You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে ভারতের দলিলপত্র - মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা ০৩ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সূত্র তারিখ
৭৩। যুদ্ধ চলাকালে ভারতী শস্ত্র বাহিনীসমূহের উদ্যেশে আকাশবাণী বেতারে প্রচারিত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বানী ইয়ার্স অফ এন্ডেভার ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১

Aparajita Neel

<১২, ৭৩, ১৮২>

বিজয়  আমাদেরই

আপনারা আমাদের স্বাধীনতা ও সম্মান রক্ষার জন্য সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। সমগ্র দেশ আপনাদের প্রশংসা করে। আমাদের জনগণ আপনাদের সাথে আছে। সব অঞ্চলের মানুষ, সব ভাষার, সব ধর্মের, সব রাজনৈতিক দল আগে কখনো এমন ঐক্যবদ্ধ ছিলোনা। তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যেমন করে আপনারা আগ্রাসককে পরাস্ত করতে প্রস্তুত। তারা তাদের কৃতকর্মের উপর গভীর আত্মবিশ্বাসী এবং আপনাদের যে ক্ষমতা আছে সেই অনুযায়ী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করুন।

শত্রুরা একটি ধর্মীয় যুদ্ধের মিথ্যা এবং ক্ষতিকর আওয়াজ তুলেছে। বাংলাদেশের জনগণ, যারা সিংহভাগ মুসলমান, তারা ইসলামাবাদের সামরিক শাসকদের মানানসই উত্তর দিচ্ছে।

আপনারা এবং আমরা একটি নীতির উপর নির্ভর করে যুদ্ধ করছি – তা হল সব ধর্মের মানুষ সমান এবং ভাই ভাই। আমরা সমতা ও ভ্রাতৃত্বের মহান আদর্শ মেনে চলি, যা আমাদের গণতন্ত্রের জীবন এবং রক্ত। ভারত অর্থ শুধুমাত্র জমি, পাহাড়, নদী – যা আমাদের দেশে দেখা যায় তাই নয় –  শুধুমাত্র ৫৬০০০০ গ্রাম ও শহর নয়, শুধুমাত্র ৫৫০ লক্ষ মানুষ নয় – বরং ভারত অর্থ সহনশীলতার আদর্শ ও নৈতিকতার প্রতি সম্মান দেখানো একটি দেশ যা ভারত বিগত ৩০ শতক ধরে বহন করছে।

প্রিয় দেশবাসী, ভালো ভাবে যুদ্ধ করুন। বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত।

আর্মড ফোর্সেস থেকে ম্যাসেজ, অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে সম্প্রচারিত, ১০ ই ডিসেম্বর, ১৯৭১

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৭৪। দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণ ইয়ার্স অফ এন্ডেভার ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash

<১২, ৭৪, ১৮৩১৯৬>

কেন এই যুদ্ধ

আমি আপনাদের কাছে আসতে পেরে খুবই আনন্দিত। আপনাদের উদ্যম দেখতে পেরে এবং এখানে কথা বলতে আসতে পেরে ভালো লাগছে। যদিও নতুন করে আমার কিছু বলার নেই। আমরা কি জন্য যুদ্ধ করছি? আমরা শুধুমাত্র আমাদের অঞ্চল এবং সম্মানের জন্য না বরং কিন্তু কিছু উচ্চ আদর্শের জন্য যুদ্ধ করছি। আমি খুশি যে বর্তমান যুদ্ধে শুধুমাত্র আমাদের সাহসী অফিসার ও জওয়ান নয়, সামগ্রিকভাবে জনগণ, ছাত্রসহ সবাই অংশ নিচ্ছেন। আমি আপনাদের থেকে জওয়ানদের জন্য পাওয়া ১০১০০০ টাকার জন্য কৃতজ্ঞ। আমি নিশ্চিত যে আপনারা জাতি পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন।

শিক্ষার্থীরা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যদি ছাত্রসমাজ মুক্তির জন্য আমাদের সংগ্রামের পুরোভাগে না থাকতেন, তাহলে আমরা সাফল্য অর্জন করতাম না। বিগত বহু বছর ধরে, আমরা যে স্বাধীনতা শক্তিশালী করার চেষ্টা করছি। সদা জাগ্রত থাকার দরুণ স্বাধীনতা অর্জিত হয়। আমরা সবসময় আমাদের একতা জোরদার করেছি এবং দৃঢ়তা ও সাহসের সঙ্গে তা করেছি। এছাড়াও, আমাদের এই কাজ মানুষের কাছে অর্থপূর্ণ হতে হবে।

আমরা অনেক অর্জন করেছি তবু আমাদের ভাগ্য এখনো আমাদের স্বপ্নের মত রূপ লাভ করেনি। দারিদ্র্য ও পশ্চাৎপদতা সাধারণ মানুষের স্বাধীনতার ফল পাবার পথে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। আমাদের জনগণ বিনামূল্যে নাগরিকের সব অধিকার ভোগ করতে সক্ষম হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করার সুযোগ আছে। এই দেশের অনেক মানুষ এখনও এই বিশেষ সুবিধা থেকে বঞ্চিত আছে। আমাদের স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ থাকবে  যতদিন প্রতিটি গ্রামে উন্নয়নের জন্য পূর্ণ সুযোগ থাকবে – হোক সেটা সমতল, পাহাড় বা মরুভূমিতে।

আমরা ক্রমাগত যে পথ নিজেদের জন্য বেছে নিয়েছি তার জন্য গর্বিত। আমাদের এই পথে অনেক দুর্বলতা, ভুল এবং বাঁধা এসেছে। আমাদের বিরুদ্ধে আগ্রাসন ছিল। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল। এই সব সত্ত্বেও এগিয়ে গেছি। একটি মুহূর্ত অবকাশ ছিল না। তোমরা আনুগত্যের নিশ্চয়তা দাও তাহলেই আমি জানি যে ছাত্রসমাজ এই দেশের সামনের সকল বিপদের  জন্য প্রস্তুত হবে। আমাদের অবশ্যই জানতে হবে যে নিছক উদ্দীপনাই যথেষ্ট নয়। আমাদের আদর্শ ও মূলনীতির জন্য যুদ্ধ হয় যা এই দেশের ঐক্যের ভিত্তি।

আমরা যুদ্ধে যেতে চাই না। এটা সবাই জানে যে বিশ্বের শান্তির জন্য আমরা ২৫ বছর ধরে চেষ্টা করছি। এবং আমরা অবশ্যই বিশ্বের কিছু অঞ্চলে শান্তি আনার ব্যাপারে ভূমিকা রেখেছি। কিন্তু, শান্তি কি? শান্তি মানে এই নয় যে একটি প্রতিবেশী দেশের লোকদের অত্যাচার দেখেও আমরা শান্ত থাকব। যে যুদ্ধ আজ আমাদের সীমানার কাছে হচ্ছে এবং বাংলাদেশে – তাতে আমাদের কোন হাত নেই। এমনকি আমরা জানতাম না যে সেখানে একটি যুদ্ধ হতে চলছে।

আমরা খুশি ছিলাম যে পাকিস্তান সামরিক শাসনের অনেক বছর পর একটি সাধারণ নির্বাচন হয়েছে। একটি নির্দিষ্ট দলের নেতা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। আমরা নির্বাচনের সঙ্গে বা নেতাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলাম না। কিন্তু আমরা কি জানি যে যারা জয়ী হয়েছিল, ভারতের পক্ষ থেকে তাদের সাথে বন্ধুত্ব চেয়েছিলাম। আমরা কখনোই প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে যুদ্ধ চাইনা। যাইহোক, কিছু ঝামেলা আছে, যেটা আমাদের ওপর প্রভাব ফেলে। আমরা খুশি ছিলাম যে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং সেখানে একটি সরকার হবে যারা আমাদের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ হবে। এবং আমরা একসঙ্গে আমাদের সমস্যা সমাধান করব। মানুষের দারিদ্র্য বিমোচন ও দেশের উন্নতির জন্য।

আমাদেরও একটি সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল। এবং আমরা একটি নতুন সরকার গঠন করি। আমাদের প্রতিবেশী দেশের  নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। কিন্তু তাদের  নিজস্ব সরকার গঠন করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। এই পর্যায়ে যুদ্ধ সত্যিই শুরু হবার উপক্রম হল।

আমি বর্তমান ঝামেলাকে ঐতিহাসিক পটভূমি দিয়ে বুঝতে চাই। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং আমরা আশা করেছিলাম যে আলোচনা ফলপ্রসূ হবে এবং একটি জনপ্রিয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে। যদিও আমরা জেনেছি যে সমঝোতার নামে  চাতুর্য করে  পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে বিশাল পরিমাণ সেনা আনা হচ্ছিল। এই বাহিনী ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র মানুষের উপর বড় হামলা চালায়। আওয়ামী লীগ নেতারা আমাদের ২৪ তারিখ বলেছিল যে তারা আশা করে যে সমঝোতা ফলপ্রসূ হবে। কিন্তু তাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ এর জন্য তারা প্রস্তুত ছিল না। একই ধরণের আক্রমণের চিন্তা তারা করেছিল যখন ভারত ব্রিটিশদের  বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলনে ছিল। কিন্তু তারা সে সুযোগ পায়নি। তারা বন্দুক ও মর্টার দিয়ে হামলা চালায়। তাদের মহান নেতাকে গ্রেফতার করা হয় এবং তাকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে  ‘অভিযুক্ত করা হয়। ফলে স্বাধীনতা চাওয়া ছাড়া তাদের আর কোন বিকল্প নেই।

বাংলাদেশে নৃশংসতার জন্য সেখানকার মানুষের জন্য আমাদের গভীর সমবেদনা আছে – যদিও পাক সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে ক্রোধ রয়েছে তবু আমরা চুপ করে রইলাম। আমরা একটি শব্দও উচ্চারণ করিনি বা একটি পদক্ষেপ নেইনি যাতে বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের মধ্যে একটি উপনিবেশিক মনোভাব  আসতে পারে। তবে পাকিস্তান যখন বাংলাদেশের জনগণ, আবালবৃদ্ধ, নারী ও শিশু দের নির্যাতন করা শুরু করে এবং বন্যার মত আমাদের দেশে নিরস্ত্র অসহায় মানুষদের প্রবেশ শুরু হয় তখন এটি শীঘ্রই আমাদের জন্য একটি বড় বোঝা হয়ে ওঠে। এই সব করার পর এটা আর পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার থাকল না।

এই পর্যায়ে আমরা বলেছিলাম যে কি বাংলাদেশে কি ঘটছে তা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন এবং যদিও এ সম্পর্কে কথা বলার কোন অধিকার আমাদের ছিলোনা। এটা সিদ্ধান্ত নিবে বাংলাদেশের জনগণ  ও তাদের নেতারা। আমরা বলেছিলাম  যে ভারত শুধু  গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবে তাদের সমস্যার জন্য আমাদের কি প্রভাব পড়বে সেটি নিয়ে। এটি অবশ্যই আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। আমরা আমাদের চোখ বন্ধ করে রাখতে পারিনা। আমরা এটা পুরো বিশ্বের কাছে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত করেছি এবং বুঝাতে পেরেছি যে দুই দেশ যুদ্ধের কাছাকাছি এগিয়ে যাচ্ছে। যদি বিশ্বের দেশগুলি যুদ্ধ বন্ধ করতে চায় তাহলে এখনো তাদের সময় আছে – তারা তা পারে। তারা বাংলাদেশের জনগণের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য কাজ করতে পারে।

আমরা জানি যে, এটা হঠাৎ করে করা যাবেনা। এবং আমরা বলি নি যে এটা অবিলম্বে সম্পন্ন করা উচিত। আমরা শুধুমাত্র বলেছি তাদের একটি বা দুটি ধাপ গ্রহণ করা উচিত। তাতে বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্খার পূরণ হতে পারে। এবং তা নিশ্চিত করার জন্য তাদের ইচ্ছা শোনা গেল। এমন পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি হতে পারে। ভুয়া নির্বাচন অনুষ্ঠান হবে নির্ধারিত ছিল। এবং সর্বশেষে, আলোচনার কিছু বিষয় সাজানো হয়  যা বাংলাদেশের জনগণ ভেবেছিল যে হয়ত হবে।

এই অবস্থায় একটি আন্দোলনের পরিবেশ ছিল। আমাদের বলা হয়েছিল বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। আমরা স্পষ্ট বিশ্বাস করেছি যে আমরা এমন কোন সরকার মেনে নেবনা যারা নির্বাচনে হেরেছে। বাংলাদেশের মানুষও এমনটা মেনে নেবেনা।

আমরা কখনোই বলিনি যে আমরা পুরো বিষয়টা চেয়েছিলাম। আমরা শুধুমাত্র বাস্তব পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছি। আমরা সচেতন করেছিলাম যে পাকিস্তানের একটি নির্দিষ্ট বাহিনী বাংলাদেশে অন্যায়ভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। যখন কোন মানুষ মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে, নিজের প্রাণ উতসর্গ করতে প্রসূত থাকে, তাদের সংগ্রাম সফল হতে বাধ্য। এই সব ব্যাপারে বিশ্বজুড়ে মানুষের অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমরা বারবার যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশগুলির কাছে বাস্তব পরিস্থিতির সন্ধান করতে বলেছি। স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম দমন করা সম্ভব না হলে ভবিষ্যতে অন্য পদক্ষেপ বিবেচনা করা হবে। কারণ বাংলাদেশ এখন আমাদের সীমানায়। কাজেই সীমানার কোন ঘটনা আমাদের উপর প্রভাব ফেলতেই পারে।

প্রতিটি দেশের  তার নিজস্ব আদর্শ ও স্বার্থ রয়েছে। আমাদের আদর্শ ও দেশের স্বার্থ একই। আমরা শান্তি চাই, আমরা শান্তি পাব। এমনকি যদিও আমাদের শান্তির জন্য  অভেদ্য লড়াই করতে হয়। এর জন্যই আজ যুদ্ধ  চলছে। যতক্ষণ না বাংলাদেশের পরিস্থিতি শান্ত হয় ততক্ষণ সেখানে বা আমাদের দেশের পূর্বাঞ্চলে শান্তি আসবেনা।

বর্তমান অবস্থার কারণ পরীক্ষা করা যাক। পাকিস্তান একটি ভুল ভিত্তির ওপর গড়ে উঠেছে। যথা, তারা এক ধর্মের  ভিত্তিতে একটি জাতির গঠন করতে চায়। বিশ্বে এমন কোন দেশ নাই যেখানে শুধু এক ধর্মের মানুষ রয়েছে। বস্তুত, সব দেশই আজ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ আছে এবং তাদের সমতা ও ন্যায়বিচার দেয়া হয়। পাকিস্তান গঠনের ভিত্তিতেই এই ভুলটা ছিল।

এখানে এমন কিছু লোক আছে যারা মনে করে পাকিস্তান চূর্ণ করার এটাই শেষ সুযোগ। যদিও এটি কখনই সরকারের নীতি না। আমি নিশ্চিত যে এটা দেশের মানুষের মতামত নয়। আমরা পাকিস্তানের অস্তিত্ব চাই। কিন্তু এটি সম্ভব শুধুমাত্র যদি সঠিক পথ অনুসরণ করা হয়। যদি পাকিস্তান নিজেই নিজের ধ্বংস ডেকে আনে তাহলে বাইরের কারো কিছু করার নেই।

বড় ক্ষমতাশালি দেশগুলো  পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্তি বাড়ানোর ব্যাপারে সাহায্য করেছে কিন্তু তারা সেখানকার মানুষের জন্য কিছু করতে পারেনি। তারা যে সাহায্য দিয়েছে তা মানুষের কাছে  কখনও পৌঁছেনি। শাসকরাই সব নিয়ে গেছে। ফলে পাকিস্তানের  শক্তি সম্পর্কে মিথ্যা ধারনা হয়েছে – আসলে তাদের ভিত্তি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।

অনেক দেশ আমাদের ঐক্য নিয়ে উপহাস করেছে। তারা বলছে যে আমাদের আছে অনেক ভাষা এবং অনেক ধর্ম। এখানে কীভাবে একতা হয়। তারা বলেছিল কিভাবে নিরক্ষর এবং দরিদ্র মানুষের একটি দেশে গণতন্ত্র হবে? পশ্চিমা মন্তব্যকারীরা অবাক হল এটা দেখে যে কিভাবে ভারত এত বৈচিত্র্যের  মুখে তাদের ঐক্য বজায় রাখতে পারল? যাইহোক, আমরা আমাদের পথ অনুসরণ করব। কারণ আমরা নিশ্চিত যে এটা সঠিক পথ। এবং যারা আমাদের সমালোচনা করবে তাদের অতীতের মত বহুবার আমরা প্রমাণিত করে দেব আমরা কি ছিলাম। এটা দু: খজনক যে তারা ভারত এবং তার সাহসী মানুষদের  বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল।

আমাদের দেশ অনেক পুরনো – আমাদের সভ্যতা কয়েক শতাব্দী পুরনো। এবং আমরা সেই সময় থেকে নীতি অনুসরণ করার চেষ্টা করি। মানুষ হিসেবে অবশ্যই সর্বোচ্চ আদর্শের অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি। আমরা এও জানি যে, আমাদের সমাজ জীবনে সবসময় তা প্রতিফলিত হয় না। যাইহোক, আমরা চেষ্টা করি, এবং আমরা আদর্শ সমুন্নত রাখার প্রক্রিয়া চালিয়ে যাব। আমরা আমাদের স্বপ্নের দেশ গড়ে তুলতে চেষ্টা করে যাব এবং এই প্রচেষ্টা আমাদের মানুষ যারা বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন ভাষার এবং বিভিন্ন মতামতের – এদের সবাই মেনে চলব। তাই যতদিন আমরা এই আদর্শ অনুধাবন করব এবং আমাদের মনোনীত পথ মেনে চলব ততদিন কোন কিছুই আমাদের ঐক্য চূর্ণবিচূর্ণ বা আমাদের দুর্বল করে দিতে পারবেনা। এটাই বাইরের মানুষ বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে।

ছোট দেশ যেখানে মানুষ একাধিক ভাষায় কথা বলে – আমরা দেখেছি সেখানে অন্তহীন যুদ্ধ চলছে। ভাষা প্রশ্নে আমাদেরও প্রশ্ন জাগে কিন্তু বাইরে মানুষ বুঝতে অক্ষম যে এখানে মানুষ অনেক ভাষায়- প্রায় ষোলটি – কথা বললেও ঐক্য বজায় আছে। যাইহোক, এতে আমাদের  কোন সমস্যাই হচ্ছেনা।

স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই আমরা দেশ গঠনে নিযুক্ত আছি। এটি একটি দু: খের বিষয় যে আমরা অনেক বছর দাসে পরিণত হয়ে ছিলাম। আমাদিগের এই মহান দেশ, তার সভ্যতা বিদেশী আধিপত্যের দ্বারা চূর্ণ হয়েছে। আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বৃহৎ পরিসরে নিষ্পেষিত হয়েছিল – যাতে করে আমরা নিজেদের দুর্বল ভাবতে বসেছিলাম। এবং আমরা অন্য দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পারছিলাম না। দুর্ভাগ্যবশত, এই ভয় কিছু মানুষের হৃদয়ের মধ্যে বদ্ধ হয়ে ছিল। তারা বিদেশী পণ্য ক্রয় করতেন এই  চিন্তায় যে সেগুলোর মান উচ্চতর। তা সত্ত্বেও বিদেশীরা আমাদের দেশের কিছু ক্রয় করতে পেরে আনন্দিত হত। বিদেশী দের অধীনে থাকতে থাকতে আমাদের মধ্যে হীনমন্যতা আশ্রয় করে নিয়েছিল। আমরা কি তার বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করিনি?

এটা সত্য যে, আমরা অনেক কিছুতে পিছিয়ে আছি। তার কারণ আমরা এগিয়ে যাওয়ার জন্য সুযোগ পাইনি। একটা সময় ছিল যখন ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে শিল্প বিপ্লব ঘটে। আমরা ক্রীতদাস ছিলাম। আমরা পিছনে ছিলাম। আমাদের প্রশাসকদের এই দেশে কোন প্রগতিশীল শক্তি সৃষ্টি হোক তা ভালো লাগে নি। তারা চেয়েছে যাতে আমরা নিজেদের উপর বিশ্বাস দুর্বল করে রাখি কারণ তারা জানত য়ে এটাই আমাদের অনগ্রসর রাখার একমাত্র উপায় ছিল। কিন্তু ইতিহাসে এমন একটি সময় আসে যখন একটি জাতি ঘুরে দাঁড়ায়। বিদেশী শাসনের সময়কালে, এই ধরনের কিছু একটা ঘটেছে। এটা আমাদের মানুষকে শক্তি দিয়েছে এবং তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল।

ব্রিটিশ শাসকরা আমাদের সংস্কৃতি চাপা দেবার জন্য আমাদের ইংরেজি ভাষা শেখার জন্য আমাদের বাধ্য করেছে। আজ ইংরেজি অধ্যয়নের  বিরোধিতা করা উচিত নয় কারণ এই ভাষা নতুন নতুন আইডিয়ার জন্য একটি বাহন হিসেবে কাজ করে এবং সত্যিকার অর্থে আমাদের স্বাধীনতার জন্য আমাদের সংগ্রাম করাতে উদ্বুদ্ধ করেছে। আমরা ইংরেজি শিখেছি এবং যারা বিদেশে গিয়েছে তারা জেনেছে স্বাধীনতা কি এবং দেখিয়েছে কিভাবে আমরা তা অর্জন করতে পারে। তারা শিখেছে আমরা কিভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারি এবং আমাদের নিজেদের দেশে একটা বিপ্লব আনতে পারি। এর আগে, আমাদের মানুষ এই ভাবে ভাবেনি। কিন্তু ব্রিটেন থেকে আমাদের কাছে এসে আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে এবং ব্রিটিশ শাসনের সংগ্রাম আমাদের সংকল্পকে আরও শক্তিশালী করতে ভূমিকা রেখেছে।

আমি তোমাদের একটি ঘটনা বলব যা আমার এই মুহুর্তে মনে পড়ছে। যখন আমি ইংল্যান্ডে স্কুলে পড়ি এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীর  জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখন স্কুলের প্রধান পরিদর্শক আমাকে আমাদের প্রথম সভায় জিজ্ঞাসা করলেন কেন আমি আমার দেশ এবং বাবা মাকে রেখে এই দেশে এসেছি যেখানকার ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন ছিল? আমার উত্তর ছিল যে আমি এখানকার মানুষকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে জানতে এসেছি যাতে আমি তাদের সাথে আরও ভালো করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে পারি। ইংরেজি এমন একটি ভাষা যা আমাদের স্বাধীনতার অর্জনের জন্য জোর দিয়েছে। অবশ্য এটি একটি পুরানো গল্প।

আমাদের স্বাধীনতা আবার হুমকির সম্মুখীন। আমাদের অঞ্চল, আমাদের চিন্তাভাবনা ও আদর্শ – ধর্মনিরপেক্ষতা, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি ও আমাদের স্বাধীন চিন্তা – এমনকি আমাদের সংকল্প ও মতামত আজ আগ্রাসনের মুখোমুখি।

কিছু জাতি আছে যারা সহ্য করতে পারে না যে ভারত স্বাধীনভাবে তার নিজ  সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা রাখে। তারা অন্যান্য জাতিকে নির্দেশ দেয় একটি নির্দিষ্ট আচরণ করার এবং তারা তা পালন করে। আমরা তাদের বন্ধুত্বকে স্বাগত জানাই এবং বলি যে, আমরা কৃতজ্ঞ জন্য সব ধরনের সাহায্যের জন্য। কিন্তু যদি এই বন্ধুত্ব, বা সাহায্যের সাথে স্বার্থ জড়িত থাকে যা আমাদের স্বাধীনতা এবং আমাদের স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করে, সেক্ষেত্রে আমরা সাহায্যের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেই। আমাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। এটা মনে হয় তারা বুঝতে পারেনি যে আমরা যা বলি তা করি। এবং আমরা আমাদের স্বাধীন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে বদ্ধপরিকর।

বিদেশে ভারতের  সমালোচক  অনেক। জাতিসংঘের একটি বড় সংখ্যা আমাদের বিরুদ্ধে ভোট দেয়। তারা বলে যে যুদ্ধ একটি খুব খারাপ জিনিস এবং যখন এটা বন্ধ করা হবে তখন কিছু বন্দোবস্ত পৌঁছে দেয়া হবে। আমরা আট মাসের জন্য একটি নিষ্পত্তির জন্য অপেক্ষা করছি। আমি কিছু কিছু নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করি এবং তাদের এই পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাই।

একবার আমাকে একটি বিদেশী দেশে  জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল এটি নিষ্পত্তির জন্য কত সময় লাগতে পারে। আমাদের রাষ্ট্রদূত বলেন, “মাত্র কয়েক সপ্তাহ”। এরপর তারা বলেন যে যদি আমরা কয়েক মাসের জন্য অপেক্ষা করি তাহলে সম্ভব। আমাদের রাষ্ট্রদূত বলেন যে অবস্থা মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে একটি বিশেষ মোড় নেবে। বেশ কয়েক সপ্তাহ এবং মাস পেরিয়ে গেছে কিন্তু তারা কিছুই করেনি। বিদেশের  কিছু লোক বলে যে আমি আমার আগের বিবৃতি মেনে চলি না, বা আমি তাদের যুদ্ধের সম্ভাবনা বিরুদ্ধে সতর্ক করা করিনি। আমি জানতাম না একটি যুদ্ধ সৃষ্টি হবে। কিন্তু আমি খুব পরিষ্কারভাবে বিবৃত করেছিলাম যে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে খারাপ দিকে মোড় নিচ্ছে। যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তাহলে যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব নাও হতে পারে।

আমি তাদের বললাম যে, তারা যদি যুদ্ধ প্রতিরোধ করতে চায় তাহলে তারা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এবং সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করুক। যদি এই কাজ করেন তাহলে যুদ্ধ হবেনা। অন্যথায়, যুদ্ধ এড়ানো কঠিন হবে। তারা একটি সমগ্র জাতিকে ধ্বংস করে যাচ্ছে যা ভারত সহ্য করবেনা। এটি বিশুদ্ধরূপে অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হিসাবে গণ্য করা উচিত। কিন্তু বাংলাদেশে যে দমন চলছে তা একটি বড় সমস্যা হয়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতির এইভাবে ঘটানো হয়েছিল যে তা আমাদের মুখের সামনে চলে এসেছে এবং আমাদের না জড়িয়ে কোন উপায় নেই।

যদি আমরা যুদ্ধ শুরু করতে চাই আমাদের কিছু নেতা রাজধানীতে থাকতেন। আমি কলকাতা, যেখানে লক্ষ লোকের একটি খুব সভা  ছিল। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পাটনা এবং বেঙ্গালুরু থেকে ফিরছিলেন। অর্থমন্ত্রী পুনা ছিল এবং এমনকি জানি যে তিনি অবসরের ছিলেন কিনা বা অন্যত্র যাচ্ছেন কিনা। ৫ টা ৪৫ মিনিটে আমাদের পাকিস্তানি আগ্রাসন সম্পর্কে জানানো হয়। আমরা বিকাল ৫ টায় শুরু করেছিলাম। তখন দ্রুত আমি রাজধানীতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করি। আমরা যুদ্ধ শুরু করিনি। এমনকি, তবুও কিছু দেশ বলেছে যে ভারত  আগ্রাসী ছিল।

আমরা স্বাভাবিকভাবেই গভীরভাবে আহত হয়েছি যে যারা গণতন্ত্রের পতাকাবাহী নামে মাত্র পরিচিত তারাই চুপ করে ছিলেন। একটি দেশ গণতান্ত্রিক ফর্মে চলবে নাকি সামরিক শাসনের অধীনে চলবে সেটা নিয়ে তাদের কোন চিন্তাই ছিলোনা। তারা বড় আদর্শের কথা বলে। কিন্তু যখন সময় আসে, তারা তা সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে। আমি জানি না তারা তাদের নিজেদের স্বার্থে বা অন্য কারো স্বার্থে তাই করেছিল কিনা। আমি তাদের বলেছি তারা যদি বাংলাদেশের ব্যাপারে সজাগ না হন, অথবা আমাদের নিজস্ব অসুবিধা সম্পর্কে – তাহলে তারা যা ইচ্ছা করতে পারেন।

এছাড়াও আমি আগেই বলেছি যে, তারা যদি তাদের স্বার্থ চিন্তা করেন তাহলে হয়ত বাংলাদেশ চূর্ণ হয়ে গেলেও তাদের কিছু যায় আসেনা। বাংলাদেশের নাশকতা পাকিস্তানকে  শক্তিশালী করতে পারে না, বরং দুর্বল করে দেবে। অনেক দেশের সশস্ত্র বাহিনী সেখানে যেতে পারে কিন্তু যতক্ষণ  মানুষ নৃশংসতার শিকার হচ্ছেন ততক্ষণ সেই জাতি কখনো শক্তিশালী জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনা।

আজ আমরা পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি না – যারা নিপীড়িত। তাদের কণ্ঠস্বর শোনা যায় না এবং তারা অন্যরা কি বলে তাও শুনতে পায়না। তারা জানে না বাংলাদেশে ঘটছে। এমনকি করাচির মানুষ বেলুচিস্থান বা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে কি ঘটছে তাও জানেনা। সেখানে মানুষ দরিদ্র। তাদের কাছে সরকারের সাহায্য পৌঁছায় না। কোনো ক্ষেত্রেই এই সাহায্যে উন্নয়ন কাজ করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে না। বিশ্বের দেশগুলি এই সরকারকে সাহায্য করছে। আমি পাকিস্তানের জনগণ ও সশস্ত্র বাহিনীকে  জিজ্ঞাসা করতে চাই কেন তারা একটি সরকারের পক্ষে যুদ্ধ করছে যে তাদের স্বার্থ দেখছেনা? কেন তারা এমন যুদ্ধ করছে যা তাদের দুর্বল করে দিচ্ছে?

এখন আমরা যুদ্ধে লিপ্ত। জয় আমাদের প্রথম প্রচেষ্টা। একটি মুহূর্ত আমি আস্থা হারাইনা। আমাদের বিজয় হবেই। কারণ আমাদের সেনাবাহিনী শক্তিশালী এবং সাহসী। আমাদের যখন প্রথম হামলা চালানো হয়, তখন আমাদের সশস্ত্র বাহিনী পাকিস্তানের  অনুরূপ ছিল। তারা তাদের লোকদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন। কিন্তু ১৯৬২ এর যুদ্ধের পর এবং বিশেষ করে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর, মানুষ এবং সশস্ত্র বাহিনী একে অপরের খুব ঘনিষ্ঠ করিয়েছি। সেনাবাহিনী জানে দেশের জনগণ কি করছে। তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা কি কি এবং তারা কিভাবে একটি ভাল জীবন নিশ্চিত করার জন্য সমাধান করতে পারে। আমাদের সাহসী সৈন্যরা তাদের বাবা, ভাই-বোন, যারা দেশের অন্যত্র আছে এবং তাদের যাই হোক না কেন এগুলো একে অন্যকে প্রভাবিত করে।

আজ যাদের গায়ে সেনাবাহিনীর পোশাক নেই তারাও এক এক জন সৈন্য। যুদ্ধে সবার হাত যুক্ত আছে। আমি আনন্দিত যে আপনারা রক্ত ​​দান করছেন। আমরা আরও চাইব। কিন্তু সে সময় এখনও আসে নি। আজ আমাদের সেনাবাহিনীর পিছনে একটি শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ জাতি আছে। যা সময়ের সাথে সাথে আরও শক্তিশালী হচ্ছে।

আমরা পূর্ণ বিজয় অর্জন করব যখন বাংলাদেশ সম্পূর্ণ স্বাধীন হবে এবং তার নিজস্ব সরকার থাকবে। এখন তাদের একটি সরকার আছে, কিন্তু সেটাকে সংগঠিত করতে হবে এবং, তারা তাদের সব উদ্বাস্তু ফিরিয়ে নিয়ে যাবে, তাদের কাজ দেয়া হবে, যাতে বাংলাদেশ আবার সোনার বাংলা হয় –  তাদের জাতীয় সংগীতে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে।

এগুলো আমাদের করতে হবে। যারা সীমান্তে নাই তারা আমাদের সামাজিক সব দুর্বলতা সরিয়ে ফেলবেন। যাতে যখন যুদ্ধ শেষ হয়, তখন দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় আগের গতিতে। শুধুমাত্র যুদ্ধ ক্ষেত্র নয় বরং আমাদের নাগরিক জীবনেও বিজয়ী হতে হবে। আমাদের গর্ব করার মতো এগিয়ে চলতে হবে। তোমাদের আর আমার সামনে এখন অনেক কাজ।

আমরা নিশ্চিত করতে চাই যে আমরা অন্যদের নিন্দা করিনা। যদিও তারা আমাদের বিরোধিতা করে। আমরা বিশ্বকে দেখাতে চাই যে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আছি এবং কেউ আমরা পরিবর্তন করতে পারবে না – এমনকি যদি পুরো বিশ্ব আমাদের বিরোধিতা করে। আমরা সঠিক পথে আছি এবং আমরা প্রমাণ করব যে এটাই সঠিক। আমার বিশ্বাস আমরা আমাদের দীর্ঘ চেষ্টায় সফল হব। এই আমাদের দেশের ঘটনা ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলিতে প্রমাণিত হবে।

আমরা জাতিসংঘকে বৃহত্তর সমর্থন দেওয়া দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। আমরা তার সর্বোচ্চ কমিটিকে সম্মান করি কিন্তু আমরা তার দুর্বলতার ব্যাপারেও  সচেতন। তারা অনেক রেজুলেশন গ্রহণ করেছে কিন্তু তার অনেকগুলোই অকার্যকর হয়েছে। জাতিকে  সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাদের এই ৫৫ কোটি মানুষ এক থাকবেন কি থাকবেন না।

বিশ্বের কয়েকটি দেশ আছে যেখানে তাদের পুরো জনসংখ্যা জাতি নির্মাণ কাজে নিয়োজিত। যুদ্ধ একটি সাম্প্রতিক ব্যাপার কিন্তু আমাদের প্রধান কাজ আমাদের উন্নয়ন এগিয়ে নেয়া। যদি আমরা শক্তিশালী হয়ে উঠি এবং আমাদের আদর্শ তুলে ধরতে পারি তাহলে শুধুমাত্র ভারত নয় বরং সমগ্র বিশ্বের উপকার হবে। আমরা বিশ্বের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেব। কিন্তু আজ তা শোনা হচ্ছে না।

এটা একটি ক্লান্তিকর বিষয় বাইরে থেকে এত এত পরামর্শ শোনা। এমন লোকদের কাছ থেকেও পরামর্শ আসে যাদের নিজস্ব নীতিই  ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। এমনকি আমাদের নিজের দেশে আমরা মাঝে মাঝে আমাদের সংবাদপত্র ও আমাদের ভাইদের কাছ থেকে পরামর্শ পেতে পারি। তারা এখানে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, । রেফারেন্স নেওয়ার  প্রয়োজন নাই। কারণ এরা তাদের নেতাদের মতামত অনুযায়ী প্রকাশ করে। এমনকি একজন সাধারণ ব্যক্তি তার মতামত পুনর্বিবেচনা করতে অয়ারেন যদি তিনি ভুল বলেন। পরিবর্তে, তাদের নেতাদের আরেকটি মতামত যা সমানভাবে ভুল বলে প্রমাণিত হতে পারে।

আমি আজ তাদের সমালোচনা করতে চাইনা। কারণ আমরা এক আছি। আমরা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ। এটা দুটি টি উপায়ে করা যেতে পারে, রক্ত ​​দান করে এবং যেসব সৈন্যরা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের পরিবারকে সাহায্য করে। এটা জানা মানুষের দরকার যে বর্তমানে আমাদের কোন পার্থক্য নেই। আমরা শুধুমাত্র দেশকে শক্তিশালী করার জন্য কাজ করব এবং যা কিছু আমাদের স্বার্থ বিরোধিতা থেকে বিরত থাকব। কখনো কখনো কিছু কিছু জিনিস আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভুল ব্যাখ্যা ও অপব্যবহার হয়। যদিও আমরা কখনো নিজেরা আগে থেকে যুদ্ধে লিপ্ত হইনি। আমরা তাদের সাথে আলাপ করেছিলাম বলে তাঁর মনে করে আমরা যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এই সময় সবার উপলব্ধি করতে হবে যে আমরা যা করেছি দেশের স্বার্থে এবং দৃঢ়ভাবে আমরা তা মেনে চলব।

আমি আপনারদের কাছে কৃতজ্ঞ কারণ আপনারা বলেছেন আপনারা আমার সাথে আছেন। আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই যে সরকার ও জনগণ এক। আমাদের লক্ষ্য মানুষকে শক্তিশালী করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। আমরা জানি যে, গণতন্ত্র দৃঢ় হতে পারে না যদি সেখানে মানুষ আর সরকারের মধ্যে দূরত্ব থাকে।

দুর্বল গণতন্ত্র মানে  দুর্বল মানুষ। এবং যদি মানুষ দুর্বল হয় তাহলে সেনাবাহিনী শক্তিশালী হলেও জাতীকে শক্তি দিতে পারেনা। এগুলো আমদের মনে রাখতে হবে।

আজ আমাদের শুভ কামনা এবং প্রার্থনা সেই সব সাহসী অফিসার ও সৈন্যদের প্রতি যারা দেশের জন্য জীবন বলিদান দিয়েছেন। এটা গৌরবের বিষয় যখন একজন নাগরিক দেশের জন্য তার জীবন সমর্পণ করেন। এটা একটি বড় সুযোগ। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কি পরিমাণ ত্যাগস্বীকার করব বিভিন্ন ক্ষেত্রে। আমি আশা করি ছাত্ররা গভীরভাবে এগুলো বিবেচনা করবে তারা এই সঙ্কটের সময়ে কি ধরণের সাহায্য দিতে পারে।

ছাত্ররা বিবেচনা করবে তারা শহর ও বিশ্ববিদ্যালয়ে কি দরকারী পরিবর্তন করতে পারেন। আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বছরগুলিতে ইংল্যান্ডে সবকিছুর  সংকট ছিল। সেখানে সব ধরনের অসুবিধা ছিল। তবুও মানুষ সেখানে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, তাদের স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য জিনিস সংস্কার করেন। এখন আমরা সব ঐক্যবদ্ধ, আমরা জাতি কে আকৃতি দিতে কাজ করব। স্বাস্থ্য সেবা ও স্যানিটারি অবস্থার উন্নতি করার চেষ্টা করব।

আমাদের অঙ্গীকার করতে হবে যে আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করব। আমরা কোন হুমকিকে ভয় করিনা। এবং আমরা সব চাপ প্রত্যাখ্যান করতে পারি। এর মানে এই নয় যে আমরা অন্যদের কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণ করতে অপছন্দ করি। আমরা সবসময় অবশ্যই অন্যদের কাছ থেকে শুনতে চাই। আমরা গুরুত্ব সহকারে তাদের পরামর্শ বিবেচনা করব। কিন্তু যখন আমরা দেখি যে তারা আমাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কিছু গ্রহণ করতে অস্বীকার করবে তখন আমরা তা ভেবে দেখব। আমরা বলছি না যে, আমরা কোনো পরামর্শ গ্রহণ করব না। যদি তা লাভজনক হয় তাহলে আমরা তা বিবেচনা করব এবং মানুষের মতামত গ্রহণ করব। কিন্তু যদি সবাই মনে করে যে এতে জাতির স্বার্থ ছিল না, তাহলে সেটা বিবেচনা করার অধিকার আমাদের নেই। সেক্ষেত্রে আমরা সঠিক পথ বেছে নেব।

আমরা আমাদের সাহসী সৈন্যদের  অর্জনে খুশি। তারা অনেক স্থানে বিজয়ী হয়েছে। সামনে কঠিন ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে। কিন্তু আমরা আমাদের হৃদয়ে আলো জ্বালিয়ে রাখব। যদি তা পারি তাহলে আমরা আমাদের দেশকে যেমন সমৃদ্ধিশালী করতে পারব তেমনি সুখ বয়ে আনতে পারব – এবং ইসিহাসে অনবদ্য এক জাতী হিসেবে পরিচিতি পাব। আমি জানি শুধু যুবকরাই সেই আলো জ্বালিয়ে রাখতে পারে। যা গড়ে তুলতে পারি একটি জাতী আর মানবতা। যুদ্ধ যাবে আসবে কিন্তু আমাদের সবচেয়ে বড় কাজটি আমাদের স্বপ্নের ভারত গড়ে তুলতে হবে।

আমি সবশেষে এখান থেকে আপনাদের উদ্যেশ্যে বলতে চাই  সাধারণ নির্বাচন এর পরে আমরা নির্দিষ্ট নীতি ও আদর্শের জন্য যুদ্ধ করেছি। নির্বাচনী প্রচারণা আমরা আমাদের নিজের লোকদের সামনে করেছি। এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশ ও তা পর্যবেক্ষন করেছে। আমরা ফুটিয়ে তুলেছি এই দেশের লক্ষ্য ও ভবিষ্যৎ চিত্র। আমরা বিশ্বের কাছে প্রমাণ করেছি যে আমাদের জনগণ আমাদের বুঝতে পেরেছে এবং তাদের দায়িত্ব বুঝতে শুরু করেছে। যদি এই কথা কাজগুলোকে যুদ্ধ বলা যায় – তবে তা ছিল কথা যুদ্ধ – যার প্রেক্ষিতে আমরা ভোটে জয় ছিনিয়ে এনেছি।

যুদ্ধ এখন অন্য ধরণের রূপ লাভ করছে। নির্বাচনের আগে যারা আমাদের বিরোধী ছিলেন তারা আজ আমাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন। এগুলো দেশের সব মানুষ, সব রাজ্যের, সব ধর্মের, এবং বিভিন্ন ভাষার, সবার কাছে পেশ করা হয়েছে। আমরা গণতন্ত্রের জন্য আজ যুদ্ধ করছি এবং বিশ্বকে দেখাতে চাই যে একটি জাতি ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করা যায় না। পৃথিবীতে সব দেশে আজ নানা ধর্মের মানুষ আছে। প্রশ্ন হল সংখ্যালঘুদের নাগরিক সব অধিকার দেওয়া হয়েছে কিনা। আজ লড়াইয়ের কারণ আমরা বিশ্বাস করি প্রত্যেক জাতি স্বাধীনতার অধিকার রাখে। এবং তার দাবী যদি ন্যায্য হয় তবে তার  কন্ঠস্বর সবার কাছে পৌছা উচিৎ। আমরা নিশ্চিত যখন মানুষ স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ও ভ্রাতৃত্বের জন্য যুদ্ধ করে তখন তারা নিশ্চিত বিজয়ী হয়। আমাদের অনেক সৈনিক আমাদের সীমান্তে যুদ্ধে  আজ প্রাণ হারাচ্ছেন এবং অনেকে আহত হয়েছেন। ভারতের সমস্ত জনগণ তাদের পিছনে আছে।

ভারত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভাল অগ্রগতি লাভ করেছে। আমরা যা চেয়েছিলাম তা অর্জন করতে পারছি। কিন্তু আমরা জানি যে অন্ধকার দিন এগিয়ে আসছে এবং আমাদের বিপদও ক্রমশ  বাড়ছে। যারা গণতন্ত্রের কথা বলেন এবং আমাদের দিকে আঙুল উত্থাপিত করেন – এই বলে যে, সম্ভবত আমাদের গণতন্ত্র, বিশ্বাস, যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল না – তারা এখন ভুলে গেছে তারা এর আগে আমাদের সম্পর্কে কি বলতেন। যারা গরীব মানুষের রক্ষক বলে নিজেদেরকে উপস্থাপন করত ও স্বাধীনতার জন্য সকল সংগ্রামকে সমর্থন দিত বলে দাবি করত, তারাই আজ তাদের নীতি-নৈতিকতা ও প্রকাশ্য ঘোষণা ভুলে গিয়ে আমাদেরকে বল প্রয়োগের মাধ্যমে দমন করছে। ।

আপনারা একটি গান শুনেছেন সারফারোসি কি তামান্না…… (আমরা স্বাধীনতার জন্য আমাদের প্রাণ দিতে প্রস্তুত ) – যখন আমি ছোট ছিলাম এই গান স্বাধীনতার জন্য খুব জনপ্রিয় ছিল। এটা সভা ও বিক্ষোভ মিছিল গাওয়া হতো। আরেকটি জনপ্রিয় গান যারে তো যারে……… (ভারত আমাদের জীবনের বিনিময়ে হলেও স্বাধীনতা ফিরে পাবে) – এ পুরানো গান আজ আমাদের জাতীয় জীবনে একটি নতুন অর্থ অর্জন করেছে। আমরা এখন একটি বড় বিপদের  সম্মুখীন। এটা এ কারণে যে আমরা অন্য দেশের অঞ্চল দখল করতে বা অন্য কোন জাতি ধ্বংস করতে চাই না। আমরা এমনকি অন্য এলাকার এক ইঞ্চি জায়গা দখলের বা কোনো দেশের ক্ষতি করতে চাইনা। আমরা জানি যে বাংলাদেশে স্বাধীনতার জন্য যে চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে তা দুনিয়ার কোন শক্তি দ্বারা চূর্ণ করা যাবে না। যে আগুন দেশপ্রেমিকদের অন্তরে জ্বলছে তা আমাদের নিজস্ব স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং মৌলিক নীতিগুলো বিপন্ন করতে পারে। এই জন্য আজ আমরা যুদ্ধ করছি।

আমরা অন্যের জমির এক ইঞ্চির প্রতি লোভের জন্য যুদ্ধ করছিনা। বা অন্য কোন দেশের ক্ষতি করতে ও নয়। আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারবিভিন্ন দেশে পরিচালিত হচ্ছে। আমাদের আন্তরিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তারা তা করছেন। স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশের মানুষের যে চাহিদা, সেখানে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ ও নৃশংসতা, তরুণ, পুরুষ, নারী ও শিশুদের উপর সংঘটিত অত্যাচার, বন্যার মত আমাদের দেশে শরনার্থিদের আগমন – এগুলোর প্রভাব আমাদের দেশের উপর পড়ছে। যদিও পাকিস্তান সেনাবাহিনী জনগণের উপর যে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে তাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের চোখ বন্ধ করে রেখেছেন।

তারা বলে এটি তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার যদিও তারা একটি পুরো জাতি বা সম্প্রদায় ধ্বংস করে চলছে।

কীভাবে ভারত চুপ করে বসে থাকতে পারে যখন আমরা দেখি লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু আমাদের কাছে এসে আশ্রয় নিচ্ছেন? তাদের মনোবল এবং সংস্কৃতি চূর্ণ করা হয়েছিল। বিদেশে আমার সাম্প্রতিক সফরে আমি পরিষ্কারভাবে এবং উন্মুক্তভাবে বিভিন্ন দেশে বলে এসেছি যে ভারত এই সব ব্যাপারে শুধু নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকবেনা। এমন অভিযোগ করা হয় যে আমি আগে যা বলাছি তা করিনি। তারা সম্ভবত আমাদের চিনতে পারেনি।

আমরা, এই দেশে, যুবক ও মহিলারা, একটি মহান সভ্যতা গড়ে তুলেছি। যা শতাব্দীর ধরে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া। হাজার হাজার বছর ধরে আছে। আমরা কষ্ট সহ্য করতে জানি। কিন্তু আমাদের দুর্ভোগ অনেক হয়েছে। অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছি। বিশেষ করে যখন তা সীমা অতিক্রম করে করেছে। ভারত তার নিজের স্বাধীনতা হারিয়ে অত্যাচারিত হয়েছে। মানুষ এখানে সেখানে তাদের মাথা বাড়াতে চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তারা দাবীয়ে রেখেছে। এমন এক সময় ছিল যখন এই দেশের মানুষ অশিক্ষিত দরিদ্র বা দুর্বল ছিল। কিন্তু এক সময় তারা  উঠে দাঁড়াল। তারা জানলো যে স্বাধীনতা তাদের জন্মগত অধিকার। কিন্তু তা দমিয়ে রাখার সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আমরা জয়ী হলাম।

আমরা বিশ্বাস করি যে আমরা এখন যুদ্ধ করছি আমাদের নিজস্ব স্বাধীনতা শক্তিশালী করার জন্য। বিদেশে আমাদের বিরোধী অনেকে আছেন। পাকিস্তানে কি ঘটেছে সে সম্পর্কে তারা সত্যিই চিন্তিত না। তারা বিরক্ত কারণ আমরা নিজেরাই আমাদের নিজের পথ খুঁজে নেয়ার সাহস দেখাচ্ছি এবং আমরা যা জানি যে আমরা যা করব তা সঠিক। আমরা বিশ্বাস করি যে আমরা আমাদের নিজেদের দেশে এবং আমাদের নিজেদের নীতির জন্য যুদ্ধ করছি। কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশ শতাব্দী ধরে বিদেশী দের আধিপত্যের  অধীনে নিপীড়িত হয়েছে। এভাবে চলতে পারে না। ঐ সব দেশ উপলব্ধি করতে পারে না কিভাবে তারা বিদেশী আধিপত্যের  অধীন নিষ্পেষিত হচ্ছে। আমরা অবশ্য জানি, এবং আমরা সচেতন যে, যদি আমরা আজ যুদ্ধ না করলে ভবিষ্যতে একই ভাগ্য বরণ করতে হবে। ভারত স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে। আমরা যেকোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত আছি – যেকোন হুমকির মুখে। আমাদের আদর্শ থেকে কেউ টলাতে পারবেনা।

বিদেশী শক্তি আমাদের হুমকি দিয়েছে। এটা আমাদের বলা হয়েছে যে, পাকিস্তানের সঙ্গে নির্দিষ্ট চুক্তি করে সমঝোতা করতে। যতদূর আমি জানি তারা কমিউনিজম ধারণ করার উদ্দেশ্যে করেছে। এই জোট গণতন্ত্রের জন্য ছিলোনা। এটি  ছিল দুনিয়াকে ধোঁকা দেয়ার প্রচেষ্টা। এখানকার কিছু মানুষ আমাদের নীতি নিয়ে সমালোচনা করতেন। এবং এই দেশে কমিউনিজম উত্সাহিত করতেন। তারা আমাদের বলেছেন যে, তারা আমাদের চীন থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমরা তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করিনি।

যাই হোক তাদের মনোভাব এর মধ্যে একটি সম্পূর্ণ পরিবর্তন এসেছে। তারা আজ বলছে চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় দেশ। এতে বোঝা যায় কিভাবে বড় ক্ষমতা ধর দেশগুলো সম্পূর্ণরূপে তাদের অবস্থান পাল্টে ফেলেন। আপনি যদি অতীত ইতিহাসের দিকে তাকান তাহলে দেখতে পাবেন শুধুমাত্র এক দেশ ও এক জাতি নীতিতে চলা ভারত  তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেনি। আমরা সবসময় আমাদের নীতির প্রতি অটল ছিলাম থাকব।

আমি আবার বলি, আমাদের সেনা বাহিনী অন্য বিশ্বশক্তিগুলোর চেয়ে দুর্বল হতে পারে, কিন্তু আমরা অস্ত্র দিয়ে কারো ভোগদখল করিনা। কারণ আমরা সত্য ও ন্যায়ের পথ অনুসরণ করি। বিশ্বের সেই সব বাহিনীর বিরোধিতা সত্ত্বেও, পৃথিবীর কোন শক্তি নেই যা আমাদের বাকিয়ে ফেলবে। আমরা যে ধরনের মনোভাব পোষণ করি তা শুধুমাত্র দৃঢ় সাহস এর উপর ভিত্তি করে হতে পারে। এটা বলতে চাই যে আমরা অন্য কোন জাতি কে ধ্বংস করার অভিব্যক্তি নিয়ে চলিনা। এটা ঠিক যে সাহস দৃঢ় আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত।

আমাদের প্রথম প্রতিশ্রুতি গণতন্ত্র এবং এটিকে মানুষের জন্য অর্থবহ করা। এটা কেবল তখনই সম্ভব যখন সবাই ধর্ম বা সম্প্রদায় যাই হোক না কেন এক দেশে একসাথে বাস করতে পারে এবং ভাষা যাই থাকুক তাদের অধিকার সমান দেয়া হয়।

আমাদের মৌলিক নীতি সব ধর্মের মানুষের সাথে  সমান আচরণ করতে হবে। গণতন্ত্র গভীরে প্রোথিত হবেনা যদি ধনী ও দরিদ্র মধ্যে বৈষম্য হ্রাস করা হয়। যদি আমরা এই আদর্শের অনুধাবন করি তাহলে সত্য বিজয় লাভ করবে।

কিভাবে আমরা এই সংকটে জড়িত হতে পারি?

আমি আগেই বলেছি, একটি দরিদ্র প্রতিবেশী দেশকে পিষে ফেলার সকল প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে। এটা এগিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো সুযোগ পায়নি। এটি আমাদের চেয়ে বেশি পিছিয়ে। এটি একটি অসম যুদ্ধ, একপাশে সাধারণ নিরস্ত্র মানুষ এবং অন্য পাশে সেনা। এমনকি যদি এই দেশ আমাদের সীমানা থেকে দূরেও হত আমরা তাদের স্বাধীনতার জন্য তাদের সংগ্রামে আমাদের সহানুভূতি প্রকাশ করতাম। এই বিশেষ ক্ষেত্রে, সংশ্লিষ্ট দেশ আমাদের প্রতিবেশী, আমাদের দোরগোড়ার প্রতিবেশী। তাই আমরা আমাদের চোখ কান বন্ধ রাখতে পারিনা। কারণ সেখানে যা ঘটছে তা আমাদের অর্থনীতি, আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় বা রাজনীতিতে – এমনকি আমাদের নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করছিল।

যেসব দেশগুলি দূরে ছিল তারা তাদের চোখ বন্ধ করে রেখেছে। আমরা এক দিন না, এক সপ্তাহ না, এক মাস না, পুরো নয় মাস ধৈর্য ধরে এই সব ঘটনা দেখেছি। একটি দিনও নেই যেদিন আমরা আমাদের সর্বাত্তক প্রচেষ্টা চালাইনি বাংলাদেশে একটি শান্তিপূর্ন পরিবেশ স্থাপনের লক্ষে যাতে তারা তাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে। আমরা দেখেছি সেখানে মানুষরা স্বাধীনতা ছাড়া আর কোন  বিকল্প চিন্তা করছিলোনা। আমি বিশ্বের অনেক দেশে গিয়ে এটা বলেছি। কিন্তু ভারত কি চায় বা না চায় তাতে তারা তেমন অনুভূতি দেখায়নি।

মৌলিক প্রশ্ন হল বাংলাদেশের জনগণ কি চায়। আমরা তাদের যতটুকু দেখেছি তাতে বোঝা যায় তাদের স্বাধীনতাই একমাত্র লক্ষ্য। ৯ মাস গেছে বিশ্বশক্তিগুলো মধ্যস্থতা করে সমাধান খুঁজে বের করেনি। অথচ এই পুরো সময়ের মধ্যে ভারত কি করবে না করবে তারা সেই উপদেশ দিয়ে গেছে।

আর যখন আমরা আক্রান্ত হই, আমাদের “আগ্রাসক” বলে অভিযুক্ত করা হল। আমাদের জাতির জীবনে এই ধরনের ঘটনা আগেও ঘটেছে। সেইসাথে আন্তর্জাতিক বিষয়ক অভিজ্ঞতাও  আছে। বিশ্ব এই ঘটনা সম্পর্কে এবং এর প্রভাব সম্পর্কে জানে। এই ধনী দেশগুলোর অনেকে অভিযোগ করেছেন যে তাদের লোকেরা ভুল পথ অনুসরণ করছে। তারা তাদের নিয়ম-কানুন ও অনুশীলন এর প্রভাব দেখতে ব্যর্থ। মৌলিক বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা আবশ্যক। সময় এখন এসেছে যখন আমাদের আরও দূরদর্শী হতে হবে। আর যা কিছু প্রয়োজন হয় তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু আমরা নিশ্চিত করতে চাই যে ঐক্য আমরা অর্জন করেছি তা শুধুমাত্র যুদ্ধের সময় নয়। আমাদের মৌলিক আদর্শ ও চিন্তার ঐক্য ও বজায় থাকবে। সত্যিকারের একতা থাকলেই আমরা দেশকে শক্তিশালী করতে পারব। আমরা যুদ্ধের মোকাবিলা করার জন্য আমাদের পক্ষে যা কিছু করা সম্ভব আমরা তার সবটাই করছি। আমরা আমাদের সেনাবাহিনীর  জন্য প্রর্থনা করি এবং জয় আশা করি। আমাদের শুভ কামনা তাদের জন্য রয়েছে। আমরা তাদের সাহস, উৎসাহ নিয়ে গর্বিত। আমরা তাদের আশ্বাস দিতে চাই যে দেশের মানুষ তাদের পিছনে দৃঢ়ভাবে আছে। একটি শক্তিশালী জাতি, একটি পরিষ্কার এবং প্রগতিশীল জাতি গড়ার দায়িত্ব আমাদের সকলের। আমাদের দারিদ্র্য দূর করতে হবে। এই আত্ম বিশ্বাস আমাদের জওয়ানদের মাঝে দিতে হবে।

যখন আমরা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর প্রশংসা করি আমরা যেন আমাদের মুক্তিবাহিনী ভাইদের কোথা ভুলে না যাই। ১২ বছর বয়সের  ছেলেরা মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেছে  এবং তারা প্রশিক্ষণ নিয়ে কয়েক দিন পর যুদ্ধে চলে গেছে। তারা মহান সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। এটি কোন সাধারণ সাহস নয় – এটি এত শক্তিশালী যাতে নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ এবং বাংলাদেশের তরুণরা  অনুপ্রাণিত হয়েছে। এই সাহস শুধু স্বাধীনতার ইচ্ছা থেকে বের হয়ে আসতে পারে। তাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ আজ বাস্তবে পরিণত হয়েছে। তাদের ভিত্তি যথেষ্ট শক্ত। আমরা আশা করি যে তাদের নেতারা এবং যোদ্ধারা একটি শক্তিশালী জাতি গড়ে তুলতে চেষ্টা করবে। আমাদের মনে রাখা দরকার যে শক্তিশালী যুদ্ধ দীর্ঘ স্থায়ী হবে না। বাস্তব যুদ্ধ শুরু হবে আরও পরে। বাংলাদেশের জনগণের দুর্ভোগের কাহিনী খুবই প্রাচীন। কারণ তারা স্বাধীন। ভারত তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে চায় না এবং তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সাথে  বাস  করতে চায়। এবং বিশ্বকে দেখাতে চাই কিভাবে দুই প্রতিবেশী তাদের আভ্যন্তরীন বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই একে অপরকে সাহায্য করতে পারে। আমরা একটি নতুন আদর্শ বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করব।

এখন বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তেমন শক্তিশালী নয়। আমি আশা করি তারা বাংলাদেশের মানুষের দাবী বুঝতে পারবে। এবং কি উদ্যমে  মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সৈন্যদের  মানুষ স্বাগত জানিয়েছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাস্তব পরিস্থিতি দেখে এবং অবিলম্বে সেখানে থেকে সেনা প্রত্যাহার করা উচিৎ। আজ কের একটি ছোট পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে পারে যে তারা ভবিষ্যতে ভালো বন্ধু হতে পারবে। এটি হবে শুধুমাত্র যদি তারা বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু ফিরিয়ে নেয় এবং তাদের বাড়িতে ফিরে যাবার ব্যাবস্থা করে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান নিজের বাড়িতে চুপ করে বসে আছেন এবং উদ্বাস্তুদের ফিরে যেতে দিচ্ছেনা। বিপরীতভাবে, বাংলাদেশে যা কিছু  ঘটছে তার জন্য ভারতকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে।

জাতিসংঘের কয়েকজন কর্মকর্তা নিরাপদে ঢাকা থেকে বের হতে চাইছিল। তারা আমাদের অনুরোধ করেছিল শহরের বোমাবর্ষণ বন্ধ করতে যাতে তারা সহজেই বেড় হতে পারে। আমরা তাদেরকে বলেছি যে, ভারত তাদের প্রস্তাবনায় একমত এবং ঢাকা থেকে তারা নিরাপদে প্রস্থান করতে সক্ষম হবে। আমরা তাদেরকে বলেছি যে, যদি তারা আমাদের সাহায্য চায় তাহলে কলকাতা আসেন এবং সেখানে থেকে নিরাপদে ফিরে যান। আমরা তাদের কলকাতায় আনতে একমত হলাম এবং তাদের আশ্বস্ত করলাম যে তারা কোন বিপদের মধ্যে পরবেনা। কিন্তু যখন বিমান ঢাকা পাঠানো হল তারা বিমানকে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ অবতরণ করার অনুমতি দিলনা। আর এটা বলা হয়েছে যে ভারত প্রথমে তাদের প্রথমে জায়গা ফাকা করে দিতে বলে কিন্তু পরবর্তীকালে প্লেন অবতরণ না করে প্রত্যাখ্যান করে। মিথ্যা অপপ্রচার করে যে ভারত প্লেন অবতরণ করায় নি। বিদেশীদের বোঝানো হয় যে আমরা তাদের সাহায্য করতে আসিনি। তবে আমরা যথাযত সাহায্য করেছি যাতে তারা নিরাপদে ফিরে যেতে পারে।

আমি আশা করি আপনারা সকলেই জানেন বর্তমান পরিস্থিতিতে কী করতে হবে। আপনি নিশ্চিত, দাম ওঠানোর জন্য কিছু মজুদ করা হয় না। মানুষ শুধুমাত্র দরকারি জিনিস ক্রয় করবেন এবং অকারণে ব্যয় করবেন না। আমাদের, পুরুষ, নারী ও শিশুদের সবাই মূলত এক একজন সৈন্য। আমরা দেখতে চাই যে দেশ ঐক্যবদ্ধ এবং শক্তিশালী। এই অন্ধকার দিনে আমরা শুধুমাত্র যদি সংযম ও কঠোরতা প্রয়োগ করব।

আমি খুব দু:খিত যে স্বাধীনতা সংগ্রামের আমাদের পুরানো কমরেড কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী গুলাম মোহাম্মদ সাদিক, আজ দেহত্যাগ করেছেন। তিনি বেশ কয়েক মাস ধরে অসুস্থ ছিলেন। গত দুই সপ্তাহ ধরে গুরুতর অসুস্থ ছিলেন। তাঁর মৃত্যু আমাদের জন্য এক বিরাট ক্ষতি। আমি তাকে ১৯৫৩ সালে প্রথম দেখি এবং তিনি মুষ্টিমেয় যারা কাশ্মীরে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর আগমনের পূর্বে, তিনি তাদের মানুষদের পাকিস্তানী সৈন্য এবং অনিয়মিত যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত। মানুষ, নারী, পুরুষ, যুবক-বৃদ্ধ এবং তাদের কি ভারত দাঁড়িয়ে বলেন.। কাশ্মীরে যখন সময় তাদের মুসলিম লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ এবং একটি ইসলামী রাষ্ট্র, একটি সাম্প্রদায়িক ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য এসেছিলেন ভারতের অংশ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন. কিন্তু তারা তাদের নীতি দৃঢ়ভাবে আটকে. যা আমাদের নিজের মতই. তারা এই আদর্শের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা খুব দু: খিত যে সময় আমরা যখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল শ্রী সাদিক এর পরামর্শ এবং জ্ঞান, তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছে মনে হয়. যাইহোক, আমি নিশ্চিত যে কাশ্মীরের জনগণ তাঁকে পছন্দ করে এবং তাকে সম্মানিত, তাঁর প্রদর্শিত করবে ও  পথে পরিচালিত মেনে চলে এবং সব ধর্মের

এমন বিয়োগান্তক অবস্থা নানা ব্যাক্তি ও জাতির জীবনে ঘটেছে। এখন দাবী হল আমার কি তাদেরকে আমাদের সাথে যুক্ত করব নাকি তাদের হাওয়া লাগাতে পারলেই হবে।

অসুবিধা এবং বিপদ যদি কিছু আসে আমরা তাদের মুখোমুখি হব। কিছুই সামনে চলাকে বাধ্যতামূওক করবেনা। আমি আপনাদের সমস্ত মানুষকে অভিনন্দন জানাচ্ছি, কারণ আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকতে পেরেছি। আমরা আমাদের শক্তি বাড়িয়েছি শত্রুদের তাড়িয়ে দেবার জন্য ও তাদের পরিকল্পনা নষ্ট করার জন্য।

আমাদের শত্রু পাকিস্তান বা তার জনগণ নয়। পাকিস্তানের জনগণ দীর্ঘ দিন নিষ্পেষিত হয়েছে। যুদ্ধের কারণে তারা হয়ত আমাদের অপব্যবহার করতে পারে কিন্তু তারা দরিদ্র। তাদের দেশের প্রশাসন বলে কিছু ছিল না। এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলোনা। আমি জাই যে তারা দারিদ্র্য নির্মূল করতে চায় এবং নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। তাদের নেতারা তাদের অন্য দেশের উপর নির্ভরশীল করেছেন এবং তারা যে নীতি অনুসরণ করছেন তা জনগণের স্বার্থে নয়। একটি দরিদ্র ও দুর্বল দেশে একটি বড় জাতি বৃহৎ পরিমাণ অস্ত্র বিনামূল্যে সরবরাহ করছে। এতে করে শান্তি আসবেনা। তাতে যাই ঘটুক না কেন। পাকিস্তানি শাসকরা জানতেন যে বড় শক্তিশালী জাতি তাদের উপরে আছে। পাকিস্তানি শাসকরা ভাবতেন বিদেশ থেকে প্রাপ্ত সাহায্য ও অস্ত্র দিয়ে তারা জনগণেকে শাসন করবেন এবং জনগণের ইচ্ছাকে উপেক্ষিত করবেন। পাক সরকার বাঙালি, বেলুচ ও সীমান্ত প্রদেশের মানুষ দের দাবী উপেক্ষিত রেখেছেন। আমি বলতে পারি যেসব দেশ পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ করছে তারা আসলে পাকিস্তানকে দুর্বল করে দিচ্ছে। পাকিস্তান আজ যদি কোন ক্ষতি করতে আসে তাহলে, এর জন্য তারাই দায়ী হবে। এই ক্ষমতাশালীরা  আমাদের সঙ্গে ভালো থাকেনা। আমরা এই ধরনের সাহায্যের প্রত্যাখ্যান করেছি। কারণ, আমরা জানতাম যে, আমরা যদি আমাদের নিজস্ব স্বাধীনতা খর্ব করি তাহলে কেউই আমাদের শক্তিশালী করতে পারবে না। আমাদের স্বাধীনতা যদি সত্যি হয় আমরা শক্তিশালী হব। কোন বিদেশী এইড ছাড়া, আমরা আমাদের প্রয়োজন মিতাতে পারব।

আসুন সবাই একসাথে যোগদান করে সঠিক পথে চলি। এবং আমি নিশ্চিত আমাদের অসুবিধা দূর হয়ে যাবে। আমাদের সৈনিকের পোশাক গায়ে থাক বা না থাক, আমাদের সঙ্গে বন্দুক থাক বা না থাক, আমরা সৈন্য হিসাবেই কাজ করব, তাদের মত যারা সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত। আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করব। শুধুমাত্র তখনি আমরা আমাদের জওয়ানদের ও দেশকে তার প্রয়োজনে সাহায্য করতে পারব। আমাদের একসঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে। শুধুমাত্র সেক্ষেত্রেই আমরা বিজয় সুনিশ্চিত করতে পারব।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৭৫। ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এর সাথে পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংহের সাক্ষাৎকার

‘দি নিউইয়র্ক টাইমস’

 

১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১

 

Fakhruzzaman Sayam

<১২, ৭৫, ১৯৭১৯৮>

দি নিউইয়র্ক টাইমসে পররাষ্ট্র মন্ত্রী সরদার শরণ সিংহের সাক্ষাৎকার

ডিসেম্বর ১২, ১৯৭১

 

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজ (১২ ডিসেম্বর) এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে তাঁর সরকারের কোন পরিকল্পনা নেই এবং পাকিস্তান ভেঙ্গে দিতে চায় না।

শরণ সিংহ, লম্বা দাঁড়িওয়ালা লোক, সাদা পাগড়ি ও নেহরু জ্যাকেট পড়ে ছিলেন। তিনি বলেন যে ভারত কখনই সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা অন্য কোন শক্তির অধীন ছিল না। চীনের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় থাকবে বলে ভারত আশা রাখে, তিনি যোগ করেন।

মি শরণ সিংহ, কার্লাইল হোটেলে প্রশ্নোত্তরকালে তাকে প্রশ্ন করা হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানের ভেঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশ পাকিস্তানের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হবে বলে তিনি মনে করেন কিনা। তিনি উত্তর দেনঃ

“আমি একে পূর্ব পাকিস্তানের ভাঙ্গন বলব না। ভুগোলিকভাবে, দুটি অংশ ১০০০ মাইলেরও বেশি দূরে। নৃতাত্ত্বিকভাবে এবং ভাষাগতভাবে, তারা সম্পূর্ণরূপে আলাদা। পাকিস্তানের কোন ভয়ের কারণ আমি দেখছি না। যদি তাঁদের স্ব-নির্ধারণী কথা বলার অধিকারের থেকে থাকে, বাংলাদেশের মানুষ বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে সফল। ”

স্বঅস্বীকৃতি আইন

“আমরা চাই না পাকিস্তান ধ্বংস হোক। ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগে সম্মত নেতৃত্ব এখনও বলবৎ আছে।”

যখন ভারত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মি শরণ সিংহ যোগ করেন যে, “আমরা ভারতের চিন্তা পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করেছি, বাংলাদেশকে নিয়ে আমাদের কোন আঞ্চলিক নকশা নেই।”

“এটি ছিল একটি আত্ম-অস্বীকৃতি”, তিনি বলেন। “আমরা চাইতাম না বাংলাদেশে কোন আর্মি দখলদারীত্ব কিংবা কোন আঞ্চলিক পরিকল্পনা থাকুক।”

হোয়াট হাউজে ডাকা এক নতুন সেক্রেটারি কাউন্সিল সভায়, উপমহাদেশের যুদ্ধকে পাকিস্তানের আর্মি দ্বারা আক্রমণকৃত “অস্তিত্বের” লড়াই বলে ঘোষণা করার কিছুক্ষণ আগে মি শরণ সিংহ এসব বলেন।

নিরাপত্তা পরিষদে চীনা একা প্রতিনিধি এই অভিযোগ করে তাঁকে উত্তেজিত করে যে, চীনকে আয়ত্বে রাখতে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের পুতুল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং সে মনে করে যে চীনা হস্তক্ষেপ হুমকির মুখে পড়বে যদি পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়।

“আমি সুনিশ্চিতভাবে এবং খুব পরিষ্কারভাবে বলতে চাই যে, U S S R এর উপর ভারতের নির্ভরশীলতা নিয়ে কোন প্রশ্ন থাকতে পারে না। ”

“স্বাধীনতার শুরু থেকে, ভারত, তার পরিচয় প্রতিষ্ঠা করেছে এবং ভারতীয় ব্যক্তিত্ব সব সময় যেকোন শক্তির পুতুল হওয়াকে প্রত্যাখান করে এবং সবসময় প্রত্যাখান করবে। আমাদের কাজ করার নিজস্ব পন্থা এবং নিজস্ব উদ্দেশ্য আছে।”

প্রতিবেশীদের মধ্যকার দূরত্ব

“ভারত এবং চীন প্রতিবেশী রাষ্ট্র। নিকট অতীতে, এবং বর্তমান সময়ে, দূরত্ব রয়েছে। প্রতিবেশীদের মধ্যে দূরত্ব থাকাটা অপ্রচলিত নয়। আমরা বিশ্বাস করি যে চীনের জনগণ এবং ভারতের জনগন ভাল প্রতিবেশী হিসেবে বসবাস করতে চায় এবং ওই সময়টা দূরে নয় যখন সম্পর্কগুলো স্বাভাবিক হবে।”

“চলমান স্বৈরশাসনে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক আইন বলবৎ এবং নির্বাচনের ফল মেনে না নেয়া বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এটাই, অপরিণামদর্শী রাষ্ট্র, যা বাংলাদেশের জনগণকে একতাবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীতা সৃষ্টি করেছে যা চরম ভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের উত্থানে ভূমিকা রাখে। ” তিনি উত্তর করেন।

আমি বুঝি না কেন গণপ্রজাতন্ত্রী চীন একটা বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে যা, উৎপত্তিগত এবং ঐতিহাসিকভাবে, পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মধ্যকার সামরিক শাসনের বিষয়। আমরা ১০ মিলিয়নের মত উদ্বাস্তুকে ভারতের মাটিতে জায়গা করে দিয়েছি।

“আমি বুঝি না কিভাবে এবং কেন গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সরকার এই পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজনীতা বোধ করে।”

সংকটের সময়ের যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলতে গিয়ে মি শরণ সিংহ বলেন,

“আমরা বিশ্বাস করি যে যুক্তরাষ্ট্র তার চরমভাবে প্রভাবিত রাষ্ট্রপতিকে(আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান) নিয়ে তাদের প্রভাব প্রয়োগের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক নেতাদের এবং বাংলাদেশের জনগণের এক পুনর্মিলন নিয়ে আসতে পারবে। যদি যুক্তরাষ্ট্র প্রভাব প্রয়োগ করে তাহলে পাকিস্তানের এই সংকট সমাধানে সহায়ক হবে। ”

বিলম্বের অভিযোগ অস্বীকার

ভারতের নিরাপত্তা পরিষদ এবং সাধারণ সভা তার বাহিনী দেয়ার মাধ্যমে বিলম্বিত আক্রমণে পূর্ব পাকিস্তানে জয় অর্জন করতে চায় বলে কিছু প্রতিনিধির করা অভিযোগ পররাষ্ট্রমন্ত্রী শক্তভাবে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, “আমাদের নিয়ে কোন প্রশ্ন থাকতে পারে না। আমরা কখনই যুদ্ধ শুরু করিনি। কখনই যুদ্ধের ঘোষণা দেইনি। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় এটি পরিবর্তিত হচ্ছে। বাংলাদেশের জনগণ ছাড়া স্বাভাবিক ও শান্তিপূর্ণ অবস্থার বিবেচনা করার সম্ভাবনা ব্যর্থ হবে। এই বিবেচনায় বলা যায়, বাংলাদেশে কি ঘটছে তা জানতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ব্যর্থ হয়েছে।”

“পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী জেনারেদের সংঘর্ষের শেষ করতে হবে এবং বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের বাহিনী সরিয়ে নেয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে করে, বাংলাদেশের জনগণ তাঁদের ভবিষ্যৎ তাঁদের নিজের হাতে নিতে পারে। এটাই আসল বিষয়। ”

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৭৬। যুক্তরাষ্ট্রের এনবিসি টেলিভিশনের সাথে পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং-এর সাক্ষাৎকার ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১
Fakhruzzaman Sayam

<১২, ৭৬, ১৯৯>

 

যুক্তরাষ্ট্রের এনবিসি টেলিভিশনের সাথে পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংএর সাক্ষাৎকার, ডিসেম্বর ১৩, ১৯৭১

প্রশ্নঃ পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানকে স্বীকৃতি দিবে যে এটি এখন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, এই শর্তে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা?

