৩ কোটি জনতার যৌথ সংগ্রাম।

আমি প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে আরেকটি কথা বলতে চাই। আজকে তিনি কোন একক ব্যক্তিত্ব নন, নন কোন দলের প্রধাণ কিংবা ভারতের প্রধাণমন্ত্রী, আজকে তিনি আমাদের দেশের ব্যক্তিত্ব এবং জাতির জ্বলন্ত নিশান। সমগ্র জাতি মহাশক্তির এই জ্বলন্ত নিশান দেখতে সম্ভবপর সব কিছু করতে প্রস্তুত। ভারতীয় জনতার ধর্ম বিশ্বাসের এই মহাশক্তি শুধুমাত্র পাকিস্তানী আগ্রাসনকে উপড়েই ফেলবে না, শুধুমাত্র আমাদের জাতীয় সীমান্তই রক্ষা করবে না, চিরতরে পাকিস্তানের একনায়কতন্ত্রের সকল যুদ্ধ সরঞ্জামকে দুমড়ে মুচড়ে দিবে যা বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে চূর্ণ করতে চেয়েছিল।

আধ মরা সাপ অত্যন্ত ভয়ংকর। সাপকে মারতে হবে এবং চিরতরে শেষ করতে হবে, আমরা চাই ইয়াহিয়া খানের সাপকে চিরতরে শেষ করতে।

আমি এই পর্যবেক্ষণে আমার বক্তব্য শেষ করতে চাই যে, এই গুরুতর মুহূর্তে আমাদের নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস এর স্বাধীনতা সংগ্রাম কালীন নেয়া অঙ্গীকার অনুসরণ করা উচিৎ। তিনি সেই সময়ে মুক্তি সেনাদের জন্য ৩ টি প্রাথমিক মন্ত্র বা ভিত্তি প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি একতা, ভরসা এবং বিসর্জন এই শব্দগুলো ব্যবহার করেছিলেন। জনগণের একতা, আমাদের সর্বোচ্চ মূল্যবোধের উপর ভরসা এবং এই দুটি লক্ষ্য পুরনের জন্য সর্বোচ্চ বিসর্জন।

ইতিমধ্যে বক্তব্য দেয়া আমার বাকি বন্ধুগণ প্রস্তাব রেখেছেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে সারা বিশ্বকে অবশ্যই জানানো উচিৎ যে, আমরা ভারতীয় জনগণ স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য আমাদের সবকিছু ঝুকির মুখে রাখতেও প্রস্তুত।

শ্রী ইব্রাহীম সুলাইমান সাইত ( কোঝিকোডে )— মাননীয় স্পীকার, আমি এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আমাদের পবিত্র দেশের উপর পাকিস্তানের অপ্ররোচিত নগ্ন হামলার তীব্র নিন্দা জানাই। আমি আরও আমার মাতৃভূমির রাষ্ট্রপতির জরুরী ঘোষণার পক্ষে সমর্থন জানাই।

আজকে দেশ ইতিহাসের অন্যতম সংকটপূর্ণ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আজকের এই সংকট মুহূর্তে দেশ এবং দেশের বাইরের সবার বোঝার সুবিধার জন্য আমি পরিস্কার করে বলতে চাই, এই দেশের ৮ কোটি সক্ষম যোদ্ধা মাতৃভুমির নিরাপত্তা, সম্মান এবং অখণ্ডতা রক্ষার জন্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ এবং প্রয়োজনে জীবন দিতেও প্রস্তুত আছে।

জনাব, অতীতে আমাদের দেশ বিভিন্ন সংগ্রামে রক্তের সাগর পার করেছে। আজকে একই পরিস্তিতিতে, সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদে এই সংগ্রামও আমরা সফলতার সাথে পার করতে পারবো।

আমি এইসব কোন পক্ষের ভয়ে ভীত হয়ে বলছি না বা কারও পক্ষপাতিত্ব করতেও বলছি না। কিন্তু দেশপ্রেম, দেশের নিরাপত্তা এবং দেশের সাহসী সেনার উপর ভরসা থেকে বলছি। সেকারণে, সংসদে আমার সম্মানিত সহকর্মী জন সংঘ দলের নেতা শ্রী বাজপেয়ীর সাথে একমত হয়ে বলতে চাই, আজকে আমাদের কোন দলীয় পার্থক্য নেই। আজকে আমাদের একটাই দল, ভারতীয় দল এবং একজনই নেতা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী।

আমার দল ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লীগ এর পক্ষ থেকে আমি আমার দেশ, সরকার এবং জনতার উপর পূর্ণ সমর্থন জানাই। আমি আরও আমাদের যুদ্ধরত সেনাদের শুভ কামনা জানাই।

শ্রী এস.এ.শামীম ( শ্রীনগর ) — স্পীকার মহোদয়, এই সংসদ এবং এই দেশ গত ২৫ বছরে খুব নাজুক ও ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। কিন্তু আজকের মুহূর্ত সম্ভবত এ দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশী নাজুক এবং সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এর আগে আমরা যুদ্ধ করেছি নিজ দেশ রক্ষার জন্য, নিজেদের নিরাপত্তার জন্য, কিন্তু আজকের যুদ্ধের তাৎপর্য ভিন্নতর। আজ আমরা শুধু নিজ দেশ রক্ষার জন্যই লড়াই করছি না, আমরা বাংলাদেশের জন্যও লড়ছি। আমরা শুধু নিজ দেশের স্বাধীনতা রক্ষার লড়াই করছি না, বরং পশ্চিম পাকিস্তানের পরাধীন জনগণের স্বাধীনতার লড়াইও লড়ছি। বিশ্বাস করুন এ যুদ্ধে শুধু ভারতের ৫৫ কোটি লোকই নয়, বরং সমগ্র বিশ্বমানব এবং বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানের উৎপীড়িত জনতাও আপনাদের সঙ্গে রয়েছে যারা বিগত ২৫ বছর ধরে ইয়াহিয়া খান ও আইয়ুব খানের মিলিটারী শোষণ যন্ত্রে নিষ্পেষিত হচ্ছে।

সুতরাং আমি মনে করি, আজকের যুদ্ধ শুধু সীমান্ত রক্ষার যুদ্ধ নয়। আজকের যুদ্ধ মহাত্মা গান্ধী, জওয়াহেরলাল নেহেরু এবং মারটিন লুথার কিং প্রমুখেরা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন সেসব স্বপ্ন প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। এই যুদ্ধের সীমারেখা ফাজেলকায় শেষ হয় না, কাশ্মীরে শেষ হয় না এর সীমারেখা আপনি ভিয়েতনামের সঙ্গে মিলিত দেখতে পাবেন। রোডেশিয়ার জনগণের যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধের মধ্যে গভীর পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে। সুতরাং আমি আশা করি, দেশের জনগণ এ যুদ্ধের গুরুত্ব বুঝবে।

সংসদের সামনে আমি এই বিশেষ দিক থেকে বলতে চাই যে, দেশের সেই রাজ্যের সঙ্গে আমার সম্পর্ক যার ওপর পাকিস্তানের লোলুপ দৃষ্টি বিগত ২৫ বছর ধরে লেগে আছে। আমি এই সংসদকে, এই দেশকে এবং সমগ্র বিশ্বের মানুষকে যারা, যেকোনো স্থান থেকেই হোক না কেন, অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে – প্রত্যায়িত করতে চাই যে, যেভাবে কাশ্মীরের জনগণ অতীতে পাকিস্তানী আক্রমণের এবং পাকিস্তানী হীন ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করেছে, এই গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক যুদ্ধে কাশ্মীরের বাহাদুর ও দুর্ধর্ষ জনগণ শুধু পাকিস্তান সামরিক জান্তাকেই নয় বরং পাকিস্তানের আদর্শকেও টলিয়ে দেবে।

মাননীয় স্পীকার — আরও অনেক সম্মানিত সংসদ সদস্যগণ তাদের বক্তব্য পেশ করতে আগ্রহী। আমি তাদেরকে ১ থেকে ২ মিনিতের মধ্যে তাদের বক্তব্য শেষ করার অনুরোধ করছি। এই বিষয়ে ইতিমধ্যে প্রচুর বক্তব্য রাখা হয়েছে।

শ্রী ত্রিদিব চৌধুরী ( বেরহামপুর ) — মাননীয় স্পীকার, আজকে সভায় জরুরী অবস্থা ঘোষণার এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত এবং আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ প্রতিহত করার সংকল্পের সর্বসম্মত সমর্থনের সাথে আমি একমত।

এই মুহূর্ত কথার নয় কাজের। তাই আমি এই সভায় লম্বা বক্তব্য রাখতে চাই না। কিন্তু আজকে আমি আমার কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হবো যদিনা, আমি সরকার এবং নেতৃবৃন্দের প্রতি কোন সতর্কবাণী না উচ্চারণ করি। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, এই যুদ্ধ শুধু ভারতের নিরাপত্তা এবং অখণ্ডতা রক্ষার যুদ্ধ নয়, এই যুদ্ধ অনেকটা সে কারণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে। আমরা ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের দ্বারপ্রান্তে দাড়িয়ে। বিশ্ব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানে অস্বীকার করেছে। বিশ্ব বাংলাদেশের প্রাথমিক সমস্যা বিষয়ে কর্ণপাত করা থেকে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। আমাদের অনুধাবন করতে হবে যে, বিশ্ব বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া বিস্ফোরণের কারণে ভারত যে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে তা সম্পর্কে দেখতে ও জানতে ব্যর্থ হয়েছে। এই জন্য শুধুমাত্র ভারতের দ্বারাই স্বীকৃতি নয়, একই সময়ে বিশ্বকে জানাতে হবে এটা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার যুদ্ধ নয়। তাদেরকে অবশ্যই পরিস্কারভাবে জানাতে হবে এটা অন্য যুদ্ধ, বাংলাদেশের জনগণের যুদ্ধ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক সরকারের যুদ্ধ। এবং এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত অবশ্যই ভারতের অধিকার আছে বাংলাদেশের জনগণকে যুদ্ধ জয়ে সাহায্য করার।

এরই সাথে আমি আবারও জরুরী অবস্থা ঘোষণার সমর্থন জানাই।

ডঃ কারনি সিং ( বিকানের ) — পাকিস্তান আমাদের জাতির সামনে বিশাল হুমকি জাহির করেছে। এখন প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকের সামনে সময় এসেছে কোমর বেঁধে শুধু পাকিস্তান ও শত্রুর সামনে নয়, সমগ্র বিশ্বের সামনে ঐক্যের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরার। পাকিস্তান এই যুদ্ধ ত্বরান্বিত করেছে, আমার এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই শীঘ্রই বাংলাদেশ স্বীকৃতি পাবে এবং পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে, এবং আমি আশা করি নিজস্ব এই আগ্রাসনের কারণে সৃষ্ট ধ্বংসস্তূপ থেকে পাকিস্তান এই অঞ্চলের দুর্বল গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে উদিত হবে যেখানে ভারত অগ্রগামী ভুমিকায় থাকতে পারবে।

আমি বলতে চাই, আমাদের অসংখ্য অল্পবয়সী সংসদ সদস্যগণ নিজেদের সামর্থ্যের শেষ বিন্দু দিয়ে হলেও দেশের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত হতে চায়। আমার ৩০ বছর আগের বিশ্ব যুদ্ধে বিমান বাহিনীতে যোগদান করার স্বপ্ন ছিল, এবং আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে ভারতীয় বিমান বাহিনীতে যোগদান করে সেবা প্রদানের অঙ্গীকার করছি।

আমি লক্ষ্য করেছি সংসদের বিভিন্ন দলের সম্মানিত সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়েছেন। আমরা স্বতন্ত্র সদস্যরাও একই ভাবে সমর্থন জানাচ্ছি। এবং আমি আশা করছি জরুরী সময়ে প্রধানমন্ত্রী তার বিজ্ঞতার বিচারে জাতীয় সরকার কাঠামো গঠনের বিবেচনা করবেন।

আমাকে বক্তব্য দেবার সময়ের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। আমি শুধুমাত্র এটুকু বলতে চাই যে, আমার সম্মানিত বন্ধু জনাব শামীম এবং অন্যান্য মুসলিম বন্ধুগণ বিশ্বকে নিশ্চিত করেছে যে ভারত ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ, যা একসময় মহান মহাত্মা গান্ধী এবং জওয়াহেরলাল নেহেরু বলতেন। তারা প্রমাণ করেছেন ভারত প্রকৃতপক্ষেই ধর্ম নিরপেক্ষ জাতি।

শ্রী ভি.কে. কৃষ্ণ মেনন ( ত্রিভেন্দ্রুম ) — এই সভায় সর্ব সম্মতভাবে যে অনুভূতির প্রকাশ পেয়েছে তা শুধু পাকিস্তানের প্রতি ঘোষণাই নয়, পুরো বিশ্ব, বিশেষ করে বিশ্বের সেসব অংশের জন্য যাদের অস্ত্র সর্বদা আমাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা হয়। এই অভিব্যক্তিগুলো জাতির অনুভূতি থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছে। যদি প্রধানমন্ত্রী কখনও এর প্রমাণ চাইতেন তবে আজ তা তিনি তাদের মুখ থেকেই পেয়েছেন যারা পেশাদারিত্ব থেকে নয় বরং তাদের কাজের অংশ হিসেবেই তার সমালোচনা করে থাকে।
বেলা ১২ ঘটিকা

এই মুহূর্তে ১ থেকে ২ টি ব্যাপারে আমি আলোচনা করতে চাই। আমি বলছি না এই বিষয়ে আমার কথাই শেষ কথা। কাশ্মীরে যুদ্ধ বিরতি এখন আর কার্যকর নয়। আগ্রাসনের ফলে এই যুদ্ধবিরতি অঙ্গীকার অকার্যকর হয়েছে। জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণ দলের সদস্যদের বহির্গমন অনুমতিপত্র বিষয়ক সিদ্ধান্ত সরকারকে নিতে হবে। কারণ যুদ্ধ বিরতি পর্যবেক্ষণ করা এখন তাদের উদ্দেশ্য নয় বরং পর্যবেক্ষণ করা আমাদেরকে প্রতিহত করা শক্তির মিত্রদের। উপরন্ত, এই পর্যবেক্ষকগণ জেকন সময় মারা যেতে পারেন। তাই আমাদের মহান দায়িত্ব থেকে আমরা তাদের কে ফেরত পাঠিয়ে দিতে পারি বা আমাদের অতিথিশালায় রাখতে পারি, কারণ এ ব্যপারে বিশাল আন্তর্জাতিক দায়িত্ব রয়েছে। একজন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকের জীবন এমন আবেগী পরিবর্তন আনতে পারে যে জাতিসংঘের কাছে অন্য কিছুর মূল্য থাকবে না।

দ্বিতীয়ত, আমার শ্রবণ শক্তি এখনও প্রখর এবং আমি শুনেছি প্রধানমন্ত্রী বলেছেন পাকিস্তান আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। আমি আমি তার বক্তব্যের সথিকতা যাচাইয়ের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। কারণ, যদি পাকিস্তান আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সেটা এক বিষয়। কিন্তু যদি পাকিস্তান বলে থাকে তারা যুদ্ধাবস্থা ঘোষণা করেছে তবে তা ভিন্ন বিষয়। যুদ্ধাবস্থা ঘোষণা পাকিস্তান কেবল নিজ দেশে করতে পারে এবং তথাপি তা অঘোষিত যুদ্ধ। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা জড়িত, যুদ্ধ বিদ্যমান। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের রাষ্ট্র দূতকে বহির্গমনের অনুমতিপত্র দেয়া উচিৎ, যা বাংলাদেশের স্বীকৃতি দানের পথের সকল বাধা দূর করবে। এই প্রসঙ্গে বলতে হয়, আমাদের কাছে পাকিস্তান আর এখন স্বীকৃত রাষ্ট্র নয়। অবশ্যই যদি তারা যুদ্ধ ঘোষণা করে তবে এর একটা শেষ আছে। এবং এই বিষয়ে আমাদের মাঝে কোন বাধা নাই। কিন্তু এই বিষয়টা পরিষ্কার করতে হবে, কারণ প্রধানমন্ত্রী তার বিশেষ অবস্থানে থেকে যদি সংসদে বলেন যে পাকিস্তান আমাদের বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে তবে আন্তর্জাতিক অভিমত অনুসারে এটাকে বাড়িয়ে বলা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হবে। এটা অবশ্যই বাড়িয়ে বলা হয় নি কিন্তু এই ব্যাপারে আমাদের নিজেদেরকে কোন ঝামেলায় জড়ানো উচিৎ হবে না। এটা যদি ঘোষিত যুদ্ধ না হয় তবে অঘোষিত যুদ্ধ যা স্বতপ্রনোদিত যুদ্ধ নামে পরিচিত। স্বতপ্রনোদিত যুদ্ধ সবচেয়ে কলুষিত। এই পদ্ধতিতে কাকে আঘাত করা হবে এবং কোথায় আঘাত করা হবে তা অবশ্যই সরকারের সিদ্ধান্ত, জেনারেল এর না। যুদ্ধের মত গুরুতর বিষয় জেনারেলদের হাতেই ন্যস্ত থাকা উচিৎ। তাই এই বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই যে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী যদি অন্য কোন কাজে নিয়োজিত না থেকে থাকে তবে, তিনি এ বিষয় নিশ্চিত করবেন যাতে যুদ্ধে কাকে এবং কোথায় আঘাত করা হবে তা যেন শুধু জেনারেল কতৃক নির্ধারিত হবে।

