You dont have javascript enabled! Please enable it! বিভিন্ন যুদ্ধের বর্ননা ০৮ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সূত্র                           তারিখ
১১। ৬ নং সেক্টরের যুদ্ধ বর্ননা ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক কথা বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র জুন-ডিসেম্বর, ১৯৭১

সাক্ষাতকার এয়ার ভাইস মার্শাল এম কে বাশার*
১৫-৫-১৯৭৩

১৪ই মে আমরা কুমিল্লা হয়ে সোনামুড়ার নিকটবর্তী শিবের বাজারে রাত্রিযাপন করি। স্থানীয় জনসাধারণ আমাদের যথেষ্ট আদর-যত্ন করে এবং তারাই পরের দিন আমাদেরকে সোনামুড়ায় পৌছায়। সোনামুড়া বি-এস-এফ ক্যাম্পে আমরা নিজেদেরকে ব্যাবসায়ী বলে পরিচয় দেই। সেখানে ইষ্ট বেঙ্গল রিজিমেন্টের একজন অফিসার মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুট করেছিলেন। আমরা তার কাছে গিয়ে নিজেদের পরিচয় দেই। আমার সাথে ছিলেন তৎকালীন গ্রুপ ক্যাপ্টেন খোন্দকার, স্কোয়াড্রন লিডার সদরুদ্দীন, ফ্লাইট লেঃ বদরুল আলম, ফ্লাইট লেঃ কাদের, এক্স ফ্লাইট লেঃ রেজা। এখান থেকে আমাদেরকে মুজিবনগরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জেনারেল ওসমানী আমাদের সাক্ষাৎকার গ্রহন করেন। আমরা ওনাকে বিমান বাহিনী গঠন করার প্রস্তাব করেছিলাম। কিন্তু সে সময় এটা সম্ভব ছিল না। তারপর আমরা স্থলযুদ্ধে সংকল্প জানালাম। সেখানে আমাকে ৬নং সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

৬নং সেক্টরে রংপুরে একটা মুক্তিবাহিনী মেজর নওয়াজেশের অধীনে ভূরুংগামারীর কাছে সংগব্ধ হয়েছিল এবং আর একটা বাহিনী দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁও হয়ে মেজর নাজমুলের অধীনে ভজনপুরে নদীর উপরে একটা পুল উড়িয়ে নদীর উত্তর পারে প্রতিরক্ষাবুহ্য তৈরি করে। দুটো জায়গাই বাংলাদেশের ভিতর ছিল এবং এখান থেকে কখনো আমরা পিছু হটিনি, বরং এগিয়ে গিয়েছিলাম। মেজর নওয়াজেশের একটা দল সুবেদার বোরহান উদ্দীনের (ই-পি-আর) নেতৃত্বে রংপুরের রুহুমারী এলাকায় প্রতিরক্ষা বুহ্য তৈরি করে এবং এ যায়গা বাংলাদেশের স্বাধীনতাপ্রাপ্তি পর্যন্ত মুক্ত ছিল। এলাকা পরিবর্তন কালে ১১ নং সেক্টরকে দিয়ে দেওয়া হয়।

রংপুরে পাটগ্রাম থানাও মুক্ত এলাকা ছিল। এখানেও মেজর নওয়াজেশের একটা দল প্রতিরক্ষা বুহ্য তৈরি করেছিল। মেজর নওয়াজেশ এবং মেজর নাজমুলের দুটো বাহিনী (ই-পি-আর আনসার, মোজাহেদ, পুলিশ, ছাত্র, শ্রমিক, ড্রাইভার) মিলিয়ে ৭০০ জন ছিল। অস্ত্র বলতে ছিল শুধু রাইফেল সামান্য ক’টা, এল-এম-জি, মর্টার এবং একটা মেশিনগান। গোলাবারুদও খুব কম ছিল।

আমার দুটো সমস্যা ছিল। প্রথমত আমি বাহিনীর অফিসার-ঐ এলাকায় সৈনিক, অফিসার এবং জনগণ আমাকে ঠিকভাবে গ্রহন করবে কিনা সে প্রশ্ন, এবং দ্বিতীয়ত: সৈনিকদের সংঘবদ্ধ করা এবং সংগঠিত করা। আমাদের অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদও কম ছিল। কিভাবে আরোও বেশি অস্ত্র সংগ্রহ করতে হবে সেটাও একটা প্রধান সমস্যা ছিল। ভারত থেকে কিভাবে অস্ত্রশস্ত্র-গোলাবারুদ সংগ্রহ করতে হবে সেটাও একটা সমস্যা। রিক্রুটমেন্ট এবং ট্রেনিং সমস্যা ছিল। তাছাড়া হাসপাতালও ছিল না, ঔষধপত্র ও ডাক্তারের অভাব ছিল। রেশন আমরা ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী থেকে পেতাম কিন্তু খাদ্য সরবরাহ নিয়মিত ছিল না। যে সমস্ত মুক্তিযোদ্ধা তাদের পরিবার নিয়ে এসেছিল তাদেরকে রেশন সরবরাহ করা কষ্টকর ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের কোন পোশাক ছিল না। লুঙ্গী এবং গেঞ্জি পরেই তারা যুদ্ধ করছিল। তাদের কোন বিছানাপত্র ছিল না। তাদেরকে খোলা মাঠে থাকতে হত। টাকা-পয়সারও যথেষ্ট অভাব ছিল।

এখানে বলে রাখা ভাল যে, যে সমস্ত টাকা-পয়সা ঠাকুরগাঁও এবং কুড়িগ্রাম ব্যাংক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা নিয়ে এসেছিল সে সমস্ত টাকা সীলমোহর করা ব্যাংকে মুজিবনগরে বাংলাদেশের সরকারের কাছে অর্পণ করা হয়েছিল। সে টাকা কিভাবে খরচ করা হবে তা বলতে পারছি না। তখন পর্যন্ত ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীতে শরণার্থী শিবির থেকে নিয়োগ করতো এবং ট্রেনিং দিচ্ছিল। শরণার্থী শিবিরগুলোতে অধিকাংশ হিন্দু ছিল। তারা তাদেরকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে ট্রেনিং-এর জন্য পাঠাত। এ ব্যাপারে আমাদের কোন কতৃত্ব ছিল না। কিন্তু সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব গ্রহন করার পর আমি এ ব্যাপারে ওদের সাথে আলাপ-আলচনা করি এবং তাদেরকে বলি যে রিক্রুটমেন্ট আমরা করব। আপনারা আমাদেরকে অস্ত্রশস্ত্র এবং ট্রেনিং এর ব্যাবস্থা করবেন। অপরেশনে পাঠানোর দায়িত্ব আমাদের থাকবে। অনেক বাকবিতণ্ডার পর ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সম্মত করা হয়। সৌভাগ্যবশত ভারতে আমাদের যে ট্রেনিং ক্যাম্প ছিল (মূর্তি টি এষ্টেট) সেখানকার কমান্ডার লে: কর্নেল সেনগুপ্ত ছিলেন একজন বাংগালী হিন্দু। তিনি আমাদেরকে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। ব্রিগেডিয়ার জোসীও আমাদেরকে যথেষ্ট সাহায্য এবং সহানুভূতি দেখিয়েছেন।

সেনগুপ্ত ট্রেনিং এর চার্জে ছিলেন। সীমান্ত এলাকায়, যারা বাংলাদেশের ভেতর থেকে ট্রেনিং-এর জন্য আসত তাদেরকে প্রথমে হোল্ডিং ক্যাম্পে রাখা হত, তারপর কেন্দ্রীয় একটা ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে ৩ সপ্তাহের গেরিলা ট্রেনিং দেওয়া হতো। পরে এদেরকে আমার কাছে পাঠানো হতো বিভিন্ন অপরশনে পাঠানোর জন্য। এবং আমার মনে হয় সমস্ত সেক্টরে এই নিয়ম অনুসরণ করা হয়েছিল।

তিন সপ্তাহের ট্রেনিং যথেষ্ট ছিল না। তাই ঠিক করা হয়েছিল গেরিলাদের নিয়মিত বাহিনীর সাথে আরোও ১৫ দিন রাখার এবং যুদ্ধের কলাকৌশল সম্পর্কে ট্রেনিং দেয়ার। এ সময়ের মধ্যে আমরা কাকে কোন দলের নেতৃত্ব দেয়া যায় তা ঠিক করতে পারতাম। তারপর বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় ছেলেদের বিভিন্ন দলে ভাগ করে ভিতরে পাঠিয়ে দেওয়া হতো শত্রুর অবস্থানের কাছে গিয়ে রেকি করার জন্য। তারপর তাদেরকে অপারেশন চালানোর নির্দেশ দেওয়া হতো।

শত্রুর অবস্থানের আশেপাশে আমাদের গেরিলা বেইসগুলো ছিল। আমার সেক্টরে প্রায় ১২০টার মতো গেরিলা বেইস ছিল। প্রতেকটি গেরিলা বেইস থেকে কুরিয়াররা প্রতি সপ্তাহে এসে আমাদের কাছে অপরেশনের খবর এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিভিন্ন খবর দিয়ে যেত। কোন কোন সময় নিয়মিত বাহিনী নিয়েও শত্রুর অবস্থানগুলোতে আক্রমণ চালাতে হত। ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে আমরা গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্য নিতাম।

মেজর নওয়াজেশ সাব-সেক্টর কমান্ডার (রংপুর) ছিলেন-ভুরুংগামারী থেকে পাটগ্রাম পর্যন্ত। ক্যাপ্টেন দেলোয়ার ছিলেন মোগলহাটে। ক্যাপ্টেন মতিউর ছিলেন বাউরাতে। চিলাহাটিতে ছিলেন ফ্লাইট লে: ইকবাল। ক্যাপ্টেন নজরুল ছিলেন হলদীবাড়িতে। সুবেদার মেজর ওসমান গনি (ই-পি-আর), স্কোয়াড্রন লিডার সদরুদ্দীন-ইনডাকশন ট্রেনিং শেষ হবার পর বিভিন্ন অপরেশনে পাঠানো এদের দায়িত্ব ছিল।

দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমার অমরখান নামক জাইগায় আমাদের প্রতিরক্ষা বুহ্য ছিল। রংপুর জেলার বড়খাতায় আমাদের প্রতিরক্ষা বুহ্য ছিল। ভুরংগামীর নিকটে আমাদের আরেকটা প্রতিরক্ষা বুহ্য ছিল। এখানে মেজর নওয়াজেশ ছিলেন। বড়খাতায় ছিলেন ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান। অমরখানে ছিলেন ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার। আমাদের সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছিল পাটগ্রামের কাছে বুড়িমারী নামক জায়গায় (বাংলাদেশের অভ্যস্তরে)। আমাদের নিয়মিত বাহিনী নিতান্ত নগণ্য ছিল, সুতরাং আমাদেরকে হ্যারাসিং, ফায়ার, রেইড, এমবুশ, মাইন পুঁতে রাখা এগুলোর উপর জোর দিতে হয়েছিল।

প্রধান আক্রমণ যে সমস্ত জায়গায় চালানো হয়েছিল সেগুলো হল: ভূরুংগামারী (রংপুর), মোগলহাট (রংপুর), অমরখান (দিনাজপুর), বড়খাতা (তেঁতুলিয়া) এবং পাটগ্রাম। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারবর্গের থাকার জন্য দুটো ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছিল। আমাদের পুরো সেক্টরের জন্য দুজন এমবিবিএস ডাক্তার ছিলেন। তেঁতুলিয়াতে ৫০ বেডের একটা হাসপাতালের দায়িত্বে ছিলেন। বুড়িমারীতে ২৫ বেডের একটা হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছিল। ক্যাপ্টেন হোসেন এখানে ছিলেন। দুজন ছাত্র ফন্টে ছিল। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম এদের কাছে পাঠানো হত। এরা ছোটখাটো অস্ত্রপচার করত এবং প্রাথমিক চিকিৎসার পর হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হত। রংপুর কলেজের কয়েকজন ছাত্রী হাসপাতালে নার্সিং ডিউটি করার জন্য তাদের ভলান্টিয়ার করে। মারাত্তকভাবে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের বাগডোগরা কম্বাইন্ড মিলিটারি হাসপাতালে এবং জলপাইগুড়ি বেসামরিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। ঔষধপত্র যন্ত্রপাতি ভারতীয় সামরিক বাহিনী থেকে পাওয়া গিয়েছিল। বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সুত্রে যোগাড় করেছিলেন। স্থানীয় ভারতীয়রাও সাহায্য করেছিলন। জুলাই-আগষ্ট থেকে খাদ্যদ্রব্য, কাপড়চোপড়, ঔষধপত্র, অস্ত্রশস্ত্র সরবাহ আগে থেকে নিয়মিত ছিল। যদিও পর্যাপ্ত পরিমানে ছিল না, তবুও মুক্তিযুদ্ধের গতি বৃদ্ধি পেতে থাকল। ট্রেনিং ক্যাম্প থেকেই ট্রেনিং প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা নিয়মিতভাবে আসতে থাকল। এই সময় বিভিন্ন সেক্টরে অফিসারদের সল্পতা দেখা দিয়েছিল। বাংলাদেশ সরকার মূর্তিতে অফিসারদের ট্রেনিং এর জন্য ক্যাম্প স্থাপন করেন। এখানে প্রথম ব্যাচে প্রায় ৬৪ জন অফিসার ট্রেনিংপ্রাপ্ত হন। এখানে পাসিং আউট প্যারেডে সালাম গ্রহন করেছিলেন তৎকালীন অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম। অতিথিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কর্নেল ওসমানী, প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ। এই পাসিং আউট প্যারেডের খবর পাকিস্তানে গোয়েন্দা বাহিনীর মাধ্যমে চলে গিয়েছিল।

এই সময় বাংলাদেশের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ আমার সেক্টরে পরিদর্শনে গিয়েছিলেন, এবং চারদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আমাদের অবস্থান ঘুরে ঘুরে দেখেন। তিনি তেঁতুলিয়া, ভজনপুর, পাটগ্রামে জনসভায়ও ভাষণ দিয়েছিলেন এবং বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। জনাব কামরুজ্জামান যখন আমাদের সেক্টর পরদর্শনে তখন তিনি তার মন্ত্রণালয় পটগ্রামে স্থানান্তরিত করার সিধ্যান্ত নিয়েছিলেন। সমস্ত সেক্টরে নিয়মিত বাহিনীর লোকেরা ৭৫ টাকা করে মাসিক পকেট খরচ এবং খাদ্য, কাপড়-চোপড় পেতো। অফিসাররা ২০০ টাকা করে পেতো এবং গোরিলারা পেত ৫০ টাকা করে পকেট খরচ এবং ফ্রি রেশন এবং অথবা দু’টাকা করে প্রত্যহ রেশন মানি।

অমরখানাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্তিশালী ঘাটি ছিল- তাদের ফ্রন্টিয়ার ফোর্স এবং মিলিশিয়া বাহিনী মিলে প্রায় দুই কোম্পানি সৈন্য ছিল। জুলাই মাসে টাস্ক ফোর্স দুই কোম্পানি এবং এক কোম্পানি ফ্রিডম ফাইটার নিয়ে শত্রুঘাঁটি আক্রমণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। শত্রুবাহিনীর পেছনে গোরিলাদের অনুপ্রবেশ করানো হয় ক্যাপ্টেন শাহরিয়ারের নেতৃত্বে। দুই কোম্পানি ই-পি-আর সৈনিকদের সাহায্য প্রধান আক্রমণ চালানো হয়। এই আক্রমনে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীরও সাহায্য নেয়া হয়েছিল। যদিও শত্রুঘাটি আমরা দখল করতে সক্ষম হয়েছিলাম কিন্তু পাকিস্তানী গোলন্দাজ বাহিনীর আক্রমনের ফলে আমাদেরকে ঐ স্থান ত্যাগ করতে হয়।

এই ব্যর্থতা থেকে আমরা কতোগুলো শিক্ষা গ্রহন করেছিলাম। আক্রমনের পূর্বে শত্রুবাহিনীর শক্তি সম্পর্কে জানতে হবে। রেডিও বা অয়ারলেসে যোগাযোগের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে। আর যদি পুর্বাহ্নেই পাকিস্তান গোলন্দাজ বাহিনীর অবস্থান জানতে পারতাম তাহলে ঐ অবস্থানের উপর সেলিং করা যেত।

ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের নেতৃত্বে ই-পি-আর এবং আনসার, মুজাহিদ, ছাত্র নিয়ে বড়খাতায় (রংপুর) জুলাই মাসে অপারেশন চালানো হয়। এখানে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্য নেয়া হয়েছিল। অবশ্য এই আক্রমনে আমরা সফলতা অর্জন করতে পারিনি। আমাদের পক্ষে অনেকেই হতাহত হয়। আমাদের সৈন্যদের ভালো প্রশিক্ষণ ছিল না। ভারী অস্ত্রশস্ত্র ছিল না। এই সমস্ত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে আমাদের সৈন্যদের সুশিক্ষিত এবং সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়েছে।

প্রাথমিক পর্যায়ে বিভিন্ন অপারেশনে আমাদের ব্যর্থতা আমাদেরকে অনেক শিক্ষা দিয়েছিল। আমাদের নিজেদের দোষক্রুটি শোধরাতে পেরেছিলাম। যার ফলে বিভিন্ন আক্রমণে আমরা সফলতা অর্জন করতে পেরেছিলাম।

অক্টোবর মাস থেকেই আমাদের বিজয় শুরু হয়। অক্টোবর মাসে বড়খাতা ভুরংগামারী অমরখানা দখল করতে সমর্থ হই।

মেজর নওয়াজিশের নেতৃত্বে তিন কোম্পানির সৈন্য ভূরুংগামারীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করা হয় (জুলাই-আগষ্ট মাসে)। এর আগে ভূরুংগামারীতে রেইড, এম্বুশ ইত্যাদি চালিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। কিন্তু এই আক্রমণে আমরা সফলতা অর্জন করতে পারিনি।

এই তিনটি বৃহৎ আক্রমণের ফলে শত্রুবাহিনী বুঝতে পারে যে মুক্তিযোদ্ধারা যে কোন বড় আক্রমণ করতে পারে। তাই তারা আরোও সৈন্য এবং অস্ত্রশস্ত্র আনতে শুরু করে। এমবুশ রেইড এতে আরোও বেড়ে যায়। এইসব আক্রমণের ফলে আমরা বুঝতে পারি সৈন্যসংখা বৃদ্ধি করতে হবে। অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ সংগ্রহ করতে হবে।

অক্টোবরের মাঝামাঝি ভূরুংগামারীর উপর আবার আক্রমণ চালানো হয় মেজর নওয়াজেশের নেতৃত্বে। তিন কোম্পানি সৈন্য দিয়ে এই আক্রমণ চালানো হয়েছিল। ১৮ ঘন্টা প্রচণ্ড যুদ্ধের পর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ভূরুংগামারী ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। এই আক্রমণে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্য নেয়া হয়েছিল। এই যুদ্ধে আমাদের পক্ষে অনেকেই হতাহত হয়। শত্রুবাহিনীকে আমরা পিছু ধাওয়া করি। শত্রুবাহিনীর সাথে আবার যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে লেফটেন্যান্ট সামাদসহ অনেকই শহীদ হন। লেফটেন্যান্ট সামাদের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। জয়মনিরহাটে মসজিদের সামনে তাকে সমাহিত করা হয়। জয়মনিরহাটকে সামাদনগর নামকরণ করা হয়। সামাদের মৃতদেহ উদ্ধার করতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা দু’ভাই মৃত্যুবরণ করেন। এদেরকেও সামাদের সাথে সমাহিত করা হয়।

ভূরুংগামারীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোম্পানি-হেডকোয়ার্টার ছিল। ঐ বিল্ডিং এর এক কক্ষে ১৫ জন যুবতীকে বন্দি অবস্থায় পাওয়া যায়। কাছাকাছি এক স্কুলের বিল্ডিংএ নারী, পুরুষ, ছেলেমেয়ে, প্রায় ২০০ জনকে বন্দী অবস্থায় পাওয়া যায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের জোর করে খাটিয়ে নিত। অনেককে ভোগের সামগ্রী হিসাবে ব্যাবহার করা হয়েছিল।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অনেকের মৃতদেহ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। ভূরুংগামারীর আশেপাশের সমস্ত বাড়িঘর সম্পূর্ণরূপে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। চাষাবাদ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ ছিল। জনমানবের কোন চিহ্নই পাওয়া যায় নাই। চারিদিকে শুধু ধ্বংসের চিহ্ন। সমস্ত এলাকা একটা ভুতুড়ে বাড়ির মত মনে হচ্ছিল। ভূরুংগামারীতে বাস্কারের মধ্যে অনেক যুবতীর লাশ পাওয়া যায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাস্কারের মধ্যে এসব মেয়েদের উপর পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছিল।

এর পরপরই অমরখানা এবং বড়খাতাতে আক্রমণ চালানো হয়। দুই জায়গা থেকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। বড়খাতার পতনের পর পাক সেনাবাহিনীর মনোবল একেবারে ভেংগে যায়। তাদের বিভিন্ন ঘাঁটির দ্রুত পতন ঘটতে থাকে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মনোবল পুরাপুরি ভেংগে গিয়েছিল। অমরখানা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা পচাঁগড়, বোদা দখল করে ঠাকুরগাঁও দিকে অগ্রসর হয়। এ দলটার নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার ও স্কোয়াড্রন লিডার সদরুদ্দীন। দলটি হাতিবান্ধা আক্রমণ করেছিল। হাতিবান্ধা পতনের পর তার ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের নেতৃত্বে লালমনিরহাটের দিকে অগ্রসর হয়।

ভূরুংগামারী পতনের পর মেজর নওয়াজিশের এই বাহিনীটি নাগেশ্বরী দখল করে এবং ধরলা নদীর উত্তর পাশে পৌঁছায়।

এ ছাড়াও আরোও দুটি গেরিলা বাহিনীর দুটো কলাম ফ্লাইট লেঃ ইকবালের নেতৃত্ব চিলাহাটি দিয়ে ডোমার, ডিমলা এগুলো দখল করে নীলফামারীর দিকে অগ্রসর হয়। মোগণহাট থেকে আর একটি কলাম ক্যাপ্টেন দেলোয়ারের নেতৃত্বে লালমনিরহাটের দিকে অগ্রসর হয়।

রংপুর, সৈয়দপুর সেনানিবাস ছাড়াও ৬ নং সেক্টরের সমস্ত এলাকা ১৬ই ডিসেম্বরের আগে মুক্ত হয়।

স্বাঃ খাদেমুল বাশার

১৫-৫-১৯৭৩

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১২। ৬ নং সেক্টরের যুদ্ধ সম্পর্কে অন্যান্যের প্রদত্ত বিবরণ ও তথ্যাদি

বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র

 

১৯৭১

নীলাঞ্জনা অদিতি               

<১০, ১২., ৩০৩৩০৯>       

সাক্ষাৎকারঃ লেঃ কর্নেল দেলোয়ার হোসেন

১৬- ১০- ১৯৭৪

২২ শে আগস্ট আমাকে ৬ নং সেক্টরে (রংপুর- দিনাজপুর) ক্যাপ্টেন আজিজ পাশাকে ২ নং সেক্টরে এবং ক্যাপ্টেন শাহজাহানকে নয় নং সেক্টরে পোস্টিং দেয়া হয়। ২৩ শে আগস্ট রাতে আমি শিলিগুড়ি পৌছি এবং প্রথমে ৬ নং সেক্টরে কর্তব্যরত ক্যাপ্টেন নাজমুল হকের (বর্তমানে মেজর)  সাথে দেখা করি।

বাংলাদেশের মুক্ত এলাকায় এসে নিজেকে গৌরবান্বিত করি। আমার এত আনন্দ হয়েছিল যা আজ আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। শীঘ্রই আমি ৬ নং সেক্টরে কর্তব্যরত স্কোয়াড্রন লিডার সদরুদ্দিনের সাথে দেখা করি। এরপর আমি আমাদের সাহায্যে নিয়োজিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসারদের সাথে সাক্ষাৎ করি। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম কবে আমি অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে যাব এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাব। যদিও আমার রংপুর ও দিনাজপুর এলাকা সম্বন্ধে ধারণা খুব কম ছিল তবুও দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। এই সময় আমি শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রথম অপারেশন শুরু করি। আমি শত্রুদের বিরুদ্ধে আক্রমন চালিয়ে তাদের ৫ জন কে নিহত ও ১২ জন কে আহত করি। আমার সাথে যারা ছিল তারা সবাই নতুন শিক্ষাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের ১ জন সামান্য আহত হয়। আমরা হালকা মেশিনগান এস এম জি ৩০৩ রাইফেল ও ২ ইঞ্চি মর্টারের সাহায্যে শত্রুদের বিরুদ্ধে আক্রমন চালিয়েছিলাম। আমাদের ডিফেন্স পজিশন থেকে ৩ ইঞ্চি মর্টারের সাহায্য দেয়া হয়।

অমরখানা সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন শাহরিয়ারের শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা আমি জীবনে ভুলতে পারব না। তার মত সাহসী যোদ্ধার কথা ইতিহাসে লেখা থাকবে বলে আমি মনে করি। ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার শত্রুদের  যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করেছিল। পাকসেনাদের কাছে সে ভীতির কারন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাকে একটানা কয়েকদিন ও রাত না ঘুমিয়ে থাকতে দেখেছি। ৬ নং সেক্টরের অফিসারদের তার মত এত কৃতিত্বের দাবীদার আর কেউ নয়। আমি ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার কে কোন সময়ে বিমর্ষ দেখিনি। দেশপ্রেমিক ও প্রকৃত যোদ্ধার মত তিনি শত্রুদের মোকাবিলা করেছিলেন।

৬ নং সেক্টরের উইং কমান্ডার মিঃ বাশারের (বর্তমান গ্রুপ ক্যাপ্টেন) সাথে আমার তখনো পরিচয় হয়নি। একদিন তিনি আমাকে তাঁর সাথে দেখা করার জন্য বলে পাঠালেন। আমি তাঁর নির্দেশ মত দেখা করি। একজন এয়ার ফোর্সের অফিসার হউয়া সত্বেও তিনি ৬ নং সেক্টরে যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন তা যেকন দক্ষ পদাতিক অফিসারের সাথে তুলনা করা চলে। তিনি নিপুণতার সাথে ৬ নং সেক্টর পরিচালনা করেন। দদীর্ঘ ৯ মাস তিনি সুদক্ষ ভাবে শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছেন। ৬ নং সেক্টর রংপুর – দিনাজপুর জেলা নিয়ে গঠিত। অনেক সময় তিনি আমাকে যথাযথ নির্দেশ দিয়ে অপারেশনে বহু সাহায্য করেছেন।

আমাদের সেক্টর ৬ এর সদর দফতর বুড়িমারিতে স্থাপন করা হয়। বাংলাদেশের অন্যান্য সেক্টরগুলির তুলনায় একমাত্র আমাদের সেক্টরেই বহু  মুক্ত এলাকা ছিল। আমাদের সেক্টর সদর দপ্তর ও সাব সেক্টর দপ্তর বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই স্থাপন করা হয়েছিল। ক্যাপ্টেন নওয়াজেশের (বর্তমান মেজর) উপর ন্যস্ত ছিল সাহেবগঞ্জ সাব সেক্টর। তাঁর নিয়ন্ত্রণে কিছু নিয়মিত ও ই পি আর বাহিনীর সৈন্য ছিল। সাহেবগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ অনেক আগেই শত্রুদের হাত থেকে মুক্ত করেছিলেন। পাটগ্রাম সাব সেক্টর পরিচালনার ভার ছিল ক্যাপ্তেন মতিয়ুর রহমানের উপর। তিনি অনেক স্থান শত্রুমুক্ত করে রেখেছিলেন। দিনাজপুরের তেঁতুলিয়া সাব সেক্টর পরিচালনার ভার ছিল স্কোয়াড্রন লিডার সদরুদ্দিনের (বর্তমান উইং কমান্ডার) উপর। এখানেও অনেক এলাকা মুক্ত ছিল।

মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য সেক্টর ৬ এর বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প করা হয়েছিল। ঠাকুরবাড়ি কোটগাছ হিমকুমারী শীতলকুচি গিতলদহ সোনাহাট প্রভৃতি স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল। সেই সময়ে সামরিক অফিসারের অভাবে ঠাকুরবাড়ি এবং কোটগাছ ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ  দেয়া যাচ্ছিল না। সেক্টর কমান্ডার বাশার আমাকে মুক্তিযোদ্ধাদের ঠাকুরবাড়ি ও কোটগাছ ক্যাম্প পরিচালনার ভার দেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিতে নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশ মত ঠাকুরবাড়ি ও কোটগাছ ক্যাম্প এ মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিতে থাকি। শত শত শিক্ষিত ও অশিক্ষিত যুবককে সামরিক ট্রেনিং দিতে থাকি। এরা প্রায় সকলেই সামরিক ট্রেনিং এ অনভিজ্ঞ ছিল। সহজেই বুঝতে পারা যায় যে অনভিজ্ঞ যুবকদের কত কষ্টে সামরিক শিক্ষা দিতে হয়েছে। কিন্তু আমার অধীনে শিক্ষা প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক ট্রেনিং ও জ্ঞান অর্জনে যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। তারা কোন দিন কোন অসুবিধার কথা আমাকে জানায়নি। তাদের যাকে যা কাজ দেয়া হত তারা তা ভালভাবেই সম্পন্ন বা কর্তব্য পালন করবার চেষ্টা করত। মুক্তিযোদ্ধাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠিয়ে দেয়া হত। সেই জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের কোম্পানী প্লাটুন ও সেকশনে ভাগ করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের ভিতরে পাঠাবার পূর্বে সেই স্থান ভালভাবে রেকী করা হত এবং আমি নিজেই অনেক স্থান রেকি করে তাদের পাঠিয়েছি।

প্রথমে আমি  যে সব এলাকায়  মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রবেশ করাই সে এলাকাগুলো হল দিনাজপুর জেলার বালিয়াডাঙ্গি রুহিয়া লেহেরী ও আটাওয়ারী। এসব এলাকায় আমিই রেকী পরিচালনা করেছিলাম। রেকী করা কালে অনেক সময় ইপিকাফ রাজাকার এবং পাকিস্তানী রেঞ্জারদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলাম। এই রকম একটি ঘটনা ঘটে ৫ ই সেপ্টেম্বরে। রেকী করার জন্য যাই। আমার সাথে ১২ / ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিল, আর সঙ্গে ২ টা এল এম জি, একটি ২ ইঞ্চি মর্টার, স্টেনগান ও ৩০৩ রাইফেল ছিল। একটি স্কুলে পাকসেনাদের শক্তিশালী প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল। সেখানে পাকসেনাদের ২ টা প্লাটুন ছাড়াও ইপিকাফ ও বিহারী রাজাকার ও ছিল। আমাদের রেকী করার খবর কিছু দালাল পাকসেনাদের জানায়। আমি সাধারণত গেরিলা যুদ্ধ চালাতাম। শত্রুদের অকস্মাৎ আক্রমন করে দ্রুত  সরে পরাই আমাদের লক্ষ্য ছিল। শত্রুরা আমাদের উপর আক্রমন শুরু করে দেয়। তিন ঘন্টা ধরে যুদ্ধ চলার পর আমি আমার দল নিয়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হই। এ যুদ্ধে আমার ২ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়। এই ঘটনার পর আমি মুক্তিযোদ্ধাদের বাংলাদেশের ভিতরে অনুপ্রবেশ করানোর জন্য সীমান্তের নিকটবর্তী কয়েক স্থানে বেইস স্থাপন করি। পরে এই স্থানগুলি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রবেশ করানো হয়। ৫০০ মুক্তিযোদ্ধাকে প্রতিষ্ঠিত বেইস দিয়ে ঠাকুরগাঁও রানীসংকৈল বোদা পচাগর ইত্যাদি স্থানে পাঠান হয়। এইভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের ভিতরে অনুপ্রবেশের ব্যবস্থা সম্পন্ন হলে সেক্টর কমান্দার উইং কমান্ডার বাশার আমাকে রংপুরের গীতলদহ ও শীতলকুচিতে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প পরিচালনার ভার নিতে নির্দেশ দেন। তখন পর্যন্ত এই এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা বিশেষ কোন কৃতিত্ব দেখাতে পারেনি। গীতলদহ ক্যাম্পে ২০০০ এবং শীতলকুচি ক্যাম্পে ৫০০ মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং নিচ্ছিল। আমার দায়িত্ব ছিল নিম্নরূপ –

(ক) ট্রেনিং থেকে প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রহন করা।

(খ) মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন অপারেশনে পাঠাবার ব্যবস্থা করা। তাদের এম্বুশ রেইড আক্রমণ রেল ও সড়ক সেতু (যেগুলো শত্রুদের যাতায়াতে সাহায্য করত) উড়িয়ে দেয়া ইত্যাদি কাজ সম্পন্ন করার নির্দেশ প্রদান।

(গ) মুক্তিযোদ্ধাদের ঐ এলাকার রাস্তাঘাট ও অন্যান্য বিষয়ে জানানো।

(ঘ) মুক্তিযোদ্ধাদের ঐ এলাকার জনগনের সাথে মিশে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্বন্ধে জানানোর ব্যবস্থা করা।

(ঙ) সর্বোপরি পাকসেনাদের অধিকৃত এলাকার ভিতরে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রবেশের ব্যবস্থা করা।

আমি এই দুইটি গুরুত্বপূর্ণ মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প পরিচালনার ভার নিয়ে প্রথমে তাদের পরীক্ষা করে দেখি। তাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ব্যপারে কিছু জানা নাই এবং সামরিক কৌশল সম্বন্ধে ধারণা নাই। সামরিক অফিসারের অভাব থাকার জন্যই তাদের পক্ষে সামরিক কৌশল সম্বন্ধে জানা সম্ভব হয়নাই। সেই জন্য ক্যাম্প দুটির মুক্তিযোদ্ধাদের ঠিকমত পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি। আমি তাদের সুস্পষ্টভাবে সামরিক কৌশল শিখিয়ে অপারেশনে পাঠানোর জন্য তৈরী করি। তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কোম্পানী প্লাটুন সেকশনে বিভক্ত করি। তাদের সংগঠিত করে পাকসেনাদের উপর দিনে কমপক্ষে ৫ বার হামলা করতে থাকি। এর ফলে তারা এত ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পরে যে পাকসেনারা দিনেও বাংকার থেকে বেরিয়ে আসতে সাহস করত না। আমি অনেক অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যেতাম এবং এই ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বাড়িয়ে তুলি। আমার ব্যক্তিগত অংশগ্রহণের ফলে মুক্তিযোদ্ধারা আমার নির্দেশ মেনে চলার চেষটা চালায়। আমি মুক্তিযোদ্ধাদের পাকসেনাদের এমবুশ ও রেইড করা এবং রেল ও সড়কসেতু ধ্বংস করে দেয়ার নির্দেশ দেই। তাদেরকে অধিকৃত অঞ্চলে বেইস করে গড়ে তোলার নির্দেশ দেই। অনেককে ভেতরে পাঠিয়ে দেই পাকসেনাদের এমবুশ ও রেইড করে পর্যুদস্ত করার জন্য্য।

যেসব মুক্তিযোদ্ধা নতুন ট্রেনিং নিয়ে আসত তাদেরকে প্রথমে শত্রুদের বিরুদ্ধে এমবুশ ও রেইড করার নির্দেশ দিতাম। রেল ও সড়কসেতু ধ্বংস করে পাকসেনাদের যাতায়াতে বাধা সৃষ্টি করার জন্য পাঠাতাম। ছোটখাটো অপারেশনের দায়িত্ব দিয়ে তাদেরকে যুদ্ধকৌশলে পারদর্শী করে তোলা হত ।

একটি অপারেশনের কথা আমার মনে পরছে। লালমনিরহাট থেকে মোগলহাটে অবস্থানরত পাকসেনাদের জন্য প্রতিদিন সকালে ট্রেনে করে রসদ ও সৈন্য আসত। এই সাব সেক্টরের দায়িত্ব ছিল অসমসাহসী যোদ্ধা ক্যাপ্টেন নওয়াজেশের উপর। তিনি আমাকে এই অপারেশন পরিচালনা করার ব্যপারে যথেষ্ট সাহায্য করেন। তিনি পিছনে অবস্থানরত প্লাটুনের সাহায্যে শত্রুট্রেনের উপর মর্টার চালানোর নির্দেশ দেন। দিনটি ছিল যতদুর সম্ভব ৬ সেপ্টেম্বর। ভোর ৫ টার সময় ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে মোগলহাট রেললাইনের নিকট অবস্থান নেই। রেললাইনের উপর এন্টি ট্যাঙ্ক মাইন বসানো হয়। গ্যালাটিন  ও পি ই কে ঠিকমত বসিয়ে দূরে সুইচ লাগিয়ে শত্রুট্রেন আসার অপেক্ষায় অবস্থা নিয়ে অপেক্কা করতে থাকি। ঠিক সময়মত ট্রেনটি সামনের কয়েকটি বগিতে বালি ও অন্যান্য জিনিসে ভর্তি করে পিছনের বগীগুলিতে আসে। আমাদের এন্টি ট্যাঙ্ক মাইনের আঘাতে ইঞ্জিনসহ সামনের কয়েকটি বগী বিধ্বস্ত হয়। পাক সেনারা সঙ্গে সঙ্গে তাদের অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে আমাদের গোলাগুলির জবাব দিতে শুরু করে। তারা ট্রেন থেকে নেমে তিনদিক থেকে আমাদের ঘিরে ফেলে। অবস্থা বেগতিক দেখে মুক্তিযোধাদের আমি পেছনে সরে যেতে নির্দেশ দেই। আমার কাছে ১ টা হালকা মেশিনগান ছিল। সেই মারণাস্ত্র দিয়ে আমি শত্রুসেনাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে যাই এবং এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে পিছনে সরে যেতে সক্ষম হয়। এই অপারেশনে ২ জন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা নিহত ও ৪ জন আহত হয়। আমিও বাঁ হাতে সামান্য আঘাত পাই। শত্রুদের ৫ জন নিহত ও অনেকে  আহত হয়। এই অপারেশন পরিচালনার জন্য পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকার আমাকে বীরপ্রতিক উপাধিতে ভূষিত করেন। এই অপারেশনের খবর টি স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচারিত হয়। এ ছাড়া আমি যেসব অপারেশনে অংশগ্রহন করি সেগুলো হল মোগলহাট পাক অবস্থানের উপর অকস্মাৎ আক্রমন নাগেশ্বরী পাক কোম্পানী হেডকোয়ার্টার আক্রমন, কম্বলপুর ব্রীজ অপারেশন কূলাঘাট শত্রু অবস্থানের উপর হামলা দোরাকুটি পাক অবস্থানের উপর হামলা নুমেরি পাক অবস্থানে আক্রমন, পটেশ্বরী শত্রু গোলন্দাজ অবস্থানের উপর হামলা ভাতমারী শত্রু কোম্পানী অবস্থানের উপর হামলা, কালীগঞ্জ পাক অবস্থান আক্রমন, তুষভান্ডা শত্রু প্লাটুনের উপর অকস্মাৎ আক্রমণ,  হাতিবান্ধা শত্রুকোম্পানীর উপর আক্রমণ ইত্যাদি।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সীমান্তবর্তী  থানাগুলতে আক্রমন চালানোর জন্য আমি কয়েকটা বেইস গড়ে তুলি। ফুলবাড়িতে ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। লালমনিরহান থানার ইমানগঞ্জ হাট ও কর্নার হাট এলাকায় আমাদের ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। কালিগঞ্জ থানায় দাইখোয়া ও চালতায় বেইস গড়ে তোলা হয়। এসব স্থান থেকে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা বিভিন্ন পাক অবস্থানের উপর এমবুশ ও রেইড করত। তারা রেল ও সড়কসেতু উড়িয়ে দিয়ে পাকসেনাদের যাতায়াতে বাধার সৃষ্টি করত।

এসব সীমান্ত এলাকায় ঘাঁটি স্থাপন করার পর রংপুর জেলার ভিতরে মুক্তিযোদ্ধাদের কিভাবে অনুপ্রবেশ করানো যায় সে চিন্তা করতে থাকি। সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা ইতিমধ্যে পাকসেনাদের উপর আক্রমন চালিয়ে ক্ষতিসাধন করতে থাকি। পাকসেনারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পরে এমনকি দিনের বেলাতেও পাকসেনারা বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে আসার সাহস করত না। পাকসেনাদের গতিবিধি অনেক কমে যায়। আমাদের কার্যকলাপ বৃদ্ধি পাবার ফলে পাকসেনারা গ্রামে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। এর পূর্বে পাকসেনারা গ্রামে গিয়ে লুটতরাজ, নারীধর্ষণ, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া ও গ্রামবাসিদের উপর অত্যাচার চালাত। আমাদের কার্যকলাপের ফলে গ্রামবাসীরা অনেক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তারা আমাদের শত্রুপক্ষের অনেক গোপন তথ্য জানিয়ে সাহায্য করত। আমার পক্ষে সব বেইস এলাকায় থাকা সম্ভব ছিল না। তাই মাঝে মাঝে প্রায় সব কটি বেইস এলাকায় গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে শত্রুদের বিরুদ্ধে অনেক অপারেশনে অংশগ্রহন করতাম। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল অনেক বেড়ে যায়। আমি ভিতরে অনেক লোককে নিয়োগ করি শত্রুপক্ষের গোপন তথ্যাদি ও গতিবিধি সম্বন্ধে খবর দেবার জন্য। তারা আমাকে ঠিকমত খবর দিয়ে অপারেশনে সাহায্য করত।

মুক্তিযোদ্ধারা প্রতি রাতেই তাদের অবস্থান বদল করত। এক স্থানে অবস্থান নিয়ে বসে থাকত না। আমি নিম্নলিখিত এলাকায় বেইস তৈরী করি। এগুলো হলঃ লালমনিরহাট থানার কস্তুরীহাট, কাউনিয়া থানার তেপাহাটা, গংগাচরা থানার গংগাচরা, লালমনিরহাট থানার শিবরাম ও পাঁচগ্রাম কাউনিয়া থানার সারাই ও নাজিরদহ পীরগাছা থানার জিগাবাড়ি ও বাজে মশকুর কাউনিয়া থানার তেপামধুপুর,  মিঠাপুকুর থানার রাজপুকুর, জলঢাকা থানার খৈলমারি ইত্যাদি।

এসব এলাকায় বেইস তৈরী করার পর আমি প্রতি এলাকার জন্য ১০ থেকে ২০ জন মুক্তিযোদ্ধার পার্টি নিয়োগ করি শত্রুদের বিরুদ্ধে অপারেশন চালানর জন্য। তিনদিন অন্তর তাদের প্রত্যেক পার্টিকে ভাগাভাগি করে অপারেশনের দায়িত্ব দিতাম। সেপ্তেম্বর মাসের শেষের দিকে প্রায় সব কটি বেইস এলাকায় তারা যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হয়। অক্টবর মাসের শেষ দিকে প্রায় প্রতি বেইসে ১৫০ জন প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়োগ করতে সক্ষম হই। ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ৭০ মাইল ভিতরেও বেইস তৈরি করতে সক্ষম হই।  এক বেইস এলাকার সাথে অন্য বেইস এলাকার যোগাযোগ রাখা হত। এইভাবে তারা একে অন্যের সাহায্য  করে এবং আমার সাথে চেইন হিসাবে যোগাযগ রাখে। প্রতি বেইস এলাকা থেকেই তারা সিচুয়েশন রিপোর্ট পাঠাত। আমি কোম্পানি কমান্দারদের কাছে নির্দেশ পাঠাতাম এবং সপ্তাহ অন্তর কোম্পানী কমান্ডাররা তাদের রিপোর্ট পাঠাত। দূরবর্তী কোম্পানী কমান্ডারদের এক সপ্তাহের কাজ দিতাম। তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল শত্রুদের সামনে থেকে আক্রমন না করে এমবুশ ও রেইড করে ব্যতিব্যস্ত রাখার জন্য এবং যোগাযোগ ও যাতায়াত বন্ধ করে দেয়ার জন্য সড়ক ও রেলসেতু ধ্বংস ও উড়িয়ে দেয়ার জন্য। মুক্তিযোদ্ধাদের উপর আরো নির্দেশ ছিল গ্রামবাসী ও এলাকাবাসির সাথে মিশে তাদের সাহায্য নিয়ে অপারেশন করার জন্য। কিন্তু আবার এই সময় রাজাকার আল বদর আল শামস মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর দালালরা ও বিহারীরা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের কার্যকলাপে বাধা সৃষ্টি করত। কিন্তু আবার অনেক রাজাকার এমনকি শান্তি কমিটির অনেক সদস্য গোপনে শত্রুদের অনেক খবর আমাদের দিত। লালমনিরহাট থানার বাবোবাড়ি ইউনিয়ন শান্তি কমিটির সদস্য আবুল কাসেমের বাড়িতে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত দেখতে পাওয়ায় পাকসেনারা নির্মমভাবে আবুল কাসেমকে হত্যা করে। আবুল কাসেমের স্বাধীনতা সংগ্রামে  অবদান কম নয়।

নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকসেনারা কোনঠাসা হয়ে পরে। প্রতি রাতেই তাদের উপর হামলা চালানো হত। রংপুরের সিনেমা হলে গ্রেনেড বিস্ফোরন ঘটানো হয়। ১০ জনের মুক্তিবাহিনীর একটি পার্টিকে এ কাজের জন্য পাঠান হয়েছিল। লালমনিরহাট, কালীগঞ্জ,ভোতমারী, নাগেশ্বরী, কুড়িগ্রাম,তিস্তাঘাট, কাউনিয়া, পীরগাছা,গঙ্গাচরা, মিঠাপুকুর ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ পাক অবস্থানে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এমনকি রংপুর শহরেও আমাদের কার্যকলাপ শুরু হয়ে যায়। এর মধ্যে আমাদের কার্যকলাপ গ্রাম ছাড়িয়ে শহর ও সামরিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে শুরু হয়। পাকসেনারা এরপর আরো কোনঠাসা হয়ে পরে। তারা প্রায় ই  সবসময় বাঙ্কার ও ছাউনি ছেড়ে বাইরে যেত না। কোন অপারেশনে গেলে তারা রাজাকারদের সামনে এগিয়ে দিত এবং নিজেরা ডিফেন্স পজিশনে থাকত।

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আমরা অনেক এলাকা পাকসেনাদের হাত থেকে মুক্ত করে ফেলি। পীরগাছা, মিঠাপুকুর, গঙ্গাচরা ও কাউনিয়া থানা এলাকা আমাদের নিয়ন্ত্রনে চলে আসে। ২ রা ডিসেম্বরে সেক্টর কমান্দার বাসার আমাকে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ১ টা ব্যাটেলিয়ন তৈরী করে লালমনিরহাট ও তিস্তাঘাট হয়ে রংপুরের দিকে অগ্রসর হবার নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশ সহ আমি মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে লালমিরহাটের দিকে অগ্রসর হই। পাটগ্রাম সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মতিয়ুর রহমান বারখাতা, হাতিবান্ধা,  কালিগঞ্জ হয়ে লালমনিরহাটের দিকে এগিয়ে আসেন। অন্যদিকে সাহেবগঞ্জ সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ ভুরুঙ্গামারী, নাগেশ্বরী,  পটেশ্বরী,  কুড়িগ্রাম হয়ে রংপুরের দিকে অগ্রসর হন। নীলফামারী মুক্ত করে আমরা তিস্তা ঘাটে একত্রিত হয়ে রংপুর শহরের দিকে অগ্রসর হই। ১৫ ই ডিসেম্বর অনেক বাধাবিপত্তির পর রংপুর শহরে পৌছতে সক্ষম হই। আমরা তাদের উপর ক্রমাগত চাপ দিয়ে শহর থেকে সরে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় যেতে বাধ্য করি। ১৬ ই ডিসেম্বর পাকসেনারা মিত্রবাহিনী ও আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার ১০০ জন মুক্তিযোদ্ধা আমার কাছে প্রশিক্ষন নিয়ে অভ্যন্তরে চলে যায়। এসব মুক্তিযোদ্ধারা অসমসাহসী ছিল। তারা পাকসেনাদের বারবার আচমকা আক্রমণ চালিয়ে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছিল। আগস্টের শেষে প্রাক্তন এম সি এ কে বি এম আবু হেনা এদেরকে নিয়ে সিরাজগঞ্জে চলে যান। জনাব হেনা স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজেকে আত্মোৎসর্গ করেছিলেন। তার মত সাহসী এম সি এ ও মুক্তিযোদ্ধা আমি খুব কম ই দেখেছি। দেশ কে মুক্ত করার জন্য তিনি নিজের জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ছিলেন। সিরাজগঞ্জের ১০০ জন মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে আবু হেনাকে কোম্পানী কমান্ডার মিঃ সাইদুর রহমান কে সেকেন্ড ইন কমান্ড মিঃ আমির হোসেন, বেলায়েত হোসেন ও বজলুর রহমান কে প্লাটুন কমান্ডার করে আবু হেনার নেতৃত্বাধীনে সিরাজগঞ্জ এলাকায় পাঠিয়ে দেই।

মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণ ও সুশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য তাদের মধ্য থেকে কোম্পানী কমান্ডার,  প্লাটুন কমান্ডার ও সেকশন কমান্ডার নিয়োগ করি। মুক্তিবাহিনীকে কোম্পানী, প্লাটুন ও সেকশনে ভাগ করি শ্ত্রুদের উপর সুষ্ঠুভাবে আক্রমন পরিচালনার জন্য। আমরা কয়েকজন সাহসী শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান মুক্তিযোদ্ধার নাম নিম্নে প্রদান করছিঃ

(১) বদরুজ্জামান কোম্পানী কমান্ডার (২) সিরাজুল ইসলাম,কোম্পানী সেকেন্ড ইন কমান্ড (৩) মজাহার আলী,প্লাটুন কমান্ডার সেকেন্ড ইন কমান্ড (৪) একরামুল হক প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৫) নুরুল আলম খোকন,,প্লাটুন কমান্ডার (৬) শহীদুর রহমান,প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৭) ওয়াদুর রহমান,প্লাটুন কমান্ডার (৮) আব্দুল করিম,প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৯) মোঃ তাজিব উদ্দীন,কোম্পানি কমান্দার (১০) গোলজার হোসেন,কোম্পানী সেকেন্ড ইন কমান্ড (১১) ইমান আলী,প্লাটুন কমান্ডার (১২) রবিউল আলম,প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (১৩) শফিকুল ইসলাম,প্লাটুন কমান্ডার (১৪) আব্দুস সালাম,প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (১৫) মোজাফফর হোসেন,প্লাটুন কমান্ডার (১৬) খোরশেদ আলম,প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (১৭) মাহতাব আলী সরকার,কোম্পানী কমান্ডার (১৮) নুরুল আজিজ, কোম্পানী সেকেন্ড ইন কমান্ড (১৯) শামসুল আলম, প্লাটুন কমান্ডার (২০) আদুর রশীদ, প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (২১) আশরাফ আলী,প্লাটুন কমান্ডার (২২) জমির আলী আহমেদ,সেকেন্ড ইন কমান্ড (২৩) ওয়ারেশ আলী, প্লাটুন কমান্ডার (২৪) আতিয়ার রহমান, সেকেন্ড ইন কমান্ড (২৫) আব্দুর রউফ, কোম্পানী কমান্ডার (২৬) মোঃ ইলিয়াস,  কোম্পানী  সেকেন্ড ইন কমান্ড (২৭) জয়দেব রায়,  প্লাটুন কমান্দার (২৮) দীনেশ রায়, প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (২৯) নুরুদ্দীন,  প্লাটুন কমান্ডার (৩০) যোগেশ সরকার,  প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৩১) মজিবর রহমান, প্লাটুন কমান্ডার (৩২) মোঃআজাদ, প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৩৩) সিরাজুল হক, কোম্পানী কমান্ডার (৩৪) লুতফর রহমান, কোম্পানী সেকেন্ড ইন কমান্ড (৩৫) কলিমউদ্দিন, প্লাটুন কমান্ডার (৩৬) ওসমান গনি,  প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৩৭) মোস্তাফিজুর রহমান,  প্লাটুন কমান্ডার (৩৮) খাইরুজ্জামান, প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৩৯) ফরিদ হোসেন, প্লাটুন কমান্ডার (৪০) জুলহাস হোসেন, প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৪১) মোখলেসুর রহমান,  কোম্পানী কমান্ডার (৪২) কফিলউদ্দিন,  প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৪৩) আবুল হোসেন,  প্লাটুন কমান্ডার (৪৪) মোহাম্মদ আলী, প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৪৫) আব্দুস সামাদ, প্লাটুন কমান্ডার (৪৬) আব্দুস সামাদ, (২) প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৪৭) এ কে এম আব্দুর রশীদ,  প্লাটুন কমান্ডার (৪৮) বেলাল হোসেন,  প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৪৯) মফিজুল হক, কোম্পানী কমান্ডার (৫০) সাবের আল, কোম্পানী সেকেন্ড ইন কমান্ড (৫১) আইয়ূব আলী, প্লাটুন কমান্ডার (৫২) মোঃ আবু সিদ্দিক, প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৫৩) মজিবর রহমান,  প্লাটুন কমান্ডার (৫৪) আজিজুল হক, প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৫৫) জহুরুল হক,  প্রধান প্লাটুন কমান্ডার (৫৬) আব্দুর রাজ্জাক, প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৫৭) আজহারুল ইসলাম, কোম্পানী কমান্ডার  (৫৮) বেলায়েত হোসেন, কোম্পানী সেকেন্ড ইন কমান্ড (৫৯) মোঃ শাজাহান, প্লাটুন কমান্ডার (৬০) আনিসুর রহমান, প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৬১) মুসলিম উদ্দিন,  প্লাটুন কমান্ডার (৬২) ওয়াজেদ আলী, প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৬৩) সিরাজুল ইসলাম,  প্লাটুন কমান্ডার (৬৪) দেলোয়ার হোসেন, প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৬৫) খাইরুজ্জামান, কোম্পানী কমান্ডার (৬৬) মোঃ শামসুল আলম, কোম্পানী সেকেন্ড ইন কমান্ড (৬৭) এম আর প্রধান, প্লাটুন কমান্ডার (৬৮) রফিউল আলম, প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৬৯) আকবর আলি, প্লাটুন কমান্ডার (৭০) খুরশিদ আলম, প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৭১) মেসবাহউদ্দিন, প্লাটুন কমান্ডার (৭২) আতিয়ার রহমান, প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৭৩) শমসের আলী,  প্লাটুন কমান্ডার (৭৪) শামসুল হক,  প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড।

এ ছাড়া আমি কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন পরিচালনা করি। নীচে সেসব অপারেশনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হল –

প্রথম অপারেশনঃ লালমনিরহাট এবং মোগলহাটের মধ্যবর্তী রেললাইন ও ইঞ্জিনসহ উড়িয়ে দেয়া হয়।  প্রকাশ যে, মোগলহাটে পাকবাহিনীর একটি শক্ত ঘাঁটি ছিল। এই ঘাঁটিতে প্রত্যেক দিন সকাল সন্ধ্যা পাকসেনারা একদলকে রেখে ডিউটিরত দলকে অন্যত্র নিয়ে যেত। ১৫ ই সেপ্টেম্বর ভোর রাতে দুরাকুটি নামক জায়গাতে মাইন ও বিস্ফোরক পদার্থ সহযোগে পাক সেনাবাহিনীর রেলগাড়ি উড়িয়ে দেয়া হয়। এই অপারেশনে অন্ততপক্ষে ২৭ জন পাকসেনার মৃত্যু ঘটে এবং ১০/ ১২ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়। এই অপারেশনের খবর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকেও প্রচার করা হয়। এই অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধারা অংশগ্রহন করে। এই অপারেশনে আমি নিজে আহত হই এবং আমাদের মুক্তিযোদ্ধা একজন শহিদ হন এবং ৪ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়।

দ্বিতীয় অপারেশনঃ রংপুরের ভূরুঙ্গামারি জয়মনিরহাট রায়গঞ্জ অপারেশন। যুদ্ধকালীন সময়ে যাতে করে পাকবাহিনী কুড়িগ্রাম থেকে ধবলানদী অতিক্রম করে রসদ গোলাবারুদ ও সৈন্য পাটেশ্বরী নাগেশ্বরী এবং ভুরুঙ্গামারীর দিকে সরবরাহ না করতে পারে সেজন্য এই অপারেশন চালানো হয়। এই অপারেশনে ভূরুঙ্গামারীতে মেজর নওয়াজেশ তার দল নিয়ে আক্রমণ করেন আর আমার দলের দুটো গ্রুপের একটা ছিল পাটেশ্বরী এবং অপরটি ছিল নাগেশ্বরীতে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঈদের রাতে এই অপারেশন চলে। এই অপারেশনে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় ১০ / ১২ জন সদস্য শহিদ হন অপরদিকে পাকসেনাদের কমপক্ষে সোয়াশ নেতা নিহত হয়। এই অপারেশনেও আমরা সাফল্য অরজন করি। এই অপারেশনে ১ জন অফিসারসহ ১০ থেকে ১৫ জন পাকসেনা ধরা পরে এবং ২ জন অফিসার নিহত হয়।

৩য় অপারেশনঃ লালমনিরহাট এবং তিস্তাঘাটের মধ্যবর্তী বড়বাড়ি ইউনিয়নে বাকবাহিনীর আরেকটি ঘাঁটি ছিল। নভেম্বরের ১০ তারিখের সন্ধ্যায় এই ঘাঁটি আক্রমন করা হয়। আমার বাহিনীর মাত্র ৬০ জন সদস্য নিয়ে আমি নিজে এই ঘাঁটি আক্রমণ করি। আমাদের তীব্র আক্রমনের ফলে ৫ জন পাকসেনা নিহত এবং বাকীরা পালিয়ে যায়। আমরা ওদের রান্নার কজে সহযোগিতাসহ আমাদের খবর সরবরাহকারী তাদের পাচক এবং সেই ক্যাম্পে যে মহিলাকে নিয়ে পাকসেনারা রাত কাটাত তাকেও ধরে নিয়ে আসি। এই অপারেশনে আমাদের ৪/ ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা মারাত্মকভাবে আহত হয়। পূর্বোল্লিখিত আমার বাহিনীর ২ এম দল তিস্তাঘাট এবং তার আশে পাশে ডিসেম্বরের প্রথম দিকেই পাক সেনাদের অবস্থানগুলোয় আক্রমণ চালায় এবং তাদের সফল আক্রমণের মুখে হানাদার বাহিনী টিকতে না পেরে তারা রংপুর হেডকোয়ার্টারে কেন্দ্রীভূত হয়। এছাড়া ২ এম দলও পীরগাছা থানা এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় পাকবাহিনীর অবস্থানগুলোর উপর চোরাগোপ্তা আক্রমন চালায়। তাদের সে আক্রমণের মুখে পাকবাহিনী কুলাতে না পেরে পীরগাছা ছেড়ে রংপুরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে এইসব আক্রমণে প্রচুর পরিমান অস্ত্রশস্ত্র পাকবাহিনী এবং রাজাকারদের কাছ থেকে উদ্ধার করতে আমরা সক্ষম হই। এসব আক্রমণে বিপুল সংখ্যক রাজাকারও নিহত হয়। প্রসংক্রমে আরো উল্লেখ্য যে, এরা ছিল পাকবাহিনি অধিকৃত বাংলাদেশের অভ্যন্তরস্থ এলাকার আক্রমনকারী।

সীমান্ত এলাকা থেকে দীর্ঘ ৬৫ মাইল ভিতরে আমার বাহিনীর ১ পি দল মিঠাপুকুর থানার রানীপুকুরে শত্রুবাহিনির উপর সফল আক্রমন পরিচালনা করে। তারাও ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই শত্রুবাহিনীকে সন্ত্রস্ত করে তলে এবং তাদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে প্রচুর অস্ত্র শস্ত্র উদ্ধার করে। তাদের হাতেও অনেক রাজাকার নিহত হয় ও আত্মসমর্পণ করে। এর ফলে ১০ ই ডিসেম্বরের মধ্যে এই সমস্ত এলাকা শত্রুমুক্ত হয়। এরপরে ক্যাপ্টেন মতিয়ুর রহমান পাটগ্রাম থেকে রংপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন এবং নওয়াজেশ ভূরুঙ্গামারী, কুড়িগ্রাম হয়ে রংপুরের দিকে অগ্রসর হন এবং আমি আমার বাহিনী নিয়ে লালমনিরহাট হয়ে রংপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকি। ডিসেম্বরের ১১/১২ তারিখের দিকে আমরা তিনজন নিজ নিজ দলসহ লালমনিরহাট মিলিত হয়ে সম্মিলিতভাবে রংপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকি এবং ১৪ ই ডিসেম্বর রংপুর শহরে পৌঁছে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমনের প্রস্তুতি নিতে থাকি। বিকেলে মিত্রবাহিনীও রংপুর পৌঁছে এবং তারা আমাদের কে ক্যান্টনমেন্টে আক্রমণ স্থগিত রাখার নির্দেশ দেন। তারা ইতিমধ্যে মেসেজ পেয়েছিলেন যে রংপুরস্থ পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে এবং সেজন্য তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ সংবাদ পেয়ে আমরা তাদেরকে আক্রমন থেকে বিরত হই। আমাদের রংপুর পৌছার খবর পেয়ে সেখানকার জনগন ও আশেপাশের গ্রাম গ্রামান্তর থেকে আগত সাধারণ মানুষ আমাদেরকে এবং মিত্রবআহিনীকে বীরোচিত সংবর্ধনা দেন। তাদের বিজোয়োল্লাস এবং আমাদের প্রতি তাদের অকৃত্রিম ও প্রাণবন্ত সংবর্ধনায় আমরা মুগ্ধ হয়ে পরি।

স্বাক্ষরঃ এম দেলয়ার হসেন

১৬-১০-৭৪

*১৯৭১ সালে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন।

 

নীলাঞ্জনা অদিতি     

<১০, ১২.২, ৩১০-৩১৩>                  

সাক্ষাতকারঃ মেজর সুলতান শাহরিয়ার রশীদ

 

আমাকে দেওয়া হয় ৬ নং সেক্টরের ১নং সাব সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব। ১৩ ই জুলাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান কার্যালয় থেকে পরিচয়পত্র নিয়ে ৬ নং সেক্টরের নিয়ন্ত্রণাধিনে দিনাজপুর জেলার তেতুলিয়া নামক স্থানে ১৭ ই জুলাই দায়িত্বভার গ্রহন করি।

প্রথম সপ্তাহে আমার সাব সেক্টরের মুক্ত এলাকা রেকি করা হয় ও পরিচিত হই। সেই সময় উক্ত এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভংগ অবস্থায় ছিল। জুলাই মাসের ২৯ তারিখে তেঁতুলিয়া থানা উন্নয়ন কেন্দ্রে সকল মুক্তিযোদ্ধাদেরকে একত্রিত করার চেষ্টা করি। সেখানে তৎকালীন ই পি আর আনসার মুজাহিদ ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জোয়ানরা একত্রিত হই। তার মধ্যে তৎকালীন ৯ নং ই পি আর উইং এর জোনের সংখ্যাই বেশি ছিল। এখানে তিনটি কোম্পানী গঠন করা হয়।

“এ” কোম্পানী কমান্ডার সুবেদার আহমেদ হোসেন প্রাক্তন ই পি আর

“বি” কোম্পানী কমান্ডার সুবেদার খালেক প্রাক্তন ই পি আর

“সি” কোম্পানী কমান্ডার সুবেদার আবুল হোসেন প্রাক্তন ই পি আর।

আগস্ট মাসের ২ তারিখে ভজনপুরে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার স্থাপন করা হয়। ৪ ঠা আগস্ট ভজনপুর থেকে কোম্পানী দেবনগরে ডিফেন্স নেয়। সেখানে অবস্থানকালে ময়নাগুড়ি, কামারপাড়া, বিলখাঁজুদ, ফকিরপাড়া, নয়াপাড়া গ্রামসহ সাত আট মাইল জায়গা দখল করে নেয়া হয়। সেখানে পাকবাহিনীর পোস্ট হিসাবে ছিল। এইসব এলাকা আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহের ভিতরেই আমাদের দখলে চলে আসে। আগস্ট মাসের ২য় সপ্তাহের মধ্যে সম্মুখের দিকে ১ মাইল জায়গা আমরা দখল করে নেয়। প্রশস্ত ছিল ৭ মাইল। সেখানে জাবরী দেয়ার, গোয়ালঝার, বানিয়াপাড়া, ডাঙ্গাপাড়া, বামনগাঁও, কামাদা ও ভেলুকা পাড়া গ্রাম দখল করে নেই। সেখানে পাক বাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যুহ ছিল। এই সময় পাকবাহিনী আমাদের উপর ভেলুকাপাড়া, গোয়ালঝাড়, ও জারীদোয়ার গ্রামে আক্রমন করে। এই আক্রমনে প্রথমে আমাদের কোম্পানি ছত্রভংগ হয়ে যায়। সেই সময় আমার অনুরোধে ভারতীয় আর্টিলারি রেজিমেন্ট পাকবাহিনীর উপর শেলিং করে। এই সুযোগে আমরাও তাদের উপরে পালটা আক্রমন চালাই, ফলে পাকবাহিনি উক্ত গ্রামগুলি ছেড়ে পেছনে চলে যায়। এই যুদ্ধে আমাদের ২৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে শাহাদাতবরন করে ও কয়েকজন আহত হয়। আগস্ট মাসের শেষের দিকে আর এক কোম্পানি গঠন করা হয় ছাত্র যুবক ও কিছু সামরিক জোয়ান দিয়ে। এই কোম্পানি কমান্ডার নিযুক্ত হয় সুবেদার আবুল হোসেন। সে সময় আমাদের মোট শক্তি চার কম্পানির মত। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে চুই নদীর পশ্চিম পাড়ে, চকরমারী গ্রাম ফকিরপাড়া খইপাড় ডাঙ্গাপারা পাথিলগাঁও জুতরারপাড়া খাসপাড়া বালিয়াপাড়া ও প্রধানপারা আমরা দখল করে নেই। এই এলাকা দখলে আনতে আমাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর সঙ্গে কয়েকবার সম্মুখযুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং সমস্ত চুই নদীর পশ্চিম পারে পাক বাহিনির মুখোমুখি ডিফেন্স নেয়া হয়। সেই সময় ভারতীয় বি এস এফ বাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হবার সময় সাহায্য করে। চুই নদীর পশ্চিম পারে চার কম্পানি মুক্তিযোদ্ধা ডিফেন্স লাগিয়েছিল। সে সময় আমাদের অপর কম্পানী ও আমাদের ব্যাটেলিয়ন হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে টেলিফোন যোগাযোগ স্থাপন করা হয়।

সেপ্টেম্বর মাসের ৩য় সপ্তাহে পাকবাহিনির পাক্কা ঘাঁটি অমরখানা তিন কম্পানি নিয়ে আক্রমন করি। অমরখানায় পাকবাহিনির সঙ্গে  আমাদের মুক্তিযদ্ধাদের প্রচন্ড যুদ্ধ হয় কিন্তু পাকবাহিনির তীব্র আক্রমনের মুখে টিকতে না পেরে আমরা পুনরায় চুই নদীর পশ্চিম পারে আমাদের ডিফেন্সে চলে আসি। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে জগদলহাটে পাকবাহিনীর ঘাঁটির উপর আক্রমন চালাই। জগদলহাটেও পাকবাহিনীর সঙ্গে আমাদের ভীষন যুদ্ধ হয় কিন্তু তাদের তীব্র আক্রমনের মুখে টিকতে না পেরে চুই নদীর পশ্চিম পারে চলে আসি।

অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে অমরখানা ও  জগদলহাটে পুনরায় ক্রমন করা হয়। কিন্তু পাক বাহিনীকে প্রতিহত করা যায় নাই। অক্টোবর মাসের ২য় সপ্তাহে বাংলাদেশের প্রথম কমিশনপ্রাপ্ত ২য় লেঃ এ মতিন চৌধুরি ও ২য় লেঃ মাসুদুর রহমান আমার সাব সেক্টরে যোগদান করে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের ভিতরে পচাগড়, পুটিমারি, বোদা, ঠাকুরগাঁও ও বীরগঞ্জে এবং দিনাজপুরের এফ এফ বাহিনীকে হাল্কা অস্ত্র ও ডিফেন্স দিয়ে পাঠান হয়। সেই সময় পাকবাহিনী রাজাকারদের ডিফেন্সের উপর আমাদের কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধাগন সেকশন ভিত্তিতে ভাগ হয়ে পাকবাহিনীর গতিপথে রেইড ও এমবুশ করে। আমাদের এমবুশে পাকবাহিনীর বহু সৈন্য হতাহত হয়। এইভাবে নভেম্বর মাসের ২য় সপ্তাহ পর্যন্ত পাকবাহিনীর উপর হামলা, রেইড ও এমবুশ চলতে থাকে।

২২ শে নভেম্বর রাতে আমার তিন কোম্পানি নিয়ে পুনরায় অমরখানা আক্রমন করি। এই যুদ্ধে ভারতীয় আর্টিলারি পাকবাহিনীর ঘাঁটির উপর খুব শেলিং করে। তীব্র আক্রমনের মুখে পাকবাহিনী হটে যায়। আমরা অমরখানা দখল করি। এই যুদ্ধে বি এস এফ বাহিনী আমাদেরকে কভারিং ফায়ার দিয়ে যথেষ্ট সাহায্য করে। সেই দিন ই ভারতীয় ১২ রাজপুতানা রাইফেলস অমরখানার সম্মুখে অবস্থান নেয়। নভেম্বর মাসের ২৩ তারিখে চুই নদির পশ্চিম পাড়ে আমাদের ডিফেন্সের পেছনে ভারতীয় ৭ নং মারাঠা রেজিমেন্ট অবস্থান নেয়। মুক্তিযুদ্ধের মোড় পরিবর্তন হয়ে যায়।

২৩ শে নভেম্বর রাতে ভারতীয় বাহিনীর সহযোগীতায় আমরা জগদলহাট আক্রমণ করি। উভয়পক্ষে ভীষন গুলি বিনিময় ও আর্টিলারি শেলিং হয় কিন্তু সেদিন জগদলহাটে আমাদের সাফল্য লাভ হলো না। আমাদের পক্ষে সেই যুদ্ধে ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা হতাহত হয়। ২৪ নভেম্বর পুনরায় জগদলহাট আক্রমন করি। আমাদের আক্রমনে পাকবাহিনী জগদলহাট ডিফেন্স ছেড়ে দিয়ে পচাগড় অভিমুখে পশ্চাদপসরন করে। জগদলহাট আক্রমনে ভারতীয় ১২ রাজপুতানা রাইফেলস রেজিমেন্টের “এ” কোম্পানী আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে যুদ্ধ করে। জগদলহাট দখলে আমাদের ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাতবরন করে। তার মধ্যে হাওলাদার সাকিমউদ্দিন বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে শাহাদাতবরন করে। কয়েকজন আহত হয়।

এই সময় চুই নদীর পশ্চিম পারে অমরখানা ও জগদলহাটে বরাবর ভারতীয় সেনাবাহিনীর সৈন্যগন পজিশন নেয়। ২৪ আহে নভেম্বর সম্মিলিত বাহিনী জগদলহাট হতে পচাগড় অভিমুখে রওনা হয়। পথে  পচাগড় থেকে ১ মাইল দূরে থাকতে পাকবাহিনী আমাদের উপর বিক্ষিপ্তভাবে শেলিং ও গুলি করতে থাকে। ফলে সেখানে ডিফেন্স নিতে হয়। উক্ত জাউগায় আমাদের তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাতবরন করে ও সাতজন আহত হয়। তার মধ্যে ২য় লেঃ এম মতিন চৌধুরীও গুরুতরভাবে আহত হয়।

পচাগড়ে পাকবাহিনীর খুব মজবুত ঘাঁটি ছিল। এখানে পাক বাহিনীর প্রায় তিন ব্যাটেলিয়ন সৈন্য নিয়োজিত ছিল। পাকবাহিনির পচাগড়ের চতুর্দিকে পাক্কা বাংকার ও মজবুত ট্রেঞ্চ ছিল।

২৬ শে নভেম্বর রাতে আমাদের মুক্তিবাহিনীর ১ ব্যাটেলিয়ন ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর ২ ব্যাটেলিয়ন যৌথভাবে পাক বাহিনীর পাকা ঘাঁটি পচাগড় আক্রমন করে। সারারাত যুদ্ধ চলে কিন্তু পাকবাহিনী পচাগড় ডিফেন্সে থাকতে সমর্থ হয়। এই রাতে ভাররতীয় বাহিনীর ১০০ জনের মত জোয়ান ও ২২ জন মুক্তিবাহিনি হতাহত হয়। ২৭ তারিখ সারা দিনরাত যুদ্ধ চলে। সেদিন ভারতীয় বিমান বাহিনী পচাগড়ে পাকবাহিনীর উপর বিমান হামলা চালায় ও ২৮ তারিখ দিনেও আক্রমন অব্যাহত থাকে। ২৮ তারিখ রাতে পুনরায় ভারতীয় বাহিনির তিন ব্যাটেলিয়ন ও মুক্তিযোদ্ধা ১ ব্যাটেলিয়ন ও ৩ শত এফ এফ তাদের উপর আক্রমন চালায়। সেই রাতে ভারতীয় আর্টিলারি রেজিমেন্ট ৬০ টি গান থেকে একসাথে শেলিং করে। উক্ত রাতে ৬ হাজার গোলা পাক ডিফেন্সের উপর নিক্ষিপ্ত হয়। পাক বাহিনী ২৮ তারিখ রাতে পচাগড় ছেড়ে ময়দান দীঘিতে ডিফেন্স নেয়। ঐ রাতের যুদ্ধে আমাদের সম্মিলিত বাহিনির ২৫০ জনের মত হতাহত হয়। ২৭ জন পাক সেনাকে জীবন্ত ধরে ফেলা হয়। প্রচুর অস্ত্র গোলাবারুদ ও ৮ টি গাড়ি উদ্ধার করা হয়। পঁচাগড় যুদ্ধ মিত্রবাহিনি ও মুক্তিবাহিনির বাংলাদেশের ভিতরে বৃহৎ যুদ্ধগুলির মধ্যে অন্যতম।

৩০ তারিখ দিনের বেলায় বোদা থানার উদ্দেশ্যে রওনা হই। বেলা ৩ টার সময় পুটিমারী নামক স্থানে দুশমন আমাদের অগ্রগতি প্রতিহত করে। ফলে আমরা সেখানে ডিফেন্স নিতে বাধ্য হই।

৩১ তারিখ ১২ টায় আমরা পাকবাহিনির উপর আক্রমন চালাই। এই আক্রমনে মুক্তিবাহিনির ৫ জন ও ভারতীয় বাহিনির ৫৫ জন হতাহত হয়। পরে আমরা ময়দান্দীঘি দখল করে ফেলি। বিকেলে আমরা বোদার উদ্দেশ্যে রওনা হই। পাকবাহিনি বোদাতে আমাদের উপর আক্রমন চালায়। আমরা বাধ্য হয়ে বোদা থানার ১ মাইল দূরে ডিফেন্স নেই। বিকালে বোদা হেডকোয়ার্টার আক্রমন করি। এখানে পাকবাহিনীর সাথে আমাদের ভীষন যুদ্ধ হয়। এখানে ভারতীয় আর্টিলারির ক্যাপটেন সুধির নিহত হয়। সন্ধ্যায় বদা থানা আমাদের দখলে আসে। পাকবাহিনীর ৬০/ ৭০ জন হতাহত হয়। ভারতিয় বাহিনী বোদাতে এসে বিশ্রাম নেয় কিন্তু মুক্তিবাহিনি বোদা থেকে তিন মাইল সম্মুখে ঠাকুরগাঁও এর পথে ডিফেন্স নেয়। সেদিন রাতে ভুলে মিস ফায়ার হয়। তাতে ভারতীয় ২০/২৫ জন জোয়ান হতাহত হয় এবং আমাদের খাদ্য ও রান্না বহনকারী পার্টির ৪/৫ জন নিহত হয়। এ রাতেই ভারতীয় কোম্পানীর সহিত মুক্তিবাহিনির ৪০ জন জোয়ানকে পাঠাই। তারা ভুলিরপুলের নিকতে গেলে পাকবাহিনি তাদের উপর আক্রমন চালায়। তখন ভারতিয় বাহিনীও তাদের পাল্টা জবাব দেয়। পাক সৈন্যরা ভারতীয় বাহিনির আক্রমনে টিকতে না পেরে ভুলির ব্রিজ নষ্ট করে পেছনে হটে। ১লা ডিসেম্বর আমরা ব্রিজ থেকে ২ মাইল দূরে অগ্রসর হয়ে ডিফেন্স নিতে থাকি। ভারতীয় বাহিনী তখন ব্রিজ মেরামত করে।

৩ রা ডিসেম্বর আমরা সম্মিলিত বাহিনী ঠাকুরগাঁও এর দিকে অগ্রসর হই। এই সময় পাক বাহিনী ঠাকুরগাঁ ত্যাগ করে। ঠাকুরগাঁ তে পাক বাহিনীর সহিত আমাদের কোন সংঘর্ষ হয়নাই। ওই দিন ই আমরা ঠাকুরগাঁ দখল করে ঠাকুরগাঁ থেকে আরো তিন মাইল সম্মুখে অগ্রসর হই। ৪ তারিখে আমরা বটতলি নামক স্থানে ডিফেন্স করি। ৫ তারিখ সারাদিন পাক বাহিনির পুঁতে রাখা মাইন উঠাই। ৬ তারিখ আমরা বীরগঞ্জ  আক্রমন করি। পাক বাহিনীর সহিত আমাদের বহু সময় যুদ্ধ হয়। শেষে পাকাহিনী বীরগঞ্জ ছেড়ে পিছনে হটে। এখানে ভারতীয় বাহিনির ১০/১২ জন জোয়ান নিহত হয়। ৭ তারিখ আমরা সম্মিলিত বাহিনী ভাতগাঁও ব্রীজের দিকে রওনা হই। পাকবাহিনি তখন ভাতগাঁও ব্রীজ নষ্ট করে রাস্তার দুপাশে মাইন পুঁতে রেখে পিছনের দিকে অগ্রসর হয়। আমরা তখন ভাতগাঁও ব্রীজের চারপাশ থেকে মাইন তুলতে শুরু করি।

৯ তারিখে আমাদের দুটি কোম্পানি  ভারতীয় দুটি ব্যাটেলিয়ন দিনাজপুর আক্রমন করতে অগ্রসর হয়। দিনাজপুরের নিকটে গিয়ে কাঞ্চন নদি পার হয়ে আমরাও দিনাজপুর আক্রমন করি। এখানে পাকবাহিনীর সহিত আমাদের অনেক্ষন যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধে আমাদের সম্মিলিত বাহিনির ৩০/ ৩৫ জন নিহত ও ১০/ ১২ জন নিখোঁজ হয়। পরে আমরা সেখান থেকে পিছনে হটি। ফেরার পথে দশ মাঙ্গল নামক স্থানে পাকবাহিনীর আরেকটি ডিফেন্সের উপর আক্রমন করি। এখানে আমরা ২৩ জন পাকসৈন্যকে জিবন্ত ধরে ফেলি এবং প্রচুর অস্ত্র উদ্ধার করে সরে পরি। কারন পাকবাহিনির কয়েকটি ট্যাঙ্ক পেছন থেকে আসছিল।

১০ তারিখে ভারতীয় দুটি ব্যাটেলিয়ন সৈন্য পাকবাহিনীকে আক্রমন করে কিন্তু এখানে পাকবাহিনীর তীব্র আক্রমনে তারা আর সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারেনি। এই যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর প্রায় ১৫০ জন জোয়ান মারা যায়। পরে পাকবাহিনি পেছনে হটে। তখনো আমাদের হেডকোয়ার্টার বীরগঞ্জেই ছিল। ইতিমধ্যেই হিলি থেকে আমাদের বাহিনী ও ভারতিয় বাহিনী হিলি দখল করে দিনাজপুরের নিকট এসে পরে।

১২ ই ডিসেম্বর আময়া দিনের বেলায় খানসামা আক্রমন করি। আমাদের সঙ্গে ভারতীয় বাহিনীও ছিল। এই আক্রমনে ভারতিয় বাহিনীর ১৫ জনের মত ক্ষয়ক্ষতি হয়। আমাদের ৭ জন মারা যায়। এখানে আমরা মেজর খুরশীদ সহ ১৯ জনকে জিবন্ত ধরে ফেলি। ঐ  দিন ই আমরা সামনের দিকে অগ্রসর হই এবং নিলফামারি দখল করে ফেলি।

১৩ তারিখে আমরা  সৈয়দপুরের দিকে অগ্রসর হই। সৈয়দপুর থেকে ৫ মাইল দূরে পাক ট্যাঙ্কের সহিত আমাদের ট্যাঙ্কের সংঘর্ষ হয়। তাতে ভারতীয় বাহিনির দুটি ট্যাঙ্ক ও পাক বাহিনির তিনটি ট্যাঙ্ক সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যায়। ১৩ তারিখ বিকালে ৪৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অধিনায়ক ও একজন অফিসার সহ প্রায় ১০৭ পাকসৈন্য আমাদের সম্মিলিত বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে।

১৫ ই ডিসেম্বর রাতে পাক ব্রিগেড কমান্দার সাইফুল্লাহ যুদ্ধ স্থগিত রাখার জন্য অনুরোধ করেন। কিছুক্ষন পর তিনি কয়েকজন গার্ড সহ আমাদের সম্মিলিত ক্যাম্পে আসেন। তার সঙ্গে আমাদের অনেক সময় ধরে আলাপ আলোচনা হয়। পরে পাক ব্রিগেড কমান্ডার চলে যান।

১৭তারিখ সকালে সেখানে অবস্থানরত সকল পাকসৈন্য মিত্রবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে।

                                                                                               স্বাক্ষরঃ মেজর সুলতান শাহরিয়ার রশীদ

কুমিল্লা সেনানিবাস

১৪-১০-৭৩

নীলাঞ্জনা অদিতি

<১০, ১২.৩, ৩১৩-৩১৪>

সাক্ষাতকারঃ সৈয়দ মনসুর আলী

 

১৯৭১ এর ২ রা নভেম্বর ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ সাহেব আমাকে মুক্তিবাহিনীর দুটি এলাকার (বুড়াবুড়ি এবং যাত্রাপুর) কোম্পানী কমান্ডার করে পাঠান। প্রথমে নাগেশ্বরী থানার মাদারগঞ্জে করা হয় ক্যাম্প এবং সেখান থেকে যাত্রাপুর অপারেশন করা হয়। একদিন যাত্রাপুর বাজারে তিনজন পাকসেনা এবং ৯ জন রাজাকার সংঘর্ষে নিহত হয়। জনগণের সহায়তায় ১৫০ জন রাজাকারকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করা হয় (৯ ই নভেম্বর ১৯৭১)। ৯ ই নভেম্বর স্বাধীন বাংলায় প্রথম পতাকা উত্তোলন করা হয়। এ সংঘর্ষের খবর পেয়ে কুড়িগ্রাম থানায় ঘোগাদেহ ইউনিয়নের ৩০০ রাজাকার স্বেচ্ছায় তাদের হাতিয়ারসহ যাত্রাপুরে আমার নিকট আত্মসমর্পণ করে। এই আত্মসমর্পণের খবর বিভিন্ন স্থানের রাজাকারদের মনে বিরাট প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তারা কুড়িগ্রাম মহকুমার বিভিন্ন স্থান থেকে যেমন নুনখাওয়া বুড়াবুড়ি, মোগলবাছা ইত্যাদি ইউনিয়ন থেকে স্বেচ্ছায় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে থাকে। কুড়িগ্রাম শহরের পাকসৈন্যের ঘাঁটি থেকে বহূ রাজাকার তাদের হাতিয়ারসহ পালিয়ে গিয়ে বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

কুড়িগ্রাম শহরের নিকটবর্তী মোগলবাছা ইউনিয়নে হানাদার বাহিনীর ঘাঁটি ছিল আমি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তিনবার পাক ঘাঁটি আক্রমন করি। তৃতীয়বারের সংঘর্ষে উনিপুরগামী ট্রেনের দুটি বগী বিচ্ছিন্ন করি ডিনামাইট দিয়ে। এতে প্রায় ৩৫ জন পাকসৈন্য হতাহত হয়। মোগলবাছা ইউনিয়নের অর্জুনমালায় রেললাইনের নীচে ডিনামাইট রাখা ছিল। পাকবাহিনীর ট্রেন অতিক্রমের সময় ডিনামাইটটি বিস্ফরিত হয়। কার্যরত সময়ে বিস্ফোরণে মীর নামের একজন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়।

৭ ই ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনির ব্রিগেডিয়ার যোশীর নির্দেশে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনী যৌথভাবে কুড়িগ্রাম শহরে বর্বর পাক বাহিনীর অবস্থানে ভারী ও দুরপাল্লার কামান দিয়ে আক্রমন করে। পাক বাহিনী তেমন মোকাবিলা না করেই কুড়িগ্রাম থেকে সরে পরে।

