You dont have javascript enabled! Please enable it!

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২১। সম্পাদকদের সাথে বৈঠক কালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ঘোষনা – শরনার্থিদের নিরাপত্তার সাথে দেশে ফেরত পাঠাতে আমি প্রতিজ্ঞ দৈনিক স্টেটসম্যান ১৮ জুন ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ২১, ৪৪>

শ্রীমতী. গান্ধী বলেন —
“আমি তাদের ফেরত পাঠাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ”

নয়া দিল্লি. ১৭ জুন, মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসার সাথে সাথে শরণার্থীদের ফেরত পাঠাতে ভারতের সংকল্পের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। UNI এর রিপোর্ট। “আমি শুধু তাদের ফেরত পাঠাতে যাচ্ছি’ – অর্থনৈতিক সম্পাদকদের এক সভায় তিনি একথা বলেন।

ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে মিসেস গান্ধী প্রধানত পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের অন্তঃপ্রবাহ ভারতের উপর “বোঝা” হয়ে উঠেছে বলে উল্লেখ করেন। এত অল্প সময়ে এই ধরনের বিশাল বোঝা বহন করা যে কোন দেশের জন্যই কঠিন।
.
মিসেস গান্ধী স্বীকার করেন ভারতের এই শরণার্থীদের জন্য একটি বড় অংকের অর্থ খরচ করতে হবে। এগুলো পরিকল্পনা কমিশন ও অন্যান্য বিভাগের দ্বারা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে সহায়তা পাওয়ার উপরও এটা নির্ভর করে। এ পর্যন্ত ভারত মাত্র ৩৬ মিলিয়ন ডলার গ্রহণ করেছে।

মিসেস গান্ধীকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তিনি আর্থিক দৈন্যতার কারণে পরিকল্পিত ৬০ কোটি রুপি বাজেট ঘাটতির জন্য এবং আন্তর্জাতিক মহলের অংশিদারিত্ত বাবদ উদ্বাস্তুদের জন্য কোন সহায়তা চাইবেন কিনা?

মিসেস গান্ধী বলেন, “আমি ব্যক্তিগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এটা শুরু করেছি। একটি প্রোগ্রাম কাজ করছে। “

তিনি এই ব্যাপারে ভারতের প্রেসের ভূমিকায় জোর দেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ প্রতি ভারতের মনোভাবে কোনো পার্থক্য আসবেনা। শুরু থেকে ভারত একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তির দাবি জানিয়ে আসছে। “আমি নিশ্চিত যদি সব বিশ্বশক্তিগুলোর প্রয়োজনীয় চাপ আগে থেকে দেয় তবে এটা(বন্দোবস্ত) সম্ভব হতে পারে। কিন্তু মনে হয় সে আশা সুদূর পরাহত।

মিসেস গান্ধী বলেন যতটুকু জানা যায় একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তি শেখ মুজিবুর রহমান ও তার আওয়ামী লীগের সদস্য যারা সাম্প্রতিক নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল তারা চায়। “তারা তাদের সিদ্ধান্ত নিতে চেয়েছিল”, বলেন তিনি।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২২। বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতের ভূমিকা বিশ্বে প্রশংসিত হচ্ছে – প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনাকালে শিল্পমন্ত্রীর অভিজ্ঞতার বর্ননা দৈনিক স্টেটসম্যান ১৮ জুন ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ২২, ৪৫-৪৬>

বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতের ভূমিকা বিশ্বে প্রশংসিত হচ্ছে
– প্রধানমন্ত্রীকে মঈনুল হক চৌধুরী
(আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি)

নয়াদিল্লি, ১৭ জুন; জনাব মইনুল হক চৌধুরী, শিল্প উন্নয়ন মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত বাংলাদেশের ব্যাপারে দেশের অবস্থান ব্যাখ্যা করার জন্য কিছু ইউরোপীয় দেশ সফর শেষ করে গত রাতে ফিরে আসেন। তাঁর অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, সুইডেন, হল্যান্ড এবং ইতালি সফরের ফলাফল তাকে জানান।

জনাব চৌধুরী এই সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে এসব দেশের মতামত জানান। ছয় মিলিয়ন শরনার্থির জন্য সৃষ্ট গুরুতর সমস্যার ব্যাপারে তাদের সাথে আলোচনা করা হয়েছে।

তিনি আশ্বাস পেয়েছিলেন যে তাদের মিত্রদের সাথে পরামর্শক্রমে বাংলাদেশ ইস্যুর রাজনৈতিক সমাধান আনা সম্ভব হবে।

এসব দেশে তার সফরে জনাব চৌধুরী বিভিন্ন দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাদের সাথে আলোচনা করেন। তিনি তাদের সঙ্গে শরনার্থিদের পরবেশের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি দেশেগুলকে মনে করিয়ে দেন যে শরনার্থিদের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক বিশ্ব সম্প্রদায়ের দায়িত্ব আছে।

মিস্টার চৌধুরী এসব দেশে বলেন যে পাকিস্তান ভারতের খরচে তার জনসংখ্যার খরচ থেকে পরিত্রাণ পেতে চেষ্টা করছে। এই আগ্রাসন একটি গুরুতর অপরাধ। নিজেদের জনসংখ্যা কমানোই একটি উদ্যেশ্য ছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাঙালি বুদ্ধিজীবি, রাজনীতিবিদ ও হিন্দু সংখ্যালঘুদের তারা হত্যা করছে।
তিনি বলেন বর্তমান সরকার পাকিস্তানকে বাংলাদেশে তাদের সামরিক কর্ম বন্ধ এবং রাজনৈতিক সমাধান চাওয়ার কথা বলেছে। তিনি বলেন বন্দুকের মুখে কিছু আদায় করা যায়না। দেশ গুলোকে বোঝানো হয়, যে গণহত্যা একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা; অতএব এটা সবার জন্যই উদ্বেগের বিষয়।

তিনি এসকল দেশকে অনুরোধ করেন যাতে তারা পূর্ববাংলায় একটি রাজনৈতিক সমাধান চাইতে এবং ছয় মিলিয়ন উদ্বাস্তুকে “সম্মান ও শান্তিতে বাড়ীতে ফিরে যেতে” যাবার পরিবেশ তৈরি করতে পাকিস্তানকে বাধ্য করে। সেখানে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। প্রতিরক্ষার জন্য পাওয়া অস্ত্র দিয়ে পাকিস্তান নির্দোষ এবং নিরস্ত্র নাগরিকদের হত্যা করছে। আন্তর্জাতিক দাতাসংস্থা ও দাতাদেশগুলোর পাকিস্তানকে দেওয়া সমস্ত মানবিক সাহায্য তত্বাবধান করা উচিত ও সেইসব ত্রাণ মানুষের কাছে পৌঁছানর বিষয় তাদের তত্ত্বাবধান করা উচিৎ। উল্যেখ্য, পূর্ববঙ্গে মর্মান্তিক ঘূর্ণিঝড় এর পরে এইড হিসাবে দেওয়া স্পিডবোট এখন সেখানে মানুষ হত্যা করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৩। বাংলাদেশের প্রশ্নে যে কোন শীর্ষ সম্মেলনের আগে অবশ্যই হত্যাকাণ্ড এবং নির্যাতন বন্ধ করতে হবে বলে শ্রীনগর সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা দৈনিক স্টেটসম্যান ২১ জুন, ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ২৩, ৪৭-৪৮>

পূর্ব বাংলার সম্মেলনে ভারতের শর্ত –
হত্যাকাণ্ড অবশ্যই বন্ধ করতে হবে – প্রধানমন্ত্রী

শ্রীনগর, জুন ২০, মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বলেন যেকোন সম্মেলনের আগে পূর্ববাংলায় গণহত্যা বন্ধ করতে হবে। – ইউ এন আই, পি টি আই।

কাশ্মীর ভ্যালিতে ২ দিনের ভিজিট শেষ করে ৩০ মিনিটের মত স্থায়ী একটি সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন যদি অন্য দেশের ডাকা কোন সম্মেলনে ভারতকে ডাকা হয় সেক্ষেত্রে এই শর্ত তাদের আগে মানতে হবে।

পূর্ববাংলায় ঘটিত সন্ত্রাসী কার্য কলাপের ফলশ্রুতিতে সেখান থেকে প্রচুর শরণার্থীর অনুপ্রেবেশ এর ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় তিনি বলেন তাদেরকে চিরদিন এভাবে ভারতে রেখে দেয়া যাবেনা।

বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহ উল্লেখ করে তিনি বলেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জানানো হয়েছে যে সেখানকার পরিস্থিতি বিপদসংকুল ও উদ্বেগজনক।

বাংলাদেশকে স্বীকৃতি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন – ‘এখনই নয়। ’ তিনি বলেন একটি অংশের জনমত এর পক্ষে থাকলেও এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সরকারীভাবে। কাজেই দেশের জন্য যা ভালো হবে এটা বিবেচনা করে সরকার তার মতামত জানাবে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে যা ঘটছে ভারত তার নজর রাখছে। এই মূহুর্তে এই সমস্যার কোন সমাধান তার কাছে নেই। তিনি বলেন, ‘আমি শুধু জানি তারা শরনার্থীদের এখানে থাকতে দিচ্ছে – অন্যদিকে আমরা চাচ্ছি সেখানে গণহত্যা বন্ধ করতে।

ভারতের পরিকল্পনা কি জানতে চাওয়া হলে হালকা চালে তিনি বলেন, ভারতের আবেদনে সাড়া দিতে যদি পাকিস্তান ব্যার্থ হয় তাহলে আমরা আগে পরিস্থিতি দেখব তারপরে প্রেসকে জানাব।

সম্প্রতি কাশ্মীর সহ কিছু বর্ডার এলাকায় যে পরিস্থিতি তাতে কি আপনি মনে করেন নিকট ভবিষ্যতে পাকিস্তান আক্রমণ করতে পারে?

মিসেস গান্ধী – ‘সন্দেহ আছে’

সর্বদয়া নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ সম্প্রতি একটি মন্তব্যে বলেন যে ভারত অযথা চীন ভীতির কারণে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তুলনামূলক ধীরে আগাচ্ছে – এই ব্যাপারে মিসেস গান্ধীর মতামত জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন ‘আমরা কাউকেই ভয় পাইনা, বিশেষ করে চীনকে। ’

গণভোট ফ্রন্ট

সম্প্রতি গণভোট ফ্রন্ট একজনের ট্রাইব্যুনাল করে বিচারে সাম্প্রদায়িক পক্ষপাত দেখিয়েছিলেন যার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার তাদের নিষিদ্ধ করার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার সম্ভবনা আছে কিনা জানতে চাওয়া হলে মিসেস গান্ধী বলেন এই প্রশ্নটি ওঠেনি কারণ সরকার ঐ ফ্রন্টের ব্যাপারে যে বিষয়টি তুলেছিল তা সমর্থন করে এবং নিষেধাজ্ঞা বলবত আছে।

একজন রিপোর্টার প্রশ্ন করেন তাহলে একই রকম অপরাধে অন্য একটি দলকে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হচ্ছেনা কেন? বিশেষ করে মিরাজ মওলানা ফারুকের নেতৃত্বে প্রো-পাকিস্তানী আওয়ামী একশন পার্টির যে অপসারণ দাবী প্রচার হয়েছে।

তিনি বলেন, তিনি এই বিষয়ে তেমন জানেন না। তবে তিনি বলেন কার নামে কে কি বলেছে তার চেয়ে আসলে কি ঘটেছে বা কি করেছে সেটাই মূল বিষয় হওয়া উচিৎ।

প্রধানমন্ত্রী বলেন কাশ্মীরের একটি স্থানীয় প্রেস বাংলাদেশ নিয়ে ‘মিথ্যা প্রচারণা’ করেছে। সেখানে বাংলাদেশ ও কাশ্মীরের তুলনামূলক অবস্থান তুলে ধরে মুখ্যমন্ত্রী জনাব জি এম সাদিক এর সঙ্গে জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে ব্র্যাকেটবন্দি করে সমালোচনামূলক সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে।

তিনি বলেন: এভাবে তুলনা করাটা খুব অযৌক্তিক। হয় সেখানে খুব বড় সমস্যা আছে অথবা এটা ইচ্ছাকৃত ভাবে করা হয়েছে অথবা দুইটাই।

গুরেজ ও টাংদারে তাঁর সফর সম্বন্ধে বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, কাশ্মির অনেক উন্নত ছিল। কিন্তু প্রগতির গতি এখনো পরিকল্পিত অর্থনীতির পূর্ণ সুবিধা লাভ করতে পারেনি। সেখানে অনেক প্রকল্প চলছে যা শিক্ষিত যুবকদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেবে।

মিসেস গান্ধী বলেন, কাশ্মিরকে পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করা যায়না। কারণ এটি অনেক অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করেছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের জনগণ টিকে আছে মিথ্যা অপপ্রচারের উপর এবং তাদের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা হচ্ছে।

সরকার সেখানে “নকশাল ভীতি” নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে কিনা জানতে চাওয়া হলে, মিসেস গান্ধী উত্তর দিয়েছিলেন: “পুরোপুরি না; সমস্যা এখনও বিদ্যমান”

সরকারের যে “গরিবি হটাও” পরিকল্পনা ছিল সে ব্যাপারে মিসেস গান্ধী জানান সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে এবং হাতে এখনও কিছু পদক্ষেপ আছে। যেহেতু ব্যাংক জাতীয়করণ হচ্ছে তাই এই ব্যাপারে ব্যাবস্থা নেয়াও শুরু হয়েছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৪। পাকিস্তান যুদ্ধ চাপানোর চেষ্টা করছেঃ প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য দৈনিক যুগান্তর ২১ জুন, ১৯৭১

Aparajita Neel
<১২, ২৪, ৪৯>
পাক জঙ্গীশাহী যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার অবস্থা সৃষ্টি করছে
প্রতিরক্ষামন্ত্রী

জলন্ধর, ২০ জুন – প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রী জগজীবন রাম আজ সেনাবাহিনীর অফিসার ও জওয়ানদের বলেছেন, পাকিস্তানী জঙ্গিশাহির বেপরোয়া কাজের ফলে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হোক তাঁর মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

শ্রী জগজীবন রাম এখানে সেনাদের কাছে বলেন যে, পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলে ভারতের সীমান্ত লঙ্ঘন করছে। ‘আমরা শান্তিকামী, যুদ্ধ চাই না। কিন্তু আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার মত পরিস্থিতিই পাকিস্তান সৃষ্টি করছে। ‘

তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে ব্যাপক হারে শরনার্থি ভারত আসায় বহু সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। শরনার্থিদের দেখাশোনার দায়িত্ব ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গে সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশের লোকদের ভারত আসতে বাধ্য করে পাকিস্তান ‘দুরভিসন্ধিমূলক আগ্রাসন’ ঘটিয়ে যাচ্ছে। এর পরিণাম ভয়াবহ হতে বাধ্য।

প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, ভারতীয় সৈন্যরা যে কোন আগ্রাসন মোকাবিলায় পূর্বাপেক্ষা ভালোভাবে প্রস্তুত। শিল্পেও উন্নতি ঘটছে। অস্ত্র কারখানাগুলিতে প্রয়োজনীয় সব জিনিসই তৈরি হচ্ছে।

তিনি বলেন, সৈন্যরা যে কঠিন পরিস্থিতিতে কাজ করছেন এবং বসবাস করছেন সরকার তা জানেন। তাদের বেতন বাড়াতে এবং তাদের জন্য আরও বাড়িঘর নির্মান করতে সরকার সচেষ্ট। তবে প্রয়োজন অনুযায়ী সম্পদ দেশের নেই, একথাও মনে রাখতে হবে।

তিনি একদিনের সফরে এখানে আসেন, এখানকার হাসপাতালটিও পরিদর্শন করেন।
– পি টি আই ও ইউ এন আই

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৫। পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধের প্রশ্নটি কয়েকটি দেশ বিবেচনা করছে বলে লন্ডনে পরিরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি দৈনিক আনন্দবাজার ২৩ জুন, ১৯৭১

Abu Jafar Apu
<১২, ২৫, ৫০>

পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধ সম্পর্কে বিশ্ব রাষ্ট্রগুলি বিবেচনা করছে -শরণ সিং

লন্ডন, ২২শে জুন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী শরণ সিং গতকাল সন্ধায় এখানে বলেন যে, গত এক পক্ষকাল হতে যে কয়েকটি দেশ তিনি সফর করেছেন সেই কয়েকটি দেশের সরকার পাকিস্তানকে সাহায্যদান বন্ধ করার কথা বিবেচনা করছেন।

শ্রী সিং বিশ্বের যে ছয়টি রাষ্ট্র সফর করে এসেছেন সেই কয়টি রাষ্ট্র বর্তমান পরিস্থিতিতে পাকিস্তানকে সাহায্যদান বন্ধের কথা সম্মত হয়েছে কিনা, সাংবাদিক সম্মেলনে এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন যে, ঘরোয়া ভাবে তাকে যে বলা হয়েছে যেসব কথা তিনি প্রকাশ করতে পারেন না, তবে তিনি একথা বলতে পারেন যে, দুটি কারনে কয়েকটি রাষ্ট্র পাকিস্তানকে সাহায্যদান বন্ধের কথা বিবেচনা করছে।

প্রথমত: পাকিস্তান নিজের দোষে অর্থনৈতিক সংকট করেছে এই অবস্থায় সাহায্যদান সেখানে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয়ত: এই রাষ্ট্রগুলো মনে করে যে বর্তমানে করলে সংখ্যালঘু প্রশাসন সেই সাহায্য সংখ্যাগুরুকে দমনের কাজে লাগাবে।

এর আগে সফরের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে শ্রী শরণ সিং বলেন যে, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির মূল কারন এবং সমস্যাগুলি কি তা সংশ্লিষ্ট সরকার রাষ্ট্রসংঘ সংস্থা এবং বেসরকারী নেতৃবৃন্দ ও সংবাদপত্র সহ এইসব রাষ্ট্রের জনগনকে অবহিত করার উদ্দেশ্যেই তিনি এই সফর করেছেন।
শ্রী শরং সিং বলেন যে, এই সমস্যার মূল কারন হচ্ছে যে, প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত গনতান্ত্রিক নির্বাচনের ট্যারিফ পদ্ধতিতে এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের দ্বারা দমন নীতি চালিয়ে বাতিল করে দিতে চাওয়া হয়েছে। এর ফলে ব্যাপক গনহত্যা হয়েছে এবং লক্ষ লক্ষ মুসলমান, হিন্দু খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধ নিজেদের ঘরবাড়ী ছেড়ে ভারতীয় এলাকায় চলে এসেছে। শ্রী সিং বলেন যে, তাঁদের কাছে নিশ্চিত প্রমান আছে যে, কোন কোন এলাকায় পরিকল্পিতভাবে হত্যা চালিয়ে সেই এলাকায় অধীবাসিদের উৎখাত করা হয়েছে।

শ্রী সিং বলেন যে, প্রশ্ন হচ্ছে যে, এই পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশ্বরাষ্ট্রগুলির কি মনোভাব হওয়া উচিত? ৬০ লক্ষ লোক শুনতে খুব বেশী নয়, কিন্তু যেখানে এই ৬০ লক্ষ লোক আসে সেখানকার অবস্থা সাংঘাতিক হয়ে দাঁড়ায়। যে দেশের জনসংখ্যা এমনিতেই বেশী এবং সেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা রেয়েছে সেখানে উদ্বাস্তুদের এই রকম ব্যাপক আগমন হলে যে সমস্যার উদ্ভব হয়, অর্থের ভিত্তিতে তার সমাধান সম্ভও নয়। শ্রী সিং বলেন যে, পরিস্থিতি ক্রমেই আরো সংকটজনক হয়ে উঠছে উন্নতির কোন আভাস নেই। বিশ্বের রাষ্ট্রগুলির প্রধান মনোভাব এই হওয়া উচিত যাতে পাকিস্তানে বর্তমান বিপরীত অবস্থা সৃষ্টি হয়, উদ্বাস্তু আগমন বন্ধ হয় এবং এখানকার অবস্থার এমন পরিবর্তন হয় যাতে উদ্বাস্তুদের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা সম্পর্কে আস্থা ফিরে আসে। বিশ্বের রাষ্ট্রগুলির যাতে এই বিষয়ে দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়, সেই উদ্দেশ্যেই তিনি এই সফরে বেরিয়েছেন।

শ্রী সিং বলেন যে, কেউ যদি এই সমস্যার প্রতি গভীরভাবে দৃষ্টি দেন তাহলে তিনি বুঝতে পারবেন যে, বর্তমান পরিস্থিতির উপর জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কোন নিয়ন্ত্রন ক্ষমতা নেই। উদ্বাস্তুদের বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার আহবান জানিয়ে ইয়াহিয়া খান ২২শে মে যে বিবৃতি দিয়েছিলেন তারপরও ২০ লক্ষ উদ্বাস্তু ভারতে এসেছে। এ থেকে বোঝা যায় যে, যে পরিস্থিতিতে উদ্বাস্তুরা বাড়ীঘর ছেড়ে ভারতে এসেছে, সেই পরিস্থিতি এখনও বর্তমান – সেখানে এখনও আস্থার সংকট রয়েছে।

সুতরাং বর্তমান অবস্থায় বাংলাদেশে যাদের হাতে আইন ও শৃঙ্খলার ভার রয়েছে তাঁরা যদি জনগনের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করতে পারেন তাহলেই উদ্বাস্তুদের আবার স্বদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

শ্রী সিং বলেন যে, শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর আওয়ামী লীগ দলের শুধু পূর্ববঙ্গেই নয়, সমগ্র পাকিস্তানেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। সুতরাং তাদের সঙ্গেই একটা রাজনৈতিক মীমাংসায় আসতে হবে, যাতে জনগনের প্রতিনিধিরা সরকার গঠন করতে পারেন। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষকে বাংলাদেশ অধিবাসীদের সঙ্গে একটা মিমাংসায় পৌঁছতে হবে। বাংলাদেশের পক্ষে একমাত্র নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই কথা বলতে পারেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্ব রাষ্ট্রগুলির কর্তব্য হচ্ছে পাকিস্তানের উপর সম্ভাব্য সর্বপ্রকার চাপ সৃষ্টি করা। এবং পাকিস্তান সরকারকে সুস্পষ্টভাবে বলা যে বাংলাদেশে অত্যাচার চালানোর অর্থই জনগনের অধিকারের উপর অত্যাচার এবং এই অত্যাচার বন্ধ করতে হবে।

শ্রী সিং বলেন যে, পাকিস্তানকে সর্বপ্রকার সরকারী এবং বেসরকারী সাহায্যদান বন্ধ করতে হবে, কেননা এই সাহায্য পেলে পাকিস্তান অত্যাচার চালিয়ে যেতে উৎসাহিত হবে এবং এই মর্মম্ভদ অবস্থা দীর্ঘায়িত হবে। পাকিস্তান যাতে রাজনৈতিক মীমাংসায় বাধ্য হয় সেজন্য চাপ সৃষ্টি করতে হবে।

– পি টি আই

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৬। জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে ভারত সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি ডঃ করন সিংয়ের সফর শেষে প্রকাশিত ইন্দো জি ডি আর যুক্ত বিবৃতি ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২৪ জুন, ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ২৬, ৫২-৫৩>

জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে ভারত সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি ডঃ করন সিংয়ের সফর শেষে প্রকাশিত ইন্দো-জি ডি আর যৌথবিবৃতি, ২৪ জুন ১৯৭১

২২ থেকে ২৪ জুন, ১৯৭১ ডঃ করণ সিং, পর্যটন ও বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রী, পূর্ব পাকিস্তানে বিয়োগান্তক ঘটনা থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য জিডিআর সরকারের সাথে আলোচনা করতে জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক ভিজিট করেন।

জিডিআর থাকাকালিন, মন্ত্রী ডঃ করণ সিং কে জিডিআর এর মন্ত্রী পরিষদ এর চেয়ারম্যান উইলি স্টপ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী অটো উইনজার সাদরে গ্রহণ করেন।

এছাড়াও তিনি পরিবহন মন্ত্রী, অটো আর্ন্ডট এর সঙ্গে বৈঠক করেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধীর পক্ষ থেকে মন্ত্রী ডা করণ সিং পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক গুরুতর সমস্যা নিয়ে ভারতের মনোভাবের কথা মন্ত্রী পরিষদের চেয়ারম্যান ও ডেনমার্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে অবহিত করেন।

ভারতীয় মন্ত্রী জার্মানির রাজনৈতিক অবস্থান ও সেইসাথে মানবিক সহায়তা প্রদানের প্রশংসা করেন। এতে উদ্বাস্তুদের সমস্যার সঙ্গে সহানুভূতি ও সংহতি প্রকাশ হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন যা ছিল পাকিস্তানী মিলিটারি একশনের ফল। ২১ মে, ১৯৭১ সালে প্রধানমন্ত্রী উইলি স্টপ এর ইন্দিরা গান্ধিকে লেখা চিঠির কথা মনে করিয়ে দিয়ে মন্ত্রী পুনর্ব্যক্ত করেন জিডিআর ভারত যে ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করছে সেটিকে আগের মত আমলে নেবে এবং জরুরীভাবে যে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি হতে যাচ্ছে তা শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের ব্যাপারে সমর্থন বলবত রাখবে।

ভারতীয় মন্ত্রী সমস্যা কতটা জরুরী ও তাতপর্যবহ তা ব্যাখ্যা করেন। পূর্ববঙ্গ থেকে প্রতিনিয়ত লাখ লাখ শরণার্থী দেশে আসা অব্যাহত রেখেছেন এবং তাদের সংখ্যা প্রায় ৮ মিলিয়নে এসে দাঁড়িয়েছে। এতে করে ঐ এলাকার শান্তিরক্ষা ও ভারসাম্য রক্ষা করা কষ্টকর হয়ে পড়ছে এবং এর ফলে তা ভারত-এর জন্য গুরুতর সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে।

উভয় পক্ষ সমস্যার নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেন এবং তারা একমত হন যে উদ্ভূত পরিস্থিতির বাস্তবমুখী ও সঠিক সমাধান করার একমাত্র পথে হচ্ছে শরনার্থিদের ফিরে যাবার জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা। তার একমাত্র পথ হচ্ছে পূর্বপাকিস্তানের জনগণ ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করে তাদের মত অনুযায়ী ব্যাবস্থা গ্রহণ।

ভরত মনে করে শরণার্থীদের অনুপ্রবেশ একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। জি ডি আর মন্ত্রীদের কাউন্সিলের সভাপতি ভারতের অবস্থানকে সমর্থন জানান। তিনি জার্মান ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিকের পক্ষ থেকে তার অবস্থান প্রকাশ করেন এবং ঘোষণা দেন যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে পালিয়ে আশা শরনার্থিদের সাহায্যে বাবদ তারা ৬ মিলিয়ন মার্ক বা ১ কোটি রুপি দেবেন।

আন্তর্জাতিক শান্তি ও প্রবৃদ্ধি বজায় রাখার স্বার্থে উভয়ে পরস্পর যোগাযোগ রাখার ব্যাপারে একমত হন।

উভয়ে আঞ্চলিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন এবং জি ডি আর এর সাথে ভবিষ্যৎ সুসম্পর্ক ও বোঝাপোড়া বজায় রাখার ব্যাপারে আলোচনা করেন।

উভয় পক্ষ মনে করেন যে ডঃ করণ সিং এর ভিজিটের ফলে দুই দেশের বন্ধুত্তপূর্ন সম্পর্ক ও সহযোগিতা আরও ফলপ্রসূ হবে।

ভারতীয় মন্ত্রী অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক কল্যাণের ক্ষেত্রে জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক এর সাফল্যের প্রশংসা করেন। এবং জি ডি আর এর পররাষ্ট্র মন্ত্রীর কাছ থেকে ইউরোপের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অবস্থা নিয়েও আলোচনা করেন। তাছাড়া তিনি তার আগমন উপলক্ষয়ে তাকে দেয়া উষ্ণ অভ্যর্থনা ও আতিথেয়তার জন্য সার্বিকভাবে ধন্যবাদ জ্ঞ্যাপন করেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৭। বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধানই সংকট নিরসনের একমাত্র পথ – পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি দৈনিক হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড ২৬ জুন, ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ২৭, ৫৪-৫৫>

বাঙ্গালীর কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধানই সংকট নিরসনের পথ বলে মনে করে বিশ্বশক্তিগুলো – সিং
(বিশেষ প্রতিবেদক)

নয়াদিল্লি, জুন-২৫, মন্ত্রী জনাব শরণ সিং, আজ সংসদে বলেন যে সম্প্রতি তিনি কয়েকটি দেশ পরিদর্শন করেন এবং তারা মনে করে পূর্ববাংলার জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য এমন কোন পদক্ষেপ নিলেই কেবল মাত্র উদ্ভূত পরিস্থিতি সমাধান করা সম্ভব।

আরও কিছু বিষয় চুক্তিতে উঠে আসে। (১) বাংলাদেশে সব রকম সামরিক কর্ম অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে, (২) বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু প্রবাহ অবিলম্বে অবশ্যই বন্ধ করতে হবে (৩) শান্তি ও নিরাপত্তার মধ্যে তাদের বাড়িতে ফিরে আসার অবস্থার সৃষ্টি করা আবশ্যক। এতে করে শরণার্থীরা বাংলাদেশে তাদের নিজ নিজ বাড়িতে নিরাপদে যেতে পারবে। (৪) বর্তমান পরিস্থিতি ভয়াবহ, এবং তা এ অঞ্চলে শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য ঝুকিপূর্ন।

যারা তার বিদেশে সফরের ব্যাপারে সংসদের উভয় কক্ষের একটি বিবৃতি দেন। তিনি বলেন বিশ্বনেতারা এটা একমত হয়েছিলেন যে পূর্ববাংলা থেকে এই দেশের অভ্যন্তরে ছয় মিলিয়ন উদ্বাস্তুর এই বিশাল অন্তঃপ্রবাহ দ্বারা ভারত সরকারের জন্য অসহনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই ব্যাপারে অর্থ ও অন্যান্য সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছে।

তিনি দেখেছেন যতগুলো দেশে ভ্রমণ করেছেন সেখানকার সবাই উদ্বাস্তুদের এই বৃহৎ অন্তঃপ্রবাহ দেখাশোনার ব্যাপারে ভারত সরকার ও ভারতের জনগণের দ্বারা প্রদর্শিত সেবা অত্যন্ত প্রশংসা কুড়িয়েছে। এহেন পরিস্থিতি যা মানব ইতিহাসে নজিরবিহীন হিসাবে স্বীকৃত ছিল। মনুষ্যসৃষ্ট এই দুর্যোগে এই দেশে আসা পূর্ববাংলার জনগণের জন্য এখানকার পরিস্থিতিও গুরুতর আকার ধারণ করেছে। এটি আমাদের উপর একটি বিশাল বোঝা। এর ফলে এই অঞ্চলের শান্তি এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছেনা – সেটি তাদের অবগত করা হয়েছে।

মন্ত্রী এটা স্পষ্ট করেন যে, পূর্ববাংলা থেকে উদ্বাস্তু দের দেয়া সাহায্য মূলত পাকিস্তানকে সাহায্য করা। কারণ তারা সেই দেশের নাগরিক। যদিও তারা তাদের নিজেদের সরকার কর্তৃক এই পরিণতি ভোগ করছে।

মন্ত্রি বলেন, আমি এও বলেছিলাম যে, বাংলাদেশের নির্যাতিত জনগনকে আন্তর্জাতিক নজরদারির মাধ্যমে দেয়া মানবিক সহায়তা ছাড়া অন্য যে কোন ধরনের অর্থনৈতিক সহায়তা দিলে সেটা কেবল সেদেশের সংখ্যালঘু সামরিক জান্তা, যারা সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর উপর অত্যাচার চালাচ্ছে, তাদেরকে ক্ষমতায় থাকতে সহায়তা করবে, এবং এটা হবে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে একটি দুর্ভাগ্যজনক হস্তক্ষেপ।

আমি উল্লেখ করি যে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপে যে দেখা গেছে সেখানে মিলিটারি জান্তারা কি বীভৎসতা চালাচ্ছে। ফলে এখানে যে কোন ধরণের আর্থিক সহায়তা পরিস্থিতির সমাধানের প্রতিকূলে যাবে।

আমি আরো বলেছিলাম, মানবিক বিবেচনায় বাংলাদেশের নির্যাতিত জনগণের স্বার্থে দেয়া আর্থিক সহায়তা ব্যাতীত অন্য যেকোন অর্থনৈতিক লেনদেন কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ নিপীড়নে নিয়োজিত সামরিক জান্তাকেই প্রভাবিত করবে এবং এটি তাদের আভ্যন্তরীন বিষয়ে একটি দুর্ভাগ্যজনক হস্তক্ষেপ হিসেবেই গণ্য হবে।

৬ জুন থেকে ২২ জুনের মধ্যে, জনাব সিং মস্কো, বন, প্যারিস অটোয়া, নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন এবং লন্ডন সফর করেন। এসব রাজধানীতে প্রতিটি সরকার প্রধান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেন। U.N. মহাসচিব এবং তার সহকর্মীরা আলোচনায় ছিল। তিনি সরকারের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ, সম্পাদক, সমাজকর্মী ও নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

মন্ত্রী বলেন, এই আলোচনায় পূর্ববাংলা থেকে ছয় মিলিয়ন উদ্বাস্তু আসায় আমাদের অঞ্চলে সৃষ্ট অব্যাহত সঙ্কটের ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষন ও জোর দেয়া হয়। পূর্ব পাকিস্তানে পাকসেনা কর্তৃক সংগঠিত ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের জন্য উদ্বাস্তুদের এই অনুপ্রবেশ হচ্ছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৮। বাংলাদেশ প্রশ্নে কোন হঠকারী নীতি নয় – প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা দৈনিক কালান্তর ৩০ জুন, ১৯৭১

Aparajita Neel
<১২, ২৮, ৫৬>

বাংলাদেশের ব্যাপারে সরকার হঠকারী নীতি নেবেনা
শ্রীমতী গান্ধী

নয়াদিল্লী, ২৯ জুন (ইউ এন আই) – বাংলাদেশের ব্যাপারে সরকার কোন হঠকারী নীতি নেবেনা। আজ কংগ্রেস পার্লামেন্টারি পার্টির এক সভায় ভাষণদানকালে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এই কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, এই রকম একটি সূক্ষ্ণ সমস্যায় কোন সরকারই অগ্র পশ্চাৎ বিবেচনা না করে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেনা।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক তৎপরতার নৈরাশ্যজনক ছবি উপস্থিত করায় শ্রীমতী গান্ধী দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে পাকবাহিনীর নরহত্যা অথবা এর ফলে ভারতের নিরাপত্তা ও অর্থনিতিতে প্রশ্নটা বিশ্বের রাজধানীগুলিতে বোঝানো হয়নি বললে সদস্যরা ভুল করবেন।

প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, সদস্যরা তাদের নির্বাচনি কেন্দ্রে ফিরে কেন বাংলাদেশের সমর্থনে জনমত সংগঠিত করছে না। ত্রাণের কাজে জনসাধারণের সহযোগিতা আদায়ে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

ইতিপূর্বে শ্রী নাগী রেড্ডী বলেন, ভারতের বিরুদ্ধে বৃহৎ শক্তিগুলি চক্রান্ত করছে। শারনার্থিদের সংখ্যা এক কোটিতে পৌঁছাতে পারে। ভারতের উচিৎ কঠোর পন্থা অবলম্বন করা।

পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের পূর্ব বাংলা থেকে সাময়িকভাবে হটিয়ে দিতে হবে, এই কথা বলেন শ্রী মহাজন।

অন্যদিকে শ্রী প্রবোধ চন্ত্র পুরোকায়েত অভিযোগ করেন চীন আতংকের জন্য ভারত সরকার সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছেনা।

তিনি বলেন, প্রতিনিধি পাঠিয়ে বিদেশী রাষ্ট্রকে প্রভাবান্বিত করা যাবেনা কারণ তারা নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী নীতি নির্ধারন করে থাকে। তিনি মন্তব্য করেন, আমরা যুদ্ধ সম্পর্কে কথাবার্তা নাও বললে পারি কিন্তু আমাদের যুদ্ধ ভীতি থাকলে চলবে না।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৯। জাতিসঙ্ঘের ইকনমিক এন্ড সোশাল কাউন্সিলে ভারতীয় পর্যবেক্ষকদলের নেতা এন কৃষ্ণের ভাষণ ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৯ জুলাই, ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ২৯, ৫৭>

৯ জুলাই, ১৯৭১ তারিখে রাষ্ট্রদূত এন কৃষ্ণান, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের ৫১ তম অধিবেশনে ভারতীয় অবজারভার ডেলিগেশনের নেতা হিসেবে বিবৃতির চুম্বক অংশ

গত কয়েক বছর ধরে ভারতে আশাপ্রদ প্রবৃদ্ধি থেকে বোঝা যাচ্ছে এটি একটি টেকসই ও সারগর্ভ অগ্রগতির দিকে যাচ্ছে। এবছর ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর আমাদের সরকার আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার মোকাবেলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু পূর্ব বাংলার ঘটনার ফলে সেখান থেকে উদ্বাস্তুদের একটি বৃহৎ অন্তঃপ্রবাহ আমাদের উন্নয়নের ছন্দকে বড় সমস্যায় ফেলেছে। ইতিমধ্যে জুন শেষে তার সংখ্যা ৬.৩ মিলিয়ন এ পৌঁছেছে। এটা স্পষ্ট যে, খাদ্য, আশ্রয় ও তাদের ওষুধ প্রদানের কাজটি অবশ্যই অগ্রাধিকার পাবে। এমনকি এই উদ্দেশ্যে বর্তমান বছরের জন্য আমাদের বাজেটে এই খাতে ৮০ মিলিয়ন রুপি বরাদ্দ রাখা হয়েছে এবং যার জন্য আমাদের জনগণের ওপর ৩০ শতাংশ অতিরিক্ত করের বোঝা চাপানো হয়েছে। আমরা আমাদের বোঝা মোকাবিলার জন্য জাতিসংঘ ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি সহানুভূতিশীল হবার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। যাইহোক, এখনও উদ্বাস্তুদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যার সাথে মিলিয়ে ত্রাণ চাহিদা দিতে হবে। কিন্তু এটি শুধুমাত্র একটি অস্থায়ী সমাধান হতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অনুধাবন করেছে এর থেকে নিষ্কৃতি পেতে হলে আগে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে হবে। তেমন পরিবেশ সৃষ্টি হলে ও তারা তাদের নিরাপত্তার আশ্বাস পেলে তাদের মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করার আশা সৃষ্টি হবে এবং ফিরে যাওয়া ত্বরান্বিত হবে।

আমাদের প্রতিনিধিদল কৃতজ্ঞ যে যুগোস্লাভিয়া ও নিউ জিল্যান্ড পরিষদের চলতি অধিবেশনে এটা নিয়ে আলোচনা করার প্রস্তুতি শুরু করেছে। তাছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইউ.কে. হাঙ্গেরি, নরওয়ে এবং অন্যদের প্রতিনিধিরাও তাদের বিবৃতি প্রকাশ করার সময় এই বিষয়টি আলোচনায় এনেছিলেন। আমরা তাদের সবার কাছে কৃতজ্ঞ। আমরা আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করছি উদ্বাস্তুদের জন্য ইউ এন হাইকমিশনার আগামী সপ্তাহে পরিষদে বিবৃতি দেবেন। আমরা নিশ্চিত যে, আলোচনার ফলে উদ্বাস্তুদের ত্রাণ চাহিদা পূরণ এবং তাদের দ্রুত এবং স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনএর ব্যাপারে আরো মনোযোগ বৃদ্ধি পাবে। আমরা আশা করি ECOSOC সমস্যা বিবেচনা করে তার সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করবেন এবং একটি টেকসই ও স্থায়ী সমাধান দেবেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩০। প্রতিরক্ষা বাহিনীকে প্রস্তুত থাকতে হবে – প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর বক্তৃতা দৈনিক হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড ২০ জুলাই, ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ৩০, ৫৮>

পিণ্ডির “কুচক্রী আক্রমণ” হতে পারে – জে রাম
“টাইমস অফ ইন্ডিয়া” সংবাদ সেবা

বোম্বে, জুলাই ১৯- প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, জনাব জে রাম বলেছেন যে পাকিস্তান বাংলাদেশে ‘কুচক্রী আগ্রাসন” চালাচ্ছে এবং সেখান থেকে লাখ লাখ মানুষ তাড়িয়ে দিচ্ছে।

তিনি আইএনএস “ভিক্রান্ত” বোর্ডে কর্মকর্তা ও পশ্চিমা নৌ কমান্ডের নাবিকদের সামনে ভাষণ দিচ্ছিলেন।

পিটিআই যোগ করে: বাংলাদেশের মধ্যেকার ঘটনার জন্য ভারতের নিজস্ব নিরাপত্তা প্রস্তুতি জরুরী। অবশ্যই, পাকিস্তান ও চীন থেকে নিরাপত্তা হুমকি আসতে পারে। মন্ত্রী বলেন, জনগণ সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষমতার উপর পূর্ণ আস্থা রাখে। দেশের দীর্ঘ তটরেখা নৌবাহিনীর হাতে নিরাপদ।

জনাব জগজীবন রাম বলেন ভারত বাংলাদেশের থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের দেখাশোনা করছে। কিন্তু তারা ফিরে যাবে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে, মুজিবুর রহমানের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে মুক্ত করতে। তিনি আত্মবিশ্বাসী যে মুক্তি বাহিনী চূড়ান্তভাবে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে সক্ষম হবে।

জনাব রাম বলেন আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানের অনুপ্রবেশের ব্যাপারে সজাগ আছে।

মন্ত্রী কে ভাইস অ্যাডমিরাল এস এন কোহলি FOC-ইন-সি, ওয়েস্টার্ন কমান্ড স্বাগত জানান।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩১। জাতিসঙ্ঘের মহাসচিবের সহকারীকে প্রদত্ত ভারতের জবাব ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২ আগস্ট, ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ৩১, ৫৯-৬২>
অনুবাদ

জাতিসঙ্ঘের মহাসচিবের সহকারীকে প্রদত্ত ভারতের জবাব
২ আগস্ট, ১৯৭১

১। ভারত সরকার জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের দৃষ্টিগোচর করে যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে শরণার্থীদের আগমন তাদের জন্য পরম উদ্বেগের ব্যাপার। পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক নৃশংসতা দ্রুত বন্ধ করা জরুরী। দৈনিক ৪০০০০ থেকে ৫০০০০ উদ্বাস্তু ভারতে প্রবেশ করছে। নৃশংসতা চলতে থাকলে এদের দেশ ছেড়ে ফিরে যাবার সম্ভবনাও কম। ভারত সরকার ইতোমধ্যে উদ্বাস্তু ফেরত পাঠানোর জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে – এর সংখ্যা এখন চার মিলিয়ন হয়ে গেছে। গত ২৫ মে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বিবৃতি দিয়েছেন যে তিনি পাকিস্তানি নাগরিকদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেবেন।

২। ভারতে সাত লক্ষেরও বেশি উদ্বাস্তু আছে। দৈনিক দেশত্যাগ এখনও অব্যাহত আছে। এর মূল কারণ পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি। বিশৃঙ্খলা ও সামরিক দমন এবং পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ হত্যা অপ্রতিহতভাবে অব্যাহত আছে। আন্তর্জাতিক প্রেসে তা স্পষ্ট। এই বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক রিপোর্ট ও স্বাধীন বিদেশী পর্যবেক্ষকরা ভারতে তাদের ক্যাম্পে সফর এবং উদ্বাস্তুদের থেকে দুঃখের কাহিনী শুনে নিজেরাই বিবৃতি দিয়েছেন।

৩। উদ্বাস্তুদের সংখ্যা এখনও প্রতিদিন বাড়ছে। লক্ষ লক্ষ লোকদের দেখাশোনা করা ভারত সরকারের উপর বোঝা। এটা সবাই লক্ষ্য করেছেন। তাছাড়া পাকিস্তান পর পর দুটি বিপর্যয় সামলাতে পারছেনা- একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ অন্যটি মানুষসৃষ্ট। ফলে পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও প্রশাসনিক ব্যার্থতা প্রকট হচ্ছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতির উত্তরণেও এটা বাঁধা হয়ে আছে। পূর্ব পাকিস্তানে একটি উন্নত রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হলে ভারত থেকে শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে চিন্তা করা সম্ভব। দেশের অখন্ডতা রক্ষা ও স্বনিয়ন্ত্রণের মূলনীতির মধ্যে যে সঙ্ঘর্ষ তা বিশেষ ভাবে প্রতিভাত হচ্ছে পুর্ব পাকিস্তানে, যেখানে সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী নিপীড়িত হচ্ছে একটি সংখ্যালঘু সামরিক শাসনের হাতে, যারা গত বছরের ডিসেম্বরে তাদেরই নিজেদের দেয়া নির্বাচনের ফলাফল অস্বীকার করছে, এবং সাড়ে সাত কোটি মানুষের উপর নির্বিকার হত্যাকাণ্ড, গনহত্যা ও সাংস্কৃতিক দমন চালাচ্ছে।

৪। প্রিন্স সদরুদ্দিন ভারতের প্রধান মন্ত্রিকে কিছুদিন আগে বলেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানা ভাষার, নানা পেশার কর্মীদের আনলে শরনার্থিদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে। ইউএনএইচসিআর ১৬ জুলাই জেনেভায় অনুষ্ঠিত ECOSOC সভায় সীমান্তে উদ্বাস্তুদের জন্য কোন পরামর্শ দেয় নাই। বর্ডারের উভয় পাশে হাই কমিশনারদের প্রতিনিধি দেয়া হলে শরনার্থিদের ফিরে যাওয়া তরান্বিত হবে কিনা সে ব্যাপারে তিনি কিছুই বলেন নাই।

৫। এই পরিস্থিতিতে ভারত সরকার সীমান্তের ভারতীয় অংশে কিছু লোককে পোস্টিং দেবার উদ্যেশ্য বুঝতে পারছেনা। আমরা মনে করি এতে করে উদ্বাস্তুরা বাড়ী ফিরে যাবেনা। তাছাড়া তারা পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ দ্বারা নির্বিচারে গণহত্যার মুখোমুখি হবে। পাশবিক বল প্রয়োগের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের ৭৫ মিলিয়ন মানুষ এখন নির্যাতিত। এতে সেখানে বিরাজমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক বাস্তবতার প্রকাশ হয়। পাক সরকার উদ্বাস্তুদের ফিরে যাবার পরিবেশ সৃষ্টি করেনি। বরং এটাকে অসম্ভব কঠিন করে দিয়েছে। তারা ইচ্ছা করে ভারতে অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে।

৬। উদ্বাস্তুদের প্রবেশে বাঁধা দেবার কোন ইচ্ছা ভারতের নেই। আমরা তাদের দ্রুত নিরাপদে ফিরে যাওয়া নিয়ে শঙ্কিত। এই প্রেক্ষাপটে, UNHCR এর সেক্রেটারি জেনারেল ৩০শে জুন বিবৃতি দেন ভারতের অভিযোগ উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবর্তন বাধা গ্রস্ত হচ্ছে। প্রিন্স সদরুদ্দিন বলেন হোস্ট সরকারের বিপক্ষে কোনো প্রমাণ নেই যে তারা শরণার্থীদের বাধা দিচ্ছেন। আবার প্যারিসে এক প্রশ্নের জবাবে ১০ জুলাই প্রিন্স বলেন, এটা বলা ঠিক হবেনা যে ভারত তাদের প্রবেশে বাঁধা দিচ্ছে। ১৯ জুলাই, কাঠমান্ডুতে ব্রিটিশ সংগঠন “ওয়ার্ণ ওয়ান্ট” পাকিস্তানের বিবৃতিকে “আবর্জনা” বলে আখ্যায়িত করেছে। কারণ পাকিস্তান বলেছে ভারত উদ্বাস্তুদের রেখে দিচ্ছে ইচ্ছা করে এবং তাদের ফিরতে দিচ্ছেনা। কলকাতায় ২২ জুলাই, জনাব ম্যানফ্রেড ক্রস, একজন অস্ট্রেলিয়ান এমপি, পাকিস্তানের কথাকে “অসম্ভব” বলে উড়িয়ে দেন। যুক্তরাষ্ট্রের হাউজের প্রতিনিধি মাননীয় কর্ণেলিয়াস ই গ্যালাঘের ১০ জুলাই বলেন পাকিস্তানের সৃষ্ট সংকট ভারত সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সামলাচ্ছেন। তারা অবিশ্বাস্য সংযম দেখিয়ে যাচ্ছেন। তারা উদ্বাস্তুদের সাহায্য ও সমবেদনা দেখাচ্ছেন। সত্যি করেই বলা যায় এই সরকার নৈতিক ও মানবিক আচরণ করছেন। যেদিন প্রথম উদ্বাস্তু বর্ডার অতিক্রম করেছে সেদিন থেকেই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সরকার সুনাম অর্জন করে চলেছেন। উদ্বাস্তুদের অনুপ্রবেশের সংখ্যা দেখলেই বোঝা যায় পাকিস্তান সরকার নির্বাচনে জয়ী না হতে পেরে তাদের উপর কি পরিমাণ পেষন ও নৃশংস নীতি অবলম্বন করছেন। আমি উদ্বাস্তুদের সাক্ষাৎকার নিয়ে দেখেছি। আমি এখন বিশ্বাস করি খুব হিসাব করে বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষদের – অধ্যাপক, ছাত্র, এবং সেনাবাহিনী কর্তৃক ডিস্টিংশনপ্রাপ্ত দের হত্যা করে নিশ্চিনহ করে দেয়া হচ্ছে। আমার এই মতামত গণহত্যার পক্ষে রায় দেয়। এছাড়া আরও যত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে যার কোথাও বলা নেই যে এটি ছাড়া শরনার্থিদের অনুগমনের অন্য কোন কারণ আছে।

৭. এই পটভূমিতে ভারত সরকার একটি “উভয় পক্ষের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের সীমিত উপস্থাপনা” এর প্রস্তাব আনার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে যেখানে তারা বলবে যে তারা শরনার্থিদের ফিরে যেতে বাঁধা দিচ্ছেনা। তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো গুরুতর প্রভাবিত হলেও শুধুমাত্র মানবিকতার ভিত্তিতে ভারত প্রবেশের অনুমতি দিয়ে যাচ্ছে। ভারত সরকার উদ্বিগ্ন যে তারা সহসা দেশে ফিরে যেতে পারবে কিনা। জাতিসংঘ বা ইউএনএইচসিআর প্রতিনিধিদের উপস্থিতি এই ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবে না। অপরপক্ষে, এটা মূল সমস্যাকে চাপা দিয়ে দেবে – যেটি হচ্ছিল মূলত সামরিক নৃশংসতার ধারাবাহিকতা থেকে। বিশ্বের মনোযোগ অন্যদিকে প্রবাহিত হলে শরণার্থীদের আরও অন্তঃপ্রবাহ বজায় থাকবে। এবং রাজনৈতিক নিষ্পত্তির অভাবে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নেতৃত্বের শাসন প্রতিস্থাপন বিলম্বিত হবে।

৮. ইউএনএইচসিআর এর দিল্লিতে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের একটি মোটামুটি শক্তিশালী দল রয়েছে এবং তাদের জন্যে শরণার্থী শিবিরে দেখার জন্য সুবিধা দেওয়া হয়েছে। বস্তুত জনাব টমাস জেইমসন, ইউএনএইচসিআর এর পরিচালক, ভারতে ইউএনএইচসিআর কার্যালয়ের প্রধান প্রতিনিধি। তিনি সম্প্রতি শরণার্থী শিবিরে সফর করে এসেছেন। সব শরণার্থী শিবিরে প্রবেশ অনুমতি প্রদান করা হয় এবং সীমান্ত এলাকায় এইসব ক্যাম্পে যানবাহন সুবিধা দেওয়া হয়। এছাড়াও ১০০০ বিদেশী পর্যবেক্ষক শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন এবং তাদের অধিকাংশ প্রকাশ্যে বলেছেন যে উদ্বাস্তুরা বাংলাদেশের সামরিক অপারেশন এর কারণে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে এবং যদি উপযুক্ত অবস্থার সৃষ্টি করা হয় তাহলে তারা নিরাপদ ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করবে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার নির্বাচিত সহকর্মীরা এই ব্যাপারে একটি রাজনৈতিক বক্তব্য রেখেছেন। সরকারী সাহায্য প্রতিষ্ঠানগুলো পরিশেষে জানায় আন্তর্জাতিক সংস্থাদের এগিয়ে আসা উচিৎ। এসে তার উদ্বাস্তুদের পরিস্থিতি দেখুন। তাদের রিলিফ প্রোগ্রাম, মানবিক সহায়তা এবং কিছু লোকবল নিয়োগ করুন। মানুষের এই হতাশাজনক দুর্ভোগ আর ভোগান্তিতে সবাই এগিয়ে আসুন এই আশা ব্যাক্ত করা হয়।

৯. ভারত সরকারের কোনো প্রস্তাব নেই যা মৌলিক সমস্যা থেকে মনোযোগ অন্যদিকে ধাবিত করে। কারণ এতে শরণার্থীদের পরিণতিও অপরবর্তিত থাকবে। তারা জাতিসংঘের যে কোনো কর্ম বা পদক্ষেপ সমর্থন করবে। পর্যাপ্ত আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে শরণার্থীদের ভূমি, ঘরবাড়ী এবং সম্পত্তির নিশ্চয়তা নিশ্চিত করে পূর্ব পাকিস্তানে তাদের ফেরত পাঠানো হবে। এমন অবস্থা সেখানে তৈরি করা হবে যে তা আন্তর্জাতিক সংস্থার অধীনে থাকবে এবং উদ্বাস্তুরা নিরাপদে ফিরে আসতে পারে এবং পুনরায় কোন প্রতিহিংসামূলক হুমকি বা নিপীড়নের স্বীকার না হয় সেই ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে। ভারত সরকার ২৭ জুলাই প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমস এর রিপোর্ট এবং ফোটোগ্রাফিতে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের দৃষ্টি আকর্ষণ করান। এই অবস্থায় ভারতীয় সীমান্তে কাউকে পোস্টিং দেয়া হলে তাতে পরিস্থিতির কোন উন্নতি হবেনা। ভারত সরকার এটাকে সমর্থন করতে পারেন না কারণ এটা তাদের তারা মনে করে এটা অবাস্তব ও বিপদজনক হবে। তাই তারা এই প্রস্তাব কোন ভাবেই মেনে নেবেন না।

১০. পূর্ববাংলার মূল সমস্যা সেখানে বহুদূর থেকে আসা একটি সেনা বাহিনী নিষ্ঠুরভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণ করছে। যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পূর্ববঙ্গে উদ্বাস্তুদের ফেরতের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সজাগ হয় তাহলে সেখানে ইতিমধ্যে নির্বাচিত নেতাদের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তির মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের ভিতরে স্বাভাবিক অবস্থার পুনরুদ্ধার সম্ভব।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩২। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্বাক্ষরিত ২০ বছর মেয়াদি শান্তি বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা চুক্তির বিস্তারিত বিবরণ ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণাল¬য় ৯ আগস্ট, ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ৩২, ৬৩-৬৫>
অনুবাদ

শান্তি, বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার ভিত্তিতে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর, আগস্ট ৯

আন্তরিক বন্ধুত্বের তাগিদে বিদ্যমান সম্পর্ক সুদৃঢ় করার অভিলাষ।

একথা বিশ্বাস করা যে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার উন্নয়নের ফলে উভয়ের মৌলিক জাতীয় স্বার্থ ও সেইসাথে এশিয়া ও বিশ্ব শান্তির স্বার্থ পূরণে ভূমিকা রাখবে।

সর্বজনীন শান্তি ও নিরাপত্তা উন্নীত করনের জন্য এবং আন্তর্জাতিক উত্তেজনা ও উপনিবেশবাদের অবশিষ্টাংশ চূড়ান্ত বর্জন করার প্রচেষ্টা করতে হবে।

শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে একত্রে থাকতে হবে।

দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে যে বর্তমান বিশ্বের আন্তর্জাতিক সমস্যা শুধুমাত্র দ্বন্দ্ব দ্বারা সমাধান করা যাবেনা।

জাতিসংঘের উদ্দেশ্য ও চার্টার মূলনীতি মেনে চলতে সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করা হয়।

একদিকে ভারতের প্রজাতন্ত্র এবং অন্য দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এই চুক্তির ব্যাপারে একমত হন এবং এটি সম্পন্ন করতে নিম্নলিখিত রাষ্ট্রদূতরা নিয়োগপ্রাপ্ত হন।

ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের পক্ষে:
সরদার শরণ সিং, পররাষ্ট্রমন্ত্রী

সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে:
জনাব এ গ্রমিকো, পররাষ্ট্র মন্ত্রী, তাদের প্রতিটি সম্ভবনা আলোচনা করেন যা সঠিকভাবে ক্রমান্বয়ে নিম্নে লিপিবদ্ধ হল।

ধারা ১: চুক্তিবদ্ধ শপথে ঘোষণা করা হয় যে উভয় দেশের শান্তি ও বন্ধুত্ব দেশের এবং দেশের জনগণের মধ্যে প্রাধান্য পাইবে। উভয় দেশ স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অপরপক্ষের অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করবে এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকবে। দেশ দুটির আন্তরিক বন্ধুত্ব বজায় থাকবে এবং তারা ভালো

প্রতিবেশীসুলভ মন নিয়ে কাজ করবে এবং ব্যাপক সহযোগিতার পূর্বোক্ত নীতির ভিত্তিতে ও সেইসাথে সমতা ও পারস্পরিক সুবিধার জন্য বিদ্যমান সম্পর্ক সংহত করা চালিয়ে যাবে।

ধারা ২: প্রত্যেক সম্ভাব্য উপায়ে শান্তি এবং তাদের জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য উচ্চ চুক্তিবদ্ধ দল সংরক্ষণ এবং এশিয়া ও বিশ্বের সর্বত্র শান্তি জোরদার করার জন্য কাজ করা। অস্ত্র, জাতি এবং সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ অর্জন করার জন্য একসাথে কাজ করা যা এশিয়া সহ সারা বিশ্বে অবস্থান দৃঢ় করবে।

ধারা ৩: সাম্য ও আদর্শের প্রতি আনুগত্য পূর্বক ঔপনিবেশিকতা ও বর্ণবাদ সম্পূর্ণ বর্জনের জন্য সংগ্রাম করতে তারা সংকল্পবদ্ধ হন।

উচ্চ চুক্তিবদ্ধ দল এই লক্ষ্য অর্জন করার জন্য অন্য দেশকে সহায়তা করতে পারে যাতে যাতে এবং উপনিবেশবাদ ও জাতিগত আধিপত্যের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামে জাতির আকাঙ্খার সমর্থন করার অন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা করবে।

ধারা ৪: ভারত সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতের শান্তিকামী নীতিকে সন্মান করে। এতে সকল দেশের প্রতি বন্ধুত্ব ও সহযোগিতাপূর্ন সম্পর্ক সৃষ্টি হয়।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতীয়দের উদারনীতিকে সম্মান করে এবং মনে করে যে এই নীতি বিশ্বশান্তি ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিরাপত্তা রক্ষণাবেক্ষণ এবং বিশ্বের উত্তেজনা কমাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করবে।

ধারা ৫: সর্বজনীন শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার ব্যাপারে তারা আগ্রহ প্রকাশ করেন। চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশগুলো এই চুক্তিবদ্ধ হয় যে আন্তর্জাতিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সমস্যায় একে অপরের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ বজায় রাখবে এবং তাদের নেতৃস্থানীয় রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে মতবিনিময়, মিটিং, সরকারি প্রতিনিধি এবং দুই সরকারের বিশেষ দূতদের ভিজিট এবং কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করবে।

ধারা ৬: তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার তাত্পর্যপূর্ণ সংযুক্ত এবং প্রসারিত করবে। ব্যাপক সহযোগিতার পাশাপাশি প্রসারিত তাদের মধ্যে বাণিজ্য, পরিবহন ও যোগাযোগ অব্যাহত থাকবে। এসকল চুক্তি হবে ডিসেম্বর-২৬, ১৯৭০ এর ইন্দো-সোভিয়েত ট্রেড এগ্রিমেন্ট এর ভিত্তিতে।

ধারা ৭: বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, প্রেস, রেডিও টেলিভিশন, সিনেমা, পর্যটন ও ক্রীড়া ক্ষেত্রে সম্পর্ক আরও উন্নত করা হবে।

ধারা ৮: চুক্তি ঘোষণা করে যে একপক্ষ অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে পরিচালিত কোন সামরিক জোটে অংশগ্রহণ করতে পারবে না।

একে অন্যের বিরুদ্ধে আগ্রাসন থেকে বিরত থাকবে এবং অন্যদের সেনাবাহিনীর ক্ষতিসাধন হয় বা সম্পদ নষ্ট হয় এমন কোন আগ্রাসন অন্যের ভূখণ্ডে চালানো যাবেনা।

ধারা ৯: তৃতীয় পক্ষের কেউ যদি অন্যের ক্ষতিসাধনের জন্য কোন চুক্তি করতে চায় তাহলে তা থেকে বিরত থাকতে হবে। এমন অবস্থায় অবিলম্বে এই দুই দেশ হুমকি অপসারণ করার জন্য পারস্পরিক আলোচনা শুরু করিবে এবং শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য উপযুক্ত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

ধারা ১০: তারা শপথ ঘোষণা করে যে একে অন্যের গোপন এক বা একাধিক তথ্য প্রকাশ থেকে বিরত থাকবে বা কোন চুক্তি যা বর্তমান চুক্তিবিরোধী হয় সেগুলো বর্জন করবে। তারা আরও ঘোষণা করে যে কোন বাধ্যবাধকতা ছাড়াই তারা একে অপরের সামরিক ক্ষতির কারণ হতে পারে এমন কিছুতে জড়াবেনা।

