শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১। বাংলাদেশের ওপর পাকিস্তানী সৈন্যের আক্রমণে উদ্বেগ প্রকাশ করে ভারতের লোকসভার প্রস্তাব | বাংলাদেশ ডকুমেন্টস – ১ম খণ্ড (পররাষ্ট্র দপ্তর প্রকাশিত) | ৩১ মার্চ, ১৯৭১ |
<১২, ১, ১>
পার্লামেন্টে ৩১ মার্চ ১৯৭১ এ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবিত রেজোল্যুশন থেকে
“পূর্ববঙ্গে সৃষ্ট সাম্প্রতিক অবস্থায় এই হাউজ গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পাঠানো সশস্ত্র বাহিনীর ব্যাপক হামলায় পূর্ব বাংলার সমগ্র জনগণের উপর দুর্যোগ নেমে এসেছে। তাদের ইচ্ছা ও দাবির বিরুদ্ধে সেখানে চলছে নানারকম কর্মকান্ড।
ডিসেম্বর ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের নির্বাচনের মাধ্যমে মানুষ তাদের ইচ্ছা প্রকাশ করলেও সেটাকে সম্মান দেখানোর পরিবর্তে পাকিস্তান সরকার জনগণের ম্যান্ডেট এর সাথে বিদ্রুপ করছেন।
পাকিস্তান সরকার আইনত নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অস্বীকার করেছে। শুধুমাত্র তাই নয় তারা বিনা কারণে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল করেছে। এতে ঐ প্রতিনিধিদরা তাদের ন্যায়সঙ্গত এবং সার্বভৌম ভূমিকা রাখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। পূর্ববাংলার জনগণের উপর চলছে শক্তির নগ্ন ব্যবহার। বেয়নেটের খোঁচায়, মেশিনগান, ট্যাংক, কামান ও বিমান দিয়ে তাদের দমন করা হচ্ছে।
ভারতের সরকার ও জনগণ সবসময় পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ স্বাভাবিক এবং ভ্রাতৃসুলভ সম্পর্ক বজায় রাখতে চেয়েছে। ভারত উপ-মহাদেশের মানুষ শতাব্দীকালব্যাপী ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পুরনো বন্ধনে আবদ্ধ। এই হাউস আমাদের সীমান্তের কাছে ঘটতে থাকা কর্মকান্ড নিয়ে উদাসীন থাকতে পারেনা। আমাদের দেশের সমস্ত এলাকা জুড়ে সকল মানুষ সেখানকার নিরস্ত্র ও নিরীহ জনগণের ওপর নজিরবিহীন নৃশংসতার বিরুদ্ধে নিন্দা জ্ঞ্যাপন করছে।
এই হাউস পূর্ববাংলার জনগণের গণতান্ত্রিক জীবনসংগ্রামের সাথে গভীর মমত্ব ও সংহতি প্রকাশ করছে।
শান্তি প্রতিষ্ঠার শাশ্বত অভিপ্রায়ে ভারত মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও প্রতিরক্ষায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এই হাউজ অনতিবিলম্বে শক্তি প্রয়োগ করে অসহায় মানুষের উপর নিপীড়ন বন্ধের দাবি জানাচ্ছে। এই হাউজ পৃথিবীর সব দেশ ও তাঁর জনগণের কাছে এমন একটি গঠনমূলক পদক্ষেপ নেয়ার ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষন করছে যাতে তারা পাকিস্তান সরকারকে গণহত্যা বন্ধ করার ব্যাপারটি বোঝাতে সক্ষম হন।
এই হাউস গভীরভাবে বিশ্বাস করে পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক বিজয় হবে। হাউস তাদের আশ্বাস দিচ্ছে যে তাদের সংগ্রাম ও উতসর্গের পথে ভারতের জনগণের সহানুভূতি ও সমর্থন পাবেন।
- বাংলাদেশের ঘটনাবলী সম্পর্কে ভারতের প্রথম প্রতিক্রিয়া ২৭ মার্চের লোকসভা ও রাজ্যসভার কার্যবিবরণীতে দ্রষ্টব্য।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২। পাকিস্তানের নৃশংসতার প্রশ্নে রাষ্ট্রসংঘের নির্লিপ্তির সমালোচনা করে প্রেরিত ভারতের লিপি | দৈনিক ‘যুগান্তর’ | ২ এপ্রিল, ১৯৭১ |
<১২, ২, ২>
রাষ্ট্রসংঘে ভারতের লিপি
পাকিস্তানের ব্যাপারে নিশ্চেষ্টতা অমার্জনীয়
রাষ্ট্রসংঘ, ১লা এপ্রিল (পি টি আই)- পশ্চিম পকিস্তানী সৈন্যরা বাংলাদেশের মানুষের উপর যে হারে নির্যাতন শুরু করেছে, তা বর্তমানে এমন এক স্তরে এসে পৌঁছেছে যে, তা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন ব্যাপার মনে করে নিশ্চেষ্ট থাকার আর সময় নেই। আত্তর্জাতিক মানবগোষ্ঠী কর্তৃক একটি উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করা অত্যাবশ্যক হয়ে উঠেছে – ভারত গতকাল রাষ্ট্রসংঘকে এই কথাটি স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
রাষ্ট্রসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উ থান্টের কাছে ভারতের এই অভিমত একটি পত্রাকারে পেশ করা হয়। রাষ্ট্রসংঘ ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি শ্রী সমর সেন পত্রটি পেশ করেন এবং পত্রটি তার অনুরোধে রাষ্ট্রসংঘ সদস্যদের নিকট প্রচার করা হয়। পরে রাষ্ট্রসংঘের একটি ইস্তেহার হিশেবে তা প্রকাশ করা হয়।
এই পত্রে শ্রী সমর সেন বলেছেনঃ মানব দুর্গতি এই মুহুর্তে এই নিষ্ক্রিয়তা ও নিরবতাকে দুর্গত জনসাধারণ বহির্বিশ্বের উদাসীনতা বলে ভাববে।
শ্রী সেন সতর্ক করে দেন যে, পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীকে সংযত না করলে এবং আন্তর্জাতিক অভিমত বাংলাদেশের জনসাধারণের প্রতি সহানুভূতি ও সমর্থনসূচক না হলে এই উপ-মহাদেশে উত্তেজনা ক্রমশই বৃদ্ধি পাবে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৩। ইয়াহিয়ার প্রতি চীনের প্রকাশ্য সমর্থন ভারতকে নিরস্ত্র করবে না – প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা | দৈনিক অমৃতবাজার | ১৪ এপ্রিল ১৯৭১ |
<১২, ৩, ৩>
ইয়াহিয়ার প্রতি চীনের প্রকাশ্য সমর্থন আমাদেরকে নিরস্ত্র করবে না – প্রধানমন্ত্রী
(আমাদের লক্ষ্ণৌ অফিস থেকে)
লক্ষ্ণৌ, এপ্রিল ১৩, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সতর্ক করেন যে ভারত বাংলাদেশের ঘটনাবলির জন্য নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকবেনা। এবং ঘোষণা করেন যে, বাংলাদেশের বিপক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের সাথে চীন এর “খোলামেলা সমর্থন” আমাদের অবস্থানের উপর কোন প্রভাব ফেলবে না।
এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তৃতাকালে মিসেস গান্ধী বলেন, “আমরা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারি এবং আমাদের মনোভাব অন্যদের কর্মের উপর নির্ভর করে না”।
বাংলাদেশের নতুন গঠিত সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া হবে কিনা জানতে চাওয়া হলে মিসেস গান্ধী বলেন এ ব্যাপারটি বিবেচনাধীন। অপর এক প্রশ্নে ছিল, বাংলাদেশের যুদ্ধ পশ্চিম পাকিস্তানের ‘ইম্পেরিয়াল ওয়ার’ কিনা? জবাবে মিসেস গান্ধী বলেন শুধু শক্ত কথায় কোন লাভ হবেনা।
মিসেস গান্ধী মনে করেন পূর্ববাংলার অবস্থা তাঁর দেশের অন্যান্য অংশেও প্রভাব ফেলে। পূর্ববাংলা ও ভারতের মধ্যে বসবাসকারী মানুষের রক্তের সম্পর্ক ছিল এবং ভারতীয়দেরও পূর্ববাংলার জনগণের প্রতি সহানুভূতি আছে – এটাই স্বাভাবিক।
পাকিস্তানে নির্বাচনী ফলাফল সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে মিসেস গান্ধী বলেন, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে উভয় দেশ লাভবান হবে এবং সম্পর্কের উন্নতি হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে যা ঘটছে তাতে এখন সবকিছু বদলে গেছে এবং এটিকে উভয় দেশের জন্য দুর্ভাগ্য হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে।
সিলন ও অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলোর সুস্পষ্ট রেফারেন্স দিয়ে মিসেস গান্ধী বলেন সেখানে যা ঘটেছিল এই দেশের ক্ষেত্রেও তার পরোক্ষ প্রভাব পড়বে।
যেগুলো তিনি আগে বলেছেন সেই সব প্রশ্নের নতুন কোন জবাব তিনি দিতে অসম্মতি জ্ঞ্যাপন করেন। তিনি জানান এসব ব্যপারে নতুন কিছু যোগ করার নেই।
পরে কংগ্রেস আইনপ্রণেতাদের সাথে একটি সাক্ষাৎকারে মিসেস গান্ধী বলেন, যদিও অন্যান্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা উচিত নয় কিন্তু সেটাকে পুরোপুরি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ক হিসাবে বর্ণনা করা যায়না।
মধ্যমেয়াদী জরিপে পর তার প্রথম সফরে মিসেস গান্ধী কে তার আসনের মানুষ একটি আড়ম্বর সংবর্ধনা দেয়।
জেলার অর্থনৈতিক সমস্যার উপর এক সেমিনারে বক্তৃতাকালে এবং একটি বাস টার্মিনাল স্টেশন উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রী স্থানীয় নাগরিকদের সাথে বৈঠক করেন।
ইউ পি মুখ্যমন্ত্রী, জনাব কমলাপতি ত্রিপাঠি এবং তার মন্ত্রিসভার সহকর্মীদের সাথে মিসেস গান্ধী লক্ষ্ণৌ থেকে হেলিকপ্টারে করে এখানে আসেন। সংসদবিষয়ক মন্ত্রী, জনাব ওম মেহতা এবং জনাব উমা শংকর দীক্ষিত তার সঙ্গে এসেছিলেন।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৪। সীমান্তে হামলার ব্যাপারে পাকিস্তানের প্রতি ভারতের হুশিয়ারি | দৈনিক আনন্দবাজার | ১৬ এপ্রিল ১৯৭১ |
<১২, ৪, ৪>
আর যেন গোলাগুলি না পড়েঃ পিণ্ডিকে দিল্লীর হুশিয়ারি
সীমান্তে হামলাবাজি বন্ধ কর। আর যেন গোলাগুলি না পড়ে। দিল্লী পিণ্ডিকে কড়া ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে।
সীমান্তের ওপারে যখন কামানের নলে আগুন, এপারেও তখন কথার আগুন ছুটছে। ভারতের সাফ সাফ বয়ান একটা কূটনৈতিক লড়াইয়ের সূচনা বলা যেতে পারে। আমাদের গ্রামের ওপর পাক বাহিনী গোলা নিক্ষেপ করেছিল, তারই বিরুদ্ধে এই নোট, তীব্র প্রতিবাদ। অদিকে পিণ্ডি ভারতীয় এলাকা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া তিনজন সিপাহিকে ফেরত দেবার দাবী সরাসরি খারিজ করে দিয়েছে।
নয়াদিল্লী থেকে আমাদের বিশেষ সংবাদদাতা জানাচ্ছেন ত্রিপুরা পূর্ববঙ্গ সীমান্তে ভারতীয় এলাকার মধ্যে পাক সশস্ত্র বাহিনী বিনা প্ররোচনায় গুলি বর্ষনের বিরুদ্ধে ভারত অদ্য (বৃহস্পতিবার) পাক হাই কমিশনের কাছে কড়া প্রতিবাদলিপি পাঠিয়েছে।
প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়েছে, ত্রিপুরা সীমান্তের কাছে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সমাবেশ ঘটেছে এবং বিপজ্জনক অবস্থার সৃষ্টি করেছে।
বহির্বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে ঐ লিপিটি পাঠানো হয়েছে। লিপিতে বলা হয়েছে এই ধরণের আক্রমণাত্মক কাজকর্ম বন্ধের জন্য অবিলম্বে পাক সশস্ত্র বাহিনীকে যথোপযুক্ত নির্দেশ দেওয়া উচিৎ। পাক বাহিনী এ রকম করে গেলে যে কোন রকম পরিণাম বা পরিণতির জন্য পাক সরকারকে দায়ী কড়া হবে।
আগে প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়েছে যে, দিনাজপুর অঞ্চলে মোতায়েন পাকবাহিনী ভারতীয় এলাকায় বিশেষ করে সামজিয়া গ্রামে হাল্কা মেশিন গান ও মাঝারি মেশিন গান থেকে গোলা বর্ষন করেছে। তাছাড়া, ৭ এপ্রিল থেকে ত্রিপুরার বিপরীত দিকে বিবিবাজারে (কুমিল্লায়) পাকসেনাদের সমাবেশ হচ্ছে এবং বিনা প্ররোচনায় পাক বাহিনীর গোলাবর্ষনে ভারতীয় নাগরিকরা আহত হয়েছেন।
পি টি আই জানাচ্ছেনঃ পাকিস্তান বেতারে বলা হয়েছে যে, কদিন আগে অপহৃত ভারতীয় সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর তিনজন সিপাহিকে ফেরত দেবার জন্য ভারতের দাবীটি পাকিস্তান অগ্রাহ্য করেছে।
১১ এপ্রিলে ভারতের নোটে বলা হয়েছে, গত ৯ এপ্রিল ওইসব সিপাই ২৪ পরগনা-যশোহর সীমান্তে কর্তব্যরত ছিলেন, ভারতীয় এলাকার মধ্য থেকে তাদের অপহরণ কড়া হয়। পাক বেতারে বলা হয়েছে, ভারতের দাবী ভিত্তিহীন। সিপাইদের পুর্ববঙ্গের এলাকায় আটক কড়া হয়।
পূর্ব পাকিস্তান নয়
(বিশেষ সংবাদদাতা)
নয়াদিল্লী, ১৫ এপ্রিল – ভারত সরকারের কাছে পূর্ব পাকিস্তান বলে আর কোন কথা নেই। এর স্থান নিয়েছে ‘পূর্ববঙ্গ’।
আজ এই প্রথম বহির্বিষয়ক মন্ত্রক পাকিস্তানী হাইকমিশনকে দেওয়া তাদের সরকারী নোটে সর্বত্র ‘পূর্ববঙ্গ’ কথাটি ব্যাবহার করেন। ভারতীয় এলাকার মধ্যে সশস্ত্র বাহিনীর গুলিবর্ষনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ঐ নোট দেওয়া হয়েছে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৫। পাকিস্তানের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে ভারতের প্রতিবাদ | দৈনিক যুগান্তর | ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ |
<১২, ৫, ৫–৬>
ভারতের বিরুদ্ধে অপপ্রাচার চালিয়ে গণহত্যার বর্বরতা ঢাকা যাবেনা
পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবাদ
(দিল্লী অফিস থেকে)
১৬ এপ্রিল – বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে ভারত কোন না কোনোভাবে জড়িত আছে বলে পাকিস্তানী জঙ্গীশাহি ভারতের বিরুদ্ধে যে মিথ্যা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে ভারত আজ তাঁর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। ভারত সরকারের এই প্রতিবাদ একটি বিবৃতির আকারে আজ পররাষ্ট্র দপ্তরের জনৈক মুখপাত্র বিশ্বের সাংবাদিকদের কাছে পেশ করেন।
উক্ত মুখপাত্র প্রসঙ্গত বলেন যে, ভারতের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ ও প্রচার চালিয়ে পাক জঙ্গীশাহি বাংলাদেশে যে বর্বর ও অমানুষিক গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে তা কিছুতেই ঢাকতে পারবে না।
কেউ কেউ এই প্রতিবেদক কে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার পূর্ব সূচনা বলে মনে করছেন। একজন বিদেশী সাংবাদিক এ সম্পর্কে প্রশ্ন করলে সরকারী মুখপাত্রটি এর সরাসরি কোন উত্তর না দিয়ে বলেন, যখন যে অবস্থা দেখা যাবে তখন তাঁর সেইভাবে মোকাবিলা হবে। এই হল ভারত সরকারের নীতি।
পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্রটি আরও বলেন যে, পাক জঙ্গীশাহী বাংলাদেশে যে মধ্যযুগীয় পৈশাচিক হত্যালীলা চালাচ্ছে তা থেকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেবার জন্যই ভারতের বিরুদ্ধে তারা মিথ্যা প্রচারে নেমেছে। কিন্তু বিশ্বের নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের অনেকেই পাক বর্বরতা স্বচক্ষে দেখেছেন। কাজেই পাকিস্তান যতই চেষ্টা করুক তাঁর পক্ষে এই নিদারুণ নির্মম সত্য চাপা দেওয়া সম্ভব হবেনা। তিনি জোরের সঙ্গে বলেন যে, ভারতের বিরুদ্ধে দেশ বিদেশে যতই অপপ্রচার ও বিষোদগার করা হোক না কেন ইসলামাবাদের জঙ্গী শাসক চক্র কিছুতেই এই অকাট্য ও প্রত্যক্ষ সত্য চাপা দিতে পারবেনা যে, পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ ও নিপীড়নের নাগপাশ ছিন্ন করার জন্য বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ছেন।
স্বীকৃতি দানের প্রশ্নে
পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্রের এই বিবৃতিতে কেউ কেউ বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি দানের পূর্ব সূচনা বলে মনে করছেন। জনৈক বিদেশী সাংবাদিক এ সম্বন্ধে প্রশ্ন করলে সরকারী মুখপাত্রটি তাঁর সরাসরি উত্তর না দিয়ে কেবল বলেন, সরকার অবস্থা বুঝে ব্যাবস্থা নেবেন। তাঁর এই মন্তব্য থেকে এই কথাই মনে হয় যে, বাংলাদেশ সরকার হয়ত এখন সরকারিভাবে স্বীকৃতির জন্য অনুরোধ জানান নি। অথবা এমনও হতে পারে যে, ভারত সরকার এখনো এ ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নেননি।
বাংলাদেশ সরকারের দুজন দূত ইউরোপে রওনা হয়ে গেছেন বলে ভারত সরকার কোন খবর রাখেন কি – জনৈক সাংবাদিকের এই প্রশ্নের উত্তরে মুখপাত্রটি বলেন, ‘কাগজে পড়েছি’। সরকারী মুখপাত্রের এই ধরণের কাটা কাটা উক্তি থেকে মনে হয় সরকার ভবিষ্যতের কথা ভেবেই এখন সতর্কতা অবলম্বন করে চলছেন।