মিত্র ও মুক্তিবাহিনী ১০ ই ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম শহরে প্রবেশ করে। মুক্তিযোদ্ধারা কুড়িগ্রাম নতুন শহরে উঁচু পানির ট্যাঙ্কে প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে। পাকবাহিনীর অবস্থান ঘাঁটিসমূহ ছিলঃ (১) রিভারভিউ হাইস্কুল (ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ ও গোলন্দাজ গ্রুপ) (২) কুড়িগ্রাম ধরলা নদির ঘাট (৩) কুড়িগ্রাম সি এন্ড বি অফিস গোডাউন (৪) নুতন টাউন কোর্ট বিল্ডিং (৫) শান্তিকমিটি ও রাজাকার ট্রেনিং কেন্দ্র (সঞ্জীব করঞ্জাই এর গোডাউন ও কুড়িগ্রাম কলেজ)

স্বাক্ষরঃ সৈয়দ মনসুর আলি টিংকু

২৭-৭-৭৩

নীলাঞ্জনা অদিতি

<১০, ১২.৪, ৩১৪-৩১৮>

 

সাক্ষাতকারঃ সুবেদার মেজর মোঃ কাজিমউদ্দিন

 

জুন মাসের শেষের দিকে উইং কমান্ডার মোহাম্মদ খাদেমুল বাশার আমাদের সেক্টরের অধিনায়ক নিযুক্ত হইয়া আসিলেন এবং তেঁতুলিয়ায় তাহার দপ্তর স্থাপন করিলেন। তিনি পাক বিমান বাহিনির অফিসার। সদ্য মুক্তিবাহিনিতে যোগ দিয়েছেন। স্থলযুদ্ধের অভিজ্ঞতা তাঁহার সীমাবদ্ধ বৈকি। তবু তাহাকে পাইয়া আমরা আরো উতসাহিত হই এবং আমাদের মনোবল বাড়িয়া যায়। তিনিও অল্পদিনের মধ্যে বিশেশ নিপুনতার পরিচয় দিয়া আমাদেরকে চমৎকৃত করিলেন। রংপুর ও ঠাকুরগাঁও এলাকা নিয়া সেক্টর গঠিত ছিল। তেতুলিয়ায় থাকিয়া কিছুদিন পর্যন্ত কাজ করার পর স্কোয়াড্রন লীডার সদরউদ্দিন সাহেব আসিলেন। ৬ নং সেক্টরকে ২ টি সাব সেক্টরে ভাগ করা হইল। ঠাকুরগাঁ এলাকা নিয়া সাব সেক্টর ৬ এ এবং রংপুর এলাকা নিয়া সাব সেক্টর ৬ – বি। সদরউদ্দিন সাহেব ৬ এ সাব সেক্টর কমান্ডার এবং ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ সাহেব সাব সেক্টর বি এর কমান্ডার নিযুক্ত হইলেন। তখন ক্যাপ্টেন নজরুল হক সহ সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হইলেন। জুলাই মাসের প্রথম দিকে নজরুল হক সাহেব অসুস্থ হওয়ায় আমাকেই পুনরায় কমান্ড নিতে হইল কেননা সদরউদ্দিন সাহেবও উপস্থিত ছিলেন না। আমাদের কাজ চলিতে থাকে। প্রারম্ভ হইতে এই সময় পর্যন্ত আমরা স্বাধীন এলাকার জনসাধারনের সাহায্য সহানুভূতি পাইয়াছি প্রচুর। সমর্থন ও ভালবাসা পাইয়াছি অফুরন্ত। এই দুর্দিনে এদের মধ্যে এককভাবে যিনি আগাগোড়া আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসিতেন, এমনকি অনেক সময় সামরিক অফিসারের ভূমিকা নিয়া কাজ করিতেন তিনি হইলেন পঞ্চগড় ময়দানদীঘির স্বনামধন্য এডভোকেট জনাব সিরাজুল ইসলাম এম সি এ।

যাই হউক, ইতি মধ্যে আমরা নূতন সেক্টর কমান্ডারের নির্দেশ ও প্রেরনায় এবং পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার প্রয়াস পাইতেছি। দুশমন কে অনেকটা ঘেরাও করিয়া তাহার নিকটবর্তী হওয়ার চেষ্টায় আছি। ভজনপুর ডিফেন্স হইতে কোম্পানীগুলিকে উঠাইয়া এলাকার পরিপ্রেক্ষিতে ৩-৬ মাইল আগ বাড়াইয়া অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে লাগানো হইল। কাজেই দুশমনের সঙ্গে ছোটখাটো সংঘর্ষ আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যপার হইয়া দাঁড়াইল। বন্ধুরাষ্ট্রের সাহায্যে আমরাও দুশমন কে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিলাম। দিনে দিনে নূতন মুক্তিসেনার দল ট্রেনিং শেষে বাহিনিতে আসিয়া যোগ দিতে লাগিল, আর পরিকল্পনা অনুসারে আমরা তাহাদিগকে দখলকৃত এলাকায় পাঠাইতে আরম্ভ করিলাম। এই সময় আমরা ফিল্ড হেডকোয়ার্টার ভজনপুর হইতে ৫ মাইল সামনে দেবনগর নামক স্থানে স্থাপন করিলাম এবং সাব সেক্টর হেডকোয়ার্টার তেঁতুলিয়া হইতে ভজনপুর নিয়ে আসা কোম্পানিগুলোর পজিশন ছিল সুবেদার হাফিজের এ কোম্পানী  পঞ্চগড়ের পেছনে কাগপাড়া – ওমরখানা, নায়েক সুবেদার আব্দুল খালেকের বি কোম্পানী সাহেবজুত বেড়াজুত এবং নায়েক সুবেদার মুরাদ আলীর সি কোম্পানী নছুয়াপাড়া এলাকা। সন্দেহ নাই পূর্বের বিধ্বস্ত অবস্থা কাটাইয়া আমরা তখন অনেকটা সংগঠিত ও সুবিন্যস্ত। তবু যেন একটা বিরাট শুন্যতা সব সময় আমরা অনুভব করিতে লাগিলাম। মঙ্গলময়ের ইচ্ছায় এমনি সময় জুলাই মাসের ১৫ তারিখে আঞ্চলিক অধিনায়ক উইং কমান্ডার বাশার একজন নুতন অফিসার নিয়া দেবনগর আসিলেন কনফারেন্স করিতে। তথায় উপস্থিতদের মধ্যে সুবেদার মেজর কাজিমউদ্দিন,  সুবেদার মুহাম্মদ আব্দুল হাফিজ, নায়েক সুবেদার হাজী মুরাদ আলি ও নায়েক সুবেদার আব্দুল খালেকের নাম উলেখযোগ্য। সিও সাহেব বলিলেন, “ আমাদের মুক্তিবাহিনী পুরোপুরি সংগঠিত হইতে যাইতেছে এবং ভবিষ্যতে আমাদের যুদ্ধের অসুবিধা অনেক ক্ষেত্রেই লাঘব হইবে। তারপর তিনি সঙ্গে আসা সেই নতুন অফিসারকে পরিচয় করাইয়া দিলেন এবং তাহাকে আমাদের সাব সেক্টরের ফিল্ড অফিসার হিসাবে নিযুক্ত দিলেন। অন্যান্য অফিসারের অনুপস্থিতিতে সাময়িকভাবে তিনি  সাব সেক্টর কমান্ডার পদেও অধিষ্ঠিত হইলেন। আমি আবার সহকারী হিসাবে কাজ করিতে লাগিলাম।

নূতন ফিল্ড অফিসার পাইয়া আমরা ভারী খুশি। তাহার সঙ্গে অনেক কথাবার্তা হইল। খুব হাসিখুশি, চটপটে আর ছোট্ট গড়নের মানুষটি তিনি, কিন্তু তেজোদীপ্ত চেহারা। পাক পদাতিক বাহিনীর ক্যাপ্টেন তিনি। নাম সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান। কুমিল্লার অধিবাসি। বর্তমান বসতি চাঁটগা। ৬৮ তে কমিশন পাইয়ছেন শুরুতে ১১বালুচ ও পরে ৩১ এফ এফ রেজিমেন্টে চাকুরী করিয়াছেন। সেখান হইতে ন্যাশনাল সার্ভিস ক্যাডেট কোরে চলিয়া যান এবং পলায়ন পূর্ব পর্যন্ত লাহর রৈস্যাবারে পি টি এস ও এবং প্রশিক্ষনদাতার পদে বহাল ছিলেন। কার্য উপলক্ষ্যে আজাদ কাশ্মীর, ঝিলাম,মংলা, শিয়ালকোট ঘুরিয়া অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তিনি। ৭১ সালের ৩ রা জুলাই কন এক সুযোগে (পশ্চিম) পাকিস্তান হইতে পালাইয়া আসেন তিনি মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করিতে। শুধু নিজেই আসেন নাই সঙ্গে নিয়া আসিয়াছেন আরো তিনজন অফিসার। যাই হউক অতঃপর কনফারেন্স শেষে অফিসাররা চলিয়া গেলেন সেদিনকার মত।

১৮ ই জুলাই ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার আমাদের অধিনায়ক পদয়ে যোগ দিলেন দেবনগরে। দেখিলাম আমাদের প্রথম দর্শনের অনুমান মিথ্যা নয়। তাহার উপস্থিতিতে আমাদের মুক্তিসংগ্রাম অভূতপূর্ব এক মোড় নিল। তাহার যাদু স্পর্শে যেন সঞ্জীবিত হইয়া উঠিল সুপ্ত সাব সেক্টর অকুতোভয় অপরাজেয় মনবলের অধিকারী আর নিবেদিতপ্রাণ খাঁটি বাংলা মায়ের সন্তান তিনি। নিমেষে খাপ খাওয়াইয়া নিলেন নিজেকে বাংলার কাদামটির সঙ্গে। নিখুঁত বীর, মর্দে মোজাহিদ তিনি। মুক্ত এলাকার জনসাধারণ এবং আমরা তাহার কাজে মুগ্ধ হইয়া আদর করিয়া তাহাকে বাংলার বিচ্ছু বলিয়া ডাকিতাম। অনেকের মত নাক সিটকাইয়া ভ্রু কুচকাইয়া ভড়ং দেখন না। তিনি আসিয়াই সমস্ত  ডিফেন্স এরিয়া ঘুরিয়া প্রত্যেকটি সৈনিকের সঙ্গে দেখা করিলেন এবং তাহাদিগকে বিভিন্নভাবে সান্ত্বনা ও উৎসাহ দান করিলেন। সৈনিকেরা তাহার পরশে আবার যেন নতুন করিয়া আশার আলো দেখিতে পাইল। তাহাদের এতদিনের শূন্যতা ঘুচিয়া একটা মূখ্য অভাব পূরন হইল। কারন ক্যাপ্টেন ছিলেন পদাতিক বাহিনীর লোক। তাই নবম শাখার অভাব অসুবিধা সম্বন্ধে অবগত হইতে এবং খুঁটিনাটি খুঁজিয়া বাহির করিতে তাঁহার বেশী সময়ের প্রয়োজন হয়নাই। অবশ্য মানসিক ও দৈহিক পরিশ্রম করিতে হইয়াছিল যথেষ্ট। সবচেয়ে বড় অসুবিধা ছিল রেশন ও গোলাবারুদ সরবরাহ ও সংগ্রহ নিয়া। এক সপ্তাহের মধ্যে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ ও এজেন্সীর সাথে যোগাযগ করিয়া আন্তরিক সম্পর্কের মাধ্যমে সংগ্রহ ও সরবরাহ করিয়া আনিলেন তিনি। তারপর ডিফেনসিভ পজিশন ও যুদ্ধের অন্যান্য জরুরী ব্যপারগুলির খুটিনাটি খুঁজিয়া বাহির করিয়া কিছুটা ঠিক করিলেন। যে সমস্ত সৈন্য নানাভাবে বিভিন্ন সময়ে ছত্রভংগ হইয়া বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়াছিল তাহাদিগকে খবর পাঠানো হইল। কোন কোন স্থানে লোকও পাঠানো হইল যাহাতে তাহারা নিজেদের ইউনিটে যোগদান করে। ক্রমে সৈন্যসংখ্যা বাড়িতে লাগিল এবং তাহারা মাসিক ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা পাইতে শুরু করিল। সৈন্যদের মনোবল ক্রমাগত দৃঢ় হইতে লাগিল এবং সঙ্গে সঙ্গে পাকবাহিনী বিভিন্ন অপারেশনের মাধ্যমে বুঝিতে পারিল এই এলাকায় মুক্তিবাহিনীর শক্তি ও রণনৈপুন্য দিন দিন বাড়িয়া চলিয়াছে। তাই তাহারাও তাহাদের শক্তি ও সংখ্যা বাড়াইতে লাগিল। এইদিকে নবম শাখার কিছু লোক পুলিশ ও আনসার তেঁতুলিয়া বাংলাবান্ধা ও অন্যান্য স্থানে বিশ্রামে রত ছিল। ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার সেই দিকেও খেয়াল করিলেন। ইতিমধ্যে আমাদের পুরাতন তিনটি কোম্পানি পঞ্চগরের দিকে আরো দুই মাইল অগ্রসর হইয়া পজিশন নিল। পাকিস্তানিদের শক্তি এবং সংখ্যাও দিন দিন বাড়িতে লাগিল। তাই তেঁতুলিয়া ও অন্যান্য স্থানের বিশ্রামরত লোকদেরকে ক্যাপ্টেন নিজে গিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়া আসিলেন এবং তাহাদিগকে নিয়া নতুন কম্পানি খাড়া করিলেন। কম্পানির নাম দেওয়া হইল “ডি” এবং সুবেদার আবুল হাশেমকে সেই কোম্পানীর অধিনায়ক নিযুক্ত করা হইল। নূতন কোম্পানির কিছু প্রশিক্ষনের প্রয়োজন ছিল তাই কয়েকদিন তাহারা ডিফেন্সের পিছনে থাকিয়া তা সমাপ্ত করিল। ইতিমধ্যে পাকবাহিনির কর্মতৎপরতা বাড়িয়া উঠিল। তাহাদের সাথে আমাদের ছোটখাটো সংঘর্ষ হইল। এরপর প্রধানপাড়া, ডাঙ্গাপাড়া ও নুনিয়াপাড়া নামক গ্রামে তাহারা হঠাত আমাদের উপর বড় রকমের আক্রমন চালায়। ইহাতে  আমাদের কিছু লোক আহত ও শহিদ হইলেন। “এ” কোম্পানী যেটা উক্ত এলাকায় ছিল প্রায় ছত্রভংগ হইয়া পরিল। কিন্তু তাহার সুযোগ্য অধিনায়ক সুবেদার হাফিজ একদিনের মধ্যেই সমস্ত কোম্পানিকে একত্র করত আরো শক্ত করিয়া ডিফেন্স নিলেন। তারিখটি ছিল ২৮ শে জুলাই। দিন কয়েক পর পাকিস্তানীদের কয়েকটি অগ্রবর্তী ঘাঁটি যাহা চাওয়ি নদীর তীরে ছিল তাহাতে আমরা প্রচন্ড আঘাত হানি। তাহাদের অনেক হতাহত হয়। আমরা কিছু হাতিয়ার ও গোলাবারুদ কব্জা করি। এরপর ঘন ঘন ছোট খাটো আক্রমন প্রতিআক্রমন বেশ কয়েক দফা হইয়া গেল। আমাদের নিয়মিত ফাইটিং পেট্রল পাকসেনাদের উপর আক্রমন চালাইয়া বহূ হতাহত করিতে লাগিল। এমন একটি দিন ও রাত বাকী থাকিত না যে, পাকিস্তানীরা আহত ও মৃত সৈন্য নিবার জন্য পালটা আক্রমন ও কভারিং ফায়ার না করিত। এইদিকে আমাদের নবগঠিত “ডি” কোম্পানীও পজিশনে আসিল এবং সবাই মিলে আর এক মাইল অগ্রসর হইয়া পজিশন নিল। পাকিস্তানিদের বিতৃষ্ণার সীমা রহিল না কিন্তু সংখ্যা তাহাদের পুরন হইতে থাকিত পিছনে হইতে নিয়মিত সৈন্য আমদানি করিয়া। এই পর্যায়ে একদিন প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ দ্বিতীয়বারের মত আমাদের সাব সেক্টরে যান এবং ফিল্ড হেডকোয়ার্টার দেবনগরে শুভাগমন করতঃ বিভিন্ন অগ্রবর্তী ঘাঁটি পরিদর্শন করিয়া আমাদের জোয়ানদেরকে উৎসাহিত করেন।

আমাদের কর্মতৎপরতা দেখিয়া কর্তারা খুশি হইলেন এবং গোলাবারুদ ও গোলন্দাজ সাহায্য নিয়মিতভাবে দিতে লাগিলেন। এইদিকে আমাদের মর্টার প্লাটুনও গোলাবারুদ পাইয়া গুরুত্বপূর্ণ পাকিস্তানী অবস্থানসমুহের উপর সুযোগমত বারবার গোলাবর্ষণ করিয়া তাহাদের মনে ভীতির সঞ্চার করিয়া দিল। আমাদের সাব সেক্টরের সৈন্যসংখ্যা বাড়িল, হাতিয়ার বাড়িল, গোলাবারুদ বাড়িল,  শক্তি ও মনোবল আরো দৃঢ় হইল, কর্মতৎপরতা ও রণনৈপুণ্যে পাকিস্তানিরা পরাজিত হইতে লাগিল, কিন্তু পূর্ণতার জন্য আরো কিছু প্রয়োজন ছিল আরো প্রশিক্ষন ও কলাকৌশল দরকার ছিল। তাই ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার একখানা ছোট বই ছাপাইয়া তাহার কপি সবাইকে দিলেন। তাহাতে সব নূতন পুরাতন হাতিয়ারের যাবতীয় বিবরণ ও ব্যবহার পদ্ধতি সুন্দরভাবে লেখা ছিল। তাহাতে আরো ছিল বিভিন্ন খবরাখবর ও উতসাহের কথা যাহা যুদ্ধের প্রয়োজনে জানা নেহায়েত দরকার। এইভাবে কাজের ও যুদ্ধের ফাঁকে অসুবিধা সত্বেও চারিদিকে প্রশিক্ষন চলিতে লাগিল। আমাদের ক্যাপ্টেন শ খানেক উৎসাহী গ্রাম্য ছেলে ভর্তি করিলেন যারা ছিল অত্র এলাকার বাসিন্দা। তাহাদের একমাস প্রশিক্ষন দেবার পর চারটি কোম্পানীতে  ভাগ করিয়া দেয়া হইল যাহাতে রাজাকার ও অন্যান্য দালাল ধরিয়া দিতে অসুবিধা না হয়। অধিকন্তু এলাকা ও দুশমন সম্বন্ধে যেন সঠিক খবর পাওয়া যায়। এইসব নতুন লোক ভর্তি ও বিভিন্ন প্রশিক্ষনের বদৌলতে ইতিমধ্যে সাব সেক্টরে একটি সুসংগঠিত পদাতিক ব্যাটালিয়নে পরিনত হল।

সেপ্টেম্বর মাসের ৭ তারিখ একবার জগদলহাট অধিকার করা হইল কিন্তু পাকসেনাদের গলন্দাজ ও জিপে বসানো মেশিনগানের গোলাগুলিতে টিকিয়া থাকা মুশকিল হইল। তাহারা পালটা আক্রমন করে। আমাদের বাহিনী পশ্চাদপসরনে বাধ্য হয়। ঐ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ হইতে পাকিস্তানীরা রীতিমত ভড়কাইয়া গেল কারন তখন হইতে হাতেকলমে সামরিক শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা লাভের জন্য সদ্য ও স্বল্প প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা প্রতি সপ্তাহে গড়ে ২/ ৩ শত করিয়া আমাদের কাছে আসিতে লাগিল। তাহারা সপ্তাহ দুই একের জন্য আসিত এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের পর নিজ নিজ অঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধের জন্য চলিয়া যাইত। ইহাতে আমাদের সরবরাহ ও ব্যবস্থাপনার অনেক অসুবিধা হইত বটে কিন্তু যুদ্ধেরব ব্যপারে সুবিধাও ছিল অনেক। আমাদের ক্লান্ত সৈন্যরা মাঝে মাঝে স্বস্তিতে বিশ্রাম করিতে পারিত।

জগদলহাটের আক্রমনটা কিন্তু আমাদের চূড়ান্ত যুদ্ধের মহড়া ছিল। এ ধরনের মহড়া আমরা প্রায়ি করিতাম। ভীত ও নিরাশ পাকিস্তানীরা বহু হতাহতের দরুন হাঁপাইয়া উঠিল। সুযোগ বুঝিয়া আমরা আরো দুই মেইল অগ্রসর হইলাম এবং চাওই নদী আমাদের নিয়ন্ত্রনে নিয়া আসিলাম। তাহাতে অবশ্য আমাদেরও কিছু হতাহত হইল। এ পর্যায়ে ৯ ই অক্টোবর স্বাধীন বাংলার কমিশন প্রাপ্ত প্রথম ক্যাডেট দলের সদ্য পাশ করা তরুন সেঃ লেফটেন্যান্ট আব্দুল মতিন চৌধুরী ও সেঃ লেফটেন্যান্ট মাসুদুর রহমান আমাদের সাব সেক্টরে যোগদান করিলেন। অফিসারের নিতান্তই অভাব ছিল তাই নতুন হলেও এতে আমরা যথেষ্ট উপকৃত হইলাম।

এরপর পাকিস্তানীদের চলাচল একেবারে সীমাবদ্ধ হইয়া পড়িল, কারন আমরা অগ্রসর হওয়াতে অমরখানা পঞ্চগড় রাস্তা আমাদের পেট্রল ও প্রতিরক্ষা হাতিয়ারের আঘাত খমতার আওতায় আসিয়া গেল। আমরা তাহাদের পক্ষে সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিকর রক্ষাবুহ্য রচনা শুরু করিলাম। গড়ে বিভিন্ন অপারেশনে প্রতিদিন পাকিস্তানীদের পাঁচ/ছয় জন করিয়া হতাহত হইতে লাগিল। ২০/ ২৫ দিন এমনতর চলিল। পাকিস্তানীরা সৈন্য পরিবর্তন ও পরিপূরন করিতে লাগিল।

তারপর আমরা দুশমনদের সুদূরবিস্তৃত ঘাঁটিগুলি এমনভাবে ঘেরাও করিয়া বিভিন্ন হাতিয়ারের সাহায্যে আক্রমন চালাইতে লাগিলাম যাহাতে তাহারা অগ্রবর্তী ঘাটীগুলি ছাড়িয়া পিছে হটিতে শুরু করিল। এই সূত্র ধরিয়া ২১ শে নভেম্বর বিকাল ৪ ঘটিকায় আমাদের প্রথম অগ্রাভিযান শুরু হয় তেঁতুলিয়া –ঠাকুরগাঁ সৈয়দপুর পাকা রাস্তাকে অক্ষরেখা ধরিয়া। দুশমন পালাইতেছে আর আমরা পিছনে ধাওয়া করিয়া চলিয়াছি। ২২ তারিখ অমরখানা দখল করিয়া জগদলের দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলাম। লাল স্কুলের কিছু আগে দুশমনের আভাস পাওয়া গেল। রাত তখন ১১ টা। পিছনে বহু কিছু বাকি ভাবিয়া ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার অগ্রগমন বন্ধ করিয়া আত্মরক্ষামূলক পজিশন নিতে বলিলেন। অগ্রাভিযানের অক্ষে ছিল বি ও সি কোম্পানী। বি কোম্পানীর অধিনায়ক ছিলেন সুবেদার আব্দুল খালেক আর সি কোম্পানীতে ছিলেন লেফটেন্যান্ট আব্দুল মতিন ও সুবেদার হাজি মুরাদ আলী। আবার তাহাদের ডাইনে বামে ছিল যথাক্রমে সুবেদার আহমদ হোসেনের “এ” কম্পানী ও সুবেদার আবু হাশেমের “ডি” কোম্পানী। তাহারা সকলে নিজ নিজ কোম্পানির জিম্মাদারি এলাকা বুঝিয়া নিলেন ক্যাপ্টেনের কাছ হইতে।

পরদিন সকাল হইতে শুরু হইল আমাদের অগ্রাভিযান। আমরা এখন দলে ভারী। আমাদের চার কোম্পানী ছাড়াও ৫/৭ জন মুক্তিযোদ্ধা আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে। গোলাবারুদ সাজসরঞ্জামের  কমতি নাই। কাজেই দুশমনের উপর দিলাম ভীষন চাপ। দুশমনদের পা এখন শূন্যে। তাহারা বহুদিনের পুরাতন রক্ষাব্যুহসমূহ ছাড়িয়া দিয়া আর পা মাটিতে লাগাইতে পারতেছেনা।তাহাদের ভাব এখন পালাই পালাই প্রাণ বাঁচাই। আমাদের ভাব মার-মার। তাহারা ভীতসন্ত্রস্ত সদাচকিত পলায়নপর। আর আমরা মহাপ্রাপ্তির বিজয়ের নেশায় আর শতগুনে উতসাহিত ও মাতোয়ারা দিগ্বিজয়ী বীরের বেশে অগ্রসরমান। এ যেন অনেকটা নেকড়ে আর মেষের মোকাবিলা। তবু জগদলের নিকট বেশ কয়েকজন আহত ছাড়াও আমার সাব সেক্টরের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর বেঙ্গল রেজিমেন্টের লেঃ নায়েক শাকিলউদ্দিন শহিদ হন। আমাদের আগে বাড়ার পালা চলিতে লাগিল। কোথাও তুমুল সংঘর্ষ, কোথাও মামুলি,  আবার কথাও একেবারে না।

২৭ শে নভেম্বর। পঞ্চগড় শহর মুক্ত হইল। আগাইয়া চলিলাম। বোদা পৌছিলাম। যুদ্ধের সাধারন বাধাবিপত্তি কাটাইয়া (কোথাও দুশমন কর্তৃক পুল উড়াইয়া দেওয়া,  কোথাও বা মাইন পুঁতিয়া রাখা) অগ্রাভিযান জারি থাকিল। ৩ রা ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁ শহর কব্জা হইল। ৪ ঠা ডিসেম্বর সমাগত। এক্ষনে মিত্রবাহিনী সাঁজোয়া ও গোলন্দাজ ইউনিটসহ আমাদের সঙ্গে আসিয়া যোগ দিলেন। কেননা পাকিস্তান ততক্ষনে যুদ্ধ ঘোষনা করিয়াছে এবং মহান ভারতও তাহার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করিয়া প্রত্যক্ষ সমরে নামিয়াছে। বাস। আমাদের পায়াভারী। আরো নির্ভয় ও বেপরোয়া হইয়া উঠিলাম। আগে বাড়িয়া চলিলাম। বিরাম নাই। আগে বাড়িতে বাড়িতে একেবারে বিরগঞ্জ ভাতগাঁও ব্রীজ। এ অগ্রাভিযানে ইতিমধ্যে বোদা বীরগঞ্জ ও অন্যান্য স্থানে বহু দুশমন হইয়াছে আহত আর বন্দী। প্রচুর হাতিয়ার ও গোলাবারুদ রেশন হইয়াছে আমাদের হস্তগত। রাজাকার ও দালালের ত কথাই নাই। কুড়ি কুড়ি শ শ প্রতিদিন আত্মসমর্পণ করিতেছে আর অজস্র হাতিয়ার গোলাবারুদ দিয়া যাইতেছে জমা।

৯ অথবা ১০ ই ডিসেম্বর। স্থান ভাতগাঁও ব্রিজ আর তার আশপাশ এলাকা। দুশমনদের নিকট থেকে আসল ভীষন বাধা। দুইটি ট্যাঙ্ক ধ্বংসসহ বহু মিত্র সৈন্য হতাহত হইল যাহা এই এলাকায় এর আগে হয়নাই কখনো। অগত্যা একনাগাড়ে কয়েকদিন ওখানে থাকিতে হইল, মিত্রবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করা হইল। সম্মুখের দিকে একেবারে চুপ থাকিয়া বাম হাতে খানসামা হইয়া হঠাত প্রবল আক্রমন চালানো হইল যাহাতে অংশ নিল মিত্রবাহিনীর ৬ টি মাঝারিসহ ৬০ টি বিমান, একখানা হেলিকপ্টার, দুইটি ফাইটার ও একটি ট্যাঙ্ক বহর। মুহূর্তে বহু দুশমন সেনা হতাহত হইল ধ্বংস হইল ৬ খানা ট্যাঙ্ক বাকী দুশমন সৈন্য ঘাঁটি ছাড়িয়া লেজ গুটাইয়া নীলফামারির দিকে দিল ছুট। ফলে প্রধান অংশ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া অবরুধ হউয়ার নিশ্চিত আশঙ্কায় দুশমনরা ভাঙ্গিয়া পরিল। তাহারা ভাতগাঁওয়ের বিখ্যাত ও গুরুত্বপূর্ণ মজবুত পুলটিকে একেবারে ধ্বংস করিয়া আমাদের জন্য একটি বিরাট বাধা সৃষ্টি করতঃ সে এলাকা হইতেও পাততাড়ি গুটাইল একেবারে সৈয়দপুর। আমাদের তরফ হইতেও দুইমুখী পশ্চাদ্ধাবন চলিতে লাগিল নাছোড়বান্দা হইয়া। সৈয়দপুর প্রায় ঘেরাও। হঠাত দেখা গেল পাকবাহিনীর হাতে সাদা নিশান শান্তির প্রতীক আত্মসমর্পণের চিহ্ন। জেনেভা কনভেনশন নমস্য। তাই আমাদের অস্ত্র সংবরন করিতে হইল লড়াইয়ে দিতে হইল ইতি। দিনটি ছিল ১৬ই ডিসেম্বর।

স্বাক্ষরঃ মো কাজিমউদ্দিন

ডি এ ডি

১২- ৬-১৯৭৪

 

 

নীলাঞ্জনা অদিতি

<১০, ১২.৫, ৩১৮-৩২১>

সাক্ষাতকারঃ মোঃ নূরুজ্জামান

 

২৭ শে মে ভোরবেলা সেক্টর কমান্ডিং প্রধান ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ সাহেব, সুবেদার গোলাম মোস্তফা এবং আমি থানা হেডকোয়ার্টারে বসে ছিলাম। এমন সময় উলিপুর (থানা) নিবাসী বলে পরিচয় দানকারী দুজন মৌলভী সাহেব পাকিস্তানী সৈন্যরা ধরলা নদী আক্রমন করেনি বলে জানায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদেরকে পুনরায় পটেশ্বরী ডিফেন্সে পাঠাতে অনুরোধ করে। হানাদার সৈন্যরা ধরলা নদী আক্রমন করেনাই এই মর্মে তারা শপথ করে। উক্ত শপথের উপর ভিত্তি করে একটি ট্রাক, একটি পিক আপ গাড়ি ও একটি জিপগাড়ি বোঝাই প্রায় ১০০ জন গেরিলাকে ঐ দিন ই পুনরায় পটেশ্বরী ডিফেন্সে পাঠানো হয়। গেরিলাদের বহনকারী গাড়ি তিনটি পটেশ্বরি ডিফেন্সের কাছাকাছি পৌঁছতেই এমবুশরত পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের ঘিরে ফেলে। ফলে গেরিলারা দিশেহারা হয়ে লাফিয়ে নিচে নেমে হানাদার সৈন্যদের সাথে খন্ডযুদ্ধে লিপ্ত হয়। কিছুক্ষনের মধ্যেই গেরিলারা ছত্রভংগ হয়ে পরে এবং বেশ কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা হানাদার সৈন্যদের গুলিতে নিহত হন। গেরিলা যোদ্ধাদের অন্যতম প্রধান কমান্দার মোজাহিদ ক্যাপ্টেন শত্রুসৈন্যদের অজস্র গুলির মুখেও সংঘর্ষ স্থল পরিত্যাগ করেনাই। বেশ কিছু সংখ্যক হানাদার সৈন্যকে খতম করে তিনি বীরের ন্যায় মৃত্যুবরন করেন। এই সংঘর্ষে নিহত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন ১) সিপাহী আবুল কালাম, সাবেক ই পি আর নং ১৯৩৭৭ ২) সিপাহী আবুল কাশেম,  সাবেক ই পি আর নং ৫৫৩৪ ৩) সিপাহী সেকেন্দার আলী,  সাবেক ই পি আর নং ১৪২৮০ ৪) এম এপ দেলোয়ার হোসেন ৫ ) এম এফ ড্রাইভার আফজার হোসেন ৬) এম এফ ড্রাইভার গোলাম রব্বানী ৭ ) আতিকুর রহমান (কুক) ৮ ) সিপাহি আবদুল আলী,  সাবেক ই পি আর ৯ ) মোজাম্মেল হক (কুক) ১০ ) এম এফ রবিজউদ্দিন ভুইয়া (ছাত্র) ১১) এম এফ আবুল কাশেম (ছাত্র) ১২ ) এম এফ আসাদুল্লা (ছাত্র) ১৩ ) এম এফ আব্দুল ওহাব (ছাত্র)।

এই ঘটনার পর পটেশ্বরী প্রতিরোধ ঘাঁটি ভেঙ্গে যায়। পাকিস্তানী সৈন্যরা নাগেশ্বরি থানা বাজারে ঢুকে সমগ্র বাজারে আগুন ধরিয়ে দেয়। বাজারে অবস্থানরত একজন পাগলকে দেখামাত্র সৈন্যরা তাকে গুলিবিদ্ধ করে হত্যা করে। হানাদার সৈন্যরা নাগেশ্বরি বাজারে প্রবেশের পরপরি রায়গঞ্জ সেতুর নিকট ডিফেন্স রত মুক্তিযোদ্ধাদের সরিয়ে নেয়া হয়। ভুরুঙ্গামারি থানার সাথে যোগাযোগ রক্ষাকারি রায়গঞ্জ বাজার সংলগ্ন বৃহৎ সেতুটি মুক্তিযোদ্ধারা ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়।

নাগেশ্বরি থানায় অবস্থান পাকাপোক্ত করার পর হানাদার সৈন্যরা ভুরুঙ্গামারী থানার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। ইতিমধ্যে ভুরুঙ্গামারী থানা সদরে অবস্থিত গেরিলা প্রশিক্ষন কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হয় এবং গেরিলা দফতর সীমান্তের ওপারে পশ্চিম বাংলার কুচবিহার জেলার সাহেবগঞ্জ বাজারে সরিয়ে নেওয়া হয়। সেখানেই দ্রুত কয়েকটি অস্থায়ী গেরিলা ঘাঁটি গরে তোলা হয়।  পরে গেরিলা যোদ্ধারা এই অস্থায়ী ঘাঁটিগুলো থেকে ভুরুঙ্গামারী থানা সদরে পারশ্ববতী স্থানে অবস্থানরত হানাদার সৈন্যসের উপর অতর্কিতে আক্রমন শুরু করে।

সুবেদার বোরহান তাঁর অধিনস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ভুরুঙ্গামারী থানার অন্তর্গত সাবেক রেলওয়ে স্টেশন সোনাহাটে চলে যান। পাকিস্তানী সৈন্যরা ভুরুঙ্গামারী থেকে সাবেক পাটেশ্বরী রেলওয়ে স্টেশনের নিকটবর্তী দুধকুমার নদীর উপর অবস্থিত পাটেশ্বরি রেলওয়ে ব্রিজ অতিক্রম করে সোনাহাতে যাতে পৌছতে না পারে সেজন্য পাটেশ্বরী ব্রিজের পূর্বতীরে মুক্তিযোদ্ধাদের মোতায়েন করা হয়।

১৫ ই জুন সাহেবগঞ্জ অস্থায়ী ঘাঁটির গেরিলারা ভুরুঙ্গামারির অদূরে বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত ই পি আর ফাঁড়িতে অবস্থানরত পাকসৈন্যদের উপর আক্রমন চালায়। এই আক্রমনে বেশ কয়েকজন পাকসৈন্য নিহত হয়। গেরিলাদের পক্ষে মোট ৩ জন নিহত হন। নিহত গেরিলারা হলেন(১) সিপাহি আব্দুস সোবহান ই পি আর নং- ১৬০৭৪ (২) সিপাহী মনসুর আহমেদ ই পি আর নং – ৫৮০৪ (৩) কুক আবু কালাম (ই পি আর)।

২৯ শে জুন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল মোগলহাতে অবস্থানরত পাকসৈন্যদের উপর হঠাত হামলা চালিয়ে বেশ কয়েকজন কে হতাহত করে। এখানে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বারি নিহত হন। মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার সৈন্যদের বেশ কিছু অস্ত্র দখল করতে সক্ষম হন।

১৪ ই জুলাই বড়খাতায় অবস্থানরত পাকসৈন্যদের উপর অতর্কিত আক্রমন চালিয়ে গেরিলারা ব্যপক ক্ষতি সাধন করে। মুক্তিযোদ্ধা সিপাহী মুহাম্মদ আলী (ই পি আর নং ৭২৯৬) হানাদার সৈন্যদের গুলিতে নিহত হন। বড়খাতায় হানাদার সৈন্যদের অবস্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের অপর আর একটি দল আক্রমন চালায় ২৩ শে জুলাই। সিপাহী আনোয়ার হোসেন ই পি আর এর এই সংঘর্ষে নিহত হন।

ভুরুঙ্গামারী থানা সদরে প্রবেশের পর পাকসৈন্যরা বাজার সংলগ্ন ভুরুঙ্গামারি কলেজে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছিলো। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বিরাট দল ভারী অস্ত্র সজ্জিত হয়ে ২ রা আগস্ট হানাদার সৈন্যদের উক্ত অবস্থানের উপর প্রচন্ড আঘাত হানে। এই সংঘর্ষে উভয় পক্ষই মেশিনগান ও কামান ব্যবহার করে। মুহুর্মুহু প্রচন্ড কামানের শব্দে চারদিক প্রকম্পিত হতে থাকে। হানাদার সৈন্যরা তাদের অবস্থান থেকে সরে না গেলেও বহু হতাহত হয়। এই প্রচন্ড যুদ্ধে  ম্যক্তিযোদ্ধা আনসার আলি নিহত ও বেশ কিছু সংখ্যক আহত হন। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সৈন্যদের উপর চাপ অব্যাহত রাখেন। ১৩ ই আগস্ট পুনরায় বুরঙ্গামারী বাজারের সন্নিকট থেকে হানাদার সৈন্যদের উপর আক্রমন চালান হয়। এই আক্রমন অল্প সময়ের মধ্যেই প্রচন্ড সংঘর্ষে রূপ নেয়। সৈন্যরা ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি স্বিকার করে।মুক্তিযোদ্ধা সিপাহি কবির আহমদ,  ই পি আর নিহত হন। এর পর থেকে আমাদের গেরিলা যোদ্ধাদের আক্রমন ক্ষমতা বেড়ে যায়। ভারত থেকে আমরা পর্যাপ্ত গোলাবারুদ পাচ্ছিলাম। ভারী অস্ত্র চালনায় গেরিলা যোদ্ধারা বেশ দক্ষ হয়ে উঠছিল।

২৫ শে আগস্ট কুড়িগ্রাম শহরে অবস্থানরত পাকিস্তানী সৈন্যদের প্রেরিত গেরিলা লিডার সিপাহী মকবুল হোসেনকে (ইপকাপ নং ২৯১২৭) কুড়িগ্রাম থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে প্রতাপ নামে ছদ্মবেশে তৎপর থাকাকালীন আমাদের গেরিলারা গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রেরিত গেরিলা লিডার মকবুল নারীর ছদ্মবেশে উক্ত গ্রামে খবর সংগ্রহের জন্য ঘোরাফেরা করছিল।

৬ ই নভেম্বর প্রত্যুষে প্রায় আড়াই হাজার মুক্তিযোদ্ধা এম এম /এফ এফ ৪ থেকে ৫ ব্যাটেলিয়ন ভারতীয় সৈন্যদের সহযোগীতায় ভুরুঙ্গামারী থানার জয়মনিরহাটে পাকিস্তানি সৈন্যদের শক্তিশালী অবস্থান ঘাঁটির উপর প্রচন্ড আঘাত হেনে দখল করে নেয়। এই প্রচন্ড সংঘর্ষে বহূ সংখ্যক পাকিস্তানী সৈন্য হতাহত হয়। পাকিস্তানীদের বিপুলসংখ্যক মারণাস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনী হস্তগত করে। ভারতীয় বাহিনির কিছুসংখ্যক জোয়ান সংঘর্ষ কালীন নিহত হয়। অথচ মুক্তিযদ্ধাদের এম এফ /এফ এফ দের মধ্যে মাত্র কয়েকজন নিহত হন।

১৩ ই নভেম্বর ভুরুঙ্গামারি থানার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এদিন মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সহায়ক সৈন্যদের সম্মিলিত বিরাট বাহিনির বীরযোদ্ধারা হানাদার সৈন্যদের দখল থেকে ভুরুঙ্গামারি মুক্ত করেন। এই অভিযানে ভারতীয় সহায়ক বাহিনীর নেতৃত্ব দেন ব্রিগেডিয়ার জোশি এবং মুক্তিযোদ্ধাদেরকে পরিচালনা করেন সাবেক বিমান বাহিনীর উইং কমান্ডার ও যুদ্ধকালীন সেক্টর কমান্ডার কে এম বাশার ও সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর নওয়াজেশ। ১৩ ই নভেম্বরের এই সম্মিলিত আক্রমনে ৩ জন পাঞ্জাবি সৈন্যকে জীবন্ত ধরা হয়। কোন পথেই পাকিস্তানীরা পালাতে না পেরে বহু মারা পরে। সৈন্যদের পরিত্যক্ত বিপুল সমরসম্ভার সম্মিলিত বাহিনীর হস্তগত হয়। ভুরুঙ্গামারি দখলের পরপরই বেশ কিছু সংখ্যক বাঙালি শিক্ষিতা মহিলাকে স্থানীয় সার্কেল অফিসার উন্নয়ন অফিসে বন্দী অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। মহিলাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন। বর্বর সৈন্যরা এদেরকে বিভিন্ন স্থান থেকে অপহরন করে এখানে এনে রেখেছিল।

২২ শে নভেম্বর রংপুর জেলার অন্তর্গত বড়খাতায় হানাদার বাহিনীদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের এক প্রচন্ড সংঘর্ষে কোম্পানী কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান (নং ০৫৯৩) শহীদ হন। এছাড়া আরো দুজন মুক্তিযোদ্ধা সংঘর্ষকালে শহিদ হন। সংঘর্ষে পাকিস্তানীরা গোলন্দাজ বাহিনী ব্যবহার করে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেনঃ হাবিলদার রঙ্গু মিয়া (নং ৭০২১২৪৭) ও এম এফ নাসির আহমেদ।(এম এফ নাসির আহমেদ ঐ সময় মেজর পদে উন্নিত হয়েছিলেন)।

২০ শে নভেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনিতে কমিশনপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুন ছাত্র লেঃসামাদ কুড়িগ্রাম মহকুমার অন্তর্গত রায়গঞ্জ সি এন্ড বি পুলের দুই পার্শ্বে অবস্থানরত হানাদার বাহিনির শক্তিশালী ঘাঁটির উপর আক্রমন চালান। তাঁকে ভারতীয় সহায়ক বাহনী দিয়ে সাহায্য করে ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার যোশি। প্রচন্ড সংঘর্ষে এক পর্যায়ে যখন হানাদার সৈন্যদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতাহাতি সংঘর্ষ শুরু হয় তখন দুঃসাহসী সামাদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচালনা করেছিলেন বীর বিক্রমে। হঠাত হানাদার বাহিনীর গুলির আঘাতে আহত হয়ে তিনি সংঘর্ষ ক্ষেত্রেই মৃত্যু বরন করেন। এই ভয়াবহ সংঘর্ষে নিহত অপর মুক্তিযোদ্ধা হলেন ই পি আর সিপাহী কবীর আহমেদ (৫০১৬৫) এবং আব্দুল আজীজ। তীব্র মুখোমুখি যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধাগন শত্রুদের রায়গঞ্জ ও আন্ধারীঝাড় অবস্থান দখল করেন। বহুসংখ্যক পাকিস্তানী সৈন্য হতাহত হয় এবং বিপুল পরিমান সমরাস্ত্র সম্মিলিত বাহিনীর হাতে আসে।

২৪ শে নভেম্বর মুক্তিবাহিনির যোদ্ধারা নাগেশ্বরী থানাও পাটেশ্বরিতে অবস্থানরত সৈন্যদের ঘেরাও করে। ঐ দিনের সংঘর্ষে সাইদুর রহমান এফ এফ ৯০/৩৫, সেরাজুল হক এফ এফ ১১৮/২০ এবং সোহরাব আলী এফ এফ ১১৮/৩৬ নিহত হন।

২৮ শে নভেম্বর সম্মিলিত বাহিনী নাগেশ্বরী ও বেপারীহাট মুক্ত করে। বেপারীহাট সংঘর্ষে সিপাহি এম এফ আলী আকবর (৫০৭১২) এবং সিপাহি এম এফ আবুল হসেন (৫০৮৫৩) নিহত হন। এর পর পরই ধরলা নদীর উতর দিকের বিস্তীর্ণ অঞ্চল হানাদার বাহিনীর কবলমুক্ত হয়।

মোঃনুরুজ্জামান

বাংলাদেশ রাইফেলস

১৫-৭-৭৮

*সাক্ষাৎকারটি প্রকল্প কর্তৃক ১৫-৭-৭৮ তারিখে গৃহীত হয়।

নীলাঞ্জনা অদিতি

<১০, ১২.৬, ৩২১-৩২৬>

 

সাক্ষাৎকারঃ লেঃ কর্নেল মতিউর রহমান

 

আমরা দিল্লী থেকে কলকাতাতে ফ্লাই করি মে মাসে। তারপর আমরা বাংলাদেশের ফোর্সেস হেডকোয়ার্টারে আসি। সেখানে নূরকে নিযুক্ত করা হল এডিসি টু সি-ইন-সি। আমি এবং ডালিম- দুজনকেই সি ইন সির গেরিলা এডভাইজার হিসাবে এপয়েন্টমেন্ট দেয়া হয়। আমি ছিলাম ৬ নং সেক্টরের জন্য ডালিম ছিল যশোর এরিয়ার অর্থাৎ ৮ নং সেক্টরের জন্য। আমরা জেনারেল ওসমানির সাথে দিল্লী থেকে কলকাতা এলাম। যদিও আমি আমার ইউনিটে অর্থাৎ ৩ য় ইস্ট বেঙ্গলে যোগদান করতে চেয়েছিলাম কিন্তু জেনারেল ওসমানি তাতে মত দিলেন না। তিনি আমাকে নিয়ে এলেন ৬ নং সেক্টর এলাকায়। তখনো ৬ নং সেক্টর হয়নি। ওখানে তখন ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ ছিলেন। তাঁর কাছে আমাকে রেখে দেন। আমাকে ইন্সট্রাকশন দেয়া হয় আমি যেন বাংলাদেশের ভেতরে না ঢুকি। কেন আমাকে এই ইন্সট্রাকশন দেয়া হল আমি বুঝতে পারিনি। ইন্ডিয়ানদেরকেও বলে দেয়া হয় আমাকে যেন বাংলাদেশের ভেতরে ঢোকার অনুমতি না দেয়া হয়। আমি কর্নেল নওয়াজেশের সাথে থাকতে থাকতে বোর ফিল করি। কোন কাজ নেই একমাত্র এসেসমেন্ট ছাড়া। আমি আস্তে আস্তে বি ডি আর ট্রুপ্স নিয়ে ছোটখাট রেইড ও এমবুশ করতে থাকি। কর্নেল নওয়াজেশ ভুরুঙ্গামারি এলাকায় থাকতেন।

একবার মনে আছে ইন্ডিয়ানরা খবর দেয় যে, ভুরুঙ্গামারিতে ৩০/৩৫ জন পাকসেনা আছে। ৩৫ জন লোক খুব কমই। তখন আমি একটা প্লাটুন এবং কর্নেল নওয়াজেশ একটা প্লাটুন নিয়ে ভুরুঙ্গামারী রেইড করতে যাই। ম্যাপ অনযায়ী আমাকে শুধু একটা নদী পার হতে হবে। আমার কাছে পাকিস্তানী সৈন্যের বুলেটকে যত না ভয় ছিল তার থেকে পানি পার হওয়া বেশি ভয়ের ব্যপার ছিল। যাই হোক তারা আমাকে দুটো কলাগাছ একসাথে করে ভেলা বানিয়ে তার উপর শুইয়ে শুইয়ে টেনে টেনে পার করা হয়। এই নদীই রাতে আমাকে চার পাঁচবার পার হতে হয়েছে। আমাকে ফাঁকি দেয়ার জন্য তারা একবার এপারে আবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওপাড়ে এভাবে চারবার পার করিয়েছে। সে সময়ের মধ্যে আমাদের ভুরুঙ্গামারী যাবার কথা সেই সময় পার হয়ে যায়। ম্যাপ অনুযায়ী আমি বুঝতে পারছিলাম না কোথায় যাচ্ছি, কেননা পানিতে আমি পুরোপুরি অন্য লোকের উপর নির্ভর করতাম। যখন ভোর হয়ে আসে তখন আমি ওদের চালাকি বুঝতে পারি। আমরা ফেরত আসি। তখন ইন্ডিয়ান যে ব্রিগেডিয়ার ছিলেন তিনি খুব তাচ্ছিল্যের সাথে আমাকে বলেছিলেন যে আমার জন্যই রেইডটা সফল হয়নি আমার সাহস নেই এইসব। এতে আমার খুব রাগ ধরে। ব্রিগেডিয়ার সাহেবকে দেখাবার জন্যে সম্ভবতঃ জুলাই মাস হবে পরের রাতে আমিও আমার ব্যাটম্যান এবং আরেকটা লোক আমরা তিনজনে ভুরুঙ্গামারি যাই। সেখানে আসলে একটা কম্পানী ছিল। এই কোম্পানীর ৪ মাইল দূরে আরেকটা প্লাটুন ছিল। কোম্পানী কমান্ডার সন্ধ্যার সময় প্রায়ই বলতে গেলে রোজই ঐ প্লাটুন থেকে মূল কোম্পানিতে চলে যেত। আমরা প্ল্যান করি পথের মধ্যে ঐ কোম্পানী কমান্ডারকে এম্বুশ করব। আমরা দুপুরে খাওয়ার পরে রওনা হলাম। আমরা বর্ডার ক্রস করে ভিতরে ঢুকি। জায়গায় পৌঁছে রাস্তা থেকে ৩০০/৪০০ গজ দূরে থাকতে কোম্পানী কমান্ডারের জীপ আমাদেরকে ক্রস করে চলে যায়। ফলে তাকে এমবুশ করা সেদিনের মত হয়নি। কিন্তু তাকে ধরবার জন্য খোলা মাঠের উপর দিয়ে আমরা পিছনে পিছনে দৌড়ে যাই হঠাত দেখি সামনে সাদা বিল্ডিং। আমি শুনেছিলাম যে, ভুরুঙ্গামারি কলেজে পাকিস্তান আর্মি থাকে। ভুরুঙ্গামারির একমাত্র সাদা বিল্ডিং হচ্ছে ঐ ভুরুঙ্গামারি কলেজ। আমরা দৌড়াতে দৌড়তে সাদা বিল্ডিং  এর প্রায় ৩০ গজ দূরে চলে গিয়েছিলাম। যখন বাঁশঝাড় থেকে বের হই তখনই দেখি সদা বিল্ডিং এর সঙ্গে সঙ্গে আমরা থেমে যাই। আবার বাঁশ ঝারের ভিতর চলে যাই। কেননা, এখানেই পাকিস্তান আর্মি থাকে। আমরা তখন ওদের কথাবার্তা শুনছি। বাঁশঝাড় থেকে কলেজ খুব বেশি হলে ৫০ গজ। সামনে ছোট ছোট পাটগাছ। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, চাঁদ ছিল তাই পরিস্কার সব কিছু দেখা যায়। কলেজের পাশ দিয়ে পাকিস্তানী সেন্ট্রিগুলো হাঁটছে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। ইন্ডিয়ান ব্রিগেডিয়ার যে কমেন্ট করেছিল সেটা আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। আমার মাথায় চিন্তা ছিল কিছু একটা করতে হবে। সেজন্য আমি  অপেক্ষা করতে থাকি। আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি যেন বৃষ্টি আসে। অন্ততঃ মেঘ আসুক যাতে চাঁদ না থাকে অন্ধকার হয়ে যায়। এ রকম অপেক্ষা করতে করতে রাত যখন দেড়টা দুইটা তখন ঠিকই মেঘ আসল এবং ঝির ঝির করে বৃষ্টি পরতে শুরু করল। রাত সাড়ে ১০ টার দিকে পাকিস্তানী আর্মি দিনের ডিউটি শেষ করে ঘুমাতে যায় সেন্ট্রি বাদে। সেন্ট্রীদের দেখতে পাচ্ছিলাম। হাঁটাচলা করছে। আমি এবং আমার ব্যাটম্যানের হাতে দুটা করে গ্রেনেড। আমাদের সাথে যে আরেকটি লোক ছিল ও হাতে এল এম জি ছিল। তাকে আমরা পাশে রেখেছিলাম। তাকে অর্ডার দিয়েছিলাম যে গ্রেনেডের চারটা এক্সপ্লোশন হওয়ার পরে সে ফায়ার করতে থাকবে যেন আমরা উইথড্র করতে পারি। বৃষ্টির ভিতর আমরা পাটক্ষেতের মধ্য দিয়ে ক্রস করতে করতে বিল্ডিং এর কাছে পৌছাই এবং আমরা দেখতে পাচ্ছি বিল্ডিং এর বারান্দায় চৌকির উপর পাকিস্তানী আর্মিরা শুয়ে আছে। পাকিস্তানী সেন্ট্রিটা যখন হেঁটে আমাদের ক্রস করে চলে যায় তখন আমরা দুজন দৌড়ে আমাদের গ্রেনেড ফেলে দিয়ে ফেরত আসি। তখনো আমরা জানতাম না পাকিস্তানীদের কি ক্ষয়ক্ষতি হল।আমরা দৌড়ে ফেরত আসছি ততক্ষনে পাকিস্তানিরা গুলি করতে  শুরু করেছে। হঠাত আমি আছাড় খেয়ে পরে যাই। মনে হল আমার পায়ে কিছু একটা লেগেছে। পরে দেখি আমার দান পাটা অবশ হয়ে গেছে আমি আর উঠতে পারছি না। আমার ব্যাটম্যান এবং আমার সাথের লোকটি দুজনে ধরে আমাকে উঠায়। তখন দেখি আমার পায়ে একটা গুলি লেগেছে। গুলিটা বেশি ভেদ করে যেতে পারেনি কেননা আমরা বেশ দূরে ছিলাম ওরা তাড়াতাড়ি ঘাড়ে করে আমাকে নিয়ে আসে। এবং আমরা আবার ইন্ডিয়াতে ফেরত আসি। সেখানে আমাদের ডাক্তার ছিল, সে গুলি বের করে ব্যান্ডেজ করে দেয়। আমি সাতদিন পরেই ঠিক হয়ে যাই। পরে আমরা জানতে পারি যে, সেদিনের গ্রেনেড বিস্ফোরনের ফলে ৭ জন পাক আর্মি নিহত ও ১৫ জন আহত হয়েছে।

কয়েকদিন পর ভুরুঙ্গামারীতে দুই কোম্পানী নিয়ে আক্রমন করার প্ল্যান করা হয়। খুব সম্ভব জুলাই/আগস্টের দিকে। সেখানে পাকিস্তানীদের এক কোম্পানী ছিল। ঐ জায়গাটা দখল করার জন্য আক্রমনের প্ল্যান করা হয়। ইন্ডিয়ানরা আমাদের আর্টিলারি সাপোর্ট দিবে। আমরা দুই কোম্পানী সারারাত হাঁটার পরে ভোরবেলা ঐ কলেজের কাছে পৌছাই। ভোর হচ্ছে হচ্ছে এমন সময় জয় বাংলা বলে আক্রমন করি। মোট দুটি কম্পানী ছিল। দুটির ই ফিল্ড কমান্ডার আমি ছিলাম। কর্নেল নওয়াজেশ অবশ্য কোম্পানী কমান্দারের কাজ করেন নি তিনি ব্যাটেলিয়ন কমান্ডারের কাজ করেছেন। তিনি যুদ্ধকে ডাইরেক্ট করেছিলেন পেছন থেকে। এছাড়াও আরও ৮০ জন গিয়েছিল সেটা লেঃ ফারুকের অধীনে ছিল। তাদের কাজ ছিল নাগেশ্বরী থেকে যে রোড এসেছে ভুরুঙ্গামারীতে সেই রোডের উপর এমবুশ করা যাতে পাকিস্তানীরা রিইনফোর্সমেন্ট না আনতে পারে। এজন্য সে প্রায় সাড়ে ৩ মাইল দূরে জয়মনিরহাট রেলওয়ে স্টেশনের কাছে এমবুশ পাতে ও আমরা ৫০ গজ দূর থেকে জয়বাংলা বলে আক্রমন শুরু করি। পাকিস্তানিরা প্রথমেই গুলি করে। তাদের সম্মুখে যে বাঙ্কারগুলি ছিল সেগুলো থেকে উইথড্র করে তারা পিছনে সরে যায়। আমাদের লোকেরা সবাই পাকিস্তানিদের গুলি আসার সাথে সাথে মাটিতে শুয়ে পরে। আমি অনেক চেষ্টা করেও তাদের মাটি থেকে উঠাতে পারিনি। তবে আমি কিছু লোক নিয়ে কলেজ বিল্ডিং এর দিকে এগিয়ে যাই। ইতিমধ্যে ইন্ডিয়ানরা যে আমাদের আর্টিলারি সাপোর্ট দিচ্ছিল সেটা ভুল হউয়াতে আমাদের গোলাই আমাদের উপরে এসে পরতে শুরু করে যার ফলে আমাদের ৪/৫ জন মারা যায়। আমরা দেখছিলাম যে, পাকিস্তানীরা পালিয়ে যাচ্ছিলো। আমরা তাদের উপর গুলি করছিলাম। এবং কলেজ বিল্ডিং এ তাদের যা কিছু ছিল তাতে আমরা আগেই আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাম। এভাবে প্রায় সাড়ে আটটা বেজে যায়। ইতিমধ্যে পেছন দিক থেকে লেঃ ফারুক যে রোডের উপর এমবুশ করছিল শত্রুরা সেই এমবুশের উপর দিয়ে তাদেরকে ক্রস করে আমাদের পিছন দিকে চলে আসে। সুতরাং আমাদের সামনেও পাকিস্তানীরা ছিল পিছন দিকেও পাকিস্তানীরা ছিল। যদিও কর্নেল নওয়াজেশ আমাকে আক্রমন চালিয়ে যাবার জন্য উৎসাহ দিচ্ছিলেন কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম যে আক্রমন চালিয়ে যাওয়া মানে আমার দলের অনেক লোক হতাহত হওয়া। কারন আমাদের দলের লোকদের ভাল ট্রেনিং নেই। পাকিস্তানীরা মর্টার ছোড়া শুরু করেছিল। ওখানে থাকা মানে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হওয়া। এইজন্য আমি ওখান থেকে আমার লোকজন নিয়ে উইথড্র করে আবার ইন্ডিয়াতে ফেরত চলে আসি। এই ব্যপারটা নিয়ে কর্নেল নওয়াজেশের সাথে আমার বেশ গন্ডগোল হয়, যার ফলে তখন আমাদের সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হয়েছিলেন এম কে বাশার। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে আমাকে একটা আলাদা সাব সেক্টর দেওয়া হবে। সেটা হচ্ছে পাটগ্রাম। পাকিস্তান আর্মি তখনো পাটগ্রামে আসেনি।

পাটগ্রাম এমন এক জায়গা যেটা লম্বায় প্রায় ২২ মাইল,  চওড়ায় দুপাশে ইন্ডিয়া অনেকটা লাউ এর মত।লাউ এর গলাটা আড়াই মাইল। আড়াই মাইল জমি বাংলাদেশের, মধ্যিখানে ইন্ডিয়া। মধ্যখান দিয়ে একটা রেলওয়ে লাইন চলে গেছে। এজন্যই হয়ত সেই এলাকায় পাকিস্তান আর্মি আসেনি বা আসতে সাহস করেনি। আমাকে বিডি আর মুক্তিফৌজের একটি কোম্পানী দিয়ে বলা হল যে, পাটগ্রাম এলাকাকে যে কোন ভাবে মুক্ত রাখতে হবে। আমি ঐ এক কোম্পানী নিয়ে সোজা চলে যাই পাটগ্রাম এলাকাতে। এবং লাউ এর  গলার মাঝখানটা অর্থাৎ যেখান টায় সবচেয়ে কম জায়গা সেখানে একটা ডিফেন্স নেই এবং এক কোম্পানি দিয়ে পাটগ্রামের ডিফেন্সের আয়োজন করি। এটা খুব সম্ভব আগস্টের শেষের দিকে হবে। অরে অবশ্য আমাকে পাটগ্রাম ডিফেন্সের জন্য ৫ টা কোম্পানী দেয়া হয় ৫ টা মুক্তিফৌজ কোম্পানী। বাওরা বলে একটা জায়গা আছে সেখানে আমরা ডিফেন্স নেই। ইতিমধ্যে, খুব মজার ব্যপার পাকিস্তানিরা হাতিবান্ধায় চলে এসেছে। হাতিবান্ধা ও বাওড়ার মধ্যে পার্থক্য তিন থেকে সাড়ে তিন মাইল। পাকিস্তানীরা হাতিবান্ধায় এসে ডিফেন্স নিয়েছে আর আমি বাওড়ায় একটা ডিফেন্স খুলেছি। তখন বর্ষাকাল ছিল বলে রেললাইনের উপর ছাড়া কোন যানবাহন চলতে পারত না। আমি চিন্তা করলাম রেলকাইনটা যদি কাট করা যায় তাহলে পাকিস্তানীরা আর আসতে পারবে না। আমার সাথে ৯০ জন লোক হাতে কোন মেশিনগান ছিল না। কিন্তু আমি তখনকার ইপিআরদের দেখে বুঝতে পারছিলাম যে, তাদের পক্ষে পাকিস্তানীদের আক্রমনের মুখে সবসময় এক জায়গা দরে রাখা সম্ভব নয়। সেজন্য আমি রেলওয়ে লাইনের আশেপাশে যে সকল গ্রাম ছিল প্রত্যেক গ্রামে ডিফেন্স করে রেখেছিলাম। আমি ভাবছিলাম যদি পাকিস্তানিরা একটা গ্রামে আক্রমন চালায় তাহলে তারা যেন সেই জায়গা ছেড়ে পরবর্তী গ্রামে গিয়ে বসতে পারে।পাকিস্তানীরা সাধারনতঃ এক এক রাতে এক এক গ্রামে আক্রমন চালাত। আমাদের লোকেরা পরবর্তী গ্রামে গিয়ে ডিফেন্স নিত। ডিফেন্স খোলা ছিল। পাকিস্তানীরা আমাদের জায়গায় এসে কিছুক্ষন থাকার পরেই ভোর হবার আগেই তাদের মেইন ডিফেন্স হাতিবান্ধায় চলে যেত। আমরা আবার সকালবেলায় আমাদের পুরোনো জায়গায় গিয়ে বসতাম। এ রকম খেলা চলতে লাগল প্রায় এক মাসের মত। পাকিস্তানীদের এক কোম্পানী ছিল হাতিবান্ধায়। এভাবে আগস্ট মাস পার হয়ে যায়। এর মধ্যে আমি আরেকটা কোম্পানী পাই। তখন রেললানের উপাশে দুটা কোম্পানী লাগিয়ে একটা পার্মানেন্ট ডিফেন্স নিযুক্ত করি। পাকিস্তানীদের ও তখন শক্তি বেড়েছে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমার ৫ টা কম্পানী গড়ে ওঠে। আমাদের উপর বারবার আক্রমন হবার ফলে আমাদের বেশ ক্যাজুয়ালটি হত। ফলে আমাদের সেক্টর কমান্ডার মনে করলেন যে জায়গাটা ধরে রাখতে হবে জায়গাটা গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য তিনি আমাকে আরো ৫ তা কোম্পানী পরে দেন। আমার পিছনে বি এস এফ এর একটা ব্যাটেলিয়ন ছিল, তারপরে ইন্ডিয়ান আর্মির একটা ব্যাটেলিয়ন ছিল। আমাদের সাপোর্টে তিনটা ট্যাঙ্ক ছিল এবং ইন্ডিয়ান আর্টিলারির ব্যাটারি ছিল। আমাদের ডিফেন্স খুব শক্তিসম্পন্ন হয়ে গেছে। পাকিস্তানীদেরও আর্টিলারি ব্যাটারি ছিল। মোট কথা, ডিফেন্সিভ যুদ্ধ দুই পাশ থেকেই চলতে থাকে। কিন্তু আমাদের ইচ্ছা ছিল আমরা ক্রমাগত আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগিয়ে যাবো। কেননা আমাদের সামনের গ্রামে যদি আর্মিরা না থাকত তখন আমরা ঐ গ্রামে গিয়ে বসে থাকতাম। এভাবে এগোতে এগোতে আমরা সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানীদের থেকে ৪০০ গজ দূরে এসে ডিফেন্স নিলাম। মধ্যখানে ধানক্ষেত। এপাশে আমরা অপাশে ওরা। সে সময় আমাদের মরাল খুব ই ডাউন ছিল। কেননা এ পর্যন্ত আমরা কোন কিছুতেই তেমন সফলকাম হতে পারিনি। পাকিস্তানী ডিফেন্সের বিপরীতেও আমরা আক্রমন চালাই কিন্তু তাদের ডিফেন্স এত শক্ত ছিল যে আমার লোকজনের তেমন ভাল ট্রেনিং না থাকায় অনেক সময় আমরা তাদের বাঙ্কারের উপর বসে থাকতাম। তারা বাঙ্কারের ভিতরে কিন্তু আমরা তাদের মারতে পারতাম না। ফলে আমরা হতাহত হয়ে পিছনে হটতাম। এবং তারা যে মাইন বসাতো তাতে আমাদের অনেক লোক হতাহত হত। সুতরাং আমি দেখলাম যে এভাবে আমাদের কোন সাকসেস হবেনা অন্যভাবে হয়ত হবে। আমার ডানপাশে ছিল তিস্তা নদী। তিস্তা নদীর ওপাশে পাকিস্তানীদের অবাধ গতি। রৌমারী থানার অন্তর্গত সুঠিবাড়ি এলাকা বলে একটা জায়গা ছিল। আমরা খবর পেতাম সেখানে পাকিস্তানীদের একটা প্লাটুন আছে এবং সাথে ইপিকাফের আরো একটি প্লাটুন। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম মুক্তিযোদ্ধাদের কোম্পানী নিয়ে ঐ জায়গাটি রেইড করব। আমার বিশ্বাস ছিল সাফল্য আমাদের আসবে। এবং এ সাফল্যে আমার ট্রুপ্স এর মনোবোল বেড়ে যাবে।

আমি এক কোম্পানি নিয়ে বাওড়া থেকে দুটি নৌকাযোগে তিস্তা পার হই। সেই রাতে প্রচুর ঝড়বৃষ্টি হছিল। নদীর মাঝখানে পৌছে মনে হয়েছিল আমার নৌকা বুঝি ডুবে যাবে এবং আমরা সবাই ডুবে মারা যাব কারন নদীতে ছিল প্রচন্ড স্রোত। নদী পার হয়ে গাইডের সাহায্যে আমরা সুঠিবাড়ি – যেখানে একটা বিল্ডিং ছিল সম্ভবতঃ কৃষি দফতরের ভবন -প্রায় পৌছে যাই। বিল্ডিং এর সামনে প্রায় ৫০ গজ চওড়া একটা ছোট ক্যানেল ছিল। আমাদের আক্রমন করতে হলে ক্যানেলটি পার হতে হবে। তখন প্রায় ভোর হয় হয়। আমি আমার কোম্পানীকে দু ভাগে ভাগ করলাম। একটি দল ইতিমধ্যে  ক্যানেল ক্রস করে রৌমারীর দিকে যে রাস্তা সেই রাস্তায় এমবুশ করে বসেছে। প্ল্যান ছিল আমি আক্রমন চালালে পাক ফৌজ পালিয়ে যেন রৌমারীর পথে যেতে না পারে। অপরদিকে রৌমারী থেকেও যেন পাকসেনারা সাহায্যে এখানে আসতে না পারে। আমি ক্যানেলটির পার থেকে পাকসেনাদের মুভমেন্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু আমি নিজে ক্যানেল ক্রস করতে পারছিলাম না। দ্রুত সময় পার হচ্ছিল। ক্রমশ আমার মনে দ্বিধা জন্মাচ্ছিল আক্রমন করব কিনা। সিদ্ধান্ত নিলাম আক্রমন করবই। আমি আমার মর্টার দিয়ে প্রথম ফায়ার ওপেন করলাম। পাকসেনারা কিছুক্ষন বিচলিত হয়ে পরক্ষনেই পাল্টা আক্রমন চালায়। আমি এক সময় নদীতে ঝাঁপিয়ে পরি।আমার কোমরে দড়ি বাঁধা থাকত। আমার ঝাঁপ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার ব্যাটম্যানও নদীতে ঝাঁপ দেয়। দড়ির বাকী অংশ তার হাতেই ছিল।  ব্যাটম্যান টেনে আমাকে ক্যানেলের অপর পাড়ে নিয়ে যায়। আমার সঙ্গের সবাই ক্যানেল পার হয়ে বিল্ডিং এর উপর চড়াও হয়। পাকিস্তানিরা তখন পালাবার চেষ্টা করতে থাকে। এই আক্রমনে ১৫জন পাকিস্তানী সেনা নিহত হয়। ১৫ জনের ৭ জন ছিল পাক সেনাবাহিনীর এবং ৮ ছিল ই পি কাফ। আহত হয় প্রচুর। ঐ সংঘর্ষ আগস্টের শেষের দিকে অথবা সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঘতে। ঠিক তারিখ আজ আর  মনে নাই। ভারতীয়রা বলত প্রমান স্বরূপ যুদ্ধে নিহত পাকসেনাদের মাথা কেটে নিয়ে আসতে হবে। আমরা ১৫ টি মাথা কেটে এবং তাদের ইউনিফর্ম নিয়ে আমাদের গন্তব্যে রওয়ানা হই। এই সংঘর্ষে আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং তিনজন গুরুতররূপে আহত হন। এই আক্রমনের জন্যেই পরবর্তীতে আমাকে বীরবিক্রম উপাধি দেয়া হয়। সংঘর্ষে আমাদের ছেলেদের মনোবল সাংঘাতিক ভাবে বেড়ে যায়। পাকসেনারা যখন অস্ত্র ফেলে পালাচ্ছিল তখন আমার ছেলেরা পিছু ধাওয়া করে তাদের হত্যা করছিল। আমার ছেলেদের সাহসিকতা দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম আমি সেদিন। এই অপারেশনে আমার সাব সেক্টরে ভীষন মরাল ইফেক্ট হয়েছিল- যার ফলে আমার রেইডিং পার্টি পরবর্তীতে সৈয়দপুর পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে রেইড করত। এবং প্রতিটি রেইড ই সাকসেসফুল হয়েছে।

বয়রাতে আমাদের ডিফেন্স ছিল। আমরা লম্বালম্বি নিয়েছিলাম আমাদের সামনে ৪০০/৫০০ গজ দূরে পাকসেনারা ডিফেন্সে ছিল। পাকিস্তানীরা প্রায়ি আমাদের উপর আক্রমন চালিয়ে আমাদের ডিফেন্স দখল করার চেষ্টা করত কিন্তু আমাদের ডিফেন্স এত মজবুত ছিল যে তারা বারবারই পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। আমরাও চেষ্টা করতাম তাকে পিছু হটাতে।

একটি অপারেশনের কথা আমার মনে আছে। পাকিস্তানীদের ডিফেন্সের সামনে মাইনফিল্ড ছিল। আমাদের এটাকিং ফোর্স লেঃ ফারুকের কমান্ডে মাইন ফিল্ড অতিক্রম করে পাকসেনাদের বাঙ্কারের উপর চলে গিয়েছিল কিন্তু আমাদের ছেলেরা যুদ্ধের সকল বিষয় অয়াকিবহাল না হওয়ায় যথাযথ আক্রমনে ব্যর্থ হয় এবং মাইনে আমাদের বেশ হতাহত হয়।

পাটগ্রাম থানা স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশেই চলত আমাদের প্রশাসন ছিল এবং আমরা উরো থানা নিয়ন্ত্রন করতাম। পাটগ্রামের পেছনে বুড়িগ্রামে আমাদের সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছিল। হেডকোয়ার্টারে আমাদের সেক্টর কমান্ডার এম কে বাশার থাকতেন। তিনি দিনাজপুর থেকে রংপুর পর্যন্ত কমান্দ করতেন। তাঁর সম্পর্কে  দু একটি কথা বলতে হয়। যদিও তিনি বিমান বাহিনীর অফিসার ছিলেন তথাপি তিনি অতি সাফল্যের সঙ্গে আমাদের প্রায় ৩০০ মাইল সেক্টর এরিয়া দেখতেন।তাকে কোন সময় রাতে বিছানায় শুতে দেখিনি। জীপে জীপেই একটু আধটু ঘুমাতেন। কারন সারারাতই তাঁকে এক সাব সেক্টর থেকে অন্য সাব সেক্টরে ঘুরতে হত। তার প্রেরনা ছিল অফুরন্ত- আমাদের পাথেয়।

আমাদের হাতীবান্ধা অপারেশন ছিল ভয়াবহ। হাতীবান্ধাতে পাকিস্তানিদের একটি কোম্পানী ছিল। আমি ইতিপূর্বে কয়েকবার চেষ্টা করেছি- হাতীবান্ধা দখল  করতে ব্যর্থ হয়েছি। নভেম্বর ২০/২১ হবে। ঈদের দিন ছিল। আমরা ঈদের সুযোগ নিয়ে ঠিক সকাল ৮ টায় হাতীবান্ধা আক্রমন করি যদিও দিনের আলোতে ঐ সময় আক্রমনের উপযোগী ছিলনা। আমরা অবশ্য ভেবেছিলাম ঈদের দিন পাকসেনারা হয়ত একটু রিলাক্স করবে এবং ঐ সময় অন্যান্য কাজে বস্ত থাকবে। আমরা চারটি কোম্পানী নিয়ে দুদিক থেকে আক্রমন করি। আমাদের সৌভাগ্য ছিল বলতে হবে। কারন পাকসেনাদের একটি কোম্পানী বদলী হচ্ছিল এবং নতুন দল সে স্থান দখল করছিল কিছু সৈন্য রওয়ানা হয়েছে কিছু হচ্ছে কিছু নতুন সৈন্য পজিশনে গেছে ঠিক এমনি সময়ে আমরা আক্রমন করে বসি। আমাদের প্রথম আক্রমনেই পাক অফিসার কোম্পানী কমান্ডার নিহত হয়। কমান্ডার নিহত হওয়ায় পাকসেনারা পিছু পালাতে থাকে। তারা প্রায় ১০০০ গজের মত পিছু হটে একটি গ্রামে পৌছে ডিফেন্স নেয়। সেখানে তাদের আর্টিলারি পজিশন ছিল। আমরা সামনে অগ্রসর হয়ে ডিফেন্স নেই। এই আক্রমনে ভারতীয় আর্টিলারি অবশ্য খুব সাহায্য করে। পরবর্তীতে সকল আক্রমনেই ভারতীয় বাহিনীর আর্টিলারি প্রভুত সাহায্য করে। আমরা ক্রমশঃ আঘাত হেনে পাকিস্তানীদের পিছু হটিয়ে অগ্রসর হতে থাকি। আমার সাব সেক্টর ট্রুপ্স নিয়ে ১০ ই ডিসেম্বর লাঙ্গলহাটে পৌছাই। ইতিপূর্বে হাতীবান্ধা ছাড়া এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ যুধ আর হয়নি। পাকসেনারা লাঙ্গলহাটি ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে তিস্তার অপর পারে চলে যায়। আমরা ১৩ ই ডিসেম্বর হারাগাছা এলাকা দিয়ে তিস্তা নদী অতিক্রম করি। সেখানে কোন পাকসেনা ছিলনা। হারাগাছার এই স্থান থেকে রংপুরের দুরত্ব ৮ মাইল হওয়া সত্বেও রংপুর পৌছতে আমাদের সময় লাগে তিন দিন। কারন পথে অনেক জায়গায়ি পাকসেনা ছিল। রংপুর এলাকাতে পৌছাই ১৫ ডিসেম্বর। ১৬ ই ডিসেম্বর ঢাকায় পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করলেও রংপুরে পাকসেনারা আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। হিলির দিক থেকে আগত ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। ইতিমধ্যে কর্নেল নওয়াজেশের সাব সেক্টর ট্রুপস ও চলে যায়। আমাদের দুই সাব সেক্টর ট্রুপস এক হয়ে গেছিল। আমরা আমাদের ট্রুপস নিয়ে রংপরে থকি। ভারতীয় সেনাবাহিনী রংপুর সেনানিবাসে অবস্থান নেয়।

প্রশ্নঃ সমগ্র যুদ্ধকালীন সময়রে আপনার এমন একজন সহকর্মীর কথা বলুন যিনি যুদ্ধক্ষেত্রে সাহসিকতা দেখিয়েছেন।

উত্তরঃ আমি ফারুকের কথা বলব। ফারুককে লেফটেন্যান্ট বলা হলেও এ কোন কারনেই হোক পাকিস্তানে সে কমিশন পয়নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য সে আমার সাব সেক্টরে  যোগদান করে। সে সময় আমার সাব সেক্টরে আমিই একমাত্র অফিসার ছিলাম। আর একজন অফিসারের অভাব আমি বিশেষভাবে উপলব্ধি করছিলাম। ফারুককে পেয়ে আমি ভীষন ভাবে খুশি হই। বস্তুতঃ তাঁর মত সাহসী ছেলে আমি খুব কম দেখেছি। হাতিবান্ধা আক্রমনের পর আমি একটি বি ও পি থেকে ওয়ারলেসযোগে পাকিস্তানীদের উপর আঘাত হানার জন্যে আরটিলারি ডাইরেক্ট করছিলাম। সেক্টর কমান্ডার বাশার আমার প্রায় ৬০০ গজ পিছনে ছিলেন। আমি আর ফারুক পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। পাকিস্তানীরা আমাদের উপর আর্টিলারির গোলা ছুঁড়ছিল। গোলা যখন পরে তখন লক্ষ্যবস্তুর আশেপাশে পরার পরই লক্ষ্যবস্তুর উপরে ফেলা হয়। আমাদের আশেপাশে গোলা পরছিল এবং বুঝতে পারছিলাম এখনি আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে পরবে। ফারুককে বললাম কভার নিতে কিন্তু সে কভার না নিয়ে আমার কাছে সরে আসে। পাকিস্তানী কামানের গোলা তখন ১৫/১৬ গজ দূর এসে পরে। সৌভাগ্যই বলতে হবে ডিপ্রেশন থাকায় গোলা তেমন কাজে আসে না। আমি গ্রাউন্ডে গেলাম। আমি উঠেই তার খোঁজ করলাম দেখি সে হাসছে। আমি বললাম চলো কভারে যাই। সে বলল স্যার এখানে আর শেল পরবে না। আমরা দুজন যেখানে গোলা পরেছিল সেই গর্তে গিয়ে দাঁড়া্লাম। তেমনি ছোট ছোট অনেল ঘটনার মধ্য দিয়েই লেঃ ফারুকের সাহসিকতার পরিচয় পেয়েছি।

আমি সেক্টর কমান্ডারের কথা বলব। তার সকল অপারেশনে যাওয়ার কথা নয় কিন্তু তিনি মেজর অপারেশনের প্রতিটিতেই স্বয়ং থাকতেন তদারক করতেন। এতে ট্রুপস এর মনোবল বৃদ্ধি পেত।

আর একজন বিডিআর হাবিলদার রাঙ্গু মিয়ার কথা বলব। তার চেহারা দেখতে মনে হত সে একটা ডাকাত। হাতীবান্ধা অপারেশনে রাঙ্গু মিয়া (শহীদ) বীরবিক্রম এবং নায়েব সুবেদার সম্ভবতঃ লুতফর (শহীদ) বীরবিক্রমের কথা না বললেই নয়। তখন বেলা সাড়ে আটটা। পাকিস্তানীদের ডানদিকের পজিশন ফল করছে। কিন্তু বামদিকের পজিশন ছিল একটি বিওপিতে। বেশ উঁচুতে। আমাদের উচিত ছিল আগে বামদিকের পজিশন দখল করা। পরে ডানদিকের পজিশনে আঘাত হানা। আমরা প্ল্যানিং এ ভুল হওয়ায় আমি প্রথমে ডান ও পরে বামদিকে আক্রমন চালাই। কিন্তু ডানদিকে আক্রমন চালিয়েই আমি আমার ভুল বুঝতে পারি এবং বামদিকে দখল না করতে পারলে যে আমরা এখানে থাকতে পারব না তাও বুঝতে পারলাম। দুটি কোম্পানীর একটি কমান্ডার ছিলেন বিডিআর নায়েক সুবেদার লুতফর আর তাঁরাই সঙ্গে ছিল হাবিলদার  রাঙ্গু মিয়া। আমরা এটাকিং পজিশন থেকে ৩০০/৪০০ গজ দূরে একটা বাঁশঝাড় থেকে এগুচ্ছি বামদিকে। সময় তখন বেলা সারে ১০ টা। আমরা অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে পাক আর্টিলারি গোলা এসে পড়তে লাগল। এই গোলা শূন্যেই ফাটে এবং এত ক্ষয়ক্ষতি হয় বেশী। এরই মধ্য দিয়ে এই দুজন বিডিআর সৈনিক নির্ভয়ে পাকিস্তানীদের বাঙ্কার চার্জ করে এবং দখল করে। এদের সাহস ও আত্মত্যাগ তুলনাহিন। জাতির দুর্ভাগ্য দুজনই সংঘর্ষে পাকিস্তানী বাঙ্কার চার্জ করতে গিয়ে শহিদ হন।

প্রায় ২২ মাইল লম্বা এবং চওড়া ন্যুনতম ৩ মাইল, কোথাও ১৮ মাইল আমার সাব সেক্টর মুক্ত ছিল। বলতে গেলে পুরো পাটগ্রাম থানাটাই আমরা মুক্ত রেখেছিলাম আমার সাব সেক্টরে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ একবার আসেন। স্থানীয় এম পি মতিয়ুর রহমান মাঝে মাঝে আসতেন অন্য আর কেউ তেমন আসতেন না। সি ইন সি কোনদিন আসেননি। বিদেশী সাংবাদিক আসেননি তবে ভারতীয় সাংবাদিকরা আসতেন।

 

 

 

 

নীলাঞ্জনা অদিতি

<১০, ১২.৭, ৩২৬-৩২৮>

সাক্ষাতকারঃ মেজর মোঃ আব্দুস সালাম

জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে আমি ফুলবাড়িতে যে ক্যাম্প দেখে এসেছিলাম সেখানে যোগদান করি। শুরু থেকে আমার গেরিলা জীবনের শেষ পর্যন্ত এখানেই ছিলাম, অর্থাৎ নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এখান থেকেই ছোটখাটো অনেক অপারেশনে গিয়েছি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বোয়ালিয়া ব্রীজ অপারেশন। আমরা বড় পুল বলতাম। এখানে রাজাকাররা পাহারায় ছিল। আমাদের পরিকল্পনা ছিল এই ব্রীজে গ্রেনেড নিক্ষেপ করা। আমরা এ পরিকল্পনায় বেরিয়েছিলাম। ঐদিনই সম্ভবতঃ কুড়িগ্রাম থেকে একটা দল ট্রেনে করে তিস্তার দিকে যাচ্ছিল। এই ব্রীজের আরেকটু দূরে আরেকটা দল বি ডি আর এর নায়েক সুবেদার ওহাবের নেতৃত্বে তাদের উপর আক্রমন শুরু করে। পরে আমরাও যোগ দেই সেই আক্রমনে এবং আশেপাশের অনেক লোক আনসারদের মধ্যে যারা ছিল তারা সবাই যোগ দেয়। পরবর্তী পর্যায়ে হানাদারদেরকে ওখান থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়। আমরা সেখানে গিয়ে অনেক রক্তের দাগ দেখতে পাই এবং পরে জেনেছিলাম তাদের অনেক হতাহত হয়েছে। তারপর রেললাইনের নীচু দিয়ে অপর পাশের কভার দিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এই ঘটনাতা একটা পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।

প্রশ্নঃ কোন পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল?