ধারা ১১: এই চুক্তি বিশ বছরের জন্য গৃহীত হল এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে আরও ৫ বছর চলতে থাকবে যদি এর মাঝে কোন উচ্চ পর্যায়ের পরিবর্তনের প্রয়োজন না হয়। চুক্তি স্বাক্ষরের এক মাসের মধ্যে মস্কো থেকে এটি সঞ্চালিত হবে ও বলবত্ থাকবে।

ধারা ১২: চুক্তিতে কোন বোঝার ভুল থাকলে উভয় টিম শান্তিপূর্ন আলোচনা করে তা স্পষ্ট করবে এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সমঝোতার মনোভাব নিয়ে শান্তিপূর্ণ উপায়ে দ্বিপক্ষীয়ভাবে তা করা হবে।

রাষ্ট্রদূতরা হিন্দি, রাশিয়ান এবং ইংরেজিতে উপস্থিত চুক্তি স্বাক্ষর করেছে এবং সব গুলো সমানভাবে অর্থপূর্ন করা হয়েছে এবং তাদের সিল- স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে।

নয়া দিল্লিতে ৯ অগাস্ট, ১৯৭১ এটি সম্পন্ন হয়।

ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং স্বাক্ষর করেন।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ গ্রমিকো সই করেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৩। নয়াদিল্লীর ইন্ডিয়া গেঁটে অনুষ্ঠিত জনসভায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির ভাষণ ভারতের তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয় প্রকাশিত দি ইয়ার্স অফ এন্ডিভার ৯ আগস্ট, ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ৩৩, ৬৬-৬৮>
অনুবাদ

সংকটের মুখোমুখি

সংসদ ১৯ মার্চ শুরু হয় এবং ২৫ ও ২৬ মার্চ বাংলাদেশে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা বিশ্বকে মর্মাহত করেছে। বাংলাদেশের জনগণ একই উদ্দেশ্য নিয়ে লড়ছে যার জন্য আপনি এবং আমি আমাদের দেশে একটা দীর্ঘ সংগ্রামের সময় অতিবাহিত করেছি।

বাংলাদেশের ঘটনা সঙ্কট সৃষ্টি করছে। ৭৩ লাখ মানুষ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার কারণে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। আমরা তাদের আমন্ত্রণ জানাইনি। কীভাবে আমরা তা করতে পারি? আমাদের নিজের দেশে অনেক কিছুর ঘাটতি আছে। সুতরাং, কিভাবে আমরা তাদের আসতে বলি? আমাদের নিজের জনগণের দুর্ভোগ বৃদ্ধি পেয়েছে এতে। এটা আমাদের কোনো দোষ না যে তারা এসেছেন। তারা তাদের দেশ ছেড়ে বিপদ পরে তাদের দুঃখ কষ্ট থেকে অব্যাহতি পাবার আশায় এখানে এসেছেন। এমনকি যাঁরা রাজনীতির সঙ্গে কোনোভাবে জড়িত ছিলোনা তাদেরকেও হত্যা করা হয়েছে। তাদের ঘর অগ্নিসংযোগ এবং নৃশংসতার সব প্রক্রিয়া তাদের উপর চালানো হয়েছিল।

আপনাদের মধ্যে কেউ যদি শরনার্থিশিবিরে যান তাহলে তাদের দুর্দশার চিত্র দেখতে পাবেন। যে যাবে সে বলবে না যে ভারত সরকার শরনার্থিদের ফেরত পাঠাতে চায়। কোন মানুষই, তার কোলে একটা বাচ্চা নিয়ে সমস্ত দিন ও রাত্রি কাদা ও পানিতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা। কারণ দাঁড়িয়ে থাকবার জন্য কোন শুকনো জায়গা নেই। যদি থাকত তাহলে তারা স্বদেশই থাকতেন যদি সেখানে একটি বিশ্রামের জায়গা খুঁজে পান। কিন্তু, না। তাদের নিজের মাটিতেই তাদের উপর বর্বর শত্রুরা নৃশংসতা চালিয়েছে। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি এই লক্ষাধিক লোককে ত্রাণ দিতে। আমরা তাদের বলেছি, আমরা তাদের শুধুমাত্র স্বল্প সময়ের জন্য রাখতে পারি। কোন দেশ অন্য কোন দেশ থেকে আসা এত মানুষের ভার বইতে সামর্থ নয়। আমাদের পক্ষেও সম্ভব না। আমরা বিশ্ববাসীকে এটা জানিয়েছি।

আপনারা জানেন যে আমরা যা বলি তা করি। কিন্তু কেউ কেউ মনে করেন যে, স্লোগান দিলেই যথেষ্ট। যারা সবসময় সত্যাগ্রহের বিপক্ষে ছিল তারাই বাংলাদেশ ইস্যুতে সত্যাগ্রহের সাথে যোগ দিয়েছেন। বর্তমানে সত্যাগ্রহের কোণ মানে নেই। সত্যাগ্রহের মূল্য ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়। যখন সত্যাগ্রহ জানত না যে তাদের ৭ বছর বা ১০ বছর কারাগার যাপন করতে হবে। সেটি ছিল সত্যাগ্রহের দিন। কিন্তু এখন উপহাস করা হচ্ছে। সত্যাগ্রহের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান। আমরা কখনোই বলিনি যে আমরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবনা। সরকার সাবধানে সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। এবং তখন সেটি আমাদের জনগণ দ্বারা সমর্থিত হবে। কিন্তু আমাদের ভাবতে হবে এটা আমাদের ও বাংলাদেশের উপর কোন প্রভাব ফেলবে কিনা।

আপনাদেরকে সত্যি বলছি, সরকার তার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করবে। সরকার সব সময় এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে যা আমাদের জনগণের এবং বাংলাদেশর জন্য মঙ্গলজনক হবে।

আপত্তি আসতে পারে কেন আমি অন্য দেশের মানুষের কথা উল্লেখ করছি? কিন্তু সচেতন ভাবে খেয়াল করলে দেখবেন কিভাবে সেখানকার ঘটনা আমাদের ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে।

এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ আজ উদ্বাস্তুদের এই বিশাল অন্তঃপ্রবাহ বরণ করে নিবে না এবং তাদের সাহায্য দিতে প্রস্তুত হতে পারবেনা। আমরা বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলির মধ্যে অন্যতম। আমাদের পক্ষে এই বোঝা গ্রহণ করা খুব অস্বস্তিকর। একমাত্র পথ ছিল যে বর্ডারে ঢুকতে চাওয়ার সময় গুলি করার ভয় দেখানো। এছাড়া এত বিপুল সংখ্যক লোকের অন্তঃপ্রবাহ বন্ধ করার কোণ পথ ছিলোনা। এই সমস্যার আরেকটি দিক রয়েছে। আমরা জানি যে এই লোকগুলোকে ঢুকতে দেয়া না হলে তাদের দেশে তাদের হত্যা করে ফেলা হবে- এটা জেনেও কি আমরা না ঢুকতে দিতে পারি? আমরা নিশ্চই তাদের সাথে এমনটা করতে পারিনা। আমাদের ঐতিহ্য হল ভারত সবসময় আর্তপীড়িতদের পাশে থেকেছে তাতে আমাদের যত সমস্যাই হোক। আমরা যতোটুকু সম্ভব তাদের সাহায্য করছি এমনকি আমাদের জনগণও এইসব লোকদের জীবন বাঁচানোর জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমরা তাদের জন্য যথেষ্ট করতে পারছিনা।

আমরা অবশ্যই বাইরে থেকে সাহায্য চাই এবং আমরা কিছু পাচ্ছি। কিন্তু আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বুঝতে হবে যার উপর আমি জোর দিচ্ছি এবং আমাদের জনগণকে বলছি। আমাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে এবং অন্যদের উপর নয়। যত কষ্টই হোক আমরা নিজেরা এই ব্যয় বহন করব এমনকি যদি কেউই আমাদের সাহায্য করতে না আসে। প্রশ্ন হল আমাদের বন্ধু আছে কিনা বা আমাদের সাহায্য করার মত কেউ আছে কিনা। আমাদের সাহায্য করার জন্য যদি কেউ আসে তাহলে আমরা কৃতজ্ঞ হব। কিন্তু আমরা অন্যদের উপর নির্ভর করতে পারি না।

আমি আমাদের বোঝা ঠিক কত বড় হবে সেই ব্যাপারে আমরা সজাগ আছি। আগেই বলেছি, এমনকি সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে ধনী দেশ এই ভারী বোঝায় বিচলিত হবে। আমরা ঠাট্টার স্বীকার হব কিন্তু আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছি কারণ আমরা জানি য়ে আমরা আমাদের ঐতিহ্য, আত্মসম্মান এবং ভাল প্রতিবেশীর প্রতি আদর্শ আচরণ করছি।

সামনের পথ অনেক কঠিন এবং সমস্যাপূর্ন। এটা অনেক বছর ধরেই এমন ভাবে চলছে। এবং এটি আরও বাড়তে পারে। কিন্তু আমি জানি, বড় অসুবিধায় আমাদের সাহস ও শক্তিও বড় হতে হবে। আমরা বিশ্বকে দেখাতে পারবে যে, দারিদ্র্য, অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতা এবং নিরক্ষরতা থাকা সত্ত্বেও আমাদের শক্তি আছে। অনেকে আমাদেরকে হুমকি দিয়েছে, অনেকে তাদের তরবারি উঁচিয়ে আছে। কিন্তু সেটা আমাদের পথ নয়। আমরা আমাদের করুন অবস্থা দেখিয়ে এইসব লোকদের গৌরবান্বিত বোধ করাতে চাইনা। আমরা জানি, যারা এই ধরনের হুমকি দিতে পারে তাদের বাস্তবে কোণ শক্তি নেই। তারা নিজেদের রক্ষা করার জন্য অজুহাত খুঁজে পেতে চেষ্টা করে। এই অবস্থা ভিন্ন কিছু জাতি ও আমাদের নিজেদের দেশের কিছু মানুষের সাথেও হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের ভয়ানক দুঃখভোগ চলছে। যদিও এই দেশে বাংলাদেশ ইস্যুতে অনেকে রাজনৈতিক ফায়দা করতে চেষ্টা করছেন। বিরোধী দলের নেতা বলেছেন, আমি যদি আজ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে প্রয়োজন না মনে করি তার মানে এই না যে এই ইস্যুতে মতের ঐক্য ছিল না। আমি বলছিনা যে সেখানে দ্বিমত হতে পারে না। আমি শুধুমাত্র বলতে চাই এই মুহুর্তে সরকারকে কঠোর ও বাস্তব সম্মত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এখন ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিতর্ক করে সরকারকে দুর্বল করে দেয়া ঠিক হবেনা। তাতে বিশ্ব শুধু অবাক হবে। আমাদের মিটিং এর অন্যতম উদ্যেশ্য ছিল এটা দেখানো যে ছোট ছোট রাজনৈতিক ইস্যু এই মুহুর্তে ভারতের কাছে কোন বিষয় না। ভারত ঐক্যবদ্ধ আছে এবং আমরা শক্তিশালী। আমাদের সরকার ও মানুষ কষ্ট করার জন্য প্রস্তুত আছে এবং আমাদের তার জন্য কঠিন ব্যাকিং আছে। তারা জানে যে তারা যদি সাহসের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তার প্রভাব শুধুমাত্র আমাদের প্রতিবেশীদের রাষ্ট্রই নয় বরং সমগ্র বিশ্বে ছাপিয়ে যাবে। আমাদের শক্তি প্রয়োগ করে আমরা বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সাহস ও অনুপ্রাণিত করতে পারব। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল আমরা তাদের বুঝাতে পারি যে আমরা কোন পরিস্থিতিতেই দুর্বল না। এবং কোনো চাপ বা হুমকি আমাদের মনোভাব পরিবর্তন করতে বাধ্য করতে পারবেনা। আমাদের লক্ষ্য বাংলাদেশের মানুষকে সাহায্য করা। পাশাপশি আমরা আমাদের নিজেদের জনগণকেও সাহায্য করব। আমাদের সারা দেশকে শক্তিশালী করতে হবে এবং এরপর আমরা আমাদের কার্যপ্রণালী অনুযায়ী এগিয়ে যেতে থাকব।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৪। শেখ মুজিবের বিচারের ব্যাপারে পাকিস্তানের ওপর প্রভাব খাটানোর আবেদন জানিয়ে রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে প্রেরিত প্রধানমন্ত্রীর বার্তা ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১০ আগস্ট, ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ৩৪, ৬৯>
অনুবাদ

রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে প্রেরিত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বার্তা
১০ অগাস্ট, ১৯৭১

প্রধানমন্ত্রী, মিসেস ইন্দিরা গান্ধী, ১০ আগস্ট, ১৯৭১ সালে সরকার প্রধানদের কাছে নিম্নলিখিত বার্তা প্রেরণ করেন –

সরকার ও ভারত সেইসাথে আমাদের প্রেস ও সংসদ ব্যাপকভাবে বিচলিত কারণ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বিবৃতি দেন যে, তারা কোন বিদেশী আইনি সহায়তা ছাড়া শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন সামরিক বিচার শুরু করতে যাচ্ছে। আমরা বলতে চাই যে এই তথাকথিত বিচার শুধুমাত্র শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার উদ্যেশ্যে ব্যবহার করা হবে। পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি তীব্রতর করা হবে এবং এ কারণে আমাদের জনগণের শক্তিশালী অনুভূতি এবং সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে একটি মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। এটি আমাদের জন্য একটি গভীর উদ্বেগের বিষয়। আমরা আপনাদের কাছে আবেদন করছি একটি বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এ অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার বৃহত্তর স্বার্থে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আপনাদের প্রভাব অনুযায়ী ব্যাবস্থা নিবেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৫। শেখ মুজিবের বিচার হবে – ঘোষণায় উদ্বেক প্রকাশ করে জাতিসঙ্ঘের মহাসচিবের প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বার্তা ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১০ আগস্ট, ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ৩৫, ৭০>
অনুবাদ

জাতিসঙ্ঘের মহাসচিবের প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বার্তা
আগস্ট ১০, ১৯৭১

পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব শরণ সিং, জাতিসংঘ মহাসচিব, উ থান্টকে, নিম্নলিখিত বার্তা পাঠিয়েছেন ১০ আগস্ট, ১৯৭১:

আমরা মর্মাহত এবং ক্ষোভ প্রকাশ করছি এই জন্যে যে রাওয়ালপিন্ডি ঘোষণা দিয়েছে আগামীকাল থেকে তারা শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার আরম্ভ করতে যাচ্ছে। এই ঘোষণায় বিভিন্ন শ্রেণীগত বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে যে সম্প্রতি তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন এবং রাষ্ট্রদ্রোহমূলক কাজকর্মে লিপ্ত থাকার জন্যে শেখ মুজিবকে দোষী করা হচ্ছে। শেখ মুজিবুর রহমান তার জনগণের কাছে একজন অসামান্য নেতা, অনেক প্রিয় এবং অনেক সম্মানিত। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসের নির্বাচনে তাঁর যে বিজয় হয়েছে সম্ভবত এত অতুলনীয় নির্বাচন বিশ্বের কোথাও কোনো অনুরূপ নির্বাচনে দেখা যায়নি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের জনগণ, প্রেস সংসদ এবং সরকার লক্ষ্য করেছে যে পূর্ববঙ্গে পাকিস্তান সরকারের সৃষ্ট পরিস্থিতির জন্য আমাদের উপর তার প্রভাব পড়া শুরু হয়েছে। যদি পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের উপর কোন ধরণের চরম সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে আমাদের উপর তার প্রভাব আরও দশ গুন বৃদ্ধি পাবে। তাই আমরা আপনাদের কাছে এই ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেবার জন্য অনুরোধ করছি যাতে পাকিস্তান সরকার এমন কোন হটকারি সিদ্ধান্ত না নেয় যা তাদের সমস্যা আরও বাড়িয়ে দেবে এবং তাদের সাথে আমাদেরও। মুজিবের ব্যাপারে এই মুহুর্তে গৃহীত যেকোন অন্যায় পদক্ষেপ এর পরিণতি হবে খুব ভয়ানক ও বিপজ্জনক।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৬। ইন্দোনেশিয়ায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর শেষে প্রকাশিত ভারত ইন্দোনেশিয়া যুক্ত ইশতেহার ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১৫ আগস্ট, ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ৩৬, ৭১-৭৪>
অনুবাদ

ইন্দোনেশিয়ায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এর সফর শেষে প্রকাশিত ভারত ইন্দোনেশিয়া যুক্ত ইশতেহার, আগস্ট ১৫, ১৯৭১

ইন্দোনেশিয়া প্রজাতন্ত্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মান্যবর আদম মালিকের আমন্ত্রণে মান্যবর সরদার শরণ সিং, ভারত প্রজাতন্ত্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী, ১২ থেকে ১৫ ই আগষ্ট, ১৯৭১ ইন্দোনেশিয়া সফর করেন। সাথে সঙ্গী ছিল মেনন, ভারত সরকারের সেক্রেটারি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জনাব আর ডি সাথী, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব এবং জনাব ই গনসালভেস, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিভাগের যুগ্ম সচিব।

সফরকালে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোঃ সুহার্তো সাদরে তাদের গ্রহণ করেন। আলোচনার সময় তার সঙ্গে মহামান্য জেনারেল উ এইচ নসুশন, প্রোভিশনাল পিপলস কনসালটেটিভ পরিষদের চেয়ারম্যান, মান্যবর আদম মালিক, পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও মান্যবর ডঃ শরীফ তৈয়ব, জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ছিলেন। এই আলোচনায় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার প্রতিনিধিদলের সদস্যদের এবং মান্যবর এনবি এর সহায়তা নেন।

ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জনাব আর বি আই এন ডিজাজডিনিগ্রাত, পররাষ্ট্র বিভাগের রাজনৈতিক বিষয়ক মহা-পরিচালক, জনাব ইসমাইল তাজিব, পররাষ্ট্র দপ্তরের এক্সটার্নাল অর্থনৈতিক বিষয়ক মহাপরিচালক, জনাব হার তাসিং, পররাষ্ট্র দপ্তরের নিরাপত্তা ও কমিউনিকেশন বিভাগের ডিরেক্টর জেনারেল, জনাব এবি লুবিস, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পরিচালক, এবং জনাব নুরমাথিয়াস, পররাষ্ট্র বিভাগের এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিষয়ক পরিচালক মহোদয় গ্রহণ করেন।

দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে আন্তরিকতা ও সমঝোতার পরিবেশে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় এবং সাধারণ স্বার্থ এবং আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি সহ বিভিন্ন সাম্প্রতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত বিষয় তাদের আলোচনায় উঠে আসে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ভারত মহাসাগর, নিরপেক্ষ জাতিদের মধ্যে সহযোগিতা, শান্তির সাম্প্রতিক চুক্তি, বন্ধুত্ব ও কো-অপারেশন, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়।

নিজস্ব অঞ্চলের সমস্যা নিয়ে আলোচনা, উভয় পক্ষের জোটনিরপেক্ষ নীতি, তাদের বিশ্বাস, সর্বজনীন শান্তি ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিরাপত্তা রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি অনেক বিষয় গুরুত্বের সাথে আলোচনায় আসে। বিশেষ করে এশিয়ায় বিরাজমান বর্তমান অবস্থা আলোচনা করে প্রতিটি দেশের মানুষ বাইরের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত হয়ে তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করা উচিত বলে একমত প্রকাশ করা হয়। সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে এই অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব এবং সব প্রান্তিককৃত দেশগুলির স্বাধীনতা সংহত করার প্রয়োজন স্বীকার করা হয়। তারা এশিয়ায় সাম্প্রতিক উন্নয়নের জন্য এবং শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য একটি পরিবেশ তৈরি করার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেন। এবং এর ফলে তাদের বন্ধন শক্তিশালী হবে হবে আশা প্রকাশ করেন। এছাড়া অন্য দেশগুলোও লুসাকা সম্মেলনে তাদের এইসব পলিসি নিয়ে এগিয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করা হয় যে।

দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে উদ্বাস্তু প্রবেশ ও এর জন্য উদ্ভূত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন এবং উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তারা এদের ফিরে যাবার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কাজ করার প্রয়োজনের উপর একমত হন।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ ঘটনায় তার উদ্বেগ জানান এবং বলেন যে ইন্দোনেশিয়া সরকারের কোন প্রচেষ্টা আবশ্যক হলে তারা সেটা করবেন যা হবে শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল অবস্থা অর্জনের লক্ষ্যে।

তারা ইতিমধ্যে পূর্ববর্তী সভায় এ অভিমত ব্যক্ত করেন যে ইন্দো-চীন সমস্যা একটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা যেতে পারে।

দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও উন্নত ও বিস্তৃত করার ব্যাপারে তারা চুক্তিবদ্ধ হন।

দুই মন্ত্রীদের ১৯৫৫ সালের সাংস্কৃতিক এবং শিক্ষাগত চুক্তির কাঠামো অনুযায়ী তারা গত দুই বছর সময় সম্পর্কের অগ্রগতি নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। তারা দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা পর্যালোচনা করেন এবং পারস্পরিক লাভজনক পরিধি বিস্তৃত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে সম্মত হন – বিশেষ করে শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে।

দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের দু’দেশের নেতৃবৃন্দের মধ্যে ক্রমবর্ধমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও গভীর ও শক্তিশালী করার কথা ব্যাক্ত করেন। এ প্রসঙ্গে তারা দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতার কথা পর্যালোচনা করেন। দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতার ক্ষেত্র চিহ্নিত করণ, বাণিজ্য ও যৌথ শিল্প উদ্যোগ উন্নয়নের প্রচারের জন্য একসাথে কাজ করার প্রত্যয় ব্যাক্ত করেন।

দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার লক্ষ্য অর্জনের জন্য বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ জোরদার করার প্রয়োজনীয়তা পুনরায় আলোচনায় আনেন। এ প্রসঙ্গে তারা এশীয় মন্ত্রী কাউন্সিল ECAFE এর উদ্যোগের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞ্যাপন করেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা আন্তর্জাতিক ফোরামে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকান্ডের সকল ক্ষেত্রে সহযোগিতা জোরদার করার জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত নেন এবং বাণিজ্য ও উন্নয়নের জন্য প্রথম ও দ্বিতীয় ইউনাইটেড ন্যাশনস কনফারেন্স এর আলজিয়ার্স সনদের বিধানাবলীর ভিত্তিতে প্রয়োজনীয়ভাবে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইন্দোনেশিয়া সফরের সময় তাকে ও তার দলকে উষ্ণ স্বাগত ও আন্তরিক আতিথেয়তার জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি ইন্দোনেশিয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ করেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৭। বিশ্ব শান্তি পরিষদের মহাসচিবের সাথে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতকার ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৩০ অগাস্ট, ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ৩৭, ৭৪-৭৬>
অনুবাদ

বিশ্ব শান্তি পরিষদের মহাসচিবের সাথে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতকার
আগস্ট ৩০, ১৯৭১

প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বিশ্ব শান্তি পরিষদ মহাসচিব রমেশ চন্দ্রের সাক্ষাতকারঃ

প্রশ্নঃ ম্যাডাম, ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তি ভারতের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছে। এর কারণ কি হতে পারে?
উত্তরঃ ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে বন্ধুত্ব অনেক বছর ধরে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, আমরা উভয়ে শান্তির জন্য কাজ করেছি এবং বর্ণবাদ এবং উপনিবেশবাদের বিরোধিতা করেছি। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভারী শিল্পের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের জন্য আমাদের প্রোগ্রাম সাহায্য করেছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অভাবনীয় দ্রুততার সাথে পরিবর্তন, প্রসারণ ও একটি নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। পুরনো ক্ষুদ্রতা কাটিয়ে নতুন নতুন চুক্তিতে আবদ্ধ হচ্ছে নানা দেশ। এটি একটি সাধারণ প্রবণতা। কিন্তু কিছু সুবিধাবাদী দেশ এসব পরিবর্তনের সুবিধা গ্রহণ করে ফায়দা লুটার চেষ্টা করছে।
আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি, বর্তমান চুক্তিতে এই ধরনের হঠকারিরা নিরুৎসাহিত হবে। আমাদের জনগন সোভিয়েত ইউনিয়নকে বন্ধু হিসেবে দেখবে। এজন্যই চুক্তি আমাদের দেশে এই ধরনের ব্যাপক প্রশংসা লাভ করেছে।
প্রশ্নঃ এতে এই এলাকার শান্তির পরিস্থিতি – বিশেষ করে বাংলাদেশের জনগণের মুক্তি সংগ্রামে কোন প্রভাব হবে কি?
উত্তরঃ আপনার প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশ দিয়ে শুরু করছি। বাংলাদেশের সংগ্রামের মূল ব্যাপার হচ্ছে এর একপাশে ৭৫ মিলিয়ন মানুষ এবং অন্য দিকে ইসলামাবাদের, প্রতিহিংসাপরায়ণ নিষ্ঠুর ও স্বৈরাচারী সামরিক শাসক – এই দুইয়ের মধ্যে সংঘাত। বাংলাদেশের মানুষ তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য লড়াইয়ে ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু আমরা জানি যে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। তাছাড়া বালুচিস্তান, এন.ডাব্লিউ.এফ.পি অথবা সিন্ধু ও পাঞ্জাব কে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত প্রদেশের মত দেখা হচ্ছে।
আমাদের জনগণ, সংসদ ও সরকার এবং বাঙলা দেশের জনগণের প্রতি পূর্ণ সহানুভূতি ও সমর্থন দেখাচ্ছে। আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের সঙ্গে কোন ঝগড়া করছিনা। অর্থাৎ সমস্যাটি ইন্দো-পাকিস্তান সম্পর্কিত নয়।
ইসলামাবাদে সামরিক শাসকেরা নিজেদের লোকদের থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন রেখেছে এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। পাকিস্তানের জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে দিতে তারা এই সমস্যাকে একটি ইন্দো-পাকিস্তান সমস্যায় রুপ দিতে চেষ্টা করছে। বিশ্বের বাকি দেশের কাছেও এমনটি করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। যুদ্ধের হুমকি থেকে বেপরোয়া পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। তাই আমরা কি করে এটাকে গুরুত্ব না দিয়ে থাকি? যাইহোক, আমরা মনে করি যে চুক্তি গৃহীত হয়েছে তাতে ইসলামাবাদ কোন হঠকারি সিদ্ধান্ত নিতে গেলে একটু হলেও চিন্তা করবে।
কিন্তু শান্তি মানে নিছক যুদ্ধ অনুপস্থিতি নয়। নিপীড়ন ও অবিচারের মুখে শান্তি বজায় থাকতে পারেনা। তাই জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের উপর ভিত্তি করে শান্তি স্থাপনের ব্যাবস্থা করা উচিত।

প্রশ্নঃ আপনি ন্যায়ত বলেছেন যে চুক্তি করা মানেই জোটনিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সরে যাওয়া নয়। কিন্তু এতে করে সমস্ত বিশ্বে জোটনিরপেক্ষ শক্তিগুলো এক হবার সুযোগ সৃষ্টি তরান্বিত হবে কি?
উত্তরঃ পাওয়ার ব্লকের অবস্থায় আমরা বিভিন্ন সরকারের বন্ধুত্ব চেয়েছি। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য যুদ্ধ থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন। এর জন্য মৌলিক নীতিমালা হয়েছে। একই সঙ্গে আমরা উপনিবেশবাদ এবং বর্ণবৈষম্যবাদের বিরোধিতা করেছি। এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক জাতি অনুরূপ নীতি অবলম্বন করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের নীতিকে সম্মান ও সমর্থন করেছে। চুক্তিটি নিজ প্রয়োজনেই অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
জোটনিরপেক্ষ শব্দটিকে অপব্যাখ্যা করা হয়েছে। এজন্য এ ধরনের সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। এই চুক্তি আমাদের নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সরায়নি বলে আমরা মনে করি।

জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর জাতীয় স্বার্থ হচ্ছে সামরিক হঠকারিতার হুমকি থেকে দেশকে সুরক্ষিত করা। সিকিউরিটি এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে করে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করা যায়। ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তির ফলে সৃষ্ট বন্ধুত্ব, শান্তি ও সহযোগিতার মূল অর্জন এটি।

প্রশ্নঃ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও পশ্চিম এশিয়ায় শান্তি স্থাপনের জন্য আপনার অনুমান কি?
উত্তরঃ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শান্তি নির্ভর করে ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়ার সমস্যার সমাধান উপর। এই তিনটি এখন পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। তবে, দক্ষিণ ভিয়েতনাম কিছুটা এগিয়েছে। এটি স্বীকৃত যে সামরিক সমাধান কোন সঠিক সমাধান না। সম্প্রতি দক্ষিণ ভিয়েতনামের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার নির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে আছে বিদেশী সৈন্য প্রত্যাহার, বিশেষভাবে আমেরিকান বাহিনী। আমার কোনো সন্দেহ নেই যে, এই প্রত্যাহার একটি নির্দিষ্ট নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে করা হবে। তারপর দক্ষিণ ভিয়েতনাম বাইরের সামরিক বা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছাড়া তাদের ভবিষ্যতের কর্ম্পন্থা ঠিক করতে পারবে। আজ না হোক কাল, ভিয়েতনাম সমস্যা এই পদ্ধতিতেই সমাধান হবে।
বর্তমানে পশ্চিম এশিয়ায় একটু স্থিরতা আসছে। তবে সম্ভাব্য পরিস্থিতি বিপজ্জনক। সমাধান খুঁজে বের করতে যত বিলম্ব হবে পরিস্থিতি ততই আরো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। জাতিসঙ্ঘের কাছে এর একটি সমাধান চাওয়া হয়েছে।
১৯৬৭ সালের নিরাপত্তা পরিষদে প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত একটি ধারাবাহিক প্রস্তাব দিয়েছেন। আমরা মনে করি সেগুলো বিবেচনায় আনা উচিৎ।

প্রশ্নঃ চুক্তিটি ছিল উপনিবেশবাদ, বর্ণবাদ এবং নিরস্ত্রীকরণ এর উপরে। তাহলে কিভাবে আপনি মনে করেন এটা অ্যান্টি-উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের উপর অবদান রাখবে? এবং নিরস্ত্রীকরণ কে অগ্রগতির দিকে নিবে? ‘
উত্তরঃ চুক্তিতে উভয় সরকারের উপনিবেশবাদ এবং সব ধরনের বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে ইচ্ছা পুনর্ব্যক্ত হয়েছে। একইভাবে, আমরা নিরস্ত্রীকরণের জন্য কাজ অব্যাহত রাখব। দু’দেশ শান্তি ও ন্যায়বিচারের জন্য সংকল্পবদ্ধ।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৮। নেপালে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর শেষে প্রকাশিত ইন্দোনেপাল যুক্ত ইশতেহার ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ৩৮, ৭৭-৭৮>
অনুবাদ

নেপালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ শিং এর সফর শেষে প্রকাশিত ইন্দোনেপাল যুক্ত ইশতেহার, ৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং, ৩ থেকে ৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ নেপালে শুভেচ্ছা সফর করে গেলেন। নেপালের মহামান্য রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে। শ্রী পি এন, মেনন, সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শ্রী টমাস আব্রাহাম, যুগ্ম-সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও শ্রী এস ভেংকাটরমণ, আন্ডার সেক্রেটারি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়. তার সাথে ছিলেন।

সফরকালে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহামান্য নেপাল রাজার সাথে বৈঠক করেন। তিনি মাননীয় আর টি শ্রী কীর্তী নিধি বিস্তা, নেপাল সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং এছাড়াও মাননীয় শ্রী গ্যানেন্দ্র বাহাদুর কারকি, শিক্ষা মন্ত্রী, ভূমি সংস্কার, খাদ্য, কৃষি ও বন মন্ত্রী এদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন।

কাঠমান্ডুতে ভারতের রাষ্ট্রদূত মান্যবর শ্রী এল পি সিং নয়া দিল্লির নেপালের রাষ্ট্রদূত মান্যবর সরদার ভীম বাহাদুর পান্ডে, শ্রী বি আর ভাণ্ডারী, নেপাল সরকারের পররাষ্ট্র সচিব, এবং শ্রী পি এন মেনন, ভারত সরকারের সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এই বৈঠকে সহায়তা করেন।

প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী গভীর ভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারত ও নেপালের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেন। তারা তাদের পারস্পরিক সম্মান, এবং আগ্রহ, একে অপরের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও অখণ্ডতা, এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি পুনর্ব্যক্ত করেন। তারা দু’দেশের বিভিন্ন বিষয়ে জনগণের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে গড়ার উপর জোর দেন এবং তাদের পারস্পরিক সুবিধার জন্য তাদের শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহামান্য রাজার বিজ্ঞ পরিচালনায় নেপালের বহুতরফা অগ্রগতির প্রশংসা করেন।

মহামান্য নেপালের প্রধানমন্ত্রী নেপালে ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সহায়তার জন্য মহামান্য সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং আশা প্রকাশ করেন যে এই সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নেপালের প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বাস দেন যে, ভারত সরকার দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার ক্ষেত্র বিস্তীর্ণ করবে এবং তাদের এই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

দুই মন্ত্রী ট্রেড অ্যান্ড ট্রানজিট এর সদ্য সমাপ্ত চুক্তি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং আশা প্রকাশ করেন যে এতে নেপালে দ্রুত শিল্পায়ন ও বাণিজ্য বহুমুখীকরণ নীতি বাস্তবায়ন হবে।

নেপালের প্রধানমন্ত্রী ও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী আন্তর্জাতিক ইস্যুতে সর্বজনীন শান্তি ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিরাপত্তা এবং বিশ্বের উত্তেজনা কমানোতে একত্রে কাজ করার ইচ্ছা ব্যাক্ত করেন। এর একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে জোটনিরপেক্ষ নীতির প্রতি আনুগত্য পুনর্ব্যক্ত করেন।

নেপালের প্রধানমন্ত্রী পূর্ব পাকিস্তান থেকে লাখ লাখ শরণার্থী আসায় ভারতে সৃষ্ট সামাজিক ও অর্থনৈতিক কুপ্রভাব দৃষ্টিগোচর করেন। দুই মন্ত্রী তাদের উদ্বাস্তুদের তাদের বাড়িতে ফেরত পাঠানোর জন্য অবস্থার সৃষ্টির জন্য জরুরী প্রয়োজনের উপর একমত প্রকাশ করেন।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ও তার দলকে কাঠমন্ডুতে দেয়া আতিথেয়তা এবং সৌজন্যতার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞ্যাপন করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী, শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষ থেকে নেপালের প্রধানমন্ত্রীকে সুবিধাজনক সময়ে ভারতে আসার আমন্ত্রণ জানান – যা সাদরে গৃহীত হয়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৯। বাংলাদেশ প্রশ্নে নিরপেক্ষ দেশগুলির প্রতি ভূমিকা গ্রহণে আহবানঃ রাষ্ট্রসংঘে পররাষ্ট্র সচিবের বিবৃতি দৈনিক আনন্দবাজার ১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

Aparajita Neel
<১২, ৩৯, ৭৯-৮০>

বাংলাদেশের ব্যাপারে নিরপেক্ষ দেশগুলিকে সোচ্চার হতে হবেঃ
রাষ্ট্রপুঞ্জে শ্রী টি এন কল

রাষ্ট্রপুঞ্জ, ১৭ সেপ্টেম্বর – ভারতের পররাষ্ট্র সচিব শ্রী টি এন কল রাষ্ট্রপুঞ্জে নিরপেক্ষ গোষ্ঠীকে সুস্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন যে, বাংলাদেশে শোচনীয় মানবিক বিপর্যয় সম্পর্কে যদি এই গোষ্ঠী সুস্পষ্ট মতামত জানাতে না পারেন তাহলে ঐ সব নিরপেক্ষ দেশের মন্ত্রী সম্মেলনে ভারত যোগদান করতে পারে নাও করতে পারে। আগামী সপ্তাহে নিরপেক্ষ রাস্ট্রগোষ্ঠীর মন্ত্রী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।

গতকালের সভায় এক জোরালো বক্তৃতায় শ্রী কল বলেন, নিরপেক্ষ দেশগুলি যদি বাস্তব অবস্থাকে উপেক্ষা করে এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধানের জন্য প্রস্তাব দেবার সাহস দেখাতে না পারে তাহলে সারা বিশ্বের কাছে তারা নিন্দিত হবে ও নিরপেক্ষতার মৌল ধারনাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

আজ রাত্রে নিরপেক্ষ দেশগুলির দ্বিতীয় অধিবেশন বসলে বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের কঠোর মনোভাব জানাবার জন্য পররাষ্ট্র সচিব এই আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন।

নিরপেক্ষ গোষ্ঠীর প্রস্তাবিত যুক্ত ইশতেহারে বাংলাদের সমস্যার ‘রাজনৈতিক মীমাংসার’ কথা বাদ দেওয়া উচিৎ বলে মরক্কোর প্রতিনিধি প্রস্তাব করেন। তারপরই শ্রী কল বক্তৃতা প্রসঙ্গে ঐ কথা বলেন। অবশ্য মরক্কোর ঐ প্রতিনিধি বাংলাদেশ থেকে আগত শরনার্থিদের দেখাশোনা করার ব্যাপারে ভারত যে বিপুল দায় নিয়েছে তাঁর জন্য সহানুভূতি জানান।

নাইজেরিয়া মরক্কোর এই বক্তব্য সমর্থন করে।

আলজিরিয় প্রতিনিধি ভারতের প্রতি তাঁর দেশের সৌহার্দ প্রকাশ করেন এবং শরনার্থি সমস্যার কথা উল্লেখ করেন। এশিয়ার দুটি বিরাট দেশ পারস্পরিক সংঘর্ষে লিপ্ত হবে সেজন্য তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন এবং বলেন যে, এর মীমাংসার জন্য নিরপেক্ষ দেশগুলিকে এগিয়ে আসতে হবে।

রাষ্ট্রপুঞ্জে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি শ্রী আগা শাহী এর আগে ভারত ছাড়া অন্যান্য সব নিরপেক্ষ দেশগুলির কাছে এক পত্রে বলেছেন যে, খসড়া ইশতেহারে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের কথা যেন না থাকে। কেননা, তাঁর মতে, এটা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার।

নিরপেক্ষ দেশগুলির আলোচনা চক্রে বাংলাদেশের বিষয়ে আলোচনার চেষ্টা হওয়ায় রাষ্ট্রপুঞ্জে পাকিস্তানের প্রাক্তন সহকারী প্রতিনিধি এবং বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিনিধি শ্রী এস এ করিম স্বাগত জানান। শ্রী করিম তাঁর পত্রে বলেছেন, পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণ মুক্তিসংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। পর্তুগালের বিরুদ্ধে এঙ্গোলা ও মোজাম্বিকের জনগণের সংগ্রাম থেকে এ সংগ্রাম পৃথক নয়। পাকিস্তানের মত তারাও আঞ্চলিক সংহতীর নামে ঔপনিবেশিক শাসন বজায় রাখার চেষ্টা করছে।

শ্রী কলের সোজা ভাষায় বক্তৃতার পড় সভাপতি ও জাম্বিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি শ্রী ভারনন জনসন সোয়াঙ্গা যুক্ত ইশতেহারে বাংলাদেশ সংক্রান্ত অনুচ্ছেদে ঐক্যমত্য স্থাপনে তাঁর প্রভাব বিস্তার করেন।

বাংলাদেশ সমস্যা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার শ্রী কল এটা মানতে নারাজ। তিনি বলেন, এটা আভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়, আন্তর্জাতিক সমস্যা। তিনি বলেন, সেক্রেটারি উ থান্ট গত ১৪ সেপ্টেম্বর তাঁর সাংবাদিক বৈঠকে বলেছিলেন যে, বাংলাদেশের মৌল সমস্যাই হল রাজনৈতিক।

শ্রী কল বলেন, নিরপেক্ষ গোষ্ঠীর একই নীতি ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের জন্য ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রয়োগ করা উচিৎ নয়। তিনি বলেন, ভারত দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় মুক্তি আন্দোলন এবং প্যালেস্টেনিয়ান শরনার্থিদের নিজেদের দেশে প্রত্যাবর্তনের অধিকার সমর্থন করে এসেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেই একই নীতি প্রযোজ্য হওয়া উচিৎ। অথচ এই বাংলাদেশের ঘটনা ইতিহাসে অভূতপূর্ব। ৯ মাসে ৯০ লক্ষ শরনার্থির আগমন ইতিহাসে কোন সময়ে ঘটেছে কিনা সন্দেহ।

বক্তৃতার উপসঙ্ঘারে শ্রী কল বলেন, ১০ ডিভিশন পাক সামরিক বাহিনী বাংলাদেশর সাড়ে সাত কোটি লোককে কখনোই চেপে রাখতে পারবেনা।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪০। পাকিস্তানের যুদ্ধের হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বিবৃতি দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়া ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ৪০, ৮১>
অনুবাদ

জে. রামের ভাষ্য- ইয়াহিয়াকে নতিস্বীকারে বাধ্য করা হবে
নয়াদিল্লি, ১৮ সেপ্টেম্বর:

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, জনাব জগজীবন রাম, আজ বাংলাদেশ সমস্যায় ভারতের ‘রাজনৈতিক সমাধান’ এর ব্যাপারে ধারণা দেন। তিনি বলেন সেখানকার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের স্বীকার করে নেয়া হবে অন্যতম উপায়।

এই নির্বাচিত প্রতিনিধিরা বলেন সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া ছাড়া কোন কিছুইতেই তারা সন্তস্ট হবেন না। জনাব জগজীবন রাম আজ “ভারতের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির” উপর আলোচনা করতে গিয়ে এক সভায় একথা জানান।

মুক্তিবাহিনী বিপুল ভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কৌশল এবং মনোবল ধ্বংস করছে। এবং পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবে পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে একটি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হচ্ছে। হতে পারে যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এই চাহিদা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বলেন ভারতের বিপক্ষে ‘’যুদ্ধ” এর হুমকি যদি পুনরাবৃত্তি হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশ যেভাবে মুক্ত করছে তাতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রমবর্ধমান শক্তির ব্যাপারে সচেতন হচ্ছেন বলে আমরা মনে করি।

তিনি বলেন এই হুমকি একজন “চরম পরিশ্রান্ত জেনারেল” উচ্চারণ করতে পারেন যিনি তার দেশের মানুষের কাছ থেকে এবং এমনকি সেনাবাহিনীর বিদ্রোহের মুখোমুখি হয়েছিলেন।

তিনি বলেন একমাত্র ‘নৈরাশ্যের রাজা’ই মনে করতে পারেন যে যুদ্ধে ভারত সেনাবাহিনী পরাস্ত হবে। অন্যদিকে “সেনাবাহিনী, নৌ ও বিমান বাহিনীতে আমার ছেলেরা আদেশের জন্য প্রস্তুত”, যোগ করেন তিনি।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বলেন যদি হামলা চালায়. “আমি শুধু আমার সীমানা রক্ষা করা করবো না বরং তার সীমানার গভীরে তাকে প্রথিত করব। ’’

জনাব জগজীবন রাম বলেন ইন্দো- পাকিস্তান বিরোধের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের বাহিনী হস্তক্ষেপ করবে না বলে তিনি মত পোষণ করেন। তিনি বলেন যারা উদ্বাস্তু- অন্তঃপ্রবাহের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেন তাদের প্রজ্ঞার গভীরতা তার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪১। মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির ভাষণের সারাংশ ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২৯ সেপ্টেম্বের, ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ৪১, ৮২>
অনুবাদ

মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির ভাষণের সারাংশ
২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

ভারতীয় জনগণের প্রচেষ্টা প্রায়ই নস্যাৎ হয়ে গেছে বিভিন্ন বহির্মুখী চাপে। এই বছরের শুরুর দিকে আমাদের সাধারণ নির্বাচনে ভারতের জনগণ আমাদের দেশ এগিয়ে নিয়ে যাবার ম্যান্ডেট দিয়েছে। আমরা অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নয়নে জোর দিয়েছি। ঠিক এমনই এক সময়ে আমাদের সীমানা জুড়ে একটি নতুন ধরনের অনুপ্রবেশ শুরু হল। এরা কোন সশস্ত্র লোক নয়। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা অসহায় সন্ত্রাস জর্জরিত নারী, পুরুষ ও শিশুদের একটি সুবিশাল অন্তঃপ্রবাহ হতে থাকল। এদের অনেকে আহত, অসুস্থ এবং সবাই ক্ষুধার্ত। গত ছয় মাসের মধ্যে ৯ মিলিয়ন মানুষ এসেছে এবং আসছে প্রতিনিয়ত। ইতিহাসের পাতায় এর চেয়ে বড় কোন মাইগ্রেশন আর কি হয়েছে?

যখন লাখ লাখ মানুষ অন্য দেশের সীমানায় পুশ করা হয়, সেই দেশের মানুষের স্বাভাবিক জীবন, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা, নিরাপত্তা ও শান্তি হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ে। আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ সহনশীলতায় দেখাচ্ছি। কিন্তু দরকার হলে সঙ্কটের মূল কারণ দূর করার জন্য অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে নিয়ে গ্রহণযোগ্য একটি রাজনৈতিক সমাধান এর জন্য ব্যাবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত, এমন কোন চেষ্টা করা হচ্ছেনা। এটা বিশ্ববাসীর দায়িত্ব যে আর দেরী না করে নিরাপত্তা এবং মর্যাদার সাথে উদ্বাস্তুদের তাদের বাড়িতে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া সক্রিয় করতে সচেষ্ট হয়ে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে সাহায্য করা —-

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪২। বাংলাদেশ প্রশ্নে পাকিস্তানের সাথে কোন আলোচনা হবেনা – জাতিসঙ্ঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধির ঘোষণা দৈনিক স্টেটসম্যান ৭ অক্টোবর, ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ৪২, ৮৩>
অনুবাদ

বাংলাদেশ প্রশ্নে পাকিস্তানের সাথে কোন আলোচনা নয় – জাতিসঙ্ঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধির ঘোষণা

ইউ.এন.এইচ.কিউ ৬ অক্টোবর – বাংলাদেশের সমস্যা শুধুমাত্র পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় – এই কথায় ভারত সকল দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা দৃঢ় ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।
– ভাষ্য পিটিআই।

জাতিসঙ্ঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি, জনাব সমর সেন সাধারণ পরিষদে স্পষ্ট ভাবে গতকাল একটি সমুচিত জবাব দেন। তার আগে পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের নেতা জনাব মাহমুদ আলী তার বক্তব্যে এমন অভিযোগ করায় তার উত্তরে তিনি একথা বলেন।

জনাব সেন বলেন, ‘বাংলাদেশের সমস্যা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে। ’ তিনি ঘোষণা করেন, ‘আমরা এর ভিতরে আসতে চাইনা। ’

“আমরা এটার ভেতরে ঢুকতে পারিনা এবং আমাদের আসা উচিত নয়। যারা মনে করে যে এক্ষেত্রে ভারতীয় সহযোগিতার প্রয়োজন তাদের উপলব্ধি করা উচিত যে, প্রতিবেশীর সঙ্গে সহযোগিতা সবসময় স্বাগত জানানো হয়। পাকিস্তান যে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে, যেখানে মানবাধিকার বিলুপ্তির পথে, সেই কাজ করতে ভারত অংশীদারিত্ব করতে পারেনা। পাকিস্তান কাশ্মীর সম্পর্কে এবং সেখানকার নৃশংসতার ব্যাপারে কখনো কথা বলতে আসেনি।

ভারত পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব শরণ সিং উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু জনাব সেন ভারতের পক্ষ থেকে বিবৃতি দেন।

জনাব সেন জনাব আলী কর্তৃক প্রণীত অভিযোগ অস্বীকার ও ভিত্তিহীন বলে আখ্যা দেন। জনাব আলি প্রথমে একটি সংবাদ সম্মেলনে এবং পরে সাধারণ পরিষদে বলেন যে ভারত ২৯ সেপ্টেম্বর আগরতলায় সীমান্ত জুড়ে ১০০০ শেল নিক্ষেপ করেছে। নয়া দিল্লির একটি টেলিগ্রাম তিনি পাঠ করেন, যাতে বলা আছে শেলিং আসলে পশ্চিম পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী ভারতীয় ভূখণ্ডের উপরে করেছে এবং গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বিপুল মানুষ হত্যা করছে।

ভারত ৪০০ টি অভিযোগ করেছিল, টেলিগ্রামে উল্লেখিত।

জনাব সেন বলেন জনাব আলীর অভিযোগে প্রমাণিত হয় যে পাকিস্তান আগ্রাসী প্রয়াস চালাচ্ছে।

তার বক্তব্যে পাকিস্তানের প্রতিনিধি কাশ্মীরের সাথে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সমার্থক বোঝাতে চেয়েছিলেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, প্রায় ১ মিলিয়ন উদ্বাস্তু ভারত থেকে কাশ্মীর পালিয়ে গেছে এবং তারা অভিযোগ করে যে ভারত তাদের ফিরিয়ে নেয়ার পরিবেশ তৈরি করছেনা।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪৩। সিমলায় অনুষ্ঠিত সর্বভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষণ ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৮ অক্টোবর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ৪৩, ৮৪-৯১>
অনুবাদ

সিমলা সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এর ভাষণ, অক্টোবর ৮, ১৯৭১

আমি, এ.আই.সি.সি সদস্যদের প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ যারা সর্বসম্মতিক্রমে এবং সর্বান্তকরণে ইন্দো-ইউ.এস.এস.আর চুক্তি অনুমোদন করেছেন। এটি একটি রাজনৈতিক কাঠামো, তাই, পৃথক সাধারণ অনুমোদন এবং পূর্ণ এনডোর্সমেন্টের এর পাশাপাশি আমাদের জন্য পরিষ্কারভাবে এই নথির বিষয়বস্তু এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ধারনা সম্পর্কে স্পট হওয়া জরুরী। আমি এই চুক্তিটিকে চারটি গুরুত্বপূর্ণ দিক এবং উপাদানের সমন্বয়ে বিবেচনা করতে চাই। প্রথমত, এটা দুই দেশের মধ্যে চলমান চুক্তি উপনিবেশবাদ বর্জন এবং বর্ণবাদী শাসকদের অবদমনের জন্য কাজ করবে। এটি একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ যৌথ ঘোষণাপত্র। একথা অনস্বীকার্য যে এখনো বিশ্বের বড় অংশ ঔপনিবেশিক আধিপত্য ও বর্ণবাদী শাসকদের অধীনে আছে। পর্তুগিজ ঔপনিবেশিক শাসন এখনও ঔপনিবেশিক আধিপত্য ও বর্ণবাদী শাসকদের অধীনে চলমান। বর্ণবাদী শাসকরা এখনও দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন অংশ গিনি, নামিবিয়া এবং রোডেশিয়ায় তাদের প্রভাব চালাচ্ছে এবং জাতিসংঘের গৃহীত রেজল্যুশনে তা অন্তর্ভুক্ত। এটা সবসময় আমাদের অর্গানাইজেশনের লক্ষ্য ছিল যে উপনিবেশবাদ বর্জন করতে হবে এবং বর্ণবাদী শাসকদের হটানোর জন্য কংগ্রেস কাজ করছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধু আমরা ধারণ করিনা বরং স্বাধীনতার পর এটা আমাদের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। কংগ্রেস সংগঠন সবসময় উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে একটি খুব শক্তিশালী কন্ঠ উত্থাপন করেছে এবং বাস্তবিকই জাতির পিতা মহাত্মা জি, দক্ষিণ আফ্রিকাতেই নিজেই তার প্রথম রাজনৈতিক কার্যকলাপ শুরু করেছিলেন। এটা পরিতাপের বিষয় এবং দুর্ভাগ্যের ব্যাপার যে দক্ষিণ আফ্রিকা এখনও বর্ণবাদী শাসনামলে নিমজ্জমান ও জাতিবিদ্বেষ অনুশীলন চলছেই। চুক্তিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের মধ্যকার চুক্তিতে যে উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদের অবশিষ্টাংশ শেষ করার গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল যা মনে করিয়ে দেয়া হয়।

চুক্তির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল জোটনিরপেক্ষ নীতি যা ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্বীকৃতি পেয়েছে। এটা অবাক ব্যাপার যে কিছু মানুষ, প্রাথমিক পর্যায়ে এটাকে সমালোচনা করেছেন এই বলে যে এই চুক্তি ভারতের জোটনিরপেক্ষ নীতির সাথে সাঙ্ঘর্ষিক। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এই মন্তব্য কোন জোটনিরপেক্ষ দেশ থেকে আসেনি। বরং এমন কেউ মন্তব্য করেছে যারা নিজেরাই জোট নিরপেক্ষ নয় এবং যেখানে সামরিক শাসন ব্যাবস্থা পরিচালিত। ভারতের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের চুক্তি স্বাক্ষরে একে অপরের সাথে কো-অপারেশন ও ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে। অথচ এতে এমন কিছু দেশ কষ্ট পেয়েছে যারা সামরিক চুক্তি এবং প্রতিরক্ষা চুক্তির সদস্য। প্রকৃত পক্ষে এই চুক্তি প্রমাণ করে যে ভারতের কর্মকান্ডে সোভিয়েত ইউনিয়নের শ্রদ্ধা রয়েছে।

শুধু তাই নয়, আমি মনে করি, এটা প্রথমবারের মত একটি আনুষ্ঠানিক নথি যেখানে সোভিয়েত ইউনিয়ন শান্তির জন্য একটি প্রধান ফ্যাক্টর হিসেবে জোটনিরপেক্ষতাকে সমর্থন দেয়। এটি মূলত সারা বিশ্বে উত্তেজনা কমানোর জন্য ছিল। সুতরাং, শুধুমাত্র ভারতের নীতি সম্পূর্ণরূপে সংরক্ষণ করা হয়েছে তা নয় বরং আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির প্রেক্ষাপটে জোটনিরপেক্ষ ধারণার বৈধতা চতুর্থ ধারায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

আমিও সর্বশেষে মস্কোতে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সফর শেষে যে চুক্তি করা হয় সেই ব্যাপারে হাউসের মনোযোগ আকর্ষন করছি। সেখানেও ভারতের জোটনিরপেক্ষ নীতির ধারণা বিশেষভাবে যৌথ ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়েছিল।

চুক্তির তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিধান হল বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা। দুটি দেশ, প্রযুক্তি ক্ষেত্রে এবং পারস্পরিক সুবিধার জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্পর্কযুক্ত থাকে। ফলে এই চুক্তি অনুযায়ী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পাওয়া যাবে। সর্বশেষ অত্যাধুনিক প্রযুক্তি অগ্রিম ভিত্তিতে, ইলেকট্রনিক্স ক্ষেত্রে অগ্রগতি ও অন্যান্য অত্যাধুনিক ক্ষেত্র যাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিঃসন্দেহে অসাধারণ উন্নতি করেছে, ভারত এই চুক্তি অনুযায়ী সম্পূর্ণরূপে কোনো বিশেষ পরিস্থিতির জরুরী প্রয়োজনে উপকৃত হবে বলে আশা করা যায়। ভারতের সুবিধা হল যে আমরা আমাদের অর্থনীতিকে, শিল্পকে এগিয়ে নিতে পারি। ইউএসএসআর এর প্রযুক্তি যা আমাদের কাছে আসবে তা দিয়ে আমরা আমাদের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও জ্ঞান বিস্তারের জন্য জন্য সম্পূর্ণ সুবিধা নিতে পারব।

চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ বিধান যা সম্পর্কে বেশ স্বাভাবিকভাবেই আলোচনা হবে কারণ এটি খুব জনপ্রিয় একটি চুক্তি। বিস্তৃতভাবে এটি নিরাপত্তা দৃষ্টিভঙ্গি উপর বর্ণনা করা যেতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ এই চুক্তিতে ৩ টি ক্লজ আছে যাতে দু’দেশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে যদি অন্য পক্ষ সামরিক সংঘাতে জড়িত হয় তাহলে সেও জড়িত হবে। এই চুক্তি প্রচলিত সামরিক চুক্তি বা পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তির থেকে আলাদা। সেখানে অন্যান্য দেশ জড়িত হলে দেশ এক সশস্ত্র সংঘর্ষে জড়িয়ে যেতে পারে। এই চুক্তিতে এ ধরনের কোন বিধান নেই। সেখানে অবশ্য অনাক্রমণ হিসাবে বর্ণনা করা যেতে পারে। এ সম্পর্কে স্পষ্ট বিধান আছে। অর্থাৎ দুই দেশের কেউ যদি অন্য দেশের সাথে কোনো সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত হয় তাহলে এদের কেউ ঐ দেশকে কোনো ধরনের কোনো সাহায্যের দেব না। তাহলে যদি আমরা কোন দেশের সাথে সংঘাতে লিপ্ত হই তাহলে পূর্বচুক্তি থাকার কারণে সেই দেশকে আমাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ কোন দেশ কোন প্রকার সহায়তা দিতে পারবেনা।

একথা অনসীকার্য যে আমরা ধারাবাহিকভাবে আমাদের শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করব। আমি আশ্বস্ত করতে চাই যে এই চুক্তির ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক সম্পূর্ণরূপে বিবেচনায় নিয়ে এই চুক্তি সুরক্ষিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী সোভিয়েত ইউনিয়ন এখন পাকিস্তানকে কোনো ধরনের সামরিক সরবরাহ করতে পারবেনা। আবার, চৌহান জিভারি স্বচ্ছভাবে ব্যাখ্যা করেন যে, এই চুক্তি খুব গুরুত্বপূর্ণ যা আমাদের নিরাপত্তার জন্য অত্যাবশ্যক। কিন্তু চুক্তির কারণ যুদ্ধ এবং সংঘর্ষ নয়। কিন্তু যুদ্ধ এড়াতে এবং শান্তির বাহিনীকে অধিকতর শক্তিশালী করতে এটি দরকার। সংক্ষেপে, এই চুক্তির ফলে যখন দেশ যেকোন কারণে আক্রান্ত হয় বা একটি আক্রমণের হুমকির সম্মুখীন হয়, তখন দুই দেশ হুমকি এড়ানোর জন্য একে অপরের জন্য “কার্যকর পদক্ষেপ” গ্রহণ করবে। এর ফলে আক্রমণের হুমকির এড়ানো সহজ হবে। এটা খুবই মজার যে অনেকে আমাদের মনে করিয়ে দেন “কে এবং কোথায় তোমার বন্ধু? ’’ তারা আসলে আমাদের চুক্তির ছিদ্র খুঁজছেন। আমি মনে করিয়ে দিতে চাই এই চুক্তি হবার পরে বিরোধী দলের অবস্থান সম্পর্কে – যারা ঐতিহ্যগতভাবে কংগ্রেস এর বিরোধিতা করে। এমনকি তারাও এই চুক্তির পরে প্রথম প্রতিক্রিয়া হিসাবে, তেমন কিছু জোরালভাবে বলেননি। কারণ জানত যে, এই চুক্তি পক্ষে দেশের অনুভূতি এতটাই শক্তিশালী যে, তারা সম্পূর্ণভাবে এর পক্ষে ছিলেন। তারা চুক্তি সমর্থন করেছে তবে তাদের মূল অবস্থান পরিবর্তন করেনি এবং শুধু ফরম্যাট পরিবর্তন করেছে। তবে দেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে – এতে কোন সন্দেহ নেই। যে কেউ স্বীকার করতে বাধ্য হবে যে এর ফলে আমাদের স্বাধীনতা ও জোটনিরপেক্ষতা সুরক্ষিত থাকবে এবং একই সময়ে এটা আমাদের পারস্পরিক সহযোগিতায় গঠনমূলক ভূমিকা রাখবে। নিরাপত্তা কোণ থেকে এই চুক্তি বিবেচনা করলে দেখা যায় এটি আমাদের সার্বভৌমত্ব ও দুই দেশের নিরাপত্তা রক্ষা করার জন্য দরকারি একটি পদক্ষেপ।

সাম্প্রতিক বাংলাদেশ?