আমি আশা করি, আজ, কাল কিংবা যেকোনো সময় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হবেই এবং তা হবে পাকিস্তানের প্রতি যথার্থ জবাব। যা কিনা আমাদের প্রাণঘাতী আঘাতের মতই শক্তিশালী।

আমি এই বলে শেষ করতে চাই যে, এটি একটি শোচনীয় অধ্যায়। যুদ্ধ একটি ভয়ংকর ব্যাপার, বিশেষ করে আমাদের মত বিশাল জনসংখ্যার জন্য যাদের আশ্রয়ের এবং এ জাতীয় প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব রয়েছে, এবং সেই জাতির জন্য যারা নিজের মাটিতে ওয়ান্ডিওয়াশ লড়াইয়ের পর কোন যুদ্ধ দেখেনি। এই বিষয়ে বলতে হবে, আমাদের জনগণ এবং পেশাদার সেনাবাহিনী গৌরবের সাথে অনেক যুদ্ধক্ষেত্রে লড়েছে, কিন্তু নিজেদের মাটিতে আমরা যুদ্ধ দেখিনি। যুদ্ধ একটি ভয়ংকর ব্যাপার যেখানে অন্ধকারাচ্ছন্ন ও বোমা বর্ষণের ও বিভিন্ন বিষয়ের ভয় থাকে। এই ভয়ংকর সময়ে কে কত বেশী চরমপন্থি বক্তব্য দিতে পারে তার প্রতিযোগিতা হতে পারে। আমি প্রধানমন্ত্রীকে নিশ্চিত করে বলতে পারি যে আমি একটি দলের প্রতিনিধিত্ব করি এটা ছাড়া আর কোন পার্থক্য আমাদের নেই, আমরা সকলে এক জাতি।

ষোড়শ শতাব্দীতে স্পেন এর ফিলিপ ব্রিটেন দখলের সময় ভেবেছিলেন স্কটল্যান্ড এর মেরী কুইন তাকে সাহায্য করবে, যেহেতু তিনি ক্যাথলিকদের নিষ্পন্ন করেছিলেন। কিন্তু এটা একই ব্যাপার যা আপনি মুসলিম লীগের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে শুনেছেন। আমরা একটি দেশ এবং একটি জাতি এবং আমার বলতে কোন দ্বিধা নেই আজকে আমরা ব্যক্তিগত আদর্শ নির্বিশেষে একক নেতৃত্তের অধীনে। আমি মনে করি না তিনি এদেশে সমাজতন্ত্রবাদ ফিরিয়ে আনবেন। আমি খুব অকপটে এই কথা বলতে চাই কারণ আপনি অবশ্যই একটি গর্তে ঝাঁপ দিয়ে তারপর লফ দিতে পারবেন না। কিন্তু এটা ভিন্ন ব্যাপার যা আমরা পরবর্তীতে বিবেচনা করবো। এই জাতি টিকে থাকলে সমাজতন্ত্র বা কোন তন্ত্রই কাজ করবে না। এই জাতির টিকে থাকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

যুদ্ধের বিষয়ে আসা যাক, এই দেশ যুদ্ধকে প্রতিহত করতে চেয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধবিরতির সময় দুর্ভাগ্যবশত অন্য দেশের কারণে যদি আমাদের সম্মুখ যুদ্ধের সেনাদের সংকটপূর্ণ আবস্থার মুখোমুখি হতে হয়, যখন সেই অন্য দেশ আমাদের সীমান্ত লঙ্ঘন সহ এই ধরণের অপরাধ ঘটায় তখন ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তাই যদিও আমরা শান্তিতে বিশ্বাস করি কিন্তু আমাদের পরিস্থিতি প্রাক্তন আমেরিকান রাষ্ট্রপতির মত, যিনি বলেছিলেন, ” আমি যেকোনো মূল্যে শান্তি কামনা করি এবং বর্তমানে শান্তির মূল্য যুদ্ধ। ” কিন্তু বর্তমানের এই বিষয়ে আমাদের কোন সিদ্ধান্ত নিতে হয় নি, শত্রুই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। তারা আমাদের বিমান ঘাটিতে বোমা বর্ষণ করে আমাদের সেনাদের অকেজো করে দিতে চেয়েছে। এবং আমার কোন সন্দেহ নেই এই ব্যাপারে যে এই যুদ্ধে পাকিস্তানের সাধারণ জনতার সাথে আমাদের কোন শত্রুতা নেই এবং আমরা নাজিদের মত তাদের সীমানা লঙ্ঘন করে তাদের নিরীহ লোকদের হত্যা করে তাদের দেশ দখলের চেষ্টা করবো না, যেমনটা শ্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত তার বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন। শুধুমাত্র চরম পরিস্থিতিতে সামরিক বাহিনীর বোমা বর্ষণে সাধারণ জনগণের সমস্যা হতে পারে। কিন্তু আমরা নাপাম বোম নামের প্রাণঘাতী বোমার ব্যবহার করবো না যা অল্পবয়সীদের পঙ্গু করে দেয়। আমি জানি শত্রুকে কখনোই গুড়িয়ে দেয়া যাবে না, একবার গুড়িয়ে দিলে আমার পুনর্গঠিত হতে পারবে, কিন্তু আমাদের সেইসব বিষ দাঁত ভেঙে দিতে হবে যা আমাদের কামড়ে দিতে চেয়েছিল।

জরুরী অবস্থা ঘোষণা বিষয়ে আমি একটি কথা বলতে চাই। এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই যে বিভিন্ন আইনি কারণে জরুরী অবস্থা ঘোষণা আবশ্যক ছিল। অন্যথায়, সরকারকে অনেক বিলম্ব ও অসংলগ্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হত। যদিও তারা কর্মকর্তাদের পরবর্তীতে ক্ষতিপূরণ দিতে পারবে। কিন্তু আমি নিশ্চিত প্রধানমন্ত্রী সেই মহান সম্রাটের প্রবাদ তার বিবেচনায় আনবেন, যাতে বলা হয়েছে মহান সম্রাট ও ছোট বুদ্ধি এক সাথে যায় এবং উদারতা সর্বদাই নুন্যতম পুণ্য। আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। শুধুমাত্র বিরোধী দল না সংসদের সকল সদস্যকেই একসাথে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। আমি জাতীয় সরকারের কথা বলছি না কারণ সরকার জাতীয়ভাবে নির্বাচিত। যখন দীর্ঘ যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে তখন সরকারের খেয়াল রাখতে হবে যেন আমরা নিজেদের মধ্যে কোন ঝামেলায় না জড়িয়ে যাই।

সবশেষে, আমি আশা করি প্রধানমন্ত্রী সংসদ অধিবেশন বন্ধ করবেন না। অনেকেরই ধারণা সংসদ হচ্ছে একটি বিলাসিতা যা আমরা সহ্য করি। আসলে এটা তা নয়। সংসদ একটি অপরিহার্য স্থাপত্য। মাঝে মাঝে সংসদ নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে তাই সংসদ কার্যক্রম অবশ্যই চালু রাখতে হবে। যখন লন্ডনে বোমা বর্ষণ করা হচ্ছিল তখন বৃটিশ সংসদ অধিবেশন মাঝ রাতে অনুষ্ঠিত হত এবং বাস্তবিকপক্ষে, ২ টি বোমা সংসদে আঘাত করেছিল যখন তাদের অধবেশন চলছিল। এই বিষয়টা হিটলারকে ভাবিয়ে তুলেছিল যে বোমা বর্ষণের সময়ও তারা স্থান ত্যাগ করছে না। আমাদের জনগণও একই ধরণের। আমরা দেশ প্রতিরক্ষায় অত্যন্ত আবেগী। যখন আমরা মহান সম্রাটকে তার ভিত্তি থেকে নড়িয়ে দিতে পারি, তখন আমরা আক্রমণকারীর সমর্থক মহান সম্রাজ্যকেও নাড়িয়ে দিতে পারবো। আমাদের বিশ্বকে সতর্ক করে দেয়া উচিৎ যে, ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণকারীকে সাহায্য করা ভারতকে আক্রমণ করার শামিল।

শ্রী এম. সত্যনারায়ণ রাও ( করিমনগর )— মাননীয় স্পীকার, এই মুহূর্তে বক্তব্য দেয়া নয় কাজ করা প্রয়োজন। আমাদেরকে বিসর্জন দিতে হবে। তেলানাঙ্গা প্রজা সমিতির পক্ষ থেকে আমি প্রধানমন্ত্রীকে নিশ্চিত করতে চাই যে সমগ্র জাতি তার সাথে রয়েছে। আসুন আমরা আমাদের ক্ষুদ্র সমস্যাগুলো ভুলে যাই। এখন আমাদের সামনে একটাই সমস্যা, আগত আক্রমণকারীকে কিভাবে এ দেশ থেকে নির্গত করা যাবে তার উপায় বের করা।

আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করবো যাতে আমাদের কম বয়সী সংসদ সদস্যদের উপর কিছু দায়িত্ব অর্পণ করতে। আমরা জানি আমাদের সৈনিকরা শুধু যুদ্ধ করছে না, তারা প্রয়োজনে জীবন দিচ্ছে। আমাদের উচিৎ যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে কিছু করা। অন্ততপক্ষে আমাদের সৈনিকদের মাঝে আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করা উচিৎ, যাতে তারা বুঝতে পারে সমগ্র দেশ তাদের সাথে আছে এবং আমরাও কিছু করার চেষ্টা করছি। আমি আশা করি প্রধানমন্ত্রী এই সমস্যার সমাধান করবেন।

শ্রী বিরেন্দর সিং রাও ( মহেন্দ্রগড় ) — জনাব, বিশাল হারিয়ানা পার্টির পক্ষ থেকে আমি এই সভায় পেশ করা সকল ভাবানুভুতির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করছি। আমি নিজে একজন সাবেক সৈন্য হিসেবে গর্ব বোধ করছি। এবং আমি একজন বৃদ্ধ সৈনিক নই, বরং আজকে আমি নিজেকে অনেক কম বয়সী হিসেবে উপলব্ধি করছি। আমি প্রধান্মন্ত্রিকে নিশ্চিত করতে চাই যে, আমাদের লক্ষাধিক সাবেক সৈন্য ও সেনা কর্মকর্তা তাকে সমর্থন জানাচ্ছে। আমরা সবাই আমাদের দেশ রক্ষায় কথিন্তর দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত আছি। আমি নিশ্চিত ভারত অবশ্যই জয়ী হবে কারণ আমরা ন্যায়ের পক্ষে। আমি নিশ্চিত, এই বিংশ শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে যেসব রাষ্ট্র নিজেদের মানবতার রক্ষক হিসেবে দাবী করছে তারা সবাই মানবতাকে হার মানিয়েছে। স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র ও মানবতার যথার্থ রক্ষক হিসেবে বিশ্ব দুয়ারে ভারতের উত্থান ঘটবে।

জনাব, আপনি মাননীয় স্পীকারের আসনে আসীন থাকা অবস্থায় আপনার পক্ষ হয়ে আমি কিছু কথা বলতে চাই।

মাননীয় স্পীকার — আপনি ইতিমধ্যে সাবেক সৈন্য হিসেবে আমার পক্ষে বলে ফেলেছেন।

শ্রী বিরেন্দর সিং রাও — গত রাতে আপনার জেলায় বোমা বর্ষণ করা হয়েছে। আমাদের পাঞ্জাব ও রাজস্থানের সীমান্তবর্তী এলাকার জনতা পশ্চিম বঙ্গ এবং আসামের মতই সাহসের পরিচয় দিয়েছে। আজ সকালে অমৃতসারে কিছু বন্ধুর সাথে ফোনে কথা হয় এবং তাদের সন্তানদের দিল্লী পাঠানোর অনুরোধ করি যাতে তারা নিরাপদ থাকে এবং আমরা পাকিস্তানকে দীর্ঘ মেয়াদী উচিৎ শিক্ষা দিতে পারি। কিন্তু তারা সবাই আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বলেছেন, অমৃতসার জনশূন্য করা হবে না, তারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সেখানে থাকতে চান। মাননীয় স্পীকার, আমি আপনাকে সাধুবাদ জানাই এমন জেলার প্রতিনিধিত্ব করার এবং পাঞ্জাব ও রাজস্থানের সীমান্ত এলাকার জনতা যারা অত্যন্ত সাহসী।

ডক্টর জি.এস.মেলকোটে ( হায়দ্রাবাদ ) — জনাব, আমি জরুরী অবস্থা ঘোষণার সমর্থন জানাই। আমি কি জানাতে পারি যে, আমরা আমাদের নেতৃর শাণিত কণ্ঠের আহবান শুনতে পেয়েছি? এই উপলক্ষে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের কর্মীরা এই সভায় তাদের পক্ষ থেকে এই কথা জানাতে অনুরোধ করেছে যে, বিগত ২ টি আক্রমণের সময় তারা ২৪ ঘণ্টা করে সবসময় কাজে লিপ্ত ছিল কিন্তু বিভিন্ন কল কারখানার পরিচালনা পরিষদ থেকে তাদের প্রতি পাক্ষিক দিবসের পর ১ দিনের ছুটি দেয়। তারা অভিযোগ করে এবং জানতে চায় কেন এই ছুটি দেয়া হোল। পরিচালকগণ জবাবে জানান, মানুষের ভুলের জন্য নয়, যন্ত্রপাতি ভেঙে যাওয়াতে এই ছুটির ব্যবস্থা করা হয়। এই সংকট মুহূর্তে আমি আমাদের নেতৃবৃন্দকে ভরসা দিতে চাই আমরা যুদ্ধক্ষেত্রের জওয়ানদের সাহায্যার্থে আগের চেয়েও সম্ভবপর অধিক কাজ করার জন্য প্রস্তুত রয়েছি।

এই কথার সাথে আমি জরুরী অবস্থার ঘোষণার সমর্থন জানাই।

শ্রী সুরেন্দ্র মোহান্তি ( কেন্দ্রাপারে ) — মাননীয় স্পীকার, আমি এই সংসদে উতকাল কংগ্রেস এবং ইউনাইটেড ইনডিপেন্ডেন্ট গ্রুপের প্রতিনিধিত্ব করছি। আমি প্রধানমন্ত্রী কতৃক প্রস্তাবিত জরুরী অবস্থা ঘোষণার বিষয়ে আমাদের পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছি। এই অন্তিম সময়ে আমাদের সামনে প্রশ্ন হচ্ছে যুদ্ধে জড়িত হওয়া নাকি যুদ্ধ প্রতিহত করা। যখন লড়াইয়ের আহবান করা হয়েছে তখন আমাদের অবশ্যই যোগ দিতে হবে এবং মুক্তির সংগ্রামের পবিত্র শিখায় নিজেদের উৎসর্গ করতে হবে। তবে আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আর্জি জানাচ্ছি যাতে উনি লক্ষ্য রাখেন জরুরী অবস্থার নামে মুক্ত সমাজের গুণাবলীগুলো হত্যা না করা হয়।

শেষ করার আগে আমি আমার বিজ্ঞ বন্ধু শ্রী কৃষ্ণ মেনন এর বক্তব্য র সমর্থন জানাই, উনি উল্লেখ করেছেন, সংসদ অধিবেশন যেন বন্ধ না হয়। এই অস্থির সময়ে সংসদ অধিবেশন চালু রাখা উচিৎ যাতে আমাদের দেশের আত্মবিশ্বাস ও সৎ সাহসের পরিচয় ফুটে উঠে।

শ্রী এস.এম.ব্যানারজী ( কানপুর ) — মাননীয় স্পীকার, সমগ্র ভারত প্রতিরক্ষা কর্মচারী সমিতির সভাপতি হিসেবে আমি প্রধানমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রীকে আমার পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছি। আমি আরও নিশ্চিত করছি যে ১৯৬২ এবং ১৯৬৫ সালের মত প্রতিরক্ষা কর্মচারীগণ এক সত্ত্বা হিসেবে কাজ করবে এবং পূর্বের তুলনায় অধিক বিসর্জন দিতে প্রস্তুত যাতে পাকিস্তানের এই নগ্ন আগ্রাসনকে সর্ব শক্তি দিয়ে নিরস্ত্র করা যায়। তারা সেনাবাহিনীকে সম্মুখ যুদ্ধে এবং পেছন থেকে সব কিছুর প্রস্তুতিতে এবং এই কঠোর সময়ে সরকারকে সাহায্য করবে।

মাননীয় স্পীকার — প্রস্তাবিত বিষয় হচ্ছে,

“রাষ্ট্রপতি কতৃক ৩রা ডিসেম্বর, ১৯৭১ এ স্বাক্ষরিত সংবিধানের ৩৫২ নং ধারা অনুযায়ী জরুরী অবস্থা ঘোষণাকে সংসদে মঞ্জুর করা হোল। ”
প্রস্তাব গ্রহণ করা হল

মাননীয় স্পীকার — বিশ্লেষণটি সর্বজন স্বীকৃত হয়েছে। এই অন্তিম মুহূর্তে এই সভা যেভাবে ঐক্যের পরিচয় দিয়েছে এবং কঠোর সংকল্পের প্রদর্শন করেছে, আমি এই সংসদের স্পীকার হিসেবে গর্ব বোধ করছি। আমরা সবাই প্রার্থনা করি যাতে জাতি একক নেতৃত্তে এক সংকল্পে একতাবদ্ধ থাকতে পারে। সৃষ্টিকর্তা আমাদের সহায় হোন।

———-

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৩০। পাকিস্তানের আক্রমণের পর যুদ্ধ পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বিবৃতি ভারতের লোকসভায় কার্যবিবরণী ৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১