উত্তরঃ আমি একে এভাবে দেখব না, যদিও আমরা ভারত, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছি এবং প্রকৃতপক্ষে বাস্তবতা উপলব্দি করতে পশ্চিম পাকিস্তান কিছু সময় নিবে। কিন্তু এটি একটি দারুন অগ্রগতি হবে যদি পশ্চিম পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ-সামরিক শাসন-এবং রাজনীতিবিদগন এই বাস্তবতা স্বীকার করে।

প্রশ্নঃ আলোচনায় আপনাদের দিক থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির ব্যপারে দাবী থাকবে কি?

উত্তরঃ আমরা এটি সম্পূর্ণরূপে পরিষ্কারভাবে বলেছি যে, শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি একটি অবস্থা যা খুব তাড়াতাড়ি বাংলাদেশের পরিস্থিতির স্থিতাবস্থা নিয়ে আসবে এবং এই স্থিতাবস্থা খুব জরুরী।

প্রশ্নঃ পূর্ব পাকিস্তানকে সমর্থন দেয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কের এখন কি অবস্থা?

উত্তরঃ আমরা দেখতে পাচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছে, এবং আমরা আরও বুঝতে পারছি যে এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের অভিগমন নিরপেক্ষ নয়, এবং, তাই, আমরা এই আচরনে খুশি নই। কিন্তু আমরা আমাদের মত এগিয়ে যাব।

প্রশ্নঃ যদি যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন পাকিস্তানকে, সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গানাইজেশন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ট্রিটি অর্গানাইজেশন-এর আওতায় সামরিক সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখে, তাহলে কি ঘটতে পারে?

উত্তরঃ পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী কিংবা অন্যদেরকে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া যেকোন সাহায্য যা পাকিস্তানকে আরও আপসবিমুখ করে তুলে, তা পাকিস্তানের লাভ হওয়ার সম্ভাবনা নেই এবং এই অঞ্চলের শান্তির স্বার্থেও না।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৭৭। যুক্তরাষ্ট্রের  প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে লেখা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর চিঠি ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১

Raisa Sabila

<১২, ৭৭, ২০০২০২>

 

.৫ কোটি মানুষের জীবন, মুক্তি এবং সুখের অধিকার

যুক্তরাষ্ট্রের  প্রেসিডেন্ট মিঃ রিচারড নিক্সনকে লেখা ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর চিঠি

১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১

জনাব রাষ্ট্রপতি,

আমি ভারাক্রান্ত মন নিয়ে এমন একটি সময়ে আপনাকে লিখছি, যখন দুই দেশের অন্তর্বর্তী সম্পর্ক একটি দুঃখজনক মোড় নিয়েছে। আমি সবধরনের গর্ব, সংস্কার এবং আবেগকে সরিয়ে রেখে আপনাকে অনুরোধ করব, এখানে যে বিয়োগান্তক পরিস্থিতি ঘটে গেছে, তার কারণগুলো পুনরায় বিশ্লেষণ করে দেখতে। এমন অনেক সময় আসে যখন চরম শোক ও তার রেশ কেবলমাত্র অতীতের সোনালী সময়ের স্মৃতিচারণের মাধ্যমেই বিলীন করা সম্ভব। এমনি একটি ক্ষণজন্মা মুহূর্তেই সেই বিবৃতিটি দেওয়া হয়েছিল, যাতে বলা হয়েছে, যদি কোন সরকার গনমানুষের জীবন, স্বাধীনতা ও সুখের অধিকার খর্ব করে, তবে ঐ জনগনেরও অধিকার আছে ঐ সরকারকে ক্ষমতা থেকে অপসারন করা বা বিকল্প সরকার নির্বাচন করার।

যারা নিরপেক্ষভাবে ২৫শে মার্চ থেকে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনাগুলো জরিপ করেছেন, তারা অবশ্যই এই সাড়ে সাত কোটি মানুষের বিদ্রোহকে স্বীকৃতি দিবেন, কেননা তাদেরকে এমন এক পরিনতির দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছিল যেখানে তাদের জীবন, স্বাধীনতা কিংবা সুখের সকল অধিকার এর তো প্রশ্নই আসেনা, এ বিষয়ে কথা বলারও অধিকার দেয়া হয়নি। আমেরিকার বেশিরভাগ স্কলারগন যারা এ উপমহাদেশ সম্পর্কে জ্ঞাত, তারা প্রত্যেকেই পূর্ব বাংলার এসকল হতাশার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন।

যে দুঃখজনক যুদ্ধ চলছে, তা খুব সহজেই এড়ানো যেত যদি মহান বিশ্বনেতারা ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান আমাদের উপর হামলা চালানোর পূর্বে এখানে যে বিদ্রোহের সুচনা হয়েছিল সেদিকে নজর দিতেন, ঘটনার আসল কারণগুলোর দিকে মনোনিবেশ করে সমস্যা সমাধানের সঠিক উপায় অনুসন্ধান করতেন। আমি অসংখ্যবার এবিষয়ে চিঠি লিখেছি। এমন একটি সময়ে দেশ ত্যাগ করা কঠিন হলেও আমি শান্তির সন্ধানে বারবার বিদেশে ভ্রমন করেছি। বিশ্বনেতাগণকে ঘটনার ভয়াবহতা বোঝানোর চেষ্টা করেছি। দুঃখের সাথেই বলতে হচ্ছে যে দরিদ্র শরণার্থীদের জন্য সকলেই ব্যাথিত হলেও এর পেছনের মুল সমস্যাটি সকলের কাছেই অবহেলিত ছিল।

যদি সকল রাষ্ট্র, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র তার ক্ষমতা, প্রভাব এবং কর্তৃত্ব খাটিয়ে শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তি নিশ্চিত করতে পারতেন, তাহলেও এ যুদ্ধ এড়ানো যেত। তার বদলে আমাদের বলা হয়েছিল যে একটি বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। সকলেই জানে যে বেসামরিক প্রশাসনের নামে আমাদের ধোকা দেয়া হয়েছে, এবং আজকে সেই ধোকা একটি বিয়োগান্তক পরিস্থিতিতে পরিনত হয়েছে।

এ সমস্যার সমাধানে প্রচুর মৌখিক প্রতিশ্রুতি দাওয়া হলেও, বাস্তবে কোন কিছুই করা হয়নি। বরং, পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগন জোরপূর্বক তাদের সকল হেরে যাওয়া আসনগুলোকে শুন্য ঘোষনা করে ভুয়া নির্বাচন করেছে।

বহির্বিশ্বের কেউই মুজিবর রহমানের সাথে যোগাযোগ করার কথা উচ্চারনও করেননি। আমরা শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তির জোর দাবী জানাই। এমনকি আটক অবস্থাতেও তার সাথে যোগাযোগ করা যেত, কিন্ত সে সম্ভাবনা কখনোই যাচাই করা হয়নি, কেননা যুক্তরাষ্ট্র এমন কোন কিছুই করবেনা, যাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান উৎখাত হতে পারেন। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র জানে যে মুজিবর রহমান একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব এবং পরবর্তীতে পাকিস্তানের স্বৈর শাসন স্থাপনের ক্ষেত্রে একটি হুমকিস্বরূপ, সুতরাং তাকে বারবার বর্তমান পরিস্থিতির জন্য এবং দেশ শাসনে ইয়াহিয়া খানের অসুবিধা সৃষ্টির জন্য দায়ী করা হয়েছে।

জনাব রাষ্ট্রপতি, আমি আন্তরিকভাবেই আপনাকে প্রশ্ন করতে চাই, শেখ মুজিবর রহমানের সাথে গোপন আলোচনা কিংবা তার মুক্তি কি একটি যুদ্ধের সুচনার চেয়েও বেশি মারাত্নক?

আসল সত্য হল এইযে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগন জানেন যে, দুই অঙ্গরাজ্যের মধ্যকার সম্পর্ক অত্যন্ত খারাপ হলেও, জনগনের তীব্র বিরোধিতার মুখেও, পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে অলঙ্ঘনীয় রাখতে তারা যে কোন কিছুই করতে পারবে, মানবাধিকার, স্বাধীনতার অধিকার সকলই ভুলুন্ঠিত করতে পারবে। কেননা কেউ, এমনকি যুক্তরাষ্ট্র তাদের জনগনের পক্ষে প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসবেনা।

জনাব রাষ্ট্রপতি, গত নয় মাস ধরে শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার কারনে আমরা ক্রমাগত পাকিস্তানী সরকারের চাপ এবং অবাধ্যতা সহ্য করে আসছি, কোন সহিংস প্রতিবাদ করিনি। গত ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ দিনেদুপুরে পাকিস্তানী বাহিনী অম্রিতসার, পাঠানকোট, শ্রীনগর, অবন্তিতপুর, উত্তরালয়, যোধপুর, আম্বালা এবং আগ্রায় অবস্থিত বিমানঘাটিগুলোতে প্রচণ্ড বোমাহামলা চালানোর পরই যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়া আমাদের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে। এসময় আমি কোলকাতায় অবস্থান করছিলাম, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পাটনায় অবস্থান করছিলেন এবং তার সেখান থেকে তার দক্ষিনে ব্যাঙ্গালোরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার কথা ছিল। অর্থমন্ত্রী বোম্বেতে অবস্থান করছিলেন। কোন দুরভিসন্ধি নিয়েই তারা রাজধানীতে আমরা অনুপস্থিত থাকার সময়টিকে হামলার সময় হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এমন অবস্থায় আমরা কি করে এ বিশ্বাস থেকে হাত গুটিয়ে বসে থাকব, যে পাকিস্তানী শাসকগন ও তাদের মন্ত্রনাদাতাগনের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ, গঠনমূলক এবং যৌক্তিক?

আমাদের কাছে জানতে চাওয়া হয় যে আমরা কি চাই। আমরা আমাদের জন্য কিছুই চাইনি। আমরা প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তান বা বর্তমান বাংলাদেশের কোন অংশ চাইনা। আমরা পশ্চিম পাকিস্তানেরো কোন অংশ দাবী করিনি। আমরা পাকিস্তানের সাথে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাই। কিন্তু পাকিস্তান কি কাশ্মির দখল করার জন্য গত ২৪ বছর ধরে যে বিরামহীন এবং অর্থহীন আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে, তা থেকে বিরত হবে? তারা কি ভারতের প্রতি তাদের বিদ্বেষপূর্ণ প্রচারনা এবং শত্রুতাপূর্ণ মনোভাব প্রদর্শন ত্যাগ করবে? আমার পিতা অথবা আমি কতবার তাদের শান্তিচুক্তি করবার আহবান জানিয়েছি? ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে, যতবার এধরনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, পাকিস্তান সাথে সাথে তা প্রত্যাখ্যান করেছে।

আমরা অত্যন্ত ব্যাথিত হই যখন বর্তমান সংকটের জন্য পরোক্ষভাবে আমাদেরকেই দায়ী করা হয় বা আমাদের জন্যই সমাধান সম্ভব হচ্ছেনা বলে কটাক্ষ করা হয়। আমি জানিনা, কারা এধঅরনের অপবাদ দিয়ে যাচ্ছেন। আমি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, অষ্ট্রিয়া এবং বেলজিয়ামে সফরে থাকাকালীন জনসমক্ষে এবং ব্যাক্তিগত আলোচনায় বারবারই একটি রাজনৈতিক মধ্যস্ততার বিষয়ে জোর দিয়েছি। আমরা নয় মাস ধরে এর জন্য অপেক্ষা করেছি। অগাস্ট, ১৯৭১ এ যখন ডঃ কিসিঞ্জার আসলেন, আমি তাকে দ্রুত একটি রাজনৈতিক মধ্যস্ততা স্থাপনের গুরুত্বটি বুঝিয়ে বলেছিলাম। কিন্তু আমরা আজ পর্যন্ত কোন ধরনের মধ্যস্ততার সামান্য কোন উদ্যোগ ও দেখতে পাইনি যার মাধ্যমে আমরা ধরে নিতাম যে আমরা যা ভেবেছি তা সঠিক নয়।

যা হওয়ার তা হয়ে গেছে, আমি আন্তরিকভাবে আশা করব যে, আপনি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হিসেবে, যুক্তরাষ্ট্রের জনগনের সকল আকাঙ্ক্ষা এবং আদর্শের প্রতিনিধি হিসাবে, সকল দিক গভীরভাবে বিবেচনা করে আমাকে জানাবেন যে, আমরা কি ভুল পদক্ষেপ নিয়েছি, যার কারনে আপনার মুখপাত্র ও প্রতিনিধিগন আমাদের সাথে এধরনের অসৌজন্যমূলক আচরন করছে।

শুভেচ্ছা ও শুভকামনায়,

বিনীতা

ইন্দিরা গান্ধী।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৭৮। যুক্তরাষ্ট্রের সিবিএস টেলিভিশনে দেওয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রী শরণ সিং এর সাক্ষাৎকার ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

২০ ডিসেম্বর, ১৯৭১

 

 

Raisa Sabila

<১২, ৭৮, ২০৩২০৫>

যুক্তরাষ্ট্রের সিবিএস টেলিভিশনে দেওয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রী শরণ সিং এর সাক্ষাৎকার

২০ ডিসেম্বর, ১৯৭১

কলাম্বিয়া ব্রডকাস্টিং সিস্টেম

সংবাদদাতা জন হারটঃ

 

আধ ঘন্টার মধ্যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং ভারতের ভবিষ্যত নিয়ে কথা বলতে আমাদের সাথে যোগ দিচ্ছেন, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী। তাজা খবর এই যে, পাকিস্তান আজ থেকে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে তাদের নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে পেতে যাচ্ছে, যিনি গত সপ্তাহে জাতিসংঘের প্রতিরক্ষা কাউন্সিল থেকে ওয়াক আউট করেন। সদ্য যুদ্ধে হেরে যাবার পর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান পদত্যাগ করেন এবং ভুট্টো তার স্থলাভিষিক্ত হন। এর আগে ভুট্টো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছিলেন। গত ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যে নির্বাচন বাতিল বলে ঘোষনা করেছিলেন, তাতে পশ্চিম পাকিস্তানের বা বর্তমান অক্ষত পাকিস্তানের বেশিরভাগ আসনে ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পার্টি জয়লাভ করে। গত সপ্তাহে ভুট্টো বলেছেন, তার আর কোন ইলেকশন দেওয়ার প্রয়োজন নেই, কেননা তিনি গতবারই জয়লাভ করেছেন। মুলত গত বছর শেখ মুজিবর রহমানের পার্টি সর্বচ্চো সঙ্খ্যক আসনে জয় লাভ করেছিল, কিন্ত তার পার্টি পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করছিল, যা বর্তমানে বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। শেখ মুজিব হয় মৃত্যুবরন করেছেন নয়ত তিনি এখনও ভুট্টোর হাতে বন্দী। এ মুহূর্তে ভারতের সাথে আপস করার দায়িত্বও ভুট্টোকেই নিতে হবে, এবং তিনি ভারতের দখল করা এলাকাসমুহ ফেরত চেয়ে বিবৃতি দিয়েছেন।

আজ সকালে আমাদের সাথে আছেন, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সর্দার শরণ সিং, এবং জনাব, আমার প্রথম প্রশ্ন হলঃ আপনারা কখন আলোচনা শুরু করতে যাচ্ছেন?

উঃ পাকিস্তানের নেতারা যখনি চান, আমরা তখনি আপস মীমাংসার জন্য সংলাপে বসতে প্রস্তুত আছি।

প্রশ্নঃ তা কবে নাগাদ হতে পারে, সে বিষয়ে কি আপনারা কোন ধারনা পেয়েছেন?

উঃ আমার জন্য সেটা বলা খুবি কঠিন, কিন্ত আমি আশা করছি শীঘ্রই।

প্রশ্নঃ মিঃ সিং, মুলত কোন বিষয়ে সংলাপ হবে, আপনারা কি স্থায়ী শান্তি স্থাপনের লক্ষ্য নির্ধারণ করছেন?

উঃ মুলত সেটাই উদ্দেশ্য থাকবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে যখন বাংলাদেশকেও আমরা নতুন রাষ্ট্র  হিসাবে পেয়েছি, সেটিকে স্বীকৃতি দেওয়ার ইস্যু ও আলোচিত হবে।

প্রশ্নঃ এটিই কি শান্তি স্থাপনের সংলাপকে সফল করার মুল শর্ত  হিসেবে বিবেচিত হবে?

উঃ আপনি এটাকে একটা শর্ত বলতে পারেন, কিন্তু ৭.৫ কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে অবমাননা করে কোন সমাধান কিংবা শান্তি স্থাপন আসলে বাস্তবে সম্ভব হবেনা।

প্রশ্নঃ শেখ মুজিবর রহমানের কি হবে? তাকে এখনও কোথাও দেখা যায়নি। কেউ জানেনা তিনি জীবিত না মৃত। এ বিষয়টি কি সংলাপের আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত হবে, বা পরবর্তী শান্তিস্থাপন বিষয়ক আলোচনা সমুহে?

উঃ আমরা আশা করছি যে তিনি বেঁচে আছেন এবং অবশ্যই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মানুষের নির্বাচিত নেতা হিসেবে তিনি সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশটির ভবিষ্যৎ রূপরেখা দানে বলিষ্ঠ ভুমিকা রাখবেন।

প্রশ্নঃ যদি তিনি বেঁচে না থাকেন, বা পাকিস্তান যদি তাকে মুক্তি না দেয়, সেক্ষেত্রে সংলাপ কোন দিকে মোড় নিবে?

উঃ আমি ধারনা করছি যে এবিষয়ে আওয়ামীলীগ দলের নেতারাই আলোচনা করবেন, কিন্তু আমার মনে হয়না পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী শেখ মুজিবর রহমানকে শেষ করে দেয়ার মত চরম পদক্ষেপ নিবে। পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

প্রশ্নঃ ভারত কি যুদ্ধের সময় কাস্মীর এবং পাঞ্জাবের সীমান্তবর্তী পাকিস্তানের দখলকৃত ১৪০০ মাইল এলাকা বা অন্যান্য যে সকল এলাকায় তাদের সৈন্য আছে তা ফিরিয়ে দেবে?

উঃ আপনি যদি পূর্বাংশের কথা বলে থাকেন, আমরা বাংলাদেশকে একটি গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছি এবং আমাদের একটি দিনের জন্যও সেখানে অবস্থান করার অভিপ্রায় নেই। সকল দ্বন্দ্বের অবসান হয়ে পরিস্থিতি কিভাবে স্বাভাবিক হয় তার উপরি সবকিছু নির্ভর করছে। পশ্চিম অংশেও, আমরা আমাদের অবস্থান স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছি যে- পাকিস্তানের কোন অংশই আমরা আমাদের বলে দাবী করছিনা, সংলাপের ফলে অবশ্যই এই বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে।

প্রশ্নঃ কিন্তু, কাস্মীরের কি হবে, মিঃ সিং- সেটি তো আসলে পাকিস্তানের অধীনে নয়?

উঃ এটি এমন একটি বিষয়, যা নিয়ে আরো সংলাপ হতে পারে। একটি যুদ্ধ হয়েছে, অস্ত্র-সংবরন করা হয়েছে, প্রয়োজনে আবারো তা করা হবে।

প্রশ্নঃ কিন্ত আমাদের নিউদিল্লিতে আমাদের রাষ্ট্রীয় মুখপাত্রগন বলছেন যে গত কয়েক সপ্তাহের যুদ্ধে ভারত কাশ্মীরের নতুন যেসব এলাকা দখল করে নিয়েছে, তা ফিরিয়ে দেবেনা।

উঃ আমি বলবো, তা সংলাপের মাধ্যমেই স্থির করা হবে, এবং প্রতি ক্ষেত্রেই একটি অস্ত্র সংবরন রেখা নিরধারিত হবে, যেমনটি প্রতিটি সশস্ত্র সঙ্ঘাতের পর করা হয়ে থাকে।

প্রশ্নঃ পূর্বাঞ্চল থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী কখন সরিয়ে নেয়া হবে?

উঃ আমি ইতিমধ্যেই বলেছি যে আমরা সেখানে একটি দিনও বেশি থাকতে চাইনা। অনেক কাজ বাকী রয়েছে। আত্মসমর্পণকারী পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করানোর বিষয়টি বাকি রয়ে গেছে। তাদের উপর মানুষ প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে আক্রমন করতে পারে। এক্ষেত্রে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে। এ সকল বিষয়ই বিবেচনাধীন রয়েছে। ভারত এবং বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে লক্ষ্য রাখবে।

প্রশ্নঃ মিঃ মিনিস্টার, ভারত এবং পাকিস্তানের এ যুদ্ধ, অবশ্যই এই দুই দেশের সীমা ছাড়িয়ে একটি বৈশ্বিক অস্থিরতা তৈরি করেছে, কেননা রাজনৈতিক এবং পরোক্ষভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন, চায়না এবং যুক্তরাষ্ট্রের মত পরাশক্তিও এ যুদ্ধে জড়িয়ে পরেছে। এখন কি নতুন করে ভারসাম্য ফিরিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব? যদি, আমরা ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্কের কথাই ধরি, ভারতের জনগন বেশ প্রকটভাবেই যুক্তরাষ্ট্র-বিরোধী মনোভাব ব্যাক্ত করেছে। ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্কে কি এ বিষয়গুলো প্রভাব ফেলবে?

উঃ আমরা সবসময়ি বিশ্বাস করি যে ভারসাম্য স্থাপনের কোন সীমা নেই, কোন নির্দিষ্ট ভিত্তিও নেই। ক্ষমতার কৃত্রিম ভারসাম্য রক্ষার্থে যখন অন্যান্য ক্ষমতাসীন ব্যাক্তিবর্গ ব্যাস্ত হয়ে পরেন, সেটাই বরং আরো সমস্যার সৃষ্টি করে। আপনি আমাকে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের কথা জিজ্ঞেস করছেন। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, যুক্তরাষ্ট্রের সরকার কোন নিরপেক্ষ ভুমিকা পালন করেনি। একি সাথে এটিও মনে রাখতে হবে যে, এদেশের সাংবাদিকগন, সংবাদমাধ্যম, জনপ্রতিনিধিগণ, সিনেটর এবং কংগ্রেসম্যান অনেকেই বাস্তব ঘটনাকেই সমর্থন করে গেছেন। আমি বলব না যে এর কোন প্রভাব দুই রাষ্ট্রের সম্পর্কে পরবেনা, কিন্তু এখন যেহেতু যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে প্রশাসন কিভাবে এ সমস্যা মোকাবেলা করে, তার উপরি সব কিছু নির্ভর করবে।

প্রশ্নঃ সেক্ষেত্রে, প্রশাসন কি করতে পারে বলে আপনি মনে করেন, মিঃ সিং?

উঃ ভারতের সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে, আমাদের সমস্যাগুলোর ক্ষেত্রে একটি নিরপেক্ষ ভুমিকা পালন করতে পারে।

প্রশ্নঃ ভারতের সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে অবশ্যই তা প্রয়োজন। আপনি কি একি সাথে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার কথাও বোঝাচ্ছেন?

উঃ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে সময় লাগবে। কিন্তু সেটি ছাড়াও, অনেক বিষয়েই যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনিক অবস্থান ভারত এবং পাকিস্তানের বিষয়ে তাদের অনিরপেক্ষ মনোভাবকেই স্পষ্ট করে তোলে।

প্রশ্নঃ কোন কোন অবস্থান, মিঃ সিং? আপনি কি আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে পারবেন?

উঃ যেমনঃ তারা এখনও ভিত্তিহীন গল্প বানিয়ে বলছে যে এই যুদ্ধের জন্য ভারতই দায়ী। আমরা শুধুই নিজেদের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করেছি, এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ ডিসেম্বর আমাদের বিভিন্ন এলাকায় বিমান হামলা করার নির্দেশ দেওয়ার পরই যুদ্ধ শুরু হয়। এরপরও এ যুদ্ধের জন্য ভারতকে দায়ী করা ভিত্তিহীন এবং কোনভাবেই ন্যায়সঙ্গত নয়।

প্রশ্নঃ ভারত এবং চায়নার ভবিষ্যৎ সম্পর্কের ক্ষেত্রে আপনার মন্তব্য কি?

উঃ আমরা সবসময়ই চাই যেন ভারত এবং চায়নার সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকে, এবং আমরা সবসময়ই এই নীতি অবলম্বন করবো। চায়না এক্ষেত্রে কিরকম সাড়া দেয়, তার উপর অনেক কিছুই নির্ভর করবে, কিন্তু আমরা সবসময়ই এমন নিতী গ্রহনে আগ্রহী যা চায়নার সাথে আমাদের সম্পর্কের আরো উন্নতি সাধন করবে।

প্রশ্নঃ চায়নিজদেরকে বর্তমানে অসম্ভব সন্দিহান মনে হচ্ছে। জাতিসংঘে তারা বলছেন যে ভারতে তিব্বতি শরণার্থীদের উপস্থিতি তিব্বতে ভারতের অভিযানের একটি ন্যায়সঙ্গত অযুহাত হিসেবে দেখানো হতে পারে। তারা বলেন, ঠিক একি কারন দেখিয়ে পূর্ব বাংলাতেও সামরিক অভিযান চালানো হয়েছে। এসকল অভিযোগ সম্পর্কে আপনি কি মনে করেন?

উঃ প্রথমত বাংলাদেশ এবং তিব্বতের পরিস্থিতি কোনভাবেই এক নয়। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা এবং ইচ্ছাকে সেনাবাহিনীর স্বেচ্ছাচারিতায় নির্দয়ভাবে দমন করা হচ্ছিল। অন্যদিকে, আমাদের কোন সন্দেহই নেই যে, তিব্বত চায়নারই অধীন একটি রাজ্য। আপনারা যদি তিব্বতের শরণার্থীদের কথা বলেন, তবে আমরা নিতান্তই মানবতার খাতিরে তাদের আশ্রয় দিয়েছি। আমরা তাদেরকে কখনও কোন রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার অনুমতিও দেইনি। যদি তারা সত্যি এমনটি সন্দেহ করে থাকে, তবে আমি বলবো এ সন্দেহের কোন ভিত্তি নেই এবং আমি এই দুই পরিস্থিতির মধ্যে কোন যোগসুত্র তৈরি করার সুযোগ দেখিনা।

প্রশ্নঃ মিঃ সিং, নৈতিক দিক থেকে বিবেচনা করলে, পাকিস্তান বাংগালিদের সাথে যে আচরন করেছে তা সঙ্গত নয়, কিন্তু এধরনের জাতিগত সমস্যার সমাধানে অস্ত্রের ব্যবহার নতুন অস্থিরতারও জন্ম দিতে পারে বলে জাতিসংঘ উদ্যোগ প্রকাশ করেছে। বিশ্বের অনেকে দেশেই এধরনের সমস্যা বিদ্যমান, বাঙ্গালিরাও অনেক দেশে ছড়িয়ে আছেন। এ মুহূর্তে সেসকল দেশ, এবং তাদের প্রতিবেশিরা পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ কিংবা অস্থিতিশীল সম্পর্ক বজায় রাখলেও, এধরনের একটি উদাহরন কি তাদের ক্ষেত্রে আরেকটি সশস্ত্র যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি করতে উৎসাহ যোগাতে পারে?

উঃ আমি এধরনের আশঙ্কার কোন ভিত্তি খুজে পাইনা। প্রথমত, খুব বেশি সঙ্খ্যক বাংলাদেশি বিশ্বের অন্যান্য স্থানে অবস্থান করেন না। আমি কোনভাবেই ভাবতে পারিনা, ৭.৫ কোটি মানুষ সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্ভুলভাবে তাদের ইচ্ছা প্রকাশ করার জন্য সামরিক বাহিনীর হাতে এভাবে নিগৃহীত হতে পারে। আমি এমন উদাহরন আর কোথাও কখনো দেখিনি। বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে বা অন্যান্য রাষ্ট্রে হয়ত এমন ধরনের সমস্যা থাকতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশে যা ঘটেছে তা আর কোথাও হয়নি। আমার মনে হয়না যে অন্য কোন দেশে এর পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে বলে আশংকা করার কোন প্রয়োজন আছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৭৯। জাতিসঙ্ঘে পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং এর সাংবাদিক সম্মেলন ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২২ ডিসেম্বর ১৯৭১

 

Rajib Chowdhury

Bijoya Chowdhury

<১২, ৭৯, ২০৬২১০>

 

জাতিসঙ্ঘে পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং এর সাংবাদিক সম্মেলন

ডিসেম্বর ২২, ১৯৭১

 

ফরেন মিনিস্টারঃ আপনাকে আপনাদের বেশিক্ষণ অপেক্ষায় রাখব না। আপনাদের অনেক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আমার কোন স্বাগত বক্তব্য দেয়ার ইচ্ছে নেই। আপনারা ইচ্ছেমত আমাকে প্রশ্ন করতে পারেন।

প্রশ্নঃ আপনি কি মনে করেন গতরাতের সিকিউরিটি কাউন্সিলের প্রস্তাবনা কাজে আসবে?

উত্তরঃ আমি মনে করি এটা কাজে আসবে কারণ এটাতে মোটাদাগে যুদ্ধবিরতির প্রয়োজনীয়তা দেখানো হয়েছে, বিরতির মূলনীতিগুলোও গৃহীত হয়েছে। এবং এটা বেশ ভাল একটা সমাধান। এখানে বর্তমান পরিস্থিতির বর্ননা দেয়া হয়েছে এবং এমন কিছু বলা হয়নি যা বাস্তবসম্মত না।

প্রশ্নঃ এখানে কিভাবে বাস্তবতা বোঝানো হয়েছে?

উত্তরঃ এখানে পূর্ব ও পশ্চিমের জন্য দুইটি চুক্তির কথা বলা হয়েছে। পূর্বে অতি সত্বর মিলিটারি সরাতে হবে – এছাড়া যার কোন উপায় নেই। সেখানে সিভিল সরকার স্থাপিত হয়েছে ইতোমধ্যে। এইটুকুই আমি জানি। ১৯৭০ এর ডিসেম্বরের নির্বাচনে সমস্ত লোক তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছে। বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনা সরাতেও কিছু সময় লাগবে।

প্রশ্নঃ আপনি কি শেখ মুজিবকে দেশে ফিরিয়ে আনানোর জন্যে অন্য দেশগুলোর সাথে কোন আলোচনা করছেন? কোন উদ্যোগ নিচ্ছেন কি?

উত্তরঃ আমি একটা প্রেস রিলিজে দেখেছি শেখ মুজিবর রহমানকে জেল থেকে সরিয়ে একটা ঘরে নিয়ে রাখা হয়েছে। হয়ত তাঁর শারীরিক সুবিধার উন্নতি হয়েছে। কিন্তু মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত উনি জেলে নাকি ঘরে সেটা কোন মুল্য বহন করেনা। আর এখন উনার দেশে ফেরত আসাটাই সবচে জরুরী।

প্রশ্নঃ আপনি কি চান যে শেখ মুজিব ফিরে আসার আগেই পাক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে যাবে?

উত্তরঃ আমি এর মাঝেই সিকিউরিটি কাউন্সিলের কাছে স্টেটমেন্ট দিয়েছি যে পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনী যাদের পূর্ব পাকিস্তানে ফেলে রাখা হয়েছে, তাদের পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত নিয়ে যেতে হবে সমঝোতার মাধ্যমে। বাংলাদেশ সরকার গঠিত হবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা, যারা সিদ্ধান্ত নেবে তাদের কি প্রয়োজন এবং তার জন্যে একটা দিনেরও বেশি দরকার নেই।

প্রশ্নঃ আপনি কি বলছেন যে ওরা শেখ মুজিবর রহমানকে ছেড়ে না দিলেও আপনারা পাকিস্তানী সৈন্যদের ফেরত পাঠাবেন?

উত্তরঃ আমরা শেখ মুজিবর রহমানকে ছেড়ে দেয়ার উপত গুরুত্ব দিয়েছি। কারণ তিনিই কেবল সারে সাতলক্ষ মানুষকে দিক নির্দেশনা দিতে পারেন। আর যেকোন মুল্যে তাঁর ফিরে আসাটা জরুরী এই দেশের মানুষের জন্যে।

প্রশ্নঃ জনাব পররাস্ট্র মন্ত্রী, আপনি গতকাল রাতে দুটো শর্তের কথা বলছিলেন যে দুটো অবশ্যই যুদ্ধবিরতির আগেই পূরণ হতে হবেএকটা ছিল রিফিউজিদের অবশ্যই নিজেদের দেশে ফেরত পাঠানোকিন্তু আমি পরেরটা শুনতে পাইনি

উত্তরঃ আসলে আমি গতকাল সিকিউরিটি কাউন্সিলে তা উল্লেখ করেছি, কিন্তু এটা ভারতীয় সৈন্যদের বাংলাদেশে থাকার অযৌক্তিকতা বোঝাতে অসমর্থ হয়েছিল। আমি কিছু কারণ উল্লেখ করেছিলাম, একটা ছিল বাংলাদেশে তাদের স্বদেশী লোকেরা ফেরত আসবে আর অন্য গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুটা হল পশ্চিমা সেনাবাহিনি যারা এই মুহুর্তে বাংলাদেশে বেশ করুন অবস্থায় আছে এবং প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছে তাদের রক্ষার জন্যে ইন্ডীয়ান সেনাবাহিনীর ওখানে থাকাটা জরুরী। যারা ন মাস ধরে অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করেছে তাদের পক্ষে এমন প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা স্বাভাবিক। এই বিশাল প্রতিহিংসার ঢেউ সামাল দেয়ার জন্যে কিছুটা সময় হলেও ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনীকে ওখানে থাকতে হবে।

প্রশ্নঃ কতদিন লাগতে পারে বলে আপনার ধারণা?

উত্তরঃ নির্ভর করে আন্তর্জাতিক কমিউনিটির সিদ্ধান্তের উপর। যত দ্রুত এটা সম্ভব হবে তত দ্রুত আমরা এই সমস্যা থেকে রেহাই পাব। বাংলাদেশ থেকে পাক সৈন্যদের বের করে নিয়ে আসতে পারব। কিন্তু এই বিবৃতিকে যদি পশ্চিম পাকিস্তান কোন পাত্তা না দেয়, এবং তারা মনে করে এখনো তাদের বাংলাদেশে সৈন্য পাঠানোর অধিকার আছে তাহলে পরিস্থিতি ভিন্ন মাত্রা ধারন করবে। বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারও ততবেশি দেরী হবে। আন্তর্জাতিক কমিউনিটি এটা যত দ্রুত বুঝতে পারবে তত দ্রুত বাংলাদেশ একটা সুঠাম কাঠামোতে দাঁড়াতে পারবে। এরপর ইন্ডিয়ান সৈন্যদেরও ফেরত পাঠানো যাবে।

প্রশ্নঃ জাতিসঙ্ঘের ধীরগতির কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে আপনার মতামত কি? বিশেষকরে গত গ্রীষ্মে সেক্রেটারি জেনারেলকে পুনরায় ডেকে এনে ইউ এন থেকে পদ্দক্ষেপ নেয়ার জন্যে বলা হয়েছিল

উত্তরঃ আমি সেটা নিয়ে কোন বক্তব্য দিতে পারব না। আপনারা সবাই সেটা জানেন। আমি মনে করি মূল কারণ ছিল কিছু দেশ যুদ্ধ পরিস্থিতি ও গণহত্যা বন্ধে ও রিফিউজি সরাতে আপত্তি জানিয়েছিল। কারন তাদের সাথে পাকিস্তানের ঘনিষ্টতা ছিল। কিন্তু কিছু দেশের পারষ্পরিক সম্পর্কের কারনে বিশালাকার একটা সমস্যা যার মুখোমুখি ইন্ডিয়া হয়েছে এবং ইন্ডিয়ায় মজুদ এক কোটি ঘরহীন মানুষ, তখন এটা একটা বিশালাকার এক সমস্যা যা বিশ্ব কমিউনিটি সুরাহা করবে এবং এর কারণেই মূলত বাংলাদেশে পাক বাহিনীর উপর উলটো অত্যাচার শুরু হয়েছে যা একদিন পাকিস্তানী বাহিনী নিরস্ত্র ও নিরীহ বাংলাদেশের মানুষের সাথে করেছিল।

প্রশ্নঃ আপনি হয়ত দেখেছেন প্রেসের যে সব কমিটিযতদুর মনে পরে ব্রিটিশ প্রেস থেকে বলা হয়েছিলএই উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় যখন ভারত পাকিস্তান নিজেদের সমস্যা মেটানোর জন্যে ব্যস্ত সেই সময় বিশাল ক্ষমতাধর দেশের জন্যে এখানে একটা পথ খুলে গেছে

উত্তরঃ আমরা ভারতীয়রা কখনোই ক্ষমতার সমতায় বিশ্বাস করিনা যেমন করে পশ্চিমাবাসীরা করে থাকেন। কারণ এটা ওখানে যারা বসবাস করে তাদের ভবিষ্যত ও ভাগ্যের সাথে জড়িত এবং সন্দেহাতীতভাবে গনতান্ত্রিক দেশগুলোর মাঝে ভারত যে ঐতিহ্য ধারন করে তা প্রয়োজনীয়ও বটে। আমরা ভারত পাকিস্তান মতবিরোধিতা নিয়েও বিশ্লেষন করেছি এবং আমাদের পাকিস্তানের সাথে কোন স্থানগত মতবিরোধ নেই। যদিও এখন আমরা বাংলাদেশের জন্যে সবাই কাজ করছি কিন্তু প্রথম থেকেই তো বলে আসছি যে এগুলো সব বাংলাদেশের মানুষের জন্যে-তাদের ভবিষ্যতের জন্যে। আর যদি উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশের মানুষেরা আন্তর্জাতিক জোটসমূহের দ্বারা প্রলুব্ধ হয় এবং নিজেদের ভবিষ্যত ও ভাগ্যের সহায় হয় তাহলে বহিঃশত্রু কখনোই ওখানে প্রবেশ করতে পারবেনা। এবং আমি আন্তরিকভাবে আশা করি বহিঃশক্তিদের প্রভাব কখনোই কঠিন আঁকার ধারন করবেনা।

প্রশ্নঃ আপনি কি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পরিবর্তন সম্পর্কে আমাদের কিছু বলবেন?

উত্তরঃ ভুট্টো সাহেব যদিও পাকিস্তানের গনতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতা কিন্তু তার দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্টতা পায়নি। এটা যোগ করা গুরুত্বপূর্ন যে নুরুল আমিনের অধীনে ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার থাকার কথা ছিল, যেখানে নুরুল আমিন প্রধানমন্ত্রীত্ব পেয়েছেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পালটে গেছে। নুরুল আমিনকে এখন ভাইস প্রেসিডেন্টশিপ নিয়েই খুশি থাকতে হবে। এটা প্রমান করে যে ভুট্টো সাহেব নিজেকে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা মনে করতেই পারেন কিন্তু কখনোই পুরো পাকিস্তানের নয়, কারন বাংলাদেশে তো তার পার্টি একটা সিটও পায়নি। সুতরাং যে পাকিস্তানের সর্বময় কর্তা হবে তাকে আমাদের মেনে নিতেই হবে। আর ভুট্টো সাহেবকে অন্য সকল মানুষের মতই ভাবতে হবে।

প্রশ্নঃ এই আপোষ অনুষ্ঠান কবে হচ্ছে সিং বাবু?

উত্তরঃ আমরা এখনি এটা করার জন্যে তৈরি তবে আমি জানিনা পাকিস্তান এটা এখনো করার জন্যে তৈরি কিনা। হয়ত বিশাল কোন পরিবর্তন না ঘটলে হয়ত খুব শিঘ্রই ওরা আলোচনায় বসবে না। আমাদের দিক থেকে আমরা তৈরি।

প্রশ্নঃ আপনি কি শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তি আলোচনার আগেই সমাপ্ত হোক এটা চান?

উত্তরঃ আমার মতে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পাকিস্তান অনেক দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। সবক্ষেত্রেই মিলিটারি জেনারেল মিলিটারিদের মতই পদক্ষেপ নেবে। প্রেসিডেন্ট ভুট্টো দ্রুত পদক্ষেপ নেবে যেন শেখ মুজিব দ্রুত ছাড়া পায়। আর সে ক্ষেত্রে আমার মনে হয় শেখ মুজিবর রহমান দ্রুত ছাড়া পেতে পারেন। আমরা চাই তিনি ছাড়া পান।

প্রশ্নঃ ভুট্টো সাহেবের যুদ্ধনীতি কি আপনাদের সবাইকে বিরক্ত করেছে?

উত্তরঃ আমি খুশি হবোনা যদি তিনি প্রেসিডেন্ট হবার পরের ভাষনেই প্রথম উক্তি হিসেবে যদি বলেন তিনি যুদ্ধ করতে চান। আমি জানিনা যুদ্ধটা কিজন্যে চালাবেন উনি? আর পাকিস্তান ডেলিগেশন গতকাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের বক্তব্যগুলো মেনে নিয়েছে। এটা প্রমাণ করে যে তাদের মূল গন্তব্য এবং পথচলা এক নয়, ঠিক যেমন ভুট্টোর চরমপন্থী বক্তব্যও ঠিক নয়।

প্রশ্নঃ এই আপোষ অনুষ্ঠান কোথায় হতে পারে?

উত্তরঃ যেকোনখানে। আমাদের তেমন কোন পছন্দ নেই। যেকোনখানে আমরা যেতে রাজি আছি। আমরা ইসলামাবাদে যেতে রাজি আছি। আবার আমরা তাদের দিল্লীতে অভর্থনা জানাব যদি তারা চায়।

প্রশ্নঃ আমাদের দয়া করে বলবেন যে আপনি সেক্রেটারি জেনারেলের সমান পদমর্যাদা সম্পন্ন লোকেদের উপস্থিতি কামনা করেছেনকি কারনে?

উত্তরঃ যতদুর সম্ভব সেক্রেটারি জেনারেলের রিপ্রেজেন্টেটিভকে মানবিক দিক বিবেচনায় রাখা হচ্ছে এবং এটা হলে আরও ভালো হবে। কিন্তু ইন্ডিয়া পাকিস্তান নিয়ে অন্যান্য তর্ক গুলো দ্বিপাক্ষিক, এবং অতীতে ফিরে তাকালে দেখা যাবে জাতিসংঘও এই সমস্যা নিয়ে হাবুডুবু খেয়েছে। দুই পক্ষেই যুদ্ধবিরতি হয়েছে, যদিও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।

প্রশ্নঃ সোভিয়েত কি ইন্ডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে? আমি বলছি ইন্ডিয়ার নিরপেক্ষতার ইস্যুতে?

উত্তরঃ ইন্দো সোভিয়েত চুক্তির ফলে সোভিয়েত এর সাথে জোট নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে ভারতের অবস্থান আরও স্পষ্ট হয়েছে। এই চুক্তিই প্রমাণ করে যে ইন্ডিয়া জোট নিরপেক্ষ দেশ। এবং ইউ.এস.এস.আর সম্ভবত প্রথম কোন নথি পেশ করল যেখানে বিশ্বস্থিতিশীলতার ব্যাপারে জোটনিরপেক্ষতার প্রয়োজনীয়তা প্রকাশিত হল। সুতরাং ইন্দো সোভিয়েত চুক্তি প্রমান করে যে আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষায় এর গুরুত্ব।

প্রশ্নঃ আমার ধারনা ওয়াশিংটন এভাবে ভাবছেন না

উত্তরঃ ওয়াশিংটনের পরিস্থিতি অনুধাবন করার নিজস্ব পদ্ধতি আছে, এবং আমি মনে করি সময় হলে ওয়াশিংটন বুঝতে পারবে। ইন্ডিয়া এখন নিজের পারিপার্ষিক পরিস্থিতিতে পরিপক্ক্ব হয়েছে এবং নিজের খুশিমতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে, এজন্যে অন্য কোন দেশের সাপোর্ট প্রয়োজন হয়না, অন্য কোন পক্ষের শত্রুতে পরিণত হওয়ার ভয়ও পায়না। এ বিষয়গুলো ইন্ডিয়ার মত দেশকে দেখতেই হয়, সময় গেলে এ বিষয়গুলো ধীরে ধীরে লোকচক্ষুর সামনে উন্মোচিত হবে।

প্রশ্নঃ আপনি দ্বিপাক্ষিক সমঝোতার কথা বলছেন, এটা কি দ্বিপাক্ষিক হবে নাকি ত্রিপাক্ষিক?

উত্তরঃ কিছু বিষয়ে ত্রিপাক্ষিকও হবে বিশেষ করে বাংলাদেশ বিষয়ে। তবে পশ্চিমের বিষয়গুলোতে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হবে।

প্রশ্নঃ মাননীয় মন্ত্রী, আমরা শুনেছি, জম্মু কাশমীর ইস্যুটি এখানে উঠে আসবে এবং সরকার ও নতুন করে ভাবতে শুরু করবে

উত্তরঃ জম্মু কাশমীর ইন্ডিয়ার অন্তর্গত অংশ, এই দুটি ইন্ডিয়ার সরকারী নিয়ম অনুসারে চালানো হয়। আর বাংলাদেশে যে নৃশংস গনহত্যা চালানো হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের মিলিটারি দ্বারা, সেখানে তারা গনতান্ত্রের দমন নীতি দেখিয়েছিল। তারা অনেক স্বপক্ষযুক্তি দেখায় যার সবকিছু অযৌক্তিক। আমি মনে করি বাংলাদেশের বিষয়ের সাথে জম্মু কাশমিরের কোণ সম্পর্ক নেই।

প্রশ্নঃ আপনি সিকিউরিটি কাউন্সিলে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের ভুমিকা নিয়ে কি মনে করেন?

উত্তরঃ ব্রিটেন ও ফ্রান্স এই পরিস্থিতিতে সবকিছু বুঝেছে এবং তাদের সমর্থণ ও পাওয়া গেছে এই বিষয়ে।
কারণ তাদের উদ্দেশ্যই ছিল সিকিউরিটি কাউন্সিলের মাধ্যমে কোন একটা সমাধানে আসা। এবং একটা বাস্তবসম্মত সমাধানে আসা গেছে। ইন্ডিয়া এই সমাধানে আসার জন্যে তাদের প্রতি আন্তরিকতাও প্রকাশ করেছে। বাস্তবতা ছিল বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনগণের ভাগ্য।

প্রশ্নঃ জনাব পররাষ্ট্রমন্ত্রী, এমন একটা উত্তেজনাপূর্ন বিষয়ের কথা বলার জন্যে

উত্তরঃ এটা তেমন উত্তেজনাপূর্ণ ছিলোনা।

প্রশ্নঃ আপনি নতুন সেক্রেটারি জেনারেল সম্পর্কে কি মনে করেন যেহেতু তার সাথে আপনাকে অনেক কাজ করতে হবে?

উত্তরঃ আমি এম্বেসেডর ওয়াল্ডহেমকে অনেকদিন ধরে চিনি, এবং মনে করি উনি খুবই ভাল একজন মানুষ এবং বিশ্ব কমিউনিটিতে উনি ভালো অবদান রাখবেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৮০। লেট পাকিস্তান স্পিক ফর হারসেলফ ভারতের তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয় প্রকাশিত পুস্তিকা ডিসেম্বর ১৯৭১

Rajib Chowdhury <২১১-২১৮>
Niaz Mehedi <২১৯-২২২>

<১২, ৮০, ২১১২২২>

পাকিস্তানের নিজের বক্তব্য শোনা যাক

এখন ০০০

দশদিনের মাঝে আমি হয়ত রাওয়ালপিন্ডি ছেড়ে যাব, যুদ্ধে নেমে যাব।

(প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, এ.পির রিপোর্ট, ২৫নভেম্বর ১৯৭১)

আমি মিসেস গান্ধীর সাথে সাক্ষাত করব না, তিনি আমার কথাবার্তা পছন্দ করেন না। কিন্তু এই ব্যাপারটা আমার কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয় কারণ, তিনি না পেরেছেন মহিলা হতেনা পেরেছেন দেশনেত্রী হতে।

 

তাঁর বাবার মত তাঁর কোন গুণ নাই। যদি তাঁর সাথে আমার দেখা হয় তাহলে আমি তাকে বলব– “চুপ থাকুন আপনি। দূর হন আপনি

(প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এর সাক্ষাৎকার, প্যারিসের ল্য ফিগারোতে প্রকাশিত, সেপ্টেম্বর ১৯৭১)

মানুষ আমাকে ক্ষমতায় বসায়নি। আমিই বসেছি।

(সাংবাদিক সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, টাইম ম্যাগাজিন রিপোর্ট, ২ আগস্ট ১৯৭১)

এখন সময় জিহাদের এবং রাজনীতি কিংবা ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় নয়।

(মৌলভি ফরিদ আহমদ, ভাইস প্রেসিডেন্ট, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি, পাকিস্তান টাইমস, লাহোর, ১২ মে ১৯৭১)

এটা হল ভারতের মিথ্যা আস্ফালন ঠেকিয়ে একে ভাল পথে আনার প্রচেষ্টা। ভারতকে জোর খাটিয়ে থামাতে হয় এবং পাকিস্তান শুধু এটাই করবে।

(কোহিস্তান, লাহোর, ৬ আগস্ট ১৯৭১)

আমাদের সৈনিকেরা পুরোপুরি প্রস্তুত এবং আমাদের এখন যুদ্ধ বার্তার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই।

(ব্রিগ. মোহাম্মদ ইউসুফ, ডেপুটি সাবমার্শিয়াল ল এডমিনিস্ট্রেটর, জঙ্গ, করাচী, ১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১)

দুদেশের মধ্যে যুদ্ধ এটা নিশ্চিত এবং ধর্মের ভিত্তিতেই যুদ্ধ করা হবে।

(সর্দার আব্দুল কাইয়ুম খান, প্রেসিডেন্ট গভর্নমেন্ট পাকিস্তান অকুপাইড, কাশ্মীর, ডন, করাচী, ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১)

ভারতের বিপক্ষে জিহাদ ঘোষণার জন্যে পাকিস্তান সরকারের পুরো জাতিকেই প্রস্তুত থাকতে বলা উচিত।

(জামায়াত ই ইসলামিক পার্টির প্রধান, সিন্ধু প্রদেশ, জঙ্গ এর রিপোর্ট, ২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১)

পাকিস্তান নিজে থেকেই যুদ্ধটা করেছে যেন প্রতিবেশী দেশ উচিত শিক্ষা পায়, যেটা সে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে পেয়েও ভুলে গেছে।

(মওলানা মুফতি মাহমুদ, সেক্রেটারী জেনারেল অফ জামায়াতে ইসলামী, পাকিস্তান টাইমসের রিপোর্ট, লাহোর, ৩০ আগস্ট, ১৯৭১)

ইন্ডিয়াকে ধবংস করে দাও। আমরা জয়ী হবো।

(করাচীর গাড়ি গুলোতে সাঁটানো স্টিকারে ছাপানো, জঙ্গ, করাচী, ৮অক্টোবর ১৯৭১)

উপমহাদেশের মুসলমানদের সাথে হিন্দুদের যুদ্ধ ১০০০ বছর ধরে চলছে এবং যুদ্ধটা ইন্ডিয়ার সাথে বিরোধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত চলবে।

(জেড. এ. ভুট্টো, পাকিস্তান টাইমসের রিপোর্ট, লাহোর, ২১ ডিসেম্বর ১৯৭১)

গিলগিট ও বাস্তিস্তান এর মানুষেরা রাজ্যের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে স্ট্রাইক করছে মার্চের ১ তারিখ থেকেবলা হচ্ছে রাষ্ট্র জোরপূর্বক দমন পীড়ন নীতিমালা গ্রহন করে সকল রাজনৈতিক কর্মকান্ড বন্ধ করে দিয়েছে এবং নাগরিক স্বাধীনতা ও দিচ্ছেনা।

(পাকিস্তান অবজারভার, ৭ মার্চ, ১৯৭১)

কাশ্মীর ইস্যুটাকে মানুষের মনে আবারো জাগিয়ে তোলা দরকার, টেবিল বৈঠক করে বন্ধন মুক্তি ঘটবেনা। রক্তের বিনিময়েই মানুষ অধিকার আদায় করে।

(সর্দার আব্দুল কাইয়ুম খান, প্রেসিডেন্ট, গভর্নমেন্ট অফ পাকিস্তান অকুপাইড, কাশ্মীর, ডন, করাচী, ১২ মে ১৯৭১)

জম্মু ও কাশ্মীরকে যুক্ত না করা গেলে পাকিস্তানে শান্তি ফিরে আসবেনা।

(সর্দার আব্দুল কাইয়ুম খান, প্রেসিডেন্ট, গভর্নমেন্ট অফ পাকিস্তান অকুপাইড, কাশ্মীর, পাকিস্তান টাইমস, লাহোর, ৩১ আগস্ট ১৯৭১)

জে এন্ড কে লিবারেশন লিগের প্রেসিডেন্ট, জনাব কে এইচ খুরশিদ (পাকিস্তানের দ্বারা স্বীকৃত) ঘোষণা করেছেন যেপাকিস্তান সরকারকে দমন ও নগ্ন করার সকল অপচেষ্টার দায় আজাদ কাশ্মীর সরকারের। প্রথমেই আজাদ কাশ্মীর গভর্নমেন্টকে ঢেলে সাজানো দরকার।

(পাকিস্তান টাইমস, লাহোর, ৯ জানুয়ারী, ১৯৭১)

পাকিস্তান খ্রিষ্টান ডেমোক্রেটিক কাউন্সিলের জেনারেল সেক্রেটারী জনাব এন. পত্রাস ও বাবা স্যামুয়েল নামের ৮৫ বছরের এক বৃদ্ধ সহকারে পাঞ্জাবের কিছু ডিস্ট্রিক্টে চার্চ অবমাননার প্রতিবাদে সোমবারে অনশনে গেলেন। জনাম পত্রাস সাংবাদিকদের বললেন যে  কিছু দিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে দমন পীড়ন চলছে তার্কিশ আর্ট অফ লাভ ইন পিকচারসবইটির পাবলিকেশন এর বিরুদ্ধে যা খ্রিষ্টানদের উপর ডাইভার্ট করা হয়েছে এবং পবিত্র স্থানগুলোতে আঘাত এসেছে।

(পাকিস্তান টাইমস, লাহোর, ১৯ জানুয়ারী, ১৯৭১)

জনান আবদুল হাফিজ কারদার, পাঞ্জাব এসেম্বলির নির্বাচিত মেম্বার ও একজন সাবেক ক্রিকেটার ভারতের হকি খেলোয়ারদের পাকিস্তানে বিশ্বকাপ হকি খেলায় (লাহোরে) আমন্ত্রণে বাঁধা দিয়েছিলেন।

 

তিনি পাঞ্জাবের খেলোয়ারদের ওয়াই.এম.সি.এ হলের একটি রিসিপশন অনুষ্ঠানে বলেছিলেনভারতের সাথে এই প্রতিরোধ প্রতিটা ক্ষেত্রে প্রতিটি বিভাগে ঘটবে এটাই হল পাকিস্তান পিপলস পার্টির বৈদেশিক নীতি। এবং বর্তমান ইলেকশনের জনগনের ম্যান্ডেটের বিরুদ্ধেই পাকিস্তানে ইন্ডিয়ান টিমের আগমনকে ঠেকানো হবে।

(মর্নিং নিউজ, ঢাকা, ৩০ ডিসেম্বর, ১৯৭০)

কিছুক্ষণ হাইজ্যাকারদের সাথে কথা বলে (যারা লাহোরে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স হাইজ্যাক করেছিল) ভুট্টো বললেন – “আমরা তোমাদের সাথে আছি

(পাকিস্তান টাইমস, লাহোর, ১ ফেব্রুয়ারী ১৯৭১)

দুজন হাইজ্যাকারের মাঝে একজন মোহাম্মদ আশরাফ লাহোর এয়ারপোর্টে আসা একজন সাংবাদিককে বলেছিল পাকিস্তানের জনগনের চেয়ারম্যান জনাব ভুট্টো সব কিছু তার উপর ছেড়ে দিতে বলেছেন।

 

ভুট্টো ঢাকা থেকে ফিরেই হাইজ্যাকারদের সাথে দ্রুত দেখা করতে গিয়েছিলেন।

(পাকিস্তান অবজারভার, ১ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১)

এয়ারপোর্টে একটা ইন্টারভিউতে ভুট্টো বলেছিলেন তিনি তার দলের লোকেদের নির্দেশ দিয়েছেন তারা যেন জম্মু কাশ্মীরে ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (পাকিস্তানের মদদপুষ্ট)এ যোগাযোগ করে যেন ওরা দুই হাইজ্যাকারকে সকল প্রকারের সাহায্য করতে পারে। ভুট্টো দুই বীর হাইজ্যাকারের অনেক প্রসংশা করেছিলেন।

(ডন, করাচী, ৪ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১)

আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ মুজিবর রহমান প্লেন হাইজ্যাক করার ঘটনায় নিন্দা প্রকাশ করেন। এবং সরকারের এই ঘটনায় অনুসন্ধান বন্ধ করে দেয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন যেন এই অবস্থার একটা পরিসমাপ্তি ঘটে।

(মর্নিং নিউজ, ঢাকা, ৪ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১)

আমি একটা লিস্ট বানিয়েছি যাতে সেই সব সাংবাদিকের নাম আছে যারা নির্বাচনের সময়কালে আমার পার্টির বিপক্ষে ছিল এবং সবাইকেই থামিয়ে দেয়া হবে।

(জেড.এ. ভুট্টো, পাকিস্তান টাইমস এর রিপোর্ট, লাহোর, ২১ ডিসেম্বর, ১৯৭০)

পাকিস্তান পিপলস পার্টি পাঞ্জাব ও সিন্ধের বড় অংশ জিতে নিয়েছে। কেন্দ্রের প্রকৃত ক্ষমতা এই দুটো অঞ্চলকে ঘিরেই। কেন্দ্রে কোন সরকারই নেই থাকলেও পি.পি.পির সমর্থন ছাড়া চলতে পারবে?

(জেড.এ. ভুট্টো, পাকিস্তান টাইমস রিপোর্ট, লাহোর, ২১ ডিসেম্বর, ১৯৭০)

পাঞ্জাব ও সিন্ধু  এখন আর ক্ষমতার জন্যে উচ্চাভিলাষী নয়। জনগনের গনতান্ত্রিক আন্দোলন এই ক্ষমতার বেষ্টনীর বিপক্ষে।

(জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ(এখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী), ডন, করাচী, ২২ ডিসেম্বর, ১৯৭০)।

এমনভাবে পুরো সামাজিক ব্যবস্থাকে গঠন করা হয়েছে যেন বাঙালী সংস্কৃতি কোনকালেই মাথা তুলে দাড়াতে না পারে। এমনকি যে গানগুলো শুনলেই মন ভরে যেত সেই গানগুলো ও নিষিদ্ধ হয়ে যায়। রেডিও টেলিভিশনে ইসলামের নামে রবীন্দ্রনাথের গান প্রচারিত হত না। একটা সুক্ষ্ম চাল ছিল এটাযেন পূর্ব পাকিস্তানের লোকেদের তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করা যায়।

(পাকিস্তান টাইমস এ শেখ মুজিবর রহমান, লাহোর, ১ জানুয়ারী ১৯৭১)

পাকিস্তান একটি মুসলমান রাষ্ট্র এবং এতে ধর্ম নিরপেক্ষ সাম্যবাদী সংবিধান কার্যকর।

(মওলানা সৈয়স আব্দুল আলী মওদুদী, জামায়াতী ইসলামী আমীর, ডন, করাচী, ৪ জানুয়ারী, ১৯৭১)

ঢাকায় সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় শেখ মুজিবর রহমান অনুধাবন করলেন যে শুধু বাংলাদেশেই নয় পুরো দেশেই আওয়ামীলীগ সংখ্যাগরিষ্ট। এটা দিয়েই শাসনতন্ত্র রচনা করা যেত। কিন্তু তাঁর দলকে ভুট্টো সাহেব ও অন্যান্যদের কাছে সাহায্য চাইতে হবে।

(পাকিস্তান অবজারভার, ৩০ জানুয়ারী, ১৯৭১)

আওয়ামীলীগের প্রধান, শেখ মুজিবর রহমানকে মিথ্যা অভিযোগে বরখাস্ত করা হয়েছে। তাঁর উপর অভিযোগ করা হয়েছে যে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের উপর ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন যদি পশ্চিম পাকিস্তানের প্রাদেশিক অংশ গুলো বাংলাদেশের মত সমান অধিকার না চায় অথবা যদি সমপরিমান অতিরিক্ত ক্ষমতা কেন্দ্রে সমর্পন না করে তাহলে এই ছয়দফা দাবী নিজের অবস্থান হারাবে।

 

আওয়ামীলীগের এই প্রধান আরো বলেন তাঁর পার্টি কখনোই এই ছয় দফা দাবীকে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রাদেশিক অংশগুলোকে জোর পূর্বক আরোপ করার চেষ্টা করেনি।

(ডন, করাচী, ১৫ ফেব্রুয়ারী ১৯৭১)

পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জনাব জুলফিকার আলী ভূট্টো ন্যাশনাল এসেমব্লীর কার্যক্রম থামানোর দাবী জানালেন। তিনি বললেন যে পিপিপি ন্যাশনাল এসেমব্লীতে একটা গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা পালন করেছে। উনার পার্টির ৮৫জন সদস্যকে ছাড়া এই সম্মেলন সংগঠিত হলে তিনি জাতীয় আন্দোলন শুরু করবেন। ভুট্টো সাহেব বললেন পিপিপি চায় যে পাকিস্তানের মানুষেরা যারা ঢাকা থেকে এসে ক্ষমতা চায় তাদের উপর প্রতিশোধ নিক। যদি পাকিস্তান না পারে তাহলে পিপিপি নিজেই এই দায় কাঁধে তুলে নেবে। তিনি আর বলেন কেউ যদি এই সেশনে যোগ দেয় তাহলে পার্টি থেকে তাকে বহিষ্কার করা হবে।

(ডন, করাচী, ১ মার্চ, ১৯৭১)

পাকিস্তান ডেমোক্রটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট জনাব নুরুল আমীন এক জবানীতে বললেনতিনি ন্যাশনাল এসেম্বলির এমন বন্ধ ঘোষণা মোটেই আশা করেননি। তিনি অবাক হয়েছেন।

(ডন, করাচী, ২ মার্চ, ১৯৭১)

বেঙ্গল ন্যাশনাল লীগের জেনারেল সেক্রেটারী জনাব আলী আহাদ( আহাদ গ্রুপ) বলেনঃ এই ন্যাশনাল এসেমব্লীর নাটকীয় রদ ঘোষণা এই দেশের জনগণের ক্ষমতা বিজয়ীদের হাতে হস্তান্তরের প্রশ্নে একটি সাবোটাজ

(ডন, করাচী, ১ মার্চ, ১৯৭১)

এয়ার মার্শাল (রিঃ) নুর খান প্রেসিডেন্টের ঐ মুহুর্তের পরামর্শদাতাদের দায়ী করেন এবং কিছু আমলাকে দায়ী করেন যারা রাজনৈতিক দলগুলোকে ন্যাশনাল এসেম্বলিতে যেতে নিষেধ করেছিল। আমলাতন্ত্র ছেয়ে গিয়েছিল দেশে। এরা জনগণের ক্ষমতা ভয় পেত। তাই গনতান্ত্রিক সরকারশব্দটা তাদের কাছে ঈশ্রাফিলের শিঙার শব্দের মতো মনে হত

 

ওরা ভুটো সাহেবকে পেল নিজেদের ইচ্ছের ক্রিড়ানক হিসেবে। ভুট্টো সাহেবের একমাত্র ইচ্ছেই ছিল ক্ষমতায় আরোহন করা। উনাকেই আমলারা পেল যে নিজেদের ক্ষমতার জন্যে দেশকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে, যেন তিনি নিজে পশ্চিম অংশ পুরোটা দখল করে নিতে পারেন।

(জাসারাত, করাচী, ৭ মার্চ, ১৯৭১)

বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবিগণ, সাংবাদিক্, রাজনীতিক, সামাজিক এবং ব্যবসায়ী পরিষদ এবং ছাত্র ও কর্মীরা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্যে চাপ দিলেন।

উনারা ভাবলেন পূর্বপাকিস্তানকে পশ্চিম অংশ নিজেদের সকল অধিকার শান্তিমতই দিয়ে দেবে।

(ডন, করাচী, ১০ মার্চ, ১৯৭১)

মুসলিম লীগের প্রধান মুমতাজ মোহাম্মদ খান দৌলতানা অনুধাবন করেছিলেন যে শেখ মুজিবর রহমানের দাবীগুলো যৌক্তিক এবং পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্যে এগুলোকে মেনে নেয়া উচিত।

(ডন, করাচী, ১৪ মার্চ, ১৯৭১)

পাঞ্জাব আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মালিক হামিদ সরফরাজ বললেন যে জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো একটা অস্বস্থিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছেন যা মানুষের কাছে রাজনৈতিক অদক্ষতার প্রমাণ। তিনি আরো বলেন যে পূর্ব পাকিস্তান এখন শেখ মুজিবর রহমানের কথায় চলছে এবং তিনি যদি চান তাহলে এই দেশ দুভাগ হয়ে যাবে সহজেই। কিন্তু এটা সত্যি যে শেখ মুজিব নয় বরং ভুট্টো সাহেবই মূল বিচ্ছিন্নতাবাদী।

(ডন, করাচী, ১৭ মার্চ, ১৯৭১)

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবর রহমানের সাথে দেশের সাংগঠনিক সমস্যার পুনসমাধানের জন্যে বসেছিলেন

যখন সাংবাদিকেরা শেখ মুজিবর রহমানকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছিলেন, তখন আওয়ামীলীগের এই প্রধান বললেনআমার জন্মদিন কি? আমার মৃত্যুদিবসই বা কি? আমি আমার মানুষের মাঝে আছি। আমার মানুষের কোন নিরাপত্তা নাই। ওদের মৃত্যু হচ্ছে।

(পাকিস্তান টাইমস, লাহোর, ১৮ মার্চ, ১৯৭১)

পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ওয়ালি গ্রুপ) বেলুচিস্তান শাখা একটি মিটিং এ শেখ মুজিবর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে মার্শাল ল তুলে দেয়ার জন্যে দাবী জানালো। তিনি ভুট্টো সাহেবে অপেক্ষাকৃত কম শক্তির দলকে ক্ষমতায়নের মাধ্যমে দ্বিজাতিতত্ত্ব নীতির ও বিরোধিতা করেন।

(ডন, করাচী, ১৯ মার্চ, ১৯৭১)

(ইউএন সেক্রেটারী জেনারেল ইউ থ্যান্ট’ এর সমাধির উপর শেখ মুজিবর রহমানের প্রতি অবিচারের বিরুদ্ধে মতামত অঙ্কিত আছে)ঃ

ইউ থ্যান্ট শেখ মুজিবর রহমানের শাস্তি ও পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন বিষয়াদির ব্যাপারে সাম্যবাদী ছিলেন। দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে অনাহুতের মত হস্তক্ষেপের জন্যে পাকিস্তানের জনগন কখনোই ইউ.ট্যান্টকে ক্ষমা করবেনা।

(কোহিস্তান, লাহোর, ১৮ আগষ্ট, ১৯৭১)

শেখ মুজিবর রহমানের মৃত্যুদন্ড কার্যকর বিলম্বিত হওয়া এবং বিশ্বজনমতকে এতে নাক গলাতে দেয়ার জন্যে পাকিস্তান সরকারই দায়ী। মরক্কো, সুদান ও ঈজিপ্ট থেকে সরকারকে শিক্ষা নেয়া উচিত ছিল যেখানে বিশ্বাসঘাতকদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করতে মুহুর্ত ও বিলম্ব হয়না।

(নাবাবী ওয়াক্ত, লাহোর, ১৬ আগষ্ট, ১৯৭১)

 

পাকিস্তান সরকারের দ্রুত সমস্ত কারাবন্দীদের মুক্তি দেয়া উচিত। সরকারের উচিত রাজনৈতিক নেতাবৃন্দের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া, অনেক মানুষ যারা ভিন্ন মতাবলম্বী তারা বিনা বিচারে কারাবন্দী আছে তাদের ওয়ারেন্ট তুলে নেয়া।

(মীর গাউস বক্স বিজেঞ্জো, প্রেসিডেন্ট, বেলুচিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালী গ্রুপ), ডন এর রিপোর্ট, করাচী, ৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১)

এবং তারআগে

দুটো জাতিজিন্নাহ সাহেব! প্রত্যেকটা প্রদেশে মুখোমুখি? সব শহরে? সব গ্রামে?