উত্তরঃ এটা “আনন্দবাজার” পত্রিকায় ছাপা হয়। ঐ সময়ে প্রাথমিক পর্যায়ে গেরিলা তৎপরতার একটা উল্লেখযোগ্য সাফল্যের খবর ছিল এটা।

দ্বিতীয় ঘটনাটা তবে সম্ভবতঃ জুলাই এর শেষের দিকে বা আগস্টের প্রথম দিকে। আমি এই ঘটনায় প্রথমে ছিলাম না পরে জড়িয়ে পরি। ঘটনাটা আমাদের এলাকায়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একজন সদস্য মেয়েলোকের পোষাকে ঐ এলাকায় আসে। মকবুল খান তার নাম ছিল। মহিলা সেজে অন্য মেয়েলোক ধরতে সমস্যা হবে না এই রকম একটা মোটিভ নিয়ে সে এসেছিল। আমরা গ্রামের মধ্যে “ আর্লি ওয়ারনিং” সিস্টেম রেখেছিলাম। গ্রামের কোনে কোনে আমাদের যুবকরা পাহারা দিত। গ্রামের মধ্যে কেউ ঢুকলে ওরা তাড়াতাড়ি খবর দিত। একজন এসে বলল যে একটা মেয়েলোক গ্রামের দিকে আসছে সে দেখতে অস্বাভাবিক। আমাদের দেশের মেয়েলোক সাধারনতঃ এই রকম দীর্ঘকায় মোটাসোটা হয়না। তাই সবার মনেই একটা সন্দেহ হল। সে গ্রামে ঢুকেছে মেয়েলোকদের ধরার চেষ্টা করেছে, পারেনি রবং এক জায়গায় একটা মেয়েকে ধরেছিল সে চিৎকার করে পালিয়ে গেছে। এই খবর টা কিছুদূর পর্যন্ত পৌছে যায়। এক পর্যায়ে যুবক দলের মধ্যে আব্দুর রহমান নামে এক সাহসী ছেলে লোকটিকে ধরে ফেলে। লোকটির কাছে বোধ হয় একটা হুইসেল ছিল অথবা তার ঠোট দিয়ে সে খুব জোরে একটা হুইসেল দেয়। হুইসেল দেয়ার ফলে সেই বোয়ালিয়া ব্রিজ থেকে গুলি শুরু হয়। সেখানে পোস্ট ছিল। সেখানকার লোক এসে তাকে উদ্ধার করতে পারেনি। ছেলেদের সেই দল মকবুল খান কে ধরে নিয়ে ধরলা নদী পার হয়ে ফুলবাড়িতে চলে আসে। সেদিন ই আমরা যাচ্ছিলাম একটা অপারেশনে। ধরলার পারে ওদের দেখা পেলাম। মকবুল খানকে ফুলবাড়ি ক্যাম্পে নিয়ে আসি। পরে তাকে সাহেবগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমাদের সাব সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছিল ক্যাপ্টেন নওয়াজেশের নেতৃত্বে। তার কাছ থেকে অনেক কথা জানা যায়। সে ছিল পাঞ্জাবি। তার উদ্দেশ্য ছিল ঐ একটাই গ্রামে এসে মেয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া। এটা একটা চমকপ্রদ ঘটনা বলতে হবে।

তারপর ডাইরেক্ট কোন সংঘর্ষ হয়নি। তবে একটা ঘটনার কথা মনে পরে। তখন আমরা ফুলবাড়ি ডিফেন্সে ছিলাম। লালমনিরহাট থেকে ফুলবাড়ির দিকে একটা রাস্তা গেছে। লালমনিরহাট থেকে ফুলবাড়ির দিকে একটা রাস্তা গেছে। লালমনিরহাট এবং ফুলবাড়ি মধ্যে ধরলা নদী। ফেরীর ওপারে অর্থাৎ ফুলবাড়ির দিকে আমাদের এফ এফ ডিফেন্স ছিল। এম এফ কোম্পানী ছিল মোবাইল। তারা ঐ এলাকায় যেত পেট্রোলিং করে আবার ফিরে আসত। কিন্তু এফ এফ কম্পানি পারমানেন্টলি ওখানে থাকত। একবার আমরা অখানে গিয়েছিলাম সারারাত ওখানে পেট্রোলিং করেছি। আমার জীবনে এই প্রথম সেদিন গুলি ছুড়ি। আমাকে সেখানে শিক্ষা দেয়া হয় কিভাবে গুলি ছড়তে হয়। সারারাত খাওয়া হয়নি। দুপুরবেলা খাবার কিছু পাইনি। স্থানীয় এক বাড়িতে বসে আমরা জাউ খাচ্ছিলাম। এমন সময় আমাদের উপর মেশিনগানের ফায়ার। নদীর এপার থেকে ওপার। মাঝখানে নদীর দূরত্ব ৫০০/৬০০ গজ। আমরা যে বাড়িতে খাচ্ছিলাম সে বাড়ির কলাগাছে এবং টিনের চালে খুব গুলি পড়ছে। আমরা তাড়াতাড়ি করে দৌড়ে গিয়ে পজিশন নিলাম। প্রশিক্ষন তখনো কিছু নেই। তবে একটা রাইফেল হাতে কেবল নিয়েছি, দৌড়ে কিভাবে গুলি করতে হয় সেটা শিখেছিলাম। ওরা সবাই দৌড়ে গিয়ে রাইফেল হাতে তাড়াতাড়ি পজিশন নিয়েছে। আমিও নিয়েছি তবে তত তাড়াতাড়ি না পারায় ১০/১৫ হাত পিছনে পজিশন নিয়েছি। ওরা সেখান থেকে ফায়ার করছে পালটা জবাব দিচ্ছে। আমিও অনুমান ১০/১৫ হাত পিছনে একপাশ থেকে পালটা জবাব দিচ্ছি। আনসারের একজন লোক ছিল সে আমাকে যেভাবে গালি দিচ্ছিল সে গালির কথা আমি কখনো ভুলব না। খুব মজার গালি। “সামনে সামনে এসে ফায়ার কর নাইলে তোকে মেরে ফেলবে”। ও শেখাচ্ছিল যেন আমি আমার নিজের জীবন বাঁচাতে পারি। এবং একি সময় আমি আমার বন্ধুর জীবন কেও যেন রক্ষা করতে পারি। তারপর সামনে গিয়ে বেশ কিছুক্ষন ফায়ার করলাম।২” মর্টার ছিল আমাদের কাছে। এক সময় ফায়ার বন্ধ করি। পরে জানতে পেরেছিলাম ওদের উদ্দেশ্য ছিল নদী পার হয়ে আসা। কলাগাছ দিয়ে ভেলা তৈরি করেছিল তারা। পাকসেনারা লং রেঞ্জে ফায়ার করে দেখতে চেয়েছিল আমরা এপারে কেউ আছি কিনা। পরে আমাদের পালটা জবাব পেয়ে তারা আর নদী পার হবার সাহস পায়নি। এটা আগস্টের ঘটনা হবে। তারপর সেখান থেকে আমরা চলে যাই বাগভান্ডার বি ও পি তে। বাগভান্ডারে বিডিআর এর সুবেদার মেজর আরব আলী ছিল। তার একটি কোম্পানি ছিল এবং আমি সেই কোম্পানির ভিতর একজন সাধারন সৈনিক ছিলাম। সুবেদার আরব আলি ই সেই কোম্পানীর কমান্ডার ছিলেন। সাহেবগঞ্জ সাব সেক্টর অধীন বাগভান্ডার ডিফেন্স ই আমি বেশ কিছুদিন ছিলাম ওখানে থাকাকালীন আমাদের কটা উল্লেখযোগ্য অপারেশন হয়েছিল অক্টোবরের শেষের দিকে। লেঃ সামাদ যিনি শহিদ হয়েছেন এবং লেঃআবদুল্লাহ এরা কেবল কমিশন পেয়ে এসেছেন আর আমরা সেকেন্ড ব্যাচের জন্য সিলেক্ট হয়েছি যাবো। এরা যখন পথম আসলো তখন এদেরকে নিয়ে একটা অপারেশন করা হল জয়মনিরহাটে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটা কোম্পানী সেখানে ছিল। আমরা তা জানতে পেরেছিলাম। এই রেইডের পরিকলনা করেন ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ আমি সেদিন তার সাথেই ছিলাম। আমি ছিলাম তাঁর সিগনাল অপারেটর, অয়ারলেস সেট নিয়ে একটা তেঁতুল গাছের উপর মাচা তৈরি করে উনি ছিলেন আর আমি তেঁতুল গাছের নীচে অয়ারলেস সেট নিয়ে ছিলাম। সেখান থেকে তিনি পাক ক্যাম্পের উপর ডাইরেক্ট আক্রমন করেছিলেন। আমার কম্পানী অর্থাৎ যেটা সুবেদার আরব আলির কোম্পানি এবং ডানদিকে একটা এফ এফ কোম্পানি ছিল সুবেদার শামসুল হকের নেতৃত্বে এই দুটো কোম্পানীর একটি দেয়া হল লেঃ সামাদের নেতৃত্বে এবং অপরটা লেঃ আবদুল্লাহর নেতৃত্বে। এই দুটো কোম্পস্নি নিয়ে ভুরুঙ্গামারী আক্রমন করি সন্ধ্যের পর। পরিকল্পনা মোতাবেক দুটো কোম্পানি প্রায় ভুরুঙ্গামারির কাছে পৌঁছে যায়। বাঁ দিকে সোনারহাটে যে কোম্পানি ছিল তাদেরকে রাস্তার উপর ব্লক করতে বলা হল যাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনি ঐ দিকে পালিয়ে যেতে না পারে। তাদের একটাই পথ খোলা রাখা হয়েছিল সেটা হল নাগেশ্বরির দিকে। কিন্তু ঐ কোম্পানী ঠিকমত একশন নিতে পারেনি ফলে পাকিস্তানীরা ভুরুঙ্গামারী ছেড়ে সোনাহাটা দিয়ে ভেতরে ঢোকে এবং উলটা দিক দিয়ে আমাদের দিকে হায়ার করতে শুরু করে। আমরা জানতে পাই যে ওটা এফ এফ কোম্পানির দল না। ওটা পাকিস্তানীরা বিতাড়িত হয়ে উলটা দিক দিয়ে ভিতরে এসে আমাদের উপর আঘাত হানছে এজন্যে সেখানে বেশীক্ষন থাকা সম্ভব হয়নি। সবকিছু তছনছ করে বাঙ্কার ভেঙ্গে দিয়ে আমরা রাতের অন্ধকারেই ওখান থেকে ফিরে আসি। রেইড হিসাবে এটিকে আমরা সফল রেইড বলতে পারি, তবে আক্রমন হিসাবে এটা সফল ছিল না। কেননা পরবর্তীতে পাকিস্তানীরা আবার সেখানে ডিফেন্স গড়ে তুলেছিল।

*সাক্ষাৎকারটি প্রকল্প কর্তৃক ২২-০১-১৯৮০

 

নীলাঞ্জনা অদিতি

<১০, ১২.৮, ৩২৮-৩৩৩>

 

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি

রায়গঞ্জ দখলের লড়াই

লেঃ সামাদ আর লেঃ আবদুল্লাহ ২৫ মাইল রেঞ্জের অয়ারলেস হাতে দুই গ্রুপ কমান্ডো নিয়ে বেরিয়ে পরেছিল ১৯ শে নভেম্বর পাকিস্তানীদের শক্ত ঘাঁটি রায়গঞ্জ দখলের জন্য। সবার হাতে একটা করে স্টেনগান আর কিছু গ্রেনেড। প্রতিজ্ঞা নিয়ে তারা বেরুলো রায়গঞ্জ দখলের। লেঃ সামাদের গ্রুপে ছিল কমান্ডো মাহবুব, কাসেম ও অন্যান্য এবং লেঃ আব্দুল্লাহর গ্রুপে ছিল ১৫ জন শক্তিশালী কমান্ডো। দুই গ্রুপ রায়গঞ্জে অবস্থিত ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট কে লক্ষ্য করে দুই দিক থেকে যাত্রা শুরু করে। ঠিক হয় ৫০০ গজের মধ্যে গিয়ে অয়ারলেসে সামাদ ও আব্দুল্লাহ দুজনের পজিশন জানিয়ে দেবে। জাঙ্গল শু পরে চাদর গায়ে জড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধারা রাত নটায় নিঃশব্দে বেড়িয়ে পড়ে ৬ নং সাবসেক্টর ভুরুঙ্গামারি থেকে ঈদের আগের রাতে। সোয়া ঘন্টা যাত্রার পর রায়গঞ্জ ব্রিজের সন্নিকটে পৌঁছে লেঃ সামাদ সহসা দেখলেন তার গ্রুপের সবাই ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ট্র্যাপে পরে গেছেন। তিনি বুঝলেন ভুল রেকি হয়েছে। রায়গঞ্জ ব্রিজের নিচে ২৫ পাঞ্জাবের এল এম জি সহ বাঙ্কার রয়েছে এ খবর তিনি পাননি।ছোট শিশ এর সঙ্কেতে তিনি সবাইকে শুয়ে পরতে বললেন। অয়ারলেস সেট ওপেন করে “হ্যালো আব্দুল্লাহ” বলতেই শুরু হয়ে গেল ক্রস ফায়ারিং সেই সাথে পাকিস্তানীরা তাদের উপর আর্টিলারি গান ও ৩ ইঞ্চি মর্টার চালাতে লাগল। বীর সামাদ বল্লেন “ কেউ এক ইঞ্চি পিছু হটবে না মরলে সবাই মরব বাঁচলে একসাথেই  বাঁচব”। শুরু হয়ে গেল মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন মৃত্যু পাঞ্জা লড়াই। অনেক শক্তিশালী ও দক্ষ এবং অনেকগুন ভারী অস্ত্রে সজ্জিত ২৫ পাঞ্জাব বাহিনীর ঘেরাও এর মধ্যে পরে বাংলার তরুন বীরেরা সেদিন ফুলের মত ঝরে পরতে লাগল। কিন্তু কেউ সামাদের আদেশ অমান্য করেনি। নিশ্চিত মৃত্যুমুখে থেকে মুহুর্মুহু মর্টার শেল ও বুলেটের মুখে পরে মুক্তিযোদ্ধারা কেউ এতটুক দমেনি। নিজের শেষ বুলেটটি শত্রুর প্রতি নিক্ষেপ করেছে তারপর নিজে শহিদ হয়েছে। আমাদের ১৫/ ২০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা সেদিন এক ব্যাটেলিয়ন ২৫ পাঞ্জাবের বিরুদ্ধে যে অসম সাহস ও বীরত্ব নিয়ে লড়াই করেছে পৃথিবীর যে কোন বীরত্বব্যঞ্জক লড়াই এর সাথে তার তুলনা হতে পারে।

অপরদিকে লেঃ আবদুল্লাহ হেডকোয়ার্টারকে ডেভলপমেন্ট জানিয়ে দিল। ৬ নং সেক্টর কমান্ডার উইং কমান্ডার বাশারের নেতৃত্বে মূল বাহিনী এগিয়ে এলো। ১৯ তারিখ ভোর থেকে ২০ তারিখ সন্ধ্যা পর্যন্ত কামান ও আর্টিলারি দিয়ে আঘাত হানলেন ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের উপর। গ্রাম থেকে লোক এসে বলল খান সেনারা ভেগে যাচ্ছে। ২১ শে নভেম্বর সকালে সেই শক্তিশালী ট্রেইন্ড ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট বিধ্বস্ত হয়ে রিট্রিট করল ৫ মাইল দূরে নাগেশ্বরিতে।

এই যুদ্ধে ২৫ পাঞ্জাবের কমপক্ষে সাড়ে ৩০০ থেকে ৫০০ জন নিহত বা আহত হয়েছে। রণাঙ্গনেই পরে ছিল ৩০/৩৫ জনের মৃতদেহ। লেঃ সামাদের গ্রুপে মাহবুব ও কাশেম ফিরে আসতে পেরেছিল। এই যুদ্ধ ছিল আমাদের জন্য একটি বড় বিজয় ও পাকিস্তানী ফোরসের জন্য একটি আঘাত। কেননা ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ছিল তাদের গর্ব। কিন্তু এই যুদ্ধে যেসব মুক্তিযোদ্ধাকে আমরা হারিয়েছিলাম তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন বীর। এবং সেই যুদ্ধে প্রত্যেকেই বীরের মৃত্যুবরন করেছিলেন। আমরা দের সবাইকে সালাম জানাই। সালাম জানাই সেই নির্ভীক যোদ্ধা লেঃ সামাদকে। ২১ তারিখ ভোরে রায়গঞ্জ ব্রিজের কাছে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি মুখে প্যান্টের ভিতর হাফশার্ট ঢোকান মাতির উপর মুখ থুবরে পরে থাকা অবস্থায় লেঃসামাদকে সবাই দেখল জীবনে যেমন সে বীরবিক্রমে লড়াই করেছে মরনেও তেমনি বীরবিক্রমে মাতৃভূমিকে আলিঙ্গন করে শুয়ে রয়েছে। উইং কমান্ডার বাশার সামরিক কায়দায় ডান হাত কপালে তুলে সেল্যুট করলেন তাকে। সেল্যুট করল সবাই। জয়মনিরহাট মসজিদের পাশে তাকে কবর দেয়ার ব্যবস্থা করা হল। কিন্তু জানাজা পড়ার জন্য মৌলভী পাওয়া গেল না। সীমান্তের ওপার থেকে এক মসজিদের ইমামকে আনা হল জানাজার জন্য। ৪১ বার গান সেলুটের সাথে সাথে রনাঙ্গনে বেজে উঠল লাস্ট পোস্ট। সব শহীদের জানাজা ও দাফন সম্পন্ন করে সবাই চলল ফ্রন্টের দিকে, হাতে ইস্পাতের চকচকে অস্ত্র চোখে পানি। উইং কমান্ডার বাশার অন্যদের চোখ মুছিয়ে দিচ্ছিলেন নিজে কাঁদছিলেন। ফ্রন্টে ফ্রন্টে বিজয় হয়েছে, সেই সাথে বেদনার সুর বেজেছে। অশ্রুজলে সবাই সিক্ত হয়েছে।

বড়খাতা ব্রীজঃ ব্রীজ অন রিভার তিস্তা

রাজধানী ঢাকার প্রেক্ষাগৃহে বসে যারা ‘ব্রীজ অন রিভার কাউয়াই’ দেখে আতঙ্কে ভয়ে শিউড়ে ওঠেন তাদের কেউ জানলেন না কোনদিন যে একাত্তরে সারা বাংলার বুক জুড়ে ‘ব্রীজ কাউয়াই’ এর এর চেয়ে লোমহর্ষক বহু অপারেশন করেছিল আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা।

‘বড়খাতা ব্রিজ’ অপারেশন তার একটি। এই ব্রিজটি উড়ানোর জন্য মুক্তিযোদ্ধারা প্ল্যান করে মে মাসে। এই ব্রিজটি পাক হানাদারদের জন্য ছিল অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এই ব্রীজের ওপর দিয়ে চলে গেছে রেললাইন। যার সাথে রংপুরের সমগ্র এলাকা যুক্ত রেখে পাকবাহিনী ভারী রসদ ও সমরাস্ত্র সরবরাহ অটুট রখেছে। এই ব্রীজ খতম করতে পারলে সরাসরি রংপুরের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করা যায় এবং পুরোপুরি মুক্ত হতে পারে হাতিবান্ধা, বড়খাতাসহ ২২ মাইল এলাকা।

৬ নং সেক্টর কমান্ডার উইং কমান্ডার খাদেমুল বাশার সিদ্ধান্ত নিলেন হানাদারদের রেললাইন বিচ্ছিন্ন করে ওদের কাবু করতে হবে এবং এই বড়খাতা ব্রীজ উড়িয়ে দিতে হবে। মে মাসের শেষ সপ্তাহে একটা কমান্ডো গ্রুপ পাঠালেন তিনি। বড়খাতা ব্রীজের ওপর পাক-পাঞ্জাবীর বাহিনী ছিল প্রস্তুত। কোন সুযোগ ই ছিলনা মুক্তিইবাহিনীর কমান্ডো গ্রুপ টার কাছে ভিরবার। ফিরে এলো তারা।

জুলাই মাসের মাঝামাঝি আতক কমান্ডো গ্রুপ কে পাঠালেন। দুর্ভেদ্য সে অঞ্চল। পিঁপড়ের মত ছেয়ে আছে পাকফৌজ ব্রীজের ওপরে।নীচে। ডাইনে ও বামে। ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলো তারা।

আগস্ট মাসের ৪ তারিখ। তৃতীয়বারর মত একটা গ্রুপ গেল সাথে প্রাক্তন ই টি আর বাহিনি বাঙালি জোয়ান। ব্রীজের কাছাকাছি প্রায় পৌঁছেছিল তারা। কিন্তু না। হানাদার বাহিনি শকুনের চোখ মেলে প্রস্তুত ছিল। ফায়ার ওপেন করে দিল আমাদের কমান্ডো গ্রুপটার ওপর। ক্যাজুয়েলটিসহ ব্যর্থ হয়ে ফিরে এল তারা।

বসলেন কমান্ডার খাদেমুল বাশার। হেডকোয়ার্টারে ডাকলেন ঐ এলাকার সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মতিয়ুর রহমান কে (বীরবিক্রম), ডাকলেন কোম্পানী কমান্ডার হারেসউদ্দিন সরকার কে। চুলচেরা বিশ্লেষন হয়ে গেল হাতিবান্দার ম্যাপ নিয়ে। পথঘাট একে দিয়ে দিলেন তিনি ক্যাপ্টেন মতিয়ুর ও হারেসউদ্দিনের কাছে।

পাকিস্তানের পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ১ কোম্পানি ফোর্স ছিল এই ব্রিজ রক্ষায়। এতেই অনুমান করা যায় এই ব্রিজের গুরুত্ব তাদের জন্য কত অপরিসীম ছিল। পাকিস্তানিদের পজিশন ছিল বড়খাতা ২ নং ব্রীজের উপর ও দুই সাইড। রেলওয়ে স্টেশন ও গড্ডিমারির সংযগ এই ব্রীজটি ছিল তিস্তা নদীর ওপর।

তিন তিনবার ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার পর এই গুরুত্বপূর্ণ ‘এসাইনমেন্ট’ ঘাড়ে তুলে নিলেন বাংলার দুই বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর ও হারেস। তৃতীয় ব্যর্থতার ৮ দিন পর ১২ ই আগস্ট, রাত ৮ টা। এক কোম্পানি শক্তিশালী পাঞ্জাবি আর্মির সামনে কতজন বাঙালি বীর গেলেন? ১২ জন। হ্যা, মাত্র ১২ জন বাঙ্গালী বুকে দেশপ্রেমের মন্ত্র নিয়ে মুখে কলেমা শাহাদাত ‘লা ইলাহা ইল্লালাহ’ পড়তে পড়তে বাউরা রেলস্টেশন থেকে যাত্রা করল ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান (বীরবিক্রম), কোম্পানি কমান্ডার হারেস উদ্দিন সরকার (বীর প্রতীক), মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেন (পরে যিনি পাটগ্রামে হানাদার দের সাথে শহীদ হন), নজরুল ইসলাম, মন্সুর আলি, শওকত আলি প্রমুখ। হাতে তাদের এক্সপ্লোসিভস, ডেটনেট, এল এম জি, স্টেনগান ও তিন ইঞ্চি মর্টার। তাদের পেছনে প্রয়োজনমত কাভারিং দেয়ার জন্য লেঃ মেজবাউদ্দিনের (বীরবিক্রম)ও সুবেদার আব্দুল মালেকের নেতৃত্বে ২ টা এফ এফ কোম্পানি থাকল। মুক্তিযদ্ধারা যখন বাউরা থেকে জিপে যাত্রা শুরু করে তখন পাক বাহিনীর পজিশন ছিল মাইল দূরে ‘বড়খাতা ব্রীজ’। পাকবাহিনীর পজিশনে দুই মাইল দূরে গিয়ে জীপ যখন থামল রাত তখন পৌনে ১২ টা। জীপ থেকে সবাই নামল। এবার হাঁটার পালা। পায়ের তলায় শুকনো পাতাও যেন না পরে এমন সতর্কতায় পা ফেলে চলেছে ১২ জন বংগ জননির বীর সন্তান। সামনে লক্ষ্য শুধু ব্রিজ বড়খাতা। তিন তিনবার ফিরে গেছে মুক্তিবাহিনী। এবার তারা জীবন দেবে শুধু ব্রীজ অক্ষত রেখে যাবে না। কদম কদম পা ফেলে যকন তারা এগুচ্ছে এলো আল্লাহর আশীর্বাদ, মুশলধারে বৃষ্টি। সেই বৃষ্টিকে সাথি করে গায়ের জামা খুলে ‘এক্সপ্লোসিভ’ গুলকে জড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে চলল ব্রীজ বড়খাতার দিকে। আকাশ ঘনিয়ে এলো অন্ধকার। বৃষ্টির গতি গেলো বেড়ে। ব্রীজ বড়খাতার ওপর চোখ পরল মুক্তিবাহিনীর। বৃষ্টিতে মুখ বুজে আছে পাকিস্তানীদের বাঙ্কারগুলো। ব্রীজের দুই মুখে পৌঁছে গেল হারেসউদ্দিন মতিউর রহমান ও অন্য সাথীরা। রাত তখন দেড়টা হবে। পাঞ্জাবীরা বৃষ্টির মুখে বাঙ্কারে ঢুকে বসে আছে। তলায় ততক্ষনে ত্রস্ত হাতে ক্ষিপ্রগতিতে এগিয়ে চলেছে মুক্তিবাহিনী অপারেশন। ব্রীজের তিন জায়গায় এক্সপ্লোসিভ বাঁধা হল। মুল প্লান ছিল দুই জায়গায়। কিন্তু বৃষ্টির জন্য পাক হানাদাররা যখন ‘ওয়াচ’ করতে পারছে না কিছুই তখন মতিউর রহমান সেই সুযোগটা কাজে লাগালেন। মাত্র ২৫ মিনিটে এক্সপ্লোসিভস লাগানর কাজ শেষ হয় যেটার জন্য সময় দেয়া ছিল ৩০ মিনিট। এটা সম্ভব হল কেননা মুক্তিবাহিনীর যেসব ছেলেদের তিস্তার পারে গার্ড থাকার কথা ছিল তারা বরং ব্রীজের তলায় কাজ করে। বৃষ্টির সুবিধার জন্য সিদ্ধান্ত টা অন দা স্পট চেঞ্জ করা হয়। এক কোম্পানী পাঞ্জাবি হানাদার ব্রীজের ওপর ডানে বামে দুর্ভেদ্য বাঙ্কারে বসে বসে যখন বৃষ্টির শব্দ শুনেছে ততক্ষনে তাদের মৃত্যুঘন্টা বেজে গেছে তিস্তা নদীর স্রোতের উপর।

অত্যন্ত সন্তর্পণে ধীরে ধীরে ক্যাপ্টেন মতিউর তিস্তার ওপর থেকে তুলে আনলেন তাঁর ১২ জন সাথিকে। গুনে গুনে নিলেন তিনি। হ্যা এবার পেছনে চলো সবাই। ৬০০ গজ দূরে এসে থামলেন তিনি। সেই মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে রাত পৌনে দুটার দিকে ডেটনেটে আগুন ধরালেন তারা। প্রচন্ড শব্দে সেই বৃষ্টিপাতের মধ্যে মনে হল আকাশ ভেঙ্গে রাশি রাশি বৃষ্টিপাত হচ্ছে ‘ব্রীজ বড়খাতার’ উপর। তিস্তার বুকে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ভেঙ্গে পরছে হানাদারদের বাঙ্কার ভেঙ্গে পরছে হানাদারদের শরীর। ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে এল এম জির ফায়ার ওপেন করে দিল মতিউর হারেসরা। বাংলার দুশমনরা পেছনে ১৫ টি ডেডবডি ফেলে রিট্রিট করল। ব্রীজ বড়খাতার ওপারে উড়ল মুক্তির পতাকা। তিস্তার ওপাশ মুক্ত হয়ে গেল চিরতরে। যে ব্রীজের জন্য পাঞ্জাবিরা গর্ব করে বেড়াত তাদের দালালরা যে বড়খাতা ব্রীজের কথা বলে মুক্তিবাহিনীর পরাজয়ের প্রমান খারা করত সেই বড়খাতা ব্রীজের বিজয় যখন সম্পন্ন হল আনন্দে আবেগে কাঁদল ক্যাপ্টেন মতিউর, কাঁদল হারেসরা। একে অপরকে জড়িয়ে ধরল বুকে।

যুদ্ধের ইতিহাসে “ব্রীজ রিভার অন কাউয়াই” যদি থাকে, থাকবে আমাদের মুক্তিযদ্ধাদের বিরত্বগাঁথা নিয়ে “ব্রীজ রিভার অন তিস্তা” এর নাম।

চার রাত্রির কাহিনীঃ

কজন জানেন যে, আমাদের ৩১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ৪ দিন আটকা পরে শুধু বিস্কিট আর পানি খেয়ে বেঁচে ছিল? ৬ নং এইচ কিউ তে বসে সেক্টর কমান্ডার খাদেমুল বাশার সাহেব পর্যন্ত প্রায় ধরে নিয়েছিলেন তারা মারা গেছে।

সেই ‘দুঃখের চার রাত’ ছিল ৩ রা সেপ্টেম্বর থেকে ৭ ই সেপ্টেম্বরের রাত। এই রাতের শুরু হয়েছিল আরো আগে তিস্তার গা বেয়ে শঠিবাড়ি বন্দরের বুকে।

মুক্তিবাহিনীর পজিশন ছিল শঠিবাড়ির উত্তর ও পূর্ব দিকে। তাদের এক মাইল পেছনে তিস্তা নদী বয়ে চলেছে। তিস্তা নদীর অপর পারে পশ্চিম ও দক্ষিন দিকে এফ এফ কোম্পানি নং ৭ এর কমান্ডার হারেসউদ্দিন সরকার ৩৫০ জন এফ এফ নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছেন। হানাদার পাকিস্তানিদের ডিফেন্স হচ্ছে শঠিবাড়ি বন্দরের দক্ষিন ও পশ্চিম সাইডে। এক কোম্পানি ফোরস নিয়ে সিমেন্টের মজবুত বাঙ্কারে মেজর হায়াত শক্তিশালী ডিফেন্স নিয়ে দীর্ঘ ৬ মাস বসে আছে। তাদের সাথে আছে ই পি কাফ এর এক কোম্পানী রাজাকার ছিল শ তিনেক। তার ওপর এছনে ছিল আরটিলারি। হেভি মেশিনগান, ছয় ইঞ্চি মর্টার, এল এম জি ১ টা তিন ইঞ্চি মর্টার কিছু স্টেনগান আর বাকি সব থ্রি নট থ্রি।

সেক্টর কমান্দার খাদেমুল বাশার সাহেবের নিকট থেকে ৭ নং কোম্পানী কমান্ডার নির্দেশ পান শঠিবাড়ির হানাদারদের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য। প্রথম দিকে মুক্তিযোদ্ধারা ‘হিট এন্ড রান’ পদ্ধতি অনুসরন করে পুরা আগস্ট মাস। সেপ্টেম্বর মাসের ২ তারিখ পর্যন্ত তাদেরকে ব্যস্ত রাখে। ইতিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা গড়ে তোলে পাকা বাঙ্কার। শঠিবাড়ি বন্দরের পূর্ব ও উত্তর দিকে পাক হানাদারদের এক হাজার গজ দূরে এই সব বাঙ্কার তৈরী করে মুক্তিযোদ্ধারা মনোবল বাড়িয়ে তোলে। এবং এই সময় মুক্তিযোদ্ধা ও পাক হানাদাররা যার যার পজিশন থেকে গোলাগুলি বিনিময় করত।

সেপ্টেম্বরের ২ তারিখ। কম্পানী কমান্দার হারেসউদ্দিন সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাক হানাদারদের ৬০০ গজ দূরত্বের মধ্যে চলে আসে। ২ রা সেপ্তেম্বর রাত ৩ টায় কমান্ডার নিচে এস এল আর নিয়ে হানাদার পজিশনে ফায়ার ওপেন করে দেন। শুরু হয় মরনযুদ্ধ। হারেসের ছেলেরা প্রতিজ্ঞা করে শথিবারি বন্দর দখল না করে তারা পিছু ফিরবে না।

শঠিবারি হাইস্কুলের ভেতরে নির্মিত দুর্ভেদ্য ঘাঁটি থেকে শেল বর্ষণ করে খান সেনারা। শুরু হল তুমুল যুদ্ধ। খান সৈন্যদের মুহুর্মুহু শেল ও রকেটের আঘাত এসে পরছে মুক্তিবাহিনীর ওপর। ভাংছে বাঙ্কার আহত হচ্ছে মুক্তিসেনা। ধরাধরি করে তাকে নিয়ে যাওয়া হছে পেছনে। সামনে এগুচ্ছে আরেকজন মুক্তিসেনানী, করছে আঘাত শত্রুর বাঙ্কারে, পজিশনে গোলাগুলি আর আর্তনাদে ভরে উঠল ডিমলা থানার শঠিবাড়ি বন্দর। সমান গতিতে যুদ্ধ চলছে। ঘন্তার পর ঘন্টা। কেউ এক ইঞ্চি পিছু হঠছে না। সমানে সয়ানে যুঝে যাচ্ছে একে অপরকে একদিকে কমান্ড করছেন হানাদার বাহিনীর দুর্ধর্ষ মেজর হায়াত অন্যদিকে শ্যামল বাংলার এক তরুন বীর হারেসউদ্দিন সরকার। এক বাহিনী ছুড়ছে কামানের গোলা, রকেট ও শেল। অন্য বাহিনী দু একটি এল এম জি আর থ্রি নট থ্রি দিয়ে তার জবাব দিচ্ছে।

ঘন্টার পর ঘন্টা হয়ে যাচ্ছে। ৪ তারিখ সকাল থেকে যুদ্ধের তীব্রতা বেড়ে গেল। হারেস উদ্দিন সরকার কয়েকজন সাহসী সাথীকে নিয়ে পর পর কয়েকটি সম্মুখের বাঙ্কার পার হয়ে এডভান্স করে গেল সম্মুখপানে। হানল এ এম জির নিখুঁত আঘাত হানাদার বাহিনীর মেইন পজিশন শঠিবাড়ি স্কুলের ভেতরের বাঙ্কারে। দুপুর ১২ টার দিকে চাঞ্চল্য দেখা গেল হানাদারদের বাঙ্কারে ও ডিফেন্স পজিশনে। দ্বিগুন শক্তিতে হারেসের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ছুটে যেতে লাগল সম্মুখপানে। সে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। শঠিবাড়ি বন্দর আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধাদের করায়ত্ব হবে। প্রতিটি বাঙ্কারের মুক্তিযোদ্ধারা বৃষ্টির ঝাঁকের মত গুলি ছুড়ছে। হানাদার বাহিনী তাদের ডিফেন্স লাইন ছেড়ে পিছনে হটে যাচ্ছে বীর হারেস, বীর তার বাহিনি বুকে থ্রি নত থ্রি চেপে ধরে সম্মুখপানে গড়িয়ে গড়িয়ে দখল করছে সামনের ভুমি। মরিয়া হয়ে টিপে যাচ্ছে থ্রি নট থ্রি ট্রিগার। জয় তারা ছিনিয়ে আনবেই। হানাদারকে পালাতে হবে শঠিবাড়ি থেকে। ট্রেন্ড পাকিস্তানী বাহিনি তাজ্জব বনে গেল। এক তরুন মুক্তিযোদ্ধার কমান্দে এগিয়ে আসছে থ্রি নত থ্রি হাতে বাঙালি তরুন বালক। অব্যর্থ গুলি ছুড়ছে তাদের বাঙ্কারে। ছেড়ে যেতে হচ্ছে তাদের ডিফেন্স পজিশন।

কোম্পানী কমান্ডার হারেসউদিন ঘোষনা করে দিল ৪ ঠা সেপ্টেম্বর সূর্য ডোবার আগেই শঠিবাড়ি বন্দর মুক্ত হয়ে যাবে। তিনশ মুক্তিযোদ্ধা দম ধরে গুলি চালিয়ে যাচ্ছে হানাদারদের প্রত্যেকটা বাঙ্কারে। শঠিবারি বন্দরের জয় অত্যাসন্ন। আক্রমনের মুখে আর দাঁড়াতে পারছে না হানাদারেরা। আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই পতন হয়ে যাবে। মুক্তিযোদ্ধারা পতাকা তুলে জয় বাংলা বলে চিৎকার করছে। এমন সময় হানাদার এলো আকাশ পথে। ৪ ঠা সেপ্তেম্বরের শঠিবাড়ি বন্দরে যখন মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতা পতাকা উত্তোলনের জন্য উদ্যোগ নিচ্ছে পশ্চিম গগনে সূর্য যখন ঢলে পরেছে ঠিক তেমন সময় গর্জন করতে করতে এলো দুটি হেলিকপ্টার। হারেসউদ্দিন ও তার বাহিনীর বাঙ্কারের পজিশনে বৃষ্টির মত বোমা ফেলল তারা। আক্রোশে ক্ষোভে মুক্তিযোদ্ধারা এল এম জির ফায়ার করল। হেলিকপ্টার দুটো চলে গেল প্রায় ২০ মিনিট ধরে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন পজিশনে বোমা বর্ষণ করে। ডান পায়ে ডান হাতে এবং কপালে বোমার আঘাতে আহত হলেন সেই বীর তরুন যিনি ছিলেন সেই তিনশ মুক্তিযোদ্ধার বীর নায়ক। আহত হল আরো অনেকেই। এক নিমেষেই নিভে গেল সেই মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ের আশা। রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত আহতদের ব্যান্ডেজ ও ফার্স্ট এইড শুরু হল। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল ৬ নং এইচ কিউ এর সাথে সকল যোগাযোগ। খাবার ও অন্যান্য সামগ্রীর উপর বোমা পরায় সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেল যদিও অস্ত্র ও গোলাবারুদের তেমন কোন ক্ষতি হয়নি মুক্তিযোদ্ধাদের বাঙ্কার এবং ডিফেন্স থেকে গুলি বন্ধ হওয়ায় হানাদার বাহিনী শুরু করল নতুন উদ্যমে গুলি-গোলা বর্ষণ।

সেই অসহায় অবস্থায় ৪ ঠা সেপ্টেম্বর রাত্রে অনেক মুক্তিযোদ্ধা যখন হতাশ হয়ে পরেছিল তখন রক্তাপ্লুত কোম্পানী কমান্ডার চিৎকার করে বললেন “যুদ্ধ চলবে মৃত্যু পর্যন্ত, যুদ্ধ চলবে, কেউ এক ইঞ্চি পিছু হটবে না। কাউকে যদি পিছনে তাকাতে দেখি, এই আহত অবস্থায় তার উপর আমি গুলি চালাব। জন্মভূমির বুকে বীরের মত লড়ে প্রাণ দাও সবাই। হেডকোয়ার্টার থেকে আমরা তিনশ জন বিচ্ছিন্ন, বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। ধরে নাও আমরা সবাই মরে গেছি”। তিনি সবাইকে অনুরোধ করে বললেন “ মৃত্যুর আগে একবার শেষ লড়াই করে যাও”।

মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণ ফিরে পেল। আবার ফিরে গেল বাঙ্কারে। হাতে তুলে নিল থ্রি নট থ্রি। এমনভাবে পার হয়ে গেল ৪ তারিখ রাত। ৫ তারিখ সারাদিন যুদ্ধ চলল সন্ধ্যায় দু পক্ষেই ফায়ার বন্ধ হল। সারারাত আহতদের সেবা শুশ্রুষা হল। ছয় তারিখ ভোরে হানাদার বাহিনি ছয় ইঞ্চি মর্টার ও রকেট লঞ্চার দিয়ে তুমুল আক্রমন শুরু করল।

একদিকে খাবার নেই। আড়াই দিন পার হয়ে যাচ্ছে। বিস্কুট এবং পানি খেয়ে বেঁচে আছে তিনশ মুক্তিযদ্ধা। শুধু ব্যান্ডেজ বেঁধে আহতরা পরে আছে বাঙ্কারে। সামনের দিক থেকে ছুটে আসছে কামানের গোলা মেশিনগানের গুলি। সবকিছু অনিশ্চিত। সব দিক দিয়ে বিচ্ছিন্ন। তবু মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই চালিয়ে গেল। সঙ্কিছু অনিশ্চিত জেনেও দাঁত দাঁতে কামড়ে জীবন বাজি ধরে লড়ে গেল শঠিবাড়ি বন্দরে। ছয় তারিখ রাত আটটায় শঠিবাড়ির ডানদিকে মুক্তিযোদ্ধারা আকস্মিকভাবে তিনশ গজ ছুটে গিয়ে হানাদারদের কয়েকটি ডিফেন্স পজিশন দখল করে নেয়। এটা ছিল একটি আত্মঘাতী পদক্ষেপ। সেই ডিফেন্স লাইনে ছিল প্রায় দেড়শ রাজাকার। তারা অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। আহত কোম্পানী কমান্ডারের নির্দেশ মোতাবেক মুক্তিযোদ্ধাদের ফ্রন্ট লাইনে বসিয়ে হানাদারদের বিরুদ্ধে গুলি চালাবার আদেশ দেয়া হয়। ধৃত রাজাকাররা সে আদেশ পালন করে। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বেড়ে যায়। চাঙ্গা হয়ে ওঠে তারা। ৬ ই সেপ্তেম্বর সারারাত গুলি আর পালটা গুলি চলতে থাকে। ৭ ই সেপ্টেম্বর ভোর বেলা পাকবাহিনী অবস্থান ত্যাগ করে নিলফামারির দিকে পালিয়ে যায়। ৭ ই সেপ্টেম্বর সকাল ৭ টা ২০ মিনিটে শঠিবাড়ি বন্দরের বুকে উড়ল মুক্তির পতাকা।

*দৈনিক ‘সংবাদ’- এর ১৫ ও ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৮১ সংখ্যায় প্রকাশিত মুসা সাদিক রচিত প্রতিবেদন থেকে সংকলিত।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৭ নং সেক্টরে সংঘটিত যুদ্ধের বিবরণ   মে-ডিসেম্বর ১৯৭১

অয়ন মুক্তাদির

<১০, ১৩., ৩৩৪৩৪২>

অনুবাদ

 

যুদ্ধের ঘটনাপঞ্জীঃ ব্রিগেডিয়ার গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী*

৩০১০৭০

 

Date Events Casualties
০৪-০৫-৭১ চারজন মুক্তিযোদ্ধার একটি দলকে বিশেষ মিশনে রাজশাহী পাঠানো হল। এক জন শান্তি কমিটি চেয়ারম্যানকে আহত করা হয়েছে।
১০-০৫-৭১ নায়েব সুবেদার মুবশশারুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি দল চারঘাট থানা আক্রমন করল। ১০ জন পাক সেনা/মিলিশিয়া নিহত এবং ৭ জন আহত
১৩-০৫-৭১ হাবিলদার খঃ আঃ মতিন এক সেকশন সেনা নিয়ে সারদা পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার আক্রমন করল। ৬ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত
১৪-০৫-৭১ আমাদের একটি দল মীরগঞ্জ বিওপি আক্রমন করল ৭ জন পাকি সেনা নিহত এবং আরো ৭ জন আহত
১৪-৫-৭১ ল্যান্স নায়েক শারিকুর রহমানের নেতৃত্বে একটি দল মুখতারপুরে হানা দিলো। ৩ জন পাকিস্তানি দালাল নিহত
১৪-০৫-৭১ আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহীতে আক্রমন চালালো। ৬ জন পাকিস্তানি দালাল নিহত
১৪-০৫-৭১ আমাদের মুক্তিযোদ্ধার একটি দল মীরগঞ্জে নাকিমুদ্দিন নামে একজন শান্তি কমিটি মেম্বারের বাড়িতে হামলা করলো। ১ জন শান্তি কমিটি মেম্বার নিহত
১৫-০৫-৭১ হাবিলদার কাওসারুদ্দিন এর নেতৃত্বে একটি দল আলাতলির মুসলিম লীগের চেয়ারম্যানের বাড়িতে হামলা করলো। মুসলিম লীগের চেয়ারম্যান নিহত
১৫-০৫-৭১ হাবিলদার আমিরুজ্জামান সহ ১০ জন সেনা সারদা পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার আক্রমন করলো। ভেড়ামারায় বিদ্যুৎ সঞ্চালন খুঁটি ধ্বংস করা হয়েছে।
১৬-৫-৭১ নায়েব সুবেদার মোহাম্মদ ইসমাইলের নেতৃত্বে এক সেকশন যোদ্ধা গোদাগাড়ীতে শত্রু অবস্থানের উপর হামলা করলো। ৩ জন অবাঙ্গালী পাহারাদার নিহত
১৬-৫-৭১ হাবিলদার আমিরুজ্জামান ৫ জন সেনা সাথে নিয়ে আলাইপুর এর এক শান্তি কমিটি মেম্বারের বাড়ি আক্রমন করলো। ১ জন শান্তি কমিটি মেম্বার নিহত
১৬-৫-৭১ আমাদের মর্টার সেকশন রাজশাহী পুলিশ লাইনের উপর গোলাবর্ষন করলো। ১৭ জন পাক সেনা নিহত এবং ২৫ জন আহত।
১৬-৫-৭১ হাবিলদার মজিবর রহমানের নেতৃত্বে ১২ জন সেনার একটি দলকে বিদিপুর সড়কের সেতু উড়িয়ে দেবার জন্য পাঠানো হল। বিদিপুর সড়ক সেতু উড়িয়ে দেয়া হল।
১৭-৫-৭১ Mjd মিনুরুল ইসলাম যোদ্ধাদের একটি দলকে সাথে নিয়ে বাগদানিতে একজন পাকিস্তানি দালালের বাড়িতে হামলা করে। এক জন পাকিস্তানি দালাল নিহত।
১৮-৫-৭১ নায়েক একরাম আলি ৫ জন যোদ্ধাকে সাথে নিয়ে খারচাক্কা এলাকার পাকিস্তানি দালাল আব্দুস সাত্তারের বাড়িতে হামলা করে। এক জন পাকিস্তানি দালাল নিহত।
২৪-৫-৭১ ১৫ জন যোদ্ধাকে সাথে নিয়ে হাবিলদার আজিজুর রহমান বাসুদেবপুর গ্রামে আক্রমন চালায়। ২৫ জন পাকিস্তানি দালাল নিহত, আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়েছেন।
০৪-০৬-৭১ শত্রু আমাদের মুক্তাঞ্চল পোলাডাঙ্গাতে হামলা করে। আমাদের সেনারা শত্রুর সাথে যুদ্ধ করে শত্রুকে একাধিক লাশ পেছনে ফেলে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। ১৭ পাক সেনা নিহত, ২৫ জন আহত, এবং ২৫ জন পাকিস্তানি দালাল নিহত। আমাদের হাবিলদার মতিন এবং অন্য একজন কনস্টেবল আহত হয়েছে।
১৯-৬-৭১ হাবিলদার হুমায়ুন কবির ১০ জন সৈনিক নিয়ে পাকিস্তানি দালাল প্রেমতলির মালেক স্বর্ণকারের বাড়িতে হামলা করে। মালেক স্বর্ণকারকে হত্যা করার পাশাপাশি গোদাগাড়ী এবং নবাবগঞ্জের মধ্যকার টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।
২১-৬-৭১ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের বাড়িতে হামলা চালায়। চেয়ারম্যান নিহত।
২৪-৬-৭১ গোদাগাড়ীর পাকিস্তানি দালাল মেসের বিশ্বাসের বাড়িতে হামলা করে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল। মেসের বিশ্বাস কে হত্যা করা হয়েছে।
২৪-৬-৭১ হাবিলদার কাওসারউদ্দিনের নেতৃত্বে ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শান্তি কমিটির একজন মেম্বারের                                                                                                                                                        বাড়িতে হামলা করে। শান্তি কমিটি মেম্বারকে হত্যা করা হয়েছে।
২৫-৬-৭১ একদল মুক্তিযোদ্ধা আজ রাজশাহী টেলিফোন এক্সচেঞ্জে হামলা করেছে। এক মিলিশিয়া গার্ড নিহত হয়েছে।
২৫-৬-৭১ একদল মুক্তিযোদ্ধা আজ নাটোর – রাজশাহী সড়কে রেল ক্রসিং এ হামলা করেছে। একজন রেলওয়ে গার্ড নিহত ও একজন আহত হয়েছে।
২৫-৬-৭১ চারঘাট থানার বানেস্বর এ একজন শান্তি কমিটি মেম্বারের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা হামলা করলো। একজন শান্তি কমিটি মেম্বার নিহত হয়েছে।
২৬-৬-৭১ কাটাখালিতে একটা সড়ক সেতু ধ্বংস করার জন্য একটি ডেমোলিশন পার্টি পাঠানো হল। রাজশাহী ইউনিভার্সিটি এলাকাতে শত্রুর অবস্থানের উপর ৩” মর্টারের ৪ টি গোলা বর্ষন করা হল। কাটাখালি সেতু ধ্বংস করা হয়েছে। দুজন বেসামরিক পাহারাদার নিহত। সালদার কাছে বিদ্যুতের খুঁটিও উড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
২৭-৬-৭১ এক আক্রমনে কাটাখালিতে একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং ৪ টি ট্রান্সফর্মার ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। ৩ মিলিশিয়া নিহত।
২৭-৬-৭১ তেলাইমারিতে একজন শান্তি কমিটির মেম্বারের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা হামলা করেছে। শান্তি কমিটি মেম্বারের বাড়ীর ক্ষতি করা হয়েছে।
৩০-৬-৭১ সারদা পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারের কাছে একটি রেলসেতু ধ্বংস করার জন্য ডেমোলিশন পার্টি পাঠানো হল। ৭ জন পাক সেনা নিহত।
৩০-৬-৭১ পানিকামরি, চারঘাটের বাহার নামের একজন শান্তি কমিটি মেম্বারের বাড়িতে হামলা করা হল। শান্তি কমিটি মেম্বার নিহত।
৩০-৬-৭১ নওহাটা, রাজশাহীর একজন শান্তি কমিটি মেম্বার/পাকিস্তানি দালালের বাড়িতে হামলা করা হল। দুইজন শান্তি কমিটি মেম্বার নিহত।
৩-৭-৭১ একদল মুক্তিযোদ্ধা অপারেশন চালানর জন্য রাজশাহী গেল। অপারেশনের পর নদী পার হতে গিয়ে শত্রুর হাতে একজন ছাত্র নিহত হয়েছে এবং আহত অন্য আরেকজনকে বারাকপুর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
১-৭-৭১ কুঠিপারায় শত্রু অবস্থানের উপর মুক্তিযোদ্ধারা হামলা করেছে। ২ জন পাকসেনা নিহত।
৩০-৭-৭১ মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুর একটি জীপের উপর অ্যামবুশ করেছে। জীপের উপর গ্রেনেড ছোঁড়া হয়েছে।
৩০-৭-৭১ মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহী বিদ্যুৎকেন্দ্রে হামলা করেছে। ২ জন মিলিশিয়া গার্ড নিহত, বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে।
১-৭-৭১ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল সাহেববাজারে হামলা করেছে। ৪ জন পাকিস্তানি দালাল নিহত।
১-৭-৭১ কিছু বেসামরিক লোক মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দলকে ধরিয়ে দেবার চেষ্টা করছিল। ১ বেসামরিক লোক নিহত।
১-৭-৭১ পবা থানার সুজাপুরে একজন শান্তি কমিটি মেম্বারের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা হামলা করলো। শান্তি কমিটি মেম্বার নিহত।
১-৭-৭১ পবা থানার খন্দকাটারে একজন শান্তি কমিটি মেম্বারের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা হামলা করলো। ২ জন পাকিস্তানি দালাল নিহত।
১-৭-৭১ পবা থানার বেতকুরি গ্রামে একজন শান্তি কমিটি মেম্বারের এবং পাকি সেনাদের দালালের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা হামলা করলো। ১ জন পাকিস্তানি দালাল নিহত।
১-৭-৭১ পালপুরে জামায়াতে ইসলামীর এক কর্মীর বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা হামলা করলো। ১ পাকিস্তানি দালাল নিহত।
১-৭-৭১ মুক্তিযোদ্ধারা নওহাটা বিমানবন্দরে হামলা করলো। ৬ পাকিস্তানি দালাল নিহত।
১-৭-৭১ মুক্তিযোদ্ধাদের একটা দল রাজশাহী শহরে আক্রমন চালালো। ৫ জন অবাঙ্গালী নিহত।
১-৭-৭১ চারঘাট থানার কুঠিপাড়াতে শত্রু অবস্থানের উপর হামলা করেছে মুক্তিযোদ্ধার দল। ২ পাক সেনা এবং ১ দালাল নিহত।
২-৭-৭১ রাজশাহীর দামকুড়াতে একজন পাকিস্তানি দালালের বাড়িতে হামলা করলো মুক্তিযোদ্ধারা। ১ পাকিস্তানি দালাল নিহত।
২-৭-৭১ মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহী টেলিফোন এক্সচেঞ্জ আক্রমন করলো। ১ পাকিস্তানি দালাল নিহত ও আরেকজন আহত হয়েছে।
২-৭-৭১ রাজশাহীর দুর্গাপুরে একজন শান্তি কমিটি মেম্বারের বাড়িতে হামলা করলো মুক্তিযোদ্ধারা। ১ পাকিস্তানি দালাল এবং একজন শান্তি কমিটি মেম্বার নিহত।
২-৭-৭১ মুক্তিযোদ্ধারা দুর্গাপুর তহশিল অফিসে হামলা করলো। তহশিল অফিস পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে এবং দুর্গাপুর এবং সারদার মধ্যে টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।
৩-৭-৭১ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল রাজশাহী বিহারী কলোনিতে জনৈক আলাউদ্দিনের বাড়িতে হামলা করলো। আলাউদ্দিন, তার স্ত্রী এবং শিশু নিহত।
৩-৭-৭১ একজন শান্তি কমিটি মেম্বারের বাড়িতে হামলা করলো মুক্তিযোদ্ধারা। শান্তি কমিটি মেম্বার নিহত।
৬-৭-৭১ আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা ঈশ্বরদীতে হামলা করল। পাকসী ও ভেরামারার মধ্যকার টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।
৭-৭-৭১ রুস্তমপুরে একজন শান্তি কমিটি মেম্বারের বাড়িতে হামলা করলো মুক্তিযোদ্ধারা। একজন শান্তি কমিটি মেম্বার নিহত।
৭-৭-৭১ আমাদের যোদ্ধারা আড়ানি রেলওয়ে স্টেশনে হামলা করেছে। আড়ানির সাথে অন্য সব স্টেশনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।
১৪-৭-৭১ রাজশাহী শহরে আমাদের যোদ্ধারা হামলা করলো। ৩ জন অবাঙ্গালী নিহত হয়েছে এবং আরও তিনজন আহত হয়েছে
১৪-৭-৭১ আমাদের যোদ্ধারা নওহাটায় সেনা অবস্থানের উপর হামলা করলো। ৪ সেনা, ২ পাক দালাল নিহত এবং আরো দুজন আহত।
১৪-৭-৭১ আমাদের যোদ্ধারা হরিয়ান চিনিকলে হামলা করে মিল কম্পাউন্ডে গ্রেনেড ছুঁড়ে মেরেছে।  
১৬-৭-৭১ আমাদের যোদ্ধারা গোপালপুর ও লালপুরে হামলা চালালো। একজন পাকিস্তানি দালাল নিহত ও একজন আহত।
১৬-৭-৭১ আমাদের যোদ্ধারা আটারি সেতুর গার্ডদের উপর হামলা চালালো। এক জন রাজাকার নিহত এবং ২ জন মিলিশিয়া আহত।
১৬-৭-৭১ আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা আজ রাজশাহী বিমানবন্দরে হামলা চালালো। একজন পাকিস্তানি দালাল নিহত।
১৭-৭-৭১ চারঘাট থানার একজন শান্তি কমিটি মেম্বারের বাড়িতে হামলা করলো মুক্তিযোদ্ধারা। গ্রেনেড হামলায় দুজন শান্তি কমিটি মেম্বারকে আহত করা হয়েছে।
১৯-৭-৭১ পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার পাইলট স্কুলে যোদ্ধারা হামলা করলো। পাইলট স্কুলের পাহারাদার নিহত।
১৯-৭-৭১ রাজশাহীতে পাকিস্তানি দালাল আজিমুদ্দিনের বাড়িতে হামলা করলো মুক্তিযোদ্ধারা। তাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে।
১৯-৭-৭১ বিনোদপুরের একজন শান্তি কমিটি মেম্বারের বাড়িতে হামলা করলো মুক্তিযোদ্ধারা। গ্রেনেড হামলায় তাকে হত্যা করা হয়েছে।
২০-৭-৭১ রাজশাহী শহরের ফুড়কিপারায় আজ শত্রুর একটি টহল দলের উপর অ্যামবুশ করা হয়েছে ৪ জন মিলিশিয়া নিহত
২০-৭-৭১ লালপুর পুলিশ ফাঁড়িতে আমাদের যোদ্ধারা আক্রমন করলো ৭ জন অবাঙ্গালী পুলিশ নিহত।
২২-৭-৭১ নায়েব সুবেদার মোবাশারুল সাথে আরো দুজনকে নিয়ে মিরগঞ্জে রাজাকার অবস্থানের উপর হামলা চালালো। ৫ জন রাজাকার নিহত হবার পাশাপাশি চারঘাট এবং মিরগঞ্জের মধ্যে টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন
২৪-৭-৭১ বাঘার কাছে ভেরামারা-রাজশাহী বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের তিনটি খুঁটি উড়িয়ে দিয়েছে আমাদের যোদ্ধারা।  
২৪-৭-৭১ ২” মর্টারের সহায়তার লালপুর পুলিশ ফাঁড়ির উপর হামলা চালালো আমাদের যোদ্ধারা। পাক সেনাবাহিনির একটি জিপ ধ্বংস হয়েছে।
৩১-৭-৭১ নবাবগঞ্জ এবং রাজশাহীর মধ্যকার দুটি টেলিফোন পিলার ধ্বংস করা হয়েছে  
৩-৮-৭১ আমাদের ৭ জন যোদ্ধার একটি দল তাহিরপুরে ১৫ জন শত্রুসেনার একটি টহলদলকে অ্যামবুশ করেছে। ১৫ জন শত্রুসেনা তাহিরপুর নদীতে ডুবে মারা গেছে।
৪-৮-৭১ যোদ্ধাদের ৬ জনের একটি দল তাহিরপুর স্কুলে আক্রমন করলো। ৮ মিলিশিয়া নিহত এবং ২ জন আহত।
৪-৮-৭১ আমাদের যোদ্ধারা একটি সামরিক জীপকে অ্যামবুশ করেছে। ২ পাক সেনা নিহত।
৪-৮-৭১ আমাদের ২ জন যোদ্ধা কাটাখালিতে শত্রুর সেন্ট্রি পোস্টে আক্রমন করেছে। এক জন শত্রু নিহত এবং ৩ জন আহত।
৫-৮-৭১ সিতলাইতে আমাদের ডেমলিশন পার্টি অপারেশনে গেল সিতলাই রেল সেতু ধ্বংস করা হয়েছে।
৫-৮-৭১ গোদাগাড়ী থানা হাই স্কুলে অবস্থান নেওয়া রাজাকার ও মিলিশিয়াদের উপর আমাদের ২” মর্টার সেকশন গোলাবর্ষন করলো। ৩ রাজাকার/মিলিশিয়া নিহত এবং ৪ জন আহত।
১০-৮-৭১ আমাদের যোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের ভ্যানের উপর অ্যামবুশ করেছে এবং পিটিআই ট্রেনিং মাঠে অ্যান্টি পার্সোনাল মাইন স্থাপন করেছে। ৮ রাজাকার নিহত এবং একজন আহত।
১৫-৮-৭১ সাব সেক্টর কমান্ডারের নেতৃত্বে আমাদের যোদ্ধারা হরিপুর ব্রিজে রাজাকারদের উপর হামলা করেছে এবং নবাবগঞ্জে ইপিকাফ লাইন, পুলিশ লাইন এবং কোর্ট এলাকায় ২০০ গজ দূর থেকে মর্টার হামলা করেছে। ৯ জন রাজাকারকে আটক করা হয়েছে এবং হরিপুর ব্রিজ সম্পুর্নরুপে ধ্বংস করা হয়েছে।
১৫-৮-৭১ নাটোরের আটারি থানায় হামলা চালিয়েছে আমাদের ৮ জন যোদ্ধার একটি দল। ৮ জন রাজাকার নিহত।
২০-৮-৭১ আমাদের এক সেকশন সেনা রাজশাহী জেলার দুর্গাপুর থানা আক্রমন করলো। ১১ রাজাকার নিহত এবং ১২ জন আহত। ১ জন শান্তি কমিটি মেম্বার নিহত।
২০-৮-৭১ এক সেকশন মুক্তিযোদ্ধা দুর্গাপুর থানা আক্রমন করলো। ৯ রাজাকার নিহত, ১২ আহত, ২ আটক
২৩-৮-৭১ ৪৫ জনের একটি এফএফ/এমএফ সম্মিলিত দল সাব সেক্টর কমান্ডারের নেতৃত্বে অভয়া ব্রিজ আক্রমণ এবং ধ্বংস করতে গেল।  
২৩-৮-৭১ রাজশাহী শহর থেকে ২০ মাইল দূরে রাজশাহী – নবাবগঞ্জ সড়ক শত্রুর সাথে গুলি বিনিময়ের পর যাত্রীসহ শত্রুদের দুটি নৌকা ডুবে যেতে দেখা গেছে। আমাদের এক জন নিহত ও ২ জন আহত হয়েছে।
২৫-৮-৭১ পবা এলাকার আফিপাড়া থানায় শত্রু অবস্থানের ওপর মুক্তিফৌজ আক্রমন চালালো। ৬ রাজাকার ও ১ পাক সেনা নিহত।
৩-৯-৭১ আমাদের যোদ্ধারা বাজুবাকাতে শত্রু অবস্থানের ওপর হামলা চালায়। ৩৪ রাজাকার নিহত এবং ২৪ জন আহত।
৬-৯-৭১ আমাদের দুই সেকশন সৈন্য প্রেমতলিতে পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানের উপর আক্রমন চালালো। ২ পাক সেনা ও ২ রাজাকার নিহত, ৭ জন আহত
১৩-৯-৭১ এক প্লাটুন মুক্তিসেনা রামচন্দ্রপুরে পাক সেনা অবস্থানের উপর আক্রমন করলো। ২০ পাক সেনা ও ১২ রাজাকার নিহত, ১৩ পাক সেনা আহত। আমদের ১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন, ২ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত।
১৬-৯-৭১ আমাদের মর্টার সেকশন সারদা পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারের উপর আজ গোলাবর্ষন করেছে। ৩০ রাজাকার/পাকসেনা নিহত, ৫০ জন আহত
২০-৯-৭১ মুক্তিযোদ্ধারা চারঘাটে শান্তি কমিটির সেক্রেটারির বাড়িতে হামলা করেছে। শান্তি কমিটির সেক্রেটারি নিহত
২২-৯-৭১ জামাতে ইসলামীর সভা চলাকালে আমাদের যোদ্ধারা ইসলামপুর ইউসি আক্রমন করে ২ শান্তি কমিটি মেম্বার গ্রেপ্তার
২২-৯-৭১ এক সেকশন মুক্তিযোদ্ধা কাটাখালি পাওয়ার স্টেশনে হামলা করে। ৩” মর্টারের সাহাজ্যে ২৪ টি বোমা কাটাখালি পাওয়ার স্টেশনের উপর ফেলা হয়। ২ পাকসেনা নিহত এবং ১০ জন আহত
২২-৯-৭১ ১৫ জন যোদ্ধা সাথে নিয়ে হাবিলদার শফিকুল ইসলাম রুস্তমপুর হাটে রাজাকারদের উপর আক্রমন করে। ২ রাজাকার নিহত
২৪-৯-৭১ আমাদের যোদ্ধারা একজন পাকিস্তানি দালালের বাড়িতে হামলা করেছে। ১ পাকিস্তানি দালাল নিহত
২৬-৯-৭১ হাবিলদার মজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দুই সেকশন যোদ্ধা আইয়ুব ক্যাডেট কলেজের পেছনে মুক্তারপুরে হামলা চালিয়েছে। মুক্তারপুরে দুইটি বিদ্যুতের খুঁটি উড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
২৭-৯-৭১ মুক্তিযোদ্ধারা আজ ৩” মর্টার থেকে নবাবগঞ্জ থানার রামচন্দ্রপুর হাটে গোলাবর্ষন করেছে। ৭ পাকসেনা নিহত
৩-১০-৭১ হাবিলদার শফিকুরের নেতৃত্বে এক প্লাটুন যোদ্ধা ডাকড়া বাজারে রাজাকারদের উপর হামলা করেছে। ১ পাকসেনা, ২০ রাজাকার, এবং এক পাকি দালাল নিহত এবং এ রাজাকার আহত
৩-১০-৭১ মুক্তিযোদ্ধারা বেলবাড়িয়াতে রাজাকার/মুজাহিদদের উপর আক্রমন করলো। ১৫ রাজাকার নিহত ও ৪ জন আহত
১০-১০-৭১ মুক্তিযোদ্ধারা নবাবগঞ্জে রাজাকারদের উপর আক্রমণ করেছে এবং রেল লাইনে মাইন স্থাপন করেছে। পাকিস্তানিদের সেনা বহনকারী একটি ট্রেন ধ্বংস করা হয়েছে, ২৫ জন পাকসেনা নিহত।
১০-১০-৭১ শত্রু সেনারা ইসলামপুরে আমাদের উপর হামলা করেছে। যুদ্ধে ২০ জন পাক সেনা নিহত হয়েছে। আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়েছে।
১১-১০-৭১ সাব সেক্টর কমান্ডারের নেতৃত্বে ২ সেকশন মুক্তিযোদ্ধা গোদাগাড়ী ও সুলতানপুরে শত্রুর অবস্থানের উপর ৩” মর্টারের ৪৬টি গোলা বর্ষন করেছে।  
১২-১০-৭১ ৩” মর্টারের গোলা বর্ষন করে শত্রুর অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিয়েছে আমাদের সেনারা। ৫০ শত্রু সেনা নিহত এবং ৩০ জন আহত। আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়েছেন।
১০-১০-৭১ মাইনের সাহায্যে শক্তিবৃদ্ধির জন্য রাজশাহী থেকে আমনুরাগামী সেনাবাহী বিশেষ ট্রেনকে উড়িয়ে দিয়েছে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা। ৩০ জন পাকসেনা হতাহত হয়েছে
২৭-১০-৭১ মুক্তিযোদ্ধারা বাগদানি, রাজশাহীতে রাজাকার/মিলিশিয়া ঘাঁটিতে আক্রমন করেছে। ৫ জন রাজাকার/মিলিশিয়া নিহত। মিলিশিয়া ক্যাম্প সম্পুর্নরুপে বিধ্বস্ত।
১০-১০-৭১ মুক্তিযোদ্ধা ও নিয়মিত বাহিনীর সম্মিলিত দল রাজাকারদের একটি টহলদলকে আক্রমণ করেছে ৩ রাজাকার নিহত, ৪ রাজাকার গ্রেফতার।
৯-১০-৭১ বড়কান্তপুর ও সুন্দরপুর মুক্তাঞ্চলে শত্রু ৩০ রাউন্ড গোলা বর্ষন করেছে।  
১৩-১০-৭১ শত্রু ৩” মর্টার দিয়ে আনুমানিক ৫০ রাউন্ড গোলাবর্ষন করেছে জয়ান্দিপুরে আমাদের অবস্থানের উপরে।  
১৪-১০-৭১ আমাদের বাকেরালি ঘাঁটির উপর গোলাবর্ষন করেছে শত্রু। আমাদের সেনারা ৩” মর্টার দিয়ে পাল্টা জবাব দিয়েছে।  
১৫-১০-৭১ স্থানীয় এক পুলিশের সহায়তায় এক প্লাটুন রাজাকার লালপুরে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের উপর হামলা করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে রাজাকারদের গুলিবিনিময় হয়। ২০ রাজাকার নিহত। একজন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়েছেন।
২১-১০-৭১ ১৫ জন করে মুক্তিযোদ্ধা ও নিয়মিত বাহিনীর দুটো দল ফরহাদপুর সেতুর উপর বিশেষ মিশন নিয়ে হামলা করে। সেতুর দুইদিকে শত্রুর বাঙ্কার থাকার পাশাপাশি রাজাকারদের প্রহরাও ছিল। ফরহাদপুর সেতু সম্পুর্নরুপে ধ্বংস করা হয়েছে
২৫-১০-৭১ মুক্তিযোদ্ধাদের ২৫ জনের দল লালপুরে থানা আক্রমণ করলো। লালপুর থানার বুলমারিয়ার ৮ জন রাজাকার আত্মসমর্পন করেছে
৩০-১০-৭১ মুক্তিযোদ্ধারা সুন্দরপুরে শত্রু অবস্থানের উপর হামলা করেছে। শত্রু পালিয়ে গেছে।
৩০-১০-৭১ জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা মুক্তাঞ্চলে হামলার চেষ্টা করলে মুক্তিযোদ্ধারা গুলি ছুঁড়েছে। ২ জন জামায়াত কর্মী নিহত।
৩০-১০-৭১ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল কুমারপুর সেতু ধ্বংস করতে গিয়ে সেতুর দিকে শত্রুর এক গাড়ী বহর আসতে দেখে তাড়াহুড়া করে একটি অ্যামবুশ করে। শত্রুর দুটি জিপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে
৬-১১-৭১ আমাদের এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা পেবিনগরে শত্রু অবস্থানের উপর আক্রমণ করেছে। কিছুক্ষন গুলিবিনিময়ের পর শত্রু পালিয়ে যায়। ২ পাকসেনা নিহত।
৭-১১-৭১ মুক্তিযোদ্ধা ও নিয়মিত বাহিনির সমন্বিত দুটি প্লাটুন ইসলামপুরে ও জয়ান্দিপুরে শত্রুর ওপর হামলা করেছে।  
৮-১১-৭১ জহুরপুর গ্রামে পাঞ্জাবিরা বাংলাদেশ সমর্থকদের বাড়িঘর লুটপাট ও আগুনে পুড়িয়ে এসেছিল। খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত সেখানে যায় এবং একটা অ্যামবুশ করে। ৫ মিলিশিয়া নিহত, একজনের লাশ টেনে ঘাঁটিতে আনা হয়েছে।
৭-১১-৭১ মুক্তিযোদ্ধারা শাহপুর বিওপি (বর্ডার অবজার্ভের্শন পোস্ট) আক্রমণ করেছে। ৩ রাজাকার নিহত।
১১-১১-৭১ নরেন্দ্রপুরে আমাদের রক্ষন অবস্থানের ওপর ৩” মর্টারের দুটি গোলা বর্ষন ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে শত্রুর একটি দল হামলা চালায়। আমাদের সেনারাও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের মাধ্যমে পাল্টা জবাব দিয়েছে।  
১২-১১-৭১ আমাদের এক প্লাটুন যোদ্ধা জয়ান্দিপুরে শত্রুর উপর হামলা করে শত্রুদেরকে তাদের বাঙ্কার ও অন্যান্য জায়গা থেকে উৎখাত করেছে। আমাদের প্লাটুন ইন চার্জ আহত হয়েছেন। এক সেকশনের চেয়ে বেশি যোদ্ধা বড়রহিয়া আক্রমণ করেছে।

৫ জন রাজাকার এবং শান্তি কমিটি মেম্বারকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

২ জন রাজাকার নিহত হয়েছে।

১৩-১১-৭১ রশিয়া এবং বাগডাঙ্গাতে ১২ টি বাড়ী পুড়িয়ে দিয়েছে।  
১২-১১-৭১ ২ কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা বিএসএফ এর মর্টার সেকশনের সহায়তায় রাজারামপুরে শত্রু অবস্থানের উপর হামলা করেছে। ১জন অফিসার সহ ৯ পাক সেনা নিহত, ৬০ রাজাকার/ইপিকাফ নিহত এবং ১২ রাজাকার গ্রেফতার। আমাদের ৪ জন মুক্তিফৌজ ও ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়।
২৪-১১-৭১ শত্রুরা ইসলামপুর, চাটাইডুবি ও প্রোগ্রামে নিজেদেরকে সংহত করছে।  
২৫-১১-৭১ মুক্তিযোদ্ধাদের দল দরাই ও বাগদানিতে আক্রমণ করেছে। দরাই সেতু ধ্বংস করা হয়েছে। ৬ পাকসেনা নিহত। ২ জন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়েছেন।
১৭-১১-৭১ মিরাপাড়াতে শত্রুর অবস্থানের উপর আমাদের মর্টার থেকে গোলাবর্ষন করা হয়েছে। ১২ পাকসেনা নিহত।
২৮-১১-৭১ মুক্তিযোদ্ধারা জনৈক পাকিস্তানি দালালের বাড়িতে হামলা করে। ২ পাকিস্তানি দালাল ও একজন রাজাকার নিহত। বাড়ি পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে।
২৮-১১-৭১ রাজাকাররা ৩” মর্টার হামলার আড়ালে মুক্তাঞ্চল থেকে গবাদিপশু তাড়িয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে। গবাদিপশু তাড়িয়ে নিয়ে যাবার সময় আমাদের টহলদল রাজাকারদের দিকে গুলি করে। রাজাকাররা গরু ফেলেই পালিয়ে গেছে।  
১৬-১২-৭১ শত্রু নবাবগঞ্জে ২ কোম্পানি নিয়মিত সেনা ও ১ কোম্পানি ইপিকাফ নিয়ে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে, সহায়তা পাচ্ছে ১২০ মিমি মর্টার ব্যাটারি এবং ৮২ মিমি মর্টার থেকে। আমাদের তিন কোম্পানি সেনা ভোর ৬ টায় নবাবগঞ্জ আক্রমণ করেছে।  

 

** ১৯৭১ সালের মার্চে ক্যাপ্টেন পদে কর্ম্রত ছিলেন। বিবরণটি প্রকল্প সংগৃহীত দলিলপত্র থেকে সংকলিত।

ডাঃ মোঃ রাজিবুল বারী (পলাশ)

<১০, ১৩.২, ৩৪২-৩৪৭>

রাজশাহীতে সৈন্যসমাবেশ

(ব্রিগেডিয়ার গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী, বি বি , পি এস সি (অবঃ)

তৎকালীন মেজর গিয়াস; কমান্ডার – রাজশাহী সাব-সেক্টর  – এর ডায়রি থেকে)

২২শে এপ্রিল আমি একটি মেসেজ পাই কর্ণেল ওসমানীর (পরবর্তীতে জেনারেল) কাছ থেকে। রাজশাহীর পাতি তলার উল্টোপাশে তিনি আমাকে দেখা করতে বলেছেন। ২৫শে এপ্রিল ১৯৭১, বিএসএফ ব্যাটালিয়নের একটি জিপে করে ভারত হয়ে আমি সেখানে যাই। সকাল ৯টার দিকে সেখানে একটি রেস্টহাউজে কর্নেল ওসমানীর সাথে সাক্ষাত করি। সেখানে ক্যাপ্টেন আনোয়ারের (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) সাথেও দেখা হয়। ৩ নং ইস্ট বেঙ্গলের একটি অংশের তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন যেখানে সায়েদপুর  ক্যান্টনমেন্ট থেকে বিচ্যুত হওয়া একটি অংশও তার সাথে যোগ দেয়।

আমি সাথে একটা ম্যাপ এনেছিলাম এবং তাঁকে (কর্ণেল ওসমানী) আমার শেষ অপারেশন সম্পর্কে বলছিলাম। এর পরও যে আমার কাছে আরও অস্ত্র ছিল সেব্যাপারে তার কোন ধারনাই ছিলোনা। সেগুলোর মধ্যে ছিল – ৩০০০ রাইফেল, ৯৮ টি বেরেটা গান, ৬টি মাঝারি মর্টার, ৩লাখ ৩০৩ এম্মুনিশন, ১৪০০ মর্টার শেল ইত্যাদি। তিনি খুবই চমকিত হলেন এবং সেগুলো নেবার জন্য তার আদেশের অপেক্ষা করার অনুরোধ করলেন। তিনি আমাকে রাজশাহী জেলা এবং কুষ্টিয়া ও দিনাজপুর জেলার কিছু অংশ নিয়ে একটি সেক্টরের ইন-চার্জ করলেন। এছাড়াও ভারতের মালদহ ও মুর্শিদাবাদের মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সমবেত করারও আদেশ দিলেন।

       মে এবং জুনে স্বাধীনতার ব্যাপারে খুবই হতাশা কাজ করছিল। শুরুতে আমি ৩টি ক্যাম্প গঠন করি। একটি হল ফরিদপুর বিওপি র মুক্ত এলাকা এবং পদ্মা ও মহানন্দার মাঝামাঝি কিছু চর এলাকা। সেখানে মূলত বিডিআর এর ট্রেনিং প্রাপ্ত সৈন্য, সেনা, আনসার ও মুজাহিদদের নিযুক্ত করি। মেজর রশিদের নেতৃত্বে সেনা ট্রেনিং প্রাপ্তদের নিয়ে আরেকটি ক্যাম্প করি। সেটা ছিল সারদা পুলিস একাডেমীর উল্টোপাশে বাংলাদেশ অংশের কিছু চর এলাকা। তৃতীয়টি ছিল ঐতিহাসিক লাল গোলা এলাকায়। ক্যাম্পগুলো গঠিত হয়েছিল যারা স্বেচ্ছায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চায় তাদেরকে সমবেত করা। খুব অল্প দিনেই প্রচুর সংখ্যক যুবকেরা ক্যাম্পে যোগ দিল – যাদের বেশীর ভাগই ছিল ছাত্র। তারা এত দ্রুততার সাথে গেরিলা ট্রেনিং এ দক্ষতা অর্জন করছিল যে আমি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলাম। ২-৩ সপ্তাহেই এই ছেলেগুলোকে ফরিদপুর এবং চারঘাট/সারদাহ ডিফেন্স অপারেশন ক্যাম্পে যুক্ত করি।

প্রাথমিক সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য আমাদের যথেষ্ট খাদ্য ও গোলাবারুদ ছিল।

জুনের মাঝামাঝিতে লেঃ জেনারেল অরোরা জিওসি (সি ইস্টার্ণ কমান্ড) মুর্শিদাবাদ জেলা সদরে অবস্থিত বহরমপুরে ১৯ মারাঠা রেজিমেন্ট পরিদর্শনে আসেন। আগেই এই ব্যাটালিয়নটিকে ইলেকশন ডিউটির জন্য পাঠানো হয়। রাজশাহীতে আমাদের সফলতার কথা শুনে ১৯ মারাঠা রেজিমেন্টের একজন অফিসার মারফত তিনি আমাকে তার সাথে দেখা করতে বলেন। সিজে-৫ মডেলের একটি খোলা জিপ চালাচ্ছিলাম আমি আর মেজর রশিদ (পরবর্তীতে কর্নেল) আমার পাশে বসা ছিলেন। লালগোলা থেকে মুর্শিদাবাদের দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার। তাই একটু তাড়া ছিল। পথে একটি গরু হঠাত রাস্তার মাঝখানে এসে পড়ায় আমি জিপটি নিয়ে রাস্তার পাশে পড়ে যাই এবং আমার চোয়ালের (ম্যান্ডিবল) হাড়টি ভেঙ্গে যায়। ফলে ১০ সপ্তাহ আমাকে হাসপাতালে থাকতে হয় এবং এই সময়ে মেজর রশিদ আমার দায়িত্ব পালন করেন।

সুস্থ হয়ে আমি মুজিবনগরে কর্নেল ওসমানীর সাথে দেখা করতে যাই। তিনি আমাকে ডাক্তারের কথামত ২ মাস বিশ্রাম নিতে বলেন যেহেতু তখনো আমার মুখের একটি অংশ প্যারালাইজড। আমার জায়গায় ইতোমধ্যে তিনি সেক্টর কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব দিয়েছেন মেজর জামান (পরবর্তীতে কর্ণেল) কে – ৭নং সেক্টরের প্রধান হিসাবে। আমি বললাম যে আমি বরং নিজস্ব হেডকোয়ার্টার ফরিদপুর বিওপি তে ফিরে যাই এবং রাজশাহী অংশের অপারেশনের দেখভাল করি। কারণ আমি বিশ্রাম নিতে চাচ্ছিলাম না। অপারেশনের দিকে মনোযোগ দেয়ার ব্যাপারেই তাগিদ অনুভব করলাম। তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। এর আরেকটি কারণ ছিল তৎকালীন মন্ত্রী  রাজশাহীর কামরুজ্জামান আমাকে তার এলাকায় চাচ্ছিলেন। আমাকে একটি স্বাধীন সাব-সেক্টরের (৪নং) চার্জ দেয়া হল। প্রশাসনিক সাপোর্ট লেঃ কর্নেল মঞ্জুরের কাছ থেকে এবং অপারেশন কো-অর্ডিনেট করবে ৭নং সেক্টরের লেঃ কর্নেল জামানের সাথে। আমি পুনরায় ট্রেনিং কার্যক্রম, সংগঠিতকরন এবং অপারেশন প্ল্যান ইত্যাদি শুরু করি। সাথে ছিলেন মেজর রশিদ। আরও কিছু ইয়াং অফিসার আমার নেতৃত্বে অন্তর্ভুক্ত হয়।

আমার নেতৃত্বে নিম্নোক্ত মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন।

১) নিয়মিত বাহিনী :

ক) ফরিদপুর বিওপির নবাবগঞ্জ টাউনের নাইমিতা বাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন

খ) মেজর রশিদের নেতৃত্বে সারদা পুলিশ স্টেশনের এক ব্যাটালিয়নের কিছু কম সংখ্যক

২) গেরিলা বাহিনী :

ক) প্রায় ৬০০০। তারা অবস্থান করবে লালগোলা/ভগবানগোলা এলাকার উল্টো দিকে। তাদের গ্রুপ লিডার, থানার লিডার এবং স্পেশাল টাস্ক ফোর্স লিডার ছিল। তারা সাধারণত ভিতরে যেত এবং স্যাবোটাজ করে ফিরে আসত। এর ১৫ দিন বা ১ মাস পরে মুক্ত অঞ্চল দিয়ে মুল ডিফেন্সে যেত। আম্যুনিশন অথবা বিশ্রামের পর তারা নিজস্ব অপারেশন এলাকায় ফিরে যেত যেখান থেকে তারা এসেছিল।

৩) তথ্য প্রদানকারি/মোটিভেটর : আমরা অনেক যুবকদের তথ্য জোগাড়ের ট্রেনিং দেই। তাদের দায়িত্ব ছিল ভেতর থেকে শত্রুদের পরিমাণ, প্রতিরক্ষা পদ্ধতি, গতিবিধি এবং মানসিক অবস্থা ইত্যাদি তথ্য সংগ্রহ করে আমাদেরকে জানানো। এছাড়াও স্থানীয় গেরিলাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে এবং আম্যুনিশন সহায়তা সহ গাইড হিসাবে কাজ করাও তাদের দায়িত্ব। তাছাড়া স্থানীয় জনগণকে শত্রুদের অসহযোগিতা করার ব্যাপারে উৎসাহিত করাও তাদের দায়িত্ব।

একটু ভিন্ন পদ্ধতিতে এবং কৌশলে আমি আমার নিয়মিত বাহিনী নিয়ে অপারেশনের আয়োজন করি। আমার অপারেশন এলাকার একটি নির্দিস্ট অংশের দিকে আমি মনোযোগ দেই। সামনে থেকে শত্রুপক্ষকে ব্যাস্ত রেখে আমরা অন্য দিক দিয়ে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা শুরু করি – যেমন ব্রিজ উড়িয়ে দেয়া, বিদ্যুৎ লাইন কেটে দেয়া, সাব-স্টেশন ধ্বংস করা, টেলিফোন লাইন অচল করা ইত্যাদি।

কিছুক্ষণ শত্রুদের ব্যাস্ত রেখে আমরা এর মধ্যে সর্বত্র অ্যামবুশ তৈরি করি। অনেক ক্ষেত্রে আমরা সফল হই। সপ্তাহে এক দুইবার আমরা তাদের সাথে মুখোমুখি পিচ ব্যাটেলে যুক্ত হতাম এবং পিছু হটে যেতাম। এভাবে তাদের মনোবল নিয়ে খেলা করতাম। অনেক ছোট ছোট অপারেশন চালাই যার সবগুলো এখানে বলা সম্ভব নয়। তবে আমার নেতৃত্বে দুটি খুব সফল অপারেশন সম্পর্কে বলতে চাই। যদিও ম্যাপে যে জায়গাগুলো চিহ্নিত করা ছিল সবগুলোর নাম দেয়া অসম্ভব।

 

 

অপারেশন ‘’কাবযাকারা’’