সম্প্রতি পাকিস্তানী বাহিনী ভারত সীমান্ত এলাকা থেকে কয়েকজন সীমান্ত রক্ষী ও অসামরিক নাগরিকদের ধরে নিয়ে গেছে। ভারতীয় এলাকা থেকে সীমান্ত রক্ষী ও নাগরিকদের জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়ার পেছনে পাকিস্তানের একটা গুঢ চক্রান্ত থাকাও বিচিত্র নয়। হয়ত পাকিস্তান পরে এটাই প্রমাণ করতে চাইবে যে ভারত সরকার এদের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সামিল হয়ে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য বাংলাদেশে পাঠিয়েছিল। কিন্তু ভারত অংকুরেই পাকিস্তানের এই দুরভিসন্ধি ফাঁস করে দিতে চান এবং সেই জন্যই এই প্রতিবাদ। পাকিস্তানের অপপ্রচার ক্রমশ এমন একটা স্তরে পৌঁছেছে যে, এর প্রতিবাদ না করলে তা যে অংশত সত্য এ কথাই মনে হবে। তাই বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারত সরকারের প্রকৃত নীতি কি তা সকলকে জানানোর জন্যই ভারত পাক অপপ্রচারের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৬। পাকিস্তানের আক্রমণ বরদাস্ত করা হবেনাঃ প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ঘোষণা | দৈনিক যুগান্তর | ২৫ এপ্রিল, ১৯৭১ |
<১২, ৬, ৭>
পাক হামলা বরদাস্ত কড়া হবেনা
-প্রতিরক্ষামন্ত্রী
শিবপুরি (মধ্যপ্রদেশ), ২৪ এপ্রিল (পি টি আই) – কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রী জগজীবন রাও আজকে এই সতর্বানি উচ্চারণ করেছেন যে, ভারতীয় এলাকায় পাকিস্তানের কোন সামরিক অভিযানই বরদাস্ত করবেনা।
পশ্চিমবঙ্গে বনগাঁর অনতিদূরে সীমান্তে পাকিস্তানী গোলাবর্ষনের সংবাদ পেয়েই ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এই হুশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি এখানে একটি ভাষণ দিচ্ছিলেন।
প্রসঙ্গত শ্রী জগজীবন বলেন, ভারতকে সর্বক্ষন সজাগ সতর্ক এবং ভারতের মাটিতে যে কোন আক্রমণ প্রতিহত করবার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
ভারত-তিব্বত সীমান্ত বাহিনীর শিক্ষার্থী সদস্যেদের উদ্যেশে ভাষণ দিয়ে গিয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রী কথাগুলি বলেন।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৭। ভারতের মাটিতে গোলা নিক্ষেপের জন্য পাকিস্তানের প্রতি ভারতের সতর্কবানি | সৈনিক আনন্দবাজার | ২৫ এপ্রিল, ১৯৭১ |
<১২, ৭, ৮>
ভারতের মাটিতে গোলা ফেলা বন্ধ করো নতুবা
পরিণামের জন্য দায়ী হবেঃ পাকিস্তানের প্রতি সতর্কবানি
ভারতীয় সীমান্ত বনগাঁর কাছে শনিবার সকালে পাকিস্তানী গোলা এসে পড়েছে। তাছাড়া এক কোম্পানি পাক ফৌজ নিষিদ্ধ সীমার ৫ কিলোমিটার ভিতরে এসে, পেটরাপোলে রেল লাইনের কাছে অবস্থান নিয়ে, শনিবার বিকালে চারটে থেকে এক ঘণ্টা ধরে ভারতীয় গ্রামগুলির উপর গুলি চালায়। পরে তারা বেনাপোলে হটে যায়। নয়াদিল্লী থেকে এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। দাবী করা হয়েছে যে, পাকিস্তানকে কথা দিতে হবে যে, এ ধরনের ব্যাপার আর ঘটবে না, আর না হলে সম্ভাব্য পরিণাম যা ঘটবে তাঁর জন্য পাকিস্তান দায়ী হবে।
সকালে পাকফৌজ ভারতীয় সীমান্তের (বনগাঁ) ওপারে মুক্তিফৌজের শিবির লক্ষ্য করে মর্টার চালায়। তারই কয়েকটি গোলা ভারতীয় এলাকায় এসে পড়েছিল। দ্বিতীয় ঘটনাটি আরও গুরুতর।
বহির্বিষয়ক মন্ত্রক পাক হাইকমিশনকে ঐ ঘটনাগুলির প্রতিবাদে যে নোট পাঠিয়েছেন তা রীতিমত কড়া ধাঁচের। এছাড়া অন্য একটি নোটে পাকিস্তানকে জানানো হয়েছে যে, ভারতের সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর লোকেরা কখনোই পাকিস্তানে প্রবেশ করেননি। এ বিষয়ে পাকিস্তানের ১৪ এপ্রিল তারিখের অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন। অর্থাৎ আজ ভারত পাকিস্তানকে দুইটি নোট পাঠিয়েছে।
ভারত আরও বলেছে যে, অপহৃত তিনজন সীমান্তরক্ষীকে ফেরত দিতে হবে এবং অপহরণকারীদের যারা পাকফৌজের লোক তাদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে।
ভারত আরও জানিয়েছে যে, ১২ এপ্রিল রাত এগারটায় পাকফৌজ সোনামুড়ার কাছে ত্রিপুরার উপমন্ত্রী শ্রী মনসুর আলীর বাড়ির উপর গুলি চালিয়েছিল এবং ১৪/১৫ এপ্রিল রাত্রে ঐ অঞ্চলে কর্তব্যরত নায়ক মনিকুমারকে গুলি চালিয়ে হত্যা কয়েছিল। ১৭ এপ্রিল ঐ অঞ্চলে আরও কয়েকজন ভারতীয় নাগরিকের আবাসের উপর পাকিস্তানীরা গুলি চালিয়েছিল। ভারত এইসব ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং বলেছে যে সে পাকিস্তানের কাছে এজন্য ক্ষতিপূরণ দাবী করতে পারে। এ ধরণের ব্যাপার বন্ধ না হলে যা পরিণাম ঘটবে পাকিস্তান সে জন্য এককভাবে ও সম্পূর্ণভাবে দায়ী হবে।
– পি টি আই ও ইউ এন আই
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৮। সীমা ছাড়ালে গুরুতর পরিণতি হবেঃ পাকিস্তানকে ভারতের হুশিয়ারি | দৈনিক আনন্দবাজার | ২৯ এপ্রিল, ১৯৭১ |
<১২, ৮, ৯>
পাকিস্তানকে ভারতের হুশিয়ারি–সীমা ছাড়ালে পরিণতি গুরুতরঃ
নিহতদের জন্য ক্ষতিপূরণ দিন
(বিশেষ সংবাদদাতা)
নয়াদিল্লী, ২৮ এপ্রিল – গত ২৬শে এপ্রিলের পর থেকে ভারতীয় সীমান্তের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বুকে ঢুকে পাকিস্তানী সেনারা যে আক্রমণ চালিয়েছে, ভারত আজ তাঁর বিরুদ্ধে কড়া ভাষায় পাকিস্তানের কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছে। আক্রমণের চারটি ঘটনায় গতকাল এবং তাঁর আগের দিন তেত্রিশ জন ভারতীয় নাগরিক পাকফৌজের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন। অন্ততঃ আটজন আহত হয়েছে, দুজন নিখোঁজ।
আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুযায়ী ভারত তিনটি নোটে পাকিস্তানের কাছে আজ ক্ষতিপূরণ চেয়েছে এবং হুশিয়ার করে দিয়েছে যে, ভবিষ্যতে ১৯৬০ সালের ভূমি নীতি লঙ্ঘনের এরূপ ঘটনা ঘটলে গুরুতর পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে। এইসব নোট পররাষ্ট্র দফতর আজ পাকিস্তান হাই কমিশন অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
ইতিমধ্যে জানা যায় যে, বাংলাদেশে পাক ফৌজের ইউনিটগুলি পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসাম সীমান্তে পৌঁছে সীমান্তের ঘাঁটিগুলিতে ছড়িয়ে পড়তে চেষ্টা করেছে। মনে হয়, সেনাবাহিনীর নির্দেশ অনুযায়ী হত্যায় সুখী পাকফৌজ এ জন্যই সীমান্তের এপারে গুলি চালিয়ে যাচ্ছে।
১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের সীমান্ত থেকে সেনাবাহিনীকে অন্তত এক হাজার গজ দুরে রাখার জন্য ভূমিনিতি তৈরি করেন। পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস এবং ভারতীয় সীমান্তরক্ষীকারী বাহিনীর জন্য এই নীতি তৈরি হয়। এখন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস বলে কিছু নেই। কাজেই ভারত যে এখনো পাকিস্তানের সঙ্গে আইনের কচকচিতে ব্যাস্ত এটা খুবই মজার ব্যাপার।
সরকারী মহল বলেন, ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সীমান্ত থেকে এখনো অন্তত এক হাজার গজ দুরে রাখা হচ্ছে। সীমান্ত রক্ষী বাহিনীই সীমান্তের ভার আপাতত বইতে পারবে মনে করেই এই ব্যাবস্থা।
ভারতের নোটে যে সমস্ত ঘটনার প্রতি পাকিস্তানের দৃষ্টি আকর্ষন কড়া হয়েছে এবং প্রতিবাদ জানানো হয়েছে তা হলঃ
২৬ এপ্রিলঃ পাকিস্তানী সৈন্য জলপাইগুড়ির কাছে ভারতীয় সীমান্তের বনাপারা পর্যন্ত চলে আসে এবং ভারতীয় এলাকার মধ্যে গুলি চালিয়ে দুজন ভারতীয় গ্রামবাসীকে নিহত করে।
২৭ এপ্রিলঃ বয়রা এলাকায় (বনগাঁর উত্তরে) পাকফৌজ ভারতের লাখিমপুর গ্রাম পর্যন্ত চলে আসে এবং গুলি চালিয়ে পাঁচজনকে নিহত করে। নিহতদের একজন নাবালিকা। তিনজন আহত হয়।
২৭ এপ্রিলঃ বনগাঁর কাছে ভারতীয় এলাকায় ঢুকে পাক সৈন্য সীমান্তরক্ষী দলের উপর গুলি চালায়।
২৭ এপ্রিলঃ পাকসেনা ধরলা নদী পেরিয়ে ভারতীয় ছিটমহল বাঁশপাচিরে বেলা দুটো নাগাদ প্রবেশ করে। বেপরোয়া গুলি চালিয়ে হানাদাররা অন্তত পঁচিশ জনকে হতাহত করে।
২৬ এপ্রিলঃ কাছার সীমান্তে প্রহরারত সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর উপর পাক সৈন্য হামলা করে। একজন কনস্টেবল নিহত হন। পাঁচ জন আহতদের মধ্যে একজন ইন্সপেক্টর, দুজন কনস্টেবল নিখোঁজ।
পাক সৈন্যরা দুটি ওয়ারলেস সেট, একটি রাইফেল এবং দুটি হাল্কা মেশিনগান ছিনিয়ে নেয়।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৯। পাকিস্তানের ঘটনাপ্রবাহ শেষ পর্যন্ত ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি করবে – প্রধানমন্ত্রীর সতর্কবানি | দৈনিক স্টেটসম্যান | ৭ মে ১৯৭১ |
<১২, ৯, ১০>
পাকিস্তানের ঘটনাপ্রবাহ শেষ পর্যন্ত ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি করবে —শ্রীমতী গান্ধী
(আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি)
নয়াদিল্লি, ৬ মে – মিসেস. গান্ধী বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তানে যাই ঘটুক না কেন ভারত চোখ বন্ধ করে থাকতে পারেনা। কারণ সেটা এই দেশ ও দেশের অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলতে বাধ্য।
প্রধানমন্ত্রী জেলা কংগ্রেস কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এর একটি সম্মেলন উদ্বোধনকালে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে শরনার্থিদের ঢালাও প্রবেশ সম্পর্কে উল্লেখ করে বলেন, প্রায় ২ মিলিয়ন লোক পূর্ব পাকিস্তান থেকে তার দেশে প্রবেশ করেছে।
যখন লড়াই থামবে তখন তাড়া ফিরে যাবে। ইতোমধ্যে তিনি আশা প্রকাশ করেন যে সারা দেশের মানুষ তাদের সাহায্য করবে। আমরা শুধুমাত্র বর্তমানে তাদের দেখাশোনাই করবোনা বরং যুদ্ধ শেষে তারা যাতে তাদের বাড়িতে ফিরে যেতে পারে সেদিকেও খেয়াল রাখব। মিসেস গান্ধী বলেন, জনাব এমসি শীতলভাদের নেতৃত্বে শরনার্থিদের সাহায্য করার জন্য ইতিমধ্যে একটি কেন্দ্রীয় সহায়তা কমিটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
মিসেস গান্ধী বলেন যে “সীমান্ত জুড়ে ঘটিত ঘটনার ফলস্বরূপ একটি নতুন বোঝা তার দেশের উপর এসেছ”। পূর্ব পাকিস্তানের এসব ঘটনায় শুধু পশ্চিমবঙ্গের উপর নয় বরং পুরো দেশের উপর নিশ্চিতভাবে প্রচণ্ড প্রভাব ফেলবে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১০। এখনই ভারতের স্বীকৃতি বাংলাদেশের স্বার্থের অনুকূল হবে না-বিরোধী নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনাকালে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য |
দৈনিক ‘আনন্দবাজার’ | ০৮ মে, ১৯৭১ |
রায়হান হোসেন রানা
<১২, ১০, ১১–১২>
এখনই ভারতের স্বীকৃতি বাংলাদেশের স্বার্থের অনুকূল হবে না–
তবে মুক্তি আন্দোলনকে পূর্ণ সমর্থন দেওয়া হবে
– শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী
(বিশেষ সংবাদদাতা)
নয়াদিল্লী, ৭মে- আজ সকালে বিরোধী নেতাদের সঙ্গে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বৈঠকে বসেছিলেন। প্রায় সকলেই বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানান। (ব্যতিক্রমঃ বিকানীরের মহারাজা ডঃ করণ সিং এবং মুসলিম লীগ নেতা মহম্মদ ইসমাইল। দুজনের বক্তব্যে অবশ্য কিছু পার্থক্য ছিল।) সকলের কথা শোনার পর প্রধানমন্ত্রী যা বলেন তাঁর মর্ম এইরকমঃ বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের প্রতি ভারত পূর্ণ সমর্থন জানাবে কিন্তু বাংলাদেশকে এখনই কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়া এই দেশেরই স্বার্থের পরিপন্থী হবে। সারা বিশ্বে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি প্রচুর সহানুভুতি থাকলেও স্বীকৃতির ব্যাপারে ভাবনা চিন্তা চলছে। তবে তাজউদ্দিন সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না এমন কথা তিনি বলেননি বা সরকার এ ব্যাপারে ঠিক কি করবেন তার কোন আভাস দেননি। শুধু স্পষ্টভাবে তিনি বলেন যে, কোন অবস্থাতেই ভারত ভীত নয়।
ভারতের স্বীকৃতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী
ইন্দিরাজী বলেন যে, পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে নানা উসকানিমূলক কাজ করছে। ভারতকে নানা ভাবে বাংলাদেশের ব্যাপারে জড়াতে চাইছে। যাই হোক, ভারত যা ঠিক মনে করবে তা করতে ভীত নয়।
দুই ব্যাতিক্রম । অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের দাবির বিরোধীতা করেন বিকানীরের মহারাজা ডঃ করণ সিং। তিনি লোকসভায় কয়েকটি ছোট গোষ্ঠী ও কয়েকজন নির্দল সদস্যের নেতা। সেই গোষ্ঠী ও ব্যাক্তিরা অবশ্য আগেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার দাবী জানিয়েছেন।
ডঃ কিরণ সিং এর বক্তব্যঃ বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন আসলে বাঙালীদের বিদ্রোহী ভারতের এ ধরনের ব্যাপার ঘটলে সরকার কি করতেন? কাশ্মীরের কথাও ভাবা দরকার ।
ইন্দিরাজ তাঁকে বলেনঃ কাশ্মীরে যারা হাঙ্গামা বাধাতে চায় তারা জনসাধারন থেকে বিচ্ছিন্ন। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের পিছনে বিপুল গরিষ্ট সমর্থন রয়েছে। বাংলাদেশে গরিষ্ট অভিমত পাকিস্তান দাবিয়ে রাখতে চাইছে।
মুসলিম লীগ নেতা মহম্মদ ইসমাইল যা বলেন তার মর্মঃ এমন কিছু করা ঠিক হবে না যাতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ে বা কোন সঙ্কট সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে ওই ধরনের সঙ্কট দেখা দিতে পারে। তবে সরকার এ ব্যাপারে যে কোন ব্যবস্থাই নিন না কেন তার প্রতি তাঁহাদের দলের সমর্থন থাকবে।
ইন্দিরাজ বলেন যে, বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে কিছু লোক সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করতে চাইছে। সকলকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
স্বীকৃতির স্বপক্ষে জোর দাবিঃ অধিকাংশ বিরোধী নেতা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য জোর দাবি জানান। পরিস্থিতি সম্পর্কে ইন্দিরাজীর বিশ্লেষণ তাঁরা মেনে নেননি। তাঁরা বলেন যে, বাংলাদেশ একটি বাস্তব সত্য। স্বীকৃতি দিয়ে সরকার শুধু সেই সত্যটিকেই মেনে নেবেন আর তাতে সেইখানকার আন্দোলন জোরদার হবে। ভারত এ বিষয়ে জোর করলে ভারতেরই ক্ষতি হতে পারে।
এই দাবি জানান – সি পিএম, সি পি আই, ডি এম কে, আদি কংগ্রেস, পি এস পি, এম এস পি, ফঃ বঃ আর এস পি। শ্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত (সি পি আই) তাঁর দলের পশ্চিমবঙ্গ কমিটির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে একটি স্মারকলিপি দেন। শ্রী এ কে গোপালান ( সি পি এম ) বলেন যে, পাকিস্তানকে ভয় না করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধাদের সকল রকমের সাহায্য দেওয়া হোক। শ্রী কে মনোহরণ (ডি এম কে) শ্রী শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী (জঃ সঃ) শ্রী চিত্ত বসু (ফঃ বঃ), শ্রী ত্রিদিব চৌধুরী (আর এস পি) শ্রী এন জি গোরে (পি এস পি) ও শ্রী এস এন মিশ্র (আদি কং) একই দাবি তোলেন।
ত্রাণকার্য সম্পর্কে একটি আলাদা বৈঠক বসবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন যে পাকিস্তানী ফৌজের অত্যাচার থেকে বাঁচবার জন্য এ পর্যন্ত প্রায় পনের লক্ষ লোক ভারতে এসেছেন। আরও আসবেন। এ জন্য ত্রাণকার্য সম্পর্কে কি করা যায় সে বিষয়ে আলোচনার জন্য তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বিরোধী নেতাদের সঙ্গে পৃথক একটি বৈঠকে বসবেন। (অর্থমন্ত্রী শ্রী চ্যবন নাকি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে এ জন্য মোট ষাট কোটি টাকা দরকার)। তবে ওই বৈঠকে কবে বসবে তা ঠিক হয়নি। ভারত চায় যে, এই ত্রাণকার্য আন্তর্জাতিক রুপ নিক।
ইন্দিরাজী আরও বলেন যে, বাংলাদেশে আগে দুই ডিভিশন পাক ফৌজ ছিল। এখন আছে চার ডিভিশন। শহরগুলি অধিকাংশ পাক ফৌজের দখলে আছে। গ্রামাঞ্চলের বহু এলাকাই এখনও মুক্তিফৌজের নিয়ন্ত্রণে। গেরিলা তৎপরতা চালিয়ে তাঁরা পাক ফৌজের তৎপরতা সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করছেন।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠক
নয়াদিল্লী, ৭ মে-প্রকাশ বাংলাদেশ সম্পর্কে আলোচনার জন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা আজ এক বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠকে পূর্বনির্ধারিত ছিল না।
বিরোধী দলনেতাদের সঙ্গে আলোচনার পরেই প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধী স্বল্প সময়ের নোটিশে তার সহকর্মীদের ঐ বৈঠকে আহবান করেন।
এক ঘন্টাব্যাপী বৈঠকে শ্রীমতি গান্ধী বিরোধী নেতাদের সঙ্গে তাঁর আলোচনার বিষয়ে সহকর্মীদের অবহিত করেন।
-পি টি আই
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১১। জাতিসঙ্ঘের ‘সোশ্যাল কমিটি অব দি ইকনমিক এন্ড সোশ্যাল কাউন্সিল’ এ ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেনের ভাষণ | ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় | ১২ মে ১৯৭১ |
<১২, ১১, ১৩–১৮>
মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনের এজেন্ডা আইটেম ৫ (ক) এর উপরে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের সামাজিক কমিটিতে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত এস সেন এর স্টেটমেন্ট, ১২ মে ১৯৭১
জনাব চেয়ারম্যান,
আমার প্রতিনিধিদল এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপর আলোচনায় অংশ নেয়ার জন্য এই অনুষ্ঠানকে যথাযথ মনে করে। কমিশনের বর্তমান রিপোর্টে এটি স্পষ্ট যে মানবাধিকার রক্ষা এখনো একটি গুরুত্তপূর্ন সমস্যা। প্রকৃতপক্ষে, সাধারণ পরিষদের ২৫ তম অধিবেশনে গৃহীত স্মারক ঘোষণাপত্রের রিপোর্টের অনুচ্ছেদ ৮-এ প্রকাশিত একটি অনুচ্ছেদে বাস্তবায়নের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। প্রসঙ্গিক বাক্যটিতে লেখা আছে – “যদিও কিছু অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব হয়েছে, তথাপি এখনও বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে একাধিক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন সংঘটিত হচ্ছে। আমরা নিজেদেরকে মানুষের অধিকার রক্ষার মৌলিক স্বাধীনতাসমূহ লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ক্রমাগত এবং নির্ধারিত সংগ্রামের অঙ্গীকার করি। এই লঙ্ঘনের মৌলিক কারণগুলো দূর করতে হবে। মানুষের মর্যাদার জন্য জাতিসংঘ কর্তৃক প্রদত্ত চার্টার ব্যবহারের মাধ্যমে জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ, ভাষা বা ধর্ম নির্বিশেষে সার্বজনিন শ্রদ্ধাবোধ তরান্বিত করতে হবে। ”
চার্টার এর ১(৩), ৫৫ (গ) এবং ৫৬ আর্টিকেলে, মানবাধিকার নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তার কথা বলা আছে। ১৯৬৮ সাল, যেটাকে আন্তর্জাতিকভাবে মানবাধিকার বছর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, সেদিন ‘Human Rights-A Compilation of International Instruments of the United Nations” নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। এই পুস্তিকার শেষ পৃষ্ঠায় মানবাধিকার মোকাবেলার যন্ত্র হিসাবে ৩৪ টি বিষয়ের একটি তালিকা দেওয়া হয়। এছাড়া এই তালিকা থেকে, গত তিন বছরে বিভিন্ন অন্যান্য নথি, ঘোষণা এবং রেজুলেশন গৃহীত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সামাজিক অগ্রগতি ও উন্নয়ন ঘোষণাপত্র ১৯৬৯ এর কথা উল্লেখ করা উচিত। ২৫ তম অধিবেশন ঘোষণাপত্র আমি ইতিমধ্যে উল্লেখ করেছি, যেখানে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আইন ও এর মূলনীতি ঘোষণা সহ ইউনাইটেড নেশনস চার্টার অনুযায়ী সহযোগিতার কথা উল্লেখ আছে – এগুলো সবই মাত্র ছয় মাস গৃহীত হয়। উপরন্তু, তেহরান মানবাধিকার ঘোষণাও অপ্রাসঙ্গিক। ১৯৪৯ সালের যুদ্ধকালীন সময়ে বেসামরিক ব্যক্তিদের সুরক্ষা সংক্রান্ত জেনেভা কনভেনশনটিও তাই। উপরন্তু, সাধারণ পরিষদে গত বছর চারটি রেজুলেশন ২৬৭৪, ২৬৭৫, ২৬৭৬ ও ২৬৭৭ গৃহীত হয়, যেগুলোর সবই আর্মস কনফ্লিক্টে সৃষ্ট মানবাধিকার প্রশ্ন সংক্রান্ত। ভারত শুরু থেকেই মানবাধিকার কমিশনের সদস্য। এবং জাতিসংঘসহ সব বড় মাপের ফোরামে ছোট বড় সব রকমের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে তার অবস্থান জনিয়ে এসেছে। আমি যতোগুলো ঘোষণার কথা বলেছি এগুলো সবই যেখানেই মানবাধিকার লঙ্ঘন হয় সেটা নিয়েই আলোচনা করে থাকে। তেহরান ঘোষণা, মে ১৯৬৮ সালে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এর ৫ম অনুচ্ছেদে আছে- “জাতিসংঘের প্রাথমিক লক্ষ্য সর্বোচ্চ স্বাধীনতা ও মর্যাদার মাধ্যমে প্রত্যেকটি মানুষের মানবাধিকার সংরক্ষণ। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য, সকল দেশের আইন প্রতিটি ব্যক্তিকে জাতি, ভাষা, ধর্ম বা রাজনৈতিক বিশ্বাস – নির্বিশেষে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও তথ্য অধিকার এবং পাশাপাশি ধর্ম পালনের অধিকার দান করা উচিত, এবং তার দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক জীবনে অংশগ্রহণের অধিকার থাকা উচিৎ। ”
যতক্ষণ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিভিন্ন দেশে আইনের লঙ্ঘন পর্যবেক্ষন না করে এবং তার প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা না নেয় ততক্ষণ আমরা মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষা প্রশ্নে যাই বলি না কেন সেটা বিদ্রুপ মাত্র। এটা বারবার অনেকভাবেই জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামে প্রকাশ করা হয়েছে এবং আমি কৃতজ্ঞ বিশেষ করে পাকিস্তানের বিশিষ্ট প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত আগা শাহীর কাছে কারণ তিনি আফ্রিকা এবং ফিলিস্তিনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের উপর মে ২০, ১৯৭০ তারিখে অনুষ্ঠিত সামাজিক কমিটির সভায় বলেন –
“অন্যান্য কোন পরিস্থিতি যেখানে মানবাধিকারের ব্যাপক লঙ্ঘন হবে সেগুলো পরীক্ষা ও তদন্ত করা হবে এবং মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা বিষয়ে জাতিসংঘের সনদ বাধ্যতামূলক ভাবে মানতে হবে যাতে এটি বিদ্রুপ ও একাডেমিক বিতর্কে সীমাবদ্ধ না হয়ে যায়। ”
এটা প্রসঙ্গে উদাহরণস্বরূপ ভারত সরকার গভীর ক্ষোভের সাথে মানবাধিকার লংঘনের একটি বর্তমান অবস্থা গোচরে আনতে চায় যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। এটি জানানোর পাশাপাশি আমার দেশে যে লক্ষাধিক শরণার্থী আসছে সেই অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে মানবিক ত্রাণ ব্যবস্থার জন্য আবেদন করছি। সমস্যা যে আকার ধারণ করেছে তাতে এটি এখন একটি আন্তর্জাতিক উদ্বেগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
এই মর্মান্তিক মানবিক সমস্যা বোঝার জন্য তার কারণগুলো ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। এর ফলে বিশ্ব সম্প্রদায়ের পক্ষে এটির গুরুত্ব ও ধারাবাহিকতা অনুধাবন করা সহজ হবে এবং তার ফলে সেটা কমাতে জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণ করে লাখ লাখ মানুষের দুর্ভোগ কমানোর ব্যাপারে আগানো যাবে।
I
পাকিস্তান সরকার মানবাধিকার কনভেনশনের বিভিন্ন ঘোষণা, রেজুলেশন ও কনভেনশন গ্রহণ ও সমর্থণ করে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তারা পূর্ববঙ্গে মিলিটারি একশনে এই আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা ব্যাপকভাবে লঙ্ঘন করেছে। এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গভীর উদ্বেগের বিষয়। আমি সেখানে যেসকল অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে সেগুলো এত বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন মনে করছিনা। এগুলো সবারই জানা। এতে তাদের মধ্যে হতাশা সঞ্চিত হচ্ছে। বছরের পর বছর তারা যে অসাম্যের স্বীকার হচ্ছে তার ফলে এমন মর্মান্তিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ফলে অনেক ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ জন্ম নিচ্ছে। এমন প্রচুর ঘটনা আমি লক্ষ্য করেছি। এই বছর মার্চের শেষের দিকেও আমাদের প্রত্যাশা ছিল যে এই মনুষ্যসৃষ্ট অসুবিধা দূর করার জন্যে পূর্ব বাংলার মানুষের দাবী মেনে নেয়া হবে। কিন্তু করা হয়েছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিপরীত। একটি সামরিক অভিযান পূর্ববাংলায় রাজনৈতিক চেতনা ও কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। ২৬ মার্চ পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি যেসব কথা বলেন তার মধ্যে বলেন –
“আমি সারা দেশে সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আওয়ামী লীগ একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে নিষিদ্ধ করা হল। আমিও একটা সম্পূর্ণ প্রেস সেন্সরশিপ আরোপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সামরিক আইন প্রবিধান খুব শীঘ্রই এই সিদ্ধান্ত অনুসারে জারি করা হবে। ”
এ প্রসঙ্গে আমি মানবাধিকার ঘোষণাপত্র, সম্পূর্ণরূপে পাকিস্তানের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নথির মূল বিধান কমিটির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। এই ঘোষণাপত্রের অনুচ্ছেদ ৩: “জীবন, স্বাধীনতা এবং ব্যক্তি নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার আছে”। পূর্ববাংলায় গৃহীত ব্যবস্থা এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। অনুচ্ছেদ ৫: “কোন মানুষের বিরুদ্ধে অবমাননাকর আচরণ অথবা শাস্তি, নির্যাতন করা বা নিষ্ঠুর আচরণ করা যাবে না”। যা আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে দেখা গেছে তাতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয় যে, এই অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়েছে। আর্টিকেল ৭, ৮, ৯, ১২, ১৩, ১৭, ১৮, ১৯, ২০ ও ২১ এর বিধান একভাবে অবমাননা করা হয়েছে। জনাব চেয়ারম্যান, আমি দেখাতে পারি মানবাধিকার সংক্রান্ত যেকোন নথিতেই পাকিস্তানের সমর্থন আছে এবং এটাও নিঃসন্দেহে দেখানো যায় যে পাকিস্তান প্রায় সব বিধান ভঙ্গ করেছে।
পূর্ববাংলার জনগণের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের জাতিগত, ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক পার্থক্য আছে। তথাপি পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক সম্পত্তি ধ্বংস করে কনভেনশনের ২ নং ধারা লংঘন করা হয়েছে যেটা সাধারণ পরিষদ কর্তৃক স্বাক্ষরিত এবং যার অনুসমর্থন প্রস্তাব হয়েছিল ৯ ডিসেম্বর, ১৯৪৮ সালে [রেজোলিউশন ২৬০-এ- (iii)]। পাকিস্তান নিজেও এই কনভেনশন এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। একইভাবে সামরিক আইন ঘোষণা, কঠোর নিয়মকানুন পূর্ব বাংলায় কঠোরভাবে চালানো হচ্ছে। তাদের আইন মেনে না চললে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দেয়া হতে পারে। যে স্বাধীনতাকে জাতিসঙ্ঘে মৌলিক বিবেচনা করা হয়েছে সেটাও দমন করা হচ্ছে।
১২ আগস্ট, ১৯৪৯ জেনেভা কনভেনশনের আর্টিকেল ৩ এ সাধারণ জনগণের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। বিশেষভাবে নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির জীবন, অঙ্গহানি ও নির্যাতনের সহিংসতা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া বিশেষ অমানবিক ও অবমাননাকর আচরণ নিষিদ্ধ। পূর্ববর্তী রায় নিয়মিতভাবে গঠিত সাধারণ আদালত দ্বারা না হলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর অবৈধ হবে সেকথাও বলা আছে। সকল কনভেনশনের বিধান লঙ্ঘিত হয়েছে। আর আশ্চর্যের ব্যাপার, পাকিস্তান সরকার ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টস দ্বারা তৈরি আপীল কে সামান্যতম ভ্রুক্ষেপ করার চিন্তা-ভাবনাও দেখায়নি। আমি তাদের টেলিগ্রাম পড়ছি। ২ এপ্রিল ১৯৭১ –
“ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টস গভীরভাবে পূর্ব পাকিস্তানে বিয়োগান্তক ঘটনা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন। মৃত্যুর পরিমাণ কমাতে সর্বোচ্চ ব্যাবস্থা গ্রহণ করুন এবং রাজনৈতিক বন্দীদের সংযম ও শ্রদ্ধার সাথে মোকাবেলা করুন”।
এপ্রিল ১৫ তারিখের টেলিগ্রাম:
‘আমাদের ২ এপ্রিল-এর টেলিগ্রাম এর প্রেক্ষিতে, ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টস বিশেষ সামরিক ট্রাইবুনাল করে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচার করার চেষ্টায় উদ্বিগ্ন। আইন অনুযায়ী স্বাভাবিক বেসামরিক আদালতের কার্যধারা মোতাবেক আগালে তা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা বলে আন্তর্জাতির বিশ্ব কর্তৃক সন্তোষজনক হবে।
ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টস সবসময় রাজনৈতিক অপরাধের জন্য অভিযুক্ত রাজনৈতিক বিরোধীদের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইবুনাল প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেয়না। কারণ বিশেষ ট্রাইবুনাল যা আইনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিচারকদের দ্বারা যথাযথভাবে আদালত গঠন হয়না এবং এখানে আইনি প্রয়োগে স্বাধীনতা ও সম্মানের অভাব থাকে। শেখ মুজিবুর রহমান বা অন্য আওয়ামী লীগ নেতারা যদি পাকিস্তানের আইনের অধীনে কোনো অপরাধ করে থাকেন, সেখানে দরকার হলে তাদের বেসামরিক আদালতে আনা যেতে পারে।
এই পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমরা আন্তর্জাতিক মতামত ইতিমধ্যে দিয়েছি। এবং ইতোমধ্যে কমিটি এই ব্যাপারে শোকাহত। যেহেতু জাতিসঙ্ঘ অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাই তাদের এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাবস্থা গ্রহণ জরুরী। বড় মাপের গণহত্যা, নারী ও শিশু, নৃশংসতা, এবং ব্যাপক স্কেলে সংঘটিত অত্যাচার এবং সম্পত্তি ধ্বংস পূর্ববাংলার নিরস্ত্র বেসামরিক জনগণের উপর নেমে আসা হত্যাকাণ্ড প্রভৃতির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিবেক প্রজ্বালিত করা আবশ্যক ও বিশ্বের এই অংশে সভ্য সমাজ পুনঃস্থাপন করার জন্য আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা আবশ্যক।
II
কিন্তু সেখানে মানবাধিকারের আরও ঘটনা ঘটছে যা বর্তমান কমিটির নজরে আনা উচিত। পূর্ববাংলায় নেয়া সামরিক কর্মের ফলস্বরূপ, ভারতে শরণার্থীর সংখ্যা ইতিমধ্যে অতিক্রম করেছে ১.৮ মিলিয়ন। সুনির্দিষ্ট হিসাবে সীমান্তের কাছাকাছি ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ৩ মে দিল্লি থেকে উলি্ল্লখিত ছিল ১, ৪৮১, ১০১ জন। এই চিত্র যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। ৩ মে, ১৪১, ৫৮৮ জন উদ্বাস্তু আসাম ও মেঘালয় (ভারতীয় একটি পূর্ব রাজ্য) প্রবেশ করে; যখন ৩৯৩, ৮৩ জন ক্যাম্পের বাইরে, ১, ২০০, ৯৬২ জন শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেছে এই ১০২, ২০৫ জন ক্যাম্পে, এগুলোর ৫৩২, ৬৭৫ জন ক্যাম্পে, ৬৬৮, ২৮৭ জন ক্যাম্পের বাইরে হয়; ১৩৬, ৫৩২ জন উদ্বাস্তু ত্রিপুরা প্রবেশ করে; ৩৫, ০০০ জন বাইরে। এগুলোর ১০১, ৫৩২ জন ক্যাম্পে, ২, ০১৯ জন শরণার্থী বিহার প্রবেশ করেছে। এভাবে ক্যাম্পে শরণার্থী মোট সংখ্যা ৭৩৮, ৪৩১ জন এবং বাইরে ৭৪২, ৬৭০ জন। ৩ মে আমরা ১৫৬ টি ক্যাম্প স্থাপন করেছি এবং মহাসচিব ও যেমন ইউএনএইচসিআর, ইউনিসেফ, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে অন্যান্য ইউ এন সংস্থা জ্ঞ্যাত আছে। এ ছাড়াও, ক্যাথলিক রিলিফ অর্গানাইজেশন, কারিতাস ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।