দুটো জাতিপ্রত্যেকটা প্রদেশে মুখোমুখি। সব শহরে এবং সব গ্রামে এবং এটাই একমাত্র সমাধান।

একটা ভয়াবহ সমাধান জিন্নাহ সাহেব

এটা ভয়াবহ, কিন্তু একমাত্র সমাধান

(জনাব এম.এ. জিন্নাহ এডওয়ার্ড থমসনের সাথে একটা ইন্টারভিউতে, এনলিস্ট ইন্ডিয়ান ফর ফ্রিডম এর বাণী, লন্ডন, ১৭৪০, ৫২ নং পৃষ্ঠা)

পাকিস্তান জয় করার জন্যে রক্তপাতই একমাত্র পথ, এবং দরকার হলে অমুসলিমদের হত্যা করা হবে, এবং তা হবে মুসলমানদের জন্যে অহিংস।

(সর্দার আব্দুর রব নিসার, ৩০ জুলাই, ১৯৪৬)।

পাকিস্তান একটা বাধ্যবাধকতার মাঝে আছে, এটা আন্তর্জাতিক হোক বা অন্য যেকোনভাবেই হোক, এটাই কাশ্মীরে সৈন্য পাঠাতে বাধা দিচ্ছে।

(স্যার মোহাম্মদ জাফরুল্লাহ খান, পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী, করাচীতে ৮সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮)

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রেস রুম থেকে উল্লসিত লাখো জনতার উদ্দেশ্যে লিয়াকত আলী খান ঘোষণা করেনঃ আজ থেকে আমাদের প্রতীক হবে এটা এবং জানালা দিয়ে তিনি তার মুষ্টিবদ্ধ হাত বের করে রাখলেন।

(ডন, করাচী, জুলাই ২৮, ১৯৫১)

যদি জাতিসংঘ নিজেদের চোরের দল প্রমান করে, এতে আমাদের কিছু করার নেই। আমরা প্রমান করবই যে আমরা কাশ্মীর আমরা আমাদের অস্ত্র দিয়েই স্বাধীন করতে পারি।

(মিয়ান মুমতাজ দৌলাতানা, চীফ মিনিস্টার পাঞ্জাব,

জমিনদার, লাহোর ১৭ জানুয়ারি, ১৯৫২)

আমরা যদি ইসলামের দিকনির্দেশনা মোতাবেক বাঁচতে চাই এবং আমাদের সঠিক ইসলামের ছাঁচে তৈরি করতে চাই, তাহলে আমাদের শত্রুদের আমাদের তলোয়ার এর শক্তি দিয়ে যাচাই করতে হবে। আমি নেহেরু কে সাবধান করেছি যদি সে তার দৃষ্টিভঙ্গি না বদলায়, পাকিস্তানিরা দিল্লি অভিমুখে অগ্রসর হতে এবং ভারতীয়দের একটি শিক্ষা দিতে দ্বিধা করবেনা।

(এ এম কোরায়েশী, পশ্চিম পাকিস্তানি বিধানসভা সদস্য,

মুসলমান, করাচী, ৮ মার্চ, ১৯৫৬)

তাদের(নেহেরু এবং ভারত) কে জবাব একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ও সিয়েটোর সহায়তায় কাশ্মীর দখল ও বাংলাদেশ চুক্তি করেই দেয়া যাবে।

(নয়া রশ্মি, করাচী, ১ এপ্রিল ১৯৫৬)

আমাদের উচিৎ ভারতের সাথে সকল প্রকার আলোচনা বন্ধ করে দেয়া এবং চূড়ান্ত ফয়সালা করা। এবং এই ফয়সালা একমাত্র যুদ্ধের মাধ্যমেই হতে পারে। আল্লাহ আমাদের সাথে আছে।

(প্রি এলাহী বক্স, সাবেক মন্ত্রী, সিন্ধু প্রদেশ

নয়া রশ্নি, করাচী, ১৬ এপ্রিল ১৯৬৫)

আমরা প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে প্রস্তুত, আক্রমণাত্মক এবং আত্মরক্ষামূলক উভয়ই, যেকোন দেশের সাথে যারা আমাদের একমাত্র শত্রু ভারতের বিপক্ষে আমাদের সাহায্য করবে।

(সর্দার আব্দুর রব নিশতার, সভাপতি, মুসলিম লীগ, লাহোর ২৬ নভেম্বর, ১৯৫৬)

আমরা তাদের(বাগদাদ চুক্তিতে ব্রিটেনকে) আমাদের আত্মরক্ষাজনিত কারনে। আমাদের প্রথম দায়িত্ব আমাদের প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করা, নির্দিষ্টভাবে ভারতের বিপক্ষে অন্য কেউ যাই বলুক না কেন।

(মালিক ফিরোজ খান নূর, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পাকিস্তান

পাকিস্তান টাইমস, লাহোর, ৮ ডিসেম্বর, ১৯৫৬)

আমরা বামপন্থীদের অধিকরণ, অনুপ্রবেশ ও আগ্রাসন নিয়ে ব্যাপক উদ্বিগ্ন। আমরা আমাদের তাদের প্রভাব থেকে যতদূর সম্ভব সরিয়ে রাখতে চাই। পৃথিবীর শান্তি আসলে মুক্ত গণতন্ত্রের হাতেই নিহিত।

(এইচ.এস সোহরাওয়ার্দী, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লস এঞ্জেলেসের একটি সংবাদ সম্মেলনে,

সিভিল ও মিলিটারী গেজেট, ১৭ জুলাই ১৯৫৭)

এটা বিশ্বাস করা কষ্টকর যে পকিস্তানের একজন প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে বলতে পারেন যে আমরা ১১ বছর ধরে কাশ্মীর দ্বন্দের সমাধার জন্য ভারতকে শুধু যুদ্ধের হুমকিই দিয়ে আসছি। কিন্তু তবুও জনাব নুন এটা বলেছেন সোমবারে।

(লিডার, করাচী, ৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৮)

মানুষ এখনো প্রথম এবং সবচেয়ে কার্যকরী অস্ত্র যুদ্ধের। এবং পাকিস্তান যেহুতু সর্বশ্রেষ্ঠ বাহিনী সেহুতু তারা ভারত বা যেকোন পশ্চিমা দেশকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে নিজেদের স্বাধীনতা সংরক্ষন ও হেফাজত করতে।

(চৌধুরী গোলাম আব্বাস, সভাপতি, জম্মু এবং কাশ্মীর মুসলিম সম্মেলন

ডন, করাচী, ২২ ডিসেম্বর ১৯৬২)

পশ্চিম পাকিস্তানের অজনপ্রিয় সরকারের একটি প্রচলিত রীতি হয়ে দাড়িয়েছে যে সর্বদা দেশের জনপ্রিয় রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে ভারতীয় দালাল বলা।

(সংবাদ, ঢাকা, ৮ ডিসেম্বর, ১৯৬৪)

কিছুদিন ধরেই শাসকগোষ্ঠী গনতন্ত্রকামী অভ্যুত্থান কে দমন করার জন্য শুধুমাত্র পুলিশের উপর আর অধিক নির্ভর করছেনা। বরঞ্চ হিটলার ও মুসোলিনির পদাঙ্ক অনুসরন করে একদল ভাড়াটে গুন্ডা নিরস্ত্র দেশবাসীর উপর লেলিয়ে দিয়েছে।

(দৈনিক ইত্তেফাক, ঢাকা, ১০ ডিসেম্বর, ১৯৬৪)

১৯৫৮ সালে ক্ষমতা দখলের পর, আইয়ুব খান ভারত কে উত্তরীয় দেশগুলোর হুমকি মোকাবেলায় একটি যৌথ সামরিক চুক্তির প্রস্তাব দেন। সে রাতেই সেই বিপদ জাদুবলে উধাও হয়ে যায় এবং রাতারাতি উত্তর বন্ধু হয়ে যায় এবং পাশাপাশি নিরন্তর ভারতবিরোধী কথার জেহাদে লিপ্ত হয়। যথারীতি কাশ্মীর নিয়ে একটি চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়। পরিস্থিতি এমন মনে হচ্ছে যেন পাকিস্তানি শাসকেরা ভারতের সাথে ঝামেলা করার ব্যাপারে মনস্থির করেছেন।

(‘ভীমরুল’ দৈনিক ইত্তেফাক, ঢাকা, ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৬৪)

কাশ্মীরকে ভারতের ইউনিয়নের সাথে একীভূত করার পদক্ষেপে বাধা দিতে এক হাজারের ও বেশী যোদ্ধা আজ যুদ্ধবিরতি রেখা অতিক্রম করবে।

(মাশরিক, লাহোর, ২৯ জানুয়ারি, ১৯৬৫)

একীভূত করার পদক্ষেপের বিরুদ্ধে একমাত্র জবাব হল জিহাদ করা; পাকিস্তানের জাতিসংঘ থেকে পদত্যাগ করা উচিৎ

(জং, করাচী, ১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৫)

আমরা যুদ্ধভীত নই, এবং যুদ্ধের সময় যুদ্ধে যেতে দ্বিধা করবনা।

(ডন, করাচী, ১১ মার্চ, ১৯৬৫)

 

আমাদের উচিৎ একটি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়া, একটি জিহাদের প্রস্তুতি নেয়া।

(ডন, করাচী, ২২ মার্চ, ১৯৬৫)

আমি আমাদের সৈনিক প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করছি এখনি আক্রমণ করতে, কারন প্রতিবাদে কাজ হবেনা।

(ডন, করাচী, ২৩ মার্চ ১৯৬৫)

দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেটা দেশের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে সেটাকে গণতন্ত্রের সাথে তুলনা দেয়া যায়না।

(দৈনিক ইত্তেফাক, ঢাকা ২৩ মার্চ, ১৯৬৫)

১৯৫৬ সালের গনতান্ত্রিক সংবিধান দূরে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। জনগন সকল প্রকার মৌলিক ও রাজনৈতিক অধিকার হতে বঞ্চিত। এমনকি জাতি, ধর্ম, বর্ন, গোত্র নির্বিশেষে জনগণের ভোটাধিকার, যেটি বিদেশী শাসনের সময় ও বলবৎ ছিল, যেটির অধীনেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেই অধিকার জনগনের থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। জনগনের অর্থনৈতিক মুক্তি আজ অধরা স্বপ্ন। আজকের সরকার কিছু নির্দিষ্ট সংখ্যক কোটিপতি ও পুঁজিপতি কে অবাধ সুযোগ দিয়েছে তাদের মুনাফা বাড়ানোর। অথচ অপরদিকে ১০ কোটি মানুষ আজ প্রচণ্ড দারিদ্র্যে দিনানিপাত করছে ও দেউলিয়া হয়েছে। অল্পকিছু মানুষ আমাদের শিল্প ও অর্থনৈতিক উন্নতির সুবিধাভোগী। একদিকে লাখো মানুষের ক্ষুধা এবং অন্যদিকে অল্পকিছু মানুষের সমৃদ্ধি ও ঐশ্বর্যএটাই পাকিস্তানের বর্তমান চিত্র।

(সংবাদ, ঢাকা, ২৩ মার্চ, ১৯৬৫)

যাদের দৃষ্টি স্বার্থপরতার প্রবৃত্তি দ্বারা আচ্ছন্ন আমরা তীব্রভাবে তাদের বিপক্ষে। তাদের সৎ বা অসৎ যেকোন উপায় ভালো যদি সেটা তাদের নিজেদের খিদমত করতে পারে। তাদের উদ্দেশ্য আত্মতুষ্টি দেশের কল্যাণ নয়।

(ফাতিমা জিন্নাহ, ডন করাচী, ১৩ এপ্রিল ১৯৬৫)

কাশ্মীরের সমস্যা সমাধানে জিহাদই একমাত্র পন্থা।

(পাকিস্তান টাইমস, লাহোর ২৮ শে এপ্রিল, ১৯৬৫)

যখন রনে যুদ্ধ চলছিল, ভারতের একমাত্র বিমানবাহী রণতরী ভিকরান্ত, এবং অন্যান্য ট্যাংকার গুলো পাকিস্তানের একটি সাবমেরিন দেখে আরব সাগরে পালাতে বাধ্য হয়েছিল।

(জং, করাচী, ৩ মে, ১৯৬৫)

হাজার হাজার রাজাকার যুদ্ধবিরতি ভাঙতে প্রস্তুত এবং কাশ্মীরে প্রবেশ করে তাদের ভাইদের মুক্ত করে আনতে প্রস্তুত।

(সর্দার রহমতুল্লাহ, রাজ্য পরিষদের সদস্য,

পাকিস্তান টাইমস, ১৭ মে ১৯৬৫)

পাকিস্তান সরকারের উচিৎ যুদ্ধবিরতির বিপরীতে তাদের আপত্তি জানিয়ে দেয়া এবং কাশ্মীরকে একটি পূর্নাঙ্গ জিহাদ শুরুতে সাহায্য করা।

(সর্দার আব্দুল কাইয়ুম খান,

ডন, করাচী, ২৫ মে ১৯৬৫)

গত সাত বছরেও আমরা কোন নির্বাচন দিতে পারিনি তাদের নিজস্ব সরকার নির্বাচন করে নিতে, এটা আমাদের কাজের কোনভালো প্রতিফলন নয়। দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদ ছাড়া বাকি সকল পদই অকাশ্মীরী নাগরিক দ্বারা পদায়ন করা। তিক্ত সত্য এটাই যে আমাদের থাকাকালীন সময়ে আজাদ কাশ্মীরে আমরা আমাদের অজনপ্রিয় করে তুলেছি, এবং ইহা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।

(সিভিল ও মিলিটারি গেজেট, ৫ জুন ১৯৬৫)

আমরা যেকোন ভারতীয় ষড়যন্ত্রে চীনের সাহায্য প্রাপ্তি সুভাগ্য মনে করব।

(আজাদ, ঢাকা, ৬ জুন, ১৯৬৫)

আজ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই শুধু অসমতা নয় বরং প্রশাসনিক, কার্যনির্বাহী এবং বিধানিক ক্ষেত্রেও অসমতা বিরাজমান। কারন যেকোন বিধানিক প্রস্তাবেই প্রেসিডেন্ট ভেটো দেন। প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থাতেও চরম অসমতা। পূর্বপাকিস্তানিরা কারো হাঁসমুরগীর খাবার নয় এবং হতেও চায়না। অনেক ক্ষেত্রেই পূর্বপাকিস্তানিদের মতামত বা কল্যাণ অগ্রাহ্য করেই নানারকম রীতিনীতি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এগুলো তেমন কোন ব্যাপার হত না যদি আমাদের একটি গনতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত সরকার যেখানে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা মন্ত্রীসভার নিকট থাকত এবং মন্ত্রীসভা একটি সার্বভৌম সংসদের নিকট দায়বদ্ধ থাকতেন।

(নুরুল আমিন, পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে,

পাকিস্তান অবজার্ভার, ঢাকা, ৬ জুলাই ১৯৬৫)

ভারতের সাথে যুদ্ধের ঘটনায় পাকিস্তানের সৈন্য দিল্লি পর্যন্ত মার্চ করবে, লাল দুর্গ অধিকার করবে এবং পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করবে।

(পাকিস্তান টাইমস, লাহোর, ১১ জুলাই, ১৯৬৫)

 

পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ এই তথ্য হতেই জানা যায় যে, পুর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি গ্রামে পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মকর্তা।

( এ.এম.কামারুজ্জামান, ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে,

পাকিস্তান টাইমস, লাহোর ২০ জুলাই, ১৯৬৫)

ভারত বিশ্ববাসীকে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাবহৃত অস্ত্র কেবল পকিস্তান থীক আসতে পারে। এটা বিশ্বাস করা বোকামী যে অস্বাভাবিক সরকারের বিপক্ষে যেকোন জনপ্রিয় প্রতিরোধ অস্ত্রের অভাবে আজকের পৃথিবীতে বেশীদিন টিকে থাকবে।

(পাকিস্তান, লাহোর টাইমস, ১৭ অগাস্ট, ১৯৬৫)

 

কাশ্মীরিরা যুদ্ধবিরতিতে কোন পক্ষ না, এবং যুদ্ধবিরতি রেখা অতিক্রম করার অধিকার তাদের রয়েছে।

(ডন, করাচী, ২২ অগাস্ট, ১৯৬৫)

শিরোনাম সুত্র তারিখ
৮১। বাংলাদেশের প্রশ্নে ভারতের বিভিন্য রাজ্য সভা ও বিধান সভা প্রতিক্রিয়া দৈনিক আনন্দবাজার ২৯ মার্চ, ১৯৭১

Aadrita Mahzabeen

<১২, ৮১, ২২৩>

বাংলাদেশের লোকদের সাহায্যের জন্য আবেদন

মহারাষ্ট্র বিধান পরিষদের মুলতবী প্রস্তাব অগ্রাহ্য

মহারাষ্ট্র বিধান পরিষদে আজ পূর্ববঙ্গের ঘটনাবলী সম্পর্কে আকটি মুলতবী প্রস্তাব উত্থাপিত হলে চেয়ারম্যান তা অগ্রাহ্য করেন।

চেয়ারম্যান শ্রী ভি এস পেজ বলেন যে, বিষয়টি সংসদের আওতায়। সুতরাং এ সম্পর্কে এই সভায় আলোচিত হতে পারে না।

উত্তর প্রদেশ বিধান সভা

লক্ষ্ণৌ, ২৯শে মার্চ – উত্তর প্রদেশ বিধান সভা স্বাধীন বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি দানের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে সর্বসম্মতিক্রমে অনুরোধ জানিয়েছে।

রাজস্থান বিধান সভা

জয়পুর, ২৯শে মার্চ – আজ রাজস্থান বিধান সভার সমস্ত দলের সদস্য বাংলাদেশে পাক সৈন্যদলের অমানুষিক হত্যাকান্ডের জন্য “গভীর উদ্বেগ” প্রকাশ করেন।

– পিটিআই

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৮২। বাংলাদেশকে আশু স্বীকৃতিদানের জন্য পশ্চিম বাংলার মন্ত্রীসভার সদস্যের আহবান দৈনিক ‘হিন্দুস্থান টাইমস’ ১৯ এপ্রিল, ১৯৭১

 

Shuvadittya Saha

<১২, ৮২, ২২৪২২৫>

আশু স্বীকৃতি প্রদানের জন্য মন্ত্রীর আহবান

 

নয়া দিল্লি, এপ্রিল ১৮ (পিটি আই ) – পশ্চিম বাংলার খাদ্য এবং দুগ্ধসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রী বাবু কে কে মৈত্র বাংলাদেশকে আশু স্বীকৃতিদানের আহবান জানিয়েছেন। আজ এখানে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, ভারত বাংলাদেশ যে স্বীকৃতি দিতে আরো দেরি করলে আর এভাবে বাংলাদেশের নিরীহ সাধারণ জনগনের উপরে চলমান হত্যাযজ্ঞ যদি আরো দীর্ঘ সময় ধরে চলতেই থাকে, তাহলে পশ্চিম বাংলার পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটবে।

বাংলাদেশকে আশু স্বীকৃতিদানের দাবি জানিয়ে মৈত্র বাবু বলেন যে, সদ্যজাত দেশটি স্বীকৃতি পাওয়ার চারটি শর্ত যথা: জনসংখ্যা, ভৌগলিক সীমারেখা, সরকার এবং সার্বভৌমত্ব পূরণ করেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে যা ঘটছে তা একটি জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব ছাড়া কিছুই নয়। তার মতে সংবাদ মাধ্যম এবং অল ইন্ডিয়া রেডিও এর উচিত ” চীনের ভূমিকা” যথাযথভাবে তুলে ধরা, যা কিনা পশ্চিম পাকিস্তানকে একটি “শক্তিশালী গনমানুষের বিপ্লবকে” পৈশাচিকভাবে দমন করতে সহায়তা করছে।

মৈত্র বাবু আরো বলেন, পশ্চিম বাংলার সরকার পূর্ব বাংলার শরণার্থীর ঢল নামবে বলে আশঙ্কা করছে এবং উদভুত পরিস্থিতি যথাযথভাবে সামাল  দেবার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে।

এক লাখের মত শরণার্থী ইতিমধ্যেই পশ্চিম বাংলায় এসে পৌঁছেছেন এবং তাদের মধ্যে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে ৪০০ গ্রাম চাল করে, এবং শিশু প্রতি ২০০ গ্রাম চাল করে প্রতিদিন দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

তিনি সতর্ক করে বলেন, শরণার্থী সমস্যা সামনের মাসগুলোতে আরো অবনতির দিকে যাবে এবং সেজন্য তিনি কেন্দ্রীয় সরকারকে উদার হস্তে রাজ্য সরকারের সাহায্যে এগিয়ে আসার আহবান জানান।

এছাড়াও মৈত্র বাবু শরণার্থীদের জন্য রাজ্যের অভ্যন্তরে অন্যান্য জায়গায় আশ্রয় দেওয়ার উপরে জোর দেন কেননা, সীমান্ত এলাকাতে দীর্ঘ সময় ধরে  অস্থায়ী আশ্রয় শিবির চালনা করা “বিপদজনক” হতে পারে বলে তিনি মনে করেন। তিনি অস্থায়ী শিবিরগুলোকে বিভিন্ন দানশীল প্রতিষ্ঠান যেমন: রামকৃষ্ণ মিশন দ্বারা চালিত করার পক্ষে মত দেন।

সাম্যবাদী কংগ্রেস পার্টির প্রেসিডেন্ট এবং এমপি অধ্যাপক শিবেন লাল সাক্সেনা ও বাংলাদেশকে “স্বাধীন সার্বভৌম দেশ” হিসেবে আশু স্বীকৃতি প্রদানের দাবি জানান। তিনি আরো একধাপ এগিয়ে বলেন ভারতের  তার সেনাবাহিনীকে কে এই মুহূর্তে  সেখানে গণহত্যা ও ধংসযজ্ঞ বন্ধ করতে “মানবতার মিশনে” প্রেরণ করা উচিত।

পশ্চিম বাংলার পূর্ব সীমান্ত এলাকাগুলোতে তিন দিনের এক সফর শেষে কংগ্রেস পার্টির এমপি শশী ভূষণ বাবু আজ এক বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশকে আশু স্বীকৃতি প্রদানের গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তা নিয়ে তার কোন দ্বিধা নেই। তিনি বলেন, আধুনিক অস্ত্রসস্ত্র এর তীব্র অভাব সত্বেও বাংলার মুক্তি বাহিনী আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা দেড় বিরুদ্ধে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। তিনি অনতিবিলম্বে বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য ভারতের সরকারের কাছে আবেদন করেন।

কোচিন: কেরালা প্রদেশ মুসলিম লীগের কার্যকরী সভায় পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি বাহিনী কতৃক গণহত্যার নিন্দা জানানো হয় এবং বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থানের সাথে একাক্ততা ঘোষণা করা হয়।

শিরোনাম সুত্র তারিখ
৮৩। কোলকাতার বুদ্ধিজীবী সমাবেশে  বাংলাদেশের সমর্থানে পশ্চিম বঙ্গের পাচজন মন্ত্রী দৈনিক ‘যুগান্তর’

২২ এপ্রিল, ১৯৭১

 

 

Aadrita Mahzabeen

<১২, ৮৩, ২২৬>

 

বুদ্ধিজীবী সমাবেশে পাঁচজন জন মন্ত্রীর ভাষণ

(স্টাফ রিপোর্টার)

কোলকাতা, ২১শে এপ্রিল- পঃ বঃ লেখক, শিল্পী, শিক্ষাব্রিতি, সমাজসেবী সংঘের এক বৈকালিক আসরে আজ রাজ্য সরকারের পাছজন মন্ত্রী তাঁদের বক্তব্য রাখেন। সভাপতিত করেন শ্রীমনোজ বসু।

স্বাস্থ্যমন্ত্রি ডাঃ জয়নাল আবেদিন বলেছেন, বাংলাদেশের সংগ্রামে পশ্চিম বাংলা মানুষের পুরো সমরথন আছে। শরণার্থীদের জন্য সীমান্তের বিভিন্ন স্থানে স্বাস্থ্যকেন্দ্র খোলা হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে যত তাড়াতাড়ি হানাদারদের হটানো যায় ততই ভাল। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে গরীবী এবং বেকারী হটাবার যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল তা রক্ষা করা হবেই। বাংলাদেশের এই পরিস্থিতির উদ্ভব হবে বলে ভাবা যায়নি।

বিচার মন্ত্রী শ্রী অজিত পাঁজা বলেন, সমাজের কাঠামো যদি ভাল করে গড়া যেত তাহলে সমাজবিরধী সমস্যায় আমাদের পড়তে হত না। সমাজের যুবকদের জন্য চাকুরীর ব্যবস্থার করতে হবে।

শিক্ষামন্ত্রী অধক্ষ্য শান্তি দাশগুপ্ত বলেন, রাজ্য সরকারের সকল কাজ যাতে বাংলায় হয় তার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ কাজে তিনি বুদ্ধিজীবী সমাজসেবীদের সহযোগীতা আহবান করেছেন। স্বায়ত্তশাসন মন্ত্রী মহঃ রউফ আনসারী বলেন, সিএমডি’র মাধ্যমে কলকাতার ১০০টি ওয়ারদের ১০০টি বস্তীতে আধুনিক জীবনযাত্রায় সুযোগ করে দেওয়া হবে। রাষ্ট্রমন্ত্রী (পরিকল্পনা) শ্রী রথীন তালুকদার বলেন, বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করে সমাজবাদী চীন তার আসল রুপ প্রকাশ করেছে।

আজের বৈকালিক আসরের আলোচনায় শ্রী প্রবোধ সান্যাল, ডাঃ বিজনবিহারী ভট্টাচার্য, ডাঃ আশুতোষ, ভট্টাচার্য, শ্রী দক্ষিনারঞ্জন বসু, শ্রী সন্তোষকুমার ঘোষ, শ্রী রঞ্জিত সেন প্রমুখ ব্যাক্তিরা অংশগ্রহণ করেন। স্বাগত ভাষণ দেন শ্রী বিনয় সরকার।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৮৪। বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যে সকল রাজ্যকে আসার জন্য পশ্চিম বঙ্গ সরকারের  আহবান দি স্টেটসম্যান ২২শে এপ্রিল, ১৯৭১

Prodip Mitra

<১২, ৮৪, ২২৭২২৮>

 

বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যে সকল রাজ্যকে আসার জন্য পশ্চিম বঙ্গ সরকারের  আহবান

রিলিফের সকল খরচ বহন করার প্রতিশ্রুতি দিল কেন্দ্রীয় সরকার

                                                                                                                                      (বিশেষ প্রতিনিধি)

 

বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু আগমনের হার আশঙ্কাজনক হরে বৃদ্ধি পাবার পর   পশ্চিম বঙ্গ সরকার জরুরীভিত্তিতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে গত বুধবার এই বার্তা পাঠান যে তাদের প্রাদেশিক সরকার একা সব  শরণার্থীদের খাদ্য, আশ্রয়, এবং চিকিৎসার ভার নিতে পারছে না এবং যেহেতু অন্য রাজ্যগুলোও বাংলাদেশের সমর্থক, তাই তাদের এই দায়িত্তের ভার নেয়া উচিত।

দিল্লিতে আমাদের বিশেয প্রতিনিধিসূত্রে জানা যায়, শ্রম ও পুনর্বাসন মন্ত্রী  জনাব আর. কে. খাদিলকার বলেন যে পূর্ববাংলা থেকে আগত সব উদ্বাস্তুর জন্য  ত্রাণ সামগ্রী কেন্দ্রীয় সরকার সরবরাহ করবে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের চিন্তা আসলে যে গত মাত্র ১০ দিনে  ২৭৩, ০০০ জন উদ্বাস্তু পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেছে, এ ধারায় চলতে  থাকলে শীঘ্রই মোট উদ্বাস্তুর সংখ্যা ১০ লাখে পৌঁছাবে। তখন পরিস্থিতি  মোকাবিলা করার সামর্থ্য  রাজ্য বা  কেন্দ্রীয় সরকারের কারোরই থাকবে না। অন্যান্য বছরগুলোতে যখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল, যেমন গত ১৯৭০ সালে আসা  মোট ২২৬, ০০০ জন উদ্বাস্তু কে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের ব্যবস্থায় ভারতে প্রবেশের মাত্র ২ সপ্তাহের মধ্যে সারা ভারতে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানো হয়। তখন শুধু আশ্রয়স্থলের ব্যবস্থা করাই  ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের মূল  দায়িত্ব। কিন্তু এখন  রাজ্য সরকারের জন্য সমস্যাটি আরো জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন বেশিরভাগ উদ্বাস্তুর জন্য  শুধু আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দেয়াই  যথেষ্ট নয়, বাংলাদেশে ফেরত যাবার মতো পরিস্থিতি না হওয়া পর্যন্ত তাদের জন্য স্থানাহার ও চিকিৎসার বন্দোবস্ত করতে হচ্ছে। তাই পশ্চিমবঙ্গ সরকার মনে করছে যে বাংলাদেশী উদ্বাস্তু সমস্যা শুধু তাদের একার নয়, বরং তা জাতীয়ভাবে মোকাবেলা করা উচিত  আর অন্য সব রাজ্য যারা বাংলাদেশকে সমর্থন দিচ্ছে, তাদের উদ্বাস্তুদের ভার নেবার জন্য কেন্দ্র হতে আহ্বান জানানো উচিত।

প্রশংসিত ইঙ্গিত

রাজ্য সরকার অবস্ব শরণার্থীদের  রক্ষার জন্য পূর্ন আর্থিক সাহায্যের জন্য  কেন্দ্রীয় সরকারের ওয়াদার প্রশংসা করেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ  এতে সমস্যার শুধু ক্ষুদ্র একটি  সমাধান  হবে।

অপরপক্ষে মন্ত্রিসভা হতে  অর্থমন্ত্রি তরুন কুমার ঘোষ, পিডাব্লিউ মন্ত্রি সন্তোস রায় এবং পুনর্বাসন মন্ত্রি আনন্দমোহন বিশ্বাসের সমন্বয়ে সাবকমিটির ঘোষণা দেয়া হয়। তারা উদবাস্তুদের ত্রানের সমন্বয়সাধন করবেন। তাছাড়া মন্ত্রিদের কয়েকজন সীমান্তে কিছু জেলায় ঘুরে ঘুরে পরিস্থিতি যাচাই করবেন। নয়াদিল্লিতে আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি আরো যোগ করেন যে, খাদিল্কার বিশেবভাবে উল্লেখ করেননি যে  আসলে মোট কত টাকা সাহাজ্য দেয়া হবে, কিন্তু মানবিক দিকগুলো বিশেষভাবে বিবেচনা করে কেন্দ্রিয় সরকার এই ভার বহন করতে প্রস্তুদ এবং তারা পুর্বপাকিস্তান হতে বাধ্যহয়ে চলে আসা মানুষদের সাহাজ্যে  যত টাকা প্রয়োজন তা প্রদানে ইচ্ছুক। খাদিল্কার আরো যোগ করেন যে, আজঅবধি প্রায় ২৭৩, ২৯৯ জন মানুষ সীমান্ত পেড়িয়ে চলে এসেছন, এবং এপ্রিলের মাঝামাঝি  অবধি আসা পুরুষরা পুরবপাকিস্তান ফিরে গিয়ে যুদ্ধ করতে চাছেন। শুধু নারি, শিশু, এবং বৃদ্ধরাই আশয়কেন্দ্রে থেকে যাচ্ছেন।

হটাত উত্থান

 

১৫ই এপ্রিলের পর থেকে উদবাস্তু আসার গতি হটাত করে বেড়ে যায়, ধারনা করা হচ্ছে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনির চরম নিঃশংস্রতার কারনে তা হচ্ছে। আর যারা সীমান্ত পেড়িয়ে আসছেন, তাদের অনেকেই সরকারের সাহাজ্য নিচ্ছেন না, যা বোঝা যায়  এই দেখে যে তাদের মধ্যে মাত্র ৮৯, ৬০০ জন ক্যাম্পে আছেন আর বাকি ১৬৯, ১০০ জন আত্মিয় ও বন্ধুবান্ধবের সাথে আছেন।

খাদিল্কার আরো পরিষ্কার ভাবে  ব্যাখ্যা করে তুলে ধরেন, যে বিভিন্য প্রদেশের ক্যাম্পে, যেমন  পশ্চিমবঙ্গে ৬১, ৮০০ জন, আসাম ও মেঘালয়ে ১০, ৭০০ জন, ত্রিপুরায় ১৭, ১০০ জন আছেন। বাকি ১৬৯, ১০০ জন যারা ক্যাম্পের বাইরে আছেন তাদের অধিকাংশ পশ্চিমবঙ্গে। সেখানে ১৫১, ৪০০ জন, আসামে ৭, ৭০০ জন, ও ত্রিপুরায় ১০, ০০০ জন বিভিন্য আত্মিয়স্বজনের বাসায়। উদবাস্তুর সংখ্যা সরকারের জন্যে আসলে কম কি না, একজন তা জানতে চাইলে খাদিল্কার তা অস্বীকার করেন। ত্রান বিতরন ত্বরান্বিত করতে কলকাতায় একজন অতিরিক্ত সচিবের অধিনে মন্ত্রালয়ের বিশেষ শাখা স্থাপন করা হয়েছে। উক্ত শাখার অধিনে আসাম ও ত্রিপুরায় লিয়াজো অফিসার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অন্য আরেক প্রশ্নের জবাবে খাদিল্কার বলেন যে সরকার ত্রানকার্যে অবাঞ্ছিত সংঘটনের অযাচিত প্রভাব ব্যহত করতে সতর্ক থাকবে। সব সেচ্ছাসেবি সংগঠনদের তাদের ত্রান কার্য জাতিয় পর্যায়ে স্থাপিত বাংলাদেশ সহায়তা কমিটির অধিনে পরিচালনের জন্যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

শরনার্থীর ছদ্দবেশে গুপ্তচর প্রবেশ থেকাতে সরকার কি করছে এই প্রশ্নের জবাবে খাদিল্কার বলেন যে তারা যারা আসছেন তাদের যাচাই করার সর্বত চেষ্টা করছেন। খাদিল্কার বলেন যে রাজ্য সরকার এইপরযন্ত ৫৫টি অভ্যর্থনা ও ত্রানকেন্দ্র স্থাপন করেছে। অভ্যর্থনাম কেন্দ্রের সংখ্যা যথাযথ, তবে দরকার হলে এর সংখ্যা আরো বাড়ানো হবে। মৌসুমি ঋতু চলাকালিন সময়ে শরনার্থিদের সহায়তার জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

শিরোনাম সুত্র তারিখ
৮৫। শরণার্থী আশ্রয়ের প্রশ্নে পশ্চিম বংগ বিধান সভায় রাজ্যপালের ভাষণ দৈনিক ‘আনন্দবাজার’ ৬ মে, ১৯৭১

Aparajita Neel

<১২, ৮৫, ২২৯>

 

শরণার্থীদের এখানে আশ্রয় দেওয়াই সরকারের নীতি ধাওয়ান

(স্টাফ রিপোর্টার)

বাংলাদেশের থেকে আগত আশ্রয়প্রার্থীদের মধ্যে যারা ভারতের মাটিতে আশ্রয় চাইবেন,তাদের সকলকে আশ্রয় দেওয়া পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি হবে। বুধবার রাজ্য বিধানসভার অধিবেশনে রাজ্যপাল শ্রী শান্তিস্বরূপ ধাণায়ন তার ভাষনী কথা ঘোষণা করেন।

শ্রী ধাণায়ন মনে করেন, ওই বাংলার পরিকল্পিত গণহত্যার ফলেই অগণিত মানুষ দেশ্ত্যাগকরে এপারে চলে আসছেন।

আসলে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেবার দাবি জানিয়ে এবং বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদ করে বুধবার বিধানসভায় একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব আসবে। বুধবার বিধানসভা ভবনের সরকার এবং বিরোধী পক্ষের নেতাদের মধ্যে বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়।

রাজ্যপাল তার ভাষণে আরও বলেন, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শেষ কয়দিন হতে বাংলাদেশে থেকে অভুতপূর্ব উদবাস্তু আগমন হচ্ছে। এর ফলে খাদ্য সরবরাহ ও নিরাপত্তার সমস্যা দুটি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। অনুমিত হয় যে ১০ লক্ষেরও অধিক নরনারী সীমান্ত পার হয়ে এসেছেন এবং উদবাস্তু আগমনের স্রোত অব্যাহত আছে। পূনর্বাসনমন্ত্রকে কোলকাতায় তাদের শাখা অফিসে একজন অবয় সচিবকে কর্মী নিযুক্ত করেছেন এবং সামরিক আশ্রয়শিবির গঠন ও পরিচালনা ও জন্স্বাস্থের সুযোগ-সুবিধা বিধানের ব্যয় নির্বাহের প্রস্তাব, করেছেন। অব্যাহত আশ্রয়প্রার্থী আগমনের ফলে আজ আমাদের রাজ্যের প্রশাসন ব্যবস্থায় বাধা সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিলেও আশ্রয় সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি হবে যারা ভারতের মাটিতে আশ্রয় লইবেন তাদের সকলকে আশ্রয় দেওয়া।

শ্রীধাওয়ান বলেন, সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশের ঘটনাবলী আমাদের উপর গভীর প্রসার বিস্তার করেছে এবং নির্মম সামরিক অভিযানের দরুণ এবং উপমহাদেশের ওই অঞ্চলের পরিকল্পিত গনহত্যা বলে যা মনে হয় তার কারণ অগণিত মানুষের দেশত্যাগের ফলে আমাদের উপর এসে পড়েছে নতুন উদ্বাস্তু সমস্যা।

বাংলাদেশ সংক্রান্ত প্রস্তাব

বুধবার বিধানসভা অধিবেশন শেষে বিরোধী দলনেতা শ্রী জ্যোতি বসু এলেন মুখ্যমন্ত্রী শ্রী অজয় মুখার্জীর কামরায়। সঙ্গে সিপিএম নেতা শ্রী হরেকৃষ্ণ কোঙার। মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে উপ-মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বিজয়সিংহ নাহার, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডাঃ জয়নাল আবেদীন উপস্থিত। একে একে সিপিআই নেতা শ্রী বিশ্বনাথ মুখার্জী সংযুক্ত বামপন্থী ফ্রন্টের আহ্বায়ক শ্রী সুধীন কুমার, এস ইউ সি নেতা শ্রী সুবোধ ব্যানার্জীও এলেন।

দীর্ঘ আলোচনার পর বাংলাদেশ সম্পর্কে তারা একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব রচনা করলেন। বৈঠকশেষে বেরোবার মুখে সুবোধ বাবু বললেন আমরা একমত হয়েছি। একটি শব্দ নিয়ে এখনো একটু মতভেদ আছে। তবে ঠিক হয়ে যাবে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৮৬। বাংলাদেশকে অস্ত্রসহ সকল প্রকার সাহায্যদানের দাবির প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং বিরোধী নেতাদের ঐক্যমত্য দি স্টেটসম্যান ৭ মে ১৯৭১

Masroor Ahmed Makib

<১২, ৮৬, ২৩০>

প্রাদেশিক পরিষদ দাবি করবেঃ বাংলাদেশকে অস্ত্র সরবরাহ সহ সর্বাত্তক সহযোগীতা

আমাদের বিশেষ প্রতিবেদকের প্রতিবেদনঃ

বৃহস্পতিবার পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায়  সরকারী ও বিরোধীদল বাংলাদেশ বিষয়ে এক রেজুল্যুশনে সর্বসম্মতিক্রমে রাজি হয়েছে। এটি হবে একটি সরকারী রেজুল্যুশন এবং এটি শুক্রবারে  উত্থাপন করবেন মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জি ও সমর্থন করবেন বিরোধীদলীয় নেতা জনাব জ্যোতি বসু।

বাংলাদেশের ৭৫ মিলিয়ন মানুষের উপর পাকিস্তান সামরিক বাহিনী  দ্বারা সংঘটিত  নারকীয় গণহত্যার প্রতি নিন্দা  জানানো হবে  রেজুল্যুশনে। দাবি  করা হবে কেন্দ্রীয় সরকার অবিলম্বে বাংলাদেশের সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রকে স্বীকৃতি দেবে  এবং অস্ত্র সরবরাহের সহ সব প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবে।

রেজুলুশ্যনের খসড়ায় বলা হয়েছে এর সিদ্ধান্তের বিপরীতে বৃহত্তর  ব্যবস্থা  গ্রহণে বিলম্ব হলে  বাংলাদেশের মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে। পরিষদ বলেছে, তারা পশ্চিমবঙ্গের জনগনের কাছে দাবি করবে কেন্দ্রিয় সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টি করার জন্য যাতে কেন্দ্রিয় সরকার এসব দাবি মেনে নেয়। এছাড়া পরিষদ  বাংলাদেশে অবরুদ্ধ জনগনের মুক্তি, আবাসন ও ত্রাণ প্রদান সহ সকল প্রয়োজনীয়  ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য আহ্বান জানাবে।

বৃহস্পতিবারে এসইউসি নেতা জনাব সুবোধ ব্যানার্জি বিভিন্ন দলের মধ্যে একটি চুক্তি করতে উদ্যোগ গ্রহন করেন যা রেজুল্যুশনের অস্ত্র সরবরাহ সহ অন্যান্য দাবিগুলোকে সুরক্ষা দেবে। তিনি মুখ্যমন্ত্রী, উপমুখ্যমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা ও সিপিআই নেতা জনাব সোমনাথ মুখারজীর সাথে আলাদা আলাদাভাবে দেখা করেন এবং এই সব নেতাদের মধ্যে একটি সভার আয়োজন করেন। উক্ত সভায় রেজুল্যুশনের উপর সবাই ঐক্যমতে পৌছে।

এতে বোঝা যায় যে সিপিআই গণতান্ত্রীক জোটের দলগুলোর উপর রেজুল্যুশনে থাকা ‘অস্ত্র সরবরাহ’ চুক্তির প্রতি সম্মত  হতে চাপ প্রয়োগ করে। বাংলাদেশ ও তার সরকারের প্রতি মুসলিম লীগ ও কোয়ালীশানের অন্যান্যদলগুলো তাদের মনোভাব এখনো প্রকাশ করেনি।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৮৭। পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভায় সর্বসম্মত প্রস্তাবঃ বাংলাদেশকে স্বীকৃত দিন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার কার্যবিবরণী ৮ মে ১৯৭১

<১২, ৮৭, ২৩১২৮২>

Shahriar Faruk – পেজঃ ২৩১-২৪১

তাজমুল আখতারপেজঃ ২৪২-২৫১

মোঃ কাওছার আহমদপেজঃ ২৫২- ২৫৮

তানভীর আহমেদ নোভেলপেজঃ ২৫৯- ২৬১

Rashed Islam পেজঃ ২৬২-১৭১

Minhaz Uddin পেজঃ ২৭২-২৮২

জনাব স্পিকারঃ আমি এখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাবটি পেশ করছি এবং এর পর আমি সবাইকে অনুরোধ করব নিজ নিজ আসন থেকে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের নিহত শহীদদের স্মরণে ২ মিনিট নীরবতা পালন করতে।

শ্রী অজয়কুমার মুখার্জী: স্পীকার মহাশয়, আপনার অনুমতি নিয়ে আমি এই প্রস্তাবটা আনছি।

বিগত ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত আওয়ামীলীগ এর অসামান্য ও ঐতিহাসিক সাফল্যর মধ্যে প্রকাশিত জনগণের সুস্পষ্ট রায়কে পদদলিত করিয়া বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনগনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সামরিক শাসকচক্র যে নারকীয় গণহত্যাভিযান চালাইতেছে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা তাকে তীব্র ধিক্কার জানাইতেছে এবং বাংলাদেশের জনগণ পূর্ণ জাতীয় স্বাধীনতার জন্য যে মরণপণ সশস্ত্র সংগ্রাম চালাইতেছেন তার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ও সেই সঙ্গে সংগ্রামী জনগণকে অভিনন্দন জানাইতেছে।

পাকিস্তানের সামরিক শাসকচক্র যাহাতে অবিলম্বে এই বর্বর গণহত্যা বন্ধ করিতে এবং বাংলাদেশ হইতে তাহার সমস্ত সামরিক বাহিনী তুলিয়া লইতে বাধ্য হয় তাহার জন্য উপযুক্ত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এই বিধানসভা ভারত সরকারসহ অন্যান্য দেশের সরকারের নিকট আবেদন করিতেছে।

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা এই বিশ্বাস রাখে যে, তাহাদের সংগ্রাম যতই কঠোর ও প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হউক না কেন বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণ শেষ পর্যন্ত জয় লাভ করিবেনই। এই সভা আর ও আশা রাখে যে, যেহেতু এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম সর্বপ্রকার আধুনিক মরাণাস্ত্রে সুসজ্জিত পাকিস্তানের সামরিক শাসকচক্র কর্তৃক বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণের উপর চাপাইয়া দেওয়া হইয়াছে এবং ইহা জাতীয় স্বাধীনতার জন্য অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত সংগ্রাম, সেই হেতু ইহা শুধু ভারতীয় জনগণের নিকট হইতে নহে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের এমনকি পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজ্যের জনগণের নিকট হইতেও ক্রমবর্ধমান সক্রিয় সমর্থন লাভ করিবে।

বাংলাদেশের জনগণের জাতীয় স্বাধীনতার জন্য মরণপণ সংগ্রামের প্রতি ভারতের আশু ও জরুরি কর্তব্যের কথা বিবেচনা করিয়া এই বিধানসভা ভারত সরকারের নিকট দাবি জানাইতেছে যে, অনতিবিলম্বে বাংলাদেশ সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ও তাহার সরকারকে স্বীকৃতি এবং অস্ত্রশস্ত্রসহ সর্বপ্রকার প্রয়োজনীয় কার্যকরী সাহায্য দিতে হইবে। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ নরনারী যখন বুকের রক্ত দিতেছেন তখন পশ্চিমবঙ্গের জনগণ ইহার কমে কিছুতেই রাজী হইতে পারেন না।

এই ব্যবস্থাগুলি গ্রহণ করিতে যতই দেরি হইতেছে ততই বাংলাদেশের জনগণের দু:খ, দুর্গতি ও লাঞ্ছনা বৃদ্ধি পাইতেছে। ইহাতে পশ্চিম বঙ্গের বিধানসভা ও জনগণ গভীর উদ্বেগ বোধ করিতেছে। এই অবস্থায় যাহাতে অবিলম্বে উক্ত দাবিগুলি স্বীকৃতি হয় তাহার জন্য ভারত সরকারের উপর প্রয়োজনীয় চাপ সৃষ্টি করার জন্য বিধানসভা, পশ্চিমবঙ্গের জনগণ সরকারের নিকট আহবান জানাইতেছে।

ব্যাপক নরহত্যার মুখে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ সীমান্ত পার হইয়া পশ্চিম বাংলায় চলিয়া আসিতে বাধ্য হইতেছেন। সৌভ্রাতৃত্বের ও মানবতার অপরিহার্য অঙ্গ হিসাবে তাহাদের জন্য সর্বরকম প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা একান্ত দরকার। ইহা পশ্চিমবঙ্গের ও উহার পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলির আর্থিক ক্ষমতার বাহিরে। এই কঠিন সত্য বিবেচনা করিয়া পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভারত সরকারের নিকট এই বিষয়ে যাবতীয় ব্যয়ভার বহনের দাবি জানাইতেছে।

মিঃ স্পীকারঃ পূর্ব বাংলার মুক্তি সংগ্রামের জন্য যাঁরা জীবন দিয়েছেন, তাঁদের সম্মানার্থে সবাইকে দাঁড়িয়ে দু’ মিনিট নীরবতা পালন করবার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।

[সদস্যরা উঠে দাঁড়ালেন ও ২ মিনিট নীরবতা পালন করলেন]

শ্রী অজয়কুমার মুখোপাধ্যায়ঃ আমার প্রস্তাবে অতি বিস্তৃতভাবে সবই বলা হয়েছে, আর বলার বেশী কিছু নাই। আপনারা সবাই জানেন যে, পাকিস্তানের দুটি অংশ – পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান – পরস্পর বিচ্ছিন্ন বহু দূরে অবস্থিত। পূর্ব পাকিস্তানের আধিবাসীদের বরাবরই এই অভিযোগ ছিল যে পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসীরা সংখ্যালঘু হয়েও পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে সংখ্যায় তারা কম হয়েও পূর্ব পাকিস্তানের উপর প্রভুত্ব করছে, শোষণ করছে। এই অভিযোগ তাদের ছিল। এমনকি, মাতৃভাষা পর্যন্ত বিলোপ করার চেষ্টা করেছে। সেজন্য পূর্ব – পাকিস্তানের বাংলাভাষা নিয়ে সংগ্রাম হয়, অনেক জীবন পর্যন্ত দিতে হয়েছে। এবং আনন্দ ও গৌরবের বিষয়, বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি পূর্ব- পাকিস্তানে খুব ভাল হয়েছে।

শ্রী সুবোধ ব্যানার্জিঃ মূখ্যমন্ত্রী মহাশয় পূর্ব পাকিস্তান না বলে বাংলাদেশ বলুন।

শ্রী অজয়কুমার মুখোপাধ্যায়ঃ আমি তাতে আসছি, ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? তারপর ওদের অনেক আন্দোলনের পর সেখানে স্বৈর শাসন পরিসমাপ্তি করার জন্য ঘোষণা করা হয় যে, গণতন্ত্র অনুযায়ী গণভোটে সেখানে সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। যথানিয়মে সেখানে স্বৈরতন্ত্রের নেতৃত্বে গণভোট গৃহীত হল এবং তাতে বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ শুধু পূর্ব-বঙ্গে নয় সমস্ত পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেন, কেন্দ্রীয় সরকারে, কেন্দ্রীয় বিধানসভায়, আইনসভায়। সাধারণ গণতন্ত্রের নিয়ম অনুসারে সমস্ত পাকিস্তানে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বসতে দেওয়া উচিৎ ছিল। এবং আইনসভায় কাজ করার এবং মন্ত্রীমন্ডলী গঠন করার সুযোগ দেওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু তা না দিয়ে সেখানে স্বৈরশাসক সেটা জোর করে ভেঙ্গে দিলেন, ভেঙ্গে দিয়ে তিনি চরম অত্যাচার শুরু করলেন।

জনগনের যে সুস্পষ্ট রায় অর্থাৎ তাঁরা যে রকম ভোট পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিলেন এ রকম ভোট পৃথিবীতে কে কোথায় পেয়েছে আমার জানা নেই। কিন্তু তাকে অগ্রাহ্য করে যখন জবরদস্তি স্বৈরশাসন চালান হল তখন অগত্যা পূর্ববাংলা স্বাধীনতা ঘোষণা করল। তাঁরা প্রথমে পূর্ণ স্বাধীনতা চাননি তাঁরা চেয়েছিলেন পূর্ববাংলায় পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন এবং সেটা পাকিস্তানের মধ্যে থেকেই। কিন্তু এই অত্যাচারের ফলে তাঁরা পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন এবং তারপর বললেন এটা বাংলাদেশ সরকার। তারপরই ভীষণ অত্যাচার শুরু হল- অর্থাৎ গণহত্যা, নারী নির্যাতন, গৃহদাহ প্রভৃতি অমানুষিক অত্যাচার দিনের পর দিন ধরে চলছে। এই অবস্থায় প্রতিবেশী রাজ্য হিসেবে আমরা চুপ থাকতে পারিনা বিশেষ করে আমাদের সঙ্গে যখন তাঁদের নাড়ীর সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের প্রস্তাবে যেকথা বলা হয়েছে আমি তার আর পুনরুল্লেখ করতে চাই না। আমরা ভারত সরকারকে বলছি যত শীঘ্র সম্ভব এই যে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাকে স্বীকৃতি দিন এবং তাঁদের সর্বপ্রকার সাহায্য দিন। এই সর্বপ্রকার সাহায্যের মধ্য দিয়ে আমরা অস্ত্রশস্ত্রের কথাও বলেছি। আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার এটা বিবেচনা করে দেখবেন অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা মানে যুদ্ধ ঘোষণা করা হবে কিনা। কিন্তু আমাদের দাবি অর্থাৎ বিধানসভার দাবি অবিলম্বে তাঁদের সর্বপ্রকার সাহায্য করা হোক। আমরা তাঁদের বীরত্বের জন্য প্রশংসা করেছি। আশ্চর্যের বিষয় একক নেতৃত্বের অধীনে থেকে এ রকমভাবে জনগণের সংগ্রাম করা এটা পৃথিবীতে দুর্লভ। এইজন্যই আমরা তাঁদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছি এবং তাঁদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি। আমরা দেখেছি হিন্দু- মুসলমান মিলে ১২-১৩ লক্ষ লোক এখানে এসছে যাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে, আত্মীয়স্বজনকে হত্যা করা হয়েছে, সেখানে তাদের বসবাস অসম্ভব করে তোলা হয়েছে এবং নিষ্ঠুরভাবে মানুষকে খুন করা হচ্ছে। আপনারা জানেন আমাদের পশ্চিম বাংলা অত্যান্ত জনবহুল। ভারতবর্ষের মধ্যে যে দুটি প্রদেশ বর্তমানে জনবহুল তার মধ্যে একটি হচ্ছে কেরালা এবং আর একটি হচ্ছে আমাদের এই পশ্চিমবাংলা। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের এই পশ্চিমবাংলায় আমরা তাঁদের সাদরে আশ্রয় দিচ্ছি এবং তাঁদের বাস করার, থাকা খাওয়ার খরচ যতদূর সম্ভব কেন্দ্রীয় সরকার দিচ্ছেন। আমরা যে খুব ভালভাবে পারছি তা নয়। হঠাৎ দিনের পর দিন যদি হাজার হাজার লোক আসতে থাকে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তাদের আশ্রয় এবং খাওয়া- দাওয়ার ব্যবস্থা করা এটা সম্ভব নয়। কাজেই তাদের হয়ত কষ্ট হচ্ছে। কতদিন এই যুদ্ধ চলবে এবং কত লোক আসবে তার কোন ঠিক নেই। আমরা কেন্দ্রীয় সরকারকে বলেছি পশ্চিম বাংলায় যত লোক আসবে তাদের দেবার মত স্থান আমাদের নেই অর্থাৎ এমন ভূমি নেই যেখানে তাদের জন্য শিবির তৈরি করতে পারি। কাজেই আমরা তাদের অনুরোধ করেছি আমাদের এখানে ৫ লক্ষ লোকের স্থান রেখে অর্থাৎ ট্রানজিট ক্যাম্পের মত করে তারা যদি অন্যান্যদের অন্য প্রদেশে নিয়ে যান তাহলে ভালো হয়। এটা পশ্চিম বাংলার কথা নয়, এটা সারা ভারতবর্ষের কথা এবং সারা পৃথিবী থেকে তাদের জন্য সাহায্য এবং সহানুভূতি আসছে।

শ্রী জ্যোতি বসুঃ মাননীয় অধ্যক্ষ মহাশয়, বাংলাদেশ সম্পর্কে মূখ্যমন্ত্রী যে প্রস্তাব এনেছেন আমি তাকে সমর্থন জানাচ্ছি। সমর্থন জানাতে গিয়ে আমি বলব যে, আমরা সকলে মিলে চেষ্টা করেছি যাতে করে সরকার পক্ষ এবং বিরোধী পক্ষ এক হয়ে এই প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারি। কারণ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বাংলাদেশের মানুষ নিশ্চয় এটা জানেন যে, আমাদের এখানকার কি মতপার্থক্য আছে। এবং সেটা ভয়ংকর মতপার্থক্য। আমরা যারা বিরোধী দল এখানে আছি কংগ্রেস দলের সঙ্গে এবং তাঁদের যারা সমর্থন করছেন তাঁদের সঙ্গে কোন বিষয়ে আমরা একমত নই। তথাপি এই বিষয়ে যা নিয়ে প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে তা আমরা সকলেই সমর্থন করি। এর পাশে এসে দাঁড়াবার জন্য আহবান জানাচ্ছি। এটাকে আমি মনে করি যে এমন একটা বিষয় শুধু পৃথবীর পক্ষে নয়, আমাদের গণতন্ত্রের পক্ষে, আমাদের আগিয়ে যাবার পক্ষে ঐ যে একসঙ্গে হয়ে এইরকম একটা আন্দোলন, সংগ্রাম, লড়াই হচ্ছে স্বাধীনতার জন্য তাকে যদি জেতাতে না পারি তাহলে আমাদের সমূহ বিপদ, নিজেদের দেশের গণতন্ত্রের হবে- এই জন্যই আমরা চেষ্টা করছি। তাতে যদি আমাদের ত্যাগ স্বীকার করতে হয় তা আমাদের করতে হবে এবং ঐ বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষ তারা নিশ্চয় তাদের বিচার করবেন শুধু এই প্রস্তাব পড়ে নয়, দেখে নয়, ভবিষ্যৎ এই প্রস্তাব কার্যকরী করার জন্য আমরা কি ব্যবস্থা অবলম্বন করেছি। তাই দেখে তাঁরা বুঝবেন যে, আমাদের কি আন্তরিকতা আছে এর পিছনে। এই প্রস্তাব যাতে কাগজের প্রস্তাব না হয়ে থাকে সেই প্রচেষ্টা আমাদের করতে হবে দৃঢ়তার সঙ্গে আমি একথা ঘোষণা করছি যে, এটা শুধু কাগজের প্রস্তাব হবে না এই প্রতিশ্রুতিতেই আমরা একসঙ্গে এই প্রস্তাব গ্রহণ করছি। এই প্রস্তাবকে কার্যকরী করার জন্য আমরা সচেষ্ট হব যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। আমি এটা মনে করিয়ে দিতে চাই যে, অনেক দিন হয়ে গেল প্রায় এক- দেড় মাস হল এই সংগ্রাম বাংলাদেশে হচ্ছে। এইরকম বহু আবেদন নিবেদন ঐ গণতান্ত্রিক মানুষ সমস্ত সরকারের কাছে করেছে যাতে আমরা তাদের সমর্থন জানাই যাতে তাঁদের বিপদের সময় পাশে এসে দাঁড়াই। যাঁরা এই প্রস্তাব সমর্থন করছেন তারা নিশ্চয় এই কথা মনে করেন যে, বাংলাদেশের মানুষ একটা ন্যায়ের লড়াই করছেন, অন্যায় কিছু করছেন না- তাদের দেশকে বাঁচাবার জন্য, বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচাবার জন্য তাঁদের স্বাধীনতা, তাঁদের অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য তারা লড়াই করছেন। এটা সবাই জানেন যে, কিছু কিছু প্রচার হচ্ছে যেটা অন্যায় প্রচার যে, ওখানকার মানুষ যারা আওয়ামীলীগ বা অন্যান্য বাংলাদেশের মানুষ তারা হয়ত পাকিস্তানকে এক অংশ থেকে আর এক অংশে বিচ্ছিন্ন করবার জন্য লড়াই করছে পাকিস্তানকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। আমি লক্ষ্য করেছি অনেক মুসলিম ভাই আছেন যাঁদের মধ্যে এই প্রচার চলেছে যে, পাকিস্তানকে ধ্বংস করার জন্য পাকিস্তানকে টুকরোটুকরো করার জন্য এই লড়াই শুরু হয়েছে। এটা একেবারেই ঠিক নয়, তা আমরা এই প্রস্তাবে রাখবার চেষ্টা করেছি। এটা আমরা জানি পৃথিবীকেও জানতে হবে যে, এই পাকিস্তান টুকরোটুকরো হচ্ছে সাময়িকভাবে তার জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী হচ্ছে ওখানকার মিলিটারি শাসকগোষ্ঠী ঐ ইয়াহিয়া গোষ্ঠী। বহুদিন ধরে তারা এইরকম করছে। তারা মিলিটারি শাসন চালাচ্ছে। তারা গণতন্ত্রকে মেনে নিতে চায় না এবং এই জন্যই পাকিস্তান টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।

কারণ একটা অংশ এবং তারাই হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ। সেই অংশের মানুষের সামান্যতম অধিকার, বেঁচে থাকার অধিকার, তাদের ভাষার অধিকার, তাদের অন্যান্য যেসব বিষয়ে অধিকার আছে সেগুলি যদি না মানেন ২৩৪ কোন সরকার – স্বৈরাচারী সরকার, সেই শাসকগোষ্ঠী, যারা সেখানে মুষ্টিমেয়র প্রতিনিধিত্ব করছেন তাহলে এটা কি আশা করা যায় যে, এক হয়ে সে দেশ এইভাবে থাকতে পারে। সেজন্য আমরা মনে করি যে, পৃথিবীর সমস্ত গণতান্ত্রিক মানুষ যতই তাঁরা এই ঘটনা বুঝবেন ততই বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রামকে তাঁরা সমর্থন করবেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ সহ। পশ্চিম পাকিস্তানেও আজ বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষ আছে, বিভিন্ন ইউনিট সেখানে আছে এবং তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মানুষও আছেন। আজ হয়ত তাদের দু’চারজন এর ক্ষীণ কণ্ঠস্বর বা তাদের কথা আমরা শুনেছি। তাঁদের বক্তব্য আমরা সংবাদপত্রে দেখেছি, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি পশ্চিম পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক মানুষ যাঁরা আছেন তারা বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে একতাবদ্ধ হয়ে, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের সঙ্গে একতাবদ্ধ হয়ে আগের দিনে যেমন বহু লড়াই করবার চেষ্টা করেছেন তাঁরা তা করবার চেষ্টা করবেন। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণ, তাঁরা সবাই ভুট্টো নন, ইয়াহিয়া নন বা সবাই মিলিটারি গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত নন, তাঁরা সাধারণ মানুষ – মজুর, কৃষক, মধ্যবিত্ত, মেহনতি মানুষ তারা নিশ্চয়ই বাংলাদেশের মানুষের এই স্বাধীনতার লড়াইকে সমর্থন করবেন, পৃথিবীর গণতান্ত্রিক মানুষের সঙ্গে এক হয়ে। এ থেকে আমাদেরও কিছু শিক্ষার আছে। অনেক সময় আমরা দেখেছি, পৃথিবীতে এটা হয়েছে, এটা নতুন নয়, দু:খজনক হলেও এ ঘটনা ঘটেছে যে, পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি সংসদীয় গণতন্ত্রে ভোট বা জনমত পদদলিত হয়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের মানুষ রায় দিয়ে যা চাইলেন তাঁরা তা পাননি। কারণ শাসকগোষ্ঠী, ঐ শাসকগোষ্ঠী, যারা জমিদারদের প্রতিনিধিত্ব করে, পুঁজিপতিদের প্রতিনিধিত্ব করে যা মুষ্ঠিমেয় লোকের প্রতিনিধিত্ব করে তারা তা করতে দেয়নি। ইতিহাসে আমরা দেখেছি জনমতকে তারা পদদলিত করেছে। এখানেই সেই একই ঘটনার পুনারাবৃতি আমরা দেখতে পেলাম, বিশেষ করে পাকিস্তানে যা যা ঘটছে তার মধ্যে দিয়ে। সেখানে জনমত সুস্পষ্ট। এটা মুখ্যমন্ত্রী মহাশয় ঠিকই বলেছেন যে, এ রকম রায়, এত সংখ্যায়, এ সংসদীয় গণতন্ত্রে খুব কমই দেখা যায় তারা যে সুস্পষ্ট রায় দিয়েছেন তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই, তথাপি আমরা দেখেছি যে, সমস্ত কিছু পদদলিত হয়ে গেল। শুধু পদদলিত হল না সেখানে মিলিটারির অতর্কিত আক্রমণ হলো, আকাশপথ, স্থলপথে, সমুদ্রপথে বিভিন্ন দিক থেকে সে আক্রমণ সেখানে শুরু হল তখন আর কোন উপায় ছিল না, বাংলাদেশের মানুষ, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের আর কোন পথ ছিলনা, সেই জন্যই সেখানে তাঁদের স্বাধীনতার লড়াই, অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই সব এক হয়ে মিশে গিয়েছে। এ ছাড়া অন্য কোন পথ তাঁরা নিতে পারতেন না, অন্য কোন দিকে ও যেতে পারতেন না। এইভাবে কোণঠাসা হয়ে। তাছাড়া তাঁরা প্রস্তুতও ছিলেন না এটা সুস্পষ্ট, তাঁদের নেতৃবৃন্দরা ও মনে করতে পারেন নি যে এরকম ঘটনা ঘটতে পারে। সেজন্য তারা প্রস্তুত ও ছিলেন না। কিন্তু ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বারবার এ জিনিস দেখি- আমরা মার্ক্সবাদীরা একথা বারবার বলেছি যে, সংসদীয় গণতন্ত্রে জনগণ থেকে আক্রমণ আসে না, আক্রমণ আসে শাসকগোষ্ঠী থেকে, যারা মুষ্টিমেয়র প্রতিনিধিত্ব করেন। বাংলাদেশেও সেই একই জিনিস ঘটছে, এখানেও আমরা মিলিটারির আক্রমণ দেখতে পাচ্ছি। জানি না, কত সংখ্যক মানুষ – নরনারী, শিশু, বৃদ্ধ, যুবক সেখানে জীবন দিয়েছেন, এর কোন হিসেব নিকাশ পাওয়া যাচ্ছে না এমন কি বর্ডার পেরিয়ে যারা এখানে আস্তে পেরেছেন এবং এখানে এসে বিবৃতি দিয়ে বা আলোচনা করে যা বলেছেন তাতেও তাঁরা সবটা যে জানেন তা নয়। কিন্তু তার ভয়াবহতা ওরা নিজেরা দেখে এসেছেন। প্রত্যক্ষদর্শী, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে তারা এসেছেন। আমাদের সঙ্গে তাদের আলোচনায় তারা যে বিবরণ দিয়েছেন তা থেকে আমরা বুঝতে পারছি যে, কি ধরনের নারকীয় ঘটনা সেখানে ঘটেছে এবং এই অবস্থার মধ্যে পাকিস্তানের যে শাসকগোষ্ঠী, মিলিটারিতে যে গোষ্ঠী আছেন তারা মনে করছেন যে, তার জয়ী হয়েছেন। তবে হ্যাঁ, কিছু স্থান এখানে ওখানে তারা পুনর্দখল করেছেন। যারা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছেন তাদের পক্ষ থেকে এখনও সেখানে আছেন। সেজন্য তারা জানেন যে, শুধু মিলিটারি কোন সলিউশন নয়। সে সমাধান শুধু মিলিটারি দিয়ে হবে না, এটা সেই মিলিটারি গোষ্ঠী ভালো করে জানেন। একটা জাতিকে মিলিটারি দিয়ে পিষে মারা যায়, শ্মশানে পরিণত করা যায়। কিন্তু আজ না হয় কাল আবার যখন সেখানে মানুষের উত্থান হবে তখন সেই মিলিটারিকে তারা খতম করবে, এটাও। সেই মিলিটারি গোষ্ঠী, যারা সেখানে শাসন চালাচ্ছে তারা জানে। সেজন্য তারা কি চেষ্টা করছে? আমরা দেখছি যে, তারা আবার সেখানে নতুন করে দালাল তৈরি করবার চেষ্টা করছে। কিন্তু কাউকে খুঁজে পাচ্ছে না। আজ না হয় কাল কাউকে বসাতে হবে, শুধু মিলিটারি দিয়ে রাজত্ব করা যাবে না। আমরা কি দেখছি? আমরা দেখছি একজনের নাম, আমার খুব পরিচিত অবশ্য তিনি নিজে কিছু করছেন কিনা আমি বলতে পারব না। সংবাদপত্র থেকে জানতে পেরেছি, নূরুল আমিন সাহেব। তিনি আমাদেরই এখানে বসতেন। স্পীকার ছিলেন ১৯৪৬ সালে, মুসলিম লীগের আমলে যখন আমরা এই সভায় ছিলাম। আমার যতদূর মনে আছে তার পার্টি সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়েছিল। উনি বোধহয় একাই নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই ব্যক্তিকে খুঁজে বার করে বক্তৃতা দেওয়ানো হচ্ছে সেই বলছে যে, জোর করে দেওয়ানো হচ্ছে, আবার কেউ বলছেন ইচ্ছাকৃতভাবে দিয়েছেন। সে যাই হোক, এই রকম মানুষের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে, এই হচ্ছে চরম দূর্গতি। মিলিটারি নির্যাতন সেখানে চলছে এবং তার সঙ্গে মুসলিম লীগ? যারা পাকিস্তান তৈরি করেছিল, যারা পাকিস্তানের স্রষ্টা, কোথায় গেল সেই মুসলিম লীগ? সব ধুয়ে মুছে গেছে দেশ থেকে। শুধু যে একটা পার্টি হিসেবেই তা নয়, তাদের যে আইডিওলজি বা ভাবধারা, যা তারা প্রচার করেছিলেন, হিন্দু মুসলমান ভাগ করা প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মের দিক থেকে কোথায় সে সব ভাবধারা? আজকে আর সে সব কিছু নেই। আজকে আর কিছু না হোক, এইসব ছেলেরা যারা এসেছে, যুবকরা যারা এসেছে, সাধারণ মানুষ যারা সেখান থেকে এসেছে, এমনকি অফিসারও কিছু কিছু এসেছেন, আমরা তাদের দেখেছি, অনেক দিন তাদের সঙ্গে দেখা হয়নি। তাদের দেখে আমার আশ্চর্য মনে হয়েছে এই জন্য যে, অনেক খবর ওদের দেশের আমরা রাখতাম না। তাদেরও রাজনীতি আজ কত উর্দ্ধে, কত স্বচ্ছ, কত প্রসারলাভ করেছে, কত গণতান্ত্রিক হয়েছে। এইসব নতুন নতুন যুবক, ছাত্র, যারা ওখান থেকে এসেছেন তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার চিহ্ন মাত্র নেই। এইসব কল্পনাও তাদের মধ্যে কোনদিন আসেনি এই সমস্ত নতুন যুবক সম্প্রদায়, একটা নতুন জাতি, যেন মনে হচ্ছে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ সমস্ত নিয়ে একটা সত্যিকারের জাতি তৈরি হয়েছে। আমরা এখানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলি। রায়টে রায়টে সমস্ত ভারতবর্ষ ভরে গেছে। লজ্জার সঙ্গে, দু:খের সঙ্গে, ক্ষোভের সঙ্গে বলতে হচ্ছে গত ৩-৪ বছর ধরে এত অব্যবস্থা সত্ত্বেও, এত প্ররোচনা সত্ত্বেও আমরা বোধ করি সেজন্য ঐ পূর্ব পাকিস্তানে, বাংলাদেশে সেই ধরনের রায়ট বহুদিন ধরে সেখানে দেখিনি। এই সমস্ত নতুন নতুন রাজনৈতিক মানুষ সেখানে তৈরি হয়েছে। আজকে সেখানে ঐ সব দল ধুয়ে মুছে গেছে। মানুষ থেকে যারা বিচ্ছিন্ন, হয়েছে বিতাড়িত সেই সমস্ত মুসলিমলীগ নূরুল আমীনের দল এদের ধরবার চেষ্টা হচ্ছে। যদি কোনরকমে বেঁচে থাকতে পারা যায়। আজকে আমরা সেজন্য একথা মনে করব, এই প্রস্তাবের মধ্যে আমরা যে কথা বলেছি, যদি আরো আন্তরিক ভাবে এই প্রস্তাবকে সমর্থন করি, তাহলে একথা আমাদের বলতে হবে। করি কিনা জানি না, সে ভবিষ্যতে আমরা বিচার করব। মানুষ বিচার করবে ভারতবর্ষে, পাকিস্তানে, বাংলাদেশে সমস্ত জায়গায়, পৃথিবীর মানুষ সেটা বিচার করবে। কিন্তু আমাদের এটা মনে হয় যে, আন্তরিকতা আছে কিনা। আমরা সকলে মিলে সমর্থন জানাই।

সরকার সমর্থন জানিয়েছেন। ভিন্ন প্রদেশের বিধানসভা ও আইন সভাগুলিতেও আমরা দেখেছি সেখান থেকে সমর্থন করে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নিজেও সংসদে প্রস্তাব এনেছিলেন এবং সেটা গৃহীত হয়েছে। কিন্তু আমাদের মনে খানিকটা যদি সন্দেহ হয় তাহলে আমাদের এখানকার কিছু সদস্য, মাফ করবে, উপায় কিছু নেই, কিন্তু আমাদের প্রথমে মনে হচ্ছে একটি প্রস্তাবের পিছনে যদি আন্তরিকতা না থাকে আমরা যদি এটা মনে না করি যে, এই প্রস্তাব কাগজে হবে না, একে আমাদের কার্যকরী করতে হবে, এই আমাদের কার্যকরী করতে হবে, এই আমাদের জীবনমরণ সংগ্রাম ওদের মতো, যারা ওখানে সংগ্রাম করছেন, যারা ওখানে বুকের রক্ত ঢেলে দিচ্ছেন, যারা ত্যাগ স্বীকার করছেন- যদি তা হয়, তাহলে আমাদের পরিষ্কার করে নিতে হবে যে, আন্তরিকতা কোথায় সেটা ঠিক করতে হবে। কিন্তু একটু সন্দেহ হয়, এটা আপনারা সবাই বিবেচনা করে দেখবেন। আমাদের জানতে ইচ্ছে করে যে, এখনকার সরকারপক্ষ থেকে এই প্রস্তাব তারা এনেছেন, এই প্রস্তাব মুখ্যমন্ত্রী নিজে এখানে রেখেছেন, যে সরকারের মধ্যে মুসলিম লীগ আছে, ওরা কি আন্তরিকতার সঙ্গে সমর্থন করেন বাংলাদেশের এই সংগ্রামকে, এই স্বাধীনতার আন্দোলনকে আমরা এখনো তার প্রমাণ পাইনি। কাজেই আমরা নিশ্চয়ই জানতে চাই তাদের বক্তৃতা শুনব। কিন্তু আমাদের মনে হয় এখানে যদি আমরা সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দিই এবং অনেক সময় ইয়ং পিপল যারা বাংলাদেশ থেকে এসে আমাদের বলছে এখানে আবার মুসলিম লীগ, ওখানে তো সব শেষ হয়ে গেছে, ওদেরকে আমরা তো শেষ করে দিয়েছি, ওখানে যাতে গণতন্ত্র প্রসার লাভ করে তার ব্যবস্থা করছি, অথচ এখানে এখন বেঁচে রয়েছে, নতুন করে সৃষ্টি হচ্ছে, এই কথা তাঁরা আমাদের বললেন। আমরা বললাম, আপনাদের ওখানে সংবাদপত্র যায় না এবং সুযোগ না থাকায় আপনারা অনেক খবর জানেন না, আপনারা নিজেরা ঘুরে ঘুরে সমস্ত দেখুন, আপনাদের অনেক নতুন অভিজ্ঞতা হবে। কিন্তু এটা তো সত্যিকারের প্রশ্ন যে, মুসলিম লীগ যারা ধর্মের বিচারে মানুষের রাজনীতি করেন, মানুষকে ভাগ করবার চেষ্টা করেন, সেই পুরানো জিনিস আজও চলছে এবং নতুন করে তার রিভাইভ্যাল বা পুনরুজ্জীবন আমরা দেখতে পাচ্ছি।

শ্রীমহঃ শামন বিশ্বাসঃ অন এ পয়েন্ট অর্ডার, স্যার, আমরা কোয়ালিশন মিনিষ্ট্রিতে অংশগ্রহণ করেছি জনকল্যাণের জন্য। আজকে বিরোধী দলের সভাপতি যে বক্তব্য রাখলেন, উই হ্যাভ গিভেন ইউ এ পেসেন্ট হিয়ারিং, এন্ড উই হোপ ইউ উইল অলসো গিভ আস এ পেসেন্ট হিয়ারিং।

মি স্পীকারঃ এতে পয়েন্ট অব অর্ডার হয় না। আমরা সর্বসম্মতিক্রমে একটা প্রস্তাব পাশ করবার জন্য রেজোলিউশন নিয়েছি। আপনি প্রিসাইজলি আমাকে বলুন।

শ্রীমহঃ শামন বিশ্বাসঃ উনি ডাইরেক্টলি আক্রমণ করেছেন। একজন লিডারের মুখ থেকে এইসব ভাষা আমরা শুনতে চাই না। এই রকম চিৎকার করে কোনদিন জনকল্যাণ করা যায় না। আই ডু নট লাইক টু সারেন্ডার মাইসেল্ফ।

মি: স্পীকারঃ ইট ইজ নট এ পয়েন্ট অব অর্ডার। প্লিজ টেক ইওর সিট।

শ্রীমহঃ শামন বিশ্বাসঃ আমরা গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে বিশ্বাসী বলেই আজকে গণতান্ত্রিক কোয়ালিশন সরকারে অংশগ্রহণ করেছি।

মি: স্পীকারঃ আপনি বসুন। আপনার বক্তব্য যেটা আপনি বলেছেন দেয়ার ইজ নো পয়েন্ট অব অর্ডার। কাজেই মাঝখানে আপনি কমেন্ট করবেন এটা আমি চাইনা। আই উইল রিকোয়েস্ট ইউ টু টেক ইওর সীট। প্লিজ টেক ইওর সীট।

শ্রী সুবোধ ব্যানার্জিঃ স্পীকার মহাশয়, আজকে যে প্রস্তাব আমরা আলোচনা করছি সেখানে আমি সরকার পক্ষ এবং বিরোধী পক্ষের সদস্যদের অনুরোধ করব, যে বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করছি সেটা অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং আমাদের কাছে এটা অতি প্রিয়। কাজেই এটা আমাদের গণআন্দোলনের সামনে একটা অতি বড় উদাহরণ উপস্থাপিত করেছে। সেইজন্য এইরকম একটা বিষয় নিয়ে সকলের যুক্ত চেষ্টায় ইউন্যানিমাস রেজোলিউশন করা হয়েছে। তাই আমি অনুরোধ করব সেই ফিলিং নষ্ট করে দেবেন না।

মি: স্পীকারঃ মি: ব্যানার্জী, আমি আশা করি প্রত্যেকটা সদস্যের তেমনি মনোভাবই থাকবে। আমরা যেন অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে এই প্রস্তাব আলোচনা করি। কোনরকম উত্তেজিত না হয়ে আমাদের সামনে এই হাউসের সামনে যে প্রস্তাব রয়েছে, সেই সম্পর্কে আলোচনার সময় প্রস্তাবের উপর যথোচিত গুরুত্ব দিয়েই যেন মাননীয় সদস্যরা আলোচনা করেন এবং তাদের ব্যাবহারটাও যেন সেইভাবেই হয়। আমি হাউসের কাছে আপিল করছি, যে প্রশ্নই উঠুক না কেন আমরা হাউসেতে যেভাবে প্রস্তাব নিচ্ছি, তার গুরুত্ব যেন কোনরকমেই খর্ব না হয়।

শ্রী জ্যোতি বসুঃ মি স্পীকার, স্যার, আমি যেটা বলছিলাম- তার জবাব নিশ্চয়ই পাব যখন মুসলিম লীগের প্রতিনিধিরা বক্তৃতা দেবেন যদি আন্তরিকতা থাকে। এমনকি ডেমোক্রেটিক কোয়ালিশন সরকার সম্বন্ধে যদি তাদের আন্তরিকতা থাকে, বাংলাদেশকেও সমর্থন করবেন যদি আন্তরিকতা থাকে। সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। কংগ্রেস দল তাঁরা সমর্থন করছেন এই প্রস্তাবকে। তাঁরা শুধু এই প্রস্তাবকে সমর্থন করছেন না, এখানকার কংগ্রেস সরকার বা ডেমোক্রেটিক কোয়ালিশন সরকার, কংগ্রেসের দ্বারা পরিচালিত সরকার- তারা যখন সরকার গঠন করেছিলেন, তখন প্রথমেই বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা প্রস্তাব করে দিল্লীতে পাঠিয়েছেন। আমরা দেখছি আনুষ্ঠানিক দিক থেকে এই কংগ্রেস সরকারের বাংলাদেশের সংগ্রামের প্রতি সমর্থন আছে- সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আবার প্রশ্নটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুবোধবাবু যেমন বলেছেন মনে এক, মুখে আর এক রকম যেন না হয়। প্রস্তাব পাশ করে দিলাম বটে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে যেন অন্যরকম না হয়। সে জন্য বলছিলাম আপনাদের আনুষ্ঠানিক সমর্থন থাকলেও আমার কতকগুলি প্রশ্ন জেগেছে মনে। এটা কি সম্ভব যে, আমাদের দেশে আমরা অন্য দেশের গণতন্ত্রকে সমর্থন করছি, পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছি তাদের স্বাধীনতার জন্য অথচ আমাদের দেশের গণতন্ত্রকে আমরা সমর্থন করিনা, গণতন্ত্রকে যেখানে আমরা খতম করবার চেষ্টা করছি, গণতন্ত্রের উপর আমরা বারে বারে আক্রমণ করছি, তার নিয়ম কানুন আইন কিছুই আমরা মানি না। আমাদের নিজেদের দেশের গণতন্ত্রের ব্যাপারে সেখানে আমার মনে হয় এটা সম্ভব নয়। এর মধ্যে কোন আন্তরিকতা থাকতে পারে না। মার্ক্স বলেছিলেন, অন্য বিষয়ে বৃটিশদের বলেছিলেন, আয়ারল্যান্ড এর উপর তোমরা আধিপত্য করছ- এ নেশন হুইচ অপ্রেসেস এনাদার নেশন ক্যাননট বি ফ্রি। আমিও সেই কথা বলি অন্য দিক থেকে। যদি আমাদের দেশে গণতন্ত্র আমরা না মানি, তারা মানবেন অন্য জায়গায়? আমরা মনে করি না এই সম্পর্কে তাদের কোন আন্তরিকতা থাকতে পারে।