Fahmida Bristy
<১২, ২৩০, ৯২১-৯২২>
অনুবাদ

বিকাল ৫টা ৪০ মিনিট
পরিস্থিতি প্রসঙ্গে বিবৃতি
প্রসঙ্গঃ ভারতের উপর পাকিস্তানের আক্রমণ

প্রতিরক্ষামন্ত্রী (শ্রী জগজীবন রাম): আপনারা অবগত আছেন যে পাকিস্তান আমাদের উপর একটি যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে।

পাকিস্তান বিমানবাহিনী বিকাল পাঁচটা পঁয়তাল্লিশ মিনিট থেকে আমাদের বিমানঘাঁটি গুলোতে আগে বিমানহানা দিয়েছিলো। গতকাল পাকিস্তান বিমান আমাদের বারোটি বিমানঘাঁটিতে হানা দিয়েছে, এগুলো হলো: অমৃতসার, পাঠানকোট, শ্রীনগর, ফরিদজোট, হালওয়ারা, আম্বালা, আগ্রা, উত্তরলাই, যোধপুর, জামনগর, সার্ষা, এবং সারশাওয়া। গোদ্রা রোড, জাম্মু এবং বারমারের রেলওয়ে সংযোগও আক্রমণের শিকার হয়েছিলো। আক্রমণকারী বিমানগুলোর মধ্যে চারটি বিমানকে গুলি করে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। আমাদের কিছু রানওয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো, ভূমিতে থাকা কোন বিমান আক্রান্ত হয়নি, একটি এলাকায় বসানো যন্ত্রপাতি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো। আমাদের সকল বিমানঘাঁটি পুরোপুরি প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত। পূর্ব-পরিকল্পিত অগ্রে আক্রমণের মাধ্যমে মোটারকম ক্ষয়ক্ষতি আরোপ করার পাকিস্তানী উদ্দেশ্য প্রত্যাহত করা হয়েছে।

ভারতীয় বিমানবাহিনী পাকিস্তান বিমানঘাঁটিগুলোকে প্রতিশোধমূলক আক্রমণের মাধ্যমে জবাব দিয়েছিলো। প্রথম আক্রমণ গতরাত ১১:৫০ ঘটিকায় বাস্তবায়িত করা হয়েছিলো। চান্দেরি, শেরকোট, সারগোধা, মুরিদ, মিয়ানয়ালী, মাসরুর (রাওয়ালপিন্ডির কাছে) এবং চাঙে মাঙ্গা (লাহোরের কাছে) আক্রমণের শিকার হয়েছে। দলটি ভালো ফলাফল অর্জনের কথা জানিয়ে প্রতিবেদন জানিয়েছে। তারা মাটিতে থাকা কিছুসংখ্যক পাক-বিমান আঘাত করেছিলো এবং কিছু পেট্রোল ট্যাঙ্ক জ্বালিয়ে দিয়েছিলো। সারগোধা বিমানঘাঁটিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাদীনে (কুচ) রাডার স্টেশনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একটি হান্টার, একটি এইচ এফ – ২৪ এবং একটি শুকোই ছাড়া আমাদের সকল বিমান ঘাঁটিতে ফিরে এসেছে।

গতকাল সন্ধ্যা ছয়টা থেকে পাকসেনারা পুঞ্চ, সাম্ব জুরিয়ান, অমৃতসার, ফযিলকা এবং পাঠানকোটে আমাদের অবস্থানে গোলাবর্ষণ করে যাচ্ছে। পাকিস্তান বাহিনীর স্থল আক্রমণ সকল সেক্টরেই প্রতিহত করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের বর্ডার সেইফ ফোর্সের কিছু সংখ্যক যারা রবি নদীর সম্মুখীন ছিলো, তারা পশ্চাৎপদ হয়েছে। পাকিস্তানও নদীটির আমাদের পার্শ্বে তাদের বাহিনীর একই ধরণের অপসরণ ভোগ করেছে। পুঞ্চে আমরা পাঁচজন বন্দীকে নিয়েছি যারা ২৬ নাম্বার পদাতিক বাহিনীর। সাম্ব জুরিয়ানে পাকবাহিনী পশ্চাৎপদ হওয়ার সময় একজন মৃত এবং একজন আহত সৈনিককে রেখে যায়, দুজনেই পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ৪৩ নাম্বার পদাতিক বাহিনীর।

৪ঠা ডিসেম্বর ভোরের দিকে, আমাদের বাহিনী তিত্থালের পাঁচ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে একজন পাকিস্তানী প্রহরীকে বন্দী করেছিলো। উড়ি এবং হাজিপুরের মধ্যে একটি হিল ফিচার দখল করা হয়েছে। আমাদের বাহিনী একজন জে সি ও সহ ১৩ জন বন্দিকে আটক করেছে।

আখনুর থেকে ৩০ মাইল পশ্চিমে পাকবাহিনী অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদসহ এক বিশাল শক্তি নিয়ে কঠিন যুদ্ধে লিপ্ত। ছয়টি শত্রু ট্যাংকসহ ধ্বংস সহ, যেগুলোকে জ্বলতে দেখা গিয়েছিলো, অনেক হতাহত হয়েছে।

ফিরোজপুর সেক্টরে, পাকসেনাদলের আনুমানিক একটি ব্রিগেড আকাশ সহায়তা, অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে ফিরোজপুর ও হুসাইনিওয়ালা এলাকায় আমাদের সেনাদলের উপর আক্রমণ চালাচ্ছে। আমাদের বাহিনী শত্রুদের উপর বিশাল হতাহতের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে সকল আক্রমণ প্রতিহত করেছে। আমাদেরও হতাহত হয়েছে এবং কিছু এলাকার দখল হারিয়েছি। হুসাইনিওয়ালা ব্রীজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের বেশ কিছু পয়েন্টে গেছে এবং মুক্তিবাহিনীর সাথে একযোগে কাজ করছে। আমাদের বাহিনী মুক্তিবাহিনীর সাথে একত্রে ত্রিপুরা এবং কাচারে বিমানঘাঁটিসহ শমশেরনগর আওতায় নিয়েছে। আখাউড়ার চারপাশের এলাকাগুলোতে এখনও প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে। আমাদের বাহিনী কুমিল্লা সেক্টরের সাঁইগঞ্জ এবং মজলিশপুর দখল করেছে। ঠাকুরগাঁও, দর্শনা এবং গাজীপুর এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণে। একজন জে সি ও এবং ২৬ নাম্বার সম্মুখ শক্তি রাইফেল ব্যাটেলিয়নের একজন হাবিলদার-মেজরসহ ৪২ জন বন্দিকে ফুলবাড়িতে ধরা হয়েছে।

বাংলাদেশে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা বিমানঘাঁটিগুলোতে ভারতীয় বিমান বাহিনী আক্রমণ চালিয়েছে। এ পর্যন্ত ৮টি পাকিস্তানী স্যাবর জেট নামিয়ে দেওয়া হয়েছে, চারটি ঢাকার কাছে এবং চারটি যশোরের কাছে। আমরা ২ জন যোদ্ধাকে হারিয়েছি।

ভারতীয় নৌবাহিনীর পূর্ব এবং পশ্চিম বহর এখন শত্রুদের যুদ্ধজাহাজ খোঁজার ও ধ্বংস করার এবং পশ্চিম পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যকার উপকূলবর্তী যোগাযোগ পথ বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে আছে এবং পশ্চিম পাকিস্তান বাহিনীকে সমুদ্র সহায়তা ভোগদখলের সমর্থন দেওয়া অস্বীকার করেছে। একটি পাকিস্তানী বাণিজ্য জাহাজ আমাদের বিনাশকারীদের একজনের হাতে আজ সকালে ধরা পড়েছিলো। নৌবাহিনীর কর্মচারিবৃন্দের একটি দল জাহাজ যাত্রা করেছে যেটিকে সবচেয়ে নিকটস্থ পোতাশ্রয়ের দিকে যাওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে।

পূর্ব নৌবহরের ইউনিটগুলোও কক্সবাজারে আঘাত হেনেছে। আক্রমণটির ফলাফল হয়েছিলো বিমানঘাঁটি স্থাপনার বিধ্বস্ততা।

ভারতীয় নৌবাহিনী পাকিস্তান বন্দরসমূহের জন্য অভিপ্রেত সরবরাহের ব্যাপারে নিষিদ্ধ পণ্য নিয়ন্ত্রণ জারি করেছিলো। বাংলাদেশে পাকিস্তানের জন্য নিয়োজিত বন্দরসমূহকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

বিকাল ৫:৪৭ ঘটিকা
তখন লোকসভা সোমবার সকাল দশটা, ডিসেম্বর ৬, ১৯৭১, অগ্রহায়ন ১৫, ১৮৯৩ (সাকা) পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৩১। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি এবং তার ওপর আলোচনা
ভারতের লোকসভার কার্যবিবরণী
৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১

Tanvir Tanz Hedayet
<১২, ২৩১, ৯২৩-৯৪০>
অনুবাদ

বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান সংক্রান্ত বিবৃতি

শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ( মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আণবিক শক্তি মন্ত্রী, ইলেকট্রনিক্স মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ) — ভয়ানক বিরোধীতার মুখোমুখি সাহসী সংগ্রামের ফলে বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বীরত্বের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।

পূর্বে, তারা নির্বাচনে বিশাল গণতান্ত্রিক জয় নিশ্চিত করে এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতিও শেখ মুজিবুর রহমানের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার ন্যায়সঙ্গত দাবী মেনে নেয়। আমরা কখনোই জানবো না যে যদি এই সদাশয় আচরণ এবং বাস্তব পদক্ষেপ সত্যি হয়ে থাকে তবে কিসের হস্তক্ষেপে তা বিশ্বাসঘাতকতা ও ঘৃণায় রূপান্তর হয়।

আমাদেরকে বলা হয়েছিল, শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার দল আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারের বিরুদ্ধে অহিংস প্রতিরোধ আন্দোলনের পরিকল্পনা করে। কিন্তু তাদেরকে অনবগত অবস্থায় পাশবিক সামরিক হামলার শিকার হতে হয়। স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া ছাড়া তাদের আর কোন বিকল্প ছিল না। পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট মিলে মুক্তি ফৌজ গঠন হয় যা পরবর্তীতে মুক্তি বাহিনী নাম দেয়া হয় এবং নিজেদের ভবিষ্যত রচনা এবং দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতে দৃঢ়বদ্ধ সহস্রাধিক পূর্ব বঙ্গের যুবক এই মুক্তি বাহিনীতে যোগদান করেন। যেই একতা, দৃঢ়তা, এবং সাহসিকতার সাথে সমগ্র বাংলাদেশের জনগণ এই স্বাধীনতার সংগ্রাম করছে তা বিশ্ব সংবাদ মাধ্যমগুলোতে নথিভুক্ত করা হয়েছে।

আমাদের সামনে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনা এবং এর ফলশ্রুতিতে আমাদের সীমান্তে বাঁধ ভাঙ্গা শরণার্থীদের আগমন আমাদের দেশের ওপর এর চেয়ে বেশী সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে না। এটা অবশ্যই স্বাভাবিক ব্যাপার যে বাংলাদেশের জনগণের সাম্প্রতিক সংগ্রামে আমাদের সহানুভূতি থাকবে। কিন্তু আমরা বাংলাদেশের স্বীকৃতির ব্যাপারে কোন হঠকারী পদক্ষেপ নেই নি। আমাদের সিদ্ধান্ত কোন আবেগ বশত ছিল না বরং প্রাদুর্ভূত ভবিষ্যৎ বাস্তবতার মূল্যায়ন থেকে নেয়া।

বাংলাদেশের সমগ্র জনগণের সর্বসম্মত বিদ্রোহ এবং সংগ্রামের সাফল্য থেকে এটা প্রকট হয়ে উঠেছে যে, তথাকথিত পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশের জনগণকে এর শাসনের অধীনে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে অক্ষম। আর বাংলাদেশের সরকারের বৈধতা বিষয়ে এ মুহূর্তে সারা বিশ্বই অবগত যে এটা বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতামতের প্রতিফলন যা আগের কোন সরকারের সময়ে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হিসেবে প্রকাশ পায়নি। এই মানদণ্ডে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা অনেক রাজ্যেই তাদের শোষণ চাপিয়ে দিতে উদ্বিগ্ন হলেও পশ্চিম পাকিস্তানে নিজেদের লোকদেরই প্রতিনিধিত্ব করার সমর্থন পায়নি।

এমতাবস্থায় যখন পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন আমাদের পক্ষ থেকে স্বাভাবিক সংশয় কাজ করছে যাতে আমরা এমন কিছু না করি যাতে শান্তিপূর্ণ অবস্থার ব্যতিক্রম ঘটায় অথবা, এমন কোন মধ্যবর্তী অবস্থার ব্যাখ্যা করে যা বর্তমান অবস্থায় তাৎপর্যহীন। বাংলাদেশের জনগণ তাদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই করছে আর ভারতের জনগণ লড়াই করছে আগ্রাসনের পতন ঘটাতে, এবং উভয়ই বর্তমানে নিজেদের একই পথের সহযাত্রী হিসেবে খুঁজে পেয়েছে।

বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে এবং বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধের প্রেক্ষিতে আমি এই সভায় এটা জানাতে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত যে, কঠোর বিবেচনার পর ভারত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এর স্বীকৃতি দানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

আমরা আশা করি সময়ের সাথে সাথে অন্যান্য জাতিও স্বীকৃতি প্রদান করবে এবং অচিরেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন জাতীয়তার একটি অংশ হয়ে উঠবে।

এই মুহূর্তে এই নতুন রাষ্ট্রের জনক শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আমাদের পূর্ণ সমবেদনা ও সমর্থন রয়েছে। আমি নিশ্চিত এই সভার সকলেই বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী এবং তাদের সকল সহকর্মীকে আমাদের তরফ থেকে শুভেচ্ছা ও উষ্ণ সংবর্ধনা জানাবে।

আমি বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে পাওয়া যোগাযোগ পত্রের অনুলিপি এই সভার সামনে উপস্থাপন করছি। মাননীয় সংসদ সদস্যগণ জেনে খুশী হবেন যে, বাংলাদেশ সরকার তাদের রাষ্ট্রের মূল নীতি ঘোষণা করেছেন। এবং রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং এমন একটি সমাজ ব্যবস্থা যেখানে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার থাকবে। বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার উপনিবেশবাদ, স্বজাতিকতা এবং সাম্রাজ্যবাদের সাথে জোট নিরপেক্ষভাবে শান্তিপূর্ণ সহবস্থানের নীতি অনুসরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা ভারতও অনুসরণ করে।

বাংলাদেশ সরকার আমাদের দেশে অস্থায়ী শরণার্থীদের নিজ দেশে ফিরিয়ে আনা এবং তাদের জমি এবং সম্পত্তির পুনর্বাসনের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আমরা স্বাভাবিকভাবে এই ব্যাপারে সম্ভাব্য সকল উপায়ে তাদের সহায়তা করবো।

আমি বিশ্বাস করি ভবিষ্যতে ভারত ও বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ যারা একই আদর্শ ও উৎসর্গে বিশ্বাসী, এমন একটি পারস্পরিক সম্পর্ক তৈরি করবে যার মূল ভিত্তি হবে পারস্পরিক সার্বভৌমত্ব ও প্রাদেশিক অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধা, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, সমতা ও পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষা করা। এইভাবে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য একসাথে কাজ করে আমরা আদর্শ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারি যা এই অঞ্চলের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতি নিশ্চিত করবে। বাংলাদেশকে আমাদের শুভেচ্ছা।

ভারতীয় রাষ্ট্রপতি বরাবর ২৪.৪.১৯৭১ এ লিখিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের চিঠি।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
মুজিবনগর
এপ্রিল ২৪, ১৯৭১
বরাবর
ভারতীয় রাষ্ট্রপতি
নয়া দিল্লী

মহামান্য,

২৬শে মার্চ, ১৯৭১ এ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা ঘোষণার পর শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধাণ করে সরকার গঠন করা হয়।

আপনার অবগতির জন্য স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, আইনের ধারাবাহিকতা বলবতকরন এবং সংসদ সদস্যদের তালিকার একটি অনুলিপি “ক”, “খ” এবং “গ” অক্ষর দ্বারা চিহ্নিত করে এই পত্রের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সরকার ২৬ শে মার্চ, ১৯৭১ এর আগ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত অঞ্চলে পূর্ণ সার্বভৌমত্ব ঘোষণা ও আইন প্রণয়ন করেছে এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আইন অনুসারে রাষ্ট্রের সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের মধ্যকার ঐতিহ্যগত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের প্রেক্ষিতে আমি আপনার মহামান্য সরকারের কাছে বিনীত আবেদন জানাচ্ছি যাতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ সরকার ভারতের সাথে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন ও রাষ্ট্রদূত বিনিময় করে কৃতজ্ঞ থাকবে যাতে করে আমাদের দুই দেশের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হয়।

মহামান্য, দয়া করে আমাদের প্রতিশ্রুতির সর্বোচ্চ বিবেচনা করবেন।

স্বাক্ষরিত/- (সৈয়দ নজরুল ইসলাম)
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি
স্বাক্ষরিত/- (খন্দকার মোশতাক আহমেদ)
(বাংলাদেশ সরকারের সীলমোহর) পররাষ্ট্র মন্ত্রী