আমি আনন্দের সাথে বলতে চাই যে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ভাবে শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য ব্যাবস্থা নেয়া হচ্ছে। উদ্বাস্তু অনেক নারী ও শিশুদের কঠিন চাপের মুখে এবং সবচেয়ে কঠিন অবস্থার মধ্যে তাদের বাড়িঘর ও গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। এই বৃহৎ অন্তঃপ্রবাহ দৈনিক বাড়তে থাকে যেমন আমি ইতিমধ্যে উল্লেখ করেছি। পূর্ববাংলায় পাকিস্তানের নৃশংসতার ফলে এত বিপুল সংখ্যক লোক তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে ভারতে চলে আসছে। সামান্য খাদ্য এবং ব্যক্তিগত জিনিসপত্র সঙ্গে কষ্টসহকারে নিয়ে বিপজ্জনক যাত্রায় তারা আসছে। পূর্ববঙ্গে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসা পর্যন্ত, মানবিক ভিত্তিতে, এই ক্ষুধার্ত মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার ও যারা রোগ এবং অনাহারে ভুগছে তাদের মানবিক কারণে আমরা সাহায্য করছি। পাকিস্তান সরকারের কর্তব্য তাদের নিপীড়ন বন্ধ করা এবং স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা যাতে উদ্বাস্তুরা নিরাপদে ফিরে যেতে পারে। যতক্ষণ পর্যন্ত পাকিস্তান পূর্ব বাংলায় নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা শরনার্থিদের আমরা সানন্দে সাহায্য করব। অন্যান্য সরকার এবং সেইসাথে আন্তর্জাতিক সংস্থা এগিয়ে আসতে হবে। এটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের উদ্বেগের বিষয় এবং আমরা আশা করি যে কাউন্সিল এই সমস্যা উপলব্ধি করবে এবং এই আপীল অনুমোদন করবে।
III
পূর্ববঙ্গে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক গৃহীত আরেকটি পদক্ষেপের ফল সেখানে অর্থনৈতিক জীবনের ভাঙ্গন শুরু করেছে। মার্চ থেকে শুরু করে সব বিদেশী সংবাদ প্রতিনিধিদের বহিষ্কার করা হয়েছে এবং নির্ধারিত ৫ বা ৬ জন কে প্রহরায় পূর্ববাংলার যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সেসব ভ্রমণের বিস্তারিত অনেক মাস বহিঃবিশ্ব জানতে পারবেনা। সহিংসতার প্রাদুর্ভাবে পরিবহন ও বন্টন ব্যবস্থা এবং অন্যান্য অপরিহার্য পরিষেবার সম্পূর্ণ ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। যেহেতু পূর্ববঙ্গ তার বৃহৎ জনসংখ্যার জন্য প্রচুত খাদ্যশস্য আমদানির উপর নির্ভর করে তার উপরে কয়েকমাস আগে একটি সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড় প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করে যায়। তার উপর যেহেতু সামরিক প্রভাব জারি হয়েছে তাই এবার আবাদ মৌসুমও প্রভাবিত হবে। এই অবস্থার অধীনে দুর্ভিক্ষ হবার সম্ভাবনা প্রকট এবং সাধারণত মহামারি ও রোগ আরও বৃদ্ধি পাবে। ফলে পূর্ববাংলা থেকে ভারতে পালিয়ে আসবে আরও উদ্বাস্তু। এভাবে লাখ লাখ শরণার্থী ভারতে ঢালাও প্রবেশের ফলে এই অঞ্চল একটি অস্থিতিশীলতার দিকে ধাবিত হতে পারে। তাই ভারতে পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তুদের অন্তঃপ্রবাহ বন্ধ করা জরুরী। এটি একটি আন্তর্জাতিক উদ্বেগের বিষয় হওয়া উচিত। এটি সম্ভব একমাত্র যদি এই কাউন্সিল নিশ্চিত করতে পারে যে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংগঠনগুলোকে সেদেশে ঢুকে অভাবগ্রস্ত বাঙ্গালীদের সাহায্য করার অনুমতি দেয়।
আন্তর্জাতিক ত্রাণ অপারেশন সঙ্ঘটিত হলে বর্তমান সৃষ্ট সঙ্কটের অপসারণ করতে সক্ষম হবে।
এটা হতাশাজনক যে এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান সরকার আন্তর্জাতিক রেড ক্রস দলের করাচিতে গিয়ে পূর্ববঙ্গে কার্যধারা চালানোর অনুমতি পায়নি। এপ্রিল ১ তারিখে ইউ বলেন যে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক মানুষের দুর্ভোগ ও ক্ষতি সম্পর্কে উদ্বিগ্ন এবং বলেন যদি পাকিস্তান সরকারের সেক্রেটারি জেনারেল এর কাছে মানবিক প্রচেষ্টার সাহায্য চান তবে তার ক্ষমতার সবকিছুই খুশি মনে করবেন। উত্তরে পাকিস্তানীরা ছোট্ট করে শুধু বলেছেন – এখনো নয়। এই প্রসঙ্গে আমরা আজ সকালে নিউ ইয়র্ক টাইমস সম্পাদকীয়র মন্তব্যটি উল্লেখ করতে চাই। বিশ্বের অন্যান্য অনেক সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা গুলো পূর্ব পাকিস্তানের শোচনীয় পরিস্থিতি অনুধাবন করে সাহায্য করার জন্য উৎসুক আছে কিন্তু পাকিস্তান সরকার বরাবরের মত বলেছে তাদের দেশে যথেষ্ট খাদ্য মজুদ আছে। মাত্র কয়েক মাস আগে, একটি ভয়াবহ সাইক্লোন পূর্ব বাংলার কিছু অংশ বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। সে সময়ে, অনেক কমিটি ও জাতিসংঘের অন্যান্য ফোরামে রেজুলেশন পাশ হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগের রিলিফ এর জন্য ও অনেক পদক্ষেপ গৃহীত হয়। পাকিস্তান নিজেও সাহায্যের জন্য ব্যাপকভাবে আপীল করে বিশাবাসীর কাছে। আমার দেশ ও তাতে সাড়া দেয়। কিন্তু অবাক করে দিয়ে এখন তারা বলছে পাকিস্তানে যথেষ্ট খাবার আছে।
এই অবস্থায় প্রথম অপরিহার্য পদক্ষেপ হল পাকিস্তানকে জিজ্ঞাসা করতে হবে যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদকে অবিলম্বে ত্রাণ কাজের সম্মতি দিবে কিনা যাতে জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় সুশৃঙ্খলভাবে ও সমন্বিত সাহায্য কর্মসূচি জন্য পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা যেতে পারে। যেহেতু সেক্রেটারি জেনারেল, ইতিমধ্যে সব মানবিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন তাই এটা এখন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল আচরণ হবে আন্তর্জাতিক ত্রাণ প্রচেষ্টার ব্যাপারে।
আমরা আশা করি এবং বিশ্বাস করি যে পূর্ব বাংলার জনগণের মৌলিক চাহিদা ও সেবা মেটানোর জন্য যথাযথ ব্যাবস্থা নেয়া হবে এবং তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে সহায়তা করা হবে। তারা যথেষ্ট ভুগেছে। এবং তারা অবশ্যই মনে রাখবে কে তাদের মনে রেখেছে আর কে ছিল নীরব দর্শকের ভূমিকায়।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১২। বাংলাদেশের আন্দোলনকে সমর্থনের জন্য বিশ্বশান্তি কংগ্রেসের প্রতিনিধিদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আহবান | দৈনিক আনন্দবাজার | ৫ মে ১৯৭১ |
<১২, ১২, ১৯>
পুর্ববঙ্গের স্বাধীনতা আন্দোলন সমর্থন করুনঃ
বিশ্বশান্তি কংগ্রেসে ইন্দিরাজীর বার্তা
বুদাপেস্ট, ১৩ মে – আজ এখানে বিশ্বশান্তি কংগ্রেসের দিনব্যাপী অধিবেশন শুরু হয়েছে। অধিবেশনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থন জানানোর জন্য ভারতের বক্তব্য অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিরা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও একজন প্রতিনিধি সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন।
৮০ টি দেশের প্রায় ৭০০ প্রতিনিধির সামনে প্রকাশ্য অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর বার্তাটি পড়ে শোনানো হয়। তাতে শ্রীমতী গান্ধী বলেছেন, ভারতের অবস্থায় পূর্ববঙ্গের ঘটনাবলিতে উদাসীন থাকা কঠিন।
প্রধানমন্ত্রী ঐ বার্তায় বলেছেন, প্রায় ২০ লক্ষ উদ্বাস্তু ভারতে চলে এসেছেন – ফলে আমাদের উপর প্রচণ্ড চাপ পড়েছে। এই উদ্বাস্তুরা যাতে নিরাপদে মর্যাদার সঙ্গে দেশে ফিরে যেতে পারেন – তেমন অবস্থা সৃষ্টি করার জন্য পাকিস্তানকে অবশ্যই বাধ্য করতে হবে।
শ্রীমতী গান্ধী বলেছেন, আশা করি, বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানব সমাজ মানবিক অধিকার রক্ষার জন্য উঠে দাঁড়াবেন। পুর্ববঙ্গের জনসাধারণের ন্যায্য দাবী, তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই তাদের দেশ শাসন করবেন। বিশ্বের মানুষ আশা করি, এই দাবী সমর্থন করবেন, এবং তাদের ঐ অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য সচেষ্ট হবেন। এই গুরুত্বের পরিস্থিতি এবং লক্ষ লক্ষ নির্দোষ মানুষের অবর্ননীয় দুর্দশায় আমার মন ভারাক্রান্ত।
ভারতীয় প্রতিনিধি দলের সদস্য শ্রী অমৃত নাহাত বার্তাটি পড়ে শোনান। তাঁকে প্রবল হর্ষধনী জানিয়ে সদস্যরা অভিনন্দন জানান।
ভারতীয় প্রতিনিধি দলের নেতা শ্রীকৃষ্ণ মেনন বলেন, পূর্ববঙ্গে গৃহযুদ্ধ নয় – গুলি চালিয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমন হচ্ছে। তিনি হিটলারি অত্যাচারের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের ঘটনার তুলনা করেন।
শ্রী মেনন আরও বলেন, পূর্ববঙ্গ বিশ্বের অষ্ট জাতীয় এলাকা এবং হাঙ্গেরির চেয়ে তাঁর জনসংখ্যা ১০ গুণেরও বেশী।
– পি টি আই
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৩। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সফল হবে – প্রধানমন্ত্রীর আশা প্রকাশ | দৈনিক স্টেটসম্যান | ১৬ মে ১৯৭১ |
<১২, ১৩, ২০>
বাংলাদেশর সংগ্রাম বৃথা যাবে না – প্রধানমন্ত্রী
আগরতলা, ১৫ মে: প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী, আজ আশা প্রকাশ করেন যে বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রাম বৃথা যাবেনা। তারা শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা এবং তার থেকে গণতান্ত্রিক সরকার অর্জন করবেন।
মিসেস গান্ধী, এখান থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে মোহনপুরে একটি বিশাল সমাবেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ভারত পূর্ববাংলায় একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠিত হলে তাকে স্বাগত জানাবে এবং তার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখবে।
ভারতের মত পূর্ব বাংলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেখানে মানুষ তাদের নিজস্ব সরকার গঠন করতে পারেনাই যা তাদের দেশ থেকে দারিদ্র্য দূর করতে সাহায্য করবে।
সম্পদের সীমাবদ্ধতা
প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন, ভারত এবং পূর্ব বাংলার মানুষ গণতান্ত্রিক পথ অনুসরণ করবে এবং তারা নিজেরাই তাদের নিজ নিজ জাতির স্বার্থে সাম্প্রদায়িকতার বিষকে আশ্রয় দেবেনা।
মিসেস গান্ধী বলেন; ‘ আমাদের ভাই ও বোন যারা ভারতে এসেছে তাদের সাহায্য করতে আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু আমাদের সম্পদ সীমিত “।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটি শুধু পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার ছিল, কিন্তু এখন এটি ভারতের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শরনার্থিদের সাহায্য করার অবর্ননীয় সমস্যা উল্লেখ করে তিনি বলেন, শরণার্থীদের প্রবল অনুপ্রেবেশ দেশের অর্থনীতির উপর একটি ভয়ানক বোঝা হবে। কিন্তু এটি ভারতের কোন নির্দিষ্ট রাজ্যের উদ্বেগ না – এটি পুরো দেশের জন্যই চিন্তার বিষয়। তাই কেন্দ্র সরকার এই দায়িত্ব বহন করবে।
তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, এই মানুষগুলো তাড়াতাড়ি তাদের দেশের শান্তি পুনরুদ্ধার করতে পারবে এবং তাদের নিজস্ব সরকার গঠন করে তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে সক্ষম হবে।
ত্রিপুরায় মিসেস গান্ধী নরসিংগড়, মোহনবাড়ি এবং সিমনাতে শরনার্থি ক্যাম্পের ব্যক্তিদের খাদ্য ও জীবনযাপনের সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেন।
এর আগে আসামের শিলচর-এর কাছাকাছি উধারবন্দের একটি শরণার্থী শিবিরে মিসেস গান্ধী বলেন, বাংলাদেশের এবং ভারতের জনগণ এই দুর্ভোগ লাঘবের জন্য একত্রে যথাসাধ্য সবকিছু করবে।
মিসেস গান্ধী শরনার্থিদের দুঃখের কাহিনী মনোযোগ দিয়ে শোনেন।
উধারবন্দ শরণার্থী শিবিরে প্রায় ২৫০০০ শরনার্থি আছে।
মিসেস গান্ধী দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, পাকিস্তান ভারতে সাম্প্রদায়িক উগ্রতা উসকে দেয়ার প্রয়াস নিচ্ছে। এজন্য মানুষকে সতর্ক থাকতে অনুরোধ করেন।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৪। ‘যথাসময়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হবে’ প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক শরনার্থি সমস্যার উপর গুরুত্ব আরোপ | দৈনিক স্টেটসম্যান | ১৭ মে ১৯৭১ |
<১২, ১৪, ২১–২৪>
ভুল সময়ে কোন স্বীকৃতি নয়:
প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক শরনার্থি সমস্যার উপর গুরুত্ব আরোপ
(আমাদের বিশেষ প্রতিনিধির মাধ্যমে)
প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী, রোববার দমদম বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত মতবিনিময় সভায় স্পষ্টভাবে বলেন যে, বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার মত বহুল আলোচিত বিষয়টি এই মুহুর্তে কেন্দ্রীয় সরকার সবচেয়ে জরুরি বিষয় হিসাবে দেখছে না।
তিনি বলেন, প্রধান বিবেচনার ব্যাপার হল কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক উক্ত স্বীকৃতি বাংলাদেশের মানুষকে এই মুহূর্তে কোন সাহায্য করবে কিনা। “আমি মনে করি এটা তাদের কোন সাহায্য করবে না এবং ভুল সময়ে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত নয়, ” বলেন তিনি।
যখন একজন রিপোর্টার জিজ্ঞাসা করল আপনি কি অন্য কোন দেশের স্বীকৃতির জন্য অপেক্ষা করছেন কিনা তক্ষণ তিনি দৃশ্যত বিরক্ত হয়ে পরলেন। তিনি বলেন, এ ধরনের প্রশ্ন আগে বেশ কয়েকবার করা হয়েছে। তিনি সব সময়ই বলেছেন যে ভারতের একটি স্বাধীন নীতি আছে এবং বিভিন্ন ইস্যুতে সে তার অবস্থান প্রণয়নে অন্যদের উপর নির্ভর করে না।
“আমরা স্বাধীন দেশ নিজেদের স্বাধীন নীতি দিয়ে চলি। খুব শক্তিশালী চোখ দিয়ে স্বাধীন সূর্যের নিচে নানা বিষয় নিয়েই আমরা বাস করি এবং অন্যরা কে কি বলল বা করল তার উপর আমরা নির্ভরশিল না। ”
দুই শরণার্থী শিবির এবং বনগাঁর একটি হাসপাতালে সফর করার পর একটি বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টারে করে বিমানবন্দরে পৌঁছলে প্রধানমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রী এবং পশ্চিমবঙ্গের উপ-মুখ্যমন্ত্রী, জনাব অজয় মুখার্জির সঙ্গে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। শ্রীযুক্ত বিজয়গুপ্তের সিং নাহার, শ্রীযুক্ত সিদ্ধার্থ শংকর রায়, ইউনিয়ন শিক্ষা মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন। বৈঠকটি আধা ঘন্টা স্থায়ী হয়।
মিসেস গান্ধী আসাম থেকে হলদিবাড়ি ভ্রমন করে সকালে দমদম বিমানবন্দরে পৌঁছান ২টা ১৫ মিনিটে। তাঁর সাথে জনাব রায় ও মিস পদমজা নাইডু, যিনি বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির প্রধান – এরা উপস্থিত ছিলেন। দমদম থেকে প্রধানমন্ত্রী ও তার দল হেলিকপ্টারযোগে বনগাঁও যান। আরেকটি হেলিকপ্টার পশ্চিমবঙ্গ মন্ত্রীদের নিয়ে যায়। তারা একটু পরে সাড়ে পাঁচটায় দমদম আসেন।
প্রধানমন্ত্রী একটি নীল শাড়ি এবং একটি ফুলস্লিভ ব্লাউজ পড়া ছিলেন এবং তাকে ক্লান্ত লাগছিল। নতুন এয়ারপোর্ট এর লাউঞ্জে প্রথম তলায় এসে তিনি তার পরিচারকের কাছে নিচের তলায় দ্রুত একটি কনফারেন্স কল করেন – সাথে ছিলেন জনাব অজয় মুখোপাধ্যায় ও জনাব নাহার।
প্রেস সাংবাদিকদের দোতলায় লাউঞ্জে অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে। কিছু সময় পর, মিস পদমজা নাইডু কনফারেন্সে আসেন ও ত্রাণ সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন।
জনাব অজয় মুখোপাধ্যায় ও জনাব নাহার এর সঙ্গে বৈঠক চলাকালে জনাব সিদ্ধার্থ রায় এর পশ্চিমবঙ্গ সংক্রান্ত বর্তমান সমস্যা ও আলোচনায় আসে। পরে যোগাযোগ করা হলে জনাব নাহার বলেন, কিছু গুরুতর সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে কিন্তু তিনি সেগুলো এখনই প্রকাশ করতে চাচ্ছেন না।