বস্তুত আমি এই বিষয়ে আসছি। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সম্পর্কে কথা বলতে গেলে আমাকে আগে চুক্তি সম্পর্কে বলা উচিৎ ছিল। সেটা বলা শেষ করে আমি এখন রাষ্ট্রপতির অনুমতি নিয়ে আমার সম্প্রতি বিভিন্ন রাজধানীতে এবং জাতিসংঘে সাম্প্রতিক সফর সম্পর্কে কিছু বলতে চাই। আমি আন্তর্জাতিক বিশ্বকে বাংলাদেশ সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন দেব। আপনারা সন্দেহাতীতভাবে অবগত আছেন যে, প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রশ্নটি মূলত একটি অভ্যন্তরীণ প্রশ্ন এবং পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার ছিল। কিন্তু সামরিক কর্তৃপক্ষের গণহত্যা, নিপীড়ন এবং নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিক ও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক দলের বিরুদ্ধে শোষণ চলছিল। মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা অবদমনের ফলে এমন নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হয় যে জোরপূর্বক প্রচুর দেশান্তর ঘটতে থাকে। পরিস্থিতি স্পষ্টত আন্তর্জাতিক উদ্বেগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আমার সহকর্মী ও অনেকে নিজে থেকে ভিজিট করে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছেন – বিভিন্ন রাজধানীতে বিবৃতি, যৌথ বিবৃতি, কখনো কখনো সরকারি বিবৃতি দিয়েছেন। এই সমস্যা সমাধান এখন মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অপরিহার্য। অতি সত্ত্বর উদ্বাস্তুদের ফিরে যাবার জন্য একটি নির্ভরযোগ্য পরিবেশ সৃষ্টি করা অবশ্যম্ভাবী।

এখন যদি আমরা সাবধানে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বিতর্ক পরীক্ষা করি তাহলে দেখা যায় যে চারটি বড় ক্ষমতাধর দেশে- যারা নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের ভেটো দেয়ার ক্ষমতা রাখে, তাদের মুখপাত্রদের, তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বক্তব্যে বোঝা যায় তারা পরিস্থিতি বুঝতে পেরেছেন। এই পরিস্থিতির ফলে অসহায় মানুষ বাধ্য হয়ে দেশত্যাগ করছে ও ভারতীয় ভূখন্ডে জড়ো হচ্ছে যা ভারতের জন্য একটি বোঝা। এর ফলে এই এলাকায় অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি হচ্ছে। একটি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধান পারে উদ্বাস্তুদের ফিরে যাবার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে। জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান বাংলাদেশের মানুষের কাছেও গ্রহণযোগ্য হবে এবং সন্দেহাতীতভাবে বাংলাদেশের মানুষ তাদের উপর নির্ভর করে এবং শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের ওপর তাদের নির্ভরতা আছে যেটি তারা অভূতপূর্ব নির্বাচনী বিজয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন যেখানে জাতীয় পরিষদে ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি আসন পেয়ে দলটি জয়ী হয়েছে। এই ছিল পরিস্থিতি এবং নিরাপত্তা পরিষদ-এর চার স্থায়ী সদস্য সোভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং সেইসাথে বৃটেন এগুলো বিস্তৃতভাবে গ্রহণ করে এবং নিরাপত্তা পরিষদে তাদের বিবৃতি তাদের প্রতিনিধিদের দ্বারা প্রণীত হয়েছে। বিভিন্ন দেশের, বিশেষ করে যেখানে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, এবং সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা প্রকাশ্যে এই পরিস্থিতিতে ভারতের পদক্ষেপের প্রশংসা করেছে।

সমগ্র বিশ্বে, আমরা শুধু ইতিবাচক বিষয়গুলো বলব, নেতিবাচক বিষয়গুলো নয়। এই সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা যে সার্বভৌম দেশ, যারা জাতিসংঘের সদস্য, তাদের একটি মোটামুটি বড় সংখ্যা আছে যাদের তাদের দেশে ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে সামরিক শাসক – যার মধ্যে পাকিস্তানও আছে। ঔপনিবেশিক যুগ-পরবর্তী সময়ের জন্য এটি একটি দু: খজনক অভিজ্ঞতা। বিপুল সংখ্যক দেশ স্বাধীন হয়েছে। এদের মধ্যে কিছু সংখ্যক দেশে গণতন্ত্র চর্চা, গণতান্ত্রিক কাঠামোর, গণতান্ত্রিক মতাদর্শ, গণতান্ত্রিক সংবিধান এগুলো সৃষ্টি হয়। কিন্তু এটি নিষ্ঠুর বাস্তবতা যে কোথাও কোথাও গণতন্ত্র শিকড় গাঁড়তে অক্ষম ছিল। প্রেসিডেন্সিয়াল বা পার্লামেন্টারি যে ধরণের হোক না কেন তা টেকেনি। শোনা যায় যে ইয়াহিয়া খান নির্বাচন দিতে ব্যার্থ হয়েছিলেন। এমনকি তারা নির্বাচন করার কথা বলে এখন পিছুটান দিচ্ছেন। এখন অবস্থা এমন যে তিনি চাইলেও এর থেকে এড়িয়ে চলতে পারবেন না। এতকিছুর কারণে আমাদের গণতান্ত্রিক আদর্শ, আমাদের আনুগত্য, আমাদের প্রেম যখন বাধাগ্রস্ত হবে তখন স্বাভাবিকভাবেই আমরা তা মেনে নেবনা। কারণ আমাদের দেশে আমরা গণতন্ত্রের শিকড় প্রতিষ্ঠায় সফল হয়েছি। অন্য কিছু দেশ যাদের অভিজ্ঞতা আমাদের মত না তারা অনেকে আমাদের মত প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না- কারণ আমাদের মত তারা বিষয়গুলো অনুধাবন করলে এইসব ইস্যুতে স্বাভাবিক ভাবে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াত।

জাতিসংঘে উপরোক্ত আলোচনার পরে আমি একটি ইতিবাচক এবং একটি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে চাই। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি হল এইসকল ইস্যুতে ইতোমধ্যে যেসব দেশের প্রতিনিধিরা আমাদের সমর্থন দিয়েছেন তারা পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের মনোভাব পরিবর্তন সম্পর্কে একই ধারনা পোষণ করেন এবং এর ফলে ভবিষ্যতে তাদের কাছ থেকে তাদের প্রভাবকে কাজে লাগানো যেতে পারে। এবং আমি বলতে চাই যে, পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু যারা পাকিস্তানের সাহায্যকারী তারা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও তার সামরিক জেনারেলদের পরিস্থিতি মোকাবেলা করার পদ্ধতি জেনে ও এই সামরিক পদ্ধতির ব্যর্থতা সম্পর্কে আন্দাজ করতে পেরেছে এবং তারাও মনে করে সামরিক পদ্ধতি পরিত্যক্ত করা উচিৎ। এবং তারা মনে করে রাজনৈতিক ভাবেই এর সমাধান করতে হবে। আমরা জানতে পেরেছি যে যারা পাকিস্তানের বন্ধু তারাও এখন পাকিস্তানকে বোঝানো শুরু করেছে যে সামরিক কর্মকান্ড বন্ধ করতে হবে এবং সমস্যা সমাধানের জন্য রাজনৈতিক পথ অবলম্বন করতে।

আমাদের নিজেদের দেশে কিছু সমালোচক আমাদের নীতির ছিদ্রানুসন্ধান করার চেষ্টা করেছে। আমরা যখন বলি যে সেখানে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা হতে হবে, তখন তারা বলে কেন আমরা বাংলাদেশ সম্পর্কে আপোস করছি? আমি এই দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে কিছু বলতে চাই। আমাদের অবস্থান স্পষ্ট। আমরা বলি যে বাংলাদেশের জনগণ দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে যা গ্রহণযোগ্য তা আমাদের কাছেও গ্রহণযোগ্য হবে। এটা স্বাধীনতার ভিত্তিতে হবে নাকি বৃহত্তর একটি উপনিবেশ হবে সেটা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সিদ্ধান্ত নেবেন। একমাত্র এই পদক্ষেপের পরেই সেখানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে পারে। যা শরণার্থীদের ফেরত যেতে সহজতর করবে।
আমি এই পর্যায়ে বলতে যে এটি সর্বজন গৃহীত হয়েছে এবং এটা সবাই উপলব্ধি করেছে যে ভারত শরণার্থীদের বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছে এবং তাড়া তাদের রেখে দিতে চায়না। ঐতিহাসিক কারণে এবং বিভিন্ন সমস্যা থাকা সত্ত্বেও মানবিক কারণে আমরা উদ্বাস্তুদের প্রতি সমবেদনা মনোভাব গ্রহণ করি। নিজেদেরকে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের দেখাশোনার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এখন স্বাধীনতার ২০ বছর পর একজন পাকিস্তানে অবস্থানরত মানুষ হয় একজন পাকিস্তানি নাগরিক, অথবা বাংলাদেশের নাগরিক অথবা একটি পশ্চিম পাকিস্তানের নাগরিক এবং যখন কোন বিদেশি নাগরিক ভারতে আসে আমরা তাকে দেখাশোনা করব এটাই স্বাভাবিক। ভৌগলিক কারণে আমাদেরকেই আগে এগিয়ে আসতে হবে। প্রাথমিক দায়িত্ব আমাদের উপর বর্তালেও আন্তর্জাতিক আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও দায়িত্ব রয়েছে। আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সাহায্য দিতে বলি তাতে আমাদের উপর সামান্য ভরও যদি কমে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, কোনো দেশ যারা আমাদের এই উদ্বাস্তুদের দেখাশোনা করার জন্য এইড দিতে পারে। মনে রাখতে হবে এটি পাকিস্তান বা বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাহায্য। ভারতের কোন সহায়তা নয়। আমরা বলেছি যেকোন পরিমাণ সাহায্য সাদরে গৃহীত হবে যা আমাদের বোঝা লাঘব করবে। ৯ মিলিয়ন লোক সেখানে যে আর্থ-সামাজিক সমস্যা তৈরি করেছে তা পরিমাপ যোগ্য নয়। এটাকে ডলার, পাউন্ড, ডাচমার্ক বা ইয়েন দিয়ে মাপা যায়না। এতে বস্তুত আমাদের পুরো দেশ ভুক্তভোগী।

আমি বলতে চাই আমাদের এই গভীর সমস্যায় সমগ্র প্রশাসন ও কেন্দ্রীয় সরকার সাধ্যমত পদক্ষেপ নিয়েছে। উদ্বাস্তুদের দেখাশোনা যতটুকু সম্ভব চালিয়ে যাবার পাশাপাশি আমাদের উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। ভারতের ৫৫ কোটি মানুষ যে ভোগান্তি আর ক্ষতির স্বীকার হচ্ছে তা কোন পরিসংখ্যান, হিসাব, অর্থমূল্য দিয়ে বিচার করা যায়না। উদ্বাস্তুদের জন্য আমরা অসংখ্য স্কুল বন্ধ করে দিয়েছি। অসংখ্য হাসপাতালে চিকিৎসকরা শুধু তাদের চিকতসা দেবার জন্য নিয়জিত আছেন। এমনকি মেডিকেলের ছাত্ররা তাদের পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটিয়ে সেখানে উদ্বাস্তুদের জন্য কাজ করছে। কত শত শিক্ষার্থি আর স্বেচ্ছাসেবক উদ্বাস্তুদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে তার সীমা নেই। যদি এদের জন্য যত অর্থ দরকার তার সবটা পাওয়া যেত হয়ত ভারত নিশ্চিন্ত থাকতে পারত। এই একটি খুব বিপজ্জনক দিক যে সাধারণভাবে যদি আপনি অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেন, তারা আপনাকে বলবে এটি বেশ বড় বোঝা, তারা অনেকটা সহানুভূতিশীল হবে, আমরা জানি। কিন্তু এটা করা আমাদের উদ্যেশ্য না। হয়তো আমরা আমাদের এই বোঝা শেয়ার করার আবেদন জানাব কিন্তু আমাদের মূল দাবী বাংলাদেশের অবস্থার পরিবর্তনের জন্য পদক্ষেপ নেয়া যাতে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায় এবং এর ফলে উদ্বাস্তুরা তাদের দেশে ফিরে যেতে সচেষ্ট হবে। এটি সমাধানের একমাত্র পথ হচ্ছে বাংলাদেশে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মেনে নেয়া। পুরো দেশের জন্য এটি সবচেয়ে জরুরী এই মুহুর্তে। আমি মনে করি এর গুরুত্ব ইতোমধ্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সরকারগুলো অনুধাবন করেছেন। আমরা বোঝাতে পেরেছি যে আমাদের ধৈর্যের সীমা আছে। এবং আমাদের অধ্যবসায় ও সংযম এর সময় পেরিয়ে গেলে আমাদের জন্য তা আরও বিপদ জনক হবে। এই অবস্থার উন্নতিকল্পে বিশ্বকে এখনই এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের মৌলিক ঐক্য ও আমাদের জাতি ও আমাদের মানুষের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার মানসিকতাই এই মুহূর্তে আমাদের মূল শক্তি।

চীন গণপ্রজাতন্ত্রী সম্পর্কে, লক্ষ্য করে থাকবেন যে পিকিং থেকে কিসিঞ্জার তার দ্বিতীয় সফর শেষে দেখা গেল আমেরিকা তাদের নীতি পরিবর্তন করেছে। তাদের চেষ্টা ছিল চিনকে জাতিসংঘের বাইরে রাখা। যখন যুক্তরাষ্ট্র তাদের নীতি অবলম্বনকারী কিছু দেশেকে একীভূত করতে চাইছে ঠিক সেই মুহুর্তে তারা ওইসব দেশের ব্যাপারে তাদের কূটনীতি পরবর্তন করে ফেলেছে। তবে কূটনীতি হঠাত করে পাল্টে ফেলা যায়না। তাই তাদেরকে খুব রহস্যজনক পদ্ধতি অবলম্বন করতে হচ্ছে। হঠাৎ করে দেখা যাচ্ছে যে আমেরিকা চিনকে জাতীয় পরিষদের সদস্য করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে ও পদক্ষেপ নিচ্ছে – শুধু তাই নয় নিরাপত্তা পরিষদেও চিনকে প্রবেশ করানোর জন্য কাজ করছে যেখানে ভেটো ক্ষমতা পর্যন্ত রয়েছে। অন্যদিকে তাইওয়ানকেও তারা প্রতিনিধিত্ব করছে। ঐতিহাসিকভাবে আমেরিকা তার সমর্থকদের এতদিন বুঝিয়ে এসেছে যে তাইওয়ান সরকার শুধু ফরমোজা ও তাইওয়ানের নয় বরং এটি সমস্ত চিনের। কিন্তু হঠাত করে এখন তারা তাদের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। ভারত যতদূর জানে, চীনের সাথে আমাদের সম্পর্কে যত সমস্যা থাকুক না কেন, সেটি খুব স্পষ্ট এবং এই পরিবর্তিত অবস্থায় আমাদের মনোভাব একটি কমাও পরিবর্তন করার প্রয়োজন আমরা মনে করিনা। আমরা বিশ্বাস করি চিন এক এবং চীন একটি গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র এবং একটি সরকার সেখানে বলবত আছে। এবং জাতিসংঘে তার ন্যায়সঙ্গত জায়গা তার পুনরুদ্ধার করা উচিত। তবে এই সেশনে তারা ফরমজাকে নিজেদের হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারবে কিনা সে ব্যাপারে আমি সন্দিহান। আমি মনে করি সে তার অবস্থান পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে প্রচুর সমর্থন পাবে। আমরা বিশ্বাস করি অস্থিতিশীল বিশ্বের লাঘব কমাতে চীন তার সাধ্যমত দায়িত্ব পালন করবে এবং জাতিসঙ্ঘে তাদের অবস্থান তুলে ধরবেন। এর জন্য আন্তর্জাতিক বিশ্ব দীর্ঘদিন আগ্রহী – যার জন্য আমরাও অপেক্ষা করছি।

আমাদের ধারনা যে চীনকে এত সময় বাইরে রাখায় কিছু জটিলতা ও অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। এটা স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগবে – যদিও চীন জাতিসঙ্ঘের সাথে যুক্ত হয়। আন্তর্জাতিক কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মুখোমুখি আমরা অবস্থান করছি।

আরও স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, আমি কয়েক মিনিট ইউরোপের সর্বশেষ উন্নয়ন সম্পর্কে বলব। কোনো সন্দেহ নেই যে, ইউরোপে স্পষ্টভাবে উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হয়েছে। এই প্রাথমিকভাবে সম্ভব হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির চ্যান্সেলর জনাব উইলি ব্রান্ডিট এঁর সাহসের কারণে। তার ইচ্ছাতেই সোভিয়েত নীতির পরিবর্তন করা হয়েছে এবং অবশ্যই সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে একটি খুব ভাল ফল পেয়েছে। এবং জার্মানি ও ইউএসএসআর এর মধ্যে মস্কো চুক্তি ইউরোপীয় উত্তেজনার শিথিলকরণে একটি নতুন দ্বার খুলেছে। উভয় পক্ষ মনে করেন এতে নতুন উন্নয়নশীল অবস্থা সৃষ্টি হবে। সর্বশেষ বার্লিনে চার ক্ষমতা চুক্তি, একটি আশা সৃষ্টি করেছে যে ইউরোপের উত্তেজনা শিথিলকরণ হচ্ছে। এতে করে শান্তি তরান্বিত হবে বলে আমরা মনে করছি। এর ফলে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে বৈরিতার অবসান ও উত্তেজনার শিথিলকরণ হবে। একটি নতুন যুগের সূচনা হচ্ছে বলেই আমরা মনে করছি। সশস্ত্র সংঘাত থেকে মুক্ত হয়ে কিছু উন্নয়নশীল দেশ উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে তাদের অর্থনীতি বিকশিত করার জন্য সুযোগ পাবে।

এই হল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি। ভিয়েতনাম ও মধ্যপ্রাচ্যের অবস্থা সম্পর্কে আমার কাছে নতুন কোন তথ্য নেই। পশ্চিম এশিয়া এবং পূর্ব এশিয়ায় এখনও যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করছে – জানিনা এখান থেকে শান্তির পথে কবে আমাদের উত্তরণ হবে – যদিও আমরা তার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছি।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪৪। পাকিস্তান যুদ্ধ বাধালে ভারতের সৈন্যরা দখল করা পাকিস্তানী এলাকা ছাড়বে না – প্রতিরক্ষা মন্ত্রী দৈনিক যুগান্তর ১৮ অক্টোবর ১৯৭১

Aparajita Neel
<১২, ৪৪, ৯২-৯৩>
পাকিস্তান যুদ্ধ বাধালে ভারতের সৈন্যরা দখল করা পাক অঞ্চল ছাড়বেনা
– জগজীবন

জলন্ধর, ১৭ অক্টোবর (পি টি আই ও ইউ এন আই) – প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শ্রী জগজীবন রাম আজ পাকিস্তানকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে, ভারতের উপর যদি যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয় তাহলে যা ঘটুক না কেন, ভারতীয় সৈন্যবাহিনী পাকিস্তানের যে অঞ্চল দখল করবে সেখান থেকে তারা সরে আসবে না। আমরা সেখান থেকে সৈন্যবাহিনী অপসারণ করব না।

শিয়ালকোট ও লাহোর থেকে জনসাধারণ অন্যত্র চলে যাচ্ছে এই মর্মে সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদের উল্লেখ করে প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, পাকিস্তানী সামরিক জান্তা আমাদের উপর যদি যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় তাহলে আমাদের সেনাবাহিনী এগিয়ে গিয়ে এই সব শহর দখল করবে এবং পাকিস্তানের দখলীকৃত অঞ্চল থেকে এবার আমরা সরে আসবও না, তাতে যাই ঘটুক না কেন।

প্রতিরক্ষামন্ত্রী আরও বলেন যে, বাংলাদেশ প্রসঙ্গে অমীমাংসিত থাকা পর্যন্ত সীমান্ত থেকে ভারত তাঁর সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করবে না।

এখান থেকে ২০ কিলোমিটার দুরে কর্পুর তলায় এক জনসভায় ভাষণ প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী এ ব্যাপারে যেকন আন্তর্জাতিক চাপ প্রতিরোধে ভারতের দৃঢ় সংকল্প ঘোষনা করেন।

শ্রী রাম বলেন যে, ভারতের আঞ্চলিক অখণ্ডতার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের যে কোন দুরভিসন্ধির উপযুক্ত জবাব দেওয়ার জন্য বর্তমান প্রস্তুতি অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের যুদ্ধ হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রস্তুতি প্রয়োজন। ইয়াহিয়া খান বলেছেন যে, বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী কোন অঞ্চল দখল করলে, পাকিস্তান ভারতের উপর তাঁর প্রতিশোধ গ্রহণ করবে।
শ্রী রাম বলেন, সময় যত অতিবাহিত হবে, মুক্তিবাহিনী ততই অগ্রগতি হবে এ বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই এবং অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশে পরিণত হবে।

নাশকতামূলক কাজের জন্য ভারত পুর্ব বঙ্গে অনুপ্রবেশকারীদের পাঠিয়েছে বলে পাকিস্তান যে অভিযোগ করেছে তিনি তাঁকে ভিত্তিহীন ও খেলো বলে বর্ননা করেন।

শ্রীরাম বলেন যে, পাকিস্তান নিজের অপকর্মের জন্য ভারতকে দোষারোপ করতে যাচ্ছে। জনসভায় প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে পাঞ্জাবের বীরত্ব ও সাহসিকতার প্রতীক একখানি তরবারি উপহার দেয়া হয়। শ্রী রাম উপহার গ্রহণ করে, পাকিস্তান যদি ভারত আক্রমণের সাহস করে থাকে তাহলে পাকিস্তানকে পরাভূত করার আশ্বাস দিয়ে বলেন যে, তিনি চিরদিন গান্ধীজীর আদর্শে বিশ্বাসী কিন্তু দেশের অখণ্ডতার সঙ্গে কোন প্রকার আপোষ হতে পারেনা।

তিনি বলেন, শরনার্থিরা একদিন তাদের নিজ গৃহে ফিরে যাবে, কিন্তু ইয়াহিয়া খানের পাকিস্তানে নয়, মুজিবের বাংলাদেশে।

শ্রী জগজিবন রাম বলেন যে, পাকিস্তানের প্রায় অর্ধাংশের বিলুপ্তি হয়েছে এবং ভারতের যুদ্ধ করতে নাও হতে পারে। ইয়াহিয়া খান এখন বুঝতে পারছেন যে, বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীর শক্তি বাড়ছে এবং বিশ্বের জনমত ক্রমশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিবাহিনী শুধু এক ঘা দেওয়া প্রয়োজন।

শ্রী রাম বলেন যে, সীমান্তের নিকটবর্তী গ্রামবাসীদের তিনি অন্যত্র সরে যেতে বলবেন না কারণ তিনি জানেন যে, তাদের মনোবল অটুট আছে এবং সাহসের সঙ্গেই তারা যে কোন বিপদের সম্মুখীন হতে পারবেন।
শ্রী বিদ্যাচরন শুক্লের ভাষণ
রায়পুর, ১৭ অক্টোবর (পি টি আই) – প্রতিরক্ষা উৎপাদন দফতরের মন্ত্রী শ্রী বিদ্যাচরন শুক্ল গত রাত্রে এখানে এক সাংবাদিক বৈঠকে বলেন যে, সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তানী সৈন্য সমাবেশের সংবাদ সম্পর্কে ভারত সম্পূর্ন অবগত।

তিনি বলেন, পাক সৈন্য অথবা যে কোন শত্রপক্ষ আক্রমণের মোকাবিলার জন্য আমরা সম্পূর্ন প্রস্তুত এবং আমরা আমাদের শত্রুপক্ষকে আমাদের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি জানিয়ে দিতে চাই।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪৫। নিউইয়র্ক টাইমস এর প্রতিনিধি সিডনি এইচ শ্যানবার্গের সাথে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির সাক্ষাতকার দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস ১৯ অক্টোবর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ৪৫, ৯৪-৯৬>
অনুবাদ

সিডনি এইচ শ্যানবার্গের সাথে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির সাক্ষাতকার

১৯ অক্টোবর, ১৯৭১ নিউ ইয়র্ক টাইমস, এর সংবাদদাতা সিডনি এইচ শ্যানবার্গ ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর একটি সাক্ষাত্কার প্রকাশিত করে।

প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা করেছেন যে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সীমান্তে সামরিক পরিস্থিতি খুব খারাপ।

১ ঘন্টা দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা অবশ্যই যুদ্ধবিগ্রহ শুরু করতে চাইনা। কিন্তু আমরা আমাদের স্বার্থ রক্ষা করব এবং আমাদের নিরাপত্তা রক্ষা করব’।

“দুর্ভাগ্যবশত” তিনি আরো বলেন, “পাকিস্তান ঘৃণা এবং হতাশার রেকর্ড করেছে। সামরিক শাসক তার নিজের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছে এবং জানিনা এর পরে তারা কি করবে। ”

প্রধানমন্ত্রীকে সচিবালয়ে তার কার্যালয়ে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। তাকে পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা বিদ্রোহীদের ভারত সামরিক সহায়তা প্রদান করছে বলে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বিরক্ত হন।

কিন্তু তিনি সুনিশ্চিতভাবে অস্বীকার করেন নি যে ভারত তাদের সাহায্য করছেনা। তিনি বলেন, “সম্ভবত আপনি জানেন, তাদের নিজেদের অনেক সাহায্যকারী আছে, বেশিরভাগ, সব বিশ্বজুড়ে। এছাড়াও, অনেক পথ তাদের জন্য খোলা আছে।

সাক্ষাত্কারে মিসেস গান্ধী বলেন, তাদের অস্ত্র থাক বা না থাক তাদের সংগ্রাম কেউ বন্ধ করতে পারবেনা।

তিনি বিশেষত সপ্তাহে আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের দেয়া বক্তব্যকে উল্লেখ করেন, যে বক্তৃতায় তিনি ভারতকে “উন্মাদের মত যুদ্ধপ্রস্তুতি” নেবার দায়ে অভিযুক্ত করেন এবং এই হুমকি মোকাবেলায় তার দেশের ১২০ কোটি মুজাহিদ বা ইসলাম প্রচারকদের, যাদের “হৃদয় মহানবী (স) এর প্রতি ভালবাসায় পূর্ণ” আহবান জানান।

তিপ্পান্ন বছর বয়সী প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়ভাবে বলেন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এই সময়ে কোনো শান্তি আলোচনা হবে না। আগে পাকিস্তানকে তার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে একটি আপস বন্দোবস্ত করে পূর্ব পাকিস্তান সংকটের সমাধান করতে হবে।

প্রায় সাত মাস ধরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদ আন্দোলন চলছে তা দমন করার চেষ্টা করছে। এই দল গত ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেও সামরিক শাসকদের দ্বারা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল ২৫ মার্চ।

সামরিক দমনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে লাখ লাখ শরণার্থী পালিয়ে আসছে।

মিসেস গান্ধীকে জিজ্ঞেস করা হয় যদি শরণার্থীদের কারণে ভারতের অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপ ব্রেকিং পয়েন্টে চলে আসে তাহলে ভারত অন্তঃপ্রবাহ বন্ধে পাকিস্তানের বিপক্ষে সামরিক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে কিনা।

“আসলে আমি বলব, আমরা ইতিমধ্যে সেই পয়েন্টে এসে পৌঁছেছি”, তিনি বললেন। “কিন্তু এর মানে এই নয় যে, আমরা এর কারণে ফাটল সৃষ্টি করতে যাচ্ছি”।

“আমরা অবশ্যই একটি দ্রুত সমাধান চাই, কিন্তু আমরা বড় কোন সমস্যার সৃষ্টি করতে চাই না”। “যেহেতু আপনারা জানেন, আমরা অত্যন্ত সংযত হয়ে আছি। আমি এই ব্যাপারে গভীর চিন্তা করছি। আপনারা একটি দেশের নাম বলুন যারা এতোটা সংযম ও ধৈর্য দেখাতে পারে। ’’

গত কয়েক সপ্তাহে, উভয় দেশ তাদের পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে তাদের সৈন্য সংখ্যা বাড়িয়েছে। উভয় দেশের প্রেসে অনেক লেখা হয়েছে। ১৯৬৫ সালে কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধ হয়।

তা সত্ত্বেও, মিসেস গান্ধী বলেন তার পরিকল্পনায় এখনো তিনি কোন পরিবর্তণ আনেননি যদিও পরিস্থিতি খুব ভয়াবহ। তার পরবর্তি ৩ সপ্তাহ বিদেশ সফর করার কথা আছে যা আগামী রবিবার থেকে শুরু হবে। তিনি লন্ডন এবং ওয়াশিংটন সহ ছয় টি পশ্চিমা রাজধানীতে যাবেন যার পরে তার পরিকল্পনা নির্দেশিত করবেন।

প্রধানমন্ত্রী বললেন যে আমেরিকার অবস্থান দেখে বোঝা যাচ্ছে তারা দুরদর্শী চিন্তা করছেন না পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে।

“বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক শাসন কোন ভাবেই পাকিস্তান শক্তিশালীকরণ করছেনা – বলেন তিনি।

মিসেস গান্ধী নিক্সন প্রশাসন থেকে কিছু অস্ত্র চালান পাকিস্তানে আসছে বলে উল্লেখ করেন। তারা পাকিস্তান সরকারকে নিয়ে সমালোচনায় আগ্রহী নন।

তবে আমাদের সাথে আমেরিকা এবং তার জনগণের সাথে বন্ধুত্ব বজায় আছে। তিনি বলেন, “কিন্তু যতদূর ভারতীয় জনগণ বুঝতে পারে যে তারা মূলত ভারত ও পাকিস্তানকে ব্যালেন্স করে চলছেন। ’’

পাকিস্তানে আমেরিকান অস্ত্র সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমি জানি না তারা আসলে কি চাচ্ছেন, কিন্তু অতীতে তারা বড় পরিমাণে সরবরাহ করেছেন। তারা শুধু ভারতের বিরুদ্ধে এগুলো ব্যাবহার করছে।

“এই ব্যাপারে”, তিনি বলেন, “আমরা অবশ্যই সোভিয়েত ইউনিয়ন এর কাছ থেকে অনেক বেশি বুঝতে পারছি। ’

মিসেস গান্ধী বলেন “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্ক আমাদের কাছে খুবই অদ্ভুত মনে হয়। আমরা সোভিয়েত ইউনিয়নকে আমেরিকার চেয়ে বেশী সমর্থন করি না, বরং আমরা উভয় কে সমানভাবে সমর্থন করি।

মূল বিষয় হল সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের কিছু মৌলিক বিষয়ে আমাদের সমর্থন করে যার জন্য আমরা লড়াই করেছি। এবং এই সব নিয়ে আমরা জাতিসংঘেও তাদের সঙ্গে ছিলাম সন্দেহ নেই। একটু আগে, আপনি আমেরিকান সাহায্যের সম্পর্কে বললেন। আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে খুব কৃতজ্ঞ এবং তারা নানাভাবে আমাদের সাহায্য করেছেন। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন আমরা রাষ্ট্র খাতের বিকাশ চেয়েছিলাম কিন্তু তখন তারা রাষ্ট্র খাতের সাহায্য করেনি যেটা কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন করেছিল”।

আমরা অবশ্যই ব্যক্তি হিসাবে আমেরিকানদের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রাখছি। ধরেন যদি আমরা রাশিয়ান বা অন্য কেউ হতাম তাহলে কি হত? ভাষাগত বিষয় অবশ্যই একটা ফ্যাক্টর। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে আমি অ্যামেরিকার প্রযুক্তিগত ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিকে পছন্দ করি।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪৬। সীমান্তের পরিস্থিতি মারাত্মক, ভারত তথাপি যুদ্ধ এড়াতে চায় – সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ দৈনিক স্টেটসম্যান ২০ অক্টোবর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ৪৬, ৯৭-৯৯>
অনুবাদ

সীমান্ত পরিস্থিতি ভয়াবহ – শ্রীযুক্তা গান্ধী
-কিন্তু ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ এড়াতে চায়
এর আগে চীনের সঙ্গে রাষ্ট্রদূতদের সাক্ষাতকার বিবেচিত হয়নি
(আমাদের রাজনৈতিক প্রতিবেদক থেকে প্রাপ্ত সংবাদ)

নয়া দিল্লি, ১৯ অক্টোবরঃ ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত পরিস্থিতি বর্ননা করতে গিয়ে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী আজ ঘোষণা করেন যে, ভারত সশস্ত্র সংঘাত এড়াতে সবকিছুই করতে পারে। তিনি যোগ করেন, “কিন্তু যে হাত মুঠো করে রেখেছে তার সাথে করমর্দন করা যায় না।

তবে, কেউ যুদ্ধের বিষয়ে ভবিষ্যতবাণী করতে পারে না। পাকিস্তান বাহিনী সব সীমান্তে ভীড় করেছে। ভারতও প্রয়োজনীয় আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

প্রধানমন্ত্রী আজ সকালে একটি প্রেস কনফারেন্স বলেন যে পাকিস্তানের ভয়প্রদর্শন সত্ত্বেও ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার আসন্ন সফর যাচ্ছেন। সরকার এই পরিস্থিতিতে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করবেন কিনা।

আত্মবিশ্বাসে ভরপুর, প্রধানমন্ত্রী স্বচ্ছন্দে এবং খোশমেজাজে জবাব দেন যে বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতের সঙ্গে আলোচনায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির যে প্রস্তাব, সেটা তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। ভারত শুধুমাত্র একটি ব্যাপারে জড়িত আছে আর তা হল বাংলাদেশের জনসংখ্যার ১৩% এখন ভারতীয় ভূখণ্ডে অবস্থান করছে। এবং এটা হচ্ছে তাদের গণহত্যার কারণে।

তিনি এটা স্পষ্ট বলেন যে ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে চেয়েছিল। বাংলাদেশ ভারত-পাকিস্তান ইস্যু ছিল। বাংলাদেশ মূলত পাকিস্তানের সামরিক শাসন এবং বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে একটি ব্যাপার ছিল। যত দ্রুত শরণার্থীরা তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে পারবে ততই তা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্ভাব্য অগ্নিদাহ দূর করবে।

মিসেস গান্ধী বলেন মার্কিন বা সোভিয়েত ইউনিয়ন কেউ বলেনি কীভাবে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হওয়া যায়। সবাই শুধু ভারতের কথা প্রশংসা করেছে। আর অন্যরা অস্ত্র নিয়ে বসে আছে।

মিসেস গান্ধী জানান যে সমস্যা পাকিস্তানের সরকার ও বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ছিল। তাই তিনি এসব নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি। সামরিক শাসকদের অধীনে একটি স্বাধীন নির্বাচন হয়েছিল – নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সুযোগ দেয়া হলে হয়ত অবস্থা এমন হতনা। এই প্রতিনিধিরা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত হয়, “যে নির্বাচনের উপেক্ষা করা যায়না”।

পাকিস্তানি সামরিক জান্তার প্রথম কাজ হল একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তির দিকে যাওয়া। বাংলাদেশে নৃশংসতার বন্ধ করা এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে গ্রহণযোগ্য অবস্থার সৃষ্টি করা।

মিসেস গান্ধী বলেন জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক পাঠাবে বলেছে। এই ব্যাপারে ভারতের অবস্থান সম্পর্কে বিভ্রান্তির কোন সুযোগ নাই। ভারত উদ্বাস্তু বিষয়ক হাই কমিশনের সদস্যদের জন্য এমনকি সংসদ সদস্য ও সাংবাদিকদের জন্য সব শরণার্থী শিবির দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন। এটা ইউ এন এর দায়িত্ব যে তারা উদ্বাস্তু শিবির ঘুরে দেখবে যে বাংলাদেশে কি ঘটছিল এবং শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবে। এটা করার পর জাতিসঙ্ঘ আমাদের এপ্রোচ করতে পারে। এই মুহুর্তে ভারত এটার দেখাশোনা করছে। বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে ভারত যা করছে তা সহজেই নষ্ট করা যাবেনা। পাশাপাশি, পাকিস্তানী শাসকরা যদি বাংলাদেশে একটি পাপেট সরকার বানীয়ে রাখে তাতেও সমস্যা দূরীভূত হবেনা।

মিসেস গান্ধী ভারত-চীন সম্পর্কে অনেক প্রশ্নের উত্তর দেন কিন্তু নতুন কোণ তথ্য দেন নি। ভারতের প্রতি চীনা মনোভাব ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে। ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তিতে জনাব চৌ এন লাই এর প্রতিক্রিয়া উল্লেখযোগ্য। জনাব চৌ এর কাছ থেকে কোণ চিঠি এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। চীন কেন রাষ্ট্রদূত বিনিময় করবেনা তাঁর আসলে কোণ যুক্তিযুক্ত কারণ নেই। মিসেস গান্ধী বলেন, তিব্বত বর্ডারে চিনা সৈন্য আছে। তিনি মনে করেন না যে তার পরিমাণ খুব বেশী। মার্শাল টিটোর সঙ্গে তার আলোচনার ইঙ্গিত করে যে, চীন সম্পর্কে ভারত ও যুগোস্লাভিয়ার মনোভাব বিস্তৃতভাবে একই রকম।

ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তির এক প্রশ্নের একটি উত্তপ্ত জবাবে ইন্দিরা গান্ধীর বলেন কোন বিদেশী রাষ্ট্র জাতীয় স্বার্থে ভারতের পারমাণবিক অস্ত্র মজুদ করন থামাতে পারবেনা। এই ব্যাপারে জনসাধারণের মনে কোন সন্দেহ নেই। এটা শুধুমাত্র কৌতূহলী কিছু সংবাদপত্র ও রাজনৈতিক দলগুলোর ছড়ান গুজব। এতে সরকারের স্ট্যান্ড কোনো পার্থক্য হবে না। চুক্তিটি ভারতের অবস্থান শক্তিশালী করেছে এবং ইন্দো-সোভিয়েত মৈত্রী আরও শক্তিশালী হবে।

মিসেস গান্ধী স্বীকার করেন যে শরণার্থী অন্তঃপ্রবাহ দেশের অর্থনীতির উপর একটি তীব্র চাপ সৃষ্টি করেছে। তাই, সরকার মনে করে তা ছিল চতুর্থ পরিকল্পনা। অর্থমন্ত্রী ইতিমধ্যে অতিরিক্ত সম্পদ তোলার সম্ভাবনা পরীক্ষা করার জন্য মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। দামের প্রশ্ন চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সম্পর্কিত। তাই সরকার রাজস্ব ও অন্যান্য নীতিসমূহ ঠিক করছেন মূল্যের উপর যাতে প্রভাব কম হয়।

প্রেস সবচেয়ে বড় যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করেছিলে সেটা হল যে তারা বলেছিল আমি শরনার্থিদের ফিরে যাবার জন্য ৬ মাস সমসয় বেঁধে দিয়েছি। আমি আসলে পার্লামেন্ট বলেছিলাম আপনারা আমাকে হিসাব করে জানান ৬ মাসে কত আর্থিক বোঝা সৃষ্টি হবে এমন একটা ধারণা দিতে। কারণ পরিস্থিতি মূল্যায়ন করার জন্য আমার এই ধারণা নেয়া দরকার ছিল। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কি ঘটেছিল সেটা বোঝাও আমাদের দরকার। তাছাড়া অসাধারণ এই অর্থনৈতিক বোঝা থেকে, আরও কি কি সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনার সম্ভাবনা হতে পারে তাও আমাদের ধারণা নেয়া দরকার ছিল। সেখানকার শান্তি, নিরাপত্তা ও পূর্ব অঞ্চলের স্থিতিশীলতার সমস্যা আমাদের ভাবতে হবে।

শরণার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা ও সরকারি অগ্রাধিকার এর মধ্যে পার্থক্য করা অর্থহীন। ভারত আর্থিক সহায়তা চায় ঠিক কিন্তু উদ্বাস্তুদের এখানে থাকার ব্যাপারে তাদের কোণ প্রশ্ন আপাতত নেই। তারা একটি অস্থায়ী ভিত্তিতে এখানে আছে এবং যত তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি ভালো হবে তারা ফিরে যাবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তারা সফল হবেই। ইতিহাস দেখিয়েছে যে, এই ধরনের সংগ্রামে বাধা আসে কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা জিতে। উপরন্তু, বাংলাদেশের সমগ্র মানুষ মুক্তিবাহিনীতে সমর্থিত। এমনকি দেশের বাইরে অবস্থিত বাংলাদেশি নাগরিকরাও সাহায্য করছিল।

ইউ.এন.আই এবং পিটিআই যোগ করে পশ্চিম এশিয়া ও ইন্দো-চীন এর পরিস্থিতি পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে একই রয়ে গেছে। যদিও সেখানে অনেক পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে বৈরিতার অবসান করার জন্য। তবে এশিয়ায় দ্বন্দ্ব চলছেই।

টানা অট্রহাসি শোনা গেল যখন প্রেস কনফারেন্সে মিসেস গান্ধী বললেন যা বের করা সাংবাদিকদের দায়িত্ব, তা ফাস করে দিয়ে তিনি তাদের ভাত মারতে চান না, অতঃপর মন্ত্রী সভার পূন বিন্যাস এর খবরটিকে তিনি গুজব হিসেবে বর্ননা করলেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪৭। প্রেসিডেন্ট টিটোর ভারত সফর শেষে প্রকাশিত ভারত- যুগোস্লাভ যুক্ত ইশতেহার ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০ অক্টোবর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ৪৭, ১০০-১০৩>
অনুবাদ

প্রেসিডেন্ট টিটোর ভারত সফর শেষে প্রকাশিত ভারত- যুগোস্লাভ যুক্ত ইশতেহার
২০ অক্টোবর, ১৯৭১

ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্রী ভি ভি গিরির বন্ধুত্বপূর্ণ আমন্ত্রণে, ১৬ অক্টোবর থেকে ২০ অক্টোবর ১৯৭১ যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল জসিপ ব্রজ টিটো রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে আসেন। ভারত-যুগোস্লাভ এর অব্যাহত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং শান্তি, স্বাধীনতা, স্বাধীনতা ও আন্তর্জাতিক সহায়তা বৃদ্ধির জন্য এই সফর খুব গুরুত্ববহ।

যুগোস্লাভিয়া সমাজতান্ত্রিক ফেডারেল প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট, ভারতের রাষ্ট্রপতি ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী গুরুত্বপূর্ণ বর্তমান আন্তর্জাতিক বিষয় এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উপর আলোচনা করেন।

যুগোস্লাভ দিকে আলোচনায় অংশগ্রহণকারী ছিলেন:

জনাব রাটো ডুগ্নোজিজ, যুগোস্লাভিয়া সমাজতান্ত্রিক ফেডারেল প্রজাতন্ত্র প্রেসিডেন্সি সদস্য;

জনাব ইলিয়া রায়াচিচ, ভয়ভোডিনা স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ পরিষদের চেয়ারম্যান, ও যুগোস্লাভিয়া সমাজতান্ত্রিক ফেডারেল প্রজাতন্ত্র প্রেসিডেন্সি সদস্য; জনাব আন্তন ভ্রাতুসা, যুগোস্লাভিয়া সমাজতান্ত্রিক ফেডারেল প্রজাতন্ত্র ফেডারেল নির্বাহী পরিষদের সদস্য;

জনাব মার্কো ভ্রুনচে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিপরিষদ ভারপ্রাপ্ত প্রধান;

জনাব মিলোস মেলোভস্কি, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিসভায় পররাষ্ট্র কাউন্সেলর;

জনাব এডুয়ার্ড কিউন, পররাষ্ট্র ফেডারেল সচিবালয়ের এশিয়া বিভাগের প্রধান; এবং

জনাব আনডেল্কো ব্লাজেভিচ, দূতাবাসের নয়া দিল্লি যুগোস্লাভিয়া সমাজতান্ত্রিক ফেডারেল প্রজাতন্ত্র এর চার্জ দ্যা এফেয়ার্স.

ভারতীয় দিকে ছিল:

সরদার শরণ সিং, এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার মন্ত্রী;

ডঃ করণ সিং, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রী; শ্রী সুরেন্দ্র পাল সিং, পররাষ্ট্র উপমন্ত্রী;

শ্রী টি এন কাউল, পররাষ্ট্র সচিব; শ্রী এস কে বন্দ্যোপাধ্যায়, সচিব (পূর্ব); শ্রী পি এন মেনন, সম্পাদক (পশ্চিম); শ্রী এইচ লাল, সচিব, বৈদেশিক বানিজ্য মন্ত্রী; শ্রী আর জয়পাল, ভারত যুগোস্লাভিয়া থেকে রাষ্ট্রদূত; শ্রী কে পি মেনন, যুগ্ম-সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়; শ্রী আর ডি সাথী থেকে, যুগ্ম-সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়; শ্রী উ পি ভেঙ্কাটেশরন, যুগ্ম-সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

উভয় পক্ষই আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন, বিশ্ব শান্তি, জাতীয় স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে তাদের প্রচেষ্টা সহ কিছু বিষয়ে একমত প্রকাশ করেন।

আইডেন্টিটি বা মতামতের ঘনিষ্ঠতা দু ‘দেশের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। পারস্পরিক আস্থা ও সমঝোতার মনোভাব নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।

উভয় পক্ষই দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা আরও জোরদার করবে এবং বছরের পর বছর ধরে সংহত সম্পর্কের সাথে তারা এঁকে ওপরের কাছে সুপরিচিত। তারা স্বীকার করেন একটি দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে এটি আরও সম্প্রসারণ করা এবং সর্বক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার জন্য তাগিদ দেন। তারা নিয়মিত দ্বিপাক্ষিক আলোচনা চর্চা চালানোর সিদ্ধান্ত নেন।

দুই পক্ষের যৌথ কমিটির মাধ্যমে দুই দেশের অর্থনৈতিক উনয়নের প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করেন এবং অন্যান্য সংস্থা উভয় দেশে বা তৃতীয় দেশের মধ্যে যৌথ প্রকল্প নিয়েও আলোচনা করেন। একটি পারস্পরিক সুবিধাজনক ভিত্তিতে বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত দক্ষতার শেয়ারিং নিয়েও আলোচনা হয়।

পূর্ববাংলায় সাম্প্রতিক ঘটনার ফলে সৃষ্ট মারাত্মক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা হয়। এর ফলে ভারতের সৃষ্ট গুরুতর সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অর্থনীতির উপর চাপ যুগোস্লাভিয়ার কাছে অনুভূত হয়েছে। শরনার্থিদের প্রবেশ – যার সংখ্যা প্রতিদিন হাজার হাজার বাড়ছে – এটি নিয়ে যুগোস্লাভ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। উভয় পক্ষ একমত হয় যে এই সমস্যা শুধুমাত্র নির্বাচিত প্রতিনিধিদের – যারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছিল – তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি রাজনৈতিক সমাধান দ্বারা সমাধান করা যেতে পারে। পূর্ববাংলায় অবস্থা স্বাভাবিক হলে শরণার্থীরা জাতী-ধর্ম নির্বিশেষে নিরাপত্তা ও সম্মানজনকভাবে তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে সক্ষম হবে।

উভয় পক্ষই অধিকার এবং পূর্ববাংলার জনগণের বৈধ স্বার্থ অনুযায়ী এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। জনগণের সিদ্ধান্তকে এড়িয়ে গেলে সমস্যা আরও তীব্রতর হবে বলে তারা একমত হন।

উভয় পক্ষ একমত হয়েছে যে এই অস্থিরতা ও উত্তেজনার একটি সমাধান তাড়াতাড়ি না বের করলে অবস্থার গুরুতর অবনতি হতে পারে।

যুগোস্লাভ শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্যের ব্যাপারে শঙ্কিত কারণ তাঁর সাথে যা কিছু অন্যায় করা হচ্ছে তার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে বলে তারা মনে করেন।

প্রেসিডেন্ট টিটো, দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করেন যে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান এর স্বার্থে এবং শান্তি ও উপ-মহাদেশের স্থিতিশীলতার স্বার্থে শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যাপারে কোণ হঠকারী সিদ্ধান্ত নেয়া ভালো হবেনা। তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জনাব ইয়াহিয়া খান এর প্রতি এই আবেদন করে যান ১৪ আগস্ট, ১৯৭১। ভারতের প্রধানমন্ত্রী পূর্ববাংলার নির্বাচিত নেতা, শেখ মুজিবুর রহমানকে নিশর্তে মুক্তিদানের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য এটি অপরিহার্য।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন ভারত সরকার চায় যে শরণার্থীরা তাদের মাতৃভূমিতে অবিলম্বে ফিরে যাক এবং এর জন্য যেসব ব্যাবস্থা করা দরকার তা করা উচিৎ। যুগোস্লাভ এর সঙ্গে একমত হয়। উভয় পক্ষ আরও একমত হয়েছে যে এই লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের সাহায্য করা সমগ্র বিশ্ব সম্প্রদায়ের উপর পরে।

দুই পক্ষই লক্ষ্য করে যে ইউরোপ যদিও এখনও বিভক্ত এবং তবুও শেষ যুদ্ধের বোঝা তাদের টানতে হচ্ছে। তবুও তাদের অবস্থার উন্নতি অনেক হয়েছে। সমতার ভিত্তিতে ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে নিরাপত্তা এবং শান্তি ও গঠনমূলক সহযোগিতার জোরদারের একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

উভয় পক্ষই মনে করে যে, তাদের মধ্যকার জোট নিরপেক্ষ নীতি তাদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে। যুগোস্লাভিয়া ও ভারতের নীতি বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে নিরপেক্ষ দেশগুলোর আন্তর্জাতিক কার্যক্রমে সহায়ক।

উভয় পক্ষই অশান্তিকর আন্তর্জাতিক আর্থিক সংকট ও অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে আলোচনা করেন। তারা উল্লেখ করেন যে, উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে দূরত্ব কমানোর জন্য কোন ব্যাবস্থা গৃহীত হয়নি। এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রভাবিত বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার কারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

তারা পুনর্ব্যক্ত করে উন্নয়নশীল দেশগুলো যাদের অধিকাংশ বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক সংকটের দ্বারা প্রভাবিত তাদের আরও জোরাল পদক্ষেপ সম্মিলিতভাবে নিয়ে পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে।

উভয় পক্ষই একমত যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে আন্ত-আঞ্চলিক, আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক পর্যায়ে একসাথে কাজ করতে ইচ্ছুক। এই প্রসঙ্গে তারা তারা ব্যাংককে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ফরেন ট্রেড মন্ত্রীবর্গের এবং গ্রুপ ৭৭ এর মিনিস্টিরিয়াল কনফারেন্স এর প্রতি গুরুত্বারোপ করেন।

তারা একমত হন যে U.N.C.T.A.D. -III তে গৃহীত পদক্ষেপ ও জাতিসঙ্ঘের দ্বিতীয় দশ বছর মেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনার গৃহীত পদক্ষেপগুলির বাস্তবায়নের ব্যাপারে উন্নয়নশীল দেশগুলোর একটি ঐক্যমত্য নিশ্চিত করতে হবে।

উভয় পক্ষই আন্তর্জাতিকভাবে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ এর প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

দুই পক্ষ জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেন এবং জাতিসংঘের সব সদস্যের বিধানাবলী পালন প্রয়োজনীয়তার গুরুত্বের সাথে নেন। তারা সদস্যপদের সার্বজনীনতা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে একমত হন। তারা জাতিসঙ্ঘে ভুটান, বাহরাইন ও কাতারের যোগদানে স্বাগত জানান। তারা জাতিসংঘে চীনের বৈধ অধিকার অবিলম্বে পুনবিবেচনার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেন। তারা মনে করে ইউ.এন এর বাইরে অন্যান্য দেশেরও ইউ.এন. এবং তার সংস্থার কার্যক্রমে অংশ নেয়া উচিৎ।

উভয় পক্ষই জাতীয় মুক্তি আন্দোলন এবং ঔপনিবেশিক আধিপত্য এর বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য তাদের সমর্থন ঘোষণা করেন এবং ঔপনিবেশিক দেশকে স্বাধীনতা প্রদানের ব্যাপারে জাতিসঙ্ঘের ঘোষণা অনুযায়ী উপনিবেশবাদ সম্পূর্ণ বর্জনের দাবি করেন। তারা মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা বিরোধী হিসেবে বর্ণবাদী নীতি ও চর্চার নিন্দা জ্ঞ্যাপন করেন।

দুই পক্ষের ইন্দো-চীন বিষয়ে বিদেশী হস্তক্ষেপের ধারাবাহিকতা ধরে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেন। শান্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থে বাইরে থেকে কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই ইন্দো-চীন থেকে সব বিদেশি সেনা দ্রুত প্রত্যাহারের দাবী পেশ করেন। এ প্রসঙ্গে লক্ষনীয় যে দক্ষিণ ভিয়েতনামের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের সাত দফা প্রস্তাব একটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি গঠন করে। তারা আশা করেন ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়ার প্রশ্নে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান জেনেভা চুক্তিতে থাকবে।

দুই পক্ষই পশ্চিম এশিয়ায় উত্তেজনাকর পরিস্থিতি এবং সংকট সমাধানের জন্য তাদের গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তারা একমত যে ২২ নভেম্বর, ১৯৬৭ -এর নিরাপত্তা পরিষদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ একটি শান্তিপূর্ণ চুক্তি আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য দেয়া হয়েছিল। তারা ইস্রায়েল ও ফিলিস্তিনের জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকারের প্রতি সম্মানসহ রেজোলিউশন তৈরি ও তার প্রয়োগের জন্য আবেদন করেন। তারা দীর্ঘস্থায়ী, স্থিতিশীল এবং স্থায়ী শান্তি অর্জনের প্রয়োজনীয়তার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।

যুগোস্লাভিয়ার রাষ্ট্রপতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতিকে আমন্ত্রণ জানান। তার আমন্ত্রণ অত্যন্ত আনন্দের সাথে গৃহীত হয়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪৮। পাল্টা আঘাত হানতে দুই মিনিটের বেশী সময় লাগবে না – প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও রাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণা দৈনিক আনন্দবাজার ২২ অক্টোবর ১৯৭১

Aparajita Neel
<১২, ৪৮, ১০৪>

আমরা প্রস্তুত, পাল্টা আঘাত হানতে দুই মিনিটের বেশী সময় লাগবে না

নয়াদিল্লী ২১ অক্টোবর – ভারতের সমর প্রস্তুতি পুরদমে চলছে এবং সামরিক বাহিনী সম্পূর্ন সজাগ। আমরা আক্রান্ত হলে পাকিস্তানকে পাল্টা আঘাত হানতে দুই মিনিটের বেশী সময় লাগবে না। প্রতিরক্ষা উৎপাদন দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী বিদ্যাচরন শুক্লা আজ এখানে এই কথা বলেন। এ খবর ইউ এন আই এর।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শ্রী জগজিবন রামও দৃঢ় কণ্ঠে আজ ঘোষণা করেন যতক্ষণ পাকিস্তানের দিক থেকে যুদ্ধের হুমকি থাকবে ভারত ও পাক সীমান্ত থেকে সৈন্য সরাবে না। আমাদের বিশেষ সংবাদদাতার এই খবরে আরও বলা হয়েছে, শ্রী রাম তাঁর মন্ত্রকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংসদীয় পরামর্শদাতা কমিটির সভায় আজ বলেন যে, ভারতের জাতীয় স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে ভারতের সমর প্রস্তুতির কোন রকম শিথিলতা হবে না।

পাকিস্তানের যুদ্ধের হুমকিতে সদস্যরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। কিন্তু প্রতিরক্ষামন্ত্রী আশ্বাস দিয়ে বলেন যে, পাক আক্রমণ মোকাবিলার জন্য ইতিমধ্যেই যথোপযুক্ত প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। ভারত বিন্দুমাত্র ভিত নয়। ভারত আক্রমণের মত নির্বুদ্ধিতা করলে পাকিস্তান সমুচিত জবাব পাবে।

তবে তিনি মন্তব্য করেন, পরিস্থিতি গুরুতর। পাকিস্তানের সেনা সমাবেশের জন্য পশ্চিম সীমান্তে ভারতকেই সৈন্য মোতায়েন করতে হয়েছে।

প্রতিরক্ষা উৎপাদন দফতরের মন্ত্রী শ্রী শুক্লা এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে দেশের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির এক হিসাব দেন। তিনি বলেন, ১৯৬৫ সালে পাক আক্রমণের পর সমরাস্ত্র উৎপাদনের ব্যাপারে ভারতের সর্বাত্তক অগ্রগতি ঘটেছে। আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর হাতে এখন আধুনিক ও অতি আধুনি সমরাস্ত্র বৈজয়ন্ত, ট্যাঙ্ক, যুদ্ধ জাহাজ, মিগ প্রভৃতি।

দেশের অস্ত্র কারখানাগুলোই প্রতিরক্ষা চাহিদার বড় অংশ মেটাচ্ছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪৯। প্ররোচনার মুখে ভারতের সংযমকে মনে করলে পাকিস্তান মারাত্মক পরিণতির মুখে পড়বে – রাষ্ট্রপতির সতর্কবানি দৈনিক যুগান্তর ২৩ অক্টোবর ১৯৭১

Aparajita Neel
<১২, ৪৯, ১০৫>
পাকিস্তানকে রাষ্ট্রপতির হুশিয়ারি
নয়াদিল্লী, ২২ অক্টোবর (পি টি আই) – রাষ্ট্রপতি শ্রী ভিভি গিরি আজ পাকিস্তানকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, গুরুতর ও ক্রমবর্ধমান প্ররোচনা সত্ত্বেও ভারত যে সংযম ও ধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছে তাঁকে যেন দুর্বলতার চিনহ বলে কেউ ভিল না করেন।
তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেন আমরা আমাদের সার্বভৌমত্ত ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষার জন্য সম্পূর্ন্রূপে প্রস্তুত।

আজ সকালে ইরাকের রাষ্ট্রদূত মিঃ আবদুল্লা সালেমুস আলসামারায়ে রাষ্ট্রপতি ভবনে তার পরিচয়পত্র পেশ করছিলেন তখন রাষ্ট্রপতি তার ভাষণে বলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের অত্যাচারের ফলে পুর্ববঙ্গ থেকে ৯৫ লাখের ও বেশী শরনার্থি ভারতে আশ্রয় নেওয়ায় ভারতের সামনে বিরাট সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। এই শরনার্থি আগমন বন্ধ করতে হবে। এবং এরা যাতে নিরাপদে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে পারেন তার জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। রাষ্ট্রপতি বলেন যে, এ ধরণের গুরুত্ততপূর্ন বিষয়ে বন্ধু দেশগুলো নীরব থাকলে শান্তি আসতে পারে না।

রাষ্ট্রপতি বলেন, সমস্যাটি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নয়, এটা হল পুর্ব বঙ্গবাসী এবং পাক জঙ্গিশাহির পরিচালিত নির্বাচনে, জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা পদদলিত হওয়ায় এর উদ্ভব। পূর্ব পাকিস্তান থেকে ব্যাপকভাবে শরনার্থি আগমনের কথা উল্লেখ করে ইরাকি রাষ্ট্রদূত বলেন, ইরাক বাংলাদেশের শরনার্থি সমস্যার মানবিক দিক এবং রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থণৈতিক ক্ষেত্রে ভারতের অসুবিধা সম্পর্কে সম্পূর্ন ওয়াকিবহাল।

তিনি বলেন, উন্নতিশীল দেশগুলোর ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি থাবা বিস্তারে উদ্যত। তাদের এই অপপ্রয়াস ব্যার্থ করে দিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে মধুর প্রতিবেশী সুলভ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হোক, গণতন্ত্রী ইরাক সরকার তা আশা করেন।
শিরোনাম সূত্র তারিখ
৫০। কয়েকটি রাষ্ট্র সফরে যাওয়ার প্রাক্বালে দেশবাসীর উদ্যেশ্যে প্রধানমন্ত্রীর বেতার ভাষণ ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২৩ অক্টোবর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ৫০, ১০৬>
অনুবাদ

জাতির উদ্যেশ্যে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সম্প্রচারিত ভাষণ
২৩ অক্টোবর ১৯৭১

কাল সকালে, আমি কিছু দেশে সফরে যাচ্ছি। আমি বলতে চাই যে, আমি যত দুরেই যাই আমি আপনাদের সাথই থাকব। এইরকম একটি মুহূর্তে আমি বসে থাকতে পারিনা। আমাদের দেশ বিপদের সম্মুখীন। তা সত্ত্বেও, অনেক চিন্তার পর, আমি যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অন্যান্য দেশের নেতাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য ও মতামত বিনিময়ের জন্য দীর্ঘদিনের আমন্ত্রণ ছিল। আমি তাদেরকে আমাদের বর্তমন পরিস্থিতির বাস্তবতা সম্পর্কে বলতে চাই।

আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে আমরা যখন কোন সমস্যায় পড়ি তার সমাধান আসলে আমাদের হাতেই থাকে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি এমন যে আমরা এটাকে এভাবে চলতে দিতে পারিনা। শুধু রাগ বা তাড়াহুড়া করে আমরা অবস্থান নষ্ট করতে চাইনা। শুধুমাত্র আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীর উপর নির্ভর করে বসে থাকলেই চল্বেনা। এই মুহুর্তে আমাদের সব মানুষের সতর্কতা প্রয়োজন। গত কয়েক মাসে, সাহস, মর্যাদা ও সংযম দিয়ে আমরা এই চ্যালেঞ্জ প্রতক্ষ্য ও মোকাবেলা করেছি। আমি নিশ্চিত যে ভবিষ্যতে আপনারা যে কোন বিপদ একই ভাবে মোকাবিলা করবেন। আমাদের ঐক্য ও শৃঙ্খলা প্রয়োজন। আমি আন্তরিকভাবে আশা করি যে আমাদের সকল রাজনৈতিক দলগুলো আমাদের সাথে দাঁড়াবেন।

দেশের প্রত্যেকটি জনগণ তাদের বাড়িতে কষ্ট করছেন। জাতির সম্পদ রক্ষা করা এবং আরো সম্পদ বাড়াতে আমাদের সব রকমের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কৃষি ও শিল্পে আমাদের উৎপাদন বাড়াতে হবে। কৃষক ও শ্রমিক, ব্যবস্থাপক ও কারখানার মালিক সবাই একটি অতিরিক্ত জাতীয় দায়িত্ব হিসেবে তদের সর্ব শক্তি দিয়ে এটা করার চেষ্টা করবেন।

যে কোন সংকটে, মজুদ দেশ-বিরোধী অপরাধ। ব্যাবসায়িদের একটি বিশেষ দায়িত্ব এই সময়ে লাভের আশায় দাম বৃদ্ধি না করা। আমাদের আরও কাজ করতে হবে এবং সঞ্চয় করতে হবে। গুজব ছড়ানো্‌, সাম্প্রদায়িকতা উস্কানি ইত্যাদি আমদেরকে প্রতিহত করতে হবে।

বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তুর অন্তঃপ্রবাহ আমাদের জন্য একটি বোঝা। তবুও আমরা আমাদের সীমান্তে সঙ্কটের পরেও তাদের দেখাশোনা করছি – এই মুহুর্তে তারা ভূমিহীন এবং বেকার। আমরা পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। ভারতীয় জনগণের অসুবিধা সাময়িক এবং একটি ভাল এবং শক্তিশালী দেশ গড়ে তোলার ব্যাপারে আমাদের আরও আন্তরিক হতে হবে।