নভেম্বরের ১০ তারিখ লেঃ কর্নেল কিউ এন জামান আমাকে অনুরোধ করেন সাতমসজিদ এলাকায় মালদহ-নবাবগঞ্জ রোডে একটি অপারেশন চালাতে। শত্রুপক্ষ সেখানে খুব শক্ত অবস্থানে ছিল। এক ব্যাটালিয়নের অ বেশী সেনা, নিয়মিত সি এ এফ এবং রাজাকার সেখানে মোতায়েন ছিল। আন্তর্জাতিক সীমানার সমান্তরালে  উত্তর-দক্ষিন বরাবর সীমানার ৭/৮ মাইল ভেতর দিয়ে প্রায় ৭৫ ফিট চওড়া একটি গভীর খাল ছিল। কয়েকবার সেখানে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বাধীন ৩টি কোম্পানি লেঃ কাইউম, লেঃ রশিদ ও লেঃ কায়সারের অধীনে সেখানে অপারেশন চালায় কিন্তু বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বার বার ব্যর্থতার জন্য সবার মনোবল দুর্বল হয়ে যায়। তাই এই গুরুত্তপূর্ন অংশটি শত্রুমুক্ত করা জরুরী হয়ে পরে এবং আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। এই এলাকাটি শত্রু কবলিত থাকার জন্য নওয়াবগঞ্জে শত্রুদের প্রভাব বিস্তার করা সহজ ছিল। লেঃ কর্নেল জামানের কাছ থেকে সংক্ষেপে জানার পর আমি সরাসরি সেখানটা রিকু করেতে যাই। দেখতে পাই ঐ খালের সাথে কয়েকটি সংযুক্ত নালা রয়েছে – প্রতিটি প্রায় ১ মাইল দীর্ঘ – যেটা তাদের অন্যতম যোগাযোগ ব্যাবস্থা। স্থানীয় লোকের সহায়তায় তারা বাঁশ, কাঠ ও গাছের গুড়ি দিয়ে প্রচুর বাঙ্কার বানিয়ে রেখেছে।

সম্ভবত প্রত্যেকটিতে এলএম জি অথবা মেশিনগান ছিল। উঁচু দালান অথবা গাছের উপর তাদের অব্জার্ভেশন পোস্ট ও ছিল। সম্ভ্যাভ্য সকল পথে মর্টার ফিট করা ছিল।

সমস্ত এলাকা রেকু করতে প্রায় ২ দিন লেগে গেল। এই মিশনটি সফল করা আমার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ালো। প্রত্যেকটি প্লাটুন ও অস্ত্র আমি চিহ্নিত করি। তৈরি করা বিশাল মানচিত্রটি যে কাউকেই পুরো এলাকা সম্পর্কে একটি পূর্ণ চিত্র তুলে ধরতে সক্ষম ছিল। ৪টি কোম্পানি আমি নির্বাচন করি। আমাদের 3x৮১ মি মি মর্টার (মধ্যপাল্লা) ছিল। এছাড়া আমাদের ৭৫/২৪ ফিল্ড আর্টিলারি গান সাপোর্ট ছিল। আমি সকল অধিনায়কদের ডেকে ১৩ই নভেম্বর সকাল ৯টায় পুরো অপারেশন সম্পর্কে বিস্তারিত বুঝিয়ে বলি। নকশা সহ। সকল অধিনায়কদের প্রত্যেকটি সন্দেহ ও প্রশ্নের সমাধান করি।

সকল সৈন্যকে তৈরি করা লেআউট সহ সব কিছু বুঝিয়ে বলা হয়। এধরনের ছবির মানচিত্র দেখে সবাই খুব খুশি ও উৎসাহিত হয়। অনেকেই এর আগে এমন ম্যাপ দেখেনি বা শোনেনি। প্রত্যেকের চোখে মুখে আমি অত্যন্ত আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়তা দেখতে পাই। আমরা রাতে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেই সেটা অর্ধ-ট্রেনিং প্রাপ্ত সৈন্যদের জন্য কষ্টকর ব্যাপার ছিল। কিন্তু এর চেয়ে অন্য কোন উপায় আমার ছিলোনা যেহেতু শত্রুদের আমাদের চেয়ে অনেক ভালো অস্ত্র, গোলাবারুদ, বাঙ্কার এবং শক্তিশালী প্রতিরক্ষাবুহ্য ছিল। সিদ্ধান্ত হল ভোর ৪টায় আক্রমণ করা হবে। ১৪ই নভেম্বর ১৯৭১, লেঃ কর্নেল জামান ও আমার অপারেশনের আদেশের সময় সেখানে ছিলেন। তিনি ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন এইস গানার। তিনি স্বেচ্ছায় এমএফসি (মোবাইল ফায়ার কন্ট্রোলার) এর দায়িত্ব নিলেন। ওইদিন সন্ধ্যায় আমি এবং লেঃ কর্নেল জামান কিছুদূর হেঁটে গিয়ে টার্গেট রেজিস্ট্রেশনের স্থান নির্বাচন করতে যাই। সন্ধ্যার একটু আগে আমরা এটি করি। সেখানে একটি ২ তোলা দালান ছিল যেখান থেকে পুরো শত্রু এলাকা দেখা যেত। আমি লেঃ কর্নেল জামানের গানারির প্রশংসা না করে পারলাম না। ৪/৫টি আর্টিলারি শটে তিনি তিনি টার্গেটে আনতে পারতেন। এরপর আমরা ফিরে যাই। ৪ প্লাটুন এবং টাস্কফোর্স বাহিনীকে সাপোর্ট অস্ত্র – যেমন ৮১ মি মি মর্টার সব টার্গেটের ২৫০০ গজের মধ্যে ১টার মধ্যে জড়ো করতে বলি। আমাদের বাহিনী ঠিক ২ টার সময় খাল পাড় হওয়া শুরু করবে এবং এফইউপি তে পজিশন নেবে যেটা ছিল শত্রু এলাকার মধ্যবর্তী একটি অংশ। আমি এদের সাথে খালপাড় পর্যন্ত যাব এরপর আমার নির্ধারিত পয়েন্টে ফিরে আসব যেখান থেকে আমি অপারেশন পরিচালনা করব। শত্রুকে ভুল বোঝানোর জন্য একটি প্লাটুন দিয়ে সম্মুখভাগ থেকে আক্রমণ করা হবে যাতে তারা মনে করে আক্রমণ সম্মুখভাগেই। বাম দিক দিয়ে শত্রুপক্ষের খুব কাছে চলে গেল একটি প্লাটুন এবং অস্ত্র রেডি রাখল। ৭৫/২৪ আর্টিলারি শেল ধীরে ধীরে পজিশন নিল ৩টার মধ্যে। তারা হাল্কা কিছু শেল বাম দিক থেকে ব্যাবহার শুরু করল। এতে শত্রু পক্ষ ভাবল আক্রমণ বাম দিক থেকে এগিয়ে আসছে। যদিও আমাদের মূল আক্রমণ ডানে প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদের বাহিনী হিসেবমত ৪টার মধ্যে জায়গা মত পৌঁছে যাবে এবং আক্রমণ শুরু করবে। ২টি ক্রসিং পয়েন্ট নির্বাচন করা হল খাল পাড় হবার জন্য। প্রত্যেক পাশে ৪টি করে দেশী নৌকার ব্যাবস্থা করা হল ক্রসিং এর জন্য। প্রতি পাশ থেকে ২ প্লাটুন খাল পাড় হবে। এমন স্থানে পারাপারের ব্যাবস্থা করা হল যেখানে শত্রু পক্ষের কোন সৈন্য নেই – এমনকি তারা আশাও করেনি যে সেখান দিয়ে পার হতে পারি। বোমাবর্ষনের প্ল্যানটি খুব সুনিপুণ ভাবে করা হয়েছিল। এবং ওয়ারলেস সাইলেন্ট করা ছিল যতক্ষণ আমরা শত্রুদের নিকটবর্তী ফায়ারিং রেঞ্জের ভিতরে ঢুকি। ধরা ছিল যে এটা ৪টা ১৫ মিনিটের দিকে সম্পন্ন হবে। খাল পর্যন্ত এসে দুই প্লাটুন করে দুই গ্রুপে ভাগ করে আমি আমার পূর্বনির্ধারিত পয়েন্টে চলে যাই যেখান থেকে আমি পুরো যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো। লেঃ কর্নেল জামান খালের উল্টো পাশে পজিশন নিলেন যেখান থেকে তিনি আর্টিলারি গান দিয়ে টার্গেট রেজিস্ট্রেশন করেছিলেন। তিনি আর্টিলারি ফায়ার প্রস্তুত করলেন। আমাদের মিডিয়াম মর্টার (৮১ মি মি) খালের যতদূর সম্ভব কাছে আনা হল যাতে শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করতে সমস্যা না হয়।

দুর্ভাগ্যবশত ঐ রাতে খুব কুয়াশা ছিল। এমনকি ৫ গজ দূর থেকেও একজন অন্য জনকে দেখতে পারছিলনা। এতে আমাদের সৈন্যদের খুবই সমস্যা হল। আমরা ধারনা করেছিলাম সবকিছু ৪টা ১৫ মিনিটের মধ্যে প্রস্তুত হয়ে যাবে। কিন্তু হয়তো ৪টা ৩০ পেরিয়ে প্রায় ৫টা বেজে যাবে। এ এবং বি ফোর্সের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর পেছন থেকে শত্রুদের এনভেলপ করবেন এবং সি ও ডি এর দায়িত্বে ছিলেন লেঃ কাইয়ুম। কারো কোন সাড়া না পেয়ে ৪টা ৩০ মিনিটে আমি তাদের কোড নেইমে ডাকা শুরু করি। কিন্তু কোন সাড়া পেলাম না। ৫টা ১০ মিনিটে আমি লেঃ কাইয়ুম কে ওয়ারলেসে পাই। কথা বলে বুঝতে পারি ১ঘন্টা ১০ মিনিট পেরিয়ে গেলেও তারা এখনো এফইউপি তে পৌঁছাননি। দেরির কারণ হল ২টি নৌকা খারাপ হবার কারণে ডুবে যায় এবং সৈন্যরা অনেকেই এইব্যাপারে অনভিজ্ঞ ছিল। অন্য দলটিকে যোগাযোগ করলে তারা সন্তোষজনক কিছুই বললেন না। কিন্তু গ্রুপের সাথে কথা বলতে পেরে আমি স্বস্তি পেলাম। তারা একটু দ্রুত গিয়েছিল যেহেতু একটু জ্যোৎস্না ছিল যদিও তাদের দেখার সীমানা খুব কম ছিল কুয়াশার জন্য। প্রায় ৫টা ৩০ মিনিটে ডান পাশ থেকে ফায়ারিং শুরু হল। শত্রু পক্ষ হতচকিত হয়ে গেল কারণ তারা আশা করেছিল বাম পাশ থেকেই আক্রমণ হবে। ৫টা ৪৫ মিনিটে তারা শত্রুদের মুখোমুখি যুদ্ধ শুরু করল। শত্রুপক্ষ এতোটাই অবাক হয়েছিল যে তারা আক্রমণের বদলে দ্রুত ট্রেঞ্চ ও বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে নিরাপদে পালাতে শুরু করল। একের পর এক নানা পজিশন থেকে আক্রমণ চলল। ৭টার দিকে লেঃ কাইউম এর বাহিনী লক্ষ দখলে নেয়।

৬টার দিকে আমি ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরকে রেডিওতে পাই। খালের পানিতে তার রেডিও ভিজে গেছিল কারণ তার ওয়ারলেস অপারেটর খাল পাড়ের সময় ডুবে গেছিল। সে এটা পরিষ্কার করে ঠিক করেছে। তবুও আমি পরিষ্কারভাবে কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম না যেহেতু কণ্ঠ ভেঙ্গে ভেঙ্গে আসছিল। কিন্তু এটা যে তার কণ্ঠ তা বুঝতে পারছিলাম। সে ৬টা ৩০ মিনিটে শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করে। সেই দিকে ছিল শত্রুপক্ষের মূল ডিফেন্স। প্রায় ১ ঘণ্টা পর শত্রুপক্ষ প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ ফেলে রেখে অবস্থান ত্যাগ করে। ৮টার মধ্যে পুরো এলাকা পরিষ্কার হয়ে যায়। সৈন্যরা সম্মিলিত হয়। পাকসেনাদের ১ জন ক্যাপ্টেন সহ ১১ জন নিহত হয় এবং আহত ৫ জনকে আমরা বন্দি করি। আমাদের কেউ নিহত হয়নি – তবে ৭ জন আহত হয়েছিল। একটি বিষয়ই আমাকে হতবাক করেছে – সেটা হল খালজূড়ে এতগুলো ট্রেঞ্চ এবং বাঙ্কার থাকার পরেও – যেখান দিয়ে ৬ফুট উঁচু সংযোগ ট্রেঞ্চও ছিল যেখান দিয়ে আমাদের সৈন্যদের চোখ ফাকি দিয়ে সহজেই চলে যাওয়া যায় – তবুও তারা বিনা যুদ্ধেই হাল ছেড়ে দিল। আমার ধারণা হল সম্ভবত তাদের মনোবল খুব দুর্বল ছিল এবং যুদ্ধ করার কোন ইচ্ছা তাদের ছিলনা।

অন্যদিকে আমাদের সৈন্যদের মনোবল আকাশ চুম্বী হয়ে গেল এবং তারা বিজয়উল্লাস করছিল। যদিও এদের প্রত্যেকে মূল আক্রমণভাগে পৌঁছাতে অনেক কষ্ট হয়েছে – শুধু তাই নয় আক্রমণ শুরু করতেও আশাতীত দেরি হয়েছে-তবুও এদের কারো চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ দেখলাম না। জয়ের আনন্দে তারা এক বাঙ্কার থেকে অন্য বাঙ্কারে যাচ্ছিল আর শত্রুদের ফেলে যাওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করছিল।

সে যুদ্ধ থেকে একটি বিষয় আমার কাছে খুব পরিষ্কার হল যে যেকন সফলতার পেছনে স্রিস্টিকর্তার আশির্বাদ খুবই দরকার। যদি ৯টা পর্যন্ত কুয়াশা না থাকতো তাহলে আমাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্ভবনা ছিল – এমনকি অপারেশন ব্যার্থও হতে পারত। কুয়াশা আমাদের সৈন্যদের খাল পাড়ের সময় আবরণের কাজ করে এবং আক্রমণের সময়ও আমরা সুবিধা পাই। পরিশেষে একটি কথাই বলব – কষ্ট করলেই কেষ্ট মেলে।

 

নীলাঞ্জনা অদিতি

<১০, ১৩.৩, ৩৪৭-৩৫০>

                                                          

সাক্ষাৎকারঃ মেজর (অবঃ) রফিকুল ইসলাম

লেঃ কর্নেল কাজী নূরুজ্জামান ছিলেন সাত নম্বর সেক্টর কমান্ডার। এই সেক্টরটিকে কয়েকটি সাব সেক্টরে ভাগ করা হয়।

একঃ লালগোলা সাব সেক্টর-

ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী এই সাব সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন।

দুইঃ মেহেদীপুর সাব সেক্টর

বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ছিলেন সাব কমান্ডার।

তিনঃ হামজাপুর সাব সেক্টর

ক্যাপ্টেন ইদ্রিস সাব সেক্টর কমান্ডার ছিলেন।

চারঃ শেখপাড়া সাব সেক্টর

ক্যাপ্টেন রশিদ সাব সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন।

পাঁচঃ ভোলাহাট সাব সেক্টর

লেঃ রফিকুল ইসলাম এর সাব সেক্টর কমান্ডার ছিলেন।

ছয়ঃ মালন সাব সেক্টর

প্রথম দিকে ক্যাপ্টেন মহিউদিন জাহাঙ্গীর সাব সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। পরে একজন সুবেদার এই সাব সেক্টরের কমান্ডার করেছেন।

সাতঃ তপন সাব সেক্টর-

মেজর নজমুল হক প্রথমদিকে কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। পরে একজন সুবেদার সাব সেক্টর কমান্ডার ছিলেন।

আটঃ ঠকরাবাড়ি সাব সেক্টর

সুবেদার মোয়াজ্জেম সাব সেক্টর কমান্ডার ছিলেন।

নয়ঃ আঙ্গিনাবাদ সাব সেক্টর

গণবাহিনীর জনৈক সদস্য মিত্রবাহিনির তত্বাবধানে কমান্ড করেছেন।

সেক্টরের প্রতিটি সাব সেক্টর এলাকায় প্রচন্ড যুদ্ধ চলে। অতর্কিত আক্রমন এমবুশ ও সেতু ধ্বংস করে মুক্তিবাহিনী এক অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। মে মাসে খঞ্জনপুর পত্নীতলা ধামহাট গোদাগাড়ী চারঘাট সারদা পুলিশ একাদেমি পুটিয়া দুর্গা পুর ও কাঁটাখালি বিদ্যুত কেন্দ্রে বারবার আক্রমন করা হয়। পাকবাহিনীর মনোবল দারুনভাবে ভেঙ্গে পরে।

দিনাজপুরের ঠনঠনিয়াপাড়ায় একটি বড় রকমের যুদ্ধ হয় ১৮ ই জুন। মেজর নাজমুল হক নিজে এই যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। ঠনঠনিয়াপাড়া মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে এবং ১৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন ও ২ জন আহত হন।

জুলাই মাসের ৪ তারিখ মেজর নাজমুল হক কাঞ্চন সেতুর উপর পাক ঘাঁটি আক্রমন করেন। এই আক্রমন যদিও সফল হয়নি তবু পাকসেনাদের কলাবাড়ি ছেড়ে কানসাটে পলায়ন করে।

ক্যাপ্টেন ইদ্রিস ও সুবেদার মেজর মজিদ ২৩ শে আগস্ট কানসাট আক্রমন করেন। এই ভয়াবহ যুদ্ধ চার ঘন্টা স্থায়ী হয়। প্রচুর পাকসেনা হতাহত হয়। চাঁপাই নবাবগঞ্জ থেকে অনেক পাকসেনা সাহায্যে এগিয়ে আসে।

কানসাটে ২৬ শে আগস্ট শুরু হয় আবার যুদ্ধ। নদী পার হয়ে ক্যাপ্টেন ইদ্রিস ও সুবেদার মেজর মজিদের দল কানসাট আক্রমন করে। পাকসেনারা কানসাট ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। কিন্তু অল্প সময় পরেই পাকসেনারা পালটা আক্রমন করে। মুক্তিবাহিনী আক্রমনের মুখে পেছনে সরে আসে।

৩ রা আগস্ট তাহেরপুর পাকঘাঁটি আক্রমন করেন ক্যাপ্টেন রশিদ। সীমান্ত থেকে ২৫ মাইল ভেতরে পুঠিয়া থানার ঝলমলিয়া ব্রীজে হাবিলদার শফিকুর রহমানের দলের সাথে সংঘর্ষ বাধে। অক্ষত অবস্থায় মুক্তিবাহিনী ফিরে আসে।

৪ ঠা আগস্ট পাকিস্তানী দল নদীপথে তাহেরপুরের দিকে আসছিল। হাবিলদার শফিক পাকসেনাদের এমবুশ করেন। এতে ১৮ জন পাকসেনা নিহত হয়।

দূর্গাপুরে ২৬ শে আগস্ত হাবিলদার শফিক অতর্কিতভাবে  পাকসেনা কর্তৃক আক্রান্ত হন। মুক্তিযোদ্ধা ২” মর্টার ও হালকা মেশিনগানের গোলা নিক্ষেপ করে নিরাপদে ফিরে আসে।

সারদা পুলিশ একাদেমিতে অবস্থানরত পাকিস্তানি কোম্পানির উপরে অতর্কিত আক্রমন করা হয় ১৭ ই আগস্ট। এই দুঃসাহসিক অভিযানে ১ জন ছাড়া সকলেই শহিদ হন।

মীরগঞ্জে ২২ শে আগস্ট সুবেদার মবসসারুল ইসলাম চারঘাট থানার মিরগঞ্জ বি অ পি আক্রমন করেন। নিদ্রামগ্ন পাকসেনারা সকলেই নিহত হয়।

১৪ ই অক্টোবর মুক্তিবাহিনি শেখপাড়া সাব সেক্টর কমান্ডারের নির্দেশে দুর্গা পুর থানার গলহরি যান। পাকসেনারা জানতে পেরে আক্রমন করে। বাঁশের সেতুর উপর দিয়ে যখন পাকসেনা আসা শুরু করে তখন মুক্তিবাহিনি গুলিবর্ষণ শুরু করে। এখানে ৭৩ জন পাকসেনা ও ২ জন অফিসার নিহত হয়।

লালগোলা সাব সেকটরে মেজর গিয়াসের নেতৃত্বে অমিতবিক্রমে যুদ্ধ চলে। রাধাকান্তপুরের যুদ্ধ ও ইসলামপুরে অবস্থিত পাকঘাঁটি আক্রমন সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। পাকসেনারা নবাবগঞ্জে পশ্চাদপসরন করতে বাধ্য হয়।

হামজাউর সাব সেক্টরে ১৩/১৪ ই নভেম্বর ঘনেপুর বি ও পি আক্রমন করে ৩০ জন পাকসেনাকে হত্যা করে। ২৭ শে নভেম্বর মেজর গিয়াস পাঁচ কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে পোড়াগ্রাম আক্রমন করেন। এই ভয়াবহ যুদ্ধে ৩০ জন পাকসেনা ও ৫০ জন রাজাকার নিহত হয়।

ভোলাহাট সাব সেক্টর মকরমপুর আলীনগরস্থ পাকঘাঁটিতে লেঃ রফিকের নেতৃত্বে অতর্কিত আক্রমন করা হয় ৭ ই নভেম্বর। পাঁচজন পাকসেনা নিহত হয় এবং মহানন্দা নদী পার হয়ে পাকসেনারা পালিয়ে যায়। ভোলাহাট থেকে রহনপুর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ১০০ বর্গমাইল এলাকা ছিল সম্পূর্ণ মুক্ত। সাব সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছিল দলাদলিতে। মহানন্দা নদীর দু’পাশে আলীনগর থেকে শাহপুর গড় পর্যন্ত দীর্ঘ ৭ মাইল মুক্তিবাহিনীর ডিফেন্স ছিল। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের সার্বিক তত্বাবধানে আলমপুর আম্রকাননে অবস্থিত পাকঘাঁটি আক্রমন করা হয়েছিল ১৮ ই নভেম্বর। এই যুদ্ধে লেঃ রফিক ও লেঃ কাইয়ুম ২ কম্পানি সৈন্য নিয়ে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। প্রচন্ড যুদ্ধের পর আলমপুর দখল হয়েছিল কিন্তু আকস্মিকভাবে পিছন দিক থেকে শত্রুর গুলি আসতে থাকে। পেছনের বাঙ্কারে শত্রু জীবিত অবস্থায় লুকিয়ে ছিল অগ্রসরমান মুক্তিযোদ্ধারা কেউই তা খেয়াল করেনি। মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পরে এবং পাকসেনারা আলমপুর পুনর্দখল করে।

নভেম্বরের শেষের দিকে সংঘটিত হয় শাহপুর গরের যুদ্ধ। পাকসেনার একটি ব্যাটেলিয়ন শাহপুর গড় আক্রমন করে।সারাদিন যুদ্ধ চলে। রাত দেড়টার সময় মুক্তিবাহিনী আক্রমন করে। এই আক্রমনে রনাঙ্গনে উপস্থিত থেকে নেতৃত্ব দেন স্বয়ং সেক্টর কমান্ডার লে; কর্নেল নুরুজ্জামান।

বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর কলাবাড়ি, ছোবরা কানসাট ও বারঘরিয়ার যুদ্ধে বীর নায়ক হয়ে আছেন। একটি মানুষ যে কত সাহসি ও তেজস্বী হতে পারে জাহাঙ্গীর ছিলেন তার দৃষ্টান্ত। প্রতিটি যুদ্ধে সবার আগে তিনি নেতৃত্ব দিতেন।

এ ছাড়া ক্যাপ্তেন ইদ্রিসের বীরত্ব ও সাহসের বর্ণনা করা একটি অসম্ভব ব্যপার। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তিনি যে শৌর্যবীর্যের পরিচয় দিয়েছেন তা সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য গর্ব ও অহঙ্কারের ব্যপার। বিরলের যুদ্ধ এখন ঐ অঞ্চলের মানুষের মুখে শোনা যায়। এই যুদ্ধে ক্যাপ্টেন ইদ্রিস আহত হন। তিনদিন পর লেঃ সাইফুল্লাহ গুলিবিদ্ধ হন। লেঃ কায়সার ও আমিন এই যুদ্ধে বিশেষ বীরত্বের পরিচয় দেন।

                                                                                                               স্বাক্ষরঃ রফিকুল ইসলাম                                                                                                                   ২৪-৮-৮৩

 

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৪) ৭নং সেক্টরে সংঘটিত যুদ্ধের আরও বিবরণ   ১৯৭১

মুক্ত বিহঙ্গ

<১০, ১৪., ৩৫১৩৫৪>

একটি অপারেশনঃ ডাঃ মাহবুবু আলম, এমবিবিএস, বিপি

৩০/১০/১৯৭৯

১৪ই আগস্ট, ১৯৭১ সন। রাজশাহীর দক্ষিণাঞ্চল বন্যাকবলিত। পদ্মা নদীর দুই কূল ভেসে গেছে। যেদিকে চোখ যায় মনে হয় যেন একটি সাগর, তারই মাঝে চোখে পড়ে দু-একটি গ্রাম। বহু গৃহপালিত পশু ভেসে যাচ্ছে আর নদীর দু’পাশের লোকজন প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করে ঠাঁই পেতে চেষ্টা করছে তারই ঘরের চালে বসে অনাহারে-উপবাসে। সেই দিনটিতেই পাকবাহিনী ঢাকঢোল পিটিয়ে উদযাপন করতে চাইছে ১৪ই আগষ্ট, স্বাধীনতা দিবস। আর তার সাথে যোগ দিয়েছে তাদেরই পদলেহনকারী কিছু সংখ্যক আলবদর বাহিনীর লোক। চাঁপাইনওয়াবগঞ্জ শহরের লোকজনকে জড়ো করা হয়েছে পাকসেনাদের মহত্ত্বের প্রশংসা করতে, বিকেলে টাউন হলে সম্বর্ধনা সভা ডেকে। আর্মি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক প্রধান অতিথি। জাঁকজমক পরিবেশে সবকিছুর পূর্ব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এদিকে ফরিদপুরে বি-ও-পি তে সকাল ৭টায় সেদিন প্রায় এক কোম্পানী মুক্তিযোদ্ধা একত্রিত করেছেন মেজর গিয়াস (বর্তমানে বিগ্রেডিয়ার) পদ্মা ও মহানন্দা নদীর মাঝামাঝি এ বি-অ-পিসহ আরো চার বি-ও-পি জুড়ে প্রায় দুইশত বর্গমাইল এলাকা ২৬শে মার্চের পর থেকেই মুক্ত ছিল। পাকবাহিনী বহু চেষ্টার পরও এর কোনটি অধিকার করতে পারেনি স্বাধীনতার পূর্বমূহূর্ত পর্যন্ত। ৮৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে মনোনীত করা হল অপারেশনের জন্য। বি-ও-পি’র ভিতরে পাকা মেঝেতে সুন্দর একটা নকশা পূর্ব থেকে বানানো ছিল-যার আশেপাশে সকলকে বসানো হল। সেদিন প্রত্যেকটি মুক্তিযোদ্ধার চোখেমুখে ছিল জিঘাংসা আর দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের চিহ্ন।

নকশার উপর শত্রুর ঘাঁটি আর অবস্থান সম্বন্ধে একে একে বুঝিয়ে দিলেন মেজর গিয়াস। শত্রুর অবস্থান ছিল তখন নিম্নরূপঃ

ক) একটি ইনফ্যানট্রি ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার নওয়াবগঞ্জ ও তার সাথে একটি কোম্পানী, যারা নওয়াব গঞ্জ শহরের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে সি-এ-এফ’র সাথে নিয়োজিত ছিল।

খ) হরিপুর পুলের উপর দুই সেকশনের কিছু বেশী লোক পাহারা দিচ্ছিল। ২২০ ফুট লম্বা এ ব্রিজটি নওয়াবগঞ্জ থেকে দুই হাজার গজের কিছু বেশী দূরে রাজশাহী-নওয়াবগঞ্জ রাজপথের উপর অবস্থিত।

গ) আমনুরা রেলওয়ে স্টেশনে ছিল সেনাবাহিনীর একটা প্লাটুন, আরক এক প্লাটুন ছিল নওয়াবগঞ্জ স্টেশনে। এই প্লাটুনদ্বয়ের কাছে একটা ইঞ্জিন ও দুটি করে বগি থাকত এবং বিশেষ করে রাত্রে তারা আমনুরা ও নওয়াবগঞ্জের সাথে পেট্রোলিং করে বেড়াত।

এছাড়া এক প্লাটুন আর্মি ও সি-এ-এফ’এর গার্ডও ছিল, যারা নওয়াবগঞ্জের অদূরে নওয়াগঞ্জ-আমনুরা রেললাইনের উপর দুটি পুল বিদিলপুর নামক জায়গায় পাহারা দিচ্ছিল।

এই ৮৬জন মুক্তিযোদ্ধাকে বাছাই করলেন মেজর গিয়াস নিজে। তিনি তাদের তিনটি ভাগে ভাগ করলেন। ঘোষণা করলেন যে তিনি নিজে সেই অপারেশন পরিচালনা করবেন। কিংবদন্তী নায়ক মেজর গিয়াসের নাম রাজশাহীর লোকের মুখে মুখে। তিনি নিজে অপারেশন পরিচালনা করছেন শুনে সকলে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো।

ক) এক নম্বর গ্রুপে বিশজন লোক দেওয়া হলো-যার কমান্ডার সুবেদার ইসমাইলকে করা হয়। তার কাছে দেওয়া হল তিনটি মাঝারি মর্টার আর ৯০টি বোমা। কাজ দেওয়া হল নওয়াবগঞ্জ শহরে ১৪ই আগষ্ট রাত দশটা এগারটা পর্যন্ত গোলাবর্ষণ করা।

খ) দুই নম্বর গ্রুপে ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধাকে দেওয়া হল। কমান্ডার নিযুক্ত হলেন সুবেদার আমিরুজ্জামান। মেজর স্বয়ং এই গ্রুপের সাথে রাইলেন-তিন গ্রুপের পরিচালনা করবেন ওয়ারলেসের সাহায্যে। কাজ দেওয়া হল হরিপুর পুলের উপর হামলা করা এবং প্রহরারত হানাদার বাহিনীর লোকদেরকে হত্যা অথবা বন্দী করে পুলটিকে উড়িয়ে দেওয়া, যাতে করে নওয়াবগঞ্জ আর রাজশাহীর মধ্যেকার একমাত্র সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

গ) তৃতীয় গ্রুপের কমান্ডার ছিলেন নায়েক সুবেদার আমানউল্লাহ, যাকে দেওয়া হয়েছিল ৩১ জন মুক্তিযোদ্ধা। কাজ দেওয়া হয়েছিল বিদিলপুর রেলওয়ে উড়িয়ে দেওয়ার।

ছয়খানা নৌকা যোগাড় করা হয়েছিল আগে থেকে। আমাদের নৌকার কান্ডারী ৫৯ বছর বয়স্ক হুরমত আলী। সাধা ধবধবে লম্বা দাড়ি-চুলের অধিকারী এই বৃদ্ধের মাথায় ছিল গোল একখানি টুপি। কপালে দেখা যাচ্ছিল সুস্পষ্ট কাল দাগ, এবাদতের চিহ্ন। ছয়টি নৌকায় সকলে গিয়ে উঠলাম। মনে হচ্ছিল যেন আমরা সাগর পাড়ি দিচ্ছি অথৈ জলের মাঝে। হুরমত আলী রওনা হওয়ার আগে কি যেন বিড় বিড় করে পড়ল, তারপর মোনাজাত করল। সকাল ন’টার সময় আমরা গন্তব্যস্থানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। হুরমত আলীর নৌকা সকলের আগের ছিল, তাতে ছিলেন মেজর গিয়াস নিজে। সব মিলে ১৭ মাইল রাস্তা অতিক্রম করতে হবে। নৌকার পাল উঠাতেই নৌকার গতিবেগ চার থেকে পাঁচ মাইলে পৌঁছাল।

সন্ধ্যা হতে না হতেই টারগেটের দু’মাইলের মধ্যে পৌঁছান গেল। কিন্তু সবচেয়ে বন্ধুর আর ভয়াবহ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই দুই মাইল রাস্তা। যেতে হচ্ছে মহানন্দার ছোট্ট উপনদী-শাখানদী ধরে। আগে থেকে জানা ছিল মিরজাফরের বংশধরদের বেশকিছু লোক এ অঞ্চলে এসেছে, যারা আলবদর আর রাজাকারের মুখোশ পরে এতদঞ্চলে অবস্থান করছে। বহু কষ্টে আরও এক মাইল পথ অতিক্রম করতে আরও দেড় ঘন্টা সময় লেগে গেল। এক মাইল রাস্তা আরও যেতে হবে। তখন সাড়ে সাতটা। সাড়ে দশ ঘন্টা কেটে গেছে নৌকায়। হঠাত হুরমত আলী ইশারা দিল সকলকে থামতে। আমার কাছে এসে ফিস ফিস করে বলল যে, সে রাস্তাটা যেন হারিয়ে ফেলেছে। সব কটা নৌকায় হঠাত ফিসফিস শব্দ বেড়ে উঠল আর নীরব গুঞ্জন ভেসে এল। পাশের একটা গ্রামে কিছু হারিকেনের আলো চোখে পড়ল। মেজর গিয়াস হুরমত আলীকে নিয়ে সেই গ্রামে উঠলেন এবং সেখান থেকে একটা ছেলেকে নিয়ে পুনরায় গন্তব্য স্থানের দিকে দৃষ্টি রেখে রওনা হলেন। ভীত সন্ত্রস্ত গ্রাম থেকে উঠানো ছেলেটি নৌকায় উঠে সেদিন এতগুলি মুক্তিযোদ্ধাকে দেখে কেঁদে ফেলেছিল। ভেবেছিল বুঝিবা তার জীবনের অবসান ঘটাবার জন্য তাকে নেওয়া হচ্ছিল।

হরিপুরের পুল থেকে ছয়শত গজ পেছনে রাত ৯টায় রাজশাহী-নওয়াবগঞ্জ সড়কের উপর এক নম্বর ও দুই নম্বর গ্রুপকে অবতরণ করতে আদেশ দিলেন মেজর গিয়াস। তিন নম্বর গ্রুপকে পাঠান হল বিদিলপুর রেলওয়ে পুলের উদ্দেশ্যে দুটো নৌকা করে। বন্যায় ডুবন্ত রাস্তার উপর দিয়েই নৌকা দুইটি অতিক্রম করে গেল। এক নম্বর গ্রুপকে অবতরণ ক্ষেত্রে ডিফেন্স লাগাতে বলে দুই নম্বর গ্রুপ দুই ভাবে বিভক্ত হয়ে পুলের দিকে অগ্রসর হল সড়কের ডান ও বাঁইয়ের কিনারা ধরে। আকাশে চাঁদ ছিল না তবে তারকারাশির মিটিমিটি আলো বন্যার পানিতে পড়ে পরিবেশকে বেশ আলোকিত করে তুলেছিল। প্রায় একশত গজের মধ্যে পৌঁছাতেই আধো আলো আর ছায়ার মাঝে মনে হল কারা যেন তড়িৎ গতিতে পুলের পাশে পজিশন নিচ্ছে। আর একটু অগ্রসর হতেই শত্রুপক্ষের একজন চেঁচিয়ে উঠল ‘হল্ট’ ‘হ্যান্ডস আপ’। নায়েক মিহনাজউদ্দিন, সম্মুখবর্তী সেকশন এর কমান্ডার, তারই জবাবে আমগাছের আড়াল থেকে উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, “তেরে বাপ আয়া, শালা সারেন্ডার কর”। একথা শেষ হতে না হতেই শত্রুপক্ষ পুলের উপর থেকে একটা এল-এম-জি ও তিন-চারটা রাইফেল থেকে গুলি চালালো আমাদের প্লাটুনের উপর কালবিলম্ব না করে। আমাদের প্লাটুন ঝাঁপিয়ে পড়ল দুশমনদের উপর। পেছন থেকে আমাদের মেশিনগান সহায়তা করে চলল। পুল দখলে এসে গেল কয়েক মিনিটের মধ্যে, দুশমন অনুধাবন করার আগেই দু’জন শত্রুসেনা মারা গেল। দু’জন ঝাঁপ দিয়ে নদীতে পড়ে পালিয়ে গেল। একজন আহত হল এবং বাকী ১১জনকে বন্দী করা হল। আমাদের পক্ষের একজন নিহত ও একজন আহত হয়।

পুল কব্জা করার সাথে এক নম্বর প্লাটুনটি পুলের উপর দিয়ে নওয়াবগঞ্জের দিকে দ্রুত ধাবিত হল। নওয়াবগঞ্জ শহর থেকে মাত্র এক হাজার গজ দূরে রাস্তার পাশেই তারা মর্টারের জন্য স্থান বেছে নিল আর শহরের উপর শুরু হল গোলাবর্ষন। শত্রুপক্ষ কোনদিন এত নিকটে আমাদেরকে আশা করেনি। হানাদার বাহিনীর জন্য মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান নাকি সে সময় বেশ জমে উঠেছিল টাউন হলে আলবদর বাহিনীর বদৌলতে। প্রথম গোলা টাউন হলের নিকটে পড়ার সাথে সাথে প্রধান অতিথিসহ তাদের চেলা-চামুন্ডা হলঘর ছেড়ে দে ছুট- এই বুঝি শহর মুক্তিবাহিনীর কবলে গেল। যখন এদিক থেকে গোলাবর্ষণ চলছিল তখন সব কয়েকটি দুশমনের অবস্থান থেকে গোলাগুলি আসছিল। তৃতীয় গ্রুপটি তাদের অবস্থান পর্যন্ত পৌঁছুবার আগেই দুশমন তাদের মেশিনগান আর রাইফেল থেকে গুলি ছোড়া শুরু করল। তৃতীয় গ্রুপটি পুল দখল করতে পারেনি। এদিকে দু’নম্বর গ্রুপটি পুল উড়াবার কাজ করেই চলছে। ‘ডিপ মাইন’ ও প্রেশার চার্জ দিতে হবে। পুলের গোড়ার অংশ ৫ ফুট পরিমাণ খুঁড়তে হল ‘ডিপ মাইন’ চার্জ বসাবার জন্য। আমাদের প্রয়োজন ছিল সাড়ে চারশত পাউন্ড এক্সপ্লোসিভের। আমাদের কাছে ছিল যে সময় তিনশত জিলাটিন এক্সপ্লোসিভ যেগুলো সাধারনত খনিজ পদার্থের মাইন। ফিল্ডে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ছয়টি পুরাতন ধরনের ব্রিটিশ এ্যান্টি ট্যাংক মাইন সাথে আনতে বলেছিলেন মেজর সাহেব। সেগুলো জুড়ে দিয়ে পুলের এবেট্মেন্ট উড়াবার জন্য চার্জ তৈরী করতে বললেন মোট ২৪০ পাউন্ড এক্সপ্লোসিভ দিয়ে। উপরে অনুমান একশত দস পাউন্ড এক্সপ্লোসিভ দিয়ে প্রেশার চার্জ লাগান হল। মাটি ভরে দিয়ে ডিপ মাইন চার্জ আর পুলের উপর প্রেশার চার্জ লাগিয়ে রিং মেন সার্কিট বানান হল কর্ডেক্স-এর সাহায্যে। এদিকে মর্টার প্লাটুনের কয়েকজন ফেরত এসে পড়েছে। পুলের উপর উঠে পুলটা শেষ বারের মত দেখে নিলেন আমাদের অধিনায়ক মেজর গিয়াস। বন্যার পানি পুলের উপর ছুঁই ছুঁই করছে, আর স্রোতের গতিবেগ জোরে বয়ে যাচ্ছিল। নওয়াবগঞ্জের দিক থেকে কিছু মর্টার আর মেশিনগানের গুলি পুলের দিকে আসছিল। এক সময় আমরা সন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়েছিলাম যখন দু’তিনটি গাড়ির রাজশাহীর দিকে থেকে আসতে দেখতে পেলাম রাজপথ ধরে, কিন্তু কিছু দূর আসতে যেন গাড়ীর বাতিগুলি থেমে গেল। তারপর বুঝতে পেলাম যে রাস্তা এক মাইল পেছনে জলমগ্ন হয়ে আছে যার ফলে গাড়ী আর বেশিদুর এগুতে পারেনি। ওরা রাস্তার পেট্রোলিং-এ বেরিয়েছিল সম্ভবত।

রাত ঠিক বারটা বেজে পাঁচ মিনিট। সকলকে প্রায় ছয় শত গজ দূরে নৌকায় বসতে হল কানে হাত চেপে ফিউজে আগুন লাগাতে বললেন অধিনায়ক। পেছনে দৌড়িয়ে এসে ৫০০ গজ দূরে রাস্তার পাশে বসে পড়লাম, মেজর গিয়াস ও সুবেদার আমিরুজ্জামান। গগনবিদারী আওয়াজে যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। সে আওয়াজের সাথে সাথে বেশ কয়েকটি গ্রামের লোক ঘুম থেকে চিৎকার করে উঠল, ভাবল হয়ত কেয়ামত এল বুঝি। বেশ কয়েক সেকেন্ড লেগে গেল আকাশে উত্থিত ইট, কংকর পাথর নেমে আসতে। আনন্দের উচ্ছ্বাসে সকলে দৌড়িয়ে গেলে পুলের অবস্থা দেখতে। পুল আর দেখা যাচ্ছে না-দেখা যাচ্ছিল অপর অংশের অর্ধেকটা দূরে কাত হয়ে পড়া অবস্থায়। স্রোতের টানে ইত্যবসরে ছোট নদীটার এপারের অংশ পুলের ভিত্তিপ্রস্তর থেকে আরো ১০/১৫ ফুট বেড়ে গেছে । আমরা নৌকায় উঠে আরো একটু পেছনে চলে এলাম। কিছুক্ষনের মধ্যে রেলওয়ে পুল উড়াবার তৃতীয় গ্রুপও আমাদের সাথে যোগ দিল। তারা কৃতকার্য হতে পারেনি তাদের উদ্দেশ্যে। কিন্তু শত্রুর যে ক্ষতি করতে পেরেছে তা আরেক মজার কাহিনী।

শত্রুর যে দুটি প্লাটুন একটা আমনুরা ও অপরটি নওয়াবগঞ্জে ছিল, সে দুটি প্লান্টুনই গোলাগুলির আওয়াজ শুনে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে রেলের ইঞ্জিন আর বগি নিয়ে রওয়ানা দিল, তাদের পেট্রোল করার রাস্তায়। পুলের কাছে আমনুরা হতে আগত পেট্রোলটি পৌঁছাতেই কিছু গুলির আওয়াজ পেল। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় ইঞ্জিনও এসে পৌঁছাল। শত্রুপক্ষ মনে করেছিল হয়তোবা নওয়াবগঞ্জ মুক্তিবাহিনী দখল করে নিয়েছে আর তাদেরই লোকজন সম্ভবতঃ সম্মুখের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। নিজেদের মধ্যে গোলাগুলি বেশি কিছুক্ষন চললো। সুযোগ বুঝে সেই ফাঁকে কেটে পড়ল আমাদের তৃতীয় গ্রুপটি। নিজেদের গুলিতে সেইদিন দুশমনের ৬ জন নিহত হয় আর ৭ জন আহত হয় সেই স্থানেই।

সেই অপারেশনে আমরা আমাদের একজন প্রিয় সিপাইকে হারাই ও দু’জন মুক্তিযোদ্ধা গুরুতররূপে আহত হয়। যদিও অতি সাধারণ কিন্তু দুর্গম শত্রুর এলাকার ভিতর অপারেশন করা সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল না। এটাও সম্ভব হত না যদি না জাতি হিসাবে বেঁচে থাকার অদম্য স্পৃহা আর জাগ্রত মনুষ্যত্ববোধ, আত্মবিশ্বাস আর অপরাজয়কে জয় করে প্রমাণ করার অভিলাষ থাকতো।

**প্রকল্প সংগৃহীত দলিলপত্র থেকে সংগৃহীত

 

 

 

 

মুক্ত বিহঙ্গ

<১০, ১৪., ৩৫৪৩৫৫>

 

সাক্ষাৎকারঃ নায়েক মোঃ আমিনুল্লাহ

১২০৬১৯৭৩

৩০শে মে আমি ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে মহিসকুন্তি (কুষ্টিয়া জেলা) হামলা করিতে রওয়ানা হই। শত্রুর সংখ্যা খুব বেশী জানিতে পারিয়া মাঝ পথে আমার কিছু মুক্তিযোদ্ধা পিছনে পালাইয়া যায়। আমি মাত্র ১৪ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে পাক বাহিনীর এক কোম্পানী সৈন্যের উপর বেলা ৩টার সময় অতর্কিত আক্রমণ চালাই। ফলে পাক সৈন্য ৩২ জনের মৃত্যু হয় এবং ৩৫ জন আহত হয়, যাহা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হইতে প্রচার করা হইয়াছিল।

১৫ই জুন আমাকে বেতার যোগাযোগের জন্য আবার লালগোলা ডাকা হয়। আমি পুরা সাব-সেক্টর ৪নং এর বেতার পরিচালনা করি এবং কোয়ার্টার মাষ্টারের কাজও পরিচালনা করিয়া থাকি।

২০শে সেপ্টেম্বর মেজর সাহেব আমাকে নিয়া স্পেশাল অপারেশনের জন্য সাব-সেক্টর ৩ ও ৭ নং সেক্টর মেহেদীপুর যান এবং এখানে আমাদের নেতৃত্বে সোনা মসজিদ (রাজশাহী) এলাকায় দুটি বড় অপারেশন সমাধা হয়। এতে মিত্রবাহিনী আমাদিগকে আর্টিলার দ্বারা সাহায্য করে যার ফলে আমরা ধোবড়া পর্যন্ত দখল করি। এই সময় বহু পাকসৈন্য হতাহত হয় এবং বাদবাকী ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করে। এখানে উল্লেখ থাকে যে, ১৫ সেপ্টেম্বর আমার কাজে মুগ্ধ হইয়া মেজর সাহেব আমাকে হাবিলদার হইতে নায়েক সুবেদারে পদোন্নতি দেন।

১লা অক্টোবর আমাকে সম্মুখযুদ্ধের জন্য এক প্লাটুনের পরিচালনভার দেওয়া হয় এবং আমি হাকিমপুর ঘাট হইতে আস্তে আস্তে অগ্রসর হইতে থাকি। এতে বহু বড় বড় অপারেশন করিয়াছি এবং শত্রুকে পিছনে হটিতে বাধ্য করিয়াছি।

১০ই অক্টোবর আমাকে ৪নং সাব-সেক্টরে ‘বি’ কোম্পানী পরিচালনার ভার দেওয়া হয়।

১২ই নভেম্বর আমি ইসলামপুর পাক ঘাঁটিতে হামলা করি। এতে বহু রাজাকার ও পাক সৈন্য হতাহত হয় এবং দুর্ভাগ্যবশতঃ আমার সহকর্মী হাবিলদার জামান সাহেব শত্রুর গুলিতে বাগডাঙ্গায় আহত হন। আমি আমার বেতারে খবর পাইয়া দৌড়াইয়া গিয়া তিন মাইল দূর হইতে তাহাকে উদ্ধার করিয়া আনিতে সক্ষম হই। প্রকাশ থাকে যে, তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাকে বন্ধুর মত সাহায্য করিয়াছেন।

১২ই ডিসেম্বর যুদ্ধ পুরাদমে শুরু হয়ে যায়। আমি আমার ঘাঁটি (হাকিমপুর) হইতে নবাবগঞ্জের দিকে অগ্রসর হইতে থাকি। পথে পোড়াগ্রামে শত্রুর ঘাঁটির সম্মুখীন হই এবং তাদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ হয়। শত্রুরা বহু মৃতদেহ ও অস্ত্রশস্ত্র ফেলিয়া পলায়ন করিয়া বাহারমপুর গ্রামে ঘাঁটি স্থাপন করে।

১৩ই ডিসেম্বর আমি ও আমার দল শত্রুর এলাকায় গিয়া এম্বুশ পাতি। দুইখানা সৈন্যবাহী গাড়িসহ অগ্রসররত বহু শত্রুকে সমূলে ধ্বংশ করি। শহীদ সিপাহী নজিরউদ্দিনের কবর ঐ স্থানেই বিরাজমান।

১৪ই ডিসেম্বর আমরা নবাবগঞ্জ দখলের উদ্দেশ্যে নবাবগঞ্জ পাকঘাঁটির উপর হামালা চালাই। সারাদিন যুদ্ধ চলে এবং এতে বহু পাক সৈন্য হতাহত হয়। দুঃখের বিষয় আমাদের ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা এখানে শহীদ হন। আমরা নবাবগঞ্জ শহরে উঠিয়া পড়ি। বিকাল বেলা রাজশাহী হইতে ৫০/৬০ গাড়ী পাক সৈন্য নবাবগঞ্জ ঢুকিয়া পড়ে যাহার জন্য আমাকে একটু পিছু হটিয়া যাইতে হয়। রাত্রী ১২টার সময় তাহার তাহাদের ১৪০ জন মৃতদেহসহ পাকা রাস্তার ওভারপুল উড়াইয়া রাজশাহীর দিকে পলায়ন করে।

১৫ই ডিসেম্বর আমরা নবাবগঞ্জ দখল করিয়া দেখিতে পাই বহু পাঞ্জাবীর মৃত দেহ ই-পি-আর লাইনের বাগানে পড়িয়া আছে। এবং অনেকেই মরিচার ভিতর দাফন করিয়া রাখিয়াছে। তারপর আমরা রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হইতে থাকি কিন্তু অভয়া পুল ভাঙ্গা থাকায় পার হইতে দেরি হয়।

১৬ই ডিসেম্বর আমি গোদাগাড়ীতে ১৪০ জন রাজাকারকে অস্ত্রশস্ত্রসহ আত্মসমর্পন করাইতে সক্ষম হই এবং শত্রুর পিছন পিছন ধাওয়া করি।

ঐদিন সন্ধ্যা ৭টার সময় রাজশাহী দখল করি। কিন্তু দুঃখের বিষয় শত্রুদের আর পাওয়া যায়না। তারা নাটোর গিয়া আত্মসমর্পণ করিবে বলিয়া খবর পাঠায়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ঐদিনই আমাদের বিজয় দিবস- ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১।

**বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র থেকে সংকলিত।

 

মুক্ত বিহঙ্গ

<১০, ১৪., ৩৫৫৩৫৬>

সাক্ষাৎকারঃ হাবিলদার মোঃ ফসিউদ্দিন আহমদ

১৯৭৪

       ভারতের সহযোগিতায় আমাদের পুনর্গঠন শুরু হয়। গেরিলা যুদ্ধ বাংলাদেশের ভেতরে চলতে থাকে।

ক্যাপ্টেন গিয়াসের নেতৃত্বে পোলাডাঙ্গা এবং সাহেবনগর চরে মুক্তিযোদ্ধারা এপ্রিল মাসের শেষের দিকে ডিফেন্স নেয়। চর এলাকাকে নিজেদের আয়ত্তে রাখার জন্য মে মাসের প্রথম দিকে পাকিস্তানীরা আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। আমাদের কিছু সংখ্যক লোক হতাহত হয়। পাকিস্তানীদেরও ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় চর ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়।

মে মাসের শেষের দিকে ক্যাপ্টেন গিয়াসের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পদ্মা নদী পার হয়ে ফরিদপুরে ডিফেন্স তৈরি করে। ডিফেন্স মজবুত করা হয়। সেখান থেকে প্রায়ই গেরিলা অপারেশন চালানো হতো। জুলাই মাস পর্যন্ত আমরা পোড়াগাঁও, হাকিমপুর, বাঘের আলী এলাকা আমাদের দখলে আনি। পোড়াগাঁওতে আমাদের উপর পাকিস্তানীরা আক্রমণ চালায়। উভয়পক্ষে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর আমরা পোড়াগাঁও এলাকা ছাড়তে বাধ্য হই। ভারতের লালগোলা এবং বাংলাদেশের ভেতরে ফরিদপুর থেকে বিভিন্ন দলকে রাজশাহী শহর, নওয়াবগঞ্জ, পাবনা এবং বগুড়াতে গেরিলা অপারেশন চালানোর জন্য পাঠাতে হত।

অক্টোবর মাসে আমরা আবার পোড়াগাঁও পর্যন্ত দখল করে নেই। ডিসেম্বর মাস থেকে আমাদের সাথে সম্মুখযুদ্ধ শুরু হয়। ডিসেম্বরে আমরা নওয়াবগঞ্জ দখল করে নেই। নওয়াবগঞ্জের দিকে অগ্রসর হবার সময় আমাদের ও পাকিস্তানীদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর নওয়াবগঞ্জ দখলের সময় শহীদ হন। নওয়াবগঞ্জ দখলের পূর্বদিন আমাদের সাথে ভারতীয় এক রেজিমেন্ট বি-এস-এফ দেয়া হয়। দুই-তিন মিনিট যুদ্ধের পর তাদের বহু আহত হয় এবং মর্টার, মেশিনগান এবং গোলাবারুদ ফেলে তারা পলায়ন করে। নওয়াবগঞ্জ দখলের সময় কোন ভারতীয় সৈন্যের সাহায্যের প্রয়োজন পড়ে নাই।

১২ই ডিসেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা নওয়াবগঞ্জ থেকে রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হয়। পাকিস্তানী সৈন্যরা রাজশাহী ছেড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে নাটোরে আশ্রয় গ্রহণ করে।

স্বাক্ষরঃ মোঃ ফসিউদ্দিন

২-৫-১৯৭১

**বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র থেকে সংকলিত।

 

মুক্ত বিহঙ্গ

<১০, ১৪., ৩৫৬৩৫৭>

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি

সে পথ দিয়ে পাকসেনারা ফিরলো না আর

অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে ক্যাপ্টেন ইদ্রিস আকস্মিকভাবে একটি সিক্রেট ইনফরমেশন পেয়ে গেলেন। ধেয়ে চললেন তিনি তার মুক্তিবাহিনী নিয়ে। হাতে তাদের থ্রি-নট-থ্রি, গ্রেনেড আর দুটি এল-এম-জি। হানাদার পাক বাহিনী সেদিন দিনাজপুর শহর থেকে স্কুলপাড়া হয়ে বর্ডার সাইডে আসছিল যে রুটে সেই রুটে পৌঁছে গেল ক্যাপ্টেন ইদ্রিস, খানসেনারা পৌঁছানোর আগেই। বিকেল তিনটা। খানদের ট্রাকের আওয়াজ পাওয়া গেল। দিনাজপুরের স্কুলপাড়ার রাস্তার পাশে, ঝোঁপেঝাড়ে, গাছের ফাঁকে, আমগাছের ওপর, বাঁশঝাড়ের ফাঁকে প্রস্তুত লেঃ সাইদুল্লাহ, লেঃ আমিন, লেঃ কায়সার, সুবেদার এস এ রহমান, সুবেদার ইয়াসিন, হাবিলদার হাসান, হাবিলদার আজিজ, প্লাটুন কমান্ডার দেলওয়ার হসেন, এফ-এফ-বাবলু, আবদুল লতিফ, আব্দুর রাজ্জাক, নূর মোহাম্মদসহ দেড়শ মুক্তবাহিনীর বীর সেনানী। এগিয়ে আসছে হানাদার ট্রাক দুটো স্কুলবাড়ির সন্নিকটে। ক্যাপ্টেন ইদ্রিস পরপর দুটো শিস দিলেন। দম ধরে মুক্তিযোদ্ধারা গুনে যাচ্ছে প্রতিটা সেকেন্ড। মুক্তিবাহিনীর এ্যামবুশের ভেতরে ঢুকেছে হানাদারদের প্রথম ট্রাক। ট্রাকের ওপর ২০/৩০ জন জোয়ান, হাতে তাদের অটোমেটিক চায়নিজ অস্ত্র। ট্রাকের ওপর এল-এম-জি ধরে দাঁড়িয়ে আছে তাগড়া দুজন, সামনের ট্রাক এ্যামবুশ পার হয়ে যাচ্ছে প্রায়। ক্যাপ্টেন ইদ্রিস সংকেত দিচ্ছেন না। সবাই হতভম্ব হয়ে যাচ্ছে। কি হচ্ছে। কিন্তু ক্যাপ্টেনের লক্ষ্য তখন পেছনে। আরও ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঢুকছে আরেক ট্রাক পেছনে, সেটাকে এ্যামবুশের মধ্যে এন না ফেলে তিনি পারেন না। সামনের ট্রাকে ফায়ার ওপেন করার নির্দেশ দিলেন।

সৌভাগ্য খানদের। পেছনের ট্রাক প্রায় ১৫০ গজ ব্যবধানে এলো এবং এ্যামবুশের এলাকায় এক ইঞ্চি ঢোকা মাত্র ক্যাপ্টেনের শিস সাথে ফায়ার। বজ্র কড় কড় আওয়াজের মত ভেঙ্গে পড়লো মুক্তিবাহিনী হানাদারদের উপর। এমন হাতের মুঠোয় বহুদিন পায়নি খানদের। সম্পূর্ণ নিরাপদে দাঁড়িয়ে অকস্মাৎ বজ্রপাতের মত ঝাঁপিয়ে পড়লো মুক্তিবাহিনীর জোয়ানরা। পেছনের ট্রাক, সামনের ট্রাক- দুই ট্রাকের ওপরেই চলছে বৃষ্টির মত থ্রি-নট-থ্রি আর এল-এম-জি’র ফায়ার। সম্বিত ফিরে পাবার আগেই পেছনের ট্রাক শেষ, এ্যাম্বুশের যেখানে ঢুকেছিল, সেখানেই দাঁড়িয়ে। খুনী ৩২ জন হানাদারদের ছিন্নভিন্ন দেহ সেখানেই লুটিয়ে। কোনটা ট্রাকের ওপর। বাকিগুলি পাশে, রাস্তায়, নীচের খানায়। কিন্তু না, সামনের ট্রাককে ততখানি কাবু করা গেল না। মাত্র দুটো ডেডবডি পেছনে ফেলে ট্রাকটি গোঁ গোঁ করতে করতে ছুটে বেরিয়ে গেল কব্জা থেকে- যদিও ট্রাকটি পালাবার আগেই গাছের ওপর থেকে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা ফায়ার করে কয়েকজনকে আহত ও নিহত করে। পাওয়া যায় বহু গোলাবারুদ, এক ইঞ্চি মর্টার, কয়েকটি এল-এম-জি, দুই ইঞ্চি মর্টার এবং চায়নিজ অটোমেটিক রাইফেল কিছু। ৩রা অক্টোবর সেই সাফল্যের পর এ্যামবুশে হানাদারকে খতম করার পরিকল্পনা ক্যাপ্টের ইদ্রিস বাড়িয়ে দেন এবং বহু এভাবে খানসেনারা ঐ সেক্টরে হতাহত হতে থাকে এবং গেরিলা যুদ্ধের এই কৌশলের এবং সাফল্যের প্রোগ্রাম সকল সেক্টরে জানিয়ে দেয়া হয়। এর ফলে সব স্থানে অনুপ্রেরণার সৃষ্টি হতে থাকে। ৪ঠা অক্টোবর সেই আম-জাম-বাঁশঝাড়ে ঢাকা স্কুলপাড়া দেখতে যায় হামজাপুরের সকল মুক্তিযোদ্ধা। খানদের চরমভাবে পরাজিত ও খতম করে দেয়ার সেই পবিত্র ভূমিতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা স্কুলপাড়ার মাটি কপালে ছুঁইয়ে যাত্রা করে ফ্রন্টের দিকে। ১৪ই ডিসেম্বর যুদ্ধে লেঃ সাইদুল্লাহ’র একটা হাতের সমস্ত মাংস কাঁদের নীচ থেকে উড়ে যায় শত্রুর ব্রাশ ফায়ারে। কিন্তু হাড় ভাঙ্গেনি। দিনাজপুরের রণাঙ্গনে যে বীর বহুবার পাঞ্জা লড়েছে হানাদারদের সাথে বিজয়ের দু’দিন আগে তিনি আহত হন। দুর্ধর্ষ ক্যাপ্টেন ইদ্রিসও আহত হন অন্য যুদ্ধে এবং তার কোমরের নীচ দিয়ে ব্রাশ ফায়ার লেগে হিপের মাংস ধসে যায়।

**দৈনিক ‘সংবাদ’ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৮১ সংখ্যায় প্রকাশিত মুসা সাদিক রচিত প্রতিবেদন থেকে সংকলিত।

মুক্ত বিহঙ্গ

<১০, ১৪., ৩৫৭৩৬৪>

 

৭নং সেক্টর আওতাধীন বগুড়া জেলায় মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা

 

পশ্চিমবঙ্গ হইতে সামরিক ট্রেনিং লইয়া সাইফুল ইসলাম বগুড়া জেলার পূর্বাঞ্চলে ফিরিয়া আসে। সাইফুলের নেতৃত্বে পরিচালিত গেরিলা দল জুলাই মাসে ধুনট থানা আক্রমণ করে। থানাতে বেশ কিছু সংখ্যক পাঞ্জাবী পুলিশ ছিল। এই অতর্কিত হামলায় ৭ জন পাঞ্জাবী পুলিশ নিহত হয় এবং গেরিলা দল পূর্ব বগুড়ার কয়েকটি সামরিক কনভয় এবং হানাদার সৈন্য বোঝাই ট্রেনের উপর আক্রমণ চালায়।

জুলাই মাসে গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার হারুনুর রশিদের দল ভেলুরপাড়া রেল স্টেশনে সিচারপাড়ার উত্তর ধারে মাইন বিস্ফোরণ ঘটাইয়া একটি মিলিটারী স্পেশাল ট্রেন বিধ্বস্ত করার ফলে চারজন অফিসারসহ সাতাশজন পাকসৈন্য নিহত হয়।

৭ই আগষ্ট সকাল ৮টা ৩০ মিনিটের সময় ৭ নম্বর সেক্টরের গেরিলা প্রধান আহসান হাবিব (ওয়ালেস) – এর নেতৃত্বে তাহার দল সাবগ্রামে এএকটি মাইন বিশস্ফোরণ ঘটাইয়া একটি মিলিটারী লরী সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করে। ঘটনাস্থলেই তিনজন পাকসৈন্য নিহত ও একজন আহত হয়। পুনরায় ৯ই আগষ্ট তারিখে বেলা ১১টার সময় পাক সৈন্যরা বিধ্বস্ত লরীটি উদ্ধার করিতে যায়। ঐ দিনই মাইন বিস্ফোরণের ফলে ৫ জন পাকসৈন্য নিহত ও ৬ জন আহত হয়।

বগুড়া শহরেরে ওয়াপদা পাওয়ার হাউস সাব-সেকশন উড়াইয়া দেওয়ার অভিপ্রায়ে সাইফুল ইসলাম মাত্র দুইজন সঙ্গী লইয়া ১১ই আগষ্ট হাটসেরপুর হইতে বগুড়া শহরের দিকে রওনা দেয়। তাহারা ৯ ঘটিকায় মাদলার ঘাটে আসিয়া পৌঁছে। তখন কোন নৌকা না থাকায় কলাগাছের ভেলা তৈয়ারী করিয়া ৩ জন সূর্যসৈনিক করতোয়া নদী পার হয়। পরিকপ্লিত পথে মালগ্রামের ভিতর রাতের অন্ধকারে অগ্রসর হইতে থাকে। হানাদার বাহিনী প্রহরীররা তাহাদিকে চিনিয়া ফেলে। আত্মরক্ষার কোন পথ নাই জানিয়া সাইফুলেরা হানাদার বাহিনীর দিকে গ্রেনেড ছুড়িয়া মারে। হানাদারদের রাইফেল তখন গর্জিয়া ওঠে। তিনজনি অন্ধকারের মধ্যে তিনদিকে দৌড় দেয়। খান সেনাদের এলোপাতাড়ি গুলি আসিয়া সাইফুলের মাথায় লাগে। সাইফুল তৎক্ষণাৎ মাটিতে লুটাইয়া পড়ে। অর্ধমৃত অবস্থায় হানাদার বাহিনী সাইফুলকে ধরিয়া ফেলে।

আগষ্ট মাসের মধ্যভাবে একদিন রাত্রি তিন ঘটিকার সময় গেরলা বাহিনী কর্তৃক বগুড়া- সারিয়াকান্দি রাস্তায় লাঠিমাররঘোন গ্রামের নিকটবর্তী ব্রীজটি ডিনামাইট দ্বারা উড়াইয়া দেয় এবং ব্রীজের দুই ধারে ৫০/৬০ গজ দূরে মাইন মাটির নীচে পুঁতিয়া রাখিয়া তাহারা চলিয়া যায়। পরের দিন সকালে ব্রীজের দুই ধারে পশ্চিম দিকের মাইনটি পাকসেনারা সন্ধান পাইয়া তুলিয়া নিয়ে যায় কিন্তু পূর্ব দিকের মাইনটির সন্ধান পায় নাই। তার পরের দিন ভোরে কয়েকটি গরুর গাড়ি পাট লইয়া গাবতলী বন্দরে যাইতেছিল। একটি গরুর গাড়ীর চাপ মাইনের উপর পড়িলে মাইনটি বিস্ফোরণ ঘটে। ফলে গাড়ীটি ছিন্নভিন্ন হইয়া উড়িয়া যায়। একজন গাড়োয়ান সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যূবরণ করে। আর একজন গুরুতররূপে আহত হয়। এর পরের দিন সারিয়াকান্দি ক্যাম্প হইতে পাকসেনারা আসিয়া ব্রীজের অবস্থাদৃষ্টে লাঠিমাররঘোন গ্রামে প্রবেশ করিয়া গ্রামের লোকদিগকে অমানুষিকভাবে মারপিট করে এবং কয়েকটি বাড়িতে আগুন লাগাইয়া পুড়াইয়া ফেলে। তৎপর তাহারা কালুডাঙ্গা, শাহবাজপুর এবং সাতটিকরি গ্রামে প্রবেশ করিয়া কতকগুলি বাড়ি আগুন লাগাইয়া ভস্মীভূত করে। এই ব্রীজ ভাঙ্গাকে কেন্দ্র করিয়া বর্বর পাক বাহিনী লাঠিমারঘোন গ্রামে পরপর তিনবার প্রবেশ করিয়া বাড়িঘর লুটপাট করে।

১৬ই আগষ্ট সৈয়দ ফজলুর আহসান দিপুর দল সারিয়াকান্দি থানার নিকটবর্তী রামচন্দ্রপুর গ্রামে পাক বাহিনীর সহিত এক ভীষণ সংগ্রামে লিপ্ত হয়। প্রচুর গোলাগুলির পর ময়নুল হক নামে সারিয়াকান্দি থানার এক দারোগা, ৫ জন পাক সৈন্য ও কয়েকজন রাজাকার নিহত হয়।

আগষ্ট মাসের মধ্যভাগে কমান্ডার আবুল হোসেন (বালুরঘাট), মোস্তফা রেজানুর (দিনাজপুর), এস, এম, ফারুক (বগুড়া), প্রভৃতির দ্বারা হিলিতে ট্রেন অপারেশন হয়। ইহার ফলে বহুসংখ্যক এবং কিছু সংখ্যক অবাঙ্গালী নিহত হয়। লাইন অপারেশনের সময় আবুল হোসেন নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়।

আগষ্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহে মীর মঞ্জুরুল হক সুফীর নেতৃত্বে গেরিল দল বগুড়া-সারিয়াকান্দি রাস্তার একটি ব্রীজে এক্সপ্লোসিভ লাগাইয়া সম্পূর্ণ ধ্বংস করে এবং ব্রীজের এক মাইল দূরে রাস্তায় মাইন পুঁতিয়া রাখে। পরে মাইন বিস্ফোরণে একটি মিলিটারী জীপগাড়ী ধ্বংস হওয়ার ফলে একজন অফিসারসহ ৬ জন পাক সৈন্য নিহত হয়।

২০শে আগষ্ট মাসুদ হোসেন আলমগীর নবেলের দল সারিয়াকান্দি থানার আওলাকান্দী গ্রামের পূর্বে যমুনা নদীতে একটি মিলিটারী লঞ্চ রকেট দ্বারা বিধ্বস্ত করে।

২রা সেপ্টেম্বর বর্বর পাকবাহিনী গাবতলী থানার জাত হলিদা গ্রাম অতর্কিত আক্রমণ করে। তখন সৈয়দ আহসান হাবিব দিপুর দল পালটা গুলিবর্ষণ করার ফলে একজন পাকসৈন্য নিহত হয়। পাকসৈন্যরা নিরীহ ৫ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে। পরে সমস্ত গ্রামটাই আগুন জ্বালাইয়া পোড়াইয়া দেয়।

৪ঠা সেপ্টেম্বর ৬ জন পাক পুলিশ খাদ্য লইয়া বগুড়া হইতে সারিয়াকান্দি যাইতেছিল। পথে পাক পুলিশেরা যখন ফুলবাড়ি ঘাটে খেয়া নৌকায় উঠে তখন মোফাজ্জল হোসেন (লাঠিমারঘোন), গোলাম জাকেরিয়া রেজা (ধাওয়া) সাইদুল ইসলাম (বাইগুলি), মন্টু (হুমাকুয়া) এবং গেরিলাবাহিনীর সৈয়দ আহসান হাবিব দিপুর নেতৃত্বে নৌকা মাঝনদীতে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে তাহারা রাইফেল, মেশিনগান দ্বারা গুলিবর্ষণ করিতে থাকে। ফলে দুইজন পুলিশ নিহত হয়। আর ৪ জন জীবন্ত অবস্থায় দৌড়াইয়া পালাইয়া যাইবার কালে ধড়া পড়ে। জনগণ তাহাদিগকে লাঠিসোটার দ্বারা পিটাইয়া হত্যা করে। পাক পুলিশদের রাইফেল ও কিছু খাদ্য সামগ্রী মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।

গেরিলা বাহিনী কমান্ডার মীর মঞ্জুরুল হক সুফীর নেতৃত্ব সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ৭নং সেক্টর হেড কোয়ার্টার থেকে অস্ত্র গোলাবারুদ নৌকা পথে আনিবার কালে বাহদুরাবাদ ঘাটের নিকট সশস্ত্র সংঘর্ষে শত্রুদের একটি টহলদার গানবোট সম্পূর্ণ ধ্বংস করিয়া দেয়।

১৮ই সেপ্টেম্বর ই-পি-আর কমান্ডার সালেক (বগুড়া), বেঙ্গল রেজিমেন্টের মান্নান, ঢাকা পুলিশের হাবিলদার রজব আলী এবং ছাত্র রঞ্জি কুমার মহন্ত, প্রদীপ কুমার কর (গোবিন্দগঞ্জ) প্রভৃতির নেতৃত্বে হিলির পার্শ্ববর্তী স্থানে পাকহবাহিনির সহিত ভীষণ সংঘর্ষ বাধে। এই সংঘর্ষে পাকবাহিনীর বহু সৈন্য হতাহত হয়। ঘোড়াঘাটের ফিলিপস-এর (সাঁওতালী) নেতৃত্বে মাইন বিস্ফোরণে পাকসেনাদের একটি বেডফোর্ড মটর কার ভীষণভাবে ধ্বংস হয়।

গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার মীর মঞ্জুরুল হক সুফীর নেতৃত্বে ১৯শে সেপ্টেম্বর সারিয়াকান্দি থানার তাজুরপাড়া গ্রাম অনুপ্রবেশকারী একদল পাকবাহিনীকে ঘেরাও করা হয়। প্রচন্ড গোলাগুলির পর ঘটনাস্থলে শত্রুপক্ষের কতক সেনা নিহত ও বাকী সেনা পলায়ন করিতে বাধ্য হয়।

২৪শে সেপ্টেম্বর আহসান হাবিব ওয়ালেসের নেতৃত্বে বেলা দুপুর সাড়ে বারোটার সময় হ্যান্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করিলে সুখনাপুকুর রেলস্টেশন গৃহে আগুন ধরিয়া যায় এবং তাহাতে টেলিফোন লাইন নষ্ট হয়। একটি রাইফেল ও কিছু গুলি, সাত জোড়া পাকসেনার পোশাক উদ্ধার করা হয়। কিছু সৈন্য ও রাজাকার পালাইতে সক্ষম হয়।

২৭শে সেপ্টেম্বর কমান্ডার মোত্তালিব এবং কমান্ডার এস, এম ফারুকের নেতৃত্বে হিলিতে পাকবাহিনীর সহিত প্রচন্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আড়াই ঘন্টা যাবত যুদ্ধ চলিতে থাকে। কমান্ডার মোত্তালিব মর্টারের গুলিতে আহত হয় এবং ৪ জন পাকসৈন্য নিহত হয়। ঐ সময় বগুড়ার এক ১৪ বৎসরের অসমসাহসী ছেলে সাইদুর রহমান (চুটকু) হিলি স্টেশনে রেললাইনের মাইন বিস্ফোরণ ধ্বংস করিয়া দেয়। সেইদিন রেল চলাচল সম্পূর্নরূপে বন্ধ হইয়া যায়। এই ঘটনায় একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়। এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন আসাম রেজিমেন্ট ও বর্ডার সিকিউরীট ফোর্স।

সেপ্টেম্বর মাসের শেষভাগে মুক্তিবাহিনী নশরতপুর রেলস্টশনের পশ্চিম ধারে একটি এন্টি-ট্যাঙ্ক মাইন পুঁতিয়া রাখে। তাহার বিস্ফোরণে একটি মিলিটারী ট্রেন আক্রান্ত হয়। ফলে হানাদার পাকবাহিনী ক্ষিপ্ত হইয়া লাইনের ধারের লক্ষীপুর, পূর্ব ডালম্বা, কোটকুরী ও শিতলাই গ্রাম আক্রমণ চালায় এবং কফিরউদ্দিন মিস্ত্রী, আবেদ আকন্দ, আজিজ প্রাং (লক্ষীপুর), মহীরউদ্দিন প্রাং (পূর্ব ডালম্বা), ভোলা প্রাং, কোরবান আলী (কোচকুরী), শরিফউদ্দিন সরকার (শিতলাই) প্রভৃতি লোকদিগকে লাইন করিয়া গুলি করিয় হত্যা করে।

অক্টোবর মাসের প্রথম ভাগে গাবতলী থানার শিহিরপুর গ্রামে সরকার বাড়িতে মুক্তিবাহীনী ঘাঁটি ছিল। মুক্তিবাহিনী রাত্রি নয় ঘটিকায় সরকার বাড়ির পিছনে রেললাইনে একটি মাইন পুঁতিয়া রাখে। কারণ মুক্তিবাহিনী জানিতে পারে যে সৈয়দপুর হইতে বোনারপাড়া জংশন হইয়া একটি সৈন্যবাহী ট্রেন আসিতেছে। সেই ট্রেনটি ধ্বংসই তাহাদের লক্ষ্য ছিল কিন্তু ১৫ মিনিট পূর্বেই মাইনটির বিস্ফোরণ ঘটে। সেই সৈন্যবাহী ট্রেনটি ঐদিন আর আসে না।

পরের দিন রাত্রী ১১টার সময় সৈন্যবাহী ট্রেনটি সুখানপুকুর স্টেশন অতিক্রম করিবে জানিতে পারিয়া মুক্তিবাহিনী সরকার-বাড়ির অর্ধ মাইল দক্ষিণে মাইন পুঁতিয়া রাখে। মাইন বিস্ফোরণে সৈণ্যবাহী ট্রেনটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ফলে ৪ জন পাক ইঞ্জিনিয়ারসহ ১৪৬ জন পাকসেনা নিহত হয়।

অক্টোবর মাসের মধ্যভাগে ওয়াপদার নিকট কৈচোর রেললাইনের ব্রীজের দুই পাশে মাসুদ হোসেন আলমগীর (নোবেল) মাত্র ৬ জন সঙ্গী লইয়া পাকবাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। বহু গুলি বিনিময়ের পর ৬ জন খানসেনা ও ১০ জন রাজাকার নিহত হয় এবং কতকগুলি পাকসৈন্য অস্ত্রশস্ত্র ফেলিয়া কাহালুর দিকে পালাইতে বাধ্য হয়।

অক্টোবর মাসের মধ্যভাগে মুক্তিবাহিনীর দল গাবতলী থানা জয়ভোগা গ্রামের নিকটস্থ সারিয়াকান্দি রোডের উপর মাইন পুঁতিয়া রাখিয়া যায়। পরে তাহা বিস্ফোরণ ঘটিয়া ৫ জন পাকসৈন্যের মধ্যে ৩ জন নিহত ও ২ জন আহত হয়।

১৮ই অক্টোবর বগুড়া শহরের পশু ডাক্তার থানা নিকটস্থ ট্রান্সমিটারটি গ্রেনেড দ্বারা ধ্বংস করিবার জন্য গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। ট্রান্সপিটার ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পার্শবর্তী দোকানদার মুন্সি নজরুল ইসলামকে বর্বর হানাদারবাহিনী ধরিয়া ক্যাম্পে লইয়া যায়। ৪ দিন অমানুষিক নির্যাতন করার পর মুক্তি দেয়।

২০শে অক্টোবর নারচী ও পার্শ্ববর্তী গণকপাড়া গ্রামে পাকসৈন্যদের সহিত গেরিল বাহিনীর চারটি দলের এক ভীষণ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে সকাল ৭টা হইতে পরের দিন সকাল ৭টা পর্যন্ত চলে। এইসব দলের মধ্যে তোফাজ্জল হোসেন মকবুল (চরহরিণ), সৈয়দ ফজলুল আহসান দিপু, শোকরানা (রানা), আবদুস সালাম (বুলবুল), রেজাউল বাকী, গোলাম মোস্তফা (গাবতলী), কামাল পাশা (বৃন্দাবনপাড়া), রিজাউল হক মঞ্জু (ধাওয়া), স্বপন এবং হুয়াকুয়ার রেজাউল করিম মন্টু, আখতার হোসেন বুলু, আতোয়ার হোসেন গামা, আব্দুর রাজ্জাক হানজু, আবদুল বারী ও আরও অন্যান্য গেরিলাদের সহিত পাকবাহিনীর প্রচন্ড গোলাগুলি বিনিময় হয়। সেই সময় গ্রামের নারী পুরুষ নির্বিশেষে জীবনের ভয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে গ্রাম ছাড়িয়া পালাইতে থাকে, তখন এলোপাতাড়ি গুলি চলিতে থাকে। পাকসেনার দল দিপুর দলকে ঘিরিয়া ফেলে। উপায়ান্তর না দেখিয়া দিপুর দল গ্রেনেড নিক্ষেপ করিয়া ধুম্রজাল সৃষ্টি করতে বাধ্য হয়। তৎপর গণকপাড়া ঈদগাহ মাঠে গেরিলাবাহিনী পজিশন লইয়া তুমুল গোলাগুলি বর্ষন করতে থাকে। পাকসৈন্যরা আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র দ্বারা প্রবল আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে গেরিলা বাহিনী টিকতে না পারিয়া অবস্থান পরিবর্তন করিতে বাধ্য হয়। এমতাবস্থায় বহু বাড়ি জ্বালাইয়া-পোড়াইয়া দেয়। এদিকে শোকরানা রানার দল ও অন্যান্য দলের ৫০/৬০ জন্য গেরিলা যোদ্ধা টিউরপাড়া গ্রামের দিকে অগ্রসর হইয়া পজিশন নেয়। হানাদার বাহিনীর সহিত গেরিলাবাহিনীর পালটা গোলাগুলি চলিতে থাকে। ঐসময় হানাদারবাহিনীর টিউরপাড়া গ্রামের ১২ জন গ্রামবাসীকে গুলি করিয়া হত্যা করে। গেরিলাবাহিনীর গোলাগুলিতে পাকবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেনসহ ৯ জন নিহত হত। তৎপর সারা রাত্রি পাকবাহিনীর সহিত গেরিলাবাহিনী বাঁশগাড়ি ও নারচীতে প্রচন্ড গোলাগুলি চলার পর ভোরবেলা পাকবাহিনী ছত্রভঙ্গ হইয়া পলায়ন করে। এই ঘটনার দুই দিন পরে তিন দিক হইতে পাকসেনা নারচী গ্রামে প্রবেশ করিয়া গ্রামের বহু বাড়িঘর পুড়িয়া ভস্মীভূত করে।

১০ই নভেম্বর নারচীর আবদুল হাসিম বাবলুর দল বগুড়া সারিয়াকান্দি রোডের বাইগুনী গ্রামে মাইন বিস্ফোরণ ঘটাইয়া কর্নেলসহ ৫ জন পাকসৈন্য নিহত করে। ঐ দিন গেরিলাবাহিনীর কমান্ডার মীর মঞ্জুরুল হক সূফীর নেতৃত্বে বগুড়া শহরের নিশিন্দারায় ১১ হাজার কিলোওয়াট ভোল্টের ট্রান্সমিটার ধ্বংস করা হয়।

১২ই নভেম্বর ইন্ডিয়ান মারহাট্টা রেজিমেন্ট, আসাম রেজিমেন্ট ও মুক্তিযোদ্ধারা হিলি সীমান্তে পাকহাবিনীর সহিত মোকাবিলা করার জন্য উপস্থিত হয়। হিলিতে পাকবাহিনী তখন ঘোড়াঘাট হইতে ফ্রন্টিয়ার ফোর্স আনিয়া পালটা আক্রমণ করিবার প্রস্তুতি নেয়। তখন ৬নং আসাম রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন রায়সিং ডোগরা ও মুক্তিযোদ্ধা এস,এম, ফারুক (বগুড়া), আবুল কাশেম (জয়পুরহাট), মোজাহার (গাবতলী), মোস্তফা রেজানুর (দিনাজপুর) দলের নেতৃত্বে পাকবাহিনীর সহিত প্রবল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে বহু পাকসৈন্য ও কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়। পাকসৈন্যদের সঙ্গে মেশিনগান, ভারী কামান, ট্যাঙ্ক এবং বিমানবিধ্বংসী কামান ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে স্টেনগান, টমিগান, রাইফেল প্রভৃতির দ্বারা যুদ্ধ চলে। ঐদিন বিমান হইতে প্রচন্ড বোমাবর্ষন হয়।

১৩ই নভেম্বর মহিমাগঞ্জের দুলুর নেতৃত্বে ও সিহিপুরের বাবলু, খালেক, হামিদ, খলিল, নুরুল, শুকু ফিনু, জগলু, হাল্লু, লিন্টু ও আরও অনেকের সহযোগিতায় সুখানপুকুর রেল স্টেশনের ধারে শিহিপুরের নিকট একটি পাকসৈন্যবাহী স্পেশাল ট্রেন ডিনামাইট দ্বারা ধ্বংস করিয়া দেয়। ফলে প্রায় দেড়শত পাকসৈন্য মৃত্যুবরণ করে।

১৫ই নভেম্বর গেরিলা বাহিনী কমান্ডার মীর মঞ্জুরুল হক সুফির নেতৃত্বে সুখানপুকুর রেলস্টেশনে শত্রুদের খাদ্যবাহী একটি ট্রেন মাইন বিস্ফোরণ ঘটাইয়া ধ্বংস করে।

২৫শে নভেম্বর গাবতলীর নিকটস্থ জয়ভোগ গ্রামের রেলওয়ে ব্রীজ পাকবাহিনীর নিকট হইতে দখল করিবার জন্য একদল মুক্তিযোদ্ধা পাকসৈন্যদিগকে আক্রমন করিয়া গুলি বিনিময় করিতে থাকে। ফলে পাকসৈন্যরা গাবতলী থানাস্থ ক্যাম্পের দিকে পলায়ন করিতে বাধ্য হয়। দুই ঘন্টা পর পাকসৈন্য বোঝাই একটি ট্রেন গাবতলী স্টেশনে থামিলে পাকসৈন্যরা ট্রেন হইতে নামিয়া জয়ভোগা ও বইগুনী গ্রামের দিকে গুলিবর্ষণ করিতে করিতে অগ্রসর হয়। ফলে বাইগুনী গ্রামের আবুল হোসেনসহ কয়েকজন গ্রামবাসী গুলির আঘাতে নিহত হয়। পরে নেপালতলী গ্রামের দিক হইতে গেরিলাবাহিনীর একটি দল আসিয়া পালটা আক্রমন করিবার ফলে পাকসৈন্যরা গাবতলী ক্যাম্পে ফিরিয়া যাইতে বাধ্য হয়।

২৮শে নভেম্বর সারিয়াকান্দি থানা আক্রমণ করা হয়। এক আক্রমণের নেতৃত্ব দেয় নারচীর আবদুল হাসিম বাবলু, আবদুর রশিদ, চরহরিণার তোফাজ্জেল হোসেন মকবুল, হুয়াকুয়ার আবদুর রাজ্জাক, রামচন্দ্রপুরের মহসিন। মৌরের চরের সরুজ্জামান। ৭নং সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধা দল ও গেরিলাবাহিনী প্রবল গোলাবর্ষণ করে। পাকবাহিনী পালটা আক্রমণ চালাইবার ফলে দুইজন পাকসৈন্য নিহত হত। গেরিলাবাহিনী অদম্য সাহসে মাতৃভূমির পাবিত্র মাটি থেকে বর্বর পাকবাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করার দৃপ্ত পণ লইয়া যুদ্ধ করিতে থাকে। বেলা ১১টার সময় ব্রাশফায়ারে কয়েকজন পাকসৈন্য মাটিতে পড়িয়া যায়।

পরের দিন সকাল ৮টায় গেরিলা বাহিনী সারিয়াকান্দী থানা পুনঃ আক্রমণ করিয়া ৪৪ জন রাজাকারকে নিহত করে। থানার অফিসার ইনচার্জসহ ১৮ জন পাকসৈন্য নিহত হয়। এই প্রচন্ড গোলাগুলির ফলে গেরিলা বাহিনীর ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়। সমস্ত দিবারাত্রি প্রচন্ড গোলাগুলি চলিতে থাকে।