বিশাল সমস্যা
শরণার্থী সমস্যা প্রসঙ্গে তিনি সাংবাদিকদের বলেন: “এটি একটি বিশাল সমস্যা এবং এটা নিয়ে কঠিন মোকাবেলা করতে হবে। আমাদের দ্রব্যমূল্য অপর্যাপ্ত এবং পরিস্থিতি মেটানোতেও ঘাটতি আছে; তবে সরকার ভালভাবে কাজ করছে। “
তিনি বলেন যে সেখানে অনেকে আছেন যারা এখনো আশ্রয় পান নাই – যাদের ব্যাপারে তিনি সজাগ আছেন। তিনি বলেন জিনিসপত্র পৌঁছাতে একটু সময় লাগবে। যখন জিজ্ঞাসা করা হল কোনো সাহায্য বিদেশ থেকে আশা করছেন কিনা; তিনি জানান যে কেউ এটা আশা করতে পারে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তেমন কিছুই অন্যান্য দেশ থেকে আসেনি। তিনি আরো বলেন, তিনি মনে করছেন যে, বাইরে থেকে যদি সহায়তা আসে তবে, কি এসেছে ও কার কাছ থেকে এসছে সেটা ভারত জানাবে।
প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শরনার্থীদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছেড়ে যেতেই হবে, কিন্তু “কিভাবে শীঘ্রই সেটা সম্ভব হবে, আমি জানি না। ” তিনি মনে করেন যে, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো একটি অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে তাদের ফিরে যাওয়ার জন্য।
পাকিস্তান সরকার দাবি করে বাংলাদেশের উদ্বিগ্ন অবস্থা কেটে স্বাভাবিক হয়েছে – এই কথার উপর মন্তব্য করতে গিয়ে মিসেস গান্ধী বলেন, জনগণকে অন্য কোথাও সরিয়ে দিয়ে খুব সহজেই উদ্বিগ্ন অবস্থা স্বাভাবিক করা যেতে পারে তবে আমার মতে এটি কোন স্বাভাবিক পন্থা নয়।
কেন্দ্রীয় সরকার সীমান্ত এলাকা থেকে শরনার্থীদের হস্তান্তর করার জন্য প্রস্তাব বিবেচনা করছে। ত্রিপুরার মত ছোট্ট একটি রাজ্যে এই অবস্থা একটি বড় সমস্যার সৃষ্টি করছে। তিনি বলেন, দেশের অন্যান্য অংশে এদের আশ্রয় দেবার ব্যবস্থা বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে তিনি নিশ্চিত না সেটা সম্ভব হবে কিনা।
বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সহায়তার জন্য অনেক রাজনৈতিক দলগুলোর যে প্রস্তাব সে ব্যাপারে মন্তব্য করতে বলা হলে, মিসেস গান্ধী বলেন, “এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য বা প্রতিক্রিয়া নেই”।
ঢাকা থেকে ভারতের কূটনীতিকদের ফিরিয়ে দেবার ব্যাপারে পরামর্শ চাইলে তিনি বলেন যে বিষয়টি একদম থমকে আছে; কারণ পাকিস্তান সরকার কোনো প্রস্তাব গ্রাহ্য করছেন না।
মিসেস গান্ধী বলেন সংবাদপত্রগুলোকে সংবাদ ও মতামত প্রকাশে খুব সতর্ক হতে হবে। এটা মনে রাখতে হবে যে শত্রুদের এজেন্টরা খুব সজাগ। খেয়াল রাখতে হবে শরনার্থী ইস্যুটি যেন একটি জাতীয় সমস্যা হিসাবে প্রকাশিত হয় – কোন সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে নয়।
তিনি বলেন, ভারত সীমান্ত বরাবর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ফায়ারিং করছে। এই ক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। “সবসময় ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব নাও হতে পারে’- প্রধানমন্ত্রী বলেন।
বনগাঁ
আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক বলেন – এর আগে আজ বিকেলে বনগাঁতে বাংলাদেশের শরণার্থীদের উদ্যেশ্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটি একটি দু:খের বিষয় যে পূর্ববঙ্গে স্বাধীনতাযুদ্ধকে এখন একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলে রং দেবার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ধরনের প্রচেষ্টা শুধুমাত্র সে দেশের দুর্বলতার কারণ হবে।
বিকেলে মিসেস গান্ধী পেট্রাপোল ও ইটখোলাতে দুটি শরণার্থী ত্রাণকেন্দ্র পরিদর্শন করেন। তিনি বনগাঁর মহকুমা হাসপাতাল পরিদর্শন করেন এবং যারা পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গুলিতে আহত হয়েছে তাদের সঙ্গে কথা বলেন।
তিনি উদ্বাস্তুদের বলেন যে ‘পূর্ববঙ্গের মুক্তিযুদ্ধ সকল দমন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। মনে রাখবেন, আপনাদের যুদ্ধ আমাদের যুদ্ধ। ’’
অবিচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সময় বাংলাদেশের জনগণ ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। “আমরা জানি যে আমাদের সব সাহায্য সত্ত্বেও, আপনারা এখানে সমস্যার মুখোমুখি হতে পারেন কারণ আমরা ধনী দেশ না। ’’
মিসেস গান্ধী আশা করেন যে শরণার্থীদের দীর্ঘদিন ভুগতে হবে না এবং তারা খুব শীঘ্রই দেশে ফিরতে সক্ষম হবেন। তিনি বলেন, ভারত একটি গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব নেই। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, পূর্ব বাংলার জনগণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য এবং যৌথভাবে মুক্তির জন্য যুদ্ধে লড়াই করবে।
পেট্রাপোল ক্যাম্পে যেখানে চার হাজারের অধিক শরণার্থী বসবাস করছে সেখানে মিসেস গান্ধী একটি ছোট মেয়েকে খাবার খেতে দিচ্ছিলেন। মেয়েটি বলে, সে তার অনেক আত্মীয় হারিয়েছে। ১০ বছর বয়সী একটি ছেলে তার কাঁধে তার ছোট বোনকে বহন করে নিয়ে আসার বর্ননা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। তিনি একজন নারীর সাথেও কথা বলেন যার স্বামী পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে নিহত হয়েছে।
ভরত সেবাশ্রম এর একজন মুখপাত্র বলেন পেট্রাপোল ক্যাম্পের জনসংখ্যার প্রায় ৪০% মুসলমান। আট বছরের নীচের ছেলেমেয়ের সংখ্যা ২২০০।
কলকাতা বিমান বন্দরে অবতরণের পর অবিলম্বে বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবিতে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংগঠন এবং গণতান্ত্রিক যুব সংস্থার সমর্থকরা একটি বিক্ষোভের আয়োজন করে। বিক্ষোভকারীরা বাংলাদেশের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের মনোভাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে।
জনাব জে.সি. দে, ইন্ডিয়ান রেড ক্রস সোসাইটির পশ্চিমবঙ্গ শাখার সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী, এবং ইন্ডিয়ান রেড ক্রস সোসাইটির চেয়ারম্যান মিস পদমজা নাইডুকে পেট্রাপোল রাজ্য ইউনিটে তাদের কার্যকলাপ ব্যাখ্যা করে।
হলদিবাড়ি
হলদিবাড়িতে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক বলেন – ভারতীয় সীমানার মধ্যে পাকিস্তানের বারবার অনুপ্রবেশের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন সীমান্তের কাছে বসবাসকারী মানুষেরা “কিছু ঝুঁকির সম্মুখীন হবে”। তিনি বলেন, সীমান্তের নিকতবর্তী এলাকায় যারা শেখ মুজিবকে গত নির্বাচনে ভোট দিয়েছে তাদের ভারতে বহিষ্কার করে পূর্ববাংলার জনসংখ্যা হ্রাস করাই এর উদ্দ্যেশ্য।
এস ইউ সি এর স্থানীয় ইউনিট এবং ফরওয়ার্ড ব্লক ও আরও একটি প্রতিষ্ঠান মিসেস গান্ধীর কাছে বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতির দাবিতে স্মারকলিপি পেশ করে।
এস ইউ সি সমর্থকরাও হেলিপ্যাডে এবং গণপূর্ত বিভাগের বাংলো যেখানে তিনি দলের প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন তার সামনে বিক্ষোভ করে।
ইউ এন আই যোগ করে – মিসেস গান্ধী পশ্চিমবঙ্গের দুই মন্ত্রীকে নয়া দিল্লিতে ত্রাণ ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেণ। তিনি রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী, জনাব জয়নাল আবেদিন ও গণপূর্ত মন্ত্রী, জনাব সন্তোষ রায় কে ধন্যবাদ জানান। তারা বৃহস্পতিবার নয়া দিল্লির উদ্যেশ্যে রওনা হবেন বলে আশা করা যায়।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৫। যে কোন পরিস্থিতির জন্য ভারত প্রস্তুত – পাকিস্তানের প্রতি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সতর্কবানী | দৈনিক স্টেটসম্যান | ১৯ মে ১৯৭১ |
<১২, ১৫, ২৫>
ভারত কোনো পরিণামের জন্য প্রস্তুত
পাকিস্তানকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সতর্কবানী
বড় শক্তিগুলো শরনার্থী সমস্যা নিয়ে কথা বলেছে
রানিখেত, ১৮ মে, প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী, আজ পাকিস্তানকে সতর্ক করেন যে ভারত তার উপর হুমকির বিষয়ে অনড়। “যদি আমাদের উপর কোন বিশেষ চাপ দেয়া হয়, তাহলে আমরা প্রয়োজনে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত” – UNI রিপোর্ট।
প্রধানমন্ত্রী জনসভায় বক্তৃতাকালে ‘পূর্ববাংলায় সবকিছু স্বাভাবিক আছে’ – পাকিস্তানের এই দাবীকে চ্যালেঞ্জ করে বলেন যদি এটা সত্যি হয় তবে অতি সত্বর পাকিস্তানের উচিৎ শরনার্থিদের ফিরিয়ে নেয়া।
ভারতীয় সীমান্তে উদ্বাস্তুরা ভারত-এর জন্য একটি বড় সমস্যা তৈরি করেছে। এটি গুরুতরভাবে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন প্রভাবিত করবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
মিসেস গান্ধী গণতান্ত্রিক জাতির কাছে পাকিস্তানকে পূর্ববাংলায় তার সামরিক নৃশংসতা থামাতে বলতে অনুরোধ করেন। তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বুঝাতে চেষ্টা করেন যে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা ধীরে ধীরে ভারত-এর জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে উঠছে। তবে তিনি বলেছেন “শরনার্থীদের বোঝা আমাদের উপর অনেক বড় চাপ ফেলছে, কিন্তু কিভাবে আমরা অসহায় শরণার্থীদের উপেক্ষা করতে পারি? “
সেখানে কার্যত উদ্বাস্তুদের থাকার কোন ব্যাবস্থাই ছিলনা। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয় সীমান্ত এলাকায় সকল হাসপাতাল, স্কুল এবং অন্যান্য সরকারী ভবন উদ্বাস্তুদের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়। যাইহোক, ভারতীয়রা উদ্বাস্তুদের সাহায্যরে জন্য সর্বোত্তম চেষ্টা করবে। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ধনী দেশগুলোর কাছ থেকে সাহায্য আসছিলনা।
পিটিআই: ভারত পশ্চিমাদের জানায় যে পূর্ববঙ্গে সৃষ্ট পরিস্থিতি ভারতের জন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিকর ছিল। সীমান্তের ভারতীয় অংশে জমা হওয়া শরনার্থিরা সেখানে বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
তিনি তাদের বলেছিলেন যে, পাকিস্তান ভারতের জন্য একটি কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করেছে। কোন দেশই এই রকম আচরণ করার অধিকার রাখেনা। যদি অতি সত্বর এই পরিস্থিতির উন্নতি না হয় তাহলে ভারত সুনির্দিষ্ট ব্যাবস্থা গ্রহণ করবে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৬। শরনার্থিদের প্রত্যাবর্তনের জন্য বিশ্বকে নিশ্চয়তা দিতে হবে – প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মন্তব্য | দৈনিক হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড | ২১ মে ১৯৭১ |
<১২, ১৬, ২৬–২৭>
সব শরণার্থীদের ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করতে হবে: রাম
(স্টাফ রিপোর্টার)
আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলাদেশ শরণার্থী শিবিরগুলোতে সফর শেষে কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, জনাব জগজীবন রাম, রোববার বিকেলে বনগাঁর কাছে পেট্রাপোল এ সাংবাদিকদের বলেন বিশ্ববাসীকে “নজিরবিহীনভাবে’’ বাংলাদেশ থেকে ভারতে শরনার্থি প্রবেশের ব্যাপারে কি ব্যাবস্থা নেয়া যায় সেটা বের করে এই সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে।
তিনি বাংলাদেশের জনগণের প্রতি পাকিস্তান সরকারের কাজকে “বর্বরোচিত” হিসাবে মন্তব্য করে বলেন এটি “সমগ্র মানব ইতিহাসে একটি বড় কলঙ্কজনক ঘটনা”।
মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে পূর্ববাংলায় অমানবিক কর্মকান্ড থামানোর জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি অনুরোধ করার ব্যাপারে বিশ্ববাসীর শরণাপন্ন হয়েছি।
এরপরও তিনি আরো বলেন, যদি পাকিস্তান “তার বর্বর নীতি চালিয়ে যায় যার দরুন লক্ষ লক্ষ নারী, পুরুষ ও শিশুরা নিরাপত্তার জন্য ভারতের ঢুকতে থাকে তাহলে বিশ্ববাসীকে এই সমস্যার সমাধান করতে অন্যান্য পদক্ষেপ নিতে হবে।
দিল্লি যাওয়ার আগে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী দমদম বিমানবন্দরে বলেন সরকার শরনার্থিদের ঠেকানোর জন্য সকল ব্যাবস্থা নিয়েছে। তিনি একজন সাংবাদিকএর সাথে একমত প্রকাশ করে বলেন যে অনুপ্রবেশকারী দের জন্য এই দেশে একটি সামাজিক সমস্যা তৈরি হবে এবং একটি অর্থনৈতিক বোঝা সৃষ্টি হবে।
উদ্বাস্তু দের অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে, জনাব রাম বলেন, তিনি এর আগে কেন্দ্রীয় পুনর্বাসন মন্ত্রী, জনাব খাদিখার এবং মুখ্যমন্ত্রী জনাব অজয় মুখার্জির সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। কিন্তু “খুব শীঘ্রই” ফলাফল নাও পাওয়া যেতে পারে।
হাজার হাজার শরনার্থিদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বলেন, ভারত পাকিস্তানকে বার বার বলেছে সেখানে সহনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য যাতে তাদের জনগণ ফেরত যেতে পারে।
জনাব রাম বলেন, “আমি আমার নিজের চোখ দিয়ে আপনাদের দুঃখজনক অবস্থা দেখতে এসেছি এবং এই কষ্ট প্রশমিত করার জন্য নতুন করে ভালো কিছু করা যায় কিনা দেখছি। ” প্রায় ৩ টার দিকে জনাব রাম হেলিকপ্টার করে দমদম বিমানবন্দর আসেন। তার ১৫ মিনিট পর একটি আই এ এফ থেকে দিল্লীর উদ্যেশ্যে রওনা করেন।
দুপুরে রাজভবন, কলকাতা, এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, বলেন বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ শরনার্থিদের প্রবেশ “আমাদের উপর একটি বড় বোঝা”। তিনি বলেন, তাদের সংখ্যা আমাদের আয়োজনের চেয়ে অনেক বেশী। অনেকে খোলা আকাশের নিচে বাস করছেন।
পাকিস্তানি সেনারা রোববার জনাব জগজিবন রাম, পেট্রাপোল এ আগমনের পূর্বে ভারতের ভিতরে শেলিং করে।
আজ সকালে একটি ৮১ মিঃ মিঃ মর্টার শেল ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী ঘাঁটির পাসে পরে। সেখানে কেউ হতাহত হয়নি। শেলটি যশোর রোডের ডান দিকে পরে। বিএসএফ সেখানে তাদের অবস্থান নেয়। কিন্তু গুলি করেনি।
বৃহস্পতিবার তিন জন বিএসএফ সদস্য পাকিস্তানি গোলাবর্ষণের কারণে আহত হয়। তারা হাসপাতালে রয়েছেন।
শনিবার রাতে পাকিস্তানি সেনারা সাদিপুর গ্রামে ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি আগুন ধরিয়ে দেয়। কিছু বাসিন্দা যারা সেখান থেকে ভারতে পালিয়ে যায়নি তাদের হত্যা করা হয়।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৭। বাংলাদেশের জনগণকে ভারত সাহায্য দিয়ে যাবে – প্রধানমন্ত্রীর ঘোষনা | দৈনিক কালান্তর | ২৩ মে ১৯৭১ |
<১২, ১৭, ২৮>
বাংলাদেশের জনগণকে ভারত সাহায্য দিয়ে যাবে
– ইন্দিরা গান্ধী
নয়াদিল্লী, ২২ মে (ইউ এন আই) – বাংলাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক শরনার্থী আমাদের আভ্যন্তরীণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ ইতিমধ্যেই ভারতের সীমান্ত রাজ্যগুলিতে প্রায় ৩০ লক ২০ হাজার শরনার্থি এসেছেন। এই সমস্যা সংকটজনক হয়ে উঠতে পারে। শরনার্থী সমস্যাকে সমস্ত দেশগুলিরই নিজেদের সমস্যা হিসেবে গণ্য কড়া উচিৎ বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ইন্দিরা কংগ্রেস সংসদীয় দলের সাধারণ সভায় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ দিচ্ছিলেন।