শ্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ঃ অন এ পয়েন্ট অব অর্ডার, আমরা কি বর্তমান ইস্যু থেকে সরে যাচ্ছি না? আমাদের দেশের সমালোচনা করবেন, না আজকের রেজোলিউশনটা যা আছে বাংলাদেশ সম্পর্কে তার সমালোচনা করে বক্তৃতা করবেন।

মি: স্পীকারঃ পয়েন্ট অব অর্ডার তুলতে গেলে এখানে যা বলা হয়েছে তাতে কোন রুল ইনফ্রিজ করা হয়েছে এইরকম যদি হয়, তাহলে নিশ্চয়ই পয়েন্ট অব অর্ডার তুলবেন।

শ্রী সুব্রত মুখার্জিঃ আমি বলছি আমাদের যা রেজোলিউশন আছে এবং আপনি যে রেজোলিউশনের উপর বক্তৃতা করার অনুমতি দিয়েছেন, সেই রেজোলিউশনের উপর বক্তৃতা করা হচ্ছে না, আমাদের দেশের গণতন্ত্র কতখানি, তার মাপকাঠিতে সমালোচনা করা হচ্ছে।

মি: স্পীকারঃ যে প্রস্তাব এখানে এসছে, তাতে যিনি বক্তা, তিনি তাঁর আর্গুমেন্ট ডেভেলপ করতে গিয়ে যেটা ভাল বুঝবেন সেই রকমভাবে ডেভেলপ করবেন, সেইভাবে আর্গুমেন্ট পেশ করবেন। আপনার বলার সময় আপনিও তাই করবেন।

শ্রী জ্যোতি বসুঃ ধরুন, এই পশ্চিম বাংলায়, কারণ এখানকার বিধানসভার কাছ থেকে আমরা এই প্রস্তাব গ্রহণ করছি- এখানে কি হচ্ছে, এখানে যতটুকু গণতন্ত্র ছিল আজ তা শেষ হতে বসেছে। কারা শেষ করছে, কংগ্রেস দল, কংগ্রেস সরকার, এখানে অসংখ্য পুলিশ আছে, ৬০ হাজারের ওপর পুলিশ আছে। তার ওপর এক বছরে দেখেছি, যেখানে শ্রীমতী গান্ধীর রাজত্ব ছিল, অর্থাৎ রাষ্ট্রপতির শাসন- এই এক বছর ধরে দেখেছি, নির্বাচন পর্যন্ত যেখানে সি আর পি এসেছে, অসংখ্য হাজার হাজার সি আর পি আনা হয়েছে। শুধু তাই নয় তারপর আমরা দেখলাম একটা অভাবনীয় জিনিস। সেই অভাবনীয় জিনিস আমরা দেখলাম যে, নির্বাচন যখন ঘোষণা করা হল, তারপর আবার মিলিটারি এল, ৬০ হাজার পুলিশ হবে না, হাজার হাজার সি আর পিতে হবে না, বাংলাদেশের পুলিশ দিয়ে হবে না, তার ওপর এল মিলিটারি। যেখানে একটা নির্বাচন হবে, সেখানে এল মিলিটারি এবং নানারকম জুলুম অত্যাচার তাদের দিয়ে করানো হল। কোথায় গণতন্ত্র? এ তো গণতন্ত্র এর যেটুকু ছিল তাকে শেষ করার ব্যবস্থা হচ্ছে। এবং শুধু তাই নয়, এখানে সাধারণ মানুষের উপর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উপর – গণতান্ত্রিক আন্দোলন যারা সংগঠিত করেন মজুর, কৃষক, ছাত্র- যুবক, তাদের উপর নানাভাবে অকথ্য অত্যাচার গুন্ডাবাহিনী তৈরি করে নকশালদের কাজে লাগিয়ে, অন্য সমাজবিরোধীদের কাজে লাগিয়ে পুলিশের একটা প্রধান অংশ, সরকার সমস্ত মিলিয়ে, এই আক্রমণ, এই অত্যাচার তারা চালিয়েছে, এই জিনিস আমরা দেখেছি। গত এক বছরে দেখেছি আমাদের সাথী ২৫০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আজও শুনলাম এখানে, যে ঘটনাগুলো বলা হল, একটা রাত্রের মধ্যে, ২৪ ঘন্টার মধ্যে – আমরা এখানে ৬ জনের কথা শুনলাম, তারা জীবন দিয়েছেন এবং গুন্ডারা আক্রমণ করছে। শুধু গুন্ডারা আক্রমণ করলে কিছু বলতাম না, তাদের পেছনে পুলিশ আছে, তাদের পিছনে সরকারী যন্ত্র আছে, এই জিনিস এখানে চলেছে। সুতারং এইভাবে কি করে গণতন্ত্র বাঁচবে। দুটো নির্বাচন হয়ে গেল, এরই মধ্যে নির্বাচন হল, কিন্তু নির্বাচনের আগে আমরা দেখেছি চারি ধারে ১৪৪ ধারা জারী করে রাখা হয়েছে, এটা কখনও শুনিনি ২৩ বছরের কংগ্রেসী রাজত্বেও। স্বাধীন যেদিন থেকে হয়েছি, সেদিন থেকে যে নির্বাচন হয়ে যাবার পর আমরা উৎসব আনন্দ করতে পারব না, নির্বাচনকে বিশ্লেষণ করতে পারব না, পর্যালোচনা করে বাংলাদেশের জনসাধারণের কাছে রাখতে পারব না, ১৪৪ ধারা দিয়ে আমাদের কণ্ঠরোধ করা হল। বলা হল আমরা এই বিষয়ে অনুমতি দিতে পারি না। এখন এই রকম একটা অবস্থার মধ্যে আমরা মনে করি যে, এখানে গণতন্ত্রকে আমরা এইভাবে হত্যা করব, গণতান্ত্রিক অধিকার যেটুকু আছে সেটাকে কেড়ে নেব, এইভাবে বিনা বিচারে মানুষকে আমরা আটক করে রাখব। আবার শুনছি পি ডি এক্ট হবে, তাতে হাজার হাজার ধরে রাখা হবে, প্রতিপক্ষকে এইভাবে ঘায়েল করবেন, তাদের এসেম্বলিতে আসতে দেবেন না, তারা বিচারাধীন হবে, একটা ভোট দেবার জন্য এই যদি চলতে থাকে এবং তারাই যদি আবার শাসক দলের হয়, তাহলে যদি সন্দেহের কিছু অবকাশ সেখানে আমাদের থাকে যে এরা কি সত্যিই আন্তরিকতার সঙ্গে এই প্রস্তাব রেখেছেন, না লোক দেখানোর জন্য এটা তারা করছেন। আমাদের পশ্চিম বাংলার মানুষের মত তারা জানে, এমন কি ভারতবর্ষের বিপ্লবী গণতান্ত্রিক মানুষের মত তারা জানে, তাদের মত প্রতিফলিত হয়েছে এক মাস ধরে, সেইজন্য তারা এই প্রস্তাবটি নিচ্ছেন। এর মধ্যে আন্তরিকতা যদি থাকে তাহলে সেটা কার্যকরী ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাব। কিন্তু মাননীয় স্পীকার মহাশয়, আমি ও পক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি যে, ওরা যদি এই পদ্ধতিতে শাসনব্যবস্থা চালান, এর যদি খানিকটা পরিবর্তন না করেন তাহলে আমরা বুঝব যে, সত্যিকারের কোন সমর্থন হবে না, এ কাগজের প্রস্তাব তাদের কাছে থাকবে। এখানকার দাবিগুলি কি- আমরা সবাই পরিষ্কার ভাবে বলেছি যে, যে সরকার ওখানে হয়েছে তাকে মেনে নেওয়া হোক। মাননীয় স্পীকার মহাশয় আপনার মনে আছে, শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সাধারণভাবে অনেক আগে বলেছিলেন, তখন বাংলাদেশ সরকার হয়নি, আমি কাকে রেকগনাইজ করব, কাকে মেনে নেব। তারপর সরকার গঠিত হয়েছে, এখন আর সেকথা বললে চলবে না। তারা আজ ওখানে গেরিলা কায়দায় লড়াই এর জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন, নেতৃত্ব দিচ্ছেন, অসংগঠিত মানুষ আজ সংগঠিত হবার চেষ্টা করছেন, পরস্পর মিলেমিশে কাজ করবার চেষ্টা হচ্ছে, তাদের সেই লড়াইকে গ্রামে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি চলেছে, সেজন্য আমরা চেয়েছিলাম আর বিলম্ব কেন, এই প্রস্তাব ১৫ দিনের মধ্যে আমরা দিল্লীকে বলি যে, তোমরা বাংলাদেশকে মেনে নাও, কিন্তু আমরা দেখলাম টাইম লিমিট না করাই ভাল, ওদের কিছু অসুবিধা করতে পারে, সেজন্য আমরা এই প্রস্তাবে লিখলাম যে, এক্ষুনি রিকগনিশন দেওয়া হোক। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে যেটা এর সংগে ওত:প্রোতভাবে জড়িত, সেটা হচ্ছে ওদের আগে চাই অস্ত্রশস্ত্র। খাদ্য, বস্ত্র, ওষুধ সেসব তো আমাদের দিতেই হবে। কারণ অসংখ্য শরণার্থী আছে তাদের দিতে হবে। কেন্দ্রিয় সরকার সেগুলি করছেন বলে শুনেছি, বিভিন্ন কমিটি আছে তার জন্য, কিন্তু সবচেয়ে বেশি আগে যেটা দরকার সেটা হচ্ছে অস্ত্রশস্ত্র গোলাগুলি। তাদের হয়ত কিছু রাইফেল আছে যেগুলি সৈন্যদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে, কিন্তু সেগুলি চালাবার মত গুলি নেই। তারা জীবন দেবার জন্য প্রস্তুত, কিন্তু গুলী নেই। আমরা যদি তাদের সেটা দিতে না পারি, একটা হাওয়াইজাহাজ নিচে নেমে এসে গুলী করছে, তাকে প্রতিহত করার জন্য চাই এন্টিএয়ারক্রাফট গান, এসব তাদের নেই, এসব যদি তাদের না দিতে পারি তাহলে তারা কি করে লড়াই করবে। শুধু সহানুভূতি জানিয়ে, রেডিওতে গান করে ওদের সত্যিকারের সাহায্য করতে পারব না। সেজন্য আমরা একমত হয়ে এই প্রস্তাব দিচ্ছি। তৃতীয়ত যারা নাকি ওখান থেকে বাধ্য হয়ে চলে আসছে, পরিস্থিতি অন্য রকম হলে তারা বেশীরভাগ ফিরে যাবে, তাদের সম্বন্ধে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন। তাদের শুধু টাকা দিলে হবে না তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে খুব তাড়াতাড়ি বর্ষা এসে যাচ্ছে, আমরা জানি কি দুর্গতি হবে। ৬০ লক্ষ বাস্তুহারা পশ্চিম বাংলায় এসেছে, বেশিরভাগ বাইরে গেছে, এখানে কিছু আছে। সেজন্য খাদিল্কার দিল্লীতে বলেছেন আমাদের একশো কোঠি টাকা খরচ হবে, অতএব ইউএনও, আন্তর্জাতিক সংস্থা এর ভার নিক। কে করবে না করবে বলতে পারব না, আমাদের কথা হচ্ছে এটা কেন্দ্রীয় সরকারের পূর্ণ দায়িত্ব এবং তাদের এখানে লোক পাঠিয়ে ব্যবস্থা করা যাতে তাদের খেটে খাবার ব্যবস্থা হয়। যারা সক্ষম তারা যাতে এখানে কাজকর্ম করে খেতে পারেন শুধু বসে খেতে না হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে। যারা আজ ওখানে লড়াই করছেন তারা পৃথিবীর গণতান্ত্রিক মানুষের জন্য লড়াই করছেন, এজন্য আমাদের এইসব ব্যবস্থা করা দরকার। তারপর যেটা আছে সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেইখানে আসল বিচার হবে। আমি বলেছি প্রস্তাবের মধ্যে এক হয়ে বলেছি কেন্দ্রীয় সরকার যদি এই দাবিগুলি মেনে না নেন তাহলে আমরা বলছি এই প্রস্তাবের মধ্যে সরকার এবং জনগনকে এসেম্বলি থেকে ডাক দেওয়া হচ্ছে অর্থাৎ পশ্চিম বাংলার সরকার এবং জনগনকে ডাক দেওয়া হচ্ছে আপনারা চাপ সৃষ্টি করুন। ব্যবস্থা করুন যাতে ওরা এটা মেনে নেন। এইটা আমি জানি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা দেখব, তাদের কি অসুবিধা আছে। আজকে প্রধানমন্ত্রী মিটিং ডেকেছেন দিল্লীতে। আমাদের প্রতিনিধিরা সেখানে গিয়েছেন। কি হবে না হবে সেটা নিশ্চয়ই বিরোধী দলের লোকেরা বিচার করবেন। অন্য কোন রকম রাজনীতি করতে চাই না। এটা করছেন না কেন তা বুঝতে পারছি না। আমরা কোন বড় রকমের ঝুঁকি আছে বলে মনে করছি না। আমরা মনে করি এটা মেনে নেওয়া উচিৎ। আমরা এটা প্রতিজ্ঞা করেছি এই প্রস্তাব গ্রহণ করে সে প্রতিজ্ঞা করেছি। এই কথা বলতে চাই যে, আমরা সদস্যরা যারা ভোট দিবেন এই প্রস্তাবের পক্ষে তারা বুঝেশুনে দেবেন, পরবর্তীকালে আমাদের আন্দোলন করতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে বাধ্য করতে হবে। এই দাবিগুলো যা আছে তা যাতে মেনে নেওয়া হয়।

আমার এই বিষয়ে একটা সুপারিশ আছে। আমরা যেন শুধু একটা চিঠি পাঠিয়েই চুপ করে বসে না থাকি, অর্থাৎ প্রস্তাবের একটা কপি পাঠিয়ে দিয়েই শুধু এতে আমরা সন্তুষ্ট না হই। আমরা যারা এই প্রস্তাব গ্রহণ করছি তার মধ্যে কয়েকজন প্রতিনিধি যদি দিল্লিতে গিয়ে সেখানকার সরকারের কাছে উপস্থাপিত করতে পারি এবং আমাদের এই প্রস্তাব নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারি। যদি তাদের কোন অসুবিধা থাকে তাহলে আমাদের বলবেন এবং আমাদের বক্তব্য যাতে এক সঙ্গে রাখতে পারি তার ব্যবস্থা করুন।

আমি বসবার আগে শুধু একটা কথা বলতে চাই, এই প্রস্তাব অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। আমরা মনে করি এটা আমাদের জীবনমরণের সংগ্রাম। গণতান্ত্রিক সংগ্রাম এই কথাগুলো বলে বলব আমি আশা করি এখানকার সদস্যরা ভূল বুঝবেন না এবং আমরা যারা এই বিরোধী দলে আছি, এই পক্ষে আছি আমাদের সরকারের সঙ্গে কোন একটি ক্ষেত্রেও মিল নেই, কোন মৌলিক ব্যাপারে কোন বিষয়ে মিল নেই। আমরা এই সরকারের যত তাড়াতাড়ি পতন হয় তাই চাই। কিন্তু যতদিন এই সরকার আছে যতদিন আমরা বিরোধী আছি এবং এর মধ্যে আমাদের উপর যত আঘাত হোক, আমাদের রক্ত ঝরিয়ে, আমাদের জেলে পাঠিয়ে, গুন্ডার আক্রমণ, পুলিশের আক্রমণ, কংগ্রেসি আক্রমণ – যত কিছুই হোক এবং এই রক্তাক্ত অবস্থায়, এই রকম অশ্রু বিসর্জনের সময় বাংলাদেশের মানুষের এই সংগ্রামে এই প্রতিশ্রুতি দিতে চাই যা কিছুই হোক আমরা আছি তাদের সঙ্গে। এই কথা বলে এই প্রস্তাবকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি।

( এর পরে ২০ মিনিট বিরতি দেয়া হয়)

( বিরতির পর)

শ্রী আবদুস সাত্তার : মাননীয় স্পীকার মহাশয়, আমাদের মুখ্যমন্ত্রী বাংলাদেশ সম্পর্কে যে প্রস্তাব এই হাউস- এ এনেছেন তা আমি সমর্থন করছি এবং সমর্থনের পিছনে আমার যে কারণ তা আপনার সামনে রাখবার চেষ্টা করব। আমাদের বিরোধী দলের নেতার বক্তব্যর প্রথম অংশটা আমার সত্যিই ভাল লেগেছিল। তিনিবারবার বলেছেন এই রেজোলিউশন এর পেছনে কংগ্রেসের সত্যিকারের অনেষ্টি আছে কিনা সে সম্বন্ধে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন এবং তা আমি সরকারের তরফ থেকে বলছি আজ যে প্রস্তাব আনয়ন করা হয়েছে সেই প্রস্তাবের পেছনে আমাদের সম্পূর্ণ সমর্থন আছে এবং আন্তরিকতা আছে। আমাদের প্রথম যে ক্যাবিনেট মিটিং হয় সেই ক্যাবিনেট মিটিং এ আমরা এই প্রস্তাব নিয়েছিলাম এবং প্রধানমন্ত্রীকে আমাদের এই সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলাম। এটা ঠিক আমি তার সঙ্গে একমত যে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান হয়েছিল। কিন্তু আজ ২৩ বছর পর এই তত্ব যে ভুল সেটা প্রমাণিত হয়ে গেছে। আজ আমরা যদি হিন্দু মুসলমান আলাদা ভাবে চিন্তা করি তাহলে গণতন্ত্র এর বিশ্বাসী কোন লোক তা মেনে নিতে পারে না। অনেক মুসলমান যারা ভাবছেন যে, বোধ হয় পাকিস্তান এই কথাটা উড়ে যাবে এই সন্দেহ তিনি প্রকাশ করেছেন, কিন্তু জানিনা কেউ এই মনোভাব পোষণ করেন কিনা। আমি সেদিন এক বক্তিতায় এই দ্বিজাতিতত্বের কথা বলেছিলাম। আমাদের প্রফেটের জীবনি যদি আলোচনা করি তাহলে দেখি যে, প্রফেট যখন মক্কা থেকে মদিনায় গিয়েছিলেন তখন সেখানে অনেক ইহুদী, খৃষ্টান বাস করত। অর্থাৎ সেখানে অনেক নন মুসলিম বাস করত। মক্কাবাসিরা মদিনা আক্রমণ করার ষড়যন্ত্র করে এবং তখন মদিনায় বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী লোক বাস করত। তিনি তখন সেখানকার অধিবাসিদের বলেন, আমরা এক জাতি – ওয়ান নেশন- এবং আজ যদি কেউ মদিনা আক্রমণ করে তাহলে আমরা মুসলমান, ইহুদি, খৃষ্টান ইত্যাদি সকলে সমবেতভাবে বাধা দেবার চেষ্টা করব।

সুতারং আমি বলতে চাই, যে তথ্যের ভিত্তিতে এটা হয়েছিল সেটা ভুল। ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না কারণ আমরাও তার শরিক ছিলাম, আমরাও তা স্বীকার করে নিয়েছিলাম, আজকে সেটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তাই সেদিক থেকে বলছি যে, আজকে বাংলাদেশ সম্পর্কে – যে বাংলাদেশের স্বাধিনতা, অর্থাৎ এটা বলা হয়েছে যে, বাংলায় প্রথম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যে নির্বাচন হয়েছিল সেই নির্বাচনে যে কর্মসূচির ভিত্তি মুজিবুর রহমান সাহেব করেছিলেন সেই নির্বাচনের রায়কে আজকে ইয়াহিয়াশাহী, জঙ্গিশাহী, মানেননি, আজকে না মানার ফলেই এই অবস্থা হয়েছে আজকে আমি বলব ইসলামিক রাষ্ট্রের নাম নিয়ে ইয়াহিয়া সাহেব সেভাবে সেখানকার অধিবাসিকে, হিন্দু- মুসলমান নির্বিশেষে হত্যা করেছেন এবং যেভাবে নারীর উপর পাশবিক অত্যাচার করছে, আজকে সেগুলি আমার মতে ইসলামবিরোধী কাজ ছাড়া আর কিছু বলা যেতে পারে না। আজকে ইসলামের নাম নিয়ে যারা এই জিনিসকে সমর্থন করে তারে আমি বলব তারা ইসলামের মূল কথা জানে না, এবং তা বিশ্বাসও করে না। তারা একটা গোঁড়ামির বশে, তারা একটা সেন্টিমেন্টের বশে কিম্বা না বুঝে এই সব করছে। কিন্তু দু:খের বিষয় আজকে এই বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে বাঙ্গালি অবাঙ্গালী কথাটা এসে পড়েছে। বাঙ্গালি অবাঙ্গালী কথাটা আসবার ফলে আজকে কলকাতায় কিংবা বাংলাদেশের বুকে যারা অবাঙ্গালী মুসলমান আছে কিংবা অবাঙালী হিন্দু পর্যন্ত তাদের মধ্যে একটা সন্দেহ দেখা দিয়েছে, পরস্পর পরস্পরকে যেন একটা সন্দেহ করছে। এই জিনিসটা আমার মনে হয় দেশের পক্ষে অমঙ্গল। দেশের পক্ষে অমঙ্গল এইজন্য বলছি আজকে সেখানকার লড়াই বাঙ্গাল- অবাঙ্গালী বলে নয়, আজকে জঙ্গিশাহি ইয়াহিয়া খান কিংবা পশ্চিম পাকিস্তানের কর্মকর্তা যারা তারা বাংলাদেশের লোককে সমস্ত রকম জিনিস থেকে বঞ্চিত করে শাসন করতে চেয়েছিল। আজকে বৃটিশ আমলে গোটা ভারতবর্ষে যেভাবে শোষণ চালাতে হয়েছিল আজকে সেইভাবে শোষণ করার পরিকল্পনা তারা নিয়েছিল। আজকে তারা এই দেশের অর্থ নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে সমৃদ্ধশালী করতে চেষ্টা করেছিল তাই সেখানে তারা তাদের একটা অধিকার দাবি করেছিল, তারা যে জিনিস চেয়েছিল তারা একটা স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিল। আজকে যেখানে শতকরা ৯৯ জনের প্রতিনিধিত্ব পাওয়া সত্ত্বেও সেই দলকে ইয়াহিয়া খান তাদের সুযোগ দেননি তাদের অস্ত্রের বলে। আমি তাই আজকে যে নরহত্যা চলছে সেটা খুবই দু:খের কথা, এর সঙ্গে আমি বলব, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কথা, আজকে সহজেই দেখতে পাচ্ছি এই যে নরহত্যা, গণহত্যা চলছে, সংগ্রামী মানুষকে যে এইভাবে পিষে মারছে, আজকে তাদের পিছনে অনেকের সহানুভূতি আসছে, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসছে না। আমি বলব ভারতবর্ষ তবুও এগিয়ে এসেছে, এগিয়ে এসে সেই দু:স্থ লোকদের সাহায্য করছে। কিন্তু আজকে ভারতবর্ষের যে বাধা সেই বাধার একমাত্র বাধা হচ্ছে চীন। আজকে এই সংগ্রামকে, জঙ্গিশাহি শাসক ইয়াহিয়াকে যদি কেউ সমর্থন করে থাকে, আজকে আমার মনে হয় বিদেশী দেশের মধ্যে চীন দেশই তাকে সমর্থন করে। এটা খুবই দু:খের কথা। যারা সংগ্রামী মানুষের পিছনে যে দেশ বলে আমরা আছি, যারা সংগ্রামী মানুষের জন্য কুম্ভীরাশ্রু, ফেলে, তারা সেই চীন দেশের বলে বলীয়ান হয়ে আজকে ইয়াহিয়া খান এবং তার জঙ্গীশাহী এদের দমন পীড়ন করতে আরম্ভ করেছে এটা বড়ই দু:খের বিষয়। আশ্চর্যের বিষয় আজকে যিনি আমাদের বিরোধী নেতা, সেই কমিউনিষ্ট পার্টির নেতা, গণতন্ত্র সম্বন্ধে তিনি অনেক উপদেশ আমাদের দিয়েছেন, কাকে বলে গণতন্ত্র, গণতন্ত্র কিভাবে হত্যা করা হচ্ছে, এইসব বলেন কিন্তু, তাঁকেই আমি বলছি, আপনার এই মোশনকে সমর্থন করছে বলে আমরা সত্যিই আপনার কাছে ঋণী। তবে আপনি আপনার অন্তরে অন্তস্তল থেকে তো আপনি সত্যিকারের রাজনীতি করছেন, না আপনি সত্যিকারের নিরপেক্ষভাবে এবং অনেষ্টলি এটাকে সমর্থন করেন।

এখানে আমাদের যথেষ্ট সন্দেহ আছে, কারণ আমরা জানি যে, ইয়াহিয়া খানকে মোটামুটিভাবে কারা সমর্থন করেছেন অস্ত্র দিয়ে। এমন কি দেখা গেছে যারা এসেছেন ওপারে থেকে তারাই বলেছেন যে, সেখানে চীনা সৈন্য দেখ। তিনি গণতন্ত্রের কথা বলেছেন, আমি বলব এই গণতন্ত্রের হত্যাকারী কে? ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৭০ সালের মার্চ পর্যন্ত আপনার রাজত্ব করে গেছেন, কেবল রাজত্বই করেননি, আপনি হোম ডিপার্টমেন্টের মালিক ছিলেন। আপনার কি মনে নেই যে, সেই সময় সাধারণ লোক রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করতে পারেনি। ( বিরোধী পক্ষের বেঞ্চ হইতে তুমুল হট্টগোল)। আপনি তো সবই জানেন। আজকে আপনি সি আরপি আনার কথা বলেছেন। আমি বলব এই সিআরপি আনা হয়েছে আপনাদেরই গার্ড দেওয়ার জন্য। আজকে আপনাদের বাড়ির চারপাশে, আপনাদের নেতাদের বাড়ির চারপাশে সি আরপি রাখার প্রয়োজন হয়েছে বলেই এই সি আরপি আনা হয়েছে। কাজেই ১৩ মাস রাজত্ব করার ফলেই আপনাদের এই সি আরপি রাখার প্রয়োজন হয়েছিল। তাই প্রেসিডেন্ট রুলের আমলে সি আরপি এনে আপনাদের বডিগার্ড দেওয়া হয়েছে। আর এই ১৪৪ ধারা কাদের জন্য? আজকে যারা গণতন্ত্র রক্ষা করতে পারে না, মানুষকে খুন করা যাদের নেশা তাদের জন্যই এই ১৪৪ ধারা, সাধারণ মানুষ যাতে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে সেইজন্যই এই ১৪৪ ধারা করা হয়েছে।

মি: স্পীকারঃ  মি: সাত্তার, ইওর টাইম ইজ আপ। প্লীজ ফিনিস।

শ্রী আবদুস সাত্তার: আচ্ছা স্যার, ঠিক আছে। তিনি একটা কথা বলেছেন যে, বড় রকমের কোন ঝুঁকি নেই সাহায্য করার। আমি বলব কোন ঝুঁকি নেই সাহায্য করার তবে একটু ভয় আছে- জ্যোতিবাবু কি দয়া করে চীনকে একটু নিষেধ করে দেবেন যাতে করে কোন ঝুঁকি না নিতে হয় বা কোন বিপদ না আসে। এই বলেই আমি আমার বক্তৃতা শেষ করলাম।

শ্রী সুবোধ ব্যানার্জি : স্পীকার মহাশয়, মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভার সামনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের উপর যে প্রস্তাব রেখেছেন আমি সর্বান্ত:করণে তাকে সমর্থন করছি। সীমান্তের ওপারে লক্ষ্য লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজেদের বুকের রক্ত দিয়ে নতুন ইতিহাস রচনা করছেন। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ যে সংগ্রাম করছেন সেই সংগ্রাম সফল হবেই। আর সেই সংগ্রাম সফল হলে তার ঢেউ, তার প্রভাব, সীমান্ত পার হয়ে আমাদের দেশে আসবে এবং তার ফলে আমাদের দেশের শোষিত মানুষও ঠিক ওদের মতই সশস্ত্র পথে গণমুক্তির জন্য নামবে, পুঁজিবাদ খতম হবে এবং এখানকার মানুষ শোষণমুক্ত হবে। কাজেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুধু তাদের নয়, এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এই সংগ্রাম আমদেরও সংগ্রাম, বিশ্বের যেখানে যত শোষিত মানুষ আছেন তাদের ও সংগ্রাম। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আমি এই সংগ্রামকে সমর্থন জানাই তার সাফল্য কামনা করি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী মানুষের প্রতি সংগ্রামি অভিনন্দন জানাই।

স্পীকার মহাশয়, বাংলাদেশের এই স্বাধীনতার সংগ্রাম সম্পর্কে কতকগুলি প্রশ্ন উঠেছে এখানে। এ ব্যাপারে কিছু কিছু অপপ্রচার আমাদের দেশে চলেছে, আমাদের রাজ্যেও চলেছে। কেউ কেউ বলেছেন বাংলাদেশের এই সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম নয়, এই সংগ্রাম পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য এক বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, যাকে বলে সিসেসনিস্ট মুভমেন্ট। না আমরা এই সংগ্রাম সেইভাবে দেখি না। এটা বিচ্ছিন্নবাদী আন্দোলন, না এটা জাতীয় স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম তা বিচার হবে কোন মাফকাঠি দিয়ে? কোন জনসমষ্টি হোমোজিনিয়াস নেশন অর্থাৎ একিভূত জাতি হিসাবে গড়ে ওঠার পর সেই জাতি থেকে জাতীয় স্বার্থবিরোধী সন্কীর্ণ স্বার্থের জন্য যখন একটা অংশ বিচ্ছিন্ন হবার উদ্দেশ্য আন্দোলন করে তখন সেটাকে বলা হয় সিসেসনিস্ট মুভমেন্ট। যেমন ঘটেছিল আব্রাহাম নিন্কনের সময় আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ অঞ্চলে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের জনসাধারণ একটি জাতি হিসেবে গড়ে উঠেছিল। সেখানে দাসপ্রথা রাখার অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ প্রতিক্রিয়াশীল দাবিতে দক্ষিণ অঞ্চলের কিছু লোক জাতীয় রাষ্ট্র হতে বিচ্ছিন্ন হতে চেয়েছিল। তাই সেটা ছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী বা সিসেসনিষ্ট মুভমেন্ট। বাংলাদেশের মানুষ আর পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে এক জাতীয়তাবোধই গড়ে ওঠেনি। পাকিস্তানী পিপল ডিড নত ডেভেলপ এজ এ মোর্মোজিনিয়াস নেশন। কি জীবনধারার দিক থেকেই দেখুন, কি ভাষার দিক থেকেই দেখুন, এক জাতি মানসিকতা থেকে বলা হয়ে থাকে ওয়ান নেশন সাইকোলজিক্যাল মেকআপ হুইচ কনস্টিটিউটস দি মেন ফ্যাক্টর ইন দি ফরমেশন অফ এ নেশন। তার কোনটাই পাকিস্তানের উভয় খন্ডের জনশাধারণের মধ্যে এক ও অভিন্ন নয়। এক ন্যাশনাল সাইকোলজিক্যাল মেকআপ পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের এবং বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। এটা হয়ত কালক্রমে গড়ে উঠতি যদি উভয় খন্ড পরস্পর সংলগ্ন হত। তখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ ন্যাশনালিটি কর্তৃক সংখ্যালঘিষ্ঠ ন্যাশনালিটির উপর জাতীয় নিপীড়ন থাকত এবং তার জন্য বিক্ষোভও থাকতো যেমন আমাদের দেশে আছে। কিন্তু পাকিস্তানে তা নয়; যেখানে দুই খন্ডের মধ্যে ফারাক ১২০০ মাইল। যখন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা বর্তমান বাংলাদেশের মানুষের উপর শোষন চালিয়েছে তাই যখন যেটা বাংলাদেশের মানুষের কাছে রূপ নিয়েছে একটা কলোনিয়েল এক্সপ্লয়টেশন, অর্থাৎ ঔপনিবেশিক শোষণ হিসেবে এক জাতি কর্তৃক ভিন্ন জাতিকে শোষন করা হিসাবে। এক জাতীয়তাবোধ ও মানসিক গঠন না গড়ে ওঠার ফল। বাংলাদেশের মানুষ তাই বারবার অনুভব করেছে যে, তাঁরা পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকচক্রের দ্বারা ঔপনিবেশিক শোষন ও শাসনে ভুগছে। সেই বোধ থেকেই নতুন বাংলাদেশের জাতীয়তাবোধের জন্ম এবং সেই কারনে জাতীয় স্বাধীনতার জন্য তাঁরা সংগ্রাম করছে। সেই সংগ্রাম এই কারনেই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন; সেটা হচ্ছে স্ট্রাগল ফর কমপ্লিট ন্যাশনাল ইন্ডিপেন্ডেন্স অর্থাৎ পূর্ণ জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রাম। উত্থাপিত প্রস্তাবে সে বক্তব্য রাখা হয়েছে। এই সত্য যেন আমরা না ভূলে যাই। ভূলে গেলে এর গুরুত্ব আর বৈশিষ্ট্য বুঝতে পারব না। আর তা ঠিকভাবে বুঝতে না পারলে এই সংগ্রামের প্রতি আমাদের যে কর্তব্য তাও আমরা করতে পারব না।

একথা ঠিক যে, ভারতবর্ষ বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার সব মানুষ এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বাংলাদেশের সংগ্রামকে দেখছে না। কারও কারও মনে উঠিতে অয়ারে এই দুই বাংলা হোক এবং সেই কারনে তাঁরা বাংলাদেশের সংগ্রামের সমর্থক। কেউ কেউ মনে করতে পারে পাকিস্তান দুর্বল হোক এবং সেই মানসিকতার জন্য তারা বাংলাদেশের সংগ্রামকে সমর্থন করতে পারে। তবে আমি বলব যে এইভাবে ভাবলে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার সংগ্রামকে  আমরা শক্তিশালী করার বদলে দুর্বলই করব। বাংলাদেশের মানুষ বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলাকে যুক্ত করে আবার একটা অখন্ড বাংলাদেশ গড়ার জন্য লড়ছে না। তাঁরা এক জাতির মানসিকতা নিয়ে একটা স্বাধীন সার্বোভৌম জাতীয় রাষ্ট্র স্থাপন করার জন্যই সংগ্রাম করে চলছে। এ বোধ ও দাবি ভারতীয় জাতীয়তাবোধের প্রোডাক্ট নয়। একটি নতুন জাতি প্রতিষ্ঠা লাভের সংগ্রাম। আমাদের সঙ্গে মিলে অখন্ড বাংলা গড়ার জন্য তাঁরা লড়ছে না।

আমি কিছু কিছু সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় ও চিঠিপত্রের স্তম্ভ দেখেছি দুই বাংলা এক হোক, এই স্লোগান এখন দেওয়া হচ্ছে। এটা দেওয়া উচিত হবে না। আমার কথাকে ভুল বুঝে কেউ যেন না ভাবেন যে আমি দুই বাংলা এক হোক তা চাই না। নিশ্চয়ই চাই। তবে তা পারার পথ কি, তার পদ্ধতি কি হবে? তার পদ্ধতি কি হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে দুর্বল করা? নিশ্চয় না। কোন সুদূরভবিষ্যতে দুই বাংলা এক হতে পারে, এখন নয়। ভবিষ্যতে যখন আমাদের দেশে ও বাংলাদেশে উভয় দেশেই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম হবে তখন উভয় দেশের মানুষ স্বেচ্ছায় যদি দুই বাংলাকে এক করতে চায় কেবলমাত্র তখন দুই বাংলা এক হবে। তাঁর আগে দুই বাংলার এক হবার সম্ভাবনার কণামাত্রও নেই। আর উভয় দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলেই যে এটা হবে তাও না। জাতীয় মনোভাব ও জাতীয় রাষ্ট্রের সামজিক স্তর অতিক্রম করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা গড়ার পথেই তা সম্ভব হবে। একথা যদি আমরা আমাদের দেশের মানুষকে বোঝাতে পারি তাহলে আমি মনে করি যে, উভয় বাংলা এক হোক এই স্লোগান তোলার দ্বরা পাক সরকারের হাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাবার একটা হাতিয়ার তুলে দেওয়া হবে। তা যেন আমরা না করি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আমরা সাহায্য কতদূর কি করেছি তা নিয়ে বিতর্কে অবকাশ আছে, তবে তাঁদের সংগ্রামের কোন ক্ষতি যেন না করি। এ আবেদন আমি এই বিধানসভার মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে রাখতে চাই।

মাননীয় স্পীকার মহাশয়, আপনি জানেন যে, আরও কতগুলি প্রশ্ন এখানে উঠছে। আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্য করতে চাই। আমরা কি চাই আমাদের প্রস্তাব তা আছে। বাংলাদেশে যে সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র এবং তাঁর সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাঁকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত কিনা প্রশ্ন উঠেছে। আমি মনে করি ভারত সরকারের অবিলম্বে এই স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। কোন দেশ স্বীকৃতি, কোন দেশে সংগ্রামকে কি বলছে সেটা নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাবার প্রয়োজন নেই। ভারত সরকার কি করছেন সেটাই আমাদের বিচার্য বিষয় হওয়া দরকার। ভারত সরকার যদি স্বীকৃতি দিতে না চান বা গড়িমসি করেন তাহলে তার কঠোর সমালোচনা করা উচিত এবং ভারত সরকার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য করা উচিত। আমি কংগ্রেস পক্ষের বন্ধুদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে, এই প্রস্তাবে স্বীকার করা হয়েছে যে, ভারত সরকার ঠিকমত চলছেন না এবং আমরা প্রস্তাবে তার সমালোচনাও করেছি। এতোদিন হয়ে গেল তবু কেন ভারত সরকার সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ও তার সরকারকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন না? এখানে কেউলেউ চীনের সমালোচনা করেছেন। আমি মনে করি চীনের সমালোচনার বদলে  ভারত সরকারের সমালোচনা করা উচিত। ভারত সরকার ভারতবাসীর কাছে দায়ী, ভারতবাসীকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য। ভারতবাসীরা চায় বাংলাদেশের সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ও তাঁর সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়া হোক। ভারত সরকার তা দিছেন না কেন? কি অন্তরায় আছে? ইন্টারন্যাশনাল না? আন্তর্জাতিক আইন? তাতে তো স্বীকৃতি দিতে বাধা নেই। ভূ খন্ড, জনসংখ্যা ও একটি সরকার হলেই আন্তর্জাতিক আইন একটি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে পারেন। এইসব বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আছে। আন্তর্জাতিক আইনেও যখন আটকায় না তখন ভারত সরকার স্বীকৃতি দিচ্ছেন না? কেন অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য দিচ্ছেন না ভারত সরকার? বলা হচ্ছে যে, অস্ত্রশস্ত্র দিইয়ে সাহায্য দিলে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়তে হতে পারে। কথাটাও ঠিক নয়, আপনাদের চোখের সামনে কি উদাহরণ নেই? স্পেনে যখন গৃহযুদ্ধ চলছিল তখন সারা বিশ্বের গণতান্ত্রিক মানুষ স্পেন দেশের গণতান্ত্রিক মানুষকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য অস্ত্রশস্ত্র, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, ইন্টারন্যাশনাল বিগ্রেডঃ কি পাঠায়নি? ভারত সরকারেরও যদি সত্যিকারের ইচ্ছা থাকে সাহায্য করার তাহলে তাঁরা পারেন না এই কাজ করতে? চীন কোরিয়াইয় মার্কিন আক্রমণ ঠেকাতে সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী পাঠায়নি? ভারত সরকার যদি সত্য সত্যি =ই সাহায্য করতে চাইতে তাহলে তুলে দিতেন না দেশের মানুষের হাতে অস্ত্র? যে আর্মস এক্ট দিয়ে গোটা জাতিকে নিবীর্য পঙ্গু করে রেখেছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা সেই অস্ত্র আইন চালু রেখে আজও জাতিকে পঙ্গু করে রাখা হচ্ছে না? সেই ঘৃণা আইন তুলে নিয়ে মানুষের হাতে অস্ত্র দিয়ে আওয়াজ তুলুন তোমরা স্বেচ্ছাসেবক হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্য করতে চলে যাও। দেখবেন হাজারে হাজারে স্বেচ্ছাসেবক যাবে। একেই বলে সক্রিয় সাহায্য করা। আমার মনে হচ্ছে ভারত সরকারের এই ব্যাপারে একটা কিন্তু আছে। এই কিন্তু অবিলম্বে দূর হওয়া দরকার যদি সত্যিকারের আমরা সাহায্য করতে চাই।

কিছু কিছু সমালোচনা এসে পড়ে। সরকার পক্ষের সদস্যরা ইন্দিরা শোড়কাড়েড় প্রগতিশীলতার কথা বলছেন। কিন্তু আমাদের দল বিশ্বাস করে না যে, ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস বা সরকার প্রগতিশীল। আমাদের স্থির স্বিদ্ধান্ত যে তিনি একটা প্রগতিশীলতার মুখোশের অন্তরালে থেকে ভারতবর্ষে ফ্যাসীবাদ কায়েম করার চেষ্টাই করছেন। আমরা সমাজ বিজ্ঞানের ভিত্তিতে এই স্বিদ্ধান্তে এসেছি। তার জন্য ভারত সরকারের ব্যাবহারে নানা উল্টাপাল্টা জিনিষ দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের সংগ্রামের প্রতি মৌখিক সমর্থন কিন্তু কার্যক্ষেত্রে উল্টো ব্যাবহার – তার একটা প্রমান। যে সরকার বাংলাদেশের জন্য এত চোখের জল ফেলেও অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছেন না সেই সরকার কিন্তু সিঙ্ঘলে অস্ত্র পাঠাতে বিলম্ব করেননি। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সৈনিকদের অস্ত্র দিতে পারেন না। এটা ভন্ডামি নয়? ভিয়েতনামের মানুষ যেখানে স্বাধীনতার জন্য অতুলনীয় লড়াই করেছে সেই জায়গায় মানুষের সমর্থনে না এসে দক্ষিন ভিয়েতনামে যে মার্কিন পদলেহী সরকারআছে তার কাছে মোটর, ট্রাক ও আরও নানারকম সামরিক উপকরণ বিক্রয় করতে অনুমতি সেই সরকারই দিয়েছেন। এমনটা কেন হয়? হয় এই কারনে যে, ফরেন পলিসি ইজ আফটার অল দি প্রজেকশন অফ দি হোম পলিসি। যদি অভ্যন্ততীন নীতি প্রতিক্রিয়াশীল হয় তাহলে বৈদেশিক নীতিতে তা প্রতিফলিত হবেই। পুজিবাঁদকে শক্ত করাই যেখানে অভ্যন্তরীন নীতি সেখানে বৈদেশিক নীতি প্রগতিশীল হয় না। এই ভারত সরকারের এই ভাব। ভারত সরকার যে সাহায্যের কথা মুখে বলছেন এর একটা বিশেষ উদ্দ্যেশ্য এবং এক বিশেষ শ্রেণীর দৃষ্টি ও স্বার্থ নিহিত আছে, যে শ্রেণী শাসক ভারতীয় পুঁজিপতি শ্রেণী। এটা যেন আমরা না ভূলে যাই। আর উদ্দ্যেশ্য হল, মৌখিক দরদ দেখিয়ে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করা। সে যাই হোক, আমরা দেখেছি যে বাংলাদেশের আন্দোলনের গোড়ায় স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল না। প্রথমে মুজিব নেতৃত্বে চেয়েছিলেন প্রভিন্সিয়াল অটনমি উইদিন পাকিস্তান- পাকিস্তানের মধ্যেই পূর্ব প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন। যখন সে দাবি স্বীকৃত হল না, তখন এই দাবী পাকিস্তানের সামরিক চক্র মানল না বাধ্য হয়েই বাংলাদেশের মানুষ অসহযোগ আন্দোলন শুরু করল এবং সেই শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলনও বিশ্বের ইতিহাসে এক নজির সৃষ্টি করেছিল। গান্ধীজীর নেতৃত্বে ভারতবর্ষে অশযোগ আন্দোলন হয়েছিল। কিন্তু সে আন্দোলনও এত ব্যালক রূপ ধারন করে নাই। মোট জনসংখ্যার তুলনায় সামান্য লোকই তাতে অংশগ্রহণ করেছিল; সর্বস্তরের মানুষ এতে যোগ দেয়নি। আর বাংলাদেশে দেখলাম সমস্ত স্তরের সাধারণ মানুষ শুধু নয়, সেখানকার পুলিশ, সেখানকার সীমান্ত রক্ষী বাহিনী, সেখানকার আমলাতন্ত্র এমনকি সেখানকার হাইকোর্টের জজরা পর্যন্ত এই অসহযোগ আন্দোলনে নেমে গেল, গোটা জাতি এই আন্দোলনে নেমে গেল। সেই আন্দোলনের তুলনায় ভারতবর্ষে গান্ধীজীর নেতৃত্বে পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলন নিঃসন্দেহে ম্লান। এমন অসহযোগ আন্দোলন পৃথিবীর আর কোথায়ও হয় নাই। তারপর তাতেও যখন হল না তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ বাধ্য হলেন সশস্ত্র সংগ্রামের পথে নামতে যখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তাঁদের উপর আক্রমণ শুরু করল, যুদ্ধ তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হল। যুদ্ধ মাত্রই খারাপ না। যারা প্যাসিফিস্ট বুর্জোইন ইলিউশনে ভূগেন তাঁরা যুদ্ধ মাত্রকেই ঘৃণা করেন। কিন্তু যুদ্ধ মাত্রই খারাপ নয়, এ ওয়ান মে আনিজাস্ট ওয়ার অফ এগ্রেশন, অর এ জাস্ট ওয়ার অফ ন্যাশনাম ইন্ডিপেন্ডেন্টস, এ জাস্ট ওয়ার ফর ইনম্যানসিপেশন অফ পিপ্ল ফ্রম সর্টস অফ এক্সপ্লয়টেশন অফ ম্যান বাই ম্যান।

ঘৃণা করতে হবে অন্যায় যুদ্ধকে, বিরোধিতা করতে হবে অন্যায় যুদ্ধকে, সমর্থন করতে হবে ন্যায় যুদ্ধকে। বাংলাদেশের মানুষ যে সংগ্রাম করছে, আমাদের এই প্রস্তাবে আমরা রেখেছি তা জাস্ট ওয়ার ফর ন্যাশনাল ইন্ডিপেন্ডেন্স। জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ন্যায় যুদ্ধ। একে সমর্থন করতেই হবে আমাদের পশ্চিম বাংলার মানুষকে, পৃথিবীর সমস্ত স্বাধীনতাকামী শান্তি আসতে পারে এই যুদ্ধবাজদের হীন চক্রান্ত পরাস্ত করে।

পাকিস্তানী সামরিক চক্র বাংলাদেশে যে কাজ সেটা যুদ্ধ নয়, গণহত্যা-জিনোসাইড। আন্তর্জাতিক আইনেও যা অপরাধ। কিন্তু এ কথাটা যেন না আসে যে, পাঞ্জাবী বিরুদ্ধে বাঙ্গালীরা লড়ছে বা বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবীদের বিরুদ্ধে লড়ছে। লড়ছে স্বাধীনতাকামী দেশপ্রেমিক মানুষ ফ্যাসিস্ট সামরিক চক্রের বিরুদ্ধে। এখানে ধর্ম, বর্ণ উপজাতি প্রভৃতির প্রশ্ন আসে। তাই মাননীয় স্পীকার মহাশয়, আমার বক্তব্য পরিস্কার। যে প্রস্তাব আমরা রেখেছি সেটা যে ন কাগুজে প্রস্তাবে না হয়। আর কাগুজে প্রস্তাবে যদি আমরা না করতেই চাই আমি আশা করব কংগ্রেস দলের সদস্যরাও আমাদের বিরোধী পক্ষের সদস্যদের সঙ্গে মিলে ভারত সরকারের উপর চাপ দেবেন। আমি মনে করি ভারত সরকার আজ পর্যন্ত মৌখিক সহানুভূতি ছাড়া বিশেষ কিছুই করেন নি। নৈতিক সমর্থন নিশ্চয় করতে হবে, কিন্তু তার দিন দীর্ঘদিন গত হয়েছে। আজকে স্বাধীনতা সংগ্রামকে অস্ত্র দিলে মেটিরিয়াল হেল্প বাস্তব কার্যকরী সাহায্য দেওয়া দরকার। এ লড়াই তাড়াতাড়ি শেষ হবে না। এ সংগ্রামকে জনযুদ্ধ হতেই হবে তাঁকে সফল হতে হলে; যার একদিকে সংগঠিত সশস্ত্র সেনাবাহিনী অন্যদিকে জনসাধারণ। এই জনযুদ্ধ স্থায়ী হতে বাধ্য। এই সংগ্রাম মদদ দিতে হলে আমাদেরও সেইভাবে সাহায্য দেবার দরকার আছে। ভারত সরকারকে যদি বাস্তব কার্যকরী সাহায্য দিতে বাধ্য করতে না পারি তাহলে আমরা কর্তব্যচ্যুত হব। এই প্রস্তাবে পশ্চিম বাংলা সরকার এবং মানুষকে সে কথা জানানো হয়েছে। একথা যেন মুখের কথা না হয়, এটা যেন কার্যকরী আন্দোলনে রূপ নেয়। সরকারপক্ষের সদস্য ও সরকার এবং সমস্ত মানুষকে এই অনুরোধ আমি করছি। আন্দোলন গড়ে তুলতে এ রাজ্যের মানুষকে আমি আহবান জানাচ্ছি।

শ্রী সামসুদ্দিন আহমেদঃ মাননীয় স্পীকার মহাশয়, আজকে বাংলাদেশের উপর মাননীয় মূখ্যমন্ত্রী যে প্রস্তাব এনেছেন সেই প্রস্তাবে আমি সর্বান্তঃকরণে সমর্থক করে দু-একটি কথা বলতে চাই। স্যার, আমার কনস্টিটিউয়েন্সি একেবারে সীমান্তে অবস্থিত, তার নাম কালিয়া চক। এই কনস্টিটিউয়েন্সির ভেতর আমি নিজের চোখে দেখেছি অনেকগুলো শিবির সেখানে খোলা হয়েছে। এই সমস্ত শিবিরে ঘুরে এবং জিজ্ঞাসাবাদ করে যে বিবরণ আমি পেয়েছি তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ঐ জঙ্গী শাসকগোষ্ঠী কি রকম অমানুষিকভাবে স্বাধীনতাকামী তথা গণতন্ত্রের বাহক বাঙ্গালী জনসাধারণের কন্ঠরোদ করতে কি অত্যাচার চালাচ্ছেন তার বিবরণ যারা এসেছেন তাদের কাছ থেকে আমি শুনেছি। এসব কথা বলতে গিয়ে তাঁরা অঝোরে কেঁদেছেন। স্বামী স্ত্রী হতে, শিশু মা হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে এখানে এসেছেন। হয়তো স্বামী রয়ে গিয়েছেন বাংলাদেশে, স্ত্রী কোন প্রকারে চলে এসেছেন আমাদের পশ্চিম বঙ্গে। এ রকম করুণ বিবরণও আমি পেয়েছি।

আমি এই প্রসঙ্গে বলতে চাই যে, গণতন্ত্রে বিশ্বাসী আমরা এবং গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সেই শাসনের অধীনে বহুদিন থাকার পর নানারকম অনাচার, অত্যাচার সহ্য করার পর বাংলাদেশ তথা পূর্ব বাংলার জনমুখ উচ্ছসিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল। সুযোগ পেয়েছিল নির্বাচনে মাধ্যমে এবং তার জবাব জনসাধারণ দিয়েছিল। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী আমরা এবং গণতন্ত্রের মাধ্যমে আমরা বলতে চাই যেমন পৃথিবীর মানুষ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে শান্তিতে এখন নিজের কথা চিন্তা করতে পারছে। তাদের মুখ থেকে শুনে আজ একথা বলতে চাই, তাদের অনেক এম এল এ, এম পি-র সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে এবং তাদের কাছ থেকে যে বিবরণ পেয়েছি এবং অনেকে পেয়েছেন, আমার বিশ্বাস তাঁরা যে লড়াই করছে সে লড়াই তাঁরা করতে চায়নি সশস্ত্রভাবে। তাঁরা চেয়েছিল অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে, শান্তির মাধ্যমে গণতন্ত্রের মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসন, যাতে তাঁরা নিজেদের কথা নিজেরা চিন্তা করতে পারে সেইরকম সুযোগসুবিধা নেওয়ার কথা তাঁরা চিন্তা করেছিল। কিন্তু আমরা জানি এবং খবরের কাগজ থেকে দেখেছি এবং তাদের কাছ থেকে শুনেছি যে নেতা মুজিবুর রহমান যে প্রস্তাবগুলি রেখেছিলেন সে বিষয়ে আলোচনা করার অভিনয় করার জন্য জঙ্গীশাহী ইয়াহিয়া সাহেব এসেছিলেন এবং তার সারেদ ভূট্টো সাহেবও এসেছিলেন। তারপর আলোচনা চলতে চলতে হঠাৎ ভূট্টো সাহেব অন্তর্হিত হলেন এবং ইয়াহিয়া সাহেবও অন্তর্হিত হলেন এবং তার বদলে রেখে গেলেন- কি রেখে গেলেন? রেখে গেলেন সশস্ত্র ঐ সৈনিকদের যারা শিশু, মাতা, স্বামী, পুত্র সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলী করে মারল। সবচেয়ে দুঃখের কথা সেখানে যারা শিক্ষক, শিক্ষিত সমাজ এবং যারা ছাত্র যারা যুবক, যারা আইনবিদ, যারা বৈজ্ঞানিক, যারা ইঞ্জিনিয়ার, সবাইকে তারা গুলী করে মেরেছে। তাদের এক একটা করে ধরে শ্যুট ডেড করেছে। কোন প্রশ্ন নেই, কোণ ট্রায়াল নেই, তাদের গুলি করা হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীর মুখ থেকে শোনা কথা যে, যাকে সন্দেহ করা হয়েছে রাস্তার উপর তাঁকে গুলী করে মারা হয়েছে। যাকে সন্দেহ করা হয়েছে ছাত্র তাঁকে গুলী করা হয়েছে। এমনকি আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে সন্দেহ হয়েছে যাকে যাকে, তাঁকে গুলী করে মারা হয়েছে। সাধারণ মানুষ, সবাই তো আর পার্টির সমর্থক নয়, প্রতিটি মানুষ তো পার্টির সভ্য নয়, তাঁরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে তাদের নিজেদের মত ব্যাক্ত করেছিল। এই রকমভাবে তাঁরা বলি হয়েছে সেই জঙ্গী শাসনে কাছে। আমার বক্তব্য হচ্ছে, আমরা প্রবনতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এই আইনসভায় অনেক কথা বলে চলেছি। অনেক প্রশ্ন উঠেছে, অনেক সন্দেহের কথা উঠেছে। কিন্তু আমার মনে একটা প্রশ্ন জেগেছে যে প্রশ্নটা এখানে উত্থাপন করতে চাচ্ছি মাননীয় স্পীকার মহাশয় আপনার মাধ্যমে। আমরা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যা দেখতে পাচ্ছি তা সকলেই জানেন যে, ইয়াহিয়া খান মদদ কোথা থেকে পাচ্ছে, কোন কোন দেশ অস্ত্র সাহায্য দিচ্ছে। আজকে দেখতে পাচ্ছি যে, গ্রামদেশে ছোট ছোট ছেলেরা মুজিবের লাল সেলাম বলছে, জয় বাংলা লাল সেলাম বলছে। কিন্তু আজকে বিরোধী দলের নেতা যিনি এখানে উপস্থিত আছেন তাঁকে আমার স্বঅনুরোধ জানাচ্ছি এবং তাঁকে দয়া করে বুঝতে বলছি, আজকে ইয়াহিয়া খান এই নিরপরাধ জনসাধারণকে অস্ত্রের দ্বারা গুলী করে হত্যা করছে তাঁকে লাল সেলাম কে জানাচ্ছে? জানাচ্ছে চীন। চীন আজকে মদদ জানাচ্ছে ইয়াহিয়া খানকে। তাই আমি বিরোধী পক্ষের নেতাকে অনুরোধ করছি যে, তিনি দয়া করে চীনের নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তিদের অনুরোধ করুন যাতে ইয়াহিয়া খানকে মদদ দেওয়াটা বন্ধ করেন। সর্বশেষে আমি এই প্রস্তাবকে সর্বান্তঃকরনে সমর্থন করে আমার বক্তব্য শেষ করছি।

শ্রী সুধীন কুমারঃ মাননীয় অধ্যক্ষ মহাশয়, যে প্রস্তাব মাননীয় সদস্য শ্রী অজয় মুখোপাধ্যায় আমাদের হাউসে পেশ করেছেন এবং সেটা আমাদের সদস্য শ্রী জ্যোতি বসু সমর্থণ করেছেন সেই প্রস্তাব সম্পূর্ণ সমর্থন করে আমি কয়েকটি কথা আপনাদের সামনে পেশ করতে চাই। আমাদের এই হাউসে অনেকে খুব উৎসাহের সঙ্গে বলছেন যে, এত বড় গণসমর্থন ইতিপূর্বে খুব কম দেশেই দেখা গেছে সেখানে আন্দোলন শুরু হবার পর থেকে এত ব্যাপক এবং এত ঐক্যবদ্ধ সমর্থন আন্দোননের পিছনে আছে। এখানে আরো অনেক তর্কের কথা উঠেছে। কিন্তু সেই তর্কের অবসান ঘটবে যদি আমরা আন্দোলনে ইতিহাসটুকু একটু দেখি। এই আন্দোলন হঠাৎ শুরু হয়হয়নি। নির্বাচনের উৎসাহের কথা আমাদের প্রস্তাবে দেওয়া আছে। কিন্তু সেই নির্বাচনের আগে দীর্ঘ ২০ বছরে সংগ্রামের ইতিহাস পূর্ব পাকিস্তানের আছে। ১৯৪৮ সালের প্রথম দিন থেকে যেদিন জিন্না সাহেব ঢাকায় গিয়ে ঘোষনা করলেন যে, পাকিস্তানে একটি মাত্র ভাষা হবে, সে ভাষা হবে উর্দু ভাষা সেদিন থেকে পূর্ববাংলার গণআন্দোলন এটাকে স্বীকার করে নেয়নি। তাঁরা বুঝেছিল যে, তাদের নিজস্ব স্বকীয়তা চাপিয়ে দেবার প্রচেষ্টা পাকিস্তানের শাসক শ্রেণী করছেন এবং সেদিন থেকে আন্দোলনের নানা দিক প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪৮ সালে ভাষার ব্যাপারে আমরা আন্দোলনের ইতিহাস দেখেছি। ১৯৫০ সালে যে কৃষক আন্দোলন হয়েছিল, আমাদের এই হাউসে তার একজন অন্যতম নেতা উপস্থিত আছেন এবং তাদের আহবানে রাজশাহী জেলে যে গুলী চলেচিল সেই গুলী খাওয়া মানুষ এখনও আমাদের এই হাউসে উপস্থিত আছেন। গত হাউসে আর একজন ছিলেন যিনি ঐ আন্দোলনের নেতা ছিলেন। ১৯৫২ সালে সেই আন্দোলনে ১৩ জন ছাত্র এবং শ্রমিকদের মধ্যে কিঞ্চিত নিহত হয়েছিলেন। তারপরে ওরা প্রথম নির্বাচন করতে বাধ্য হয়। সেই সীমাবদ্ধ ক্ষমতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ভোটাধিকারের মধ্যে নির্বাচন হয়। কিন্তু নির্বাচন হলে কি হবে- যে সরকার তখন গঠিত হয়েছিল, সেই সরকার বুঝতেন যে, চলতে দেওয়া হবে না এবং সেই নির্বাচনে- যে মুসলিম লীগের কথা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, গণআন্দোলনের ফলে পূর্ববাংলার ইতিহাস থেকে তারা মুছে গেছে। সেদিন সেখানে জয়যুক্ত হয়েছিল যুক্তফ্রন্ট, যে যুক্তফ্রন্টের মধ্যে সম্মানীয় ফজলুল হক সাহেব ছিলেন এবং আরো অন্যান্য নেতারা ছিলেন। এবং কৃষক শ্রমিক বাঁচার জন্য যে গভর্নমেন্ট গঠন করেন তাঁকে চলতে দেওয়া হয়নি, সেই কুখ্যাত সেকশান ৯২ ব্যাবহার করে তাঁকে বাতিল করে সেই গভর্নমেন্টকে ভেঙ্গে দিয়ে ইস্কান্দর মির্জাকে পাঠিয়ে সেখানে স্বেচ্ছাচারী শাসন কায়েম করেছিল। তার পরবর্তী ইতিহাস হচ্ছে ১৯৫৬ সালে সাধারণ নির্বাচন- তারপর সমস্ত পাকিস্তানে এই প্রথম সাধারণ নির্বাচন হয়েছে এবং সেখানে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে। মুসলিম লীগের সে চেহারা ছিল না এবং আতাউর রহমান সেখানে চীফ মিনিষ্টার হয়েছিলেন এবং ফজলুল হক সাহেব গভর্নর হয়েছিলেন। পরবর্তী ইতিহাস আপনাদের স্মরণে আছে যে কেমন করে সেখানে গভর্নমেন্ট ভেঙ্গে দিয়ে ভাসানী সাহেব, আবদুল গফফর সাহেব তাঁদের জেলে পাঠানো হয় এবং কেমন করে সেখানে গভর্নমেন্ট ভেঙ্গে দেওয়া হয়। তারপর ১৯৬২ সালে সেখানে ছাত্ররা আন্দোলন করেছিলেন কুখ্যাত এডুকেশন রিপোর্ট বাতিল করার জন্য এবং তখন থেকেই গণতন্ত্র ও স্বাধিকারের দাবীতে ঢাকার রাস্তায় আন্দোলন শুরু করেছিল। এবং তারই সেই প্রতিবাদের চেহারা দেখে আয়ুবশাহী সেখানে নতুন কনস্টিটিউশন  এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং প্রতিশ্রুতি দিয়ে আবার গণতন্ত্রের নামে তার সেই তথাকথিত গণতন্ত্র, সেটা বেসিক ডেমোক্রেসি তাঁরা বলতেন, তাঁরা সেইটা দিয়ে চালাবার চেষ্টা করেছিলেন, পুরো গণতন্ত্র দেন নাই, সীমাবদ্ধ গণতন্ত্র দিয়েছিলেন তাই চালাবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে বিশেষ করে পূর্ববাংলায় গণআন্দোলন তীব্রভাবে দেখা দিয়েছিল। সেই আন্দোলনের ইতিহাস বেয়ে ১৯৬৩ সালে ইতিপূর্বে সিক্স-পয়েন্ট প্রোগ্রাম ইনিসিয়েট করেন অল্প দিনের মধ্যেই সেই ছ-পয়েন্ট ধরে তাঁদের ১১ দফা সাবী তাঁরা তুলে ধরেছিলেন। এই দীর্ঘ ইতিহাসের পরিণতি আজ পূর্ব বাংলায় বিরাট গণআন্দোলন তথামুক্তি আন্দোলন সেখানে শুরু হয়েছে। সুতরাং এটা হঠাৎ ঘটেনি। একজন ব্যাক্তির নেতৃত্বে হঠাৎ নির্বাচনে জয়ের ভেতর দিয়ে এটা ঘটেনি। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে রক্ত দিয়ে আমাদের বাংলাদেশের দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্য বহন করেছেও, এ পারে বন করে নতুন গণতান্ত্রিক আন্দোলন ভারতবর্ষ সৃষ্টি করেছিল ওপারেও তাঁরা সেই ঐতিহ্য বহন করেছে, স্বাধীনতাএ জন্য লড়াই করেছে, যেমন আমরা লড়েছিলাম। তাঁরা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বাধীনতার লড়াই এর জন্য অগ্রসর হয়ে এসেছিলেন। সেইজন্য আমরা দেখেছি এটা বিরাট আন্দোলনের চেহারা। দিত্বীয়ঃ এই আন্দোলনে একটা জিনিস এসেছে- ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করেছে। এই ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে লড়াই-এর চেহারা আর একটা টেনে নেওয়া দরকার- ন্যাশনাল কোশ্চেন সেখানে এখন আবির্ভূত হয়েছে। শোষনের ইতিহাস এই আচরণের মধ্য দিয়ে এখানে এসেছে। আমি সেটা এখানে তুলে ধরতে চাচ্ছি। পূর্ববাংলার অধিবাসীদের তারা জাতিগতভাবে কিভাবে অপেশান করছে, এক্সপ্লয়েট করেছে তাঁরা তার একটি বিবরণ দিয়েছেন। রাজস্ব খাতে ব্যায় যেখানে এক হাজার পাঁচ শো কোটি টাকা সেখানে পশ্চিম পাকিস্তান রাজস্ব খাতে ব্যায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। উন্নয়ন খাতে বাংলাদেশে ব্যায় তিন হাজার কোটি টাকা আর পশ্চিম পাকিস্তানে হচ্ছে ছয় হাজার কোটি টাকা। বৈদেশিক বাণিজ্যের আয় আসে শতকরা ২০ ভাগ বাংলাদেশে আর শতকরা ৮০ ভাগ যায় পশ্চিম পাকিস্তান। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরির শতকরা ৮৫ ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের অধিকারে আর শতকরা মাত্র ১৫ জন বাংলাদেশের অধিবাসী পায়। সামরিক বিভাগের শতকরা ৯০ জন পশ্চিম পাকিস্তানী আর মাত্র ১০ জন বাংলাদেশের লোক। চালের দাম যেখানে ৫০ টাকা বাংলাদেশে সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানে ২৫ টাকা। আটার দাম পশ্চিম পাকিস্তানে যেখানে ১১৫ টাকা, বাংলাদেশে সেখানে ২৫ টাকা। সরিষার তেল বাংলাদেশে হচ্ছে ৫ টাকা আর আড়াই টাকা হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানে। সোনার দাম বাংলাদেশে ১৭০ টাকা আর পশ্চিম পাকিস্তানে সেই সোনার দাম ১৩৫ টাক এবং এই যে বৈষম্য তাঁরা তুলে ধরেছেন, এই যে জাতিগতভাবে তাঁদের উপর বৈষম্য দেখানো হচ্ছে- এই যে পক্ষপাতদুষ্ট সরকার এবং তার অত্যাচারের যে কাহিনী সেটা আরও অনেকে বলেছেন তার পুনরাবৃত্তি আমি করতে চাই না- সেই জন্য সেখানে এই জাতীয় প্রশ্ন এসে গেছে। যে জাতীয় প্রশ্ন আমাদের দেশে সেইভাবে নেই এবং এই জাতীয় প্রশ্ন থাকার জন্য সেখানে এই বিরাট সমর্থন দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস এবং এই অবস্থায় আমরা আজ তাঁদের সমর্থন  জানাতে গিয়ে যে সমস্ত কথা বলেছি, আমরা আশা করি যে, যদিও উভয় পক্ষ থেকেই বলছি, তারা যা যে উদ্দ্যেশ্য নিয়েই বলে থাকুন আশা করা যায় আগামী দিনে তার পরীক্ষা তাঁরা নিবেন। আগামী দিনে, যারা আজ এখানে প্রতিবাদ করেছেন, তাঁরা সমর্থন আনান। তাঁরা বাস্তব পত্রে তার পরিচয় দেবেন, কিন্তু এখন পর্যন্ত বা আজকে উঠেছে বলে উল্লেখ করার দরকার এবং যেটা আমাদের কর্তব্য, এখানে গভর্নমেন্ট পক্ষের সমস্ত দল এটা সমর্থন করেছেন, কিন্তু আমি যতদূর জানি যে গভর্নমেন্ট পক্ষের অন্ততঃ মুসলিম লীগের, যাদের ওখানে সে ভূমিকা। সেই ভূমিকা থেকে তাঁরা নিজেদের যদি পৃথক করতে চান, নিশ্চয় সেই অধিকার তাঁদের আছে এবং এটাকে সমর্থন করছে, আমি আশা করি তাঁদের ভূমিকা কোথায়, সেটা জানাবার জন্য, বাংলাদেশের যে একটিমাত্র মিশন আমাদের দেশে আছে, সেই মিশনে গিয়ে এরা তো তাঁদের সমর্থন জানিয়েছেন বলে শুনিনি। আমরা তো শুনিনি তাঁদের পক্ষে এই আন্দোলনে বাংলাদেশের সংবাদ আছে, মিটিং এর ক্ষেত্র আছে, বিরাট ময়দান আছে- অনেকেই তো সমর্থন জানিয়েছেন প্রকাশ্যে কিন্তু ওদের পক্ষ থেকে কাউকে তো সেই বিরাট আন্দোলনকে অভিনন্দন জানাতে শুনিনি। সেটা যদি আজও না শুনে থাকি কালকে যদি তার পরিচয় দেন তাহলে আমরা খুশি হব। কিন্তু সেই পরিচয় আমরা পাইনি। সেই জন্য এই হাউসের সামনে যদি আমাদের সকলের কর্তব্য স্মরণ করার সঙ্গে এটাও আমরা মনে করি যে, সরকার পক্ষ থেকে যখন এত অকুন্ঠ সমর্থনের কথা বলা হচ্ছে, তখন যে মুসলিম যোদ্ধার গাড়ি নিয়ে এসেছে এখানে, সেই গাড়ি কেন এসডিও বাজেয়াপ্ত করেছে সামান্য রেশন কার্ড চাইবার জন্য, তাঁরা আমদের এই হাউসের সদস্য গভর্নমেন্ট নেতাদের কাছে গেছেন, তাঁদের বলা হয়েছে দরখাস্ত করুন, মশারি চাওা হয়েছে যে সমস্ত যুবক সেখানে থেকে লড়ে এসেছে গায়ে ক্ষত আছে, যারা হাঁসপাতালে আছে তাঁরা কিছু সাহায্য চেয়েছে, তাঁদের বলা হয়েছে দরখাস্ত কএউন। একজন একটা সরকারী হাসপাতাল থেকে পরশুদিন আমার কাছে টেলিফোন করেছিলেন যে, তার ব্যাবহার্য একটু সাবানও তাঁরা পাননি। আমাদের সেটুকু যোগান দিতে হবে। সরকারী সদিচ্ছার প্রমান এর মধ্যে দিয়ে পাওয়া যায় না, যদি তা প্রমান করতে হয় তাহলে তার ব্যবস্থাতেও করা উচিত। প্রস্তাব ভাল জিনিষ, কিন্তু প্রস্তাবের সঙ্গে তার ব্যবস্থা নেবার দায়িত্ব আশা করি মূখ্যমন্ত্রী যিনি এই প্রস্তাব রেখেছেন তিনি লক্ষ্য রাখবেন। শেষ পর্যন্ত যদি কেন্দ্রীয় সরকার না মানেন- এখানে এই হাউসে আহবান করা হয়েছে যে, যেন বাংলাদেশে যে গণআন্দোলন চলছে কেন্দ্রীয় সরকারকে তাঁরা যেন চাপ দেন এবং বাধ্য করেন যাতে আমাদের দাবী মেনে নেন। সেখানে আমরা সেই সততার পরিচয় দিতে বলবো যে, যদি ধর্মঘট করার প্রয়োজন হয়, যদি বাংলাদেশের সাধারণ ধর্মঘট করার প্রয়োজন হয় বাংলাদেশের মানুষ গণআন্দোলননের মাধ্যমে যেভাবে তাঁদের মতামত প্রকাশ করতে এবং রায় দিতে অভ্যস্ত সেই পথ যদি নিতে হয়, আশা করবো যে, সরকার পক্ষের সমস্ত দল যারা আজকে এই প্রস্তাবে পক্ষে, তারাও সেই সাধারণ ধর্মঘটে তাদেরো সমর্থন জানিয়ে, আজকের এই প্রতিশ্রুতির পরিচয়স্বরূপ রাখবেন।

শ্রী সংকর ঘোষঃ মাননীয় স্পীকার মহাশয়, আজকে যে প্রস্তাব মূখ্যমন্ত্রী করেছে তা আমি সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করছি। বাংলাদেশে যে আন্দোলন হচ্ছে, সেই আন্দোলনের নজীর ইতিহাসে নাই এবং এই যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, এই আন্দোলনের মাধ্যমে মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে একটা গণতান্ত্রিক সমাজবাদী ব্যাবস্থা করতে চেয়েছিলেন।

মুজিবুর রহমান প্রথমে সহস্ত্র বিলবের কথা ভাবেননি। মুজিবুর যখন আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন তখন তিনি অসহযোগ আন্দোলন করেছিলেন। পাকিস্তানে তখন কোন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিল না। মুজিবুর রহমানকে তাই গণআন্দোলন করতে হয়েছিল, তাতে আয়ুব খাঁ ক্ষমতা হারায়। তারপর ইয়াহিয়া খাঁ আসেন এবং সেই গণআন্দোলনের জন্য ইয়াহিয়া খাঁকে নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিতে হয়। সেই নির্বাচনে মুজিবুর রহমানের দল বাংলাদেশে ১৬৯ টি আসনের ভেতর ১৬৭ টি আসন পায়।

এত বড় বিরাট জয় নির্বাচনের ইতিহাসে কোন দিন হয়নি। এর কারন আছে। মুজিবুরের যে সংগ্রাম সেই সংগ্রাম সর্বাত্বক ছিল। সেই সংগ্রাম কেবলমাত্র অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, রুটিরুজির সংগ্রাম ছিল না, কেবলমাত্র পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম ছিল না, সে সংগ্রাম সাংস্কৃতিক সংগ্রাম ছিল, যে সংগ্রামের ভিত্তি ভাষা আন্দোলন ছিল এবং সেই সংগ্রাম সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক সংগ্রামের সমন্বয়। তারই জন্য বাংলাদেশ একটা অভূতপূর্ব একতা দেখা যায়। এই জন্য মুজিবুরের সংগ্রামকে সর্বস্তরের মানুষ সহায়তা করল। আজকে আমরা মুজিবুরের সংগ্রাম থেকে যে শিক্ষা লাভ করেছি সেটা হল এই যে, যে দেশে গণতন্ত্র নেই সেখানে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের কথা আসে।