আমার সংহতি এবং ভারতীয় জনগণের প্রতি দায়িত্বানুভূতির কারণে আমাকে এই সফরে যেতে হবে। দল ও ধর্মগত সব পার্থক্য মুছে যাক। আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হই এবং একসাথে দাঁড়াই। আসুন আমরা একসাথে কাজ করি। আমাদের জাতির অখণ্ডতা ও স্বাধীনতা ধরে রাখতে একসাথে কাজ করি।

জয় হিন্দ

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৫১। জাতিসঙ্ঘ দিবসে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তৃতা ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২৪ অক্টোবর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ৫১, ১০৭>
অনুবাদ

নয়া দিল্লীতে জাতিসঙ্ঘ দিবসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংয়ের বক্তৃতা-
২৪ অক্টোবর, ১৯৭১

নিম্নে ভাষণের উপর একটি রিপোর্ট দেয়া হল:

জনাব শরণ সিং বলেন এটা অপরিহার্য যে পূর্ব বাংলার জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাথে একটি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হবে। শুধুমাত্র তখনই উদ্বাস্তুরা দেশে ফিরে যেতে শুরু করবে।

“আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই সমস্যার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে। এবং একটি সম্মিলিত পদ্ধতিতে কাজ করে এটি সমাধান করা তাদের দায়িত্ব।

জনাব শরণ সিং বলেন পাকিস্তান অযথা আক্রমনাত্মক ভাবে ভারতীয় সীমান্তে বাহিনী জড়ো করছে এবং মূল ঘটনা অন্যদিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে।

“তবে পূর্ববাংলায় মূল সমস্যা রাজনৈতিক। মন্ত্রী উল্লেখ করেন।

ভারত, বাংলাদেশের শরণার্থীদের উপর আস্থা রাখে। পূর্ব বাংলায় নিরাপত্তা এবং শান্তি পুনরুদ্ধার হলে তারা তাদের নিজের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে পারে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, যখন সামগ্রিকভাবে মানবজাতির উপর পূর্ববাংলায় পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা গণহত্যা ও নিপীড়ন চালাচ্ছিল তখন সরকার ধীরে চলছিল।

জনাব শরণ সিং বলেন শুধুমাত্র একটি সমাধান যা হল পূর্ব বাংলার জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে গ্রহণযোগ্য পরিস্থিতি তৈরি করা – এটি করা গেলেই শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর জন্য পরিবেশ তৈরি হবে।

তিনি বলেন ভারতীয় সীমান্ত জুড়ে পাকিস্তান তাদের সৈন্য জড়ো করে পূর্ববাংলায় তাদের কলঙ্কজনক রেকর্ড ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে।

জনাব শরণ সিং, যারা বিদেশী নীতি সংক্রান্ত বিষয়ে ইউ.এন. এর সদস্যপদ আছেন তাদের এই পরিস্থিতিতে অবদান রাখা উচিৎ।

জনাব শরণ সিং বলেন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইউ.এন. এর অর্জন অসাধারণ। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমি তেমনটি বলতে পারছিনা।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী উল্লেখ করেন এখনো অনেক বড় বড় সমস্যা সমাধান এর জন্য প্রতীক্ষিত। উদাহরণ হিসেবে তিনি অনেক আফ্রিকান দেশে চলমান সংখ্যালঘু সরকার কে ক্রমাগত অস্বীকার করার কথা তুলে আনেন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৫২। ব্রাসেলসে রয়্যাল ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এফেয়ার্স এ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির ভাষণ ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২৫ অক্টোবর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ৫২, ১০৮>
অনুবাদ

রয়্যাল ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এফেয়ার্স এ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির ভাষণের চুম্বক অংশ, ২৫ অক্টোবর ১৯৭১

একটি নতুন সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে যার বিশালতা ছড়িয়ে পড়ছে এবং আমাদের সমস্যার সম্মুখীন করে ফেলেছে। প্রায় বেলজিয়ামের জনসংখ্যার সমান ৯ মিলিয়ন মানুষ পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের দ্বারা নির্যাতিত। এবং তাদেরকে আমাদের সীমানার ভিতরে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এটি আমাদের স্বাভাবিক জীবন এবং আমাদের ভবিষ্যতের পরিকল্পনায় আঘাত হানবে। বিশ্ববাসীর কি এই আগ্রাসনের ব্যাপারে সচেতন হওয়া উচিত নয়? প্রচলিত অর্থে এটি গৃহযুদ্ধ নয়। এটা বেসামরিক নাগরিকদের গণহত্যার বিশাল যজ্ঞ কারণ তারা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। আমরা যথেষ্ট ধৈর্য্য ধরে আছি কিন্তু জানি যে এটা আমাদের নিরাপত্তা ও স্ট্যাবিলিটির জন্য হুমকি স্বরূপ। এই সমস্যার মূল কারণ অবশ্যই সমাধান করতে হবে। এর একটি রাজনৈতিক সমাধান বেড় করা আবশ্যক, এবং বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হতে হবে। যারা শরণার্থীদের অন্তঃপ্রবাহ থামাতে এবং যারা ইতিমধ্যে ঢুকে পড়েছে তাদের ফেরত পাঠাতে চান তাদের অতি সত্বর সমাধানের দিকে এগিয়ে আসা উচিৎ।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৫৩। যুদ্ধের হুমকি থাকলে সীমান্তে সৈন্যও থাকবেঃ প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ঘোষণা দৈনিক আনন্দবাজার ২৬ অক্টোবর ১৯৭১

Aparajita Neel
<১২, ৫৩, ১০৯>

যুদ্ধের হুমকি থাকলে সীমান্তে সৈন্যও থাকবেঃ প্রতিরক্ষামন্ত্রী
(বিশেষ সংবাদদাতা)

নয়াদিল্লী, ২৫ অক্টোবর – ভারতের প্রতি পাকিস্তানের যুদ্ধের হুমকি যতদিন বজায় থাকবে ততদিন সীমান্তে ভারতীয় সেনাদের মোতায়েন রাখা হবে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রী জগজীবন রাম ভারতের এই দৃঢ় সংকল্পের কথা আজ আবার ঘোষণা করেন।

এখানে ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে বক্তৃতা প্রসঙ্গে শ্রীরাম বলেন, ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এমন কোন ব্যাবস্থা নেবে না যাকে আক্রমণাত্মক কাজ বলা যাতে পারে। কিন্তু ভারতের বিরুদ্ধে যে কোন আক্রমণ পূর্ন শক্তি নিয়ে প্রতিহত করা হবে।

প্রতিরক্ষামন্ত্রী ঘোষণা করেন যে আমাদের দেশ আক্রান্ত হলে আমরা শুধুমাত্র সীমান্ত রক্ষার ব্যাবস্থা করেই তুষ্ট হব না। শত্রুকে আমরা তাদের একালাতেই হটিয়ে নিয়ে যাব। আমাদের দেশে নয়, লড়াই যাতে শত্রুভুমিতেই হয় আমরা সেই ব্যাবস্থাও করব।

তিনি আরও বলেন, সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ দেয়া হলে ভারত দাবী জানাবে যে এক কোটি শরনার্থির বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার দায়িত্ব ওইসব রাষ্ট্র নিক। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে ভারতে শরনার্থি আগমন অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে এবং ভারত থেকে শরনার্থিদের বাংলাদেশে ফেরার কাজও শুরু করতে হবে। শুধুমাত্র সেই অবস্থায় সৈন্য প্রত্যাহারের কথা ভারত বিবেচনা করবে।

শ্রীরাম বলেন পাকিস্তানী ক্যান্টনমেন্ট গুলো সীমান্তের এত কাছে যে, পাকিস্তান সৈন্য প্রত্যাহার করে নিলেও অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের আবার সীমান্তে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু ভারতের ক্যান্টনমেন্টগুলি অধিকাংশই সীমান্তের ছয়শ থেকে নয়শ মাইল দুরে। কাজেই ভারতীয় সেনাদের সীমান্তে নিয়ে আসতে অনেক বেশী সময় প্রয়োজন।

তিনি বলেন। ভারত সব সময়ই পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্তপূর্ন সম্পর্ক রাখতে চেয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তাদের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য সাড়া পাওয়া যায়নি।

প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ব্যাপারে ভারতের যে উদ্বেগ রয়েছে, সেটা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পক্ষে স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের অর্থণৈতিক ও সামাজিক স্থায়িত্ব ক্ষুণ্ণ করার কুমতলবে পাক শাসকরা পুর্ব বাংলার বিপুলসংখ্যক নাগরিককে ভারতে পালিয়ে আসতে বাধ্য করেছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৫৪। পশ্চিম জার্মান টেলিভিশনে প্রচারিত প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজিবন রামের সাক্ষাতকার দৈনিক স্টেটসম্যান ২৭ অক্টোবর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ৫৪, ১১০-১১১>
অনুবাদ

পশ্চিম জার্মান টেলিভিশনে প্রচারিত প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রামের সাক্ষাতকার
২৬ অক্টোবর, ১৯৭১

সাক্ষাত্কারের উপর একটি রিপোর্ট:

প্রশ্নঃ প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে ভারত যুদ্ধের কত কাছে?
উত্তরঃ আমাদের উদ্দেশ্য সবসময় শান্তিপূর্ণ ছিল। আমরা যুদ্ধ চাই না। এ কারণে প্রধানমন্ত্রী বিদেশে ব্যস্ত সময় কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যদি যুদ্ধ আসে তাহলে তার দায় সম্পূর্ণরূপে পাকিস্তানের উপর হবে।

প্রশ্নঃ সম্প্রতি আপনি বলেছেন: যদি যুদ্ধ হয়, এটা পাকিস্তানের মাটিতে হবে, এবং যাই হোক আমরা লাহোরে সোজা চলে যাব এবং সেখানে যা হবার হবে – আপনি কি মনে করেন যে, এই মন্তব্য দিয়ে, আপনার প্রধানমন্ত্রী আত্মরক্ষামূলক ভঙ্গি বুঝিয়েছেন?
উত্তরঃ ঠিক সেরকম নয়। আমরা সবসময় আত্মরক্ষামূলক। কিন্তু আত্মরক্ষামূলক মানে এই নয় যে, যদি আমাদের দেশ আক্রমণ করা হয়, আমরা শুধুমাত্র সীমান্তে বা আমার মাটিতে বসে থাকব। এর মানে হল যে আমরা হানাদারদের ঠেলে নিয়ে যাব তাদের দেশে। এবং আত্মসমর্পণ করতে তাদের বাধ্য করা হবে। এটার মানে আগ্রাসন নয়।

আমি সবসময় বলে যে আমরা যুদ্ধ চাই না। যদি আমরা আক্রান্ত হই অবশ্যই আমরা আমাদের দেশ রক্ষার জন্য লড়াই করব। কিন্তু প্রতিরক্ষা শুধু সীমান্তে যুদ্ধ বা তার সীমানায় ঠেলাঠেলি নয়।

প্রশ্নঃ বর্তমানে সীমান্তে সৈন্য অবস্থানকে কিভাবে দেখেন?
উত্তরঃ আপনারা পুরো বিতর্কের উৎপত্তি জানেন। আমি জানি না কিভাবে কি ঘটবে না ঘটবে তাঁর জন্য আমরা দায়ী হতে পারি? এটা পূর্ববাংলার সঙ্কট। আমাদের নাক গলানোর কিছু নাই। যদি জেনারেল ইয়াহিয়া খান দুষ্ট চক্রান্ত করে ভারতে প্রায় সাড়ে নয় মিলিয়ন লোক পাঠিয়ে ভারতের অর্থনীতি এবং সামাজিক উত্তেজনা তৈরি না করত তাহলে আমরা এতোটা জড়িত হতাম না।

তাছাড়া, তিনি ঘোষণা দেন যে তিনি আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন যদি বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা পূর্ববাংলার কিছু এলাকা মুক্ত করে ফেলে।

এখন যদি মুক্তিযোদ্ধারা নির্দিষ্ট এলাকা মুক্ত করে ফেলে তাঁর জন্য আমরা কেন শাস্তি পাবো? এবং তার ঘোষণা ফলোআপ করার জন্য তিনি সীমান্ত এলাকায় সেনানিবাস থেকে তার সৈন্য পাঠিয়েছেন। এখন, যে কোন দেশের যে কোন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, এই অবস্থায় তাঁর দেশ এবং সীমানার নিরাপত্তা রক্ষা করার জন্য অবশ্যই ব্যবস্থা নিবে।

প্রশ্নঃ কীভাবে আপনি পাকিস্তানীদের সাথে আপনার কমান্ডের অধীনে সেনাবাহিনীর শক্তির তুলনা করবেন?
উত্তরঃ ভারতের যুদ্ধ শক্তি পাকিস্তানের চেয়ে অনেক অনেক গুন বেশী।

প্রশ্নঃ যুদ্ধ লাগলে কতদিন স্থায়ী হবে বলে আপনি মনে করেন?
উত্তরঃ এসব বিষয়ে বলা খুব কঠিন। বর্তমান যুগে কোনো নিষ্পত্তিমূলক যুদ্ধ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। যুদ্ধ চলতে থাকে এবং বিশ্বের ক্ষমতাধররা এসে যুদ্ধবিরতির জন্য চেষ্টা করে।

প্রশ্নঃ কীভাবে আপনি সীমান্ত পরিস্থিতি মূল্যায়ন করবেন?
উত্তরঃ দুই দেশের সেনারা সীমান্তের উভয় পাশে জমা হচ্ছে। একথাও ঠিক যে, সীমান্ত পরিস্থিতি ভয়াবহ, এবং আমি বলতে পারি পাকিস্তানি সেনাদের ব্যাপক কার্যক্রমের জন্য আমরা আমাদের সৈন্য রাখতে বাধ্য হয়েছি। যখন সৈন্যরা সীমানা জুড়ে একে অপরের মুখোমুখি হয়, তখন অবস্থা গুরুতর হয়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৫৫। অস্ট্রীয় বেতারে প্রচারিত প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতকার ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২৭ অক্টোবর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ৫৫, ১১২-১১৩>
অনুবাদ

অস্ট্রিয়ান রেডিওতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাত্কার
২৭ অক্টোবর ১৯৭১

প্রশ্নঃ অস্ট্রিয়া এবং বিশ্ব সফরে আপনার প্রত্যাশা কি?
উত্তরঃ শুধু বোঝাপোড়া ও বন্ধুত্বের প্রত্যাশা।

প্রশ্নঃ ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধের দোরগোঁড়ায়। ভিজিট অসফল হলে কি করবেন?
উত্তরঃ আচ্ছা, আমি আগেই বলেছি যে আমি শুধু ইউরোপীয় পরিস্থিতি বুঝতে এসেছি। পাশাপাশি নেতাদেরকে আমি ভারত ও এশিয়ার পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারনা দিতে এসেছি। সুতরাং, সাফল্য বা ব্যর্থতার কোন প্রশ্নই ওঠে না। আমি শুধু এটুকু বলতে চাই যে আমি কোন লক্ষ্য নিয়ে আসিনি।

প্রশ্নঃ আপনার মতে কীভাবে একটি সশস্ত্র সংঘাতের পথ পরিহার করা যায়?
উত্তরঃ পূর্ববাংলার পরিস্থিতি রাজনৈতিকভাবে নিষ্পত্তি করতে হবে – যা সেখানকার মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং পূর্ববাংলার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে গ্রহণযোগ্য।

প্রশ্নঃ শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন করাতে ভারত ও পাকিস্তানের মাটিতে স্টেশন করার জন্য ইউ.এন. এর প্রস্তাব পাকিস্তান গ্রহন করলেও ভারত কেন করেনি?
উত্তরঃ প্রথমত, আমরা জাতিসংঘের হাই কমিশনারের কাছ থেকে ১০ জন পেয়েছি যারা ইতিমধ্যে ভারতে শরনার্থি ক্যাম্প ও সীমান্ত পরিদর্শন করেছেন। দ্বিতীয়ত, যদি ভারতে আসেন তাহলে তাদের কাজ কি হবে? তাদের আগে আরও শরনার্থি অনুপ্রবেশ বন্ধ করার ব্যাবস্থা নেয়া উচিৎ যা প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪২ হাজার। তাদের কাছে জানা যাচ্ছে হাজারো ভোগান্তির নির্মম ঘটনা। তাই কেউ এই বিষয়ে আগ্রহ দেখালে তার প্রথম কাজ হওয়া উচিৎ ভারতে উদ্বাস্তুর আরও অন্তঃপ্রবাহ প্রতিরোধ করা। তারপরই শুধুমাত্র পরবর্তী ধাপ বিবেচনা করতে পারেন।

প্রশ্নঃ দ্য ব্রিটিশ সানডে পত্রিকা “অবজার্ভার” আপনাকে ধারালো নখের সঙ্গে একটি ঘুঘু ডেকেছেন। পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থার অবনতি হলে আর কি ঘটবে? সেখানে কি দুর্ভিক্ষ হবে? কী হবে আর কী অবস্থা হবেনা সেটা বড় নয় – এ অবস্থা ভারতের জন্য অসহনীয় হবে।
উত্তরঃ পরিস্থিতি খুব ভয়াবহ। কারণ আমরা মনে করি যে এটি আমাদের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি। আমরা সমস্যার সমাধান হিসেবে যুদ্ধ বিশ্বাস করি না। আমরা দ্বন্দ্ব প্রতিরোধ করার জন্য যতদূর সম্ভব সবকিছু করব। কিন্তু আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তা রক্ষা করার ক্ষেত্রে কোন ছাড় দেয়া হবেনা।

প্রশ্নঃ এর প্রায় তিন মাস আগে একটি চুক্তি হয় ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন-এর মধ্যে। এবং এই চুক্তিতে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য আক্রমণ বা আক্রমণের হুমকি নিয়ে আলোচনা ও চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর মানে কি এই যে, ভারতের নিরপেক্ষতার ঐতিহ্যগত নীতি এখন বিলুপ্ত হয়েছে?
উত্তরঃ আমাদের অস্ট্রিয়ার মত নিরপেক্ষ নীতি ছিলনা। আমরা জোটনিরপেক্ষ, অর্থাৎ একটি নীতি অব্যাহত আছে। আমরা বিশ্বাস করি যে আমাদের বিষয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা আমাদের আছে। আমরা আন্তর্জাতিক বিষয়ক ব্যাপারে যথার্থতা বিচার করে এবং দেশের স্বার্থ ও বিশ্ব শান্তি বিবেচনা করে এগিয়ে যাব। আমি মনে করি না সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে এই চুক্তির ফলে আমাদের স্বাধীনতার উপর কোন প্রভাব পড়বে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৫৬। ভিয়েনায় রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের সারাংশ ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২৭ অক্টোবর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ৫৬, ১১৪>
অনুবাদ

ভিয়েনায় রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ
২৭ অক্টোবর ১৯৭১

কিছু বিশেষ অংশ নিম্নে বর্নিত হল –

ভারতের যাত্রা সহজ না, কিন্তু কঠিন ধাপ বেয়ে বেয়েই আমরা এগিয়ে গিয়েছি। আজ আমাদের অন্যান্য সমস্যা আমাদের সীমান্তের ঘটনার কাছে ম্লান হয়ে গেছে। অস্ট্রিয়ার উদ্বাস্তুদের সঙ্গে ডিল করার অভিজ্ঞতা আছে। সুতরাং, আপনারা বুঝবেন যে অস্ট্রিয়ার নিজস্ব জনসংখ্যার সমান আকারের শরনার্থি প্রবেশ করলে কি কি সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু উদ্বাস্তুদের সমস্যা একটি আনুষঙ্গিক সমস্যা মাত্র। কারণ খুঁজলেই জানা যাবে কেন এত মানুষ তাদের বাড়ি ছেড়ে ছাউনিতে আশ্রয় নিচ্ছে। তাঁদের অনেকেই, ভারী বর্ষণের সময় গাছের নীচে বসে থাকতে বাধ্য হয়। ভারতীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী তাদের থাকার যথাসাধ্য ব্যাবস্থা করা হয়েছে। যাইহোক, আমরা এটিকে স্থায়ী হিসেবে মেনে নিতে পারিনা।

এই মুহূর্তে, আমাদের প্রধান চিন্তার বিষয় হল আমাদের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা; শরনার্থি নয়। ভারতের জনগণ অস্ট্রিয়া থেকে যে সহানুভূতি এবং সমর্থন পেয়েছে তাঁর জন্য কৃতজ্ঞ। আমাদের আন্তরিক ইচ্ছা যে অস্ট্রো-ভারতীয় সম্পর্ক বছরের পর বছর ধরে বজায় থাকবে। আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি বা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সমস্যা হতে পারে। আমাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা হল যখনই আমরা একটি সমস্যা সমাধান করতে যাই তখন আরও ১০ টা এসে হাজির হয়। কিন্তু আমরা মনে করি এটা জীবনের অংশ এবং আমরা মনে করি যে প্রতিটি সমস্যা আমরা নিজেরাই মুখোমুখি হয়ে সমাধান করতে পারব।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৫৭। ভিয়েনায় অস্ট্রিয়ান সোসাইটি ফর ফরেন পলিসি এন্ড ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স এ প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার সারাংশ ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২৮ অক্টোবর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ৫৭, ১১৫-১১৬>
অনুবাদ

ভিয়েনায় অস্ট্রিয়ান সোসাইটি ফর ফরেন পলিসি এন্ড ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স এ প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার সারাংশ, ২৮ অক্টোবর, ১৯৭১

আপনারা জানেন গত সাত মাস ধরে আমাদের সীমানায় গুরুতর অবস্থা চলছে। সম্ভবত আপনারা জানেন যে পাকিস্তানের দুই অংশ ভারতীয় অঞ্চলের হাজার হাজার মাইল দ্বারা ভাগ করা। পরিস্থিতি সৃষ্টি হবার কারণ পূর্ব বাংলার জনগণের বৈধ অধিকারকে সময় মত মূল্য না দেয়া। যখন নির্বাচন সংঘটিত হয় শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী পার্টির নেতা ছিলেন। তখন একটি ছয় দফা কর্মসূচি ছিল। এতে তারা পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিল, স্বাধীনতা নয়। তারা ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত রাখতে চেয়েছিল। কারণ পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেহেতু এই বাণিজ্য বন্ধ ছিল তাই তারা চেয়েছিল ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য।

এই দফা প্রকাশ্য ছিল এবং এই দফার ভিত্তিতে নির্বাচন হয়। কেউ বলতে পারবেনা যে এখানে কিছু গোপন করা হয়েছিল। কিন্তু যখন শেখ মুজিবুর রহমান সংখ্যাগরিষ্ঠভাবে জয়ী হন তখন শোষক সরকার এটাকে ভালভাবে নেয় নি।

আরও একটি জিনিস আমি বলতে চাই। এই সংখ্যালঘুর প্রশ্ন না। সম্পূর্ন পাকিস্তানকে এক ধরলে পূর্ববাংলার জনগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু সরকার স্বাভাবিক গণতন্ত্রের পরিবর্তে আলোচনার নামে আরও সৈন্য আনে এবং সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে যা বিশ্ববাসী দেখছে। পূর্ববাংলার জনগণ তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে। তাদের সমগ্র জনসংখ্যার প্রায় ১৩ শতাংশ ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। শরণার্থী ও নিহতদের মধ্যে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী লোক আছে। শুরুতে বিশেষ বিশেষ লোকদের – যেমন পণ্ডিত লেখক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক হত্যা করা হয়। ২৫ মার্চ রাতে বৃহস্পতিবার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিশেষ আক্রমণ করা হয় এবং ৩০০ জনেরও বেশি লোক-ছাত্র, অনুষদ সদস্য এবং অন্যান্য দের নিহত করা হয়েছিল।

শত শত বছর ধরে ভারত উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিয়েছে – কিন্তু এবার তাঁর সংখ্যা ও প্রবেশের হার অনেক বেশী। তাই সমস্যার আকার এবং চরিত্র ভিন্ন। আমাদের দেশে সৃষ্ট উত্তেজনা – রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক – সব দিক থেকে সৃষ্টি হয়েছে। এটি আমাদের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি স্বরূপ।

আমাদের উন্নতিতে আমাদের জনগণের অধৈর্য শাণিত হয়েছে। এটা সত্য নয় যে গরীবরা আরও গরীব হয়েছে – তাদেরও কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু এটা সত্য যে তারা তাদের দারিদ্র্যকে অনেক সূক্ষ্মভাবে দেখে। তাই তারা আর অপেক্ষা করতে প্রস্তুত নয়। আমরা সমাজতন্ত্রের পথে চলে যাব কারণ আমার মনে হয় অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকলে সত্যিকারের গণতন্ত্র হতে পারে না। এমনকি সংবিধান সমান অধিকারের কথা বললেও জনগণ এর থেকে লাভবান হতে পারবে না। তাই ভারত যদি তার স্থায়িত্ব বজায় রাখতে না পারে তাহলে এটা পূর্ব এশিয়ার জন্য এমনকি বিশ্বের শান্তির জন্যও হুমকি। অনেক দেশের সরকার এবং সংসদীয় নেতাদের বিষয়টি বোঝানো হয়েছে কিন্তু অনেকে অভিনয় করছেন, বলা যায় কিছুটা অন্তর্দৃষ্টির অভাব।

আমি অস্ট্রিয়াতে যে বোঝাপড়া ও সমবেদনা পেয়েছি তার জন্য কৃতজ্ঞ। অনেক সাধারণ মানুষ, একজন মহিলা যিনি শাকসবজি বিক্রি করেন, অনেক শিশু, এরকম বিভিন্ন গ্রুপ, আমার কাছে এসেছেন তাদের সহানুভূতি প্রকাশ করার জন্য এবং এমনকি ছোট ছোট অনুদান দিতেও। আমি এই সহানুভূতির জন্য কৃতজ্ঞ এবং যে সব মানুষ এই কঠিন সময়ে বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করেছেন তাদের অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এটাই বিশ্বের শান্তির ভিত্তি: যখন অন্যরা সমস্যায় পরে আমরা আমাদের নিজস্ব ক্ষমতা অনুযায়ী সাহায্য করার চেষ্টা করি।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৫৮। যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হলে অবস্থার মোকাবিলায় ভারত প্রস্তুত – অর্থমন্ত্রি চ্যাবনের মন্তব্য দৈনিক আনন্দবাজার ২৮ অক্টোবর ১৯৭১

Aparajita Neel
<১২, ৫৮, ১১৭>

উদ্বাস্তুরা ফিরে যাবার সঙ্গে সঙ্গে নতুন করগুলি প্রত্যাহার করে নেয়া হবে
-চ্যাবন
(দিল্লী অফিস থেকে)

২৮ অক্টোবর- কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রি শ্রী ওয়াই বি চ্যাবন আজ এখানে প্রেস ক্লাব অফ ইন্ডিয়ায় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় সুস্পষ্টভাবে জানান যে, নতুন যেসব কর ধার্য করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ সাময়িক, পূর্ব বাংলার উসবাস্তুরা স্বদেশে ফিরে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই তা প্রত্যাহার করে নেয়া হবে। তিনি বলেন, সত্যি কথা বলতে কি, এই নতুন কর ধার্যের উদ্যেশ্য কেবল অতিরিক্ত অর্থ সংগ্রহ করাই নয়, দেশবাসীকে সংকট সম্পর্কে অবহিত করাও।

শ্রী চ্যাবন বলেন, সরকারের বাজেটের হিসাব অনুযায়ী উদ্বাস্তুদের ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই স্বদেশে ফিরে যাবার কথা। সেই সময় পর্যন্ত তাদের ভরন-পোষণের জন্য মোট ৪৫০ কোটি টাকার দরকার। যদিও ভারত একটা আন্তর্জাতিক ট্রাস্ট হিসেবে উদ্বাস্তুদের ভরন পোষণের দায়িত্ব নিয়েছে, বাইরে থেকে যে সব সাহায্য আসছে তা অত্যন্ত কম। এমনকি প্রতিশ্রুত ১২৫ কোটি টাকার মধ্যে মাত্র ৩০ কোটি টাকার মত সরকারের হাতে এসেছে।

শ্রী চ্যাবন স্বীকার করেন যে, পূর্ব বাংলা থেকে বিরাট সংখ্যক উদ্বাস্তু আগমনের ফলে ভারতের অর্থনিতির উপর প্রচণ্ড চাপ পড়েছে এবং তার অর্থণৈতিক চিত্র কিছুটা বিকৃত হতে চলেছে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ এই সমস্যার ফলে মুদ্রাস্ফীতি প্রবণতা দেখা দিয়েছে এবং তা দ্রব্যমূল্যের উপর প্রতিফলিত হয়েছে।

উদ্বাস্তুরা ডিসেম্বর মাসের মধ্যে ফিরে যাবে বলে কেন তিনি মন্তব্য করেছেন শ্রী চ্যাবন তা স্পষ্ট করে কিছু বলেন নি। এবং যদি ঐ সময়ের মধ্যে উদ্বাস্তুরা ফিরে যেতে না পারে তাহলে সরকার কি করবেন তাও তিনি বিশদভাবে প্রকাশ করতে অস্বীকার করেন। তার মতে, পরিস্থিতি ক্রমশ দানা বাধছে। তবু তিনি সংকট নিরসনে ভারতের তড়িঘড়ি কোন ব্যাবস্থা গ্রহণের সম্ভবনা বাতিল করে দেন।

তিনি বলেন আমরা যুদ্ধ চাইনা। তিনি আরও বলেন, সশস্ত্র সংঘর্ষ এড়াতে ভারত কোন চেষ্টাই বাদ রাখবেনা। তবে আমাদের উপর যদি যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয় তা আমরা সেই জরুরী অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত। সঙ্গে সঙ্গে তিনি একথাও স্মরণ করিয়ে দেন যে, যুদ্ধ যদি বাঁধে তাহলে আমাদের অর্থনীতির উপর আরও চাপ পড়বে।

জাতীয় অর্থনিতির চিত্রণে শ্রী চ্যাবন বলেন, উদ্বাস্তু আগমনের ফলে আমদের অর্থনিতির উপর প্রচণ্ড চাপরা সত্ত্বেও সরকার সামাজিক ও বৈষয়িক উভয় প্রকার উন্নয়নমূলক পরিকল্পনায় অগ্রসর হতে কৃতসংকল্প। এই সব ক্ষেত্রে কোন রকম ছাটাই হবেনা। শিল্পক্ষেত্রে অচলাবস্থা দেখা দেওয়ায় অর্থমন্ত্রি কিছুটা অসন্তোষ প্রকাশ করেন। শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধি মোটেই সন্তোষজনক নয়। সরকার ইতিমধ্যেই এই সমস্যা বিচার করে দেখেছেন। শিল্প ক্ষেত্রে বর্তমান আচলাবস্থার কারণ নির্নয়ের উদ্যেশে পরিকল্পনা কমিশন সারাদেশে একটা অনুসন্ধান শুরু করেছেন। কারণ নির্নিত হবার পর অবস্থার উন্নতির জন্য সংশোধনী ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হবে।

শ্রী চ্যাবন নিশ্চিত, এই ব্যাবস্থা যদি সফল করা যায় তাহলে বর্তমান যে মূল্যরেখা উর্ধগতি হয়েছে সরকার তাঁকে ঘরে রাখতে সমর্থ হবেন। কারণ প্রাকৃতিক বিপর্যয় সত্ত্বেও কৃষি উৎপাদনের সামগ্রিক চিত্র ভালোই রয়েছে। তবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সরকারের হিসাব কিছু বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, বন্যা ও খরা ত্রাণে বাজেটে মাত্র ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এ পর্যন্ত বিভিন্ন রাজ্যকে মোট প্রায় ১৫০ কোটি টাকা দিয়েছেন। এর ফলেও আমাদের অর্থনিতির উপর কিছুটা বাড়তি চাপ পড়েছে।

যাই হোক, ভালোভাবে অর্থ সংগ্রহ করে এবং ব্যয় হ্রাস করে বিশেষ করে পরিকল্পনা বহির্ভুত বিষয়ে – সরকার পরিস্থিতি সামলে নেবেন বলে আশা করছেন। এ কাজে রাজ্য সরকারগুলির সাড়াও উতসাহব্যাঞ্জক।

আবার সরকার আবশ্যিক দ্রব্যগুলির বিলি বণ্টনের মূল ব্যাবস্থাগুলি ঠিক করে রাখবেন যাতে প্রয়োজন হলে কোন কোন ক্ষেত্রে কন্ট্রোল প্রবর্তন করা যায়। তবে এই মুহুর্তে সরকার কন্ট্রোলের কথা ভাবছেন না।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৫৯। লন্ডনস্থ ইন্ডিয়া লীগ এ প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের সারাংশ ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৩১ অক্টোবর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ৫৯, ১১৯-১২৩>
অনুবাদ

লন্ডনস্থ ইন্ডিয়া লীগ এ প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের সারাংশঃ
লন্ডন, ৩১ অক্টোবর ১৯৭১

বন্তব্যের চুম্বক অংশ নিম্নরূপঃ

আপনারা সবাই জানেন যে নির্বাচনের আগে, দলীয় বিভক্তির আগে, ভারতে মারাত্মক খারাপ একটি খরা হয়েছে। বিদেশী সংবাদপত্র ছাপিয়েছিল “ভারত কি টিকবে? ভারতের গণতন্ত্র কি টিকবে? ’’ আমরা মারাত্মক ভুল বোঝাবুঝি এবং সমালোচনার স্বীকার হই। যখন আমরা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করি – প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল: ‘আমরা কি অহিংসা দিয়ে স্বাধীনতা জয় করতে পারি? ” তখন প্রশ্ন তোলা হয়েছিল “এত নিরক্ষরতা নিয়ে এমন একটি বিশাল দেশ গণতান্ত্রিক হতে পারে? ” আমরা পাঁচটি নির্বাচনে প্রমাণ করে দিয়েছি যে গণতন্ত্র কাজ করতে পারে এবং গণতন্ত্র ভারতে গভীর শিকড় দিয়ে বিস্তৃত। গণতন্ত্র একটি শিক্ষামূলক প্রক্রিয়া। কারণ প্রতি নির্বাচনে ভারতীয় জনগণ পরিপক্বতা লাভ করে। আমি বলতে পারব না যে সবাই বিজ্ঞতার সাথে ভোট দেয়। কিন্তু যদিও সেখানে মানুষ অপপ্রচারে বিভ্রান্ত করে তাদের ঐ সংখ্যাটা তেমন বড় হয়না।

এই ছিল ভারত পরিস্থিতি যখন আমরা আমাদের নতুন সংসদ গঠন করি। আমরা উচ্চ আশা নিয়ে এসেছি; ভারতের সমগ্র জনগণের আশা নিয়ে। আমরা কিছু প্রোগ্রাম হাতে নেই। কিন্তু এক সপ্তাহ পরে একটি খুব বড় বোঝা আমাদের উপর আসে। এবং এটি আমাদের সীমানা জুড়ে স্থান নেয়। এতে আমাদের জীবনযাপন বিঘ্নিত হচ্ছে। কিন্তু এটা তার চেয়েও আসলে বড় কিছু। আমি দেখেছি ইংল্যান্ড এবং অন্যান্য দেশে যেখানে আমি পরিদর্শন করেছি; সেখানে এই সীমান্ত পরিস্থিতি সমস্যা নেই বল্লেই চলে। আমি বলতে চাই ৯০০০০০০ সংখ্যাটা মোটেই ছোট নয়। এবং অবশ্যই একসাথে এই অতিরিক্ত মানুষের দেখাশোনা করা সহজ কাজ নয়। কিন্তু বাংলাদেশের সমস্যা নিছক ভারতের উদ্বাস্তু সমস্যা নয়। এটা একটি গভীর সমস্যা এবং নানাভাবে আমাদের প্রভাবিত করে। শরণার্থীদের সমস্যা আমাদের জন্য বড় সমস্যা, কারণ তারা একটি বিশাল অর্থনৈতিক বোঝা। তারা সামাজিক সমস্যা, রাজনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি করেছে ও সর্বোপরি নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও ভারতের অখণ্ডতা প্রশ্নে আমরা জর্জরিত। আমাদের দেশের বাইরে যা ঘটছে সেটা নিয়েও আমরা সমানভাবে উদ্বিগ্ন। বিশ্ব দেখতে পাচ্ছে কিরমকম নৃশংসতা ও বর্বরতা চলছে যা আমরা শুনেছি শরণার্থীদের কাছ থেকেও – যা রোজ রোজ বাড়ছে নতুন মাত্রায়।

যখন আমি ভারত লীগের জন্য কাজ করছিলাম আমাদের প্রধান চিন্তার বিষয় হল ভারত-এর স্বাধীনতা। কিন্তু তখন ইউরোপে কি ঘটছে সে সম্পর্কে কম উদ্বিগ্ন ছিলাম। কারণ তখন স্পেনীয় গৃহযুদ্ধ ছিল বেশী গুরুত্তপূর্ণ। সে সময় ফ্যাসিবাদ এবং নাত্সিবাদ ইউরোপে শক্তি লাভ করছিল। ভারত লীগ তখন এই সব আন্দোলন সম্পর্কে সজাগ ছিল। আমরা মনে করি মানবতা যেখানে নিষ্পেষিত সেখানেই মানব জাতির পরাজয়।

আজ বাংলাদেশের সমস্যা একই। প্রতিটি মানুষ যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে, যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, মৌলিক মানবাধিকারে বিশ্বাস করে – তাদের এটি অনুধাবন করা উচিৎ। অবশ্য যেখানে মানবাধিকার নেই সেখানে কোন গণতন্ত্র হতে পারে না। আমি, অথবা ভারত সরকার, অথবা ভারতের মানুষ, কখনোই পাকিস্তান বা পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে নই। আমরা সবসময় তাদের ভাল চাই কারণ আমরা বিশ্বাস করি এটা আমাদের স্বার্থ যে আমাদের প্রতিবেশী দেশে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতি বজায় থাকুক। আমরা জানি যে, ঠিক যেমন আমাদের প্রধান সমস্যা দারিদ্র্য ও বৈষম্য তেমনি এটি পাকিস্তানেরও সমস্যা। আমরা গভীরভাবে সেখানে মানুষের মঙ্গলের বিষয়ে উদ্বিগ্ন। কিন্তু আমরা যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতির কথা বলি তা শুধুমাত্র আসতে পারে সেখানকার মানুষের চাওয়ার মূল্যায়ন করা হলে। যেখানে আমাদের মানুষ অবহেলিত ও অনগ্রসর সেখানেই আমাদের কাজ করতে হবে। আমরা জানি যে, এটা যাদুর মত মুহুর্তেই সমাধান করা যাবেনা। তবে এই অনুযায়ী আমাদের কাজ করতে হবে। কিন্তু এর জন্য আমাদের প্রতিটি এলাকায় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং জনগণের ন্যায়সঙ্গত ক্ষোভ দূর করতে হবে। মানুষকে নিজেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পরিবেশ দিতে হবে এবং তাদের উন্নয়ন কর্মসূচিকে এগিয়ে দিতে হবে। এটাই গণতন্ত্র। এর জন্য মানুষ আমাদের ভোট দেয়। কিন্তু তাদের সব প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করা উচিত যাতে গণতন্ত্র কাজ করে এবং মানুষের জন্য উন্নত জীবন এনে দিতে পারে।

আমাদের নির্বাচনের আগে সমগ্র পাকিস্তানে নির্বাচন ছিল। সেখানে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমাদের কোনো চুক্তি ছিল না। কিন্তু আমরা অনেক মানুষের কাছ থেকে শুনেছি আওয়ামী লীগের নির্বাচনে জয়লাভ করার সম্ভবনা ছিল। আমরা দেখতে পেলাম একটি অসাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তারা জয়ী হয়। এত বড় জয় হবে তা আমাদের ধারণার বাইরে ছিল। আমার মনে হয় সমস্ত বিশ্বে কোন গণতান্ত্রিক নির্বাচনে এটিই সর্বচ্চ জয়। যখন আমাদের দেশে নির্বাচন হয় স্বয়ংক্রিয় ভাবে যে দল জিতে তার নেতা প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু সীমান্ত জুড়ে ভিন্ন ঘটনা চলছিল। এটি একটি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং ভয়ানক দিকে মোড় নেয়। আমাকে বলা হয়েছে যে, ২৪ মার্চ বাংলাদেশের নেতাদের সাথে যে কথা হয়েছিল তার বাইরেও কিছু একটা হতে যাচ্ছে। পরে দেখা গেল এটি ছিল মূলত সমুদ্র পথে সৈন্য আনার জন্য কালক্ষেপণ। তারা মূলত ২৫ মার্চের জঘন্যতার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। গণহত্যার শুরু হয় বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে। প্রথম হামলা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং একটি বৃহৎ সংখ্যা, আমি বিশ্বাস করি প্রথম দিনে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ছাত্র, অধ্যাপকদের সহ ৩০০ জনেরও বেশি লোক হত্যা করা হয়।

এরপরে ভারতে বন্যার পানির মত মানুষ আসতে শুরু করল – পরিমাণ এত বেশী ছিল যে সমস্ত বিশ্ব এর আগে এমনটি পরখ করেনি। ভারত উদ্বাস্তুদের আশ্রয়স্থল হিসাবে ব্যাবহ্রিত হয়। এটা আমাদের জন্য একটা নতুন ঘটনা নয়। নতুন জীবন খুঁজে পেতে যারা আমাদের দেশে এসেছে তাদের সাহায্য করার জন্য আমাদের দরজা ঐতিহ্যগতভাবে খোলা রয়েছে প্রায় শত বছর ধরে এটা আমাদের রীতি। কিন্তু যদি কয়েক সপ্তাহের মধ্যে লক্ষ লক্ষ লোক আসে তখন ভারতের মতো একটি বিশাল দেশও তা পরিচালনা করতে পারবেনা। আমাদের জায়গা, টাকা বা উপকরণ কোনটাই নেই। তাই আমরা বাইরে থেকে আসা সাহায্যকে স্বাগত জানাই। কিন্তু, আমি আগেই বলেছি, সাহায্য করতে গিয়ে বিশ্ব যেন ভুলে না যায় যে কেবল মাত্র উদ্বাস্তুদের সাহায্য করাই মূল সমস্যার সমাধান নয়। উদ্বাস্তুদের সাহায্য মানে ভারতকে সাহায্য করা নয়। আবার এটি বাংলাদেশের জন্যও সাহায্য নয়। কারণ আমরা শরণার্থীদের ফেরত পাঠাতে চাই, এবং আমরা সম্পূর্ণরূপে সচেতন যে তারা এই মুহুর্তে সম্ভবত ফিরে যেতে পারবেনা। আরো শরণার্থী আসা বন্ধ করতে হবে। তাদের পরিমাণ এখন ৯০০০০০০ এর অধিক এবং প্রতিটি দিন আরও ৩০ থেকে ৪০০০০ নতুন উদ্বাস্তু আসছে। বেশিরভাগ তথ্য আমরা তাদের কাছ থেকেই পাই।

তাই আমাদের এমন অবস্থা সৃষ্টি করতে হবে যাতে আরও মানুষ নিজেদের বাস্তুভিটা ছেড়ে যেতে বা চায়। এরপর দ্বিতীয় ধাপে আমরা যারা ইতিমধ্যে এসে পড়েছে তাদের যেতে বলতে পারি। প্রশ্ন হল এই মুহুর্তে এটা সম্ভব কিনা – উত্তর হল অবশ্যই না। আমাদের বলা হল জাতিসংঘ থেকে পর্যবেক্ষক গ্রহণ করা। কিন্তু এতে খুব বেশি পার্থক্য হবেনা। সম্ভবত আপনারা জানেন ইতোমধ্যে এখানে তাদের ১০ জন আছে। জাতিসংঘের হাই কমিশন থেকে আসা দশ জন পর্যবেক্ষক আমাদের আছে এবং তারা সেখানে শুরু থেকে আছে। আমাদের লুকানোর কিছু নেই। সীমান্ত, সেইসাথে ক্যাম্পে সব বিদেশী সংবাদদাতারা আছেন। তাদের জন্য সেগুলো সব সময় খোলা থাকে। আপনারা যারা ইংল্যান্ডে বসবাস করছেন তারা ব্রিটিশ সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর দেখেছেন। এবং সম্ভবত আপনারা জানেন যে অনুরূপ রিপোর্ট আমেরিকান পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। ইউরোপের অনেক দেশ এবং বিশ্বের অন্যান্য অংশেও এসব খবর যাচ্ছে। সুতরাং সেখানে যে সংস্করণটি বেরিয়ে আসছে সেটি ভারতীয় সংস্করণ নয়। এটা প্রত্যক্ষদর্শী যারা নিজেরা এই ঘটনা দেখেছ তাদের সংস্করণ। বস্তুত, আমাদের অধিকাংশ তথ্যও এই সব মানুষের কাছ থেকে পাচ্ছি। প্রকৃতপক্ষে সেখানকার উদ্বাস্তু এবং সেইসব মানুষ ছাড়া আমাদের নিজস্ব তথ্য সংগ্রহ করার আর কেউ নেই।

এটা আমাদের জন্য খুবই মারাত্মক সমস্যা। এটা নিছক ভারত-এশিয়ার উদ্বেগ নয় বরং এটি পুরো বিশ্বের উদ্বেগ। সবাই আজ আমাদের বলার জন্য ব্যস্ত যে আমাদের সংযম প্রদর্শন করতে হবে। আমি মনে করি না যেকোনো ব্যক্তি বা কোনো সরকার আমাদের চেয়ে বৃহত্তর সংযম দেখাতে পারবে। তাছাড়া আমাদের উস্কানী ও দেয়া হচ্ছে এবং আমাদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে এবং আমাদের তা দূর করতে হবে। কিন্তু সংযম আমাদের কি দিচ্ছে? এতে কোন সমাধান তো হচ্ছেনা। বরং আমাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক অবস্থা দিনে দিনে খারাপ হচ্ছে।

লোকজন আমাকে জিজ্ঞাসা করে কতদিন ভারত এভাবে চালাতে পারবে? আসলে সেই তারিখ আগেই গত হয়ে গেছে। আমি মনে করি যে, আমি একটি আগ্নেয়গিরির উপরে বসে আছি এবং আমি সত্যিই জানিনা কখন এটি বিস্ফোরণ হতে যাচ্ছে। তাই আমরা কিভাবে সংযত থাকব সেটি এখন প্রশ্ন নয়। বরং সীমান্তজুড়ে কি ঘটবে সেটাই এখন প্রশ্ন হওয়া উচিৎ। আমরা মনে করি এই যে একটি উপায় খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব আছে। একথাও ঠিক যে, সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, মানবিক পথ, রাজনৈতিক সমঝোতা এবং রাজনৈতিক নিষ্পত্তির চেষ্টা এবং এটা হতে পারে শুধুমাত্র বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত নেতাদের সাথে গ্রহণযোগ্য পদক্ষেপেরে মাধ্যমে।

এটা আমার কাছে খুব অদ্ভুত মনে হয় এমন পরিস্থিতিতে হঠাৎ কিছু নির্বাচিত ব্যক্তিকে নিখোঁজ করে দিলেই নাকি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে যেখানে তাদের অস্তিত্ব বিশ্বজুড়ে। আপনি হঠাৎ যদি বলেন যে আপনি নতুন নির্বাচন দেবেন এবং তাতেই সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে – কিন্তু আসলে তা হবেনা। নির্বাচন যখন হয়েছিল তখন তা অবৈধ হিসেবে গণ্য করা হয়নি। এবং নির্বাচন একই সরকারি কর্তৃপক্ষের অধীনে হয়েছে। তারা একটি ছয় দফা কর্মসূচি দিয়েছে যা উভয় পাকিস্তান এর লোকদের দ্বারা সমর্থিত ছিল। কেউ তাতে আপত্তি করেনি। কিন্তু তারা আপত্তি উত্থাপন করেছে যে তারা ৬ দফা মানেনা।

আজ ভারত খুবই গুরুতর পরিস্থিতির মুখোমুখি। সত্যি বলতে, আমি জানিনা এটা কিভাবে মোকাবেলা করব। আমি শুধুমাত্র দেখতে পাচ্ছি যে দিন দিন পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। সঙ্কট আরও তীব্র হয়ে উঠছে। ভারত একটি দেশ যা সবসময় যুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে। আমরা সব সময় বিশ্বাস করি সমস্যা ও বিরোধ আপস এবং আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যেতে পারে। কিন্তু জাতীয় স্বার্থের বিবেচনায় আমি আমাদের জনগণের স্বার্থ, তাদের নিরাপত্তা এবং তাদের স্থায়িত্ব বিঘ্নিত হতে দিতে পারিনা। আমি ভারতে আমার জনগণকে বলতে চাই এই অবস্থায় আমাদের এক থাকতে হবে এবং ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। যাই ঘটুক না কেন, আমরা না শুধুমাত্র অদূর ভবিষ্যত না দূরবর্তী ভবিষ্যতের কথাও মাথায় রাখব। আমাদের নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য স্বাধীনতার আগে এবং স্বাধীনতার পর যা ভেবেছি সেভাবে কাজ করে যেতে হবে।

আমি শুধু বলতে চাই যে এই দূরত্বে বসে মানুষ শুধুমাত্র আমাদের ভুল, অভাব, দুর্বলতা আর কলহ দেখতে পায়। কিন্তু বাস্তবে এই সব জিনিস বিদ্যমান নয়। আপনারা যদি মনে করেন এটি সমগ্র ভারতের চিত্র তাহলে ভুল হবে। আমরা ষোলটির বেশী ভাষায় কথা বলা দেশ। কিন্তু সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এবং ঐ সব ভাষার প্রত্যেকটিতে ইউরোপের যে কোনো দেশের জনসংখ্যার চেয়ে বেশী লোক কথা বলে। আমরা হস্তক্ষেপ করতে চাই না, আমরা অভিন্নতা চাই না। কিন্তু সত্য যে তার পরেও বিভাজন-প্রক্রিয়া, আন্দোলন ক্রমাগত স্থান দখল করে আছে। তবুও ভারতীয় ঐক্যের সুদৃঢ় ভিত্তি আছে। ভারতীয়দের আছে শক্তিশালী আত্মবিশ্বাস। বলা হয়েছিল আমরা কিছু করতে পারিনা এবং আমরা দেখিয়েছি যে, আমরা করতে পারি। আমি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে, গণতন্ত্র সম্পর্কে কথা বলেছি। ইন্ডিয়ার উইকলি পত্রিকা বলেছিল ভারত কোনোদিন তার ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাবারের ব্যাবস্থা করতে পারবে না। অথচ এই বছর, ১৯৭১ সালে আমরা সম্পূর্ণরূপে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হই। যদিও আমরা শুধুমাত্র গম ও চালের দিকে মনোযোগ দিয়েছি। আমাদের এখনো অনেক গবেষণা করতে হবে। অন্যান্য ক্ষেত্র সব ধরণের উৎপাদন বাড়াতে হবে। আমাদের বলা হয়েছিল যে আমাদের পরিকল্পনা কাজ করবে না। পরিকল্পনার অবশ্যই উত্থান পতন আছে কিন্তু আমরা এটিকে নির্দিস্ট দিকে ধাবিত করেছি। এটা সত্য যে আমরা মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন। কিন্তু মনে করি না যে আমরা হতাশ। মনে হয় না যে আমরা নিরুৎসাহিত। আমাদের সাহস পরিপূর্ন, আত্মবিশ্বাস পূর্ণ এবং আমরা জানি যে আমরা ধৈর্য ধরে অবশ্যই ভারী বোঝা বহন করতে পারব। আমরা সাহায্যের হাতকে স্বাগত জানাই এবং আপনাদের সমর্থন চাই। তবে আমরা কারো সাহায্য বা সহানুভূতি উপর পুপোপুরি নির্ভরশীল নই।

আরেকটি প্রশ্ন হল কেন আমরা আমেরিকানদের বাদ দিয়ে রাশিয়ার কাছে গেছি। সত্যি বলতে আমরা আসলে কারো কাছে যাইনি। আমাদের সাহায্য যদি কেউ করতে চায়, আমরা না বলতে পারিনা। আমাদের জাতীয় স্বার্থের জন্য ভালো হবে এমন যে কোন কিছু আমরা সাদরে গ্রহণ করতে রাজি আছি।
অর্থনৈতিক উন্নতি ও প্রবৃদ্ধির জন্য দারিদ্র্য ও বৈষম্য কমিয়ে আনা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু, আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। তা হল আমাদের স্বাধীনতা। আমরা শুধুমাত্র সেই সাহায্য গ্রহণ করছি যা আমাদের স্বাধীনতার উপর কোন প্রভাব ফেলবে না। আমরা সবসময় বন্ধু দেশের সঙ্গে বিশ্বাস স্থাপন করেছি এবং আমরা এটি অব্যাহত রাখব কিন্তু আমি আগেই বলেছি, আমাদের জাতীয় স্বার্থে অনেক কিছু বিবেচনায় আনা লাগতেS পারে – এবং আমরা সবসময় তার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৬০। বিবিসিতে প্রচারিত মার্ক টালির সাথে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতকার দি ইয়ার্স এন্ডেভার ১৬ নভেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ৬০, ১২৪-১৩৩>
অনুবাদ

একটি গুরুতর অবস্থা

প্রশ্ন: প্রধানমন্ত্রী, শরণার্থীদের সংকটে আপনি বলেছেন অন্যান্য দেশগুলোর উচিৎ পাকিস্তানের ওপর চাপ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি দূরীভূত করতে সাহায্য করা যাতে শরণার্থীরা ফিরে যেতে পারে। আপনি কি ধরনের চাপ দেবার কথা বোঝাচ্ছেন?
প্রধানমন্ত্রী: পাকিস্তান অন্যান্য দেশ থেকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য পাচ্ছে। এটা থেকে বোঝা যায় যে তারা কোন সাহায্য পূর্ব বাংলায় করবেনা। এটা বেশী দিন চলতে দেয়া যায়না।

প্রশ্ন: কিন্তু আপনি কি মনে করেন এই মুহুর্তে অন্য দেশ এমন কিছু করতে পারে?
প্রধানমন্ত্রী: বেশ উন্মুক্তভাবে বললে; আমি সত্যিই নির্দিস্ট কিছু দেখতে পারছি না। তবে আমি নিশ্চিত কিছু মানুষ আশাবাদী হয়ে জন্ম নেয়। তাই আমি মনে করি সবচেয়ে জটিল সমস্যা ও সমাধান করা যায় যদি কেউ খুঁজে পেতে ইচ্ছুক হয়।

প্রশ্ন: এটা জিজ্ঞাসা করতে সম্ভবত একটু বিব্রত লাগছে। আপনি কি এ ব্যাপারে আমেরিকান সরকারের মনোভাব সম্পর্কে বিশেষভাবে চিন্তিত?
প্রধানমন্ত্রী: আমি আমেরিকান সরকারকে বিছিন্ন করব না কারণ আমি মনে করি যে অনেক সরকার এই বিষয়ে বিব্রত বোধ করছে। উদ্বাস্তুদের সংখ্যা বেশী হবার কারণে এবং আমাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতা কম হবার কারণে আমাদের ব্যাপারে ইতিবাচক অবস্থান নিতে সমস্যা হয়। জনগণের দৃষ্টিও উদ্বাস্তু ইস্যুর কারণে বিভক্ত আছে। আমরা তাদের সহানুভূতি চাই। এটা খুবই দু: খজনক হবে যদি সব মনোযোগ উদ্বাস্তু দের উপর গিয়ে পরে – সমস্যার মূল কারণ এড়িয়ে।

প্রশ্ন: এর কি কোনো প্রতিকার নেই?
প্রধানমন্ত্রী: পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান করলেই এটা ঠিক হয়ে যাবে।

প্রশ্ন: কিন্তু আপনি আরও নির্দিষ্টভাবে বলবেন কি যে কিভাবে সমস্যার সমাধান হবে?
প্রধানমন্ত্রী: প্রথমে আমার মনে হয় পূর্ব বাংলার জনগণ এবং তাদের নির্বাচিত নেতারা কি চান সেটা দেখা উচিৎ।

প্রশ্ন: তাদের পূর্ণ অধিকার বলতে আপনি কি বুঝাতে চান? স্বায়ত্তশাসন নাকি স্বাধীনতা?
প্রধানমন্ত্রী: এই মুহূর্তে উভয় পক্ষে তিক্ততা এবং ঘৃণা রয়েছে। পূর্ব বাংলার মানুষ কে হত্যা করা হয়েছে। ২৫ মার্চ রাতে সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় এর ছাত্র এবং অনুষদ সদস্যদের অনেককে হত্যা করা হয়েছে সম্পূর্ণ বিনা উস্কানিতে। এমনকি এখনো নিহত হচ্ছে বুদ্ধিজীবি, অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোক।

প্রশ্ন: আমার মনে হয় ভারত যেভাবে উদ্বাস্তু দেখাশোনা করছে তা সার্বজনীন প্রশংসা লাভ করেছে। তারপরেও কিছু লোক কেন ভারত শরণার্থী শিবিরে একটি বৃহৎ জাতিসংঘের দলের উপস্থিতির অনুমতি দেবনা সেটা বলছে – যে সুপারিশ পাকিস্তান করেছিল – এই প্রশ্নের যথাযথ জবাব কি?
প্রধানমন্ত্রী: U.N. পর্যবেক্ষকদের ইতিমধ্যে দশ জন সেখানে আছে। সেটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সংবাদপত্রের ওপর কোন সেন্সরশীপ নেই। যারা ক্যাম্প পরিদর্শন করবেন তাদের ওপর কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। এবং আমাদের নিজেদের ও অন্যান্য দেশ থেকে যারা আছেন কারো উপরে নিষেধাজ্ঞা নেই। তাহলে U.N. পর্যবেক্ষক দলের উদ্দেশ্য কী হবে? যদি একশ U.N. পর্যবেক্ষক আসে এটা কোন ব্যাপার না। কিন্তু আসলে তাদের কোন কাজ থাকবেনা।

প্রশ্ন: পূর্ব পাকিস্তানে গেরিলাদের কারণে সেখানে অস্থিরতা আছে। ভারত তাদের ব্যাপকভাবে আশ্রয় দিচ্ছে বলে রিপোর্ট আছে। আপনি কী মনে করেন এই আশ্রয় ও সহায়তা প্রত্যাহার করলে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা কিছুটা শান্ত হবে?
প্রধানমন্ত্রী: অবশ্যই না। এর বিপরীতে আমার মনে হয় এটা খুব খারাপ হবে। আপনারা জানেন আমাদের সীমান্তে যে মানুষ আসছে বা যাচ্ছে তা বন্ধ করতে পারবেন না। এমনকি একটি ব্রিটিশ দল আমাদের এখান থেকে না জানিয়ে ভারত ত্যাগ করে সেখানে গেছে এবং ফিরে এসেছে। আপনারা জানেন পূর্ব বাংলার সুবিশাল জনসংখ্যার অনেকে ইংল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য বিভিন্ন দেশে বসবাস করছে যারা এই আন্দোলনকে সমর্থন করে। উপরন্তু গেরিলা কার্যক্রম সমস্ত পূর্ব বাংলায় হচ্ছে – শুধু বর্ডারে নয়। এবং তাদের আধাসামরিক বাহিনী আছে যারা আগে-ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, ইস্ট বেঙ্গল রাইফেলস এ ছিল যাদের কিছু অস্ত্রও ছিল।

প্রশ্ন: প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে একটি প্ল্যাটফর্ম হিসাবে আপনি বলেছেন “গরিবি হটাও ‘ অর্থাৎ দারিদ্র্য নির্মূল কর। এখন পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে শরণার্থীদের বোঝা আসায় ভারতীয় অর্থনীতি খুব নির্মম পরিস্থিতিতে আছে। এই মুহুর্তে ভারতীয় অর্থনীতির অবস্থা কি?
প্রধানমন্ত্রী: অর্থনীতি যেমন স্বাস্থ্যবান হবার কথা তেমন নয়। সমস্যা আরো তীব্রতর হচ্ছে, যদি কেউ মনে করে আমাদের পতন হচ্ছে তাহলে তাদের বলছি, ভারতীয় জনগণ তাদের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিখছে। তাদের বিরাট বোঝা বহন করার ধৈর্য আছে। আমার মনে হয় কষ্ট সহ্য করার ধারণক্ষমতাও অসীম।

প্রশ্ন: ভারতের পররাষ্ট্রনীতি সংক্ষেপে জানা যাবে? সোভিয়েত – ভারত শান্তি চুক্তি নিয়ে কিছু মানুষ চিন্তিত কারণ ভারত সবসময় জোট নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। চুক্তিটি ভারতের এতদিনের কর্মকান্ডের সাথে সামঞ্জশ্যপূর্ন নয়।
প্রধানমন্ত্রী: কিন্তু এমনটা তারাই ভাবছেন যারা নিজেরাও জোট নিরপেক্ষতার বিপক্ষে। এই চুক্তি কোন ভাবেই জোট নিরপেক্ষতাকে বাধাগ্রস্ত করেনা। আমরা আমাদের নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার এবং আমাদের নিজস্ব পদক্ষেপ নেয়ার স্বাধীনতা রাখি।

প্রশ্ন: ভারত বলে যে তারা চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে চায়। রাশিয়ার সাথে চুক্তির ফলে সেই সম্ভবনা তো আর থাকছে না।
প্রধানমন্ত্রী: কেন নয়? সম্ভবত আপনারা দেখেছেন জনাব চৌ এন লাই কি বলেছেন। তিনি বলেন, এতে কোন সমস্যা হবেনা।

প্রশ্ন: আপনি কি পাকিস্তান – চীন সম্পর্কে চিন্তিত নন?
প্রধানমন্ত্রী: না।

প্রশ্ন: জাতিসংঘের সম্পর্কে কি অবস্থান? ভারত সবসময় জাতিসংঘে চীন এর এন্ট্রিকে সমর্থিত করেছে। আপনি কি মনে করেন যে এখন যেহেতু চীন অন্তর্ভুক্ত তাই জাতিসংঘের দক্ষতা বাড়বে না কমবে?
প্রধানমন্ত্রী: আমি মনে করি এটি উত্তর দেবার মত কোন প্রশ্ন না। আমি সত্যিই জানি না এটা কিভাবে কাজ করতে যাচ্ছে। কেবল ভবিষ্যতই বলতে পারে। কোন কারণ নেই কম দক্ষ হবার। আপনি বলতে পারেন এটা অন্য দিক মোড় নিতে পারে।

প্রশ্ন: এখন কি আমরা সাহায্য ও বাণিজ্য চালু করতে পারব? প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ডলার রক্ষা করার জন্য একটি প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন সিনেটের এইড বিলে। আপনি কি মনে করেন এতে করে বাণিজ্য যুদ্ধ হতে পারে?
প্রধানমন্ত্রী: স্বাভাবিকভাবেই এটা আমাদের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করবে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত আমেরিকানদের। আমাদের শুধু তারা যা করবে তার সাথে মিলিয়ে ব্যাবস্থা নিতে হবে।

প্রশ্ন: আমি জানি যে ভারত আই এম এফ এর সম্প্রতি যে নীতি ঘোষণা করেছে তার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে কারণ সেখানে অনুন্নত দেশের দিকে নজর দেয়া হয়নি। আপনি কি মনে করেন ওইসব দেশকে এর আওতায় আনা সম্ভব?
প্রধানমন্ত্রী: আমার স্বার্থ শুধুমাত্র এই সব অনুন্নত দেশের ব্যাপারে। কারণ ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে বিভাজন বেশী হলে তা শুধুমাত্র বিশ্বের অস্থিরতা বাড়াবে। এবং আমি মনে করি এই ভাসমান মুদ্রা খুব সহায়ক হবে না। আমরা আরো স্থিতিশীল অবস্থা চাই।

প্রশ্ন: সর্বশেষে আমি শুধু জানতে চাই ভারত ও পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার সর্বশেষ দৃষ্টিভঙ্গি কি?
প্রধানমন্ত্রী: আমি মনে করি যে প্রধান সমস্যা সীমান্ত নয়। আমি মনে করি মানুষ মৌলিক বিষয়টি জানতে চায়। আপনি যদি আসল সমস্যার মূল দিকটা না সমাধান করে কাজ করেন তাহলে এক সময় মূল সমস্যাটা আরও প্রকট আকার ধারণ করবে।

প্রশ্ন: কিন্তু আপনি কতদিন এই অবস্থা আরও গুরুতর হয়ে যুদ্ধের দিকে চলে যেতে পারে বলে মনে করেন?
প্রধানমন্ত্রী: এটা এখন আরও গুরুতর হয়ে যাচ্ছে।

প্রশ্ন: ভারতের মধ্যে প্রচুর শরনার্থি প্রবেশ করছে যা বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষন করেছে। ভারত এই অবস্থায় কেমন বোধ করছে?
প্রধানমন্ত্রী: আমাদের কিছু করার নেই। পরিস্থিতি ক্রমশ অবনতি হচ্ছে। এটি ভারতের অর্থনীতি, স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা ও দেশের অখণ্ডতার উপর হুমকি।

প্রশ্ন: কিন্তু পশ্চিম ইউরোপ থেকে সফর করে আপনি কি মনে করেন যে এই সব দেশ ভারত-এর জন্য তাদের যে সহমর্মিতা প্রকাশ করেছে, তা থেকে তারা কিছু বাস্তব পদক্ষেপও নেবে?