শ্রীমতী গান্ধী আরও বলেন, যা ছিল পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যা তা আজ আমাদের আভ্যন্তরীণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ ইতিমধ্যেই ভারতের সীমান্ত রাজ্যগুলিতে প্রায় ৩০ লক্ষ ২০ হাজার শরনার্থী এসেছেন। এই সমস্যা সংকটজনক হয়ে উঠতে পারে। শরনার্থী সমস্যাকে সমস্ত দেশগুলিরই নিজেদের সমস্যা হিসেবে গণ্য কড়া উচিৎ বলে তিনি উল্লেখ করেন।
শ্রীমতী গান্ধী বলেন যে সমস্ত রাজ্য শরনার্থিদের আশ্রয় দিয়েছে তাদের একার পক্ষে এই ভার গ্রহণ কড়া সম্ভব নয়। দেশের মানুষ, ও বিশ্ব রাজনৈতিক, অর্থণৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে।
তিনি বলেন, শরনার্থিরা যাতে তাদের ঘরে পুনরায় ফিরে যেতে পারেন পাকিস্তানকে সেই অবস্থা সৃষ্টির জন্য পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রের নজর দেয়া উচিৎ।
শরনার্থী শিবিরগুলি পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা বর্ননা করে তিনি বলেন যে, পূর্ব বাংলায় মানবিক অধিকারকে অবদমন করা হচ্ছে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৮। পাকিস্তানের ওপর প্রভাব খাটানর আহবান জানিয়ে প্রেসিডেন্ট সাদাটের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর চিঠি | দৈনিক ‘হিন্দুস্তান স্টান্ডার্ড’ | ২৪ মে ১৯৭১ |
<১২, ১৮, ২৯>
ইয়াহিয়াকে ফেরাতে সাদাতের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান
কায়রো, ২৩ মে -ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইউ ও এ আর (UOAR) এর সভাপতি জনাব সাদাতকে একটি ব্যাক্তিগত ম্যাসেজ পাঠিয়েছেন যা প্রাথমিকভাবে পূর্ববাংলা ও ভারতীয় উপমহাদেশের অবস্থার একটি প্রতিবিম্ব তুলে ধরেছে। পিটিআই।
মিসেস গান্ধীর বার্তা বিষয়বস্তু জানা যায়নি কিন্তু এটা ধারনা করা হয় যে, প্রধানমন্ত্রী জনাব সাদাতের কাছে আপীল করেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান কে পূর্ববাংলায় রক্তপাত বন্ধ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বলার ব্যাপারে।
ধারণা করা হয় যে মিসেস গান্ধী গত সপ্তাহে পশ্চিম এশিয়ায় সমস্যার একটি শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তির জন্য মিশরের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে দিয়ে বাহিত জনাব সাদাতের প্রতি ভারতের সমর্থন নবায়ন ও প্রসারিত করার সুযোগে এই প্রস্তাব দিতে পারেন।
মিসেস গান্ধীর চিঠি UAR এর ডেপুটি প্রিমিয়ার ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী, জনাব রিয়াদ, ভারতীয় রাষ্ট্রদূত জনাব আমি জে বাহাদুর সিং, গতকাল বিকালে হস্তান্তর করেন।
রাষ্ট্রদূত ৪০ মিনিটের বৈঠকে পূর্ববাংলার বিশেষ করে সেখান থেকে ভারতে উদ্বাস্তুদের প্রবেশ ও তার গুরুতর প্রভাব সম্পর্কে বলেন।
জনাব রিয়াদ পূর্ববাংলার অবস্থার ব্যাপারে UAR এর মনোভাব কি ছিল তা প্রকাশ করেন নি। তবে বোঝা যাচ্ছে যে ভারতের কথা বিশেষ বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৯। বাংলাদেশ পরিস্থিতির মোকাবিলা করা হবেঃ কোলকাতায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হুশিয়ারি | দৈনিক কালান্তর | ৬ জুন ১৯৭১ |
<১২, ১৯, ৩০–৩১>
বাংলাদেশের ঘটনার গুরুতর পরিণতি হটে পারেঃ
প্রধানমন্ত্রীর হুশিয়ারি– যথাসময়ে ব্যাবস্থা নেওয়া হবে
(স্টাফ রীপোর্টার)
কোলকাতা, ৫ জুন – প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী আজ এখানে বলেন, পূর্ব বাংলা থেকে লক্ষ লক্ষ শরনার্থী আগমনের ফলে অতি গুরুতর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। এবং এর পরিণতি দেশের পক্ষে গুরুতর হতে পারে। কিন্তু আমরা যেন তাতে শঙ্কিত না হই। আমাদের সুস্থিরভাবে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে যাতে ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের শরনার্থিরা যাতে স্বদেশে ফিরে যেতে পারেন, তাঁর জন্য প্রয়োজনীয় অবস্থার সৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন।
আজ রাজভবনে মুখ্যমন্ত্রী ও উপ-মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলাদাভাবে এবং তাঁর পড়ে সামরিক অফিসার সহ বিভিন্ন অফিসার ও রাজ্যের মন্ত্রীসভার সঙ্গে বাংলাদেশের শরনার্থি সমস্যা নিয়ে আলোচনার পর সাংবাদিকদের কাছে তিনি উপরোক্ত মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের ব্যাপারে ‘সমস্যার বিরাটত্ব অনুযায়ী আন্তর্জাতিক সমর্থন মেলেনি। ’
তিনি জানান, পশ্চিমবঙ্গের শরনার্থি সমস্যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের শরনার্থিদের রাজ্যের বাইরে কেন্দ্রীয় সরকারের যে জমি আছে, সেই সব জমিতে শিবির করে নিয়ে যাবার অবস্থা হচ্ছে কিন্তু সমস্ত ব্যাবস্থাই হচ্ছে অস্থায়ী ভিত্তিতে কারণ শরনার্থিদের দেশে ফিরে যেতে হবে এবং তাদের স্বদেশে ফিরে যাবার অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি করতে হবে।
পুর্বাহ্নে প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দফতরের প্রতিমন্ত্রী শ্রী কে সি পন্থ জানান, রাজ্যের মন্ত্রীসভার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠককালে মুখ্যমন্ত্রী ও উপ-মুখ্যমন্ত্রী মন্ত্রীসভার পক্ষ থেকে লক্ষ লক্ষ শরনার্থির অব্যাহত আগমনের ফলে রাজ্যের প্রশাসনের উপরে যে গুরুতর চাপ পড়েছে তা বিস্তারিতভাবে জানিয়ে যেসব ব্যাবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেন তাঁর মধ্যে ছিল,
ক) ভারত সরকার কর্তৃক শরনার্থিদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাবার ব্যাবস্থা করা
খ) শরনার্থিদের ক্যাম্পের মধ্যে রেখে যাতে তাদের রক্ষণাবেক্ষণ করা যায় তাঁর উপযুক্ত ব্যাবস্থা করা।
কারণ শরনার্থিরা এই দেশের অধিবাসীদের সঙ্গে মিলে মিশে গেলে অসুবিধার সৃষ্টি হবে।
তারা এই দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন যে, কিছু কিছু লোক শরনার্থিদের এখানে জমি ও লোকদের বাড়ি দখল করতে প্ররোচিত করছে। এর ফলে অনাবশ্যক একটা আইনশৃঙ্খলা সমস্যার উদ্ভব হবে এবং তা শরনার্থিদের স্বার্থানুগত হবেনা।
এই বৈঠকে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি রোধ করার জন্য প্রয়োজনীয় সব রকমের ব্যাবস্থা নেবার প্রয়োজনীয়তাও বিশেষভাবে আলোচিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধী মন্ত্রীসভাকে জানান যে, ভারত পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতায় উৎসাহী নয়। বাংলাদেশ যে অশান্ত, তা পাকিস্তানেরই সৃষ্টি। কিন্তু ওইসব ঘটনা সম্পর্কে আমরা উদাসীন থাকতে পারিনা। কারণ আমরা ভারতের শান্তি ও স্থায়িত্বে আগ্রহী। ভারতের শান্তি ও স্থায়িত্বকে বিঘ্নিত করে এমন যে কোন ঘটনাই আমাদের স্বার্থের সাথে জড়িত। বস্তুত আমরা মনে করি, ভারতে শান্তি ও স্থায়িত্ব পাকিস্তানের উপরেও একটা নিয়ামক প্রভাব বিস্তার করবে।
প্রধানমন্ত্রী কার্যকরিভাবে আইন- শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মোকাবেলা করার উপরেও জোর দেন।
পশ্চিমবঙ্গের সমস্যা সম্পর্কে কেন্দ্র যে সর্বদা রাজ্য সরকারের সঙ্গে ঘনিস্ট যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে, তা জানিয়ে শ্রী পন্থ বলেন যে, শরনার্থিদের কত দ্রুত ও কি পরিমাণে এই রাজ্য থেকে অপসারণ করা যায় সে বিষয়ে নির্দিস্ট পরিকল্পনা করার জন্য আগামী সোমবার পশ্চিমবঙ্গের দুজন অফিসার দিল্লী যাচ্ছেন। শরনার্থিদের শিবিরের প্রশাসন চালাবার ব্যাপারে রাজ্য সরকারকে যতটা সম্ভব দায়িত্বমুক্ত করার জন্যও কেন্দ্র চেষ্টা করবে।
তিনি আরও জানান, ভারতের বিভিন্ন মন্ত্রী বিদেশী রাষ্ট্রগুলোকে বাংলাদেশ থেকে উদ্ভূত সমস্যা ব্যাখ্যা করতে এবং এই সমস্যা সমাধানে কতটা তারা সাহায্য করতে পারে তা জানাবার জন্য সফরে যাচ্ছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়াও শিক্ষামন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় চারটি রাষ্ট্র সফর করবেন।
মন্ত্রীসভার সঙ্গে আগে প্রধানমন্ত্রী সেনাবাহিনীর ইস্টার্ণ কমান্ড – এর জি ও সি লেঃ জেঃ জগসিত সিং আরোরা, পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল শ্রী প্রসাদ বসু, কোলকাতার পুলিশ কমিশনার শ্রী রঞ্জিত চ্যাটার্জির সঙ্গে আলোচনা করেন। ‘
দুর্যোগপূর্ন আবহাওয়ার দরুন প্রধানমন্ত্রীর দিল্লী প্রত্যাবর্তন আজকের মত স্থগিত রাখছেন। আগামীকাল তিনি ফিরে যাবেন।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২০। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধান প্রয়োজন – ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল প্রেসক্লাবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এর ভাষণ | ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রকাশিত পুস্তিকা | ১৭ জুন, ১৯৭১ |
<১২, ২০, ৩২–৪৩>
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধান দরকার
জাতীয় প্রেস ক্লাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এর বক্তৃতা
ওয়াশিংটন, জুন ১৭, ১৯৭১
আমাকে আমন্ত্রণের জন্য আমি জাতীয় প্রেসক্লাবকে ধন্যবাদ জানাই। এর একটি বিশেষ কারণ আছে। আমি আপনাদের নেতাদের সাথে একটি সমস্যার শান্তিপূর্ন অস্থায়ী সমাধানের জন্য এখানে এসেছি। সমস্যাটি প্রেসে ইতোমধ্যে বিষদভাবে রিপোর্ট করা হয়েছে। তাই আমি আমেরিকান প্রেসের প্রতিনিধিদের মাঝে কথা বলার সুযোগ পেয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। নিশ্চই আমেরিকান প্রেস জনমত গঠনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
পূর্ববাংলার ট্রাজেডি আজ ভারতের জন্য বড় সমস্যা। এশিয়ার জুড়েও এটা এখন গুরুত্তপূর্ন। আমাদের অঞ্চলে এটা শান্তি এবং উন্নতির পথে চরম হুমকি।
পূর্ববাংলার অবস্থা আপনারা ভালো জানেন। কিন্তু আমাদের জন্য এবং আমাদের পুরো অঞ্চলের জন্য এটি কত বড় সমস্যা সেই ব্যাপারে আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে আজ যদি নিজেদের অসহায়ত্বের কারনে অথবা যারা এই ঘৃন্য কাজগুলো করছে তাদের উপর কোন বিশেষ দুর্বলতার কারনে, আমরা এই ঘটনাকে অবহেলা করি অথবা এই ঘটনাগুলোকে আরো বাড়তে দেই, তাহলে পুরো পৃথিবীকে এক সময় এর ফলাফল ভোগ করতে হবে।
পূর্ববাংলার অস্থিরতার জন্য যে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা আমাদের সামনে হাজির হয়েছে তা শুধু ভারতের একার নয়। আপনাদেরও। পূর্ববাংলার ঘটনাবলির ধরণ ও মাত্রা এমন যে সেটি পাকিস্তানের সীমানা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে উদ্বেগের বিষয় হতে বাধ্য।
গণতন্ত্র নিষ্পেষিত
আমাদের দুই দেশের গণতান্ত্রিক নীতি ও মূল্যবোধের প্রতি একটি সাধারণ অঙ্গীকার আছে। এই একই মূল্যবোধ ও নীতিগুলোকে পূর্ববাঙলায় নৃশংসভাবে দমন করা হচ্ছে।
পূর্ববাংলায় সেনাবাহিনী গণতান্ত্রিক নীতির দমনে নিয়জিত থাকায় এটি সেখানে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে রূপ নিচ্ছে। গত ডিসেম্বর সেখানে নির্বাচন হয়েছে একটি এসেম্বলি করে পাকিস্তানে সংবিধান প্রণয়ন করার জন্য। বৃহত্তর পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং প্রাদেশিক শাসনকর্মে তাদের প্রাধান্য দাবি করে। এটা মনে রাখতে হবে যে আওয়ামী লীগের ৬ দফা দাবীগুলো বিচ্ছিন্নতাবাদী কিংবা স্বাধীনতার দাবি ছিল না, স্বাধীনতার দাবি ওঠার পেছনে ছিল উত্তাল মার্চ মাসের ঘটনা গুলো এবং ২৫শে মার্চের গণহত্যার শুরুর মাধ্যমে এই দাবি জোরালো হয়। এই ঘটনার পেছনে দায়ী পশ্চিম পাকিস্তানের একটি সংখ্যালঘু গোষ্ঠী যাদের হাতে ছিলো বিদেশী অর্থ ও অস্ত্র যেগুলোর মাধ্যমে জনতার রায়কে তারা পরিবর্তন এবং ধুলিস্যাৎ করতে চেয়েছিল।
সেনাসন্ত্রাসের এই রাজত্বের ফলে ৬ মিলিয়ন মানুষ পূর্ববাংলা থেকে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে এবং ভারতে শরণার্থী হিসেবে অবস্থান নিয়েছে। এবং এটি চলমান আছে। প্রতিটি দিন প্রায় ১ লাখ মানুষ আমাদের দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে – পূর্ববাংলার সীমান্ত জুড়ে পাকিস্তান আর্মিরা তাদের তারিয়ে দিচ্ছে। সহজ করে বললে প্রতি সেকেন্ডে ১ জন শরনার্থি আমাদের দেশে প্রবেশ করছে।
আমরা এই উদ্বাস্তুদের সামর্থ্য অনুযায়ী ত্রাণ দিচ্ছি। আমাদের পূর্ব বাংলার রাজ্যের শিশুদের স্কুলগুলো শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদান করার জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের স্বাস্থ্য সেবা সীমিত এবং সেখানে পরিবহন ও তাঁবু, খাদ্য ও ওষুধ এবং অন্যান্য সম্পদ সংকট আছে। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে প্রত্যেক স্থানীয় বাসিন্দাদের বাড়িতে ১ জন পূর্ববাংলা থেকে আসা শরণার্থী অবস্থান নিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ, আগে থেকেই অনেক জনবহুল, তার উপর শরনার্থিদের ব্যাপক অণুপ্রবেশে অনেক বড় সমস্যা তৈরি হয়েছে।
খাদ্য, আশ্রয় ও ওষুধ প্রদান অগ্রাধিকারে রাখা আবশ্যক। ত্রাণ খরচ মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। আমরা বর্তমান বছরের জন্য আমাদের বাজেটে ৮০ মিলিয়ন ডলারের একটি টোকেন বরাদ্ধ রেখেছি, এবং এর জন্য আরও ৩০ মিলিয়ন অতিরিক্ত করের বোঝা অর্পিত করা হয়েছে যা আমাদের জনগণকে এই বছর বহন করতে হবে।
আমাদের সম্পদ সীমাবদ্ধতা আছে তবে যথাসাধ্য চেষ্টা করছি শরণার্থীদের দেখাশোনার ব্যাপারে। পাশাপাশি আমরা বিদেশি সরকারগুলোর থেকে ও নানারকম স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও সংস্থা থেকে এবং ব্যক্তিগতভাবে নাগরিকদের থেকে সাহায্য প্রার্থনা করেছি ও পাবো আশা করছি। যদি এই অবদান খুব বড় নাও হয় তবুও এর পেছনের আবেগকে আমাদের সরকার ও জনগণকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে এটাই সার্থকতা।
যাইহোক, এটি অনেক বড় কাজ। এমনিতেই ভারতে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব নিয়ে ভুগছে। অতএব, আশা করি যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, উদার মানবিক প্রবৃত্তি নিয়ে এগিয়ে আসবে এবং পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য সমৃদ্ধ দেশও এগিয়ে আসবে।
সামরিক অ্যাকশন এখনই বন্ধ করতে হবে
কিন্তু ত্রাণ শুধুমাত্র সাময়িক উপশমকারী; সমস্যার সমাধান নয়। তাই এই পরিস্থিতির মূলে ব্যবস্থা গ্রহণ সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ। তাই পাকিস্তান থেকে আরও উদ্বাস্তু অন্তঃপ্রবাহ অবিলম্বে থামাতে হবে। এবং সেটার জন্য পূর্ববাংলায় সামরিক কর্মকান্ড অবিলম্বে বন্ধ করা দরকার। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিৎ পাকিস্তান সরকারকে এই ব্যাপারে চাপ দেয়া।
পাশাপাশি, যারা তাদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে তাদের পূর্ব বাংলায় নিরাপদে ফেরত পাঠানোর জন্য অবস্থা তৈরি করতে হবে। পাকিস্তান সরকারকে এই শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য সঠিক দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। এই সময়ের মধ্যে পূর্ব বাংলায় তাদের সম্পদ সংরক্ষণ করতে হবে এবং তাদের প্রত্যাবর্তন আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে করা উচিৎ।
নিজ নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন এবং উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনে সময় লাগবে এবং ত্রাণ ব্যবস্থা প্রয়োজন হবে। তাই সেখানে প্রয়োজনে ক্যাম্প সেট আপ করতে হবে। আমাদের মত পূর্ব পাকিস্তানে অস্থায়ী ত্রাণ শিবিরে স্থাপন করা উচিত।
পাকিস্তান সরকার পূর্ব বাংলার শিবির বা অভ্যর্থনা কেন্দ্র স্থাপন করেছেন বলে দাবি করে, কিন্তু শরণার্থীরা সেখানে ফিরে যাচ্ছেনা। কারণ তারা দৃশ্যত পাকিস্তান সরকারের ক্ষমার ঘোষণা বিশ্বাস করে না। অতএব তদের ব্যক্তি ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধান নিশ্চিত ও বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য সকল ব্যাবস্থা নিতে হবে।
আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধান
পাকিস্তান আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে উদ্বাস্তুদের জন্য অস্থায়ী ক্যাম্প বসাতে পারে।
মৌলিক সমস্যা হচ্ছে একটা রাজনৈতিক বিষয় এবং এটির রাজনৈতিক সমাধান দরকার। ভালো একটি সমাধান ছাড়া, শরনার্থিরা ফিরে আসার আস্থা ও নিরাপত্তার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করবেনা। এর জন্য দুটি অপরিহার্য শর্ত আছে –
প্রথমত, প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সমাধান জরুরি ভিত্তিতে করা আবশ্যক, এবং দ্বিতীয়ত, সমাধান কার্যকর হতে হবে এবং পূর্ববঙ্গ ও তাদের নির্বাচিত নেতাদের ও জনগণের ইচ্ছার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই তা করতে হবে।
পূর্ববাংলার জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গৃহীত যেকোন ব্যাবস্থা গ্রহণের চেষ্টা পরিস্থিতি তো ঠিক করবেই না বরং দূরত্ব আরও বাড়বে এবং এর ক্ষতিকর প্রভাব পুরো পূর্ববাংলায় পরিলক্ষিত হবে।
মুজিবের জন্য উদ্বেগ
আমরা মুজিবের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং সুস্থতা নিয়ে চিন্তিত। তিনি খুব উচ্চ মর্যাদা এবং বিরল মানবিক গুণাবলির একজন মানুষ যিনি পূর্ব বাংলার সমগ্র জনগণের প্রাণপ্রিয় নেতা। আমরা আশা করি যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে পাকিস্তানের শাসকদের উপর সকল প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবেন এবং পূর্ব বাংলার মানুষের আশা, আকাঙ্ক্ষা ও উজ্জীবনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করবেন যা প্রতিফলিত হয়েছিল গত ডিসেম্বরের শেষের দিকে। শুধু কারারুদ্ধ করে এটিকে নির্বাপিত করা যাবে না।
আমরা সামগ্রিকভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, এবং বিশেষ করে যেসব দেশের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক ভালো তাদের অনুরোধ করছি একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য পাকিস্তান সরকারকে প্রভাবিত করতে।
পাকিস্তানে সামরিক সাহায্যের অনুদান বিষয়ে আমাদের অবস্থা স্পষ্ট। অবস্থা এখন এমন হয়েছে যে অর্থনৈতিক অনুদান বর্তমানে পাকিস্তানের জনগণকে দমন করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। সুতরাং এ বিষয়টি পাকিস্তানের জনগণের জন্য উদ্বেগের। এটি যত দ্রুত সম্ভব শেষ করতে হবে। তাই আমরা যতদিন না একটি রাজনৈতিক সমাধান আসে ততদিন পাকিস্তানে তাদের মিলিটারি ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করার ব্যাপারে সকল দেশের প্রতি আহবান করছি।
ভারতকে হুমকি
আমি আশা করি যে এই দেশের মানুষ বুঝতে পারবে কেন আমরা পূর্ববাংলার পরিস্থিতির উপর আমাদের উদ্বেগ প্রকাশ করছি। মার্চ ২৫ থেকে পূর্ববাংলায় যে হত্যাকাণ্ড হচ্ছে তার ফলাফল আমাদেরকেও প্রভাবিত করছে। অবস্থা এখন এমন হয়েছে যে পাকিস্তানের সামরিক সরকারের কার্যক্রম আমাদের সমাজ ও আমাদের রাষ্ট্রের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশকে প্রভাবিত করছে। এর ফলে আমাদের এলাকায় সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে যার পরিণতি চিন্তার বাইরে।
আমরা ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও সংযমের সাথে আচরণ করছি। কিন্তু যদি আমাদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক অবস্থা হুমকির সম্মুখীন হয় তবে আমরা বসে থাকব না।
আমাদের স্বাধীনতার পর থেকে ২৩ বছর ধরে, আমরা আমাদের গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানের জন্য লড়াই করছি। আমরা আমাদের দেশ থেকে দারিদ্র্য ও ক্ষুধা এবং রোগ নির্মূল করতে সফল হইনি। কিন্তু আমাদের জনগণের জীবনযাপন গত আড়াই দশকের তুলনায় কিছুটা উন্নত হয়েছে। আমরা আমাদের খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ করেছি। শিক্ষা, চিকিৎসা ও কাজের সুযোগের প্রাপ্যতা বিস্তৃত হয়েছে। আমাদের রপ্তানির বার্ষিক বৃদ্ধির হার গত বছরে ৭ শতাংশ মাত্রা স্পর্শ করে এবং আমাদের প্রবৃদ্ধির হার বার্ষিক শতকরা ৫ এ উন্নীত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের প্রচেষ্টাকে সাহায্য করেছে এবং আমি নিশ্চিত এই সাফল্যের তারাও অংশীদার।
পাকিস্তানের তৈরী সংকট
ফেব্রুয়ারিতে সাধারন নির্বাচনের পর, আমাদের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও আমাদের দল, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, আমাদের প্রোগ্রামের জন্য জনগণের বিপুল সমর্থন পেয়েছে। আমরা আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার উপর একটি শক্তিশালী হুমকির আভাস পাচ্ছি। আর, তারপর এখন আসল পাকিস্তানের তৈরি সমস্যা যা আমাদের ফসলের উপর হুমকি এবং আমাদের শান্তি ও আমাদের সন্তানদের জন্য অগ্রগতির প্রত্যাশা হুমকির সম্মুখীন করে তুলেছে।
যেকোনো দায়িত্বশীল সরকারের জন্য এটি একটি অসহনীয় অবস্থা। তাই আমাদের উদ্বেগ অতি দ্রুত পূর্ব পাকিস্তানে একটি রাজনৈতিক সমাধান তৈরি করা যা বাঙালি এবং তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে গ্রহণযোগ্য। যাতে শান্তি ফিরে আসতে পারে এবং উদ্বাস্তুদের যারা আমাদের দেশে এসেছে তাদের বাড়িতে ফিরে যেতে পারে।
আমরা একটি মারাত্মক পরিস্থিতির সম্মুখীন। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি যে বিশ্ব সম্প্রদায় সম্মিলিতভাবে এর একটি সন্তোষজনক সমাধান বের করবেন এবং ভারতের স্থিতিশীলতার জন্য এবং এই অঞ্চলের শান্তির জন্য হুমকি দূর করবেন।
এই আশায় আমি ওয়াশিংটনে সফরে এসেছি এবং আমি বুঝেছি যে ওয়াশিংটন আমাদের আশঙ্কা অনুধাবন করেছেন এবং আমরা তাদের সাহায্য সহানুভূতি পাব।
[উপরের বক্তৃতা প্রতিনিধি কর্ণীলিয়াস ই গালাঘার এর অনুরোধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেশনাল রেকর্ডে সংরক্ষণ করা হয়েছে]
বক্তৃতার পরে প্রশ্নোত্তর পর্ব —
প্রশ্নঃ আপনি গত রাতে বলেছেন যে আপনারা ৬ মিলিয়ন শরনার্থিকে ৬ মাস দেখভাল করবেন। যদি পাকিস্তান এই শরনার্থিদের নিতে অস্বীকৃতি জানায় তাহলে আপনারা কী করবেন?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। যদি সেখানে ৬ মিলিয়নের বেশী হয় তখন কী ঘটবে? সেটাই আমাদের উদ্বিগ্ন হবার কারণ। আমাদের প্রথম দাবি, আর যাই হোক না কেন, উদ্বাস্তুদের এই অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে। আর এর জন্যে কোন বড় ধরণের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন দরকার পড়েনা। তাহলে এখন সেখানে প্রশাসনিক ও সামরিক যন্ত্রপাতি পরিচালনা করছেন তারা যদি কৌশলে জনগণকে পুশ করে, যদি অস্ত্র থামিয়ে জনগণের আস্থা আনতে পারেন, যে কোন মূল্যে অনুপ্রবেশ ঠেকানোর চেষ্টা করেন, তবেই তা বন্ধ হওয়া সম্ভব। পরিস্থিতি এতোই ভয়াবহ যে, আমি আমার বক্তৃতায় বলেছিলাম – এই অবস্থা চলতে থাকলে, আমরা অসহায়ভাবে বসে থাকতে পারব না। তাছাড়া এটি আমাদের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার পথে ক্রমবর্ধমান হুমকিস্বরূপ এবং শুধুমাত্র তাই নয় এটি আমাদের পুরো অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেবে।
প্রশ্নঃ কেন আপনি পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ব বাংলা বলছেন? এটি কি পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার একীভুতকরণের ইঙ্গিত দেয়?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ আমি এটাকে পূর্ববাংলা বলি কারণ মূলত এটা পূর্ববাংলাই ছিল। বাংলার দুটি অংশ পূর্ব ও পশ্চিম। তাছাড়া এটি বলার আরেকটি কারণ হল আমরা পূর্ব বাংলার ৭৫ মিলিয়ন মানুষের আদর্শে একাত্মতা প্রকাশ করি। তারা মিলিটারি প্রভাব ও শোষণ থেকে মুক্তির জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। এবং এগুলো মূলত পরিচালিত হয় পাশ্চিম পাকিস্তানীদের ও তাদের সংবিধান দ্বারা।
এটি বলার মানে এই নয় যে ভবিষ্যতে আমরা আমাদের পশ্চিমবাংলার সাথে পূর্ববাংলাকে একীভূত করতে চাই – যদি পূর্ববাংলা স্বাধীনও হয় তবুও এই একীভূতকরণ সম্ভব না। পশ্চিমবঙ্গ ভারতের একটি অংশ। ভারতের সংবিধানে পরিচালিত। কাজেই এখানকার জনগণের দুশ্চিন্তার কিছু নেই। পূর্ব বাংলার ভাগ্যে যাই ঘটুক না কেন- হয় তারা ৬ দফা আদায় করে সফল হোক অথবা তারা মিলিটারিদের বিরুদ্ধে সম্পূর্ন জয়লাভ করে স্বাধীন হিসাবে আত্মপ্রকাশ করুক – তাতে পশ্চিমবঙ্গের জনগণের দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই।
প্রশ্নঃ প্রেসিডেন্ট নিক্সন এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে পূর্ববঙ্গে গণহত্যার নিন্দা করেননি। তিনি কি তার সাথে আপনার ব্যক্তিগত আলোচনায় এটা করেছেন?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ আমি নিশ্চিত এইসব উদ্বেলিত শ্রোতা আমাকে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পক্ষ হয়ে তার বক্তব্য আমি বলে দেই সেটা পছন্দ করবেন না। আপনি হয়ত জানতে চেয়েছেন রাষ্ট্রপতি নিক্সনের মনে কি আছে। তাই এটা বলা আমার পক্ষে কঠিন যে তিনি কী ভাবছেন বা ভাবছেন না। আমার কাজ হল আমার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা। সেটা যেভাবেই হোক আমাকে আমার কথা প্রেসিডেন্ট নিক্সন এবং সরকারের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের কাছে তুলে ধরতে হবে এবং তারপরে তারা ভেবে দেখবেন তাদের মনোভাব তারা জনসম্মুখে প্রকাশ করবেন কি করবেন না। আমি এটা নিয়ে তাদের সঙ্গে কোনো বিতর্ক করতে চাই না।
প্রশ্নঃ কূটনৈতিক প্রতিবাদ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের উপর বাঙালিদের উপর অমানবিক অত্যাচার বন্ধের জন্য আর কী পদক্ষেপ নিতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ আমার মনে কোন সন্দেহ নেই যে আপনার প্রশ্নে উল্লেখিত কূটনৈতিক প্রতিবাদ ছাড়াও শুধু যদি আমেরিকান সরকার ও জনগনের অসন্তুষ্টির ব্যাপারটা সঠিক ভাবে প্রকাশিত হয়, তাহলে সেটাই সামরিক শাসকদের উপর একটা বড় প্রতিক্রিয়া ফেলবে, এমনকি তা পশ্চিম পাকিস্তানের জনগনের উপরও ফেলবে, যারা সংবাদপত্র মাধ্যমের উপর নানা ধরনের কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের কারনে আসলে কি হচ্ছে পুর্ব পাকিস্তানে সেটা জানে না। এবং এই অসন্তুষ্টির ব্যপারে একটি কঠোর ও পরিষ্কার ঘোষণা শুধু ভুক্তভোগীদের প্রয়োজনীয় ও প্র্যাপ্য সান্ত্বনা দিতেই অনেক সাহায্য করবে না, বরং চলমান সামরিক অভিযানের মাধ্যমে যারা এই ঘৃণ্য অপরাধগুলো করছে গনতন্ত্রের ও মুক্ত ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে, তাদের উপরেও চাপ সৃষ্টি করবে।
প্রশ্নঃ আপনি বলেছেন ‘ভারত চুপ করে বসে থাকবেনা’ – এর দ্বারা আপনি কি ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের ইঙ্গিত দিচ্ছেন?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ যুদ্ধ ছাড়াও আমাদের উদ্যেশ্য বাস্তবায়নের জন্য আমাদের আরও অনেক পথ আছে। তবে আমরা আশা করি সেসকল পদ্ধতি আমাদের নেয়ার দরকার পরবেনা। এবং এটাও আশা করি যে আপনারা সেসব সম্পর্কে আমাকে এখন কিছু বলতে বাধ্য করবেন না।
বর্তমানে আমরা জনমত গঠনের কাজে নিযুক্ত আছি- সরকারী ও বেসরকারি লেভেলে। আমরা মৌলিক সমস্যা গুলোর প্রতি মনোযোগ আকর্ষনের চেষ্টা করছি। আমরা অল্প চেষ্টাতেই এখন এই বিষয়টি যাচাই করতে পারছি। আমাদের দৃঢ় আশা ও বিশ্বাস যে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ করার একমাত্র পথ হল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গুলোকে সরকারী – বেসরকারি উভয় পর্যায়ে এগিয়ে আসতে হবে। এই অবস্থায় যদি দেশগুলো নিশ্চুপ থাকে তাহলে মিলিটারি একশন আরও ভয়ানক রূপ ধারণ করবে। এবং এর ফলাফলও খুব তীব্র হবে।
প্রশ্নঃ জনাব মন্ত্রী, আপনি কি মনে করেন যে, পশ্চিমা দেশগুলোর পররাষ্ট্র অফিস থেকে পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যার সম্পর্কে সামান্যই বলার ছিল?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ আমি তাদের পক্ষ থেকে কথা বলতে পারি। কিন্তু কঠিন বাস্তবতা এই যে তারা স্বল্পভাষী। কিন্তু এখন তাদের বিবেকে নাড়া দেবার সময় এসেছে। সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুযায়ী তাদের বাইরে কথা বলা উচিত। এবং মূল বিষয়ের আশেপাশে না গিয়ে গভীরে গিয়ে মোকাবিলা করা উচিৎ।
প্রশ্নঃ হিন্দু শরণার্থীদের কি পূর্ব বাংলায় আসতে বলা হবে? আর আপনি একটি একীভূত পূর্ববাংলা বলতে কি বুঝিয়েছেন? এটি কি ভারত ও পাকিস্তান থেকে আলাদা কিছু?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় একজন হিন্দু উদ্বাস্তু বা একজন মুসলিম শরণার্থী যেই হোক না কেন তাকে দেশে ফিরে যেতে হবে। আপনার সাথে আমি আরেকটি তথ্য যোগ করে বলতে চাই এই দুইটি ধর্মের লোক ছাড়াও খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মের শরনার্থিরাও সেখানে আছে। পাকসেনারা সকল সম্প্রদায়ের লোকদের উপরই অত্যাচার চালিয়েছে।
ফিরে যেতে বললেই শরনার্থিরা ফিরে যাবেনা। তারা যখন মনে করবে যে পরিস্থিতি যাবার মত হয়েছে কেবলমাত্র তখনি তারা ফিরে যেতে চাইবে। তাই জনে জনে জিজ্ঞেস করে এটা সম্পন্ন করা যাবেনা। বরং পূর্ব বাংলার মানুষের চাহিদাকে সন্মান করে কাম্য রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হলে তারা যেতে উদ্বুদ্ধ হতে পারে। তারা তাদের মতামত গত নির্বাচনে দিয়েছে যেখানে আওয়ামীলীগ ১৬৯ টি আসনের ১৬৭ টি পেয়েছে। আমি মনে করি পৃথিবীর যেকোন মানদণ্ডে যেকোন স্থানের তুলনায় এটি একটি রেকর্ড, একটি বিশাল সফলতা।
তাই জনগণের আস্থা আসে এমন সরকারকে সেখানে প্রতিস্থাপন করতে হবে। এতে করে শরনার্থিদের ফিরে যাওয়ার পরিবেশ তৈরি হবে।
দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব আমি ইতিমধ্যে দিয়েছি। পশ্চিমবঙ্গ, ভারত উপমহাদেশের একটি বিশেষ সম্প্রদায়, তাদের সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে দেশের উন্নয়ন প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। ভারতীয়দের জনজীবনে এটির বিশেষ দখল ও প্রভাব রয়েছে। পুর্ব বাংলায় যা কিছু হচ্ছে তাতে আমরা মনে করি এর প্রভাবে ঐ অঞ্চলের মানুষের সামনে এগিয়ে যাবার স্বপ্ন বহুগুণে পিছিয়ে যাবে এবং এর প্রভাব আমাদের অংশেও পড়বে।
প্রশ্নঃ মান্যবর, আপনি কি একটি রেডিও রিপোর্টের উপর মন্তব্য করবেন দয়া করে? সেখানে বলা ছিল আপনার সরকার পাকিস্তানি শরনার্থিদের জন্য আমেরিকান এয়ারলিফট এর প্রচারে প্রেসকে বাঁধা দিচ্ছে – অন্যদিকে একই ধরণের সোভিয়েত এয়ারলিফটকে কভারেজ এর অনুমতি দিয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ আমরা সম্পূর্ণরূপে এই দুই সুপার পাওয়ারের মধ্যে নিরপেক্ষ অবস্থানে আছি। আর আমি কোনো প্রান্তিকে সি -১৩০ প্লেন এর সাথে এ এম ১২ বা এ এম -১৪ প্লেন এর প্রতি বৈষম্য করছি এমন ধরনের অনুভূতি দুর করতে চাই। আমি নিজে আমেরিকান প্লেন সজ্জার একটি পূর্ণ রিপোর্ট দেখেছি। আমি নিশ্চিত যে, ভারতের প্রেস স্বাধীন – এমন একটি ভাবমূর্তি সেখানে রয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগ কোন দাতব্য প্রতিষ্ঠান নয়। তবু তারা কখনো নালিশ করেনি যে সেখানে কোন অনিয়ম হয়েছে।