আমাদের ভারতবর্ষের ব্যবস্থা সম্বন্ধে অনেক বক্তা বলেছেন যে, এখানে ফ্যাসিজম রয়েছে, গণতন্ত্র নেই। আমি বলব তাঁরা বাস্তব অবস্থার ভিত্তিতে কথা বলছেন্না। মুজিবুর বাংলাদেশে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তিনি আশা করেছিলেন যে, সামরিক সরকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবেন। মুজিবুর বাংলাদেশে প্রথমে স্বাধীনতা ঘোষনা করেননি, সশস্ত্র বিপ্লবের পথ নেননি। ২৫শে মার্চ যখন মুজিবুরের দলকে বেআইনী ঘোষনা করা হল, মুজিবুরকে দেশদ্রোহী বলা হল তারপর মুজিবুর সশস্ত্র সংগ্রামের কথা বললেন। সুতরাং মুজিবুরের আন্দোলন থেকে একথা আসে যে, সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া কোন পথ নেই, সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। মুজিবুর প্রথমে অসহযোগ আন্দোলন করেছিলেন এবং আশা করেছিলেন যে এই অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে গণতন্ত্র স্থাপিত হবে।

আমাদের ভারতবর্ষে চতুর্থ সাধারণ নির্বাচনের পর এই বাংলাদেশে কংগ্রেস সরকার পরাজিত হয়েছিলেন এবং যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করেছিলেন। তার জন্য কোণ সশস্ত্র অভ্যুত্থানের দরকার হয়নি, সেটা সংবিধানের ভেতর দিয়ে হয়েছিল। সেই যুক্তফ্রন্ট সরকার যখন এলেন তখন তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল, তাঁদের সংখ্যা ছিল ২১৮। এত বড় সংখ্যাগরিষ্ঠতা কোন সরকারের ছিল না। এই যুক্তফ্রন্ট সরকার যখন এলেন তখন কংগ্রেস দল তাঁদের বাধা দেয়নি, কোন রক্তপাত হপয়নি, বোমা, পিস্তল ছোঁড়া হয়নি।

এবারেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার এলেন গণতান্ত্রিক পথে। সুতরাং আজকে এই, গণতন্ত্র হত্যার কথা উঠেছে সেই হত্যা কারা করছে সেটা একটু অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বিবেচনা করুন, বাস্তব অবস্থার দিকে তাকিয়ে দেখুন।

অত্যন্ত দুঃখের কথা এই যে, এই প্রস্তাব সমর্থনের ভিত্তিতে সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ হয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম প্রস্তাবটা সর্ববাদীসম্মতভাবে এসেছে, এর ভেতর কোন বিভেদ, আক্রমণ, সমালোচনা থাকবে না। কিন্তু আমরা দেখতে পেলাম বাংলাদেশের কথা ছেড়ে অনেক কথা এখানে হয়ে গেল। সুতরাং এই যে বাংলাদেশ, এই বাংলাদেশের কথাই আমি বলতে চাই। এই বাংলাদেশের গণহত্যা বন্ধ করার জন্য এই সভা যে প্রস্তাব এনেছে তাকে সমর্থন করে আমি এই কথা চাই যে, এই গণহত্যাকে ধিক্কার দেওয়া হয়েছিল রাষ্ট্রসংঘে ৯ই ডিসেম্বর ১৯৪৮ সালে। তখন রাষ্ট্রসংঘে একটা প্রস্তাব আনা হয়েছিল গণহত্যাকে বেআইনী ঘোষণা করে এবং তাতে একথাও বলা হয়েছিল যে, দেশে গণহত্যা চলবে রাষ্ট্রসংঘের অধিকার থাকবে যে সে দেশের গণহত্যা বন্ধ করবার জন্য ব্যাবস্থা নেওয়ার এবং সে প্রস্তাব যখন পেশ করা হয়েছিল তখন পাকিস্তানের যে সদস্য ছিলেন তিনি সেই প্রস্তাব বিশেষভাবে সমর্থন করেছিলেন এবং রাষ্ট্রসংঘের সেদিনের সভায় তিনি অনেক করতালি পেয়েছিলেন। সুতরাং পাকিস্তান বলছে যে, বাংলাদেশের যে গণহত্যা চলছে, জেনোসাইড চলছে তাতে রাষ্ট্রসংঘের কোন এখতিয়ার নেই হস্তক্ষেপ করার সেটা তার স্ববিরোধী। রাষ্ট্রসংঘের চ্যাপ্টার-সেভেনে আছে যে, সেখানে যুদ্ধের আশংকা রয়েছে, শান্তি বিঘ্নিত হবার আশংকা রয়েছে, সেখানে রাষ্ট্রসংঘ ব্যাবস্থা নিতে পারেন। সুতরাং আমি আমরাশা করি রাস্ট্রসংঘ দেরীতে হলেও এ ব্যাপারের প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নেবেন। আমরাও আশা করি যে, ভারত সরকার তাঁদের স্বীকৃতি দিবেন। দুঃখের বিষয়, লালচীন যে পিপল ও লিবারেশনের কথা বলে তাঁরা বাংলাদেশের পিপলের লিবারেশনের জন্য বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির জন্য একবারও এগিয়ে এলেন না।

শ্রীরাম চ্যাটার্জিঃ স্পীকার মহাশয়, আজ বাংলাদেশে পূর্ব বাংলায় যে স্বাধীনতা সংগ্রাম সেই মুক্তি সংগ্রামকে পুরোপুরি সমর্থন করতে গোটাকতক কথা বলবো। পূর্ব বাংলা আমার রক্ত আমার খুন, আমার প্রাণের বাংলা। সেখানে বাঙ্গালীরা লড়ছে, তাঁরা মরছে, তার মাথা নত করছে না মুক্তির জন্য। নাড়ীর যোগ আছে, রক্তের যোগ আছে তাঁদের সাথে। সাথে সাথে আছে নাড়ীর সম্বন্ধ। ওই যে পূর্ব বাংলার মানুষ করাচীর একটা কলোনীতে পরিনত হয়েছিল, ব্যাথায় ব্যাথায় মানুষ সেখানে নিষ্পেষিত হচ্ছিল। বলবো, হে পূর্ব বাংলার মানুষ, সমব্যাথী হিসাবে এখানকার এই পশ্চিম মানুষ দিল্লীর কলোনিতে পরিণত হয়েছে। পাঁচ শত কোটি টাকা এখান থেকে সমস্ত নিয়ে যাচ্ছে, মাত্র ৫০ কোটি টাকা দিয়ে দিচ্ছে। আর আমরা চাতক পাখির মতো ‘হা, হা, হা’ করে চেয়ে থাকি। আমাদের আকাশে বাতাসে কি দেখি? আমরা প্রতিনিধি হয়ে এসেছি, যখন নির্বাচিত হয়ে যাই, নির্বাচিত প্রতিনিধি গিয়ে কি দেখে, না খেয়ে মানুষ কুঁকড়ে পড়ে আছে, বিক্ষোভ আর বিক্ষোভ। চারদিকে বিক্ষোভ দেখছি, শুনছি, আরও দেখছি। হিমালয় থেকে নেমে এসেছে একদিকে গঙ্গা, আর একদিকে পদ্মা। পদ্মায় যে কারেন্ট রয়েছে, সেই কারেন্ট চলেছে পূর্ববাংলাকে বিধৌত করে, আর আমাদের গঙ্গায় চরা পড়ে গিয়েছে। সেই পদ্মায় বান ডাকবে, সেইদিন যারা নির্মম্ভাবে আমাদের উপর অত্যাচার করে যাচ্ছে তারা টিকবে না, ওই কারেন্টে ভেসে যাবে, আমাদের সরকারের সাহস হবে না। চীনের কথা বলবো না, রাশিয়ার কথা বলবো না, আমি এ দেশের মানুষ, ভারতবর্ষের কথা বলবো। আমার সরকার কি করছে? সাথে মানে প্রশ্ন জাগে, প্রশ্নয়টা হচ্ছে এই, কেন অস্ত্র দিচ্ছে না? কারন লুঙ্গি পরা মানুষগুলো, চাষী –মজুর তাঁরা একসাথে লড়ছে। তাঁদের হাতে অস্ত্র পড়লে না জানি কি হয়। পূর্ব বাংলা মুক্ত করে হয়ত সেই মানুষ এগিয়ে আসবে সেই অস্ত্র নিয়ে। এটা সন্দেহ জাগছে মনে। এটা কি সত্য? এতদিন হয়ে গেল। রেডিও মারফত চারদিকে আওয়াজ, কান্নার আওয়াজ, গানের আওয়াজ। ক্ষুদাতুর শিশু চায় না কিন্তু খালি দুটো ভাত, একটু নুন। কিন্তু সেখানকার মানুষ চায় অস্ত্র, বুলেট। কারণ তাঁরা চাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানী যারা তাঁদের উপর অত্যাচার করছে তাঁদের হাত থেকে বাঁচতে চায়। কিন্তু আমরা এখানে ত্রান করছি- তাঁদের আমরা ত্রানকর্তা নই। তাঁরা বলছে, আমাদের মুক্তির জন্য অস্ত্র দাও। আমাদের অভ্যাস আছেরিলিফ দেওয়া কিন্তু রিলিফ চায় না, অস্ত্র চায়, কিন্তু তা দেওয়া হচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের জনসাধারণ কত সুন্দর। বাচ্চা ছেলে দুলিটার নিয়ে যাচ্ছে কোথায়, না গাছতলায়, কেউ আবার জলখাবার থেকে দু’খানা কাপড় কিনে যাচ্ছে। কিন্তু আজকে পূর্ববাংলার অধিবাসীদের বলছি, মীর জাফরের দল রয়েছে- ঐ মুসলিম লীগ- যে দে উইল স্ট্যাব ফ্রম ব্যাক। আমরা জানি পশ্চিম ও পূর্ববাংলার আকাশে-বাতাসে বেঈমান ছড়িয়ে আছে- এসেম্বলী হাউসের ভিতরে কি বাইরে চারদিকে বেঈমান ছড়িয়ে আছে। তাই বলছি হুঁশিয়ার হয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা এক কথায় নিশ্চয়ই সমর্থন করবো ভারত সরকার তাঁদের যা কিছু সশস্ত্র সাহায্য দিক এবং সাথে সাথে আমাদের অপোজিশন থেকে স্বেচ্ছাসেবক এগিয়ে যাবে রক্ত দান করার জন্য, আমার নিজের এক্সপিরিয়ান্স হচ্ছে, আমরা নিজেরা গিয়েছিলাম ডাইরেক্টর অব মেডিকেল কলেজের কাছে, ১০-১৫ হাজার লোক দরকার রক্ত দেবার জন্য। কিন্তু তিনি বললেন ৫০ জনের বেশি নিতে পারি না, কারন আমাদের রক্তে নাকি দোষ হয়ে গেছে। অর্থাৎ আমাদের রক্ত গেলে যদি সেটা বিরুদ্ধে যায়, কারণ আমাদের রক্তে গেলে নাকি দোষ হয়ে গেছে। আজ আপনারা যে হাসছেন এ হাসি মিলিয়ে যাবে। কিছুদিন আগে আমি পাড়াগাঁয়ে গিয়েছিলাম সেখানে একজন বুড়ি বললে যে, তোমাদের দেশের লোক সব মাতাল হয়ে আছে। আগে একটা বোতল ছিল তাতে কিংকং মার্কা ছবি ছিল। সেটা একটা বিশ্রী ভদ্রলোকের ছবি ছিল বলে চলছিল না, সেজন্য তাঁরা সে বোতলে একটা ভাল ছবি দিল এবং লোকেও সে খেয়ে নিল। কিন্তু তাতে ভারতবর্ষের বেশিরভাগ আদিবাসীর নেশা কেটে গেল। তাই আজকে বুঝতে পারবেন এ ইন্দিরা মার্কা বোতল খেয়ে লোকের নেশা একদিন কেটে যাবে এবং সেদিন বুঝতে পারবে কোনটা কি? এটাই হবে চোলাই মদের জবাব। এই বলে আমি এইটাকে সমর্থন করছি।

শ্রী বিশ্বনাথ মুখার্জিঃ মাননীয় ডেপুটি স্পীকার মহাশয় যে প্রস্তাব এখানে উত্থাপন করা হয়েছে আমি তাঁকে সমর্থন করে সোজাসুজি এই প্রস্তাবের মূল কথা সেটা সম্বন্ধে বলতে চাই। আমরা এই বিধান সভায় ভারত সরকারের কাছে দাবী করছি যে, “ অনতিবিলম্বে বাংলাদেশে সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ও তাহার সরকারকে স্বীকৃতি এবং অস্ত্রশস্ত্রসহ সর্বপ্রকার প্রয়োজনীয় কার্যকরী সাহায্য দিতে হইবে। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ নরনারী যখন বুকের রক্ত দিতেছেন, তখন পশ্চিমবঙ্গের জনগণ ইহার কমে কিছুতেই রাজী হতে পারেন না। ” তা আজকে আমরা সকলেই একমত যে, আমরা বাঙ্গালী সেইজন্যই নয়, আমরা সকলেই মানি যে, বাংলাদেশের লড়াই তাঁদের জাতীয় স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের লড়াই, প্রগতির লড়াই। পৃথিবীর যে- কোন দেশে গণতন্ত্র, প্রগতি এবং স্বাধীনতার লড়াই, এবং তাঁদের ভারতবর্ষের স্বাধীনতাকামী, প্রগতিশীল জনসাধারণ চিরদিন সর্বান্তঃকরণে তাকে সমর্থন করেছে আর এ তো আমাদের পাশে, শুধু নয় আমাদের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক আছে, সুতরাং আমাদের সকলে মিলে এখানে এই চেষ্টাই করা দরকার যে, কি করে এটা সফল হয় এবং যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি সফল হয়। যত লক্ষ লক্ষ লোক সেখানে মরছে। প্রাণ দিচ্ছে, আরো হয়ত অনেক দিতে হবে এবপং যত বেশী তাঁকে সাহায্য করা সম্ভব, যত তাড়াতাড়ি তাঁরা জিততে পারে সেটাই আমাদেরসকলের কাম্য। আমাদের সকলেই উদ্বিগ্ন যে, ওখানে কোটি কোটি মানুষের অভ্যুত্থান তাঁকে সামরিক শাসকচক্র অস্ত্র দিয়ে দমন করছে, তবু সেখানে নিরস্ত্র মানুষ যেটুকু অস্ত্র পেয়েছে তা দিয়ে তাঁরা বীরের মতো লড়ছে, আমরা উদ্বিগ্ন এই জন্য যে আমরা এত বড় রাষ্ট্র তার পাশে রয়েছি আমরা এই স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রকে স্বীকার করছি না কেন? আমরা এই সার্বভৌম রাষ্ট্রের জনগন যাতে জয়যুক্ত হতে পারে তার জন্য  যথেষ্ট সাহায্য দিতে অগ্রসর হচ্ছি না কেন? আমি বলছি না যে কিছুই সাহায্য দেওয়া হচ্ছে না। ভারত সরকার নানাভাবে সাহায্য সমর্থন জানিয়েছেন, সাহায্য হয়তো কিছু কিছু দিচ্ছেন কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ উদ্বিগ্ন এই জন্য যে, যথেষ্ট সাহায্য দেওয়া হচ্ছে না। দিতে হবে এবং একথা ঠিক যে, শুধু চাল ডাল পাঠানোই নয়, ঔষধ কিছু দরকার হতে পারে, কিন্তু প্রধান সাহায্য তাঁরা চাচ্ছে অস্ত। যত লোক এসেছে, ফিরে গিয়েছে বা এখনও এখানে আছে, সকলের কাছ থেকে আমরা শুনছি যে আমাদের অস্ত্র দাও, বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি দাও। এই সূত্রে আমি একটা কথা বলতে চাই, এই রকম লড়াই যখন হয় তখন বেছে মানুষ লড়ে না, তখন ব্যাপকভাবে মানুষ লড়তে চায় এবং তার সম্প্রদায় যাই হোক, তার রাজনৈতিক মতবাদ যাই হোক, সে যদি স্বাধীনতার জন্য লড়ে তাহলে তাঁকে লড়তে সাহায্য করতেই হবে। পূর্ব পাকিস্তানের, এখন বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি তাঁরা প্রকাশ্যে আহবান জানিয়েছে ওখানকার স্বাধীনতার যুদ্ধে সমস্ত স্বাধীনতাকামী দলের মোর্চা গঠনের এবং সেখানে আমাদের এ কর্তব্য নয় যে, কার কি রাজনৈতিক মত সেই বেছে সাহায্য করা। সেখানকার মানুষ যারা লড়ছে, লড়তে চায় এবং লড়বার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে, তাঁদের সাহায্য দিতে হবে। অবশ্য সেখানে গভর্নমেন্ট আছে, গভর্নমেন্টকে আমরা সাহায্য করবো, গভর্নমেন্টকে স্বীকার করবো, তার মারফত সাহায্য দেবো তাতে কোন কোন সন্দেহ নেই কিন্তু আমাদের গভর্নমেন্টের তরফ থেকেও বলা উচিত, পাকিস্তানের দলমত নির্বিশেষে সমস্ত স্বাধীনতাকামী যোদ্ধা যেন ঐক্যবদ্ধভাবে লড়তে পারে, যাতে তাড়াতাড়ি জয়যুক্ত হতে পারে। একটি কথা উঠেছে যে, আমরা যদি স্বীকৃতি দিই তাহলে যুদ্ধ হবে কিনা, ঠিক কথা। পাকিস্তানের সামরিক চক্র তাঁরা যেকোন প্ররোচনা দিতে পারে। একথাও ঠিক যে, পৃথিবীর বৃহৎ রাষ্ট্রের মধ্যে এক সোভিয়েত ইউনিয়ন তার রাষ্ট্রপতি পদর্গনি, তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির কাছে প্রতিবাদ করে হোক, দাবী জানিয়ে হোক, একটি চিঠি দিয়েছেন।

পাকিস্তান – এর সামরিক চক্র হয়তো কোন কোন বৃহৎ রাষ্ট্রের সমর্থন বা পেতে পারে কিন্তু তাই থেকে ভয় দেখানো হচ্ছে যে, যুদ্ধ বেজে যাবে। যুদ্ধ বেধে যাওয়া অত সহজ কথা নয় আজকালকার আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে কিন্তু আমি বলবো যে, সেই আশংকাতে আমরা স্বীকৃতি দেব না, অস্ত্র দেব না এবং নিরস্ত্র মানুষকে এইভাবে হত্যা করা চলবে, আর সেখানে যারা বীর যোদ্ধা তাঁদের বুলেট নেই, তাঁরা লড়বে, এইভাবে কতদিন চলতে পারে? আমি মনে করিয়ে দেব যে, ভারতেও ক্ষমতা আছে করাচী, লাহোরের উপর বোমা ফেলার কিন্তু আমি আপনাদের একটা কথা বলছি, আমাদের চেয়ে চেহারায় অনেক ছোট একটা রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক ভিয়েতনাম প্রজাতন্ত্র ভিয়েতনামের স্বাধীনতার যুদ্ধকে সাহায্য করেছে অস্ত্রশস্ত্র সব কিছু দিয়ে, তার জন্য পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ রাষ্ট্র পাকিস্তানের চেয়ে শত গুনে শক্তিশালী রাষ্ট্র  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুতা অর্জন করেছে এবং সমস্ত আন্তর্জাতিক নিয়মবিধি লঙ্ঘন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হ্যানয়ের উপর ভিয়েতনামের রাজধানীর উপর দিনের পর দিন বোমাবর্ষন করেছে। তার ফলে সেখানকার জনসাধারণ কি ভয় পেয়েছে? সেখানকার জনসাধারণ কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মাথা নত করেছে, সেখানকার গভর্নমেন্ট কি পিছু ছুটে এসেছে- একটু নয়। ভিয়েতনাম আমাদের তুলনায় অনেক ছোট কিন্তু সেই ভিয়েতনাম যদি দক্ষিন ভিয়েতনামের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহসের সঙ্গে সাহায্য করে থাকতে পারে তাহলে ভারতবর্ষ কেন পারে না? আমরা জানি কমিউনিষ্টদের নেতৃত্বে পরিচালিত সেই রাষ্ট্র সেখানকার।

জনগণকে যেভাবে ঐক্যবদ্ধ ও সংঘবদ্ধ করেছে তা ভারতবর্ষের পক্ষে সম্ভব নয়। বিরোধী নেতা জ্যেতিবাবু যখন বক্তৃতা করেন তখন তার মুখ থেকে আমি এ কথাটা শুনব আশা করেছিলাম কিন্তু নিশ্চয় করে বলতে পারি, এই আশ্বাস আমি ভারত সরকারকে দিতে পারি-সকলে দিতে পারি, সমস্ত পক্ষ থেকে দিতে পারি, বাংলাদেশের সমস্ত প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল দিতে পারে, সমস্ত জনসাধারণ দিতে পারে যেন স্বীকৃতি দাও, অস্ত্র দাও, কার্যকারী সাহায্য দাও, তারা লড়ুক, তাদের লড়বার যথেষ্ট লোক আছে, তারা লড়ুক, তারা জিতুক, তার জন্য কোন বিপদ যদি ভারতের উপর আসে। আমারা সকলে আমাদের অনান্য বিষয়ে যে কোন মতপার্থক্য থাক, আমাদের শ্রেণীবিভেদ আছে, শ্রেণীর সঙ্গে লড়াই আছে, বিরোধী দলের মতভেদ আছে, আমাদের মধ্যে সংঘর্ষ আছে কিন্তু আমাদের মধ্য যাইথাকুক না কেন, আমরা সকলে জোট বেঁধে দাঁড়াব এবং আমরা মোকাবিলা করব। আমি মনে করি যখন বিরোধী পক্ষ এবং সরকার পক্ষ উভয়ে মিলে এই প্রস্তাব একজোট হয়ে এনেছি তখন নিশ্চয় এই বিষয়ে আমরা একমত আছি এবং এই আশ্বাস আমরা দিতে পারি, এই বিষয়ে আশংকার কোন কারণ নেই। তেমনি জরুরী পরিস্থিতির যদি সৃষ্টি হয় তখন নিশ্চয় আমরা সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়াব তার সম্মুখীন হওয়ার জন্য। সেই বিষয়ে ভয় পাবার এবং পিছু হটবার কোন কারণ নেই। অনেক কথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্বন্ধে বলার আছে-অনেকেই বলেছেন, আমি সেই সবের পুনরাবৃত্তি করতে চাইনা, আজকের দিনে এতকথাশুনবার আমাদের অবকাশ নেই-আজকের দিনে যখন তারা লড়ছে, মরছে, যখন ওদিকে লক্ষ লক্ষ লোক মরছে, আবার লক্ষ লক্ষ লোক যখন পালিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে আমাদের এখানে তখন যে কথাটা সবচেয়ে জোরে সঙ্গে এই প্রস্তাবের মধ্য বলবার চেষ্টা করা হয়েছে, আমাদের আইনসভার উদ্বেগ, আমাদের পশ্চিম বাংলার জনগণের উদ্বেগ এবং অবস্থার জরুরীত্ব সম্বন্ধে জোর দিয়ে যে কথাটা তুললাম নিশ্চয় আমরা সকলে মিলে ভারত সরকারের উপর প্রয়োজনীয় চাপ দেব কিন্তু আমি চাপ দেওয়ার কথাটা বলতে গিয়ে বলছি আমরা এই আশ্বাস ও দেব যে, হ্যাঁ স্বীকৃতি দাও, সাহায্য কর, তার জন্য যে-কোন ঝামেলা আসুক, ঝক্কি আসুক, বিপদ আসুক আমরা সমস্ত দল সকলে মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে তার সম্মুখীন হব এই আশ্বাস আমরা দিচ্ছ। শ্রী সুশীলকুমার ধাড়া: মাননীয় উপাধ্যক্ষ, আজকে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মহাশয় যে প্রস্তাব এখানে উপস্থাপিত করেছেন তাকে সম্পূর্ণভাবে এবং আন্তরিকতার সঙ্গে সমর্থন জানাচ্ছি। আমি এই প্রসঙ্গে দু’চারটি কথা বলার সুযোগ নিচ্ছি, এবং সেই সুযোগ এই কথা বলতে চাই, ওপার বাংলায় যে সংগ্রাম হচ্ছে সেই সংগ্রামে লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের জীবন বলি দিয়েছে, সর্বস্ব হারিয়েছে এবং হারাচ্ছে। তাই আমাদের প্রাণ, আমাদের মন তাদের কাছে চলে গেছে। এই লক্ষ লক্ষ মানুষের আত্নাহুতির জন্য এপার বাংলার মানুষের একটা বিশেষ উদ্বেগ এবং আবেগ বোধ করছে সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। সারা ভারতবর্ষের মানুষের মধ্যে সেটা হয়েছে। সেটা যত বেশিই হোকনা কেন, এপার বাংলার মানুষের অনুভূতি সেটা কিনা তা বলতে পারিনা। এটা দেখা গিয়েছে অধিকাংশ বিধানসভার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে, সেই সংগ্রামকে সমর্থন করে এবং লোকসভায় ও প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে সর্বসম্মতিক্রমে। এর তিনটি মৌলিক কথা হচ্ছে সিমপ্যাথি, সাপোর্ট, সলিডারিটি। এই সিমপ্যাথি কি জন্য, যাতে তারা এই সংগ্রামে জয়ী হতে পারে, সাপোর্ট দিতে হবে এই জন্য যাতে তারা সংগ্রামে জয়ী হতে পারে। এবং বলার পর তারা আশ্বাস পেয়েছে এবং তারা মুখে মুখে একথা বলছে যে তাদের যা কিছু বল তা হচ্ছে ইন্ডিয়া এবং ইন্ডিয়া। তাই যদি হয় ইন্ডিয়া এবং ইন্দিরাকে আজ দেখতে হবে। একথা বলে আমি বলবো -আজকে লক্ষ লক্ষ মানুষ আসছে তাদের প্রকৃত যত্ন নেওয়া হচ্ছে না। সমস্ত প্রচেষ্টা সত্বেও। আমি বিভিন্ন সময়ে সহকারী কর্মচারীদের টেলিফোন করেছি, খুব ভাল যে সাড়া পেয়েছি তা মনে করিনা। সেই গতানুগতিক ধারায় জবাব দিয়েছে, আর কি করতে পারা যায়। এদের স্বাগত করেছি, রিফিউজি বলে মনে করিনা, এবং বলে দেওয়া হয়েছে তোমরা রিফিউজি নও, কিন্তু তাদের যেভাবে ব্যাবহার করা উচিৎ সেভাবে করছে না। তাদের এখানে থাকার যে ব্যবস্থা তা অপ্রতুল, স্বাস্থ্যর ব্যবস্থা অপ্রতুল, খাদ্যের ব্যবস্থাও অপ্রতুল। এমনও দেখেছি যারা এসেছে এপারে তাদের দুইদিন দেড় দিন পরে একটা মিল পেয়েছে। এটা উচিৎ নয়। এটা অবিলম্বে দেখা উচিৎ। এবং সঙ্গে সঙ্গে একথাও বলব মুক্তিফৌজের যেসব মানুষ এসেছে এপারে তাদের পরের দিন খাদ্যের দিতে পারিনি, এই খবর আমার কাছে আছে। এবং আরও অনেক ঘটনা আছে। আমি আজকে এই প্রস্তাব সমর্থন করে একথা বলতে চাই যে, কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে যে চাপ দেওয়ার কথা উঠেছে, তাতে যেন এই দাবী থাকে যে, অবিলম্বে অর্থের সংস্থান করুন যাতে কোন অবস্থায়ই কোন দ্বিধা বা সংকটে আনা পড়াতে হয়। এই যে স্রোতের মত লোক আসছে তাদের জন্য কতগুলি ব্যবস্থা যদি না করতে পারি তাহলে অন্যায় হবে, পাপ করা হবে, যে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, তা থেকে দূরে আসা হবে। এটা একটা গণতান্ত্রিক আন্দোলন অহিংস পথে হচ্ছে। আমাদের সুবোধবাবু একটা কথা উল্লেখ করেছিলেন। সেদিন ভারতবর্ষে যে স্বাধীনতার সংগ্রামে করেছিলেন তাঁরা অধিকাংশ রাজনৈতিক কর্মী।

আমার মনে হয় অনেক দিনের কথা বলে সুবোধবাবু হয়ত ভুলে গেছেন। সেদিন অসংখ্য কৃষক এই লড়াইয়ে সামিল হয়েছে এবং কৃষক রমণী মাতাঙ্গিনী হাজরা মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন। এ রকম অনেক উদাহরণ থাকলেও আজকে সেখানকার লড়াইয়ে তারা যে ত্যাগ, শৌর্য, বীর্যের উদাহরণ দেখিয়েছেন সেটা সত্যি ভারতবর্ষে মিলিবে না। আমি একদিন স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষুদ্র সৈনিক ছিলাম এবং মাতঙ্গিনী হাজরা আমার কাছে প্রণম্য। কিন্তু রোসেনারা বেগম শৌর্যে, বীর্যে মাতঙ্গিনী হাজরাকেও ছাড়িয়ে গেছে বলে আমি তাকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। জহরব্রতের কথা হয়েছে। পঞ্চাশটি ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেল থেকে লাগিয়ে পড়ে যেভাবে মরেছে তা অতুলনীয়। কাজেই আমি মনে করি সেখানে তারা জহরব্রতের চেয়ে বড় ব্রত উদযাপন করেছেন। আমি তাদের নেতৃবর্গের কাছে শুনেছি এ রকম হাজার হাজার সুইসাইডিয়াল স্কোয়াড তৈরি হয়ে রয়েছে যারা জীবন দিতে পারবে। কাজেই আজকে তাদের মদদ দিতে হবে। আজকে যারা এসছে তারা অস্ত্র, শত্রু চেয়েছে, তারা কেউ খেতে চায়নি। আমরা যদি খাদ্যের দিতে চাই সেটা আমরা পৌঁছে দিতে পারব না। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আছে, আমি তাদের কাছ থেকে নিজের শুনেছি একটি, ডাব খেয়ে দুই দিন যুদ্ধ করেছে, এতখানা আখ খেয়ে টানা তিনদিন যুদ্ধ করেছে, এর জন্য তারা তৈরি। তারা চায়, অস্ত্র, শত্রু, যুদ্ধের সরঞ্জাম। মুক্তিফৌজের জন্য যা প্রয়োজন তা যদি আমরা তাদের দিতে না পারি, তাদের যদি রিকগনিশন দিতে না পারি তাহলে কোন ফল হচ্ছে না এবং ঐগুলি পৌঁছান যাচ্ছেনা। আমি মনে করি, ভারত সরকার এই ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করছেন এবং ত্রতে কোন ফল হবে না। আমি আশা করি না আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার যারা জাতীয় সরকার বলে পরিচিত, তারা আর একটি জাতীয় সংগ্রামের জন্য পিছপা হবেন। ঝুঁকি আছে জানি। কিন্তু সেটা না নিয়ে অন্যদেশের অনুকরণ করা উচিৎ নয়। আমি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবী করেছি আমাদের পথ অন্যান্য দেশ অনুসরণ করুন এবং সেটা করাতে হলে অবিলম্বে তাদের স্বীকৃতি দেওয়া সরকার এবং তার সঙ্গে সঙ্গে যা কিছু প্রয়োজন তা পৌঁছে দেওয়া দরকার। এক প্রাণ, এক জাতি তারা গঠনে করতে পেরেছি। সেটা আমরা পারিনি। তারা ভাষা আন্দোলন করেছিল এবং বাংলাদেশের মাটিকে, বাংলাদেশের গানকে জাতীয়কে তারা যেভাবে গ্রহণ করেছে আমরা তা পারিনি। আমাদের সরকারি দপ্তরে আজকেও বাংলা ভাষা ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়নি। আমরা বিধানসভায় সিন্ধান্ত করেছিলাম, কিন্তু তা পারিনি। কিন্তু ওখানে গাড়ীর নম্বর ইংরেজি বা উর্দু ভাষার নয় বাংলায় লেখা। কাজেই দেখা হচ্ছে ওঁরা যা পেরেছেন আমরা তা পারিনি। ওখানকার মানুষ হিন্দু- মুসলমান, বৌদ্ধ খ্রিষ্টান, প্রভৃতি সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের উর্ধ্বে চলে গেছে। কিন্তু এখানে দেখছি এখনও সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত নি:শ্বাস ফেলা হচ্ছে। যা হোক, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার জন্য এবং সর্বপ্রকার সাহায্য করবার যে পথ আমরা নিতে চলেছি এই প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানিয়ে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি।

শ্রী শ্যামাচরণ মূর্মূ: মাননীয় অধ্যক্ষ মহাশয়, আজকে মুখ্যমন্ত্রী মহাশয় পূর্ববাংলা সম্বন্ধে যে প্রস্তাব এনেছেন আমি তাকে সর্বান্তকরণে সমর্থন করছি। আজকে হাউসে যে সমস্ত আলোচনা হল তা আমি সবই শুনলাম। আমি আজকে সমস্ত সদস্যের কাছে আবেদন জানাচ্ছি আমরা আমাদের নিজেদের সমস্ত রাজনীতি ভুলে গিয়ে পাকিস্তানের অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষরা খেয়ে পরে বাঁচার জন্য জঙ্গীশাহীর সঙ্গে যে লড়াই করছে তাতে তাদের সাহায্য করবার জন্য আমাদের প্রত্যক্ষভাবে নামতে হবে। এখন যদি আমরা কোন রকম

রাজনৈতিক কারচুপি নিয়ে খেলা করি তাহলে ভুল করা হবে। বড় বড় বক্তৃতার মাধ্যমে কোন কাজ হয় না। একতাবদ্ধ হয়ে আমাদের কাজ করে যেতে হবে। আজকে যে সেখান হাজার হাজার মানুষ মরছে সে সম্বন্ধে শুধু বক্তৃতা দিলেই হবে না। তাই আমি পশ্চিম বাংলা সরকার তথা ভারত সরকারকে অনুরোধ জানাচ্ছি এই সমস্ত মানুষের মানুষের মত বেচেঁ থাকার জন্য যা কিছু সাজ-সরঞ্জাম প্রয়োজন তা দিতে হবে। পশ্চিম বাংলার অধিবাসীরা এবং পূর্ব বাংলার অধিবাসীদের এক সময়ে ভারতবর্ষের মধ্যেই ছিলেন। মাহাত্না গান্ধী এবং জিন্নার ভুল বুঝাবুঝির জন্য হিন্দুস্থান এবং পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়। হয়ত মুসলমানেরা পাকিস্তানের মধ্য গেলে কত সুখ শান্তি উপভোগ করব। কিন্ত বাইশ তেইশ বছর পর তারা দেখল জঙ্গীশাহীর লোকেরা এখান থেকে সব জিনিস নিয়ে যাচ্ছে। এবারে তারা মুজিবুরের নেতৃত্বে গণতন্ত্রের জয়লাভ করলেন কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল জঙ্গীবাহিনীর কায়েমী সরকার তাদের বিলোপসাধনের জন্য চেষ্টা করছেন। শেষ পর্যন্ত মুজিবর বাধ্যহল যুদ্ধ ঘোষণা করতে। আমি হয়তো খুব বেশি বলতে পারছিনা এই কথা বলেই আমি তাদের পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছি। আর একটা কথা হচ্ছে ঐ যে পূর্ব বাংলায় যে সমস্ত মানুষ লড়াই করছে কি হিন্দু কি মুসলমান কি আদিবাসী কি সাঁওতাল -সমস্ত শ্রেণীর লোক আজ এক প্রাণ, একক জাতি হয়ে লড়াই করছে। কাজেই আমাদের এখানে কর্তব্য সমস্ত রকম বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে সর্বান্তকরণে সাহায্য করা এই বলে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি।

শ্রী গোবিন্দচন্দ্র মন্ডল:মাননীয় স্পীকার মহাশয়, আমি মুসলিম লীগ পার্টির চীফ হুইপের তরফ থেকে বলছি আমি (গোলমাল) স্যার ও’রা যেভাবে আমাকে সন্দেহ করছে সেটা ঠিক নয়। তা ছাড়া আমাদের দলকে সাম্প্রদায়িক দল বলে যা বলছেন সেটাও ঠিক নয়, এসব সম্পূর্ণ্য অসত্য কথা। কেননা আমি কেরলের অনুকরণে মুসলিম লীগে এসেছি………. (গোলমাল) স্যার না নাগাল না পেলে আংগুড় টক হয়ে যায়। এরা এখন মুসলমানকে সাম্প্রদায়িক বলছেন। কিন্ত এর আগে গোর্খা লীগকে বলেননি। তাছাড়া বর্তমানে ঝাড়খণ্ড দলকেও সাম্প্রদায়িক দল বলে করছেন না। তবে আপনার যাই বলুন, আমি আশা রাখি আগামী দিনে নির্বাচনোত্তর কেরলের মত আপনাদের উল্টো প্রমোশন হবে। …….(গোলমাল)

শ্রী বীরেন্দ্র নারায়ণ রায়: অন এ পয়েন্ট অব অর্ডার স্যার ………. মি:ডেপুটি স্পীকার :হোয়াট ইজ ইউর পয়েন্ট অব অর্ডার? শ্রী বীরেন্দ্র নারায়ণ রায়:স্যার আমার পয়েন্ট অব অর্ডার হল, আজকে বাংলাদেশের উপর সমর্থনে একটা পার্টকুলার রেজুলিউসানের উপর বিতর্ক হচ্ছে। কিন্তু মাননীয় সদস্য যা বলছেন তার সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই। ওর যদি এর উপরে কিছু বলার না থাকে তাহলে উনি বসে পড়ুন।

মি:ডেপুটি স্পীকার :ইট ইজ নো পয়েন্ট অব অর্ডার। লেট হিম স্পিক ইন হিজ ওন ওয়ে। শ্রী গোবিন্দচন্দ্র মন্ডল :মাননীয় স্পীকার মহাশয়, আজকে এসেম্বলিতে কোয়ালিশন গভর্নমেন্টের মুখ্যমন্ত্রী মহাশয় বাংলাদেশ সম্পর্কে যে প্রস্তাব এনেছেন তা আমি সর্বান্তকরণে সমর্থন করছি। শ্রী দেবী প্রসাদ বসু:স্যার যারা ইয়াহিয়ার সেই দাড়িওয়ালা মুসলমানকে বলতে বলুন। (গোলমাল)

শ্রী সুব্রত মুখার্জি:স্যার অবজেকশন দিচ্ছি। মাননীয় সদস্যকে এটাকে উইথড্র করতে হবে। আপনি উইথড্র করতে বলুন। গোলমাল মি:ডেপুটি স্পীকার :নো মেম্বার সুড মেক এনি স্টেটমেন্ট হুইচ এফেক্টস দি সেন্টিমেন্ট অব আর্দাস। ডা:জয়নাল আবেদীন :মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, অন এ পয়েন্ট অব অর্ডার। আপনি জানেন মুসলমানদের কিছু অবশ্য কর্তব্য আছে এবং আজকে যে উক্তি করলেন এবং বিরোধী দলের মাননীয় নেতা, উপনেতা এরা বসে আছেন, একটা ধর্মের উপর আঘাত করা হয় যেটা আমাদের ধর্ম বলে মনে করছি এবং সেটা গর্হিত বলে মনে করছি। মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, আজকে যে গুরুতর বিষয় অবতারণা করা হয়েছে, এটার এত বেশি গুরুত্ব যে আজকে এই টীকা টিপ্পনীতে মনোযোগ দেবার অবকাশ নেই। কিন্তু যে বক্তব্য উনি রেখেছেন, এটা গর্হিত বক্তব্য এবং এটা এখানে চলে না। আমি আপনাকে অনুরোধ করব যে, উনি যদি এই উক্তি প্রত্যাহার না করেন তাহলে এটা প্রসিডিংস থেকে এক্সপাঞ্জ করে দেবেন। এইটুকুই আমার সাব মিশন। মি:ডেপুটি স্পীকার :কোন সেনটেন্স এ- যদি অপর পক্ষের কারো সেন্টিমেন্টে কোথাও আঘাত লাগে এবং মনকষ্ট হয় তাহলে আমার মনে হয় এটা করা উচিৎ নয়। যদি কারো হয়ে থাকে তাহলে উইথড্র করা উচিৎ। শ্রী মনসুর হবিবুলস্না :মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশ্র, এই প্রসঙ্গে এখানে আলোচনা হবে কি? কার কিসে আঘাত লাগে, কে পার্টির নাম মুসলিম রাখে, কে হিন্দুমহাসভা করেন, তখন তার সেটা মনে রাখা উচিৎ পরে এটা নিয়ে সমালোচনা করা চলে না। (গোলমাল) তখন তাকে বুঝতে হবে, তখন মনে রাখা উচিৎ। কাজেই এখানে ঐ প্রসঙ্গে আলোচনা হবে না রেজলিউশন -এ আলোচনা হবে, এটা আগে ঠিক করুন….. শ্রী মতি গীতা মুখার্জি :মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, যে বিষয় এখানে আলোচনা হচ্ছে তার গুরুত্ব সমধিক নয়, হিন্দু -মুসলমানের দৃঢ়তম ঐক্যের ভিত্তিতে একমাত্র এখানে জয় সম্ভব। সে জন্য আশা করবো সকল পক্ষ থেকে যেন এই আলোচনার মধ্যে আর এই ধরণের কথা না হয় এবং প্রস্তাবের উপযুক্ত মর্যাদা থাকে। শ্রী দেবীপ্রসাদ বসু:স্যার, আমি মুসলিম লীগ সম্বন্ধে গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করে থাকি। তার কারণ, আমাদের ভিতরে প্রচুর মুসলমান সদস্য রয়েছে, কংগ্রেসের মধ্যে আছেন, অন্য দলের মধ্য আছেন। কারো সমন্ধে কোন মুহূর্তে আমি কটাক্ষপাত করিনি কোন ধর্ম সমন্ধে, এটা মাননীয় মন্ত্রী জয়নাল আবেদীন মহাশয় জানেন। আমি যেটি বলতে চেয়েছিলাম সেটা হচ্ছে গোবিন্দ মন্ডল মহাশয়কে দিয়ে মুসলিম লীগের বক্তব্য না রেখে মুসলিম লীগের একজন দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন সদস্য তিনি এই বক্তব্য রাখুন। তাতে নাম বলতে না পেরে তাড়াতাড়িতে আমি বললাম যে, যার মুখে দাড়ি রয়েছে তিনি উঠে বলুর। এতে যদি কেউ আঘাত পেয়ে থাকেন তাহলে আমি এই এই কথা প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। শ্রী রাধাগোবিন্দ বিশাল:মাননীয় অধ্যক্ষ মহাশয়, আজকে সরকার পক্ষ থেকে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সমর্থনে এবং স্বাধীনতার সমর্থনে তাদের সাহায্য দেওয়ার সমর্থনে সরকার পক্ষ থেকে যে প্রস্তাব উথথাপন করা হয়েছে তাকে সর্বান্তকরণে সমর্থন করে আমি দু-একটি কথা বলতে চাই। আমরা যারা এই প্রস্তাব সমর্থন করতে উঠেছি তাদের বক্তৃতার মধ্যে কেউ এই আন্তরিকতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, আবার অনেক সাম্প্রদায়িকতার উক্তিও হচ্ছে, আবার পশ্চিম বাংলার কেন্দ্রীয় সরকারের ঠিক অনুরুপভাবে জেহাদ করার কথা কেউ কেউ বলেছেন। আমি এইসবের মধ্যে না গিয়ে এই কথা বলতে চাই যে যে, বৃহত্তর স্বার্থের জন্য, মহৎ আর্দশ পালনের জন্য সীমান্তের ওপারে আমাদেরই ভাইবোন যারা আত্নত্যাকরেছেন, যারা সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন, তাদের কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখবার আছে। যেদিন আমাদের নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে আজাদ, হিন্দ ফৌজ গঠন করেছিলেন সেদিন এমনিভাবে এই বাংলাদেশের মত সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণ, ধর্ম, ভাষা ইত্যাদি সমস্ত কিছু বিভেদ অতিক্রম করে একটি মহত্ত্বের ঐক্য গড়ে উঠেছিল, আজকেপূর্ববাংলায় অর্থাৎ বাংলাদেশে তা সম্ভব হয়েছে। আমরা আজকে যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে নিরাপদ দূরুত্বে বসে অনেক তর্ক করতে পারি অনেক উৎসাহ দিতে পারি, অনেক রকম সমালোচনা করতে পারি, কিন্তু এই কথা মনে রাখতে হবে যে, প্রতিটি মুহূর্তে সেখানে জীবন যাচ্ছে, প্রতিটি মুহূর্তে সেখান জীবন কোরবানি হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং আমাদের আর এইসব তর্ক, বিতর্কের কোন অবকাশ নেই। যে সমস্ত মাননীয় সদস্য সর্বপ্রকার সাহায্য দেবার কথা বলেছেন, আমি তাদের সেই বক্তব্য কে অভিনন্দিত করি। আমাদের স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ করেই হোক, যেমন করেই হোক, অর্থ, রসদ, অস্ত্র-শস্ত্র ইত্যাদি দেবার দাবী যেমন সরকারের কাছে দেব তেমনি বেসরকারিভাবে আমাদের যা কিছু করণীয় আছে তাই আমরা করবো। আমাদের পক্ষ আজকে এটা সৌভাগ্যর বিষয় এবং গর্বের বিষয় যে, স্বাধীনতা সংগ্রামী, স্বাধীনতাকামী শান্তিপ্রিয় মানুষসমর্থনের বিষয়ে আমাদের বক্তব্য আমরা রাখছি এবং যতটা করা দরকার ততটা করার চেষ্টা করছি। ভারত সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ যে, এই প্রস্তাব নিশ্চয়ই কার্যকারী করতে হবে এবং যাতে তারা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি সত্বর লাভ করতে পারে এবং বাংলাদেশের এই নূতন সরকার আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মর্যাদা লাভ করতে পারে নিশ্চয় আমাদের সেই ব্যবস্থা করতে হবে। সাহায্য দিয়ে, ত্রাণের ব্যবস্থা করে, আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে সক্রিয়ভাবে যে ব্যবস্থা আমরা করতে যাচ্ছি সেটা কতদিন এই রকম চালিয়ে যেতে পারি তাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ এবং যত শীঘ্র সম্ভব বাংলাদেশের সরকার স্বীকৃতি লাভ করে আবার এই সমস্ত ঘরের মানুষ ঘরে ফিরে যেতে পারবেন তার ব্যবস্থা হতে পারে, সেই জন্যই আমাদের অবিলম্বে তাদের স্বীকৃতি দেওয়া উচিৎ। সেইজন্য আমাদের অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়া উচিৎ এবং এদের যুদ্ধে যাতে দ্রুত তারা সাফল্য লাভ করতে পারে, জয়যুক্ত হতে পারে তার জন্য প্রয়োজন হ’লে আমাদের যুদ্ধের মধ্যে যেতে হবে। আমরা যতঈ বৈষয়িক সমস্যায় জর্জরিত হই না কেন, এই সমস্যাকে আমরা কিছুতেই অবহেলা করতে পারিনা বা ফেলে দিতে পারিনা এবং দেখেও না দেখার ভান করতে পারিনা। বাইরের অন্যান্য বৈদেশিক রাষ্ট বাংলাদেশকে সরকারকে স্বীকৃতি দিতে দেরী করতে পারে কিন্তু আমাদের মোটেই দেরী করা উচিৎ হবেনা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হবে। আমরা বৈষয়িক স্বার্থের কথা, রাজনৈতিক স্বার্থের কথা ভাবতে পারি। কিন্তু আমাদের বোঝ উচিৎ এই রাষ্ট একদিন আমাদেরই অঙ্গছিল। আমরা যারা উনিশশত ছয়চল্লিশ সালের প্রত্যক্ষ সংগ্রামের দিনগুলি দেখেছি তা কখনো ভোলা যায় না। সেই দিনগুলি ছিল কি ভয়ংকর! কি রকম রক্তাক্ত অবস্থার মধ্যে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল। আজকে কালের করাল প্রবাহে দ্বিজাতিতত্ত্ব যে কত অসার ও অর্থহীন তা প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে। মানুষকে মানুষের ভাষার ঐক্য সামাজিক ঐক্য, সাংস্কৃতিক ঐক্যই ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারে। সীমান্তের ওপারে আমাদের ভাইবোনেরা নিরস্ত্র হয়ে যে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম করছে সশস্ত্র এক পাশবিক শক্তির বিরুদ্ধে তা তুলনাবীহিন। আমরা তাদের সেই যুদ্ধে সমর্থন জানাচ্ছি, আগেও জানিয়েছি, আজকে এই সভায় সরকার যে প্রস্তাব এনেছেন তা আমি সমর্থন করছি। এই প্রস্তাবে কার্যকরী করবার জন্য যা যা প্রয়োজন, তার সহায়তা করতে থাকবো। এই প্রস্তাব গ্রহণ করতে গিয়ে সসাম্প্রদায়িকতার ধুয়া ধরে যে কথাকাটাকাটি হল তা বাস্তবিকই খুব দুঃখজনক। মাননীয় সুবোধবাবু যে কথাবলেছিলেন তা অতি মর্মস্পর্শী। তিনি বহুদিনের সভ্য, লেজিসলেচারের ব্যাপারে তাঁর প্রচুর অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা রয়েছে। আমরা যারা নতুন নির্বাচিত হয়ে এসেছি, আমাদের এই হাউসের কাজকর্ম ভালভাবে দেখাদরকার, শেখা দরকার। আমরা যারা জনগণের দ্বারা প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়ে এসেছি, আমাদের উপর জনগণ গুরুতর দায়িত্ব দিয়েছে। সেই দায়িত্ব সম্পর্কে আমরা যেন সচেতন থাক। জয় বাংলা।

শ্রী হরেকৃষ্ণ কোনারঃমাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, বাংলাদেশের মানুষ লড়ছে। তারা তাদের বুকের রক্ত ঝড়াচ্ছে। আমাদের কর্তব্য হল একে শুধু সমর্থন করা নয়, একে আমরা কি করে শক্তিশালী করতে পারি, তাদের জয়ের পথকে কিভাবে সুগম করে তুলতে পারি, তার ব্যবস্থা করা। মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, এখানে খবরের কাগজগুলি পড়লে মনে হয় বাংলাদেশের মানুষের জন্য আমাদের এখানে প্রায় চোখের জলের এক প্রতিযোগিতা চলছে। তাঁর দাম আছে। যে মানুষ লড়ছে তার জন্য কিছু করতে না পেরেও যদি কাঁদতে পারা যায় তারও মূল্য আছে। কিন্তু আমাদের সীমান্তের ওপারে আমাদের ঘরের কাছে মানুষ যখন রক্ত দিচ্ছে তখন শুধু কান্নার প্রতিযোগিতা করে বাংলাদেশের মানুষের প্রতি কর্তব্য পালন করা যাবে না। সেজন্য আমাদের কয়েকটি কর্তব্য আছে। সেই কর্তব্য দু-রকম এক রকম বাংলাদেশের মানুষের লড়াইকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেবার অজুহাত হিসাবে পাকিস্তানের শাসকচক্র শুধু মিথ্যা প্রচার করে চলছে। এ কথা বললে ভুল হবে, যে নিজের মনকে ভুল বোঝান হবে-যদি মনে করি যে, পৃথিবীর কোথাও কোন মানুষকে তারা ভুল বোঝাতে পারছে না-এ কথা আমাদের বোঝা দরকার। একটা দেশের মানুষ লড়ছে, তাদের এই লড়াই এর দাবী যুক্তিসংগত, এ ছাড়া তাদের পথ ছিলনা, এটা যদি দুনিয়ার মানুষকে বোঝান যায়, তাদের সমর্থন যদি টানা যায়, তাহলে অনেক কাজ হবে। শুধু আমাদের মানুষের সমর্থন নয় পশ্চিম পাকিস্তান বলে যে জায়গা আছে, সেখানে যে মানুষ আছে, যদি সেখানকার মানুষের সমর্থন আদায় না করা যায়, তা’হলে বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে লড়াই করা আর একটু কষ্টকর হবে। তারা পারবে না আমি সে কথা বলছিনা। কিন্তু যদি পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষদেরও বোঝানো যায় এবং তাদের সমর্থন পাওয়া যায় তাহলে পাকিস্তানের সামরিক শাসকচক্র আরও বেকায়দায় ফেলা যায় এবং তার ফলে বাংলাদেশের জনগণের সাহায্য হয়। যেমন করে ভিয়েতনামের লড়াইকে আমেরিকার অভ্যন্তরে সেখানকার ছাত্ররা এবং যুবকরা যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখায়, তারা ভিয়েতনামের মানুষদের এইভাবে সাহায্য করে। তাই বারে বারে ভিয়েতনামের জনগণের নেতা কমরেড হোচিমিন আমেরিকার জনগণকে অভিনন্দন জানিয়েছে, তাদের যারা ভিয়েতনামের সমর্থনে আমেরিকার সরকারের বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টি করেছেন। এমনিভাবে বাংলাদেশের পক্ষেও প্রয়োজন আছে যাতে পাকিস্তানের সামরিক চক্র সাধারণ মানুষকে ভুল বোঝাতে না পারে। তা ছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য দেশও আছে, সেখানের জনগণেরও সমর্থন প্রয়োজন। সেই জন্য আমাদের একটা কর্তব্য হচ্ছে এই য, বাংলাদেশের সংগ্রামের তাৎপর্য সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরা। আমরা ভারতবর্ষের মানুষ কেন সমর্থন করছি সে সম্বন্ধেও স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। কারণ পাকিস্তানের শাসনচক্র দুনিয়াকে ভুল বোঝাবার চেষ্টা করছে যে, আমাদের যে সমর্থন এটা বাংলাদেশের মানুষ যার জন্য লড়ছে অর্থাৎ তাদের স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের আমাদের দরদ তার জন্য নয় এরা ভারতবর্ষের লোক পাকিস্তান বিরোধী মনোভাব থেকে সমর্থন করছে। এটা কিন্তু বোঝাবার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা যদি পাক সামরিকচক্র বোঝাতে পারে তাহলে স্বভাবত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লোক কিছুটা বিভ্রান্ত হতে পারে এই ভেবে যে একটা দেশ টুকরো টুকরো হয়ে যাবে, আলাদা হয়ে যাবে এবং তার গভর্নমেন্ট এর পক্ষে মেনে নেওয়া মুশকিল। শুধু তাই নয়, আমাদের ভারতবর্ষের মধ্যেও বহু জাতির মানুষ আছে, বহু ধর্মের মানুষ আছে এবং তাদের সকলের ঐক্যেরও প্রয়োজন আছে। যদি পাকিস্তানের সামরিকচক্র এই কথা ভালভাবে প্রচার করতে পারে যে, একটা দেশকে টুকরো টুকরো করে দেবার জন্য বাংলাদেশের এই লড়াই তাহলে কি আমরা জোর করে বলতে পারি যে, আমাদের ভারতবর্ষের কোঅংশের মানুষের মনে কোন বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারেনা? যদি তারা বোঝাতে পারে যে, এই সংগ্রাম পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের বিরুদ্ধে বাঙ্গালীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, এই বোঝাতে পারে, ভুল বোঝাতে পারে, তাহলে কি ওদের সংগ্রামকে দুর্বল করতে পারা যায়না? আমি এই কথাটার উপর জোর দিতে চাই যে, বাংলাদেশের মানুষেরা পাকিস্তানকে ভেঙ্গে দেবার জন্য লড়াই শুরু করেনি। তারা চেয়েছিল গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসন। এই প্রসঙ্গে বলতে পারি যে, যদি কোন দেশের রাষ্ট্র শক্তি ইতিহাসের এক বিশেষ শিক্ষাকে গ্রহণ না করেন তাহলে তিনি নিজে ভুল করবেন। বক্তৃতা দিয়ে অন্য কিছু করা যায়না। সেই শিক্ষা হল যে, যদি কোন দেশ বহুজাতিভিত্তিক হয়, বহু জাতির সমন্বয়ে গঠিত হয়, সেই দেশের কেন্দ্রীয় সরকার যদি সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে সমস্ত রাজ্যগুলির ওপর একেবারে একাধিপত্যর ও শোষণের রথ চালিয়ে যান, তাহলে সেই দেশ কালক্রমে ভাঙ্গতে বাধ্য। সেইসব দেশে বিভিন্ন জাতির ভিত্তিতে যে এক-একটি রাজ্য, সেই রাজ্যগুলিতে ব্যাপক স্বায়ত্তশাসন এর অধিকার নেওয়া প্রয়োজন। এ না হলে দেশের ঐক্যকে রক্ষা করা যায় না। বাংলাদেশের মানুষ এই স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিল। এ না হলে দেশের ঐক্যকে রক্ষা করা যায় না। বাংলাদেশের মানুষ এই স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিল। এ না হলে দেশের ঐক্যকে রক্ষা করা যায় না। বাংলাদেশের মানুষ এই স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিল। সেখানে তের বছর ধরে মিলিটারি বুটের দাপট পাক সরকার চালান, গণতান্ত্রিক অধিকার তাদের কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। তবুও তারা মরেনি। পঞ্চাশ হাজার কি সত্তর হাজার মিলিটারি জনগণের বুকের উপর যদি বছরের পর বছর ধরে চাপিয়ে দেওয়া যায় তাতে কেউ যদি মনে করেন সেই দেশের প্রাণ শক্তি ভেঙ্গে দেওয়া যায় তাহলে তারা মূর্খের স্বর্গে বসবাস করছেন, যেমনভাবে পাক সামরিক চক্র মূর্খেস্বর্গে বসবাস করেছিল তের বছর ধরে। 25 শে মার্চের আগে মিলিটারি মেশিনগান চালিয়ে গণহত্যা শুরু করেনি, তের বছর ধরে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের বুকের উপর তারা চেপে বসেছে, এই তারা করেছে। জনগণ চেয়েছিল তার থেকে বাঁচতে। তাদের ছয় দফা দাবি ছিল; এখন খবরের কাগজ পড়লে 6- দফা দাবি আর পাবেন না, সব গুলিয়ে যাচ্ছে। তাদের কথা ছিল এই যে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় গভর্নমেন্টের হাতে দেশরক্ষার মত সাধারণ কয়েকটি জিনিস থাকবে। বাকী সমস্ত ক্ষমতা বাংলাদেশের রাজ্যর হাতে থাকবে। এই দাবি শুধু বাংলাদেশের জন্য ছিলনা, পাকিস্তানের, প্রত্যেকটি রাজ্যর অধিকারের কথা তারা বলেছিলেন। এতে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষের অন্তরে সাড়া জেগেছিল। ওরা লড়াই চায়নি, ওরা চেয়েছিল ভোটের মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসন। পাকিস্তানের সামরিকচক্র তার জবাব দিল আক্রমণ করে। তারা মিলিটারিকে অর্ডার দিলেন যে মিলিটারি তের বছর ধরে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের বুকের উপর চেপে বসেছিল তাদের অর্ডার দেওয়া হল, বাংলাদেশের উপর তোমরা গণহত্যা অভিযান শুরু করে দাও। শুধু কম্বিং করলে চলবে না, এনসার্কিলিং করলে চলবে না, একেবারে নিশ্চিহ্ন করার অভিযান চালাও। ওখানে হচ্ছে তাই। দেড় মাসের মধ্য যদি এক থেকে দু লক্ষ খুন হয়ে থাকে তাহলে এটা গণহত্যা ছাড়া আর কি? তারা স্বায়ত্তশাসন, গণতন্ত্র চেয়েছিল শান্তিপূর্ণভাবে ভোটের ভেতর দিয়ে, তার জবাব এল মিলিটারিতে, মেশিনগানের গুলিতে। কি করতে পারত বাংলাদেশের মানুষ? যদি তাদের মনুষ্যত্ববোধ থাকে তাহলে তার একমাত্র উত্তর ছিল অস্ত্রের ঝঞ্চার উত্তর অস্ত্রের ঝঞ্চনার দিয়ে। তাই হয়েছে তাইতো স্বাধীনতার দাবি এল। এই বিষয় আমাদের তুলে ধরা উচিৎ। এইটুকু যদি তুলে ধরতে পারি তাহলে পৃথিবীর গণতান্ত্রিক মানুষের সমর্থন পাওয়া যাবে। কিন্তু এই সমর্থন একদিনে পাওয়া যাবে না-ভিয়েতনামের পক্ষে সমর্থনে একদিনে পাওয়া যায়নি সময় লাগবে। সে জন্য এটা নিয়মিত প্রচার করার দরকার আছে যে, বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তান কে ভেঙ্গে দিতে চায়নি, তারা চেয়েছিল মানুষের মত মর্যাদা নিয়ে, গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে বাঁচতে। তাদের খুন করে বাধ্য করা হল লড়তে। তাদের সামনে স্বাধীনতা ছাড়া বাচাঁর কোন পথ থাকল না। এটা দুনিয়ার সামনে তুলে ধরার প্রয়োজন আছে। পাকিস্তানের সামরিকচক্র প্রতিনিয়ত আর একটি বিরুদ্ধ প্রচার করছে এবং বাংলাদেশের ভেতরে কিছু দালাল সংগ্রহের চেষ্টা করছে। তাদের দু’একটি নাম আপনাদের কাছে এসেছে। যেসব ভাইরা এখানে এসেছে, যেসব ভাইরা এখানে এসেছেন তাদের কাছ থেকে খবর পাচ্ছি যে, সেখানকার কিছু কিছু মানুষকে ভুল বোঝাবার চেষ্টা হচ্ছে যে, ভারত বর্ষের যারা সমর্থক তারা পাকিস্তানকে দুর্বল করতে চাইছে; বাংলাদেশ যদি স্বাধীন হয় তাহলে বাংলাদেশ ভারতবর্ষের একটা অনুগত দেশ হবে। আমি আপনাদের বলছি, বাংলাদেশের প্রতি আমাদের সমর্থনের কদর্য করে পাক সামরিকচক্র আমার এখানে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে এটা যেন না হয়। পাকিস্তানের সামরিক চক্র কে এই কথা বলতে চাই যে, একটা দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ যদি একবার অস্ত্র হাতে নিয়ে পাকিস্তানের আধুনিক অস্ত্রে সাজ্জিত সামরিক বাহীনিকে পর্যুদস্ত করতে পারে তাহলে আত্নমর্যাদাসম্পন্ন সে জাতি অন্য কোন জাতি বা অন্য কোন গভর্নমেন্টের কাছে, তা সে যত চেষ্টাই করুক না কেন, যার মনে যতই আশা থাকনা কেন, সে জাতি কোনদিন কারো কাছেমাথা নোওয়াতে পারেনা। এইভাবে যদি পাকিস্তানের মিথ্যা প্রচার ব্যর্থ করতে পারি, তাহলে আমার গোটা দেশকে ঐক্যবদ্ধ করে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াতে পারবো।

মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, আমার যা তৃতীয় বক্তব্য তা এবার আমি বলব। তবে তার আগে বলি কংগ্রেস বেঞ্চের সদস্যরা হয়ত মনে করবেন এটা আমি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ব্যবহার করছি। কিন্তু আমি তার জন্য বলছি না। এখানে শাসকগোষ্ঠীর সন্তানের বিরুদ্ধে আমরা সংগ্রাম করতে জানি। ভারতবর্ষের সঙ্গে চীনের লড়াই চলে, আর আমাদের জেলে পুরে দেওয়া হলো। পাকিস্তানের সাথে ভারতের লড়াই হলো আমাদের জেলে পুরে দেয়া হলো। আমরা মার্ক্সবাদীরা শান্তিপূর্ণ মীমাংসা চেয়েছিলাম বলে। আমরা আমাদের নিজেদের সংগ্রাম করতে জানি। তারজন্য বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের সংগ্রাম কে ব্যবহার করার কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা জানি পশ্চিম বাংলায় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কীভাবে লড়াই করতে হয়। সি আর পি মিলিটারি দিয়ে, পিভিএ বা পিডি দিয়ে আমাদের দাবান যায় না। তার জন্য আমাদের কারো উপর নির্ভর করতে হয় না। যদি আমাদের নিজেদের সংগঠনের ক্ষমতা থাকে, যদি পশ্চিম বাংলার সাড়ে চার কোটি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারি, তাহলে এই সন্ত্রাস মূলক আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারি। আপনারা ভুল বুঝবেন না। আমি অন্যকোনো উদ্দেশ্যে বলছি না। ধরুন, আপনারা সন্ত্রাসমূলক আক্রমণের সাফাই দিচ্ছেন শান্তি – শৃঙ্খলা’র কথা বলে। পাকিস্তানের শাসক ইয়াহিয়া খান বলেছেন, ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় মিলিটারি দিয়ে অত্যাচার চালান হচ্ছে। এটা কিন্তু আমাদের জন্য বলছে না। ওরা বলছে বাংলাদেশের যে মানুষ লড়ছে তাদের ভুল বোঝাবার জন্য। তোমরা বাংলাদেশে মিলিটারির বিরোধীতা করছো, তাহলে পশ্চিম বাংলায় শান্তির সময় কেনো মিলিটারি আছে? কিন্তু চার ডিভিশন, তারমানে প্রায় ৫০ হাজার মিলিটারি আছে? বাংলাদেশে সাড়ে সাত কোটি মানুষের বিরুদ্ধে পাক সেনারা ব্যবহার করেছে ৭০ হাজার। মিলিটারি, এখন হয়ত একলক্ষ হবে। কিন্তু পশ্চিম বাংলায় সাড়ে চারকোটি মানুষের বিরুদ্ধে প্রায় ৫০ হাজার। এখানে চার ডিভিশন মিলিটারি আছে, এই চার ডিভিশন মানে ৫০ হাজার। এই প্রচার যদি ওরা করে? তাহলে পশ্চিমবঙ্গে সিআরপি ব্যবহার দ্বারা কি ইয়াহিয়া’র হাতকে শক্তিশালী করা হচ্ছেনা? আপনারা ভুল বুঝবেন না। ৫০ হাজার মিলিটারি সাড়ে চার কোটি মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে পাক সামরিক চক্রের আক্রমণের পক্ষে যুক্তি দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশকে কিছু রাইফেলের সাহায্য দেওয়ার চেয়ে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হবে যদি আমরা দেখাতে পারি, ইয়াহিয়ার কোনো কুৎসা করার সুযোগ নেই। এখানে সবাই জানেন বিশেষ করে যারা মন্ত্রী হয়েছেন তারা জানেন, আমরামরা মার্ক্সবাদীরা সরকারের আক্রমণ হতে রক্ষার জন্য ওইসবের উপর নির্ভর করি না, নিজেদের ক্ষমতার উপর নির্ভর করি। ক্ষমতা থাকলে লড়াই করবো একথা জানি কিন্তু পাকিস্তানের শাসনচক্র যখন লোককে বোঝায় যে, ভারতবর্ষের সমর্থন হলো একটা চালাকি, বাংলাদেশকে ভারতের একটা অনুগত রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা -তখন এর কি জবাব দেবেন, এটা বিপদজনক। মিলিটারি পশ্চিমবঙ্গে থাকলে আমি আতঙ্কিত নই। মানুষের অভ্যাস হওয়া ভালো। ১৩ বছর ধরে পূর্ববাংলার লোকদের মিলিটারি দেখতে দেখতে অভ্যেস হয়ে গেছে, এবং তার জন্য তারা মিলিটারির বিরুদ্ধে রাইফেল ধরতে শিখেছে। সেজন্যে দেখবেন কোনোদেশের যারা বুদ্ধিমান গভর্নমেন্ট তারা সাধারণ অবস্থায় মিলিটারি করে না। আমাদের ভারতবর্ষের শাসকরা কেনো তা বুঝছেন না, তা জানি না। আমি বলছি পশ্চিমবঙ্গে মিলিটারি ব্যবহার বাংলাদেশের লড়াইকে কি দুর্বল করেনা? আমি যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলছি সেটা বোঝার প্রয়োজন আছে। জ্যোতিবাবু তাই বলেছিলেন আনাদের দরদ কোথায় আছে? কথায় বলে যে, ‘আপনি আচারি ধর্ম পরেরে শেখাও’। পূর্ববাংলায় মানুষ স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিল বলে ইয়াহিয়া তার জবাব বুলেটে দিয়েছেন। ভারতবর্ষ বহু জাতির দেশ। এখানে ”স্বায়ত্তশাসন” শব্দটি এখনও ওঠেনি। শুধু এইইটুকু দাবী করা হয়েছিল যে, রাজ্যগুলির আরও অধিকাত পাওয়া উচিৎ। কিন্তু তার জবাবে প্রধানমন্ত্রী বললেন যে, রাজ্যগুলির অধিকতর ক্ষমতার দাবীর মানে হলো কেন্দ্রকে দুর্বল করাএবং কেন্দ্র দুর্বল হওয়া মানে দেশ দুর্বল হওয়া। কিন্তু যখন ইয়াহিয়া খান বলেন যে, রাষ্ট্রগুলোর স্বায়ত্তশাসন চাওয়া -বিশেষ করে দুহাজার মাইল দূরের একটা রাজ্যের স্বায়ত্তশাসন চাওয়া মানে পাকিস্তান কে দুর্বল করা তখন শুনতে খারাপ লাগে। মাদ্রাজের মুখ্যমন্ত্রী আমাদের দলের লোক নন, নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে ছিলেন, যখন রাজ্যের ক্ষমতার কথা বলেন তখন কি তিনি তাহলে দেশদ্রোহী? আমি হিন্দু ইত্যাদি পত্রিকায় বড় বড় হে’দ ললাইনে দেখেছি, তিনি বলেছেন যে, রাজ্যগুলি কে অধিকতর অধিকার না দেওয়া হয় তাহলে ইফ নট ইন দিস জেনারেশন পরবর্তী জেনারেশনে এ সমস্ত দেশ ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাবে। আমরা বললে আপনারা বলতেন দেশদ্রোহী, কিন্তু যেহেতু তিনি কংগ্রেস কে ১০ টি সিট পার্লামেন্ট এ দিয়েছেন অতএব তিনি তা নন। ইয়াহিয়া খান, আয়ুব সাহেব -স্বায়ত্তশাসন এর দাবী শুনে হেসেছিলেন, কিন্তু সেটা থাকেনি। তারা ভেবেছিলেন এখানে স্বায়ত্তশাসন এর দরকার নেই। শুধু রাজ্যগুলি তাদের প্রয়োজনে ইসলামাবাদের কাছে হাতজোড় করে দাড়িয়ে থাকবেন। এটাই ছিলো ওদের যুক্তি, যেটা আমাদের এখানেও দেখানো হয়। আমাদের বন্ধুস্থানীয় জনৈক সদস্যের পার্টির একটি পত্রিকায় লেখা হয়েছে যে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারিয়েট পশ্চিম পাকিস্তানের ৬৯২ জন অফিসার আর পূর্ববাংলার মাত্র ৫২ জন। সেই তুলনামূলক হিসাব যদি সম্প্রদায় হিসাবে রাইটার্স বিল্ডিং অফিসার এর বেলায় ধরা হয় তাহলে এর দ্বারা খারাপ ফল হবে। উই উইল প্লে ওয়ানলি ইন্টু দ্যা হ্যান্ডস অফ আদারস। তাই এরকম যুক্তি ঠিক নয়। কিন্তু আমি যখন বলল যে পাক শাসক চক্রের দ্বারা বাংলাদেশের মানুষ কে লুট করা হচ্ছে, তখন আমরা কেনো ভুলে যাবো যে, পশ্চিমবঙ্গের মতো সমস্যাসংকুল রাজ্যে চতুর্থ পরিকল্পনার ৫বছরে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার হতে আমরা পাবো মাত্র ২২১ কোটি টাকা, অথচ প্রতি বছর আমাদের এখান হতে সেন্টারল ট্যাক্স কেন্দ্রে যাবে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার বেশি। এগুলো কি পাকিস্তান গভর্নমেন্ট দেখছে না? পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এক যুক্তি আর ভারতের ক্ষেত্রে উল্টো যুক্তি হতে পারেনা। জ্যোতি বাবু ওই অর্থে বলেছিলেন ইফ ইউ আর সিনিয়র, যদি সত্যিই বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রাম কে আমরা সমর্থন করি, যদি সেটা পাকবিরোধী মনোভাব থেকে নয়, এই মনোভাব থেকে হয় যে, তারা এমন একটা নীতির জন্য লড়ছে যার জন্য মানুষের প্রাণ দেয়া উচিৎ, তাহলে সেই নীতি ভারতেও প্রয়োগ করা উচিৎ। এবং যদি না হয় তাহলে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর হাত শক্তিশালী করবো। তাদের দাবী যদি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ হয় তাহলে পশ্চিম বাংলায়ও তো সে দাবী কে মূল্য দেয়া উচিৎ আমাদের। ওখানে গণতন্ত্রের জন্য মানুষের লড়াই কে যদি শ্রদ্ধা জানাই তাহলে পশ্চিমবঙ্গেও গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের আমরা বিরোধীতা করতে পারিনা, তাকেও শ্রদ্ধা জানাতে হবে। ওখানে যদি মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ এর অধিকার কে আমরা সেলাম জানাই, তাহলে এখানে অন্তত রাজ্যগুলির একটু অধিকতর থাকা উচিৎ। এগুলা হওয়া উচিৎ। এ যদি না হয় তাহলে ভুল কার হবে? দ্বিতীয় যেটা বলতে চাচ্ছি সেটা একটু ভেবে দেখুন। আমাদের এখানে পশ্চিম বাংলায় ৫০ হাজার মিলিটারি যদি মাসের পর মাস থাকে, যদি মাসের পর মাস সিআরপি আমাদের এখানে থেকে উৎপীড়ন চালায়, তাহলে কি একথা বলা চলে যে আমরা সত্যিকারের বাংলাদেশের মানুষ কে আন্তরিকতার সঙ্গে সমর্থন করছি। আমি একথা বলতে চাই এজন্য, কারণ বাংলার হিন্দু, মুসলমান বাঙালী, অবাঙালী সমস্ত মানুষের অধিকার নির্ভর করছে আমাদের এখানকার গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার উপর।
মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, আমি আর একটা কথা বলব। বাংলাদেশের মানুষ দেড় মাস ধরে লড়ছে। এটা আপনিও জানেন, আমরাও জানি যে, এই লড়াই-এ যোদ্ধা বাহিনীর পিছনে কি ছিলো। এর পেছনে ছিলো জনগণের অপূর্ব সমর্থন কিন্তু প্রধানত যারা হাতিয়ার ধরে লড়েছে তারা হল পূর্ববাংলার পুলিশ, আনসার বাহিনী, বেঙ্গলী রেজিমেন্ট ইত্যাদি। এরা কিছু অস্ত্র পেয়েছিলো, কিন্তু তারা সোজাসোজি লড়তে জানত, স্বভাবতই তারা গেরিলাযুদ্ধের সব কায়দা জানে না। পাকিস্তানী মিলিটারির বিরুদ্ধে তারা এলোপাতাড়ি গুলি খরচ করল, ফলে অস্ত্রের অভাব পড়ল, অস্ত্রের খোড়াকের অভাব পড়ল। তখন তাদের জরুরী কি প্রয়োজন ছিলো? প্রয়োজন ছিলো চোখের জল নয়, ঐ সীমান্তে কিছু চিঁড়ে, গুড় দেওয়া নয় বা ট্রিপল অ্যান্টিজেন ইঞ্জেকশন দেওয়া নয়। কেউ কেউ বলেছিল ভলান্টিয়ার দিতে রাজি আছি। ওরা ভলান্টিয়ার চায়নি-সাড়ে সাত কোটি মানুষ প্রাণ দেবার জন্যে প্রস্তুতই, তারা ভারতবর্ষের কাছে ভলান্টিয়ার চাচ্ছি না; তারা চেয়েছিলো রাইফেল, মর্টার, অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট গান, যা নিয়ে তারা লড়তে পারে। কিন্তু দেড় মাস দেরী হয়ে গেল, আর কত দেরী হবে? সেখানে কি গেছে না গেছে, তারা কি পেয়েছে বা না পেয়েছে তা আমরা জানি না; কিন্তু গত দেড় মাস ধরে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত একটা আর্মির বিরুদ্ধে তারা লড়েছে, মরেছে, সেখানে অনেক জায়গা আর্মি দখল করে নিয়েছে। ওরা সেখানে থাকতে পারেনি।
ওদের অসুবিধা গ্রামগুলি এখনও সংগ্রামের ঘাটি হিসেবে তৈরী হয়নি। অবশ্য বাংলাদেশের মানুষের লড়াই কিভাবে চলবে না চলবে সেই বিষয়ে উপদেশ দেবার স্পর্ধা আমার নেই; কারণ ওরা লড়ছে মরছে – কাজেই তাদের উপদেশ দেয়া উচিত নয়। তবে আমি এ কথা বলবো যে এদের লড়াই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, অর্থাৎ কৃষক ওদের বাহিনীর ভিত্তি হয়ে দাঁড়াবে। এটা তারা শিখবে তাদের অভিজ্ঞতা থেকে। এটা লেলিনের কথা যে, শান্তির সময় যে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে এক বছর সময় লাগে একটা সংগ্রামের মাঝখানে সেই অভিজ্ঞতা পাঁচ দিনে এসে যায়। ওরা নিজেদের প্রয়োজনেই শিখবে। আমার স্টেটসম্যান এবং অন্যান্য কাগজে দেখেছি তারা কি লিখছে। তারা লিখেছে এই লড়াই যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, এই লড়াই যদি গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে “একট্রিমিস্টস আর ওয়েটিং বিহাইন্ড দি স্ক্রীন” অর্থাৎ উগ্রবাদীরা পর্দার আড়ালে অপেক্ষা করছে; নেতৃত্ব চলে আসবে। এতে আমাদের বিচলিত হবার কি আছে? ওদের নেতৃত্বে কে থাকবে তা আমরা কেন বিচার করবো? এ ব্যাপারে আমরা মাস্টারী না-ই করলাম। আমরা সবাই জানি যে, আজকাল বিধানসভায় এই প্রস্তাব কেমন করে রচিত হয়েছে। প্রস্তাবে এই কথাটা দেয়া হয়েছে যে, প্রতিকূল অবস্থা যা-ই হোক না কেন বাংলাদেশের মানুষ শেষ পর্যন্ত জয় লাভ করবেনই। যারা লড়ছে তারা লড়বে, মরবে, জয়লাভ করবে কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে আমরা ওদের কার্যকরী কিছুই দিচ্ছি না। দেড় মাস দেরী হয়ে গেল, এখনো যদি দেরী করি তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। স্বীকৃতি তো এমন কিছুই নয় যে, শুধু তা ধুয়ে ধুয়ে তারা জল খাবে এবং তাতে তাদের পেট ভরে যাবে। স্বীকৃতির এই জন্য প্রয়োজন যে, তাহলে তাদের অস্ত্র দিতে পারেন, অস্ত্র বিক্রি করতে পারেন, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র তাদের দিতে পারেন। কাজেই শব্দটা এই প্রস্তাবে আমার জন্য আমরা খুবই আনন্দিত এবং এরই জন্য আমরা একমত হতে পেরেছি। মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, কিছু কিছু বন্ধু কটাক্ষ করবার জন্য জ্যোতিবাবুকে বলেছেন তার “বন্ধুদেশ” চীনতে বোঝাতে। আমি পার্টির একজন দায়িত্বশীল কর্মী হিসাবে এই কথা বলতে পারি যে আমাদের বলায় যদি কাজ হত তাহলে বাংলাদেশের লড়াইকে বাঁচাবার জন্য ও তাকে সমর্থন কঅঅরবার জন্য যা কিছু করবার প্রয়োজন তা করার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম। একথা সবাই জানেন এবং যিনি বমেছেন তিনিও জানেন, জয়নাল আবেদীন সাহেব ও জানেন যে, সোভিয়েট বা চীনের প্রশ্ন তোলা ঠিক নয়। আমরা কারো গুড বুকে নেই। উভয়েই আমাদের সমালোচনা করেন – একদল বলেন আমরাই আমরা কারো গুড বুকে নেই। উভয়েই আমাদের সমালোচনা করেন- এক দল বলেন আমরা বিভেদকাকামী, আরেকদল বলেন আমরা নয়া সংশোধনবাদী। কিন্তু আমি বলি আমরা নিজেদের পায়ে দাড়াতে শিখেছি এবং আমাদের মাথাটাকে কারো কাছে বন্ধক দিইনি। আমরা সব দেশকে শ্রদ্ধা করি। আর একজন সদস্য বললেন চীনকে না। ওরা কি জানেন না যে, চীন আমাদের কি চোখে দেখেন? আসলে এই সুযোগে একটু চীনবিরোধী রাজনীতি করছেন ওরা- এটা যদি বলি তাহলে কি অন্যায় চোখে বলা হবে? কই একবারও তো বললেন না আমেরিকার ট্যাঙ্কের কথা- শ্রীমতি গান্ধী নিকসন সাহেবকে একটু কম সেলাম করুন। আগে নিজেরা পরিচয় দিন, তারপর তো অন্য কথা বলবেন। কই, বললেন না তো দক্ষিন ভিয়েতনামে সাহায্য পাঠানো বন্ধ করে দিন। কাজেই আমি বলব আপনারা চীনবিরোধী রাজনীতি করছেন। বাংলাদেশকে আপনারা কার্যত সমর্থন করছেন না। তা যদি করতেন তাহলে আপনারা আমেরিকার ট্যাঙ্কের কথা বলতেন, সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড় হয়ে যে মিলিটারি যাচ্ছে তার কথা বলতেন, বলতেন ভারতবর্ষ থেকে কেন ট্রাক যাবে, জিনিসপত্র যাবে হত্যাকারীদের সাহায্যের জন্য? পূর্ব জার্মানির স্বীকৃতির কথা বলতেন। আমি সেজন্য বলছি এই যে বাংলাদেশের লড়াই সত্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ লড়াই। এর সমর্থনের জন্যে যে প্রস্তাব তাতে ভারতের আভ্যন্তরীন ব্যাপার আমি জানতে চাই না এবং আমরা প্রথমে যে ড্রাফট তৈরি করেছিলাম তাতেও আভ্যন্তরীণ ব্যাপারের কথা ছিলো না। আমি শুধু বলতে চাই যে বাংলাদেশের লড়াইকে বাঁচাতে গেলে শুধু ইয়াহিয়ার চক্রের কথা বলে লাভ নেই, কাজে সাহায্য করতে হবে। আমাদের পার্টির তরফ থেকে আমি এ কথা বলতে চাই যে, আমাদের সমর্থন শুধু মহানুভবতার জন্যে নয়, তাদের জন্য শুধু আমাদের প্রাণ কাদার জন্য নয়। আজকে বাংলাদেশের মানুষ যদি এগিয়ে যায় তাহলে ভারতবর্ষের মানুষ ও এগিয়ে যাবে, তারা যদি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে তাহলে আমাদের গনতন্ত্রের শক্তি বেড়ে যাবে এবং সেজন্য আমরা আছি, সমস্ত শক্তি দিয়ে আমরাও এগিয়ে যাব এবং সাহায্য করব। এই বলে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি।