প্রধানমন্ত্রী: যদিও এখানে মানুষ উদ্বিগ্ন, কিন্তু ইউরোপ সবসময়, ইউরোপীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্বের দিকে তাকায়। অন্য দিকে এশিয়া ও আফ্রিকার সব অন্যান্য দেশ তাদের নিজস্ব সমস্যার কারণে অন্যদের নিয়ে চিন্তার সময় পায়না। ইউরোপীয় অনেক দেশ উপমহাদেশে ‘ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করে। তাই আমি মনে করি এই প্রশ্ন তাদেরকে করুন – কারণ তারাই বলতে পারবেন ভারত দুর্বল, নাকি অস্থিতিশীল; ভারত এশিয়ার শান্তির জন্য কোনো দরকারী কিছু করতে পারবে কিনা।

প্রশ্ন: আপনি কি বলবেন যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আপনার বৈঠক সফল হয়নি যেহেতু আপনি মনে করেন আপনি বোঝাতে ব্যার্থ হয়েছেন?
প্রধানমন্ত্রী: না, আমি হতাশ নই। প্রথমত, আমি কখনো বিশেষ কিছু আশা করিনা। এখন প্রশ্ন হল তারা অনুধাবন করেছেন কিনা অথবা তারা গভীরভাবে এটা সম্পর্কে কিছু করতে চান কিনা।

প্রশ্ন: কাশ্মীরের সমস্যার মত দীর্ঘ ইতিহাস দেখে, মানুষ কি একরকম বিশ্বাস করবে যে এটাও দীর্ঘদিন ধরে চলতে পারে?
প্রধানমন্ত্রী: কোন মানুষ? আপনারা দেখছেন অন্য সব কিছুই আগের মত আছে – ভারত ছাড়া। অন্য দেশ কি ভাবছে তাঁর উপর আমরা নির্ভরশিল না। আমরা জানি আমাদের কি লাগবে এনং আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করব। আমরা যে কোন দেশ থেকে সাহায্যকে স্বাগত জানাই। কিন্তু যদি তা না আসে তবু ভালো।

প্রশ্ন: পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্তে সামরিক পরিস্থিতি কেমন আপনি কি বলতে পারবেন? কারণ এটা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গত সপ্তাহে সাঁজোয়া বাহিনী এবং সেনা বাহিনীকে অবস্থান নিতে আহবান জানিয়েছেন যা ইঙ্গিত করে যে যুদ্ধাবস্থা আসছে।
প্রধানমন্ত্রী: আমরা যুদ্ধাবস্থার মধ্যে আছি। যেহেতু সেনারা নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে জানে, তাই উভয় সীমান্তে তারা প্রস্তুত আছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এর সেনা মোতায়েনের আগে চিন্তা করা উচিৎ। আমাদের সেনা শুধুমাত্র তখনই সরানো হয় যখন আমরা মনে করি যে আমাদের নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকির মুখে। আমার কোনো সন্দেহ নেই আমরা এখনো প্রস্তুত না। আমি আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে এর আগে আমরা দুইবার পাকিস্তান দ্বারা আক্রান্ত হয়েছি।

প্রশ্ন: কিন্তু গত সপ্তাহে জানা যায় কিছু ব্যাটেলিয়ন সেখানে কর্মযজ্ঞ করেছে আর কিছু বিমান সেখানে নিযুক্ত ছিল। প্রায় পাঁচশত হতাহত হয়েছে। এটাই কি সীমান্তের চিত্র?
প্রধানমন্ত্রী: আমার এতে সন্দেহ আছে। সীমান্ত জুড়ে সেখানকার কিছু নেতা বিশ্ব ফোরামে কিছু কথা বলে যাচ্ছেন যা আসলে সত্য নয়। এমন কথা এর আগেও শুনেছি অনেক।

প্রশ্ন: কিন্তু সেখানে কিছু কামানের গোলা ব্যাবহ্রিত হয়েছে। পূর্ব দিকে কি নেই?
প্রধানমন্ত্রী: হ্যাঁ, কিছু গোলাবর্ষণ হয়েছে।

প্রশ্ন: তারা কি এখনো চালিয়ে যাচ্ছে?
প্রধানমন্ত্রী: আমি তাই মনে করি।

প্রশ্ন: সীমান্তে উত্তেজনা আপনি কিভাবে দেখছেন তাহলে?
প্রধানমন্ত্রী: হ্যাঁ, এটা খুবই উত্তেজনাকর।

প্রশ্ন: যুদ্ধের পরিবেশ কি থেমে যাচ্ছে নাকি আরও ঘনীভূত হচ্ছে?
প্রধানমন্ত্রী: যুদ্ধ একটি মন্দ জিনিস। ভারত সবসময় যুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল। কিন্তু কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। আজ আমরা মনে করি যে, ভারতীয় জনগণের স্বার্থ যেমন বিবেচ্য তেমনি এশিয়ায় শান্তি তথা বিশ্বের শান্তি, স্থিতিশীলতা, অখণ্ডতাও বিবেচ্য। এটাই মূল বিষয়।

প্রশ্ন: হ্যাঁ, আমি সত্যি বলতে চাচ্ছি যে ভারত যুদ্ধের দিকেই যাচ্ছে হয়তো। যদিও আপনি বলেছেন এটা এড়িয়ে যাবার ব্যাপারে আপনি খুব মনযোগী। তবুও বলব পরিস্থিতি যদি যুদ্ধের অবশ্যম্ভাবিকতার দিকে যায় তাহলে আপনি কি থামাতে পারবেন?
প্রধানমন্ত্রী: আমরা এটা থামিয়েছি। তাহলে যদি শান্ত না থাকতাম এবং সংযত না হতাম তাহলে খারাপ দিকেই যেত যুদ্ধ পরিস্থিতি। আমি বা আমার সরকারের কেউ কি যুদ্ধের পক্ষে একটি শব্দও উচ্চারণ করেছে? কিন্তু আপনারা যদি অন্য পক্ষের কিছু বক্তব্য শোনেন তাহলে দেখবেন তারা পাবলিকলি কিভাবে ইঙ্গিত দিয়ে কথা বলেছেন।

প্রশ্ন: আপনি কি মনে করেন পাকিস্তান আক্রমণ করতে পারে?
প্রধানমন্ত্রী: নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছেনা। এটি নির্ভর করবে আগ্রাসন এর উপর। ১৯৬৫ সালে হাজার হাজার অনুপ্রবেশকারীদের পাঠানো হয় কিন্তু তারা তা স্বীকার করেনি। কিন্তু পরে জানা গেল যে সেটি আগ্রাসন ছিল এবং উদ্যেশ্য ছিল সেনাবাহিনীর জন্য পথ পরিষ্কার করা।

প্রশ্ন: আপনি কি বিশ্বাস করেন উদ্বাস্তুদের ঢোকার ব্যাপারে কঠোর হলে অবস্থা কিছুটা ভালো হবে? হয় কূটনৈতিক অথবা সামরিক? এখন কি পরিস্থিতি অনুকূলে আছে?
প্রধানমন্ত্রী: আমি জানি না পরিস্থিতি এর অনুকূলে আছে কিনা। কিছু কাজ সম্পন্ন করা বাকি আছে। আমরা পাকিস্তান সমস্যার সাথে নিজেদের ভারাক্রান্ত করতে চাচ্ছিনা। তাদের সমস্যা খুব বড়। নির্বাচনে প্রচুর লোক তাদের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। বর্তমান সরকারের তত্ত্বাবধানেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল ভোট। তাই জুলুম, হত্যা বা সীমান্ত জুড়ে পুশ করা শুরু করে তারা। তাই কেন আমরা অন্য দেশের সমস্যা আমাদের মাথায় নেব? এর কি কোন যুক্তি আছে?

প্রশ্ন: কিন্তু আপনি কতটা দৃঢ় প্রত্যয়ী? আপনি যা বলেছেন তা কতটা বিশ্বাসযোগ্য?
প্রধানমন্ত্রী: আমি কোন কিছু বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ করতে আগ্রহী নই। আমি আমার দেশের জনগণের ভবিষ্যত এবং বর্তমান নিয়ে চিন্তিত। তারা আমাকে বিশ্বাস করে এবং আমি তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারিনা।

প্রশ্ন: আপনি প্রথম পদক্ষেপ বলেছেন উদ্বাস্তুদের প্রবেশ থামাতে হবে কিন্তু কিভাবে?
প্রধানমন্ত্রী: গণহত্যা, ধর্ষণ, গ্রাম পোড়ানো থামাতে হবে।
প্রশ্ন: আপনি অবস্থার উন্নতির জন্য প্রথম পদক্ষেপের কথা বলেছেন। বলেছেন উদ্বাস্তুদের দেশত্যাগ বন্ধ করতে হবে। কিন্তু ভারত যে গেরিলাদের সাহায্য করছে যারা পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই করছে। আপনি কি মনে করেন না যে গেরিলাদের সাহায্য করা বন্ধ করলে পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হবে?
প্রধানমন্ত্রী: তার মানে কি বলতে চাচ্ছেন আমরা হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাওয়ার ইন্ধন দিচ্ছি? প্রথম কী ঘটেছিল? ব্রিটিশ সংবাদপত্র, ফরাসি, আমেরিকার পত্রিকাসমূহ, কানাডিয়ান সংবাদপত্র, আরব সংবাদপত্রের সংবাদদাতাদের হিসাব অনুযায়ী কত জন মানুষ নিহত হয়েছে তার আগে? গেরিলাযুদ্ধ শুরু হবার অনেক আগে থেকেই গণহত্যা চলছিল।

প্রশ্ন: কিন্তু আমি আসলে পরিস্থিতি থামানোর ব্যাপারে বলছিলাম।
প্রধানমন্ত্রী: এখন প্রশ্নটা কি তাহলে? প্রশ্নের অর্থ কি আমরা ইন্ধন দিচ্ছি? আমরা যদি গণহত্যা সমর্থন করতাম তাহলে এটা কি থামানো যাবে? আপনি কি মনে করেন মানুষের সামনে তাঁর পরিবারের মহিলাদের ধর্ষন করবে আর তারা বসে বসে দেখবে? অবশ্যই না – আমরা এই পরিস্থিতি থামাতে চাই। সেখানে যা হচ্ছে তা সবচেয়ে খারাপ ধরনের যুদ্ধ, সবচেয়ে খারাপ ধরনের নৃশংসতা।

প্রশ্ন: কিন্তু গেরিলাদের না থামিয়ে কিভাবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে থামানো যায়? তারা তো তাদের দেশের শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য তেমনটা করতে বাধ্য থাকবে। তাই প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে কি করতে পারেন আপনি?
প্রধানমন্ত্রী: হিটলার যখন তাণ্ডব চালাচ্ছিলেন তখন আপনারা কেন বলেননি। আসুন চুপ থাকি – শান্তি কামনা করি জার্মানির। ইহুদীরা মরুক, বেলজিয়াম মরুক, ফ্রান্স মরুক। আপনি কি বলবেন তখন সব নিশ্চুপ ছিল?

প্রশ্ন: কিন্তু কিভাবে তাহলে এই প্রথম ধাপ নিয়ন্ত্রণ করার প্রস্তাব করেন …?
প্রধানমন্ত্রী: আমরা বিশ্ব সম্প্রদায়কে সজাগ করছি। তারা সংবাদপত্র থেকে জানতে পারছে কি হচ্ছে। লোকজন তথ্য দিচ্ছে। আমরাও আমাদের বেশীর ভাগ খবর নিচ্ছি ব্রিটিশ, অ্যামেরিকানসহ বিদেশী পত্রিকাগুলো থেকেই।

প্রশ্ন: তাহলে কি আপনি সমস্যা নিষ্পত্তির জন্য বিস্তৃত রূপরেখা দিতে পারবেন?
প্রধানমন্ত্রী: আমরা বাংলাদেশের জনগণের নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত নিতে পারিনা। এটা শুধুমাত্র তারা নিজেরা নিতে পারেন। কিন্তু আমি কেবল বলতে পারি যেহেতু ইতিমধ্যে একটি গণতান্ত্রিক ও মুক্ত নির্বাচন হয়েছে। এই অবস্থায় আরেকটি নির্বাচন করা প্রহসনমূলক।

প্রশ্ন: কিন্তু আপনি বলেছেন যে উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবর্তন ঠেকাতে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ঠিক করার দরকার – তাতে যদি পূর্ন স্বাধীনতা এই মুহুর্তে অর্জিত না হয় তবুও। স্বায়ত্তশাসন কি পূর্ণ স্বাধীনতার চেয়ে কম নয়?
প্রধানমন্ত্রী: এটা সম্পূর্ন তাদের উপর নির্ভর করে। এটা আমরা দেখাতে চাইনি। এটা তাদের দেখানোর বিষয়। আমরা কোন বিশেষ খেলার কথা বলছিনা যে তারা একটি পদক্ষেপ নিলে তারপরে আমরা নেব। আমরা লাখ লাখ মানুষের জীবন সম্পর্কে কথা বলেছি।

প্রশ্ন: আপনার সাম্প্রতিক বক্তৃতায় আপনি বলেছেন যে আপনি একটি আগ্নেয়গিরির উপর বসা, আমি মনে করি আপনি একটি খাঁচার ভিতরে বসা যেটি সব সমস্যা থেকে দূরে। আপনি বলেছেন পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্য স্থিতিশীলতা আনতে হবে – কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব?
তাদের একত্রিত করবেন কিভাবে?
প্রধানমন্ত্রী: আমরা জানি না তারা কিভাবে একত্রিত হবে। এটা আমাদের উদ্বেগের বিষয়। যদিও বিষয়টি পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসক এবং পূর্ববাংলার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে। পাকিস্তানের সেনা আমাদের পূর্ব সীমান্তেও জড়ো হচ্ছে। তাই একটি খাঁচার ভিতরে বসে থাকার অবস্থা আমাদের নেই। এর মানে এই নয় যে আমরা কিছু জানিনা। আমরা সজাগ আছি। তবে আমরা জানিনা পূর্ববাংলার জনগণ কী করবে। তাদের সিদ্ধান্ত তারাই শুধু নিতে পারে।

প্রশ্ন: কিন্তু আপনি যখন পুর্ব পাকিস্তান মুক্তকারিদের সাহায্য করছেন তখন তো আপনি হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেন না। আপনি জড়িত আছেন এবং আপনাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির আলোচনার প্রস্তাব দিলেও আপনি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। এটি কি আপনার অবস্থানের সাথে একটি স্ববিরোধিতা নয়?
প্রধানমন্ত্রী: একদম না। আপনি কি চান যেসব মানুষ ভারতে প্রবেশ করছে আমি তাদের হত্যা করি? ঠেকাতে হলে রাস্তা একটাই তাহলে তাদের খুন করতে হবে। এছাড়া আসলে আর কোন পথ নেই।

প্রশ্ন: না, অবশ্যই না। আমি তা সুপারিশ করি না।
প্রধানমন্ত্রী: কিন্তু তেমনটাই মনে হয় —

প্রশ্ন: কিন্তু আমি ভাবছি আপনি কেন আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন? এটা কি গুরুত্বপূর্ণ নয় – অন্তত বড় কোন ঝামেলা হবার আগে?
প্রধানমন্ত্রী: কার সাথে কিসের কথা? এখন পর্যন্ত, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সবাইকে বলছেন যে বাংলাদেশের পরিস্থিতি একেবারে স্বাভাবিক। এখন, হয় সে জানে না কী ঘটছে বা তিনি ইচ্ছাকৃত ভাবে মিথ্যা বলছেন। যেটাই হোক, সেক্ষেত্রে আলাপের ভিত্তি কি?

প্রশ্ন: আপনি কি মনে করেন ভারত উপ-মহাদেশের দুই দেশের বিভাজনের ফলে এটা ব্যর্থ হয়েছে?
প্রধানমন্ত্রী: আমরা খুব পরিষ্কারভাবে বলেছি ভারতীয় জনগণ পুরো জিনিসটার বিরুদ্ধে ছিল। কিন্তু আমি ও আমাদের নেতারা মনে করেছি এই ভাবে শান্তি আনতে হবে। এটা ভারতকে এগিয়ে নেবার এবং ভারতের দরিদ্র মানুষের জন্য একটি ভাল জীবন গড়ে তুলতে সহায়ক হবে। তারা এটা গ্রহণ করেছিল এবং আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ছিলাম না। পাকিস্তানের জনগণের প্রতি আমার বন্ধু সুলভ মনোভাব আছে। তারা একটি সামরিক শাসন চালাচ্ছে যা তাদের জনগণের জন্য কল্যাণকর না।

প্রশ্ন: পূর্ববাংলায় যা হচ্ছে তা কি ভারতকে বিপদের সংকেত দেয় না?
প্রধানমন্ত্রী: তেমনটা নয়।

প্রশ্ন: এতে কি ভারতের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতাও বাড়তে পারে?
প্রধানমন্ত্রী: না না। কারণ আমরা আমাদের মানুষের সাথে মোকাবেলা করতে পারি এবং আমরা দেখি যখন তাদের বৈধ ক্ষোভ তারা প্রকাশ করে আমরা তা সমাধান করি।

প্রশ্ন: আপনি কি দেখছেন যে উপমহাদেশে ক্ষমতার অপব্যাবহার ও রাজ্যের ভাষাগত পার্থক্যের কারণে যে পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে তা কি আপনি ঠেকাতে পারবেন?
প্রধানমন্ত্রী: হ্যা মানুষ বোঝা খুব কঠিন। আমাদের ১৬ টি ভাষার লোকদের মাঝে; ২০ টিও হতে পারে – কোন বৈরিতা তৈরি করার পরিকল্পনা আমাদের নেই। আমরা মনে করি আমরা এক। আমাদের মাঝে কোন দ্বন্দ্ব থাকলেও জরুরী অবস্থায় আমরা এক থাকতে পারি। আমাদের সীমানা জুড়ে যা হচ্ছে অথবা তিন বছর যে খরা হয়েছিল তখন আমরা এক ছিলাম।

প্রশ্ন: আপনি ঠিক বলেছেন। এক সপ্তাহ আগে প্রচুর উদ্বাস্তু আপনার উপর এসে পড়ল – তখন কেবল আপনি জগণের ম্যান্ডেট পেয়েছিলেন। ভারতের আমূল পরিবর্তন এবং সংস্কারের উপর প্রতিশ্রুতিশীল হয়ে আপনি জয়ী হয়েছেন। কিন্তু এখন শরণার্থী সমস্যার কারণে আপনি বিপদগ্রস্ত। নির্বাচনী অঙ্গীকার এর ব্যাপারে এই মুহুর্তে আপনার অবস্থান কি?
প্রধানমন্ত্রী: শুনতে অবাক লাগতে পারে ভারতীয় মানুষের সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা ও পরিপক্বতা পশ্চিমাদের চেয়ে বেশী। তাদের ক্ষোভ আছে, দাবি আছে। কিন্তু অসুবিধার সময়ে আমরা একসঙ্গে দাঁড়াতে পারি। আমাদের কষ্ট সহ্য করার অসীম ক্ষমতা আছে। যদি আমাদের তা করা লাগে আমরা করব।

প্রশ্ন: আমি বলতে চাচ্ছি আপনি কি মনে করেন আপনি আপনার কথা যদি পূরণ করতে না পারেন তাহলে গণতন্ত্র নিজেই ভূলুণ্ঠিত হবে?
প্রধানমন্ত্রী: না। ভারতে এমনটি হবেনা। গণতন্ত্র পৃথিবীর সব দেশ থেকে চলে যেতে পারে – কিন্তু ভারত থেকে নয়। শুধুমাত্র বিদেশীরাই ভাবে যে গণতন্ত্র হুমকির মুখে। আমি কখনই এক মুহুর্তের জন্যও তা বিশ্বাস করি না।

প্রশ্ন: কিন্তু আপনি নিজে কেমন বোধ করেন যখন আপনি দেখেন যে ভারতে যে পরিবর্তনের ভিত্তিতে নির্বাচিত হয়েছে এটা এখন বিপন্ন হতে চলেছে?
প্রধানমন্ত্রী: হ্যাঁ, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা আমাদের দারিদ্র্য হ্রাস করেছি। আমাদের বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবিচার ও বৈষম্য আছে এখনো। কিন্তু কিছু ব্যাপার তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ – বিশেষ করে যেখানে দেশের স্বাধীনতা জড়িত। আমি মনে করি রাজনৈতিক দলগুলোও – হোক ডানে/বামে বা কেন্দ্রে – তারাও আমাদের নিরাপত্তা ইস্যুতে আমাদের সাথে থাকবে।

প্রশ্ন: অত্যন্ত সংক্ষিপ্তভাবে, প্রধানমন্ত্রী, পরিশেষে, আপনাকে এই দেশের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়ন করার জন্য বলা হয়েছে। আমাদের ভাগ্য আসলে দুই বা তিন শত বছর পরে নির্ধারিত হবে। তবু সেই সময়টাকে আপনি কেমন দেখতে চান?
প্রধানমন্ত্রী: প্রথমত অতীতকে ভুলতে হবে। আগের সমপর্ক কেমন ছিল বিশেষ করে সেগুলো। স্বাধীনতার সাথে সাথে সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হয়েছে। এমন সময় ছিল যখন আমাদের তেমন বন্ধুত্বপূর্ন সমপর্ক ছিল না। কিন্তু আমি মনে করি আমরা এখন একটি নতুন ভিত্তিতে বন্ধুত্ব করতে পারি। আরও প্রাসঙ্গিকতার সাথে, উভয় দেশের বিভিন্ন সমস্যায় সাহায্য করতে পারি। পারস্পরিক সুবিধার অবস্থান তৈরি করতে পারি।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৬১। ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট নিক্সন প্রদত্ত ভোজসভায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণ ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৪ নভেম্বর ১৯৭১

Zulkar Nain &
Ibrahim Razu
<১২ ৬১, ১৩৪-১৩৭>

ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ৪ঠা নভেম্বর, ১৯৭১
“ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট নিক্সন প্রদত্ত ভোজসভায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণ”

আজ আমরা এই বাড়িতে অবস্থান করছি এটা যেমন সত্য। তেমনি বাস্তবিক অর্থেই এই কক্ষ এমন অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। অনেক বিখ্যাত মানুষ এখানে ছিলেন, যাদের আদর্শ এবং কর্ম দ্বারা প্রভাবিত ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের সীমানা অতিক্রম করেছে।

আমার মনে পড়ে, প্রথম যখন আমার বাবা জেফারসন এবং লিংকনের কর্মচঞ্চল এলাকার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, বাচ্চা মেয়ে হিসাবে আমি কতটা শিহরিত হয়েছিলাম। সেই দিনগুলোর পরে বিশ্বে অনেক কিছু ঘটেছে। অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। কিন্তু কিছু চিন্তা চেতনা আর আদর্শ মানুষকে একত্র করেছিল। যদিও অনেক ভুখন্ড আর মহাসাগর আমাদের পৃথক করে রেখেছে, আমি মনে করি আপনাদের দেশ ও আমার দেশের মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকলেও দুই দেশের মানুষের মধ্যে অনেক মিলও আছে, আমাদের উভয়েরই জাতিগত উপাদানে গঠিত বৃহৎ সমাজ আছে যারা আমাদের ধর্মীয় মুল্যবোধ নিয়ে গর্বিত, এবং চাপিয়ে দেওয়া বিভিন্ন বিষয়ে ক্ষুব্ধ। আমাদের জনগন বন্ধুত্বপূর্ণ এবং উদার, একে অপরকে জানতে চায়, তাড়াতাড়ি তাদের অনুভূতি প্রকাশ করে এবং একই সাথে ক্ষমা প্রদর্শন এর জন্যও তারা সদাপ্রস্তুত।

স্বাভাবিকভাবেই, সেখানে বৈশিষ্ট্য ও মূল্যায়নের অনেক পার্থক্য আছে। এবং যেহেতু আমাদের জনগণ এবং আমাদের আইনসভা টিকে আছে স্পষ্টবাদিতার জন্য, তাই সেখানে বিশ্রী অকপটতার অনেক মুহূর্ত আছে। কিন্তু এটাও মনে রাখবেন যে উভয় সমাজে আমাদের সবচেয়ে স্পষ্টভাষী সমালোচকগুলো আমরাই।

আমি মনে করি একটি সচল গণতন্ত্র এই ধরনের দুর্বলতাকে সবলে পরিণত করে। গত মার্চে আমাদের পঞ্চম সাধারণ নির্বাচনে, মি. প্রেসিডেন্ট যেখানে আপনি অত্যন্ত উদারভাবে উল্লেখ করেছিলেন যে, আমাদের জনগণ গণতান্ত্রিক উপায়ে জাতীয় সমস্যার সমাধান করতে পেরেছে। তারা জাতিকে দারিদ্রের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম করার জন্য নতুন আত্মবিশ্বাস ও তরুণ উদ্দীপনার একটি পরিষ্কার ও সুসঙ্গত নির্দেশনা দিয়েছিল।

১৯৬০ সালের উন্মাদনা যেটি আমাদের প্রবৃদ্ধিকে দুর্বল করে দিয়েছিল সেটা কাটিয়ে উঠেছি। আপনাদের মূলধন ও খাদ্যের দীর্ঘমেয়াদি সাহায্যের কারণে আমাদের পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত হয়েছিল। বিদেশী সাহায্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটা সরাসরি অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে উন্নত দেশগুলোর, বিশেষভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের, অবদান তুলে ধরে। কিন্তু আমাদের জনগনের একান্ত প্রচেষ্টা আর ত্যাগের মাধ্যমে আমরা অভূতপূর্ব এবং দ্রুত সফলতা অর্জন করেছি।

আজ আমরা খাদ্য-শস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বৈদেশিক ঋণ আমাদের সম্পদের সামান্য কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ। সবকিছু এত সহজে অর্জিত হয়নি। এবং যদিও এই সময়গুলোতে আমরা অনেক হাসিখুশি ছিলাম, মি. প্রেসিডেন্ট আপনি জানেন, ভারতের জন্য তা কতটা কঠিন ছিল।

খরার সময়ে অনেকেই মনে করেছিল আমরা হয়তো আর বাঁচবো না। কিন্তু ঐ গুরুত্বপূর্ণ সময়টাতে আমরা কৃষিক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করেছিলাম যেটি আজ আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলেছে।

আপনি আমাদের নির্বাচনের কথা বলেছিলেন। তারা খুব সহজে জয়ী হয়নি। আমি তখনই মিসেস নিক্সনকে বলছিলাম যে সব কিছু নিষ্পত্তি করার জন্য আমাদের হাতে সময় খুব কম কারণ আমরা নির্দিষ্ট সময়ের ১ বছর ৩ মাস আগেই নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কারণ জনগন প্রায়ই বলতো “আপনারা সংখ্যালঘু সরকার। আপনাদের এটা করার অধিকার নাই, ওটা করার অধিকার নাই”, এসবে আমরা বিরক্ত হয়ে গেছিলাম। আমরা বলেছিলাম, “ঠিক আছে, তাহলে নির্বাচন করি”। তেতাল্লিশ দিনে আমি ৩৬০০০ মাইল পথ ঘুরেছিলাম। আমি ৩৭৫টা সভায় অংশ নিয়েছিলাম যার মধ্যে কোথাও ১ লাখের বেশী, কোথাও ২ বা ২.৫ লাখ মানুষ হয়েছিল। এটা ছিল একজন মানুষের প্রচেষ্টা, কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই এটা করতে লক্ষ মানুষের দরকার ছিল। আমরা কেন নির্বাচনে জিতেছিলাম তার বড় কারণ আমাদের প্রচেষ্টা না, বরং আমরা জনগণ তথা গরিব মানুষ, ছোট ব্যবসায়ী, গরীব কৃষক, যারা দারিদ্রতার নিম্নসীমায় বাস করে, এবং সর্বোপরী যুবক শ্রেণীর মানুষদেরকে আমরা বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম যে আমরা তাদের জন্য যতটুকু করেছি অন্যরা সেটুকু করেনি।

তাই প্রচারনা শুধু দলীয় না জনগণের প্রচারণায় রূপ নিয়েছিল। আমি জানিনা যুক্তরাষ্ট্রে কি হয়, কিন্তু আমাদের দেশের নেতা-কর্মীরা প্রার্থীর ব্যাপারে সমানভাবে উৎসাহী ছিল না। (প্রেসিডেন্ট নিক্সন – আমাদের ক্ষেত্রেও একই) কিছু জায়গায় স্বাভাবিকভাবেই আমরা ভেবেছিলাম আমাদের সবচেয়ে ভালো প্রার্থীকে পেয়েছি। আবার কিছু জায়গায়তে আমরা বিভিন্ন কারনে তা হয়নি। আবার এমন অনেক জায়গা ছিল যেখানে আমরা ভেবেছিলাম আমাদের প্রার্থী জিতবে না, কারণ যারা (মাঠ পর্যায়ের দলীয় নেতা-কর্মী) আমাদের প্রার্থীকে জিততে সাহায্য করবে তারা প্রার্থীকে কোন ধরনের সহযোগীতাই করে নি। কিন্তু আবার এমন অনেক জায়গায় জনগন এভাবে বলেছে যে – প্রার্থী যেই হোক, সে যদি মিসেস গান্ধীর অধীনে প্রার্থী হয় আমরা তাকে নির্বাচনে জিতাব, সেখানে দলীয় লোক কি বলল বা অন্য কেউ কি বলল তা মুখ্য ছিল না। এভাবেই আমরা এই নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলাম।

আমাদের নতুন সংসদে সপ্তাহে মাত্র একবার দেখা হয়েছিল, এবং অন্যান্য সকল রাজনীতিবিদদের মত তখনো আমরা একে অন্যকে পিঠ চাপড়ে অভিনন্দন জানাতেই ব্যস্ত ছিলাম, তখন হটাৎ করেই সমগ্র বিশ্বে পরিবর্তন ঘটে গেল। যেটাকে আমরা সূর্যের আলো ভেবে সামনে এগিয়ে যেতে এবং বাকি সমস্যাগুলো সমাধানের কথা ভেবেছিলাম সেটা অন্ধকারের কালো ছায়ায় ঢেকে গেল। এবং কোন সতর্কবার্তা ছাড়াই আমাদের সীমান্ত জুড়ে গুরুত্বর সঙ্কট সৃষ্টি হয় এবং প্রায় আমাদের গ্রাস করে ফেলে, আমাদের কষ্টার্জিত স্থিতিশীলতাকে হুমকির মধ্যে ঠেলে দিল।

যা ঘটেছিল, তা সমসাময়িক ইতিহাসের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ, আমার এটা নিয়ে ভাবা ঠিক না, কিন্তু আমি কি সেই সমস্যার সত্যিকারের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারি? আপনারা কি ভাবতে পারেন মিশিগানের সমস্ত জনগন হঠাৎ করে নিউ-ইয়র্কে জড়ো হলো? কল্পনা করুন তখন নিউ-ইয়র্ক প্রশাসনিক অবস্থা, স্বাস্থ্য সেবা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা, খাদ্য এবং আর্থিক অবস্থা কেমন হবে? এবং এটা সমৃদ্ধিশালী অবস্থায় ছিলনা, বরং দেশটি ইতিমধ্যে দারিদ্র্য এবং জনসংখ্যা সমস্যার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতেছিল।

আমরা আমাদের উন্মুক্ত সমাজের ঐতিহ্যের মূল্য দিয়েছি। নিশ্চিতভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের জনগন এটা বুঝবে। আপনার সমাজ কি এমন লোক দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়নি যারা সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবিচার থেকে দূরে থেকেছেন? আপনাদের দরজা কি তাদের জন্য সবসময় উন্মুক্ত ছিল না?

প্রত্যেক জাতিকে তার নিজের ক্রুশ বহন করতে হবে। আমাদের জনগণ দৃষ্টান্তমূলক একতা, আত্ননীর্ভরশীলতা, এবং সংযমের সাথে এই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু কাছের এবং দূরের প্রতিবেশী এবং অন্য যারা গণতন্ত্রকে গুরুত্ব দেয় এবং গণতান্ত্রিক নীতি মেনে চলে, আমরা তাদের বোঝার এবং আমি আরো বললে – আমরা তাদের থেকে বড় ধরনের সাহায্য কামনা করি।

আমাদের কোন বন্ধু চাইবেনা, এবং বিশেষ করে যারা আমাদের আদর্শের কেউ না, যে আমরা আমাদের দীর্ঘদিনের গণতান্ত্রিক নীতি পরিহার করি। যদি আজ আমরা ভয়াবহ আর্থিক মন্দায় পড়ি এবং আমাদের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হয়, তার জন্য দায়ী থাকবে আমাদের গণতান্ত্রিক নীতি এবং ভৌগোলিক নৈকট্য যেটা আমাদেরকে মধ্যযুগীয় বর্বরতার শিকার হয়ে লক্ষ লক্ষ অসহায় শরনার্থীতে পরিণত করেছে।

পরিস্থিতি আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিণতির কথা ভাবার সুযোগ দেয়নি। আমাদের প্রশাসন ইতিমধ্যে বিশাল জনসাধারনের চাহিদা মেটানো নিয়ে চাপে আছে, তার মধ্যে অতিরিক্ত আশ্রয়হীন নয় মিলিয়ন মানুষের দেখাশোনার ঝামেলায় আছে যারা সবাই অন্যদেশী। খরার জন্যে রাখা মজুদ খাদ্য ব্যবহার করা হচ্ছে। উন্নয়নমূলক কাজের জন্য বরাদ্ধকৃত সীমিত সম্পদের পরিমান ক্রমশই হ্রাস পাচ্ছে।

অপপ্রচার নিয়ে ভাবার থেকে এই অনুষ্ঠান অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের জনগন বুঝতে পারছে না যে, কিভাবে আমরা ক্ষতির শিকার হলাম, আমরা যারা সব ধকল বহন করেছি এবং বীরত্বপূর্ন সহিষ্ণুতার সাথে নিজেদের সামলাচ্ছি, আমদের কেন যারা এই দুর্দশার জন্য দায়ী তাদের সমান গণ্য করা হচ্ছে।

এর পরিনাম কতদুর পৌছাবে সেটা এখনো বলা যাচ্ছেনা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এই সমস্যার মূলোৎপাটনের চেষ্টা করা। ভারত এব্যাপারে যর্থাথ উদার প্রতিক্রিয়া দেখাবে।

তন্মধ্যে, আমার দেশের জনগনের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার দায়িত্ব বা কর্তব্য আমি এড়িয়ে যেতে পারি না।

মি. প্রেসিডেন্ট, আমরা আমাদের স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের উপর বিশ্বাস রেখে আপনার সাথে আছি। আমার দেশের আকার, এবং জটিল পরিস্থিতি আমাদের অনেক হতাশাজনক ভবিষ্যদ্বাণীর মুখোমুখি করেছে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত ভারতের অনেক সহনশীল যা সমাজ, বিভিন্ন সঙ্কট থেকে বের হওয়ার সমাধান এবং শক্তির নতুন উৎস ভেদে ব্যাতিক্রম নয়।

মি. প্রেসিডেন্ট, সুচিন্তাভাবনার জন্য সারা বিশ্বেই আপনার তারিফ রয়েছে যার জন্যে আপনি সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আমি নিশ্চিত যে, এত সুন্দর লাবন্যময়ী এবং মনোমুগ্ধকর ফার্স্ট লেডি আপনার শক্তির উৎস।

আজ সকালে, আপনি যখন ঝলমলে রোদের কথা বলেছিলেন, এবং বাস্তবিক অর্থেই দিনটি ছিল অসাধারন। আমি জানিনা এরজন্য আপনি নাকি আমি দায়ী কারণ ভারতে মানুষের ইচ্ছানুযায়ী আবহাওয়া আনার জন্য আমার বেশ সুনাম আছে। স্বাভাবিকভাবেই এটা বৃষ্টি, মোটেই ঝলমলে রৌদ্র না, কারণ আমাদের ফসলের জন্য বৃষ্টি দরকার এবং এমনকি খরার মৌসুমে প্রচন্ড খরার সময়ে, আমি যখন কোথাও যেতাম, সেখানে বৃষ্টি হত, যদিও পার্থক্য তৈরি করার জন্য সেটা নগন্য কিন্তু দুই বা তিন ফোঁটা হত শুধু বলার জন্য যে, “বেশ, আমি সেখানে ছিলাম”।
সম্ভবত, ঝলমলে রৌদ্রজ্জল দিনে আমার কিছু করার ছিল।

কিন্তু ঐ সূর্যকিরণ যখন স্বাভাবিকভাবেই আপনার অতি চমৎকার বাগান ও বাড়ির সৌন্দর্য্য বাড়ায় এবং যেটা আমরা এখান থেকে দেখতে পারছি, আপনি তখন অন্য একটি গাঢ় সূর্যকিরণের উল্লেখ করেন, যেটি আপনি মনে করেন আমাদের বন্ধুত্বকে ব্যাপক অর্থবহ এবং উদ্দেশ্যমন্ডিত করবে।

সুতরাং, যখন আপনি সূর্যকিরণের কথা উল্লেখ করলেন, তখন কিছু একটা আমার মনের মাঝে একটা ঘন্টা বাজল, কিন্তু আমি তাৎক্ষনিকভাবে বিশ্ব নিয়ে ভাবিনি। সেসব বিষয় আমার পরবর্তীতে মনে এসেছিল। আমাদের একটি বেদ গ্রন্থে যা বিশ্বের বিদ্যমান প্রাচীন সাহিত্য, সেখানে একটা উদ্ধৃতি খুঁজে পেলাম – সূর্যোদয়ের সাথে যেমন পদ্ম তার দ্যুতি পায়, তেমনিভাবে বন্ধুদের চিন্তা ভাবনা সুপ্রসন্ন হয় এবং সমৃদ্ধি বয়ে আনে।

সুতরাং আমরা আশা করি এই কক্ষে বন্ধুদের মাঝে হওয়া আলোচনা সমৃদ্ধি বয়ে আনবে। অবশ্যই ইতিমধ্যে আপনার দেশ উন্নতির শিখরে পৌঁছে গেছে, কিন্তু আমরা আশা করি আপনি অন্যদেরও সাহায্য করবেন যারা এখনো সেখানে পৌঁছায় নি, এবং আপনারা আরো উন্নতির চরম শিখরে পৌছান। গ্রহণযোগ্যতা মানুষকে সমৃদ্ধি উপভোগ করতে সাহায্য করে। আপনার সমৃদ্ধ হওয়ার উপাদান আছে। আমরা অনেক দেশ দেখেছি যাদের অনেক কিছু আছে, কিন্তু কোন কারণে জনগন তা উপভোগ করছে না। তারা কিছু একটা খুঁজছে কিন্তু তারা জানে না তারা কি খুঁজছে।

আমি আন্তরিকভাবে এই ইচ্ছা আপনাদের সাথে ভাগাভাগি করছি, শুধু ব্যক্তিগতভাবে নয় বরং ভারত সরকার এবং ভারতের সমগ্র জনগনের পক্ষ থেকে বলছি যারা যুক্তরাষ্ট্রের জনগনের প্রতি শ্রদ্ধাভাজন এবং বন্ধু সুলভ।

আমি বলেছিলাম, স্বাধীনতার সংগ্রামকালে যুক্তরাষ্ট্রের আহবানে এবং পরবর্তীতে আপনাদের বিজ্ঞানীদের এবং আরো যারা বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানকে এগিয়ে নেয়ার কর্মকান্ডে আমাদের জনগন কতটা উৎসাহ পেয়েছিল।

ভারতে, যদিও আমাদের অনেকেই আগামী দিন নিয়ে ভাবে, কিন্তু যখন আমরা কিছু বলতে চাই, আমরা নিজের অজান্তেই অতীতে খুজতে থাকি। অনেক কথা আছে যেগুলো হাজার বছর পূর্বে লেখা হলেও সেটা আজো খুব ভালোভাবে লেখা যেতে পারে। আমাদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে এমন কিছু অংশ (আমি নিশ্চিত আপনাদের আমেরিকাতেও তেমন আছে) এবং কিছু মহান আদর্শ আছে, যত উন্নতিই হোক আর মানবজাতি যত অগ্রসরই হোক আমরা সেগুলো টিকিয়ে রাখতে চাই।

তাই কিছু বিষয় থাকা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ন কিন্তু এর থেকে আরো গুরুত্বপূর্ন হলো কিভাবে তা উপভোগ করবেন এবং তাদের মধ্য দিয়ে কিভাবে আনন্দকে অন্যদের সাথে ভাগাভাগি করবেন।

আমি আপনাকে আবারো একবার ধন্যবাদ দিতে চাই আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য যার জন্য আমার এখানে আশা সম্ভব হয়েছে এবং আপনার সাথে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং আনন্দদায়ক কথা বলার সুযোগ করে দেয়ার জন্য মি প্রেসিডেন্ট, এবং আশা করি আগামীকাল এই প্রসংসনীয় সমাবেশের সুন্দর মনোমুগদ্ধকর পরিবেশে উপস্থিত থেকে আরো অনেক বিশিষ্ট মানুষের সাথে গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটাবো।

আমি কি আপনাদের সবাইকে, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি এবং বিভিন্ন সময়ের ফার্স্ট লেডি এবং আগামী দিনের মহান ব্যক্তিবর্গদের সুস্বাস্থ্য কামনা করে এবং আমাদের দুই দেশের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উপলক্ষ্যে ভোজসভার আয়োজনে অংশ নেওয়ার জন্য বলতে পারি?

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৬২। ওয়াশিংটনে ন্যাশনাল প্রেসক্লাবে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা ও প্রশ্নোত্তর ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৫ নভেম্বর ১৯৭১

Razibul Bari Palash
<১২, ৬২, ১৩৮-১৪৭ >

ওয়াশিংটনে ন্যাশনাল প্রেসক্লাবে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা
৫ নভেম্বর, ১৯৭১

আমি এখানে আবার আসতে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত। আপনাদের অনেকের সাথে আমার আগে পরিচয় হয়েছে ভারতে বা বাইরে। আপনারা আমার কিছু বর্ণনা দিচ্ছিলেন। কিন্তু সম্ভবত যারা রাজনীতি করেন তাদের জীবনের দুটি দিন কখনো একরকম হয়না। অনেক সময় অনেক দরকারি অথবা বাধ্যবাধকতাও মেনে চলতে হয়। অনেক কিছু ইচ্ছার বিরুদ্ধেও করে যেতে হয়।

যখন আমি মানুষের সাথে থাকি সেটাই আমার আনন্দ। বিশেষ করে যখন আমি বিশেষ কোন মানুষদের সাথে থাকি যেমন আজকের এই হলরুমের আপনারা।

আমাদের সময় সীমিত, তাই আমি দীর্ঘ বক্তৃতা করতে যাচ্ছি না। আমি শুধু কয়েকটি পয়েন্ট বলব যা আপনাদের প্রশ্নগুলোর উত্তর পাইয়ে দিতে সহায়ক হবে। অবশ্যই, কোন বিশেষ বিষয়ে আগ্রহী হলে প্রশ্ন করবেন।

আমি এখানে পাঁচ বছর আগে এসেছিলাম এবং আমি আপনাদের বলেছিলাম ভারতে কি কি কাজ করার চেষ্টা করছি। সে সময় শুধু ভারতেই, বিশ্বের সব অংশে অনেক কিছু ঘটছিল। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই, এখন আমি আমার নিজের দেশে নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন।

১৯৬৬ সালে আমার দেশ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছিল। সেটা করেছিল বিশ্বের প্রেস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রেস – আমাদের ঐক্য, গণতন্ত্র এবং এমনকি আমাদের বেঁচে থাকার ক্ষমতা সম্পর্কে। সেসব পেরিয়ে এখানে আমি আবার এসেছি। তবে আমরা অনেক অন্ধকার এবং অসুবিধা পার করেছি যা অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রমী মানুষের জন্যও কষ্টকর। আমরা এখন গম, ধান ও অন্যান্য শস্যতে স্বয়ংসম্পূর্ণ, যা আমাদের জনগণের প্রধানতম খাদ্য। সেচ সুবিধা ও সারের প্রতুলতায় অন্যান্য পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির কিছু প্রভাব ছিল। গত মার্চ মাস পর্যন্ত আমাদের জনসংখ্যা চৌদ্দ মিলিয়ন।

আমাদের রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা পরিবর্তন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এটি আমাদের জাতীয় জীবনে বৃহত্তর সঙ্গতি ও দিকনির্দেশনা দিয়েছে। আমাদের জনগণের আত্মবিশ্বাস আমাদের সাধারণ নির্বাচনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ষাট শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছে। শুধু শহরে নয়; প্রত্যন্ত অঞ্চলে ও পাহাড়ি এলাকাতেও। জনগণ আমাকে এবং আমার দলকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের বিশেষ দিক ছিল মানুষের উদ্যম; বিশেষ করে তরুণদের ভেতরে – যার জন্য তারা নিজেরাই স্বপ্রণোদিত হয়ে নির্বাচন প্রচারণা চালিয়েছিল।

নির্বাচন আমাদের মানুষের মনে নতুন আশার সঞ্চার করেছে এবং আমাদের নতুন শক্তিতে বলিয়ান করেছে এবং জীবন বোধ তৈরি করেছে। কিন্তু আজ আমাদের চিন্তাধারা বাংলাদেশ সঙ্কট নিয়ে বিষণ্ণ। সেখানেও নির্বাচন হয়েছিল। এমনকি সামরিক সরকারের অধীনে পূর্ববাংলার জনগণ মহা উচ্ছ্বাসে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য। ভোটে তারা তাদের রায় ও আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিল। সামরিক সরকার আলোচনার নামে সময় ক্ষেপণ করছিল। মূলত সেই সময়ে তারা প্রচুর সৈন্য নিয়ে আসছিল। এর পর যখনি আওয়ামীলীগ একটি পরিণতির দিকে যাচ্ছিল তখনি নেমে আসল ন্যাকারজনক সন্ত্রাস – ইতিহাসে যার তুলনা বিরল।

আমি মাঝে মাঝে আত্মরক্ষার্থে প্রেসের সমালোচনা করতে দ্বিধা করিনি। কিন্তু আজ এই অনুষ্ঠানে আমি বিশ্বের অনেক দেশের প্রেস সংবাদদাতাদের ধন্যবাদ দেই বিশ্বের বিবেককে জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করার জন্য। তারা পূর্ববাংলার ভয়ানক বিয়োগান্ত ঘটনাগুলো প্রকাশ করার মত সাহস ও অধ্যবসায় দেখিয়েছেন। তাদের রিপোর্ট ছিল সৎ এবং স্পষ্ট। কিন্তু ফোটোগ্রাফ দিয়ে তারা সেসব দুঃখ, দুর্দশা পৌঁছে দিতে পারেননি।

সেখানে যা হচ্ছে সেটি কোন গৃহযুদ্ধ নয়। এটা গণতান্ত্রিকভাবে ভোট দেবার অপরাধে বেসামরিক নাগরিকদের গণহত্যা। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার খুব ন্যাকারজনক পদ্ধতি এটি। এবং ইচ্ছাকৃতভাবে দেশের অসহায় মানুষকে অস্ত্র হিসাবে ব্যাবহার করে প্রতিবেশী দেশকে বিব্রত করার কৌশল। শরণার্থীদের সংখ্যা ইউরোপের কিছু দেশের জনসংখ্যার চেয়ে বেশী – যেমন অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম – যেখানে কিছুদিন আগে আমি গিয়েছিলেম।

আমরা মনে করি এটি একটি নতুন ধরণের আগ্রাসন। এটা অবশ্যই আমাদের উপর একটি বড় অর্থনৈতিক বোঝা। এর ফলে আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক উত্তেজনা সৃষ্টি হচ্ছে। এটা একটি দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। কারণ পূর্ব পাকিস্তানে যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সমস্যা হচ্ছে তাতে অন্য দেশও ভুক্তভোগী হবে – আর তা হল ভারত। এটি কোন আন্তর্জাতিক বিরোধ না। একটি ইন্দো-পাকিস্তান বিরোধও নয়।

আমাদের বলা হয়েছে যে সৈন্য মুকাবিলা শান্তির জন্য হুমকি। সমগ্র জনগণের হত্যা করা হলে সেটা কি শান্তির জন্য হুমকি নয়? বিশ্ব কখন উদ্বিগ্ন হবে? দুই দেশের সমস্ত মানুষ যদি যুদ্ধের কারণে মৃত্যুবরণ করে, হাজার হাজার শত শত জবাই করা হয় ও জনগণের বিরুদ্ধে সামরিক শাসন যুদ্ধ ঘোষণা করে তাদের দেশ থেকে বহিস্কৃত করে তখনো কি তারা উদ্বিগ্ন হবেনা?

আমরা আগ্রাসনের এই অবাক করা অবস্থা মোকাবেলা করতে পারছিনা। আমাদের নতুন ভাবে জবাব দিতে হবে। তাই আমরা বিশ্ব নেতাদের সংকটের প্রকৃতি এবং মীমাংসা সম্পর্কে ধারনা দিতে ও নিতে এসেছি। আমি বেশ কয়েক মাস আগে সরকার প্রধানদের কাছে চিঠি লিখেছি এবং তাদের সাথে দেখা করতে আমার সহকর্মীরা প্রস্তুত আছে। আমরা তাদের অবহিত করি যে পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা পূর্ব বাংলায় শেখ মুজিবুর রহমান ও তার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতা না করে জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নানারকম তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।

বিশ্ব নেতারা এটা বুঝতে পারলে এই দুর্বিপাক এবং অনেক লক্ষ লক্ষ লোকের মাইগ্রেশন এড়ানো যেত। দিন চলে যাচ্ছে। কিন্তু এখনও সময় আছে বিশ্বনেতার পরিস্থিতির বাস্তবতা উপলব্ধি করার।

আমি বিভিন্ন সফরে অনেক রাজধানী পরিদর্শন করেছি। আমি জানতে চেয়েছি সমাধান কি হওয়া উচিৎ। জানতে চেয়েছি কীভাবে পূর্ব বাংলার জনগণ একটি দীর্ঘস্থায়ী সমাধান পেতে পারে?

আমি বিশ্বের নেতাদের বলেছি পূর্ব বাংলার জনগণের স্বার্থ বিরোধী কোন মতামত যেন তারা না দেন। একটি জাতির ভাগ্য তাদের অজান্তেই অন্যদের দ্বারা নির্ধারন করা ঠিক নয়। এশিয়ার জনগণের চাহিদা অনুযায়ী তাদের নিজস্ব পছন্দ অনুসারে টেকসই গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করা উচিৎ। গণতন্ত্র যদি আপনাদের জন্য ভালো হয় তাহলে ভারতের জন্যও ভালো। এবং এটা পূর্ববাংলার জনগণের জন্যও ভালো হবে।

গণতন্ত্র অবদমনের চেষ্টাই পাকিস্তানে সব ঝামেলার মূল কারণ। বিশ্বের দেশগুলির চিন্তা করা করা উচিত তারা কি চান? এক ব্যক্তি ও তার মেশিন এর পক্ষে কাজ করা নাকি একটি পুরো জাতির স্বার্থ – কোনটি তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ?

আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে ভারত কি উদ্যোগ নেবে। আমি মনে করি সবচেয়ে বড় কাজ হল ধইর্য ধরে থাকা। আমরা দেখতে চাই না যে এটি একটি ইন্দো- পাকিস্তান ইস্যু হয়ে যায়। দুই দেশের মধ্যে কোন সরাসরি আলোচনা এই পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করবে। সমাধান আরো কঠিন হবে। পাকিস্তান এমন একটি পরিস্থিতি বানানোর চেষ্টা করছে যাতে তারা বলতে পারে যে তাঁরা প্রতিবেশী দেশ দ্বারা আক্রান্ত। আমি বলেছি, হুমকি পাকিস্তান থেকে এসেছে- আমাদের দিক থেকে নয়। যখন তারা দেখছে তাদের প্ল্যান অনুযায়ী কাজ হচ্ছেনা তখন তারা আমাদের পশ্চিম প্রান্তে সৈন্য জড়ো করতে থাকে।

পাকিস্তান জাতিসংঘ থেকে পর্যবেক্ষক ভারতে পাঠাবার প্রস্তাব করেছে। প্রাথমিক ভাবে তাকালে এটিকে ভালো একটি কাজ বলে মনে হয়। কিন্তু এটি আসলে মূল সমস্যা থেকে বিশ্ববাসীর মনোযোগ অন্য দিকে ধাবিত করার কৌশল। আমরা আক্রান্ত হতে রাজি না। পূর্ববাংলার জনগণের জন্য কথা বলার কোন অধিকার আমাদের নেই – যার জন্য আমরা তাদের সাথে কোন আলোচনায় যেতে পারছিনা। শুধু শেখ মুজিব ও তার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এই অধিকার আছে।

আমি কিছু নির্দিষ্ট পয়েন্ট উল্লেখ করেছি যেগুলো ভেবেছিলাম আপনাদের আগ্রহ সৃষ্টি করবে। এখন আমাকে প্রশ্নের জন্য সময় দেয়া উচিৎ। তবে একটি কথা বলি আপনাদের – ক্লাবের প্রেসিডেন্ট সাহেব বলেছেন আমি সাহায্যের জন্য এখানে এসেছি – কিন্তু আমি কোন সাহায্যের জন্য আসিনি। এমনকি যে কয়টি দেশ আমি ভিজিট করেছি তার কারো কাছে আমি সাহায্য চাইনা। আমি আর আমার প্রতিবেশী দেশের অবস্থা জানানো আমার দায়িত্ব – যাতে দেশগুলোর নেতারা পরিস্থিতি বুঝতে পারেন। তারা তাদের সিদ্ধান নেবেন। আমার কাছ থেকে শোনার পরে আমি জানতে চাই তারা এটা নিয়ে কি ভাবছেন বা কি মনে করেন বা তাদের কি করা উচিৎ।

এখানে আসার আমার প্রধান উদ্যেশ্য ছিল প্রেসিডেন্ট নিক্সনের আমন্ত্রণ। এটি ১ বছর আগে দেয়া হয়েছিল। এইসব ঘটনা ঘটার অনেক আগে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সরকার প্রধানদের তাদের চিন্তাভাবনাকে একে অপরের সাথে শেয়ার করা উচিৎ।

প্রধানমন্ত্রীকে করা প্রেস এর কিছু প্রশ্নের জবাব নিচে উল্লেখিত হল –

প্রশ্ন: মাদাম গান্ধী, আপনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সাথে কি আলোচনা করেছেন একটু বলবেন কি?
প্রধানমন্ত্রী: এই প্রশ্নটি আমাকে ১৫ নভেম্বর করা হয়েছিল আমাদের সংসদে। কোন আলোচনা ফলপ্রসূ হবে না যদি আপনি না জানেন ঠিক আগের আলোচনায় কি কি আলোচিত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীঃ আমি মনে করি আলোচনা সফল হয়েছে। ইউরোপ, এশিয়া; দ্বিপাক্ষিক বিষয়াদি, আন্তর্জাতিক বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমি মনে করি আমি যে মত দেব সেটাই তাদের অর্জন। আমি মনে করি প্রেসিডেন্ট এখন জানেন ভারত কি ভাবছে। এবং আমারও একটি ভালো ধারনা হয়েছে যে এই বিষয়ে আমেরিকা কি ভাবছে। এর চেয়ে বিস্তারিত মনে হয় এই অবস্থায় বলা দরকার নাই।

প্রশ্ন: আপনি হয়তো উত্তর দেবেন না, কিন্তু প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী আমরা জেনেছি পাকিস্তান ইস্যুতে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সাথে আপনার ফলপ্রসূ আলোচনা হয়নি। এই রিপোর্ট কি সঠিক? আপনি কি কিছু বলবেন?
প্রধানমন্ত্রী: না এই প্রতিবেদন সঠিক নয়। আমি আগেই বলেছি, এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার এবং প্রেসিডেন্ট দেখবেন যে তারা এই ব্যাপারে কি করতে পারেন। আমি অবশ্যই রাষ্ট্রপতির আন্তরিক ইচ্ছার প্রশংসা করি। আমার ধারনা এই রিপোর্ট মূলত আমাদের সাক্ষাৎ সম্পর্কে পূর্ব থেকে প্রত্যাশিত ধারনার উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছিল। আমাদের আলোচনা অনেকক্ষণ ধরে চলেছে। এর কারণ হল আমরা অনেক বিষয় নিয়ে আলাপ করেছি যার জন্য আজ সকাল পর্যন্ত আলোচনা গড়ায়।

তবে দুই দেশের যার যার দৃষ্টিভঙ্গি তার তার মত। কারণ ভূ-রাজনৈতিক অবস্থা দ্বারা এটি প্রভাবিত। সুতরাং, যদিও আমি বলতে চাই যে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একই রকম আলাপ করেছি তবে বিষয়টি অন্য কোন দেশের সাথে করা আলোচনার সাথে নাও মিলতে পারে।

তাই এই ক্ষেত্রে, আমরা প্রেসিডেন্ট ও তার সহকর্মীদের আমাদের সীমানার অবস্থা মূল্যায়ন করার ব্যাপারে বলেছি। আমরা মনে করি ভারতের স্থিতিশীলতা, শান্তি, আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন। তবে এটি শুধুমাত্র, আমাদের না তথা এশিয়া বা এমনকি পুরো বিশ্বের জন্য গুরুত্তপূর্ন।

প্রশ্ন: আপনি কি আশা করেন যখন গণতন্ত্র পূর্ববাংলায় হুমকির সম্মুখীন তখন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের উচ্চকণ্ঠে এর বিপক্ষে দাঁড়ানো উচিৎ? আলোচনার ফলস্বরূপ, আপনি কি আমেরিকান নীতিতে পরিবর্তন আশা করেন?
প্রধানমন্ত্রী: আমি মনে করি না প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কি করা উচিৎ সে সম্পর্কে মন্তব্য করা। এটা তার বিচার করার বিষয় – সব দিকে বিবেচনায় নিয়ে।

এখন, আপনারা দেখুন, আমেরিকা তার নীতিতে কোন পরিবর্তন করে কিনা। আমি মনে করি যে প্রেসিডেন্ট একটি উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। যদিও এর থেকে পথ বের করা অনেক কঠিন।

প্রশ্ন: ভারত কেন সীমান্ত থেকে ভারত ও পাকিস্তানি সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য ইয়াহিয়া খানের প্রস্তাবে রাজি হয়নি?
প্রধানমন্ত্রী: আমি আমার আগের মন্তব্যে এই পয়েন্ট স্পর্শ করেছি। যখন উদ্বাস্তু প্রথম ভারতে প্রবেশ শুরু করে তখন আমরা জাতিসংঘের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। আর সেই সময়ে বলা হয়েছিল যে এটি একটি আভ্যন্তরীন সমস্যা। পরে পাকিস্তান আমাদের পশ্চিম সীমান্তে সেনা এনেছিল। ভারত তখনো সরায়নি। সেখানে বিষয়টি জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকদের মনোযোগ আকৃষ্ট করে এবং তারা এই প্রক্রিয়াটি প্রশ্নবিদ্ধ করে। পাকিস্তান বলেছিল এটা শুধুমাত্র সামরিক মহড়া।

একথাও ঠিক যে, তা খুব বিশ্বাসযোগ্য উত্তর ছিল না। কিন্তু, সম্ভবতঃ, এটা সত্য হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু আমরা সত্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারিনি। আমাদের নিরাপত্তা বিপদের মধ্যে ছিল। আপনারা জানেন আমাদের মাটিতে তিনটি বড় ধরনের আগ্রাসন আছে। একটি চীন থেকে এবং দুইটি পাকিস্তান থেকে। আমাদের সীমান্ত এলাকার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ তেমন ভালো না। তাই সরকারের প্রধান হিসেবে এটা দেখা আমার দায়িত্ব ছিল। আর সে জন্যই আমরা আমাদের সৈন্য সরিয়েছি।

সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়ে বলব, এটা ছিল মূল সমস্যা থেকে বিশ্বের ফোকাস অন্য দিকে সরানো। ১৯৬৫ সালের সংঘাতে, কাশ্মীরে হাজার হাজার অনুপ্রবেশকারীর চলাফেরায় দেশকে দুর্বল করার উদ্যেশ্যে একটি প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল যাতে সেই সুযোগে পাকিস্তানী আর্মি প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু সেটা সফল হয়নি। কারণ যদিও অনুপ্রবেশকারীরা আমাদের ভেতরে প্রবেশ করেছিল তবুও আমাদের মানুষ- কৃষক, যাযাবর গোত্র তাদের দেখাশোনা করেছে – এমনকি তাদের সাথে আশা ছাগল, গরু ইত্যাদিরও দেখাশোনা করেছে এবং আমাদেরকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সাহায্য করেছে।

সুতরাং, সেখানে কোন মুকাবিলা হয়নি। আর এই রকম পরিস্থিতি এখন পূর্ববাংলায় ঘটছে। এবং আমি মনে করি না এটাকে আলাদা কিছু হিসেবে দেখার সুযোগ আছে।

প্রশ্ন: প্রশ্ন U.N. মহাসচিব কি ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা কমানোর জন্য ভালো পদক্ষেপ নিচ্ছেন? যদিও ভারত কে দায়ী করা যায় না, তবুও কেন আপনি দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি রক্ষার জন্য আপনার এলাকায় U.N. পর্যবেক্ষকদের আসার অনুমতি দিচ্ছেন না?
প্রধানমন্ত্রী: দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর আগে দিচ্ছি। আমি বলতে চাই আমাদের ইতোমধ্যে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকরা আছে। পশ্চিম ফ্রন্টেও কিছু আছে বহু বছর ধরে। পূবে আছে জাতিসংঘের শরণার্থী হাইকমিশনের দশ জন প্রতিনিধি। সুতরাং, কোন পর্যবেক্ষক বা কোন বিদেশী নেই তা ঠিক নয়।

এছাড়াও, আমাদের সমাজ খুব উন্মুক্ত। সেখানে এম্ব্যাসেডর, কূটনৈতিক কোরের অন্য সদস্যরা, অনেক দেশ থেকে আসা প্রেস, রেডিও, টেলিভিশন এর প্রতিনিধি, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ইউরোপের দেশগুলোর, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান, ল্যাটিন আমেরিকান, জাপান, নিউজিল্যান্ড থেকে আসা সংসদীয় প্রতিনিধি দলের মানুষরা আছে।

সুতরাং, সেখানে আমাদের কিছু গোপন করার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু প্রশ্ন হল তারা কি দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি আনতে সক্ষম হবে? পূর্ববাংলায় যা ঘটছে তাতে শান্তি কীভাবে আসবে? এখনও খুন করা হচ্ছে। হাজার হাজার শরণার্থী এখনো প্রতিটি দিন আসছে। এখন, আপনি যদি বলেন যারা এসেছে তাদের ফিরে যেতে হবে – প্রশ্ন হল – এটা কি নিরাপদ? আর যদি নিরাপদ হয় তাহলে আরো মানুষ আসছে কোথা থেকে? সুতরাং, এই একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম হলেই আপনারা উত্তর পেয়ে যাবেন।

কিন্তু যদি মহাসচিব বা আগ্রহী কেউ যদি নিশ্চিত করেন যে এই অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে সক্ষম হবেন তাহলে পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে, তিনি বলতে পারেন যে বাকিরা তাহলে ফিরে যেতে পারেন তেমন পরিবেশ সৃষ্টি করুন।

প্রশ্ন: বর্তমান সঙ্কটের দিনে কেন আপনি জাতিসংঘে একটি ভিজিট দিচ্ছেন না?
প্রধানমন্ত্রী: আমি মনে করি না এতে তেমন কাজ হবে।

প্রশ্নঃ কিছু পর্যবেক্ষক বলেছেন যে নতুন ভারত-সোভিয়েত চুক্তির কারণে স্পষ্টভাবে ভারত তার নিরপেক্ষ অবস্থা থেকে সরে গেল। এই ব্যাপারে আপনি কিছু বলবেন?
প্রধানমন্ত্রী: ভারত কখনো নিরপেক্ষ শিবিরে ছিলোনা। এই শব্দটা আমেরিকাতে ব্যাবহ্রিত হয়। ভারতে আমরা এই শব্দ ব্যাবহার করিনা। জোট- নিরপেক্ষতা মানে নিরপেক্ষ বা অসচেতনতা বা বিশ্বের অন্যন্য বিষয়ে অমনোযোগী বোঝায় না। এর অর্থ হতে পারে আমরা কোন মিলিটারি ব্লকের অধীনে না। আমরা নিজের যোগ্যতায় প্রতিটি আন্তর্জাতিক ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার রাখি। এর মানে এই না যে আমাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা U.S.S.R. সমর্থন দেয় বলে। এগুলো আমরা আমাদের নিজস্ব দৃষ্টি ভঙ্গি থেকে বিবেচনা করি। এবং অবশ্যই তা বিশ্ব শান্তির জন্য।

ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তি সম্পর্কে যতটুকু বলতে পারি এর ফলে আমরা আমাদের জোট নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সরে যাচ্ছিনা। আমরা কোনো দেশে সামরিক ঘাঁটির অনুমতি দেই নাই। আর, চুক্তি অনুযায়ী আমরা সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে কোনো বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে আমরা তাদের সাথে পরামর্শ করতে পারব কিন্তু সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণরূপে ভারতের নিজস্ব ব্যাপার। কি কি পদক্ষেপ নেব তাও আমাদের ব্যাপার।

প্রশ্ন: পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তা করার জন্য ভারত মহাসাগরের উপর সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি আউটলেট চেয়েছে বলে জানা যায়। এটির ব্যাপারে কিছু বলবেন?
প্রধানমন্ত্রী: আমি জানিনা কিভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ববাংলায় যা ঘটছে তার জন্য ভারত মহাসাগরের একটি আউটলেট পাবে। আমার মনে হয় এতে তেমন কোন লাভ হবেনা।

প্রশ্নঃ হল ভারত কোন সহযোগিতা করছে কিনা। আমি মনে করি যে ভারত একটি বাস্তবসম্মত পরিস্থিতির ব্যাপারে ভাবছে। এর স্থায়ী সমাধান কি হতে পারে? কি সমাধান করলে পূর্ববাংলার জনগণের জন্য সেখানে থাকা সুবিধাজনক হবে? এটাই প্রশ্ন। আমার মনে হয় সেখানে যে পরিমাণ বিদ্বেষ গত কয়েক মাসে হয়েছে তাতে একটু আশু সমাধান কীভাবে আসতে পারে তাই চিন্তার বিষয়।
প্রধানমন্ত্রীঃ এটাই এখন বাস্তবতা। তাতে আমাদের পছন্দ হোক বা না হোক।

প্রশ্ন: যেহেতু আপনি U.N. পরিদর্শনের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন না – তাহলে কি আপনি মনে করছেন যে এটির শক্তি ও যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ?
প্রধানমন্ত্রী: ইউনাইটেড নেশনস এর দুর্বলতা রয়েছে। কিন্তু আমরা সবসময় তাদের সমর্থন করেছি। কারণ আমরা মনে করি এই ধরনের একটি ফোরাম অপরিহার্য। যখন নেশনস লীগ ছিল, সবাই মনে করেছে এটা ঠিক মত কাজ করছে না যা করা উচিৎ। পরে জাতিসংঘ নামে এটি আসল। আমরা যদি জাতিসঙ্ঘ থেকে মুক্তি চাই তাহলে দেখা যাবে অন্য কোন নতুন নামে আবার সেটা শুরু হয়েছে।

সুতরাং, এটা থাকা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমরা সবাই জানি যে এর নির্দিষ্ট কিছু দুর্বলতা আছে। এটা সবসময় নিজের মত কাজ করতে পারেনা।

প্রশ্ন: অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ম্যাক মোহন অন্য একদিন প্রেসক্লাবে বলেছিলেন পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে কোন যুদ্ধ হতে পারেনা। তিনি বলেছিলেন তিনি আপনাদের সাথে কথা বলবেন। তিনি কি বলেছিলেন?
প্রধানমন্ত্রী: আমি অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করেছি কিন্তু আমার মনে পড়েনা তিনি এমন কিছু বলেছেন। স্বাভাবিকভাবেই তিনি উদ্বিগ্ন, ঠিক যেমন প্রেসিডেন্ট নিক্সন উদ্বিগ্ন এবং রাশিয়ান নেতা এবং আমাদের নেতারাও উদ্বিগ্ন। তারা সবাই জানেন যুদ্ধ ভালো নয় – এটি আরও নতুন নতুন সমস্যা সৃষ্টি করে। যেমনটি প্রেসিডেন্ট নিক্সন বলেন বর্তমান দুনিয়ায় সম্পূর্ণ বিজয় বলে আসলে কিছু নেই।

সুতরাং, আমরা এটাকে সম্পূর্ণরূপে প্রশংসা করি। আমি এর সাথে সম্পূর্ণরূপে একমত। কিন্তু, এটা আমাদের দেশের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতার প্রশ্ন। যেকোন কিছুর বিনিময়ে তা রক্ষা করা হবে।

এই সমস্যা দূরীকরণে যুদ্ধ ছাড়া আমাদের যা কিছু করা সম্ভব তার সবটাই করছি। আমরা সমাধান বের করার চেষ্টা থামাব না। এই সিদ্ধান্ত আগেই নেয়া আছে। আমি নিশ্চিত এটা মীমাংসা করা যাবে। কিন্তু এখন, আরও অনেক বিষয় এসে পড়েছে। প্রথমেই আমি বলছি ভারতের সাথে পাকিস্তানের বা পাকিস্তানের জনগণের কোন বিরোধ নেই। কিন্তু আমরা মনে করি যে, একজন ব্যক্তির ভুলের কারণে পাকিস্তান ভুগছে। কিন্তু যদি আমরা সেই ব্যক্তিকে সরাতে যাই তাহলে ভারতের কিছু হবেনা – তবে পাকিস্তানের অস্তিত্ব নিয়ে সমস্যা হবে।

প্রশ্ন: যদি পাকিস্তান তার বাকি হিন্দুদের বের করে দেয় তাহলে ভারতে অবস্থিত ষাট মিলিয়ন মুসলমানের পরিণতি কি হবে?
প্রধানমন্ত্রী: আমি বিশ্বাস করি যে তারা পুরোপুরি নিরাপদ থাকবেন। যদিও আমাদের কিছু জনগণের খুব খারাপ ধারনা আছে, আমাদের দাঙ্গা হয়েছে, যেটা আমি লজ্জার মনে করি – সরকার এই বিষয়ে খুব দৃঢ় আছে। এবং আমি মনে করি যে, আজকের সকল ভারতীয়, এমনকি ঐসব দল যারা সাধারণত আমাদের সমর্থন করে না, তারাও ভারতের শান্তি রক্ষায় আমাদের সংখ্যালঘুদের যথাযথ নিরাপত্তা দেবে যাতে তারা তাদের সাংবিধানিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারে।

পাকিস্তানের বিপক্ষে না যাবার আমাদের কিছু কারণও আছে। পররাষ্ট্র সচিব খুব সুন্দরভাবে আমাকে দৃষ্টি আকর্ষন করিয়েছেন। আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই পাকিস্তানের কোনো অঞ্চলের প্রতি ভারতের কোন দখল পরিকল্পনা নেই। এবং আমি যোগ করে বলি – এমনকি তা যদি পূর্ব বাংলার কোন ক্ষুদ্র অঞ্চলও হয়। আমরা অবশ্যই পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ চাই না।

প্রশ্ন: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সাহায্যের বিলের ব্যাপারে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
প্রধানমন্ত্রী: আমি মনে করি এটি একটি আভ্যন্তরীণ ব্যাপার যার উপর অনেক দেশ প্রভাবিত …. (হাসি)। আমি ভবিষ্যতবানি করতে পারছিনা। তাই আমি সত্যিই জানি না কি ঘটতে যাচ্ছে। আমরা সাহায্যকে স্বাগত জানিয়েছি। এবং যা আমরা নানা দেশ থেকে পেয়েছি তা দিয়ে আমরা অনেক কিছু করেছি যার সাহায্য না হলে পারতাম না। তবে অল্প অল্প করে আমরা স্বনির্ভরশীল হচ্ছি এবং আমাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হচ্ছি।

তবে বোঝা দিন দিন ক্রমবর্ধমান এবং এর সিংহভাগ আমাদের সামলাতে হচ্ছে। আমরা সেগুলো আমাদের জনগণের উদ্যম ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে সমাধান করছি। তবে আমরা আগে যা পেয়েছি সাহায্য এখন তার চেয়ে অনেক কম। সুতরাং, এতে আমাদের সত্যিই খুব বেশি সাহায্য করে না।

প্রশ্ন: চীন – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের উন্নতি ভারতের উপর এবং অন্যান্য এশীয় দেশগুলোর উপর কি প্রবাভ ফেলবে?
প্রধানমন্ত্রী: ভালো প্রভাব থাকবে। কোন সম্পর্ক, যদি অন্য কারো বিরুদ্ধে না হয় তাহলে শান্তি থাকবে। আর সে জন্যই আমরা এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানাই। এবং আমরা আন্তরিকভাবে আশা করি এর ফলে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে টানটান পরিস্থিতি অনেকটা কমে যাবে …..

প্রশ্ন: সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে চুক্তি কি আপনার বাবা প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর জোটনিরপেক্ষ নীতির সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সুসংগত হয়?
প্রধানমন্ত্রী: আমরা তাই মনে করি। প্রেসিডেন্ট টিটো কিছুদিন ভারত সফর করার সময় বলেছেন এর ফলে জোটনিরপেক্ষ বিষয়ে কোন প্রভাব পরবেনা। এবং আমি বিশ্বাস করি যে আমাদের বন্ধু চৌ এন লাইয়ের কিছু বিদেশী সংবাদদাতাদের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এতে আমাদের নীতিগত অবস্থানে ব্যাত্যয় ঘটবেনা।

প্রশ্ন: পূর্ব পাকিস্তান কি একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতি হিসেবে প্রকাশ হওয়া উচিৎ?
প্রধানমন্ত্রী: আমি আগেই বলেছি, এই প্রশ্ন পূর্ববাংলার জনগণকে করা উচিত।

প্রশ্ন: ভারত মহাসাগরের ব্যাপারে একটি ফলো-আপ প্রশ্ন। আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়ে এই এলাকার মধ্যে নৌ বাহিনী পাঠাচ্ছে। এর সম্পর্কে আপনি কেমন অনুভব করেন?
প্রধানমন্ত্রী: আমরা শুধু আশা করতে পারি যে এর ফলে কোন উত্তেজনা সেখানে বৃদ্ধি পাবে না ……..

প্রশ্ন: যদি একটি সমাধান বড় ক্ষমতাধর দেশগুলো পূর্ববাংলার ব্যাপারে গ্রহণ না করতে পারে তাহলে মিশর ও ইসরাইলের সমাধান কীভাবে দিতে পারে?
প্রধানমন্ত্রী: এই মুহূর্তে আমি মনে করি যে, মিশর ও ইসরাইল ও মধ্যপ্রাচ্যে পরিস্থিতি খুব আশাবাদী নয়। আমরা জানি কখনো কখনো অনেক শক্ত বাঁধন সহজেই কেটে ফেলা যায়। এই একটাই মাত্র আশা।

এর আগে, সোভিয়েত চুক্তি নিয়ে একটি প্রশ্ন ছিল। সম্ভবত আপনি জানেন যে এটার ৪র্থ অনুচ্ছেদে বিশেষভাবে বলা হয় যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের জোটনিরপেক্ষ নীতির প্রতি সম্মান প্রকাশ করেছে। উদ্বাস্তুদের সমস্যা পিছনে পরে যাচ্ছে। একটা তুলনা দিলে পুরো বিষয়টা আরও সুন্দরভাবে বোঝা যাবে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা হিটলারের জার্মানিতে ইহুদীদের সমস্যা বলতে পারি। ধরুন আপনি বললেন, “আমাদের কিছু পর্যবেক্ষক সেখানে যাক”। কিভাবে তারা ইহুদীদের জন্য পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে সাহায্য করতেন? তারা কি বৈষম্য ও হত্যা থেকে রক্ষা করতে পারতেন? অনুরূপ অবস্থা আজ পূর্ববাংলায় বিরাজ করছে।

প্রশ্ন: পূর্ববাংলা সম্পর্কে আপনি যতটুকু জানেন, আপনি কি মনে করেন যদি পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীনতা দিয়ে দেয়াও হয় তারা জাতিগতভাবে ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত আছে?
প্রধানমন্ত্রীঃ আমরাও আমাদের স্বাধীনতার সময় এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলাম। আমাদের প্রতিনিয়ত বলা হয়েছিল যে, ব্রিটিশরা খুব আনন্দের সাথে আমাদের স্বাধীনতা দিতে চায় কিন্তু ভারত এটার জন্য প্রস্তুত না। এবং আমি মনে করি আমরা অবশ্যই দেখিয়ে দিয়েছি। একইভাবে অন্যান্য অনেক দেশের কথা বলা যায় – হয়ত তারা ভুল করবে – কিন্তু সেগুলো থেকেই তারা শিখবে এবং তাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে।

প্রশ্ন: আপনি অনেক দেশের নেতাদের সাথে দেখা করে যাচ্ছেন। আপনি কি মনে করেন না যে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করবার প্রয়োজন থাকতে পারে?
প্রধানমন্ত্রী: আমি বলেছি, যদি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আমাকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার জন্য দেখা করতে চান, আমি খুব খুশি হবে। কিন্তু সমস্যা যদি ভারতীয় সমস্যা সংশ্লিষ্ট না হয় তাহলে তা আলোচনা করার জন্য নয়। এই সমস্যা পূর্ববঙ্গ ও তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাথে সম্পর্কিত।

কিন্তু সেখানে আরো এক একটি দিক আছে। আপনি শুধুমাত্র এমন ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করতে পারেন যদি সেখানে তারা উভয়েই উভয়কে বিশ্বাস করে। কিন্তু যদি তা না হয় তাহলে করমর্দন করতেও আমার অসুবিধা আছে। পরিস্থিতি এখন এমনটাই। আপনি যদি দেখেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আমাকে ব্যক্তিগতভাবে বা সাধারণ ভাবে যেসব মন্তব্য করে যাচ্ছেন তাতে এটি মনে হয় না যে এখানে কোন বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা হতে পারে। আমি কারো সম্পর্কে অভদ্র শব্দ কখনই উচ্চারণ করিনি। (হাসি এবং সাধুবাদ) ….
—————-

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৬৩। যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির বক্তৃতা ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৬ নভেম্বর, ১৯৭১

Zulkar Nain
<১২, ৬৩, ১৪৮-১৫১>

“যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বক্তৃতা”

ভাষণ থেকে নেওয়া উদ্ধৃতাংশ নিচে দেওয়া হলোঃ

আমি যদি মাত্র কয়েক মাস আগে আসতাম এবং আপনি যদি আমাকে প্রশ্ন করতেন, সমস্যাগুলো কি, আমি হয়তো বলতাম “এখন কোন সমস্যা নাই”। আমরা ঐক্যবদ্ধ। আমরা আমাদের উদ্দেশ্যে দৃঢ়। এবং একটার পর একটা সমস্যা সমাধান করে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি”। কিন্তু আমাদের নতুন সংসদ পূর্ন করে যখন আমাদের বিজয় উপলক্ষ্যে আমরা সব গণতান্ত্রিক সমাজকে পরস্পর অভিনন্দন জানাচ্ছি তার ঠিক একসপ্তাহ পরেই নতুন এক ভয়ঙ্কর বোঝা আমাদের উপর এসে পড়লো। আপনারা সবাই এসম্পর্কে অবগত। তাই আমি এটা নিয়ে কিছু বলতে চাইনা। কিন্তু আমি কিছু প্রশ্ন তুলে ধরতে চাই এবং যেগুলো আমরা খুব মৌলিক প্রশ্ন বলে মনে করি। আমাদের বাহিনী এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বাহিনী সীমান্তে পরস্পরের মুখোমুখি হওয়ার কারণে আজ আমাদের বলা হয় যে সেখানে যুদ্ধের হুমকি আছে। এবং এটা সত্য। কিন্তু দুই বাহিনীর মুখোমুখি হওয়া প্রকৃত সমস্যা নয়। পূর্ববাংলায় যা ঘটেছে সেটাই হলো আসল সমস্যা। আজ যদি পূর্ববঙ্গে শান্তি থাকতো, তাহলে পশ্চিম বা পূর্বে আমাদের সৈন্যরা মুখোমুখি হলেও কোন ব্যাপার ছিল না। সেখানে কোন যুদ্ধ হবে না। কিন্তু এটা সেখানে খুব গুরুতর একটা সমস্যা। এবং এটা কিভাবে শুরু হলো? সেখানে ঘটা কোন বিদ্রোহ বা পাকিস্তানের এক অংশের পৃথক, বিচ্ছিন্ন বা স্বাধীন হতে চাওয়ার কারণে এই সমস্যার উত্থান ঘটেনি। সেখানে এমন কিছু বলা হয়নি। সেখানে পাকিস্তানের বর্তমান সামরিক নেতৃত্বে একটি উন্মুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রকাশ্যে জনগনের সামনে নিরপেক্ষ নির্বাচন কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হয়। যদি পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারের এই কর্মসূচীর নিয়ে আপত্তি থাকতো, সেই মুহূর্তে বলতে পারতো, “আমরা এই নির্বাচন মানবো না, আমরা আপনার ছয়দফা মেনে নিতে পারবো না, আমরা তাদের অনুমোদন দেবো না”। কিন্তু এরকম কিছুই বলা হয়নি। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং পাকিস্তানের উভয় অংশের মানুষ একদলীয় আওয়ামী লীগের পক্ষে সিংহভাগ ভোট দিয়েছিল।

আমি আমার ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠে অভিনন্দিত হয়েছি। কিন্তু এটা পাকিস্তানের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল তার তুলনায় কিছুই না। এটা তার জন্য একটি অসাধারণ বিজয় ছিল। এবং সে কোন চরমপন্থী নয়। তিনি একজন মধ্যমপন্থী ব্যক্তি। বস্তুত, আমি যদি শব্দটা বলতে পারতাম, কিছু মানুষ তাকে এক সময় আমেরিকার দালাল বলতো। কিন্তু নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর, দৃশ্যত এটা পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের জন্য বিস্ময়কর হয়ে ওঠে। এবং তারা এই ফলাফল এড়ানোর উপায় খুঁজে বের করতে চেয়েছিলেন।

আলোচনা শুরু হয়েছে। আমরা শেখ মুজিব বা পূর্ব বাংলায় তার দলের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম না। আমরা জানতাম না সেখানে কি ঘটছে। আমরা পত্রিকায় পড়েছি যে সেখানে আলোচনা হয়েছে। পরবর্তীতে অনেক পরে, আমার এখানে আসার মাত্র এক সপ্তাহ আগে এমন একজনের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয় যিনি আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন। এবং ২৪শে মার্চ তারা ভেবেছিল যে তারা (পশ্চিম পাকিস্তানিরা) হয়তো মীমাংসা করতে আসছে, তবে কোন সন্তোষজনক মীমাংসা নয় কিন্তু এখনো সেটা করা যায়। কিন্তু এবার পশ্চিম পাকিস্তান সৈন্য নিয়ে এসেছিল, এবং ২৫শে মার্চ রাতে সন্ত্রাসের রাজত্ব ছেড়ে দেওয়া হয়। আপনারা সম্ভবত শুনেছেন যে, তাদের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা সবচেয়ে বড় হামলা চালিয়েছিল, যেখানে সে রাতেই বিভিন্ন অনুষদের বহু ছাত্রদের হত্যা করা হয়। সমগ্র পূর্ব বাংলার বেসামরিক, আধা-সামরিক বাহিনী, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও পূর্ব পাকিস্তানের রাইফেলস তাদের বশ্যতা পরিবর্তন করে, অর্থাৎ তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এটাই আজকের পূর্ব বাংলার মানুষের লড়াইয়ের ভিত্তি। জনগণই সীমান্ত পার হয়ে আসা তরুণদের গেরিলাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।

এখন, আমাদের প্রশ্ন করা হয়েছে যে কেন ভারত জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকদের অনুমতি দেওয়ার বিষয়ে দ্বিধান্বিত! প্রকৃতপক্ষে, আমরা দ্বিধান্বিত নই, কারণ আমরা কিছু পর্যবেক্ষক ইতোমধ্যে ঢুকতে দিয়েছি। অনেক বছর ধরে পশ্চিম সীমান্তে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক আছে এবং আমরা পূর্ব সীমান্তে শরণার্থীদের ত্রাণ দেয়ার জন্য জাতিসংঘের হাই কমিশন থেকে প্রায় দশজন লোক আছে। আমাদের সমাজ অনেক উন্মুক্ত, যে কেউ আসতে চায়, আপনাদের যে কেউ – কূটনীতিকরা যারা সেখানে আছে, সাংবাদিক, ইউরোপের, ল্যাটিন আমেরিকা, এশিয়া, নিউজিল্যান্ড, আরব দেশ, স্ক্যানডিনেভীয়ার দেশগুলিতে থেকে যাওয়া সংসদীয় প্রতিনিধিদল – এনারা সবাই আমাদের সেনা-শিবিরে ছিলেন; সীমান্তেও ছিলেন এবং তাদের অনেকেই সীমান্ত পার হয়ে পুর্ব বাংলায় গেছিলেন। ব্যতিক্রম ছাড়াই, প্রত্যেকেই সেখানে ভয়ঙ্কর দুর্দশা এবং অতিমাত্রায় বিশৃঙ্খলা কথা বলেছেন। এখন এই মুহূর্তে আমাদের বলা হয়েছে কিছু আসন খালি দেখিয়ে একটা বেসামরিক সরকার গঠনের প্রচেষ্টা চলছে, যদিও আসনগুলো খালি নেই। যারা বৈধভাবে নির্বাচিত হয়েছে তারা সেখানে আছে তবুও তাদের আসন শূন্য ঘোষণা করা হয়েছে এবং আমাকে বলা হয় যে ৫৫ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এখন বর্তমান পরিস্থিতিতে পুরো সংসদই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে পারে কারণ নিশ্চিতভাবেই এখন কারো পক্ষে ভোট দেওয়া সম্ভব নয়।

যদি জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক যায়, তাহলে তারা কি ইচ্ছা পোষণ করে? তারা যদি সত্যিই পূর্ব বাংলায় শান্তি আনার উদ্দেশ্যে যায়, আমাদের পক্ষ থেকে তাদের স্বাগতম; তারা যেদিকেই যেতে চান, আমরা তাদের সেখানে যেতে সাহায্য করবো। কিন্তু তারা এটা করতে চান না। তারা বলতে চায়, “পূর্ব বাংলায় যা ঘটছে সেটা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যা – আমরা শুধু দেখতে চাই সীমান্তে কি ঘটছে”। সীমান্তে যা ঘটছে সেটাকে পূর্ব বাংলার ভিতরে যা ঘটছে তার থেকে আলাদা করা যাবেনা। আপনি বলতে পারেন না, “আমরা যাব এবং চেষ্টা করবো গেরিলা প্রতিরোধে, কিন্তু সেনাবাহিনীর কতৃক সাধারণ মানুষকে হত্যা প্রতিরোধ করতে পারবো না”। এমনকি সেখানে কিছু নারীর উপর যে অত্যাচার হচ্ছে তা আমি উল্লেখ করতে পারছি না। জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকরা ঐসব ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে যাবেন না, কিন্তু তারা মুক্তিযোদ্ধারা কি করছে তার উপর হস্তক্ষেপ করতে চান।

আপনি প্রশ্ন করতেই পারেন, “ভারত কি সমর্থন দিয়ে এব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে? ” আমি আপনাদের বলছি, আমরা যেটুকু করেছি তাতে পূর্ব বাংলার মানুষেরা ততটা খুশি নয়। তারা মনে করে, আমরা এপর্যন্ত খুব সামান্যই করেছি এবং আমি তাদের সাথে একমত। এবং আমরা এমন কিছু করছি যেটা আমরা তাদের করতে দিতে পারিনা। মানুষের সীমান্তের অন্যপাশ থেকে আমাদের পাশে আসা অথবা আমাদের এপাশ থেকে পূর্ব বাংলায় ফিরে যাওয়া আমরা বন্ধ করতে পারিনা। আমরা যদি এমনটা করতে সক্ষম হতাম, তাহলে আমরা অবশ্যই এই লক্ষ লক্ষ শরনার্থী আসা ঠেকানোর ব্যবস্থা নিতাম। প্রথমদিকে প্রতিক্রিয়া ছিল, “তারা ব্যাপক কষ্টে আছে, আমরা তাদের প্রবেশের অনুমতি দেই”। কিন্তু খুব শীঘ্রই আমাদের জন্য এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলো এবং এটি এখন অত্যন্ত জটিল পরিস্থিতি তৈরি করছে।

আমেরিকার মানুষ উদারতা দেখিয়েছে। এখানে আসায় আমাকে একটি চেক দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন দেশের দরিদ্র মানুষেরা শিশুদের দিয়ে আমাকে চেক দিয়েছে, সব ধরনের মানুষ, এবং আমরা তাদের সাহায্যের জন্য কৃতজ্ঞ। কিন্তু প্রধান সমস্যা আর্থিক নয়। আমরা গরীব, এই লক্ষ লক্ষ মানুষের ভরণপোষণের সামর্থ্য আমাদের নাই। কিন্তু দরিদ্র হওয়ার কারণে আমরা জানি কিভাবে খাদ্য ও প্রয়োজন ছাড়া বাঁচতে হয়, আমাদের যেকোনো অসুবিধা দেখা দিতে পারে। আমরা যেকোন সংখ্যক মানুষ দেখাশোনা করতে পারবো, অবশ্যই তাদের ও আমাদের অত্যন্ত অসুবিধা হবে, হয়তো কিছু লোক মারাও যাবে। যাইহোক, আমরা এই সমস্যা থেকে বাঁচতে পারবো। কঠিন ব্যাপার হলো রাজনৈতিক পরিণতি, সামাজিক টানাপোড়েন, প্রশাসনিক সমস্যা থেকে বেঁচে যাওয়া এবং সর্বশেষ কিন্তু সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমাদের পরাধীনতা, স্থিতিশীলতা ও ঐক্যতার প্রতি হুমকি। কারণ উদ্বাস্তুদের সঙ্গে যারা আসছে তারা প্রকৃত উদ্বাস্তু নয়। আমরা নাশকতার শিকার হচ্ছি। আমাদের ট্রেন উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, এবং অন্যান্য সব ধরণের অঘটন ঘটেছে।

সুতরাং, ভারত আজ বাস্তব হুমকির সম্মুখীন। আমরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক স্থিতিশীলতার একটা জায়গাতে পৌঁছে গেছিলাম, এটা মোটেই সোজা ব্যাপার ছিলনা; অনেক ঝামেলার মধ্য দিয়ে আমরা সেটা অর্জন করেছিলাম। আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ বিভিন্ন দেশের সাহায্য পেয়েছিলাম, কিন্তু এটা বৃহৎ সাফল্যের অনেক ক্ষুদ্র একটা অংশ। সবথেকে বড় ধকল হলো, এটা উদ্বাস্তুদের সমস্যা হোক বা আমাদের নিজেদের সমস্যা হোক, ভুগছে ভারতের জনগণ। এক্ষেত্রে অবস্থার যদি কোন উন্নতি হয়, সেটার কারণ অবশ্যই সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য ভারতের মানুষের প্রচেষ্টা এবং আত্মত্যাগ।

সুতরাং, একটা পর্যায়ে এসে যখন আমরা ভাবছি যে এবার আমরা সহজেই অনেক দ্রুত সামনে এগিয়ে যেতে পারবো, তখনই আমরা হঠাত অন্য দেশের সমস্যায় জড়িয়ে পড়েছি। তারা আমাদের সমস্যা না। এই অন্য দেশটি তাদের সেসব মানুষকে সীমান্ত পার হতে বাধ্য করছে যারা তাদের সরকারকে ভোট দেয়নি, বরঞ্চ তারা তাদের কাঙ্খিত শাসককে ভোট দিয়েছে। এই মানুষগুলোর অন্য কোন অপরাধ নেই, কারণ স্বাধীনতার ডাক উঠেছে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করার পর, তার আগে নয়। তিনি নিজে, আমি যতদূর জানি, স্বাধীনতার জন্য ডাক দেননি, এমনকি এখনও না। কিন্তু তিনি গ্রেফতার হওয়ার পর, সেখানে নারকীয় গণহত্যা হয়, এটা বোধগম্য যে এরপর বাকি মানুষরা বলবেঃ “এরপর কিভাবে আমরা একসঙ্গে বাস করবো? আমাদের পৃথক হতে হবে।

এই হলো অবস্থা। আমাদের পাকিস্তানের প্রতি কোন বিদ্বেষ নাই যদিও তারা নিয়মিত “ভারত ধ্বংস কর”, “ভারত জয় কর” প্রচারণা চালাচ্ছে। তারা একদিন দেখেছে, একসপ্তাহ দেখেছে এরপর তারা তাদের গাড়িতে হামলা করেছে। আমরা কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়িনি, এবং পড়বো না। আমরা এমনকি চীনাদের বিরুদ্ধেও ছিলাম না। চীন আমাদের আক্রমণ করেছিল, পাকিস্তান আমাদের আক্রমণ করেছিল। আমাদের পক্ষ থেকে আমরা সবসময়ই বন্ধুত্ব চেয়েছি। আমাদের দিক থেকে, আমরা সবসময় একতরফা পদক্ষেপ নিয়েছি যাতে আমরা সম্পর্কের একটি সহনীয় পর্যায়ে যেতে পারি। কিন্তু ওদিক থেকে কোন সাড়া পাচ্ছিনা।

কোন প্রতিক্রিয়া না পেলেও, আমরা কিছু মনে করবো না। কিন্তু তারা যখন তাদের সমস্যা আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার কথা ভেবেছে, আমরা মনে করি তখনই এটা আমাদের সহ্যের শেষ সীমায় পৌছে গেছে। তারা এখানে একটা সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল, তাদের মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল। তো আপনি কি করবেন? তাদের সীমান্ত দিয়ে বের করে দিবেন। এক খোঁচায়, আপনি আপনার শত্রুদের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতেন, আপনি জনসংখ্যা থেকে পরিত্রাণ পেতেন, এবং আপনি ভারতকে দুর্বল করতে পারতেন, যা আপনি দুর্বল করতে চান। এসব ব্যাপার ভারত কখনোই সহ্য করতে পারে না। হতে পারে, আমি সহ্য করতে পারবো। কিন্তু আমি সংসদে আমার সব সংখ্যাগরিষ্ঠদের পক্ষে, এটা কোন একনায়কতন্ত্র নয়। আমাকে শুধু আমার দল নিয়ে থাকলে চলবেনা, গুরুতর পরিস্থিতিতে আমাকে ভারতের অন্য সব দলকেও সাথে নিতে হবে। এবং আমরা মনে করি যে, এটা শুধু ভারতের জন্য নয়, কারণ আমরা বিশ্বাস করি, যদি ভারতের শান্তি হুমকির সম্মুখীন হয়, যদি ভারতের স্থিতিশীলতা হুমকির সম্মুখীন হয়, পাকিস্তানের আমার অংশে শান্তি এবং স্থিতিশীলতা আসবে না। চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য যেকোন দেশ হোক, সারা বিশ্বের সৈন্যবাহিনী তাদের সাথে আছে। কিন্তু উপমহাদেশের প্রধান অংশে অস্থিরতা পুষে রেখে তারা সেখানে শান্তি আনতে পারবে না।

আজ কিছু দেশ একজন ব্যক্তির সম্মান রক্ষা করতে গিয়ে সমগ্র উপমহাদেশের শান্তিকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করিনা, যে তারা এমন কোন ব্যক্তিকে সমর্থন দিয়ে পাকিস্তানকে রক্ষা করা, অখণ্ড রাখা বা এটাকে শক্তিশালী করতে পারবেনা, যিনি নির্বাচিত ব্যক্তি নয় এমন একজন সামরিক স্বৈরশাসক। আজ আমরা যে সমস্যা নিয়ে ভাবছি এটা আসলে আজকের সমস্যা নয়, কিন্তু আমরা মৌলিক মূল্যবোধের জন্য লড়ছি, যার জন্য অনেকেই প্রাণ দিয়েছেন। আমাদের মূল্যবোধকেই আঘাত করা হয়েছে।

এবং তারা যদি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে আক্রমণ করতে পারে, তাহলে তারা (বাঙালিরা) যে আমাদের দেশে টিকে থাকতে পারবে বা এখানে এসে যে তাদের উপর আক্রমণ করা হবেনা তার নিশ্চয়তা কি! এটাই আমাদের বিব্রত করছে। কে দোষী এটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যদিও আমি মনে করি এখানে পাকিস্তান দায়ী, কিন্তু আমি কোন তর্কে যেতে চাইনা। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো কিভাবে আমরা শান্তিতে থাকতে পারি? শুধু সৈন্য সরানো উচিত এটা বললেই শান্তি আসবে না। শুধুমাত্র মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধান করেই শান্তি স্থাপন করা সম্ভব। এবং মৌলিক সমস্যা পশ্চিমে নয় যেখানে সৈন্যরা পরম্পর মুখোমুখি হচ্ছে, বরং সমস্যা পূর্বে।

যেহেতু আমি সৈন্যদের কথা উল্লেখ করেছি, আমি আরো একটি কথা বলতে চাই, এবং সেটা হলো আমরা কিছু করার এক সপ্তাহ বা দশ দিন আগেই পাকিস্তান সৈন্য ওখানে সরিয়ে নেয়। আর ওখানে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক যারা ছিল, এই প্রশ্ন তারা তাদের কাছে করেছিল। তারা বলেছিল, “এটা তেমন গুরুত্বর কিছুই না, এটা শুধুমাত্র একটা সাধারণ প্রশিক্ষণ অনুশীলন”। প্রকৃতপক্ষে এটা খুব অদ্ভুত যে, আপনারা যখন অনুশীলন করছেন তখন আপনি একদিনের জন্য নয়, দুই দিনের জন্য নয়, বরং দশ দিনেরও বেশি আপনার সৈন্যদের দায়িত্ব বহাল রেখেছেন। এবং দশ দিন হয়ে গেলেও জাতিসংঘ বা অন্য কেউ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এরপর আমরা বললাম, “এইসব লোক আমাদের আক্রমণ করতে পারে এবং নিজেদের রক্ষার জন্য আমাদেরও সৈন্য সরাতে হবে”। ইতোমধ্যে দুইবার এবং চীনাদের হিসাব আনলে তিনবার আমাদের উপর আক্রমণ করা হয়েছে, এবং কোনবারই আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। জনগন যদি ভাবে যে কোন সরকার দেশের নিরাপত্তা রক্ষা করতে অক্ষম, তাহলে সেই সরকার কখনো স্থায়ী হয়না।

আমরা ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করেছি এই ভেবে যে কিছু একটা হবে, হয়তো ভালো কিছুই হবে। কিন্তু কারো কোন মাথাব্যথা নাই। আমাদের সিমান্তে এসব সৈন্যরা আমাদের মুখোমুখি হয়েছিল তখন কেউ একটা শব্দও করেনি। তখনই করেছিল যখন আমাদের সৈন্যরা এগিয়ে গেল, তখন সারা বিশ্বের হঠাত চিন্তার উদয় হলো, “ওহ, দুই সৈন্য গ্রুপ পরস্পর মুখোমুখি হচ্ছে”।

এটা সত্য যে, যুদ্ধ একটি ভয়ঙ্কর ব্যাপার। আমি গত যুদ্ধে বিমান আক্রমণের সবথেকে খারাপ সময়টাতে লন্ডনে বাস করেছি। এবং আমি জানি সেই যুদ্ধ এখন আরো ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। আমি জানি বেসামরিক নাগরিকের উপর কি ঘটছে সেখানে। কেউ কখনো তার জনগণের জন্য যুদ্ধ চায়না। এবং ভারত কখনোই দ্বন্দ্ব বা যুদ্ধকে উস্কে দেয়ার মত কিছু করবেনা। কিন্তু ভারত তার স্বার্থ রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর। ভারত তার স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ভারত এখন আগের থেকে অনেক ঐক্যবদ্ধ, এবং হোক স্বাধীনতা বা হোক গণতন্ত্র, ভারত এখন এইসব মৌলিক বিষয় সম্পর্কে অনেক আগ্রহী। এটা আমাদের সাথে টিকে থাকা জীবনের সংস্কৃতি। আমরা কোন একটি মতবাদ বা ‘ধর্ম’ অনুসরণ করিনা। এটা আমাদের জীবনের সংস্কৃতি যেটা আমাদের জাতিকে ত্রিশ শতাব্দী বাচিয়ে রেখেছে। কারোর মতের সাথে এটা যাক বা না যাক, এটাকে আমরা ধ্বংস হতে দিচ্ছিনা। আমরা সাহায্য চাই, আমরা সমর্থন চাই, আমরা সমবেদনাকে স্বাগত জানাই। কিন্তু বস্তুত, বিশ্বের প্রতিটা ব্যক্তিই শেষ পর্যন্ত একা এবং প্রত্যেক জাতিই চরমভাবে একা। এবং যুদ্ধের প্রয়োজন মনে হলে ভারত একাই লড়াই করার জন্য প্রস্তুত…

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৬৪। এন .বি.সি. টেলিভিশনে (যুক্তরাষ্ট্র) “মিট দ্য প্রেস” অনুষ্ঠানে প্রচারিত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নভেম্বর ৭, ১৯৭১

Shuvadittya Saha
<১২, ৬৪, ১৫২-১৫৮>
অনুবাদ

এন .বি.সি. টেলিভিশনে (যুক্তরাষ্ট্র) “মিট দ্য প্রেস” অনুষ্ঠানে প্রচারিত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার, নভেম্বর ৭, ১৯৭১
মডারেটর: লরেন্স ই. স্পিভাক
প্যানেল: এ. এম. রোসেন্থাল (নিউ ইয়র্কস টাইমস),
সেলিগ হ্যারিসন (দ্য ওয়াসিংটন পোস্ট)
পলিন ফ্রেডরিক ( এন. বি. সি নিউজ)

মি. স্পিভাক: “মিট দ্য প্রেস” অনুষ্ঠানে আমাদের আজকের অতিথি ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, যিনি সরকারি সফরে বর্তমানে আমাদের দেশে আছেন।

মিস ফ্রেডরিক: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি যখন ওয়াসিংটনে গিয়েছেন, আপনি বলেছেন, আপনি ভারতীয় উপমহাদেশের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি আসা করছেন। আপনি কি মার্কিন কর্মকর্তাদের মাঝে সেই গভীর উপলব্ধি খুঁজে পেয়েছেন?

প্রধানমন্ত্রী: আপনি জানেন, ভারতের বর্তমান পরিস্থিতি যথেষ্ঠ গুরু গম্ভীর। আমি বলব, আমি এখানে আসার আগে তাদের সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে যে উপলব্ধি ছিল, তাদের এখনকার উপলব্ধি তার তুলনায় যথেষ্ঠ ভাল।
মিস ফ্রেডরিক:
আপনি বলছেন “যথেষ্ঠ ভাল”, যেটা ঠিক “গভীর উপলব্ধি” পর্যায়ে উন্নীত হয়নি। আপনি কি সুনির্দিষ্ট করে বলবেন, “গভীর উপলব্ধি” বলতে আপনি মার্কিন কর্মকর্তাদের থেকে ঠিক কি আশা করেছিলেন?

প্রধানমন্ত্রী: আসলে পরিস্থিতি এতটাই জটিল যে, এখানে একটি নির্দিষ্ট দেশ বা সরকার বা কর্মকর্তা কি করতে পারে, তা বলা খুব মুশকিল। আমরা শুধু এতটুকু বলতে পারি যে, সেখান যা ঘটছে তার আমাদের মূল্যায়ন আমরা দিতে পারি, এবং পুরো ব্যাপারটিকে আমরা ভারতের গণতন্ত্র এবং ভারতের স্থিতিশীলতার জন্য একটি হুমকি বলে মনে করি। ভারতে আমরা মনে করি যে, আমরা যেভাবে একটি প্রাচীন সভ্যতা থেকে বছরের পর বছর ধরে একটি শক্তিশালী এবং আধুনিক রাষ্ট্র হবার দিকে এগিয়ে চলেছি, তা যদি সামান্য পরিমাণেও বিপন্ন হয়, বিশ্বশান্তির জন্য তা মারাত্বক পরিণতি বয়ে নিয়ে আসবে।

মিস ফ্রেডরিক: আপনি ভারতের গণতন্ত্র এর উপরে হুমকির কথা বললেন, এবং বিশ্বশান্তির উপরে এর মারাত্বক পরিণতির কথা বললেন। সংবাদ মাধমে আমরা সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি, তা যথেষ্ঠই গুরুতর। আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য যুক্তরাষ্ট্র আপনাকে যা করতে বলছে, তা বুমেরাং হবে নাকি যুক্তরাষ্ট্র আপনাকে যা করতে পরামর্শ দিচ্ছে, সেটা আপনার কাছে গ্রহনযোগ্য নয়?

প্রধানমন্ত্রী: কোন কিছু করতে আমাদের পরামর্শ দেওয়া হয়নি। আমি মনে করি, সমস্যা সমাধানের জন্য একটি আন্তরিক প্রয়াস আছে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা বিশ্বের সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উপলব্ধি আছে কিনা, আমি নিশ্চিত নই। পশ্চিমা বিশ্বের ভারত এবং পাকিস্তানকে সমতায় রাখার একটা প্রবণতা আছে। এখন সেটা পাকিস্তানকে সাহায্য করবে কিনা আমি বলতে পারবনা।

মি. রোসেন্থাল: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমার মতে, এই মুহূর্তে সবার মনে যে শঙ্কা উঁকি দিচ্ছে, তা হলো ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্ভাব্য যুদ্ধের বিপদ। পরিস্থিতির ব্যাপারে আপনার যে মূল্যায়ন, তাতে এই বিপদ কতটা নিকটবর্তী বলে মনে করেন?

প্রধানমন্ত্রী: এটা আসলে বলা খুব মুশকিল। আমরা সারা পৃথিবীর কাছে এই ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, কারন আমরা জানি, পূর্ব বাংলায় যখন থেকে বিশৃখল পরিস্থিতি তৈরী করা হয়েছে এবং শরণার্থীর ঢল নেমেছে, তখন থেকেই সম্ভাব্য যুদ্ধের এই পরিণতির দিকে পরিস্থিতি মোড় নিতে পারে।

এখন যুদ্ধের এই বিপদ যে শুধু আমাদের পূর্ব সীমান্তেই তা নয়, পশ্চিম সীমান্তেও ভারত এবং পাকিস্তানের সেনাবাহিনী পরস্পরের মুখোমুখি অবস্থানে আছে।

ভারত নীতিগতভাবে সবসময় যুদ্ধের বিরুদ্ধে, এবং বিশ্বশান্তি বজায় রাখতে ব্যাপারে আমাদের দৃঢ় অবস্থান আছে। আমরা বিশ্বের অন্যান্য বিভিন্ন সমস্যার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে দাঁড়িয়েছি, কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কি করণীয় তা আমরা বুঝতে পারছি না। আমরা কোন পদক্ষেপ নেবার আগেই, সপ্তাহ খানেক বা দিন দশেক আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পশ্চিম সীমান্তে মোতায়েন করা হয়েছে। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করেছি, বিশ্ব বিবেক এ ব্যাপারে নীরব, এবং পাকিস্তানিদের এই ব্যাপারে জাতিসংঘে জিজ্ঞেস করলে তারা জানিয়েছে, সেখানে তারা সেনাবাহিনীর নিয়মিত প্রশিক্ষন শিবির পরিচালনা করছে।

পরিস্কারভাবেই এখনকার পরিস্থিতিতে তাদের এই জবাব একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য না। সুতরাং বাধ্য হয়েই আমরাও আমাদের সেনাবাহিনীকে সেখানে নিয়ে এসেছি। এই হলো এখানকার আজকের পরিস্থিতি।

মি. রোসেন্থাল: সত্যি কথা বলতে সীমান্তের উভয় পাশেই যদি সেনাবাহিনী এরকম শক্ত অবস্থান নেয়, তাহলে যে কোন মূহ্র্তেই দুর্ঘটনাক্রমে যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যেতে পারে, যেই যুদ্ধ পরিকল্পনা মাফিক শুরু হয়না। কেউ কেউ মনে করেন, দুর্ঘটনাক্রমে যুদ্ধ এড়ানোর জন্য জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দল যদি সীমান্তের দুই পাশে থাকে, তাহলে তা একটা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। আমি জানি, আপনি এই ব্যাপারে তেমন উৎসাহী নন। আপনি কি আপনার এই অবস্থানের কারন একটু ব্যাখ্যা করবেন আমাদের কাছে?

প্রধানমন্ত্রী: এখন এই প্রশ্নটিকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। আপনি জানেন, পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ বিরতির চুক্তি মোতাবেক, পশ্চিম সীমান্তে কাশ্মীরে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দল ইতিমধ্যেই আছে। তাই সেই সীমান্তে আরো জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক আনলে তা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে কিনা, সেই প্রশ্ন অবান্তর। তাই সত্যিকারের প্রশ্ন হলো পূর্ব সীমান্তে তাদের আনা দরকার কিনা। এই মুহূর্তে পূর্ব সীমান্তেও দশজন জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনের পর্যবেক্ষক আছেন। এছাড়াও এই বিষয়ক কমিশনার জনাব সদরুদ্দিন সাহেব ও সেখানে আছেন বা দু-একদিনের মধ্যে ভারতে এসে পৌঁছাবেন। যদি আরো লোক আসতে চায়, আমাদের দিক থেকে কোন বাধা নেই। আপনি জানেন, আমাদের সেখানে একটি উম্মুক্তসমাজ ব্যবস্থা আছে, যেটা কারো কারো মতে একটু বেশিই উম্মুক্ত। আপনাদের সংবাদ মাধ্যমের লোকজন, রেডিওর লোক, টেলিভিশনের লোক, পত্রিকার সাংবাদিক, আপনাদের সংসদের প্রতিনিধি, এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকগণ পূর্ব সীমান্তে বিভিন্ন ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন। তাই আমাদের সেখানে লুকানোর কিছু নাই। কিন্তু আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এই মুহূর্তে জাতিসংঘের আরো লোক এনে সমস্যা সমাধানে কোন কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারবে না। আপনাকে যা বললাম, তাদের দশজন প্রতিনিধি ইতিমধ্যেই সেখানে আছে।

প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত, পূর্ব বাংলায় একটি শান্তিপূর্ণ অবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, যাতে নতুন করে আরো শরণার্থীর ঢল না নামে কারন প্রতিদিন সেখান থেকে শরণার্থী আসছে। তাই এটাই সর্ব প্রথম করণীয়। এই পরিস্থিতিতে সীমান্তে পর্যবেক্ষন করে কাজের কাজ কি হবে আমি সত্যি জানি না, এবং যে ক্ষতি এর মধ্যে দিয়ে হচ্ছে সেটা হলো, বিশ্ববাসীর চোখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেব হচ্ছে, সত্যিকারের মানুষের কষ্ট, দুর্দশা, ভুলন্ঠিত মানবতার বদলে বিশ্বের অনেকে এটাকে ভারত-পাকিস্তান বিবাদ হিসেবে দেখছে, যেটা আদৌ সত্যি না। সত্যিকারের বিবাদ হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তার সাথে পূর্ব বাংলার জনগণ আর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির। ভারতে শরণার্থীর ঢল নামাতে এবং শরণার্থীর ছদ্মবেশে বা অন্য ভাবে কিছু বাজে লোক এখানে এসে অন্তর্ঘাত কার্য্ক্রম করাতে ভারত এই সমস্যার মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে এবং আমি আবার বলছি, আমরা বিশ্বাস করি, এই পরিস্থিতি আমাদের জন্য সত্যিকারের বিপদ ডেকে আনছে।

মি. হ্যারিসন: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, গত এপ্রিল মাসে নয়াদিল্লিতে আমাদের সাক্ষাৎকারের সময় আপনি বলেছিলেন, সংঘাত শুরু হবার পূর্বে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যদি আরো আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাওয়া অনুমোদন করতেন, তাহলে পূর্ব পাকিস্তানের সরকার স্বাধীনতার জন্য দাবি করত না। আপনার বোধহয় ধারণা হয়েছিল যে পাকিস্তানের দুই প্রান্তের মধ্যে দুর্বল যোগাযোগ এখনো সম্ভব এবং পূর্ব বাংলাকে আরো স্বায়ত্বশাসন দেবার মাধ্যমে একটা রাজনৈতিক মধ্যস্থতা হতে পারে।

আপনি কি এখনো মনে করেন যে জনৈতিক মধ্যস্থতা হতে পারে নাকি গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ন স্বাধীনতা অর্জনই বর্তমান অবস্থার একমাত্র সমাধান?

প্রধানমন্ত্রী: পূর্ব বাংলার জনগণ যদি অনুমোদন করে, তাহলে যেকোন কিছুই সম্ভব। আমার মনে হয় না তারা কি অনুমোদন করবে আর কি করবে না, সে বিষয়ে কথা বলার কোন অধিকার আমাদের আছে। এটা তাদের দেশ, তাদের আন্দোলন, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তারাই নিবে।

মি. হ্যারিসন: যদি যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম পাকিস্তানকে আর কোন সামরিক এবং অর্থনৈতিক সাহায্য না করে, তাহলে যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করতে তাদের কতদিন লাগবে বলে আপনি মনে করেন?

প্রধানমন্ত্রী: আমার মনে হয়না যে কোন সুনির্দিষ্ট তারিখ বলে দেওয়া সম্ভব, কিন্তু আমরা যেই ধরনের খবরাখবর পাচ্ছি, তাতে গেরিলা কার্য্ক্রম শুধু সীমান্তবর্তী এলাকাতেই সীমাবদ্ধ না, বরং পূর্ব বাংলার একেবারে গভীরে যেমন সবচেয়ে সুরক্ষিত ঢাকা শহরেও চালিত হচ্ছে।
মি. জাব্বালা: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এই দেশে এবং অন্যত্র একটা সন্দেহ অনেকদিন ধরেই বিরাজমান যে, ভারত পাকিস্তানকে আপাদত দুর্বল করা এবং ভবিষ্যতে ধংস করে ফেলার গভীর চক্রান্তে লিপ্ত। এখন এই সন্দেহ ঘুচানোর জন্য শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া এবং সাহায্য করা ছাড়া আপনি কি আপনার সরকারের গৃহীত আর কোন সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ এর কথা বলতে পারেন?

প্রধানমন্ত্রী: এই কথা পাকিস্তানের সরকার গত ২৪ বছর ধরেই শুরু থেকেই বলে আসছে। কিন্তু সত্যিকারের অভিজ্ঞতা কি বলে? অভিজ্ঞতা এটাই বলে যে পাকিস্তানই বরং আমাদের উপজাতি বিদ্রোহীদের, সে মিজো হোক বা নাগা হোক, তাদের অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ দিয়েছে। পাকিস্তানই কাশ্মীরকে অস্থিতিশীল করার জন্য সেখানে হাজার হাজার অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়েছে, যা সেই বছর সেখানে সংঘাত উস্কে দিয়েছে। আর আপনি দেখছেন, তারা বর্তমানে রেডিও এবং অন্যান্য গণমাধ্যমে উস্কানিমূলক এবং হুমকির ভাষায় কথা বলছে। ভারত এরকম কোন ঘোষণা দেয় নাই এবং আমি আপনাকে নিশ্চিত করে বলতে পারি, ভারতের সরকার বা ভারতের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সেই ধরনের কোন বাসনা নেই। আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নই, এবং পাকিস্তানের জনগনের প্রতি আমাদের বন্ধুভাবাপন্ন মনোভাব আছে। আমরা মনে করি, এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক যে, পাকিস্তান তাদের অস্তিত্ব এবং ঐক্যের জন্য সারাক্ষন ভারতবিদ্বেষের উপরে নির্ভর করে।

মি. জাব্বালা: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি কিছুক্ষন আগে বলেছেন যে, আপনি মনে করেন, ভারতীয় উপমহাদেশের অবস্থা সম্পর্কে নিক্সন প্রশাসনের এখন যথেষ্ঠ ভাল উপলব্ধি হয়েছে। যদি এই যথেষ্ঠ ভাল উপলব্ধির কোন বাস্তব প্রতিফলন তাদের কাজকর্মে দেখা না যায়, তাহলে আপনার প্রতিক্রিয়া কি হবে?

প্রধানমন্ত্রী: আমরা খুবই পরিণত মানুষ মি. জাব্বালা। আপনি জানেন আমাদের চীনের সাথে সংঘাত আছে, কিন্তু আমরা সবসময় সংযত এবং পরিণত আচরণ করে আসছি, এবং আমরা আমাদের মূলনীতিতে সবসময় অটল ও আপোষহীন। যদি যুক্তরাষ্ট্র ভারতের স্বার্থের পরিপন্থী কিছু করে, আমরা অবশ্যই অসন্তুষ্ট হবে, কিন্তু এর জন্য আমাদের মাথা খারাপ হয়ে যাবে না।
মি. স্পিভাক: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, পরিস্কারভাবেই আপনি মনে করছেন, এই কঠিন সমস্যার একটা সমাধান আছে। মনে হচ্ছে আমরা কোন সমাধান খুঁজে পাচ্ছি না। জাতিসংঘ ও কোন সমাধান বের করতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না। আপনি কি সমাধান প্রস্তাব করছেন?

প্রধানমন্ত্রী: আমরা আগে যেই সমাধান প্রস্তাব করেছিলাম, এবং আমি মনে করি, সেটাই একমাত্র সত্যিকারের সমাধান, সেটা হলো, পূর্ব বাংলার মানুষের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবর রহমানের সাথে কথা বলা উচিত এবং আপনার নিশ্চয় মনে আছে, তিনি গত নির্বাচনে সেখানে বিপুলভাবে নির্বাচিত হয়েছেন, যেমন ভারতে গত সাধারণ নির্বাচনে আমি বিজয়ী হয়েছি। কিন্তু আমি বলব, শেখ মুজিব আমার চেয়েও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন, এবং তাকে পাকিস্তানি সামরিক জনতার অধীনে অনেক বেশি প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে নির্বাচন করতে হয়েছে। তাঁর নির্বাচনী কার্য্ক্রম, নির্বাচনী প্রচারণা অত্যন্ত সত্তা এবং নিষ্ঠার সাথে সেখানকার সরকার ও জনগনের সামনে পেশ করা হয়েছিল, যার ভিত্তিতে তিনি এরকম ভূমিধস বিজয় লাভ করেছেন।

এখন কথা নাই, বার্তা নাই, আপনি হঠাৎ বললেন, তিনি বিশ্বাসঘাতক। তিনি কিন্তু স্বাধীনতা চাননি আগে। তিনি সীমিত স্বায়ত্বশাসন, ভারতের সাথে বাণিজ্য এরকম কিছু বিষয় চেয়েছিলেন। পাকিস্তানের সরকার বিচক্ষনভাবে হোক আর অবিবেচকভাবে হোক, যেটা আপনি বলেন, তাকে বন্দি করল এবং তাকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে ঘোষণা করল। তারা আবার পুন্:নির্বাচনের চেষ্টা করছে, যেখানে নির্বাচনী জনপ্রতিনিধি বর্তমান আছেন। প্রথমে নির্বাচন করা এবং এরপরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জোর করে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা, এটা অত্যন্ত আশ্চর্যজনক ব্যাপার। আপনি একদিকে সমস্যা সমাধানের কথা বলবেন, অন্য দিকে যে আপনার বিরোধিতা করবে, তাকে দেশছাড়া করবেন, এটাতো একটা বর্বর ব্যাপার।

মি. স্পিভাক: আমরা কি ধরে নিব, আপনি এখন যা বললেন, সেটাই একমাত্র সমাধানের পথ বলে মনে করছেন?

প্রধানমন্ত্রী: হ্যা, কারন আর কিভাবে আপনি জানতে পারেন যে একটা সমাধান সেখানকার মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্য হবে? আমি বা আপনি আমাদের কাছে যেটা সঠিক মনে হয়, সেরকম সমাধান দিতে পারি, কিন্তু সেটা যদি তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য না হয়, তাহলে সংঘাত চলতেই থাকবে, কেননা এটা তাদের লড়াই, তাদের আন্দোলন, তাদের যুদ্ধ।

মি. স্পিভাক: কিন্তু সেটা কি তাদের একটা অভ্যন্তরীন সমস্যা না?