(ক) স্বাধীনতার ঘোষণা
মুজিবনগর, বাংলাদেশ
তারিখ – ১০ই এপ্রিল, ১৯৭১

যেহেতু, রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের জন্য প্রতিনিধি নির্বাচনের লক্ষে ৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭০ থেকে ১৭ই জানুয়ারী, ১৯৭১ পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

এবং

যেহেতু, এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত করে যারা আওয়ামী লীগের সদস্য।

এবং
যেহেতু, জেনারেল ইয়াহিয়া খান রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের উদ্দেশে ৩রা মার্চ, ১৯৭১ জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিমন্ত্রণ জানান।

এবং

যেহেতু, সংসদ অধিবেশন অন্যায় ও অবৈধভাবে অনিদৃস্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছ।

এবং

যেহেতু, বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া অবস্থায় প্রতিশ্রুতি পূর্ণ না করে পাকিস্তান কতৃপক্ষ অন্যায়ভাবে ও বিশ্বাসঘাতকতা করে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
এবং

যেহেতু, পাকিস্তান কতৃপক্ষ এই নির্মম ও হিংস্র যুদ্ধ সংগঠিত করার পর এখনও বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশের অসামরিক এবং নিরস্ত্র জনগণের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার ও গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে।

এবং

যেহেতু, পাকিস্তান সরকারের চাপিয়ে দেয়া এই অন্যায় যুদ্ধ এবং গণহত্যার এবং অন্যান্য দমনমূলক আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের পক্ষে সরকার গঠন ও শাসন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

এবং

যেহেতু, বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা এবং বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড দ্বারা নিজেদের অধিকারভুক্ত অঞ্চলের উপর কার্যকরীভাবে দখল নিয়েছে।

আমরা বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ, বাংলাদেশের জনগণের দেয়া এমন এক সম্মানে আবদ্ধ যাদের ইচ্ছায় মূলত আমরা নিজেদের সংগঠিত করেছি যাতে একটি গণপরিষদ গঠন করতে পারি,

এবং

বাংলাদেশের জনগণের জন্য সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা পারস্পরিক আলোচনা করেছি,

সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ গঠন ও সেকারণে ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কতৃক দেয়া স্বাধীনতার ঘোষণা,

এবং

এই মর্মে প্রত্যায়ন এবং সংকল্প করা হচ্ছে যে, একটি পূরনাঙ্গ সংবিধান প্রণীত হবার সময় পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি থাকবেন এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম সহকারী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন, এবং প্রজাতন্ত্রের সকল সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক থাকবেন রাষ্ট্রপতি, ক্ষমা মঞ্জুরের ক্ষমতা সহ প্রজাতন্ত্রের সকল নির্বাহী ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রাখবেন, প্রধানমন্ত্রী এবং প্রয়োজন অনুসারে অন্যান্য মন্ত্রী নিয়োগের ক্ষমতা রাখবেন,

কর প্রয়োগ এবং রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যায় সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, গণপরিষদ সংগঠন ও স্থগিত করার ক্ষমতা,

এবং

বাংলাদেশের জনগণের জন্য আইনসম্মত ও সুশৃঙ্খল সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নেয়া।

আমরা বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ আরও নিশ্চিত করছি যে, এমন কোন সময়ে যদি রাষ্ট্রপতি না থাকেন বা রাষ্ট্রপতি তার দপ্তরে প্রবেশ করতে সক্ষম না হন বা যেকোনো কারণে রাষ্ট্রপতি তার দায়িত্ব ও ক্ষমতার ব্যবহারে অক্ষম হন তবে, রাষ্ট্রপতির সকল দায়িত্ব ও ক্ষমতা সহকারী রাষ্ট্রপতির উপর বর্তাবে।

আমরা এই মর্মে আরও অঙ্গীকার করছি যে, জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী এর সদস্য দেশের উপর বর্তানো সকল দায়িত্ব ও কার্যাবলী সঠিকভাবে পালন করা হবে।

আমরা আরও সাব্যস্ত করছে যে, স্বাধীনতার ঘোষণা ২৬শে মার্চ, ১৯৭১ থেকে কার্যকর হয়েছে।

আমরা আরও সাব্যস্ত করছি যে, এই দলিল কার্যকর করতে এবং রাষ্ট্রপতি ও সহকারী রাষ্ট্রপতির শপথ গ্রহণের জন্য আমরা অধ্যাপক এম. ইয়ুসুফ আলী কে আমাদের সাংবিধানিক আইন প্রণেতা হিসেবে নিয়োগ করছি।

স্বাক্ষরিতঃ
এম. ইয়ুসুফ আলী সাংবিধানিক আইন প্রণেতা
বাংলাদেশ সংবিধান ও গণপরিষদ

(খ) আইনের ধারাবাহিকতা বলবৎকরণ আদেশ

মুজিবনগর
তারিখ – ১০ই এপ্রিল, ১৯৭১

আমি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ১০ ই এপ্রিল, ১৯৭১ এ স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র অনুযায়ী সহকারী রাষ্ট্রপতি এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বরত, এই মর্মে ঘোষণা করছি যে, ২৫শে মার্চ, ১৯৭১ এর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে কার্যত সকল আইন বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছায় গঠিত সার্বভৌম স্বাধীন বাংলাদেশের প্রয়োজন সাপেক্ষে পরিবর্তন করে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হবে। সকল সরকারী কর্মকর্তা তথা বেসামরিক, সামরিক, বিচারিক এবং কূটনৈতিক কর্মকর্তাগণ যারা বাংলাদেশের আনুগত্যের স্বপক্ষে শপথ গ্রহণ করবেন, তারা যতদিন নিজেদের দায়িত্ব উপভোগ করতে পারবেন ততদিন কর্মরত থাকবেন এই শর্তে নিজ নিজ কর্মস্থানে যোগদান করতে পারবেন। বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে সকল জেলা বিচারক এবং জেলা প্রশাসকগণ এবং অন্যত্র সকল কূটনৈতিক প্রতিনিধিগণ নিজেদের আয়ত্তের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্যের এই শপথ গ্রহণের আয়োজন করবেন।

২৬শে মার্চ, ১৯৭১ থেকে এই আদেশ কার্যকর হবে।
স্বাক্ষরিতঃ সৈয়দ নজরুল ইসলাম
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি

(গ) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

মন্ত্রী পরিষদ সদস্য —

রাষ্ট্রপতিঃ শেখ মুজিবুর রহমান
সহকারী রাষ্ট্রপতিঃ সৈয়দ নজরুল ইসলাম
প্রধানমন্ত্রীঃ জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ
পররাষ্ট্র এবং সংসদ বিষয়ক আইন মন্ত্রীঃ খন্দকার মোশতাক আহমেদ
অর্থ, বাণিজ্য এবং শিল্প বিষয়ক মন্ত্রীঃ জনাব এম. মনসুর আলী
অভ্যন্তরীণ, সরবরাহ, ত্রাণ এবং পুনর্বাসন বিষয়ক মন্ত্রীঃ জনাব এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান

———–

ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর ১৫.১০.১৯৭১ এ লিখিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের চিঠি।
( বাংলাদেশ সরকারের সীলমোহর )
মুজিবনগর
১৫ ই অক্টোবর, ১৯৭১

মাননীয়া,
ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে ২৪শে এপ্রিল, ১৯৭১ এ লেখা চিঠির ধারাবাহিকতায় এবং পরবর্তী যোগাযোগ ও ব্যক্তিগত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা এই চিঠি লিখছি। মাননীয়া, আপনি অবগত আছেন যে, ১০ ই এপ্রিল সংসদীয় সভার সদ্য নির্বাচিত জাতীয় এবং আঞ্চলিক সদস্যগণ স্বাধীনতার ঘোষণা দেন যা কিনা বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি জনতার ইচ্ছারই প্রতিফলন। একতরফা ও নিষ্ঠুর আচরণ ও জনগণের রায় কে অস্বীকার করে এবং ২৫ শে মার্চ, ১৯৭১ থেকে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী কতৃক বাংলার জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ও মৌলিক মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ করার প্রেক্ষিতে এই ঘোষণার বাস্তবায়ন হয়।

এটা সর্বজনবিদিত যে, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের জনগণ নির্মম ঔপনিবেশিক আধিপত্য, অর্থনৈতিক শোষণ এবং ধারাবাহিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন বৃত্তের স্থূল রাজনৈতিক শোষণ ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের শিকার। ২৪শে এপ্রিল, ১৯৭১ এর চিঠির মাধ্যমে আপনাকে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের অধীনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের গঠনতন্ত্রের কথা জানানো হয়েছে।

বিগত কয়েক বছর ধরে আমাদের জনগণ মৌলিক অধিকার আদায়ের দাবীতে শান্তিপূর্ণ ও অহিংস আন্দোলন চালিয়ে আসছে। এমনকি পাকিস্তান সামরিক বাহিনী কতৃক জাতীয় সংসদ স্থগিত করে দেবার পরও আমরা সহিংসতার পথে না গিয়ে আমাদের অহিংস আন্দোলন জারি রেখেছিলাম। পাকিস্তানী সামরিক শাসক এই অবস্থার সুবিধা নিয়ে ২৪শে মার্চ, ১৯৭১ এর রাত পর্যন্ত তথাকথিত আলোচনার মিথ্যা বাহানা দিয়ে নিজেদের সৈন্য বহরের শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে।

২৫ শে মার্চের কালো রাতে তাদের পরিকল্পনা পুরো বিশ্বের সামনে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে যখন পূর্ব পরিকল্পিতভাবে তারা আমাদের দেশের নিরীহ ও অসহায় নারী, পুরুষ ও শিশুদের উপর তাদের সেনা বাহিনী লেলিয়ে দেয়। তারা আমাদের বুদ্ধিজীবী, জুবক ও শ্রমিক নেতা, কৃষক ও ছাত্রদের বিশেষ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। এই পরিস্থিতি আমাদের অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য করে।

১০ই এপ্রিলের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণার পর আমাদের মুক্তির সংগ্রামে অনেক শক্তি ও গতি সঞ্চার হয়েছে। প্রাক্তন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এবং অন্যান্য আধা সামরিক বাহিনী থেকে প্রায় ৬০০০০ সদস্য বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি জনতার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে মাতৃভূমির মুক্তির লক্ষ্যে অস্ত্র হাতে নিয়েছে। এরকম আরও শত সহস্রাধিক যুবক তাদের কাছে প্রশিক্ষন গ্রহণ করে দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষার লড়াইয়ে যোগ দান করে যাতে এই ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের বন্ধন থেকে দেশকে মুক্ত করতে পারে।

বাংলা ভাষা ভাষী মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হ্রাস ও নেতৃত্ব শুন্য করার লক্ষ্যে দমন নীতি ও বর্বরতা বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এই গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নি সংযোগ ও লুণ্ঠন এর ফলশ্রুতিতে প্রায় নব্বই লক্ষ পুরুষ, মহিলা ও শিশু আপনাদের দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে এবং আরও অনেকে দেশ ত্যাগ করছে।

আমাদের অবিসংবাদিত নেতা ও রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে গোপনে সামরিক বিচার পরিচালনা করে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়া হয়েছে। গত ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে এককভাবে জয়ী আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী নির্বাচিত ৭৯ জন জনপ্রতিনিধিকে অযোগ্য ঘোষণা করেছে এবং তথাকথিত জনগণের সরকারের নাম দিয়ে পরাজিত ও দেশদ্রোহী প্রার্থীদের নিয়ে সরকার গঠন করেছে যা পাকিস্তানের সামরিক জান্তার সমর্থন প্রাপ্ত। এই আচরণে বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি জনতা প্রতারিত হয়নি বরং এর ফলে সামরিক শোষকদের কপটতা ও প্রতারণার মূল ছবি উদ্ভাসিত হয়েছে। আর এই সব থেকে আমরা বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য আরও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়েছি।

মাননীয়া, আমরা আপনাকে জানাতে পেরে আনন্দিত যে আমাদের এই স্বাধীনতা সংগ্রাম সফল হচ্ছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মুক্তি সেনার দল মুক্তি বাহিনী দেশের অর্ধেক অঞ্চলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রন নিয়েছে। আমরা আরও নিশ্চিত করছি যে, বাংলাদেশ সরকার এই অঞ্চলে অত্যন্ত কার্যকর বেসামরিক প্রশাসন স্থাপন করেছে যার কার্যক্রম অত্যন্ত সুন্দর ভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এই অগ্রগতি এখনও সকল জনগণের মাঝে পৌঁছায়নি কিন্তু সকলের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনে আমাদের সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

অতএব, এই মর্মে গত ২৪শে এপ্রিল, ১৯৭১ এর ইতিবাচক বার্তার আলোকে স্বাধীন ও নব্য গঠিত বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতির আবেদন জানাচ্ছি। আপনার তরফ থেকে এমন একটি স্বীকৃতি বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারকে এই স্বাধীনতা সংগ্রামে অসাধারণ গতি সঞ্চার করবে। এর ফলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ সম্ভব হবে যার ফলশ্রুতিতে এই অঞ্চলের স্বাধীনতা, শান্তি ও স্থিতিশীলতা বর্ধিত হবে। মাননীয়া এই কারণে আপনার কাছে এই বার্তার দ্রুত জবাব আশা করছি।

মহামান্য, দয়া করে আমাদের সর্বচ্চো সম্মানসূচক প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করবেন।

স্বাক্ষরিত/- স্বাক্ষরিত/-
(সৈয়দ নজরুল ইসলাম) (তাজউদ্দীন আহমেদ)
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সীলমোহর ১৫ অক্টোবর, ১৯৭১

শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী
মাননীয় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী
নয়া দিল্লী

ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর ২৩-১১-৭১ এ লিখিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের চিঠি।

(বাংলাদেশ সরকারের সীলমোহর)
মুজিবনগর
২৩শে নভেম্বর, ১৯৭১
মহামান্য,

গত ১৫ই অক্টোবর আপনার ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গমনের প্রাক্কালে আমাদের তরফ থেকে লেখা চিঠির প্রতি আপনার সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমরা আশাবাদী ছিলাম, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এবং এর সরকারকে স্বীকৃতি দানের সাধারণ অনুরোধ বিবেচনার সাথে সাথে আমাদের এই চিঠির মাধ্যমে এই স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের ক্রমবর্ধমান অনুভূতি ও প্রেরণার কথা আপনি বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে তুলে ধরবেন। নেতৃবৃন্দের সাথে আপনার আলোচনায় প্রাপ্ত এক প্রতিবেদনে আশার সৃষ্টি হয়েছে যে, তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে আমাদের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাথে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান কে আলোচনা করার জন্য প্ররোচিত করবে।

পনি বিদেশে অবস্থানকালীন সময়ে যখন সত্যিকার পরিস্থিতি চিত্র সকলের কাছে তুলে ধরছিলেন এবং বাংলাদেশের জনগণের ঘোষিত নির্বাচিত রাজনৈতিক সমাধানের অপরিহার্যতা সম্পর্কে জোর দান করছিলেন, সেসময়ে নিশ্চিত ইঙ্গিত পাই যে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসক গোষ্ঠী আমাদের জনগণের উপর তাদের নিপীড়ন ও বর্বরতা নীতি চালিয়ে যাবার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ১২ ই অক্টোবর এ রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের বক্তব্য অনুসারে বাংলাদেশের বেসামরিক জনগণের উপর পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর অন্যায় কার্যক্রম বৃদ্ধি এবং বিশ্ব নেতৃবৃন্দের আহবান প্রত্যাখ্যান করা ও তিরস্কার করার মাধ্যমে আমাদের উপরোক্ত মূল্যায়ন নিশ্চিত করা হয়েছে।

বিশেষ করে বিগত দুই সপ্তাহের ঘটনাচক্র থেকে এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী বাস্তব পরিস্থিতি অনুধাবন করে ন্যায় এর পথে ফিরে আসার পক্ষে কোন যুক্তি পরামর্শ নিতে অপারগ। এদিকে, আমাদের দেশের জনগণের দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেয়া অব্যাহত রয়েছে, যা আমাদের জনগণের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের সেনা বাহিনীর অত্যাচার নিপীড়নের সরাসরি প্রভাবে ঘটছে। পাকিস্তানী সামরিক জান্তা আমাদের জনগণের উপর নির্যাতন অব্যাহত রাখার পাশাপাশি প্রতারণামূলক শাসন ব্যবস্থা জারি করেছে। সামরিক আইনের মাধ্যমে নির্বাচনে পরাজিত ও দেশদ্রোহী প্রার্থীদের নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক সরকার গঠন করা হয়েছে যা বাংলাদেশের সকল মানুষের কাছে ঘৃণিত। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের জনগণকে জোরপূর্বক শাসন করার জন্য তাদের নৃশংসতা এক নতুন ও অকল্পনীয় মাত্রা নিয়েছে। আপনি অবশ্যই গত পাক্ষিক সময়ের প্রতিবেদনে বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তান সেনা বাহিনীর কারফিউ, গ্রেফতার ও আগুনে পুড়িয়ে সব ধ্বংস করার বিষয়ে জানতে পেরেছেন। সম্পূর্ণ গ্রাম ধ্বংস করে জনমানব শুন্য করা হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তান সেনা বাহিনী এমন নিয়মতান্ত্রিক ভাবে নির্যাতন চালিয়েছে যে লক্ষাধিক বাংলাদেশী বাস্তুহারা হয়েছে। আমাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পঞ্চাশ লক্ষাধিক বাংলাদেশী জনগণ এই করুন ও হৃদয় বিদারক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে যাদের কোন ত্রাণ সাহায্য নেই। এই সংখ্যা ভারতে আশ্রয় নেয়া ১০ লক্ষাধিক শরণার্থীদের সংখ্যার বাইরে এবং প্রতিনিয়ত ক্রম বর্ধমান। উপরোক্ত তথ্য থেকে নিশ্চিত উপসংহার টানা যায় যে, পাকিস্তান সামরিক শাসক গোষ্ঠী পূর্ব পরিকল্পিত ও পূর্ব নির্ধারিত ভাবে আমাদের সমগ্র বাঙালী জাতি ধ্বংস করার জন্য বদ্ধ পরিকর।