গেরিলা বাহিনীর খাদ্য ও পানীয় সরবরাহে কোন অসুবিধা হয় নাই। পার্শ্ববর্তী গ্রামের জনসাধারণ স্বতঃফূর্ত হইয়া খাদ্যদি সরবরাহ করিতে থাকে। পরিশেষে রাজাকার ও পুলিশেরা আত্মসমর্পন করে। কিছু সংখ্যক পুলিশ অন্ধকারে গ্রামের দিকে পালাইয়া প্রাণ রক্ষা করে। গেরিলা বাহিনীর যে ৩ জন শহীদ হয় তাহার হইতেছেন বালিয়ার তাইরের মমতাজ উদ্দীন, সাত বেকীর মোজাম্মেল হক ও আর একজন। এই প্রচন্ড যুদ্ধে সারিয়াকান্দি থানা দখল হয়। গেরিলা বাহিনী কর্তৃক ৫৩ জন রাজাকার ও ১৯ জন পুলিশ বন্দী হয়। ১৯ জন রাজাকারকে গুলি করিয়া হত্যা করে। গেরিলা বাহিনী ১১৮টি রাইফেল, ৪২টি এলএমজি, ১টি রিভলবার, ১টি গ্রেনেড ও বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ উদ্ধার করে। ঐদিন বিমান আক্রমণ হয়, তাহার ফলে কয়েকজন জনসাধারণ নিহত হয়। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দীনের দল এই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে।

নভেম্বর মাসের শেষভাগে পাকসৈন্যরা ভেরুরপাড়া রেলস্টেশনে যাইবার কালে পথিমধ্যে ট্রেন থামাইয়া জোড়গাছা গ্রামের কতকগুলি বাড়িতে আগুন জ্বালাইয়া দেয়। সংবাদ পাইয়া পার্শ্ববর্তী গ্রাম হইতে মুক্তিযোদ্ধা দল আসিয়া হানাদার বাহিনীকে ঘিরিয়া ফেলিয়া গোলাগুলিবর্ষন করিতে থাকে। পাক সৈন্যরা ভীতসন্ত্রস্ত হইয়া দৌড়াইয়া ভেলুরপাড়া স্টেশনে বাঙ্কারে আশ্রয় লয়। মুক্তিযোদ্ধাগণ সেখানেও তাহাদিগকে ঘিরিয়া ফেলিয়া গুলিবর্ষন করিতে থাকে। ফলে ৪ জন পাক সৈন্য নিহত হয়।

পরের দিন মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার হুয়াকুয়ার রেজাউল করিম মন্টুর নেতৃত্বে আব্দুস সালাম, আতোয়ার হোসেন প্রভৃতি এবং স্থানী গেরিলা বাহিনী ও জনসাধারণ রেল স্টেশনটি পোড়াইয়া দেয়। পরে চকচকে ব্রীজ সম্পূর্নরূপে ধ্বংস করিয়া ফেলে। তৎপর রেলওয়ে স্লিপার উঠাইয়া রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করিয়া দেয়।

ডিসেম্বর মাসের প্রথমভাগে রংপুর পলাশবাড়ী হইতে পলাতক একদল শত্রুসৈন্য গাবতলী থানার রামেশ্বরপুর গ্রামে প্রবেশ করিয়ে গ্রামবাসীর উপর অত্যাচার শুরু করে। পার্শ্ববর্তী গ্রাম জাগুলির প্রাক্তন সৈনিক গোলাম ছারওয়ার খানের নেতৃত্বে তাহার দল প্রতিরোধ আক্রমণ চালায়। ইহাতে প্রচুর গোলাগুলির বিনিময় হয় ফলে ২ জন শত্রুসৈন্য নিহত, ২ জন শত্রুসৈন্য আহত এবং ১২ জন্য পাকসৈন্য আত্মসমর্পণ করিতে বাধ্য হয়। এই ঘটনার পূর্ব দিন সকাল বেলা পীরগাছা মিলিটার ক্যাম্প হইতে একটি সৈনিক প্রাণের ভয়ে পালাইয়া আসিলে লস্করী পাড়ার নিকটস্থ জেলা বোর্ডের রাস্তার ব্রীজের নিকট শফিউল আলম স্টেনগানের গুলিতে তাহাকে নিহত করে। ঐদিন মহাস্থান হইতে ৫ জন হানাদার সৈন্য পালাইয়া আসিবার কালে গাবতলী থানার কদমতলী গ্রামে প্রবেশ করিবার সময় ৭ জন গ্রামবাসীকে গুলি করিয়া হত্যা করে। ঐ সময় চরহরিণার তোফাজ্জল হোসেন মকবুল ও তাহার দল ৫ জন পাক সৈন্যকে ধরিয়া ঘটনাস্থলেই গুলি করিয়া হত্যা করে।

৪ঠা ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার জাহেদুর রহমান (বাদল) ও আরও অনেকে রংপুর জেলার ভরতখালি বাঁধের পার্শ্বে পাকসৈন্যদের সহিত এক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ফলে রাজাকারসহ ৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে জাহেদুর রহমানসহ ৫ জন শহীদ হয়। এই ৫ জনের লাশ ভরখালী স্কুল প্রাঙ্গণে কবরস্থ করা হয়।

৬ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার আবুল হোসেন (কলসা) এর নেতৃত্বে তাহার দল পাকহানাদার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে। তুমুল লড়াইয়ে পর পাক সৈন্যরা নঁওগা অভিমুকে পশ্চাদপসরণ করে। কিছু সংখ্যক পাকসৈন্য হতাহত হয়।

১০ই ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী সম্মিলিত বিমান আক্রমণে সান্তাহার রেলওয়ে জংশন পাওয়ার হাউস মেকানিক্যাল ওয়ার্ক্স ও রেলওয়ে জংশন লোকোশেডের উপর বোমাবর্ষণ করে। ফলে কিছু পাকসৈন্য হতাহত হয়। মুক্তিবাহিনীর আনসার আলী নামে একজন বিমান কর্মচারী আহত হন।

১২ই ডিসেম্বর ভারতীয় মিত্রবাহিনী রংপুরের পলাশবাড়ী অতিক্রম করার পর পাকসৈন্য ভীতসন্ত্রস্ত হইয়া দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হইয়া পড়ে। তাহারা বগুড়া শহরের এতিমখানা হইতে অনবরত শেলবর্ষণ করিতে থাকে। তাহার ফলে পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহের বহু লোক হতাহত হয়। উপর হইতে ভারতীয় বিমান বাহিনী ঘন ঘন বোমাবর্ষন করিতে থাকে। তখন পাকসৈন্যরা বাঙ্কারে লুকাইয়া পড়ে। কিছু পাকসৈন্য পালাইয়া গ্রামের দিকে ধাবিত হয়। গ্রামবাসী তাহাদিগকে ধরিয়া যে যেখানে পারে হত্যা করে।

১৩ই ডিসেম্বর কিছু সংখ্যক সৈন্য জয়পুরহাট হইতে পালাইয়া আসিয়া সদর থানার সরলপুর গ্রামের পাঁচ পীরের দরগায় আশ্রয় নেয়। মুক্তিফৌজের কমান্ডার আবদুস সোবহান খান বাবুল ও তাহার দল জানিতে পারিয়া তাহাদিগকে ঘেরাও করিয়া ফেলে। মুক্তিফৌজের সহিত প্রচন্ড গোলাগুলিতে দুইজন মুক্তিসেনা ঘটনাস্থলে শহীদ হন। তন্মধ্যে ছিলেন মুক্তিফৌজের কমান্ডার আবদুস সোবহান খান বাবুল।পার্শ্ববর্তী গ্রামের লোকজন দা, কুড়াল খন্তা প্রভৃতি অস্ত্র লইয়া আসিয়া পাক বাহিনী সমস্ত সৈন্যকে হত্যা করে।

ঐদিন গাবতলী থানার কদমতলী গ্রামে পীরগাছা মিলিটারী ক্যাম্প হইতে কয়েকজন পাকসৈন্য পালাইয়া আসিবার সময় কদমতলী গ্রামের রহিমউদ্দিন প্রামানিক নামে একজন লোক ভিটার মধ্যে মিলিটারীর ভয়ে হামাগুড়ি দিয়া লুকাইয়া থাকে। তখন একজন মিলিটারী তাহার পিঠে গুলি করে। তাহার পাশেই গোবর্ধন রবিদাস নামে একজন মুচিকে গুলি করিয়া হত্যা করে। নিকটস্থ গেরিলা বাহিনী আসিয়া তাহাদিগকে ঘিরিয়া ফেলে।

প্রচন্ড গোলাগুলি হওয়ার পর পাকসৈন্যদের একজন নিহত হয়। বাকী পাক সৈন্যরা একটি গর্তের মধ্যে লুকাইয়া পড়ে। পরে তাহারা সন্ধ্যার পর পালাইয়া যায়। ঘটনাস্থলে সারিয়াকান্দি থানার বোহালী গ্রামের রফিক নামের একজন মুক্তিসেনা শহীদ হন। এই প্রচন্ড লড়াইয়ে হাট ফুলবাড়ি, জাতহলিদা, বাইগুলি ও নারচী গ্রামের গেরিলা বাহিনী অংশ নেয়। পাক সেনারা মৃত দেহটি পরে নারচীরে গেরিলা দল মহিষের গাড়ী করিয়া লইয়া যাইয়া নারচীর সমুখস্থ বাঙ্গালী নদীতে ফেলিয়া দেয়। দীঘলকান্দির চান্দ কশাই ও চরকাধিকার একজন গ্রামবাসী পাক বাহিনীর গুলিতে মৃত্যূবরণ করে।

১৩ই ডিসেম্বর বর্বর পাক বাহিনীর সবিত মিত্রবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর সহিত হিলি সীমান্তে এক তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মিত্রবাহিনীর সঙ্গে ছিল মেশিনগান, ভারী কামান, ট্যাঙ্ক এবং বিমানবিধ্বংসী কামান ও বোমা। আমাদের বাংলাদেশের কতকগুলি দামাল ছেলের সঙ্গে ছিল, সামান্য স্টেনগান, এসএলআর রাইফেল, এলএমজি আর পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে ছিল কতকগুলি মানব হত্যার মারণাস্ত্র।

এই যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হইয়াছিল আলম বাহিনী, সেলিম বাহিনী এবং এবাদ বাহিনী। প্রথম মিত্রবাহিনী পাকসৈন্যদের উপর বিমান থেকে গুলি বর্ষন করিতে থাকে। তারপর শুরু হয় এক ঐতিহাসিক তুমুল যুদ্ধ। পৃথিবী থাকিবে, বাংলাদেশ থাকিবে, তাহার সহিত এই হিলির যুদ্ধ চিরদিন বাংলার ইতিহাসের পাতায় লিখা থাকিবে। এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর সাতশত সৈন্য নিহত এবং কতকগুলি অস্ত্রশস্ত্র, ট্যাঙ্ক, মেশিনগানসহ আড়াইশত পাক সৈন্য আত্মসমর্পণ করে। মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর অল্পসংখ্যক যোদ্ধা হতাহত হয়। হিলি দখল করার পর বিবরঘাঁটি থেকে তিনশত নির্যাতিত নারীকে উদ্ধার করা হয়।

ঐদিন বগুড়ার পুলিশ লাইন হইতে অহরহ শেলবর্ষণ হইতে থাকে। শহরের এবং কলোনীর বিহারীরা ভীত সন্ত্রস্ত হইয়া যেখানে পারে নিরাপদ আশ্রয় গ্রহন করে। পাকসৈন্যরা পরাজিত মনে করিয়া তাহার করতোয়া রেলওয়ে ব্রীজ ও ফতেআলী ব্রীজ ধ্বংস করিবার উদ্দেশ্যে ডিনামাইট পুঁতিয়া রাখে। ঐদিন মিত্র বাহিনীর একশত সাতাশটি ভারতীয় ট্যাঙ্ক ত্রিমুখী সাঁড়াশী আক্রমণ করিবার জন্য গাবতলী হইয়া মাদলার পথে এবং মহাস্তান ও দুপচাচিয়া হইয়া বগুড়া শহরের উপকন্ঠে আসিয়া পৌঁছে। তুমুল ট্যাঙ্ক যুদ্ধ ও বোমা বিস্ফোরণে সমস্ত শহর প্রকম্পিত হয় এবং আগুনের লেলিহান শিখা দৃষ্ট হইতে থাকে। দুই একটি বোমার আঘাতে পার্শ্ববর্তী গ্রামের কিছু সংখ্যক লোক হত ও বাড়ীঘর বিধ্বস্ত হয়।

১৪ই ডিসেম্বর বগুড়া শহর হইতে পলাতক দুইজন পাকসৈন্য সদর থানার সাবরুল ইস্কুলের মাঠ দিয়া পালাইয়া যাইতেছিল। ঐ সময় গেরিলা বাহিনীর আনোয়ার হোসেন, রফিক ও আরও অনেকে এবং গ্রামবাসী লাঠিসোটা এবং বর্শা প্রভৃতি লইয়া তাহাদিগকে আক্রমণ করে। তাহাদিগকে ধরিয়া মারপিট করিয়া হত্যা করে।

১৫ই ডিসেম্বর পলাতাক পাকবাহিনী ও কিছু অবাঙ্গালী বগুড়া শহর হইতে পালাইয়া যাইবার সময় গোলাগুলি করিতে থাকে। তাহারা সহ হইতে একটি লরী লইয়া যাইতেছিল লরীটি বিকল হইয়া গেলে তাহার মার্চ করিতে পদব্রজে অগ্রসর হইতে থাকে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন গ্রাম হইতে মুক্তিবাহিনীর দল আসিয়া পালটা গুলিবর্ষন করিতে থাকে। ফলে মুক্তিবাহিনীর একজন শহীদ ও দুইজন আহত হয়। জানা যায়। ঘটনার কয়েকদিন পূর্বে পাকসৈন্যরা ডেমাজানী আসিয়া আকস্মিক গুলিবর্ষন করিতে থাকে। ফলে কমলরাজভর নামে একজন নিহত হয়। পরে পাকসেনারা ফিরিয়া যাইবার পথে আড়িয়ার বাজারে ডঃ ফনিন্দ্রনাথ দেব, সুরেশচন্দ্র পাল, শিরিষচন্দ্র পাল, খোকা বৈরাগী, তপেন্দ্রনাত পাল ও আরও কয়েকজনকে গুলি করে।

ঐদিন বৈকালে আনুমানিক ৪ ঘটিকার সময় ডিনামাইট বিস্ফোরণে করতোয়া রেলওয়ে ব্রীজ ও ফতেআলী ব্রীজ ধ্বংস হইয়া যায়। ঐদিন মিত্রবাহিনীর সহিত পাকসৈন্যদের তুমুল যুদ্ধ চলিতে থাকে। ফলে বহুসংখ্যক পাকসেনা হতাহত হয়। ঐ সময় ভারতীয় বিমান হইতে কয়েকটি ভারী বোমাবর্ষন হলে এতিমখানার নিকটস্থ স্থানের ঘরবাড়ি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং দুটি বৃহদাকার গর্তের সৃষ্টি হয়। পরের দিন ১৬ই ডিসেম্বর আনুমানিক তিন হাজার পাকসেনা সহ উচ্চপদস্থ অফিসারেরা মিত্রবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করিতে বাধ্য হয়।

**এ, জে, এম, শামসুদ্দিন তরফদার-রচিত ‘দুই শতাব্দির বুকে’ বগুড়া, ১৯৭৬ থেকে সংকলিত।

 

অপরাজিতা নীল

<১০, ১৪., ৩৬৪৩৬৬>

অনুবাদ

 

অপারেশন অভয়া ব্রিজঃ জনাব বদিউজ্জামান

১৪-১৫ আগস্ট রাতে রাজশাহী-নবাবগঞ্জ রোডের সফল অপারেশনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বেশ বৃদ্ধি পেয়েছিলো এবং মেজর গিয়াসের তত্ত্বাবধায়নে কাছাকাছি এলাকায় আরেকটি অপারেশন করার জন্য তারা বেশ উত্তেজিত ছিল। ১৪-১৫ আগস্ট রাতে ‘হরিপুর ব্রিজ’ নামক একটি অতি গুরুত্বপূর্ন একটি ব্রিজ আমরা দখল করি এবং ১২ জন পাকিস্তানি আর্মি ও রাজাকার আটক করি। এর ফলে রাজশাহী এবং নবাবগঞ্জের মধ্যকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে। একই সময় আমাদের আরেকদল নবাবগঞ্জ শহরে ৩ ইঞ্চি মর্টার দিয়ে প্রায় ঘন্টা ধরে গোলাবর্ষণ করে; তাতে পাকিস্তানি আর্মিদের স্থানীয়ভাবে আয়োজিত স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে বাঁধা পরে।

উপরোক্ত অপারেশনের পর মেজর গিয়াস একদিন বিশ্রাম নিয়ে পরবর্তী অপারেশনের প্রিপারেশন নেন। স্টাফ অফিসার হওয়ায় তার সাথে খুব কাছে থেকে কাজ করার সুযোগ হয়েছে আমার। শত্রুর ঘাঁটি থেকে তথ্য বেড় করে আনার জন্য তিনি আমায় ইনফরমার গ্রুপ থেকে ৬ জন কে প্রস্তুত করতে বললেন। আমাদের কিছু মুক্তিযোদ্ধা এই ব্যাপারে আগেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিল। তিনি সবাইকে আলাদা আলাদা করে ব্রিফ করলেন এবং তারা সেই মোতাবেক যথেস্ট তথ্য নিয়ে ২০ তারিখে ফিরে এলো। ঐদিনই আমি জানতে পারলাম যে মেজর গিয়াস ‘অভয়া ব্রিজ’ নামক সোনামসজিদ-নবাবগঞ্জ-রাজশাহী মুখী খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্রিজে অপারেশনের প্লান করছেন। কারন হিসাবে তিনি বললেন, ‘হারিপুর ব্রিজ’ ধ্বংসের পর শত্রুবাহিনী এখনো সেটি মেরামত করে সারতে পারেনি; এখন যদি অভয়া ব্রিজ ধ্বংস করে দেওয়া যায় তাহলে নবাবগঞ্জ শহরে অবস্থিত প্রায় ২ ব্যাটেলিয়ান আর্মি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। তাতে, রাজশাহী শহর থেকে প্রায় ৫০ মাইল এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে আসবে। ইতোমধ্যে, মহানন্দা আর পাডিল্লা নদীর চারপাশের প্রায় ২০০ স্কয়ার মাইল এলাকা মেজর গিয়াসের তত্ত্বাবধায়নে মক্তিযোদ্ধাদের দখলে ছিল।

নিয়মিত বাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে মেজর গিয়াস ৪৫ জনকে বাছাই করলেন এবং তার নিজেস্ব  টেকনিক অনুযায়ী আগস্টের ২২ তারিখে পুরো এলাকার একটি স্কেচ করে একটি কাপড়ের তৈরী বিশাল মডেলের সামনে সবাইকে নিয়ে বসলেন। আমি, ডঃ আলম, এবং রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ফাইনাল ইয়ারের একজন ছত্র ছিলো ভাগ্যবানদের মধ্যে কয়েকজন যাদের কাছে মেজর গিয়াস এই অপারেশন সম্পর্কে সম্পূর্ন ব্রিফ করেছিলেন। ঐ সময় রাজশাহী-নবাবগঞ্জ এলাকা বন্যা কবলিত ছিল। উল্লেখিত ব্রিজটি রাজশাহী শহর থেকে ১৯ মাইল দূরে অবস্থিত ছিল। সকাল ১১টার দিকে তিনটা গ্রুপে ভাগ হয়ে ৩ টি বড় নৌকায় করে রওনা দিলাম। ভারী অস্ত্র বলতে আমাদের কাছে একটি ২ ইঞ্চি ভিকার মেশিন গান, ২টি ২ ইঞ্চি মর্টার, ৮টি এলএমজি, ৮টি স্টেনগান, প্রত্যেকের সাথে একটি করে গ্রেনেড ছাড়াও আরো ৪৫০ কেজি বিস্ফোরক ছিলো। যেহেতু আমাদের বিষ্ফোরকের অভাব ছিলো, আমাদের লিডার ২৫০ কেজি জেলেটিন এক্সপ্লোসিভ, এবং প্রতিটিতে ১০ পাউন্ড করে এক্সপ্লোসিভ সমৃদ্ধ ২০ টি এন্টি ট্যাঙ্ক মাইন সাথে নিলেন। ঠিক একই কম্বিনেশনের বিষ্ফোরক হরিপুর ব্রিজ ধ্বংসের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল।

আরভি এর যেখান থেকে আমরা রওনা হই সেটা ছিল এক্স বি ডি আর এর ফরিদপুর বি ও পি। এখানে বাংলাদেশ নিয়মিত বাহিনীর রেগুলার ফোর্স ছিল। পুরো সময় এটা মেজর গিয়াসের নেতৃত্বে ছিল। পদ্মা ও মহানন্দা নদীর পাশ দিয়ে এরকম আরম ৬ টি বি ও পি ছিল আমাদের নেতৃত্বে। পাল তোলা নৌকায় আমাদের ১২ ঘণ্টায় পৌঁছে যাবার কথা ছিল। আমাদের সাথে হ্যাভারস্যাক লঞ্চ ছিল। ১২ ঘন্টার মধ্যে আমাদের গন্তব্যে পৌছে যাওয়ার কথা থাকলেও আমরা গন্তব্যের কাছা কাছই এসে পথ হারিয়ে ফেলি। কারণ চারপাশের স্বমত এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছিল এবং অন্ধকার হয়ে এসেছিল। পরবর্তীতে একজন স্থানীয় লোকের সহযোগিতায় নির্ধারিত সময়ের ২ ঘন্টা পরে ১২টা ১০ মিনিটে গন্তব্যে পৌছাই।  এবং ১০০০ গজ দূরে নৌকা থেকে নেমে যাই। সেখান থেকে ২০০ গজ আগানোর পর দেখতে পেলাম যে রাস্তা অভয় ব্রিজের দিকে যায়, সেটা বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। হাটু পানিতে আমরা খুব ধীরে ধীরে আগাতে লাগলাম। ১০০ গজ আগানোর পর চাঁদের উজ্জ্বল আলোতে আমরা ব্রিজ দেখতে পেলাম। তখন রাত ১টা। ইতিমধ্যে নৌকা থেকে নামার ৫০ মিনিট পার হয়ে গেছে। আমরা এগোতে থাকি এবং আমাদের ছেলেরা মানসিকভাবে প্রচন্ড উদ্দীপ্ত ছিলো। যখন আমরা ব্রিজ থেকে মাত্র ৪০/৫০ গজ  দূরে তখন ৫/৬ টা এলএমজি থেকে আমাদের দিকে ওপেন ফায়ার শুরু হোলো। এক পশলা গুলি আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেলো। এরকম কোন কিছু আমরা আশা করছিলাম না। হঠাত শুনলাম, মেজর গিয়াস চিৎকার করে বলছেন, “আলাদা আলাদা হয়ে যাও এবং পজিশন নাও।” আমাদের বেশীরবভাগ লোক মেইন রাস্তা থেকে সরে যেতে চাইছিল, কিন্তু হাটু পানিতে তারা বেশিদূর আগাতে পারছিলো না। বেশিরভাগই গলা পানিতে ডুবন্ত ঘরগুলোর পাশে আড়াল নীল।  প্রথম ৪/৫ মিনিট যখন মেশিঙ্গানের গুলি বর্ষিত হচ্ছিল, আমরা একেবারেই হতভম্ব অবস্থায় ছিলাম। আমি আর মেজর গিয়াস রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে আছি এবং ঐ সময়, পজিশন নেওয়ার ওর্ডার দেওয়ার প্রথম দুই মিনিটের মধ্যে তিনি তার প্রিয় চাইনিজ সাব-মেশিনগান থেকে ফায়ার শুরু করে দিয়েছিলেন, যেটি তিনি যুদ্ধের পুরোটা সময় নিজের সাথে রেখেছিলেন। তিনি আরো দুইটা মেগাজিন খালি করে ফেললেন। এরমাঝে, ভিকার মেশিনগান থেকেও ফায়ার শুরু হয়ে গেছে।

দুইদিক থেকেই সমানতালে গুলিবর্ষণ হচ্ছে। আমি দেখলাম আমাদের লিডার এম্বুশ সাইটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, এবং সকল মুক্তিযোদ্ধারা তাকে অন্ধের মত ফলো করছে। ব্রিজ দখল করতে আমরা হাটু থেকে গলা পর্যন্ত পানির মধ্যে আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগলাম। অপরদিকে, শত্রুপক্ষও সকল শক্তি দিয়ে আমাদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলো। দীর্ঘ ৩ ঘন্টা যুদ্ধের পর আমরা দেখলাম, শত্রুপক্ষ পিছু হাঁটছে এবং ব্রিজের পাশে বাঁধা ৩টা নৌকায় করে পালাচ্ছে। পরে বুঝতে পেরেছি যে, ব্রিজের ঐপারের রাস্তাও বন্যার পানিতে ডুবে গিয়েছিলো এবং পালানোর জন্য শত্রুপক্ষকে নৌকার ব্যাবস্থা করতে হয়েছিল।

শত্রুরা পালাচ্ছে বুঝতে পেরে আমরা গোলাগুলি চালু রাখি। ব্রিজের ওপাশ থেকে এক এলএমজি ছাড়া গোলাগুলি প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিলো। আমাদের গোলাগুলির মাঝেই শত্রুপক্ষের নৌকার থেকে আমরা ‘বাঁচাও’ ‘বাঁচাও’ চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। জ্যোৎস্নার আলোয় দেখতে পাচ্ছিলাম আমাদের গোলগুলিতে একটা নৌকা ডুবে গেলো। যখন আমরা ব্রিজ দখল করলাম তখন ভোর ৪.৩০ মিনিট। আমাদের গোলাবারুদ শেষের পথে ছিলো এবং মনবল তুঙ্গে থাকা সত্বেও আমাদের যোদ্ধারা খুবই ক্লান্ত ছিল। এবার ব্রিজ উড়িয়ে দেবার প্রসঙ্গ এলো। কিন্তু, আমরা চিন্তিত ছিলাম এই নিয়ে যে, সকালে যে কোন মুহুর্তে শত্রুপক্ষ আবার আক্রমন করে বসতে পারে। তাই আমরা ক্যাম্পে ফিরে যাওয়ার মনস্থির করলাম। এছাড়াও, ব্রিজের গোড়ায় মাইন বসাতে ২ ঘন্টার মত সময় লাগতো; অন্যদিকে,  বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য প্রয়োজনীয় করডাইট এবং ডেটনেটর যুদ্ধের মধ্যে নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। তাছাড়াও, যুদ্ধে আমাদের সাহসী যোদ্ধা ল্যান্স নায়েক মোহর আলী বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।এছাড়াও আমাদের আরো দুই যোদ্ধা মারাত্বকভাবে আহত হয়েছিলেন, তাদের জরুরীভিত্তিতে সার্জারি করার দরকার ছিল।

স্বীকার না করে উপায় নেই যে আমাদের মিশন আংশিকভাবে সফল হয়েছিলো। আমরা ব্রিজ উড়াতে না পারলেও যুদ্ধে ২ জন পাকিস্তানি আর্মি এবং ৬ জন রাজাকার মারা গিয়েছিল। তাদের মৃতদেহ দুইদিন পর নদীর তীর হতে উদ্ধার করা হয়েছিলো। আমরা পরবর্তীতে নিশ্চিত হয়েছিলাম, অন্তত এক ডজন পাকিস্তানি আর্মি ও রাজাকার যুদ্ধে মারাত্বকভাবে আহত হয়েছিল। এই যুদ্ধ সত্যিকারভাবে পাকিস্তানি আর্মিদের মনোবল গুড়িয়ে দিয়েছিল।

আগস্ট মাসে আমাদের দুইটা সফল অভিযানের কারনে পাকিস্তানি সৈন্যদের চলাফেরা সীমিত হয়ে গেল; তখন তারা শুধু দিনেরবেলাতেই কমপক্ষে দুইটি গাড়িবহর নিয়ে চলাফেরা করত। তারা বাধ্য হলো বেশী সংখ্যক সৈন্য ব্রিজ এবং কালভার্ট পাহারা দেওয়ার কাজে নিয়জিত করতে, তাতে যুদ্ধ করার মত সৈন্য কমে গেলো। প্যারামিলিশিয়া দিয়ে যেখানে কাজ চলত, সেখানে এই ঘটনার পর তারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রেগুলার আর্মি দিয়ে রাজশাহী-নবাবগঞ্জ রাস্তা পাহারা দিতে লাগল। দক্ষ একটা নেতৃত্ব থাকলে কিভাবে ছোট একটা দল নিয়েও সকল প্রতিকূলতা দূরে ঠেলে জয় ছিনিয়ে আনা যায়, তা আমি শিখলাম এই অপারেশন থেকে।

শিরনাম সূত্র তারিখ
১৫। ৮নং সেক্টরের সংঘটিত যুদ্ধ বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র

মে-ডিসেম্বর১৯৭১

 

মিনহাজ উদ্দিন

<১০, ১৫.১, ৩৬৭-৩৬৯>

সাক্ষাৎকারঃ লেঃ কর্নেল এম এ ওসমান চৌধুরী**

৩১-১-৭৪

খুলনা ও যশোরের ছিন্নমূল ও বিক্ষিপ্ত অনেক ইপি আর এবং আরও কিছু সংখ্যক নিয়মিত বাহিনীর সৈন্য  পুলিশ আমার সাথে যোগদান করে। আমি আমার সমস্ত  বাহিনীকে পুনঃসংঘটিত করে ৭টি কোম্পানীতে বিভক্ত করে করে ৭ জায়গায় ৭জন কোম্পানী কমান্ডারের অধীনে ৭টি বিভিন্ন সীমান্তবর্তী এলাকায় নিয়োগ করিঃ (১)প্রথম কোম্পানী উত্তরে মহেশকুন্ড বিওপি এলাকায় লেফটেন্যান্ট জাহাঙ্গীরের (বর্তমানে ক্যাপ্টেন) অধীনে। (২) দ্বিতীয় কোম্পানী তার দক্ষিণে জীবননগর বিওপি এলাকায় ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমানের অধীনে। (৪) ৪র্থ কোম্পানী কাশিপুর/ মুকুন্দপুর বিওপি এলাকায় ক্যাপ্টেন খন্দকার নাজমুল হুদার (বর্তমানে লেঃ কর্নেল) অধীনে ।(৫) ৫ম কোম্পানী বেনাপোল কাস্টম চেকপোস্ট এলাকায় ক্যাপ্টেন আবদুল হালিমের অধীনে। (অবশ্য এই কোম্পানীর কমান্ডার বেশ কয়েকবার পরিবর্তিত হয়। ক্যাপ্টেন তৌফিকও কিছুকাল এই কোম্পানীর কমান্ডার ছিলেন) (৬) ৬ ষ্ঠ কোম্পানী আরও দক্ষিণে বাকশা/ কাকডাঙ্গা বেনাপোল থানাধীন এলাকায় ক্যাপ্টেন শফিউল্লাহর অধীনে (৭) ৭ম কোম্পানী ভোমরা এলাকায় ক্যাপ্টেন( বর্তমান মেজর) সালাহউদ্দিনের অধীনে। মে মাসের শেষদিকে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন হেডকোয়াটার  মুজিবনগরে বদলি হলে ক্যাপ্টেন মাহবুবউদ্দিনকে এই কোম্পানীর ভার দেয়া হয় ।

আমার বাহিনী পুনঃ সংগঠিত হওয়ার পর আমি সম্মুখ সমর পরিহার করে যথাসম্ভব গেরিলা পদ্ধতিতে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য নির্দেশ দেই। মে মাসের প্রথমার্ধে মুজিবনগরে বাংলাদেশ ফোর্সেস হেড কোয়াটার সংগঠিত হয়। ঐ মাসেরই শেষার্ধে গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করার পুরোপুরি সিদ্ধান্ত নেয়া এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ নিয়ম সহকারে সমস্ত সেক্টরে নির্দেশ প্রচার করা হয়। আমার সেক্টর হেড কোয়াটার স্থাপন করি বেনাপোলের সীমান্তবর্তী এলাকায়। ওখান থেকে সময়ে সময়ে যেসব বিদেশী গুরুত্বপূর্ণ লোকজন অথবা সাংবাদিকও টেলিভিশন রিপোর্টাররা যুদ্ধের প্রত্যক্ষ রিপোর্ট নিতে আসতেন, তাঁদেরকে বাংলাদেশের ভিতরে নিয়ে যেতাম। মে মাসের শেষার্ধে খবর আসলো যে, ইংল্যান্ড থেকে মাননীয় জন স্টোন হাউস এম পি ও মিঃ চেসওয়ার্থ মুক্তিবাহিনী দ্বারা মুক্ত এলাকা সত্যি বাংলাদেশের কিনা , সেই তথ্য পর্যবেক্ষণ করতে বাংলাদেশে আসবেন। আমার নির্দেশমত ব্যবস্থা হল ভারতের বয়রা এলাকা দিয়ে তাঁরা বাংলাদেশে ঢুকবেন। সব ব্যবস্থা করে আমি সীমান্তের একটা সীমান্ত খুঁটির কাছে মহামান্য অতিথিদের অপেক্ষায় রইলাম । অতিথিদের আগমনের সাথে সাথেই আমি তাদেরকে খুঁটি দেখিয়ে বললাম- -`This is the border survey post and the moment you have crossed this post, you are on the Bangladesh soil. Sir let us have a photograph here as a mark of identification between the two lands.” ওখানে ফটো তোলার জন্য তাঁদেরকে ভিতরে নিয়ে গেলাম।গাছের উপর, বাড়ির ছাদে, তাঁরা বাংলাদেশের পতাকার জন্য দেখতে পেলেন। পরিদর্শন করলেন আমার সেখানকার কোম্পানী হেড কোয়াটার। দেখতে পেলেন মুক্তিবাহিনীর আনাগোনা, কর্তব্য পালন, পাহারা ও ডিউটি পরিবর্তন ইত্যাদি।খুশি হলেন, আমাদের সাথে মোরগের মাংস দিয়ে দুপুরের খাওয়া খেলেন।আমাদের অধিকৃত চীনা হাতিয়ার হাতে নিয়ে বাংলাদেশের পতাকাকে পিছনে রেখে ছবি তুললেন।মুক্ত এলাকা পরিদর্শন করলেন। সবশেষে বিদায় নেবার পূর্বে মাননীয় স্টোনহাউসের আন্তর্জাতিক পাসপোর্ট আমি স্বাক্ষরও সেক্টর হেড কোয়াটার মোহর দিয়ে লিখে দিলাম-‘‘Admitted into Bangladesh and allowed to visit liberal area.”

১৫ইমে থেকে নিয়মিতভাবে প্রত্যেক কোম্পানীকে সাপ্তাহিক অপারেশনাল ট্যাস্ক দিতে থাকলাম এবং সেগুলোর বাস্তব সিচুয়েশন রিপোর্ট নিয়মিতভাবে বিডিএফ হেডকোয়াটারে পাঠাতে থাকলাম।সেক্টর কমান্ডার হিসাবে আমি প্রতিনয়তই কোম্পানী থেকে কোম্পানী এলাকা ভ্রমণ,পরিদর্শনও অপারেশনাল কাজকর্মগুলো সমন্বয় করতে থাকলাম।

একটা কথা বলতে ভুলে গেছি যে, মে মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রাক্তন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট জামালুদ্দিন চৌধুরী এমপি-এ ও ক্যাপ্টেন আবদুল ওহাব এবং লেফটেন্যান্ট ইনামুল হক(বর্তমান ক্যাপ্টেন ও প্রেসিডেন্ট এডিসি) আমার হেডকোয়াটারে যোগদান করেন। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট জামালুদ্দিন চৌধুরীকে আমার সেক্টর সদর দপ্তরে স্টাফ ক্যাপ্টেন পদে নিয়োগ করি।সমস্ত অপারেশনের পরিকল্পনা নিয়ন্ত্রণও নির্দেশনার ভার ছিল তাঁর উপর,যা তিনি অতি সুষ্ঠু সমর পরিচালকের মত সম্পন্ন করেন।

প্রায় প্রত্যেক অপারেশন টাস্ক সম্পূর্ণ করতে গিয়ে কিছু না কিছু পাকসেনা হতাহত এবং অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করা হত।মাঝে মাঝে শত্রুসেনা বন্দীও করা হত।রাজাকার আত্মসমর্পণ,দালাল নিধন ইত্যাদি ছিল প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।তন্মধে উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ হয় ৭ম কোম্পানী এলাকায় ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিনের অধীনে।সেদিন ছিল ২৭মে ১৯৭১সাল। আমাদের অবস্থান ছিল সীমান্তবর্তী একটা বাঁধের উপরেও তার পিছনটায়। আমাদেরই এই উঁচু পজিশনের জন্য পাকিস্তানীরা কাছে ঘেঁষতে পারত না।দূর থেকেই তাদের আমরা তাড়িয়ে দিতে পারতাম।এই পজিশনটাকে ভাইটাল মনে করে পাকিস্তানীরা ২৭মে ভোর ৪টার দিকে ২ কোম্পানী সৈন্য দিয়ে আমাদেরকে আক্রমণ করে।তীব্র যুদ্ধের পর তাদের ঐ আক্রমণ প্রতিহত করা হয়। ২ঘণ্টা পর আবার তারা ২কোম্পানী সৈন্য নিয়ে আমাদের অবস্থানকে আক্রমণ করে। এবারও তাদের আক্রমণ ব্যর্থ করা হয়।এভাবে পরপর ৬বার তারা ২ কোম্পানী এবং ১ ব্যাটালিয়ন দিয়ে আলাদা আলাদাভাবে আমাদের উপর আক্রমণ চালায় কিন্ত ক্ষয়ক্ষতির পর তারা পিছপা হতে বাধ্য হয় এই যুদ্ধ ১৪ ঘণ্টাকাল স্থায়ী হয় এবং তাদের আনুমানিক ৩০০ সৈন্য হতাহত হয়। এর মধ্যে তাদের ব্যাটালিয়ন কমান্ডার আহত হয় এবং ব্যাটালিয়নের ২য় কমান্ডারও ১জন ক্যাপ্টেন মারা যায়। উৎসাহ ভরে এই ক্যাপ্টেনের লাশ নিজ এলাকায় দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় ঐ ক্যাপ্টেনের লাশ আনতে সক্ষম হয়। ঐ চেষ্টায় প্রথমত ১জন জওয়ান মারা যায়। দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় ঐ ক্যাপ্টেনের লাশ আনতে সক্ষম হয়।এছাড়া আরও ৫টি পাকসেনার লাশ উদ্ধার করে অপর বাংলার জনসাধারণকে দেখানোর জন্য পাঠানো হয়। ভারতীয় জনগণ বাঙ্গালীদের বীরত্বের ভূয়সী প্রশংসা করে। এভাবে চলতে থাকে আমাদের দৈনন্দিন মুক্তিযুদ্ধ এবং শত্রুহনন অভিযান। হিসেব করে দেখা গেছে এই সেক্টরে গড়ে প্রতি মাসে ৭০০ শত্রুসেনা নিধন হয়েছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, ১৯৭১ সনের জুন অথবা জুলাই মাসে বাংলাদেশের সেনাপতিও ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের মধ্যে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, বাংলাদেশের সেক্টরগুলিতে কিছু সংখ্যক ভারীও হালকা হাতিয়ার বন্ধুরাষ্ট্র ভারত আমাদেকে দেবে। সেই অনুযায়ী আমি বারবার ভারতীয় কমান্ডারদের কাছ থেকে চেয়েও ঐ হাতিয়ারগুলি পাইনি। সময়মত অস্ত্রশস্ত্র না পাওয়ার আমাদের যুদ্ধ চালাতে যথেষ্ট অসুবিধা হয়।

১৯৭১ সনের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ ফোর্সেস হেডকোয়াটার মুজিবনগরে সেক্টর কমান্ডারদের কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়।এই কনফারেন্সের উদ্বোধনী দিনে সাধারণভাবে বাংলাদেশ বাহিনীর সেনাপতি কর্নেল ওসমানীরই ভাষণ দেবার কথা,কিন্ত উদ্বোধনী ভাষণ শুরু করলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীও প্রতিরক্ষামন্ত্রী মাননীয় তাজউদ্দিন আহমদ। ব্যবস্থানুযায়ী তা যদিও বা হল তবুও কর্নেল ওসমানীর উপস্থিতি সেখানে ছিল অপরিহার্য। কিন্ত তিনি নেই দেখেই ব্যাপারটা অস্বাভাবিক মনে হল। যাই হোক লম্বা- চওড়া উদ্বোধনী বক্তৃতার পর প্রধানমন্ত্রী সাহেব যা বললেন তার অর্থ হল- এই যে সেক্টর কমান্ডারদের অনাস্থাবশতঃকর্নেল ওসমানী পদত্যাগপত্র দাখিল করেছেন। তিনি অনুরোধ করলেন যে, ঐ সঙ্কট মুহূর্তে সেনাপতির পরিবর্তন আন্তর্জাতিক দৃষ্টিতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অগভীরতা ও অনৈক্যেরই পরিচালক হবে। ব্যাপারটার গুরুত্ব উপলব্ধি করে আমরা সমস্ত সেক্টর কমান্ডারই কর্নেল ওসমানীর সেনাপতিত্বে আস্থা প্রকাশ করি।

প্রাসঙ্গিকভাবে একটা কথা বলতে চাই যে, কর্নেল ওসমানীর আদেশক্রমে আমার সেক্টর এর ইপিআর বাহিনী থেকে ভাল ভাল যুবক সৈনিকদের এক এক করে ছিন্নমূল প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে পুনঃসংগঠিত করি এবং আমরাই পাকসেনাদের কাছ থেকে দখলকৃত ভারীও হালকা অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ দিয়ে ওদেরকে সম্পূর্ণরূপে সজ্জিত করি। মে মাসের শেষদিকে এই পুনঃসংগঠিত ব্যাটালিয়নকে উত্তর-পূর্ব রণাঙ্গনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেনাপতির কাছে নিবেদন করেছিলাম যে, আমার বাহিনীর ‘ক্রিম অব সোলজারস’ নিয়ে গেলে আমার সেক্টরের ক্ষমতা বহুলাংশে কমে যাবে। তিনি বলেছিলেন যে, আমাকে নতুন নতুন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্য দেওয়া হবে। নতুন নতুন প্রশিক্ষিত সৈন্য আমি ঠিকই পেয়েছিলাম কিন্ত তারা ছিল গেরিলা ট্রেনিংপ্রাপ্ত অনিয়মিত বাহিনীর সদস্য যাদেরকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত করে অস্ত্রশস্ত্র –গোলাবারুদও সামান্য টাকাপয়সা দিয়ে ভিতরে পাঠিয়ে দিতে হয়েছে। আমার সেক্টর নিয়মিত বাহিনীর ‘ক্রিম অব সোলজারস’ চলে গেলো তার আর কোন দিন রিপ্লেসমেন্ট হয় নি। সময়ে সময়ে পাকিস্তান থেকে যেসব নিয়মিত বাহিনীর সৈন্যরা এসেছিল তাঁদেরকেও উত্তর-পূর্ব রণাঙ্গনেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। এতদসত্ত্বেও এই সেক্টরের সাফল্য প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অন্য কোন সেক্টরের এর তুলনায় যে কম ছিল না, আন্তর্জাতিক দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক পত্রিকা এবং টেলিভিশনও রেডিও রীলগুলি স্টাডি করলেই বোঝা যাবে।

সপ্তাহকাল কোম্পানী এলাকাগুলো পরিভ্রমণও পরিদর্শনের পর ১৫ই আগস্ট বিকেল ৬টায় আমার সেক্টর সদর দপ্তরে পৌঁছে দেখতে পেলাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর এম এ মঞ্জুর( বর্তমান কর্নেল) আমার অফিসে বসে আছেন। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যে, তিনি ‘প্রপার মুভমেন্ট’ অর্ডার নিয়ে আমার থেকে সেক্টর এর কর্মভার গ্রহণ করার জন্য এসেছেন। শুনে অবশ্য আশ্চার্যবোধ করলাম যে, আমাকে না জানিয়ে এটা কেমন করে সম্ভব! টেলিফোন করে জানতে পারলাম যে, মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরে মুজিবনগরে এসিস্ট্যান্ট চীফ অব স্টাফ(লজিস্টিকস) এই দপ্তরের সংগঠন ও দায়িত্ব পরিচালনার জন্য আমার ওখানে যাওয়া একান্ত প্রয়োজন। এই সংবাদে সেক্টর এর নিয়মিত বাহিনী অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। আমিও কমান্ড পরিবর্তনকে আমার উপর ইনসালট বলে মনে করি। এতদসত্ত্বেও সেনাপতির প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে ১৮ই আগস্ট বিকেলে সেক্টর-এর কর্মভার হস্তান্তর করে আমি মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরে হাজির হই।

** ১৯৭১ সালে মেজর পদে কর্মরত ছিলেন।

 

 

মিনহাজ উদ্দিন

<১০, ১৫., ৩৬৯৩৭১>

সাক্ষাৎকারঃ লেঃ কর্নেল এম মঞ্জুর

২৯১৯৭৩

মানসিক দিক থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার জন্য। পালাবার পথ খুঁজেছিলাম। অবশেষে সে সুযোগ হয় ২৬ শে জুলাই। ইতিপূর্বে আলাপ-আলোচনা পরিকল্পনা করেই রেখেছিলাম। মেজর জিয়াউদ্দিন, মেজর তাহের, ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী , আমার পরিবার এবং আরদালী সহ বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ি। আরও আগে বেরোবার চেষ্টা করেছি কিন্ত সুযোগ হয়নি, তাছাড়া আমার শিশু সন্তান তখন মাত্র কয়েক দিন ছিল।

অনেক পথ পেরিয়ে ৭ই আগস্ট আমি কলকাতা আসি। তারপর ১১ই আগস্ট আমাকে ৮নং সেক্টরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ৯ই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর এম এ জলিল। তবুও যুদ্ধ সংক্রান্ত ব্যাপারে এই সেক্টরের দায়িত্বও আমাকে দেওয়া হয়েছিল।

আসার পর পরই আমি পেট্রো পোলে আমার এলাকা পরিদর্শনে যাই। সেখানে  শুনলাম ছয়জন রাজাকারকে গণবাহিনীরা  ধরে নিয়ে এসেছে এবং মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আমি জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদেকে মুক্তি দেই এবং গ্রামে ফিরে গিয়ে দেশের জন্য কাজ করতে বলি। পরে শুনেছিলাম দুই জন অনুশোচনায় অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গেছে, অপর চার জন বাংলাদেশের জন্য মরণপণ লড়াই করেছে । ফিরে এসে এ বিষয়ে গভীরভাবে ভাবতে  থাকি এবং কতকগুলি অবস্থা লক্ষ্য করলাম।

গণবাহিনী নিয়মিত বাহিনী থেকে সম্পূর্ণ ভাবে পৃথক। তারা অন্য কমান্ডের আওতায় কাজে-চিন্তায় নিয়মিত বাহিনী থেকে আলাদা। বস্তুতঃ পক্ষে গণবাহিনী এবং নিয়মিত বাহিনী পৃথক রাজ্যে বাস করতো।

গণবাহিনী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মাঝে মাঝে গেলেও পাকবাহিনী আসছে শুনলে সে গ্রাম বা গৃহ থেকে পালিয়ে যেত। এতে কোন মুক্তিবাহিনীর প্রতি জনসাধারণের আস্থা ক্রমশ হারাতে থাকে।অপরদিকে নিয়মিত বাহিনী ভারতের সীমান্তের কাছাকাছি বিভিন্ন ‘ পকেটে’ থাকতো। তারা বিস্তৃত পরিসরে ঘুরতো না।বস্তুতঃ তাদের কাজ অত্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। গণবাহিনী কোন কোন সময় জোর করেও কোন কোন বাড়িতে থেকেছে, এতেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলাম।‘ আঘাত কর এবং পালাও’এই নীতির ফলে পাকবাহিনী এসে গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিত, হত্যা লুণ্ঠন সন্ত্রাসও বাদ যেত না। অপরদিকে যেসব রাজাকারদের ধরে সবদিক বিবেচনা না করে হত্যা করতো সেই পরিবারের গোটা লোককে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করতে দেখলাম।এমনিভাবে তারা বাংলার মানুষের সহযোগিতা হারাতে বসেছিল।এছাড়া গণবাহিনী মাঝে মাঝে দেশের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতো। অপরদিকে একজন মিয়মিত সৈনিক হিসাবে তাদের কাছে যা পাওয়া উচিত ছিল তার প্রায় কিছুই পাওয়া যাচ্ছিল না। আমি বুঝলাম গণবাহিনীকে যদি আমার অধীনে নিয়ে আসতে না পারি তাহলে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়বে। শুধু কতকগুলি সিদ্ধান্ত নেই।(১)সেক্টরটিকে পুরাপুরি পুনঃসংগঠিত করি।এবং পুনরায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করি।(২) গণবাহিনীকে সম্পূর্ণ আমার আওতায় নিয়ে আসি।(৩) আমার এলাকাকে বিভিন্নস্থানে বিশেষ বিশেষ এলাকায় ভাগ করি এবং সেখানকার জন্য একজন কমান্ডার নিযুক্ত করি।সবাই দেশের অভ্যন্তরে থাকবে, যাবতীয় সরবরাহ আমরা করবো এ সিদ্ধান্তও নিই।(৪) গণবাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবার জন্য রাজনৈতিক উপদেষ্টা পাঠাই।(৫)রাজাকারদের প্রশ্নেও বিশেষ নির্দেশ দিয়েছিলাম।

আমি আসার পর গণবাহিনীতে ভর্তি বাড়িয়ে দেই। ট্রেনিং এর সময় কমিয়ে তিন সপ্তাহ করি।প্রতি মাসে তিন হাজার করে গণবাহিনী তৈরি করে দেশের অভ্যন্তরে পাঠাবার ব্যবস্থা করি। ভিতরে পাঠাবার সময় প্রত্যেকের খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি বাবদ রাহাখরচ৮০ টাকা করে দেবার ব্যবস্থা করেছিলাম। এর আরেকটি দিক ছিল তা হলো দেশের ভিতরে এইভাবে সবাই টাকা ব্যয় করলে অন্যেরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উপকৃত হলে আমাদের প্রতি সহানুভূতির সৃষ্টি হবে।

গণবাহিনী ভিতরে পাঠাবার পর প্রত্যেক গ্রুপের মাত্র একজন সীমান্ত নিকটবর্তী আমাদের স্থায়ী ’পকেটে’ এসে সবার জন্য টাকা, অস্ত্র এবং অন্যান্য নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করি। সেপ্টেম্বরের মধ্যে পুনর্গঠনের কাজ হয়ে যায়।

পরবর্তী পর্যায়ে নিয়মিত বাহিনীও ভিতরে এগিয়ে যায়। মোটামুটিভাবে নিয়মিত বাহিনী এবং গণবাহিনীকে একটি বিশেষ ‘চেইনে’ নিয়ে আসি।এতে করে ভাল ফল হতে লাগলো।এই বাহিনীর ভিতরে প্রবেশ করলে আমি এদেরকে ট্রাঙ্ক দেই- যেমন রেল লাইন উড়িয়ে দেওয়া, সেতু ধ্বংস করা, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ধ্বংস করা ইত্যাদি। এসব শুরু হলে পাকবাহিনী ভীষণ বিপদের মুখে পড়ে যায়। আমরা সাফল্যের পথে এগিয়ে যাই। শুধু তাই নয়, আওতাভুক্ত এলাকাতে যাতে প্রশাসন যন্ত্র চালু হয় এবং সুষ্ঠুভাবে চলে তার নির্দেশ নেই। এতে করে ভাল ফল পাওয়া গেল।ত্বরিত যোগাযোগের জন্য বিভিন্নস্থানে অয়ারলেস পাঠাই এবং এ বিষয়ে একটি দলকে প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা করি। দেশের ভিতরে গিয়ে বুদ্ধিমান এবং সাহসী ছেলে বেছে এনে ‘ ইন্টেলিজেন্স’ বিভাগ খুলি। এর ফলে যাবতীয় খবরাখবর আমরা অতি সহজে পেতে থাকলাম।আমাদের অগ্রগতি এগিয়ে চলে।

অপরদিকে আমি লক্ষ্য করেছিলাম যে শুধুমাত্র পাকবাহিনীকে হত্যা বা তাড়ানোর ব্যবস্থা করলেই চলবে না, তাতে করে পুরো প্রশাসন ভেঙ্গে পড়ে সেদিকেও নজর দিতে হবে। একাজের প্রাথমিক দিক হিসাবে আমি প্রথমে পুলিশ থানাগুলি দখল করতে বলি। অপরদিকে চালনা এবং মংলা পোর্ট যাতে অকেজো হয়ে যায় তার নির্দেশ দেই। সঙ্গে সঙ্গে কাজ হয় নৌবাহিনীর একটি দল বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেয়।

এইভাবে কাজ করে যেতে আমরা একের পর এক জয়ের পথে এগিয়ে যেতে থাকলাম।গণবাহিনীও নিয়মিত বাহিনী অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কাজ করতে লাগলো।মুক্তিযুদ্ধের সবচাইতে যেটি প্রয়োজন, জনসাধারণের সমর্থন, তা পেতে লাগলাম।আমরা সাফল্যের পথে এগিয়ে গেলাম।

এরপর নভেম্বরের ২০ তারিখ থেকে মিত্রবাহিনী আমাদের সাথে সাথে আসে।এবং মিত্রবাহিনী ও আমাদের বাহিনী মিলিতভাবে শত্রুদের উপর আক্রমণ চালিয়ে একের পর এক এলাকা জয় করে চললো। অবশেষে ১৬ই ডিসেম্বর সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশ মুক্ত হয়।

আলবদর বা আলশামসদের ক্ষেত্রে অন্য কথা হলেও রাজাকার প্রশ্নে বলা যায় যে, তারা সবাই সমান ছিল না। এদের অনেকেই আমাদের পক্ষে কাজ করেছে, যদিও মানুষ এদের ঘৃণা করতো।

সত্যিকার অর্থে যশোর সেনানিবাসটাকেই গণকবর স্থান বলা যেতে পারে। কারণ, বিভিন্ন স্থানে ঘটনা বিক্ষিপ্তভাবে যা পাওয়া গেছে, শোনা গেছে, দেখা গেছে তা অবর্ণনীয়। যাবার পথে পাকবাহিনী সেনানিবাসের বহু ব্যারাক ও স্টোরে আগুন লাগিয়ে দিয়ে গেছে। সেনানিবাসের ভিতরে মডেল প্রাইমারী বিদ্যালয়, দাউদ বিদ্যালয় ইত্যাদি স্থান ছিল চাপ চাপ রক্তে ভরা। অনেক মানুষকে রশি দিয়ে গাছে টাঙ্গিয়ে হত্যা করা হতো। আরও শুনলাম কিভাবে মেয়েদের উপর অত্যাচার করা হয়েছে। হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে নৃশংসভাবে, তার পরিচয় পাওয়া গেল।

ডিসেম্বরে পুরামাত্রায় যুদ্ধ বেধে গেলে বাংলার মানুষ আনন্দিত হয়ে উঠে। তারা উন্মুখ হয়ে থাকে মিত্র আর মুক্তিবাহিনীর অপেক্ষায়।

মুক্তিবাহিনী এবং মিত্রবাহিনীকে বাংলার মানুষ প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানায়। শিশু, বৃদ্ধ, যুবক, নারী সবাই যে যা পেয়েছে তাই দিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছে। স্বাধীনতার পর জনমনে সাড়া পড়ে যায়। বাংলার আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে।

                                                                                             স্বাক্ষরঃ মঞ্জুর                                                                                     ২৯-৩-১৯৭৩

** মেজর হিসাবে কর্মরত অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। পরবর্তীতে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৬।৮নং সেক্টরে সংঘটিত যুদ্ধ সম্পর্কে অন্যান্যের বিবরণ বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র মে-ডিসেম্বর ১৯৭১

মিনহাজ উদ্দিন

<১০, ১৬., ৩৭২৩৭৪>

সাক্ষাৎকারঃ লেঃ কর্নেল মোস্তাফিজুর রহমান

১০১৯৭৩

 

বেতাই, বানপুর, বনগাঁ, গোজাডাঙ্গা ইত্যাদি স্থানে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প করা হয়ঃ ১। বেতাই ক্যাম্পের কোম্পানী কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী। ২।বানপুরে ছিলেন ক্যাপ্টেন মোস্তাফিজুর রহমান। ৩।বয়রায় ছিলেন ক্যাপ্টেন কে,এন, হুদা। ৪। বনগাঁয় ছিলেন ক্যাপ্টেন তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী। ৫।গোজাডাঙ্গায় ছিলেন ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন এবং পরে ক্যাপ্টেন মাহবুব উদ্দিন।

আমাকে বানপুর ক্যাম্পে রাখার উদ্দেশ্যে ছিল, আমি ছিলাম প্রকৌশলী অফিসার। যশোর, ঈশ্বরদী, কুষ্টিয়াতে যে সমস্ত রেল চলাচল করত কৌশলে যাতে ঐ সমস্ত রেল লাইন চলাচল ব্যাহত করতে পারা যায় তার জন্য বিশেষভাবে আমাকে ক্যাম্পে নিয়োগ করা হয়।

মে মাসঃ মে মাসের ১২/১৩ তারিখে কুষ্টিয়া জেলার জীবননগর বিওপিতে অ্যামবুশ করে পাক আর্মিদের কাছ থেকে একটি জীপ দখল করা হয়। পাক আর্মি মাঝে মাঝে বিওপিতে আসত। তারা মুক্তিবাহিনীর হামলায় জীপটি রেখে চলে যায়। মুক্তিবাহিবাহিনী সর্বপ্রথম ঐ জীপটি পাকবাহিনী থেকে উদ্ধার করে। ঐ জীপের ভিতর থেকে পাক আর্মির ব্যক্তিগত চারখানা চিঠি উদ্ধার করা হয়। চিঠিগুলোর মধ্যে একটিতে উর্দুতে এক সৈন্য তার বাবার কাছে লিখেছে যে,’ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যেসব ঘটনা ঘটছে পশ্চিম পাকিস্তানে বসে শুনেছেন তার চেয়ে বহুগুণ সব ঘটছে।‘’ ২য় পত্র জনৈক সৈনিক তার বন্ধুর কাছে লিখেছেঃ ‘’একটি কমান্ডো ব্যাটালিয়নের চট্টগ্রাম যুদ্ধে আমরা ৪/৫ জন ছাড়া  আর সবাই মারা গেছে। আমাদের অন্য ব্যাটালিয়নের সাথে থেকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে।’’

এভাবে যুদ্ধ করতে করতে মে মাস কেটে গেল। মে মাসের ১১/১২ তারিখে দর্শনাও জীবননগরের রাস্তার মাঝামাঝি স্থানে শিয়ালমারী নামে একটি জায়গা আছে। ঐ রাস্তায় মুক্তিযোদ্ধারা ৪ খানা বিধ্বংসী ট্যাঙ্ক মাইন লাগায়। সেখানে ব্রীজ না থাকার জন্য একটি ডাইভারশন সড়ক ছিল। এই মাইন লাগানোর ফলে পাকবাহিনীর একটি ট্রাক উল্টে যায়। এর ফলে ৮/১০ জন পাকসেনা মারা যায় এবং কিছু আহত হয়। মাইন বিস্ফোরণের সময় পাকবাহিনী বুঝতে পারেনি যে মাইন ফেটেছে। তারা মনে করেছিল মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করেছে। ঐ রাস্তা দিয়ে একই সঙ্গে দুটি ট্রাকও একটি জীপ যাচ্ছিল। প্রথমে জীপটি রাস্তা পার হয়ে চলে যায়। পরে ট্রাকটি ধ্বংস হয় এবং সবার পিছনের ট্রাকটি রক্ষা পায়। পাকবাহিনী ওখানে ২/৪ গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করেও এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে।

মে মাসের ১৫তারিখের দিকে নায়েক বাশার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের(অনার্স) একজন ছাত্র বাবলু ও অপর তিনজন মুক্তিযোদ্ধাকে এক্সপ্লোসিভ দিয়ে দর্শনা থেকে ২ মাইল উত্তরে দুতপাতিলা নামক স্থানে রেলব্রীজ উড়িয়ে দেয়ার জন্য পাঠান হয়। তাদের কাজ ছিল ঐ দিনরাত্রিতে যে ট্রেনটি আসবে এবং তা যখন ব্রীজের উপর দিয়ে যাবে তখন তাকে এক্সপ্লোসিভ দিয়ে উড়িয়ে দেয়া। দুঃখের বিষয়, ঐ দিন সারারাত আর কোন ট্রেন আসেনি। মুক্তিযোদ্ধারা এক্সপ্লোসিভ তার নিয়ে পাশে আখক্ষেতে অপেক্ষা করছিল। ভোর বেলায় একজন কৃষক জমি চাষ করার জন্য ঐ পথ দিয়ে আসছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ছাত্র মনে করেছিল যদি কৃষকের লাঙ্গলে এক্সপ্লোসিভের তার লাগে তবে তারটি উপরের দিকে উঠে যাবে। তাই ভেবে, কৃষকটি তারের কাছে আসার পূর্বেই সে এক্সপ্লোসিভ ফাটিয়ে দেয়, এর ফলে প্রচণ্ড আওয়াজ করে ব্রিজটি ধ্বংস হয়। এ আওয়াজ পেয়ে গ্রামবাসীরা যার যার ঘর থেকে বের হয়ে আসে। ঐ মুক্তিযোদ্ধারা আখক্ষেতে থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বাবুল ও নায়েক বাশার গ্রামবাসীর হাতে ধরা পড়ে যায়। কিন্ত গ্রামের মুসলিম লীগ দালালের খপ্পরে পড়ার ফলে মুসলিম লীগের দালালরা তাদেরকে দর্শনা পাকফৌজ ক্যাম্পে চালান করে দেয়। এরপর তাদের দুজনকে যশোর ও পরে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। ঢাকা বেতার থেকে তাদের বিবরণী প্রচার করা হয়েছিল। তাদের প্রহার করে কিছু কিছু গোপন সংবাদও তাদের মুখ থেকে বের করা হয়েছিল।

জুন মাসে তেমন কোন অপারেশন হয়নি। বিভিন্ন জায়গায় মাইন পোঁতা হয়েছিল, তাতে কোন কাজ হয়নি। বিভিন্নস্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রেনেড দিয়ে পাঠানো হয়েছিল, কিন্ত মুক্তিযোদ্ধারাও কোন অপারেশন করতে পারে নাই।

জুলাই১৯৭১ঃ১৩ই জুলাই দর্শনা পাকবাহিনীর ক্যাম্পে ভারতীয় বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধারা যৌথ উদ্যোগে রেইড করার ফলে ১২/১৪ জন পাকসেনা মারা যায়।

দর্শনা-ঝিনাইদহ রাস্তার ডিঙ্গাসহ ও জালসুক ব্রীজ দুটি এক্সপ্লোসিভ দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয়। এর ফলে পাকবাহিনীর চলাচলে বিঘ্ন ঘটে।

জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে মুক্তিযোদ্ধারা দর্শনা, জীবননগর, হাঁসদহ, খালিশপুর, কোটচাঁদপুর, কাপাশডাঙ্গা, দত্তনগর, কালিগঞ্জ ইত্যাদি স্থানে সড়কও রেলব্রীজের উপর এত বেশী মাইন পাতে যে, শেষপর্যন্ত পাকবাহিনী ট্রেনের ইঞ্জিনের সামনে বালির গাড়ি লাগিয়ে চলাচল করত, যাতে মাইনের আঘাতে ইঞ্জিন নষ্ট না হয়। এমনকি তারা গ্রামের লোকের হাতে  লণ্ঠন দিয়ে রাত্রে দেয়ার ব্যবস্থা করে, যাতে মুক্তিযোদ্ধারা মাইন লাগাতে না পারে। কিন্ত এত বাধাবিপত্তির পরও মুক্তিযোদ্ধারা মাইন লাগাত। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসগুলিতে যে সমস্ত মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং নিয়ে আমার ক্যাম্পে আসত তাদেরকে ভিতরে বেইস গড়ার জন্য পাঠাতে থাকি। এই বেইসগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ক্যাপ্টেন ওহাব সাহেবের নেতৃত্বে যশোর জেলার মাগুরাতে এবং কুষ্টিয়া জেলার হরিনাকুন্ডুতে  আবদুর রহমান নামে একজন প্রাক্তন সৈনিকের নেতৃত্বে ক্যাম্প খোলা হয়। ক্যাপ্টেন ওহাবের সাথে ছিলেন সহকারী লেঃ মোস্তফা এবং ৭০ জন নিয়মিত বাহিনীর লোক। ক্যাপ্টেন ওহাব মাত্র ৭০ জন সৈনিক নিয়ে মাগুরা যান। এ সংবাদ পাকসেনারা জানতে পায়। কিন্ত গুজব রটে যে, একজন ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে ৭/৮ হাজার মুক্তিযোদ্ধা মাগুরাতে অপারেশন করতে আসছে। এ সংবাদ জেনে পাকবাহিনীর সৈন্যরা মনোবল হারিয়ে ফেলে। শেষপর্যন্ত পাকবাহিনী ডিসেম্বর মাসে যুদ্ধের সময় মাগুরা থেকে ফরিদপুর চলে যায়। ক্যাপ্টেন ওহাব একটি সংবাদ যৌথ-সেনাবাহিনীর কাছে পৌঁছায় যে, মাগুরাতে পাকসেনাদের পেট্রোল ডিপো আছে।ডিসেম্বর মাসে ভারতীয় বিমানবাহিনীর আক্রমণে পেট্রোল ডিপোটি ধ্বংস হয়ে যায়। অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে হরিণাকুণ্ড ক্যাম্পের আবদুর রহমানের দল হরিণাকুণ্ড থানা আক্রমণ করে। এর ফলে একজন পাকিস্তানী ডি এস পি মারা যায়এবং ডি এস পির পোশাক হেড অফিসে পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং ঐ থানা আক্রমণে কয়েকজন পুলিশ মারা যায়।

নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে ভারতীয় সৈন্যরা তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের ভেতর প্রবেশ করতে থাকে। দর্শনা সীমান্তের বা দিকে মদনাতে ভারতীয় বাহিনীর ৪১ পাবর্ত বিগ্রেডের কিছু অংশ ঐ সমস্ত স্থানে মুক্তিবাহিনীকে সঙ্গে করে ডিফেন্স নিতে আরম্ভ করে। ভারতীয় বাহিনীর উপর একটি বিগ্রেড দর্শনার ডানদিকে( ভারত থেকে ডানদিকে) জীবননগর, দত্তনগর,কৃষিখামার, ধোপাখালি এলাকায় রেকি করতে থাকে। ১২ই নভেম্বর রাত্রিতে এক ভারতীয় প্লাটুন মুক্তিবাহিনীর সাথে মেজর বার্মার নেতৃত্বে এবং ২ জন ভারতীয় ক্যাপ্টেনের সাথে আমি ধোপাখালী বিওপি রেইড করতে যাই। এই রেইড করার ফলে পাকসেনাদের ১৫/২০ জন সৈন্য নিহত হয়। এ যুদ্ধে আমার পেটে গুলি লাগে। অয়ারলেস অপারেটর নায়েক মোহাববতের সহায়তায় ক্যাম্পে ফিরে যেতে সক্ষম হই। ঐ গুলি লাগে ২টার সময় এবং মেজর ভার্মা পায়ে ও হাতে আঘাত পান। আমাকে চিকিৎসার কোর ফিল্ড হাসপাতালে পাঠান হয়।

পাকিস্তানী সৈন্যরা বিগত কয়েকমাস যাবত যুদ্ধে কোনদিন আর্টিলারী ব্যবহার করেনি। কিন্ত ঐ দিনের অপারেশনে পাকিস্তানীরা তাদের সব অস্ত্র ব্যবহার করে। কিন্ত এ সমস্ত অস্ত্র ব্যবহার না করার ফলে মুক্তিযোদ্ধারা ও ভারতীয় বাহিনী জানত না পাকিস্তানীদের কি কি অস্ত্র এবং কোন স্থানে আছে। পাকবাহিনী তা ব্যবহারের পরে সমস্ত কিছু জানা গেল। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী ধোপাখালী(কুষ্টিয়া) বিওপি ব্যাপকভাবে আক্রমণ করে যার ফলে পাকবাহিনী আর্টিলারী ব্যবহার করতে বাধ্য হয়। এই অপারেশনে মুক্তিবাহিনীও ভারতীয় বাহিনীর কোন ক্ষতি হয়নি।

*১৯৭১ সালে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন

 

 

মিনহাজ উদ্দিন

<১০, ১৬., ৩৭৪৩৭৬>

 

সাক্ষাৎকারঃ তৌফিক এলাহী চৌধুরী*

শেষবারের মত এপ্রিলের শেষে যশোরের বেনাপোল থেকে ভারতে পশ্চাদপসরণ করার সময় আমাদের দুঃখকষ্ট সীমাহীন ছিল।বর্ষার আগমনে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল এবং আমাদের সঙ্গীদের শোয়া দূরে থাক, মাথা গোঁজার ঠাইটুকুও ছিল না। অবিরাম বৃষ্টি, অর্ধাহার, অনাহার তার উপর আপাতদৃষ্টিতে পরাজয়ের গ্লানি মিলিয়ে আমরা অনেকটা দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। এই রকম অবস্থায় বাংলার মাটিকে ছেড়ে বিদেশে বিতাড়িত হওয়া যে কি মানসিক যন্ত্রণা সেটা যারা কোনদিন এই রকম অবস্থায় পড়েনি তাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়ের মানসপটে ভেসে উঠেছিল তাদের ফেলে আসা গ্রাম, ঘরবাড়ি, বাবা- মা- স্ত্রী-পুত্র পরিজন। তাদের কাছ থেকে কতদিনের বিদায় নিয়ে যাচ্ছিল তারা জানত না।এই বেদনাবিধুর বিদায়লগ্ন আমাদের কেউ কোনদিন ভুলাতে পারবে না।

এই সময়ে ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমাদের কথাবার্তা শুরু হয়। আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রাথমিকভাবে কিছুদিন বিএসএফ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদের রেশন, গোলাবারুদ এবং সরবরাহের দায়িত্ব নেন। খুব সম্ভবতঃ ১৮ বিএসএফ এর ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেঈ সিং এর অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। ১৯৬৫ সনের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ‘বীরচক্র’ পাওয়া এই সামরিক অফিসারটি আমাদের এই চরম দুর্দিনে বাণী শুনিয়েছেন।এই সময় আমরা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুনভাবে সংগঠন শুরু করি এবং সময়সূচি গ্রহণ করি। আমাদের সমস্ত ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ এবং অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের এবং প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের কয়েকটি কোম্পানীতে ভাগ করে দেয়া হয়।প্রায় ৩৫০ মাইল সীমান্তে(কুষ্টিয়ার উত্তর থেকে খুলনার দক্ষিণাংশে পর্যন্ত) আমাদের স্টাটেজিক দায়িত্ব ছিল কয়েকটিঃ

১। শত্রুর প্রতিরক্ষা ব্যূহগুলিতে শত্রুকে হয়রানি করা। ২। শত্রুর উপর অতর্কিত রেইড চালিয়ে কুষ্টিয়া জেলার উত্তর মাথা থেকে দক্ষিণে খুলনার সাতক্ষীরা- কলারোয়া রাস্তা অবধি কতগুলো বিশেষ সামরিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের মোতায়েন করা। এফ কোম্পানী কুষ্টিয়ার প্রাগপুর বিওপির বিপরীতে কমান্ডার প্রথমে ছিলেন লেফটেন্যান্ট জাহাঙ্গীর এবং আমি।৩। শত্রুর যোগাযোগ ব্যবস্থার বিঘ্ন সৃষ্টি করা, ব্যহত করা এবং সম্ভব হলে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া। ৪।শত্রুদের ছোট ছোট দলগুলোর উপর পেট্রল পার্টির অ্যামবুশ করা ইত্যাদি। মোটামুটিভাবে শত্রুর দুর্বল জায়গাগুলিতে অতর্কিত হামলা চালিয়ে সরে পড়াই আমাদের দায়িত্ব ছিল। যেসব জায়গায় সম্ভব হচ্ছিল আমরা বাংলাদেশের কিছু ভেতরে সামরিক প্রতিরক্ষাব্যূহও গড়ে তুলেছিলাম।

সি কোম্পানীঃ মেহেরপুর শহরের বিপরীতে কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী।

বি কোম্পানীঃ দর্শনার বিপরীতে, কমান্ডার ছিলেন তৎকালীন ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমান।

ডি কোম্পানীঃ চৌগাছার বিপরীতে, কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন হুদা।

এ কোম্পানী ছিল খুলনার ভোমরা বিওপির বিপরীতে,কমান্ডার ছিলেন প্রথমে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন এবং পরে ক্যাপ্টেন মাহাবুব উদ্দিন আহমদ।

এইচ কোম্পানী ছিল বেনাপোলের বিপরীতে, প্রথমে ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে আর কমান্ডার ছিলাম আমি নিজে। সর্ব দক্ষিণে জি কোম্পানী। সাতক্ষীরা- কলারোয়া রাস্তার বিপরীতে এই কোম্পানী মোতায়েন ছিল। কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন শফিউল্লাহ। এই সময় আমাদের হেডকোয়াটারে মুন্সিগঞ্জের এসি এ  ফ্লাইট লেঃ জামাল যোগ দেন।

এইরকম একটা সামরিক প্রতিরক্ষা ব্যূহ, যেটা এ কোম্পানী ভোমরা বিওপির আশেপাশে গড়ে তুলেছিল, তার উপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী আক্রমণ চালিয়েছিল ৩০শে মে তারিখে। প্রায় ১৭ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তার গোলন্দাজ বাহিনীকে ব্যবহার করে। মুক্তিযোদ্ধারা এই দৃষ্টান্তমূলক সাহসও সংকল্পের পরিচয় দেয়। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন এবং ক্যাপ্টেন মাহবুব এই যুদ্ধ  দক্ষতার সাথে পরিচালনা করেন। প্রায় তিন শতাধিক শত্রুসৈন্য একজন অফিসার সহ এই যুদ্ধে হতাহত হয়। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন শত্রুর কয়েকটি মৃতদেহ আমাদের কৃষ্ণনগর হেডকোয়াটারে পাঠিয়ে দিতে সক্ষম হন। সেদিন কৃষ্ণনগরের জনসাধারণ এই লাশ দেখার জন্য হেডকোয়াটারে ভেঙ্গে পড়েছিল এবং ভারতীয় সংবাদপত্রের প্রতিনিধিরা মৃতদেহ দেখতে এসেছিল।

এই সময় আমাদের মূল সাংগঠনিক কাজ চলতে থাকে। আর্মি হেডকোয়াটার থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে পূর্ণ শক্তিতে বলীয়ান করে তোলার। সমস্ত মুক্তিবাহিনীকে ২টা ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়।১। নিয়মিত বাহিনী (ক) সেন্টার ট্রুপস (খ) রেগুলার ট্রুপস ২। অনিয়মিত বাহিনী- গণবাহিনী।

 বেনাপোল পতাকা

পশ্চিম রণাঙ্গনে আমাদের সংগ্রাম এবং গৌরবের প্রতীক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়মাস পর্যন্ত বেনাপোল চেকপোস্টে বাংলাদেশের পতাকা উড্ডীয়মান ছিল। এই পতাকার পেছনের ছোট ইতিহাস আছে।

এপ্রিলের শেষদিকে যখন আমাদের জনশক্তি সীমান্তের অপর পারে চলে যায় তখনো বেনাপোল সীমান্তে উড্ডীয়মান পতাকাকে আমরা অসহায়ভাবে ফেলে যাইনি। মে মাসের প্রথমার্ধে যখন মুক্তিবাহিনীর সংগঠন এবং পুনর্বিন্যাস চলছিল তখন এই পতাকার সংরক্ষণের ভার নিয়েছিলেন ১৮-বিএস এফ এর কমান্ডার লেঃকর্নেল মেঈ সিং(বীরচক্র)। বাংলাদেশের পতাকার প্রতি এতদূর শ্রদ্ধা এবং সম্মানও অনুরাগ আমি আর কোন ভারতীয়দের মধ্যে দেখিনি। এই রাজপুত অফিসারটি আমাদের পতাকাকে সম্মান দিয়ে সমস্ত বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছিলেন এবং তিনি বারবার এই কথাই বলতেন। ১৮-বিএস এফ তাদের মেশিনগান দিয়ে এই পতাকাকে কভার করে রেখেছিল।মনে হয় একটি কাকপক্ষীও ভিড়তে পারেনি। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা বা গভীর রাতে মেশিনগান গর্জে উঠত, যদি তার আশেপাশে সামান্য গতিবিধি পরিলক্ষিত হত। মেশিনগানের আওয়াজ শুনলে আমরা বুঝতে পারতাম মেঈ সিং এর লোকজন তৎপর হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের এই পতাকার আশপাশ দিয়ে কত হাজার হাজার গোলাবর্ষণ হয়েছে। পতাকাকে ধ্বংস করার জন্য পাকিস্তানীদের সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।পাকিস্তানীদের এই অপচেষ্টাকে কেন্দ্র করে কতজন হতাহত হয়েছে তা বোঝা মুশকিল। এই পতাকা নিয়ে সীমান্ত সবসময় সরগরম থাকত। এ ছিল আমাদের  অনাগত দিনের বিজয়ের প্রতীক। প্রসঙ্গত উল্লেখ্যযোগ্য যে যশোর সেনানিবাসে যখন প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্ট আক্রান্ত হয়( আনুমানিক এপ্রিলের প্রথমার্ধে) মেঈ সিং তার১৮ বিএসএফ ব্যাটালিয়নকে নিয়ে বাংলাদেশের ভেতর স্বীয় অনুপ্রেরণায় ঢুকে পড়েন এবং ঝিকরগাছার কাছে তার বাহিনীর সাথে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে বিএসএফের কিছুসংখ্যক হতাহত হয় এবং কিছুসংখ্যক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। মেঈ সিং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢোকার এই সিদ্ধান্ত নিজে নিয়েছিলেন বিধায় ভারত সরকারের হাতে তাকে নাজেহাল হতে হয়েছিল। শুধু তাই নয় , এই সময় তিনি একবার গোপনীয়ভাবে ক্যাপ্টেন হাফিজের সাথে আমাদের চুয়াডাঙ্গা সদর দফতরও দেখতে আসেন।মেঈ সিং এর এই একগুঁয়েমি বেনাপোল চেকপোস্টে পরে মোতায়েনরত ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৭পাঞ্জাব ব্যাটালিয়ন সহ্য করতে পারত না। তারা কয়েকবার প্রস্তাবও করেছিল যে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে গোলাগুলি বন্ধ হোক। কিন্ত মেঈ সিং কোনদিন এই প্রস্তাব মেনে নেননি। পরে তাঁর ব্যাটালিয়নকে এখান অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়। কর্নেল মেঈ এর পথে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্ট এই পতাকা সংরক্ষণের দায়িত্ব নেন।

জুন-জুলাই মাসে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্ট বেনাপোল সীমান্ত থেকে জেড ফোর্সে যোগদান করার জন্য বাংলাদেশের উত্তর সীমান্তে চলে যায়। এই সময় বাংলাদেশের পতাকাটি বেনাপোলে সীমান্তে একটা স্বীকৃতি সত্য হয়ে গিয়েছিল। এরপর ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং আমার কোম্পানী মিলে এইচ কোম্পানী যৌথভাবে এই পতাকা সংরক্ষণের দায়িত্ব নেই। এবং বেনাপোল সীমান্ত থেকে প্রায় ৭০০/৮০০ গজ জায়গা নো ম্যান্স ল্যান্ড এ পরিণত হয়। আমার মনে আছে ‘ওমেগা’ রিলিফ দল যেদিন এই সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে তখন আমিও ২/৩ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে রাস্তার পাশ দিয়ে বড় গাছগুলোর আড়াল দিয়ে ক্রল করে এগুচ্ছিলাম। চার/পাঁচ গজ দূরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লোকজন এদের জন্য অপেক্ষা করছিল। রাস্তার পাশ থেকে এদেরকে আমরা পতাকা দেখাই এবং বলি যে এই এলাকা আমাদের দখলে আছে। ‘ওমেগা’ দল ভয়ে ডান, বাঁয়ে তাকাতে সাহস পায়নি। এইভাবে দীর্ঘ নয়মাস আমরা বেনাপোল পতাকাকে রক্ষা করেছিলাম এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কোনদিন এই পতাকা ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি। পতাকা যেখানে উড্ডীয়মান ছিল তার আশেপাশে পেট্রল পার্টি পাঠানো হত এবং তাদের সাথে পাকবাহিনীর প্রতিদিন গোলাগুলি বিনিময় হত। মে মাসে এই পতাকাকে সামনে রেখে বিবিসির প্রতিনিধিরা ক্যাপ্টেন হাফিজ এবং মেজর ওসমানের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন।

                                                                                                              স্বাক্ষরঃতৌফিক-ই- এলাহী চৌধুরী

১৪-১০-৭৩

**কুষ্টিয়ার মেহেরপুরে এসডিও থাকাকালীন অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।

 

মিনহাজ উদ্দিন

<১০, ১৬., ৩৭৬৩৭৭>

 

সাক্ষাৎকারঃ মেজর আবদুল হালিম

২২১১১৯৭৩

 

মুক্তিযুদ্ধকে অব্যাহত রাখার জন্য মে মাসের শেষদিকে ভারতীয় সীমান্তের বিভিন্নস্থানে শিবির স্থাপন করা হয়।আমাকে ৩রা জুন ১৯৭১ সালে দক্ষিণ পশ্চিম সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত করেন। শিকারপুর সাব সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হওয়ার পর আমাকে১ কোম্পানী ইপিআর, মুজাহিদ দেওয়া হয়। আমার সহ-অধিনায়ক হিসেবে কাজ করেন ইপিআর বাহিনীর সুবেদার মজিদ।

(১)শিকারপুর সীমান্ত দিয়ে প্রথম অপারেশন করা হয় বাংলাদেশের ভিতরে সাহেবনগর নামক স্থানে। সেখানে পাকবাহিনীও রাজাকাররা স্থানীয় মানুষের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগও পাশবিক অত্যাচার করছিল। এই সংবাদ পেয়ে গভীর রাতে ২ প্লাটুন নিয়ে তাদের উপর আক্রমণ করি। আমাদের আক্রমণে পাকবাহিনী রাজাকার সহ ২৬জন নিহত হয়। সেখান থেকে কিছু গোলাবারুদ নিয়ে রাত্রেই সীমান্ত অতিক্রম করে শিকারপুর চলে যাই।

(২)কাজীপুরে পাকবাহিনী কর্তৃক আমাদের ডিফেন্স আক্রমণঃ কাজীপুরে সুবেদার মজিদের নেতৃত্বে আমাদের যে এক প্লাটুন ইপিআর ছিল পাকবাহিনী চতুর্দিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলে। এই সংবাদ পেয়ে আমরা আরও ২ প্লাটুন নিয়ে তাদেরকে সাহায্য করতে এগিয়ে যাই। সেখানে আমাদের পরবর্তী ২ প্লাটুন পাকবাহিনীর অবস্থানের উল্টা দিক থেকে তাদের উপর তীব্র আক্রমণ করে। পাকবাহিনীর সাথে এই যুদ্ধে রাজাকাররা বাহিনীও অংশগ্রহণ করে, কিন্তু আমাদের চতুর্দিক থেকে আক্রমণের মুখেও রাজাকার বাহিনীও পাকবাহিনী মর্টার থেকে অনবরত গোলা নিক্ষেপ করে। আমাদের সাথে পাকবাহিনীর সারারাত যুদ্ধ হয়। পাকবাহিনী কাজীপুর ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। বহু খানসেনা নিহত হয়। বহু অস্ত্রও গোলাবারুদ আমরা দখল করি তাছাড়া বাংলাদেশের ভিতরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পথে সেতুও কাঠের পুল নষ্ট করে দেইও রাজাকারদের পেট্রোলিং পার্টির উপর রেইড করি।

জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে আমাকে শিকারপুর সাবসেক্টর থেকে বনগাঁও সাবসেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। শিকারপুরের কমান্ডার নিযুক্ত হন কমান্ডার লেঃ জাহাঙ্গীর সাহেব।

বনগাঁও সেক্টরে আমার থাকাকালীন সময়ে প্রথম অপারেশন হয় রঘুনাথপুরে। পাকবাহিনীর পেট্রোলিং পার্টির উপর এমবুশ করে ২৫ জন খানসেনা হত্যা করা হয় ও তাদের তাদের হাতিয়ার নিয়ে আসা হয়। সেই সময়ে এই সংবাদ বাংলাদেশ রেডিও হতে প্রচার করা হয়।

১২ ই আগস্ট ধোপাখালী বিওপিতে পাকবাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করা হয়। উক্ত আক্রমণে পাকবাহিনী বিওপিতে পালিয়ে যায়। আমরা সেখানে ডিফেন্স স্থাপন করি এবং শেষ পর্যন্ত পোটখালী বিওপি আমাদের দখলে থাকে।