প্রধানমন্ত্রী: আমরা বলেছি, এটা অভ্যন্তরীন সমস্যা, কিন্তু সেটা শুধু তাদের ভূখণ্ডেই সীমাবদ্ধ নেই, সেটা ভারতের মধ্যে ঢুকে গেছে। আমাদের অর্থনীতির উপরে এর প্রভাব পড়ছে। শুধু নয়, এটা রাজনৈতিক, সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করছে এবং সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হলো আমাদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে বলে আমরা মনে করছি।

মিস ফ্রেডরিক: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অনেকেই ভাবছেন যে পরিস্থিতি কেন, কিভাবে এতো বেশি উত্তপ্ত হলো, এবং সেখানে একটা বড় ধরনের যুদ্ধের সম্ভাবনা আছে, অথচ ভারত কেন ইউ থান্ট এর সাথে আলোচনায় অনাগ্রহী বা আপনি কেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে সরাসরি আলোচনা করার কথা ভাবছেন না?

প্রধানমন্ত্রী: আমরা সরাসরি আলোচনা করছি না, কেননা এটা ভারত-পাকিস্তানের কোন সমস্যা না। এই সমস্যাটা পাকিস্তানের সামরিক জান্তার সাথে পূর্ব বাংলার জনসাধারণের বা জনগনের দ্বারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের। কেউ থান্ট এর ব্যাপারে বলতে পারি, তিনি আমাদের কাছে সবসময় আমন্ত্রিত কিন্তু এটাও পরিষ্কার হওয়া দরকার, জাতিসঙ্ঘ এখানে কি লক্ষ্য অর্জন করতে চাচ্ছে বা তার সাথে আলোচনা করে কি অর্জন করা সম্ভব। আমরাই প্রথম এই বিষয়ে উনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি অথচ এখন মনে হচ্ছে উনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমাদের সাথে কথা বলতে চাচ্ছেন।

মিস ফ্রেডরিক: কিন্তু এই পরিস্থিতি যদি চলতেই থাকে, তাহলে আপনিও হয়তো আমার সাথে একমত হবেন, যে পৃথিবীর বৃহৎ শক্তি দেশগুলোর এতে জড়িয়ে পড়ার ভয় রয়েছে। ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে প্রথম প্রতিরক্ষা চুক্তি করে ফেলেছে। ঐ দিকে পাকিস্তানের রাজনৈতিক প্রতিনিধি ভুট্টো পিকিং সফরে গেছেন অবশ্যই কোন সাহায্যের আশায়, কেননা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেছেন, তিনি পিকিং এর দিকে ঝুঁকবেন। এখন তাহলে কি হবে? বৃহৎ শক্তিগুলো কি সেখানে জড়িয়ে পড়বে অনিবার্যভাবে নাকি বৃহৎ শক্তিগুলোর সংঘাতে জড়িয়ে পড়া কোনভাবে এড়ানো সম্ভব? প্রেসিডেন্ট নিক্সন কি বলেছেন যে তিনি পিকিং এবং মস্কোর সাথে এই ব্যাপারে কথা বলবেন দেশ দুটিতে সফরের সময়?

প্রধানমন্ত্রী: আমার মনে হয় না, এরকম কোন কথা তিনি নিশ্চিত করে বলেছেন কিন্তু তিনি বলেছেন যে তিনি উদ্বিগ্ন এবং অন্য পক্ষগুলোর এতে কোনভাবে জড়িয়ে পড়া ঠিক হবে না। আমি আগেই পরিষ্কার করে বলেছি, আমরা যে কোন ধরণের যুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং যুদ্ধ শুরু হতে পারে, এরকম উস্কানিমূলক কিছু আমরা করব না। কিন্তু একটা বিষয় যে কোন দেশের জন্যই অধিক গুরুত্বপূর্ন। আমরা স্বাধীনতার জন্য অনেক বছর ধরে লড়াই করেছি এবং আমাদের স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়লে আমরা তা কিছুতেই বরদাস্ত করব না, সেটা যার দ্বারাই হোক না কেন। আমরা সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে কোন প্রতিরক্ষা চুক্তি করিনি। এটাকে বন্ধুত্ব, সহযোগিতার এবং শান্তির চুক্তি বলা যেতে পারে। আমরা হয়তো তাদের সাথে এটা নিয়ে কথা বলতে পারি, কিন্তু এই চুক্তিকে কোনভাবে সামরিক চুক্তি বলা যায় না।

মিস ফ্রেডরিক: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি তাহলে আর্টিকেল ৯ সম্পর্কে কি বলবেন, যেখানে বলা হয়েছে, দুই দেশের যে কোন এক দেশ আক্রান্ত হলে অন্য দেশ অন্য দেশ তার সুরক্ষায় ব্যবস্থা নিবে? এটাকে কি সামরিক চুক্তি বলা যায় না?

প্রধানমন্ত্রী: এটাকে ঠিক সেভাবে প্রতিরক্ষা চুক্তি বলা যায় না, কেননা সামরিক সাহায্যই আসবে, এরকম কোন সিদ্ধান্ত হয়নি এই চুক্তিতে। তাছাড়া স্বাভাবিক অবস্থায় তাদের সাথে বা অন্য বন্ধু দেশের সাথে আমাদের যেই ধরনের সহযোগিতা আগে হয়েছে, এখানে তার ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। আমরা অবশ্যই আশা রাখি, আমরা বিপদে পড়লে শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নই নয়, বরং অন্য সকল বন্ধু দেশ আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে।

মি. রোসেন্থাল: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি কিছুক্ষন আগেই চীনের প্রসঙ্গে কথা বললেন। আপনার দেশ যদিও যুদ্ধ চায় না, কিন্তু বাস্তবতা হলো, আপনার দেশ প্রায় দশ বছর আগে চীনের সাথে যুদ্ধে জড়িয়েছে এবং এজন্য আপনাদের যথেষ্ট ভোগান্তি হয়েছে, বলা যায় শোচনীয় পরাজয়। চীন সেনাবাহিনীর উপস্থিতি নিয়ে কি আপনি উদ্বিগ্ন? আপনি কি মনে করেন যে তারা ভারতের জন্য অব্যাহত হুমকি?

প্রধানমন্ত্রী: আমি মনে করি, বিশ্বের প্রতি চীনের দৃষ্টিভঙ্গির যথেষ্ট পরিবর্তন এসেছে এবং ব্যক্তিগতভাবে আমার ধারণা তারা এই ধরণের কোন সংঘাতে এখন জড়াতে চাইবে না। কিন্তু অবশ্যই এই বিষয়ে নিশ্চিতকরে কোন ভবিষ্যৎবাণী করা খুব কঠিন হবে।

মি. রোসেন্থাল: সেটা কি তাহলে আপনার প্রতিরক্ষা সমস্যা অনেকটা কমিয়ে দিয়েছে বা চীন সীমানায় কি তাহলে তাহলে সেভাবে নজরদারীর সেরকম দরকার নেই বলেছেন?

প্রধানমন্ত্রী: আমার মনে হয়, আমাদের সব সীমান্তেই সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

মি. হ্যারিসন: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ হলো, আপনি কাশ্মীরের বিষয়ে আর পাকিস্তানের বিষয়ে দ্বৈত নীতি অনুসরণ করছেন। একদিকে আপনার দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছেন কাশ্মীরের রাজনৈতিক নেতা শেখ আব্দুল্লাহ। তিনি বলেছেন, একদিকে আপনি পাকিস্তানের সমালোচনা করছেন শেখ মুজিবর রহমানের বাঙালি নেতাদের জেলে ঢুকানোর জন্য। অন্য দিকে আপনি শেখ আব্দুল্লাহর চলাফেরার উপরে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। তিনি গত ৯ মাস ধরে কাশ্মীরে যাবার এবং সেখানে নির্বাচন করার অনুমতি পাননি। আপনি কেন তার চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করছেন?

প্রধানমন্ত্রী: প্রথমত, আমি অবাক হচ্ছি দেখে যে, আপনি এই দুটোর মধ্যে কোন পার্থক্য দেখছেন না। পূর্ব বাংলার মানুষের উপরে চলমান গণহত্যা, তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারকে গলা টিপে মেরে ফেলা, মেয়েদের পাইকারি হরে ধর্ষণ- নির্যাতন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের হত্যা করা, লক্ষ লক্ষ পূর্ব বাংলার মানুষকে দেশ ছাড়া করে আমাদের দেশে ঠেলে দেবার সাথে কি আপনি শান্তিপূর্ণ কাশ্মীরের কোন পার্থক্য দেখছেন না, যেখানে এখন নির্বাচিত সরকার রয়েছে, যেখানে মানুষ পড়াশুনা, প্রগতি এবং সব ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে?
এটা সত্যি যে আমরা শেখ আব্দুল্লাহর উপরে কিছু বিধি নিষেধ দিয়েছি, কিন্তু তিনি একজন মুক্ত মানুষ। তিনি কাশ্মীর ছাড়া যেকোন জায়গায় স্বাধীনভাবে যেতে পারেন, কিন্তু কাশ্মীরে সর্বোপরি শান্তিপূর্ণ অবস্থা থাকলেও কিছু রাজনৈতিক অস্থিরতা আছে এবং কিছু নিরাপত্তার সমস্যা আছে। তাই আমরা সেখানে যেয়ে ঝামেলা পাকাতে পারে, এমন কারো ঝুঁকি নিতে পারি না।

মি. জাব্বালা: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মিস ফ্রেডরিক এর প্রশ্নের উত্তরে আপনি যা বলেছেন, আমি একটু সেই প্রসঙ্গে ফিরে আস্তে চাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি পাকিস্তানকে সবরকম সামরিক এবং অর্থনৈতিক সাহায্য দেবা বন্ধ করে দেয়, তাহলে তা বর্তমানের সেখানকার রাজনৈতিক অবস্থার সমাধানে কি ভূমিকা রাখবে বলে আপনি মনে করেন?

প্রধানমন্ত্রী: আপনি বুঝাতে চাচ্ছেন, যদি তারা শেখ মুজিব বা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সাথে কোন আলোচনা না করে?

মি. জাব্বালা: না। আমি বলতে চাচ্ছি, যদি আমেরিকা পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য দেবা বন্ধ করে দেয়, তবে তা পরিস্থিতির সমাধানে কি ভূমিকা রাখবে বলে আপনি মনে করেন? তাহলে কি ইয়াহিয়া বাধ্য হবে শেখ মুজিবের সাথে আলোচনা করতে?

প্রধানমন্ত্রী: আমার মনে হয়, আমেরিকা এবং আরো কিছু শক্তিশালী দেশ ইচ্ছা করলে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের উপরে চাপ দিতে পারে, যেন তারা পূর্ব বাংলার নেতাদের সাথে সমস্যা সমাধানে আলোচনায় বসে।

মি. স্পিভাক: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমাদের দেশের সংবাদমাধ্যমে অভিযোগ উঠেছে, ভারত বাংলার গেরিলা মুক্তিবাহিনীকে আশ্রয়, অস্ত্র, গোলা বারুদ, গেরিলা ট্রেনিং এবং যাবতীয় সবকিছু দিয়ে সাহায্য করে যাচ্ছে। এই অভিযোগের বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি?

প্রধানমন্ত্রী: খোলাখুলিভাবে আমার বলতে কোন দ্বিধা নেই, পূর্ব বাংলার মানুষের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামের প্রতি আমাদের সমর্থ রয়েছে। আমি আগেই বলেছি, তারা আগে স্বাধীনতা বা বিচ্ছিন্ন হতে চায়নি। তারা গণতান্ত্রিক ভাবে চলে এসেছে, তাদেরকে যেভাবে গণতান্ত্রিকভাবে নির্ভয়ে ভোট দিতে বলা হয়েছে, তারা তাই করেছে অথচ সেই কারণেই আজ তাদের শাস্তি পেতে হচ্ছে। তারা নিজেরাই গেরিলা বাহিনী তৈরী করেছে এবং ততক্ষন পর্যন্ত আমরা কোন হস্তক্ষেপ করিনি। আপনি হয়তো জানেন, ইস্ট বেঙ্গল রাইফেলস এবং ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্ট থেকেই এই গেরিলা বাহিনী তৈরী হয়েছে। এই গেরিলা যুদ্ধের সেটাই ভিত্তি। তারাই সেখানকার তরুণ যুবকদের যুদ্ধের ট্রেনিং দিচ্ছে। তারা হয়তো কখনো কখনো ভারতের ভূখণ্ডে আসে, কিন্তু তাদের ভিত্তি ভারতে না। ভারতের সীমান্ত থেকে পূর্ব বাংলার গভীরে পর্যন্ত গেরিলা লড়াই ছড়িয়ে পড়েছে। আর্মির ভয়ঙ্কর জুলুম সত্বেও পূর্ব বাংলার সাধারণ জনগনের অভূতপূর্ব সমর্থনের কারণেই একমাত্র তা সম্ভব হচ্ছে।

মি. স্পিভাক: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, “মিট দ্য প্রেস” অনুষ্ঠানে আমাদের আজকের অতিথি হয়ে আসার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৬৫। প্যারিসে রাষ্ট্রী ভোজ সভায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির ভাষণ ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ৮ নভেম্বর, ১৯৭১

Nusrat Jahan Ima

<১২, ৬৫, ১৫৯-১৬০>

৮ নভেম্বর ১৯৭১ প্যারিসে রাষ্ট্রীয় মধ্যাহ্ন ভোজনে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভাষন

আমার মন ছুয়ে গেছে আপনার কথায়, এবং আমি আপনাকে এবং আপনার মাধ্যমে ধন্যবাদ জানাতে চাই ফ্রান্সের এই আতিথেয়তা ও বন্ধুত্বপূর্নতার জন্য। এক বছর আগে, জেনারেল দ্যা গল এর স্মরন সভায় শোক পালনে তাড়াহুড়ো করে এসেছিলাম। তিনি একজন বিশাল মর্যাদাবান ব্যাক্তি ছিলেন। দূর্দশার দিনে তিনি ছিলেন ফ্রান্সের গৌরবমূর্তী। আমরা ভারতীয়রা তাকে শ্রদ্ধা জানাই, জানাই তাকে সালাম।

ফ্রান্সের প্রতি আমাদের গভীর টান আছে। ফ্রান্স, ভারতের মতই এটি শুধু একটি দেশ নয়, এটি একটা বিশ্বাস। ইতিহাস জুড়ে আপনাদের এবং আমাদের পরিচয় আছে বিজয় এবং বিয়োগান্তের সাথে, তবুও আমরা চেষ্টা করেছি সামাজিক মূল্যবোধ গুলো বজায় রাখতে। বিগত কয়েক শতাব্দীতে, শিল্প এবং বিজ্ঞান, দর্শন এবং সাহিত্য এবং রাজনীতিতে, বিশ্ব ঋনী থাকবে ফ্রান্সের মত সৃজনশীল মননের জাতির কাছে। ফ্রান্স আমাদের শিখিয়েছে, উদ্দেশ্য এবং মানব জীবনে পরিস্থিতি, এবং আইন ও যুক্তির অগ্রগতি হচ্ছে স্বাধীনতা। আপনাদের দেশের মতো আর কোথাও জনগনের ভাগ্য নিয়ে এত তীব্র ও আন্তরিক ভাবে আলোচনা করা হয় না। ফ্রান্স কখনোই তার মহীমা ফিরে পেতে তার জনগনকে পন্য করেনি। গত ত্রিশ শতাব্দী ধরে, ভারতীয় সভ্যতার অর্জন হচ্ছে এর অবিচলতা। এই টিকে থাকা সম্ভব হয়েছে, সহনশীলতা আর আয়ত্তকরনের ক্ষমতা এবং বিশ্বাস যে, ক্ষমতা আর অবস্থানের চাইতে মানুষের জীবনের মুল্য অনেক বেশি।

অনেক উত্থান-পতনের পরে, আমরা আবারো ইতিহাসের মুলস্রোতধারায়। আমাদের ব্যাস্ত রাখা হয়েছিলো বছরের পর বছর সামন্ত তন্ত্র ও ঔপনিবেশিক শাষনের চিরস্থায়ী প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে। তখন আমরা শিল্প, প্রযুক্তি এবং সামাজিক পরিবর্তন থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলাম। ভিন্ন মত ও অসন্তোষ কথার এবং অসংগঠিত প্রচারনার অভাবে একটি গনতান্ত্রিক সমাজের অর্জনের ফলাফল, একটি নিয়ন্ত্রিত সমাজের তুলনায় কম চিত্তাকর্ষক মনে হতে পারে। যদিও আমরা বিশ্বাস করি, গনতন্ত্র একটি নিশ্চিত এবং কার্যকর পদ্ধতি যা মানুষকে শক্তি দেয়।

স্বাধীনতা প্রত্যাশা কে জাগায় এবং গনতন্ত্র প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করে। উন্নয়নের প্রথম অর্জন আরো নতুন দুঃশ্চিন্তার উদ্রেক করে। অপেক্ষাকৃত কম বিশ্বস্ত অঞ্চলের ও ধর্মের লোকেরা এখান থেকে কিছু সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করে, যা আমাদের মত বিশাল বৈচিত্র পূর্ন দেশে একটু বেশি হয়ে থাকে। আমরা চেষ্টা করছি বিভিবন্ন বিভাগ গুলির মধ্যে বৈষম্য হ্রাস করা এবং খুদ্র ব্যক্তি পর্যায়েও বেশি করে সুযোগ প্রদান করা। আমাদের অনেক সংখা লঘু আছে। তারা সংখালঘু এবং জাতি হিসেবে সমস্ত অধিকার ভোগ করে থাকে।

আমরা অবশ্যই চাইবো আমাদের সমাজ প্রযুক্তির দ্বারা উপকৃত হোক, কিন্তু কখনোই প্রযুক্তির কাঠামো দ্বারা বন্দী হতে চাই না। আমাদের কোন ইচ্ছা নেই পশ্চিমের অভিজ্ঞতা কে পুনরাবৃত্তি করার, আমাদের জাতিগত ব্যাক্তিত্বকে নিজস্ব উপায়ে বিকশিত করতে দেয়া উচিত। উপাদানগত সমৃদ্ধির প্রবৃদ্ধি মানুষের একান্ত আয়কে সন্তোষজনক করে না। সমাজের উচিত সেই সব মূল্যবোধ কে অনুপ্রানিত করা যা মানুষকে পরিপূর্নতা খুজে পেতে সক্ষমতা দেয় এবং তার জগৎ কে উপভোগ্য করে তোলে।

এই নীতি আমাদের সকল প্রচেষ্টার পথনির্দেশক হয়েছে। বিপ্লব ছাড়া পুরোনো রীতিকে পরিবর্তন করা অথবা আশ্রয়ের জন্য জোড়জবরদস্তি ছাড়া, বিচিত্র মানুষগুলোকে যুক্তিযুক্ত ভাবে একটি আধুনিক জাতির ছাচে ফেলা অতো সহজ না। যেমন তেমন ঐক্যের প্রচেষ্টা হিসেবে কাজটি ছিলো সুবিশাল, একধরনের ধর্মান্ধ আবেদন আসে যা ধর্মীয় বা ধর্মীয় মতবাদ থেকে। এই শতাব্দীর পাদপ্রান্তে এসে, একটি যৌক্তিক গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষায়, ভারতের সমস্যাকে বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা সবসময় দেখে এসেছি। আমরা মনে করি স্নায়ুযুদ্ধ পৃথিবীর বড় বড় সমস্যাগুলোকে এড়িয়ে অন্যদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করায়। এবং পারস্পরিক সহযোগীতার বদলে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। একথা অনস্বীকার্য যে কোল্ড ওয়ার এর ফল ভালো হয়নি। ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে বৈরিতার অবসান কে আমরা স্বাগত জানাই। আমরা আনন্দিত যে, অবশেষে চীন জাতিসংঘের সাথে যুক্ত হয়েছে, এবং মার্কিন যুক্ররাষ্ট্র এবং চীন সংলাপ শুরু করেছে। এই সময়ের মধ্যে, ফ্রান্স দূরদর্শিতা এবং সর্বোচ্চ শৃংখলার রাষ্ট্রনায়োকচিত ভাব প্রদর্শন করেছে।

সুতরাং, সেখানে একটি শান্তুপূর্ন বিশ্বের দিকে বিবর্তনের আশা করার অনেক কারনই ছিলো এবং স্বাভাবিক ভাবে ভারতেরও সেই আশা ছিলো। আমাদের গত সাধারণ নির্বাচন রাজনৈতিক স্থিতিশিলতার সৃষ্টি করেছে। যা অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে আরো ত্বরান্বীত করেছে।

নতুন সরকার গঠনের এক সপ্তাহের মধ্যে, কোন সতর্কবাণী ছাড়াই এবং আমাদের পক্ষ থেকে কোন অন্যায় আচরণ না থাকা সত্ত্বেও একটি বিশালাকার নতুন বোঝা আমাদের ওপর এসে পড়ল। পূর্ব বাংলা থেকে প্রায় কম-বেশি ৯ মিলিয়ন – যে সংখ্যাটা বেলজিয়াম বা অস্ট্রিয়ার জনসংখ্যার সমান – এই পরিমাণ উদ্বাস্তু যাদেরকে পাকিস্তানের সামরিক শাসক তাড়িয়ে আমাদের দেশের ভেতরে জোর করে পুশ করেছে। এতে আমাদের আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়েছে এবং আমাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনার জন্য হুমকি স্বরূপ। বিশ্বের কি এই আগ্রাসী ঘটনায় সজাগ হওয়া উচিৎ নয়? স্বাভাবিক অর্থে এটি গৃহযুদ্ধ নয়। এটা গণতান্ত্রিকভাবে ভোট দেয়ার অপরাধে বেসামরিক নাগরিকদের উপর নাজিল হওয়া গণহত্যা। এটা একটি প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে অসহায় মানুষকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করার সামিল। মানুষের আকাঙ্ক্ষা, স্বাধীনতার কামনা এবং মর্যাদার দাবীকে নির্বাপিত করা যায় না।

আমরা ভারত সর্বাধিক সংযম দেখিয়েছি। কিন্তু কোন সন্দেহ নেই যে, আমাদের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন। এই সঙ্কটের মূল কারণ দূর করা উচিত। একটি রাজনৈতিক সমাধান বের করতে হবে। যা বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য হবে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৬৬। বিশ্ব এখন বাংলাদেশ সংকট সম্পর্কে আগের চাইতে বেশী সচেতন – বিদেশ সফর শেষে ডিলিটে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মন্তব্য দি স্ট্যাটসম্যান ১৪ নভেম্বর, ১৯৭১

Zulkar Nain
<১২, ৬৬, ১৬১-১৬২>

“বিশ্ব এখন বাংলাদেশ সঙ্কট সম্পর্কে আগের চাইতে বেশি সচেতন
– মিসেস গান্ধী

নতুন দিল্লী, ১৩ই নভেম্বর – তিন সপ্তাহের বিদেশ সফর থেকে ফিরে মিসেস গান্ধী আজ সকালে বললেন, তিনি বিশ্বনেতাদের সাথে বৈঠক নিয়ে “মোটের উপর” সন্তুষ্ট হলেও, একটা যুদ্ধ ছাড়া শুধুমাত্র তাদের হস্তক্ষেপে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধান কতটা কার্যকর হবে তা তিনি বলতে পারছেন না। পালামে নামার পরপরই প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সারাবিশ্ব উপমহাদেশের সঙ্কটের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছে।

তিনি বলেন, ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যকার যুদ্ধের প্রশ্ন যেমন তার মনকে ভাবাচ্ছে তেমনি বিশ্বনেতাদের মনেও উদ্বেগ তৈরি করছে। তিনি সীমান্ত পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত আছেন, কিন্তু এর সঠিক মূল্যায়ন নির্ভর করছে তার সহকর্মীদের সাথে করা আলোচনার উপর।

মিসেস গান্ধী, সেখানে তার ও প্রেসিডেন্ট নিক্সন মধ্যে কোন সাক্ষাত হয়নি, বিদেশী সাংবাদিকদের এরূপ মন্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। এই সিদ্ধান্ত সম্পুর্নরুপে ঠিক ছিলনা। উল্লেখযোগ্যভাবে, প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, অস্ত্র বিক্রির উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আমেরিকার অন্যান্য তৃতীয় পক্ষের অস্ত্র বিক্রয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে কিনা সে ব্যাপারে তিনি স্পষ্ট নন। উপরন্তু কিভাবে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব উইলিয়াম রজারের বক্তব্য, যাতে বলা হয়েছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের একটা ভারত-পাকিস্তান বিরোধ টিকিয়ে রাখবে, এর প্রেস রিপোর্ট ব্যাখ্যা করবেন সেটাও অনিশ্চিত।

চীনাদের উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নিজেকে এবং প্রেসকে অবশ্যই প্রকাশিত সংবাদের উপর নির্ভর করতে হয়েছিল। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, চীনাদের আচারনে একটা পরিবর্তন এসেছে। প্রেস রিপোর্ট ও অন্যান্য সাম্প্রতিক “ঘটনায়” তা প্রতিফলিত হয়েছিল। তিনি এমন ভাব দিয়েছিলেন যেন জনাব ভুট্টোর উদ্দেশ্য খুব বেশি সফল হয়নি।

এক বিদেশী সংবাদদাতার শরনার্থী সমস্যা আপোষের সম্ভবনা সম্পর্কিত এক প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী বিরক্ত হন। প্রশ্নকারী প্রস্তাব দেন যে, যেহেতু শরনার্থীদের অধিকাংশ হিন্দু তাই ভারত তাদের গ্রহন করতে পারে। মিসেস গান্ধী তখন জোর গলায় বলেন, কোন দেশ এসব বিদেশী নাগরিকদের কেন গ্রহন করবে যারা নিজেদের ইচ্ছায় তাদের দেশ ত্যাগ করেনি, বরং একটি গনতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক পদ্ধতিতে ভোটাধিকার প্রয়োগ করার কারনে তাদেরকে দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হওয়ার পাশাপাশি, “আমরা ভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে কোন তারতম্য করিনা”।

যদিও শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্য সম্পর্কে তিনি কোন তথ্য পাননি, তবু জেনারেল ইয়াহিয়া খান এমন প্রস্তাব করবেন ভেবে মিসেস গান্ধী বলেন এটা অসম্ভব যে আওয়ামীলীগ নেতারা তাকে ছাড়া সামরিক শাসকদের সাথে কথা বলতে একমত হবেন। শুধুমাত্র নির্বাচিত নেতৃবৃন্দরাই কোন সমাধান গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করতে পারেন। একটা রাজনৈতিক সমাধানে আসতে বিশ্বসম্প্রদায়, ভারত বা পাকিস্তানের কতদিন লাগতে পারে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মিসেস গান্ধী বলেন, এ ধরনের সমস্যায় কেউ নির্দিষ্ট তারিখ বলতে পারেনা।

তিনি চ্যান্সেলর ব্রান্ডিট এর সঙ্গে একমত হয়েছিলেন যে, তিনি বা অন্যান্য বিশ্ব নেতাদের হয় স্বতন্ত্রভাবে অথবা সমষ্টিগতভাবে সম্ভাব্য পরিণতির জন্য পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের উপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে কোন রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া। তিনি জোর দিয়ে বলেন, বাংলাদেশের মানুষ যদি চায় তাহলেই শুধুমাত্র রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব, অন্য কোন কিছু দীর্ঘস্থায়ী হবেনা।

উদ্বাস্তু ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে কোন পদ্ধতিগত ব্যবস্থা নিয়ে তিনি আলোচনা করেননি। এটা সত্য যে, পুর্বাঞ্চলের পরিস্থিতির গুরুত্ব সম্পর্কে তিনি তার ইচ্ছাগুলো বিদেশে উল্লেখ করেছিলেন। মূলত, পশ্চিম সীমান্তে কি ঘটছে তাতে পুর্ব বাংলার অবস্থায় কোন প্রভাব ফেলছেনা। বাংলাদেশ সমস্যা সমাধান নাহলে, টানাপোড়েন লেগে থাকবে।

প্রেসিডেন্ট গিরি এবং মিসেস গান্ধীর মন্ত্রীসভা সহকর্মীরা বিমানবন্দরে তাকে অভিবাদন জানানোর জন্য উপস্থিত ছিলেন। সেখানে কূটনৈতিক দল এবং সংসদ সদস্যদের বড়সড় একটা সমাবেশ ঘটেছিল। বিমানবন্দরে বিপুল জনগন তাকে উৎফুল্ল করেছিল, এছাড়াও বিমানবন্দর থেকে তার বাসভবনে ফেরার সময় রাস্তার পাশে জনতার ভিড়ের উৎফুল্লতা তিনি গ্রহণ করেছিলেন।

শিরোনাম
সুত্র তারিখ
৬৭। নিউজউইকের সাথে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ১৫ নভেম্বর, ১৯৭১

Nusrat Jahan Ima
<১২, ৬৭, ১৬৩-১৬৪>

নিউজ উইক ম্যাগাজিনে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার
১৫ নভেম্বর ১৯৭১

পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ প্রসঙ্গ

বেশ দীর্ঘ সময় ধরে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কর্মকান্ড ও বক্তব্য খুবই প্ররোচনামূলক ও হুমকিস্বরুপ হলেও, ভারত এক্ষেত্রে কিছুই করেনি। এখন, যখন আমরা মনে করছি যে আমাদের কে হুমকি দেয়া হচ্ছে, স্বাভাবিক ভাবে আমরা আমদের সীমান্ত অরক্ষিত অবস্থায় রাখতে পারি না। আমি জানি না এমন কোন দেশ আছে কিনা যারা বলবে, “ আমরা আমাদের সীমান্ত অরক্ষিত অবস্থায় রেখে যাবো”। আমাদের সীমান্তে যখন এ অবস্থা চলছে, তখন আমাদের কি করা উচিত? আমরা কি শুধু বসে থাকবো আর বলবো, “যা খুশি করো, এমনকি এর পরিনতি যদি আমাদের জন্য খুবই বিশাল হয়? … আমি এটাই বলবো, মোটের উপর, ভারতের মানুষ যুদ্ধ চায় না। আমাদের অনেক বাক্যবাগীশ লোকজন আছেন, যারা যুদ্ধ চায়, আবার কিছু চরমপন্থীরাও আছেন, যারা যুদ্ধ চান। কিন্তু আমাদের লোকজনদের মধ্যে ভারত-ঘৃনা আন্দোলনের (যা পাকিস্তানের আছে) মতো পাকিস্তান-বিরোধী কোন আন্দোলন নেই। আমি আন্তরিক ভাবে বিশ্বাস করি, সেখানে কোন যুদ্ধ হবে না। এবং আমি আমার সাধ্য মতো সব করছি যাতে এমনটা না হয়, পশিম পাকিস্তানের সীমান্ত থেকে আমরা সৈন্য সরিয়ে ফেলায় যুদ্ধের আশংকা এখন অনেক টাই কম। কিন্তু যদিও পরিস্থিতি ঠিক হয়ে উঠছে, তবুও পূর্ব দিকেই বিপদের আশংকা বেশি। আমরা অনুভব করতে পারছি, পুর্ব ভারতের বিপদ প্রতিদিনই একটু করে বাড়ছে।

বাঙ্গালীদের সমর্থনে

শুধুমাত্র শরনার্থীদের আসতে শুরু করা দেখেই কি আপনি বলবেন যে পাকিস্তান সংকটে ভারতের হাত ছিলো? নাকি এর পর (পাকিস্তানী সেনা সন্ত্রাস) শুধু বলবেন, “আচ্ছা, হয়তো কিছু গেরিলারা ভারত থেকে এসেছে” ……… কিছু প্রশিক্ষন হয়তো আমাদের দিক থেকে দেয়া হয়েছিলো, কিন্তু সব টাই না। এমনকি গেরিলারাও এখন আর ভারতের উপর নির্ভরশীল নয়। আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে, বেশিরভাগ গেরিলারাই পূর্ব বাংলার আধা সামরিক বাহিনীর …… এবং তারাই নতুন দের প্রশিক্ষন দিচ্ছে……… যা ছিলো বাঙালী মননে সুগভীর ক্ষত।

আর যতক্ষন তাদের মধ্যে উদ্দীপনা আছে, এই পাকিস্তানিদের উপর বাঙ্গালীদের নিয়ন্ত্রন নেবার আগেই, পাকিস্তানীদের পূর্ব পাকিস্তানের এই সাড়ে সাত কোটি মানুষদের মেরে ফেলতে হবে… ভারত কেবলমাত্র খুবই সামান্য ও পরোক্ষ ভাবে এ ধরনের গনহত্যা প্রতিহত করতে পারে। এবং আমার বলতে দ্বিধা নেই যে, আজ আমি যদি বাঙ্গালীদের ন্যায় এই পরিস্থিতিতে থাকতাম, আমি অবশ্যই যুদ্ধ করতাম। সে যাই হোক, আমরা ব্রিটিশ দের সাথে যুদ্ধ করেছি এবং সারা বিশ্ব জুড়ে সকল স্বাধীনতা সংগ্রাম কে উৎসাহিত করি।

বাঙ্গালী শরনার্থীদের নিয়ে

শরনার্থীদের তদারকি করার মানে হলো আমাদের অনেক কার্যক্রম কে কমিয়ে আনা, এর নিশ্চিত মানে ছিল জীবন যাপনে কঠোরতা নিয়ে আসা, সরকারি ব্যয় হ্রাস করা এবং বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচির নতুন করে তৈরি করা। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল বেশ, অনেক বেশি (বোঝা)। আমি মনে করি না যে এটা আমাদের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিবে, আর আমরা তলিয়ে যাবো… কিন্তু এই প্রধান বিপদ এই বোঝা নয়, যা আরো অনেক বেশি। এটা ছিল সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনা যা এই সমস্যা থেকে ক্রমবর্ধমানে বেরিয়ে আসছিলো। এবং আমাদের মনে হয় এখানে আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে খুবই বাস্তব হুমকি আছে।

পাকিস্তান ভাঙ্গন

আমি মনে করি না, কোন সুবিবেচক দেশই চাইবে না তার প্রতিবেশী দেশের ক্ষতি হোক। দূর্বল প্রতিবেশি ছাড়াও আমাদের নিজেদেরই যথেষ্ট সমস্যা আছে। এটা কোন সুস্থ পরিস্থিতি না… (কিন্তু) আমাদের মূল্যায়ন হচ্ছে, যে পুর্ব বাংলা আর কখনোই একইভাবে পাকিস্তানের সাথে ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারবে না।

ভারতকে সোভিয়েত এর সাহায্য

আমি কোন কালেই সাহায্য চাইনি। এমনকি বাচ্চা কালেও আমি কোন মানুষকে বলিনি, “ দয়া করে আপনি আমার জন্য এটা একটু করে দিবেন অথবা আমাকে এটা দিবেন? ” আমি সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে সাহায্য চাইনি। পরিস্থিতি কেমন, তার ব্যাখ্যা আমি তাদের দিয়েছি যেমন অন্য দেশ গুলোতে দিয়েছি। এখন, ভারতের স্থিতিশীলতা, আমাদের প্রদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ন কি না তা নির্ভর করে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং অন্যান্য দেশের সিদ্ধান্তের উপর। আমরা অবশ্যই সহযোগিতা কে স্বাগত জানাই, তা যে কিঞ্চিৎ পরিমানই আসুক। আমরা সমর্থনকে স্বাগত জানাই, আমরা সহমর্মিতা কে স্বাগত জানাই। কিন্তু আমি সব সময়ই আমার নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছি এবং আমি চাই ভারত ও সর্বদা তার নিজের পায়ে দাড়াক। আমরা বিশ্বের কোন দেশের উপরই নির্ভরশীল হতে চাই না।

ইয়াহিয়া খান সম্পর্কে

সে এমন একজন ব্যাক্তি, যে তার নিজের দেশেই নির্বাচিত হতে পারেনি, যদি সেখানে সুষ্ঠ নির্বাচন হয়েও থাকে। আমি বলবো, এমনকি সে কোন প্রদেশের জন্যও নির্বাচিত হবে না যদি সেখানে সুষ্ঠ নির্বাচন হয়ে থাকে। ( নিউজ উইকের সাক্ষাৎকারে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার এক বিবৃতির জবাব দিতে বলা হলে, মিসেস গান্ধী লক্ষ্য করেন যে, ইয়াহিয়া তাকে “ ঐ মহিলা” বলে উল্লেখ করেছেন)। “ঐ মহিলা” এই মন্তব্য নিয়ে আমি মোটেও চিন্তিত না, কিন্তু এতে এই ব্যাক্তির মানষিকতা কিরুপ তা বোঝা যাচ্ছে। আমি বলতে চাচ্ছি, পূর্ব পাকিস্তান বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে তিনি তার ক্ষমতা কীভাবে যাচাই করবেন? যদি সে তার নিজের দেশের ছোট্ট অংশের ও বিচার করতে না পারেন, তো ভারতে তার বিচারের কি মূল্যই বা আছে? তিনি এ নিয়ে কি বা জানেন? এটা এমন এক বিশ্ব যা তার চিন্তার ও বাইরে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৬৮। বনস্থ বিথোভেন হলে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভাষন ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ২১ নভেম্বর, ২০১৬

Nusrat Jahan Ima
<১২, ৬৮, ১৬৫-১৭২>

নিম্ন লিখিত ভাষন থেকে উদ্ধৃতাংশঃ

ইলেকশনের পর আমরা ভেবেছিলাম যে, আমাদের পথ এখন পরিষ্কার, আপনার সবাই জানেন যে, আমরা তখন ব্যাস্ত ছিলাম একে অপরকে অভিবাদন জানাতে, একে অন্যের পিঠ চাপরাতে, হঠাৎ নতুন এক ঝামেলা শুরু হল, কোনপ্রকার সতর্ক বাণী ছাড়াই, আমাদের কোন দোষ ছাড়াই আমাদের উপরই অবতীর্ন হল এবং সেই সংকট আমাদের সীমানা জুড়ে চলছে। সাধারনত আমি অন্য দেশ সম্পর্কে মন্তব্য করতে পছন্দ করি না, কিন্তু এই মুহুর্তে যাতে আপনারা বুঝতে পারেন এখনকার অবস্থা, আমি কিছু বলতে চাই। ভারতীয় উপমহাদেশে যখন স্বাধীনতা সংগ্রাম চলছিলো, তখন সমগ্র উপমহাদেশ জুড়েই এই আন্দোলন বা সংগ্রাম ছিলো, এমনকি বর্তমান পাকিস্তান অংশতেও। কিন্তু যখন স্বাধীনতা অর্জিত হয়, দেশ বিভক্ত হয়, আমরাও সেই বিভক্তি মেনে নিয়েছিলাম, যদিও অখুশি মনেই। এই অবস্থা পরিবর্তনের জন্য আমাদের কাছে না বলার মতো কোন শব্দ বা কারন কিছুই ছিলো না। ভারতে যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে যুদ্ধ করেছিলেন তারাই নির্বাচনে অংশ নেন এবং সরকার গঠন করেন। অন্যদিকে পাকিস্তানে যারা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন তারা জেলে রয়েছেন এবং যারা বিদেশি শাষক গোষ্ঠীদের সহযোগীতা করেছিলো তারাই সরকার গঠন করেছে। সামরিক ও বেসামরিক উভয় ক্ষেত্রেই। এটাই হল দুই দেশের পার্থক্য।

পাকিস্তান ২ বার ভারত আক্রমন করেছে এবং এখন আবারো যুদ্ধের আশংকা আছে। আমরা এমন কিছুই করব না বা করিনি যা একটা যুদ্ধকে প্ররোচিত করতে পারে। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি যুদ্ধের মতই, কেননা আমাদের সৈন্যরা সীমান্তে মুখোমুখি হচ্ছে। কিছুদিন আগে এই প্রশ্নটি আমাকে করা হয়েছিলো টিভিতে, “ভারত কেন সৈন্য প্রত্যাহার করছে না, যখন এই প্রস্তাবনা নেয়া হয়েছে? এই ভারতই জাতিসংঘের নিকট শরনাপন্ন হয়েছিলো, যখন এই সংকট অবস্থার ষড়যন্ত্র শুরু হয়।

আপনারা জানেন, ভারতে ঠিক যেমন আমাদের নির্বাচন হয়েছিলো, ঠিক তেমনই বেশ দীর্ঘ একটা সময় পর পাকিস্তানেও নির্বাচন হয়। কারন জনগন সামরিক শাষনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো এবং সেখানে নির্বাচনের একটি সাধারন চাহিদা ছিলো। পাকিস্তানে, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি ভারতে আমার সংখ্যাগরিষ্ঠতার তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন। পূর্ব বাংলার প্রায় প্রতিটি নারী পুরুষ এই মানুষটিকে ভোট দিয়েছিলেন। ভারত মনে করে আপনি নির্বাচনে জয়ী হলে, আপনিই সরকার গঠন করবেন – এটাই যৌক্তিক। কিন্তু সেখানে তা ঘটে নাই। এই ছয় দফা কর্মসূচি কোন নতুন কর্মসূচি না, শেখ মুজিবর রহমান নির্বাচনের আগেই জনগনের সামনে এই কর্মসূচি পেশ করেছিলেন। এটি ছিলো নির্বাচন কর্মসুচির নির্বাচনী প্রচারণা। কারো যদি এ ক্ষেত্রে কোন প্রকারে আপত্তি থাকে, নেতা বা অন্য কারো, নির্বাচনের আগেই আপত্তি জানানোর সময়। তাদের বলা উচিত ছিলো যে, এই ছয় দফার ভিত্তিতে তারা নির্বাচন করবে না। কিন্ত্ কেউ কোন কিছুই বলে নাই। বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচন জেতার পর এটা ঘটল। এর মানে হলো আরও বেশী শায়ত্বশাষন আমরা দিতে প্রস্তুত। আলোচনা শুরু হল। আমরা ভেবেছিলাম, পূর্ব বাংলার মানুষেরা ভেবেছিলো, আপোষে আসার এটাই ছিলো একমাত্র সঠিক উপায়; কিন্তু এই সময় গুলো ব্যাবহৃত হয়েছিলো আরো বেশি সৈন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সমুদ্র পথে নিয়ে আসার জন্য, এবং যখন তারা মনে করলো জনগণকে মোকাবিলা করার জন্য তাদের যথেষ্ট সৈন্য এসেছে, তখন ২৪শে মার্চে আমি পূর্ব পাকিস্তানের এক নেতা – যদিও তিনি মিটিং রুমে না থাকলেও ঐ স্থানেই ছিলেন – তিনি বললেন যে তিনি মনে করেছিলেন, সব কিছু ঠিক মতই চলছে এবং তারা একটি সমাধানের দিকে যাচ্ছেন।

এর পরের দিনই সন্ত্রাস এবং গনহত্যার রাজত্ব কায়েম হয় যার পরিমাণ ছিল মাত্রা ছাড়া। এর ফলাফল হচ্ছে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু যার পরিমাণ ৯০ লক্ষেরও অধিক, যা বেলজিয়াম বা অস্ট্রিয়ার মোট জনসংখ্যার সমান – যারা এখন ক্যাম্পে সর্বোচ্চ দুর্ভোগ আর দূর্দশা নিয়ে ভারতের মাটিতে অবস্থান করছে।

এখন, একটি সমৃদ্ধশালী দেশেও যদি হঠাৎ করে ৯০ লক্ষ মানুষ প্রবেশ করে তাহলে তারাও পুরো পরিস্থিতিকে সামাল দিতে পারবে না। ভারত হচ্ছে দরিদ্রতম দেশ গুলোর মধ্যে অন্যতম যার সম্পদ খুবই সীমিত এবং এই মুহুর্তে আমাদের দেশে আরও ৯০ লক্ষ মানুষ এসেছে। আপনারা কল্পনা করতে পারেন এটি প্রশাষন, সম্পদ ও অর্থের উপর প্রভাব ফেলবে। বেশির ভাগ শরনার্থী এসেছে ভারতের পূর্ব প্রদেশের ৪টি রাজ্য থেকে, এবং এর মধ্যে একটি হচ্ছে ত্রিপুরা যেখানে একজন অতিরিক্ত মানুষকে রাখার জন্যও জায়গা নেই। তারা থাকছে স্কুল কলেজ, পার্ক এবং সম্ভাব্য সব পাবলিক আবাসনগুলোতে। শুরুতে সবাই খুব সহমর্মী ছিলো। এখন, বাবা মায়েদের বক্তব্য, আমরাও সমব্যাথী কিন্তু আমাদের ছেলে মেয়েদের কি হবে? স্কুল গুলো কবে খুলবে? তারা কি পড়াশুনা এক বছর বাদ দিবে? তাই, এই সব রাজ্য গুলোতে সকল প্রকার প্রশাষনিক কাজ কর্ম স্থবির হয়ে আছে। প্রত্যেক কর্মচারী এখন ক্যাম্প দেখা শোনায় ব্যাস্ত।

অর্থনৈতিক চাপ ছিলো ভয়ঙ্কর, প্রশাষনিক সমস্যাও ছিলো, কিন্তু যে রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা তৈরী হয়েছে তা আরো বেশি। আমাদের সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন আছে। তাদের একটি নির্দিষ্ট রেট আছে। এখন, আমরা শরনার্থীদের ক্যাম্পে রাখার চেষ্টা করেও পারছি না। কিন্তু কারন তাদের সংখ্যা এত বেশি এবং বেশির ভাগই ক্যাম্পে না এসে অত্যন্ত কম রেটে পরিসেবা দেয়। এখন সেখানেও ঝামেলা; কারন শ্রমিক ইউনিয়ন বলে, “এটা আমাদের রেট এবং আপনাকে চাকরী দেয়া সম্ভব না”। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে সুযোগ নেবার মতো লোক ও আমাদের আছে এবং এর কারনে আমাদের বেশ সামাজিক দুঃশ্চিন্তা ও আছে। আমি শুধুমাত্র বোঝানোর জন্য একটা উদাহরন দিলাম যাতে বোঝাই যায় এটা ভারতের স্থিতীশীলতার উপর হুমকি। এই শরনার্থীদের মধ্যে অনেকেই আছে যারা সত্যিকারের শরনার্থী নয়। আমাদের কোন উপায় নেই তাদের কে রাখার। আমরা অনেক অন্তর্ঘাতের স্বীকার হচ্ছি, ট্রেন উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, ছিন্ন ভিন্ন অঙ্গ প্রতঙ্গ পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন জায়গায় এবং ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মাঝে বিভিন্ন ধরণের গুজব ছড়িয়ে উত্তেজনার সৃষ্টি করা হচ্ছে।

শরনার্থীদের সংখ্যা নিয়ে পাকিস্তানীরা প্রশ্ন তুলেছিল, আমরা বলেছিলাম ৯০ লক্ষেরও বেশি। তারা যে সংখ্যাটা দিয়েছিল, যেটা ছিলো ২৫ থেকে ৩০ লক্ষের মত। এখন, তাদের এই তর্কের পেছনে কিছু যুক্তিও আছে, কেননা এই ২৫ থেকে ৩০ লক্ষের সংখ্যাটা ছিলো মুসলিম শরনার্থীদের। কিন্তু আমাদের কাছে শুধু মুসলমান শরনার্থীরাই ছিল না, ছিল হিন্ধু, খ্রীষ্টান এবং বৌদ্ধ শরনার্থীও। ত্রিপুরা, মেঘালয় এবং আসাম এই তিন প্রদেশের প্রত্যকেরই একটি করে রেশন কার্ড আছে, এর ভিত্তিতে তাদের কে সম্পূর্ন গননা করা হয়। এটা সত্যি যে, পশ্চিম বাংলা খুব একটা সুসংগঠিত না, কারন সেখানে বহু লোকের বাস। কিন্তু যখন এ প্রশ্নটি উঠে এসেছে, আমরা সমস্ত ক্যাম্প গুলোর হিসাব পুনরায় গননা করছি, এবং এটি প্রায় শেষের দিকে। এটি শুরু হয় আমার দেশ ত্যাগের কিছুদিন পর থেকেই। কম বা বেশিও হতে পারে। আমার মনে হয় না আমার দেয়া হিসাবের সাথে সেখানে খুব বড় ধরনের পার্থক্য থাকবে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, (১) জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকদের নিয়ে, এবং (২) সৈন্য প্রত্যাহার নিয়ে। যখন আমরা জাতিসংঘকে এ বিষয়ে দৃষ্টিপাত করতে বললাম, আমাদেরকে তখন বলা হলো এটি একটি আভ্যন্তরীন ব্যাপার, জাতিসংঘ এ ক্ষেত্রে কিছু করতে পারে না। সংকটের শুরুর দিকে একথা গুলো ঠিক ছিলো। আমরা তাদের শুরু থেকেই বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছিলাম যে, হতে পারে এটি আভ্যন্তরীন ব্যাপার, কিন্তু এর ফলাফল ভারতকে প্রভাবিত করে বিশাল সমস্যার সম্মুখীন করেছে, আর জাতিসংঘের এক্ষেত্রে নজর দেয়া উচিত। এখন জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দল আসতে চায়, কিন্তু তারা পূর্ব বাংলার সংকটের কারনগুলো সমাধান করতে নয়, উলটো দেখতে এসেছে কারা সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছে। তারা বলতে চায় যে শরনার্থীরা ফিরে যাক। আমরা শরনার্থীদের বলছি, ফিরে যান এবং যদি এই কথা বলতে আরও কেউ আসে সেটা তারা পারেন। আমরা তাদের স্বাগত জানাই। কিন্তু ভারতে একটি অবাধ মুক্ত সমাজব্যাবস্থা প্রচলিত। বেশির ভাগ সাংবাদিক যারা আপনাদের দেশ থেকে, কানাডা থেকে, আমেরিকা থেকে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে, এবং অন্যান্য দেশ থেকে পুর্ব পাকিস্তান, পশ্চিম পাকিস্তান দুই অঞ্চলেই গেছে, তারা অবাধে রিপোর্ট করছে, কুটনৈতিক সৈন্যবাহিনী ইচ্ছে মতো যেখানে খুশী সেখানে যেঁতে পারে। যে কোন প্রতিনিধি দল আমেরিকা, লাতিন আমেরিকা, উত্তর আমেরিকা, জাপান, নিউজল্যান্ড এবং ইউরোপী স্ক্যান্ডেনেভিয়ান বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছিলেন সেখানে। তারা স্বাধীনভাবে শরনার্থি ক্যাম্পে যাওয়া, রিপোর্ট করা ও তাদের সাথে শরনার্থীদের সাথে কথা বলতে পেরেছেন। তাই এটা কোন বড় ধরনের পার্থক্য তৈরী করবে না। এমনকি জাতিসংঘ হাই কমিশনে আরো ১০ জন প্রতনিধিও আমাদের এখানে আছে। তাই আরও প্রতিনিধি আসাটা কোন সমস্যা নয়। সেখানে আরো কিছু আন্তর্জাতিক সংগঠন, যেমন কারিতাস (CARITAS ), ইউনিসেফ UNICEF, কেয়ার (CARE), ওয়ার-অন –ওয়ান্ট (WAR-ON-WANT), ওক্সফ্যাম (OXFAM) এবং আরো অন্যান্য সংগঠন আছে। তাই তারা আসলে এমন কোন প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু আমাদের আপত্তি আছে। আমাদের আপত্তির কারন হলো এরা সামগ্রিক ভাবে সমস্যা মোকাবেলা করতে আসছে না। সমস্যার একটা অংশ দিয়ে মোকাবেলা করার চেষ্টা করছে। যখন আমরা শরনার্থীদের বললাম, যা আমি অনবরত বলেই যাচ্ছি যে, ভারত স্থায়ী বোঝা হিসেবে এইসব শরনার্থীদের রাখতে পারবে না, তাদের কে অবশ্যই পূর্ব বাংলায় ফিরে যেতে হবে, তারা কয়েক মাসের জন্য থাকতে পারে, যদি তাদের মধ্যে কোন এতিম ছেলে মেয়ে এবং গৃহহীন নারী থেকে থাকে তো তারা থাকতে পারে। কিন্তু আমরা লক্ষ লক্ষ শরনার্থিদেরকে এভাবে আমাদের দেশের থাকতে দিতে পারি না। আমরা এ ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তাদের উত্তর, আমরা ফিরে যেতে চাই, কিন্ত কীভাবে ফিরে যাবো যখন সেখানে গনহত্যা এখনো অব্যাহত। শুরুর দিকে শরনার্থির সংখ্যা ছিলো ৩০ থকে ৪০ হাজার, এর পর এর সংখ্যা বেড়ে গিয়ে দাড়িয়েছে ৬২ হাজারেরও অধিক। এখন আমাকে বলা হচ্ছে এদের প্রবেশের হার নাকি এখন কিছুটা কমে এসেছে, কিন্তু এখনো তা ১৬ থেকে ২০ হাজারের মতো। কিন্তু এখনো অনেক মানুষই আসছে যাদের সেই একই বর্বরতা, ভয়, হত্যা, ধর্ষনের কাহিনী। আমরা কীভাবে তাদের কিভাবে বলতে পারি যে ফিরে যাও। এবং আমরা বললে কারাই বা শুনবে? প্রথমত, শর্ত হচ্ছে ওপারে যাবার জন্য শরনার্থীদের নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করা যাতে তারা মর্যাদা নিয়ে যেতে পারবে। এটাই আমরা বলেছিলাম জাতিসংঘের কাছে।

এবার সেনা সংক্রান্ত বিষয়ে বলছি। পাকিস্তানিরাই প্রথমে সীমান্তে তাদের সেনা মোতায়েন করে, তারা প্রথমে পুর্ব সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে, কেননা তারা প্যারা ফোর্সেস। আমাদের তাদের সাথে চুক্তি আছে, তারা সামরিক সৈন্যবাহিনী হতে পারবে না, শুধু মাত্র আধা সামরিক – যাদের আমরা ইস্ট বেঙ্গল রাইফেলস – ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং আমাদের দিকে আমরা যাকে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বলি। তাদের এই রেজিমেন্ট এবং রাইফেলসের লোকেরা মার্চেই পাকিস্তানের চাকরী ছেড়ে দিয়েছে। যখনই এই সব ঘটনা শুরু হয়, তারা পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদান করে। তাই তাদের সীমান্ত অরক্ষিত অবস্থায় থেকে যায়। হয় তারা ছেড়ে আসতো অথবা তারা সীমান্তের চেক পোষ্টের এই লোকগুলোকে বিশ্বাস করতে পারে নাই। তারা তাই সীমান্তে তাদের সৈন্য নিয়ে আসে। কিছু সময় পর আমরাও আমাদের সৈন্য সরাতে বাধ্য হই। পশ্চিম ভাগেও কোন সমস্যা ছিলো না, যেমন কাশ্মীর, পাঞ্জাব, রাজস্থান, কিন্তু একদিন তারাও তাদের সৈন্য সেখান থেকে সরিয়ে নিয়েছে। এখন, আমাদের জাতিসংঘ বলছে, ‘ওহ এরা তো সামান্য ব্যায়াম প্রশিক্ষনের জন্য”। অবশ্যই, এটা এমন কথা না যা আমরা বিশ্বাস করতে পারি। অথচ, আমরা এক সপ্তাহের বেশি সময় কোন ব্যাবস্থা নেই নাই। কিন্তু একেবারে শেষ মুহুর্তে গিয়ে আমরা দেখতে পাই যে তাদের আসলে সৈন্য সরিয়ে নেবার কোন ইচ্ছাই ছিল না। আমরা সীমান্তে সৈন্য সরিয়ে আনতে বাধ্য হই।

এখন, প্রত্যাহারের মানে কি? লোকে বলে, যদিও এটা তাদের ভুল ছিলো, সেক্ষেত্রে সৈন্য প্রত্যাহারে কি ক্ষতিই বা ছিলো? ? ভালো, প্রশ্ন হচ্ছে, তাদের সেনানিবাস ঠিক সীমান্তের কাছেই। কিন্তু আমাদের তো আর না, আমাদের টা ছিলো বেশ দূরে এবং আমরা যদি সৈন্য সরিয়েও নেই, আমাদের পক্ষে কোন ভাবেই দেশকে সঠিক ভাবে প্রতিরক্ষা করা সম্ভব হবে না, যদি তারা তাদের মন পরিবর্তন করে ফেলে। এবং আমাদের কাছে তাদের কে বিশ্বাস করার মতো কোন কারন ও নেই। তারা আমাদের কে দুইবার আক্রমন করেছে। এবং প্রতিবার তারা বলেছে আমরা কোন অনুপ্রবেশকারীকে পাঠাইনি। এবং পরে তারা পাব্লিক ফোরামে যেমন নিরাপত্তা পরিষদে বা অন্য কোথাও তারা এসব বলেছে। এটাই হচ্ছে ইতিহাস আর এটাই তার পটভুমি। ভারত গভীর ভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ শান্তির জন্য এবং ভারত সার্বিক নিরস্ত্রীকরনে বিশ্বাস করে। সরকারপ্রধান হিসাবে আমি মনে করি যুদ্ধ কখনো সমস্যার সমাধান করতে পারে না। কিন্তু এই বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা আমাদের সীমান্ত অরক্ষিত অবস্থায় ফেলেও রাখতে পারি না। বিশেষ করে, পাকিস্তান থেকে যেসব খবর আসছে যে, পূর্ব বাংলা তারা প্রায় হারাতে বসেছে। তো তারা কেন পশ্চিমের কিছু অংশ দখল করবে না? এই হচ্ছে অবস্থা, যার সম্মুক্ষীন হচ্ছি আমরা। দূর থেকে দেখলে ভারতকে মনে হবে, “আচ্ছা, এখানে এমন কোন প্রভাব পরে নাই”। কিন্তু সেসকল মানুষেরা যারা সীমান্ত এলাকায় বসবাস করে, এবং এমন আছে যে থাকার ঘর আমাদের অংশে আর রান্নাঘর পূর্ব পাকিস্তানে অথবা তার উল্টোটা – এইসব মানুষের জন্য সীমান্ত পরিস্থিতি খুব খারাপ। আমাদের কোন প্রাকৃতিক সীমানা ছিল না, ছিলো না কোন নদী অথবা রাস্তা অথবা অন্য কিছু। যেসব লোকেরা সীমান্তে বসবাস করেন, তাদের জন্য এটা বেশ বড় সমস্যা। তারা রক্ষিত না অরক্ষিত? তাদের রক্ষার দায় সরকারের উপর নির্ভর করবে কিনা?