পাকিস্তান সামরিক শাসক দল এখনও শেখ মুজিবুর রহমান এবং বাংলাদেশ সরকারের সাথে আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করছে। এর ফলস্বরূপ পাকিস্তানের সামরিক শাসক ও রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান থেকে শুধুমাত্র বাংলাদেশের জনগণ নয় পাকিস্তানের অন্যান্য অংশের জনগণকেও বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের জনগণ এমনভাবে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছে যে পশ্চিম পাকিস্তান সরকার ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি কে নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয় যারা পশ্চিম পাকিস্তানের প্রাদেশিক অঞ্চলের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে।

এইসব থেকে আমাদের মূল মূল্যায়ন প্রতিবেদন নিশ্চিত করে যে পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের সামরিক নির্যাতন ষড়যন্ত্রের স্বপক্ষে ছিল না বরং সমগ্র নির্যাতন কৌশলের পেছনে ছিল সামরিক জেনারেল দের দুরভিসন্ধি। রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের গত মাসের ঘোষণা ও কর্মকাণ্ড থেকে এটা নিশ্চিত ইঙ্গিত প্রদান করে যে, শুধুমাত্র বাংলাদেশের জনগণের গণতন্ত্রের চেতনা নয় সমগ্র পাকিস্তানের জনগণের গন্তান্ত্রিক অধিকার দমন করার জন্য তিনি বদ্ধ পরিকর।

গত ১৫ই অক্টোবর এর চিঠিতে আমরা আপনাকে মুক্তি বাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত করেছি, যাদের কার্যক্রমে এখন অনেক গতির সঞ্চার হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণের সার্বজনীন সমর্থন প্রাপ্ত মুক্তি বাহিনী অত্যন্ত সাফল্যের সাথে সামরিক শাসকদের থেকে দেশের বিশাল অঞ্চলের কার্যকরী প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রন নিতে সক্ষম হয়েছে। ১৫ই অক্টোবর এর চিঠিতে আমরা দেশের অর্ধেক অঞ্চলের নিয়ন্ত্রন নেবার কথা জানিয়েছিলাম। অমরা অত্যন্ত আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে এই মুহূর্তে দেশের দুই তৃতীয়াংশ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রন এখন আমাদের দখলে। আমরা এই অঞ্চলগুলো শুধুমাত্র মুক্ত করিনি, এইসব এলাকা আমাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বেসামরিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা কার্যকর করেছি। এমনকি বাকি অঞ্চল গুলোতে জন সমর্থিত মুক্তির সংগ্রাম এমন পর্যায় পৌঁছেছে যে, পশ্চিম পাকিস্তান বাহিনী সীমিত কিছু স্থানে দেয়াল আবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। আমাদের সাফল্যের পাশাপাশি পশ্চিম পাকিস্তানের ঘটনা আমাদের বৈধতার কারণ। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসক গোষ্ঠীর একগুঁয়েমি এবং আমাদের জনগণের বিরুদ্ধে সংঘটিত হওয়া সকল কর্মকাণ্ড এই ইঙ্গিত বহন করে যে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান শুধুমাত্র তার দমন নীতির মাধ্যমেই বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রন তার অধীনে নিতে ইচ্ছুক। এই পরিস্থিতি আমাদের মাতৃভুমি সম্পূর্ণরূপে মুক্ত করার সঙ্কল্পকে আরও মজবুত করেছে এবং আমরা আমাদের লক্ষ্য অর্জনের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী। আমরা অনেক সংগঠিত হয়েছি এবং আমাদের সামরিক বাহিনী শৃঙ্খলা ও সংকল্পের সাথে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। মুক্তিবাহিনিতে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার দেশপ্রেমিক যুবক যোগদান করছে যারা সরবকালের জন্য বাংলাদেশের জনগণকে ঔপনিবেশিক দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। গত দুদশক ধরে আমরা যে নিপীড়নের শিকার হয়ে আসছি, যার সর্বচ্চো পরিনাম ঘটে ২৫ শে মার্চের কালো রাতে এবং এর পরবর্তী ঘটনাবলী, এর মূল কারণ সম্পূর্ণরূপে মিটিয়ে দেয়াই আমাদের অপরিবর্তনীয় অভিপ্রায়। এটি দাসত্বের শিকার হওয়া মানুষের তাদের শোষকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম।

আমরা আশা করি আমাদের এই সংগ্রাম আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে আমাদের প্রতিবেশী ভারতের আশু এবং বাস্তব সমর্থন পাবে। গত ৩১শে মার্চে, ভারতীয় সংসদে বাংলাদেশের জনগণের মুক্তি সংগ্রামের জন্য সহানুভূতি ও পারস্প্রিক নির্ভরতার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক উপায়ে জীবন যাপনের উপর অলঙ্কারপূর্ণ বক্তব্যগুলো আমাদের প্রত্যাশার ভিত্তি। ইতিমধ্যে আট মাস অতিক্রান্ত্র হয়েছে কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে পাকিস্তানী সামরিক শাসকদের বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাথে কোনরূপ আলোচনার জন্য জোর কিংবা পরামর্শ দেয়া হয় নাই। এমনকি, আপনার সহনশীলতা এবং সংযম, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নিপীড়নের ব্যাপারে পশ্চিমের শাসকদের উপর কোন কাঠামোগত প্রভাব ফেলেনি। পাকিস্তানী সামরিক শাসক দল এই ঘটনাকে ভারত -পাকিস্তান দ্বন্দ্ব হিসেবে তুলে ধরে বিশ্বের মনোযোগ অন্যত্র সরিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাস্তব পরিস্থিতি ও সত্যিকারের ঘটনা তুলে ধরতে আপনার সরকারের সঙ্গতিপূর্ণ প্রচেষ্টা সম্পর্কে আমরা সচেতন। শান্তিপূর্ণ বক্তব্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ ও পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের মধ্যকার কলহ প্রতিরোধের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, এবং ইয়াহিয়া খানের সাম্প্রতিক বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড থেকে রাজনৈতিক সমাধানের আশা প্রায় নেই। এই প্রেক্ষাপটে, আমরা অত্যন্ত বিস্মিত ও বিচলিত যে ভারত পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসক দলের বিরুদ্ধে সাবধানতা ও সংবরণ নীতি চালিয়ে যাচ্ছে।

আফ্রো – এশিয়া অঞ্চল থেকে অশুভ উপনিবেশবাদ তৈরির পেছনে ভারতের মূল ভুমিকার বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষ সচেতন। বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের পক্ষে সঙ্গতিপূর্ণ ভাবে সমর্থন দেবার মাধ্যমে ভারত বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে যা উপনিবেশবাদ নিশ্চিহ্ন করতে ত্বরান্বিত করছে। আপনার সরকার ও জনগণ সবসময় সেসব মানুষের পক্ষে কথা বলেছে যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে এবং মানুষের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমতা লুণ্ঠন করা হয়েছে। বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের পক্ষে আপনার অটল সমর্থন সর্বজনিত। নির্যাতিত মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষা ও স্বাধীনতা সংগ্রামে সমর্থনের জন্য ভারত এক নজির সৃষ্টি করেছে। আপনি গণতন্ত্রের মূলনীতি, ধর্ম নিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র এবং নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির উপর অটল সমর্থন দিয়েছেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ও আমাদের দেশের সরকারের অন্যান্য ঘোষণাগুলো স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে আমরা একই আদর্শে বিশ্বাসী। এখানে পুনরাবৃত্তি করতে চাই যে, আমরা ইতিমধ্যে আমাদের রাষ্ট্রের মূল নীতি ঘোষণা করেছি। গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং একটি সমধিকারের সমাজ নিরমান যেখানে জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ নিয়ে কোন বৈষম্য করা যাবে না। আমাদের পররাষ্ট্র নীতিতে আমরা নিরপেক্ষতা, শান্তিপূর্ণ সহবস্থান, উপনিবেশ বিরোধিতা, সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করেছি। আমরা বুঝতে পারছিনা আদর্শ ও নীতির সম্প্রদায়ের এই পটভূমির বিরুদ্ধে ভারত সরকার কেন এখনও আমাদের স্বীকৃতি দানের আবেদনে সাড়া দিচ্ছে না।

আমাদের নিজেদের দেশে সন্ত্রাসের মুখোমুখি হওয়া অসংখ্য জনগণের আপনার দেশে আশ্রয় নেবার মাধ্যমে আপনার দেশের উপর অনাকাঙ্ক্ষিত চাপের ব্যাপারে আমরা সচেতন। আমাদের দেশ থেকে আগত লক্ষাধিক শরণার্থীর কারণে আপনার দেশের উদ্বেগের জন্য আমরা সমানভাবে উদ্বিগ্ন। এই বিশাল সংখ্যক শরণার্থীদের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক এবং সামাজিক – রাজনৈতিক উত্তেজনার ভার সমানভাবে ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের। আমাদের অঞ্চলের উপর কার্যকর নিয়ন্ত্রন এবং সংগঠিত বেসামরিক প্রশাসন গঠনের মাধ্যমে আমরা আশা করছি ২৫ শে মার্চের পর নিজেদের ঘর ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া অসংখ্য শরণার্থী আপনাদের মহানুভবতা ও অতিথেয়তা সত্ত্বেও দ্রুত দেশে ফেরত আসতে শুরু করবে। আমরা এই মুহূর্তে তাদের নিজ দেশে ফেরত এসে নিরাপত্তা ও সম্মানের সাথে পুনর্বাসনের নিশ্চয়তা দিতে সক্ষম। শীঘ্রই শীতকাল আসছে, সময় এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নারী, বৃদ্ধ ও শিশুদের বাংলাদেশ প্রত্যাবর্তন ত্বরান্বিত করে তাদের স্বাস্থ্য ও অবস্থার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। শরণার্থীদের দ্রুত নিজ দেশে ফেরত আনার ব্যাপারে আমাদের সরকারের সবরকম সহায়তার পূর্ণ নিশ্চয়তা দান করছি। আমরা চাইনা তাদের প্রয়োজনের সময়ে আমরা ব্যর্থ হই।

বিগত আট মাসে ভারত ও বাংলাদেশের জনগণের উপর বয়ে যাওয়া উত্তেজনা ও ধকল উপশমে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আপনার ক্রমবর্ধমান সমর্থন অপরিহার্য। শুধুমাত্র রাজনৈতিক ও নৈতিক সমর্থন নয়, স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দান করে আমাদের সাধারণ লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব। আমরা নিশ্চিত যে, আপনাদের স্বীকৃতি অনুযায়ী এবং এই স্বীকৃতিতে বাস্তব স্বতন্ত্রতা দানের মাধ্যমে আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক বাংলাদেশের সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধান ত্বরান্বিত করবে।

আমাদের সংগ্রামে আপনার প্রচেষ্টার জন্য এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আমাদের সংগ্রামের বিষয় তুলে ধরার প্রচেষ্টার জন্য আমরা আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আমরা মনে করি আমাদের এখন আপনার আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক সমর্থন প্রয়োজন যাতে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে আমাদের স্বীকৃতি ত্বরান্বিত হয়। আপনার স্বীকৃতি আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত পেতে উদ্দীপনা দিবে। আমাদের বিবেচিত মূল্যায়ন অনুসারে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে ভারত সরকারের স্বীকৃতি উপমহাদেশের স্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্যই প্রয়োজনীয় নয়, বরং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার শান্তি, উন্নতি নিশ্চিত করার জন্যও জরুরী। সেকারণে, আমরা ১৫ই অক্টোবর এর চিঠির বিষয়ের পুনরাবৃত্তি করে দ্রুত সম্ভব সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বীকৃতি দানের অনুরোধ জানাচ্ছি।

দয়া করে আমাদের সর্বচ্চো সম্মানসূচক প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করবেন।

স্বাক্ষরিত/- স্বাক্ষরিত/-
(সৈয়দ নজরুল ইসলাম) (তাজউদ্দীন আহমেদ)

শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
নয়া দিল্লী
ভারত

ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর ৪-১২-১৯৭১ এ লিখিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের চিঠি।

(গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সীলমোহর)

প্রেরক
সৈয়দ নজরুল ইসলাম
ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ

এবং

তাজউদ্দীন আহমেদ
প্রধানমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ

বরাবর
শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী
মাননীয় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,

গভীর বিস্ময়ের সাথে সবেমাত্র আমরা জানতে পারলাম যে ৩রা ডিসেম্বর বিকেলে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা বাহিনী আপনার দেশের বিরুদ্ধে ভয়াবহ আক্রমণ পরিচালনা করেছে। ইয়াহিয়া খানের সর্বশেষ বেপরোয়া চুক্তিভঙ্গের এই প্রদর্শন প্রমাণ করলো যে উনি এই উপমহাদেশের রাষ্ট্র গুলোর উপর ধ্বংস, উত্তেজনা এবং আর্থ-সামাজিক নিপীড়ন বিস্তারের জন্য বদ্ধপরিকর; বাংলাদেশের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানী সরকারের এমুখ উদ্দেশ্যের ব্যাপারে অবগত ছিল এবং প্রায় নয় মাস আগে তারা স্বাধীনতার সংগ্রামের সূচনা করে। এই পরিস্থিতির বাস্তবতা এবং পাক বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ়তার কথা উল্লেখ করে গত ১৫ই অক্টোবর ও ২৩শে নভেম্বর আমরা আপনার নিকট বার্তা পাঠিয়েছিলাম। ইয়াহিয়া খান এবং তার সেনাপতিরা আপনার দেশের উপর যে আগ্রাসন চালিয়েছে, তার বিরুদ্ধে রুখে দারাবার জন্য, ভারত ও বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতা ও মূল্যবোধ রক্ষ্যার জন্য আমাদের দুদেশের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাদের মোকাবিলা করা আরও প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমরা গৌরবের সাথে আপনাকে অবগত করছি যে, ৩রা ডিসেম্বরে আপনার দেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সরাসরি আগ্রাসী হামলার সাপেক্ষে বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনী পাকিস্তানী সামরিক শক্তির সাথে বাংলাদেশের যেকোনো সেক্টরে অথবা যেকোনো সদরে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদের যৌথ অবস্থান আরও মজবুত হবে যদি আমরা একটি আনুষ্ঠানিক কূটনীতিক সম্পর্কে উপনিত হতে পারি। অতএব, আমরা আপনার নিকট পুনরায় অনুরোধ করছি যে ভারতীয় সরকার অবিলম্বে আমাদের দেশ ও সরকারকে অনতিবিলম্বে স্বীকৃতি দেয়। আমরা আপনাকে নিশ্চিত করতে চাই যে দুদেশের এমুখ শনিক ঘণ্টায় বাংলাদেশের সরকার ও মানুষ আপনাদের পাশে দৃঢ়তার সাথে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা আন্তরিকভাবে আশা করি যে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের পৈশাচিক উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনার বিরুদ্ধে আমাদের যৌথ প্রতিরোধ সফল পরিণতি নিয়ে আসবে।

আগ্রাসনকারীদের বিরুদ্ধে আপনাদের যথাযথ সংগ্রামে আমাদের সরকারের সম্পূর্ণ সহায়তার ব্যাপারে আমরা আস্থা দিচ্ছি।
দয়া করে আমাদের সর্বচ্চো সম্মানসূচক প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করবেন।

৪ ঠা ডিসেম্বর, ১৯৭১

শ্রী মল্লিকারজুন (মেডাক) — আমি এই পবিত্র দেশের প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানাই। আমি তাকে আমাদের স্বর্গীয় ভারতের একজন অদ্বিতীয় অবতার হিসেবে দেখি। স্রস্টা এই দেশকে সকল নৈপূন্যে মহিমান্বিত করুন এবং আমরা সর্বদাই বিজয়ীর আস্নে থাকবো। জয় বাংলাদেশ।

শ্রী জিয়ত্রিময় বসু (ডায়মন্ড হারবার) — আমার দলের পক্ষ থেকে আমরা এই দিন কে অভিনন্দন জানাতে অত্যন্ত আনন্দিত। ১৯৪৭ এর পর আজকের দিন অন্যতম সেরা দিন।

শ্রী এইচ. এন. মুখারজী (কলকাতা উত্তর-পূর্ব) — এই মুহূর্তে আমরা বাক্যহারা। আমরা অনেকদিন ধরে প্রতীক্ষায় ছিলাম কবে আমাদের দেশ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে পুরনাঙ্গ সমর্থন জানাবে। আমি জানিনা এই পরিস্থিতিতে আমার বক্তব্য জরুরী কিনা। আমরা আনন্দিত। আমরা প্রধানমন্ত্রীকে জানাতে চাই, এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে তিনি তার দায়িত্ব পালন করেছেন। এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। আমরা বিশ্বের এই প্রান্ত থেকে সারা বিশ্বে আমাদের বার্তা পৌঁছে দিতে চাই। ইসলামাবাদের ক্ষমতা লোভী লোকদের বিরুদ্ধে, সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম অবশ্যই সফল হবে এবং স্বাধীনতা আমাদের এবং মানবতার পক্ষে থাকবে।

শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী (গোয়ালিয়র) — স্পীকার মহাশয়, দেরিতেই হোক না কেন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে একটি সঠিক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ইতিহাসের গতি পরিবর্তনের পক্রিয়া আমরা প্রত্যক্ষ করছি। নিয়তি এই সংসদ, এই দেশকে এমন গুরুত্বপূর্ণ কাল পর্যায়ে এসে উপস্থিত করেছে যখন আমরা মুক্তি সংগ্রামে আত্মাহুতি দানকারী লোকদের সমভিব্যাহারে যুদ্ধ করছি, আমরা কিন্তু ইতিহাসের গতির নতুন দিক নির্দেশের জন্যও সচেষ্ট রয়েছি। আজ বাংলাদেশে নিজেদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধরত লোকদের এবং ভারতীয় সৈন্যদের শিকারে পরিণত হবে না। বাংলাদেশের মুক্তি এখন ঘনিয়ে আসছে। আমার মনে হচ্ছে, আমাদের সেনাবাহিনী এখন ঢাকার উপকণ্ঠে পৌঁছে যাচ্ছে। ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে শুধু মুক্তি সংগ্রামেরই সহায়তা করেনি, বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় ভূষিত করেছে। এখন সে নিরাপত্তা পরিষদে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে যাবে, এজন্য এ সময় তাকে আমাদের স্বীকৃতি দান আরও অর্থপূর্ণ হল।

আমি মনে করি আমাদের প্রধানমন্ত্রী সত্যিই ধন্যবাদের পাত্রী। নিত্যদিন আমি এরুপ আরও খবরের প্রত্যাশা করতে থাকব।

শ্রী শেযহিয়ান (কুম্বাকোনাম) — এটা একটা ঐতিহাসিক দিন যখন স্বাধীন বাংলাদেশকে ভারত স্বীকৃতি দান করলো। বাংলাদেশ এবং এর বীরসুলভ জনগণকে আমাদের শুভেচ্ছা। আমি আমার দল ও এই সংসদের পক্ষ থেকে আপনাকে অনুরোধ জানাই বাংলাদেশ সরকার এবং এর জনগণকে শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা জানাতে। স্বাধীনতা সংগ্রামে বিজয় অর্জন ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আমরা তাদের সাথে একীভূত। এখন যে লড়াই চলছে তা ইসলামাবাদ ও দিল্লী কিংবা ইসলামাবাদ ও বাংলাদেশের মধ্য না। এই লড়াই সামরিক শক্তি ও গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যে। ইতিহাসের দেখানো পথ অনুসারে গণতান্ত্রিক অধিকার সবসময় জয়ী হবে। বাংলাদেশে নতুন ইতিহাস রচিত হরেছে।

শ্রী শ্যামনন্দন মিশ্র (বেগুসরায়) — স্পীকার মহোদয়, এই অবসরে আমরা প্রধানমন্ত্রী মহাশয়া এবং আমাদের সেনাবাহিনীকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী মহাশয়া এবং সেনাবাহিনী যেভাবে দেশের বিশ্বাস অটুট রেখেছেন সে বিশ্বাস ভবিষ্যতেও রাখবেন এবং বহু জটিলতা নিয়ে যেসব দিন আসছে সেগুলিতেও পূর্ণ আস্থা, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে কাজ করবেন। আমি উপলব্ধি করছি, এ যাবত আমরা যতদূর সফল হয়েছি তাতে আমাদের সাহস বেড়েছে, আমাদের দেশের মর্যাদাও বৃদ্ধি এবং বিশ্বের অনেক স্থানে এ সম্পর্কে যেসব কথা হচ্ছে তাতেও অনেক কিছুর মূল্যায়ন অন্য দেশের লোকদের ধারণা পরিষ্কার হয়ে যাবে। ভারতের অবস্থা সম্পর্কে তারা অনেক বিভ্রান্তির মধ্যে ছিল। ভারতের অবস্থান আজ সুস্পষ্ট হয়ে গেছে এবং যুদ্ধের তৃতীয় বা চতুর্থ দিনেই, আজ আমরা যখন একত্রিত হচ্ছি, আমি মনে করি, বিশ্বে যে নানারকম কথাবার্তা উঠছে, সে সব কথা শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সুফলপ্রদ মোড় নেবে।

আমি বেশী সময় না নিয়ে শুধু এই বলবো, এখনই আমাদের দেশবাসী যেন একথা মনে না করে যে, আমাদের সফলতা শেষ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে, আমাদেরকে অনেক কোরবানি দিতে হবে, অনেক চিন্তা ভাবনা, আস্থা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে চলতে হবে।

শ্রী পি. কে. দেও (কালাহান্ডি) — আমি প্রধানমন্ত্রীকে তার সাহসী সিদ্ধান্তের জন্য আমার অন্তরের অন্তস্থল থেকে অভিনন্দন জানাই। দেরীতে হলেও তিনি সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন।

সম্মানিত সংসদ সদস্য — সঠিক সময়ে।

শ্রী পি. কে. দেও — আমার দলের পূর্ণ সমর্থন তার প্রতি আছে। পাকিস্তান যে ভৌগলিক ভাবে একটা অর্থহীন দেশ আজকে তা প্রমাণিত হয়েছে। আমরা আশা করি দেশ ভাগের ফলে যে ক্ষতি হয়েছিল তা পূরণ হবে, এবং আমরা সম্পূর্ণ আশা রাখি উপমহাদেশের ইতিহাসে এক সোনালী অধ্যায়ের সূচনা হবে। এই সাহসী সিদ্ধান্ত সত্যিই অনেক সাহসিকতাপূর্ণ এবং ভারতীয় জাতির মধ্যে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনার সঞ্চার করেছে এবং আমি মুক্তিযোদ্ধা, আমাদের সেনা এবং শহীদদের সালাম জানাই যারা বাংলাদেশের জন্য তাদের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন।

শ্রী ত্রিদিব চৌধুরী (বেরহামপুর) — এটা প্রকৃতপক্ষেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত এবং এই নিয়ে লম্বা বক্তব্যের কোন প্রয়োজন নেই। তথাপি, আমাদের সেই দিন স্মরণ করিয়ে দেয় যখন রাভি নদীর তীরে পণ্ডিত জহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে ভারতীয় জাতি একত্রিত হয়েছিল। আমরা স্বাধীনতার সঙ্কল্পে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলাম। একইভাবে এবছর ২৬শে মার্চে বুড়িগঙ্গার তীরে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়, এবং বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার শপথ গ্রহণ করে বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করেন। প্রধানমন্ত্রী এবং সরকার আজকের মত আর কখনোই জাতির সাথে এভাবে একাত্মতা প্রকাশ করেনি। আমি প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।

প্রফেসর মধু ডান্ডাভাট (রাজাপুর) — মাননীয়, প্রয়াত জওহরলাল নেহেরু একবার বলেছিলেন, শান্তির মতই স্বাধীনতা অদৃশ্য। এবং বিশ্বের এক প্রান্তের স্বাধীনতার প্রতি হুমকি অন্য প্রান্তের স্বাধীনতার জন্যও হুমকিস্বরূপ। আমি আনন্দিত প্রধানমন্ত্রী তার পিতার কণ্ঠ শুনতে পেরেছেন এবং সন্দেহাতীতভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষ নিয়েছেন যা আমাদের দেশের ঐক্যের সাথে জড়িত। আজকে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ গণ অবশ্যই অনুভব করতে পারবেন তাদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। তারা অবশ্যই বুঝতে পেরেছিলেন কূটনৈতিক আলোচনার আসরে বাংলাদেশের স্বীকৃতি আসবে না, বিপ্লব ও সংগ্রামের মাধ্যমেই তা উদ্ভূত হবে। এবং এই ভাবেই ভারত কতৃক বাংলাদেশের স্বীকৃতির উদ্ভব। এই জন্য আমি প্রধানমন্ত্রী এবং সমগ্র দেশকে অভিনন্দন জানাই।

আমি অধিক সময় নিতে চাই না। আজকে বাংলাদেশের মহান শহীদ এবং মুক্তিযোদ্ধারা অবশ্যই সেই কবিতার পঙক্তি স্মরণ করবে যেখানে কবি বলেছেন –

“ওহ স্বাধীনতা – মানবকূল পারবে কি তোমায় পরিত্যাগ করতে
একবার তোমার উদার শিখার আঁচ অনুভবের পর?
পারবে কি কোন অন্ধকুপ, খিল কিংবা গরাদ বা চাবুক তোমার আত্মাকে নিস্তেজ করতে? “

এই শব্দগুলো সারা বিশ্বের অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে তাদের লক্ষ্যে উদ্দীপ্ত করেছে। এই শব্দগুলো বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন ও উৎসর্গকে উদ্দীপ্ত ও আলোকিত করবে। আমি আনন্দিত ভারত ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার শক্তি নিজেদের একত্রীভূত করতে পেরেছে। এমনটাই হবে সারা বিশ্বের চিত্র যা আমরা সবসময় আশা করেছি এবং ভারত সবসময় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পাশে থাকবে। আমাদের সেনা বাহিনী কখনোই কোন দেশ দখল করতে যাবে না, আমাদের সেনা বাহিনী সবসময় স্বাধীনতা রক্ষার জন্য লড়াই করবে। এটা আমাদের মহান দেশের ঐতিহ্য।

শ্রী এস.এ.শামিম (শ্রীনগর) — সুতরাং, বিলম্বিত স্বীকৃতি- স্বীকৃতি দানের অস্বীকার নয়। আমি প্রধানমন্ত্রীকে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। কিন্তু এই উত্তেজনাকর মুহূর্তে আমি এই সংসদকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, এই যুদ্ধের মূল তাৎপর্য আমাদের ভুলে যাওয়া উচিৎ নয়। মূল তাৎপর্য হচ্ছে, বাংলাদেশের সেনা বাহিনী এবং ভারতের হিন্দু ও মুসলিম গণ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে পরাজিত করার জন্য লড়াই করছে। এটাই এই যুদ্ধের সারমর্ম। ১৯৪৭ এ পাকিস্তান তৈরি হয়েছিল ধর্ম ভিন্নতার কারণে এবং ধর্ম সীমানা তৈরি করে দিয়েছিল। আজকে বাংলাদেশে একজন মুসলিম সেনাপতি জেনারেল ওসমানী ধর্মকে ভুলে শুধুমাত্র মানবতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে বৃহত্তর ধরে সেনা বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এটাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সারমর্ম। আমি নিশ্চিত জনাব বাজপেয়ী এবং অন্যান্য যারা বাংলাদেশের পক্ষ নিয়েছেন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এবং এদেশের আদর্শে এর প্রয়োগ করবেন।

শ্রীমতী এম. গডফ্রে ( নির্বাচিত অ্যাংলো ইন্ডিয়ান) — মাননীয়, আমাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধার কথা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই তাকে আমাদের এই কঠিন সময়ে সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। সৃষ্টিকর্তা তাকে আরও বিচারিক ন্যায় নিরদারনের ক্ষমতা দিয়েছেন যাতে তিনি আজকের দিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতির ঘোষণা দিয়েছেন। আমি জানি অন্য কারও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য এখন কঠিন সময়। আমি মনে করি আজকের দিন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সঠিক সময়। তাই আমরা সবাই সমস্বরে এই ঐতিহাসিক দিনে এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ধন্যবাদ জানাই। এটা ইতিহাসের পাতায় সর্বদা লেখা থাকবে। আরও একবার, আমি তাকে অভিনন্দন জানাই এবং প্রার্থনা করি যাতে সৃষ্টিকর্তা তাকে সবসময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার দিক প্রদর্শন করেন, যা তিনি আমাদের দেশের এই কঠিন সময়ে সর্বদাই করে আসছেন।

শ্রী এস.বি.গিরি (ওয়ারাঙ্গাল) — মাননীয়, অবশেষে বাংলাদেশের এবং ভারতের জনগণের গণতান্ত্রিক ইচ্ছার বিজয় ঘটে এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করা হয়। তেলাঙ্গনা প্রজা সমিতির পক্ষ থেকে আমি প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশের স্বীকৃতি দানের জন্য অভিনন্দন জানাই। আমি আশা করি অন্যান্য দেশও আমাদের অনুসরণ করবে। আমি আশা করি আমেরিকা যারা জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা বলে এবং সর্ব বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ, শীঘ্রই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করবে।

শ্রী ইসহাক সম্ভলী (আমরোহা) — স্পীকার মহোদয়, আমাদের সবচাইতে বেশী অভিনন্দন জানাতে হবে বাংলাদেশের যোদ্ধাদের, যারা স্বাধীনতা, সমাজতন্ত্র ও সেকুলারিজম এর জন্য লড়াই করছে। তারা নিজেদের সরকার গঠন করে নিয়েছে। আমি আনন্দিত এবং আমি ধন্যবাদ জানাই ভারতের জনগণ ও প্রধানমন্ত্রীকে যারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটি একটি ঐতিহাসিক বিষয়। সেটি এক ধর্মমতাবলম্বী অর্থাৎ মুসলমানদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের দেশ। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা সেকুলারিজম এর আদর্শ গ্রহণ করেছে। আমার বিশ্বাস, বিশ্বের কোটি কোটি লোকের স্বাধীনতার যুগ এই কাল থেকে আরম্ভ হয়েছে এবং তারা প্রতিটি পরাধীন অঞ্চল স্বাধীন করতে সক্ষম হবে।

এসব কথার দ্বারা আমি বাংলাদেশকে এবং এই সরকারকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।

জনাব স্পীকার — আমি মনে করি এখন আরও বক্তব্য রাখা উচিৎ। আমিও প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানাই। সকল দল বক্তব্য রেখেছে। তাদের সকলের পক্ষ থেকে যারা কোন দলের অন্তর্গত নয়, যারা কোনভাবে বিতর্কিত নন এবং যারা ট্রেজারি বেঞ্চ এবং বিরোধী দল উভয়ের সাথে সম্পৃক্ত, এদের সকলের এবং সংসদের পক্ষ থেকে আমি প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানাই। আজকে আমার স্পীকার হিসেবে কর্মজীবনে প্রথমবারের মত আমি টেবিল চাপড়ানোর ঐতিহ্যে যোগদান করে নিজের টেবিলে চাপড়েছি। আমি মনে করি, প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা বাংলাদেশের সাদিনতা কামী জনতার সাথে আমাদের সহযোগিতা ও ঐক্যের ঘটনা হিসেবে ইতিহাসে লেখা থাকবে। এইসব সকল লোকের পক্ষ থেকে এবং আপনাদের সকলের পক্ষ থেকে আমি বাংলাদেশ সরকারকে এই গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণার জন্য অভিনন্দন জানাই যা তাদের দেশের গণতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা, সামাজিকতা, বিশ্ব শান্তি এবং মানবাধিকারের ভিত্তি স্থাপন করেছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৩২। পাকিস্তান আক্রমনের পর সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর বিবৃতি
ভারতের লোক সভার কার্যবিবরণী
৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১

Raisa Sabila
<১২, ২৩২, ৯৪১-৯৪২>
অনুবাদ

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী (শ্রী জগজীবন রাম)ঃ সম্মানিত সদস্যরা নিশ্চয়ি মনে করতে পারছেন, ৪ ডিসেম্বর আমি হাউসে কি বক্তব্য প্রদান করেছিলাম। আমি তখন বলেছিলাম যে পাকিস্তানের পূর্বপরিকল্পিত ভাবে আমাদের আক্রমন করে ক্ষতিসাধন করার যে উদ্দেশ্য ছিল, তা ব্যর্থ হয়েছে। পাকিস্তানী বাহিনী নিরন্তরভাবে আমাদের আক্রমন করার চেষ্টা করে গেছে এবং আমাদের প্রতিরক্ষার দুর্বলদিক খুজে বের করার চেষ্টা করে গেছে। আমরা পাকিস্তানী সেনাবাহিনির এই আগ্রাসী আক্রমনের উপযুক্ত জবাব দিতে তৎপর হয়েছি।

পাকিস্তানী বিমানবাহিনী আমাদের বিমানঘাঁটি গুলোতে হানা দিয়েছে, কিন্তু যে ক্ষতি তারা করতে পেরেছে, তা দ্রুত কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়েছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্থ বিমানঘাটিগুলো দ্রুত মেরামত করে তাদের কার্যক্ষম করে তুলেছি। পাকিস্তানের আক্রমন ধীরে ধীরে কমে আসছে। আমরা তাদের বিমানঘাঁটি এবং বিমানের উপর যে আক্রমণগুলি চালিয়ে এসছি, এটি তার ফলাফল হতে পারে। আমরা এখন পর্যন্ত ৫২টি পাকিস্তানী যুদ্ধবিমান ধ্বংস করেছি এবং খুব সম্বভত আরো ৪টির ক্ষতি করেছি। ৩ জন পাকিস্তানী পাইলট আমাদের হেফাজতে আছে।

আমাদের বিমানবাহিনিকে গত দুইদিন ধরে ফরোয়ার্ড পজিশনে জড় করা হচ্ছে এবং তারা গ্রাউন্ড পজিশনে দারুন সহযোগিতা করছে। আমরা একি সাথে পাকিস্তানের যোগাযোগ ব্যাবস্থা বিচ্ছিন্ন করতে পেরেছি, তাদের সাপ্লাই ডাম্প এবং তেল সংরক্ষণাগার গুলোতেও হামলা চালিয়ে ছিন্নভিন্ন করেছি সফলতার সাথে। সবমিলিয়ে আমরা ২২টি বিমান হারিয়েছি।