৩১শে আগস্ট ধোপাখালী বিওপি থেকে কয়েক মাইল ভিতরে বাঘছড়া থানা হেড কোয়াটারে রাজাকার বাহিনীর ডিফেন্স আক্রমণ করি। কিন্ত রাজাকাররা আমাদের সংবাদ পূর্বে পেয়েই পালিয়ে যায়। আমরা তাদের মালপত্রও রেশনে অগ্নিসংযোগ করি। তাছাড়া ৪ টি সরকারী পাটগুদামেও অগ্নিসংযোগ করি। পথে একজন শান্তি কমিটির সদস্যের বাড়ী থেকে ৪টি বন্দুক সহ চারজন রাজাকারকে ধরে নিয়ে আসি।

 

মিনহাজ উদ্দিন

<১০, ১৬., ৩৭৭৩৭৯>

সাক্ষাৎকারঃ অলীক কুমার গুপ্ত*

কর্নেল মঞ্জুর সাহেব ১১ই অক্টোবর তারিখে বাংলাদেশের ম্যাপ দেখালেন এবং কোথায় কোথায় অপারেশন করতে হবে তার নির্দেশ দিলেন। ১৪ই অক্টোবর কর্নেল মঞ্জুর সাহেব অপারেশনের জন্য ৩৮৫ জন গণবাহিনীর যুবককে তাদের সেক্টরে পৌঁছে দেয়ার ভার দিলেন আমার উপর। এদের নিয়ে বয়রা সাবসেক্টরে এসে মেজর নজমুল হুদার নিকট রিপোর্ট করি। ১৫ই অক্টোবর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান ও পাক বাহিনীর অবস্থান পর্যবেক্ষণ করি এবং সিদ্ধান্ত নিই যে, ভারতের মধ্যে না থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকাই শ্রেয়। আমি কাশীপুরে হেডকোয়াটার স্থাপন করি এবং আমার এলাকা ছিল দক্ষিণ বেনাপোল রোড, বামে মহেশপুর থানা, জীবননগর থানা। ঝিকরগাছা থেকে বামে রাধানগরে আমার মেইন বেইস ছিল। ভারতীয় সীমান্ত থেকে চার মাইল দীর্ঘ পথ গণবাহিনীর সাহায্যে মুক্ত করি এবং সেখানে জার্মান রাষ্ট্রদূত আসেন এবং বাংলাদেশে মন্ত্রী মহোদয়গণও এসে দেখে যেতেন। অক্টোবর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে মধুখালী গ্রামের নিকট এই দলটি পাকবাহিনীর এমবুশে পড়ে যায়। সেখানে ৩ জন আহত হয়। গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পিছনে চলে গিয়ে কোন রকমে জীবন রক্ষা করি। অক্টোবর মাসের শেষদিকে পাকবাহিনীর ডিফেন্স দোষদিনাতে সন্ধ্যার দিকে আক্রমণ করি। এই যুদ্ধে গণবাহিনীর ১৫ জন গেরিলা অংশগ্রহণ করেন। এই আক্রমণে  ৫টা চাইনিজ রাইফেল ও কিছু হেলমেট এবং খাদ্য আমাদের দখলে আসে।জনসাধারণের মুখে জানা যায়, প্রায় ১০জন খানসেনা নিহত হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে ১জন গেরিলা আহত হন। এই যুদ্ধে সেকেন্ড কমান্ডার ছিলেন আবদুল জলিল(সাবেক ইপিআর)।

অক্টোবরের শেষে ঝিকরগাছার ২ মাইল দূরে শিমুলিয়া সাহেব বাড়িতে পাকবাহিনী সহ ২০ জন রাজাকার ঘাঁটি করে অবস্থান করছিল। সেই ঘাঁটি থেকে পেট্রোল ডিউটিতে আসে ১০জন পাকসেনা সহ রাজাকার। এই দলের উপর আক্রমণ চালাই এবং ৩জন খানসেনা, ১জন বিহারী রাজাকার নিহত হয় এবং একজন রাজাকার আহতও তিনজন জীবন্ত ধরা পড়ে। পরে উক্ত তিনজন রাজাকার মুক্তিবাহিনীর সাথে কাজ করে। এই আক্রমণের ফলে পাকসেনারা ঐ মিশন ছেড়ে পালিয়ে যায়। পরে নভেম্বর মাসের দিকে পাকসেনারা ভারী অস্ত্রশস্ত্র পুনরায় ঐ গ্রামে আক্রমণ করে এবং তিন ব্যক্তিকে হত্যা করে ও বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। পাকসেনারা সাবেক ইপিআর আবদুল জলিল ভ্রমে উক্ত তিনজনকে হত্যা করেছিল। তার পূর্বে উক্ত এলাকা থেকে আমাদের দল চলে যায়।

৩রা নভেম্বর ১২ জন গণবাহিনী ও সাবেক ইপিআর ৩০ জনকে নিয়ে ভোরের দিকে চৌগাছার বিওপির সামনে এমবুশ পেতে রাখি। সেই সময় উক্ত বিওপি পাকসেনাদের দখলে ছিল। পাকসেনাদের একটা পেট্রোল পার্টির সাথে সংঘর্ষ শুরু হয় সকাল ৯টা থেকে। যখন পেট্রোল পার্টি ধ্বংস হয়ে যায়, তখন তাদের সাহায্যের জন্য উক্ত বিওপি ক্যাম্প থেকে বহু পাকসেনা এসে আমাদের দলটি ঘিরে ফেলে এবং যুদ্ধ চলতে থাকে। নিরুপায় হয়ে তখন আমিও আমার দলবল বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করতে থাকি। এই সংবাদ পেয়ে সাবেক মেজর নজমুল হুদা মুক্তিফৌজ ক্যাম্প থেকে যুবকদের নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে আসেন এবং আমাদের সাহায্য করেন। ভারতীয় সৈন্যরা দূর থেকে ৩ ইঞ্চি মর্টার দিয়ে মুক্তিফৌজকে সাহায্য করেন। যদিও এমবুশ করে আমাদের ফিরে যাবার ইচ্ছা ছিল কিন্ত তা সম্ভব না হওয়াতে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এর ফলে পাকসেনারা উক্ত বিওপি ছেড়ে পালিয়ে যায়। এই যুদ্ধে প্রায় ১৮/১৯ জন মৃত পাকসেনার লাশ নিয়ে যেতে সক্ষম হই। পরে জনসাধারণের আরো প্রায় ২০ জন পাকসেনার লাশ বিভিন্ন এলাকা উদ্ধার করে। স্টেনগান, চাইনিজ রাইফেল, এলএমজি ও ছোট একটা অয়ারলেসও উদ্ধার করি। এই যুদ্ধে একজন সাবেক ইপিআর ল্যান্স নায়েক আহত হন। পরে হাত কেটে তাকে বাঁচানো হয়।

১২ই নভেম্বর সন্ধ্যার সময় চৌহগাছা চোরামনকাটির মাঝামাঝি রোডে একটি গাড়ি সহ রোডের ব্রীজ সহ উড়িয়ে দিই আমিও আমার তিন সঙ্গী।

গুলবাগপুর গোয়ালহাট নামক স্থানে পাকসেনারা আমাদের দলের উপর ঈদের দিন আক্রমণ করে তা দখল করে নেয়। এই যুদ্ধে ৯জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন এবং ৩ জন গণবাহিনীসহ ৩জন মানুষও শহীদ হন। জনসাধারণ আহত মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যায়। জনসাধারণ সেই সময় এই এলাকাতে সব কাজ করেন মুক্তিবাহিনীর পক্ষে। সেই দিন কর্নেল মঞ্জুর ৬/৭ ঘণ্টার মধ্যে হৃত এলাকা পুনরুদ্ধার করার হুকুম দেন। আমার আক্রমণকালে পাক বিমান আক্রমণ করে। পরে ভারতীয় সৈনিকের সাহায্যে উক্ত এলাকা পুনরায় দখল করি। এরপর আমি মিত্রবাহিনীর সাথে কাজ করতে থাকি। ভারতীয় বাহিনীর আগে এবং পাকবাহিনীর সামনে থেকে মিত্রবাহিনীকে সাহায্য করি।

২৪শে নভেম্বর গরীবপুর গ্রামে মিত্রবাহিনীর সাথে ট্যাংক যুদ্ধ হয়। সেই সময় পাকিস্তানী ১৪টি ট্যাংক ছিল। এই যুদ্ধে ৫টি ভারতীয় ট্যাংক নষ্ট হয়ে যায়।পাকিস্তানী সমস্ত ট্যাংক নষ্ট হয়ে যায়। ১৪টি ট্যাংকের মধ্যে ৮টিকে ভারত নিয়ে ছবি তোলা হয়। ২৬শে নভেম্বর চৌগাছা মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে।

৩রা নভেম্বর আমি কামাল ও  তৌফিক সাহেব মিলে নাভারন ও ঝিকরগাছা রোডের মধ্যবর্তী স্থানে একটি জীপগাড়ি উড়িয়ে দিই। ২জন খানসেনা নিহত হয়।

৭ই ডিসেম্বর যশোর মুক্ত হয়। ৩ইঞ্চি মর্টার বাহিনী নিয়ে আমি নড়াইল যাই। সেখানে ১৫০জন পাকসেনা আত্মসমর্পণ করে।

                                                                                                                                       স্বাক্ষরঃ অলীক কুমার গুপ্ত

যশোর সেনানিবাস

২৮-৩- ৭৩

*১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত।

 

 

 

 

মিনহাজ উদ্দিন

<১০, ১৬., ৩৭৯>

সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার মেজর তবারক উল্লাহ

২৮১৯৭৪

সেপ্টেম্বর মাসের ১৬তারিখ রাত বারটার সময় আমি এবং ক্যাপ্টেন শফিক উল্লাহ এক কোম্পানী মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বোয়ালিয়া বাজারের কাছে বেলে ডাঙ্গার পশ্চিম দিকে পাকবাহিনীর একটি প্রতিরক্ষাব্যূহে আক্রমণ চালাই। চারদিন পর্যন্ত তুমুল লড়াই চলে। এই যুদ্ধে আমাদের পক্ষে সিপাহী মতিয়ুর রহমান, ল্যান্স নায়েক আবুল হাশেম, ল্যান্স নায়েক শফিক উদ্দিন চৌধুরী,শাহাদাতবরণ করেন। কয়েকজন বেসামরিক ব্যক্তিও শাহাদাত বরণ করেন। পাকিস্তানীদের পক্ষেও অনেকে হতাহত হয়। আমাদের একটি  কোম্পানী উপর শত্রুদের ৪টি কোম্পানী আক্রমণ চালায়। ক্যাপ্টেন শফিক উল্লাহ এই যুদ্ধে আহত হন।

মিনহাজ উদ্দিন

<১০, ১৬., ৩৭৯৩৮০>

সাক্ষাৎকারঃ নায়েক সুবেদার আবদুল মতিন পাটোয়ারী

মুজিবনগর গার্ড অব অনার দেওয়ার পর আমি ক্যাম্পে ফিরে যাই এবং সেখান থেকে আবার যুদ্ধে অংশ নেই। ২০শে মে তারিখে আমি আমার পেট্রোল নিয়ে মুজিবনগরে ছিলাম।খবর পেলাম পাকসেনাদের একটি প্লাটুন বল্লভপুর মিশনারী চার্চে এসেছে লুটতরাজ করতে। আমি আমার প্লাটুনকে দুই ভাগে ভাগ করে একটিকে নিয়ে আমি নিজে বাগুয়ানে এমবুশ করে থাকি, অপর দলটিকে বল্লভপুর রোডে জংশনে বসিয়ে রাখি। বেলা দেড়টার সময় পাকসেনারা ফিরছিল। আমি আক্রমণ করে বসি। প্রায় এক ঘণ্টা যুদ্ধ হয়। পাকবাহিনীর ১৭ জন নিহত ও ৫ জন আহত হয় এবং ১টি গাড়ি সহ বহু অস্ত্র উদ্ধার করি।

আমি মুজিবনগরে পাক্কা ঘাঁটি করে থাকতাম। ৩রা জুন তারিখে পাকবাহিনীর  ৫০০/৬০০ সৈন্য ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ব্যাপক আক্রমণ করে বেলা ৪ টার সময়। আমাদের মোট সৈন্য সংখ্যা ছিল মাত্র ৪০ জন। একটি দল ছিল আমার নেতৃত্বে। অপরটি ছিল নায়েক সুবেদার তফাজ্জল হোসেনের নেতৃত্বে। পাকসেনারা সারিবদ্ধভাবে বাগুয়ানে কিছু প্রস্তুতি রেখে আমাদের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পাকসেনাদের আক্রমণে আমরা টিকতে ব্যর্থ হই।পিছু হটতে থাকি।একসময় পাকসেনারা আমাদের ঘাঁটি দখল করে নেয়। আমাদের ঘাঁটি দখলের পর পাকসেনারা ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্তভাবে আমাদের ঘর দুয়ারে আগুন লাগিয়ে দেয় আমরা তা দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি পুনরায় কিছু জওয়ান নিয়ে পিছন দিক থেকে আখক্ষেতে বসে সামরিক কায়দায় বড় রকমের আক্রমণের কমান্ড দেই। উদ্দেশ্য ছিল এটা বোঝানো যে আমরা বহু আছি। সাথে সাথে এলএমজি ব্রাশ চালাতে থাকি। এতে বহু পাকসেনা খতম হয়। বাকিরা সব পালাতে থাকে। পাকসেনারা পজিশন নেবার সুযোগ পায় না। আমরা আবার ঘাঁটি দখল করে নেই। পাকসেনা খতম হয় ২৮ জন, ২০জন আহত হয়। আমাদের পক্ষের কেউ হতাহত হয়নি। তারপর ১৪ই জুন, ২০শে জুন ও ২১শে জুন তারিখে পাকবাহিনীর সাথে আমাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। একদিনের যুদ্ধে আমাদের কোন হতাহত হয়নি। পাকবাহিনী বেশকিছু ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে।

১৭ই জুলাই তারিখের ঘটনা। আমাদের ইনফরমার ছিল ভাদু মণ্ডল। গোপালনগরে সে পাকসেনাদের সাথে থাকত। ভাদু মণ্ডল লোক মারফত খবর পাঠায় যে, ২৭শে জুলাই তারিখে ১০/১৫ জন পাকসেনা তার গরুর গাড়ী করে রেশন নিয়ে  মানিকনগরে যাবে নটোদা থেকে। ভাদু মণ্ডল বলে পাঠায় তার গাড়োয়ান যেন না মরে। আমি ১৫ জন নিয়ে একজন সিভিল গাইডের সহায়তায় অগ্রসর হয়ে বাগুয়ান এবং রতনপুর ঘাটের নিকটে এমবুশ করে বসে থাকি। গাইডও আমাদের সাথে ছিল। ভোর ৬টায় আমরা রেশন নিয়ে যাওয়া পার্টির উপর আক্রমণ করি। যুদ্ধ ১ ঘণ্টা স্থায়ী হয়। মানিকনগরেও নাটোদা হাইস্কুলে পাকবাহিনীর ঘাঁটি ছিল। গোলাগুলির শব্দে পাকবাহিনীর দুটি পার্টি এসে আমাদের ঘিরে ফেলে। মানিকনগরে অবস্থিত পাকবাহিনীর উপর অপর দল আক্রমণ চালিয়ে পাকবাহিনীকে ব্যস্ত রাখে। আমাদের হ্যান্ডস- আপ করতে বলে। আমি বলি, ক্ষমতা থাকে তো এসে ধর। সামনা সামনি গোলাগুলি চলছে, ফায়ার করছি আর পিছু হটছি। আমাদের গাইড পিছনে পড়ে যায় এবং তাকে ধরে ফেলে। ঐ দিন বিকেলে ঐ অঞ্চলের সব লোকজন ডেকে নাটোদা স্কুলে দুহাত বেঁধে সবার সামনে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুচিয়ে তাকে অত্যন্ত  নৃশংসভাবে হত্যা করে।পাকবাহিনী ঘোষণা করে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করলে এমন শাস্তি দেওয়া হবে। আমরা সবাই মূল ঘাঁটিতে আসতে সমর্থ হই।

২০শে জুলাই থেকে ৩০শে জুলাই পর্যন্ত আমি দল নিয়ে মানিকনগরে পাকবাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করি। রাতে এই অপারেশনগুলোতে বেসামরিক লোক যারা ছিল তাঁদের সাহসিকতায় আমি ও আমার অফিসাররা চমকিত হয়েছিলাম। দিনের বেলায় মেহেরপুর ঢুকে বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুর উপর সার্থক অপারেশন চালিয়ে তারা ভরা নদী সাঁতরে ফিরে এসেছে, পাকবাহিনীর বাঙ্কারে ঢুকে বিভিন্ন গ্রেনেড ছুঁড়েছে। এঁদের ত্যাগ সাহসিকতা মনে রাখার মত। লোকগুলো ছিলঃ (১) মোঃ সারি(২) রবী মণ্ডল (৩) মফিজ উদ্দিন (৪) রওশন আলী (৫) বরকত আলী (৬) জামান আলী (৭) নায়েক আলী । আরও অনেকের নাম এই মুহূর্তে মুনে পড়ছে না। একেক রাতে ৩/৪ বার অপারেশন করেছি।এই কয়েকদিনের অপারেশনে ৭০ জন পাকসেনা খতম  হয়।

৩রা আগস্ট তারিখে পাকসেনারা মানিকগঞ্জ ঘাঁটি ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। পাকসেনারা মোনাখালী ঘাটে এসে আবার ঘাঁটি গাঁড়ে। আমি মানিকগঞ্জ ঘাঁটি দখল করি। বহু মাইনও অন্যান্য গোলাবারুদ উদ্ধার করি।

১৩রা আগস্ট তারিখে পাকবাহিনীর একটি দল তাদের প্রতিরক্ষা মজবুত করা এবং গ্রেনেডের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কাঁটাতার নিয়ে যাচ্ছিল। আমি আমার পার্টি নিয়ে আক্রমণ করে বেশকিছু হতাহত করি।

২৪শে আগস্ট তারিখে পাকবাহিনীর একটি কোম্পানী নাটোদা থেকে মুজিবনগরের পথে  অগ্রসর হই। আমি একটি পার্টি নিয়ে বাগুয়ানে এবং অপরটি মানিকনগরে।সকাল দশটার সময় ওরা আমাদের আওতায় চলে আসে। আমরা ফায়ার ওপেন করি।যুদ্ধ প্রায় আড়াই ঘণ্টা হয়। পাকসেনারা ৯জন নিহত ও বেশকিছু আহত হয়ে পিছু হটে। আমাদের একজন এলএমজি ম্যান আহত হয়। যুদ্ধ চলা অবস্থায় ওখানকার ছোট ছোট ছেলেরা গোলাবারুদ মাথায় করে আমাদের সাপ্লাই দিত। অঞ্জলি নামে একজন খ্রিষ্টান নার্স সব সময় আমাদের সেবা শুশ্রূষা করতো। সে আগে গ্রাম রেকি করে আমাদের খবর দিত। সব সময় প্রথম সারিতে থাকতো।

এরপর ৯নং সেক্টরকে সাহায্য করার জন্য ক্যাপ্টেন এ আর আযম চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি কোম্পানী নিয়ে সেপ্টেম্বর মাসে খুলনা যাই। ওখানে ৮/১০ দিন বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেই। সেপ্টেম্বর মাসেই আমি মুজিবনগরে ফিরে আসি। তারপর ৩রা নভেম্বর মানিকনগর, ৬ই নভেম্বর রশিপুর ঘাট, ১২ই নভেম্বর মোনাখালী ঘাট, ১৮ই নভেম্বর রশিপুর ঘাটে, ১৯শে নভেম্বর মানিকনগর ঘাটে, ২৬শে নভেম্বর রশিপুর ঘাট, ৩০শে নভেম্বর রাজাপুর ঘাট, ১লা ডিসেম্বর রাজাপুর, ৩রা ডিসেম্বর রাজাপুর প্রভৃতি স্থানে আমার নিজের কমান্ডে যুদ্ধ করেছি। তারপর যৌথ অপারেশনে অংশ নেই।

স্বাক্ষরঃ আবঃ মতিন পাটোয়ারী

২১-১০-৭৪

 

মিনহাজ উদ্দিন

<১০, ১৬., ৩৮১>

সাক্ষাৎকারঃ ক্যাপ্টেন আবদুল গনি*

১০৭৯

একটি রেইডঃ ৪ঠা ডিসেম্বর হরিণাকুণ্ড থানার উপর তারা যখন রেইড করে তখন তাদের সাথে আমি ছিলাম। রেইড করার পর তারা যখন সেখানে বসে যায় তখন আমাকে তারা বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসে।

প্রশ্নঃ সেখানে কি নিয়মিত বাহিনী ছিল, না রাজাকার ছিল?কি জন্য রেইড করেছিল?

উত্তরঃ সেখানে কোন নিয়মিত বাহিনী ছিল না। সেখানে ২০/৩০ জন রাজাকার এবং কিছু পুলিশ ছিল। এদের মধ্যে কয়েকজন রাজাকার ধরা পড়েছিল। পুলিশদের ধরা যায়নি, তারা পালিয়ে গিয়েছিল এবং যে কজন রাজাকার ধরা পড়েছে তাদের ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মেরে ফেলা হল।

প্রশ্নঃ কতক্ষণ গুলি বিনিময় হয়?

উত্তরঃ সেদিন হাটবার ছিল। সন্ধ্যার পর যখন ভেঙ্গে গেছে তখন সাধারণ লোকের মাঝে মিশে গিয়ে পুরো থানাকে ঘিরে ফেলি। কমান্ডার প্রাক্তন হাবিলদার আবদুর রহমানের নির্দেশ ছিল তিনি প্রথমে গুলি করলে তারপর চারদিক থেকে গুলি করা শুরু হবে। রাত ৯টার সময় সাধারণ লোকজনও বাইরে ছিল না। তখন আমরা পজিশন নিয়ে ফেলেছিলাম। আমরা সেখানে ৭০জন ছিলাম। রাত ৯টার সময় কমান্ডার প্রথম ফায়ার করেন, তারপর আমরা চারদিক থেকে ফায়ার শুরু করি। প্রায় আধা ঘণ্টা ফায়ার চলতে থাকে। তারপর আমাদের পক্ষ থেকে যখন অটোমেটিক গান চালানো শুরু হয় তখন তারা আর না পেরে ফায়ার বন্ধ করে যে যেদিকে পেরেছে পালিয়ে গেছে। কিন্ত চারজন রাজাকার পালাতে না পেরে আমাদের কাছে ধরা দিয়েছে।

প্রশ্নঃ অটোমেটিক আর্মসের মধ্যে কি কি ছিল আপনাদের কাছে?

উত্তরঃ অটোমেটিক আর্মসের মধ্যে একটি লাইট মেশিনগান এবং কয়েকটা ইন্ডিয়ান এলএমজি ছিল, সেমি অটোমেটিক ছিল, এসএলআর ছিল। রাজাকারদের কাছে শুধু রাইফেল ছিল, অটোমেটিক কিছু পাওয়া যায় নাই।

প্রশ্নঃ থানা কি ক্যাপচার করে ফেলেন?

উত্তরঃ জী হ্যাঁ, পুরো থানাটা ক্যাপচার করে ফেলি। ওদের অস্ত্রাগারে যাই। ভেঙ্গে সব আর্মস এমুনিশন আমাদের ওখানে নিয়ে আসা হয়।

প্রশ্নঃ গ্রামের লোকজন আপনাদের খুব সহযোগিতা করেছে?

উত্তরঃ আমাদেরকে পুরো থানার লোকজন খুব সহযোগিতা করেছে। তারা নানা ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে- যেমন আর্মিরা কোথায় আছে, রাজাকাররা আর্মিদের সাথে কোথায় যাচ্ছে এই খবর সংগ্রহ করে আমাদের কমান্ডার আবদুর রহমানের কাছে জানাতো। কমান্ডার সেই মত কাজ করতেন- কবে,কিভাবে, কোথায় রেইড করতে হবে।

*প্রকল্প গৃহীত সাক্ষাৎকার থেকে সংকলিত।

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৭। ৯নং সেক্টরে সংঘটিত যুদ্ধের বিবরণ মেজর (অবঃ) এম এ জলিল রচিত ‘সীমাহীন সমর’ (১৯৭৪) ১৯৭১

<১০, ১৭, ৩৮২-৪২১>

দীপংকর ঘোষ দ্বীপ <৩৮২-৩৯০>

হুসাইন মুহাম্মাদ ইশতিয়াক <৩৯১-৪১০>

আল্লামা বোরহান উদ্দিন শামীম <৪১০৪২১>

 

প্রতিবেদনঃ মেজর (অবঃ) এম.. জলিল

                                  বরিশালের রণাঙ্গন

 

১০ই এপ্রিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বরিশাল, পটুয়াখালি, ফরিদপুর ও খুলনা এই চারটি জেলার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আমাকে সেক্টর কমান্ডার ঘোষণা করা হয়। ঘোষণায় আরও উল্লেখ করা হয় যে, যুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চীফ কর্নেল এম এ জি ওসমানীর তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশকে ৬টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছে। মিঃ তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট করে চার সদস্যের একটি অস্থায়ী সরকার ‘মুজিব নগরে’ গঠন করার কথাও স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে ঘোষণা করা হয়। ব্যাপার যাই হোক না কেন, এই ঘোষণার ফলে বাংলার জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধারা সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য অন্ততঃ একটা ভিত খুঁজে পেল। শুরু হল পাকিস্তানী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ। ইতিমধ্যে ১৭ই এপ্রিল একজন পাকিস্তানী গোয়েন্দা বরিশালে গ্রেফতার হয়। আমাদের অবস্থানগুলো ও প্রস্তুতির খবরাখবর সংগ্রহ করার জন্য পাক-সামরিক বাহিনীর লেঃ কর্নেল শামস উক্ত গোয়েন্দাকে খুলনা থেকে বরিশালে পাঠায়। উক্ত গোয়েন্দাকে যে পুরস্কার দিতে পেরেছিলাম সেটা হলো কঠিন মৃত্যু। বরিশাল স্টেডিয়ামে জনতার সামনে প্রকাশ্যে তাকে গুলি করে হত্যা করা হল। তার অপরাধ ছিল ক্ষমার অযোগ্য।

বোধ হয় ১৭ই এপ্রিলের ঘটনার ফলশ্রুতিস্বরুপ পাক-বিমান বাহিনীর দু’খানা স্যাবর-জেট ফাইটারকে বরিশালের আকাশ দেখা গেল। এই প্রথমবারের মতো হিংস্র সামরিক জান্তা আমাদের যুদ্ধ প্রস্তুতির উপর আঘাত আনার সাহস পেল। ওই জঙ্গী বিমানগুলোকে ঠেকাবার মতো আমাদের হাতে অনেক কিছু ছিল না। তবুও আমাদের সাহসী মুক্তিযোদ্ধারা সামান্য রাইফেল দিয়ে গুলি করার অনেক চেষ্টা করলো। শহরের বিভিন্ন বেসামরিক অবস্থানের ওপর নির্বিচারে গোলাবর্ষণ করলো। বেলস পার্কের উত্তর দিকে ইংরেজ আমলের একটি উঁচু কাঠের ঘরে হেডকোয়ার্টার। এই ঘর ও বেলস পার্কের উপর প্রচণ্ড গোলা এসে পরতে লাগলো। এই পার্কের মধ্যেই ছেলেরা ট্রেনিং নিত। ছেলেরা ট্রেঞ্চের ভিতরে ঢুকে আত্মরক্ষা করলো। দু’একটি ছোটখাট আঘাত ছাড়া আমাদের তেমন বিশেষ কোন ক্ষতি হয়নি। জঙ্গি বিমান দুটো যখন ঘুরপাক খেয়ে গুলিবর্ষণ করার জন্য নিচে নেমে আসে তখন বেসামরিক লোকজন বাইরে লাফিয়ে এসে মজা দেখতে থাকে। এই সরল মানুষগুলো এর আগে কখনও ভাবতে পারেনি যে, ওই সুন্দর সুন্দর বিমানগুলো এমন নির্মমভাবে দংশন করতে পারে। অজ্ঞতা ও সরলতার জন্য ওরা অনেক ভুগছে। বেসামরিক ডাক্তাররা ভয়ে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করতে লাগলো। মুহূর্তের ভেতরে গ্রামের দিকে ছুটে চললো মানুষের কাফেলা। ভয়ে সব ফেলে শহর খালি করে উন্মাদের মত দৌড়াতে লাগলো শহরতলীর দিকে। কি মর্মান্তিক দৃশ্য।

১৮ই এপ্রিল রাত্রে বিষাদের কালোছায়া শহরের সারা আকাশটা গুমোট করে ফেললো। শহরের রাস্তাগুলো জনমানবশূন্য। ভীষণ নীরব। কোথাও জীবনের স্পন্দন নেই। যেন ঘুমন্ত প্রেতপুরী। রাতে ভয়ানক অস্বস্তিবোধ করলাম। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটা বেশ বড় বাহিনী তৈরি করলাম। কিন্তু সামান্য কিছু রাইফেল জোগাড় করেছিলাম। এসব হালকা অস্ত্র দিয়ে শুধু আত্মরক্ষা করা চলে। যা হোক, এপ্রিল মাসের ২২ তারিখে মিঃ মঞ্জু সুন্দরবনের গোপন পথ দিয়ে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ভারত হতে কিছু অস্ত্রপাতি নিয়ে এলেন। তিনি জানালেন যে, আরো ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাকে গিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছ থেকে ওগুলো নিয়ে আসতে হবে। সংবাদটা শুনে খুবই উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। এই সুযোগে সুন্দরবন, বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারত থেকে অস্ত্র নিয়ে আসা সম্ভব হবে। এই দুর্যোগময় মুহূর্তেও আমার ছোট্ট মনটি অপার উৎসাহে চোখ ফাঁকি দিয়ে অস্ত্র নিয়ে আসবো। লেফটেন্যান্ট মেহেদী, লেঃ জিয়া এবং লেঃ নাসেরকে যথাক্রমে পটুয়াখালী, বরিশাল ও খুলনায় যুদ্ধ চালিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়ে ক্যাপ্টেন হুদাকে সাথে নিয়ে ভারত রওনা হলাম।

                                  গুপ্ত পথে যাত্রা

সুন্দরবন বাংলাদেশের বিখ্যাত অরণ্যানি। এই সুন্দরবনের গোপন পথ ধরেই আমার ভারত যাত্রা শুরু হলো। রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিতাবাঘ, হরিণ ও অজগরে সুন্দরবন ভরপুর। জানা-অজানা অনেক শংকা ও বিপদের ঝুঁকি দিয়ে ছোট একটি লঞ্চ, পথের জন্য সপ্তাহের কিছু রেশন ও অন্যান্য জিনিসপত্র আমরা যাত্রা শুরু করলাম। সবাই মিলে লঞ্চে আমরা বিশজন নাবিক ছিলাম। এদের মধ্যে দু’জন প্রকৃত যুদ্ধ করার মত। পনের থেকে বিশের মধ্যে এদের বয়স। আগে সেনাবাহিনীতে ছিল। নাম সিদ্দিক ও জব্বার। আমাদের বলা হয়েছিল সুন্দরবনের চারপাশে পাকিস্তানী হানাদাররা ‘গানবোট’ নিয়ে পাহারা দিচ্ছে। আর বাংলাদেশের নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর বর্বরের মতো নির্বিচারে গোলাবর্ষণ করে ভয়ানক সন্ত্রাসের সৃষ্টি করছে। সন্ধ্যার দিকে অনেক দূরে ‘পশুর’ ও ‘শিপ্সা’ নদীর মোহনায় হঠাৎ করে একটা গানবোট চোখে পড়লো। এই বিরাঠ নদী দুটো অতিক্রম করে আমাদের নিরাপদ জায়গায় যেতে হবে। সামনেই দিগন্তবিস্তৃত বঙ্গোপসাগর। ‘পশুর’ ও ‘শিপ্সা’ এই বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে। অন্ধকারে বিশাল জলরাশির দৃশ্য ভয়ংকর ও ভীতিপ্রদ। একটা প্রেতপুরীর মতো। দলের অধিনায়ক হিসেবে আসন্ন বিপদের ভয়কে চেপে গিয়ে আত্মবিশ্বাসকে ঘা দিয়ে চাংগা করে তুললাম। আমাদের লঞ্চের প্রধান পাইলট কিছুদিন আগেও একজন চোরাচালানী ছিল। জংগলের সব গোপন রাস্তা তার নখদর্পণে। তাকে বললাম যদি কোন পথ থেকে থাকে তাহলে লঞ্চের গতি সেই দিকেই ঘোরাতে। সে আমার আদেশ মানলো। আমি আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলাম। পরদিন ভারতের সীমান্তবর্তী চৌকি ‘পারগোমতী’ এসে পৌছলাম। ভারতের সীমান্তরক্ষীরা আগেই আমাদের আসার খবর পেয়েছিল। তারা আমাদের আসার বৈধতা পরীক্ষা করে সামনে এগুবার অনুমতি দিল।

২৪শে এপ্রিল ভোরে ‘পারগোমতী’র একটা জায়গায় ভারতীয় সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর ইন্সপেক্টর মিঃ পি কে ঘোষ আমাদেরকে বিদায় সম্ভাষণ জানালেন এবং অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে যোগাযোগের পর ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সতর্ক পাহারায় ক্যাপ্টেন হুদা ও আমাকে সামনে এগুবার অনুমতি দিলেন। এই সময় আমরা ‘হিঙ্গুলগঞ্জ’ নামক অপর একটি ভারতীয় সীমান্ত চৌকির দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম। সিদ্দিকসহ লঞ্চের অন্যান্য সাথীদের লঞ্চসহ এখানেই ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে রেখে গেলাম।

নিরাপদ স্থানে পৌঁছার জন্য ভারতের সীমান্ত ধরে আমরা এগুতে লাগলাম। কারণ, নদীর ওপারেই পাকিস্তানী হানাদাররা ওঁৎ পেতে বসেছিল। ওপারের দূরত্ব এক হাজার গজের বেশি নয়। বর্বর পাকিস্তানী হানাদারদের মেশিনগানগুলো যে কোন সময় গর্জে উঠতে পারে। এই ভয়ে আমরা সতর্ক ও সচেতন ছিলাম। দেখতে পেলাম ওপারে পাকিস্তানী সৈন্যরা ট্রিগারে হাত দিয়ে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। নদীর ঢেউগুলো স্পীডবোটের কাঠের দেহটাকে হাপরের মতো পিটাচ্ছিল। ভয় হল ওর দেহটা না টুকরো টুকরো হয়ে যায়।

ঢেউয়ের বুক চিরে ক্ষুদে দৈত্যের মতো স্পীডবোটটা আমাদের নিয়ে দ্রুতগতিতে ছুটে চললো গন্তব্যস্থানের দিকে। মুখ ঘুরাতেই সামনে দেখতে পেলাম নদীর তীর বরাবর ভারতীয় সীমান্তে বেশ বড় বড় কতকগুলো বাড়ি। উপর দিকটা লাল, এমন কতকগুলো সেনানিবাস এই বাড়িগুলো চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে। বহু আকাংক্ষিত স্থানে নিরাপদে পৌঁছাতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম। নতুন করে ইস্পাত কঠিন সংকল্প ও শক্তি সঞ্চয় করলাম। ওই দিনই অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ফিরে পাকিস্তানী পশুগুলোর উপর বর্বরতার সমুচিত জবাব দেবার জন্য মনটা আমার কঠিন হয়ে উঠলো। হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা আমার নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের জন্য অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছিল। যাতে করে সাড়ে সাত কোটি অগ্নিদগ্ধ আত্মার শান্তির জন্য হিংস্র জানোয়ারদের উপর চরম আঘাত হানা যায়।

আমরা হিংণ্ডলগঞ্জে নামলাম এবং সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর অধিনায়ক ক্যাপ্টেন পান্ডের অফিসে হেঁটে গেলাম। তিনি তাঁর অফিসে আমাদের স্বাগত জানাবার জন্য প্রতীক্ষা করছিলেন। ক্যাপ্টেন পান্ডে সুঠামদেহী, সুন্দর ও বেশ লম্বা। অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে স্বাগত জানালেন। আমি যা আশা করেছিলাম তার চাইতে বেশী।

এক কাপ গরম কফির পর আমাকে আবার এখনই হবে প্রথম হাসনাবাদ, পরে ব্যারাকপুর। প্রথম ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক মিঃ মুখার্জী সেখনে আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের সময় ক্যাপ্টেন পান্ডে শরণার্থী হয়ে ভারত চলে আসেন। আমাকে স্বাগত জানাতে পেরে তিনি খুব আনন্দবোধ করলেন। তার চোখের কোণে আশা ও প্রত্যয়ের ছাপ দেখলাম।

আমাদের অনেক রাস্তা যেতে হবে। সুতরাং সময় নষ্ট না করে ওদের সেনাবাহিনীর পাহারায় আমরা তিনচাকার একটা গাড়ীতে চেপে পড়লাম। এই গাড়ীটির বন্দোবস্ত করেহিলেন মিঃ পান্ডে। তিনি হাসনাবাদে আমাদের আগমন বার্তা অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন। সহকারি অধিনায়ক ক্যাপ্টেন বিশ্রাম সিং সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন।

হিংণ্ডলগঞ্জ থেকে হাসনাবাদের দূরত্ব ১২ মাইল। কিন্তু মাঝপথে আমাদের দুটো খেয়া পার হতে হবে। এই তিনচাকা গাড়ীটা দেখতে বেশ অদ্ভুত লাগে। এটার নাম টেম্পো।

বেশ  কষ্টকর ভ্রমণের পর আমরা হাসনাবাদ পৌঁছে গেলাম। গণপরিষদ সদস্য মিঃ নূরুল ইসলাম মঞ্জুর কাছ থেকে ক্যাপ্টেন বিশ্রাম সিং আমার সম্বন্ধে অনেক কথা আগেই শুনেছেন। মিঃ মঞ্জুর সাথে আগে থেকেই এদের জানাশুনা হয়েছিল। ক্যাপ্টেন সিং কোমল হৃদয়ের অধিকারী, সুন্দর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। আমাদের সবার কাছেই খুব প্রাণখোলা মনে হলো। সামনে এসে মিসেস সিংও আমাদের খোশ আমদেদ জানালেন। এই ভদ্রমহিলা আর এক মধুর ব্যক্তিত্ব। দীর্ঘাংগী, সুন্দরী। তারা আমাদের সাথে  অতি পরিচিত বন্ধুর মত ব্যবহার করলেন। বেশ কয়েক রকুম সুস্বাদু খাবার খাওয়ার পর আমরা ব্যারাকপুর যাত্রা করলাম। এখান থেকে ব্যারাকপুর প্রায় সত্তর মাইল সামনে। এবার স্বয়ং ক্যাপ্টেন ক্যাপ্টেন বিশ্রাম সিং-এর পাহারায় রওনা হলাম। হঠাৎ করে ঝড় ও অবিরাম বর্ষণ শুরু হলো। কিন্তু সামরিক গাড়ীগুলোর আশ্রয় পেয়ে কতটা নিরাপদ হলাম। দীর্ঘ দু’ঘণ্টা ভ্রমণের পর গাড়ীটা একটা দালানের কাছে থামলো। ওর গায়ে লেখা ছিল ‘অফিসার মেস’, ৭২নং বিএসএফ (বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সে)। এটাই আমাদের সামরিক গন্তব্য স্থান। বৃষ্টি থেমে গিয়ে আকাশে তারাগুলো উঁকি মারলো। বাইরে কিছুক্ষণ কাটানোর পর আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো ওদের অফিসার মেসে। আমাদের ৭২নং বিএসএফ অফিসার মেসে। পথের ক্লান্তিতে বিশ্রাম নিতে ইচ্ছা করলাম। সুতরাং শিগগিরই পানীয় এলো। সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসের ধ্বনি ছড়িয়ে এক ঝলক হাসি মুখে নিয়ে উপস্থিত হলেন একজন  নতুন যুবক। ইনি হচ্ছেন ক্যাপ্টেন সরকার। ভাই ও বন্ধুর চেয়েও বেশী অমায়িক ব্যবহার পেয়েছিলাম এই  ভদ্রলোক ও তার স্ত্রীর কাছ থেকে। পরে আমরা আত্মীয়র চাইতে বেশী আপন হয়েছিলাম। এই ৭২ বিএসএফ বাহিনীর এডজুট্যান্ট ছিলেন তিনি। মিত্রবাহিনীর বন্ধুদের উল্লাসের ধ্বনিতে আমি স্বস্তি অনুভব করতে লাগলাম। বাস্তবিক পক্ষে আমরা খুব সুখে ছিলাম। এই সময় অধিনায়ক মিঃ মুখার্জী এসে পৌঁছালেন। অধিনায়কের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো। বয়সী লোক। ধূসর চুল, মুখাবয়বে অভিজ্ঞতার ছাপ। আমরা খুব আস্তে আস্তে কথা বললাম।

ভেতরটা তার বড্ড নরম, বড্ড কোমল। পরবর্তী পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধে যে সফলতা এসেছে সেটা সম্ভব হয়েছিল তার সুষ্ঠ নির্দেশনা ও ব্যক্তিত্বের জন্য। তাকে ভুলব না।

সুন্দরবনে প্রেতাত্মা

কোন কোন লোকের কতলগুলো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন আমি দেখেছি যখনই তারা তাদের ইপ্সিত কোন কিছু সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছে, তখনই বশ্যতা স্বীকার বা মাথা নোয়াবার পরিবর্তে ওই কাজটাকে সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করার জন্য দ্বিগুন উৎসাহে বার বার চেষ্টা করেছে। নিরাশ হয়নি বা আশা ছেড়ে দেয়নি। এইসব লোকদের আমি ঈর্ষা করতাম, তাদের পদাংক অনুসরণ করার জন্য স্থিরপ্রতিজ্ঞ হতাম।  একবার দূঢ় আত্মপ্রত্যায়ে বলীয়ান হলে পরাজয়ের গ্লানিটুকু অকিঞ্চিতকর মনে হয়। বাংলাদেশের সীমান্ত অতিক্রম করে যখন আমি ভারতে আসি, তখন মুক্তিসংগ্রাম চলাকালে এ রকম একটা অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলাম। শেষবারের মতো আমি ৭২ নং ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর অধিনায়ক মিঃ মুখার্জীর বাসভবনে থামলাম। অস্ত্রশস্ত্র যোগাতে তিনি আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। নৈশভোজের পর তিনি আমাদের গাড়ীতে করে কোলকাতায় নিয়ে গিয়ে তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিরাপত্তা বাহিনীর ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল মিঃ মজুমদারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাঁকে জানালেন যে, অধিনায়ক হিসেবে মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে দেশের জন্য আমি অনেক কাজ করতে পারবো। আমার কি কি অস্ত্রশস্ত্র প্রয়োজন মিঃ মজুমদারকে জানালাম। তিনি বেশ ধৈর্যের সাথে কথাগুলো শুনে আমাকে আশ্বাস দিয়ে ভদ্রভাবে বললেন যে, তাঁর সামর্থ্যমত প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র যুগিয়ে দিতে চেষ্টার ত্রুটি করবেন না। মিঃ মজুমদারের ব্যবহারে মুগ্ধ হলাম। বেশী আশ্চর্য হলাম তাঁর সুন্দর ভদ্রতাবোধ দেখে এবং আশ্বাস বাণী শুনে।

ওই দিনই সন্ধ্যায় কোলকাতার আসাম হাউজে নিরাপত্তা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মিঃ রুস্তমজীর সাথে সাক্ষাৎ করতে হলো। মিঃ মুখার্জীকে নিয়ে তাঁর সাথে দেখা করলাম। আমার প্রতি যে আন্তরিকতা ও ভদ্রতা দেখিয়ে তিনি আমাকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন তাতে সত্যিই মুগ্ধ হয়েছিলাম। বেশ আকর্ষণীয় চেহারার অধিকারী সিনিয়র অফিসার। তার সাথে কথাবার্তায় আমার দূঢ় বিশ্বাস হলো যে, বেশ অল্পদিনের ভেতরেই আমরা অস্ত্রশস্ত্র পেয়ে যাব। অস্ত্র যোগাড় করাটাই আমার আসল উদ্দেশ্য। আমার চলাফেরার সময় মিঃ মুখার্জী ও তার অফিসের কর্মচারীরা আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। তাদের ব্যবহার অত্যন্ত অমায়িক ও বন্ধুসুলভ।

১৯৭১ সালের ২৪শে এপ্রিল মিঃ মুখার্জীর গাড়ীতে করে আমাকে মেজর উসমানের কাছে নিয়ে গেলেন। তিনি মুক্তিসংগ্রামের আর একজন অধিনায়ক। পাক দখলদার বাহিনীর সাথে তাঁর ক্ষুদ্র শক্তি নিয়ে পর পর কয়েকটা যুদ্ধ করে উত্তর বাংলার পট্রাপোলে  তিনি ঘাঁটি গেড়েছেন। মেজর উসমান পাক আমলে ইপিআর-এ চাকরি করতেন। তিনি অনেক হালকা অস্ত্রশস্ত্র যোগাড় করে রেখেছিলেন তাঁর ঘাঁটিতে। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র জমা দেখে আমার লোভ হলো। কারণ, পৃথিবীর যে কোন জিনিসের চাইতে এই প্রয়োজনের সময় যুদ্ধক্ষেত্রে একজন সৈনিকের কাছে একটি মাত্র রাইফেল সবচেয়ে বেশী মূল্যবান। কেননা, অস্ত্র ছাড়া একজন সৈনিকের গর্ব ভূলুণ্ঠিত হতে বাধ্য। যাহোক অনেক কষ্টে অনেক বলা-কওয়ার পর মেজর উসমানকে বুঝতে সক্ষম হলাম যে আমিও তাঁর মত দেশের জন্য যুদ্ধ করতে যাচ্ছি। কিছুটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেজর উসমান রাজী হলেন। অন্ধকারের ভিতর আশার আলো দেখতে পেলাম। সমস্ত কৃতিত্বই অধিনায়ক মিঃ মুখার্জীর। তিনি নিজে মেজর উসমানকে ব্যাপারটা গুরুত্ব বুঝিয়ে রাজী করিয়েছিলেন। সুতরাং এক ট্রাক বোঝাই হালকা অস্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম নিয়ে আমি হাসনাবাদ ফিরে এলাম। এখানে এগুলো লঞ্চে বোঝাই করার বন্দোবস্ত করতে হবে। মেজর উসমানের সাথে আলাপ-আলোচনার সময় আমার সহকারী ক্যাপ্টেন হুদা বেশ ধৈর্য ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। তার উপরে প্রশাসনিক দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে আমি মিঃ মুখার্জীর সাথে ফোর্ট উইলিয়াম ও পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সদর দপ্তরে রওয়ানা হয়ে গেলাম।

প্রথমে ইস্টার্ন কমান্ডের ইনটেলিজেন্স অফিসার কর্নেল খেরার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি আমাকে  অনেক প্রশ্ন করলেনঃ পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে থাকাকালীন আমি কোথায় কোথায় ছিলাম। কি কি করেছি ইত্যাদি। তিনি যা প্রশ্ন করলেন সবগুলোরই উত্তর দিতে হলো আমাকে। একটা লোক তাঁর কানে কানে কি বলতেই আমাকে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সর্বাধিনায়ক লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সাক্ষাৎ পেলাম। তাঁর স্মিত হাসি ও আন্তরিক ভদ্রতা আমাদের ভেতর ‘পদের’ বাধা মুছে ফেললো। আমার মনে ভরসা এলো। তাই কোন সংশয় না করে বা কোন কথা গোপন না করে তার কাছে মনের কথা সব কিছু খুলে বললাম। এর ফলে আমার উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল হলো। একটা মানচিত্র তুলে ধরে বাংলাদেশের কোথায় আমার গেরিলা ঘাঁটি আছে তাঁকে দেখালাম। দেখে মৃদু হাসলেন এবং বললেন, খুব ভাল। সাথে কর্নেল খেরাকে নির্দেশ দিলেন আমাকে প্রয়োজনীয় সবরকম সাহায্য করতে। এখানে কর্নেল খেরার সাথে আমাকে পুরো তিনটা দিন থাকতে হয়। সামরিক বাহিনীতে অন্যান্য গোয়েন্দা অফিসারের মত তার অনুসন্ধিৎসু মনটা আমার সম্বন্ধে খুব উৎসুক হয়ে উঠলো। বিশেষ গোয়েন্দা বিভাগের লোক হিসেবে খুব সতর্কতার সাথে কথা বললেন, নানা রকম প্রশ্ন করে নিশ্চিত হতে চাইলেন যে, আমি সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা কিনা। আমার পরিকল্পিত কাজের বিলম্ব হওয়াতে এই কয়টা দিন আমি ভয়ানক অস্থিরতার ভেতর কাটিয়েছিলাম। যাহোক, আমার বিরক্তি সত্ত্বেও তার ধৈর্য, বুদ্ধিমত্তা ও দেশের জন্য নিরাপত্তা বোধের আন্তরিক প্রশংসা না করে পারছি না। এখানেই তার কাছে প্রথম শুনলাম, ২৫শে এপ্রিল পাকিস্তানী দস্যুদের হাতে বরিশাল-ফরিদপুরের পতন হয়েছে। হতাশায় মনটা ভেঙ্গে পড়লো। এই জিলাগুলিকে রক্ষা করার পূর্ব পরিকল্পনা আমার সাময়িকভাবে ব্যাহত হওয়া সত্ত্বেও কঠিন সংকল্প নিলাম যে, যেভাবেই হোক এইসব অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতেই হবে। অস্ত্র তুলে দিতে হবে মুক্তিসংগ্রামীদের হাতে। আমার আশায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে ওরা। আমার বিলম্ব হবার আরও একটা কারণ হলোঃ সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষের কাছ থেকে খবর পেয়েছিলাম যে, কর্নেল এম এ জি ওসমানী যেভাবেই হোক আমার সাথে কোলকাতায় সাক্ষাৎ করতে চান।

৫ই মে পর্যন্ত আমি তাঁর অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু তাঁর ফিরে আসার কোন লক্ষণই দেখলাম না। কেউ বলতে পারলো না কখন তিনি ফিরে আসবেন। তিনি তখন সীমান্তবর্তী অন্যান্য সেক্টর কমান্ডারদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য কঠোর চেষ্টা করেছিলেন। এই বিলম্বে ভয়ানক চিন্তাম্বিত হয়ে স্থির করলাম আবদ্ধ কাজ সমাধান করার জন্য আমাকে এখনই রওয়ানা হয়ে যেতে হবে। ঠিক এই সময় মিঃ নূরুল ইসলাম মঞ্জু, লেঃ নাসের ও ক্যাপ্টেন হুদা পরিবার-পরিজন নিয়ে হাসনাবাদে পৌছলো। বরিশালের পতন হওয়াতে তারা চলে এসেছে।

ক্যাপ্টেন হুদাকে নির্দেশ দিলাম যে, যখন আমি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকবো, তখন যেন বাহকের মাধ্যমে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। পরিস্থিতি অনুকূল মনে হলে সরবরাহ ব্যবস্থা যেন অব্যাহত রাখে। আমাদের ক্যাম্পের দিকেও লক্ষ্য রাখতে বললাম। এই ক্যাম্পে মিঃ মঞ্জু, লেঃ নাসের ও ক্যাপ্টেন হুদার পরিবার-পরিজনও থাকতো।

সবাই মিলে মোট চল্লিশজন লোক দুটো লঞ্চে করে যাত্রা করলাম। আমাদের ভেতর চারজন নিয়মিত সেনাবাহিনীর লোক ছিল। বাকী সব ছাত্র। আমাদের গন্তব্যস্থানের রাস্তাঘাট আমার নিজেরও জানা ছিল না। লঞ্চে এরকম একটা দুঃসাহসিক যাত্রায় মোটেই ভরসা পাচ্ছিলাম না। যে কোন সময় বিপর্যয় আসতে পারে। যেহেতু যাওয়ার পথে শত্রুরা চারদিকে ওঁৎ পেতে বসেছিল, আমরা সবাই লঞ্চের পাইলটের উপর নির্ভর করলাম। পাইলটরা তাদের অনেক বছরে অভিজ্ঞতার বড়াই করে আশ্বাস দিল যে, তারা আমাদের নিরাপদে পৌছে দেবে। ওদের দুঃসাহসিক কথাবার্তা ও আত্মবিশ্বাসের জোর দেখে স্বভাবতই আমি আদেশ করা থেকে বিরত রইলাম, যেহেতু যাওয়ার প্রকৃত রাস্তাঘাট সম্বন্ধে আমি সম্পূর্ণ অপরিচিত। রাস্তা সম্পর্কে আমার ম্যাপ দেখা অস্পষ্ট ধারণা ছিল মাত্র। তৎসত্ত্বেও একটা সংক্ষিপ্ত ‘অপারেশন প্ল্যান’ তৈরী করলাম। প্রাথমিক পর্যায়ে বুঝিয়ে বললাম কিভাবে দুটো লঞ্চে অস্ত্রশস্ত্র  ভাগাভাগি করে নিতে হবে এবং শত্রুর সাক্ষাৎ পেলে নাগরিকরা কি করবে।

যাত্রা শুরু করার হুকুম দিলাম। একটা লঞ্চে মিঃ মঞ্জু, লেঃ নাসের এবং আরও কয়েকজন লোক আগে আগে চললো। আমার লঞ্চটা আগেরটার পিছু পিছু রওয়ানা হলো। কারণ, আমার লঞ্চে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও অনেক অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই ছিল। সামনের লঞ্চটায় মিঃ মঞ্জু ও লেঃ নাসেরকে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করার ভার দিলাম। পথের নিরাপত্তা সম্বন্ধে তাঁরা দু’জনেই বেশ আশ্বস্ত ছিলেন। কারণ মাত্র দু’দিন আগেই তাঁরা এই পথে হাসনাবাদ এসেছেন। ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর পেট্রোল বোট ‘চিত্রাঙ্গদা’ আমাদেরকে শামশেরনগর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল। এখান থেকেই আমরা যাত্রা শুরু করব। শামশেরনগর ভারতের শেষ সীমান্ত ঘাঁটি। রাত ৯টা। শুরু হলো যাত্রা। আশা-নিরাশার দোদুল দোলায় সারা দেহ -মনে চাপা উত্তেজনা। যাত্রার লগ্নে দূরে বহু দূরে দেখতে পেলাম গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ছাড়াও রাত্রের গুমোট অন্ধকার। গত কয়েক দিনের ক্লান্তিতে আমার চোখ দুটো জড়িয়ে এলো। গুম পেল আমার। ইঞ্জিনের কর্কশ শব্দের মাঝেও আমি গভীর ঘুমে গা এলিয়েদিলাম। হঠাৎ একটা ধাক্কা খেয়ে ঘুম থেকে উঠে দেখি কে যেন চাপা গলায় ডাকছেঃ ‘গানবোট, গানবোট স্যার’।

হ্যাঁ, সত্যিই তো গানবোট। ভূত দেখার মত উপরতলার ক্যাবিন থেকে ঝড়ের বেগে চীনা ‘কার্বাইনটা’ হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। ইঞ্জিন কক্ষে ঢোকা মাত্রই দু’দিক থেকে প্রচণ্ড সার্চলাইটের আলো আর মেশিনগানের গুলি আসতে লাগলো। ভেতরটা আমার অসম্ভব রকমের ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো। বুঝতে পারলাম, পাকিস্তানী গানবোট ওঁৎ পেতে আমাদের ঘিরে ফেলেছে। রাতটা ভয়ানক বিক্ষুদ্ধ। ঝড়ের দাপাদাপি। তার উপর চারদিক সূচীভেদ্য অন্ধকার আর মেশিনগানের অবিরাম গুলিবর্ষণ। সার্চলাইট দিয়ে এই বৃষ্টির মধ্যে হানাদাররা তন্নতন্ন করে আমাদেরকে খোঁজ করতে লাগলো। একটা গুলি এসে লঞ্চের পিছন দিকটায় আঘাত করলো। শত্রুপক্ষকে বিভ্রান্ত করার জন্য আমার সাথের চার জন সৈনিক সিদ্দিক, হাবিলদার জব্বার মোখছেদ ও ইউসুফকে প্রথমে রাইফেলের গুলি করতে বললাম। যেন শ্ত্রুপক্ষ মনে করে আমাদের শক্তি খুব কম। আশ্চর্যজনকভাবে আমার এই পরিকল্পনাটা কাজে এলো। দেখতে পেলাম আমাদের বাঁ দিকের গানবোটটা পুরো সার্চলাইট জ্বালিয়ে বৃষ্টি ও বিক্ষিপ্ত ঢেউগুলোর  ভেতর  দিয়ে এগিয়ে আসছে। আমাদের লঞ্চটার পিছন দিকটায় আরও কয়েকটি গুলি এসে লাগলো। বাইরে প্রবল বৃষ্টিপাত ও বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দে গুলির আওয়াজ অস্পষ্টভাবে আসছিল। সার্চলাইটের আলোকিত পথটুকুই শুধু চোখে পড়লো। পৃথিবীর আর সব কিছুই দৃষ্টির বাইরে। কোন পথই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সমস্ত ব্যাপারটা এলোমেলো হওয়া সত্ত্বেও অল্প সময়ের ভেতর পাল্টা আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিলাম। ইতিমধ্যে যে গানবোট আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিল। সেটা প্রায় লঞ্চের কাছাকাছি এসে গেল। বলতে ভুলে গিয়েছি যে, আমাদের লঞ্চটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু এটা নদীর তীরে, না মাঝখানে অন্ধকারে ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না।

দু’জনকে মেশিনগান, দু’জনকে ‘এনারগা গ্রেনেড’ সজ্জিত রাইফেল দিয়ে বাম দিকে বসিয়ে দিলাম। আমি নিজে একটা মেশিনগান ডানদিকের গানবোটটাকে লক্ষ্য করে প্রস্তুত হয়ে রইলাম। নির্দেশ দেওয়ার সাথে সাথেই চারজনে ওই গানবোটটাকে লক্ষ্য করে প্রচন্ডভাবে গোলাবর্ষণ শুরু করলো। এই সময় গানবোটটা আমাদের বেশ আওতার মধ্যে এসে গিয়েছিল। এই অতর্কিত আক্রমণে শত্রুরা ভয়ানক ঘাবড়ে গেল এবং ওদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হলো। ওদের হৈ চৈ শুরু হলে এবং গানবোট থেকে বিরাঠ একটা আগুনের গোলা ছিটকে পড়লে বুঝতে পারলাম, আমাদের নিক্ষিপ্ত রকেট ঠিক জায়গায় আঘাত করেছে। বামদিকের গানবোটটাকে চিরদিনের জন্য নিস্তব্ধ করে দিয়ে ডানদিকের গানবোটটাকে আক্রমণের জন্য ঘুরে বসলাম। কিন্তু ওটা বিপদের আশংকা করে মেশিনগানের আওতার বাইরে পালিয়ে গেল। যাহোক, শত্রুপক্ষকে ভীতসন্ত্রস্ত রাখার জন্য গুলিবর্ষণ অব্যাহত রইলো। এই সুযোগ অন্য দু’জন লোককে  আমাদের আগের লঞ্চটার খোঁজ নিতে বললাম। কিন্তু মনটা ভীষণভাবে দমে গেল যখন দেখলাম আগের লঞ্চটা ঠিক আমাদের বামদিকে চড়ার উপর বিধ্ধস্ত অবস্থায় পড়ে আছে এবং ওর ভেতরের লোকজন আগেই পালিয়ে গিয়েছে।

সাথের বেশীর ভাগ লোকজন পালিয়ে গিয়েছে দেখে মনটা ভয়ানক দুর্বল হয়ে পড়লো। এমন সময় পালিয়ে গেল যখন তাদের প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশী। অযথা চিন্তায় সময় নষ্ট না করে আমাদের সাথের চারজনের প্রত্যেককে এক-একটা ডাল, আমরা তীরের কাছাকাছি ছিলাম। অনিশ্চয়তা, নিরাশা ও ভয়ের আশংকা। আমরা তাড়াতাড়ি লঞ্চ থেকে লাফিয়ে পড়লাম। পায়ের নিচে আঠালো কাদা। কোমর পরিমাণ জলের ভেতর দিয়ে অনেক কষ্টে নদীর তীরে পৌছালাম। তীরটা আমার কাছে উঁচু বাঁধের মত লাগলো। নদী থেকে অনেক উঁচুতে বাঁধের উপর তাড়াতাড়ি ঘাঁটি গেড়ে বসলাম। সামনে থেকে যত আক্রমণই করা হোক না কেন আমরা এখানে পুরোপুরি নিরাপদ। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। অচেনা, অজানা পথ। জীবনে কোনদিন এখানে আসিনি। এসব চিন্তা করে নিজেকে বড় অসহায় মনে হলো। শত্রুর উপস্থিতি, ঝড়ের বিলাপ , কুচকুচে কালো আঁধার-সব মিলে রাতটাকে একটা প্রেতাত্মার ছায়ার মত মনে হলো। হঠাৎ দেখতে পেলাম বাঁধের পিছন দিকে মানুষের একটা অস্পষ্ট ছায়া মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। শংকিত পদে ভয়ে  ভয়ে কাছে গিয়ে দেখলাম একটা লোক পালাবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। এত ভীত যে মনে হলো পৃথিবীটা খুঁড়ে তার ভেতর গিয়ে লুকাবে। মৃদুভাবে তাঁকে স্পর্শ করতেই এমন জোরে চিৎকার করতেই জোরে চিৎকার শুরু করলো যে, ভয়ে আমার শরীর কাঁপতে লাগলো। তাকে সান্ত্বনা দেয়া সত্ত্বেও সে এমন বিলাপ করে চিৎকার আরম্ভ করলো যে, উপর দিকে একবারও চাইবার সাহস পেল না। গরীব বেচারা। প্রায় বিকারগ্রস্ত। অনেক চেষ্টার পর সে শান্ত হলো। এই লোকটা হচ্ছে সেইসব পাইলটদের একজন যারা লম্বা লম্বা গালভরা কথা বলেছিল। অবশ্য তার কোন দোষ নেই। কারণ সে কোনদিন গুলির শব্দ শোনেনি। যাহোক এই লোকটা আমার অনেক উপকার এলো। আমি কোন জায়গায় আছি এটা সে নির্ভুলভাবে বলে দিল। এসব ব্যাপার এই ক্ষুদে ‘সাহসী’ লোকটির বেশ জোর আছে। এই জায়গাটার নাম ‘গাবুরা’। জায়গাটার পরিবেশ ও অবস্থানের কথা চিন্তা করে সংশয় জাগলো যে, ভোর হওয়া পর্যন্ত যদি আমরা এখানে থাকি তাহলে শত্রুপক্ষ হয়তো বা আমাদের  মত লোভনীয় বস্তুগুলোর উপর হাওয়াই হামলা চালিয়ে ওদের করেই বসে তাহলে কিছুতেই রুখতে পারব না। এই অত্যাসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাবার একমাত্র উপায় হচ্ছে, কোন রকমে ‘ক্রলিং’ করে গ্রামের  অভ্যন্তরে চলে যাওয়া।

আমাদের পিছন দিকে এই গ্রামগুলো প্রায় এক মাইল দূরে। ইতিমধ্যে শত্রুপক্ষের গানবোটটা অনেক দূরে পিছিয়ে গিয়ে বাঁধের উপর আমাদের অবস্থান ও নদীর তীরে পরিত্যক্ত লঞ্চ দুটোকে লক্ষ্য করে ভীষণভাবে মেশিনগান ও রকেটের গোলাবর্ষণ শুরু করলো। ওদের অবিরাম গোলাবর্ষণে আমাদের দুটো লঞ্চেই আগুন ধরে গেল। বর্তমান অবস্থানে থাকাটা অযৌক্তিক ভেবে আমরা ক্রুলিং করে কোন রকমে বাঁধের নিচের দিকে চলে গেলাম আর খোদাকে স্মরণ করতে লাগলাম। কারণ এ দুঃসময়ে এক খোদা ছাড়া আর কেউ শত্রুর হাত থেকে আমাদের বাঁচাতে পারবে না। কারণ আমাদের কাছে পর্যাপ্ত গোলাবারুদ ছিল না। ঠিক এই সময় আমার সঙ্গের চারজন সৈনিক এদিক-ওদিক সরে পড়লো। সম্ভবত তারা গ্রামের দিকে পালিয়ে যাচ্ছিল। পাইলট ছাড়া আর কাউকে আমার চারপাশে দেখলাম না। মেশিনগানের গর্জন আর রকেটের প্রচণ্ড আওয়াজ শুনে পাইলট আধমরার মতো আমার কাছে পড়ে রইল। গোলার ভয়ংকর আগুনে আমাদের লঞ্চ দুটোকে নির্দয়ভাবে গ্রাস করলো। পরাজিত মন ও ক্লান্ত দেহটা বাঁধের পিছন দিকে এলিয়ে দিয়ে হতাশার গ্লানি নিয়ে চেয়ে রইলাম লেলিহান বহ্নিশিখার দিকে। গোলার প্রচণ্ড শব্দ, রকেট বিস্ফোরণের বিকট আওয়াজ। উৎকট গন্ধে ভরপুর সমস্ত আকাশটা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন- পরাজয়ের কালিমায় কিছুটা মলিন। পূর্ব দিকটা সামান্য হালকা হতেই পাইলটকে টেনে নিয়ে কোন রকমে গ্রামের ভিতর ঢুকে সাহস করে সেখানে এক হাজী সাহেবের বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। আমাদের প্রতি সহৃদয় হবার জন্য ইঙ্গিতে তাকে অনুরোধ জানালাম। যখন তাকে খোদার চাইতেও জেনারেল ইয়াহিয়ার উপর বেশী অনুগত দেখলাম তখন যুগপৎ ভয় ও বিস্ময়ে মনটা বিচলিত হলো। গ্রামের অধিকাংশ লোককেই দেখলাম বর্বর   ইয়াহিয়ার প্রতি অনুগত ও ভক্ত। আমাদের প্রতি ভয়ানক বিরুপ মনোভাবাপন্ন মনে হলো। প্রকৃতপক্ষে এখানকার স্থানীয় লোকজনই আমাদের সাথের লেঃ নাসের, গণপরিষদ সদস্য মিঃ মহিউদ্দিন ও আরো ছাব্বিশজন লোককে ধরে তাদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালায় এবং সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। আমিও এই রকম একটা গন্ধ পেলাম যে হাজী সাহেব আমাদেরকে পাকিস্তানী হানাদারদের হাতে তুলে দেবার জন্য গোপনে প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদের চারদিকে অনেক লোকের ভীর। তারা আমাদেরকে উৎসুক দৃষ্টিতে দেখছে। আমরা দু’টি যেন অদ্ভুত জীব। আমাদের এরকম দুরবস্থা দেখে ওদের মধ্যে কেউ কেউ দুঃখও প্রকাশ করলো। এ অবস্থা দেখে হাজী সাহেবেরও বোধ হয় দয়া হলো। তিনি আমাদের কিছু ভাত ও মধু দিলেন। এটা সুন্দর বনাঞ্চলের লোকদের একটা বিশেষ খাদ্য। খাবার দেখা মাত্র আমার চোখ দুটো বড় হতে লাগলো। কেননা আমি ও আমার সঙ্গের পাইলট উভয়েই ভয়ানক ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত ছিলাম। গত রাতের ভয়ংকর পরিবেশ আমি ওর সাথে বড্ড একাত্ম ও আপন হয়ে গিয়েছিলাম। যখনই এই অনির্ধারিত খাবার শেষ করে ফেলেছি, ঠিক সেই সময় হাজী সাহেব হাতে করে রাইফেলের ‘ছেরেফ’ একটা ‘বোল্ট’ নিয়ে হাজির হলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন যে, এটা কি ? কেননা তার ধারণা ছিলো এটা কোন কাজে আসে না। তার চোখের কোণে ভীতির চিহ্ন।

এই দালাল শিরোমণিকে নিয়ে কিছু মজা করবো স্থির করলাম। তার হাতে বোল্টটা দেখেই ভীতিজড়িত কন্ঠে চিৎকার দিয়ে উঠলাম এবং হাজী সাহেবকে বললাম যে, তাঁর হাতের জিনিসটা খুব মারাত্নক ডিনামাইট। মাটিতে যেন কোনরকমে না পড়ে তাহলে সবাই মারা যাবে। শুনে হাজী সাহেব ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেলেন। এইবার হাজী সাহেবকে হাতের মুঠোয় পেলাম। আমার কথায় তার কাঁপন শুরু হলো। তার চক্ষু স্থির, রক্তহীনের মত বিবর্ণ। আপাদমস্তক ভয়ে কাঁপতে লাগলো। আমার হুঁশিয়ারি স্মরণ করে তিনি বোল্টটাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার মত সৎ সাহসও দেখাতে পারছিলেন না। তাঁর শোচনীয় অবস্থা দেখে আমি বললাম যে, ডিনামাইটের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে, ওটাকে পানির মধ্যে ফেলে দেয়া। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো আমার কথা খুব আস্তে আস্তে আঙ্গুল টিপে টিপে বোল্টটার দিকে অপলক দৃষ্টি মেলে হাজী সাহেব পুকুরের দিকে রওনা হলেন। এই দুরবস্থার মধ্যেও আমার ভয়ানক হাসি পেল। যখনই এই মজার ব্যাপারটা ঘটছিল তখন হঠাৎ গানবোট থেকে হাজী সাহেবের বাড়ির দিকে আবার গোলাবর্ষণ শুরু হলো। হাজী সাহেবের বাড়ীটা বড় একটা দালান। বহু দূর থেকে দেখা যায়। এই আকস্মিক ঘটনায় গ্রামের লোকজন যে যেদিকে পারলো ছিটকে পড়লো। এটা আমাদের পালানোর জন্য আশীর্বাদস্বরূপ দেখা দিল। আমার সাথের পাইলটটি মাত্র নদীর পথ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিল। সে সাহচর্য ছাড়া আর কোন প্রয়োজন আসলো না। যাহোক, একটা গর্তের মধ্যে লুকিয়ে থেকে দিনটা কোন রকমে কাটিয়ে দিলাম। সন্ধ্যার সাথে সাথে  আরম্ভ হলো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ। হাজী সাহেবের ছেলে আমাদের প্রতি খুব সদয় ছিল। হাজী সাহবের ব্যবহারে আশ্বাস ও স্বস্তির রেশটুকু খুঁজে না পেলেও আমাদের প্রতি তার ছেলের মমত্ববোধ দেখে এই দুঃসময়েও বাঁচার ক্ষীণ আশায় বুক বাঁধলাম। হাজী সাহেবের ছেলে আমাদের খুঁজে বের করলো। তাকে দেখে ভরসা পেলাম। সে আমাদের আশ্বাস দিল যে, খুব ভোরে একটা নিরাপদ জায়গায় পৌছে দিবে। তাঁর সহানুভূতিশীল মনের পরিচয় পেয়ে যেখান থেকে পালিয়ে এসেছিলাম- আবার সেখানে ফিরে গিয়ে সযত্নে প্রহরায় নির্বিঘ্নে রাত কাটিয়ে দিলাম। প্রতিশ্রুতিমত হাজী সাহেবের ছেলে রাস্তার সব খবরাখবর আমাদেরকে খুলে বললো এবং খুব ভোরে একটা নিরাপদ জায়গায় পৌছিয়ে দিয়ে গেল। খেয়া পার হবার জন্য সে আমাদের কিছু টাকা-পয়সাও দিল। কেননা রাস্তায় অনেক নদী ও খাল পার হতে হবে। পথটা অত্যন্ত বিপদসংকুল। তাছাড়া সমস্ত অঞ্চলটা পাক দালালে ভর্তি। প্রাণটা হাতে নিয়ে অনেক কষ্টে আমরা প্রায় আধ মাইল পথ অতিক্রম করলাম। কখনো হেঁটে, কখনো নৌকায় এইভাবে ভারতে সীমান্তবর্তী ঘাঁটি হিংগলগঞ্জ এসে পৌছালাম। হিংগলগঞ্জের ঠিক উল্টো দিকে পাকিস্তানী সীমান্ত ঘাঁটি বসন্তপুর। পাকিস্তানী সৈন্যরা আমাদের ফেরার খবর আগে থেকেই পেয়ে ওঁৎ পেতে আমাদের ধরার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। কিন্তু ওদের চোখে ধুলো দিয়ে আমরা নিরাপদ জায়গায় পৌছে গেলাম। ২৬ জন ছাড়া সঙ্গের অন্যান্য সবাইও পৌছে গেল।

আমরা যে বেঁচে গিয়েছিলাম এটা ভাগ্য নয়। এটা একটা চরম পরাজয়। আর এজন্য আমি দায়ী। কেননা অধিনায়ক হিসেবে রাস্তাঘাটের সাথে পরিচিত ছিলাম না। তারপর অধীনস্থ লোকদের উপর নির্ভরশীল হয়ে নিজের বিবেককে করেছিলাম খর্ব, তাই হারিয়ে ফেলেছিলাম নির্দেশ দেওয়ার শক্তি। কিন্তু এক অর্থে এই পরাজয়ের গ্লানি একটা বিরাঠ বিজয়। কেননা, এটা একটা সাহসী পদক্ষেপ মাত্র। ভবিষ্যত যাতে চরমভাবে আঘাত হানতে পারি তার জন্য নতুন করে শপথ নিলাম।

সর্বাধিনায়কের দরবার

জুলাই মাসের মাঝামাঝি কোন এক সময়ে আমাদের সর্বাধিনায়ক সব আঞ্চলিক অধিনায়কদের নিয়ে প্রথমবারের মত একটা বৈঠক বসেন এবং উপরোক্ত ৬টি অঞ্চলকে নয়টি উপ-অঞ্চলে বিভক্ত করেন। কিন্তু সত্য কথা বলতে কি, এর আগ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ছিল নিষ্প্রভ। এটা অবশ্য ভাল পদক্ষেপ। কিন্তু বেতারযন্ত্রের অভাবে নদীবহুল বাংলাদেশের  এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের উপর সুষ্ঠভাবে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ছিল। এক-একটা অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ছিল কমপক্ষে দু’ থেকে তিনটি জেলা। অন্যান্য সেক্টর কমান্ডারদের কার্যকলাপ সম্বন্ধে আমি কোন মত প্রকাশ করব না। তারা হয়তো তাদের অধীনস্থ নিয়মিত সেনাবাহিনী নিয়ে ভিন্ন রকম অবস্থার মোকাবেলা করেছিলেন। কিন্তু আমার ব্যাপারটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমার শক্তির প্রধান উৎস মুক্তিযোদ্ধা এবং নগন্য সংখ্যক সশস্ত্রবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর লোক। যাহোক এই সময় আমার অবস্থা ছিল খুব নাজুক ও অস্বস্তিকর। কেনা সৈন্যবাহিনী বা অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াই আমি অধিনায়ক হয়েছিলাম। সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানী সাহেব পরিস্কারভাবে জবাব দিলেন যে, আমাকে কোন অস্ত্রশস্ত্র দেয়া হবে না। এমন কি যে অস্ত্রশস্ত্রগুলো পাক হানাদারদের সাথে মোকাবেলার সময় সুন্দরবনে খোয়া গিয়েছিল সেগুলো উদ্ধার করার জন্য আমাকে চেষ্টা করার উপদেশ দিলেন। আমি তার কথাগুলো সন্তুষ্ট চিত্তে হজম করিনি এবং এটাকে আমি একটা চ্যালেঞ্জ হিসাবে গ্রহণ করলাম। মেজর ওসমানীকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কিছু হালকা অস্ত্রপাতি দেয়ার জন্য তাঁকে রাজী করালাম। এইভাবে কাছ থেকে কিছু অস্ত্রশস্ত্র এবং অধিনায়ক মুখার্জীর বদান্যতায় আরও কিছু অস্ত্রপাতি যোগাড় করে পাকবাহিনীর ঘাঁটি বসন্তপুরের ঠিক অপর দিকে হিংগলগঞ্জে ক্যাপ্টেন হুদার নেতৃত্বে একটা আক্রমণ পরিচালনার ঘাঁটি স্থাপন করবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ক্যাপ্টেন মেহদী ও লেঃ জিয়ার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করার জন্য চিন্তা করতে লাগলাম। কোন সহ-অধিনায়কের সাথে আমার কোন যোগাযোগের ব্যবস্থা না থাকায় আমার অধীনস্ত অঞ্চল থেকে অস্পষ্ট ও অতিরঞ্জিত খবর আমার কানে এসে পৌঁছতে লাগলো। যাহোক নির্ভরযোগ্য সূত্রে খবর পেলাম যে, বরিশালে হাবিলদার হেমায়েত, পটুয়াখালীতে ক্যাপ্টেন মেহদী এবং সুন্দরবন এলাকায় লেঃ জিয়া হানাদার বাহিনীর সাথে প্রচণ্ড যুদ্ধ করছে, কিন্তু অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাগুলির অপ্রতুলতা একটা বিরাঠ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই সময় ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরাই মুক্তিযুদ্ধে প্রধান শক্তি হিসাবে কাজ করছিলেন। সর্বশেষ পরিস্থিতি জানাবার জন্য আমি অধিনায়ক মুখার্জীর কাছে ছুটে গেলাম। তিনি তার স্বভাবসিদ্ধ নম্র ব্যবহারে আমাকে মুগ্ধ করলেন সর্বরকমের সাহায্যের আশ্বাস দিলেন। একবার যদি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কমান্ডারদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা যায়, তাহলে আমার অধীনস্থ সেক্টরের ভবিষ্যৎ কি হবে আমি যেন দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পেলাম। সমস্তু আগ্রহ ও ঔৎসুক নিয়ে ক্যাপ্টেন হুদাকে সাথে করে বিভিন্ন ঘাঁটি পরিদর্শন ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহের আশায় দিনরাত অবিশ্রান্ত ভাবে ছুটতে লাগলাম। কারণ প্রথম ব্যর্থতার বোঝাটা আমি যেখনেই যেতাম সেখানেই আমাকে ধাওয়া করতো। যতক্ষণ না বর্বর পশুগুলোর উপর একটার পর একটার পর একটা প্রতিহিংসা নিতে পারলাম ততক্ষণ পর্যন্ত ওই ব্যর্থতার গ্লানিকর ছায়াটা ভয়ানক দুঃস্বপ্ন হয়ে আমার কাঁধ চেপে রইল। সর্বক্ষণ আমি চলার উপর ছিলাম। জুন মাসের আগ পর্যন্ত আমার কোন সদর দপ্তর ছিল না।

 

মৃত্যুঞ্জয়ী কাফেলা

যদিও কোন করুন দৃশ্য আমি খুবই বিচলিত হয়ে পড়তাম এবং আমার উপরে প্রভাব ছিল ভয়ানক প্রবল, তবুও নৃশংস পাক-হানাদার বাহিনীর অত্যাচার আমার মনে জমা হতে লাগলো চরম প্রতিহিংসা ও জিয়াংসার আগুন। বর্বর পশুগুলো হাজার নিরীহ নিরপরাধ বাঙ্গালীকে গরু-ছাগলের মত ঘরছাড়া করে নিক্ষেপ করেছে দুঃখের অর্থে সাগরে। এক মুহুতে সময় নষ্ট না করে আমাদের যা কিছু সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র ছিল, তাই নিয়ে ক্যাপ্টেন হুদাকে হিংগলগঞ্জে একটা আক্রমণ ঘাঁটি স্থাপন করার জন্য নির্দেশ দিলাম।

হিংগলগঞ্জ হাসনাবাদ থেকে বারো মাইল দক্ষিণে পথের মাঝখানে দুটো নদী। ১৯৭১ সালের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ক্যাপ্টেন হুদা ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ও ২০টি রাইফেল নিয়ে হিংগলগঞ্জের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। হাসনাবাদ ও হিংগলগঞ্জ এর মধ্যে যাতায়াতের ব্যবস্থা ছিল তিন চাকা বিশিষ্ট টেম্পো নামে এক প্রকার গাড়ী আর নৌকা। ইছামতী নদী নৌকায় করে পার হতে হতো। কিন্তু এই নদীটা পার হওয়া খুব একটা নিরাপদ ছিল না। কারণ ওপারে নদীর তীর বরাবর পাকবাহিনী অসংখ্য বাস্কার ও ট্রেঞ্চ খনন করে ওদের ঘাঁটি সুদৃঢ় করে নিয়েছিল। এই ঘাঁটিগুলো ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে একজন পথিকেরও চোখে পড়তো। হিংগলগঞ্জএ ভারতের ৭২ নং সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর একটা স্থায়ী ফাঁড়ি আছে। ক্যাপ্টেন পান্ডে এর অধিনায়ক তিনি তার ফাঁড়ির এক মাইল দক্ষিণে একটি ঘাঁটি বানাতে ক্যাপ্টেন হুদাকে সবরকম সাহায্য করলেন। এ ঘাঁটিটা ইছামতী নদীর তীর থেকে আধ মাইল ভিতরে। এর ঠিক উল্টো পারে পাক-হানাদারের সুদৃঢ় পর্যবেক্ষণ ফাঁড়ি। এখানে ঘাঁটি স্থাপন করা কত কষ্টসাধ্য ক্যাপ্টেন হুদার তা ভালভাবেই জানা ছিল। আমারও ভাবনার অন্ত ছিল না। কেননা, অধিনায়ক হিসাবে তার চাহিদা মত তাঁবু, খাদ্য, অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, টাকা-পয়সা এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈন্যবাহিনীর মঙ্গলামঙ্গল ও অগ্রগতির জন্য অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্র পাঠাতে ব্যর্থ হয়েছিলাম। কারণ তাদের জন্য গভীর সহানুভূতি ছাড়া আমার কাছে তহবিল ছিল না। এর জন্য দুয়ারে দুয়ারে আমি পাগলের মত ঘুরেছি। শীগগীরই আমরা জীবনকে কঠিনভাবে উপলদ্ধি করতে শিখলাম এবং গভীর পারস্পরি সমঝোতার মাধ্যমে সব বিপদ, সব প্রতিকূল অবস্থাকে রুখে দাঁড়াবার নতুন শক্তিতে উদ্বুদ্ধ হলাম।

বসন্তপুর ইছামতী নদীর পূব তীরে। কেউ শুনে বা বইয়ে পড়ে দুঃখের কাহিনী হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে না। ভারতের সীমান্তে হিংগলগঞ্জে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি মেলে দিলে দেখা যাবে ওপারে বসন্তপুর। মাঝখানে ছোট্ট ইছামতী। দুর্নিবার ইচ্ছা, ভাবাসা ও অসক্তি সত্ত্বেও ওই রূপসী বাংলার কোলে ফিরে যাওয়া আমার পক্ষে ভয়ানক কষ্টসাধ্য। কেননা, ওপারে মারণাস্ত্র নিয়ে অপেক্ষা করছিল মানবতার জঘন্যতম শত্রু। আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। ওই অসভ্য বর্বরদের হাত থেকে আমার মা-বোনদের বাঁচিয়ে আনার উদগ্র বাসনায় উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। ছটফট করতে লাগলাম। কিন্তু কি দিয়ে আমি তাদের বাঁচাবো? মাত্র ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা আর ২০টা রাইফেল নিয়ে? হ্যাঁ, এই অসম্ভব কাজেও আমরা জীবনকে বাজী রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম এবং সফল হয়েছিলাম।

১৯৭১ সালের জুন মাসের ১২ তারিখ। সকাল থেকে ভয়ানক ঝড়। ভিতরে আমার ভয়ানক অস্বস্তি। কারণ, আমি জানতাম যে, ক্যাপ্টেন হুদার সাথের ছেলেরা এই ঝড়ের মধ্যে ছেঁড়া তাঁবুতে বসে বৃষ্টির জলে অসহায়ের মত ভিজছে। তা ছাড়াও আমি ভাবলাম শত্রুর উপর অতর্কিত আঘাত আনার এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। ভাবনাটা মাথায় আসতেই আমি উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। বলিষ্ঠ যুবক ডাক্তার শাহজাহানকে তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে আমার সাথে আসতে বললাম। প্রাণ-প্রাচুর্যের জীবন্ত এই ডাক্তার সাহেব। সকাল ৮টায় আমরা দু’জনে দুটো ওভারকোট নিয়ে হাসনাবাদ থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ইছামতী পার হতে পুরো এক ঘন্টা সময় লাগলো হিংলগঞ্জে যাওয়ার পথে এটাই প্রথম নদী। বাত্যাবিক্ষুব্ধ ছোট্ট ইছামতী আজ ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। এছাড়া খেয়ার মাঝি এই দুর্যোগময় মুহুর্তে খেয়া ছাড়তেও অস্বিকার করলো। টাকায় সবকিছু সম্ভব। তাই সেই হাড্ডিসার রোগা খেয়াঘাটের মাঝি টাকার লোভ সংবরণ করে আমাদের প্রস্তাব উপেক্ষা করতে পারলো না। খুব কষ্টে নদী পার হলাম। কিন্তু বড় বিপদে পড়লাম। কেননা, কোনো টেম্পো গাড়ীওয়ালা এই দুর্যোগ ঝড়ের মধ্যে গাড়ী ছারতে সাহস পেল না। এই দুঃসাহসিক কাজে ওদের রাজী করাবার জন্য বেশ খানিকটা সময় কেটে গেল। শেষ পর্যন্ত তিনগুণ ভাড়ায় পৌছে দিতে ওরা সম্মত হলো। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আমরা বরুনহাট নামক একটা জায়গায় নদীর পাড়ে পৌছলাম। খুলনা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমার সাথে দুটো প্রধান স্থলপথে বসন্তপুরের যোগাযোগ ব্যবস্থা- একটা পারুলিয়া হতে কালিগঞ্জ ও নাজিমগঞ্জ হয়ে, অন্যটা সাতক্ষীরা- শ্যামনগর রোড। পারুলিয়া থেকে যে রাস্তাটা গিয়েছে সেটা বেশ প্রশস্ত। সিএ-বি’র রাস্তা। ভারী সামরিক যানবাহন এর উপর দিয়ে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারে। কিন্তু পরেরটা বিশেষ সুবিধাজনক নয়। তবুও পাকিস্তানী শত্রুবাহিনী প্রায়ই এই রাস্তায় চলাফেরা করতো। তাই সৈন্য চরাচল ও আক্রমণ পরিচালনার জন্য সামরিক দিক দিয়ে বসন্তপুর ভয়ানক গুরুত্বপূর্ণ। বসন্তপুর অধিকার করে উপরোক্ত রাস্তা দুটোর উপর প্রভাব বিস্তার করার অর্থ একশ’ বর্গমাইল মুক্ত এলাকা হাতের মধ্যে আসা এবং এই সংকটময় দিগুলোতে এটা একটা সাংঘাতিক ব্যাপার।