ডঃ জয়নাল আবেদীনঃ মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহোদয়, হঠাৎ বন্ধুরা চঞ্চল হয়ে উঠলেন কেন বুঝি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চা্ই আজকে এই বিতর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে হচ্ছে। এই বিতর্ক, আলোচনার সঙ্গে আমাদের জীবন-মরন সমস্যা জড়িত; শুধু ওপার বাংলার মানুষের নয়, আমাদেরও। তা্ই আমি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই যে, আজকে গভর্নরের এ্যাড্রেসের উপর আলোচনা হচ্ছে না।

মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহোদয়, আজকের এই এসেম্বলীর একটা শুভদিন। অন্ততঃ একটা বিষয়ে এই দুর্দিনে, এই দুর্দিনে শুধু সীমান্তের ওপারেই সীমাবদ্ধ নয়, যে ধারায় এই সংগ্রাম পরিচালিত হচ্ছে, তার যে সম্ভাব্য পরিণতি তাতে আমরাও বিপদমুক্ত এ কথা বলতে পারি না। এই জন্য শুভদিন বলছি, বিরোধী পক্ষের বন্ধুরা একদিনের জন্য এই গরমিল নিয়েই আলোচনার সূত্রপাত করতে চাই। বাংলাদেশের সংগ্রাম প্রাথমিক পর্যায়ে অহিংস এবং অসহযোগ আন্দোলনই ছিল। জ্যোতিবাবু বলে গিয়েছেন দ্বিজাতিতত্ত্ব ধুয়ে মুছে গেছে। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই এই ভুল থিওরী দ্বারা যে একটা সংকট সৃষ্টি করা হয়েছিল তাতে যে পক্ষ ছিল সে পক্ষ স্বার্থান্বেষী পক্ষ ছিল। নিশ্চয় তারা মুছে গেছে। আমরাও গর্বিত। এই আন্দোলনে যারা বিরোধিতা করেছির সেই কংগ্রেস এই দ্বিজাতিতত্ত্ব বিশ্বাস করেনি বলেই, হিন্দু মুসলিম এই ভেদে বিশ্বাস করেনি বলেই আজকে কংগ্রেস দ্বিগুণ বলে বলীয়ান হয়ে এসছে সর্বত্র; এ কথাটা তিনি বলে গেলেন না্। কংগ্রেস আজকে এই তত্ত্বে বিশ্বাস করিনে বলেই একদিকে মুছার নিশানা আর এক দিকে বিপুল শক্তির সূচনা। এটার স্বীকৃতি দিলে খুশি হতাম।

এখন যে কথা বলছিলাম, এই সশস্ত্র বাংলাদেশের মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে এই সংগ্রাম অসহযোগ এবং ঐতিহাসিক পর্যায়ই রেখেছিল। হাইকোর্টের জজ, সুপ্রীম কোর্টের জজ গভর্নরের শপথ গ্রহণ করায়নি। সেজন্যই একদিন গান্ধীজী মন্ত্র দিয়েছিলেন আন্দোলন অসহযোগের দ্বারা, হিংসার দ্বারা নয়। কিন্তু আমাদের বিরোধী দলের বন্ধুরা হিংসা ছাড়া কোন সমস্যার সমাধান খুঁজে পান না। মাহাত্মা যে বানী দিয়ে গেছেন তা হল অহিংস অসহযোগ-এর পথই একমাত্র পথ, এই পথে পৃথিবীর সমস্যার সমাধান সম্ভবপর। মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহোদয়, জোর করেই হোক আর যে রকম উপায়েই হোক এই সংগ্রাম সশস্ত্র পর্যায়ে চলে গিয়েছে। এর সম্ভাব্য পরিণতি কি হতে পারে? এই সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, মুক্তিফৌজের সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। ইয়াহিয়া খাঁর বাহিনী একবার দখল করতে পারে, আবার মুক্তিফৌজ পাল্টা দখল করতে পারে। এই যে সংঘবদ্ধ অসম সংগ্রাম সাধারণ নাগরিক কৃষকমজর সংঘবদ্ধ হয়ে আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে দেরী লাগতে পারে, এই সংগ্রাম ছড়িয়ে যাচ্ছে, তাতে সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হবার পথেই যাচ্ছে। এর আর একটা পরিনতি হতে পারে। বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে দালাল লাগিয়ে, মুসলিম লীগের লোকদের হাত করে বা নুরুল আমিনপন্থী যারা আছে তাদের হাত করে বা ওই জাতীয় এজেন্ট যারা আছে তাদের হাত করে দেশের আন্দোলনকে নষ্ট করে দিতে পারে এবং বেয়নেট দিয়ে, প্রলোভন দিয়ে, ইয়াহিয়া বাহিনী সমস্ত দেশ দখল করতে পারে এবং তার ফলে আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে। আমরা দেখছি আজকের এই যুদ্ধে মা এভং মেয়েরাওসামিল হয়েছেন। এইভাবে যদি তারাও সামিল হন অর্থাৎ স্বাধীনতা যুদ্ধের  সামিল হন তাহলে এটা বাস্তব সত্য যে, এটা একটা পরিপূর্ণ রূপ নেবে। আজকে একটা জিনসি দেকছি আন্তর্জাতিক বৃহৎ শক্তিগুলি নির্বাক দর্শক হয়ে রয়েছে-কেউ কোন কথা বলছেন না এবং যদি বা কেউ কিছু বলেন তাহলে খুব সতর্কতার সঙ্গে বলছেন। আর একটা জিনিস দেখছি ওপারে যারা নিজেদের মহাশক্তি বলে বলছেন সেই মহাচীন এতে মদদ দিচ্ছেন এবং তাঁরা চাচ্ছেন এটাকে ডোর-স্টেপ ফর ইন্ডিয়া করতে। আজকে মহাচীনের কথা বলাতে কৃষ বাবু আপত্তি করেছেন। কিন্তু এর সম্ভাব্য পরিণিতি অস্বীকার করবেন কি করে?

আজকে ইয়াহিয়া খাঁনের যে পরোক্ষভাবে চীনেরই শক্তি সে কথা কি করে অস্বীকার করবেন? মাননীয় ডেপুটি স্পীকার

 

আজকে ইয়াহইয়া খাঁনের যে পরোক্ষভাবে চীনেরই শক্তি সে কথা কি করে অস্বীকার করবেন? মাননীয় ডেপুটি স্পীকার মহাশয়, আমি আমেরিকার প্রশস্তি গাইছি না। আমেরিকানরা ব্রিটিশ ইম্পিরিয়ালিজম-এর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলন করে স্বাধীন হোল অথচ আজকে যখন ওখানকার মানুষরা সেই একইভাবে সংগ্রাম করছে তখন তাদের মুখে টুঁ শব্দটি নেই। তারা যখন এইভাবে অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করছে তখন তোমাদের কি বিবেক! মাননীয় ডেপুটি স্পীকার মহাশয়, আমি যে সম্ভাব্য পরিণতির কথা বলছিলুম সেই প্রসঙ্গে আর একটা কথা হচ্ছে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলি চেষ্টা করবে এই যুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী হোক যাতে করে এখান থেকে স্বার্থ লুট করা যায়। কিন্তু প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসাবে, ভারতীয় হিসাবে আমাদের প্রধান কর্তব্য হবে বাংলাদেশের লোক শক্তিশালী হয়ে ইয়াহিয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে এগিয়ে যাক এবং এই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটুক। আজকে এই জন্যেই প্রয়োজন আমাদের যে-কোন প্রকার সুযোগ-সুবিধা দেওয়া। যদি প্রয়োজন হয়, অস্ত্র-শস্ত্র দিয়ে নয়-অস্ত্রশস্ত্র্র ব্যতিরেকে শুধু স্বীকৃতি দিয়ে নয়, যে যে কার্যকরী পন্থা নিলে বাংলাদেশ জয়যুক্ত হয়, তা করা উচিত। আজকে এদের নিশ্চিত করুন এবং এটা ভারত সরকারের কর্তব্য। এ কথাও ঠিক, এ বিষয়ে  ভারত সরকারের দায়িত্ব্য রহিয়াছে। বিরোধী দলের নেতা শ্রী জ্যোতি বসু বলেছেন যে, কাগজের প্রস্তাব না হয়ে দ্বাড়ায়। নিশ্চয়ই আমরা স্বীকার করেছি এবং প্রথম দিন যেদিন স্বীকৃতি দেবার দাবী এই বিধানসভায় সর্বসম্মতিক্রমে তোলা হয়েছে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী যে প্রস্তাব এনেছেন, তাতে আমরা সকলে একমত হয়েছি। শুধু মুখ্যমন্ত্রীই নয়, শুধু পশ্চিম বাংলা নয়, বাংলাদেশের আশেপাশে যারা রয়েছেন তাঁদেরও এ বিষয়ে দেখা দরকার এবং ভারতবর্র্ষের মধ্যে আর যে রাষ্ট্রগুলি রয়েছে সেখানকার মুখ্যমন্ত্রীরা একজোট হয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবী তোলা উচিত যে, বাংলাদেশের সংগ্রামকে এইভাবে শক্তিশালী মদদ করা উচিত যাতে বাংলাদেশবাসী জয়ী হয়। সেইজন্যে আমাদের প্রয়োজন কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর শুভ উদ্বেগ করা। আমরা এই প্রশ্নেকে যেন রাজনৈতিক দিক থেকে বিচার না করি, এটা সামরিক প্রশ্ন। সুতরাং এত বড় একটা ঝুঁকি নেবার আগে নিশ্চয়ই ভারত সরকারের কর্তব্য রয়েছে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে বৃহৎ শক্তি এবং ক্ষুদ্র শক্তির শুভ বুদ্ধিকে জাগ্রত করা। এই কাজ করলেই বাংলাদেশকে সাহায্য করা হবে যাতে করে তারা ঐ বর্বরতার বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে পারে এবং সেই তৎপরতা ভারত সরকার চালিয়ে যাচ্ছে নানা প্রচেষ্টায় এবং আমরা মনে করি ভারত সরকার তার দায়িত¦ পালন করে চলেছে। মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, আপনি জানেন যে, আজকে বাংলাদেশবাসী কি দুর্দশায়, দুর্গতি ও লুন্ঠনের সম্মুখীন হয়েছে। এই অবস্থায় বিরোধী দলের বন্ধুরা সেখানে কিছু রাজনৈতিক স্বার্থ আদায় করার চেষ্টা করে চলেছে। আজকে হরেকৃষ্ণবাবু বলেই গেলেই ভারতের এই সাহায্য করা প্রথম দায়িত্ব আছে বলে আমরা মনে করি না। তিনি কেন্দ্রিয় সরকারের উপর চাপ দিয়ে যে কথা বলেছেন তার বেশি তাঁর আর কিছু বলার নেই, কারণ দেশের জনগণ কেন্দ্রিয় সরকারের সিলেন্ডার মেজরিটি দিয়ে দিয়েছেন-দুই-তৃতীয়াংশ মেজরিটি দিয়ে তাঁরা দিল্লির পার্লামেন্ট করে দিয়েছে। মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, ওরা মাঠে ঘাটে এই কথা বলেছিলেন যে, ইন্দিরা হঠাও। কিন্তু আজকে ওদের নাগালের বাহিরে চলে গেছে-ভারতবর্ষের মানুষ ইন্দিরাজীকে যে সংখ্যায় বসিয়ে দিল, তা এখন ওদের নাগালের বাহিরে। কিছুতেই নড়ান যায় না। ওদের কিছু উম্মা হয়েছে। সি.আর পি, মিলিটারি কেন এখানে আছে-সম্পূর্ণ নিরাপদজনক অবস্থা। কিন্তু এ কথা কি ঠিক? পশ্চিম বাংলা সীমান্তবর্তী রাজ্য।

(গোলমাল)

মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, পশ্চিম বাংলা যে সীমান্তবর্তী রাজ্য একথা অস্বীকার করলে চলবে না। এর অপর প্রান্তে রয়েছে চীন। এই কিছুদিন আগে চীনের রেসিয়াজিলম এমন কি তিব্বতকে গ্রাস করে নিল। আজকে বাংলাদেশের জন্য যে বন্ধুরা চোখের জল ফেলছেন, আমি তাদের সাধুবাদ জানাচ্ছি। কিন্তু এই তিব্বতকে চীন যখন গ্রাস করল তো একটি প্রতিবাদও ওঠেনি। পরোক্ষে তাদের সমর্থন জানিয়েছিলেন। মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, সীমান্তবর্তী রাজ্য হিসাবে ভারতের কথা পশ্চিম বাংলার নিরাপত্তার জন্য এবং আর একটা শক্তির কাছ থেকে জনসাধারণকে রক্ষা করার জন্য এখানে মিলিটারির প্রয়োজন আছে। একথা কি ও’রা অস্বীকার করতে পারেন? টু রেক দি কনস্টিটিউশন ফ্রম উইদিন একথা ওরা একাধিক বার বললেন গণতন্ত্রের কথা কিন্তু আজকে সেইজন্যই মিলিটারি ও সি আর পি-র প্রয়োজন আছে।

(গোলমাল)

আজকে দেখেছি ওদের রক্ষা করার জন্য সি আর পি বিপুল বাহিনীর প্রয়োজন হয়েছিল। বিরোধী দলের নেতাকে রক্ষা করার জন্য দু’হাজার টাকা ব্যয় হয় বলে জানা গেছে। শেষ কথা, এই প্রস্তাবে সরকারের আন্তরিকতা আছে কিনা, বিরোধী দলের নেতা তা বার বার বলেছেন। আমরা মুখে এক, আর মনে আর এক কথা বলি না- আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। আমরা সুবিধাবাদী, সুযোগসন্ধানী নই। আমাদের গোবিন্দ ভাই (এম এল এ) বার বার সে কথা বলার চেষ্টা এবং আলোকপাত করার চেষ্টা করেছেন। মাননীয় নাম্বুদ্রিপাদ সাহেব মুসলিম লীগের পিছনে ছুটে নাগাল পাচ্ছে না, এ কথা আমরা এখানে বলতে চাই না। আমি বলতে চাচ্ছি মাননীয় জ্যোতিবাবুর দল ঐ হারুন অর রশিদের পেছনে ঘোরাঘুরি করে হয়রান হয়ে গেলেন। এই আঙ্গুর কখন টক হল? তারপরে আমি ওকে জিঞ্জাসা করি গনতন্ত্রের প্রতি অবিচল আস্থা থাকে তাহলে কোন সাহসে কোন ধৃষ্ঠতায়, কোন কৌশলে বা কি মনে করে ২৭৭ জনের হাউজে ১২৩ জনকে নিয়ে সরকার গঠনের দাবী করেন? আর এম এল এ-দের পণ্যের মত কেনা বেচার সংকল্প করেন-মুসলিম লীগের এম এল এ-কে দলে টানার চেষ্টা করেনই বা কি করে? কাজেই স্যার, আমি এই কথাই বলতে চাই যে, এ সমালোচনা জ্যোতিবাবুর সাজে না। মাননীয় সভাপাল মহাশয়, কার্যকরী ব্যবস্থার কথা সুবোধবাবু বলেছেন। সেই একই সুরে আমি বলতে চাই যে পশ্চিম বাংলার এই অবস্থা কেন করলেন আপনারা? আজকে তাদের ট্রেনিং দেওয়া যাচ্ছে না। কারন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের যেখানে ট্রেনিং দেওয়া হবে সেখানে জ্যোতিবাবুর দলের লোকেরা শিখে এসে গুলিটা চালাবে জয়নালের বুকে, নইলে গোবিন্দর বুকে কিম্বা দেশের নিরীহ মানুষের বুকে। স্যার, এ নজীর আপনি কি পাননি? আমি তাই আজকে জ্যোতিবাবুকে জিঞ্জাসা করি কেন এই অবস্থার সৃষ্টি আপনারা করলেন? সীমান্তে যেখানে আমাদের ভাইবোনেরা পড়ে রয়েছে সেখানে ত্রাণের জন্য ছুটে যাওয়া যাচ্ছে না। কারণ যাবার সময় ভাবতে হচ্ছে ঐ দমদম দিয়ে যেতে হবে যেটা জ্যোতিবাবুর এলাকা, সেখান দিয়ে যাওয়া যাবে না। এখানে গেলেই পাইপ গানের গুলি বা অন্য কিছু লাগতে পারে। কাজেই এই যে আভ্যন্তরীণ অরাজকতার সৃষ্টি আপনারা করেছেন তার চরম মূল্য আমাদের এই সংকটের সময় দিতে হচ্ছে। তবুও বলি স্যার, শুভ বুদ্ধির উদ্রেক হোক। স্যার, এই প্রসঙ্গে ওদের বলি, এই যে হানাহানির শিক্ষা বা প্রচলন যাতে আপনারা মনে করেছেন লাভবান হবেন, আজকে দিন এসেছে জ্যোতিবাবু খতিয়ে দেখুন লোকসানের হিসাবটা কি? তা না হলে আপনারা ওদিকে ছিলেন আমরা ওদিকে ছিলুম, আজকে গনতন্ত্র সেটা প্রমান করেছে বলেই আপনারা ওদিকে গিয়েছেন, আমরা এদিকে এসেছি। এই হুঁশিয়ারী বা সতর্কতা দিয়ে আপনাদের স্মরণ করিয়ে বলছি, গণতন্ত্রের নামাবলি গায়ে দিয়ে ভন্ডামি চলে না তার বিচার করেছে জনসাধারণ। একটা জাতি আজকে যেখানে বিপদে বা সংকটে পড়েছে যেখানে সমস্ত কপটতা ভুলে গিয়ে সমস্ত ভন্ডামীর ঊর্ধ্বে উঠে আসুন নিজেদের সংশোধন করে নিয়ে আমরা এগিয়ে যাই। ইতিহাসের শিক্ষা আপনারা স্মরণ করুন। আজকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন যাতে ঐ সমস্ত ভাইবোনের সংগ্রাম জয়যুক্ত হয়। আপনারা এগিয়ে আসুন, আমাদের তরফে কোন কপটতা নেই, আপনারাও আপনাদের কপটতা বর্জন করুন। আর তা করে বাংলাদেশের সংগ্রামকে জয়যুক্ত করুন, অনুরোধ জ্যোতিবাবু, এ থেকে আপনারা অতিরিক্ত মুনাফা লোটবার চেষ্টা করবেন না। মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, আমার শেষ কথা হল, আজকে শুধু সাহায্য বা স্বীকৃতি নয়, আজকের এই আন্দোলন যাতে জয়যুক্ত হয় ভারত যেন কার্যক্রম গ্রহন করেন এবং সেটা করবার জন্য আমরা এই সরকার পক্ষে যতজন আছি, আমরা ঐকবদ্ধ, দৃঢ়বদ্ধ মত পোষণ করি যে, আমরা এটা সমর্থন করি। এটা জয়যুক্ত হবে বলেই আমরা বিশ্বাস করি এবং তাই শুধু ওদের জীবনপণ নয়, আমাদেরও জীবনপণ করে আমরা সকলেই একে সমর্থন জানাচ্ছি। জয় হিন্দু।

শ্রী সব্রত মুখোপাধ্যায়: মাননীয় ডিপুটি স্পীকার মহাশয়, আমি প্রথমে মূখ্যমন্ত্রী কর্তৃক আনীত যে প্রস্তাব সেই প্রস্তাবকে সর্বান্তঃকরণে সমর্থন জানাচ্ছি। সমর্থন জানাচ্ছি আরও যাঁরা এখানে তাঁদের বক্তব্য রেখেছেন তাদের মধ্যে বিরোধী দলের অন্য সকলকে বাদ দিলেও সুবোধ বাবুর কিছু কিছু আ্যানালিসিসকে। যদিও তার সমস্ত বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারিনি তবুও তার বক্তব্য অন্যান্য বিরোধী দলের প্রবীণ অভিজ্ঞ নেতার চেয়ে অনেক দৃঢ় এবং প্রস্তাবের স্বপক্ষে অনেক কার্যকরী সহায়তা হবে এবং অনেকটা সহযোগিতা করেছে। আমি অবাক হয়ে দেখেছি যে, এই ঐতিহাসিক মুহুর্তে যখন আমাদের সদস্যদের একটা প্রচন্ড দায়িত্ব রয়েছে অত্যন্ত গভীরভাবে এটা চিন্তা করার, সেই মুহুর্তে আমরা অনেক জায়গায় সেটাকে লাইট করে দিয়েছি। অনেক জায়গায় প্রবীণ অভিজ্ঞ সদস্য হওয়া সত্ত্বেও তারা সেটাকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করার অপচেষ্টা করেছেন, সেটা অস্বীকার করে লাভ নেই। অনেক বক্তব্য প্রস্তাবের স্পিরিটকে শক্তিশালী করার চেয়ে তাদের দলের স্বার্থে ব্যবহার করার চেয়ে তাদের দলের স্বাথে ব্যবহার করার চেষ্ট করেছেন, বা জয়নাল আবেদীন মহাশয় তার বক্ততায় বলেছেন। সেটা অত্যান্ত দুঃখের ব্যাপার। আপনারা প্রস্তাবকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। দলগত নির্বিশেষে এই প্রস্তাবকে গ্রহন করার জন্য আমি বিরোধী  এবং সকল সদস্যকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। দরগত নির্বিশেষে এই প্রস্তাবকে গ্রহন করার জন্য আমি বিরোধী এবং অন্যান্য সকল সদস্যকে অভিনন্দন জানাই আর অভিনন্দন জানাই শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশ সম্পার্কত এ যাবত সমস্ত কার্যাবলীকে এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণে তিনি যে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন তার জন্য। এটা আমার মুখের কথা নয়। হয়ত আমাদের দাবি আছে অনেক, অনেক আমাদের বক্তব্য আছে। আমাদের দাবি আদায়ের জন্য হয়ত জায়গায় একটু চাপ সৃষ্টি করতে হবে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এটাও সত্যি কথা, সীমান্তে গিয়ে দেখি আসুন যে, পূর্ব বাংলার একটা বিশেষ একটা অংশ একদিন সেখান থেকে বিতাড়িত হয়ে আসা সত্ত্বে আজকে তারা শ্রীমতি ইন্দিরা নামে জয়ধ্বনি করেছে যখন ইন্দিরা গান্ধীর সাহায্য ওপার বাংলায় যাচ্ছে। আমি সীমানেত গিয়েছি। যারা সেখোনে গিয়ে তারাও নিশ্চয়ই দেখেছেন। অবশ্য সকলে গিয়েছেন কিনা আমি জানি না। তবে গেলে দেখবেন যে, এপারের বহু নরনারী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর দেশ থেকে দু’ হাত নেড়ে তাদের অভিন্দন জানাচ্ছে। সবচেয়ে আশ্চযের কথা হচ্ছে যে, প্রস্তাবের সমস্ত অংশটাকে বাদ দিয়ে ‘অস্ত’ এবং ইন্দিরা গান্ধী এই দুটো শব্দকে প্রধান্য দিয়েছেন বিরোধীরা। কিসের জন্য বাংলাদেশের এই প্রস্তাবরক স্পিরিটকে আপনারা নিতে পারলেন না? নিলেন শুধুমাত্র দলীয় স্বার্থকে বড় করে দেখবার জন্য। আজকে ‘ইন্দিরা গান্ধী’ এই দুটো কথা বাংলাদেশের বুকে খবরের কাগজে বড় করে দেখবার প্রচেষ্টা করলেন। আমরা চেয়েছিলাম নেচার অফ দি মুভমেন্ট তাকে আ্যানালিসিস করা হবে। আমি বিরোধী দলের সদস্য বলে অপরাধ করিনি। অত্যান্ত ঐতিহাসিক রেজিলিউশন-এ একচটা সুযোগ চেয়েছিলাম যে আমরা পাইনি। আমি অত্যান্ত ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ্য ককেছি যে, বিভিন্ন জায়গায় জোর করে কংগ্রেসদল এবং ইন্দিরা গান্ধীরা সমালোচনার চেষ্টা হয়েছে আমি তার দু-একটা কথা এখানে বলতে চাই। যেখানে ইয়াহিয়ার দ্বারা মানুষ অত্যাচারিত হয়েছে সে কথা অজানা নয়। সেই মুক্তি সংগ্রামীরা কেমন সংঘাতিকভাবে লড়াই করেছে সেটা আমাদের আ্যানালিসিস করে দেখতে হবে। শুধু মুজিবর জিন্দাবাদই নয়। শুধুমাত্র বিরাট বিরাট প্রস্তাব ইত্যাদি বাংলাদেশের মানুষের সামনে তুলে দেওয়া নয়, সঙ্গে সঙ্গে এটাও সি পি এম সমর্থকরা চিন্তা করুন- জাতীয়তাবাদী শব্দটি ব্যঙ্গ করেছেন-বুর্জোয়াদের শোষণ করার শব্দ বলে আ্যানালিসিস করে বারবার বক্তৃতায় বলেছেন, ময়দানে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। সেই শব্দের যে কত জোর আ্যানালিসিস করে দেখুন। মুখ্যমন্ত্রী, আমাদের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী তখনকার গনতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে এই কার্জন পার্কে জাতীয়তাবাদী মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে গণতান্ত্রিক অধিকারে অনশন করেছিলেন। তখন আমি জানি সি পি এম বহু সদস্য প্র¯্রাব গায়ে দেবার চেষ্টা করেছিলেন। এ কথা অস্বীকার করতে পারবেন? এখন আবার গণতন্ত্রের কথা বলছেন? আমরা বন্দে মাতনম বলি বলে এই অপরাধে স্কুলে যেতে পারব না, আমাদের মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এসে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করা হবে, আমাদের বাড়ি সাঁই পরিবারে পরিণত হবে। এরপরও কি মাননীয় সি পি এম সদস্যদের কাছ থেকে গণতন্ত্রের মত বড় বড় কথা শুনতে হবে? মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, মানব অভুত্থানের ¯্রষ্টা হিসাবে পৃথিবীর ইতিহাসে যে ক’টা নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে মহাত্মা গান্ধী এবং মহাত্মাজীর পরে আর একটি নাম যোগ করুন, তিনি হচ্ছেন জাতীয়তাবাদী মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। দুটোকে এক সঙ্গে দেখিয়ে আমরা বলেছি গণ-অভুত্থানের ব্যাপারে মহাত্মা গান্ধী পৌঁছতে পারেননি, সেখানে মুজিবুর রহমানর কোন কোন জায়গায় পৌঁছে দিয়েছেন। আমরা মুজিবুর রহমানের সংগ্রামকে শ্রদ্ধা করি, কিন্তু তার চেয়ে বড় শ্রদ্ধা করি এই সংগ্রামের ক্যারেক্টারকে এবং নেচারকে। আমরা দেখেছিলাম ভিয়েতনামে লড়াই হচ্ছে। আজতে আপনারা চেঁচাচ্ছেন ভিয়েতনামে লড়াই হচ্ছে বলে। কিন্তু আপনারা বুকে হাত দিয়ে বুলন তো ভিয়েতনামের মুক্তি সংগ্রামের প্রতিই যদি আপনাদের সমর্থন হয় এবং সেই সমর্থনে সেদিন যে সুর আপনাদের কাছ থেকে শুনেছিলাম আপনারা ভাতের হাঁড়ির কাছ পর্যন্ত, বাচ্চা ছেলের কানের কাছে ভিয়েতনাম, ভিয়েতনাম গান পৌঁছে দিয়েছিলেন এবং আপনাদের সমস্ত ক্রেডিট সেদিন ছিল, আমি আজকে তা অস্বীকার করছি না। সেদিন মুক্তি সংগ্রামীদের সমর্থনে হাজার হাজার মিছিল বেরিয়েছিল ব্রিগেড ময়দানে এবং কত লক্ষ টাকা খরচ করে তোরণ গেট নির্মাণ করা হয়েছিল এবং বহুবার ব্রিগেড ময়দানে মিটিং হয়েছিল। আজকে বাংলাদেশে শুধু একটি ভিয়েতনামবাসীর মত নয়, শত শত মুক্তি সংগ্রামী এগিয়ে আসছে দেখছি, তখন তো আপনাদের একটাও গেট দেখিনি, বাংলাদেশের স্বার্থে একটি শ্লোগানও তো দেখিনি যে, মিছিল ভিয়েতনামের মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থনে দেখেছিলাম, বিরোধী দলের নেতারা তো এখানে বসে আছেন, আপনারা বলুন ভিয়েতনামের জন্য ব্রিগেড যে ক’টা মিটিং করেছিলেন সেই হিসাব আজকে মিলিয়ে নিতে চাই। মুক্তি সংগ্রামই বড় কথা, না ইডিওলজি অ্যান্ড ইজম বড় কথা সেটা আপনারা পরিষ্কার করে বলুন। যদি ইডিওলজি অ্যান্ড ইজম বড় কথা হয় তাহলে আর আপনারা লোকদের ভাঁওতা দেবেন না। আর যদি মুক্তিযোদ্ধাদের কথা বড় কথা হয় তাহলে আমাদের সুরে সুর মিলিয়ে বলুন যে, ভিয়েতনাম যেমন যোগ্য সম্মান পাবে, বাংলাদেশের মুজিবুরের মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধও তেমনি যোগ্য পাবে। অনেক আন্তরিকতার অভাব দেখলাম, যে আন্তরিকতা তারা অনেক জায়গায় দেখিয়েছেন। তারা চাপ সৃষ্টি করবার কথা বলেছেন। তারা বলেছেন ইন্দিরা গান্ধীর কাছে চাপ সৃষ্টি করতে হবে। ডেফিনেটলি সৃষ্টি করতে হবে। কিন্তু চাপ সৃষ্টির করার মানে এই নয় যে, আগামী ট্রাম, বাস পুড়িয়ে আপনাদের মসনদ ফিরিয়ে দেবার জন্য একই রকম চাপ সৃষ্টি যেন না হয় সেদিকে একটু লক্ষ্য রাখবেন। এবং এদিকে লক্ষ্য রেখে সেইভাবে চাপ সৃষ্টি করবেন। আমি জানি এখানে মিলিটারির কথা আগে উঠেছিল। মাননীয় জ্যোতিবাবু তখন পুলিশমন্ত্রী। বিরোধী পক্ষ একবার মিলিটারি, সি আর পি-র কথা তুলেছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন যে মিলিটারি সি আর পি আমাদের পয়সা পোষা হচ্ছে এবং প্রয়োজনে তারা আমাদের সার্ভিস দেবে। আমি বহু মাননীয় বিরোধী দলের নেতা, মাননীয় সদস্যদের জানি- বহু বাড়ি জানি- যেখানে শুধুমাত্র তাদের স্ত্রী-পুত্রদের সি আর পি পাহারা দেয়নি, তাদের স্ত্রী-পুত্রের পুতুলকে পর্যন্ত সি আর পি পাহারা দেয়। কলকাতা মহানগরীর বুকের উপর এমন বহু বিরোধী দলের নেতা আছেন, যাদের বাড়ি সি আর পি-তে পাহাড় দিচ্ছে আপনারা নিজেই গিয়ে দেখে আসবেন। আপনাদের নেতারা বলেছেন, “সি আর পি হঠাও, একটা বড় জুতো” একটি দেওয়ালে লেখা আছে। সঙ্গে সঙ্গে আর একটি দেওয়ালে দেখবেন সেখানে আমাদের মানে লেখা আছে “সি আর পি-র কোলে জ্যোতিবাবু দোলে” এবং সেখানে দুটি লেখার মানে সত্যিকারে মিলিয়ে নেবেন। তাই আমি মাননীয় সদস্যদের কাছে অনুরোধ করছি যে, আপনারা ইয়াহিয়ার সাথে আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে এক করে দেখবেন না এবং এখানে অনেকে এক করে দেখবার চেষ্টা করেছেন।

(গোলমাল)

চিৎকার করে আমাকে বসাতে পারবেন না। আপনারা যদি আমাকে বলতে না দেন তাহলে জ্যোতিবাবুকে আমি কোনদিনও বলতে দেব না। তাই আমি অনুরোধ করছি যে, ইয়াহিয়ার সাথে আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে এক করে দেখবেন না। আমি আপনাদের কাছে উদাহরণ দিয়ে বলছি যে, ইয়াহিয়া মুজিবুর রহমানের সমস্ত গণতান্ত্রিক অধিকার এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়েছে। মুজিবুর রহমান মানুষের দ্বারা নির্বাচিত ইলেক্টেড প্রতিনিধি হওয়া অ্যাসেম্বলি বসিয়ে তাদের বক্তব্য রাখবার যে অধিকার সেদিন ইয়াহিয়া দেয়নি। কিন্তু আপনাদের প্রধানমন্ত্রী, আপনাদের সরকার সে অধিকার ছিনিয়ে নেয়নি। তাহলে আপনারা কি করে বললেন যে, আপনাদের প্রধানমন্ত্রী আর ইয়াহিয়া এক? আজকে মুজিব যেভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন, আপনারা কি সেইভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন? সুতরাং আমি আর অধিক কথা বলব না। আমি শুধু একটি কথা বলছি যে, ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে সমস্ত ব্যক্তি স্বার্থের দলীয় স্বার্থের সমস্ত রকম রাজনৈতিক স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে আসুন দলে দলে তীর্থযাত্রীর মত সত্যিকারের সক্রিয় সহযোগিতা নিয়ে, একটি শব্দ বা দুটি শব্দ বড় করে না দেখে ‘অর্থ’, ‘ইন্দিরা গান্ধী’ অন্য জায়গায় দেখব, প্রয়োজনে সমালোচনা করব। আজকে অন্তত আমরা একটি প্লাটফর্মে সকলে এক হয়ে একে সমর্থন জানাই।

শ্রী মহ: ইলিয়াস রাজী: মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, মাননীয় মন্ত্রী মহাশয় যে প্রস্তাব নিয়ে আজকে এসেছেন, আমি সেই প্রস্তাব সমর্থন করছি। আজ আমরা যে প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করছি, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আমরা সবাই জানি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করছেন, এই সংগ্রাম দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত অন্যায় অত্যাচার এবং শোষণের বিরুদ্ধে এই সংগ্রাম। এই সংগ্রাম যারা আজকে পূর্ব বাংলার মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়েছে ইয়াহিয়া এবং তার সামরিক শাসকগোষ্ঠী, তারা পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষকে বোঝাবার চেষ্টা করছে এবং বোঝাচ্ছে যে, পূর্ব বাংলা মানুষ এই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করতে চাচ্ছে। এটা অত্যন্ত ভুল কথা, মিথ্যা কথা। আমরা জানি পূর্ব বাংলার মানুষ শাসকগোষ্ঠীর অন্যায় অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে যখন আওয়াজ তুলেছিলেন তখন তো তারা একথা কোনদিন বলেননি যে, এরা পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে চায়। আজ যে ছয় দফা দাবির ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, সেই ছয় দফা দাবির ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসনের দাবি ইয়াহিয়া খাঁ পদদলিত করেছে, উপেক্ষা করেছে, তার ফলে এখন যে সংগ্রাম চলেছে এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামকে পূর্ব পাকিস্তানের শসস্ত্র সামরিক বাহিনী পূর্ব বাংলার অগণিত মানুষকে হত্যা করছে। ইতিমধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষ মানুষকে হত্যা করেছে এবং আগামী দিনেও আরও অনেক শহরকে ধ্বংস করেছে, অনেক শিক্ষাকেন্দ্র, বাড়িও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র তারা ধ্বংস করে দিয়েছে। এইসব ধ্বংসলীলা, অত্যাচার ও নিষ্পেষণ কেন? এটা শুধু এই জন্য যে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ তাদের যে অধিকার, বাঁচবার যে অধিকার, সেই অধিকারকে তারা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল, যার জন্য ইয়াহিয়া শাসকগোষ্ঠী ঐ রকম অন্যায় অত্যাচার করে যাচ্ছে। আমাদের কাছে অর্থাৎ ভারত সরকারের কাছে পূর্ব বাংলার সংগ্রামী মানুষ সাহায্য ও সহানুভূতি চাচ্ছে। যদিও সাহায্য ও সহানুভূতি আমরা তাদের কিছু কিছু দিচ্ছি। কিন্তু তাদের রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়ার যে ব্যাপার-ভারত সরকার যদি সেই স্বীকৃতি দিতে দেরী করেন, তাহলে সেখানকার মানুষের দুঃখ কষ্ট দুর্গতি যা হয়েছে ও হচ্ছে, সেই দুঃখ-দুর্গতি আরও বাড়বে, বেশি হবে। সেইজন্য আজকে তাদের স্বীকৃতি দেওয়াটা বড় প্রশ্ন। বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়াটাই হচ্ছে জরুরী ব্যাপার আমাদের ভারত সরকারের কাছে। এটাই সমধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং এই আশা এবং ভরসা আমরা করছি যে, পূর্ব বাংলা জয়ী হবে সেখানে এমন একটা সরকার কায়েম করবে যেখানে কৃষক, শ্রমিক, মেহনতী মানুষ বাঁচবার মত সুযোগ পাবে, এই আশা এবং ভরসা নিয়ে আজকের এই প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি।

শ্রী কাশীকান্ত মৈত্র: মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, আজকের এই ঐতিহাসিক এবং স্মরণীয় যে প্রস্তাবটি এসেছে, সেই প্রস্তাবটি আমি সমর্থন জানাচ্ছি এবং বিরোধী দলের যেসব নেতারা এই হাউস-এ একটা প্রস্তাব করার যে প্রচেষ্টা করেছেন তাদের আমি আন্তরিক অভিনন্দন এবং শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আমাদের দু’পক্ষের ব্যবধান যতই হোক না কেন, আজকের দিনে যদি একমত হয়ে একটা প্রস্তাব নিই, সেই প্রস্তাবের গুরুত্ব আন্তর্জাতিক এবং সেই প্রস্তাব পাস হওয়ার একান্তা প্রয়োজনীয়তা ছিল। আজকে সর্বাগ্রে আমি মনে করি যে, সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হচ্ছে স্বাধীন বাংলাকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা প্রশ্ন। আন্তর্জাতিক রাজনীতি আপনারা জানেন। যে কয়টি শর্ত স্বীকৃত হলে আন্তর্জাতিক আইনে একটা রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া চলে, আর প্রত্যেকটি টেস্ট বা পরীক্ষাতেই এই স্বাধীন বাংলা উত্তীর্ণ হয়েছে। আইনে আছে আপনারা জানেন টেরিটরি পপুলেশন, অর্গানাইজেশন সভেরন্টি বোথ এক্সটার্নাল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল, এই চারটি শর্ত যদি উত্তীর্ণ হতে পারে তবে যে কোন রাষ্ট্র এবং যে কোন জাতি আত্মানিয়ন্ত্রণের ভিত্তিতে স্বীকৃতি পেতে পারে। বিগত বিশ্বযুদ্ধের সময় আমরা জানি এই পূর্ব এশিয়াতে নেতাজী সুবাস চন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দু সরকার গঠিত হয়েছিল, সেই আজাদ হিন্দু সরকারের স্বীকৃতি মিলেছিল আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রের কাছ থেকে। পৃথিবীর ন’টি রাষ্ট্রের কাছ থেকে এবং সেখানেও এই পপুলেশন, অর্গানাইজেমন, সভরেন্টি, টেরিটরি এই চারটি পরীক্ষাতে তার সরকার উত্তীর্ণ হয়েছিল। গত যুদ্ধের সময় দেখেছিলাম ফ্রান্সের সরকার জেনারেল দ্য গল তার নিজের দেশ থেকে পালিয়ে এমিসার গভর্নমেন্ট করে গভর্নমেন্ট ইন এক্সাইল- ফরাসী থেকে ইংল্যান্ড এসে বসেছিলেন এবং সেখানে তার পেছনে এই সমস্ত টেস্টে উত্তীর্ণ হবার তার কোন কারণই ছিল না এবং সেদিন তিনি হননি। তা সত্ত্বেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ দ্য গলের গভর্নমেন্ট ইন এক্সাইলকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। আজকে কেন বাংলাদেশের সরকার স্বীকৃতি পাবে না। স্বীকৃতি নিশ্চয়ই তারা পাবে এবং তার জন্য সমস্ত রকমের চাপ পশ্চিম বঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে পশ্চিমবঙ্গের জনগণের পক্ষ থেকে আমরা দেবে এই বিষয়ে বিরোধী পক্ষের সঙ্গে একমত। কিন্তু আমি একটা প্রশ্ন করছি, মাননীয় সুবোধ বাবু কয়েকটি তাত্ত্বিক প্রশ্ন তুলেছেন। তাত্ত্বিক প্রশ্ন নিয়ে মতভেদ থাকবেই। কিন্তু আমি বলছি যে, ওপার বাংলায় যে বিরাট ঐতিহাসিক আন্দোলন চলেছে, তার সম্বন্ধে তারই দলের নেতা শ্রী শিবদাস ঘোষ মহাশয়ের বক্তৃতা আমি শুনিনি কিন্তু কাগজে পড়েছি, তাতেও স্বীকার করতে কোন দ্বিধা থাকা উচিত নয় যে, ওপার বাংলায় এই যে বিরাট আন্দোলন সাড়ে সাত কোটি মানুষের হচ্ছে, এরা মার্কস পড়ে নেতৃত্বে দিচ্ছেন না, মার্কস, চেগুয়েভারা, স্ট্যালিন, লেলিন, ট্রটস্কি, মাও সে তুং এদের তত্ত্বের উপর নির্ভর করে লড়াই করছে না, অতি সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক তত্ত্বকে ছেড়ে দিয়ে স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করে লড়াইয়ে নেমেছে। জীবন তত্ত্বের চেয়ে অনেক বড়। তত্ত্বও নিয়ে আমরা পড়ে থাকি, তাহলে আমরা দেখব জীবন তত্ত্বকে ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে। জীবনের জন্য তত্ত্ব, তত্ত্বের জন্য জীবন নয়। মাননীয় সুবোধ বাবু তিনি স্পেনের সিভিল ওয়ারের কথা বলেছেন। স্পেনের সিভিল ওয়ারের ইতিহাস পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পড়েছি, আজকে এখানে স্মরণ করবার নানা কারণ আছে, আমি তাকে ধন্যবাদ দিই যে, তিনি স্পেনের গৃহযুদ্ধের কথা তুলেছেন। মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয় স্পেনের গৃহযুদ্ধে অন্যতম বড় শিক্ষা হয় যে, সেদিন পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রজাতান্ত্রিক স্পেনের পিছনে আসেনি এবং সেদিন ফ্রাঙ্কো যে সমর্থন ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রদ্বয়ের কাছ থেকে পেয়েছিলেন তারা হলেন জার্মানি ও ইতালি এবং তারই ফলে ফ্রাঙ্কো জিতেছিলেন এবং প্রজাতান্ত্রিক স্পেনের সংগ্রামী ভাইরা সেদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আর একদিক থেকে খুব ট্রাজিক হলেও স্বীকার করতে হয় যে, স্পেনের গৃহযুদ্ধের ইন্টারন্যাশনাল ওয়ারকিং ক্লাস সেদিন এগিয়ে আসেনি। বর্গানুর মত একজন কমিনিস্ট নেতা যিনি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল সেক্রেটারিয়েট ছিলেন তাঁর বিখ্যাত পুস্তক কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল তিনি স্বীকার করে গেছেন যেম স্পেনের গৃহযুদ্ধে দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করতে হচ্ছে যে পৃথিবীর কোন সমাজতান্ত্রিক কি বুর্জোয়া দেশের শ্রমিক শ্রেণি সেদিন এগিয়ে আসেনি যা তাদের আসা উচিত ছিল। অথচ একটি ফ্যাসিষ্ট রাষ্ট্র তার সমস্ত শক্তি নিয়ে প্রজাতান্ত্রিক স্পেনের বিরোদ্ধে সমর্থন  জানিয়েছিল। এখানেও তাই ঘটেতে চলেছে। আজকে আমরা যদি গণতান্ত্রিক শক্তিকে সমর্থন না করি, আমরা যদি বাংলাদেশের যে বিরাট মুক্তিযুদ্ধ চলেছে তাকে সর্বতোভাবে সমর্থন না জানাই তাহলে ফ্যাসিবাদের যেখানে উদ্ভব হবে এবং আমরা ইতিহাসের কাঠগড়ায় উঠব। সুতরাং স্বীকৃতি আমাকে দিতেই হবে। তত্ত্বের কথা বলেছেন- তত্ত্বের সেই ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কিং ক্লাস সলিডারিটি কোথায়? এ তো সিংহালে কথা একজন সদস্য বলেছেন, আমি তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে, সিংহলে যুক্তফ্রন্টে হয়েছিল শ্রীমতি বন্দনায়কের নেতৃত্বে। সেখানকার ট্রটস্কিপন্থী এবং বিপ্লবী সমস্ত দল যুক্তফ্রন্ট তৈরি করে সরকার করলেন। যেদিন যুক্তফ্রন্ট সরকার তৈরি হল সেদিন ময়দানে প্রথম বিজয় উৎসবের সমাবেশে ডাঃ কটিশা সিলভা, সেখানে ট্রটস্কি দলের নেতা, আর্ন্তজাতিক বিশ্ব বিপ্লবের নেতা তিনি বক্তৃতা দিয়ে বলেছিলেন তালিম উদ্ভব ভারতবাসীরা তোমরা এবার চলে যাও, আমাদের দেশের সিংহলের মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। ওয়ার্কিং ক্লাস অফ দি ওয়ার্ন্ড ইউনাইটেড কোথায়? ভিয়েৎনামের একটি মাইলাই হয়েছিল, তাতে লক্ষ মানুষ মরেছে আমেরিকার সা¤্রাজ্যবাদীদের সামনে। কিন্তু কোথায় আমেরিকার শ্রমিক শ্রেণী তার বিরুদ্ধে দাঁড়ালো? নিউ লেফট লিবারেল যারা উদারপন্থী তরুণ যুবকের দল, শিক্ষা, অধ্যাপক, সাধারণ মানুষ তারা তো আমেরিকার যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়নি? কই আমেরিকার কারখানার শ্রমিকরা প্রোডাকশন বন্ধ করে দেয়নি যে, না, ভিয়েতনামের শ্রমিক কৃষক ছাত্র যুবক নারীর উপর নির্বিচারে আমেরিকার সেনাবাহিনী গুলী চালাচ্ছে, বোমাবর্ষন করছে, নেপাম বোমা ফেলেছে, আমরা এ মারণান্ত্র তৈরি করব না। ওয়ার্কিং ক্লাস সলিডারিটি এ কথা তো লেনিন বলেছিলেন, কিন্তু ইতিহাসের সে জীবন তত্ত্বের  আমি তো কোন মিল দেখছি না। চীনে যাঁরা সমাজতন্ত্রের কথা বলেছেন তাঁরা আজকে ইয়াহিয়া খাঁনকে সম্পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছেন। মাননীয় সদস্য হরেকৃষ্ণ কোঙার মহাশয়কে আমি খুব বিনয়ের সঙ্গে বলছি, তাঁকে কোন আঘাত করব না, রাজনীতে আমার সঙ্গে তার মতের তুমুল পার্থক্য আছে ও থাকবে। তিনি কয়েকটা প্রশ্ন তুলেছেন, তিনি একটা তুলনামূলক বক্তৃতা ভারত সরকারের সঙ্গে করেছেন এবং সব সময় আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, বাংলাদেশের আন্দোলন সম্বদ্ধে যদি স্পষ্টভাবে প্রচার ঠিক না হয়ে তাহলে বিদেশী রাষ্ট্ররা তার সুযোগ নিয়ে এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে যাবে। কিন্তু আমি তাকে দুঃখের সঙ্গে বলছি যে, তিনি যে বক্তৃতা করলেন সেই বক্তৃতা যদি ঝাপিয়ে বিলি করা যায় পাকিস্তান এমব্যাসি তার সবচেয়ে বেশি সুযোগ নেবেন। তবে আশার কথা এই যে, আমাদের বিধানসভার প্রসিডিংস ছেপে যখন বেরুবে তখন ২-৩ টা সরকার অদলবদল হয়ে যাবে, ২-৩ টা বিধনসভা বসবেএবং সেটা যাবে না, এটা আশার কথা। আরও তিনি বলেছেন কেন মিলিমিটারি থাকবে। আজযে যে মুহূর্তে স্বীকৃতি দেয়া হবে সে মুহূর্তে প্রস্তুত থাকতে হবে যুদ্ধের জন্য, যে কথা মাননীয় সদস্য বিশ্বনাথ মখার্জি তুলে ধরেছেন। আমি জিজ্ঞাসা করছি তখন কি মাননীয় সদস্য হরেকৃষ্ণ কোঙার এবং অন্যান্য দলেরা বললেন যে, না চীন সমাজতান্ত্রিক দেশ? মনে রাখবেন ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ হয়ে গেছে এক কালে। কিন্তু ভেড়া চুরির অভিযোগে একটা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিশ্বযুদ্ধের হুঙ্কার দিতে পারে সে এক চীন সম্রাজ্য দেখিছিল যে, ভারত চীনের ৯০০ ভেড়া চুরি করে নিয়ে গিয়ে ছিল। তার জন্য তারা ৯০ ঘন্টার আন্টিমেটাম দিলেন। আমাদের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন কারণ তাঁর শক্তি ছিল না। তখন কি আবার ভারতবর্ষ আক্রমণস্থলে আক্রমণকারী রাষ্ট্র এবং আক্রান্ত রাষ্ট্রের মার্ক্সিস্ট শ্রেণী চরিত্র নিয়ে বিচার বসবেন? জিজ্ঞাসা করছি বলতে হবে আপনাকে। ভারতবর্ষ স্বীকৃতি দিক আমরা চাই, কিন্তু স্বীকৃতি দিলে তার পরিণতি স্বরূপ যদি বিশ্বযুদ্ধ আসে, যদি চীন বা যে কোন রাষ্ট্র ভারতবর্ষের উপর হামলা করে তাহলে আমরা সবাই কি তখন হাত মিলিয়ে সরকারের পিছনে দাঁড়িয়ে লাড়াইয়ের জবাব দেব, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়তে বলব? বলুন না? তখন দেখবেন আবার শ্রেলীতত্ত্বের আলোচনা এসে যাবে। আজকে যখন লড়াই আসবে তখন সৈন্য আসবেই। আমি, জ্যোতিবাবু, হয়ে কৃষ্ণবাবু ধুতি-পাঞ্জাবী পরে লড়ব না।

(শ্রী হরেকৃষ্ণ কোঙারঃ দয়া করে আপনার সাথে আমার নাম জড়াবেন না। সি আই এর এজেন্ট। )

কে কার এজেন্ট? একটা কথা মনে পড়ছে শ্রদ্ধেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাস দেবদাস লিখবার পর বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা সাহিত্য সমালোচক, তিনি আজ পরলোক। তিনি ঐ বইয়ের অত্যন্ত প্রশংসা শুনে সহ্য করতে না পেরে লিখলেন, “হ্যাঁ শরৎবাবু গণিকালয়ের যে ছবি এঁকেছেন বড়ই নিখুঁত এবং বড়ই বাস্তবগ্রাহ্য এবং চমৎকার। ” যখন শরৎচন্দ্র চট্রোপাধ্যায়ের কাছে এই সমালোচনাটা পড়ে শোনানো হল তিনি তখন বললেন, “অভিজ্ঞ ব্যক্তির কাছেই ধরা পড়েছে-এইটাই আমার সান্ত্বনা। ”  তা সি আই এ সম্বন্ধে এত খবর যারা রাখেন তাঁরা সি আই এ স্পেশালিস্ট। ওঁরা সি আই এ বলে দুনিয়াকে খেপাচ্ছেন। এই তো নকশালপন্থিদের সি আই এ বলছেন। সবাই সি আই এ; তবে আপনারা কারা? সুতরা! এত খবর রাখছেন কি করে? দালালের খবর দালালরাই রাখে। ‘দালালস্য দালাল’ যারা তারা রাখে।

সুতরাং মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, আজকে যে ঐতিহাসিক প্রস্তাব এসেছে তাকে আমরা সর্বান্ত:করণে সমর্থন জানাচ্ছে। আমি………………………………….

(বিরোধী পক্ষের বাধাদান)

আমরা বক্তৃতার সময় যতই ওরা বাঘা দিন ও ‘দালাল’ বলে গালাগালি দিন আমি কখনই দাঁড়াইনি  বা ভবিষ্যতেও করব না এ আশ্বাস প্রত্যেকে দিচ্ছি। কিন্তু মনে রাখবেন কাচের ঘরে বাস করে রাস্তার লোককে ইট মারলে বড় বিপদ হয়। রাস্তার ধারে কাচের ঘরে বাস করে লোককে ইট ছুঁড়লে যা পরিণতি হয় তার জন্য আপনারা প্রস্তুত থাকবেন। সরকারী আশ্রয় দালালী করে মেলে না। সত্য কথা বলে যাব। তাতে আপনাদের কাছে দালাল হতে পারি। চিরদিন ভারতবর্ষের আপামর জনসাধারণের দালাল হব। চীনের দালাল হব না, আমেরিকার দালাল হব না এবং বিড়লার দালাল হব না। মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয় খেয়েও পেট ভরছে না। আমেরিকার কাছ থেকে, চীনের কাছ থেকে, রাশিয়ার কাছ থেকে খেয়েও পেট ভরে নি, শেষকালে টাটা-বিড়লার কাছ গিয়ে হাত পাতছে। সুতরাং ওসব কথা বলে লাভ নাই।

                              (সরকার পক্ষের তুমুল হর্ষধ্বনি)

ওসব নাটক করে লাভ নেই। আমরা জানি হু ইজ হু অ্যান্ড হোয়াট ই হোয়াট। এখনও চ্যালেঞ্জ করছি হরেকৃষ্ণবাবু ও তার দলের কাছে- বলুন- ভারতবর্ষ অস্ত্র দিক, আমরা দাঁড়িয়ে বলছি পাকিস্তান কি চীন হামলা করলে আমরা এক সাথে দাঁড়িয়ে লড়ব। ঘরের লড়াই আমরা বিচার করব। কিন্তু সে উত্তর আসবে না। সুতরাং এখান থেকে ই বুঝবেন আসল লক্ষ্যটা কি।

আমি আমার বক্তব্য শেষ করবার আগে আবার বলছি যে, বাংলাদেশে……………..

                                          (গোলমাল)

মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, আপনাকে হাউসের শান্তি রক্ষা করতে হবে। তা না হলে এটা তো  একতরফা যাবে না। আপনাকে তো আমাকে প্রোটেক্ট করতে হবে। তা না হলে প্রিভিলেজ আমারও ভায়োলেটেড হবে।

আজকে তাই বলছি, যে প্রস্তাব এসেছে তাকে সমর্থন করছি এবং ওপার বাংলায় যে ঐতিহাসিক লড়াই চলছে তাকে কেউ ব্যর্থ করে দিতে পারে না। যাঁরা বলছেন ওপার বাংলা থেকে আমাদের প্রেরণা পাবার কিছু নেই তাঁরা ভুল। যদি ভিয়েৎনাম থেকে প্রেরণা পাওয়া যেতে পারে, যদি রুশ বিপ্লব থেকে প্রেরণা পাওয়া যেতে পারে তাহলে আমি বলব ভারতবর্ষের ৫৩ কোটি মানুষ আজকে সবচেয়ে বেশি প্রেরণা পাবে ওপার বাংলার বঙ্গবন্ধু মুজিবের নেতৃত্বে যে লড়াই হচ্ছে এবং সর্বশেষে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কথায় বলি:-

(বিরোধী পক্ষের হাস্যরোল)

বিশ্বকবির নাম হতেই এত ব্যঙ্গ কেন বুঝতে পারছেন। কারণ রবীন্দ্রনাথ ওদের কাছে বুর্জোয়া কবি।

           “মৃত্যুর অন্তরে পশি অমৃত না পাই যদি খুঁজে

            সত্য যদি নাহি মেলে, দু:খ সাথে যুঝে

            পাপ যদি নাহি মরে আপনার প্রকাশ লজ্জায়,

            অহঙ্কার নাহি মরে আপনার অসহ্য সজ্জায়। ”

মাননীয় ডেপুটি স্পীকার মহাশয়, এই রকমভাবে একটা অশালীন আচরণ যদি একটা দল করে তাহলে অন্যায় হয়। …………..(এ ভয়েসঃ প্রেস লিখছে। ) প্রেস আমাদের লোক নয়। প্রেস আপনাদের ভয় করে, আমাদের করে না। আপনারা আনন্দবাজার —- যুগান্তরের সাংবাদিকদের মেরেছেন, ভ্যান জ্বালিয়ে দিয়েছেন। ঐ আনন্দবাজারের লোকদের সঙ্গে আপনাদের দলের নেতা জ্যোতিবাবু গ্র্যান্ড হোটেলে ভোজন করেছেন। ঐ আনন্দবাজার, হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড, যুগান্তর ইত্যাদিরা ফলাও করে আপনাদের খবর বের করে। ——–(গোলমাল) “বীরের রক্তস্রোত, মাতার অশ্রুধারা; এর যত মূল্য সে কি করার ধূলায় হবে হারা”এত রক্তস্রোত কখনও ব্যর্থ হবে না। মুজিবরের নেতৃত্বে যে আন্দোলন চলছে সেই আন্দোলন জয়যুক্ত হবেই। ওঁরা কারুর প্রেরণা পান, না পান তাতে কিছু আসে যায় না। আমরা প্রেরণা পেয়েছি, গোটা বিশ্ব প্রেরণা পেয়েছে। জয় হিন্দ।

শ্রী অনিলকুমার মান্না: মাননীয় ডেপুটি স্পীকার মহাশয়, আমি গণতান্ত্রিক কোয়ালিশন সরকারের মখ্যমন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের যে প্রস্তাব এনেছেন সেই প্রস্তাব অন্তরের সঙ্গে সমর্থন করছি। সেই সঙ্গে সমর্থন জানাই  আজ বিরোধী পক্ষ ও সরকার পক্ষ একত্রিত হয়ে এই বিরাট মানুষের অধিকার অর্জনের যে অধিকার সেই অধিকারকে আজ উভয় পক্ষ মেনে নিয়েছেন এবং  তাই তাদের জানাই আমাদের অন্তরের আন্তরিকতা। আমি একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, বিরোধী নেতা তার বক্তব্যে একটা কথা বলে গেছেন যে, আজ এই প্রস্তাব শুধু প্রস্তাব থেকে যাবে না। এর ভেতরে আন্তরিকতা আছে- আমি এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে একমত। আমি বলতে চাই যে, আজ এক মাস অতিক্রম হয়ে গেল পশ্চিম পাকিস্তানের জঙ্গীশাহী শাসনের বর্বর অত্যাচারে ওপার বাংলার হাজার হাজার শিশু, বৃদ্ধ নরনারী তাদের জীবনের সমস্ত দিয়ে লুন্ঠিত হচ্ছে, নি ষ্পেষিত হচ্ছে। আজও তারা ঐ রকম জঙ্গীশাহী ট্যাঙ্ক, বুলেটের কাছে নিষ্পেষিত হচ্ছে, কিন্তু ঐ জঙ্গীশাহী শাসনের অবসান করতে পারে নি। কিন্তু আজও তারা পূর্ব বাংলার মানুষের ওপরে  নির্যাতন  এবং পশ্চিমশাহী জংলী শাসনের অবসান করতে পারে নি, তাদের সেই প্রস্তাব প্রস্তাবই থেকে গেছে, তাদের মুখের কথা কথাই থেকে গেছে। তার সুরাহা করতে বা সেই জংলী শাসনের অবসানকল্পে কোনরকম একটা প্রস্তাব ভারত সরকার বা পৃথিবীর অন্য কোন রাষ্ট করেনি। যারা আজকে পৃথিবীর বড় বড় রাষ্ট, যাদের কথায় পৃথিবীর পৃথিবীর প্রতিটি উঠে বসে আজ তারা কোথায়, আজকে তারা নিরব কেন? আমি তাদের প্রশ্ন করি বাঙ্গালী জাতির প্রতি তাদের কি কোন কর্তব্য নেই? আজকে পূর্ব বাংলার এই যুদ্ধ কি ইতিহাসের যুদ্ধের মতই থেকে যাবে? একটা দেশ আর একটা দেশকে জোর করে দখল করছে, তাদের ভূখন্ড হরণ করে নিয়েছে- এই সমস্ত মানুষগুলির বাঁচার অধিকারকে পশ্চিমবাহী জংলী শাসন বছরের পর বছর ধরে হরণ করে রেখেছে, সেই অধিকারকে অর্জন করার জন্য আজকের এই সংগ্রাম। আজকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ভারত সরকার তাদের স্বীকৃতি  দিচ্ছে না। আজকে আমি ইন্দিরা সরকারকে প্রশ্ন করব কেন তোমরা ওপারের বাঙ্গালীর বাঁচার অধিকারকে আজও স্বীকৃতি দিচ্ছ না। আজকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে কোন বাধা নেই, কারণ পূর্ব বাংলা তাদের নিজস্ব ভূখন্ড এবং সেখানে ৯৯.৬ দশমিক গণতান্ত্রিক ভোটে জনগণ তাদের রায় দিয়েছে, সেখানে জাতীয় সভার সভ্যদের নির্বাচিত করেছে অথচ কেন তাহলে আজকে ভারত সরকার তাদের স্বীকৃতি দিচ্ছে না-এই প্রশ্ন আজকে প্রতিটি ভারতবাসীর, এই প্রশ্ন আজকে বাঙ্গালী জাতির, এই প্রশ্ন আজকে প্রতিটি শোষিত মানুষের। যখন  আমরা দেখতে পাচ্ছি পশ্চিম বাংলার হাজার হাজার মানুষ দুবেলা খেতে পাচ্ছে না, যখন তারা তাদের জীবনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে তখন আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, পূর্ব বাংলা থেকে হাজার হাজার মানুষ এসে ভারতের বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার এই সমস্যাকে আরও সমস্যাসঙ্কুল করে তুলছে। আজকে ইন্দিরা সরকার বোধ হয় মনে করছে যদি আমরা পূর্ব বাংলাকে স্বীকৃতি দেই তাহলে অন্য কোন রাষ্ট চীন, রাশিয়া বা আমেরিকা আমাদের আক্রমণ করবে বা

অন্যকোন কোন রাষ্ট্র আমাদের আক্রমণ করবে- এই ভয়ই ইন্দিরা সরকারের প্রধান বাধা। কিন্ত তারা দেখেছেন যে, ১৯৬২ সালে যখন চীনের দ্বারা আমাদের দেশ আক্রান্ত হয়, যখন ১৯৬৪সালে পাকিস্তান আমাদের দেশ আক্রমণ করে তখন এটা প্রমাণ হয়ে গেছে ভারতবর্ষের মানুষ তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, তারা দেখিয়েছে যে, ঐরকমভাবে নিজেদের আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য যেকোনো সংগ্রামের পেছনে তারা রয়েছে, তার জন্য নিজেদের শক্তি, নিজেদের রক্ত, নিজেদের সমস্ত অধিকারকে তারা বিলিয়ে দিয়েছে। যেকোনো আন্তর্জাতিক শক্তি, যেকোনো রাষ্ট্র যদি আমাদের রাষ্ট্র ভারতকে আক্রমণ করে- আমরা একতাবদ্ধ হয়ে সমস্ত জাতি যদি রুখে দাড়াই তাহলে কোন শত্রু আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবেনা এই বিষয়ে আমরা সুনিশ্চিত। তাই আমি বলতে চাই, পূর্ব বাংলার মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য ভারত সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দিতে হবে, শুধু ঐ প্রস্তাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে আমাদের জনমত সংগ্রহ করতে হবে, আমাদের এখানে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে, যে আন্দোলনের ফলে ভারত সরকার এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রগুলি তাদের স্বীকৃতি দেবে এবং বাঙ্গালী জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে তারা মেনে নিবে এই বলেই আমি শেষ করছি। জয় হিন্দ।

শ্রী প্রয়াগ মণ্ডলঃ মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী যে প্রস্তাব বাংলাদেশ সম্পর্কে রেখেছেন সেই প্রস্তাব আমি সমর্থন করছি এবং সমর্থন করার সাথে সাথে বলছি যে, এই প্রস্তাব সম্বন্ধে কোন আন্তরিকতা আছে কিনা সেই প্রশ্ন বিভিন্ন দিক থেকে উঠেছে এবং এটা উঠাই স্বাভাবিক। কারণ আমরা জানি অনেক সময় অনেক প্রস্তাব নেওয়া হয়ে থাকে কিন্ত সেই প্রস্তাবগুলি ঠিকভাবে কার্যকরী করা হয় না। প্রস্তাব বা চুক্তিগুলি নেওয়া এক কথা এবং এগুলো কার্যে পরিণত করা আর এক কথা। সুতরাং আমি একমত যে এটার মধ্যে আন্তরিকতা আছে কিনা। নেহেরু-লিয়াকত যে চুক্তি ছিল তা মানা হয়নি। তাছাড়া জেনেভা এগ্রিমেন্ট যেটা আছে সেটাও হয়ত মানা হয় নি এবং আমাদের পূর্ববাংলা ইয়াহিয়ার জঙ্গীশাহী যে আক্রমণ সেটা আমাদের পশ্চিমবাংলার হয়ত ৪-৫ কিলোমিটারের মধ্যে হয়ত এসে পড়েছে এবং অনেক লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমি আরও বলতে চাই যে, আমাদের এই সমস্ত ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের পূর্ববাংলার ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের মত গণ্য করতে হবে। আমি বলতে চাই সরকার পক্ষকে যে, এই প্রস্তাব শুধু কাগজে না লিখে মুখ্যমন্ত্রী তো দিল্লী যাচ্ছেন, তিনি বলুন কেন্দ্রীয় সরকারকে এদের স্বীকৃতি দিতে হবে। আমি আনন্দিত যে এই প্রস্তাবের মধ্যে অস্ত্রশস্ত্র কথাটি আছে এবং সাথে আছে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি। এখানে আমি একটু বলতে চাই, অস্ত্রশস্ত্র কথাটাকে গৌণ ধরে মুখ্য হিসাবে যদি চাল, মুড়ি, বিড়ি এগুলোকে ধরা হয় তাহলে খারাপ হবে এবং এই প্রস্তাবের কোন অর্থ থাকবেনা। তাই আমি বলছি, এক মাস বারো দিন পর কেন এই প্রস্তাব নিতে হবে, এটা আপনারা তো ইচ্ছা করলেই করতে পারেন। আপনারা দিল্লীতে গিয়ে বলুন বা সমস্ত জায়গা থেকে দিল্লীতে গিয়ে আবেদন করুন যে, এই সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হোক বা অস্ত্রশস্ত্র দেওয়া হোক। যাই হোক এছাড়া এই প্রস্তাবের মধ্যে অন্যান্য যে সমস্ত কথা রয়েছে যে, ইয়াহিয়া খান খারাপ লোক বা তার গণহত্যা অভিযানকে ধিক্কার জানানো হোক-এগুলি জানিয়ে লাভ নাই কারণ এক একটা শ্রেণীর এক একটা চরিত্র থাকে এবং সেই চরিত্রমত সে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিক্রিয়াশীলদের পায়ের তলা থেকে যখন মাটি সরে যায় তখন তারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে এবং শেষ কামড় দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে এবং সেটাই পূর্ববাংলায় হচ্ছে এবং তার ঢেউ এখানে এসেছে। ঠিক ইলেকশনের আগে প্রেসিডেন্ট রুলের সময় আমরা দেখেছি যে, বিভিন্ন জায়গাতে, গ্রামে সি আর পি মিলিটারি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্ত আমাদের সীমান্তে চীন আছে। যেকোনো সময় তারা  আক্রমণ করতে পারে। এগুলি প্রতিক্রিয়াশীলদের পয়েন্ট, এক ঠেকা দেওয়ার জন্য তাঁরা অনেক কথা বলেন। এগুলি যারা করেন সেই সরকার কি করে পূর্ববাংলার আন্দোলনকে সমর্থন জানাবেন? যা হোক সরকার পক্ষ থেকে শুনলাম তাঁদের নাকি আন্তরিকতা আছে। ভাল কথা, আনন্দের কথা। আমাদের পশ্চিম বাংলার মানুষ যখন জাগবে, যারা অত্যাচারিত, নিষ্পেষিত তারা একদিন না একদিন জাগবে এটা খুব পরিষ্কার। তখন তাঁরা মন্ত্রীসভায় থাকুন আর নাই থাকুন, পশ্চিম বাংলার নাগরিক হিসাবে তাঁদের যে আন্দোলন হবে তাকে অন্ততঃ অন্তর থেকে সমর্থন জানাব এই বলে আমি শেষ করছি।