পাকিস্তান পুঞ্চে বারবার হামলা চালাচ্ছিল, আমরা তার দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছি। চাম্ব এলাকায় প্রচণ্ড চাপ ছিল, আমরা আমাদের ট্রুপ সরিয়ে মোনাওয়ার তাভি নদীতে বসিয়েছি। এই অবস্থান পরিবর্তনের পর যে যুদ্ধ হয়, তাতে পাকিস্তান ২৫টি ট্যাংক এবং জনবল হারিয়েছে। আমরা আখনুর এবং শাকারগরেও তাদেরকে পাল্টা চাপে রাখছি।

দেরা বাবা নানক ছিটমহল থেকেও পাকবাহিনীকে হটানো হয়েছে। রবির উপরে যে ব্রিজ আছে, তা এখন আমাদের দখলে আছে। পাকবাহিনীর লুকিয়ে সীমান্তের ভেতরে ঢোকার চেষ্টাও ব্যর্থ করে দেয়া হয়েছে।

অমৃতসর সেক্টরে, গুটিকয়েক পাকিস্তানী সীমান্তঘাটি আমরা আমাদের দখলে এনেছি। ফিরোজপুর এলাকায়, সেজ্রা ছিটমহল থেকে পাকবাহিনীকে হটানো হয়েছে। রাজস্থান সেক্টরে, পাকিস্তানের একটি আরমার্ড বাহিনী চেষ্টা করেছিল রামগর দখল করতে। পুরো বাহিনীকে লোঙ্গানাওয়ালাতে আটক করা হয় এবং লন্ডভন্ড করে দেয়া হয়। ২০টি ট্যাংক ধ্বংস করা হয় এবং আরো ৭টির ক্ষতিসাধন করা হয়। সিন্ধু থেকে দুইদিক দিয়ে তারা প্রবেশ করার চেষ্টা করেছিল, আমরা সেটা রুখে দিয়েছি। আমাদের ট্রুপ্স নানা পয়েন্টে এগিয়ে আছে, এবং আমরা নয়া চর থেকে মাত্র দশ মাইল পিছনে অবস্থান করছি। আমরা ইসলামগর দখল করেছি। এখন পর্যন্ত, আমরা ৯৬টি পাকিস্তানী ট্যাঙ্ক ধ্বংস করেছি।

পশ্চিমাংশে, আমাদের বাহিনী মুক্তিবাহিনীর সাথে একসাথে যুদ্ধ করছে। আমাদের হামলায়, পাকিস্তানী বাহিনী পিহু হটতে বাধ্য হচ্ছে। আজ সকালে যশোর বিমানঘাঁটি আমরা দখলে এনেছি। কালীগঞ্জের পশ্চিমের সকল এলাকা পাকবাহিনীর কাছ থেকে মুক্ত হয়েছে। মেহেরপুর ভায়া ঝিনাইদহ তো গোয়ালন্দঘাট পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সড়কটিকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। হিলি/দিনাজপুর এলাকা থেকে আমাদের বাহিনী রংপুর-বগুরা হাইওয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। লালমনিরহাট ও এই এলাকার বিমানঘাঁটি আমাদের দখলে চলে এসেছে। কুড়িগ্রাম, রংপুরের উত্তরাংস পাকবাহিনীর দখল থেকে মুক্ত হয়েছে। সম্মানিত সদস্যরা দুইদিন আগে আখাউড়া দখলের কথা জানেন। মৌলভিবাজার ও ব্রাক্ষনবারিয়ায় তাদের স্ট্র্যাটেজি সেন্টারগুলো ঘিরে ফেলা হয়েছে। গতকাল ফেনি থেকে সকল পাকিস্তানী সৈন্য অপসারিত হয়েছে। আমাদের বাহিনী এখন চাঁদপুর ফেরির দিকে আগাচ্ছে।

বাংলাদেশের আকাশ থেকে পাকিস্তানী বিমান বাহিনী সম্পূর্ণ মুছে ফেলে আমাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সাগর থেকে সেনাবাহিনির বিভিন্ন সরঞ্জাম চট্টগ্রাম, চালনা, মংলা এবং খুলনায় জড় করা হচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে এখানকার পাকিস্তান বাহিনীর উপকূলবর্তী সবধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। সম্মানিত সদস্যরা ৪/৫ ডিসেম্বর রাতে ভারতীয় নেভির চালানো অপারেশনের কথা জানেন। দুইটি পাকিস্তানী যুদ্ধতরী ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে এবং আমার বিশ্বাস আরো একটি প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের নেভাল ফোরস করাচি সমুদ্রসীমার ১৫ মাইল ভিতরে চলে গিয়েছে। তাদের প্রচণ্ড গোলাবর্ষণে সমুদ্রে অবস্থানরত পাকিস্তানী নেভির ঘাটি ও তেলের ট্যাঙ্কগুলোর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বঙ্গপোসাগরে আমরা একটি পাকিস্তানী সাবমেরিন ডুবিয়ে দিয়েছি। বাংলাদেশে পাকিস্তানের দখলকৃত সমুদ্রসীমাগুলোতে ইস্টার্ন ফ্লিট অপারেশন চালাচ্ছে।

তিন বাহিনীই গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে নিয়োজিত। প্রতিটি পরিকল্পনায় তাদের যে দক্ষতা এবং পারস্পরিক সহযোগিতা, তা সন্তোষজনক।
জাতিসংঘের ব্যাপারে আই হাউসকে জানাতে চাচ্ছি, জাতিসংঘের বিমান সি-১৩০ কে ডিসেম্বর এর ৬ তারিখে সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত নিরাপদ অনুমোদন দেয়া হয়। তারা তা কাজে লাগাতে পারেনি। নয়া দিল্লির জাতিসংঘ প্রতিনিধির অনুরোধে, ৭ ডিসেম্বর আবারো সকাল ৭টা থেকে ১১ টা পর্যন্ত অনুমোদন দেয়া হয়। গত রাত ১০টা থেকে ঢাকায় কোন অপারেশন চালানো হয়নি। আমাদের জানানো হয়েছে যে, জাতিসংঘের একটি বিমান ঢাকা বিমানঘাটিতে বিপর্যস্ত হয়েছে। আমাদের এয়ার হেডকোয়ারটারগুলো জানিয়েছে যে কোন ভারতীয় বিমান সে সময় ঐ এলাকায় ছিলনা। আমি, সদস্যদের পক্ষ থেকে আমাদের বিরোচিত বাহিনীকে দেশরক্ষায় এই মহান অবদানের এবং শত্রুপক্ষকে পরাজিত করার জন্য অভিনন্দন জানাতে চাই।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৩৩। ভারত মহাসাগরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের তৎপরতা সম্পর্কে আলোচনা ভারতের লোকসভার কার্যবিবরনি ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ২৩৩, ৯৪৩-৯৫০>
অনুবাদ

লোকসভা দশটায় আরম্ভ হয়

( জনাব. স্পিকার আসন গ্রহণ করেন)

শ্রী জ্যোতির্ময় বসু. (ডায়মন্ড হারবার): স্যার, আমি মার্কিন সপ্তম নৌবহর এর আগমনের কারণে ভারতের উপর প্রভাব – এর উপর একটি মুলতবি প্রস্তাব নোটিশ দিয়েছি।

ভারত মহাসাগরে মার্কিন সপ্তম নৌবহর এর চলাচল

জনাব স্পীকার: তিনি একজন পার্লামেন্টারিয়ান। তিনি একটি বিষয়ে মুলতবি প্রস্তাব দিয়েছেন যা সরকারের আমলে আছে এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে। সরকার কি এটা জ্ঞ্যাত আছেন?

শ্রী জ্যোতির্ময় বসু: এটা অনুযোগের জন্য নয়।

জনাব. স্পিকার: দয়া করে বসুন।

শ্রী জ্যোতির্ময় বসু: সরকার একটি বিবৃতি দিতে পারে। আমিও একটা মনোযোগ আকর্ষণ নোটিশ দিয়েছি।

জনাব. স্পিকার: আমি দেখব বিষয়টা।

শ্রী জ্যোতির্ময় বসু: এখন আপনি আপনাকে সামান্য সময় দিয়েছেন। আমাকে আমার সাবমিশন করতে দিন। এটা সরকারের কাছে অনুযোগের বিষয় নয়। কিন্তু আমরা চাই এই হাউস এই বিষয়টির উপর আলোচনা করুক কারণ এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

জনাব. স্পিকার: অনুগ্রহ করে মুলতুবির ব্যাপারে কোন নতুন সংজ্ঞা দিতে হবে না।

শ্রী এস এ শামীম (শ্রীনগর): মুলতবি প্রস্তাব মানেই একটি তিরস্কার প্রস্তাব নয়। আমি শুধুমাত্র স্পষ্ট করছি মাত্র।

জনাব. স্পিকার: নতুন সংজ্ঞা দিতে হবে না।

শ্রী এইচ এন মুখার্জি (কলকাতা, উত্তর-পূর্ব): স্যার, আমি ভারত মহাসাগরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের বিচরণের ব্যাপারে এখানে কিছু বলতে চাই। এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুখপাত্র এই রিপোর্টের ব্যাপারে অসঙ্গতি প্রকাশ করেননি। তিনি আরও বলেছেন এটি করা হয়েছে ঢাকায় মার্কিন ব্যক্তিদেরকে নিরাপদে ফেরত নেয়ার জন্য। এখন মনে হচ্ছে সেই পুরানো দিনের যুদ্ধ নীতির গানবোট পলিসি শুরু হয়েছে। কূটনীতি ও ব্ল্যাকমেইল ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। ভারত এটা সমর্থন করতে পারে না। সুতরাং, আমি আপনার মাধ্যমে সরকারের কাছে অনুরোধ করতে চাই, অতি বিলম্বে সরকার এই ব্যাপারে দেশবাসীকে অবগত করুন এবং সংসদে বিষয়টি সমাধান করুন। সবার অনুমতিক্রমে। কারণ এরা সবাই পুরো দেশকে প্রতিনিধিত্ব করছেন। আমাদের এমনভাবে এক হতে হবে যাতে কেউ আমাদের টলাতে না পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র – যারা ভিয়েতনামে মার খেয়ে ফিরেছে – তারা এখন চিনের সাথে গড়াগড়ি দিয়ে আমাদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে। এবং আমরা যদি নুয়ে পড়ি এটা ভয়ানক হবে। আমি বলছি না যে সরকার নুয়ে পড়তে যাচ্ছে। আমি আমার দেশের কাছ থেকে ভাল কিছু প্রত্যাশা করি। এজন্যই চাই সরকার এই সংসদে এটা নিয়ে আলোচনা করুন এবং এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমরা কি করতে যাচ্ছি তা প্রকাশ করুন এবং দাম্ভিক ও অহংকারীভাবেই আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সিধান্তের জবাব দেব।

শ্রী জ্যোতির্ময় বসু: স্যার এটা একটা চতুর এবং পরিকল্পিত পদক্ষেপ যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন সিঙ্গাপুর এর মালাক্কা প্রণালিতে জাহাজগুলোকে সম্ভ্যাব্য চূড়ান্ত নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে বলেছেন। তিনি সেগুলোকে বঙ্গোপসাগরে এগিয়ে যেতে বলেছেন ঢাকায় মার্কিন নাগরিকদের উদ্ধার করার অজুহাতে। এবং তিনি পরমাণু চালিত এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার এন্টারপ্রাইজকেও এই আদেশ করেছেন। এটা শুধুমাত্র পরমাণু চালিত এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার এন্টারপ্রাইজ না বরং এতে কিছু এম্ফিবিয়াস (উভচর) জাহাজ ও ডেস্ট্রয়ার আছে যা আসলে গত শুক্রবার তার গন্তব্যের উদ্যেশ্যে রওনা দিয়ে ফেলেছে। এই এন্টারপ্রাইজ একটি ৯৯০০০ টনের জাহাজ যাতে তার রক্ষীবাহিনী আছে। এটি ইউ এস এর সবচেয়ে বড় ক্যারিয়ার। এবং এটি পরমাণু শক্তি সম্পন্ন। এটি একটি বৃহত্তম বিমান বাহক যাতে আছে ১০০ ফাইটার বোমারু বিমান, পরিদর্শনকরণ এয়ারক্র্যাফট, যোদ্ধা ও হেলিকপ্টার। এটা মার্কিন ৭ম নৌবহরের একটি অংশ। এটি একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং ভারতের নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি। অতএব, এই বিষয়টি এই হাউসে আলোচনা করা দরকার।

শ্রী এস এম ব্যানার্জী (কানপুর): স্যার, প্রফেসর আর এন মুখার্জি যা বলেছেন তার আমি আমি তেমন কিছু যুক্ত করতে চাইনা। আমি বলতে চাই যে এটা আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদীদের একটি নতুন পদক্ষেপ। তারা পাকিস্তানি বাহিনীকে সমর্থন দিচ্ছে যারা প্রতিদিন আত্মসমর্পণ করছে। গতকাল সকালে পাকিস্তান রেডিও, বিশেষ করে লাহোর রেডিও একটি বিবৃতি দেয়। তারা বাংলাদেশে তাদের সৈন্য ও অফিসারদের একটি বার্তা প্রদান করে যে আমেরিকান সরকার ভারতের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ সমর্থনে তাদের জন্য ৭ম নৌবহর আনতে অঙ্গীকার করেছে। এটি আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদীদের একটি নতুন পদক্ষেপ, একটি খুব অশুভ পরিকল্পনা, এবং এটি ভারতের জন্য একটি হুমকি।

আমি জানি আমাদের প্রধানমন্ত্রী এবং ভারত সরকার এতে আতংকগ্রস্ত হবে না। এমনকি যদি তারা ৭ ম নৌবহর নিয়ে আমাদের দেশ স্পর্শ করার সাহস করে তাহলে তাদের উত্তর কোরিয়া এবং ভিয়েতনামের মত ভাগ্য বরণ করতে হবে। আমি জানি যদি অ্যামেরিকা ভারত আক্রমণ করে তবে তা হবে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদীদের ওয়াটারলু। কথায় আছে ঘেউ ঘেউ করা কুকুর কদাচিৎ কামড়ায়। কিন্তু আমাদের দেখতে হবে কুকুর যেন ঘেউ ঘেউ না করে। আমরা পবিত্র মাটির জন্য যুদ্ধ করতে প্রস্তুত।

জনাব. স্পিকার: এখন, কাগজপত্র রাখুন।

বিবৃতি: ভারতে পাকিস্তানের আগ্রাসন সংক্রান্ত সর্বশেষ অবস্থান।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী (শ্রী জগজীবন রাম): জনাব ডেপুটি স্পিকার, আজ আমাদের উপর পাকিস্তান দ্বারা যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার এগারোতম দিন। শত্রু তার আক্রমণের লক্ষ্য অর্জনে প্রায় সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায়, পাকিস্তানী বাহিনী প্রচুর লোকসান দেবে। যা শুধুমাত্র বিদেশি উৎস থেকে তারা মেটাতে পারে। আমি আপনাকে বিভিন্ন ফ্রন্টে যুদ্ধের বিস্তৃত ধারনা দিতে চেষ্টা করব।

কারগিল এবং তিথওয়াল সেক্টরে বেশ কিছু পোস্ট দখল করা হয়েছে। ফলস্বরূপ, এটা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে যে শত্রুদের যান এই এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতে পারবেনা।

উরি, পুঞ্চ, রাজাউরি এবং নাউশেরা সেক্টরে শত্রুর পক্ষের প্রচেষ্টা ব্যার্থ হয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনীর যুদ্ধবিরতি লাইন থেকে চাপ বিরতি নেয়া হয়েছে। আরও কিছু পোস্টে অভিযান চালিত হয় এবং কয়েকটি আমাদের দখলে আসে। আমাদের রণকৌশলগত অবস্থান এখন অনেক ভালো এবং শ্রেয়।

হাউস ছিম্ব খাতে উন্নয়নের ব্যাপারে এখন সতর্ক। এক পর্যায়ে শত্রুরা মুন্নাওয়ার তাওই এর পূর্বাঞ্চলীয় পাড়ে এগিয়ে চাপ সৃষ্টি করতে চায়। শত্রুরা ইস্টার্ন ব্যাংক ছাড়তে বাধ্য হয়। শত্রুরা যদিও এখনও মুন্নাওয়ার তাওই এর পশ্চিমে উপস্থিত কিন্তু পূর্ব পাড়ে আমাদের প্রতিরক্ষাবাহিনী তাদের প্রচেষ্টা বানচাল করেছে। আমাদের বাহিনী এখন নদীর পূর্ব তীরে পরিখা খনন করেছে এবং ভালো অবস্থানে আছে এবং এখন তারা পশ্চিম তীরে টহল করতে সক্ষম। সাম্বা-পাঠানকোট সেক্টরে আমাদের অনুসন্ধান যথেষ্ট কৌশলী অবস্থানে উন্নত হয়েছে এবং পিছনে আমাদের অত্যাবশ্যক সড়ক যোগাযোগ এখন আরও সুরক্ষিত।
পাঞ্জাব সেক্টরে শত্রু আমাদের অঞ্চল দখলের জন্য বারবার প্রয়াস চালায়। কিন্তু রবির দুপাশে ছিটমহলের দখল আমাদের। আমাদের আত্মরক্ষামূলক অবস্থান এখন অনেক শক্তিশালী। গত কয়েক দিন ধরে, সেখানে তেমন কিছুই হয়নি।