ইছামতি নদীর চাইতে বরুনহাটের এই নদীটি পাশে ছোট। কিন্তু দেখতে ভয়ংকর দৈত্যের মতো। এই অবস্থায় খেয়া পার হওয়া সাংঘাতিক বিপজ্জনক। অযথা সময় নষ্ট না করে সুযোগসন্ধানী এক নৌকার মাঝিকে বেশী টাকা দিয়ে নদী পার হলাম। কোন যানবাহন ছিল না। দীর্ঘ পাঁচ মাইল রাস্তা হেঁটে হিংগলগঞ্জে ক্যাপ্টেন হুদার আস্তানায় পৌছতে হবে। ভায়নক শীত। তার উপরে বৃষ্টিতে সারা শরীর ভিজে গিয়েছিল। হাঁটু পরিমাণ কাদা ভেঙ্গে ক্যাপ্টেন হুদার ঘাঁটিতে পৌছলাম। সামান্য একটু উচু জায়গায় তাঁবু খাটিয়ে ক্যাপ্টেন হুদা আস্তানা গেড়েছিল। তাঁবু ভেদ করে বৃষ্টির পানি পড়ছে। ক্যাপ্টেন হুদাকে বড় বিষন্ন মনে হলো। উঁচু জায়গাটার চারদিকে বৃষ্টির পানি জমে সমুদ্রের মত মনে হলো। প্রবল বৃষ্টির মধ্যে আমাকে আসতে দেখা হুদা যেন নতুন প্রাণ ফিরে পেল। মুখ তার দৃঢ়প্রত্যয়ের হাসি। কাছে গিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করলাম। ‘জয় বাংলা’ বলতেই সবাই বৃষ্টি মধ্যে লাফিয়ে পড়ে ‘জয় বাংলা’ ও ‘শেখ মুজিব জিন্দাবাদ’ ধ্বনি তুলে আমাদের স্বাগত জানালো। এই দৃশ্য অভূতপূর্ব। ইত প্রাণচাঞ্চল্য আমি আর আগে কখনও দেখিনি। ওদের সেই প্রাণচাঞ্চল্যে খুঁজে পেলাম আগামী দিনের বিজয়োৎসবের গোপন সংকেত। ওদের মনেভাবের উত্তপ্ততা লক্ষ্য করে আমি চিৎকার করে প্রশ্ন করলামঃ ‘আজ রাতেই তোমরা কি সবাই যুদ্ধ করতে রাজী আছো?’ ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ৩৫ শত লোকের মত চিৎকার দিয়ে উত্তর দিলঃ ‘হ্যা স্যার, আমরা সবাই প্রস্তু।” ওদের উচু মানসিক শক্তির পরিচয় পেয়ে আমি খুব ভরসা পেলাম। আগ্রহী কন্ঠ বললাম, ওকে। এই বলে ওদের বিদায় দিয়ে হুদার তাঁবুতে ফিরে গেলাম এবং আমরা ম্যাপের উপর ঝুঁকি পড়ে কোথায় আক্রমণ চালাতে হবে সবাইকে বুঝিয়ে দিলাম। এ ব্যাপারে সোবহান নামে একজন হাবিলদার অনেক সাহায্য করেছিল। পাকিস্তানী আক্রমণের আগে সোবহান বসন্তপুর গোয়েন্দার কাজ করেছে। কাজেই সেখানকার সব খবরই তার জানা ছিল। ক্যাপ্টেন হুদার নেতৃত্বে এই অভিযান পরিচালনার ব্যাপেরে সে অত্যন্ত বিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়েছিল।

রাত একটায় শত্রুপক্ষের বাষ্কারে ঝাটিকা আক্রমণের পরিকল্পনা। উদ্দেশ্যে, ওদের বাষ্কারে নিক্ষেপ করে কাবু করা এবং পরিত্যক্ত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাড়াতাড়ি পালিয়ে আসা। পরিকল্পাটার শুনতে মধুর ও উত্তেজনাকর লাগলেও-এই ঝড়ের রাতে এই দুঃসাহসিক কাজটা সমাধান করা ছেলেখেলা নয় তবু তারা, বা প্রথম অভিজানের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন হুদা, মোটেই দমলো না। খুব জেরে ঝর বইছিল। একবার ভালাম ঝড়ের রাতে এই বিক্ষুব্দ নদীটা পার হওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু মন থেকে এই নৈরাশ্যকে দূরীভূত করলাম। করলাম কেননা আমাদের বিজয় সম্বন্ধে আমি খুবই আশাবাদী ছিলাম। জানতাম সবাইকে বিস্মিত করে অভিযান সফল হবেই। ব্যাস্তসমস্ত হয়ে সবাই সামান্য খাবার খেয়ে নিলাম। শৌখিন পাচকেরা এসব পাক করেছিল। তারাও অভিযানে শরিক হলো। যখন আমি হুদার কাছে আমার উদ্দেশ্যের কারণ ব্যাখ্যা করছিলাম, তখন হঠাৎ করে আমার মাথায় একটা ধারণা এলো যে, একই সঙ্গে টাউন শ্রীপুরে পাক হানাদারদের অপর একটি ঘাঁটি আক্রমন করব। ভারতের সীমান্তবর্তী শহর ‘টাকি’র অপর দিকেই টাউন শ্রীপুর। সেখানে শাজাহান নামে একটা স্কুল শিক্ষকের অধীনে অনেট ট্রে- মোজাহিদ আছে। মিঃ শাজাহান বুদ্ধিমান, হাসিখুশী এবং উৎসর্গীকৃত প্রাণ। তিনি টাউন শ্রীপুরের বাসিন্দা ছিলেন এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে হালকা অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত একটি মোজাহিদ বাহিনীও গড়ে তুলেছিলেন। তারা টাউন শ্রীপুরের বাসিন্দা হওয়ায় ওখানকার পাকিস্তানী ঘাঁটির সঠিক অবস্থান, রাস্তাঘাট ও অন্যান্য খুটিনাটি সম্বন্ধে বেশ ওয়াকেবহাল ছিল। সুতরাং দুর্যোগময় রাতটার তাৎপর্য আমার কাছে দ্বিগুণ হয়ে উঠলো।

ক্যাপ্টেন হুদাকে বিদায় জানিয়ে আমি ও ডাক্তার শাহজাহান দু’মাইল রাস্তা হেঁটে ‘টাকি’ এলাম এবং মিঃ শাজাহানের সাথে আলাপ-আলোচনা করলাম। তিনি সন্তুষ্ট চিত্তে আমার অধীনে কাজ করতে রাজী হলেন। মিঃ শাজাহানের অধীনে লেঃ মুখার্জী নামে একজন অসম সাহসী যুবক কাজ করতো। সে পূর্বে যশোরের অধিবাসী ছিল এবং দাবী করতো যে, সে ভারতীয় সামরীক বাহিনীর একজন ভূতপূর্ব অফিসার। বয়স পঁচিশের কাছাকাছি। বেশ শক্তিশালী। অন্য দু’দজন মোজাহি সেকশন লিডার মিঃ ম-ল ও সোবহানের সাথে লেঃ মুখার্জী একত্রে ট্রেনিং নিয়েছ। টাউন শ্রীপুরে পাক-হানাদারদের ঘাঁটি আক্রমণ করবো শুনে মুখার্জী উত্তেজিত হয়ে উঠলো। বসন্তপুর অভিযানের মতো এখানেও এদের ইছামতী পার হয়ে যেতে হবে। ইছামতী আরও উত্তরে গোজাডাঙ্গা পর্যন্ত গিয়ে গঙ্গায় পড়েছে। ভারতীয় সীমান্তবর্তী ঘাঁটিগুলোর ঠিক অপর দিকে পাকিস্তানী পর্যবেক্ষণ ঘাঁটি। আমার সেক্টরে ইছামতী নদীর তীর বারবার দু’তিন মাইল অন্তর পাকিস্তানী ঘাঁটিগুলোর অবস্থান। সর্ব উত্তরে ‘শংকরা’। সেখান থেকে দক্ষিণ দিকে টাউন শ্রীপুর, দেবহাটা, খানজী, বসন্তপুর, উখসা ও সর্বশেষ কৈখালি। এসমস্ত পাকিস্তানী ঘাঁটিগুলোর শক্ষি বিভিন্ন রকমের। ভাবলাম, আমার প্রথম কাজ হলো, রাতের অন্ধকারে এবং গোপনে ক্রমাগত আক্রমণ চালিয়ে এই বিক্ষিপ্ত পাকিস্তানী ঘাঁটিগুলো আবিষ্কার করা। এতে করে গেরিলাদের জন্য কতকগুলো গোপন অবস্থানের পরিকল্পনা করা আমার পক্ষে সুবিধাজনক হবে। যার ফলে একটা মুক্তাঞ্চলে গড়ে তোলা যায়। বাস্তবিক পক্ষে প্রথম অবস্থায় আমার পরিকল্পনা ছিল ভারতীয় সীমান্তে টাকি, হিংগলগঞ্জ ও শসমেরনগর এই তিন জায়গায় আক্রমণ ঘাঁটি করে এর ঠিক বিপরিত দিকে পাকিস্তানী ঘাঁটি টাউন শ্রীপুর, বসন্ত পুর ও কৈখালি অধিকার করা। কিন্তু অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অপ্রতুলতা হেতু আমার আশা সফল হয়নি। তবুও আমার কল্পনার উদ্দাম গতি থামেনি। যারা নিজেদের ভাগ্য গড়তে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, আল্লাহ তাদের সাহাযোগ্য এগিয়ে আসেন। এ কথার সত্যতা প্রমাণীত হলো ১৩ই জুন-যখন ক্যাপ্টেন গুদা বাগকের মারফত খবর পাঠালো যে, সেই দুর্যোগময় রাত্রে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী ঘাঁটি আক্রমণ করে ২০ জন হানাদারকে খতম এবং ৫০টি রাইফেল, দু’টি এল-এম-জি, অনেক অসশস্ত্র, গোলাবরুদ, গ্রেনেড ও বিষ্ফোরক দ্রব্য হস্তগত করেছে। মুক্তিযোদ্ধারা ঘুমন্ত শত্রুদের উপর হামলা চালিয়েছিল। শত্রুপক্ষের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলিতে আমাদের একজন যুবক সামান্য আহত হয় মাত্র। শত দুঃখের মাঝেও বিজয়গর্বে বুক ফুলে উঠলো। লেঃ মুখার্জি, মিঃ ম-ল, সোবহান ও মিঃ শাহজাহান আমার সদর দপ্তরে এসে খবর দিল যে, তাদের আক্রমণও সফল হয়েছে। ওদের সবার মুখেই বিজয়ের হাসি। বিজয়োল্লাসে মিঃ শাজাহান আমাকে অভিনন্দন জানালো। আমিও আন্তরিকভাবে ওদেরকে স্বাগত জানালাম। আমার সুন্দরবনের ব্যর্থতার গ্লানি আজ যেন কিছুটা লাঘব হলো। পরক্ষণেই প্রতিহিংসার দাবানল আমার ভেতর আবার দ্বিগুণভাবে জ্বলে উঠলো। মিঃ শাজাহানের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা ৩৫টি রাইফেল ও প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র অধিকার করেছিল। এই বাড়তি অস্ত্রশস্ত্র হাতে আসায় আমার আক্রমণ পরিচালনা ঘাঁটির পরিধি আরও প্রসারিত করতে মনস্থ করলাম। ওই দিনই মিঃ শাজাহানের সহায়তায় টাকিতে আমার অন্তর্বর্তীকালীন ঘাঁটি স্থাপিত হলো। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানী দক্ষ সৈন্যর উপর দুর্যোগের মধ্যে হামলা চালিয়ে এই বিরাট সফলতা অর্জন করার জন্য আমি ক্যাপ্টেন হুদা, মিঃ শাজাহান, লেঃ মুখার্জী ও মিঃ মণ্ডলকে অভিনন্দন জানালাম। একই সঙ্গে খুব অল্প সময়ের ভেতর সীমান্তবর্তী সমস্ত পাকিস্তানী ঘাঁটিগুলো আক্রমণ করার ইচ্ছা ওদের কাছে প্রকাশ করলাম। এছাড়াও আর একটা জিনিসের উপর জোর দিলাম যে, সীমান্তের ওপারের ছেলেদের জোগাড় করে এই মুহূর্তেই ওদের ট্রেনিং দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। এই জন্য টাকি থেকে দুই মাইল দুরে ‘টকিপুরে’ একটি যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলার পরিকল্পনা নিলাম। সীমান্তের ওপার থেকে ছেলে জোগাড় করার দায়িত্ব মিঃ শাজাহনকে দিলাম। বসন্তপুর ও টাউন শ্রীপুরে আমাদের সফলতার খবর সর্বাধিনায়কের কানে শিগগিরই পৌঁছে গেল। ভবিষ্যতে আরও এরকম সফলতা আশা করে তিনি স্বাগত জানালেন।

ইতিমধ্যে সামরিক বাহিনীর অনেক লোক ও স্কুল-কলেজের ছাত্র সীমান্ত পার হয়ে এপারে চলে এলো। ছাত্রদের টাকিপুর যুবকেন্দ্রে ট্রেনিং-এর জন্য এবং সামরিক বাহিনীর লোকদের হুদায় ঘাঁটিতে পাঠিয়ে দিলাম। ওদের সাথে বরিশাল থেকে এম, এ, বেগ নামে একজন লোক এসে পৌঁছলো। যুবক, শিক্ষিতও চটপটে। গায়ের রং কালো, সারা মুখমণ্ডলে প্রতিভা ও চাঞ্চল্যের স্বাক্ষর ও সে পাকিস্তান সৈনাবাহিনীতে একজন দক্ষ প্যারাসুট সৈনিক ও একজন ফ্রগম্যান হিসেবে অনেক দুঃসাহসিক কাজে নিযুক্ত ছিল। এই কাজে ওর সমতুল্য বড় একটা কেউ ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানের চেরাটে’ দীর্ঘ আট বছরের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের পর পাকিস্তানের নৌবাহিনীতে ‘মিডশীপম্যান’ হিসেবে প্রশিক্ষণ নেয়। ওখান থেকে ১৯৭১ সারের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে সে বাংলাদেশ পালিয়ে আসে। এ রোমঞ্চকর জীব ছেড়ে পালিয়ে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করায় সে উত্তর দিল – ‘বাংলাদেশ’।

আরোও দুটো সাহসী ছেলেকে সাথে নিয়ে বেগ জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে হাসনাবাদ পৌঁছলো। বরিশাল জেলার স্বরূপকাঠি থানার কুড়িগ্রাম নামক একটা গ্রামে পাক হানাদারদের সাথে সংঘর্ষের এক চমকপ্রদ কাহিনী শুনালো সে। জায়গাটা স্বরূপকাঠি থানার অনেক ভেতরে। এখানে সারি সারি অনেক পেয়ারা বাগান আছে। দুটো সারির মাঝখানটা নালার মত। সেখানে যে কেউ অনায়াসে আত্মগোপন করে থাকতে পারে। বেগ প্রায় একশ’ ঝানু মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে দিনের বেলায় এই নালার মধ্যে লুকিয়ে থাকতো এবং রাতের অন্ধকারে ওখান থেকে বেরিয়ে এসে হানাদারদের উপর আঘাত হানতো। সবার কাছে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না। কারো কারো কাছে মান্ধাতায় আমলের তীর-ধনুক, বর্শা ইত্যাদী থাকতো। বেগ-এর বাহিনীর অবিরাম আক্রমণে বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত পাক-হানাদার একদিন, এক দালালের কাছে খবর পেয়ে দিনের বেলায়াই ওদের উপর আক্রমণ চালাবার জন্য অগ্রসর হলো। বেগও ঠিক সময়মত বাহকের মারফত হানাদারদের অগ্রসর হবার সংবাদ জেনে গেল এবং হাতের কাছে যে সমস্ত আগ্নেয়াস্ত্র ও পুরনো আমলের তীর-ধনুক পাওয়া গেল-তাই নিয়েই ওর লোকজনদের প্রধান প্রধান জায়গায় বসিয়ে দিল। একদিকে নগণ্য অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত বাংলার দুর্জয় মুক্তিবাহিনী, অন্যদিকে আধুনিকতম অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পৃথিবীর অন্যতম দুর্ধর্ষ পাকিস্তানী সৈন্য। সবাই প্রস্তুত। কিন্তু প্রাচিন রোন নগরী বা অন্য কোন ইতিহাসপ্রসিদ্ধ যুদ্ধের মত এখানে বেজে উঠলো না কোন রণদামামা। উত্তেজনা চরমে উঠলো যখন দালালরা প্রায় ৫০ জন হানাদারকে সাথে নিয়ে এস পেয়ারা বাগানের ভেতর তল্লাশী চালাতে বললো। হানাদাররা বাগানে ঢুকে খুব সর্তকতার সাথে বাগানের গভীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করলো। দক্ষ শিকারীর মত বেগ তার দুঃসাহসিক মুক্তিবাহিনী নিয়ে অসম্ভব রকমের চুপচাপ। কোন সাড়াশব্দ নেই। ওরা অপেক্ষায় ছিল কতক্ষণে শত্রুপক্ষ বন্দুকের নলের আওতায় আসবে। পাক হানাদাররা মুক্তিযোদ্ধাদের ‘মুক্তি’ বলে ডাকতো। অনেক তল্লাশী চালিয়ে কোন ‘মুক্তির’ খোজ না পেয়ে হানাদাররা পাক পেয়ারায় ভর্তি একটা গাছের উপর বিশ্রাম নিতে লাগলো। আর কি! চতুর্দিক থেকে আচমকা ছুটে আসতে লাগলো বন্দুকে গুলি, তীর, বর্শা ইত্যাদি। হতভম্ব হয়ে হানাদাররা চিৎকার করতে করতে এদিক ওদিক ছুট দিল। ঘটনাস্থলেই ২০ জন হানাদার খতম হলো। বাদবাকিগুলো জীবনের মায়ায় পেয়ারা গাছের ভেতর দিয়ে দৌড়াতে লাগলো। ওদের পলায়নের পালাটাও খুব আরামে কাটলো না। বাগানের বোলতা ও মৌমাছি ভয়ানকভাবে ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হাতেমুখে হুল ফুটাতে লাগলো।

পরে শুনেছি, পেয়ারা বাগানের এই পরাজয় হানাদারদের মনোবল ভেঙে দিয়েছিল। এই বোকাগুলো শেষ পর্যন্ত স্থানীয় লোকজন দ্বারা সম্পূর্ণ পেয়ারা বাজান কেটে ফেলে আগুন ধরিয়ে দেয় যাতে করে ভবিষ্যতে ওরা নিরাপদ হতে পারে। এই ঘটনার পর বেগ তার গোপন আড্ডা দিয়ে অন্য আর একটি জায়গায় গিয়ে ‘যাদু’ দেখাবার আয়োজন করছিল। ঠিক এই সময় গোলাগুলির অভাব দেখা দিল। তাই ওকে বাধ্য হয়ে সুন্দরবনের গোপন পথ ধরে হাসনাবাদ আসতে হয়েছে। এই সময় বেগের মত একজন দক্ষ লোকের সাহায্য ও সহযোগিতার খুবই প্রয়োজন ছিল। কেননা, সে নতুন মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা পদ্ধতি ও কলাকৌশল সম্বন্ধে প্রশিক্ষণ দিতে পারবে। তার ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গিয়ে শত্রুদের উপর আঘাত হানবে। কিন্তু ওকে আমি যেতে দিলাম না। প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে ওকে ক্যাপ্টেন হুদার কাছে পাঠালাম। বেগকে পেয়ে ক্যাপ্টেন হুদা ওর কাঁধেও কিছুটা দায়িত্ব চাপিয়ে দিল।

বসন্তপুর ঘাঁটি ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে আক্রমণ পরিচালনা করার দায়িত্ব ওদের একলার উপর ছেড়ে দিয়ে আমার দৃষ্টি আরও দক্ষিণে শমসেরনগরে দিকে নিবদ্ধ করলাম। হাসনাবাদ থেকে শমসেরনগরের দূরত্ব চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ মাইল। আক্রমণ পরিচালনার জন্য কৌশলগত কতকগুলো মূল অসুবিধা ছিল। প্রথমতঃ জায়গাটা আমাদের আওতা থেকে অনেক দূরে। যাতায়াত ব্যবস্থা একমাত্র নদীপথ। দ্বিতীয়তঃ যদিও ভারতীয় সীমান্তবর্তী ফাঁড়িতে একটা বেতার ব্যবস্থা ছিল, তবুও আমাদের নিজস্ব কোন বেতারযন্ত্র না থাকায় এতদূর নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করা আমাদের পক্ষে কষ্টসাধ্য। তাছাড়াও নতুন আক্রমণ ঘাঁটি স্থাপন করার আগে জনশক্তিও প্রয়োজন উপকরণ সামগ্রীর স্বল্পতার কথা চিন্তা করতে হবে। এই সমস্ত সমস্যা বিদ্যমান থাকা জনশক্তিও প্রয়োজন উপকরণ সামগ্রীর স্বল্পতার কথা চিন্তা করতে হবে। এই সমস্ত সমস্যা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও নতুন করে কোন কিছু করতে যাব কিনা এ বিষয়ে নিজে নিজে ভাবছিলাম। সৌভাগ্যবশতঃ একদিন ভোরে ২০০ ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা বিহার প্রদেশের ‘চাকুলিয়া’ থেকে এসে হাজির হলো। এইসব যুবক মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে ‘ক্রাশ প্রোগ্রামে’ ট্রেনিং লাভ করে। প্রয়োজনের সময় ওদের প্রেয়ে খুব স্বস্তি অনুভব করলাম। সংবাদ বাহকে মাধ্যমে আমাদের সর্বাধিনায়কের কাছ থেকে একখানা চিঠি পেয়ে আরও খুশি হলাম। তাতে লেখা ছিলঃ “ব্যারাকপুরে চার্লি সেক্টর থেকে এই দু‘শো’ মুক্তিযোদ্ধারা জন্য শীগগীরই অস্ত্রশস্ত্র পেয়ে যাবেন।” সংবাদটা দ্বিগুণ জোরে আমার কানে বাজতে লাগলো দু‘শা’ রাইফেল।

সংবাদটা পাওয়ার পরেই মোজাহিদ ক্যাপ্টেন মিঃ শাজাহানকে ডেকে টাকির কাছাকাছি কোথাও একটা ঘাঁটি স্থাপন করার জন্য স্থান নির্বাচন করতে বললাম। নিরাপত্তার খাতিরে আমি চাইনে যে, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা অদক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে টাকিপুর যুদ্ধক্ষেত্রে এক হয়ে মিশে থাক। আমার দপ্তরে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে মিঃ খুরশীদকে নিয়ে জীপে চাপলাম। খুরশীদ তথাকথিত আগরতলা মামলার একজন আসামীও ছিলো। সে সাধারণতঃ লেঃ খুরশীদ নামেই পরিচিত। জীবনের মূল্যবান অংশটা সে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে কাটিয়েছে। একথা সে আমাকে প্রায়ই সম্মরণ করিয়ে দিত। মিঃ খুরশীদ খুব সরল, সৎ ও দেশপ্রেমিক। মুখে সবসময় হাসি। এই ভদ্রলোকটি বন্ধুবান্ধবের জন্য যে কোন সময় নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিতে পারতো। একমুখ দাড়ি-প্রশস্ত দৃষ্টিভঙ্গী। খুরশীদকে একজন পাক্কা গোয়েন্দার মত লাগতো। জন্ম থেকেই সে আশাবাদী। ভয়ানক দুঃসময়ে ওকে আমি হাসতে দেখেছি। তার সাহচর্য পেয়ে খুব আশ্বস্ত হলাম এবং তাকে নিয়ে আমাদের সর্বাধিনায়কের সাথে দেখা করার জন্য তাঁর সদর দপ্তরে রওনা হলাম। কি আর বলবো- তিনি এমন একটা জায়গায় সদর দপ্তর স্থাপন করেছিলেন, যার নাম নিরাপত্তার (!) খাতিরে প্রকাশ করা যায় না। যা হোক, কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে তাঁর সাথে সাক্ষাৎপর্ব শেষ করলাম। কারণ, তিনি স্বল্পভাষী। বেশী কথাবার্তা বলে তাঁর সাথে সাক্ষাৎপর্ব শেষ করলাম। কারণ, তিনি স্বল্পভাষী। বেশী কথাবার্তা পছন্দ করতন না। কোলকাতাতেই মিঃ খুরশীদ, সুলতান আহমেদ নামে চটপটে এক ভদ্রলোককে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। আলাপ পরিচয়ে বুঝতে পারলাম মিঃ সুলতান আহমেদ বেগের একজন প্রশিক্ষণ-গুরু। এই সংবাদে শুধু সাহসই পেলাম না, রীতিমত উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। কেনা, এতে করে আমার নতুন আখড়ায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছেলেদের আরও উন্নত প্রণালীতে শিক্ষা দেওয়ার সুযোগ এস গেল। আর এ জন্য মিঃ সুলতানের তত্ত্বাবধানে কাজ কার জন্য বেগকে নির্দেশও দিলাম।

সুলতান ও খুরশীদকে সংগে করে কর্মচঞ্চল কোলকাতার রাস্তা দিয়ে ব্যারাকপুরের দিকে ছুটলাম। চার্লি সেক্টর খুঁজে বের করতে বেশ সময় লেগে গেল। কেননা, এটা একটা নতুন সংস্থা। আমার ও মেজর ওসমানের সেক্টও থেকে আক্রমণ পরিচালনায় সমন্বয় সাধনের জন্য ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী এই সংস্থা স্থাপন করেছে। সংক্ষেপে চার্লি সেক্টরের পরিচয় হলো- এর অধিনায়ক একজন ব্রিগেডিয়ার, তাঁর অধীনে দু’জন মেজর, দু’জন ক্যাপ্টেন এবং কয়েকজন কেরানী। ব্রিগেডিয়ার জানালেন যে, ভবিষ্যৎ আক্রমণ পরিচালনার জন্য সম্ভাব্য সব রকমের সাহায্যের জন্য তিনিই দায়ী। সব সময় তাঁর ও ষ্টাফেল সক্রিয় সহযোগিতা পাব বলে আশ্বাস দিলেন। দুর্যোগময় চারটি মাসের ব্যথা-বেদনা, হতাশা ও অনিশ্চয়তার মাঝে এই প্রথমবারের মত সক্রিয় আশ্বাসের বাণী শুনলাম। এই প্রতিশ্রুতি আমাকে ভরসা দিল, সাহস যোগালো। আমর ঝিমিয়ে পড়া মনটাকে আবার আশা- আনন্দের নতুন উদ্দীপনায় সজীব করে আরও কঠিনভাবে শত্রুপক্ষের উপর আঘাত হানার জন্য ফিরে এলাম আমার সদর দপ্তরে হাসানাবাদে।

এক এক দলে ছ’জন করে মোট ষাটজন মুক্তিযোদ্ধাকে জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে খুলনা পাঠিয়ে দিলাম। উদ্দেশ্য, শহরের ভেতরে ও চতুর্দিকে গেরিলা ঘাঁটি স্থাপন করা। মুক্তিযোদ্ধাদের বলে দিলাম, প্রাথমিক কাজ সমাধা করার পর যারা পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে, তাদেরকে আমার ঘাঁটিতে ফেরৎ পাঠিয়ে দিতে- যাতে করে ওরা চেনা গোপন পথ ধরে পরপর গেরিলা দলকে বাংলাদেশের ভেতরে নিয়ে যেতে পারে। এই গিরিলা পদ্ধতি প্রবর্তন করার প্রথম উদ্দেশ্য হলো বিকল্প গোপন পথ খুঁজে বের করা। দ্বিতীয়তঃ নির্ভরযোগ্য স্থানীয় লোকদের সহায়তায় শহরের ভেতরে ও তার চতুর্দিকে গোপন ঘাঁটি স্থাপন করা। তৃতীয়তঃ পথপ্রদর্শকদের ফেরত পাঠিয়ে খবরাখবর আদান-প্রদান কর। তখনকার দিনে এই কাজগুলো সমাধা করা খুবই কষ্টসাধ্য ছিল। কেননা, পাকিস্তানী পশুগুলোর হিংস থাবা গ্রামবাংলার সব জায়গায় তখন ছড়িয়ে পড়েছে। তবুও অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা কঠিন আত্মবিশ্বাসের দুটো কারন হতে পারে। প্রথমতঃ খুলনার অধিবাসী দ্বিতীয়তঃ পাকিস্তানী হানাদাররা নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠলেও ভেতরের জনসাধারণের আওয়ামীলীগের উপর আস্থা ছিল। গেরিলাদের কাছে ছিল ষ্টেনগান গ্রেনেড ও চাকু। ওদের নিরাপত্তা ও পথে যদি ওরা হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে অথবা শত্রুর সামনে পড়ে তাহলে ওদের মোকাবেলা করার জন্য কিছু হালকা ধরনের বিস্ফোরক দ্রব্যও সাথে দিয়ে দিলাম। প্রাণঢালা আশীর্বাদ করে আগের নির্দেশানুযায়ী ওদের বিভিন্ন রাস্তায় পাঠিয়ে দিলাম।

সময়টা ছিল ১৪ই জুলাইয়ের রাত্রি। শত্রুপক্ষের সামরিক যন্ত্রটাকে শুদ্ধ করার জন্য শিল্প এলাকায় আমার দ্বিতীয় পর্বের আক্রমণ শুরু হলো। শিল্প এলাকাগুলোর কার্যক্ষমতা অচল করে দিতে পারলে সামরিক যন্ত্রটাকে বাঁচিয়ে রাখার মত হানাদারদের অর্থের অনটন ঘটবে। এই কাজটা খুবই মর্মান্তিক। কেউই চায় না তার নিজের দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিসাধন বা ধ্বংসপ্রাপ্ত হোক। এছাড়া কোন উপায় ছিল না। কেননা, আমাদের সামগ্রিক সাফল্য অর্জনের জন্য এ কাজটা ভয়ানক প্রভাব বিস্তার করবে এবং সেই সঙ্গে শত্রুপক্ষের আক্রমণধারাও পংশু করে দেবে। ইতিমধ্যে ক্যাপ্টেন হুদাও তার ঘাঁটি থেকে আক্রমণের গতি বেশ সন্তোষজনকভাবে বাড়িয়ে দিল। জুলাই মাসের শেষ নাগাদ ৩৫ জনের ছোট্ট বাহিনীটি বাড়তে বাড়তে ৩৩০ জনে এসে দাঁড়ালো। শত্রুপক্ষের উপর রীতিমত আক্রমণ চালিয়ে তারা বেশ কিছুটা সাফল্য অর্জন করলো। বেগের অক্লান্ত সহযোগিতায় হুদা পাকবাহিনীর তিনটি সীমান্ত ঘাঁটি ধ্বংস করে দেয়। এর ভেতর ছিল দক্ষিণে উকসা, বসন্তপুরের উত্তরে দেবহাটা ও খানজী সীমান্ত ফাঁড়ি। মাইন, ডিনামাইট ও গ্রেনেড বিস্ফোরণে ওই ফাঁড়িগুলো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। উকসা অঞ্চলে পাকিস্তানী সৈন্যরা পাহারায় বেরুলে মুক্তিযোদ্ধারা কিভাবে ওদের কাবু করেছিল, সে সম্বন্ধে হুদা আমাকে একটি চমপ্রদ কাহিনী শোনালো। ওঁৎ পেতে পাকিস্তানী সৈন্যদের উপর আঘাত হানার জন্য জুলাই মাসের ২৮ তারিখ ক্যাপ্টেন হুদা ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধারা একটি দল নিয়ে ইছামতি পার হলো। পাকিস্তানী সৈন্যরা উকসা ঘাঁটিতে খুব ভোরে পাহারায় বেরুতো। হুদা ও তার সাথের লোকের একটা খুঁটির সাথে ‘জয় বাংলা’ পতাকা লটকিয়ে তারা চারিদিকে ‘এন্টিপার সনাল’ মাই পুঁতে রেখে নিকটবর্তী একটা ধানক্ষেতের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। হঠাৎ করে ওরা ফিস ফিস শব্দে শুনতে পেল। পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তখনও গাছের ফাঁকে ফাঁকে কিছু কিছু আবছা অন্ধকার। হুদা ও তার সাথের লোকন জলভর্তি ধানক্ষেতের মধ্যে চুপচাপ প্রস্তুত হয়ে রইলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ হানাদাররা এদিকে আসলো না। উড়ন্ত ‘জয় বাংলা’ পতাকাটা চোখে পড়তেই মাথাভারী কুত্তার দল তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো এবং ওটাকে নামিয়ে পুড়িয়ে ফেলার জন্য বিশ্রী ভাষায় গালিগালাজ করতে করতে ছুট আসলো। আর যায় কোথায়? গমস্ত পৃথিবীটাকে কাঁপিয়ে প্রচ- বিস্ফোরণ। হাতির মত পাকিস্তানী দৈত্যগুলো টুকরো টুকরো হয়ে ছিটকে পড়লো এবং হুদা তার লোকজন ও শত্রুদের পরিত্রক্ত অস্ত্র নিয়ে নিরাপদে ঘাঁটিতে ফিরে এলো।

আমার মনে পড়ে, ‘ভট্টাচার্য’ নামক দশ বছরের একটি ছেলে বেগের বিশেষ ‘বাহিনীতে’ যোগ দেয়। এই বিশেষ বাহিনীটির নাম ‘হার্ড কোর অব সার্জেন্টস’। এর বিশেষত্ব ছিল বারো বছরের ঊর্দ্ধে কোন বালককে এই বাহিনীতে নেয়া হতো না। নতুন এসেও, ভট্টাচার্য কঠিন পরিশ্রমের বলে সার্জেন্ট মেজরের পদে উন্নতী হলো। সে নিজের অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। উপরন্ত, চারদিকে শত্রুথাকা সত্ত্বেও তাদের অবস্থান, শক্তি, সাতক্ষীরা- কালিগঞ্জ রাস্তায় পারূলিয়া ব্রীজের খুঁটিনাটি-সব মূল্যবান সংবাদ সংগ্রহের জন্য তার ক্ষুদে বাহিনীকে যোগ্যতার সাথে পরিচালনা করেছি। পারুলিয়া ব্রীজটা লম্বায় প্রায় ১৫০ ফুট। এই ব্রীজের উপর দিয়েই হানাদাররা তাদের রসদসম্ভার, অস্ত্রশস্ত্র কালিগঞ্জ ও বসন্তপুরের নিয়ে যেত। ব্রীজটার উপর হামলা চালানোর দিন ভট্টাচার্য রাতের অন্ধকারের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে ব্রীজের এক প্রান্তে পাহারারত সান্ত্রীদের কয়েক গজের মধ্যে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। আর এদিকে বেগ ব্রীজের নিচে বিস্ফোরক দ্রব্য রেখে দিল। সংকেত দিতেই এই দশ বছরের সার্জেন্ট মেজরটি ঝোপের আডাল থেকে শত্রুর দিকে গ্রেনেড ছুড়ে মারলে কোনদিক থেকে গ্রেনেড ছুঁড়েছে টের পাবার আগে সান্ত্রীরা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। তারপর সার্জেন্ট মেজরটি তার ছোট্ট কনুইয়ের উপর ভর করে হামাগুড়ি দিয়ে পূর্বনির্ধারিত স্থানে বেগের সাথে এসে মিলিত হলো এবং নীরব অপেক্ষা করতে লাগলো কখনো বিস্ফোরণের ভয়ানক গর্জনটা কানে ভেসে আসবে। দীর্ঘমেয়াদী বিস্ফোরক দ্রব্য বুকে নিয়ে ব্রীজটা অসম্ভব সকমের নীরব ও শান্ত। মগজহীন হানাদার সান্ত্রীরা ভারী বুট পায়ে ব্রীজের অপর প্রান্তে পায়াচারি করছিলো। বেগ হাতঘড়িটার দিকে তাকালো। সময় আসন্ন। উহ কি ভয়ানক উত্তেজনা। প্রচ- শব্দ করে ব্রীজের বেশীর ভাগ অংশ উড়ে গেল। আর পোশাক পর পাকিস্তানী পশগুলো চিরদিনের জন্য ভেসে গেল স্রোতের জলে।

আমাদের উপর্যুপরি সাফল্যে একদিন যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল উন্নত হলো, অন্যদিকে অনেকগুলো অসুবিধাও দেখা দিল। কেননা, মুক্তিযোদ্ধারা ঘন ঘন আক্রমণ করায় পাক হানাদাররা ক্ষেপে গিয়ে সীমান্ত অঞ্চলের লোকজনের উপর চরম অত্যাচার আরম্ভ করলো। ওদের অকথ্য অত্যাচারের ফলে স্থানীয় লোকজন আমাদের উপর কিছুটা বিরূপ মনোভাবাপন্ন হয়ে উঠলো। এর ফলে আমাদের গেরিলা কৈৗশল অনেকটা ব্যাহত হলো। বেসামরিক জনসাধারণ আমাদেরকে শত্রুমনে করতো না। কোন অঞ্চল মুক্ত হলে সেখানে আমরা অবস্থান করি, এটা তারা মনে মনে সব সময় কামনা করতো। কিন্তু নানান অসুবিধার জন্য আমরা মুক্তাঞ্চলে থাকতাম না। প্রথমতঃ প্রকৃতপক্ষে কোন জায়গা দখলে রাখা আমাদের উদ্দেশ্য ছিল না, দ্বিতীয়তঃ আমাদের ছেলেরা আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নয়। তৃতীয়তঃ লোকসংখ্যা ও অস্ত্রশস্ত্রের দিক দিয়ে ওরা আমাদের চাইতে অনেক উন্নত। খ-যুদ্ধ চালাবার মত শক্তি আমাদের ছিল না। সুতরাং একমাত্র কৌশল আমাদের সামনে যা খোলা ছিল, সেটা হলো সেই পুরানো কায়দা-‘আক্রমণ করো এবং পালিয়ে এসো।’ এই কৌশল আবলম্বন করায় যুদ্ধক্ষেত্রের চারদিকের নিরীহ লোকদের জীবনে নেমে আসলো অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট। কিন্তু আমাদের কোন বিকল্প পন্থাও ছিল না।

শাসনকার্য পরিচালনার জন্য কিছু লোক হিংগলগঞ্জ রেখে ক্যাপ্টেন হুদা ইতিমধ্যেই তার দপ্তর উকসা নিয়ে এসেছে। উকসায় তাঁকে পর্বতপ্রমাণ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কেননা, নদীর তীর বরাবর উঁচু বাধ ছাড়া আর কোন জায়গা ছিল না, যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য ঘাঁটি গেড়ে বসতে পারে। বঁধের নীচে যতদূর চোখ যায় শুধু কর্দমাক্ত ধানক্ষেত। অন্য কোন উপায় না থাকায় বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য গর্ত খুঁড়ে তার মধ্যে মাথা গুঁজতে হতো। তাড়াতাড়িতে খোঁড়া এই ব্যূহগুলো প্রবল বৃষ্টির ঝাপটা সহ্য করতে পারতো না। এই মুক্তিযোদ্ধারা অনেক সময় বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে ভিজতো। বেশীর ভাগ সময় আধপেটা খেয়ে দিন কাটাতো। কেননা, রান্নাবান্না কার অনেক অসুবিধাও ছিল। যুদ্ধে পাঠিয়ে দিয়ে হুদা ওদের মনোবল বাঁচিয়ে রেখেছিল। ভাবতে অবাক লাগে, মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়ার চাইতে যুদ্ধের দিকে আসক্তি ছিল বেশী। শত্রুর উপর হামলা করার জন্য ক্যাপ্টেন হুদা ও সহ-অধিনায়ক বেগ দুশো মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে একদিন রাতে শ্যামনগরের দিকে অগ্রসর হলো। সময়টা এমনভাবে নির্ধারিত করা হয়েছিল যে রাত্রে রওনা হয়ে ভোর হওয়ার কিছু আগেই শ্যমনগর পৌঁছে যায়-যাতে করে মুক্তিযোদ্ধাদের ছোট ছোট দলে ভাগ করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বসিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট সময় হাতে পাওয়া যায়।

ছোট ছোট ছেলেদের পক্ষে ধানক্ষেতের মধ্যে এই দীর্ঘ পথ হেঁটে যাওয়া খুব আরমদায়ক ছিল না। নিচে পায়ে কাঁটার আঘাত, উপরে ঠাণ্ডা বাতাস আর বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ওরা অন্ধকারের ভেতর এগিয়ে চললো শ্যামগরের দিকে। পথের সাময়িক বাধাকে ওরা ভ্রক্ষেপই করলো না। কেননা ওদের অন্তরে ছিল বাংলার সোনালী ভবিষ্যৎ আর শ্রত্রুর প্রতি হিংসার চরম আগুন। সারাদিন তীব্র সংঘর্ষের পর সন্ধ্যা নামতেই শত্রুপক্ষের কামান, মর্টার, মেশিনগান স্তব্ধ হয়ে গেল এবং হানাদাররা চরম পরাজয় বরণ করলো। যুদ্ধক্ষেত্রের কিছু পেছনে শত্রুপক্ষের পঞ্চাশজনের একটা দল বেতারযন্ত্র ও ভারি অস্ত্রপাতি নিয়ে অবস্থান করছিল। ওদের মর্টার ও কামানের গুলি শ্যামল-শস্যক্ষেত পুড়িয়ে ছারখার করে দিল। কিন্তু আমাদের বিশেষ ক্ষতি করতে পারলো না। শত্রুপক্ষের লোকজন পালিয়ে যাবার সময় পথে গোপন স্থানে লুকিয়ে থাকা আমাদের ছেলেরা অতর্কিত ওদের উপর হামলা চালিয়ে খতম করে দেয়।

শ্যামনগর থেকে পালাবার দুটো মাত্র পথ খোলা ছিল। একটা ভেটখালির দিকে, অন্যটা বসন্তপুরের দিকে। এই দুটো রাস্তাতেই হাবিলদার সোবহান ও মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকতের অধীনে আমাদের ছেলেরা ওঁৎ পেতে বসে ছিল। লিয়াকত দুর্দান্ত সাহসী। নভেম্বর মাসের কোন সময়ে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীতে অফিসার পদের প্রশিক্ষণের জন্য চলে যায়। শ্যামনগরের উপরে এই আক্রমণ আমার সেক্টরে একটা বিরাট বিজয়। এই বিজয়ে জনসাধারণেরও মনোবল অনেকাংশে বেড়ে গেল। শত্রুপক্ষের ক্ষতির তুলনায় আমাদের তেমন বিশেষ ক্ষতি হয়নি। ওদের অনেক লোকজন মারা যায়। আমাদের চারটি ছেলের মধ্যে মারাত্মকভাবে দু’জন জখম হয়। আর দু’জন সামান্য আঘাত পায়।

শ্যামনগর মুক্ত হওয়ায় জনগণের চক্ষু খুলে গেল। ওরা এই প্রথমবারে মত মুক্তিবাহিনীর শক্তির পরিচয় পেল। হুদার কাছে খবর পাঠালাম, যেভাবেই হোক একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শ্যামনগর আমাদের দখলে রাখতেই হবে। কেনন, আমার ইচ্ছা দখলক্রত রাস্তা ধরে খুলনা, মংলা ও চালনা পোর্টে মুক্তিবাহিনী পাঠিয়ে দিয়ে শত্রুর উপর আঘাত হানবো। আমার নির্দেশমত হুদা ও বেগের উপর শ্যামনগরের সমস্ত দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে কালিগঞ্জ-বসন্তপুর অঞ্চওে শত্রুপক্ষের উপর হামলা জোরতার করার জন্যা সে নিজেই হিংগলগঞ্জে ছুটে এলো।

পদাতিক বাহিনীর দ্বারা সাহায্যযুষ্ট শত্রুপক্ষের একদল সৈন্য এই অঞ্চলে ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল। ওরা নদীপথে ইছামতী দিয়ে যাতায়াত করতে পারতো না। কিন্তু ওদের গানবোটগুলো কালিগঞ্জ বরাবর যমুনা নদী দিয়ে দক্ষিণে পাইকগাছা পর্যন্ত পাহারা দিত। যাতায়াত ও সরবরাহ ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার এটাই প্রধান রাস্তা। শত্রুদের সরবরাহ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করার জন্য উত্তর-পূর্বদিকে যমুনার তীর বরাবর গেরিলা ঘাঁটি স্থাপন করার জন্য ক্যাপ্টেন হুদাকে একটা পরিকল্পনা তৈরী করে দিলাম। যখন খবর পাওয়া গেল যে, পাকিস্তানী গানবোটগুলো যমুনায় পাহারা দিয়ে বেড়াচ্ছে, তখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটা দল ‘রিকয়েললেস’ রাইফেল নিয়ে হিংলগঞ্জ এসে ঘাঁটি গাড়লো। এই দূরপাল্লার রাইফেল দিয়ে গানবোটগুলোকে সহজেই আঘাত করা যায়। সেন বর্মা নামে একজন অল্পবয়স্ক লেফটেন্যান্ট এই বাহিনীর অধিনায়ক। ভারতের প্রধান নির্বাচনী কমিশনার মিঃ সে বার্মার পুত্র। পূর্বে বরিশাল জেলার অধিবাসি ছিলেন। এ সময় ভারতীয় সৈন্যরা সরাসরী মুক্তিযুদ্ধে অংশহগ্রহণ করতো না। প্রয়োজনবোধে মুক্তিযোদ্ধারা কোন সাহায্য চাইলে ভারতীয় সৈন্যরা পিছন থেকে শত্রুপক্ষের উপর গোলাবর্ষণ করতো। কিন্তু প্রতিভাদীপ্ত যুবক এই সেন বর্মাকে বাধা দেবে? সে ক্যাপ্টেন হুদার ইছামতী পার হয়ে হানাদারদের উপর ক্ষিপ্রগতিতে আক্রমণ চালিয়ে আবার এপারে ফিরে আসতো। ক্যাপ্টেন হুদা লেঃ সেন বর্মাকে সহযোগী হিসাবে পেয়ে খুবই খুশী হলো।

আক্রমণ পরিচালনায় হুদার যোগ্যতার উপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখে আমি ফ্লাইট সার্জেন্ট সলিমুল্লাহকে নিয়ে শমসেরনগরে যুদ্ধ পরিচালনা ঘাঁটি স্থাপন করার পাকাপোক্ত সিধান্ত নিলাম। সলিমুল্লাহ শক্তিশালী ও সাহসী। তখনকার পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য তাকেই উপযুক্ত মনে করলাম। হাসানাবাদে আমার যে লঞ্চটি ছিল তাকে করে ত্রিশজন মুক্তিযোদ্ধাকে সলিমুল্লাহর অধীনে শমসেনগর পাঠিয়ে দিলাম। শমসেরনগর অনেক দূরে রায়মংগল নদীর তীরে অবস্থিত। এই জায়গাটার অনেক রকমের অসুবিধা ছিল। কিন্তু আমার সার্বিক যুদ্ধ পরিচালনার জন্য স্থানটার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। প্রথমতঃ আমি চাচ্ছিলাম সমগ্র সুন্দও বনাঞ্চলে আধিপত্র বিস্তার করে বাংলাদেশের অভ্যান্তরে গেরিলা ঘাঁটিগুলোতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহের জন্য একটা নিরাপদ রাস্তা। দ্বিতীয়তঃ আমি ভাবছিলাম বাংলাদেশের অভ্যান্তরে একটা আক্রমলকারী দল পাঠিয়ে বরিশাল, পটুয়াখালী ও গোপালগঞ্জে যেসব বিক্ষিপ্ত মুক্তিবাহিনী শত্রুপক্ষের উপর আক্রমণ পরিচালনা করে তাদের সাথে একটা সুষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন করা। মুক্তিযোদ্ধাদের কোন তাঁবু, রেশন ও পোশাক না থাকা সত্ত্বেও সলিমুল্লাহ হৃষ্টচিত্তে শুধুমাত্র সাহসের উপর ভর করে আগষ্ট মাসের শেষদিকে শমসেরনগরে ঘাঁটি স্থাপন করতে উঠে পড়ে লেগে গেলা। বর্ষা ঋতুতেই সে ঘাঁটি বানাবার মনস্থ করলো। শমসেরনগরে ভারতীয় সীমান্তবর্তী ফাঁড়ির আধ মাইল দক্ষিণে নদীর তীরে বাঁশ দিয়ে একটা ঘাঁটির মত তৈরী করা হলো। এর চতুর্দিকে কাদাপানি। ওকে যে কাজের ঘাঁটিটার চারদিক জলকাদা। আসওে সলিমুল্লাহ সাহেব একজন কেতাদুরস্ত লোক। বর্ষা ও কাদামাটির ভেতর যখন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়তো, তখন ফ্লাইট সার্জেন্ট সলিমুল্লাহকে খুবই খুশী মনে করত। বিশেষভাবে তাগিদ দেয়ায় তার ছেলেদের জন্য বর্ষাতি পাঠিয়ে দিলাম। সপ্তাহ শেষে প্রয়োজনীয় রেশনপত্র পাঠিয়ে দিতাম। সলিমুল্লাহর তেমন আর কোন অভিযোগ ছিল না। শুধু প্রধান লঞ্চচালক মোশাররফ মিযা মাঝে মাঝে অস্ত্রশস্ত্রের একটা বড় তালিকা নিয়ে হাজির হতো।

শমসেরনগর যাবার কিছুদিন পরেই কৈখালিতে পাক বাহিনীর উপর উপর্যুপরি কয়েকবার হামলা চালিয়ে সীমান্তবর্তী ঘাঁটিটা অধিকার করি এবং সরাসরি এপারে সলিমুল্লাহ আর একটা ঘাঁটি স্থাপন করে। ইতমধ্যে সুন্দরবনের ‘রাজা’ নওয়াবদীর সাথে পরিচয় হয়। সুন্দরবন এলাকায় এই নওয়াবদী রূপকথার সেই কালো দৈত্যটার মত। বেশ বড় মুখম-ল। সারামুখ ভর্তি দার্ড়ি। প্রায় ছ’ফুট লম্বা। দেহগঠন অত্যান্ত সুদৃঢ়। সারা সুন্দরবন এলাকায় সে একটা ভয়ানক ত্রাস। তার একমাত্র ব্যবসা চোরাচালানি। পূর্বের কুকীর্তি সত্ত্বেও, যখন আমি সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তার সাথে দেখা করলাম তখন আমার কাছে সে অত্যান্ত লাজুক, ভদ্র ও অতিথিপরায়ণ বলে মনে হলো। হ্যাঁ, মনে পড়ছে, তারিখটা ৩রা সেপ্টেম্বর।

আমার সেক্টরের একটা লঞ্চে করে যাচ্ছিলাম। আমার অধীনস্থ লঞ্চগুলো শীগগীরই ‘বাংলাদেশ নেভি’ নামে পরিচিত হলো। সেপ্টেম্বরের শেষদিক আমার নৌ-বাহিনীতে ৬টা মটর লঞ্চ যোগাড় করা হয়। এগুলো শত্রুবাহিনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল। শুধুমাত্র যাতায়াত ব্যবস্থার জন্য নিয়োজিত রাখার চাইতে আমি ভাবলাম, এগুলোকে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে গানবোটের কায়দায় ব্যবহার করা ভাল। সর্বধিনায়ক কর্নেল ওসমানীর কাছে আমি আমার পরিকল্পনার কথা জানাতেই তৎক্ষণাৎ রাজী হয়ে গেলেন। তারপর অধিনায়ক মুখার্জীর আন্তরিক প্রচেষ্টায় ভারতীয় বাহিনীকে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আমার ছ’টি লঞ্চের জন্য ৫০টি ব্রাউনিং বিমানধ্বিংসী মেশিনগান নিয়ে এলাম। হালকা মেনিগান ও ছোট ধরনের অস্ত্রশস্ত্র চালাবার জন্য এক একটি লঞ্চে দশজন করে নাবিক মোতায়েন করলাম। আমার ভাগ্য ভাল যে, আমি সব নৌ-বাহিনীর লোকজন পেয়ে গিয়েছিলাম। আগে তার পাকিস্তান নৈৗ-বাহিনীতে চাকরিরত ছিল। বদরে আলম নামে একজন বেশ অভিজ্ঞ লোকের অধীনে নৌ-বাহিনীর এইসব লোকজনকে একত্র করলাম। যুদ্ধের সময় বদরে আলমকে সম্মানসূক লেফটেন্যান্ট পদে ভূষিত করা হয়। লেঃ খুরশীদ এই নৌ-বাহিনী গড়তে আমাকে সাহায্যে করেছে। এইসব লোকেদের যোগাড় করার জন্য সে একসেক্টর থেকে আর এক সেক্টরে অক্লান্তভাবে ঘুরে বেরিয়েছে। ছেলেরা মানের মত কাজ পাওয়ায় ওর উপর খুব কৃতজ্ঞ হলো। আমার এই সংস্থাটি পরে ‘বাংলাদেশ নৌবাহিনী’ নামে পরিচিত হয়ে ভয়ানক উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল। এই বাহিনীর উপর প্রথম কাজ দেয়া হলো, সুন্দরবনের অভ্যন্তরে গেরিলা ঘাঁটিগুলোতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রীতিমত সরবরাহ করা। দ্বিতীয়তঃ নদীতে আক্রমণাত্বক পাহার দেয়া। তৃতীয়তঃ নৌ-সংক্রান্ত কাজকর্ম সুসমাধা করা। নৌ-সংক্রান্ত কাজকর্ম বলতে বুঝায়-মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নির্দিষ্ট ঘাঁটিতে নামিয়ে দেয়া। তারপর কাজ সমাধা হলে আবার তাদের ফিরিয়ে নিয়ে আসা।

সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখ রাত্রে যার সাথে দেখা হয়েছিল, সুন্দরবনের ‘রাজা’ সেই নওয়াবদী প্রসঙ্গে ফিরে আসি। হাসনাবাদ থেকে দীর্ঘ পাঁচ ঘন্টা লঞ্চে থাকার পর শমসেরনগর পৌছলাম। তখন রাত গাঢ় অন্ধকার। মূষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। এত অন্ধকার যে দু’গজ সামনে পর্যন্ত দেখা যায় না। চালকের পক্ষে লঞ্চ চালনা করা বেশ কষ্টকর হয়ে উঠলো। সার্চলাইটের আলোতে বেশীদুর দেখা যায় না। প্রমত্তা রায়মঙ্গল এর উপর ভেসে বেড়াচ্ছি। হঠাৎ তীর থেকে আমাদের উপর টর্চলাইটের আলো এসে পড়লো। অনুসন্ধানে জানতে পারলাম যে, ওটা ভরতের সীমান্ত ফাঁড়ির আলো। ওই ফাঁড়ির লোকেরা সলিমুল্লাহার আস্তানায় পৌছতে আমাদেরকে যথেষ্ট সাহায্য করলো। এই সময় বৃষ্টির মধ্যে দেখতে পেয়ে সলিমুল্লাহ আনন্দে আত্মহারা। ওখানকার সব ছেলের সাথে আমি দেখা করলাম। বৃষ্টির ঝাপটা এসে বাঁশের ঘরের মধ্যে ঢুকছিল। এই বর্ষার রাত্রেই সুন্দরবনের ‘রাজা’ নওয়াবদীর সাথে আমার দেখা হয়। পাক-বর্বরদের নৃশংস অত্যাচারে টিকতে না পেরে সুন্দরবনের হরিনগর গ্রামে তার পৈতৃক ভিটামাটির মায়া ত্যাগ করে ঝড়ের মধ্যেই পরিবারের সবাইকে তিনটি নৌকায় নিয়ে নওয়াবদী বেরিয়ে পড়ে। সুন্দরবনের রাজার চোখে জল। সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে, তার জীবন এমন দুঃখের দিন কখনো আসবে এবং পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যেতে হবে। হারিকেনের আবছা আলোতে দেখতে পেলাম তার চোখে প্রতিহিংসার আগুন। চপলমতি ছোট্ট বালকের মত হঠাৎ সেই শক্ত মানুষটা ডুকরে কেঁদে উঠলো। সে আমাকে জানালো যে মাত্র চারটা রাইফেল পেলে আজ রাত্রেই তার পরিবারের লোকজন নিয়ে সে গ্রামে ফিরে যাবে। তক্ষুনি তাকে চারটা রাইফেল দিয়ে দিলাম। নিকষ কালো লোকটা প্রচ- উল্লাসে সাদা দাঁতগুলো বের করে দুরন্ত বাতাসের সাথে দৈত্যের মত অন্তর্হিত হলো। এর ফলে শীগগীরই সে সুন্দরবনের গভীরে আমাদের গেরিলা ঘাঁটি প্রসারিত করতে নিষ্ঠার সাহে সাহায্য করেছিল।

বেগের একটি ‘যুদ্ধবাহিনী’ ছিল। তারা সবাই স্বেচ্ছাসেবী। বাংলাদেশের যে কোন জায়গায় যে কোন ঝুঁকি নিতে তারা সর্বদা প্রস্তুত থাকেতো। সংখ্যায় সব মিলিয়ে দুশো হবে। সবাই যুদ্ধ করার মত উপযুক্ত। যা কল্পনা করেছিলাম- সেই প্রস্তুতি, সেই উৎকর্ষতা ওদের মাঝে দেখতে পেয়ে আমি সুন্দরবনের গভীরে গেরিলা ঘাঁটি স্থাপন করার লোভ সামলাতে পারলাম না। সুন্দরবনটা দেখতে প্রায় ভিয়েতনামের হো চি মিন সড়কের মতো। কোন কারণে যুদ্ধ বিলম্বিত হলে, প্রাকৃতিক গুপ্তস্থানে ভরপুর এই সুন্দও বনাঞ্চল ছাড়া বাংলার আর কোন জায়গা এতটা সুবিধাজনক নয়। ব্যূহ রচনার কৌশলাদি ঠিকমত নিরূপণ করে এই অঞ্চলে যদি ঘাঁটি স্থাপন করা যায় তাহলে মুক্তিযুদ্ধ যে কোনভাবে যে কোন সময়সীমা পর্যন্ত চালিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। এই পরিকল্পনা মনে রেখে কৈখালিতে সলিমুল্লাহর জায়গায় বেগকে বসিয়ে দেয়ায় আমি তাকে শ্যামনগর থেকে নিয় এলাম। কাজ শুরু করার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে বেগকে বুড়ি গোয়ালিনী, হরিনগর ও মুন্সিগঞ্জে ঘাঁটি স্থাপন করার দায়িত্ব দিলাম। ফ্লাই সার্জেন্ট সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে রাতের বেলায় অতর্কিত হামলা চালিয়ে দু’জন পাকিস্তানী সৈন্য কয়েকজন রাজাকার খতম করে এক সপ্তাহ আগে এই ‘বুড়ি গোয়ালিনী’ অধিকার করা হয়। বুড় গোয়ালিনীতি বন বিভাগের অফিস ও একটা শক্তিশালী ট্রান্সমিটার ছিলো।

দুঃসাহসিক কাজের জন্য সলিমুল্লাহকে সম্মানসূচক লেফটেন্যান্ট পদে উন্নীত করা হয়। এই বুড়ি গোয়ালিনী অধিকার করা আমাদের পক্ষে একটা বিরাট সফলতা। কেননা, এখান থেকেই পাক সৈন্যরা সুন্দরবনের ভেতরে ও অগ্রভাগে আমাদের চলাচলের উপর নজর রাখতো এবং খবর সংগ্রহ করতো। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এই ট্রান্সমিটারটাই আমার যাত্রার উদ্দেশ্যটা ব্যর্থতার পর্যবসিত করেছিল। সলিমুল্লার কাছ থেকে দায়িত্ব নেওয়ার পর বেগ ও তার বাহিনী শত্রুপক্ষের হামলা করার জন্য অস্থির হয়ে উঠলো। গানবোটগুলির উপর আঘাত করার জন্য বেগ সবসময় ওঁৎ পেতে প্রস্তুত হয়ে থাকতো। বুড়ি গোয়ালিনি পতনের পর পাক হানাদাররা মাঝে মাঝে আমাদের ঘাঁটির নিম্নাঞ্চল গানবোট নিয়ে পাহারায় বেরুতো। অক্লান্ত পরিশ্রম করে উপর্যুপুরি কয়েকবার আক্রমণ চালিয়ে হরিনগর ও মুন্সিগঞ্জ থেকে হানাদার বাহিনী বিতাড়িত করে বেগ সেখানে গোপন ঘাঁটি স্থাপন করলো। এইসব ঘাঁটি থেকে বিতাড়িত হবার পর পাক হানাদাররা সহসা পাল্টা আক্রমণ করতো না। কোন কারণে তারা যেন নরম হয়ে গেল। আমরা কখনও আক্রমণ করলে হানাদাররা খুবই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠতো। বোধ হয় ওদের ভয় ধরেছিল যে, আমরা ওদের চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলেছি। কেননা একদিকে সুন্দরবনের উপরিভাগ থেকে বেগ ও তার দুঃসাহসী যোদ্ধারা শত্রুদের উপর ক্রমাগত আক্রমণ চালাচ্ছি, আর অন্যদিকে দক্ষিণ শরণখোলা থেকে কঠিন আঘাত হানছিল ক্যাপ্টন জিয়া।

মাত্র সীমান্ত পরিধির ভেতর সীমাবদ্ধ এই যুদ্ধে আমি খুশী ছিলাম না। কেননা, সীমান্ত এলাকা থেকে মাত্র কয়েক মাইল জুড়ে আমাদের মুক্তাঞ্চল গড়ে উঠেছে এবং পাকিস্তানের সুশিক্ষিত সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে সার্বিক বিজয় অর্জন করতে আমাদের বহু বছর লাগতে পারে। কারন ওরা বৃত্তাকারে সুদৃঢ় ব্যূহ রচনা করে দীর্ঘসূত্রতার কৌশল অবলম্বন করছে এবং যতই সময় যাচ্ছে, ওরা নিজেদের অবস্থার খুবই মজবুত করে নিচ্ছে। যদিও পাকিস্তানী হানাদাররা বৃত্তাকার যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, তবুও তারা মানসিক দিক দিয়ে একদম ভেঙ্গে পড়েছিল। তৎসত্ত্বেও ওদের উপর বড় রকমের আঘাত হানার মত অবস্থান আমাদের ছিল না। তাছাড়া, মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা যুদ্ধ পদ্ধতি সম্বন্ধেও খুব বেশী পারদর্শী নয়। তাড়াতাড়িতে যেটুকু প্রশিক্ষণ পেয়েছিল, তাতে কোন কোন খন্ডযুদ্ধে সবাইকে একত্রে জড় হয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে দেখা গেছে। এটা আমাদের পক্ষে আত্মঘাতী স্বরূপ। যখনই আমাদের বড় রকমের একটা বিপর্যয় এসেছে, তখনই দেখা গেছে যে, এটা ওদের একত্রে জড় হবার চিরাচরিত অভ্যাসের পরিণত। যা হোক, সময়ে যুদ্ধ করে সফলতা আমরা অর্জন করেছি, তা থেকে পরিষ্কারভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছি যে, যুদ্ধকৌশল নয়-আক্রমণের গতিধারা ও আক্রমণাত্মক মনোভাবটাকে যদি বাঁচিয়ে রাখতে পারি, তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের সফলতা আসবেই।

এই রুপরেখাটা মনে রেখে বিশদভাবে পরিকল্পনা তৈরী করলাম যে, দেশের প্রতি আনাচে-কানাচে মুক্তিযোদ্ধাদের ছড়িয়ে দিতে হবে ও আক্রমণের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করতে হবে প্রতি থানায়। থানা থেকে গ্রামে। গ্রাম থেকে ঘরে ঘরে-যেন শত্রুরা পিছনে দেখতে ‘আজরাইল’ ওদের সামনে। যে হারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা আমার নতুন ক্যাম্প ‘বাকুনদিয়া’ এসে জড় হচ্ছিল, তাতে ওদের জন্য যদি প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র যোগাড় করা যায়, তাহলে এই পরিকল্পনার রূপায়ণ মোটেই কষ্টকর নয়। বাকুদিয়া বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ব্যস্ততম ও বৃহত্তম পাদপীঠ-যেখানে মুক্তিগামী মানুষের এই মৃত্যুঞ্জীয় কাফেলা প্রবল প্রাণোদ্দামে ভরপুর হয়ে এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হতে উল্কার মতো ছুটে গিয়েছিল ঐ মানুষখেকো বাঘ ও হিংস্র জন্তুর অবাধ লীলাক্ষেত্র সুন্দরবনের গভীর অভ্যন্তরে এবং বাংলার মাঠে-ঘাটে, প্রতিটি গ্রামে ও গঞ্জে।

গেরিলা অভিযান

৯ নং সেক্টর আমার অধীনে সর্বসাকুল্যে তিনখানা জীপ, একটি বাস ও একটি ট্রাক ছিল। এর ভেতরে মেজর ওসমানের কাছ থেকে নেযা টয়োটা জীপটাও আছে। আমি ভাগ্যবান যে, গেরিলা পদ্ধতি প্রবর্তনের সময় এই যানবাহনগুলো পেয়েছিলাম। গাড়ী ও ট্রাকগুলো বৃষ্টির মধ্যে অনেক সময় চলতে পারতো না। এই গাড়িগুলোর অবস্থা খুবই শোচনীয় ছিল। কোননা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে এই গাড়ীগুলো বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসা হয়। তারপর থেকে এর কোন রক্ষণাবেক্ষণই হয়নি। অবশ্য শেষের দিকে ১৯৭১ সালের অগষ্ট মাসের কোন এক সময়ে ব্যারাকপুরের চার্লি সেক্টর পশ্চিম রণাঙ্গনের ‘জয় বাংলা’ গাড়ীগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেয়। এ কাহিনীর একটা দিক মাত্র। নৌকায় খালবিল দিয়ে গেরিলা পাঠানোর চেয়ে স্থলপথে পাঠানোর অনেকটা কম সমস্যা- সংকুল। স্থলপথে যারা যাবে তাদের শুধু রেশনের টাকা দিয়ে দিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু যারা জলপথে যাবে, তাদের জন্য চাই পথঘাট ভাল চেনে এইরকম উপযুক্ত মাঝি। এই সময় ওই রকম মাঝি যোগাড় করা খুবই দুষ্কর ছিল। ভাগ্য ভাল, এ ব্যাপারে আদম সন্তান পাচার করে এই রকম একজন চোরাচালানীর সাক্ষাত পেয়ে গেলাম। সারাজীবন সুন্দর বনের খাল বিল দিয়ে সে চোরাকারবার করেছে। সুতরাং মানচিত্রের চাইতেও সুন্দরবনের গোপন পথঘাটের খবর তার কাছে সঠিকভাবে পাওয়া যেত। সে প্রাণ দিয়ে কাজ করছে এবং কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে পথ দেখিয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে বরিশাল, ভোলা ও পটুয়াখালীতে নিরাপদে পৌঁছে দিয়েছে। তার নাম রইজুদ্দিন। এক সময়ের কোটিপতি। আজ তার সর্বস্ব পাকহানাদাররা কেড়ে নিয়েছে। বয়স পঞ্চাশের মাঝামাঝি, পাতলা, কালো। এই রইজুদ্দিন ভয়ানক ধূর্ত ও চটপটে একদিন সে গর্ব করে বললেঅ, “স্যার, হানাদারদের বাপের সাধ্য নেই আমাকে ধরে। কোননা, এই দীর্ঘ পঁচিশ বৎসর ওদের চোখে ধুলো দিয়ে ‘কাম’ করে আসছি। কিন্তু খোদাকে বিশ্বাস করি। তিনি নারাজ হলে যে কোন মুহূর্তে আমি ধরা পড়তে পারি।

জুলাই মাসে ৬০ জন লোকের একদল মুক্তিযোদ্ধা খুলনার উদ্দেশ্য যাত্রা করেছিল। আরও দল, পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার পথপ্রদর্শকদের আগষ্ট মাসের শেষ সপ্তাহে ফেরত পাঠিয়ে দেবার কথা ছিল। কিন্তু ওরা মাত্র চারজন ফিরে এসে খবর দিল যে, রাজাকারদের জন্য খুলনায় থাকা খুবই কষ্টকর হয়ে উঠেছে। মুসলিম লীগের পান্ডরা বাঙ্গালীদের দিয়ে এই রাজাকার বাহিনী গঠন করেছে। জুন মাস থেকেই রাজাকার বাহিনীতে লোক ভর্তি বেড়ে যায়। কেননা, ওই সময়ে বেশীভাগ জোয়ান ছেলেরা প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্ত পার হয়ে ভঅরতে চলে আসে। তখন থেকে আগষ্ট মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে একটা থমথমে ভাব। এই সময়ে রাজাকারদের ঘৃণ্য সহযোগিতায় পাক-বর্বররা নৃশংস হত্যাযজ্ঞের মাত্রা বহুলাংশে বাড়িয়ে দেয়। এর উপর এই সময়ে বিহারী মুসলমানদের নিয়ে গঠিত আর একটা বাহিনী দেশব্যাপী লুন্ঠন, ধর্ষণ ও নারকীয় হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠলো। এমনকি, ওদের প্রভুদের পশুপ্রবৃত্তিকে খুশি করার জন্য এই পা-চাটা কুকুরের দল নারী হরণ পর্যন্ত করতে এতটুকু সংকোচ বা দ্বিধা করলো না। এইসব হৃদয়বিদারক খবর শুনে আমরা যে কিরূপ মর্মাহত হয়েছিলাম, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সেই প্রতিহিংসার অনির্বাণ শিখা প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার অন্তরে দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগলো। সারা জুলাই মাস ধরে পুরো বর্ষা। দপ্তরে দপ্তরে প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা, অধিনায়ক এখনই এই মুহুতে শত্রুবাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত। সবাই যুদ্ধংদেহী চিৎকারে ফেটে পড়লো। বর্ষাকালেই শত্রুর বিষদাঁত ভেঙ্গে ফেলে বাংলার পবিত্র মাটিতে যুদ্ধ করার চিরদিনের জন্য স্তব্ধ করে দিতে হবে। মোট কথা জুলাই, আগষ্ট-এই দু’মাস মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিবিদ উভয়ের কাছেই ভয়ানক উত্তেজনাপূর্ণ। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে সবচেয়ে জরুরী কাজ হলো- বৃত্তাকার যুদ্ধে, শক্তি কেন্দ্রীভূত না করে বেশী সংখ্যায় দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযোদ্ধা পাঠিয়ে রাজাকার ও অন্যান্য গজিয়ে ওঠা সহায্যকারী সংগঠনগুলোর প্রসার এখনই স্তব্ধ করে দেয়া। আমাদের সর্বাধিনায়ক যে পরিকল্পনা অনুযায়ী ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা ও পটুয়াখালী এই চারটি জেলাকে ১৯টি অঞ্চলে বিভক্ত করা হলো। আগের কার্যক্রম অনুযায়ী এক একটি অঞ্চলে দু’একটি থেকে তিনটি থানা থাকবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আগে হতেই যেসব গেরিলা ঘাঁটি ছিল তা সর্বমোট ৮৩টি। প্রতিটি জেলা, প্রতিটি অঞ্চল, প্রতিটি থানার দায়িত্ব যথাক্রমে একজন সামরিক অফিসার, একজন জুনিয়ার কমিশন অফিসার, অথবা অভিজ্ঞ নন-কমিশন অফিসার এবং বাছাই করা একজন ছাত্রের উপর ন্যস্ত থাকবে। সকল পর্যায়ে এদের সাথে থাকবে একজন করে সহ-অধিনায়ক।

আরও স্থির করলাম যে, উপরের সংখ্যানুযায়ী একই অনুপাতে রাজনৈতিক নেতারাও তাদের সহকারীদের নিয়ে এ ঘাঁটিতে থাকবেন-যেন গেরিলারা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় কার্যকারীভাবে আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি করতে পারে। কেননা, আমি জানি যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক শক্তি সঞ্চয় ব্যতিরেকে, শুধুমাত্র সামরিক আক্রমণ পরিচালনা করেই আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবো না। রাজনৈতিক শক্তি এসে যোগ না দিলে যে কোন রকম সামরিক সফলতা, ঐক্যবদ্ধ, সমঝোতা ও সমন্বয়ের অভাবে চরম লক্ষ্যে পৌঁছা যাবে না। যা হোক, আমাদের সর্বাধিনায়ক এবং চার্লি সেক্টরের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার এন.এ. সালিক আমার পরিকল্পনাটা অনুমোদন কররেন এবং তাড়াতাড়ি এর বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশও দিলেন।

বিভিন্ন কেন্দ্রে গেরিলাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। আমি চারটি কেন্দ্রের খবর জানতাম। সেগুলো হলো, চাকুলিয়অ ও মূর্তি বিহার প্রদেশে, একটি মেঘালয়ে ও অপরটি বীরভূম জেলায়। বিভিন্ন কেন্দ্রের ছেলেদের নিকটবর্তী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। বাংলাদেশের সাহায্য ও পুর্নবাসন মন্ত্রী জনাব কামরুজ্জামান ভারতীয় সাহায্য ও পুর্নবাসন মন্ত্রীর সহযোগীতায় এই যুব এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো পরিচালনা করতেন। বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারের সাথে আলোচনা করে সাধারণ নীতিমালা গ্রহণ করেন যে, পঞ্চশ হাজার লোককে গেরিলা ও বিশ হাজার লোককে নিয়মিত সামরিক ট্রেনিং দিতে হবে। জুলাই মাসে সব সেক্টর কমান্ডারের যে আলোচনা সভা ডাকা হয়, তাতে মিঃ তাজউদ্দীন আহমদ (তখনকার প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী) একথা প্রকাশ করেন। আমাদের কেউ কেউ গেরিলা ও সৈন্য সংখ্যা এই নির্দিষ্ট অংকে সীমাবদ্ধ রাখার কারন জিজ্ঞেস করলেন। কেননা আমরা মনে করতাম যে, নূন্যতম সংখ্যার হয়তো সীমারেখা বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ঊর্ধ্বতম সংখ্যা কোন সীমারেখা থাকা উচিত নয়। মনে হল এর কারন তিনি নিজেও জানতেন না। কাজেই অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে এর কারন ব্যাখ্যা করতে তিনি ব্যর্থ হলেন। ভাবতে এখনও আশ্চর্য লাগে যে, মাত্র এই দুটো বাহিনীর উপর নির্ভর করে এত তাড়াতাড়ি তিনি বিজয়ের আশা করেছিলেন কোন আশ্বাসের উপর ভর করে?