শ্রী অজিত কুমার গাঙ্গুলীঃ মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহোদয়, মুখ্যমন্ত্রী মহাশয় যে প্রস্তাব এনেছেন, সেই প্রস্তাব আমি সর্বান্তকরণে সমর্থন করছি। শুধু মুখ্যমন্ত্রী মহাশয় এই প্রস্তাব এনেছেন বলেই নয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন বাংলাদেশের মানুষকে সেখানের সমস্ত শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন, আজকে এই হাউসে এই যে প্রস্তাব এসেছে সেটা চার কোটি পশ্চিমবঙ্গ বাসীর প্রতিভূ এই বিধানসভার সদস্যদের পক্ষ থেকে এসেছে। সেজন্য এর একটা মৌলিক গুরুত্ব আছে। সাধারণভাবে অনেকসময় অনেক প্রস্তাব এখানে সমর্থিত হয়, সেটা একটা দিক, আজকে উপাধ্যক্ষ মহাশয় যদি প্রস্তাবটা দেখেন এটা শুধু সমর্থনসূচক নয়, এই প্রস্তাবের একটা গভীর তাৎপর্য রয়েছে। প্রতি প্যারাতে দেখবেন একটি কার্যকরী সমন্বিত ধারা রয়েছে। আমি সেদিক সম্বন্ধে আপনার মাধ্যমে এই সভায় উপস্থিত করতে চাই। সেটা হচ্ছে, আপনি লক্ষ্য করেছেন, বাংলাদেশে যে লড়াইটা হচ্ছে সেই লড়াই অত্যাচারীর বিরুদ্ধে লড়াই নয়, এটা একটা উপনিবেশিক দাসত্ব থেকে মুক্তির লড়াই। লিবারেশন স্টাগল ফ্রম কলোনিয়াল অপ্রেশন। এটা আমাদের বুঝতে হবে। আমারও বাড়ি পূর্ববঙ্গে। আপনারা প্রায়ই বনগাঁর নাম শুনে থাকেন, সেই বনগাঁ থেকে ঝিকরগাছা ১৯ মাইল দূরে গেলেই দেখতে পাবেন, সেখানে নতুন বাড়ি ১১খানার বেশি হয়নি এই অত্যাচারী শাসনের অধীনে। ওখানে বেনাপোলের বাজার, নাভারণ বাজার, ঝিকরগাছা বাজার যতদূর যাবেন দেখতে পাবেন কত অন্যায় হয়েছে। একটা উপনিবেশিক দেশকে সেই অবস্থায় রেখে দিয়েছে। আমরা এটা বুঝি। কেননা আমরা এই উপনিবেশিক দাসত্বের মধ্যে ছিলাম, আমরা জানি ব্রিটিশদের অত্যাচার কি। সেই অত্যাচারের কাহিনী মনে রেখে আমরা এই জিনিস উপলব্ধি করতে পারি। কারণ, উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই পশ্চিমবঙ্গবাসী করেছিল। আজকে ওখানে যে লড়াই চলছে সেই লড়াইয়ের প্রতি সেদিক দিয়ে আমাদের সহানুভূতি আরও গভীর। এরা কি অত্যাচারই না করেছিল। আপনি উপাধ্যক্ষ মহাশয়, জানেন ইয়াহিয়া জন্ত- জানোয়ারকেও ছাড়িয়ে গেছে। যশোরে পোলের হাট বলে একটা জায়গা আছে। সেখানে বাড়িতে চারজন মরা পড়ে আছে। একটা কুকুর পোষা কুকুরই হবে সেই মড়াগুলিকে শকুনের হাত থেকে রক্ষা করবার জন্যই হয়ত পাহারা দিচ্ছে। একটা কুকুরের যে বোধ আছে ইয়াহিয়ার সেই বোধও নেই। শিশু, নারী, বৃদ্ধ নির্বিচারে হত্যা করে চলেছে। সাড়ে সাত কোটি মানুষ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, মাননীয় সদস্যরা অনেকে জানেন, খবরের কাগজ দেখে থাকবেন, লোকমুখেও শুনে থাকবেন এই লড়াইয়ের কাহিনী। তাদের অনেকে দশ- বারদিন পর্যন্ত স্নান করতে পারেনি, তার মধ্য থেকেই লড়েছে, তাদের দেহ বন্ধ হয়ে আসছে কিন্ত এর মধ্যে থেকেই লড়াইয়ের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এই অবস্থার মধ্যে তারা এতদিন রয়েছে। একমাসের বেশী হয়ে গেল আজ পর্যন্ত তাদের স্বীকৃতি দিতে পারলেন না। প্রথমদিকে কথা উঠেছিল কিভাবে সমর্থন দেব? গভর্নমেন্ট কোথায়? তারপর সেখানে প্রতিষ্ঠিত হল। এখন সে প্রশ্ন উঠতে পারেনা। প্রশ্ন হতে পারে, আমরা তো দিতে পারি কিন্ত পৃথিবীতে তো অনেক দেশ আছে কই কিছু তাঁরা তো করলেন না। কেন্দ্রীয় সরকার যদি এই ভেবে বসে থাকেন যে, আরও অন্যান্য দেশ সমর্থন করুন, তখন  আমরাও করব। তাহলে বুঝতে হবে খানিকটা মজা দেখার মনোভাব নিয়ে তারা থাকছেন। এখানে ওই প্রস্তাব এককভাবে হয়েছে এবং জ্যোতি বাবু বলেছেন আমরা দিল্লী যেতে চাই। আমি বলি দিল্লী যাবেন তাতে আমাদের সমর্থন আছে, কিন্ত মনে রাখবেন দিল্লী সব নয়। আমরা যখন একসঙ্গে বসে প্রস্তাব রচনা করেছি তখন কেন তাকে কার্যকরী করার ব্যবস্থা করতে পারব না? কেন তার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারব না? কাজেই আমি মনে করি যখন এককভাবে সর্ববাদীসম্মতভাবে প্রস্তাব এসেছে তখন একে কার্যকরী করার জন্য একটা সুপরিকল্পনা আমাদের একসাথে বসে করতে হবে যাতে অদূর ভবিষ্যতে এর জন্য আমরা ব্যবস্থা করতে পারি। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন যুদ্ধে যেমন সামনের ফ্রন্ট লড়াই করে ঠিক তেমনি বিয়ারেরও একটা কাজ থাকে। এখানে যারা এসেছে এই সরকার তাদের বাস্তুহারা মনে করেন। তাঁরা মনে করেন না যে লক্ষ লক্ষ লোক এসেছে ওই বিহারের। এদের শুধু খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থাই নয়, মুখ্যমন্ত্রী মনে রাখবেন এই সমস্ত সৈনিক যারা এসেছে তাদের অস্ত্র দিয়ে, ট্রেনিং দিয়ে এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে তারা আবার ওখানে যেতে পারে। আমি সুবোধবাবুর সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলছি আমাদের দেশেও ভলান্টিয়ার রেইজ করতে হবে এবং তাদের হাতে অস্ত্র দিতে হবে। সেটা তারা আমার বুকে মারবে না কার বুকে মারবে সেই আতঙ্ক করে কোন লাভ নেই। দরকার হলে যারা উপনিবেশ করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে একথা বলে আমার বক্তব্য শেষ করছি।

শ্রী মহম্মদ সামায়ুন বিশ্বাসঃমাননীয় ডেপুটি স্পীকার মহাশয়, মুখ্যমন্ত্রী মহাশয় বাংলাদেশের নির্যাতিত সাড়ে সাত কোটি জনসাধারণের সমর্থন এবং তাদের সর্বপ্রকার  সাহায্য করার যে প্রস্তাব এনেছেন মুসলিমলীগের তরফ থেকে আমি সেই প্রস্তাবকে আন্তরিকভাবে সমর্থন জানাচ্ছি। বলা বাহুল্য ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন অব মুসলিমলীগের সভাপতি জনাব কায়েদে মুল্লা ইসমাইল সাহেব এবং পশ্চিমবাংলা রাজ্য মুসলিমলীগের সভাপতি সেকেন্দার আলি মুল্লা বাংলাদেশের নিপীড়িত লোকের সমর্থনে এক যুক্ত বিবৃতি দিয়েছেন। খুবই পরিতাপের বিষয় সংবাদপত্রগুলি এই মুসলিমলীগের প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণ করেন এবং সেজন্য বিরোধীপক্ষ অনেক কথা সোচ্চারে বলেছেন আর একটা কথা বলছি যখন আমরা এই গভর্নমেন্টের অংশীদার তখন মুখ্যমন্ত্রী মহাশয় যে প্রস্তাব এনেছেন তাকে সমর্থন না করার প্রশ্ন কি উঠতে পারে? কাজেই আমরা এই প্রস্তাব সমর্থন করছি। এই প্রসঙ্গে আমি জ্যোতি বাবুকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই, তিনি যে কিছুদিন আগে কমিউনিস্ট দেশগুলি ঘুরে এলেন সেখানে তিনি এই বাংলাদেশের নিপীড়িত লোকদের জন্য কোন বক্তব্য রেখেছেন কি? অথবা বাংলাদেশের জনগণকে সমর্থন করবার জন্য কোন সক্রিয় ভূমিকা নিতে বলেছেন কিংবা সরাসরি তিনি কোন বক্তব্য রেখেছেন কি? এই পর্যন্ত সংবাদপত্র পড়ে যা দেখেছি তাতে তিনি সেইরকম কোন বক্তব্য রাখেননি। কাজেই এখানে একরকম কথা বলবেন এবং অন্যরকম শলাপরামর্শ করবেন এটা বিস্ময়কর। দ্বিতীয় কথা মুসলিমলীগ সম্বন্ধে একটি চার্জ এনেছেন। পরিতাপের বিষয় যে, আমরা বারবার বলেছি যে, মুসলিমলীগ সাম্প্রদায়িক দল নয়, আসলে মুসলিমলীগের জন্ম হয়েছে বিমাতৃসুলভ আচরণ দেখবার ফলে। যদি নিরপেক্ষ দৃষ্টি থাকত তাহলে হয়ত এই মুসলিমলীগের জন্ম হত না। আমরা নবকংগ্রেসকে স্বাগত জানিয়েছি সত্য। যখন জাতীয় কংগ্রেস যুক্ত ছিল তাদের প্রতি আমাদের আস্থা ছিল না। তাঁদের মধ্যে বিমাতৃসুলভ আচরণ ছিল এটা বেদনাদায়ক কথা। তাই তাঁদের পাশে আমরা দাঁড়াতে পারিনি। আজকে আমরা নবকংগ্রেসকে সমর্থন জানিয়েছি। কারণ তাদের প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য যে, যখন যুক্তফ্রন্ট সরকার বারবার সরকার গঠন করেছেন তখন এসমস্ত  মুসলিমদের প্রতি দৃষ্টি দেয়নি। তারা ছলে বলে কৌশলে অন্যকথা বলেছেন। আপনারা যেভাবে ব্যাঙ্গ করে বা কুৎসা করে চলেছেন তাতে জনকল্যাণ হওয়া শক্ত। আপনাদের এই কি প্রতিযোগিতার পরিচয়? কেরলে যখন মুসলিমলীগের সঙ্গে কমিউনিস্ট দল যখন জোট বেধেছিল তখন মুসলিমলীগ কি সাম্প্রদায়িক ছিল না? তখন যদি না হয়ে থাকে তাহলে নবকংগ্রেসের সঙ্গে মিলিত হল বলে তারা সাম্প্রদায়িক হল কি করে? আজকে বাংলাদেশের জনগণ হিন্দু মুসলিম এক মনে এক প্রাণে আমাদের কাছে সাহায্য চাচ্ছে এবং সেই সাহায্যের ভিত্তিতে আমরা সে প্রস্তাব কার্যকরী করার জন্য এক মন একপ্রাণ হয়েছি।

                                           (গোলমাল)

আজ যদি চীন হুমকি দেয় তাহলে জ্যোতিবাবু কি এগিয়ে যাবেন না, না পিছিয়ে যাবেন? আর একটা প্রশ্ন রাখছি যে, প্রতিদিনের আমাদের সমস্যা আছে, আমাদের সকলেরই সমস্যা আছে এবং এই সমস্যা থাকা সত্ত্বেও আমি এই স্বীকৃতি জানিয়ে বিদায় নিচ্ছি।

শ্রী মহম্মদ আমিনঃ মাননীয় ডেপুটি স্পীকার মহোদয়, বাংলাদেশ বিষয়ে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী তা আমি সমর্থন করছি এবং সমর্থন করতে গিয়ে একটি মন্তব্যের প্রতি লক্ষ্য রাখছি। একটু আগে শুনলাম কংগ্রেস বেঞ্চ থেকে কেউ বললেন যে কমিউনিস্ট লিডারের বাড়িতে নাকি সি আর পি পাহারা দেয়। তিনি কোথায় থেকে জানলেন জানিনা। তবে শুনে মনে হল কংগ্রেস হলেই কি মিথ্যা কথা না বললেই হয় না? এইরকম একটা কথা তাঁরা বললেন কি করে? আমি বলতে পার যে, কোন সিপিএম লিডারের বাড়িতে কোন সি আর পি নাই। একথা সম্পূর্ণ অসত্য। দ্বিতীয়তঃ এখানে অনেক মাননীয় সদস্যের কথা শুনলাম। একটু আগে মুসলিম লীগের একজন যুক্তি দিয়ে বললেন এখানে মুসলিমলীগ করা হয়েছে তার কারণ মুসলিমদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হত। তিনি এইটুকুই কেন বললেন আমি জানিনা। তাঁর এটা বলা উচিত ছিল এবং আমাদের পার্টি এই কথাই বলেছে কংগ্রেসী রাজত্বে মুসলমানদের প্রতি শুধু বৈষম্যমূলক আচরণই নয় তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানিয়ে রাখা হয়েছে। একথা বলার সৎ সাহস তাঁদের নেই কিন্ত আমাদের পার্টি বলেছে এবং আমরা সংগ্রামও করেছি। সংখ্যালঘুদের যে সমস্যা সেটা আমরা জানি। কিন্ত তাদের সমর্থনের জন্য মুসলিমলীগ গঠন করার দরকার হয়না। তাই যারা মুসলিমলীগ সদস্য আছেন তাদের ভেবে দেখতে অনুরোধ করব যে, আজকে পাকিস্তানে যা হচ্ছে  সেই পাকিস্তানই কি করে হল। অতীতের সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা কি আমরা ভুলে যাব? আমি খুশি হলাম সাত্তার সাহেব যখন বললেন দ্বিজাতিতত্ত্ব ভুল এটা শুনে। এটা ভুল প্রমাণ হবেই, কিন্ত অনেক ক্ষয়ক্ষতির পরে। এত মূল্য দিতে হবে স্বাধীনতার একথা কেউ জানে না। আমার মনে পড়ে না যে এইভাবে কোনদেশ স্বাধীন হয়েছে। যাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের ঘরবাড়ি পুড়ে গিয়েছে, তাদের হত্যা করা হয়েছে। এত নির্যাতন পৃথিবীর ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যাবেনা। আজকে যারা মুসলিমলীগ করছেন তাঁদের মনে সত্যিই জানিনা মুসলমানদের ভাল করার ইচ্ছা আছে কিনা, যদিও তা থেকে থাকে তাহলে এটা কি বুঝতে পারছেন না যে, মুসলিমলীগ করা মানেই হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। তারা কি বুঝতে পারছেন যে, মুসলিমলীগ বাড়লে জনসঙ্ঘও বাড়তে বাধ্য। তখন বাংলাদেশের আবহাওয়া বিষাক্ত হবে এবং তাতে বেশি ক্ষতি হবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের, যাদের নিয়ে তাঁরা কথা বলছেন। তারপর ওঁরা বলেছেন ডেমোক্রেটিক কোয়ালিশন এলিয়াস, ১৪৪ হচ্ছে ডেমোক্রেটিক কোয়ালিশন। যেদিন স্যার এই গভর্নমেন্টের জন্ম হল সেই দিন থেকে ১৪৪ ধারা। আর স্যার, আমার বিশ্বাস যেদিন এর মৃত্যু ঘটবে সেদিন পর্যন্ত ১৪৪ধারাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে। যা ইতিপূর্বে হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের সে অভিজ্ঞতা আছে, ১৪৪ ধারা, মিলিটারি, সি আর পি এসব দেখা গিয়েছে। সংগ্রামের মাঠে তাঁর ফয়সালা হবে বলেছেন আমাদের কমরেড হরেকৃষ্ণ কোঙার। তিনি বলেছেন, সংগঠনের জোর যদি আমাদের থাকে, মানুষকে আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ করতে পারি তাহলে দেখে নেব। আর একটি কথা বলেই আমি শেষ করব। স্যার, বাংলাদেশে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা হঠাৎ হয়ে যায়নি। এখনে, অনেক মাননীয় সদস্য বলেছেন আমি সেই কথার পুনরাবৃত্তি করতে চাইনা, শুধু এটুকুই বলব, পাকিস্তান হবার পর থেকেই এই আন্দোলন চলছে। কোনদিনই পাকিস্তানের জনগণ এই স্বেচ্ছাচার শাসককে মেনে নেয়নি। পাকিস্তান হবার পর থেকেই তারা দাবি করে আসছেন গণতন্ত্রের, যে দাবি এমন কিছুই ছিল না। ২৫ মার্চের আগে পর্যন্ত তাদের দাবি এইটুকুই ছিল। সেখানে এ ইয়াহিয়া খান এত অত্যাচার করলেন তিনি মিলিটারি দিয়ে এটাকে দাবিয়ে দিতে চেয়েছেন। পাকিস্তানের জনগণকে আমি একথাই বলতে চাই যে, আমাদের বাংলাদেশের আন্দোলন সম্পর্কে যে মনোভাব সেটা শুধু এই জন্য নয়, পাকিস্তান আমাদের প্রতিবেশী, তার থেকেও যেটা বেশী ২৩ বছর আগে আমরা একাই ছিলাম। আমাদের একই ভাষা, একই ঐতিহ্য, একই ইতিহাস, একই সমস্ত জিনিস আমাদের কোন জিনিসে পার্থক্য করা যায়না। আমাদের দেশে যখন জাতীয় মুক্তির আন্দোলন বেড়ে গেল, বিদেশী সম্রাজ্যবাদীরা যখন বুঝল যে, সরাসরি এই দেশ আর শাসন করা যায় না, তখন তারা এই ষড়যন্ত্র করেছিল। তারা দেখলেন যে, ধর্মের নামে একটা বিভেদ আনা যায়, এবং একথা বললে সম্পূর্ণ হবেনা। তারপর মুসলিমলীগ পাকিস্তানের দাবি তুলল এবং তারপর দেশ বিভক্ত হল। শুধু এইটুকুই বললে সম্পূর্ণ হবেনা। কেননা, মুসলিমলীগ এতে কৃতকার্য হত না, যদি এই ষড়যন্ত্রের  শেষদিকে কংগ্রেস নেতারা লিপ্ত হয়ে যেতেন। সেজন্য বলছি, এত বড় অন্যায় যা হল তার জন্য সেই কংগ্রেস এবং সেই মুসলিমলীগ দায়ী। যাদের কোনদিন ইতিহাস ক্ষমা করবেনা। আজকে দেখছি ইতিহাসের পরিহাস। সেই দুটি দল আবার মিলিতভাবে এখানে ডেমোক্রেটিক কোয়ালিশন করছে এবং আমাদের শিক্ষা দেবার চেষ্টা করছে যে, তারা নাকি দেশের ভাল করার চেষ্টা করছে। মাননীয় স্পিকার মহাশয়, আমি আপনার মাধ্যমে আমার শেষ কথা বলে আমার বক্তব্য শেষ করছি। আমাদের নেতা জ্যোতি বাবু যেকথা বলেছেন যে আমরা নিশ্চয়ই প্রস্তাবটি পাস করাব। কিন্ত এর মধ্যে ঐ ট্রেজারি বেঞ্চের লোকদের কতটা আন্তরিকতা আছে সেটা আমাদের ভেবে দেখতে হবে। সেভাবে এটাকে বিচার করতে হবে। আমরা আশা করি এই প্রস্তাবকে কার্যকরী করার জন্য আমরা সমস্ত শক্তি নিয়ে এগিয়ে যাব। এই কথা বলে আমার বক্তব্য শেষ করছি।

শ্রী প্রফুল্ল কুমার সরকারঃ মাননীয় স্পীকার মহাশয়, আজ মুখ্যমন্ত্রী যে প্রস্তাব বাংলাদেশ সম্পর্কে এই সভায় উপস্থাপনা করেছেন আমি ভারতীয় জনসঙ্ঘ দলের পক্ষ থেকে সেই প্রস্তাবকে সর্বান্তকরণে সমর্থন করছি। সমর্থন প্রসঙ্গে আমি কিছু আলোচনা এই সভার সামনে উত্থাপন করতে চাই। মাননীয় স্পিকার মহাশয় নিশ্চয়ই জানেন, দ্বিজাতিতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল। তৎকালীন মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতা জিন্নাহ সাহেব ভারতবর্ষের মুসলমান সমাজকে বুঝিয়েছিলেন একথা যে, ভারতবর্ষের মুসলমান তারা জাতি হিসেবে ভারতীয় নয়। ভারতবর্ষের মুসলমান জাতি হিসাবে  মুসলমান এবং তার  জন্য আলাদা রাষ্ট্র চাই। ব্রিটিশ সরকার মুসলিমলীগের এই দাবির ভিত্তিতে তৎকালীন ভারতবর্ষের কংগ্রেস দলের নেতৃবৃন্দ এই দাবিকে স্বীকার করে নিয়ে ভারতবর্ষকে দ্বিধা বিভক্ত করেছিল। একদিকে পাকিস্তান আর একদিকে ভারতবর্ষ তৈরি করা হয়েছিল। বাংলাদেশ বিভক্ত হয়েছিল এবং বাংলাদেশের একটা অংশ পূর্বপাকিস্তান নামে খ্যাত হয়েছিল। কিন্ত মুসলিমলীগের সাম্প্রদায়িক পরোচনার জন্য ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়েছিল এবং তৎকালীন কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ মুসলিমলীগের এই দাবি স্বীকার করে নিয়ে যে ভুল করেছিল আজকে বহুরকমভাবে ভারতবর্ষের জনতাকে এবং পূর্ববঙ্গের জনতাকে তার খেসারত দিতে হচ্ছে। স্পিকার মহাশয় ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠন করা যায়না। ধর্ম এক হলেও একটা জাতি হয়না। আজকে দিবালোকের মত এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, মুসলমান হিসাবে তারা যে জাতি গঠন করতে চেয়েছিল- পাকিস্তানের এক অংশের মুসলমান আর এক অংশের মুসলমানের উপর আক্রমণ চালাচ্ছে। পাঞ্জাবী, বেলুচি মুসলমানরা বাঙ্গালী মুসলমানের উপর আজকে অত্যাচার চালাচ্ছে। জাতি হিসাবে ধর্ম দিয়ে যে জাতি গড়া যায়না এটা তার পরিষ্কার নিদর্শন। এবং দ্বিজাতিতত্ত্ব সম্পূর্ণরূপে ভ্রান্ত নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা আজকে প্রমাণিত হয়েছে। স্পীকার মহাশয়, মুজিবুর রহমানকে আজকে দেশদ্রোহী বলা হচ্ছে। মুজিবুর রহমান দেশদ্রোহী নয়। মুজিবুর রহমান দেশদ্রোহী নয় এবং আওয়ামীলীগ প্রকৃতপক্ষে সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার। এই কথা আমি এইজন্য বলছি যে, পূর্ববঙ্গে আজকে যে ঘটনা সংগঠিত হচ্ছে সেই ঘটনার পটভূমিকা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে ভারতবর্ষ বিভক্ত হবার পর থেকে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্বপাকিস্তানের জনগণের উপর যে নির্মম শাসন এবং শোষণ চালিয়ে আসা হচ্ছিল, শুধু শাসন এবং শোষণ নয়, তাদের কালচারের উপর, তাদের  কৃষ্টির উপর, বাঙ্গালী সভ্যতার উপর, বাংলা ভাষার উপর যেভাবে অত্যাচার চালানো হচ্ছিল, বাঙ্গালী জাতিকে যেভাবে শ্বাসরোধ করে মারার উপক্রম করা হয়েছিল আজকের ঘটনাবলী তার বিস্ফোরণ মাত্র। মুজিবর  পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে চাননি। মুজিবর চেয়েছিলেন, পাকিস্তানের সংবিধান এমনভাবে তৈরী করা হোক যে, সংবিধানের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্বপাকিস্তানকে শোষণ, শাসন, অত্যাচার করতে না পারে তার ব্যবস্থা থাকবে। কিন্ত কেন্দ্রে একটা সরকার থাকুক এটা মুজিবর রহমান বা আওয়ামীলীগ চেয়েছিলেন এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিও আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে রাখা হয়েছিল। কিন্ত ইয়াহিয়া আর ভুট্টো ষড়যন্ত্র করে। কিন্ত আওয়ামীলীগ বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভ করেছিলেন এবং পূর্ববঙ্গের মানুষদের একত্রিত করে এক জায়গায় এনেছিলেন। তার ফলে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকরা ভীত এবং সন্ত্রস্ত হয়েছিলেন। তাই কিভাবে এই জাতিকে নস্যাৎ করা যায় তারা সেই চক্রান্ত তারা করেছিলেন এবং তারপর ১১দিন ধরে সেখানে আলাপআলোচনার নাম করে ভিতরে ভিতরে সামরিক সমস্ত প্রস্তুতি চালিয়ে তারা গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন এবং গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে হঠাৎ ২৫ তারিখে আলোচনা ভেঙ্গে দিয়ে আবার নতুন করে সামরিক শাসন প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। তখন সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা হয়ে গেল এবং মুজিবর স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। তাই আজকে বাঙ্গালী জাতি সেখানে মরণপণ করে স্বাধীনতার জন্য লড়ছেন। আমরা বাঙ্গালী হিসাবে মনে করি ওরা আমাদের স্বজাতি, তারা বাঙ্গালী জাতি, পাকিস্তানী নয়, মুসলমান নয়, বাঙালী জাতি। সেখানে হিন্দুরাও স্বাধীনতার জন্য লড়ছেন, মুসলমানরাও স্বাধীনতার জন্য লড়ছেন। কাজেই সেখানকার স্বাধীনতা সংগ্রামকে বাঙ্গালী জাতি হিসাবে- এটা আমাদের দেশের একটা অংশ ছিল, ভারতবর্ষের একটা অংশ ছিল, সে অংশ ঐ সামরিক একনায়কতন্ত্রের কবল থেকে ছিনিয়ে আনবার জন্য আমাদের সর্বপ্রকার সাহায্য দান করা প্রয়োজন। যদি অস্ত্র সাহায্যের প্রয়োজন হয় সে সাহায্য আমাদের করতে হবে। আমি সঙ্গে সঙ্গে উল্লেখ করতে চাই আজকে বিরোধীদলের মাননীয় নেতা বক্তব্যের সময় যে কটাক্ষ করেছেন এখন এই কটাক্ষের সময় নয়। আর একটি কথা আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই যে, সীমান্তের ওপার থেকে দশ লক্ষের বেশী লোক এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে এবং তারা সম্পূর্ণ নিরাশ্রয় এবং আরও বহুসংখ্যক লোক এখানে এসে উপস্থিত হবে। আমি মুর্শিদাবাদের সীমান্ত থেকে এসেছি। আমাদের এলাকা থেকে সংবাদ পেয়েছি যে, প্রতিদিন ১০হাজার করে লোক একমাত্র জলঙ্গী সীমান্ত অতিক্রম করে উপস্থিত হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ রাস্তার উপর অবস্থান করছেন এবং হাজার হাজার মানুষের কোনরকম আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়নি। মাননীয় স্পীকার মহাশয়, আপনি সরকারের কাছে অনুরোধ রাখবেন যেন এই সমস্ত লোকদের জন্য উপযুক্ত আশ্রয়ের ব্যবস্থা অবলম্বন  করা হয়। এই কথা বলে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি।

শ্রী গোপাল বসুঃ মিঃ স্পীকার, স্যার লবির বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাফেরা  অধিকার আপনি খর্ব করতে চান? আপনি কে এস বির লোকদের এখানে থাকতে অনুমতি দিয়েছেন। তা না হলে তাঁরা এখানে কি করে আসে? সেদিনও এই নিয়ে গোলমাল হয়েছে, আজকে আবার তারা এখানে এসে ঘোরাফেরা করছে। আমি জানি, আপনি পারমিশন দেননি, অথচ তারা এখানে ঘোরাফেরা করছে। আমাদের মেম্বারদের অসুবিধা সৃষ্টি করছে। এটা যদি এভাবে চালান তাহলে আপনি আমাদের বলে দিন যে, পারমিশন দিয়েছি- তাহলে আমরা বুঝতে পারছি আপনার অনুমতি আছে, আর যদি না হয় সেটা খুলে বলুন। আর যদি না হয়- সেটা আপনি পারমিশন দেবেন না- আমাদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করবার জন্য নয়, অধিকার রক্ষা করবার জন্য। কাজেই ওটা যাতে বন্ধ হয় তার জন্য স্ট্রিক্টলি আপনার অফিসে বলুন।

মিঃ স্পীকারঃ এর আগেও আমি আপনাদের অভিযোগ লক্ষ্য করেছিলাম। আজও আপনি অভিযোগ করলেন। আমি দেখব যাতে কোন মাননীয় সদস্যের অধিকার ক্ষুণ্ণ না হয়।

শ্রী দিলীপ কুমার রায়ঃ মাননীয় স্পীকার মহাশয়, মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মহাশয় এখানে যে প্রস্তাব রেখেছেন তার প্রতি আমার পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে আমার বক্তব্য রাখতে চাই। তার সাথে সাথে ওপার বাংলার যারা শোষণ থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম করছে, তাদের জানাই আমার অভিনন্দন।

মাননীয় স্পীকার মহাশয়, আপনি জানেন হিন্দু- মুসলিম এই দুই জাতি এই ভিত্তিতে ভারতকে ভাগ করা হয়েছিল। সেদিন আমরা ফরওয়ার্ড ব্লকের তরফ থেকে তীব্র প্রতিবাদ করেছিলাম। আজকে অনেক মাননীয় সদস্য এখানে উপস্থিত আছেন, তাঁরা সেদিন তাঁদের দ্বিজাতিতত্ত্বকে মেনে নিয়ে এই দেশ বিভাগকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। আজ ওপার বাংলায় যা ঘটছে তা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে, দ্বিজাতিতত্ত্ব ভ্রান্ত এবং তাদের বক্তব্যও ভ্রান্ত।

মাননীয় স্পীকার স্যার, আমি এই প্রসঙ্গে বলতে চাই যে, ওপার বাংলায় ইয়াহিয়া সরকার যে বর্বর আক্রমণ চালাচ্ছে সেই ঘটনার বিবরণ দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিনা। তবু আমি বলতে চাই ওপারের যে আন্দোলন সে আন্দোলন জাতীয়তাবাদের আন্দোলন, দেশপ্রেমের সংগ্রাম, গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রাম। কিন্ত আমরা কি দেখছি! ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে, আজকে অনেক প্রগতিশীল রাষ্ট্র যারা সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার তারা নিরব হয়ে আছে। দক্ষিণআফ্রিকা, রোডেশিয়া, আরব এদের প্রশ্নে যারা সোচ্চার, ভিয়েতনামের নামে যারা মুখরিত, আজকে তাদের নীরবতার কি কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। আমি মনে করি এই হাউসের পক্ষ থেকে এই নীরবতার বিরুদ্ধে ধিক্কার জানানো হোক।

আমি সীমান্ত কোচবিহার জেলার প্রতিনিধি। আমি সেখানে বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি, মুক্তিফৌজের অনেকের সাথে কথাবার্তা বলেছি। আমি তাঁদের অটুট মনোবল লক্ষ্য করেছি। তাঁরা আমায় একথা বলেছেন, আমাদের দেশে দুর্ভিক্ষ আসে নি, আমাদের দেশ বন্যাপীড়িত নয় আমাদের দেশে মহামারী দেখা দেয় নাই। কাজেই শুধু অন্নবস্ত্রের এই সাহায্য দিলে চলবে না, আমাদের অস্ত্র দিন যাতে ইয়াহিয়া সরকারের আক্রমণকে প্রতিহত করতে পারি। এই দুঃখের দিনে আমরা আক্রান্ত হলেও ভারত সরকার নীরব। আজকে যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে অস্ত্রশস্ত্র জন্য তার উল্লেখ করে আমি বলতে চাই শুধু অস্ত্রশস্ত্র নয় আমাদের এমন গণআন্দোলন এবং জনমত সৃষ্টি করতেও হবে যাতে বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্র স্বাধীন বাংলা সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং সর্বতোভাবে সাহায্য করে তাদের সংগ্রামকে সাফল্যমণ্ডিত করতে সচেষ্ট হয়। এই প্রসঙ্গে আমি বলতে চাই ওপার বাংলা থেকে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু এই বাংলায় এসেছে। আমি দেখেছি আমাদের হলদিবাড়ি থানায় প্রায় দু’ লক্ষ লোক এসেছে। মাননীয় মন্ত্রী সন্তোষ রায় মহাশয় সেখানে গিয়েছিলেন কিন্ত আজকে ১৫-১৬ দিন হল লক্ষ লক্ষ লোক যারা গাছতলায় পড়ে রয়েছে, কোন আশ্রয় পাচ্ছেনা, কোন খাদ্য পাচ্ছেনা, তাদের কোন ব্যবস্থা হচ্ছেনা, আমি মন্ত্রী মহাশয়কে সব জানিয়েছি। কিন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। কাজেই সরকারী দানের কথা উল্লেখ করে বলতে চাই যে, যুদ্ধকালীন ব্যবস্থা যেমন নেওয়া হয়, সেইভাবে জেন অতিসত্বর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এই দাবি রেখে আমার বক্তব্য শেষ করছি।

শ্রী তিরিবরণ ভাদুড়িঃ মাননীয় স্পীকার মহাশয়, আজকের এই সভায় আমাদের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী অজয় কুমার মুখোপাধ্যায় যে প্রস্তাব রেখেছেন সেই প্রস্তাবের বিশেষ সারমর্ম দেখেছি, দিল্লীর মসনদে গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী কংগ্রেস সরকার সেই মসনদে সুপ্রতিষ্ঠিত। যে কংগ্রেস সরকার গণতন্ত্রের কথা না বলে, প্রগতিবাদের কথা না বলে সকালবেলা জল গ্রহণ করেন না, সেই সরকারের কাছে আজকে আমাদের বাংলাদেশের স্বাধীন সরকারের দাবি এবং ইয়াহিয়া সরকারের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র বাংলাদেশের জনগণের উপর যে ব্যবহার হচ্ছে তার বিরুদ্ধে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র প্রয়োজনের দাবি জানানো হয়েছে। মনে হচ্ছে এই দাবি একটা কাগজে লেখা ছাড়া আর কিছু নয়। কেননা, আজকে দীর্ঘদিন পর দেখছি, প্রায় দেড় মাস হয়ে গেল নিছক একটা ভাওতা দিয়ে ইন্দিরা সরকার সামান্য একটা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, ঘোষণা দেবই, অস্ত্রশস্ত্র দেবই। এই ঘোষণা দিলেই আমাদের অস্ত্রশস্ত্র দিতে বেশী দেরী লাগবে না। কিন্ত দেখছি, আজকে প্রায় দেড় মাস হয়ে গেল এখনও সেই ঘোষণা এল না, অস্ত্রশস্ত্রের কথা আলাদা। সেই সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পাচ্ছি পূর্ব বাংলার জনগণ ইয়াহিয়া সরকারের অত্যাচারে আমাদের মা বোনেরা যেভাবে আজকে পদ্মা পেরিয়ে এবং বিভিন্ন বর্ডার পেরিয়ে আমাদের এই অঞ্চলে বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষে আশ্রয় নিয়েছে তাঁর প্রতি কণামাত্র সাহায্য তো দূরের কথা সমবেদনা পর্যন্ত দেখাতে পারছেন না এটি দুঃখের বিষয়। যে কংগ্রেস সরকার বাংলাদেশের মুসলিমলীগের সঙ্গে কোয়ালিশন করেছেন, সেই মুসলিমলীগের কোন সদস্যকে আজ দেখতে পাচ্ছি না। বেলেডাঙ্গায় প্রায় একমাস আগে মস্ত বড় জনসভা করে মুসলিমলীগের মন্ত্রীগণ কথা বলেছেন এবং প্রচুর লোক তাদের কাছে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনারা পূর্ববাংলায় যে জনযুদ্ধ বা গনমুক্তির যুদ্ধ চলছে সেই যুদ্ধের ব্যাপারে আপনাদের ভূমিকা কি? বড় দুঃখ, লজ্জা, ক্ষোভের সঙ্গে আজকে আমাকে সভায় বলতে হচ্ছে যে, তাদের মুখ দিয়ে একটি কণা কথাও বেরোয়নি। তার কাছে অনেক মুসলমান ছেলে, আমার দলের অনেক মুসলমান লোক চিরকুট দিয়ে বলেছিলেন যে, মোল্লা সাহেব সাহেব বলুন পূর্বপাকিস্তানে যে লড়াই চলছে সেই লড়াই সম্পর্কে আপনাদের ভূমিকা কি? সেই ভূমিকা আমরা গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী কংগ্রেসীরা যে কোয়ালিশন সরকার প্রতিষ্ঠিত করেছেন তাঁদের কাছে কতখানি আশা করব। ওনারা আবার গণতন্ত্রের কথা বলেন। ভাঁওতা দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রেখেছেন। আমরা তাই দেখতে পাচ্ছি অবিলম্বে কথাটা তারা ব্যবহার করেছেন। আমরা পূর্বেই দেখেছি এই সমস্ত কথা ব্যবহার করা হয় সাধারণ মানুষকে ধোঁকা বা ভাঁওতা দেবার জন্য। আমরা তাই বলতে চাই অবিলম্বে কথাটা বাদ দিয়ে একটা সময় বেঁধে দেওয়া হোক দশ দিন কি সাতদিন কি পনের দিন সেই সময়ের ভেতর যদি ইন্ডিয়া সরকার যদি আমাদের দাবি মেনে না নেন তাহলে আন্দোলনের মাধ্যমে তা আমাদের আদায় করে নিতে হবে এই কথা এই সভায় সমস্ত সদস্যের বিবেক বুদ্ধির প্রশ্ন নিয়ে বলা উচিত। জয়নাল আবেদিন মহাশয় অনেক বড় বড় সুন্দর সুন্দর কথা বললেন। কিন্ত তাঁদের কাছে আমার প্রশ্ন তাঁরা তো বলেছিলেন আকার ইঙ্গিতে যে আমরা স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিচ্ছি, অস্ত্রশস্ত্র দিচ্ছি। কিন্ত কোথায় দিচ্ছেন? কই তাঁদের ইন্দিরা সরকার তো এখনও দিচ্ছেন না। বড় গলা করে জোতদার জমিদারদের বিরুদ্ধে বলেছিলেন, কিন্ত বাংলাদেশের অবস্থা আমরা দেখতে পাচ্ছি। সামান্য গরীব জমির মালিক সি আর পির অত্যাচারে জোতদারদের সহযোগিতায় জমি থেকে উৎখাত হচ্ছে। এই সমস্ত দেখে আমাদের লজ্জা ক্ষোভ লাগে। আমরা সরকারের চরিত্র দেখতে পাচ্ছি। এই সরকারের কাছে মৌলিক একটা প্রস্তাব দিলেই আমাদের সমস্ত দাবি আদায় হবে না। আমাদের দাবি আদায় করতে হবে আন্দোলনের বিরুদ্ধে। গণআন্দোলন ছাড়া প্রতিক্রিয়াশীল চক্রদের কাছ থেকে কোন দাবি আদায় করা যাবেনা। মিঃ স্পীকার স্যার, কবির সুরে একটি কবিতা আমার মনে জেগে উঠেছে—

                      সাবাস বাংলাদেশ-

                   এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়,

                   জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার তবু

                     মাথা নোয়াবার নয়।

মিঃ স্পীকার স্যার, বাংলাদেশের যে সমস্ত অগণিত যুবক, ছাত্র, অগণিত ভাই, বোন, যে বিপ্লবী চেতনা, যে বিপ্লবী উন্মেষ তুলে ধরেছেন তাকে অভিনন্দন জানিয়ে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি।

শ্রী সুধীর চন্দ্র বেরাঃ মাননীয় স্পীকার মহোদয়, আমি মুখ্যমন্ত্রী কর্তৃক যে প্রস্তাব এই সভায় আনা হয়েছে তা সর্বান্তকরণে এবং পূর্ণভাবে সমর্থন করি। আমি এখানে দেখলাম আলোচনার মাধ্যমে এই প্রস্তাব সমর্থন করতে গিয়ে কোন কোন রাজনৈতিক দল নিজেদের মূলধন বাড়াবার চেষ্টা করেছেন। এটা আমি তীব্রভাবে নিন্দা করছি। পূর্ববাংলার এই স্বাধীনতা সংগ্রাম বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ স্বাধীনতার জন্য মানুষের সংগ্রাম জন্মগত। মাননীয় অধ্যক্ষ মহাশয়, আপনি যদি ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখেন তাহলে দেখবেন মানুষ তার আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের জন্য অনেক রক্ত, অনেকে জীবন দিয়েছে। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে আরম্ভ থেকে ফরাসী বিপ্লব প্রভৃতির মধ্য দিয়ে একথাই স্বীকৃত হয়ে এসেছে যে প্রতিটি জাতির তার স্বাধিকার রক্ষার অধিকার থাকবে, তার আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার থাকবে। পূর্ববাংলার লোক যখন তাদের স্বাধিকার প্রয়োগ করতে গেল তখন মদগর্বী ইয়াহিয়ার আঘাত লাগল; তিনি পাল্টা আঘাত লাগালেন। মাননীয় স্পীকার মহাশয়, আপনি জানেন পূর্ববাংলায় যে সংগ্রাম হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানের মিলিত সংগ্রাম এর নজির ভারতবর্ষের ইতিহাসে দুর্লভ এবং পৃথিবীর ইতিহাসে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। এই স্বাধীনতা সংগ্রামের তিনটি পর্যায়ে বিভক্তি দেখতে পাই। প্রথম হচ্ছে- অহিংস অসহযোগ আন্দোলন, দ্বিতীয় হচ্ছে- সশস্ত্র সংগ্রাম এবং তৃতীয় হচ্ছে- স্বাধীনতা ঘোষণা। ভারতবর্ষের মধ্যে অনেকে অভিযোগ করেছেন- কংগ্রেস সরকার দেড় মাস পর্যন্ত ঘুমিয়েছিলেন। তাঁরা যদি একটু ভেবে দেখেন তাহলে দেখবেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার করার আগ পর্যন্ত এটা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার ছিল এবং আন্তর্জাতিক আইনে আমরা সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারতাম না। কিন্ত যে মুহূর্তে তারা সরকার গঠন করেছেন এবং স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন সেই মুহূর্তে থেকে সংগ্রামী রূপ বদলে গিয়েছে এবং আজকে তাদের স্বীকৃতি দিলে সার্বভৌম সরকার হবে এবং তার উপর হস্তক্ষেপ করলে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের আওতায় পড়ে। দুঃখের বিষয়, আজ বড় শক্তি, বিগ পাওয়ার্স, যাদের বিগ ব্রাদার্স হওয়া উচিত ছিল তারা স্বীকৃতি দেয়নি এবং আমরা স্বীকৃতি দাবি করছি কারণ আমরা মনে করি বাংলাদেশ সরকার- জনগণের দ্বারা জনগণের সরকার – এবং জনগণের সরকার পৃথিবী থেকে মুছে যেতে পারেনা।

এই বলে বাংলাদেশ সরকার এবং জনগণকে অভিনন্দন জানিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি।

শ্রী এ এইচ বেসটারউইচঃ স্যার শেষ করার আগে আমি একটি পয়েন্ট অব অর্ডার আনতে চাই। গতকাল পরিবহন নিয়ে আমাদের কথা হয়েছিল কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সরকারিপক্ষ থেকে আমরা কোন তথ্য পাইনি। অথবা কোন নির্দেশনাও পাই নাই যে এটা করা হবে কিনা। আমি শুনেছি কিছু কিছু দল তাদের মত করে পরিবহনের ব্যাবস্থা করেছে কিন্তু সেটা সবার জন্য সম্ভব না। ১৬৯২ সাল থেকে পরিবহনের ব্যাপারটি প্রচলিত আছে কিন্তু আজ আয়োজনের এই অবস্থা দেখে আমি হতাশ। তাই আমি এটা উত্থাপন করছি এবং সরকার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন পর্যন্ত আমি কোন ব্যাবস্থা দেখতে পাচ্ছিনা।

মি: স্পীকারঃ জনাব বেস্টউইচ, আমি এটার খোঁজ অন্যদের কাছ থেকে নিয়েছি। আপনি আমার কাছে প্রস্তাব দিয়েছেন যে সদস্যদের বাসায় যাবার জন্য খরচ দেয়া উচিৎ। আমি বিরোধী দলের কয়েকজনের সাথে কথা বলেছি। তারা আমাকে বলেছে তাদের নিজস্ব ব্যাবস্থা আছে। এই অবস্থায় সরকার বা বিরোধী দলের চিপ হুইপ কারো পক্ষ থেকেই আমার কাছে কোন অনুরোধ আসেনি। তাই আমি দেখতে পাচ্ছি শুধুমাত্র জনাব বেসটারউইচ আমাকে এটার জন্য চাপ দিচ্ছেন এবং অন্য কেউ এরকম করছেন না। যদি যথেষ্ট সংখ্যক সদস্য এটা দাবী করেন তাহলে তারা তাদের দলের চিপ হুইপ মার্ফত আমাকে জানালে আমি পরবর্তি ব্যাবস্থা নেবার চেষ্টা করব। কিন্তু এখন পর্যন্ত জনাব বেসটারউইচ ছাড়া এটা কেউ চাচ্ছেন না। তাই আমি মনে করি এই ব্যাপারে সরকারের পদক্ষেপ নেয়া ন্যায়সঙ্গত নয়। এর পরেও যদি আপনার খুব দরকার পরে তাহলে আপনি বিভিন্ন দলের চিপ হুইপের সাথে আলোচনা করে আমার চেম্বারে যোগাযোগ করতে পারেন। তখন আমি সরকারকে অনুরোধ করব প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নিতে।

শ্রী জনাব বেস্টারউইচঃ স্যার, ১৯৬২ ও ১৯৬৭ সালে আমি এটা উত্থাপন করেছিলাম এবং এখনো আমিই সবার পক্ষে থেকে এটা উত্থাপন করলাম। কোন সদস্য যদি তাদের নিজেদের জন্য কোন ব্যাবস্থা করে থাকেন তাতে অন্যান্য সদস্যদের কোন লাভ নেই। আমরা গরিব মানুষ। আমাদের এরকম আয়োজন বা ব্যাবস্থা করার সামর্থ্য নেই। আমাদের বলতেই হবে- কারণ গভীর রাতে ট্যাক্সি বা বাস পাওয়া যায়না।

মি: স্পীকারঃ দুর্ভাগ্যজনক জনাব বেসটারউইচ, কেউ আপনার প্রস্তাবকে সমর্থন দিচ্ছেনা।

শ্রী সুধিন কুমারঃ আপনার এটা গৃহীত হলে খুব কম সংখ্যক সদস্যই এই সুবিধা গ্রহণ করবে।

মি: স্পীকারঃ আমি সন্মানিত সদস্যদের অনুরধ করব ১২ ও ১৩ তারিখে আমার চেম্বারে দেখা করতে।

শ্রী সুবোধ ব্যানার্জিঃ স্যার হাউজের সবার পক্ষে দেখা করা সম্ভব না। সরকার গত কয়েক বছর ধরে এসব করছেন। সরকারের উচিৎ এটা করে দেয়া। ক্ষতি কি?

মি: স্পীকারঃ আমাকে জনাব গোপাল বসু ও অন্যান্যরা বলেছেন যে তাদের নিজস্ব ব্যাবস্থা আছে।

 

শ্রী জ্যোতি বসুঃ ঐ ব্যবস্থাটা কংগ্রেস গভর্নমেন্টেরও ছিল। তিনটা রুটে তিনটা বাস ছিল। যে রুট দিয়ে যে যে বাস যেত মেম্বাররা সেই বাসে চলে যেতেন। এখন আমরা নিজেরাই ব্যবস্থা করছি। কারণ জীবন নিয়ে টানাটানি। বাস থেকে টেনে নিয়ে মারছে। ওপক্ষ একটা ব্যবস্থা করেছেন। কিন্ত অন্যেরা এসব বাস অ্যাভেল করতে পারছেন না। সেজন্য বলছি যে, সোমবার থেকে একটা কিছু ব্যবস্থা যদি করেন তাহলে ভালই হয়।

মি: স্পীকারঃ আমার কোন আপত্তি নেই।

শ্রী রাম চ্যাটার্জিঃ আমাদের যেটা আছে সেটা রাখতে হবে। কারোর পকেট থেকে দিতে বলছি না। গভর্নমেন্টের খরচে বাস আসে যায়। এতে একপক্ষ লাভ করবে, আর একপক্ষ লাভ করবে না, সেটা হবেনা। আমাদের মেম্বাররা হাঁটতে হাঁটতে ফিরছে, আর একপক্ষ বাসে করে চলেছে সেটা হবেনা।

শ্রী অজিত কুমার পাঞ্জাঃ সরকারের জানা মতে কোন সদস্য সরকারের কাছে পরিবহনের ব্যাপারে কোন মতামত বা অনুরোধ করেনি। তবেযদি কেউ করে আমরা ব্যাপারটা দেখব।

শ্রী গোপাল বসুঃ আপনি তো একটা অ্যারেঞ্জমেন্ট করে দিলেই পারেন।

মি: স্পীকারঃ আপনারা নিজেরাই বলেছেন যে, আপনাদের ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। আমিও দেখলাম অলমোস্ট অল দ্যা মেম্বার্স তাঁরা নিজেদের ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। হয়ত দু-চারজনের কিছু অসুবিধা হতে পারে সেজন্যই বোধহয় তাঁরা কিছু বলেননি।

শ্রী সুবোধ ব্যানার্জিঃ গভর্নমেন্ট শুনেছেন, অ্যারেঞ্জমেন্ট করবেন। এতে এত আলোচনার দরকার কি আছে? ওঁরা শুনেছেন। আগে যেরকমভাবে চলত সেইরকম একটা অ্যারেঞ্জমেন্ট করবেন। আটটা বেজে গেছে। আমাদের শুধু জীবন নয়, প্রেস গ্যালারিও আছে। ওদেরও আমাদের দেখতে হবে। কাজেই আমরা একটু তাড়াতাড়ি ফিনিশ করি।

মি: স্পীকারঃ আমি এখন প্রধানমন্ত্রীকে তার জবাব দিতে অনুরোধ করছি।

শ্রী অজয় কুমার মুখোপাধ্যায়ঃ আমার আর কিছু যোগ করার নেই।

শ্রী সুবোধ ব্যানার্জিঃ এটা খুব ভালো জবাব।

মি: স্পীকারঃ আলোচনা এখানেই শেষ হল।

শ্রী অজয় কুমার মুখার্যি বললেন –

‘’ বিগত ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত আওয়ামীলীগের অসামান্য ও ঐতিহাসিক সাফল্যের মধ্যে প্রকাশিত জনগণের সুস্পষ্ট রায়কে পদদলিত করিয়া বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনগণের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সামরিক শাসক চক্রের যে নারকীয় গণহত্যাভিযান চালাইতেছেন পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা তাকে ধিক্কার জানাইতেছে এবং বাংলাদেশের জনগণ পূর্ণ জাতীয় স্বাধীনতার জন্য যে মরণপণ সশস্ত্র সংগ্রাম চালাইতেছেন তাঁর প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ও সেই সঙ্গে সংগ্রামী জনগণকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাইতেছে।

পাকিস্তানের সামরিক শাসকচক্র যাহাতে অবিলম্বে এই বর্বর গণহত্যা বন্ধ করিতে এবং বাংলাদেশ হইতে তাহার সমস্ত সামরিক বাহিনী তুলিয়া লইতে বাধ্য হয় তাহার জন্য উপযুক্ত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এই বিধানসভা ভারত সরকারসহ অন্যান্য দেশের সরকারের নিকট আবেদন করিতেছে।

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা এই বিশ্বাস রাখে যে, তাহাদের সংগ্রাম বর্তমানে যতই কঠোরও প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হোক না কেন বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণ শেষপর্যন্ত জয়লাভ করিবেনই। এই সভা আরও আশা রাখে যে, যেহেতু এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম সর্বপ্রকার আধুনিক মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত পাকিস্তানের সামরিক শাসকচক্র কর্তৃক বাংলাদেশের জনগণের উপর চাপাইয়া দেওয়া হইয়াছে এবং ইহা জাতীয় স্বাধীনতার জন্য অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত সংগ্রাম সেই হেতু ইহা শুধু জাতীয় জনগণের নিকট নহে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের এমনকি পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজ্যের নিকট হইতেও ক্রমবর্ধমান সমর্থন লাভ করিবে।

বাংলাদেশের জনগণের  জাতীয় স্বাধীনতার মরণপণ সংগ্রামের প্রতি আশু ও জরুরী কর্তব্যের কথা বিবেচনা করিয়া এই বিধানসভা ভারত সরকারের কাছে দাবি জানাইতেছে যে, অনতিবিলম্বে বাংলাদেশের সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রও তাঁহার সরকারকে স্বীকৃতি এবং অস্ত্রশস্ত্র সহ সর্বপ্রকার প্রয়োজনীয় কার্যকরী সাহায্য দিতে হইবে। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ নরনারী যখন রক্ত দিতেছেন, তখন পশ্চিমবঙ্গের জনগণ আহার কমে কিছুতেই রাজী হইতে পারেন না।

এই ব্যবস্থাগুলি গ্রহণ করিতে যতই দেরী হইতেছে ততই বাংলাদেশের জনগণের দুঃখ, দুর্গতি, লাঞ্চনা বৃদ্ধি পাইতেছে। ইহাতে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ও জনগণ গভীর উদ্বেগ বোধ করিতেছে। এই অবস্থায় যাহাতে অবিলম্বে উক্ত দাবিগুলো স্বীকৃত তাহার জন্য ভারত সরকারের উপর প্রয়োজনীয় চাপ সৃষ্টি করার জন্য বিধানসভা, পশ্চিমবঙ্গের জনগণ ও সরকারের নিকট আহবান জানাইতেছে।

ব্যাপক নরহত্যার মুখে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধা সীমান্ত পার হইয়া পশ্চিমবাংলায় চলিয়া আসিতে বাধ্য হইতেছেন। সৌভাতৃতের ও মানবতার অপরিহার্য অঙ্গ হিসাবে তাঁহাদের জন্য সর্বরকম প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা একান্ত দরকার। এই পশ্চিমবঙ্গ ও উহার পার্শ্ববর্তী সীমান্তরাজ্যগুলির আর্থিক ক্ষমতার বাহিরে। এই কঠিন সত্য বিবেচনা করিয়া পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভারত সরকারের নিকট এই বিষয়ে যাবতীয় ব্যয়ভার বহনের জন্য দাবি জানাইতেছি’’

মি: স্পীকারঃ আজকের অধিবেশন শেষ হল।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৮৮। বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগে ‘সংগ্রামী স্বাধীন বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি’ গঠিত দৈনিক আনন্দবাজার ৮ই এপ্রিল, ১৯৭১

 

দীপংকর ঘোষ দ্বীপ

<১২, ৮৮, ২৮৩>

বুদ্ধিজীবী সাহিত্যিক শিক্ষাবিদদের সংস্থা

সংগ্রামী স্বাধীনবাংলাদেশসহায়ক সমিতি

গত ৪ঠা এপ্রিল পশ্চিম বাংলার বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবি, প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, সমাজকর্মী, সাংবাদিক প্রভৃতি ভারতীয় সংস্কৃতি ভবনে মিলিত হয়ে ‘সংগ্রামী স্বাধীন বাংলাদেশে সহায়ক সমিতি’’ নামে একটি সংস্থা গঠন করে। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সম্ভাব্য সকল উপায়ে সাহায্য করা এই সমিতির উদ্দেশ্য।

ইতিপূর্বে মুখ্যমন্ত্রী শ্রী অজয় কুমার মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা সহায়ক কমিটি (কমিটি ফর অ্যাসিসট্যান্স টু দ্য ফ্রিডম স্ট্রাগল ইন বাংলাদেশ) নামে যে সংস্থা গঠিত হয়েছে, এই সমিতি তাঁর সঙ্গে যোগ রেখে কাজ এবং সমিতির অর্থ সংগ্রহ এবং অন্যান্য সাহায্য ওই কমিটির মাধ্যমে যথাস্থানে পাঠানো হবে।

নতুন এই সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন শ্রী তারা শংকর বন্দোপাধ্যায়। শ্রী সন্তোষ কুমার ঘোষ এবং শ্রী বিনয় সরকার যথাক্রমে কোষাধ্যক্ষ এবং যুগ্ম-সম্পাদক। সমিতির কার্যালয়ঃ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন হল, ৬২, বিপনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিট, কলকাতা।

সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত একটি প্রস্তাবে সমিতি বাংলাদেশ পশ্চিম পাকিস্তানী জংগীশাহীর গণহত্যা, ধ্বংসলীলা, নারীধর্ষণ এবং লুণ্ঠনের তীব্র নিন্দা করেন। প্রস্তাবে বলা হয়, ভারত সরকার যেন কালবিলম্ব না করে শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ঔষধাদি এবং অন্যান্য সকল রকম সাহায্য পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।

সেদিনের সভায় বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিদের হত্যার জন্য এবং ওখানে রেড-ক্রসের প্রবেশ নিষিদ্ধ করার জন্য পাকিস্তানী জংগীশাহীর প্রতি ধিক্কার প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশের অবস্থা নিরুপণ করার জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জকে একজন পরিদর্শক পাঠানোর ব্যবস্থা করতেও অনুরোধ করা হয়।

মুক্তিযোদ্ধাদের নানা রকম সাহায্যের দরকার। সকলকে তাঁদের সাধ্যমত দান সমিতির দফতরে শ্রী সন্তোষ কুমার ঘোষের নিকট পাঠাতে অনুরোধ করা হয়েছে।

দৈনন্দিন কাজ চালানোর একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হয়েছে। তার সভাপতি শ্রী এস পি মিত্র।

প্রথম দিনের সভায় উপস্থিত ছিলেন : সর্বশ্রী তুষার কান্তি ঘোষ, মনোজ বসু, এস পি মিত্র, নির্মল ভট্টাচার্য, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, শৈবাল গুপ্ত, প্রবোধ কুমার সান্যাল, এন দত্ত মজুমদার, পি বসু মল্লিক, এস কে দত্ত, রঘুবীর চক্রবর্তী, এস ব্যানার্জী, ও পি শাহা। এছাড়া সমিতির আছেন শ্রী সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, শ্রী এস এন সেন, শ্রীমতি রমা চৌধুরী, শ্রী পি কে বসু প্রভৃতি।

৬ এপ্রিল সমিতির অপর এক সভায় একটি কো-অরডিনেশন কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটিতে আছেনঃ সর্বশ্রী মনোজ বসু, প্রবোধ কুমার সান্যাল, অজিত রায় মুখার্জি, হরেন মজুমদার, নির্মল ভট্টাচার্য, সুশীল রায়, শৈবাল গুপ্ত, সন্তোষ কুমার ঘোষ (শেষোক্ত দুইজন যুগ্ম-আহবায়ক) অন্যান্য যেসব সংস্থা বাংলাদেশের সাহায্যকল্পে কাজ করছেন, কো-অরডিনেশন কমিটি তাদের সঙ্গে যোগ রক্ষা করবেন এবং দেখবেন যাতে সকলের কাজ যুক্ত হয়ে বাংলাদেশের সংগ্রামকে তার লক্ষ্যের পথে নিয়ে যেতে সাহায্য করে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৮৯। পূর্বাঞ্চলের পাঁচজন মুখ্যমন্ত্রীর আহবানঃ শরণার্থী প্রশ্নকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে গন্য করা হোক দৈনিক আনন্দবাজার ৯ মে, ১৯৭১

 

দীপংকর ঘোষ দ্বীপ

<১২, ৮৯, ২৮৪২৮৫>

শরণার্থীদের প্রশ্নকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে গণ্য করা হোক

কলকাতায় মুখ্যমন্ত্রীদের আবেদন

(স্টাফ রিপোর্টার)

শনিবার মহাকরণে পূর্বাঞ্চলের পাঁচটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের জরুরী বৈঠকে স্থির হয় যে, কেন্দ্রকে তাঁরা এই অনুরোধ জানালেন যে, বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের শুধু সংশিষ্ট রাজ্যগুলির সমস্যা বলে গণ্য না করে জাতীয় সমস্যা বলে গণ্য করা হোক।

দলে দলে আগত এই আশ্রয়প্রার্থীদের আশ্রয়, খাদ্য, স্বাস্থ্যরক্ষা ইত্যাদি গুরুদায়িত্ব বহনে অংশগ্রহণের জন্য মুখ্যমন্ত্রীরা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি এবং সব স্বাধীন রাষ্ট্রকে অনুরোধ জানাতে মনস্থ করেন।

জানা গিয়াছে যে পশ্চিম বংগে বিধান সভায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের দাবী জানিয়ে গৃহীত সর্বসম্মত প্রস্তাবটি কেন্দ্রীয় সরকারকে পাঠানো হচ্ছে।

এদিন রাত্রে দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধীর সংগে ওই সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে যাওয়ার প্রাক্কালে পাঁচটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী একত্রে মিলিত হয়ে একটি সর্বসম্মত বক্তব্য প্রণয়ন করেন। এই বৈঠকে আসামের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী মহেন্দ্রমোহন চৌধুরী, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী কর্পুরী ঠাকুর, ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শ্রী শচীন্দ্রলার সিংহ, মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী ইলিয়মসন সংমা এবং পশ্চিম বংগের উপ-মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বিজয় অজয় কুমার মুখোপাধ্যায় প্রায় দু ঘন্টা ধরে আলোচনা করেন। এছাড়া বৈঠকে পশ্চিম বংগের উপ-মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বিজয় সিংহ নাহার রাজ্য মন্ত্রিসভায় বাংলাদেশ সাব-কমিটির সদস্য হিসেবে শ্রী সন্তোষ রায় এবং ডাঃ জয়নাল আবেদিনও উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকে কেন্দ্রের কাছে এইরূপ আবেদন করা হবে বলে স্থির হয় যে, এমন অবস্থার সৃষ্টি করতে হবে যাতে এই শরনার্থীরা আবার বাংলাদেশে ফিরে যেতে পারে এবং সেই জন্য কেন্দ্রকে অবিলম্বে উদ্যোগী হতে হবে। আরও বলা হয় যে, শরণার্থীদের ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হবে যাতে সংশ্লিষ্ট অর্থনীতি বিপর্যস্ত না হয়ে পড়ে।

 

আরও নিরাপত্তা পুলিশ ব্যবস্থার দাবী

বৈঠকের পর পশ্চিম বংগের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী মুখার্জী সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থীদের জন্য আশ্রয় ও খাদ্যের ব্যবস্থার জন্য যা অর্থ লাগে সবই দেবেন বলেছেন। কিন্তু এছাড়া আইন শৃংখলা রক্ষা ইত্যাদি আরও নানা প্রশ্ন ও সমস্যা আছে। এদিনের বৈঠকে মোটামুটি ঠিক হয়েছে তাঁরা সীমান্তের আরও নিরাপত্তা ও পুলিশী ব্যবস্থার জন্য যে অর্থ লাগে তাও কেন্দ্রকে দিতে বলবেন।

মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, সীমান্তের অস্থায়ী শিবিরগুলিতে বড় জোর পাঁচ লক্ষ শরণার্থীদের সামরিক আশ্রয়ের ব্যবস্থা আছে। এর উদ্বৃত্তের সংগে সংগে অন্যান্য রাজ্যে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থার ভার কেন্দ্রকে নিতে হবে।

উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিনীধিরূপে শ্রী রাম নারায়ণ ত্রিপাঠিও এদিন অজয় বাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের শরণার্থীদের ব্যাপারে তাঁরা কীভাবে সাহায্য করতে পারেন তা জানতে চান। ইউপি সিটিজেনস কাউনসিলের সাধারণ সম্পাদক শ্রী ত্রিপাঠি রবি ও সোমবার কয়েকটি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করবেন।

বৈঠকে আলোচনা আবেদন

বাংলাদেশ থেকে শরণার্থীদের অভূতপূর্ব ভিড়ের চাপ যে অবস্থায় সৃষ্টি হয়েছে পাঁচটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা তা আলোচনা করেন। ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলিতে আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা আঠারো লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছে। তাঁরা এভাবে আসতে থাকলে অবিলম্বে এই সংখ্যা বিশ লক্ষের উপরে উঠে যাবে।

বৈঠকে এই মত প্রকাশ করা হয় যে, শুধু সংশ্লিষ্ট রাজ্যেগুলির বহন করার পক্ষে এ সমস্যা অত্যন্ত গুরুভার। বহু জায়গায় এই শরণার্থীদের মাথার উপর কোন আচ্ছাদন নাই। কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় যে খাদ্যশস্য মঞ্জুর করছেন তার সরবরাহও অনিয়মিত। লবণ, চিনি, কেরোসিন, বাসনপত্র এবং কাপড়চোপড়ের সরবরাহও সর্বদাই প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। যানবাহনের ঘাটতির ফলে পাঠাবার ব্যবস্থাও ব্যাহত হচ্ছে। স্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা সম্পর্কে সমস্যা দেখা গিয়াছে। কলেরা দেখা দিচ্ছে বলে খবর আসছে।

মুখ্যমন্ত্রীরা আশা করেন তাঁদের আবেদনে ভারতের সব রাজ্য এই গুরু দায়িত্ব বহন করতে এগিয়ে আসবেন। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দিকে দিকে স্বতঃস্ফূর্ত সহানূভুতির প্রকাশ হয়েছে। বাংলাদেশের জংগী নির্যাতনের কবল থেকে যাঁরা দলে দলে চলে আসছেন অবিলম্বে তাঁদের খাদ্য, আশ্রয় ও স্বাস্থ্যরক্ষার ব্যাপারে এই সহানুভূতিকে সক্রিয় করে তোলা প্রয়োজন।

মানবিকতার প্রশ্নে ভারতের এই দায়িত্ব বহনে অংশগ্রহণের জন্য মুখ্যমন্ত্রীরা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি এবং সব স্বাধীন রাষ্ট্রকেও অনুরোধ জানাতে মনস্থ করেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৯০। শরণার্থী সমস্যা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে পশ্চিম বংগের মুখ্যমন্ত্রীর আলোচনা দৈনিক ‘যুগান্তর’ ১০ মে, ১৯৭১

 

দীপংকর ঘোষ দ্বীপ

<১২, ৯০, ২৮৬>

শরণার্থী সমস্যা প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি

মুখ্যমন্ত্রী

(স্টাফ রিপোর্টার)

রবিবার সকালে দিল্লি থেকে ফিরে মুখ্যমন্ত্রী শ্রী অজয় কুমার মুখোপাধ্যায় দমদমে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যায় চলে আসা শরণার্থীদের নিয়ে যেসব সমস্যার উদ্ভব হয়েছে সে সম্পর্কে আমরা প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি।

মুখ্যমন্ত্রী বলেন, এই সব সমস্যা সমাধানের জন্য যত দ্রত সম্ভব কার্যকর গ্রহন করতে ও আমরা তাঁকে অনুরোধ করেছি।

উপ-মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বিজয় সিংহ নাহার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দিল্লী গিয়েছিলেন। তিনি বলেন আমাদের দিল্লী যাওয়ার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে।

আসাম, ত্রিপুরা, বিহার, মেঘালয়, পশ্চিম বংগ নিয়ে পাঁচটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী শনিবার কলকাতায় এক বৈঠকে মিলিত হওয়ার পর দিল্লী যান এবং সেখানে শরণার্থী পুনর্বাসনের প্রশ্ন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সংগে আলোচনা করেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৯১। শরণার্থীদের পশ্চিম বংগের বাইরে পাঠানোর জন্য কেন্দ্রের প্রতি মন্ত্রিসভার দাবী। ‘যুগান্তর’ ৫ জুন, ১৯৭১

দীপংকর ঘোষ দ্বীপ

<১২, ৯১, ২৮৭২৮৮>

 

প্রধানমন্ত্রীর কাছে রাজ্য মন্ত্রীসভা দাবী করবেন

শরণার্থীদের পশ্চিমবংগের বাইরে পাঠাতে হবে

(স্টাফ রিপোর্টার)

কলকাতা, ৪ঠা জুন- প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দ্রিরা গান্ধীর কাছে পঃ বঙ্গ মন্ত্রিসভার সদস্যরা আগামীকাল যৌথভাবে দাবি জানাবেন: বাংলাদেশ থেকে আগত প্রায় অর্ধ কোটি শরণার্থীর রক্ষণাবেক্ষণের পূর্ণ দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারকে নিতে হবে। রাজ্য সরকার তার সামগ্রিক সামর্থ্য নিয়োগ করেও শরণার্থী আগমনজনিত সমস্যার মোকাবেলা করতে পারছে না। ভারতের অন্যান্য রাজ্যে তাদের তজন্য শিবির স্থাপন করে তাদের স্থানান্তরিত করতে হবে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডাঃ জয়নাল আবেদিন বলেছেন, কেন্দ্রীয় সরকার যদি শরণার্থীদের সম্পূর্ণ দায়িত্ব না নেয় তবে রাজ্য সরকারকে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের কথা ভাবতে হবে। ত্রাণ দপ্তরে রাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী আনন্দমোহন বিশ্বাসও বলেছেন, শরণার্থীদের বিষয়ে যে গুরুত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া উচিত তা তাঁরা দেননি।

মুখ্যমন্ত্রী ও উপ-মুখ্যমন্ত্রী দুজনেই আজ সাংবাদিকদের বলেছেনঃ শরণার্থীরা এখন ও ত্রাণের জন্য ক্রমশঃই শহরের দিকে এগিয়ে আসছে। সীমান্ত জেলাগুলিতে স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে শরণার্থীদের সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে, যার ফলে আইন শৃংখলার প্রশ্ন দেখা দিতে পারে।

মুখ্যমন্ত্রী বলেছেনঃ কোন কোন জায়গায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেনঃ শরণার্থীদের মধ্যে কলেরা এবং মহামারী ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। মুখ্যমন্ত্রী শ্রী অজয় মুখার্জী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রাজভবনে তাঁর বৈঠকে সরাসরি বলবেন: শরণার্থীদের বিভিন্ন রাজ্যে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করুন। বিভিন্ন রাজ্যে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করুন। বিভিন্ন রাজ্যে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করুন। বিভিন্ন রাজ্য সরকারের উপর চাপ দিন। নচেৎ পঃ বঙ্গের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়বে।

উপ-মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বিজয় সিং নাহার সাংবাদিকদের বলেছেনঃ এখন পঃ বঙ্গের সমস্ত উন্নয়ন কাজ বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে। “ওদের আশ্রয় দিতে পারছি না, খেতে দিতে পারছি না। ” ওদের সম্পূর্ণ আলাদাভাবে রাখা দরকার।

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বিবরণ

 

রাজ্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডাঃ জয়নাল আবেদিন আজ সাংবাদিকদের জানান যে কলেরা ও অন্যান্য রোগে পীড়িত দেড় লক্ষ শরণার্থীকে এ পর্যন্ত সরকারী ব্যবস্থায় চিকিৎসা করা হয়েছে। হাসপাতাল ও আশ্রয় শিবিরে ৮৯৪ জন শরণার্থী শিবিরে মারা গেছেন। বাইরে আরও অনেকে মারা গেছেন, এটা ধরে নেওয়া যায়।

রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তর সাড়ে পনের লক্ষ শরণার্থীকে টিকা এবং সাড়ে এগার লক্ষ শরণার্থীকে বসন্তের টিকা দিয়েছেন।

ডাঃ আবেদিন বলেন, এ পর্যন্ত সাধ্যমত সব কিছুই করা হয়েছে। কিন্তু যেভাবে আজ পর্যন্ত আশ্রয়প্রার্থীরা আসছেন তাতে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ উজাড় করে সবাই এখানে চলে আসবেন। রাজ্য প্রশাসন ও স্বাস্থ্য দপ্তরেরএই অবস্থার মোকাবেলার সাধ্য নাই বলে তিনি মনে করেন। পরিস্থিতি এখন যা দাঁড়িয়েছে তাতে তাঁর মনে হয়, অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে বসেছে।

কেন্দ্রীয় সরকার সমস্ত শক্তি নিয়ে এবং রাজ্যগুলি তাদের সামর্থ্য নিয়ে আশ্রয়পার্থীদের সাহায্যে এই মুহুর্তে এগিয়ে না এলে পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

কেন্দ্র এবং রাজ্যগুলি এই বিষয়ে কার্যকরী উপযুক্ত তৎপরতা না দেখালে রাজ্য সরকারকে অন্য পন্থা নেবার কথা ভাবতে হবে বলে তিনি মনে করেন।

ত্রাণমন্ত্রীর অভিযোগ

 

রাজ্য ত্রাণ দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী আনন্দমোহন বিশ্বাস অভিযোগ করেন এই সংকট মুহুর্তে কেন্দ্রের যতটা তৎপর হওয়া ছিল তা দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে রাজ্য সরকারী কর্মচারীদের একাংশও একই মনোভাব দেখাচ্ছেন। ফলে গণতান্ত্রিক কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা যত দ্রুত ও সুষ্ঠভাবে আশ্রয়প্রার্থীদের সাহায্য করতে চাইছেন, তা সম্ভব হচ্ছে না।

সল্ট লেকে আশ্রয়

কলকাতা অভিমুখী শরণার্থীদের সল্ট লেক এলাকায় অস্থায়ীভাবে আশ্রয় দেবার ব্যবস্থা হয়েছে। উপ মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ওদের ওখান থেকে সরিয়ে নেওয়া দরকার।

শিরোনাম

সূত্র তারিখ
৯২। সীমান্ত পরিস্থিতি এবং অসামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রশ্নে পশ্চিম বঙ্গ সরকারের উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের ওপর প্রতিবেদন দৈনিক ‘আনন্দবাজার’ ২২ অক্টোবর, ১৯৭১

 

দীপংকর ঘোষ দ্বীপ

<১২, ৯২, ২৮৯>

 

অসামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রস্তুত রাখার নির্দেশ

সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে দীর্ঘ বৈঠক

(স্টাফ রিপোর্টার)

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে পাক ফৌজের ব্যাপক সমাবেশ ঘটায় পশ্চিমবঙ্গ তথা পূর্ব ভারতের প্রতিরক্ষা ও আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা সম্পর্কে বৃহস্পতিবার রাত্রে রাজভবনে এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে বসে। আক্রান্ত হলে পাল্টা আঘাত হানার ব্যাপারেও ওই বৈঠকে কতকগুলি গুরত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তিন ঘন্টাকাল স্থায়ী এই বৈঠকে রাজ্যপাল শ্রী এ, এল, ডায়াস, মুখ্যসচিব শ্রী এন সি, সেনগুপ্ত, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দফতরের অতিরিক্ত সচিব শ্রী বি আর গুপ্ত ছাড়া ‍দিল্লী থেকে আগত কয়েকজন পদস্থ ব্যক্তি যোগ দেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শ্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়ও এই বৈঠকে নানান বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।

যে কোন মুহুর্তে ডাকলেই যাতে পাওনা যায় সেইজন্য অসামরিক প্রতিরক্ষায় লোকদের প্রস্তুত থাকার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার নির্দেশ দিয়েছেন।

বৃহস্পতিবার মহাকরণে কেন্দ্রীয় অসামরিক প্রতিরক্ষা দফতরের ডিরেক্টর জেনারেল লেঃ জেনারেল মতিসাগর রাজ্যের সংশ্লিষ্ট দফতরের কয়েকজন পদস্থ অফিসারের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হয়ে ওই নির্দেশের কথা জানান।

এদিন লেঃ জেনারেল মতিসাগর রাজভবনে রাজ্যপাল শ্রী এ এল ডায়াসের সঙ্গেও মিলিত হন। পৌরসভা, পুলিশ ও দমকলের অফিসারদের সঙ্গে তিনি অপর একটি বৈঠক করেন। রাজভবনের বৈঠকে মুখ্য সচিব ও অন্যান্য পদস্থ অফিসাররা উপস্থিত ছিলেন।

আজ শুক্রবার সকালে মহাকরণে লেঃ জেনারেল মতিসাগর বিভিন্ন জেলার জেলা শাসকদের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হচ্ছেন। ওই বৈঠকে রাজ্যপাল শ্রী ডায়াস পৌরোহিত্য করবেন।

তাছাড়া এই দিন রাজ্য পুলিশের শ্রী রঞ্জিত গুপ্তের অসামরিক প্রতিরক্ষা দফতরের তদারকির দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে। আজ শুক্রবার থেকেই পুরাদমে এই দফতরের কাজ করার জন্য বৃহস্পতিবার রাজ্যপাল শ্রী এ এল ডায়াস শ্রী গুপ্তকে নির্দেশ দেন। স্বরাষ্ট্র সচিবের অধীনে থেকে শ্রী গুপ্ত ওই তদারকির কাজকর্ম করবেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৯৩। শরণার্থীর সাথে পাকিস্তানী দুষ্কৃতকারীরা ভারতে অনুপ্রবেশ করছে বলে আসামের অর্থমন্ত্রীর উক্তি দৈনিক ‘হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড’ ১৬ই মে, ১৯৭১

Prodip Mitra

<১২, ৯৩, ২৯০>

পিন্ডি উদ্বাস্তুদের সাথে গুপ্তঘাতক পাঠাচ্ছে” – আসাম রাজ্যের মন্ত্রী

শিলং, ১৫ই মে – ইউনির তথ্যসূত্রে জানা যায়, আসামের অর্থমন্ত্রী কে পি ত্রিপাঠী আজ বলেন যে, পাকিস্তান সরকারের ইচ্ছাকৃত ভাবে  দশ লক্ষাধিক উদ্বাস্তুকে ভারতের দিকে ঠেলে দেয়া

ভারতের  সাথে যুদ্ধের পায়তারার সামিল। অর্থমন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেন, পাকিস্তান  শুধু ইচ্ছাকৃত ভাবেই নয় বরং  সুচিন্তিত উপায়ে নিজের দেশের মানুষদের ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী আখ্যা দিয়ে ভারতে ঠেলে দিচ্ছে, এবং তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, এই সমস্যার একমাত্র কার্য্যকর সমাধান হতে পারে ভারতের হয়ে পাকিস্তানে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা যাতে এই মানুষ গুলো নিজেদের দেশে নিরাপদে ফিরে যেতে পারে।

ত্রিপাঠী এরপর পাকিস্তানি সরকারের নামে অভিযোগ করেন যে তারা গুপ্তচর, নাশকতাকারি এবং দাঙ্গাকারিদের উদ্বাস্তুদের মাঝে পাথিয়ে দিচ্ছে। তিনি বলেন যে দাঙ্গাকারিরা, বিদ্যমান সামাজিক সমস্যাকে ব্যবহার করে দাঙ্গা লাগিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে পারে, এবং তা পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও কেচারে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা, এবং আসাম উপত্যাকা ও বিহারে বাঙ্গালিবিরোধী দাঙ্গা, অথবা অনুরুপ কোন দাঙ্গার  রুপ নিতে পারে।

তিনি আরো সতর্ক করেন যে নাশকতাকারিরা যোগাযোগ ব্যবস্থা ও গুরুত্ত্বপুর্ণ শিল্পক্ষেত্রগুলো স্থবির করে দিতে পারে এবং ট্রেড ইউনিয়নের মাধমে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ শুরু করতে পারে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৯৪। শরণার্থীদের ভেতরে বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা চলছে বলে আসামের মন্ত্রীর বিবৃতি দৈনিক ‘হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড’ ২০ জুন, ১৯৭১

 

Prodip Mitra

<১২, ৯৪, ২৯১>

উদ্বাস্তুদের মাঝে বাংলাদেশবিরোধী অপশক্তি বিদ্যমান ত্রিপাঠী

(শিলং অফিস থেকে প্রাপ্ত)

১৮ই জুন – কিছু অপশক্তি সীমান্তে উদ্বাস্তু প্রবেশের হার যেসব স্থানে বেশি, সেখানে তাদের মধ্যে বাংলাদেশ বিরোধীতা সৃষ্টির অপচেষ্টা দূরথেকে চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের অপচেষ্টা ফাঁস হয়ে যায় যখন মিছিলথেকে তারা ইয়াহিয়া জিন্দাবাদ স্লোগান দেয়া শুরু করে, জানান  আসামের অর্থমন্ত্রী ত্রিপাঠি।

তিনি জানান যে সরকার এদের  বিরুদ্ধে শুধু সতর্ক দৃষ্টি রাখলেও জরুরি অবস্থা জারি না থাকায় কোন  পদক্ষেপ এখনো নেয়নি।

প্রতিবেশী কিছু রাজ্য উদ্বাস্তুদের ছত্রভঙ্গ করে দিতে চাইলে কেন্দ্রীয় সরকার তাতে রাজি হয়, যা উদ্বাস্তুদের সাথে অসদাকরণের উদ্দেশে নয় বরং তাদের অবস্থার উন্নতি ঘটানোর জন্যে করা হয়। জনাব ত্রিপাঠি বলেন, এই সমস্যার যথাযথ সমাধান তাদের ছত্রভঙ্গ করার মধ্যে নয়, বরং তাদের দেশে ফিরে যাবার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করার মধ্যে নিয়ত।

ভারত বিদেশী পরাশক্তিদের কাছে  পূর্বপাকিস্তানে যাতে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা যায় যেখানে উদ্বাস্তুরা ফেরত যেতে পারে, তা সৃষ্টিচেষ্টার জন্য সম্মত করতে দূত পাঠিয়েছে। অন্যথায়  সংঘাত এড়ানো যাবে না। ১ কোটি উদ্বাস্তুর চাপ সামলানো সমস্যা নয়, সমস্যা হলো বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা স্থাপন করা।

এর আগের যুদ্ধে ইংল্যান্ড ও আমেরিকা গণতন্ত্র স্থাপনের জন্যে যুদ্ধ করেছে। কিন্তু এখন যখন পুর্ববঙ্গে গণতন্ত্র ক্রূশবিদ্ধ, তখন তারা নিস্চুপ।

পাকিস্তান ও বাংলাদেশের  ৯৯% জনগণ বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে ভোট  দিয়েছে, কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক জান্তা তা হিটলারীয় উপায়ে এবং অমানুষিক অত্যাচারের মধ্যে ধ্বংস করে দিতে চায়। ইংল্যান্ড এবং আমেরিকা, যারা গণতন্ত্রের জন্যে এর আগে যুদ্ধ করেছে, তাদের কি শুধু তাকিয়ে দেখা উচিৎ? এর অর্থ কি এই যে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার শুরু তাদের উন্নত রাষ্ট্রের জন্যে, যেমন যখন জার্মানি আর ইংল্যান্ডের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল, কিন্তু তাদের জন্যে নয় যখন একই দেশের দুই অংশের মধ্যে যুদ্ধ লাগে?