সন্মানিত সদস্যদগন শত্রুরা জয়সালম সেক্টরের রামগড় এলাকায় যে আক্রমণের চেষ্টা করেছে সে সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। এই প্রয়াসে শত্রুদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতিসহ তারা হতাশ হয়েছে.। তাদের আমাদের অঞ্চল ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে এবং এখন আমরা তাদের সীমানার মধ্যে কয়েক মাইল অগ্রসর হয়েছি। বার্মার সেক্টরের আরও দক্ষিণে নয়া চরে যুদ্ধ আগাচ্ছে। বাহিনীরা তাদের অবস্থান চাঙ্গা করেছে এবং ভালো জবাব দিচ্ছে। আমি এই হাউজে জানাতে চাই যে রাজস্থান বর্ডারের হুমকি দূর করা হয়েছে।

কুচ সেক্টরে আমাদের বাহিনী ভিরাঅয়াহ গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল করে এবং নাগাড়পার্কার এলাকা দখল হয়। আমাদের বাহিনী এখন সিন্ধু প্রদেশের প্রায় এক হাজার বর্গকিলোমিটারের কাছে। সেই এলাকায় সাধারণ নাগরিক বিষয়ক ব্যাপারগুলো এখন দেখাশোনার চেষ্টা চলছে।

এখন, আমি পূর্ব ফ্রন্টের ব্যাপারে বলব। সন্মানিত সদস্যরা এই ব্যাপারে সচেতন যে মুক্তিবাহিনীর সাথে মিলে এক সঙ্গে আমাদের বাহিনী বাংলাদেশের বৃহৎ এলাকায় স্বাধীনতা সফল করার কাজ করছে। নোয়াখালী, লাকসাম, চাঁদপুর, ফেনী, কুমিল্লা, গাইবান্ধা, সিলেট, ময়মনসিংহ, জামালপুর, কুষ্টিয়া, যশোর ও হিলি প্রধান শহরগুলোতে দুই শক্তির সম্মিলিত হামলায় সেগুলোতে এখন পাকসেনারা ভূপতিত। পাকিস্তানি সৈন্যদের কিছু জোট এখন আত্মসমর্পণ করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে।

আমাদের দ্রুতগতি ঠেকাতে শত্রুরা সেতু ধ্বংস এবং নদীতীর ধ্বংস করছে। মুক্তিবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের বাহিনীকে সাহায্য করার চেষ্টা করছে এবং নদী পাড় হতে সাহায্য করছে। আমরা হেলিকপ্টার ব্যবহার করছি শত্রু লাইনের পিছনে আমাদের সৈন্য পৌঁছাতে। এয়ার প্যারাট্রুপ্স ইতিমধ্যে ঢাকার উত্তর এলাকায় নেমেছে। এবং তারা মুক্তিবাহিনী এবং আমাদের স্থল বাহিনীর সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে।

আমাদের বাহিনী এখন বিভিন্ন দিক থেকে ঢাকা আগাচ্ছে। ঢাকার কিছু অংশ আমাদের আর্টিলারি সীমানার মধ্যে আছে। আগে আমাদের চিফ পাকিস্তানী বাহিনীর কাছে দুইটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন যার কোন জবাব আসেনি। পরে তিনি তৃতীয় একটি বার্তা জেনারেল রাও ফরমান আলী বা অন্য কোন কর্মকর্তা যিনি ঢাকা গ্যারিসন কমান্ডিং করছেন তার কাছে পাঠান। তিনি লিখেছেন সবার উচিৎ নিরপরাধ রক্তপাত প্রতিরোধের জন্য দায়িত্ব নেয়া। তিনি দখলদার বাহিনীর কমান্ডার এর কাছে আপিল করেছেন যেন তাকে তার মানবিক দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে পালনের ব্যাপারে সহযোগিতা করা হয়। তিনি আহ্বান জানিয়েছেন যে ক্ষেত্রে ঢাকা গ্যারিসন যদি প্রতিরোধের প্রস্তাব বহাল করার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে সকল বেসামরিক নাগরিক এবং বিদেশী নাগরিকদের সংঘাতের এলাকা থেকে যেন নিরাপদ দূরত্বে অপসারণ করা হয়। আমি বিশ্বাস করি যে অন্তত এই পর্যায়ে জেনারেল মানেকশ এর পরামর্শে তারা মনোযোগ দেবে এবং সেই ভাবে কাজ করবে।

আমরা সংঘাতের এলাকায় বেসামরিক জনগণের ব্যাপারে গভীরভাবে সচেতন আছি। এটা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একমত যে সমগ্র বেসামরিক জনগণ ও বাইরে থেকে যারা সেখানে আছে তাদের প্রটেকশন নিশ্চিত করে আমাদের কাজ করতে হবে।

এটির জন্য আমরা আটকা পড়া বিদেশী নাগরিকদের করাচি, ইসলামাবাদ এবং ঢাকা থেকে সরে যেতে বলেছি। আমাদের বিমান বাহিনী আগাম বিজ্ঞাপিত সময়ে বিরত আছে। যাতে এই সব শহর থেকে সরে যেতে সুযোগ পায়। একইভাবে, ভারতীয় নৌবাহিনী নিরপেক্ষ জাহাজ গুলোকে নিরাপদে পাকিস্তান ছেড়ে যাবার জন্য সাহায্য করার নির্দেশ দেয়া আছে। এই ব্যাপারে জাতিসংঘ এবং বিদেশি সরকারগুলোর আমাদের ডিফেন্স সার্ভিসে কে প্রশংসা করেছে। কিন্তু শত্রুপক্ষ এই যুদ্ধবিরতির সুযোগ নিয়ে তাদের নিজস্ব এয়ারফিল্ডে যুদ্ধ উপকরণ অবতরণ করাচ্ছে এবং তাদের জলভাগে মাইন স্থাপন করছে।

পাকিস্তান বিমানবাহিনী বিমান ধ্বংস করে দেবার জন্য আক্রমণ চালিয়েই যাচ্ছে এবং আমাদের ইনস্টলেশন ও রানওয়ে অব্যবহার্য করার চেষ্টা করছে। হাউস শুনে খুশি হবেন যে এপর্যন্ত তারা আমাদের একটি মাত্র বিমান ধ্বংস করতে পেরেছে এবং আমাদের সবগুলো এয়ারফিল্ড ঠিকঠাক আছে। অন্যদিকে আমাদের প্রতিরোধমূলক হামলায় পাকিস্তানের সংকেত ইউনিট, রানওয়ে এবং অন্যান্য স্থাপনা যথেষ্ট ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছে। শত্রুরা দিবালোকে হামলা খুব কম করছে। রাতেও অবশ্য তাদের কার্যকলাপ কমে গেছে। পাক বিমানবাহিনী কিছু অঞ্চলে স্থল অভিযানে ভালো সহায়তা প্রদান করেছে। ভারতীয় বিমান বাহিনী পাকিস্তানী বাহিনীর সরবরাহ বন্ধ করার এবং তাদের সাঁজোয়া গঠন এবং সেনা একত্রীকরণে বাঁধার জন্য কাজ করে যাচ্ছে।

আমাদের বিমান বাহিনীর অপারেশন বাংলাদেশে দ্রুত প্রবেশে বিশাল ভূমিকা রাখছে এবং আমাদের পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তানের পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়েছে।

সম্প্রতি পাকিস্তানের বোমা আরো এলোমেলো এবং ত্রুটিযুক্ত হয়ে গেছে। তারা এখন ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু বেসামরিক টার্গেটে আক্রমণ করছে। তিন দিন আগে জুল্লুন্দুর এর কাছাকাছি কিছু গ্রামে বেসামরিক লোকদের উপর বোমাবর্ষণ করা হয়। প্রায় ১০০ জনের মত হতাহত হয়। জুরজান এ একটি বেসামরিক হাসপাতালে আক্রমণ করা হয়। শ্রীনগরের কিছু বেসামরিক এলাকা পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের নজর কেড়েছে। অন্যদিকে আমাদের বিমান বাহিনী শুধুমাত্র সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করছে। বেসামরিক এলাকা এড়াতে চেষ্টা করছে। হাউস এখন একটি সত্য জানবেন যে ঢাকায় পাকিস্তানি বিমান একটি এতিমখানা ধ্বংস করে আমাদের উপর সেই দায় চাপিয়েছিল।

এই হাউস অবগত আছেন যে ভারতীয় নৌবাহিনী সফলভাবে করাচী ন্যাভাল পোতাশ্রয়ের প্রতিরক্ষাকে ভেঙ্গে ঢুকে গেছিল এবং গাওয়াদার থেকে করাচি পর্যন্ত পাকিস্তানি নৌ ইনস্টলেশনের উপর সফল সাহসী অভিযান চালিয়েছিল। পাকিস্তানি বহরের একটি অংশ ধ্বংস করা হয়েছে, পশ্চিম পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সমুদ্রসীমা সংযোগ ছিন্ন হয়েছে, এবং করাচি সমুদ্র দিয়ে সরবরাহ এবং পাক-অধিকৃত বাংলাদেশে পোর্ট প্রতিরোধ করা হয়েছে। নেভি বিচক্ষণতা এবং নমনীয়তার সাথে নিয়ন্ত্রণ জোরদার করতে সক্ষম হয়েছে। কিছু পাকিস্তানি জাহাজ এবং পাকিস্তানের কার্গো বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে আমাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু সাধারণ শিপিং লাইন ঝামেলার সম্মুখীন হয়েছে – তাদের ব্যাপারটি সন্তোষ্টজনক সমাধান করা হয়েছে। নিরপেক্ষ জাহাজগুলোকে সংঘর্ষের এলাকা থেকে দূরে সরতে পর্যাপ্ত সুযোগ প্রদান করা হয়েছে।

পাকিস্তানি নৌবাহিনী আমাদের বণিক জাহাজের উপর হস্তক্ষেপ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের পোর্ট পূর্ণ গতিতে চলছে। এই সব নৌ অপারেশনে, আমরা কেবল একটি ছোট রণতরিবিশেষ হারিয়েছি।
এই হাউস স্বাভাবিকভাবেই হতাহতের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন আছে। গত দশ দিন ধরে তীব্র লড়াইয চলছে। আমার কাছে গত কাল সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত সব তথ্য আছে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর হতাহতের তালিকা –
হারিয়ে যাওয়া – ১৬৬২ জন
আহত – ৫০২৫ জন
নিহত – ১৯৭৮ জন

পাকিস্তানের হতাহত আরও অনেক বেশী। আমার কাছে সঠিক তথ্য নেই। সম্ভবত, এখন পর্যন্ত ৪১০২ জন কর্মকর্তা ও পাকিস্তানের নিয়মিত বাহিনী ও তাদের আধা সামরিক বাহিনীর থেকে ৪০৬৬ জন অফিসার ও সৈনিকরা আমাদের হেফাজতে আছে।

আমরা এখন পর্যন্ত ১৭৫ টি পাকিস্তানি ট্যাংক হিসেব করেছি যার ১৮ টি সচল অবস্থায় আমাদের কাছে আছে। আমাদের মাত্র ৬১ টি ট্যাংক ধ্বংস হয়েছে।

৯ জন পাইলট এবং ভারতীয় বিমান বাহিনীর ৩ জন ন্যাভিগেটর প্রাণ হারিয়েছেন। ৩৬ জন পাইলট এবং ৩ জন ন্যাভিগেটর নিখোঁজ রয়েছেন। আমরা এক নৌ বিমান সহ ৪১ টি প্লেন হারিয়েছি।

পাকিস্তানি পাইলট ও ন্যাভগেটরের ক্ষতির পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। তবে আমুনানিক হিসাবে প্রায় ৮৩ টি বিমান হারিয়েছে বলে জানা যায়।

পাক নৌবাহিনীর বড় লোকসান হল ২ টি ডেস্ট্রয়ার ২ টি মাইন পরিস্কারক, ২ টি সাবমেরিন, ১৬ টি গানবোট এবং ১২ টি বিবিধ নৈপুণ্যের যান। তবে কর্মকর্তা ও পাক নৌবাহিনীর সদস্যের সংখ্যা আমাদের জানা নেই।

হাউস জানেন, আমরা আমাদের ব্যাপক নৌ অভিযানে শুধুমাত্র একটি রণতরিবিশেষ হারিয়েছি। ১৮ জন কর্মকর্তা ও ১৭৩ জন নাবিক এখনো নিখোঁজ। ৬ কর্মকর্তা ও ৯১ নাবিকদের উদ্ধার করা হয়েছে।

আমি নিশ্চিত, এই হাউস সেই সকল অফিসার ও সৈনিক যারা আমাদের মাতৃভূমি রক্ষার জন্য প্রাণ হারিয়েছেন তাদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করবে।

এছাড়া হাউস ধন্যবাদ দেবে এই কারণে যে লড়াইয়ের প্রধান অংশ শত্রু দের মাটিতে হয়েছে এবং আমাদের পশ্চিম সীমানা নিরাপদ দূরত্বে ছিল। এই মহৎ কর্ম সঞ্চালনের জন্য আমাদের ডিফেন্স সার্ভিসেসের প্রতি হাউস কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে।

বাংলাদেশ সরকার ও তাদের নিয়মিত বাহিনীকে ধন্যবাদ দিতেই হবে কারণ তারা আমাদের সেনাবাহিনীর সঙ্গে ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছে যে কারণে দখলদার বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশ ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ অভিযানের মাধ্যমে বাংলাদেশ মুক্তির প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন হবে।

জনাব. ডেপুটি স্পিকার: হাউস আগামীকাল সকাল ১০ টা পর্যন্ত মুলতবি করা হল।

বিবৃতি: বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানের বাহিনীর
নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ

প্রধানমন্ত্রী, আণবিক শক্তি মন্ত্রী, ইলেক্ট্রনিক্স মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী (শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী): জনাব স্পিকার, আমি একটি ঘোষণা দেব যার জন্য হাউস অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছে। পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নিঃশর্তে বাংলাদেশে আত্মসমর্পণ করেছে। পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ডের পক্ষ থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা জিওসি-ইন সি (ভারত ও বাংলাদেশের বাহিনী) আত্মসমর্পণ পত্র গ্রহণ করেন। ঢাকা এখন একটি স্বাধীন দেশের মুক্ত রাজধানী।

এই হাউস এবং সমগ্র জাতি এই ঐতিহাসিক ঘটনায় আনন্দিত। আমরা মহানন্দে বাংলাদেশের মানুষের প্রশংসা করছি। আমরা তাদের বীরত্ব এবং উতসর্গের জন্য সাহসী যুবক ও মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের প্রশংসা করছি। আমরা গর্বিত আমাদের নিজস্ব সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রতি, যারা এত চমৎকারভাবে তাদের মান এবং ক্ষমতা দেখিয়েছে। তাদের শৃঙ্খলা ও কর্তব্য নিষ্ঠা সুবিদিত। ভারত কৃতজ্ঞতার সাথে যারা জীবন দিয়েছেন তাদের ও তাদের পরিবারের সঙ্গে থাকবে এবং তাদের আত্মত্যাগ স্মরণ করবে।

জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যুদ্ধের পাকিস্তানি বন্দিদের চিকিৎসার জন্য এবং মানবিক পদ্ধতিতে বাংলাদেশের সবস্তরের মানুষের সাথে অবস্থান করতে কড়া নির্দেশ দেয়া হল। মুক্তিবাহিনীর কমান্ডাররাও তাদের বাহিনীকে অনুরূপ আদেশ জারি করেছে। যদিও বাংলাদেশ সরকার এখনো জেনেভা কনভেনশন স্বাক্ষর করতে সুযোগ পায়নি। তবে তারা ঘোষণা করে যে, তারা সম্পূর্ণরূপে তা মেনে চলবে। যে কোনো প্রতিহিংসামূলক কাজ বাংলাদেশ সরকার, মুক্তিবাহিনী ও ভারতের সশস্ত্র বাহিনী প্রতিরোধ করবে।

আমাদের উদ্দেশ্য ছিল সন্ত্রাসের রাজত্ব থেকে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে তাদের মুক্তিবাহিনীকে ও মানুষদের সাহায্য করা এবং তাদের উপর আসা আগ্রাসন প্রতিহত করা। পাশাপাশি আমাদের দেশকে সুরক্ষা করা। ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী তার প্রয়োজন ছাড়া একটি মুহুর্তের জন্য বাংলাদেশে থাকবে না।

লক্ষ লক্ষ মানুষ যারা আমাদের সীমানা জুড়ে তাদের বাড়িঘর ফেলে এসেছিল তারা ফিরে যাচ্ছে। এই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে তাদের পুনর্বাসনের জন্য সরকার ও জনগণকে কাজ করার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে।

আমরা আশা করি এবং বিশ্বাস করি যে এই নতুন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান তার নিজের লোকদের সঠিক দিকনির্দেশনা দেবেন এবং শান্তি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবেন। একদসঙ্গে তাদের দেশকে সোনার বাংলা করার সময় এসেছে। তাদের জন্য আমাদের শুভ কামনা।

এই জয়জয়কার শুধু তাদের একার নয়। সমস্ত জাতি যারা স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগ করেছেন সবাই এর অংশীদার।

বিভিন্ন সদস্যগন: ইন্দিরা গান্ধী জিন্দাবাদ।

শ্রী সমর ঘা (Contai): প্রধানমন্ত্রীর নাম বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে স্বর্নাক্ষরে খচিত থাকবে।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!