কিছুদিন আগে আমাকে কাশ্মীর নিয়ে আরেকটা প্রশ্ন করা হয়েছিলো। এখন কাশ্মীরের কি হবে? পাকিস্তান অপপ্রচার চালাচ্ছে যে, কাশ্মীর হচ্ছে আদি পাকিস্তান, এবং আমি ভীত এই কারনে কিছু মানুষ তাদের এই অপপ্রচারে সহায়তা করছে। ১৯৬৫ সালে তারা অনেক প্রশিক্ষিত অনুপ্রবেশকারীদের পাঠায়। তারা ভেবেছিলো এদেরকে স্থানীয়রা স্বাগত জানাবে। কিন্তু তারা মোটেও স্বাগত জানায়নি। স্থানীয় লোকেরাই আমাদের সর্ব প্রথম খবর দিয়েছিলো, কারন, এটা যখন হয়, সে সময় ওইখাঁনে আমাদের তেমন বাহিনী ও ছিল না, এমনকি রাজধানী শ্রীনগরেও আমাদের পর্যাপ্ত পুলিশ বাহিনী ছিল। এটাই ছিলো সবচেয়ে বড় দূর্বলতা। এটাই ছিলো তার কারন, ইতোমধ্যে ১৯৬২ সালেও, আমাদের অন্য আরেক সীমান্তে আক্রমন হয়েছিলো, এবং সেখানে আমাদের সেনাবাহিনী ছিলো। কিন্তু ১৯৬৫ সালে যে আক্রমনটি সংঘঠিত হয়, তখন স্থানীয় লোকদের ঐক্য ছিলো। তারা শুধু আমাদের খবরা-খবরই দিচ্ছিল না, সামনের দিকে প্রতিরক্ষা লাইন তৈরী করেছিলো যতক্ষন না পর্যন্ত সৈন্য বাহিনী এসে তাদের দেশকে রক্ষা করে। ঠিক এভাবেই, আমরা শুধু পাকিস্তানীদের কাশ্মীরে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলাম। এ অঞ্চলের বিশাল একটা অংশ, যার বেশ কিছু সুবিধাজনক পয়েন্ট আছে, যা পূর্বে পাকিস্তানের দখলে ছিলো সেগুলো নিয়ে আমরা নেই। এখন, কাশ্মীর অনেক বছর ধরে শান্তিতেই আছে। সেখানে ভিন্নমত ও আছে, আমি বলছি না যে নেই, কার্যত সব দেশেই এমন আছে। এমন কোন দেশ খুজে পাওয়া দুষ্কর যেখানে ভিন্নমতের মানুষ নেই। পরিস্থিতি বিচারের জন্য সেখানে শান্তি আছে কি নেই সেখানে সরকার স্বাভাবিক ভাবেই যাতায়াত করছে, কাশ্মীরে শিক্ষার সম্প্রসারন ঘটছে, কৃষি ব্যাবস্থের উন্নতি, শিল্পের অগ্রগতি ঘটছে। প্রত্যেকেই স্বাধীন ভাবে সেখানে যেঁতে পারে। এটা সত্যি যে সম্প্রতি আমরা কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছি তাদের দু একজন নেতার উপর। তারা সব জায়গায় যেঁতে পারবে, কিন্তু কাশ্মীরে প্রবেশ করতে পারবে না, কারন সেখানে সব কিছু শান্তিপূর্ন আছে এবং আমরা চিন্তা করেছিলাম, এই মুহুর্তে কারো জন্য ঝামেলা সৃষ্টি করা মোটেও দেশের স্বার্থে নয়।

সুতরাং আমাদের লুকানোর কিছুই নেই এবং আমি আগেই বলেছি, এই ঝামেলা গুলোকে প্ররোচিত করবার মতো মানুষ আমরা না, আমরা করবো ও না, অবশ্যই না। কিন্তু যদি মনে করে থাকেন যে, এই বর্তমান অবস্থা স্থায়ী হবে, তবে তা অবাস্তব। যদি মনে করেন যে, পূর্ব বাঙ্গালীদের অন্তরে এই তিক্ততা ও ঘৃনা কোন প্রকার ইতিবাচক কার্যকলাপ ছাড়াই চলে যাবে, এটা সত্যি অবাস্তব। একজন রাজনীতিবিদ হিসাবে, বর্তমান পরিস্থিতির বাস্তবতার সাথে মুখোমুখী হতেই হবে। প্রশ্ন এটা নয় যে, আমি কি মনে করি বা আমি কি চাই? এটি একটি অস্তিত্বের প্রশ্ন এবং পূর্ব বাংলার মানুষ তাদের নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই নির্ধারন করবে। তারা আমাদের কাছ থেকে উপদেশ চায় না, এবং আমি যদি দিয়েও থাকি তারা সেটা নিবে না। আজ তারা জাতীয়তাবাদের চেতনায় উজ্জীবিত। এটা ভালোও হতে পারে, আবার খারাপও হতে পারে, সেটা পরের ব্যাপার। কিন্ত এটা এমন এক অবস্থা যা কেউ উপেক্ষা করতে পারে না। আর এ কারনেই আমরা চাই, বিশ্বের উচিত এ ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে চেষ্টা করে দেখা যাতে একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তিতে পৌছানো যায় যেটা স্থায়ী হবে, এবং কোন কিছুই স্থায়ী হবে না যদি পূর্ব বাংলার মানুষ এবং তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা তা গ্রহনযোগ্য না হয়।

এখন, পাকিস্তান সরকার ঘোষনা করেছে যে, তারা পুনঃনির্বাচন করবে। আমরা সত্যিই বুঝতে পারছি না। যারা নির্বাচনে জয়ী হয়েছে তারা এখানে, তারা জীবিত। আপনি হঠাৎ করে এখন বলতে পারেন না, এই আসন গুলো খালি। তারা শুধু ‘এই আসন গুলো শুন্য’ এ কথা বলছে না, ৫৫ জন ব্যাক্তিকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ওই শুন্য আসনে নির্বাচিত করেছে। এটি একটি অস্বাভাবিক অবস্থা, এবং আমার মনে হয় না গনতন্ত্রে এবং স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে এমন কোন লোক এই পরিস্থিতিকে মেনে নিবে।

উপরন্তু ভারতের উপর চাপ, বিশেষ করে অর্থনৈতিক চাপ অস্বাভাবিক। কিছুক্ষন আগেই আমি আরেকজন শ্রোতাকে বলছিলাম, যখন আপনি অভাবী হবেন, আপনি জানেন যে আপনি আরো দরিদ্রতর হয়ে যেতে পারেন। যদি পর্যাপ্ত খাবার না থাকে, তবুও হয়ত সর্বদাই শেয়ার করতে চাইবে। এটাই আমরা আমাদের দেশে দেখতে পাই, এবং আমাদের অভিজ্ঞতা আছে, যেখানে খরা হয়েছে, অথবা যেখানে যুদ্ধ হয়েছে, সেখানে এই গরীব লোকগুলোই সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে। আজকে, যদিও এই চাপ অস্বাভাবিক, এর জন্য আমাদের বিশাল মুল্য দিতে হবে, এটা শুধু অর্থেই নয়, উন্নয়নের জন্য, মানুষকে দেয়া প্রতিশ্রুতির মুল্য দিতে হবে, কর্মসংস্থান কর্মসূচি সহ, প্রত্যেক কর্মসূচীর মুল্য দিতে হবে। আমরা চেষ্টা করছি এই কর্মসুচী গুলো বাদ না দিতে, কিন্তু আমি জানি না কীভাবে এটা অটুট থাকবে, সবকিছুকেই কাট ছাট করতে হবে। ইতোমধ্যে আমাদের উপর বেশ বড় কর আরোপ করা হয়েছে, এবং ঠিক কিছু দিন আগেও আমাদের কে অতিরিক্ত কর আরোপ করতে হয়েছে সম্ভাব্য প্রত্যেকটি জিনিসের উপর যতটা আমদের মনে হয়েছে। এবং আমরা সবাই বসে ভেবেছি সম্ভাব্য করের আওতায় আর কি হতে পারে এবং তাদের কর আওতাভুক্ত করেছি। তো আমাদের উপর এই বিরাট বোঝা আছে, কিন্তু আমার জনগনের প্রতি আস্থা আছে। তারা দেখিয়েছে যে, তাদের যে কোন প্রকার চাপ সহ্য করবার, যে কোন প্রকার দুর্ভোগ সহ্য করার অথবা আত্নত্যাগের ক্ষমতা আছে। এবং আজকে যদি এটা আমাদের একতার জন্য করতে হয়, স্থিতিশীল অবস্থার জন্য করতে হয়, স্বাধীনতার জন্য করতে হয়, আমি জানি ভারতের জনগন, এবং এমনকি রাজনৈতিক দলগুলো যারা পুরোপুরি আমার বিপক্ষে, আমি জানি এই প্রশ্নে, আমরা সবাই এক। এবং আমাদের সেই চাপ সহ্য করার মত সংকল্প আছে। এই অর্থনৈতিক চাপ অথবা আর যে চাপই যত বেশিই হোক না কেন আমরা তলিয়ে যাবো না।

কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা, স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য যা যা পদক্ষের নেয়া দরকার তা আমদের নিতে হতে পারে, এবং আমি মনে করি, এটা শুধু ভারতের স্বার্থেই নয়, এখানে পাকিস্তানেরও নিজ স্বার্থ আছে। ভারত অস্থির থাকলে পাকিস্তান টিকে থাকতে পারবে না। যদি পাকিস্তান কিছু মুহুর্তের জন্য অস্থিতিশীল হয়েও পড়ে এবং ভারত স্থির থাকে, তবে পাকিস্তান তার স্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে ফিরে আসতে পারে। কিন্তু উপমহাদেশের এই বিশাল অংশে একটা সমস্যা আছে যে কেউই পাকিস্তান বা অন্য কোন ছোট দেশ কে রক্ষা করতে পারবে না। এবং, আমার মনে হয়, যদি ভারতে অস্থিরতা বিরাজ করে, এটার একটা প্রভাব সমগ্র এশিয়াতে পড়বে এবং এমনকি বিশ্বের অন্যান্য অংশেও পড়বে।

আজকে মানুষ যতটা না বুঝতে পারছে, তার চাইতে অনেক বেশি ঝুকি আমরা উপলব্ধি করতে পারছি; এবং আমি আজ সরকারে পক্ষ থেকে বা অন্য কোন দেশের হয়ে কিছু বলতে আসি নি। এবং বিদ্যমান এই অবস্থার কেবল মাত্র মুল্যায়ন করতে এসেছি। এবং এরপর এইসব দেশ, এই সরকার অথবা জনগনের জন্য সিদ্ধান্ত নিতে, এই পরিস্থিতিতে তাদের ঠিক কি করা উচিত, তারা কি যাহায্য করবে কি করবে না সেটা দেখার বিষয়। সাধারনত, সবাই সহানুভুতিকে, বন্ধুত্বকে, সমর্থন কে স্বাগত জানায়, কিন্তু আমরা জানি যে, জীবনের চুড়ান্ত বিশ্লেষনে, সবাই- এমনকি একজন পিতা/মাতা, একজন সন্তান, অথবা একজন ভাই অথবা একজন বোন, প্রত্যেকেই একা, প্রত্যেকটি দেশই একা, এবং ভারতকে তার নিজের পায়ে দাঁড়ানো শিখতে হবে; সে তার নিজের পায়ে দাড়াবে এবং নিজস্ব সমস্যার সঙ্গে নিজেই মোকাবেলা করবে।

নিচে প্রদত্ত শ্রোতাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত কিছু প্রশ্ন এবং প্রধানমন্ত্রীর জবাব

প্রশ্নঃ আপনি পূর্ব পাকিস্তানের মানবতা নিয়ে বলেছেন। আপনি কীভাবে ফারাক্কা বাধ নির্মান সম্পর্কে ব্যাখ্যা করবেন, যা অবশ্যই সেখানে কৃষি ও অর্থনীতি ধ্বংস করতে যাচ্ছে?
প্রধানমন্ত্রীঃ আমি জানি না, মেয়েটি ঐ জায়াগাটার ভৌগলিক অবস্থান সম্পর্কে জানেন কিনা? পুর্ব বাংলার দূর্ভোগ পানি স্বল্পতা নয়, বরং অতিরিক্ত পানি… ( করতালি)। এই বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চলছে। দূর্ভাগ্যবশতঃ পাকিস্তান এখন এটিকে রাজনৈতিক প্রশ্নে তৈরী করার চেষ্টা করছে, যদিও এটা তা না। এটা কোন ভাবেই পূর্ব পাকিস্তান বা পুর্ব বাংলাকে ক্ষতি করার কোন পন্থা নয়।

প্রশ্নঃ মিসেস গান্ধী, আমি আপনাকে বলতে চাই, আমি আন্তর্জাতিক মহিলা কাউন্সিলের মাইগ্রেশন কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট। আপনার দেশের উদ্বাস্তুদের নিয়ে এই বিশাল সমস্যা নিয়ে আমস্টারডামে আমাদের মিটিং এ আমরা একটি সমাধানে এসেছি, যা ছিলো ৬০ সদস্যের কাউন্সিলকে আহবান করা যাতে তারা আরো বেশি সমস্যাটি নিয়ে আরো মনোযোগী হয় এবং জাতিসংঘকে বিশ্বের সংখালঘুদের প্রতি দেখাশোনার জন্য আহবান জানানো হয়।
প্রধানমন্ত্রীঃ আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

প্রশ্নঃ ম্যাডাম, ইতিমধ্যে আপনার বক্তব্যে বলেছেন যে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ জাতীয়তাবোধে অনুপ্রানিত। আপনার কি মনে হয় না, পশ্চিম বঙ্গের মানুষদের মধ্যে এই জাতীয়তা বোধের এই উদ্দীপনা অনুপস্থিত? কারণ বাঙ্গালীরা একটি জাতি, সেহেতু, তাদের একটি রাষ্ট্র থাকা উচিত? আপনি পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের কে একটি রাষ্ট্র গঠন থেকে কীভাবে প্রতিরোধ করবেন, তারাও তো ঠিক একই রকম বাঙালী?

প্রধানমন্ত্রীঃ এটা খুব ভাল একটা প্রশ্ন; এটা জিজ্ঞাসা করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমার আসলে এটা আমার বক্তৃতায় উপস্থাপন করা উচিত ছিল। আচ্ছা, প্রথম উত্তর হল, পশ্চিমবঙ্গকে বাকি ভারত থেকে আলাদা করার কোন অভিপ্রায় নেই। দ্বিতীয়ত, প্রশ্ন শুধু এটা না যে পশ্চিম বঙ্গ কি করতে চায়, বরং পুর্ব বাংলায় বসবাসকারী লোকেরা পশ্চিম বঙ্গ তাদের সাথে যোগ দিক এটা চায় কিনা। অবশ্যই এই পৃথিবীতে কোন কিছুই অসম্ভব না এবং এটা একটা সুদুর সম্ভাবনা। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না যে এরকম কিছু ঘটবে, কারন শিল্পের দিক দিয়ে হোক, শিক্ষার দিক দিয়ে হোক অথবা অন্য যে কোন দিক দিয়ে হোক, পশ্চিমবঙ্গ পুর্ববাংলা থেকে অনেক উন্নত। আমরা আমাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে ভিয়েতনামে কি হয়েছিল, তারা তাদের চেয়ে একটি বড় সত্ত্বাকে সংযুক্ত করতে চাইবেনা যে তাদের উপর কর্তৃত্ব করবে।

প্রশ্নঃ আপনি শেখ মুজিবুর রহমানের ৬-দফা কর্মসুচি সম্পর্কে কিছু উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু আমার মনে হয় আপনার শ্রোতাদের জানান উচিত যে, ৬ দফায় দেশ বিভাগের কথা উল্লেখ নেই। আর এটা স্ট্রাউসের চ্যান্সেলর নির্বাচনে জয়ী হবার এবং সে জার্মানি থেকে বাভারিয়াকে আলাদ করতে চাইবার মত বিষয় হবে। আমার মনে হয় না জার্মানীর জনগণ সেটা মানবে।
প্রধান মন্ত্রীঃ আমার মনে হয় আমি এইটা পরিষ্কারভাবে বলেছি যে, ৬-দফা নির্বাচনের আগে ঘোষণা করা হয়েছিল। সেগুলো মানাও হয়েছিল, সম্ভবত, কারন তা না হলে কেনো নির্বাচন হলো? এটা ছিল পুর্ব বাংলার জনগনের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য প্রাথমিক কর্মসূচি এবং এবং এটা শুধু পুর্ব বাংলার জনগণের জন্য নয় বরং পশ্চিম পাকিস্তানে যেসকল লোক শেখ মুজিবুর রাহমানকে ভোট দিয়েছে তাদের জন্যও।

প্রশ্নঃ ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তি ও ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে বৈরিতার অবসান সংক্রান্ত ব্যাপারে কিছু বলুন।
প্রধান মন্ত্রীঃ এই ব্যাপারটার সাথে আমাদের ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তির কোন সম্পর্ক নেই। আমরা বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে বৈরিতার অবসানকে স্বাগত জানাই এবং আমরা আশা করব যে, যেখানেই এরকম দ্বন্দ আছে সেই সব রাষ্ট্রের মধ্যে সকল বৈরিতার অবসান ঘটবে। যতদূর ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তির প্রশ্ন আসে, এটা তাই যা এতে বলা আছে, এর নামেই বলা আছে, “শান্তি, বন্ধুত্ব এবং সহযোগিতার চুক্তি”।

বহু লোক যারা কখনই জোট নিরপেক্ষতাকে সমর্থন করেনি, তারা এখন বলার চেষ্টা করছে যে, এই চুক্তি জোট নিরপেক্ষতার বিপক্ষে যাচ্ছে, ভারত এখন আর জোট নিরপেক্ষ নয় এবং আরো অনেক কিছু। স্বাভাবিকভাবেই আমরা এইসব যুক্তিতে একেবারেই প্রভাবিত নই কারন আমরা জানি যে আমাদের নীতি কি এবং সেটা অপরিবর্তিত রাখতে আমরা বদ্ধপরিকর।

প্রশ্নঃ মাননীয় প্রধান মন্ত্রী, শ্রীমতী গান্ধী, আমার প্রশ্ন প্রায় আগের প্রশ্নের মতই, আমি শুধু একটি বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাই। এটা সত্য যে আমাদের সভিয়েত ইউনিয়নের সাথে চুক্তির উদ্দেশ্য আমাদের জোট নিরপেক্ষতার নীতিকে প্রভাবিত করা নয়; কিন্তু আমার মনে হয় যে বিশ্বে আমাদের অংশে রাশিয়ার প্রভাব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমি যত দূর জানি, সোভিয়েত নৌবাহিনীর অন্তত কিছু অংশ, আমাদের কিছু বন্দরের দিকে অগ্রসর হয়েছে। এবং দীর্ঘ সময়ে রাশিয়ার ক্ষমতা এবং শক্তি এত বড় যে, আমি বলতে চাচ্ছি যে, আমাদের দীর্ঘকালের সম্পর্কের সময়কালে ভারত কি সত্যিই অক্ষুন্ন এবং জোট নিরপেক্ষ থাকতে পারবে?
প্রধানমন্ত্রীঃ এটা নিঃসন্দেহে একটি অসাধারন প্রশ্ন, যদি আমি তাই বলি। সম্ভবত তিনি বেশ কিছুদিন ভারতের বাইরে ছিলেন এবং তিনি জানেন না যে আমরা কি অনুভব করি। সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি ভারত মহাসাগরে থাকে তো তাতে কি হয়েছে, অন্যান্য নৌ বাহিনীরাও তো আছে। তিনি তো আর অন্য কোন নৌ বাহিনীর আমাদেরকে প্রভাবিত করার কথা বলেননি। তাহলে সোভিয়েত কেনো অন্যদের থেকে বেশি প্রভাব ফেলবে? পৃথিবীর প্রত্যেকটা দেশ, সেটা ছোট হোক আর বড় তা অন্য দেশকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করবে। প্রশ্ন হচ্ছে আমরা সেই চাপ প্রতিরোধ করতে পারব কিনা? আমরা সবসময়ই সেটা করেছি। আমরা আমাদের স্বাধীনতার জন্য লড়েছি। আমরা এটার জন্য ভিক্ষা চাইনি। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে এটার জন্য লড়াই করেছি (দীর্ঘ হাততালি)।

শিরোনাম
সূত্র তারিখ
৬৯। আত্মরক্ষার প্রয়োজনে ভারতীয় সেনাবাহিনী সীমান্ত অতিক্রম করবেঃ সরকারী মুখপাত্রের ঘোষণা দৈনিক যুগান্তর ২৫ নভেম্বর, ১৯৭১

Vincent Biswas
<১২, ৬৯, ১৭৩-১৭৪>

যশোর সীমান্তে ১৩ খানি পাক ট্যাঙ্ক ধ্বংসঃ সরকারী মুখপাত্রের ঘোষণা
আত্মরক্ষায় ভারতীয় সৈন্য সীমান্ত অতিক্রম করবে
(দিল্লী অফিস থেকে)

২৪শে নভেম্বর- আজ এখানে একজন সরকারী মুখপাত্র বলেন যে, সৈন্যবাহিনীর প্রতি পূর্বনির্দেশের পরিবর্তন করা হয়েছে। আত্মরক্ষার জন্য সৈন্যবাহিনীকে সীমান্ত অতিক্রমের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

সোমবার পশ্চিমবঙ্গ-যশোর সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় সৈন্যবাহিনী কর্তৃক ১৩টি পাকিস্তানী ‘সাফে’ ট্যাঙ্ক ধ্বংস করার কারণ বিশ্লেষণ করে এই মুখপাত্রটি বলেন, পরিস্থিতিকে আরও সঙ্কটজনক করে তোলা অথবা সংঘর্ষ শুরু করা আমাদের কোন সময়েই ইচ্ছা নয়। কিন্তু পাকিস্তানী বাহিনী আক্রমণাত্মক কার্যকলাপ জোরদার করায় পশ্চিমাঞ্চলের চেয়ে পূর্বাঞ্চলে পরিস্থিতি গুরুতর আকার ধারণ করেছে। পাক বাহিনীর এই ধরনের জঙ্গীবাজী বৃদ্ধি পাওয়ার যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে তারই ফলে সরকার নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি প্রদত্ত পূর্বনির্দেশের কিছু পরিবর্তন করেছেন।

গত রবিবার বয়রার কাছে পাকিস্তানী বাহিনী ট্যাঙ্ক ও কামান নিয়ে বিপজ্জনকভাবে সীমান্তের দিকে অগ্রসর হলে ভারতীয় প্রতিরক্ষা ঘাঁটি বিপন্ন হওয়ায় নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি পূর্বনির্দেশ পরিবর্তন প্রয়োজন হয়ে পড়ে। স্পষ্টতই পাক বাহিনীর এই অভিযান প্রতিরোধ করার জন্যই ভারতীয় বাহিনীকে ট্যাঙ্ক নিয়োগ করতে হয়। এই সংঘর্ষের ফলে ১৩টি পাকিস্তানী সাফে ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয়েছে। ভারতের কোন ট্যাঙ্কের ক্ষতি হয়নি এবং ভারতীয় যে ন্যাট বিমানগুলি পাকিস্তানী স্যাবর জেট বিমান ভূপাতিত করে সে বিমানগুলিরও কোন ক্ষতি হয়নি।

এই মুখপাত্রটি বলেন, এই প্রথম ভারতীয় বাহিনীকে আত্মরক্ষায় সীমান্ত অতিক্রম করতে হয়। ভারতীয় ট্যাঙ্কগুলি তাদের কাজ শেষ করার পর সেদিনই ভারতীয় এলাকায় ফিরে আসে। তিনি আরও বলেন, ভবিষ্যতে যদি আবার এ রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তাহলে ভারতীয় বাহিনী অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। ভারতীয় ট্যাঙ্ক এবং বিমান ধ্বংস হয়েছে বলে পাকিস্তান যে দাবী করছে এই মুখপাত্রটি তা সুস্পষ্টভাবে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন সামান্য হয়ে থাকতে পারে।

এই মুখপাত্রটি বলেন, পশ্চিমাঞ্চলের চেয়ে নিশ্চিতভাবেই পূর্বাঞ্চলের পরিস্থিতি আরও গুরুতর। তবে পশ্চিমাঞ্চলে পাকিস্তানীরা সীমানা লঙ্ঘন করছে।

মুখপাত্রটি বলেন, ভূপাতিত তৃতীয় পাকিস্তানী স্যাবর জেট বিমানের পাইলটকে পাওয়া যায়নি। এই পাইলট পাকিস্তানী এলাকাতেও থাকতে পারে। সীমান্ত অতিক্রম না করার জন্য পূর্বে সৈন্য বাহিনীকে যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল তা পরিবর্তনের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এই মুখপাত্রটি বলেন, অপর পক্ষের সৈন্যরা যখন ট্যাঙ্ক নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে তখন স্বভাবতই এইসব নির্দেশের কিছু পরিবর্তন করতে হয়েছে। আমরা আমাদের লোকদের এগিয়ে গিয়ে এদের প্রতিরোধ করতে বলা ছাড়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ট্যাঙ্কগুলিকে অগ্রসর হতে দেখতে বলতে পারি না।

ভারতীয় ট্যাঙ্কগুলি কতখানি সীমান্ত অতিক্রম করেছিল এই প্রশ্নের উত্তরে মুখপাত্রটি বলেন- খুব সামান্য দূর। আর একটি প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কতদূর তারা যেতে পারবে তা নির্দিষ্ট করে কিছু বলা সম্ভব নয়। তবে তিনি মনে করেন না যে, এইরকম পরিস্থিতি উদ্ভব হলে যাতে মার্কিন সৈন্যরা কম্বোডিয়াতে যতটা ভেতরে ঢুকেছিল ভারতীয় সৈন্যদের পাকিস্তানের ততদূর ভেতরে প্রবেশ করতে হবে। আত্মরক্ষার জন্য সীমান্ত অতিক্রম করা যখন প্রয়োজন, স্থানীয় কমান্ডারই তা ঠিক করবেন।

এই মুখপাত্রটি বলেন, বাংলাদেশে কোন ভারতীয় সৈন্য নেই। এখন যে যুদ্ধ হচ্ছে তা মুক্তিবাহিনী ও পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের মধ্যে।

মুখপাত্রটি বলেন, পাকিস্তানী সৈন্যরা আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে ভারতীয় এলাকার ওপর গোলাবর্ষণ করে চলেছে। গতকাল পাকিস্তানী সৈন্যরা কিষাণগঞ্জের পূর্বে এবং রাণাঘাটের দক্ষিণ-পূর্বে ভারতীয় ঘাঁটির ওপর গোলাবর্ষণ করে। ২২শে নভেম্বর মধ্য রাত্রে পতিরানের উত্তরে মাঝে মাঝে পাকিস্তানী সৈন্য ও ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মধ্যে গুলী বিনিময় হয়। গত ২২শে নভেম্বর শিকারপুরের বিপরীত দিকে অবস্থিত পাকিস্তানী সৈন্য লাইট মেশিনগান ও ক্ষুদ্রাস্ত্র থেকে গুলিবর্ষণ করে। সীমান্ত রক্ষী বাহিনী পাল্টা জবাব দেয়, পাকিস্তানী সৈন্যরা অপসারণ করে। ভারতীয় পক্ষে কেউ হতাহত হয়নি। একই দিনে রাণাঘাটের দক্ষিণ-পূর্বে পাকিস্তানী সৈন্য ও সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মধ্যে গুলি বিনিময় হয়। ২২শে নভেম্বর পাকিস্তানী সৈন্য গঙ্গারামপুরে এবং কালুরঘাটের নিকটবর্তী অঞ্চলের ওপরও গোলাবর্ষণ করে।

২২শে নভেম্বর আসামের করিমগঞ্জের দক্ষিণ-পশ্চিমে ভারতীয় পর্যবেক্ষক বিমান যখন ভারতীয় এলাকার মধ্যে ঘুরছিল তখন পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে। ভারতীয় বিমানের কোন ক্ষতি হয়নি। একই দিনে পাকিস্তানী সৈন্যরা করিমগঞ্জের উত্তরে একটি এলাকায় ভারতীয় টহলদারী সৈন্যদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। একজন সীমান্ত রক্ষী আহত হয়েছে। একুশে নভেম্বর পাকিস্তানী সৈন্যরা করিমগঞ্জের পশ্চিমে ভারতীয় ঘাঁটির ওপর গোলাবর্ষণ করে। সীমান্ত রক্ষী বাহিনী এই গোলাবর্ষণের পাল্টা জবাব দেয়। কেউ হতাহত হয়নি।

১৯শে নভেম্বর পাকিস্তানী নাশকদের পোঁতা দুটি বোমা বিস্ফোরণের ফলে কিষাণগঞ্জের প্রায় আটত্রিশ কিঃ মিটার উত্তর-পূর্বে ইসলামপুরে একটি স্কুলবাড়ী সৈন্যরা সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

২২শে নভেম্বর, পাকিস্তানী সৈন্যরা যুদ্ধবিরতি সীমারেখার ওপার থেকে গুরাইস-এর উত্তর-পূর্বে ভারতীয় টহলদারী সৈন্যদের ওপর লাইট মেশিনগান ও রাইফেলের গুলিবর্ষণ করে। একই দিনে ঐ এলাকার ওপর পাকিস্তানী সৈন্যরা সীমান্তের ওপার থেকে লাইট মেশিনগানের গুলিবর্ষণ করে।

রাজৌরী ও নওশেরা সেক্টরে পাকিস্তনী সৈন্যরা গত ২২শে নভেম্বর উড়ির দক্ষিণ-পশ্চিমে ও নওশেরার উত্তর-পশ্চিমে যুদ্ধবিরতি সীমারেখার ওপার থেকে গুলিবর্ষণ করে। নওশেরা এলাকায় একজন সীমান্ত রক্ষী আহত হয়েছে। কারমিলের উত্তর-পূর্বে এবং উড়ির দক্ষিণ-পূর্বে পাকিস্তানীরা নতুন বাংকার তৈরী করছে। রাষ্ট্রসংঘ পর্যবেক্ষকদের কাছে এইসব যুদ্ধ-বিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ করা হয়েছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৭০। মুজিবকে মুক্তি দিয়ে রাজনৈতিক সমাধানের পথে আসার জন্যে ইয়াহিয়ার প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহবান দৈনিক আনন্দবাজার ২৮ নভেম্বর ১৯৭১

Aparajita Neel
<১২, ৭০, ১৭৫>

মুজিবকে মুক্তি দিন, রাজনৈতিক সমাধানে আসুন
ইয়াহিয়ার উদ্যেশ্যে প্রধানমন্ত্রী
(রাজধানীর রাজনৈতিক সংবাদদাতা)

নয়াদিল্লী, ২৭ নভেম্বর – বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধানে আসুন এবং অবিলম্বে শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়ার জন্য ব্যাবস্থা নিন। পাক প্রেসিডেন্টকে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের অবস্থা ভারতের ওপর এক অসহনীয় ভার হয়ে রয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী এই আহবান বানী ভারতীয় হাই কমিশনার শ্রী অটলের মারফত মুখেই চালান করে দেওয়া হয়েছে। তিনি সম্প্রতি শলাপরামর্শের জন্য দিল্লীতে এসেছিলেন। শ্রী অটলের মারফত মুখেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া একটা ঈদের বানী পাঠিয়েছিলেন। শ্রীমতী গান্ধীর এই বানী তারই উত্তর।

জবাব দিতে গিয়ে শ্রীমতী গান্ধী পাক প্রেসিডেন্টের ঈদের স্বাগত বানীর প্রত্যুত্তরে পাল্টা অভিনন্দন জানিয়েছেন। একজন সরকারই মুখপাত্র বলেন, একথা সত্য নয় যে প্রধানমন্ত্রী ইয়াহিয়া খাঁর সঙ্গে অভিনন্দন বানী বিনিময় করেননি।

মুখপাত্রটি স্বীকার করেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন। এ ব্যাপারে মুখপাত্রটি জানান, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি পাক প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে রাজি, তবে বাংলাদেশ তাদের মধ্যে আলোচনার বিষয় হতে পারেনা।

বাংলাদেশের জনসাধারনকে তিনি কোন সমাধানে রাজি হয়ে যেতে বলতে পারেন না। কারণ এ ব্যাপারে তার কোন অধিকার নেই।

শিরোনাম
সূত্র তারিখ
৭১। “আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থে যা ভাল তাই করব”- দিল্লীতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ঘোষণা দি স্টেটসম্যান
২ ডিসেম্বর ১৯৭১

Fakhruzzaman Sayam
<১২, ৭১, ১৭৬-১৭৭>

আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থে যা ভাল তাই করবঃ মিসেস গান্ধী
নয়া দিল্লী, ২রা ডিসেম্বর

প্রধানমন্ত্রী, মিসেস ইন্দিরা গান্ধী, আজকে ঘোষণা দেন যে, ভারতকে কে আগ্রাসী রাষ্ট্র বলল এ নিয়ে ভারত মোটেও বিচলত নয় যখন ভারত কোন প্রকার আগ্রাসনই চালানো হয়নি, পিটিআই’এর প্রতিবেদন। লন্ডন হতে প্রকাশিত সংবাদপত্রে ব্রিটেন আবারও ভারতকে স্পষ্টভাবে আগ্রাসী রাষ্ট্র বলে উল্লেখ্য করে। মিসেস গান্ধী বলেনঃ “শেষ পাঁচ বছরে সময় পরিবর্তন হয়েছে। যদি কোন রাষ্ট্র ভাবে যে আমাদের আগ্রাসী বলার মাধ্যমে আমাদেরকে জাতীয় স্বার্থ ভুলে যেতে প্রভাবিত করবে তাহলে সে রাষ্ট্র বোকার স্বর্গে বসবাস করছে এবং তাদের স্বাগত জানাচ্ছে।” মিসেস গান্ধী দিল্লীর কংগ্রেস সদস্যদের কথা উল্লেখ্য করেন যারা জাতীয় এই সংকটকালে আজ সকালে তার বাসভবনে সমবেত হয়ে তাদের সংহতি প্রকাশ করেন।

মিসেস গান্ধী বলেনঃ “সময় পরিবর্তন হয়েছে যখন তিন বা চার হাজার মাইল দূর থেকে কোন দেশ তাদের শ্রেষ্ঠত্বের উপর ভিত্তি করে তাদের ইচ্ছে মত ভারতীয়দের নির্দেশ দিত। ভারতের পরিবর্তন হয়েছে এবং তা কারো নিজের সম্পত্তি নয়।”

“আজকে আমরা তাই করব যা আমাদের জাতীয় স্বার্থে ভাল এবং তা নয়, যা এ সকল তথাকথিত বড় রাষ্ট্রগুলো আমাদের দিয়ে করাতে পছন্দ করে। আমরা তাদের সাহায্য সহযোগিতার এবং বন্ধুত্বের সম্মান দেই কিন্তু আমরা রাষ্ট্রের আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌম ক্ষমতা ত্যাগ করতে পারি না। ”

ব্রিটেনের কথা উল্লেখ্য করে মিসেস গান্ধী বলেন যে, ১৯৬৫ সালের ইন্দো-পাক যুদ্ধের সময় ব্রিটেন ভারতকে আগ্রাসী রাষ্ট্র বলে ভুল করেছে। “কিন্তু এখন তাদের বাস্তবতা দেখা উচিৎ, একের পর এক ঘটনা, বাংলাদেশের ভেতরকার কার্যকলাপ এবং ইন্দো-পাক সীমান্তের অবস্থা।”

“ব্রিটেনের কাছে আমার একমাত্র চাওয়া হচ্ছে যে, তারা এই পরিস্থিতির দিকে আলোকপাত করবে।” তিনি যোগ করেন।
পশ্চিমবঙ্গে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকদের নিযুক্তিতে পাকিস্তানের সামর্থ্যের কথা উল্লেখ্য করে মিসেস গান্ধী বলেন যে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই সকল পর্যবেক্ষকরা কোন উপায়ে পর্যবেক্ষণ করবে তা তিনি বুঝতে পারছেন না।

বিভিন্ন দেশ, জাতিসংঘ সিনেটরস, ত্রানদলের বিদেশী গণ্যমান্য নীতিনির্ধারকগণের একটি বিরাট সংখ্যা, স্বাধীন সংস্থাসমূহ, মন্ত্রীবর্গ এবং অন্যান্যরা পশ্চিমবঙ্গের সাথে পূর্ব বাংলার সীমান্ত পরিদর্শন করে উদ্বাস্তুদের দুরাবস্থার সাক্ষী হয়েছেন। সন্ত্রাস মুক্ত এলাকায় বাংলাদেশের মানুষের উপর পাকিস্তানী আর্মির কার্যকলাপও তারা দেখেছে কিন্তু কি হল? “এটি কি বাংলাদেশের সমস্যা সমাধান করবে? এই সকল বড় রাষ্ট্রগুলোর কেউ কি বাংলাদেশের গণহত্যা বন্ধ করতে পাকিস্তানকে বলবে? না, তারা এটা করবে না।”

তিনি বলেন, “শুধুমাত্র পাকিস্তানী আর্মিকে বাংলাদেশ ছেড়ে আসতে বলার মাধ্যমে বাংলাদেশের এই সমস্যা সমাধান হতে পারত, যাতে করে তাদের ফেলে আসা বাসস্থান এবং হৃদয়ে এই হাজার হাজার মানুষ ফিরে যেতে পারে এবং শান্তিতে জীবন যাপন করতে পারে।”

“এই উপমহাদেশে শান্তি ফিরে আসবে কেবল যদি সীমান্ত অথবা ভারতের পূর্ব একই সাথে পশ্চিম থেকে পাকিস্তানী আর্মি সরিয়ে নেয়া হয়।” বলেন মিসেস গান্ধী।

মিসেস গান্ধী বলেন, “যখন পাকিস্তান তার আর্মি ভারতের সীমান্তে আনে তখন এই সকল দেশের কেউ কিংবা জাতিসংঘ টুঁ শব্দটি করে না, সময়ের সাথে ভারত যখন ভূমি রক্ষার্থে তার বাহিনী এগিয়ে নিয়ে যায়, তখনই শান্তি বিপদাপন্ন বলে চেঁচামেচি হয়। আমি এই বিষয়গুলি বুঝি না।”

পাকিস্তান ভারত আক্রমন করবে না এই ব্যপারে জাতিসংঘ নিশ্চয়তা দিতে পারবে কিনা মিসেস গান্ধী তার ঘণ্টাব্যপি বক্তব্যে জানতে চান, “জাতিসংঘ কি নিশ্চিত করতে পারবে যে এই সকল আক্রমণের ঘটনায় পাকিস্তান কর্তৃক দখলকৃত কোন ভূখণ্ড জনশূন্য ছিল?”

তিনবার আক্রমন
আগে তারা পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তের সৈন্যবাহিনী অপসারণের কথা বলে। তাদের মনে রাখা উচিৎ যে ভারত তিনবার পাকিস্তান কর্তৃক আগে আক্রান্ত হয়েছিল কিন্তু জাতিসংঘ কিংবা অন্য কোন শক্তি একবারও পাকিস্তানকে দোষারোপ করেনি। এখন কিভাবে তারা আশা করে আমরা তাদের উপর বিশ্বাস রাখব?

তিনি বলেন, “পাকিস্তানী আর্মি সম্মুখবর্তী অবস্থান দখলের পর ভারত দশ দিনের জন্য পূর্ব সীমান্তে আর্মি নিত না। আমরা জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকদের কাছে গিয়েছিলাম এবং তাদের কাছে প্রতিবাদ করি যে পাকিস্তানী বাহিনীদের সামনের এগিয়ে নিয়ে আসার সহায়ক হওয়া উচিৎ হবে না। পর্যবেক্ষণের পর জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকগণ আমাদের জানান যে পাকিস্তানীরা সামরিক মহড়া চালাচ্ছে এবং দশ দিন পর তা তুলে নিবে। দশ দিন কি শেষ হয়নি? এ সকল কর্মকাণ্ডে আমি বুঝতে পারছি না কি করে আমরা তাদের উপর বিশ্বাস রাখব।”

মিসেস গান্ধী বলেন যে, মুক্তিবাহিনীর কার্যকলাপ খতিয়ে দেখাই ছিল পশ্চিমবঙ্গে জাতিসংঘ প্রতিনিধিদের পাঠানোর প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছিলেন যে ভিয়েতনামে গেরিলা কার্যক্রম বন্ধ করতে সকল প্রকার গুপ্তচরবৃত্তি ও কর্তৃত্ব প্রদর্শন পরাজিত হয়েছিল। “আমি ভাবতে পারি না কিভাবে পর্যবেক্ষকরা কাজ করবে যখন বাংলাদেশ সরকারই এটি তৈরি করেছে এবং এটি তাদের জীবনের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না।” মিসেস গান্ধী যোগ করেন।

তিনি বলেন, “এখানে বলতে পারেন যে ভারত তার মাটি থেকে মুক্তিবাহিনীকে পরিচালনা করতে সহায়তা দিচ্ছে। আমরা কি করে এটি বন্ধ করতে পারি? পশ্চিমবঙ্গে আমাদের সীমানা এত দীর্ঘ যে আমরা এটা করতে পারি যদি ভারত তার সম্পূর্ণ সেনা সেখানে নিয়জিত করে। তাদেরকে নিবৃত্ত করা সম্ভব নয়। ”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “জাতিসংঘ অথবা কোন দেশ তখন এই সকল প্রশ্নে দৃষ্টিপাত করতে প্রস্তুত ছিল না। ”

ভারত তার প্রতিবেশীর ভেতরকার ঘটনায় অনধিকার চর্চা করছে বলে আনিত অভিযোগ সম্পূর্ণরূপে ভিত্তিহীন বলে মিসেস গান্ধী ব্যাখ্যা করেন। পাকিস্তানী আর্মি বাংলাদেশের ভেতরে কি করছে আমরা কেবল বিশ্বকে তা বলছিলাম। হাজারে হাজারে মানুষ হত্যা হয়ত বিশ্বের কাছে নগণ্য কিন্তু ভারত এতে বিচলিত এবং এটি’ই উদ্বাস্তুদের ভারতের মাটিতে আসার অনুমতি দিতে ভারতকে প্ররোচিত করেছে।
“এই সকল দেশগুলো যারা আজ পাকিস্তানের ভেতরকার ঘটনায় ভারতের অনধিকার চর্চা বলে চেঁচাচ্ছে [হাউকাউ করছে!], তারা, যখন তাদের দরকার ছিল, অন্যান্য দেশের ঘটনায় অনধিকার চর্চা করেছিল এবং এখানে যখন আমরা কিছুই করি নি। আমাদের অভিযুক্ত করা হচ্ছে। তবে, এটি আমাদের তেমন বিচলিত করছে না। এমনকি চীনের মত দেশ অন্য দেশের ব্যপারে নাক গলায়।”

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৭২। কোলকাতার জনসভায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বক্তৃতা “দি ইয়ারস অফ এন্ডীভার” ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১

Farjana Akter Munia
<১২, ৭২, ১৭৮-১৮১>

আমরা সফল হবোই
আপনারা সবাই অবগত আছেন যে আজ আমরা এক নতুন ধরণের সংকটের মুখোমুখি। বাংলার এবং দেশটির অন্যান্য অংশের জনগন অতীতে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং গত সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদেরকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে এনেছে। আমরা ভেবেছিলাম যে আমাদের উন্নতির পথে সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করা সম্ভব হয়েছে এবং আমরা এখন একটি শক্তিশালী দেশ গড়তে কঠোর পরিশ্রম করে যাবো। কিন্তু অচিরেই একটি বিষাদময় ঘটনা ঘটল যা আমাদের জনগণের উপর একটি বিশাল বোঝা চাপিয়ে দিল, যদিও আমরা একভাবে এতে জড়িতই ছিলাম। শুরুতে এটা ছিল কেবলই অর্থনৈতিক বোঝা। পূর্ব বাংলা থেকে শরণার্থীদের অবিরাম আগমন পশ্চিম পাকিস্তান, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরার জনগণের জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে পাল্টে দিয়েছে এবং তাদের দুর্ভোগ বাড়িয়ে তুলেছে। আমরা মনে করেছিলাম যে আমাদের এই বোঝাটা হয়ত অল্পকিছুদিনের জন্য বহন করতে হবে এবং অন্যান্য দেশের সহযোগিতার মাধ্যমে আমরা তা সহজেই করতে পারবো। কিন্তু আমরা যে সহযোগিতা পেয়েছি, প্রয়োজনের তুলনায় তা অকিঞ্চিৎকর। যদিবা কেউ কেউ সাহায্য করেও থাকে, তারা এই সংকটের কারণ সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র চিন্তিত ছিল না যে কেন একটি বিশাল জনগোষ্ঠী তাদের ভিটেমাটি ত্যাগ করছে এবং বানভাসি জলের মত আমাদের দিকে ভেসে আসছে। সঠিকভাবে মূল নির্ণয় করা না গেলে কোনো রোগই সম্পূর্ণ আরোগ্য করা সম্ভব হয় না। এই বিশাল (জনগণের) অন্তঃপ্রবাহের কারণ সম্পর্কে মাথা না ঘামিয়ে আমরা যদি তা বন্ধ করতে চাই, তাহলে আমাদের কী করণীয়? আমরা সত্যিটা প্রকাশ করেছি এবং অন্যরা আমাদের সাথে একমত হয়েছে কিন্তু কেউই এ ব্যাপারে কিছু করেনি।

বর্তমান সংকট সম্পর্কে বুঝতে হলে আমাদেরকে এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করতে হবে এবং জানতে হবে যে পাকিস্তান কীভাবে গঠিত হয়েছিল। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ সমগ্র দেশেই সংঘটিত হয়েছিল, অবশ্যই বর্তমানে পাকিস্তান হিশেবে অভিহিত এলাকাতেও তা হয়েছিল। ‘সীমান্ত গান্ধী’ নামে সমধিক পরিচিত খান আব্দুল গাফফার খান এবং আব্দুল সামাদ খান, – যাকে ‘বেলুচ গান্ধী’ বলা হত, – এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান যখন গঠিত হল তখন এই নেতারা ক্ষমতায় অভিষিক্ত হননি। ভারতে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীরা নির্বাচনে জয়লাভ করেছিলেন এবং সরকার গঠন করেছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানে তাদের স্থান হয়েছিল কারাগারে এবং যারা অতীতে ব্রিটিশ সরকারকে সহায়তা করেছিল, তারাই পাকিস্তানে সরকার গঠন করেছিল। তারা সেনাবাহিনীতে বা অন্যান্য অফিসে পদ দখল করেছিল। তাদের এবং আমাদের মতাদর্শে একটি মৌলিক পার্থক্য ছিল। আমরা তখনো উদ্বিগ্ন ছিলাম এবং এখনো সমান উদ্বিগ্ন যে আমাদের নতুন প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সাথে সবচেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা উচিত বিশেষত যখন পাকিস্তান আদর্শটি সত্যিতে বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সাথে সবসময় বচসা করা কোনো রাষ্ট্রের জন্যই স্বাস্থ্যকর নয়। কিন্তু আমরা যখনই বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছি, তখনই অন্যপাশে পেয়েছি একটি বদ্ধ মুষ্ঠি এবং অস্থিতিশীল, উত্তেজনাকর পরিস্থিতি। আমাদের বিশ্বাস, এরূপ পরিস্থিতির কারণ এই যে অন্যান্য কিছু রাষ্ট্র পাকিস্তানকে এটা করতে উৎসাহ যোগাত। পাকিস্তানের সাথে বন্ধুসুলভ পরাশক্তিগুলো যদি শুরুতেই পাকিস্তানকে ভারতের সাথে যুদ্ধ না করতে পরামর্শ দিত, পাকিস্তান হয়ত যুদ্ধংদেহী ভূমিকা নিত না। ভারতের সাথে যুদ্ধে নামার শক্তিসামর্থ্য বা সাহস- কোনোটাই পাকিস্তানের ছিল না। কিন্তু তারা তা করেছিল; কারণ তারা বিদেশ থেকে সহযোগিতা ও যুদ্ধের সরঞ্জাম পাচ্ছিল। এমনকি তারা যখন আমাদের সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করল, তখনো তারা তাদের বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে সমূহ উৎসাহ পেয়েছিল। তারা ইন্ধনদাতা রাষ্ট্রগুলো, যেহেতু তাদের পদ্ধতি বদলায়নি, যুদ্ধের ফলাফলের মাধ্যমে তারা আক্রমণকারী হিশেবেও চিহ্নিত হয়নি। এই সমস্তকিছুর ফলাফল হল এই যে, পরাশক্তিদের সাথে বন্ধুত্ব থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তান একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারেনি, বরং রাষ্ট্রটি আরো দুর্বল হয়েছে।

আমরা সবাই ভারতীয়, যদিও আমরা ভিন্ন ভাষাভাষী এবং ভিন্ন ভিন্ন ধর্মমত পোষণ করি। যে কোনো প্রদেশেই আমরা বসবাস করি না কেন, আমরা সকলেই এই রাষ্ট্রের নাগরিক, যারা এই দেশটিকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অভিন্ন প্রচেষ্টায় নিয়োজিত। একমাত্র উন্নত আদর্শই পারে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মমতের, অভ্যাসের, পোশাকের এবং ভাষার জনগোষ্ঠীকে এক সুতোয় বাঁধতে। কেবল ধর্ম ও ভাষা আজকের পৃথিবীর কোনো সম্প্রদায়কে এক জাতি হিশেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। আমাদের এই সংকীর্ণ চিন্তাচেতনার বাইরে যেতে হবে। ধর্ম একটি ভালো ব্যাপার এবং প্রত্যেকে অবশ্যই তার ধর্ম পরিপালন করবে। কিন্তু ধর্মের ভিত্তিতে একটি জাতি গঠন করা যায় না এবং জনগণকে একতাবদ্ধ রাখা যায় না। পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের সময়ই আমরা একথা বলেছি কিন্তু না ব্রিটিশ সরকার না অন্য কেউ, – কেউই আমাদের কথা কানে তোলেনি এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কিন্তু আমরা দেখেছি যে পাকিস্তানের সূচনালগ্ন থেকেই সেখানে এক ধর্মের মানুষেরা অন্য ধর্মাবলম্বী সংখ্যালঘুদের উপর নৃশংসতা চালিয়েছে।

আরেকটা ব্যাপার পাকিস্তানে ঘটে আসছিল এবং বাকি পৃথিবী তা উপেক্ষা করে যাচ্ছিল; তা হলো এমনকি একই ধর্মের সংখ্যাগরিষ্ঠরাও অত্যাচারিত হচ্ছিল। আমরা এটা জানতাম কিন্তু এটা অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন ব্যাপার হওয়ার কারণে আমরা এতে হস্তক্ষেপ করতে পারিনি। কিন্তু এই অবস্থা দীর্ঘদিন বজায় থাকতে পারত না এবং শেষমেষ এটা পাকিস্তানকে আরো দুর্বল করে তুলেছিল। পাকিস্তান যদি আরো দুর্বল হয়ে থাকে, তা একারণে না যে আমরা এরকম চেয়েছি। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি দুর্বল রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে কারণ অন্য রাষ্ট্রসমূহ একে (পাকিস্তানকে) ভুল নীতি অনুসরণ করতে সাহায্য করেছে যা সম্ভবত তাদের স্বার্থানুগামী ছিল এবং পাকিস্তানের স্বার্থের পরিপন্থী ছিল। আমাদের নেতারা জাতীয় স্বার্থ-অনুযায়ী নীতি গ্রহণ করেছিলেন এবং দৃঢ়ভাবেই তা অনুসরণ করেছেন।

আমাদের উন্নয়ন-পরিকল্পনা ইতোমধ্যে বাস্তবায়নাধীন কিন্তু ইতোমধ্যেই একটা বিরাট বোঝা আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। বোঝাটি মূলত অর্থনৈতিক কারণ শরণার্থীদের সংখ্যা অত্যন্ত ব্যাপক। এই অন্তঃপ্রবাহ একইসাথে কিছু সামাজিক, প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক সমস্যাও সৃষ্টি করেছে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমাদের নিরাপত্তার প্রতি যে হুমকি এটি চাপিয়ে দিয়েছে। এটা আরো বড় বিপদের আকার নিতে পারে।

আপনারা জেনে থাকবেন যে আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত যত শরণার্থী এসেছেন, আমরা সবাইকেই পুনর্বাসিত করেছি। একটি দরিদ্র দেশ হওয়া সত্ত্বেও এবং বহির্বিশ্ব থেকে নামমাত্র সাহায্য পাওয়া সত্ত্বেও আমরা তা করেছি। আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম যেহেতু আমাদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা একটু একটু করে আরো হুমকির সম্মুখীন হচ্ছিল। পশ্চিমবঙ্গ এবং পূর্ববঙ্গের মধ্যবর্তী সীমান্তে আমাদের পাশে মোতায়েন রয়েছে ‘বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স’ এবং অন্যপাশে ‘পূর্ববঙ্গ’ বা ‘পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস’ যদিও তারা তাদের নাম পাল্টে ফেলেছে এবং নিজেদেরকে ‘মুক্তিবাহিনী’ বলে অভিহিত করেছে।

এমতাবস্থায়, পাকিস্তান তার সেনাবাহিনীকে আমাদের সীমান্তের দিকে সরিয়ে আনলো; পশ্চিমে তারা কাশ্মীর, পাঞ্জাব, রাজস্থান ও গুজরাটের দিকে আরো অগ্রসর হলো। যখন তাদের বাহিনী কাশ্মীর সীমান্তে উপনীত হলো, আমরা এর প্রতি জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক দলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। তারা আমাদেরকে বলল যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সামরিক প্রশিক্ষণ কুচকাওয়াজের অংশ হিশেবে এটা করছে। কে এটা বিশ্বাস করতে পারে? বিশেষত এমন একটা দেশ, যে কিনা ইতঃপূর্বে তিন তিনবার পাকিস্তানী আগ্রাসনের শিকার হয়েছে? আমাদের নিরাপত্তার প্রতি বিপদ প্রতিমুহূর্তেই বাড়ছিল কিন্তু আমরা দশ দিন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করিনি। দশম দিনের পর আমরাও আমাদের সেনাবাহিনীকে এগিয়ে নিলাম। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা আমাদের সেনাবাহিনীকে সীমান্তের দিকে এগিয়ে নেইনি, আমাদের সীমান্তে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অস্তিত্ব পৃথিবীর কোনো দেশেরই, — ছোট কি বড়, — চোখে পড়েনি। আমাদের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি সম্পর্কে তারা চিন্তিত ছিল না বা এ ব্যাপারে যে তাদের কিছু করা উচিত, তা-ও তাদের মনে হয়নি। কেউই, কোনো রাষ্ট্রই, এ-ব্যাপারে কোনো মতামত প্রকাশ করেনি। কিন্তু যেইমাত্র আমাদের বাহিনী সামনে অগ্রসর হলো, অন্য কারো ভূমিতে না, আমাদেরই নিজস্ব সীমানায়, অমনি বিশ্বশক্তির অংশীদাররা হৈচৈ তুলে ফেললেন যে বিশ্বশান্তি সংকটাপন্ন এবং তারা বলতে শুরু করলেন যে উভয় দেশেরই তাদের সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেওয়া উচিত। এখন, আমরা কি এটা মেনে নিতে পারি? ন্যূনতম দায়িত্ববোধসম্পন্ন কোনো সরকার, কোনো মন্ত্রী বা অন্য যে কোনো অফিস তার দেশ এবং সীমান্তের নিরাপত্তাকে বিপদাপন্ন করে তুলতে পারে না। আমরা জানতে চেয়েছিলাম যে কেন পাকিস্তানী বাহিনীকে আমাদের সীমান্তের দিকে অগ্রসর করা হয়েছে এবং এটা আদৌ আমাদের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি বহন করে না কিনা। আমরা যদি আমাদের সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করতাম, তাদেরকে সীমান্ত থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিতে হত, যেখানে আমাদের সেনানিবাসগুলো ও অন্যান্য বন্দোবস্ত রয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের শহরগুলো এবং সেনানিবাসগুলো তাদের সীমান্তের কাছাকাছিই অবস্থিত। তারা যদি কিছুটা প্রত্যাহার করেও, তখনো তারা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে। আমাদের আক্রমণ করতে চাইলে তারা দ্রুতই সীমান্তে পৌঁছাতে পারে। আমরা তা পারি না। কে আমাদের এই নিশ্চয়তা দেবে যে যদি আমরা আক্রান্ত হই, তারা আমাদের সাহায্য করবে এবং হানাদার বাহিনীর দখলকৃত ভূমি আমাদের ফিরিয়ে দেবে? কেউই এই বিষয়টি বিবেচনা করতে প্রস্তুত নয়। তারা সবাই বলছে যে সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে। আমরা এই দাবিকে নাকচ করিনা। তবে আমাদের কিছু প্রস্তাব আছে। কিন্তু এটা কতটুকু যৌক্তিক যে শুধুমাত্র অন্যপক্ষের প্রস্তাবই মেনে নেওয়া হবে? আমাদের প্রস্তাব এই যে, পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীকে পূর্ব বাংলা থেকে প্রত্যাহার করতে হবে। পূর্ব বাংলায় তাদের আগমন এবং অবস্থানের কারণেই সেখানে ত্রাসের রাজত্ব বিরাজ করছে এবং বিশাল জনস্রোতে শরণার্থীরা আমাদের দেশে প্রবেশ করছে। তারা যদি পূর্ব বাংলা ত্যাগ করে, যুদ্ধ অবিলম্বেই বন্ধ হবে। কিন্তু কেউই এই দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবতে রাজী নয়।

আমাদেরকে আমাদের পূর্ব সীমান্তে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক দলকে স্বাগত জানানোর প্রস্তাবেও একমত হতে বলা হয়েছিল। আমার জানামতে, যতদূর সম্ভব, তাদের কেউ কেউ সেখানে ছিল। সম্ভবত তারা এখনো সেখানে অবস্থান করছে। কিন্তু প্রশ্নটা হল কেন তাদেরকে সেখানে নিযুক্ত করা হবে? তাদের সেখানে অবস্থান কি শরণার্থীদের নিজদেশে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করবে? শরণার্থীরা বলেছে যে বাংলাদেশে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ না করা পর্যন্ত তারা সেখানে ফিরে যাবে না। এমতাবস্থায় আমরা কি তাদের ফিরে যেতে বলতে পারি যখন আমরা দেখছি যে সেখানে একটি যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করছে, গণহত্যা ও নারী নির্যাতন চলছে এবং একের পর এক গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে? কীভাবে আমরা তাদেরকে এরকম একটি পরিস্থিতির মধ্যে ফিরে যেতে বলতে পারি? সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করাই বৈশ্বিক সম্প্রদায় এবং আমাদের প্রাথমিক কর্তব্য হওয়া উচিত। আমরা অনেকদিন অপেক্ষা করেছি, অপেক্ষা করেছি দেখতে যে অন্য কোনো রাষ্ট্র এই ব্যাপারে সাহায্য করে কিনা এবং সেখানে বিরাজমান ত্রাসের রাজত্ব বন্ধ করে কিনা।

আমি ইউরোপে এবং যুক্তরাষ্ট্রে কিছু দেশে ভ্রমণ করেছিলাম। আমাকে সবজায়গাতেই আশ্বস্ত করা হয়েছিল যে বাংলাদেশে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে একটি রাজনৈতিক সমাধানের প্রয়োজনের ব্যাপারে তারা আমার সাথে একমত। তারা বলেছিল যে তারা এই সমস্যাটিকে গুরুত্ব দিয়ে বিচার করছে। কিন্তু এ থেকে কোনো ফলাফলই আসে নি। আমরা কাউকে হুমকি দেই না, বা অযথা কোনো শোরগোল তুলতে চাই না। কিন্তু আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থের পক্ষে ভালোমন্দ বুঝি এবং আমরা এই স্বার্থ পরিত্যাগ করতে যাচ্ছি না। পূর্ব বাংলার জনগণ স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তাদের রক্ত ঝরাচ্ছে। অতীতে আমাদের দেশেও এরকম হয়েছে। অসংখ্য কৃষক, বুদ্ধিজীবী এবং আইনজীবী স্বাধীনতার জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। এখন কোনো রাষ্ট্র যদি ভাবে যে আমরা আমাদের স্বাধীনতা রক্ষা করবো না এবং তাদেরকে তাদের নিজস্ব অশুভ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে দেবো; আমরা তাদের অশুভ পরিকল্পনার ভুক্তভোগী হতে পারি না।

এই দেশের প্রত্যেক নাগরিককেই এই বোঝা বা ভার বহন করতে ভূমিকা রাখতে হবে, হোক সে যুবক বা বৃদ্ধ, পুরুষ কিংবা নারী। কষ্ট ও দুর্ভোগ সওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সকলকে অংশগ্রহণ করতে হবে এবং বিপদের মোকাবিলা করতে হবে। যদিও সমগ্র দেশকেই এই বোঝা বইতে হবে, আপনাদের পশ্চিবঙ্গবাসীদের এই ভারের একটু বেশিই অংশ নিতে হবে। যা-ই হোক না কেন, আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।

আমি আপনাদেরকে আশ্বস্ত করছি যে আমি যুদ্ধ চাই না। আমি ঐকান্তিকভাবেই শান্তিকামী। আমি জানি যুদ্ধ কী এবং এটা কীভাবে জনগণকে, বিশেষ করে জনগণের দুর্বল অংশকে, ক্ষতিগ্রস্ত করে। আমি যুদ্ধ ঘৃণা করি। আমার আন্তরিক কামনা এই যে আমি যুদ্ধ সংঘটনের পক্ষে প্রভাবক হিশেবে ভূমিকা রাখতে চাই না। নেহেরু শান্তির ব্যাপারে অনেক বলেছেন কিন্তু এমনকি তিনিও বলেছেন যে আমাদের যদি নিজেদের স্বাধীনতার প্রতি কোনো আক্রমণকে মোকাবেলা করতে হয়, আমাদের অবশ্যই তা সর্বোচ্চ শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমেই তা করতে হবে।

কিছু বিদেশি পত্রিকায় আমাকে জেদী হিশেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। হ্যাঁ, আমাদের নিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এমন বিষয় সম্পর্কে আমি অবশ্যই জেদী; এবং আমার মতে, বাংলাদেশে চলমান গণহত্যা অবশ্যই বন্ধ হওয়া উচিত এবং শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনগণকে হত্যা করে নির্মূল করা আমাদের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। সুতরাং, আমাদের অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে, বাংলাদেশে যে ভয়াবহ নৃশংসতা চলছে তা বন্ধ হবে। এটা জেদী হওয়া নয়। আমরা যদি আমাদের জাতীয় স্বার্থের কথা বিবেচনা করি, তাহলে এর কোনো বিকল্প নেই। আপনারা অবগত আছেন যে কেবল স্থিরচিত্তে বিবেচনার পরেই আমরা কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। আমরা তাড়াহুড়ো করে কিছু করিনি। আমরা কেবল তা-ই করছি, যা যথাযথ এবং আমাদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট। যখনই কোনো বৈদেশিক শক্তি আমাদের সাথে আলোচনা করেছে, আমরা সতর্কভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেই তবে তাদের কোনো প্রস্তাব মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছি এবং আমাদের সাধ্যমত প্রস্তাবগুলো মেনে নিয়েছি। আমরা একটি সংকটের মুখোমুখি এবং এমতাবস্থায় জনগণকে উদ্যমী হতে হবে। বদলে যাওয়া পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে কীভাবে এই জন-উদ্যমকে ব্যবহার করা যায়, – আমাদের তাও ভেবে দেখতে হবে। জয়ী হতে হলে যেকোনো সৈন্যবাহিনীকেই যুদ্ধ করতে হয়। আর আমাদের শিল্প-স্থাপনা, কলকারখানা এবং বিদ্যালয়গুলো বন্ধ হয়ে গেলে এবং হাসপাতালে সেবাদান ক্ষতিগ্রস্ত হলে এটা সম্ভব হবে না। যদি আমরা সত্যিই জয়ী হতে চাই, কলকাতার নাগরিকদের নিশ্চিত করতে হবে যেন শহরে ও গ্রামে প্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ড আরো দক্ষভাবে ও বেশি উদ্যমের সাথে পরিচালিত হয়।

আমাদের দেশের জন্য এটি একটি অগ্নিপরীক্ষার সময় কিন্তু আমি আত্মবিশ্বাসী যে আমরা সাফল্য লাভ করবো। সংগ্রামের প্রকৃতি যেমনই হোক না কেন, আমরা ঠাণ্ডা মাথায় এবং দৃঢ়ভাবে এর মোকাবেলা করব যাতে আমরা আমাদের জনগণের কাছে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি তা পূরণ করতে পারি এবং আমরা উন্নতির পথে যাত্রা অব্যাহত রাখতে পারি। যত বড় বিপদই আসুক না কেন, যত ব্যাপক চাপই প্রয়োগ করা হোক না কেন, আমাদেরকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে, এমনকি যদি আমরা নিঃসঙ্গও হই। আমাদের সীমান্তের কাছাকাছি বসবাসরত নাগরিকেরা জানেন যে পাকিস্তানীরা আগরতলা এবং অন্যান্য জায়গায় গুলিবর্ষণ করছে। আমাদের হাসপাতালগুলো আহতদের দ্বারা পরিপূর্ণ। আমাদের হৃদয়-নিংড়ানো শুভকামনা তাঁদের সাথী এবং আমি আমার পক্ষ থেকে, জাতির পক্ষ থেকে, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। আমরা তাঁদের সাহসিকতায় গর্বিত এবং আমরা আশা করি যে তাঁদের মনোবল উত্তুঙ্গু থাকবে। যদিও তাঁরা এখন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করতে পারছেন না, তবুও তাঁরা আমাদের সৈনিক, আমরা তাঁদের সাহসকিতা ও উদ্যমে গর্বিত।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!