প্রশ্নঃ আপনি কি মনে করেন যে পাকিস্তান সরকার দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করবে?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ এ ব্যাপারে আমি সন্দিহান। এগুলো সত্যি অসহায় লোকদের হাতে পৌঁছাবে কিনা সেব্যাপারেও আমি নিশ্চিত নই। এই বিষয়টি আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে এবং ইউ এন সার্কেলে আলোচনা করেছি। এই কারণেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই ব্যাপারটি তদারকি করার জন্য জোর দিচ্ছে।
অভিজ্ঞতার কোন বিকল্প নেই। এটা সবার জানা যে কয়েক মাস আগে সাইক্লোনে যে ত্রাণ ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য পাকিস্তান সরকারকে দেওয়া হয়েছিল তার একটি অংশ এখনো অব্যবহৃত রয়ে গেছে। তাছাড়া ত্রাণ কাজের জন্য সেই সময় যে স্পিড বোট দেয়া হয়েছিল সেগুলো পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ব্যাবহার করছেন।
প্রশ্নঃ জনাব মন্ত্রী, আপনি কি মনে করেন যে দুই পাকিস্তান একটি সরকারের অধীনে চলতে পারে?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ আমি ভবিষ্যতে কি হবে তার উপর মন্তব্য করতে চাই না। আমি বর্তমান সমস্যা নিয়ে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে চাই। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ এবং পূর্ববাংলার জনগণের মধ্যে চলমান ব্যাপারটিতে আমরা আমাদের অবস্থা তুলে ধরছি মাত্র। এব্যাপারে পূর্ববাংলার জনগণ তাদের ভবিষ্যতে নির্ধারন করবে। এবং আমরা খুশি হব যদি সেখানকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের প্রশাসনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়। তাছাড়া এই ব্যাপারে আমরা এখনো নির্দিস্ট কোন অবস্থান নেইনি।
প্রশ্নঃ আগের একটি প্রশ্নের জের ধরে জানতে চাই ভারত কি পূর্ব বাংলাকে তাদের একটি রাজ্য বানাতে চায়? আপনি বলেছেন পশ্চিম বাংলা দুই বাংলাকে একীভূতকরণে ভারত সরকারের প্রচেষ্টায় বাঁধা দেবেনা। এব্যাপারে এমনি মূল প্রশ্নের উত্তরটি দেবেন কি?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ আপনি প্রশ্নটি আবার করুন।
প্রশ্নঃ আগের একটি প্রশ্নের উত্তরের ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে চাই – সেটা হল – ভারত কি পূর্ববাংলাকে তাদের সাথে একীভূত করে নেবে কিনা? এই ব্যাপারে আপনি কি আর কিছু বলবেন দয়া করে?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ পূর্ববাংলার মুক্তিযোদ্ধারা তাদের স্বাধীনতার জন্য যেভাবে লড়াই করছে তাতে আমি কখনোই মনে করিনা যে তারা আবার ভারতের অংশ হয়ে অর্থাৎ অন্য একটি দেশের কাছে পরাধীন হয়ে থাকবে। তাদের স্বাধীনতার আখাঙ্খা এর থেকে অনেক শক্তিশালী।
এই অভিব্যাক্তির ব্যাবহার বোঝায় না যে পশ্চিমবংগ (যা ভারতীয় রাষ্ট্রসঙ্ঘের একটি সদস্য)স্বাধীন হয়ে গেলেও পূর্ববঙ্গের সাথে যোগ দেবার কোন ঝুকি আছে। তারা আমাদের দেশ, তথা মহান ভারতবর্ষের মত দেশে, যেখানে তারা রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রেখেছে, সেখানে সমঅংশদারিত্ব হবার মূল্য বোঝে, এবং সেকারনেই আমার মনে হয়, পশ্চিমবঙ্গ, যা ভারতের একটি অংগ, তার জনগন কখনো ভারত হতে বের হয়ে যেতে চাইবেন, তা সে পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ্য যাই হোক না কেন, সেটা আওয়ামীলীগের বর্নিত ৬ দফা অনুসারে অর্থনৈতিক স্বায়ত্ব শাসনই অর্জন করুক বা সামরিক জান্তা কতৃক জনগনের আশা আকাঙ্ক্ষা ক্রমাগতভাবে ভাবে চাপা দেয়া রাষ্ট্রতে পরিনত হোক।
প্রশ্নঃ আপনি কি সঠিক কোন সংখ্যা বলতে পারবেন যে ঠিক কতদিনের জন্য আন্তর্জাতিক মানবিক সাহায্য দরকার বলে ভারতীয়রা বিশ্বাস করে?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ এ প্রসঙ্গে আমি একটি বা দুইটি কথা বলতে চাই। প্রথমত, সবচেয়ে দরকারি যে কথাটা সবার আগে বলতে চাই তা হল যেসকল পূর্ব পাকিস্তানী নাগরিক আমাদের ভিতরে প্রবেশ করেছে তাদের দায়-দায়িত্ব স্পষ্টত পাকিস্তান সরকারের উপর বর্তায়। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও দায়িত্ব রয়েছে যার অংশ হিসেবে ভারত তার অংশটুকু দেখবে।
এবং যদি এই উদ্বাস্তুদের জন্য আন্তর্জাতিক ভাবে কোন ত্রাণ পাওয়া যায় সেটা ভারত নিজেদের ধরে নেবেনা। এটা পাকিস্তানকে দেয়া হয়েছে বলে ধরা হবে। কারণ এই ত্রাণের ফলে পাকিস্তান সরকারের উপর যে দায়িত্ব ও চাপ বর্তায় তা কিছুটা কমবে বলে ধরা যায়।
হিসেব করলে দেখা যায় যা এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে তা মূল চাহিদার থেকে খুবই সামান্য। তার চেয়ে গুরুত্তপূর্ন বিষয় হল আমাদের অঞ্চলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। এই অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে তা অদূর ভবিষ্যতে যে সমস্যার সৃষ্টি করবে তা শুধুমাত্র টাকা দিয়ে সমাধান করা বা মেটানো যাবেনা। এই বিষয়টা অবশ্যই আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।
এই কারণেই আমরা বরাবরের মতো একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ আশা করছি পূর্ব পাকিস্তানে। কারণ মূল কারণের সমাধান না করে শুধু উদ্ভূত সমস্যার সমাধান করলেই বিষয়টা মিটে যাবেনা।
আমরা খেয়াল করেছি এখন পর্যন্ত অনেক উদার দাতারাও যে সাহায্য করেছেন তা মূল চাহিদার তুলমায় একেবারেই নগণ্য। এটা দিয়ে খুব সামান্য সংখ্যক উদ্বাস্তুকে সাহায্য করা যাবে। তবুও আমরা তাদের শ্রদ্ধা করছি – টাকার পরিমাণ যাই হোক – তাদের মনোভাবের জন্য।
প্রশ্নঃ চীন এর বিশ্বাসযোগ্যতা এবং বিশ্বের তার প্রভাব বিবেচনা করে সে যেভাবে পাকিস্তান সরকারের কাজকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে এর প্রভাবে আপনার মূল্যায়ন কী?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ নিশ্চয় যেকোনো কেউ যখন পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের সমর্থন করে – তা বিশ্বের যে অংশ থেকেই হোক, এতে তারা স্তুতি লাভ করবে, একগুঁয়েমিতে আরও উৎসাহিত হবে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চিন সরকারের কাছ থেকে এই সমর্থন স্পষ্টভাবে সমগ্র পরিস্থিতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
প্রশ্নঃ জনাব মন্ত্রী, উদ্বাস্তু এবং অন্যদের মধ্যে কলেরা পরিস্থিতি কি?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ সেখানে কলেরার ঘটনা ঘটছে। এবং আমি মনে করি যে, এটি থামানোর জন্য বড় কিছু পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে যাতে কলেরা ছড়িয়ে পড়ার সম্ভবনা কিছুটা কমে এসেছে। আমাদের সুবিশাল দেশ। আমাদের বিশাল সংখ্যক জনগণের স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে হয়। স্বাস্থ্য বিভাগ কলেরা নিয়ন্ত্রণে ভালো ব্যাবস্থা নিয়েছে ও তারা সফল হয়েছে। আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অত্যধিক কলেরা ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে উদ্বিগ্ন প্রকাশ করতে বলছিনা। আমরা মনে করি কলেরা সমস্যাকে বড় করে দেখিয়ে তারা মূল ঘটনা আড়াল করার চেষ্টা করছেন। তাই আমরা এই মহামারির কথা চিন্তা না করে বরং মূল সমস্যায় মনঃসংযোগ করতে বলি।
প্রশ্নঃ কমিউনিস্ট চীন কি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কোনো ভবিষ্যৎ বিবাদের ব্যাপারে ভারতকে কোনো সতর্কতা জারি করেছে?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ একটি শব্দে বলা যায় ‘না’।
প্রশ্নঃ শরণার্থীদের ত্রাণ কার্যের জন্য ভারতের কি তার বাজেট সংকুচিত করার সম্ভবনা আছে?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ আমার মনে হয় এটা বেশ স্পষ্ট যে উদ্বাস্তুদের সমগ্র ব্যয় আমাদের জন্য লাভজনক কিছু নয়। এবং, এটা মেটানোর জন্য আমাদের কিছু উন্নয়ন খাতের বাজেট কর্তন করতে হবে। ফলে আমাদের দেশের উন্নয়ন ব্যাঘাত ঘটবে যেটা আমাদের জন্য উদ্বেগের বিষয়।
প্রশ্নঃ জনাব মন্ত্রী, কিভাবে এই অবস্থায় ইন্দো-আমেরিকান সম্পর্ক উন্নয়ন করা যায়?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ এটার উত্তর দেয়া কঠিন। তবে এটা বলতে পারি আপনারা সবাই যদি আমাকে সমর্থন দেন তাহলে তার প্রভাব খুব বড় হবে। (হাসতে হাসতে বলেন)।
প্রশ্নঃ আপনার দেশের কত শতাংশ লোক প্রতি রাতে ক্ষুধার্ত অবস্থায় বিছানায় যায়? আপনার দেশে আপনার মানুষের খাদ্যের মধ্যে প্রয়োজনীয় প্রোটিন প্রদান এর জন্য মাছের ব্যাবস্থা আছে কি? আপনি কি জনসংখ্যা বিস্ফোরণকে একটি বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করতে চান? পাশাপাশি, ভারতে জন্মনিয়ন্ত্রণ এর অগ্রগতি সম্পর্কে কিছু কি বলতে পারেন?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ বেশ কিছু প্রশ্ন একসাথে সমন্বিত করা হয়েছে। সম্ভবত এই ব্যাপারে যদি বিস্তারিত বলতে যাই তাহলে আমাদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও উন্নয়ন এর একটি পূর্ণ অবস্থা অনুধাবন করা সম্ভবপর হবে।
কিন্তু, আমি যত সংক্ষেপে পারি বলার চেষ্টা করছি। প্রথম প্রশ্ন ছিল কর জন লোক রাতে না খেয়ে ঘুমাতে যায়? আমার একটাই উত্তর – যেহেতু গত বছর আমাদের খাদ্য উৎপাদন ১ মিলিয়ন টন পাইল ফলক অতিক্রম করেছে। কেন্দ্রিয়ভাবে আমাদের অবস্থান ভালো। আমরা আমাদের খাদ্য আমদানি অনেকটা কমিয়ে আনতে সক্ষম হতে পেরেছি। তবে আমরা কিছু পরিমাণ আমদানি করছি রিজার্ভ ঠিক রাখার জন্য।
দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছিল আমিষের যোগানদাতা হিসাবে মাছের ভূমিকা নিয়ে। এটাই কি আসলে বুঝিয়েছেন?
প্রশ্নঃ হ্যাঁ, স্যার. আপনার দেশের মৎস্য সম্পদ কি আপনার মানুষের খাদ্যের মধ্যে প্রয়োজনীয় প্রোটিন প্রদান করছে?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ আমাদের চাহিদা মাফিক যথেষ্ট মাছ উৎপাদন হয়না তবে আমরা আরও বাড়াতে চাই। এবং আমরা মাছ আহরণের জন্য আরও জোরালো ব্যাবস্থা গ্রহণ করছি।
আমাদের মাছ খাওয়াতে কোন সমস্যা নেই। আপনারা যদি মাছ পরিবেশন করেন এবং দেখেন যে ইন্ডিয়ানরা কাঁটাচামচ দিয়ে মাছকে কেমন করে বাগে আনছে, তাহলেই এর উত্তর পেয়ে যাবেন।
পরের প্রশ্ন?
প্রশ্নঃ আপনি কি মনে করেন জনসংখ্যা বিস্ফোরণ আজ বিশ্বের একটি বড় সমস্যা?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ হ্যা। এবং পাশাপাশি একটি কথা আমি বলতে চাই জনসংখ্যা সমস্যা যেমন পুরো বিশ্বকে ভাবাচ্ছে – এটাকে যেমন ভাগ করে নেয়া যাচ্ছেনা – সবাই মিলেই সমাধান করতে হচ্ছে তেমনি শান্তিকেও ভাগ করে দেয়া যাবেনা – সবাই মিলেই শান্তির জন্য এগিয়ে আসতে হবে। একারণেই সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে শান্তি প্রতিষ্ঠায়। যার যার পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব তা করতে হবে। তা না হলে তুলনামূলক গরীব দেশে যদি জনসংখ্যা বাড়ে এক সময় সেটা যেসব দেশে উন্নত জীবন যাপন বজায় রয়েছে সেখানেও একসময় প্রভাব ফেলতে শুরু করবে।
আর, আমরা আমাদের পক্ষে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ সম্পূর্ণরূপে নিয়েছি। এবং আমি এই চিন্তাটা আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই যে ভারতের এই ব্যাপারে কোন বাঁধা নেই। এটা নির্ভর করে আমরা কি কার্যকর পদ্ধতিতে আমাদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি এগিয়ে নিতে সক্ষম হব তার উপর।
প্রশ্নঃ আপনি রাজনৈতিক সমস্যার কথা বলছিলেন। ইউ এস সরকার তো ত্রাণ, অর্থ ও অন্যান্য সাহায্যের কথা বলেছে। তাহলে এগুলো কি বধিরের প্রলাপ মাত্র?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ যদি এটাই চুক্তি হত তাহলে কিছুই শোনা যেত না। এবং আলোচনা বন্ধ হতে হলে দুজনকেই বধির হতে হয়। আমি মনে করিনা যে উভয় আচরণ অসঙ্গত। আমেরিকা সরকার তাদের যে ত্রাণের কথা উল্লেখ করেছেন তার জন্য আমি তাদের স্বাগত জানাই।
আমরা কিন্তু শুধুমাত্র উপসর্গ নয় মূল সমস্যা মোকাবিলার তাগিদ দিয়েছি। আমি যদি বলি আমি যা বলেছি সব বধিরের সামনে বলা হয়েছে তাহলে এটা ভুল বলা হবে।
চেয়ারঃ মহামান্য, চূড়ান্ত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার আগে, আমি আপনার আগমন উপলক্ষে একটি স্মৃতিরক্ষা সনদ উপহার দিতে চাই।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
চেয়ারঃ পাশাপাশি জাতীয় প্রেস ক্লাবের অফিসিয়াল নেকটাই দিতে চাই। তবে দুঃখিত যে এটা কিন্তু আপনাকে ওয়েস্টার্ণ পোশাকের সাথে পড়তে হবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
প্রশ্নঃ শেষ প্রশ্ন, স্যার, এটা সত্য যে আপনি একবার একটি অ্যালার্মঘড়ি রাষ্ট্রদূত কেন কেটিং (Ken Keating) কে দিয়েছিলেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ একটি অ্যালার্ম ঘড়ি.
চেয়ারঃ আমি এর গুরুত্ব জানিনা।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ খুব আরামপ্রদ একটি বিষয় উত্থাপিত হয়েছে। প্রথমে আমি আপনাকে ধন্যবাদ দেই, মিস্টার প্রেসিডেন্ট। আপনার ভাবুকতা ও প্রশ্ন স্ক্রীনিং করে যতটা সম্ভব উপস্থাপনযোগ্য এবং রুচিকর আকারে উপস্থাপন করার চেষ্টার জন্য। এবং আমি আপনার চিন্তা এবং বিবেচনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
দ্বিতীয়ত, আমি এই স্যুভেনিরকে অনেক মূল্যায়ন করি যা আমার জন্য তুলে ধরা হয়েছে। এটি সর্বদা আমাকে একটি খুব আরামপ্রদ ও স্মরণীয় অনুষ্ঠানের কথা মনে করিয়ে দেবে যে আমি এমন একটি মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়েছিলাম এবং আমি প্রেসকে একটিভ দেখতে চাই। কিছুক্ষণের জন্য আমি এই বিষয়টা মিস করছিলাম কারণ আমি এই মুহূর্তে প্রায় ১০ দিন ধরে আমার পার্লামেন্ট ও প্রেস থেকে দূরে আছি। দেশে গিয়ে এই অতিথিপরায়ণতার কথা খুব মনে পড়বে। দেশকে ও দেশের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে অসাধারণ এই সুযোগটি আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
শেষ প্রশ্ন ছিল রাষ্ট্রদূত কেটিং কে একটি অ্যালার্ম ঘড়ি দেয়া সম্পর্কে। আমি বলতে চাই যে, জনাব রাষ্ট্রদূত সিনেটর কেটিং আমাদের কূটনৈতিক কোরের মধ্যে সবচেয়ে পছন্দ এবং সম্মানিত রাষ্ট্রদূতদ। আমি স্বীকার করি যে তিনি আমাদের দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের, তাদেরকে শক্তিশালী করার জন্য চমৎকার কাজ করেছেন। এবং যেখানে ফলপ্রসূ সহযোগিতা এবং একত্রীকরণ করার চেষ্টা করেছেন। আমি আপনাকে আশ্বস্ত করতে চাই যে, মানুষ হিসেবে আমরা যুক্তিসঙ্গতভাবে বিনীত হতে চাই, এবং আমরা এলার্ম ঘড়ির মত হাস্যকর কিছু উপহার দিয়ে কাউকে বিব্রত করতে চাইনা।
আর, জনাব কেটিং খুব সতর্কবান মানুষ। তার জাগার জন্য এলার্ম ঘড়ির প্রয়োজন হয় না। তিনি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কদাচিৎ ঘুমান। তাই ঘড়ির এলার্ম দিয়ে তাকে উঠিয়ে দেবার প্রয়োজন নেই। সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনি সদা জাগ্রত।
আর, হতে পারে, আমি তার জন্য কিছু ঘুমের বড়ি কিনতে পারি। কিন্তু আমি বলতে চাই যে জনাব কেটিং আমেরিকার ঐতিহ্যবাহী জীবন যাপনে অভ্যস্ত। এবং, আমি খুবই আনন্দিত যে তিনি চমৎকার কাজ করছেন।
কিন্তু, তারপরেও কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নের ফাঁকে এমন একটি ছেলেমানুষি প্রশ্নের সুযোগ রাখা যেতেই পারে।
ধন্যবাদ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, নয়াদিল্লী।