You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সূত্র তারিখ

৫। ৩নং সেক্টরের ও ‘এস’ ফোর্সের যুদ্ধ বিবরণ

 

সাক্ষাৎকারঃ মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ

 

——–১৯৭১

 

 

শোয়েব কামাল

<১০, , ১৯৯২১৬>

সাক্ষাৎকারঃ মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ

তেলিয়াপাড়া পতনের পর সিলেটের মনতলা হতে সিংগারবিল পর্যন্ত এলাকা আমাদের নিয়ন্ত্রণধীন ছিল। এ এলাকা থেকে আমরা গেরিলা ট্রেনিংপ্রাপ্ত ছেলেদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কিভাবে ক্ষতি করতে হবে সেভাবে টাস্ক দিয়ে পাঠাতাম।

যখন আমরা এ কাজে ব্যস্ত ছিলাম তখন আমাদের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওসমানী সমগ্র বাংলাদেশকে ১১ টা সেক্টরে বিভক্ত করে এক নির্দেশ পাঠান। সেই নির্দেশ মোতাবেক আমার সেক্টরের নামকরণ করা হয় ‘তিন নং সেক্টর’। যে এলাকার যুদ্ধ পরিচালনার ভার আমার উপর দেওয়া হয়ছিল, সে এলাকাগুলো ছিল সীমান্ত এলাকা-উত্তরের সিলেটের চূড়ামনকাটি (শ্রীমঙ্গলের কাছে) এবং দক্ষিনে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার সিংগারবিল। অভ্যন্তরীণ যে সকল এলাকার যুদ্ধ পরিচালনার ভার আমার উপর দেওয়া হয়েছিল সেগুলো হল, সিলেটের মৌলভীবাজার সাবডিবিশন এর কিয়দংশ,সম্পূর্ণ হবিগঞ্জ মহকুমা নবিনগর থানার কিছু অংশ বাদে সমস্ত ব্রাক্ষণবাড়িয়া মহকুমার এবং নায়ায়ণগঞ্জ মহকুমার আড়াইহাজার এবং বৈদ্যরবাজার থানা ছাড়া সমস্তটা, ঢাকা শহর ছাড়া ঢাকা নর্থের সমস্তটা, কিশোরগঞ্জ মহকুমা এবং গফরগাঁও এবং ভালুকা থানা। এইগুলি ছিল আমার অভ্যন্তরীণ সেক্টরের এলাকা। এ এলাকা ছাড়াও ঢাকা শহর এবং নারায়ণগঞ্জ শহরের বিভিন্ন গেরিলা তৎপরতায় আমি আমার গেরিলা যোদ্ধাদের পাঠিয়েছিলাম। এভাবে এলাকা ভাগ করে দেওয়ার পর আমরা বাংলাদেশের ভেতর বিভিন্ন স্থানে স্থানে গেরিলা বেইস তৈরি করি। সেখানে কিছুসংখ্যক নিয়মিত বাহিনীর লোক পাঠাই যেন তারা গেরিলা ট্রেনিংপ্রাপ্ত পরিচালনা করতে পারে। আমার এলাকার যে সমস্ত জায়গাতে গেরিলা বেইস তৈরি করেছিলাম, তা ছিল সিলেটের চুনারুঘাট,হবিগঞ্জ ও বানিয়াচংগে। একটাই ছিল সিলেটে। ব্রাক্ষণবাড়িয়া মহকুমার নাসিরনগর,সরাইল,মুকুন্দপুর,ব্রাক্ষণবাড়িয়া এবং নবীনগরে একটি করে বেইস। কিশোরগঞ্জে যেসব বেইস তৈরি করি সেগুলো হল কুলিয়ার চর,বাজিতপুর, কটিয়াদি, পাকুন্দিয়া, হোসেনপুর এবং কিশোরগঞ্জে- প্রত্যেকটি জায়গায় একটি করে বেইস তৈরি করি। ঢাকা জেলাতে যেসব বেইস তৈরি করি তা-রায়পুর, শীতপুর,নরসিংদী,কাপাসিয়া,মনোহরদি,কালিয়াকৈর,জয়দেবপুর এবং কালীগঞ্জ। ময়মনসিংহের গফরগাঁও এবং ভালুকাতে একটি করে গেরিলা বেইস তৈরি করি।

এসব বেইস-এ ট্রেনিং দিয়ে ছেলেদের পাঠাবার জন্য আমরা শরনার্থী ক্যাম্প থেকে ছেলেদেরকে রিক্রুট করতাম। ঢাকা-ময়মনসিংহ এবং কুমিল্লা জেলার অভ্যন্তরে যেসব বেইস তৈরি করেছিলাম যেসব বেইস-এ গেরিলা তৎপরতা চালাতে বিপুলসংখ্যক ছেলে ট্রেনিং এর জন্য আসত। এসব জেলা থেকে যেসব তরুন ছেলেরা ট্রেনিং নেয়ার জন্য আসত তাদের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে, তাদের সবাইকে ট্রেনিং দেয়া আমাদের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ত। তাই তখন রিক্রুটমেন্ট- এ যেতাম। এতে বেশ কিছুসংখ্যক ছেলে সিলেক্ট না হতে পেয়ে নিরাশ হয়ে যেত। কিন্ত সিলেট জেলায় আমাকে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। যখন এসব বেইসগুলাতে হাজার হাজার ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলা পৌঁছে গিয়েছিল, তখনও আমি সিলেট জেলার বেইসগুলাতে গেরিলা পাঠাবার জন্য কোন ছেলেকে রিক্রুট করতে পারিনি। দু’চারজন যারা রিক্রুট হয়েছিল তারাও জেলার অভ্যন্তরে তৎপরতা চালাবার সাহস পায়নি। অবশেষে আমরা বেইস তৈরি করার জন্য অস্ত্রের সাহায্য নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। গেরিলা যুদ্ধে সমস্ত নীতির অন্যতম নীতি হল যে,গেরিলা যুদ্ধকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য জনগণের সাহায্য একান্ত প্রয়োজন কিন্ত সিলেটে এ সমর্থনের বিশেষ অভাব ছিল। তাই প্রথম পর্যায়ে আমাদের ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলা হয়তবা পাক সেনাবাহিনী কতৃক ধৃত হয়েছে অথবা জনগণ দ্বারা ধৃত হয়েছে। যারা ধরা পড়েছিল তার কখনো ফিরে আসেনি। যেহেতু সিলেটে প্রথম দিকে গেরিলা তৎপরতা কম ছিল, সেহেতু পাকিস্তানী সৈন্যরা সিলেটে এবং নিকটবর্তী অঞ্চলে নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারতো।

একেবারেই যে সাহায্য পায়নি সেটা বললেও ভুল হবে। কিছুসংখ্যক লোক আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করেছে এবং যারা সাহায্য করেছে তারা মনেপ্রাণে সাহায্য করেছে, তাই জুলাই মাসের পর থেকে সিলেট জেলার ভেতরে গেরিলা বেইস তৈরি করার জন্য আমরা সাহায্য নেই। তারপর থেকে গেরিলা তৎপরতা কিছুটা প্রকাশ পায়।

আমাদের নিকট অস্ত্রশস্ত্র ছিল খুব অল্প। বন্ধুরাষ্ট্র থেকেও তখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য তেমন কোন অস্ত্র পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই যেসব যুবককেই আমরা ভিতরের বেইস-এ কাজ করার জন্য পাঠাতাম তাদেরকে ১০ জনের একটা ব্যাচ করে তাদের হাতে দুটো কি তিনটা হাতিয়ার, একটা করে গ্রেনেড এবং কিছু পরিমাণ বিস্ফোরক দ্রব্য দিয়ে পাঠাতাম। এইসব অস্ত্র এবং বিস্ফোরক দ্রব্যের ব্যবহার আমার নির্দেশ এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী গণবাহিনী এবং নিয়মিত বাহিনীর সমন্বয়ে, যৌথ পরিকল্পনা ও পরামর্শে, নিয়মিত বাহিনীর কমান্ডারের নেতৃত্বে ব্যবহৃত হত।

আগস্ট মাস হতে বন্ধুরাষ্ট্র ভারত থেকে আমরা বেশ কিছুসংখ্যক অস্ত্রশস্ত্র পাই। তখন আমরা দশজনের দলের জন্য আটজনকে অস্ত্র দিতে পেরেছিলাম। তারপর থেকেই গেরিলা তৎপরতা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভীষণভাবে জোরদার হয়ে ওঠে। তখন থেকেই পাকিস্তানীদের একস্থান থেকে অন্যস্থানে চলাফেরার নিরাপত্তা যথেষ্ট বিঘ্নিত হয়।

অক্টোবর- নভেম্বর পর্যন্ত আমরা যেভাবে গেরিলাদের ভেতর ট্রেনিং দিয়ে পাঠিয়েছি, তাতে এমন বাড়ি বাদ ছিল না যেখানে ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলা ছিল নাহ।

আমি যে এলাকায় যুদ্ধ পরিচালনা করেছি সে এলাকায় প্রায় ২৫/৩০ হাজার গেরিলা নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত কাজ করছিল। যে অস্ত্র তাদের দিয়েছিলাম সে অস্ত্র ছাড়াও পাকবাহিনী রাজাকার, আলবদর, আলশামস এবং পুলিশ ষ্টেশন থেকে ছিনিয়ে নেয়া অস্ত্রশস্ত্রের সংখ্যা বিশেষভাবে বেড়ে যায় এবং ছেলেদের মনোবলও সাথে সাথে বেড়ে যায়।

এমন কতগুলা জায়গা ছিল, সেগুলো পাকবাহিনী কখনো তাদের নিয়ন্ত্রনে নিতে পারেনি, যেমন- রায়পুরা, শিবপুরে উত্তরাংশ, মনোহরদী, কাপাসিয়া, বাজিতপুর, কুলিয়াচর, ভালুকা, গফরগাঁও এই সমস্ত এলাকায় আমাদের প্রশাসন ব্যাবস্থাও ছিল।

যেহেতু আমরা যুবকদের ট্রেনিং দিয়ে গেরিলা যুদ্ধের জন্য ভেতরে পাঠাচ্ছিলাম এবং আমাদের কনভেশনাল যুদ্ধ প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল, সেহেতু মনতলা থেকে সিংগারবিল পর্যন্ত এলাকায় কনভেশনাল পদ্ধতিতে প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরী করি-কিন্ত নিয়মিত বাহিনীর সৈনিকদের দ্বারা গেরিলা অপারেশন-এর জন্য ব্রাক্ষণবাড়িয়া-সিলেট মহাসড়ক পাকবাহিনীর জন্য এক মরণফাঁদ ছিল।

তাই পাক-বাহিনী আমাদেরকে এ জায়গা থেকে সরাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। আমরাও আমাদের ঘাঁটিকে সুরক্ষিত করার চেষ্টা করি। কারণ এটাই ছিল আমাদের সর্বশেষ আশ্রয়ের স্থল। এ জায়গা যদি আমরা হারাই তাহলে আমাদের ভারতে আশ্রয় নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল নাহ। যদিও তখন আমাদের সমস্ত ট্রেনিং ক্যাম্প এবং হেডকোয়ার্টারের কিয়দংশ ছিল ভারতে।

এই ক্ষুদ্র জায়গাটুকু রক্ষা করার জন্য আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করি। কিন্ত পাকবাহিনী ও আমাদের পিছু হঠাবার জন্য বেপারোয়া আক্রমন চালায়। কারণ আমাদের হটিয়ে দিতে না পারলে সিলেট হাইওয়ে তাদের জন্য নিরাপদ ছিল নাহ এবং আখাউড়া-সিলেট ট্রেন চালু করতে পারছিল না। বলা বাহুল্য,পাক বাহিনী ২৫শে মার্চের পর থেকে এই লাইনে আর কখনো গাড়ি চালাতে পারেনি।

আমাদের এই ঘাঁটির উপর প্যাকবাহিনী বার বার আক্রমণ করে এবং এসব আক্রমণে তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। প্রতিদিন তাদের ২০ থেকে ৩০ জন্য সৈনিক হারাতে হোত। অবশেষে জুন মাসের ২১ তারিখে পাকবাহিনী আমাদের এই অবস্থানের উপর মারাত্মকভাবে হামলা চালায়। আমার সৈনিক সংখ্যা ছিল মাত্র তিন কোম্পানি। কিন্ত প্যাকবাহিনীর উপর্যুপরি প্রায় চার ব্যাটালিয়ন সৈন্য নিয়ে আক্রমন চালায়। এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য ইটাখোলা, তেলিয়াপাড়ার দক্ষিন দিকে মনতলার দিকে অগ্রসর হয়। এক ব্যাটালিয়ন মাধবপুর থেকে মনতলার দিকে অগ্রসর হয়। এক ব্যাটালিয়ন চানহরা থেকে হরশপুরের দিকে অগ্রসর হয়। আর এক ব্যাটালিয়ন মুকুন্দপুর থেকে হরশপুর-এর দিকে অগ্রসর হয়।

একই সময়ে চারদিক থেকে তারা আমাদের উপর আক্রমণ শুরু করে এবং এ আক্রমণে তারা দূরপাল্লার ভারী অস্ত্র বেপরোয়াভাবে, ব্যাপকভাবে ব্যাবহার করে। যখন তিন দিক থেকে তারা আমাদের উপর আক্রমণ করতে অগ্রসর হচ্ছিল তখন হেলিকপ্টারযোগে তারা পিছনে কিছু সংখ্যক কমান্ডো অবতরন করায়। আমি শেষ পর্যন্ত আমার সৈনিকদের পিছনে হটে যেতে আদেশ দেই। হরশপুরের নিকট আমার যে কোম্পানি ছিল তারা পাকসৈন্যদের প্রায় ঘেরাওয়ের ভিতরে পড়ে যায়। এই কোম্পানিকে ঘেরাও থেকে উদ্ধার করতে আমার বেগ পেতে হয়েছিল। যদিও আমরা আমাদের অবস্থান থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম তবুও শেষ পর্যন্ত প্রায় ৪০ বর্গমাইল এলাকা আমাদের আওত্তাদিন রাখতে সমর্থ হয়েছিলাম। এই এলাকা স্বাধীনতা লাভের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত মুক্ত ছিল।

ঐদিনই ২১শে জুন আমি আমার লোকজনকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত ভারতের ভিতর চলে যেতে বাধ্য হই। ভারতে চলে যাওয়ার পর আমরা পূর্ণোদ্যমে নবাগত তরুণদের ট্রেনিং দিতে শুরু করি, যাতে করে গণবাহিনীর সাথে সাথে নিয়মিত বাহিনীও গড়ে উঠে। ভারতে চলে যাবার আগে থেকেই আমরা গণবাহিনী গড়ে তোলার জন্য ট্রেনিং দেয়া শুরু করি। এবং ভারতে যাবার পর ট্রেনিং আরও জোরদার করি। জুন মাস পর্যন্ত আমরা বেশি কিছু সংখ্যক যুবকদের ট্রেনিং দিয়েছিলাম।

যে সমস্ত টাস্ক দিয়ে দিয়ে গেরিলাদের ভিতরে পাঠাতাম, সে সমস্ত টাস্ক যাতে সুসংহত ও সুপরিকল্পিতভাবে সম্পন্ন হয়, সে ব্যাপারে আলোচনার জন্য জুলাই মাসের ৭/৮ তারিখে সমস্ত সেক্টর কমান্ডারদের মুজিব নগরে এক কনফারেন্স হয়। এই কনফারেন্স-এ প্রথম সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি আমাদের লক্ষ্য যে ভাষণ দেন তার মর্ম ছিল যে- পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আমাদের উপর যে অত্যাচার অবিচার করছে টার পরিপ্রেক্ষিতে আজ আমরা এখানে।

আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যে লড়াই করছি,টা স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত যেন চালিয়ে যেতে পারি। এতে আমাদের সবাইকে একই লক্ষ্য সামনে রেখে কার্য পরিচালনা করা উচিৎ। এ লক্ষ্যে পৌছাতে বিভিন্ন মহলের প্ররোচনায় আমরা যেন পথভ্রষ্ট না হই। বাংলাদেশ সরকার যথাসাধ্য সর্বপ্রকার সাহায্য করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। অস্ত্রশস্ত্র সমরসম্ভার বন্ধুরাষ্ট্র ভারত যতটুকু দেয় টা আমরা গ্রহণ করব। তাছাড়াও যদি সম্ভব হয় অন্য কোন রাষ্ট্র থেকেও আনার চেষ্টা করব। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে আমরা অনুপ্রাণিত হই।

কিভাবে আমাদের লক্ষ্যে পৌছাতে হবে এ ব্যাপারে পরে কর্নেল ওসমানীর নেতৃত্বে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করি। কনফারেন্স প্রায় দশদিন পর্যন্ত চলে। এই কনফারেন্সে বাংলাদেশের ভিতরে গেরিলা পদ্ধতিতে কিভাবে লড়াই চালাতে হবে সে পরিকল্পনা নেয়া হয়,যাতে করে সমস্ত সেক্টর একই ধরণের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে পারে। যেসব পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল তার মাঝে গুরুত্বপূর্ণ গুলো হলো-

১। সেক্টরের সীমানা সঠিকভাবে চিহ্নিত করা হয়।

২। গেরিলা তৎপরতা সুষ্ঠুভাবে চালাবার জন্য ভেতরে গেরিলা ঘাঁটি তৈরি করা।

৩। গেরিলা ঘাঁটিগুলোতে শুধু গেরিলা থাকবে নাহ। কিছু সংখ্যক নিয়মিত বাহিনীর লোকদেরও ঐ সমস্ত ঘাঁটিতে পাঠানো হবে যাতে গেরিলাদের সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারে।

৪। খবরাখবর আনা-নেওয়ার জন্য এক ইন্টেলিজেন্স চেইন তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

৫। প্রত্যেক গেরিলা বেইসে -এ একজন করে রাজনৈতিক উপদেষ্টা থাকবে। যার উপদেশে রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালিত হবে।

৬। প্রত্যেক গেরিলা ঘাঁটিতে একটি করে মেডিকেল টিম থাকবে। যারা গেরিলা চিকিৎসায় দায়িত্বভার এবং ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

৭। গেরিলা ওয়েলফেয়ারের সাথে সাথে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার ও চালিয়ে যেতে হবে যাতে করে পাকিস্তানী সৈন্যদের মনোবল নষ্ট হয়ে যায় এবং আমাদের জনসাধারণের মন অটুট থাকে।

৮। আমাদের সামরিক পরিকল্পনা (প্যাকটিক্যাল প্লান) এ রকম হওয়া উচিৎ যাতে করে পাক সেনাবাহিনী আইসোলেটেড হয়ে পড়ে।

৯। তাদের (পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে) প্রথম আইসোলেটেড করতে হবে এবং পড়ে তাদের এনিহিলেট (নিশ্চিহ্ন) করতে হবে।

১০। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র,যানবাহন,খাদ্যদ্রব্য ইত্যাদি যাতে চলাফেরা করতে না পারে সেজন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে।

১১। পাকিস্তান যেন বাংলাদেশ থেকে কাঁচামাল বা ফিনিশড প্রোডাক্ট রফতানী করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে না পারে সেজন্য এ দ্রব্য সামগ্রী সরকারী গুদাম ধ্বংস করতে হবে।

১২। কলকারখানা যেন চলতে না পারে সেজন্য বিদ্যুৎ এবং পেট্রোল ইত্যাদির সরবরাহ ব্যবস্থা বিধ্বস্ত করতে হবে।

১৩। গাড়ি ঘোড়া,রেলগাড়ি,বিমান,জলযান যেন ঠিকভাবে চলাচল করতে না পারে সেজন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

১৪। যে সকল মানুষ লোক পাক-সেনাবাহিনীর সহযোগিতা করবে তাদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে হবে এবং চরম ব্যবস্থা নিতে হবে।

১৫। ‘‘বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে” –পাকিস্তানী শাসকদের এই প্রচারণাকে মিথ্যা প্রমাণিত করার জন্য ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে অস্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। কনফারেন্স শেষে আমরা যার যার সেক্টরে চলে যাই এবং সকল পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য আমাদের নিজ নিজ সেক্টরে পরিচালনা পরিকল্পনা নেই।

আমি আমার ৩নং সেক্টরকে নিম্নলিখিত দশটি সাবসেক্টরে ভাগ করি। প্রত্যেকটি সাবসেক্টর যেসব সাবসেক্টর কমান্ডারদের অধীনে ছিল তাদের নামও দেওয়া হলঃ

১।আশ্রম বাড়ি, ২। বাঘাই বাড়ি( এ দুটি সাবসেক্টরের কমান্ডার ছিল প্রথমে ক্যাপ্টেন আজিজ তারপর ক্যাপ্টেন এজাজ ), ৩। হাতকাটা-ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান,৪।সীমানা-ক্যাপ্টেন মতিন, ৫। পঞ্চবটি-ক্যাপ্টেন নাসিম, ৬। মনতলা, ৭। বিজয়নগর (এই দুই সাবসেক্টর-এর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভুঁইয়া, ৮। কালাছড়া-লেঃ মজুমদার, ৯। কলকালিয়া, ১০। বামুটিয়া(এ দুটি সাবসেক্টরের কমান্ডার ছিলেন লেঃ মোরশেদ এবং লেঃ সাঈদ)

এই সেক্টরগুলিতে কনভেনশনাল যুদ্ধ ছাড়া গেরিলা যুদ্ধ চালাত। যুদ্ধ পরিচালনা ছাড়াও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে,বিভিন্ন বেইস-এ গেরিলা পাঠাবার দায়িত্ব এই সমস্ত সাবসেক্টর কমান্ডারদের উপর ন্যস্ত ছিল। সাবসেক্টর কমান্ডাররা সীমান্ত অতিক্রম করে ভেতরে পাঠিয়ে দিত। গেরিলাদের পাঠাবার নিশ্চিন্ত করারও সাবসেক্টর কমান্ডারদের দায়িত্ব ছিল। এই নিরাপত্তা নিশ্চিন্ত করতে কখনো তাদেরকে পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধেও লিপ্ত হতে হয়েছিল।

আমাদের প্রধান সেনাপতির নির্দেশ অনুযায়ী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আমরা আমাদের কর্মতৎপরতা জোর দার করি। প্রধান সেনাপতির নির্দেশের পূর্ব থেকেই আমরা বাংলাদেশের ভেতরে গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধির জন্য বেইস নির্মাণ শুরু করেছিলাম। কিন্ত তার এই নির্দেশ মোতাবেক এ বেইসগুলোকে আরও সুসংহত করি। যাতে এক সেক্টরের গেরিলার সাথে অন্য সেক্টরের গেরিলাদের সংঘর্ষ না ঘটে সেজন্য আমাদের বেইসগুলোকে এমনভাবে তৈরি করি যেন বর্ডারিং বেইসগুলো একে অন্যর সাথে সুপরিকল্পিতভাবে পরিচালিত হতে পারে।

সেপ্টেম্বরের (১৯৭১) প্রথম দিক থেকে ডিসেম্বরের (১৯৭১) মাঝামাঝি পর্যন্ত আমাদের গেরিলা তৎপরতা এমনভাবে বেড়ে যায় যে,পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা বাংলাদেশের ভিতরে ছিলনা বললেই চলে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের ভিতরে নিম্নলিখিত গেরিলা অপারেশনগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য-

 

 

রায়পুরার নিকটবর্তী বেলাবো অপারেশন১৪ই জুলাইঃ

পাকিস্তান সেনাবাহিনী তখনো রায়পুরা, নরসিংদী, কাপাসিয়া, মনহরদী, কুলিয়াচর, কটিয়াদী এলাকায় ১৪ই জুলাই পর্যন্ত তাদের নিয়ন্ত্রণ আনতে পারেনি। কারণ আমাদের নিয়মিত বাহিনী দ্বারা গঠিত এই ক্যাম্পগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। তাদের এসব জায়গা থেকে উচ্ছেদ করার জন্য পাকবাহিনী লঞ্চের সাহায্যে বেলাবো অভিমুখে অগ্রসর হয়। বেলাবোতে আমার যে দল ছিল তার নেতৃত্ব করছিল সুবেদার বাশার। সে বেলাবোর নিকটবর্তী এলাকা টোকের কাছে তার লোকজন দ্বারা এক অ্যামবুশ এর তৈরি করে। দুর্ভাগ্যবশত সুবেদার বাশারের এ অ্যামবুশের খবর পাকবাহিনী নিশ্চয়ই কোন বিশ্বাসঘাতকের সহযোগিতায় জানতে পারে। তাই পাকিস্তানী সৈনিকরা যে মটর লঞ্চে করে আসছিল, তার মধ্যে থেকে কিছুসংখ্যক পাকসৈনিক সর্বাগ্রে নৌকা করে আসে এবং নৌকার বেশ কিছু পিছনেই আসছিল একখানা খালি লঞ্চ। যেহেতু সুবেদার বাশার এবং তার সাথীরা বসেছিল লঞ্চের অপেক্ষায়, নৌকা করে যেসব পাকসেনা সর্বপ্রথম অগ্রসর হয়েছিল তা তারা টের পায়নি। এবং যেইমাত্র খালি লঞ্চ তাদের সামনে আসে তারা সে লঞ্চের উপর গোলাগুলি করে। তাদের এ গোলাগুলির সাথে সাথে পাকবাহিনীর অগ্রগামী এবং পেছন থেকে অগ্রসরমান সৈনিকরা এ দলটিকে চারিদিকে ঘিরে ফেলে। আমাদের সাহসী সৈনিকগণ শত্রুর হাতে অস্ত্র সমর্পণ না করে বীরবিক্রমে লড়তে থাকে। এ লড়াই কয়েক ঘন্টা অব্যাহত থাকে। অবশেষে কিছুসংখ্যক সৈনিক পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। যারা এ যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন তারা হলেন, ১। সুবেদার আবুল বাশার,২। সিপাহী আব্দুল বারী, ৩।সিপাহী নুরুল ওহাব, ৪। সিপাহী সোহরাব হোসেন, ৫। সিপাহী মমতাজ উদ্দীন. ৬। সিপাহী আব্দুল হক, ৭। সিপাহী আব্দুস সালাম।

সুবেদার বাশারের মৃতদেহ হলদী ক্ষেতের ভিতর থেকে উদ্ধার করা হয়,দেখা যায় তার পেটের ক্ষতস্থানটি তাঁর নিজের শার্ট দিয়ে বাঁধা। এলএমজি মৃতদেহের পাশেই ছিল। মূল্যবান কাগজপত্র মৃত্যুর আগে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে তিনি পাশে ফেলে রাখেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ সুবেদার বাশার এবং তাঁর সঙ্গীদের অবদান ভুলবার নয়। বেলাবোর জনগণ এখনো তাঁকে এবং তাঁর সঙ্গীদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে।

 

 

 

কটিয়াদি অ্যামবুশ,৭ই আগস্ট,১৬ আগস্ট

পাকিস্তান সেনাবাহিনী বেলাবোতে জয়লাভের পর এক প্রকার বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। তারা এমনি আত্মতৃপ্তি নিয়ে চলাফেরা করত যে,তারা মনে করেছিল যে তাদের চলাফেরায় বাধা দেবার আর কেউ নাই। আমাদের সৈনিকরাও চুপ করে ছিল না। তারও সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। ৭ই আগস্ট থেকে আমাদের সৈনিকরা পাকসেনাদের গতিবিধি লক্ষ্য করেছিল। অবশেষে ১৬ আগস্ট সে সুযোগ আসে। ঐদিন পাকিস্তানী সৈনিকরা কয়েকখানা মটর লঞ্চে করে কটিয়াদীর দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। আমাদের সৈনিকরাও নদীর পাড়ে তাদের অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে বসে থাকে। সমস্ত মটর লঞ্চ যখন ঐ ফাঁদের ভিতরে চলে আসে তখন চারদিক থেকে তাদের উপর গোলাবর্ষণ শুরু করা হয়। এই গোলাগুলিতে বেশ কয়েকখানি লঞ্চ ডুবে যায় এবং বহু শত্রুসেনা হতাহত হয়। কিছু সংখ্যক পাকিস্তানী সৈনিক পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় এবং মনোহরদী রিইফোর্সমেন্ট এসে আহতদের উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। এই উদ্ধারকারর্যের জন্য পাক সেনাবাহিনী হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে বাধ্য হয়। পরে জানা যায় যে, ১৪৩ জন নিহত এবং বহুসংখ্যক আহত হয়েছিল।

এ অ্যামবুশে নেতৃত্ব দিয়েছিল হাবিলদার আকমল আলী। আমাদের সৈনিকরা এ যুদ্ধে বিশেষ সাহসের পরিচয় দেয় এবং বেলাবোতে আমাদের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল তার প্রতিশোধ গ্রহণ করি।

 

মুকুন্দপুর অ্যামবুশ১৩ই সেপ্টেম্বরঃ

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রেলপথে যাতায়াত বাধা সৃষ্টি করার জন্য আমরা রেলওয়ে লাইনে ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন পুঁতে রাখতাম। এ ব্যাপারে পাকিস্তানীরা বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করে। তারা রেলগাড়ির ইঞ্জিনের আগে দুটো কি তিনটে ওয়াগন জুড়ে দিত। এতে ঐ ওয়াগনগুলোই প্রথম বিধ্বস্ত হত এবং ট্রেনের বিশেষ কোন ক্ষয়ক্ষতি হত না।

তাদের এই ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা অন্য কৌশল অবলম্বন করি,মাইন এমনভাবে ফাটে পাতে করে ট্রেনের বিশেষ অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তাই ট্যাংক বিধ্বংসী মাইনকে ফাটাবার জন্য আমরা বিদ্যুতের সাহায্য (ইলেকক্ট্রিক ডেটোনেটিং সিস্টেম) আমাদের ইচ্ছামত মাইন ফাটাবার ব্যবস্থা নেই। পাকবাহিনী যখন আখাউড়া-সিলেট রেলগাড়ি চালু করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে, তখন আমরা কিছুদিন তাদের গতিবিধি এবং ক্রিয়াকলাপ লক্ষ্য করি। এই পদ্ধতিতে ট্রেন ধ্বংস করার জন্য মুকুন্দপুর এলাকাতে এক অ্যামবুশ তৈরি করি। অ্যামবুশ লাগানো হয়েছিল দু’খানা এন্টি ট্যাংক মাইন দিয়ে। তার সাথে বৈদ্যুতিক তার যোগ করে প্রায় ৩০০ গজ দূরে রিমোট কন্ট্রোল স্থাপন করা হয়-যেখান থেকে সুইচ টিপলে যেন মাইন ফেটে যায়। এই সুযোগ এসেছিল ১৩ সেপ্টেম্বর। ঐ দিন পাক-বাহিনীর প্রায় এক কোম্পানী সৈন্যর ট্রেনে আখাউড়া থেকে মুকুন্দপুর হয়ে হরশপুর পর্যন্ত যাবার পরিকল্পনা ছিল। আমাদের ফাঁদ ছিল মুকুন্দপুর এবং হরশপুরের মাঝামাঝি জায়গায়, মুকুন্দপুরের নিকটে ঐ ট্রেনে দু’জন পাকিস্তানী অফিসার ছিল।

ট্রেনের সম্মুখভাবে দু’খানা বালি বোঝাই ওয়াগন লাগানো ছিল। রাত তখন প্রায় চারটা। যখন ট্রেন মুকুন্দপুর থেকে হরশপুরের দিকে যাত্রা করে তখনই আমাদের অ্যামবুশ পার্টি তৎপর হয়ে ওঠে। ট্রেন আস্তে আস্তে অগ্রসর হচ্ছিল। বালি বোঝাই ওয়াগন ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন পার হবার পর যখন ইঞ্জিন এবং সৈন্য বোঝাই মাইনের উপর আসে তখনই সুইচ টিপে মাইনকে ফাটানো হয়। এতে ইঞ্জিনখানা সৈন্য বোঝাই ওয়াগনসহ ধ্বংস হয়। এই অপারেশনে দু’জন অফিসারসহ ২৭ জন পাকসেনা নিহত হয় বলে জানান যায়। তাছাড়া অনেক আহত হয়েছিল। এই অ্যামবুশ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন লেঃ মোরশেদ। বৈদ্যুতিক প্রক্রিয়ায় (সিস্টেম) ট্রেন ধ্বংস করার পদ্ধতি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে এটাই ছিল প্রথম।

কালেঙ্গা জঙ্গলে অ্যামবুশ২৪শে সেপ্টেম্বরঃ

সিলেটের অভ্যন্তরে যে সমস্ত গেরিলা পাঠাতাম, তাদেরকে এই কালেঙ্গা জঙ্গলের মধ্যে দিয়েই পাঠাতাম। পাক সেনাবাহিনী এ খবর পেয়ে কালেঙ্গা জঙ্গলে তাদের তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। তারা যাতে নিরাপদে চলফেরা না করতে পারে সেজন্য কালেঙ্গা রেস্ট হাউসের পাশে কিছুসংখ্যক এন্টি-পারসোনাল মাইন পুঁতে রাখা হয় এবং এর প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করার জন্য লোক নিয়োগ করি। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কিছু সৈনিক সেপ্টেম্বর মাসের ২০/২১ তারিখে কালেঙ্গা জঙ্গলে আসে এবং কিছুক্ষন ঘোরাফেরার পর তারা রেস্ট হাউসের দিকে ফিরে যায়। রেস্ট হাউসের দিকে ফিরে যাবার সময় তাদের পায়ের চাপে দু’খানা মাইন ফেটে যায় এবং তাতে একজন মারা যায় ও দু’তিনজন আহত হয়। পাকসেনারা সেখান থেকে সিন্দুরখানের দিকে চলে যায়। পরদিন বেশ কিছুসংখ্যক লোক আসে সে মাইন পরিস্কার করা এবং সেখানে ঘাঁটি নির্মাণের পরিকল্পনা করার জন্য। ঐ দিন যদিও আমাদের লোক সেখানে ছিল,সেদিন তাদের কোন বাধা দেয়া হয়নি। আমাদের সৈনিকরা তাদের উপর মারাত্মক আঘাত হানার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

২৪ শে সেপ্টেম্বর আমাদের সৈনিকরা সিন্দুরখান-কালেঙ্গা রাস্তার উপর ছোট ছোট পাহাড়ের উপর অ্যামবুশ লাগিয়ে শত্রুর অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে থাকে। ঐদিন পাকসেনারা বেশকিছু লোকসহ কালেঙ্গার দিকে আসছি। তাদের দলের সবচেয়ে আগে ছিল প্রায় ২০/২৫ জন বাঙ্গালী রাজাকার। তাদের পেছনেই ছিল পাকিস্তানী সৈন্য। দু’দিন আগে যখন তারা এখানে ঘাঁটি নির্মাণের পরিকল্পনা করার জন্য এসেছিল তখন কোন বাধা পায়নি। তাই ২৪ তারিখ যখন তারা কালেঙ্গার দিকে আসছিল সেদিন বেপরোয়াভাবেই অগ্রসর হচ্ছিল। আমাদের সৈনিকরাও তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করে বসেছিল। রাজাকারের দল যখন আমাদের ফাঁদের ভিতর চলে আসে তখন তাদের কিছু বলা হয়নি। আমাদের সৈনিকরা শুধু পাকসেনাদের অপেক্ষায় ছিল। সে জায়গাতে আমাদের অ্যামবুশ ছিল সেখান থেকে পাকসেনাদের অগ্রসরমান সব সৈনিককেই দেখা যাচ্ছিল, তাই রাজাকারদের দল আমাদের ফাঁদের ভিতর থেকে যখন বেরিয়ে যায় তখন তাদের কিছু করা হয়নি। যখন পাকিস্তানী সেনারা আমাদের ফাঁদের ভিতরে ঢুকে পড়ে তখনি আমাদের সৈন্যরা সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং চারদিক থেকে তাদের উপর গোলাগুলি শুরু করে। তাদের দল্টি বিস্তীর্ণ এলাকার উপর দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। এতে সকল সৈনিক আমাদের ফাঁদের ভেতর পৌছাতে পারেনি। যারা ভিতরে প্রবেশ করেছিল, তারা প্রায় সবাই নিহত হয়। পেছনের যে সমস্ত পাকসেনা আমাদের ঘেরাওয়ের বাইরে ছিল,তারা তাদের বিপদগ্রস্থ সঙ্গীদের বাঁচাবার উদ্দেশ্য আমাদের সৈনিকদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। আমরা যেহেতু পরিখা খনন করে বসেছিলাম তাই শত্রুদের গোলাগুলি আমাদের কোনরূপ ক্ষতি করতে পারেনি। এমন সময় হটাৎ নায়েক আব্দুল মান্নান পরিখা থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে পড়ে এবং “জয় বাংলা” বলে চিৎকার করে ওঠে এবং এই বলে অগ্রসর হয় যে জীবিত পাকসেনাদের ধরে ক্যাপ্টেন সাহেবের(ক্যাপ্টেন আজিজ) সামনে হাজির করব এবং দেখব ক্যাপ্টেন সাব আমায় গলায় মালা পরান কিনা। তার দিন ফুরিয়ে গিয়েছিল তাই সে এরূপ বেপরোয়াভাবে পরিখা থেকে বেরিয়ে আসছিল। সে কিছুদূর অগ্রসর হবার পরই পাকসেনাদের মেশিনগানের গুলি তার বক্ষ এবং মস্তিস্ক ভেদ করে এবং সে কালেমা পড়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।

এ যুদ্ধে পাকসেনাদের একজন অফিসারসহ ৬১ জন সৈনিক নিহত হয়। এছাড়া কিছুসংখ্যক আহত হয়েছিল। কিন্তু তারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল।

মনোহরদী অবরোধ২১ শে অক্টোবরঃ

অক্টোবর মাস পর্যন্ত আমাদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়াতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের ছোটখাটো দলকে (ডিটাচমেন্ট) থানা হেডকোয়ার্টার পর্যন্ত পাঠাতে বাধ্য হয়েছিল। প্রত্যেক থানা হেডকোয়ার্টারের সৈন্যসংখ্যা এক কোম্পানির কম রাখতে সাহস পেত নাহ। এক কোম্পানী করে সৈন্য প্রত্যেক থানাতে দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠছিল না। কারণ কোন কোন স্থানে সৈন্যসংখ্যা এক ব্যাটালিয়নেরও বেশি রাখতে হত।

২৫শে মার্চ রাতে পাক সেনাবাহিনী পিলখানাস্থ ইপিয়ার ক্যাম্প আক্রমণ করে প্রায় ৭০০ থেকে এক হাজার ইপিয়ার-এর বাঙ্গালী সৈন্যকে জেলখানাতে আটকে রাখে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস পর্যন্ত তাদের উপর নানারকম নির্যাতন চালায় এবং তাদের কাছ থেকে এই প্রতিশ্রুতি নেয় যে তারা কখনো পাক সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করবে না এবং তাদের সুযোগ দেওয়া হবে আনুগত্য প্রমাণ করার জন্য। এই প্রতিশ্রুতি নিয়ে কিছুসংখ্যক ইপিআর সৈনিকদের পাকিস্তানী সেনাদের নেতৃত্বাধীনে তাদের থানায় থানায় মোতায়েন করা হয়। আমাদের এলাকায় যে সমস্ত জায়গায় তাদের মোতায়েন করা হয়েছিল সেসব জায়গা হল রায়পুরা, নরসিংদী, শিবপুর, মনোহরদী, কাপাসিয়া ওঁ কালীগঞ্জ ইত্যাদ। এসব জায়গাতে ইপিআর এবং পাক বাহিনীর লোকদের প্রায় সমান সমান ছিল। আমরা যেসব গেরিলা বেইস তৈরি করেছিলাম তারা প্রায় সবাই ইপিআর এর বাঙ্গালী সৈনিকদের সাথে যোগাযোগ করে ই-পি-আর এর সৈনিকদের আমাদের সাথে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করতে বললে তারা বলে যে তারা সংখ্যায় খুব কম। বেশিরভাগ এখনো জেলে আছে। তারা যদি পাকবাহিনীর কাছে আনুগত্য প্রমাণ করতে পারে তাহলে বাকী সৈনিকদেরও ছেড়ে দেওয়া হবে। এখন যদি তারা গেরিলাদের সাথে যোগ দেয়,তাহলে যে সমস্ত ইপিআর-এর লোক জেলে আছে তাদের সবাইকে মেরে ফেলা হবে। এমতাবস্থায় পাক সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ছেড়ে আসার সময় এখনো হয়নি। তবে সময় আসলে তারা মুক্তিবাহিনীর সাথে থাকবে বলে নিশ্চয়তা দেয়।

মনোহরদীতেও ছিল অনুরূপ এক ক্যাম্প। সেখানে পাকসেনাদের সংখ্যা ছিল ৩৬ জন এবং প্রাত্তন ই-পিআর-এর লোকসংখ্যা ছিল প্রায় ৪০ জন। ২১শে অক্টোবরের আগে থেকেই আমাদের গেরিলা বেইস যেটা মনোহরদীতে ছিল তাদের সাথে যোগসূত্র কায়েম হয় এবং এই প্রতিশ্রুতি নেয়া হয় যে যখন আমাদের মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ করবে তখন তারা আমাদের সাথে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে লড়বে। ২১ শে অক্টোবর হাবিলদার আকমল প্রায় এক কোম্পানি গেরিলা নিয়ে মনোহরদীতে পাকিস্তানী বেইস অবরোধ করে। এই অবরোধের সময় ইপিআর- এর যেসব লোক পাকিস্তানীদের সাথে ছিল তারা হাবিলদার আকমলের পক্ষে চলে আসে এবং যুদ্ধ শুরু হয়।

এ যুদ্ধ প্রায় কয়েক ঘন্টা স্থায়ী হয়। অবশেষে পাকবাহিনীর প্রায় ২৫ জনের মত সৈনিক মারা যায়। বাকী ১১ জন আমাদের সৈনিকদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানী সৈন্যদের বেঁধে আমার হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাবার সময় পথিমধ্যে ক্রুদ্ধ জনতা অনেককে পিটিয়ে মেরে ফেলে এবং মাত্র ৪ জনকে আমারা হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। এ যুদ্ধে হাবিলদার আকমলের কার্যাবলী অত্যন্ত প্রশংসনীয়। এ যুদ্ধে এটাই প্রমাণিত হয়েছিল যে,বাঙ্গালীরা যে যেখানেই ছিল আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতো।

এ সমস্ত উল্লেখযোগ্য অপারেশন ছাড়া আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন আমার সৈনিকরা সাফল্যজনকভাবে সমাধান করেছে। তার সংখ্যা এত বেশি যেসব বর্ণনা করা সম্ভব নয়। জুলাই মাসের ৭/৮ তারিখে মুজিব নগরে সেক্টর কমান্ডারদের যে কনফারেন্স হয়েছিল সে কনফারেন্সে-এ তদানীন্তন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং সেনাবাহিনীর প্রধান যেসব নির্দেশাবলী আমাদের দিয়েছিলেন সেগুলো আমরা যথাযথ ভাবে পালন করতে সক্ষম হই। তা নিদর্শন নিম্নে দেয়া হলঃ

গেরিলা তৎপরতা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলা ঘাঁটি তৈরি করার যে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল সে পরিপ্রেক্ষিতে আমার নিয়ন্ত্রাণাদিন এলাকার মধ্যে যে গেরিলা ঘাঁটি ছিল সেগুলো হলোঃ ১। সিলেটের চুনারুঘাট,হবিগঞ্জ এবং বানিয়াচং,২। ব্রাক্ষণবাড়িয়া মহকুমাতে নাসিরবগর,সরাইল,মুকুন্দপুর এবং ব্রাক্ষণবাড়িয়া, ৩। কুমিল্লাতে নবীনগর থানা, ৪। ঢাকা জেলায় রায়পুর, শিবপুর, নরসিংদী, কাপাসিয়া, কালিয়াকৈর, মনোহরদী, জয়দেবপুর এবং কালীগঞ্জ, ৫। ময়মনসিংহে গফরগাঁও এবং ভালুকা, ৬। কিশোরগঞ্জ মহকুমাতে কিশোরগঞ্জ, কুলিয়ার চর, বাজিতপুর, কটিয়াদী, পাকুন্দিয়া এবং হোসেনপুর।

এই ঘাঁটিগুলোর প্রায় সবগুলোতে কিছুসংখ্যক নিয়মিত বাহিনীর লোক ছিল এবং বাকি সব ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলা ছিল। এই সমস্ত ঘাঁটিগুলোর সাথে হেডকোর্টারের নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য লোক (রানার) নিয়োগ করা হয়েছিল। এ সমস্ত ‘রানার’ ছাড়াও রায়পুরা এবং মনোহরদীতে অবস্থিত দুটো ওয়ারলেস সেট-এর মাধ্যমে হেডকোর্টারের খবরাখবর দেওয়া হত।

প্রত্যেকটি গেরিলা বেইস-এ দু’জন করে রাজনীতিক উপদেষ্টা ছিল, যারা গেরিলাদের রাজনীতিক নির্দেশাবলী দিত। এই রাজনীতিক উপদেষ্টারা প্রত্যেক মাসেই আমার হেডকোর্টারে এসে যোগাযোগ করত। ভিতরে অবস্থিত ঘাঁটিগুলোর গেরিলা এবং নিয়মিত বাহিনীর বেতন-ভাতা রাজনীতিক উপদেষ্টা এবং ঘাঁটির কমান্ডারদের মাধ্যমে পাঠানো হত। তারা প্রতি মাসে এসে বিল দিয়ে যেত এবং পরের মাসে টাকা নিয়ে যেত।

আগস্ট-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমাদের গেরিলা তৎপরতা এত তীব্র এবং ব্যাপক হয়ে উঠেছিল যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লোকেরা ছোট দলে বিভক্ত হয়ে চলফেরা করতে সাহস পেত না। যে সকল স্থানে তাদের ঘাঁটি ছিল সে সমস্ত ঘাঁটির চারিদিকে বাঙ্গালী রাজাকার দিয়ে প্রথম এবং দ্বিতীয় বেষ্টনী তৈরি করে রাখতো যাতে ঘাঁটি আক্রান্ত হলে প্রথমেই বাঙ্গালীদের আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয় এবং তারা সতর্কতা অবলম্বন করতে পারে। এতে বোঝা যায় যে, পাক সেনাবাহিনী মনোবল বেশ ভেঙ্গে পড়েছিল। তারা এমন ভীত সস্ত্রস্ত ছিল যে, ওসব ঘাঁটির নিকটবর্তী এলাকার কোন প্রকার আওয়াজ বা শব্দ শুনলেই তারা ভয়ে আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে চিৎকার করে বলে উঠত’মুক্তি আগেয়া’।

গারি, ট্রেন,ষ্টীমার এবং লঞ্চ চলাচল এক রকম বন্ধই ছিল। হাট-বাজার,স্কুল-কলেজ স্বাভাবিক আকারে কখনো আসতে পারেনি। এমনকি বড় বড় শহরে,যেখানে পাকিস্তানীদের নিয়ন্ত্রণ ছিল সেখানেও স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ছিল নাহ বললেই চলে। অপরপক্ষে যেসব এলাকা আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল সেখানে জীবনযাত্রায় কোন বিঘ্ন সৃষ্টি হয়নি।

আগস্ট মাসের শেষের দিকে মুজিব নগর হেডকোয়ার্টার থেকে আমার কাছে এক নির্দেশ এসেছিল যে গেরিলা বাহিনীর সাথে সাথে নিয়মিত বাহিনী গড়ে তোলার জন্য যেন প্রস্তুত হই। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম তারিখে আমি আমার সেক্টরকে ( ৩নং সেক্টরকে )তিন ভাবে ভাগ করি এবং আমার বাহিনীকে পুনর্গঠিত করি। ৩নং সেক্টরে যেসব লোক ছিল তাদের দ্বারাই এটা করা হয়। ৩নং সেক্টরে,২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ১১ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এই দুই বাহিনীতে পরিনত করা হয়।

একটি হল ৩নং সেক্টর বাহিনী যা দশটি কোম্পানী দ্বারা গঠিত। সেক্টর হেডকোয়ার্টার থাকে হেজামারাতে,আর একটি ‘এস’ ফোর্স  হেডকোয়ার্টার স্থাপিত হয় ফটিকছড়াতে। এই ‘এস’ ফোর্স হেডকোয়ার্টারের অধীনে ২ এবং ১১ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল।

এসব হেডকোয়ার্টার এবং ব্যাটালিয়নে নিম্নলিখিত অফিসাররা ছিলঃ

১। ‘এস’ ফোর্স হেডকোয়ার্টারঃ কমান্ডার-লেঃ কর্নেল সফিউল্লাহ। খ)বি,এম (বিগ্রেড মেজর)-ক্যাপ্টেন আজিজুর রহমান গ) ডি,কিউ- ক্যাপ্টেন আবুল হোসেন। ঘ) সিগন্যাল অফিসার- ফ্লাইট লেঃ রউফ।

২। ২ ইষ্ট বেঙ্গলঃ ক) কমান্ডিং অফিসার- মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী। খ) কোম্পানি কমান্ডারগন হলেনঃ এ কোম্পানি- মেজর মতিউর রহমান এবং লেঃ আনিসুল হাসান, বি কোম্পানি-লেঃ বদিউজ্জামান এবং লেঃ সেলিম মোঃ কামরুল হাসান, সি কম্পানি-লেঃ মোহাম্মদ ইব্রাহীম, ডি কোম্পানি-লেঃ গোলাম হেলাল মোরশেদ। গ) এডজুট্যান্ট-লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ সাঈদ। ঘ) মেডিক্যাল অফিসার- লেফটেন্যান্ট আবুল হোসেন।

৩। ১১ ইষ্ট বেঙ্গলঃ ক) কমান্ডিং অফিসার-মেজর মোহাম্মদ নাসিম। খ) কোম্পানি কমান্ডারগণঃ বি কোম্পানি-মেজর সুবেদ আলী ভূঁইয়া এবং লেঃ আবুল হোসেন, ডি কোম্পানি-লেফটেন্যান্ট নাসের, সি কোম্পানি-লেফটেন্যান্ট নজরুল ইস্লাম, এ কোম্পানি- লেফটেন্যান্ট শামসুল হুদা বাচ্চু।গ) এডজুট্যান্ট- লেফটেন্যান্ট কবির। ঘ) মেডিক্যাল অফিসার- মইনুল হোসেন।

৪। ৩নং সেক্টরঃ ক) কমান্দার-মেজর নুরুজ্জামান খ) সিভিলিয়ান স্টাফ অফিসার-নুরুউদ্দিন মাহমুদ ও এম,এ,মহী। গ) কোম্পানি কমান্ডারগণ হলেনঃ মেজর মতিন,ক্যাপ্টেন এজাজা আহমদ চৌধুরী,লেঃ সাদেক,লেঃ মজুমদার, লেঃ জাহাঙ্গীর (এরা প্রত্যেকে দুটো করে কোম্পানি পরিচালনা করত)। অ্যাসিস্ট্যান্ট সিভিলিয়ান অফিসার-আলকাস মিয়া এবং আশেক হোসেন।

৩ নং সেক্টরকে আমি ‘এস’ ফোর্স- থেকে পৃথক করে দেই যাতে তারা সীমান্ত এলাকায় বহাল রাখতে পারে। ‘এস’ ফোর্স- কে পৃথক জায়গায় নিয়ে যাই যাতে তারা কনভেনশনাল ওয়ারফেয়ার- এর জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারে। এছাড়াও যেহেতু ব্যাটালিয়নে লোকসংখ্যা কম ছিল সেহেতু তাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য নতুন করে লোক নিয়োগ করা দরকার ছিল। এ ব্যাটালিয়নগুলোর শক্তি বৃদ্ধির জন্য আমি ১২০০ নতুন লোক ভর্তি করি। এ ভর্তি শেষ হয় সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে। অক্টোবর এবং নভেম্বর মাস পর্যন্ত তাদের ‘নিয়মিত’ যুদ্ধ করার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

এই ট্রেনিং-এর সময় আমাকে ২ ইষ্ট বেঙ্গল থেকে এক কোম্পানি সৈন্য পাঠাতে হয়েছিল বেলুনিয়ার যুদ্ধে ১০ ইষ্ট বেঙ্গলের সাথে ২ নং সেক্টরে যুদ্ধ করার জন্য। নভেম্বর মাসের ২১/২২ তারিখের দিকে এই যুদ্ধ সংঘঠিত হয় এবং বেলুনিয়া সেক্টর আমাদের হস্তগত হবার পর নভেম্বর মাসের ২৮ তারিখে আমি তাদেরকে আমার এলাকায় ফিরিয়ে আনি এবং আখাউড়া আক্রমণের পরিকল্পনা নেই।

‘আখাউড়া যুদ্ধের’ জন্য আমি দুই ব্যাটালিয়ন সৈনিক নিয়োগ করেছিলাম। এক ব্যাটালিয়ন অর্থাৎ ১১ ইষ্ট বেঙ্গলকে (এই ব্যাটালিয়ন-এর সৈনিকদের ১৫৭ জন ব্যতীত সবই নতুন ছিল) এ ভার দেওয়া হয় যে, তারা যেন পাকিস্তানী কোন সৈনিককে সিলেটের দিক থেকে অগ্রসর হতে না দেয়। আর ২ ইষ্ট বেঙ্গলকে এ কাজ দেওয়া হয় তারা যেন সিংগারবিল থেকে আখাউড়া পর্যন্ত সমস্ত এলাকা শত্রুমুক্ত করে। এ দু ব্যাটালিয়ন সৈন্য ছাড়াও আমি ৩নং সেক্টর থেকে দু কোম্পানি সৈন্য মোতায়েন করি যাতে পাকিস্তানী সৈন্যরা আগরতলা বিমানবন্দরের দিক থেকে আক্রমণ করে ২য় ইষ্ট বেঙ্গলের কোন ক্ষতি না করতে পারে।

এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা হয় ৩০ শে নভেম্বর/১লা ডিসেম্বর রাতে.৩০শে নভেম্বর পর্যন্ত আমার সৈন্যগণ এভাবে মোতায়েন করা হয়:

১১ ইষ্ট বেঙ্গল,মুকুন্দপুর,হরশপুর এলাকাগুলো তাদের নিয়ন্ত্রাধীনে আনে। এ ব্যাটালিয়নে নেতৃত্ব দেন মেজর নাসিম(বর্তমানে লেফটেন্যান্ট কর্নেল)।

তিন নং সেক্টরে যে দুটো কোম্পানি নিয়োগ করা হয়েছিল তারা আগরতলা বিমানবন্দরের উত্তর পশ্চিমাংশে খনন করে তাদের অবস্থা শক্তিশালী করে। এ কোম্পানি দুটোর নেতৃত্ব দেন মেজর মতিন।

দ্বিতীয় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট আক্রমণের জন্য তাদের স্টার্ট লাইনে তৈরি। এ ব্যাটালিয়নে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা হলেন ব্যাটালিয়ন কমান্ডার মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী এবং কোম্পানি কমান্ডারের মধ্যে ছিলেন-এ কম্পানি-মেজর মতিয়র, বি কোম্পানি-লেফটেন্যান্ট বদিউজ্জামান,সি কোম্পানি- লেফটেন্যান্ট ইব্রাহীম, ডি কোম্পানি লেফটেন্যান্ট মোরশেদ।

আক্রমণের সময় ছিল রাত ১টা। ১লা ডিসেম্বরের সকাল ৬ টা পর্যন্ত ব্যাটালিয়ন যুদ্ধ করে আজমপুর রেলওয়ে স্টেশনের উত্তরাংশ পর্যন্ত দখল করে। বেলা প্রায় তিনটা পর্যন্ত আজমপুর রেলওয়ে স্টেশন এবং তার দক্ষিণাংশ  আমাদের হস্তগত হয়। ১লা/২রা ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আজমপুর অবস্থানরত আমাদের সৈনিকদের উপর আক্রমণ চালায় এবং এতে আমাদের সৈনিকদের পিছু আসতে বাধ্য হয়। ২রা ডিসেম্বর পুনরায় আক্রমণ চালিয়ে রেলওয়ে স্টেশন আমরা পুনর্দখল করি। কিন্ত রেলওয়ে স্টেশনের সম্মুখভাবে পাকিস্তানীদের বাঙ্কার এতো মজবুত ছিল যে সম্পূর্ণ এলাকা স্বল্পসংখ্যক সৈন্য এবং স্বল্প পরিমান ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দখল খুবই কষ্টকর ছিল। ৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার ৪ ঠা ডিসেম্বর ভারতের ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন আখাউড়ার যুদ্ধে আমাদের সাথে মিলিত হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী আখাউড়াতে দক্ষিন এবং পশ্চিমাংশ দিয়ে আখাউড়াকে অবরোধ করে। অবশেষে পাক বাহিনী ৫ই ডিসেম্বর আখাউড়াতে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডের নিকট আত্মসমর্পণ করে। এ যুদ্ধে আমাদের যে সব সৈনিক শহীদ হয়েছেন তারা হলেন ১। নায়েক সুবেদার আশরাফ আলী খান। ২। সিপাহী আমীর হোসেন। ৩। লেফটেন্যান্ট বদিউজ্জামান। ৪। সিপাহী রুহুল আমীন। ৫। সিপাহী শাহাব উদ্দিন। ৬। সিপাহী মুস্তাফিজুর রহমান। আখাউড়া পতনের পর কিছুসংখ্যক সৈন্য ব্রাক্ষণবাড়ীয়াতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। পলায়নের সময় বেশ কিছু সংখ্যক সৈন্য আমাদের হাতে নিহত হয় এবং ধরা পড়ে।

এরপর ব্রাক্ষণবাড়ীয়াকে অতি সত্বর আক্রমণের পরিকল্পনা নেয়া হয়। এ আক্রমণ ব্রাক্ষণবাড়ীয়ার দুই দিক থেকে পরিচালিত হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। একদিক হল  ব্রাক্ষণবাড়ীয়াকে দক্ষিন দিক থেকে ব্রাক্ষণবাড়ীয়া শহর এবং অপরদিক হল উত্তর দিক থেকে সিলেট সড়ক দিয়ে ব্রাক্ষণবাড়ীয়া শহর পর্যন্ত। ভারতীয় সেনাবাহিনী আখাউড়া ব্রাক্ষণবাড়ীয়া রেললাইন এবং উজানিস্যা ব্রাক্ষণবাড়ীয়া সড়ক দিয়ে অগ্রসর হবে এবং আমার এস ফোর্স সিলেট ব্রাক্ষণবাড়ীয়া সড়ক দিয়ে অগ্রসর হবে। ৫ই ডিসেম্বর আমি আমার ফোর্সকে নিম্নলখিত নির্দেশ দেইঃ

৫ই ডিসেম্বর রাতে আমাদের যাত্রা শুরু হবে এবং বাহিনীর সামনে থাকবে ১১ ইষ্ট বেঙ্গল। আর ২য় ইষ্ট বেঙ্গল তাদের অনুসরণ করবে। তিন নং সেক্টরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে সে যেন তার সেক্টর কোম্পানি নিয়ে তেলিপাড়া ও মনতলা দখল করে নেয়। তাদের (১১ ইষ্ট বেঙ্গলকে)যে কাজ দেওয়া হয়েছিল তা হল চান্দুরার উত্তরাংশে একটি রোড ব্লক তৈরি করা যাতে সিলেট থেকে পশ্চাদপসারণকারীরা এ রাস্তায় না আসতে পারে। দ্বিতীয় কাজ হলো চান্দুরা থেকে সরাইল পর্যন্ত এলাকা শত্রুমুক্ত করা। এ নির্দেশ পালনের জন্য ব্যাটালিয়ান কমান্ডার নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নেনঃ

তিনি এক কোম্পানি সৈন্য মেজর সুবেদ আলী ভূঁইয়ার নেতৃত্বে চান্দুরার উত্তরাংশে রোড ব্লাক তৈরি করার জন্য পাঠিয়ে দেন এবং বাকী ব্যাটালিয়নকে চান্দুরা থেকে সরাইল পর্যন্ত এলাকা শত্রুমুক্ত করার নির্দেশ দিয়ে অগ্রসর হবার আদেশ দেন। এ ব্যাটালিয়ন হরশপুর দিয়ে চান্দুরার দিকে অগ্রসর হয়। মেজর সুবেদ আলী ভূঁইয়ার যে কোম্পানিকে চান্দুরার উত্তরাংশে রোড ব্লক তৈরি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। সে কোম্পানি রোড ব্লক তৈরি করে খবর পাঠায়। তখন ব্যাটালিয়নের বাকী সব লোক চান্দুরার নিকটবর্তী এলাকা পাইকপাড়াতে ছিল। রোড ব্লক তৈরির খবর পাবার পর ব্যাটালিয়ন কমান্ডার মেজর নাসিম ব্যাটালিয়ন এর বাকী সবাইকে চান্দুরা হয়ে শাহবাজপুর সরাইল এবং ব্রাক্ষণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হবার জন্য আদেশ দেন।

বেলা তখন প্রায় ১২টা। অপারেশনের অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করার জন্য আমিও তখন পাইকপাড়াতে ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টারে পৌঁছি। আমার সাথে ছিল আমার রানার। এই প্রায় এক হাজার গজ পেছনে ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টার এ কোম্পানিকে অনুসরণ করছিল। আমিও ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারের সাথে সাথে অগ্রসর হই। চান্দুরাতে যে পর্যন্ত পাকিস্তানী সৈন্য ছিল তারা পশ্চাদপসরণ করে শাহবাজপুরে আস্তানা তৈরি করে। ব্যাটালিয়ন কমান্ডারকে আমি নির্দেশ দেই যে যতো শীঘ্র সম্ভব শাহাবাজপুরে তিতাস নদীর উপরস্থ পুল দখল করতে,যাতে শত্রু সৈন্যরা সেটা ভেঙ্গে দিয়ে আমাদের অগ্রগতি রোধ করতে না পারে। তাই অগ্রসরমান কোম্পানি দ্রুতগতিতে অগ্রসর হচ্ছিল। ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারে আমিও আমার রানারসহ ৮ জন লোক ছিলাম।

এই হেডকোয়ার্টার যখন ইসলামপুরের নিকট পৌঁছে তখন পেছন থেকে একখান ট্রাক আসতে দেখা যায়। ট্রাকখানা যে রঙ্গের ছিল সে রকম একখান গাড়ী ১১ ইষ্ট বেঙ্গলেরও ছিল। ব্যাটালিয়ন কমান্ডার গাড়ীখানা দূর থেকে দেখে আমাকে বলে ‘স্যার তেলিয়াপাড়া নিশ্চয়ই আমাদের হস্তগত হয়েছে এবং আমার গাড়ীও চলে আসছে। ’এখানে বলে রাখা দরকার যে গাড়ী একমাত্র তেলিয়াপাড়া হয়ে আসতে পারতো। আমাদের গাড়ী ছাড়া অন্য কোন গাড়ী আসতে পারবে বলে বিশ্বাস ছিল নাহ। কেননা চান্দুরা এবং মাধবপুরের মাঝামাঝি জায়গায় আমাদের রোড ব্লক ছিল,যার কমান্ডার ছিল মেজর সুবেদ আলী ভূঁইয়া। গাড়ী আমাদের কাছে আসতেই ড্রাইভারকে ইশারা দিয়ে আসতে বলা হয় এবং গাড়ী থেমে যায়। আশ্চর্যের বিষয় যে গাড়ী আমাদের ছিল না। সে গাড়ীতে পাকিস্তানী সৈন্য বোঝাই ছিল। তারা তেলিয়াপাড়া থেকে পশ্চাদপসরণ করে আসছিল। গাড়ীতে পাকিস্তানী সৈন্য দেখে তাদের আত্মসমর্পণ এর নির্দেশ দেই। দু’চারজন অস্ত্র রেখে হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে যায় এবং তার মধ্য থেকে দুই একজন আমাদের সংখ্যা কম দেখে গুলাগুলি শুরু করে এবং গাড়ীর চারিদিকে লাফিয়ে পড়ে। গাড়ীর সামনের সিটে বসা ছিল একজন সুবেদার। সেও গাড়ী থেকে লাফিয়ে পড়ে আমাকে ধরে ফেলে। বাকি সৈন্যরা গাড়ী থেকে নেমে রাস্তার অপর পাশে চলে যায়। এসব সৈনিকদের অধিকাংশ ছিল পাঠান এবং মিলিশিয়া পোশাক পরিহিত।

আমরা ইসলামপুরের যে স্থানে ছিলাম সেখানে থেকে এক হাজার গজ দূরে শাহবাজপরের দিকে ছিল এক কোম্পানি সৈন্য। এবং আমাদের প্রায় মাইলখানেক পিছনে পাইকপাড়া থেকে ক্রস কানট্রি হয়ে চান্দুরার দিকে অগ্রসরমান বাকী সৈন্য। গাড়ীর দক্ষিন পার্শে এবং পেছনে আমাদের লোক অস্ত্র উঠিয়ে ছিল। গাড়ীর উত্তর পাশ দিয়ে লাফিয়ে পড়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা গ্রামের দিকে পালিয়ে যায় এবং সেখানে গুলাগুলি ছোড়ে। সুবেদার সামনের সিটে দক্ষিন পার্শে বসা ছিল। সে গাড়ী থেকে লাফিয়ে পড়ে আমাকে ধরে ফেলে। সুবেদার এর কাছে ছিল পিস্তল। আমার কাছেও ছিল পিস্তল। দুইজনের পিস্তল ছিল ‘পাউচ’এর মধ্যে। আমার এসএমজিটা আমার রানারের কাছে। রানার ছিল আমার পিছনে দাঁড়িয়ে। সুবেদার এবং আমার মাঝে ধস্তাধস্তি প্রচণ্ড। কেউ কারোর পিস্তল বের করার সুযোগ পাচ্ছিলাম নাহ। ইতিমধ্যে আমার রানার কয়েকবার সুবেদারকে লক্ষ্য করে গুলি করতে চেয়েছিল। হটাৎ আমার রানারের পায়ে গুলি লাগে এবং সে পড়ে যায়। পড়ে গিয়ে গুলি করার চেষ্টা করছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে মেজর নাসিমও গুলিবদ্ধ হয় এবং আহত হয়ে পড়ে যায়। আমি অবশেষে জুডো কায়দায় তার বেষ্টনী থেকে মুক্তি পাই এবং আমি জোরের সাথে তার মুখের চোয়ালে এক ঘুষি মারি। তাতে সে পড়ে যায় এবং গিয়ে আমার রানারকে ধরে ফেলে এবং স্টেন দিয়েই আমাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। তার এবং আমার মাঝে ব্যবধান ছিল মাত্র খুব বেশি হলে এক গজ। গুলি যে বেরিয়ে গেছে সেটা আমি দেখেছি কিন্ত কোথায় লেগেছে তা লক্ষ্য করিনি।

সে সময় আমাদের ‘একজন সৈন্য সেখানে রাইফেল উঁচিয়ে গুলি করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আমি তার কাছ থেকে রাইফেলটা নিয়ে সে সুবেদারের মাথায় বাড়ি দেই। সুবেদার মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। আমি রাইফেল দিয়ে তার মাথায় কয়েকবার আঘাত করেছিলাম। সে সময় আমাদের কোন সৈন্যই অবস্থানে ছিল না। তাদের সবার অবর্তমানে। ঐ সুবেদারকে মেরেছিলাম। আমরা যখন ধস্তাধস্তি, গোলাগুলিতে ব্যস্ত ছিলাম তখন আমাদের সম্মুখে যে কোম্পানি অগ্রসর হচ্ছিল তারা পেছনের দিকে আসে এবং যারা পেছন থেকে আসে তারাও সম্মুখে অগ্রসর হ। ঠিক এ সময় আমি দেখি যে আর একখান গাড়ী পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সেটা একটা বাস ছিল। সে বাস থেকে অবতরণ করছিল পাকিস্তানী সৈন্য। আমি তা দেখে রাইফেল উঁচিয়ে তাদের উপর গুলি করার প্রস্তুতি নেই। কিন্তু দেখলাম যে রাইফেলটা ভেঙ্গে গেছে। রাইফেলটা ছুড়ে ফেলে আমি চিৎকার করে বলি আমার স্টেন কোথায়? এবং সাথে সাথে পিস্তল বের করি। পিস্তল বের করে দেখি সেটাও বিকল হয়ে গেছে। তখন বুঝতে পারলাম সুবেদার যখন আমাকে এসএমজি দিয়ে গুলি করেছিল তা পিস্তলে লেগেছিল। পিস্তলে দুটো গুলির আঘাত বিদ্যমান ছিল। পিস্তলটাকে আমি আবার পাউচ-এর ভিতর রেখে কোন উপায় না দেখে এক ডোবার ভিতর লাফিয়ে পড়ি। আমার পরনে ছিল অলিভ গ্রীন পোশাক। ডোবায় ছিল কাদা। অলিভ গ্রীন আর কাদা মিলে দেখতে প্রায় মিলিশিয়া পোশাকের মতোই হয়ে গিয়েছিল। আমি তখন দেখছিলাম যে গাড়ী থেকে প্রায় ২০/২৫ জন লোক নেমে ঐ গ্রামের চারদিকে অবস্থান নিচ্ছে। আমি যে ডাবার মাঝে ছিলাম তা তারা দেখেছিল। বুঝতে পারলাম যে কোন মুহূর্তে তারা আমাকে গুলি করবে। ভাবছিলাম কাদাপূর্ণ ডোবার ভিতর মরার চেয়ে আর একবার চেষ্টা করে দেখা যাক। তাই আমি ডোবার মধ্য থেকে উঠেই তাদের মধ্য দিয়েই চলে যাই এবং এক বাড়িতে ঢুকে পড়ি। ঐ বাড়িতে একটা খোলা ঘরের ভিতরে ঢুকে সেখানে বসে পড়ি এবং মৃত্যুর প্রহর গুনতে থাকি। কারণ সে বাড়ির চারিদিকেই পাকিস্তানী সৈন্য মোতায়েন ছিল। আমি যখন ঘরের ভিতর বসেছিলাম তখন আমাদের সৈন্যরা পাকিস্তানী বাহিনীর দুই দিক থেকে আক্রমণ করে। বেলা তখন প্রায় ৪টা।

এ আক্রমণে পাকিস্তানী সৈন্যদের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। আত্মরক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পিছনে হটতে থাকে। পশ্চাদপসরণকালে সবাই ধরা পড়ে। এ খন্ডযুদ্ধে পাকিস্তানীদের ২৫ জন মারা যায় এবং ঐ দিন ১১ জনকে জীবিত অবস্থায় ধরা হয়। পরের দিন আরও তিনজনকে ধরা হয়। আমাদের দুইজন শহীদ হয় এবং ১১ জন আহত হয়। এই খন্ডযুদ্ধে যারা সাহসের পরিচয় দিয়েছিল তারা হলঃ ১। লেফটেন্যান্ট নজরুল ইসলাম। ২। নায়েক মুস্তফা আলী। ৩। হাবিলদার আবুল কালাম। ৪। হাবিলদার রফিক (শহীদ)।

এ যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন হাবিলদার রফিক এবং সিপাহী মুজিবর রহমান। আমাদের ডাক্তার লেফটেন্যান্ট মইনুল ইসলাম আহত হন। তাই আহতদের পাকিস্তানী ট্রাকে (আমাদের দ্বারা দখলকৃত) করে চান্দুরার দিকে নিয়ে যাই। সাথে কোন ড্রাইভার না থাকায় আমি নিজে গাড়ী চালিয়ে চান্দুরার দিকে নিয়ে যাই।এ ঘটনা এতো অল্প সময়ের মধ্যে ঘটেছিল যে, পেছনে থেকে যারা অগ্রসর হচ্ছিল তারা ঘটনাস্থলে তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে পারেনি। আমি যখন গাড়ী চালিয়ে চান্দুরার দিকে যাচ্ছিলাম তখন আমাদের লোক মনে করেছিল যে শত্রুরা পালিয়ে যাচ্ছে। তখন তারা আমাদের উপর মেশিন গান দিয়ে গুলিবর্ষণ করে। আল্লাহ অপার করুণায় তাদের মধ্যে কেউ হয়ত আমাকে চিনতে পারে এবং গুলিবর্ষণ বন্ধ করে। আমি কোম্পানি লোকদের ভিতর দিয়ে গাড়ী যখন চান্দুরার দিকে যাচ্ছিলাম তখন পেছনের সর্বশেষ যে কোম্পানি (আমাদের) ছিল তারা ভেবেছিল যে শত্রু এই কোম্পানির হাত থেকেই রক্ষা পেতে সক্ষম হয়েছে।তাই তারাও আমার উপর বেপ্রোয়াভাবে গুলিবর্ষণ করে।এতে গাড়ীর উইন্ড স্ক্রীন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। কিন্ত এবার খোদার অসীম কৃপায় পূর্বের মতো বেঁচে যাই। তারপর চান্দুরায় পৌঁছে আহতদের চিকিৎসা ব্যবস্থা করি। যেহেতু সবাই গুরুতরভাবে আহত হয়েছিল,তাই খুব দ্রুত তাদের হাসপাতালে পৌঁছাবার ব্যবস্থা নেই। সবাইকে স্ট্রেচারে করে আগরতলা পাঠিয়ে দেই।

ব্যাটালিয়ন কমান্ডার নাসিম এ খন্ডযুদ্ধে আহত হন। তার পরবর্তী সিনিয়র সুবেদ আলী ভূঁইয়ার উপর থেকে আমার আস্থা চলে গিয়েছিল এজন্য যে, সে রোড ব্লক করা সত্তেও কিভাবে শত্রুরা আমাদের পেছনে চলে আসলো? আমার রিয়ার হেড কোয়ার্টার এর সাথে আমার কোন যোগাযোগ ছিল না।কারন এ যুদ্ধে অয়ারলেসটাও নষ্ট হয়ে যায়। তাই আমি অন্য কোন অফিসার এনে এ ব্যাটালিয়নের কমান্ডার পদে নিয়োজিত করার সিদ্ধান্ত নিলাম।

এ ব্যাটালিয়ন শতকরা ৮০জন সৈনিক ছিল নতুন শিক্ষাপ্রাপ্ত এবং এটাই ছিল খন্ডযুদ্ধের মাধ্যমে তাদের প্রথম অপারেশন। যুদ্ধে ব্যাটালিয়ন কমান্ডার আহত হওয়াতে সৈনিকদের মনোবল একটু দমে যায়। আমি আবার পাইকপাড়ার দিকে ফিরে আসার সময় লে. নাসিমকে ব্যাটালিয়ন নিয়ন্ত্রনে রাখতে নির্দেশ দিয়ে আসি এবং তাঁকে এও বলে আসি যে আমি অফিসার নিয়ে আসছি। পাইকপাড়ায় পৌঁছে আমি সিদ্ধান্ত নেই যে যতো শীঘ্র হোক আমাকে পেছনে যেতে হবে এবং সেখান থেকে অফিসার আনতে হবে। আমি পেছনে না গেলে হয়তো অন্য কোন অফিসারকে আনা সম্ভব নয়। কারণ তারা কোন না কোন কমান্ড-এ আছে। এই অসুবিধার জন্য আমি সেদিন রাতেই রিয়ার হেডকোয়ার্টারে চলে যাই এবং সেক্টর কোম্পানী কমান্ডার মেজর মতিনকে এবং আমার বিএম ক্যাপ্টেন আজিজকে এই ব্যাটালিয়নে যোগ দিতে নির্দেশ দেই। মেজর মতিনকে ব্যাটালিয়নের কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ করি।

৭ই ডিসেম্বর সকালে এ দুইজন অফিসার নিয়ে আমি পাইকপাড়া ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টারের উদ্দেশ্য যাত্রা করি এবং বেলা প্রায় দুটোর দিকে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারে পৌঁছি।

মেজর মতিনকে নতুন ব্যাটালিয়ন কমান্ডার নিয়োগ করে তাকে ব্যাটালিয়নের ভার গ্রহণ করতে বলি

এবং আমাদের অগ্রগতি যেন রোধ না হয় সে জন্য সামনে অগ্রসর হবার জন্য নির্দেশ দেই।বলা বাহুল্য, ৬ই ডিসেম্বর আমরা ইসলামপুরের খন্ডযুদ্ধে লিপ্ত থাকাতে শাহবাজপুরের তিতাস নদীর উপর সময় মতো দখল না পারায় পাকবাহিনী সে পুলটি ভেঙ্গে দেয়।

পুলটি ভেঙ্গে যাওয়াতে নদীর ওপারে পাকিস্তানী সৈন্যসংখ্যা কি পরিমান ছিল তা না জেনে অগ্রসর হওয়া সম্ভব ছিল না। তাই আমি ব্যাটালিয়ন কমান্ডারকে আমি শিগগির পাক বাহিনীর আস্তানা সম্বন্ধে খবর নেওয়ার নির্দেশ দেই।ব্যাটালিয়ন কমান্ডার ব্যাটালিয়নে একেবারে নতুন এবং পৌঁছেছিল প্রায় বিকেলের দিকে। তাই তাকেও খবরাখবর নেওয়ার জন্য একটু সময় দিতে হয়েছিল। ৭ই ডিসেম্বর রাতে এক কোম্পানী সৈন্য শাহবাজপুরের দিকে পাঠানো হয় এবং রাতের মধ্যেই যখন খবর পাওয়া গেল যে সেখানে সৈন্যসংখ্যা কম তখন সে কোম্পানী নদীর অপর পার দখল করে নেয়। এ সংবাদ পাওয়া গেল ৮ই ডিসেম্বর সকালে। খবর পাবার সাথে সাথেই ব্যাটালিয়নের বাকী কোম্পানী শাহবাজপুরের দিকে অগ্রসর হয়।

যে কোম্পানী ৭/৮ ডিসেম্বর রাতে শাহবাজপুর দখল করেছিল তার অধিনায়ক ছিল মেজর সুবেদ আলী ভূঁইয়া। আমি ব্যাটালিয়ন কমান্ডারকে নির্দেশ দেই,মেজর সুবেদ আলী ভূঁইয়া যেন তার কোম্পানী নিয়ে সরাইলের দিকে অগ্রসর হয়। কোম্পানী সরাইল পর্যন্ত পাকিস্তানীদের কোন বাঁধা পায়নি।আমার এস ফোর্সের অগ্রভাগ যখন সরাইলে পৌঁছে তখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন ব্রাক্ষণবাড়িয়াতে পৌঁছে গিয়েছিল। ব্রাক্ষণবাড়িয়া শত্রু না থাকাতে কোন যুদ্ধ হয়নি। পাকবাহিনী ব্রাক্ষণবাড়িয়া এবং সরাইল ত্যাগ করে আশুগঞ্জ এবং ভৈরববাজারে একত্রিত হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী আশুগঞ্জের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। আমি সময় নষ্ট না করে ব্রাক্ষণবাড়িয়া দিকে অগ্রসর না হয়ে আমার ফোর্সকে নির্দেশ দেই আশুগঞ্জের দিকে রওনা হবার জন্য। ৮ই ডিসেম্বর বিকাল পর্যন্ত আমার ফোর্সকে আজমপুর এবং দুর্গাপুর পৌঁছে। আমার ফোর্স-এর অগ্রভাগে তখন পর্যন্ত ছিল ১১ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, দ্বিতীয় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ঐ দিন ছিল শাহবাজপুরে।

আমার হেডকোয়ার্টার আমি তৈরি করে সরাইলে,যেখানে ১১ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২ কোম্পানী সৈন্য ছিল। ১১ ইষ্ট বেঙ্গলের বাকী দুই কোম্পানী সৈন্য আজমপুর এবং দুর্গাপুরে ছিল। শাহবাজপুরে কোম্পানী নেতৃত্ব দিয়েছিল মেজর সুবেদ আলী ভূঁইয়া এবং দুর্গাপুরে লে.নাসের। আমার ফোর্স যখন আজমপুর এবং দুর্গাপুরে অবস্থান করছিল তখন ভারতীয় ৩১১ মাউন্টেন ডিভিশনের তিনটি ব্যাটালিয়ন নিম্নলিখিত স্থানে মোতায়েন ছিল ১০,বিহার রেজিমেন্ট দুর্গাপুরের দক্ষিনে, ১৮ রাজপুত রেজিমেন্ট তালশহর এবং দুর্গাপুরের মাঝামাঝি জায়গায়,৪ গার্ড তালশহরে এবং ৭৩ মাউন্টেন ব্রিগেড ব্রাক্ষণবাড়িয়াতে।

আশুগঞ্জের সন্নিকটবর্তী হবার পর আমরা সামনে অগ্রসর হতে পারছিলাম নাহ। কারণ পাক বাহিনী ভৈরব বাজার থেকে আমাদের উপর দূরপাল্লার কামানের গোলাবর্ষণ করছিল অবিশ্রান্তভাবে। কিন্ত ভারতীয় দূর পাল্লার কামান তখন আগরতলা এবং সিঙ্গারবিলের আশেপাশে ছিল। আগরতলা এবং সিঙ্গারবিল থেকে তাদের গোলা ভৈরব পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছিল না। তাই আমাদের অগ্রগতিতে বাঁধা পড়ে। ৮ই ডিসেম্বর এভাবে অতিবাহিত হয়। ৯ই ডিসেম্বর আমার সৈনিকরা আজমপুর এবং দুর্গাপুর থেকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে আশুগঞ্জের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। ভারতীয় ৩১১ মাউন্টেন ব্রিগেডও অনুরুপভাবে অগ্রসর হচ্ছিল। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আশুগঞ্জ এবং ভৈরবের ঘাঁটি খুবই শক্তিশালী ছিল। কারণ আখাউড়া,তেলিয়াপাড়া এবং ব্রাক্ষণবাড়িয়া এসব স্থানে তাদের ১৪, ডিভিশন ছিল। তারা বিভিন্ন স্থান থেকে পশ্চাদপসরণ করে। সমস্ত ফোর্স ভৈরব এবং আশুগঞ্জ একত্রিত করে। যদিও তারা আমাদের চেয়ে বেশি ছিল তবুও তাদের মনোবল ছিল না বললেই চলে। ৯ই ডিসেম্বর এভাবে দূরপাল্লার কামানের গোলাগুলি চলে। ১০ই ডিসেম্বর ভোরের দিকে ১৮ রাজপুত রেজিমেন্ট আশুগঞ্জের পাকিস্তানী প্রতিরক্ষাব্যূহের ভিতর ঢুকে পড়ে এবং এক প্রকার পাকিস্তানী ফাঁদের ভিতর পড়ে যায়। তাই ১০ বিহার রেজিমেন্টর এবং আমার ফোর্স ১১ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট-এর দুটো কোম্পানী তাদের সে ফাঁদ থেকে মুক্ত করার জন্য দুর্গাপুরের দিক থেকে আশুগঞ্জ আক্রমণ চালায়। যখন এ আক্রমণ চলছিল তখন আমি দুর্গাপুরে। বেলা প্রায় সাড়ে দশটায় পাকিস্তানী সৈনিকরা ভৈরব পুলের আশুগঞ্জের সংলগ্ন অংশ ডিনামাইট দ্বারা উড়িয়ে দেয়। ভারতীয় এক স্কোয়াড্রন ট্যাংকও দুর্গাপুরের দিক থেকে এ আক্রমণে অংশ নেয়। যেহেতু ১৮ রাজপুত রেজিমেন্ট ফাঁদের ভেতর ছিল,তাদের সে ফাঁদ থেকে উদ্ধার করার জন্য বেপ্রোয়াভাবে আক্রমণ চালাতে হয়। ভারতীয় ট্যাংকগুলিও পাকিস্তানী ট্যাংকবিধ্বংসী ফাঁদের ভিতর পড়ে যায়। ১৮ রাজপুত রেজিমেন্ট ফাঁদ থেকে মুক্ত হবার সুযোগ পায়। কিন্ত উভয় দলেরই ভীষণ ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ যুদ্ধে পদাতিক ছাড়াও ভারতীয় ৪টি ট্যাংক বিধ্বংস হয়। ১০ তারিখের এই যুদ্ধের পর আমরা আবার পিছনে ফিরে আসি এবং আশুগঞ্জ ও ভৈরব আক্রমণের জন্য পরিকল্পনা নেই। ১০/১১ ডিসেম্বর রাতে যে সব পাকিস্তানী সৈন্য আশুগঞ্জ ছিল,তারা ভৈরব চলে যায়। ১১ই ডিসেম্বর ভারতীয় ১৯ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানী হেলিকপ্টারযোগে নদীর অপর পাড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ঐ দিনই বেলা প্রায় সারে এগারোটায় ভৈরব পুলের ভৈরব সংলগ্ন অংশ ডিনামাইট দিয়ে ভেঙ্গে দেওয়া হয়। এবং তার সাথে আশুগঞ্জ আমাদের হস্তগত হয়। ভৈরব তখন অবরোধ অবস্থায় থাকে।

সম্মিলিত কমান্ডারে হেডকোয়ার্টারে তখন এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে ভৈরব অবরোধ অবস্থাতে থাকবে। এ অবরোধ আমার এক ব্যাটালিয়ন এবং ভারতীয় ৭৩ মাউন্টেন ব্রিগেড থাকবে। আর বাকী ভরতীয় ৩১১মাউন্টেন ব্রিগেড এবং আমার বাকী সৈন্য ভৈরবকে পাশ কাটিয়ে নরসিংদী দখল করার জন্য ৪ গার্ড রেজিমেন্টকে নির্দেশ দেওয়া হল এবং তাদেরকে হেলিকপ্টারযোগে নরসিংদীতে অবতরণ করানো হল। ৩১১ মাউন্টেন ব্রিগেডের বাকী ব্যাটালিয়নকে (১০,বিহার এবং ১৮ রাজপুত) পদব্রজে নরসিংদীতে রওনা হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। আমি ১১ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ভৈরব এবং আশুগঞ্জে অবরোধের নির্দেশ দিয়ে তাদের মোতায়েন করি। ২য় ইষ্ট বেঙ্গল এবং সেক্টর ট্রুপসদের নির্দেশ দেই যে তারা যেন পদব্রজে নরসিংদীর দিকে রওনা দেয়।

১২ই ডিসেম্বর ২য় ইষ্ট বেঙ্গল ব্রাক্ষণবাড়িয়ার লালপুর হয়ে মেঘনা নদী অতিক্রম করে রায়পুরাতে পৌঁছে। আমি আমার হেডকোয়ার্টার ২য় ইষ্ট বেঙ্গলের সাথে রাখি। ১২ই ডিসেম্বর রাত আমরা রায়পুরাতে কাটাই। ১৩ই ডিসেম্বর সকালে আমরা নরসিংদী অভিমুখে রওনা হই।সেদিনই বিকেলে আমরা নরসিংদী পৌঁছি। নরসিংদী পৌঁছে আমরা শুনতে যে ৪ গার্ড রেজিমেন্ট নরসিংদী দখল করেছে। তারা এখানে হেলিকপ্টারযোগে এসেছিল। ১৩ই ডিসেম্বর আমরা নরসিংদীতে অবস্থান করি। যেহেতু ৪,গার্ড রেজিমেন্ট নরসিংদীতে সর্ব প্রথম পৌঁছেছিল,তাই নরসিংদীর সমস্ত গারী,যানবাহন তাদের হস্তগত হয়। ১৪ই ডিসেম্বর যখন আমরা ঢাকা অভিমুখে রওনা হই তখন আমাদের কাছে কোন যানবাহন ছিল না। তাই আবার আমরা পদব্রজে ঢাকা অভিমুখে রওনা হই। এ অভিযানে ৪,গার্ড রেজিমেন্ট সম্মুখভাবে ছিল। তারা নরসিংদী ডেমরা সড়ক দিয়ে বড় পা পর্যন্ত পৌঁছে। আমি তাদের অনুসরণ না করে ২য় ইষ্ট বেঙ্গলকে নির্দেশ দিলাম যে তারা যেন তারাবোর দিকে না গিয়ে ভুলতা থেকে মুরাপাড়া রুপগঞ্জ হয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হয়। ১৪ই ডিসেম্বর আমার সমস্ত ফোর্স মুড়াপাড়া পৌঁছে যায়। এবং শীতলক্ষ্যা নদী পার হয়ে বালু নদীর পাড়ে পৌঁছে যায়। ১০ বিহার রেজিমেন্ট ঐ দিন রূপসী পৌঁছেছিল। ১৪ ডিসেম্বর আমাদের অবস্থান নিম্নরুপ ছিলঃ গার্ড এবং ১৮ রাজপুত রেজিমেন্ট ডেমরার পূর্ব পাড় তারাবোতে,১০ বিহার রেজিমেন্ট শীতলক্ষ্যার পূর্ব পাড়ে রূপসীতে। আমার ফোর্স-এর ২য় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট শীতলক্ষ্যার পশ্চিম পাড় গাঁও এবং বালু নদীর পশ্চিম পাড়ে ডেমরার পেছনে ছিল। সেক্টর ট্রপস বাসাবোর আশেপাশে। ১৪,১৫ এবং ১৬ই ডিসেম্বর যুদ্ধ হয়। ১৬ই ডিসেম্বর বেলা প্রায় ১০টা থেকে ডেমরা ঢাকা রোড আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল। ডেমরাতে পাকিস্তানী সৈন্যরা প্রায় অবরোধ অবস্থায় ছিল। ১৬ই ডিসেম্বর সকাল থেকেই কথা হচ্ছিল যে পাকিস্তানী সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করবে। কিন্ত বেলা বারোটা পর্যন্ত যুদ্ধও অব্যাহত থাকে। বেলা সাড়ে বারোটায় পাকিস্তানীরা ডেমরা-ঢাকা সড়কের উপর অস্ত্র সংবরণ করে। ডেমরা-ঢাকার যুদ্ধে পাকিস্তানীরা যদিও ফ্রেশ ট্রুপস ( সীমান্ত এলাকার সৈনিকরা ঢাকা আসার আগেই অবরোধ অবস্থায় ছিল এবং ঢাকাতে অবস্থানরত সৈনিকরা ঐ দিন পর্যন্ত কোন যুদ্ধে লিপ্ত হয় নাই,তাই যুদ্ধক্লান্ত ছিল না)। ব্যবহার করেছিল,কিন্ত তবুও তারা বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি এ জন্য যে,তাদের নিকট দূরপাল্লার কামান ছিল না। সে গুলোর প্রায় সবগুলোই সীমান্ত এলাকায় ছিল। কিন্ত অপরদিকে ভারতীয় ট্যাংক এবং দূরপাল্লার কামান ঢাকার আশেপাশে আনতে সক্ষম হয়েছিল। এখানে বলে রাখা দরকার যে,আগরতলা থেকে ঢাকা শহর পর্যন্ত আমাদের অভিযানে বিশেষ করে আমার এস ফোর্স কোন যানবাহন পায়নি। তাই সমস্ত রাস্তাটুকু তাদের পায়ে হেঁটে আসতে হয়েছিল। পায়ে হেঁটে আসতে হয়েছে ঠিকই তবুও তারা ক্লান্তি অনুভব করছিল না। কারণ তারা সবাই জানতো যে পাকিস্তানীদের পতন হচ্ছে এবং ঢাকার পতন অত্যাসন্ন। আমরা আগরতলা থেকে অগ্রসর হই,তখন অস্ত্র শস্ত্র গোলাবারুদ ছাড়া আর কিছুই আমাদের সাথে আনিনি এবং অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সবগুলোই জনসাধারন ঢাকা পর্যন্ত বহন করে নিয়ে এসেছিল। শুধু আমাদেরই নয়,ভারতীয় সেনাবাহিনীর অস্ত্রশস্ত্রও এভাবে করে আনা হয়।

৬ই ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ দশ দিন আমরা কোন প্রকার রসদ সাথে বহন করিনী। কিন্ত আমরা এক বেলাও না খেয়ে থাকিনি।আমাদের খাবারের ব্যবস্থা জনসাধারণ করেছিল। আমাদের খাবারের ব্যবস্থার কথা কাউকে বলতেও হয়নি। কোন কোন জায়গায় এমনও হয়েছে যে,খাবারের প্রস্তুতির দেরী দেখে আমরা সামনে অগ্রসর হয়েছি এবং জনসাধারণ পড়ে পেছনে থেকে মাথায় করে চার পাঁচ মাইল দূর পর্যন্ত খাবার বহন করে নিয়ে এসেছে আমাদের খাওয়ানোর জন্য।

১৬ই ডিসেম্বর বেলা প্রায় দুটায় ডেমরাতে পাকবাহিনী আমাদের বাংলাদেশে- ভারত যৌথ কমান্ডের কাছে অস্ত্র সংবরণ করে। ঐ সময় আমাকে সংবাদ দেয়া হয় যে,বেলা সাড়ে তিনটায় আমি যেন ঢাকা বিমান বন্দরে উপস্থিত থাকি। কারণ সে সময় লেঃ জেনারেল অরোরা আসছেন এবং লেঃ জেনারেল নিয়াজীও সেখানে উপস্থিত থাকবেন। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আমি যেন উপস্থিত থাকি। যদিও ডেমরাতে পাকসেনা আত্মসমর্পণ করেছিল তবুও ডেমরা ও ঢাকার মধ্যবর্তী এলাকা মাতুয়াইলে তখনো পাকসেনারা তাদের অবস্থান রক্ষা করছিল। বেলা তখন প্রায় ২ টা। আমাকে সাড়ে তিনটায় বিমানবন্দরে উপস্থিত থাকতে হবে। তাই ২য় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার মেজর মইনকে ব্যাটালিয়ন নিয়ে ঢাকা চলে আসার নির্দেশ দেই। পাকিস্তানী ব্যাটালিয়ন কমান্ডার কর্নেল খিলজীকে বলি যে,আমাকে বিমানবন্দর যেতে হবে। এবং তোমার সৈনিকরা যারা মাতুয়াইলে আছে তাদেরকে তুমি গোলাগুলি বন্ধ করতে নির্দেশ দাও। আমরা একই জীপে ডেমরা থেকে মাতুয়াইলের দিকে দিকে যাই এবং কর্নেল খিলজীকে আগে পাঠিয়ে দেই সে যেন তার সৈনিকদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে। সৈনিককে নিয়ন্ত্রণে আনতে খিলজীকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। অবশেষে সে তার সৈনিকদের আত্মসমর্পণ করাতে সক্ষম হয়।

মাতুয়াইলে আত্মসমর্পণের পর আমি এবং ডেল্টা সেক্টর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার সাবেক সিং ঢাকা বিমানবন্দর অভিমুখে রওয়ানা হই এবং সাড়ে তিনটার মধ্যে আমরা বিমানবন্দরে পৌঁছে যাই। বিমানবন্দরে পৌঁছে দেখতে পাই যে, সেখানে জেনারেল নিয়াজী এবং ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের জেনারেল জেকব,জেনারেল স্বাগত সিং,জেনারেল নাগ্রা ও আরো অনেকে উপস্থিত রয়েছেন। আমি বিমান বন্দরে পৌঁছে তাদের সাথে কথা বলি এবং জেনারেল নিয়াজীকে জিজ্ঞাসা করি,’ স্যার ডু ইউ রিমেম্বার মি?আই এ্যাম এক্স-মেজর শফিউল্লাহ অব টু ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট অ্যান্ড নাউ কর্নেল শফিউল্লাহ অব বাংলাদেশ আর্মি।

জেনারেল নিয়াজীকে খুবই চিন্তিত ও বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। তিনি আমার কোন কথার জবাব না দিয়ে শুধু মাথা নেড়ে সায় দিলেন যে তিনি আমাকে চিনছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই হেলিকপ্টারযোগে জেনারেল আরোরা তাঁর দলবলসহ বিমান বন্দরে পৌঁছেন। এরপর বিমানবন্দর থেকে আমরা তদানীন্তন রমনা রেসকোর্স( বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পৌঁছি। সেখানে সেদিন বহু লোকের সমাগম হয়েছিল। জেনারেল আরোরার সাথে গ্রুপ ক্যাপ্টেন (বর্তমানে এয়ার কমোডোর ) খোন্দকারও এসেছিলেন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উপস্থিত থাকার জন্য।

বেলা প্রায় পাঁচটার দিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জেনারেল নিয়াজী যৌথ কমান্ডের (বাংলাদেশ ভারত) নিকট আত্মসমর্পণ দলিল স্বাক্ষর করেন। এ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে গ্রুপ ক্যাপ্টেন (বর্তমান এয়ার কমোডর) খোন্দকার এবং আমি উপস্থিত ছিলাম। ১৯৭১ সালের ২৯শে মার্চ ময়মনসিংহে ঢাকা দখলের যে স্বপ্ন দেখেছিলাম তা ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাস্তবায়িত হয়েছিল।

ঢাকা দখলের যে গৌরব তা আমার ফোর্সের প্রথম ছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর প্রায় সাড়ে পাঁচটায় আমার ফোর্স ঢাকা স্টেডিয়ামে শিবির স্থাপন করে। ১৬ই ডিসেম্বর আমার হেডকোয়ার্টার ঢাকাতে পৌঁছে যায়। প্রথম সেটা স্থাপিত হয় স্টেডিয়ামের পাবনা এম্পোরিয়ামের তেতলার এবং ১৭ই ডিসেম্বর সেটা আমি ৩৫,মিন্টু রোড-এ স্থানান্তর করি। ঢাকা সেনানিবাসে হেডকোয়ার্টার স্থানান্তরিত করার পূর্ব পর্যন্ত আমার  হেডকোয়ার্টার ৩৫, মিন্টু রোডে থেকে যায়। ২য় ইষ্ট বেঙ্গল তখন সোহরাওয়ারর্দী উদ্যানে অবস্থান করে। ভৈরবে আত্মসমর্পণের পর ১১ ইষ্ট বেঙ্গল ভৈরব থেকে ঢাকা চলে আসে এবং ভিকারুন্নিসা বালিকা বিদ্যালয়ে তারা প্রথম কয়েকদিন অবস্থান করে। সেক্টর ট্রুপসদের জায়গা দেওয়া হয় বিভিন্ন স্থানে যেমন বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠ,আজিমপুর ইত্যাদি স্থানে। এই সেক্টর ট্রুপস পরে ১৬ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নামে পরিচিত।

এ স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আমার সেক্টর যে সব যুদ্ধ সংক্রান্ত কার্যকলাপ হতো সেগুলো আমি কখনো পাবলিসিটি করতে দেইনি। কারণ ৩০শে মার্চ ১৯৭১-এ আমি যখন ভৈরব ব্রাক্ষণবাড়িয়াতে পৌঁছি তখন কিছু সংখ্যক বিদেশী এবং ভারতীয় সাংবাদিকদের সাথে আমার দেখা হয়। তারা আমাকে কিছু প্রশ্ন করেছিল এবং সে প্রশ্নের জবাব তাঁর কিছুদিন পর ভারতীয় সংবাদপত্রে দেখতে পাই। যেমন আমার ব্যাটালিয়ন কোন দিক থেকে,কোথা থেকে এসেছে? সৈন্য সংখ্যা কত ও কতজন অফিসার এবং কি করতে যাচ্ছি? এ সমস্ত গোপন তথ্য আমি পত্রিকাতে দেখতে পেয়ে সাংবাদিকদের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলি। এবং পরবর্তীতে নয় মাসের যুদ্ধে কোন সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দেইনি। এতে যদিও গোপন তথ্য গোপন রাখতে পেরেছি কিন্ত আমার মনে হয় আমার সেক্টরের ছেলেরা যেভাবে কাজ করেছে তা বাংলাদেশের কেউ জানে না। কিন্ত আমার বিশ্বাস সত্য কখনো গোপন থাকে না। আমার ছেলেরা যে উত্তম কাজ করেছে তা যারা স্বচক্ষে দেখেছে,তারাই লোকদের যতোটুকু বলেছে,সেটাই আমি অনেক বেশি মনে করি। এ সেক্টরের কার্যকলাপ আমি লোকমুখে যতোটুকু শুনতে পাই তা এতটুকুও অতিরঞ্জিত নয়।

ভারতে থাকাকালীন ভারতীয় হাসপাতালের সাহায্য ছাড়াও আমি দুখানা হাসপাতাল তৈরি করেছিলাম।এর একটা ছিল আমার হেডকোয়ার্টার হেজামারাতে,সেটা ছিল ৩০ বেডের। অপরটি ছিল আশ্রম বাড়ীতে। সেটা ছিল ১০ বেডের। আমাদের সৈনিকদের এবং গণবাহিনীর চিকিৎসা ছাড়াও নিকটবর্তী গ্রামবাসীরাও এ হাসপাতালের চিকিৎসা লাভ করতো। এ নয় মাসের সংগ্রামে আমাদের প্রতিবেশী ভারত সরকার আমাদের যে ভাবে সাহায্য করেছিল তা হয়তো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যারা ছিল তারা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবে না। সমস্ত সীমান্ত এলাকাতে লাখ লাখ শরণার্থীদের থাকার,খাবার পরার ব্যবস্থা যে সুশৃঙ্খলভাবে করা হয়েছিল তা কোন শরণার্থী ভুলতে পারবে না। শুধু শরণার্থী নয়,আমরা যারা সামরিক বাহিনীর লোক ছিলাম আমাদের সবাইকে টাকা-কড়ি,অস্ত্রশস্ত্র এবং রসদপত্র ইত্যাদি আমাদের প্রয়োজনুপাতে তারা দিতে চেষ্টা করেছিল। তারা যতোটুকু দিয়েছে এটা না দিলে আমাদের হয়তো খুবই অসুবিধা হতো।

আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম নয় মাসের মধ্যেই শেষ হয়েছে। তাও শুধু তাদের অংশগ্রহণের জন্য। যদি তারা এ সংগ্রামে শেষের দিকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত না হত,তাহলে আমাদের আরও কিছুদিন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হতো। আমার দৃঢ়বিশ্বাস ছিল যে দেশ স্বাধীন হবেই। বাংলাদেশের জনগণও দেশ স্বাধীন করার পক্ষে ছিল।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর যুদ্ধে অংশগ্রহনে আমাদের স্বাধীনতা লাভ একটু তরান্বিত হয়েছে মাত্র। যদি তা না হতো তা হলেও বাংলাদেশ স্বাধীন হত, হয়ত কিছুদিন সময় লাগতো।

শিরোনাম সূত্র তারিখ

৬। ৩ নং সেক্টরের যুদ্ধ সংক্রান্ত অন্যান্যের বিবরণ

 

বাংলা একাডেমির দলিলপত্র

তারিখ

 

——–১৯৭১

 

 

রানা আমজাদ

<১০, ৬.১, ২১৭-২১৯>

সাক্ষাৎকারঃ ব্রিগেডিয়ার এম, এ, মতিন*

আমাদের হেডকোয়ার্টার তেলিয়াপাড়া থেকে তুলে ভারতীয় সীমান্ত সীমানাতে স্থানান্তরিত করা হয়। মে মাসের প্রথমে আমার কোম্পানী নিয়ে তেলিয়াপাড়াতে ঘাঁটি, সংখ্যায় ছিলাম ৮০/৮৫ জন। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া চট্টগ্রাম থেকে এসে আমাদের সাথে যোগ দেন। এরপর আমরা দুজন পরামর্শ করে ডিফেন্স নেই।

মে মাসের প্রথম থেকে পাকবাহিনী ৮/১০ বার হামলা চালিয়েও আমাদের সরাতে পারেনি। ওখানে মাঝে মাঝে যুদ্ধে আমরা পাকবাহিনীর গাড়ি ও অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করেছি। প্রত্যহ হামলা করতো পাকবাহিনী। বেসামরিক লোক, ইপিয়ার, মুজাহিদ এরা এতো সাহসিকতার সাথে পাকবাহিনীর সাথে মোকাবেলা করে যে আমি বিস্ময় প্রকাশ করি। ইপিআরদের কথা ভোলা যায় না। এত সাহস আমি জীবনে দেখিনি। হেডকোয়ার্টার থেকে খাবার আসতো। এমনও দিন গেছে যে ২/৩ দিন খাবার পায়নি। বৃষ্টিতে ভিজে অনাহারে যুদ্ধ করতে হয়েছে। মুজাহিদ দুলামিয়ার একটি ঘটনা বলা দরকার। মুকুন্দপুর হরশপুর (সিলেট) ওখানে পাকবাহিনীর সাথে এক যুদ্ধে দুলামিয়া বেশকিছু পাকবাহিনীকে খতম করে। পাক বাহিনীর চাপে অন্যান্যরা চলে যায়, দুলামিয়ার পেটে গুলি লেগে মারা যাবার মতো তবুও গামছা দিয়ে বেঁধে এলএমজি ফায়ার করতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে প্রায় জ্ঞান হারায় এমন অবস্থা। কর্ণেল শফিউল্লাহ পিছন থেকে দুই কোম্পানী সৈন্য নিয়ে আক্রমণ করে দুলামিয়াকে উদ্ধার করে। দুলামিয়া প্রায় অজ্ঞান হয়ে গেলেও তা ট্রিগারে হাত ছিল। শফিউল্লাহ তাকে উদ্ধার করে উঠে আসার সাথে সাথে বলে আমার এলএমজি কোথায়। আর বলতো, স্যার আমি মরে গেলে ‘জয় বাংলা’ বলবেন।

ইপিআর নায়েক সুবেদার মালেক, নায়েক আব্দুল ওহিদ, ল্যান্স নায়েক মফিজ, নায়েক সালাম, সেপাই হায়দার আলী, গোলাম মওলা, মুজাহিদ তাজুল ইসলাম, ল্যান্স নায়েক নুরুল ইসলাম এবং সিপাই কবির – এদের নাম ভোলা যায় না। ছাত্রদের মধ্যে সেলিম এবং আনিসের দুই ভাই এবং শাহজামান মজুমদারের কথা অতুলনীয়। সেলিম মীরপুর অপারেশনে শহীদ হয় বিহারী কলোনীতে। মরার সময় সে বলেছিল যে, ‘স্যার পাকবাহিনীর হাতে মারা গেলাম না, কুত্তা বিহারীদের হাতে মারা গেলাম’।

যাহোক, ১৯শে মে পাকবাহিনীর আর্টিলারী এবং অন্যান্য ভারী অস্ত্রের সাহায্যে ব্যাপক আক্রমণ চালালে আমরা তেলিয়াপাড়া ছাড়তে বাধ্য হই। যুদ্ধে আমাদের ৮/৯ জন মারা যায়। পাকবাহিনীর অনেক সৈন্য মারা যায়। যুদ্ধ চলে সারাদিন ধরে।

২০শে মে ভোরে আমি পাল্টা আক্রমণ করি তেলিয়াপাড়াতে। সকালে আমরা ৪/৫ টা বাঙ্কার দখল করে নেই কিন্তু পাক বাহিনীর আরো সৈন্য আসায় আমরা প্রায় ১১টার দিকে পিছু হটে আসি। আমাদের ১০জন মারা যায়। পাকবাহিনীর ২০/২৫ জন মারা যায়। ইতিমধ্যে যুদ্ধনীতি পরিবর্তন হয়। আমরা বাহিনীকে গেরিলা শিক্ষা দিই।

১৭ই মে ক্যাপ্টেন মুর্শেদ কিছুদিনের জন্য তেলিয়াপাড়াতে আসে। ক্যাপ্টেন মুর্শেদ তার দল নিয়ে তেলিয়াপাড়া সিলেট রাস্তায় মাইন বসিয়ে প্রস্তুত হয়ে থাকে। পাক বাহিনীর ১২টা গাড়ী ওখান দিয়ে যাচ্ছিল। পাকবাহিনীর গাড়ি ধ্বংস হয় এবং ৭০ জন মারা যায়। ২টি ট্রাক এবং একটি বাস, চিঠিপত্র এবং অনেক গোপন তথ্য আমাদের হস্তগত হয়।

সম্মুখযুদ্ধ ছেড়ে দিয়ে আমরা গেরিলা যুদ্ধ শুরু করি। এতে করে আমরা কৃতকার্য হতে লাগলাম। দুইবার একেবারে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচেছি। বুলেট লুঙ্গি ও হাফ হাতা জামার হাতা ভেদ করে গেছে কিন্তু আমার শরীর স্পর্শ করেনি।

ইতিমধ্যে সেনাবাহিনী পূনর্গঠিত করতে থাকি। বিভিন্ন স্থান থেকে নিয়ে এসে ট্রেনিং দিয়ে আমাদের মধ্যে কিছু কিছু নিতে থাকি এবং সার্বিক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকি। সেপ্টেম্বর মাস থেকে সম্মুখ সমরে আসতে হয়। আমাদের উপর নির্দেশ আসে শত্রুঘাঁটি আক্রমণ করে, ধ্বংস কর, অস্ত্র কাড়ো, এগিয়ে যাও। আমরা তখন দলে বেশ ভারী হয়ে চলেছি, অস্ত্রশস্ত্র বেশ আছে। আমরা কাজ আরম্ভ করে দেই। সেপ্টেম্বর মাসেই একাদশ বেঙ্গল তৈরি হয়। পুরাতন আর্মি, মুজাহিদ, আনসার এবং ছাত্র মিলে ব্যাটালিয়ন পুরা করা হয়। কোন সময়ে আমি একা, কোন সময়ে দুই কোম্পানী মিলে, কোন সময়ে তিন কোম্পানী মিলে সম্মুখসমরে অবর্তীর্ণ হয়েছি সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত। হরশপুর, মুকুন্দপুর, তেলিয়াপাড়া, মনতলা, সিলেট, সাজিবাজার, শাহপুর ইত্যাদি স্থানে পাকবাহিনীর মুখমুখি হয়ে আমরা জয়লাভ করি। ভারতিয় বাহিনীর আর্টিলারী আমাদের মাঝে মাঝে সাহায্য করতো।

৩০সে নভেম্বর আমার উপর নির্দেশ আসে আখাউড়া দখলের জন্য। ১লা ডিসেম্বর আমি, মিত্রবাহিনী, ২য় বেঙ্গলের বাহিনী সম্মিলিতভাবে আমরা আখাউড়া শহরের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ঘিরে ফেলি এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে আক্রমণ চালাই। দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়- ১লা ডিসেম্বর তারিখে শুরু হয় , ৬ই ডিসেম্বর সকালে আখাউড়া আমাদের দখলে আসে। কর্নেল শফিউল্লাহ আমাকে মাধবপুরে রওনা হয়ে যেতে বলেন। কর্নেল নিজে ১১ বেঙ্গল এবং ২য় বেঙ্গল নিয়ে ব্রাহ্মনবাড়িয়ার দিকে রওনা হলেন বললেন রাস্তায় দেখা হবে। ঐ দিন ২টার দিকে আখাউড়া থেকে রওনা দিই, পুরাতন ক্যাম্প মনতলাতে রাত ১০/১১টা দিকে পৌঁছাই। সকালে মাধবপুরের দিকে অগ্রসর হবার মনস্থ করি। ৭ই ডিসেম্বর সকাল সাতটায় মেজর নুরুজ্জামান আমার ক্যাম্পে এসে একটি দুর্ঘটনার খবর দেন এবং আমার কোম্পানীকে রেখে আমাকে একাদশ বেঙ্গলের দায়িত্ব নিতে বলেন। মেজর বলছিলেন কর্নেল শফিউল্লাহ যখন অগ্রসর হচ্ছিলেন তখন হঠাৎ করে সিলেটের রামপুরে পাকবাহিনীর ৪০/৫০ জনের একটি দল আক্রমণ চালায়। ওখানে পাঞ্জাবী সুবেদারের সাথে কর্নেল শফিউল্লাহর হাতাহাতি হয় কিন্তু শফিউল্লাহ বুদ্ধি বলে রাইফেলের বাঁট দিয়ে সুবেদারকে আঘাত করে ধরাশায়ী করেন। ২ জন মুক্তিবাহিনী মারা যায়। ১০/১২ জন আহত হয়। মেজর নাসিম গুরুতর রুপে আহত হয়। কর্নেলের পিস্তল যেখানে গুলি লেগে পিস্তলটি অকেজো হয়ে যায়। কিন্তু কর্নেল বেঁচে যান। ১৫/১৬ জন পাঞ্জাবী মারা যায়, বাকি সব আত্নসমর্পণ করে একাদশ বেঙ্গলের কাছে।

কর্নেল সাহেবের সাথে দেখা করে একাদশ বেঙ্গলের দায়িত্ব নেই এবং তিনি ঐ রাতেই মাধবপুর, শাহবাজপুর সরাইল হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাবার নির্দেশ দেন। ৭ই ডিসেম্বর রাতে পুরা ব্যাটালিয়ন নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হই। ৮ই ডিসেম্বর বিকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া হস্তগত করি। পথিমধ্যে শত্রুপক্ষ আক্রমণ করলেও আমাদের কোন ক্ষতিসাধন করতে পারেনি। মিত্রবাহিনীর সহযোগীতায় আশুগঞ্জ দখলের জন্য নির্দেশ দেন কর্নেল শফিউল্লাহ ১১ই ডিসেম্বর। ১১ই ডিসেম্বর আশুগঞ্জ দখল করি। ভৈরব সেতু ধ্বংস করে ভৈরব শহরে পাকবাহিনী আস্তানা গাড়ে। মিত্রবাহিনী এবং কর্নেল শফিউল্লাহ দ্বিতীয় বেঙ্গল নিয়ে নরসিংদী হয়ে ঢাকার পথে রওনা হন আমাকে আশুগঞ্জে রেখে। আমাকে নির্দেশ দিয়ে যান আমি আমার বাহিনী নিয়ে পাকবাহিনীকে ব্যস্ত রাখি, যাতে তারা ঢাকার পথে পিছন দিক থেকে গিয়ে কর্নেল শফিউল্লাহ বা মিত্রবাহিনীর কোন ক্ষতি করতে না পারে। আমরা দুই দিক থেকে পাকবাহিনীকে ব্যস্ত রাখলাম। মাঝে মধ্যে আক্রমণ করে আমরা পাকবাহিনীর বিপুল ক্ষতি করি। ভৈরবের অপর পাড়ে যে পাক ঘাঁটি ছিল ১৭ই ডিসেম্বর তারা আমাদের কাছে আত্নসমর্পণ করে।

বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে এবং ২৫ তারিখে নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রেক্ষিতে অস্ত্র ধরি। অসহযোগ আন্দোলনে পুরো সমর্থন আমাকে এগিয়ে দেয়।

স্বাক্ষরঃ মেজর, এম, এ মতিন

২৮-৩-৭৩

*১৯৭১ সালে ক্যাপ্টেন পদে ছিলেন। ছুটিতে থাকাকালীন অবস্থায় মার্চ মাসে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেন।

 

রানা আমজাদ

<১০, ৬.২, ২১৯-২২২>

সাক্ষাৎকারঃ লেঃ কর্নেল হেলাল মুর্শেদ*

 

৪ঠা মে আমি আমার প্লাটুনসহ শাহবাজপর পৌছি। ৫ই মে সকালে আমি রেকি করি এবং রাত্রে রেইড করি। ৬ই মে সকালে জনসাধারণের মুখে শুনতে পাই ৯ জন পাকিস্তানী সৈন্য মারা যায়। তার ফলে পাকিস্তানী সৈন্যরা জনসাধারণের বাড়ীঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। আমার প্লাটুনের মাত্র ১ জন আহত হয়। রেকি করে ৭ই মে আমি আহত সৈন্যসহ প্লাটুন নিয়ে মাধবপুর পৌছি। মাধবপুরে তখনো আমাদের ডিফেন্স ছিল। আমরা মাধবপুর পৌঁছার পর এবং মেজর শফিউল্লাহ তেলিয়াপাড়া থেকে মাধবপুর পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানী সৈন্যরা শাহবাজপুর থেকে মাধবপুর পৌঁছে আমাদের উপর আক্রমণ চালায় এবং গোলাগুলি করে। ঐ মুহুর্তে আমরা যদিও অত্যন্ত ক্লান্ত ছিলাম তথাপি মেজর শফিউল্লাহ আমাকে শত্রুর বাদিক দিয়ে আক্রমণ করার আদেশ করেন। আমি প্লাটুন নিয়ে শত্রুর বাদিকে অগ্রসর হই। উদ্দেশ্য ছিল শত্রুর আক্রমণ কে প্রতিহত করা। ঐ সময় আমি শত্রুর উপর আক্রমণ করতে পারলাম না এ জন্য যে আমাদের চতুর্দিক দিয়ে শরণার্থী যাচ্ছিল। বিকেল ছটা পর্যন্ত পাকিস্তানীদের সঙ্গে যুদ্ধ চলে। পাকিস্তানীদের চরম আক্রমণে আমাদের আলফা কোম্পানী সৈন্য তুলে নিয়ে মনতলায় নতুন করে ডিফেন্স তৈরি করে।

মনতলায় আমি তাদের সঙ্গে যোগদান করি। মনতলায় আমাদের প্রধান ঘাঁটি তৈরি করে এবং সেখান থেকে ছোট ছোট রেইড এবং এ্যামবুশ করার সিদ্ধান্ত নেই।

এ সময় পাকিস্তানী সৈন্য মাধবপুর দখল করে তেলিয়াপাড়া পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছে। তেলিয়াপাড়া জঙ্গলের মধ্য দিয়ে তারা রাস্তা তৈরি করে সিলেটের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। মাধবপুর এবং তেলিয়াপাড়া হয়ে যে বড় রাস্তা সিলেট পর্যন্ত বিস্তৃত সেই রাস্তায় পাকিস্তানী সৈন্যদের রেইড এবং এ্যামবুশ করাই শ্রেয় মনে করি এবং সেভাবে রেইড ও এ্যামবুশ করতে থাকি। কেননা ঐ রাস্তা দিয়ে পাকিস্তানী গাড়ী যাতায়াত করতো।

মনতলা থেকে আমি কয়েকবার এ্যামবুশ করি। আমি প্রথম এ্যামবুশ করি ইসলামপুর গ্রামের রাস্তায়। ঐ রাস্তায় মাইন বসিয়ে গাড়ি উড়ানোর চেষ্টা করি এবং তাদের যোগাযোগ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেই। মাইন বসানোর ফলে আমার প্রথম এ্যামবুশে একটা জীপ, একটা ট্রাকসহ মোট ৩০ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত ও আহত হয়। আমাদের গুলিতেও প্রায় ২০ জন নিহত হয়। সর্বমোট প্রায় ৫০ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত ও আহত হয়। মনতলায় এটাই আমার সাফল্যজনক এ্যামবুশ। পরেও কয়েকবার এ্যামবুশ করি কিন্তু তত সুবিধা করতে পারিনি।

এরপর মনতলা থেকে তেলিয়াপাড়া যাবার নির্দেশ পাই। আমি মেজর নাসিমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তেলিয়াপাড়া চলে যাই। তেলিয়াপাড়া যে কোম্পানীটি ডিফেন্সে ছিল তার ক্যাপ্টেন (বর্তমান মেজর) মতিনের পরিবর্তে আমাকে দেওয়া হয়। আমাকে আমার প্লাটুনসহ উক্ত কোম্পানীর কমান্ডার নিযুক্ত করে। তেলিয়াপাড়া অবস্থানকালে আমার কোম্পানী নিয়ে আরও একটি এ্যামবুশ করি।

১৬ই মে তেলিয়াপাড়া রাস্তার ৮১ মাইল পোস্টের নিকট উক্ত এ্যামবুশ করি। ঐ এ্যামবুশে দুটি পাকিস্তানী ট্রাক ধ্বংস করতে সক্ষম হই। একটা ট্রাক দখল করি এবং প্রায় ৫০ জন সৈন্য হতাহত হয়।

মে মাসের ১৫ তারিখে পাকিস্তানী সৈন্য তেলিয়াপাড়া আক্রমণ করে। সেখানে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে প্রায় ৪০ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। আমাদের শহীদের সংখ্যা ছিল ৫ জন। পাকিস্তানী সৈন্যদের আর্টিলারী ও মর্টার আক্রমণ আমরা তেলিয়াপাড়া থেকে সৈন্য তুলে নিয়ে সিমলা চলে যাই এবং সেখানে হেডকোয়ার্টার স্থাপন করি। তেলিয়াপাড়া থেকে সৈন্য তুলে নেয়া সত্ত্বেও তেলিয়াপাড়া সিলেট বড় রাস্তায় আকস্মিক আক্রমণ আমরা অব্যাহত রাখি।

সিমনা থেকে ডেল্টা কোম্পানী আমার অধীনে দেয়া হয় এবং এই ডেল্টা কোম্পানী নিয়ে আমি শাহবাজপুর মাধবপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন করি এবং জুলাই মাস নাগাদ আমি ঐ সমস্ত জায়গায় যুদ্ধ করি।

১৮ই জুলাই পাকিস্তানী সৈন্যরা আমার কোম্পানী এবং ক্যাপ্টেন নাসিমের কোম্পানীর উপর আক্রমণ করে রাত প্রায় ৪ টার সময়। এক ব্রিগেড পাকিস্তানী সৈন্য আমাদের দুটি কোম্পানীর উপর আক্রমণ করে। ১৯শে জুলাই বিকেল ৩ টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলতে থাকে। এখানে আমরা একটি পাকিস্তানী লঞ্চ ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হই। আমার কোম্পানীর ১ জন শহীদ ও একজন আহত হয়। পাকিস্তানী সৈন্যও কয়েকজন নিহত হয়।

২৯শে জুলাই মুকুন্দপুর হরশপুর রেল স্টেশন আমি আমার কোম্পানী নিয়ে পুনরায় আক্রমণ করি। তখন আমার ঘাঁটি ছিল লক্ষীপুর গ্রামসহ আর ৪টি গ্রাম নিয়ে। মাঝে মাঝেই আমরা মুকুন্দপুর হরশপুর রেলস্টেশনের চতুর্দিক থেকে আক্রমণ করি। কেননা তখন পাকিস্তানী সৈন্যদের অবস্থান ছিল মুকুন্দপুর হরশপুর রেল স্টেশনের মাঝে।

লক্ষীপুর ছিল আমার কোম্পানীর মূল ঘাঁটি। এখান থেকে আমার এক প্লাটুন সৈন্য পাঠিয়ে আমিরগঞ্জ ব্রিজ ভেঙ্গে দেই। আমিরগঞ্জ ব্রিজে পাকিস্তানী মুজাহিদ বাহিনীর দশজন মুজাহিদকে আক্রমণ করলে তারা পালিয়ে যায়। এবং আমার প্লাটুন, উক্ত ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে সেখানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে।

১৩ই সেপ্টেম্বর সিঙ্গারবিল এবং মুকুন্দপুর-এর মাঝখানে এক খানা ট্রেন নষ্ট করে দেই। ট্রেনে ৪ টা বগি ছিল। ইঞ্জিনটা মাটিতে পড়ে যায়। ৪টা বগির প্রায় ৭০ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত এবং আহত হয়। উক্ত ট্রেন ধ্বংস করে দেওয়ায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুকুন্দপুর থেকে তাদের ঘাঁটি তুলে নেয়।

সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উক্ত এলাকা আমাদের দখলে থাকে। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে পাকিস্তানী সৈন্য পুনরায় মুকুন্দপুর দখলের চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত তারা মুকুন্দপুর রেললাইন মেরামত করে পুনরায় দখল করে নেয়।

২৪ সেপ্টেম্বর ক্যাপ্টেন (বর্তমান মেজর) ভূঁইয়া তার কোম্পানী নিয়ে ধর্মঘর নামক জায়গায় পাকিস্তানীদের উপর চরম আক্রমণ করেন। ক্যাপ্টেন ভূঁইয়াকে সাহায্য করার জন্য আমার কোম্পানী ছিল বাঁ দিকে ফ্ল্যাঙ্ক প্রোটেকশনে। ক্যাপ্টেন নাসিমের কোম্পানী ছিল ডান দিকের ফ্ল্যাঙ্ক প্রোটেকশনে। উক্ত যুদ্ধে পাকিস্তানী সৈন্যদের একজন জুনিয়র কমিশন্ড অফিসারসহ দশজন নিহত হয়। আমাদের পক্ষে কোন হতাহত হয়নি।

২রা নভেম্বর ১০ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট ইন্ডিয়ান আর্মির সহায়তায় বেলুনিয়াতে একটি বড় যুদ্ধের পরিকল্পনা করে এবং ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টকে অনুরোধ করে ১টি কোম্পানী সেখানে পাঠানোর জন্য। অনুরোধ অনুযায়ী আমাকে বেলুনিয়া পাঠান হয়। আমি আমার ডেল্টা কোম্পানী নিয়ে বেলুনিয়ায় রওনা হই এবং বিকেলে পৌঁছি। বেলুনিয়ায় আমি দশম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যোগদান করি।

১০ নভেম্বর বেলুনিয়া বাল্‌জ-এ অবস্থানরত পাকসেনাদের ছত্রভঙ্গ বা বিচ্ছিন্ন করার জন্য প্রথমে আমার কোম্পানী নিয়ে আমি শত্রুপক্ষের ভিতরে অনুপ্রবেশ করে দুইভাগ করে দেই যে তাদের যোগাযোগ বা একত্রিত হওয়া সম্ভব না হয়। আমার কোম্পানীসহ দশম বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৪ কোম্পানী এখানে চারদিন অবস্থান করি এবং যুদ্ধ করি। তারা একজন নায়েক শহীদ হন এবং একজন নায়েক সুবেদার আহত হন। যুদ্ধের দ্বিতীয় দিনে এবং তৃতীয় দিনে আমাদের উপর পাক বিমানবাহিনী আক্রমণ করে। এতে দুজন মুক্তিসেনা শহীদ হন এবং ১ জন মুক্তিসেনা গুরুতরভাবে আহত হন।

১৫ই নভেম্বর এভাবে অনবরত যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১ ব্যাটালিয়ন ইন্ডিয়ান আর্মি ঢুকে পাকসেনাদের উপর আক্রমণ করে এবং তাদের ঘিরে ফেলে। ফলে প্রায় ২৫ জন পাকসেনা নিহত এবং ৫০ জন ইন্ডিয়ান আর্মির হাঁতে বন্দী হয়। বেলুনিয়া মুক্ত হয়। বেলুনিয়া মুক্ত হবার পর দশম বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৪ কোম্পানীসহ আমার কোম্পানীকে ফেনী পৌঁছে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা নিতে আদেশ করা হয়।

প্রথমে আমি আমার কোম্পানী নিয়ে ফেনীর দিকে অগ্রসর হই এবং পরপর দশম বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৪ কোম্পানীও পৌঁছে। ২৩শে নভেম্বর এই দিন ফেনী এয়ারপোর্টের কাছাকাছি পৌঁছে আমরা ডিফেন্স বসাই। ফলে এয়ারপোর্ট থেকে পাক বাহিনী সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।

২৬ নভেম্বর আমার কোম্পানী তুলে নিয়ে ২য় বেঙ্গল রেজেমেন্টে যোগদান করার নির্দেশ পাই। ২৮শে নভেম্বর আমি আমার কোম্পানী তুলে নিয়ে আখাউড়ায় রওনা হই। এবং ২৯ নভেম্বর আখাউড়া পৌঁছি। আখাউড়া পৌঁছে দেখতে পাই আমার ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্ট আখাউড়া অপারেশন করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

১লা ডিসেম্বর পুরা ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে রাজাপুর এবং আজম্পুর গ্রামে অবস্থানকারী পাকসেনাদের উপর চরম আঘাত হানি। ১লা ডিসেম্বর থেকে ৫ই ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রচণ্ড মুখোমুখি যুদ্ধ হয়। এখানে শত্রু পক্ষের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। অসংখ্য সৈন্য হতাহত হয়। ২৫ জন খান সেনা আমাদের হাতে বন্দী হয়। এখানে আমাদের লেঃ বদিউজ্জজামান ও একজন নায়েক সুবেদারসহ কয়েকজন শহীদ হন। রাজাপুর এবং আজমপুর আমরা দখল করতে সক্ষম হই।

৬ই ডিসেম্বর আমরা ডেমরার অভিমুখে রওনা হই এবং ১২ই ডিসেম্বর ডেমরা পৌঁছি। ১২ই ডিসেম্বর থেকে ১৭ই ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের পরবর্তী পরিকল্পনা শুরু করি।

১৬ই ডিসেম্বর ডেমরা থেকে রওনা হয়ে যখন বালুনদী অতিক্রম করি তখন বিকেল সাড়ে চারটা। কিছুক্ষণ পরই শুনতে পেলাম পশু শক্তি বর্বর পাকহানাদার বাহিনীর আত্নসমর্পণের কথা। আত্নসমর্পণের কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে। হাজার হাজার জনতা জয়োল্লাসে ফেটে পড়ে রাস্তায় রাস্তায়। “জয় বাংলা” আর “জয় মুজিব” স্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত করে ফেলে। আমরা সোজা ঢাকার অভিমুখে রওনা দেই। রাস্তায় একইভাবে জনসাধারণ আমাদের স্বাগত জানাতে থাকে এবং বিজয় উল্লাসে মেতে উঠে। রাত ১২ টার সময় আমরা ঢাকা স্টেডিয়ামে পৌঁছি এবং সেখানে অবস্থান করি।

ঐতিহাসিক ঢাকা নগরীও তখন লোকে লোকারণ্য। সারা রাত ধরে মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা আনন্দে আকাশে অসংখ্য ফাঁকা গুলি ছুড়তে থাকে। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে যে সমস্ত বেঙ্গল রেজেমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ, মুক্তিবাহিনীর সদস্য ও জনসাধারণ অসীম বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে শহীদ হন তাদের নাম বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হবে, এই কামনাই করি। নয় মাসের যুদ্ধে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ পাকিস্তান পদাতিক বাহিনীর চরম পরাজয়ে এটাই প্রমানিত হয় যে, বাঙ্গালী সৈনিক, যুবক তথা জনসাধারণ প্রকৃতপক্ষেই সৎ সাহসী, বীর সৈনিক ও রণকৌশলী। এ দেশের আপামর জনসাধারণ একযোগে একবাক্যে সম্মিলিত হয়ে শত বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হয়েও মাতৃভূমিকে হানাদার বর্বর পাক সামরিক বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। এ স্বাধীনতা সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর স্বাধীনতা। এ স্বাধীনতা সমগ্র বাঙালী জাতির স্বাধীনতা। এ স্বাধীনতাকে রক্ষা করাই আমাদের একমাত্র কর্তব্য। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

স্বাক্ষরঃ ক্যাপ্টেন গোলাম হেলাল মুর্শেদ খান

*১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টে লেফটেন্যান্ট পদে কর্মরত ছিলেন। সাক্ষাৎকারটিঃ ১৯৭৩ সালে গৃহীত

 

 

রানা আমজাদ

<১০, ৬.৩, ২২২>

সাক্ষাৎকারঃ সিপাই আফতাব হোসেন*

১৯৭১ সালের মে মাসেই আমরা ময়মনসিংহের বাজিতপুর থানা আক্রমণ করি। পাক দালালদের অনেক ঘরবাড়ি ও দালাল খতম করি। বাঙ্গালি পুলিশরা পাকসেনাদের সহযোগিতা করতো। মুসা নামে এক কুখ্যাত দালাল পাকসেনাদের মেয়ে সরবরাহ করত এবং কারফিউ দিয়ে হিন্দু-মুসলমান সবার বাড়িতে থানার বাঙ্গালী পুলিশদের নিয়ে লুটতরাজ চালাত। রাত ১১টায় আমরা থানাতে হামলা চালাই। পুলিশরা পালিয়ে যায়। মুসাসহ অনেক দালালকে হত্যা করা হয়। এখান থেকে ১৯টা রাইফেল উদ্ধার করি। ৭টি সিভিল গানসহ প্রচুর এম্যুনিশন উদ্ধার করি। আমাদের গেরিলা দলে লোক বৃদ্ধি পেতে থাকে। ছত্রভঙ্গ অনেক ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ ও ছাত্র আমাদের সাথে যোগ দিতে থাকে।

১৯৭১ সালের মে মাসে ভৈরব থানা এলাকা থেকে আমরা একটা ৩ ইঞ্চি মর্টার, ২টা চীনা হালকা মেশিনগান এম্যুনিশন্সহ হালকা মেশিনগানের এম্যুনিশন ভরা ৪৮টি ম্যাগজিন উদ্ধার করি। এক ডাকাত সর্দারের বাড়ি থেকে ঢাকার বেলাবো (রায়পুরা থানার) আবদুল হাজি সাহেব আমাকে খবর দেন যে, ঐ ডাকাতের বাড়িতে উপরোল্লিখিত অস্ত্রশস্ত্র আছে।

জুন মাসে আমরা কুমিল্লা জেলার নবীনগর থানার এক দালালের বাড়িতে হামলা চালাই। উক্ত কুখ্যাত দালাল (চেয়ারম্যান পেরা মিয়া) পাকসেনাদের মেয়ে সরবরাহ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ করতো। মুক্তিযোদ্ধাদের পাকসেনাদের কাছে ধরিয়ে দিত। সে ঢাকার চরসিন্দুরের এক মুক্তিযোদ্ধাকে (ছাত্র) পাকসেনাদের কাছে ধরিয়ে দেয়। এবং পাকসেনারা ঐ ছাত্র কে হত্যা করে। কুখ্যাত দালাল পালিয়ে যায়। তার স্ত্রী ছেলেমেয়ে বাড়িতে পাহারারত সবাইকে হত্যা করা হয়। (পেরা মিয়া বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা ঘোষনায় মুক্তি পায়)।

জুলাই মাসে আমরা ঢাকা জেলার মনোহরদী থানা এলাকার রামপুর গ্রামে পাক বাহিনীর লঞ্চ ও গানবোটের উপর হামলা চালাই। এই আক্রমণে অনেক খান সেনা নিহত হয়। পাকিস্তানীরা এখানে হেলিকপ্টারের সাহায্যে লাশ নিয়ে যায়। এরপর থেকে পাকসেনারা আর কোনদিন লঞ্চ গানবোট নিয়ে আসে নাই।

উক্ত জুলাই মাসে আমরা ঢাকা জেলার কাপাসিয়া থানার নদীর মধ্যে পাক দালালদের লঞ্চ ও বালির নৌকার উপর আক্রমণ চালাই। দালালরা হাজার হাজার মণ বালি নিয়ে পাক সেনাদের দোতলা তিতলা বাঙ্কার পাকা করে দিত বালি সিমেন্টের সাহায্যে। আক্রমণে নৌকা লঞ্চগুলো নদীতে ডুবে যায়। দালালদের খতম করা হয়।

এদিকে মেজর শফিউল্লাহ (৩নং সেক্টর কমান্ডার) ও ক্যাপ্টেন নূরুজ্জামান শত শত ছাত্রকে গেরিলা প্রশিক্ষণ দিয়ে আমাদের অধীনে পাঠাতে থাকেন। তখন আমরা ময়মনসিংহের দক্ষিণাঞ্চলে। ঢাকা-ময়মনসিংহের বিস্তীর্ণ এলাকা মিলিয়ে গঠিত ৩ নং সেক্টরের অধীনে একটি সাবসেক্টর গঠন করি এবং ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেই।

*২৪-৭-১৯৭৪ তারিখে গৃহীত সাক্ষাৎকারটি বাংলা একাডেমির দলিলপত্র থেকে সংকলিত।

রানা আমজাদ

<১০, ৬.৪, ২২৩-২২৪>

সাক্ষাৎকারঃ মেজর দোস্ত মোহাম্মদ সিকদার*

আমাকে আলফা কোম্পানীতে পোস্টিং করা হলো। কোম্পানীর কমান্ডার ছিলেন মেজর নাসিম, যিনি এখন ব্রিগেড কমান্ডার। এখনো তিনিই আমার ব্রিগেড কমান্ডার তাঁর সাথে আমি গেলাম। আমি তাঁর কোম্পানীতে কোম্পানী অফিসার হিসেবে কাজ করতাম। একটা বড় রকমের অপারেশনের জন্য কোম্পানীগুলো প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, ঠিক তখনই আমি গিয়ে উপস্থিত হই। ব্রিগেডিয়ার নাসিম আমাকে নিয়ে কয়েক জায়গায় ঘুরোঘুরি করেছেন। আমার সাথে তেমন কোন আলোচনা করেন নাই। তবে কয়েকটা মহড়া দেখেছি তাঁর মধ্যে একটা আমার মনে পড়ে খুব ইন টেলিজেন্স মহড়া, যেটা ইন্ডিয়ায় হয়েছিল। মানুষ কিভাবে চট করে ফক্স হোল তৈরি করে নিজেকে লুকিয়ে রেখে শত্রুপক্ষের সাথে লড়ত, এটা তারই মহড়া। তিনি বললেন, এটা সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি তাড়াতাড়ি নিজেকে রক্ষা করার জন্য। কেননা মাটিতে ট্রেঞ্চ করতে সাধারণত বেশ সময় লাগে কিন্তু ফক্স হোল পদ্ধতি চট করে করা যায়। তাঁরা কয়েকটা সেকশন মিলে একটা প্লাটুন তৈরি করে ছিলেন আমি সেটা বুঝতেই পারিনি। এটাতে নিজেকে আত্নরক্ষা করা যায়। আবার শত্রু পক্ষকে ঘায়েল করা যায়। এসব দেখে আমি এতে যোগদান করি। আমাদের একটা টার্গেট ছিল, ঠিক সেই টার্গেটই আমরা আক্রমণ চালাই। টার্গেট ছিল আগরতলার উত্তর দিকে ধর্মঘর বলে একটা জায়গা ছিল, তারপর বামুটিয়া। এরপর ঠিক জায়গাগুলোর নাম মনে নেই, তবে বামুটিয়া ঐ সব এলাকার কাছাকাছি।

প্রশ্নঃ ওখানে পাকিস্তানী স্ট্রেনথ কত ছিল?

উত্তরঃ ওখানে শুধু নিয়মিত আর্মি ছিলনা, মিক্সড ছিল- রাজাকার মিলে ছিল। সংখ্যা ছিল এক কোম্পানী। মাসটা ছিল অক্টোবরের দিকে। আমাদের প্লানে ছিল যে সেখানে কিছু আর্টিলারী বোমবার্ডমেন্ট পাব। সেকেন্ড বেঙ্গলের আলফা কোম্পানী এবং ডেলটা কোম্পানী এই অপারেশনে অংশ নেয়। আলফা কোম্পানীর কমান্ডার ছিলেন মেজর নাসিম এবং ডেল্টা কোম্পানীর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন হেলাল মুর্শেদ।

আমরা এদিক থেকে এক কোম্পানী যাই এবং আরেক দিক থেকে ক্যাপ্টেন মুর্শেদ আরেক কোম্পানী নিয়ে এলে একসাথে মিলিত হই। মাঝখানে থেকে ইন্ডিয়ান আর্মি ঢুকে এডভান্স করে। ইতিপূর্বে আর্টিলারী ফায়ার হয়। আমরা পিছনে থাকি। আমরা টার্গেট থেকে ১৫০০ গজ দূরে ছিলাম। মেজর নাসিমের পরামর্শে সেখানে যে টেলিফোন লাইন ছিল সেটি কেটে দেয়া হয়। নিশ্চয় সেটা ঠিক করবার জন্য পাকিস্তানীরা আসবে। ঠিক তাই কয়েকজন পাক সেনা (এক সেকশন মত) রাইফেল নিয়ে এদিকে আসছিল কিন্তু হঠাৎ করেই  আমাদের  থেকে একজন আনকন্ট্রোল হয়ে ফায়ার করে ফেলে। এটা প্রিম্যাচিউর টার্গেট হয়ে গিয়েছিল। আমরা ৬/৭ জন মারতে পেরেছিলাম আর কিছু আহত হয়েছিল, কেউ কেউ সরে পড়েছিল। সাথে সাথে বোমবার্ডমেন্ট শুরু হয়ে গেছে। আমরা মারতে চাইনি জীবিত ধরতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তা বোমবার্ডমেন্ট লিফট আপ হবার পরে আসতে আসতে ফর্সা হতে লাগলো। ফর্সা হবার পরে আমরা অর্ডার পেলাম আমাদের পুল আউট করতে হবে।

প্রশ্নঃ আপনারা আর চার্জ করেননি?

উত্তরঃ আমরা আর চার্জ করিনি। এটাক করিনি। আমার মনে হয় এটাকিংটা  এবানডেন্ট করে ফেললো। কেননা কেউতো বলে না কোন কিছুতে হেরে গেলে। যেহেতু আমরা ছিলাম বাঙ্গালী ফোর্স আর তারা ছিলেন ইন্ডিয়ান ফোর্স, এটা একটা লজ্জার ব্যাপার। আমরা দেখেছি আমাদের পাশ দিয়ে তাঁরা চলে এসেছে। তাতে বোঝা যায় তারা অবজেকটিভ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। আমরা বুঝতে পারলাম, এই অপারেশনে তারা কৃতকার্য হয়নি। তাঁরা যখন চলে যাচ্ছিল আমাদের পাশ দিয়ে তখন বলছিল ভাই এটা তোমাদেরই দেশ। যত রকম ঝুঁকি নেওয়ার তোমরা নাও, আমরা পারবো না- এই বলে চলে যাচ্ছিল। তারা যাবার পর আমরা পুল আউটের অর্ডার পেয়ে আমাদের পুরনো ছাউনি, যেখানে আমরা থাকতাম সেই পঞ্চবটিতে চলে এলাম। এরপর আর কোন অপারেশনে যাইনি। ব্যাটালিয়ন রেইজ করলো। আমি রিক্রুটমেন্টে ব্রিগেডিয়ার নাসিমকে সাহায্য করতাম। ১১ বেঙ্গল রেইজ করলো অর্থাৎ এস ফোর্সকে কমপ্লিট করার জন্য। রেগুলার ব্রিগেড তৈরি হলো।

প্রশ্নঃ আপনি কতোদিন রিক্রুটিং-এ কাজ করেছেন সেখানে?

উত্তরঃ ঠিক দিন মনে পড়বে না, তবে মূর্তিতে যোগদান করার আগ পর্যন্ত কাজ করেছি। সেখানে সেকেন্ড ব্যাচ ট্রেনিং শুরু হয়।

*১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত। সাক্ষাৎকারটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখন ও মুদ্রণ প্রকল্প কর্তৃক ৮-১০-১৯৭৯ তারিখে গৃহীত।

রানা আমজাদ

<১০, ৬.৫, ২২৪-২২৫>

সাক্ষাৎকারঃ মেজর শামসুল হুদা বাচ্চু*

১৫ই-১৬ই অক্টোবর আমাকে আগরতলা নিয়ে আসা হয় ‘সি’ সেক্টরের হেডকোয়ার্টারে। সে সময় সেখানে দুজন অফিসারকে পাই। তার মধ্যে একজন হচ্ছেন বজলুল রশিদ। তিনি পিএমএ-তে ছিলেন। কিছুদিন আগে তিনি পাকিস্তান থেকে এসেছেন। আগরতলা আসার পর আমাকে ‘সি’ সেক্টরের কাছেই একটা কোম্পানী ছিল সেখানে পাঠানো হলো। সেখান থেকে বর্ডার মাইল দু’য়েক দূরে ছিল। এই কোম্পানীতে পুলিশ, বিডিয়ার সবাই ছিল। তাদের নিয়ে মাঝে মধ্যে বর্ডারে যেতাম। সামনেই একটা ডিফেন্স ছিল। সেখানে থাকা অবস্থায়ই একবার মার্চ করে মাইল পাঁচেক ভিতরে ঢুকেছিলাম কিন্তু বেশী সুবিধা করতে পারিনি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল রেইড করা কিন্তু তা করা সম্ভব হয়নি। কারণ প্রস্তুতি তেমন ছিল না এবং ট্রেনিংও পাকা হয়নি। তখন সেই সময় ব্রিগেডিয়ার নাসিম ১১তম বেঙ্গল রেজিমেন্ট গড়ে তুলেনীবং আমাকে তাঁর রেজিমেণ্টে নিয়ে আসে। এই বেঙ্গলে ট্রেইন্ড লোক অনেক ছিল। মেজর নুরুদ্দিন, মেজর আবুল হোসেন এই বেঙ্গলে ছিলেন। নভেম্বরের শেষের দিকে ১১তম বেঙ্গল যখন পুরপুরি গড়ে উঠে তখন আমরা সেখান থেকে মার্চ করে বাংলাদেশের ভিতরে প্রবেশ করি। আমাদের উদ্দেশ্য  ছিল ঢাকা। পুরো এক ব্যাটালিয়ন সৈন্যসহ হেঁটে যখন আমরা ভৈরব পার হই তখন পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে আমাদের  সংঘর্ষ হয়। সেখানে আহত হয় মেজর নাসিম, ৪জন ভারতীয় লোক, মেজর সাফায়েত জামিল ও ভারতীয় ১জন ক্যাপ্টেন। শত্রুদের সাথে জেনারেল শফিউল্লাহর হাতাহাতি যুদ্ধ হয়েছিল। এই সময়টা ছিল ডিসেম্বরের ৬ কি ৭ তারিখে। সেখানে যে মেজর নাসিম আহত হয়ে ছিলেন তার মূলে ছিল আমাদের একজন অফিসারের ভুল পরিকল্পনা। এরপর আমাদের ব্যাটালিয়নকে টেক অভার করেন মেজর মতিন। টেক ওভার করার পর যখন আমরা আশুগঞ্জ যাই তখন পাকিস্তানীদের সাথে সংঘর্ষ হয়।

পাকিস্তান আর্মিরা সকালবেলা আশুগঞ্জে যে ব্রীজটা ছিল সেটা উড়িয়ে দিয়েছিল। তাই ইন্ডিয়ান আর্মি মনে করেছিল যে পাকিস্তানীরা আর আশুগঞ্জে নেই, নদীর ওপারে ভৈরবে চলে গেছে। তখন সেখানে ১০ম বিহার ব্যাটালিয়ন ছিল। তারা দেখতে একদম কালো ছিল। তাদের সাথে ছিল ২০তম রাজপুত। আশুগঞ্জে জায়গাটা এমন যে সেখানে ৩টা কি ৪টা তিনতলা দালান ছিল এবং সামনে একমাইল মত জায়গা ছিল একদম ফাঁকা। ভারতীয় আর্মির ধারনা ছিল যে, সেখানে পাকিস্তান আর্মি নেই কিন্তু আমাদের মনে হয়েছিল হয়তো পাকিস্তান আর্মি আছে। কথা ছিল ভারতীয়দের সাথে ১১তম বেঙ্গলের একটা কোম্পানী থাকবে কিন্তু পরে এসে বললো থাক তোমাদের যেতে হবেনা। তবুও আমাকে আমার কোম্পানী নিয়ে শহর থেকে আধ মাইল দূরে একটি উঁচু গ্রাম ছিল, সেখানে বসে থাকার জন্য আমার এডজুটেন্ট লেঃ নাসির বললেন। তখন সেখানে আমার সাথে ছিল ১০ম বিহারের মেজর গাঙ্গুলী (কোম্পানী কমান্ডার)। আমার কোম্পানী নিয়ে আমি সেখানে বসে আছি, তখন দেখি ভারতীয় সৈন্যের দুটি ব্যাটালিয়ন মার্চ করে মাঠের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তাদের সাথে ছিল ছোট চারটা ট্যাংক। ভারতীয়রা যখন সেই দালানগুলির মাঝামাঝি চলে এসেছিল তখন আমরা ৪/৫ মিনিট গুলির শব্দ ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাইনি। আমরা বুঝতেই পারছিলাম না যে এই গোলাগুলির আওয়াজ কোথা থেকে হচ্ছে। তারপর দেখলাম ভারতীয় সৈন্যরা খুড়িয়ে খুড়িয়ে দৌড়াচ্ছে, কাউকে টেনে নিয়ে আসা হচ্ছে, কারো শরীর দিয়ে রক্ত বেয়ে পড়ছে। ৫/১০ জন করে পিছনের দিকে আমরা যেখানে আছি সেই লাইনের দিকে সেই লাইনের দিকে সরে আসছে। সেখানে চারটা ছোট ট্যাংকের মধ্যে দুটো জ্বলে গিয়েছিল এবং দুটো ট্যাংক নিয়ে আসতে সক্ষম হয়ে ছিল ভারতীয়রা। তখন আমাকে ওয়ারলেসে বলা হলো যে তোমার কোম্পানী নিয়ে তুমি তাড়াতাড়ি পিছনে চলে  এসো। আমরা যেখানে ছিলাম তার থেকে ২০০ গজ পিছনে আরেকটা উচু জায়গা ছিল এবং তারপর আধ মাইলের মত পরিষ্কার জায়গা এবং তারপরই গ্রাম শুরু হয়ে গেছে। এই সময় দেখি যে পাকিস্তান আর্মি সামনের  ঐ জায়গা দিয়ে যাচ্ছে অর্থাৎ তখন পাকিস্তানী আর্মি আমাদের রেঞ্জের ভিতর। তখন আমরা উইড্র করে সামনে আসলাম। এর মধ্যে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেছে পিছনে ভারতীয় আর্মির যারা বেঁচে ছিল বা যারা চলতে পারে তারা সামনে চলে এসেছে। তখন এখানে এসে আমি জেনারেল শফিউল্লাহকে পেলাম। তিনি একটা গাছের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি বললেন, ভারতীয় আর্মি এত বড় একটা ভুল করে ফেলল যা কল্পনা করা যায় না। আমরা দ্রত সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের সাথে ভারতীয় সৈন্যরাও আছে। এর মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়ে গেছে এবং আশে পাশে অনেকজন পড়েও গেছে। তখন আমি শফিউল্লাহকে বললাম যে স্যার দৌড় দেন। আমি আর শফিউল্লাহ দৌড়ে ঐ দূরত্বটা পার হই এবং যখন দেখলাম যে গোলাগুলি খুব বেশী শুরু হয়ে গেছে তখন আমরা শুয়ে পড়লাম। ২/১ মিনিট শুয়ে থাকার পর আবার উঠে দৌড়ে যেখান থেকে গ্রাম শুরু হয়েছে সেখানে একটা পুল ছিল সেটা পার হয়ে গ্রামের সীমানার মধ্যে ঢুকে গেলাম। পরে আমরা শুনলাম আমরা প্রথমে যে জায়গায় ছিলাম পাকিস্তান আর্মিরা সে পর্যন্ত এসেছিল আর এগিয়ে যায়নি। তারপর দিন সকাল বেলা অর্ডার এলো তোমরা যাও। কারন আশুগঞ্জ থেকে পাকিস্তানী আর্মিরা চলে গেছে। তারপর আমরা আশুগঞ্জ গেলাম। গিয়ে দেখি ওরা চলে গেছে এবং জিনিসপত্র সব বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। পাকিস্তান আর্মিরা সন্ধ্যার পরপরই নদী পার হয়ে ওপারে চলে গিয়েছিল। যে সব ভারতীয় সৈন্য মারা গিয়েছিল তাদের লাশ পাকিস্তানীরা আগেই সরিয়ে ফেলেছিল। তবে সেখানে গিয়ে আমি মেজর মুখার্জীর লাশটা দেখেছিলাম। সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল। এর মধ্যে ভৈরবের দিক থেকে শেলিং শুরু হয়ে গেছে। আমাদেরও কিছু আর্টিলারী চলে এসেছে। ইতিমধ্যে মুজিব ব্যাটারীও এসেছে, তারাও অপারেশন করছে। ভারতীয় বাহিনীও এসে গেছে। লেঃ কর্নেল আজিজও তখন এখানে আমাদের সাথে ছিলেন, আরও অনেক অফিসার ছিলেন। ১৬ই ডিসেম্বর যেদিন পাকিস্তান আর্মি সারেন্ডার করে সেদিন সারাদিন প্রচুর ফাঁকা গুলি ও ফুর্তি হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান আর্মির যারা ভৈরবে ছিল তারা ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত সারেন্ডার করেনি। ১৯শে কি ২০শে ডিসেম্বর ভারতীয় জেনারেল গেলেন ভৈরবে, তারপর তারা সারেন্ডার করে। তারপর দুইদিন সময় লাগে পাকিস্তানীদের সরিয়ে জায়গা খালি করতে।

*১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখন ও মুদ্রণ প্রকল্প কর্তৃক ১০-১০-১৯৭৯ তারিখে গৃহীত সাক্ষাৎকার।

রানা আমজাদ

<১০, ৬.৬, ২২৫-২৩৪>

মেজর এস, এ, ভূঁইয়ার প্রতিবেদন*

একটি এ্যামবুশ ও সুবেদার চান মিয়ার বীরত্ব

প্রায় সাড়ে তিন মাসের মত আমি বি-কোম্পানীর সাথে মনতলায় ছিলাম। ঐ সময়ের মধ্যে আমরা অনেক ছোট বড় অপারেশন করেছি। সবগুলোর বিবরণ লেখা সম্ভব নয় বলে আমি মাত্র কয়েকটার কথা নিচে লিখলাম।

২৭শে জুন রাত্রে আমি বি-কোম্পানীকে নিয়ে বাংলাদেশের ভিতরে যাই। দিনের বেলায় গিয়ে শত্রু সৈন্যরা কোথায় আছে, কিভাবে আছে, কেমনভাবে অবস্থান করছে তাই দেখবার জন্য ভিতরে যাই। দেখতে পাই সিদাইই থানার সামনে শত্রুর দুটো ছোট ঘাঁটি আছে এবং তারা সেখানে বিনা দ্বিধায় চলাফেরা করছে। তাদের সংখ্যা ৬০/৭০ জন।

সিদাই থানার পুলিশ ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী থেকে আমরা তাদের অবাধ চলাফেরা সম্বন্ধে নিশ্চিত হলাম। সেদিন রাত্রে সেনাদলকে দুটিভাগে ভাগ করলাম। সুবেদার চান মিয়াকে আমি আমার একটি গ্রুপের ভার দিলাম এবং তাঁর সহকারী হুসেবে দিলাম সুবেদার তৈয়বকে। আমি নিজে অন্য দলটা সঙ্গে নিলাম। আমাদের সাথে ছিলেন সুবেদার শফিউল্লাহ। রাত ৩ টায় আমরা বাংলাদেশের ভিতরে ঢুকলাম। দুশমনের অগ্রবর্তী ঘাঁটি দূরে ছিলনা। সুবেদার চান মিয়া গেলেন বাম দিকের অবস্থানে, আমি গেলাম ডান দিকের অবস্থানে। ভোর ৪টার দিকে শত্রুর খুব কাছে গিয়ে আমরা লুকিয়ে ওঁত পেতে থাকলাম। যেই রাস্তা দিয়ে শত্রু সৈন্য দল বেঁধে টহল দিচ্ছিল সেই রাস্তার পাশেই আমরা ওঁত পেতে অপেক্ষা করতে লাগলাম। চান মিয়ার দল বাড়ির আনাচে কানাচে এবংপাট ক্ষেতের ভিতরে পজিশন নিলেন। এলাকাটা ছিল সমতল এবং তার অধিকাংশ জায়গা জুড়ে ছিল ধান ক্ষেত। আর সে ধান ক্ষেতের উচ্চতা ছিল এক ফুটের মতো। অতএব লক্ষ্যবস্তু একেবারে সুস্পষ্টভাবে আমাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে ছিল।

আমরা যার যার স্থানে তো অস্ত্রশস্ত্রসহ পজিশন নিয়ে ছিলামই, উপরন্তু সিদাই থানার বামদিক থেকে শত্রুর প্রতি তাক করে রেখেছিলাম একটি রিকয়েললেস রাইফেল। রাতের অন্ধকারেই আমরা এই কাজ শেষ করি।

সকাল ৭টার দিকে শত্রুরা প্রায় ৩০/৪০ জন সৈন্য নিয়ে আগের মতো সুবেদার চান মিয়ার অবস্থানের দিকে টহল দিতে বেরুল। আমরা আরো দেখতে পেলাম শত্রু বাহিনীর আর একটি দল শান্তি বাহিনীর কিছু সংখ্যক লোক নিয়ে সীমান্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। শত্রুরা কাছাকাছি পৌঁছামাত্র চান মিয়ার পুরো দলটাই তাদের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করলো। তাঁর দলের হাঁতে ছিল দুই ইঞ্চি মর্টার আর ১৮ টি বোমা। সবগুলোই তারা কাজে লাগালো। প্রায় ৩০ মনিট ধরে সংঘর্ষ হলো এবং চান মিয়াদের তীব্র গুলিবর্ষণে ভয়ার্ত হয়ে অনেকগুলো মৃত সৈনিককে পিছনে ফেলে পাক সৈন্যরা পিছু হটতে বাধ্য হলো। শত্রু পক্ষের অন্য দলটি প্রতিশোধের স্পৃহায় সুবেদার চান মিয়ার দলকে আক্রমণ করতে চাইলো। তারা কামান দিয়ে গোলাবর্ষণ শুরু করলো। শত্রুর ইচ্ছা ছিল উত্তর দিক থেকে এসে লেফট(বাম) ফ্ল্যাঙ্ক করে চান মিয়ার দলকে পিছন থেকে আক্রমণ করা। শত্রুর অগ্রগমনের পথে আমি আমার দল নিয়ে বিপুল আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। যেই মাত্র তারা আমাদের কাছে এলো অমনি আমরা হালকা মেশিনগান ও রাইফেলের সাহায্যে তাদের উপর গুলিবর্ষণ করতে শুরু করলাম। আমাদের সঙ্গেও একটা দুই ইঞ্চি মর্টার ছিল। সেটারও আমরা পুরোদস্তুর সদ্ব্যবহার করলাম। ঐ দিকে রিকয়েললেস রাইফেলের অবস্থান থেকে ৪টি রিকয়েললেস রাইফেলের গোলা বর্ষিত হলো শত্রুর বাঙ্কারের উপর। শত্রুর দুটি বাঙ্কার সেই গোলার আঘাতে চুরমার হয়ে গেলো। এবারও শত্রুরা আমাদের ওঁৎ পেতে আক্রমণ করার ফাঁদে পড়ল। দিশেহারা হয়ে তারা আমাদের অবস্থানের উপর কামানের গোলাবর্ষন শুরু করল। এখানেও তাদেরকে নিহত সঙ্গীদের লাশ ফেলে পিছনে হটতে বাধ্য করা হলো। আমরা শত্রু সৈন্যের কামানের গোলাবর্ষণকে অত্যন্ত ভয় করতাম। কারন তাদের নিশানা ছিল অদ্ভুত রকমের নির্ভুল। এখানেও সেই নির্ভুল নিশানার পরিচয় পেয়ে আমাদের ঐ অবস্থানে থাকা আর নিরাপদ মনে করলাম না। সুতরাং মর্টার থেকে শত্রুদের দিকে গোলা বর্ষণ করতে করতে তারই আড়ালে আমরা পিছনে সরে এলাম। কামানের গোলা তখন এমন অবিশ্রাম ধারায় এসে পড়ছিল যে, পিছনে হটে আসা ছাড়া আমাদের গত্যন্তর ছিল না। ঐ সময় আমাদের কোন পরিখা ছিলনা। আমার কোম্পানীতে এই প্রথমবারের মতো সেদিন রিকয়েললেস রাইফেল ব্যবহার করি। তাতে চমৎকার ফল হয়। আমরা দুটো বাঙ্কার সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হই।

ঐ দিন আমার দলের একটি মাত্র ছেলের শরীরে গোলার টুকরো এসে আঘাত করে। অন্যান্যরা খোদার একান্ত রহমতে সক্ষম অবস্থায় ফিরে আসে। আমার রানার ও আমি এক স্থানেই ছিলাম। কামানের গোলাগুলো যখন ভীষণ শব্দ করে আমাদের আশেপাশে  পড়ছিল তখন মনে হচ্ছিল মৃত্যু বুঝি আমাদের ঘাড়ের উপর খঞ্জর ধরে বসে আছে। আমার কাছ থেকে মাত্র ২০ গজ দূরে একটি কামানের গোলা সশব্দে ফেটে পড়লো। লক্ষ্য করে দেখলাম আমাদের কারো মুখে হাসির লেশমাত্র নেই। আমরা তখন মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলাম। আর মুখে উচ্চারণ করতে থাকলামঃ লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সোবাহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজজোয়ালেমিন।

পাকিস্তান রেডিও থেকে সেদিন প্রচার করা হয়েছিল যে, আমাদের মৃতের সংখ্যা ২০ জন। কিন্তু প্রকৃত খবর পাই ঘটনার ৫ দিন পরে। শত্রুপক্ষে নিহত হয় ১৭ জন আর আহত হয় ১৯ জন। গোপন অবস্থান থেকে অতর্কিতে আক্রমণ করলে দিশেহারা শত্রু সৈন্যদের আত্নরক্ষার প্রায় উপায় থাকে না এবং তখন তাদের এমনি সীমাহীন ক্ষতি মেনে নিতে হয়। এর সাধারণ কারণ এক পক্ষের সতর্কতামূলক পূর্বপ্রস্তুতি,  অন্য পক্ষের অজানা বিপদ সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং অপ্রস্তুতি। আর শত্রুপক্ষ সমরশক্তিতে যতই উন্নত পর্যায়ের হোক না কেন আকস্মিকভাবে এমনি ওঁৎ পাতা ফাঁদে পড়লে তারা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যায় এবং সাধারণ মনোবল হারিয়ে ফেলে। সে আক্রমণাত্মক ভূমিকায় সেই মুহুর্তে অংশ নিতে আর সাহস পায় না। ফলে পালিয়ে প্রাণ বাঁচানোটাই তার কাছে বড় হয়ে উঠে।

যাহোক, অপূর্ব সাহস দেখিয়েছিলেন সেদিন সুবেদার চান মিয়া। ঐ দিনের যুদ্ধের পর চান মিয়ার প্রতি আমার পূর্ণ বিশ্বাস জন্মেছিল। পরে কর্তৃপক্ষ কোন এক কারণে আমার দল থেকে তাকে বদলী করতে চাইলেও আমি তাতে রাজি হইনি।

আর একটি রেইড

আর একটি ঘটনার কথা আমি উল্লেখ করছি। দিনটি ছিল  ৮ই জুলাই। ২৭শে জুন যে স্থানেটিতে আমরা  এ্যামবুশ করেছিলাম, পাক  সৈন্যরা সেখানে নতুন করে  কতকগুলো বাঙ্কার করেছিল।  নতুন করে তারা আরো অনেক সৈন্য এনে তাদের অবস্থানকে মজবুত করে তুলেছিল। আমরা প্ল্যান করলাম রেইড করে শত্রুর নবনির্মিত বাঙ্কারগুলো উড়িয়ে দেবো। ২৭ শে জুন তারিখে আমাদের হাতে প্রচণ্ড আঘাত খেয়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা সীমান্ত  এলাকার দিকে আর আসতো না অথবা অবস্থান ছেড়ে অন্য কোথাও নড়াচড়া করা তা অর্থহীন বলে মনে করতো। ২৭শে জুন এবং ৮ই জুলাই তারিখের মধ্যে আমরা বার কয়েক শত্রুঘাঁটির কাছে ওঁৎ পেতে ছিলাম কিন্তু পাক সেনারা তাদের ঘাঁটি ছেড়ে না বেরুনোর জন্য বিশেষ সুবিধা করতে পারিনি। এই সময়ের মধ্যে পাকিস্তানী সৈন্যদের অবস্থানের উপর আমরা কয়েকবার ৩ ইঞ্চি মর্টার দিয়ে গুলিবর্ষণ করেছিলাম।

৮ই জুলাই তারিখে আমরা সমস্ত কোম্পানী নিয়ে দুই দিক থেকে শত্রুর এলাকায় ঢুকলাম। ভোর চারটার দিকে অগ্রসর হলাম আমরা। শত্রুর অবস্থান ভারত সীমান্ত থেকে বেশী দূর ছিল না। সিদাই থানা থেকে তাদের অবস্থানগুলো আমাদের নজরে পড়তো। আমরা শত্রুকে মাঝখানে রেখে দুই পাশ থেকে ঢুকলাম। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা রিকেয়েললেস রাইফেল ও মর্টার শত্রুর দিকে তাক করে রেখেছিলাম। আগে থেকেই সময় নির্দিষ্ট করে রেখেছিলাম যাতে একই সময় রিকেয়েললেস রাইফেল, মর্টার, রাইফেল সব কিছুর সাহায্যে আমাদের সৈন্যরা একযোগে শত্রুদের উপর আঘাত হানতে পারে। ভোর সাড়ে পাঁচটার সময় শত্রুর অবস্থানের উপর আমরা অতর্কিতে গুলিবর্ষণ শুরু করলাম। রিকেয়েললেস রাইফেলের গোলার আঘাতে শত্রুদের দুটো বাঙ্কার উড়িয়ে দেওয়া হলো। সবচেয়ে ভাল কাজ করেছিল মর্টারগুলো। আমরা পনেরো মিনিট গোলাগুলি বর্ষণ করার পর পাক সেনারা আমাদের উপর কামানের গোলাবর্ষণ শুরু করে দিল। ঐ এলাকার শত্রুর প্রতি সম্ভাব্য আক্রমণের স্থানগুলো তাদের কামানের লক্ষ্য কেন্দ্র হিসেবে পূর্বনির্দিষ্ট ছিল। জ্যামিতিক নিয়মমাফিক তাদের কয়েকটা গোলা আমদের অবস্থানের উপর এসে পড়ে। বিপদ বুঝে ঐখান থেকে আমরা আমাদের বাহিনী সরিয়ে নিয়ে আসি। ঐ আক্রমণে পাক বাহিনীর কি পরিমান ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল প্রায় এক সপ্তাহ পরে বেসামারিক লোক মারফত আমরা সে খবর পাই। পাক সেনাদের  ৬ জন সৈন্য মৃতের তালিকা পূর্ণ করেছিল।

ধর্ম ঘরে সুবেদার তৈয়বের কৃতিত্ব

 

আমার সাবসেক্টেরের মধ্যে ধর্মঘরে এসে অধিক পরিমাণ পাকিস্তানী সৈন্য জমায়েত হয়। ধর্মঘর ছিল সাবেক ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল বাহিনীর বিওপি অর্থাৎ বর্ডার অবজারভেশণ পোস্টস। পাকিস্তানী সৈন্যরা সেখানে আসার পর থেকে আমি সেখানে কোন দিন অপারেশন করিনি। তারপর ঐ শত্রু ঘাঁটির উপর মনোযোগ দিলাম। আমি নিজে প্রায় ৫০ জন সৈন্য নিয়ে দু্’ দু’ বার ঐ এলাকায় অতর্কিত আক্রমণ করার জন্য ফাঁদ পেতেছিলাম, কিন্তু শত্রুরা তার কাছে ভেড়েনি। তাই দূর থেকে কিছু করা যায় কিনা তার ফন্দীফিকির আঁটলাম।

ঐ এলাকায় কয়েকবার মর্টারের সাহায্যে আমরা গোলাবর্ষন করি।আমাদের সাথে ছিল সুবেদার তৈয়ব। মর্টারের গোলাবর্ষণে সুবেদার তৈয়ব একজন দক্ষ ওস্তাদ। যতবারই তিনি শত্রু ঘাঁটিতে মর্টারের সাহায্যে গোলাবর্ষণ করেছেন ততবার শত্রুর কিছু না কিছু ক্ষতি হয়েছে। একবার আমাদের কয়েকটি মর্টারের গোলা ধর্মঘর দীঘিতে পড়ায় দীঘির বহু মাছ মরে গিয়েছিল। সারা ধর্মঘরের লোক কয়েকদিন ধরে সেই মাছ খেয়েছিলেন।

অন্য আর একদিন আমরা দুই দিক থেকে ৪ টি মর্টার দিয়ে শত্রু সৈন্যের ধর্মঘর পজিশনের উপর গোলাবর্ষন করি। সেদিন মেজর মতিনের কোম্পানী থেকে ২টি মর্টার ধার করে এনেছিলাম। আমরা প্রায় ৬০টি মর্টারের গোলা ব্যবহার করেছিলাম। আমাদের গোলাবর্ষণ ছিল অত্যন্ত নির্ভুল। কয়েকদিন পরে আমরা জানতে পারলাম যে আমাদের গোলা সঠিক জায়গায় পড়ায় পাঞ্জাবীরা ঐ জায়গা ছেড়ে অন্য গ্রামে যেতে বাধ্য হয়েছিল।

মতিন সাহেবের কোম্পানীতে নায়েক আজিজ নামে একজন যবুক ছিল। মর্টারের গোলাবর্ষণে সে বেশ সাফল্য অর্জন করেছিল। তার মর্টার ফায়ার সম্বন্ধে কোম্পানীতে বেশ সুনাম ছিল।

এই এলাকাতেও রাজাকারের সংখ্যা ছিল খুব বেশী। ঐ রাজাকারদের চোখে ধুলো দেওয়া খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। তারা কেন যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সমর্থন করতো না তা বুঝতে পারিনি। সম্ভবত ঐ এলাকার মত রাজাকার বাংলাদেশের কোথাও ছিল না। তারা পাঞ্জাবী সৈন্যদের পথ দেখিয়ে ভারতের সীমানার কাছে এসে আমাদের আন্দোলনের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবীদের সহোযোগিতা করতে শুরু করলো। তাদের এই ক্রিয়াকলাপে আমরা গভীর ভাবে ব্যথিত হতাম।

যাহোক, বিজয়নগর এলাকাতেও আমরা কয়েকটি গোপন আতর্কিত হামলা চালাই। কিন্তু তাতেও আমরা খুব একটা সুবিধা করতে পারিনি। মাত্র একদিন এ্যামবুশ করে কয়েকজন পাঞ্জাবীকে যমদ্বারে পাঠিয়ে দিই।

 

 

বীর মুজাহিদ দুলা

 

এ প্রসঙ্গে কয়েকজন মুজাহিদের নাম করা যায় যাদেরকে আমি তেলিয়াপাড়াতে দেখেছি। এদের মধ্যে মনে রাখার মতো দুটি নাম দুলা এবং আহাদ। দুলার বয়স ছিল ২৬ বছর। তার বাড়ি কুমিল্লা জেলার শালদা নদীর কাছে। সে মুক্তিবাহিনীর প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলের কোম্পানীতে মেজর মতিনের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। সমগ্র মুক্তিবাহিনীতে দুলার মত সাহসী যুবক আর কজন ছিল আমার জানা নেই।

তেলিয়াপাড়ার যুদ্ধে সে যে সাহসীকতার পরিচয় দিয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার তুলনা হয় না। বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণের মধ্যেও এই অকুতোভয় যবুক লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করেনি কিংবা রণক্ষেত্র ছেড়ে দূরে সরে যায়নি, আপন লোকদেরকেও সে গোলাবারুদ বিতরণ করেছিল।

২১শে জুন আমি যখন শত্রুর ত্রিমুখী প্রচণ্ড আক্রমণের দরুন মনতলা থেকে সরে আসতে বাধ্য হই সেদিন দুলা কলকলিয়ার লড়াইয়ে যে বীরত্ব দেখিয়েছিল তার কিছুটা পাঠকের সামনে তুলে ধরছি।

কলকলিয়া ছিল ক্যাপ্টেন মোর্শেদের অধীনে এবং দুলা সেই ফ্রন্টেই লড়ছিল। ২১শে জুন রাতে শত্রু বাহিনী যখন আমাদের অবস্থানের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায় সেই একই সময়ে কলকলিয়াতেও তারা আক্রমণ চালায়। মোর্শেদের সৈন্যরা শত্রুদের সাথে সারারাত  প্রচণ্ড যুদ্ধ করে। কিন্তু শত্রুর সংখ্যা বহুগুন বেশী থাকায় মোর্শেদের দল সেখান থেকে অবশেষে পিছনে হটতে বাধ্য হয়। সে সময় দুলা মিয়ার হাতে ছিল একটা হালকা মেশিন গান। সে তার হালকা মেশিন গান দিয়ে অনবরত গুলি ছুড়ে যাচ্ছিল এবং শত্রুর অগ্রগতিকে সারারাত ব্যাহত করে রেখেছিল। নিঃশঙ্কচিত্তে অপারবিক্রমে সে এক ভয়াবহ শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছিল। অবস্থা প্রতিকূল দেখে যখন তার সংগীরা আত্নরক্ষা করতে পিছু হটছিল তখন দুলা সেই পশ্চাদপসরণে অংশগ্রহণ না করে নির্ভয়ে তার হালকা মেশিন গান থেকে অবিরাম গুলি ছুড়ে যাচ্ছিল। তারই অসীম সাহসীকতা ও গুলি ছোড়ার ফলে দলের অন্যান্যরা পিছু হটার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু দুলার বড়ই দুর্ভাগ্য, সে অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেই এক মহা বিপদে আটকে পড়ে। শত্রু পক্ষের মেশিনগানের এক ঝাঁক গুলি এসে দুলা কে বিদ্ধ করে। দুলার পক্ষে একমাত্র দুলার মেশিনগানই সক্রিয় ছিল এবং শত্রুদের আক্রমণের তীব্রতাকে তারই মেশিনগানটি কিছুটা বাধা দিচ্ছেল। ফলে শত্রুর একমাত্র লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছিল দুলা। অবশেষে শত্রুরা দুলাকে আহত করতে সক্ষম হয়ে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কিন্তু নিদারুণ আহত অবস্থায় দুলা সংজ্ঞা হারায়নি এবং শেষ কর্তব্য স্থীর করে সে তার হালকা মেশিনগান থেকে অন্তিম মুহুর্ত পর্যন্ত শত্রুকে বাধা দিয়ে যাবে তা স্থির করল। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে সে জান দিবে কিন্তু জীবিত অবস্থায় তার শরীরকে শত্রু হস্তে কলুষিত হতে দেবে না।

আমি যখন মনতলা থেকে সরে এসে ভারতের সিদাই থানায় (আগরতলার উত্তরে) তখন লেঃ কর্ণেল শফিউল্লাহ আমার এখানে উপস্থিত হলেন। কিছুক্ষণ আলাপের পর তিনি আমাকে মোর্শেদের অবস্থানের কথা জানালেন এবং তাড়াতাড়ি কলকলিয়া চলে যেতে নির্দেশ দিলেন। তিনি আরো বললেন, “মোর্শেদের সৈন্যরা দারুণ বিপদে আছে। তারা সবাই শত্রু দ্বারা পরিবেষ্টিত। তুমি তাড়াতাড়ি গিয়ে তাদের বিপদ মুক্ত করতে সাহায্য কর।”

এই কথা বলে তিনি কলকলিয়া চলে গেলেন এবং তাঁর পিছুপিছু আমিও কলকলিয়া পৌঁছুলাম। আমরা যাওয়ার পর দেখতে পেলাম আল্লাহর মেহেরবাণীতে ক্যাপ্টেন মোর্শেদসহ তার কোম্পানীর সবাই নিরাপদ স্থানে পৌঁছে গেছে। তাদের সবাই কে দেখে আমরা আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া আদায়

করলাম।

সবাই এলো কিন্তু তখনো পর্যন্ত দুলা এলো না। তখন বেলা ১১টা। খবর এলো দুলার পেটে এবং ডান পায়ে কয়েকটি গুলি লেগেছে। সে কাদা পানির মধ্যে অসহায় অবস্থায় পড়ে আছে। ছোট্ট একটা সৈন্যবাহিনী গিয়ে তাকে উদ্ধার করতে না পেরে ফিরে এসেছে। শত্রু তখন মেশিনগান বসিয়ে পজিশন নিয়ে আছে এবং কাউকে নড়তেই দেখলেই গুলি ছুড়ছে। শত্রু মেশিনগান বসিয়েছিল ছোট্ট একটি টিলার উপর।

আমরা সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম। ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের কাছ থেকে দূরবীন নিয়ে দেখলাম শত্রুর কিছু সৈন্য পজিশন নিয়ে আছে এবং অন্যান্যরা পরিখা খনন করেছে। আমরা সবাই চিন্তা করছি দুলাকে কিভাবে শত্রুদের ঐ বেড়াজাল থেকে উদ্ধার করবো। কোনো একটা ফন্দি উদ্ভাবনে আমরা যখন চিন্তিত তখনই একটা ছেলে দৌড়ে এসে খবর দিল যে দুলাকে নিয়ে আসা হচ্ছে। আহত দুলা গুলি ছুড়তে ছুড়তে সম্পূর্ন নিস্তেজ এবং নিশ্চুপ হয়ে গেলে শত্রুরা তাকে মৃত মনে করেছিল এবং তার দিকে আর গুলি ছোঁড়া প্রয়োজন নেই মনে করে তারাও গুলি ছোড়া বন্ধ করেছিল। এই রকম একটা সুযোগ পেয়ে আমাদের দুই সাহসী ছেলে সন্তর্পণে  নালার ফাঁকে ফাঁকে গিয়ে দুলাকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিল।

দুলাকে যখন আমদের সামনে আনা হলো তখনকার দৃশ্য এত করুণ এবং বেদনাদায়ক যে তা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। মুমূর্ষু দুলা বাম হাত দিয়ে তার গুলিবিদ্ধ পেট চেপে ধরে আছে। কেননা ক্ষতস্থান থেকে তার নাড়িভূড়ি বের হয়ে আসার উপক্রম করছিল। ডান পায়ে গুলি লেগে ছিন্নভিন্ন মাংসগুলি কোনোক্রমে পায়ের হাড়ের সংগে লেগেছিল।আর তার সমস্ত শরীর রক্তরঞ্জিত।

একটা গুলিবিদ্ধ বাঘের মতো সে ছটফট করছিল। তখনও সে বাকশক্তি হারায়নি। আমাদের চোখের দিকে চোখ রেখে সে বলল, স্যার আমি আর বাচঁব না, এক্ষুনি মারা যাব। আমার আফসোস রয়ে গেল স্বাধীন বাংলার মাটিতে আমি মরতে পারলাম না। স্বাধীন বাংলা দেখা আমার ভাগ্যে হয়ে উঠল না। স্যার আমাকে কথা দিন যেভাবেই হোক স্বাধীন বাংলার মাটিতে আমাকে কবর দেবেন। আজ হোক কাল হোক বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। তাই আমার লাশ বাংলাদেশের মাটিতে কবর দেবেন।

সে আরো বললো, স্যার গুলির আঘাতে আমার পেটের নাড়িভূড়ি বের হয়ে গেছে। আমার বাঁচার কোনোই সুযোগ নেই।

মুমূর্ষু দুলার করুণ কণ্ঠ শুনে সেদিন আমরা সবাই গভীর শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়েছিলাম। সমস্ত হৃদয় আমাদের বিষাদে ভরে গিয়েছিল। আমরা আবেগ সংযত কণ্ঠে তাকে যতই সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করি সে তাতে শান্ত হয় না, সে তার অন্তিম মুহূর্তের আভাস পেয়ে শেষ মনের কথাটি আমাদের জানিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। সে বলতে থাকে, স্যার পাঞ্জাবী দস্যুরা যখন আমাদের বাঙ্গালিদের নির্মমভাবে, নির্বিচারে হত্যা শুরু করে তখন আমার ৮ বছরের মেয়েটি আমাকে কি বলেছিল জানেন? বলেছিল, আব্বা তুমিও মুক্তি ফৌজে যোগ দাও, পাঞ্জাবীদের বিরুদ্ধে লড়াই কর, দেশকে স্বাধীন কর। আব্বা তুমি বাড়ি থেকে কি করবে? যদি দেশ স্বাধীন না হয় আমাদের অবস্থা কি হবে? তারা ত যাকেই সামনে পাচ্ছে তাকেই গুলি করে মারছে।

আমার হাত ধরে দুলা বলল, “স্যার আপনার বাড়ি কুমিল্লা, আপনি নিশ্চয়ই শালদা নদী চেনেন। সেখানে আমার বাড়ি। আমার এলাকার সবাই আমাকে চেনে। দয়া করে আমার মেয়েকে এবং সেই এলাকার কাউকে আমার মৃত্যুর খবরটা দেবেন না। আমার মৃত্যুর খবর পেলে আমার মেয়েটি বাঁচবে না। সে আমার জান। দয়া করে তার কাছে আমার মৃত্যুর খবরটা গোপন রাখবেন। তবে আমার একটা দাবী, আমার হতভাগিনী মেয়েটিকে দেখবেন। স্যার আমার এই একটি কথা ভুলে যাবেন না।”কথা বলার মাঝে মাঝে একটা কথা ঘুরেফিরে বারবার বলছিল, “জয় বাংলা দেখে যেতে পারলাম না।”

দুলার এই মুমূর্ষু অবস্থায় এম্বুল্যান্স আসতে কিছুটা দেরী হবে বলে মনে করে লে. কর্নেল শফিউল্লাহ তাকে নিজের জীপে করে আগরতলা পিজি হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। আমাদের মুক্তিফৌজের ডাক্তার আবুল হোসেনও দুলার সাথে হাসপাতালে গেলেন যাতে দুলা তার মনের ভরসা না হারায়। হাসপাতালে যাওয়ার পর দুলার অপারেশন করা হয় এবং যখন ডাক্তার জানালেন যে দুলার সঙ্কটাবস্থা কেটে গেছে তখন লেঃ কর্ণেল শফিউল্লাহ হাসপাতাল ত্যাগ করেন। সেদিন দুলার সাথে আরো কয়েকজন আহত হয়েছিল। তাদেরকেও হাসপাতালে পাঠানো হলো।

দুলার অবস্থা দেখে সেদিন আমার মত অনেকে ধরনা করেছিল দুলা আর বাঁচবে না। কিন্তু আল্লাহর অসীম ক্ষমতা আমাদের ক্ষুদ্র ব্যক্তির পক্ষে নিরুপণ করা অত্যন্ত কঠিন। তাঁরই অশেষ কৃপায় এবং অত্যন্ত করুণায় দুলা দেড় মাস পর আরোগ্য লাভ করল এবং পুনরায় ক্যাপ্টেন মোর্শেদের কোম্পানীতে যোগদান করল। পরবর্তীকালে অসীম বীরত্বের সংগে দুলা অনেক রণক্ষেত্রে পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে বাঙালীর বীর্যবত্তার ইতিহাস সমুজ্জ্বল করে তুলেছে।

এবার বলছি আহাদের কথা। আহাদের বয়স মাত্র ১৫ বছর। অতুলনীয় সাহসী ছিল এই বীর মুজাহিদ কিশোর। মুজাহিদ হিসাবে তেলিয়াপাড়া যুদ্ধে তার বীরত্ব প্রদর্শন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে একটি নক্ষত্রোজ্জ্বল ঘটনা। দুলা ও আহাদের বীরত্বের সম্মানস্বরুপ লেফটেন্যাণ্ট কর্ণেল শফিউল্লাহ তাদের কে ২৫০০ টাকা করে পুরুস্কার প্রদান করেন।

এর পর আসে পুলিশ প্রসঙ্গ। আমার সঙ্গে যে ৫ জন পুলিশ ছিলেন তারা হলেন মিজান, সুরুয মিয়া, খোরশেদ মিয়া, তাহের মিয়া এবং কানু মিয়া। আমার কোম্পানীতে এরা মর্টার ছুড়তেন। মাত্র সামান্য কয়েকদিনের শিক্ষায় এরা মর্টার চালনায় প্রায় পেশাদার সৈনিকের মত দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে এই ৫জন পুলিশ সৈনিকের দান সামান্য নয়। অসীম বীরত্বের সঙ্গে এঁরা শত্রুসৈনিকের সাথে বারবার লড়াই করেছেন।

মেজর মতিনের কোম্পানীটি ছিল পুরোপুরি প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল বাহিনী দ্বারা সংগঠিত। আমি এবং মেজর মতিন যখন তেলিয়াপাড়ায় লড়াই করেছি তখন দেখেছি কি রকম নিষ্কম্প হৃদইয়ে ঐ পূর্ব পাকিস্থান রাইফেলের জোয়ানরা লড়াই করেছে। মেজর মতিনের ই-পি- আর কোম্পানী পরবর্তীকালেও বিভিন্ন ফ্রন্টে খুব সাহসের সঙ্গে লড়েছিল। তাদের এই বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের প্রশংসা না করে আমি পারি না।

চূড়ান্ত লড়াই ও আখাউড়ার যুদ্ধ

নভেম্বরের ২০ তারিখের পরে যুদ্ধের তীব্রতা বেড়ে গেল। যশোরের কাছে পাকিস্থান স্যাবর জেটগুলো ভারতীয় সীমানা অতিক্রম করায় আকাশযুদ্ধে ভারতীয় বিমান আক্রমণে ৩টি পাকিস্থানী স্যাবর জেট ভূপাতিত হয়। এতে যুদ্ধের তীব্রতা মারাত্মক আকার ধারণ করে। মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে এ সময়ের যশোরের চৌগাছার পতন হয়। এবং তারা যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট দখল করার জন্য পাকিস্তানী সৈন্যর সঙ্গে মরণপণ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়।

নভেম্বরের এই সময়টাতে আমরা আখাউড়ার শত্রুসৈন্যের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হই। শত্রু বিরুদ্ধে এবার আমরা পুরোপুরি আক্রমণাত্মক ভূমিকা গ্রহন করি। আমাদের আক্রমণও একই রকম তীব্র ও প্রচণ্ড। এ সময় “এস” ফোর্সের অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল শফিউল্লাহর অধীনে ছিল পুরা দুই ব্যাটালিয়ন পদাতিক সৈন্য। এই দুই ব্যাটালিয়নই ছিল যাবতীয় সমরাস্ত্রে সুসজ্জিত। এ-ছাড়াও ছিল কয়েকটা কোম্পানী যাকে আমরা সেক্টর ট্রুপস বলতাম।

কর্নেল শফিউল্লাহ ‘এস’ ফোর্সের ২নং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কমান্ডিং অফিসার মেজর মঈন এবং ১১ নং বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কমান্ডিং অফিসার মেজর নাসিমকে এই মর্মে নির্দেশ দিলেন যে, মেজর মঈনের ব্যাটালিয়ন আখাউড়ার দিকে আক্রমনাত্বক অভিযান চালাবে এবং তাদের সাথে থাকবে সেক্টর ট্রুপস, আর মেজর নাসিমের ব্যাটালিয়ন (১১ নং বেঙ্গল রেজিমেন্ট) আগরতলার উত্তর দিকে ধর্মঘরের ওখানে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেবে যাতে করে সিলেট থেকে মনতলা হয়ে পাকবাহিনী পেছন থেকে আমাদের বাহিনীর উপর আক্রমণ করতে না পারে। লেঃ কর্নেল শফিউল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী আমরা ধর্মঘরকে সামনে রেখে মোহনপুর – আগরতলা রোডে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করি। এ সময় আমি একটি কোম্পানীর নেতৃত্বের ভার নেই। শত্রু যাতে মোহনপুর – আগরতলা রোড ধরে অগ্রসর হতে না পারে সে উদ্দেশ্যেই আমরা আখাউড়া যুদ্ধের আগেই প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সে সময় আমি যে কোম্পানীর পরিচালনার নেতৃত্ব নিয়েছিলাম সেটি হল বি-কোম্পানী।

ওদিকে তখন আখাউড়ায় কি ঘটছিল তার কিছুটা বিবরণ, আমি যা সংগ্রহ করতে পেরেছি, দেওয়া যাক। ২৭ নভেম্বর কর্নেল শফিউল্লাহ মেজর মঈনকে মেরাসানি, নিরানসানি, সিঙ্গারবিল রেলওয়ে স্টেসনে, সিঙ্গারবিল ঘাঁটি, রাজাপুর, আজমপুর ইত্যাদি এলাকা দখল করতে নির্দেশ দেন। উল্লেখযোগ্য যে, এইসব এলাকা আখাউড়া রেলওয়ে জংশনের কাছাকাছি। কর্নেল শফিউল্লাহ মেজর মঈনকে ৩০শে নভেম্বর এবং ১লা ডিসেম্বর তারিখ রাতে রাতে এইসব এলাকায় আক্রমণ চালাবার আদেশ দিয়েছিলেন।

মেজর মঈন দ্বি-ধারা আক্রমণ চালালেন। প্রথম আঘাত হানলেন নভেম্বর-ডিসেম্বর ৩০/১ তারিখ রাত ১টার সময়। প্রথম পর্যায় দখল করলেন সিঙ্গারবিল রেলওয়ে স্টেশন ও সিঙ্গারবিল ঘাঁটি। শুনেছি, সে রাতে লড়াই চলছিল ভোর পাঁচটা পর্যন্ত।

এই অভিযান আমাদের পক্ষ থকে অংশ নিয়েছিল মুক্তিফৌজের প্রায় এক ব্যাটালিয়ন। শত্রুপক্ষের সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় এক ব্যাটালিয়নেরও বেশী। এই যুদ্ধে শত্রুসেনারা আর্টিলারী, মর্টার, মেশিনগান ইত্যাদি ছোটবড় সব অস্ত্রশস্ত্রই ব্যবহার করে। আমাদের পক্ষেও সেদিনকার লড়াইয়ে আর্টিলারী এবং মর্টারের সাপোর্ট ছিল। সেক্টর ট্রুপসের কাছেও ছিল মেশিনগান।

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, সে রাতগুলো ছিল খুবই অন্ধকার এবং ডিসেম্বরের শীত-রাত্রির কুয়াশায় আচ্ছন্ন। কিন্তু এই অন্ধকার ও কুয়াশার বাধা আমাদের জওয়ানদের পারেনি বিন্দুমাত্র হতোদম্য করতে। একটা পর একটা স্থান দখলে আসাতে তারা ক্রমে মানসিক দিক থেকে আরো শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল এবং নব উন্মাদনায় দ্বিগুণ শক্তিতে শত্রুদের আঘাত হেনে পর্যুদস্ত করছিল। আখাউড়ার এক যুদ্ধে হতোদ্যম পাকিস্তানী সেনারা পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয় এবং তাদের প্রচুর লোকসান স্বীকার করতে হয়। একজন শত্রুসেনা জীবিত অবস্থায় বন্দী হয় এবং ২০ জন হয় নিহত। এছাড়া মুক্তিফৌজের হস্তগত হয় হানাদার বাহিনীর প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র, রেশন, পোশাক-পরিচ্ছদ, ডিফেন্স স্টোর  ( প্রতিরক্ষা সামানা )। আমাদের পক্ষ হতে পাকবাহিনীর হাতে এই যুদ্ধে ইয়াসিন খাঁ নামে মুক্তিফৌজের একজন সিপাহী শহিদ হন। তাকে সমাহিত করা হয় সিঙ্গারবিলে। তাছাড়া এই লড়াইয়ে মুক্তিফৌজের সিপাহী আবু জাফর,  সিপাহী হুমায়ূন, সিপাহী আব্দুল লতিফ, হাবিলদার আকতার হোসেন, হাবিলদার মুফাজ্জল হোসেন চৌধুরী, হাবিলদার নবিউল্লাহ এবং অপর একজন আহত হয়। পর্যুদস্ত শত্রুবাহিনী সাময়িকভাবে পিছু হটলেও ২রা ডিসেম্বরের সকালে আমাদের বাহিনীর উপর পাল্টা আক্রমণ শুরু করে এবং সারাদিন ধরে খণ্ডযুদ্ধ চলতে থাকে। শত্রুবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে আমাদের বাহিনী পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। আর্টিলারীর সহাতায় মারাত্মক আক্রমণ চালিয়ে এই এলাকা শত্রুবাহিনী পুর্নদখল করে। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির পর আমাদের বাহিনী সিঙ্গারবিলে গিয়ে জমায়েত হয়। এই যুদ্ধে শত্রুবাহিনীরও অসম্ভব ক্ষতি সাধিত হয়। মুক্তিফৌজের নায়েক সুবেদার আশরাফ আলী শত্রুর হাতে শাহাদৎ বরণ করেণ। অন্যান্য যারা আহত হন তাঁরা হলেন সিপাহী আবদুল আউয়াল, হাবিলদার মাজু মিয়া, নায়েক নাসিরুজ্জামান, নায়েক আবদুস সালাম, সিপাহী মিজানুর রহমান।

৩রা ডিসেম্বর আমাদের বাহিনী নিজেদেরকে পুনর্গঠিত করে পাক বাহিনীর উপর পুনরায় আক্রমণ চালায় এবং আজমপুর স্টেশন ও তার এক হাজার গজ অগ্রবর্তী স্থান দখল করে। এই আক্রমণে শত্রু পক্ষের এগারজন সৈন্য নিহত হয়। আমাদের পক্ষে দু’জন সিপাহী ও একজন নায়েক সুবেদার শহীদ হন। আমাদের বাহিনী যখন যুদ্ধে লিপ্ত এমনি সময়ে আমরা খবর পেলাম পাকিস্তান ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে বিমান হামলা চালিয়ে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করেছে। এবার আর যুদ্ধ কেবল বাংলাদেশ বাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে সিমাবদ্ধ থাকল না। পাকিস্থানী বাহিনীর সংগে সংযুক্ত ভারত-বাংলাদেশ বাহিনীর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। ডিসেম্বরের ৩/৪ তারিখ রাতে আমাদের বাহিনী পুর্নদখলকৃত এলাকাকে সুরক্ষিত করল। বলা বাহুল্য, মুক্তিফৌজের অবিরাম আঘাতের পর আঘাত, দেশের অভ্যন্তরে গেরিলা মুক্তিবাহিনীর চাতুর্যপূর্ণ অতর্কিত আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তখন বেসামাল হয়ে পড়েছিল। এবার তারা সমস্ত দোষ ভারতের উপর চাপিয়ে ভারত আক্রমণ করে বসল।

৩রা ডিসেম্বর যেদিন পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করে সেদিন অপরাহ্নে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতার এক বিশাল জনসমাবেশে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। ঐ দিন রাত্রি দ্বিপ্রহরে তিনিও ভারতের জওয়ানদের পাকিস্তানী হামলা প্রতিহত করার জন্য হুকুম দেন।

অতএব মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হল ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাত। সম্মিলিত বাহিনী ভীমবেগে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে, প্রচণ্ড গতিতে আক্রমণ করল অন্যায় যুদ্ধে লিপ্ত পাকিস্থানী সেনাবাহিনীকে। বাংলাদেশের সীমানার চতুর্দিক দিয়ে যৌথ কমান্ডের অধীনস্থ সৈন্যদল ঢুকে পড়ল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে।

এদিকে পাক সামরিক সরকার ভারতের  বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করলে ৪ঠা ডিসেম্বর থেকে ভারতীয় সৈন্য মিত্রবাহিনীর নাম নিয়ে আখাউড়া যুদ্ধে নেমে পড়ে। আক্রমণ চালানো হয়েছিল অতি প্রত্যুষে। উল্লেখযোগ্য যে, এই সময় আমাদের বাহিনীর পক্ষে খুব বেশী আর্টিলারী সাপোর্ট (কামানের সহায়তা) দেওয়া হয়েছিল। সেই সঙ্গে ছিল মর্টারের প্রচুর সহায়তা। এই আক্রমন শুরু করার আগে মেজর মতিনের নেতৃত্ব সেক্টর ট্রুপসের দুই কোম্পানি দিয়ে পাশ থেকে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। মেজর মতিনের ই-পি-আর কোম্পানী মারাত্মক প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হয়েও নিজের অবস্থান থেকে বিন্দুমাত্র নড়েনি। আমাদের সেক্টরে ৪ঠা ডিসেম্বরের যুদ্ধে মুক্তিফৌজের যে বীর সৈন্যরা শাহাদাত বরণ করে তাঁরা হচ্ছেন- লেঃ বদিউজ্জামান, সিপাহী রুহুল আমিন, সিপাহী সিদ্দিকুর রহমান। যাঁরা আহত হন তাঁরা হচ্ছেন- সুবেদার চান মিয়া, হাবিলদার কামরুজ্জামান, কোম্পানী হাবিলদার মেজর নূরুজ্জামান এবং আরো ১৫ জন। এই লড়াইয়ে শত্রুপক্ষের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়। মুক্তিফৌজ ১৩জন শত্রুসেনাকে হত্যা করে এবং ৪ জন শত্রুসেনা তাদের হাতে বন্দী হয়। মুক্তিফৌজ ছোটবড় হাতিয়ারসহ শত্রুবাহিনীর ৩২টি রাইফেল কবজা করে।

ডিসেম্বরের ৫ তারিখে পাকিস্থান বাহিনী আমাদের বাহিনীর উপর পালটা আক্রমণ চালায়। কিন্তু আমাদের তীব্র প্রতি-আক্রমণের মুখে তারা পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। আখাউড়ায় তুমুল লড়াই চলে। এই লড়াইয়ে মুক্তিবাহিনী ও সংযুক্ত মিত্রবাহিনী অপরিসীম বীরত্ব ও সাহসীকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে। অবশেষে ৫ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী আখাউড়া দখল করে। ৪/৫ ডিসেম্বরের যুদ্ধে এই এলাকায় শত্রুবাহিনীর প্রায় ১৬০ জন সৈন্য মারা যায়।

আখাউড়া রেলওয়ে স্টেশনে শত্রু অবস্থান ছিল খুবই সুদৃঢ়। ফলে এখানকার যুদ্ধ হয় ব্যাপক এবং মারাত্মক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আখাউড়ার লড়াইয়ের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এখানকার যুদ্ধে উভয় পক্ষই সর্বাধিকসংখ্যক আর্টিলারী ব্যবহার করে। কয়েকটি আক্রমন চালিয়ে ২নং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের পাল্টা আক্রমণের মুখে পাঞ্জাবী সৈন্যরা তাদের মনোবল হারিয়ে ফেলে। এমতবস্থায় মিত্রবাহিনী আমাদের বাহিনীর সাথে যোগ দেবার পর সম্মিলিত আক্রমণের মুখে তারা আর দাঁড়াতে পারিনি। বলাবাহুল্য, আখাউড়ার পতনের পর শত্রুবাহিনী আর  কোথাও ভালভাবে অবস্থান নিতে পারেনি।

আখাউড়ার যুদ্ধে কোম্পানী কমাণ্ডার হিসাবে যেসব অফিসার অংশগ্রহন করেন তাঁরা হলেনঃ মেজর মতিউর রহমান, ক্যাপ্টেন মোরশেদ, লেফটেন্যাণ্ট ইব্রাহিম, লেফটেন্যাণ্ট বদিউজ্জামান, লেফটেন্যাণ্ট সলিম (কোম্পানী অফিস)।

এখানে আমি ২নং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট সম্পর্কে সামান্য কিছু আলোকপাত করতে চাই। পাকিস্থান সেনাবাহিনীতে ২নং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ছিল বেঙ্গল রেজিমেণ্টের অন্যতম পুরনো ব্যাটালিয়ন। হানাদার পাকবাহনী বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ শুরু করার পর এই ব্যাটালিয়ন তখনকার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড মেজর শফিউল্লাহর (বর্তমান কর্নেল এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান) অধীনে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। মুক্তি সংগ্রামে এই ব্যাটালিয়নের অবদান অতুলনীয়।

এখানে আখাউড়ার যুদ্ধে শাহাদাৎপ্রাপ্ত বীর সৈনিক লেফটেন্যাণ্ট বদিউজ্জামান সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করে তাঁর শহীদী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে চাই ।

লেফটেন্যাণ্ট বদিউজ্জামান রংপুর মিলিটারী কাস্টোডি থেকে পালিয়ে এসে ১৬ই আগস্ট মনতলায় আমার সাথে যোগ দেন। আমি ১১ নং বেঙ্গল রেজিমেণ্টে যোগদানের আগ পর্যন্ত তিনি আমার অন্যতম প্লাটুন কমাণ্ডার হিসাবে আমার সাথেই ছিলেন। তিনি আমার সাথে বহু অভিযানে অংশ গ্রহণ করেন।

লেফটেন্যাণ্ট বদিউজ্জামান ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রান সাহসী সৈনিক। সদা হাসিমুখে এই অসম সাহসী যোদ্ধা যদিও মূলত ছিলেন একজন ক্যাভালরি অফিসার, তবুও একজন ইনফ্যানন্ট্রি অফিসারের চেয়ে কোন অংশ কম ছিল না। যুদ্ধ চলাকালে শত্রুবাহিনীর একটি শেল তাঁকে আঘাত করে এবং সেই আঘাতে তিনি শহীদ হোন। তাঁর মরদেহ আজমপুর রেলওয়ে স্টেশনে একটি মাজারের কাছে সমাহিত করা হয়। সিপাহী রুহুল আমিনের মরদেহও এরই কাছে সমাহিত করা হয়।

২১ বছরের যবুক লেফটেন্যাণ্ট বদিউজ্জামান ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জে জন্মগ্রহন করেন। সদা প্রফুল্লচিত্ত নিরহংকারী বীর সৈনিক মাতৃভূমির স্বাধীনতা সংগ্রামে হাসিমুখে আত্মৎসর্গ করেন। তাই দেশবাসী কৃতজ্ঞতার সঙ্গে চিরদিন তাঁর কথা স্মরণ করবে। আল্লাহ তাঁর আত্মাকে শান্তি দিন।

আশুগঞ্জের লড়াই এবং ঢাকার পথে ‘এস’ ফোর্স

 

এদিকে লেঃ কর্নেল শফিউল্লাহ তাঁর ‘এস’-ফোর্স নিয়ে কোন পথে অগ্রসর হচ্ছেন তার বিবরণ সংক্ষেপে দিচ্ছি। ৬ই ডিসেম্বর বিকালে লেঃ কর্নেল শফিউল্লাহ ইসলামপুর ব্রীজের কাছে এক দুর্ঘটনার সম্মুখীন হন এবং নিশ্চিত মৃত্যর হাত থেকে রক্ষা পান। তারপর এখান থেকে ‘এস’-ফোর্স ৭ই ডিসেম্বর ঢাকার পথে রওনা হয় এবং এইদিন শাহবাজপুরে তাদের সাথে আর একটি খন্ডযুদ্ধ হয় ও পরে শত্রুরা ভেগে যায়। তারপর ‘এস’-ফোর্স ও মিত্রবাহিনী সরাইল পৌছে যায়। আশুগঞ্জে আমরা আবার শত্রুসৈন্যর সম্মুখীন হলাম ৮ই ডিসেম্বর। আশুগঞ্জে শত্রুবাহিনী প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গড়েছিল। সেটা ছিল যুদ্ধকৌশল সমৃদ্ধ এবং তার ঘাঁটিগুলি ছিল অত্যন্ত মজবুত। আমাদের ‘এস’-ফোর্স ও মিত্রবাহিনী প্রথম আক্রমন চালায় ৯ই ডিসেম্বর বেলা ৩টার সময়। এই আক্রমণে আমাদের পক্ষে ছিল তবুও তার সেই ভয়াবহ রূপ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করাও কঠিন। সম্মিলিতভাবে ‘এস’- ফোর্স ও মিত্র বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে শত্রু বাহিনীও ভীষণভাবে মারমুখী হয়ে উঠে। একদিকে যখন আমাদের পদাতিক বাহিনী বিনা বাধায় শত্রুর উপর বোমা নিক্ষেপ করে যাচ্ছে। এমতাবস্তায় শত্রুপক্ষ তাদের ভারী মেশিনগান ও বিমানবিধবংসী কামান দিয়ে অবিরামভাবে গুলি ছুড়ে যাচ্ছে। তাদের আর আর (রিকয়েললেস রাইফেল) গুলোও তখন নিরস্ত ছিল না। তারাও তখন আমাদের পক্ষের ট্যাঙ্কগুলোকে লক্ষ্য করে গোলা নিক্ষেপ করে যাচ্ছিল। আমাদের পক্ষের গোলন্দাজ বাহিনীর মিডিয়াম গানগুলো শত্রুপক্ষের উপর অবিশ্রান্তভাবে গোলা নিক্ষেপ করছিল, ঠিক তার পালটা জবাবে শত্রুপক্ষও তখন সমভাবে আমাদের উপর গোলা নিক্ষেপ করছিল। তুমুল লড়ায়ের পর শত্রুবাহিনীর প্রচণ্ড পালটা আক্রমণের মুখে ‘এস’-ফোর্স ও মিত্রবাহিনীকে সাময়িকভাবে সেদিন  পিছু হাটতে হয়। যুদ্ধে উভয় পক্ষেরই প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। কিন্তু তুলনামূলকভাবে তাদের ক্ষয়ক্ষতি আমাদের থেকে অনেক বেশী ছিল। ঐ দিনকার যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর চারখানা ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয় এবং প্রায় ৪০/৫০ জন বীর যোদ্ধা মারা যান।যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের প্রায় দেড় শতাধিক লোক নিহত হয়।

দ্বিতীয়বার আক্রমণের পর অবশেষে শত্রুসৈন্য ১০ই ডিসেম্বর আশুগঞ্জ থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং ভৈরববাজারে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, শত্রুপক্ষ আশুগঞ্জ থেকে ভৈরববাজারে যাবার পূর্বে ভৈরব ব্রীজের তিনটি স্প্যা্ন ধ্বংস করে দিয়ে যায়। যুদ্ধের গতিবেগ রক্ষা করার জন্য কোন সময় নষ্ট না করে লেঃ কর্নেল শফিউল্লাহ একাদশ বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ভৈরববাজার ঘিরে থাকার জন্য নির্দেশ দেন এবং তিনি নিজে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল সেক্টর ট্রুপস নিয়ে পদব্রজে নরসিংদীর দিকে রওনা হন।

তিনি নরসিংদী পৌঁছানোর পূর্বেই মিত্রবাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন হেলিকপ্টারযোগে সেখানে পৌঁছে গেছে। কিন্তু শত্রুপক্ষ সেখান থেকে পালিয়ে গেছে। ১২ই ডিসেম্বর তিনি শীতলক্ষ্যা পার হন। ইতিমধ্যে তিনি দুটি ছোটখাটো সংঘর্ষে লিপ্ত হন। এছাড়া তিনি দুটি দলকে ঢাকার দিকে পাঠিয়ে দেন। তার একটি ছিল বাসাবো এলাকার জন্য ও অপরটি ছিল ঢাকা সেনানিবাসের জন্য। ১৬ই ডিসেম্বর শত্রুপক্ষের ৩০০ জনের একটি দল ডেমরাতে তাঁর নিকট আত্মসমর্পণ করে।

১৩ই হইতে ১৬ই ডিসেম্বর বিকাল ৪টা পর্যন্ত ‘এস’-ফোর্স ডেমরা ও শহরের বিভিন্ন উপকন্ঠে লড়াই করে। এরপর তারা ডেমরার পরবর্তী এলাকা মাতুয়াইলে একবার বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল। পরে লেঃ কর্নেল শফিউল্লাহ জেনারেল অরোরার সাথে ১৬ই ডিসেম্বর বেলা ৪টা ৩১ মিনিট রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। ইতিমধ্যেই দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ও সেক্টর ট্রুপস ঢাকা স্টেডিয়ামে পৌঁছে যায়।

*১৯৭১ সালের মার্চে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন। প্রতিবেদঙ্গুলি তাঁর রচিত ‘মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৭। ৪ নং সেক্টরে সংঘটিত যুদ্ধের বিবরণ বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র মে-ডিসেম্বর’ ১৯৭১

 

শাহরিয়ার ফারুক

<১০, , ২৩৫২৪৪>

 

সাক্ষাৎকারঃ ব্রিগেডিয়ার চিত্তরঞ্জন দত্ত*

মে ১৯৭১ সন।ভারতীয় বিভিন্ন এলাকায় খোলা হল নানা ট্রেনিং ক্যাম্প।পুরো সিলেট সেক্টরের ভার আমার উপর দেয়া হল।মোট দুটি সাব-সেক্টর খোলা হল।আমার সৈন্যদের মনোবল ভাঙ্গল না।বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে তারা কাজ করতে আরম্ভ করল।সিলেটের সব থানা থেকে লোক ভর্তি করা শুরু হলো এবং প্রশিক্ষনের কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলে।বি ডি আর, আনসার, মুজাহিদ ও পুলিশকে নিয়ে গড়ে উঠল ‘সেক্টর ট্রুপস’ আর স্কুল কলেজের ছাত্রদের নিয়ে গড়ে উঠল ‘গণবাহিনী’।সিলেটে মোট ৬টি সাব-সেক্টর ছিল।

১।জামালপুর সাব-সেক্টরঃ গণবাহিনীর মাহমুদূর রব সাদী এই সাব-সেক্টর কমান্ড করতো।অল্পবয়স্ক সুন্দর ছেলেটি বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য যে স্পৃহা নিয়ে কাজ করত,তা দেখলে সত্যি আশ্চর্য লাগত।যেখানেই তাকে পাঠানো হয়েছিল,প্রত্যেকটি অপারেশনে সে কৃতকার্য হয়েছে। এই সাব-সেক্টর থেকে অপারেশন চালানো হয়েছে আটগ্রাম,জাকীগঞ্জ,লুবাছড়া ও কানাইঘাটি এলাকায়।নভেম্বরের শেষের দিকে সাদীকে সিলেটের ভিতরে নবীগঞ্জ এলাকায় প্রায় ৫০জন বিশ্বস্ত গণবাহিনী ছেলে দিয়ে নবীগঞ্জ এলাকা মুক্ত করতে পাঠানো হয়েছিল।

২।বারোপুঞ্জী সাব-সেক্টরঃএটা কমান্ড করত ক্যাপ্টেন রব।সাপ্লাই কোরের অফিসার হয়ে পদাতিক সৈন্য পরিচালনায় সে অশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে এবং সাব-সেক্টর লাটু,বিয়ানিবাজার,শারোপার,বারোগ্রাম,জাকীগঞ্জ,আটগ্রাম,কানাইঘাট,চিকনাগুল এলাকায় অসীম সাহসের সাথে যুদ্ধ পরিচালনা করেছে।

৩।আমলসিদ সাব-সেক্টরঃবাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লেঃজহীর এই সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিল।এই তরুণ অফিসারটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে খুবই সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দিয়েছে।কানাইঘাট অপারেশনে তার দক্ষতার প্রশংসা না করে পারা যায়না, ডিসেম্বর এর প্রথম সপ্তাহে এই সাব-সেক্টরটি ‘জেড ফোর্সের প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কাজ করেছে।

৪।কুকিতল সাব-সেক্টরঃএটার কমান্ডার ছিল ফ্লাইট লেফটেন্যন্ট কাদের। বিমানবাহিনীর অফিসার হয়ে এত সুষ্ঠভাবে পদাতিক বাহিনী পরিচালনা করায় তাকে প্রশংসা না করে পারা যায়না। মাঝে মাঝে সে প্রায়ই বলত, স্যার আমাকে একটা জঙ্গিবিমান এনে দেন,আমি পাকিস্তানীদের খতম করব।আপনাদের যুদ্ধ খুব মন্থর গতিতে চলছে,আমি চাই তাড়াতাড়ি পাকিস্তানীদের শেষ করে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে।আমি তাকে স্বান্তনা দিতাম ‘স্লো এন্ড স্টীডি ইউনস দি রেস’ । এই সাব-সেক্টর দিলখুশ চাবাগান,কুলাউড়া, জুবী চা বাগান এলাকায় অপারেশন চালিয়ে শত্রুকে নাস্তানাবুদ করেছে।পরে এই সাব-সেক্টরে ক্যাপ্টেন শরিফুল হক যোগ দিয়েছিল।এই নির্ভীক যুবক পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ করে।এর কৃতিত্বের কথা পরে আসবে।

৫।কৈলাশশহর সাব-সেক্টরঃলেঃ ওয়াকিউজ্জামান এই সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিল।নয় মৌজায় বাংলাদেশ পতাকা উত্তোলন ও শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এত বড় এলাকাকে মুক্ত রাখার জন্যএই তরুণ অফিসারকে প্রশংসা না করে পারা যায় না।এই সাব-সেক্টর ডিসেম্বরের দিকে ফেঞ্চুগঞ্জ মুক্ত করে সিলেটের দিকে গিয়েছিল।এবং ভারত যখন যুদ্ধ ঘোষনা করল তখন এই সাব-সেক্টর ভারতের ৫৯ ভারতীয় ব্রিগেডের সঙ্গে সিলেটে প্রবেশ করেছিল।

৬।কমলাপুর সাব-সেক্টরঃএটার কমান্ডার ছিল ক্যাপ্টেন এনাম।এই তরুণ অফিসার পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়।এবং এই সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার হয়ে অনেক কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে। ধলাই চা বাগান এবং পার্শ্ববর্তী চা বাগানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য এই সাব-সেক্টরকে কৃতিত্ব দেয়া যায়।ভারত যুদ্ধ ঘোষণার পর এই সাব-সেক্টর ৮১ ভারতীয় ব্রিগেডের সঙ্গে মিলিত হয়ে মৌলভীবাজারে প্রবেশ করেছিল।

লোহারবন্দ নামে এক জায়গায় সমস্ত ছেলেদের প্রশিক্ষণ দেয়া হত।রিলিফ ক্যাম্প,শরনার্থী শিবির এবং নানা জায়গা থেকে স্কুল কলেজের ছেলেদের এবং বাংলাদেশের কর্মক্ষম নাগরিকদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়া হত।প্রশিক্ষণ দেবার পর ছেলেদের পাঠিয়ে দেয়া হত বিভিন্ন সাব-সেক্টরে।এই কাজের জন্য সিলেটের ফরিদ গাজী,নুরুল ইসলাম,আজিজ,তোয়াবুর রহীম, ডক্টর আলী,হাবিব রহমান, ডক্টর মালেক,লতিফ প্রমুখ লোকের নাম না করলে তাঁদের প্রতি অবিচার করা হবে।রাত দিন কাজ করে নানা জায়গা থেকে লোক সংগ্রহ করে তাঁরা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠিয়ে দিতেন। আমার সৈন্যদের সাব-সেক্টর খাওয়া -দাওয়া এবং থাকার ব্যবস্থা করতেন,তার জন্য আমি তাঁদেরকে জানাচ্ছি আমার আন্তরিক ধন্যবাদ।

সেক্টর ট্রুপস এর কাজ শত্রুদের ধ্বংস করা,এ্যামবুশ করা এবং গণবাহিনীর কাজ ছিল পুল ধ্বংস করা, বিদ্যুৎ সরবরাহ বিপর্যস্ত করা,মাইন পোঁতা ও ছোটখাটো শত্রুঘাঁটি ধ্বংস করা।বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক থেকে আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল যত চা বাগান আমার এলাকায় আছে তাদের অকেজো করে দেয়া।কাজ পুরোদমে চলতে লাগল। এদিকে একদিন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, বিধু দাশগুপ্ত আমার কাছে এসে বলল যে,শিলং দিয়ে সুনামগঞ্জ এলাকায় অপারেশন করা উচিত। আমি তাদেরকে সব সাহায্য দিলাম।পরে এই দুই নির্ভীক যুবক তাদের নিজ নিজ এলাকার ভিতর ঢুকে পাকিস্তানী সৈন্যদের বিপুল ক্ষতি সাধন করেছে। সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের দিরাই অপারেশন এবং বিধু দাশগুপ্তের মাঘালকান্দী এবং আজমিরীগঞ্জ অপারেশন এলাকার সকলেরই সুবিদিত।এরা সত্যই প্রশংসার যোগ্য।

মে-জুন সেক্টর ট্রুপস এবং গণবাহিনী তাদের নিজ নিজ কাজ পুরোদমে চালিয়ে যেত থাকে।শেওলা, সাদা খাল,বারইগ্রাম রবং কাংলী ফেরীর উপর এরা আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানীদের বিপর্যস্ত করতে লাগল।অনেক দালালকে মেরে ফেলা হল।ছোট ছোট দলে সেক্টর ট্রুপস ও বাহিনীকে পাঠানো হত ফেরীগুলোকে নষ্ট করতে।এক একটা নৌকাকে নষ্ট করতে বেশ সময় এবং পরিশ্রমের দরকার। এখন মনে পড়ে নায়েব কুতুবের কথা।আজ সে আমাদের মাঝে নেই। সাদা খাল ফেরী নষ্ট করতে হবে।সংগে আরো দুজন সিপাহী ও দুজন ছাত্র।সাদা খাল তখন পানিতে ভর্তি। বেশ স্রোত কচুরিপানা ভেসে যাচ্ছিল এখানে ওখানে,খেয়া ছিল নদীর ওপারে, যেদিকে শত্রু ছিল।সবাই ওরা নদীতে নেমেছে খেয়াগুলিকে নষ্ট করতে। নদীর মাঝখানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃস্টিরমত গুলি আসতে শুরু করল।নায়েক কুতুব ডুব দিয়ে প্রায় নৌকার কাছে চলে এসেছিল, সামনে ছিল কচুরিপানা। ওগুলো মাথায় দিয়ে স্রোতের দিকে ভেসে গেল।দুদিন পর এসে আমার পায়ে প্রণাম করে বলল, বড় বেঁচে গেছি স্যার।আমি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম।চোখ দিয়ে আনন্দে জল গড়িয়ে পড়ল।কেবল বললাম,বেঁচে থাক ‘জয় বাংলা, চারজন ফিরে এসে যখন অবস্থার বর্ণনা দিয়েছিল তখন ভেবেছিলাম ওকে বোধ হয় আর ফিরে পাব না।যাই হোক ওকে আমার কাছে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।

পুরো জুন-জুলাই আমাদের কাজ অব্যহত থাকে।হিট এন্ড রান কায়দায় শত্রুদের বিপর্যস্ত করাই আমাদের মূখ্য উদ্দেশ্য ছিল।শত্রুদের ঘাঁটি লাটু, বড়লেখা, ফুলতলা, আটগ্রামের উপর হানা দিলাম। চা-বাগানগুলো অকেজো করতে আরম্ভ করলাম।রাজকী, ফুলতলা, শেওলা, পৃথিমপাশা,সমনভাগ,সোনারুপা,হাসনাবাদ,চূড়ামণি, গাহেরা,সাগরনাল চা বাগানগুলো অকেজো করা হল।বিস্ফোরক দ্রব্য বেশী ছিল না।তবুও তাই দিয়ে চা বাগানের বড় বড় মেশিনের যন্ত্রপাতি অকেজো করা হল।

জুনের প্রথম সপ্তাহে লাঠিটিলা চা বাগানের উপর মস্তবড় হামলা চালানো হল।জানতে পারলাম লাঠিটিলাতে শত্রুদের এক প্লাটুন সৈন্য পরিখা খনন করে আছে।

এই আক্রমণে আমাকে ভারতীয় গোলান্দাজ এবং মেশিনগানের সাহায্য নিতে হয়েছিল। শত্রুদের শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল আমাদের কাছে যে সেন্য এবং অস্ত্রশস্ত্র ছিল তা দিয়ে শত্রুদের মোকাবেলা করা সম্ভব ছিল না বলে আমাকে ভারতীয়দদের সাহায্য নিতে হয়েছিল। এই আক্রমণ ক্যাপ্টেন রবের নেতৃত্বে হয়েছিল। খুব ভোরে চারটা থেকে ভারতীয় গোলান্দাজ বাহিনী গোলাগুলি শুরু করলো এবং মেশিনগান থেকে গুলি ছুড়তে শুরু করল।আর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সৈন্যরা শত্রুর দিকে অগ্রসর হতে আরম্ভ করল।বেলা প্রায় ১১টার সময় শত্রুরা আমাদের সম্মিলিত আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটে যায়।আমার সৈন্যরা তার উপর হামলা করে,অনেক গোলাবারুদ এবং অস্ত্র উদ্ধার হয়েছিল। দুটো পাকিস্তানি সৈনিক আহত অবস্থায় ধরে নিয়ে আসা হয়েছিল। একদিন পর আরেকজন পাঞ্জাবী ল্যান্স নায়েককে পাতনি চা বাগানে পাওয়া গিয়েছিল।

এই যুদ্ধে নায়েক শফিকউদ্দিন আহমেদকে বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল। নায়েক শফিকই হাতাহাতি যুদ্ধে নিজের জীবন বিপন্ন করে গ্রেনেড ছুড়ে আহত সিপাহীটিকে ধরে আনতে সক্ষম হয়েছিল। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ‘হীট এন্ড রান কৌশল অব্যাহত থাকে।বেশীরভাগ চা- বাগানগুলো অকেজো করে দেয়া হল।এবং স্থির হলো যে গণবাহিনীর ছেলেদের সিলেটের ভেতরে ঢুকানো হবে। এদেরকে বলা হল,সিলেটের ভিতরে গিয়ে ডাকঘর,পুলিশ স্টেশন, বাণিজ্য কেন্দ্রে ইত্যাদিতে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত করতে হবে।এদিকে ক্যাপ্টেন শরিফুল হক জুলাই মাসের মাঝামাঝি দিলখুশ ও জুবিতে অনেক অপারেশন করলো এবং খবর পাওয়া গেল দিলখুশ চা বাগানে পাকিস্তানীরা পরিখা খনন করেছে এবং আমাদের জুবী যাবার রাস্তা বন্ধ করে দেবার চেষ্টা করছে।ক্যাপ্টেন শরিফুল হককে বলা হল দিলখুশে পাকিস্তানী ঘাঁটি ধ্বংস করতে।এই ঘাঁটি ধ্বংস করার জন্য আমাকে ভারতীয় গোলান্দাজ বাহিনীর সাহায্য নিতে হয়েছিল।ক্যাপ্টেন হক একজন আর্টিলারি অফিসার।টার্গেট নির্দেশ করার প্রশিক্ষণ তার ছিল,দিলখুশ আক্রমণের জন্য কি কি কাজ করতে হবে তা সৈন্যদেরকে বুঝিয়ে দেয়া হল।দিলখুশ থেকে প্রায় এক মাইল দূরের একটা উঁচু লম্বা গাছ থেকে পুরো দিলখুশ এলাকাটা দেখা যায়।আক্রমণ শুরু হল।ক্যাপ্টেন হক গাছে চড়ে অয়ারলেসের সাহায্য টার্গেট সঠিকভাবে নির্দেশ করতে আরম্ভ করলেন।আমাদের গোলাগুলি পাকিস্তানীদের উপর পড়তে লাগল।তারা দৌড়াদৌড়ি আরম্ভ করল,বুঝা গেল তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে।যুদ্ধ যখন শেষ অবস্থায় এসে পৌঁছল তখন শত্রুদের একটা ৩”মর্টরের গুলি এসে হক যে গাছে ছিল তার নিচে এসে পড়ল এবং হক আহত হয়ে পড়ে গেল।আমাদের পক্ষের গোলাগুলি এরপর থেকে ঠিক লক্ষ্য স্থানে পড়ছিল না-এমনি আমাদের উপরেই পড়তে আরম্ভ করল।আমাদের সৈন্যরা তখন পিছু হটতে বাধ্য হল।হককে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হল।যদিও এ আক্রমণ সফল হয়নি,তবুও পাকিস্তানীদের মনোবল অনেক ভেঙ্গে গিয়েছিল এবং বেশকিছু হতাহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এই এ্যাকশন এর পর পাকিস্তানীরা দিলখুশে আর তাদের ঘাঁটি বানায়নি।এই যুদ্ধের জন্য ক্যাপ্টেন হককে বীর উত্তম উপাধির সুপারিশ করা হয়েছিল।আগষ্ট মাসে লুবাছড়া,কাড়াবালা,মুখাটিলা,আমলসিদ,ন মৌজা আমাদের মুক্ত এলাকা বলে ঘোষিত হল।পাকিস্তানীরা এই মুক্ত এলাকা দখল করার জন্য বার বার আক্রমণ চালিয়েছে কিন্তু সফল হতে পারেনি।

খবর পাওয়া গেল লাটুতে শত্রুসৈন্য (প্রায় এক কোম্পানি) পরিখা খনন করেছে এবং বড়লেখা পর্যন্ত তারা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।লাটু এমন একটি জায়গা যেটা দখল করা আমাদের পক্ষে খুবই দরকার ছিল।কারণ লাটু দখল করলে শত্রুদের কুলাউড়া -শ্রীহট্ট রাস্তায় চলাচলে অনেক অসুবিধা হবে।মেজর রবের অধীনে প্রায় ৩০০ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে লাটু দখলের পরিকল্পনা নিলাম।আমার পরিকল্পনা ছিল লাটু রেলওয়ে ষ্টেশনে কিছুসংখ্যক সৈন্য দিয়ে আক্রমণ চালানো আর বাকি সৈন্য দ্বারা লাটুর বাঁয়ে পাহাড়ের গা ঘেঁষে লাটুর উপর পুরোপুরি আক্রমণ চালিয়ে দখল করা।লাটু-বড়লেখা রাস্তায় মাইন পুঁতে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল,যাতে পাকসেনারা বড়লেখা থেকে অগ্রসর হতে না পারে এবং বাধাপ্রাপ্ত হয়।আমাদের কাছে কোন অয়ারলেস সাজসরঞ্জাম ছিল না।তাই একদলের সাথে অন্যদের যোগাযোগ ছিল না।আগষ্টের শেষের দিকে ভোর চারটায় আক্রমণ শুরু হল।বেলা সাড়ে এগারটায় লাটু -বড়লেখা রাস্তায় মাইন পোঁতার জন্য যাদেরকে পাঠানো হয়েছিল টার সাড়ে এগারটায় ফিরে আসে।দুইজন গুরুত্বরভাবে আহত হয়েছিল মাইন পোঁতার সময়।তাদের সবাইকে মেজর রবের কাছে পাঠিয়ে দিলাম।পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চলতে থাকে।বেলা প্রায় দুটোর সময় দেখা গেল যে পাকসেনারা বাংকার ছেড়ে পেছনে চলে যাচ্ছে,পরক্ষণেই আরম্ভ হল শত্রুসৈন্যর লাটুর উপর গোলাগুলি নিক্ষেপ।বোঝা গেল বড়লেখা থেকে শত্রুসৈন্য লাটুতে এসে যোগ দিয়েছে।শত্রুদের কাছ থেকে ৩ ইঞ্চি এমজির গোলাগুলি আসতে লাগল।বেলা প্রায় সাড়ে পাঁচটা।শত্রুদের প্রচন্ড আক্রমণের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা টিকতে না পেরে পিছনে চলে আসতে শুরু করে।মনটা খারাপ হয়ে গেল।এই যুদ্ধে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছিল।

সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আবার আক্রমণ চালানো হল।সারোপার এবং লাটু এই দুটো জায়গা আবার দখল করার প্রচেষ্টা চালানো হয়।তুমুল যুদ্ধের পর সারোপার আমাদের হস্তগত হয়।সারোপার দখলে একটা সুবিধা হল যে শত্রুসৈন্যর এখন কুলাউড়া থেকে সিলেটে সরাসরি আসা বন্ধ হয়ে গেল।পুরো সেপ্টেম্বর মাসটা লাটু,বড়লেখা এমনি ফেঞ্চুগঞ্জ পর্যন্ত আমাদের আক্রমণ চলতে লাগল।ইতিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সাদী তার সৈন্যদের নিয়ে চা বাগানে আক্রমণ চালায় এবং দুদিন তুমুল যুদ্ধের পর পুরো লুবাছড়া -কাড়াবালা আমাদের হস্তগত হয়।লুবাছড়া মুক্ত হবার পর পাকিস্তানীরা বারবার চেষ্টা চালিয়েছে লুবাছড়া দখল করার জন্য।কিন্তু লুবাছড়া পুনরায় দখল করতে তারা সমর্থ হয়নি।লুবাছড়া স্বাধীনতা লাভ পর্যন্ত মুক্ত ছিল।আমাদের আক্রমণের ভবিষ্যৎ কর্মসূচী লুবাছড়া থেকে নির্ধারিত হয়েছিল। এই যুদ্ধে খাজা নিজাম উদ্দীনসহ নিম্নলিখিত মুক্তিযোদ্ধারা শহীদ হয়েছিল এবং তাদের বীরত্বের জন্য লুবাছড়া আমাদের হস্তগত হয়েছিল।তাদেরকে এওয়ার্ড দেয়ার জন্য আমি সি-এন-সি’র কাছে অনুরোধ করেছিলাম।

নিহতরা হলোঃ১।খাজা নিজামুদ্দীন বীরশ্রেষ্ঠ। ২।রফিক উদ্দিন বীরোত্তম।৩।মোহাম্মদ বশির আহম্মদ বীরপ্রতীক, ৪।মোহাম্মদ মইজুল ইসলাম বীরপ্রতীক, ৫।মোহাম্মদ শাহাবউদ্দীন বীরশ্রেষ্ঠ, ৬।মোহাম্মদ হোসেন,৭।আতিকুল ইসলাম বীরপ্রতীক,৮।আশরাফুল হক বীরোত্তম, ৯।মাহমুদূর রব বীরোত্তম।

নয়টা গ্রাম নিয়ে গঠিত একটি মৌজা -নাম ন’মৌজা।এটি ভারতের কৈলাশশহের বিপরীতে অবস্থিত ছিল।লেঃ ওয়াকিউজ্জামানের নেতৃত্বে ন’মৌজায় পাকিস্তানী ঘাঁটির উপর আঘাত হানা হল এবং ন’মৌজাকে শত্রুমুক্ত করা হল।এমনিভাবে লুবাছড়া,কাড়াবালা,মোকামটিলা,আমলসিদ,ন’মৌজা আমাদের দখলে আসে।এবং পরবর্তী পর্যায়ে পাকিস্তানীদের উপর আঘাত হানা হল এই সমস্ত ঘাঁটি হতে।

অক্টোবরের মাঝামাঝি মেজর জিয়া (বর্তমানে মেজর জেনারেল) ১ম এবং ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে আমার সেক্টরে যোগ দেন।তাতে আমার শক্তি অনেক বেড়ে যায়।১ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে এবং ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট মেজর আমিনের নেতৃত্বে (বর্তমানে দুইজনই লেফটেন্যন্ট কর্ণেল) সিলেটের চা বাগানগুলোর উপর আক্রমণ চালানো হয়।পরিকল্পনা ছিল চা বাগানগুলো শত্রুমুক্ত করে আমরা সবাই মিলে সিলেটের দিকে অগ্রসর হবো।১ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রথম আঘাত হানল কেজুরীছড়া চা বাগানের উপর,সঙ্গে সঙ্গে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট আঘাত হানল ফুলতলা-সাগরনাথ চা বাগানের উপর।এমনিভাবে সেক্টর ট্রুপস এবং জেড ফোর্স পুরো সিলেট জেলার উপর একটার পর একটা আঘাত হানতে শুরু করল,এবং পাকিস্তানীদের পর্যুদস্ত করতে শুরু করল।৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট দক্ষিণগুলো চা বাগানের উপর আক্রমণ চালালো।শত্রুদের ২২ বেলুচ রেজিমেন্ট ওখানে ছিল।পাকিস্তানীরা অনেকবার দক্ষিণগুলের উপর আক্রমণ চালিয়েছে,কিন্তু ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট দক্ষিণগুল হাতছাড়া করেনি।আমার মনে হয়,বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে এই সর্বপ্রথম দক্ষিণগুলে ১০৫ মিলিমিটার আর্টিলারি দক্ষতার সাথে এবং কার্যকরীভাবে শত্রুর বিরুদ্ধে,ব্যবহার করা হয়েছিল।দক্ষিণগুল জয়ের অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে ১০৫ আর্টিলারির সাফল্যজনক ব্যবহার অনেকাংশে সাহায্য করেছিল।১০৫ মিলিমিটার আর্টিলারি ব্যবহারের প্রশিক্ষণ সিলেট সেক্টর আমারই তত্ত্বাবধানে ক্যাপ্টেন রশীদের পরিচালনায় সর্বপ্রথম হয়েছিল।আমার যতদূর মনে হয়,১০৫ মি.মি.আর্টিলারিকে পরবর্তীকালে মুজিব ব্যাটারি বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিল।

নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে আটগ্রাম -জাকীগঞ্জ দখল করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ল।কারণ জাকীগঞ্জ সিলেটের এক কোণে অবস্থিত।ভারতের করিমগঞ্জ শহরটি ঘেঁষে জাকীগঞ্জের অবস্থিতি।মাঝখানে ছোট্ট একটা নদীর ব্যবধান,জাকীগঞ্জ থেকে পাকিস্তানীরা শিলচর-করিমগঞ্জ রেলওয়ে লাইনের উপর রাতের অন্ধকারে মাইন পুঁতে রাখত।তার ফলে দু’দুবার মালবাহী ট্রেন দূর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিল। এতে আমরা অত্যন্ত লজ্জাবোধ করতাম,কারণ বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানীরা এসে বন্ধুরাষ্ট্রের ক্ষতিসাধন করছে।তাই জাকীগঞ্জ দখল করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ল।সেক্টর ট্রুপস এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিয়ে হামলা চালানো হল।জাকীগঞ্জের এই যুদ্ধে ভারতের সাহায্য সহযোগীতা কোনদিন ভুলিবার নয়। তাদের সাহায্য না পেলে হয়ত জাকীগঞ্জ -আটগ্রাম শত্রুমুক্ত করা সহজ বা সম্ভব হত না।প্রচন্ড যুদ্ধের পর জাকীগঞ্জ আটগ্রাম আমাদের দখলে আসে।দখলের পর ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট আটগ্রামে অবস্থান করেছিল।ভারতের ৯৯তম মাউন্টেন রেজিমেন্টকে জানাই আমার সালাম।

খবর আসতে লাগল শত্রুসৈন্য সমস্ত সিলেট জেলায় আমাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে না পেরে বিপর্যস্ত হয়ে পিছু হঠতে শুরু করেছে,তারা রাতে ভয়ে কোথাও বের হত না।পাকিস্তানীদের একা একা কোথাও দেখা যেত না।গেরিলা অপারেশন অত্যন্ত সাফল্যজনকভাবে পরিচালিত হচ্ছিল।পাকিস্তান সেনাবাহিনী গেরিলা অপারেশনের সফলতায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল। তারা তাদের ঘাঁটি থেকে বের হতে সাহস করত না।তাদের চলাফেরা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল।

সিলেট জয় করতে হলে কানাইঘাট দখল করা সর্বপ্রথম প্রয়োজন।আমি সেক্টর ট্রুপস নিয়ে কানাইঘাট জয়ের জন্য লুবাছড়ার দিকে অগ্রসর হয়ে ওদিক থেকে আক্রমণের পরিকল্পনা নিলাম।আমার সঙ্গে ছিল বাংলাদেশ রাইফেলের ছেলেরা,আনসার,মোজাহিদ পুলিশ ও স্কুল কলেজের ছাত্ররা, সব মিলিয়ে প্রায় ৪০০ জন।লুবাছড়া পৌঁছতে বিকেল হয়ে আসল।চিন্তা করতে লাগলাম কিভাবে কানাইঘাট দখল করা যায়।আমাকে হুকুম দেয়া হয়েছিল যেভাবে হোক কানাইঘাট দখল করতে হবে।

সিলেট সেক্টর ট্রুপস কানাইঘাটের যুদ্ধ একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা, ১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর সেক্টর ট্রুপস অগ্রসর হল।সৈন্যসংখ্যা চারশো জনকে নিয়ে চারটি কোম্পানি গঠন করা হল।একটি কোম্পানিকে লেফটেন্যন্ট গিয়াসের নেতৃত্বে দরবস্ত -কানাইঘাট রাস্তার মধ্যে ‘কাট অফ কোম্পানি’ হিসেবে কাজ করার দায়িত্ব দেয়া হল।ওর কাজ ছিল শত্রুসৈন্য দরবস্ত হতে কানাইঘাট যুদ্ধে যেন কোন সাহায্য করতে না পারে। লেফটেন্যন্ট জহীরকে আর একটা কোম্পানির দায়িত্ব হতে কানাইঘাট -চোরঘাই রাস্তায় ‘কাট অফ কোম্পানি হিসেবে কাজ করার দায়িত্ব দেয়া হল।ওকে এই দায়িত্ব দেওয়ার কারণ হলো চোরঘাই থেকে যেন শত্রুসৈন্য কানাইঘাটে সাহায্য এগিয়ে আসতে না পারে।এবং কানাইঘাট থেকে শত্রুসৈন্য পালিয়ে চোরঘাইর দিকে না যেতে পারে।আর দুটি কোম্পানি মেজর রব ( বর্তমানে লেফটেন্যন্ট কর্ণেল) এর অধিনায়কত্বে নদীর পাড় ও মধ্যে দিয়ে শত্রুর উপর হামলা চালিয়ে কানাইঘাট দখলের দায়িত্ব দেয়া হল।রাতের অন্ধকারে কানাইঘাট যুদ্ধ জয়ের অভিযান শুরু হল।রাত দেড়টায় গোলাগুলির আওয়াজ শুনা যায়।লেফটেন্যন্ট গিয়াসের সঙ্গে শত্রুসৈন্যর গুলি বিনিময় হচ্ছে। লেফটেন্যন্ট গিয়াসের কোম্পানি জায়গায় পৌঁছাতে পারছে না।ইতিমধ্যে তার একজন সৈন্য আহত হয়।আমি তাকে বললাম যেভাবে হোক তোমার গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে হবে।লেফটেন্যন্ট জহীরের কাছ থেকে খবর আসল সে বিনা-বাধায় কানাইঘাট -দরবস্ত রাস্তা পার হয়ে গন্তব্যস্থলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রাত যত বাড়তে লাগল ততই গোলাগুলির আওয়াজ বাড়তে লাগল।রাত প্রায় দুটোর সময় লেফটেন্যন্ট গিয়াসের কাছ থেকে খবর পেলাম ওরা শত্রুসৈন্যকে ঘিরে ফেলেছে। তবে তার একটি ছেলে শহীদ হয়েছে এবং সে শত্রুদের উপর শেষ হামলা চালাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে।এদিকে জহীরের কাছ থেকে খবর পেলাম তার গন্তব্যস্থল প্রায় ৭০০/৮০০ গজ দূরে,তার উপর ভীষণভাবে মর্টারের গোলাবর্ষণ হচ্ছে এবং সে এগুতে পারছে না, মেজর রবের কাছ থেকে খবর পেলাম তার দুটো কোম্পানি ধীরগতিতে গন্তব্যস্থলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।তবে সে এখনও মুখোমুখি সংঘর্ষের সম্মুখীন হয়নি।লেফটেন্যন্ট গিয়াসের কাছ থেকে ৪ ঠা ডিসেম্বর রাত তিনটার সময় খবর আসল শত্রুদের একটি পুলের চারকোণায় চারটি বাংকার।এবং তার ভেতর থেকে প্রচন্ড গোলাগুলি আসছে। লেফটেন্যন্ট গিয়াসের সৈন্যরা বাংকারের উপর গ্রেনেডের সাহায্য শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।ভেতর থেকে বাংলায় চিৎকার করে বলল,’আমরা বাঙ্গালী,আমাদের মারবে না।দুটো পশ্চিম পাকিস্তানী রাস্তার উপর দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।আমরা আপনাদের সাহায্য করব”।রাত প্রায় সাড়ে তিনটে-চারটে হবে।লেফটেন্যন্ট গিয়াসের কাছে খবর পেলাম ওরা ওদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছে।বাংকারের ভেতরে ওরা যেতে পারেনি।কারণ বাংকারে অনেক মৃতদেহ পড়ে আছে,এবং ৭ জন রাজাকার বাইরে চলে এসে আত্মসমর্পণ করেছে,নয়জন পশ্চিম পাকিস্তানী গ্রেনেড ছোড়ার ফলে মারা যায়।দু’জন পশ্চিম পাকিস্তানী পালাবার সময় মুক্তিযোদ্ধারা মেরে ফেলে।৭ জন বাঙ্গালী রাজাকার আত্মসমর্পণ করে।লেফটেন্যন্ট গিয়াসকে পুরো এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হলো,যাতে দরবস্ত থেকে শত্রুরা কানাইঘাটের দিকে আসতে না পারে।রাত বাড়তে লাগল,লেফটেন্যন্ট জহীরের কাছ থেকে খবর পেলাম সে এগুতে পারছে না।এদিকে মেজর রব শত্রুসৈন্যর মুখোমুখি প্রায় এসে পড়েছে।তার উপর প্রচন্ড গোলাবর্ষণ হচ্ছে।বেলা বাড়তে লাগল,মেজর রব শত্রুসৈন্যকে নদীর তীর দিয়ে প্রায় ঘিরে ফেলেছে।সে ওদের কাছ থেকে দুশো গজ দূরে আছে।তার দুটো ছেলে গুরুত্বরভাবে আহত হয়েছে।তার গোলাবারুদ দরকার বলে সে জানাল।৪ ঠা ডিসেম্বর সকাল ৬টায় জহীরের কাছ থেকে খবর পেলাম এম-জি এবং মর্টারের গোলাগুলিতে সে এগুতে পারছে না।তিনজন গুরুত্বরভাবে আহত হয়েছে। আরও সৈন্য এবং গোলাবারুদ চেয়ে সে অনুরোধ জানাল।আমি বললাম সৈন্য আর পাঠাতে পারব না,তবে গোলাবারুদ পাঠিয়ে দিচ্ছি।সকাল ৭টায় মেজর রবের কাছ থেকে খবর পেলাম নদীর ওপার থেকে ওদের উপর গোলাগুলি আসছে,আমি জানতাম আটগ্রামে ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট আছে এবং এটাও জানতাম নদীর ওপারে শত্রুসৈন্য আছে।১ম বেঙ্গলকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল নদীর ওপার থেকে শত্রুসৈন্যদের সরিয়ে দিতে।আমার সঙ্গে ১ম বেঙ্গল রেজিঃ এবং জেড ফোর্স এর বেতার যোগাযোগ ছিল না।মেজর রবের উপর নদীর ওপার থেকে থেকে গোলাগুলি আসতে লাগল।মেজর রবকে বললাম ভারতের সাথ বেতার যোগাযোগ করে ভারতীয় গোলান্দাজ বাহিনীর সাহায্য আমি নিচ্ছি।তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করে যাও।ভারতের সাথে যোগাযোগ করি এবং গোলান্দাজ বাহিনীর সাহায্য পাবো বলে আশ্বাস দেয়।এদিকে যেহেতু মেজর রবের আরো সৈন্যর দরকার ছিল সেইহেতু জহীরকে মেজর রবের সাহায্য পাঠানো হল।লেফটেন্যন্ট গিয়াসের কাছ থেকে খবর পেলাম দরবস্ত থেকে পাকিস্তানীদের কানাইঘাটের দিকে আসার কোন পরিকল্পনা আছে বলে তার মনে হচ্ছে না।গিয়াসকে লেফটেন্যন্ট জহীরকে সাহায্যের জন্য পাঠানো হল।মেজর রব এবং লেফটেন্যন্ট জহীরের দলের উপর শত্রুর ভীষণ গুলাগুলি হচ্ছিল।আস্তে আস্তে ওরা এগুতে লাগল।বেলা প্রায় দশটায় খবর পেলাম নদীর ওপার থেকে পাকিস্তানীরা পেছনে পালাচ্ছে।এদিকে কানাইঘাট থেকেও পাকিস্তানীরা বাংকার থেকে উঠে পড়েছে।কানাইঘাটে শত্রুদের উপর মুক্তিযোদ্ধারা ঝাঁপিয়ে পড়ল।বেলা প্রায় সাড়ে দশটায় মেজর রব,লেফটেন্যন্ট গিয়াস ও লেফটেন্যন্ট জহীরের সৈন্যরা সম্মিলিতভাবে কানাইঘাটে শত্রুসৈন্যদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।এবং হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।পাকিস্তানীরা রাস্তা না পেয়ে নদীতে ঝাঁপ দিতে আরম্ভ করল এবং নিজেদের পোঁতা মাইন বিস্ফোরণে নিজেরাই মরতে আরম্ভ করল।যারা নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল ওরাও মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে প্রাণ হারায়।নদীর পানি লাল হয়ে গিয়েছিল।অনেকে পানিতে ডুবেও মারা যায়।ভীষণ শব্দে মাইনগুলো ফাটছিল।যারা চুরবাইর দিকে পালাতে চেষ্টা করেছিল তারও মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে প্রাণ হারায়।বেলা প্রায় ১১ টায় এগারটায় কানাইঘাট আমাদের দখলে আসল। কানাইঘাটে শত্রুসৈন্য ও অনেক লাশ ছিল।লাশগুলো সৎকারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।চারধারে জয় বাংলা ধ্বনি,ছেলেদের মুখে হাসি। মনটা গর্বে ভরে উঠল।কানাইঘাট জয়ের কথা জানানো হল।নানা জায়গা থেকে আমাদেরকে অভিনন্দন জানানো হল।জেনারেল উসমানীর কাছ থেকেও অভিনন্দন বার্তা পেলাম।কানাইঘাট যুদ্ধে পাকিস্তানীদের মৃতের সংখ্যা ছিল ৫০ জন,আহত ছিল ২০ জন।বাঙ্গালী রাজাকার ছিল ২০ জন তারা পায়ে ধরে ক্ষমা চাওয়াতে ওদেরকে মুটে-মজুরের কাজ দেয়া হয়েছিল।এই যুদ্ধে আমাদের পক্ষে শহীদ হয়েছে ১১ জন,এবং আহত হয়েছিল ১৫ জন।আমার ডাক্তার ছিল সিলেট মেডিক্যাল কলেজের, ছাত্র নজরুল,যেভাবে সে আহতদের চিকিৎসা করেছে তাকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারছি না।অবাক হয়ে চেয়ে থাকতাম কখনো ব্লেড গরম করে,কখনো বেয়নেট গরম করে কাটাছেঁড়া করছে।অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে সে।

এতবড় দায়িত্ব সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছি বলে যারা ভাল কাজ করেছে তাদেরকে উপাধিতে ভূষিত করার জন্য সর্বাধিনায়কের কাছে নাম পাঠিয়েছিলাম।তারা হলঃ ১।মেজর রব বীরোত্তম,২।লেফটেন্যন্ট জহীরুল হক বীরপ্রতিক,৩।সুবেদার মতিন বীরোত্তম,৪।সুবেদার বাছর আলী বীরোত্তম,৫।নায়েক সুবেদার শামসুল হক বীরোত্তম,৬।হাবিলদার মোহাম্মদ শাহ আলম (শহীদ) বীরশ্রেষ্ঠ।৭।হাবিলদার আবদুল জব্বার বীরপ্রতীক, ৮।সিপাহী কামাল উদ্দিন বীরপ্রতীক, ৯।নায়েক আলী আকবর বীরপ্রতীক, ১০।এফ,এফ,নূরউদ্দিন আহমেদ বীরোত্তম, ১১।এফ,এফ,নীলমণি সরকার।

কানাইঘাট জয়ের পর খবর আসল আমাকে দরবস্ত হয়ে সিলেট যেতে হবে।দরবস্ত জায়গাটা হল তামাবিল এবং সিলেটের মধ্যে।খবর পেলাম দরবস্তে এক কোম্পানি পাকিস্তানী সৈন্য আছে।যদি দরবস্ত শত্রুমুক্ত করা না যায় তাহলে সিলেটে আমাদের যাওয়া যাবেনা, এবং তামাবিল ও গোয়াইনঘাট হতে আমাদের যে সৈন্য আসছে ওরাও সিলেট যেতে পারবে না,তাই যেভাবেই হোক দরবস্ত শত্রুমুক্ত করতে হবে।আমার এই অভিযান শুরু করার কিছুক্ষণ আগে সর্বাধিনায়কের কাছ থেকে খবর পেলাম জেড ফোর্সকে আমার এক কোম্পানি দিতে হবে।কারণ ওর সৈন্য সংখ্যা কম।লেফটেন্যন্ট জহীরকে জেড ফোর্সের ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে সাহায্য করার জন্য দিলাম।যতটুকু আমি জানি মেজর জিয়া ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে এবং সেক্টর ট্রুপস এর একটা কোম্পানি নিয়ে শালুটিকার বিমান ঘাঁটির দিকে যাবেন।ওদিকে ভারতের একটা ব্যাটালিয়ন সিলেটের দক্ষিণদিকে হেলিকপ্টারে ছত্রীসেনা নামিয়ে দেবে।ভারতের ছত্রীসেনার সংগে মিলিত হয়ে মেজর জিয়া তার সৈন্য নিয়ে সিলেট আক্রমণ করবে।আমার সৈন্য দরবস্ত জয় করে খাদিমনগর হয়ে সিলেটের উপর আক্রমণ করবে।মেজর শওকত (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) এর সৈন্যদল ও ৩য় বেঙ্গল রেজিমেন্ট গোয়াইনঘাট-ছাতক হয়ে সিলেটের পেছন দিক থেকে আক্রমণ করবে।আর একটা বাহিনী ভারতের সাহায্য মেজর এনামের দায়িত্বে মৌলভীবাজার হয়ে সিলেট আক্রমণ করবে।আর একটা বাহিনী ভারতের সাহায্যে লেফটেন্যন্ট ওয়াকিউজ্জামান এবং ফ্লাইট লেফটেন্যন্ট কাদেরের সেক্টর ট্রুপস নিয়ে ফেঞ্চুগঞ্জ হয়ে সিলেট আক্রমণ করবে।এই ছিল সিলেট যুদ্ধের পরিকল্পনা,যতটুকু আমি জানতে পেরেছিলাম।

শুরু হল দরবস্তের পথে যাত্রা।প্রায় ১৫ মাইল হাঁটতে হয়েছিল।এফ,এফ রবকে দিয়ে একটা কোম্পানি তৈরী করলাম এবং অগ্রবাহিনী হিসেবে কাজ করার নির্দেশ দিলাম।এফ,এফ শুকুরের কোম্পানি রইল তার পিছনে।আমার পিছনে রইল মেজর রব ও সুবেদার ফজলুল হকের কোম্পানি।পেছনে ধরা পড়া রাজাকাররা আনল গোলাবারুদ ও খাদ্য সরঞ্জাম।

৬ ডিসেম্বর বিকেল প্রায় পাঁচটা।সবাইকে এক জায়গায় জড় করলাম,বললাম যেভাবে হোক দরবস্ত দখলে আনতে হবে।দরবস্তে পাকিস্তানীদের একটা কোম্পানি আছে।দরবস্ত দখল না করলে সিলেট জয় করা খুবই মুশকিল হবে।কারণ ভারত থেকে ইতিমধ্যে গুর্খা ব্যাটালিয়ন এবং এফ,এফ,দের একটা কোম্পানি নিয়ে তামাবিল দখল করে দরবস্তে আমাদের সংগে মিলে সিলেটে একসঙ্গে যাব।যদি দরবস্ত দখল করতে না পারি তাহলে তাদের পক্ষে সিলেট থাকা মুশকিল হবে।তাই আজ রাতের মধ্যেই দরবস্ত দখল করতে হবে।শুরু হল আমাদের অভিযান।গ্রামের নামটা মনে নেই, প্রায় দেড় মাইল দূরে এসেছি।বাঁয়ে সদ্য ফেলা মাটির একটা উঁচু টিলা।মনটা ভাল লাগল না।পাশেই বেশ কয়েকটি বাড়ি ছিল,একজন বুড়ো ভদ্রলোককে ডাকলাম।সে আমাকে দেখে কেঁদে উঠল, কিছুদিন আগের একটা ঘটনা,৭/৮ টা পাকিস্তানী এসেছিল ওদের গ্রামে,সঙ্গে ছিল বাঙ্গালী রাজাকার।সমস্ত গ্রামটা তছনছ করে দিয়েছিল।ওদেরকে খাবার দিতে হবে,যা অল্পবিস্তর খাবার ছিল দেয়া হল।হালের গরুটাকেও ওরা ছাড়েনি।ওদেরই বাড়িতে রান্নাবান্না হল।খাওয়া শেষ হল,রাত ঘনিয়ে আসতে লাগল।চারদিকে অন্ধকার।ঘরে ভেতরে মেয়েছেলেরা ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত।হঠাৎ ২/৩ টা সৈন্য ভেতরে ঢুকতে চেষ্টা করল।ওরা সবাই নিষেধ করল।শুরু হল অমানুষিক মারধর।এমনিভাবে চার-পাঁচটা বাড়িতে হামলা করল।মেয়েদের উপর অকথ্য নির্যাতন করল।চারপাশের বেশ কয়েকজন জোয়ান ছেলেকে উঁচু জায়গায় নিয়ে গেল।ওদেরকে দিয়ে মাটি কাটানো হল।তারপর শোনা গেল বেশ কয়েকটা গুলির আওয়াজ এবং সাথে সাথে আর্তনাদ।সবশেষে ডাকা হল বাকি যারা ছিল ওদেরকে মাটি দিয়ে গর্ত ভরতে।যারা বূড়ো ছিল চোখের পানিতে নিজের ছেলের কবর দিতে লাগল।এই হল রাস্তার পাশে ছোটটিলার ইতিহাস।চোখ ভরে পানি এল।প্রতিহিংসার তীব্র জ্বালা মনে এল।প্রতিশোধ নিতেই হবে।

দরবস্ত এখনো অনেক দূরে।দূরে গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম।বুঝতে পারলাম না এই গোলাগুলির আওয়াজ কিসের।আন্দাজ করলাম ভারতীয় সৈন্যদের সাথে পাকিস্তানীদের কাছাকাছি কোথাও যুদ্ধ চলছে।দেরী করলে চলবে না।আজকে রাতের মধ্যেই আমাকে দরবস্ত দখল করতে হবে।রাত প্রায় বারটা হবে।এফ,এফ রবের কাছ থেকে খবর পেলাম ওদের উপর গোলাগুলি আসছে।রবের সৈন্যদের দরবস্তকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলতে এবং এফ,এফ শুকুরকে দরবস্তের বাঁ দিকে ঘিরে ফেলতে নির্দেশ দেয়া হল।মেজর রবের কোম্পানি রাস্তার ঠিক বাঁয়ে এবং সুবেদার ফজলুল হকের কোম্পানি রাস্তার ডানদিক দিয়ে সোজা দরবস্তের উপর আক্রমণ করবে।দরবস্ত তখন প্রায় তিন মাইল দূরে।বেশ কিছুক্ষণ গোলাগুলির আওয়াজ শোনা গেল।রব এবং শুকুরের সাথে আমার বেতার যোগাযোগ ছিল না।মেজর রব এবং ফজলুল হকের কাছ থেকে খবর পেলাম যে রব এবং শুকুরের সাথে তাদের কোন যোগাযোগ নেই,তবে তারা দরবস্তের কাছে পৌঁছে গেছে।

৭ই ডিসেম্বর সকাল চারটা।মেজর রব এবং ফজলুল হক খবর দিল যে দরবস্ত দখল হয়ে গেছে।মেজর রব এবং সুবেদার ফজলুল হকের সৈন্যদের বিশ্রাম নিতে বললাম।যখন একটু বেলা হয়ে যাবে তখন যেন ওরা এক-একটা করে প্লাটুন পাঠিয়ে দেয় রব এবং শুকুরের সৈন্যদের খুঁজে বের করতে।সকাল প্রায় ৭টা।দেখছি দু,ধার থেকে এফ,এফ,রব এবং এফ,এফ শুকুরের সৈন্যরা এসে আমাদের সাথে একত্রিত হচ্ছে।এফ,এফ রবের কাছ থেকে জানলাম ওরা যখন পাকিস্তানীদের পেছনে ধাওয়া করছিল তখন ওরা দিক হারিয়ে অনেক ডানে চলে গিয়েছিল,এবং পরে একটা গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল তবে কোন পাকিস্তানীকে পায়নি।এফ,এফ শুকুরের খবরে জানলাম পাকিস্তানীরা রাতের অন্ধকারে হরিপুরের দিকে দৌড়ে পালাচ্ছিল।ওদেরকে পিছু ধাওয়া করতেই ওরা অন্যপথে চলে গিয়েছিল।তারাও একটা গ্রামে আস্তানা গেড়েছিল।ওখানেও গ্রামের বাড়িতে একটা পাকিস্তানী সৈন্য লুকিয়েছিল,তাকেও শেষ করা হয়েছে।ইতিমধ্যে ভারতের গুর্খা সৈন্যরা ৫নং সেক্টরের একটা কোম্পানি নিয়ে দরবস্ত পৌঁছেছে।

৮ই ডিসেম্বর,বেলা প্রায় দশটা হবে।একদিনের জন্য দরবস্তে,আমার আস্তানা গেড়েছি।ব্রিগেডিয়ার ওয়াছকে এবং ব্রিগেডিয়ার বার্নে এসে দরবস্ত পৌঁছলেন।ঠিক হল গুর্খা রেজিমেন্ট রাস্তার ডান পাশ হয়ে দরবস্ত -সিলেট যাবে এবং আমার সৈন্যরা রাস্তার বাঁদিক দিয়ে খাদেমনগর হয়ে সিলেট যাবে।

১০ই ডিসেম্বর পৌঁছালাম লামা নামক একটা গ্রামে।ব্রিগেডিয়ার ওয়াছকের সঙ্গে দেখা হল।উনি বললেন,হিমু চা বাগানের কাছে পাকিস্তানীরা শক্ত ব্যূহ রচনা করেছে।একটা পুল আছে হিমুর কাছে।তার নিচ দিয়ে একটি নদী চলে গেছে।এবং হিমুর আগে বেশকিছু উঁচু জায়গা আছে।আমাদের পক্ষে এগুনো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তাছাড়া হিমু যাবার পুলটা পাকিস্তানীরা উড়িয়ে দিয়েছে।আমাকে বলা হল হিমুর পেছন দিক থেকে শত্রুসৈন্যকে আক্রমণ করতে এবং যেভাবে হোক হিমু শত্রুমুক্ত করে হরিপুরের উপর আক্রমণ চালাতে।

খাওয়া-দাওয়া করে গ্রাম থেকে দুজন গাইড নিয়ে চললাম হিমুর উদ্দেশ্য।সারারাত নদী-খাল-বিল পার হয়ে পৌঁছালাম আটগ্রাম বলে একটি গ্রামে।সেখান থেকে হিমুর দুরত্ব প্রায় দু’মাইল।আটগ্রাম পৌঁছলাম ভোত চারটায়।গ্রামের পাশে নদী পার হতে হবে অনেক কষ্টে।দুটো নৌকা যোগাড় করা গেল।ওপারে সবাই পৌঁছলাম।ওপারে প্রায় ৭০০/৮০০ গজ দূরে খোলা মাঠ,তার উপরে অনেকগুলো উঁচু টিলা,যা পুরো আটগ্রাম গ্রামকে ঘিরে রেখেছে।সকাল হতে চলেছে।দেখলাম হিমু পর্যন্ত পুরো খোলা মাঠ।চিন্তা করলাম দিনের বেলা এই খোলা মাঠের ভেতর দিয়ে যাওয়া সমীচীন হবে না।তাই সবাইকে বললাম আজকের দিনটা আটগ্রামে কাটিয়ে দিই।সন্ধ্যার সময় হিমুর পথে যাত্রা করা যাবে।ভারতীয় গুর্খা সৈন্যদের সংগে বেতার যোগাযোগ করতে পারলাম না।যাই হোক আবার সবাই মিলে নদী পার হয়ে আটগ্রামে ফিরে আসলাম।আমার সৈন্যদের কে কোথায় জায়গা নেবে পুরো হুকুম দেবার সময় পেলাম না।বেলা প্রায় আটটা হবে।পাকিস্তানীদের দিক থেকে শুরু হল আমাদের উপর ৩ ইঞ্চি মর্টারের গোলাবর্ষণ।সঙ্গে আরম্ভ হল আমাদের উপর মেশিনগান এবং এল-এম-জির গোলাবর্ষণ।সৈন্যরা নিজের নিজের জায়গায় অবস্থান নিল।কিছুই করার নেই একেবারে শত্রুর মুখে পড়ে গেছে।কিন্তু বুঝলাম একেবারে আচানক শত্রুর গোলাগুলিতে আমার সৈন্যরা একেবারে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছে।

আটগ্রাম ছোট গ্রাম।বৃস্টির মত গোলাগুলি হচ্ছিল।আমাদের এমন কিছুই করবার নেই,চিন্তা করলাম যদি আটগ্রাম থাকি তাহলে আমরা সবাই মারা যাব।কারণ পাকিস্তানীরা আমাদের জায়গা জেনে ফেলেছে।তাই সবাইকে বললাম যে যেভাবে পারে পেছনে দু,তিন মাইল দূরে অন্য এক গ্রামে চলে যেতে।যাবার সময় আহতদের নিয়ে যাবার জন্য বলা হল।ডাক্তার নজরুলকে বললাম যারা শহীদ হয়েছে তাদের কবরের ব্যবস্থা করার জন্য।আমরা সবাই চললাম গ্রামের দিকে,সৃষ্টিকর্তার অশেষ দয়া ছিল।যখন আমরা আটগ্রাম ছেড়ে পেছনের গ্রামে যাচ্ছিলাম তখন আমাদের কেউ শহীদ বা আহত হয়নি।যদিও আমাদের উপর গোলাগুলি হচ্ছিল,একটি গুলিও আমাদের উপর লাগেনি।যখন সবাই এসে পৌঁছলাম তখন দেখলাম আমার ১১ জন ছেলে শহীদ হয়েছে এবং পাঁচজন গুরুত্বরভাবে আহত হয়েছে।সবার সাথে আলাপ করে বুঝলাম সবাই ঘাবড়ে গেছে।ভাবলাম একটা দিন পুরো বিশ্রাম নেয়া উচিৎ।গ্রামের লোকেরা আমাদের যথেষ্ট খাতির করেছে।

১২ই ডিসেম্বর বিকেলবেলা হিমু থেকে খবর পেলাম পাকিস্তানীরা চলে গেছে চিকনাগুল চা বাগানের দিকে।সোজা চিকনাগুল চা বাগানের দিকে যাবার পরিকল্পনা নেয়া হল।চারধার থেকে গোলাগুলির আওয়াজ আসতে লাগল।বিনা বাধায় চিকনাগুলে পৌঁছলাম।ভারতের গুর্খা ব্যাটালিয়নের সঙ্গে তখন পর্যন্ত আমাদের যোগাযোগ সম্ভব হয়ে উঠেনি।পরেরদিন রাস্তায় দেখ হল গুর্খা ব্যাটালিয়নের সি-ওর সঙ্গে,ঠিক হল রাস্তার ডানদিক দিয়ে খাদেমনগরের উপর আক্রমণ চালাবে গুর্খা ব্যাটালিয়ন,বাঁয়ে আক্রমণ চালাবে আমাদের সৈন্যরা।খাদেমনগর পাকিস্তানীদের বিরাট এবং শেষ ঘাঁটি।

১৫ ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সন।চারধারে পাকিস্তানীরা মজবুত ব্যূহ রচনা করেছে,যতবড় ব্যূহই রচনা করুক বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে।সিলেট আর বেশী দূরে নয়।তারা এগিয়ে যাবেই।পেছনে যাবার কোন প্রশ্নই উঠে না।ভারতের গুর্খা ব্যাটালিয়ন রাস্তার ডানে এবং আমাদের সৈন্যরা রাস্তার বাঁয়ে এগিয়ে চলেছে,খাদেমনগর দখলের চেষ্টা,কিছুদূর এগিয়েছি।সামনে ঈদগা এবং উঁচু টিলা থেকে মর্টার ও মেশিনগানের গোলাগুলি আসতে লাগল।কিছুক্ষণ বিরতির পর আবার শুরু হয় গোলাগুলির আওয়াজ।বেলা বাড়তে লাগল।রাস্তার ডানে এবং বাঁয়ে গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল।ইতিমধ্যে আমার এক কোম্পানি ঈদগার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।একেবারে খোলা জায়গা,তবে দু-একটা টিলা ছিল।বেলা প্রায় পাঁচটা। হাবিলদার গোলাম রসূল ছেলেটি বেশ নির্ভীক।ঈদগার উপর একা আক্রমণ করতে গিয়ে শহীদ হল।বৃস্টির মত গোলাগুলি চলছিল।তবু সে এগিয়ে গিয়েছিল,রাত হয় হয়।ঈদগা আমাদের দখলে আসল।ই পি আর এর এই নির্ভীক ছেলেটি ঈদগার দখল দেখে যেতে পারল না।তারই বীরত্বে ঈদগা দখল সম্ভব হয়েছিল।তাকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি দেয়ার জন্য আমাদের সর্বাধিনায়কের কাছে নাম পাঠিয়েছি।সেদিন রাতে চিকনাগুলের কাছে তাকে কবর দেয়া হয়।এই যুদ্ধে একজন শহীদ ও তিনজন গুরুত্বররুপে আহত হয়েছিল।

পরদিন খাদেমনগরের কাছে এসে পৌঁছলাম এবং খাদেমনগর আক্রমণ করার পরিকল্পনা নিলাম।আমাদের উপর ভীষণভাবে গোলাগুলি আসছিল।আমাদের পক্ষ থেকেও ভীষণ গোলাগুলি খাদেমনগরের উপর পড়ছিল।গ্রামের লোকেরা খুব সাহায্য করেছে।১৬ ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সন।সবাইর মনে আনন্দ।যারা আনন্দের দিনে আমাদের সঙ্গে নেই,যাদের রক্তের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীনতা পেলাম, পরমেশ্বরের কাছে হাতজোড় করে জানালাম অজস্র প্রণাম।তাদের আত্মার সদগতি হোক।জয় বাংলা।

সিলেটের স্বাধীনতা এসেছিল ১৭ ই ডিসেম্বর।

স্বাক্ষরঃচিত্তরঞ্জন দত্ত,

ব্রিগেডিয়ার

২৪-৩-৭৪

**১৯৭১ সালের মার্চে মেজর পদে কর্মরত ছিলেন। বর্ত্মানে মেজর-জেনারেল। সাক্ষাৎকারটি ২৪-৩-১৯৭৪ তারিখে গৃহীত হয়।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪ নং সেক্টরের যুদ্ধ সম্পর্কে অন্যান্যের প্রদত্ত বিবরণ সাক্ষাৎকারঃ লেঃ কর্নেল মোঃ মোহাম্মদ আব্দুর রব মে-ডিসেম্বর, ১৯৭১

শুভাদিত্য সাহা

<১০, ., ২৪৫২৫৭>

অনুবাদ

সাক্ষাতকারঃ লেঃ কর্নেল মোঃ আব্দুর রব*

১৭১২১৯৭৯

৪ নং সেক্টর বাংলাদেশ ফোর্স (বি ডি এফ) এর অবস্থা ভিন্ন ছিল। আমি চেষ্টা করব ৪ নং সেক্টর বাংলাদেশ ফোর্স এর অবস্থা, বিশেষ করে স্ট্রাটেজিক ভাবে গুরুত্ব্পূর্ন যেই যুদ্ধগুলো এখানে তুলে ধরতে। যুদ্ধের সময় আমি ডাইরি লিখতাম্। সেখান থেকেই মূলত এই বর্ননা গুলো তুলে ধরব।

মেজর চিত্তরন্জন দত্ত (বর্তমানে কর্নেল) যুদ্ধের  প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ৪ নং সেক্টর এর কমান্ডার ছিলেন।  আমার মনে আছে, সেক্টর গুলো ভাগ করা হয়েছিল ১৯৭১ সালের মে মাসে। অপারেশনের সুবিধার জন্য পুরো বাংলাদেশ কে অনেকগুলো সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল। প্রতিটা সেক্টর কে আবার বিভিন্ন সাব্-সেক্টর এ ভাগ করা হয়েছিল। এছাড়া এই সেক্টর গুলোর বাইরেও বিভিন্ন বাহিনী সংগঠিত ছিল্, যেমন্: হেমায়েত বাহিনী, কাদেরীয়া বাহিনী ইত্যাদি। যদিও এই বাহিনী গুলো খুব বেশী সংগঠিত ছিল না, তবুও সবার উদ্দেশ্য এক ছিল্, বাংলার মাটিকে হানাদার  শত্রু মুক্ত করা।

আমার বর্ননা শুধু ৪নং সেক্টর এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। ৪নং সেক্টর সিলেটের (পূর্ব আর দক্ষিন-পূর্ব মিলে) ১০০ মাইল বিস্তির্ন সীমানা ধরে গঠিত ছিল। দক্ষিনে হবিগন্জ থেকে শুরু করে উত্তরে কানাইগন্জ পর্যন্ত এর সীমা বিস্তির্ন ছিল। সিলেটের এই বর্ডার এরিয়া ছিল পুরোটাই পাহাড়ী, যার মদ্ধে ছিল পাটারিয়া পাহাড়্, সাতগাও পাহাড় ইত্যাদি। আমাদের অপারেশন এরিয়ার মধ্যে ১০০ টা  চা বাগান ছিল। এটা মিলিটারী  দৃষ্টিকোন থেকে  গেরিলা অপারেশন চালানর জন্য চমৎকার ছিল।

গুরুত্বপূর্ন যুদ্ধ গুলোর ব্যপারে বলার আগে আমার মনে হ্য় যুদ্ধের পটভূমি, বিশেষ করে মার্চ- এপ্রিলের উত্তাল সময় এর কথা একটু বলা দরকার। এসময় টা ছিল উত্তেজনা, সংশয় আর ডামাডৌলের সময়। যদিও মানুষ প্রতিরোধ তৈরী করছিল্, কিন্তু সেগুলো সংগঠিত ছিল না। আমাদের বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করছিল্, এবং মিলিটারী ব্যাকগ্রাউন্ডের জন্য  তারা তুলনামূলক ভাবে ভাল অবস্থায় ছিল।

পুরো মুক্তিবাহিনী ২ ভাগে বিভক্ত হয়ে ছিল: নিয়মিত বাহিনী আর গনবাহিনী। নিয়মিত বাহিনী মূলত গঠিত হয়েছিল আর্মড ফোর্স এর সদস্য যেমন: ই পি আর্, পুলিশ্, আনসার এদের দিয়ে।  আর্মি আর ইপিআর এর সদস্য এর বাইরে অন্যদের যুদ্ধের ইন্ফ্রান্টি অস্র আর তার ব্যবহার সম্পর্কে তেমন ধারনা ছিল না। তাদের গেরিলা এবং সম্মুখ সমর এর জন্য অল্প সময় এ ট্রেনিং দিতে হয়েছিল। তারা খুব অল্প সময়ে এগুলো রপ্ত করেছিল এবং যুদ্ধের ময়দানে অসামান্য বীরত্ব এর প্র্মান রেখেছিল। বিশেষ করে ইপিআর সদস্য দের একক অবদান, সাহসিকতা  বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। তারা শেষ পর্যন্ত কখনো বিস্বাসঘাতকতা করেনি।

গনবাহিনী ছিল সবচেয়ে ত্যাগী এবং তারা সাহসীকতা আর হিরোইসমের প্রতিকে পরিনত হয়েছিল। গনবাহিনী গঠিত হয়েছিল ছাত্র, তরুন্, যুবক দের নিয়ে। তাদের সবাই ভারতের বিভিন্ন মুক্তিবাহিনী এর গেরিলা প্রশিক্ষন কেন্দ্র থেকে থেকে প্রশিক্ষন নিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ ছিল পুরো জাতির বাচা মরার লড়াই। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে, বিভিন্ন পেশা থেকে  মানুষ এই গনবাহিনী তে যোগ দিয়েছিল।

৪নং সেক্টর মূলত গঠিত হয়েছিল সেক্টর ট্রুপ্স নিয়ে। এরা প্রায় সবাই এক্স্-ইপিআর্, এক্স্-আর্মি আনসার্, মুজাহিদ এবং অল্প কিছু পুলিশ সদস্য ছিল। এই সেক্টর ৬ টা সাব্-সেক্টরে ভাগ ছিল। শুরুতে শুধুমাত্র  মেজর  চিত্তরন্জন দত্ত (বর্তমানে কর্নেল)  এবং আমি (ক্যপ্টেন এ. রব) ছিলাম এই সেক্টর এর অফিসার রাঙ্কের। পরে ৭১ এর জুন মাসে ক্যাপ্টেন হ্ক (এখন মেজর), ফ্লাইট লে: কাদের আর ক্যাপ্টেন আনাম আমাদের সাথে যোগ দেয়।

পাকবাহিনী সিলেটে পাইকারী হারে মানুষ মারা শুরু করে ৭১ এর ২৬ মার্চ থেকে।  সিলেটে এক ব্যটেলিয়ন পাঞ্জাব রেজিমেন্ট (৩১ পাঞ্জাব) ছিল। ক্রাকডাউনের সময় পাকবাহিনী পুরো সিলেট জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল কিন্তু এর পরপরই তারা সিলেট শহরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে আমরা সিলেট শহর কে পুর্ব, পশ্চিম, এবং দক্ষিন দিক থেকে ঘিরে ফেললাম। ক্যাপ্টেন আজিজ এর নেতৃত্বে এক কোম্পানী বেঙ্গল রেজিমেন্ট দক্ষিন দিকে সুরমা সেতু কাভার করছিল। এক কোম্পানি ইপিআর পূর্ব দিক থেকে শহরে প্রবেশ করে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ সিলেট শহরে পাকবাহিনী এর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ছিল।  ভারী অস্র আর বিমান হামলার মোকাবিলার জন্য  আমাদের শক্তি আর একটু বেশী থাকলে আমরা অপ্রিল ৫ বা ৬ , ১৯৭১ এর দিকে সিলেট সহজেই পাকাপোক্তভাবে দখল করে নিতে পারতাম। এপ্রিল ৬ এর পর থেকে C-১৩০ বিমান হামলার সাহায্যে শত্রু রা পুনরায় দখল নেয়া শুরু করে।

৮ এপ্রিলের মধ্যে শত্রুবাহিনী ঢাকা থেকে ১ ব্যাটেলিয়ন সেনা নিয়ে আসে এবং সিলেট শহর এর বাইরে আগাতে থাকে। শহরে থাকা ইপিআর তাদের প্রতিরোধ করলেউ টিকতে পারল না। বেঙ্গল রেজিমেন্ট সুরমা ব্রিজের কাছে সাহসিকতার সাথে তাদের শক্ত প্রতিরোধ করল এবং কিছু সময় এর জন্য তাদের থামিয়ে রাখল। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে সিলেট-মৌলভীবাজার রোডের উপর শেরপুরে তুমুল যুদ্ধ হয়। পূর্ব দিকে সিলেট-সুতারকান্দি রোডের উপর গোপালগঞ্জ নামক স্থানে এক ব্যাটেলিয়ন বর্ডার সিকিউরিটি ফোরস (বি এস এফ) আর মুক্তিবাহিনী মিলে শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করে। এপ্রিলের শেষ ২ সপ্তাহে শত্রুর কাছে এই ঘাটিটি আমরা হারিয়ে ফেলি।

দেশের ভিতর পাকবাহিনীর সীমাহীন আত্যাচার- বর্বরতা বাড়ার সাথে সাথে বর্ডার এর দিকে রিফিউজি মানুষ এর ঢল নামছিল। যেখানেই পাকবাহিনী মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধের সম্মুখিন হয়, সেখানেই পাকবাহিনী সাধারন জনসাধারনের উপর নির্মম অত্যাচার ও ধ্বংসলীলা চালায়। সিলেটের প্রায় সবখানে এরকম ধ্বংসলীলা হয়েছিল। প্রতিদিন সিলেটের বিভিন্ন জায়গা থেকে হাজার হাজার লোক ভারতের সীমানা পার হচ্ছিল। ভারত তার সব সামর্থ দিয়ে এই বিশাল সংখ্যক রিফিউজি এর চাপ সামাল দিচ্ছিল। এক রাতের মধ্যে তাদের রিফিউজি ক্যাম্প ও রিফিউজি ওয়েল্কাম সেন্টার বানাতে হচ্ছিল। জুলাই, ১৯৭১ এর মধ্যে শুধুমাত্র কাচার জেলাতেই তারা নতুন তৈরী ক্যাম্পে ২ লাখ রিফিউজিকে আশ্রয় দেয়। কিন্তু তারপরেও রিফিউজিরা সীমাহীন দুঃখ, কষ্ট আর অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিল।

শুরুর প্রতিরোধ এর পরে মুক্তি বাহিনী এর আক্রমন গুলো কিছুতা সমন্বয়হীন হয়ে পরে। এগুলো সমন্বয় করতে, গুছিয়ে উঠতে কিছুটা সময় লেগে যায়। গোপালগঞ্জ ঘাটির পতনের পরে আমাদের বাহিনী পিছু হঠে বড়গ্রাম বিওপি এবং সুতারকান্দি চেকপোস্টে প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করে। সেসময় আমাদের হাতে সব মিলিয়ে ১ কোম্পানি এর মত সৈন্য ছিল, যার মধ্যে ইপিআর ও সেনা সদস্য ছিল। সৌভাগ্যক্রমে তাদের সবার কাছে রাইফেল ছিল্, কিছু লাইট মেশিনগান্, ২” মর্টার আর ১টা মিডিয়াম মেশিনগান ছিল।

১৯৭১ এর এপ্রিল মাসের শেষ পর্যন্ত এই ছিল আমাদের অবস্থা। শত শত ট্রেনিংপ্রাপ্ত এবং অট্রেনিংপ্রাপ্ত মানুষ আমাদের সাথে যোগ দিতে চায় কিন্তু তাদের সবাইকে অস্র ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস সরবারহ করার অবস্থা আমাদের ছিল না। তাই আমরা তাদেরকে ট্রেনিং ক্যাম্পে পাঠালাম। শত শত মানুষ মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগ দিতে সীমান্ত এলাকায় এলো। কিন্তু আমাদের নেতাদের ম্যানেজমেন্ট সেসময়ে খুব ভাল ছিল না। তাই তাদের অনেককেই নিজ নিজ বাসায় ফেরত পাঠানো হলো। আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে বেশীরভাগই নানা রাজনৈতিক কাজে ব্যস্ত ছিল। শুধু অল্প কয়েকজন কি করে মুক্তিবাহিনী কে সংগঠিত করা যায়, নতুন ট্রেনিংক্যাম্প তৈরি করা যায়, সেখানে নতুনদের পাঠানো যায়, এসব নিয়ে তৎপর ছিল। এই অল্পকজন এর মধ্যে দেওয়ান ফরিদ গাজী, এম সি এ এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য।

সুত্রাকান্দির যুদ্ধ

(২৪ মে, ১৯৭১)

আমরা গোপালগঞ্জ এর প্রতিরক্ষা ব্যুহ থেকে পিছু হটার পরে বড়গ্রাম বিওপিতে আমাদের বিকল্প প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করলাম। আমাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল অগ্রগামী পাকিস্তানী বাহিনীকে শেওলা ঘাট থেকে কুসিয়ারা নদী অতিক্রম করতে না দেবা। সেসময় বিয়ানী বাজার আর জাকিগঞ্জ থানার পুরো এলাকা ছিল মুক্তাঞ্চল।

মে মাসের প্রথম সপ্তাহে এক কোম্পানি ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট  নদীর অপর পাড়ে শেওলা ঘাটে আসল। ২য় সপ্তাহের মধ্যে তারা আরও শক্তি বৃদ্ধি করলো।আমি বুঝতে পারছিলাম, তারা খুব তাড়াতাড়ি নদী পার হয়ে আমাদের উপর আক্রমন করার চেষ্টা করবে। আমার কাছে সব মিলিয়ে এক কোম্পানি এর মত মুক্তি্যোদ্ধা ছিল। এর মধ্যে আমরা অতর্কিত চোরাগপ্তা হামলার মাধ্যমে পাকবাহিনীকে ব্যাতিব্যস্ত রাখলাম এবং নদী পার হবা থেকে তাদের বিরত রাখলাম। এর মাঝে আমি সেক্টর কমান্ডার মেজর দত্ত এর মাধ্যমে ভারত ঠেকে কিছু অস্ত্র আর গোলা বারুদ পাবার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু তিনি সফল হননি।

২০ মে শত্রুবাহিনী ঘুরা পথে কুশিয়ারা নদী পার হতে  সক্ষম হলো। তাড়া  কুশিয়ারা নদী বরাবর তাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করল। শত্রুবাহিনী তখন আমাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে।

২৩ মে ১৯৭১ ছিল চাঁদনি রাত। চারদিকে তখন পিনপতন নিরবতা। আমি ভোর হবার আগেই শত্রুকে অভ্যর্থনা জানাতে দৃঢ় প্র্তিজ্ঞ ছিলাম। রাত ১১টার দিকে দুজন গ্রামবাসী দৌরে এসে আমাদের জানালো পাকবাহিনীর এক বিশাল বহর আমাদের আমাদের ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে আসছে।

দুর্ভাগ্যবসত সেই সন্ধ্যাতেই আমি এক প্লাটুন মুক্তি্যোদ্ধা সবুজপুর রেলওয়ে ষ্টেশনে শত্রু ঘাটি রেইড করতে পাঠিয়েছিলাম। আমি ভোর হবার আগেই যেভাবে হোক তাদের আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহে ফেরত আসতে নির্দেশ দিলাম। অল্প ফোর্স নিয়ে বিশাল শত্রুবাহিনীকে ঠেকিয়ে রাখা আমাদের জন্য কঠিন ছিল। কিন্তু আমাদের মনোবল তখন তুঙ্গে। আমি নিশ্চিত ছিলাম, হয় তাদের ঠেকিয়ে রাখা যাবে, না হলে মরার আগে প্রচুর সংখ্যক শত্রুবাহিনীকে মেরে তারপরে মরব। ভোর হবার আগেই এক প্লাটুন মুক্তি্যোদ্ধা সবুজপুর রেলওয়ে ষ্টেশন থেকে ফেরত আসল।

ভোরবেলা, ২৪ মে, ১৯৭১। ৬টার দিকে  শত্রুবাহিনী আমাদের রাইফেলের রেঞ্জের মধ্যে চলে আসল। আমরা এতটুকু হতচকিত হইনি, বরং আমরা তাদের  প্রতিক্ষাতেই ছিলাম। আর্টিলারী কাভার নিয়ে ২ কোম্পানি পাকসেনা আমাদের উপর হামলা করল। এক কোম্পানি সুত্রাকান্দি আক্রমন করলো, আর এক কোম্পানি  লাপ্সাল গ্রাম দিয়ে বড়গ্রাম বিওপিতে আক্রমণ করলো।

আমরা শত্রুর অপেক্ষাতেই ছিলাম। এটা ছিল দিনের আলোয় খোলা ময়দানে আক্রমণ। আসলে আমরা বিরাট এলাকা অল্পসংখ্যক মুক্তি্যোদ্ধা নিয়ে ধরে রেখেছিলাম।

শত্রুর প্রথম হামলা আমরা সাফল্যের সাথে প্রতিহত করলাম। খোলা মাঠে যুদ্ধে শত্রুবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির হার ছিল ব্যাপক। আধাঘন্টার মধ্যে ২৫ জনের মত শত্রুর লাশ পরে থাকল। আমাদের একমাত্র মিডিয়াম মেশিনগান খুব কাজে আসল। শত্রুবাহিনীর আর সাহস হয়নি মেইন রোড দিয়ে আগানোর।

ভারতের সীমানার অপর পাড়ে বিওপিতে সেদিন মাত্র ১৫ জনের মত পাহারায় ছিল। কিন্তু ৩ মেইল দূরত্বের মধ্যে ২ কোম্পানি ভারতীয় বিএসএফ ছিল রিসার্ভ ফোর্স হিসেবে। দুর্ভাগ্যবসত রিসার্ভ ফোর্স কিছু বুঝার আগেই পাকবাহিনী ভারতীয় সীমানার বিওপি আক্রমণ করে সেদিন বেলা ১২ টার দিকে, যা তাড়া ধারনা করেনি।তাদের ২ জন সিপাহী মারা পড়ে এবং পাকবাহিনী তাদের কিছু অস্ত্র হস্তগত করে।

এর পরে সকাল সাড়ে সাতটার দিকে শত্রুবাহিনী সামনের দিক থেকে এবং ডানদিক থেকে আমাদের উপর আক্রমণ করে। কিন্তু বেলা ১০টা পর্যন্ত তারা আমাদের একচুলও নড়াতে পারল না। আমাদের গোলাবারুদ শেষ হয়ে আসছিল। আমাদের অনুরধে ভারতীয় বিএসএফ আমাদের কয়েকশ রাউন্ড গোলাবারুদ দিল, কিন্তু এর বেশী তারা আর দিতে পারছিল না। সকাল সাড়ে এগারটার দিকে আমাদের সব গোলাবারুদ শেষ হয়ে গেল। কোন উপায় না দেখে আমি আমাদের বাহিনীকে পিছু হটতে নির্দেশ দিলাম। আমাদের দলের ২ জন সেদিন শত্রুর হাতে ধরা পড়ল। শত্রুবাহিনী আরও এগোতে থাকল এবং এক সময় আন্তর্জাতিক সীমা রেখা অতিক্রম করল।পাকবাহিনী তাদের উপর হামলা করার আগ পর্যন্ত বিএসএফ এক রাউন্ড গুলিও ছুড়ল না। তারা চিন্তাও করতে পারেনি যে, পাকবাহিনী সীমানা অতিক্রম করে তাদের উপর আক্রমণ করার সাহস সত্যি দেখাবে। বেলা ১২টা নাগাদ পাকবাহিনী ভারতীয় বিওপি দখলে নিল।

যদিও আমাদের পিছু হটতে হয়েছিল, আমরা আমাদের লক্ষ অর্জন করি। তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়, এবং আমরা পিছু হটার আগে তাদের ৩৯ জনের লাশ পড়ে ছিল। আমরা ২ জনকে হারাই আর কয়েকজন সামান্য আহত হয়। ২ জন পাঞ্জাবীকে আমরা পাকড়াও করি। সবচেয়ে বড় ব্যপার হল, এই যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আমাদের নিজেদের সামর্থের উপর সাহস ও ভরসা হাজারগুনে বাড়িয়ে দিল।

১লা জুন, ১৯৭১। এদিন বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক  কর্নেল (পরে জেনারেল) ওসমানী আমাদের ক্যাম্প পরিদর্শন করেন এবং সবরকমের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। আমাদের শক্তি-সামর্থ দিন দিন বেড়ে চলছিল। ১০জুন, ১৯৭১ আমরা বড়পঞ্জিতে আমাদের ক্যাম্প করলাম। এর মধ্যে ইন্ডিয়া আমাদেরকে অস্ত্র,গোলাবারুদ, আর রেসমের খাবার সরবরাহ শুরু করে। আমাদের কাউন্টার পার্ট ছিল ইন্ডিয়া ইকো সেক্টর, যাদের কাজ ছিল আমাদের সবরকমের সাহায্য করা।

আমরা এর মধ্যে ট্রেনিংক্যাম্প এর বন্দোবস্ত করেছিলাম। সেটা তখন পুরদমে চলছিল। নতুন ট্রেনিং পাওয়া গনবাহিনী তখন বেশ ভাল করছিল। মধ্য জুনের মধ্যে আমার সাব-সেক্টর এর সদস্য সংখ্যা ৬০০ হল আর তাদের সবার কাছে অস্ত্রও ছিল। ব্রিজ আর রেললাইন ধ্বংস করা ছিল আমাদের রুটিন কাজ। আমাদের এরিয়াতে একটা ব্রিজও পাওয়া যাবে না, যেখানে আমরা অপারেশন করিনি।অন্যদিকে বর্ডার এরিয়া তে সাধারন জনগনের উপরে পাকবাহিনীর বর্বরতম নির্যাতন সব সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। প্রতিরাতে আমাদের দুই তৃতীয়াংশ সদস্য কোন না কোন রেইড, অ্যাম্বুস বা গেরিলা হামলায় অংশ নিত। প্রায় প্রতিদিনই আমরা কিছু পাঞ্জাবি বা রাজাকার ধরে নিয়ে আসতাম।

পাকবাহিনীর বর্বর নির্যাতন ক্রমেই বেড়ে চলছিল। জুলাই মাসের কোন একদিন আমাদের ২জন গেরিলা যোদ্ধা তাদের হাতে ধরা পরে।পাকিস্তানীরা তাদের খোলা মাঠে গরুছাগলের মতো জবাই করে।আমার মনে আছে, তারা ২ জনই ইন্টারমিডিয়েট এর ছাত্র ছিল।  আর একদিন তারা আমাদের ৩জন গেরিলাকে ধরে ফেলে। তাদের উলটা করে ঝুলিয়ে রাখা হয় ৭ দিন। তাঁরা কাদতে কাদতে মারা যায়। আর একবার তারা আমাদের দলের একজন কে ধরে ফেলে। তাঁর ২ চোখ উপড়ে ফেলা হয়। সে ওইখানেই শহীদ হয়। এসব দেখার পরে স্বাভাবিক কারও পক্ষে মাথা ঠিক রাখা বা পাকিস্তানীদের প্রতি প্রতিশোধপরায়ন না হয়ে উঠার কোন কারন নাই।

লতি টিলার অপারেশন

(১৯ জুন, ১৯৭১)

 

যুদ্ধের সময় সবার আগে দরকার শৃংখলা। শৃংখলার প্রশ্নে কোন আপস করা চলে না। নিয়মিত বাহিনীকে নিয়ে কোন সমস্যা ছিল না, কিন্তু গনবাহিনীকে শৃংখলার মধ্যে রাখা বেশ কঠিন কাজ ছিল।

১৮ জুন, ১৯৭১। একটা জরুরি কাজে আমি বাইরে ছিলাম। ২টার দিকে যখন ফিরলাম, হেড কোয়ার্টার এ আমার জন্য ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলছিল। ফিরে আসার সাথে সাথে আমাকে জানানো হলো, আমার এক কোম্পানি কুকিতাল বিওপি(ভারত) এর দিকে রওনা হবে, পাকিস্থানি লতি টিলার বিওপিতে অপারেশন করতে। আমাকে বলা হলো, প্রয়জনীয় সব সহযোগিতা সেখানে পাওয়া যাবে। অপারেশন চালাতে আরটিলারী সাপোর্ট ও পাওয়া যাবে।

যাই হোক, রাতের দিকে এক কোম্পানি নিয়ে আমি কুকিতালে চলে আসলাম। আসার পরে ৭ রাজপুত রাইফেলের কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল দেব আমাকে ব্রিফ করলেন, এক প্লাটুন পাকিস্থানি সেনা লতি টিলার বিওপির প্রতিরক্ষায় অবস্থান করছে। আরটিলারি কামানের গোলাবর্ষণ এর পরে তাদের পজিশনে হামলা করা হবে। তিনি আরও জানান, তাঁর অধীনে থাকা ২ কোম্পানি সেনাও আমাদের পিছনে থাকবে। যদি দরকার পরে, তাঁরা আমাদের সব রকমের সাহায্য করবে। সত্যি বলতে, এই পরিকল্পনা আমার একদম পছন্দ হয়নি। আমি তাকে বললাম, এটা আমার পছন্দ না। হয় আমাকে অপারেশনের কাজ আমার মত করে করতে দেবা হোক, অথবা, তাঁরা তাদের সেনা নিয়ে অপারেশন করুক। তিনি জানালেন, তাঁর একার পক্ষে এই প্ল্যান বদল করা সম্ভব না। এরপরে আমি তাকে বললাম আমাকে কিছু সময় দিতে যাতে আমরা ঐ জায়গাটা রেকি করে আসতে পারি, কিন্তু তাতেও তিনি রাজি হলেন না। আমাদের দলের কেউ এরকম তাড়াহুড়া টাইপ প্ল্যান পছন্দ করেনি।

মাঝ রাতে আমি তাঁর থেকে বিদায় নিলাম এবং কোথাও বিশ্রাম নিতে চাচ্ছিলাম। একটা পাহাড়ের নিচে আমার সাথে ক্যাপ্টেন কুমার (ভারতীয় সেনাবাহিনি)এর দেখা হলো। তিনি আমাকে অপারেশনের পরিকল্পনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। আমি খেয়াল করলাম, তিনিও অপারেশনের প্ল্যান নিয়ে সন্তুষ্ট নন। আমরা একটার পর একটা সিগারেট ধরাতে লাগলাম। হঠাত বৃষ্টি শুরু হলো। এভাবে সারারাত পার হয়ে গেল। ভোর ৪ তাঁর দিকে আমি আমার কোম্পানি কে প্ল্যান মোতাবেক অগ্রসর হবার জন্য নির্দেশ দিলাম।

সীমান্ত থেকে জায়গাটা বেশী দূরে ছিল না। ভোর পোনে ছয়টার দিকে আমরা পাকিস্থানী ঘাটি চারদিক থেকে ঘিরে ফেললাম এবং তাদের টেলিফোন এর লাইন কেটে দিলাম। শত্রুর ঘাটি একটা ছোট পাহাড়ের উপড়ে ছিল এবং সুরক্ষিত ছিল। সমস্ত বাংকার শেল প্রুফ ছিল।১০০ মিটার দূর থেকেও বাইরে থেকে বুঝার কোন উপায় ছিল না ভিতরের অবস্থা সম্পর্কে। দেখে মনে হচ্ছিল, ভিতরে বোধহয় কেউ নেই।

ভিতরের অবস্থা বুঝার জন্য আমি ৪ জন জওয়ান পাঠালাম হ্যান্ড গ্রেনেড সহ এবং তাদের বললাম, বাংকার এর যত কাছে সম্ভব যেতে। প্ল্যানটা ছিল, শত্রুর শক্তি এবং অবস্থান সম্পর্কে পরিস্কার ধারনা পাবার পর আমরা সেটা পাস করে দিব এবং সেই মোতাবেক কামানের গোলা ছোড়া হবে। তারপরে আমরা সেই ঘাটি আক্রমণ করব।

আমার ৪ জন সেপাই ফিরে এসে খবর দিল, বিওপি তে কেউ নেই। কিন্তু তারপরও নিশ্চিত হবার জন্য আমি ১ জন হাবিলদার আর ২ জন সেপাইকে পাঠালাম বাংকার এর একদম কাছে যেয়ে গ্রেনেড চার্জ করতে। নির্দেশ মত তাঁরা বাংকার এর কাছে গিয়ে গ্রেনেড চার্জ করতেই পাকিরা ফায়ারিং শুরু করল। আমার ৩জন সিপাহীই গুলিবিদ্ধ হলো কিন্তু তাঁরা ফিরে আসতে সক্ষম হলো। ২০ মিনিটের মধ্যে ৫০০ আরটিলারি শেল শত্রু বিওপি তে আঘাত হানল। আরটিলারি শেলিং থামার সাথে সাথে আমরা বিওপি আক্রমণ করলাম। আমরা জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে এত জোরে চিৎকার করে ঝাপিয়ে পড়লাম যে পাকিস্থানীরা হতভম্ব হয়ে পড়ল। আমরা তাদের ঘাটির কাছে আসার আগেই তারা কাছাকাছি জঙ্গলে পালিয়ে গেল। পশ্চাদপসরণ করার সময় পাকিস্থানী সেনাদের বেশীরভাগ গুলি খেল। হঠাত অবাক হয়ে দেখলাম অর্ধনগ্ন একজন মেয়েও দৌরে পালাচ্ছে। দুর্ভাগ্যবশত পাকিস্থানী সেনাদের সাথে সেও রাইফেলের গুলি থেকে বাচতে পারল না। আমরা ঐ বিওপি সম্পুর্নরুপে ধ্বংস করে দিলাম। প্রচুর অস্ত্র আর গোলাবারুদ আমাদের হাতে আসল এবং ২২ বালুচ এর ১ জন সেপাই আর ১জন হাবিলদার কে আমরা জীবন্ত আটক করলাম। মুক্তিযুদ্ধ এর শেষ পর্যন্ত পাক আর্মি এদিকে আর আসেনি।

জুন, জুলাই, আগস্ট মাস আমাদের জন্য সবচেয়ে ভাল সময় ছিল। এসময় আমরা শত্রুর সবচেয়ে বেশী ক্ষয়ক্ষতি করলাম। এসময় উল্লেখযোগ্য পরিমানে মুক্তিযোদ্ধা ছোট ছোট অপারেশন পরিচালনা করে। সত্যি বলতে, সিলেট শহর এর ভিতরে আমরা শুরুতে তেমন উল্লেখযোগ্য পরিমানে সাহায্য পাইনি। আমাদের বেশ কিছু ছেলে অস্ত্র সহ ধরা পড়ে। সহযোগিতার অভাবে আমাদের বেশ কিছু পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। কিছু অসাধু উলেমা ভিতরে তৎপর ছিল। আবার এমন অনেক মানুষও ছিল, যারা আমাদের সাহায্য করেছে এবং যতদূর সম্ভব সাহায্য করার চেষ্টা করে গেছে। যুদ্ধদের শেষদিকে আমরা যখন একেবারে গভীরে ঢুকে গেছি, তখন আমরা লোকাল মানুষজনের থেকে অনেক বেশী সাহায্য সহযোগিতা পাই। তাদের যা কিছু ছিল, তাই দিয়ে আমাদের সব ভাবে সাহায্য করেছে।

এসময় আমার সাব-সেক্টরের সদস্য সংখ্যা এক হাজার নিয়মিত বাহিনী ছাড়িয়ে যায়। এর বাইরেও কয়েকশ গেরিলা যোদ্ধা ছিল, যারা একেবারে ভিতরে ঢুকে দুঃসাহসিক অপারেশন করে এসেছে। এটা ছিল যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায় এবং এসময়ে আমাদের কাজ ছিল শত্রুর সর্বোচ্চ ক্ষতি সাধন করা।

 

 

সবুজপুর (লাটু) রেলওয়ে স্টেশন অপারেশন

(১০ আগস্ট ১৯৭১)

 

কিছুদিন ধরে আমি সবুজপুর (লাটু) রেলওয়ে স্টেশনে বড় ধরনের অপারেশন করার কথা ভাবছিলাম। আগস্ট এর প্রথম সপ্তাহে আমি অপারেশনের মাস্টার প্ল্যান সেক্টর কমান্ডার লেঃ কর্নেল চিত্ত রঞ্জন দত্ত কে দিলাম তাঁর অনুমুতির জন্য। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার উডকে আমাদের সব ধরনের সাহায্য করার আশ্বাস দিলেন। তিনি আমাদের প্রয়জনীয় আর্টিলারি সাপোর্ট দেবারও প্রতিশ্রুতি দিলেন।

সবুজপুর (লাটু) রেলওয়ে স্টেশন ছিল পাহাড়ি এলাকা। পুরো এলাকা ৩১ পাঞ্জাব এর এক প্লাটুন এবং এক প্লাটুন অস্ত্রধারী রাজাকার দিয়ে সুরক্ষিত ছিল। শত্রুর ঘাটিতে সরাসরি হামলা করার কোন সহজ উপায় ছিল না। গেরিলা হামলা চালানোর মত অবস্থাও ছিল চিন্তার বাইরে। তবুও আমরা হামলা চালাতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম। আমি ১০ আগস্ট, ১৯৭১ অপারেশনের দিন (“D” দিন) ঠিক করলাম। আমার হাতে ৫ কোম্পানি ছিল এই অপারেশনের জন্য। রেকি করার পরে সিদ্ধান্ত নিলাম, সামনা সামনি হামলা করা ছাড়া কোন উপায় নেই, কিন্তু সেটা হবে অনিয়মিত উপায়ে। এক কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধার কাজ হবে বিয়ানিবাজার থেকে শত্রুর সংযোগ লাইন কেটে দেবা। তাদের উপরই দায়িত্ব পড়ে পিছন দিক দিয়ে শত্রুর উপর প্রথমে হামলার সূচনা করা। ঠিক ১০ মিনিট পরে তাঁরা ফায়ারিং বন্ধ করবে। এর পরে তাঁরা পিছু হঠবে এবং একি সময়ে এক ব্যাটারি মিডিয়াম গান শত্রুর উপর ফায়ারিং করবে তাদের ব্যাস্ত রাখতে। ৫ মিনিটের জন্য শেলিং করা হবে এবং তারপরে ৩ কোম্পানি সামনা সামনি শত্রুর উপর হামলা করবে। অবশিষ্ট এক কোম্পানি  শাহবাজপুর-বড়লেখা রাস্তায় পজিসন নিয়ে থাকবে, যাতে সেখানে শত্রুরা জমায়েত হতে না পারে। শুরুতে সবকিছু প্ল্যান মোতাবেকই হল।

৫টার দিকে আমার সব কোম্পানি তাদের নিজ নিজ নির্ধারিত পজিশনে চলে গেল। কোম্পানিগুলোর নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের কোন উপায় ছিল না। আমি যেহেতু আক্রম্নকারী দলের সাথে ছিলাম, আমার পক্ষে অন্য কোম্পানিগুলোর সাথে যোগাযোগের কোন পথ ছিল না। অন্য ২ কোম্পানির কাজটা এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, তাঁরা যদি শত্রুর সাপ্লাই লাইন বন্ধ না করতে পারে, পুরো অপারেশনটা ফেল করবে।

শত্রুর বাংকার অবস্থান এত মাটির এত গভীরে খনন করা ছিল যে, মিডিয়াম গান এর শেলিং তেমন কোন ক্ষতি করতে পারল না। যাই হোক, আমরা আমাদের পুরো শক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লাম। ১৫ মিনিটের মধ্যে শত্রু বাহিনী পিছু হটা শুরু করল। ৭ টার দিকে আমরা শাহবাজপুর রেলওয়ে স্টেশনের একটা বড় অংশ মুক্ত করলাম। এবার শত্রুর যেই অবস্থান থেকে সবচেয়ে বেশী প্রতিরোধ আসছিল, সেখানে চার্জ করলাম। সেখানে তখনও পাকিস্থানী পতাকা উড়ছিল। আমরা সেটা সড়িয়ে সেখানে আমাদের বাংলাদেশের পতাকা উড়ালাম।

এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আমাদের বাহিনী ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। আমি তাদের সমন্বয় করার চেষ্টা করলাম কিন্তু ব্যর্থ হলাম। এসময় একজন দৌরে এসে খবর দিল, শত্রুরা আমাদের বাম দিকে জড়ো হচ্ছে। বড়লিখা থেকে সাপ্লাই লাইন বন্ধ করে দেবার এবং তাদের পুনরায় একত্রিত হতে বাধা দেবার যেই দলের দায়িত্ব ছিল, তাঁরা ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যে পাকিস্থানীরা আমাদের অবস্থানে আর্টিলারি শেলিং শুরু করে।  আমি লেঃ কর্নেল দত্ত কে এই অবস্থা জানালাম। উনি আমাকে বলেছিলেন,  অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে। কিন্তু নতুন উদ্যমে একত্রিত হবা পাকিদের আর্টিলারি শেলিং এর মুখে টিকে থাকা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছিল। তাই অবশেষে আমরা পিছু হঠলাম।

যাই হোক, আমরা পিছু হঠলেও আমাদের শাহবাজপুর মিশন সফল ছিল। আমরা শত্রুর বিওপি দখল করে নিয়েছিলাম, রেলওয়ে স্টেশন ও প্রায় দখল করে ফেলেছিলাম। ওখানে ৮ জন শত্রু সেনার লাশ পড়েছিল সেদিন। প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ আমাদের হাতে আসে কিন্তু ট্রান্সপোরটেশান না থাকায় সেগুলো সব আমরা সেদিন নিয়ে যেতে পারেনি। এছাড়াও পাকিরা পিছু হঠার সময় তাদের হতাহত অনেককে সাথে নিয়ে যায়। পরে জানতে পারি, শত্রু পক্ষে হতাহতের সংখ্যা ৫০ এর মত। আমাদের পক্ষে ৬ জন শহীদ আর ৫ জন আহত হন। আমি আমার কিছু সাহসী যোদ্ধাকে এদিন হারাই। যেমনঃ ইপিআর হাবিলদার কুতুব, যে কিনা ইপিআর ফুটবল দলের অন্যতম সদস্য ছিল, কিংবা নায়েক মান্নান, যে খুব ভাল আথলেট ছিল। ফেঞ্চুগঞ্জ এর হাবিলদার ফাইজ যে কিনা কাটা পোড়া এর ওষুধ তৈরী করে বিখ্যাত হয়েছিল, এদিন শহীদ হন।

চারটে চা বাগানসহ ২০ বর্গমাইল এলাকা মুক্ত হয় এবং আমাদের দখলে আসে। শত্রুরা বিভিন্ন জায়গা দিয়ে এখানে হামলার চেষ্টা করে কিন্তু তাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। আমাদের সবচেয়ে বেশী সংখ্যায় গেরিলা যোদ্ধা এসময় সিলেটের একেবারে ভিতরে ঢুকে পড়ে এবং অনেক সফল অপারেশন করে। কিন্তু যা আগে বলেছি, যদি তাঁরা আরও বেশী লোকাল সাপোর্ট পেতো, তাঁরা আরও বেশী সফল হতো।

আমার অধীনে কিছু অসাধারন বীর গণবাহিনী দলনেতার দুঃসাহসিক অভিযানে আমি সত্যি গর্বিত। তাদের সবাই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। তাদের সবার নাম আমার মনে নেই, কিন্তু তারপরও কিছু নাম যেগুলো মনে আছে, যেমন এ মতিন চৌধুরী, শামীম, বাবুল, মুক্তাদির বিশেশভাবে উল্লেখযোগ্য।

১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১। ২ ব্যাটেলিয়ন এর মত পাকসেনা আমাদের বিয়ানিবাজার, বড়লেখা এবং জাকিগঞ্জ থানার ঘাটিতে আক্রমন করে। তাদের প্রচুর সেনা হতাহত হয় এই যুদ্ধে। আমাদের পক্ষে ৭ জন শহীদ হন। ১৩ সেপ্টেম্বর আমার স্ত্রী আমার সাথে সীমান্তে দেখা করে। সেই সময় শত্রুর চোখকে ফাকি দিয়ে আমার সাথে দেখা করা তাঁর মত সাহসী মেয়ের পক্ষেই সম্ভব ছিল।

সম্ভবত ২০ অক্টোবর, ১৯৭১। আমার কাছে অর্ডার আসল আমার বাহিনী নিয়ে জাকিগঞ্জ পুলিশ থানার উল্টাদিকে জালালপুর সাব-সেক্টরে যোগ দিতে। ধর্মনগর সাব-সেক্টর, অমলশিদ সাব-সেক্টর, এবং কুকিতাল সাব-সেক্টর থেকেও মুক্তিযোদ্ধারা এখানে যোগ দিয়েছে। সবাইকে আমার কম্যান্ড এর অধীনে দেবা হল। সেখানে ২ সপ্তাহের ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা হয় সরাসরি যুদ্ধ এর এবং আরও যুদ্ধের ময়দানের নানা কলাকৌশল রপ্ত করার জন্য। এসময় আমাদের কোম্পানি গুলোর যোগাযোগের জন্য কিছু ওয়্যারলেস সেটও দেবা হয়। এগুলো কিভাবে ব্যবহার করতে হয়, সেজন্য ও কিছু ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা হয়।

 

 

আটগ্রাম অপারেশন

(০৯ নভেম্বর, ১৯৭১)

 

আমাদের হাতে নিয়মিত বাহিনী এবং ট্রেনিংপ্রাপ্ত গণবাহিনী এর সদস্য সংখ্যা এক হাজার এর মত ছিল। আমাদের কাছে সেমি-অটোমেটিক রাইফেল, লাইট মেশিনগান, কিছু মিডিয়াম মেশিনগান, এবং আরও কিছু ভারী অস্ত্র ছিল। সারকথা, আমরা শত্রুর উপড়ে চূড়ান্ত আঘাত হানতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিলাম।

আটগ্রাম অপারেশনে আমি ৪ কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা মোতায়েন করি। লেঃ কর্নেল দত্ত এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে আমরা অপারেশনের প্ল্যান করি। ২ কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা ছিল ক্যপ্টেন আনাম এর তত্ত্বাবধানে, যাকে শেষ মুহূর্তে কমলপুর অপারেশনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। পরে সেকেন্ড লেঃ জহিরকে এই ২ কোম্পানির দায়িত্ব দেবা হয়। তাদের উপর দায়িত্ব ছিল, শ্ত্রুকে পাশ কাটিয়ে সুরমা নদী পার হয়ে পিছন থেকে আক্রমণ করা। তাঁর কোম্পানিগুলোর রাস্তার ২ দিক থেকে চারগ্রাম-দর্পনগর এর কাছে অবস্থান নেবার কথা ছিল। এর লক্ষ ছিল, যাতে সিলেট থেকে পাকিস্তানিদের সাহায্য করতে কোন দল আসলে তাদের ঠেকানো, এবং আটগ্রাম থেকে পিছু হঠতে গেলে যেন তাদের আক্রমণ করা যায়। লেঃ গিয়াস এর অধীনে ১ কোম্পানি ছিল, যার উপর দায়িত্ব ছিল প্রথমে আটগ্রাম-জাকিগঞ্জ এর রাস্তা ক্লিয়ার করা এবং আস্তে আস্তে অপারেশনের অন্য সব রাস্তা ক্লিয়ার করা এবং সব শেষে ডিফেন্সিভ পজিশন নেবা।

চতুর্থ এবং সর্বশেষ কোম্পানির কাজ ছিল আরাআড়িভাবে গোটাগ্রাম গ্রাম থেকে প্রতরক্ষা ব্যুহ তৈরি করা এবং সেখানে অবস্থান নেবা। এখানে বলা দরকার, পাকবাহিনী এপ্রিল-মে মাসের দিকে আটগ্রাম থেকে জাকিগঞ্জে আসার একটা শর্টকাট রাস্তা বানায়। এই রাস্তা দিয়েই শত্রুর সবচেয়ে বেশী আনাগনা ছিল। এই রাস্তা অবরোধ করতে পারলে শত্রুবাহিনী জাকিগঞ্জে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরবে। কিন্তু এটা খুব কঠিন কাজ ছিল। তাই আমি এই কোম্পানি কে এই কাজের দায়িত্ব দেই।

সুরমা নদী পার হবাও বেশ কঠিন কাজ ছিল। সেসময় কোন দেশী নৌকা পাওয়া যাচ্ছিল না। কোন রকমে আমরা ২টা নৌকা জোগাড় করি, এবং সেগুলো দিয়ে ৪ ঘণ্টায় পুরো দলটিকে পার করি।

আমাদের এই অপারেশনের প্রধান লক্ষ ছিল আতগ্রাম এর পাকিস্থানী ঘাটি কে চারদিক থেকে অবরুদ্ধ করে ফেলা। এটা খুব শক্ত ঘাটি ছিল। এই ঘাটি অপারেশনের জন্য উপর থেকে নির্দেশ ছিল। আমার মতে এটা একটা দুঃসাহসিক অভিযান ছিল। প্রথম থেকে এই অপারেশনের সাফল্যের ব্যপারে আমি খুব একটা ভরসা পাচ্ছিলাম না। তাই আমি যারা প্ল্যান করেছে, তাদের সাথে বেশ ক’বার এটা নিয়ে কথা বলি। যাই হোক, আমাদের উপর নির্দেশ ছিল, তাই আমরা শেষ পর্যন্ত এই অপারেশনে যাই। আমাদের প্ল্যান ছিল শত্রুর উপরে আগে আক্রমণ না করা। বরং এমনভাবে আগানো, যাতে, তারা আমাদের উপরে আগে আক্রমণ করে, এবং আমরা ডিফেন্স পজিশন থেকে তাদের মোকাবেলা করি।

নভেম্বর ৯, ১৯৭১। সূরযাস্তের পরে আমরা নতুন উদ্যমে আগানো শুরু করি। রাত ১১ টার দিকে প্রথম কোম্পানি যার কাজ ছিল, কমলপুর গ্রাম এর কাছে রাস্তা ক্লিয়ার করা শত্রুর মুখমুখি হয়। রাস্তা ক্লিয়ার করতে তাদের ৩০ মিনিট এর মত সময় লাগে। বাকি কোম্পানিগুলো শত্রুকে পাশ কাটিয়ে নিরাপদে নিজ নিজ অবস্থানে চলে যায়। রাস্তা ঘাট তখন খুব কর্দমাক্ত এবং খাল-বিলে ভরা ছিল। আমরা গোটাগ্রাম গ্রামে ভোর ৫ টার দিকে পৌছালাম। এই গ্রামে রাজাকারদের ক্যাম্প ছিল। আমাদের একটা দল সেই ক্যাম্প ঘিরে ফেলে। রাজাকাররা তখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছিল। তারা সব মিলিয়ে ১২ জন ছিল। ১জন বাদে সবাইকে আমরা ধরে ফেললাম। ১ জন কি করে যেন পালাতে সক্ষম হয়, এবং আটগ্রামে পাকিস্থানি ক্যাম্পে খবর দেয়। আটগ্রামে ১ কোম্পানি পাকি সেনা, ১ কমানির মত রাজাকার এবং খাইবার স্কাউট ছিল। ভোর সাড়ে ৬টার মত বাজে। আমরা তখনও আমদের ব্যাংকারগুল ঠিকমত রেডি করতে পারিনি। এমন সময় শত্রুরা প্রথম আমাদের উপড়ে হামলা করে। শত্রুর আমাদের শক্তি সম্পর্কে কোন ধারনা ছিল না। তারা ভেবেছিল, আমরা কোন ছোট দল নিয়ে এখানে আছি। তারা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি, আমরা এত বড় দল নিয়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এখানে অবস্থান করছি। ওরা আমাদের দিকে ভাবলেশহীনভাবে এগিয়ে আসছিল আর চিৎকার করছিল “মুজিব কে বাচ্চে, হাতিয়ার ছোর দো, আগার নাতো, কয়ি জিন্দা বাপাস নেহি যাওগে”। ১ প্লাটুনের মত পাকি সেনা রাস্তার ২ দিক থেকেই এগিয়ে আসছিল। তারা ১০০ গজের মধ্যে আসার সাথে সাথে আমি রাস্তার ২ দিক থেকে আমাদের ৪টা লাইট মেশিনগান চার্জ করতে বললাম। মুহূর্তের মধ্যে আমাদের মেশিন গান গর্জে উঠল। কিছু বুঝে উঠার আগেই ১৮ জন পাক সেনার লাশ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। বাকিরা পাশের নালায় আশ্রয় নেয় এবং পালিয়ে যায়। এর মধ্যে ১টা পাক সেনা ভর্তি ৩-টন ট্রাক জাকিগঞ্জ থেকে আসার পথে আমাদের এণ্টি-ট্যাঙ্ক মাইন এর আঘাতে উড়ে যায়। অন্য দিক থেকেও কিছু হামলা হয়, যেগুল আমরা সফলতার সাথে প্রতিহত করি। সন্ধ্যা হবা পর্যন্ত শত্রুর দিক থেকে আর কোন সাড়া শব্দ পেলাম না। এর ভিতরে তারা সিলেট থেকে আরও সেনা এবং ভারী অস্ত্র নিয়ে আসে।

১০ নভেম্বর, ১৯৭১। এই সন্ধ্যাটার কথা আমার এখনও পরিস্কার মনে আছে। তখন বিকাল ৫ টা হবে। আটগ্রাম থেকে সংখ্যায় বেশ ভারী একদল লোক দেশীয় অস্ত্র হাতে চিৎকার করতে করতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিল। তাদের কাভারিং নিয়ে পিছনে পাঞ্জাবি সেনারা ছিল। ফায়ারিং রেঞ্জের মধ্যে আসার সাথে সাথে আমি গুলি করার নির্দেশ দেই। সুনির্দিষ্ট সংখ্যা বলতে পারব না, কিন্তু তাদের আনুমানিক ৫০ জনের মত মাটিতে লুটিয়ে পড়ল গুলি খেয়ে। মুহূর্তের মধ্যে বাকি জনতা উধাও হয়ে গেল। এরপরে শুরু হল আসল যুদ্ধ।

শত্রুরা ৩ দিক থেকে আর্টিলারি গোলার কাভারিং নিয়ে আমাদের উপর হামলা করল। শত্রুরা ২ বার চেষ্টা করল, কিন্তু আমাদের ১ ইঞ্চিও সরাতে পারল না। রাত বাড়ার সাথে সাথে শত্রুর হামলার পরিমান ও চাপ বাড়তে লাগল। রাত ৮ টার দিকে আমাদের গোলাবারুদ শেষ হয়ে আসতে লাগল। সব গোলাবারুদ শেষ হয়ে গেলে আমরা মহাবিপদে পরব।এসময় পিছন দিক থেকে গোলাবারুদ এর সরবরাহ পাবারও কোন আশা ছিল না। আমি সেক্ট্র কম্যান্ডার লেঃ কর্নেল দত্ত কে ওয়্যারলসে জিজ্ঞেস করলাম, কি করা উচিত বা কি করব তখন। তিনি আমাদের বললেন, গুলি শেষ হবার আগেই নিরাপদ জায়গায় সরে যেতে।

২ দিনের যুদ্ধে আমরা ৩৯ জন পাকিস্তানি সেনা কে মারি, এবং তাদের অস্ত্র হস্তগত করি। এছাড়াও ১১ জন রাজাকারকে জ্যান্ত ধরে ফেলি। আমাদের পক্ষে ২জন শহীদ হয় এবং ৫ জন আহত হয়।

২০ নভেম্বর, ১৯৭১। এদিন ছিল ঈদের দিন। যেহেতু আমার স্ত্রী করিমগঞ্জে একা ছিল, আমি কিছুক্ষনের জন্য তাঁর সাথে দেখা করতে যাই। যৌথ কম্যান্ডের সিদ্ধান্ত অনুসারে ২০/২১ নভেম্বর “ডি ডে” হিসেবে নির্ধারণ করা হয় এবং এসময় শত্রুর উপড়ে চূড়ান্ত আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়। এই সময় থেকেই ভারতীয় মিত্র বাহিনী সরাসরি আমাদের হয়ে যুদ্ধের ময়দানে নামে। ঈদের দিন হবার কারনে সারা দেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কিছুটা হাল্কা মুডে ছিল। পরে একজন পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দির কাছ থেকে আমরা জানতে পারি, তারা এদিনে হামলার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না।

সিলেটের ঐ অঞ্চলের  “ডি ডে” প্ল্যান ছিল এরকম। ট্যাঙ্ক এবং আর্টিলারি সাপোর্টসহ এক ব্যটেলিয়ন যোদ্ধাকে দায়িত্ব দেবা হয় জাকিগঞ্জ শহরকে শত্রুমুক্ত করার। এক ব্যাটেলিয়ন গুর্খা রেজিমেন্ট এবং প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কে দায়িত্ব দেবা হয় পাকিদের শক্তিশালী ঘাটি আটগ্রামকে মুক্ত করার। আটগ্রামের উলটা দিকে, সুরমা নদীর অপর পাড়ে সালামটিলা এবং রাজাটিলা নামে শত্রুর ২টা চেকপোস্ট ছিল। এই ২টি ঘাটি ক্লিয়ার করার দায়িত্ব দেবা হয় লেঃ কর্নেল জিয়ার (এখন কর্নেল) অধীনে থাকা “জেড ফোর্সকে”। তাঁর কাছে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল।

২১ নভেম্বর ১৯৭১, সকাল ১০টা। জাকিগঞ্জ শহর শত্রু মুক্ত হয়। ২২ নভেম্বর ৭১ পর্যন্ত আটগ্রাম ক্লিয়ার করা যায়নি। আমি আমার এক ব্যটেলিয়ন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ২০/২১ নভেম্বর শেষ রাতের দিকে যোগ দেই। যেহেতু এই এলাকাটা আমাদের রেকি করা হয়নি, সিদ্ধান্ত নেই, ভোরবেলায় আক্রমণ করা যাবে না। আমাদের ২টা লক্ষ্য ছিল। তাই আমরা ২টা দলে ভাগ হয়ে যাই। আমি ২ কোম্পানি কে লেঃ জহির এর অধীনে দেই রাজা টিলা আক্রমণ করতে, আর আমার অধীনের দলের কাজ ছিল সালাম টিলা আক্রমণ করা। ২১ নভেম্বর সকালের আলো ফুটার আগেই আমরা শত্রু অবস্থান ঘিরে ফেললাম।

জায়গাটা কিছুটা রেকি করে সিদ্ধান্ত নেই, বিকাল ৩টায় একসাথে উভয় ঘাটিতে হামলা করা হবে। প্ল্যান মত বিকাল ৩টায় শত্রুকে হতভম্ব করে দিয়ে আমরা সামনা সামনি দুঃসাহসিক ভাবে শত্রুর উপরে হামলা চালাই। পাকিস্থানিরা পুরো জায়গাটা মাইন পেতে রেখেছিল। ফলে, যুদ্ধে আমাদের ৪ জন সহযোদ্ধা এর পা উড়ে যায়। ২ ঘণ্টার তুমুল লড়াই এর পরে শত্রুরা পিছু হটা শুরু করে। পাশে ঘন জঙ্গল থাকায় পাকিদের বেশীরভাগ পালাতে সক্ষম হয়। তারা বিপুল পরিমানে গোলাবারুদ ফেলে যায়। সালাম টিলা এবং রাজা টিলা আমাদের দখলে আসে, এবং ২ জন পাকি সেনা কে আমরা ধরে ফেলি।

২৩ নভেম্বর, ১৯৭১। আমি হেড কোয়ার্টার থেকে মেসেজ পাই, আটগ্রামে কর্নেল জিয়ার কাছে রিপোর্ট করতে। আমি ১২টার দিকে যখন পৌছালাম, তাকে বেশ হাসিখুশি দেখলাম। তিনি মিত্র বাহিনী এর এক ব্রিগেডিয়ার এর সাথে ব্যাঙ্কারে বসে ছিলেন। তিনি আমাকে স্বাগত জানালেন এবং একটা সিগারেট অফার করলেন। আমাদের কুশলাদি জিজ্ঞেস করার পরে তিনি আমাকে নির্দেশ দিলেন, সুরমা নদীর অন্য পাশ দিয়ে কানাইঘাট এর দিকে অগ্রসর হতে এবং যে কোন মুল্যে কানাইঘাট-দূর্বাস্ত রাস্তা ব্লক করতে। নির্দেশ পেয়ে আমি আমার ক্যাম্পে ফেরত আসি এবং আমার দল কে আমাদের ক্যাম্প থেকে ১০ মাইল দূরে লুবা চেরা চা বাগানের দিকে অগ্রসর হতে বললাম। ২৫/২৬ নভেম্বর, ১৯৭১। আমরা লুবা চেরা চা বাগানে ডিফেন্সিভ পজিশন নেই।

এই ৪-৫ দিনে মুক্তি বাহিনী ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সরাসরি সহায়তায় পুরো জাকিগঞ্জ থানা এবং কানাইঘাট থানার অর্ধেকের বেশী মুক্ত করে ফেলি। ঐসব এলাকায় মানুসের মুক্তির আনন্দ, উচ্ছাস ছিল চোখে পরার মত। হানাদারদের হাতে  ৯ মাস এর অত্যাচার, অনিশ্চিত জীবন যাপনের পরে মুক্তির বাধ ভাঙ্গা আনন্দ বলে বুঝানর মত না। ঐ এলাকাতে পাকিস্থানিদের অত্যাচার এর কোন সীমা ছিল না। শত শত মেয়ে কে ওরা ওদের ক্যাম্পে নিয়ে অত্যাচার, ধর্ষণ করে। জাকিগঞ্জ মুক্ত করার পর একটা ব্যাঙ্কার থেকে ১জন মেয়ে সহ পাকিস্থানি সেনার লাশ পাওয়া যায়। ঐ ব্যাঙ্কার থেকে ১টা মেয়ের লাশ এবং প্রচুর শাড়ি, মেয়েদের পোশাক পাওয়া যায়।স্থানীয়দের থেকে আমরা জানতে পারি, পাকিরা মেয়েদের জোর করে ধরে নিয়ে আসত এসব ক্যাম্পে এবং নির্মম অত্যাচার করত তাদের উপড়ে। বিশেষ করে তাদের মিলিশিয়া বাহিনী এজন্য কুখ্যাত ছিল।

অন্য সব ফ্রন্টেও যুদ্ধ তখন জমে উঠেছে। সব জায়গায় পাকিদের লেজেগোবরে অবস্থা। যুদ্ধ করার সাহস, মনোবল তারা হারিয়ে ফেলেছিল। মক্তিবাহিনী এবং জনরোষের ভয়ে তারা ভীত হয়ে পড়েছিল।

২৬ নভেম্বর, ১৯৭১। আমরা আমাদের পরের লক্ষ্যে আগানো শুরু করলাম। আমার লক্ষ্য ছিল, কানাইঘাট-দূর্বাস্ত রাস্তা কেটে দেবা। কানাইঘাত শত্রুর শক্তিশালী ঘাটি ছিল। প্রথমে এটা দখল করা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের লক্ষ্য ছিল। ২৬/২৭ নভেম্বর রাতে আমি বড়চাতাল গ্রামে পৌছালাম, যার ২দিক দিয়ে পুকা রোড চলে গেছে। আমরা এই গ্রামে পজিশন নেই, যাতে পাকিরা কানাইঘাত থেকে পালাতে বা বাইরে থেকে কানাইঘাটে কোন সাহায্য না আসতে পারে। এটা খুব কঠিন কাজ ছিল, কারন পাকিরা এটা কোনভাবেই হতে দিবে না। পাকিরা ২ দিক থেকে আমাদের উপরে বৃষ্টির মত ১০৫ মিমি. আর্টিলারির শেলিং করা শুরু করল।

আমি জানতাম, এখানে পাকিদের বড় ধরনের হামলার মুখে পড়ব। সেকারনেই এটা বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। যাই হোক, আমি ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত এই পথ দিয়ে পাকিদের  আনাগনা  বন্ধ করে রাখলাম।

এই অপারেশন সিলেটে আমাদের মিত্র বাহিনী এবং মুক্তিবাহিনী এর একটা বড় সাফল্য ছিল। কানাইঘাটের পতন হবা পাকিদের জন্য একটা বড় ধরনের ধাক্কা ছিল। এখানে হেরে যাবার পরে তাদের বামদিকে চরকাই, আর ডানদিকে হরিপুরে পিছু হটা ছাড়া আর কোন পথ ছিল না। আমাদের এই বিজয় দ্রুত সিলেট এর পতন কে ত্বরান্বিত করে।

১ ডিসেম্বর, ১৯৭১, বিকাল ৫টা। আমরা তখনও রাস্তা ব্লক করে বসে আছি। সেক্টর কম্যান্ডার লেঃ কর্নেল চিত্ত রঞ্জন দত্ত আমার কাছে এলেন। অল্প কিছু কথা হবার পরে তিনি বললেন, পরদিন ভোর হবার আগেই কানাইঘাট আক্রমণ করতে হবে। আমি তাঁকে বুঝানোর চেষ্টা করলাম, এটা অসম্ভব কারন প্রথমত, আমরা খুব ক্লান্ত। দ্বিতীয়ত গত ৩ দিন যাবত আমাদের ঘুম হয়নি। তৃতীয়ত আমাদের গোলাবারুদ এর প্রয়জন। তিনি আমার সাথে একমত হলেন না। তিনি জানালেন, এটা হাই কম্যান্ডের নির্দেশ। তিনি আরও জানালেন, আরও বড় বড় অপারেশন আটকে আছে শুধুমাত্র কানাইঘাট এর জন্য।

প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও আমরা রাত ৮টার দিকে কানাইঘাট এর দিকে যাত্রা শুরু করলাম। আমাদের ভিতর এর রাস্তা দিয়ে ১২ মাইল পার হতে হয়েছে। যাই হোক, ২রা ডিসেম্বর রাত ৮টার দিকে আমরা আমাদের নির্ধারিত জায়গায় মিলিত হলাম।

কানাইঘাট একটা থানা হেড কোয়ার্টার। সুরমা নদীর তীরে চমতকার একটা শহর। এখানে এক কোম্পানি পাকি সেনা এবং প্রচুর সশস্ত্র রাজাকার ছিল। শত্রুরা শহরের চার দিকে তাদের দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা তৈরি করে ছিল। তাদের কিছু ব্যাঙ্কার সিমেন্টের বানান ছিল। চারদিকে প্রচুর মাইন পাতা ছিল। ব্যাঙ্কার এর কাছে ধারে যাবা চিন্তার বাইরে ছিল। তাদের মুখমুখি আক্রমন করা ছাড়া আমাদের আর কোন পথ খোলা  ছিল না। এক ব্যাটারি ১২০ মিমি আর্টিলারি মর্টার ছিল তাদের সাথে। অন্য দিকে, আমাদের কাছে শুধু ২টা ৩ ইঞ্চি মর্টার ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা ছিল ক্লান্ত। সব মিলিয়ে এটা খুব কঠিন ছিল আমাদের জন্য।

যেখানে আমরা মিলিত হইয়েছিলাম, সেখান থেকে রাত ৩ টার দিকে বের হয়ে পড়লাম। পথে শত্রুর কিছু বাধা হটিয়ে লক্ষ্যের ৫০০ গজের মধ্যে আসতে আমাদের পাক্কা দেড় ঘন্টা সময় লেগে যায়। প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। আমাদের সব সহযোদ্ধা চলে এসেছে। আমরা বুঝতে পারলাম, দিনে দুপুরে এরকম শক্ত অবস্থানে হামলা করলে আমাদের বড় ধরনের মুল্য দিতে হবে। আমি খুব কাছ থেকে শত্রুর অবস্থান দেখে নিলাম এবং নিশ্চিত হলাম, এই অবস্থায় শত্রুকে হটানো প্রায় অসম্ভব। আমি পিছনে গিয়ে লেঃ কর্নেল দত্ত কে পুরো ব্যপারটা ওয়্যারলেসে বুঝালাম। তিনি প্রথমে আমাকে যেভাবে হোক, আক্রমণ করতে উতসাহিত করলেন, কিন্তু পরে বুঝলেন, সেটা থিক হবে না। তিনি আমাকে পিছু হঠতে বললেন। আমি সর্বশক্তিমান এর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম, কেননা এই অবস্থায় হামলা করলে আমাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রানহানি হত সেদিন।

আমরা সেদিন কিছুক্ষন বিশ্রাম নিলাম। বিরামহীন পরিশ্রমের ফলে আমাদের ১৫০ জন যোদ্ধা ২রা ডিসেম্বর সন্ধ্যার মধ্যে অপারেশন করার জন্য আনফিট হয়ে পরল। আমার সাথে শুধু ৩ কোম্পানি যোদ্ধা থাকল কানাইঘাট অপারেশনের জন্য। আমাদের সেক্টরের মিত্রবাহিনীর ও মুক্তিবাহিনী এর কম্যান্ডার ব্রিগেডিয়ার ওয়াটকি সেদিন সন্ধায় আমাদের এলাকায় এলেন। আমরা তাঁর কাছ থেকে অন্য সব ফ্রন্ট এর সর্বশেষ আপডেট পেলাম। চারদিকে মুক্তিবাহিনী এর সাফল্যের সংবাদে আমরা পুনর্জীবিত হলাম। গত ১০-১৫ দিন আমরা রেডিও শুনারও সময় পাইনি।

এই অপারেশনে আমাদের কোম্পানি কম্যান্ডার ছিল এ মতিন চৌধুরী, লেঃ জহির, লেঃ গিয়াস। এদের সবাই খুব সাহসী যোদ্ধা এবং অধিনায়ক ছিলেন।

সেদিন সন্ধার দিকে আমরা বেশ ভাল বোধ করছিলাম এবং কানাইঘাটের শত্রুর ঘাটি গুড়িয়ে দেবার ব্যপারে বদ্ধপরিকর হলাম। আমরা শত্রুর ব্যাপারে আরও কিছু খোজ খবর করলাম। খোজ খবর থেকে মনে হল, তারাও ৩রা ডিসেম্বর ভোর এর আগেই আমাদের কে আশা করছে।

৩ ডিসেম্বর ভোর ৪টা। আমরা কানাইঘাটের শত্রু ঘাটি এর ৩০০ গজের মধ্যে চলে আসলাম এবং পজিশন নিলাম।আমরা ভোর সাড়ে পাচটায় শত্রুর দিকে ফায়ার ওপেন করলাম। তারাও পাল্টা গুলি ছুড়ল। তারা আরটিলারি গোলা ছুড়তে লাগল আমাদের দিকে। আমরা শত্রুর উপড়ে চাপ বাড়াতে লাগলাম ৩ দিক থেকে আক্রমণ করে। ১ ঘণ্টা এর মধ্যে আমাদের ১৫ জন হতাহত হল। ভোর ৭ টার দিকে শত্রু পিছু হটা শুরু করল। ভোর সোয়া সাতটার দিকে আমরা শত্রুর ব্যাঙ্কারে চার্জ করলাম। আমরা বর্বর পাঞ্জাবি সেনাদের কে বেয়নেট চার্জ এবং গ্রেনেড দিয়ে মারা শুরু করলাম। তাদের বেশীরভাগ অস্ত্র ফেলে সুরমা নদীতে ঝাপ দিল এবং মারা পড়ল। সর্বশক্তিমানের অসীম কৃপায় আমরা সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে কানাইঘাটকে সম্পূর্ণ মুক্ত করলাম এবং হেড কোয়ার্টার এ মেসেজ পাঠালাম।

কানাইঘাটে শত্রুরা ব্যাপক ক্ষ্যক্ষতির সম্মুখীন হয়। তারা ১২ জন লাশ ফেলে যায়। পরদিন লোকাল লোকজনের থেকে পরে জানতে পারি, তারা আরও অনেক লাশ ভাসতে দেখে সুরমা নদীতে। তাদের ফেলে যাওয়া বিপুল পরিমান গোলাবারুদ ও আমাদের হস্তগত হয়।

নয় মাস পরে হানাদারমুক্ত হয়ে লোকজনের খুশির কোন সীমা ছিল না। তারা আমাদের কাছে আসত এবং এই নয় মাসে পাকিস্থানিদের নির্মম অত্যাচার এর বর্ণনা দিত।

কানাইঘাট এর যুদ্ধে আমাদেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়, কিন্তু আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা যে বীরত্ব দেখায় এই যুদ্ধে, তা  ছিল কিংবদন্তী এর মত। এটা মিত্র বাহিনী এর সাহায্য ছাড়া আমাদের একক বড় বিজয় ছিল। আমাদের ৬জন শহীদ হয় এবং ২০ জন আহত হয় এই যুদ্ধে। কানাইঘাটের পতন হবার ফলে শত্রুর পায়ের তলার মাটি একেবারে সরে যায়।

৩রা ডিসেম্বর, ১৯৭১। হাজার হাজার উতফূল্ল জনতার সামনে আমরা কানাইঘাট ডাকবাংলো তে বাংলাদেশের পতাকা উত্তলন করি।

৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১। আমরা সিলেটের দিকে আগানোর নির্দেশ পাই। জেড ফোর্স এর কম্যান্ডার কর্নেল জিয়া প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে কানাইঘাট হয়ে সিলেটের দিকে যাচ্ছিলেন। আমি ও লেঃ জহির এর সাথে এক কোম্পানি প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পাঠালাম। জওয়ানরা তখন সিলেট শহর এর পথে আগুয়ান। ৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭১। সিলেট-শিলং রোডে পাকিদের আর এক শক্তিশালী ঘাটি দারবস্ত এর পতন হয় আমাদের এবং মিত্র বাহিনীর হাতে। পাকিরা হরিপুরে পিপিএল (পাক পেট লিমিটেড) এর আশেপাশে ঘাটি করে ছিল। এক গুর্খা ব্যাটেলিয়ন এখানে কয়েকবার আক্রমণ করে, কিন্তু উল্লেখযোগ্য সাফল্য পাচ্ছিল না।

১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১। আমরা আবার উলটা পথে এসে পিছন দিক থেকে হরিপুরে আক্রমণ করতে গেলাম। বেশ বড় পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। ২টা বড় দেশী নৌকায় করে আমরা ১৫ মাইল এর মত পথ পাড়ি দেই। ভোর ৫টার দিকে আমরা নদী পার হই, কিন্তু হঠাত শত্রু বাহিনী আমাদের ঘিরে ফেলে। সেদিন আমাদের অনেকে হতাহত হয়। আমার ৫ জন সহযোদ্ধা শত্রুর আর্টিলারি গোলার আঘাতে টুকরা টুকরা হয়ে যায়। সেদিন আমরা কিছুই করতে পারলাম না। ১২ ডিসেম্বর রাতে আমরা আবার সুরমা নদী পাড়ি দিলাম এবং পিছন থেকে হরিপুরে তাদের উপড়ে হামলা করলাম। ১৩ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় হরিপুর আমাদের দখলে আসে। ঐ রাস্তায় চিকনাগুল নামক জায়গায় শত্রুরা আমাদের প্রতিরোধ করে। ১৪ই ডিসেম্বর এর ঐ যুদ্ধে আমরা আমাদের ৩জন বীর যোদ্ধাকে হারাই। আরো ৪ জন গুরুতর আহত হয় সেদিন। অবশেষে পাকবাহিনী খাদেমনগর এর দিকে পালিয়ে যায়। ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১। আমরা এবং মিত্রবাহিনী খাদেম নগর ঘিরে ফেলি। এটা ছিল, সিলেট শহরের বাইরে তাদের সর্বশেষ ঘাটি।

১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। আমাদের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় এর সূচনা হয়। যৌথবাহিনী এর কাছে পাকিস্থানি বাহিনী এর শোচনীয় পরাজয় আমার কাছে কোন বিস্ময় ছিল না। আমরা জানতাম,এটা ছিল অবধারিত। আজ হোক, আর কাল হোক, এটা হতেই হত। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেল। জনতা উল্লাস করছিল, চিৎকার করছিল। আমি সাব কিছুর সাথে সামিল হতে পারিনি। আমি গত ৯ মাসের প্রতিটা মুহূর্ত সেদিন মনে করছিলাম। যেসব সহযোদ্ধা কে হারিয়েছি, যাদের বাচাতে পারিনি, তাদের কথা খুব বেশি মনে পরছিল। আমি কাদছিলাম। মনে হচ্ছিল, তাদের আত্মা অমর হয়ে আমার চারপাশেই ঘুরছে। আমরা একসাথে যাত্রা শুরু করেছিলাম, কিন্তু আজ যখন আমরা লক্ষ্যে পৌছালাম, তখন আমি যেন অনেকটাই একা। সেদিন আমরা যারা একসাথে যাত্রা শুরু করেছিলাম, দেশের জন্য, তাদের বেশিরভাগকেই হারিয়ে ফেলেছি। আমি কিভাবে জানি বেচে আছি এখনও। কিন্তু আমি কি করতে পারি? এটা বিস্ময়কর যে আমি এখনও বেচে আছি। মৃত্যু আমার কানের পাশ দিয়ে বেশ কবার হ্যালো বলে চলে গেছে। আমরা এখন মুক্ত, স্বাধীন। আসুন, আমরা অন্তত কোনদিন তাদের কথা না ভুলি এবং তাদের অমর আত্মার শান্তি কামনা করি।

** ১৯৭১-এর মার্চে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন।

 

 

 

সাক্ষাৎকারঃ লেঃ কর্নেল মোঃ মোহাম্মদ আব্দুর রব

 

মুক্তাদির অয়ন

<১০, ., ২৫৮২৭৭>

অনুবাদ

 

যুদ্ধের ডায়েরী

তারিখ স্থান বিবরণ
২৪ মে ‘৭১ লাতু

ভোর চারটার দিকে আমাদের সেনারা শত্রুদের উপর হামলা করে লাতু নামক স্থানে এবং ৭ জন শত্রুসেনা কে নিহত এবং ৩ জনকে আহত করেছে।

 

১ জুন ‘৭১ ফকিরবাজার

কমান্ডার ইন চিফ আজ ফকিরবাজার ক্যাম্প পরিদর্শনে আসেন এবং সবার সাথে দেখা করেন।

 

৬ জুন ’৭১ ফকিরবাজার

রাত দুটোর দিকে জকিগঞ্জে হামলা করলাম, বাঙ্গালিবিরোধী তিন জনকে হত্যার পাশাপাশি বাংলাদেশের বিপক্ষে পাকবাহিনীকে সহায়তে দেবার অপরাধে জকিগঞ্জ থানার একজন এসআইকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জকিগঞ্জ টেলিফোন এক্সচেঞ্জের ক্ষতিসাধন করা হয়েছে।

 

৯ জুন ’৭১ বড়গ্রাম

সাদনাপুর, বড়গ্রাম এবং কাঙ্গলিঘাটে অবস্থানরত শত্রুদের উপর হামলা করে তিনজন সেনা নিহত করলাম।

 

১০ জুন ৭১       বড়্গ্রাম বড়গ্রাম

আমাদের সেনাদলকে বড়পুঞ্জিতে সরিয়ে নেয়া হল।

 

১২ জুন ’৭১ বড়গ্রাম

৪০ জন নতুন সৈন্য আমাদের দলে যোগ দিলো, ২৬ জন ছাত্রও আমাদের ক্যাম্পে যোগ দিলো। ৭ জন  কে বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে বাংলাদেশ এলাকায় পাঠানো হল।

 

১৩ জুন ’৭১ বড়গ্রাম

২৬ জন ছাত্রের মধ্যে ২০ জন বিশেষ দায়িত্ব নিয়ে  বাংলাদেশে চলে গেল। আরও ৫ জন ছাত্র বিশেষ দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশের দিকে চলে গেল সন্ধ্যা ৭:৩০ এর দিকে। বিকেল ৫ টার দিকে বিশেষ মিশন নিয়ে ৮ জন সৈন্য বাংলাদেশে গেল।

 

১৩ জুন ’৭১ কুমারসাইল

সুবেদার আব্দুল আজিজ ৬ জন সৈনিক সাথে নিয়ে কুমারসাইলের হাজী রকিব আলির বাড়িয়ে অভিযান চালিয়ে তাকে বাংলাদেশবিরোধী কর্মকান্ডের জন্য গ্রেফতার করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হল।

 

১৪ জুন ’৭১ কুমারসাইল

নায়েব সুবেদার মতিউর রহমান এগার জন সৈনিক এবং দুজন কুককে সাথে নিয়ে কুকিতাল ক্যাম্পে চলে গেল। রাত ৮ টার দিকে এক জন অফিসার

এসে আবার রাত ১১:৩০ তে বিশেষ অভিযানের দায়িত্ব নিয়ে বের হয়ে গেলেন। উনি ১৫ জন অস্ত্রধারী সৈনিকের সাথে ৫ জন ছাত্রকে নিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে বিশেষ মিশনের নেতৃত্ব নিয়ে গেলেন।

 

১৫ জুন ‘৭১ শাবাজপুর

সৈনিকদের সহায়তায় একদল ছাত্র শাবাজপুরে গিয়ে শাবাজপুর রেলওয়ে স্টেশনের থেকে দেড় মাইল দুরত্বে অবস্থিত লাতু-জুরি সড়কের দালাওয়ারি ব্রিজ ধ্বংস করে দিয়েছে। ওরা অত্র এলাকার শান্তি কমিটির মেম্বার হাজি মকবুল আলীর নির্দেশে ব্রিজ পাহারার দায়িত্বরত দুইজনকে ধরে এনেছে।

 

১৫ জুন ’৭১ শালিয়া চা বাগান

৪ জন সৈনিক আর এক দল ছাত্র আজ বিকাল ৪  টার দিকে শালিয়া চা বাগানে হামলা করে ফ্যাক্টরি বিধ্বস্ত করে, অ্যান্টি ট্যাঙ্ক মাইন দিয়ে একটি জীপ ধ্বংস করার পাশাপাশি ম্যানেজার এবং অন্য জনকে, যাদের একজন ছিল প্রাক্তন সেনা, খুন করে।

 

১৬ জুন ’৭১

০৪০০ ঘটিকা

শাবাজপুর

নায়েব সুবেদার আব্দুল দায়ান এর নেতৃত্বে তেরজন সৈনিক শাবাজপুরে শত্রু অবস্থানের উপর হামলা করে ১৮ জন শত্রুসেনা হতাহত করে। ৩০ জন সৈনিক নিয়ে মুক্তিবাহিনীর একটা দল করিমগঞ্জ থেকে এখানে এলো।

 

১৭ জুন ’৭১

০২০০ ঘটিকা

শাবাজপুর

এ কাইয়ুমের সাথে ১২ জন সৈনিকের প্রহরায় এক দল ছাত্র শাবাজপুর এলাকায় গিয়ে শাবাজপুর রেল স্টেশনের দুই মাইল দূরে বারিগ্রাম-জুরি সড়কের কবিরা ব্রিজ হাই এক্সপ্লোসিভ দিয়ে ধ্বংস করে দেয়।

 

১৭ জুন ’৭১ শাবাজপুর

দুপুর ২:৩০ এর দিকে সিলেট শহরের বিদ্যুৎ বিতরণ সাব স্টেশন এবং নায়ের পুল এলাকায় টেলিফোন স্থাপনা বিস্ফোরক দিয়ে ধ্বংস করে ফিরে এল এক দল ছাত্র।

 

১৮ জুন ’৭১ শাবাজপুর

দুপুর ১ টার দিকে জনাব তামিদের নেতৃত্বে ৬ জন ছাত্রের একটা দল এবং নায়েক আব্দুল জব্বার এর সাথে থাকা ১০ জন সৈনিক শাবাজপুরে গিয়ে শাবাজপুর রেল স্টেশনের আড়াইমাইল দূরে অবস্থিত সুজাউল গ্রামের নিকটবর্তী দেওছরি রেল সেতু উড়িয়ে দেয়।

 

২১ জুন ’৭১ কারারদি

দুপুর ১টার দিকে হাবিলদার আজিরুদ্দিনের সাথে ৭০ জন সৈনিকের একটা দলের পাহারায় আশরাফুজ্জামানের নেতৃত্বে একদল ছাত্র বিস্ফোরক

নিয়ে শেওলা ঘাটের ৩ মাইল দক্ষিন পশ্চিমে শেওলা-বড়িয়াগ্রাম সড়কের কড়াইদি চাঙ্গার পুলের দিকে বিস্ফোরক নিয়ে গেল।

 

২৪ জুন ’৭১ পাল্লাথাল

পাল্লাথাল চা বাগান থেকে ধরে আনা কাজল নামের একজন পাকি সিপাইকে হত্যা করা হয়েছে। পাল্লাথাল চা বাগানে হামলা করে বিশ ব্যাগ চা এবং ওজন মাপার একটা যন্ত্র দখল করা হয়েছে। পাকবাহিনীকে সহায়তা করার অভিযোগে আব্দুর রহমান নামের একজনের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করে ক্যাম্পে আনা হয়েছে।

 

২৫ জুন ’৭১ পাল্লাথাল

উপরোল্লেখিত আব্দুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদের পর প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নেওয়ার জন্য পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য বিএসএফ মহিশ্মশান এর হাতে তুলে দেয়া হয়েছে।

 

২৬ জুন ’৭১ কাঙ্গলিঘাট

আশরাফুজ্জামানের নেতৃত্বে ৬ জন ছাত্র এবং তাদের  হায়তায় থাকা হাবিলদার কাইউমের ১৭ জন সৈনিকের দল কাঙ্গলিঘাটের দেড় মাইল পশ্চিমে অবস্থিত বড়ইগ্রাম-জুরি সড়কের কাঙ্গলিঘাট ব্রিজ

বিস্ফোরক দিয়ে ধ্বংস করে দেয়।

 

২৯ জুন ’৭১ বিয়ানীবাজার

সুবেদার আব্দুল আজিজ এর নেতৃত্বে ৬ জন সৈনিকের দল বিয়ানীবাজারের আসাদুর আলীর বাড়িতে অভিযান চালিয়ে পাকবাহিনীকে সহায়তা করার অভিযোগে টার দুই ছেলে শফিকউদ্দিন ও শামসুদ্দিনকে গ্রেফতার করে। জিজ্ঞাসাবাদে এরা নির্দোষ বিবেচিত হওয়ায় এদেরকে স্বেচ্ছায় মুক্তিবাহিনী হিসাবে ট্রেনিং নেওয়ার জন্য করিমগঞ্জ ট্র্যানজিট ক্যাম্পে পাঠান হল।

 

৩০ জুন ’৭১ বড়গ্রাম

আমাদের প্রায় ৩০ জনের একটা দল ০৩০০ টার দিকে বড়গ্রাম এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৪ জন পাক সেনাকে নিহত করেছে।

 

১ জুলাই ’৭১ শেওলাঘাট

হাবিলদার আরিশের নেতৃত্বে ১৫ জন সৈনিককে কাকড়দি গ্রামের কাছে শেওলা ফেরী ধ্বংসের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হল। পথে তারা পাক  মবুশের শিকার হয়, এবং দুই পক্ষের গোলাগুলিতে ঘটনাস্থলেই ল্যান্স নায়েক ফজল হোসেন নিহত হন। শত্রুদের ৩/৪ জনকে হতাহত করার পাশাপাশি ১০০ রাউন্ড গুলি সহ শত্রুর একটি এলএমজি আমাদের হস্তগত হয়।

 

১ জুলাই ’৭১ শাবাজপুর

শাবাজপুর এবং বড়লেখা স্টেশনের মধ্যস্থ রেল লাইনে মাইন পাতার জন্য গাইড আরিজউদ্দিন এবং ২ জন সৈনিক সহ একদল ছাত্র আশরাফুজ্জামানের নেতৃত্বে বড়লেখা এলাকায় যায় রাত ১১:৩০ এর

দিকে, কিন্তু শত্রুরা আগেই ওখানে অ্যান্টি পার্সোনাল মাইন পেতে রাখায় তারা ব্যর্থ হয়।

 

২ জুলাই ’৭১

০২০০ ঘটিকা

জলঢুপ

বড়ইগ্রাম-লাতু সড়কে মাইন পাতার জন্য হাবিলদা কুতুবুদ্দিনের নেতৃত্বে ১৫ জন সৈনিক এবং একদল ছাত্র জলঢুপের দিকে রওনা দেয় কিন্তু নদী পারাপারের জন্য নৌকা না পাওয়ায় তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

 

২ জুলাই ’৭১ জলঢুপ

আব্দুল মিয়া নামে একজন পাক সিপাইকে গ্রেফতারের পর বিএসজি মহিশাশনের হাতে তুলে দেয়া হয়।

 

৩ জুলাই ’৭১

১৯৩০ ঘটিকা

জলঢুপ

সুবেদার আব্দুল আজিজের নেতৃত্বে ১৫ জন সৈনিকের ডেমোলিশন পার্টি জলঢুপে গিয়ে জলঢুপ থানা বাজারের কাছে বড়ইগ্রাম-লাতু সড়কে তিনটি মাই পেতে রাখে। পরের দিন সকালে শত্রুরা সে মাইন সরিয়ে ফেলে বলে খবর পাওয়া গেছে।

 

৪ জুলাই ’৭১ অমলশিদ

ক্যাপ্টেন এম এ রবের নেতৃত্বে ৪০জন জেসিও/সৈনিকের প্রহরায় আশরাফুজ্জামানের নেতৃত্বে থাকা একদল ছাত্র অমলশিদ বিওপি এলাকায় গিয়ে রাত ৩ টার দিকে রহিমপুর সেতু বিস্ফোরক দিয়ে ধ্বংস করে দেয় এবং সেতু প্রহরারত রাজাকারদের কাছ থেকে দুটো থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ছিনিয়ে নেয়।

 

০৬ জুলাই ’৭১

০৫০০ ঘটিকা

 

সুবেদার আব্দুল আজিজ এবং সিপাই হাবিব আলি (দুজনই পুলিশ সদস্য) ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে গেলো।

 

০৬ জুলাই ’৭১ বিয়ানীবাজার

চারজন সৈনিকের সহযোগিতায় এক দল ছাত্র বিয়ানীবাজার এলাকায় মাইন পেতে রাখার জন্য গিয়েছিল, কিন্তু শত্রুর ভারী গুলিবর্ষনের কারনে তারা ব্যর্থ হয়।

 

৭ জুলাই ’৭১

২২০০ ঘটিকা

শাবাজপুর

হাবিলদার আব্দুল কাইউমের নেতৃত্বে চার জন সৈনিকের ডেমলিশন পার্টি রাত ১০টার দিকে শাবাজপুর এলাকায় সেতু ধ্বংস করতে যায়, তবে পাক বাহিনীর উপস্থিতির জন্য তারা সফল হতে পারেনি।

 

৭ জুলাই ’৭১ বড়গ্রাম

বড়গ্রাম গ্রামে, বড়গ্রাম স্কুলে শত্রু অবস্থানের থেকে ৩০০ গজ দূরে আজ একদল স্নাইপার অবস্থান নিয়েছিল ১৫৩০ ঘটিকায়। তারা গুলি করে ৩ জন শত্রু সেনা হত্যা করতে সক্ষম হয়। আমাদের তরফে কেউ আহত হয়নি।

 

৮ জুলাই ’৭১

০৫০০ টা

শাবাজপুর

দুপুর ৩ টার দিকে শাবাজপুর রেল স্টেশনে শত্রু অবস্থানের থেকে ৫০০ গজ উত্তরে বালিয়াটিলাতে আমাদের ৬ জন সৈনিকের একটা দল অবস্থান নেয়। তারা শত্রুর উপর গুলিবর্ষণ করে। শত্রু ২” মর্টার ও মেশিনগান দিয়ে পাল্টা আক্রমন করে। শত্রুদের ৭ জন হতাহত হয়েছে, আমাদের কেউ আহত হয়নি।

 

৯ জুলাই ’৭১

০৪০০ টা

বড়গ্রাম

ক্যাপ্টেন এমে রবের নেতৃত্বে আমাদের ২৪ জন সৈনিকের একটা দল ভোর ৪ টার দিকে বড়গ্রাম এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২ জন শত্রু সেনা হত্যা করেছে।

 

১১ জুলাই ’৭১

০১৩০ টা

বড়লেখা

রাত দেড়টার দিকে লাতু-বড়লেখা সড়কের পাবনিয়া সেতু (জিআর ৪৭৫৫৫৪, ৮৩ ডি/আই) সম্পুর্নভাবে বিধ্বস্ত করে দেয় আমাদের ডেমোলিশন পার্টি।

 

১১ জুলাই ’৭১ বড়গ্রাম

বড়লেখা, লাতু এবং বড়গ্রামের দিকে তিনটি দল পাঠানো হল। তারা শত্রু অবস্থানের উপর ২” মর্টার এবং ক্ষুদ্র অস্ত্র দিয়ে হামলা করে। শত্রুপক্ষ লাতুতে ৩” মর্টার এবং মেশিনগান দিয়ে জবাব দেয়,

অন্যদিকে বড়গ্রামে তারা শুধু মেশিনগান এবং ক্ষুদ্র অস্ত্র দিয়ে পালটা হামলা করে। শত্রুপক্ষের কয়জন হতাহত হয়েছে জানা যায়নি। আমাদের পক্ষে কেউ আহত হয়নি।

 

১০ জুলাই ’৭১ শাবাজপুর

হাবিলদার ময়নার নেতৃত্বে ১২ জনের একটা ডেমোলিশন পার্টি শাবাজপুর রেল স্টেশনের আধা মাইল দক্ষিনে অবস্থিত নান্দুয়া সেতু ধ্বংস করার লক্ষ্যে যায়, কিন্তু শত্রুর কড়া পাহারার কারনে ব্যর্থ হয়। সৈনিকরা সবাই নিরাপদে ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছে।

 

১১ জুলাই ’৭১ শাবাজপুর

ক্যাপ্টেন এম এ রবের নেতৃত্বে এক প্লাটুন সৈনিকের ছত্রছায়ায় আজ একদল ছাত্র শাবাজপুর-বড়লেখা সড়কের দিকে যায়। এদিন সেখানে শত্রুর অবস্থান ছিল না। ফিরে আসার আগে তারা রাস্তায় তিনটা মাইন স্থাপন করে আসে। তার ফলাফল এখনও জানা যায়নি।

 

১২ জুলাই ’৭১

২৩০০ টা

বড়গ্রাম

শত্রুপক্ষকে উত্যক্ত করার উদ্দেশ্যে বড়গ্রাম এলাকাতে ২” মর্টার দিয়ে শত্রু অবস্থানের উপর গোলাবর্ষন করা হয়। শত্রুপক্ষ মাঝারি ও হালকা মেশিনগান দিয়ে পালটা জবাব দেয়। শত্রুপক্ষের হতাহতের খবর জানা যায়নি।

 

১২ জুলাই ’৭১

০০৩০ টা

শাবাজপুর

হাবিলদার ময়না মিয়ার নেতৃত্বে আরেকটি দল রাত ১২:৩০ টার দিকে শাবাজপুর রেল স্টেশনে শত্রু অবস্থানের উপর ২” মর্টার দিয়ে হামলা করে ২ জন পাক সেনাকে হত্যা করে।

 

১৩ জুলাই ’৭১

০০২০ টা

শাবাজপুর

মাইন পাতার জন্য আশরাফুজ্জামানের নেতৃত্বে একটি দল শাবাজপুর এলাকার নান্দুয়া গ্রামের দিকে যায়, কিন্তু প্রতিকুল অবস্থার কারনে ব্যর্থ হয়। ১১ জুলাই ধ্বংস করে দেয়া পাবনিয়া সেতু পার হতে

গিয়ে একজন শত্রুসেনার নিহত হবার খবর পাওয়া গেছে।

 

১৩ জুলাই ’৭১ শাবাজপুর লাতু এবং বড়লেখার মধ্যে টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করার জন্য শাবাজপুর এলাকায় একটি দল যায় এবং ২০০০ গজ তার কেটে নিয়ে আসে।

১৪ জুলাই ’৭১

০০৩০ টা

শাবাজপুর

হাবিলদার আরিশ আলির নেতৃত্বে ২৫ জনের একটি দল শত্রুপক্ষকে উত্যক্ত করার উদ্দেশ্যে রাত তিনটার দিকে শাবাজপুর রেল স্টেশনে হামলা করে। তারা ২” মর্টার এবং এলএমজি দিয়ে শত্রুর বাঙ্কারের

উপর গোলাগুলি করে। শত্রুও তাৎক্ষণিক ভাবে ২” মর্টার এবং মাঝারি মেশিনগান দিয়ে জবাব দেয়। ৫ মিনিট পর তারা ৩” মর্ট্র দিয়েও ৫ রাউন্ড গোলা ছুড়ে। হামলার ফলে আগুন লেগে স্টেশন ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

 

১৫ জুলাই ’৭১

০৫০০ টা

শাবাজপুর

নায়েক মোহাম্মদ ইলিয়াসের নেতৃত্বে এক সেকশন সৈনিককে অ্যামবুশ পার্টি হিসাবে শাবাজপুর পাঠান হয়। আনুমানিক ভোর ৫ টার দিকে তারা এক প্লাটুন শত্রু সেনাকে তাদের সামনে দিয়ে যেতে দেখে। শত্রুসেনারা অস্ত্রবিহীন অবস্থার শারীরিক কসরত করছিল।

 

১৫ জুলাই ’৭১

০৫০০ টা

শাবাজপুর

তারা ২০০ গজের মধ্যে চলে এলে এলএমজি এবং রাইফেল দিয়ে তাদের উপর হামলা করা হয়। হতচকিত শত্রুপক্ষের আনুমানিক ২০ জন নিহত হয়, ৯ জনের মৃতদেহ সূর্যাস্ত পর্যন্ত সেখানেই পড়ে ছিল। এছাড়াও শত্রুপক্ষের অনেককে বিভিন্ন রকম আঘাত নিয়ে অন্যদের সহায়তায় পালিয়ে যেতে দেখা গেছে।

 

১৫ জুলাই ’৭১ শাবাজপুর

আমাদের ৩” মর্টার সেকশন কুমারসাইল চা বাগানের ডান দিক থেকে শত্রুর প্রধান অবস্থান শাবাজপুর রেলওয়ে গুদামের উপর ১৪টি গোলাবর্ষন করে সকাল ৮:৩০ এ। রেল স্টেশনে গোলা পড়তে ও ধোঁয়া বের হতে দেখা গেছে। ক্ষয়ক্ষতির হিসাব এখনো আসেনি। শত্রু ৩” মর্টার দিয়ে আমাদের উপর ৭ রাউন্ড গোলাবর্ষন করে। আমাদের কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

 

১৬ জুলাই ’৭১

০৪০০ টা

বড়গ্রাম

শত্রুকে উত্যক্ত করার জন্য ভোর চারটার দিকে শাবাজপুর রেল স্টেশনে শত্রু অবস্থানের উপর ২” মর্টার এবং এলএমজি দিয়ে হামলা করা হয়। শত্রু মাঝারি মেশিনগান এবং রাইফেলের গুলিতে জবাব

দেয়। শত্রুর ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা যায়নি, আমাদের কোন ক্ষতি হয়নি।

১৬ জুলাই ’৭১ পাল্লাথাল

পাল্লাথাল চা বাগান এলাকায় একটি অ্যামবুশ পার্টি গেল, কিন্তু হত্রু পক্ষের টহলদল সেখানে এলোনা।

 

১৬ জুলাই ’৭১ পাল্লাপুঞ্জি লাতু এবং বড়লেখার মধ্যকার রেললাইন ধ্বংস করার জন্য একটি ডেমোলিশন পার্টি পাঠানো হয়। ভোর ৫টায় শত্রুর চোখে আমাদের দলটি ধরা পরে যায় এবং জায়গামত পৌঁছানর আগেই শত্রুর এলএমজি এবং রাইফেলের গুলির সম্মুখীন হয়। আমাদের দল পালটা গুলি করে। স্থানীয় লোকদের বরাতে দুইজন শত্রু সেনা আহত হবার খবর পাওয়া গেছে।

১৭ জুলাই ’৭১

২৩০০ টা

চানারু ঘাট

শত্রুর ভারী গুলিবর্ষনের মধ্যেই একটি ডেমোলিশন পার্টি রেললাইন ধ্বংস করতে যায়। আমাদের দলটি চারগ্রাম নামের গ্রামের কাছে পৌঁছে (এস কিউ৪৬৫৫) এবং সফলভাবে কয়েক স্থানে রেললাইন উড়িয়ে দেয় এবং লাতু-বড়লেখার প্রধান সড়কে ১০টি প্লাস্টিক মাইনও পেতে আসে। কোন ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই আমাদের দল ফিরে এসেছে।

 

১৭ জুলাই ’৭১ শাবাজপুর

ভোর চারটায় দুটি শত্রু উত্যক্তকারী দল ২” মর্টার আর সাব মেশিনগান নিয়ে শাবাজপুরে যায় এবং সফল ভাবে লাতু বিওপি (পাকিস্তানি) আক্রমণ করে ১২ রাউন্ড ২” মর্টারের গোলাবর্ষন করে। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা যায়নি।

 

১৮ জুলাই ’৭১

০৪৩০ টা

বড়গ্রাম

বড়গ্রাম এলাকায় শত্রু উত্যক্তকারী দল গিয়ে ২” মর্টার দিয়ে বড়গ্রাম স্কুলের মোড়ে কাছে শত্রু অবস্থানের ওপর গোলাবর্ষন করে ভোর ৪:৩০ এর দিকে। শত্রু তাৎক্ষণিকভাবে মাঝারি ও হালকা মেশিনগান দিয়ে পাল্টা আক্রমন করে। জবাবে আমাদের সৈনিকরা এলএমজি ও রাইফেল দিলে গুলিবর্ষন করে তিন জন শত্রুসেনাকে গুরুতর আহত

করেছে।

১৯ জুলাই ৭১

০৯৩০ টা

শাবাজপুর

আমাদের ৩” মর্টারবাহী দল কুমারসাইল চা বাগান থেকে শাবাজপুর রেল স্টেশনে শত্রু অবস্থানের উপর ২৪ রাউন্ড গোলাবর্ষন করে সকাল ৯:৩০ এ। শত্রুও ৩” মর্টারের ৪ রাউন্ড গোলা ছুঁড়ে। আমাদের আক্রমনে শত্রুদের ৪ জন নিহত এবং ২ জন আহত হয়েছে। রেল স্টেশনের কাছে দুটো ছোট বাড়িতে আগুন ধরে গিয়েছে। কোন ক্ষতি ছাড়াই আমাদের দল ফিরে এসেছে।

 

২০ জুলাই ’৭১

০৪২০ টা

বড়গ্রাম

হাবিলদার শামসুল হকের নেতৃত্বে একটি টহলদল ২” মর্টার নিয়ে বড়গ্রাম বিওপি এলাকায় অভিযানে যায় এবং শত্রুর উপর গোলাবর্ষন করে। শত্রুও বিওপি এর পেছনদিক এবং স্কুল এলাকা থেকে হালকা ও মাঝারি মেশিনগানের গুলিতে পাল্টা জবাব দেয়। এছাড়াও শত্রুরা ১২০ মিমি মর্টারের বেশি কিছু গোলা আমাদের উপর বর্ষন করে। শত্রুর ক্ষয়ক্ষতি অজানা। আমাদের ক্ষতি শুন্য।

 

২০ জুলাই ’৭১ বড়গ্রাম

স্থানীয় সুত্রে জানা গেছে যে আমাদের ১৭ তারিখে পেতে রাখা প্লাস্টিক মাইনের বিস্ফোরণে ৩ জন শত্রুসেনা গুরুতর আহত হয়েছে।

 

২৫ জুলাই ’৭১

১২০০ টা

শাবাজপুর

২৫ তারিখ রাত ১২ টার দিকে আমরা পাচটি দলে ভাগ হয়ে শাবাজপুর রেল স্টেশন আক্রমন করলাম। আরো দুটি দলকে পাঠানো হল বড়লেখা আর কাঙ্গলি সড়কে মাইন পেতে শত্রুর পশ্চাদপসারন অথবা রিইনফোর্সমেন্ট ঠেকানোর জন্য। আমরা দুপুর  ১ টার দিকে শত্রুর বিওপি আক্রমন করে ওদের পতাকা ছিনিয়ে নিয়ে আসি। শত্রু পক্ষে ২০ জন মারা গেছে। আমাদের পক্ষে চার জন মারা গেছে, কয়েকজন আহত হলেও বাকি সবাই ফিরে এসেছে।

 

২৭ জুলাই ’৭১

১২০০ টা

শাবাজপুর

দুটি দল শত্রুকে উতক্ত করতে লাতু রেল স্টেশনে গিয়েছিল। সারারাত ধরে থেকে থেকে গুলি করে গেছে আমাদের সেনারা। শত্রুর বাঙ্কার পাহারার দায়িত্বে থাকা দুজন রাজাকার নিহত হয়েছে। সেনারা নিরাপদে ফিরে এসেছে।

 

২৮ জুলাই ’৭১

২১৩০ টা

পাল্লাথাল

পাল্লাথাল চা বাগান এলাকায় একটি অ্যামবুশ পার্টি পাঠানো হয়েছিল। তারা আর ফেরত আসেনি। নতুন সেনাদের সাথে প্রশিক্ষনরত আমাদের ৯০ জন সেনার একটি দল এর পরের পক্ষে পাঠানো হল।

 

৩১ জুলাই ’৭১

০৪০০ টা

কেরামতনগর

১৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল কেরামতনগর টিজি তে হামলা করতে যায়। একটি বিল্ডিং ধ্বংস করার পাশাপাশি ৭ জন শত্রু হত্যা করতে সক্ষম হয় তারা। আমাদের ক্ষয়ক্ষতি শুন্য।

 

১ আগস্ট ’৭১ শাবাজপুর

শাবাজপুর রেল স্টেশনে একটি দল গিয়েছিল। তারা

শত্রুকে উত্যক্ত করার লক্ষ্যে ২” মর্টার দিয়ে গোলাবর্ষন করে। শত্রু খুব দ্রুততার সাথে জোরালভাবে পাল্টা জবাব দেয় ৩” মর্টার এবং মাঝারি মেশিনগান দিয়ে। আমাদের দল এলএমজি এবং রাইফেলের গুলিতে পাল্টা জবাব দেয়। শত্রুপক্ষে হতাহতের খবর জানা যায়নি। আমাদের ক্ষয়ক্ষতি শুন্য।

 

১ আগস্ট ’৭১ শাবাজপুর

সকাল ৯ টার দিকে শাবাজপুর বিওপি এলাকায়

বাঙ্কার বানানোর সময় পাকবাহিনী এবং রাজাকারদের উপর ৬ রাউন্ড ৩” মর্টারের গোলা সফলভাবে বর্ষন করা হয়। শত্রু ঝড়ের গতিতে পালিয়ে যায় এবং এখনও ফেরত আসেনি। এই পদ্ধতি চালু রাখা হয়।

 

১ আগস্ট ’৭১ শাবাজপুর

নিম্নলিখিত অভিযান পরিচালনার জন্য গেরিলাদের

(বাংলাদেশের) ভেতরে পাঠানো হয়: ১/ চারজন মুক্তিযোদ্ধার একটি দলকে বিস্ফোরকসহ সিলেট শহরের আড়াই মাইল পুর্বে গোটা টিকার নামের এক স্থানে পাঠানো হল ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানার দিকে যাওয়া গ্যাস পাইপলাইন ধ্বংস করার জন্য। ২/ গ্রেনেড সাথে দিয়ে দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে সিলেট শহরে রাতে পাকবাহিনীর চলাচলের সময় তাদের ওপর গ্রেনেড হামলা করার জন্য পাঠানো হল। ৩/ দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে গ্রেনেড সাথে দিয়ে চারকাই পাঠানো  হল পোস্টঅফিস আর টেলিফোন অফিস ধ্বংস করার জন্য। ৪/ দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে গ্রেনেড সাথে দিয়ে গোলাপগঞ্জ পাঠানো  হল পোস্টঅফিস আর টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ধ্বংস করার জন্য। ৫/ চারজন মুক্তিযোদ্ধাকে পেক-১ (বিস্ফোরক) সাথে দিয়ে মংলা বাজারে পিলার ধ্বংস করার জন্য পাঠানো হল।

 

২ আগস্ট ’৭১

০২০০ টা

পাবনিয়া ব্রিজ

মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল বড়লেখা এবং শাবাজপুরের

মধ্যস্থ পাবনিয়া সেতু (GR476554) ধ্বংস করার জন্য পাঠানো হয়। দলটি সফলভাবে সেতুটি সম্পুর্নভাবে ধ্বংস করে ফিরে আসে। সেতু ধ্বংস করার সময়ে তাদের উপর শত্রুর গুলিবর্ষন চলছিল। এই সেতুটি আগেঅ একবার ধ্বংস করা হয়েছিল, তবে পাক সেনারা সেটা আবার মেরামত করে নিয়েছিল।

 

২ আগস্ট ’৭১

১০০০ টা

শাবাজপুর

আমরা ১২ রাউন্ড ৩” মর্টারের গোলা বর্ষন করি

শাবাজপুর রেল স্টেশনের উপর। একজন রাজাকার নিহত হবার পাশাপাশি দুইজন পাকসেনা এবং দুজন রাজাকার গুরুতর আহত হয়েছে বলে জানা গেছে।

 

৩ আগস্ট ’৭১

০১৪৫ টা

কাংলি

এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা কাংলি ফেরী ধ্বংস করতে এবং

এর পাহারায় থাকা রাজাকারদের উপর হামলা করতে যায়। রাত ১:৪৫ এর দিকে আমরা হামলা করে একটি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ছিনিয়ে নেই। বিস্ফোরকের মাধ্যমে নতুন ফেরীটা ধ্বংস করে ডুবিয়ে দেয়া হয়। আমাদের ক্ষয়ক্ষতি শুন্য।

 

৩ আগস্ট ’৭১

০১৪৫ টা

শাবাজপুর

শাবাজপুর রেল স্টেশন এবং গুদামের উপর ২৪ রাউন্ড

২” মর্টারের গোলাবর্ষন করে শত্রুকে উত্যক্ত করে আমাদের জিটার পার্টি। শত্রুর ক্ষয়ক্ষতি জানা যায়নি। আমাদের ক্ষয়ক্ষতি শুন্য।

 

৩ আগস্ট ’৭১ বিয়ানীবাজার

আরেকটি শত্রু উত্যক্তকারি দল বিয়ানীবাজারে পাঠান

হয়। তারা টার্গেটে পৌঁছানর আগেই রাজাকাররা তাদের উপর গুলি করে। আমাদের দলটি পাল্টা গুলি করে রাজাকারদের তাড়িয়ে দেয়।

 

৩ আগস্ট ’৭১

২২০০ টা

বড়লেখা

বড়লেখা সড়কে অ্যান্টিপার্সোনাল মাইন বসানর জন্য একটি

দলকে পাঠানো হয়। তারা ১৬ টি মাইন স্থাপন করে ফিরে আসে। বড়লেখায় পাকিস্তান সমর্থকদের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। একজন পাকিস্তান সমর্থকের বাসা থেকে একটি অস্ত্রও উদ্ধার করা হয়।

 

৪ আগস্ট ’৭১ পাল্লাথাল

পাল্লাথাল চা বাগান সড়কে আমাদের একটি অ্যামবুশ পার্টি পাঠানো হয়েছিল। তারা অগ্রসরমান পাক সেনাদের একটি টহল দলের উপর গুলিবর্ষন করে। শত্রু পালিয়ে যাবার সময় ৩টি এলএমজি ম্যাগাজিন এবং ২৫০ রাউন্ড থ্রি-নট-থ্রির গুলি ফেলে যায়।

 

৫ আগস্ট ’৭১ ছোটলেখা

বড়লেখা ঘাটি থেকে একটি উত্যক্তকারি দল ছোটলেখাতে যায়। তারা পাকবাহিনীর উপর ২” মর্টার দিয়ে হামলা করে। শত্রু হালকা অ মাঝারি মেশিনগান দিয়ে পাল্টা গুলি করে।

 

৭ আগস্ট ’৭১

(০৩০০)

শাবাজপুর

আমাদের ৩” মর্টার সেকশন শাবাজপুর রেল স্টেশনের উপর ১২ রাউন্ড গোলাবর্ষন করে। বাঙ্কারে থাকা ৩ জন পাক সেনা নিহত হবার পাশাপাশি দুটি বাঙ্কারও ধ্বংস হয়েছে।

 

৭ আগস্ট ’৭১ পাল্লাথাল অগ্রসরমান পাকসেনাদের একটি টহল দলের উপর আমাদের অ্যামবুশ পার্টি হামলা করে পাল্লাথাল চা বাগান এলাকায়। এতে একজন পাকসেনা ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। পালিয়ে যাবার সময় তারা চারটি এলএমজি ম্যাগাজিন এবং ৮০ রাউন্ড থ্রি-নট-থ্রির গুলি ফেলে যায়।
৭ আগস্ট ’৭১ পাল্লাথাল

আমাদের একটি টহলদলকে পাকিস্তানিরা ধরে ফেলে। আমাদের রিইনফোর্সমেন্ট দ্রুত সেখানে যায় এবং আমাদের সেনাদের মুক্ত করে নিয়ে আসে। ৩” মর্টার এবং এলএমজি দিয়ে তাদের কাভারিং ফায়ার দেয়া হয়। শত্রু ৩” মর্টার ছাড়াও হালকা ও মাঝারি মেশিনগান দিয়ে পাল্টা জবাব দেয়। শত্রুর ক্ষয়ক্ষতির অবস্থা জানা যায়নি। আমাদের দুজন আহত হয়েছে।

 

৮ আগস্ট ’৭১ গোলাপগঞ্জ

দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে গ্রেনেড দিয়ে পাঠানো হয়েছিল গোলাপগঞ্জের পোস্ট অফিস এবং টেলিফোন অফিস ধ্বংস করার জন্য। তারা পোস্ট এবং টেলিফোন অফিস ধ্বংস করে দিয়েছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা পালিয়ে যাবার সময় রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েছে।

 

১৩ আগস্ট ’৭১ সুতারকান্দি

৩০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দলকে সুতারকান্দি পাঠানো হয়। তারা ৩” মর্টারের গোলা বর্ষন করে। শত্রু হালকা ও মাঝারি মেশিনগান দিয়ে পাল্টা জবাব দেয়। শত্রুর ক্ষতির পরিমান জানা যায়নি। আমাদের ক্ষয়ক্ষতি শুন্য।

 

১৩ আগস্ট ’৭১ (০০০১টা) সুতারকান্দি

আমাদের ৩” মর্টার সেকশনকে বড়গ্রামে পাঠানো হয় জনপুর/বড়গ্রামে গোলাবর্ষন করার জন্য। সুজনপুরে আমাদের ৩” মর্টারের হামলায় ৩জন নিহত, ৫ জন আহত হবার পাশাপাশি ৪ জন বেসামরিক লোক আহত হয়েছে। আমাদের ক্ষয়ক্ষতি শুন্য।

 

১৩ আগস্ট ‘৭১ (২০০০ টা ) কাংলি ঘাট

৫০ জনের একটা দলকে কাংলি ঘাটে ফেরী ধ্বংস করতে পাঠানো হয়। তারা সেখানে পৌঁছে ফেরী দেখতে পায়নি, তবে এই কাজে ব্যবহৃত দুটি বড় নৌকা দেখতে পেয়ে সেগুলোকে ধ্বংস করে নিরাপদে ফিরে আসে।

 

১৩ আগস্ট ’৭১ (০০০১টা) কোনাগাঁও

৩০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটা দল কোনাগাঁও এর চেয়ারম্যানের অফিসে হামলা করতে যায়। কিন্তু আমাদের দল সেখানে পৌঁছানর আগেই শত্রুদল পালিয়ে যায়।

 

১৪ আগস্ট ’৭১ (২২০০ টা) বড়লেখা রেলসেতু

৫৫ জনের একটি দলকে পাঠানো হয় বড়লেখা এবং লাতুর মধ্যস্ত রেল সেতু ধ্বংস করার জন্য। শত্রুর গোলাগুলির মধ্যেই তারা সেখানে পৌঁছে এবং সেতু পাহারায় থাকা রাজাকারদের আক্রমন করে। এক জন রাজাকার নিহত হয়েছে। আমাদের একজন আহত হয়েছে। চারদিক থেকে শত্রুর অবিরাম গুলিবর্ষনের কারনে ডেমোলিশন পার্টি টার্গেটে পৌঁছুতে পারেনি।

 

১৪ আগস্ট ’৭১ (০০০১টা) বিয়ানীবাজার

৩০ জন মুক্তিফৌজের একটি দল বিয়ানীবাজারে পাঠানো হয়েছিল। তারা পথে একদল রাজাকারের দেখা পায়। আমাদের দল তাদের উপর গুলিবর্ষন করে দুজন রাজাকার হত্যা করে। আমাদের কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

 

১৪ আগস্ট ’৭১ শাবাজপুর

১২ জন মুক্তিযোদ্ধাকে অ্যান্টি পার্সোনাল মাইন পাতার জন্য শাবাজপুর পাঠানো হয়েছিল। তারা শত্রুর চলাচলের পথে ২০ টি এম-১৪ মাইন পেতে রেখে এসেছে।

 

১৪ আগস্ট ’৭১ (০৭০০টা) বড়লেখা

৪টি অ্যান্টি পার্সোনাল মাইন এবং প্রত্যেককে ২ টি করে গ্রেনেড দিয়ে ৭ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বড়লেখাতে পাঠানো হল ভীতি সৃষ্টি করার জন্য।

 

১৪ আগস্ট ’৭১ (১৭০০ টা) সিলেটের নিকট

প্রত্যেককে গ্রেনেড এবং ৮ পাউন্ড বিস্ফোরক দিয়ে গতাতিকার (সিলেটের কাছে) পাঠান হল গ্যাস পাইপলাইন উড়িয়ে দেওয়ার জন্য।

 

১৪ আগস্ট ’৭১ সিলেট

সিলেটে বিদ্যুৎ পরিবহনের খুঁটি ধ্বংস করার জন্য ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা পাঠানো হল। প্রত্যেককে একটি করে গ্রেনেড আর ৮ পাউন্ড বিস্ফোরক দেয়া হল।

 

১৪ আগস্ট ’৭১ (১৮০০ টা) চারখড়ি

২ জন মুক্তিযোদ্ধা প্রত্যেকে ২ টি করে গ্রেনেড নিয়ে চারখড়ি পোস্ট অফিস এবং টেলিফোন অফিস ধ্বংস করতে গেল।

 

১৪ আগস্ট ’৭১ সিলেট

জনমনে ভীতি সঞ্চার করার লক্ষ্যে ২ টি করে গ্রেনেড সাথে নিয়ে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা সিলেটে গেল।

 

১৭ আগস্ট ’৭১ লাতু

১২০জন মুক্তিযোদ্ধার এবং ৪০ জন গণবাহিনীর একটা দল আজকে চারগ্রাম রেল সেতু ধ্বংস করার লক্ষ্যে পাঠানো হয়। কিন্তু শত্রুপক্ষের ব্যাপক প্রতিরোধের কারনে তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে।

 

১৮ আগস্ট ’৭১ (২২০০টা) চারগ্রাম রেলসেতু

১৫০জন মুক্তিযোদ্ধার এবং ৬০ জন গণবাহিনীর একটা দলকে চারগ্রাম রেল সেতু ধ্বংস করার লক্ষ্যে পাঠানো হয়। শত্রুর ব্যাপক প্রতিরক্ষার চেষ্টা সত্বেও তারা সেতুটিকে সম্পুর্নভাবে ধ্বংস করে দেন। আমাদের ক্ষয়ক্ষতি শুন্য।

 

১৮ আগস্ট ’৭১ (০০০১টা) সুতারকান্দি

সুতারকান্দিতে আমাদের শত্রু উত্যক্তকারি দল ২” মর্টার আর এলএমজি দিয়ে গোলাগুলি করে। জবাবে শত্রুপক্ষ ৩” মর্টারের ৬ রাউন্ড গোলা বর্ষনের পাশাপাশি মাঝারি ও হালকা মেশিনগানের গুলি চালায়। শত্রু পক্ষের হতাহতের খবর জানা যায়নি। আমাদের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

 

১৬ আগস্ট ’৭১ (০৪৩০টা) বঘা

১১ জন মুক্তিযোদ্ধাকে অ্যান্টি পার্সোনাল মাইন পাতার জন্য একটি নদীর ধারে পাঠানো হয়, যেখানে শত্রুর দল আখ নিতে আসে বলে জানা গেছে। সেই মাইন বিস্ফোরণে এক জন পাক সেনার গুরুতর আহত হবার সংবাদ পাওয়া গেছে।

 

১৬ আগস্ট ’৭১ ছোটলেখা চাবাগান

৩০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল ছোটলেখা চা বাগানে অ্যামবুশ করে। তারা অগ্রসরমান পাকিস্তানই সেনা ও রাজাকারদের উপর এলএমজি ও রাইফেল দিয়ে গুলিবর্ষন করে। এতে ২ জন রাজাকার ও একজন পাক সেনা আহত হয়। পাকিস্তানি সেনাদের তথ্যদিয়ে সহায়তাকারী দুজনকে ধরে জিজ্ঞাসাবাদের পরে হত্যা করা হয়। শত্রুরা তাদের আহতদেরকে নিয়ে পালিয়ে যায়।

 

১৮ আগস্ট ’৭১ (২০০০টা) সিলেট শহর

সিলেট শহরে পাকিস্তনাই সেনা হত্যা করার জন্য দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে পাঠানো হয়। রাত ৮ টার দিকে তারা কদমতলা জালোপাড়ার কাছে একটি সামরিক জিপকে আসতে দেখে। তারা সেই জিপে দুটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে যার ফলে ঘটনাস্থলেই একজন পাকিস্তানি অফিসার, ২ জন সেনা এবং ২ জন স্থানীয় দালাল নিহত হয়। আমাদের যোদ্ধারা নিরাপদে ফিরে এসেছে।

 

১৯ আগস্ট ’৭১ (০২৩০টা) ছোটলেখা

৫০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটা দলকে শত্রুকে উত্যক্ত করতে ছোটলেখা চা বাগানে পাঠানো হয়। তারা রাত ২:৩০ এর দিকে দুই দিক থেকে ২” মর্টার এবং এলএমজি দিয়ে আক্রমন করে। শত্রুপক্ষ চরম ভয় পেয়ে গিয়ে এলোপাথারি গোলাগুলি করতে থাকে। পরে জানা গেছে যে তাদের নিজের গুলিতেই শত্রুদের অনেকে আহত হয়েছে।

 

১৯ আগস্ট ’৭১ লাতু সড়ক ২০ জন মুক্তিফৌজকে অ্যামবুশ করার জন্য পাঠানো হল লাতু এবং বড়লেখার মধ্যের রাস্তায়। শত্রুদল সেদিন এ পথে এলো না।
১৯ আগস্ট ’৭১ (০৪৩০টা) শাবাজপুর

৩০ জনের একটা জিটার পার্টি পাঠানো হল শাবাজপুর রেল স্টেশনে। আমাদের দল শত্রুর দিকে গুলি ছুঁড়ল। শত্রু মাঝারি মেশিনগান আর ২” মর্টারের গোলা দিয়ে পাল্টা জবাব দেয়।

 

১৯ আগস্ট ’৭১ (০১৩০টা) সুতারকান্দি

গয়লাপুর গ্রামে অভিযান চালাতে ৩৪ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল গেল। শত্রু অবস্থানের ডান দিক দিয়ে আমাদের দল আক্রমন করে, কিন্তু ধরা পড়ার আগেই শত্রুদল পালিয়ে যায়। তারপরেও দুজন পাকিস্তানি দালালকে গ্রেফতার এবং হত্যা করা হয়। এক জন পাকিস্তানি সেনা আহতও হয়েছে। একটি ওয়ান ব্যান্ড ট্রাঞ্জিস্টর বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।

 

২০ আগস্ট ’৭১ লাতু সড়ক

আমাদের একটি দল লাতু-বড়লেখা সড়কে অ্যামবুশ পেতে বসে ছিল। রাজাকারদের একটি দলকে দেখে তারা গুলি চালায়। হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

 

২০ আগস্ট ’৭১ বাংলাদেশ

গ্রেনেড এবং অ্যান্টি পার্সোনাল মাইন নিয়ে ৪৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বাংলাদেশের ভেতর পাঠানো হল। এদের মধ্যে একটা দল ঢাকার দক্ষিন অঞ্চলে একটি গুপ্ত ঘাঁটি স্থাপন করার চেষ্টা করবে।

 

২০ আগস্ট ’৭১ (০১৩০টা) তালু খাল

৭০ জন মুক্তিসেনার একটা দলকে তালু খাল এলাকায় পাঠানো হয় বাধ উড়িয়ে দেবার জন্য। বিস্ফোরক দিয়ে তারা সে বাধ ধ্বংস করে দেয়। বাধ ধ্বংস করে দেবার ফলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ২০ থেকে ৪০ মাইল এলাকা এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

 

২১ আগস্ট ’৭১ (০৪৩০টা) ভঞ্জ

অমলশিদে ২ প্লাটুন মুক্তি সেনা পাঠান হল জালালপুরে অবস্থিত আমাদের বাহিনিকে শত্রুকে মোকাবেলা করায় বাড়তি সহায়তা দেবার জন্য।

 

২২ আগস্ট ’৭১ সারাপার

সারাপারে বাংলাদেশ সীমান্তের দুই মাইল ভেতরে সোনাই নদীর তীরে রক্ষণাত্মক অবস্থান নেয় ১৫০ জন মুক্তি সেনার একটা দল। মহিশাশনের বিপরীতে বাংলাদেশের বঘাতে এক প্লাটুন সৈনিক রাখা হয়েছে এবং শত্রুর চলাচলে বাঁধা দেবার জন্য আটুয়াতে এক দল সেনা রাখা হল।

 

২৩ আগস্ট ’৭১ গোবিন্দপুর গোবিন্দপুর আর বারুদা এলাকায়ও ১৫০ জন মুক্তিসেনার দল রক্ষনাত্মক অবস্থান নিয়েছে। এতে করে প্রায় ১০ স্কয়ার মাইল এলাকা মুক্তিবাহিনী কর্তৃক মুক্ত হল। আমাদের রক্ষণাত্মক অবস্থানের চারপাশে অ্যান্টি পার্সোনাল মাইন স্থাপন করতে নির্দেশ দেয়া হল। সে নির্দেশ মোতাবেক সব রক্ষণাত্মক অবস্থানের চারপাশে অ্যান্টি পার্সোনাল মাইন পেতে রাখা হল।
২৪ আগস্ট ’৭১ সারাপুর

সারাপুর এবং লাতুতে অবস্থিত ভারতীয় অ্যাডভান্স ক্যাম্পের মধ্যে একটি টেলিফোন লাইন স্থাপন করা হল ০৯০০টায়।

 

২৪ আগস্ট ’৭১ সারাপুর

আমাদের স্থাপন করা অ্যান্টি পার্সোনাল মাইনের বিস্ফোরণে একজন বেসামরিক লোক পা হারিয়েছে।

 

২৫ আগস্ট ’৭১ (০২৩০টা) লক্ষ্মীবাজার

লক্ষ্মীবাজার এলাকার কাছে একটা বাধ কেটে ফেলার জন্য ২২ জন সেনার একটি দল পাঠানো হয়। তারা বিস্ফোরকের সহায়তায় সফলভাবে বাধ ধ্বংস করে দেয়। কোন হতাহত হয়নি।

 

২৬ আগস্ট ’৭১ কাঙ্গলিঘাট

কাঙ্গলিঘাট ফেরী ধ্বংস করার জন্য বিস্ফোরক সহ ৪০ জন মুক্তিসেনার একটি দল পাঠানো হয়। কিন্তু শত্রুর ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে তারা অসফল হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়।

 

২৭ আগস্ট ’৭১ (০০৪৫টা) কাকড়দি শেওলা ঘাটের কাছেই

কাকড়দিতে একটি সেতু ধ্বংস করতে ২০ জন মুক্তিসেনার একটি দল পাঠানো হয়। তারা সেতুর কাছে পৌঁছুলে সেতুর পাহারায় থাকা রাজাকাররা আমাদের দলের উপর গুলি ছুঁড়ে। আমাদের দল ও পাল্টা গুলি ছুঁড়ে, যার ফলে ২ জন রাজাকার নিহত হয় এবং একটি রাইফেল ও দুই রাউন্ড গুলি সহ আরেকজন আমাদের হাতে ধরা পড়ে। সেতুটি পরে সফলভাবে বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয়। আমাদের কেউ আহত হয়নি।

 

২৭ আগস্ট ’৭১ কাঙ্গলিঘাট কাঙ্গলিঘাট ফেরী ধ্বংস করার জন্য বিস্ফোরক সহ ২৩ জন মুক্তিসেনার আরো একটি দল পাঠানো হয়। কিন্তু শত্রুর ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে তারাও অসফল হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়।
২৮ আগস্ট ’৭১ তাজপুর ২৪০ জন মুক্তি সেনা তাজপুরে রক্ষনাত্নক অবস্থান নিয়েছে। শত্রুরা শাবাজপুর রেল স্টেশন থেকে তাজপুর গ্রামের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হতে চেষ্টা করলে আমাদের অগ্রসর দল তাদের উপর হামলা করে এবং ৪ জন রাজাকারকে নিহত করে। ১ জন পাকি সেনা সহ কয়েকজন বেসামরিক ব্যক্তি আহত হয়েছে।
২৯ আগস্ট ’৭১ তাজপুর শত্রুপক্ষ বিয়ানীবাজার এবং শাবাজপুর থেকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু আমাদের দল তাদের সে চেষ্টা প্রতিহত করেছে।
২৯ আগস্ট ’৭১ কুমারসাইল কুমারসাইল চা বাগানে, যা একেবারে সীমান্ত লাগোয়া এবং আমাদের ক্যাম্প থেকে মাত্র ৫০০ গজ দূরে, শত্রুসেনা এসেছে শুনে ৫০ জন মুক্তিসেনা সেখানে পাঠানো হল। আমাদের দল শত্রুকে পেছন থেকে ঘিরে ফেলে। শত্রুরা সংখ্যায় ছিল শতাধিক। তারা ফিরে যেতে বাধ্য হয়। ৫ জন শত্রু আহত হয়েছে। আমাদের একজন গুরুতর আহত হয়েছে, অন্য ৫ জনের ছোটখাট আঘাত লেগেছে।
৩০ আগস্ট ’৭১ মুক্তাঞ্চল রক্ষা সত্রু বঘা ও খড়মপুর গ্রামের দিক থেকে ২ কোম্পানী সেনা নিয়ে আক্রমন করার চেষ্টা করে কিন্তু তাদের আক্রমন চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়া হয়। মাইন বিস্ফোরণে শত্রুদলের ৩ জন নিহত হয়। আমাদের ক্ষতি শুন্য।
৩০ আগস্ট ’৭১ কুমারসাইল শত্রুর একটা দল কুমারসাইল চা বাগানে এসে ট্রেঞ্চ খননরত আমাদের সেনাদের উপর গুলি চালায়। আমাদের মুক্তিসেনারা দুই দিক থেকে তাদের উপর আক্রমন চালিয়ে প্রায় দুই ঘন্টা গুলি বিনিময়ের পর তাদেরকে পিছু হটতে বাধ্য করে। চা বাগানটি এখন আমাদের দখলে আছে এবং এর প্রতিরক্ষায় একটি প্লাটুন নিয়োজিত আছে। শত্রুপক্ষের ৭ জন নিহত হয়েছে। আমাদের হতাহত শুন্য।
৩১ আগস্ট ’৭১ টাকাইকোনা

৩১ আগস্ট রাত ২ টার দিকে পাক সেনা ও রাজাকারদের দুটো কোম্পানী টাকাইকোনা, বঘা এবং খড়মপুর থেকে আমাদের উপর আক্রমন করে। কিন্তু আমাদের প্রবল প্রতিরোধের কারনে তারা ভোর ৪:৩০ এর দিকে ফিরে যায়। মাইন বিস্ফোরণে শত্রুদের ৬ জন নিহত হয়েছে।

 

দুপুর ১টার দিকে শত্রুরা একই দিক থেকে আবারো আক্রমন করে। এবার তারা মরনপন আক্রমন করে, কিন্তু আমাদের ৩” মর্টারের সফল গোলাবর্ষনের ফলে তারা আবারো পিছাতে বাধ্য হয় বিকেল ৪ টার দিকে। শত্রুদের ৭ জন নিহত এবং ৫ জন আহত হয়েছে আমাদের গোলাবর্ষনের ফলে। আমাদের মধ্যে দুজন বুলেটের আঘাতে এবং ২ জন গোলার আঘাতে আহত হয়েছে।

 

২ সেপ্টেম্বর ’৭১ কোনাগ্রাম ৪৫ জন মুক্তিসেনার একটা দল কোনাগ্রাম আর বিয়ানীবাজারে অভিযানে যায়।, কিন্তু কোন পাক সেনার দেখা তারা পায়নি। ৩ জন রাজাকার এবং একজন পাকিস্তানি দালালকে হত্যা করা হয়েছে।
২ সেপ্টেম্বর ’৭১ শাবাজপুর/বড়লেখা

১০ জনের দুটি দল পাঠানো হয়েছিল দুটি রেল সেতু ধ্বংস করার জন্য, কিন্তু তারা বিফল হয়ে ফেরত এসেছে।

 

২ সেপ্টেম্বর ’৭১ কাঙ্গলি ফেরী শত্রুর একটি টহল দল কাঙ্গলি ফেরির কাছে এলে আমাদের নিজেদের টহলদল তাদের উপর গুলি ছুঁড়ে তাদেরকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে।
২ সেপ্টেম্বর ’৭১ কুমারসাইল শত্রু কুমারসাইল চা বাগানে আমাদের রক্ষন অবস্থানের উপর জোরাল হামলা করে। প্রায় দুই ঘন্টা গুলি বিনিময়ের পর তারা ফিরে যায়। শত্রুরা আক্রমনের জন্য মাঝারি মেশিনগান, ২” মর্টার এবং অন্যান্য অস্ত্র ব্যবহার করে। শত্রুর হতাহতের হিসাব জানা যায়নি।
৩ সেপ্টেম্বর ’৭১ শাবাজপুর/বড়লেখা ৬ জন মুক্তিসেনাকে অ্যান্টি ট্যাঙ্ক মাইন রেল লাইনে বসানর জন্য পাঠানো হয়। তারা বিস্ফোরক বসায় দুই জায়গাতেই, কিন্তু একটি জায়গায় লাইন বিধ্বস্ত করতে সক্ষম হয়। ৩ সেপ্টেম্বর ’৭১ তারিখে শাবাজপুরে ট্রেন আসতে পারেনি।
৪ সেপ্টেম্বর ’৭১ অমলশিদ

অমলশিদে মুক্তাঞ্চল পাহারায় থাকা ২ প্লাটুন মুক্তিসেনার উপর রাত ৮ টার দিকে শত্রু চারিদিক থেকে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র নিয়ে হামলা করে। শত্রুর সাথে যুদ্ধ পরদিন সকাল পর্যন্ত চলে। বাঙ্কার প্রহরারত থাকা আমাদের দুজন সেনা শত্রুর গোলা বর্ষনে শহীদ হয়েছে এবং একজন গুরুতর আহত হয়েছে। শত্রুর হতাহতের সংখ্যা জানা যায়নি। (শহীদ: ১। মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক, পিতা আব্দুল করিম ২। মুক্তিযোদ্ধা আকমল আলি, পিতা নুরুজ আলি)

 

৫ সেপ্টেম্বর ’৭১ তাজপুর

৩০০ মুক্তিসেনা মুক্তাঞ্চল রক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিল এখানে। শত্রু দুবার চেষ্টা করে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেঙ্গে ফেলার। তারা বিপুল শক্তি নিয়ে আক্রমন করে কিন্তু আমাদের কাছে ব্যর্থ হয়। একজন পাক সেনা ও ৬ জন রাজাকার নিহত হয়েছে। আমাদের কেউ নিহত বা আহত হয়নি।

 

৬ সেপ্টেম্বর ’৭১ বঘা/খড়মপুর

শত্রু পুর্নশক্তিতে বঘা এবং খড়মপুর গ্রামে আমাদের রক্ষনব্যুহের উপর আক্রমন করে মর্টারের সহায়তা নিয়ে। শত্রু ৩” মর্টারের ৫০ রাউন্ড গোলা বর্ষন করে আমাদের উপর। এছাড়াও তারা প্যারাশুট বম্ব ও অন্যান্য স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহার করে। তারা অনেক কষ্টে তাদের নিহত সৈনিকদের মৃতদেহ নিয়ে পালায়। ৩ জন পাকিস্তানি সেনা এবং ৪ জন রাজাকার নিহত হয়েছে। আমাদের কেউ আহত বা নিহত হয়নি।

 

৬ সেপ্টেম্বর ’৭১ সোর্স রিপোর্ট চর মারফত জানা গেছে যে “শত্রুদের একটা বিশাল বাহিনী শাবাজপুর চা বাগান এলাকায় জড়ো হয়েছে, প্রায় দুই কোম্পানী সাধারণ সৈনিক এবং রাজাকার। এক কোম্পানী শাবাজপুর চা বাগানে, দুই প্লাটুন রহমানীয়া চা বাগানে, আরও দু প্লাটুন ছোটলেখা চা বাগানে এবং ২ কোম্পানী বড়লেখা চাবাগানে। পুরো এক ব্যাটেলিয়ন (২১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট) সৈনিক এখন বড়লেখা এবং বিয়ানীবাজারের মধ্যবর্তি এলাকায় আছে। আমাদের রক্ষণাত্মক অবস্থানগুলোর জন্য আর্টিলারি সাপোর্ট এখন খুবই দরকার। প্রয়োজনীয় অবস্থা নিন।”
৮ সেপ্টেম্বর ’৭১ মুক্তাঞ্চল রক্ষণ

শত্রু একাধিকবার বঘা গ্রামে বাম দিক দিয়ে আমাদের রক্ষণব্যুহ ভেঙ্গে এগুনোর চেষ্টা করে। শত্রুদল ৩” মর্টার সহ সব ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করে। তাদের ৬ জন নিহত হয়েছে।

 

৯ সেপ্টেম্বর ’৭১ শাবাজপুর

আমাদের সেনারা পাকিস্তানিদের একটি টহলদলকে অ্যামবুশ করে বিয়ানীবাজার সড়কে। শত্রু বেশ দূরে থাকতেই আমাদের দল গুলিবর্ষন শুরু করে। গত দুই তিন দিন ধরে ট্রেন আসা যাওয়া করছে।

 

৯ সেপ্টেম্বর ’৭১ শাবাজপুর স্টেশন শত্রুর একটি এমআই-৮ হেলিকপ্টার আজ আমাদের রক্ষণ অবস্থানের উপর দিয়ে উড়ে যায়। শত্রু সম্ভবত আকাশ পথে হামলার চিন্তা করছে।
১১ সেপ্টেম্বর ’৭১ (০২০০টা) শাবাজপুর

আমাদের রক্ষণব্যুহের উপর দিয়ে শাবাজপুর থেকে সুতারকান্দির দিকে শত্রুর একটি বিমান উড়ে যায় রাত দুটোর দিকে। শত্রুরা শাবাজপুরের দিক থেকে গোলাগুলিও করে।

 

১২ সেপ্টেম্বর ’৭১ (০২৩০টা) শাবাজপুর চাবাগান

৫০ জন মুক্তিসেনার দল শাবাজপুর চা বাগানে ২” মর্টার আর এলএমজি নিয়ে হামলা করে রাত ২:৩০ এর দিকে। শত্রু ১০ মিনিট পরে জবাব দেয়া শুরু করে। ১৫ জন পাক সেনা ও রাজাকার নিহত হয়েছে। আমাদের ক্ষয়ক্ষতি শুন্য।

 

১৩ সেপ্টেম্বর ’৭১ আবঙ্গি

শত্রু আমাদের রক্ষণব্যুহ ভেঙ্গে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করে কিন্তু আমাদের শক্ত প্রতিরোধের মুখে হার মানতে বাধ্য হয়। ১১ জন পাকিস্তানি সেনা/রাজাকার নিহত হবার খবর পাওয়া গেছে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউনুস শহীদ হয়েছেন এবং কুকিতাল থেকে আসা আরো দুজন আহত হয়েছে।

 

১৪ সেপ্টেম্বর ’৭১ (০৪৩০টা) কুমারসাইল

ভোর ৪:৩০ এর দিকে শত্রু বিপুল শক্তি নিয়ে কুমারসাইলে আমাদের উপর হামলা করে। আমাদের সেনারা ৯:৩০ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে অবশেষে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়। ২ জন পাক সেনা নিহত হয়েছে।

 

১৪ সেপ্টেম্বর ’৭১ (০৪০০টা) বুঘা

ভোর ৪ টায় এক কোম্পানি সৈন্য আমাদের আক্রমন করে। সকাল ৯ টা পর্যন্ত দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক গুলি বিনিময় হয়েছে। ১৬ জন পাক সেনা/রাজাকার নিহত। আমাদের ক্ষতি শুন্য।

 

১৪ সেপ্টেম্বর ’৭১ (০৬০০টা) খড়মপুর

শত্রুরা দুই কোম্পানি সৈনিক নিয়ে আমাদের উপর হামলা করে ভোর ৬ টার দিকে, কিন্তু আমাদের রক্ষণব্যুহ ভাংতে ব্যর্থ হয়। সকাল ৭:৩০ তে তারা আবার আক্রমন করে। আমাদের সেনাদল সকাল ১০টা পর্যন্ত যুদ্ধ করে, কিন্তু অবশেষে অবস্থান ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়। শত্রুপক্ষের আনুমানিক ১০ জন নিহত হয়েছে।

 

১৪ সেপ্টেম্বর ’৭১ (০৩০০টা) সারাপুর/গোবিন্দপুর

শত্রু প্রায় এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য নিয়ে রাত ৩ টার দিকে আমাদের রক্ষণ অবস্থানের উপর হামলা করে। সব ধরনের অস্ত্র নিয়ে চারদিক থেকে হামলে পরে শত্রুরা। আমাদের অবস্থানের উপর আর্টিলারি গোলা বর্ষন শুরু হয় রাত ২ টার দিক থেকে। শত্রু আমাদের সাথে সারাপুরের যোগাযোগ পথ বন্ধ করে দেয়। শেষ গুলিটা থাকা পর্যন্ত আমাদের সেনারা যুদ্ধ করে যায়। পরে তারা অবস্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয় কিন্তু পিছিয়ে আসার পথ বন্ধ থাকায় তারা সোনাই নদী সাঁতরে পার হতে বাধ্য হয়, যার ফলে তারা তাদের অস্ত্রশস্ত্র পেছনে ফেলে আসতে বাধ্য হয়। আমাদের ৬ জন সেনা নিখোঁজ আছে। শত্রু সেনা নিহত হয়েছে: আস্তাগারি – ৫,  স্বরুপা – ৪, পাথারিয়া পাড়া – ৪, পীরের চক – ৬, নোয়াগ্রাম – ৩ , তাজপুর – ১৫, আভঙ্গি ১০ জন। আমাদের ৫ জন আহত এবং ৬ জন নিখোঁজ।

 

১৫ সেপ্টেম্বর ’৭১   শত্রু সকাল ৮ টা থেকে আর্টিলারি গোলাবর্ষন শুরু করে। শত্রু ১৩টি গোলা বর্ষন করে যার মধ্যে ৯ টি বড়পুঞ্জিতে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে পরে। কেউ আহত বা নিহত হয়নি।
১৮ সেপ্টেম্বর ’৭১ শাবাজপুর চাবাগান

বিশ্বস্ত সুত্রে জানা গেছে যে গত ১৩ তারিখে আমাদের সাথে যুদ্ধে ৪ জন পাক সেনা এবং ৭ জন রাজাকার মারা গিয়েছিল।

 

১৮ সেপ্টেম্বর ’৭১ শাবাজপুর চাবাগান

৬০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল শাবাজপুর চা বাগানে (ঝিঙ্গালা) হামলা করতে যায়। তারা শত্রুর উপর ২” মর্টার, এলএমজি এবং রাইফেল দিয়ে হামলা করে। ৭ জন পাক সেনা এবং রাজাকারের নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

 

১৮ সেপ্টেম্বর ’৭১ সারাপুর এলাকা ১০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল শত্রুর ফেলে যাওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে যায়। তারা ২টি এসএলআর এবং ৪ টি .৩০৩ রাইফেল উদ্ধার করে।
১৮ সেপ্টেম্বর ’৭১ সারাপুর এলাকা ৮ জন মুক্তিযোদ্ধার আরেকটি দল শত্রুর ফেলে যাওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে যায়। তারা সোনাই নদী থেকে একটি ২” মর্টার উদ্ধার করেছে।
১৮ সেপ্টেম্বর ’৭১ সুতারকান্দি

৬০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি জিটার পার্টি গয়লাপাড়া (সিলেটি পাড়ার বিপরীতে) গিয়ে এলএমজি, রাইফেল এবং ২” মর্টারের গলাবর্ষন করে, শত্রুও তাৎক্ষণিক জবাব দেয়। তারা ৩” মর্টার, মাঝারি এবং হালকা মেশিনগান দিয়ে জবাব দেয়। শত্রুদের ২ জন নিহত হয়েছে। আমাদের ক্ষতি শুন্য।

 

১৮ সেপ্টেম্বর ’৭১ সুতারকান্দি সীমান্ত এলাকার উপর দিয়ে শত্রুর একটি হেলিকপ্টার উড়ে যেতে দেখা গেছে। সম্ভবত শত্রু আমাদের ক্যাম্পের অবস্থান দেখার জন্যে এসেছিল। রাত ১ টা হয়ে শত্রু ১০৫ মিমি. কামান দিয়ে আমাদের উপর গোলাবর্ষন শুরু করে। তারা ২৫ রাউন্ড গোলা বর্ষন করে, এর সব কটিই আমাদের ক্যাম্পের উপর এবং আশেপাশে পরে। আমাদের কেউ হতাহত হয়নি।
১৮ সেপ্টেম্বর ’৭১ কুমারসাইল

৭০জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল অ্যামবুশ করে বসেছিল কুমারসাইল এবং দেওতলি এলাকায়। শত্রু সেখানে এসে আমাদের উপর এলএমজির গুলি বর্ষন করে রাত ২টায়। আমাদের দল শত্রু অস্ত্রের নাগালের বাইরে ছিল বলে পাল্টা গুলিবর্ষন করেনি।

 

১৯ সেপ্টেম্বর ’৭১ কুমারসাইল

শত্রুর একটি টহলদল কুমারসাইল চা বাগানে এসে আমাদের ক্যাম্পের দিকে প্রবল গুলিবর্ষন করে। আমাদের কেউ হতাহত হয়নি।

 

২০ সেপ্টেম্বর ’৭১ কুমারসাইল

আমাদের পেতে রাখা অ্যান্টি পার্সোনাল মাইন বিস্ফোরণে একজন পাক সেনা মারা গেছে।

 

২০ সেপ্টেম্বর ’৭১ বঘা

আমাদের পাতা মাইন বিস্ফোরণে একজন পাক সেনা মারা গেছে।

 

২১ সেপ্টেম্বর ’৭১ গোবিন্দপুর

১৫ জন মুক্তিযোদ্ধাকে গোবিন্দপুর গ্রামে একটা অ্যামবুশ পাতার জন্য পাঠানো হয়। ৩ পাক সেনা সহ এক রাজাকার নৌকায় করে গোবিন্দপুর গ্রামে আসে। রাজাকারটি পর্যবেক্ষনের জন্য যে গ্রামে আমাদের দল অ্যামবুশ করে বসেছিল সেই গ্রামে প্রবেশ করে। মুক্তিসেনারা কয়েক রাউন্ড গুলি বর্ষনের পর সেই রাজাকারটিকে ধরে ফেলে। বাকিরা পালিয়ে যায়। রাকাজারটির কাছ থেকে একটি .৩০৩ রাইফেলও উদ্ধার করা হয়।

 

২১ সেপ্টেম্বর ’৭১ পাল্লাথাল চা বাগান

১২০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল পাল্লাথাল চা বাগানে অ্যামবুশ করে বসে ছিল কিন্তু শত্রুর দল সেই পথে আসেনি।

 

২২ সেপ্টেম্বর ’৭১ কুমারসাইল

স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা গেছে যে অ্যান্টি পার্সোনাল মাইন বিস্ফোরণে ৭ জন পাক সেনা নিহত হয়েছে, এছাড়াও একইভাবে আরও ৪ জন নিহত হয়েছে ২২ সেপ্টেম্বর।

 

২৩ সেপ্টেম্বর ’৭১ কুমারসাইল এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা দেওতলিতে অ্যামবুশ করে বসে থাকার সময় পাক সেনাদের সীমান্তের দিকে আসতে দেখে। শত্রুরা যখন কুমারসাইল মসজিদের কাছাকাছি চলে আসে তখন আমাদের দল এলএমজি দিয়ে গুলি ছোঁড়া শুরু করে যার ফলে ৮ জন শত্রু নিহত হবার পাশাপাশি ১০ জন আহত হয়েছে। আমাদের কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
২৩ সেপ্টেম্বর ’৭১ কুমারসাইল

প্রায় এক প্লাটুন শত্রু সেনা কুমারসাইল চা বাগানের রাস্তা দিয়ে আসছিল। আগে থেকে অ্যামবুশ করে থাকা আমাদের দল তাদের উপর গুলি ছুঁড়ে শত্রু কিলিং রেঞ্জে আসার পর। সামনে থাকা দুজন স্কাউটকে হত্যা করে আমাদের সেনারা। বাকিরা পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে মাইন ফিল্ডে গিয়ে পড়ে এবং ৭ জন শত্রুসেনা মাইন বিস্ফোরণে তাদের পা হারিয়েছে। আমাদের কোন হতাহত নেই।

 

২৪ সেপ্টেম্বর ’৭১ (১৫০০টা) খড়মপুর

৬০ জন মুক্তিসেনার দল খড়মপুরে অ্যামবুশ করে বসেছিল। ৪০ জনের মত শত্রুসেনা সীমান্তের দিকে আসলে আমাদের দল তাদের উপর গুলিবর্ষন করে। শত্রুও হালকা ও মাঝারি মেশিনগান এবং ৩” মর্টারের কয়েক রাউন্ড দিয়ে পাল্টা জবাব দেবার চেষ্টা করে। শত্রু দলের ৫ জন নিহত হয় এবং ১০ জন আহত হয়। গত ২৪ ঘন্টার মধ্যে শত্রুরা তাদের নিহতদের লাশ নিয়ে যেতে পারেনি। আমাদের কোন হতাহত নেই।

 

২৫ সেপ্টেম্বর ’৭১ (০৬০০টা) দেওতলি

১০০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি অ্যামবুশ পার্টি দেওতলি পাঠানো হয়েছিল। তারা শত্রুর একটি অ্যামবুশ পার্টিকে সীমান্তের দিক থেকে ফিরে আসতে দেখে এবং তাদের উপর গুলি বর্ষন করে। শত্রুর দিক থেকেও প্রবল গোলাগুলি চলে। এক জন মুক্তিযোদ্ধা ২” মর্টারের গোলার আঘাতে আহত হয়েছে। শত্রুর ক্ষয়ক্ষতি অনুমান করা যায়নি।

 

২৬ সেপ্টেম্বর ’৭১ (১৭১৫টা) কুমারসাইল

৬০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল শত্রুর উপর হামলা চালাতে কুমারসাইল চা বাগানে যায়। দুই দলের মধ্যে প্রায় আড়াই ঘন্টা প্রচন্ড গোলাগুলি চলে। ৯ জন শত্রুসেনা নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে।

 

২৭ সেপ্টেম্বর ’৭১ কুমারসাইল

শত্রু আমাদের ক্যাম্পের উপর প্রায় এক ঘণ্টা ধরে আর্টিলারি গোলা বর্ষন করে। এতে আমাদের তাঁবুগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

 

২৭ সেপ্টেম্বর ’৭১ বড়াইল

২৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল বড়াইলে অ্যামবুশ করে। একদল শত্রু সেনা যখন বড়াইলে তাদের অগ্রবর্তী দলের জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছিল তখন তাদের উপর হামলা করে আমাদের দল। ২ জন পাক সেনা নিহত হয়েছে।

 

২৮ সেপ্টেম্বর ’৭১ ইন্ডাকশন

৩২ জন মুক্তিসেনা ডীপ ইন্ডাকশনের জন্য ঢাকা দক্ষিন ও হাকালুকি হাওর এলাকায় গেল।

 

১ অক্টোবর ’৭১ কুমারসাইল

৩০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল কুমারসাইল গ্রামে একটি অ্যামবুশ পাতে। শত্রুর একটি টহলদল সীমান্তের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে আমাদের দল গুলি করে। ঘটনাস্থলে শত্রুদের ৫ জনকে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। আমাদের কেউ আহত হয়নি।

 

১ অক্টোবর ’৭১ কুমারসাইল

৪৫ জন মুক্তিযোদ্ধার আরেকটি দল কুমারসাইল চা বাগানে একটি অ্যামবুশ পাতে। কিন্তু শত্রুরা সেদিন ভিন্ন পথে আসার কারনে আমাদের দল হামলা করতে পারেনি।

 

১ অক্টোবর ’৭১ কুমারসাইল

৩০ জন গেরিলাকে অস্ত্রপাতি নিয়ে বাংলাদেশের ভেতর থাকার জন্য ঢাকা দক্ষিন এবং হাকালুকি হাওর এলাকায় পাঠানো হল।

 

৪ অক্টোবর ’৭১ কুমারসাইল

অ্যামবুশ করার জন্য ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দলকে কুমারসাইল পাঠানো হল। বিকাল ৫ টার দিকে তারা শরতুর দেখা পায়। আমাদের দল গুলি করে ৩ জন পাক সেনাকে হত্যা করেছে।

 

৪ অক্টোবর ’৭১ বড়াইল

বড়াইল গ্রামে শত্রুর উপর অ্যামবুশ করার জন্য ৩০ জনের একটা দল পাঠানো হল। তারা শত্রুর টহলদলকে সেই গ্রামে দেখতে পায়। আমাদের দল শত্রুর উপর গুলি চালিয়েছে, কিন্তু হতাহতের সংখ্যা নিশ্চিত করা যায়নি।

 

  ইন্ডাকশন

৫১ জন গেরিলাকে  অস্ত্রপাতি নিয়ে বাংলাদেশের ভেতর থাকার জন্য ঢাকা দক্ষিন এবং হাকালুকি হাওর এলাকায় পাঠানো হল।

 

৫ অক্টোবর ’৭১ কুমারসাইল ২০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল কুমারসাইল গ্রামে একটি অ্যামবুশ করে। প্রায় এক প্লাটুন পাকিস্তানি সেনাকে কুমারসাইল চা বাগানে আসতে দেখা যায়। আমাদের সেনারা শুত্রুর উপর গুলি চালিয়ে পাক জন সৈন্যকে হত্যা করে। শত্রুর দল সেদিন বিকেল পর্যন্ত ৩” মর্টারের গোলাবর্ষন করে (আমাদেরকে দূরে থাকতে বাধ্য করে) মৃতদেহ সংগ্রহ করতে দেখা যায়।
৫ অক্টোবর ’৭১ আটুয়া

৩০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে অ্যামবুশ করার জন্য আটুয়া গ্রামে পাঠানো হয়, কিন্তু তারা সেখানে শত্রুর দেখা পায়নি।

 

৬ অক্টোবর ’৭১ (১৪৩০টা) কুমারসাইল

২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা কুমারসাইল গ্রামে অ্যামবুশ করে ছিল, শত্রুর টহল দল সে গ্রামে এলে তারা গুলি করে ৪ জন শত্রুসেনা হত্যা করে। একজন মুক্তিযোদ্ধা বোমার স্প্লিন্টারের আঘাতে আহত হয়েছে।

 

৭ অক্টোবর ’৭১ আটুয়া

২২ জন মুক্তিযোদ্ধাকে অ্যামবুশ করার জন্য পাঠানো হয়, কিন্তু তারা সেখানে শত্রুর দেখা পায়নি।

 

৮ অক্টোবর ’৭১ কুমারসাইল

২০ জন মুক্তিযোদ্ধা একটা দল শত্রুর ওপর অ্যামবুশ করে কুমারসাইল গ্রামে। শত্রু বৈরাগী টিলা থেকে মাঝারি মেশিনগান দিয়ে আমাদের উপর গুলি করে। হতাহত শুন্য।

 

১০ অক্টোবর ’৭১ কালাছড়া ক্যাম্প

৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা ১০ অক্টোবর ভোর রাত ৪টার দিকে কালাছড়া ক্যাম্পে হামলা করে, এবং শত্রু (বুঝে উঠে) পাল্টা গুলি করার আগেই ৫ জন শত্রুকে হত্যা করার পাশাপাশি দুজন রাজাকারকে .৩০৩ রাইফেলসহ আটক করে। আমাদের হতাহত শুন্য।

 

১২ অক্টোবর ’৭১ কুমারসাইল

৩০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে অ্যামবুশ করার জন্য কুমারসাইল গ্রামে পাঠানো হয়। তারা সারাদিন অ্যামবুশ করে থেকেও শত্রুর দেখা পায়নি।

 

১৩ অক্টোবর ’৭১ পাল্লাথাল চাবাগান

পাল্লাথাল চা বাগানের বিভিন্ন পথে প্রায় ৫০টি অ্যান্টি পার্সোনাল মাইন পেতে রাখা হল।

 

১৪ অক্টোবর ’৭১ (১৬০০টা) কালিকাপুর চা:বা:

৬০জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল কালিকাপুর চা বাগানে অ্যামবুশ করে। প্রায় এক কোম্পানি শত্রু সেনা সেই এলাকায় এসে আমাদের দলের উপর গুলি চালায়। আমাদের দল এলএমজি, রাইফেল এবং ২” মর্টার দিকে পাল্টা জবাব দিয়ে ১ জন রাজাকারকে নিহত এবং দুজন পাঞ্জাবীকে আহত করতে সক্ষম হয়। আমাদের নিজেদের কেউ হতাহত হয়নি।

 

১৬ অক্টোবর ’৭১ কুমারসাইল

শত্রুকে উত্যক্ত করার জন্য আমাদের একটি দল কুমারসাইল যায়। তারা শত্রুর বাঙ্কারের উপর এলএমজি এবং রাইফেল দিয়ে গুলি বর্ষন করে। শত্রু শাবাজপুর থেকে ৩” দিয়ে গোলাবর্ষন এবং বৈরাগী টিলা থেকে মাঝারি মেশিনগানের গুলি ছোঁড়ে। ব্যাপক গুলি বিনিময়ের পর আমাদের দল ফিরে আসে। শত্রুর ক্ষয়ক্ষতির নিশ্চিত খবর পাওয়া যায়নি।

 

১৮ অক্টোবর ’৭১ ডিপ ইন্ডাকশন

৬৭ জন গেরিলাকে তিনটি দলে ভাগ করে বাংলাদেশের ভেতর লুকিয়ে থাকার জন্য বড়লেখা, ফেঞ্চুগঞ্জ এবং বিয়ানীবাজার পাঠানো হল।

 

১৯ অক্টোবর ’৭১ ডিপ ইন্ডাকশন ২৩ জন গেরিলাকে লুকিয়ে থাকার জন্য গোলাপগঞ্জ এলাকায় পাঠানো হল।
১৯ অক্টোবর ’৭১ পাল্লাথাল চাবাগান পাল্লাথাল চা বাগানে আমাদের পেতে রাখা  মাইনের বিস্ফরনের ফলে দুইজন শত্রু সেনার আহত হবার খবর পাওয়া গেছে।
২০ অক্টোবর ’৭১ ইন্ডাকশন

আরও ৪৪ জন গেরিলাকে লুকিয়ে থাকার জন্য কয়েক দলে ভাগ করে বাংলাদেশের ভেতরে পাঠানো হল। আমাদের ক্যাম্প থেকে এরকম পাঠানো মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১৪৪। এদের মধ্যে প্রায় ১০০ জন ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পৌঁছে গেছে।

 

২১ অক্টোবর ’৭১ শাবাজপুর

৫০ জনের একটি জিটার পার্টিকে শাবাজপুরে পাঠানো হয়েছিল। শত্রুর প্রায় ৯০ জনের একটি দল সীমান্তের দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করলে আমাদের দল দুই দিক থেকে তাদের উপর অ্যামবুশ করে। শত্রু পালিয়ে যায়, তবে তাদের রক্ষণব্যুহ বঘা এবং শাবাজপুর থেকে আমাদের দিকে প্রচন্ড গুলিবর্ষন হয়েছে।

 

২০ অক্টোবর ’৭১ বঘা

আমাদের ৩” মর্টারের গোলাবর্ষনে শত্রুর দুটি বাংকার ধ্বংস হয়েছে। শত্রু ২” এবং ৩” মর্টার দিয়ে আমাদের উপর ২৩ রাউন্ড গোলাবর্ষন করে। আমাদের হতাহত শুন্য, শত্রুর হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

 

২৩ অক্টোবর ’৭১ বড়লেখা রেললাইন

বড়লেখা এবং শাবাপুরের মধ্যের রেল লাইনে একটি রেল ট্রলি মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস করে দেয় আমাদের গেরিলারা। এর ফলে ৪ জন রাজাকার নিহত হয়েছে।

 

২৪ অক্টোবর ’৭১ পাক দালাল হত্যা বরলেখার তেরাদর থানার চেয়ারম্যান এবং বিশিষ্ট পাকিস্তানি দালাল আব্দুল আজিজ আমাদের গেরিলাদের আক্রমনে গুরুতর আহত হয়েছে।
২৫ অক্টোবর ’৭১ শত্রুর অবস্থান শাবাজপুরে শত্রুর অবস্থানের উপর হামলা চালিয়ে ৩জন রাকাজারকে হত্যা এবং আরও ৪ জনকে আহত করা হয়েছে। আমাদের কোন হতাহত নেই।
২৮ অক্টোবর ’৭১  

বিয়ানীবাজারের কাছে আমুরাতে শত্রুদলের সাথে আমাদের গেরিলাদের একটি সঙ্ঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে ২৫ অক্টোবর ’৭১ তারিখে বেলা ৩টা নাগাদ। ৮ জন রাজাকার এবং দুইজন পাঞ্জাবী নিহত হয়েছে।

 

২৯ অক্টোবর ’৭১ কুমারসাইল

একটি জিটার পার্টি পাঠানো হয়েছিল কুমারসাইল গ্রামে। তারা শত্রু অবস্থানের উপর গুলি ছুঁড়লে শত্রুও সাথে সাথে এলএমজি এর গুলিতে জবাব দেয়।

 

১ নভেম্বর ’৭১ লাতু/বড়লেখা

লাতু এবং বড়লেখার মাঝের রেল লাইন বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে আমাদের সেনারা।

 

৩ নভেম্বর ’৭১  

শত্রুকে সহায়তাকারী একজন কুমারসাইল গ্রামে আমাদের পাতা মাইনের বিস্ফোরণে নিহত হয়েছে।

 

৮ নভেম্বর ’৭১  

ট্রেনিং সেন্টার থেকে ১৬৬ জন নতুন মুক্তিযোদ্ধা যোগ দিলো।

 

১০ নভেম্বর ’৭১ আটগ্রাম

শত্রুরা বাল্লা এবং গোটাগ্রাম মুক্তাঞ্চল প্রতিরক্ষায় থাকা  আমাদের এক কোম্পানি সৈনিক এর উপর আক্রমন করে, কিন্তু আমাদের সেনারা বীরত্বের সাথে তাদেরকে রুখে দেয়। শত্রু আবারো ভোর ৪:৩০ এর দিকে প্রায় ৩০০ সৈনিক নিয়ে আক্রমন করে, কিন্তু ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে আবারো পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়। পাক সেনাদের সাথে মিলে ৩০০/৪০০ স্থানীয় লোক অস্ত্র নিয়ে এগিয়ে এলে আমাদের সেনারা তাদের উপর গুলি চালাতে বাধ্য হয়। কৌশলগত কারনে আমাদের দল সেখান থেকে পিছিয়ে আসে। একজন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে নিহত হয়েছেন (অমলশিদ কোম্পানি) আরো দুজন আহত হয়েছে। শত্রুরা প্রায় ১০০ জনকে হারিয়েছে।

 

১০ নভেম্বর ’৭১ সাদিনাপুর

সাদিনাপুরে শত্রুর শক্তি বেড়ে প্রায় ১৫০ জন নিয়মিত সৈনিকে দাঁড়িয়েছে।

 

১২ নভেম্বর ’৭১ গাজুকাটা

নভেম্বরের ১০ তারিখে গাজুকাটায় আমাদের গেরিলারা দুজন রাজাকার কে হত্যা করে একটি .৩০৩ রাইফেল দখল করেছে।

 

২০ নভেম্বর ’৭১ আটগ্রাম শত্রুর ব্যাপক বাধা সত্বেও আমাদের সেনারা সালাম টিলা এবং মনিপুর টিলা দখল করেছে। দুই প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা সালাম টিলায় এবং এক প্লাটুন মনিপুর টিলায় অবস্থান নিয়েছে। শত্রু ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে অস্ত্রপাতি ফেলেই পালিয়ে গেছে। মিত্রবাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের যৌথ অভিযানে জকিগঞ্জ দখল করা হয়েছে এবং অসংখ্য শত্রু সেনা হত্যার পাশাপাশি ৩ জন পাঞ্জাবি এবং ২৩ জন রাজাকারকে আটক করা হয়েছে। একজন বালুচকে আহত অবস্থায় গ্রেফতার করার পর করিমগঞ্জ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। আমাদের সৈয়দ এমদাদুল হক আর জনাব আলি অ্যান্টি পার্সোনাল মাইন বিস্ফোরণে একটি পা হারিয়েছেন। শত্রুর গোলাগুলিতে প্রায় ১০০ বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে।
২২ নভেম্বর ’৭১ রাজা টিলা

আমাদের প্রায় এক কোম্পানি সৈন্য শত্রুর ব্যাপক প্রানহানি ঘটিয়ে রাজা টিলা দখল করে নিয়েছে। শত্রু রাতের আধারে পালিয়ে যায়। আমাদের দিকে হতাহত হয়নি কেউ।

 

২৩ নভেম্বর ’৭১  

আমাদের সেনারা কানাই ঘাটে শত্রুর অবস্থানে হামলা করার জন্য ডাউকারগালের  দিকে গিয়েছে এবং ২৫ নভেম্বর তারিখে  ডাউকারগাল  এবং লাউয়াছড়া শত্রুমুক্ত করেছে । শত্রুরা কাঙ্গলিঘাটে জড়ো হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

 

২৮ নভেম্বর ’৭১ বড়চাতাল

আমাদের সেনাদল কানাইঘাটের দিকে যাওয়া এক মাত্র রাস্তা বড়চাতাল ও দারবাস্ত সড়ক অবরোধ করে রেখেছে। শত্রু আমাদেরকে হটানোর অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। শত্রু আর্টিলারী গোলার আঘাত হানার চেষ্টা করে, কিন্তু আমাদের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি ২ জন রাজাকারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমাদের বেঙ্গল রেজিমেন্টকে মোকাবেলা করার জন্য শত্রুরা প্রায় এক কোম্পানি সেনা এনেছিল, কিন্তু তারা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়। প্রায় ৩০০ এর মত রাজাকার কানাইঘাটে জড়ো হয়েছে। রাস্তা এবং নদীর ধার দিয়ে শত্রুর চলাফেরা বন্ধ করার জন্য উত্তর  লক্ষী প্রসাদ এর অধীনে দুই প্লাটুন সেনা নিয়োজিত করা হয়েছে।

 

৩০ নভেম্বর ’৭১ বড়চাতাল

আর্টিলারী হামলার আড়ালে শত্রুর সেনারা কানাইঘাটের ৩ মাইল দূরে নয়াগ্রামে আমাদের অবস্থানের উপর হামলা করেছে। রাজাকার এবং নিয়মিত সেনা মিলিয়ে প্রায় এক কোম্পানি রিইনফোর্সমেন্ট পেয়েছে শত্রুরা।

 

৫ ডিসেম্বর ’৭১ বীরদল

এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা কানাই ঘাটের কাছে বীরদলে টহল দেবার সময় শত্রুর মুখোমুখি হয়। হতাহতের সংখ্যা শুন্য।

 

৫ ডিসেম্বর ’৭১ কানাইঘাট চারিদিক থেকে আমাদের সেনারা রক্ষণব্যূহ আরো শক্তিশালী করে তুলল।
৭ ডিসেম্বর ’৭১ কানাইঘাট মিত্র বাহিনীর সাথে সম্মিলিত ভাবে আমাদের সেনারা দারবস্তের  দিকে অগ্রসর হয় এবং কানাইঘাটকে শত্রুমুক্ত করে।
৮ ডিসেম্বর ’৭১ দারবস্ত

মিত্র বাহিনীর সাথে সম্মিলিতভাবে আমাদের সেনাদল দারবস্তে শত্রু অবস্থানের উপর হামলা করে। শত্রু আর্টিলারি এবং অন্যান্য অস্ত্রের মাধ্যমে বিপুল প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করলেও আমাদের সেনারা শত্রুর ব্যাপক ক্ষতি ঘটিয়ে সহজেই দারবস্ত দখল করে নেয়। কর্নেল দত্ত এবং মেজর রব আক্রমন নিয়ন্ত্রণ করেন। মিত্রবাহিনীর একজন অফিসার (ক্যাপ্টেন) নিহত এবং আমাদের তিনজন মুক্তিযোদ্ধা গুরুতর আহত হয়েছে। প্রায় ২০ জন রাজাকার মুক্তি বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করেছে। শত্রু এখানে থেকে পিছিয়ে গিয়ে হরিপুর এ ঘাঁটি গেড়েছে। শত্রু ৩টি আর্টিলারি কামান ব্যবহার করেছে।

 

৯ ডিসেম্বর ’৭১ হরিপুর

মিত্রবাহিনীর সাথে সম্মিলিতভাবে আমাদের সেনারা এগিয়ে গিয়ে হরিপুরের কাছে অবস্থান নিয়েছে। শত্রুরা হেমুতে  একটি সেতু ধ্বংস করে দিয়েছে। চারিদিক থেকে শত্রু সেনারা মুক্তি বাহিনীর কাছে অস্ত্র সমর্পন করছে।

 

১০ ডিসেম্বর ’৭১ হেমু

হেমুতে শত্রুর উপর চারিদিক থেকে প্রবল চাপ সৃষ্টি করার কারনে দুই পক্ষ থেকেই সকাল পর্যন্ত ব্যাপক গুলি বিনিময় হয়েছে। শত্রুর দুটি গোলা আমাদের অবস্থানের উপর পড়ার কারনে ৯ জন মুক্তিযোদ্ধা ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছে। মৃতদেহ আমরা নিয়ে আসতে পারিনি। স্থানীয় এক ব্যাক্তকে ২০০ টাকা দেয়া হয়েছে শহীদদের কবর দেওয়ার জন্য। এখানে থেকে শত্রুদলকে ঝেটিয়ে বিদায় করা হয়েছে।

 

১১ ডিসেম্বর ’৭১ (২০০০টা) চিকনাগুল

লে: কর্নেল দত্ত ৫০০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে চিকনাগুল এলাকায় গিয়ে রক্ষণাত্মক অবস্থান নিলেন।

 

১২ ডিসেম্বর ’৭১ (১৬০০টা) দারবস্ত

৮ম মাউন্টেন ডিভিশনের কমান্ডার বিকেল ৪ টায় দারবস্ত এ এসেছিলেন। তাঁর সাথে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার ওয়াতকে।

 

১৩ ডিসেম্বর ’৭১ (১৪০০টা) হরিপুর

আমাদের সেনাদল এবং মিত্রবাহিনীর সাথে মিলে হরিপুর দখল করে নিলো। শত্রুরা এমসি কলেজের দিয়ে পালিয়ে গেছে, দুজন শত্রু সেনাকে আটক করা হয়েছে, এছাড়াও তাদের অনেকেই আহত হয়েছে।। শত্রু পালিয়ে যাবার সময় বিপুল পরিমান গোলাবারুদ এবং দুটি চাইনিজ মেশিনগান ফেলে গেছে। আমাদের ৫ জন যোদ্ধা হালকা আঘাত পেয়েছেন।

 

১৩ ডিসেম্বর ’৭১ (১৬০০টা) চিকনাগুল

শত্রুসেনারা এমসি কলেজ এলাকায় জড়ো হচ্ছে খবর পেয়ে আমাদের সেনাদল সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

 

১৪ ডিসেম্বর ’৭১ (২৩০০টা) চিকনাগুল

চিকনাগুল চা বাগানের কাছে ১৩ ডিসেম্বর ’৭১ এ সারা রাত জুড়েই দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক গুলিবিনিময় চলে যা ১৪ তারিখ সকালেও চলছিল। আমাদের দল শত্রু অবস্থানের দিকে অগ্রসর হবার সময় আর্টিলারী শেলের আঘাতে একজন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়েছেন। মাঝারি মেশিনগানের গুলিতে দুজন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়েছেন এবং ৪ জন আহত হয়েছেন। শত্রু পিছিয়ে খাদেমনগরে অবস্থান নিয়েছে। বিপুল সংখ্যক রাজাকার তাদের অস্ত্র সহ মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করেছে।

 

১৫ ডিসেম্বর ’৭১ (০৭৩০টা) খাদেমনগর

শত্রু খাদেমনগরে (তাদের হেড কোয়ার্টার) শক্তিশালী রক্ষণ অবস্থান নিয়েছে, যেখান থেকে তারা ভারী আর্টিলারি কামান ব্যবহার করছে। আমাদের সেনারা মিত্রবাহিনীর সাথে সম্মিলিতভাবে খাদেমনগরের দিকে অগ্রসর হয়েছে। সারাদিন প্রচন্ড গুলি বিনিময় চলল। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুদলকে সব দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। আমাদের বেঙ্গল রেজিমেন্ট সিলেট শহরে প্রবেশ করেছে। মিত্রবাহিনীর তরফ থেকে শত্রুকে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মসমর্পনের উপদেশ জানানো হয়েছে।

 

১৬ ডিসেম্বর ’৭১ খাদেমনগর

শত্রু সম্মিলিত বাহিনীর প্রস্তাব মেনে নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করেছে।

 

১৭ ডিসেম্বর ’৭১ (১২০০টা) এমসি কলেজ

১৭ ডিসেম্বর ’৭১ তারিখে শত্রু তাদের সব সৈনিককে এমসি কলেজে অস্ত্র অ্যান্ড গোলাবারুদ সহ জড়ো করে এবং মিত্রবাহিনীর কমান্ডারের হাতে তুলে দেয়।

 

 

নীলাঞ্জনা অদিতি

<১০, ৮.৩, ২৭৮-২৮২>


সাক্ষাৎকারঃ মেজর ওয়াকিউজ্জামান

আমার পিতা ছিলেন এক্স আর্মি ম্যান। ২৪ তারিখের দিকে পাকিস্তান আর্মি আমাদের বাড়িতে আসে। সিলেটের বাসায় আমরা ছিলাম না, অন্য বাসায় ছিলাম। তারা বাসা তছনছ করে চলে গেল। তাদের উদ্দেশ্য হল আমার পিতাকে হত্যা করা এবং আমাদের উপর প্রতিশোধ নেওয়া। এরপর আমার এমন ঘৃণা জন্মে যে, আমি তাড়াতাড়ি মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগ দেই এবং তারপর ইন্ডিয়া চলে যাই।

প্রশ্নঃ ইন্ডিয়া আপনি কবে গেলেন?

উত্তরঃ ইন্ডিয়া আমি ক্রস করেছি ৩০ শে মার্চের দিকে।

প্রশ্নঃ ৩০ শে মার্চে আপনি ইন্ডিয়া গেলেন। ইন্ডিয়ার আপনি কোথায় গেলেন?

উত্তরঃ প্রথমে করিমগঞ্জে।

প্রশ্নঃ করিমগঞ্জে ত ফোর সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছিল।

উত্তরঃ প্রথমে ছিল। যেখানে আমাদের রিক্রুটমেন্ট করা হয়েছিল ওটা ছিল সেটেলমেন্ত অফিস। ওর কাছে একটি স্কুল ছিল, সেখান থেকে আমরা ট্রেনিং নিয়েছিলাম। প্রথমে আমাদের যখন সিলেকশন করা হল সেটেলমেন্টে, ওখান থেকে আমাদের কলকলিঘাট নামক একটি জায়গা আছে সেখানে কিছুদিন ট্রেনিং চলে। যে ট্রেনিংটা হয়েছিল ওটা আমাদের বি এস এফ দিয়েছিল। আমাদের ভাল ট্রেনিং এর জন্য পরে ইন্ডিয়ান আর্মির কাছে পাঠানো হয়েছিল, সেটা ইন্দ্রনগরে ছিল।

প্রশ্নঃ ওটা কতদিনের ট্রেনিং ছিল?

উত্তরঃ ওখানে আমি এক মাস ছিলাম। কিন্তু আমি তিন সপ্তাহ ট্রেনিং করার পর আমাকে সিলেকশান করে নিয়ে আসল ইন্টেলিজেন্সের জন্য। আমাকে এক সপ্তাহ ট্রেনিং দেওয়া হয় ইন্টেলিজেন্সির উপর এবং তারপর আমাকে সিলেটে পাঠান হয় বিভিন্ন সংবাদ সংগ্রহের জন্য।

প্রশ্নঃ আপনি এরকম কটা টাস্ক করেছেন ?

উত্তরঃ প্রথমবার একটাই অপারেশান, এরকম একটা টাস্ক করতে এসেছি সিলেটে। আমার কাজটা ছিল কোন জায়গায় কি ধরনের ফোরসেস আছে সে সম্বন্ধে জানানো। সে ইনফরমেশনটা আমি দিয়ে দেই এবং দেয়ার পর উনারা আমাকে একটা টাস্ক দেন। আমার সাথে কুমিল্লার দুজন ছেলে ছিল, সিলেট টাউনের ভেতরে একটা এক্সপ্লোশন করার জন্য। কারন সিলেট টাউনটা আমি যখন দেখেছি তখন সিলেট টাউনটা একেবারে নরমাল ছিল। দেখলে মনে হত না যে, বাংলাদেশের লোক স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে বা সংগ্রহ করছে। এ রকম কোন পরিস্থিতি সিলেট টাউনে ছিল না।

প্রশ্নঃ ওটা কোন মাসে?

উত্তরঃ ওটা ছিল মে এর দিকে। আমি গিয়ে যখন এ কথাটা বললাম পরে আমাকে ইন্ডিয়ান ইকো সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন ব্রিগেডিয়ার ওয়াটকে, তিনি আমাকে একটা মিশনের জন্য সিলেট পাঠালেন- তুমি গিয়ে একটা এক্সপ্লোশন কর তখন লোকে বুঝবে যে সংগ্রাম হচ্ছে এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হবে যাতে আরো লোক আমাদের দিকে আসে এবং পাকিস্তান আর্মি এত ফ্রিলি যাতে মুভ করতে না পারে। যেদিন উনি বললেন তার পরের দিন আমরা রওনা হলাম।

প্রশ্নঃ আপনারা কজন  রওনা হলেন?

উত্তরঃ আমরা চারজন ছিলাম। তিনজন কুমিল্লার ছেলে ছিল আর আমি একা সিলেটের ছেলে ছিলাম। আমরা সিলেট টাউনে আসলাম তিনদিন হাঁটার পর।

প্রশ্নঃ আপনার সঙ্গে কে কে ছিল?

উত্তরঃ আমার সঙ্গে কুমিল্লার একজন ছেলে ছিল রেবতী নাম, আর একটা ছেলে ছিল ওর নাম হল সিদ্দিক, আর একজন ছিলেন উনি মারা গেছেন উনার নাম ছিল হাফিজ।

প্রশ্নঃ আপনাদের সাথে আর্মস কি ছিল?

উত্তর্ঃ আমাদের সাথে শুধু গ্রেনেড ও এক্সপ্লোসিভ ছিল। সিলেটে আমি তিনদিন হাঁটার পর। সিলেটে একদিন ছিলাম। সিলেট টাউনে আমাদের বাড়িটা খালি ছিল। ওটাতেই আমরা এক রাত্রি কাটালাম।

প্রশ্নঃ কোন লোক জানতে পারেনি?

উত্তরঃ না জানতে পারেনি। সিলেটের কয়েকজন লোক আমাকে দেখেছে কিন্তু দেখে সন্দেহ করেনি।কারন আমি কোন পলিটিক্যাল পার্টি বা কোন স্টুডেন্ট অরগাজাইসেশনএর মেম্বার ছিলাম না। এই জন্য ওরা আমাকে সন্দেহ করেনি। যেদিন পৌছলাম সেদিন রাত্রে আমরা সিলেট টাউন টা রেকি করলাম। এর পরের দিন রাত্রি আনুমানিক একটার সময় সিলেট টাউনের সেন্টারে সিলেট টাউনে নাইয়ার পুল নামক একটা জায়গায় আছে রামকৃষ্ণ মিশন। রামকৃষ্ণ মিশনের সামনে একটি ট্রান্সফরমার ছিল এবং টেলিফোনের একটি জংশন বক্স ছিল। ওই দুটা আমি সিলেক্ট করি। আমি দেখলাম টাউনের বাইরে করলে খুব একটা এফেক্ট হবে না, এটা টাউনের হার্ট, এখানে করা উচিত- তখন আমরা ওইখানে-

প্রশ্নঃ আচ্ছা ওখানে কোন গার্ড ছিল না?

উত্তরঃ ওখানে যখন আমরা প্রথম গেলাম তখন রাস্তায় আমাদের সাথে পুলিশের দেখা হল। পুলিশ টরচলাইট মেরে আমাদেরকে দেখে যখন পিছে সর চলে গেল তখন ওই রাস্তাতা বাদ দিয়ে অন্য রাস্তায় আসলাম। একটি পুকুর ছিল, পুকুরটার সাইডে কচুরিপানার ভিতর দিয়ে আসলাম এবং ওখানে গার্ড ছিল। গার্ডও ওখান থেকে ৫০/৬০ গজ দূরে একটি দোকানের আড়ালে ছিল। ওরা খেয়াল করেনি। তখন হঠাত বৃষ্টি শুরু হল। বৃষ্টির মধ্যে আমরা আমাদের এক্সপ্লোসিভ বাঁধলাম। আমরা চারজন ছিলাম। দুজন টেলিফোনে বাঁধলাম আর দুজন ট্রান্সফরমারে বাঁধলাম। টেলিফোনেরতা আমরা কমপ্লিট করতে পেরেছিলাম, ট্রান্সফরমারটায় করেছিলাম একটু তাড়াহুড়ার ভিতরে, ওটার এয়ার টাইট হতে পারেনি, এদিকে গাড়ির পেট্রোল আসছিল সেহেতু ওটা তাড়াতারি আমাদের এক্সপ্লশন করতে হল, ট্রান্সফরমার যেটা ছিল ওটা এক্সপ্লোশন হয়নি। টেলিফোনটা এক্সপ্লোশন হয়েছিল। আমরা টোটাল সময় ছিলাম ৩৬/৩৭ মিনিট। ওটা এক্সপ্লোশন হওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে আমরা উইথড্র করে বেরিয়ে আসি এবং সিলেট টাউনের কুশিয়ারা নদী পার হয়ে আসি। ওরা আমাদের পারসু করেছিল কিন্তু ধরতে পারেনি। ওই দিন আমরা পুরা দিন হাঁটি। সন্ধ্যার দিকে আমরা বর্ডারের কাছে এসে পৌছি। সন্ধ্যার দিকে বর্ডারে ফিরে একটি গ্রামে আমরা রাত্রে থাকি। পরের দিন সকালে আমরা রওনা দেই। রওনা দেয়ার সময় আমাদের কিছু লোক ধরে ফেলেছিল। ওখানে কিছু লোক সন্দেহ করে এবং আমাদেরকে একটি ঘরে বন্ধ করা হয়েছিল। বন্ধ করে পাকিস্তান আর্মিকে খবর দেওয়া হয়েছিল। আমরা চারজন ছিলাম। আমি ওদেরকে বললাম যে, এখন পাকিস্তান আর্মি আসলেও আমরা মারা যাব আর এভাবেও আমরা মারা যাব। কিন্তু এখান থেকে বর্ডার মাত্র ৫ মাইল। আমরা শেষ চেষ্টা করি তখন আমরা একটু হৈ চৈ করলাম। ওদের একটা লোক আসল। তখন আমি বললাম দেখ আমাদের কাছে ২৪ টা গ্রেনেড আছে।আমরা যদি দুটা গ্রেনেড মারি তখন তোমাদের এখানে কিছু থাকবে না, বেশী ঝামেলা করো না। এই কথা বলে আমি একটা গ্রেনেড বাইরে থ্রো করলাম, থ্রো করতেই লোকজন সরে গেল। এই সুযোগেই আমরা বলতে গেলে পাঁচ মাইল দৌড়ে চলে এসেছি।

প্রশ্নঃ ওটাই কি সিলেট শহরে ফার্স্ট এক্সপ্লোশন?

উত্তরঃ ওটাই সিলেটের ফার্স্ট এক্সপ্লোশন, বলতে গেলে ওটাই লাস্ট এক্সপ্লোশন। এরপর কোন এক্সপ্লোশন সিলেট শহরে হয়নি। তিনদিনের মত লীছিল সেক্টর হেডকোয়ার্টারে পৌছাতে। তার আগে সিলেট টাউন থেকে লোক পালায়, বর্ডার ক্রস করে। যখন আমরা বর্ডার পৌঁছাই করিমগঞ্জে, তখন আমরা পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে সিভিলিয়ানরা যারা ছিল বাংলাদেশ আওয়ামি লীগের বা মুক্তিযোদ্ধারা, ওরা আমাদেরকে বলছিল তোমাদের একসঙ্গে অনেক লোক আসছে আমরা জানি তোমরা অমুক জায়গায় অপারেশন করছ । যে জায়গায় আমরা পৌঁছেছি সে জায়গার নামটা বলছিল। তখন ‘বাংলাদেশ’ নামে একটা পেপার বের হত। পেপারে দেখলাম খবরটা ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। হেডকোয়ার্টারে পৌঁছানোর পর আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলেন এবং পরে জেনারেল দল ও জিজ্ঞসাবাদ করলেন- কেমনে কি করলাম, কোথায় থাকা হল।

প্রশ্নঃ নেক্সট টাস্ক আপনাকে কবে দেয়া হল?

উত্তরঃ এরপর আমি টাস্ক করতে পারিনি। কারণ যেদিন পৌছলাম তার একদিন পর কমিশনের ইন্টারভিউর জন্য ডাকল।

প্রশ্নঃ আচ্ছা, তারপর আপনি চলে গেলেন ট্রেনিং এ – মূর্তিতে। ওখানে কতদিন ট্রেনিং নেন?

উত্তরঃ আমি আবার ফোর সেক্টরে চলে আসি। এখানে আসার পর আমাদের আবার এক সপ্তাহের ট্রেনিং এ ইন্দ্রনগরে পাঠানো হল এবং ওই জায়গায় আমাদের টাস্ক দেয়া হল মহড়া হিসাবে। আমাদের সেক্টর কমান্ডার কতটুকু ট্রেনিং নিচ্ছে এবং কার কতটুকু ক্যাপাবিলিটি আছে সেটা জানার জন্য উনি কিছু টাস্ক নেন। ঐ টাস্ক টা নেয়ার পর আমরা আবার শিলচর চলে আসলাম। শিলচরে চলে আসার পর আমরা বিভিন্ন যে অফিসার চার পাঁচজন ছিলাম আমাদেরকে বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হল। আমাকে দেয়া হল কৈলাশ শহর সাব সেক্টরে সাব সেক্টর কমান্ডার হিসাবে। কারন আমার আগে যিনি ছিলেন উনি একজন ইন্ডিয়ান অফিসার ছিলেন। উনার নাম ছিল ক্যাপ্টেন হামিদ।

প্রশ্নঃ ওই সাব সেক্টরে জয়েন করার পর আপনার প্রথম টাস্ক কি ছিল?

উত্তরঃ এই সাব সেক্টরে জয়েন করার পর ওখানে কিছু এলাকা ছিল আমাদের ছেলেরা দখল করে মানে ডিফেন্স লাগায়। আমাকে টাস্ক দেওয়া এই ডিফেন্সে প্রায়ি এটাক আসত পাকিস্তান আর্মির। কারণ আমাদের জায়গাটা ছিল একটা খালের পাড়ে।

প্রশ্নঃ ওটা কি বাংলাদেশের মধ্যেই?

উত্তরঃ বাংলাদেশের মধ্যেই।

প্রশ্নঃ কৈলাশ শহর জায়গাটা কি বাংলাদেশের মধ্যেই?

উত্তরঃ না, কৈলাশ শহরটি একটি ইন্ডিয়ান টাউন। টাউনটার ঠিক বর্ডার টা হল বাংলাদেশের সাথে। এটা ঠিক শমশেরনগরের অপোজিটে। আর আমাদের ঠিক অপজিটে পাহাড়ের উপরে ছিল চাতলাপুর বিওপি।

প্রশ্নঃ আচ্ছা, আপনি যখন সাব সেক্টরে আসলেন তখন সাব সেক্টরের স্ট্রেংথ কত ছিল?

উত্তরঃ তখন আমার কাছে ৬ টা কোম্পানি ছিল। আমাকে প্রথম টাস্ক দেয়া হল ডিফেন্স টা অরগানাইজ করতে। কারণ বারবার ওর উপরে পাকিস্তান আর্মির এটাক আসছে। একবার ওরা আবার নিয়েও গিয়েছিল। তারপর আবার রিক্যাপচার করা হয়েছিল। আমি ডিফেন্স টা অরগানাইজ করলাম। কারন এটাই বলতে গেলে বাংলাদেশের একমাত্র জায়গা ছিল, তখনকার দিনে সিলেট সেক্তরে বংলাদেশের আর কোন জায়গা ছিল না। আমার সেক্টর কমান্ডার পার্সোনালি আমাকে বলতেন তুমি এই জায়গাটা কোনক্রমেই ছাড়বে না। ওটা আমার দায়িত্ব ছিল। এছাড়া বিভিন্ন অপারেশন করার জন্য মৌলভীবাজারের দিকে আমাকে দায়িত্ব দেয়া হল। আমি প্রথম অপারেশন করি ওখান থেকে একটু আগে এওটি জায়গা আছে তার নাম হল মনু ব্রিজ, তার কাছে একটি স্কুল আছে, ঐ স্কুলের ওখানে আমরা পেট্রোলিং বসালাম।

প্রশ্নঃ ওটা কোন মাসে?

উত্তরঃ ওটা হল অক্টোবরের লাস্টের দিকে। পেট্রোলিং এ গেলাম। ট্রেনিং থেকে আসার পর আমি কিছু এক্সপ্লোসিভ নিয়েছিলাম। আমি আসার সময় ঐ এক্সপ্লোসিভ ও  একটা বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ নিয়ে গেছিলাম। ফ্ল্যাগ উপরে লাগালাম, নীচে বাঁশের ভিতরে এক্সপ্লোসিভ দিয়ে বাঁশের নীচে রিলিজ সুইচ দিয়ে ওখানে লাগিয়ে আসছিলাম। ভাবলাম সকালে যদি ওরা আসে বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ দেখলেই ওরা উঠাতে আসবে। উঠাতে আসলে আমার রিলিজ সুইচটা যদি রিলিজ হয়ে যায় ওখানে একটা এক্সপ্লশন হবে এবং হয়েছিলও। পরের দিন যখন ওদের পেট্রল এসে ফ্ল্যাগ টা নামাতে গেছে তখন এক্সপ্লোশন হয়। এটা ছিল আমার ফার্স্ট অপারেশন।

এর পরে আমাকে দেয়া হল একটি জিটারিং অপারেশন। এটা হবে অক্টোবরের ৩০ তারিখ। আমাদের সামনে যে ডিফেন্স টা ছিল ওদের এই ডিফেন্স থেকে খুব বেশী ফায়ারিং আসত।

প্রশ্নঃ ডিফেন্স টা কোথায়?

উত্তরঃ চাতলাপুর বিওপি। ওখান থেকে খুব বেশী ফায়ারিং আসত, আমাদের কন মুভমেন্ট হলে ফায়ারিং হত। ওদেরকে শায়েস্তা করার জন্য আমাকে জিটারিং অপারেশনে পাঠানো হল। আমার স্ট্রেংথ ছিল প্রায় এক প্লাটুন। এবং আর্টিলারি সাপোর্ট নিয়ে ওটা আমি রেইড করেছিলাম। ওদের দুই নাম্বার ও তিন নাম্বার প্লাটুন থেকে যে ফায়ার আসছিল ঐ ফায়ারের জন্য আমরা বেশিক্ষন টিকতে পারিনি। ১৫ থেকে ২০ মিনিটের ভিতর ঐ জায়গাটা ছেড়ে দিতে হয়েছে। এরপরে আমরা বিভিন্ন পেট্রোলিং ও ছোটখাট এমবুশ করেছি রাজাকারদের উপরে। শমশেরনগর থেকে মনুর দিকে কুলাউড়ার দিকে যেতে যে রেললাইন টা পরে ওর ভিতরে একটা দুইটা এমবুশ করেছি। লাস্টে আমাকে টাস্ক দেয়া হয় নভেম্বরের ২৯ তারিখে। শমশেরনগরে এটাক হবে, সেই এটাকের জন্য শমশেরনগর ও মৌলভীবাজারের ভিতরের রাস্তা টা ব্লক করতে হইবে। শমশেরনগর স্টেশন থেকে প্রায় চার পাঁচ মাইল আগে একটা দীঘি আছে রাস্তার উপরে, ওই দীঘির উপরে আমাকে পজিশন নিতে বলা হল আমার সাথে ছিল ইন্ডিয়ান আর্মির একটা কম্পানী। আমরা ২ টা পর্যন্ত ওখানে পজিশন নিলাম। এবং পুরো দিনটা রোডটা কাট অফ করে রাখলাম। সকালের দিকে আমাদের অপারেশন ভাল ছিল। সন্ধ্যার দিকে আমাদের ওপর এত বেশী আর্টিলারি ফায়ারিং আসছিল যে, আমার লেফটে যে ইন্ডিয়ান কোম্পানি ছিল সে কোম্পানীটা উইথড্র করে চলে গেল। এবং সে আর্টিলারি শেলিং এ পরে খুব বেশী ক্যাজুয়েলটি হয়েছিল।

প্রশ্নঃ ওটা কোন জায়গায় এটাক করেছিলেন?

উতরঃ ওটা এটাক না আমাদের ডিফেন্স নিতে বলা হয়েছিল যাতে রোডটা কাট অফ করে দেওয়া হয়, রোডটা যাতে অরা ইউজ করতে না পারে। মৌলভিবাজার থেকে যাতে কোন রিফোরসমেন্ট শমশেরনগরে দিকে যেতে না পারে। আমরা ওখানে ছিলাম, সকাকের দিকে আমরা অপারেশন করেছিলাম। ওদের একটি গারি রিফোরস্মেন্ট আসছিল। আমাদের শেলিং এ ওই গাড়িটি নশট হয়ে যায় এবং প্রায় ৩০ জনের মত লোক মারা যায়। এরপরে শমশেরনগর থেকে যে সমস্ত লোক আমাদের দিকে আসতে চেষ্টা করেছিল তাদের উপর ফায়ার ওপেন করলে প্রায় ৬/৭ জন মারা যায়। এরপর ওরা ঐদিনের মত স্টপ করে এবং বিকেলের দিকে ওরা আমাদের উপর এত বেশী আর্টিলারি ফায়ারিং এবং মর্টার ফায়ারিং হেভি মর্টার ফায়ারিং শুরু করেছিল যে আমার বামদিকে ইন্ডিয়ান যে কোম্পানীটা ছিল তাদের পক্ষে থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। তারা সেখান থেকে উইথড্র করে। কারন তাদের সেখানে খুব্বেশি ক্যাজুয়েলটি হয়েছিল। ঐদিন প্রায় ৩০/ ৪০ জনের মত ক্যাজুয়েলটি হয়েছিল। এর মধ্যে দুজন অফিসারো ছিল।

কৈলাশ শহরে আসার পর পরের দিন ২০ তারিখ সন্ধ্যার দিকে আমাকে পাথানো হল মনুতে যাবার জন্য। মনুতে পাকিস্তানী আর্মির একটা ঘাঁটি ছিল। মনু একটি রেলস্টেশন। মনু রিভারের উপর দুটো ব্রীজ আছে। একটা রেলওয়ে ব্রীজ আর একটা রবোরড ব্রীজ। যেটার সাথে শমশেরনগরের লিঙ্ক আছে কুলাগরের আর কুলাগরের লিঙ্ক আছে মৌলভীবাজারের সাথে।

প্রথম দিন গেলাম রাতে, আমরা পৌছুলাম ১২ টার দিকে। তিন টার দিকে ওদের পজিশন দেখতে গেলাম। পজিশন ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। দু পারেই পজিশন ছিল।

প্রশ্নঃ ওটা কত তারিখে?

উত্তরঃ ওটা ডিসেম্বরের প্রথম তারিখে। ডিসেম্বর এক তারিখ রাতে আমরা এতাক করি আমরা মনু ক্যাপচার করি। আমাকে তারপর বলা হল মনু রিভার ফলো করে মৌলভীবাজারের দিকে যেতে এবং যাওয়ার সময় যাতে রাজনগর থানা এলাকা দেখে যাই। আমি মনু রিভার ফলো করে রাজনগর থানা এলাকায় গেলাম।

প্রশ্নঃ আপনি সমস্ত ট্রুপ্স নিয়ে চলে গেলেন?

উত্তরঃ সমস্ত ট্রুপ্স নিয়ে রাজনগর এলাকায় গেলাম। রাজনগর এলাকা আমরা মার্চ করলাম। দেখি ওদিকে কোন ফোরস নাই। তারপর আমরা ওদিকে মোউলভীবাজার আসলাম মৌলভীবাজার থেকে আমি ফেঞ্চুগঞ্জ পর্যন্ত আসছলিলাম। এর ভিতরে আমার সাথে আর কোন ফোরসের দেখা হয়নি। ইন দি মিন টাইম সারেন্ডার হয়ে যায়।

 

                           শিরোনাম সূত্র তারিখ
৯। ৫নং সেক্টরে সংঘটিত যুদ্ধ সম্পর্কে বিবরণ একাত্তুরের রণাঙ্গন- শামসুল হুদা চৌধুরী .১৯৭১

মুক্ত বিহঙ্গ

<১০, , ২৮৩২৮৭>

সাক্ষাৎকারঃ লেঃ জেনারেল (অবঃ) মীর শওকত আলী*

প্রশ্নঃ একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে আপনি কখন কিভাবে কাজ শুরু করলেন?

উত্তরঃ   প্রথমে আমি জেনারেল জিয়া (তৎকালীন মেজর)- এর সাথে এক নম্বর সেক্টরে সেকেন্ড-ইন কমান্ড অর্থাৎ দুই নম্বর হিসেবে কাজ শুরু করি। ৩০শে মার্চ, ’৭১-এর পর জেনারেল জিয়া আমার সাথে আর ছিলেন না। তিনি রামগড় হয়ে সীমান্তের ওপারে চলে গিয়েছিলেন। কাজেই ৩০শে মার্চের পর থেকে উল্লিখিত সেক্টরের পুরো বাহিনীর কমান্ড আমার হাতে এসে পড়ে। আমি, বিডিআর, ছাত্র-জনতা, এবং আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক দল নিয়ে গঠিত বাহিনী নিয়ে ২রা মে, ’৭১ বিকেলে আমরা সীমান্তের ওপারে চলে গিয়েছিলাম। কিছুদিন পর জেনারেল ওসমানী সাহেব আমাকে ডেকে বললেন, ‘সিলেট এলাকায় আমাদের কোনও সেক্টর খোলা হয়নি এবং সিলেটের সুনামগঞ্জ, ছাতক এবং সালুটিকর- এইসব এলাকায় অনেক বিডিআর এবং সৈন্য বিশৃংখল অবস্থায় আছেন। কাজেই তিনি আমাকে অবিলম্বে শিলং চলে যেতে বললেন। তিনি নির্দেশ দিলেন ওখান থেকে আমি ছাতক এবং সুনামগঞ্জ এলাকায় গিয়ে যেন যুদ্ধ সংগঠন করি।

প্রশ্নঃ আপনার আনুষ্ঠানিক নিযুক্তি এবং সেক্টর সম্পর্কে ব্যাখ্যা দান করুন।

উত্তরঃ সরকার গঠিত হওয়ার পর আমাকে পাঁচ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত করা হলো। এলাকা দেয়া হলো ডাউকী থেকে সুনামগঞ্জের বাঁ দিকে বড়ছড়া নামক স্থান পর্যন্ত। এক কথায় বলা যায় ডাউকী থেকে ময়মনসিংহের সীমান্ত পর্যন্ত ছিল আমার সেক্টরের সীমানা। সিলেটে গিয়ে আমি দেখলাম আমাদের লোকজন খুব বিশৃংখল অবস্থায় আছেন। তাদের জন্য ওখানে না ছিল কোনও রসদপত্র, না ছিল কোনও যুদ্ধ সংগঠন।

আমি আমার এলাকাটিকে পাঁচটি সাব-সেক্টরে ভাগ করে দিয়েছিলাম। এই সাব সেক্টরগুলি ছিল ডাউকী, ভোলাগঞ্জ, শেলা, বালাত এবং বড়ছড়া, আমি বুঝলাম যে বিদেশের মাটিতে বসে দেশে যুদ্ধ করা যায় না। কাজেই সবদিকে আক্রমন চালিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে জায়গা করে নেয়াই আমি আমার প্রধান কর্তব্য মনে করলাম। এরই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সীমান্তের দশ মেইল অভ্যন্তরে আক্রমণ পরিচালনা করলাম এবং আমরা সফল হলাম। এক পর্যায়ে আমরা সুরমা নদীর উত্তর ভাগে পুরা অংশ আমাদের দখলে নিয়ে এলাম। আমরা আমাদের হেডকোয়ার্টার স্থাপন করলাম বাঁশতলায় (ছাতকের উত্তরে বাংলাদেশেরই একটি এলাকা)। সিলেট থেকে নদীপথে যেসব ছোট ছোট বার্জ এবং ছোট ছোট জাহাজ রসদপত্র নিয়ে ঢাকার দিকে যেতো সেগুলিকে আমরা পথে ধরতাম এবং রসদপত্রাদি কেড়ে নিয়ে কিছু আমাদের কাজে লাগাতাম এবং কিছু বাংলাদেশ হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়ে দিতাম। সেখান থেকে এসব রসদপত্র অন্য সব সেক্টরে চলে যেতো।

প্রশ্নঃ আপনার এই সংগঠনের পর্যায় কোন মাস থেকে শুরু হয়েছিল?

উত্তরঃ হুবুহু দিন-তারিখ আমার মনে নেই, তবে জুন কিংবা অনুরূপ সময় হতে পারে।

 

প্রশ্নঃ শুরুতে আপনার সৈন্যসংখ্যা কতজন ছিল? তখন নতুনদের প্রশিক্ষণের কি ব্যবস্থা নিয়েছিলেন?

উত্তরঃ প্রথমে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, বিডিআর, পুলিশ এবং মুক্তিযুদ্ধে উৎসাহী কিছু ছাত্র-জনতাসহ প্রায় চারশত লোক পেলাম। বর্ডারের ওপাররে এবং বাঁশতলায় আমরা ট্রেনিং ক্যাম্প করলাম। ভারত থেকে দু’একজন জেনারেল এসেছিলেন, তারাও কয়েকটি ট্রেনিং ক্যাম্প সংগঠন করলেন। দেশের অভ্যন্তরে থেকে যারা ওখানে গিয়েছিলেন তাদের মধ্য থেকে শক্ত সমর্থদের বেছে নিয়ে ট্রেনিং দেয়া হলো। আস্তে আস্তে বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে এই সংখ্যা প্রায় বার হাজারে গিয়ে দাঁড়ালো।

প্রশ্নঃ সরকার গঠিত হওয়ার পরের কথা বলুন।

উত্তরঃ সরকার গঠিত হওয়ার পর আমাকে সিলেট পাঠানো হলো ৫নং সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে। এলাকাটি ছিল দুর্গম। গাড়ী চলাচল করতে অসুবিধা হতো। সবটাই ছিল হাওড় এবং বিল এলাকা। সুনামগঞ্জ-ছাতক এলাকায় হয় নৌকা নতুবা পায়ে হেঁটে, সাঁতার কেটে এদিক ওদিক চলাচল করতে হতো। এসব জায়গায় সাংবাদিকও তেমন আসতেন না। সরকারের পক্ষ থেকেও লোকজন তেমন আসতেন না। একবার একজন কর্মকর্তা এসেছিলেন। তিনি হলেন নুরুল কাদের খান, যুদ্ধকালীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্থাপন সচিব। তিনি শিলং পর্যন্ত এসেছিলেন এবং আমার সাথে রণাঙ্গন পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেছিলেন। তিনি পায়ে হেঁটে আমার এলাকার গুরুত্বপূর্ণ রণাঙ্গনসমূহ পরিদর্শন করেছেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ সাহেবও একবার এসে আমাকে দেখে গিয়েছিলেন। তিনিও পায়ে হেঁটে আমার সেক্টরের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেছিলেন।

প্রশ্নঃ সেক্টর বলতে কোন পর্যন্ত বুঝাচ্ছেন?

উত্তরঃ   বাংলাদেশের ভিতর বাঁশতলা বলে একটা জায়গা আছে। তাজউদ্দীন সাহেব ওখানে এসেছিলেন।

প্রশ্নঃ মুক্তিযোদ্ধাদের আপনি কোথায় এবং কিভাবে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন?

উত্তরঃ   বাংলাদেশের ভিতরে আমাদের অনেকগুলি ক্যাম্প ছিল। সেসব ক্যাম্পে আমাদের সৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিতেন। আবার ভারতের অভ্যন্তরে সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায়ও কিছু প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ছিল। সেসব ক্যাম্পে ভারতীয় সৈন্যরা প্রশিক্ষন দিতেন।

কাজেই মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণের দু’টি উৎস ছিল। একটি ছিল সেটা আমি নিজে সংগঠন করে বাংলাদেশ থেকে এনে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতাম। আর একটি ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর মাধ্যমে আমাদের সরকার সরাসরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে মুক্তিযোদ্ধাদের পৃথক পৃথকভাবে আমাদের কাছে পাঠাতেন।

প্রশ্নঃ জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীকে কমান্ডার-ইন-চীফ হিসেবে ঘোষনা করার পর আপনি কিভাবে তার সাথে সম্পর্ক চালিয়ে গিয়েছিলেন।

উত্তরঃ আগেই বলেছি জেনারেল ওসমানী সাহেবের সাথে সর্বপ্রথম আমার দেখা হয়েছিল রামগড়ে। তবে এর আগেও ওয়ারলেসে দু’একবার তাঁর নির্দেশ আমি পেয়েছি মহলছড়িতে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায়। তখন আমি বড় রকমের একটি যুদ্ধে লিপ্ত ছিলাম। সে সময় তিনি আমাকে রামগড়ে চলে আসতে বলেছিলেন। আমি তাঁকে জানিয়ে ছিলামঃ পুরো পার্বত্য চট্টগ্রম এলাকা আমার দখলে আছে কাজেই আপনারা কেন পার্বত্য এলাকায় চলে আসছেন না? তিনি পরামর্শ দিলেনঃ এটা ঠিক হবে না। আমরা সবাই মিলে আবার নতুনভাবে সংগঠন করে যুদ্ধ চালিয়ে যাবো। জেনারেল ওসমানী সাহেবের নির্দেশানুযায়ী মহালছড়ির যুদ্ধের পর আমি রামগড়ে চলে গেলাম। জেনারেল ওসমানী ওপার থেকে রামগড়ে এলেন। সেখানেই বাংলাদেশের মাটিতে তার সাথে তার সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল। জেঃ ওসমানী আমাকে খুব প্রশংসা করলেন এবং বললেনঃ আরো দু’দিন রামগড় আটকে রাখতে হবে’। তারিখটি ছিল ৩০শে এপ্রিল, ১৯৭১। আগেই বলেছি ২রা মে বিকেলে আমরা ভারতীয় এলাকায় চলে গিয়েছিলাম। রামগড়কে আরো দু’দিন আটকিয়ে রাখতে বলার কারণ ছিল আমাদের মুক্তিবাহিনী যেসব রসদপত্র নিয়ে ছিলেন সেগুলি পার করার জন্য এবং সীমান্তে আটকে পড়া নিরীহ জনগণকে নিরাপদে ভারতে পার করে যাওয়ার জন্য দু’দিন সময়ের প্রয়োজন ছিল।

প্রশ্নঃ মুক্তিযুদ্ধে যে আপনারা জয়ী হচ্ছিলেন, এটা কখন বুঝতে পেরেছিলেন?

উত্তরঃ অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে। একটা সময় খুব খারাপ এসেছিল জুন-জুলাই মাসে। তখন অনেকে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এমনকি আমাদের এমএনএগণ পর্যন্ত বলতে শুরু করেছিলেনঃ ‘ভাই আর কি দেশে ফিরে যাওয়া যাবে?’ কিন্তু আমরা হতাশায় ছিলাম না। আমরা সব সময় আশাবাদী ছিলাম। কারণ, এতে জড়িত ছিল বাঁচামরার প্রশ্ন। হয় দেশ উদ্ধার করতে হবে, নইলে দেশ-জাতি সবই গেল। তবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে আমরা জয়ের দিকে যাচ্ছি এবং আমরা জিতবই- দু’মাস লাগতে পারে, ছয়মাস লাগতে পারে, আমরা আমাদের নিজেদের শক্তিতে জিতব। এজন্য ভারতীয় সৈন্যের প্রয়োজন হবে না।

প্রশ্নঃ পাকিস্তানী বাহিনীর তুলনায় আপনাদের সৈন্যবলতো খুব কম ছিল, অস্ত্রও ছিল খুবই সীমিত। আপনাদের রণকৌশল সম্পর্কে কিছু বলুন।

উত্তরঃ রণকৌশন যা সাধারণ হওয়া উচিৎ, তাই ছিল। শুরু দিকে যেহেতু আমরা ছোট ছোট দলে গিয়েছিলাম, তাই তখন গেরিলা রণকৌশলকে আমরা প্রধান অবলম্বন হিসাবে বেছে নিয়েছিলাম। কারণ যুদ্ধের নিয়মই হলো যখন কোন বড় শত্রুর সাথে আপনি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে চান, তখন আপনি যদি চিরাচরিত যুদ্ধনীতি ভঙ্গ করে যুদ্ধ করতে হবে, অর্থাৎ গেরিলা যুদ্ধ করতে হবে। এই পদ্ধতিতে আমরা শত্রুদের বড় বড় বাহিনীর উপর আচমকিতে গুলি চালিয়ে পালিয়ে যেতাম। তাতে শত্রুপক্ষের হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশি হতো। অপরপক্ষে আমাদের কিছু হতো না। আমাদের মূল রণকৌশলই ছিল, এই গেরিলা পদ্ধতিতে পাকিস্তান বাহিনীকে রোজ একটু একটু করে আঘাত করে ওদের শক্তি কমিয়ে দেয়া এবং ওদের অসংগঠিত করে দেয়া, ওদের রসদপত্র নষ্ট করে দেয়া ইত্যাদি। আমরা জানতাম যে একটা সময় আসবে যখন আমরা নিয়মিত বাহিনী গঠন করে ওদের আক্রমণ করে আমাদের দেশ পুনরুদ্ধার করতে পারব।

প্রশ্নঃ শত্রুবাহিনী থেকে আপনারা কি পরিমান অস্ত্রশস্ত্র ছিনিয়ে নিয়েছিলেন?

উত্তরঃ প্রচুর। শুরর দিকে আমাদের যা কিছু অস্ত্রশস্ত্র ছিল তাই দিয়ে যুদ্ধ করতাম। পরের দিকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা অনেক অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলাম। যখন আমরা আকস্মিক আক্রমণ চালাতাম তখন তারা পালিয়ে যেতো। তারা পালিয়ে যাওয়ার পর যা অস্ত্রশস্ত্র পড়ে থাকতো সব আমরা নিয়ে নিতাম।

প্রশ্নঃ ৩রা ডিসেম্বর ’৭১ পাকিস্তান এবং হিন্দুস্তানের সাথে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষনার পর আপনার রণকৌশলের কোন পরিবর্তন হয়েছিল কি?

উত্তরঃ হ্যাঁ। তখন আমরা চিরাচরিত যুদ্ধে (কনভেনশনাল ওয়ার) লিপ্ত হয়ে গেলাম। ৩রা ডিসেম্বরের পর প্রথমে আমরা দখল করলাম টেংরা টিলা। তারপর দখল করলাম, ছাতক, তারপর সুনামগঞ্জ। তারপর আমরা সমস্ত বাহিনী সুরমা নদীর এপারে পার করে সোজা সিলেটের দিকে ধাবিত হলাম। আমরা লামাকাজি পর্যন্ত দখল করলাম। তখনই পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের কথা ঘোষিত হয়ে গেল।

প্রশ্নঃ জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরাকে ইষ্টার্ন কমান্ডারের প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করার পর মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর কি ভূমিকা হয়েছিল?

উত্তরঃ জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরাকে কমান্ডে দেয়ার পর জেনারেল ওসমানীই আমাদের জানালেন যে এখন জেনারেল আরোরার নেতৃত্বে যৌথ কমান্ড হচ্ছে। কাজেই আমাদের এলাকায় নিযুক্ত ভারতীয় জেনারেলগণের সাথে ঐ সময় থেকে সংযোগ রক্ষা করে যুদ্ধ করার জন্য তিনি আমাদের পরামর্শ দিলেন।

প্রশ্নঃ জেনারেল ওসমানী সাহেব আর কমান্ড করতেন না?

উত্তরঃ করতেন তবে সরাসরিভাবে আমাদের এমন কোনও বেতারযন্ত্র ছিল না সব সময় যোগাযোগ রক্ষা করে চলার জন্য।

প্রশ্নঃ সম্মিলিত মিত্র ও মুক্তিবাহিনী মিলে ৩রা ডিসেম্বর থেকে ১৬ই ডিসেম্বর অর্থাৎ বিজয়ের পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত আপনারা কিভাবে যুদ্ধ করলেন এবং কিভাবে ঢাকা প্রবেশ করলেন?

উত্তরঃ যুদ্ধনীতির কথা তো ইতিমধ্যেই বললাম। ঢাকার এলাকায় প্রবেশকালে কোন কোন এলায়কায় মুক্তিবাহিনী ছিলেন। আবার অনেকগুলো জায়াগা ছিল যেখানে ভারতীয় বাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন গিয়েছিলেন। এছাড়া মূল সিলেট এলাকায় ভারতীয় বাহিনী তাদের ব্যাটালিয়ন নিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু সুনামগঞ্জ, টেংরাটিলা, ছাতক এসব এলাকাতে একমাত্র মুক্তিবাহিনীই এককভাবে প্রবেশ নিয়েছিলেন।

প্রশ্নঃ ঢাকার দিকে কারা এগিয়েছিলেন?

উত্তরঃ ঢাকা দিকে মেজয় হায়দার ছিলেন। যেহেতু আমি সিলেট সেক্টরে ছিলাম কাজেই এই ব্যাপারে বিস্তারিত জানা নেই।

প্রশ্নঃ আপনার বাহিনীতে মোট মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কত ছিল?

উত্তরঃ শেষের দিকে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত বিশ-পঁচিশ হাজার হয়েছিল।

প্রশ্নঃ তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা কতজন ছিল বলে আপনার ধারণা?

উত্তরঃ দশ-বার হাজার, বাকী দশ-বারো হাজার ছিল তালিকার বাইরে।

প্রশ্নঃ ভারতের মাটিতে আপনি জেনারেল (তৎকালীন মেজর) জিয়াসহ এক সাথে কতদিন যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন?

উত্তরঃ প্রায় মাসাধিক কাল। ২রা মে থেকে জুনের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত।

প্রশ্নঃ মেজর জিয়া কোথায় গেলেন?

উত্তরঃ জেনারেল ওসমানী সাহেব তাকে ‘জেড’ ফোর্স সংগঠনের ভার দিলেন। জিয়া সাহেব ময়মনসিংহের উত্তরে তুরা নামক স্থানে স্থাপন করেছিলেন তার জেড ফোর্সের প্রধান কেন্দ্রস্থল।

প্রশ্নঃ এবার রণাঙ্গনের দু’একটি অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাই। আপনারা ঘুমাতেন কি করে?

উত্তরঃ মাটিতে। কখনো গাছতলায় কখনো বাঁশের খাঁচায়, এমনি মাচাং বানিয়ে উপরে খড় দিয়ে ঢেকে দিতাম। সাধারণত রাতে ঘুমানো সম্ভব হতো না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দু’টি অপারেশন-এর ফাঁকে দিনের বেলায় কিছু সময় ঘুমিয়ে নিতাম। সাধরণতঃ সৈনিকের পোশাকেই ঘুমিয়ে পড়তাম। সৈনিকের পোশাক বলতে  একটি খাঁকি হাফপ্যান্ট এবং পায়ে একজোড়া বুটই আমার পরনে থাকত। এ প্রসঙ্গে আপনাকে একটি ঘটনা বলি। আমি রামগড় থেকে সীমান্ত অতিক্রম করার পর (২রা মে,’৭১ থেকে জুন’৭১- এর মাঝামাঝি সময়) জেনারেল ওসমানী সাহেব গিয়েছিলেন আমাদের দেখতে। আমি তখন অপারেশনে ব্যস্ত। আমার পরনে শুধু একটি খাঁকি হাফপ্যান্ট এবং পায়ে একজোড়া বুট ছিল। গায়ে কোন গেঞ্জি পর্যন্ত ছিল না। মাথা থেকে সমস্ত শরীর ছিল ধুলাময়। খবর পেয়ে ঐ অবস্থায়ই জেনারেল সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলাম। এই একটি মাত্র ঘটানা থেকেই অনুমান করতে পারেন কি অবস্থায় আমরা যুদ্ধ করেছি।

প্রশ্নঃ রণাঙ্গনে একনাগাড়ে কত সময় পর্যন্ত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছিলেন?

উত্তরঃ তিনদিন তিনরাত।

প্রশ্নঃ কোথায়?

উত্তরঃ রামগড়ের উলটা দিকে সাবরুম নামক স্থানে। মে’৭১ থেকে জুন’৭১-এর মাঝামাঝি সময়ে।

প্রশ্নঃ সবচাইতে ভয়াবহ যুদ্ধ আপনি কোথায় করেছেন?

উত্তরঃ সবগুলিই ভয়াবহ, সবগুলিই লোমহর্ষক।

প্রশ্নঃ আপনি অত্যন্ত কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলেন এবং আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে গিয়েছেন, এমন দু’একটি ঘটনা জানতে চাই।

উত্তরঃ এটা একবার হয়নি। বহুবার হয়েছে। এটা বলে শেষ করা যাবে না। বহুবার পাকিস্তানী সৈন্যরা আমার নাকের ডগা দিয়ে অতিক্রম করে গিয়েছে, ধান ক্ষেতে আমি শুয়ে রয়েছি, হামাগুড়ি দিয়ে কিংবা বুকে ভর দিয়ে আমাকে বের হয়ে আসতে হয়েছে। বহুবার ঘেরাওর ভিতর পড়ে গিয়েছিলাম, আবার বের হয়ে গিয়েছি। এই যুদ্ধে একটা বিরাট প্রমাণ, বিরাট বিশ্বাস আল্লাহর উপর আমার বেড়ে গিয়েছে; আমি দেখলাম যে যার মৃত্যু নেই, সে মরতে পারে না- সে যেমন অবস্থায় থাকুক না কেন বেঁচে আসবে। অনেক সময় দেখা গিয়েছে সম্মুখের লোক মারা যায়নি, অথচ পিছনের লোক বেশি মারা গিয়েছে।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১০। ৫ নং সেক্টরে সংঘটিত যুদ্ধ সম্পর্কে অন্যান্যের বিবরণ ……… মে-ডিসেম্বর ১৯৭১

 

 

নওশাবা তাবাসুম

<১০, ১০.১, ২৮৮-২৯০>

 

 

সাক্ষাৎকার: মেজর তাহের উদ্দিন আখঞ্জি*

 

১৯৭১-এর ৯ই অক্টোবরে আমি কমিশন পেলাম। ৯ই অক্টোবর কমিশন পাওয়ার পর সেখান থেকে আমাদের পোষ্টিং করা হলো বিভিন্ন সেক্টর, সাব সেক্টর এবং ব্যাটেলিয়নে এবং সে অনুসারে আমাকেও পোষ্টিং করা হলো ৫ নম্বর সেক্টরে। আমার সাথে ছিলেন মেজর খালেদ, তখন ছিলেন লেফটেন্যান্ট আমরা দু’জন ৫ নম্বর সেক্টরে আসার জন্য আমাদেরকে মুভমেন্ট অর্ডার দেওয়া হলো। আর বলা হলো আমাদের ১১ তারিখ চলে যেতে।

৫ নং সেক্টর বলতে ছিল একটি রেষ্ট হাউজ। ওটার সামনে আমাদেরকে নামিয়ে দিয়ে বলা হলো যে, এটা আপনাদের ৫ নং সেক্টর। আমরা সেখানে গেলাম। একটা দরজা নক করলাম। এক ভদ্রলোক দরজা খুলে দিলেন। তার সাথে পিরিচয় হলো। তিনি বাংলাদেশের একজন এমপি- নামটা ভুলে গেছি। তিনি সিলেট এলাকার একজন এমপি। ঐ রুমের মধ্যে আরোও তিনজন এমপি ছিলেন। তাদের সাথে পরিচয় হলো। আমাদের পরিচয় দেওয়ার পর তারা আংগুল দিয়ে পাশের রুম দেখিয়ে দিলেন। পাশের রুমে দরজায় নক করার পর এক ভদ্রমহিলা বের হলো এবং পরিচয় দিলেন যে, উনি মিসেস শওকত। আমরা আমাদের পরিচয় দিলাম। ৫ নং সেক্টর কমান্ডার তখন অবশ্য ছিলেন না। ছাতকে একটি অপারেশন গিয়েছেন। মিসেস শওকত আমাদেরকে রিসিভ করলেন। এবং সেখানে আমাদের থাকা খাওয়ার ব্যাবস্থা হলো। প্রায় ৫ দিন থাকার পরে আমরা রাতের বেলা দেখলাম জেনারেল (তখন লেফটেন্যান্ট কর্নেল) শওকত আসছেন। তার পরনে একটি হাফপ্যান্ট আর জীনসের কালো একটি হাফশার্ট। মুখে বেশ লম্বা দাড়ি হয়ে গেছে। যাই হোক, তার সাথে মিসেস শওকত আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। পরের দিন সকালে তিনি একটা গাড়িতে করে আমাদের দু’জনকে একটা সাবসেক্টরে নিয়ে গেলেন। ঐ সাব-সেক্টরের নাম ছিল শেলা সাব-সেক্টর। সোলা সাব-সেক্টর পর্যন্ত গাড়ি যেতো। সেখান থেকে আমাদেরকে পদব্রজে তিনি নিয়ে আসলেন ভোলাগঞ্জ সাব-সেক্টরে। আসার পর বললেন, এটা তোমাদের সাব-সেক্টর। এখানে তোমরা দু’জন থাকবে। এই সাব-সেক্টরে দেখলাম প্রায় দের হাজার ছেলে। এবং এর দের হাজার ছেলের তখন কোন কাজ নেই। একটা কোম্পানি ছিল প্রায় ১০০ জন লোকের। আর বাকি সব ছিল এফ-এফ, একজন সিভিল অফিসারের অধীনে, নাম আলমগীর। তিনি সিএন্ডবি’র একজন ইঞ্জিনিয়ার। তার কাছ থেকে আমাকে চার্জ বুঝে নেওয়ার জন্য বলা হলো। নাম্বারে আমি সিনিয়র ছিলাম মেজর খালেদের (তখন লেফটেন্যান্ট) চেয়ে। তাই সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসাবে চার্জ নিলাম। চার্জ নিয়ে অর্গানাইজ করলাম। অর্গানাইজ করার পর জেনারেল শওকত আমাদের এই সাব-সেক্টরে তিন দিন ছিলেন। এখানে হলো পাঁচটি কোম্পানি আলফা কোম্পানী, গ্রেকো কোম্পানী, চার্লি কোম্পানী, ডেলটা কোম্পানী, একো কোম্পানী। আরেকটা কোম্পানি ছিল ছিল এল এফ কোম্পানি মোট ছয়টি কম্পানির চার্জ নিলাম আমি। অপারেশন এরিয়া সম্বন্ধে জেনারেল শওকত আমাকে ব্রিফ করে দিলেন। অপারেশন এরিয়াটা ছিল বিরাট, যার জন্য উনি একটা সাব জোন ভাগ করলেন। সাব জোন এর মধ্যে তিনি তিনটা কোম্পানী দিয়ে মেজর খালেদকে ইনচার্জ করে তার দায়িত্ব দিলেন। আর বাকি কোম্পানী গুলোর দায়িত্ব আমাকে দিলেন। রেশন, সাপ্লাই ইত্যাদি কাজের জন্য রইলেন আলমগীর আগে যিনি সাব সেক্টর কমান্ডার হিসাবে কাজ করতেন। এরপর জেনারেল শওকত চলে আসলেন এবং আমরা সপ্তাহখানেক পর্যন্ত ট্রেনিং পরিচালনা করলাম। আর পুরো এলাকাটা যতটুকু সম্ভব ‘রেকি’ করলাম। আমাদের ক্যাম্পটি ছিল ভোলাগঞ্জ সাব-সেক্টরে। এটা বাংলাদেশের ভেতরেই ছিল ইন্ডিয়ার বর্ডার থেকে প্রায় ৭ মাইল ভেতরে। ঐ এলাকাটাতে পাকিস্তান আর্মি তখনো আসে নাই।

গৌরীনগর গ্রামে অবস্থান নেওয়ার উদ্দেশ্যে ১৮ই অক্টোবর রাতে দুই কোম্পানী সৈন্য নিয়ে ২৫টি দেশী নৌকাযোগে গৌরীনগরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। আগের দিনই ঐ গ্রামে রেকি করে এসেছিলাম। কিন্তু রেকি করে আসার পরই পাকসেনারা যে ঐ গ্রামে অবস্থান নিয়েছিল, সে খবর জানা ছিল না।

১৮ই অক্টোবর নৌকাযোগে গৌরীনগরের কাছাকাছি হতেই পাকসেনারা বেপরোয়াভাবে গৌরীনগর থেকে আমাদের লক্ষ্য করে গুলি চালাতে থাকে। অকস্মাৎ এই আক্রমনের জন্য আমরা আদৌ প্রস্তুত ছিলাম না। ২৫টি নৌকাভর্তি আমাদের বাহিনী নদীপথে রাতের দিক হারিয়ে ফেললো। এ অবস্থায় অনেক চেষ্টার পর আমি আমামার বাহিনী নিয়ে সরে এসে বর্নি নামক স্থানে অবস্থান নিলাম। গৌরীনগর গ্রামে পাকিস্তানীদের প্রচন্ড গোলার মুখে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং ৬ জন গুরুতররূপে আহত হয়।

বর্ণিত সুবেদার মোশারফ এবং এফ-এফ মাহবুবের কমান্ডে কোম্পানী দুটি রেখে আমি হেডকোয়ার্টার ফিরে গেলাম। বর্ণিত অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর উপর আক্রমণের মুখে সুবেদার মোশাররফ এবং এফ-এফ মাহবুব তার বাহিনী নিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করে ব্যার্থ হলেন। শেষ পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী পিছু সরে ডাকাতের বাড়ী এবং দলিরগাঁও-এ পুনরায় প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা গড়ে তোলে। বর্নির সংঘর্ষে পাকসেনাদের হাতে বন্দী এবং বেশকিছুসংখ্যক যোদ্ধা আহত হয়। মুক্তিবাহিনীর এই বিপর্যয়ে ২২/২৩শে অক্টোবর আমি সেক্টর কমান্ডার শওকতের নির্দেশে ২০০ জনের মত মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ভোর পাঁচটায় বর্ণিত পাক অবস্থানের উপর আক্রমণ চালাই। বাঁদিক থেকে আমার বাহিনী এবং ডানদিক থেকে সুবেদার মোশাররফের বাহিনী তীব্রভাবে আক্রমণ করে। আমাদের বাহিনী বর্নিতে ঢুকে পড়ে। পাকসেনারা ফ্রন্ট লাইন ছেড়ে পিছনে সরে পাল্টা আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তানীরা বিপর্যয় অবস্থা কাটিয়ে পাল্টা আক্রমণ করে। তাদের তীব্র আক্রমণের মুখে আমাদের বাহিনী পিছু হটতে শুরু করে। এই সময় আমি সেক্টর কমান্ডারের কাছে অয়ারলেসযোগে বার বার সাহায্য প্রার্থনা করি। এই বার্তা পেয়ে সেক্টর কমান্ডার শওকত মুক্তি বাহিনীর একটি প্লাটুনকে অস্ত্র, গোলাবারুদ দিয়ে পাঠান। এই প্লাটুনকে পৌঁছানোর ফলে আমাদের মনোবল অনেক বেড়ে যায় এবং পাকিস্তানীদের উপর তীব্রভাবে আক্রমণ চালাতে থাকি। বেলা ৪টা পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে শেষ পর্যন্ত পাকসেনারা চরম ক্ষতি স্বীকার করে বর্নি ছেড়ে গৌরীনগরে পালিয়ে যায়। আমাদের বাহিনী বর্নিতে দৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা গড়ে তোলে।

এরপর মুক্তিবাহিনী বর্নি থেকে আমার কমান্ডে অগ্রসর হয়ে ৩০শে অক্টোবর পাক ঘাঁটি গৌরীনগর আক্রমণ করে। এফ-এফ মাহবুবও তার বাহিনী নিয়ে এলেন। সংঘর্ষে ১৭৫ জন মুক্তিযোদ্ধা অংশ নিলো। সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত স্বয়ং ১২০ মিলিমিটার মর্টার দ্বারা সাহায্য করলেন। আমাদের বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পাকবাহিনীর প্লাটুনটি এবং রাজাকার বাহিনীর একটি কোম্পানী পেছনে সরে যেতে বাধ্য হয়। মুক্তিবাহিনী গৌরীনগর পৌছেঁ যায়। গোলাগুলির শব্দে সালুটিকার থেকে পাকিস্তানীদের একটি সাহায্যকারী শক্তিশালী দল চলে আসে এবং আমাদের উপর প্রচন্ডভাবে পাল্টা আক্রমণে আমাদের গৌরীনগর ছেড়ে দিতে হয়। এই ব্যাপক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ২ জন আহত হয়। অপরদিকে পাকসেনাদের ১১ জন হতাহত হয় বলে জানা যায়।

নভেম্বরের শেষের দিকে লামনিগাঁও-এর সংঘর্ষে লেঃ হোসেন ৩য় বেঙ্গলের একটি প্লাটুন নিয়ে বেশ বিপদে পড়ে যান। পাকিস্তানীরা লামনীগাঁও-এ লেঃ হোসেনকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছিল। এই সংবাদ পৌঁছলে আমি তৎক্ষণাৎ আমার বাহিনী নিয়ে লামনিগাঁও-এর দিকে অগ্রসর হই। পথে পাকিস্তানীরা এমবুস করে। কিছুক্ষণের সংঘর্ষে পাকিস্তানীদের পক্ষে ২ রাজাকার বন্দী এবং কয়েকজন হতাহত হয় এবং বাকি সৈন্যরা পালিয়ে যায়। আমি দ্রুত লালনিগাঁও পৌছে পাকিস্তানীদের উপর আক্রমণ করি। এই আক্রমণে পাকিস্তানীরা লালনিগাঁও ছাড়তে বাধ্য হয়। লেঃ হোসেন এবং এলাকায় আমাদের কতৃত্ব বজায় রেখেছিলাম।

এরপর আমার বাহিনী নিয়ে গৌরীনগর দখল করে বিমান বন্দরের দিকে অগ্রসর হতে আরম্ভ করি। শোলা-সাব-সেক্টর ট্রুপসহ ছাতকের উপর আক্রমণ শুরু করে। বালাঠ সাব-সেক্টর বাহিনী সুনামগঞ্জ শহরের উপর চাপ সৃষ্টি করে চলে। বড়ছড়া সাব-সেক্টর বাহিনীও ইতিমধ্যে সাচনা থেকে ধীরাই পর্যন্ত মুক্ত করে ফেলে।

৪ঠা ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর এক ডিভিশন সৈন্য সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে করিমগঞ্জ থেকে মৌলভীবাজার হয়ে পূর্বদিক থেকে সিলেটের পথে অগ্রসর হতে থাকে। অপরদিকে উত্তর এবং পশ্চিম দিক থেকে ৫ নং সেক্টর ট্রুপস সিলেটের পথে অগ্রসর হতে থাকে। বালাট সাব-সেক্টর ট্রুপস ৬ই ডিসেম্বর সুনামগঞ্জ শহর দখল করে নেয়। ঐ দিন মুক্তিবাহিনী ছাতকের উপরও তীব্রভাবে আক্রমণ চালায়। সেক্টর কমান্ডার লেঃ কর্নেল শওকত ৩য় বেঙ্গলের ২টি কোম্পানী এবং শেলা সাব-সেক্টর ট্রুপস নিয়ে ছাতক আক্রমণ করেন। ৭ই ডিসেম্বর ৮টায় ছাতক শহর মুক্ত হয়। পাকসেনারা পালিয়ে গোবিন্দগঞ্জে আশ্রয় নেয়। অন্যদিকে মেজর সাফায়াত জামিল ৩য় বেঙ্গলের ২ টি কোম্পানী নিয়ে ডাউকি সাব-সেক্টর ট্রুপস সহ রাধানগর নিয়ন্ত্রনে এনে গোয়াইনঘাট হয়ে সা লুটিকর বিমান বন্দরের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন।

৯ই ডিসেম্বর সেক্টর কমান্ডার লেঃ কর্নেল শওকত গোবিন্দগঞ্জ আক্রমণ করলেন। পাকসেনারা গোবিন্দগঞ্জ ছেড়ে নদী পেরিয়ে লামাকাজীতে প্রতিরক্ষাবৃহ্য গড়ে তোলে। কর্নেল শওকত মিত্রবাহিনীর জেনারেল গিলের কাছে বিমান সাহায্য চান। ১২ই ডিসেম্বর ভারতীয় ৪টি মিগ বিমান লামাকাজীতে পাক অবস্থানের উপর বোমাবর্ষণ করে। এর কয়েকদিন পরেই সিলেটে পাকসেনারা যৌথ কমান্ডারের কাছে আত্নসমর্পণ করে।

*১৯৭১ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত। সাক্ষাৎকারটি ১০-০১-৮০ তারিখে প্রকল্প কর্তৃক গৃহীত।

 

 

নওশাবা তাবাসুম

<১০, ১০., ২৯০২৯২>

সাক্ষাৎকারঃ মেজর এস এম খালেদ

১০ই অক্টোবর তারিখ থেকে বিভিন্ন সেক্টরে আমাদের ডেসপ্যাচ করা শুরু হয়। আমাকে দেওয়া হলো সেক্টর নং পাঁচ-এ। কমান্ডার ছিলেন তৎকালীন কর্নেল মীর শওকত আলী বীরোত্তম পিএসসি। অক্টোবরের চৌদ্দ কি পনের তারিখ আমি পাঁচ নং সেক্টরে হাজির হলাম। ছাতক আগেই দখল করা হয়েছিল, তৃতীয় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নেতৃত্বে দুটো ফ্রিডম ফাইটার ও রেগুলার ফাইটার কোম্পানি নিয়ে সম্ভবত। পাকিস্তানী সৈন্য এক ব্রিগেড দিয়ে ঘেরাও করে ফেলায় ছাতক থেকে উইথ্রড করতে হয়েছে। ঠিক সেই সময়টায় আমি সাব-সেক্টরে জয়েন করি। আমার সংগে আরোও কয়েকজন অফিসার ছিলেন- লেঃ রউফ ও লেঃ মাহবুব। আমরা এই তিনজন একত্রেই সম্ভবত সিলিংয়ে গিয়েছিলাম। শিলং থেকে জেনারেল শওকত আমাদের রিসিভ করে নিয়ে গেলেন পাথরঘাটা। সেখানে তৃতীয় ইষ্ট বেঙ্গল কোম্পানী তখন একটা অপারেশন করছিল। এরপর আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সাব-সেক্টর ভোলাগঞ্জে সেখানে তখন ছিলেন অনারারি লেফটেন্যান্ট এম এ এম আলমগীর। তিনি একজন ইঞ্জিনিয়ার। সাব-সেক্টরের এডমিনিস্ট্রেশন দেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাকে। আমি আলমগীর সাহেবের কাছ থেকে অপারেশন কমান্ড নিয়ে নিলাম। পরবর্তী পর্যায়ে ৩১ তারিখে তাহেরউদ্দিন আখঞ্জি এলেন। সাব সেক্টরকে তখন দুভাগে ভাগ করা হয়-ইষ্টার্ন এবং ওয়েষ্টার্ন। বাউন্ডারি রাখা হয়েছিল গৌরীনগর রোডটাকে-সেটার পূর্বদিক আমার নেতৃত্বে ও পশ্চিমদিক তাহেরউদ্দিন আখুঞ্জির। তখন পূর্বদিকটার ডিসকিবাড়ি বলে জায়গায় একটা প্লাটুন ছিল, সেখানে জয়েন করে প্লাটুনটাকে আরোও পূর্বে ভেদেরগাঁও-এ নিয়ে গেলাম। ওখানে বসে ছোট ছোট অপারেশনের কাজ করতাম, যেখানে রাজাকারদের আক্রমণ করা ও পাকসেনাদের যাতায়াত পথে এমবুশ করা। স্বল্পসংখ্যক সৈন্যের জন্য আমার অপারেশন ছিল সীমাবদ্ধ।

নভেম্বরের দিকে আমার স্ট্রেনথ আরো বেড়ে গেলো। চার্লি ও ডেল্টা নামক দুটো কোম্পানী এসে মিলিত হওয়ায় তখন আমি শওকত সাহেবের নির্দেশে চার্লি এবং ডেল্টা কোম্পানী নিয়ে আদারপাড়ে চলে গেলাম। ওদের নেতৃত্বের অভাব ছিল। এলাকায় আমি যাওয়ার আগে কোন প্রতিরোধব্যুহ ছিল না। আমি গিয়ে পাটনিগাং পর্যন্ত প্রতিরোধব্যুহ রচনা করলাম। সে সময় আমার সামনে ছিল ২৫ বালুচরে একটি কোম্পানী, একটি স্কাউট ও আজাদ কাশ্মীর ট্রুপস।

নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এমবুশ, রেইড করেছি-পাকিস্তান রাজাকারদের বিভিন্নাবস্থানের উপর, বিভিন্ন পেট্রোল পার্টির উপর। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত অপারেশনে ৩৪ জন নিয়মিত পাকসেনা, প্রায় এক কোম্পানী রাজাকার নিহত এবং আহত হয়। আমার পক্ষের দু’জন শহীদ এবং ৮ জন আহত হয়।

খাইরাই স্কুলে শত্রুর হেডকোয়ার্টার ছিল। ৫ই ডিসেম্বর নোয়া পাড়ায় সর্বপ্রথম এনেমি ডিলইন ফেইস করি। সেখানে শত্রুরা এল-এমজি ফায়ার করে। এল-এমজি ফায়ারের সংগে সংগে আমার ছেলেরা বসে গেল। রেগুলার ট্রেইন্ড ছেলে ছিল না কেউ, কাজেই এদের বুঝাতে আমার বহু সময় লাগলো যে এটা পাকিস্তান আর্মির ডিলইন পজিশন। ওরা ভেবেছিল পাকিস্তান আর্মি এসসে গেছে। তারপর যখন আমি ডিলইন পজিশনের উপর বিশজন ছেলে নিয়ে চার্জ করি, তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী উইথড্র করে চলে গেছে। তারপর আমার কথা ওদের কাছে সত্য মনে হলো এবং মনোবল ফিরে এলো। যখন দেখলো আমি চার্জ করে উঠে দাঁড়িয়েছি এবং কোন কিছু হচ্ছে না তখন তারা বুঝতে পারলো যে পাকিস্তান আর্মি ডিফেন্স নেই। তারা ব্যাক করছে, পালাচ্ছে।

তারপর ওখানে রিঅর্গানাইজ করে এগুতে শুরু করলাম। শেষ পর্যন্ত খাইরাই পৌঁছে গেলাম। শত্রুর হেডকোয়ার্টের পাঁচশ গজ দূরে একটা এলাকায় পৌঁছালাম। এবং ডিগিং শুরু করে সামনের দিকে যখন রেকি করতে শুরু করলাম তখন পাকসেনা সন্ধ্যায় আবছা আধারে আমাদের উপর মর্টার দিয়ে ফায়ার করলো-কিন্তু আমাদের পজিশন ঠিক বুঝতে না পারায় আমাদের ঠিক লাগছিল না। আমার ছেলেরা অত্যন্ত ক্লান্ত ছিল বলে তখন আক্রমণ করে খাইরাই দখল করা সম্ভব ছিল না। তাই ডিশকিবাড়ি ভেদেরগাঁও এলাকায় আমার একটা কোম্পানী ছিল, রাতে তাদের মুভ করিয়ে দিলাম, ওরা রাতারাতি খাইরাইর পেছনে এসে গেল। তখন রাত সারে ৪টা (৬ তারিখ)- খাইরাইর উপর ফায়ার করলো। এটা ঠিক আক্রমণ নয়, এটা হচ্ছে পলায়নপর সৈনিকদের মনোবল ভেঙে দেবার এক কৌশল।

পাকসেনারা তখন সালুটিকর থেকে আর্টিলারী সাপোর্ট চাইলো, প্রায় পাচটার দিকে আর্টিলারী শেল এসে পড়তে শুরু করলো, খাইরাইর আগে এবং চারদিক সার্কেল করে। এই সেলের কভারে পাকিস্তান সেনাবাহিনী উইথড্র করতে শুরু করলো। আমাদের সামনের ও পেছনের গোলাগুলিতে ওদের সর্বমোট পঁচিশজন মারা গিয়েছিল। আমরা কয়েকটা লাশ পেয়েছিলাম। ভোর ছ’টায় আমি খাইরাইর পাকসেনাদের ডিফেন্সে উঠে যাই। আমার আটটা ক্যাজুয়েলিটি হয়-দু’জন সিভিলিয়ানও মারা যায়। পাকসেনাদের ডিফেন্স প্রায় ছ’হাজার এম্যুনিশন, ছ’টা রাইফেল, ফিল্ড টেলিফোন এবং প্রচুর পরিমাণ মেশিন ও আরর কিছু মর্টারের রাউন্ড পেলাম।

সকাল আটটায় রওনা হলাম। তোয়াকিবাজারে কোম্পানী হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে এডভান্স করলাম পাইকরাজ, জাংগাইলের দিকে। পাইকরাজ ও জাংগাইলের মাঝামাঝি সময় থেকে সত্রুরা আমাদের উপর গুলি চালালো। আমরা তৎক্ষণাৎ ওখানে হল্ট করে গেলাম- শত্রুকে সামনাসামনি রেখে জমির নালায় পজিশন নিয়ে গুলি বিনিময় শুরু করলাম বিকেল প্রায় ৪টা পর্যন্ত। সারে চারটার দিকে আমরা চার্জ করে শত্রুর বাংকারে উঠে গেলাম। সেখানে রাজাকারও ছিল। যারা বেঁচে ছিল তাদের ধরা হল এবং ওরা মারা যাবার আগে ওদের খবর পেলাম ওদের তেরজন ও রাজাকার দশজন মারা গেছে।

সামনে এগোনো শুরু হলো আবার। ১০ই ডিসেম্বরের মধ্যে পুনাছাগাঁও, বীরকুলি এবং নোয়াগাঁওয়ের শত্রুর অবস্থান মুক্ত করে আংগারজোর আমার হেডকোয়ার্টার করলাম। বি-এস-এফের মেজর র’ এলেন আমারমার সহযোগিতার জন্য। ১১ তারিখ থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত আংগারগাঁও থেকে সালুটিকর বাজার মুক্ত করলাম। ১৫ তারিখ ম্যাসেজ পেলাম যে, কোন অবস্থাতেই যেন শত্রুর উপর যেন ফায়ার না করি, যদি তারা ফায়ার না করে। এটা সম্ভবত সারেন্ডারের ব্যাপারে করা হয়েছিল। এই ম্যাসেজ নিয়ে মতানৈক্য দেখা দিয়েছিল। পাকিস্তানের অবস্থা তখন শেষ ধাপে। আমাদের সম্মিলিত বাহিনী তখন ঢাকার কাছে বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে গেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তখন নির্জীব, তবুও আমাদের উপর ফায়ার করেছে এবং করলে পাল্টা আমরাও করেছি।

সতেরো কি আঠারো ডিসেম্বর। সালুটিকর নদীর অপর পারে পাকসেনা ছিল, তারা খবর দিল তারা সারেন্ডার করবে, তাদের উপর যেন ফায়ার না করা হয়।

সে সময় আমি চলে গিয়েছিলাম পশ্চিম দিকে, যেখানে তাহেরউদ্দিন আখুঞ্জি গোবিন্দগঞ্জ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে সিলেট শহরে ঢোকার চেষ্টা চালাতে। সেখান থেকে আমি ওয়াকিটকিতে ম্যাসেজটা পাই এবং গিয়ে হাজির হই। আমাদের সালুটিকর নদীর ও পারে যেতে দেওয়া হয়নি সারেন্ডার অনুষ্ঠানে আমার সংগের ছেলেরা গণ্ডগোল করতে পারে এই আশংকায়। আমিই শুধু গিয়েছিলাম।

আমি সেক্টর হেডকোয়ার্টারে নির্দেশ পেলাম আমারমার ছেলেরা ভেতরে যাতে ঢুকতে না পারে। কারণ তখন সম্ভাবনা ছিল আত্নসমর্পিত পাকসেনাকে পেলে ছেলেরা হয়তো মেরেই ফেলবে। আমি তখন আমার তিনটা কোম্পানী আংগারজোরে ক্লোজডোর করে রাখলাম।

তার সাত দিন পর গোটা ট্রুপস নিয়ে আমি সিলেট শহরে ঢুকি।

* ১৯৭১ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত। সাক্ষাৎকারটি ১৪-১-৮০ তারিখে প্রকল্প কতৃক গৃহীত।

নওশাবা তাবাসুম

<১০, ১০., ২৯০২৯২>

সাক্ষাৎকারঃ মোঃ রফিকুল আলম

 

২রা সেপ্টেম্বর শিলং থেকে আমাদেরকে ট্রেনিং সেন্টারে পাঠানো হয়। শিলং থেকে ৮২ কিলোমিটার দূরে খাসিয়া জয়ন্তিকা হিলে পৌঁছার পর। এরপর আমরা ই-২ সেক্টরেএ ফরম পূরণ করি। তার পরই শুরু হয় ট্রেনিং। ৯ই সেপ্টেম্বর ট্রেনিং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য তামাবিল চেকপোষ্টে (সিলেট জেলায়) আমার পোষ্টিং হয়। ঐ দিনই আমি তামাবিল পৌঁছে এবং একটি প্লাটুনের দায়িত্ব গ্রহন করি।

আমি ছিলাম জুনিয়র কমিশন অফিসার- সেনাবাহিনীর সুবেদার র‍্যাংকের সমতুল্য। তামাবিলে অবস্থানকালেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ মুজিবনগর সরকার আমাকে একটা বিশেষ দায়িত্ব দেন। কিন্তু সসরাসরি মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত থাকার তামাবিল সাব-সেক্টর থেকে আমাকে রিলিজ সার্টিফিকেট দেওয়া হয়নি। ফলে ঐ সময় আমি স্টাফ ইন্টেলিজেন্স পোষ্টে যোগদান করতে পারিনি।

১১ই সেপ্টেম্বর রাতে একদল মুক্তিফৌজ নিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যদের অবস্থানের উপর আমরা আক্রমণ চালাই। এই আক্রমণে গুলি বিনিময়ের সময় সাবেক সেনাবাহিনীর সিপাহী অফিসার বুলেটবিদ্ধ হন। পাকিস্তানী সৈন্যদের চারজন নিহত ও ছয়জন রাজাকার আহত হয়। সংঘর্ষের পর ষ্টেনগান, একটি ৩০৩ রাইফেল ও ঝুড়িভর্তি মাছ উদ্ধার করা হয়।

১৮ই সেপ্টেম্বর জৈন্তাপুর পাকসৈন্যদের অবস্থানের উপর আক্রমণ চালানো হয়। ক্যাপ্টেন ফারুক ও সুবেদার খোরশেদ আলম এই অভিযানে আমাদের সাথে ছিলেন। তীব্র সংঘর্ষের মধ্যে একটি অয়ারলেস সেট ফেলেই আমরা চলে আসি।

১৯শে সেপ্টেম্বর ক্যাপ্টেন ফারুকের নেতৃত্বে রাধানগরে পাকসেনাদের অবস্থানে আক্রমণ চালানো হয়। ২০শে সেপ্টেম্বর পাকসেনাদের উক্ত অবস্থানে এক কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আমরা পুনরায় আক্রমণ চালাই।

২৩শে সেপ্টেম্বর আমরা নয়াবস্তি নামক স্থানে ডিফেন্স দেই। ২৫শে সেপ্টেম্বর আমাকে তামাবিল সাব-সেক্টরে ডেকে পাঠানো হয়। ২৬শে সেপ্টেম্বর আমি কোম্পানির দায়িত্ব গ্রহণ করি।

১লা অক্টোবর ২০/২২ জন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে মুবাবস্তি নামক স্থানে পাকিস্তানী সৈন্যদের বাংকার আক্রমণ করি। এই আক্রমণে বেশ কিছু সৈন্য হতাহত হয়। আমাদের পক্ষে আহত হয়েছিল দু’জন। আমাদের ওয়ারলেস সেটটি খারাপ হয়ে যাওয়ার ফলে আমরা দ্রুত সরে আসি।

২রা অক্টোবর ভারতীয় মেজর মিত্র সস্ত্রীক আমাদের ক্যাম্পে আসে (বাউরভাগ ক্যাম্প)। উক্ত ক্যাম্পে অবস্থানকালে আমরা পাঞ্জাবী সৈন্যদের প্রবল চাপের সম্মুখীন হয়েছিলাম। যার ফঅলঅলে রাতে আমরা কেউ ঘুমাতে পারতাম না। মুক্তারপুর ক্যাম্প থেকে আরো ৭৫ জন মুক্তিযোদ্ধা পাঠিয়ে আমাদের শক্তি বৃদ্ধি করা হয়েছিল। ঐদিন ভারতীয় বার্মাশেল ও ই-এস এস-ওর কিছু অফিসার এবং পাংতুং থেকে মিস লিন্ডা নামে একজন লেডী ডাক্তার আমাদের ক্যাম্পে এসে খোঁজখবর নিয়ে যান।

৭ই অক্টোবর ইয়োথ ক্যাম্প থেকে জনৈক মিঃ ঘোষ ক্যাপ্টেন বি, এস রাওয়ের সাথে আমাদের ক্যাম্পে আসেন।

৮ই অক্টোবর পাকিস্তানী সৈন্যরা ৪ নং ব্রিজের পাশ থেকে আমাদের উপর প্রবল গুলিবর্ষণ শুরু করে। সারারাত আমরা জেগে থাকি।

১১ই অক্টোবর মাত্র পনেরজন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আমি কাপুরা নামক স্থানে পাকসৈন্যদের অবস্থানের উপর আক্রমণ চালাই। এই সংঘর্ষের পর বিএসএফ-এর একজন লেঃ কর্নেল এবং ষ্টেটসম্যান পত্রিকার একজন সাংবাদিক আমার সাক্ষাৎকার গ্রহন করেন।

১৮ই অক্টোবর আমি লামহাদার পাড়ায় যাই। টুনু মিয়া চেয়ারম্যানের বাড়ি আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তখন তার বাড়িতে পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশজন রাজাকারসহ ৫ জন পাঞ্জাবী অয়ারলেস সেট ও মেশিনগান সজ্জিত হয়ে পাহারা দিচ্ছিল। যাই হোক পরে টুনু মিয়া চেয়ারম্যানের বাড়ি অপারেশন করা হয়নি।

২০শে অক্টোবর খবর পাই ১০/১২ জন পাঞ্জাবী সৈন্য গোরকচি গ্রামে এসে জনসভা করার পর বেশ কিছুসংখ্যক গ্রামবাসীকে বাংকার খননের জন্য রাধানগর নিয়ে গেছে। ঐ দিন আমরা মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার সন্দেহে ৪ ব্যাক্তিকে ধরে নিয়ে এসে, তাদেরকে স্থানীয় লিবারেশন কমিটির চেয়ারম্যান বশির সাহেবের নিকট সোপর্দ করা হয়।

২৫শে অক্টোবর সারিগোয়াইন রাস্তার উপর নির্মিত সেতু (১ নং ব্রীজ নামে অভিহিত) উড়িয়ে দেবার জন্য নির্দেশ পাই। এই কাজের জন্য আমাকে এক প্লাটুন গেরিলা যোদ্ধা দেওয়া হয়। ইতিপূর্বে সেতুটি উড়িয়ে দেবার জন্য গেরিলা যোদ্ধারা তিনবার চেষ্টা চালিয়ে ব্যার্থ হয়। ২জন পুলিশ, ২১জন রাজাকার ও অপর ১৬জন বেসামরিক ব্যাক্তি সেতুটির পাহাড়ায় নিয়জিত ছিল। পুরা প্লাটুন আমরা তাদের অবস্থানের উপর আক্রমণ চালাই। ৫ জন রাজাকার সংঘর্ষ স্থানেই নিহত হয়। অন্যান্য রক্ষীরা ১টি ৩০৩ রাইফেল, ইউনিফর্ম, ব্যাজ, বেল্ট ও তাদের কাপড়-চোপড় রেখেই পালিয়ে যায়। আমরা সাফল্যের সাথে সেতুটি উড়িয়ে দিতে সক্ষম হই।

১লা নভেম্বর আমরা পাকিস্তানী সৈন্যদের অবস্থান কাপুরা আক্রমণ করি।

২রা নভেম্বর ঐ একই অবস্থানে আমরা আক্রমণ চালাই। ঐদিন পাকিস্তানী সৈন্যদের অভস্থানে আক্রমণকালে সুবেদার সালাম ও তার পার্টি, এ এস আই হাবিবুর রহমান, ইন্ডিয়ান বি এস এফ-এর খড়ক বাহাদুর থাপা (হাবিলদার) ও ক্যাপ্টেন ফারুক আমাদের সাথে ছিলেন।

৩রা নভেম্বর বারোপনে নামক গ্রাম অপারেশন করি। সে স্থানে পাক সৈন্যদের সাথে গোলাগুলি বিনিময় হয়। ইন্ডিয়ান মেজর সৎপতি আমাদের দেখে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে যান।

২০শে নভেম্বর বড়হাট নামক স্থানে সারিগোয়াইন রাস্তার উপর, ২৪শে নভেম্বর অটলু নামক স্থানে সারিগোয়াইন রাস্তার উপর এবং ২৬শে নভেম্বর মুকাম নামক স্থানে সারিগোয়াইন রাস্তার উপর মাইন বসাই। ঐ রাস্তাটি তখন পাকসেনাদের দখলে ছিল। রাস্তাটির বিভিন্ন স্থানে সৈন্য ও রাজাকার পাহারা থাকত। বড়হাট নামক স্থানে বসানো মাইনের বিস্ফারণে শত্রুসৈন্যের একটি জীপ বিদ্ধস্ত হয়। ফলে দুইজন নিয়মিত পাকসৈন্য নিহত হয়। মুকাম নামক স্থানে বসানো মাইনের বিস্ফারণে শত্রুসমর্থিত একজন বেসামরিক ব্যাক্তি নিহত এবং অপর দুই ব্যাক্তি আহত হয়। পর পর এই ঘটনার পর শত্রুসৈন্যরা রাস্তাটির ব্যাবহার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়।

২৮শে নভেম্বর ২ প্লাটুন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা, ভারতীয় বি এস এফ-এর একটি সেকশনসহ আমি সারিগোয়াইন রাস্তার নিকটবর্তী গুয়াখারা নামক স্থানে শত্রুসৈন্যদের প্রত্যাশায় এমবুশ করি। ২৯শে নভেম্বর ১-৪৫ ঘটিকায় সারিগোয়াইন রাস্তার উপর টুকেরবাজার ব্রীজটি আমরা উড়িয়ে দেই। এই স্থানে প্রহরারত রক্ষীদের সাথে সংঘর্ষে একটি ৩০৩ রাইফেলসহ চারজন রাজাকার আটক করি। কিন্তু ফেরার পথে আমাদের দলটি পাকিস্তানী সৈন্যদের এমবুশ-এর আওতায় পড়ে যায়। পাকিস্তানী সৈন্যদের মধ্যে আজাদ কাশ্মীর রিজার্ভ ফোর্স ছিল। এরা আমাদের দলটির উপর এইচ-এম-জি ও অন্যান্য স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে আক্রমণ চালায়। শত্রুসৈন্যরা চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলেছিল। এই অবরুদ্ধ এবং প্রচণ্ড গোলাগুলির মাঝেও অসীম সাহস, উন্নত কৌশল ও উপস্থিত বুদ্ধির জোড়ে শত্রুবেষ্টনি ভেদ করে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হই। আজাদ কাশ্মীর রিজার্ভ ফোর্সের মোট ১১জন আমাদের হাতে নিহত এবং ৪ জন রাজাকার আহত হয়। আমাদেরও খুব ক্ষতি হয়। ইন্ডিয়ান বিএসএফ-এর একজন সুবেদারসহ তিনজন, একজন পুলিশের এএসআই ও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা মারা যান।

১৬ই ডিসেম্বর যুদ্ধবিরতি ঘোষণার প্রাক্কালে আমরা সালুটিকর বিমান বন্দর (সিলেট) পর্যন্ত পৌঁছি। ঐদিক দুইজন রাজাকার আমাদের কাছে অস্ত্রসহ আত্নসমর্পণ করে। তারা হলো: (১) মোঃ আলী- খাস মৌজা বারহলি, ৩০৩ রাইফেল মার্ক নং ৩, নং ৪৯৬২। (২) মনোহর আলী- ফুডপুর, কুপুনাখাই, রাইফেল নং পি এফ ১৬১২৮৫ নং ৪, মার্ক-১।

সাক্ষর: মোঃ রফিকুল আলম

২২-৭-৭৮

*সাক্ষাৎকারটি ২২-০৭-৭৮ তারিখে প্রকল্প কর্তৃক গৃহীত।

মাশরুর মাকিব

<১০, ১০., ২৯৪২৯৬>

অনুবাদ

একটি অপারেশানের রিপোর্ট

একটি অপারেশানের রিপোর্ট

প্রতি ,

সাব সেক্টর কামান্ডার , তা

মাবিল এম এফ (ডাউকি)।

বিষয়ঃ ২৮ শে নভেম্বর (১৯৭১) রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনার উপর প্রতিবেদন 

জনাব,

আমি বিনয়ের সাথে আপনার নিকট রিপোর্ট করছি যে , ২৫/১১/৭১ তারিখে আনুমানিক ১৫.০০ ঘন্টায় (বিকেল ৩ টা ) আমি মেজর বি এস রাও এর সাথে দেখা করি এবং তিনি আমাকে নিম্নোক্ত আদেশ প্রদান করেন।  (ক) সারি – গোয়াইন রোড সম্পূর্ণভাবে শত্রু চলাচলের অনুপযোগী করে দেয়া (খ) মাইন স্থাপনের মাধ্যমে (গ) এমবুশ করে (ঘ) এবং রাস্তার ধারে গর্ত খুড়ে অবস্থান গ্রহন করা এবং পাকিস্তানি বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত অবস্থান ছেড়ে না যাওয়া।  এর আগে আমাকে একটি বিএসএফ সেকশন দেয়া হয় এবং আমি অপারেশনের জন্য যেখানেই যাই না কেন বিএসএফ এর ছেলেরা আমাকে সহযোগীতা করবে বলে আদেশ দেয়া হয়।  আমি সারি-গোয়াইন রোডের একটি সেতু ধ্বংসের ব্যাপারে আমার পরিকল্পনা নিয়ে তার সাথে কথা বলি।  আমি তাকে আরো অবগত করি রেকি করে জানা গিয়েছে যে টার্গেটের আশেপাশে শত্রুর কোন অস্তিত্ব নেই।

সবচে কাছের শত্রুর অবস্থান সারিঘাটে (অপারেশন স্থান থেকে ২.২৫ মাইল পূর্বে) ও লেপনাউত (১.২৫ মাইল পশ্চিমে)।  আমার বেইস হেড কোয়ার্টার এ ফেরত আসার পূর্বে আরেক বার রেকি করা হয়।  যারা রেকি করেছে তারা আমার সাথে বিগত ৭/৮ মাস ধরে কাজ করছে এবং তাদের তথ্যের উপর আমি আস্থাশীল।  অপারেশনের আগে আমি বিএসএফ এর সাব ইন্সপেক্টর সহ আমার কামান্ডারদের সাথে বৈঠক করি এবং অপারেশনের সকল বিষয় নিয়ে আলোচনা করি। আপরা অপারেশন স্থলে যাবার জন্য ২৮/১১/৭১ তারিখে ১৯১৫ ঘন্টায় (সন্ধ্যা ৭.১৫)যাত্রা শুরু করি। গুখোয়া গ্রামে পৌছানোর পরে সারি-গোয়াইন রাস্তায় মাইন স্থাপন করি ও রাস্তার পাশে প্রায় ২৫০ গজ উত্তরে এমবুশের জন্য অবস্থান গ্রহন করি।  ২৯/১১/৭১ তারিখে আমরা সেখানে প্রায় 01.30 পর্যন্ত অবস্থান করি এবং অবস্থানকালীন সময়ে শত্রুর কোন ধরনের গতিবিধি আমাদের নজরে আসেনি।  এরপর আমি সহ আমার সকল সৈন্য সেতু ধ্বংসের জন্য যাত্রা করি এবং আমরা তুকৈর বাজার সেতু নামক একটি সেতু ধ্বংস করি।  এর পূর্বে আমি আমার কামান্ডারদের ব্রিফ করি এবং প্লাটুন সমূহের কাজ নিম্নোক্ত ভাবে ভাগ করে দেই।  এ এস আই হাবিবুর রহমানের বি/৩ প্লাটুনকে সেতুটি ক্লিয়ার করার দায়িত্ব দেয়া হয়।  হাবিলদার শোয়েব আলির নেতৃত্বে ডি/১ প্লাটুনকে সারি-গোয়াইন সড়কে পশ্চিম দিক অভিমুখে (গোয়াইঘাটের দিকে) অবস্থান গ্রহন করতে নির্দেশ দেয়া হয় গোয়াইঘাটের দিক থেকে শ্ত্রু আক্রমন এলে প্রতিহত করার জন্য।  বিএসএফ এর দলটিকে ব্রিজ ক্লিয়ার করার পর সার্চ করার দায়িত্ব দেয়া হয়।  আমি বিএসএফ এর হাবিলদার কে বি থাপা ও নায়েক শর্মাকে নিয়ে বি/৩ প্লাটুনের সাথে যোগ দেই।  আমরা ১৫ মিনিটের মধ্যেই ব্রিজটি চার্জ করে ক্লিয়ার করি এবং শত্রু পক্ষের একটি রাইফেল উদ্ধার করি।  তারপর আমরা ব্রিজটি সুন্দরভাবে ধ্বংস করি। বিস্ফোরণের ফলে ব্রিজটি টুকরো টুকরো হয়ে যায়।  এটি একটি পাকা সেতু ছিলো এবং এটি দৈর্ঘ্যে আনুমানিক ৬০ ফিট ও প্রস্থে ১২ ফিট।

এরপর আমি আমার সকল যোদ্ধাদের আমাকে অনুসরন করতে আদেশ দেই এবং ডি/১ প্লাটুনের সাথে মিলিত হতে সামনে এগিয়ে যাই।  সেখানে গিয়ে আমি দেখতে পাই হাবিলদার শোয়েব আলি ৪ জন রাজাকার গ্রেফতার করেছে।  তাদের ভালোমতো বাধা হয়েছিলো এবং এরপর আমি আমার বিএসএফ সহ আমার সৈন্যদের পূর্ব নির্ধারিত স্থান রাজবারি কান্দাই গ্রামে দ্রুত পৌঁছানোর জন্য নির্দেশ দেই।  আমরা গাইড টুনু মিয়ার অধীনে সিঙ্গেল ফাইলে মার্চ করে যাত্রা শুরু করি। গাইড আমাদের ভিন্ন রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো এবং আমাদের আশ্বস্ত করছিলো এই রাস্তাটি কম দূরত্বের ও নিরাপদ।  তাকে অবিশ্বাস করার কোন কারন নেই মনে করে আমরা মার্চ শুরু করি।  আমরা পৌনে এক মাইল যাত্রা করার পরেই পেছন থেকে শত্রুর গুলির আওয়াজ শুনতে পাই।  এর কিছুক্ষন পরেই সামনে থেকেও গুলির আওয়াজ শুনতে পাই।  আমাদের পিছিয়ে যাবার কোন রাস্তা খোলা ছিলো না। তাই আমরা শত্রুর অবস্থানের উপর আক্রমন করার সিদ্ধান্ত নেই।  দুপক্ষের মধ্যেই গুলি বিনিময় হয়।  বিএসএফ এর জওয়ানদের পারফরমেন্স অনেক ভালো ছিলো কিন্তু অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা শত্রু দের দ্বারা পরিবেষ্ঠিত হয়ে পড়ি।  ডি/১ প্লাটুনের নায়েক শুকুর আলি অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেন।  তিনি শত্রুর এলএমজি এর নল ধরে ফেলেন এবং এলএমজির ব্রাশ ফায়ারে দুটি আঙ্গুল হারান।  ইতিমধ্যেই গাইড টুনু মিয়া পালিয়ে যায় এবং আমরা অনেক কষ্টে শত্রুর এমবুশ থেকে বেড়িয়ে আসতে সক্ষম হই।

এরপর আমরা আমাদের পূর্বনির্ধারিত স্থান রাজবাড়ি কান্দাই গ্রামে ফিরে আসি।  আমি আমার সৈন্য ও বিএসএফ দের গননা করি আমার ২ জন গাইড সহ ১০ জন ও বিএসএফ এর ৪ জন নিখোজ।  আমি ব্যাক্তিগতভাবে একটি সার্চ পার্টি গঠন করে নিখোঁজদের সন্ধানে বের হই এবং একজন আহত বিএসএফ ও ২ জন মুক্তিসেনাকে খুজে পাই।  এই ২ জন মুক্তিসেনা শত্রুদের হাতে ধরা পড়েছিলো এবং কোনভাবে পালিয়ে চলে আসে। আমি তাদের কাছে জানতে পারি যে হারিয়ে ফেলা বাকি সবাইকে হত্যা করা হয়েছে।  আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি মৃতদেহ গুলোকে উদ্ধার করতে কিন্তু এটি ছিলো অসম্ভব।  আমি এমবুশস্থানে যেতে পারিনি কারন ইতিমধ্যে শত্রুপক্ষ সেখানে পাকা প্রতিরক্ষা অবস্থান তৈরি করেছে।

আমি এ বিষয়ে সবকিছুই মেজর বিএস রাও কে ২৯/১১/৭১ তারিখে ১৫০০ ঘন্টায় (বিকাল ৩ ঘটিকা) অবগত করেছি।  আমাদের পক্ষে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে ৩ জন বি এস এফ জওয়ান ও ৬ জন মুক্তিসেনাকে হারানো।  এর মধ্যে বিএসএফ এর একজন এসআই , মুক্তিফৌজ এর ১ জন এএসআই ও দুই জন গাইড রয়েছে।  ধারনা করি যে তাদের সবাইকেই শত্রুসেনারা হত্যা করেছে।

শত্রুপক্ষের কমপক্ষে  ১০/ ১১ জন নিয়মিত পাকিস্তানি সৈন্য , ৪ জন রাজাকার ও ৬ জন শত্রু আমাদের গুলিতে নিহত হয়েছে।

এটি আপনার আবগতি ও পরবর্তি ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য জানানো হলো।

বিনীত ,

(মোঃ রফিকুল আলম)

লেফটেন্যান্ট ৩০/১১/৭১।

 

 

 

নওশাবা তাবাসুম

<১০, ১০., ২৯৬২৯৭>

সাক্ষাৎকারঃ নাজমুল আহসান মহিউদ্দিন আলমগীর*

ভারতের বিহার রাজ্যের চাকুলিয়ায় তিন সপ্তাহের প্রশিক্ষণ হয়। সি-কিউ-বি অস্ত্র পাতি এবং স্মল আর্মস-এর ব্যাবহার ও বিস্ফারোকের ব্যাবহার, বিভিন্ন ক্যালিবারের মর্টার ও রকেট লাঞ্চারের ব্যাবহার, বিভিন্ন ফর্মেশান, ম্যাপ রিডিং ও সেনাবাহিনী ফিল্ড সেটআপ ও ম্যানেজমেন্টের উপর প্রমিক্ষণ হয়। ৭ই সেপ্টেম্বর ৫ নং সেক্টরে তৎকালীন কমান্ডার মীর শওকত আলীর নিকট তিনটি এফ এফ কোম্পানীসহ ভোলাগঞ্জ সাব-সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করি এবং ৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের আগেই সিংগার খালের উপর উপকূল পর্যন্ত মুক্ত করি।

ঘটনাবলীর বিবরণঃ-

(১) বাংলাদেশের মাটিতে ভোলাগঞ্জ রেলওয়ে টার্মিনালে হেডকোয়ার্টার স্থানান্তর। কোনরূপ প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়নি, ধল্লা নদীর এই চরটিতে তখন কোন লোকজন ছিল না। তবে টারমিনালটি অত্যন্ত বিধ্বস্তাবস্থায় ছিল। যন্ত্রপাতি, ঘরের দরজা-জানালা এমনকি জায়গায় জায়গায় টিনের চালও ছিল না।

(২) পাড়ুয়ায় বর্ডার আউটপোস্ট দখল, সামান্য প্রতিরোধ ছিল। পাকিস্তান বাহিনীর লোকজন ৫টি ৩০৩ রাইফেল ফেলে রেখে চলে যায়।

(৩) টোকের বাজারে এডভান্স পোষ্ট বসাতে কোন প্রতিরোধ পাইনি।

(৪) কোম্পানীগঞ্জে এডভান্স পোষ্ট বসাতে গিয়ে মাঝারি ধরনের প্রতিরোধ সম্মুখীন হই। প্রথম দিন আমাদের একটি ছেলে শহীদ হয় এবং আমাদের একটি ২” মর্টার ছেড়ে আসতে হয়। পরদিন আমমরা চৌকি দখল করতে সক্ষম হই। বিপক্ষের ফেলে যাওয়া অস্ত্রপাতির সংগে আমাদের হারানো মর্টারটি ফেরত পাই। শত্রুপক্ষ দুটি মৃতদেহ ছেড়ে যায়।

(৫)পরপর তিনদিন ক্রমাগত আক্রমণ করে তেলিখাল চৌকি দখল করি। কাটাখাল এলাকায় আমাদের কাট-অফ ছিল। তেলিখাল চৌকিতে বিপক্ষের ফেলে যাওয়া দুটি ৩০৩ রাইফেল ও একটি ২” মর্টার হাতে আসে। এই পর্যায়ে পূর্ব কুরাখোলা, কান্দিগাঁও এবং গোরকি আর পশ্চিমে পারকুল ও শিবপুর বেইজ স্থাপন করি। পিয়াইন গাংএর উত্তর পাড় পর্যন্ত সম্পূর্ণ আমাদের দখলে আসে এবং সদস্য জনাব নুরুল হক টোকের বাজারে জনসভা করেন।

(৬) অপারেশন জ্যাকপটঃ পর পর তিনদিন ক্রমাগত যুদ্ধ করে বিলাজুর ও বার্নি দখল করি। এতে আমার সংগে তিনটি এফএফ কোম্পানী অংশ নেয় ও আমাদের ৩ জন ছেলে শহীদ হয়।

(৭) অপারেশন স্লেজ হ্যামারঃ সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলী শেলা সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন হেলাল কে নিয়ে ছাতক আক্রমণ করেন। আমার আর ক্যাপ্টেন নূরনবরি উপর ছাতক গোবিন্দগঞ্জ সড়কে রিইনফোর্সিং কলাম কাট-অফ করার দায়িত্ব ছিল। আমারা সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত সফলতার সংগে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখি এবং আমাদের হাতে বিপক্ষের একজন মেজর নিহত হয়।

(৮) অপারেশন লোনরেঞ্জারঃ নভেম্বরের প্রথম ভাগে সেক্টর কমান্ডার নিজে গৌরীনগর চৌকি আক্রমণ করেন। পশ্চিমের ফ্লাক্সে একটি এফ এফ কোম্পানীসহ বার্নিতে ছিলাম আমি, পূর্বের ফ্লাক্সে তিনটি এফ-এফ কোম্পানীসহ ছিলেন লেফটেন্যান্ট সাইফুদ্দিন খালেদ ও লেফটেন্যান্ট তাহেরউদ্দিন আখুঞ্জি। দুইটি কোম্পানীসহ কোম্পানী কমান্ডার কাজী আব্দুল কাদের ও কোম্পানী কমান্ডার ফখরুদ্দীন চৌধুরী কাগাইল ও গৌরীনগরের মাঝামাঝি জায়গায় কাট-অফ লে করেন। সকাল ৪ টায় আক্রমণ শুরু হয়। এই যুদ্ধে আমার সংগের ৫ জন ছেলে শহীদ হয়। আমরা একটি ৮১ মিঃ মিঃ মর্টার ও কিছু গোলাবারুদ ও অস্ত্রপাতি দখল করি।

(৯) এই পর্যায়ে সামান্য প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে আমরা ১০ই ডিসেম্বর নাগাদ সিংগারখালের উত্তর পার বরাবর কুরিগাঁও, বাদাঘাট, মিতিমহল, নোয়াগাঁও, চালতাবাড়ি প্রভৃতি অঞ্চল মুক্ত করি। (৭ই ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনীর কর্নেল রাজ সিং এই সাব-সেক্টরের মদ্ধ্যে দিয়ে সিংগারখাল পার হয়ে আরো দক্ষিণে অগ্রসর হন) বিভিন্ন সময়ের বেইজ স্থাপন ও চৌকি দখলকালে মোট ৬১ জন রাজাকার আমাদের হাতে বন্দী হয়, যারা পরবর্তী পর্যায়ে সিলেট জেলা কতৃপক্ষের হাতে সমর্পিত হয়।

(১০) দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা ১০টি এফ-এফ কোম্পানী ও তিনটি এম-এফ কোম্পানীসহ সিলেট মাদ্রাসায় ক্যাম্প স্থাপন করি।

আমাদের সংগের ১৭ জন শহীদ সহযোদ্ধাকে টোকেরবাজারে কবর দেওয়া হয়। প্রথম পর্যায়ে আমাদের গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্রের অত্যন্ত অভাব ছিল।

পরে প্রতিপক্ষের চৌকিগুলো দখলের ফলে আমাদের গোলাবারুদের অভাব কিছুটা পূর্ণ হয়। আমাদের সমস্ত রেশন, অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ শেলা হয়ে আসত ভারতের ১০১ কমান্ড এরিয়া থেকে। সবসময়ই খাদ্যদ্রব্য, শীতবস্ত্র, ঔষধপত্র ইত্যাদির প্রচণ্ড অভাব ছিল। আমরা যে সমস্ত অস্ত্রপাতি ব্যাবহার করতাম তা হলোঃ ৩০৩ রাইফেল, ৩০৩ এল-এমজি, ৭.৬২ সি সি এল এল আর, ৯ মিঃ মিঃ এস এম সি। পরবর্তীতে পাকিস্তানিদের হাত থেকে চীনা রাইফেল, চীনা ষ্টেন, ৭২ মিঃ মিঃ মর্টার ও তিনটি ৩০৩ মেশিনগান ও বেশকিছু জি-২ রাইফেল আমাদের হস্তগত হয়।

স্বাক্ষরঃ ন, আ, ম আলমগীর

ই-এস-এস, ৪০৭৫

১৪-৩-৮৩

*গনপূর্ত বিভাগে নির্বাহী প্রোকৌশলী থাকাকালে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেন। সাক্ষাৎকারটি ১৪-৩-৮৩ তারিখে প্রকল্প কর্তৃক গৃহীত।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!