দুই দেশের মধ্যে সংঘাত বন্ধ করার চেষ্টা করা যায় কি না তার জন্যে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণই বিষয়।

পাকিস্তানি আর্মির জন্যে  ১০ লক্ষ উদ্বাস্তু  ভারতের দিকে ঠেলে দেয়ায় ভারত আজ এই সংঘাতে জড়িত। এই সংঘাত এখন শুধু পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়  নয়। পাকিস্তানের ভেতরে যা হচ্ছে তার কারণে ভারতও আজ এর মধ্যে জড়িত।

এখন শুধু এক প্রশ্নেরই জবাব চাই, যে বিদেশে ভারতের দূতরা কি কোন সন্তোষজনক জবাব বয়ে নিয়ে পারবেন?

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৯৫। উড়িশ্যায় বাংলাদেশের শরণার্থীদের আশ্রয়দান প্রসঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে মুখ্যমন্ত্রীর আলোচনা দৈনিক ‘হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড’ ১৭ জুলাই, ১৯৭১

Prodip Mitra

<১২, ৯৫, ২৯২>

 

মুখ্যমন্ত্রী উদ্বাস্তু পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য নেতাদের আমন্ত্রণ জানালেন

আমাদের ভূবনেশ্বর সূত্র হতে

জুলাই ১৬ – জানা গেছে যে মুখ্যমন্ত্রী বিশ্বনাথ দাস আগামী সোমবার সব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দদের আলোচনার আহ্বানের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের উড়িষ্যার ময়রুবনজ জেলায় আবাসন নিয়ে অচলবস্থার অবসান হতে যাচ্ছে। জানা যায় যে উদ্বাস্তুদের ময়রুবনজ জেলায় সাময়িক আবাসনের ব্যবস্থা করে দেবার অনুরোধসংক্রান্ত প্রধানমন্ত্রীর পাঠানো চিঠি পেয়ে মুখ্যমন্ত্রী দলীয় নেতাদের আমন্ত্রণ জানান।

এপ্রসঙ্গে স্মরণীয় যে, এর আগে রাজ্য সরকার ময়রুবনজ জেলায় গুরমুন্সীতে ৫০০০০  উদ্বাস্তুর আশ্রয়দানের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের  অনুরোধ ওই এলাকার কিছু বিশেষ সমস্যার কথা তুলে ধরেন এবং উদ্বাস্তুদের অন্য কোথাও জায়গা দেবার প্রস্তাব করেন।

এর পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে পুনর্বাসন মন্ত্রী বৃন্দাবন নায়ক রাজ্যসভায়  জানান যে, ইউনিয়ন মন্ত্রী এব্যাপারে তাদের সাথে এর আগে কোন কথা বলেননি, এবং তাদের আগে  না জানিয়ে এমন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া উচিৎ না।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায় যে, রাজ্যসরকারের মন্ত্রীদের উপেক্ষা করে অফিসার পর্যায়ে কেন্দ্রীয় সরকার সব ব্যবস্থা করে ফেলায় এই অচলাবস্থার উদ্ভব হয়। তবে আশা করা যায় যে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ পাবার পর রাজ্য সরকার ময়রুবনজে অবশেষে বাংলাদেশী উদ্বাস্তুদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করবে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৯৬। উড়িষ্যার বাংলাদেশের শরনার্থিদের আশ্রয়দান প্রসঙ্গে রাজ্য সরকারের অভিমত দৈনিক ‘হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড’ ২৩ ই জুলাই, ১৯৭১

Prodip Mitra

<১২, ৯৬, ২৯৩>

ক্যাম্পের সমস্যা নিয়ে উড়িষ্যা কঠোর

স্টাফ সংবাদদাতা

ভুবনেশ্বর, ২২ শে জুলাই – উড়িষ্যা সরকার ময়ূরভঞ্জ জেলায় বাংলাদেশী শরণার্থীদের আশ্রয়দানের জন্যে কেন্দ্রীয় সরকারের আহ্বান বস্তুত অগ্রাহ্য করতে যাচ্ছে এবং কেন্দীয় সরকারও অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে উড়িষ্যার অন্য কোন স্থানে তাদের আশ্রয়দানের প্রসঙ্গে রাজ্য সরকারের দাবির কাছে নতিস্বীকার করছে।

প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা বিনাশক আচার্য সোহো রাজ্যসভার অনেক নেতাই বাংলাদেশের শরণার্থীদের আশ্রয়দানের জন্য ময়ূরভঞ্জ জেলা মোটেও সুবিধাজনক নয় বলে মনে করেন। গতকাল বিকেলে এক প্রেস কনফারেন্সএ এই কথা জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন যে তারা মিটিংএ কোরাতপুরে  ২ টি ও বুধ-পুলবানী জেলায় ১ টি স্থানে উদ্বাস্তুদের আবাসনের ব্যাপারে একমত হন।

মুখ্যমন্ত্রী বলেন যে তিনি ময়ূরভঞ্জ ও উত্তর বালাসোর জেলায় উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের ব্যাপারে পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়ে লেখা প্রধানমন্ত্রীর চিঠি নিয়ে আলোচনার জন্যে রাজনৈতিক নেতাদের  আলোচনায় ডাকেন।

ইন্দিরাগান্ধীর লেখা চিঠির জবাবে তিনি তাকে  অর্থনৈতিক, দাফতরিক, আইনি ও জননিরাপত্তার অবস্থা রক্ষায় নানা সমস্যার কথা  জানান। এর আগে গরুমহিসানিতে কেন্দ্রীয় সরকার শ্রমিকদের স্বল্পমূল্যে আবাসনের ব্যবস্থা করে দেয়ায় সেখানে আর কোন উদ্বাস্তুর আশ্রয়কেন্দ্রের জায়গা করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে ইউনিয়ন পুনর্বাসন কর্মকর্তা জানান যে উড়িষ্যার প্রধান সচিব ৩৫০, ০০০ জন উদ্বাস্তুর জন্য আশ্রয়কেন্দ্র খোলার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। রাজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি দল  আশ্রয়কেন্দ্রের জন্য অন্য সম্ভাব্য তিনটি প্রস্তাবিত স্থান পরিদর্শন করেছেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৯৭। পাকিস্তানের দুষ্কৃতিকারীরা আসামে ধ্বংসাত্মক তৎপরতা চালাচ্ছে বলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে মুখ্যমন্ত্রীর রিপোর্ট দৈনিক ‘হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড’ ২৩ ই জুলাই, ১৯৭১

Prodip Mitra

<১২, ৯৭, ২৯৪২৯৫>

পাকিস্তানের দুষ্কৃতিকারীরা আসামে ধ্বংসাত্মক তৎপরতা চালাচ্ছে বলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে মুখ্যমন্ত্রীর রিপোর্ট

আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি, নয়াদিল্লী, সেপ্টেম্বর ২ – বলা হচ্ছে যে এর আগে আসাম থেকে যেসব পাকিস্তানি গুপ্তচর ও নাশকতাকারীদের ভারত ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল, তারাই উদ্বাস্তুর ছদ্মবেশে আবার ভারতে অনুপ্রবেশ করছে।

আসামের মুখ্যমন্ত্রী মহেন্দ্রমোহন চৌধুরী দিল্লিতে এসে প্রধানমন্ত্রীকে আসামের বর্তমান নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত করেন। প্রধানমন্ত্রীর ইন্দিরাগান্ধীর সাথে সেই বৈঠকে তিনি তাকে জানান যে নাশকতাকারীরা আসামে ধ্বংসাত্মক কাজ চালাচ্ছে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা সহ নানা গুরুত্তপূর্ন স্থাপনা নষ্ট করতে সচেষ্ট রয়েছে।

জানা যায়, জনাব চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীকে অবিলম্বে বাংলাদেশের সাথে আসামের ১, ৩০০ কিলোমিটার সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করতে বলেন। এপ্রসঙ্গে স্মরণীয় যে এর আগে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে এসে তিনি তাকে আসামে কেন্দ্রীয় সংরক্ষিত বাহিনীর সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি করতে বলেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি আজ জানান যে, গত কয়েক সপ্তাহের ভেতর আসাম সরকার ৫০ জনকে  পাকিস্তানি চর সন্দেহে গ্রেফতার করেছে। গতমাসে কেচারে একটি ট্রেন উড়িয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করা হয়।

গতকালই মহেন্দ্রমোহন চৌধুরী প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর সাথে দেখা করে তাকে জানান যে, এই পরিস্থিতি সামাল দেবার মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আসামের হাতে নেই এবং কেন্দ্রীয় সরকারকেই বরং পরিস্থিতির অবনতি ঠেকাতে হবে। তিনি আগামীকাল আবার প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করবেন। মুখ্যমন্ত্রী এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর সাথে ভারতের পূর্বাঞ্চলে মেঘালয়, মনিপুর, ও ত্রিপুরা এই তিনটি প্রদেশ গঠনের জন্য প্রস্তাবিত বিল নিয়ে কথা বলেন।

অন্য এক বৈঠকে, রাজ্যের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী নন্দিনী সাতপথীর কাছে  জনাব চৌধুরী, এবং তার সহকর্মী বাসুদেব শর্মা আবেদন জানান যে সীমান্তে প্রচারণা বৃদ্ধি করতে হবে এবং কেচারে নতুন বেতার সম্প্রচারকেন্দ্র স্থাপন করতে হবে. রাজ্যে পাকিস্তানি গুপ্তচরদের দ্বারা ছড়ানো গুজবে আতংক সৃষ্টি হচ্ছে। জানা যায় সাতপথী তাদের কে বলেন যে কেচারে শীঘ্রই বেতারকেন্দ্র বসানো হবে। এই উদ্দেশে জমি ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু জনাব চৌধুরী তাকে জানান যে আলাদা বেতারভবন নির্মাণ করতে অনেক সময় নষ্ট হবে, তাই বরং অবিলম্বে বাড়ি ভাড়া করে সেখানে বেতারকেন্দ্র স্থাপন করা উচিত। জানা যায় সাতপথী তার প্রস্তাব মেনে নিয়েছেন।

আসামের মুখ্যমন্ত্রী এর পরে জ্বালানি তেল ও রসায়ন বিষয়ক মন্ত্রী পিসি শেঠীর সাথে দেখা করে প্রস্তাবিত পেট্রোক্যেমিকাল ভবন নিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্তে আসতে অনুরোধ করেন। শেঠী তাকে জানান যে পেট্রোক্যেমিকাল ভবনের জমি নির্বাচন এই মাস শেষের পূর্বেই হয়ে যাবে। তিনি আরো জানান যে আগামী মাসে তিনি আসামে ভবনের উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন। এছাড়া মুখ্যমন্ত্রী স্থানীয়সরকার মন্ত্রীকে সি পেন্টের সাথে আসামে তিনটি নতুন রাজ্য স্থাপনের ব্যাপারে কথা বলেন। আগামীকাল তারা আবার মিটিং করছেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৯৮। বাংলাদেশে পাক সেনাদের হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ পশ্চিম বঙ্গে সভা ও মিছিল দৈনিক যুগান্তর

২৮ মার্চ, ১৯৭১

 

Vincent Biswas

<১২, ৯৮, ২৯৬>

পূর্ববঙ্গে জঙ্গী তান্ডবের প্রতিবাদে পঃ বঙ্গ উত্তাল

(স্টাফ রিপোর্টার)

কলকাতা, ২৭শে মার্চ-সমাজের সর্বস্তরের মানুষ আজ পূর্ব বাংলার মুক্তি সংগ্রামের সমর্থনে সভা-সমিতি আর বিক্ষোভ মিছিলে ‘‘পরম আত্মীয় মুজিবর’’কে অকুন্ঠ সমর্থন জানায়। মুজিবরের জয়ধ্বনিতে মহানগরী আজ মুখরিত ছিল। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা ধর্মঘট করে। পথে ১৪৪ ধারা অমান্য করে তারা পাকিস্তান ডেপুটি হাই কমিশন অফিসের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ জানায়।

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট শ্রী ইয়াহিয়া খানের কুশপুত্তলিকা দাহ করে।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের সভা এদিন প্রস্তাব নিয়েছে-বাংলাদেশের গণহত্যা বন্ধ এবং বঙ্গবন্ধু মুজিবরের নিরাপত্তাবিধানের জন্য ভারত সরকার অবিলম্বে জাতিপুঞ্জের হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করুন।

দলমত নির্বিশেষে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ট্রেড ইউনিয়ন, ছাত্র-শিক্ষক-যুবক এবং শিক্ষাবিদগণ জাতীয়তাবাদী-নায়ক মুজিবরের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন এবং সেখানে জঙ্গীশাহীর গণহত্যা বন্ধের দাবী জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন, বিবৃতি দিয়েছে। তাঁরা দাবী করেছেন-স্বাধীন বাংলাদেশকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় স্বীকৃতি দিতে হবে।

সারা বাংলায় ছাত্র ধর্মঘট

আজ সারা বাংলায় ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়েছে। বিভিন্ন সভায় ছাত্ররা প্রস্তাব নিয়েছে ‘‘পশ্চিম বাংলার গণতান্ত্রিক ছাত্র সমাজের এই সমাবেশ শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে ‘‘বাংলাদেশের’’ স্বায়ত্তশাসনের অধিকারের সংগ্রামকে পূর্ণ সমর্থন করছে। এবং ইয়াহিয়া খান তাঁর নেতৃত্বে যে গণহত্যা অভিযান শুরু হয়েছে তার তীব্র নিন্দা করছে।

এই সভা ভারত সরকারের কাছে সার্বভৌম স্বাধীন সাধারণতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং নৈতিক ও বৈষয়িক সাহায্যদান করার দাবী জানাচ্ছে। ’’

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসভায় সভাপতি ছিলেন শ্রী পরিমল রাউত। ষ্টুডেন্টস হলের ছাত্রসভায় শ্রী রণজিৎ গুহ সভাপতি ছিলেন। আলাদা আলাদাভাবে আজকের ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেন দুই ছাত্র ফেডারশন, ছাত্র পরিষদ, ডি-এস-ও, পি-এস-ইউ, এফ-আর-এস ইত্যাদি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগঠনগুলি এবং কয়েকটি যুব সংগঠন। প্রত্যেকটি সংস্থাই আজ কলকাতাসহ রাজ্যের সর্বত্র শান্তিপূর্ণভাবে শিক্ষায়তনে ধর্মঘট সফল হওয়ায় ছাত্র-ছাত্রীদের অভিনন্দন জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৯৯। বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদে পশ্চিম বঙ্গের লেখক ও বুদ্ধিজীবিদের বিবৃতি দৈনিক যুগান্তর

২৮ মার্চ, ১৯৭১

 

Vincent Biswas

<১২, ৯৯, ২৯৭>

আমরা প্রতিবাদ জানাই, আমরা তীব্র নিন্দা করি

“স্বাধীন বাংলাদেশ’’- এর উন্নত-শির নাগরিকগণ এবং তাঁদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবর রহমান ইতিমধ্যে আমাদের হৃদয় জয় করেছেন। অসম সাহস, অফুরন্ত প্রাণশক্তি এবং অতি-সীমিত অস্ত্রবল নিয়ে তাঁরা মোকাবিলা করছেন নবতম অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েক ডিভিশন সেনাবাহিনীর সঙ্গে। বিশ্বের বিধানে সত্যের জয়, শুভের জয় সর্বদাই হয় তা বলতে হয় তা বলতে পারি না; কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে হয় তা আমরা বিশ্বাস করি। তাই আমরা বিশ্বাস করি যে, ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’- এর জয় হবেই। কিন্তু এই মুহূর্তে বাংলাদেশ আক্রান্ত হয়েছে সুদূর পশ্চিম পাকিস্তানের সত্তর হাজার যুদ্ধপটু সৈনিকের দ্বারাঃ তাদের ক্ষমতামদমত্ত সেনাপতির আদেশে তারা ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া গাড়ি নিয়ে, কামান-মেশিনগান-স্টেন গান নিয়ে হাজার হাজার শান্তিপ্রিয় স্বাধীনতাকামী যুবক এবং আবালবৃদ্ধবণিতার দক্তে পূর্ব বাংলার নগর-গ্রাম, পথমাঠঘাট লাল করে দিচ্ছি। এই বেপরোয়া গণহত্যার ফলে হতাহতের সংখ্যা কিছু দিনের মধ্যে কয়েক লক্ষ্য পোঁছাবে বলে আমরা আশঙ্কা করি।

সভা ও সংস্কৃতিবান দেশের উপর বলবান, যুদ্ধরাজ, বর্বরদের আক্রমণ ইতিহাসে বহুবার ঘটেছে, একাধিকবার পশুশক্তির সামরিক আধিপত্য দেখা দিয়েছে; বর্বর বিজেতারা সভ্য মানুষের ছিন্নমস্তক স্তূপিকৃত করে তাঁর চারিদিকে দাঁড়িয়ে অট্টহাসি করেছে। আজ ১৯৭১ সালেও কি আমরা তারই পুনরাবৃত্তি দেখব?

পৃথিবীতে আজ বহু দেশ আছে, বহু জাতি আছে যারা নিজেদের সুসভ্য বলে দাবি করে। সে দাবি অনেকাংশে স্বীকার্য। তাদের বিবেক কি আজ সাড়া দেবে না? আমরা পশ্চিম বঙ্গের সংস্কৃতি কর্মীরা বিশেষ করে আবেদন জানাই পৃথিবীর সব দেশের শিল্পস্রষ্টা ও জ্ঞানতপস্বীদের কাছে। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রে এই বীভৎস বিরাট নরহত্যার সংবাদ তাঁরা পেয়েছেন নিশ্চয়ই। তাঁদের সকলের তীব্র প্রতিবাদ ঘোষিত হোক, তাঁদের সরকারকে তাঁরা উদ্বুদ্ধ করুন এই অর্থহীন নৃশংসতার নিন্দা করতে, প্রতিরোধ করতে, এ বিষয়ে তাঁদের যথোচিত কর্তব্য পালন করতে। আমাদের সরকার কবে স্বাধীন বাংলাদেশ-এর রাষ্ট্রিক মর্যাদা স্বীকার করবেন, ঐ দেশের সংগ্রামী নিপীড়িত মানুষকে সর্ব প্রকার অসামরিক সাহায্য দানে উদ্যোগী হবেন?

আমাদের পশ্চিম বঙ্গের শিল্প-সাহিত্য-শিক্ষাসেবীদের বেদনা বিশেষ রূপে গভীর। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির খুব বড় অংশ গিয়ে পড়েছে সমগ্র বাংলার সেই অংশে যাকে ২৬শে মার্চে তার অপ্রতিদ্বন্দ্বিত সর্বজনপ্রিয় নেতা মুজিবর রহমান সাহেব স্বাধীন বাংলাদেশ বলে ঘোষণা করেছেন। গত দুই দশক ধরে এ দেশের নবজাগরণ, নব উদ্দীপনা, নব কর্মশক্তি কর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বিষয়ে নব চেতনা এবং কাব্যে উপন্যাসে প্রবন্ধে এ সবের বলিষ্ঠ প্রকাশ দেখে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি, অনেক আশা বুকে বেঁধেছি। যাদের নিয়ে সেই আনন্দ ও আশা তাদের উদ্বুদ্ধ জীবনের সাধনা ও সিদ্ধিকে বুটের তলায় মাড়িয়ে দিতে এসেছে এক বিরাট বর্বর সেনাবাহিনী। এতে কি আমাদের বেদনা সকলের অপেক্ষা তীব্র হবে না, কণ্ঠ সকলের অপেক্ষা সোচ্চার হবে না?

তারা শঙ্কর বন্দোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়, মৈত্রেয়ী দেবী, আবু সায়ীদ আইয়ুব, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, শম্ভু মিত্র, সুশোভন সরকার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, তৃপ্তি মিত্র, প্রবোধচন্দ্র সেন, তারাপদ মুখোপাধ্যায়, অম্লান দত্ত, গৌরকিশোর ঘোষ, সন্তোষ কুমার ঘোষ, নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী।

 

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১০০। বাংলাদেশের ঘটনাবলীতে ভারতের বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়া দৈনিক যুগান্তর ২৮ মার্চ ১৯৭১
নীলাঞ্জনা অদিতি

<১২, ১০০, ২৯৮৩০০>

কলকাতায় পাক দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ মিছিল

রবিবার সকালে পশ্চিমবং ছাত্র পরিষদের ( চৌরঙ্গী) উদ্যোগে পূর্ববঙ্গে মিলিটারী দাপটের প্রতিবাদে এবং সেখানকার জনগনের আন্দোলনের সমর্থনে একটি বিক্ষোভ মিছিল পাক ডেপুটি হাই কমিশন ভবনের সামনে সমবেত হয়।

ভবনের গেটের উপরে বাংলাদেশ এবং কংগ্রেস পতাকা টাঙ্গিয়ে দেয়া হয়।

ছাত্র পরিষদ কর্মীদের অনশন ধর্মঘট

বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতার সমর্থনে ছাত্র পরিষদের ( মহাজাতি সদনের) সভ্যগন রবিবার ডাঃ সুন্দরী মোহন এভেনিউ ও হাতিবাগান রোডের মোড়ে সারা দিন ব্যপী অনশন ধর্মঘট পালন করেন। ছাত্ররা গান্ধীজির মাল্যভূষিত মূর্তি সামনে রেখে দেশাত্মবোধক সঙ্গীত ও কাজী নজরুল এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাথ করেন।

শেখ মুজিবের প্রতি ছাত্র সমাজের অকুন্ঠ সমর্থন জানিয়ে বিভিন্ন ছাত্রকর্মী ও নেতা ওখানে সারাদিন তাঁদের বক্তব্য রাখেন।

বালকদের অনশন

বাংলাদেশের শোষন মুক্তির সংগ্রামে সমর্থন এবং পাকিস্তান সরকারের জঙ্গীশাহী দমন পীড়নের প্রতিবাদে যুব কংগ্রেসের ডাকে বি ও আর ক্যামপ কলিকাতা ৪০ এর মাঠে নিম্নলিখিত ১০ থেকে ১৪ বতসর বয়স বালকেরা রবিবার অনশনের মাধ্যমে বিক্ষোভ প্রকাশ করেন। দীলিপ কুমার দাশ সুজিত ঘোষ বিষ্ণু বসু গৌতম রায় অধিক্রম দাশ বীর বিক্রম দাস সুবিক্রম দাস ফটিক দে রঞ্জন গোস্বামী নির্মল কৃষ্ণ দে ত্রিবিক্রম দাশ ও সুবীর সরকার। এছাড়া শ্রীমতি লীলা বসু (৫৯) ও শ্রীমতি টুকুরানী দাশ ( ৪২) অনশন করেন।

স্বাধীন সরকারকে স্বীকৃতি দিতে জনসংঘের দাবী

রবিবার বিকালে ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট হলে জনসংঘের আহবানে এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো হয়। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক হরিপদ ভারতী।

অধ্যাপক ভারতী বলেনঃ বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধু শেখমুজিবুর রহমান স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে ঘোষনার সাথে সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের ফৌজী নায়ক যুদ্ধবাজ খুনী ইয়াহিয়া খাঁ ও তার অনুগামীরা ব্যপক গণহত্যা করা সত্বেও বাংলাদেশের তরুন মুক্তিযোদ্ধারা যেভাবে রক্ত দিয়ে সমস্ত আক্রমনের মোকাবিলা করেছেন তার জন্য এপার বাংলার মানুষরূপে আমরা গর্বিত। আমরা মনে করছি বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ আগামী দিনবে অখন্ড ভারত প্রতিষ্ঠার দিক নির্ণয় করবে।

অধ্যাপক ভারতী তার ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীন সরকারকে স্বীকৃতি দান এবং বিশ্বের জনমতকে জাগ্রত করে রাষত্র সজ্ঞহের মাধ্যমে সাহায্য দানের ব্যবস্থা করার দাবী করেন।

সভায় শ্রী শক্তিশেখর দাস ভাংলাদেশের তরুণদের কাছ থেকে দেশপ্রেমের এবং দেশের জন্য ত্যগ স্বীকারের শিক্ষা নেবার আহবান জানিয়ে বক্তৃতা করেন।

সর্বশ্রী শ্যামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় দুর্গাপ্রসাদ নাথনি জ্ঞান ব্যানার্জী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ ভাষণ দেন।

জনসংঘের মশাল মিছিল

সন্ধ্যায় ভারতীয় জনসংঘের কলকাতা শাখার পক্ষ থেকে ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট হল থেকে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে এক মশাল মিছিল বের হয়। এই মিছিল রাজভবনের সামনে গিয়ে স্বাধীন বাংলার স্বীকৃতি দাবী করে বিক্ষোভ দেখায় এবং ইয়াহিয়া খানের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়।

বাংলা জাতীয় দলের দাবী

বাংলা জাতীয় দলের উদ্যোগে আহূত এবং শ্রী রণদেব চৌধুরীর সভাপতিত্বে শনিবার মহারোধী সোসাইটি হলে বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দের এক সভায় স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকার করে নেয়ার জন্য দাবী জানানো হয়। সভার শেষে একটি মিছিল রাজভবনে যায় এবং প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে উপরোক্ত দাবী সম্বলিত এক স্মারকলিপি পেশ করা হয়।

দিল্লী পাক হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ

নয়াদিল্লী ২৭ শে মার্চ বাংলাদেশের জনগনের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ধ্বংস করবার জন্য পাকিস্তানী জঙ্গী প্রশাসন যে সেনাবাহিনী নিয়োগ করেছে তার প্রতিবাদে শত শত লোক বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। তারা পাকিস্তান বিরোধী ধ্বনি দেয় এবং কালো পতাকা উত্তোলন করে।

শ্রী কর্পুরী ঠাকুরের বিবৃতি

পাটনা ২৮ মার্চ এস এস পির চেয়ারম্যান ও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী কর্পুরী ঠাকুর ভারতের জনগনকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রেমিক ভাইদের পাশে দাঁড়াতে বলেন।

নিঃ ভাঃ ফরোয়ার্ড ব্লক

নয়াদিল্লী ২৮ মার্চ নিখিল ভারত ফরোয়ার্ড ব্লকের কেন্দ্রীয় কমিটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের জন্য পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যে অমানুষিক অত্যাচার শুরু করেছেন তার তীব্র নিন্দা করেন এবং বাংলাদেশকে সমর্থনের জন্য ভারত সরকারের নিকট  আবেদন করেন।

লেখক শিক্ষক ও ছাত্রদের সহানুভূতি

রাইপুর ২৮ মার্চ স্থানীয় লেখক সাংবাদিক শিক্ষক ও ছাত্রগন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন জানান।                                                                                     

ভারতীয় বার্তাজীবি সংঘ

পশ্চিম পাকিস্তানী প্রশাসন বাংলাদেশে বিদেশী সাংবাদিকদের কর্তব্য সম্পাদনে  যেভাবে বাধা দিচ্ছেন ভারতীয় বার্তাজীবি সংঘ আজ তীব্র ভাষায় তার নিন্দা করেন।

গনতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশে সাংবাদিকরা যেভাবে আত্মনিয়গ করছেন সংঘের সভাপতি শ্রী ভি এন রাও আন্ত্ররিকভাবে তার সমর্থন জানান।

  • পি টি আই ও ইউ এন আই

বোমবাইতে বাংলাদেশ সংহতি কমিটি গঠিত

বোমবাই ২৭ মার্চ বাংলাদেশের জনসাধারনের গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থানকে সমর্থন করবার জন্য এই শহরে বাংলাদেশ সংহতি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

স্থানীয় বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলির ট্রেড ইউনিয়ন সংস্থাগুলির প্রতিনিধিদের একটি সভায় এই কমিটি গঠিত হয়।

পাক সহ হাই কমিশনারের অফিসের সামনে বিক্ষোভ

শহরে পাকিস্তানী সহকারী হাই কমিশনারের অফিসে সামনে বাংলাদেশে পাক সৈন্যবাহিনী ব্যপক গণহত্যার প্রতিবাদে শত শত লোক বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।

রাষ্ট্রীয়  লোকসেনার বোম্বাই শাখার ৪০০০ লোকের এক মোরচা অবিলম্বে গণহত্যা বন্ধ করার দাবী জানিয়ে এক স্মারকলিপি পেশ করে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১০১। বাংলাদেশে হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে কোলকাতায় নাগরিক সমাবেশ দৈনিক যুগান্তর ২৮ মার্চ ১৯৭১
 নীলাঞ্জনা অদিতি

<১২, ১০১, ৩০১>

রবিবার ময়দান সমাবেশে দাবী

ওদের পাশে গিয়ে লড়ব আমরাও রক্ত দেব

(স্টাফ রিপোর্টার)

সংগ্রামী বাংলাদেশের জন্য এই বাংলার মানুষের যে কী গভীর উৎকণ্ঠা রবিবার কলকাতার নাগরিক সভায় তা প্রকাশ পেল। শ্রী বিজয় সিংহ নাহার বললেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে পঃ বঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তুলুন। ভারত সরকারকে বলব আমাদের অনুমতি দিন আমরা ওদের পাশে গিয়ে লড়তে চাই। শী অজয় মুখার্জী ঘোষণা করলেন আমরা নীরব দরশক হয়ে থাকতে পারিনা।

এর আগে ময়দানে বহূ সভা সমাবেশের রিপোর্ট করেছি। কিন্তু এদিনের জমায়েতের চরিত্র ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। সমস্ত পঃ বঙ্গের মানুষের মন আজ বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থনে যে আবেগে উদ্বেল এই সভায় তাই প্রতিফলিত। এদিকের সমস্ত মানুষ সারাদিন যে অসীম আগ্রহ নিয়ে ট্রানজিস্টারের সামনে বসে আছেন স্বাধিন বাংল্র বেতার ঘোষনা শোনার জন্য যে উন্মাদনায় এপারের সহস্র সহস্র যুবক ছুটে চলেছেন সীমান্তের দিকে সেই উত্তেজনায় সমস্ত সভা সারাক্ষন থরথর করে কেঁপেছে।

যখনি কোন বক্তা বলেছেন ওপারে পাক দখলদার ফৌজের বুলেটে আহত হয়ে শত শত ভাই ওপারে আশ্রয় নিচ্ছেন তাঁদের সাহায্যের জন্য রক্ত দিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে সভায় সহস্র কন্ঠের আকুল জিজ্ঞাসা – কোথায় কোথায় রক্ত দিতে হবে। সবাই সেজন্য তৈয়ার। (অসম্পূর্ণ)।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১০২। কোলকাতায় মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির জনসমাবেশে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের দাবী দৈনিক আনন্দবাজার ২৯ মার্চ ১৯৭১
নীলাঞ্জনা অদিতি                      

<১২, ১০২, ৩০২৩০৩>

বাংলাদেশে অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি দানের দাবী

(স্টাফ রিপোর্টার)

কলকাতা, ২৯ শে মার্চ- দুই বাংলার বেড়া ভেঙ্গে দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেবার জন্য মার্কসব্দী কমিউনিস্ত পার্টির নেতা শ্রী জ্যোতি বসু আজ শহীদ মিনার ময়দানে এক বিশাল জনসভায় কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবী জানিয়েছেন।

শ্রী বসু বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের লড়াইএর জন্য সরবরাহেরো দাবী জানিয়েছে। তিনি কেন্দ্রীয় কংগ্রেসী সরকারের মিষ্টি মিষ্টি কথার সমর্থনের বদলে বাংলাদেশকে সর্বপ্রপকার সাহায্যের দাবী জানান। শ্রী বসু অবশ্য বলেন এ সাহায্য কেন্দ্রের কংগ্রেসী সরকার দেবে না। কেন্দ্রীয় সরকারের আচরণকে তিনি ভন্ডামি বলে বর্ণনা করেন।

সভায় আর এক বক্তা শ্রী হরেকৃশ্ন কোঙার তথ্য ও তত্ব উপস্থিত করে বলেন নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়ী হয়েও মুজিবুর রহমানকে সরকার গড়তে দেয়া হয়নি। তাই পশ্চিমবঙ্গের সামান্য কটি বেশী আসন পেলে সংযুক্ত বামপন্থী ফ্রন্টকেও সরকার করতে দেয়া হত কিনা সন্দেহ। তিনি বলেন ইয়াহিয়া খাঁ আর ইন্দিরা গান্ধী এই প্রসঙ্গে এক ও অভিন্ন। বিচ্ছিন্ন তার অভিযোগ ইন্দিরা গান্ধীও তার লেজুড় ডান কমিউনিস্টরা তুলেছে আমার পার্টির বিরুদ্ধে এবং একই অভিযোগ তুলেছে ইয়াহিয়া খাঁ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে।

সংযুক্ত বামপন্থী ফ্রন্টের ডাকে আজকের এই জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন শ্রী জ্যোতি বসু। শহরের বিভিনন অঞ্চল থেকে মিছিল করে বহু নরনারী জনসভায় যোগ দেন।

শ্রী জ্যোতি বসু বলেন পূর্ব বাংলার মানুষ যে সংগ্রাম করছে তা থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহন করতে হবে। আজ তারা অস্থায়ী সরকার গঠন করেছে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। নির্বাচনে ওরা অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করেছে। দীর্ঘ এগারো বছর সামরিক শাসনের অধীনে থেকেছে পূর্ব বাংলার মানুষ। তবু সমস্ত সাম্প্রদায়িকতা ভুলে ঐক্যবদ্ধ এই অভিযান বিস্ময়কর। তিনি অভিনন্দন জানিয়ে বলেন আমরা ওঁদের পাশে আছি। পূর্ব বাংলার লড়াই আমাদেরও লড়াই ওঁদের পরাজয় আমাদেরও পরাজয়।

শ্রি বসু বলেন আমার বিশ্বাস আমরা ওদের সাহায্য করতে পারব। সমস্ত বাধা অতিক্রম করে কংগ্রেস সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে। ওঁদের অস্ত্রের প্রয়োজন। অস্ত্র ওঁরা কেড়ে নিচ্ছেন এটাই মুক্তিযুদ্ধের নিয়ম। এমনকি মেয়েরাও লড়াই করছেন। ঔষধ-ডাক্তার দরকার। কমপক্ষে ওয়াটার বটলও আমরা পাঠাতে পারি।

তিনি এ প্রসঙ্গে টাকার দরকারের কথা বলেন। তাই একদিনের মাইনে বা দু এক ঘন্টা বেশী কাজ করে মজুরী দানের কথা বলেন।

প্রস্তাব

 

সভায় গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়েছে যে ঐতিহাসিক সংগ্রামে পূর্ব বাংলার মানুষের পাশে কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে পশ্চিম বাংলার মানুষেরা দাঁড়াবে। শুধু নৈতিক কর্তব্যবোধেই নয় গণতান্ত্রিক সংগ্রামের বাস্তব প্রয়োজনে ভারতের জনসাধারন বাংলাদেশের জঙ্গী আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য ঐ দেশের মানুষকে সাহায্য করবে।

প্রস্তাবে আরো বলা হয়েছে শুধু মৌখিক সমর্থনই বাংলাদেশের মানুষের কোন উপকার করবে না। প্রস্তাবে তাই প্রকৃত সাহায্য দেবার জন্য এবং অবিলম্বে বাংলাদেশের সার্বভৌম স্বাধীন প্রজাতন্ত্রকে ভারত সরকার যাতে স্বীকৃতি দেন তার জন্য দাবী তোলা হয়েছে।

সংযুক্ত বামপন্থী ফ্রন্টের আহবায়ক শ্রী সুধিন কুমার সভায় প্রস্তাবটি পেশ করেন।

শ্রী হরেকৃষ্ণ কোঙার বলেন জনগনের রায়ে পূর্ব বাংলার মানুষেরা নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য এগিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তা বাধা পেল কায়েমী স্বার্থগোষ্ঠীর কাছে। তাই তাদের কাছে খোলা ছিল গোলামীর পথ বা মুক্তির পথ। গর্বের বিষয় যে তারা মুক্তির পথই বেছে নিয়েছেন। সংগ্রামের মধ্য দিয়েই তারা বেছে নিয়েছেন মুক্তির পথ। তাই তাদের সঙ্গে আমরা আছি। পূর্ব বাংলার মানুষকে আজ অস্ত্র রসদ ওষুধপত্র প্রভৃতি দিয়ে সাহায্য করা উচিত। তিনি সাধারন মানুষকে সতর্ক করে দিয়ে আরো বলেন পূর্ব বাংলার সংগ্রামকে নিয়ে স্বার্থসিদ্ধির কাজেও লাগাবার জন্য প্রতিক্রিয়াশীলরা বিভ্রান্তিকর প্রচার চালাচ্ছে। তাতে যেন কেউ সায় না দেয়।

সর্বশ্রী জ্যোতি ভটাচার্য সুকুমার রায় রাম চ্যাটার্জী নেপাল ভট্টাচার্য প্রমুখ ও বক্তৃতা করেন।

হাওড়ার নাগরিকদের সভা

 

যুগান্তরের হাওড়া অফিস থেকে জানানো হয়েছে যে সোমবার হাওড়া টাউন হলে নাগরিকদের এক সভায় স্বাধীন বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষদের অভিনন্দন জানিয়ে তাদের প্রতি পূর্ন সমর্থন জ্ঞ্যাপন করা হয়েছে। কেবলমাত্র সি পি এম ব্যতীত প্রায় সব দলই এই সভার উদ্যোক্তা ছিল। শ্রী সুরেশ্বর দত্তের পৌরহিত্যে সম্পন্ন এই সভায় ইয়াহিয়ার বর্বর অত্যাচারের প্রতিবাদ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদানের জন্য পশ্চিমবংগ তথা ভারতের যুবশক্তির প্রতি আহবান জানানো হয়।

সর্বশ্রী অরবিন্দ ঘোষাল ফঃ বঃ শরদিন্দু শেঠ কংগ্রেস সংগঠন সর্দার আমজাদ আলী বাং কং প্রফুল্ল রায় কং অমর মজুমদার সি পি আই শংকর বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেস সং রামপ্রসাদ শর্মা পি এস পি কৃষ্ণপদ রায় কং শা দিলীপ দাশ ও সুবোধ কর প্রভৃতি এই সভায় বক্ত্রৃতা করেন।

 

 

হাওড়া ছাত্র মিছিল

 

আজ হাওড়া শহরের সব স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা কালো ব্যাজ পরেন। অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বিরাট এক ছাত্র মিছিল হাওড়া শহর পরিক্রম করে স্বাধীন বাংলাফদেশের মুক্তিফৌজকে অভিনন্দন জানায়। নরসিংহ দত্ত কলেজ ব্যাঁটরা মধুসূদন পাল চৌধুরী বিদ্যালয় ব্যাঁটরা শিক্ষায়তন রামকৃষ্ণ ইন্সটিটিউট মিছিলের আয়জন করে।

ছাত্ররা ব্যাঁটরা থানার সামনে পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের একটি কুশপুত্তলিকা দাহ করেন।

শিরোনাম সুত্র তারিখ
১০৩। সারা বিশ্বের প্রতি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর আহবান জানিয়ে গৃহীত শাসক কংগ্রেস নির্বাহী পরিষদের প্রস্তাব। ‘শিকাগো সান টাইমস’ ৩১ মার্চ, ১৯৭১

Niaz Mehedi

<১২, ১০৩, ৩০৪-৩০৫>

ভারতীয় পক্ষ পুর্ব পাকিস্তানের জন্য মৌখিক স্বান্তনা চায়

নয়াদিল্লী(অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস): প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস রবিবার ভারতের জনগনের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনে সর্বাত্তক সমর্থন দেয়ার অনুরোধ জানান।

কিন্তু ভারতের ৭০০ সদস্য বিশিষ্ট জাতীয় কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা পূর্ব পাকিস্তানিদের যেকোন প্রকার সরাসরি সহায়তা থেকে বিরত থাকবে।

“কিছু প্রতিনিধিদের কাছ থেকে পূর্ব পাকিস্তানিদের অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগ অস্বীকার করে মিসেস গান্ধী বলেন, আমরা যেটা করছি সেটা হল বিশ্ব দরবারে এবং জাতিসংঘে আমাদের সীমান্তে ঘটে যাওয়া নিষ্ঠুর গণহত্যার বিপক্ষে আওয়াজ তোলা”

প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান সরকারের সমালোচনা করে বলেন যে, ‘পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া ব্যাপার নিয়ে ভারতের মন্তব্য করার অধিকার নেই’, এবং একথা বলে তিনি ঐ বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেন।

মিসেস গান্ধী বলেন, “ভারতের অন্য দেশের আভ্যন্তরিক ব্যাপারে নাক গলানোর কোন ইচ্ছে নেই”। “কিন্তু সীমান্তের ওপারে নির্যাতন ও অবাধ গণহত্যার ব্যাপারে চুপ থাকতে পারেনা”।

                                  শান্তিপুর্ন সমঝোতার উদ্যোগ

“সেখানে যা হচ্ছে তা কাউকে রাগান্বিত করতেই পারে, কিন্তু তাকে অবশ্যই এই ব্যাপারগুলো ঠান্ডা মাথায় বিবেচনা করা উচিৎ। আমাদের এমন কিছু বলা হতে সতর্ক থাকা উচিৎ যেটি শুধু পূর্ব পাকিস্তানকে আহত করবে”।

কৃষ্ণনগরের এক সীমান্তবর্তী শহর থেকে ভারতের ইউনাইটেড নিউজ এক বার্তায় বলে যে রোববার ভোরের একটু আগে, পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর বোমাবর্ষনের সময় পাকিস্তানী জঙ্গিবিমান ভারতের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। এ ব্যাপারে ভারতের বিমানবাহিনী থেকে কোন নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি”।

রেডিও পাকিস্তানের খবরে যানা যায় যে, ভারত নয়াদিল্লী থেকে ভারত-পূর্বপাকিস্তান সীমান্তে পূর্বের সীমান্তরক্ষী বাহিনিকে শক্তিশালী করার জন্য অতিরিক্ত সীমান্তরক্ষী বাহিনী এনেছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র এটি বাতিল করে দেন এবং বলেন নিরাপত্তা বাহিনীর একমাত্র কাজ হচ্ছে সীমান্ত যাতে অসুরক্ষিত না হয় সেটা নিশ্চিত করা।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী স্মরণ সিং বলেন, পাকিস্তানী সরকার দাবি করে যে তাদের পূর্ব প্রদেশে ঘটনাবলি তাদের একটি অভ্যন্তরীণ ব্যাপার এবং বিশ্ব সম্প্রদায় সেটি মানতে পারবেনা। তিনি দলীয় সমাধার প্রস্তাবনা করেন।

                                     আমাদের ভাতৃবৃন্দ এবং প্রতিবেশিবৃন্দ

তিনি বলেন, ‘ভারতের জন্য এটি একটি বিশেষ উদ্বেগের ব্যাপার,” কারন যাদের বিরুদ্ধে সাঁজোয়া যান এবং ভারী অস্ত্র ব্যাবহার করা হচ্ছে, তারা আমাদেরই ভাই এবং প্রতিবেশী। সেখানে যা হচ্ছে সেটি দ্বারা আমরাও অনাক্রান্ত নই।”

পররাষ্ট্র মন্ত্রী কিছু প্রতিনিধিদের দাবি নাকচ করে দেন যে ভারতের উচিৎ পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীন সরকারকে যত দ্রুত সম্ভব কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেয়া।

“তিনি মন্তব্য করেন, সবকিছুর জন্যই একটি সঠিক সময় রয়েছে” “যদি আমরা এসব ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করি এটার মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে। আমি চাইনা এটি একটি বিতর্কিত ব্যাপারে রূপান্তরিত হোক”।

কংগ্রেস পার্টি বিশ্বের সকল জাতির নিকট “এসকল অমানবিক নৃশংসতা থামাতে জরুরি এবং গঠনমূলক ব্যাবস্থা” নেবার আবেদন জানান।

শিরোনাম সূত্র তারিখ

১০৪। বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদে কোলকাতায়

ডাক্তারদের মিছিল

দৈনিক ‘যুগান্তর’ ৩১ মার্চ, ১৯৭১

 

দীপংকর ঘোষ দ্বীপ

<১২, ১০৪, ৩০৬>

বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদে ডাক্তারদের মিছিল

 

কলকাতা, ৩০শে মার্চ, -বাংলাদেশের মানুষদের নৃশংসভাবে হত্যা করিবার প্রতিবাদে আজ পাঁচ শতাধিক ডাক্তার ও মেডিকেল ছাত্র মৌন মিছিল করে কলকাতাস্থ পাকিস্তান হাইকমিশন অফিসে যান।

পৌরসভার স্ট্যান্ডিং হেলথ কমিটির চেয়ারম্যান ডাঃ নরেশ ব্যানার্জীর নেতৃত্বে একদল প্রতিনিধি পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশনারের হাতে এক স্মারকলিপি দেন।

স্মারকলিপিতে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য নিরস্ত্র মানুষদের বর্বোরোচিতভাবে হত্যা করায় ধিক্কার জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে যে, পাকিস্তানী সৈন্যরা হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অনেক সম্পত্তি নষ্ট করেছে। এতে সমগ্র বিশ্বের মানুষের মনে ঘৃণা জেগে উঠেছে। অবিলম্বে নিরীহ মানুষদের উপর আক্রমণ বন্ধ করতে হবে।

ডাক্তার ও ছাত্ররা বাংলাদেশের নিপীড়িত মানুষদের সেবা ও সাহায্য করতে সর্ব সময়ে প্রস্তুত আছে বলে স্মারকলিপিতে উল্লেখ আছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ

১০৫। বাংলাদেশের সমর্থনে সারা পশ্চিম বংগে

হরতাল পালিত

দৈনিক ‘যুগান্তর’ ১ এপ্রিল, ১৯৭১

দীপংকর ঘোষ দ্বীপ

<১২, ১০৫, ৩০৭৩০৯>

 

ওপারে লড়াই এপারের সমর্থন

সারা পশ্চিমবঙ্গ হরতালে সামিল

(স্টাফ রিপোর্টার)

কলকাতা ৩১ মার্চ-বাংলাদেশের মানুষের বীরত্বব্যাঞ্জক আন্দোলনের প্রতি সমর্থন, সহানুভূতি এবং একাত্মতা জানিয়ে পশ্চিম বাংলার মানুষ আজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাধারণ ধর্মঘট ও হরতাল পালন করেছেন। জীবন-মরণ যুদ্ধে লিপ্ত ও বাংলার আট কোটি মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন এ বাংলার পাঁচ কোটি বাঙ্গালী। তাঁদের ব্যথায় ব্যথিত, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার ভাগীদার।

বাংলা বিভক্ত হবার পর এই প্রথম এ-বাংলার বাঙ্গালীর প্রতি প্রকাশ্যে এবং সোচ্চারে সহানুভূতি ও সমর্থন জানালেন।

দোকান-পাট, বাজার-হাট, কল-কারখানা বন্ধ রেখে, যানবাহন তুলে রেখে, সমস্ত আনন্দানুষ্ঠান বাতিল করে দিয়ে এ বাংলার বাঙ্গালী তাঁর একান্ত আপনজন ও বাংলার বাঙ্গালী বীর শহীদের প্রতি অন্তরের শ্রদ্ধার নিদর্শনরূপে আজ ‘শোকদিবস’ পালন করে বর্বরতার বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার ও ঘৃণা প্রকাশ করেছেন।

পরম আত্মীয়ের বিয়োগ ব্যথায় মহানগরীর সর্বত্র আজ কালো পতাকা। পথের মোড়ে মোড়ে শহীদ বেদী। শ্বেতশুভ্র শহীদ বেদীগুলি ধূপধূনা আর ফুলে ফুলে সাজান।

শহীদ বেদীর পাশে অর্ধনমিত জাতীয় পতাকা। আর কালো পতাকা। নাগরিকদের বুকে কালো ব্যাজ। এই ‘কালিমা’ একাধারে প্রতিবাদ অন্যদিকে ধিক্কার। স্বাধিকার আন্দোলনে নিহত সৈনিকদের জন্য শোকের ছায়া সর্বত্র পরিব্যপ্ত।

বাঙ্গালীর বাঁচার দাবীর সমর্থনে এই শহরে সকালে এবং বিকালে অনেকগুলি প্রতিবাদ মিছিলও বের হয়। মিছিলের আওয়াজ বাঙ্গালীর জয়ধ্বনি। উদ্যোক্তা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। কতকগুলি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শহরের নানান এলাকায় অর্থ সংগ্রহ অভিযানও শুরু হয়েছে। অর্থ সংগ্রহ অভিযানে মহিলারাও এগিয়ে আসেন।

বিনা হাঙ্গামায় এমন সর্বাত্মক ধর্মঘট কলকাতা ইতিপূর্বে খুব কমই প্রত্যক্ষ করেছে। দোকান-পাট বন্ধের জন্য এদিন কাউকে শাসাতে হয়নি। কিম্বা মিছিল নিয়ে গিয়ে বোমাও নিক্ষেপ করতে হয়নি। রেল লাইন অবরোধ করার আগেই ট্রেন বন্ধ। লোক্যাল ট্রেন ’ত চলেইনি, দূর পাল্লার ট্রেনগুলি পর্যন্ত আজ এ রাজ্যে ঢোকেনি। হাওড়া-শিয়ালদা খাঁ খাঁ করছে। স্ট্যাণ্ডে রিকশা আছে-কিন্তু চালক নেই।

বন্দরেও একই দৃশ্য। দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো যে কর্মবহুল বন্দর বাঁচিয়ে রাখছে সেই কোলাহলমুখর কলকাতা বন্দরেও আজ কোন সাড়াশব্দ নেই। সারি সারি জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে, কোন কাজ হয়নি। শ্রমিকরা কাজ করেনি।

 

বিমান বন্দরে

দু’দিন আগে বিমান ধর্মঘট মিটেছে। কিন্তু বাংলাদেশে নিরস্ত্র মানুষের উপর জঙ্গীশাহীর বর্বরতার প্রতিবাদে বৈমানিকরা আজ বিমান চালায়নি। আনন্দানুষ্ঠান-সিনেমা, থিয়েটারগুলিও আজ পুরোপুরি বন্ধ ছিল।

বাংলাদেশের সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্রকে অবিলম্বে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেবার দাবীতে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের উপর জঙ্গীশাহীর বর্বর আক্রমণের প্রতিবাদে আজ পশ্চিম বাংলায় এই ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন রাজ্যের রাজনৈতিক দলগুলি, বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন এবং ছাত্র সংগঠনগুলি।

এদিন সকাল থেকেই দফায় দফায় যুবকরা-ছাত্ররা শেখ মুজিবরের জয়ধ্বনি দিতে দিতে পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশন অফিসে এসে জঙ্গীশাহীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভে জানান। একদল যুবক এবং ছাত্র বার ঘণ্টার জন্য অনশন ধর্মঘট শুরু করেছেন এই অফিসের সামনে।

উত্তর থেকে দক্ষিণে, পূর্ব থেকে পশ্চিমে সর্বত্র ঘুরেছি আজকের ধর্মঘট নিয়ে কোথাও কোন হামলার খবর পাইনি। বেলেঘাটা, শোভাবাজার, দমদম, জোড়াবাগান, বরানগর ইত্যাদি অশান্ত এলাকাগুলিও বাংলাদেশের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের সমর্থনে এদিন শান্ত ছিল। পথের মোড়ে যুবকদের জটলা এ দৃশ্য মহানগরীর সর্বত্র।

রাজপথগুলি খালি পেয়ে ফুটবল হকি এমনকি ডাঙ্গুলী খেলোয়াড়েরা তা দখল করে নেয়।

দক্ষিণের কয়েকটি স্থানে দেখলাম শহীদ বেদীর সামনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। হাত দিয়ে তিনি নির্দেশ দিচ্ছেন-তার নীচে লেখা ‘এত তাজা প্রাণ বলি হচ্ছে, তবু দুর্গম যাত্রাপথে কোন বাধা মানব না। ’ কোথাও কোথাও বাড়ীর শীর্ষেও অর্ধনমিত জাতীয় পতাকার সঙ্গে কালো পতাকা উড়তে দেখা যায়। সরকারী, আধা-সরকারী বেসরকারী অফিসে, কল-কারখানায় সর্বত্র তালাবদ্ধ।

যুব কংগ্রেসের অনশন

 

স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের ওপর পাক সেনাবাহিনীর অত্যাচারের প্রতিবাদে এন্টালী যুব কংগ্রেসের উদ্যোগে মিডল রোড ও সি আই টি মোড়ে এবং এনটালী মার্কেটের কাছে ১২ ঘণ্টার জন্য অনশন পালন করা হয়।

হাওড়ায় হরতাল

 

হাওড়া শহর ও গ্রামাঞ্চলে আজ স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়। ট্রাম, বাস, ট্রেন ও অন্য যানবাহন বন্ধ ছিল। বিনা পিকেটিং-এ হরতালের দিন হাওড়ায় কল-কারখানা বন্ধ হওয়ার ঘটনা এই প্রথম।

পাকিস্তান সৈন্য বাহিনীর অত্যাচারের প্রতিবাদে শহরে ২৩টি বড় বড় মিছিল এবং উত্তর হাওড়া ও শিবপুরে শাসক কংগ্রেসের উদ্যোগে দুটি বড় জনসভা বাংলাদেশের মুক্তিফৌজকে অভিনন্দন জানায়।

সারা পশ্চিম বঙ্গে হরতাল

 

আবেগ মথিত হ্নদয়ে ও বাংলার মানুষের সঙ্গে এ-বাংলার মানুষ ধ্বনি তুলেছেন ‘শহীদের রক্ত তারা বৃথা যেতে দেবে না’।

উত্তরে দার্জিলিং থেকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত গোটা পশ্চিম বাংলায় আজ সফল ধর্মঘট ও হরতাল পালিত হওয়ায় রাজ্যের রাজনৈতিক দল, ট্রেড ইউনিয়ন সংস্থা, ছাত্র-শিক্ষক-যুব এবং মহিলা সংগঠনগুলিও বুদ্ধিজীবী সংস্থাগুলির পক্ষ থেকে আলাদা বিবৃতিতে এ বাংলার সংগ্রামী মানুষকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।

যাঁরা বিবৃতি পাঠিয়েছেনঃ সি-পি-এম, সি-পি-আই, ছয় পার্টির আহবায়ক, বিদ্রোহী পি-এস-পি, ভারতীয় বলশেভিক পার্টি, সারা বাংলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি, পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষক সমিতি, দুই ছাত্র ফেডারেশন, পি-এস-ইউ, ডি-এস-ও, এস-ইউ-সি, আর-এস-পি, সি, ক্যালকাটা প্রেস ওয়ার্কস ইউনিয়ন, নিখিল-বঙ্গ মহিলা সংঘ, পশ্চিম বঙ্গ নার্সেস ক্যাডার্স এসোসিয়েশন, ইউ-টি-ইউ-সি, সারা বাংলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি, বিপ্লবী যুব সংস্থা, ইউনাইটেড কিষাণ সভা, হাইকোর্টের বার এসোসিয়েশন-ইত্যাদি।

মহিলাদের সভা

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সমর্থনে ১লা এপ্রিল বিকাল ৫টায় ইণ্ডিয়ান এ্যাসোসিয়েশন হলে ভারতীয় মহিলা ফেডারেশনের উদ্যোগে মহিলাদের এক সভা হবে।

আরো যাঁরা বিবৃতি দিয়েছেন-ফরোয়ার্ড ব্লক, এস-এস-পি, ছাত্র পরিষদ, মানিকতলা গভঃ হাউসিং এস্টেট, টেনেণ্টস এসোসিয়েশন, লেখক, শিল্পী-শিক্ষাব্রতী ও সমাজকর্মী সংঘ যুব কংগ্রেস।

শিরোনাম সূত্র তারিখ

১০৬। স্বীকৃতিদানের আহবান জানিয়ে প্রকাশিত

সম্পাদকীয়ঃ অবিলম্বে স্বীকৃতি দিন

“দৈনিক আনন্দবাজার”

(সম্পাদকীয়)

৩ এপ্রিল, ১৯৭১

দীপংকর ঘোষ দ্বীপ

<১২, ১০৬, ৩১০৩১১>

অবিলম্বে স্বীকৃতি দিন

 

এই চ্যালেঞ্জ কাহার প্রতি? পূর্ব বংগ বা “বাংলাদেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের? সে তো নিশ্চয়ই। মরণপণ এক সংগ্রামে তাঁহারা জড়াইয়া পড়িয়াছেন। সভ্যতার ইতিহাসে চরম এক সংকটের, ভয়ংকর এক দুর্যোগের সাত-সাতটা দিন পার হইয়া গেল, তাঁহাদের অগ্নি পরীক্ষার এখনও শেষ নাই। সেই আগুনে কত জনপথ পুড়িয়া ছাই হইল, ওই বাংলার নদী-জপমাল দৃত প্রান্তর ছারেখারে গেল, বীরের রক্তস্রোত, অশ্রু ধারার সংগে মিশিয়া লবণাক্ত মোহনার পর মোহনার দিকে বহিয়া গেল, কিন্তু কী আশ্চর্য বাহির বিশ্বের কাহারো যেন তন্দ্রা আজও ছুটিল না।

অথচ আবহমান কালের ইতিহাসে এমন দৃশ্য কোথাও দেখা গিয়াছে কিনা সন্দেহ। একটা জোড়াতালি রাষ্ট্রের মাইনরিটি মেজরটিকে পায়ের তলা থে’তলাইয়া দিতে চায় শুধু তাই নয়, দরকার হইলে গোটা একটা মানবগোষ্ঠীকে তাহারা উৎসাধন করিবে, এই তাহাদের আস্ফালন। নতুবা পশ্চিম পাক, ফৌজ কীসের আশায় ওখানে চড়াও হইয়াছে, তাহার অন্য কোনও ব্যাখ্যা হয় না। একটা জাতিকে বিলকূল ফৌৎ করিয়া নূতন পত্তনি স্থাপন না করিলে তো তাদের মতলব হাসিল হয় না। পারিবে কি পারিবে না সেটা স্বতন্ত্র প্রশ্ন। তবে ইহা ঠিক, তুড়ি মারিয়া সব ঠাণ্ডা করার-কেল্লাফতে করার-লড়াই ইহা নয়।

সবচেয়ে লজ্জার কথা এই-বাহিরের দুনিয়ায় যেন ঠাণ্ডা রক্ত, অপ্রকোপিত পিত্তে চুপ করিয়া সব দেখিতেছি। হতমান, হতবল ব্রিটেনের কথা না বলাই ভাল-তথাকথিত কমন ওয়েলথের একটি দেশের দুই ভাগে যুদ্ধ। ব্রিটেন এতএব পড়িয়াছে উভয় সংকটে। আর এক মুরুব্বী আমেরিকা এখনও সুযোগ সন্ধানী বেড়ার উপর বসিয়া; হিতোপদেশের বাঁশি বাজাইতেছে। নীরো ইহার চেয়ে বড় অপরাধ করেন নাই। রুশ আচরণের সংগে ওই দেশের ঐতিহ্যের মিল আছে। কী করিয়াছিলেন স্টার্লিন, ত্রিশের দশকে স্পেনের প্রজাতন্ত্রী বাহিনী যখন জবরদস্ত হুকুমতের সংগে লড়াই করে? পিকিংয়ের কথা না তোলাই ভাল। পিণ্ডিচক্রের সংগে তার দোস্তি সুবিদিত। আর রাষ্ট্রপুঞ্জের নায়ক প্রগতিবাদী শ্রীযুক্ত উথাণ্ট? হস্তক্ষেপ দূরে থাক, তিনি মানবতার তাগিদে আন্তর্জাতিক রেডক্রসকে নিজে এত্ত লা দিতে  চান না-বরাত দিয়েছেন ভারতকে কি গণতন্ত্রের, কি সমাজতন্ত্রের ধ্বজাদারী-সব পুরোহিতই নির্বাক।

আর চমকপ্রদ ছোটখাটো প্রতিবেশী বা কাছাকাছি দেশগুলির ভূমিকা। ভারতের উপর দিয়া বন্ধ আকাশপথটি ঘুরপথে খোলা রাখার সব রকম সুবন্দোবস্ত করিয়া দিয়াছে বামপন্থী রাষ্ট্র সিংহল। সেখানকার অধিনেত্রী শ্রীমতি বন্দরনায়েককে “মা” বলিয়া ঢাকা, নৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ, কিছুতেই সিংহলের মন টলে নাই। শতাধিক বিমান এযাবৎ পূর্ব বংগ হইতে পশ্চিমে ফেরার পথে সিংহলে নামিয়েছে। কিন্তু পশ্চিম হইতে রোজ কত জেট গিয়াছে পূর্বে তাহার নাকি কোন সরকারী হিসাব নাই। আর বর্মার নে উইন-সরকার পাক জাহাজকে তেল দিতেছেন। তেল দেওয়াটা আক্ষরিক ও রূপক উভয় অর্থে। এবং শ্রী নে উইনও নাকি সমাজমন্ত্রী। “বাংলাদেশ” সরকার করুণ আবেদন জানাইয়াছেন বিশ্বকে “পশ্চিম পাকিস্তানকে আর মারণাস্ত্র জোগাইবেন না। আপনাদের নিকট হইতে পাওয়া আয়ুধে উহারা আমাদেরই মারিতেছে। ”

বৃথা এ ক্রন্দন। সব কর্ণ বধির কেহ শুনিবে না। সব চতুর মন জানে, রুটির কোন দিকটায় মাখন-মাখানো। অতএব বিশেষ দায় আসিয়া পড়িতেছে ভারতেরই উপর। এ দায় নৈতিক এ দায় মানবিক। এদেশে হৃদয়াবেগের বান ডাকিয়াছে রক্তের। অতীতে এই ভারতই আফ্রো-এশিয়ার হইয়া পিসীমার ভূমিকা অনেক লইয়াছে, কিন্তু বিনিময়ে পাইয়াছে গলাধাক্কা-অনন্তঃ কোনায়। আরবদের হইয়া গলা ফাটাইয়া ইজরাইলকে আসামী বানাইয়াছে, অথচ কাশ্মীরের ব্যাপারে এ ছটাক আরব নেক নজরও কুড়াইতে পারে নাই। এবার যাহা ঘটিতেছে, তাহা কিন্তু ভারতেরই দ্বারপ্রান্তে। ঝাপটা ঝটকা সব এই দেশের গায়েই লাগিবে। যদি-যদির কথা বলিতেছি- ‘বাংলাদেশের প্রজ্বলিত প্রাণাগ্নি নিবু-নিবু হয় তবে দলে দলে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে বিপন্ন বিতাড়িত মানুষের জোয়ার এ দেশের তটে আছড়াইয়া পড়ে ঠেকাইবে কে? প্রশ্নটা তাই ভারতের পক্ষে শুধু মানবতার নয়-আত্মরক্ষার। ওখানকার সংগ্রাম আমাদেরও সংগ্রাম।

ওই দেশের অগণিত মানুষ আজ বড় আশায় এ দেশের দিকে চাহিয়া আছে। আমরা কী দিব তাহাদের কি দিতে পারি? শুধু মামুলী রিলিফ নয়। সেটা এই পরিস্থিতিতে যাহারা রুটি চায় তাহাদের পাথর মারিয়া ফিরাইয়া দেওয়ার মন। এমনকি শুধু হালকা হাতিয়ারে কুলাইবে না। রণাংগনের শেষের দিকটার রিপোর্টে ক্রমশঃ স্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে যে, ‘বাংলাদেশের’ মুক্তিফৌজের সব আছে-বীরত্ব সাহস ইত্যাদি সবকিছু-কিন্তু শুধু সাহস, এমন কি শুধু শত-সহস্র-লক্ষ শির ডালি দিয়াও এ যুগের যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত হয়তো জেতা যায় না। ভারী অস্ত্র এবং মাথার উপর ‘বিমানছত্র’ চাই। ওই একটি বিষয় বাংলার মুক্তিফৌজ আজও অসহায় হইয়া আছে, বিপক্ষ তাহার পূর্ণ সুযোগ লইতেছে। ‘জেনারেল মনসুন কবে দেখা দিবেন কে জানে, তাহার আগে বাংলাকে বাঁচানো চাই-বাঁচানোর উপকরণ সরবরাহ একান্ত জরুরী। যতটা তাহাদের স্বার্থে ততটা আমাদেরও যদি কূটনৈতিক কলংকের ভয়টাই বাধা হইয়া থাকে তবে সেটাকেও দূর করার সোজা রাস্তা আছে-সে রাস্তা লওয়ার বিস্তর ঐতিহাসিক নজিরও বর্তমান ও বিদ্যমান-অস্থায়ী ‘বাংলাদেশ’ সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি।