You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৯। ১১নং সেক্টরে সংঘটিত যুদ্ধের বিবরণ বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র ……… ১৯৭১

সাক্ষাৎকারঃ লেঃ কর্নেল (অব:) আবু তাহের

১০-৬-১৯৭৫

জুলাই মাসের ২৫ তারিখে বাংলাদেশের পথে ভারতে রওনা হই। আমার সঙ্গে মেজর জিয়াউদ্দিন, ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী, মেজর মঞ্জুর ও তার স্ত্রী-ছেলেমেয়ে এবং ব্যাটম্যান রওনা হন। পথে নানা বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে আমরা ২৭শে জুলাই দিল্লী এবং আগষ্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে মুজিবনগর পৌঁছাই।

আগষ্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এম,এম,জি, ওসমানী মেঘালয় ও তৎসংলগ্ন এলাকায় সরেজমিন যুদ্ধের অবস্থা অবলোকনের জন্য পাঠালেন।

পাকিস্তান থেকে আমরা যারা পালিয়ে এলাম তাদের মধ্যে মেজর জিয়াউদ্দিনকে ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট, মেজর মঞ্জুরকে ৮নং সেক্টরের, ক্যাপ্টেন পাটোয়ারীকে ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানী এবং আমাকে ১১নং সেক্টরের পরিচালনা ভার দেওয়া হয়।

সেনাবাহিনী প্রধানের নির্দেশে আমি আগষ্টের ১২ তারিখে মেঘালয় এসে পৌঁছাই। এই এলাকার মুক্তি বাহিনীর ছেলেরা ভারতীয় বাহিনীর কমাণ্ডে ইতিপূর্বেই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। কামালপুর ছিল পাকিস্তানী সেনাদের মস্ত ঘাঁটি। সিদ্ধান্ত নিলাম কামালপুর আক্রমণের।

১৫ই আগষ্ট আমি নিজে মাত্র ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে সন্ধ্যার দিকে কামালপুর পাক ঘাঁটি আক্রমণ করি। আমাদের অস্ত্র বলতে ছিল এল-এম-জি, রাইফেল এবং কিছু স্টেনগান। আমাদের আক্রমণ দু’ঘন্টা স্থায়ী হয়। আমাদের আক্রমণে ১৫/১৬ জন পাকিস্তানী নিহত হয়। অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধা আহত হলো ১৫ জন।

আমার আক্রমণের পূর্বে এই এলাকা কোন সেক্টরের আওতায় ছিল না। আমি সেনাবাহিনীর সদর দফতরে এই এলাকাকে একটি সেক্টরে পরিণত আবেদন করলে আবেদন মঞ্জুর হয়। আমার সেক্টরের নাম হলো ১১নং সেক্টর। কমাণ্ড আমাকেই দেয়া হল।

ময়মনসিংহ এবং টাঙ্গাইল জেলা নিয়ে আমার সেক্টর গঠিত হয়। সেক্টরের দায়িত্ব নেবার পর সমগ্র এলাকাকে কয়েকটি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করি। সাব-সেক্টরগুলো হলো: ১) মানকার চর ২) মহেন্দ্রগঞ্জ ৩) পুরাকশিয়া ৪) ডালু ৫) বাগমারা ৬) শিববাড়ি ৭) রংড়া এবং ৮) মহেশখালী।

সমগ্র এলাকাতে অফিসারের তীব্র অভাব অনুভব করলাম। সেপ্টেম্বর মাসে আমাকে দুজন অফিসার দেয়া হলো- ১) স্কোয়াড্রন লীডার হামিদুল্লাহ এবং ২) লেঃ মান্নান। এই সময় মেজর জিয়াউর রহমান তার ব্রিগেড নিয়ে সিলেট এলাকাতে চলে যান। অফিসার দুজনকে আমি দুটি সাব-সেক্টরের দায়িত্ব দিলাম। মানকার চর সাব-সেক্টরের দায়িত্ব দিলাম স্কোয়াড্রন লীডার হামিদুল্লাহকে এবং মহেশগঞ্জ সাব-সেক্টরের দায়িত্ব দিলাম লেঃ মান্নানকে।

সেক্টরের দায়িত্ব নেবার পর পরই প্রাথমিক পর্যায়ে মানকার চর থেকে ডালু পর্যন্ত সরাসরি আমার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসি। অবশিষ্ট এলাকা ভারতীয় বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সান্ত সিংহের কমাণ্ডে থাকে। ব্রিগেডিয়ার সান্ত সিংহের হেড কোয়ার্টার ছিল তুরাতে। ট্রেনিং ক্যাম্পের প্রধানও ছিলেন তিনি। সেক্টরে এসে লক্ষ করলাম মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন পাক পয়েন্টে বি-এস-এফ বাহিনীর নির্দেশে সরাসরি আক্রমণ পরিচালনা করছে। তৃতীয়তঃ বাহিনী বিশৃঙ্খল, বিপর্যস্ত। মুক্তি বাহিনীকে পুরোপুরি বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এবং দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের জন্য বাহিনীকে পুনর্গঠিত করতে শুরু করলাম। সম্মুখ সমর বাদ দিয়ে গেরিলা পদ্ধতিতে আক্রমণ চালাবার নির্দেশ দিলাম। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে হত্যা না করে বন্দী করে নিয়ে আসা এবং মুক্তি বাহিনীর বি-এস-এফ ক্যাম্পে দমন নিষিদ্ধ ঘোষণা করলাম এবং যুদ্ধনীতির সাথে সাথে ছেলেদেরকে রাজনীতিতে সচেতনও করে তুলতে শুরু করলাম।

সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত আমরা সেক্টরে প্রায় বিশ হাজারের মত মুক্তিযোদ্ধা কাজ করছিল। সর্বমোট বাহিনীর মধ্যে তিন হাজার নিয়মিত এবং ১৭ হাজারের মত গণবাহিনী ছিল।

মুক্তক্ষেত্রে আমি নিয়মিত ও গণবাহিনীকে একত্রে অপারেশনে পাঠিয়েছি। অপারেশনের দৃষ্টিকোন থেকে আমি মনে করি নিয়মিত এবং গণবাহিনীকে পৃথক করে ফিল্ড অপারেশনে পাঠানো ঠিক নয়। যারা অল্প দিনের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ছিল তাদেরকে পৃথক ভাবে ফিল্ডে পাঠালে নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে থাকলে অভিজ্ঞতা তারা লাভ করতো সে অভিজ্ঞতা থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছিল- আমি ঐ সব কারণে একটি মাত্র ফোর্স করলাম। আমি আরও সিদ্ধান্ত নিলাম নিয়মিত বাহিনী পুরোপুরি গড়ে না ওঠা পর্যন্ত গেরিলা পদ্ধতিতেই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার।

সামরিক দিক থেকে ময়মনসিংহের চাইতে টাঙ্গাইল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ময়মনসিংহ রেখে টাঙ্গাইল- জামালপুর হয়ে ঢাকা পৌঁছান বেশী গুরুত্বপূর্ণ মনে করলাম। রংপুর এবং বগুড়া ৭নং সেক্টরের অধীনে থাকলেও যোগাযোগের সুবিধার জন্য ঐ সেক্টরের অনেক অপারেশন আমার মাধ্যমেই হয়েছে। আগষ্ট মাসেই টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকী আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং আমার সেক্টরের অধীনে আমার কমাণ্ডে থাকেন। ময়মনসিংহের ভালুকা এলাকাতে অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক মেজর অফিসারের দেশপ্রেম, সাহস ও কর্মনিষ্ঠা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণযোগ্য। সেপ্টেম্বর মাসেই ভারতীয় বাহিনীর ৯২ মাউন্টের ব্রিগেড আমার সাহায্যে আসে। ব্রিগেডের কমাণ্ডার ছিলেন ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার। এই ব্রিগেডে তিনি ইসফ্যান্টি এবং ২টি আর্টিলারী রেজিমেন্ট ছিল। এই বাহিনীতে কর্নেল শোডি একটি ব্যাটালিয়ন কমাণ্ড করতেন। এই ব্রিগেডটি আসায় আমার এবং আমার বাহিনীর সাহস, উদ্দীপনা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। ভারতীয় অফিসারবৃন্দের সাহস, কর্মতৎপরতা এবং অমায়িক ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করে।

আমার আওতায় রৌমারী থানা বরাবরের জন্য মুক্ত ছিল। এখানে একটি মুক্তি বাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্প খুলি এবং ট্রেনিং দেওয়া শুরু করি। নভেম্বর মাস পর্যন্ত সকলের হাতে অস্ত্র না দেওয়া গেলেও দশ হাজারের মত মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়েছিল। এই থানাতে প্রশাসন পুরোপুরি চালু হওয়ারও নির্দেশ দিয়েছিলাম। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃবর্গের কাদা ছোঁড়াছুড়ির ফলে পূর্ণ প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হয়নি।

মেজর জিয়াউর রহমান তার ব্রিগেড নিয়ে চলে গেলে রৌমারী থানাকে মুক্ত রাখা বেশ মুশকিল হয়ে পড়েছিল। কারণ পাক ঘাঁটি চিলমারী থেকে পাকিস্তানীরা যেকোন সময় এসে রৌমারীর উপর হামলা চালাতে পারে। আর তাই চিলমারী শত্রু মুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করলাম।

চিলমারী যুদ্ধঃ সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে প্রায় দুই ব্যাটালিয়ন মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় মাউন্টেন ব্রিগেডের একটি সেকশন সঙ্গে নিয়ে অতর্কিত চিলমারী আক্রমণ করলাম। এখানে পাকিস্তানীদের দুটি কোম্পানী ছিল- একটি বেলুচ রেজিমেন্টের, অপরটি মিলিশিয়া বাহিনীর। ব্যাপকভাবে উভয় পক্ষের সংঘর্ষে উভয় পক্ষের বেশ ক্ষয় ক্ষতি হয়। মুক্তি বাহিনীর ৪ জন নিহত এবং বেশ কিছু আহত হয়। পাকিস্তানীদের ১০০ জন নিহত হয়।

অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে আরো পাঁচ জন অফিসার পেলাম। তারা হলেন ১) লেঃ কামাল ২) লেঃ আলিম ৩) লেঃ তাহের ৪) লেঃ মিজান এবং ৫) লেঃ হাশেম। লেঃ কামাল এবং লেঃ তাহেরকে ডালু সাব-সেক্টরে, লেঃ হাশেমকে পুরাকাশিয়াতে এবং লেঃ মিজানকে মহেন্দ্রগঞ্জ সাবসেক্টরে কাজ করতে বলা হলো।

আমার হেড কোয়ার্টারে কেবলমাত্র গরীব কৃষকদের নিয়ে একটি ট্রেনিং ক্যাম্প খুলি। প্রাথমিক পর্যায়ে ২৫০ জন কৃষক নিয়ে কাজ শুরু করি। এইসব কৃষক পরবর্তীতে যুদ্ধের ময়দানে ব্যাপকভাবে যেকোন সামরিক ট্রেইন্ড সৈনিকের চাইতে দক্ষতা প্রদর্শন করেছিল। তার কারণে বোধ হয় কৃষকের অধিকাংশই ছিল পাকিস্তানীদের দ্বারা অত্যাচারিত। আর তাই তাদের বুকে জ্বলছিল প্রতিহিংসার আগুন।

অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি ডালুর বিপরীতে হালুয়াঘাটের দক্ষিণে পাক সেনাদের একটি শক্ত ঘাঁটি ভারতীয় আর্টিলারীর সাহায্যে আক্রমণ করা হয়। মুক্তি বাহিনীর তিনটি কোম্পানী যথাক্রমে লেঃ হাশেম, লেঃ কামাল এবং লেঃ তাহের, অপরদিকে ভারতীয় দুটি কোম্পানীর (রাজপুত বাহিনী) সহযোগিতায় আক্রমণে করা হলো। পাকিস্তানীরা একটি কোম্পানী নিয়ে পূর্ণ সামরিক সম্ভারে প্রস্তুত ছিল। আমাদের বাহিনী পাক ঘাঁটি দখল করলেও বেশীক্ষণ অধিকার করে থাকতে পারেনি। পিছনে দিক থেকে পাকিস্তানীদের একটি ব্যাটালিয়ন তীব্রভাবে আক্রমণ চালালে মুক্তি বাহিনী ‘পকেট’ ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়।

অক্টোবর মাসের শেষের মাঝামাঝি থেকে কামালপুর, জামালপুর, বাহাদুরাবাদ ঘাট, বকশীগঞ্জ এবং চিলমারীতে আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়ে দেই। পাক সেনারাও বিভিন্ন স্থান থেকে সৈন্য নিয়ে এসে ঐ সব ঘাঁটিতে মোতায়েন করে প্রতিরক্ষা জোরদার করতে থাকে।

নভেম্বর মাসে মুক্তি বাহিনীর শক্তি সম্পর্কে আমি বেশ আশাবাদী হলাম। ভারতীয় সেনাবাহিনীর পর্যায়ে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার ভাবনা অনুযায়ী নিয়মিত বাহিনীর একটি ব্রিগেড গঠনের অনুমতি চেয়ে সেনা দফতরে একটি আবেদন পাঠালাম। সেনাবাহিনী প্রধান আমার আবেদন প্রত্যাখ্যান করলেন। অথচ এই সময় গেরিলা বাহিনীকে নিয়মিত বাহিনীতে রূপান্তরিত করার উপযুক্ত সময় এসেছিল।

১৩/১৪ নভেম্বর ৫টি কোম্পানী নিয়ে ভোর ৩টা কামালপুর আক্রমণ করা হয়। মুক্তি বাহিনীর লেঃ মিজান, ক্যাপ্টেন মান্নান এবং মুক্তিযোদ্ধা সাঈদের তিনটি কোম্পানী এবং ভারতীয় বাহিনীর দুটি কোম্পানী মিলে আক্রমণ পরিচালনা করা হয়। ভারতীয় আর্টিলারী আমাদের সাহায্য করে। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল কামালপুর আক্রমণ করে পাকিস্তানীদের হত্যা করা- কামালপুর নয়। আমাদের তীব্র আক্রমণে পাক সেনাদের ২টি কোম্পানী একজন মেজরসহ নিশ্চিহ্ন হয়। আমরা জয়ের আনন্দে অধীর। তখন সময় সকাল ৯টা। গুলির আঘাতে আমি গুরুতররূপে আহত হই। আমার একটি পা নষ্ট হয়ে যায়। আমাকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে দীর্ঘদিনের চিকিৎসায় আমি সুস্থ হয়ে উঠি। আমার চিকিৎসার ক্ষেত্রে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা- সাহায্য- সহানুভুতি কোনদিন ভুলবার নয়। এমনকি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ভারতরত্ন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী পুনা হাসপাতালে মাকে দেখে নানা কুশল জিজ্ঞাসা করেন। বাংলাদেশ মুক্ত হওয়া পর্যন্ত আমি সেক্টরে ফিরে যে পারিনি। আমার অনুপস্থিতিতে স্কোয়াড্রন লীডার হামিদুল্লাহ সেক্টরের দায়িত্ব হাতে নেন।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরের আমার এলাকায় সম্পূর্ণ নিজের প্রচেষ্টায় ভালুকা এলাকাতে মেজর আফসার, রৌমারী এলাকাতে সুবেদার আলতাফ এবং টাঙ্গাইল এলাকায় কাদের সিদ্দিকী প্রচুর নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে অপারেশন চালান।

বাংলাদেশের সামগ্রিক যুদ্ধকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়।

১) সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থানঃ যেখানে বাঙ্গালী ট্রপস যোগ দিয়েছিল- মার্চ, এপ্রিল।

২) দ্বিতীয় স্তরঃ গেরিলা যুদ্ধ শুরুর প্রস্তুতি- মে, জুন, জুলাই

৩) তৃতীয় স্তরঃ গেরিলা যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। আমাদের গেরিলা ফোর্সকে নিয়মিত বাহিনীতে নিয়ে যাবার যে পর্যায় এসেছিল তা কাজে লাগানো হয়নি।

** (পাকিস্তান স্পেশাল সার্ভিসেস-এ মেজর পদে কর্মরত থাকাকালে সেখান থেকে পালিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।)

 

মুক্ত বিহঙ্গ

<১০, ১৯., ৪৫১৪৫৯>

কয়েকটি অপারেশনের বর্ণনা

 

চিলমারীঃ যুদ্ধের ইতিহাসে একটি বিস্ময়

বিশাল ব্রহ্মপুত্রের অপর তীরে অবস্থিত চিলমারীর দুর্ভেদ্য শত্রু ব্যুহে এক প্রচণ্ড হানা দিয়ে আমরা শত্রুর বিপুল ক্ষতিসাধন করি। এই আক্রমণের মুক্তি বাহিনীর মূল আক্রমণ ভেবে সে এলাকায় বৃহৎ আকারের শত্রু সমাবেশ ঘটে। এধরণের আক্রমণকে শুধুমাত্র দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন মিত্র বাহিনীর ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রমণের কয়েকটি ঘটনার সঙ্গে তুলনীয়। এক্ষেত্রে সুশিক্ষিত কয়েক ডিভিশন ছাত্রীসেনা এবং স্পেশাল ফোর্স অংশগ্রহণ করেছিলেন।

যুদ্ধের ইতিহাসে চিলমারী বন্দর আক্রমণ একটি উজ্জ্বল ঘটনা। এই যুদ্ধ বাংলার সোনার ছেলেদের নিয়ে গঠিত আমার সেক্টরের প্রাইভেট আর্মি দ্বারা সংঘটিত হয়।

রৌমারীর মুক্তাঞ্চলে মাত্র ১৫ দিনের অনুশীলণপ্রাপ্ত এ সমস্ত ছেলের নিয়মিত খাবারের সরবরাহ ছিল না, হাতখরচ ব্যবস্থা ছিল না এবং শুধুমাত্র দখলীকৃত অস্ত্রের উপরই তাদের নির্ভর করতে হত। কোন অনুমোদিত ট্রেনিং ক্যাম্পে অনুশীলনপ্রাপ্ত না হওয়া এ সমস্ত মুক্তিযোদ্ধারা সেক্টর কমাণ্ডারের প্রাইভেট আর্মি হিসেবে পরিচিত ছিল। তাদের চিলমারী আক্রমণ পরিকল্পনায় দক্ষতা এবং সাহস ও নৈপুণ্যের সাথে তার বাস্তবায়নের বিষয় যুদ্ধ বিদ্যার ছাত্রদের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকে।

১১নং সেক্টরের সেক্টর কমাণ্ডার হিসেবে যখন আমি দায়িত্ব গ্রহণ করি তখন বেশ অনেকগুলো চরের সমন্বয়ে গঠিত বিশাল রৌমারী এলাকা মুক্ত ছিল। এর প্রতিরক্ষা আমাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, কারণ মুজিবনগর থেকে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারকে আমরা সেখানে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। মেজর জিয়ার (বর্তমান মেজর জেনারেল) ব্রিগেডে দুটো বেঙ্গল রেজিমেন্ট এই মুক্তাঞ্চল প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিল। শুধুমাত্র কোদালকাঠী চর ছাড়া ব্রহ্মপুত্রের পূর্বপারের সকল এলাকা মুক্ত ছিল। কোদালকাঠীতে শত্রু সৈন্যের অবস্থান স্থানীয় গ্রামবাসীদের জন্য ত্রাসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ সকল শত্রু সৈন্য প্রায়ই পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে ঢুকে পড়ে গ্রামবাসীদের উপর অত্যাচার চালাতো।

ব্রহ্মপুত্রের পূর্বাঞ্চলকে সম্পূর্ণ শত্রু মুক্ত করার জন্য সুবেদার আফতাবের নেতৃত্বে দুই কোম্পানী মুক্তিযোদ্ধা সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকের এক রাতে গোপনে কোদালকাঠীতে অনুপ্রবেশ করে এবং শত্রু ব্যুহের মাত্র কয়েকশত গজ দূরবর্তী ঝাউ বনে ট্রেঞ্চ খনন করে তাতে অবস্থান করতে থাকে। মুক্তি যোদ্ধাদের পরিখাগুলোর সামনেই শত্রু নিধনের উপযোগী বিস্তৃত খোলা জায়গা ছিল। আমাদের কৌশলের মূল উদ্দেশ্য ছিল এই মুক্তিযোদ্ধাদের পরিখাগুলোতে উপস্থিতি টের পেয়ে যখন শত্রু সৈন্য তাদেরকে উৎখাত করার জন্য আক্রমণ চালাবে, তখন আক্রমণোদ্যত শত্রুসেনাদেরকে খোলা জায়গায় পেয়ে আমরা তাদের নিশ্চিহ্ন করবো।

পরের দিন ভোরে আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী শত্রুর প্রচণ্ড আক্রমণ ঘটে এবং ত্বরিত গতিতে প্রতিহত করা হয়। শীঘ্রই সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় এবং তারপর তৃতীয় আক্রমণ ঘটে- সেগুলোও সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করা হয়। নিধন এলাকা শত্রুসৈন্যের মৃত দেহ ভড়ে ওঠে। যে কজন শত্রুসৈন্য পরিখা পর্যন্ত এগুতে পেরেছিল তাদের বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করা হয়। আমাদের অবস্থানের দু’প্রান্তে স্থাপিত মেশিনগান দুটি সেদিন আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। মেশিনগান দুটি আড়াআড়ি গুলিবর্ষণে বেশির ভাগ শত্রুসৈন্য মারা পড়েছিল তৃতীয় আক্রমণে প্রতিহত কারার পর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের পরিখা থেকে বেরিয়ে আসে এবং শত্রুদের উপর মরণ আঘাত হানার জন্য এগিয়ে যায়। খুব অল্পসংখ্যক শত্রুসৈন্য অপেক্ষমান গানবোট পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

কোদালকাঠী আমাদের হস্তগত হলো। গ্রামবাসীদের মধ্যে দারুণ উল্লাসের সৃষ্টি হয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব ও দক্ষতার উপর তাদের আস্থা বহুলাংশে বেড়ে যায়। যদিও তাদের সামর্থ্য ছিল সামান্য। তবু মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তারা রান্না করা খাবার এবং মিষ্টান্ন নিয়ে আসেন।

সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি মেজর জিয়া তার ব্রিগেড নিয়ে সিলেটের পথে ১১নং সেক্টর ত্যাগ করেন। সেদিন আমরা সবাই বিষন্ন বোধ করেছিলাম। সে সময় আমরা জামালপুর এবং টাঙ্গাইল হয়ে ঢাকার পথে এগিয়ে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। শুধু যে আমাদের রণনীতি পাল্টাতে হলো তা নয়, রৌমারীর বিরাট মুক্তাঞ্চল রক্ষার দায়িত্ব আমাকে বিচলিত করে তুলল। আমার সেক্টরে কোন নিয়মিত বাহিনী রইলনা। আমাকে রৌমারীতে ১৫ দিনের শিক্ষাপ্রাপ্ত ছেলেদের উপর নির্ভর করতে হলো। এদের মধ্যে শতকরা মাত্র ২৫ জন অস্ত্রে সজ্জিত ছিল। রৌমারীর প্রতিরক্ষার কাজে ভারতীয় বাহিনী পাঠাবার প্রস্তাব করেছিলেন ভারতীয় কমাণ্ডার। তার সে প্রস্তাব আমি বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করি। বাংলার মাটি রক্ষা করবে বাংলার বীর ছেলেরাই- রৌমারীর প্রতিরক্ষা ব্যুহ আবার ঢেলে সাজাতে হবে। নেতৃত্বের পুরো ভার পড়ল সুবেদার আফতাবের উপর। চওড়া কাঁধ আর লম্বা কোঁকড়ানো চুলের অধিকারী এই নির্ভীক জে-সি-ও সব সময়ই বীরত্ব এবং দৃঢ়তার প্রতীক ছিল। আমি যখন পুরো পরিস্থিতি তাকে বুঝিয়ে বললাম সে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে স্যালুট করল এবং বলল স্যার, পাকিস্তানীরা শুধুমাত্র সুবেদার আফতাবের মৃত দেহের উপর দিয়েই রৌমারীতে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু জেনে রাখবেন সুবেদার আফতাব মরবে না। এই বিপ্লবী নেতার মনোবল যে কত উপরে ছিল তা এই উক্তি থেকে বোঝা যায়। তখন থেকেই পরবর্তীকালের বিভিন্ন সময় দক্ষ সৈনিক, অস্ত্র এবং গোলা বারুদের অভাব পূরণের জন্য আমাকে যুদ্ধে কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়েছে। ইতিমধ্যে পাকিস্তানীরা চিলমারী বন্দর থেকে গানবোটের সাহায্যে রৌমারীর মুক্ত অঞ্চলে প্রায়ই থাবা দিতে শুরু করেছে। কিন্তু শত্রুরা কোন সময়ই সদা জাগ্রত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করতে সক্ষম হয়নি। রৌমারীর মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রে সজ্জিত করাটা আমাদের আশু কর্তব্য হয়ে দাঁড়াল। এবং আমি সব সময় চাইতাম তারা শত্রুঅস্ত্রে সজ্জিত হোক এবং অস্ত্র দখলের জন্য আমার চিলমারী বন্দরকে বেছে নিলাম।

চিলমারী আক্রমণের পেছনে আরো কারণ ছিল। নেতা আবুল কাশেম এবং তার সহযোগীদের নেতৃত্বে সেখানে বাংলাদেশ বিরোধী কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেয়েছিল। চিলমারীতে অবস্থানরত পাকবাহিনীর উপর আঘাত হানাটা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়াল, তা যতই বিপদজনক হোক না কেন। এভাবে চিলমারী আক্রমণের পরিকল্পনা রূপ পেলো।

ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিম তীরে অবস্থিত চিলমারী একটি নদী বন্দর। চিলমারীর কয়েক মাইল দক্ষিণে তিস্তা নদী ব্রহ্মপুত্রের সাথে মিলিত হয়েছে। নদীপথ ছাড়াও চিলমারী রেল ও সড়ক দ্বারা যুক্ত। চিলমারীতে পাকবাহিনীর যাতায়াতের জন্য রেল এবং নদীপথ উন্মুক্ত ছিল। আমার অক্লান্ত গোয়েন্দা অফিসার ওয়ারেন্ট অফিসার শফিউল্লা শত্রু সম্পর্কীয় খবরাখবর সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি শত্রুসৈন্যের সঠিক অবস্থানসহ চিলমারীর বিস্তারিত এবং হুবহু মাটির নকশা তৈরী করে ফেললেন। চিলমারীতে তখন পাকবাহিনীর দুই কোম্পানী নিয়মিত সৈন্য এবং দুই কোম্পানী মিলিশিয়া অবস্থান করছিল। তারা চিলমারীর ওয়াপদা ভবন, জোরগাছ, রাজভিটা, থানাহাট পুলিশ স্টেশন, বলবাড়ি রেলওয়ে স্টেশন এবং পুলিশ স্টেশন সংলগ্ন রেলওয়ে ব্রীজে মোতায়েন ছিল। তাদের সাথে ছিল কুখ্যাত ওয়ালী মাহমুদ ও পাচু মিয়ার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বড় আকারের এক রাজাকার বাহিনী।

শত্রুকে প্রচণ্ড আঘাত হানার জন্য আমাদের দরকার ছিল একই সময়ে বিভিন্ন শত্রুসৈন্যদের আক্রমণ করা এবং স্ব অবস্থানে তাদের আটকে রাখা যাতে করে তাদের একে অপরের সাহায্যে বিশেষ করে চিলমারীতে সাহায্যকারী শত্রুসেনা এগিয়ে আসতে না পারে। সেজন্য চিলমারীর বেশ পেছনে রেল এবং সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার জন্য একটি দল পাঠানোর প্রয়োজন ছিল। এ অভিযানের সাফল্যের চাবিকাঠি নিহিত ছিল শত্রুর অজ্ঞাতে অতর্কিত আক্রমণের উপর। এক বিরাট বাহিনীর পক্ষে সকলের অগোচরে প্রায় ৩২ মাইল প্রশস্ত ব্রহ্মপুত্র পাড়ি দেয়া সহজ ব্যাপার ছিল না। এছাড়া মূল আক্রমণকে সমর্থন দেওয়ার জন্য যে চারটি দুরপাল্লার কামান আমাদের কাছে সেগুলো নিকটবর্তী এক চরে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল। শত্রু সম্পর্কে বিভিন্ন খবর সংগৃহীত হল। প্রস্তুতি পর্ব সম্পন্ন হল। বিভিন্ন অবস্থানের শত্রুদের উপর একই সাথে আঘাত হানার জন্য বিভিন্ন সময়সূচী আমরা পুংখানুপুংখভাবে পরীক্ষা করে দেখলাম। এই অভিযান বিফল হয়ে যাওয়ার একমাত্র সম্ভাবনা ছিল, সেটে হচ্ছে যদি কোন অতিউৎসাহী মুক্তিযোদ্ধা আক্রমণ মুহূর্তের পূর্বেই উত্তেজনা বশতঃ কিছু করে বসে।

অক্টোবরের ৯ তারিখে সড়ক এবং রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্নকারী দলটি প্রত্যেকের নির্দিষ্ট কাজের নির্দেশ নিয়ে সন্ধ্যার পর রওনা হলো। গোপন ও অতি সন্তর্পণে এই দলটিকে উলিপুর এবং চিলমারীর মাঝামাঝি স্থানে ঘাঁটি স্থাপন করে মূল আক্রমণ শুরু না হওয়া পর্যন্ত আত্মগোপন করে থাকতে হবে। ১১ই অক্টোবর মূল বাহিনী চিলমারীর উদ্দেশ্যে রওনা হলো। অনেকগুলো বেশি নৌকা তাদের বহন করে এগিয়ে চলল। একসাথে এতগুলো দেশী নৌকার ব্যবস্থা করা ও তাদের বিভিন্ন অবস্থান থেকে গোপনে একই সময় শত্রুঘাঁটির কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া সে সময়ে বড় কঠিন ব্যাপার ছিল। কমাণ্ডার আবুল কাশেম চাঁদ, ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এ ব্যাপারে এগিয়ে এলো আর সমস্ত ব্যবস্থা সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করল। রাতের অন্ধকারে দুরপাল্লার কামানগুলো চালিয়াপাড়ায় স্থাপন করা হলো। এই ভারী অস্ত্রগুলোকে নৌকা থেকে নামিয়ে বালুচরের উপর দিয়ে টেনে নিয়ে নির্ধারিত স্থানে স্থাপন করা যে কি বিপজ্জনক এবং কঠিন ছিল তা লিখে বুঝানো যাবে না।

স্বাধীনতা যুদ্ধের আর এক অসম সাহসী সৈনিক নায়েব সুবেদার মান্নান। তার উপর ন্যস্ত ছিল ওয়াপদা ভবন ধ্বংস করার দায়িত্ব। ওখানে পাকিস্তানী অফিসাররা প্রমোদ বিলাসে মত্ত থাকতো। আমরা মাত্র দুটি রকেট লাঞ্চার তার দলকে দিতে পেরেছিলাম। কমাণ্ডার চাঁদের নেতৃত্বে বিভিন্ন দল গোরগাছা, রাজভিটা, তানাহাট পুলিশ স্টেশন এবং ব্রীজ অবস্থান আক্রমণের জন্য নির্দিষ্ট হলো। এদের অর্ধেকের সাথে ছিল ৩০৩ রাইফেল, কিছু পুরোনো স্টেনগান আর বাকিদের কাছে শুধুমাত্র গ্রেনেড। মূল বাহিনীর এই ছোট ছোট দলগুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছিল খালেদ দুল, সুলায়মান, নূর আহম্মেদ আলো, আর নজরুল। বলবাড়ি পুলিশ স্টেশনের জন্য কোন দল পাঠানো হয়নি, কারণ আমাদের জানা ছিল শত্রুসেনারা রাতে সে অবস্থান ছেড়ে চলে আসতো। আক্রমণ পরিচালনার জন্য চালিয়াপাড়া আমি আমার হেড কোয়ার্টার স্থাপন করলাম। চিলমারীর দুই মাইল দক্ষিণে গাজীর চরকে আক্রমণকারী বাহিনীর আক্রমণের পূর্ব মুহূর্তের ঘাঁটি হিসেবে বেছে নেয়া হল।

গভীর রাত। ১টার সময় খবর এলো আমাদের সম্পূর্ণ বাহিনী আক্রমণস্থলের নিকটবর্তী ঘাঁটিতে পৌঁছে গেছে এবং যার যার নির্দিষ্ট আক্রমণস্থলের উদ্দেশ্যে যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে। গ্রাউন্ড সিট বিছিয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম এবং সাড়ে তিনটায় আমাকে জানানো হল কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার বাহিনী শত্রুসেনার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। নানা ভাবনা সেই স্বল্প সময়টুকুতে আমার মনে ভীড় জমালো। হাতিয়ারের অভাব, অল্পবয়সী ছেলেরা- এরা কি পারবে এই বিরাট আক্রমণে সাফল্য লাভ করতে? কি হবে ওখানকার জনসাধারণের, যখন আমরা চিলমারী ছেড়ে চলে আসবো। রাতে খুব কাছে থেকে রকেট লাঞ্চার দিয়ে ওয়াপদা ভবনের উপর আঘাত হানার সাথে সাথে সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু হলো। সমস্ত শত্রুঘাটিতে ধ্বংসযজ্ঞ নেমে এলো। দূরপাল্লার কামান গুলো শত্রুসেনাদের গানবোটগুলোর সম্ভাব্য অবস্থানের উপর গোলা বর্ষণ করে চলেছে। কামানের গোলা গ্রেনেড, মেশিনগান আর ছোট অস্ত্রের আওয়াজে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে যেতে লাগলো। সকাল ৬টার মধ্যেই গোরগাছা, রাজভিটা, পুলিশ স্টেশন ও ব্রীজের অবস্থানগুলো আমাদের আয়ত্তে আসল, কিন্তু ওয়াপদা ভবনের আশেপাশের চলাচল আমাদের নজরে পড়ল। আমাদের একমাত্র নির্ভর রকেট লাঞ্চার দুটি শত্রু বাংকারগুলিকে নির্মূল করতে পারল না বটে, তবে ওয়াপদা ভবনে অবস্থানরত প্রচুর শত্রুসেনা খতম করতে সক্ষম হলো। শুধুমাত্র এ দুটি অস্ত্রের উপর নির্ভর করায় আমরা শত্রুর এই অবস্থানটি দখল করতে সক্ষম হলাম না। যেহেতু সম্পূর্ণভাবে শত্রুকে আঁকড়ে থাকতে হলো। কারণ একমাত্র রাতের অন্ধকারেই সফল পশ্চাদপসারণ সম্ভব। সকাল ৮টা। আমার কাছে খবর এলো চাঁদ আরো সাহায্য চাচ্ছে। মনে হলো অবস্থা সংকটজনক। সে লক্ষ করছে বলবাড়ি রেল স্টেশন থেকে শত্রুসেনারা নতুন আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমার ছোট্ট স্পীড বোটটি নিয়ে নদী পার হয়ে চালিয়াপাড়া থেকে গাজীর চরে গিয়ে পৌঁছালাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম স্কোয়াড্রন লীডার হামিদুল্লাহ বন্দীদের কাছ থেকে খবর বার করার চেষ্টা করছেন। তার ব্যবস্থাপনা মন্দ ছিল না। যাওয়ার সাথে সাথে এক মগ গরম চা পেলাম। আরও জানলাম চাঁদকে সাহায্য করার মত কোন বাড়তি দল রাখা হয়নি। তৎক্ষণাৎ আমি আমার ছোট্ট রক্ষাকারী বাহিনী নিয়ে থানা অভিমুখে এগিয়ে গেলাম। ভাগ্যক্রমে আমাদের একটি এল-এম-জি ছিল। এই অস্ত্রটি সেদিন আমাদের ভীষণ উপকারে আসে। নানা দিক থেকে মাঝে মধ্যেই গোলাগুলি চলছিল। গ্রামবাসীরা যে যেদিকে পারছিল দৌড়াচ্ছিল। কেউ কেউ জয় বাংলা জয় বাংলা বলে চিৎকার করেছিল। থানার এক মাইলের মধ্যে চলে এসেছি, এমন সময় একটি ফেলে যাওয়া গরুর গাড়ি রাস্তার মাঝখানে পেলাম। গাড়িতে শুয়ে ছিল একজন মেয়েলোক। একটি হাত ভাঙ্গা, বুকের স্তন নেই। পাকিস্তানী মর্টার শেলের শিকার। তার বাচ্চা ছেলেটি মায়ের রক্তে মাখা। বসে বসে কাঁদছে। এই নিষ্পাপ শিশুটি মাকে ছেড়ে যেতে পারেনি। একজন গ্রামবাসীকে ডেকে জানলাম মেয়েটিকে হাসপাতালে নেয়া হচ্ছিল। থানার পাশেই হাসপাতাল। তার মাকে ছেড়ে যেতে পারেনি। আর ঐ দিক থেকেই গুলি আসছে। তাই মাকে ছেড়ে সবাই পালিয়েছে। আমি লোকটিকে গাড়ি চালিয়ে আমার সাথে আসতে বললাম। আমার সাথে থাকায় সে সাহস ফিরে পেলো। হাসপাতালে যখন পৌঁছলাম গুলি বর্ষণ তখন আরো তীব্রতর হয়েছে ঝাঁকে ঝাঁকে মেশিনগানের গুলি হাসপাতালের দেয়ালে আঘাত হানছে। ভাগ্যক্রমে হাসপাতালের ভেতর ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় ডাক্তারকে পেলাম। আমি সেই হতভাগ্য মেয়েলোকটির ভার ডাক্তারের উপর ছেড়ে দিলাম,- জানি না আজ সে বেঁচে আছে কিনা। হাসপাতাল বের হয়েই দেখি চাঁদ দৌড়ে আসছে আমার দিকে। সে কাঁদছিল। আমাকে জানাল, তার দলের ছেলেরা ৭৬টি দখল করা অস্ত্র এবং প্রচুর গোলা বারুদ ফেলে থানার অবস্থান ছেড়ে চলে এসেছে। থাকে উৎসাহ দিয়ে আমরা এগিয়ে গেলাম পূর্ব অবস্থান পূণঃদখলের জন্য। মেশিনগানের এক ঝাঁক গুলি আমাদের উপর দিয়ে চলে গেল। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম পাকিস্তানী সৈন্যরা প্রায় ১০০ গজ দূরে রেল লাইনের উপর অবস্থান নিয়েছে। বাঁশ ঝাড়ের আড়ালে আড়ালে আমরা এগিয়ে এবং শত্রু বাহিনীর একপাশে আমার রক্ষাকারী বাহিনীর এল-এম-জি টি স্থাপন করলাম। একনাগাড়ে গুলি করার পর কিছু পাকিস্তানী সেনা পড়ে গেল। বাকিরা তাদের অবস্থান ছেড়ে রেল লাইনের উপরে চলে গেল। ত্বরিত গতিতে আমরা রেল লাইন দখল করলাম। গুলি চালিয়ে আরো কিছু পলায়নপর পাকিস্তানী সৈন্য খতম হলো। কিছুক্ষণ পরই বলবাড়ি স্টেশনের অবস্থান থেকে শত্রুসৈন্যরা আমাদের উপর গুলি চালাল। আমরা পিছু হটে পুলিশ স্টেশনে অবস্থান নিলাম। সেখানে পাকিস্তানীদের তৈরী পরিখার অভাব ছিল না। দখল করা অস্ত্র এবং গোলা বারুদ গাজীরচরে পাঠানো হলো একটি ঘরে আমি দশ বস্তা চাল ও দুই বস্তা গম পেলাম। চেয়েছিলাম এগুলো গ্রামবাসীরা নিয়ে যাক, কিন্তু নেয়ার মত কেউ সেখানে ছিল না। বেশ কিছুক্ষণ পর আমি একজন বুড়ো লোককে পেলাম। আমি তাকে দরকার থাকলে কিছু চাল নিতে বললাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই চারদিক থেকে লোকজন আসতে লাগলো। মনে হচ্ছিল তারা যেন মাটি ফুঁড়ে বের হচ্ছে। হট্টগোল শুরু হয়ে গেলো। ছেলে, বুড়ো, পুরুষ, মেয়েলোক সবাই কাড়াকাড়ি করছে যা পাচ্ছে তুলে নেয়ার জন্য। কয়েক মিনিটের মধ্যেই থানা ও থানার পাশের পুলিশের বাসাগুলো খালি হয়ে গেলো সে দৃশ্য ভোলার নয়।

রাতের অন্ধকার নেমে আসার সাথে সাথে আমি কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা রেখে প্রধান দলটি নিয়ে গাজীরচরে চলে এলাম। কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা রেখে আসার উদ্দেশ্য ছিল যাতে পাকিস্তানীরা আমাদের পিছু নিতে না পারে। যদিও আমরা ওয়াপদা ভবনের বাংকারগুলো এবং বলবাড়ি রেলওয়ে স্টেশনের অবস্থান সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে পারিনি, তবুও পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দারুনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। অতি নিকট থেকে সম্পূর্ণভাবে ঘেরাও হয়েও শত্রুসৈন্যরা আত্মসমর্পণ করেনি। সত্যি তারা বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছিল। আমরা জানতাম আমাদের চলে আসার পর ঐ এলাকার জনসাধারণের উপর পাকিস্তানীরা কি ভয়াবহ অত্যাচার চালাবে! কিন্তু আমাদের উপায় ছিল না। এই আক্রমণের উদ্দেশ্যই ছিল শত্রুকে অকস্মাত আঘাত হানা, যত বেশী সম্ভব শত্রুসেনা খতম করা, তাদের মনোবল ভেঙ্গে দেওয়া, অস্ত্র ও গোলা বারুদ দখল করা। আমরা সম্পূর্ণ সফল হয়েছিলাম।

আমরা চলে আসার দু’দিন পর পাকিস্তানীরা ঐ এলাকার নিরীহ, নিরস্ত্র গ্রামবাসীদের উপর নির্মম অত্যাচার চালায়। নিরস্ত্র জাতি এমনভাবে অত্যাচার সহ্য করেই বাংলার স্বাধীনতা এনেছে।

ওয়ারেন্ট অফিসার শফিউল্লার নেতৃত্বে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নকারী দলটি অভূতপূর্ব সাফল্যের সাথে তাদের কাজ সম্পন্ন করে। তারা শুধু সড়ক ও রেল পথের ব্রীজগুলো ভেঙ্গে দিয়ে ক্ষান্ত হয়নি, জায়গায় জায়গায় রেলওয়ে লাইন এবং রাস্তা কেটে তারা সমান করে দেয়। বেশ কিছুদিনের জন্য এই যোগাযোগ ব্যবস্থা পাকিস্তানীরা ব্যবহার করতে পারেনি।

১৩ই অক্টোবর। বিপুল সংখ্যক যুদ্ধবন্ধী এবং প্রচুর অস্ত্র, গোলা বারুদ নিয়ে আমরা রৌমারী ফিরে এলাম। জনগণের আদালতে ওয়ালী মাহমুদ ও পাচু মিয়ার বিচার হলো। দেশপ্রেমিক হত্যা, রাজাকার বাহিনী সংগঠন এবং লুন্ঠনের অপরাধে তারা দোষী সাব্যস্ত হয় এবং তাদের মৃত্যুদন্ড দেওয়া হল। বহুসংখ্যক বাঙ্গালী রাজাকার মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে। ওয়ারেন্ট অফিসার শফিউল্লা, নায়েব সুবেদার মান্নান, চাঁদ,  দুলু, আলো সুলেমান, নজরুল এবং আরো অনেকের বীরত্ব এবং ত্যাগের কথা কোনদিনই ভোলা যাবে না। এরাই বাংলার সোনার ছেলে।

মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান ও কামালপুর অভিযান

পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে ১১নং সেক্টরের দায়িত্ব নিয়ে একটি জিনিস দেখে বার বার অবাক হয়েছি। দেখেছি প্রত্যয় আর দৃঢ়তায় সকালের সূর্যের মত হাজার তরুণ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার জন্য নির্বাচিত না হতে পেরে অতৃপ্তির ব্যাথা নিয়ে ফিরে গেছে। তারপর যুব শিবিরে অপেক্ষা করেছে দিনের পর দিন, কখন জীবন দেবার ডাক আসে। মহেন্দ্রগঞ্জ, মানকার চর, ডালু ও অন্যান্য সীমান্ত এলাকায় ওরা আমাকে ঘিরে ধরেছে। সবারই এক প্রশ্ন, আর কতদিন অপেক্ষা করব? একজন সৈনিক হিসেবে আমি বুঝতে পারি কখন মানুষ ভয়াবহ যুদ্ধকে সহজভাবে গ্রহণ করতে স্বতঃস্ফুর্তভাবে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার দৃষ্টান্ত আর নেই। গণচীন থেকে শুরু করে ইন্দোচীনের স্বাধীনতা যুদ্ধ, কোনটাই বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মত এ দৃষ্টান্ত রাখতে পারেনি। চীন ভিয়েতনাম, কিউবাতে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে, ব্যাপক রাজনৈতিক ও সামরিক প্রস্তুতির সঙ্গে। সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব ছাড়া বাংলার তরুণরা যেভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, যুদ্ধ ক্ষেত্রে শৌর্য ও আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়েছে তার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কোন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নেই। মুক্তিযোদ্ধারা এই ইতিহাস সৃষ্টি করেছে অন্য কেউ নয়। যদি কোন দল বা গোষ্ঠী এককভাবে মুক্তিযুদ্ধ তথা জনগনের এই বিজয়কে নিজের বলে করে তা হবে অবৈধ, মিথ্যা। পাকিস্তানী উপনিবেশিক শক্তির শোষণ এত তীব্র ছিল যে বাঙ্গালী জাতির জাতীয়তাবোধ মুক্তিযুদ্ধের প্রধান কারণ হবার প্রখরতা অর্জন করেছিল। জাতীয় শোষণ থেকে মুক্তি পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা আদেশের জনগণ তথা তরুণ সমাজকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার শক্তি যুগিয়েছে। এ কৃতিত্ব জনগণের আর জনগণের যোদ্ধা তরুন সম্প্রদায়ের নিজস্ব।

আগষ্ট মাসে ১১নং সেক্টরের কার্য ভার গ্রহণ করার পর পাকিস্তানীদের ঘাঁটির উপর আমি কয়েকটি আক্রমণ পরিচালনা করি। এই আক্রমণগুলো চালাবার ফলে পাকিস্তানী রণনীতি সম্বন্ধে আমাদের একটি সুস্পষ্ট ধারণা জন্মে এবং সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের দোষ গুনগুলোও প্রকাশ পায়। পাকিস্তানীরা সে সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সম্ভাব্য প্রবেশ পথগুলো বন্ধ করার জন্য সীমান্তে শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে তোলে। এই ঘাঁটিগুলোকে সুরক্ষিত করার জন্য তারা ব্যাপকভাবে কাঁটা তারের বেড়া ও মাইন ব্যবহার করে। ঘাঁটিগুলোর ভিতর মজবুত বাংকার তৈরী করা হয়, যা তাদেরকে কামানের গোলা থেকেও বাঁচাতে পারে। ঘাঁটিগুলোতে নিয়মিত পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী ছাড়াও বেশ কিছু সংখ্যক রাজাকার ও আলবদর রাখা হয়। সীমান্তবর্তী এই সুরক্ষিত ঘাঁটিগুলো ছাড়াও সড়ক ও যোগাযোগ কেন্দ্রগুলোকে রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানী ঘাঁটি গড়ে ওঠে। দেশের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা ঘাঁটিগুলো ছিল অপেক্ষাকৃত কম সুরক্ষিত।

কামালপুর ছিল উত্তর সীমান্ত পাকিস্তানীদের একটি সুরক্ষিত ঘাঁটি। আগষ্ট মাসের মাঝামাঝি এই ঘাঁটির উপর আমরা দুবার প্রত্যক্ষ আক্রমণ চালাই। দুবারই মুক্তিযোদ্ধারা ঘাঁটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়, তথাপি তারা ঘাঁটিটি দখল করতে ব্যর্থ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা যখনই ঘাঁটিতে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে সে সময়ই তাদের উপর পাকিস্তানীদের ব্যাপক ১২০ মিলিমিটার মর্টারের গোলা বর্ষিত হয়েছে। বকশীগঞ্জের পাকিস্তানী অবস্থান থেকে এই মর্টারের গোলা ছোঁড়া হত। শত্রুসেনারা মজবুত বাংকারের ভেতর থাকত বলে এই আক্রমণে তাদের কোন ক্ষতি হত না এবং অবস্থা বেগতিক দেখলেই তারা নিজ অবস্থানের উপর নিজ মর্টার দ্বারা গোলাবর্ষণ করত। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পাকিস্তানীরা এই রণনীতির কথা চিন্তা করে এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তা ব্যাপকভাবে কাজে লাগায়। কামালপুর ঘাঁটির উপর দুটি আক্রমণ চালিয়ে আমি মুক্তিযোদ্ধাদের দোষগুলোকে সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করি।

আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্বলতম দিক ছিল- রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের অভাব। যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব মুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা ও তার মূল লক্ষ্য অন্তরঙ্গ সাহচর্যের মাধ্যমে শিক্ষা দেয় তা কোন সময়ই ছিল না। রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে কিভাবে গণসংযোগ করতে হয় তা কোন সময়ই ছিলনা। এ জন্য অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের আচরণে তারা জনসমর্থন হারিয়েছে। দ্বিতীয়তঃ সামরিক নেতৃত্বের দূর্বলতা। কয়েক সপ্তাহের ট্রেনিং প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্য থেকে একজনকে নির্বাচিত করা হত নেতা। প্রায় ক্ষেত্রেই সামরিক জ্ঞানের অভাবে সংকট মুহূর্তে সে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হত। অবশ্য এই অল্প সময়ে সরবরাহ ও অস্ত্রের দিক থেকে প্রত্যক্ষ আক্রমণের ভূমিকা গ্রহণের উপযুক্ত হয়ে ওঠেন। আগষ্ট মাসের শেষের দিকে ১১নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের আমি নির্দেশ দিই শত্রুর শক্তিশালী ঘাঁটি আক্রমণ থেকে বিরত থাকো। শত্রুকে কৌশলে প্রলুব্ধ করে তার শক্তিশালী ঘাঁটি থেকে নির্ধারিত স্থানে বের করে আনো এবং হত্যা করো।

৭ এবং ১০ই সেপ্টেম্বরের অভিযানগুলো সুরক্ষিত কামালপুর ঘাঁটি থেকে শত্রু সৈন্যদের কৌশলে প্রলুব্ধ করে নির্ধারিত স্থানে বের করে এনে হত্যা করার সুন্দর উদাহরণ। এই অভিযানগুলো ১১নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের বহুদিন মনে থাকবে। গেরিলা যুদ্ধের ছাত্রদের জন্যেও এগুলো মূল্যবান শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে থাকবে।

কামালপুরে শত্রু ঘাঁটি থেকে ৫০০ গজ পশ্চিমে ধানুয়া কামালপুর গ্রাম, দক্ষিণ  পশ্চিম ও দক্ষিণে ঘাসীর গ্রাম ও উঠানের পাড়া। ধানুয়া কামালপুর, ঘাসীর গ্রাম, আর উঠানের পাড়া এই গ্রামের সারি এবং কামালপুরের মাঝে বিস্তীর্ণ জলোমাঠ। শত্রুকে এই জলোমাঠে বের করে আনতে হবে। এই জলোমাঠই হবে তাদের মরণফাঁদ। এই উদ্দেশ্য সম্মুখে রেখে আমি ধানুয়া কামালপুর এবং ঘাসীর গ্রামে একটি নকল ব্যুহ রচনা করি। মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজকে এই রক্ষা ব্যুহ গড়ে তোলার ভার দেয়া হয়। (বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজ পরবর্তীকালে একটি অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে শহীদ হন)। মাহফুজ রাতের অন্ধকারে গ্রামবাসীদের সহায়তায় বাংকার ও ট্রেঞ্চ তৈরী করে ধানুয়া কামালপুর ও ঘাসীর গ্রামে আশ্রয় নেয়।

কামালপুর থেকে সোজা দক্ষিণে চলে গেছে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, বকশীগঞ্জ- জামালপুর টাঙ্গাইল সড়ক। ঢাকা দখলের জন্য সর্বাত্মক আক্রমণে এই সড়কটির গুরুত্ব অপরিসীম। পাকিস্তানীর এই সড়কের গুরুত্ব উপলব্ধি করতো এবং সেজন্য তারা সড়কটির পাশে বিভিন্ন স্থানে মজবুত ঘাঁটি স্থাপন করেছিল। এই সড়ক ধরেই ১৬ই ডিসেম্বর ১১নং সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা সর্বপ্রথম ঢাকা প্রবেশ করে।

কামালপুরের শত্রু ঘাঁটিকে তার যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। নকল রক্ষা ব্যুহ থেকে কামালপুর ও বকশীগঞ্জের মাঝের সড়কটিতে মুক্তিযোদ্ধারা এন্টি ট্যাংক মাইন স্থাপন করে। এই মাইন বিস্ফোরণে পাকিস্তানীদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। আগষ্ট মাসের শেষের দিকেই পাকিস্তানীদের সরবরাহ ও সৈন্য বোঝাই নয়টি ট্রাক এতে ধ্বংস হয়। ৬ই সেপ্টেম্বর বিকাল বেলা ধানুয়া কামালপুর রক্ষা ব্যুহ গিয়ে মুক্তি বাহিনীর একটি দলকে উঠানের পাড়ার কাছে কামালপুর বকশীগঞ্জ সড়কের উপর এ্যামবুশ নেবার নির্দেশ দিই। সড়কের খুব কাছে গিয়ে কেমন করে অবস্থান নিতে হবে বারবার তার মহড়া দেয়া হয়। মাঝরাতে এ দলটি তাদের নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে এ্যামবুশ পাতে। তাদের উপর নির্দেশ ছিল যতক্ষণ পর্যন্ত এ্যামবুশ স্থলে শত্রু প্রবেশ না করে সে সময় পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করবে। রক্ষা ব্যুহ থেকে মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্পে ফিরে এসে আমি আর একটি কোম্পানীকে অস্ত্র নিয়ে তৈরী থাকার নির্দেশ দিই। বামুনের পাড়া থেকে বনজঙ্গলে পূর্ণ পথ দিয়ে কামালপুর ঘাঁটিতে পৌঁছান যায়। ভোর সাড়ে চারটার সময় এই পথ দিয়ে এগিয়ে কামালপুর ঘাঁটি আক্রমণ করতে হবে। আমরা জানতাম কামালপুরের দিকে রওনা হবে। উঠানের পাড়ার কাছে মুক্তি বাহিনীর দলটি তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। রাতের অন্ধকারে আমাদের চারটি তিন ইঞ্চি মর্টার বাম রোডের উত্তর পাশে স্থাপন করি। ভোর চারটা। বাম রোডের উপর বসে আছি। আক্রমণকারী দলটি কামালপুরের দিকে এগিয়ে গেছে। সারারাত আমরা কেউ ঘুমাতে পারিনি। আসন্ন সংঘর্ষের উত্তেজনায় আমরা সমস্ত অবসাদ ভুলে গেছি। ভোর হয়ে আসছে। আক্রমণকারী দলটি কামালপুর ঘাঁটিতে পৌঁছে গেছে। হঠাৎ তাদের তীব্র আক্রমণ ভোরের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে দিল। আমাদের মর্টারগুলো কামালপুর পশ্চিম অংশে গোলা নিক্ষেপ শুরু করল। কিছুক্ষণ পর সকালের আলোতে দেখা গেল বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা কামালপুর ঘাঁটি অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে। ঘাঁটির পূর্ব অংশ তাদের দখলে। ঘাঁটির পশ্চিম অংশের বাংকার থেকে ক্রমাগত মেশিনগানের গুলি আসতে থাকে এবং সঙ্গে সঙ্গে মর্টারের গোলা। অল্পক্ষণের মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এতে দুজন মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ হারায় ও ১৭ জন আহত হয়। সকাল সাতটায় এ্যামবুশ স্থলে পাকিস্তানী সাহায্যকারী দলটির প্রথম ট্রাকটি এ্যামবুশকারী দলের স্থাপিত মাইন বিস্ফোরণে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়। এতে বেশ কিছু সংখ্যক পাকিস্তানী সৈন্য নিহত ও আহত হয়। ধ্বংসপ্রাপ্ত ট্রাকটির পেছনেই ছিল একটি জীপ ও অপর একটি ট্রাক। এই গাড়ি দুটো থেকে শত্রুসৈন্যরা ত্বরিত নেমে রাস্তার পাশে অবস্থান নেয় ও এ্যামবুশকারী দলটির সাথে গুলি বিনিময় শুরু হয়। এতে আরো পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। বেলুচ রেজিমেন্টের মেজর আইয়ুব জীপ থেকে নেমে আসার সময় মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে নিহত হয়। যখন এই গুলি বিনিময় চলছিল তখন একদল পাকিস্তানী সৈন্য কামালপুর ঘাঁটি থেকে পালিয়ে বকশীগঞ্জ যাচ্ছিল। এই পলাতক দলটি সে সময় এ্যামবুশকারী দলটির পেছনে এসে অবস্থান নেয় ও তাদের উপর গুলি চালায়। এতে ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন ও ৪ জন পাকিস্তানীদের হাতে ধরা পড়েন। এই আকস্মিক বিপর্যয়ে এ্যামবুশকারী দলটি তাদের এ্যামবুশস্থল পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এই বিপর্যয় না ঘটলে সেদিন একটি পাকিস্তানীও এ্যামবুশস্থল থেকে ফিরে যেতে পারত না। সামগ্রিক ভাবে এই অভিযোগটি ছিল একটি সফল অভিযান। অভিযান শেষে আনুমানিক ৩৩ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়েছে বলে মুজিবনগরে খবর পাঠাই। রেডিও পাকিস্তান ঢাকা থেকে সেদিনের রাতের খবরে বলা হয় যে শেষ রাতে দুই ব্যাটালিয়ন ভারতীয় সৈন্য পাকিস্তান সীমান্ত ঘাঁটি কামালপুর আক্রমণ করে। স্বল্প সংখ্যক পাকিস্তানী সৈন্য এই আক্রমণ প্রতিহত করে এবং ভারতীয় সৈন্যদের পেছনে হটিয়ে দেয়। এতে ৩০০ ভারতীয় সৈন্য নিহত হয় ও ৬৭ জন পাকিস্তানী সৈন্য শহীদ হয়। এখবর শোনার পর আমরা খুবই উল্লসিত হয়ে উঠি। নিঃসন্দেহে এই অভিযানে আমরা শত্রুকে প্রলুব্ধ করে নির্দিষ্ট স্থানে এনে বিপুল সংখ্যায় হত্যা করতে সক্ষম হয়েছিলাম।

১০ই সেপ্টেম্বর অভিযানটি ও শত্রুকে কামালপুর ঘাঁটি থেকে বের করে আনার একটি সুন্দর কাহিনী। আমি লক্ষ্য করেছি মুক্তি বাহিনীর আক্রমণের পরপরই পাকিস্তানী সৈন্যরা বেপরোয়া হয়ে উঠতো। বাংলাদেশের ভেতর মুক্তি বাহিনী তাদের কোন ক্ষতিসাধন করতে পারে এই ধারণা তারা স্থানীয় জনসাধারণকে দিতে চাইত না। তারা সবসময় এ কথা প্রমাণ করতে চাইত যে, তারা অসীম শক্তির অধিকারী এবং পাকিস্তানকে তারা টিকিয়ে রাখবেই। তাদের এই মানসিকতার জন্য আমি নিশ্চিত ছিলাম যে এবার তারা আমাদের ধানুয়া কামালপুর ও ঘাসীর গ্রাম অবস্থানগুলোয় আক্রমণ করবে। ৭ তারিখ দুপুর থেকে আমরা পাকিস্তানী সৈন্যদের কামালপুর-বকশীগঞ্জ সড়কটি ব্যবহারের অবাধ সুযোগ দিই। এসময় তারা কামালপুরে অবস্থানরত ভীত সন্ত্রস্ত পাকিস্তানী সৈন্যদের সরিয়ে নতুন সৈন্য নিয়ে আসে। আমিও তাই চেয়েছিলাম। ৮ তারিখ বিকাল বেলা মেজর জিয়াউর রহমানের ব্রিগেডিয়ার প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানী মহেন্দ্রগঞ্জে নিয়ে আসি। প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন মেজর জিয়াউদ্দিন। ৯ তারিখ ভোর বেলা মেজর জিয়াউদ্দিনকে আমি ধানুয়া কামালপুর ও ঘাসীর গ্রামের অবস্থানে যাই। কামালপুর ঘাঁটি থেকে বের হয়ে এসে পাকিস্তানী সৈন্যরা ঘাসীর গ্রামের অবস্থানের উপর আক্রমণ চালাবে বলে আমি ধারণা করি। এই অবস্থানকে মজবুত করার জন্যই প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানীটিকে সেখানে রক্ষা ব্যুহ তৈরী করার নির্দেশ দেই। কোম্পানী কমাণ্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী (বর্তমানে মেজর ও প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক)। ৯ ও ১০ তারিখ রাতে কোম্পানীটি নিজ অবস্থান নেয়। সে রাতেই মুক্তিযোদ্ধারা কামালপুর-বকশীগঞ্জ সড়কে এন্টি ট্যাংক ও এন্টি পার্সোনাল মাইন স্থাপন করে। সে সময় থেকে তারা ছোট ছোট দলে সড়কটির পাশে পেট্রোলিংও শুরু করে দেয়। কামালপুরের পূর্ব পাশেও একটি মুক্তিবাহিনী কোম্পানী নিয়োজিত করা হয়। তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয় বকশীগঞ্জ থেকে কোন সাহায্যকারী দল আসলে তাদের বাধা দেয় এবং কামালপুর থেকে যদি কোন সৈন্য বের হয়ে যায় তাদের হত্যা করা।

১০ তারিখ ভোর বেলা থেকেই আমরা কামালপুর ঘাঁটিকে সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ করে ফেলি। সরবরাহ বন্ধ, সড়ক যোগাযোগ বন্ধ, শত্রু জন্য কেবল দুটি পথ খোলা রয়েছে- হয় রাতের অন্ধকারে ছোট ছোট দলে পলায়ন করা অথবা একত্রিতভাবে আমাদের অবস্থানে আক্রমণ করা। দ্বিতীয় সম্ভাবনাটাই ঘটবে বলে আমি ধরে নিয়েছিলাম। এই আক্রমণ আসবে ১০ ও ১১ সেপ্টেম্বর রাতে। ১০ তারিখ ভোর বেলা আমি ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী রক্ষা ব্যুহ করি। রাতারাতি বেশ কতকগুলো বাংকার তৈরী করে তাদের অবস্থানকে মজবুত করে তুলেছে। তাদের অবস্থানের সামনে থেকেই জলোমাঠটির শুরু। পানির গভীরতা এক ফুট থেকে তিন ফুট। শত্রু একশত গজের মধ্যে আসলে গুলিবর্ষণ করার নির্দেশ দেয়া হয়। আমি স্থির নিশ্চিত ছিলাম যে এবার আমরা বেশ কিছু সংখ্যক সৈন্য নিধন করতে সক্ষম হবো। এর সাথে সাথে কামালপুর ঘাঁটিও আমাদের দখলে আসতে পারে। শত্রুসৈন্যরা কামালপুর ঘাঁটি থেকে বের হয়ে এসে যখন আক্রমণ চালাবে, তখন সম্পূর্ণ কিংবা আংশিক পরিত্যক্ত কামালপুর ঘাঁটিটি দখলের জন্য বেশি কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধার প্রয়োজন হবে।

এজন্য আমি এক কোম্পানী মুক্তিযোদ্ধাকে মহেন্দ্রগঞ্জে ক্যাম্পে তৈরী হওয়ার নির্দেশ দিই। নিরাপত্তার খাতিরে এই কোম্পানীকে কি কাজ করতে হবে তা জানতে দিইনি। সে সময় সীমান্ত এলাকায় ছড়িয়ে ছিল বিভিন্ন শ্রেণীর লোক। নিরাপত্তা বজায় রাখা তখন একটি দুরূহ ব্যাপার।

সন্ধ্যার পূর্বে কোন আক্রমণ পরিচালিত হবে না বলে আমি ধরে নিয়েছিলাম। আরও বেশ কয়েক ঘন্টা সময় হাতে রয়েছে। তাই দুপুর বেলা মহেন্দ্রগঞ্জ থেকে ১৮ মাইল দূরে মানকার চর সাবসেক্টরের দিকে রওনা হয়ে যাই- অপর একটি মুক্তিবাহিনী দলকে তাদের অভিযান সম্পর্কে নির্দেশ দেওয়ার জন্য। মানকার চরে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে আমি খবর পাই যে, ধানুয়া ও ঘাসী গ্রামে আমাদের অবস্থানগুলো পাকিস্তানীরা আক্রমণ করছে। এ খবর পেয়েই আমি মহেন্দ্রগঞ্জ ফিরে আসি। বেলা তখন সাড়ে চারটা। ক্যাম্পে পৌঁছে যে কোম্পানীটিকে তৈরী থাকার নির্দেশ দিয়েছিলাম তাদের খোঁজ করি। আমার অনুপস্থিতিতে পাকিস্তানী আক্রমণের খবর পেয়ে এই কোম্পানীটিকে আমাদের অবস্থানগুলোর সুদৃঢ় করার জন্য প্রেরণ করা হয়। কোম্পানীটিকে এভাবে পাঠাবার ফলে আমার পরিকল্পনার আংশিক বানচাল হয়ে যায়। সেই সময় কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে কামালপুর ঘাঁটিটি আক্রমণ করলে তা সহজেই দখল করা যেতো।

কামালপুর ঘাঁটি আক্রমণের কোন উপায় না দেখে আমি ধানুয়া কামালপুরের দিকে রওনা হয়ে যাই। পথে দেখি ছোট ছোট দলে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের জোয়ানরা মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্পের দিকে ফিরে আসছে। তাদেরকে পূর্বস্থানে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে আমি ঘাসীর গ্রামে পৌঁছি। তখন প্রায় সন্ধ্যা। পৌঁছে দেখি বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানীটি বিশৃঙ্খলভাবে তাদের অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে গেছে। ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী একজন সঙ্গীসহ তখনও সেখানে রয়ে গেছেন। জলোমাঠটির মাঝামাঝি জায়গা থেকে তখনও পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের নিহত ও আহত সৈন্যদেরকে নিয়ে যেতে ব্যস্ত। ধানুয়া কামালপুরের অবস্থানে মুক্তিযোদ্ধারা তখনও অটুট রয়েছে।

সেদিন বেলা আড়াইটার সময় আমার মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্প ছেড়ে যাওয়ার পরপরই কামালপুর থেকে আনুমানিক দুই কোম্পানী সৈন্য আক্রমণ ধারা রচনা করে ঘাসীর গ্রামের দিকে এগোতে থাকে। প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানীটি উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে নির্দিষ্ট স্থানে শত্রু আসার পূর্বেই গুলিবর্ষণ শুরু করে। পাকিস্তানী সৈন্যরা এই গুলিবর্ষণ উপেক্ষা করে নানা যুদ্ধাস্ত্র সহকারে বেপরোয়া ভাবে এগোতে থাকে। তাদের পালটা গুলিতে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন নায়েক সুবেদার ও অপর একজন জোয়ান নিহত হন। সে সময় পেছন দিকে কেউ চিৎকার করে বলে যে, বকশীগঞ্জ থেকেও সৈন্যদল তাদের আক্রমণ করতে আসছে। এতে কোম্পানীটিতে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং তারা নিজ স্থান ছেড়ে পলায়ন করে। এসময় ধানুয়া কামালপুরের দক্ষিণ দিকে ছিল আমাদের একটি এল-এম-জি। এই এল-এম-জি’র কোনাকুনি গোলা বর্ষণে বহুসংখ্যক আক্রমণরত পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয় এবং শেষ পর্যায়ে তারা হটতে বাধ্য হয়। যে মুক্তিযোদ্ধা এল-এম-জি চালাচ্ছিল, উত্তেজনা বশত সে এল-এম-জি’র ব্যারেলটি বাম হাতে চেপে ধরে রাখে। এতে তার হাতের তালু সম্পূর্ণরূপে পুড়ে যায়। বিপুল সংখ্যক পাকিস্তানী সৈন্য হত্যা এবং আক্রমণকারী বাহিনীকে পিছু হটিয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব তারই। সন্ধ্যার পর ক্যাপ্টেন পাটোয়ারীকে আমি নির্দেশ দিই তার কোম্পানীটিকে পূর্বস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। রাত ন’টার সময় বোঝা গেল কোম্পানীটির মনোবল ভেঙ্গে গেছে। তাই তাদের ঘাসীর গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। তাদের জায়গায় পাঠানো হল আর একটি মুক্তিবাহিনী কোম্পানী। এই অভিযানটিতে যদিও আমাদের অনেক ভুল-ত্রুটি হয়েছে তথাপি পরিকল্পনার দিক থেকে এর মূল্য অপরিসীম। এই অভিযানকে একটি সুপরিকল্পিত এ্যামবুশও বলা চলে। শত্রুকে প্রলুব্ধ করে জলোমাঠটিতে এনে বিপুল সংখ্যায় হত্যা করতে আমরা সমর্থ হয়েছিলাম। এই অভিযানটির পর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও আত্মনির্ভরতা বহুগুণ বেড়ে যায়। হত্যা কথাটি আমি বারবার করেছি। অবশ্য নিয়মিত যুদ্ধে এই শব্দটির বিশেষ ব্যবহার নেই। শত্রুকে পরাজিত করাই মূল উদ্দেশ্য। গেরিলা যুদ্ধে চিহ্নিত শত্রু মানবিক প্রশ্নে বড় অপরাধী। হত্যাই তার যোগ্য শাস্তি।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২০। ১১ নং সেক্টরে সংঘটিত যুদ্ধ সম্পর্কে অন্যান্যের বিবরণ বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র ১৯৭১

শাহরিয়ার ফারুক

<১০, ২০., ৪৬০৪৬২>

সাক্ষাৎকারঃমেজর আব্দুল আজিজ*

১৯৭৩

১১ নং সেক্টরের যুদ্ধ বিবরণঃ

 

১১ নং সেক্টর ছিল বাংলাদেশের বৃহত্তম সেক্টর।ময়মনসিংহ জেলা, টাঙ্গাইল জেলা এবং রংপুর জেলার গাইবান্ধা মহকুমা নিয়ে গঠিত হয় এই সেক্টর। ভারতীয় সীমান্ত এলাকার ভারতীয় সিকিউরিটি পোস্ট মাইনকারচর থেকে মহেশখোলা পর্যন্ত এটি বিস্তৃত ছিল। ময়মনসিংহ জেলার প্রায় সম্পূর্ন এলাকা ২৪ শে এপ্রিল পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। যদি তৎকালীন সামরিক নেতৃবৃন্দ সুষ্ঠুভাবে উপলব্ধি করতে পারতেন তাহলে এই এলাকা মুক্তিযুদ্ধে আরও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারতো। কিন্তু এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি মুক্তিসেনারা তাড়াতাড়ি এলাকা ছেড়ে চলে যায় এবং পাক সেনারা স্থান দখল করে। নেতৃত্বহীন মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের পথে পা বাড়ায় এবং বেশীরভাগ লোক ভারতের ডালু এবং মহেন্দ্রগঞ্জে সমবেত হয়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ দেশের অভ্যন্তরে অবস্থান করে উল্লেখযোগ্যভাবে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এদের মধ্যে টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকী,ময়মনসিংহের ভালুকার আফসার উদ্দিন এবং সিরাজগঞ্জের লতিফ মির্জার নাম উল্লেখযোগ্য। এই সেক্টরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কামালপুর,জামালপুর,টাঙ্গাইল-ঢাকা রোড। ঢাকা সড়ক ঢাকা আক্রমণের জন্য অত্যন্ত জরুরি পথ। এই সেক্টরের সামরিকগুরুত্ব প্রাথমিক অবস্থায় ভারতীয় বা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সামরিক নেতৃবৃন্দ কেউই উপলব্ধি করেননি। যার ফলে এই সেক্টর সর্বদা ৭১ সনের জুন মাস পর্যন্ত অবহেলিত ছিল। আগষ্ট মাসের পূর্ব পর্যন্ত এই সেক্টর একজন ভারতীয় অফিসার ব্রিগেডিয়ার সান্তসিংহের পরিচালনাধীন ছিল। এবং কোন বাঙ্গালী অফিসারকে সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়নি। ব্রিগেডিয়ার সান্ত সিংহ সেক্টরকে নিম্নলিখিত সাব-সেক্টরে বিভক্ত করেন(ক)মাইনকারচর(খ)মহেন্দ্রগঞ্জ (গ)পুরাখাশিয়া (ঘ)ঢালু (ঙ) বাগমারা (চ)শিববাড়ি ও (ছ) মহেশখোলা।

ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অধিনায়করাই সাবসেক্টর কমান্ডার ছিলেন। এই সমগ্র সাব-সেক্টরের অধীনে দেশের অভ্যন্তরে কোন উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ হয়নি।যুদ্ধ সাধারনতঃ সীমান্ত এলাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। দূর্ভাগ্যবশত, তাদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা দেশের অভ্যন্তরে সাব-সেক্টর কমান্ডারদের উস্কানিতে ডাকাতি,রাহাজানি ও লূটতরাজ করছে বলে একটি সাংঘাতিক বদনাম রটে যায়। গেরিলা যুদ্ধে স্থানীয় জনসাধারণের সমর্থনে প্রয়োজনীয়তা ব্রিগেডিয়ার সান্ত সিং অনুধাবন করতে ব্যর্থ হওয়ায় দেশের অভ্যন্তরে উল্লেখযোগ্য প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। অন্যপক্ষে পাকিস্তান দখলদার বাহিনী নিজেদের ক্ষমতা সুদূঢ়রুপে প্রতিষ্ঠিত করে। সমস্ত প্রবেশ পথ বন্ধ করার জন্য সীমান্তের সর্বত্র‍্য তারা সুদূঢ় ঘাঁটি নির্মাণ করে। তারা এই সুযোগে রাজাকার ও আলবদর নামে প্যারামিলিটারী বাহিনী গঠন করতে সক্ষম হয়। এই অসুবিধা থাকা সত্বেও রংপুর জেলা সম্পূর্ন রৌমারী থানা এবং জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের বেশিরভাগ এলাকা সবসময়ে মুক্তিবাহিনীর অধীন ছিল।এই এলাকা ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহত্তম মুক্ত এলাকা।এই সেক্টরের অধীনে ভারতীয় বাহিনী মুক্তিবাহিনীর জন্য একটি ট্রেনিং স্কুল খোলে।ব্রিগেডিয়ার সান্ত সিং এই সেক্টর ছাড়া ও ট্রেনিং এর দেখাশোনা করতেন। সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন জায়গায় যুব শিবিরও স্থাপন করা হয়। এই শিবিরগুলি ট্রেনিং স্কুলের জন্য মুক্তিযোদ্ধা সরবরাহ করতো। জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে মেজর (বর্তমানে কর্ণেল) জিয়াউর রহমান ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তিনটি ব্যাটালিয়ান নিয়ে ১১ নং সেক্টরে আসেন এবং তাঁকে প্রথম নিয়মিত ব্রিগেড গঠন করার দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি অতি সংক্ষিপ্ত সময়ে ব্রিগেড গঠন করেন,যা পরে জেড ফোর্স নামে পরিচিত হয়। ঐ সময়ে মুক্ত এলাকা রৌমারী পাকিস্তানী বাহিনীর হুমকির সম্মুখীন হয় এবং তিনি তাঁর দুটি ব্যাটালিয়ানকে রৌমারী রক্ষায় নিযুক্ত করেন। ‘জেড’ ফোর্স গঠিত হবার অল্প সময় পরে মেজর জিয়াউর রহমান কতিপয় দুঃসাহসিক অভিযান চালান যা স্বাধীনতা যুদ্ধের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অংশের দাবি করতে পারে।

আগষ্ট মাসের শুরুতে মেজর আবু তাহের মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়কল্পে সফরে বের হয়ে এই সেক্টরে আগমন করেন। এই এলাকায় অভিযানের গুরুত্ব উপলব্ধি করে তিনি এই সেক্টরে থাকার সিদ্ধান্ত নেন এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দফতর থেকে তাঁকে সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হয়ে তিনি কামালপুর, জামালপুর,টাংগাইল এবং ঢাকা সড়কের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেন। এর উপর ভিত্তি করে কামালপুরের বিপরীতে ভারতে মহেন্দ্রগঞ্জে এই সেক্টরের সদর দফতর স্থাপন করেন। এখান থেকে তিনি কতিপয় বিখ্যাত আক্রমণ অভিযান পরিচালনা করেন যা বিস্তারিত উল্লেখ করা যেতে পারে। এর মধ্যে চিলমারীর যুদ্ধ,কামালপুরের যুদ্ধ,তেরীখারীন যুদ্ধ,বাহাদুরাবাদ যুদ্ধ,দেশের অভ্যন্তরে টাংগাইলের জাহাজ মারার যুদ্ধ, সরিষাবাড়ি যুদ্ধ,রংপুর অভিযান এবং নেভাল কমান্ডো অভিযান উল্লেখযোগ্য।

আগষ্ট মাসের শেষ দিকে এবং সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে এই সেক্টরের সমস্ত সেক্টর ট্রুপস,মুক্তিযোদ্ধা এবং জেড ফোর্স নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের প্রস্তুতি এবং পরিকল্পনা করা হয়েছিল যাতে দেশের অভ্যন্তরে গণযুদ্ধের রুপ দেওয়া যায়। তারপর স্বাভাবিকভাবে ঢাকা অভিযানের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এজন্য অন্যান্য সেক্টরেও ভারতীয় এলাকা ত্যাগ করে বাংলাদেশে প্রবেশ করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সেই অনুযায়ী মেজর জিয়াউর রহমান যুদ্ধের পরিকল্পনা তৈরি করেন, যা লেঃ জেনারেল অরোরা ও অন্যান্য ভারতীয় সামরিক উচ্চ অফিসারবৃন্দ কর্তৃক খুব প্রশংসিত হয়েছিল। সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে মুজিব নগরে সেক্টর কমান্ডার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। যার ফলে সে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। পক্ষান্তরে সকলকে বিস্মিত করে কর্ণেল জিয়াকে তার ‘জেড ‘ ফোর্স সহ এই সেক্টর থেকে সিলেট পাটিয়ে দেওয়া হয়। ‘জেড’ফোর্সের এই স্থানান্তর ১১নং সেক্টরের জন্য ছিল সবচেয়ে মারাত্মক আঘাত। মুক্ত এলাকা প্রতিরক্ষা ব্যতীত মুক্তিযুদ্ধ দ্রুতগতিতে দেশের অভ্যন্তরে বিস্তার লাভ করতে পারেনা।জেড ফোর্স চলে যাবার পরে এই সেক্টরে মাত্র ২ জন নিয়মিত অফিসার অবস্থান করেন-স্কোয়াড্রন লীডার হামিদুল্লাহ ও লেঃমান্নান।নানা অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও এই সেক্টর উল্লেখযোগ্য অপারেশনে অংশগ্রহণ করে।

১৫ ই নভেম্বর আমি ১১ নং সেক্ট্ররে পৌঁছি এবং মেজর তাহেরের অবর্তমানে অস্থায়ীভাবে সেক্টরের যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করি। সেক্টর হেডকোয়ার্টারে পৌঁছে আমি সেক্টরের গুমোট, নির্জীব অনিশ্চয়তার মধ্যে মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের দেখতে পাই। মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা তাদের নেতাকে হারিয়ে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছিল। আমি এসে হেডকোয়ার্টার সাব সেক্টরের মহেন্দ্রগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সাক্ষাৎ করি। বিস্তারিত যুদ্ধের অবস্থা অবলোকনের পর আমি কর্মপদ্ধতি স্থির করি এবং আক্রমণাত্মক অভিযান পরিত্যাগ করে অবরোধমূলক অভিযান পরিচালনার জন্য ভারতীয় নেতৃবৃন্দের কাছে পরামর্শ পাঠাই। সমগ্র সীমান্ত এলাকাতে অভিযান শুরু করে।

কামালপুরের অবরোধঃ

১৩ নভেম্বর ২৩ তারিখ দিবাগত রাতে কামালপুরে অবরোধ করা হয় এবং পাকিস্তানের অন্যতম শক্তিশালী ঘাঁটি কামালপুরকে তাদের মূল বাহিনী থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এবং রসদ বন্ধ করে দেয়া হয়। এই অবস্থায় ১১ দিন অবরুদ্ধ থাকার পর ৪ঠা ডিসেম্বর বিকাল ৩ টার সময় কামালপুর মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।নিয়মিত বাহিনীর ২২০ লোক এবং বিপুল অস্ত্র শস্ত্রসহ পাকসেনারা বন্দী হয়।এই অবরোধ চলাকালে তারা ১১ দিনের মধ্যে ৭ দিন বাইরে আসার চেষ্টা করলে বিপুল বাধার সম্মুখীন হয়ে অপরিসীম ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিল।তিনদিন কামালপুর থেকে মুক্তিবাহিনীর অবরোধ ভেঙ্গে পাকবাহিনী বের হয়ে যাবার চেষ্টা করলে অনেক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে ৪ঠা ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। কামালপুরের পতন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকবাহিনী ময়মনসিংহের মেঘালয় সীমান্তের সব এলাকাতে মনোবল হারিয়ে ফেলে এবং দ্রুত পশ্চাদপসারণ করে জামালপুর,ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনায় মুক্তিবাহিনীর অভিযোগ করার জন্য সমবেত হয়।

১১নং সেক্টরের যুদ্ধের পরিকল্পনাঃ নভেম্বর মাসের ১৮ তারিখ ভারতীয় ৯৫ তম মাউন্টেন ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার, ভারতীয় এবজা সেক্টরের ব্রিগেডিয়ার সাম সিং এবং ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কম্যুনিশনের অধিনায়ক মেজর জেনারেল ভগৎ সিং এবং ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক হিসাবে আমার সমন্বয়ে জামালপুর,ময়মনসিংহ নেত্রকোনা প্রভৃতির সম্ভাব্য হামলার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।

স্কোয়াড্রন লীডার হামিদুল্লার নেতৃত্বে রংপুর জেলার গাইবান্ধা দখল করার পরিকল্পনা করা হয়। সাবসেক্টর মহেন্দ্রগঞ্জ এবং পুরাখাশিয়ায় ভারতীয় মাউন্টেন ব্রিগেডের সহায়তায় জামালপুর দখল করার পরিকল্পনা করা হয়। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী দেওয়ানগঞ্জ থানার হাতিবান্ধায় নিয়োজিত প্রায় ১০০০ মুক্তিযোদ্ধা লেঃ শামসুল আলমের নেতৃত্বে দেওয়ানগঞ্জ ও ইসলামপুর হয়ে জামালপুরের পশ্চিমে ব্রক্ষ্মপুত্র নদ থেকে জামালপুর জগন্নাথগঞ্জ রেল ট্র‍্যকে পর্যন্ত অবরোধ করার দায়িত্ব দেয়া হয়। পুরাখাশিয়া সাবসেক্টরের প্রায় ১০০০ মুক্তিযোদ্ধা লেঃ আসাদুজ্জামানের নেতৃত্বে ভায়াডাঙ্গা,নালিতাবাড়ি, নখলা, নুরুন্দা হয়ে জামালপুরের দক্ষিণে জামালপুর – জগন্নাথগঞ্জ রেলসড়ক থেকে জামালপুর টাঙ্গাইল সড়ক পর্যন্ত অবরোধ করার দায়িত্ব দেয়া হয়। মহেন্দ্রগঞ্জ সাবসেক্টরের অন্য হাজারের একটি দলকে লেঃ মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে ভারতীয় ৯৫ তম ব্রিগেডের অগ্রভাগে কামালপুর,বক্সিগঞ্জ ও ঝগড়ারচর হয়ে ব্রক্ষ্মপুত্র নদের উত্তর থেকে জামালপুর শহর অবরোধ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমার নেতৃত্বে সেক্টরের মূল বাহিনীকে কামালপুর,বক্সিগঞ্জ, শ্রীবর্দি, শেরপুর প্রভৃতি এলাকার শত্রু অবরোধ প্রতিহত করে নান্দিনা হয়ে জামালপুরের পূর্ব দিকে অবরোধ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়।এখানে উল্লেখযোগ্য যে জামালপুর থেকে ১২ মাইল পূর্বে লাহিড়ীকান্ধা এবং কানিল নামক স্থানে ঢাকা,ময়মনসিংহ থেকে রেলপথে এবং সড়কপথে শত্রু রিইনফোর্সমেন্ট প্রতিহত করার জন্য সার্জেন্ট ভূইয়ার নেতৃত্বে রেল ও সড়ক পথে জামালপুরের সাথে ঢাকা ও ময়মনসিংহের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য প্রায় ৫০০ মুক্তিযোদ্ধা পাঠান হয়। এবং বাকী ১৫০০ মুক্তিযোদ্ধা জামালপুরের দক্ষিণ- পুর্বে ব্রক্ষ্মপুত্র নদ থেকে টাঙ্গাইল সড়ক পর্যন্ত আমার নেতৃত্বে জামালপুর অবরোধ করেন।

জামালপুরের অবরোধ সমাপ্ত হয় ৬ই ডিসেম্বর। ৬ই ডিসেম্বর থেকে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান বাহিনীর ৩১ বেলুচ রেজিমেন্ট বহুবার মুক্তিবাহিনীর অবরোধ ভেঙ্গে পালাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় এবং বহু ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে। ১১ই ডিসেম্বর সকাল ৮ টার সময় পাকিস্তান বাহিনী মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।

এই যুদ্ধে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল ১০ ই ডিসেম্বর বিকাল ৪ টার সময় পাকিস্তানী বাহিনীর ৩১ তম বেলুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ককে আত্মসমর্পণ করার আহবান জানিয়ে একটি পত্র মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক মুন্সীকে দিয়ে একটি সাদা পতাকা হাত নিয়ে পাকিস্তানীদের সদর দপ্তরে পাঠান হয়। উত্তর পাকিস্তানী অধিনায়ক ৭.৬২ চাইনিজ সাবমেশিনগানের একটি বুলেট একটি কাগজ মুড়ে পাঠিয়ে দেয়। তার অর্থ এই যে যুদ্ধই চূড়ান্ত ফয়সালা করবে। সেদিন সন্ধ্যা থেকেই মুক্তিবাহিনী চারদিক থেকে জামালপুর শহরে প্রবেশ করে এবং অন্যদিকে ভারতীয় বিমান বাহিনী থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর উপর বোমাবর্ষণ করে পাকিস্তানী বাহিনীর অবস্থা শোচনীয় করে তোলে। তা সত্ত্বেও পাকিস্তান বাহিনী বীর বিক্রমে ১০ ই এবং ১১ই ডিসেম্বর সারা রাত ব্যাপী যুদ্ধ চালায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১১ই ডিসেম্বর সকাল ৫টায় মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।জামালপুর যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনীর ২১২ জন মৃত্যুবরণ করে,প্রায় ২০০ জন আহত হয় এবং ৫২২ জন আত্মসমর্পণ করে। তাদের অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদের পরিমান এত ছিল যে,বাইরের কোন সাহায্য ব্যতিরেকেই জামালপুর সীমান্ত এলাকাতে তারা আরও তিন মাস যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারতো।

অন্যদিকে ডালু সাব-সেক্টরেও প্রায় ১০০০ মুক্তিযোদ্ধা লেঃ আবু তাহেরের নেতৃত্বে ডালু, হালুয়াঘাট, ময়মনসিংহ রোডে অগ্রসর হয়ে বাঘমারা সেক্টরের আরো প্রায় ২০০০ মুক্তিযোদ্ধা লেঃ কামালের নেতৃত্বে হালুয়াঘাটের পশ্চিমে লেঃ তাহেরের সাথে মিলিত হয়ে ভারতীয় ‘এবজা’ সেক্টরের সহায়তায় উত্তর ও উত্তর – পূর্ব দিক থেকে ময়মনসিংহ অবরোধ এবং আক্রমণ করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল।অন্যদিকে জামালপুর পতনের পর ঐ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের ময়মনসিংহের পশ্চিম এবং দক্ষিণ দিক থেকে ময়মনসিংহে অবরোধ করে একই সময়ে ময়মনসিংহ আক্রমণ করার পরিকল্পনা ছিল।সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ডালু এবং বাঘমারা সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা লেঃ তাহের এবং কামালের নেতৃত্বে ময়মনসিংহ শহরের দিকে অগ্রসর হয়।অন্যদিকে শিবপুর এবং মহেশখোলা সাব-সেক্টরের প্রায় ৫০০ মুক্তিযোদ্ধাদের মেজর মতিউর রহমানের নেতৃত্বে নেত্রকোনা দখল করার পর কিশোরগঞ্জ হয়ে ঢাকার জয়দেবপুরে ১১ নং সেক্টরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার পরিকল্পনা ছিল।আর ময়মনসিংহ ও জামালপুরের পতনের পর এই বিরাট মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দীকির সঙ্গে সম্মিলিতভাবে টাঙ্গাইল দখল করেবিপুল বিক্রমে ঢাকার দিকে অগ্রসর হয়ে টঙ্গি পর্যন্ত অবরোধ করার পরিকল্পনা করা হয়।কিন্তু ১১ নং সেক্টরের হাতে জামালপুর পতনের পর ময়মনসিংহ এবং টাঙ্গাইল থেকে পাকিস্তানি বাহিনী পলায়ন করে।মুক্তিবাহিনী তাদের পশ্চাদবন করে এবং ভারতীয় প্যারাসুট বাহিনী টাঙ্গাইল এর নিকটবর্তী পিগনা নামক স্থানে এক ব্যাটালিয়ান ছত্রীসেনা নামায়।একদিকে ছত্রীসেনা ও অন্যদিকে ধাবমান মুক্তিবাহিনীর সম্মিলিত চাপে অসংখ্য গাড়ি সহ প্রায় ৩০০ পাক সৈন্য নিহত হয়।ময়মনসিংহ এবং টাঙ্গাইল থেকে পলায়নরত পাকিস্তানী বাহিনীর অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার কাদেরসহ সমস্ত ব্রিগেড স্টাফ ঢাকার কালিয়াকৈর এর নিকট ধরা পড়ে। এরপর ঢাকা পৌঁছা পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী আর উল্লেখযোগ্য কোন বাধার সম্মুখীন হয়নি।

১৬ই ডিসেম্বর বিকাল ৪টার সময় ১১নং সেক্টর বাহিনী বীরবিক্রমে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে প্রবেশ করে।

স্বাক্ষরঃ আব্দুল আজিজ

৭-৬-৭৩

* ১৯৭১ সালে ক্যাপ্টেন হিসাবে কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীকালে লেঃ কর্নেল পদে উন্নীত হন।

 

 

 

শাহরিয়ার ফারুক

<১০, ২০., ৪৬৩৪৬৫>

সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার মেজর জিয়াউল হক

২৭৭৪

 

আমরা ই-পি-আর’ এর তিন কোম্পানি এবং আনসার-মুজাহিদের আনুমানিক ৬/৭ কোম্পানি নিয়ে ফুলপুর-হালুয়াঘাট হয়ে ভারতের ডালুতে আশ্রয় নিই।এবং বাংলাদেশের কমালাকান্দা থানার বিপরীতে ভারতের রংরায় সুবেদার আজিজ এক কোম্পানি,ডালুতে আমরা এক কোম্পানী এবং পুরাখাশিয়া -মহেন্দ্রগঞ্জ এ সুবেদার হাকিমের এক কোম্পানি -যেখানে আনসার,মুজাহিদ এবং পুলিশ ছিল।ডালু,বারেংগাপাড়ায় মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের জন্য ভারতের পক্ষ থেকে ক্যাম্প স্থাপন করা হয়।জেলা সদর দপ্তর তুরা এখান থেকে নিকটবর্তী ছিল।পুরো এপ্রিল মাস মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্গঠন এবং প্রশিক্ষন দেয়া হয়।ইতিমধ্য সীমান্ত এলাকার লোকজন পাক সামরিক বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে।

মে মাস থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ‘আঘাত কর এবং পালাও’এ কৌশলে গেরিলা অপারেশন শুরু করা হয়।উল্লেখযোগ্য যে হাতেম আলী তালুকদার এম-সি-এ এবং আবুল মনসুর আহমদ এম-সি এ ভারতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত গেরিলা অপারেশনে আমাদের সাহায্য – সহযোগীতা করেছেন।

 

গেরিলা অপারেশন

 

২রা মে তারিখে সিপাহী এ,কে এম ফজলুল হক ৩৪ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে হালুয়াঘাটের ফুলপুর থানার রামভদ্রপুরে গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে রাজাকার বাহিনীর দু’জন কে হত্যা করে এবং ৬টি রাইফেল ছিনিয়ে নেয়।২৫-৬-৭১ তারিখে নায়েক ফরহাদ ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে নরুন্দী রেলওয়ে ষ্টেশনে এক্সপ্লোসিভের সাহায্য অপারেশন করে এবং ৮-৭-৭১ তারিখে রেললাইনের নীচে এন্টি-ট্যাংক মাইন বসিয়ে পাক-বাহিনীর খাদ্যদ্রব্য -অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই তিনটি বগি ইঞ্জিনসহ ধ্বংস করে দেয়।২৫-৬-৭১ তারিখে হাবিলদার হাফিজকে ৯ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ পাঠানো হয়।৬/৭ জুলাই তারিখে তারা মুক্তাগাছা আক্রমণ করে এবং ১৫ টা রাইফেল,একটি এস-এম-জি,২৮ টি এল-এম-জি ম্যাজিন এবং থানার টেলিফোন সেট সমেত সমস্ত গোলাবারুদ উদ্ধার করে নিয়ে আসে।৪জন বাঙ্গালী পুলিশ কনস্টেবলকে হত্যা করা হয়।থানার ওসি পালিয়ে যায়।

মুক্তিযোদ্ধা নূরুল ইসলাম।আরো ৯ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে করইতলি বি-ও-পি তে ( মহেশলাঠি গ্রাম) রাজাকারদের ক্যাম্পে হামলা চালায়।ক্যাম্পের সেন্ট্রিকে তারা ধরে নিয়ে আসে।৯ ই জুন তারিখে আমি আমার সাহসী ল্যান্স নায়েক মেজবাহউদ্দীন,আমার কুক আব্দুস সোবাহান মোল্লাসহ নালিতাবাড়ি থানার অধীনে বারমারি বি-ও-পি এবং খৃস্টানদের মিশনের মধ্যবর্তী জায়গায় মাইন পুঁতে রাখি।ঐ পথ দিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর একজন মেজর সব সময় যাতায়াত করত।৯ ই জুন ঐ সকালে মেজর,মিশনের সিস্টার,একজন সুবেদার,দুই সিপাহী ঐ পথে যাবার সময় মাইন বিস্ফোরণে নিহত হয়।

ই-পি-আর’ এর ল্যান্স নায়েক আব্দুল্ল মান্নান এবং মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক আফসারউদ্দিন আহম্মদ ভালুকা থানার ভাউলিয়া বাজার এলাকাতে পাক বাহিনীর সাথে এক সংঘর্ষে লিপ্ত হন।সাত থেকে সাড়ে সাতশ মুক্তিযোদ্ধা এই আক্রমণে অংশগ্রহণ করে।পাক-বাহিনীর প্রায় এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করে।এই আক্রমণে ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।পাক বাহিনীর পক্ষে বেশ হতাহত হয়।পাক বাহিনী চারদিক থেকে যাওয়ায় ডাক থেকে হেলিকপ্টার গিয়ে তাদেরকে ৫ জুলাই উদ্দার করে।পাকিস্তানীদের পক্ষে প্রায় ৬০ জন নিহত হয়েছিল।মুক্তিযোদ্ধারা ৭১ টি রাইফেল,১২ টি চীনা রাইফেল,৩ টি এল-এম-জি,২ টি ২” মর্টার উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।

১৩ জুলাই ল্যান্স নায়েক মন্নান ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা এবং ২০০ জন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ফুলবাড়িয়া থানার লক্ষীপুর গ্রামে একটি পাক আর্মি পেট্রলকে এমবুশ করেএবং ৪৩ টি রাইফেল,৩ টি এল-এম-জি ১ টি চীনা এল-এম-জি,২ টি চীনা রাইফেল,২ টি এস-এম-জি ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়।

৯ ই জুলাই মুক্তিযোদ্ধা আবু হানিফকে ফকির বেশে ফুলপুর থানায় পাঠানো হয়। ভিক্ষা চাওয়ার ভাণ করে থানা সেন্ট্রির নিকট থেকে রাইফেল ছিনিয়ে নেয় এবং তাকে হত্যা করে থানা থেকে একটি রাইফেল এবং ষ্টেনগান নিয়ে আসতে সক্ষম হয়।

হালুয়াঘাট এবং শম্ভুগঞ্জ এর মধ্যবর্তী নাগাল পুল অবস্থিত।মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হক চৌধুরীকে ৩৮ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ উক্ত পুল ধ্বংস করার ভার দেয়া হয়।সে ১৬ ই জুলাই রাত ১ টার সময় ঐ পুলে পাহারারত রাজাকারদের হত্যা করে তাদের নিকট থেকে ৫ টি ষ্টেনগান এবং পুলটি ধ্বংস করে দেয়।

নালিতাবাড়ি থানায় বেগুনবাড়ি ব্রীজ ধ্বংস করার জন্য মুক্তিযোদ্ধা নাজমুল হকের নেতৃত্বে তার কোম্পানীকে পাঠানো হয়।সে উক্ত পুল ধ্বংস করে।পার্শবর্তী গ্রামে সে আশ্রয় নেয়।ইতিমধ্যে পাক বাহিনী ওখানে এসে পড়ে এবং তাদেরকে আক্রমণ করে।এই আক্রমণে কোম্পানী কমান্ডার নাজমুল হক শাহাদাত বরণ করেন।উল্লেখযোগ্য যে,নাজমুল হক ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন।নালিতাবাড়িতে তার নামে একটি কলেজের নামকরণ করা হয়েছে।১৯ শে জুলাই পাক সেনাবাহিনীর তিনটি কোম্পানী ভোর পাঁচটার সময় হালুয়াঘাট ক্যাম্প থেকে রওনা হয়।এক কোম্পানী রামচন্দ্রকোরা বি-ও-পি হয়ে আমাদের হাইড-আউট ডালুর পূর্ব দিকে অবস্থান নেয়।আর এক কোম্পানী হাতি পাগার বি-ও-পি হয়ে আমাদের হাইড-আউটে আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়।আর এক কোম্পানী সোজা ফালু চেকপোস্ট অভিমুখে অগ্রসর হয়।আমার তিন দিক থেকে ঘেরাও হিয়ে যায়।তখন ক্যাপ্টেন ত্যাগীও আমাদের সাথে ছিলেন।আমরা খুব অসুবিধায় পড়ে যায় এবং তাদের সাথে মোকাবিলা করি।আমাদের পক্ষে দু’জন শহীদ হয়।এই আক্রমণে ভারতীয় বি-এস-এফ’ এর ১১ জন সিপাহী নিহত হন এবং তাদের একজন জমাদার নায়েক সুবেদারকে পাকবাহিনী ধরে নিয়ে যায়।

২৭ শে জুলাই ল্যান্স নায়েক মেজবাহউদ্দিন ও তার দলের সংগে নালিতাবাড়ি থানার অন্তর্গত তন্তর এবং মায়াঘাসিতে পাকিস্তানি সৈন্যর এক পেট্রোল পার্টির সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।এই সংঘর্ষে ১৬ জন পাকসেনা নিহত হয়।মেজবাহউদ্দিন ও মারাত্নকভাবে আহত হন।

৬ ই আগষ্ট বান্দরকাটা বি-ও-পি ২ কোম্পানী এফ-এফ ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র মাসুদ,ছাত্রনেতা হাশেম,এবং আমাদের নেতৃত্বে আক্রমণ চালানো হয়।বান্দরকাটা বি-ও-পি তে পাকিস্তানীদের যথেষ্ট হতাহত হয়।শত্রুপক্ষের ৩০ জন নিহত ও ৩৫ জন আহত হয়।আমাদের পক্ষে পাঁচজন শাহাদাৎ বরণ করেন।

স্বাক্ষরঃ মোহাম্মদ জিয়াউল হক/২৭-৬-৭৪

সুবেদার মেজর

শাহরিয়ার ফারুক

<১০, ২০., ৪৬৫৪৬৬>

সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার মোসলেহউদ্দীন আহমদ

২৬৭৩

আগষ্ট মাসের ৩০ তারিখে ঢাকা সেনানিবাসের কড়া পাহারার মধ্যে দিয়ে অন্ধকার রাত্রিতে পাহারাদারের কাছ থেকে রাইফেল হস্তগত করে পালাতে সক্ষম হই।অতঃপর সেনানিবাসের কিছু দূরে এক জঙ্গলে রাত্রি অতিবাহিত করি।পরেরদিন সকালে রাইফেলটি একটি গর্তে পুঁতে ছদ্মবেশে ময়মনসিংহের পথে রওনা হই।১০ দিন চলার পর নেত্রকোনা মহকুমার উত্তর অংশের সীমান্ত মহেশখোলা দিয়ে ভারত প্রবেশ করি।ঐ দিন ছিল মে মাসের ৯ তারিখ।সেখানে ডাক্তার আখলাক হোসেন এম-পি-এ র কাছে হাজির হই।তার কাছ থেকে পরিচয়পত্র নিয়ে তুরা চলে যাই।সেখানে আমাদের ১১ নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ছিল।তখন ঐ সেক্টরের নেতৃত্বে দিচ্ছিলেন কর্ণেল আবু তাহের।তিনি কামালপুরের যুদ্ধে আহত হওয়ার পর স্কোয়াড্রন লীডার হামিদুল্লাহ নেতৃত্বে দেন।সেই সময়ে সাবসেক্টরের (কিশোরগঞ্জ,নেত্রকোনা) নেতৃত্বে দিতেন ভারতীয় আর্মির একজন ক্যাপ্টেন।এর কিছুদিন পর বাংলাদেশ আর্মির ক্যাপ্টেন হামিদ ( বর্তমানে মেজর মতিয়ার রহমান) ঐ কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা অর্থাৎ ১১ নং সেক্টরের অধিনায়ক নিযুক্ত হন।ক্যাপ্টেন হামিদের নেতৃত্বে আর্মি মেডিক্যাল অফিসার মনোনীত হয়ে কয়েকশত মুক্তিযোদ্ধাসহ মহেশখোলা দিয়ে বাংলাদেশের ভিতরে প্রবেশ করি।সেখান থেকে নৌকাতে হাসপাতালের যাবতীয় ঔষধপত্র ও সরঞ্জাম নিয়ে বাংলাদেশের ভিতরে ধরমপাশা থানার দিকে রওনা হই।বাংলাদেশে প্রবেশ করার পথেই আমাদেরকে যোগাযোগ এবং নিরাপত্তার জন্য স্থানীয় আওয়ামীলীগ কর্মীবৃন্দের সহায়তায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প তৈরি করে আসি।

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যায় যে,আমাদের প্রথম এবং প্রধান কাজ ছিল ধরমপাশা থানা মুক্ত করা।কারণ সেখানে তিন মাইল চতুর্দিকে খান দস্যুরা অগ্নিসংযোগ,নারী নির্যাতন,হত্যা,লুন্ঠন ও ব্যভিচার করে উক্ত স্থানে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল।উক্ত থানা হেডকোয়ার্টারে প্রায় ২৫০ জন পাকসেনা,রাজাকার,আলবদর মুজাহিদ নিয়ে গঠিত এক ঘাঁটি ছিল।সেই দূর্ভেদ্য ঘাঁটিকে প্রথমে আমরা টার্গেট করলাম। কিন্তু কয়েকবারই আমরা ব্যর্থ হই।এর পরপরই মরণপণ করে তিনটি প্লাটুনে বিভক্ত হয়ে তিনদিক থেকে আক্রমণ করি।প্রথম প্লাটুনের নেতৃত্বে দেন মেজর মতিয়ার রহমান,২ নং প্লাটুনের নেতৃত্বে দিই আমি নিজে এবং ৩ নং প্লাটুনের নেতৃত্বে দেন নায়েক আব্দুর রহমান (বাংলাদেশ রাইফেল)। আমার ২ নং প্লাটুন সামনের দিকে ছিল।তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যায়।অয়ারলেস সেটের সাহায্য আমরা অভ্যন্তরীণ যোগা্যোগ রক্ষা করে চলি।এই যুদ্ধে আমাকে নেতৃত্ব দেওয়া ছাড়াও মেডিক্যাল অফিসারের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে।পাক বাহিনীর পাল্টা আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধা মোয়াজ্জেম হোসেন শহীদ হন।প্রচন্ড আক্রমণের ভিতর দিয়ে শহীদ বীরের মৃতদেহ আমি নিজে বহন করে নিয়ে আসি।বাকী মুক্তিযোদ্ধাদেরকে উৎসাহের সহিত সামনের দিকে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিই এবং আমি নিজে তাদের সংগে যুদ্ধ করি।যার ফলে তারা সাহস হারায়নি।মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তাদের মনোবল অটুট থাকে।তিনদিকের প্রচন্ড আক্রমণে খানসেনারা দিশেহারা হয়ে ১৫ জনের মত খতম হয়।বাকিরা সন্ধার অন্ধকারে পালিয়ে মোহনগঞ্জ থানার দিকে চলে যায়।উক্ত স্থান মুক্ত করে একটি প্লাটুনকে এখানে ডিফেন্সের জন্য রেখে বাকি দুই প্লাটুন ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা সহ পরেরদিন মোহনগঞ্জ আক্রমণ করি।উক্ত ধরমপাশা থানা মুক্ত হবার পর আমার সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর মতিয়র রহমান আমার বীরত্বের পরিচয়সূচক বীর প্রতীক উপাধিতে আমাকে ভূষিত করেন।যা বাংলাদেশ সরকার শেষে মঞ্জুর করেছেন।

মোহনগঞ্জ আক্রমণ করে প্রায় ২৫ জন খানসেনাকে হত্যা করি এবং উক্ত থানা মুক্ত করি।এরপর আমাদের কাজ পরিবর্তনের নির্দেশ পাই।ভৈরব বাজার থেকে কেন্দুয়া পর্যন্ত যে রেল যোগাযোগ আছে তা বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ পাই।এরপর ক্রমান্বয়ে কেন্দুয়া,আঠারোবাড়ি,নীলগঞ্জ,করিমগঞ্জ,মদন প্রভৃতি স্থানে যুদ্ধ করি ও অসংখ্য খানপশুদের হত্যা করে উল্লেখিত স্থানগুলো মুক্ত করি।তখন ব্যাটালিয়ন আ্যডজুট্যান্ট,এ্যাডমিনিসট্রেটিভ অফিসার ও অন্যান্য গুরুদায়িত্ব পালন করি।দেশ মুক্ত হবার পর সেক্টরের যাবতীয় কাগজপত্র সেক্টর হেডকোয়ার্টার ময়মনসিংহে জমা দিয়ে আমার পুরানো চাকরিতে যোগদান করি।

স্বাক্ষরঃ মোসলেহউদ্দিন আহমদ

শাহরিয়ার ফারুক

<১০, ২০., ৪৬৬৪৬৭>

সাক্ষাৎকারঃ মিজানুর রহমান খান

১১১২১৯৭৫

মহেন্দ্রগঞ্জ ছিল ১১ নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টার।২১শে জুলাই আমি মহেন্দ্রগঞ্জ সেক্টরে যোগ দিই।আগষ্ট মাসের শেষ দিকে মেজর তাহের মহেন্দ্রগঞ্জ ১১ নং সেক্টরে যোগ দেন।মেজর তাহের আসার পর তিনি আমাদের ৪৮ জন নিয়ে একটি স্পেশাল পার্টি তৈরী করেন।আমরা তুরাতে ট্রেনিং নেওয়া সত্ত্বেও মেজর তাহের আমাদের বিশেষভাবে ট্রেনিং দেন।আমাদের কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন হেলাল(সৈয়দ সদরুজ্জামান)।আমাদের পার্টি হেলাল পার্টি হিসেবে পরিচিত ছিল।আমরা ৪৮ জন কলেজ – বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম।মেজর তাহের আমাদেরকে সবসময় সম্মুখযুদ্ধের জন্য রিজার্ভ রাখতেন।প্রতিটি প্রথাগত যুদ্ধে বা সম্মুখযুদ্ধে আমরা অংশ নিয়েছি।ক্যাপ্টেন মান্নান ছিলেন সেকেন্ড ইন কমান্ড।লেঃ মিজান,লেঃ আলম সেপ্টেম্বর এর শেষের দিকে সেক্টরে যোগ দেন।১৫/১৬ আগষ্ট আমাদের ১৩৫ জনকে পাঠানো হয় কামালপুর আক্রমণের জন্য।কোম্পানী কমান্ডার ছিলেন সেনাবাহিনীর সুবেদার মনসুর।অন্যদিকে লেঃ মাহফুজ তার কোম্পানী নিয়ে ছিলেন। লেঃ মাহফুজ মহেন্দ্রগঞ্জ সাব-সেক্টর এর অধীনে যুদ্ধ করেছেন।পরবর্তীতে লেঃ মাহফুজ ডালু সাবসেক্টরে নভেম্বর মাসে এক অপারেশনে নিহত হন।

ভোর রাতে আমরা কামালপুর আক্রমণ করি।দিনের আলোতে আমরা পরস্পর কে দেখতে পাচ্ছিলাম।সংঘর্ষ আধঘণ্টা স্থায়ী হয়।এই সংঘর্ষে ৭ জন নিহত হয়।পাকিস্তানিদের ৮/৯ জন নিহত হয় বলে জানা যায়।

মুক্তিবাহিনীর নিহতদের মধ্যে আমানুল্লাহ কবিরের নাম বিশেষভাবে বলা যায়।আব্দুল মালেকসহ আরও কয়েকজন আহত হন।

নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি মেজর তাহেরের নেতৃত্বে ৮টি কোম্পানীকে নিয়ে ভারতীয় সৈন্য সহ কামালপুর আক্রমণ করা হয়।রাত ১২ টার দিকে ডিফেন্স পজিশনে চলে যাই।ভোর ৪ টা ৩০ মিনিটে আমরা কামালপুর আক্রমণ করি।আমরা ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা মেজর তাহেরের সঙ্গে ছিলাম।আমাদের উপর নির্দেশ ছিল কামালপুর দখলের পরপরই অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নিয়ে আসতে হবে।ভোর ছ’ টার দিকে মেজর তাহের সহ আমরা নয়াপাড়ার শেষপ্রান্তে গিয়ে পৌঁছায়।আমাদের অস্ত্র ছিল ২ টি ষ্টেন,৮ টি এস-এল-আর এবং আমার সঙ্গে একটি অয়ারলেস সেট ছিল।মেজর তাহেরের সঙ্গে একটি অয়ারলেস সেট ছিল এবং তার সঙ্গে সর্বমুহুর্তের জন্য একটি ছড়ি থাকতো।

রাস্তার পাশে আমরা পজিশন নিলাম।উভয়পক্ষে ব্যাপক সংঘর্ষ চলছে।সকাল প্রায় ৮ টার দিকে একটি শেল মেজর তাহেরের বাঁ পায়ে এসে পড়ে।মেজর তাহের চিৎকার করে ওঠেন।আমি তার ছড়ি এবং অয়্যারলেস সেটটি নিয়ে নিই।আমি এবং সফি মেজর তাহেরকে ধরে পেছনে নিয়ে আসি।লেঃ মিজান তাড়াতাড়ি এসে ধরলেন।আমরা কাদঁছিলাম।মেজর তাহের চুপ করতে বলে সবাইকে অগ্রসর হতে বললেন।সেদিন কামালপুর দখলের পূর্ব মুহূর্তে এই দূর্ঘটনার পর কামালপুর আর দখল করা সম্ভব হয়নি।ভারতীয় বাহিনী মেজর তাহেরকে নিয়ে যায়।

৩০ শে নভেম্বর আমরা প্রায় ৫০০ জন মুক্তিযোদ্ধা কামালপুর ঘিরে রাখি।কামালপুর পুরোপুরি অবরুদ্ধ করে রাখি।

৩০ শে নভেম্বর ভারতীয় বাহিনীর একটি সম্পূর্ন শেষ হয়ে যায়।৪ ঠা ডিসেম্বর পাকসেনারা কামালপুরে আত্মসমর্পণ করে।বিকাল ৪ টায় ভারতীয় অফিসার আমাকে ডেকে জানতে চাইলেন কে চিঠি এবং পতাকা নিয়ে কামালপুর যেতে পারবে।মুক্তিযোদ্ধা বশীরকে নির্বাচন করি।আমার জাম্পারটি সবুজ রংয়ের ফুলহাতা ছিল।বশীরকে তা দিয়ে দিই ভারতীয় অফিসারের কথা মত।বশীর জাম্পারটি পরে আমার স্টেনটি নিয়ে রওনা হয়ে যায়।অপরদিক থেকে সঞ্জু নামক মুক্তিযোদ্ধাকে পাঠানো হয়েছিল।সন্ধ্যা ৬ টায় বশীর এবং সঞ্জু ফিরে আসে।পাকসেনারা ছিল ১৬১ জন এবং দু’ জন অবাঙ্গালী অপারেটর ছিল।দুজনের মধ্যে ১ জন মেয়েও ছিল।পাক সেনারা ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।কামালপুর মুক্ত হয়।পরে ১১ ই ডিসেম্বর জামালপুর মুক্ত হয়।মেজর তাহেরকে উদ্ধার করার জন্য সরকার আমাকে বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত করেন।

মিজানুর রহমান খান

১১-১২-১৯৭৫

শাহরিয়ার ফারুক

<১০, ২০., ৪৬৭৪৭২>

সাক্ষাৎকারঃ লেঃ কর্নেল এম,,মান্নান*

১১১২৭৯ *

আমি (৩০-৩১ জুলাই জেড ফোর্সের কামালপুর সংঘর্ষে) আহত হওয়ার পর আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় পুনা।সেখানে একদিন চিকৎসা নেওয়ার পর হেলিকপ্টারে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় ১৫১ বেইস হাসপাতাল গৌহাটিতে।সেই হাসপাতালে আমি এক মাসাধিকাল চিকিৎসাধীন ছিলাম।আগষ্ট মাসের শেষের দিকে জেঃ জিয়া আমাকে দেখতে সেখানে যান।ক্রমে আমি কিছুটা আরোগ্য লাভ করি।আমি খবর পাই যে,আমার পেরেন্টস কলকাতার দিকে গেছেন।তখন আমি জেঃ জিয়ার কাছে কয়েকদিনের ছুটি প্রার্থনা করি।তিনি আমার ছুটি মঞ্জুর করেন।আমি কলকাতা চলে যায়।সেখানে ৪/৫ দিন থাকার পর জেনারেল ইসলামের কাছে খবর পাই যে,সমস্ত সেক্টর কমান্ডার ৮ থিয়েটার রোডে কনফারেন্স ডাকা হয়েছে এবং জেনারেল জিয়াও কনফারেন্সে আসবেন।ঐ কনফারেন্সে বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরসমূহের রুপরেখা ও নানাবিধ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়।এরপর আমি আমার ১ নং বেঙ্গল রেজিমেন্টের ইউনিটে ফিরে আসি।তারপর শুনতে পাই যে ১১ নং সেক্টর নামে একটি নতুন সেক্টর গঠিত হয়েছে যার হেডকোয়ার্টার মহেন্দ্রগঞ্জে।কর্নেল তাহের সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব নেন।আমি যেহেতু অসুস্থ ছিলাম তাই আমাকে দুই নং সাবসেক্টরে দেওয়া হয়।সেক্টর এক্সিকিউটিভ হিসাবে আমি দায়িত্বভার গ্রহণ করি।

এই সেক্টরে আমার যোগদান করা থেকে শুরু করে দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত ছোট বড় উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোই আমি বলবো।

কামালপুরে পাকিস্তানী আর্মির যে ঘাঁটি ছিল তা অত্যন্ত সুদূঢ় ছিল।ঐ ঘাঁটির সমস্ত বাংকারগুলো ছিল সিমেন্টের আর-সি-সি বাংকার।কমিউনিকেশন ট্রেঞ্চ দিয়ে সেগুলো কানেক্টেড ছিল।কামালপুর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি ছিল।তাই তারা এটাকে খুব শক্ত করেছিল,কারণ কামালপুরে যোগাযোগ বিস্তৃত ছিল বক্সিগঞ্জ,শেরপুর,জামালপুর,মধুপুর,হয়ে ঢাকা পর্যন্ত।তাই এই সেক্টর পাকিস্তানীদের কাছে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল তেমনি আমাদের দিক থেকেও ছিল গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য।পাকিস্তানীরা জানতো এই সেক্টরে তাদের পতন হলে ঢাকা পৌঁছা তাদের পক্ষে মুশকিল হয়ে পড়বে।আমি আমার সহকর্মীদের বলেছিলাম,কামালপুরের পতন হলে সাতদিনের ভিতর ঢাকারও পতন ঘটবে।মূলতঃ কামালপুরের পতন হলো ৪ তারিখ বিকেলে এবং এর কয়েকদিনের মধ্যে ঢাকারও পতন হলো।এই বাহিনীর ঢাকা পৌঁছাতে সময় লাগলো ৭/৮ দিনের মতো।উল্লেখ্য,কামালপুরে যে ট্রুপস ঢুকেছিল তারাই প্রথম ঢাকা পৌঁছেছিল।কামালপুরে যুদ্ধে পাকিস্তানীদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।অবশ্য তারা যুদ্ধের ব্যাপারে প্রচুর মিথ্যা প্রচারণা চালিয়েছিল।তাদের প্রচারণার এক-দশমাংশ সম্ভবত সত্য।

আমি এই সেক্টরে যোগদানের পর আরও অনেক ঘটনা বা যুদ্ধ হয়,যেমন ধানুয়া-কামালপুরের যুদ্ধ।ধানুয়াকামালপুর কামালপুরের পরেই একটি গ্রাম।এই গ্রামটির কন্টিনিউয়েশন ভারত সীমান্তের ওপারের গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত।সীমিত হাতিয়ার নিয়ে যেহেতু আমরা পাকিস্তানীদের সুগঠিত ক্যাম্প থেকে উৎখাত করতে পারছিলাম না তাই বিকল্পপন্থায় ধানুয়াকামালপুর থেকে থেকে এমবুশ করার চেষ্টা করছিলাম একটা ডিফেন্স নিয়ে।এই ধানুয়াকামালপুর একটা কন্টিনিউয়েশান ছিল ফিরোজপুর হয়ে বক্সিগঞ্জের দিকে।এই পথে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আমি ৪ থেকে ৬ সপ্তাহের মধ্যে ৬/৭ খানা পাকিস্তানী আর্মির গাড়ি মাইনের সাহায্য ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছিলাম।বক্সিগঞ্জ থেকে কামালপুরের দূরত্ব ৭ মাইল।পরবর্তী পর্যায়ে তারা কোনো গাড়ি নিয়ে কখনো মাইনের ভয়ে এই দূরুত্ব অতিক্রম করতে পারেনি।অতিক্রম করতে চাইলেও গরু কিংবা মহিষের গাড়ী দিয়ে আগে পথ পরিক্ষা করে নিত।তারপরও পরীক্ষিত পথে তারা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিল।আমার মনে আছে,একদিন আমরা ছোট একটি দল নিয়ে কামালপুর এবং বক্সিগঞ্জের মাঝখানে এমবুশ লাগিয়ে পাকিস্তানীদের অপেক্ষায় বসে ছিলাম।কামালপুরের পাকিস্তানীদের জন্য খাবার-দাবার সরবরাহ হতো বক্সিগঞ্জ থেকে।এ পথে সন্দেহজনক এক লোক যাওয়ার সময় আমরা তাকে ধরি এবং এক অফিসারের জন্য প্রেরিত খাবার-দাবার এবং পাকিস্তানীদের কিছু চিঠিপত্র হস্তগত করি।উর্দু- ইংরেজিতে লেখা ঐসব চিঠির পাঠ উদ্ধার করে আমরা জানতে পারি দিন আর বেশী নয়।তারা হ্যান্ডস আপ করবে।

আরও একটি ঘটনা -তারিখ ঠিক মনে পড়ছে না।সেদিন আমরা ৬০/৭০ জনকে নিয়ে আখক্ষেতের ভিতর ডিফেন্স নিয়েছি।পাকিস্তানীরা বেরিয়ে আসে।তাদের সাথে প্রচন্ড গোলাগুলি হয়।এতে পাকিস্তানীদের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়।আমার দুই জনের একটি ছোট্ট দল ছিল।তাদের নাম মনে পড়ছে না।১১ নং সেক্টরের ১১৩ জনের যে লিস্ট আছে তাদের কেউ হবেন।তারা ট্রেন্সের পিছনে বসা ছিল।সেখান থেকে তারা পাকিস্তানীদেরকে আক্রমণে ব্যস্ত ও মরিয়া হয়ে উঠেছিল।এক পর্যায়ে বুলেট শেষ হয়ে গেলে এরা পাকিস্তানীদের হাতে মারা যায়।দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপানীদের মতো লাস্ট বুলেট এরা লড়াই করেছিল।এদেরকে বাংলাদেশে নিয়ে এসে সামরিক মর্যাদায় দাফন করি।এদের স্মৃতিফলক বর্তমান।

ধানুয়াকামালপুরে আমরা যে ডিফেন্স নিয়েছিলাম তার একটি ঐতিহাসিক ঘটনা সেপ্টেম্বর মাসের কোন সময়ে ঘটেছিল।সেটা পরিচালনা করেছিলেন প্রথম বেঙ্গলের একটি কোম্পানি।অধিনায়ক ছিলেন মেজর জিয়াউদ্দিন।তার সাথে অফিসার ছিল বর্তমান কর্ণেল পাটোয়ারী।তারা ধানুয়াকামালপুর ডিফেন্স নিলেন।পাকিস্তানীরা এসে আক্রমণ করে,ফলে প্রচন্ড সংঘর্ষ বাধে।পাকিস্তানীদের প্রায় ৩০/৪০ জন মারা যায়,আমাদের পক্ষে মাত্র একজন আহত হয়।পাকিস্তানীদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।সেই অপারেশনে আমরা পাঞ্জাবীদের একটা মৃতদেহ নিয়ে আসতে সক্ষম হই।মৃত দেহের কপালে গুলি লাগে।এই মৃত দেহ আমাদের সকল সৈন্যদের দেখনো হয়।ফলে তাদের মনোবল বেড়ে যায়।অবশ্য পরে মুসলমান হিসাবে কবর দেওয়া হয়।পরে আমরা যখন ফিরে যাই তখন শুনতাম পাকিস্তানীরা কার নাম ধরে ডাকছে।সম্ভবতঃ মৃত লোকটিরই।

এছাড়াও কামালপুরে এমন কোন দিন ছিল না যে পাকিস্তানীরা শান্তিতে বসবাস করতে পারতো।কামালপুর-বক্সিগঞ্জে পাকিস্তানীদের যে টেলিফোন যোগাযোগ ছিল তা আমরা কেটে দিতাম।এক পর্যায়ে ১০/১২ জনের একটা ছোট দলকে এ ধরনের অপারেশনে পাঠাই।তারা প্রথমে টেলিফোনের তার কেটে দিয়ে ওঁৎ পেতে অপেক্ষা করতে থাকে।পরে যখন পাকিস্তানীদের তার ঠিক করার পার্টি আসে তখন তাদের উপর আক্রমণ করে বসে।গোলাগুলি করে।পাকিস্তানীদের ক্ষতিসাধন করে ফিরে আসে।আমাদের কোন ক্ষতিই হয়নি।

আরও একটি ঘটনা।অক্টোবর মাসের কোন এক সময় ইন্ডিয়ান আর্মির একটি ব্যাটালিয়ন দিয়ে পাকিস্তানীদের উপর আক্রমণ চালানো হল।সেই আক্রমণে ইন্ডিয়ার একটি কোম্পানি কামালপুরের একটু পিছনে এমবুশ করে।যখন তাদের উপর আক্রমণ চলছিল তখন মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি কোম্পানীও তাদের সাথে ছিল।কামালপুরের ফোর্সকে সহায়তা করার জন্য বক্সিগঞ্জ থেকে মর্টার নিয়ে তিনটি পাকিস্তানী গাড়ী আসছিল।তখন রাস্তায় এমবুশ করে গাড়ী সমেত পাকিস্তানীদের খতম করা হয়।

তারপর সম্ভবতঃ   নভেম্বর মাস হবে।ইন্ডিয়ান আর্মির মাউন্টেন বিগ্রেডের একটি ব্যাটালিয়ন নিয়ে কামালপুর আক্রমণ করানো হয় এবং একটি ব্যাটালিয়ন দিয়ে কামালপুর-বক্সিগঞ্জের মধ্যে এমবুশ লাগানো হয়।আমাদের দুটি কোম্পানী।একটির কমান্ডার আমি নিজে,সেটা নিয়ে আমি একটা ব্লকিং পজিশন তৈরী করি।সেটা কামালপুর মেইন পজিশন থেকে প্রায় ১৫০ গজ দুরে।আমার বিপরীতে ছিলেন বর্তমান মেজর মিজান।তার কোম্পানী সমেত তাঁকে নিয়ে একটি ব্লকিং পজিশন তৈরী করা হয়।আমাদের উপর নির্দেশ ছিল আমরা আখ ক্ষেতের ভিতর ট্রেঞ্চ খুঁড়ে পজিশন নিয়ে বসে থাকবো,যেন পাকিস্তানীরা এই দিক দিয়ে পালিয়ে যেতে না পারে।যখন আমরা এই পজিশনে পৌঁছালাম তখন রাত প্রায় সাড়ে তিনটা।আমাদের সাপোর্টে ছিল ইন্ডিয়ান একটি আর্টিলারী রেজিমেন্ট এবং একটি মর্টার বাহিনী।তারা কামালপুরের উপর শেলিং করছিল।সকালের দিকে যোগাযোগের জন্য আমাদের কাছে ছোটছোট অয়্যারলেস সেট দেয়া হয়।কর্ণেল তাহের থাকলেন ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ারের সঙ্গে যিনি মাউন্টেন ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন।ওখানে তিনি তাদের সাথে এই অপারেশনটা কো-অর্ডিনেশন করছিলেন।আমি যখন আমার পজিশনে পৌঁছে গেলাম তখন ছিল সকাল সাড়ে চারটা।তখন ইন্ডিয়ান আর্টিলারী ফায়ার করছিল।বেশ কতগুলো আর্টিলারী শেল আমাদের পজিশনের উপর এসে পড়লো।আমার এই কোম্পানীতে মোট ১০৯ জন ছেলে ছিল।তার মধ্যে ৯ জন আমার অত্যন্ত বিশস্ত ছিল।এরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে এলোপাতারি দৌড়াদৌড়ি করে পালিয়ে যেতে লাগলো।মাত্র ক’ জন ছেলে নিয়ে আমি সেই পজিশনে পৌঁছালাম।তারপর অয়্যারলেস সেটে কর্ণেল তাহেরের সাথে যোগাযোগ করি এবং আমাদের পজিশনের উপর শেলিংয়ের বিস্তারিত ব্যাপার তাকে জানাই এবং ফায়ারিং বন্ধ করার জন্য তাঁকে অনুরোধ করলাম।আমি বুঝে উঠতে পারলাম না ফায়ারিং কোন পক্ষের,কারণ এই পজিশনের ওপর ফায়ার করার কোন কথা ছিল না।তিনি ফায়ার বন্ধ করলেন।সম্ভবতঃ রেঞ্জিংয়ে কোন ডিফিকাল্টি ছিল,যার জন্য এটা হয়েছিল।পরে তাঁকে আমি ফায়ারিং কারেকশন জানাই।তখন সকাল হয়ে আসছে। কর্ণেল তাহের এক পর্যায়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন লেঃ মিজানের সাথে আমার কোন যোগাযোগ আছে কিনা।আমি বললাম এখন নেই।তিনি বললেন তাকে কল দাও,আমিও তার খোঁজ নিচ্ছি।তিনি ৫/৬ জনকে নিয়ে মিজানের পজিশনের দিকে গেলেন।প্রায় ৪৫ মিনিট থেকে ঘন্টাখানেক পর আমি সেটে কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম।কান্না বিজরিত কন্ঠে বেলাল বলতে লাগলো শেলিং -এ তাহের ভাইয়ের পা বিধ্বস্ত হয়ে গেছে।মিজানের পজিশনের কাছে পাকিস্তানীরা তাকে দেখতে পেয়ে ৬০ এম-এম মর্টার থেকে শেলিং করে।তার একটি পা নষ্ট হয়ে যায়।৩০/৪৫ মিনিট পর একটি হেলিকপ্টারএসে কর্ণেল তাহেরকে নিয়ে যায়।১০-১১ টা পর্যন্ত সেই পজিশনে থাকলাম।পরে আমার কাছে এক মেসেঞ্জার একটা কাগজ নিয়ে আসেন,কর্ণেল তাহেরের লেখা,তাতে লেখা ছিল আমাকে এই সেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।লেখাটুকু পুরোপুরি স্মরণ নাই।সম্ভবতঃ এ ধরনের ” Clear the road from here to Dacca.Look after my bodys.I leave everything to you and God bless you.” আরও অনেক কিছু ছিল।আমি অত্যন্ত মর্মাহত হলাম।কারণ আজ এই সেক্টরের দায়িত্ব আমার উপর দেয়া হয়েছে।আমি জানি না এই দায়িত্ব আমি সুষ্ঠভাবে পালন করতে পারবো কিনা।আমার মনে হচ্ছিল আকাশটা আমার আমার মাথায় ভেঙ্গে পড়েছে।যা হোক,সে অবরুদ্ধ অবস্থায় আমরা বিকেল পর্যন্ত সেখানে থাকলাম।স্কোয়াড্রন লীডার হামিদুল্লাহকে এই দায়িত্ব না দিয়ে আমার উপর তিনি এই দায়িত্ব দেন।অবশ্য পরে হামিদুল্লাহ আসার পর তিনি নামে মাত্র কমান্ডার রইলেন।অপারেশনের দায়িত্ব আমার উপর দেন,কারণ তিনি বিমানবাহিনীর লোক।অপারেশনর এইসব ব্যাপারে তিনি ততো অভিজ্ঞ নন।কর্ণেল তাহের আহত হওয়ায় আমরা সবাই মর্মাহত হই।একটা বিরাট শূণ্যতার সৃষ্টি হয়েছিল।অনেকটা গোটা পরিবার আকস্মিক পিতৃহীন হয়ে পড়ার মত।যাহোক অনেক কষ্টে আমি এই পরিস্থিতি সামলে নিয়েছিলাম।কর্ণেল তাহের গৌহাটিতে চিকিৎসাধীন থাকাকালে আমি সেখানে গিয়ে তার সাথে দেখা করে যুদ্ধ বিষয়ক পরামর্শ করি এবং সেক্টরে ফিরে আসি।

ডিসেম্বর এর তিন তারিখ ভারত আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষনা করে।১ তারিখ থেকে আমরা কামালপুর অবরুদ্ধ করে রাখি।আমাদের সাথে ছিল এক ইন্ডিয়ান রেগুলার ব্যাটালিয়ন,মুক্তিযোদ্ধা তিন কোম্পানী।আর ৯৫ মাউন্টেন ব্রিগেডের দুইটি ব্যাটালিয়ন কামালপুর বাইপাস করে কামালপুর পতনের আগেই বক্সিগঞ্জের দিকে চলে যায়।তখন পাকবাহিনী বক্সিগঞ্জ থেকে পিছু হটে যাচ্ছে।৪ তারিখ সকালে ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের দুটি বিমান কামালপুরের উপর স্ট্রাফিং শুরু করে।দ্বিতীয়বার আক্রমণ হয় ১২ টা কি ২ টায় তৃতীয়বার আক্রমণ করার কথা ছিল বিকাল চারটায়।ইতিমধ্যে পাকিস্তানী বাহিনী যথেস্ট হেস্তনেস্ত হয়েছে।আমরা অয়্যারলেস সেটে ইন্ডিয়ানদের কনগ্র‍্যাচুলেশন শুনছিলাম।এক পর্যায়ে কামালপুরে তাদের যে ফোর্স ছিল তারা কন্টাক্ট করে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারের সাথে এবং সাহায্য চেয়ে পাঠায় ফোর্সের জন্য।তারা জানালো তাদের কিছু করণীয় নাই।এটা বুঝে তখন জেনারেল হিরা,ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার ও আমি তিনজনে বসে বুঝাপড়া করে একটা সারেন্ডার নোট তৈয়ার করি।একজন ফ্রিডম ফাইটারকে একটি সাদা ফ্লাগ হাতে দিয়ে তা কামালপুর ঘাঁটি ভিতর পাঠাই।প্রায় ঘন্টাখানেক পর সে যখন ফেরে নাই,তখন আমি অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়লাম।দ্বিতীয়বার আর একটি ছেলেকে অয়ারলেস সেট সাথে দিয়ে আমার সাথে যোগাযোগ রেখে কামালপুর ঘাঁটিতে পাঠাই।সে ওখানে যাওয়ার পর পাকসেনারা দ্বিতীয় ছেলেটিকে রেখে প্রথম ছেলেটিকে পাঠিয়ে দেয়।তাকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করি।সে জানালো,আমাকে তারা শেলিং হচ্ছে বলে নীচে বাংকারে নিয়ে যায় রুটিটুটি খেতে দেয়।তারা আমার সাথে ভাল ব্যবহার করে।যা হোক দ্বিতীয় ছেলেটির সাথে কয়েকবার সেটে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম।পারলাম না।সে তখন তাদের সাথে আলোচনায় ব্যস্ত ছিল।তাছাড়া তারা তাকে সেটে কথা বলতে দিতে এলাউ করেনি।কিছুক্ষন পর সে যখন সেটে আসলো তখন যোগাযোগ হলো।ছেলেটি জানালো তারা সারেন্ডার করতে প্রস্তুত আছে।তখন আমি তাকে বললাম যে,আমি আর একজনকে পাঠাচ্ছি,তাদের জে-সি-ও বা অফিসার লেবেলের কাউকে তার সাথে আসতে বলো।সে গেল।যাওয়ার পর পাকিস্তান আর্মির একজন জে-সি-ও,মিলিশিয়া কাপড় পরা,সম্ভবতঃমিলিশিয়াই হবে,ছেলেটির সাথে এসে আমাদের সাথে যোগাযোগ করে এবং সারেন্ডারের কথা ব্যক্ত করে।তখন আমরা তাদেরকে সারেন্ডারের পদ্ধতি বলে দিই।সে ফিরে যায় এবং হাতিয়ার মাঠিতে রেখে সবাইকে সারেন্ডার করায়।আমরা তাদের সব হাতিয়ার এবং সকলকে আমাদের পজিশনে নিয়ে আসি।এদের মধ্যে একজন অফিসার,ইনি সম্ভবত ক্যাপ্টেন হাসান কোরেশী,একজন জে-সি-ও,এবং ১০০ জনের মত সিপাই,৩০ জনের মত রেঞ্জার এবং কিছুসংখ্যক রাজাকার ও ছিল।এদেরকে আনা হল।সমস্ত হাতিয়ার আনা হলো।আমরা যে হাতিয়ার পেলাম তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল এম-জি ৩৬ টি এবং আরও ছোটখাটো হাতিয়ার।যারা সারেন্ডার করে তাদেরকে রাখার ও খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো।তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে।আমি অবরুদ্ধ ২৪ ঘন্টা ব্যস্ত ছিলাম।খাওয়া-দাওয়া ছিল না।তাই বিশ্রামে চলে যাই।Next day morning about 8- o clock I came back to the same place and there I found one Indian Capt.and one Indian Major.They were talking to Capt.Quoreishi etc.

যুদ্ধবন্দী আচরণ সংক্রান্ত কথাবার্তা হলো।তারপর দিন আমরা বক্সিগঞ্জ পৌঁছালাম।ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার সেখানে একটি রেস্ট হাউজে ছিলেন।আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরলেন এবং কনগ্র‍্যাচুলেশন জানালেন।বললেন Mannan,our country recognize your country as a sovereign state.Now your morale should be high.we are going to fight a real battle to the pakistanis.

বক্সিগঞ্জে তখন কোন পাকিস্তানী ছিল না।তারা জামালপুরের দিকে চলে গেল।আমি আমার মুক্তিবাহিনী নিয়ে জামালপুরের দিকে অগ্রসর হলাম।আমি আগেই বলেছিলাম তাদের দুটি ফোর্স কামালপুর বাইপাস করে চলে গিয়েছিল।এই ফোর্সগুলো যখন টাঙ্গাইলের দিকে যাচ্ছিল তখন ইন্ডিয়ান ফোর্স তাদেরকে বাধা দেয়,যেন তারা টাঙ্গাইল যেতে না পারে।তারা যখন বাধা পেল তখন এক ব্যাটালিয়ন নান্দাইল হয়ে ময়মনসিংহের দিকে যে রাস্তা ছিল সেদিকে যেতে চেস্টা করে।তারাও বাধাপপ্রাপ্ত হলো।আমি আমার ফ্রিডম ফাইটারদের নিয়ে শেরপুর হয়ে জামালপুরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম।তখন আমি প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম।তখন আমি নদী পার হতে পারিনি,কারণ নদীতে কোন ফেরীর বন্দোবস্ত ছল না।আর আমি দেখতে পাচ্ছিলাম দুটি ইন্ডিয়ান এয়ারক্রাফট জামালপুরের উপর ভীষণভাবে গুলিবর্ষণ করে চলেছে।আর তুমুল “গুলাগুলির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম।প্রায় ঘন্টাদুয়েক সংঘর্ষের পর সব শান্ত হলো।ইন দি মি টাইম আমি ব্রক্ষ্মপুত্র নদ ক্রস করে জামালপুর সাইডে পৌঁছে গেলাম এবং অগ্রসর হতে লাগলাম।খবর পেলাম,পাকসেনাদের পুরো কনভয় ডেস্ট্রয় করা হয়েছে এবং প্রায় ৬ জন অফিসারসহ ৩৬০ জন পাকসেনাকে সেখানে বন্দী করা হয়েছে।তাদেরকে ইন্ডিয়ান আর্মি ঘেরাও করে জামালপুর পি-টি-আই তে রাখে।তখন আমি সেখানে গিয়ে তাদের সাথে দেখা করি।বন্দি ছয়জন অফিসারের মধ্যে একজন মেডিক্যাল কোরের সদস্য ছলেন।আর একজন সিনিয়র মেজর ছিলেন,যিনি এই ব্যাটালিয়নের ও-সি ছিলেন। তার নাম মনে নেই,তিনি পাঠান এং কর্ণেল তাহেরের কোর্স মেট।তার সাথে কর্ণেল তাহের সম্পর্কে আলোচনা হচ্ছিল।আলাপ-আলোচনার মধ্যে একজন ইন্ডিয়ান গার্ড রেজিমেন্টের সি-ও এসে যোগ দেন।পাক সিনিয়র মেজর আমাকে প্রশ্ন করেন, Manna, we fighting among us,আমি জবাব দেই,স্যার আপনারা পহেলা মার্চ থেকে থেকে ২৫ শে মার্চ যে হত্যাকান্ড করেছেন তার রিআ্যকশন স্বরুপ এছাড়া আমাদের কিছু করণীয় ছিল না।তারপর আমি তাকে আরও ঘটানার কথা বললাম।তিনি বললেন,Happy news that you are independent but I wish you are not like bhutan. আমি প্রত্যুত্তরে বলি,Sir, if we can get rid of you, we can get rid of anyone. we will never replace one master by another.

যাহোক, জামালপুর থেকে আমরা ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসর হতে থাকলাম আর ইন্ডিয়ান আর্মির যে দুটি ব্যাটালিয়ন ছিল তারা টাংগাইলের দিকে অগ্রসর হলো।আমি সেদিকে যেতে চেয়েছিলাম।কিন্তু জেনারেল নাগরা,যিনি এই ডিভিশনের কমান্ডার ছিলেন,তিনি আমাকে সেদিকে যেতে বারণ করেন।তিনি বললেন, তোমার সেদিকে যাওয়া প্রয়োজন হবে না।তুমি বরং এখানে লোকাল এডমিনিস্ট্রেশন এবং অন্যান্য সবকিছু তদারক কর।যা হোক আমি লোকাল এডমিনিস্ট্রেশন এবং সবকিছু যা যা অর্গানাইজ করার দরকার ছিল সবকিছু অর্গানাইজ করার চেষ্টা করলাম।আমি আমাদের ছেলেদের জামালপুর হাই স্কুলে ক্যাম্প করে তাদেরকে সেখানে থাকতে দিলাম।ইতিমধ্যে আমি সংবাদ পেলাম যে,জামালপুর থেকে মাইল দেড়েক দূরে পাক রাজাকার থেকে উদ্ধারকৃত ৩০০ টির মতো হাতিয়ার জড়ো করেছে এবং কোথাও সেগুলো সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে।আমি সেখানে গেলাম এবং তাদের সাথে কথা বললাম।তার জানালো এই সমস্ত হাতিয়ার পাবনা যাবে।পরে আমি সেগুলো সীজ করলাম।হাতিয়ার গুলো নিয়ে তারপরের দিন ময়মনসিংহে আসি।এসে দেখি ময়মনসিংহ ও মুক্ত।এটা আনুমানিক ১০ ই ডিসেম্বর।আমার হেড কোয়ার্টার টাউন হলে খুলি এবং আমার ফৌজ অর্গানাইজ করি।তারপর সিভিল এডমিনিস্ট্রেশন চালানোর জন্য আমরা নিজেরা উদ্যোগ নিই।

*(১৯৭১ সালে লেফটেন্যন্ট হিসাবে কর্মরত ছিলেন।পরবর্তীতে লেঃ কর্ণেল পদে উন্নীত হন।বিবরণটি প্রকল্প কর্তৃক ১১-১২-৭৯ তারিখে গৃহীত সাক্ষাৎকার থেকে সংকলিত)

 

শাহরিয়ার ফারুক

<১০, ২০., ৪৭২৪৭৫>

১১ নং সেক্টরের আরও যুদ্ধ বিবরণ*

মেজর তাহের আগষ্ট মাসে ১১ নং সেক্টরে আসেন। কিন্তু এর আগে বিখ্যাত পাকবাহিনীর কামালপুর বাংকারে সদাসর্বদা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আঘাত হানতে থাকে অল্প সামরিক শিক্ষাপ্রাপ্ত অথচ গভীর মনোবলের ভিত্তিতে গঠিত বাংলার বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ। এখানে মাঝে মাঝে বিভিন্ন সময়ে ইস্ট বেংগল রেজিমেন্টের জুনিয়ার অফিসাররাও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন। এসময়ে তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা কামালপুর শত্রুশিবিরে ছোটখাট গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে কিছু কিছু করে পাক-সৈন্য হত্যা করে দস্যুদের সদা ব্যতিব্যস্ত এবং সন্ত্রাসের মধ্যে রাখতো। এই সময় বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধক্ষেত্রে আর একটি অমর নাম শহীদ সালাউদ্দিন কামালপুর রণাঙ্গনে উপস্থিত ছিলেন। তাছাড়া অন্যানোর মধ্যে যাদের নাম উল্লেখযোগ্য তাদের মধ্যে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন হাফিজ ও লেঃ মান্নান এবং মুক্তিফৌজ কমান্ডারদের মধ্যে যারা নির্দিষ্ট ভূমিকা রাখেন, তারা হচ্ছেন কমান্ডার মুক্তা, কমান্ডার হেলাল, কমান্ডার পান্না, কমান্ডার ফয়েজুর। এর মধ্যে হেলাল কোম্পানীর একটি দিক রয়েছে। সেটা হল পাক-বাহিনীর কামালপুর বাংকারে এই শক্তিশালী পাক – ঘাঁটিটিকে ১১ নং সেক্টর থেকে মোট ১৮ বার ছোট – বড় আক্রমণ করা হয়েছে। তার মধ্যে হেলাল কোম্পানি মোট ১৪ টি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে এবং ৪ ঠা ডিসেম্বর কামালপুর মুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত এই কোম্পানী এখানে যুদ্ধরত অবস্থায় ছিল।

একদিন,সম্ভবতঃ ২৪ শে জুলাই তারিখে,ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দু’জন জুনিয়র অফিসার ক্যাপ্টেন শহীদ সালাউদ্দিন ও লেঃ মান্নান কামালপুরে শত্রুশিবিরে বাংকারে সশরীরে উপস্থিত হয়ে দু’জন খানসেনাকে হত্যা করে একটি চাইনিজ ও একটি জি-থ্রি রাইফেল নিয়ে আসে।

কামালপুরে রণাঙ্গনে একটি স্মরণীয় দিন ৩১ শে জুলাই তারিখ।শেষ রাত্রের দিকে কামালপুর বাংকারে এক বিরাট ধরনের দুর্ধর্ষ আক্রমণ করা হলো।এই দুর্ধর্ষ আক্রমণের নেতৃত্বে দিচ্ছেন সম্মুখভাগে ক্যাপ্টেন শহীদ সালাউদ্দিন,লেঃ মান্নান ও ক্যাপ্টেন হাফিজ।বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ তুমুলভাবে লড়ে যাচ্ছেন এবং পিছন থেকে ব্যাক্তিগতভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচালনা করছেন মেজর মঈনুদ্দীন।কর্ণেল জিয়াও তাঁর।সদর দপ্তর নিয়ে এ সময় উপস্থিত ছিলেন।মোট কথা এই দুর্ধর্ষ আক্রমণটি সেদিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।যুদ্ধক্ষেত্রে কিছুটা ভুল বুঝাবুঝি না হলে হয়তো সেই দিনই কামালপুর মুক্তিবাহিনীর দখলে আসতো-ভুল বুঝাবুঝি উৎরে যেয়ে তবুও হয়তো বা কামালপুর দখল করা সম্ভব হতো যদি সেদিন বাংলার বীর সন্তান ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন শহীদ না হতেন।

যুদ্ধক্ষেত্রে ক্যাপ্টেন হাফেজ একটি কোম্পানীকে কমান্ড করছিলেন।আর একটা কোম্পানীকে কমান্ড করছেন স্বয়ং শহীদ সালাউদ্দিন। নির্দিষ্ট সময়ে শহীদ সালাউদ্দিন নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছলেন কিন্তু হাফিজ একশ গজ পিছিয়ে ছিলেন।এর মধ্যেই আর্টিলারি ফায়ার শুরু হয়ে যায়। কিছুক্ষন পর ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন কামালপুর ক্যাম্পের ভিতরে চলে যান এবং আর্টিলারী ফায়ার বন্ধ করতে পারেন।ওদিকে ক্যাপ্টেন হাফেজ আর্টিলারীকে একশগজ আগের ফায়ার দিতে বলেন এবং আর্টিলারী অফিসার ক্যাপ্টেন হাফিজ সাহেবের সিগনাল ও গোলা বর্ষণ করেন।ফলে সালাউদ্দিন কোম্পানীর বেশ কিছু ছেলে হতাহত হন।এবং ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন স্বয়ং আঘাতপ্রাপ্ত হন।তবুও তিনি দমেননি।শত্রুদের অনেকেই মারা পড়ছিল এবং কেউ কেউ পালাতে চেষ্টা করছিল ও একজন পালিয়েও ছিল।ইতিমধ্যেই শত্রুপক্ষের মেশিনগান ফায়ার পশ্চিম দিক থেকে অর্থাৎ কামালপুর পোস্ট অফিস ও গোডাউনের মাঝামাঝি থেকে সালাউদ্দিন কোম্পানীর দিকে আসতে থাকে।দুর্ধর্ষ সৈনিক সালাউদ্দিন ভেবেছিলেন ঐ এম-জি টাকে স্তব্ধ করে দিতে পারলেই বিখ্যাত কামালপুর দখলে আসবে এবং এই ভেবে তিনি একাই গিয়েছিলেন সেই এম-জি টাকে মারতে।তিনি যখন গোডাউনের কাছ থেকে ফায়ার করবেন,ঠিক সেই সময়েই পোস্ট অফিসের দিক থেকে একটি এল-এম-জি হঠাৎ গর্জে উঠলো এবং বাংলার বীর সন্তান ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিনের বুক ঝাঁঝরা করে দিয়ে গেল। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন বীরের মত শহীদ হলেন।তাঁর মৃতদেহ আনা সম্ভব হয়নি এবং তার মৃতদেহ আনতে গিয়ে ১৭ জন বেঙ্গল রেজিমেন্ট সৈন্য আহত হয়েছিলেন। পরে শোনা গেছে সালাউদ্দিনের লাশ পাকসেনারা সামরিক কায়দায় সমাধিস্থ করেছে।

সেদিন এই মর্মন্তদ যুদ্ধে শুধু ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন শহীদ হননি, আরও দুজন জুনিয়র অফিসার,ক্যাপ্টেন হাফিজ ও লেঃ মান্নান গুরুত্বরভাবে আহত হন এবং আরও তিনজন জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার আহত হন।সেদিনের আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে বেঙ্গল রেজিমেন্টসহ মোট ৬১ জন সৈন্য বীরের মত শহীদ হন।অপরদিকে পাকবাহিনী হারায় একজন অফিসার সহ মোট ৭০ জন সৈন্য।সেদিন কামালপুর দখল করা সম্ভব হয়নি।

তারপর অমিতবিক্রমে কামালপুর আক্রমণ করা হয়েছিল।সেদিন ছিল ৯ ই আগষ্ট।এই আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকাই বেশী।তাছাড়া বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু সৈন্যও ছিল।৯ ই আগষ্ট রাত ৮-৩০ মিনিটে হেলাল কোম্পানীর ৩৭ জন ছেলে বক্সিগঞ্জ-কামালপুর সড়কে এমবুশ নিয়ে থাকে এবং তারা টেলিফোনের তার কেটে দিয়ে পাক বাহিনীর তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।এই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হেলাল।সেই রাত্রিটি ছিল মেঘাচ্ছন্ন,বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল।

এই এমবুশ থাকাকালীন বক্সিগঞ্জ থেকে কামালপুর গমনরত দু’জন রাজাকারকে এই দল গ্রেফতার করে দুটি রাইফেল ও ১০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে।এদের কে মহেন্দ্রগঞ্জে ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিয়ে এই দল এখানেই এমবুশে থাকে।কিছুক্ষন এখানে এমবুশে থাকার পর এই দলের ট-আই-সি বিচিক্ষন লতা দেখতে পেল তাদের পজিশন থেকে দশ হাত দূরে দুজন রাজাকারসহ পাক-বাহিনীর বিরাট বাহিনী পজিশন নিচ্ছে।সঙ্গে সঙ্গে লতা দিক নির্দেশ করে ফায়ার এর আদেশ দিল।ফলে পাক দস্যুরা আর পজিশন নিতে পারেনি।৭টা এস-এল-আর ও একটি এল-এম-জি দিয়ে বৃষ্টির মত গুলি ছুড়লো হেলাল-লতার দল।গুলির আঘাতে পাকবাহিনী দলের কমান্ডার আহত হয়ে গেল,তারপর অকথ্য মুক্তিবাহিনীর দলকে গালাগালি করতে লাগলো।ওরা সার্চ শুরু করলো।ততক্ষণে হেলাল কোম্পানীর দল ওখান থেকে উইথড্র করে চলে এসেছে।কিন্তু সবাই বিচ্ছিন্ন অবস্থায়।সবাইকে পাওয়া গেল কিন্তু লতা ও আর একটি ছেলেকে হেলাল খুঁজে পেল না।পরে ওরা রাত ১২ টার সময় নির্দিষ্ট স্থানে এলো এবং খবর দিল একজন কর্ণেল আহত ও ৪৭ জন পাক সৈন্য খতম হয়েছে।এই দুর্ধর্ষ আক্রমণে হেলালের কৃতিত্বের জন্য ওর কোম্পানীর নাম সেদিন টাইগার দেওয়া হয়েছিল।তারপর মেজর তাহের আগষ্ট মাসের ১১ তারিখে মহেন্দ্রগঞ্জে ১১ নং সেক্টর পরিদর্শনে আসেন।

মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হেলাল লেঃ কর্ণেল তাহেরের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে কামালপুর রণাঙ্গনে অভুতপূর্ব কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন।২৬ শে অক্টোবর এক সময়ে তিনি তার দল সহকারে কর্ণেল তাহেরের নির্দেশে কামালপুরের পেছনে গেদ্দা ও উঠানুরপাড়ায় পর পর তিনদিন এমবুশ থেকে বিস্ফারণ ঘটানোর কাজ করেন। তার মাইন বিস্ফোরণে এই এলাকার পাকনাহিনী খুবই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।এক সময় এক মাইন বিস্ফোরণে ৪৬ জন খানসেনা আহত হয়।

লেঃ কর্ণেল তাহের এই হেলাল কোম্পানীর বিশেষ কৃতিত্ব দেখে নভেম্বর মাসে বক্সিগঞ্জ আক্রমণ করার জন্য পাঠান।এর মধ্যে কর্নঝোরাতে তিনি পাক বাহিনীর সঙ্গে এক তুমুল সংঘর্ষে ৪ জন খানসেনাকে খতম করেন।বাকী খান সেনা পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করে।ঐ সময় হেলাল লেঃ কর্ণেল তাহেরের এই কোম্পানী ফিরে আসে এবং পরে এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা সহকারে মেলান্দহানার পাটের গুদাম ধ্বংস করার আদেশ পায়।হেলাল কোম্পানী এই নির্দেশ মেলান্দাহর দিকে যাত্রা করে।এর মধ্যে কোন এক নদীতে পাকবাহিনী দালালদের ১২০০ মণী নৌকা ধ্বংস করে এবং পাক বাহিনীর সঙ্গে এখানে এক সংঘর্ষ বাধে।তারা তিনদিক থেকে এই হেলাল কোম্পানীকে আক্রমণ করে।তরুণ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার অতি বিচক্ষণতার সাথে আক্রমণ প্রতিহত করে ১৩ জন শত্রুসেনাকে খতম করেন।পরে তার বাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে মেলান্দাহ যাত্রার পথি দূরমুরির পুল ধ্বংস করেন।পুল ধ্বংসের সময় পুলরক্ষী বাহিনী ও রাজাকারদের সাথে এক সংঘর্ষে তিনি ১৭ জন রাজাকারকে খতম করে ৬ টি রাইফেল উদ্ধার করে তাহেরের কাছে জমা দেন।

তারপর ১৪ নভেম্বর।এই ঘটনাটির কথা মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্পের কয়েকহাজার মুক্তিযোদ্ধা সহ এই এলাকার বাসিন্দা ইন্ডিয়ার জনসাধারণ চিরদিন মনে রাখবে।

১৩ ই নভেম্বর দিবাগত রাত্রি ৩-২০ মিনিট লেঃ কর্ণেল তাহের মুক্তিফৌজ কমান্ডার হেলাল,সাঈদ ( লেঃ কর্ণেল তাহেরের ছোট ভাই),পান্না,লেঃ মান্নান,গোয়েন্দা অফিসার মোঃ মনিরুজ্জামান,আবেদীন,ভুঁইয়া – এদের সবাইকে ডাকলেন এবং বললেন,আজকে কামালপুরে শক্তিশালী আক্রমণ করা হবে।তিনি কিভাবে কোথা থেকে আক্রমণ করা হবে তা সবাইকে বুঝিয়ে দিলেন।তিনি কোম্পানী কমান্ডারদের মোট ৮৫ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে কামালপুরের আশেপাশের কোন এক গ্রামে এমবুশ নিয়ে থাকতে বললেন।কোনরকম সাড়াশব্দ ব্যতিরেকে।তিনি আরও বলে দিলেন,তার নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত যেন কোন রকম গুলিবর্ষণ করা না হয়-আর যদি পাক-বাহিনী পালাতে চেষ্টা করে,তবে যেন তাদেরকে ধরা হয়।

যথাসময়ে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।যুদ্ধ পরিচালনা করছেন লেঃ কর্ণেল তাহের স্বয়ং।তিনি অয়ারলেসের মাধ্যমে মুক্তিফৌজের রণাঙ্গনের খবর রাখছেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিচ্ছেন।সকাল ৯-৩০ মিনিট হঠাৎ তুমুল সংঘর্ষ থেমে গেল।পাক-বাহিনীর ওদিক থেকে কোন গুলি আসছে না।সবাই মনে করলো ওরা সবাই খতম।মুক্তিফৌজের মনে দারুণ উৎফুলভাব পরিলক্ষিত হচ্ছিল সে সময়।এই মুক্তিযোদ্ধাদের রণাঙ্গনে কর্ণেল তাহের একটি অয়ারলেস সেট নিয়ে দৌড়ে গেলেন,কি ব্যাপার।তখন তার সঙ্গে ছিল তার দুই ভাই বেলাল ও বাহার-তারা উভয়েই আসন্ন জয়ের জন্য খুবই আনন্দিত।লেঃ কর্ণেল মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের জিজ্ঞাসাবাদ করছেন,ঠিক এই সময় লেঃ মিজান এসে খবর দিল কামালপুর ক্যাম্প এখনই চার্জ করতে হবে।কর্ণেল তাহের ভাবছেন কোন দিক থেকে কামালপুর চার্জ করা হবে।ঠিক এমন সময় একটা গোলা এসে তাঁর পায়ে লাগলো।আর্ত চিৎকারের সঙ্গে সব মুক্তিযোদ্ধা দৌড়ে ঘটনাস্থলে আসে।এসে দেখতে পায় এক অসহনীয় করুণ দৃশ্য-তাহের রণনেতা কর্নেল তাহের চিরদিনের মতো তার একটি পা হারিয়েছেন।সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিফৌজদের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে গেল যারা নাকি কিছুক্ষন আগে দুর্ধর্ষ পাক সৈন্যকে হত্যা করেছে-তারা সবাই শিশুর মতো কাঁদছে।কিন্তু লেঃ কর্ণেল তাহের,সেই অসীম সাহসী রণনেতা,এত বড়ো আঘাত পেয়েও একটুও বিচলিত হননি।তখন তার মাত্র চারটি কথা ছিল,(১) যুদ্ধ চালিয়ে যাও-(২) ঐ জায়গা দখল কর (যে জায়গায় তিনি আহত হয়েছেন), (৩) কামালপুর দখল করতে হবে,(৪) আমি আসছি এবং এসে যেন দেখতে পাই কামালপুর থেকে ঢাকার রাস্তা পরিস্কার।তারপর আহত লে কর্নেলকে কাঁধে করে নিয়ে আসে অশ্রুসিক্ত চোখে মুক্তিযোদ্ধা মিঠু ( এই মুক্তিযোদ্ধা খুবই কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে কামালপুর রণাঙ্গনে),সুজা,লেঃ মিজান,ভূঁইয়া ও আবেদীন।তারা গারোডোবা পর্যন্ত নিয়ে আসে তাঁকে।ওখান থেকে হেলিকপ্টারে লেঃ কর্ণেল তাহেরকে ভারতের পুনার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তারগণ কর্ণেল তাহেরকে দেখে বলেছেন- তিনি যদি জ্ঞান হারাতেন তবে তাঁকে বাঁচানো সম্ভব হতো না।কর্ণেল তাহেরের নেতৃত্বে সেদিনের সেই কামালপুরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যুদ্ধে পাকবাহিনী ১৩৫ জন সৈন্য হারায়।ধ্বংস হয়েছিল ৬ টি ট্রাক,১ টি জীপ এবং বহুসংখ্যক হাতিয়ার।

তারপর লেঃ কর্ণেল আবু তাহেরের অনুপস্থিতে এই সেক্টরটি সংযুক্তভাবে নেতৃত্ব দেন মেজর আজিজ,লেঃ মান্নান ও এয়ারফোর্সের অফিসার জনাব আবু তাহের সাহেবের বড় ভাই জনাব আবু ইউসুফ।এই সময়ে কর্নেল আহত হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিনিয়তই কামালপুর আক্রমণ করতে থাকে।

১৬ ই নভেম্বর তারিখের এক আক্রমণে খানসেনাদের মেজর রিয়াজ আহত হয় ও ১২ জন খান সেনা নিহত হয়।

২০ শে নভেম্বর তারিখের আর এক আক্রমণে এই দিনের আগের রাত্রে পাকনাহিনীর রিইনফোর্সমেন্ট করার সময় ৮০ জন পাকসেনা মারা পড়ে।এই সময় প্রতিটি আক্রমণের সময়ে কামালপুরকে ঘেরাও অবস্থায় রেখে আক্রমণ করা হয়।

১ লা ডিসেম্বর আর এক আক্রমণের সময় সমূহ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় পাকবাহিনীকে।এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার যে,কোম্পানী কমান্ডার হেলালসহ মেজর তাহেরের সহোদর বড় ভাই জনাব আবু ইউসুফ,ছোট ভাই কমান্ডার সাঈদ (এক্সপ্লোসিভ এক্সপার্ট),বেলাল বাহার( এক্সপ্লোসিভ এক্সপার্ট), ও আনোয়ার হোসেন (এক্সপ্লোসিভ এক্সপার্ট) – এই পাঁচ ভাই প্রত্যেকটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন।

৪ ঠা ডিসেম্বর কয়েকজন অফিসার সহ বেলুচ,পাঠান,পাঞ্জাবী সৈন্য – মোট ১৬২ জন পাক সৈন্য মুক্তিফৌজ ও মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।

পাক বাহিনীর শিবিরে গিয়ে অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা সঞ্জু বাকযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল।শেষ পর্যন্ত তারই জয় হয়।পাক-বাহিনীর অফিসারকে দিয়ে সারেন্ডারপত্র সই করিয়ে সঞ্জুই প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উড়ায়।তারপর ৬ তারিখে বক্সিগঞ্জ ও মোরাপুর মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে।৭ তারিখে দখল হয় দেওয়ানগঞ্জ ও বাহাদুরাবাদ ঘাট।এই বাহাদুরাবাদ ঘাট দখল কারী কমান্ডার ফয়েজুর রহমান জামালপুরের দিকে অগ্রসর হন।তারপর তুমুল সংঘর্ষে ৪০ জনের মতো পাকসেনা নিহত এবং ৬০০ জনের উপর শত্রুসেনা বন্দী হলে ১১ ই ডিসেম্বর সকালবেলা তিনিই জামালপুরের বুকে প্রথম স্বাধীনতার পতাকা উঠান।তারপর মেজর আজিজ লেঃ কর্ণেল তাহেরের পরিকল্পনা অনুযায়ী টাঙ্গাইলের পথে রওনা হন।

*(জুলাই ১৯৭২ এর সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত “লেঃ কর্ণেল আবু তাহের- স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সৈনিক” শীর্ষক খালেদুর রহমান রচিত প্রতিবেদন থেকে সংকলিত)

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২১। ‘জেড’ফোর্স গঠন ও তার যুদ্ধ তৎপরতা বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র ১৯৭১…

 

 

অপরাজিতা নীল

<১০, ২১.১, ৪৭৬-৪৭৭>

সাক্ষাৎকারঃ মেজর অলি আহমদ

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের প্রথম ব্রিগেড ‘জেড’ফোর্স গঠিত হয় ৭ জুলাই। মেজর জিয়াউর রহমানের নামানুসারে এই ব্রিগেডের নামকরণ করা হয় ‘জেড’ফোর্স  (জিয়া ফোর্স)। বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধে ‘জেড’ফোর্স  এক বিশেষ অবদান রেখেছে। এই ফোর্সে তিনটি নিয়মিত পদাতিক বাহিনী ছিলো – যথাক্রমে ১ম ইষ্ট বেঙ্গল, ৩য় ইষ্ট বেঙ্গল এবং ৮ম ইষ্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়ান। ব্রিগেড কমান্ড করেন তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান (বর্তমান মেজর জেনারেল)। আমি নিজে ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজরের দায়িত্ব পালন করি।

১ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যেসব অফিসার কর্তব্য পালন করেছিলেন, তারা হলেনঃ

কমান্ডিং অফিসারঃ মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী। আগষ্ট মাস থেকে মেজর জিয়াউদ্দিন এই ব্যাটালিয়নের দায়িত্ব নেন। মেজর জিয়াউদ্দিন পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে বাংলার মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।

সেকেন্ড ইন কমান্ডঃ ক্যাপ্টেন বজলুল গণি পাটোয়ারী এ্যাডজুট্যান্ট এবং কোয়ার্টার মাস্টারের দায়িত্ব পালন করেন ফ্লাইট লেফট্যান্যান্ট লিয়াকত আলী খান।

ব্যাটালিয়নে ৪ টি কম্পানী যারা কমান্ড করেছেন তারা হলেনঃ

‘এ’কোম্পানী কমান্ডারঃ ক্যাপ্টেন মাহবুব।

‘বি’কোম্পানী কমান্ডারঃ ক্যাপ্টেন হাফিজুদ্দীন।

‘সি’কোম্পানী কমান্ডারঃ ক্যাপ্টেন আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী।

‘ডি’কোম্পানী কমান্ডারঃ ক্যাপ্টেন বজলুল গণি পাটোয়ারী।

৩য় বেঙ্গল ব্যাটালিয়নে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন তারা হলেনঃ

কমান্ডিং অফিসারঃ মেজর শাফায়েত জামিল।

সেকেন্ড-ইন কমান্ডঃ ক্যাপ্টেন মহসীন।

‘এ’কোম্পানী কমান্ডারঃ ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন।

‘বি’কোম্পানী কমান্ডারঃ ক্যাপ্টেন আকবর হোসেন।

‘সি’কোম্পানী কমান্ডারঃ ক্যাপ্টেন মহসীন।

‘ডি’কোম্পানী কমান্ডারঃ লেঃ নুরুন্নবী চৌধুরী।

এছাড়া লোঃ মঞ্জুর, লেঃ ফজলে হোসেন, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আশরাফুল আলম প্রমুখ অফিসার এই ব্যাটালিয়নের বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এই ব্যাটিলিয়নে নায়েক সুবেদার আজিজের নেতৃত্বে একটি আপোর্ট প্লাটুনও ছিল।

৮ম বঙ্গলে যেসব অফিসার কমান্ড করেছেন তারা হলেনঃ

কমান্ডিং অফিসারঃ মেজর এ, টি, এম আমিনুল হক।

সেকেন্ড-ইন কমান্ডঃ ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরী।

‘এ’কোম্পানী কমান্ডারঃ ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরী।

‘বি’কোম্পানী কমান্ডারঃ ক্যাপ্টেন সাদেক হোসেন।

‘সি’কোম্পানী কমান্ডারঃ ক্যাপ্টেন মোদাসসের হোসেন।

‘ডি’কোম্পানী কমান্ডারঃ লেঃ মাহবুবুর রহমান।

এছাড়া লেঃ এমদাদুল হক, লেঃ কাজী মনিবুর রহমান, লেঃ ওয়ালি-উল-ইসলাম, লেঃ বাকের প্রমুখ তরুন অফিসাররা এই ব্যাটিলিয়নে কাজ করেন।

‘জেড’ফোর্স কামালপুর, বাহদুরপুর ঘাট, দেওয়ানগঞ্জ থানা, চিলমারী, হাজীপাড়া, ছোটখাল, গোয়াইনঘাট, টেংরাটোলা, গোবিন্দগঞ্জ, সালুটিকর বিমানবন্দর, ধলাই চা-বাগান, ধামাই চা-বাগান, জাকিগঞ্জ, আলি ময়দান, এম সি কলেজ, ভানুগাছা, কানাইয়ের ঘাট, বয়মপুর, ফুলতলা চা-বাগান, বড়লেখা, লাতু, সাগরনাল চা-বাগান ইত্যাদি স্থানে পাকসেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষে নজিরহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

*১৯৭১ সালে ক্যাপ্টেন হিসাবে ৮ম বেঙ্গলে কর্ম্রত ছিলেন।

 

অপরাজিতা নীল

<১০, ২১., ৪৭৭৪৮৮>

 

সাক্ষাৎকারঃ মেজর আমিন আহমদ চৌধুরী           

জেডফোর্সের অপারেশনসমূহঃ ১ম ইষ্ট বেঙ্গলের কামালপুর যুদ্ধ

মুক্তি সংগ্রামে শত্রুর সাথে মুখোমুখি লড়াই শুরু করি আগষ্ট’৭১-এর পর থেকে। এর আগে আমরা ছিলাম ডিফেন্সে, আর শত্রুরা আমাদের উপর আক্রমন করতো। বিলোনিয়া যুদ্ধের পর থেকে শত্রুরা আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের ভূমিকা গ্রহন করে, আর আমরা আক্রমণকারীর। আমাদের ব্রিগেডের (‘জেড’ফোর্স) প্রথম আক্রমন পরিচালনা করেন মেজর (বর্তমানে লেঃ কর্নেল) মইনুল ইসলাম চৌধুরী। (১ম ইষ্ট বেঙ্গল) ডেলটা কোম্পানি নিয়ে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন মমতাজ ও ব্রেভো কোম্পানী নিয়ে ক্যাপ্টেন হাফিজ এ আক্রমণের ব্যুহ রচনা করেন। আর ক্যাপ্টেন মাহবুব (পরে সিলেট রণাঙ্গনে শহীদ হন) কাট-অফ পার্টি নিয়ে ওঁৎ পেতে বসেন শত্রুর ডিফেন্সের পেছনে। আক্রমণ করাকালীন একটি বস্তুর প্রয়োজন হয় বেশী, তা হলো সিংহহৃদয়। ইংরেজীতে যাকে বলে লায়নহার্ট। ডিফেন্সে যারা থাকে, তারা বাংকারে থাকে, ফলে স্বভাবতই ছোট ছোত হাতিয়ার  এমনকি ডাইরেক্ট আর্টিলারী শেল থেকে রক্ষা পায়। সে জন্যই সাধারনতঃ দেখা যায় যে, একটি ডিফেন্সকে আর্টিলারী থেকে শুরু করে ট্যাংক ও বিমান হামলা করে সেই ডিফেন্সকে তছনছ করে ফেলার পরেও মাত্র দুই-একজন সাহসী যোদ্ধা অকুতভয় মনবলে বলীয়ান হয়ে বাংকার থেকে সেই প্রচন্ড গোলাগুলির মাঝে মাথা নিচু করে মুখ থুবরে পড়ে না থেকে আক্রমণকারীর আক্রমণ সম্পুর্নরুপে ব্যার্থ করে দেয়। সকল প্রকার সুষ্ঠ আক্রমণই ব্যর্থ হয়ে যায় যদি পূর্বাহ্নে পরিকল্পনা গ্রহণ না করা হয়। আর সুষ্ঠ পরিকল্পনা নেওা তখনি নেওা সম্ভব হয় যখন কমান্ডার নিজে চুপি চুপি শত্রুশিবির দেখে আসে। মিলিটারী ভাষায় এই চুপি চুপি দেখে আসার নাম হচ্ছে রেকি পেট্রোলিং।বাংলা মায়ের দামাল ছেলে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন মমতাজ ছিলেন এক অভূতপূর্ব ব্যতিক্রম, অনন্যসাধারণ সৈনিক- পাকিস্তানের কোয়েটা থেকে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে পালিয়ে এসে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন- যোগ দেওয়ার পর থেকে শত্রুর উপর প্রচন্ড আঘাত হানার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন।

ময়মনসিংহের কামালউর বি-ও-পি ছিল শত্রুদের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি, কারন জল ও স্তল উভয় পথেই কামালপুর – ময়মংসিংহ-ঢাকা সড়কের প্রবেশদ্বার ছিল এ কালামপুর। তাই শত্রুরা এখানে বাংকারগূলো অত্যন্ত মজবুত করে তৈরী করে। বাংলারের প্রথম আস্তরে মাতি ও তিনের দেয়াল, তারপর ৬ ইঞ্চি থেকে ১ ফুট ব্যবধানে রেলের লোহার বীম। এই একই প্রকার ব্যাবধানে পাকা সিমেন্টের আস্তর। বাংলারের ওভারহেড কাভারের বেলায়ও একই প্রকার প্রস্তুতি নেয়া হতো- প্রত্যেকতি বাংকারই প্রায় ঘরের মত উঁচু, অন্যদিকে সমস্ত ডিফেন্স টানেলের মারফত যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল। এদিকে মাইন, বিবিট্রাপ ও বাঁশের কঞ্চি সমস্ত ডিফেন্সটিকে দুর্ভেদ্য দুর্গের মত করে রেখেছিল। পরপর দুদিন রেকি করার পরেও সালাউদ্দীন স্বচক্ষে শত্রুশিবির দেখার জন্য লেঃ মান্নানকে সাথে করে তৃতীয়বারের মত রেকি পেট্রোলিং নিয়ে নিজে নিজে শতুশিবিরের দিকে গেলেন। বি-ও-পি’র কাছে পৌছে জমির আলীর উপর লেঃ মান্নান, সুবেদাও হাসিম, নায়েক শফি, ও দলের অন্যান্য সবাইকে রেখে শুধু সুবেদার হাইকে সঙ্গে নিয়ে শত্রুর বাংকারগুলো রেকি করতে গেলেন। বলাবাহুল্য, পাকিস্তানীরা রাত্রিতে সব সময় সেকেন্ড দিফেন্সে চলে যেত। কামালপুর রণাঙ্গনে শত্রুরা সাধারনতঃ দিনের বেলায় অনেক এলাকা জুড়ে ডিফেন্স নিয়ে থাকত, কিন্তু রাত্রিবেলায় দূরের বাংকারগুলো ছেড়ে দিয়ে ছোট অথচ ঘন ডিফেন্সে চলে যেত। খালি বাংকারগুলি দেখে সালাউদ্দীন ও হাই আরো ভিতরে চলে গেলেন। এমতাবস্থায় দুজন শত্রুসেনা সম্ভবতঃ পেট্রোলিং করে ফিরে আসার সময় এদের দুজনের মুখোমুখি হয়ে পড়ে। একশত পাঁচ পাউন্ড ওজন আর ৫’-৫” উচ্চতা বিশিষ্ট ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন মুহুর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ল লম্বা খানসেনাদের উপর, যার হাতে ৩০৩ রাইফেল। অন্ধকারে খানসেনা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে “আমি খালেদ” বলে নিজেকে সঙ্গীর কবল থেকে ছারাতে গিয়ে নিজের ভুল বুঝতে পারল সে। আসলে তারা মুক্তিবাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। মুহুর্তের মধ্যে খানসেনা সালাউদ্দীনের হালকা দেহ মাটিতে ফেলে দিয়ে গলা টিপতে শুরু করল। সালাউদ্দীন ‘মান্নান’বলে চিৎকার করে উঠলেন। মান্নান ছুটে এসে ষ্টেন ধরে জিজ্ঞেস করলো “উপরে কে?” সালাউদ্দীন গোংড়ানীর স্বরে বললো “উপরে তো ঐ শালা”। লেঃ মান্নান গাব গাছের নিচে তারাতারি পজিশন নিলেন। এদিকে সুবেদার হাইকে ‘হ্যান্ডস আপ’বলার সাথে সাথে রাইফেলের বাঁট দিয়ে আগাহত করে খানসেনার জি-থ্রি রাইফেল কেড়ে নিলেন। কিন্তু খানসেনা মুহুর্তের মধ্যে পেছনের বাংকারে ঢুকে পড়লো। আর নায়েক শফি, যে এতক্ষন ইতস্ততঃ করছিল গুলি করবে কি করবে না (কেননা ঘুটঘুটে অন্ধকারে কার গায়ে গুলি লাগে বলা মুশকিল), মুহুর্তের মধ্যে ধাবমান শত্রুর দিকে গুলি ছুড়ল। সম্ভবতঃ অন্ধকারে ঠাহর করতে পারেনি বলে বাঁ পাশের দালানে গিয়ে লাগে। সংগে সংগে হাই বাংকার লক্ষ্য করে ষ্টেনের এক ম্যাগাজিন গুলি ছুড়ল। গুলি ছুড়ে জি-থ্রি রাইফেলসহ সালাউদ্দীনের দিকে এগিয়ে এলো। গাবগাছের পাশ দিয়ে যাবার সময় মান্নান আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো – কে? ত্বতিত বেগে ‘আমি হাই’বলে সালাউদ্দীনের উপরে অবস্থানরত খান সেনাকে ষ্টেনের ব্যালে দিয়ে গুঁতো দিল। উপরের লোকটি সালাউদ্দীনকে ফেলে দৌড়াতে শুরু করল। সুবেদার হাই ওকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ল। অতঃপর রাইফেল দুতি নিয়ে ওরা ত্বরিত দেগে শত্রু শিবির ত্যাগ করে।

নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে এসে সালাউদ্দীনের সাহস গেল আরও বেড়ে। এ রেকী পেট্রলিং থেকে দুটি জিনিশ বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। তাহলো, সুবেদার হাই ও ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীনের অদম্য সাহস ও অদ্ভুত প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব। কিন্তু এতে আবার একটি গুরুত্বপূর্ন গোপনীয়তা প্রকাশ পায় যে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ আসন্ন, ফলে তারাতারি শত্রুরা তাদের সৈন্য সংখ্যা বাড়িয়ে ফেললো, তাতে করে কামালপুরে পাকবাহিনীর ৩১-বেলুচ ব্যাটালিয়নের সৈন্যসংখ্যা দাঁড়ালো দুই কোম্পানীতে (রাজাকার ছাড়া)। দুদিন পর ৩০-৩১শে জুলাই প্রথম ইষ্ট বেঙ্গল (সিনিয়র টাইগার) রাতের আধারে রওনা হলো। প্রথমে সালাউদ্দীনের ডেল্টা কোম্পানী, ফলো আপ কোম্পানী হলো ক্যাপ্টেন হাফিজের ব্রাভো, যার পিছে হলো ব্যাটালিয়ন ‘আর’গ্রুপ আর এই ‘আর’গ্রুপে ছিলেন মেজর (বর্তমানে লেঃ কর্নেল) মঈন এবং তার সাথে ছিলেন কর্নেল (বর্তমানে মেজর জেনারেল) জিয়াউর রহমান। সম্ভবতঃ ব্রিগেডের প্রথম এটাক সরেজমিনে তদারক করার জন্য কর্নেল জিয়া নিজেও এটাকিং ট্রুপসের সাথে রওনা হন। আক্রমনের ওয়াচ আওয়ার ছিল ৩০/৩১শে জুলাই-এর রাত ৩-৩০ মিনিট। কিন্তু গাইডের অভাবে প্রথম ইষ্ট বেঙ্গল এফ-ইউ-পি’তে সময়মত পৌঁছাতে পারেনি। ফলে ৩-৩০ মিনিটের সময় টাইমপ্রোগ্রাম মোতাবেক আমাদের নিজস্ব আর্টিলারী ফায়ার যখন শুরু হয় (ফায়ারের সংকেতধ্বনি ছিল হিস করে ওয়ারলেসের উপর  শব্দ করা) তখনও আমাদের ছেলেরা এফ-ইউ-পি’তে পৌছার জন্য প্রাণপণ দৌড়াচ্ছে। কাদামাটিতে এতগুলো লকের এই দৌড়াদৌড়ির ফলে যথেষ্ট শব্দ হয়, তাতে করে দুশমনের পক্ষে আক্রমণের ডাইরেকশন নির্ধারন করা একেবারেই সহজ হয় এবং নিমিষের মধ্যে তাদের আর্টিলারী ফায়ার এসে পড়তে থাকে। এদিকে প্লাটুন পর্যায়ে ডেপথ (টু-আপ) হওয়ার ফলে লোক আগে-পিছে হয়ে যায়। ফলে কমান্ড কন্ট্রোল কায়েম করা মুশকিল হয়ে পড়ে। অন্যদিকে এসেম্বেলি এরিয়া থেকে পূর্ব নির্ধারিত এফ-ইউ-পি’তে আসার মাঝপথে আমাদের নিজেস্ব আর্টিলারী ফায়ার শুরু হওয়াতে প্রথম ইষ্ট বেঙ্গল তৎক্ষণাৎ সেই অবস্থাতেই কোনক্রমে ফর্ম-আপ হতে থাকে। ফলে সে কি চিৎকার আর হট্টগোল। আবার ডাইরেকশনের অভাবে এডভান্স করাকালীন একে অন্যের উপর চড়ে বসে। আর অপেক্ষাকৃত নিচু আর কর্দামাক্ত জমির উপর আসা সাথে সাথে পাকিস্তানী ও আমাদের যুগ্ন আর্তিলারী ক্রস-ফায়ারিং-এর নিচে আসার ফলে আমাদের বেশকিছু ছেলে হতাহত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে ওয়ারলেস সেট জ্যাম হওয়াতে সংযোগ সম্পূর্নরুপে বিচ্ছিন্ন হয়। তাতে বিশৃঙ্খলা চরমে পৌঁছায়। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল হাটবাজার বসেছে আর নীলকর আদায়কারী সাহেবদের দেখে কে কোথায় পালাবে পথ পাচ্ছে না। এ অবস্থায় প্রথমে ইষ্ট বেঙ্গলের আক্রমনের ব্যুহ রচনা করা আদৌ সম্ভব ছিলো না। কারন, এটাকিং ট্রুপস যদি ঠিকমত ফর্ম-আপ না হতে পারে তবে আমাদের পক্ষে আক্রমণ করার প্রশ্নই ওঠেনা। ১৯৬৫ সনের যুদ্ধে বার্কি সেকটর বিআরবি’র ওপারে ভারতের এক দিভিশন সৈন্য যখন ফর্ম-আপ হচ্ছিল তদানীন্তন পাকিস্তান তিনটি মাত্র ট্যাংক আচম্বিতে সে সৈন্যদলের উপর হামলা চালায়। ফলে, ভারতীয় পালিয়ে যায়। যুদ্ধের ময়দানে এ ঘটনা অহরহ ঘটছে এবং ঘটবে। এদিকে কর্নেল জিয়াউর রহমান বাঘের মত গর্জে উঠলেন, ‘কাম অন, এ্যাট এনি কষ্ট উই উইল লাঞ্চ দই এ্যাটাক’। মেজর মঈন (বর্তমানে লেঃ কর্নেল) ওয়ারলেস ছেড়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিলেন। আর ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন ও হাফিজ এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছেন। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। একদিকে ইষ্ট বেঙ্গল প্রসিডিউরের চামড়া পর্যন্ত তুলে ফেলছে, অন্যদিকে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন মেগাফোনে বাংলা-ইংরেজী-উর্দুতে মিশিয়ে অকথ্য ভাষায় গালি দিচ্ছিল সৈন্যদলকে। কারূর বা কলার ধরে লাইনে সোজা করে আগের দিকে (টারগেটমুখী)মুখ করে দিচ্ছে, আর কাউকে বা হাফিজ ষ্টেনের বাঁট দিয়ে মারছে। মোগল-রাজপুতের প্রথম যুদ্ধে আশিটি যুদ্ধে বিজয়ী রানা সংগ্রাম সিংহের বিপুল রণাভিঙ্গ সৈন্যবাহিনীকে দেখে আকারে ছোট মোগল বাহিনী ভড়কে গিয়েছিল যুদ্ধের প্রারম্ভেই। কিন্তু ভেলকিবাজির মত বাবর সে সৈন্যবাহিনীকে বাগে এনে বিপুল বিক্রমে আক্রমণ করে শেষপর্যন্ত জয়ী হন। তাই সামরিক নেতা হিসাবে ইতিহাসে বাবরের স্থান অতি উঁচুতে। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন ও হাফিজের কৃতিত্ব বুঝি সেখানেই। মাঝে বিশৃঙ্খলার মাঝে শুধুমাত্র মনের জোর ও অদম্য সাহসে বলীয়ান হয়ে সালাউদ্দীন ও হাফিজ প্রতিবন্ধকার ও প্রতিকূলতা অতিক্রম করে নিজ নিজ কোম্পানীকে অভীষ্ট লক্ষ্যে উপনীত করতে সক্ষম হন এবং নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ আক্রমণ সুচারুরূপে সম্পন্ন করেন। যুদ্ধের ময়দানে ফলাফলটা সকল সবকিছুর পরিমাপক নয়, বরং ঘটনাটি কিভাবে সংঘটিত হলো সেটাই সবচেয়ে লক্ষণীয়।

দ্বিতীয় মহাসমরে মন্টগোমারীর কাছে রোমেল চরমভাবে মার খেলেন। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, মাসের পর মাস, মাইলের পর মাইল পশ্চাদপশারণ অভিয়ান অব্যাহত রাখতে হয়েছে রোমেলকে সাহারার দুস্তর মরুর পথে পথে। অথচ মন্টগোমারীর বিজয়াভেযানের চেয়ে রোমেলের সেই পশ্চাদভিযানই সকলের মনে অণুপ্রেরণা যোগায়। তাই বুঝি রোমেল শুধুমাত্র রোমেলই।

এফ-ইউ-পি’র চরম বিশৃঙ্খলা থেকে সামান্য রেহাই পেয়ে প্রথম বেঙ্গল সবেমাত্র অগ্রসর হয়েছে অম্নি পাকিস্তানী আর্টিলারী সাল্ভো ফায়ার এসে পড়লে, সংগে সংগে হতোদম্য সৈনরা মাতিতে শুয়ে পড়ল – শেষ মুহুর্তে বুঝি আক্রমণ করা সম্ভব হলো না ধেখে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়লেন। একদিকে সমগ্র বাঙ্গালী জাতির মান-ইজ্জতের প্রশ্ন, অন্যদিকে দুশো ছেলের জীবন। সালাউদ্দীন তার “ক্ষ্যাপা, দুর্বাসা ছিন্নমস্তা চণ্ডী-রনদা সর্বনাশী, জাহান্নামের আগুনে বসে হাসছে পুষ্পের হাসি” – মারছে লাথির পর লাথি। কারো বা কলার চেপে ধরে অকথ্য ভাষায় গালি দিচ্ছিল – ‘বেশরম, বেগায়রত, শালা নিমকহারামির দল – আগে বাড়ো।’আবার সৈন্যদলের মন চাংগা করার জন্য নিজের অবস্থান জাহির হয়ে যাবে জেনেও পাকবাহিনীকে লক্ষ্য করে মেগাফোনে উর্দুতে বলছিল, ‘আভিতক ওয়াকত হায়, শালালোক সারেন্ডার করো। নেহীতো জিন্দা নেহি ছাড়েংগা।’তার পরের ইতিহাস প্রতিতি বাঙ্গালীর গৌরবের ইতিহাস। এ যেন শুধুমাত্র ইতিহাস নয়, মুক্তিকামী মানুষের প্রালবন্যার ইতিহাস। বাঙ্গালী সৈন্যরা তখন ছুটছে ঝড়ের মত করতালি দিয়ে স্বর্গমর্ত্য করতলে। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালার মত প্রথম ইষ্ট বেঙ্গল মুহুর্তের মধ্যে ভাসিয়ে দিল পাকবাহিনীর ডিফেন্সের প্রথম সারির বাংকারগুলো। সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মত গুরুগর্জন করে সিনিয়র টাইগার ‘জয় বাংলা’আর ‘আকবর’ধ্বনিতে প্রকম্পিত করে তুললো যুদ্ধের ময়দানকে। বাংকার অতিক্রম করে বিশ-পঁচিশটা ছেলে কমিউনিতি সেন্টারে ঢুকে পড়লো। তাদের মাত্র দুজন আহত অবস্থায় ফেরত আসতে পেরেছিল আর বাকি সবাই হাতাহাতি যুদ্ধে শাহাদাৎ বরণ করে। প্রচন্ডভাবে তখন হাতাহাতি যুদ্ধ চলছে। বাঘের থাবাতে যত্রতত্র ভূপাতিত পাকসৈন্যরা। পিছনে তখন আমাদের পক্ষের লাশা আসা শুরু হয়ে গেছে। কর্নেল জিয়া তখন বলছেন, “আই উইল একসেপ্ট নাইনটি ফাইভ পারসেন্ট ক্যাজুয়েলটি বাট …। দেম আউট মঈন।” আহত ক্ষতবিক্ষত জোয়ানরা বলছে, “স্যার-নিয়ে এলেন কেন? আর সামান্য বাকী- কি হত, আমি না হয় মরে যেতাম।” গর্বে বুক ফুলে উঠছিলো। পিছনের উঁচু পাহাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শকেরাও বুঝতে পারছিলেন বাঙ্গালীরা শুধু বসে বসে (এমনকি না খেয়ে) কবিতা লিখে কিংবা গাল-গল্প করে আর শ্লোগান দিয়ে ভাবালুতার মাঝে দিন কাটায় না। যুদ্ধও করতে জানে বৈকি। আজকে শুধু আফসোস হচ্ছে যে, আজকের পেপার-টাইগার যদি সেদিন যুদ্ধের ময়দানে থাকতেন তবে সম্ভবত আজ আর তারা আমাদেরকে ‘খোদার খাসী’বলার দুঃসাহস করতেন না। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীনের গায়ে তখনও সেই রিলিফের সাদা শার্টটা ছিল। মহানগরীর নিউ মার্কেটে গিয়ে মার্কেতিং করার অবসর তার ছিল না, না ছিল সংগতি কিংবা তেমন নীচু মনোবৃত্তি। তবে হ্যাঁ, বন্য পশুদের মত আমরা জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরছি। তাই বুঝি লুঙ্গি মাল্কোচা বেঁধে সিভিল অফিসার তৌফিক এলাহি যশোর রণাঙ্গনকে রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন।

এদিকে মাইন-ফিল্ডে ফেঁসে যাওয়া সুবেদার হাই-এর প্লাটুনের ডানে অবস্থানরত ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন বুঝতে পারলেন যে, শত্রুরা মাইন-ফিল্ডের পেছনের বাংকারগুলো ছেড়ে দিয়ে পেছনে সেকেন্ড লাইনে সরে গিয়ে কাউন্টার এটাকের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন মেগাফোনে হাইকে প্লাটুন নিয়ে ডানে যেতে বলেলেন। প্রথম আক্রমণ শুরুকালে সুবেদার হাই-এর লোকসংখ্যা ছিল ৪০ জন। কিন্তু লক্ষ্যে পৌছা পর্যন্ত সংখ্যা দাড়াল ১৫-২০ জনে। এদিকে মাইনের আঘাতে নায়েক শফির হাত উড়ে গেল আর ধারমান শত্রুদের পিছু নেওয়াকালে জোয়ানরা বারবার সালাউদ্দীনকে অনুরোধ করলো, “স্যার, পজিশনে যান” (মাটিতে শুয়ে পড়া)। সালাউদ্দীন ধমকে উঠলো, “বেটা-স্যার করে চিৎকার করিস না, শত্রুরা আমার অবস্থান টের পেয়ে যাবে। চিন্তা করিস না তুই বেটা আমার কাছে এসে দাঁড়া, গুলি লাগবে না, ইয়াহিয়া খান আজও আমার জন্য গুলি বানাতে পারেনি।” দু’দিকে বৃষ্টির মত গুলির মাঝে দাঁড়িয়ে এ কথা বলা চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। তাই বুঝি আজও ১ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কেঁদে কেঁদে খুঁজে বেড়াচ্ছে তাদের প্রাণপ্রিয় সালাউদ্দিনকে। দ্বিতীয়বার মেগাফোনে ‘হাই’বলার সাথে সাথে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীনের সামনে ২/৩টি বোমা এসে পড়লো। মুহুর্তের মধ্যে সালাউদ্দীন ধরাশয়ী হলেন। তার দেহটা প্রথমে বামে, পরে আধা ডানে ও শেষে ধরাম করে পেছনের দিকে পড়ে গেল। আশেপাশের জোয়ানরা ছুটে আসে, ‘স্যার, কলেমা পড়েন’, কিন্তু বাংলার একান্ত গৌরব সালাউদ্দীন উত্তর দিল, “আমার কলেমা পড়ার দরকার নেই। খোদার কসম, যে পিছনে হটবি তাকে গুলি করবো।” তারপর বিড় বিড় করে আবার বলে উঠলো, “মরতে হয় এদেরকে মেরে মর – বাংলাদেশের মাটিতে মর।’এমন মরণ দুনিয়ার ইতিহাসে যে বিরল, এ মৃত্যুতে আনন্দ আছে, গর্ব আছে। উঁচু মাটির টিবিতে পড়ে থাকা সালাউদ্দীনের লাশটা ২/৩ জন জোয়ান শত্রুর এলাকা থেকে টেনে আনতে চেষ্টা করলো, কিন্তু ব্যর্থ হয়ে সকলেই মৃত্যুবরণ করে। পরিশেষে একটি বিহারী ছেলে ৮ টি গুলি খেয়েও শেষবারের মত চেষ্টা করে নিজে গুরতরভাবে আহত হয় এবং লাশটি আনতে ব্যর্থ হয়। সালাউদ্দীনের গায়ে তখনো সেই সাদা শার্টটা ছিলো, যা তার খুলে ফেলার কথা ছিল, কারন সাদা শার্ট রাত্রিবালায় বেশী দেখা যায়। শেষপর্যন্ত ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীনের ঘড়ি, ষ্টেন ও অন্যান্য কাগজ নিয়ে আসা হয়।

ওদিকে ক্যাপ্টেন হাফিজ বেঁচে গেলেন অলৌকিকভাবে। হাতের স্টেন তোপের মুখে উড়ে গেলেও সামান্য আহতও হয়ে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার বেঁচে গেলেন, কিন্তু ৬০০ গজ পিছনে এফ-ইউ-পি তত্বাবধানে কর্মরত লে: মান্নান ঊরুতে গুলি খেয়ে গুরুতরভাবে আহত হলেন, যদিও বা একই জায়গায় একইভাবে ফ্লায়িং অফিসার লিয়াকতও শুয়ে ছিলেন। অন্যদিকে আহতও ক্যাপ্টেন হাফিজকে উদ্ধারকল্পে ল্যান্স নায়েক রবিউল ছুটল শত্রু অভিমুখে। কয়েক কদম যাওয়ার পর দুই হাতেই গুলি এসে লাগলো, তথাপি তার প্রানপ্রিয় তথা বাংলাদেশের অমুল্য রত্ন ক্যাপ্টেন হাফিজকে উদ্ধার করার সঙ্কল্প থেকে এতটুকু টলাতে পারেনি। যথাস্থানে পৌঁছে দেখে হাফিজকে অন্য কেউ নিয়ে গেছে। পড়ে থাকা অয়ারলেস অ রকেট লাঞ্চার উঠাবার সময় রবিউলের বুকে গুলি লাগলো। রবিউল মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। পাশের জোয়ান সাহাজ্যের ভয়ে পাশ কেটে চলে গেল। রাগে-দুঃখে রবিউল গ্রেনেডটা হাতে নিয়ে (উদ্দেশ্য, বন্দী হবে না) জীবনের আশা ত্যাগ করে নিকটবর্তী আখক্ষেতের দিকে দিলো ভোঁ দৌড়।বৃষ্টির মত শত্রুর গুলি আসছিল। কিন্তু আশ্চর্য, রবিউলের গায়ে লাগলো না। কোনমতে টেনে হিঁচড়ে আখক্ষেতে পৌঁছুতেই রবিউলের প্রতীতি জন্মালো সে সহজে মরছে না, আর অন্যের সাহায্য ব্যতিতই সে বাঁচতে পারবে। বাঁ হাত থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। ডান হাতের হাড়টি বের হয়ে আছে। নাকে মুখে রক্তের ছোপ। এ অবস্থায় পালিয়ে যেতে দেখে এগিয়ে এসেছিল গ্রামের গৃহবধুরা, যদিও গৃহস্বামীরা প্রত্যাশী নয়। তাই গৃহবধূরা দরজায় দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছিল। নিজের সাথি যখন মুখ ফিরিয়ে চলে গেল তখন সে আর কারো সাহায্য প্রত্যাশী নয়। তাই গৃহবধূদের হাত ছাড়িয়ে সে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করলো কিন্তু পরের ইতিহাস আজো তার কাছে ঝাপসা হয়ে আছে। তার বিশ্বাস দুই রমনীর কাঁধে ভর দিয়ে সে এফ-ইউ-পি এরিয়া পর্যন্ত পৌঁছবে। এদিকে সালাউদ্দীনের মৃত্যুর পর আমাদের সৈন্যদল ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেও সেই অবস্থায় ছোট ছোট গ্রুপে ওরা শত্রুর বাঙ্কারগুলোর উপর আঘাতের পর আঘাত হান্তে থাকে। বেলা তখন ৭টা বাজে। অযথা লোকক্ষয় না করে উইথড্র করে শ্রেয় জেনেও মেজর (বর্তমানে লে: কর্নেল) মঈন তার সৈন্যদলকে কিছুতেই পশ্চাদপসারন করাতে পারছিলেন না। আমাদের আর শত্রুর লাশে কমিউনিটি সেন্টার ভরে গিয়েছে। শেষ পর্যন্ত বেলা সাড়ে কিংবা নিখোঁজ আর দুইজন অফিসারসহ ৬৬ জন আহত হয়। শত্রুদের লাশ তিনটা ট্রাক বোঝাই করে নিয়ে যেতে আমাদের গ্রামের লোকেরা দেখেছে। পরদিন হেলিকপ্টারে পাক বাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসাররা, সম্ভবত জি-ও-সি আসেন কামালপুর পরিদর্শন করতে। বলাবাহুল্য,ওইদিনই পাক বেতারে কামালপুর যুদ্ধের ভয়াবহ বর্ননা করতে গিয়ে বলা হয় যে প্রায় ৪০০ দুষ্কৃতিকারী নিহত হয়েছে। এক অপারেশনে এত বড়সংখ্যক দুষ্কৃতিকারী নিহত হওয়ার সংবাদ ইয়াহিয়ার বেতারে আর কখনো প্রচার করা হয়নি।

ফলাফলঃ ব্যাংকারে বসে থাকা খান সেনাদের মনে ভীতি সঞ্চার করাই এ যুদ্ধের সবচেয়ে বড় সাফল্য। এ যুদ্ধে প্রমাণিত হলো বাঙালীরা দূর থেকে আর পালিয়ে যাবে না বরং ব্যাংকার থেকে খান সেনা তাড়ানোই তাদের উদেশ্য। তাই বুঝি এই আক্রমণের পর থেকে খান সেনারা ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তথা কিংবা কামালপুরের নাম শুনলেই আঁতকে উঠতো। তখনকার দিনে পাক শিবিরে বন্দী মেজর আজিজের ভাষায় বলতে হয় পাকিস্তানীদের নিজেদের মতে কামালপুর হলো পাকসনৈদের মরনঘাঁটি। জিজ্ঞাসাবাদের সময় আজিকে জিজ্ঞাসা করা হতো, “হয়ার ইজ ধানিয়া কামালপুর কিংবা হয়ার ইজ ইউর ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট?”। কথা প্রসংগে সেই জুলাই-আগষ্ট (১৯৭১) মাসে পাক অফিসাররা কখনও বা হঠাত বলে ফেলতো, “ইওর বেঙ্গল রেজিমেন্ট ইজ লাইক রিয়াল টাইগার্স।” আক্রমণটি ব্যর্থ হলেও এর চরম সাফল্য এ উক্তির মাঝেই নিহিত  আছে। তাই বুঝি পরবর্তীকালে বন্দী শিবির থেকে পালিয়ে মেজর আজিজ শত দুঃখ কষ্টকে অবনত মস্তকে মেনে নিয়ে যুগ সৃষ্টিকারী কামালপুর রণাঙ্গনে যোগ দেন।

মাসরুর আহমেদ

<১০, ২১.৩, ৪৮৯-৪৯১>

অনুবাদ


সাক্ষাৎকারঃ ক্যাপ্টেন মাহবুবর রহমান

তারিখঃ ৫-৯-১৯৭৩

জুনের চতুর্থ সপ্তাহে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ জেনারেল ওসমানী মেজর জলিল কে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে সরিয়ে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কামান্ডিং অফিসার  হিসেবে নিযুক্ত করেন। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান আমদের নতুন কমান্ডারকে সাথে নিয়ে বিমান থেকে নামলেন। আমরা তাকে দেখে অত্যন্ত খুশি হয়েছিলাম কিন্তু তিনি আমাদের এখানে নয় অন্যত্র বলদি হয়েছিলেন ।তার সাথে আমাদের জন্য একটি সারপ্রাইজও এসেছিলো। জুলাই এর প্রথম সপ্তাহে একটি গোপন সূত্রে জানা গিয়েছিলো যে ৩য় ইস্ট বেঙ্গলকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানো হতে পারে অপারেশন পরিচালনা করার জন্য। হঠাত করেই সংক্ষিপ্ত আদেশে  ব্যাটেলিয়নটি তার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। ৫/৬ দিন এর যাত্রা শেষে ব্যাটেলিয়নটি মেঘালয় রাজ্যের তেলঢালা নামক স্থানে এসে উপস্থিত হয়। সেখানে বাংলাদেশ আর্মির প্রথম ব্রিগেড গঠিত হয়। ব্রিগেডটি মেজর জিয়াউর রহমানের অধীনস্ত করা হয় এবং পরবর্তীতে তার নামের অদ্যাক্ষর ‘জেড’অনুসারে এই ব্রিগেডের নামকরন করা হয় জেড ফোরস।

তেলঢালাতে ব্যাটেলিয়নটির শক্তির উৎস ছিলো ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ ও ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে আসে ছাত্রদের নিয়ে।

উপযুক্ত প্রশিক্ষন গ্রহনের পর মেজর জিয়াউর রহমান ব্যাটেলিয়নসমুহ কে তাদের অপারেশনাল এরিয়া ভাগ করে দেন। ব্যাটেলিয়নগুলি তাদের অধিনস্ত  এলাকাসমুহে ট্রেনিং চলাকালেই কিছু অপারেশন পরিচালনা করেছিলো। কিন্তু এরপর তারা ভিন্ন ধরনের অপারেশন করে বাহদুরাবাদ ঘাট, দেওয়ানগঞ্জ ও জামালপুরে এবং ভালো সুনাম অর্জন করে। রংপুরে এই ব্যাটেলিয়ন কিছু এলাকা দখল করে যেমন রৌমারি, উলিপুর ও চিলমারি যেগুলো পাক বাহিনী পরবর্তীতে আক্রমন করেও আর পুনরুদ্ধার করতে পারেনি।

কোদালকাঠি, হাজির চর ও রৌমারিতে পাক বাহিনী অসংখ্য লঞ্চ, স্পিডবোট এবং অস্ত্র ও গোলাবারুদ হারায়। ব্যাটেলিয়নের কাছে  তাদের অনেক সৈন্যও নিহত হয়। এটি উল্ল্যেখ্য যে উপরোক্ত সময়ে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল ব্যাতিত বাংলাদের আর্মির অন্য কোন ইউনিট বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কোন এলাকা দখলে রাখতে পারেনি। অনেক সুপরিচিত ব্যাক্তি যেমন এজনা ফটোগ্রাফার ও সাংবাদিক যারে  এডওয়ার্ড কেনিডি পাঠিয়েছিলেন তারা মুক্তি বাহিনীর তৈরি মুক্তাঞ্চল রৌমারি পরিদর্শন করতে আসেন যা ৩য় ইস্ট বেঙ্গল দ্বারা দখল করা হয়েছিলো এবংযা তখন পর্যন্ত মুক্ত ছিলো।তাদের দেখানো হয়েছিলো কিভাবে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করে বিজয়ী হয়  তাদের অসীম সাহসী মুক্তি বাহিনীকে সাথে নিয়ে। তাদের আরো দেখানো হয়েছিলো কিভাবে এই ব্যাটেলিয়ন শত্রুদের কাছ থেকে এলাকা দখল করে, কিভাবে অস্ত্র সংগ্রহ ও মোটরচালিত লঞ্চ শত্রুদের কাছ থেকে দখল করে। ১ম ইস্ট বেঙ্গল এর মেজর জিয়াউদ্দিন এর সাক্ষাতকারও দেখানো হয় যেখানে মেজর জিয়াউদ্দিন রাওয়ালপিন্ডি থেকে তার পালিয়ে আসার কাহিনী বর্ণনা করেন।

সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ৩য় ইস্ট বেঙ্গলের অপারেশনাল এরিয়া মিত্র বাহিনীর পরামর্শে জেনারেল ওসমানীর নির্দেশে পরিবর্তন করা হয়। আবার ৩য় ইস্ট বেঙ্গল অজানার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। কিছুদিন যাত্রার পর বাহিনীটি শিলং এসে পৌঁছে। এখানে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে ব্যাটেলিয়নটি ছাতক এবং সুনামগঞ্জ আক্রমন করে দখল করবে। এরপর ব্যাটেলিয়ন শিলং ত্যাগ করে এবং পাথরঘাটা নামক স্থানে অবস্থা নেয়। পাথরঘাটায় কিছু আলোচনা ও পরিকল্পনার পর ব্যাটেলিয়ন কামান্ডার তার অধীনস্ত কোম্পানি কামান্ডারদের  কিছু আদেশ প্রদান করেন। ‘এ ‘কোম্পানির কামান্ডার ক্যাপ্টেন মোঃ আতাহার হোসেন এবং ‘বি ‘কোম্পানির কামান্ডার মেজর আখতার হোসেনকে ছাতক আক্রমান করার নির্দেশ দেয়া হয়। ‘ডি ‘কোম্পানির কামান্ডার লেঃ নুরন্নবি খানকে তেলেব হয়ে ছাতকের দিকে অগ্রসর হতে বলা হয়। ‘সি ‘কোম্পানির কামান্ডার মেজর মহসীন উদ্দিন আহমেদ কে বাংলাবাজার আক্রমন করে  টেংরাটিলার দিকে অগ্রসর হতে বলা হয়।

সিলেটঃ

পরিকল্পনা অনুসারে অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে এ ও বি কোম্পানিসহ ব্যাটেলিয়ন হেডকোয়ার্টার ছাতকের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। ব্যাটেলিয়ন হেডকোয়ার্টার পেছনে বিজয়নগর নামক এক স্থানে অবস্থান নেয় এবং এ ও বি কোম্পানি ছাতক অভিমুখে তাদের যাত্রা অব্যাহত রাখে যতক্ষন না তারা ছাতক সিমেন্ট কারখানার সীমানা প্রাচীরের অতি সন্নিকটে পৌঁছে। কারখানার পূর্ব পাশের একটি টিলার ঢালে’বি ‘কোম্পানি তাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহন করে।

১০৬ ও ৭৫ মিঃমিঃ রিকোয়েললেস রাইফেলের সাহায্যে তারা পাক বাহিনীর ৫ থেকে ৬ টি বাঙ্কার ধ্বংস করে। বাঙ্কার এর ভেতরে অবস্থান রত সৈন্যরা তখন বাইরে বেরিয়ে এসে ছোটাছুটি করতে শুরু করলে এলএমজি দিয়ে তাদের উপর গুলি করা হয় এবং এর ফলে বহু পাক সৈন্য নিহত হয়। আক্রমনে ফলে অস্ত্র ভর্তি পাক বাহিনীর  একটি জলযান নদীতে ডুবে যায়। নদীর অপর পাশে পাক বাহিনীর অবস্থান ছিলো সু-সংহত। তারা সিলেট থেকে অতিরিক্ত সৈন্য ও কামান নিয়ে আসে। কামানের সাহায্যে তারা আমাদের দিকে চতুর্দিক থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করে। টানা ছয়দিনের তীব্র  যুদ্ধের পরে দুটি কোম্পানিকে  বালিউড়া তে ফিরিয়ে নেয়া হয়।

টেংরাটিলাঃ

সি কোম্পানির কমান্ডার মেজর মহসিন উদ্দিন আহমেদ টেংরাটিলা আক্রমন  করে দখল করেন। এরপর কোম্পানি কামান্ডার দোয়ারা বাজার আক্রমন করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। আক্রমন করতে যাবার পথে তিনি তার কোম্পানিকে একটি নদী পার হতে আদেশ দেন। নদীর অপর পারে থাকা দালালেরা আমাদের অবস্থান সম্পর্কে পাক বাহিনীকে অবহিত করে। এর ফলে যখন আমাদের কোম্পানি নদী পার হচ্ছিলো পাক বাহিনী অতর্কিত চারদিক থেকে আমাদের আক্রমন করে। সৈন্যরা যখন নদীর মাঝামাঝি তখন পাক বাহিনীর এই আচমকা আক্রমনে তারা দিশে হারিয়ে ফেলে এবং আমরা সবাই আবার বাংলাবাজারে ফেরত যাই।

বাংলাদেশ আর্মির কমান্ডার নিন চিফ জেনারেল ওসমানির নির্দেশে এ ও সি কোম্পানিকে কালা বাজার ও টেংরাটিলা আক্রমন এবং দোয়ারা বাজারের দিকে অগ্রসর হতে নির্দেশ দেয়া হয়। ‘এ’কোম্পানি কামান্ডার ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন ও তার সেকেন্ড ইন কমান্ড লেঃ মানজুর আহমেদ ও ‘ডি ‘কোম্পানি কামান্ডার  লেঃ নুরন্নবি ও তার সেকেন্ড ইন কমান্ড আলী নেওয়াজকে গোয়াইনঘাট হয়ে সিলেট অফিমুখে যাত্রা করতে বলা হয়। এই দুটি কোম্পানি মেজর শাফায়াত জামিলের অধীনে ছিলো। অবশেষে অক্টোবরের ৩য় সপ্তাহে এক গভীর রাতে পায়ে হেটে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে মেজর শাফায়ার জামিল তার দুটি কোম্পানি নিয়ে গোয়াইনঘাটে এসে উপসস্থিত হন। তিনি তার দলকে বিভিন্ন অবস্থান যেমন পুলিশ স্টেশন,সার্কেল অফিস, কৃষি অফিস সহ আরো স্থাপনা  আক্রমনের দায়িত্ব ভাগ করে দেন। গোয়াইন ঘটের পাশে একটি নদী থাকায় এটি পার হতে আমাদের কিছু সময় লেগে যায়। স্থানীয় দালালেরা তখন আমাদের অবস্থান সম্পর্কে পাক বাহিনীকে অবহিত করে এর ফলে পাক বাহিনী আমাদের  আক্রমন করে এবং এখানে পাক বাহিনীর সাথে আমাদের তিন দিন টানা যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে পাক বাহিনীর অনেক সৈন্য মারা যায় এবং আমাদের পক্ষে ৪/৫ জন নিহত ও ৭/৮ জন আহত হয়।

নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে আবার রাধানগর টি এটেস্ট ও এরপর গোয়াইনঘাট দখল করার আদেশ আসে । মেজর শাফায়াত জামিল ‘এ ‘কোম্পানি কামান্ডার ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনকে নয়ানগর প্রেরন করেন। ‘ডি ‘কোম্পানি ও ব্যাটেলিয়ন হেড কোয়ার্টার লুনি ও প্রতাপপুরে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহন করে। ৭ই ডিসেমম্বর মেজর শাফায়াত জামিল ছোট খেল ও দোয়ারি খেলে আক্রমন করেন এবং আক্রমনের ফলে ছোট খেল আমাদের নিয়ন্ত্রনে আসে এবং এই যুদ্ধে পাক বাহীনির অনেক সৈন্য নিহত হয় । আমরা প্রচুর পরিমানে অস্ত্র, গোলাবারুদ, রেশন, ম্যাপ ইত্যাদি দখল করি। আমদের পক্ষে নায়েক মোশারফ হোসেন শহীদ  হন এবং কামান্ডার মেজর শাফায়াত জামিল আহত হন। তাকে পরবর্তীতে শিলং এ চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করা হয়। মেজর শাফায়াত জামিলের অনুপস্থিতিতে ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন তার দায়িত্ব গ্রহন করেন এবং ছোট খেল, দোয়ারি খেল ও রাধা নগর দখল করেন।

৮ই ডিসেম্বর গোয়াইন ঘাটও আমাদের আধীনে আসে এবং পাক বাহীনির ফেলে যাওয়া অনেক জিনিস আমরা দখল করি। ভারত সরকারের নির্দেশে ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন গোয়াইন ঘাটের দখল বিএসএফ এর কাছে বুঝিয়ে দেন ও তার দুই কোম্পানি নিয়ে শালুটিকায় সিলেটের বিমানবন্দর দখল করার জন্য শালিতা বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। শালিতা বাড়িতে আগে থেকেই একজন কর্নেলের অধীনে দুই কোম্পানি মুক্তি বাহীনি ও এক কোম্পানি ভারতীয় পদাতিক সৈন্য অবস্থান করছিলো। ভারতীয় কর্নেলের নির্দেশে দুটি কোম্পানি ১০ ডিসেম্বর  বিমানবন্দর আক্রমন করে। আক্রমনে ১৫ থেকে ২০ জন পাকসেনা খতম হয় এবং দুজন ধরা পরে। দুটি এল এম জি ও কয়েকটি রাইফেলও আমাদের হস্তগত হয়। এদিকে আমাদের পক্ষে কোন ক্ষয়ক্ষতি হয় নি।

১২ই ডিসেম্বর ‘এ ‘কোম্পানি ,’ডি ‘কোম্পানি   ও এক কোম্পানি  বিএসএফ কোম্পানীগঞ্জ আক্রমন করে ও এটি দখল করে। ‘বি’ ও ‘সি’ ‘কোম্পানি টেংরাটিলা দখল করার পর ছাতক দখল করে। ১৩ই ডিসেম্বর ‘এ’ ও ‘বি’ কোম্পানি তাদের অবশিষ্ট দুটি কোম্পানি ‘বি’ও ‘সি ’এর সাথে ছাতকে মিলিত হয় ।

১৫ই ডিসেম্বর মেজর শাফায়াত জামিল তার অধীনস্ত ৪টি কোম্পানি নিয়ে গোবিন্দগঞ্জ আক্রমন করেন। বহু পাকসেনা এখানে নিহত হয় এবং অবশিষ্ট রা সিলেট পালিয়ে যায়।

১৬ ডিসেম্বরে এই ব্যাটেলিয়নের সাথে লামাগাজিতে পাক বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। এই যুদ্ধে আমরা ৬টি মর্টার ২ টি মেশিনগান ও বিপুল পরিমান গোলাবারুদ দখল করি।

১৭ই ডিসেম্বর আমরা পাক বাহিনীকে শালুটিকা অভিমুখে চালনা করি সেখানে বিমানবন্দরে তারা মিত্র  বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।

মাহবুবুর রহমান

ক্যাপ্টেন

৩য় ইস্ট বেঙ্গল

অভিজিত ঘোষ

<১০, ২১.৪, ৪৯১-৪৯৫>

 

সাক্ষাৎকারঃ ক্যাপ্টেন আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী

৩১-১১-১৯৭৩

 

সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের নির্দেশে কোনাবনে প্রথম প্রতিষ্ঠা করি বাংলাদেশে গোলন্দাজ বাহিনী। ৫৯ মাউন্টেন রেজিমেন্টের একটি ব্যাটারী নিয়ে এর যাত্রা। এই ব্যাটারীর সাথে প্রায় দেড় মাস থাকার পর আমি প্রয়োজনের তাগিদে পাকিস্তান থেকে আগত ক্যাপ্টেন পাশার কাছে আমার দায়িত্ব হস্তান্তর করে বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার হিসেবে যোগদান করি।

প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টে তখনি কমান্ডিং অফিসার ছিলেন তদানীন্তন মেজর (বর্তমানে কর্নেল) মাঈনুল হোসেন চৌধুরী। এই রেজিমেন্টটি তদানীন্তন পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে সিনিয়র টাইগার হিসেবে পরিচিত ছিল। সিনিয়র টাইগার তখন কামালপুর অপারেশনে ব্যস্ত ছিল। এই ব্যস্ততার মধ্যে আমি আমার দায়িত্ব ভার গ্রহন করি। যেহেতু প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের এলাকাভিত্তিক দায়িত্ব ছিল মহমনসিংহ থেকে রংপুর পর্যন্ত সেহেতু আমাকে রংপুরের কোদালকাটি নামক স্থানে শত্রুর উপর হামলা চালাবার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, আমার সাথে সাথে মেজর জিয়াউদ্দিন ব্যাটালিয়ানের নতুন কমান্ডিং অফিসার হিসাবে দায়িত্ব গ্রহন করেন। তাঁর নির্দেশে আমি কোদাল মাটিতে সাময়িকভাবে ডিফেন্স স্থাপন করি। পরদিন পুরা এলাকা দেখার পর রাত্রি প্রায় ২টার সময় শত্রুঘাটি পুরোপুরি ঘেরাও করে ফেল।শত্রুরা চারদিক অবরুদ্ধ হবার পর আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। এ সময় এক প্লাটুনের উপর সাংঘাতিকভাবে আক্রমণ চলে এবং তারা প্রায় আমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সাথে সাথে আমি শত্রুর উপর প্রতি-আক্রমণ চালাই। আক্রমণের ফাঁকে পঢ়ায় হাতাহাতি চলতে থাকে। আক্রমণের ফলে উভয়পক্ষে যথেষ্ট হতাহতের পর শত্রুপিছু হটতে বাধ্য হয়। শত্রু উপায়ান্তর না দেখে নিরীহ গ্রামবাসীর উপর তাদের জিঘাংসা চরিতার্থ  করে।

ধলাই অপারেশেন (২৮শে অক্টোবর, ১৯৭১) : ধালাই সিলেট জেলার একটি অংশ। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে ধালাই রনাঙ্গন প্রখ্যাত ছিল। এই অপারেশনটা চালাবার জন্য প্রথম রেজিমেন্টকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। যদিও এটি ছিল পাক-বাহিনীর দুর্ভেদ্য ঘাঁটি তথাপি প্রথম রেজিমেন্টের এ-কোম্পানী কমান্ডার ক্যাপ্টেন মাহবুব (শহীদ) তার কোম্পানী নিয়ে একবার শত্রুর উপর আঘাত হানেন। কিন্তু স্বপক্ষের বেশ কিছু আহত সৈনিক নিয়ে তাকে ফিরে আসতে হয়। এদের মধ্যে যারা মারাত্মকভাবে আহত হন তাদের মধ্যে প্রথম দুইজন হচ্ছেন সুবেদার ইব্রাহীম এবং অন্যজন হচ্ছেন রকেট লাঞ্চার-এর নাম্বার ওয়ান হাওয়ালদার সোবহান। এদের দু’জনকেই ঘটনাস্থল থেকে হেলিকপ্টারে মুক্তিবাহিনী বেইস হসপিটালে পাঠানো হয়। এরপর আমি সফলতার সঙ্গে খেজুরীচর টার্গেটকে দখল করার পর তদানীন্তন ব্যাটালিয়ন কমান্ডার ধালাই দখল করার ভার আমার উপর ন্যস্ত করেন। যদিও আমি জানতাম এই রনাঙ্গণ থেকে ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম ছিল তথাপি দৃঢ়তার সঙ্গে আমাকে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে একদিন ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) হাফিজউদ্দিন ঠাট্টা করে বলেছিলেনঃ তোমার নতুন যে প্যান্টটা তৈরী করেছ তা অন্ততঃ একবার পরে যাও। নতুবা মরে গেলেও দুঃখ থেকে যাবে।

১৯৭১ সালের ২৭শে অক্টোবর রণাঙ্গনের দামামা বেজে ওঠে। যাহেতু পুরা ব্যাটালিয়ন এতে অংশগ্রহন করেছিল সেহেতু পরিকল্পনা অনুযায়ী ‘এ’এবং ‘ডি’কোম্পানি ২৭শে অক্টোবর রনাঙ্গনের দিকে যাত্রা করে। তাদের দায়িত্ব ছিল পেছন থেকে যাতে শত্রু যোগাযোগ করতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখা এবং শত্রু যাতে সৈন্য এবং রসদ-সরঞ্জামাদি পরিবহন করতে না পারে তা নিশ্চিত করা। ধালাই এলাকায় বেশ এক অংশ জুড়ে পাকিস্তানি সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছিল। এমনকি প্রত্যেকটা বাংকার কংক্রিটে নির্মাণ করা হয়েছিল। বাংকারগুলো এমন ধরনের ছিল যে এর ভেতর থেকে বের হবার প্রয়োজন খুব একটা হতো না। কারন রসদ সরঞ্জামাদি প্রচুর পরিমাণে মওজুত থাকত। রণকৌশলের দিক থেকে সন্মুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়াছিল আমার পরিকল্পনা। সেদিক থেকে বিচার করে ২৭শে অক্টোবর সকাল ৪টার সময় আমি কোম্পানী নিয়ে অগ্রসর হই। বলাবাহুল্য, ক্যাপ্টেন নুর প্রথমবারের মত সেদিন আমার সাথে যোগ দেন। তিনি আমার এক নম্বর প্লাটুন নিয়ে বাম দিক থেকে অগ্রসর হতে থাকেন এবং আমি আমার দুই নম্বর ও তিন নম্বর প্লাটুন নিয়ে ডান দিক দিয়ে অগ্রসর হতে থাকি। টার্গেট থেকে যখন আমি প্রায় ৫০ গজ দুরে ছিলাম তখন কিছু গোলাগুলির আওয়াজ শুনি। অয়ারলেসে জানতে পারলাম যে ক্যাপ্টেন নুর প্রায় শত্রুঘাটির ভিতরে ঢুকে গেছে। এই সময় আমি সুযোগ বুঝে শত্রুর উপর আক্রমণ চালাই। এখন শুধু বুলেটের আওয়াজ ছাড়া কিছুই শোনা যায় না। শত্রু প্রত্যক্ষভাবে আমার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। অবশেষে শত্রুর অধিকাংশ আমার উপর নিয়োজিত হয়। সুতরাং এ সময় ক্যাপ্টেন বেশ হতাহত হয়। তিনি একটু পিছে এসে ডিফেন্স নেন এবং আহতদেরকে পেছনে পাঠাবার বন্দোবস্ত করেন। আমিও আর অগ্রসর হতে পারছিলাম না। তাই ডান দিকের বেশ একটা অংশ দখল করে শত্রুর নাকের ডগার উপরে বসে যাই। আমার সাথে বেশ কিছুসংখ্যক সৈন্য হতাহত হয়েছিল, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী শৌর্যবীর্যের পরিচয় দিয়েছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ হামিদুর রহমান। এই যুদ্ধে আরও দু’জন জোয়ান তাদের দৃঢ়তা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দেন-তাদের একজন হলেন হাওলাদার মকবুল হোসেন ও অপরজন সিপাই আব্দুর রহমান, যিনি দুলে পুলিশবাহিনী থেকে আমাদের সাথে যোগ দেন। তুমুল যুদ্ধের পর ব্রিগেড কমান্ডার জিয়াউর রহমান সাহেব আমাকে যেখানে ছিলাম সেখানে থাকতে নির্দেশ দেন।

পাত্রখোলা চা-বাগানের যুদ্ধঃ এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ‘এ’‘বি’এবং ‘ডি’কোম্পানী যারা পাত্রখোলা চা বাগানের মধ্যে তাদের আধিপত্য করেছিলেন তাদের উপর বেশ কয়েকটা আক্রমণ চলে। কিন্তু আক্রমণের ফলে যথেষ্ঠ হতাহতের পর শত্রু পিছু হটতে বাধ্য হয়। যেহেতু এই স্থানটা দখল করা ছিল একান্ত প্রয়োজন সেহেতু বড় ধরনের একট পরিকল্পনা গ্রহন করে হয়েছিল। ২৯শে অক্টোবর সকাল ৫টার সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় জাঠ ব্যাটালিয়ন আমাদের সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, কিন্তু সেখানেও আমরা বেশ একটা সুবিধা করতে পারিনি। পর্যায়ক্রমে এক ব্রিগেড ভারতীয় সৈন্য এক ডিভিশন আর্টিলারী নিয়ে আমাদের সাথে অংশগ্রহণ করে। এভাবে একটানা পাঁচদিন যুদ্ধের পর শত্রুপক্ষ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। উল্লেখযোগ্য যে, যুদ্ধে ভারতীয় কমান্ডার এবং দ্বিতীয় জাঠ ব্যাতালিয়নের কমান্ডিং অফিসার আহত হন। এই যুদ্ধে শত্রুপক্ষ যথেষ্ঠ দৃঢ়তার পরিচয় দেয়।

ধালাই যুদ্ধের ফলাফলঃ পাকিস্তান সেনাবাহিনী অনবরত পাঁচদিন যুদ্ধের পর আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। তাদের মধ্যে অবশ্য প্রায় এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। বাকী সৈন্যদের মধ্যে অনেকে ধরা পরে এবং অনেকে পালিয়ে যায়। পরাজয়ের একমাত্র কারন ছিল শত্রুর লাইন অব কমিউনিকেশন চতুর্দিক থেকে কেটে দেওয়া হয়। তাই সম্মুখসমরে তারা সুবিধা করতে পারেনি। এ যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা পুরোপুরি নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। তবুও আনুমানিক বলা চলে আমাদের নিহতের চেয়ে আহতই বেশী হয়েছে। অন্যদিকে, শত্রুর নিহতের সংখ্যা ছিল বেশী। ধালাই যুদ্ধে পরাজয়ের পর সিলেটে শত্রু বাহিনীর ছোটাছুটি অনেক পরিলক্ষিত হয়। কারন যে ক’টি বিখ্যাত ঘাঁটি ছিল তার মধ্যে ধালাই ছিল অন্যতম। এখান থেকেই প্রায় ৫০ মাইল এলাকাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা হতো।

সিলেট যুদ্ধের পরিকল্পনাঃ ১৯৭১ সালের ২০শে নভেম্বর প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্ট সিলেটে সমস্ত শত্রুর দুর্ভেদ্য ঘাঁটি দখল করার জন্যে সিলেটের ভিতর দিয়ে ‘এডভান্স টু কন্ট্যাকট’চালাবার জন্য পরিকল্পনা করা হয়। ২০শে ঈদের নামাজের পর ভারতে সীমানা অতিক্রম করে বালা গ্রামের কিছু পিছনে অবস্থান করি। সমস্ত এলাকা দেখার পরে রাত প্রায় আটটার সময় পুরা ব্যাটালিয়ন নিয়ে আমরা কউএকটি টার্গেটের দিকে অগ্রসর হই। উল্লেখযোগ্য যে, বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বেশ কয়েকটি টার্গেট এখানে ছিল। এদের মধ্যে যেগুলোতে সৈন্যসংখ্যা বেশী ছিল সেগুলোর মধ্যে আটগ্রাম, চারগ্রাম ও বালা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বিক্ষিপ্ত ছোট ছোট কতকগুলো শত্রু ছাউনি থাকাতে অগ্রসর হওয়া বেশ দুষ্কর ছিল। কিছুদুর অগ্রসর হওয়ার পরেই চারদিক থেকে ছোট ছোট অস্ত্রের গোলাগুলি আসতে থাকে, ফলে আমাদেরকে কিছুক্ষণের জন্য অবস্থান নিতে হতো। পুরা ট্রুপসকে পিছনে রেখে কোম্পানী কমান্ডারকে তার দল নিয়ে রেকি করতে হত, তারপর আবার পথ চলতে হত। এভাবে রাত প্রায় ২টার সময় আমি ‘সি’কোম্পানীকে নিয়ে বালায় অবস্থিত টার্গেট থেকে প্রায় ১০০ গজ দুরে ডিফেন্স নিই। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ৪৫ গুর্খা বাহিনীও আমাদের সাথে অঙ্গশগ্রহণ করেছিল। ৪৫ গুর্খা বাহিনীর সাথে ছিল আমাদের ‘ডি’কোম্পানী। তাদের দায়িত্ব ছিল আটগ্রামের শত্রু ঘাটি দখল করা। সব কোম্পানী নিজের দায়িত্ব পালন করার জন্য সুবিধামত টার্গেটের নিকটবর্তী কোন জায়গায় হাইড-আউট করেছিল। শত্রু বাঙ্কারগুলো ইতস্তত বিক্ষিত থাকাতে আমাআদের নড়াচড়া একটু সাবধানেই করতে হতো। আমাদের এইচ-আওয়ার ছিল সকাল ৬টা। সুতরাং এইচ-আওয়ারের পাঁচ মিনিট আগে গোলন্দাজ বাহিনীকে ডাকা হয়-যাকে বলা হয় প্রি-আওয়ার গোলাবর্ষণ। ৫ মিনিট নর্মাল ফায়ার এর পর গোলন্দাজ চপ হয়ে যায়। তার সাথে বাল, চারগ্রাম ও আটগ্রামের উপর বঙ্গশার্দুল ও গুর্খারা ঝাঁপিয়ে পড়ে। অর্ধ ঘন্টার ও বেশী সময় তুমুল গোলাগুলির পর তিনটি শত্রু ঘাঁটিই আমাদের করায়ত্ত হয়। এদের মধ্যে শত্রুর সবচেয়ে বেশী ক্ষয়ক্ষতি হয় আটগ্রামে। এটা শত্রুর ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার এবং দুর্ভেদ্য ঘাঁটি ছিল। এখানে বেশকিছু এ্যামুনিশন ডাম্প ও ছিল। অবশ্য শত্রু সহজেই আত্মসমর্পন করেনি। যথেষ্ঠ হতাহতের পর কিছু আত্মসমর্পণ করে এবং কিছু এদিক ওদিক পালিয়ে যায়। আটগ্রামের শত্রুর হতাহতের সংখ্যা ছিল প্রায় ১০০ জন, এদের মধ্যে ৪জন অফিসার ছিলেন। যথেষ্ঠ গোলাবারুদ আমাদের হস্তগত হয়। এখানে শত্রু বেশকিছু গোলাবারুদ ফেলে যায় এবং হতাহতের সংখ্যা ছিল শত্রু পক্ষে ১০-১৫ জন এবং অস্ত্রসংবরণ করে ৭জন। চারগ্রামে অবশ্য শত্রু যথেষ্ঠ ছিল। কিন্তু আমাদের আক্রমণের আশংকা বুঝতে পেরে তারা পশ্চাদপসরণ করে এবং কোনরকম বাঁধা ছাড়াই আমরা চারগ্রাম দখল করি। এখানে অবশ্য হতাহতের সংখ্যা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়।

বালা দখল করার পর আমরা করিমগঞ্জের দিকে রওনা হই। করিমগঞ্জ ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহায্যে অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্ট দখল করতে সমর্থ হয়। অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার ছিলেন মেজর (বর্তমানে লেঃ কর্নেল) এ. জে. এম আমিনুল হক।

এরপর করিমগঞ্জ থেকে আমরা বৈয়ামপুর রওনা হই এবং বৈয়ামপুর আমাদের দখল নেয়ার পরিকল্পনা করি। কিন্তু বৈয়ামপুর যাবার পথে পাকসেনা আমাদের উপর এ্যামবুশ করে। ফলে আমাদের দু’জন যোদ্ধা শহীদ হন, দু’জন নিখোঁজ হন এবং ৬জন গুরুতরভাবে আহত হন। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট লিয়াকত গুরুতরভাবে আহত হন। তিনি আহত হবার পর আমি সি কোম্পানী ক্যাপ্টেন নূরকে হস্তান্তর করে ‘এ’কোম্পানী দায়িত্ব গ্রহণ করি। বৈয়ামপুর ছিল করিমগঞ্জ থেকে প্রায় ৩৫/৪০ মাইল দুরে। এ যুদ্ধে ক্যাপ্টেন মাহবুব আর্টিলারী শেলিং করেন। পাকসেনারাও আর্টিলারী শেলিং করা থেকে বিরত ছিল না। আর্টিলারী শেলিং বিনিময়ের এক পর্যায়ে ক্যাপ্টেন মাহবুব হঠাত চিৎকার করে ওঠেন। শেলিং এর টুকরা তার শরীরে আঘাত করে। অতঃপর ক্যাপ্টেন মাহবুবকে সরিয়ে নেয়া হয়। কিছুক্ষণ পর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এবং শহীদ হন। তার সিগনালারও শহীদ হন এবং রানার আহত হন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই তিনজন মুক্তিসেনার নাম অবিস্মরণীয় থাকবে যুগ যুগ ধরে, এই আশাই আমি রাখি। পরদিন সকালে ৩১তম রেজিমেন্ট আমাদের আক্রমণ করে। কিন্তু এ আক্রমণে তারা ব্যর্থ হয় এবং তিনজন অফিসার ও তিনজন সুবেদার নিহত হয়। ১২ জন পাঞ্জাবী আমাদের হাতে বন্দী হয়।

এর পরদিন সকালে আমরা বৈয়ামপুর থেকে শহীদপুরের দিকে যাত্রা করি এবং এখানেও যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করি। আমাদের নয়জন হতাহত হন। তারপর আমরা কচুয়া পর্যন্ত অগ্রসর হই এবং ডিফেন্স নিই। ই-পি-আর বাহিনী ইতিপূর্বেই কানাইঘাট দখল করেছিল। আমরা সেখানে গিয়ে উপস্থিত হই।

রণকৌশলের দিক থেকে বিচার করলে কোন দূরদর্শী সেনাবাহিনীই তার শত্রুকে পেছনে ফেলে রাখতে চায় না, কারন পিছনের আক্রমণকে প্রতিহত করা অনেক সময় কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। সে জন্যে আমরা শত্রুঘাটির মধ্য দিয়ে আডভান্স টু কন্টাকট শুরু করি। কানাইঘাট থেকে বিকাল ৫টার সময় আমরা সিলেট এম. সি. কলেজ অভিমুখে যাত্রা করি। কারন আমরা জানতাম এম. সি. কলেজকে পাকিস্তানি বাহিনী বিরাট একটা দুর্গে পরিণত করেছিল। সেই দুর্গকে অবরোধ করে দুখল করাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল। পরদিন বিকেল ৫টার সময় আমরা কেওয়াচরা চা বাগানে ডিফেন্স স্থাপন করি। রাত্রিবেলা পেট্রোল পার্টি পাঠানো হয়েছিল শত্রুর গতিবিধির খোঁজখবর নেয়ার জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ আমার পেট্রোল পার্টি শত্রুর এ্যামবুশে পড়ে এবং একজন নিখোঁজ হয়। শত্রুর অবস্থান সম্পর্কে খোঁজখবর পাওয়ার পর সকালবেলা আমি আমার কোম্পানীকে নিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছিলাম। কিন্তু শত্রু দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে কতক্ষণ ডিফেন্স থাকি। এই দুই ঘন্টার মধ্যেই অন্যান্য কোম্পানীও আমার বামদিকে গিয়ে অবস্থান নেয়। আমার কোম্পানীকে ফর্ম-আপ করে শত্রুর উপরে চার্জ করি। ফলে আমার একজন শহীদ এবং কয়েকজন আহত হন। শত্রু পিছু হটতে বাধ্য হয়। তাদের পক্ষেও যথেষ্ঠ হতাহত হয়। সেদিন সেখানেই অবস্থান করার পর সন্ধ্যার সময় আমরা এম.সি. কলেজ অভিমুখে যাত্রা করি। পরদিন সকাল চারটার সময় এম.সি. কলেজের টিলার উপরে এসে আমরা শত্রুর গতিবিধি লক্ষ্য করছিলাম। শত্রু কিন্তু আমাদের উপস্থিতি সম্বন্ধে একটুও সজাগ ছিল না। সুতরাং ডিফেন্সের ভিতর দিয়ে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করছিল। আমরা এক ফাক দিয়ে পজিশন নেয়ার বন্দোবস্ত করছিলাম কিন্তু যথেষ্ঠ পাঞ্জাবী সেনা একসঙ্গে দেখাতে নিজেকে আর দাবিয়ে রাখতে পারছিলাম না। তাই পজিশন না নিয়েই ছয়টা মেশিনগান দ্বারা তিন দিক থেকে ফায়ার শুরু করলাম। শত্রুর মাথায় যেন বজ্র ভেঙ্গে পড়ল। তারা পাগলের মত এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছিল। এর ভিতরেই বেশ কিছু পাঞ্জাবী সৈন্য নিহত হয়। কিছু সৈন্য হাত তুলে স্যালেন্ডার করে। আর্টিলারী রেজিমেন্ট তাদের অস্ত্র নিয়ে তাড়াহুড়া করে স্মল আর্মস রেঞ্জের বাইরে চলে যায়। শত্রুপক্ষে বেশ কিছু হতাহতের পর তারা আমাদের অবস্থান থেকে আরও একটু উঁচু টিলা দখল করে। তাদের সমস্ত শক্তি তারা টিলার উপর নিয়োগ করে। এরপর আমাদের ‘ডি’এবং ‘বি’কোম্পানির উপরে কয়েকটা মেশিনগান দিয়ে ফায়ার শুরু করে এবং তার সঙ্গে সঙ্গে আর্টিলারী ফায়ারও চলতে থাকে। পরে ‘বি’এবং ‘ডি’কোম্পানির যথেষ্ঠ ক্ষতি সাধিত হয়। তাদের একজন প্লাটুন কমান্ডার সুবেদার ফয়েজসহ বেশকিছু লোক নিহত হয়। যারা আহত হয়েছিল তাদেরকে আমরা পিছনে নিয়ে যাই। এভাবে আরও কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলার পর ‘বি’এবং ‘ডি’কোম্পানী একটু আড়ালে গিয়ে অবস্থান করে। তারপর আমার উপর ‘ডি’এবং ‘বি’কোম্পানির দায়িত্ব অর্পিত হয়। আমি শত্রুকে আর এক পা-ও সম্মুখে এগুতে দিইনি। কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর আমার দুইজন লোক আহত হয়।

১৫ ডিসেম্বর থেকে ১৭ই ডিসেম্বর এগারটা পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর যুদ্ধ চলতে থাকে এবং আর্টিলার সমর্থনে আমরা কিছুদুর এগুতে সমর্থ হউ। তারপরেই আসে আত্মসমর্পণের পালা। পাকবাহিনী তাদের সমস্ত হাতিয়ার আমাদের নিকট সমর্পণ করে।

পরিশেষে বলতে হয়, পৃথিবীর ইতিহাসে এমনি যুদ্ধ পরিচালনা করা বাঙ্গালী ছাড়া আর কারও পক্ষে সম্ভব হয়নি। যেখানে ছিল না বল, জন, অস্ত্রশস্ত্র সেখানে গড়ে ওঠে এক দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনী। এদের নেতৃত্বে পুরো জাতিই মুক্তিবাহিনীর রূপ ধারণ করে। বাঙ্গালী যে যেখানেই ছিল কিছু সংখ্যক লোক ছাড়া বাকী সবাই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সবশেষে আমি স্মরণ করি তাদেরকে, যারা মাতৃভূমির জন্যে নিজের শেষ রক্তটুকু বিলিয়ে দিয়েছেন। আমি স্মরণ করি তাদেরকে, যারা এই মুক্তিযুদ্ধের চরম দুঃসময়ে আমার সাথে ছিলেন এবং আমাকে প্রেরণা যুগিয়েছেম।

স্বাক্ষরঃ ক্যাপ্টেন এম, এ, কাইয়ুম চৌধুরী

৩০-১১-১৯৭৩

 

দীপংকর ঘোষ দ্বীপ

<১০, ২১., ৪৯৫৪৯৬>

সাক্ষাৎকারঃ মেজর বজলুল গনি পাটোয়ারী

….১৯৭৩

 

পাকিস্তানের ঝিলাম থেকে ১৯৭১-এর ২৫-২৬শে জুলাই শিয়ালকোট দিয়ে ভারতের পূর্ব পাঞ্জাব হয়ে কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে আমি পালিয়ে আসি। ভারতে পৌঁছানোর পর ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে আমাকে ও আমার সঙ্গী আমার সঙ্গীদের নয়াদিল্লী নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ১০ দিন জিজ্ঞাসাবাদ করার পর ৭ই আগস্ট মুজিব নগরে পৌঁছাই। ৮ তারিখে পোষ্টিং হয়ে মেঘলয় সেক্টর ১১-এর প্রথম বেঙ্গলের সহ-অধিনায়ক ও কোম্পানি কমান্ডার হিসাবে কাজে যোগ দিই। আমি ঐ বাহিনীর ‘ডি’কোম্পানির কমান্ডার ছিলাম-যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত।

আমার প্রথম অপারেশন হয় সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে কামালপুর (ময়মনসিংহ) বি-ও-পি’তে। ঐ যুদ্ধে পাক বাহিনীর আনুমানিক ৩০ জন নিহত ও ৩৩ জন আহত হয়। এ সংবাদ স্থানীয় জনগণ কর্তৃক পাওয়া যায়। আমাদের পক্ষের ২ জন শহীদ ও তিনজন আহত আহত হন। ঐ যুদ্ধে পাক বাহিনী থেকে একখানি রাইফেল ও প্রচুর এ্যামুনিশন উদ্ধার করা হয় এবং একজন শত্রুর লাশও উদ্ধার করা হয়। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে ব্যাটালিয়নকে মুভ করানো হয়  ৪ নং সেক্টরে (সিলেটের দিকে)। অক্টোবর মাসে ব্যাটালিয়ন বিভিন্ন স্থানে রেইড ও এ্যামবুশ করে, যেমন-চাবাগান, শ্রীমঙ্গল রেল ষ্টেশন, পাথরখোলা, রাজঘাট, খেজুরীচরা ইত্যাদি স্থানে। পাথরখোলাতে যুদ্ধ করার পর কিছু যুদ্ধবন্দীকে নিয়ে আসা হয় ও কিছু অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।

নভেম্বর মাসের ২য় সপ্তাহে সিলেটের জাকিগঞ্জ ও আটগ্রাম রাস্তার দিকে আমার বাহিনী অগ্রসর হতে থাকে। নভেম্বর মাসের ৩য় সপ্তাহে  সিলেটের কানাইঘাটের কাছে গৌরীপুরে এসে আমারা অপেক্ষা করি।কানাইঘাট ছিল পাক বাহিনীর ডিফেন্স। সেখানে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ১২৫ জন পাকসেনা নিহত ও ৬ জন বন্দী হয়। ৪ টি মেশিনগান, ১৫টিএল-এম-জি ও ৩৬/৩৭টি রাইফেল উদ্ধার করা হয়। ঐ যুদ্ধে পাকবাহিনীর মেজর সারওয়ারও (৩১ পাঞ্জাব ব্যাটালিয়ন) নিহত হয়।

আমার বাহিনী ডিসেম্বর মাসের ৯/১০ তারিখে সিলেট এম,সি,কলেজে উপস্থিত হয়। ঐ এলাকায় ৫ দিন যুদ্ধ হয়। আমাদের ১২/১৩ জন নিহত ও ৩৬ জন সৈন্য আহত হন এবং পাকবাহিনীর ২০০-এর মত নিহত হয়। ১৭ই ডিসেম্বর সিলেট জেলায় পাক বাহিনী যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।

 

 

দীপংকর ঘোষ দ্বীপ

<১০, ২১.৬, ৪৯৬-৪৯৮>

 

সাক্ষাৎকারঃ মেজর মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন

 

১০ই জুন ‘জেড’ফোর্সে যোগদানের জন্য ৩য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের এডভান্স পার্টি হিসাবে ৪ জন জে-সি-ও ও ১১৯ জন জোয়ান নিয়ে হিলি থেকে তেলঢালার উদ্দেশ্যে রওনা হই। ১৪ই জুন তেলঢালায় পৌঁছে। তেলঢালায় ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ৩য় বেঙ্গল ও ৮ম বেঙ্গলের অফিসার ও জোয়ানদের একত্রিত করে যুদ্ধের জন্য পুনর্গঠন করা হয়। ছাত্র-যুবকদেরকেও সৈনিক হিসাবে ভর্তি করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ২৮শে জুলাই পর্যন্ত পূর্ণোদ্যমে প্রশিক্ষণ চলে। ৩য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন তৎকালীন মেজর (বর্তমান কর্নেল) শাফায়াত জামিল সাহেব। আরও ছিলাম ‘জেড’ফোর্সের ‘এ’কোম্পানী কমান্ডার আমি ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন, ‘বি’কোম্পানী মেজর আকবর, ‘সি’কোম্পানী কমান্ডার মেজর মহসীন, ‘ডি’কোম্পানী কমান্ডার লেঃ নূরুননবী।

‘জেড’ফোর্সের প্রথম অপারেশন হিসাবে ৩য় বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ময়মনসিংহ জেলার বাহাদুরাবাদ ঘাট, দেওয়ানগঞ্জ বাজার ও দেওয়ানগঞ্জ চিনির কলের পাক-বাহিনীর ঘাঁটির উপর আক্রমণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

২৯শে জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় অধিনায়ক শাফায়াত জামিল এবং আমরা ‘এ’ও ‘ডি’কোম্পানী বাহাদুরাবাদ ঘাটের উদ্দেশে রওয়ানা হই। সারা রাত ৩০ মাইল পায়ে হেটে বাহাদুরাবাদ ঘাটের অনতিদূরে ব্রহ্মপুত্র নদের অপর পাড়ে চরে পৌঁছি। সারাদিন জোয়ানগণ বিশ্রাম নেয়। বিকালে অধিনায়ক ও আমরা দুই কোম্পানী কমান্ডার এলাকা রেকি করি।

৩১শে জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ২ কোম্পানী বাহাদুরাবাদ ঘাটের উদ্দেশে রওনা হয়। রাত্রি সাড়ে এগারটায় ব্রহ্মপুত্র নদ পার হয়ে বাহাদুরাবাদ ঘাটে পৌঁছি। রাত্রি ১২টার সময় আমরা ২ কোম্পানী অতর্কিতভাবে পাক ডিফেন্সের উপর আক্রমণ করি। পাকবাহিনীর সহিত ১ ঘণ্টা গুলি বিনিময় হয়। পরে পাকবাহিনীদের গোলাবারুদ বোঝাই একটি বার্জ ডুবে যায় এবং পাকবাহিনীর ১০০ সৈন্যের মত হতাহত হয়। সেখানে আমরা ৩” মর্টার, রকেট লাঞ্চার ও মেশিনগান ব্যবহার করি। রাত্রি ভোর হওয়ার আগেই পুনরায় ব্রহ্মপুত্র নদ পার হয়ে ২ মাইল ভিতরে অপর এক চরে আমরা সকলে আত্মগোপন করি।

১লা আগস্ট পাকবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার সারাদিন আমাদের খুঁজে বেড়ায় কিন্তু আমরা খুব সতর্ক থাকায় আমাদের সন্ধান পায়নি। তারপর আমরা দেওয়ানগঞ্জ অপারেশনের জন্য প্রস্তুত হই।

২রা আগস্ট সন্ধ্যার সময় ৬টা নৌকাযোগে দেওয়ানগঞ্জ বাজার ও চিনি কলের দিকে রওনা হই। পথে বাহাদুরাবাদ ঘাট ও দেওয়ানগঞ্জের মাঝখানে একটি রেলওয়ে ব্রীজ লেঃ নুরন্নবী উড়িয়ে দেন, যাতে পাকবাহিনী বাহাদুরবাদ সহজে আসতে না পারে। গভীর রাতে দেওয়ানগঞ্জের অনতিদূরে গিয়ে আমরা ‘এ’কোম্পানি নিয়ে দেওয়ানগঞ্জের সুগার মিলে পাক ডিফেন্সের দিকে অগ্রসর হই। লেঃ নুরন্নবী দেওয়ানগঞ্জ বাজারের দিকে চলে যান। রাত্রি পোনে চারটায় একই সময়ে নিজ নিজ টারগেটের উপর আক্রমণ চালাই। ৪৫ মিনিট এই হামলা চলে। আমাদের আক্রমণে  দেওয়ানগঞ্জ সুগার মিল ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বহু পাকসেনা হতাহত হয়। দেওয়ানগঞ্জ বাজারে রাজাকার প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ও রেলওয়ে ষ্টেশনের বহু ক্ষতি সাধিত হয়। সেই সময় সেখান থেকে নৌকাযোগে আমরা অপর চরে আত্মগোপন করি। আমাদের এই দুটি আক্রমণে ঐ এলাকার স্থানীয় জনগণ ও স্থানীয় এফ-এফ কমান্ডার আমাদের সর্বপ্রকার সাহায্য করেন।

২রা আগস্ট আমরা তেলঢালার উদ্দেশ্যে রওনা হই। ৫ই আগস্ট আমরা তেলঢালায় এসে পৌঁছি।

৮ই আগস্ট আমার ‘এ’কোম্পানী নিয়ে রৌমারী থানাকে আমাদের দখলে রাখার উদ্দেশ্যে কীর্তিমারী চরে ডিফেন্স নিই, পরে কোদালকাটির চর, পীরের চর ও চর সাজাইতে আমার বিভিন্ন প্লাটুনকে ডিফেন্সে লাগাই। উক্ত চরে ১৫ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডিফেন্সে থাকি। এই পাঁচ সপ্তাহে পাকবাহিনী কয়েকবার নদীপথে হামলা চালায়, কিন্তু প্রতিবারই আমাদের হাতে আক্রান্ত হয়ে পিছনে হটে যায়। এখানে পাক বাহিনীর অনেক সৈন্য আহত হয়। আমাদের পক্ষের পনের জন জোয়ান আহত হয়। এই পাঁচ সপ্তাহে আমরা চীলমারী থানার কয়েকটি গেরিলা অপারেশন করি।

১৬ই সেপ্টেম্বর প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের লেঃ কাইয়ুম তার কোম্পানী নিয়ে আমাদের নিকট থেকে দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। আমি আমার কোম্পানী নিয়ে তেলঢালায় ফিরে আসি। ৪ঠা অক্টোবর পর্যন্ত তেলঢালার আশেপাশে কয়েকটি ছোট ছোট অপারেশন করি।

৬ই অক্টোবর ‘জেড’ফোর্স তেলঢালা ছেড়ে দিয়ে তৎকালীন ৪ ও ৫ সেক্টরের দিকে সেক্টর কমান্ডার লেঃ কর্নেল মীর শওকত আলী ছাতক আক্রমণের জন্য আমাদের কোম্পানী কমান্ডারদের নিয়ে আলোচনায় বসেন। ১০ তারিখ সকালে উক্ত এলাকা রেকি করা হয়। ১১ তারিখ রাত্রে ছাতকের সন্নিকটে মহড়াটিলা নামক জায়গা দখল করে ফেলি। আমার বাম পার্শ্বে মেজর আকবর তার কোম্পানী নিয়ে জয়নগর টিলাতে ডিফেন্স নেন। ১২ তারিখ সকালে পাক বাহিনী আমাদের গতিবিধি দেখতে পায় এবং সেখানে পাক বাহিনীর সাথে আমাদের সঃঘর্ষ হয়। আমরা সেখানে সর্বাধুনিক হাতিয়ার ব্যবহার করি। এই যুদ্ধে পাকবাহিনীর ২ জন অফিসার নিহত হয় ও একজন কর্নেল আহত হয়। তাছাড়া বহু পাকসেনা হতাহত হয়। ঐ দিন রাত্রিতে আমরা সেখানেই থেকে যাই।

১৩ তারিখ রাত্রি ৯ ঘটিকার সময় সুরমা নদীর পাড়ে নড়াই গ্রাম ও সিমেন্ট কারখানার উপর আক্রমণ করি। আমাদের আক্রমণে পাকবাহিনী পিছু হটে যায়। আমরা নড়াই গ্রাম ও সিমেন্ট কারখানা দখল করে ফেলি এবং রাত্রেই সেখানে ডিফেন্স করি।

১৪ তারিখ সকালে পাক বাহিনীর একটি লঞ্চ ছাতক আসার পথে রকেট লাঞ্চারের সাহায্যে সেটিকে ডুবিয়ে দিই। সেখানে ৯ জন খান সেনা নিহত হয় এবং রাজাকার ইসাহাকসহ ৯ জন আমাদের হাতে ধরা পড়ে। এখানে ১৪টি রাইফেল উদ্ধার করি। সারা দিন তাদের সাথে আমাদের যুদ্ধ চলে। আমাদের ৩ জন আহত হয়।

১৫ তারিখ আমরা ছাতক ঘিরে ফেলি। সেই দিন পাকবাহিনীর একটি গানবোট নদী পার হবার চেষ্টা করলে  রকেট লাঞ্চারের সাহায্যে ডুবিয়ে দিই। সেখানে ৩ জন খান সেনা নিহত হয়।

১৬ই অক্টোবর দুপুরের দিকে আমাদের ডিফেন্স পাক বাহিনী ভীষণ শেলিং করে এবং সন্ধ্যার দিকে ‘বি’কোম্পানীর পজিশনে হামলা করে ও তাদের জয়নগর টিলা দখল করে নেয়। এই দিন বিকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত আমার জন্য সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্তজনক সময় ছিল। কারণ অয়্যারলেস সেট নষ্ট ছিল। সন্ধ্যায় প্রথমে শুনতে পাই ‘পাক ফৌজ জিন্দাবাদ’ও পরে শুনতে পাই ‘মুক্তি ফৌজ জিন্দাবাদ’। এ নিয়ে সন্দেহে পড়ে যাই। তখন সঠিক সংবাদের জন্য ২ জনকে পাঠাই কিন্তু তারা আর ফিরে আসেনি। শেষে রাত্রি সাড়ে ন’টার সময় মেজর আকবর আমার সিমেন্ট কারখানায় এসে সঠিক খবর দেন। জয়নগর টিলা পাকবাহিনী দখল করে নেবার পর বাধ্য হয়ে রাত্রি ১০টায় আমার কোম্পানী ও ‘বি’কোম্পানী নিয়ে সমস্ত রাত্রি বিলের মাঝ দিয়ে পানিতে হেঁটে টিলাগাও আসি। সেই সময় পাক বাহিনীর উপর হামলার প্রস্তুতি নেই। কিন্তু সেই সময় সেখানে পাক বাহিনী ছিল না। পরে বলুয়া হয়ে বাঁশতলা ক্যাম্পে পৌঁছি। এই ৫ দিনের যুদ্ধে আমাদের ব্যাটালিয়নের হাতে পাক বাহিনীর প্রায় ৪০০ মত হতাহত হয়। আমাদের ৭ জন শহীদ ও বেশকিছুসংখ্যক আহত হয়।

ছাতক অপারেশনের পর ৩ নং ব্যাটালিয়ন নিয়ে সিলেটের বিমান বন্দর আক্রমণ করার জন্য তামাবিল সীমান্তে ডিফেন্স নেই। সেখানে বেশ কয়েকটি অপারেশনের পর আমার কোম্পানী গোয়াইনঘাট থানা মুক্ত করে। ডিসেম্বর মাসের ৯ তারিখে আমার কোম্পানী নিয়ে সালুকটির বিমান বন্দরের অনতিদূরে পৌঁছে যাই। তখন আমাদের সাথে ভারতীয় আসাম রেজিমেন্টের একটি কোম্পানী  ছিল। সালুকটির নদী এলাকা পর্যন্ত মুক্ত হওয়ার পর ১০ই ডিসেম্বর আমাকে ও আসাম রেজিমেন্টের উক্ত কোম্পানীকে মীর শওকত ছাতক ডেকে পাঠান আমাদের ব্যাটালিয়নরে ‘বি’ও ‘সি’সাহায্য করার জন্য। ১১ তারিখে সুনামগঞ্জ-ছাতক রোড জংশনে আমাদের উক্ত দুই কোম্পানীর সাথে একত্রিত হই এবং সম্মিলিতভাবে পাক বাহিনীর উপর তীব্র আক্রমণ চালাই। পাকবাহিনী আমাদের হাতে মার খেয়ে সিলেট অভিমুখে রওনা হয়। ১৬ই ডিসেম্বর আমরা মালাগাছ ফেরির পশ্চিম পাড়ে ডিফেন্স লাগাই। সেদিন পাকবাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করে। আমরা আমাদের ব্যাটালিয়নসহ সিলেটে পাক্কা ডিফেন্স করি।

স্বাক্ষরঃ মোঃ আনোয়ার হোসেন/মেজর

কুমিল্লা সেনানিবাস

 

 

রানা আমজাদ

<১০, ২১.৭, ৪৯৮-৫০৪>

 

সাক্ষাৎকারঃ ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দিন আহমদ

২৮১৯৭৩

 

মে মাসের প্রথম সপ্তাহে কর্নেল (বর্ত্মানে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল, জাতীয় সংসদ সদস্য, বিমান ও নৌবাহিনীর মন্ত্রী) এম এ জি ওসমানী বেনাপোল পরিদর্শন করতে আসেন। তিনি বেনাপোল পৌঁছে আমার সঙ্গে আলোচনা করেন এবং আমার ব্যাটালিয়ন পুনর্গঠিত করার কথা বলেন এবং ৬০০ জন তরুণ মুক্তিযোদ্ধাকে  বাছাই করে নিতে বলেন। তাঁর নির্দেশমত আমি বাংলাদেশের বিভিন্ন যুব শিবির থেকে প্রায় ৬০০ জন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা ও ই-পি-আর বাছাই করে আমার ব্যাটালিয়নে নিয়ে নিই। উক্ত ই-পি-আর এবং তরুণদের বাছাই করার পর কর্নেল ওসমানী আমাকে মেঘালয় প্রদেশের তেলঢালা নামক জায়গায় যেতে বলেন। আমি পুরা ব্যাটালিয়ন নিয়ে তেলঢালা চলে যাই। তেলঢালায় ১ম, ৩য় এবং ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের একত্রিত করা হয় এবং একটা ব্রিগেড গঠন করা হয়। ব্রিগেডের নাম ছিল ‘জেড ফোর্স’। উক্ত ব্রিগেড ফোর্সের কমান্ডার হন মেজর জিয়াউর রহমান। এখানে ব্যাটালিয়নের নতুন রিক্রুট করা সৈন্যদেরও ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা হয়।

১৩ই জুলাই মেজর (বর্তমানে লেঃ কঃ) মঈনুল হোসেন চৌধুরী আমার ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার নিযুক্ত হন এবং আমার নিকট থেকে ব্যাটালিয়নের দায়িত্ব গ্রহন করেন। তাছাড়া আরো কয়েকজন অফিসারকে ব্যাটালিয়ন অফিসার নিযুক্ত করেন- তারা হলেন যথাক্রমে ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান, লেফটেন্যান্ট (বর্তমানে ক্যাপ্টেন) আব্দুল মান্নান,  লেফটেন্যান্ট (বর্তমানে ক্যাপ্টেন) আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন আমাদের ব্যাটালিয়ন এ যোগদান করেন।

কামালপুর যুদ্ধঃ মোটামুটি  ট্রেনিং এর পর প্রথম অপারেশনের পরিকল্পনা করা হয়। ময়মনসিংহ জেলার কামালপুরে তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি ছিল। এই ঘাঁটিকে আঘাত করার পরিকল্পনা আমরা প্রথম নিই। কামালপুর এলাকার চতুর্দিক দিয়ে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে আমরা প্রথম ‘রেকি’করি।

২৮ জুলাই গভীর রাতে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মোমতাজ, লেফটেন্যান্ট মান্নান, নায়েক সুবেদার আব্দুলহাইসহ আরও দু’জন সৈন্য ‘রেকি’করতে করতে কামালপুর শত্রুঘাঁটির ভিতর ঢুকে একটা বাঙ্কার এর মধ্যে উঁকি মারে। এমন সময় পাকিস্তানী দুজন সৈন্য অন্যদিক থেকে বাঙ্কারের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন তাদের দেখে ফেলেন এবং তৎক্ষনাৎ তাদেরকে “হ্যান্ডস আপ” করতে বলেন। দু’জনের একজন “হ্যান্ডস আপ” করে। অপরজন না করাতে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন লাফ দিয়ে উক্ত পাকিস্তানী সৈন্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং দু’জনের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তির পর যখন তারা বুঝতে পারে যে, তারা মুক্তিযোদ্ধার দ্বারা ঘেরাও তখন তারা পালানোর চেষ্টা করলে সুবেদার হাই তাদের উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়েন এবং হত্যা করে রাইফেল দুটি নিয়ে নিয়ে নেন। পরে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন সহ সবাই ঘাঁটিতে ফিরে আসেন। এ ঘটনায় আমাদের সৈন্যদের মনোবল অত্যন্ত বেড়ে যায়। নায়েক সুবেদার আব্দুল হাইকে এজন্য বাংলাদেশ সরকার “বীর প্রতীক” উপাধীতে ভূষিত করেন।

৩১শে জুলাই ভোর সাড়ে তিনটার সময় দুই কোম্পানী সৈন্য (‘বি’কোম্পানী, যার কমান্ডার ছিলাম আমি নিজে এবং ‘ডি’কোম্পানী যার কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মোমতাজ ) নিয়ে কামালপুর বর্ডার আউট পোস্ট আক্রমণ করি। আমরা একটা ফিল্ড ব্যাটারির সাহায্য নিই। ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে ‘এ’কোম্পানীকে পাঠানো হয় উঠানীপাড়াতে (কামালপুর হতে ২ মাইল দক্ষিণে)। ‘এ’কোম্পানীকে পাঠানোর উদ্দেশ্য ছিল তারা ‘কাট অফ’পার্টিতে যেন যোগ দিতে পারে। এফ-ইউ-পি’তে যোগ দিতে পারে এফ-ইউ-পি’তে পৌঁছার পরই আর্টিলারী ব্যবহার করার কথা ছিল। কিন্তু এফ-ইউ-পি তে পৌঁছার পুর্বেই আমাদের পক্ষ থেকে আর্টিলারী গোলাগুলি শুরু হওয়ায় আমাদের সৈন্যরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে।  এ সময় শত্রু পক্ষও আর্টিলারী ও ভারী মর্টারের সাহায্যে গোলাগুলি শুরু করে। তা সত্ত্বেও আমি এবং সালাহউদ্দিন আমাদের কোম্পানীদ্বয়কে একত্রীত করে শত্রুদের আক্রমণ করি এবং সম্মুখ দিকে অগ্রসর হই। দু’দিকেই আর্টিলারী ব্যবহার হওয়া স্তত্বেও আমরা ‘জয় বাংলা’ধ্বনি দিতে দিতে শত্রুর দিকে অগ্রসর হই। আমরা কাঁটাতার এবং মাইনফিল্ড অতিক্রম করে অগ্রসর হই এবং গোলাগুলি চলাকালীন সময়ের মধ্যেই শত্রুপক্ষের অর্ধেক জায়গা দখল করে নেই। ফলে শত্রুরা পিছনের দিকে হটে যায় এবং তাদের পূর্বস্থানে আর্টিলারী ও মর্টারের গোলাবর্ষন করতে থাকে। এ সময় ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন যিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও সাহসিকতার সাথে ‘ডি’কোম্পানীকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, শত্রুর গুলিতে শহীদ হন। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি তাঁর সৈনিকদের উৎসাহ ও সাহস দিতে থাকেন এবং বার বার শত্রুপক্ষকে নির্মূল করার আকুল আহ্বান জানান। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তাঁর মত দৃঢ় মনোবলসম্পন্ন সৎসাহসী বীর ও আত্মত্যাগী যোদ্ধার নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে। যে কোন দেশের যে কোন জাতি গর্ববোধ করতে পারে তাঁর মত বীর যোদ্ধার বীরত্বের জন্য। একটু পরে আমি নিজেও শত্রুর মর্টারের গুলির আঘাতে আহত হই এবং আমাকে পেছনে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার শরীরের পাঁচ জায়গায় মর্টারের গুলির টুকরো বিদ্ধ হয়। উভয় কোম্পানীতে কোন অফিসার ও অফিসার কমান্ডিং না থাকায় এবং ইতিমধ্যে যথেষ্ট সৈন্য হতাহত হওয়ায় আমাদের সৈন্যদের মনোবল সাময়িকভাবে ভেঙ্গে পড়ে। ফলে তারা পিছিয়ে আসে। এই আক্রমণ এবং যুদ্ধে আমাদের পক্ষে একজন অফিসারসহ ৩১ জন যোদ্ধা শহীদ হন এবং দুইজন জুনিয়র কমিশন অফিসারসহ ৬৫ জন আহত হন। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায় যে, শত্রুপক্ষের প্রায় ৫০ জন নিহত ও ৬০ জন আহত হয়। এই আক্রমণ যদিও পুরোপুরি সফলকাম হয়নি তবুও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটা একটা স্মরনীয় আক্রমণ ছিল। এই যুদ্ধে এটা প্রমাণ হয় যে, বাঙ্গালী সৈন্যরা সম্মুখসমরে যথেষ্ট দক্ষতার অধিকারী এবং সাহসী। এ যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সৈন্যদের দ্বারা কাঁটাতারের ঘেরা এবং মাইন বসানোকে উপেক্ষা করে আমাদের যোদ্ধারা যেভাবে অসীম সাহসিকতার সাথে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হন তা থেকেই প্রমানীত হয় যে, স্বল্পকালীন সাময়িক ট্রেনিং নেওয়া যুবকরাও অসীম বীরত্বের অধিকারী। এ যুদ্ধে অসীম সাহস ও বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করায় নিম্নলিখিত কয়েকজনকে বাংলাদেশ সরকার বীরত্বের পুরস্কার দেনঃ (১) শহীদ ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ (বীর উত্তম), (২) ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমদ (বীর বিক্রম) (৩) লেফটেন্যান্ট আব্দুল মান্নান (বীর বিক্রম), (৪) সিপাই আবদুল আজিজ (বীর বিক্রম) (৫) সিপাই গোলাম মোস্তফা কামাল (বীর বিক্রম) (৬) নায়েক সুবেদার আঃ হাই (বীর প্রতিক) (৭) নায়েক  শফিকুর রহমান (বীর প্রতিক) (৮) শহীদ ল্যান্সনায়েক সিরাজুল ইসলাম (বীর প্রতিক), (৯) ল্যান্সনায়েক রবিউল্লাহ (বীর প্রতিক) (১০) ল্যান্সনায়েক তাজুল ইসলাম (বীর প্রতিক) (১১) সিপাই তারিকুল ইসলাম (বীর প্রতিক) (১২) সিপাই শফিউদ্দিন (বীর প্রতিক) (১৩) সিপাই সাইদুর রহমান (বীর প্রতিক)।

কিছুদিন পরই মেজর (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত লেঃ কঃ) মোঃ জিয়াউদ্দিন এবং ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) বজলুল গনি পাটওয়ারী পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে আমাদের ব্যাটালিয়নে যোগদান করেন। মেজর জিয়াউদ্দিনকে ব্যাটালিয়ন কমান্ডিং অফিসার নিযুক্ত করা হয়। ৮ই সেপ্টেম্বর ‘ডি’কোম্পানী ক্যাপ্টেন পাটওয়ারীর নেতৃত্বে কামালপুরের ১ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত ঘাসিপুর গ্রামে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে।

 ১০ই সেপ্টেম্বর শত্রুপক্ষকে দুই কোম্পানী সৈন্য মর্টার নিয়ে ঘাষিপুর আক্রমণ করে। ‘ডি’কোম্পানী অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে এ আক্রমণ প্রতিরোধ করে ও তাদের আক্রমণকে ব্যররথ করে দেয়। শত্রুপক্ষের প্রায় ৪০ জন সৈন্য নিহত হয়। আমাদের পক্ষে তিনজন শহীদ এবং ৮ জন আহত হন। নায়েক সুবেদার মোজাম্মেল হক এবং ল্যান্স নায়েক ইউসুফ আলী পূর্বেও কয়েকটি যুদ্ধে বিরত্বের পরিচয় দেন। বাংলাদেশ সরকার তার বীরত্বের জন্য “বীর প্রতীক” উপাধি প্রদান করেন। এর দুইদিন পর আরো দুইজন অফিসার আমাদের ব্যাটালিয়নে যোগদান করেন, তারা হলেন ফ্লাইং অফিসার আলী খান এবং ডাঃ (বর্তমানে লেফটেন্যান্ট) মজিবর রহমান ফকির। লিয়াকত আলী খানকে ব্যাটালিয়নের এ্যাডজুটেন্ট নিযুক্ত করা হয়।

কোদালকাটির যুদ্ধ

 

১৬ই সেপ্টেম্বর ‘সি’কম্পানীর একটি প্লাটুন লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম চৌধুরীর নেতৃত্বে রৌমারীর চর কোদালকাটিতে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেয়। ২১ শে সেপ্টেম্বর শত্রুর দুই কোম্পানী সৈন্য মর্টারের সাহায্যে চরকোদাল আক্রমণ করে। আমাদের সৈন্যরা অত্যন্ত দক্ষতা ও সাহসিকতার সহিত তাদের আক্রমণকে ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হয়। এ যুদ্ধে শত্রুপক্ষের প্রায় ৩৫ জন সৈন্য নিহত হয়। আমাদের পক্ষে ৫ জন নিহত হয়।  ২৪ সেপ্টেম্বর সকালবেলা শত্রুপক্ষ পূনরায় ১ ব্যাটালিয়ন সৈন্য নিয়ে কোদালকাটি আক্রমণ করে। এবারে তুমুল যুদ্ধ হয় এবং আমাদের সৈন্যরা এবারেও তাদের আক্রমণকে ব্যর্থ করে দেয়। যুদ্ধে শত্রুপক্ষের প্রায় ৭০ জন নিহত হয়। আমাদের পক্ষে ১৫ জন আহত হয়। কোদালকাটির এ যুদ্ধে নায়েক সুবেদার আবুল হাশেম, হাওলাদার মকবুল হোসেন, ল্যান্স নায়েক আতাউর রহমান, ল্যান্স নায়েক আব্দুল হক প্রমুখ সৈন্যগণ অপূর্ব বীরত্ব প্রদর্শন করেন। এ যুদ্ধে নিম্নলিখিত সৈন্যগণ সাহসিকতার পদকপ্রাপ্ত হনঃ (১) ল্যান্সনায়েক আবদুল হক (বীর বিক্রম) এবং (২) হাবিলদার মকবুল হোসেন (বীর প্রতিক)।

কোদালকাটির যুদ্ধে পাকিস্তানী ৭০ জন সৈন্য নিহত হওয়ায় এবং আমাদের নিকট পরাজিত হওয়ায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সৈন্যদের মনোবল অত্যন্ত ভেঙ্গে পড়ে। ফলে কোদালকাটি ও রৌমারী এলাকা সর্বসময় মুক্ত থাকে এবং সেখানে বাংলাদেশের পতাকা উড়তে থাকে।

সিলেটের চা বাগানসমূহ ও অন্যান্য এলাকায় যুদ্ধঃ অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে আমাদের ব্যাটালিয়নকে সিলেট সীমান্তে যাওয়ার জন্য আদেশ করা হয়। আমরা উক্ত আদেশ পাবার পর কোদালকাটি এবং রৌমারী ত্যাগ করে সিলেট সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় চলে যাই। সিলেট বিভিন্ন চা বাগানে পাকিস্তানী সৈন্যরা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে থাকত। পাকিস্তান সরকারের উপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টির জন্য আমাদেরকে সিলেটের চা ফ্যাক্টরীগুলো সাময়িকভাবে নষ্ট করার আদেশ করা হয়। অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে আমাদের ‘এ’এবং ‘সি’কোম্পানী শত্রুর ঘাঁটির মাঝখান দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে ধালাই এবং খাজুরী চা ফ্যাক্টরীর উপর ‘রেইড’করে এবং ফ্যাক্টরীগুলোকে সামায়িকভাবে অচল করে দেয়।

১৯শে  অক্টোবর আমি ‘বি’কোম্পানী নিয়ে চম্পারায় চা ফ্যাক্টরীর উপর ‘রেইড’করি এবং সেটা নষ্ট করে দিই। এই রকম রেইডের সাফল্যে পাকিস্তানী সৈন্যদের মনোবল কিছুটা ভেঙ্গে পড়ে এবং বাঙ্গালী জনসাধারনের মনে অনেক আশা ও উদ্দীপনার সঞ্চার হয় এ সমস্ত রেইডের সময় ডাঃ মজিবর রহমান অত্যন্ত সাহসের সাথে আমাদের আহত সৈন্যদের চিকিৎসা করেন এবং আমাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকেন। এ সময় সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আনিসুর রহমান ও সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ওয়াকার হাসান নতুন কমিশনপ্রাপ্তির পর আমাদের ব্যাটালিয়নে যোগদান করেন।

২৮শে  অক্টোবর সকালে আমি ‘বি’কোম্পানীকে  নিয়ে পাত্রখোলা চা ফ্যাক্টরীর পাকিস্তানী ঘাঁটিতে আর্টিলারীর সাহায্য নিয়ে আ্ক্রমন করি এবং ঘাঁটিটি দখল করতে সক্ষম হই। একই দিনে লেফটেন্যান্ট কাইয়ুমের নেতৃত্ব ‘সি’কোম্পানী ধালাই শত্রুঘাঁটির উপর রেইড করে এবং শত্রু পক্ষের বহু সৈন্যকে হতাহত করে। সিপাই হামিদুর রহমান এ রেইডে অভূতপুর্ব সাহসের পরিচয় দেন এবং নিজে গুরুতর ভাবে আহত হওয়া সত্বেও তার এল এম জির সাহায্যে একাই ২০ জন সৈন্যকে নিহত করে এ যুদ্ধে অসীম সাহসীকতার পরিচয় দিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে শহীদ হন। বাংলাদেশ সরকার তার এ অসীম সাহসীকতার পুরস্কারস্বরুপ সর্বোচ্চ পুরস্কার “বীরশ্রেষ্ঠ” খেতাব দিয়ে তার শহীদী আত্মার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন। তাঁর নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে বলে আমরা আশা  রাখি।

ধালাই থেকে শত্রুরা পাত্রখোলার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ক্যাপ্টেন মাহবুব মাত্র চারজন সৈন্য সাথে নিয়ে ধালাই এবং পাত্রখোলার বড় সড়কের মাঝামাঝি স্থানে এ্যামবুশ করেন। পাকিস্থানী সৈন্যরা তাঁর ফাঁদে পা দিলে তিনি শত্রুপক্ষের প্রায় ২০ জন সৈন্যকে নিহত করেন এবং দুইজনকে জীবিত অবস্থায় বন্দী করেন। ঐ দিনই ক্যাপ্টেন পাটওয়ারীর নেতৃত্বে ‘ডি’কোম্পানী পাত্রখোলা ফ্যাক্টরীর দুই মাইল দক্ষিণে কাট-অফ পার্টি হিসাবে অবস্থান নেয়। শত্রুর দুই কোম্পানী পাত্রখোলার দিকে অগ্রসর হতে থাকলে ‘ডি’কোম্পানী তাদেরকে প্রবলভাবে বাধা দেয়। শত্রু তখন ‘ডি’কোম্পানীর অবস্থানের উপর আক্রমণ চালায় কিন্তু ডি’কোম্পানী তাদের আক্রমণকে ব্যর্থ করে দেয়। শত্রুপক্ষের একজন ক্যাপ্টেনসহ প্রায় ৩০ জন নিহত হয়। আমাদের পক্ষে ৬ জন সৈন্য শহীদ হন।

১লা নভেম্বরঃ এই দিন মিত্র বাহিনীর দুই ব্যাটালিয়নসহ আমাদের ব্যাটালিয়ন মিলে ধালাই বি. ও পি. এবং ফ্যাক্টরী এলাকা যা শত্রুর সুদৃঢ় ঘাঁটি ছিল তার উপর প্রচন্ড আক্রমণ চালায়। দুই দিন ধরে অনবরত প্রচন্ড যুদ্ধের পর শত্রুদের ঘাঁটি দখল করে। এ যুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনীর ৩০তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের প্রায় দুই কোম্পানী  সৈন্য (প্রায় ২০০ সৈন্য) নিহত ও আর বহু আহত হয়।

নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সিলেটের চারগ্রাম ও আটগ্রাম এলাকার শত্রুঘাঁটির উপরে কড়া রকমের একটি আক্রমণের পরিকল্পনা করি। এজন্য আমরা সব কমান্ডিং এবং কোম্পানী কমান্ডারগণ এ এলাকা ভালভাবে রেকি করি। ২২শে নভেম্বর সকালে আমি ‘বি’কোম্পানী  নিয়ে আর্টিলারীর সাহায্য চারগ্রাম শত্রু ঘাঁটি আক্রমণ করি। সারাদিন প্রচন্ড যুদ্ধের পর আমরা উক্ত ঘাঁটি দখল করে নেই। শত্রুপক্ষের প্রায় ৩০ জন হতাহত হয় এবং কয়েকজনকে আমরা জীবিত অবস্থায় বন্দী করি। এ ঘাঁটি থেকে আমরা প্রচুর পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাগুলি, খাদ্যদ্রব্য এবং অন্যান্য  যুদ্ধের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দখল করি। এ আক্রমণে সাফল্য লাফ করাতে আমদের সৈন্যদলের মনোবল অনেক গুনে বেড়ে যায়। এ যুদ্ধে ‘বি’কোম্পানী অত্যন্ত সাহস এবং রণকৌশল প্রদর্শন করে। একই দিনে ‘সি’কোম্পানী ক্যাপ্টেন নূরের নেতৃত্বে আটগ্রাম ব্রীজ আক্রমণ করে। এবং দখল করে নেয়। এ স্থানে আমরা প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র,ও গোলাগুলি দখল করতে সক্ষম হই। এইভাবে আমরা   চারগ্রাম ও আটগ্রাম এলাকাকে সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত করি। এযুদ্ধে বীরত্বের পরিচয়স্বরুপ নিম্নলিখিত সৈন্যগণকে সাহসীকতার পুরস্কার ভূষিত করা হয়। যথাক্রমে তারা হলেনঃ (১) ক্যাপ্টেন নূর চৌধুরী (বীর বিক্রম), (২) নায়েক সুবেদার আবুল হাসেম (বীরবিক্রম), (৩) নায়েক সুবেদার মোঃ ইব্রাহিম (বীরবিক্রম)। পাকিস্থানী সৈন্যরা প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে সিলেটের দিকে পশ্চাৎপদসরন করে। আমরা জিয়াউদ্দিনের সুযোগ্য নেতৃত্বে পাকিস্থানী সৈন্যদের অনুসরন করি। শত্রুরা পলায়নের সময় বেশ কয়েকটি পুল উড়িয়ে দেয় এবং রাস্তাঘাটে মাইন পুঁতে রাখে। মাইন পোঁতা রাস্তা পরিষ্কার করতে করতে তাদের পশ্চাৎ যেতে থাকি এবং গৌরিপুর এলাকায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই।

২৮শে নভেম্বরঃ এদিন ভোরে পাকিস্তানী ৩১ তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট আমাদের ‘এ’ কোম্পানীর পজিশনের উপর আক্রমণ করে। ‘এ’ কোম্পানী অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে তাদের আক্রমণ ব্যর্থ করে দেয়। এ যুদ্ধে শত্রুপক্ষের প্রায় ১০০ জন সৈন্য নিহত হয়। একজন মেজর (মেজর সারোয়ার) এবং একজন ক্যাপ্টেনও নিহত হয়। আমাদের পক্ষে ১০/১১ জন শহীদ হয় এবং প্রায় ২০ জন যোদ্ধা আহত হয়। সমস্ত যুদ্ধক্ষেত্র শত্রুপক্ষের মরা লাশে ভরে যায়। ‘এ’ কোম্পানী কমান্ডার ক্যাপ্টেন মাহাবুব বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে এই যুদ্ধে শহীদ হন। তাঁকে মরণোত্তর “বীর উত্তম” খেতাব দিয়ে ভুষিত করা হয়। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ক্যাপ্টেন মাহাবুব শহীদ হবার পর তদস্থলে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট লিয়াকত আলী যুদ্ধকালীন সময়েই ‘এ’কোম্পানীর কমান্ডার নিযুক্ত হন। তিনি সাবেক পাকিস্থান এয়ার ফোর্সের পাইলট ছিলেন। তবে এই ধরনের পদাতিক যুদ্ধে তার কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিলনা। একটু পরে তিনি শত্রুর বুলেটে মারাত্নভাবে আহত হন। কিন্তু তবু তিনি আহত অবস্থায়ই যুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং শত্রুর আক্রমণকে ব্যহত করে দেন। এ যুদ্ধে অসাধারন কৃতিত্ব প্রদর্শনের জন্য তাকে বীর উওম এবং লেফটেন্যান্ট ওয়াকার  হাসানকে বীর প্রতীক উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এ যুদ্ধে আমরা ৩১-পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ২৫জন সৈন্যকে জীবিত অবস্থায় বন্দী করি। যুদ্ধবন্দীদের জবানবন্দীতে জানতে পারি যে, ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট যে এত বীরেত্বের সাথে এবং সাহসের সাথে যুদ্ধ করতে পারে তা কখনো ভাবতে পারনি।

এ যুদ্ধে পরাজিত হবার পর তাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে এবং সিলেটের দিকে পলায়ন করে। এ সময়  মিত্রবাহিনীও  পাকিস্থান সৈন্যদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। ৪/৫ গুর্খা  রেজিমেন্টকে ছয়টি আর্টিলারি গানসহ সিলেট শহর থেকে প্রায় দূরে হেলিকপ্টারযোগে নামিয়ে দেওয়া হয়। আমাদের ব্রিগেড কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমান স্থির করেন  যে সিলেট শহরে অন্যান্য সকল বাহিনীর পূর্বেই আমাদের বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করতে হবে। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে, পাকবাহিনীর শত্রু ঘাঁটির গুলি ভেদ করে অনুপ্রবেশ করব। মিত্রবাহিনী আমাদেরকে হেলিকপ্টারযোগে খাদ্য, রসদ ও অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতিও দিলেন। আমরা জলাভূমি, খাল, বিল ইত্যাদি অতিক্রম করে অনুপ্রবেশ শুরু করি। এ সময় অত্যন্ত শীত ছিল। আমাদের যোদ্ধাদের নিকট কোন শীতবস্ত্র মোটেই ছিলনা। তবু আমাদের সৈন্যদের মনোবল ছিল অত্যন্ত দৃঢ়। কেননা আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে আমাদের চূড়ান্ত বিজয় অতি নিকটে। পর পর তিন রাত খাল, বিল এবং জলাভূমি মধ্য দিয়ে চলাচল করে শত্রুঘাঁটি দরবশত ও খাদেমনগর অতিক্রম করে আমরা গভীর চা বাগানের মধ্যে প্রবেশ করি। এ সময় আমাদের সঙ্গে কোন খাদ্যদ্রব্য ছিল না এবং একটানা হাঁটার ফলে আমাদের সৈন্যরা অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তবুও বিপুল উৎসাহ এবং আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আমরা চা বাগানে প্রবেশ করি। ‘চিকনাগুল’চা বাগানে আমরা মোজাহিদ কোম্পানীকে লেফটেন্যান্ট মুদাসসির-এর নেতৃত্বে রেখে হেলিকপ্টারযোগে খাদ্যদ্রব্য ও রসদ সগ্রহ করার জন্য। অয়ারলেসের মাধ্যমে মেসেজ দেওয়া সত্ত্বেও আমরা কোন সাহায্য পেলাম না। শত্রুপক্ষ কালগুল চা বাগানে আমাদের বাধা প্রধান করে এবং আমাদের অল্প কয়েকজন যোদ্ধা হতাহত হন। তখন আমরা এই শত্রুঘাঁটি এড়িয়ে যাই এবং  ১৪ই ডিসেম্বর ভোরে সিলেট শহরে ঢুকে এম, সি, কলেজ এলাকায় প্রবেশ করি। এম, সি, কলেজে শত্রুর অত্যন্ত শক্ত ঘাঁটি ছিল। আমরা শত্রুপক্ষ থেকে পাঁচশত গজ দূরে  এম,  সি, কলেজ উত্তর দিকে টিলাগুলোর উপর ডিফেন্স নিই। এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সামনে ছিল ‘বি’কোম্পানী এবং ‘সি’কোম্পানী- যথাক্রমে আমার এবং ক্যাপ্টেন পাটাওয়ারীর নেতৃত্বে। পিছনে বি’কোম্পানী এবং ‘সি’কোম্পানী যথাক্রমে ক্যাপ্টেন নূর এবং লেফটেন্যান্ট কাইয়ুমের নেতৃত্বে ছিল। ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারসহ মেজর জিয়াউর রহমান এ চার কোম্পানীর মাঝামাঝি একটি টিলার উপর অবস্থান করছিলেন। আমাদের সাথে মিত্রবাহিনী আর্টিলারীর একজন ব্যটারী কমান্ডার ছিলেন। কিন্তু  অয়ারলেসে সেটের  মাধ্যমে তিনি তাঁর গান পজিশনের সাথে যোগাযোগ রাখতে ব্যর্থ হন। এ সময় আমাদের ৩” মর্টারের মাত্র ১৪টি গোলা অবশিষ্ট ছিল। প্রায় তিনদিন আমাদের সৈন্যরা বলতে গেলে অনাহারে ছিল, তথাপি শত্রুর নাকের ডগায় ট্রেঞ্জ খুঁড়ে পজিশন নিতে থাকে। শত্রুপক্ষ আমাদের অতি নিকটে ছিল এবং নির্বিকারে কার্যকলাপ লক্ষ করছিল। তারা চিন্তাও করতে পারেনি যে আমরা মুক্তিবাহিনীর দল। কারণ আমাদের পোশাক, স্টীল হেলমেট। অস্ত্রশস্ত্র তাদের মতই ছিল। তাছাড়া এ সময় যুদ্ধ চলছিল আমাদের পিছনে এবং বাঁ দিকে প্রায় পাঁচ মাইল দূরে খাদেমনগর। আমরা শত্রুর পজিশনের ভিতর দিয়ে এত তাড়াতাড়ি সিলেট শহরে প্রবেশ করব তা ভাবতেও পারিনি। একটু পরে চিৎকার করে তারা আমাদের পরিচয় জানতে চাইলে আমরা তাদের চিৎকারের জবাব না দিয়ে চুপচাপ ট্রেঞ্জ খুঁড়তে থাকি। এ সময়’ডি’কোম্পানীর পজিশনের সামনের রাস্তার একটি আর্টিলারী গান ও দুটি জীপের কনভয় থামে। তখন ‘ডি’কোম্পানীর কমান্ডার মর্টারের সাহায্যে উক্ত কনভয়ের উপর গোলাবর্ষণ করেন, যার ফলে একটি জীপে আগুন ধরে যায়। শত্রু তখন আমাদের উপর সন্দিহান হয়ে পরে এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে এদিক সেদিক চলাফেরা করতে থাকে। এ সুযোগে আমরা মেশিনগান ও হালকা মেশিনগান দিয়ে তদের উপর গোলাবর্ষণ করতে থাকি। ফলে পাকবাহিনীর ২৫ জন সৈন্য রাস্তার উপরেই হতাহত হয়। শত্রুপক্ষ তখন মর্টারের সাহায্যে আমাদের উপর গোলাবর্ষণ শুরু করে মৃতদেহ সরিয়ে নিতে চেষ্টা করে। কিন্তু তখন আমাদের নিখুত গুলিবর্ষণের ফলে শত্রুপক্ষের আরও বেশকিছু সৈন্য হতাহত হয়। দুপুরের সময় শত্রুরা বাধ্য হয়ে তাদের সর্বশক্তি নিয়ে এবং মর্টারের প্রবল গোলাবর্ষণের সাহায্যে আমাদের কোম্পানীর (‘বি’কোম্পানী ‘) উপর প্রচন্ড আক্রমন চালায়। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই আমাদের মর্টারের গোলা শেষ হয়ে যায়। তবু  আমরা  মেশিনগান, হালকা মেশিনগান, এবং রাইফেলের সাহায্যে দৃঢ়তার সাথে শত্রুর আক্রমন প্রতিহত করি। এ আক্রমণের ফলে পাকবাহিনীর ৮০ জন সৈন্য নিহত হয় এবং তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। আমাদের ‘বি’কোম্পানী এবং ‘ডি’কোম্পানীর মোট ২০ জন সৈন্য শহীদ হন এবং প্রায় ২০ জন গুরুতরভাবে  আহত হন। আমার কোম্পানীর সবচেয়ে সযোগ্য সুবেদার ফয়েজ আহমদ অসীম সাহস এবং রণকৌশল প্রদর্শন করে শহীদ হন। তাকে “বীর উত্তম” খেতাবে সম্মান প্রদর্শন করা হয়। এ যুদ্ধে সিপাই বাচ্চু মিয়া, নায়েক নুরুন্নবী, সিপাই ফজর আলী,  সিপাই মহিউদ্দিন ও নায়েক আফসার আলী অসাধারণ সাহসের পরিচয় দিয়ে শহীদ হন।

এ যুদ্ধে নিম্নলিখিত যোদ্ধাগণ অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দেন এবং বীরত্বের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁদেরকে খেতাবে ভূষিত করেন। তারা হলেনঃ ক্যাপ্টেন বজলুল গনি পাটোয়ারী (বীর প্রতিক), নায়েক সুবেদার হোসেন আলী তালুকদার  (বীর প্রতিক), হাবিলদার নুরুল হক  (বীর বিক্রম), শহীদ সুবেদার ফয়েজ আহম্মদ (বীর উত্তম), হাবিলদার সাইফুদ্দীন  (বীর প্রতিক), হাবিলদার রুহুল আমীন (বীর প্রতিক), হাবিলদার আবদুল গফুর(বীর প্রতিক), সুবেদার খাইরুল বাশার (বীর প্রতিক), নায়েক সুবেদার আবদুল লফিত (বী র প্রতিক), ল্যান্স নায়েক আবুল বাশার (বীর প্রতীক), হাবিলদার আবদুল লতিফ (বীর প্রতিক)।

১৫ই ডিসেম্বরঃ সিলেট শহরের উপর পাকবাহিনীর এই চরম পরাজয়ে তাঁদের মনোবল একেবারেই ভেঙ্গে যায়। যার ফলে পরদিনই পাকিস্তানী কমান্ডারগণ আমাদের এবং মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করে। আমরা বিজয়ীর বেশে সিলেট শহরে প্রবেশ করি এবং শহরের জনগণের মনে বিপুল আশা ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। হাজার হাজার জনতা আমদেরকে স্বাগত জানাতে থাকে।

১৬ই ডিসেম্বরঃ পাকবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার রানা ব্রিগেড নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের এবং মিত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পন করে। এভাবে আমাদের নয় মাস যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং স্বাধীনতা অর্জন করি। আমাদের সৈন্যরা বিভিন্ন অসুবিধার সম্মুখীন  হয়েও অসীম সাহসিকতার ও ত্যাগের পরিচয় দেয়। আমাদের তরুণ অফিসারগণ অসীম সাহসিকতা  প্রদর্শণ করেন এবং ত্যাগ ও বীরত্বের নিদর্শণ স্থাপন করেন। তার প্রমাণস্বরুপ বলা যেতে পারে যে, এ ব্যাটালিয়নের তিনজন অফিসার সম্মুখসরে শহীদ হন এবং আরও তিনজন অফিসার গুরুতররুপে আহত হন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে খুব কম ব্যাটালিয়নই এ ধরনের নেতৃত্ব দিয়েছে এবং যুদ্ধ পরিচালনা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধে এই ব্যাটালিয়ন অসাধারণ কৃতিত্ব ও নৈপুণ্য প্রদর্শণ করে বহু শত্রুসৈন্যকে হতাহত এবং জীবিত অবস্থায় বন্দী করে। বাঙ্গালী সৈন্যরা  গতানুগতিক সম্মুখযুদ্ধেও যে যথেষ্ট দক্ষ, তা এই ব্যাটালিয়নের সৈন্যরা শৌর্যবীর্য এবং ত্যাগের মাধ্যমে প্রমাণ করেন।

স্বাক্ষরঃ হাফিজউদ্দীন আহমদ,

ক্যাপ্টেন

২৮-০৯-১৯৭৩

 

দীপংকর ঘোষ দ্বীপ

<১০, ২১., ৫০৪>

সাক্ষাৎকারঃ মেজর আবদুল হালিম

                                                                                ২২-১১-১৯৭৩

                                                                জেডফোর্সের সিগনাল তৎপরতা

সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে তৎকালীন কমান্ডার-ইন-চীফ, কর্নেল এম,এ,জি ওসমানী সাহেবের আদেশ মোতাবেক ‘জেড’ফোর্সে সিগনাল কোম্পানীর কমান্ডার হিসাবে যোগদান করি। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এটাই প্রথম সিগনাল কোম্পানী। ‘জেড’ফোর্সের অধীনে ৩টি পুরা ব্যাটালিয়ন আছে। অধিনায়ক ছিলেন বর্তমান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান।

প্রথমে সিগনাল কোম্পানীকে গঠন করিতে খুব কষ্ট করিতে হইয়াছে, কেননা যন্ত্রপাতির ছিল খুব অভাব। তাছাড়া সিগনালের জোয়ানের সংখ্যা ছিল কম। যুদ্ধক্ষেত্রে এক রণক্ষেত্র হইতে অপর প্রান্তে সংবাদ পৌঁছাইতে ছিল গাড়ির অভাব। তবুও আপ্রাণ চেষ্টার পর সুষ্টুভাবে সিগনাল কোম্পানী গঠন করিতে সক্ষম হই। অক্টোবর মাস হইতে যুদ্ধক্ষেত্রের সংবাদ ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টর ও ব্রিগেড হেডকোয়ার্টরে পৌঁছাই। আমার সিগনাল কোম্পানীতে সিগনাল কোরের সৈনিক খুব কম থাকায় প্রাথমিক অবস্থায় কিছুটা অসুবিধা হলেও পরের দিকে সুষ্টুভাবে সংবাদ পরিবেশন করি।

অক্টোবর মাসের শেষের দিক হইতে সিগনাল কোম্পানী’জেড’ফোর্স এর অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সহিত তাহাদের প্রত্যেকটি রণাঙ্গনে সংকেত পরিবেশের দায়িত্ব পালন করে। ইহার মধ্যে সিলেট জেলার বড়লেখা, ফুলতলা, আদমটিলা, বিয়ানীবাজার যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য।

স্বাক্ষরঃ আবদুল হালিম                                                                       মেজর                                                                                        ২২-১১-৭৩

 

 

দীপংকর ঘোষ দ্বীপ

<১০, ২১.৯, ৫০৫-৫০৮>

 

সাক্ষাৎকারঃ মেজর সৈয়দ মুনিবুর রহমান

 

প্রশ্নঃ অক্টোবরে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করার পর আপনাকে কোথায় পাঠানো হলো ?

উত্তরঃ সেখানে একটা ইকো কোম্পানী ছিল। সেটা তৈরী হয়েছিল বেশীর ভাগ ময়মনসিংহের ছাত্রদের নিয়ে। আমাকে তারা সেখানকার কোম্পানী কমান্ডার করে পাঠান। আমি কোম্পানী কমান্ডার হিসাবে প্রথমে তাদেরকে কিছু ট্রেনিং করাই কদমতলায়, তারপর আমরা কিছু অপারেশন করি। আমাদের প্রথম অপারেশন হয় নভেম্বরের ২/৩ তারিখ। লাঠিটিলা বিওপি’র মধ্যে আমরা এ্যামবুশ করি। তারপর আমি লাঠিটিলায় বিওপি’র উপর একটি রেইড কন্ডাক্ট করি।

প্রশ্নঃ কিভাবে কন্ডাক্ট করেন একটু খুলে বলবেন ?

উত্তরঃ আমরা খবর পাই এক সেকশন পাকিস্তানী ভোরবেলায় লাঠিটিলার ভিতর দিয়ে রাস্তাঘাট ক্লিয়ার করার জন্য ‘মুভ’করে এবং ব্রীজে ছিল রাজাকার পাহারায়। আমরা কিছু বেশী লোক নিয়ে এ্যামবুশ করি। তারা মাইনের বিরুদ্ধে প্রটেকশন নেয়ার জন্য প্রথমে একটা ট্রাক্টর চালিয়ে যায়। তারপর তারা প্রুফ পেট্রোল হিসাবে একটা সেকশন মুভ করায়। এরা সব পাকিস্তানী সোলজার ছিল। আমরা রাতে এ্যামবুশ লাগাই। ভোরে খবর আসে লোক চলে আসে। আমাদের কাছে মাইন ছিল কিন্তু আমরা মাইন লাগাতে পারিনি। ট্রাক্টরটা চলে যাবার পর আমরা ফায়ার করি। ফায়ার করে আমরা এ্যামবুশ করি। এ্যামবুশ করার সময় দৌড়াদৌড়ির মধ্যে আমাদের একটা ছেলে হারিয়ে যায়  এবং আমরা উইথড্র করে চলে আসি। আমাদের প্লাটুনের বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা ছিল। আমার সিগনালার যে ছিল সে হারিয়ে যায়।

 

প্রশ্নঃ এ্যামবুশের ফলাফল কি ছিল?

উত্তরঃ এ্যামবুশের ফলাফল ছিল ১০ জন আর্মির মধ্যে ৫ জন মারা যায় এবং ১ জন আহত হয়েছিল। আমরা পরে অন্যান্যের কাছে খবর পাই। নিজেরা কোন ডেডবডি রিকভার করিনি ঐ এ্যামবুশে।

প্রশ্নঃ এই এ্যামবুশে আপনাদের কোন ক্ষতি হ ?

উত্তরঃ না, আমাদের কোন ক্ষতি হয়নি। শুধুমাত্র আমার সিগনালার হারিয়ে যাওয়া ছাড়া। অবশ্য তাকে স্বাধীন হবার পর ফিরে পাই।

প্রশ্নঃ পরবর্তীতে আপনার অপারেশন কি ?

উত্তরঃ পরের অপারেশনে লাঠিটিলা বিওপি’র উপর আমি রেইড করি। রেইড করার সময় আমাকে এ্যাসিস্ট করেছিলেন মর্টার দিয়ে কর্নেল সাদেক। তখন তিনি ক্যাপ্টেন ছিলেন। তিনি আমাদের ইউনিটে কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন।

প্রশ্নঃ এটা কোন মাসে হয়েছিল?

উত্তরঃ এটা নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে হয়েছিল।

প্রশ্নঃ পাকিস্তানীদের কি পরিমাণ শক্তি ছিল সেখানে ?

উত্তরঃ পাকিস্তানীদের শক্তি বলতে প্রায় দেড় প্লাটুনের মত রাজাকার ছিল এবং এক প্লাটুনের মত পশ্চিম পাকিস্তানী মিলিশিয়া ছিল। আর্মিরা তখন বর্ডারে ছিলনা, অন্যদিকে ছড়িয়ে ছিল। আমরা রেইড করেছিলাম এজন্য যে, তাদের বুঝিয়েছিলাম আমাদের অপারেশন এখনও চলছে এবং আমরা অপারেশন করার মত সামর্থ্য রাখি। আমরা ফিজিক্যালী রেইড করিনি। আমরা ফায়ারের মাধ্যমে রেইড করেছিলাম। মর্টার ফায়ার দিয়ে ‘রেইড’করার কথা ছিল। আমরা একটা হিলটপে ছিলাম। বিওপি’টা অন্য হিলটপে ছিল। মাঝখানে দু-তিনশ গজের পার্থক্য।

প্রশ্নঃ আপনারা কতজন ছিলেন

উত্তরঃ এই রেইডে আমি এক কোম্পানী নিয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের ব্যাটালিয়ানে ৩” মর্টার ছিল। মর্টার দিয়েই ফায়ার করা হয়েছিল। এটাতে কোন ক্যাজুয়ালটি হয়নি। এটা একটা মোরাল বুস্টিং-এর মত অপারেশন ছিল। এরপর আমি ইউনিটে ফিরে আসি। এ সময় আমাদেরকে বলা হয়, ‘তোমাদের বাংলাদেশের ভিতর জায়গা ক্লিয়ার করে ডিফেন্স নিতে হবে’।

২২শে নভেম্বর আমরা বাংলাদেশে প্রবেশ করি। সিলেট বড়লেখা বলে একটা জায়গা আছে, সেই জায়গাতে আমরা ডিফেন্স নেই। এই ডিফেন্স নেওয়ার সময় আমাদের উপর ২/৩ বার আক্রমণ চালায় পাকিস্তান আর্মি। কিন্তু আমরা প্রতিবারই এই আক্রমণ সাফল্যের সাথে দমন করি। মুজিব ব্যাটারী-২ যেটাতে মেজর রাশেদ এবং মেজর সাজ্জাদ ছিলেন- সেই ব্যাটারী প্রথমবারের মত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ফায়ারিং সাপোর্ট দেয় এবং ফায়ার সাপোর্টের প্রথম গোলাই টার্গেটের উপর পড়ে। ২৯শে নভেম্বর আমরা কৈলাশ শহরে কনসেনট্রেট করি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে চূড়ান্তভাবে প্রবেশের জন্য। ২৯ তারিখ রাতে বাংলাদেশে ঢোকার জন্য মার্ট করে যাই পুরো ব্যাটালিয়ন। এই সময় ইন্ডিয়ান ব্রিগেডের একটা কাজের জন্য আমাদেরকে বলা হয়। ব্রিগেডের প্ল্যান ছিল শমসেরনগরের উপর আক্রমণের। আমাদেরকে বলা হয় শমসেরনগর থেকে শ্রীমঙ্গলে যে এক্সসেস আছে সেটাকে গার্ড করতে হবে। ভানুগাছে কিছু এ্যানিমি ট্রপস আছে সেখানে আমাদেরকে কাট-অফ করে একটা ডিফেন্স লাগাতে হবে। আমাদের কাছে তথ্য ছিল যে ভানুগাছে এক আর্মি প্লাটুন আছে। আমরা সেভাবে ডিফেন্স নেই। কিন্তু আমরা যখন ১ লা ডিসেম্বর ভানুগাছে পৌঁছি তখন দেখি সেখানে এক প্লাটুনের বেশী আর্মি আছে এবং কিছু ১২০ মিঃ মিঃ মর্টারও ছিল সেখানে। তারপর ২/৩ তারিখ ডিসেম্বরে আমাদেরকে ওদের উপর আক্রমণ চালাতে বলা হয়। প্রথমে আমাদের দুই কোম্পানী  আক্রমণ চালায়। দুই কোম্পানী  আক্রমণ চালালে আমাদের বেশ কিছু-প্রায় ১২৭ জন নিহত ও বেশ কিছু আহত হয়।

প্রশ্নঃ দুই কোম্পানী কে কে নিয়ে গিয়েছিলেন ?

উত্তরঃ একটা মেজর মাহবুব ও আর একটা মেজর ওয়ালিউল ইসলাম। একটা ছিল ব্রেভো কোম্পানী আর একটা ছিল আলফা কোম্পানী। পরে চার্লি কোম্পানীকে পাঠানো হয় এবং আমরা ইন্ডিয়ান আর্টিলারীর সাপোর্ট নিয়ে সেই আক্রমণকে সাকসেসফুল করি এবং পরের দিন সকালবেলায় আমরা ভানুগাছ দখল করি।

প্রশ্নঃ সেটা কত তারিখে হবে ?

উত্তরঃ সেটা ডিসেম্বর ৩/৪ তারিখে হবে। আমার মনে আছে ভানুগাছে থাকতেই যুদ্ধ ঘোষণা করা হয় এবং ইন্দিরা গান্ধীর বক্তৃতা ভানুগাছেই শুনেছিলাম। এটা করার পর আমাদেরকে বলা হয় মঙ্গলাবাজার হয়ে ফেঞ্চুগঞ্জ আসতে হবে। আমরা ভানুগাছ থেকে মঙ্গলাবাজারে আমাদের বেশকিছু ক্যাজুয়ালটি হয়। মাইন ক্যাজুয়ালটি ছিল। একটা ট্রাক এবং একটা বাস এন্টিট্যাঙ্ক মাইনে উড়ে যায়, ফলে বেশকিছু ক্যাজুয়ালটি হয়।

প্রশ্নঃ এটা কবে হয় ?

উত্তরঃ এটা ৭/৮ ডিসেম্বরে। ভানুগাছ থেকে একটা কাঁচা রাস্তা আছে ফেঞ্চুগঞ্জের দিকে। আমরা সেই রাস্তা দিয়ে আসার সময় আমাদের ক্যাজুয়ালটি হয়। ফেঞ্চুগঞ্জ হয়ে সিলেটের কাছে গোলাপগঞ্জ বলে একটা জায়গা আছে সেখানে এসে একটা স্কারমিশের মত হয়। সেখানে কিছু ‘থলস’স্কাউট ছিল। তাদেরকে আমাদের ব্যাটালিয়ন ঘেরাও করে ফেলে। এক সেকশন ‘থলস’স্কাউটকে আমরা বন্দী করে ফেলি।

প্রশ্নঃ এটা কত তারিখ ছিল ?

উত্তরঃ এটা ৯/১০ তারিখ ছিল। ইতিমধ্যে আমরা দেখছিলাম যে, সিলেট রেডিও স্টেশনের ওপর ভারতীয় ৫৫ গুর্খা রাইফেলস হেলিকপ্টারযোগে নামিয়ে দেয়- তাদের সঙ্গে পাকিস্তান আর্মির বেশ যুদ্ধ চলছিল। আমাদের মধ্যে বেশ কিছু স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ছিল। তাদেরকে আমরা নদী ক্রস করে ওপারে পাঠিয়ে দিই খবর নেওয়ার জন্য। ১৩/১৪ তারিখে আমরা খবর পাই আমাদের আর ওদিকে যাবার দরকার নেই। কেননা পাকিস্তানী আর্মিরা পালিয়ে গেছে এবং সালুকটিকরের দিকে “কনসেনট্রেটেড” হয়েছে। ১৬ তারিখ আমরা সিলেট প্রবেশ করি। কিন্তু আনফরচুনেটলি আমাদের সিলেট শহরে যেতে দেয়া হয়নি। আমাদের স্টেশনে থাকতে বলা হয়েছে।

প্রশ্নঃ কেন যেতে দেয়া হয় নাই ?

উত্তরঃ আমাদেরকে বলা হয়েছিল, আমরা যদি পাকিস্তান আর্মিদের সাথে ঝগড়া করি কিংবা তাদের মেরে ফেলি। তাছাড়া আরো হয়ত কারণ ছিল। আমরা স্টেশনে থাকাকালীন সময়ই খবর পাই যে সমস্ত দখল করা ম্যাটেরিয়ালস, আর্মস সেগুলো ট্রেনে করে ইন্ডিয়ায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সিলেট স্টেশন থাকাকালীন সময়ই ফাস্ট বেঙ্গল আমাদের সাথে যোগদান করে। ঐ সময় জেনারেল ওসমানী আসেন। জেনারেল জিয়া আসেন। জেনারেল ওসমানী সিলেট স্টেশনে ফার্স্ট বেঙ্গল এবং ৮ম বেঙ্গলের উদ্দেশে ভাষণ দেন। ইন্ডিয়ান ডিভিশনাল কমান্ডার যিনি ছিলেন জেনারেল রাও বা অন্য কেউ, আমার নামটা ঠিক মনে নেই- তিনিও আমাদের উদ্দেশে ভাষণ দেন। সেখানে তিনি একটা কথা বলেছিলেন, আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে। তিনি বলেছিলেন, “তোমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছো খুব ভাল তোমাদের যুদ্ধ এখন শেষ। এখন তোমরা যার যার জায়গায় চলে যাবে। এবং তোমাদের এখন কাজ হবে দেশের গঠনকাজে আত্মনিয়োগ করা”। হয়ত তিনি আমরা যেন আর্মি থেকে সরে যাই সেই উদ্দেশ্যে বলেছিলেন।

যাই হোক, আমরা ‘জেড’ফোর্সের আন্ডারে ছিলাম। এর মধ্যে খবর পাই ‘জেড’ফোর্সের আরেক ব্যাটালিয়ন, ৩য় বেঙ্গল যেটা ছিল ওটা ছাতক এসে পৌঁছে গেছে।

প্রশ্নঃ সিলেট পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ফাইনালি কবে সারেন্ডার করে ?

উত্তরঃ ঢাকায় যেমন ১৬ই ডিসেম্বর করেছিল তখনও সম্পূর্ণ সারেন্ডার করেনি। ১৩,১৪,১৫,১৬ ডিসেম্বর এক জায়গায় এক এক সময় করেছে। তবে ঢাকায় যেদিন হয়েছে সেদিন সিলেটের কিছু কিছু জায়গা বাকী ছিল। ১৬ তারিখে যখন আমরা রেলওয়ে স্টেশনে আসি তখন আমরা শুনতে পাই যে পাকিস্তান আর্মিরা সালুটিকর এবং এখন যেটা সিলেট কলেজ সেখানে ‘কনসেনট্রেট’করেছে। আমি নিজে ১৮ তারিখ সেই ক্যাম্পে যাই এবং দেখি তারা অলরেডি সারেন্ডার করে ফেলেছে। এক এক জায়গায় এক এক সময় যেমন ৯/১০ তারিখে শ্রীমঙ্গল আমাদের দেখে পিছু হটে গেছে। মৌলভীবাজারে আরো আগে হয়েছে। আমরা মৌলভীবাজার হয়ে এসেছিলাম। তখন সেখানে ব্রিগেড কমান্ড বা আর কোন কমান্ডার ছিল তাদের শেষের দিকে কোন কমান্ড ছিল না। ছাতকে কিছু আগে সারেন্ডার করেছে। ১৬ তারিখের দিকে সিলেট ক্যাডেট কলেজে সিলেটের পুরো আর্মি সেখানে জড়ো হয়। সেখানে পাকিস্তান আর্মির তিনজন ব্রিগেডিয়ার ছিল এবং বেশকিছু অফিসার ছিল।

প্রশ্নঃ আপনাদের মধ্যে কে কে ছিলেন সারেন্ডারের সময় ?

উত্তরঃ সারেন্ডারের সময় আমরা কেউ ছিলাম না। ইন্ডিয়ান আর্মি সারেন্ডার কন্ডাক্ট করে। আমাদের বাংলাদেশের ফোর্সকে সিলেটে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। সুরমা ব্রীজ তখন ভেঙ্গে গিয়েছিল, ইন্ডিয়ান আর্মি তা মেরামত করছিল। তাদেরকে বলে দেয়া হয়েছিল যে, বাংলাদেশের কোন গাড়ী এদিক-ওদিক করবেনা এবং আমাদেরকে যেতে নিষেধ করা হয়েছিল।

প্রশ্নঃ পরে আপনারা পুরো ব্যাটালিয়ন মুভ করেন কিভাবে ?

উত্তরঃ পরে আমরা শ্রীমঙ্গল যাই। সেখানে জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী ছিলাম। পরে ২১শে ফেব্রুয়ারী চিটাগাং এ পৌঁছাই কমান্ডিং অফিসারের সঙ্গে।

 

 

ফয় সাল

<১০, ২১.১০, ৫০৮৫০৯>

 

ইস্ট বেঙলের গর্বঃ চিলমারী যুদ্ধ

১৫ই আগস্ট ১৯৭১। আর্টিলারীসহ এক ব্যাটালিয়ন পাক হানাদার ও তিন শতাধিক রাজাকার চিলমারীতে বীর ইস্ট বেঙলের মুখোমুখি হয়।

ইস্ট বেঙল ছিল কম্বাইন্ড ফোর্স। এখানে ছিলেন সি-ও জামিল (থার্ড বেঙল), সি-ও মেজর জিয়াউদ্দীন (ফার্স্ট বেঙল) ও সি-ও মেজর আমিনুল হক (৮ম বেঙল), আর ছিল মুক্তিবাহিনীর দুটি কলাম। মূল কমান্ডে ছিলেন ‘জেড’ফোর্সের অধিনায়ক মেজ জিয়া।

 ১৫ই ও ১৬ই আগস্ট হানাদার পাকবাহিনী নেক-টু-নেক ফাইট করেছে তাদের মোস্ট লেটেস্ট ও মোস্ট সফিস্টিকেটেড আর্মস নিয়ে। কখনো বা মনে হয়েছে পাক হানাদার ইস্ট বেঙলে ডিফেন্সে ফাটল ধরাতে সমর্থ হবে। কিন্তু না, বাংলার বীর ইস্ট বেঙল রেজিমেন্ট দাঁতে দাঁতে কামড়ে পজিশন আগলে রেখে দু’দিন ধরে তাদের আক্রমণ রেসিস্ট করে গেছে। দুদিন ধরে মুক্তিযোদ্ধা রা জঙল ও বনের ফাঁক দিয়ে সংগ্রহ করে হানাদার বাহিনীর ডিফেন্সের ফাঁক-ফোকর। ১৭ইই আগস্ট চিলমারীর পূর্বদিক দিয়ে এগিয়ে গেল ৮ম বেঙল। নাশ হয়ে গেল দুটি হানাদার পজিশন। নিহত হল ৪ জন পাক হানাদার বাহিনী। জায়গা বদল করে এগুচ্ছে ফার্স্ট বেঙল, থার্ড বেঙল। রক্তক্ষয়ী চিলমারীর বুকে অসীম বীরবিক্রমে তিনদিন তিনরাত ধরে চলে যাচ্ছে বীরের বাহিনী ইস্ট বেঙল শত্রুর লেটেস্ট আর্টিলারি ও সফিস্টিকেটেড আর্মস-এর সামনে ক’টা এস-এস-এর আর থ্রি-নটথ্রি নিয়ে। অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের ইঞ্চি ইঞ্চি করে পিছু হটাচ্ছে চিলমারীর বুক থেকে, আর গ্রামের কৃষক-জনতা সবাই তাদের পিছনে ভলান্টিয়ারের কাজ করছে। জনগনের শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় উদ্দীপ্ত ইস্ট বেঙ্গল এর জোয়ানরা পাক বাহিনীর মরণ আঘাত উপেক্ষা করে প্রতি প্রহরে সামনে এগিয়েছে, নিখুঁত নিশানায় হানাদার বাংকারে গুলি ছুড়েছে।

এলো ১৯শে আগস্ট। সারাদিনের পর সন্ধ্যায় হঠাৎ যেন দুলে উঠলো হানাদার পজিশন, বাংকার। ইস্ট বেঙ্গল ও মুক্তিবাহিনী আক্রমণ শানিয়ে তুললো। বীরদর্পে অসীম দু:সাহসে সন্ধ্যায় আঁধার নামার সাথে সাথে থার্ড বেঙ্গল মেজর জামিলের সাথে আরও কয়েক গজ এগিয়ে সামনের একটা হানাদার বাংকার দখল করে নিল। বাংকারেই হত্যা করল ৪ জন হানাদারকে।

রাতের আঁধারে যুদ্ধ আরও রক্তক্ষয়ী ও হিংস্র হয়ে উঠলো। পাকিস্তানি স্ট্রং আর্টিলারির কভারিং থাকা সত্বেও চিলমারীর বুক থেকে পালাতে চায় ১ ব্যাটালিয়ন হানাদার। ‘জেড’ফোর্সের অধিনায়ক জিয়ার অর্ডার- ‘ওদেরকে রিট্রিট করতে দেয়া হবে না। চিলমারীর বুকে ওদের কবর হবে।’মুক্তিযোদ্ধারা সন্তপর্ণে ক্ষিপ্ত গতিতে গিয়ে পজিশন নেয় হানাদারদের পেছনে। ভোর রাতে জোর কদমে ইস্ট বেঙ্গল ঢুকে পড়ে পাকিস্তানি বাংকারে, পজিশনে, ডিফেন্স লাইনে।

ইস্ট বেঙ্গলের নির্ভীক যোদ্ধারা নিশ্চিত আঘাতে ভেঙে পড়তে লাগল লাগল ওদের বাংকার, গুড়ো গুড়ো হয়ে গেল পাকিস্তানি ডিফেন্স। প্রাণভয়ে চিলমারী ডিফেন্স ছেড়ে পালাচ্ছে ৭০০ পাকসেনার হেড-বডি ও আহত নিয়ে ৭/৮ মাইল দূরে, চিলমারী রেলওয়ের দিকে। পালাবার পথে প্রাণ দিচ্ছে ওঁৎ পেতে থাকা মুক্তিযোদ্ধা দের গুলির ঘায়ে।

২০শে আগস্ট মুক্ত হয়ে গেল চিলমারী। রক্তক্ষয়ী পাঁচদিন পাঁচরাত যুদ্ধের পর শত প্রাণশক্তিতে ভরপুর ইস্ট বেঙ্গলের বীর জোয়ানরা এগিয়ে চললো পলাতক পাক হানাদারদের পরবর্তী ডিফেন্স লাইন চিলমারী রেলওয়ে তে আঘাত হানার জন্যে। পশ্চাতে পড়ে থাকল রক্তস্নাত চিলমারী। আনন্দে উদ্বেলিত জনগন চিলমারী রণক্ষেত্রে এসে দেখতে পেলো বাংকারে বাংকারে পড়ে আছে শতাধিক হানাদার ও রাজাকারের লাশ। পাক হানাদারদের ডিফেন্স লাইন রক্তে ভেসে যাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা নিহত হানাদার চিলমারীতে কবর দেয়ার ব্যবস্থা করে। পাকিস্তানি দের ২ টি লঞ্চ ধরা পড়ে ও ২ টি শপীডবোট ধ্বংস হয়। ধ্বংস হয় কয়েকটি সাঁজোয়া গাড়ী। ইস্ট বেঙ্গলের ৩ জন সামান্য আহত হয়।

 [‘দৈনিক ইত্তেফাক’১৯৮২ বিজয় দিবস সংখ্যায় প্রকাশিত মুসা সাদিক রচিত প্রতিবেদন থেকে সংকলিত ]

শিরোনাম সূত্র তারিখ
নৌ বাহিনীর গঠন ও তার যুদ্ধ তৎপরতা

সূত্রঃ বাংলা একাডেমির দলিলপত্র

 

১৯৭১

মাসরুর আহমেদ

<১০, ২২., ৫১০৫১৪>

অনুবাদ

সাক্ষাৎকারঃ মোঃ রহমত উল্লাহ

১০ শে জানুয়ারি ১৯৭১ আমরা বোম্বে এয়ারপোর্ট এ পৌঁছাই এবং সেখানে  মেজর ও কমিশনার সাহেব আমাদের উষ্ণভাবে স্বাগত জানান।  পরের দিন আমরা নয়াদিল্লী তে পৌঁছাই এবং সেখানে ভারতের সেভী স্টাফ ও গোয়েন্দা শাখার কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার শর্মা আমাদের গ্রহন করেন। নয়াদিল্লী অবস্থানের প্রথম ১০ দিন আমরা ভারতীয় নৌবাহিনীর সাববেরিন ও স্থল শাখার কর্মকর্তা, ভারতীর সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা শাখার কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার প্রদান করি। এরপর  ক্যাপ্টেন রয় চৌধুরী ও ভারতীয় আন্ত বাহিনী গোয়েন্দা দপ্তরের এক কর্নেল আমাকে ভারতে পালিয়ে আসার  লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জিজ্ঞসা করেন। আমি তাদের প্রস্তাব করি আমরা নৌ কমান্ডো হতে চাই এবং এজন্য আমরা কমান্ডো প্রশিক্ষণ চাই। আমাদের প্রশিক্ষন গ্রহন শেষে আমরা ভারতীয় কতৃপক্ষের সহযোগীতায়  আমাদের  তত্বাবধানে বাংলাদেশী প্রশিক্ষণার্থীদের নিয়ে একটি কামান্ডো দল গঠন করবো। প্রস্তাবটি ভারতীয় কতৃপক্ষ মঞ্জুর করেন।

এডমিরাল নন্দা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন রয় চৌধুরী বাংলাদেশ নেভী কামান্ডোদের সব ধরনের সাহায্য করতে পেরে অনেক বেশি আনন্দিত ছিলেন। মুর্শিদাবাদের প্লেসি তে একটি ট্রেনিং সেন্টারও প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২২ শে এপ্রিল ১৯৭১ লেফটেন্যান্ট সমীর দাস ও পেটি অফিসার গুপ্তা যমুনা নদীতে (নয়া দিল্লী) আমাদের  নৌ কামান্ডো প্রশিক্ষন শুরুর  বিস্তারিত আলোচনা করেন।

নিম্নলিখিত প্রশিক্ষণ সমূহ আমাদের অনুশীলন করতে হতো। (ক) পানির নীচ দিয়ে শত্রুকে আক্রমন ও ক্ষতি সাধনের জন্য  ৬/৭ ঘন্টা সাঁতার, (খ) মাইন  (গ) ল্যান্ড মাইন (গ) ব্রীজ ধ্বংস (ঘ) নিরস্ত্র অবস্থায় যুদ্ধ। আমাদের প্রশিক্ষন গ্রহনের সময় আমরা বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান  কর্নেল (বর্তমানে জেনারেল) এম এ জি   ওসমানীর সাথে নয়া দিল্লীতে সাক্ষাৎ করি।আমরা আমাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে তার সাথে আলোচনা করি। তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেন যে আমাদের পরিকল্পনা  ও কর্মসূচী বাস্তবায়ন   করার জন্য তিনি কলকাতা ফিরে যেয়ে নৌ কমান্ডো ট্রেনিং ও ছাত্রদের গ্রুপ থেকে নৌ কামান্ডতে নিয়োগের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা করবেন।

রিক্রুট্মেন্টঃ ১০ই মে ১৯৭১ আমরা বিমানে কলকাতা পৌঁছাই। ২১ শে মে ১৯৭১, আমি বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সেনানায়ক কর্নেল (বর্তমানে জেনারেল) এম এ জি ওসমানির সাথে তাকিপুর ও ভোমরা যুব ক্যাম্প পরিদর্শন করি এবং ন্যাভাল কমান্ডো ট্রেনিং এর জন্য ১২০ জনকে নিয়োগ দেই। এই ক্যাম্পগুলো ছিলো মেজর জলিল ও লেফটান্যান্ট কর্নেল আবু ওসমানের অধীনে। নতুন রিক্রুটদের পশ্চিমবংগের প্লেসি ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহনের জন্য প্রেরন করা হয়। দ্বিতীয়  ব্যাচে প্রায় ২০০ ছাত্র কে আগরতলার বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে বিক্রুট করা হয়। আমি ইনচার্জ হিসেবে  সকল প্রশিক্ষণার্থীদের   প্রশিক্ষণ, খাদ্য, বাসস্থান এবং সকল  পরিকল্পনা ও অপারেশন  কর্মকাণ্ডের  ব্যবস্থার দায়িত্বে ছিলাম।

ভারতীয় কতৃপক্ষের সম্মতিতে পুরোদমে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। প্রশিক্ষনের মধ্যে ছিলো, ক) কমপক্ষে ৯/১০ ঘন্টা সাঁতার, পানির উপরে ও নীচে সাঁতার, উপকুলে সাঁতার, অতিরিক্ত ওজন ও মাইন সহ সাঁতার, ফিন সহ ও ফোন ছাড়া সাঁতার, রাতে শব্দহীনসাঁতার, অপারেশন, কৌশল, খ) বিস্ফোরণ প্রশিক্ষণ, গ) গ্রেনেড ছোড়ার প্রশিক্ষণ, ঘ) ক্ষুদ্রাস্ত্র ব্যবহার প্রশিক্ষণ ও ঙ) নিরস্ত্রভাবে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ । চূড়ান্ত প্রশিক্ষণ ছিলো প্লেসীর নিকটবর্তী ভাগীরথী নদীতে ১৮ ঘন্টা সাঁতার যেটির নিকটেই আমরা ১৯৫৭ সালে স্বাধীনতা হারিয়েছিলাম। এই ঐতিহাসিক স্থানটি ছেলদের কঠিন ও দীর্ঘ প্রশীক্ষন গ্রহন করে মাতৃভূমিকে স্বাধীন করতে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলো। ছেলেদের জন্য প্রশিক্ষনকালীন সময় ছিলো অনেক কষ্টের অনেক সময় লবন ছাড়াই তাদের খাবার গ্রহন করতে হতো। বাংলাদেশ সরকারও তাদের ব্যাপারে খুব বেশী উৎসাহী দেখায়নি। প্রথম ব্যাচের কমান্ডদের প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হয় ১০ ই জুলাই  ও দ্বিতীয় ব্যাচ ৩১ শে জুলাই ১৯৭১ সালে তাদের প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে।

পরিকল্পনাঃ ভারতীয় কতৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে বাংলাদেশের  প্রধান প্রধান বন্দরে অবস্থানকারী পাকিস্তানি ও বিদেশী জাহাজসমূহ ধ্বংস ও নদীপথ সম্পূর্ণভাবে  অচল করার  পরিকপ্লনা করি । নিম্নোক্ত বন্দরসমুহ অচল  করার জন্য আমাদের সর্বাত্তক প্রচেষ্টা ছিলো। ১) চট্টগ্রাম বন্দর (২) মংলা বন্দর (৩) চাদপুর অভ্যন্তরীণ  নদীবন্দর (৪) নারায়ণগঞ্জ অভ্যন্তরীণ নদীবন্দর (৫) দাউদকান্দি আভ্যন্তরিন নদীবন্দর ও অন্যান্য বন্দর। ১৭৮ জন প্রশিক্ষত কমান্ডো ৪ ভাগ করে নিম্নোক্তভাবে প্রেরিত হয়েছিলোঃ-(ক) ফ্রান্স থেকে পালিয়া আসা অন্যতম সদস্য এ ডব্লিও চৌধুরির নেতৃত্বে প্রথম গ্রুপকে  ১লা আগস্ট ৬১ জন কে চট্টগ্রামে (খ) ২য় গ্রুপে ফ্রান্স থেকে আরেক সদস্য এম বি আলমের নেতৃত্বে ২ আগস্ট ২৮ জন কামান্ডো চাদপুরে  (গ) ফ্রান্স থেকে আসা অপর সদস্য এম বি রহমানের নেতৃত্বে ২ আগস্ট  ২৮ জন সদস্যের ৩য় দল কে নারায়ণগঞ্জ এবং (ঘ) ৪ আগস্ট ১৯৭১ চতুর্থ দলকে ফ্রান্স থেকে পালিয়ে আসা আরেক সদস্য এম এ উল্লাহ এর নেতৃত্বে ৬১ জনের কমান্ডো দলকে মংলা বন্দরে প্রেরন করা হয়। প্রত্যেক দলকে  ১৬ই আগস্ট রাতে  ০০.০০ ঘন্টায়  তাদের জন্য নির্ধারিত বন্দরে আক্রমন করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়।

অপারেশনের জন্য পুরো যাত্রাপথ হেটে কমান্ডো দলগুলোর চাদপুর চট্টগ্রাম নারায়ণগঞ্জ ও মংলায় পৌঁছানো কে বাংলাদেশের সবাধীনতাপ্রিয় স্বাধীন মানুষেরা অনেক উৎসাহ প্রদান করে। চার দিন ব্যাপি এই যাত্রায় তারা একটি ভাতও  খেয়ে পারে নি । তাদের এমন সব পথ অতিক্রম করতে হয়েছে যেই পথে পাঞ্জাবী সেনা, রাজাকার ও তাদের স্থানীয় সাহায্যকারীরা মুক্তিফৌজ ধরার জন্য সর্বদা সজাগ ছিলো।

মংলা গ্রুপ ভারত থেকে স্থানীয় নৌকা চালিয়ে  মংলায় প্রবেশ করে।পুরো যাত্রায় বিশুদ্ধ পানির কোন ব্যবস্থা ছিলো না। আসার পথে তারা সুন্দরবনের গহীন জঙ্গল অতিক্রম করে। ৬ই আগস্ট, ১৯৭১  তারা একযোগে আক্রমন পরিচালনা করে এবং বাংলাদেশের মানুষ রেডিও-বাংলাদেশ, বিবিসি, লন্ডনের মাধ্যমে এই  সাফল্যের  খবরটি জানতে পারে। বাংলাদেশের নৌ কমান্ডোরা চট্টগ্রামে ৬ টি জাহাজ ও বার্য, মংলায় ৫ টি জাহাজ ও বার্য, নারায়ণগঞ্জে  তিনিটি কোস্টার ও বার্য ও চাদপুরে একটি জাহাজ ও প্নটুন ধ্বংস করে। দাউদকান্দি সেতুও সম্পূর্ণ ভাবে ধ্বংস করা হয়। এর ফলে পাকিস্তানি গানবোটগুলোর চলাচলের পথ ও চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসার একমাত্র নৌ পথটিও বাংলাদেশের নৌ কামান্ডোদের আক্রমনে  বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশের মুক্তিবাহীনি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এরকম অভিযান এর আগে হয়নি। এই খবর অংশগ্রহণকারী কামান্ডোদের অত্মায় শান্তি এনে দেয়।  অপারেশন সাফল্যের সাথে শেষ করে তারা প্লেসি ক্যাম্পে ফেরত আসে। বাংলার সাহসী বীরএর একজন  জনাব আফতাবুদিন ( নংঃ ০০৫৬) খুলনার ভুদহাটায় রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ার ঘটনা আমাকে অনেক কষ্ট দেয়। রাজাকাররা পরে থাকে নির্মমভাবে হত্যা করে ।

আগরতলা যুব ক্যাম্প থেকে ৬০ জন তরুন আমাদের ক্যাম্পে কমান্ডো ট্রেনিং এ  যোগদান করেছিলো। আবার পশ্চিমবঙ্গের ১২০ জন তরুন যুব ক্যাম্প থেকে আমাদের ক্যাম্পে যোগদান করে। ২৬ শে আগস্ট ১৯৭১ চার থেকে বিশ জনের ছোট ছোট গ্রুপ করে নিম্নোক্ত স্থানসমূহে আমরা নাশকতা ও ধংসাত্বক অপারেশন  পরিচালনার জন্য প্রেরন করি। স্থানগুলো হচ্ছে, চট্টগ্রাম বন্দর, বরিশাল, মংলা,আরিচা, সিলেট,নগরবাড়ি, মাদারীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, মাগুরা, দাউদকান্দি, ফুলছরিঘাট, খুলনা,রাজশাহী,ভোলা ,নরসিংদী,নবীনগর, রাজবাড়ী, অস্টগ্রাম ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর।  তারা তাদের নির্ধারিত স্থানে অপারেশন পরিচালনা করে সময়মত প্লেসি ক্যাম্পে ফেরত আসে ।পাকশির হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ধ্বংসের পদক্ষেপ ও নেয়া হয়। একটি অপারেশনে ৪ জনের একটি কমান্ডো গ্রুপ রাজাকারদের হাতে  ধরা পরে এবং তাদের নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। অমানুষিক অত্যাচারেও আমাদের নতুন ট্রেনিং প্রাপ্ত কমান্ডোরা তাদের পরিচয় প্রকাশ করে নি। পরে তারা মুক্তি পায়। ফরিদপুর অপারেশনে শহীদ কবিররুজামান ( নংঃ ০০৬৭) পাঞ্জাবীদের হাতে নিহত হন। চট্টগ্রাম বন্দরে আমাদের একজন সদস্য নিখোজ হন তখন তিনি বহিঃনোঙ্গর এলাকায় অপারেশনে নিয়োজিত ছিলেন। ফুলছরিঘাট অপারেশনে একটী চলন্ত গানবোটে মাইন স্থাপন করতে গিয়ে এ আর মিয়ান সহ ৩ জন নিহত হন।

বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর কামান্ডার ইন চিফ ব্রিগেডিয়ার সালেক কে  খুলনাতে আমাকে সহ ১১ জন কে একটি অপারেশনে পাঠানোর পরামর্শ দেন।  আমি ২৬ শে সেপ্টেমবর ১৯৭১ তাকিতে অবস্থিত নয় নং সেক্টর হেডকোয়ার্টারের উদ্দেশ্যে  প্লেসি ক্যাম্প ত্যাগ করি। আমাকে নিম্নোক্ত অস্ত্র সমূহ প্রদান করা হয়। ২৬ টি মাইন, ২০ পাউন্ড বিস্ফোরক, ২টি এস এল আর, ৪ টি এস এমজি ও ৬০০ টাকা। ৪০ জন মুক্তিফৌজ সহ লেফটেন্যান্ট আরেফিন, ২০ জন নৌ কমান্ডো সহ এম বি আলম  ও গ্রুপ ইনচারজ খিজির আলী ৪০ জন মুক্তিফৌজ সহ আমার সাথে ৩০ সেপ্টেমবর তাকি ক্যাম্পে যোগদান করেন। খুলনা ও সুন্দরবন এলাকায় তিনটি ট্রেইনিং ক্যাম্প সহ আমি ১৯ টি ক্যাম্প স্থাপন করি ও নিম্নোক্ত অপারেশন সমূহ পরিচালনা করি। ৮ হাজার মুক্তিসেনা এইসব ক্যাম্পে প্রশিক্ষন দেয়া হয় এবং তারা প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করে। অক্টোবর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমার নেতৃত্বে নিম্নোক্ত অপারেশনসমুহ পরিচালনা করি, (১) ৬ অক্টোবর আশাসুনি অপারেশন, এখানে ২৫ জন রাজাকার নিহত ও আহত হয়। (২) ৯ অক্টোবর চাপড়া অপারেশন, এখয়ানে ৬ জন রাজাকার নিহত ও আহত হয়। (৩) ১৫ ও ২৮ অক্টোবর সুন্দরবন অপারেশন, এখানে ৬ জন ডাকাত আটক করা হয়। (৪) ২৬ শে অক্টোবর কয়রা অপারেশন এখানে একটি জাহাজ একটি বার্য ও একটী ফ্লাট ধ্বংস ডুবিয়ে দেয়া হয়। (৫) ২ নভেম্বর মংলা বন্দরে ২টি জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া হয়। (৬) ৮ নভেম্বর লক্ষিখোলা অপারেশনে ৬ জন রাজাকার আহত ও নিহত হয়। (৭) ১২ই নভেম্বর মংলা বন্দরে একটি জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া হয়। (৮) ২৫শে নভেম্বর চালনা অপারেশনে ১০ জন রাজাকার নিহত ও আহত হয়। (৯) ৫ ডিসেম্বর কাপিলমুনি অপারেশনে ১০০ রাজাকার নিহত হয়। (১০) ৬ নভেম্বর আশাসুনি অপারেশনে ২ জন রাজাকার নিহত হয় ও একজন আত্মসমর্পণ করে। (১১) ৭ ডিসেম্বর দেবহাটা অপারেশনে একজন রাজাকার নিহত ও একজন আত্মসমর্পণ করে। (১২) ৮ ডিসেম্বর মাংলা বন্দরে সকল রাজাকার আত্মসমর্পণ করে ও সকল অস্ত্র দখল করা হয়। (১৩) ১০ ডিসেম্বর বাইটাঘাটা অপারেশনে ২ জন রাজাকার নিহত ও একজন আত্মসমর্পণ করে। (১৪) ১৪ই ডিসেম্বর গোল্লামারি অপারেশন পাক বাহিনীর তীব্র গোলাবর্ষণ এর কারনে পরিত্যাগ করা হয়  এবং (১৫)  ১৬ ও ১৭ ডিসেম্বর আমার অধীনে খুলনা জেলার  ৮০০০ মুক্তি বাহিনী ও মুজিব বাহিনী ছিলো  এবং সম্মিলিতভাবে আমরা খুলনা আক্রমন করি। শত্রুদের কাছ থেকে দখল করা ২ টি বার্জ,  ৪ টি ৪০/৬০ মিমিঃ কামান দিয়ে সজ্জিত দুটি বার্য থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থাসমূহের উপর গোলাবর্ষণ করা হয় এবং পাক বাহিনী ও রাজাকারদের সাথে প্রচন্ড সংঘর্ষের পর আমি ১৭ ডিসেম্বর সকাল ৬.৩০ ঘন্টায় খুলনা শহরে প্রবেশ করি। এখানে ৪ জন পাকসেনা নিহত হয়।

যেদিন থেকে আমি অপারেশন ও তরুনদের ক্যাম্পে প্রশিক্ষন দেয়া শুরু করি সেদিন থেকে স্বাধীনতার দিনটি পর্যন্ত নিম্নোক্ত কমান্ডারগন আমার অধীনে ছিলেন। এরা হলেন, ১) ক্যাপ্টেন শফিকুল্লাহ,২) লেফটেন্যান্ট আ স ম আরেফিন, ৩) মুজিব বাহিনীর খুলনা জেলার চীফ জনাব কামরুজ্জামান (টূকু), ৪) জনাব তৌফিক (মুজিব বাহিনী),৫)জনাব বাহার আলী (মুজিব বাহিনী),৬) জনাব কাইযুম(মুজিব বাহিনী),৭) জনাব এম এ সালাম (মুজিব বাহিনী), ৮) জনাব ইউনুস (মুজিব বাহিনী) ও ৯) জনাব খিজির আলি।

এখানে উল্লেখ্য ব্যাপার এই যে খুলনা ও মংলায় নদীতে অনেক কুমির ছিলো এবং আমাদের কমান্ডোরা পায়ে শুধুমাত্র ফিন পরে ও লিমপেট মাইন নিয়ে অপারেশনে যেতো এবং কুমিরের জন্য কোন অপারেশনেই কোন দুর্ঘটনা ঘটে নি। যদিও শীতে পানি ছিলো বরফশীতল তারপরেও আমাদের কমান্ডোদের দিনের পর দিন পানিতে থাকতে হতো। তীব্র বর্ষণ, তীব্র শীত, রেশনহীন, আশ্রয়হীন ভাবে তাদের থাকতে হতো এমনকি সুন্দরবনেও থাকতে হতো যেখানে রয়েল বেঙ্গল টাইগার আছে। এই কমান্ডোরা অনেক অনেক অপারেশন করেছে যেগুলো বর্ণনা করা সম্ভব নয়। জহুরুল হক,আব্দুল খালেক, শমশের আলী মংলা অপারেশনে গুরুতরভাবে আহত হন। কমান্ডো অপারেশনে ছোট বড় ৭৬ টি সমুদ্রগামী জাহাজ, বার্য,কোস্টার, গানবোট, কনভারটেড গানবোট,ফ্লাট ,ডুবিয়ে দেয়া হয় ও কিছু জেটি ও ব্রিজ ধ্বংস করা হয়।

এটি উল্লেখ্য যে হাসনাবাদ ও হালদিয়া ক্যাম্প দুটি পক্ষত্যাগ করা পাকিস্তানি নেভি সদস্যদের সংগঠিত করার জন্য তৈরি করা হয়েছিলো। নয় নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর জলিলের সহযোগিতায় নেভির জন্য বঙ্গবন্ধু ফ্লিট নামের একটি ফ্লিট তৈরি করা হয়েছিলো। এই ফ্লিটটি ছোট অস্ত্র দিয়ে সজ্জিত ছোট ছোট বোট  দিয়ে গঠিত হয়েছিলো। তারা সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়ে ছোট ছোট অপারেশন চালাতে আসতো। তারা বাংলাদেশে সম্পূর্ণভাবে প্রবেশ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে।

পাকিস্তানের পক্ষত্যাগ করা সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত  দুটি গানবোট পদ্মা ও পলাশ অপারেশনের জন্য খুলনা এলাকায় আসে। দুটি গানবোটই ধ্বংস হয়। ডুবে যাওয়া দুটি গানবোটে সেইলর ও সৈন্যদের পজিশন ও তাদের পরিনতি নিম্নে দেয়া হলো। শহীদঃ  রুহুল আমিন C. ERA,মোহাম্মদ মমতাজউদ্দিন  Me-1, মহিউদ্দিন  A. B. M. D. H,, মোল্লাহ  A.B., এম এম রহমান A.B, এম হক A.B, রফিকুল ইসলাম নেভাল কমান্ডো এবং ফরিদউদ্দিন আহমেদ  REN-1, আহতঃ এম এ তাহের  ME-1, এ আর ভুঁইয়া -EN-1, এম ফজল এল এম ই, আব্দুল হোক এ বি এম এ মুতালিব এ বি এম এ মজুমদার এম ই-১, নেভি কমান্ডো বশির আহমেদ ও মোঃ জালালউদ্দিন  L/S। রাজাকারদের কাছে ধরা পরেন ও নির্মম অত্যাচারের জন্য খুলনা জেলে নেয়া হয়, এম এ রউফ L/S, এম এস হক L/wrt, এম এ সরকার PO/RS, এম এ হুসেন S/td, এ আর খান To-2, রফিকুল্লাহ A. B, জাকের জাকের L/S, তাহের ME/I.।

এছাড়া নৌসেনাদের ৮ জনের একটি দল হাজামারায়  ৩ নম্বর সেক্টরে নিয়মিত বাহিনীর সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। তারা হলেন, জনাব ইসলাম ইআর, এম এম উদ্দিন L/wrt, জেড ইউ আহমেদ – CK-I, কে এন ইসলাম PM-1, সালেহ মোহাম্মদ ADD, আমিন- REN-I, ও সিরাজউদ্দিন AB।  কর্নেল শফিউল্লাহর নেতৃত্বে বি কম্পানির অধীনে  এই ৮ জন নৌসেনা  ধর্ম নগর (সিলেট) এলাকায় পাক বাহিনীর সাথে সম্মুখসমরে  যুদ্ধ করে। তিনটি আক্রমনেই তারা প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন, এছাড়া তারা প্রতিদিনই শহীদ লেফটেন্যান্ট বদিউজ্জামানের নেতৃত্বে সিলেটের অভ্যন্তরে যুদ্ধে যেতেন। তারা বর্ডার এলাকা ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। এছাড়া আরো নৌসেনা যারা বিদ্রোহ করেছিলো তারা বিভিন্ন সেক্টরের অধীনে সাহসের সাথে মাতৃভূমির জন্য  যুদ্ধে অংশ নেন।

১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশীদের জন্য একটি স্মরণীয় দিন। এদিনে ৬-৪৫ ঘন্টায় আমি খুলনা সার্কিট হাউজে বাংলাদেশের পতাকা উড়াই। শহরের জনতা সেদিন জয় বাংলা শ্লোগান তুলে উল্লাস করছিলো। তারা মুজিব বাহিনীকে শহরে পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছিলো। ১১-০০ ঘটিকায় মেজর জলিল ভারতীয় সৈন্যদের সাথে নিয়ে খুলনা শহরে প্রবেশ করেন এবং খুলনা শহরে আমাকে ও আমার গ্রুপকে দেখে আশ্চর্য হয়ে যান।

                            ___ জয় বাংলা ____

(মোহাম্মাদ রহমতুল্লাহ)

সাব লেফটেন্যান্ট, পাকিস্তান নৌ বাহিনী

১৯-১১-১৯৭৪

 

 

মোঃ কাওছার আহমদ

<১০, ২২.২, ৫১৪-৫২০>

সাক্ষাৎকার: মো: বদিউল আলম

১১৭৯

প্রথম আক্রমণঃ আমাদের নৌ-পথে বাংলাদেশ প্রথম কর্মতৎপরতা শুরু হয় আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহে প্রথম দিকে।আমি কিছু সংখ্যক ছেলেসহ কলিকাতা হয়ে আগরতলায় আসি হিন্দুস্তান বোমারু বিমানে চড়ে। আগড়তলা থেকে প্রয়োজনীয় গোলাবারুদসহ আমার সংগে বিশজন ছেলে নিয়ে আমি কুমিল্লা অভিমুখে রওনা দিই। আমার টারগেট ছিল কুমিল্লা-চাঁদপুর ফেরীঘাটসহ জাহাজ বিধ্বস্ত করা।

বিশজনের একটি গেরিলা দল নিয়ে আমি বকশনগর বর্ডার দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করি। পথটি ছিল পাহাড়ি ও বন্ধুর। দুই পাশে পাকসেনার প্রহরাশিবিরের মধ্যদিয়ে গভীর রাতে আমরা পাড়ি জমাই।স্থানীয় গ্রামবাসীরা এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করেছিলেন। সীমানা পার হয়ে আমি প্রথমে আমাদের বাংলাদেশে পদার্পণ করি এবং পূর্ণ উদ্যমে সামনের দিকে এগিয়ে চলি। কোথাও ধানক্ষেত, কোথাও বনজঙ্গল, কোথাও আবার ডোবা নালা বিল।অতি সংগোপনে আমরা সি -এন্ড রি বড় রাস্তা পার হয়ে নৌকা নিয়ে চলতে থাকি। এইভাবে কিছুদূর যাওয়ার পর আমরা পায়ে হেটে ভিতরে প্রবেশ করতে লাগলাম। এমন সময় সকাল হয়ে গেল। আমরা এক মাস্টার সাহেবের বাড়িতে উঠলাম।মাস্টার সাহেব আমাদেরকে সাহায্য করেছিলেন।সন্ধ্যার প্রারম্ভে আবার আমরা যাত্রা শুরু করি এবং চাঁদপুরের নিকট সফরমানী গ্রামে ইব্রাহিম মাস্টার (বি-টি) সাহেবের বাড়িতে এসে উঠি।মাস্টার সাহেবের দুই ছেলে সাজু ও দুলু আমার সঙ্গে ছিল।এর পরদিন আমরা ওখান থেকে গিয়ে উঠি এমসি মিজানুর হরমানের বাড়িতে। ওখানে নিরাপত্তাবোধ না হওয়ায় আমরা আবার এসে উঠি এক বিখ্যাত মুসলিম লীগ নেতার বাড়িতে। সেখানে জোরপূর্বক তার বড় ছেলেকে জিম্মা হিসাবে আটক রেখে এই হুশিয়ারী দিই যে, আমাদের অবস্থানের কথা জানিয়ে দিলে আমরা তার ছেলেকে হত্যা করবো।এতে বেশ কাজ হয়। আমরা মাঝির ছদ্মবেশে রাতে চাঁদপুরের নিকট দিয়ে নদী পাড়ি দিই।এমন সময় আমরা ঝড়ের মুখে পতিত হই।এর ফলে আমাদেরকে চরের মধ্যে বেশ কিছু সময় নৌকা নিয়ে অপেক্ষা করতে হয়েছিল।রাত্র ১১ টা থেকে ৩টা পর্যন্ত আমাদের অভিযান চলার কথা ছিল।আমরা ঠিক সময় আমাদের অভিযান আরম্ভ করি,কিন্তু দু:খের বিষয় ভাগ্য আমাদের সুপ্রসন্ন ছিল না।সবই আল্লাহর ইচ্ছা।অবশ্য আমাদের অভিযানের সংকেতধ্বনি বাজানো হয়েছিল তখনকার বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্র থেকে।আমাদের সংকেত ছিল পঙ্কজ মলিকের লেখা একটি গানের কলি-বধূ আসবে পালকি চড়ে ইত্যাদি। আমাদের অভিযান শুরু হওয়ার কথা ছিল ১৪ই আগস্ট দিবাগত রাত্রে কিন্তু ঐ দিনটি মেঘাচ্ছন্ন দুর্যোগপূর্ণ থাকায় আর তাছাড়া আমাদের পৌঁছানোর নিরাপত্তা না থাকায় অভিযান দুইদিন পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

১৭ই আগস্ট রাত ১১ টায় আমি আমার প্রথম অভিযান চালাই। এর আগে আমি দিনের বেলায় চাঁদপুর শহর ও নদীপথ ভালভাবে পরিদর্শক করে আসি যাকে রেকি বলা হয়। আমি ছেলেদের ছয়টি দলে ভাগ করে প্রত্যেককে একটি করে লিমপেট মাইন পেটে বেধে উল্টাপথে সাতার দিয়ে টারগেটের দিকে অগ্রসর হতে নির্দেশ দিই।সংগে আমিও পিছনে রওনা দেই দুইটি মাইনসহ।দুজন ছাড়া সবাই তাদের টারগেটে মাইন লাগাতে সমর্থ হয়।আমার লক্ষ ছিল সবচাইতে বড় একটি গমের জাহাজ। এজন্য আমি দুটি মাইন নিয়ে অন্য দুজন ছেলেসহ প্রথমে গমের জাহাজের নিচে ডুব দিয়ে নিজ হাতে মাইন লাগাই এবং সংগে আমার সংগী দুজন ও মাইন লাগায়।এরপর সাতরিয়ে পদ্মার মুখে এসে পড়ি।এমন সময় সৈন্যবাহী জাহাজ গাজী আমাদেরকে সম্মুখে বাধা দেয়।তখন এদিকে জাহাজে লাগানো মাইন ধুম ধুম শব্দে ফুটতে শুরু করেছে।জাহাজের ভিতরে তখন হৈ হুল্লোড় চিৎকার শুরু হয়ে গিয়াছে।দুই ধার থেকে তখন প্রহরা বাহিনী নদীর মধ্যে অজস্র গুলি ছুড়তে আরম্ভ করেছে।আমার দল তখন গুলির মুখে টিকতে না পেরে ছত্রভঙ্গ হয়ে যে যার দিকে সম্ভব আত্নরক্ষার জন্য দ্রুত সরে পড়ে।অন্য দুই দলসহ আমরা ছয়জন তখন পদ্মা নদীরমুখে গাজী জাহাজের সামনে বাধা প্রাপ্ত হই।তখন আমি একটা বার্জ এর গা ধরে কিছু সময় নিজেকে লুকিয়ে রাখি। প্রায় ভোর হয়ে আসছিল। এদিকে জাহাজ ও আর সরে না,আমরাও আমাদের পথ চলতে পারিনা।কিছু সময় অপেক্ষা করার পর আমার দলের শেষে লাগানো একটি মাইন জেটির কাছে বিষ্ফোরিত হয় এবং গাজী তাড়াতাড়ি নদীর মুখে থেকে নদীর ভিতরে চলে যায়। তখন আমরা ঐ সুযোগে তাড়াতাড়ি পদ্মার মুখ পার হয়ে এক পাটক্ষেতের পাশে ঢুকে পড়ি।এমন সময় সকাল হয়ে গেছে।আমরা তখন ৬জন মাত্র একত্রে আছি বাকী যে যার মত পেরেছে নিজেকে বাচানোর জন্য ছুটে গেছে।পূর্ব নির্দেশ মোতাবেক যেখানে আমাদের কে নৌকায় ঊঠার কথা ছিল সেই পূর্বনির্ধারিত স্থানে নৌকা না পাওয়ায় আমরা সবাই বিমূঢ় হয়ে পড়ি।আমাদের তখন শূন্য হাত,কোন অস্ত্র নেই।আছে শুধু সাতার কাটার জন্য পায়ে ফিন। এ অবস্থায় আমি দলবলসহ এক পাশের বাড়িতে গিয়ে উঠি এবং জোরপূর্বক এক নৌকায় উঠে বসি।নৌকার মালিক আমাদের দেখে জোরে চিৎকার দেয়।আমরা নৌকা নিয়ে অল্প কিছুদূর এসেছি মাত্র এমন সময় চারদিক থেকে আমাদেরকে প্রায় ১০০ নৌকা ঘিরে ফেলে।নৌকাগুলো ঐ সময় নদীতে ইলিশ মাছ ধরছিল। মাঝিরা আমাদেরকে ঘেরাও করে আমাদের দিকে আসতে থাকে। নিকটে আসার পর আমাদের অবস্থা বুঝতে পেরে আমাদেরকে ডুবুরী বলে চিৎকার দেয় এবং হিন্দুস্থানী বলে চিহ্নিত করে।আমরা নৌকা প্রায় ধর পড়ার উপক্রম। সামনে পিছনে সবব দিকে পথ বন্ধ।সব নৌকার মাঝিরা চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে।তখন বেলা উঠেছে, আমাদেরকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।এমন সময় আমাদের মাথায় উপস্থিত বুদ্ধি খেলে যায়।আমি আমমাদের ছেলেদেরকে সবগুলি ফিন উপরের দিকে উচিয়ে ধরতে বলি যে বলা সেই কাজ।আমি তখন চিৎকার করে বলি আমাদেরকে পথ ছাড় নতুবা আমরা তোমাদেরকে গুলি করে মেরে ফেলবো। আমার হাতে টর্চ লাইট থাকায় সেটা তাদের দিকে উচিয়ে ধরি এবং পথ ছাড়তে বলি।ওদিকে অনবরত চাঁদপুর বন্দরে আমাদের লাগানো মাইন ফাটা আরম্ভ হয়েছে।আমি তাদেরকে ভয় দেখিয়ে বলি ঐ যে শব্দ শুনতে পারছ,আর এই যে আমাদের কাছে বোমা দেখছো, এটা তোমাদের উপর ছেড়ে দেব। যেমন বলা আর যায় কোথায়, সবাই তখন নৌকা নিয়ে যার দিকে পালাতে শুরু করলো। এর ফলে আমরা নৌকা বদল করে নান্নু নামক এক ছেলের অন্য এক নৌকায় উঠি। পরে শুনতে পাই আমাদের কে সাহায্য করার জন্য ছেলেটিকে পাকবাহিনী গুলি করে মেরে ফেলে।

এরপর আমি সোজা পশ্চিম দিকে নৌকা চালিয়ে কলমচোরা গ্রামে গিয়ে উপস্থিত হই।ওখানকার চেয়ারম্যান দেওয়ান সাহেব তার বাড়িতে দুপুর বারোটার সময় আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করেন।ক্ষুধায় আমাদের তখন জান বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। আমাদের পরনে তখন মাত্র একটা জাংগিয়া ছাড়া আর কিছু ছিল না। অবশ্য তিনি আমাদের প্রত্যেককে একখানা করে লুঙ্গি দিয়েছিলেন আর কাউকে বা গেঞ্জি আর কাউকে বা শার্ট। আমাকে আগেই নান্নু ছেলেটা তার একটা গামছা ও গায়ের শার্ট খুলে দিয়েছিল। আমরা খাওয়ার সময় সংবাদ পাই যে,আমাদের ধরার জন্য পাকসেনা ও বেশ কিছু রাজাকার আমাদের দিকে আসছে। এমতাবস্থায় আমরা তাড়াতাড়ি অল্প কিছু নাকে মুখে দিয়ে ওখান থেকে সরে পড়ি।সন্ধ্যার সময় স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমানের বাড়িতে গিয়ে উঠি এবং রাত্রি যাপন করি অন্য এক বাড়িতে। সারারাত কোন রকম অনিদ্রায় কাটিয়ে দিই।সকাল হওয়ার সংগে সংগে আমি ছেলেদের খোজে বের হই।অনেক খোঁজাখুঁজির পর দুজনের দেখা পাই এবং তাদেরকে সংগে করে আমি চলে আসি সফরমানী গ্রামে ইব্রাহীম (হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক) সাহেবের বাড়িতে।এসে শুনতে পাই গতকাল্য চাঁদপুর বন্দরে যে অভিযান চালানো হয় তার জন্য মাস্টার সাহেবকে পাকবাহিনী দায়ী করে এবং পরের দিন গুলি করে হত্যা করে।বাড়িতে যা কিছু মালামাল ছিল সব কিছু লুট করে নিয়ে যায়।নারী নির্যাতন করতেও ছাড়ে নাই।ঘটনা শুনে মনে ভীষন ব্যাথা পাই এবং প্রতিজ্ঞা করি যে,এর প্রতিশোধ নেবই নেব খোদা যদি বাঁচিয়ে রাখেন।মাস্টার সাহেবের দুই ছেলে সাজু ও নিলুসহ আমি আমাদের শিবির আগরতলায় যাওয়ার জন্য তৈরী হতে থাকি।এমন সময় আরও দুজন বিমান বাহিনীর লোক আমার সংগে যোগ দেয়।

শিবিরে এসে শুনতে পাই আমি পাকসেনাদের হাতে ধরা পরেছি এবং আমি তাদের নিকট আত্নসমর্পন করেছি। এই খবর পাকিস্তান রেডিও থেকে জোরে ফলাও করে প্রচার হয়েছিল। অবশ্য প্রথম অভিযানের দীর্ঘ ১১দিন আমার কোন খোঁজখবর ছিল না। এতে আমার শিবিরের সকলের মনে দারুন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। আমার আগমনে সবাই এক সংগে হর্ষধ্বনি দিয়ে আমাকে ঘাড়ে উঠিয়ে আনন্দে হাততালি দিতে শুরু করলো।দুদিন যেতে না যেতে আমার ডাক পরে কলিকাতা ফিরে যাওয়ার জন্য। আমাকে বোমারু বিমানে করে কলিকাতা নিয়ে যাওয়া হয়। কলিকাতায় এসে শুনতে পেলাম অন্যান্য নৌ-অভিযানের মধ্যে সবচাইতে বেশি জাহাজ চাঁদপুর ডুবেছিল এবং চাঁদপুরের সংবাদ বিবিসি সংবাদ সংস্থা পর্যন্ত পরিবেশন করে ছিল।

দ্বিতীয় আক্রমণঃ কলিকাতা থেকে আবার পলাশী শিবিরে চলে আসে। ইতিমধ্যে আমার জন্য করে অভিযান চার্ট তৈরী করে রাখা হয়েছে। আমাকে খুলনার মঙ্গলা পোর্ট অপারেশন করতে হবে।এর আগে যে দলকে আমরা মঙ্গলা পোর্ট অপারেশন করতে দিয়েছিলাম তারা বেশী একটা সুবিধা করে উঠতে পারেনি। প্রথম মঙ্গলা দলের অধিনায়ক ছিলেন আমার বন্ধু আহসানুল্লাহ।

আমি এবার ৩০ জন ছেলে সংগে করে মঙ্গলা অপারেশন এর জন্য তৈরী হতে লাগলাম। আগস্ট মাসের শেষদিন আমি ৩০জন ছেলেসহ কলিকাতার ব্যারাকপুর চলে আসি।ওখানে আমাদের জন্য বিশ্রাম শিবির তৈয়ার করা ছিল।ব্যারাকপুর থেকে আমরা প্রয়োজনীয় গোলাবারুদ সহ ৯নং সেক্টর মেজর জলিল সাহেবের সংগে যোগ দিই।আমাকে সাহায্য করার জন্য মেজর জলিল আমাকে লে:শামসুল আরেফিন সাহেবকে সংগে দেন।আরও দেন ২০০জন স্থল গেরিলা বাহিনী। স্থল গেরিলা বাহিনী আমাদেরকে সাহায্য করবে আর প্রয়োজনবোধে পাকবাহিনীর সংগে যুদ্ধ চালাবে।বাকুন্দিয়া শিবির থেকে আমরা আবার হিঙ্গলগঞ্জ শিবিরে চলে আসি।এখানে দুদিন অপেক্ষা করার পর লে:শামসুল আরেফিন সহ আমি দলবল নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করি।

আমরা সাধারণত রাত্রিবেলায় চলাফেরা করতাম। দিনের বেলায় কোন জংগলে অথবা গ্রামের নির্জন বাড়িতে শিবির করতাম,এবং সব সময় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতাম যাতে পাকবাহিনী আমাদেরকে আক্রমণ করলে আমরা তার মোকাবেলা করতে পারি।এভাবে দুদিনে ৮০ মাইল পথ পেরিয়ে প্রায় ৩০০ লোকের একটা গেরিলা দল নিয়ে আমরা মঙ্গলা পোর্টের কাছে কৈলাশখালী গ্রামে আমাদের শিবির স্থাপন করি।

কৈলাশখালী গ্রামে লোকজন বেশী ছিলনা। অধিকাংশ বাড়ি ছিল পরিত্যক্ত। আমরা সুন্দরবনের ধারে এক হিন্দু ভদ্রলোকের বাড়িতে আশ্রয় নিই।আর অন্যান্য স্থলবাহিনী ছেলেদেরকে আমরা কয়েক ভাগে ভাগ করে পরিত্যক্ত বাড়িতে রাখি,যাতে আমাদের উপর হঠাৎ পাকসেনা আক্রমণ করলে সুবিধা করে উঠতে না পারে।

কৈলাশখালী গ্রামে একদিন বিশ্রামের পর আমি ও আমার বন্ধু শামসুল আরেফিনসহ আমরা মঙ্গলা পোর্টে রেকি করার জন্য যাই ছোট এক নৌকাযোগে। ঐসময় খিজির নামে এক মুক্তিযোদ্ধার সংগে আমাদের পরিচয় হয়।মঙ্গলা পোর্ট-এর নিকট সে আগে থেকেই গেরিলা তৎপরতা চালাচ্ছিল। আমাদের পেয়ে সে আরো সাহস অর্জন করলো খিজির ওখানকার বাসিন্দা হওয়ায় আমাদের রাস্তাঘাট চলাচলে সুবিধা হয়েছিল।আরেফিন আমি খিজির ও নৌকা চালানোর জন্য আরও কয়েকজন ছেলেসহ আমরা ঠিক সন্ধ্যার আগে মঙ্গলা পোর্ট রেকি করে আসি। পরদিন আমরা সন্ধ্যার সময় বড় বড় ছ’খানা নৌকায় মঙ্গলা পোর্টের কাছে এসে উঠি।স্থলবাহিনীকে আমরা তিন জায়গায় পজিশন মত বসিয়ে রাখি। যদি কোনরূপ আক্রমণ হয় তারা পাল্টা জবাব দেবে।অবশ্য আরেফিন সাহেব এসব বন্দোবস্ত করেন।আমি আমার নৌ কমান্ডো ছেলেদেরকে বুকে বাধা মাইনসহ বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে নিজে এক দলসহ নদীতে সাতার দেই। আমাদের সংগে থাকতো শুধু ছোট একটি ছুরি,এক জোড়া ফিন আর একটা লিমপেট মাইন।আর গ্রুপ লিডারের কাছে থাকতো একটি অথবা দুটি করে হাতবোমা।কোন জাহাজে চারজন, কোন জাহাজে ছয়জন এভাবে ভাগ করা ছিল।আমার সংগে ছিল চারজন। আমার যে জাহাজটাতে মাইন লাগানোর কথা তা নদীর অপর প্রান্তে বাধা ছিল।যাদের টার্গেট নিকটবর্তী ছিল তারা সেখানে তা লাগিয়ে যে যারমত নিজেকে নিয়ে কেটে পড়ে। আমার জাহাজে যখন পৌঁছি তখন আমার একজন ছেলে তীব্র স্রোতের মধ্যে আমাদের দল ছাড়া হয়ে যায়।আমি ডুব জাহাজের গায়ে যখন মাইন লাগাচ্ছিলাম, তখন অন্য দল দ্বারা পূর্বে লাগানো মাইন বাস্ট হয়ে নদীর মধ্য জাহাজ ডুবতে শুরু করে করেছে।আমি দ্রুত আমার কাজ শেষ করে অন্য ছেলে দুটিসহ ফিরে আসার চেষ্টা করি।এমন সময় জাহাজ থেকে খুব জোরে হুইসেল বাজানো আরম্ভ হয়।অনবরত এস ও এস (সেভ আওয়ার সোল)সংকেত ধ্বনি হতে থাকে।সংগে সংগে বন্দররক্ষী বাহিনী আমাদের লক্ষ্য করে নদীর মধ্যে গুলি ছুড়তে শুরু করে।নদীর মধ্যে বৃষ্টির গুলি চলছে।আমাদের মোতায়েন স্থলবাহিনী ও পাল্টা জবাব দিচ্ছে। উভয় পক্ষে ভীষণ রকম গোলাগুলি। নদীর উপরে আকাশ লালে লাল।সমস্ত বন্দরের আলো নেভানো। আমি আমার দলসহ নদীর কিনারায় আসতেই আমার উপর উঠে পরে একটি ছোট উদ্ধারকারী লঞ্চ। লঞ্চটির আলো বন্ধ ছিল।আর আমি উল্টোভাবে সাতার দিচ্ছিলাম। আমার মাথায় লঞ্চটি জোরে আঘাত করে।জোরে আঘাত পাওয়ায় আমার জ্ঞান হারানোর অবস্থা হয়।আমি তখন জোরে ডুব দিয়ে নিজেকে রক্ষা করার জন্য শ্রোতের অণুকুলে পানির নিচে চলতে আরম্ভ করি।জাহাজের নিচ থেকে নিজেকে রক্ষা করার পর পানির উপর ভেসে উঠে আমার কোন সংগী পেলাম না।তখন প্রায় একা একা স্রোতের প্রতিকুলে গা ভাসিয়ে সাতার কাটতে থাকি। রাত্রি প্রায় তিনটার সময় আমার পায়ের নিচে মাটি লাগে তখন আমি সাতার ছেড়ে বুকে ভর দিয়ে নদীর কিনারায় উঠে বসি।এমন সময় আমার কানের পাশদিয়ে শো শো শব্দে গুলি চলে যায়।আবার মাটিতে শুয়ে পড়ি।লক্ষ্য করে দেখি আমার থেকে মাত্র বিশ ত্রিশ গজ দূরে পাকসেনাদের বাংকার।ওর মধ্যে থেকে অনবরত আমার দিকে গুলি আসছে।কোন উপায় না দেখে আমার কোমর থেকে শেষ গ্রেনেডটি বার করলাম। গ্রেনেডের চাবি দাত দিয়ে খুলে ফেললাম এবং জোরে বাংকারের মুখ লক্ষ্য করে ছুড়ে মারলাম এবং নিচের দিকে গড়িয়ে পরলাম। আমার গ্রেনেড শব্দ করে ওঠার সংগে সংগে বাংকার থেকে গুলি ছোড়া বন্ধ হয়ে যায়।আমি তাড়াতাড়ি উঠে আমাদের নৌকা যেদিকে ছিল সেদিকে দৌড় দিই। যাওয়ার পর আমার সংগে একজন ছেলের দেখা হয়,ওকে সংগে করে আমি আবার পথ চলতে শুরু করি। এদিকে নদীর উভয় পাশ থেকে ভীষণ গোলাগুলি চলছে।আমরা মাথা নিচু করে নৌকার দিকে আসতে থাকি।প্রকৃত পক্ষে আমি এত দূরে চলে গিয়েছিলাম যে নির্দিষ্ট স্থানে আসতে প্রায় দুঘণ্টা লাগে।আমার জন্য সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। নদীতে ছটার মধ্যে পাচটা জাহাজ ডুবে গেছে আর একটি জাহাজ কাত হয়ে পড়ে আছে।

আমাকে পাওয়ার সংগে শামসুল আরেফিন ও খিজির সংগে সংগে গোলাগুলি বন্ধ করার জন্য আমাদের বাহিনীকে নির্দেশ দেন।গেরিলা বাহিনী একত্র করার পর লোজ গণনাকালে আমার দুইজন নৌকমান্ডো কম দেখতে পাই।তাদের জন্য আরও প্রায় আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করা হলো।এদিকে পূর্ব আকাশ একেবারে ফর্সা হয়ে আসছে।আর অপেক্ষা করা সম্ভব নয় দেখে আমি নৌকা ছাড়ার জন্য নির্দেশ দেই। পাকসেনার আওতার বাইরে এসে এক নারিকেল বাগানে এসে কিছু ডাব ও নারিকেল পেড়ে খেয়ে সকালের নাস্তা সেরে দুপুরে শিবিরে ফিরে দেখি আমার ছেড়ে আসা ছেলে দুটি আমার আগেই শিবিরে পৌঁছেছে। ঐদিন বিকালবেলা পোস্ট মাস্টার সাহেব আমাদেরকে জানান যে পাকসেনাদের মনোবল খুবই ভেঙ্গে পড়েছে। আরও জানাগেল, গোলাবারুদ ভর্তি দুটি জাহাজ চিটাগাং বন্দরে পাঠানোর জন্য একেবারে নদীর ধারে রাখ হয়েছে। এ ছাড়া আশে পাশে কয়েকখানা খাদ্য জাহাজও আছে।

আমি বিকাল বেলা আমার অন্য সহকর্মী দ্বিতীয় কমান্ডার মালেকের সংগে অল্প কয়েকজন বাছা বাছা নৌ কমান্ডো ছেলে এবং আরেফিন ও খিজিরের একটি গ্রুপসহ মাত্র বারটা লিমপেট মাইন নিয়ে দুইটি নৌকা করে আবার নদীর ধারে চলে আসি।আগের দিন আমাদের আক্রমণ উল্টা দিক থেকে চালানো হয়েছিল। এবার বনের পাশ ঘেষে সন্ধ্যার আগেই সি-এন্ড বি রাস্তায় এসে পড়ি।রাস্তা থেকে জাহাজের সমস্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখতে পাই।তাতে মনে হলো, আমাদের কাজ খুব সহজ হবে।তিনটি জাহাজের উপর মাত্র কয়েকজন লোক দেখলাম।

আমার দ্বিতীয় কমান্ডার মালেক জাহাজ তিনটির অপারেশনে নিজে সংগে থাকার অনুমতি চাইল। কাল বিলম্ব না করে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসার সাথে সাথে সে অন্য দুইদলসহ চারটি করে মাইন নিয়ে নদীতে নেমে পড়ে।দূরত্ব বেশী না থাকায় ১৫মিনিটের মধ্যে জাহাজের গায়ে মাইন লাগিয়ে নিকট ফিরে আসে। তাদেরকে নৌকায় যেতে নির্দেশ দিয়ে আমরা গাছের আড়ালে আত্নগোপন করে মাইন ফাটার অপেক্ষায় থাকলাম। এত তাড়াতাড়ি যে আমরা তিনটি জাহাজে মাইন লাগাতে পারবো তা ধারনা করতে পারিনি। বেশী সময় অপেক্ষা করতে হল না।১৫ মিনিটের মধ্যেই গোলাবারুদ ভর্তি জাহাজ প্রথম মাইন বিস্ফোরিত হয়।সংগে সংগে বিকট আওয়াজ করে তিনটি জাহাজ প্রায় আধঘণ্টার মধ্যে ডুবতে আরম্ভ করে।যখন বন্দররক্ষীদের নিকট থেকে গুলি ছোড়া আরম্ভ হয় তখন আমরা আমাদের অবস্থান গোপন রাখার জন্য পাল্টা গুলি ছুড়তে আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে নিষেধ করি। ওখানে আর কাল বিলম্ব না করে দলবল সহ শিবিরে ফিরে আসি।পরদিন দুপুরে কোন রকমে চারটা পেটে দিয়ে আমরা ওখান থেকে নৌকাযোগে সরে পড়ি এবং গোলাবারুদ সংগ্রহ করার জন্য পুনরায় বাকুন্দিয়া শিবিরে মেজর জলিল সাহেবের নিকট ফিরে আসি। মেজর জলিল আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন এবং অশেষ ধন্যবাদ দেন।তিনি পরদিন আমাকে বারাকপুরে যেতে নির্দেশ দেন।

মঙ্গলা পোর্টে পর পর দুইটি অপারেশন এ নয়টি জাহাজ ডুবেছিল। এ সংবাদ বড় বড় অক্ষরে আনন্দ বাজার পত্রিকায় ফলাও করে প্রচার করা হয়।তাছাড়া পৃথিবীর অন্যন্য সংবাদ সংস্থা যেমন বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা থেকেও নাকি প্রচার করা হয়েছিল।তখন হিন্দুস্থান নেভী নাকি এস ও এর সংকেত ডায়মন্ড হারবার থেকে শুনতে পেয়েছিল।

আমরা চালনা বন্দরেও ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে অপারেশন চালাতাম। ছোট নৌকা আমাদের কাছে যথেষ্ট ছিল।ছোট নৌকায় যেমন দ্রুত চলাচল করা যেত তেমনি নিরাপত্তা ও ছিল।আমরা যে জায়গায় থাকতাম, সেখানথেকে অনেকদূরে গিয়ে অপারেশন করে চলে আসতাম।ফলে আমাদের অবস্থান পাকসেনাদের দৃষ্টিগোচর হতো না।একদিন দিনের বেলে মাঝি সেজে এক জাহাজে মাইন লাগিয়ে চলে আসি।এক ঘণ্টাপর জাহাজখানা ডুবে যায়।একদিন সংবাদ পেলাম যে দুইখানা আমেরিকান জাহাজ পোর্টের মধ্যে নোংগর করেছে,তার মধ্যে একখানা বোমা ও একখানা অস্ত্র গোলাবারুদ রয়েছে।এ কথা শোনার পর ভীষণ আলোড়ন সৃষ্টি হলো।যেমন করে হোক জাহাজ দুইটি ডুবাইতেই হবে।ঐ রাত্রে আকাশের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল।প্রবল বেগে বাতাস বইতেছিল। নদীতে খুব বড় বড় ঢেউ উঠছিল। এই সময় আমাদের লক্ষ্যর চন্য উপযুক্ত মনে করে সন্ধ্যার পরপরই ২৪জন ছেলেসহ আমি নিজে তৈরী হলাম।রহমত উল্লা,আরেফিনও নদীর ধারে পজিশন নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন।

বনের মধ্যে থেকে বের হয়ে আমাদের ছোট নৌকা বিলের মধ্য দিয়ে পোর্টের দিকে অগ্রসর হতে লাগল।লক্ষ্যের নিকটবর্তী হয়ে আমরা কিছু সময় সুযোগের অপেক্ষায় থাকতাম। এর মধ্যে স্থলবাহিনীকে বিভিন্ন পজিশন নিয়ে পাল্টা আক্রমণের জন্য তৈরী থাকতে বললাম। এদিকে পোর্ট থেকে সার্চলাইট চারদিকে নজর রাখা হচ্ছে।কিছু সময় অপেক্ষা করার পর এক সুযোগ নেমে পড়ি চার ভাগে ভাগ হয়ে ৪টা জাহাজ ডুবানোর জন্য।আমার জাহাজটা ছিল একটু দূরে।ঐ জাহাজটাতে ছিল অনেক গোলাবারুদ তাতে কড়া পাহারা ছিল।কোন ছেলে ঐ জাহাজটাতে যেতে সাহস পেল না।আমি ৬জন সাহসী ছেলেসহ নিজে রওয়ানা দিলাম। এদিকে বাকী তিনটি জাহাজে ছেলেরা প্রায় পৌঁছে গেছে।আমি জাহাজের নিকট পৌঁছা মাত্রই আমার উপর সার্চলাইট এসে পড়ে।পাহারারত সাস্ত্রী আমাকে দেখতে পেয়ে আমার দিকে গুলি চালায়।গুলিটি আমার বাম হাতের কুনুইয়ে লেগে যায়।তখন আমি আমার কোমর থেকে একটা গ্রেনেড বের করে দাত দিয়ে পিনটা খুলে ফেলি।গুলি করার সংগে সংগে আমি পানিতে ডুব দিয়েছিলাম। ফলে বাকী গুলি আমার আর লাগেনি। তখন উপর থেকে আমাদের উপর ডেপথ চার্জ করা হয়।এবং পাহারাদার চিৎকার করে বলতে থাকে ক্যাপ্টেন সাহাব,মুক্তি আ’রাহা হাঁয়।আমি আমার গ্রেনেড জাহাজের উপর ছুড়ে মারি।সংগে সংগে জাহাজে আগুন ধরে যায়।এদিকে সার্চ লাইট লক্ষ্য করে আমার দল গুলি চালায়, ফলে সার্চলাইট বন্ধ হয়ে যায় আমার দুটি ছেলে ডেপথ চার্জের ফলে ভীষণভাবে আহত।আমি তখন বাকী ৪জনসহ ডুব দিয়ে জাহাজের গায়ে মাইন লাগিয়ে দিই।তখন আমার মৃত্যুভয় চলে গেলে।মরার আগে আমি জাহাজকে ডুবিয়ে মরবো। গ্রেনেড মারার ফলে জাহাজে আগুন ধরে যাওয়ার আমাদের উপর আর আক্রমণ হয়নি।তদুপরি আমাদের স্থলবাহিনী ওপর থেকে পাল্টা আক্রমণ চালাচ্ছিল। ভীষণ গোলাগুলি চলতে থাকে।পোর্টে ব্ল্যাক আউট ঘোষণা করে আমাদেরকে ধরার জন্য স্পীডবোট নিয়ে নদীর মধ্যে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দেয় পাকসেনারা।আমি তখনও জাহাজের গা ধরে কচুরিপানা মাথায় দিয়ে জাহাজের নিচে অপেক্ষা করছিলাম। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে পারলাম না।কেননা,আমার নির্দিষ্ট সময় পার হয়েগেলে মাইন ফেটে যাবে।আমার মাইন এর সময় ছিল ৪৫ মিনিট। এসময়ের মধ্যে ৫০০ গজ ডূরে না যেতে পারলে মাইন এর শব্দে বুক ফেটে মারা যাবো।আর দেরী করা নিরাপদ নয় দেখে বাধ্য হয়ে ওখান থেকে আহত ছেলে দুটোকে সংগে করে রওয়ানা দিতে গিয়ে দেখি তারা তখনও মাইন লাগাতে পারেনি।ফিরে চেয়ে দেখি আমার সঙ্গী বাকী ৪জন আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।আহত ছেলে দুটির অবস্থা এতবেশি খারাপ হয়ে গেছিল যে ডুব দিয়ে জাহাজের গায়ে মাইন লাগানোর মত ক্ষমতা ছিল না।তাড়াতাড়ি মাইন দুটি নিয়ে জাহাজের গায়ে লাগিয়ে দিই।এবং দুইজনকে আমার সংগে আমার বাহুতে এক হাত রেখে সাতার দিতে বলি।তারা এত দুর্বল ছিল যে,সাতারের ক্ষমতা তাদের রহিত হয়ে গিয়েছিল।আমারও বাম বাহু থেকে রক্ত বার হচ্ছিল।কিছুদূর সাতার কাটার পর আমিও ভীষণ পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ি। এমন সময় আমার দিকে একখানা স্পীডবোট আসতে দেখে ৩জন মিলে ডুব দিই।স্রোত এত বেশী ছিল যে,ডুব দেওয়ার পর আমরা দলছাড়া হয়ে পড়ি।তখন ছেলে দুটি যে কোন দিকে চলে গেল দেখতে পেলাম না।স্পীডবোট উপর দিয়ে চলে গেলে আমি পানির উপর উঠে আর সাথী, হতে পারলাম না।তখন একই কুলে গিয়ে উঠি। তখনও উভয় পক্ষে ভীষণ গোলাগুলি চলছে।খুব বেশী রক্ত ঝরাতে আমিও প্রায় অবশ হয়ে পড়ি।ছেলে দুটোকে রক্ষা করতে না পেরে মনের অজান্তে চোখ দিয়া অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। বেশ কিছু সময় বিশ্রাম নেয়ার পর কোমরের গামছা ছিড়ে হাতে বাধন দিই,তাতে রক্ত ঝরা বন্ধ হয়ে যায়।ছেলে দুটোকে রক্ষা করতে না পেরে ভারাক্রান্ত মনে ওয়াপদা বাধ পার হয়ে আমরা নির্দিষ্ট জায়গার দিকে এগোতে থাকি।এমন সময় নদীর মধ্যে মাইন ফাটা আরম্ভ হয়ে গেছে।এস ও এস শব্দে সারা পোর্ট ধ্বনিত হয়ে উঠছে।

শিবিরে ফেরার পর আমরা বেশ কয়েক দিনের জন্য অবরুদ্ধ হয়ে পড়ি।তখন বনের পার্শ্ববর্তী নদীমুখ গানবোট দিয়ে পাকবাহিনী পাহারা দিতে আরম্ভ করেছিল।বেশ কয়েকটি গানের আমাদের চলার পথে বাধা সৃষ্টি করে। আমাদের ঐ সময় গোলাবারুদ প্রায় শেষ হয়ে আসে। এ সময় পাকিস্তানীরা ঘোষণা করে যে, মংলা বন্দরে কোন জাহাজ ৭২ মাইলের মধ্যে আসতে পারবে না। যে জাহাজগুলি ঐ সময় ছিল সেগুলিকেও সমুদ্রের মধ্যে চলে যেতে নির্দেশ দেয় পাক সরকার। তখন বন্দর খালি হয়ে যায়।ঐ সময় গানবোট ও প্রয়োজনীয় জাহাজ ছাড়া আর কোন জাহাজ বন্দরে ছিল না।

আমাদের তৎপরতায় মংলা বন্দরে জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।আমরাও প্রায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়ি।তাছাড়া আমাদের গোলাবারুদ ও শেষ হয়ে যাওয়াতে অপারেশন একরুপ বন্ধ হয়ে যায়।এই অবস্থায়ও আমি পাক জাহাজ অর্থাৎ গানবোটের উপর আক্রমণ চালানোর চেষ্টা করি,কিন্তু গোলাবারুদ কম থাকায় সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে আমরা কলাগাছে মাইন বেধে জোয়ারের সংগে ছেড়ে দিতাম।কিছু সময় পর জোয়ারের স্রোতের সংগে ভেসে গিয়ে মাইন নদীর মধ্যে ফেটে যেতো। এতে পাকসেনারা ভীষণভাবে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়তো। আমরা কচুরিপানা একত্র করে তাতে ডিলো পেন্সিল সেট করে জোয়ারের সংগে ভাসিয়ে দিতাম।কিছু সময় পর নদীর মধ্যে বন্দরের কাছে গিয়ে তাতে আগুন ধরে যেতো, এতে সারা নদীতেই আগুন ধরে যেত।এইভাবে আমরা পাকসেনাদের মনে প্যানিক সৃষ্টি করি।

আমাদের তৎপরতায় পাকসেনারা অতিষ্ঠ হয়ে আমাদের জোর অনুসন্ধান চালাতে আরম্ভ করে।হেলিকপ্টারযোগে বনের উপর দিয়ে ভয়ে ভয়ে আমাদের সন্ধান করতে থাকে।পরে আমাদের গোপন শিবিরের জানতে পেয়ে আমাদের উপর একদিন হঠাৎ বিমান আক্রমণ চালায়।এতে আমাদের বেশ কয়েকটি ছেলে আহত।আমরা শিবির পরিবর্তন করে আরও গভীর বনের মধ্যে চলে যাই এবং নতুন শিবির স্থাপন করি।গোলাবারুদ শেষ হয়ে আসায় আমি এসময় রহমতউল্লাহ সাহেবকে শিবিরে রেখে আবার মেজর জলিলের নিকট চলে যাই গোলাবারুদ সংগ্রহ করার জন্য। আমাকে তখন কলিকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।আমি কলিকাতা চলে আসি।৮নং থিয়েটার রোডে ওসমানী সাহেবের সংগে আমাকে দেখা করিয়ে দেওয়া হয়।তখন ওসমানী সাহেব আমাকে আমাদের চৌধুরী সাহেব ও নজরুলের সংগে মিলিয়ে দেন এবং আমাদেরকে শিবিরে অপেক্ষা করতে নির্দেশ দেন।আমি কয়েকদিন অপেক্ষা করার পর কল্যাণী শিবিরে চলে আসি।ওখান থেকে আবার আমাদের পলাশী শিবিরে প্রেরণ করা হয়।পলাশীতে এসে দেখতে পেলাম শিবিরে আমার জন্য ২০০ছেলে অপেক্ষা করছে ফুলছড়িঘাট অপারেশন করার জন্য। আরও শুনতে পেলাম ফুলছড়িঘাটে আমার বন্ধু রকিব অপারেশন করতে গিয়ে মারা পড়েছেন।শুনতে পেলাম চলতি জাহাজে মাইন লাগাতে গিয়ে জাহাজের নিচে পড়ে তিনি মারা যান।রকিব আমার বিশিষ্ট বন্ধু ছিল।তার মৃত্যুতে আমার ভীষণ আঘাত লাগলো। বেশ কয়েকদিন পর আবার আমি তৈরী হতে থাকি।এমন সময় এক সন্ধ্যায় শুনতে পেলাম পাক সরকার হিন্দুস্থানের সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে।

স্বাঃ বদিউল আলম

১১-৬-৭৯

তূর্য রহমান

<১০, ২২.৩, ৫২১>

অনুবাদ

জলপথে অবিস্মরণীয় সাফল্য

বাংলাদেশের পানিপথে বর্তমান গেরিলা অপারেশনের সাফল্য মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্রতর আক্রমণে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তাঁদের সবচেয়ে দৃষ্টান্তমূলক  সাফল্য বাংলাদেশের জলপথে নয়টি সমুদ্রগামী জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া।

১৬ অগাস্ট রাতে, মুক্তিবাহিনী মংলা(খুলনা)বন্দরে ছয়টি মধ্যম আকৃতির কার্গো জাহাজ ডুবিয়ে দেয়, যার মাঝে ছিল দুটি আমেরিকান, দুটি চাইনিজ, একটি জাপানিজ এবং একটি পাকিস্তানি। উক্ত জাহাজে পাকিস্তানি আর্মির জন্য অস্ত্র ও রসদ বোঝাই ছিল।

১৬ অগাস্টে সাহসী কমান্ডোরা চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে একটি দুর্ধর্ষ অপারেশন পরিচালনা করে ‘আল আব্বাস’ এবং ‘ফরমোসা’ নামের দুটী জাহাজ ধ্বংস করেন। জাহাজ দুটীর সক্ষমতা ছিল যথাক্রমে ১৫০০০ টন ও ১২৫০০ টন। ‘আল আব্বাস’ জাহাজটি উদ্বোধন হয় আইয়ুব খান কর্তৃক, ১৯৬৮ সালে।একই দিনে পাট বোঝাই একটি মালবাহী নৌযান গেরিলারা ডুবিয়ে দেন।

মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, এক দল বিশেষায়িত গেরিলা সপ্তাহব্যাপী অপারেশনে সিলেট,ঢাকা, চাঁদপুর এবং চট্টগ্রাম থেকে ২৩ টি স্টিমার লঞ্চ ও মালবাহী নৌযান আটক করেছে এবং আটটি নৌযান ডুবিয়েছে বা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

২৩ অগাস্ট, ১৯৭১ এ সাতক্ষীরা এলাকায় একটি গানবোট ডুবিয়ে দেয়া হয়, খাদ্য ও পণ্যবাহী ঢাকা-সিলেট রুটের একটি জাহাজ চাঁদপুরে আটক করা হয় ২১ অগাস্টে। চাঁদপুরে আরেকটি সফল অপারেশনে দুটি জাহাজ এবং কার্গোসহ একটি বড় জাহাজ ধ্বংস করা হয়।

১৫ অগাস্ট, সুনামগঞ্জের সাচনা এলাকায় গেরিলারা একটি কার্গো লঞ্চ, চারটি মালবাহী নৌযান এবং ১৬ টি লঞ্চ আটক করেন।

বর্তমান গেরিলা কার্যক্রমের ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রবেশপথ বন্ধের মুখে। রিপোর্ট অনুযায়ী, হামলার পরবর্তী দিন ক্ষতির পরিমাণ নির্নয়ের জন্য লেফটেনেন্ট জেনারেল টিক্কা খান নিজে চট্টগ্রামে আসেন। গেরিলা যোদ্ধাদের সাফল্যের পর চট্টগ্রাম বন্দরের দায়িত্বে থাকা নৌবাহিনীর কিছু সিনিয়র অফিসার এবং সব প্রহরীদের গ্রেফতার করা হয়।

 

 

তূর্য রহমান

<১০, ২২.৪, ৫২১-৫২২>

অনুবাদ

নৌকমান্ডোর মোক্ষম আঘাত

 

দখলদার বাহিনীর ক্ষণায়মান মনোবলে আবারো মোক্ষম আঘাত করল বাংলাদেশি নৌবাহিনী। আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশি জলযোদ্ধাদের আক্রমণে বেশ কয়টি জাহাজ ডোবার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বন্দরগুলো গেরিলা আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য নিবিড় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।  এতদসত্ত্বেও নৌকমান্ডোগণ সফল ভাবে ‘বারমা জাদে’ নামক একটি গ্রিক তেলবাহী জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত করেন। বার্তা সংস্থা এ.পি.-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, নভেম্বরের ৩ তারিখে চট্টগ্রাম বন্দরে ধারাবাহিক বিস্ফোরণের ফলে পাকিস্তানি তেলবাহী জাহাজ ‘মাহতাব জাভেদ’ ডুবে যায়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বন্দর কর্তৃপক্ষ এ বিস্ফোরণের জন্য বাংলাদেশি গেরিলাদের দায়ী করে। এ বিস্ফোরণের জন্য বাংলাদেশি গেরিলাদের দায়ী করাকে আমরা গ্রহণ করছি, আনন্দের সাথে গ্রহণ করছি।

চট্টগ্রাম বন্দরের কিছু পোতাশ্রয় সম্পূর্ণভাবে ব্যাবহার অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এসব নৌ আক্রমণগুলো আরও সুদূরপ্রসারী ভুমিকা রেখেছে, লন্ডন ইন্সুরেন্স মার্কেটে বাংলাদেশে যাওয়া আসা করা কার্গো জাহাজের ইন্সুরেন্স হার অনেক উর্ধ্বমুখী হয়ে গেল।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠন ও তার যুদ্ধ তৎপরতা বাংলাদেশ একাডেমীর দলিলপত্র ১৯৭১

 

অপরাজিতা নীল

<১০, ২৩, ৫২৩৫২৫>

সাক্ষাৎকারঃ এয়ার ভাইস মার্শাল আবদুল করিম খন্দকার*

১৮১০১৯৭৩

১৫ই মে সকালে আমরা আগরতলাতে পৌছি। ১৬ই মে সকালে আমি কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হই। কর্নেল ওসমানির সাথে আমার দেখা হয়। ১৯/২০শে মে দিল্লিতে যাই ভারতীয় বিমানবাহিনীর সাথে যোগাযোগ করার জন্য। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল বিমান সংগ্রহ করে একটা বিমানবাহিনী গঠন করা। এব্যাপারে সম্ভাব্য ভারতীয় সাহায্যের জন্য আমার সাথে যারা ছিল তারাও ইতিমধ্যে দিল্লি পৌঁছে যায়। সেখানে ভারতীয় বিমানবাহিনীর কর্মকর্তাদের সাথে আমার বিস্তারিত আলোচনা হয়। আমরা আমাদের বক্তব্য পেশ করলাম। আলোচনা করে বুঝতে পারলাম যে, রাজনৈতিক এবং নানাবিধ কারনে তারা এখন আমাদেরকে বিমান দিয়ে সাহায্য করতে পারবে না। তবে সময় আসলে তারা আমাদেরকে সাহায্য করবে। তারা পাকিস্তান বিমানবাহিনী সম্বন্ধে অনেক গুরুত্বপুর্ন গোপনীয় তথ্য জেনে নেয়।

মে মাসের শেষের দিকে আমরা কলকাতায় চলে আসলে, তারপর সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে আমরা স্থলযুদ্ধে অংশগ্রহন করব। এই সময় আমাকে ডেপুটি চীফ অফ স্টাফের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ এবং অপারেশনঃ বিমান বাহিনীর অন্যান্য অফিসারদের বিভিন্ন সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়। মুক্তিবাহিনীর জন্য রিক্রুটমেন্ট, ট্রেনিং এবং তাদেরকে বিভিন্ন সেক্টরে পাঠানো, এসব দায়িত্ব আমার ছিল। অস্ত্রশস্ত্র অ ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সেক্টরের প্রয়োজনানুসারে দেয়া হত। বিদেশী কোন রাষ্ট্র থেকে আমরা সরাসরি কোন সাহায্য পেতাম না। ভারত সরকার থেকে আমরা অস্ত্রশস্ত্র পেতাম। কিছু ওয়ারলেস সেট আমেরিকা থেকে বাঙ্গালীরা পাঠিয়েছিলো।

প্রথমে প্রত্যেক মাসে ২/৩ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে গেরিলা প্রশিক্ষণ দেয়া হত। কিন্তু পরে প্রত্যেক মাসে ১০/১২ হাজার গেরিলাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হত। শেষপর্যন্ত প্রায় ১ লক্ষ ১ হাজার গেরিলাকে ট্রেনিং দেয়া হয়েছিল। প্রথমে প্রত্যেক গেরিলাকে এক মাসের ট্রেনিং দিয়ে ভিতরে পাঠানো হত। কিন্তু পরে ট্রেনিং-এর সময় কমিয়ে দু’সপ্তাহ করা হয়, যাতে করে বেশী লোককে ট্রেনিং দেয়া যেতে পারে। যখন দেখা গেল দু’সপ্তাহের ট্রেনিং-এ গেরিলারা ভাল কাজ করতে পারছে না, তখন এটা বাড়িয়ে তিন সপ্তাহ করা হল।

গেরিলা ট্রেনিং শেষ হবার পর গেরিলাদের প্রথমে ভারতীয় সেক্টর কমান্ডারের কাছে রিপোর্ট করতে হত। পরে ভারতীয় সেক্টর কমান্ডারদের সাথে আলাপ করে ঠিক করা হল সে গেরিলারা বাংলাদেশের সেক্টর কমান্ডারদের কাছে রিপোর্ট করবে।

ট্রেনিং শেষ হবার পর গেরিলাদেরকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনমত অস্ত্র জমা দিত না বা দিতে পারত না। অনেক সময় মাত্র একটা গ্রেনেড দিয়ে তাদেরকে অপারেশনের জন্য পাঠানো হত। এতে অনেক সময়ের অপচয় হয়েছে এবং অনেক গেরিলাকেও আমরা হারিয়েছি। পরে এ ব্যাপার নিয়ে ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষের সাথে আমাদের বিতর্ক হয়। অবশ্য পরে গেরিলাদেরকে অস্ত্র দেয়া হত।

গেরিলা বাহিনীতে স্কুল-কলেজের ছাত্র এবং যুবকরা বেশীরভাগ যোগ দিয়েছিল। ট্রেনিং শেষ করার পর প্রত্যেক সেক্টরে কতজন গেরিলা পাঠানো হবে তা হেডকোয়ার্টার থেকে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল এবং অস্ত্রশস্ত্রের পরিমানও নির্ধারন করে দেয়া হয়েছিল। গেরিলা যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে গেরিলারা সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করছিল না। অবশ্য তার কারণও অনেক ছিল, যেমন – তারা অস্ত্রশস্ত্র পেত না, নেতৃত্ব বা সংগঠন ছিল না। পরে আমরা ভারতীয় গয়েন্দা বিভাগের লোকজনসহ বসে ঠিক করে দিতাম কোথায় গেরিলা অপারেশন চালাতে হবে এবং অপারেশনের পর আমাদেরকে তার বিশদ বিবিরন জানাতে হবে। প্রকৃতপক্ষে তখন থেকেই গেরিলা যুদ্ধ কার্যকরী হয়েছিল।

গেরিলা যুদ্ধের শক্তি বৃদ্ধির সাথে সাথে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গ্রাম এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চলাচল মারাত্বক বিপন্ন হয়ে উঠছিল। কোথায় যে মুক্তিযদ্ধারা আছে তাও তারা বলতে পারত না। সব সময় একটা ভয় তাদের মধ্যে ছিল। মুক্তিবাহিনীর এই সাফল্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাংলাদেশে পরাজয়ের অন্যতম প্রধান কারণ।

প্রথমদিকে বিমানবাহিনীর সমস্ত পাইলট, টেকনিশিয়ান স্থল যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিল। পরে স্থির করা হল একটা এয়ারফোর্স ইউনিট গঠন করতে হবে। ভারতীয় বিমানবাহিনী আমাদেরকে একটা অটার, একটা অলওয়েত হেলিকপ্টার এবং একটা ডিসি-৩ ডাকোটা বিমান দিয়েছিল।

পাইলটদের মধ্যে ছিল স্কোয়াড্রন সুলতান মাহমুদ, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বদরুল আলম, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম, ক্যাপ্টেন মরহুম মালেক, ক্যাপ্টেন মরহুম শরফুদ্দিন, ক্যাপ্টেন সাত্তার, ক্যাপ্টেন মুকিত, ক্যাপ্টেন শাহাব, ক্যাপ্টেন আকরাম, এবং এয়ারফোর্সের প্রায় ৭০ জন টেকনিশিয়ান। যেহেতু আমাদের কমসংখ্যক পাইলত এবং বিমান ছিল সেহেতু আমরা পরিকল্পনা নিলাম যে আমরা এমনভাবে অপারেশন চালাব যাতে করে আমাদের পাইলট বা বিমান না হারায় বা ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই সমস্ত বিমান বোমা, রকেট এবং মেশিনগান দিয়ে সজ্জিত করা হয়। ২৮শে সেপ্টেম্বর ন্যাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে বিমানবন্দরে এদেরকে একত্রিত করা হল। আমরা রাতে আক্রমণ চালাব ঠিক করলাম। প্লেনগুলোকে মাটির উপর ৩০০ ফুটের নিচ দিয়ে ফ্লাই করার সিদ্ধান্ত নেয়া হল। কেননা ৩০০ ফুটের নিচে উড়লে রাডার স্ক্রীনেতা ধরা পরে না।

কোন নেভিগেশন সাহায্য ছাড়াই আমরা রাতে ট্রেনিং শুরু করি। বনজঙ্গলের মধ্যে গাছের ঠিক উপর দিয়েই আমরা উড়তাম। নিকটবর্তী এক পাহাড়ের চুড়ায় সাদা প্যারাসুট ফেলে সেটাকে টার্গেট করে মেশিনগান, রকেট, বমা ছোড়া হত বা নিক্ষেপ করা হত। আমি নিজে বিমানে উঠে ট্রেনিংয়ে সাহায্য করতাম। সারারাত ধরে ট্রেনিং এর কাজ চলত। অল্পদিন পরেই বুঝতে পারলাম যে নিচু লেভেলে উড়ে বাংলাদেশের অভুন্তরে গিয়ে আমরা কার্যকরভাবে অপারেশন চালাতে পারব।

৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই যুদ্ধ ঘোষণার আগে ভারতের মাটি থেকে আমরা যদি বিমান হামলা চালাতাম তাতে অনেক অসুবিধা ছিল। তাই ভারতের সাথে এ ব্যাপারে আমাদের একটা বঝাপড়া হয়েছিল কখন আমরা আক্রমন চালাব। সবশেষে সেই সুযোগ আসল।

৩রা ডিসেম্বর রাত দুটোর সময় একই সময়ে আমাদের বিমান চট্রগ্রাম বন্দরের নিকটবর্তী অয়েল ডাম্প এবং নারায়নগঞ্জের কাছে গোদানাইলে বিমান হামলা চালায় এবং এ হামলা খুব কার্যকরী হয়েছিল। এর পর থেকে আমরা বিমানে দিনের বেলাতেও আক্রমন চালাতাম। মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনীকে আমরা এয়ার সাপোর্ট দিয়েছি। এমন অনেক জায়গা ছিল যেগুলো ভারতীয় পাইলটরা চিনত না বা জানত না, সেখানে আমাদের পাইলটরা গিয়ে আক্রমন চালিয়েছে। যুদ্ধর অগ্রগতির সাথে সাথে বিশাল এলাকা মুক্ত হতে লাগল। প্রথমত, মুক্ত এলাকাগুলোর প্রশাসন সেক্টর কমান্ডারদের উপর ন্যস্ত করা হয়। আমরা বুঝতে পারছিলাম যে, যুদ্ধ খুব সুন্দরভাবে চলছে। ১৪ই পর্যন্ত আমরা বুঝলাম যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে।

১৬ই ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ আমাকে ডেকে পাঠালেন। সেখানে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জনাম মনসুর আলী, খন্দকার মুশতাক সবাই উপস্থিত ছিলেন। আমাকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসাবে আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে যাবার জন্য বলা হয়। আমি ভারতীয় সামরিক বাহিনীর হেডকোয়ার্টারের সাথে যোগাযোগ করি। আমাকে দমদম বিমানবন্দরে যেতে বলা হয়। আমি কলকাতা দমদম বিমানবন্দরে গেলাম। সেখানে জেনারেল আরোরা, জেনারেল জেকব, এবং ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অনেক উচ্চপদস্থ অফিসার ছিল। আমরা বাংলাদেশের পথে প্রথমে আগরতলা আসলাম। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে রওনা হলাম।

ঢাকা বিমানবন্দরে রানওয়ে মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। রাস্তাঘাটে খুব বেশী লোকজন ছিল না। এ অবস্থা আমরা বিমানে বসে লক্ষ করছিলাম। বিমানবন্দরে খুব একটা ভিড় ছিল না। আমরা বিমান থেকে অবতরন করলাম। জেনারেল নিয়াজী আমাদেরকে সংবর্ধনা জানালেন।

আমরা বিমানবন্দর থেকে সোজা রেসকোর্সের মাঠে গেলাম। সেখানেও আস্তে আস্তে লোকের ভিড় হচ্ছিল। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু যেখান থেকে ভাষন দিয়েছিলেন সেখানে আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। জনগন আনন্দে উল্লাসে ফেটে পড়ছিল। তারা জেনারেল আরোরাকে কাঁধের উপর উঠিয়ে নেয় এবং বিজয়োল্লাসে মেতে উঠে। জেনারেল নিয়াজীকে খুব বিমর্ষ দেখা যাচ্ছিল।

ভারতীয় সরকার এবং জনগন আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অভুতপূর্ব সাহায্য এবং সহোযোগিতা করেছেন। ভারতকে সবসময় অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করতে হয়েছে। বিশ্ব জন্মতের প্রতিক্রিয়া কি, সেটাও লক্ষ্য রাখতে হয়েছে। তাদেরকে অনেক অনেক ভেবেচিন্তে আমাদের মুক্তিসংগ্রামে সাহায্য করতে হয়েছে।

আমি বলতে চাই, তারা আবেগের বশবর্তী হয়ে কোন কিছু করেনি। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পরিস্থিতিকে পর্যবেক্ষন করেছে এবং ধীরে ধীরে এগিয়ে গেছে। রাজনৈতিক, কুটনৈতিক, এবং সামরিক দিক থেকে বিচার করলে দেখা যাবে তারা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সবকিছু করেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বের বিভিন্নদেশে সফর করে বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে উপমহাদেশের ঘটনাবলী অবহিত করেছিলেন। আমার মনে হয় ভারত যুদ্ধের জন্য প্রথমে প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু বিভিন্ন দেশ সফর করার পর হয়ত ভারত যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

ভারত প্রথমে আমাদেরকে স্বীকৃতিও দেয়নি। কারন, যদি ভারত আমাদের প্রথম স্বীকৃতি দিত তাহলে হয়ত বিশ্বজনমত যুদ্ধের জন্য ভারতকে দোষারোপ করত। অবশ্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর কিছু কিছু কার্যকলাপ জনসাধারনের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। যুদ্ধে ভারতের জয়ের তিনটি প্রধান কারণ ছিলঃ ১। মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশন চালিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যাতায়াত ব্যবস্থাকে পর্যুদস্ত করে দিয়েছিল। সেনাবাহিনীর চলাচলে কোন নিরাপত্তা ছিল না। তাদেরকে সব জায়গায় প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। ২। ভারতীয় বিমানবাহিনীর অভুতপূর্ব সাফল্য যুদ্ধের মোড় ঘুড়িয়ে দিয়েছিল। বিমানবাহিনীর আক্রমনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সব জায়গা থেকে পিছু হাটতে বাধ্য হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদের সাহায্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সমস্ত গোপনীয় তথ্য জেনে নেয়।

স্বাক্ষরঃ আবদুল করিম খন্দকার

১৮-১০-১৯৭৩

*১৯৭১ এর মার্চে গ্রুপ ক্যাপ্টেন হিসাবে কর্মরত ছিলেন।

শিরোনাম সূত্র            তারিখ
২৪। বিভিন্ন সেক্টরে চিকিৎসা তৎপরতা বাংলাদেশ একাডেমীর দলিলপত্র ১৯৭১

অপরাজিতা নীল

<১০, ২৪, ৫২৬৫২৭>

সাক্ষাৎকারঃ কর্নেল মোহাম্মাদ শামসুল হক

১৭১৯৭৩

৩রা মে আমি ঢাকা ত্যাগ করি এবং দেশের বাড়িতে বেড়াতে যাই (মতলব থাকা কুমিল্লা জেলা)। ওখানে আমার স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের নিয়ে সংক্ষিপ্ত রাইফেল ট্রেনিংয়ের ব্যাবস্থা করি। ওখান থেকে আমি লোক পাঠালাম আগরতলায়। মেসেঞ্জার এসে খবর দিল যে, সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের খুব প্রয়োজন।

আমি আমার পরিবারেকে গ্রামে রেখে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আগরতলার উদ্দেশ্যে রওনা হই। আগরতলায় পৌঁছে বাংলাদেশের অফিস কৃষ্ণনগরে আমার উপস্থিতি জানাই। ঐদিন সন্ধ্যার মেজর জিয়াউর রহমানের সাথে আমার দেখা হয়।  ঐ দিন রাতে জিয়াউর রহমানের সাথে ১নং সেক্টরের হরিনাতে যাই এবং ১ নং সেক্টরের মেদিকেল অফিসারের দায়িত্ব গ্রহণ করি। ১নং সেক্টরের বিভিন্ন সাব সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা গ্রহণ করি। কিছু ছেলেদের ফার্স্ট এইড ট্রেনিং দেই। তারপর আমাকে আগরতলা নিয়ে আসা হয় এবং ইস্টার্ন সেক্তরের মেডিকেল সার্ভিসেস এর সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব দেয়া হয়। আমার দায়িত্ব ছিল ১০ টি সেক্টরে এবং তিনটি ব্রিগেডে মেডিকেল ওফিসার, নার্সিং ও ঔষুধপত্র প্রভৃতি পাঠানো। ভারতের বিভিন্ন সমাজসেবামূলক সংগঠন এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে ঔষধপত্র পেতাম।

আমাদের বিশ্রামগঞ্জে একটি বাংলাদেশ হাসপাতাল ছিল। এখানে প্রায় ২৮০ টি বেড ছিল। বাকি সমস্ত সেক্টরে এবং সাব সেক্তরে অগ্রবর্তী ড্রেসিং ষ্টেশন প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ সকল প্রতিষ্ঠানের কাজ ছিল আহত এবং অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা করে তাদের সেনাবাহিনীর ফিল্ড হাসপাতাল অথবা বেসামরিক হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া। এ ব্যাপারে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ফিল্ড হাসপাতাল এবং বেসামরিক হাসপাতালগুলো আমাদের পুরোপুরি সাহায্য করেছে।

বাংলাদেশ ফোর্সের হাসপাতাল যেটা বিশ্রামগঞ্জে ছিল, সেই হসপিটাল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে লন্ডনের বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন ঔষধপত্র, যন্ত্রপাতি, টাকা-পয়সা, এবং ডাক্তার দিয়েও সাহায্য করেছেন। ডাক্তার জাফর উল্লাহ চৌধুরী, ডাক্তার মোমেনের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

ডিসেম্বরে পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হওয়ায় আমাদের মনোবল বেড়ে গেলো। আমরা মুঝতে পারলাম যে, কিছুদিনের ভিতর আমাদের বাংলাদেশের ভিতরে যেতে হবে। তাই প্রত্যেক সেক্টরে নির্দেশ দিয়ে দিলাম মেডিকেল অফিসার এবং স্টাফদের তারা যেন ঔষুধপত্র, যন্ত্রপাতি, সবকিছু নিয়ে তারা যেন নিকটবর্তী সি-এম-এইচ এ রিপোর্ট করে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পনের পূর্বে বাংলাদেশের সমস্ত সি-এম-এইচগুলোর (ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, রংপুর, যশোর) তোষক, কম্বল, প্রভৃতি সব পুড়িয়ে দিয়ে যায়।

বাংলাদেশে আসার পর বিভিন্ন এলাকার পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃপক্ষ পরিত্যাক্ত ঔষুধপত্র ও অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী আমরা সংগ্রহ করি।

বিভিন্ন সেক্টরে সামরিক বাহিনীর মোট দশজন ডাক্তার ছিলেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের যে সমস্ত ছাত্র ভারতে গিয়েছিল তাদের মধ্য থেকে বিভিন্ন সেক্টরে এবং সাবসেক্টরে মেডিকেল এ্যাসিস্ট্যান্ট নিয়োগ করা হয়। প্রত্যেকটা সেক্টরে অন্ততপক্ষে যদি একজন করে সামরিক বাহিনিন ডাক্তার থাকত, তাহলে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা আরো সুষ্ঠুভাবে হত।

সাক্ষরঃ মোহাম্মাদ শামসুল হক

কর্নেল

১৭-৯-৭৩

 

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৫। বিভিন্ন সেক্টরে চিকিৎসা যোগাযোগের তৎপরতা বাংলাদেশ একাডেমীর দলিলপত্র ১৯৭১

অপরাজিতা নীল

<১০, ২৫, ৫২৮>

সাক্ষাৎকারঃ মেজম এম. এইচ. বাহার

২০০১১৯৭৪

 

আগরতলা থেকে আমি রামগড়ে চলে আসি। সেখানে তখন মেজর জিয়ার নেতৃত্বে শুভপুর পুলের কাছে যুদ্ধ চলছিল। আমি যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যন্ত্রপাতি এবং প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত লোকের অভাবে সেটা সম্ভবপর হয়নি। আমি আবার আগরতলায় চলে আসি। সেখানে আমাদের সিগনালের কিছু লোক একত্রিত হয়েছিল। সেখানে তাদের জন্য একটা ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এই ব্যাপারে বি-এস-এফ-এর কর্নেল বানার্জী আমাকে অনেক সাহায্য করেছিলেন। সেখানে আমি সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, ইপিআর, এবং পুলিশের প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত লোকের সাহায্যে আগরতলা থেকে চারটি সেক্টরের সাথে রামগড়, মেলাঘর, তেলিয়াপাড়া, এবং করিমগঞ্জে বেতার যোগাযোগ স্থাপন করি। সেক্টর থেকে সাবসেক্টর পর্যন্ত বেতার ও লাইন যোগাযোগের বন্দোবস্ত করা হয়।

আগরতলা থেকে আমি জুলাই মাসে কলিকাতার ৮নং সেক্টর থিয়েটার রোডে অবস্থিত মুজিব নগরে চলে যাই পশ্চিম দিকে যোগাযোগ ব্যাবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য। তখন বিদেশ থেকে আমেরিকা, ব্রিটেন, দুবাই এই সমস্ত দেশে অবস্থানরত প্রবাসী বাঙ্গালীরা উন্নতমানের যোগাযোগ ব্যাবস্থার যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে মুজিবনগরে পাঠাতে শুরু করেন। এই সমস্ত যন্ত্রপাতি আমাদের অনেক কাজে এসেছিল।

মুজিবনগরে স্থানাভাব হেতু আমি আমার লোকজন, যন্ত্রপাতি নিয়ে ৮ নং সেক্টর হেডকোয়ার্টার কল্যানী (নদীয়া জেলা) চলে গেলাম। ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ঐখান থেকে আমি কাজ চালিয়েছি।

স্বাক্ষরঃ এম. এইচ. বাহার

মেজর

২০-১-৭৪

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৬। চূড়ান্ত পর্যায়ে সঙ্ঘঠিত যুদ্ধের বিবরণ …………… ১৯৭১

অপরাজিতা নীল

<১০, ২৬, ৫২৯-৫৩৭>

চূড়ান্ত যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী

(প্রতিবেদনঃ মেজর (অবঃ) রফিকুল ইসলাম)

 

১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের শেষের দিকে প্রতিটি সেক্টর এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস, ক্ষিপ্রতা অবশ্যম্ভাবী বিজয় দেখে পাকিস্তানী বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। সীমান্ত অঞ্চলে বিরাট এলাকা মুক্তিবাহিনী দখল করে নেয়। সারাদেশে গেরিলা তৎপরতা এত বৃদ্ধি পায় যে পাকসেনারা আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়ে এবং তাদের মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে।

পরিস্থিতি ক্রমশঃ পাকিস্তানী ও ভারতের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো।  সৃষ্টি হয়। ভারত বৃহৎ শক্তিবর্গকে একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য বারবার অনুরোধ জানানোর জন্য কোনো ফলপ্রসূ সমাধানে পৌছানো সম্ভব হয়নি। বিবিসির সাথে ২ আগস্ট এক সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন, “পূর্ব পাকিস্তানী ও ভারতের সীমান্ত বরাবর সংঘর্ষ অব্যাহত থাকলে ট্যাঁ ভয়াবহ যুদ্ধে পরিনত হতে পারে।” আমেরিকান টেলিভিশন সংস্থার সাথে এর সাক্ষাৎকারে ১১ আগস্টিয়াহিয়া খান বলেন, “দুটো দেশই এখন যুদ্ধের খুব কাছাকাছি এসে পড়েছে। আমি হুঁশিয়ার করে দিতে চাই যে, পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য আমরা যুদ্ধ করবো।”

ইয়াহিয়া খান প্যারিস থেকে প্রকাশিত ‘লা ফিগারো’ পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাৎকারে ১ সেপ্টেম্বর বলেন, “আমি এই মর্মে সমগ্র বিশ্বকে হুঁশিয়ার করে দিতে চাই যে, তারা যদি মনে করে বিনা যুদ্ধে তারা এক বিন্দু জমি দখল করতে পারবে, তবে তারা মারাত্মক ভুল করছে। এর অর্থই হবে সররাত্মক যুদ্ধ।” পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার অধিনায়ক লেঃ জেঃ এ, এ, কে নিয়াজী ৭ই অক্টোবার পকিস্তান টাইমস-এ প্রকাশিত এক ঘোষ্ণায় বলেন, “যদি ভারত পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ চায়, তাহলে সে যুদ্ধ হবে ভারতের ঘাঁটিতে।”

পাকিস্তানী সমরনায়কদের এসব বল্গাহীন বক্তব্যে এটা পরিষ্কার হয়ে উঠছিলো যে ভারত ও পাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে। এমন একটা একটি সর্বাত্মক পাকিস্তান চীন ও আমেরিকার সরাসরি হস্তক্ষেপ আশা করছিলো। অবশেষে ইয়াহিয়া ২৫ নভেম্বর আমেরিকান সংবাদ সংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেসের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ঘোষণা করলেন, “আগামী দশদিন পর আমাকে এই রাওাল্পিন্ডিতে বসে থাকতে দেখবেন না। আমি তখন সীমান্তে যুদ্ধ করবো। ইয়াহিয়া খান তার কথা অক্ষরে অপক্ষরে পালন করলেন। পাকিস্তান বিমানবাহিনী ৩ ডিসেম্বর বিকেল পৌনে ছ’টার সময় অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর, যোধপুর ও আগ্রার বিমানবন্দরগুলোতে অঘোষিত বোমাবর্ষণ করে সর্বাত্মক যুদ্ধের সূচনা করলো।

স্মরণাতীতকালের ইতিহাসে এই প্রথম একটি আক্রমণকারী দল অতিসহজেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়তে সক্ষম হয়। এর কারণ, দেশবাসী আক্রমণকারীদলকে শুধু অভ্যর্থনাই জানায়নি, অত্যাচারী হানাদার বাহিনির পরাজয়ের জন্য তারা আক্রমণকারীদলকে সর্বপ্রকার সাহায্য করেছে।

বাংলাদেশ অসংখ্য নদী-নালার দেশ। আক্রমণকারীকে বিলম্বিত ও প্রতিহত করার জন্য নদী-নালা অত্যন্ত সুবিধাজনকভাবে ব্যবহার করা যায়। কয়েকটি নদী খুবই বিশাল। এই বিশাল নদীগুলো সমগ্র দেশকে কয়েকতি ভৌগলিক এলাকায় বিভক্ত করেছে। রাস্তার উপরে ব্রীজগুলো ভেঙ্গে দিলে আক্রমণকারীকে বিরাট সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। এছাড়া বিরাট এলাকা ক্রমাগতভাবে নিচু ও জলাধারে পূর্ন। এই সমস্ত এলাকায় ভারি অস্ত্রসহ অগ্রসর হওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার।

যুদ্ধ-কৌশল অনুযায়ী পশ্চিম ও উত্তর দিক থেকে আক্রমণের সম্ভাবনা ছিলো সবচাইতে বেশী, কারন সমস্ত পাকা রাস্তা উত্তর ও পশ্চিম দিক থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকেছে এবং বড় বড় নদীগুলো উত্তর থেকে দক্ষিন দিকে প্রবাহিত। তাছাড়া পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলে ভারতীয় বাহিনী যুদ্ধের সম্ভার ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সুদৃঢ় করেছিলো।

মেঘালয় সীমান্ত থেকে অপেক্ষাকৃত শক্ত মাটির জন্য সৈন্য চলাচল সম্ভব ছিল। কিন্তু গৌহাটি থেকে শিলং পর্যন্ত একটিমাত্র পাকা রাস্তা এবং তারপরই পাহাড়ী এলাকা দিয়ে সীমান্ত আসার পথ। এই এলাকায় বড় ধরনের সামরিক অভিযান সম্ভব ছিল না বলেই সৈন্য সমাবেশ ছিলো সীমিত।

ত্রিপুরা ও শিলচর এলাকায় গোলাবারুদ ও রসদসম্ভার পর্যাপ্ত মজুত করা হয়নি। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে ধর্মনগর পর্যন্ত রেললাইন বিস্তৃত। তারপর একটিমাত্র রাস্তা ধরে দক্ষিন দিকে আগরতলা পর্যন্ত আসা যায়। পরিষ্কারভাবে অনুমান করা যায় যে এখানে বড় ধরনের অভিযান সম্ভব ছিলো না। অক্টোবরের শেষের দিকে অবশ্য পাকিস্তানীরা ভারতীয় সৈন্য সমাবেশের কথা জানতে পারে।

যেভাবেই হোক ভারতীয় বাহিনীকে সীমান্ত এলাকায় বাধা দিয়ে বিলম্ব ঘটানোই ছিল নিয়াজীর পরিকল্পনা। সিমান্তে সব ক’টি পাকা রাস্তার উপর শক্ত প্রতিরক্ষাবূহ্য রচনা করে অগ্রসরমান সম্মিলিত বাহিনীকে প্রতিহত করাই ছিলো এর উদ্দেশ্য। ১৪০০ মাইল বিস্তৃত সীমান্ত এলাকায় শক্ত-ঘাঁটি, প্রচুর, গোলাবারুদ, এবং রসদপত্র সরবরাহ নিশ্চিত করে নিয়াজী অনির্দিষ্টকালের জন্য সম্মিলিত বাহিনীকে বলম্বিত করতে চাইলেন।

অন্যদিকে সম্মিলিত বাহিনী এইসব শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থানগুলো এড়িয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। প্রথম লক্ষ্য ছিলো ক্ষিপ্রতা ও গতি। বিদ্যুৎ গতিতে খুব কম সময়ের মধ্যে যুদ্ধ শেষ করতে হবে। দ্বিতীয়তঃ সীমান্তের সব দিক দিয়ে আক্রমণ পরিচালনা করে পাকসেনাদের ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য করা। তৃতীয়তঃ ছড়িয়ে পড়া পাকবাহিনী যেন একত্রিত হয়ে পদ্মা ও মেঘনার মাঝামাঝি এলাকায় সমাবেশ না করতে পারে ট্যাঁ নিশ্চিত করা। চতুর্থতঃ পাকা রাস্তা বাদ দিয়ে কাঁচা রাস্তা দিয়ে অগ্রসর হয়ে পাকিস্তানী প্রতিরক্ষা বুহ্যকে এরিয়ে যাওয়া। পঞ্চমতঃ মনস্তাত্বিকভাবে যুদ্ধ চালিয়ে পাকিস্তানী বাহিনীর মনোবল ভেঙে দিতে হবে, যাতে তারা যুদ্ধ না করে আত্মসমর্পণ করে।

পাকিস্তানী সমরনায়করা সম্ভবত ভেবেছিলেন ভারত সরকারকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য শুধুমাত্র সীমান্ত এলাকায় কয়েকটি জেলা বা মহাকুমা শহর দখল করেই ক্ষান্ত হবে। সম্ভবত এই কারনেই তারা সীমান্ত এলাকায় শক্ত প্রতিরক্ষার পরিকল্পনা করেন। পাকিস্তানী জেনারেলরা যুদ্দের গতি ও পরিণতি সম্পর্কে উপলব্ধি করতে সক্ষম হননি। ফলে, ঢাকা রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় বাধা দিতে ব্যর্থ হয় পাকবাহিনী। বড় ধরনের যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই পলায়নপর পাকসেনারা আত্মসমর্পন করে।

পাকিস্তানীদের সৈন্য সমাবেশ ছিল নিন্মরুপঃ

যশোর এলাকাঃ নবম ডিভিশন জেনারেল আনসারীর নেতৃত্বে যশোর এলাকায় মোতায়েন করা হয়। ১০৭ ব্রিগেড যশোরে এবং ৫৭ ব্রিগেড ঝিনাইদহে অবস্থিত ছিলো। এছাড়া ২টি ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারী ও একটি রেকি এবং সাপোর্ট ব্যাটালিয়ন ছিলো।

উত্তর বাংলাঃ মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহের নেতৃত্বে ১৬ ডিভিশনকে উত্ত্র বাংলা রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৬ ডিভিশনের সদর দফতরে নাটোরে অবস্থিত ছিলো। ২৩ ব্রিগেড রংপুরে এবং ২০৫ ব্রিগেড বগুড়া এলাকায় মোতায়েন করা হয়। একটি ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারী, ২টি মর্টার ব্যাটালিয়ন, একটি রেকি ও সাপোর্ট ব্যাটালিয়ন এবং একতি আর্মড রেজিমেন্ট ছিলো।

পূর্ব এলাকঃ মেজর জেনারেল আবদুল মজিদ কাজীর নেতৃত্বে চতুর্দশ ডিভিশনকে পূর্বাঞ্চল রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়। পরে মেজর জেনারেল জামসেদের নেতৃত্বে ৩৯ ডিভিশন চাঁদপুরে গড়ে তোলা হয়। অবশ্য এ দু’টি ডিভিশন কোনক্রমেই পাকশক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করেনি, কারন বিভিন্ন ইউনিট পুনর্বিন্যাস করেই এই ডিভিশন দু’টি গড়ে তোলা হয়। ১১৭ ব্রিগেড কুমিল্লায়, ২৭ ব্রিগেড ময়মনসিংহ ও ২১২ ব্রিগেড  সিলেটে মোতায়েন করা হয়। সিলেটে একটি ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারী ও দুইটি মর্টার ব্যাটারী ও মাত্র চারটি ট্যাংক ছিলো।

চট্টগ্রাম এলাকাঃ চট্টগ্রামে ৯৩ ইন্ডিপেন্ডেন্ড ব্রিগেদ অবস্থিত ছিলো, যার অধিনায়ক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার আতাউল্লা।

অপরদিকে ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডার অধিনায়ক লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরার অধীনে ছিলো তিনটি নিয়মিত কোর, একটি কমিউনিকেশন জোন ও প্রায় এক লাখ মুক্তিযোদ্ধা সম্বলিত ১১টি সেক্টর।

দ্বিতীয় কোরঃ কৃষ্ণনগরে ছিলো দ্বিতীয় কোরের সদর দপ্তর। লেঃ জেনারেল টি, এন, রায়না ছিলেন কোর কমান্ডার। এতে ছিলো নবম ও চতুর্থ পার্বত্য ডিভিশন। এছাড়া ছিলো টি-৫৫ (রাশিয়ান) ট্যাংক সমন্বয়ে গঠিত একটি মাঝারি আর্মড রেজিমেন্ট, একটি পি-টি ৭৬ (রাশিয়ান) ট্যাঙ্ক সজ্জিত একটি হাল্কা ট্যাঙ্ক রেজিমেন্ট, ১৩০ মিলিমিটার (রাশিয়ান), একতি মাঝারি গোলন্দাজ ইউনিট ও ব্রিজিং ইউনিট।

তেত্রিশ কোরঃ তেত্রিশ কোরের সদর দপ্তর ছিলো শিলিগুড়িতে। লেঃ জেনারেল, এম এল, থাপন ছিলেন এই কোরের কমান্ডার। ৬ পার্বত্য ডিভিশন ও ২টি ব্রিগেড নিয়ে এই কোর গঠিত হয়। এছাড়া পিটি-৭৬ (রাশিয়ান) ট্যাংক সমন্বয়ে একটি হালকা আমার্ড রেজিমেন্ট, একটি মাঝারি গোলন্দাজ রেজিমেন্ট (বৃটিশ ৫.৫”) ও একটি ইঞ্জিনিয়ার ব্রিজিং ইউনিট ছিলো।

চতুর্থ কোরঃ চতুর্থ কোরের সদর দপ্তর ছিলো আগরতলায়। লেঃ জেনারেল সাগত সিং এই কোরের কমান্ডার ছিলেন। অষ্টম, সাতান্ন ও তেইশ পার্বত্য ডিভিশন নিয়ে এই কোর গঠিত হয়। এছাড়া দুই স্কোয়াড্রন পিতি-৭৬ ট্যাংক ও মাঝারি গোলন্দাজ রেজিমেন্ট (বৃটিশ ৫.৫”) ছিলো।

১০১ কমিউনিকেশন জোনঃ ১০১ কমিউনিকেশন জোনের সদর দপ্তর ছিলো গৌহাটিতে। মেজর জেনারেল জি, এস, গিল ছিলেন এর কমান্ডার। যুদ্ধে জেনারেল গিল আহত হলে মেজর জেনারেল নাগারা কমান্ডার নিযুক্ত হন। একটি পদাতিক ব্রিগেডের সমান ছিলো এর আকার ও শক্তি। এছাড়া সমস্ত সীমান্ত এলাকা জুড়ে ছিলো মুক্তিবাহিনীর ১১টি সেক্টর।

দ্বিতীয় কোর ফ্রন্টে জেনারেল রায়নার কমান্ডে দুই ডিভিশন সৈন্য মধুমতি নদীর দিকে ধাবিত হয়। পদ্মা থেকে শাখা নদী মধুমতি দক্ষিন দিকে প্রবাহিত হয়ে সুন্দরবন এলাকায় পতিত হয়েছে। এই ফ্রন্টের দায়িত্ব ছিলো পদ্মার পশ্চির তীরবর্তী সমস্ত এলাকা মুক্ত করা। দ্বিতীয় কোর কমান্ডার পাকিস্তানী শক্ত প্রতিরক্ষার উপরে  আক্রমণ অব্যাহত রেখে দ্রুতগতিতে একাধিক দলে মধুমতির দিকে অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

একটি দল কুষ্টিয়ার দিকে, অন্য একটি মাগুরা হয়ে যশোর বরাবর এবং অপর একটি দল খুলনা ও বরিশালের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। খুলনা-যশোর-কুষ্টিয়া রেলওয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। আত নম্বর সেক্টর কমান্ডার লেঃ কর্নেল মনজুরের নেতৃত্বে আগেই মুক্তিবাহিনী চৌগাছা দখল করে। ২৪ নভেম্বর সংঘটিত চৌগাছা যুদ্ধে পাকসেনারা ৪টি শাফি ট্যাংক হারায়। একটি ভারতীয় ব্রিগেড ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে। একইভাবে কুষ্টিয়ার পথে দর্শনা আক্রমণ করা হয়। আট নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ডিসেম্বরের তিন তারিখে সিংহঝুলিতে পৌঁছায়। ঝিকরগাছার পতন হয় ডিসেম্বরের পাঁচ তারিখে। তারপর তিনদলে বিভক্ত হয়ে যশোর আক্রমণ করা হয়। উত্তর দিকের দলটি যশোর-ঝিনাইদহ সড়ক ধরে আক্রমণ অব্যাহত রাখে। মধ্যবর্তী দলটি ধাঙ্কখেতের ভিতর দিয়ে চিতের বিল এলাকা দিয়ে অগ্রসর হয়। দক্ষিন দিকে বেনাপোল-যশোর সড়কে অগ্রসর হয় অপর একটি দল।

ডিসেম্বরের পাঁচ তারিখে কোটচাঁদপুরে যশোর-কুষ্টিয়া রেলওয়ে জংশন দখল করে রেলওয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। অগ্রসরমান এই দলটি উত্তরদিকে ধাবিত হয় এবং ৭ ডিসেম্বর আরও ৩০ মাইল অগ্রসর হয়ে ঝিনাইদহ দখল করে। ঝিনাইদহ যুদ্ধে মেজর মুস্তাফিজ আহত হন।

লেঃ জেনারেল নিয়াজী ৫ ডিসেম্বর রাতে পাকবাহিনীকে পেছনে সরে আস্তে নির্দেশ দেন। সম্ভবত ঢাকার পথে পেছনে এসে মেঘনার তীরে সৈন্য সমাবেশ করে ঢাকা রক্ষার পরিকল্পনা ছিলো। কিন্তু ট্যাঁ আর সম্ভব ছিলো না, কারণ যশোর-ঢাকা সড়ক মিত্রবাহিনীর দখলে চলে গেছে। মধুমতি অতিক্রম করে মিত্রবাহিনীর একতি দল খুলনার দিকে এবং অপর একটি দল কুষ্টিয়ার দিকে অভিযান অব্যাহত রাখে। পাকিস্তানী নবম ডিভিশন যশোর সেনানিবাস ছেড়ে মাগুরার দিকে চলে যায়। ৬ ডিসেম্বর যশোর মুক্ত হয়। পরবর্তীকালে মেহেরপুর দখলের পর চুয়াডঙ্গা ও কুষ্টিয়ার দিকে যাত্রা অব্যাহত থাকে।

ডিসেম্বরের ১২ তারিখে ফরিদপুরের ভাটিয়াপাড়ার মুক্তিবাহিনীর সাথে পাকসেনাদের সংঘর্ষ হয়। লেঃ সিদ্দিক ও ক্যাপ্টেন হুদা এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। লেঃ সিদ্দিক ১৪ ডিসেম্বর এই যুদ্ধে একটি চোখ হারান। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ প্রচন্ড রূপ ধারন করে এবং ১৮ ডিসেম্বর ১৫০ জন পাকসেনা আত্মসমর্পন করে।

মেজর জলিলের নেতৃত্বে নয় নম্বর সেক্টরের মুক্তিবাহিনী বীর বক্রমে অগ্রসর হচ্ছিলো। ৩ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা শত্রুমুক্ত হয়। ১০ ডিসেম্বর মিত্র ও মুক্তিবাহিনী খুলনা দখল করে। ৭ ডিসেম্বর বরিশাল মুক্ত হয় এবং পাকসেনারা ক্যাপ্টেন বেগ ও নূরুল ইসলাম মঞ্জুর কাছে আত্মসমর্পন করে। ১৭ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার হায়াত তার সৈন্যসমন্তসহ আত্মসমর্পণ করে।

৩৩ কোর ফ্রন্টে পরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন দল পাকিস্তানী শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থানগুলোকে আক্রমণ করে এবং মুল আক্রমণ পরিচালিত হয় হিলিতে।

একটি ব্রিগেড জলপাইগুড়ি সীমান্তে এবং অন্য একটি ব্রিগেড কুচবিহার সীমান্তে অবস্থিত পাকঘাঁটি আক্রমণ করে। এক ডিভিশন সৈন্য হিলি আক্রমণ করে। হিলিতে পাকসেনারা প্রচন্ড যুদ্ধ করে।

ডিসেম্বর পাঁচ তারিখে পীরগঞ্জ ও খানপুর দখল হয়। ৭ ডিসেম্বর লালমনিরহাট শত্রুমুক্ত হয়। দুর্গাপুর ৮ ডিসেম্বর দখল হয় এবং ৯ ডিসেম্বর রংপুর ও দিনাজপুর পাকঘাঁটি আক্রমণ করা হয়।

মিত্রবাহিনীর একটি দল হিলিকে এড়িয়ে পলাশবাড়ীর দিকে অগ্রসর হয়।

উইং কমান্ডার এম, কে, বাশারের নেতৃত্বে ছয় নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ৫ ডিসেম্বর ধরলা নদী অতিক্রম করে কুড়িগ্রাম দখল করে। পাকসেনারা কুড়িগ্রাম থেকে পালিয়ে লালমনিরহাটে চলে যায়। ৬ ডিসেম্বর তিস্তা নদীর তীরে মুক্তিবাহিনী অবস্থান নেয়। ৩ ডিসেম্বর তারিখে ভজনপুর সাব-সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ঠাকুরগাঁও বীরগঞ্জ দখল করে। ১২ ডিসেম্বর রংপুর ও সৈয়দপুর সেনানিবাস ছাড়া সমগ্র এলাকা মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। পাকসেনারা ১৭/১৮ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে।

সাত নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা নবাবগঞ্জের দিকে অভিযান শুরু করে। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে এই অভিযান শুরু হয়। অপর একটি দল লেঃ রফিকের নেতৃত্বে মহানন্দ নদী অতিক্রম করে রোহনপুর-নাচল-আমনুরা বরাবর অগ্রসর হয়ে নবাবগঞ্জ আক্রমণ করে। অপর একটি দল লেঃ রশিদের নেতৃত্বে গোমস্তপুর হয়ে নবাবগঞ্জ অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। ১৩ ডিসেম্বর বারঘরিয়ার নদী অতিক্রম করে প্রতিটি বাংকার চার্জ করার সময় এই নির্ভীক যোদ্ধা শহীদ হন। এই সেক্টরের তপন ও হামজা সাবসেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা পদ্মা নদী পার হয়ে রাজশাহী আক্রমণ করে এবং শেখপাড়া সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর রশিদের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর অপর একটি দল পাবনা অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। পাকসেনারা রাজশাহী ছেড়ে নাটোরে আশ্রয় নেয়। ১৭ ডিসেম্বর সমবেত পাকসেনারা নাটোরে আত্মসমর্পণ করে।

এদিকে যশোর দখলের পর লেঃ আকতার কালীগঞ্জের দিকে এবং লেঃ অলীক কুমার গুপ্ত ঝিনাইদহের দিকে অগ্রসর হয়। মিত্রবাহিনী খুলনার দিকে অগ্রসর হয়। রুপদিয়া ও নোয়াপাড়া দখলের পর শিরমনিতে যুদ্ধ শুরু হয়। এখানে পাকিস্তানী ১৫ এফ এফ রেজিমেন্ট সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করে। পশ্চিমে জলাধার আর পূর্ব্দিকে নদী। পাকসেনারা এখানে প্রবল্ভাবে বাধা দিতে সক্ষম হয়। পাঁচ দিনব্যাপী প্রচন্ড যুদ্ধের পর শিরমনির পতন হয় ১৬ ডিসেম্বর সকালে। মেজর জয়নাল আবেদীনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী রুপসা নদীর তীরে এসে পৌঁছায় এবং খুলনা আক্রমণ করে। ৭ ডিসেম্বর সাতক্ষীরার পতন হয়। নবম সেক্টর সৈন্যরা লেঃ হুদার নেতৃত্বে এবং অষ্টম সেক্টর সৈন্যরা ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে সাতক্ষীরা দখল করে।

ক্যাপ্টেন তৌফিক এলাহি, ফ্লাইং অফিসার কালাম ও লেঃ নূরুন্নবী কুষ্টিয়ায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। মেজর আযম চৌধুরী দুই কোম্পানী নিয়ে ৬ ডিসেম্বর মেহেরপুর দখল করেন ও পরদিন চুয়াডাঙ্গা শত্রুমুক্ত করেন।

ফরিদপুরের দিকে অগ্রসরমান যৌথবাহিনী কামারখালি ঘাটে ৮ ডিসেম্বর পাকিস্তানীদের সাথে সংঘর্ষ আসে। মধুমতি নদীর সকল সম্ভ্যাব্য অতিক্রম স্থানে পাকসেনারা প্রহরারত ছিলো। লেঃ মোস্তফা স্থানীয় জনগনের কাছ থেকে নৌকা সংগ্রহ করে। ১৪ এপ্রিল (ডিসেম্বর হওয়ার কথা) মধুমতি নদী অতিক্রম করে মুক্তিবাহিনী পাকসেনাদের পিছু হটিয়ে দেয়। মিত্রবাহিনী এয়ারব্রিজ অপারেশন করে মধুমতি অতিক্রম করে।

৪ নম্বর সেক্টর এলাকায় ৭ ডিসেম্বর পাকসেনারা মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের ফলে দরবশত ছেড়ে হরিপুরে পলায়ন করে। ১১ ডিসেম্বর পাকবাহিনী নদী পার হয়ে মুক্তিবাহিনীর উপর আক্রমণ করে। এই আক্রমণের ফলে মুক্তিবাহিনী বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ১২ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী হরিপুর আক্রমণ করে এবং ১৩ ডিসেম্বর হরিপুর শত্রুমুক্ত হয়। ডিসেম্বর ১৫ তারিখে পাকিস্তানী ঘাঁটি খাদিমনগরের ডান দিক থেকে মিত্রবাহিনী ও বাম দিক থেকে সেক্টরবাহিনী আক্রমণ করে। সিলেট শ্ত্রুমুক্ত হয় ১৭ ডিসেম্বর।

পাঁচ নম্বর সেক্টরে ৩ ডিসেম্বর গোয়াইঘাটে পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ হয়। ৩ ডিসেম্বরই গোয়াইঘাট মুক্ত হয়। ৪ ডিসেম্বর করিমগঞ্জ থেকে মৌলবীবাজার হয়ে সিলেটের পথে যাত্রা শুরু করে মিত্রবাহিনী। ৬ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জ মুক্ত হয়। সেক্টর কমান্ডার লেঃ কর্নেল শওকত ছাতক আক্রমণ করেন ৭ ডিসেম্বর এবং ঐ দিনই রাত আটটায় ছাতক দখল হয়। মেজর শাফায়াত জামিল সালুটিকর বিমান বন্দরের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। ৯ ডিসেম্বর গোবিন্দগঞ্জ আক্রমণ করে মুক্তিবাহিনী। ১৫ ডিসেম্বর এই বাহিনী বিশ্বনাথ দখল করে। প্রায় তিনশ’ মুক্তিযোদ্ধার একটি দল নিয়ে ক্যাপ্টেন নবী রাধানগর গোয়াইঘাট আর্টিলারী সাপোর্ট ছাড়াই আক্রমণ করে দখল করেন। এর আগে ভারতীয় গুর্খা রেজিমেন্ট দুইবার আক্রমণ করে বিফল হয়।

চতুর্থ কোর ফ্রন্টে তিন ডিভিশন ভারতীয় সৈন্য ও মুক্তিবাহিনী উত্তরে মেঘালয় সীমান্ত থেকে ত্রিপুরার দক্ষিনে ফেনী পর্যন্ত ২৪০ মাইল বিস্তৃত এলাকায় ধাবিত হয়। এই কোরের দায়িত্ব ছিলো সুরমা নদী থেকে মেঘনার পূর্বতীর পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা মুক্ত করা। চট্টগ্রাম যাওয়ার রেল-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে মেঘনা পার হয়ে ঢাকার পথে অভিযান করার পরিকল্পনা নেয়া হয়।

পরিকল্পনা মোতাবেক জেনারেল সগত সিং এক ডিভিশন সৈন্য শিলচর-করিমগঞ্জ হয়ে সিলেটের দিকে পাঠান। অন্য একটি ডিভিশন আখাউড়া-আশুগঞ্জ বরাবর পাঠানো হয়। পরিকল্পনা মতো অপর ডিভিশনটি তিন দলে বিভক্ত হয়ে প্রথম দলটি কুমিল্লা আক্রমণ অব্যাহত রাখে এবং অন্য দল দুটির একটি লাকসাম-চাঁদপুর এলাকায় এবং অপরটি ফেনী থেকে দক্ষিণে অগ্রসর হতে থাকে।

মুক্তিবাহিনী করিমগঞ্জ জয় করে মুন্সীনগরের দিকে এগিয়ে চলে। মুন্সীনগরের পতন হয় ৫ ডিসেম্বর। এরপর একটি দল মৌলবীবাজারের দিকে অগ্রসর হয়। ডিসেম্বর ৮ তারিখে মৌলবীবাজার দখল হয়। অন্য একটি দল সিলেট অভিমুখে যাত্রা শুরু করে।

সিলেট আক্রমণ সহজসাধ্য ছিলো না। নদী অতিক্রম অপারেশনের জন্য যথেষ্ট ব্রীজ তৈরির যন্ত্রাদি ছিলো না। রাতের অন্ধকারে হেলিকপ্টারের সাহায্যে এয়ার ব্রিজিং অপারেশন শুরু হয়। পরদিন সকালে এই দলটি সিলেটের উপকন্ঠে আসতে সক্ষম হয়।

চতুর্থ কোরের যে ডিভিশনটি আখাউড়া অভিমুখে যাত্রা শুরু করে-জেনারেল সগত সিং মেঘনা অতিক্রম করে ঢাকার দিকে অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন। মুক্তিবাহিনীর তিন নম্বর সেক্টর ও ‘এস’ ফোরস তখন আখাউড়ায় পাকবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।

আখাউড়া থেকে রেলওয়ে লাইন আশুগঞ্জের দিকে চলে গেছে। চলাচলের কোন রাস্তা ছিলো না। শায়েস্তাগঞ্জ থেকে ভৈরববাজার প্রায় এক মাইল দীর্ঘ নদী একটি বিরাট বাঁধা হিসেবে দেখা দেয়।

অগ্রবর্তী ব্রিগেড আখাউড়া ঘিরে ফেলে এবং গঙ্গাসাগরের দিকে এগিয়ে চলে। এইসময়ে পাকিস্তানী স্যাবরজেট বিমানগুলো হামলা চালায়। ভারতীয় জঙ্গী বিমান পাল্টা আক্রমণ চালালে পাকিস্তানী বিমানগুলো পালিয়ে যায়। ৫ ডিসেম্বর আখাউড়ার পতন হয়।

ভারতীয় ৩১১ পার্বত্য ব্রিগেড, ৭৩ পার্বত্য ব্রিগেড তখন নরসিংদীতে অবস্থান করছিলো। মিত্রবাহিনী ১২ ডিসেম্বর ডেমরা দখল করে। ‘এস’ ফোরস পদব্রজে বোলতাপুল হয়ে রূপগঞ্জ দিয়ে বালু নামক স্থানে নদী অতিক্রম করে ডেমরা পৌছায় ১৩ ডিসেম্বর। ১৬ ডিসেম্বর ১০টা পর্যন্ত সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে। ‘কে’ ফোরস দুই দলে বিভক্ত হয়ে একদল চট্টগ্রামের দিকে এবং অপর দল চাঁদপুরের দিকে অগ্রসর হয়। দশম ইষ্ট বেঙ্গল মিত্রবাহিনীর ৮৩ ব্রিগেডের সাথে যৌথভাবে ফেনী শহর দখল করে। এই বাহিনীকে নোয়াখালী সদরে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী বাঁধা দেয় কিন্তু তীব্র আক্রমণের মুখে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ঐদিনই তারা চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। ফেনী থেকে চট্টগ্রামের দুরত্ব ছিলো মাত্র ৬৫ মাইল। যৌথ বাহিনী ১৩ ডিসেম্বর কুমিল্লা পৌছায় দুপুর বারোটায়। ক্যাপ্টেন আইনুদ্দিনের নেতৃত্বে নবম বেঙ্গল এবং ক্যাপ্টেন গাফফারের নতৃত্বে চতুর্থ বেঙ্গল প্রবল পরাক্রমে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।

এখানে সবিশেষে উল্লেখযোগ্য যে, ‘এস’ ফোরস কমান্ডার লেঃ কর্নেল শফিউল্লাহ দ্বিতীয় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে আখাউড়ার প্রতিরক্ষার নিয়োজিত রেখে ভৈরবের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ‘এস’ ফোরস মাধবপুর হয়ে ব্রাক্ষণবাড়িয়া সরাইল পৌছায় ডিসেম্বর ৮ তারিখে। আখাউড়ার যুদ্ধে লেঃ বদিউজ্জামান শহীদ হন। পরিকল্পনা হয় ব্রাক্ষণবাড়িয়ার দক্ষিণ থেকে অগ্রসর হয়ে একটি দল শহরে ঢুকবে, অপর দল উত্তর দিক থেকে সিলেট সড়ক দিয়ে ব্রাক্ষণবাড়িয়া পৌছাবে- আর মিত্রবাহিনী আখাউড়া- ব্রাক্ষণবাড়িয়া রেললাইন এবং উজানী সর-ব্রাক্ষণবাড়িয়া সড়ক হয়ে অগ্রসর হবে। ‘এস’ ফোরসের ১১ বেঙ্গলকে চান্দুরার উত্তরে রোড ব্লক করে চান্দুরা থেকে সরাইল পর্যন্ত এলাকা শক্রুমুক্ত করেন। ১১ বেঙ্গল পাইকপাড়ায় এলে মেজর নাসিম শাহবাজপুর, সরাইল এবং ব্রাক্ষনবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হতে আদেশ দেন। এই সময় একটি দুর্ঘটনা ঘটে। পাকিস্তানীদের একটি গাড়ী তেলিয়াপাড়া থেকে মেজর ভুঁইয়াকে অতিক্রম করে চলে আসে। ‘এস’ ফোরস কমান্ডার নিজেদের গাড়ী মনে করে গাড়ী থামান। গাড়ী থামালে দেখা গেল গাড়ীতে পাকসেনা। পাকিস্তানী সুবেদারের সাথে কর্নেল শফিউল্লাহর হাতাহাতি শুরু হয়। পাকসেনার গুলিবর্ষণে কর্নেল শফিউল্লার কোমরের পিস্তলটি বিধ্বস্ত হলো কিন্তু অলৈকিকভাবে তিনি বেঁচে যান। মেজর নাসিমসহ ১১ জন গুরুতরভাবে আহত হন। মেজর মতিন ১১ বেঙ্গলের অধিনায়ক নিযুক্ত হন। ৭ ডিসেম্বর শাহবাজপুর আক্রমণ করে শক্রুমুক্ত করেন। ৮ ডিসেম্বর মেজর ভুঁইয়া ও ‘এস’ ফরসের দলটি সরাইল হয়ে আশুগঞ্জের দিকে অগ্রসর হয়।

পাকবাহিনীর ১৪ ডিভিশনের সুদৃঢ় ঘাঁটি নির্মাণ করেছিলো। ১০ ডিসেম্বর ১৮ রাজপুত রেজিমেন্ট পাকিস্তানী ব্যূহ ভেদ করে আশুগঞ্জে ঢুকে পড়ে। ‘এস’ ফোরস ও তিন নম্বর সেক্টর সৈন্যরা বিপুল বিক্রমে এই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১০/১১ ডিসেম্বর পাকসেনারা আশুগঞ্জ ছেড়ে ভৈরব চলে যায় এবং ভৈরব ব্রিজটি ধ্বংস করে। ১১ ডিসেম্বর ভারতীয় ১৯ পাঞ্জাবকে হেলিকপ্টার যোগে নদীর অপর পাড়ে নামানো হয়। দ্বিতীয় বেঙ্গল ও তিন নম্বর সেক্টর সৈন্যরা পায়ে হেঁটে নরসিংদী অগ্রসর হয়। ১১ বেঙ্গল ভোইরব অবরোধ করে রাখে।

কুমিরাতে পাক ঘাঁটি ছিলো খুবই শক্তিশালী। ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম দশম বেঙ্গলের এক কোম্পানী কুমিরায় রেখে পাহাড় পার হয়ে হাটহাজারী যাত্রা করেন। ১৪ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী হাটহাজারী পৌছে যায়। চতুর্থ বেঙ্গল চট্টগ্রাম- রাঙামাটি সড়ক দিয়ে হাটহাজারী দিয়ে হাটহাজারীর সন্নিকটে এসে পড়ে। নবম বেঙ্গলও এখানে এসে পৌঁছায়। ১৫ ডিসেম্বর হাটহাজারীতে সন্নিকটে এসে পড়ে। নবম বেঙ্গলও এখানে পৌঁছায়। ১৫ ডিসেম্বর হাটহাজারীতে অবস্থানরত পাকসেনাদের ওপর মুক্তিবাহিনী আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানী অফিসার মেজর হাদী এক কোম্পানী পাকসেনাসহ আত্মসমর্পণ করে। অপরদিকে পাকসেনারা কুমিল্লা ছেড়ে ফৌজদিরহাটে এসে অবস্থান নেয়। সম্মিলিত বাহিনী ফৌজদিরহাট আক্রমণ করে। ১৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম অবস্থানরত পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করেন।

এক নম্বর সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন মাহফুজের নেতৃত্বে ছাগলনাইয়া দখল করে। ক্যাপ্টেন মাহফুজ ‘কে’ ফোর্সের সাথে যোগ দিয়ে ফেনী চট্টগ্রাম সড়ক ধরে একটি দল মুহুরি নদী ধরে এবং ওপর দলটি চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।

ক্যাপ্টেন মাহফুজ সম্মিলিত বাহিনীর সাথে ৯ ডিসেম্বর যোরারগঞ্জ এসে পৌঁছায়। যোড়ারগঞ্জ যুদ্ধে ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হয়। পাকসেনারা মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণের ফলে পিছু হটতে থাকে। শুভপুর ব্রিজটি পলায়নপর পাকবাহিনী ধ্বংস করে দেয়।

সীতাকুণ্ড দখল করার জন্য ক্যাপ্টেন মাহফুল ডান দিক থেকে অগ্রসর হয়। এবং মিত্রবাহিনী সম্মুখভাগে এগিয়ে চলে। যৌথবাহিনী চন্দ্রকান্তের মন্দিরে এসে পৌঁছালে পাকসেনারা আর্টিলারির সাহায্যে প্রবল ভাবে বাঁধা দেয়। ১১ ডিসেম্বর সীতাকুণ্ডের পতন হয়। ১৪ ডিসেম্বর এই বাহিনী কুমিরায় অবস্থানরত দশম বেঙ্গলের সাথে যোগদান করে।

চতুর্থ কোর ও মুক্তিবাহিনী যৌথভাবে দ্রুত গতিতে ঢাকার ভেতরে ঢুকে পড়ে। ওপর একটি দল চট্টগ্রামের দিকে ধাবিত হয়। দ্বিতীয় কোর ও মুক্তিবাহিনী মধুমতী অতিক্রম করে অগ্রসর হতে থাকে। একটি দল মাগুরার দিক ও অন্য দলটি যশোর দখলের পড় খুলনার দিকে অগ্রসর হয়। ১৪ ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনী ফরিদপুর দখল করে। দৌলতপুরের পতন হয় একই দিনে। পাকসেনাদের কুষ্টিয়া যশোরের দিকে পালানর পথ বন্ধ হয়ে যায়।

উত্তর-পশ্চিম দিকে লালমনিরহাটের পতন হয়। এর আগে জয়মনিরহাট যুদ্ধে লে সামাদ শহিদ হন। ১২ ডিসেম্বর ঘোড়াঘাট দখল হয়। এবং মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী বগুড়ার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। গোবিন্দপুর পরদিন শত্রুমুক্ত হয়। ১৪ ডিসেম্বর বগুড়ার পতন হয়।

১০১ কমিউনিকেশন জোন এলাকায় সম্মিলিত বাহিনী টুরা থেকে জামালপুরের দিকে অগ্রসর হয়। পাকবাহিনীর একটি ব্রিগেড এই এলাকায় মোতায়েন ছিল। ব্রিগেড সদর দপ্তর ও দুইটি ব্যাটালিয়ন ময়মনসিংহে ও একটি ব্যাটালিয়ন জামালপুরে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়।

ডিসেম্বর ৯ তারিখ সম্মিলিত বাহিনী জামালপুরের নিকতবর্তি অঞ্চলে পৌঁছায়। একটি দল ব্রহ্মপুত্র অতিক্রম করে জামালপুরকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পাকবাহিনী ময়মনসিংহ থেকে একটি ব্যাটালিয়ন জামালপুরে স্থানান্তরিত করে।

১১ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনী হালুয়াঘাট ও নালিতাবাড়ি হয়ে ময়মনসিংহের দিকে ধাবিত হয়। ৬ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ শত্রুমুক্ত হয়। জামালপুরের মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর সাথে পাকসেনাদের এক প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। ১১ ডিসেম্বর পাকবাহিনী পরাজিত হয়। মেজর জেনারেল গিল গুরুতর ভাবে আহত হলে মেজর জেনারেল নাগরা অধিনায়ক নিযুক্ত হন। পাকসেনাদের একটি দল টাঙ্গাইল চলে যায়। সম্মিলিত বাহিনী টাঙাইলের দিকে অগ্রসর হয়।

১২ ডিসেম্বর টাঙাইলে ছত্রিসেনার একটি ব্যাটালিয়ন অবহরন করে। জামালপুর যুদ্ধে পরাজিত পাকসেনারা টাঙাইলের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। পাকিস্তানীদের পালাবার সকল পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। কারণ ১০১ কমিউনিকেশনের সৈন্যরা টাঙাইলে পৌঁছে যায়। ১৩ ডিসেম্বর পাকবাহিনী টাঙাইলে আত্মসমর্পন করে। পলায়নপর বিপুল সংখ্যক পাকসেনা গ্রামবাসীর হাতে নিহত হয়। সম্মিলিত বাহিনী ঢাকার পথে মির্জাপুরের দিকে যাত্রা করে। ১৪ ই ডিসেম্বর যৌথ দল টঙ্গির কাছা কাছই এসে পরে। এই বাহিনী কালিয়াকৈর হয়ে সাভার এসে পৌঁছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সম্মিলিত বাহিনী ঢাকার উপকণ্ঠে মিরপুর ব্রিজের কাছে এসে পরে। ১১ ই নভেম্বর নাগরা তাঁর এডিসি’র মারফত নিয়াজিকে আত্মসমর্পনের উপদেশ দিয়ে পত্র পাঠালেন।

১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানী ১৪ ডিভিশন কমান্ডার মেজর জেনারেল জামশেদ মিরপুর ব্রিজের কাছে এসে ভারতীয় জেনারেল গন্ধর্ব নাগরার কাছে আত্মসমর্পন করে। মুক্তিবাহিনী লক্ষ লক্ষ মানুষের জয়গান ও উল্লাসের মধ্যে ঢাকা দখল করে।

পাকিস্তান বিমান বাহিনীর পূর্বাঞ্চলে মাত্র ১ এসকোয়াড্রন ১৮ স্যাবর জেট বিমান ছিল। সর্বাত্তক যুদ্ধের দ্বিতীয় দিনে পাকিস্তানীরা বিমানশক্তি সম্পূর্নভাবে হারায়। ভারতীয় বিমান বাহিনী একচ্ছত্র আধিপত্য লাভ করে।

ভারতীয় নৌবাহিনী ফ্লিট এয়ারক্র্যাফট ক্যারিয়ার ‘ভিক্রান্ত’ বঙ্গোপসাগরে ঢুকে সমুদ্রপথের গতি রোধ করে। ‘ভিক্রান্ত’ থেকে যুদ্ধবিমান গুলো চট্টগ্রাম বন্দর , বিমান বন্দর ও চালনা বন্দর আক্রমণ করে। এই যুদ্দ জাহাজের প্রধান কর্তব্য ছিল সমুদ্রপথে পাকসেনা পালিয়ে যেতে না দেয়া এবং সমুদ্র পথে কোন সাহায্য যাতে না আস্তে পারে তা নিশ্চিত করা।

পাকিস্তান পূর্বাঅঞ্চল নৌবাহিনীর কয়েকটি মাত্র গানবোট সর্বাত্তক যুদ্ধের প্রথম কয়েকদিনের মধ্যেই ধংসপ্রাপ্ত হয়। ১২ অক্টোবর পদ্মা ও পলাশ নামে দুটি গানবোট বাংলাদেশ নৌবাহিনী সংযোজিত করে। ৬ ডিসেম্বর যশোরের পতনের পড় পদ্মা ও পলাশ এবং ভারতীয় গানবোট ‘পানভেল’ হিরণ পয়েন্ট মংলা বন্দর এবং খুলনার খালিস পুরে পাক নৌঘাঁটি পি এন এস ‘তিতুমির’ দখলে জন্য অগ্রসর হয়। ৯ ই ডিসেম্বর কোন বাঁধা ছাড়াই এই গানবোট গুলো হিরণ পয়েন্টে পৌঁছায়। পরদিন ১০ ডিসেম্বর অভিযান শুরু হয়।

বেলা ১২ টার সময় খুলনা শিপ ইয়ার্ডের সন্নিকটে আকাশে তিনটি জঙ্গি বিমান দেখা যায়। ভারতীয় নাবিক বলেন যে বিমান গুলো ভারতীয়। আকস্মিকভাবে জঙ্গি বিমান গুলো বোমাবর্ষন শুরু করে। ভারতীয় নাবিক সবাইকে জাহাজ ত্যাগ করতে বলেন। ইঞ্জিন আর্টিফিসার মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিন উপড়ে এসে চিৎকার করে জানতে চান ‘জাহাজ থামতে কেন বলা হয়েছে। আমরা মৃত্যুর ভয়ে ভিত নই – এগিয়ে যাবোই। ’ বীর শ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন ‘পলাশ’ এর উপড়ে পাকিস্তানী বোমাবর্ষনের ফলে শহিদ হন।

৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদ যুদ্ধ বিরতির জন্য প্রস্তাব পাশ করে। রাশিয়া এই প্রস্তাবে ভেটো দেয় এবং ব্রিটেন ও ফ্রান্স ভোট দানে বিরত থাকে। ইয়াহিয়া খান প্রত্যাশিত আমেরিকা ও চীনের সরাসরি হস্তক্ষেপ থেকে বঞ্চিত হন। পাকিস্তানী এক লক্ষ সৈন্যের শোচনীয় পরাজয় ও আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়ে মুক্তিবাহিনীর পরম বিজয় সূচিত হল – পৃথিবীর মানচিত্রে সংযোজিত হল স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ।

*‘রোব্বার’-স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা ১৯৮৩-তে প্রকাশিত মেজর (অবঃ) রফিকুল ইসলাম, পিএসসি-রচিত প্রতিবেদন থেকে সংকলিত।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৭। মিত্রবাহিনীর তৎপরতা ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্য ‘বাংলা নামে দেশ’ অভীক সরকার সম্পাদিত কলিকাতা ১৯৭২, পৃষ্ঠা, ৯৮-১৩৯ ১৯৭১

মিনহাজ উদ্দিন

<১০, ২৭, ৫৩৮৫৫৮>            

মিত্র বাহিনীর তৎপরতা ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্য (প্রতিবেদন)

৩রা ডিসেম্বর ১৯৭১। মধ্যরাত্রি থেকেই পুরোদমে শুরু হয়ে গেল ভারত-পাকযুদ্ধ। এবং সেই সঙ্গে শুরু হয়ে গেল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়। চতুর্দিক থেকে বাংলাদেশের দখলদার পাকবাহিনীর উপর আক্রমণ শুরু করল ভারতীয় সেনা, বিমান এবং নৌবাহিনী। আর বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা।

সব যুদ্ধই কোনও একটা মুহূর্তে শুরু হয়। কিন্ত তা বলে কোনও যুদ্ধই ঠিক আকস্মিক শুরু হয় না। প্রত্যেকটা যুদ্ধের পেছনে থাকে দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি। থাকে বিস্তারিত পরিকল্পনা।যুদ্ধের সম্ভবনা দেখা দিলেই শুরু হয় সেই প্রস্তুতি আর পরিকল্পনা। যেমন এ যুদ্ধেরও ছিল। এবারের ভারত-পাক যুদ্ধের। এবং তাঁরই মূল অংশ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত লড়াইয়েরও।

এপ্রিল- মে থেকেই ভারতীয় ও পাকিস্তানী প্রতিরক্ষা বাহিনী বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের নিজ নিজ পরিকল্পনা রচনার কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। আর সেই সঙ্গেই শুরু হয়েছিল প্রস্তুতি। সাধারণত লক্ষ্যটা স্থির করে দেন রাষ্ট্রনায়করা। সমরনায়করা সেই অনুসারে তাঁদের পরিকল্পনা রচনা করেন এবং প্রস্তুতি গড়েন।

এপ্রিল মাসের শেষদিকেই ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর সামনে ভারত সরকার বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের কয়েকটা দিক তুলে ধরেছিলেন। বলেছিলেন- (এক) বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম চালাবে মূলত বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী। ভারতীয় বাহিনী ট্রেনিং এবং অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করবে।(দুই) মুক্তিবাহিনীকে ভারত সরকার সাহায্য দিচ্ছে বলে পাকবাহিনী যদি ভারতের উপর হামলা করে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সেই আক্রমণের জবাব দিতে হবে।(তিন) বাংলাদেশের সমস্যার যদি কোন রাজনৈতিক সমাধান না হয় তাহলে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীকেও বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত লড়াইয়ের নামতে হতে পারে।(চার) যদি চূড়ান্ত লড়াইয়ে ভারতীয় প্রতিরক্ষাবাহিনীকে নামতেই হয় তাহলে তার লক্ষ্য হবে রাজধানী ঢাকা সহ গোটা বাংলাদেশকে দখলদার পাকবাহিনীর কবলমুক্ত করা।(পাঁচ) মুক্তিসংগ্রামে যদি প্রত্যক্ষভাবে ভারতীয় প্রতিরক্ষাবাহিনী নামে তাহলে রাজধানীসহ গোটা বাংলাদেশকে খুব দ্রুতগতিতে মুক্ত করতে হবে।(ছয়) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর অংশ নেওয়া মানেই হবে পাকিস্তানের সাথে ভারতের যুদ্ধ। সুতরাং লড়াই শুধু পূর্বে হবে না, হবে পশ্চিমেও। এবং(সাত) পাক- ভারত লড়াই হলে উত্তর সীমান্তে চীনের কথাও মনে রাখতে হবে।

এই নির্দেশের উপর ভিত্তি করেই ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী তাঁদের পরিকল্পনা রচনা করল এবং প্রস্তুতি গড়ে তুলল।(এক) মুক্তিবাহিনীকে ট্রেনিং দেওয়া এবং তাদের অস্ত্র সরবরাহ করা।(দুই) বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ের লড়াইয়ের জন্য পরিকল্পনা রচনা করা এবং তার প্রস্তুতি গড়ে তোলা।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ের পরিকল্পনা রচনা করতে গিয়ে আমাদের প্রতিরক্ষাবাহিনীকে প্রথমেই কতগুলি অসুবিধার কথা বিবেচনা করতে হয়। প্রথমত, বাংলাদেশের প্রকৃতি। বাংলাদেশে অসংখ্য নদীনালা। কতগুলি বিশাল নদী। আর বাংলদেশের প্রায় সর্বত্র জলাভূমি এবং এইসব জলাভূমিতেও শীতকালেও কিছু কিছু জল জমে থাকে।দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের নদীনালাগুলির অধিকাংশই উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত। তাই পশ্চিম থেকে পূর্বে অগ্রসর হওয়া বড় কঠিন। অথচ ভারত থেকে বাংলাদেশে কোনও বড় সেনাবাহিনীকে পাঠাতে হলে নানা কারণে পশ্চিম দিক থেকে পাঠানোই সুবিধা। তৃতীয়ত, বাংলাদেশের রাস্তাঘাট অত্যন্ত কম। সামান্য কয়েকটি মাত্র পাকারাস্তা আছে। সেগুলিও অসংখ্য নদীনালার উপর দিয়ে গিয়েছে। চতুর্থত, প্রয়োজনীয় সংখ্যার সৈন্য, বিমান এবং জাহাজবোট পাওয়া যাবেনা।বাংলাদেশে পাক দখলদার বাহিনীতে মোট সৈন্য এবং আধা সৈন্য প্রায় চার ডিভিশন। সামরিক বিশেষজ্ঞদের হিসাব মত ঘাঁটি থেকে কোনও সেনাবাহিনীকে উচ্ছেদ করতে হলে আক্রমণকারীর অন্তত তিনগুন শক্তি চাই। অর্থাৎ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের জন্য অন্তত বারো ডিভিশন ভারতীয় সৈন্য প্রয়োজন। অথচ, তা পাওয়া যাবে না। কারণ, পশ্চিম খণ্ডেও বহু সৈন্য, বিমান এবং জাহাজ রাখা প্রয়োজন। আর উত্তরের জন্যও কিছু সৈন্য এবং বিমান মজুত রাখতে হবে। পঞ্চমত, এইসব অসুবিধা সত্ত্বেও খুব দ্রুত ঢাকা সহ সারা বাংলাদেশকে মুক্ত করতে হবে- কিন্ত বাংলাদেশে এমন সতর্কভাবে লড়াই চালাতে হবে যাতে সাধারণ নাগরিকের কোনও ক্ষতি না হয়, দেশের কোনও সম্পদ নষ্ট না হয় এবং লড়াইটা চলে শুধু পাকবাহিনীর সাথে। অর্থাৎ তাড়াতাড়ি লড়াই শেষ করতে হবে, কিন্ত আর পাঁচটা লড়াইয়ের মত সর্বাত্মক লড়াই করা যাবে না। এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী বাংলাদেশের চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য একটা বিস্তারিত পরিকল্পনা রচনা করল।

সেই পরিকল্পনা পাঁচটা লক্ষ্য। প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য ক্ষিপ্রতা। ভারতীয় প্রতিরক্ষাবাহিনী স্থির করল যদি যুদ্ধে নামতেই হয় তবে দু সপ্তাহের মধ্যে ঢাকা পৌঁছতে হবে। কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা। একমাত্র সেইদিকেই এগুতে হবে। অন্যান্য শহর বা ঘাঁটি দখলের জন্য সময় বা শক্তি নষ্ট করা হবে না। সেগুলো এড়িয়ে যেতে হবে।

দ্বিতীয় লক্ষ্য, শত্রুকে ধোঁকা দেওয়া। তাকে বোঝাতে হবে যে, তার চেয়ে অন্তত চারগুণ শক্তি নিয়ে ভারতীয় বাহিনী আক্রমণ করতে যাচ্ছে যাতে শত্রুপক্ষ তার সৈন্যবাহিনী কোনও একটা এলাকায় জড় না করতে পারে এবং বাংলাদেশের চতুর্দিকে ছড়িয়ে রাখতে বাধ্য হয়।

তৃতীয় লক্ষ্য, সেই ছড়িয়ে পড়া পাকবাহিনীকে আবার একত্রিত হতে না দেওয়া যাতে পাকবাহিনী রিগ্রুপড হয়ে কোনও দ্বিতীয় পর্যায়ে লড়াইয়ে না নামতে পারে এবং যাতে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সৈন্য সরিয়ে এনে তারা ঢাকা রক্ষার জন্য পদ্মাও মেঘনার মাঝামাঝি অঞ্চলে কোনও শক্ত ব্যূহ না রচনা করতে পারে।

চতুর্থ লক্ষ্য, ভারতীয় বাহিনী যাতে পাকবাহিনীর সাথে কোনও যুদ্ধে লিপ্ত না হয়ে পড়ে এবং যেন ভারতীয় বাহিনীর ক্ষতি  যথাসম্ভব কম হয়। ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর পরিচালকরা এটাও জানতেন যে, কোথাও কোন বড় দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ হলে তাতে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ক্ষতি হবে এবং জাতীয় সম্পদও ধ্বংস হতে বাধ্য। এই জন্য ভারতীয় বাহিনী প্রথমে ঠিক করল বাংলাদেশে ধুক্তে হলে বড় সড়কগুলি এড়িয়ে যাবে। এবং এগুবে কাঁচা পথ দিয়ে যেখানে পাকবাহিনী তাকে আশা করবে না, যেখানে পাকবাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যূহ বা মাইন থাকবে না, যেখানে শত্রুপক্ষ ভারী অস্ত্রশস্ত্র আনতে পারবে না এবং যেখানে জনবসতি খুবই কম থাকবে।

পঞ্চম লক্ষ্য, গোড়া থেকেই আক্রমণটা চালানো এবং পরিচালনা করা যাতে বাংলাদেশের দখলদার পাকবাহিনীর মনোবল লড়াইয়ের প্রায় শুরুতেই ভেঙ্গে দেওয়া যায় এবং যাতে তারা শেষ পর্যন্ত লড়াই না করে আগেই আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

এই পাঁচটা লক্ষ্য সামনে রেখে ভারত বাংলাদেশের চতুর্দিকে এইভাবে তার সেনাবাহিনীকে সাজালোঃ

২নং কোর। সদর দফতর- কৃষ্ণনগর। প্রধান- লেঃ জেঃ টি, এন রায়না। দুটো পার্বত্য ডিভিশন ৯ম ও ৪র্থ। তৎসহ টি- ৫৫ এস রুশ ট্যাঙ্কে সজ্জিত একটি মাঝারি আর্মাড রেজিমেন্ট, পিটি-৭৬ রুশ ট্যাঙ্ক সজ্জিত আর এক হাল্কা ট্যাঙ্ক রেজিমেন্ট, একটা মাঝারি আর্টিলারি রেজিমেন্ট-১৩০ মিলিমিটার দূরপাল্লার রুশ কামান সহ ব্রিজ তৈরি করতে পারে এমন একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিট। ৯ম ডিভিশন তার প্রধান ঘাঁটি করল ২৪ পরগণার বয়রার কাছাকাছি। ৪র্থ ডিভিশনের মূল ঘাঁটি হল কৃষ্ণনগর গেদের মাঝামাঝি।

৩৩ নং কোর। সদর দফতর- শিলিগুড়ি। প্রধান- লেঃ জেঃ এম, এল, থাপান।৬ এবং ২০ নং পার্বত্য ডিভিশন। তৎসহ রুশ পিটি-৭৬ এস ট্যাঙ্কে সজ্জিত একটি হাল্কা আর্মাড রেজিমেন্ট, ব্রিটিশ ৫.৫ ইঞ্চি কামানে সজ্জিত একটি মাঝারি আর্টিলারি রেজিমেন্ট এবং ব্রিজ তৈরি করার জন্য ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিট। ২০ নং পার্বত্য ডিভিশন প্রধান ঘাঁটি করল বালুরঘাটের কাছে।৬নং ডিভিশন কোচবিহার জেলায়।

এই ৩৩ নং কোরের আর একটা অংশের ঘাঁটি হল গোহাটিতে।পরিচিতিঃ ১০১ নং কমিউনিকেশন জোন। প্রধানঃমেঃ জেঃ জি, এস গিল। শক্তিঃ দুই বিগ্রেড পদাতিক। জামাল্পুরের কাছে প্রচণ্ড এক লড়াইয়ে জেনারেল গিল আহত হওয়ার পর এই বাহিনীর প্রধান হলেন মেঃ জেঃ জি, নাগরা।

৪নং কোর। সদর দফতর- আগরতলা। প্রধান- লেঃ জেঃ সগত সিং। ৮, ৫৭ এবং ২৩ নং পার্বত্য ডিভিশন। তৎসহ দু স্কোয়াড্রন পিটি-৭৬ এস রুশ সাঁতারু ট্যাঙ্ক, ব্রিটিশ ৫.৫ ইঞ্চি কামানে সজ্জিত একটা মাঝারি রেজিমেন্ট এবং ব্রিজ তৈরির ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিট। ঐ তিনটি পার্বত্য ডিভিশনকে ভাগ ভাগ করে বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তে বিভিন্ন এলাকায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়।

এটা ভারতীয় সেনাবাহিনীর হিসাব। এর সঙ্গে ছিল কর্নেল ওসমানীর অধীনস্থ প্রায়৬০০০০মুক্তিসেনা। এরা মোটামুটি দুভাগে বিভক্ত ছিলঃ মুক্তিবাহিনী এবং মুজিব বাহিনী বা মুক্তিবাহিনী(এফ-এফ)। ট্রেনিং প্রাপ্ত ও পুনর্গঠিত মুক্তিবাহিনীর সৈন্যরা নবপর্যায়ে জুন মাস থেকেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে লড়াই চালাতে শুরু করেছিল। ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর পক্ষ থেকে এদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন মেঃ জেঃ বি, এন, সরকার। যুদ্ধ যখন পুরোদমে শুরু হয়ে গেল এবং যখন ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষভাবে লড়াইয়ে অংশ নিলেন তখন বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীকে নিয়ে গঠিত হল একটি কমান্ড। এই কমান্ডের প্রধান হলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লেঃজেঃ জগজিৎ সিং অরোরা।

এখানে দুটো জিনিস বোধহয় আগাম ব্যাখ্যা করে রাখা ভাল। ওপরের তালিকা থেকেই দেখা যাচ্ছে ভারত বাংলাদেশের চতুর্দিকে যে সৈন্য সাজালো তার অধিকাংশ পার্বত্য ডিভিশনের। পার্বত্য ডিভিশন গঠনেও অন্য যেকোনো ডিভিশনের মতই, কিন্ত যেহেতু প্রধানত পাহাড়ে লড়াই করার জন্য পার্বত্য ডিভিশন গঠিত হয় সেই জন্য তাদের অস্ত্রশস্ত্র হয় একটু হাল্কা ধরণের। ট্যাঙ্ক বা ভারী কামান পার্বত্য ডিভিশনে থাকে না। এই জন্যই বাংলাদেশ লড়াইয়ের পরিকল্পনা করে গিয়ে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী প্রতিটা ডিভিশনের সঙ্গে বাড়তি ট্যাঙ্কও আর্টিলারি রেজিমেন্ট যোগ করে। এর মধ্যে বেশকিছু রাশিয়ান সাঁতারু ট্যাঙ্কও ছিল। দ্বিতীয়ত, পার্বত্য ডিভিশনের সঙ্গে বড় ব্রিজ তৈরি করার মত ইউনিট থাকে না।কারণ, পাহাড়ের উপরে নদী চওড়া হয় না। অথচ, বাংলাদেশ চওড়া নদীতে ভরা। কতকগুলি নদী বিশাল। এই জন্য বাংলাদেশে অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকটি পার্বত্য ডিভিশনের সঙ্গে বড় বড় ব্রিজ তৈরির ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিটও দেওয়া হল।

স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হওয়ার পর থেকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রনায়করা তিন পর্যায়ের তিন কিস্তি সামরিক পরিকল্পনা তৈরি করে। প্রথম পর্যায়, ২৫শে মার্চ থেকে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত। এই পর্যায়ে পাকিস্তানী সামরিক পরিকল্পনা ছিলঃ সমস্ত শহরগুলিতে ঝটিতি বাঙ্গালীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়, যাকেই স্বাধীনতা সংগ্রামী বলে মনে হয় তাকেই শেষ করে দাও। দ্বিতীয় পর্যায়ে, অর্থাৎ যখন ট্রেনিং সহ পুনর্গঠিত মুক্তিবাহিনী যখন গেরিলা কায়দায় আক্রমণ শুরু করল তখন পাকবাহিনীও বাংলাদেশে তার সামরিক পরিকল্পনা পাল্টালো। এই পর্যায়ে তারা শুধু সেনাবাহিনীর উপর নির্ভর করল না। গড়ে তুলল দুটি স্থানীয় বাহিনীও। এর একটা হল রাজাকার বাহিনী- সামান্য ট্রেনিং প্রাপ্ত অত্যাচারীর দল। আর একটা আলবদর বাহিনী- প্রধানত ধর্মান্ধ এবং গুণ্ডা শ্রেণীর লোকদের নিয়ে গঠিত সামরিক বাহিনী। গেরিলা এবং পাক বিরোধীদের খতম করার জন্য পাক সামরিক বাহিনী এই দুই দালাল বাহিনীর সাহায্য নিল। রাজাকার বাহিনীর হাতেও অস্ত্র দেওয়া হল-প্রধানত রাইফেল। নানা রকমের দায়িত্ব পেল তারা। যেমন, গেরিলাদের খুঁজে বের করা, গেরিলাদের সহকারী এবং আশ্রয়দাতাদের উপর অত্যাচার চালানো ও তাদের নামধাম সেনাবাহিনীকে সরবরাহ করা, ব্রিজ রেললাইন ইত্যাদি পাহারা দেওয়া। আলবদর বাহিনীকেও মোটামুটি একই রকমের দায়িত্ব দেওয়া হল- এক পাহারা দেওয়া ছাড়া। তাদের সক্রিয় করে তোলা হল প্রধানত শহর অঞ্চলে। শহরে এবং শহরের আশেপাশে যারা যারা পাকিস্তান বিরোধী এবং মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক তাদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব পেল আলবদর। সেনাবাহিনী এই বাহিনীর কাজকর্ম নিয়মিত তদারক করত। এই দুই বাহিনীকেই সেনাবাহিনী ঢালাও সাহায্য দেওয়ারও ব্যবস্থা করেছিল।

মুক্তিবাহিনীকে গেলিরা আক্রমণ যতই বাড়াতে থাকল পাক কর্তৃপক্ষ ততই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। সাধারণ বাঙ্গালীর উপর সেনাবাহিনীও তার দুই দালাল গোষ্ঠীর অত্যাচারও বেড়ে চলল। একদিকে যখন সাধারণ মানুষের উপর, বিশেষ করে সাধারণ গ্রামবাসীর উপর অত্যাচার বাড়তে থাকল অন্যদিকে তখনই পাক সেনাবাহিনী সীমান্তেই মুক্তিবাহিনীর অনুপ্রবেশ বন্ধ করার জন্য ভারত- বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি চলে আসার চেষ্টা করল। বর্ষাকালে এই কাজে তাদের অসুবিধা হল। কিন্ত বর্ষা একটু কমতেই তারা রাজাকারদের নিয়ে সীমান্তের জত সম্ভব কাছাকাছি চলে আসার চেষ্টা করল। সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ এই ব্যাপারটা চূড়ান্ত পর্যায়ে উঠল। ২৭৪ টা সীমান্ত চৌকির মধ্যে ওরা প্রায় ২১০ টায় পৌঁছে গেল। ২৫ মার্চের পর পাক ফৌজও সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে ছেড়ে দিতে হয়েছিল। এই রকম সময়ে পাক রাষ্ট্রনায়করা তাদের ঢাকা কর্তৃপক্ষের জন্য আবার তাদের নতুন নির্দেশনাবলী প্রথম ভাগটা ছিল পরিস্থিতি বিশ্লেষণ। সমগ্র আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে পাক কর্তৃপক্ষ বললঃ আমরা মনে করি ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পূর্ব পাকিস্তানের কতগুলি সীমান্ত অঞ্চল দখল করার চেষ্টা করবে এবং ভারত সরকার সেই দখল করা এলাকায় স্বাধীন বাংলা সরকার বস্তুটিকে প্রতিষ্ঠিত করবে। তারপর সেই তথাকথিত স্বাধীন বাংলা সরকার দেখিয়ে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চাপ বাড়াবার চেষ্টা করবে। আমাদের মনে হয় না ভারত সরকার গোটা পূর্ব পাকিস্তান দখল করার পরিকল্পনা নিয়ে নামবে। সে সাহস তারা পাবে না। তারা চাইবে সীমান্তের কাছাকাছি কয়েকটা বড় শহর নিয়ে তথাকথিত একটা মুক্ত এলাকা গঠন করতে।

এই বিশ্লেষণের উপর ভিত্তি করে ইসলামাবাদ ঢাকাকে নির্দেশ দিলঃ সুতরাং, এমনভাবে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সাজাতে হবে যাতে ওরা পূর্ব পাকিস্তানের কোনও বড় এলাকা না দখল করতে পারে। সীমান্ত অঞ্চলে এক আধ মাইল ওরা ঢুকে পড়লে ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই।কিন্ত বেশী দূর কিছুতেই দেওয়া হবে না।

এই নির্দেশ পেয়েই বাংলাদেশে দখলদার পাকবাহিনীর প্রধান লেঃ জেঃ এ, এ, কে নিয়াজী বোঝার চেষ্টা করল ভারতীয় সেনাবাহিনী কোন দিকটায় ঢোকার চেষ্টা করতে পারে। নানাভাবে খবর নিল। পাত্র মিত্রদের নিয়ে বারবার পরামর্শ করল।কিন্ত কিছুতেই বুঝতে পারল না ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনী কোন দিক থেকে এগিয়ে কোন এলাকা মুক্ত করতে চাইতে পারে। ততদিনে সীমান্তে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রস্তুতি পুরোদমে শুরু হয়ে গিয়েছে। নিয়াজি সবদিকে খবর নিল।এবং দেখল চতুর্দিকের প্রস্তুতি।যে কোনও দিক থেকে আক্রমণ হতে পারে। এই অবস্থায় নিয়াজি একটা ‘’ মাষ্টার প্লান’’ তৈরি করল। তার পরিকল্পনাটা হল এই রকমঃ সীমান্তের সবগুলি রাস্তার উপর প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করা হবে। ভারতীয় বাহিনী যেখানে যেখানে জড় হয়েছে তার উল্টো দিকে সুদৃঢ় বাঙ্কার তৈরি করে তাতে ভারতীয় কামান সহ পাকসেনাদের বসিয়ে দেওয়া হবে। যে রাস্তা দিয়েই ভারতীয় বাহিনী অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করুক সেই রাস্তায়ই তাকে বাধা দেওয়া হবে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করবে পাক সেনাবাহিনী। আর অন্যান্য আধা সৈনিকরা লড়বে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে।

পরিকল্পনা পাকা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নিয়াজি তার গোটা সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশের চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিল।সীমান্ত থেকে দেশের ভেতরে দশ-পনেরো মাইল, কোথাও ত্রিশ- চল্লিশ মাইল পর্যন্ত বড় বড় সড়কের উপর অসংখ্য বাঙ্কার তৈরি করল এবং প্রধান প্রধান ভারতীয় ঘাঁটির মুখোমুখি ভারী কামান ও ট্যাঙ্ক সহ পাকবাহিনীকে দাঁড় করিয়ে দিল।

ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তারা তা দেখে ভীষণ খুশি হলেন। তারা বুঝলেন পাখি ফাঁদে পা দিয়েছে। নিয়াজি তার সেনাবাহিনীকে দেশের চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিয়েছে, গোটা সীমান্তটা রক্ষা করতে চাইছে এবং বুঝতেই পারছে না যে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে যোগ দিলে ভারতীয় সেনাবাহিনী কোন দিক দিয়ে এগুবে। বাংলাদেশে নিয়াজির হাতে তখন পাক সেনাবাহিনীর প্রায় ৪২টা নিয়মিত ব্যাটালিয়ন।৩৫ ব্যাটালিয়ন পাকসেনা এবং ৭ ব্যাটালিয়ন রেনজার। আর আধা সামরিকদের মধ্যে ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আরমড ফোর্সেস ১৭ টা উইং এবং ৫ উইং মোজাহেদ। অর্থাৎ মোট নিয়মিত বাহিনীর সৈন্য প্রায় ৪০০০০। এবং আধা সামরিক বাহিনীতে প্রায় ২৪২০০ লোক। এছাড়াও পাক কর্তৃপক্ষের হাতে বাংলাদেশের আরও ২৪০০০ ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিকিউরিটি ফোর্স ছিল। মোট সৈন্য ছিল মাত্র ৪২ ব্যাটালিয়ন। কিন্ত নামে ডিভিশন ছিল চারটা। ১৪, ৩৯, ৯ এবং ১৬। এছাড়াও ৩৬ নং ডিভিশন নামে আর একটা ডিভিশন ছিল মেজর জামসেদের অধীনে। প্রধানত আধা সৈনিকেরা এই ডিভিশনের আওতায় ছিল।

সীমান্তের চতুর্দিকে এই বাহিনীকে সাজিয়ে দিয়ে নিয়াজি বেশ পরিতৃপ্ত হলেন। তার হাতে তখন গুলিগোলা প্রচুর। নিয়াজি যত সৈন্য চেয়েছিল পাক কর্তৃপক্ষ তা কখনও তাকে দেয় নি, চাহিদামত ট্যাঙ্ক,বিমান ও কামানও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসেনি। কিন্ত পাকিস্তানের কর্তারা নিয়াজিকে গোলাবারুদ দিতে কার্পণ্য করেনি। যা চেয়েছিল তার চেয়েও বেশি দিয়েছিল।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন থেকে পাঠান প্রচুর গোলাগুলি তখন পাক কর্তৃপক্ষের হাতে। নিয়াজির নবম ডিভিশন তখন যশোরের ঘাঁটিতে। নবম ডিভিশনের সৈন্যরা সাতক্ষীরা থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে দাঁড়াল। ষোড়শ ডিভিশনের প্রথম হেড কোয়াটার ছিল নাটোরে। সরিয়ে সেটাকে নিয়ে আসা হল বগুড়ায়। গঙ্গা- ব্রহ্মপুত্রের মধ্যবর্তী অঞ্চলের সমগ্র সীমান্তে ষোড়শ পাক ডিভিশনের সৈন্যরা বাঙ্কার করে বসল।১৪ এবং ৩৯ নং ডিভিশনের ভাগে পড়ল পূর্ব সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব। উত্তর সীমান্তের জামালপুর থেকে দক্ষিণে কক্সবাজার পর্যন্ত ১৪ এবং ৩৯ ডিভিশনের সৈন্যরা ছড়িয়ে।

বাংলাদেশে পাকবাহিনীর হাতে ছিল ৮৪টি মার্কিন স্যাফি ট্যাঙ্ক। আর ছিল শ’ আড়াই মাঝারি বা ভারী কামান। নিয়াজি তাও সব সীমান্তের কাছাকাছি নিয়ে এল। এবং দৃশ্যমান প্রধান প্রধান ভারতীয় ঘাঁটিগুলির মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য এর প্রায় সব কিছু নিয়ে জড় করল পাঁচটা কেন্দ্রে- চৌগাছা, হিলি, জামালপুর, সিলেট এবং আখাউড়ায়। দু’ পক্ষই বুঝেছিল যা হওয়ার শীতকালেই হবে। তাই দুপক্ষই অক্টোবর- নভেম্বর মধ্যেই সীমান্তে সৈন্য- সামন্ত সাজিয়ে বসল। ওদিকে খোদ পাক সৈন্যবাহিনীও গেরিলাদের আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত। গোটা সীমান্ত বরাবর এলাকায় রাত্রে পাক সৈন্যবাহিনীর পক্ষে চলাচল অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। নিয়াজি বুঝল এবার বড় দরের কিছু একটা না করতে পারলেই নয়। তখন সীমান্তেও তার সৈন্যবাহিনী দাড়িয়ে গেছে। নিয়াজির বুকে তাই বেশ বল। হাজার হাজার লোককে বেগার খাঁটিয়ে গোটা সীমান্ত জুড়ে হাজার হাজার বাঙ্কারও তৈরি হয়ে গিয়েছে।পাক সেনাবাহিনীর লোকজনেরা সেই সব বাঙ্কারে পজিশনও নিয়ে নিয়েছে। নিয়াজি তাই হুকুম দিলঃ প্রয়োজনে সীমান্তের ওপারে গিয়ে মুক্তিবাহিনীকে ঘায়েল করে এস।

নভেম্বরেই শুরু হয়ে গেল পাক সেনাবাহিনীর ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রম। সর্বত্র এই ঘটনা ঘটতে আরম্ভ করল। চব্বিশ পরগণায়, নদীয়ায়, দিনাজপুরে, কোচবিহারে, আসামের বিভিন্ন প্রান্তে এবং ত্রিপুরার বিভিন্ন অঞ্চলে। ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং সীমান্ত রক্ষীবাহিনী অর্থাৎ বি এস এফ ও প্রত্যুত্তর দিতে আরম্ভ করল। শুরু হয়ে গেল সীমান্তের বিভিন্ন অঞ্চলে গোলাগুলি বিনিময়। এবং প্রায় প্রতিদিন এই জিনিস বেড়ে চলল।

নভেম্বরের গোঁড়ায় পাকিস্তানীরা ত্রিপুরায় প্রচণ্ড গোলা বর্ষণ শুরু করল। তারা গোলাগুলি চালাল প্রধানত আখাউড়া অঞ্চল থেকে। এই গোলা বর্ষণে কমলপুর শহর এবং আশেপাশের কতগুলি গ্রাম বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হল। ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং সীমান্ত রক্ষীবাহিনী ও নিয়মিত জবাব দিল।ওদিকে তখন মুক্তিবাহিনীও ঢাকা- চট্টগ্রাম রেললাইন ও সড়কপথ কেটে দেওয়ার চেষ্টা করছে।

আখাউড়ার কাছে পাকিস্তানীরা একটা বড় ঘাঁটি করেছিল। এর কারণও ছিল। বাংলাদেশের ট্রেন- সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় আখাউড়ার স্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রাম- ঢাকা- শ্রীহট্ট- ময়মনসিংহ রেল পথে  আখাউড়া প্রধান জংশন। রেলপথ চট্টগ্রাম থেকে এসে আখাউড়ায় দুভাগ হয়ে গিয়েছে। একটা উত্তর- পূর্বে চলে গিয়েছে শ্রীহট্টের দিকে। আর একটা মেঘনা নদী ডিঙ্গিয়ে উত্তরে গিয়েছে ময়মনসিংহের পথে। দক্ষিণে লাইনটা গিয়েছে ঢাকায়। আখাউড়া তাই বেশ গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি। ভারতের একেবারে লাগোয়া। পাক সমর নায়করা জানত, সুযোগ পেলেই মুক্তিবাহিনী আখাউড়া দখল করে চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে বাংলাদেশের বাদবাকি অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। তারা আরও জানত, লড়াই হলে ভারতীয় সেনাবাহিনীও সঙ্গে সঙ্গে আখাউড়া দখলের চেষ্টা করবে। তাই তারা আখাউড়ায় বেশ শক্ত একটা ঘাঁটি তৈরি করেছিল। এবং এই শক্ত ঘাঁটি থেকেই ত্রিপুরার নানা এলাকায় অবিরাম গোলাবর্ষণ করছিল। কিছুটা দক্ষিণে ফেনীর কাছাকাছি তারা আর একটা বড় ঘাঁটি তৈরি করেছিল। একই উদ্দেশ্য ঢাকা- চট্টগ্রাম- শ্রীহট্ট যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন চেষ্টায় বাধাদান।

এই ফেনীর ঘাঁটি থেকেও পাকিস্তানীরা ভারতীয় এলাকার উপর প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু করল। পাঁচ- ছয়দিন এইভাবে চলার পর ভারতীয় প্রতিরক্ষাবাহিনী দেখল এগিয়ে গিয়ে পাক ঘাঁটিগুলি ধ্বংস করে দিয়ে না এলে এই গোলা বর্ষণ বন্ধ করা যাবে না। কারণ পাকিস্তানীরা কংক্রিটের বাঙ্কার তৈরি করে তার ভেতরে বসে গোলা চালাচ্ছে। দূর থেকে গোলা ছুঁড়ে কংক্রিটের ঘায়েল করা যাচ্ছে না। তাই পূর্ব সীমান্তের সৈন্যবাহিনী তখন এগিয়ে গিয়ে পাক ঘাঁটি ধ্বংস করার অনুমতি চাইল দিল্লীতে। সমগ্র পরিস্থিতি বিবেচনা করে দিল্লীও সেই অনুমতি দিয়ে দিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হল অ্যাকশন। ৮নভেম্বর জাতীয় ভারত বাহিনী এগিয়ে গিয়ে ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী পাক ঘাঁটিগুলিতে জোর আঘাত হানল। পাকিস্তানীরা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্ত পারল না।সীমান্তবর্তী ঘাঁটিগুলো ছেড়ে তাদের পালাতে হল।

এক অ্যাকশনের দুটো প্রত্যক্ষ ফল হল। প্রথমত, ত্রিপুরার বিভিন্ন এলাকার উপর কামানের গোলা বর্ষণ ততটা ক্ষমতা আর পাকিস্তানীদের থাকল না।দ্বিতীয়ত, মুক্তিবাহিনীও আরও জোরে পাকবাহিনীর উপর আক্রমণ করার সুযোগ পেল। কারণ, পাকবাহিনী তখন শক্ত ঘাঁটি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে।

গোলাগুলি যেমন বাংলাদেশের পূর্ব প্রান্তে চলছিল তেমনি চলছিল পশ্চিম প্রান্তেও। পশ্চিম প্রান্তে সবচেয়ে বেশী চলছিল তিনটি এলাকা- বালুরঘাটে, গেদেতে এবং বয়রায়। অক্টোবরের শেষ থেকেই প্রায় প্রতিদিনই পাকবাহিনী এই অঞ্চলে হানা দিচ্ছিল। বিভিন্ন ভারতীয় গ্রামের লোক পাক গোলা বর্ষণের ফলে মারাও যাচ্ছিলেন। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে পাকিস্তানীরা এই তিনটি ঘাঁটির উপর বড় বড় কামানের গোলা বর্ষণ শুরু করল। ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী এবং সীমান্ত রক্ষীরা তার জবাবও দিচ্ছিল। কিন্ত এখানেও সেই একই সমস্যা দেখা দিল। পাকিস্তানীরা বাঙ্কারের মধ্যে বসে বসে দুরপাল্লার কামান চালাচ্ছে। কখনও কখনও সেই কামানের গোলাবর্ষণের আড়ালে এসে ভারতীয় গ্রামগুলির উপরও আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে বাধ্য হয়ে এখানেও ভারতীয় সেনাবাহিনীকে এগিয়ে যেতে হল।

বয়রা অঞ্চলে সীমান্ত হল কপোতাক্ষ নদ। বয়রা থেকে একেবারে সোজা মাইল বারো- তেরোর মধ্যেই যশোর ক্যান্টমেন্ট। ভারতীয় সেনাবাহিনী কপোতাক্ষের পশ্চিম পাড়ে জড় হতেই যশোর ক্যান্টমেন্ট থেকে পাক সেনাবাহিনীও এগিয়ে এসেছিল। কংক্রিটের প্রতিরক্ষাবাহিনী তখন দিল্লীর নতুন নির্দেশ পেয়ে গিয়েছে। সেই নির্দেশের মর্ম কথা, প্রয়োজন হলে সর্বত্র এগিয়ে গিয়ে এদের ওদের ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করে দিয়ে আসবে। যেন ওই সব ঘাঁটি থেকে আক্রমণ চালিয়ে ওরা না এপারের মানুষ মারতে পারে। ভারতীয় বাহিনী তাই কপোতাক্ষ অতিক্রম করে এগিয়ে গেল।

সেদিন ২১ নভেম্বর। ওদিক থেকে এগিয়ে এল পাকবাহিনীও।সঙ্গে নিয়ে এল ১৪টা চীনা সাফি ট্যাঙ্ক। ভারী ভারী কামান। এবং পাঁচ হাজার সৈন্য।

শুরু হল তুমুল লড়াই। ভারতীয় বাহিনীও বাধ্য হয়ে ট্যাঙ্ক নিয়ে আসছিল। ট্যাঙ্কে, কামানে, মেশিনগানে প্রচণ্ড যুদ্ধ হওয়ার পর দেখা গেল প্রথম রাত্রি লড়াই শেষে পাকিস্তানের ছয় ঘণ্টা স্যাফি ট্যাঙ্কই ঘায়েল। গোটা আটেক পিছু হটে পালিয়েছে।ভারতীয় বাহিনী কিন্ত সেখানেই পাকবাহিনীকে ছাড়ল না। আরও এগিয়ে এল। জগন্নাথপুর এবং গরীবপুর ছাড়িয়ে।পাক সেনাবাহিনী ওখানেও বেশ শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করেছিল।দ্বিতীয় দিন আরও বড় লড়াই হল।এবং সেখানে আরও সাতটা পাকিস্তানী স্যাফি ট্যাঙ্ক ঘায়েল হল। দ্বিতীয় দিনের লড়াইয়ে পাকিস্তান তার বিমানবাহিনীকে পুরোপুরিভাবে আসরে নামাল। প্রথম দিনের লড়াইয়েই পাক বিমানবাহিনী যোগ দিয়েছিল। কিন্ত বেশীক্ষণের জন্য নয়। ভারতীয় বিমানবাহিনী আসার আগেই তারা পালিয়ে যায়। দ্বিতীয় দিন পাক বিমানবাহিনীর বিমান আকাশে ওড়া মাত্র ভারতীয় বিমানও আকাশে উড়ল।শুরু হল বিমান যুদ্ধ। দুপুরবেলা। তিনখানা পাক স্যাবর জেট ধ্বংস হল সেই লড়াইয়ে।

তেরখানা ট্যাঙ্ক, তিনখানা বিমান এবং বেশকিছু সৈন্যসামন্ত হারিয়ে পাক সেনাবাহিনী রণে ভঙ্গ দিল।ভারতীয় সেনাবাহিনী আর এগোলা না। কারণ, তখনও দিল্লী থেকে তেমন নির্দেশ আসেনি। তবে জগন্নাথপুর আর গরীবপুর ছেড়েও চলে এল না।ওইখানেই ঘাঁটি গেঁড়ে বসে রইল। এখানেও একই ফল হল। ভারতীয় গ্রামের উপর গোলা বর্ষণ বন্ধ হল।মুক্তিবাহিনী যশোর ক্যান্টমেন্টের চতুর্দিকে আক্রমণ করার সুযোগ পেল।

এই পর্যায়ে তৃতীয় বড় লড়াই হয় বালুরঘাটে।পূর্বে যেমন আখাউড়া, পশ্চিমে তেমনি হিলি। বালুরঘাট অঞ্চলটা কুজেরই শীর্ষবিন্দু হল হিলি। হিলি শহরটা পশ্চিম বাংলার ভেতরে, কিন্ত হিলি রেলস্টেশন বাংলাদেশের মধ্যে।এই হিলি স্টেশন হয়েই চলে গিয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম রেলপথ। যে রেলপথ বাংলাদেশের উত্তর খণ্ডের সঙ্গে বাদবাকি অঞ্চলের যোগাযোগ রক্ষা করছে।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকবাহিনী বুঝল মুক্তিবাহিনী এই রেলপথটা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করবে। তাই শুরু থেকেই তারা হিলি স্টেশনে একটি শক্ত ঘাঁটি তৈরি করল।কিন্ত তৎসত্ত্বেও শুরু থেকেই হিলির উপর আক্রমণ চালাচ্ছিল। অক্টোবরের শেষাশেষি ভারতীয় প্রতিরক্ষাবাহিনীও বালুরঘাট অঞ্চলে বড় ঘাঁটি তৈরি করল। পাকিস্তানীরা ততদিনে হিলির ঘাঁটি আরও করেছে। খুব বড় বড় বেজায় মজবুত অসংখ্য বাঙ্কার তৈরি করেছিল।

সমগ্র সীমান্তে যখন উত্তেজনা এবং গোলাগুলি চলছে সেই সময় পাকিস্তানী সৈন্যরা ঐ কুজের উত্তর ও দক্ষিণ দিক থেকে বালুরঘাটের উপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু করল। প্রথম প্রথম কয়েকদিন ব্যাপারটা শুধু গোলাবর্ষণে সীমাবদ্ধ রইল। তারপর তারা এগোবার চেষ্টা করল তাদের আসল উদ্দেশ্য নিয়ে। সেই উদ্দেশ্যে দক্ষিণ দিক থেকে প্রচণ্ড আক্রমণ করে ঐ কুজটা কেটে দেওয়া এবং ওইভাবে বালুরঘাটে ভারতীয় সামরিক ঘাঁটিটাকে মূল ভূখণ্ড বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। এজন্য তারা বাংলাদেশের ধামরাহাট এবং সাপাথের মাঝামাঝি অঞ্চল থেকে ট্যাঙ্ক এবং ভারী কামান নিয়ে ভারতীয় এলাকায় ঢুকে পড়ার চেষ্টা করল। ওদিকে ভারতীয় বাহিনীও তখন চুপচাপ বসে নেই। কুজের উত্তরও দক্ষিণ থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি দেখেই তারা শত্রুপক্ষের উদ্দেশ্যটা বুঝে গিয়েছিল এবং সেইমত প্রস্তুত হচ্ছিল।

নভেম্বরের শেষাশেষি এই অঞ্চলে একটা পুরোদমে লড়াই-ই শুরু হয়ে গেল। প্রথম প্রথম ভারতীয় সেনাবাহিনী শুধু ঘাঁটিতে বসেই পাকিস্তানী গোলার জবাব দিচ্ছিল। কিন্ত যে মুহূর্তে ওরা ট্যাঙ্ক নিয়ে আসার চেষ্টা করল ভারতীয় বাহিনীও তাদের ট্যাঙ্ক নিয়ে এগিয়ে গেল।২৫,২৬,২৭ নভেম্বর গোটা অঞ্চল জুড়ে বড় ট্যাঙ্কের লড়াই হয়ে গেল। এবং শেষদিনের লড়াইয়ে পাকসেনারা এত মার খেল ধামরার হাটের দিকে পালাতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে পাকিস্তান মোট পাঁচটা ট্যাঙ্ক হারাল। কিন্ত ট্যাঙ্ক হারিয়ে বা বড় মার খেয়েও পাকবাহিনী হিলি স্টেশন ছাড়তে চাইল না। ভারতীয় সেনাবাহিনী অবশ্য হিলি স্টেশন দখল করার জন্য তেমনভাবে অগ্রসর হল না।

এইভাবে গোটা সীমান্তে অঘোষিত লড়াই চলতে চলতে শুরু হয়ে গেল পুরোপুরি যুদ্ধ- ঘোষিত হল পাক-ভারত লড়াই। এবং লড়াই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশের চতুর্দিক থেকে এগিয়ে গেল ভারতীয় সেনাবাহিনী আর বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা। নিয়াজি তখন চোখে সর্ষে ফুল দেখল। এবং এই সর্ষে ফুলেই বাংলাদেশে পাকসেনা নায়ক ইসলামাবাদ থেকে পূর্ণ যুদ্ধের খবর পেয়েও তারা রণকৌশল পাল্টালো না। তখনও তার সেনাবাহিনী এবং কামান-বন্দুক গোটা দেশের সীমান্তেই ছড়ানো রইল। এবং নিয়াজি তখনও সীমান্তে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য ব্যগ্র। এর মধ্যেও কিছুটা বাস্তব বুদ্ধির পরিচয় দিল পাক নবম ডিভিশনের প্রধান জেনারেল আনসারি। তার সদর ঘাঁটি সরিয়ে নেওয়া হল আরও বেশকিছু ভেতরে- মাগুরায়। শোনা যায় সেটা প্রধানত কামানের গোলা খাওয়ার ভয়ে। গরীবপুরের লড়াইয়ের পর খোদ যশোর ক্যান্টমেন্ট ভারতীয় কামানের রেঞ্জের মধ্যে এসে গিয়েছিল। নবম পাক ডিভিশনের প্রধান হেড কোয়াটার যশোর থেকে সরালো; কিন্ত সৈন্যসামন্ত যেমন সীমান্তে ছিল  তেমনি রইল।তখনও পাকসেনা নায়কদের সংকল্প বাঙ্কারে বসে গোলা চালিয়েই ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর অগ্রগতি রোধ করবে।

যে কোনও মুহূর্তে পাকিস্তান সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে এ খবর নভেম্বরের শেষদিকেই ভারতীয় প্রতিরক্ষাবাহিনী পেয়েছিল। তাই যে কোন মুহূর্তে লড়াইয়ে নামার জন্য ভারতীয় সেনা, বিমান এবং নৌবাহিনীও প্রস্তুত ছিল।৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বিমান যখন অতর্কিত ভারতের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উত্তর পেতে মোটেই দেরি হল না। দুই সীমান্তেই জবাব পেল সাথে সাথেই। পূর্বেও । পশ্চিমেও।

৩ ডিসেম্বরঃ ফোর্ট উইলিয়াম থেকে সংকেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ৩ তারিখ রাত্রেই ভারতীয় সেনাবাহিনী চতুর্দিক থেকে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ল। নবম ডিভিশন এগোলো গরীবপুর, জগন্নাথপুর দিয়ে ঢাকা- যশোর হাইওয়ের দিকে। চতুর্থ ডিভিশন মেহেরপুরকে পাশ কাটিয়ে কালিগঞ্জ-ঝিনাইদহের দিকে। বিংশতিতম ডিভিশন তার দায়িত্ব দুভাগে বিভক্ত করে নিল- একটা অংশ রইল হিলির পাক ঘাঁটি মোকাবিলা করার জন্য। আর একটা অংশ হিলিকে উত্তরে রেখে এগিয়ে চলল পুবে। ষষ্ঠ ডিভিশনও তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে অগ্রসর হল- একটা তেতুলিয়া থেকে ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে, আর একটা পাটগ্রাম থেকে কালিগঞ্জের মুখে এবং তৃতীয়টা কোচবিহার থেকে নাগেশ্বরী- কুড়িগ্রামের দিকে। উত্তর মেঘালয়ের দিকে যে দুটো বিগ্রেড তৈরি হয়েছিল তারাও ঐ রাত্রিতেই এগিয়ে গেল। একটা ঢালু থেকে নেমে এগিয়ে গেল জামালপুরের দিকে। আর একটা, এক বিশেষ উদ্দেশ্য, একটু এগিয়ে দাঁড়িয়ে রইল হালুয়াঘাটের মুখোমুখি।

 পূর্ব দিক থেকেও একই সঙ্গে ৮,৫৭ এবং ২৩ নং ডিভিশন নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশে ঢুকল। একটা বাহিনী এল সুনামগঞ্জ থেকে সিলেটের দিকে। ছোট ছোট তিনটা বাহিনী এগিয়ে চলল হবিগঞ্জ এবং মৌলভীবাজারের পথে। আখাউড়াকে সোজাসুজি  আঘাত করে গোটা একটা বিগ্রেডই এগিয়ে চলল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে।

ওদিকে কুমিল্লা ময়নামতি ক্যান্টমেন্টে পাকিস্তানীদের বেশ একটা শক্ত ঘাঁটি ছিল। কুমিল্লা সেক্টরের দায়িত্ব ছিল আমাদের ২৩নং ডিভিশনের উপর। যুদ্ধ শুরু হতেই ডিভিশন কুমিল্লা শহরকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলল দাউদকান্দির পথে।ময়নামতি ক্যান্টমেন্টের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য রেখে গেল মাত্র কয়েক কোম্পানী সৈন্যকে। এই ২৩ নং ডিভিশনেরই আর একটা বিগ্রেড চৌদ্দগ্রাম থেকে অগ্রসর হল লাকসামের দিকে। লক্ষ্য চাঁদপুর। পাকবাহিনীও এই আক্রমণ আঁচ করে লাকসাম একটা শক্ত ঘাঁটি তৈরি করে রেখেছিল। এখানেও ভারতীয় বাহিনী সেই একই কৌশল নিল। লাকসামের পাক ঘাঁটিকে ব্যস্ত রাখার জন্য একটা ছোট্ট বাহিনীকে রেখে কলামটা এগিয়ে চলল চাঁদপুরের দিকে। পুরে এর একটা বড় বাহিনী এগোলো বিলোনিয়া দিয়ে ফেনীর দিকে। লক্ষ্য চট্টগ্রাম যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেওয়া। এই বাহিনীরও সেই একই কৌশল। ফেনীতে পাকিস্তানীরা বেশ শক্ত ঘাঁটি তৈরি করেছিল। শুরুতেই সেই দখল করার জন্য ভারতীয় বাহিনী কোনও চেষ্টা করল না। একটা ছোট্ট বাহিনী রেখে যাওয়া হল ফেনীর পাক সৈন্যদের ব্যস্ত রাখার জন্য। আর মূল বাহিনীর পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলল দক্ষিণ-পশ্চিম।পশ্চিম প্রান্তে বিমান হামলার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বিমানও নৌবাহিনী আসরে নেমে পড়ল। বাংলাদেশে ভারতীয় বিমানবাহিনী এবং নৌবাহিনীর অ্যাকশন শুরু হল ৩রা মধ্যরাত্রি থেকে। বিমানও নৌবাহিনীর জঙ্গী বিমানগুলি ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে গিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন পাক ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালাল। প্রধান লক্ষ্য ছিল অবশ্য ঢাকা ছিল পাক বাহিনীর প্রধান ঘাঁটি। এই ঘাঁটিতে ছিল তাদের জঙ্গী বিমানগুলি। প্রথমে বাংলাদেশে পাক বিমানবাহিনীতে ছিল দুই স্কোয়াড্রন মার্কিনী সাবর জেট। যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন ইয়াহিয়া খাঁর নির্দেশে মিগ-১৯ বিমানগুলি পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হল। বাংলাদেশে থাকল শুধু সাবর গুলি। তারও কয়েকটা ঘায়েল হয়ে গিয়েছিল বয়রার লড়াইয়ে।

বাংলাদেশের কাজে নেমেই ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রধান লক্ষ্য হল পাকিস্তানী জঙ্গী বিমানগুলিকে শেষ করে দেওয়া যাতে অন্তরীক্ষে শত্রুপক্ষ  কিছুই না করতেপারে। যাতে লড়াইয়ের শুরুতেই আকাশটা মিত্রপক্ষের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

সেই উদ্দেশ্য নিয়েই ৩ তারিখ মধ্যরাত্রে ভারতীয় বিমানবাহিনী একেবারে তেজগাঁও আক্রমণ করল। ঐ বিমানবন্দরেই পাকিস্তানের সব জেট মজুত ছিল। কারণ গোটা বাংলাদেশের ওই একটি মাত্র বিমানবন্দর যেখান থেকে সব বিমান উড়তে পারে। ভারতীয় মিগ সেই ঘাঁটিতে হানা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানী সাবর জেটগুলিও বাধা দিতে এগিয়ে এল। প্রায় সারারাত ধরে চলল ঢাকার বিমান যুদ্ধ। প্রথম রাত্রি আক্রমণেই পাকবাহিনীর অর্ধেক বিমান ধ্বংস হয়ে গেল। বিমানবন্দর এবং কুর্মিটোলা ক্যান্টমেন্টও নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল।

ভারতীয় বিমান এবং নৌবাহিনীর বিমানগুলি সেদিন যে শুধু ঢাকা আক্রমণ করেছিল তাই নয়। আক্রমণ করেছিল কুমিল্লা, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং চাঁদপুরেড় অভিযান চালিয়েছিল প্রধানত বিমানবাহিনীর বিমানগুলি। চট্টগ্রাম নৌ বন্দরের প্রায় অর্ধেকটাই ধ্বংস হয়ে গেল। বন্দরের তেলের ডিপোগুলোও জ্বলে উঠল দাউ দাউ করে।

এর মধ্যে পাক বিমানবাহিনীর জঙ্গী বিমানগুলি একবার কলকাতা শহরেও হানা দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্ত প্রতিবারই তাদের ফিরে যেতে হল। আমাদের বিমানবাহিনীর বিমানগুলি সেদিন প্রায় সারারাত ধরে কলকাতা শহরকে পাহারা দিয়েছিল।

৪ ডিসেম্বর সকালে প্রতিরক্ষা দফতরে প্রধানরা আলোচনায় বসে দেখলেন ভারতীয় বাহিনী পূর্ব খণ্ডে ঠিকই এগিয়েছে। প্রথমত, তারা কোথাও শহর দখলের জন্য অগ্রসর হয় নি।

দ্বিতীয়ত, কোথাও শক্ত পাক ঘাঁটির সঙ্গে বড় লড়াইয়ে আটকে পড়েনি।

তৃতীয়ত, পাকিস্তানী সমরনায়করা তখনও বুঝতে পারে নি ভারতীয় বাহিনী কোন দিক থেকে ঢাকা পৌঁছতে চাইছে।বরং তারা মনে করছে ভারতীয় বাহিনী সবদিক দিয়েই রাজধানী দিকে অগ্রসর হচ্ছে, এবং তখনও ভাবছে ভারতীয় বাহিনী সীমান্তের মূল পাক ঘাঁটিগুলিরই আক্রমণ চালাবে।

চতুর্থত, ব্যাপক বিমান এবং স্থল আক্রমণে শত্রুপক্ষকে একেবারে বিহবল করে দেওয়া হয়েছে।

পঞ্চমত, পাক বিমানবাহিনীকে অনেকটা ঘায়েল করে ফেলা হয়েছে। তাদের বিমান ঘাঁটিগুলিও বিধ্বস্ত।

ষষ্ঠত, পাকিস্তানের প্রধান নৌ বন্দরগুলি অর্থাৎ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার,চালনা, চাঁদপুর এবং নারায়ণগঞ্জে জাহাজ বা স্টীমার বেড়াবার ব্যবস্থা অনেকটা বিপর্যস্ত। এবং

সপ্তমত, বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিক ও বাড়িঘর মোটেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। সেনা, বিমান এবং নৌবাহিনী তাই যুদ্ধের দ্বিতীয় দিনেও পূর্ব লক্ষ্য মতই এগিয়ে চলল।

পশ্চিম দিকে থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং মুক্তিফৌজের সবকটা কলামপুরে এগিয়ে চলল। কিন্ত কোথাও তারা সোজাসুজি পাক ঘাঁটিগুলির দিকে এগালো না। মূল বাহিনী সর্বদাই ঘাঁটিগুলোকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলল। এবং ঘাঁটিতে অপেক্ষমাণ পাকবাহিনী যাতে মনে করে যে ভারতীয় বাহিনী তাদের দিকেই এগিয়ে আসার চেষ্টা করছে সেই জন্য প্রত্যেক পাক ঘাঁটির সামনে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর কিছু কিছু লোক রেখে যাওয়া হল।

ওদিকে মূল ভারতীয় বাহিনী যে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানীরা সেই খবরও পেল না। কারণ প্রথমত, তাদের সমর্থনে দেশের লোক ছিল না, যারা খবরাখবর দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, তাদের বিমানবাহিনীও তখন বিধ্বস্ত। সর্বত্র উড়ে পাক বিমান ভারতীয় বাহিনীর অগ্রগতির খবরাখবর পাক সেনাবাহিনীকে জানাতে পারল না। তৃতীয়ত, বাংলাদেশে পাকবাহিনীর বেতার খবরাখবর পাঠাবার তেমন ভাল ব্যবস্থা ছিল না। সুতরাং নিজস্ব ব্যবস্থায়ও তারা খবরাখবর পেল না।

তাই ভারতীয় বাহিনী যখন সোজাসুজি যশোর, হিলি, শ্রীহট্ট, কুমিল্লা, ফেনী প্রভৃতি শক্ত ঘাঁটির দিকে না গিয়ে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল তখন পাকবাহিনীর অধিনায়করা তা মোটেই বুঝতে পারল না। বরং ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর গোলাবর্ষণের বহর দেখে তখনও তারা মনে করছে ভারতীয় বাহিনী সোজাসুজিই এগোবার চেষ্টা করছে। সেই জন্য তখনও তারা মূল সড়কগুলি আগলে বসে রইল। সীমান্তের কাছাকাছি শহরগুলিতে তখনও পাকবাহিনীতে অধিষ্ঠিত একমাত্র কুষ্টিয়া জেলার দর্শনা ছাড়া। দর্শনা যে মুহূর্তে আমাদের ৪নং পার্বত্য ডিভিশনের কামানের পাল্লার মধ্যে এসে গেল পাকিস্তানীরা অমনি শহর ছেড়ে আরও পশ্চিমে পালাল।

এদিকে তখন ভারতীয় বিমান এবং নৌবাহিনীও প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। লড়াইয়ের দ্বিতীয় দিনেও ভারতীয় বিমান এবং নৌবাহিনীর জঙ্গী বিমানগুলি বারবার ঢাকা, চট্টগ্রাম, চালনা প্রভৃতি এলাকায় সামরিক ঘাঁটিগুলির ওপর আক্রমণ চালাল। ঢাকায় সেদিনও জোর বিমান যুদ্ধ হল। কিন্ত সেদিনই প্রায় শেষ বিমান যুদ্ধ। অধিকাংশ পাক বিমানই ঘায়েল হল। বিমানবন্দরগুলিও প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হল।

ওদিকে তখন মিত্রবাহিনীও প্রচণ্ড গতিতে এগিয়ে চলেছে- প্রধান সড়ক এবং পাক ঘাঁটিগুলি এড়িয়ে। তখনও পর্যন্ত প্রধান লক্ষ্য বাংলাদেশের চতুর্দিকে  ছড়ানো পাকবাহিনীকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া এবংআবার যাতে একত্র হয়ে ঢাকা রক্ষার জন্য কোনও বড় লড়াইয়ে নামতে না পারে তার ব্যবস্থা করা।

৫ডিসেম্বরঃ লড়াইয়ের তৃতীয় দিনেই স্বাধীন বাংলার আকাশ স্বাধীন হয়ে গেল। বাংলাদেশে পাকবাহিনীর প্রায় সব বিমান এবং বিমানবন্দরই বিধ্বস্ত।গোটা দিন ভারতীয় জঙ্গী বিমানগুলি অবাধে আকাশে উড়ে পাক সামরিক ঘাঁটিগুলিতে প্রচণ্ড আক্রমণ চালাল। ভারতীয় বিমানবাহিনীর হিসাব মত বারো ঘণ্টায় দু’শ ত্রিশ বার। তেজগাঁও এবং কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটিতে পঞ্চাশ টনের মত বোমা ফেলল। কুর্মিটোলা রানওয়েতে কয়েক পাউন্ড বোমা ফেলায় ছোটখাটো কয়েকটা পুকুরই সৃষ্টি হয়ে গেল। পাকবাহিনীর শেষ সাবর জেট তিনটা ঐখানে আটকে ছিল। রানওয়ে বিধ্বস্ত হওয়ায় ছাউনিতেই সেগুলিকে আটকে থাকতে হয়। ভারতীয় বিমানের আক্রমণে সেদিন বড় রাস্তা দিয়ে পাক সেনাবাহিনীর যাতায়াতও প্রায় বন্ধ হয়ে গেল।পাকবাহিনীর প্রত্যেকটা কনভয়ের উপর ভারতীয় জঙ্গী বিমানগুলি আক্রমণ চালাল। ওদের নব্বইটা গাড়ি ধ্বংস হল। ধ্বংস হল পাকিস্তানী সৈন্য বোঝাই বেশ কয়েকটা লঞ্চ এবং স্টিমারও।

জামালপুর আর ঝিনাইদহের পাক সামরিক ঘাঁটিও ভারতীয় বিমান আক্রমণে ধ্বংস হল। তেজগাঁও এবং কুর্মিটোলা বিমানবন্দর ধ্বংস ভারতীয় জঙ্গী বিমানগুলি সারাদিন ধরে গোটা বাংলাদেশের সব কটা বিমানবন্দরে হানা দিল। উদ্দেশ্য, আর কোথাও পাক বিমান আছে কিনা খুঁজে দেখা কিন্ত কোথাও আর একটাও পাকবিমান খুঁজে পাওয়া গেল না। পরে নিজেদেরই অর্থাৎ মিত্রপক্ষেরই কাজে লাগবে এই ভেবে ভারতীয় বিমানবাহিনী অধিকাংশ বিমানবন্দকেই অক্ষত অবস্থায় ছেড়ে দিল।

পূর্বে খণ্ডে ভারতীয় নৌবাহিনীও সেদিন বিরাট সাফল্য অর্জন করেছে। বঙ্গোপসাগরে পাক সাবমেরিন’গাজী’ সেদিন ভারতীয় নৌবাহিনীর উপর আক্রমণ শেষ হল। সাবমেরিন ‘ গাজী’ ছিল পাক নৌবহরের গর্বের বস্ত।

ওইদিন ভারতীয় নৌবাহিনী প্রত্যেকটা নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের জাহাজকে হুঁশিয়ার করে দিল। প্রধান হুঁশিয়ারিটা চট্টগ্রাম বন্দর সম্পর্কে বলা হলঃ আপনারা সবাই চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে চলে আসুন। আপনাদের স্বার্থ এবং নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আমরা চট্টগ্রাম এর উপর তেমন প্রচণ্ডভাবে গোলাবর্ষণ করিনি।আজ রবিবার আপনাদের বন্দর থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। কাল সোমবার আমরা প্রচণ্ডভাবে আক্রমণ চালাব। সুতরাং কাল থেকে আপনাদের নিরাপত্তা সম্পর্কে আমরা কোনও নিশ্চয়তা দিতে পারব না।

এই ‘ওয়ার্নিং’ দুটো কাজ হল। (এক) বিশ্বের সব দেশ বুঝল বাংলাদেশের বন্দরগুলি রক্ষা কোনও ক্ষমতা আর পাকবাহিনীর নেই। এবং(দুই) ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজও বিমানগুলি বাংলাদেশের সব বন্দরগুলিকে অবাধে ঘায়েল করার সুযোগ পেল।

এদিকে তখন স্থলেও মিত্রবাহিনীও এগিয়ে চলেছে। পাক স্থলবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় বিচ্ছিন্ন। প্রধান সড়কগুলি দিয়ে না এগিয়েও ভারতীয় বাহিনী বিভিন্ন সেক্টরে প্রধান প্রধান সড়কের কতগুলি জায়গায় অবরোধ সৃষ্টি করল। ফলে ঢাকার সঙ্গে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের, নাটোরের সঙ্গে ঢাকা এবং রংপুরের এবং যশোরের সঙ্গে নাটোর ও রাজশাহীর যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। শুধু ঢাকার সঙ্গে যশোর এবং খুলনার যোগাযোগ তখনও অব্যাহত। কতকগুলি ঘাঁটি সেদিন কিছুটা লড়াইও হল। একটা বড় লড়াই হল লাকসামে।আর একটা হল ঝিনাইদহের কাছে কোটচাঁদপুরে। দুটো লড়াইয়েই পাকসেনারা বেজার মার খেল এবং ঘাঁটি দুটি ছেড়ে যেতে বাধ্য হল।

এই দুটো ঘাঁটি দখলের চেয়েও কিন্ত মিত্রবাহিনীর বড় লাভ হল পাকবাহিনীর যোগাযোগ ব্যবস্থাটা বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারায়। এটাই ছিল তাদের প্রথম পর্যায়ে বড় লক্ষ্য যাতে পাকসেনারা পিছু হটে গিয়ে আবার না রিগ্রুপড হতে পারে- ঢাকা রক্ষার লড়াইয়ের জন্য পদ্মাও মেঘনার মাঝখানে কোনও নতুন শক্ত ব্যূহ রচনা না করতে পারে। বিভিন্ন বড় সড়কে অবরোধ সৃষ্টি করে মিত্রবাহিনী সীমান্তের ঘাঁটিগুলি থেকে পাকবাহিনীর ঢাকা ফেরার পথ প্রায় বন্ধ করে দিল। এ ব্যাপারে তাদের আরও বড় সুবিধা হল আকাশে ভারতীয় বিমানবাহিনীর একাদিপত্ত প্রতিষ্ঠা হওয়ায়। গোটা বাংলাদেশের বড় বড় সড়কও নদীর উপর তখন ভারতীয় জঙ্গী বিমান পাহারা দিচ্ছে। এবং পাক সেনাবাহিনীর কনভয় চোখে পড়লেই তাকে আক্রমণ করছে।

এই রকম যখন অবস্থা নিয়াজিও সবটা বুঝতে পারল। চতুর্দিক থেকে মিত্রবাহিনীর অগ্রগতির খবর পৌঁছল ঢাকায়। আর পৌঁছল পাকবাহিনীর বিপর্যের সংবাদ।নিয়াজি আরও জানতে পারল যে মিত্রবাহিনীর সবকটা কলাম মূল পাকঘাঁটি এবং সুরক্ষিত পথ এড়িয়ে এগিয়ে আসছে। পাক সমরনায়কদের তখন বুঝতে অসুবিধা হল না যে মিত্রবাহিনীর মূল উদ্দেশ্য বিভিন্ন পাক ঘাঁটির যোগাযোগ কেটে দেওয়া।এবং পেছন থেকে পাক ঘাঁটিগুলির উপর অতর্কিত আক্রমণ করা। নিয়াজি এবং ঢাকার পাক সমরনায়করা ততক্ষণে বুঝে গিয়েছে মিত্রবাহিনী শুধু বাংলাদেশের অঞ্চল বিশেষ দখল করতে চায় না- তারা চায় গোটা বাংলাদেশের পাকবাহিনীকে পরাজিত করতে। তারা বুঝল মিত্রবাহিনী ঢাকার দিকে এগোবেই। কিন্ত তখনও তারা এটা ঠিক বুঝতে পারেনি যে, মিত্রবাহিনীর কোন কোন ঢাকার দিকে এগিয়ে আসবে। নিয়াজি তাই অন্যান্য পাক সমর নায়কদের পরামর্শ করে সেদিনই সর্বত্র হুকুম পাঠিয়ে দিল- পুলব্যাক। পুলব্যাক করে তাদের ঢাকার কাছাকাছি অর্থাৎ পদ্মা- মেঘনার মাঝামাঝি অঞ্চলে ফিরে আসতে বলা হল।

৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যে বেলায়ই সেই হুকুম সবগুলি পাক সামরিক ঘাঁটিতে চলে গেল।

৬ডিসেম্বরঃ ৬ডিসেম্বর সূর্য ওঠার আগেই কতকগুলি সীমান্ত ঘাটি থেকে পিছু হটা শুরু হল। কোনও কোনও ঘাঁটির আবার এডভান্স পার্টি পাঠিয়ে পেছনের খবর সংগ্রহের চেষ্টা করল। এবং অনেকে দেখল পেছনের অবস্থা ভাল নয়। একে তো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন তার উপর আবার বহু এলাকায় পেছনে গিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী ঘাঁটি করে বসে গিয়েছে। নিয়াজির পুলব্যাক নির্দেশের পর তাই গোটা বাংলাদেশের পাকবাহিনীতে এক অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হল।

অধিকাংশ পাক সীমান্ত ঘাঁটি সামনেই তখন এক সমস্যা- সীমান্তে ঘাঁটিতে বসে থাকার চেষ্টা করলেও মৃত্যু অনিবার্য, আবার পেছাতে গেলেও বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। কয়েকটা সীমান্ত ঘাঁটি থেকে তাই নিয়াজিকে জানানো হল পুলব্যাক করার চেয়ে শক্ত বাঙ্কারে ঘেরা বসে লড়াই চালিয়ে যাওয়াই শ্রেয়।

কুর্মিটোলার নির্দেশ তাই সর্বত্র সমানভাবে পালিত হল না। কোথাও পূর্ণ পুলব্যাক হল। কোথাও হল আধা-পুলব্যাক। কোথাও আবার যেমন ছিল তেমনই রইল। যেসব ঘাঁটিতে ওরা থেকে গেল সেগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ময়নামতি, চট্টগ্রাম, জামালপুর এবং হিলি। যেসব ঘাঁটি থেকে পালাল সেগুলির মধ্যে সবচেয়ে আগে নাম করতে হয় শ্রীহট্ট এবং যশোরের।

শ্রীহট্ট এবং যশোরের চতুর্দিকে পাকবাহিনী যতগুলো ঘাঁটি করেছিল সবগুলি ছেড়ে পালাল। পাক নবম ডিভিশনের উপর পদ্মার দক্ষিণের গোটা অঞ্চলটা রক্ষার দায়িত্ব ছিল। আগেই বলা হয়েছে যে, আনুষ্ঠানিকভাবে লড়াই শুরু করার আগেই পাক নবম ডিভিশনের সদরদফতর যশোর ক্যান্টমেন্ট থেকে সরিয়ে মাগুরা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সদরদফতর সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরও সৈন্যসামন্ত ঠিকই সীমান্তে ছিল। চৌগাছায় পরাজয়ের পর তারা তিন ভাগে ছড়িয়ে ছিল। ঝিনাইদহ- মেহেরপুর অঞ্চলে একটা অংশ, ঝিকরগাছার উত্তর-পশ্চিমে আর একটা অংশ এবং সাতক্ষীরা থেকে খুলনা পর্যন্ত আর একটা অংশ।

৫ ডিসেম্বর মাঝরাতে ভারতীয় চতুর্থ ডিভিশন আঘাত হানল ঝিনাইদহের উত্তর- পশ্চিমের পাকবাহিনীর উপর। প্রায় একসঙ্গে নবম ডিভিশন ঘা দিল ঝিকরগাছা থেকে ঝিনাইদহের পশ্চিমে ছড়ানো অংশটার উপর। এই দুই প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েই পাকবাহিনী একেবারে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল।এবং দুদিক থেকে মিত্রবাহিনীর দুটো কলাম যশোর- ঢাকা হাইওয়ের উপর এসে দাঁড়াল। ততক্ষণে নিয়াজির পুলব্যাক অর্ডারও এসে গিয়েছে।৬ ডিসেম্বর ভোর থেকেই তাই গোটা পাক নবম ডিভিশনের পলায়ন পর্ব শুরু হয়ে গেল। ইচ্ছা ছিল গোটা বাহিনীটাই ঢাকার দিকে পালাবে। কিন্ত পারল না। কারণ ততক্ষণে ভারতীয় চতুর্থ এবং নবম ডিভিশন যশোর- ঢাকা হাইওয়ে ডিভিশনের দুটি অঞ্চলে ঘাঁটি করে বসেছে। বাধ্য হয়ে তাই নবম পাক ডিভিশনের একটি অংশ পালাল মাগুরা হয়ে মধুমতি ডিঙ্গিয়ে ঢাকার পথে। আর একটি অংশ পালাল খুলনার দিকে। কুষ্টিয়ার দিক দিয়েও পালাল একটি ছোট্ট অংশ।সাতক্ষীরা অঞ্চলে যে পাকবাহিনীটা ছিল এতদিন তাদের সঙ্গে লড়াই চালাচ্ছিল প্রধানত মুক্তিবাহিনীর সৈন্যরা এবং বিএসএফের সেপাইরা।পুল ব্যাক অর্ডারের সঙ্গে সঙ্গে তারাও পালাল খুলনার দিকে। পালাবার সঙ্গে সঙ্গে সবকটা বাহিনীই রাস্তায় ওপারের সব ব্রিজ ভেঙ্গে যাওয়ার চেষ্টা করল। শ্রীহট্টের দিকেও তখন প্রায় একই অবস্থা। দু’পাশ দিয়ে এগিয়ে মিত্রবাহিনী শ্রীহট্টের পশ্চিমে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। পূর্বদিক থেকে একটা গোলন্দাজ বাহিনীর উপরও গোলাবর্ষণ করে চলেছে। শ্রীহট্টের পাক সমরনায়ক পুলব্যাক অর্ডার পাওয়া মাত্রই পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। ইচ্ছা ছিল আশুগঞ্জ থেকে মেঘনা অতিক্রম করে ঢাকার দিকে যাবে। কিন্ত পারল না। কিছুটা পিছিয়েই দেখল সম্ভাব নয়- মিত্রবাহিনী তার আগেই পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে। তখন গোটা বাহিনীটাকে দুভাগে বিভক্ত করা হল। একটা থাকল শ্রীহট্টে। আর একটা পেছন দিকে দাঁড়িয়েছে। তখন গোটা বাহিনীটাকে দুভাগে ভাগ করা হল। একটা থাকল শ্রীহট্টে। আর পেছনের দিক দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। দু’ দলই লড়াইয়ে হেরে গেল।শ্রীহট্টের বাহিনীটা বাঙ্কারে বসে ভালই লড়ল। ওই বাহিনীকে ঘায়েল করতে ভারতীয় বিমানবাহিনীকেও বেশ কয়েক টন বোমাবর্ষণ করতে হল। সমগ্র বাংলাদেশেই মিত্রবাহিনী তখন দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। তখনও এই লক্ষ্য যাতে পিছু হটে গিয়ে কোথাও না জড় হতে পারে, যাতে সীমান্তের কোনও পাক সৈন্য না ঢাকায় পৌঁছতে পারে।

৭ডিসেম্বরঃ কার্যত যশোরের পতন হয়েছিল আগের দিনই। ৬তারিখ সন্ধ্যা হতে না হতে পাকবাহিনীর সবাই যশোর ক্যান্টমেন্ট ছেড়ে পালিয়ে যায়। কিন্ত ভারতীয় বাহিনী তখনই সে খবরটা পায়নি। ৭ ডিসেম্বর বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ ভারতীয় নবম ডিভিশনের প্রথম কলামটা উত্তর দিক দিয়ে যশোর ক্যান্টমেন্টে এসে পৌঁছল। তখনও তারা জানে না যশোর ক্যান্টমেন্ট শুন্য। তখনও তাদের কাছে খবর পাকবাহিনী যশোর রক্ষার জন্য বিরাট লড়াই লড়বে। কিন্ত মিত্রবাহিনীর কলামটা যতই এগিয়ে এল ততই আশ্চর্য হল। কোনও প্রতিরোধ নেই! সামনে থেকে একটাও গোলাগুলি আসছে না! প্রায় বিহবল অবস্থায় যখন কলামটা ক্যান্টমেন্টের সামনে এসে দাঁড়াল তখন বুঝতে পারল ব্যাপারটা। দশ-পনেরো জন লোক ‘’ জয় বাংলা’’ ধ্বনি দিয়ে তাঁদের সামনে এসে দাঁড়াল। জড়িয়ে ধরে তাদের সংবর্ধনা জানাল। আর জানাল যে, আগেরদিন সব পাকসেনা যশোর ছেড়ে পালিয়েছে। ভারতীয় বাহিনী তখন গোটা ব্যাপারটা বুঝল। দেখতে দেখতে বেশ লোক এসে সেখানে জড় হল। তারাই ক্যান্টমেন্টের ভেতরটা ছিনিয়ে দিল ভারতীয় বাহিনীকে। পাকসেনারা যে ট্যাঙ্ক, কামান এবং ট্রাক- জিপ নিয়ে খুলনা পালিয়েছে যশোরের নাগরিকরা তাও ভারতীয় বাহিনীকে জানাল। সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় বাহিনী ছুটল খুলনার পথে।

ওদিকে তখন নবম ডিভিশনের সদর ঘাঁটিতেও সব খবর পৌঁছে গিয়েছে। ডিভিশনের প্রধান মেঃ জেনারেল দলবীর সিং বয়রা-ঝিকরগাছার পথ ধরে গোটা নবম ডিভিশন নিয়ে এগিয়ে গেলেন যশোর শহরে। যশোর ক্যান্টমেন্ট পাক নবম ডিভিশনের মত আমাদের নবম ডিভিশনের সদর দফতর হল।

শ্রীহট্টেরও পতন হল ওই দিনই দুপুরে। প্রথমে ভারতীয় ছত্রীসেনারা নামল শ্রীহট্টের নিকটবর্তী বিমানবন্দর শালুটিকরে। খুব ভোরে। তারপর চতুর্দিক থেকে মিত্রবাহিনী শ্রীহট্টের পাক ঘাঁটিগুলোর উপর আক্রমণ চালাল। দুপুর বেলায়ই শ্রীহট্টের পাক সেনানায়ক আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হল।

৮ ডিসেম্বরঃ বৃহস্পতিবার সকালে মিত্রপক্ষের সামরিক নেতার পূর্ব রণাঙ্গনের সমগ্র পরিস্থিতিটা বিশ্লেষণ করে দেখলেন তাঁদের প্রথম লক্ষ্য সফল হয়েছে। বাংলাদেশের নানা খণ্ডে পাক সেনাবাহিনী বিচ্ছিন্ন এবং অবরুদ্ধ। ঢাকার দিকে পালাবার কোন পথ নেই। দক্ষিণে একটা পাকবাহিনী আটকে পড়েছে খুলনার কাছে। ওদের গোটা পাকবাহিনী ব্রহ্মপুত্র ও পদ্মার মধ্যবর্তী তিন-চারটা অঞ্চলে অবরুদ্ধ। একটি বড় বাহিনী, প্রায় একটা বিগ্রেড হিলির কাছে অবরুদ্ধ। আর একটা বিগ্রেড আটকে রয়েছে জামালপুরে। ময়মনসিংহ থেকে যে বাহিনীটা সরিয়ে শ্রীহট্টের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেটা কার্যত ফিনিসড। ময়নামতি ক্যান্টমেন্টে অবরুদ্ধ আর একটা বিগ্রেড। আর একটা বড় পাকবাহিনী অবরুদ্ধ চট্টগ্রামে। একের সঙ্গে আর একের যোগ দেওয়ারও কোন সুযোগ নেই। ঢাকার দিকে পিছু হটা কার পক্ষেই সম্ভব নয়।

মিত্রবাহিনীর কর্তারা তখন তিনটি ব্যবস্থা নিলেন। প্রথম ব্যবস্থায় গোটা পাক সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হল। দ্বিতীয় ব্যবস্থায় জেনারেল সগত সিংকে বলা হল তাঁর অন্তত তিনটা কলাম খুব দ্রুত ঢাকার দিকে এগিয়ে নিতে। তৃতীয় ব্যবস্থায়, একটা বিগ্রেডকে যথা শীঘ্রসম্ভব হালুয়াঘাটের দিকে থেকে ময়মনসিংহের দিকে নিয়ে আসা হল।

যুদ্ধের শুরুতেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান মানেকশ বাংলাদেশের দখলদার পাকবাহিনীর উদ্দেশ্যে আত্মসমর্পণের আহবান জানিয়েছিলেন। ৮ ডিসেম্বর আবার তার সেই আবেদন নানা ভাষায় আকাশবাণী থেকে প্রচার করা হল। তিনি পাকসেনাদের আত্মসমর্পণ করতে বললেন এবং সঙ্গে সঙ্গে এই আশ্বাস দিলেন যে, আত্মসমর্পণ করলে পাক সেনাবাহিনীর প্রতি জেনেভা কনভেনশনের রীতি অনুযায়ী সম্মানজনক ব্যবহার করা হবে। জেনারেল মনেকশ বললেনঃ আমি জানি আপনারা পালাবার জন্য বরিশাল এবং নারায়ণগঞ্জের কয়েক জায়গায় জড় হচ্ছেন। আমি এও জানি, এখান থেকে আপনাদের উদ্ধার করা হবে বা পালাতে পারবেন এই আশাতেই মিলিত হচ্ছেন। কিন্ত আমি সমুদ্রপথে আপনাদের পালাবার সব পথ বন্ধ করে দিয়েছি। এজন্য নৌবাহিনীকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এখনও যদি আপনারা আমার পরামর্শ না শোনেন এবং ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ না করেন তাহলে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে কেউ আপনাদের বাঁচাতে পারবে না।

বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তে থেকে জেনারেল সগৎ সিং এর প্রায় সবকটা ডিভিশনই তখন প্রচণ্ড গতিতে পশ্চিমের দিকে এগোচ্ছিল। একটা এগোচ্ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া দখল করে আশুগঞ্জের দিকে। আশুগঞ্জে মেঘনার একটি বাহিনী। ওদিকে সেদিন কুমিল্লারও পতন ঘটেছে। ওই সেক্টরের সব পাকসৈন্য গিয়ে ময়নামতি ক্যান্টমেন্টে গিয়ে আশ্রয় নিল। মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরা সেদিন হেলিকপ্টারে কুমিল্লা ঘুরে এলেন। ময়নামতিকে পাশ কাটিয়ে আর একটা বাহিনী দ্রুত অগ্রসর হল চাঁদপুরের মুখে। সবকটা বাহিনীরই লক্ষ্য ঢাকা। যদি প্রয়োজন হয় তাহলে যাতে এই বাহিনী নদীপথেই নারায়ণগঞ্জ- ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এই বাহিনীর আর একটা বাহিনীর লক্ষ্য ছিল চাঁদপুর বন্দর থেকে মেঘনাও পদ্মার নদীপথের উপর নজর রাখা।

বাংলাদেশের লড়াইয়ে নামতে হতে পারে এই কথা ভাবার সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় প্রতিরক্ষা দফতরের কর্তারা ঠিক করে রেখেছিলেন ঢাকার উপর প্রধান আক্রমণটা হবে উত্তর দিক দিয়ে। ময়মনসিংহ টাঙ্গালের পথে একটা বড় বাহিনীকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হবে ঢাকায়। ওপথে নদীনালা খুব কম। সেই উদ্দেশ্যে গোড়া থেকেই তাঁরা গারো পাহাড়ে দুই বিগ্রেড সৈন্য মজুদ করে রেখেছিলেন। বেশী সৈন্য ওপথে জড় করেননি। কারণ ভয় ছিল যে, তাহলে পাকিস্তানীরা খবরটা আগাম পেয়ে যাবে এবং আগে থেকেই পথে জড় প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করে রাখবে। সেই জন্য ওপথে কম সৈন্য জড় করে রাখা হল। এবং ঠিক করে রাখা হল যে পদাতিক সৈন্য টাঙ্গালের কাছাকাছি পৌঁছবার পর ওখানে একটি ছত্রীবাহিনীও নামানো হবে।

পাক সমরনায়করাও ধরে রেখেছিল যে ভারত উত্তর দিক দিয়ে একটা বড় সেনাবাহিনী নামাবার চেষ্টা করবেই। সেই জন্য তারা জামালপুরের কাছাকাছি একটা শক্ত ঘাঁটি তৈরি করে রেখেছিল। আর একটা ছোট ঘাঁটি করে রেখেছিল হালুয়াঘাটের কাছে। লড়াই শুরু হতে ১০১ নং কমিউনিকেশন জোনের একটা বিগ্রেড এগোলো জামালপুরের দিকে। আর একটা গেল হালুয়াঘাটের কাছে। হালুয়াঘাটের সীমান্তবর্তী ভারতীয় বাহিনী প্রথমে অগ্রসর হল না। দু’ চারদিন ওখানেই অপেক্ষা করল। জামালপুরে বড় লড়াই শুরু হতে পাক সামরিক নেতারা তাদের হালুয়াঘাটের বাহিনীকে সরিয়ে নিয়ে গেল জামালপুরের দিকে।আর ময়মনসিংহ থেকে একটা বিগ্রেড নিয়ে শ্রীহট্ট- ভৈরববাজার সেক্টরে। তারা তখন ভাবতেও পারেনি যে একটা ভারতীয় বিগ্রেড হালুয়াঘাটের মুখে অপেক্ষা করছে। হালুয়াঘাট থেকে ভারতীয় বাহিনীটা খুব দ্রুত এগিয়ে গেল ময়মনসিংহের পথে।পথে বড় কোন বড় বাধাই পেল না। কারণ একটা পাকবাহিনী লড়াই করছে জামালপুরে আর একটা গিয়েছে সিলেট- ভৈরব বাজার সেক্টরে। একই বিমান আক্রমণও বাড়ানো হল। বিমানও নৌবাহিনীর জঙ্গী বিমানগুলি সারাদিন অসংখ্যবার বিভিন্ন পাক সামরিক ঘাঁটিতে আক্রমণ চালাল। বিমান আক্রমণের ভয়ে দিনের বেলা পাক সামরিক বাহিনীর চলাচলও প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। পরিকল্পনা মতই বিমান আক্রমণ বৃদ্ধি করা হল।লক্ষ্যটা একই।প্রথমত, পাক সেনাবাহিনীকে আবার কোথাও রিগ্রুপড হতে না দেওয়া। এবং দ্বিতীয়ত, ওদের মনোবল ভেঙ্গে দেওয়া এবং আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

৯ডিসেম্বরঃ ৯তারিখ চতুর্দিক মিত্রবাহিনী ঢাকার দিকে অগ্রসর হল। তখন তাদের চোখের সামনে শুধু ঢাকা। এর আগেই তাদের প্রথম লক্ষ্যটা পূরণ হয়ে গিয়েছে।অর্থাৎ মিত্রবাহিনী বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়া পাকবাহিনীকে বেশ ভালোমত বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে, তাদের ঢাকা ফেরার বা পালাবার প্রায় সব পথ বন্ধ। এবার দ্বিতীয় লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে গেল ভারতীয় বাহিনী।

দ্বিতীয় লক্ষ্যটা হল, খুব দ্রুত ঢাকার পাকবাহিনীর মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙ্গে দিয়ে নিয়াজিকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা।

সবদিক দিয়েই মিত্রবাহিনী ঢাকার দিকে অগ্রসর হল। পূর্বে পৌঁছে গেল আশুগঞ্জে, দাউদকান্দিতে এবং চাঁদপুরে। পশ্চিমে বাহিনী পৌঁছল মধুমতি নদীর তীরে। আর একটা বাহিনী কুষ্টিয়া মুক্ত করে চলল গোয়ালন্দ ঘাটের দিকে। হালুয়াঘাট থেকে এগিয়ে আসা বাহিনীও পৌঁছল ময়মনসিংহের কাছাকাছি। নৌবাহিনীর গানবোটগুলিও ততক্ষণে নানাদিক থেকে এগোচ্ছে ঢাকার দিকে।এবং বিমানবাহিনীর আক্রমণও পুরোদমেই চলছে। সেদিন বিকালে মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরা এক সাংবাদিক বৈঠকে বললেনঃ আমরা এখন ঢাকার লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত। সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করলেনঃ পাকিস্তানীরা যদি মাটি কামড়ে লড়াই চালায় তাহলে আপনি কি করবেন? জেনারেল অরোরা জবাব দিলেনঃ ওরা কি করবে জানিনা। তবে আমরা বড় ধরণের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত। জেনারেল অরোরাকে সাংবাদিকরা আবার জিজ্ঞেস করলেনঃ ঢাকাকে মুক্ত করার পথে আপনার সামনে সবচেয়ে বড় বাধা কি? অরোরা বললেনঃ নদী। তারপর আবার বললেনঃ নদী যদিও বড় বাধা সে বাধা  অতিক্রমের ব্যবস্থা আমরা করে ফেলেছি। আমাদের পদাতিক সৈন্য এবং রসদ পারাপারের ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে। আর আমাদের পি, টি৬৭ ট্যাঙ্কগুলি নিজ থেকেই নদী সাঁতরে যেতে পারবে।

১০ ডিসেম্বর পরদিনই ৫৭ নং ডিভিশন গোটা বিশ্বকে দেখিয়ে দিল মিত্রবাহিনী কিভাবে রাজধানী ঢাকার মুক্তিযুদ্ধের পথে বাধা অতিক্রম করবে। ভোররাত্রি থেকেই ভৈরব বাজারের তিন- চার মাইল দক্ষিণে নামানো শুরু হল ৫৭ নং ডিভিশনের সৈন্য। সারাদিন ধরে সেই মেঘনা অতিক্রমের কার্যক্রম চলল। প্রথম বাহিনীটা ওপারে নেমেই ঘাঁটি গেঁড়ে বসল। কিছুটা উত্তরে ভৈরববাজারের কাছেই পাক সৈন্যদের একটা বড় বাহিনী মজুত। ব্রিজটার একটা অংশ ভেঙ্গে দিয়ে নদীর পশ্চিম পাড়ে ওত পেতে বসে আছে। আকাশে সূর্য উঠতেই তারা দেখতে পেল হেলিকপ্টার নদী পার হচ্ছে। কিন্ত দেখেও তারা ঘাঁটি ছাড়ার সাহস পেল না। ভাবল, ওটা বোধহয় বিমানবাহিনীর একটা ধাপ্পা। ওদিকে ছুটে গেলেই আশুগঞ্জ থেকে মূল ভারতীয় বাহিনীটা ভৈরব বাজারের ওখানে এসে উঠবে। তারপর ভৈরব বাজার- ঢাকা রাস্তা ধরবে। সত্যিই কিন্ত পাকবাহিনীকে ভুল বোঝানোর জন্য এসে মিত্রবাহিনীর একটা বড় কলাম তখন ভাবসাব দেখাচ্ছিল যে তারা আশুগঞ্জ দিয়েই মেঘনা পার হবে।

পাকবাহিনী এইভাবে ভুল বোঝায় মিত্রবাহিনীর সুবিধা হল। একরকম বিনা বাধায় মেঘনা পার হওয়া গেল। হেলিকপ্টারে নদী পার হল কিছু সৈন্য। অনেকে আবার পার হল স্টিমারে এবং লঞ্চে করে। কিছু পার হল স্রেফ দেশী নৌকাতেই। ট্যাঙ্কগুলি নিয়ে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছিল প্রথমে। কিন্ত সে সমস্যাও দূর হল এক অভাবনীয় উপায়ে। রাশিয়ান ট্যাঙ্ক সাঁতরাতে পারে ঠিকই। কিন্ত আধা ঘণ্টার বেশী সাঁতরালে ট্যাঙ্ক ভীষণ গরম হয়ে যায়। অথচ মেঘনা পার হতে আধ ঘণ্টার বেশী সময় লাগবে। তখন ঠিক হল, ট্যাঙ্কগুলি যতটা সম্ভব নিজেই সাঁতরে এগোবে। তারপর নৌকাতে দড়ি বেঁধে ট্যাঙ্কগুলিকে নদীর ওপারে নিয়ে যাওয়া হবে। স্থানীয় মানুষের অভূতপূর্ব সাহায্য ছাড়া এই বিরাট অভিযান কিছুতেই সার্থক হত না। ওখানের মানুষ যে যেভাবে পারল মিত্রবাহিনীকে সাহায্য করল। শত শত নৌকা নিয়ে এল তারা। সেইসব নৌকা বারবার পার করল। সেখান থেকে মিত্রবাহিনী নদী পেরিয়েছিল সেখানে কোনও রাস্তাঘাট ছিল না। সেটা ছিল জলা জমি।এই জলা জমি দিয়ে কামান বন্দুক ঘাড়ে করে নিয়েছিল ওই এলাকার শত শত বাঙ্গালী। বেশ কয়েক মাইল হেঁটে তারপর তারা পৌঁছেছিল ভৈরববাজার- ঢাকা মূলসড়কে।এবং পরদিনই তারা রায়পুর দখল করে নিল।

ওদিকে তখন উত্তরের বাহিনীটাও এগিয়ে আসছে ময়মনসিংহের কাছে পৌঁছে তারা দাঁড়াল। খবর ছিল ময়মনসিংহে পাকবাহিনীর একটা বিগ্রেড আছে। কিন্ত সেই বিগ্রেডটাকে যে আগেই ভৈরববাজারের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে মিত্রবাহিনী তা জানত না। তাই মিত্রবাহিনী ময়মনসিংহে বড় লড়াই করার জন্য সেদিনটা ব্রহ্মপুত্র নদীর ওপারে শম্ভগঞ্জে অপেক্ষা করল। অন্যদিকে ভারতীয় বিমান এবং নৌবাহিনীও সেদিন পাকবাহিনীকে ভয় পাইয়ে দিল। বিমানবাহিনীর জঙ্গী বিমানগুলি ঢাকার বেতারকেন্দ্রকে স্তব্ধ করে দিয়ে এল। কুর্মিটোলার উপর বারবার রকেট আর বোমা ছুঁড়ল।

নৌবাহিনীর বিমান আক্রমণে চট্টগ্রামও চালনার অবস্থাও অত্যন্ত কাহিল। কয়েকটা ভর্তি হয়ে পাকবাহিনী বঙ্গোপসাগরে পালাতে গিয়েছিল। একটা জাহাজে নিরপেক্ষ দেশের পতাকা উড়িয়েও কিছু পাক সৈন্য সিঙ্গাপুরের দিকে পালিয়ে পালাচ্ছিল। সব ধরা পড়ল। কয়েকটা পাক বাণিজ্য জাহাজও মাঝদরিয়ায় ঘায়েল হল।

১১ ডিসেম্বরঃ ১১ তারিখ চতুর্দিকে পাক সেনাবাহিনীর প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ল। বহু পাক ঘাঁটির পতন হল।মুক্ত হল জামালপুর, ময়মনসিংহ, হিলি,গাইবান্ধা, ফুলছড়ি, বাহদুরাবাদ, পিসপাড়া, দুর্গাদীঘি, বিগ্রাম এবং চণ্ডীপুর। বিভিন্ন এলাকায় শত শত পাকসৈন্য আত্মসমর্পণ করল। এক জামালপুরেই আত্মসমর্পণ করল৫৮১ জন। চাঁদপুরের উত্তরে মতলব বাজারেও বহু পাকসৈন্য আত্মসমর্পণ করল। কিছু আবার পেছনের দিকে পালাতে গিয়ে মার খেল। যেমন জামালপুরের বাহিনীর একটা অংশ। জামালপুরের পাকবাহিনী বেশকিছু দিন ধরে ভাল লড়াই- ই চালিয়েছিল। মাটি কামড়ে তারা লড়াই চালাচ্ছিল। এই লড়াইয়ে ভারতীয় জেনারেল গিল মারাত্মকভাবে আহত হলেন। ১১ তারিখ আর পারল না। একটা বাহিনী আত্মসমর্পণ করল। আর একটা টাঙ্গাইলের দিকে পালাল।

উত্তরে ১০১নং কমিউনিকেশন জোনের একটা বিগ্রেড তখন ময়মনসিংহ দখল করে নিয়েছে। ময়মনসিংহ থেকে সোজা তারা ঢাকা এগোতে পারল না। কারণ রাস্তাটাই সোজা যায়নি। গিয়েছে টাঙ্গাইল ঘুরে। ময়মনসিংহ থেকে ঢাকার রেললাইনটা ছিল সোজাসুজি। কিন্ত পালাবার আগে পাকবাহিনী ব্রহ্মপুত্রের উপর রেলসেতুটা ভেঙ্গে দিয়েছিল ওই পথের আরও কয়েকটা রেল পুল। তাই ভারতীয় বাহিনীকে টাঙ্গাইলের পথেই এগোতে হল। সেইটাই অবশ্য ছিল তাদের পরিকল্পনা।

ওদিকে ভৈরববাজারের দিক থেকে তখনও এগিয়ে ৫৭নং ভারতীয় ডিভিশন। কিছুটা এগিয়ে তারা দুভাগে ভাগ হয়ে গেল। একটা গেল নরসিংদীর দিকে। বিমানবাহিনীও তখন পুরোদমে আক্রমণ চালাচ্ছে। পাকিস্তানীরা মিত্র পক্ষের সেনাবাহিনীর  হাত থেকে পালায় তো বিমানবাহিনীর হাতে গিয়ে ধরা পড়ে। বিমানবাহিনী সেদিন একমাত্র ঢাকাকে রেহাই দিল। কারণ, ভারত সরকার আগেই ঘোষণা দিয়েছিল, ওইদিন ঢাকাও করাচির উপর কোনও আক্রমণ হবে না। বিদেশীদের ঢাকা থেকে বের করে আনার জন্য আন্তর্জাতিক বিমান তেজগাঁওয়ে নামতে দেওয়া হবে। এবং সেজন্য তেজগাঁও বিমানবন্দর সারতেও দেওয়া হবে। নৌবাহিনী কিন্ত সেদিনও ভীষণ সক্রিয়। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং চালনার উপর নৌবাহিনীর বিমানগুলি সেদিনও প্রচণ্ড আক্রমণ চালাল।

১২ ডিসেম্বরঃ পরদিনও বিমানবাহিনী ঢাকার উপর কোনও আক্রমণ করল না। সেদিন বিদেশীদের নিয়ে ঢাকা থেকে তিনখানা বিমান এল কলকাতায়। অবরুদ্ধ ঢাকা থেকে মুক্ত মানুষেরা এল কলকাতায়। বিমানবাহিনী সেদিন অন্যত্র ব্যস্ত। ভোররাতেই ছত্রীসেনাদের নামানো হল টাঙ্গাইলে। ময়মনসিংহের দিক থেকে মিত্রবাহিনীর বিগ্রেডটাও দ্রুত এগিয়ে আসছে টাঙ্গাইলে।ভোররাতে ছত্রীসেনাদের নামানো হল নদীর দক্ষিণে। মীর্জাপুর আর টাঙ্গাইলের মাঝামাঝি।

ভুয়া ছত্রীদের নামানো হয়েছিল প্রথম রাত্রে। কিছু পাকসেনা সেই ভুয়া ছত্রীসেনা খুঁজতে ছুটল। তারপর ভোররাতে নদীর উত্তরে নামানো হল আসল ছত্রীসেনা। এক ব্যাটালিয়ন অর্থাৎ প্রায় একহাজার। মাটিতে নামতে তারা স্থানীয় অধিবাসীদের সাহায্য পেল। স্থানীয় সবাই সাহায্য করতে এগিয়ে এল। বিমান থেকে যে অস্ত্রশস্ত্র ফেলা হয়েছিল স্থানীয় অধিবাসীরা ছুটোছুটি করে তা সংগ্রহ করে দিল ছত্রীসেনাদের।

উত্তর দিকে পাকবাহিনীর একটা অংশ তখন পিছু হটে আসছিল। এদের আগমনের খবর জানা ছিল না ভারতীয় বাহিনীর। কারণ এরা প্রধানত কাঁচা রাস্তা দিয়ে আসছিল। আচমকা এই পাকবাহিনীটা এসে পড়ল ছত্রীসেনাদের সামনে। ওরাও আবার জানতো না যে ভারতীয় ছত্রীসেনারা ওখানে নেমেছে। ভারতীয় ছত্রীসেনারাই প্রথম দেখতে পেল পাকবাহিনীকে। দেখতে পেয়েই দমাদম গুলি চালাল। এবং সেই আচমকা আক্রমণে পাকবাহিনী একেবারে হতভম্ব হয়ে পড়ল। প্রথমেই তারা ছিটকে পড়ল। তারপর রিগ্রুপড হয়ে দক্ষিণে এগোবার চেষ্টা করল। কিন্ত ততক্ষণে ভারতীয় ছত্রীসেনারা পুরোপুরি তৈরি। লড়াই হল। পাকসেনারা কিছুক্ষণ লড়ার পরই পিছু হটার চেষ্টা করল। কিন্ত তাও পারলো না। কারণ ততক্ষণে ময়মনসিংহের দিক থেকে ১০১নং কমিউনিকেশন জোনের বিগ্রেডটাও এসে গিয়েছে পেছনে। বাধ্য হয়ে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করল।

টাঙ্গাইলের ছত্রীসেনারা কিছুক্ষণের মধ্যেই ছোট্ট বিমানবন্দরটা দখল করে নিল। তারপর থেকে প্রতি দশ মিনিট অন্তর সেখানে ক্যারিবু বিমানের অবতরণ শুরু হল। এল আরও সৈন্য। এল বহু অস্ত্রশস্ত্র।যুদ্ধের নানা সরঞ্জাম। কয়েক ঘণ্টা পর ১০১নং কমিউনিকেশন জোনের বিগ্রেডটা এসে তাদের সঙ্গে যোগ দিল। এবং দুই বাহিনী একত্রে এগিয়ে চলল ঢাকার পথে মির্জাপুরের দিকে।

ওদিকে তখন ৫৭ নং ডিভিশনও পূর্ব দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে ঢাকার দিক।সেই দিন তারা নরসিংদী অতিক্রম করে বেশকিছু এগিয়েছে। সেদিনই প্রথম ঢাকায় ভারতীয় কামানের গর্জন শোনা গেল। এবং সেই গর্জন শুনে নিয়াজিসহ ঢাকার পাকবাহিনী অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো।

এদিকে কলকাতায় পূর্বাঞ্চলীয় বাহিনীর চীফ অব স্টাফ জেনারেল জ্যাকবও আর এক কাণ্ড করে বসে আছেন। সকালে সাংবাদিক বৈঠক। জেনারেল জ্যাকব সেখানে সমগ্র পরিস্থিতি বোঝাচ্ছিলেন। সাংবাদিকরা তাঁকে এই ছত্রীসেনা নামাবার ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করল। জেনারেল জ্যাকব বললেন,’’ হ্যাঁ ছত্রীসেনা নেমেছে। তবে কোথায় নেমেছে, কত নেমেছে আমাকে জিজ্ঞেস করো না। বিদেশী সাংবাদিকরা যত এই ব্যাপারে প্রশ্ন করেন, জেনারেল জ্যাকব ততই প্রশ্নটাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁরই মধ্যে তিনি ইঙ্গিতে এমন ধারণা দিলেন যে, এক বিগ্রেডের বেশী ছত্রসেনা নামানো হয়েছে এবং ঢাকার কাছাকাছি বিভিন্ন এলাকায় তারা নেমেছে। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলি এই খবর সঙ্গে সঙ্গে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিল। খবরটা ঢাকায়ও পৌঁছল।এবং পাক সমরনায়করা সেই খবর পেয়ে বিষম ভয় পেয়ে গেল। তারা ভাবল হয়ত ঢাকার চতুর্দিকে মিত্রবাহিনী প্রচুর ছত্রীসেনা নামিয়েছে। এবং হয়ত সব খবর তারা তখনও পায়নি। ঢাকার সবাই বুঝল, এবার আর রক্ষা নেই। জেনারেল মানেকশের আবেদনও তখন বারবার প্রচারিত হচ্ছেঃ বাঁচতে চান তো আত্মসমর্পণ করুন।পালাবার কোন পথ নেই। লড়াই করা বৃথা। আত্মসমর্পণ করলে জেনেভা কনভেনশন অনুসারে ব্যবহার পাবেন।

১৩ ডিসেম্বরঃ মিত্রবাহিনী যতই ঢাকার দিকে এগিয়ে আসছিল এবং ঢাকার উপর বিমান হানা যতই বাড়ছিল ঢাকার পাক সামরিক নেতাদের অবস্থাও ততই কাহিল হয়ে উঠেছিল। সাধারণত বিপদে পড়লে জেনারেলরা যা করেন এরাও প্রথম প্রথম তাই করল- ইসলামাবাদের কাছে বারবার আরও সাহায্য পাঠাবার আবেদন জানাল। বলল; ভারত অন্তত ন’শ ডিভিশন সৈন্য এবং দশ স্কোয়াড্রন বিমান নিয়ে আক্রমণ শুরু করেছে। সুতরাং আমাদেরও অবিলম্বে কয়েক ডিভিশন সৈন্য এবং কয়েক স্কোয়াড্রন বিমান চাই। ইসলামাবাদ প্রথমে ঢাকার কর্তাদের বলেছিলঃ তোমরা মাত্র কয়েকটা দিন লড়াই চালিয়ে যাও। আমরা দিন সাতেকের মধ্যে পশ্চিমখণ্ডে ভারতীয় বাহিনীকে এমন মার দেব যে তারা নতজানু ক্ষমা চাইতে বাধ্য হবে। এবং তখন যুদ্ধই থেমে যাবে। সুতরাং তোমাদেরও আর কোনও অসুবিধা থাকবে না। কিন্ত দিন পাঁচ- ছয়ের মধ্যেই ঢাকার পাক কর্তারা বুঝতে পারল যে ওদিকেও বেশী সুবিধা হচ্ছে না। ভারত নতজানু হওয়ার কোনই সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না বরং ভারতীয় বাহিনী প্রচণ্ড বেগে ঢাকার দিকে এগোচ্ছে। তখন তারা অনেকেই ভয় পেয়ে গেল। ভয় পেল প্রধানত দুই কারণে। প্রথমে কারণ, পালানোর পথ নেই। কোথাও যে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করবে তার উপায় নেই। বিমানবন্দরে পালানোর মত কোনও পথ নেই। মাথার উপরে ভারতীয় বিমান। সমুদ্রে ভারতীয় নৌবাহিনীর অবরোধ। স্থলপথেই যেদিকে যাওয়া যাবে, ভারতীয় সেনা।মুক্তিবাহিনী বা স্থানীয় মানুষের হাতে পড়লে মৃত্যু অনিবার্য। তাদের অত্যাচারের ফলে বাংলাদেশের মানুষ কতটা ক্ষেপে আছে তা জানতে তাদের বাকি নেই। তাই মিত্রবাহিনী পদ্মা ও মেঘনার কূলে এসে দাঁড়ানো মাত্রই পাক কর্তাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়েছিল। তারা অসহায় বোধ করতে শুরু করেছিল। এর উপর তারা যখন দেখল যে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়ানো পাকবাহিনীও আর ঢাকার দিকে ফিরতে পারছে না তখন তারা অনেকেই একেবারে হাত-পা ছেড়ে দিল।

ওদিকে তখন পূর্ব ও উত্তর দিক থেকে মিত্রবাহিনী ঢাকায় প্রায় পনেরো মাইলের মধ্যে পৌঁছে গেছে।৫৭ নং ডিভিশনের দুটো বিগ্রেড এগিয়েছে পূর্ব দিক থেকে। উত্তর দিক থেকে এসেছে গন্ধর্ব নাগরার বিগ্রেড এবং টাঙ্গাইলে নামা ছত্রীসেনারা। পশ্চিমে সেদিন ৪ নং ডিভিশনও মধুমতি পার হয়ে পৌঁছে গিয়েছে পদ্মার তীরে। উত্তর এবং পূর্ব দিক থেকে মিত্রবাহিনীর কামানের গোলাও পড়া শুরু হয়েছে কুর্মিটোলা ক্যান্টমেন্টে। এবং ভারতীয় বাহিনীর জঙ্গী বিমানগুলিও বারবার হানা দিচ্ছে ঢাকার সব কটা সামরিক ঘাঁটির উপর। পাকবাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য মিত্রপক্ষ সেদিন সর্বতোভাবে সচেষ্ট। একদিকে চলছে কামানে-বিমানে তীব্র আক্রমণ আর একদিকে বেতারে প্রচারিত হচ্ছে আত্মসমর্পণের আবেদন। জেনারেল মানেকশঃ বাণী সেদিন প্রচারিত হয়েছিল রাও ফরমান আলীর উদ্দেশ্যে। জেনারেল মানেকশ এখন বললেনঃ আমার সৈন্যরা এখন ঢাকাকে ঘিরে ধরেছে এবং তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে এবং তাদের প্রতি ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার করা হবে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় সেদিন শত শত পাকসেনা আত্মসমর্পণ করল।এক ময়নামতিতেই আত্মসমর্পণ করল ১১৩৪ জন। কিন্ত নিয়াজি তখনও অবিচল। তখনও সে লড়াই চালিয়ে জেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এবং তখনও তার সঙ্গে একমত হয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে খুলনা, বগুড়া এবং চট্টগ্রামের পাক অধিনায়করা।

১৪ডিসেম্বরঃ নিয়াজি তখনও গোঁ ধরে বসে আছে, কিন্ত আর প্রায় সকলেরই হৃদকম্পন উঠে গিয়েছে। ১৩ তারিখ রাত থেকে ১৪ তারিখ ভোর পর্যন্ত পূর্ব এবং পশ্চিম দিক দিয়ে মিত্রবাহিনী কামান অবিরাম গোলা মেরে চলল। গোলাগুলি পড়ল গিয়ে প্রধানত ঢাকা ক্যান্টমেন্টে। কিন্ত সে গোলার আওয়াজে সারারাত ধরে ঢাকা কাঁপল। ঢাকার সবাই সেদিন ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। বুঝল, আর রক্ষা নেই। গভর্নর মালিক সেদিন সকালেই সমগ্র পরিস্থিতি বিবেচনার জন্য গভর্নর হাউসে মন্ত্রীসভার এক জরুরী বৈঠক ডাকল। এই বৈঠকে বসবার ব্যাপারেও আলী এবং চীফ সেক্রেটারী মুজাফফর হোসেনের হাত ছিল। তারা তখনও মনে করেছে, আত্মসমর্পণ ছাড়া উপায় নেই, রক্ষা নেই।

মন্ত্রীসভার বৈঠক বসল সকাল এগারোটা নাগাদ। এবং একটা পাকিস্তানী ওয়ারলেস মেসেজ ধরে মিত্রবাহিনীও প্রায় সঙ্গে সঙ্গে জেনে গেল  সেই বৈঠকের খবরটা। সঙ্গে সঙ্গে খবর চলে গেল ভারতীয় বিমানবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় হেডকোয়াটারে। এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই এক ঝাঁক জঙ্গী বিমান উড়ে এল ঢাকা গভর্নর হাউসের উপর। একেবারে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে তারা ছুঁড়ল রকেট। গোটা পাঁচেক গিয়ে পড়ল একেবারে গভর্নর হাউসের ছাদের উপর। মিটিং তখনও চলছিল। মালিক এবং তার মন্ত্রীরা ভয়ে প্রায় কেঁদে উঠল। চীফ সেক্রেটারি, আইজি, পুলিশ বড় বড় কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিল। তারাও ভয়ে যে পারল পালাল। বিমান হানা শেষ হওয়ার পর মালিক সাহেব তার পাত্রমিত্রদের সঙ্গে আবার বসলেন।এবং তারপর আর পাঁচ মিনিটও লাগল না তাদের সিদ্ধান্তে পৌঁছতে। তারা সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত করলেনঃ আমরা সবাই পদত্যাগ করলাম। সেই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত তারা সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি প্রতিনিধি রেনড সাহেবকে জানাল এবং তার কাছে আশ্রয় চাইল। রেনড সাহেব তখন ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলকে রেডক্রসের অধীনে ‘’ নিরপেক্ষ এলাকা’’ করে নিয়েছেন। এই ‘’নিরপেক্ষ এলাকা’’ তখন ঢাকার এক অদ্ভুত জিনিস। গোটা ঢাকা তখনও পাকিস্তানীদের দখলে, শুধু হোটেলটা ছাড়া। হোটেলটার উপর রেডক্রসের বিরাট বিরাট পতাকা উড়ছিল। বহু বিদেশী এবং পশ্চিম পাকিস্তানী আশ্রয় নিয়েছিল ওই হোটেলে। ১৪তারিখ সেখানে সদলবলে গিয়ে আশ্রয় নিল মালিক সাহেব। তখন ঢাকার সবাই মনে করছে- ওটাই একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়- ভারতীয় বৈমানিকরা কিছুতেই রেডক্রসের বড় বড় পতাকা ওঠা বাড়িতে আক্রমণ করবে না। রেনড সাহেব তার এলাকায় ওদের আশ্রয় দিয়ে খবর পাঠালেন জেনিভায়। সেই বার্তায়; পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সর্বোচ্চ কর্মকর্তারা পদত্যাগ করেছেন এবং রেডক্রস আন্তর্জাতিক অঞ্চলে আশ্রয় চেয়েছেন। জেনিভা চুক্তি অনুযায়ী তাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশ সরকারকে যেন অবিলম্বে সমস্ত ঘটনা জানানো হয়। খবরটা যেন সামরিক বাহিনীকে জানানো হয়।

মালিক এবং তার গোটা ‘’ পূর্ব পাকিস্তান সরকারের’’ এই সিদ্ধান্তে অবস্থা আরও কাহিল হল। ঢাকার উপর তখন প্রচণ্ড আক্রমণ চলছে। আক্রমণ চলছে কামানের। আক্রমণ চলছে বিমানের। প্রধান লক্ষ্য কুর্মিটোলা ক্যান্টমেন্ট। নাগরার বাহিনী তখন টঙ্গীর কাছে পৌঁছে গিয়েছে। এবং পাক শীতলক্ষ্যা নদীর একটা শাখার উপর ব্রিজটা উড়িয়ে দিয়ে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। মূল পাকবাহিনীটা কিন্ত কামান এবং বিমান আক্রমণে প্রায় পাগল হয়ে গিয়ে কুর্মিটোলা ছেড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে। পূর্বদিকের বাহিনীটাও প্রায় পৌঁছে গিয়েছে ডেমরায়। তবু নিয়াজি তখনও বলছে; আমি শেষ পর্যন্ত লড়ে যাব। নিয়াজি অবশ্য একথা বলেছিল প্রধানত মার্কিনীদের ভরসায়। মার্কিনী সপ্তম নৌবহর যে বঙ্গোপসাগরের দিকে এগোচ্ছে এ খবর চার-পাঁচদিন আগে থেকেই জানা গিয়েছিল। গোটা দুনিয়ায় তখন সপ্তম নৌবহরের বঙ্গোপসাগরে আগমন নিয়ে জোর জল্পনা- কল্পনা চলছে। মার্কিন সরকার যদিও ঘোষণা করলেন যে কিছু আমেরিকান নাগরিককে অবরুদ্ধ বাংলাদেশ থেকে উদ্ধারের জন্যই সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে যাচ্ছে।আসলে কিন্ত কেউ তা বিশ্বাস করল না। সকলেরই মনে তখন বেজায় সন্দেহ। সকলেরই মনে তখন প্রশ্ন; প্রেসিডেন্ট নিকসন কি ইয়াহিয়ার রক্ষার্থে মার্কিন নৌবহরকে আসরে নামাবেন। ঠিক কি উদ্দেশ্যে মার্কিন সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে এসেছিল এবং কেনই বা তারা কিছু না করে ( কিছু করতে না পেরে) সে রহস্যের এখনও সম্পূর্ণ কিনারা হয়নি। তবে ইতিমধ্যেই ঢাকায় এতটুকু খবর গিয়েছে ইসলামাবাদের খবর মত ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিয়াজি আশা করেছিল যে, সপ্তম নৌবাহিনীর জঙ্গী বিমানগুলি তার সাহায্যে আসবে নামবে। ইয়াহিয়া নিজে নাকি নিয়াজিকে সে খবর জানিয়েছিল। সেই ভরসায় নিয়াজি ১৪ তারিখেও বলে চলেছে; একেবারে শেষ পর্যন্ত শেষ পর্যন্ত লড়াই চালাব।

ওদিকে  মিত্রবাহিনী তখন প্রচণ্ডভাবে ঢাকায় সামরিক লক্ষবস্তগুলির উপর আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে কিন্ত তখনও তারা ঠিক জানেনা ঢাকার ভেতরের অবস্থাটা কি। অর্থাৎ পাকবাহিনী কিভাবে ঢাকার লড়াইটা লড়তে চায় এবং ঢাকায় তাদের শক্তিই বা কতই। সে খবর মিত্রবাহিনী জানে না। নানাভাবে এই খবর সংগ্রহের চেষ্টা হল।কিন্ত আসল খবরটা কিছুতেই পাওয়া গেল না। যা পাওয়া গেল সব ভুল। সেই ভুল খবরগুলির একটাঃপাকিস্তানীরা গোটা শহরে ছড়িয়ে পড়ে পরিখা খনন করে হাউস-টু-হাউস লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। আর একটা খবরঃ ঢাকায় পাকবাহিনীর অন্তত দেড় ডিভিশন সৈন্য রয়েছে। এবং রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্র। এই দুটো খবরই ভুল ছিল। কিন্ত তখনকার মত এই খবর দুটোই ঠিক মনে হয়েছিল। মিত্রবাহিনী এই অবস্থায় মনে করল যে ঢাকার ভেতরে লড়াই করার জন্য যদি সৈন্যদের এগিয়ে দেওয়া হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে যদি বিমান আক্রমণ চালানো হয় তাহলে লড়াইয়ে প্রচুর সামরিক মানুষও মরবে। মিত্রবাহিনী এটা কিছুতেই চাইছিল না। তাই ওইদিনই তারা একদিক যেমন পাকবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের আবেদন জানাল এবং তেমনি আর একদিকে ঢাকার সাধারণ নাগরিকদের অনুরোধ জানাল আপনারা শহর ছেড়ে চলে যান। যত তাড়াতাড়ি পারেন ঢাকা শহর ত্যাগ করুন। উত্তর এবং পূর্ব রাজধানী দুদিকেই তখন আরও বহু মিত্রসেনা এসে উপস্থিত হয়েছে। চাঁদপুরেও আর একটা বাহিনী তৈরি হচ্ছে নদীপথে অগ্রসর হওয়ার জন্য।

১৫ ডিসেম্বরঃ আগেই বলা হয়েছে নিয়াজি মার্কিন সপ্তম নৌবহরের সাহায্য আশা করছিল। এবং সেই ভরসায়ই দিন গুনছিল।কিন্ত ১৩ বা ১৪ তারিখ কোনও একটা সময়ে নিয়াজি বুঝল না মার্কিন সপ্তম নৌবহর তাকে সাহায্য করতে আসরে নামবে না। এই জিনিসটা ঠিক কখন এবং কিভাবে নিয়াজি জানল সেটা বলা মুশকিল। এখনও সে তথ্য প্রকাশিত হয়নি। ভবিষ্যতে হয়ত কোনও একদিন জানা যাবে এবং তখন বোঝা যাবে আসল ব্যাপারটা। তবে ইতিমধ্যেই যতটা জানা গিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে ১৪ডিসেম্বর সকাল থেকেই নিয়াজি সবরকম আশা ছেড়ে দিয়েছে। ওইদিনই সে শর্তসাপেক্ষে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব নিয়ে ঢাকার বিভিন্ন বিদেশী দূতাবাসের সঙ্গে আলাপ- আলোচনা করল বিশেষত মার্কিনীদের সাথে। ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের কর্মীরা সেই প্রস্তাবটা পাঠিয়ে দিলেন দিল্লীর মার্কিন দূতাবাসে।তারা আবার খবরটা পাঠালেন ওয়াশিংটনে। তখন ওয়াশিংটন ইসলামাবাদের মার্কিন দূতাবাস বহু চেষ্টা করেও ইয়াহিয়াকে ধরতেই পারল না। ১৫ তারিখ দিল্লীর মার্কিন দূতাবাস মারফৎ খবরটা পৌঁছল ভারত সরকারের কাছে- নিয়াজি আত্মসমর্পণ করতে চায়, তবে কতগুলো শর্তসহ। প্রধান শর্ত, পশ্চিম পাকিস্তানীদের সবাইকে চলে যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে এবং কাউকে গ্রেফতার করা চলবে না। ভারত সরকার এ প্রস্তাবটা সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করে দিলেন। শর্ত- টর্ত নয় বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করতে। ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের পাকবাহিনীকে অবশ্য এ আশ্বাস দিতে রাজি নয় যে যুদ্ধবন্দীরা জেনিভা চুক্তিমত ব্যবহার পাবে। নিয়াজি যে পুরো ভেঙ্গে পড়েছে, ঢাকায় যুদ্ধ চালাবার মত মনোবল তার বা তার বাহিনীর মোটেই নেই এটা কিন্ত ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তখনও জানেন না। ঢাকার ভেতরে খবরাখবর ভারতীয় বাহিনী খুব কমই পাচ্ছিল। নিয়াজির শর্তসাপেক্ষে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পেয়ে ভারতীয় বাহিনী মনে করল, এটা নিয়াজির কৌশল। আসলে সে কিছুটা সময় চাইছে যাতে সপ্তম নৌবহরের সাহায্যে সৈন্যসামন্ত পাত্রমিত্র নিয়ে বাংলাদেশ থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। নিয়াজি যে প্রস্তাব দিল তার মানে দাঁড়াল যুদ্ধবিরতি- আত্মসমর্পণ নয়। কিন্ত মিত্রবাহিনী তখন বিনা শর্তে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কিছুতেই রাজি নয়।দিল্লীর মার্কিন দূতাবাস মারফৎ সেই কথা জানিয়ে দেওয়া হলঃ আমাদের প্রস্তাব ভেবে দেখার জন্য আপনাকে ১৬তারিখ সকাল ৯টা পর্যন্ত সময় বেধে দেওয়া হল। ভারতীয় বিমানবাহিনী ওই পর্যন্ত কোনও আক্রমণ করবে না।কিন্ত মিত্রপক্ষের স্থলও নৌবাহিনী যথারীতি অগ্রসর হতে থাকবে। যদি সকাল ৯টার মধ্যে আত্মসমর্পণের খবর না পাই তাহলে তখন থেকে আবার বিমানবাহিনীর আক্রমণ পুরোদমে শুরু হবে। ঢাকার ভেতর পাকবাহিনীর অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। তাদের মনোবল একেবারে ভেঙ্গে গিয়েছে।

জেনারেল মানেকশ তাঁর শেষ বার্তায় নিয়াজিকে বলেছিলেনঃ সকাল নয়টার মধ্যে বেতার জানতে হবে আত্মসমর্পণ করেছেন কিনা। একটা বেতার ফ্রিকোয়েন্সিও বলে দিয়েছিলেন।

শোনা যায় নিয়াজি সেদিন সারারাত ধরে ইসলামাবাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে। এব্যাপারে বিভিন্ন বিদেশী দূতাবাসেরও সাহায্য নেয়। কিন্ত কোনও ফলই হল না।

ইয়াহিয়া খাঁকে কিছুতেই খুঁজে পাওয়া গেল না। ওদিকে তখন মিত্রবাহিনীর কামানের গোলার আওয়াজ বাড়ছে এবং পাকবাহিনীতে ত্রাসও বাড়ছে। ঢাকার অসামরিক পাকিস্তানীরাও আত্মসমর্পণের পক্ষে চাপ বাড়াচ্ছে। চাপ দিচ্ছে কয়েকটা বিদেশী দূতাবাসও।

১৬ডিসেম্বরঃ সকালে নিয়াজি আবার কয়েকজন বিদেশী দূতের সঙ্গে কথা বলল এবং শেষপর্যন্ত স্থির করল যে মানকশের প্রস্তাবই মেনে নেবে। তখন শুরু হল ওই ফ্রিকোয়েন্সিতে গিয়ে ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা। কয়েকজন বিদেশীর সঙ্গে বসে নিয়াজি বারবার সেই চেষ্টায়ই করতে থাকল। সকাল প্রায় সোয়া আটটা থেকে। কিন্ত কিছুতেই যোগাযোগ করতে পারল না। ন’টা বাজে বাজে তখন গোটা ঢাকা আকাশবাণীর কলকাতা স্টেশন খুলে কান পেতে বসে রয়েছে। তাঁরাও ভীষণ ভীত। তাঁরাও বুঝতে পারছিলেন ঢাকার লড়াই যদি হয়ই তাহলে তাঁদেরও অনেকের প্রাণ যাবে। তাঁরাও তখন জানতে একান্ত আগ্রহী নিয়াজি মানকেশর প্রস্তাবে রাজি কিনা। কিন্ত হায় ন’টার সংবাদে তারা আকাশবাণীর বাংলা খবরে জানতে পারল নিয়াজি কোনও জবাবই দেয়নি!বিমান আক্রমণ বিরতির সময়ও পার হয়ে গিয়েছে!ঠিক তখনই নিয়াজি মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছে। এবং জানিয়েও দিয়েছে তার বাহিনী বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করবে। তখনই ঠিক হল বেলা বারোটা নাগাদ মিত্রবাহিনীর চীফ অব স্টাফ জেনারেল জ্যাকব ঢাকা যাবেন নিয়াজির সঙ্গে আত্মসমর্পণের ব্যাপারটা পাকা করতে।ওদিকে তখন জেনারেল নাগরাও প্রায় মিরপুরের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। ঢাকা- টাঙ্গাইল রোডের উপর নাগরার বাহিনী আটকে পড়েছিল। টঙ্গীর কাছাকাছি। নদীর ওপরের ব্রিজটা পাকিস্তানীরা ভেঙ্গে দিয়েছিল।

১৬ তারিখ ভোর নাগরার বাহিনী নয়ারহাটের ফরেস্ট রোড দিয়ে সাভারের কাছাকাছি এসে ঢাকা- আরিচাঘাট রোডের উপর এসে পড়ল। পাকবাহিনী এই রাস্তায় ভারতীয় বাহিনীকে আশাই করে নি। তাই ওদিকে কোনও প্রতিরোধের ব্যবস্থায়ই রাখেনি। এমনকি ব্রীজগুলি পর্যন্ত ভাঙ্গে নি। আরিচাঘাট রোডে পড়ে গন্ধর্ব নাগরার বাহিনী সোজা ঢাকার দিকে এগোলো। মাত্র কয়েক মাইল। প্রথমেই মিরপুর। পাকবাহিনীর জেনারেল জামসেদ সেখানে গিয়ে নাগরার কাছে আত্মসমর্পণ করল। নাগরার বাহিনী ঢাকা কয়েক মিনিটের মধ্যেই জেনারেল জ্যাকব হেলিকপ্টারে ঢাকা পৌঁছলেন। নিয়াজির সঙ্গে কথাবার্তা পাকা হল। আত্মসমর্পণের দলিলও তৈরি হল।বিকাল ৪টা নাগাদ সদলবলে ঢাকা পৌঁছলেন মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরা। ৪-২১ মিনিটে ঢাকার রেসকোর্সে জনতার ‘’জয় বাংলা’’ ধ্বনির মধ্যে নিয়াজি আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করল। বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে থাকা পাকবাহিনীর কাছে ততক্ষণে আত্মসমর্পণের নির্দেশ চলে গিয়েছে। সেদিন শুধু লড়াই চলেছিল চট্টগ্রাম এবং খুলনায়। পাক নবম ডিভিশনের প্রধান ওইদিন সকালে নিজ থেকে আত্মসমর্পণ করেছিল। মধুমতি নদীর পূর্বতীরে। চট্টগ্রাম শহরেও ভারতীয় সৈন্য তখন প্রায় ঢুকে পড়েছে। আর খুলনার পাকবাহিনীর একটা অংশ তখন খালিশপুরের অবাঙ্গালী জনবসতির মধ্যে ঢুকে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ চালাচ্ছে।

নিয়াজি আত্মসমর্পণের পর সব যুদ্ধই থেমে গেল। ১৬ডিসেম্বর থেকেই বাংলাদেশ মুক্ত এবং স্বাধীন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৮। স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর অনুসৃত রণনীতি ও রণকৌশলঃ দৈনিক বাংলা ৪-৯ ডিসেম্বর, ১৯৭২ ……

 

অপরাজিতা নীল

<১০, ২৮, ৫৫৯-৫৬৭>

জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে বিশেষ সাক্ষাৎকার

হেয়াদেত হোসাইন মোরশেদ

প্রশ্নঃ মুক্তিবাহিনী কিভাবে সংগঠিত হয়েছিল এবং ২৬শে মার্চের পর থেকে ৩রা ডিসেম্বর তারা কোন ধরনের রণনীতি ও রণকৌশল অবলম্বন করেছিলেন?

জেনারেল ওসমানীঃ আপনাদের মনে আছে ২৬শে মার্চ থেকে শত্রুকে প্রতিরোধ এবং বাঙ্গালীকে দমনে শত্রুদের কার্যক্রম প্রতিরোধ করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বীর বাঙ্গালী সৈনিক, প্রাক্তন ই-পি-আর -এর বীর বাঙ্গালীরা এবং আনসার, মোজাহেদ, ও সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর বীর জওয়ানেরা। সঙ্গে সঙ্গে এদের সাথে এসে যোগ দিয়েছিলেন যুবক ও ছাত্ররা।

সর্বপ্রথমে যুদ্ধ হয় নিয়মিত পদ্ধতিতে। আর এ পদ্ধতিতে যুদ্ধ চালু থাকে মে মাস পর্যন্ত। শত্রুকে ছাউনিতে যথাসম্ভব আবদ্ধ রাখা এবং যোগাযোগ কেন্দ্রসমূহ তাকে কব্জা করতে না দেয়ার জন্য নিয়মিত বাহিনীর পদ্ধতিতে যুদ্ধ করা হয়েছিল। এ জন্য পদ্ধতি ছিল- যত বেশী বাধা সৃষ্টি করা যায় তা সৃষ্টি করা হবে; যেসব ন্যাচারাল অবস্টাকল বা প্রতিবন্ধক রয়েছে তা রক্ষা করতে হবে, এর সাথে সাথে শত্রুর প্রান্তভাগে ও যোগাযোগের পথে আঘাত হানা হবে। মূলতঃ এই পদ্ধতি ছিলো নিয়মিত বাহিনীর পদ্ধতি। আর সংখ্যায় কম হওয়াসত্ত্বেও নিয়মিত বাহিনী অত্যন্ত বীরত্বের সাথে এই পদ্ধতিতে যুদ্ধ করে। এই পর্যায়ে বেশকটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ রয়েছে। যথাঃ – ভৈরব-আশুগঞ্জের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টার শত্রুবাহিনীকে চারদিন আটকে রাখা হয়।

তবে একটা বিষয় আমি আলোকপাত করতে চাই। নিয়মিত বাহিনীর যেটা স্বাভাবিক কৌশল, তা আমাদের সংখ্যা কম হওয়ার জন্য কিছুটা পরিবর্তন করা হয়েছিল। আমরা ছোট ছোট অংশে অর্থাৎ ছোট ছোট পেট্রোল বা ছোট ছোট কোম্পানী প্লাটুনের অংশ দিয়ে শত্রুবাহিনীর তুলনামূলক অধিকসংখ্যক লোককে রুদ্ধ করে রাখি এবং সাথে সাথে শত্রুর উপর আঘাত হানতে থাকি। এভাবে চট্টগ্রাম ও অন্যান্য সর্বপ্রথমে যুদ্ধ শুরু হয়।

সে সময় আমার ও আমার অধিনায়কদের কাছে এ কথা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, আমরা কেবলমাত্র নিয়মিত বাহিনীর পদ্ধতিতে যুদ্ধ করে চলতে পারব না। কারণ আমাদের সংখ্যা তখন সর্বমোট মাত্র ৫টি ব্যাটালিয়ন। এছাড়া আমাদের সাথে প্রাক্তন ই-পি-আর-এর বাঙ্গালী জোয়ানেরা, আনসার, মোজাহেদ, পুলিশ ও যুবকরাও ছিলেন। যুবকদের অস্ত্র দেয়া একতু কঠিন হয়ে পড়েছিল। আমরা ভেতর থেকে যে অস্ত্রগুলো নিয়ে গিয়েছিলাম সেগুলো দিয়ে তাদেরকে তাড়াতাড়ি মোটামুটি প্রশিক্ষণ নিয়ে দাঁড় করিয়েছিলাম। আমাদের বিরুদ্ধে তখন শত্রুবাহিনীর ছিলো তিন-চারটি ডিভিশন। এই তিনটি ডিভিশনকেই নিতম সংখ্যা হিসাবে ধরে নিয়ে আমরা দেখতে পেলাম যে এদেরকে প্রতিরোধ করা, ধ্বংস করা সোজা নয়, সম্ভব নয়। তাই এপ্রিল মাস নাগাদ এটি আমার কাছে পরিষ্কার ছিল যে আমাদের একটি বিরাট গণবাহিনী এ রকম হতে হবে যেমন মানুষের পেটের অস্ত্রের মধ্যে একটি শক্তিশালী জীবানু অস্ত্রটিকে ধ্বংস করে দিতে পারে ভেতর থেকে শক্তিশালী গেরিলা বাহিনী শত্রুর অস্ত্রগুলো বিনিষ্ট করে দেবে। শত্রুকে ধ্বংস করা সম্ভব হবে না। কারণ তাদের সংখ্যা বেশী, তাদের অস্ত্র বেশী, তাদের বিমান রয়েছে, আর আমাদের কাছে বিমান ছিলোনা। এছাড়া সম্বল তাদের অনেক বেশী।

কিন্তু এই সাথে সাথে পরিষ্কার ছিলো যে বাইরে লেখা ক্লাসিক্যাল ওয়ারফেয়ার করে দেশ মুক্ত করতে হলে বহুদিন যুদ্ধ করতে হবে, ইতিমধ্যে আমাদের দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। আমাদের সবচেয়ে বড় জনসম্পদ ধ্বংস হয়ে যাবে। আর বিশেষ কিছু উদ্ধার করার থাকবেনা। সেজন্য এপ্রিল মাসের শেষের দিকে এটাও আমার কাছে পরিষ্কার ছিলো যে আমাদের একটি নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে সময় কমাবার জন্য। সেই পদ্ধতিতে বড় একটি গেরিলা বাহিনী গঠন করে ভেতর থেকে শত্রুকে আঘাত করতে হবে এবং সাথে সাথে নিয়মিত বাহিনীর ছোট ছোট ইউনিট কোম্পানী বা প্লাটুন দিয়ে শত্রুকে আঘাত করতে হবে এবং বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য তাকে বাধ্য করতে হবে-সে যেন কনসেন্ট্রেটেড না থেকে ডিসর্ডারড হয়। এই বিচ্ছিন্নতার ফলে তার সংখ্যাগরিষ্ঠতাজনিত শক্তি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সে ছোট ছোট সংযোগের রাস্তা, তার রিএনফোর্সমেন্টের রাস্তা ধ্বংস করে তাকে ছোট ছোট পকেটে আইসোলেট বা বিচ্ছিন্ন করা যাবে।

এজন্য আমার অনেক নিয়মিত বাহিনীরও প্রয়োজন ছিলো। এই প্রয়োজনের কথা আমি মে মাসের শুরুতে সরকারকে লিখিতভাবে জানাই। এবং এর ভিত্তিতে মিত্রদের কাছ থেকে সাহায্যও চাই। তাতে আমার উদ্দেশ্য ছিলো – (ক) কমপক্ষে ৬০ থেকে ৮০ হাজার গেরিলা বাহিনী ও (খ) ২৫ হাজারফের মত নিয়মিত বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। এই বাহিনী সত্বর গড়ে তুলতে হবে। কারণ, একদিকে গেরিলা পদ্ধতি এবং সঙ্গে সঙ্গে শত্রুকে নিয়মিত বাহিনীর কমান্ডো ধরনের রণকৌশল দিয়ে শক্তি বন্টন করার বাধ্য করতে হবে যাতে তার শক্তি হ্রাস পায়।

এই পদ্ধতি আমরা কার্যে পরিণত করি। ক্রমশঃ গড়ে উঠলো একটি বিরাট গণবাহিনী – গেরিলা বাহিনী। জুন মাসের শেষের দিক থেকে গেরিলাদের বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়। প্রথমে বিভিন্ন জায়গায় ঘাঁটি বানানো হয় এবং জুন মাসের শেষের দিক থেকে আমাদের গণবাহিনী বা গেরিলা বাহিনী এ্যাকশনে নামে। তবে, জুলাই-আগস্ট মাসের আগ পর্যন্ত শত্রুবাহিনী তাদের উপর গেরিলা বাহিনীর প্রবল চাপ বুঝতে পারেনি। যদিও শুরু থেকে আমরা কিছু সংখ্যক যুবককে ট্রেনিং দিয়ে ভেতরে পাঠিয়েছিলাম। তারা চট্টগ্রাম বন্দরে গিয়েছিলো, ঢাকায়ও এসেছিলো। তবে গেরিলাদের শত্রুরা জুলাই মাস থেকে অনুভব শুরু করে।

এর সাথে আরেক দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ হয়। আমাদের নৌবাহিনী ছিলো না। আমার কাছে নিয়মিত বাহিনীর বহু অফিসার, ওয়ারেন্ট অফিসার ও নাবিক আসেন। ফ্রান্সের মত জায়গা থেকে কয়েকজন পাকিস্তানের ডুবোজাহাজ ছেড়ে আমাদের সঙ্গে যোগদান করেন। আমি তাদেরকে ভিত্তি করে এবং আমাদের বড় শক্তি যুবকদের ব্যবহার করে নৌকম্যাণ্ডো গঠন করি। এই নৌকম্যাণ্ডো জলপথে শত্রুর চলাচল ধ্বংস করতে সক্ষম হয়।

১৯৭১ সালের ১৪ই আগস্ট থেকে আমাদের এই নৌকম্যাণ্ডোদের আক্রমণ শুরু হয়। তারা যে বীরত্ব কৃতিত্ব দেখিয়েছে, পৃথিবীর ইতিহাসে তার নজীর নেই। তারা মঙ্গলায় বহু জাহাজ ডুবায়। তার শত্রুর জন্য বিভিন্ন অস্ত্র-সামান নিয়ে যেসব জাহাজ আসছিল চট্টগ্রামে, সেগুলো ধ্বংস করে। এজন্য অত্যন্ত দুঃসাহসের প্রয়োজন ছিলো। তারা শত্রুর দুটি বন্দর বন্ধ করে দেয় এবং নদীপথেও তাদের যাতায়াত বন্ধ করে দেয়।

আমাদের কৌশল অত্যন্ত ফলপ্রসূ বলে প্রমাণিত হয়। সেপ্টেম্বরের শেষনাগাদ শত্রু রক্তহীন হয়ে উঠে। তার ২৫ হাজারের মত সৈন্য বিনষ্ট হয়। বহু যানবাহনের লোক্সান হয়। ৩রা ডিসেম্বর পর্যন্ত শত্রুর এই অবস্থা দাঁড়ায় যে একজন ব্রক্রার রিং-এর দ্বিতীয় রাউন্ডে ক্লান্ত হয়ে ঘুরছে এবং একটা কড়া ঘুষি খলে পড়ে যাবে- তার যোগাযোগ অবস্থা সম্পূর্নভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। যেভাবে আময়ার উদ্দেশ্য ছিলো সেভাবে বিভিন্ন জায়গায় তারা ছোট ছোট পকেট বানিয়েছিলো। তারা কোতি কোটি টাকা খরচ করে রি-ইনফোর্স কংক্রিটের বাংকার বানিয়েছিল। সেগুলোর মধ্যে তারা ঢুকে ছিলো। রাতের বেলাত বেরুতোই না-ই, দিনের বালায়ও বেশীসংখ্যক লোক ছাড়া বেরুতো না। শত্রুর তখন এই অবস্থা দাঁড়িয়েছিল।

অক্টোবর-নভেম্বর থেকেই শত্রু যুদ্ধকে আন্তর্জাতিকীকরণের প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল। যাতে তাদের জান বাচে, জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের পর একটা যুদ্ধবিরতি হয়, অবজারভার এসে যায় এবং জাতিসংঘের কাছে সমস্যাতি দিয়ে তাদের জান রক্ষা হয়- শত্রুপক্ষের এই ছিলো প্রসেষ্টা। কারণ, তখন তারা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলো যে তাদের পরাজয় একেবারে অনিবার্য। জাতিসংঘ যখন হস্তক্ষেপ করলো না তখন তারা একটা আন্তর্জাতিক যুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালালো যাতে জাতিসংঘ এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়। প্রথমে তারা আমাদের ঘাঁটি, পজিশন ও বেসগুলোর অপর বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হামলা করে। সাথে সাথে তারা পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরাঞ্চলেও গোলাগুলি শুরু করে।

আরেকটি ব্যাপার আমি বলতে চাই। আমার কাছে বিমান ছিলো না। তবে শেষের দিকে কয়েকতি বিমান নিয়ে আমি ছোটখাটো একটি বিমানবাহিনী গঠন করেছিলাম। আমি যা বিমান পেয়েছিলাম তা ছিলো, দু’টি হেলকপ্টার, একটি অটার এবং আমার যানবাহনস্বরুপ একটি ডাকোটা। সেই অটার ও হেলকপ্টারগুলোতে মেশিনগান লাগিয়ে বেশ সজ্জিত করা হলো। আমাদের যেসব বৈমানিক স্থলযুদ্ধে রত ছিলেন তাদের মধ্যে থেকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক লোক নিয়ে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে একটি ছোট বিমান বাহিনী গঠন করা হলো। এই বাহিনীর কৌশল ছিলো গুরুত্বপূর্ন কয়েকটি ঘাঁটিতে হামলা করা এবং ইন্টারডিকশন অর্থাৎ শত্রুর যোগাযোগের পথকে বন্ধ করে দেবার জন্য লক্ষ্যবস্তুর ওপর আঘাত হানা।

আপনারা জানেন কিনা জানিনা, শত্রুর উপর প্রথম যে বিমান হামলা হয়েছে, তা বাংলাদেশের বীর বৈমানিকরা করেছে। ২৬শে মার্চ থেকে ৩রা ডিসেম্বর পর্যন্ত যে যুদ্ধ হয়েছে তাতে যদিও আমাদের কাছে বিমান ছিলো না কিন্তু আমরা বিমান ঘাঁটিগুলোতে আঘাত হেনেছি। শেষের দিকে একজন মুক্তিযোদ্ধা সিলেট বিমা ঘাঁটিতে একটি সি-১৩০ বিমানের ওপর অত্যন্ত বীরত্বের সাথে মেশিনগান চালায়। মেশিনগানের গুলিতে যদিও সি-১৩০ বিমানটি পড়ে যায়নি, তবে কোন রকমে ঢুলু ঢুলু করে চলে গিয়ে শমসেরনগরে নেমেছিলো এবং পরে অনেকদিন মেরামতে ছিল।

প্রশ্নঃ ৩রা ডিসেম্বর থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত সম্মিলিত বাহিনীর রণনীতি রণকৌশল কি ছিলো?

জেনারেল ওসমানীঃ প্রথমেই এই কথা বলে নিচ্ছি, শেষের দিকে অর্থাৎ ডিসেম্বরের আগে শেষ পর্যায়ে শত্রুবাহিনী ভারতের উপর যথেষ্ট পরিমান হামলা শুরু করলো। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ালো যে ভারতীয়দের যুদ্ধে নামতে হবে-যদিও উপর থেকে তারা তখনো নির্দেশ পাননি। এমন কি শেষের দিকে যখন যশোর সীমান্তে ভারতের উপর হামলা হয়েছে তখনো উপর থেকে ক্লিয়ারেন্স আসেনি।

একদিনের কথা আমার মনে পড়েছে। সেই অঞ্চলে যুদ্ধরত আমার মুক্তিবাহিনীর উপর আক্রমণ হচ্ছে। আমাদের ট্যাঙ্ক ছিলো না। পাকিস্তানী ট্যাঙ্কগুলো ভারতীয় অঞ্চলের উপরও গোলাবর্ষণ করছে। আমি তখনোদের জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা এর জবাব দিচ্ছেন না কেন? তারা বললেন, “পলিটিক্যাল ক্লিয়ারেন্স নেই।” তখন আমার নিয়মিত বাহিনী ও গণবাহিনীর যোদ্ধারা অতি বীরত্ব ও কৃতিত্বের সহিত মোকাবেলা করেছে।

ভারতীয় বাহিনী ৩রা ডিসেম্বর যুদ্ধে নামে। এবং শত্র্য আত্মসমর্পন না করা পর্যন্ত ১৩ দিন যুদ্ধ করেছিলেন। অবশ্য এর আগে তারা আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। ভারতীয় বাহিনীর যখন যুদ্ধে নেমে আসার সম্ভাবনা দেখা দিলো, তখন আমরা সম্মিলিতভাবে পরিকল্পনা করে একটি রণনীতি অবলম্বন করি। সেই নীতি ছিলো, যেহেতু ভারতীয়দের কাছে ট্যাঙ্ক, কামান, ও বিমান রয়েছে সেজন্য যেখানে শক্তিশালী প্রতিরোধ রয়েছে এবং বড় অস্ত্রশক্তি প্রয়োজন সেখানে তারা প্রথম লক্ষ্য দেবেন এবং আমাদের বাহিনী শত্রুকে ‘আউটফ্লাঙ্ক’ অর্থাৎ দু’পাশ দিয়ে অতিক্রম করে- ‘ক্রস কান্ট্রি’ দিয়ে গিয়ে ব্যূহের পার্শ্বভাগে আক্রমণ করবে অথবা ভারতীয়রা সামনের দিক দিয়ে শত্রুকে ঠেকিয়ে রাখবে এবং আমাদের বাহিনী ‘আউটফ্লাঙ্ক’ করে পেছন দিক দিয়ে আক্রমণ করবে। যেহেতু অঞ্চলগুলো সম্পর্কে আমাদের বাহিনীর অভিজ্ঞতা ছিলো, আমার বাহিনী হাল্কা ছিলো ও ক্ষিপ্রতার সাথে রণাঙ্গনে চলাচলে সক্ষম এবং যেহেতু অঞ্চলগুলো সম্পর্কে আমাদের বাহিনী সম্পূর্ন সজাগ ছিলো। সে জন্যে এই কাজগুলো করার দায়িত্ব ছিলো আমাদের উপর। যেখানে অধিকসংখ্যক গোলাবারুদ, বিমান বা ট্যাঙ্কের আক্রমণ করতে হবে সেখানে ভারতীয় বাহিনী শক্তি নিয়োগ করবে।

যেসব অঞ্চল কেবলমাত্র বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী অর্থাৎ মুক্তিবাহিনী মুক্ত করেছিলো সেখানে আমাদের বাহিনী সম্পূর্নভাবে আমাদের নিজেদের পরিকল্পিত পদ্ধতিতেই যুদ্ধ করেন। আমাদের বাহিনী যেসব অঞ্চল এভাবে মুক্ত করে তারমধ্যে উত্তরবঙ্গের কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট অঞ্চল, সিলেটের সুনামগঞ্জ, ও দুতিক অঞ্চল, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা, আখাউড়া ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উত্তরাঞ্চল, চট্টগ্রামের করেহাট, হায়াকু, হাটহাজারী অঞ্চলের ‘এক্সেস অব এডভ্যান্স’, কুষ্টিয়ার আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা, ও মেহেরপুর অঞ্চল, যশোরের মনিরামপুর ও অভয়নগর অঞ্চল, খুলনার বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও কালিগঞ্জ অঞ্চল, ফরিদপুর সদর, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জ অঞ্চল, বরিশাল ও পটুয়াখালী অঞ্চল এবং ঢাকা পৌছার শেষ পর্যায়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ভৈরব, নরসিংদী, ঢাকা-এই ‘এক্সেস অব এডভান্স’ রয়েছে। শেষপর্যন্ত মিত্ররাও এই পদ্ধতিটি বেশী কার্যকর বলে মেনে নিয়েছিলেন। এই পদ্ধতি ছিলো – শত্রুর যেখানে পাকা বাঙ্কার বা রি-ইনফোর্সড কংক্রিটের শক্তিশালী ব্যূহ বা স্ট্রং পয়েন্ট রয়েছে, সেখানে গিয়ে সরাসরি ঢুঁ মারা বুরবাকের কাজ। এ ক্ষেত্রে যা করতে হবে তা ১৯৪২ সালে জাপানীরা বৃটিশ বাহিনীকে (যাতে আমিও ছিলাম) শিখিয়েছিলো। এক্ষেত্রে সামনে দিয়ে শত্রুকে ব্যস্ত রাখতে হবে এবং ‘আউটফ্লাঙ্ক’ করে ওর পেছনে গিয়ে স্ট্রং পয়েন্ট বানিয়ে বসুন। সে যাবে কোথায় এবং ওর রি-এনফোর্সমেন্ট ও গোলাবারুদ, রসদ, ইত্যাদি আসবে কোত্থুকে? এভাবে তাকে বিচ্ছিন্ন করে তার বুহ্যের পেছনে ও পার্শ্বভাগে আঘাত করুন। প্রথম প্রথম মিত্রদের অনেকে ভাবতেন আমরা কি ভীতু নাকি! তারপর একটি অভিজ্ঞতা হওয়ার পর বুঝলেন যে আমাদের পদ্ধতিই একমাত্র কার্যকর রণপদ্ধতি। এইভাবে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কেবল একটি ব্যাটালিয়ন শত্রুর ১৪নং ডিভিশনকে আশুগঞ্জের যুদ্ধের পর ঘেরাও করে অকেজো করে দেয়।

তাই যেসব অঞ্চলে আমরা একা যুদ্ধ করেছি সেখানে আমাদের পদ্ধতি ছিলো, শত্রুর শক্তিশালী ঘাঁটিকে বিচ্ছিন্ন করে তাকে সম্মুখভাগে ব্যস্ত রেখে তাকে ‘আউটফ্লাঙ্ক’ করে পেছনে গিয়ে বসা এবং তারপর পার্শ্বভাগ ও পেছনের দিক থেকে আক্রমণ করে তাকে ধ্বংস করা। অভ্যন্তর ভাগের গেরিলাদের (গণবাহিনীর) ও আমাদের নিয়মিত বাহিনীর আক্রমণের সামঞ্জস্য বিধান করা। নির্দেশ থাকতো, গেরিলারা যখন অমুক জায়গায় আক্রমণ করবে তখন দৃষ্টিকে অন্যদিকে ধাবিত করতে হবে এবং শত্রুর যাতে গোলাগুলি ও রি-ইনফোর্সমেন্ট না আসতে পারে তার ব্যবস্থা করবে। গেরিলারা অনুম জায়গায় অমুক পুলটি উড়াবেন। তবে আমরা বড় বড় পুলগুলোতে হাত দেইনি। সেই পুলগুলো শত্রুরাই আত্মসমর্পণের আগে ভেঙ্গেছিলো।

যেখানে সম্মিলিতভাবে কাজ করেছি সেখানে কৌশল ছিলো যেখানে অধিক অস্ত্র, গোলাবারুদ, ট্যাঙ্ক ব্যাবহারের প্রয়োজন দেখা দিবে, ‘এক্সেস অব এডভ্যান্স’-এ ভার শত্রুর স্ট্রং পয়েন্টের উপর চাপ প্রোয়োগ করবে এবং বাংলাদেশ বাহিনী ‘আউটফ্লাঙ্ক’ করে গিয়ে পার্শ্বভাগে বা পেছনের দিক থেকে আক্রমণ করবে।

এর সঙ্গে এটাও সুস্পষ্ট নীতি ছিলো যে, স্ট্রং পয়েন্টগুলো ‘ক্লিয়ার’ করার পরবর্তী পর্যায় শত্রুর অন্য পজিশনগুলো আয়াত্ব করতে হবে, সেখানে মুক্তিবাহিনী অর্থাৎ বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী এগোবে। তাদের অগ্রাভিযানে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনী যতটুকু সাপোর্ট দেয়ার ঠিক তততুকু দেবে।

প্রশ্নঃ মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী যখন একসাথে এগোতো তখন অগ্রবর্তী দল হিসাবে মুক্তিবাহিনী যেত এবং সাপোর্ট আসতো ভারতীয় বাহিনীর কাছ থেকে – তাই কি?

জেনারেল ওসমানীঃ দু’রকমের ছিল। সেটা হয়েছে প্রথমে ‘স্ট্রং’ পয়েন্টটি ক্লিয়ার করার পরে। মনে করুন শক্রুর খুব শক্তিশালী একটা ঘাঁটি রয়েছে। সেই ঘাঁটির উপর ভারতীয় বাহিনী ট্যাঙ্ক কামান দিয়ে হামলা করতো। সেই সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিবাহিনী ‘ক্রস কান্ট্রি’ দিয়ে গিয়ে ‘অটোফ্লাঙ্ক’ করতো। ক্রস কান্ট্রি এগিয়ে যাওয়ার বিশেষ দক্ষতা মুক্তিবাহিনীর ছিল। এর দুটো কারণ ছিল- প্রথমতঃ আমরা ন”মাস নিজের অঞ্চলে যুদ্ধ করে আসছি এবং আমাদের বাহিনী তুলনায় হালকা ছিল। দ্বিতিয়তঃ আমাদের সংযোগ ছিল স্থানীয় লোকের সাথে, আমাদের প্রতি তাদের ছিলো পুরো সমর্থন। সেজন্য আমরা সঙ্গে সঙ্গে আউটফ্লাঙ্ক করে শক্রুপারশ্বভাগ ও পেছনে থেকে আক্রমণ করতাম যাতে সে আর টিকতে না পারে। তৎপর যখন অগ্রবর্তী অন্যান্য শক্রুপজিশন আক্রমণ করতে হতো বা এগিয়ে যেতে হতো তখন আমাদের বাহিনী অগ্রসর হতো ও আক্রমণ করতো কারণ অঞ্চলের পথঘাটগুলো আমাদের জানা ছিলো, শক্রুর পজিশন সম্পর্কে প্রতি মুহূর্তের খবর আমাদের দেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত আমাদের সেলগুলোর থাকতো এবং গেরিলাদের সাথে আমাদের সমন্বয় ও সংযোগ ছিল। আবার এখানেও প্রয়োজন হলে ভারতীয় বাহিনী আমাদেরকে আর্টিলারী বা ভারী কামানের দ্বারা সাপোর্ট দিত।

 

প্রশ্নঃ ক’টি সেক্টর ছিল? হেডকোয়ার্টার কোথায় ছিল ?

জেনারেল ওসমানীঃ বাংলাদেশকে আমি ১১টি সেক্টরে ভাগ করেছিলাম। ১১টি সেক্টর একেকজন অধিনায়কের অধীনে ছিল। এবং প্রত্যেক অধিনায়কের একটি সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছিল। এবং এই সেক্টর হেডকোয়ার্টারগুলি বাংলাদেশের ভিতরেই ছিল। এই সেক্টরগুলোর উপর ভিত্তি করে আমি যুদ্ধটি লড়েছি। কারণ, বাংলাদেশের মত এত বড় একটা ‘থিয়েটার’ অর্থাৎ দেশব্যাপী রণক্ষেত্র-যার ১১টি সেক্টরের মধ্যে রয়েছে অসংখ্য নদীনালা ও ব্যাপক দুরত্ব-কেন্দ্রীভুতভাবে দৈনন্দিন যুদ্ধ পরিচালনার জন্যে যুক্ত সামরিক সদর দফতর, উপযুক্ত পরিমান অফিসার স্টাফ, যগাযোগ ব্যাবস্থা ও সম্পদ এবং সঙ্গতির প্রয়োজন তা সংগ্রহ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমার ছিল মাত্র ১০ জন অফিসার বিশিষ্ট একটি ক্ষুদ্র সশস্ত বাহিনীর রণ পরিচালনার হেডকোয়ার্টার। এছাড়া, এতবড় একটা বিরাট অঞ্চলব্যাপী সামগ্রিক যুদ্ধে পরিচালনা আমাদের তখনকার পরিস্থিতিতে শুধু অসম্ভব নয়, অবাস্তবও ছিল। তাই আমি আমার চিফ ওব স্টাফ ও অন্যান্য কামান্ডারদের কাছে আমাদের জাতীয় লক্ষ্য, আমাদের রাজনৈতিক ও সামরিক বিবেচ্য বিষয়ের সঠিক মুল্যায়ন এবং আমাদের ও শক্রুর কাছে কার্যক্রমের কোন কোন পথ উন্মুক্ত রয়েছে ইত্যাদি বিষয়ে সঠিক চিত্র তুলে ধরি। আমাদের সামরিক লক্ষ্য ও সে লক্ষ্য অর্জনের জন্য যুদ্ধ পরিচালনা সম্পর্কিত আমাদের নির্দেশের (অপারেশনাল ইন্সট্রাকশন ও অপারেশনাল ডাইরেকটিভ) মাধ্যমে সাধারনভাবে আমাদের বাহিনীর করনীয়, প্রত্যেক সেক্টরে তাদের বিশেষ করনীয়, বিভিন্ন সেক্টরের কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন এবং সাংগঠনিক ও যুদ্ধ পরিচালনা বিষয়ে জানতাম। আমার এইসব নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিটি সেক্টর কামান্ডারদের সাথে আমি লিয়াজো অফিসার ও মুক্তিযুদ্ধাদের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করতাম। এছারা আমার কামান্ডারদের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রক্ষা এবং যুদ্ধের অবস্থা সমন্ধে সরাসরি অভিজ্ঞতা লাভের জন্য আমি এক সেক্টর থেকে যেতাম অন্য সেক্টরে। সে অবস্থায় আমি যখন যে সেক্টরে থাকতাম, সে সেক্টরের হেডকোয়ার্টারই হতো আমার হেডকোয়ার্টার। এভাবে প্রত্যক্ষভাবে পরিস্থিতির সঠিক মুল্যায়ন করতাম ও সে অনুযায়ী নির্দেশ দিতাম। এছাড়া যুদ্ধকালীন মন্ত্রসভাকেও আমি যুদ্ধের অগ্রগতি ও সামরিক পরিস্থিতির সম্বন্ধে অবহিত রাখতাম।

যখন বাংলাদেশ সরকার আমাকে সর্বাধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ করেন তখন আমি তাদের অনুমোদন লেঃ কর্নেল ( বর্তমান মেজর জেনারেল) এম, এ, রবকে চীফ অব স্টাফ নিয়োগ করি। তিনি আমার পরে সবচেয়ে সিনিয়র ছিলেন। তিনি গনপরিষদেরও সদস্য।

বিভিন্ন সেক্টরের কমান্ডার নিয়োগ করিঃ (১) এক নম্বর সেক্টরে প্রথম মেজর ( বর্তমানে কর্নেল ) জিয়াউর রহমান, পরে মেজর রফিক । (২) দুই নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ  পরে তিনি যখন কে ফোরসের কমান্ডার হয়ে যান তখন বেশ কিছুদিন তিনি দুটাই কমান্ড করেছিলেন, তিনি আহত হওয়ার পরে মেজর আবু সালেক চৌধুরী কমান্ড করেন কে ফোরস এবং ২ নম্বর সেক্টরে মেজর হায়দার। (৩) তিন নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন প্রথমে ( বর্তমানে কর্নেল) মেজর শফিউল্লাহ পরে যখন তিনি এস ফোরসের কমান্ডার হয়ে যান তখন মেজর ( বর্তমানে লেঃ কর্নেল ) শফিউল্লাহ নুরুজ্জামান বর্তমানে যিনি জাতীয় রক্ষী বাহিনীর ডাইরেক্টর তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। (৪) চার নম্বর সেক্টরে কমান্ডার ছিলেন মেজর (বর্তমানে কর্নেল ) চিতরঞ্জন দত্ত, যিনি সকল নিয়মিত অফিসার যারা চাকুরীতে রয়েছেন সকলের মধ্যে সিনিয়র। আইয়ূব আমলে তাকে সুপারসিড করা হয়েছিল। (৫) পাঁচ নম্বর সেক্টরে ছিলেন মেজর (বর্তমানে কর্নেল) মীর শওকত আলী যিনি যুদ্ধের প্রারম্ভে চট্টগ্রামে ও পার্বত্য চট্টগ্রামে যুদ্ধ করেন। (৬) ছয় নম্বর সেক্টরে ছিলেন উইং কমান্ডার (বর্তমানে গ্রুপ ক্যাপ্টেন) বাশার, তিনি বৈমানিক কিন্তু স্থলে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে যুদ্ধ করেছেন। (৭) সাত নম্বর সেক্টরে কমান্ডার ছিলেন মেজর (পরে লেঃ কর্নেল ) কাজী নুরুজ্জামান। তিনি পেনশনে ছিলেন ও আমার মত যুদ্ধাবস্থায় একটিভ লিস্টে কাজে যোগদান করেছিলেন। আবার পেনশনেও চলে গেছেন। (৮) আট নম্বর সেক্টরের শুরুতে কমান্ডার ছিলেন মেজর (বর্তমানে কর্নেল) ওসমান চৌধুরী এবং আগস্ট মাস থেকে মেজর (বর্তমানে কর্নেল) মনজুর। (৯) নয় নম্বর সেক্টরে কমান্ডার ছিলেন প্রায় শেষের দিক পর্যন্ত মেজর এম এ জলিল। তিনি এখন চাকুরীতে নেই। তারপর ছিলেন মেজর জয়নাল আবেদীন। (১০) দশ নম্বর সেক্টর (নৌকমান্ডো সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল ও আভ্যন্তরীন নৌপথ)। এতে নৌ কমান্ডোর বিভিন্ন সেক্টরে নির্দিষ্ট মিশনে সংশ্লিষ্ট কমান্ডারের অধীনে কাজ করতেন। (১১) এগারো নম্বর সেক্টরে ছিলেন মেজর (পরে লেঃ কর্নেল) আবু তাহের, ইনি জখমের জন্য বোর্ড আউট হয়েছেন। এছাড়া তিনটি ব্রিগেড ফোরস যেড ফোরস ও এস ফোরস কমান্ডার ছিলেন যথাক্রমে জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ ও শফিউল্লাহ। হেডকোয়ার্টারে ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন (বর্তমানে এয়ার কমান্ডার) এ কে খন্দকার। চীফ অফ স্টাফ রব সাহেব পূর্বাঞ্চলে থাকতেন। ওখানে আমার হেডকোয়ারটারের একটি অংশ ছিল। ওখানে যতগুলো সমস্যা প্রশাসন ও রণপরিচালনা সম্পর্কিত তিনি সরাসরি ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন যেটা নীতি গ্রহণ সম্পর্কিত হত সে বিষয়ে আমার নির্দেশ চাওয়া হত।

 

প্রশ্নঃ নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা কত ছিল এবং কি ধরনের অস্ত্রে তারা সজ্জিত ছিল? গণবাহিনীর মোট সংখ্যা কত দাঁড়িয়েছিল?

জেনারেল ওসমানীঃ নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা বাড়াতে বেগ পেতে হয়েছিল। অস্ত্র নিয়ে বেগ পেতে হত। বেশীর ভাগ সময় সকলের সদিচ্ছা থাকলেও অনেক জিনিস আমরা পেতাম না। আমার চেষ্টা ও চিন্তা এই ছিল যে, আমি বিভিন্ন অস্ত্র কত তাড়াতাড়ি জোগাড় করতে পারি। কারণ ভারতীয়রা যদি ৩ রা ডিসেম্বর যুদ্ধে না নামত তাহলে তখন যে পরিস্থিতি ছিল তাতে আমাকে আরো ছয় মাস যুদ্ধ করতে হত। এসে দেশের আরো অনেক ক্ষতি হত। এজন্য শত্রুকে আরো সত্বর ধ্বংস করার জন্য অনেকগুলো অস্ত্রের আমাদের প্রয়োজন ছিল। সর্বশেষ একটি দেশের সাথে আমার সংযোগ হয়েছিল।সেই দেশটি তখনি অস্ত্র দিতে প্রস্তুত ছিল যদি আমার নিজের বিমান ঘাঁটি থাকত। সেজন্য আমি যেড ফোরস কে ( বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রথম ব্রিগেড) সিলেট পাঠিয়েছিলাম। অনেকেই জানতেন না হঠাত কেন যেড ফোরস কে সিলেটের উপর চাপালাম। তারা কেবলমাত্র স্ট্রাটেজিক কারন ই জানতেন। আমার উদ্দেশ্য ছিল দুটো বিমানঘাঁটি যত তাড়াতাড়ি পাই তত তাড়াতাড়ি আমি হয়ত অনেক জিনিস সরাসরি আনতে সক্ষম হব। এছাড়া শত্রুর শক্তিকে অন্যদিকে আকর্ষণ করাও আমার উদ্দেশ্য ছিল।

যাহোক যুদ্ধের শুরুতে খুব তাড়াতাড়ি একটা বিরাট বাহিনী গড়ে তোলা সম্ভব মনে হত না। কিন্তু আমার মুক্তিবাহিনীর সৈনিকদের নিয়মিত অফিসার ও অধিনায়কদের চেষ্টায় আমি যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত প্রায় কুড়ি থেকে বাইশ হাজার সৈন্য সম্বলিত নিয়মিত বাহিনী গড়ে তুলেছিলাম। তারা সাধারন ইনফ্যান্ট্রি অস্ত্রে সজ্জিত ছিলেন।

দুটো গোলন্দাজ ব্যাটারী আমরা গড়ে তুলেছিলাম। ভারতীয়দের প্রাচীন কিছু কামান ছিল। ওগুলো দিয়ে প্রথম ব্যাটারীটি গড়ে উঠেছিল। ওটার নাম দিয়েছিলাম ‘নম্বর ওয়ান মুজিব ব্যা্টারি’। এই ব্যাটারি যুদ্ধেও ছিল। এর পরে আমরা দ্বিতীয় ব্যাটারী গঠন করি। আগেরটির চেয়ে একটু ভাল কামান দিয়ে এটি সজ্জিত ছিল। এ ব্যাটারীও যুদ্ধ করে।

আমরা যুদ্ধ আরম্ভ করি প্রায় ৫ টি ব্যাটেলিয়ন সৈন্য দিয়ে। যুদ্ধের শুরুতেই অনেকগুলোর সংখ্যা পুরন করতে হয়েছে। যেমন, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ন একটি অত্যন্ত ঐতিহ্যবাহী পুরানো পল্টন। মাত্র ১৮৮ জনকে আমি পেয়েছিলাম। বাকিরা নিহত কিংবা আহত হয়েছিলেন যশরের যুদ্ধে। তাদের সংখ্যা পুরন করতে হল। শেষ পর্যন্ত আমি ৫ টি ব্যটেলিয়ন থেক্রে ৮ টি ব্যাটেলিয়নে উন্নীত করি। এগুলো ছিল ইস্ট বেংগল রেজিমেন্টের এক দুই তিন চার আট নয় দশ এগারো নাম্বার ব্যাটেলিয়ন। নয় দশ এগারো নম্বর ছিল নতুন।

এছাড়া সেক্টর ট্রুপ্স গড়ে তুলি। সেক্টর ট্রুপ্স এর সংখ্যা শেষ পর্যন্ত ছিল দশ হাজার। যারা প্রাক্তন ই পি আর এবং নিয়মিত বাহিনীর বিভিন্ন ব্রাঞ্চ থেকে এসেছিলেন তাদেরকে ১১ টি সেক্টরে নিয়মিত বাহিনীর সেক্টর ট্রুপস হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল। কোন সেক্টরে চারটি কোম্পানী কোন সেক্টরে পাঁচটি কোম্পানী কোন সেক্টরে ছটি কোম্পানী এভাবে প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন সেক্টুরে সংখ্যা বিভিন্ন ছিল। তারা সেক্টর কমান্ডারের অধীনে যুদ্ধ করতেন।

নিয়মিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যটেলিয়ন নিয়ে গঠিত হয়েছিল ব্রিগেড। ব্রগেডগুলোকে আমি ফোরস নাম দিয়েছিলাম। যেড ফোরস কে ফোরস এস ফোরস। ব্রিগেডগুলোর কমান্ডারদের নামে এই নামকরন হয়েছিল। যেড ফোরস কমান্ড করতেন জিয়াউর রহমান কে ফোরস খালেদ মোশাররফ ও এস ফোরস শফিউল্লাহ।

১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের আগে যে অর্গানাইজেশন ছিল আমরা তার পরিবর্তন পরিবর্তন করিনি। এই অর্গানাইজেশন অনেক চিন্তা করে বিগত দশ বছরে শান্তি ও যুদ্ধে পরীক্ষার ভিত্তিতে গড়া হয়েছিল এর সঙ্গে আমি ঘনিষ্টভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলাম সেটা ভারতীয় অর্গানাইজেশনের চেয়ে একটু স্বতন্ত্র। আমি মনে করি আমাদেরটা সুষ্ঠু। সেই অর্গানাইজেশনের ভিত্তিতে আমাদের ব্যাটেলিয়নদের সাধারন অস্ত্রসজ্জা ছিল। অন্যান্য দেশের ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটেলিয়নের যা সাধারন অস্ত্র থাকে এখানেও তাই ছিল তবে ফায়ার পাওয়ারটা এই অর্গানাইজেশনের কিছুটা বেশী। যেমন সাধারনত একটি সেকশনে একটি লাইট মেশিনগান থাকে আমাদের ছিল দুটো মেশিনগান। আর অস্ত্র ছিল যা স্বাভাবিক ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটেলিয়নে থাকে গ্রেনেড রাইফেল লাইট মেশিনগান মিডিয়াম মেশিনগান দুই ইঞ্চি এবং তিন ইঞ্চি বা ৮১ মিলিমিটার মর্টার এবং ট্যাঙ্কবিদ্ধ্বংসী কামান।

সেক্টর ট্রুপস এর অস্ত্র অ প্রায় এ ধরনের ছিল। তবে ওদের স্কেল ছিল আলাদা। ওদের কাজ ঠিক নিয়মিত বাহিনীর মত ছিল না। তাদের ভুমিকা ছিল প্রথমে তারা ঘাঁটি করবেন। সেই ঘাঁটি থেকে গেরিলা ভেতরে পাঠানো হবে এবং গেরিলদের সাথে সম্মিলিত হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে শত্রুর উপর বিভিন্ন হামলা ও অন্যান্য কাজ করবেন। তাই তাদের অস্ত্রের পরিমান বা স্কেল একটিভ ব্যাটেলিয়নের চেয়ে কিছুটা পৃথক ছিল কিছু কিছু কম ছিল।

এবার গণবাহিনীর কথায় আসছি। সর্বমোট প্রায় ৮০ হাজারের মত ছিল গণবাহিনীর সদস্য। আমি ৬০ থেকে ৭০ হাজার গণবাহিনী কাজে নিয়োগ করছিলাম। এছাড়া কয়েক হাজার প্রশিক্ষনরত ছিল। এদের অস্ত্র যা দিতে চেয়েছিলাম যে স্কেল আমরা তৈরী করেছিলাম ঠিক সেই পরিমান অস্ত্র আমরা সবসময় দিতে পারিনি। অস্ত্রের অভাব ই ছিল এর কারন। যা হোক গণবাহিনীর বীর গেরিলাদের অস্ত্র ছিল প্রত্যেকের হাতে গ্রেনেড কয়েকজনের হাতে স্টেনগান। এছাড়া ছিল রাইফেল যদিও গেরিলাদের জন্য রাইফেল সন্তোষজনক অস্ত্র নয়। কিন্তু যেহেতু আমাদের কাছে সম্বল ছিল না তাই যা পেতাম তাই ব্যবহার করতে হত। এছাড়া ছিল অল্প কয়েকটি পিস্তল ও এস এল আর। খাই হাতেও তারা যুদ্ধ করেছেন। এছাড়া বিভিন্ন নির্দিষ্ট ধরনের অপারেশনের জন্যে থাকতো বিভিন্ন ধরনের বিস্ফোরক। নৌ কমাণ্ডদের আত্মরক্ষার জন্য হালকা অস্ত্র থাকতো, বেশীরভাগ সময়ই গ্রেনেড। আর থাকতো অপারেশনের প্রয়োজনীয় সামগ্রী, যেমন – লিম্পেট মাইন।

যুদ্ধ শেষ হওয়া আমার তাই সৈন্যসংখ্যা ছিল ২০-২৫ হাজার নিয়মিত বাহিনী এবং ৭০/৮০ হাজার গণবাহিনী।

 

প্রশ্নঃ গণবাহিনীর কোন আলাদা সেক্টর ছিল কিনা? সি-ইন-সি স্পেশাল সংগঠনটিও বা কি ছিল?

জেনারেল ওসমানীঃ বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর নাম ছিল মুক্তিবাহিনী। এর ভেতর স্থল, জল, বিমান তিনটিই অন্তর্ভুক্ত ছিল। অনেকে মুক্তিবাহিনী শব্দে ভুল করেন। তারা মনে করেন শুধু গেরিলাদের বুঝি মুক্তিবাহিনী বলা হতো। আসলে তা নয়। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর পুরোটা মিলিয়ে ছিল মুক্তিবাহিনী। এর দুটি অংশ ছিল – (১) নিয়মিত বাহিনী এবং (২) গণবাহিনী ও গেরিলা বাহিনী বা অনিয়মিত বাহিনী। ভারতীয়রা এর শেষোক্ত অংশকে বলতেন এফ-এফ অর্থাৎ ‘ফ্রীডম ফাইটার’। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা তো সবাই। আর গণবাহিনীর ও নিয়মিত বাহিনীর সেক্টর একই ছিল।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য স্বীকারকারী সকলেই এই ১১টি সেক্টরের কোন না কোন একটি সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন।

সি-এন-সি স্পেশাল সম্পর্কে এবার বলছি। শুরুতেই গেরিলাদের দু’সপ্তাহের ট্রেনিং দেয়া হতো। কিন্তু এটা যথেষ্ট ছিলো না। পরে মেয়াদ খানিকটা বাড়ানো হলো। তখন তিন সপ্তাহের মতো সাধারন গেরিলা ট্রেনিং দেয়া হত। এছাড়া আমি কিছুসংখ্যক গেরিলার জন্যে একটি বিশেষ কোর্সের বন্দোবস্ত করেছিলাম। একে বলা হত স্পেশাল কোর্স। ওটা ছয় সপ্তাহের ছিল। এই কোর্সে গেরিলা লীডারদের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। এবং আরবান গেরিলা ওয়ারফেয়ার অর্থাৎ শহরাঞ্চলে আবাসিক এলাকায় যুদ্ধ করার পদ্ধতিও তাদের শেখানো হতো। এদের ভুমিকা ছিলো গেরিলাদের নায়কত্ব করা এবং সাধারন গেরিলাদের দিয়ে সম্ভব নয় এমন সব কাজ সম্পন্ন করা। এই প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের সংখ্যা ছিল খুব কম। চাকুলিয়া নামে এক জায়গায় তাদের ট্রেনিং দেয়া হতো। এসব গেরিলারা বিশেষভাবে সিলেট হয়ে যেতো এবং এদের সিলেকশনের ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে লোক নিয়োগ করেছিলাম। তাই এদের নামকেই বলতো সি-এন-সি স্পেশাল। আসলে এ নামে স্বতন্ত্র বাহিনী ছিল না।

প্রশ্নঃ যুদ্ধ পরিচালনার নির্দেশ অর্থাৎ অপারেশনাল ইন্সট্রাকশন বা ডাইরেকটিভস সম্পর্কে কিছু বলুন।

জেনারেল ওসমানীঃ সরকার গঠনের আগে আমি সর্বপ্রথমে এই যুদ্ধ পরিচালনা করেছি মুখে বলে, যোগাযোগ করে। তারপর আমি কমান্ডারদের আমাদের লক্ষ্য বা অবজেক্টিভ এবং প্রত্যেক সেক্টরে কি ফলাফল অর্জন করতে হবে তা জানিয়েছি।

এ জন্যে আমি সাধারনতঃ অপারেশনাল ইন্সট্রাকশন দিতাম। তাতে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের অধিনায়কের উপর দায়িত্ব যথেষ্ট বিকেন্দ্রীকরন করা হতো। সাধারন লক্ষ্য এবং সেই বিশেষ বিশেষ লক্ষ্য ও দায়িত্বের কথা এই হুকুমনামা বা ইন্সট্রাকশনে লেখা থাকতো। এছাড়া আমি একটি জিনিস ব্যাবহার করেছিলাম যা নতুন ছিল এবং আমার জানা মতে এর আগে কোন সামরিক বাহিনীতে তা ব্যবহার করা হয়নি। সেটা ছিল অপারেশনাল ডাইরেকটিভস নির্দেশ এবং উপদেশ। পরিস্থিতি যাচাই ও বিবেচনা করে কি পরিমাণ এই ডাইরেকটিভস একজন অধিনায়ক অনুসরণ করবেন তা তার উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। কারণ তা না হলে আমরা যুদ্ধে এগিয়ে যেতে পারতাম না। তবে মৌলিক কয়েকটি বিষয় বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়নি।

সব সময়ই মন্ত্রীসভাকে- মাসে অন্তত একবার- রণাঙ্গনের মূল্যায়ন অবহিত করতাম।

এছাড়া আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ভিত্তিক যে নির্দেশ মন্ত্রীসভা আমাকে দিতেন তা আমার অধিনায়কদের কাছে পৌঁছে দিতাম।

প্রশ্নঃ বাংলাদেশের অভ্যন্তরভাগে কিভাবে যোগাযোগ রক্ষা করা যায়?

জেনারেল ওসমানীঃ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন অঞ্চলে শুরু থেকেই আমরা ঘাঁটিগুলো গড়ে তুলেছিলাম। গণবাহিনী কাজ শুরু করার পর এই ঘাটিগুলি অধিকতর সক্রিয় হয়। ঢাকা নগরীতেও কয়েকটি ঘাঁটি ছিল। ঘাঁটি প্রায়ই পরিবর্তন করা হতো। কয়েকটি ঘাঁটি শত্রুর হাতে ধরাও পড়েছিল। ঘাঁটিগুলোতে যে কেবল মুক্তিযোদ্ধা ছিল তা নয়, এতে আমাদের ‘কনট্যাক্ট’ এবং কোরিয়াররাও ছিলেন। একটা কোরিয়ার সার্ভিস পরিচালিত হতো। ছিল ওয়ারলেস যোগাযোগ। কোরিয়ার-এর আসা যাওয়ার রাস্তা পরিবর্তন করা হতো। কোরিয়ার এর মাধ্যমে ভেতরের ঘাঁটিগুলোর মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করা হতো। ঘাঁটি সাধারনত তিন রকমেন্র ছিল – (১) যেখানে অস্ত্র জমা থাকতো, (২) যেখানে তথ্যাবলী সংগ্রহ করা হতো ও যেখান থেকে পাঠানো হতো, এবং (৩) যেখান থেকে শত্রুর উপর আক্রমণ করার প্রস্তুতি নেয়া হতো।

এছাড়া ভেতরে অনেকে ছিলেন, যারা মুক্তিযুদ্ধে বাইরে নাগিয়ে ভেতরে থেকে সহযোগিতা করেছেন।

প্রশ্নঃ অধিকৃত এলাকার জনগণের কাছ থেকে কি ধরনের সাড়া পেয়েছিলেন?

জেনারেল ওসমানীঃ বাংলাদেশের জনগণের কাছ থেকে আন্তরিক ও অকুন্ঠ সমর্থন আমরা পেয়েছি-কেবলমাত্র গুটি কয়েক লোক ছাড়া। বাংলাদেশের লোক ২৬শে মার্চ থেকে সম্পূর্ন সমর্থন দিয়ে এসেছেন। অনেকসময় নিজেদের প্রাণ বিপন্ন করে আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন, সাহায্য করেছেন। এটা অবশ্য সত্য-যারা দালালী করেছেন-রাজাকার আর বদরের যুদ্ধে অনেক জায়গায় পেয়েছি। তারা বেশীর ভাগ সাহস সেখানে যুদ্ধ করতে দেখিয়েছে যেখানে তাদের মালিক পাঞ্জাবীরা ছিল, আর তা না হলে তারা মুক্তিবাহিনী দেখামাত্র পালিয়ে যেতো। তবে অনেক জায়গায় শত্রুর একটা প্লাটুন থাকতো আর একশো-দুশোজন রাজাকার, আল-বদর হতো। জনগণের সাথে শুরু থেকেই যোগাযোগ ছিল। সাড়ে সাত কোটি মানুষের সম্পূর্ন সমর্থন ছিলো। আমার, আমার অধিনায়ক ও মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধাদের সব সময় এমন মনে হতো যে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আমাদের সঙ্গে শ্বাস নিচ্ছে।

প্রশ্নঃ অধিকৃত সময়ে আপনি কি কখনো ঢাকা এসেছিলেন?

জেনারেল ওসমানীঃ ঢাকায় আসিনি। আমি জানি, অনেকে বলেছেন, আমি ঢাকায় এসেছিলাম। সেটা ঠিক নয়। আমি অন্যান্য অঞ্চলে এসেছি ও ঘুরেছি। কিন্তু ঢাকায় আসিনি এবং ঢাকায় আসা ঠিক সম্ভবপর ছিলো না। আরেকটি কথা জনগণের সমর্থনের প্রসঙ্গে আমি বলছি। যোগাযোগ আমাদের সব জায়গায় ছিল সশরীরে- সব জায়গায়, সব শহরে। আপনারা জানেন কি না জানি না, অমুক তারিখে হাজির হতে হবে বলে টিক্কা খান আমাকে যখন সময় দিলেন তখন তার জওয়াব আমি দিয়েছিলাম। সেই জওয়াব টিক্কা খানের কাছে পৌছানো হয়। আমার হাতের লেখা জওয়াব। টিক্কা খানের বাড়ীর দেয়ালে একটি বালক গিয়ে সেই জওয়াবের কাগজ লাগিয়ে দিয়েছিল। পরের দিন সেই কাগজটি নাকি টিক্কা খানকে দেখাবার পর সে বলেছিল-হ্যা, এটি ঐ… এর হাতের লেখা।

জেনারেল ওসমানী সাক্ষাৎকারে প্রবাসী বাঙ্গালী ও প্রবাসী বাঙ্গালীদের মেডিক্যাল সমিতির চিকিৎসা সাহায্য, ভারতীয় সেনাবাহিনীর সামরিক হাসপাতালসমূহের চিকিৎসা ও সেবা কাজের ভূয়সী প্রশংসা করেন। ভারতীয় জনগণের ও সরকারের প্রতিও তার কৃতজ্ঞতার কথা জানান। তিনি বলেন, তাদের অবদানের কথা ভুলবার নয়। ভারতীয় বিএসএফ (বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স) ও সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি তিনি তাঁর আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানান।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৯। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর তৎপরতার আরও বিবরণ

দৈনিক বাংলা

১২ ই ডিসেম্বর ১৯৭২

১৯৭১

 

ডাঃ মোঃ রাজিবুল বারী (পলাশ)

<১০, ২৯, ৫৬৮৫৭০>

 

ছোট ছোট বিমান দিয়েও প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়েছিল

বাংলাদেশের বৈমানিকরা

ক্যাপ্টেন আব্দুস সাত্তার

মে মাসের মাঝামাঝি আমি আগরতলায় মিলিত হই মরহুম ক্যাপ্টেন খালেক, বর্তমান বাংলাদেশ বিমানের ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন ও ক্যাপ্টেন সরফুদ্দিনের সাথে। ক্যাপ্টেন খালেক ছিলেন পিআইএ’র ট্রাইডেন্ট বিমানের একজন কমান্ডার। পিআইএ তে বাঙালিদের অভাব অভিযোগের একজন প্রবক্তা হিসেবেও তিনি সুপরিচিত ছিলেন।

অল্প কয়েকদিনের মধ্যে মধ্যে আগরতলায় আমাদের দলে যোগ দিলেন ক্যাপ্টেন মুকিত। ক্যাপ্টেন মুকিত আদিতে ছিলেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর পাইলট। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পরে তিনি বিমান বাহিনী ছেড়ে পিআইএতে যোগদান করেন। মুকিতের যোগদানের ফলে আমাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেল। তখন থেকে আমাদের একমাত্র ধ্যান ধারণা ও প্রচেষ্টা ছিল কেমন করে একটা ছোট বিমান বাহিনী গড়ে তোলা যায়।

জুলাই মাসের দিকে পাকিস্তান বৃক্ষ বিভাগের পাইলট আকরাম আহমেদ ও ঢাকা ফ্লাইং ক্লাবের সদস্য আহমেদুল আমিন আমাদের সাথে মিলিত হন। আকরাম আহমেদ ও আহমেদুল আমিনের আগরতলা গমনের ২/৩ দিনের মধ্যেই ক্যাপ্টেন খালেক, ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন ও আমাকে ভারতীয় বৈদেশিক দপ্তর দিল্লীতে পাঠালেন। দিল্লীতে আমাদের সর্বাত্নক প্রচেষ্টা ছিল ভারতীয় বিমান বাহিনীর ও বৈদেশিক দফতরের উচ্চপদস্থ অফিসারদের অনুধাবন করানো যে ছোট ছোট দিয়েও কার্যকরী একটা বিমান বাহিনী গড়ে তোলা সম্ভব। বিমান বাহিনী প্রসঙ্গে আমাদের আরও পরিকল্পনা ছিল – ছোট ছোট বিমানে ফ্লোটিংর ডিভাইস সংযোজন করে শত্রু সৈন্যদের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করা ও তাদের শক ঘাঁটির উপর অতর্কিতে আঘাত হানা। আমাদের শক্তির সমর্থন আমরা বায়াফ্রার যুদ্ধে সুইডিশ বৈমানিক কাউন্ট ভনরজেন কর্তৃক রকেট সজ্জিত ছোট বিমানে ভূমিতেই অবস্থানরত ১১খানা নাইজেরিয়ার মিগ-১৯ বিমান ধ্বংস করার ঘটনা দৃষ্টান্তসরূপ উল্লেখ করলাম। দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পরে দিল্লীর উচ্চপদস্থ অফিসাররা আমাদের সাথে একমত হলেন এবং তারা মুজিবনগরস্থ বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে বর্তমান বাংলাদেশ বিনাম বাহিনীর প্রধান এয়ার কমোডর আব্দুল করিম খোন্দকারের সাথে এ বিষয়ে যোগাযোগ স্থাপন করলেন। পরবর্তী পর্যায়ে এয়ার কমোডর খোন্দকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ও নেতৃত্বে জন্মলাভ করল বাংলাদেশ বিমান বাহিনী। ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ তারিখে নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে আমরা বাংলাদেশ এয়ার ফোর্সের জন্ম দিবস পালন করি।

বাংলাদেশ বিনাম বাহিনীতে তখন ের প্রতিষ্ঠাতা এয়ার কমোডর এ কে খন্দকার ছাড়া আরও কয়েকজন বৈমানিক ছিলেন – মরহুম ক্যাপ্টেন খালেক, ক্যাপ্টেন সাত্তার (লেখক), ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন, ক্যাপ্টেন মুকিত, ক্যাপ্টেন আকরাম ও ক্যাপ্টেন সরফুদ্দিন। পাকিস্তান বিমান বাহিনী ছেড়ে যারা এসেছিলেন তারা হলেন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বদরুল আলম। আরও ছিলেন পাকিস্তান বিমান বাহিনী ত্যাগকারী ৬৭ জন এয়ারম্যান। আমাদের বিমান ছিল ডাকোটা অটার ও এলুভেট হেলিকপ্টার।

ডাকোটা বিমানকে পাঁচ হাজার পাউন্ড বোমা বহন করার উপযোগী করা হল এবং পরিচালনার জন্য নির্বাচিত করা হল ক্যাপ্টেন খালেক, ক্যাপ্টেন মুকিত ও আমাকে। অটার বিমানকে সজ্জিত করা হল সর্বাধুনিক রকেট, মেশিনগান ও বোমাবর্ষণের উপযোগী করে।

পরিচালনার জন্য নির্বাচিত করা হল ফ্লাঃ লেঃ শামসুল আলম, ক্যাপ্টেন আকরাম ও মরহুম সরফুদ্দিন। হেলিকপ্টারকে সজ্জিত করা হল রকেট ও ভারী মেশিনগান দ্বারা। পরিচালনার জন্য নির্বাচিত করা হল স্কোঃ লিঃ সুলতান মাহমুদ, ফ্লাঃ লেঃ বদরুল আলম এবং ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিনকে।

অতঃপর অক্টোবর মাসের প্রথম তারিখ থেকে এয়ার কমোডর খোন্দকার সাহেবের নেতৃত্বে আমাদের ব্যাপক প্রশিক্ষণ, অনুশীলন ও মহড়া শুরু হল। নাগাল্যান্ড, মনিপুর, অরুণাচল, ত্রিপুরা ও আসামের জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ী এলাকার কোন প্রকার পথ নির্ধারক ব্যাতিরেকে শুধুমাত্র কম্পাসের উপর নির্ভর করে রাত্রির পর রাত্রি আমরা অত্যন্ত নিচু দিয়ে উড্ডয়নের কৌশল আয়ত্ত করার অনুশীলন করতাম। শত্রুর রাডারকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন হয় অত্যন্ত নিচু দিয়ে বিমান চালনা করা এবং সত্যিকারের অভযানকালে যাতে শত্রুর দৃষ্টিগোচর না হতে হয় সেজন্য প্রয়োজন ছিল রাত্রিতে সঠিক পথে বিমান চালনার অভ্যাস করা। রাত্রিবেলায় নিচু দিয়ে বিমান চালনা এবং প্রদীপবিহীন রানওয়েতে অবতরণের প্রক্রিয়া আয়ত্ত করার চেষ্টা ছাড়াও বিমান আক্রমণের অন্যন্য পদ্ধতিও আমরা নিয়মিত অভ্যাস করতাম। এয়ার কমোডর খোন্দকার সাহেবের তত্ত্বাবধানে আমাদের অনুশীলন যে কত নিখুঁতভাবে পরিচালিত হয়েছিল তাঁর প্রমাণ পাওয়া যায় ৩রা ডিসেম্বর থেকে ১৬ই  ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন রণাঙ্গনে বিমান আক্রমণে আমাদের দারুণ সফলতার মধ্য দিয়ে। পরিকল্পনামাফিক ঠিকমত আক্রমণ পরিচালনা করতে পারলে ছোট ছোট বিমানও যে অত্যাধুনিক জঙ্গি বিমানের সমকক্ষ হতে পারে তা আমাদের বৈমানিকগণ দুনিয়াবাসীকে দেখিয়ে দিয়েছেন। আমাদের বৈমানিকদের দক্ষতা দেখে ভারতীয় বিমান বাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসাররা বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছেন।

আমাদের দক্ষতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্তঃ ৩রা ডিসেম্বর মধ্যরাত্রিতে স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ ও ফ্লাঃ লেঃ বদরুল আলম নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে পাকিস্তানী বিমান জ্বালানী ঘাঁটির উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। ফ্লাঃ লেঃ শামসুল আলম ও ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ ঐ একই সময়ে চট্টগ্রামে এক ব্যাপক বিমান আক্রমণ পরিচালনা করেন। চট্টগ্রামের অভিযানের পরে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্যাপ্টেন আকরাম মরহুম সরফুদ্দিনকে নিয়ে ১২ বারেরও বেশী বিভিন্ন রণাঙ্গনে পাক দুশমনদের শক্ত ঘাঁটি ও কনভয়ের উপর আক্রমণ পরিচালনা করে তাদের প্রভূত ক্ষতিসাধন করে। আমার মনে আছে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ডাকোটা, অটার অ হেলিকপ্টার এই তিন গ্রুপের মধ্যে একটি বিষয়েই প্রতিযোগিতার মনোভাব ছিল, তা হল কোন গ্রুপ কত বেশী বিপজ্জনক অভিযানের দায়িত্ব লাভ করতে পারে। এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখ করব। ডাকোটা বিমান নিয়ে বাংলাদেশের একটি বিশেষ গুরুত্তপূর্ণ স্থানে বোমা বর্ষণের জন্য একটি দিন স্থির করা হয়। অভিযানটি ছিল ভয়ানক বিপদসংকুল। কিন্তু নির্দিস্ট দিনের মাত্র ১ দিন পূর্বে যখন বিশেষ কারণে এই অভিযান পরিকল্পনা বাতিল হয়ে গেল তখন ক্যাপ্টেন খালেক ও ক্যাপ্টেন মুকিত অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে যান।

বিমান আক্রমণ পরিচালনাকালে আমদের বৈমানিকগণকে অনেকবার মারাত্মক বিপদের মুখোমুখি হতে হয়। যেমন ৭ই ডিসেম্বর পরিকল্পনা অনুযায়ী সিলেট শহর শত্রুমুক্ত হয়েছে কিনা জানার জন্য ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন হেলিকপ্টার যোগে সিলেট বিমান বন্দরে অবতরণ করতে যান। সিলেট শহর তখনো শত্রুমুক্ত হয়নি। তাই অবতরণকালে হেলিকপ্টারটি আক্রান্ত হয়। মেশিনগানের বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি হেলিকপ্টারটিকে বিদ্ধ করে কিন্তু ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন সফলতার সাথে কইলাশহর বিমান ঘাঁটিতে ফিরে যান। আবার ১০ই ডিসেম্বর সিলেটের অগ্রবর্তী এলাকা পরিদর্শনকালে ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিনের হেলিকপ্টারের টেইল রোটার ভূমি থেকে নিক্ষিপ্ত গুলির আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে ভারসাম্য যদিও ব্যাহত হচ্ছিল তবু এবারেও ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আশ্চর্য পারদর্শিতার সাথে ঘাঁটিতে ফিরে গিয়ে নিরাপদে অবতরণ করেন।

আর একদিনের ঘটনা ফ্লাঃ লেঃ বদরুল আলম ও ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন কুমিল্লা এলাকায় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীকে এয়ার সাপোর্ট দিতে থাকাকালে তাদের হেলিকপ্টারের জ্বালানি ফুরিয়ে যায়। বাধ্য হয়ে তারা কুমিল্লা বিমান বন্দরে জরুরী অবতরণ করেন। ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট তখনো শত্রু কবলিত। সেখান থেকে শত্রু হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে মর্টার ও ভারী কামানের গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এত বিপদের মাঝেও স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় বদরুল আলম এবং শাহাবুদ্দিন বিমানের জ্বালানী সংগ্রহ করে নিরাপদে ফিরে আসেন। এমনি আরও বহুতর বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছিল আমাদের এই ছোট্ট এয়ারফোর্সের প্রত্যেকটি বৈমানিককে কিন্তু তাই বলে দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য নিবেদিতপ্রাণ এইসকল বৈমানিকের কেউই কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হননি।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!