যাহোক, এ সমস্যাটা গেরিলা যুদ্ধের অগ্রগতিকে কোনক্রমেই ব্যহত করতে পারলো না। একজন বা দু’জন ছাড়া আমার সাথে কোন অভিজ্ঞ গেরিলা নেতা ছিলনা। যে দু’একজন ছিল তারা কাজকর্ম ভালই জানতো। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলারা, যারা সময় সময় আমার ক্যাম্পে আসতো-তাদের ভিতর দিয়ে দলের নেতা হবার যোগ্যতা যাদের আছে- তাদেরকেই বেছে নিতে হলো। আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন জেলার মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয় সাধন ও যুদ্ধ পরিচালনার জন্য চারটি জেলায় চারজন সামরিক অফিসার পাঠানো প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। আগে থেকেই মুক্তিবাহিনীকে নির্দেশ দেবার জন্য খুলনা-বরিশালে ক্যাপ্টেন জিয়া এবং পটুয়াখালীতে লেঃ মেহদী ছিল। কিন্তু ফরিদপুরে কেউ না থাকায় মিঃ নুর মোহাম্মদ নাম একজন অভিজ্ঞ নৌবাহিনীর গেরিলা শিক্ষককে সেখানে পাঠিয়ে দিলাম। চারটি জেলার জন্য চারজন সামরিক অফিসার পাওয়া যাওয়ায় তাদের নির্দেশ দিলাম সৎ লোকদের ভিতর দিয়ে কমান্ডার নির্বাচন করে প্রতিটি অঞ্চল ও থানায় পাঠিয়ে দিতে। পাকিস্তানী সামরিক তৎপরতার পর থেকেই যারা নিজেদের উৎসাহে ও উদ্যোগে বাংলাদেশের ভিতরে শত্রহননের কাজে নিয়জিত আছে-তাদের সাথে যাতে করে কোন মতবিরোধ না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখার জন্য ওদের আমি প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলাম।

জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সর্বাত্মক গেরিলা আক্রমণ চালানো হয়। আক্রমণ পরিচলনার জন্য আমি তিনটি জায়গা ঠিক করেছিলাম, পশ্চিম বঙ্গের উত্তর দিকের বনগাঁর নিকট বাগদাতে একটা হাসনাবাদের দক্ষিনে শমসের নগরে একটা এবং আর একটা টাকিতে। এই তিনটি ঘাঁটির ভিতর বাগদাই সবচেয়ে ব্যস্ততম। এর কারন মুক্তিযোদ্ধারা এই পথেই সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আসতো এবং এই দিকের পথ-ঘাট ওদের ভাল জানা ছিল। শমসেরনগর ঘাঁটি থেকে বরিশাল, পটুয়াখালী ও ভোলায় গেরিলাদের পরিচালনা ও নির্দেশ দেওয়া হতো। খুলনা জেলার গেরিলারা নদীপথে টাকির সাথে যোগাযোগ রেখে কাজ করত। শত্রুপক্ষের অবস্থানের পরিবর্তনের সাথে আক্রমনের গতিপদ্ধতিও পরিবর্তিত হত। পাঁচ মাসে, অর্থাৎ জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে সরকারী হিসাবমতে আট হাজার গেরিলা আমার সেক্টর থেকে হাল্কা অস্ত্রপাতি ও বিস্ফোরক দ্রব্যসহ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠিয়েছিলাম। শতকরা পঞ্চাশজন গেরিলাকে অস্ত্র দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। বাকী সবাই কেউ গোলাবারুদ, কেউ অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে যেত। সেপ্টেম্বর মাসে অবস্থার পরিবর্তন হল। তখন থেকেই সবাই হাতে অস্ত্র পেল। তাছাড়াও রাজাকার, পুলিশ ও পাক হানাদারদের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনা অস্ত্রপাতি দিয়ে বেশি সংখ্যায় মুক্তিযোদ্ধা ভেতরে পাঠিয়ে দিলাম। এমন একটা সময় এলো যখন আমার সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাড়ালো প্রায় বিশ হাজার। মুক্তাঞ্চলে স্থানীয় অধিনায়কেরা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা আরো বাড়তে লাগলো। আমার মতে, এতে ছেলেদের কষ্ট অনেকটা লাঘব হতো। কেননা, বিপদসংকুল দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ভারতে আসার কষ্ট থেকে ওরা বেঁচে যেত। মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকলেও সফলতার পরিমাণ আশানুরুপভাবে বৃদ্ধি পায়নি। সময়ে সময়ে বাহকের মারফৎ যেসব খবর পেতা, তা থেকে এটা পরিষ্কার হয়ে উঠলো যে, মুক্তিযোদ্ধারা প্রধানতঃ রাজাকার ও পুলিশদের উপর আক্রশণ চালিয়ে সফলতা অর্জন করছে পাক সৈন্যর বিরুদ্ধে খুব কমসংখ্যক আক্রমণই পরিচালিত হতো। এর কারণ গেরিলারা যে পাক-হানাদারদের ভয় করত তা নয। অল্প সময়ের প্রশিক্ষণে ওরা শুধু আক্রমণ করে শত্রুকে কিভাবে খতম করতে হয়, তাই শিখেছিল। আক্রমণ করে কিবাবে পলায়ন করতে হয়, সে কৌশল ওদের ভাল করে জানা ছিল না। যদিও গেরিলা যুদ্ধের নীতি- ‘আঘাত করো ও পালিয়ে যাও’ এ সম্বন্ধে তাদের একটা মোটামুটি ধারনাও ছিল, তবুও আমার কাছে মনে হল, ওরা যেন কম আঘাত করে বেশী করে পালিয়ে আসতো। আমার এ ধারনা অনেকাংশে সত্যি। তা না হলে যদি গেরিলারা নির্দেশ মোতাবেক তাদের দায়িত্ব পুরাপুরি পালন করতো, তাহলে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর সেক্টর থেকে যে পরিমাণ গেরিলা ভিতরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, তাতে পাক সামরিক যন্ত্রটাকে মাত্র দু’মাসের ভেতরেই বিকল করে দেওয়া সম্ভব হতো।

খুলনা জেলার তেরখাদা, মোল্লারহাট, মোড়রগঞ্জ, বাগেরহাট, সুন্দরবন, পাইকগাছা এবং ভোলা, পটুয়াখালী ও বরিশাল শত্রুপক্ষের সাথে অবিরাম সংঘর্ষের ফলে উত্তেজনায় সর্বদা উত্তপ্ত থাকতো। বস্ততপক্ষে গতিশীল নেতৃত্বের জন্যই উপরোক্ত জায়গা গুলি মুক্তিসংগ্রামে ভাল অবদান রাখতে পেরেছিল। দেশের ভিতরের এতসব ঘটনার কথা আমাদের কাছে পৌঁছতো না। কারন বাহকের মাধ্যমে সংবাদ আদান-প্রদান করা ছাড়া আর কোন ব্যবস্থা ছিল না। অনেক বাহক আমারে সদও দফতর পর্যন্ত পৌঁছতে পারতো না। পথেই কঠিন মৃত্যুর কোলে ঘুমিয়ে পড়তো। যখন দেশের আনাচে-কানাচে হানাদারেরা জাল পেতে বসে আছে, তখন বাহকের কাজটা খুব আরামদায়ক নয়। বর্ষাকালে রাত্রের অন্ধকারে বুক পরিমাণ জলের ভিতর দিয়ে হেঁটে সংবাদ নিয়ে আসাটা কতটা কষ্টসাধ্য তা সহজেই অনুমেয়। মনে পড়ছে পনের বছর বয়স্ক পাতলা গড়ন প্রবেশিকা পরিক্ষার্থী আলমের কাছ থেকে শোনা একটা লোমহর্ষক কাহিনীর কথা। বরিশাল জেলার গৌরনদী থানার একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসারের ছেলে আলম। শত শত গেরিলাকে পথ দেখিয়ে সে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, বরিশাল থেকে সুদূঢ় পশ্চিম বঙ্গ পর্যন্ত সংবাদ নিয়ে ফিরে আসে। একজন পথপ্রদর্শক ও সংবাদ বাহক হিসাবে আরম নিজেকে যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে প্রমানিত করেছিল। দেখতে খুবই বেমানান এই ছেলেছি, জলন্ত দেশপ্রেমে উদ্ভুদ্ধ হয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শত শত গেরিলাকে শুধু পথ দেখিয়েই ভিতরে নিয়ে যায়নি, ভিতর থেকে শত শত অদক্ষ যুবককে ভারতে প্রশিক্ষনের জন্য নিয়ে এসেছে। এই ছেলেটি চতুর ও বুদ্ধিদীপ্ত। অনেকবার সে পাক হানাদারদের হাতে ধরা পড়েছে। তার চেহারার ভিতর একটা সরল মাধুর্য আছে সে এত ভাল উর্দু বলতে পারতো যে, মাথাভারী দেহসর্বস্ব পাকিস্তানী সৈন্যরা তাকে বিহারী মুসলমান বলে ভূল করে ছেড়ে দিয়েছে। জুলাই মাসে সীমান্তবর্তী বাগদা থেকে আলমই সর্বপ্রথম গেরিলাদের বরিশাল ও ফরিদপুরে নিয়ে আসে।

জুলাই ও আগষ্ট মাসের সেই বর্ষণমুখর রাতগুলোর কথা আজো আমার মনে পড়েছে। প্রতি রাত্র বর্ষা মাথায় করে বাংলার অতন্দ্র প্রহরী এই গেরিলার বাগদার সীমান্ত অতিক্রম করে ভিতরে চলে যেত। প্রমত্তা ইছমতি ছুটে চলেছে। দু’কুল তার বহু দুর পর্যন্ত প্লাবিত। এরই ভিতর কত রাত দেখেছি বাংরার এই অগ্নিসন্তান গেরিলার ভয়কে দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে কোন রকম ওজর আপত্তি না করে অন্ধকারে অস্ত্র হাতে নিয়ে পানি কাদার মধ্যে শান্তভাবে হেঁটে যাচ্ছে। শুধু সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কারো মুখে কোন কথা নেই। রাইফেলটায় যাতে পানির স্পর্শ না লাগে, সে জন্য ওটাকে উপর দিকে তুলে ধরতো। কি অভূতপূর্ব দেশপ্রেম। নিজেকে অভিশাপ দিতাম, কেন ওদের সাথী না হয়ে অধিনায়ক হলাম। কেন ওদের পাশে থেকে যুদ্ধ করে ওদের মুখের হাসিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলাম না। ওদের রক্তের সাগরে দাড়িয়ে মুক্তির আনন্দক আজ বড্ড বিস্বাদ লাগলো।

কিছুক্ষণের ‘জয় বাংলা’ তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব-শেখ মুজিব’ এই ধ্বনিই তো ওদের অনুপ্রানিত করেছিল অনিশ্চয়তার আধার ও চরম বিপদের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়তে। কোন পুরষ্কার বা প্রতিশ্রুতির লোভে ওরা এ কাজ করনি। দেশ ও নেতার প্রতি অপরিসীম ভালবাসা ওদের যাদুমন্ত্রে ওদের উদ্দীপ্ত করেছিল এই মৃত্যু ভয় কে জয় করতে। আত্মোৎসর্গের কঠিন ব্রতে দীক্ষা নিয়ে বাংলার এই গেরিলারা স্বাধীনতার জন্য অবিরাম সংগ্রাম করে চলেছে। বর্ষার ঔদ্ধত্যকে সংকল্পের দৃঢ়তায় ছিন্নভিন্ন করে ওরা এগিয়ে চললো। অন্ধকারের মাঝে ওদের এগিয়ে যাওয়া আমি নিরীক্ষণ করতে লাগলাম। দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পেলাম, যুদ্ধ না করেই বজ্রকঠিন শপথের আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে হানাদারদের কাজ থেকে মুক্তির আলো একদিন এই সুর্যসন্তানেরা ছিনিয়ে আনবেই। ঘটেছিলও তাই। পাক-হানাদররা ক্রমাগত থানা ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে যেতে লাগলো। গ্রামে যেখানেই গেরিলাদের সাথে ওদের মোবাবেলা হয়েছে, সেখানেই ওরা পুনর্বার যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এরপর হানাদাররা থাা ছেড়ে জমা হতে থাকে। সামরিক ছাইনতে এবং রাজাকারদের ওরা পুরো সুযোগ দিতে লাগলো গ্রামের উপর প্রভুত্ব চালাতে। দুর্জয় গেলিাদের হাতে চরম মার খেয়ে রাজাকররা তাদের রাজত্ব চালাতে চরম অসুবিায় পড়েছিল। ওদের জঘন্য কার্যকলাপের জন্য গেরিলারা নির্মমভাবে রাজাকারদের নিশ্চিহৃ করে দিত। আমার কাছে খবর আসলো যে, গেরিলারা পুরোদমে আক্রমণ চলিয়ে শত শত রাজাকার খতম করছে। এতে সুফল হলো-যারা একদিন রাজাকারদের বর্বরতার শিকার হয়েছিল, সেই নিঃস্ব গ্রামবাসী আবার মনোবল ফিরে পেল। বাঙ্গালী রাজাকারদের হত্যা করাটা আমি যেন পছন্দ করতে পারলাম না- কারন, আমি জানতাম যে এই হত্যার দ্বারা শুধু অনাথ ও বিধবার সংখ্যাই বেড়ে গিয়ে দেশের সমস্যা আরো জটিল করে তুলবে। একবার আমি নির্দেশও পাঠিয়েছিলাম যে, রাজাকারদের মধ্যে মানসিক পরিবর্তন এনে অস্ত্রশস্ত্রসহ আত্মসমর্পন করতে বাধ্য করতে হবে। এই মর্মে কিছু প্রচারপত্র বিলি করা হলো। দেখা গেছে, এর ফলে অনেক রাজাকার অস্ত্রশস্ত্রসহ স্বেচ্ছায় আত্মসমাপন করেছে। গেরিলা পদ্ধতির প্রবর্তনের ফলে দুটো সুফল পাওয়া গেল। প্রথমতঃ গ্রামবাসী রাজাকার ও পাক-বর্বরদের অত্যাচারের হাত থেকে অনেকটাই রেহাই পেল। দ্বিতীয়তঃ হানাদাররা নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য গোপন আস্তানায় ঢুকে আত্মসমর্পন করতে লাগলো। তাছাড়াও রাজাকারদের ভিতর অর্ন্তদ্বন্ধ, অসন্তোস ও বিভেদ সৃষ্টি করতে সফল হলাম। এর ফলে হানাদরদের পরিকল্পনায় সহজেই ফাটল ধরলো।

আর কোন পথ খোলা না দেখে পাক-বর্বররা গানবোটের সাহয্যে আক্রমনের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। রাজাকার ও পাকিস্তানী সৈন্যরা গানবোটে চেপে নদীর পথ ধরে চলতে থাকলো, আর মেশিনগান ও রকেট দিয়ে নির্বিচারে গোলাবর্ষন করে নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলো জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিতে লাগলো। পাকিস্তানী গানবোট গুলোর এরূপ আকস্মিক হামলায় ক্ষেখামারে কর্মরত শত-শত কৃষক, জেলে মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করলো। বাংলাদেশের নদীপথ দিয়ে গান-বোট গুলো চালিয়ে নেওয়ার সময় হানাদারেরা যাদেরই সামনে পেত তাদের উপরই পৈশাচিক উল্লাসে মেশিন গানের গুলি ছুড়তে থাকতো। মনের অবস্থা যখন ভাল থাকতো না তখন হানাদাররা নদীর তীরে কোন গ্রামের কাছে গান-বোট ভিড়িয়ে অসভ্য তাতারের মত গ্রাম থেকে সুন্দরী যুবতী মেয়েদের ছিনিয়ে আনতো। যারা আপত্তি করতো, তাদের খতম করে দিত।

যদিও আমাদের গেরিলারা প্রাণপণ চেষ্টা করছে এই গানবোট গুলো কাবু করার জন্য, কিন্তু ওদের কাছে নিম্নমানের অস্ত্রপাতি থাকায় গানবোটগুলোর মোকাবেলায় পেরে উঠতো না। এভাবে নৃশংস অত্যাচার চালিয়ে গানবোটগুলো গ্রামের লোকদের ভিতরে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করলো। গানবোট কাবু করার জন্য ভারী অস্ত্রপাতি চেয়ে গেরিলারা আমার কাছে খবর পাঠালো আমরা যদি জনগণকে এই অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা করত না পারি, তাহলে যত রকমের সফলতাই আমরা অর্জন করিনা কেন, জনগন অচিরেই তা ভূলে গিয়ে আমাদের প্রতি সহযোগীতার হাত বন্ধ করে দিবে। বিশেষ করে আমার ৯নং সেক্টর নদীনালায় ভর্তি। পাকবাহিনী গোপালগঞ্জ, বরিশাল, পটুয়াখালী ও খুলনার হাজার হাজার গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে লাগলো। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আসলে যে কি ঘটছে আমি জানতাম। গানবোট ধ্বংস করার উপায়ও আমার জানা ছিল। কিন্তু আমার কাছ থেকে বারবার তাগিদ যাওয়া সত্ত্বেও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার সেসব নতুন অস্ত্র শস্ত্র যোগাবার জন্য কোন আন্তরীক প্রচেষ্টাই করেনি। গানবোট কাবু করতে সামনে কয়েকটা রকেট লাঞ্চারই যথেষ্ট। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ আমরা সেগুলোও পাইনি। বস্তুতপক্ষেঃ গানবাট কাবু করতে যায় এ সম্বন্ধে আমি একটা রিপোর্ট তদানীন্তন অস্থায়ী রাষ্টপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী মিঃ তাজউদ্দীন আহমদকে দেখিয়েছিলাম। তখন তাঁরা ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু তাদের আস্বাস সত্ত্বেও এ রকম একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার অর্ধমীমাংসিতই রয়ে গেল। তাদের এই নির্লিপ্ততায় আমি খুব ব্যথা পেলাম; পাগলের মত ছুটে গেলাম চার্লি সেক্টরের অধিনায়কের কাছে। তিনি তাঁর নিজের প্রচেষ্টায় আমাকে গোটা দুয়েক রকেট লাঞ্চার যুগিয়ে দিলেন। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় ও গুলো খুবই অপর্যাপ্ত। যাহোক, সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে চার্লি সেক্টরের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার এন, এ সালিক মংলা পোর্টের কাছাকাছি একটা গেরিলা। ঘাঁটি স্থাপন করতে ও কিছু পথপ্রদর্শক প্রস্তুত রাখতে বললেন। তার কথামত পঞ্চাশজন মুক্তিযোদ্ধাসহ আফজাল নামক ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন হাবিলদারকে সেখানে পাঠিয়ে দিলাম। এ ছাড়াও আগে থেকেই মিঃ খিজিরের অধীনে সেখানে একশ’ গেরিলা ছিল। মিঃ খিজির খুলনার একজন মেকানিক। হাবিলদার আফজালের যোগ্যতা ও শক্তির পরিচয় পেয়ে মিঃ খিজির উদ্দীপনা পেল এবং ‘বানীশান্ত’ নামক একটি জায়গায় আর একটি ঘাঁটি স্থাপন করলো। এখান থেকেই মংলা বন্দরে হানাদারদের গতিবিধি, সামরিক, শক্তি, জাহাজগুলোকে রক্ষা করার জন্য ওর কতটা সতর্কতা অবলম্বন করেছে ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের কাছে খবরাখবর এসে পৌঁছতে লাগলো।

এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ‘ফ্রগম্যান’ পাঠানো। আগষ্টের শেষ সপ্তাহে লেঃ জিয়া ছ’খানা নৌকা নিয়ে অস্ত্রশস্ত্র- গোলাবারুদ সংগ্রহের আশায় ভারতে এসে পৌঁছালো। সুন্দরবনের একটা বৃহত্তম গেরিলা ঘাঁটির অধিনায়ক লেঃ জিয়া। তার কাছে যেসব অস্ত্রপাতি ও গোলাবারুদ ছিল, তা খুবই অপ্রতুল। বাংলাদেশের অভ্যন্তরের খবরাখবর সে সবিস্তারে আমার কাছে খুলে বললো। কথার মাঝখানে বারবার সে গানবোট ধবংসকারী অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিতে লাগলো। সে জানালো যে পাকহানাদারদের মনোবল একদম ভেঙ্গে গিয়েছে। এখন একমাত্র গানবোটের সাহয্যেই আক্রমণ অব্যাহত রাখছে। আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে ক্যাপ্টেন শাহাজানকে বরিশাল জেলায় আক্রমণ পরিচালনা করার জন্য পাঠিয়েছিলাম। তার উপর বিশ্বাস রেখে জিয়া জানালো যে, শাজাহান ভাল কাজই করছে। ক্যাপ্টেন ওমর এই ছদ্মনামে শাহজাহনকে ডাকতাম। ক্যাপ্টেন শাজাহান পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর সিগনাল ব্রাঞ্চের একজন অফিসার। সে দুঃসাহস করে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে রাজস্থানের মরুভূমি পার হয়ে একশো মাইল পথ পায়ে হেঁটে বাংলাদেশে আসে। সে আমার সেক্টরে যোগ দেয়ার আগে সে গেরিলা বাহিনীতে দীর্ঘ ছ’মাস প্রশিক্ষণ নিয়েছে। ভালই হলো। একটা গেরিলা বাহিনী তার অধীনে পাঠিয়ে দিলাম। জিয়ার কাছে থেকে এসব খবর পেয়ে আংশিকভাবে খুশী হলাম। পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য তাকে আমাদের সর্বাধিনায়কের সদর দফতরে নিয়ে গেলাম। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, ওর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করার জন্য সর্বাধিনায়ক সাহেব কোন ঔৎসুক্যই দেখালেন না। যা হোক, কোনরকম বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সর্বাধিনায়ক সাহেবকে জিয়ার সাথে একটিবার দেখা করার জন্য কতকটা বাধ্য করলাম।

ভয়ানকভাবে সমস্যা-পীড়িত সর্বাধিনায়ক সাহেব শেষ পর্যন্ত অনেক নিয়ম-কানুন পালনের পর জিয়াকে ডেকে পাঠালেন। অসংখ্য ধন্যবাদ কয়েক মিনিটের মধ্যেই এ সাক্ষাৎ পর্ব শেষ হলো। এরপর ব্রিগেডিয়ার এন, এ, সালিকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য জিয়াকে নিয়ে আমি ব্যারাকপুর গেলাম। এটা সেপ্টম্বরের প্রথম সপ্তাহ। ব্রিগেডিয়ার সাকিল খুব ধৈর্য সহকারে লেঃ জিয়ার কথাবার্তা শুনলেন এবং তাকে আশ্বাস দিলেন যে, ভারতীয় ৯ নং ডিভিশনের অধিনায়কের আলাপ-আলোচনা করে তিনি শিগগিরই যতটা সম্ভব রকেট লাঞ্চার ও অন্যান্য ভারী অস্ত্রপাতি সরবরাহ করার চেষ্টা করবেন। ভয়ানকভাবে সমস্যা-পীড়িত সর্বাধিনায়ক সাহেব শেষ পর্যন্ত অনেক নিয়ম-কানুন পালনের পর জিয়াকে ডেকে পাঠালেন। অসংখ্য ধন্যবাদ কয়েক মিনিটের মধ্যেই এ সাক্ষাৎ পর্ব শেষ হলো। এরপর ব্রিগেডিয়ার এন, এ, সালিকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য জিয়াকে নিয়ে আমি ব্যারাকপুর গেলাম। এটা সেপ্টম্বরের প্রথম সপ্তাহ। ব্রিগেডিয়ার সাকিল খুব ধৈর্য সহকারে লেঃ জিয়ার কথাবার্তা শুনলেন এবং তাকে আশ্বাস দিলেন যে, ভারতীয় ৯ নং ডিভিশনের অধিনায়কের আলাপ-আলোচনা করে তিনি শিগগিরই যতটা সম্ভব রকেট লাঞ্চার ও অন্যান্য ভারী অস্ত্রপাতি সরবরাহ করার চেষ্টা করবেন।

‘ফ্রগম্যানদের সম্বন্ধে একটা কথা বলে রাখছি। এই ফ্রগম্যানদের দেশের বাইরে থেকে আমদানী করা হয়নি। তারা দেশেরই সরল নিরীহ যুব সম্প্রদায়। বেশির ভাগই ছাত্র। জুনের শেষ সপ্তাহে বিভিন্ন যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে ওদের যোগাড় করা হয় এবং নবাব সিরাজুদৌল্লার ঐতিহাসিক মুর্শিদাবাদের পলাশী নগরে ভারতীয় নৌ-বাহিনীর তত্ত্বাবধানে এইসব ছেলেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ভারতীয় নৌবাহিনীর লেঃ কমান্ডার মার্টিস ও লেঃ দাসির সহযোগিতায় প্রশংসনীয়ভাবে মাত্র দু’মাসের ভেতর এ সমন্ত কচি গ্রাম্য ছেলেরা দক্ষ ফ্রগম্যানশীপ ট্রেনিং নিয়ে বেরিয়ে আসে। যে কোন মূল্যায়নে মিঃ মার্টিন ও মিঃ দাসের এই আন্তরিক প্রচেষ্টা প্রশংসার যোগ্য।

আর একদল লোক পলাশীতে এই ফ্রগম্যানশীপ প্রশিক্ষণের উন্নতির জন্য যথাসাধ্য সাহায্য করেছিল। তারা পাকিস্তান নৌবাহিনীর সাবমেরিনে কাজ করতো। ফ্রান্সে যখন একটি বিশেষ কাজে ওদের পাঠানো হয়, তখন সেখান থেকে মুক্তিসংগ্রামের প্রাক্কালে ওর পালিয়ে লন্ডনে আসে। সেখান থেকে ভারতীয় হাইকমিশনের সহয়তায় দিল্লী পৌঁছে। সংখ্যায় তারা আটজন। খুলনা জেলার অধিবাসী মিঃ রহমতউল্লাহ ওদের অধিনায়ক হয়ে নিয়ে আসে। সত্যিকারভাবে রহমতউল্লাহ একজন দেশপ্রেমিক। ফ্রগম্যানশীপের কলাকৌশল সম্বন্ধে সে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলেছে।

৯ই সেপ্টেম্বর। পরিকল্পনা মাফিক বাংলার ফ্রগম্যানরা সবাই যখন, তখন নৌকাগুলো কি আর পিছনে পড়ে থাকতে পারে। ত্রিকোনা আক্রমণ করার জন্য লেঃ জিয়ার আটজন ফ্রগম্যানসহ আগেই যাত্রা করার কথা। তাকে দুটো রকেট লাঞ্চার, কিন্তু এলএমজি এবং অভ্যন্তরের মুক্তিবাহিনীর জন্য প্রচুর পরিমাণ গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র দেয়া হলো। নির্ধারিত তারিখমত লেঃ জিয়া কোলকাতার উত্তর-পশ্চিম দিকে বাসন্তী নামক একটা বন্দরনগরী থেকে রওনা হলো।

বর্ষার মাতামাতি। আবহাওয়া ভয়ানক বিক্ষুব্ধ। নদীগুলো যেন এক-একটা দৈত্যের মত রাগে ফুলছে। বুকে তার প্রচন্ড আক্রোশে ফেটে-পড়া বিদ্রোহী তরংগমালা। ফ্রগম্যানদের গোপ ঘাঁটি থেকে নৌকায় করে শমসেরনগর পৌঁছতে হবে। ফ্রান্স থেকে পালিয়ে আসা মিঃ আসাদুল্লাহর নেতৃত্বে তিনটি নৌকায় ত্রিশজন ফ্রগম্যান ‘লিম্পেট মাইন’ নিয়ে ১৫ই সেপ্টেম্বর মংলা এবং চালনা বন্দরের পাকিস্তানী বাণিজ্যিক ও নৌবাহিনীর জাহাজগুলো আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে ছিল। ওদের বিদায় দেবার জন্য ১০ই সেপ্টেম্বর লেঃ কমান্ডার মার্টিস, মেজর রায় চৌধুরী এবং আমি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটা লঞ্চে করে শমসেরনগর পৌঁছে একটা বাঁকের কাছে অপেক্ষা করতে লাগলাম। এখানে হয়েই জিয়ার নৌকাগুলো যাওয়ার কথা।

সকাল বেলা-ভয়ানক ঝড়, উথাল পাতাল ঢেউয়ের বুক চিরে নৌকা চালানো খুবই কষ্টকর। বেলা তিনটা পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করলাম। কিন্তু ওদের আসার কোন হদিস পেলাম না। দেরী হবার অবশ্য অনিবার্য কারণ ছিল, কিন্তু ওদের পৌঁছতে বিলম্ব দেখা আমার খুবই চিন্তিত ও অধৈর্য হয়ে উঠলাম। বিকার প্রায় সাড়ে চারটার সময় প্রথম নৌকা এসে বাঁকের কাছে পৌঁছলো। কেউ তাদের শিক্ষিত বা মুক্তিবাহিনীর লোক বলে চিনতে পারলো না। কেননা, ওরা বুদ্ধিমত্তার সাথে সাধারণ মাঝিও জেলের বেশ ধরে আত্মগোপন করে ছিল। পরনে ছিল লুংগী ও ছেঁড়া শার্ট। বৃষ্টির জলে ওদের জামাকাপড় সব ভিজে গিয়েছিল। কেউ কেউ চা বা অন্যকিছু গরম করার জন্য আগুন জ্বালাতে খুব চেষ্টা করতে লাগলো। যা হোক আমাদের অপেক্ষা করতে দেখে ওরা খুবই উল্লসিত হলো। ইতিমধ্যে দেখা গেল, আরো দুটো নৌকা বিক্ষুব্ধ ঢেউগুলোর সাথে যুদ্ধ করতে করতে আমাদের দিকে দ্রুত এগিয়ে আসছে। নৌকাগুলো সব এক জায়গায় হলে, মুক্তিযোদ্ধাদের সবাইকে আমাদের লঞ্চে এনে গরম চায়ে আপ্যায়িত করলাম। ছেলেদের মনোবর খুবই উঁচু বলে মনে হলো।

একজন লিডার নিয়ে চারজনসহ এক একটা দল। লিডারদের আমরা ক্যাবিনের ভিতর ডেকে নিয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশ ও কিছু টাকা পয়সা দিলাম- যেন পথে ওরা খাদ্যের জন্য কষ্ট না পায়। সবই প্রস্তুত। কিন্তু ঝড়ের দাপট প্রশমিত হবার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। এই ঝড়ের মধ্যে ওদের কে পাঠানো আমি সমীচীন মনে করলাম না। কাজেই কাজটা রাত্রের মত স্থগিত রইল এবং ১১ তারিখের খুব ভোরে ওদের যাত্রা করতে দিলাম। এই মোশাররফ পথ দেখিয়ে আমাকে ভারতে পৌঁছে দেয। সে সুন্দরবন এলাকার মুন্সিগঞ্জের স্থায়ী বাসিন্দা। সবার মুখেই হাসি। সবাই খুশী। শেষ বারের মত সবাইকে উপদেশ দিয়ে এবং ওদের মংগল কামনা করে ওই রাত্রেই আমরা হাসনাবাদ রওনা হলাম। আল্লাহকে অসংখ্য ধন্যবাদ, ঠিক তিনদিন পরেই অর্থাৎ ১৪ই সেপ্টেম্বর ভোরে ওরা নিরাপদে ঠিকমত জায়গায় পৌঁছে গেল।

১৫ই সেপ্টেম্বর সামনে। শত্রুর উপর চরম আঘাত হানার মাহেন্দ্রক্ষণ। যে জায়গা থেকে আক্রমণ পরিচালনা করা হবে তার সাথে সংযোগ সাধন, আক্রমণের পর যেখানে গিয়ে সবাই জমা হতে হবে সেখানে গেরিলাদের ঠিকমত জায়গায় রাখা, উদ্দেশ্য সমাধা করার পর সবাইকে নিয়ে নিরাপদ জায়গায় রাখা, উদ্দেশ্যে সমাধা করার পর সবাইকে নিয়ে নিরাপদ জায়গায় সরে পড়া-ইত্যাদি প্রাথমিক কাজকর্ম সম্পন্ন করার জন্য হাতে খুব কম সময়ই আছে ১৪ তারিখ ভোর থেকে ১৫ তারিখ সন্ধ্যা পর্যন্ত ওদের প্রস্তুতি নিতে কেটে গেল। হাবিলদার আফজাল ও খিজিরের স্থল গেরিলারা ওদের যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। মুক্তিযোদ্ধারা লোভাতুর চোখে চেয়ে দেখলো আটটি বানিজ্যিক জাহাজ চালনা বন্দরে দাঁড়িয়ে আছে। পশুর নদীর মাঝখানে সবগুলো নোংগর করা। ঠিক হলো ‘জোড়া পদ্ধতিতে’ আক্রমণ চালাতে হবে- অর্থাৎ দু’জন ফ্রগম্যান এক একটি জাহাজকে আঘাত করার জন্য এক-একজন ফ্রগম্যানের কাছে চারটি করে, দু’জনার কাছে মোট আটটি লিম্পেট মাইন’ থাকবে। লিম্পেট মাইন পানিতে ভাসে। সুতরাং ওদের পক্ষে এতগুলো মাইন এক সংগে বয়ে নিয়ে যাওয়া খুব সহজ হলো। ঘাঁটি থেকে প্রায় পনেরশ’ গজ দূরে জাহাজগুলো এলোমেলো অবস্থায় নোংগর করা। ১৫ সেপ্টেম্বরের সারাটা দিন কেটে গেল ওদের সবকিছু বুঝিয়ে দিতে। এক-একটা জাহাজ আক্রমণ করার ভার এক একটা দলের উপর ন্যস্ত করা হলো।

ষোলজন ফ্রগম্যান নিয়ে আটটি দল। ওরা আক্রমণ করার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। প্রথম অভিযান ব্যর্থ হলে বাকী চৌদ্দজনকে পরবর্তী পর্যায়ে আক্রমণ পরিচালনা করার জন্য রিজার্ভ রাখা হলো আঘাত করার সময় নির্ধারিত হলো রাত সাড়ে চারটা। সাধারণতঃ এই সময়েই পাক হানাদাররা বিরক্ত ও ক্লান্তিতে ঝিমিয়ে পড়ে। আর যারা ঘুমিয়ে থাকে, একই সঙ্গে তারা আরও বেঘোরে ঘুমাতে থাকে। স্থির হলো একই সংগে আটটি জাহাজের উপর হামলা চালাতে হবে।

রাত আড়াইটা। খুব অন্ধকার। বাইরে ঝড়ের দাপাদাপি। দমকা বাতাসের চাবুক খেয়ে পিছন দিকের অরণ্যটা আর্তনাদ করে উঠলো। অধিনায়ক মিঃ আসাদুল্লাহ ছেলেদের কানে কানে বললো, আঘাত করার এইতো উপযুক্ত সময়। সতর্কতার সাথে শেষবারের মত আবার সে সবাইকে পরীক্ষা করে নিলো। এখন থেকে মাত্র দু’ঘন্টা পরে সমস্ত নদীর বুক জুড়ে তরংগায়িত হবে বলে টকটকে উত্তপ্ত রক্তস্রোত।  নদীর অপর পাড়ে শত্রুপক্ষ নিশ্চিন্ত। কেননা ওরা ভাবতেই পারেনি অলস বাঙ্গালীরা ওদের পায়ের তলায় কোনদিন আঘাত হানতে পারবে। নদীতে হিংস্র জীবজন্তু আছে জেনেও দুর্যোগময় এই ঝড়ের মাঝরাতে প্রমত্তা নদতীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়া খুব একটা সহজ কাজ নয়। মৃত্যুভয়কে দূরে ঠেলে দেশপ্রেমের জলন্ত বহিৃশিখা বুকে নিয়ে ওরা ষোলজন সবাই একংগে দুটো পঁয়ত্রিশ মিনিটের সময় নদীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। মুখে লেশমাত্র ভীতের চিহৃ নেই। আত্মপ্রত্যয়ের মহান আদর্শে উদ্ভাসিত। বেয়াড়া প্রকৃতির রক্তচক্ষুকে ভয় না করে মুক্তিযোদ্ধারা নদীর বুক চিরে আস্তে আস্তে এগিয়ে চললো লক্ষ্যবস্তুর দিকে। ওদের কোমল ডানাগুলো ক্লান্তিতে ঝিমিয়ে পড়লো। কিন্তু জলের উপর ভেসে ভেসে ঢেউয়ের কোলে মাথা রেখে ওরা লক্ষ্যবস্ততে গিয়ে পৌঁছলো। সাড়ে চারটা বাজতে এখনও পাঁচ মিনিট বাকি।

অর্ধ- আবৃত তারপলিনের নীচে আবছা আলোতে ওরা সন্ত্রাসীদের দেখতে পেলো। হঠাৎ আকাশটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। ভয়ানক বৃষ্টি। আঘাত করার সময় এসে গেল। ঠিক চারটা ত্রিশ মিনিট। যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করে ওরা লিম্পেট মাইনগুলো জাহাজের তলায় লাগিয়ে দিল। এই মাইনগুলোর উপরের দিকে চুম্বক লাগানো। লোহার সংস্পর্শে এলে গায়ে লেগে থাকে। তারপর ওরা সাঁতরিয়ে ঘাঁটির দিকে ফিরে চললো। এই সময় ওরা খুব তাড়াতাড়ি সাঁতরাতে লাগলো। ওরা জনতো যে, মাইন লাগানোর এক ঘন্টা পরে, এই সুন্দর জাহাজগুলো বিকট শব্দে বিদীর্ণ হয়ে প্রজ্বলিত অগ্নিশিখার বহ্যৃৎসবে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকবে। মাইনগুলো বিস্ফোরণের জন্য ‘ফিউজে’ একঘন্টা সময় বেধেঁ দেয়া হয়েছিল- যেন ওরা নিরাপদ ঘাঁটিতে ফিরে আসতে পারে। আবেগ ও উত্তেজনায় উদ্বেলিত হয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে ওরা ষোলজন সবাই তীরে ফিরলো। যারা তীরে সাগ্রহে প্রতিক্ষয়া ছিল, তারা সবাই ওদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে চুমু খেতে লাগলো। শুয়ে পড়ে মুক্ষিযোদ্ধারা অধীর আগ্রহে জাহাজগুলো দিকে চেয়ে রইল- কখন সাড়ে পাঁচটা বাজবে। হ্যাঁ, চরম লগ্নটি এলো। সমস্ত পৃথিবীটাকে প্রচন্ডভাবে নাড়া দিয়ে বিকট শব্দে মাইনগুলো বিস্ফোরিত হলো। আটটি জাহাজের মধ্যে সাতটি ডুবে গেল। আমাদের উদ্দেশ্য সার্থক ও সফল হলো। এই ঘটনার পর বন্দরের শ্রমিকরা কাজ ছেড়ে দিয়ে যে যেদিকে পারলো পালিয়ে গেল। বেশ কিছুদিনের জন্য চালনা ও মংলা বন্দর জনশূণ্য হয়ে পড়ে রইল।

শমসেরনগরে ফিরে আসার সময় মৃত্যুঞ্জীয় মুক্তিসেনারা একটা ফরেষ্ট অফিসে হামলা চালিয়ে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র অধিকার করে। এর মধ্যে ‘বনবালা; ও ‘বনমৃগী’ এই দুটো লঞ্চও ছিল। এই লঞ্চে চেপে বিজয়ের উত্তেজনায় আত্মহারা মুক্তিযোদ্ধারা শমসেরনগরে ফিরে এলো। পাকিস্তানী ঘাঁটির অবস্থানের অনিশ্চয়তার জন্য লেঃ জিয়ার ত্রিকোণা অভিযান স্থগিত রাখা হলো। তাছাড়া আবহাওয়াও খুব অনুকুলে ছিল না। সব রকমের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও গেরিলাদের ভেতর আসা বন্ধ করতে না পারায় পাক-হানাদাররা ভয়ানকভাবে ক্ষেপে গিয়েছিল। সুতরাং ওরা সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে চালনা পোতাশ্রয়ের বিপরীত দিকে সুন্দরবনে আগুন ধরিয়ে দিল এবং গানবোট নিয়ে পাহারায় বেরিয়ে সুন্দরবনের সমস্ত পথঘাট একদম বন্ধ করে দেয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলো।

সেপ্টেম্বরের শেষদিকে হানাদাররা শ্যামনগর ঘাঁটির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারলো। আমাদের হাতেই কিছুদিন আগে এই ঘাঁটির পতন ঘটে। এবার শ্যামনগর ঘাঁটি পুনরুদ্ধার করার জন্য হানাদাররা গানবোট ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে ভীষণভাবে আমাদেরকে আক্রমণ করলো। তিনদিন তীব্র যুদ্ধ চালাবার পর, হানাদারদের চরম ক্ষতি করে, সমর-কৌশলের দিকে দিয়ে খুঁব গুরুত্বপূর্ণ এরকম অন্য একটা জায়গায় আমরা সরে গেলাম। এই যুদ্ধে আমরা পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধাকে হারিয়েছিলাম। এর মধ্যে সুবেদার মোহাম্মদ ইলিয়াস মেশিনগানের গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। আর চারজন নতুন ভর্তি মুক্তিযোদ্ধাকে হানাদাররা বন্দী করে। শ্যামনগর পুনরুদ্ধার করে ও হানাদাররা গেরিলাদের ভেতরে যাওয়া বন্ধ করতে পারলো না।

এক মাস পরে ঠিক একই উপায়ে ফ্রগম্যানরা আবার মংলা ও চালনা বন্দর আক্রমণ করলো। ১৬ই অক্টোবর আলম নামে পাক-নৌবাহিনী থেকে পালিয়ে আসা একজন সৈন্যের অধীন দ্বিতীয় দলটি শ্যামনগরের অনেক দক্ষিণ দিক দিয়ে হেঁটে ভেতরে গেল। এবারেও আমরা সফল হলাম। এই আক্রমণে শত্রুপক্ষে চারটি জাহাজ ডুবে গিয়েছিল। একটি নাম ‘লাইটনিং’ এবং অপরটার নাম ‘আল-মুরতজা’। অন্যগুলো চীনা জাহাজ বলে শনাক্ত করা হয়। আমাদের এই দ্বিতীয়বারের আক্রমণ চালনা ও মংলা বন্দরকে সম্পূর্ণ অকেজো করে দিল। এর উপরও নভেম্বর মাসে রহমতউল্লাহর নেতৃত্বে খুলনায় আক্রমণ চালিয়ে সাফল্য অর্জন করা হয়। বাংলাদেশ সশস্ত্র-বাহিনর অন্যান্য সেক্টরের নির্দেশ অনুযায়ী চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ এবং চাঁদপুরে শত্রু জাহাজের উপর আক্রমণ চালানো হয়।

এই আক্রমণের মোটামুটি ফল হলো- এইসব জায়গায় শ্রমিকরা সবাই পালিয়ে জান বাঁচলো। ডিসেম্বরে দেশ মুক্ত হবার আগ পর্যন্ত ওরা আর ফিরে এলোনা। এই ঘটনার পর এমনকি কোন বিদেশী জাহাজও বন্দরে নোংগর করতে রাজী হতো না। আমরা এটাই চেয়েছিলাম।

বিজয় অভিযান

বিজয় অভিযানে মুক্তিযোদ্ধারা শুধূমাত্র নীরব দর্শকই ছিল না। তাদের একটা নির্দিষ্ট ও উদ্দেশ্যমূলক তৎপরতা অবলম্বন করতে হয়েছিল। এই তৎপরতা নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এরপর টাকি থেকে একশো পঞ্চাশ মাইল দূরে কৃষ্ণনগরে চার্লি সেক্টরে একটা কনফারেন্সে যোগদান করার জন্য আমাকে ডাকা হয়। চার্লি সেক্টর এই সময় ব্যারাকপুর থেকে কৃষ্ণ নগরে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। ব্রিগেডিয়ার এন,এ, সাকিলও ওই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। ভারত জরুরী অবস্থা ঘোষনা করলে কিভাবে আমাকে সামনে অগ্রসর হতে হবে, এ ব্যাপারে তিনি মোটামুটি একটা ধারনা দিলেন। মিত্রবাহিনীর পরিকল্পনার কথা গোপন রেখে সাতক্ষীরা- দৌলতপুর রোডে এবং আরও দক্ষিণে আমার লোকজন নিয়ে যে কোন সময় অগ্রসর হবার জন্য তিনি আমাকে প্রস্তুত ও সতর্ক থাকতে বললেন। পরিকল্পনার কথা আমাকে না জানালেও আমি অনুমান করলাম যে, সাতক্ষীরার বাঁ দিক থেকে একটা সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে সাতক্ষীরা- দৌলতপুর বরাবর শত্রু ঘাঁটিগুলো নিশ্চিহ্ন করার জন্য যশোরের উত্তর দিক থেকে প্রধান আক্রমণ পরিচালনা করা হবে। তাছাড়া, আমরা মুক্তিযোদ্ধারা পাক-বাহিনী ও মিত্রবাহিনীর গোলাবর্ষণের মাঝখানে পড়ে যাতে বিপর্যস্ত না হয়, সেই জন্য মিত্র বাহিনীর আগে আমার সৈন্য বাহিনী পাঠাতে বারন করা হলো। আমাকে জানানো হলো যে, মিত্রবাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করার পর মুক্তিবাহিনীর উদ্দেশ্য হবে এইরুপঃ প্রথমত, সময়মত মিত্রবাহিনীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্য লোকজন দেয়া। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে প্রবেশ করার পর মিত্রবাহিনী কোন প্রশাসনিক অসুবিধার সম্মুখীন হলে তা দূর করার জন্য তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসা। তৃতীয়ত, ঘনিষ্ঠ ভাবে মিত্রবাহিনীকে অনুসরণ করা এবং তাদের সংস্পর্শে থাকা। আমাকে বলা হলো যে, যেহেতু ‘বাংলা অঞ্চল’ (বেঙ্গল এরিয়া-ভারতীয় সেনাবাহিনীর ঘাঁটি) আমার নিকটবর্তী, সেই জন্য আমার সেক্টর এখন থেকে বাংলা অঞ্চলের প্রশাসনিক আওতাধীনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাছাড়া দক্ষিন সুন্দরবন এলাকার সম্পুর্ন জলপথ বাংলা অঞ্চলের অধীনে এনে, এর দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয় জেনারেল পি,কে, রায় চৌধুরীর উপর।

সেক্টরে ফিরে আমি আমার নিজস্ব পরিকল্পনা তৈরী করলাম। আবার দুই হাজার গেরিলা সৈন্য ছিল। কিন্তু অস্ত্রশস্ত্র খুবই অপ্রতুল। তবুও আমি মনে করলাম যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলা সৈন্য ছিল। কিন্তু অস্ত্রশস্ত্র খুবই অপ্রতুল। তবুও আমি মনে করলাম যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলাদের উপস্থিতিই অনেকটা প্রভাব বিস্তার করবে। কেননা, বিজয় অভিযানের সময় সম্ভাব্য রাহাজানি, ধর্ষন ও অন্যান্য অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটতে পারে সেদিকে আমার লোকজন সতর্ক দৃষ্টি রাখতে পারবে। কাজেই, পরপর দুরাত্রিতে আঠারোশো গেরিলা সৈনযকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠিয়ে দেয়া হলো। বাদবাকী গেরিলাদের বিজয় অভিযানের সময় অগ্রসর হওয়ার জন্য অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত করে রাখা হলো। সদর দপ্তরে ও আমার সেক্টরের অন্যান্য জায়গায় আমার নিয়ন্ত্রাধীনে যেসব সৈন্য মোতায়েন ছিল, তাদের সদা সতর্ক থাকতে বলেছিলাম। আমার সেক্টর সদর দপ্তরের বিস্তৃতি অনেক দূর পর্যন্ত। অল্প সময়ের নোটিশে এটা গুটিয়ে আনা সম্ভব নয়। আমি ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হককে বুঝিয়ে বললাম যে, যে সমস্ত আর্মিরা নির্ধারিত সময়ের পূর্বে হাজির হতে পারবে না, তারা যেন দেশ মুক্ত হওয়ার পরই খুলনায় আমার সাথে মিলিত হয়। হিসাবপত্র ঠিক রাখা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি যত্ন নেয়ার জন্যও সার্জেন্ট ফজলুল হককে নির্দেশ দিলাম। কেননা, আমরা চলে গেলে যেসব মুক্তিযোদ্ধা ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অন্যান্য যুবক এখানে হাজির হবে তারা নিতান্ত অসুবিধায় পড়বে। সৌভাগ্যক্রমে দবিতীয়বারের মত লেঃ জিয়া এসে গেল। সুন্দরবন এলাকায় সে পাকিস্তানী গানবোটের সামনে শত্রুপক্ষের সাথে প্রচন্ড যুদ্ধ করে তার অঞ্চলকে সম্পুর্নরূপে মুক্ত করেছে হানাদাররা নদী বরাবর তাদের ঘাঁটিগুলো ছেড়ে দিয়ে খুলনার দিকে হেঁটে গিয়ে জড়ো হয়েছে। আমি স্থির করলাম যেসব গেরিলা খুলনার সীমান্ত বরাবর শত্রু হননে লিপ্ত, তাদেরকে খুলনা শহরের চারিদিকে সমাবেশ করে হানাদারদের পিছু হটার রাস্তা সম্পুর্নরূপে বন্ধ করে দেব। মিত্র-বাহিনীর সার্বিক পরিকল্পনা মনে রেখে মাসের ১৫ তারিখে সাব- এরিয়া কমান্ডারদের নিয়ে আমাদের দপ্তরে একটা সম্মেলনে মিলিত হয়ে তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলাম। খুলনা শহরের নিকট রূপসা নদীর পশ্চিম তীরে। আক্রমণ ব্যুহ তৈরী করার জন্য লেঃ জিয়াকে সুন্দরবন অঞ্চল থেকে ঘাঁটি গুটিয়ে ফেলার জন্য প্রয়োজনীয় আদেশ দিলাম। বাগেরহাটে সুবেদার তাজুল ইসলামের অধীনে যে সমস্ত সৈন্য ছিল তাদেরও লেঃ জিয়ার নিয়ন্ত্রণে কাজ করার জন্য নির্দেশ দিলাম। শত্রুপক্ষ যাতে নৌ-পথ ব্যবহার করতে না পারে, সে জন্য জনৈক মিঃ নোমানউল্লাহকে তেরখাদা ও মোল্লারহাটে যে সমস্ত মুক্তিযোদ্ধা ছিল, তাঁদের সাথে সমন্বয় স্থাপন করে খুলনার উত্ত্র-পূর্ব দিক থেকে এসে এক জায়গায় জড়ো হয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য সতর্ক থাকতে বললাম। আরও যেন পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায় সর্বদা প্রস্তুত থাকে। খুলনার দক্ষিনে পাইকগাছা, তালা ও আশাশুনি অঞ্চলে সেকেন্ড লেঃ আরেফিন গেরিলাদের হিসাবে কর্মরত ছিল। তাকে বললাম, সে যেন গেরিলাদের সঙ্গে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে খুলনা শহরের কাছাকাছি কোথাও প্রস্তুত হয়ে থাকে।

ক্যাপ্টেন হুদার অধীনে দুই ব্যাটালিয়নের বেশী যোদ্ধা ছিল। তাকেও সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিলাম। বসন্তপুরে শত্রুপক্ষের অবস্থান খুবই সুদৃঢ়। বসন্তপুর আমাদের খুবই নিকটে। একান থেকে হানাদারদের বিতাড়িত করে গুরুত্বপূর্ন সাতক্ষীরা- দৌলতপুর সড়কে শত্রু মুক্ত করে আধিপত্য বিস্তার করার জন্য ক্যাপ্টেন হুদাকে দায়িত্ব দিলাম। খুলনা শহরের চারিদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের জড়ো করে রাখার প্রধান উদ্দেশ্য হলো,  দখলদার আমলে বিহারীরা বাঙ্গালী মুসলমানদের উপর যে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছিল তারই প্রতিহিংসা নিতে গিয়ে অনিবার্য পরিনতি স্বরূপ বযাপক হারে বিহারী নিধন আরম্ভ হবে এবং সারাদেশ জুড়ে নেমে আসবে বিশৃংখলা। এই আশংকা করেই উপরোক্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। উল্লেখিত পরিকল্পনা ছাড়াও আমি দুটো দলকে প্রস্তুত করে বেগের নেতৃত্বাধীনে বরিশালের দিকে নৌকায় পাঠিয়ে দিলাম। প্রথম দলটি ক্যাপ্টেন ওমরের সাথে সংযোগ স্থাপন করে বরিশালের উদ্ভূত পরিস্থিতির মোকাবেলা করবে আর দ্বিতীয় দলটিকে সেকেন্ড লেঃ মুয়িনের নেতৃত্বে পটুয়াখালী পৌছানো হলো। কথা প্রসঙ্গে বলতে হয় সেকেন্ড লেঃ মুয়িন মিত্র বাহিনীর অধিনে বিহার প্রবেশের ‘মুর্তিহতে বাংলাদেশের ক্রাশ ট্রেনিং কোর্স সমাপ্ত করে আরও চারজন তরুণ অফিসার সহ প্রথম দলে অক্টোবর মাসে আমার কাছে আসে। তারা তিনমাসের ক্রাশ ট্রেনিং প্রোগ্রাম অনুযায়ী শিক্ষা গ্রহণ করে। এই তিনজন অফিসার হলো- সেকেন্ড লেঃ মোহাম্মদ অলি, আহসানউল্লাহ এবং শচীন্দ্র। তাঁদের সবাইকে ক্যাপ্টেন হুদার বাহিনীতে কাজ করার জন্য দেয়া হলো। বয়সে সবাই নবীন, কর্মক্ষম ও কষ্টসহিষ্ণু। যাহোক, নির্দেশ মোতাবেক লেঃ জিয়া, নোমান ও আরেফিন স্বস্ব গন্তব্যস্থলের দিকে রওনা হয়ে গেল। বসন্তপুরের  উপর যে কোন সময় আঘাত হানার জন্য ক্যাপ্টেন হুদা প্রস্তুত হয়ে রইল। এই সময়ে লেঃ জিয়াকে একটা বেতার যন্ত্র যোগাড় করে দিলাম। ওদের সবাইকে পাঠিয়ে দিয়ে মনের গভীরে একটা প্রশ্ন উকি দিলে নিজেই বিস্মিত হলাম- এইবার কি সত্যিই আমরা খুলনা যাচ্ছি?

ওদের যে সমস্ত আদেশ দেয়েছিলাম তা আমার কানে অবিশ্বাস্য রকমের প্রতিধ্বনি হতে লাগলো। স্বপ্নাবিষ্টের মত মনে হলো, ওগুলো যেন আমাকেই উল্টো পরিহাস করছে। কেননা, দালালও হানাদার পরিবেষ্টিত খুলনার মত বিপজ্জনক শহরে এত শীগগীর প্রবেশ করতে পারবো- একথা কল্পনাও করতে পারিনি। যদিও স্থানীয় প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত অনেক মুক্তিযোদ্ধা ছাড়াও কমপক্ষে পাঁচ হাজার গেরিলা খুলনা শহরকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছিল, তবুও হানাদারদের প্রকৃত শক্তি সম্পর্কে আমরা ছিলাম সন্দিহান।

সমস্ত শঙ্কা, সমস্ত ভয় উবে গেল। চরম লগ্নটি সমাগত। পবিত্র ঈদের দিন সকালবেলা, ১৯৭১ সালের ২০শে নভেম্বর- ক্রিং ক্রিং করে টেলিফোনে কয়েকবার শব্দ হতেই রিসিভারটা কানের কাছে নিলামঃ অত্যন্ত সুখবর। প্রশংসনীয় তৎপরতা। অবস্থান মজবুত করে টিকিয়ে রাখো। কুত্তাগুলোকে পিছু পিছু ধাওয়া করো।‘

আনন্দ- উত্তেজনায় এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে ফেললাম। ক্যাপ্টেন হুদা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বসন্তপুর, কালীগঞ্জ ও নাজিমগঞ্জে শত্রুর অবস্থানের উপর চরম আঘাত হেনে এই ঘাঁটিগুলো আমাদের কব্জায় এনেছে। কি ভয়ংকর উত্তেজনা। ক্যাপ্টেন হুদা কথা বলতে পারছিলনা। তার বাক রুদ্ধ হয়ে এলো। উত্তেজনা ও চাঞ্চল্যের অফুরন্ত আনন্দে আমরা সবাই বিস্ময়াভিভূত, হতবাক। হুদা ও তার সাথের মুক্তিসেনাদের প্রাণঢালা অভিনন্দন জানালাম। বললাম যে। শত্রুর উপর আঘাতের ক্ষিপ্রতা ও তার গতিবেগ যেন পুরোপুরি রক্ষা করা হয়। আনন্দ ও উত্তেজনায় এতটা আত্মহারা যে কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। এই পবিত্র দিনটিতে বহু প্রতীক্ষিত বিজয় অভিযান শুরু হলো। স্কল শিক্ষক মিঃ শাহাজানকে পারুলিয়া রোডের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য নির্দেশ দিলাম। কেননা বসন্তপুর ও কালীগঞ্জ ঘাঁটি থেকে শত্রুবাহিনীকে এই পথ দিয়েই পালাতে হবে এবং এটাই একমাত্র পাকা রাস্তা। একই সংগে মিঃ চৌধুরীর নেতৃত্বে ষাটজন মুক্তিযোদ্ধার একটি দলকে পারুলিয়া ব্রীজটি অক্ষত অবস্থায় অধিকার করার জন্য পাঠিয়ে দিলাম। মিঃ চৌধুরী পাকিস্তান নৌবাহিনীর একজন অভিজ্ঞ নাবিক। বেশ হাসিখূশী। কঠোর প্রকৃতির এই মানুষটি আমার পরিকল্পনায় খূশী হয়ে যাত্রার জন্য প্রস্তুতি নিলো।

প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়ার পর আমি মোস্তফাকে নিয়ে স্থানটা স্বচক্ষে দেখার জন্য বসন্তপুরের দিকে রওনা হলাম। দীর্ঘ ন’মাস যাবত ইছামতির ওপার থেকে বসন্তপুর আমাদের কতবার ইশারায় আহবান জানিয়েছে। এক ঘণ্টা পরে হিংগলগঞ্জে পৌঁছে দু’জন ষ্পীডবোটে নদী পার হয়ে তীরে নামলাম। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার আজ কোন মেশিনগান গর্জে উঠলো না। আগে অবশ্যই কোন অতিথির পদার্পন মাত্র মেশিনগানগুলো মুহুর্তে এক ঝলক আগুন ছূড়ে গর্জে উঠতো।

রক্তলাল সূর্যটাকে বুকে নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীন পতাকা যখন পত পত করে উড্ডীন দেখলাম, তখন কি যে উত্তেজনা! ওই সূর্যটাকে স্বাগত জানাতে কত না রক্ত ঢালতে হয়েছে এই ইছামতির তীরে। সমুন্নত পতাকার নিচে দু’ থেকে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা নীরবে দন্ডায়মান। শত্রুর কোন চিহ্ন নেই। বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র। গোলাবারুদ, রেশন এবং চারিদিকে কুৎসিত ধ্বংসাবশেষ রেখে হানাদাররা পালিয়েছে।

স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়াবার জন্য আত্মহুতি দিতে হয়েছিল অনেক মুক্তিপাগল তরুণকে। ওদের মহান আত্মত্যাগের জন্যই আজ স্বাধীন বাংলার পতাকা সমুন্নত শিরে উড্ডীন রয়েছে। পরিত্যক্ত অস্ত্রশস্ত্র দেখে আজ আর আমি উত্তেজিত হই না। আগে মাত্র একটা রাইফেল দেখে চঞ্চল হয়ে উঠতাম। এখন এটা আমার কাছে অস্বস্তিকর লাগলো।

বসন্তপুর অধিকার করে আনন্দ ও উত্তেজনার পরিবর্তে মন আমার বেদনাভরাক্রান্ত হয়ে উঠলো। নভেম্বরের শীতল বাতাসে উঁচু বাঁধটার উপর দাঁড়িয়ে মানুষের এই বীভৎস কংকাল গুলোর দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। কি মর্মান্তিক! ওরা রক্ত দিয়েছে, আমরা ও রক্ত দিয়েছি। সাক্ষী রয়েছে ওদের কংকালগুলো। সবাধীন্তা-পাগল আমার মুক্তিযোদ্ধাদের কংকালও ছড়িয়ে- ছিটিয়ে আছে এখানে-ওখানে।

এই মিশ্র অনুভূতি সম্বল করে কালীগঞ্জ ও নাজিমগঞ্জ পরিদর্শন করলাম। এই জায়গাগুলো কিছু ভাল বলে মনে হলো। কিছুটা প্রানের স্পন্দন এখনও যেন বেঁচে আছে।

এখানে কিছু লোকজন দেখলাম। অনেক বাড়িঘর ধবংস্তুপের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। আবার অনেকগুলো নারকীয় অগ্ন্যতসবের বিকলাঙ্গ চেহারা নিয়ে বীভৎসতার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এত দুঃখের মাঝেও যে ক’জন লোক আমরা এখানে পেয়েছিলাম, তারা আমাদের স্বাগত জানাতে কার্পন্য করলো না। স্থানীয় লোকজন বললো, গত রাত থেকেই হানাদাররা সাততাড়াতাড়িতে পালাতে শুরু করেছিল পলায়নপর হানাদারদের স্থানীয় লোকজন যখন জিজ্ঞেস করেছে’ আপনারা কোথায় যাচ্ছেন? তখন ওরা কম্পিত স্বরে জবাব দিয়েছিল, মুক্তিরা আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে, ওপরওয়ালাদের হুকুমমত তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছি’। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে হানাদাররা যে ভাবে পালিয়ে গিয়েছিল, তার বর্ণনা দিতে গিয়ে স্থানীয় লোকজন হাসিতে ফেটে পড়লো। অনেক দামী ও লোভনীয় জিনিস রেখে যাওয়া ছাড়াও হানাদাররা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নদীতে ফেলে দেয়।

ক্যাপ্টেন হুদা রাতে বসন্তপুরের উপর আক্রমণ চালায়। জবাবে সারা রাত ধরে হানাদাররাও প্রচন্ড গোলাবর্ষণ করে। আর এই গোলাবর্ষণের আড়ালে রাতের আধাঁরে গা-ঢাকা দিয়ে শত্রুরা পালিয়ে যায়। ভোরে অবস্থা অত্যন্ত শান্ত ভাব ধারন করায় হুদা, মুক্তিযোদ্ধার একটি ছোট দলকে গ্রামের অভ্যন্তরে পাঠিয়ে, যারা আমাদের গোপনে সংবাদ সরবরাহ করতো, তাঁদের কাছ থেকে প্রথম জানতে পারলো যে, হানাদাররা পালিয়ে গেছে।

সংবাদ পেয়ে হুদা এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে কালীগঞ্জ- সাতক্ষীরা রাস্তা ধরে একরকম দৌঁড়ে বসন্তপুরের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো। একটা ভাঙ্গা জীপ ছাড়া তার সাথে আর কোন যানবাহন ছিল না। জীপটা কিছুদিন আগে হানাদারদের কাছ থেকে অধিকার করা হয়। হানাদাররা তখনও পালাচ্ছিল। প্রশংসনীয় উদ্যম ও মনোবল নিয়ে ক্যাপ্টেন হুদা দীর্ঘ বারো মাইল পথ হেঁটে তার বাহিনীসহ মিঃ শাজাহানের লোকদের কাছে পৌঁছে হানাদারদের সম্মুখ থেকে আঘাত হানলো, তখন ওরা দিশেহারা হয়ে পারুলিয়ার দিকে পালাতে শুরু করে। ওদিকে মিঃ শাজাহানের নেতৃত্বে টাকি থেকে যে সৈন্যদলটি এসেছিল, তারা পলায়নপর হানাদার বাহিনীর একটি দলকে মাঝপথে অবরোধ করে ফেললো। এদিকে হুদা জানতে পারলো যে, হানাদাররা পারুলিয়া সেতু উড়িয়ে দিয়ে ওপারে আত্মরক্ষা মূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। সেতুর চার মাইল দূরে অবস্থান নিয়ে ক্যাপ্টেন হুদা দ্রুত মিঃ চৌধুরী ও শাজাহানের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীকে তার লোক জনদের একত্র করে পুনর্বিন্যাস করলো।

ওই রাতেই আমি অগ্রবর্তী এলাকা পরিদর্শন করলাম। তখন পাক-হানাদার ও আমাদের মধ্যে প্রচন্ড গুলি বিনিময় হচ্ছিল। আমাদের বাঁ- দিকে মিঃ মাহাবুবের নেতৃত্বাধীন ৮ নং সেক্টরের সৈন্যদের নিয়োগ করা হয়েছিল। মিঃ মাহাবুব একজন পি-এস-সি অফিসার। কর্মদক্ষতার জন্য তাকে মেজর পদে উন্নীত করা হয়। তিনি সাহসী ও বুদ্ধিমান। আঘাতের পর আঘাত হেনে শত্রুপক্ষকে সর্বদা ব্যস্ত রাখতেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মিত্রবাহিনীর তরফ থেকে আমরা কোন সাহায্যকারী সৈন্য পাইনি।

৭২ নং সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর সৈন্যরা আমাদের অধিকৃত জায়গাগুলো, যেমন বসন্তপুর ও কালীগঞ্জের উপরে তদারকী করতো। আর তাদের সাহায্য করতো পিছনে অবস্থানরত আমাদের মুক্তিবাহিনী। সুবেদার মেজর এ, জলিল ও লস্করের অধীনে মুক্তিবাহিনী এখানে কাজ করেছে। আমাদের সাথে মর্টার সজ্জিত মুক্তিবাহিনীর একটি দল ছিল। তারা শুধু হানাদারদের গোলাবর্ষনের জবাবে পাল্টা গুলি ছুড়তো। সুবেদার গফুর নামে একজন অভিজ্ঞ মর্টার শিক্ষক পাক-হানাদারদের গুলির জবাবে দক্ষতার সাথে পাল্টা গোলাবর্ষন করে প্রত্যেকবারই শত্রুদের প্রভুত ক্ষতি সাধন করতো। ভয়ানক ভাবে কোণঠাসা হয়ে হানাদারদের মেশিনগান গুলো সব সময় গর্জন করতে লাগলো। যেহেতু আমাদের অবস্থানের চতুর্দিকে হানাদারদের দৃষ্টির আওতায় সেজন্যে রাত্রে বা দিনের পাহারায় বেরুনোর খুবই কষ্টকর ছিল। কিছুক্ষনের জন্য যুদ্ধ দানবটা দম নিয়ে পুনর্বার আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুতি নিতো।

 

২৩শে নভেম্বর পারুলিয়া থেকে চার মাইল দূরে আর একটা ব্রীজের পেছনে হানাদাররা সরে গেল। সরে যাবার আগে ওরাই এবার নৃশংসতার স্বাক্ষর রেখে গেল। এদিকে আমাদের সৈন্যরা সামনের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো। স্পষ্ট বোঝা গেল যে হানাদাররা প্রথমে সাতক্ষীরায় ও পরে খুলনার দিকে পালাবার জন্য যুদ্ধে দীর্ঘসূত্রতার কৌশল অবলম্বন করেছে। এই ব্রীজের কাছে এসে ঊভয় পক্ষই মাঝে-মধ্যে মেশিনগানের ব্রাশ ফায়ার করে গুলি বিনিময় করতো। এখানে মূর্তজা নামে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে হারাতে হয়। সে অত্যন্ত সাহসী এবং অনেক যুদ্ধে সক্রিয় অংশ নিয়েছিল। মাথায় বুলেটের আঘাত লাগার পর তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ওকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। কেননা, বুলেটের আঘাতে ওর মগজ বের হয়ে গিয়েছিল। যাহোক, আমরা সব সময় আত্মরক্ষা মূলক অবস্থান থেকে শত্রুর প্রতিটি গতিবিধির প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতাম।

 

হানাদাররা যে সমস্ত জায়গা ছেড়ে পালিয়ে গেছে, তার খবরটা কোলকাতার জনগনের কাছে খুব দ্রুত পৌঁছে গেল। মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন করার জন্য সাংবাদিক, টিভি ক্যামরাম্যান এবং আরও অনেক সম্মানিত ব্যাক্তি আসতে লাগলেন। ইছামতীর পশ্চিম তীর লোকে লোকারণ্য, মনে হলো কোন জনাকীর্ণ মেলা। পরিদর্শনকারী দু’একটি দলকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনারা এখানে ঘোরাঘুরি করছেন কেন? উত্তর এলো, মুক্তির আনন্দ, মেজর সাহেব- মুক্তির আনন্দ’।

 

মুক্তির আনন্দই যেন বৈধ পাসপোর্ট। শিগগিরই মুক্ত-অঞ্চল লোকের আগমনে সরগরম হয়ে উঠলো। কোলকাতা থেকে শরণার্থীরা দলে দলে তাদের পরিত্যক্ত বাড়িঘরে ফিরে আসতে লাগলো। আবার নতুন করে ঘর বাধাঁর প্রবল ইচ্ছা।

 

এবার সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানী সাহেব মুক্তাঞ্চল সফর করতে এলেন। তাঁকে আমি রণাঙ্গনের অগ্রবর্তী এলাকায় নিয়ে গেলাম। কতকগুলো অসুবিধার জন্য সাতক্ষীরা থেকে আট মাইল দূরে আমাদের থামতে হয়েছিল। কি করে এই অসুবিধাগুলো দূর করা যায়, তাঁকে বুঝিয়ে বললাম। আমার পরিকল্পনা ছিল, সাতক্ষীরার পিছনে দু’দিক থেকে সৈন্য পাঠিয়ে হানাদারদের পালানোর পথ বন্ধ করে দেয়া এবং যাতে নতুন সৈন্য আমদানী করে শক্তি বৃদ্ধিকরতে না পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা। দু’টো প্রধান রাস্তা দিয়ে সাতক্ষীরার সাথে চলাচল ব্যবস্থার সংযোগ সাধন করা হতো। একটা হলো, যশোর থেকে কদমতলা হয়ে- অপরটা হলো কালিগঞ্জ থেকে যে পথ ধরে আমরা অগ্রসর হচ্ছিলাম, সেই পথ। এ রাস্তাটা সাতক্ষীরার ভেতর দিয়ে দৌলতপুর-খুলনা পৌঁছেছে। স্থির করলাম, প্রত্যেকটি রাস্তায় বাধা সৃষ্টি করবো।

 

২৯শে নভেম্বর, হাবিলদার আফজালের নেতৃত্বে দু’শো মুক্তিযোদ্ধার একটি দল সাতক্ষীরার প্তহে পাঠিয়ে দিলাম। কিন্তু যেভাবে তাকে নির্দেশ দিয়েছিলাম সেইমত কাজ করতে ব্যর্থ হলো। তারপর লেঃ আহসানউল্লাহর নেতৃত্বে দু’শো মুক্তিযোদ্ধার একটি দলকে ওই একই পথে পাঠানো হলো। আহসানউল্লাহ অত্যন্ত সাহসী যুবক। তার যোগ্যতা ও সামর্থ্য সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত ছিলাম ছিলাম। এগিয়ে যাবার প্রচন্ড শক্তি তার মধ্যে। ডানদিক থেকে একশো মুক্তিযোদ্ধার আর একটি দলকে মিঃ শাজাহানের নেতৃত্বে সাতক্ষীরা-দৌলতপুর রাস্তায় ওঁত পেতে শত্রুকে আঘাত করার জন্য পাঠিয়ে দিলাম। ক্যাপ্টেন হুদাকে বললাম যে, রাতের বেলায় আক্রমণাত্মক পাহারা দিয়ে শত্রুদের উপর চাপ সৃষ্টি করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সাতক্ষীরা অধিকার এবং সৈন্যদের দ্রুত পুনর্গঠিত করে পলায়নের পর শত্রুদের পিছু ধাওয়া করতে হবে।

 

ইতিমধ্যে প্রশাসনিক ব্যবস্থার বৃহদাংশ নদীর ওপার থেকে দেবহাটায় স্থানান্তরিত করা হয়েছে। এখানে ভুতপুর্ব সি-এস-পি অফিসার মিঃ আতাউর রহমানের তত্ত্বাবধানে পাঁচশো তরুণ যুবক নিয়ে একটা ট্রেনিং ক্যাম্প খুলে দিলাম। মিঃ আতাউর রহমান যুবক, কর্তব্যপরায়ন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি সর্বান্তকরনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এই যুদ্ধে তার দান অপরিসীম। শীগগীরই ক্যাম্পের কার্যকলাপ সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র প্রযোজকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। সব মতাদর্শের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ক্যাম্প পরিদর্শনে আসতে লাগলেন। অনেক গণ্যমান্য লোকজন সাথে নিয়ে ও পুনর্বাসন মন্ত্রী মেঃ কামরুজ্জামান এই ক্যাম্প পরিদর্শন করে অত্যন্ত খুশী হলেন। ছেলেরা ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি তুলে মন্ত্রী মহোদয়কে স্বাগত জানালে তিনি অভিভূত হয়ে পড়লেন। কিন্তু এই সৌজন্যমুলক পরিদর্শনে আমি খুশী হতে পারিনি। কেননা, সামনে এখনও অনেক দুস্তর পথ আমাদের অতিক্রম করতে হবে। ২রা ডিসেম্বর পর্যন্ত লেঃ আহসানউল্লাহর কাছ থেকে কোন ফলপ্রসু খবর পাইনি। রাস্তায় ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন পুঁতে শত্রুদের একটি জীপ সে উড়িয়ে দিয়েছিল। রাস্তার ধার দিয়ে একটা সুদৃঢ় ব্যাংকার তৈরী করে শত্রুপক্ষ অবস্থান নেয়ায় আহসানউল্লাহ ওদের কাছে ঘেঁষতে পারেনি। শত্রুদের অবস্থান থেকে দু’দিকে প্রায় দু’শো গজ পর্যন্ত উম্মুক্ত ধান ক্ষেতও জলাশয়। সবকিছুই ভালভাবে দৃষ্টিগোচর হতো না। ডান দিকে মিঃ শাজাহানের বেলায় ঠিক একই অসুবিধা। তাছাড়াও, রাজাকারদের কাছ থেকে তাকে তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়েছিল।

 

অবস্থার কোন উন্নতী হলো না। যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেল। শত্রুদের পরিকল্পনা ছিল রাজাকার দ্বারা প্রতিরোধ তৈরী করে রাতের অন্ধকারে আস্তে আস্তে সরে পড়া। সাতক্ষীরা ও তার পার্শবর্তী এলাকার প্রায় শতকরা পচাঁশি জন লোক সামরিক চক্রের দালাল হিসাবে হানাদারদের সক্রিয় মদদ যুগিয়েছে। তার ফলে সবকিছুই মন্থর গতিতে চলতে থাকে। কিন্তু ইতিহাসের ক্রমবিকাশ ও চিরন্তন গতিকে কে রুখতে পারে? পুর্ব রণাঙ্গনেই শুধু পাকিস্তানী জেনারেলরা বিভ্রান্ত ও দিশেহারা হলো না, পশ্চিম রণাঙ্গনে ও রিতিমত হিমশিম খেয়ে উঠলো। ১৯৬৭ সালে ইস্রাইল যে রকম ব্লীসৎক্রীগ’ কায়দায় আরবদের উপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, ঠিক একই কায়দায় পাক-সামরিক জান্তা তাদের বিমান বাহিনীর মিরেজ ও মিগ নিয়ে ডিসেম্বর মাসের ৩ তারিখ রাত্রে ভারতের উপর হামলা চালায়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীও খুব সতর্ক ছিলেন। তিনি ওই রাত্রেই জরুরী অবস্থা ঘোষনা করে পাক হামলার সমীচীন জবাব দিলেন। সুরায় বিভোর জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান মনে করেছিল রাজনীতি সচেতন বাঙ্গালীকে চিরদিনের জন্য দাবিয়ে রাখতে পারবে এবং এই হীন উদ্দেশ্যই সে ভারত আক্রমণ করে সমস্যাটার উপর আন্তর্জাতিক রং চাপিয়ে ভারতের সাথে একটা রাজনৈতিক মিমাংসায় আসতে চেয়েছিল। কিন্তু সে চরম ভাবে ব্যর্থ হলো।

 

৬ই ডিসেম্বর। বেলা ১১ টার সময় ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’ মারফত ঘোষনা করা হলো যে, ভারত বাংলাদেশকে সর্বভৌম রাষ্ট্র বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। দীর্ঘ ন’মাস যাবত সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী অধীর আগ্রহে দিনটির জন্য প্রতিক্ষায় ছিল। সংবাদটা শুনে মন থেকে চিন্তা ও উত্তেজনা দূরীভূত হলো। হটাত স্বীকৃতির এই ঘোষনা শুনে সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর এই বিধ্বস্ত অন্তর গর্বে ফুলে উঠলো। স্বীকৃতি শুধু ফাইলের ভেতরেই সীমাবদ্ধ রইলনা বা বাতাসে মিলিয়ে গেল না। মিত্রবাহিনী মুক্তিবাহিনীর কাধে কাধ মিলিয়ে প্রথম তিন দিনেই যশোর ক্যান্টনমেন্ট অধিকার করে নিল। সুদৃঢ় অবস্থান ছেড়ে দিয়ে পাক হানাদাররা উর্ধবশ্বাসে পালাতে শুরু করলো। প্রত্যেকেই আশা করেছিল যে, পাক বাহিনী যশোরে আমাদের প্রচন্ড বাধা দেবে। কেননা, যশোর ক্যান্টনমেণ্ট দুর্ভেদ্য বলে মনে করা হতো। কিন্তু হানাদাররা তেমন কোন বাধা দিতে না পারায় মিত্রবাহিনী ও আমরা নিরাশ হয়ে পড়লাম। অথচ মিত্রবাহিনীর কমান্ডাররা প্রথমে, মনে করেছিল যে, পাকিস্তানীদের উৎখাত করতে কমপক্ষে ১৫ দিন সময় লাগবে।

 

অপর দিকে আমাদের মুক্তিবাহিনী ডিসেম্বর মাসের ৩ তারিখে সাতক্ষীরা দৌলতপুর রোড ধরে অগ্রসর হতে লাগলো।  সাতক্ষীরা অধিকার করে যে পরিমান অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, জ্বালানী তেল, রেশন ও অন্যান্য মূল্যবান জিনিস পত্র আমাদের হাতে এসেছিল তা দিয়ে পুরা একবছর যুদ্ধ করা যেতো। কিন্ত এই সময় অধিকৃত জিনিসপত্রের প্রতি আমাদের কোন মোহ ছিল না। আমাদের একমাত্র মোহ, একমাত্র উত্তেজনা সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া। পেছনে মুক্তিবাহিনীর উপর ওইসব পরিত্যক্ত জিনিসের হেফাজতের ভার দিয়ে ক্যাপ্টেন হুদা তার বাহিনীর লোকজন নিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে অগ্রসর হতে লাগলো।

 

হানাদাররা পালাবার সময় প্রধান সেতুগুলো ধ্বংস করে দিয়েছিল। এর ফলে আমরা খুবই অসুবিধার সম্মুখীন হলাম। দু’একটা জীপ ছাড়া আমাদের কাছে কোন যানবাহন ছিল না। এই জীপ গুলো নানা উপায়ে পার করা হতো। মিঃ ফজলুল হক ও সুলতান উদ্দিন আহমেদ যথাক্রমে সদর দফতর ও গেরিলা ক্যাম্পের সামরিক দায়িত্বে নিযুক্ত ছিল। তাদের শেষ নির্দেশ দেওয়ার জন্য আমি ফিরে গেলাম।

 

চার্লি সেক্টর থেকে সর্বশেষ যে নির্দেশ পেলাম, তা হলো- অস্ত্রপাতি ছাড়া মুক্তিযূদ্ধাদের বিদায় দিতে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, বিভিন্ন যুবকেন্দ্রের ম্যানেজাররা এম সি এ’রা স্বাধীনতার উল্লাসে আত্মহারা হয়ে ছেলেদের ফেলে রেখে যে যার মত আগেই চলে যায়। আর ছেলেরা পড়ে মহাসংকটে। বাংলাদেশে ফিরে যাবার মত কোন সম্বলই ছিল না তাঁদের। তারা আমার হেডকোয়ার্টারের চারিদিকে এসে ভীড় করলো এবং অনুরোধ জানালো যে তাঁদের জন্য যেন কোন বন্দোবস্ত করে দেই। আমার এক বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করে ছেলেদের যাবার বন্দোবস্ত করার জন্য সুলতান ও হককে বলে দিলাম।

 

দিনটা ডিসেম্বরের ৯ তারিখ। সবকিছুই এলোমেলো। কারুর দৃষ্টি নেই। কাজকর্ম ফেলে রেখে সবাই বাংলাদেশের ভেতর চলে যেতে চায়। আমি তাঁদের মানসিক অবস্থা উপলব্দি করতে পারি। কিন্তু পিছনের কাজকর্ম গুছিয়ে দেয়ার জন্য কাউকে অন্ততঃ এখানে থাকতে হবে। পরিকল্পনা মোতাবেক বেগকে তার দলবলসহ গ্ণ-পরিষদ সদস্য মিঃ নূরুল ইসলাম মঞ্জুর সাথে বরিশালে পাঠিয়ে দিলাম।

 

টাকি ও হাসনাবাদের দিকে চেয়ে মনটা কেঁদে উঠলো। মনে হলো, ওরা আজ বড্ড শূন্য, বড্ড নিঃসঙ্গ। দীর্ঘ ন’মাস যাবত অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীর ভীড়ে কর্মচঞ্চল হাসনাবাদ ও টাকি আজ নীরব। যেন ফুঁপিয়ে কাঁদছে আমি ভয়ানক অন্ত জ্বালা অনুভব করলাম। শেষবারের মত ইছামতী ও আমার হেডকোয়ার্টারের দিকে অশ্রুসজল চোখ দুটো বুলিয়ে মোস্তফাকে আমার জীপে উঠতে বললাম। অন্যমনস্কভাবে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলাম, হক ও অন্যান্য সাথীদের দিকে। পরে খুলনায় এসে আমার সাথে যোগ দেয়ার জন্য ওদের নির্দেশ দিলাম এবং আমাদের অগ্রবর্তী বাহিনীর সাথে যোগ দেয়ার জন্য আমি এগিয়ে চললাম। পিছনে পড়ে রইল স্মৃতিবিজড়িত হাসনাবাদ, টাকি- চেনা-অচেনা মুখ ও হাসিকান্নার অনেক গল্প।

 

বিজয়ের আনন্দে আমার গাড়ী চাকাগুলো অসম্ভব দ্রুতবেগে ঘুরতে লাগলো। আমি দৌলতপুর থেকে ১০ মাইল দূরে একটি স্কুলের কাছে আমার লোকজনদের সঙ্গে মিলিত হলাম। এই জায়গাটার নাম শাহপুর। এখান থেকে একটি রাস্তা বের হয়ে যশোর-খুলনার বড় রাস্তার সাথে ফুলতলার কাছে এসে মিশেছে।

 

ডিসেম্বর ৯ তারিখের রাত। স্কুল থেকে অগ্রবর্তী এলাকায় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী মাত্র এক মাইল দূরে। শত্রুপক্ষের অবস্থানের হাজার গজের মধ্যে মিলে এক কোম্পানী সৈন্য মোতায়েন  করা হয়েছিল। ৯ তারিখ রাত্রেই আমি ওদের কাছে যেতে চাইলাম। কিন্তু ওদের কাছে, পৌছানো দুঃসাধ্য ছিল। কেননা, ওরা তখন সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। সুতরাং স্থির করলাম, ১০ তারিখে ভোরে ওদের সাথে মিলিত হবো। রাতটা ভয়ানক রকমের অশান্ত। সারারাত ধরে দু’পক্ষের কামানগুলো অবিশ্রান্ত গর্জন করছিল। স্কুলের ছাদে উঠে আমি, মোস্তাফা, ডাঃ শাজাহান ও হুদা দেখতে পেলাম সারা আকাশটা লালে লাল। কামানের গর্জনে স্কুলের ছাদটা থরথর করে কাঁপছে। খুবই উত্তেজক সন্দেহ নেই। কিন্তু বড় করুন, বড় নির্মম। কেননা, শত্রু মিত্র অনেক মানুষের জীবন প্রদীপ নিভে গেছে হিংস্র কামানের গোলায়। সমস্ত রাত শুধু কামানের গর্জন আর গর্জন।

 

১০ই ডিসেম্বর থেকে ১৭ই ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়টা অতিবাহিত হলো অহেতুক উদ্দীপনা, উত্তেজনা ও এক রকম বিশ্রামের মধ্য দিয়ে। মুক্তিসংগ্রামের শেষ পর্ব। দুঃখ ও আনন্দে আবহাওয়া ভারাক্রান্ত। স্থানীয় লোকজন বিজয়ের আনন্দে আত্মহারা। নানাভাবে আতিথ্য দেখিয়ে জনগন আমাদের মুগ্ধ করলো। যেন আমরা সবাই একই সংসারের লোক, একই সুখ দুঃখের ভাগী। রাস্তার পার্শে সেই স্কুলটায় যে সপ্তাহটা কাটিয়েছিলাম, তার পূর্নাংগ চিত্র তুলে ধরার জন্য রণাংগনের ডাইরীর কিয়দংশ তুলে ধরছিঃ

১০ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালঃ গতরাতে ঘুমাতে পারিনি। কামানগুলো ঝিমিয়ে পড়েছে। গুহায় আহত সিংহের মত কামানগুলো তবুও মাঝে মাঝে গোঙাতে লাগলো। ভোরে ঘুম থেকে উঠে এক মগ চা দিয়ে গলাটা ভিজিয়ে অগ্রবতী ঘাটিতে যুদ্ধরত সৈন্যদের কাছে গেলাম।এটা আমাদের দ্বিতীয় অবস্থান্ সাতক্ষীরা দৌলতপুর রাস্তায় প্রায় একহাজার গজ সামনে মেজর ঠাকুরের নেতৃত্ব ১৩নং “ডোগরা”  পদাতিক বাহিনী অবস্থান নিয়েছিল। অগ্রবর্তীদলের মর্টার সজ্জিত সৈন্য দলটি ও এখানে অবস্থান নেয়। রাস্তায় দু’দিক খোলা জলাশয়, সব কিছুই চোখে পড়ে। রাস্তায় কোন রকম চলাচল করলেই শত্রুপক্ষের মেশিনগানগুলি গর্জে ওঠে। রাস্তাটা খুব উঁচু। খুলনায় অয়ারলেস ষ্টেশনের টাওয়ার ও দৌলতপুর পানির ট্যাংক ভালভাবে দেখা যায়। এত কাছ তবু সোজাসুজি যেতে পারছি না। খুলনাকে দেখে আমি খুবই তৃষ্ণার্ত ও উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। যেহেতু পিছন দিক থেকে অনেকটা পথ ঘুরে আসতে হয়, সেজন্য আমাদের সেজন্য সৈন্যরা দু’দিক থেকে অগ্রসর হতে লাগলো। তাছাড়া মিত্রবাহিনীর আগে আমাদের যাবার কথা নয়। কাজেই আমাদের পিছনে থেকে যুদ্ধের গতিবিধি লক্ষ্য করা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কথা  বললাম। ওদের অধিকাংশই খুলনার লোক। দেখলাম, ওদের মনোবল খুবই উঁচু। ওদের ঘরদোরের করুন দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলো। স্কুলে ফিরে এসে আমাদের যা কিছু আছে সব একত্র করার জন্য হুদাকে বললাম। স্মভাব্য বিপদের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য ট্রেঞ্চ খনন করে তার ভেতর আমরা আশ্রয় নিলাম। কেননা ,এই জায়গা শত্রুক্ষের কামানের আওতায়। স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে সতর্ক হয়ে প্রস্তুত রইলাম। আকাঙ্ক্ষিত চরম লক্ষ্যবস্তুর কত কাছে আমরা-তবু কত দূরে।

১১ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালঃ যে দৃশ্য দেখেছি, তা জীবনের অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে। দেখলাম , সাতক্ষীরা-দৌলতপুর রোড লোকে লোকারন্য। বিভিন্ন যুবকেন্দ্র থেকে ওরা দলে দলে ফিরে আসছে। যতদূর চোখ যায় শুধু লোক আর লোক। কাঁধে ছোট ছোট বোঝা। রিক্ত,নিঃস্ব, সম্বলহীন। ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে আসছে মানুষের কাফেলা। আল্লাহর অসীম অনুগ্রহ, আমরা ওই রাস্তার উপরই ছিলাম, নইলে ওই রিক্ত মানুষগুলো হিংস্র শত্রুদের খপ্পরে পড়ে যেতো। সামনে অগ্রসর হতে ওদের থামিয়ে দিলাম।

একটা দোতলা দালান থাকার জন্য ঠিক করা হলো। ওদের খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে। ভয়ানক চিন্তায় পরে গেলাম। ওরা প্রত্যেকেই এসে অভিযোগের সুর বললো, ‘স্যার, আমাদের সাথে কোন টাকা পয়সা নেই। এম-এন-এ, এম-পি-এ’ রা আমাদের ফেলে পালিয়ে গেছে।‘ মুখগুলো শুষ্ক, কুঞ্চিত। কেননা পঞ্চাশ মাইল পথ ওদের পায়ে হেঁটে আসতে হয়েছে। মনটা আমার কেঁদে উঠলো। ওদের সান্তনা দিয়ে একটা বড় লংগরখানা খোলার জন্য চৌধুরীকে বললাম। খুলনা মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের এখানেই থাকতে নির্দেশ দিলাম। চৌধুরীকে লংগরখানা দেখাশুনার ভার দিয়ে আমি হেড কোয়ার্টারের দিকে রওনা হয়ে গেলাম এবং ফুলতলা পোঁছে ৯নং পদাতিক ডিভিশনের হেডকোয়ার্টারের সাথে যোগাযোগ করলাম মেজর জেনারেল দলবীর সিং এই ডিভিশনের কমান্ডার।

ফুলতলা থেকে কিছু সামনে খুলনার দিকে যে রাস্তাটা গিয়েছে তার ডানপাশে একটি কলেজের মধ্যে হেডকোয়ার্টারের অফিসাদি। মেজর জেনারেল সিং-এর দেখা না পেয়ে তাঁর ষ্টাফ অফিসারের সংগে দেখা করলাম এই ডিভিশনের একটি ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার থেকে তিনি মাইল সামনে অবস্থান নিয়েছিল।

পাক হানাদাররা এখনে তীব্র প্রতিরোধ দিয়ে খুলনা – যশোর উপর মিত্রবহিনী অগ্রগতি বন্দ করে দিল। অবিরাম গোলাবর্ষন চলতে লাগলো। মনে হলো, খুলনা শত্রুপক্ষ সুদৃঢ় ঘাঁটি গেড়েছে। সীমান্ত ও যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা জড়ো হয়েছে খুলনায়। কেননা মুক্তিবাহিনী চতুর্দিক থেকে ওদের ঘিরে রেখেছে। হানাদাররা মিত্রবাহিনীর চাইতে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ ভয় করতো।

১৩ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালঃ আমাদের আত্ম রক্ষামূলক অবস্থানের সামনে শত্রুঘাঁটির উপর বিমান হামলা পর্যবেক্ষন করার জন্য আমি, ডিভিশনের ষ্টাফ অফিসার মেজর ভট্টাচার্‍্য  ভারতীয় বিমান বাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট দত্ত আমাদের দ্বিতীয় অবস্থানে বসে সারা দিন অপেক্ষা করলাম। মিঃ দত্তের নির্দেশে এই বিমান হামলা পরিচালিত হচ্ছিল। বায়ুস্তর ভেদ করে বিমানগুলো উড়ে আসতেই মিঃ দত্ত বেতার যন্ত্র মারফত পাইলটদের সাথে যোগাযোগ করলেন এবং সঠিক লক্ষ্যস্থলের বর্ননা দিয়ে আঘাত হানার নির্দেশ দিলেন। পাইলটদের ঠিকমত নির্ভূলভাবে লক্ষ্য বস্তু চিনে বারবার বিমান নিয়ে ‘ড্রাইভ’ দিতে লাগলো। হানাদারদের কোন বিমান বা বিমানধ্বংসী কামান না থাকায় তার এই বিমান আত্রুমনের কোন প্রত্যুত্তর দিতে পারল না। অসাহায়ের মত শুধু মার খেতে লাগলো।

১৪ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালঃ মেজর জেনারেল দলবীর সিং-সাথে তাঁর হেড কোয়ার্টারে সাক্ষাৎ করলাম। দেখলাম গাড়ীর ভেতর তিনি একটি ম্যাপ দেখছেন এবং খুবই ব্যস্ত। তাঁকে  ভয়ানক বিরক্ত ও রাগান্বিত মনে হলো। কেননা, প্রচন্ড গোলাবর্ষন করার পরও তিনি এগুতে পারছিলেন না। তাঁর অগ্রগতি থেমে গিয়েছিল।

ভারতের সর্বাধিনায়ক জেনারেল মানেকশ’ অল ইন্ডিয়া রেডিও মারফত ঘোষনা করলেন যে, আত্মসমর্পনকারী সৈন্যদের জীবনের নিরাপত্তা দেয়া হবে। তৎসত্বেও শত্রুপক্ষের আত্মসমর্পন করার কোন লক্ষন দেখা গেল না।

জেনারেল দলবীর সিং তাঁর একটি বাহিনীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার কাজে আমার কাছে কয়েকজন দক্ষ লোক চাইলেন। উদ্দেশ্য, শত্রুদের বাঁদিক থেকে আত্রুমন করে বিভ্রান্ত করে ফেলা। তারাতারি হেড কোয়ার্টারে ফিরে গিয়ে খুলনার পথ-ঘাট যাদের ভাল জানা আছে এ-রকম পাঁচজন আমি নির্বাচিত করলাম।

১৫ই ডিসেম্বর ,১৯৭১ সালঃ গতরাতে মুষলধারে বৃষ্টি থাকায় মিত্র-বাহিনী সামনে এগুতে পারলো না। আজকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হবে। এদিকে লেঃ দত্তের তত্ত্ববধানে দৌলতপুর ও খুলনার কয়েকটা নির্দিষ্ট জায়গায় বিমান হামলা চালানো হলো। বারবার বিমান হামলায় খুলনা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে দেখে মনে ব্যথা অনুভব করলাম এবং পাক হানাদাররা এখনও আত্মসমর্পন না করায় মনে মনে ওদের অভিশাপ দিতে লাগলাম। আজকে একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল। আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা বুলেটের আঘাতে প্রান হারায়। ক্যাম্পের আর একজন মুক্তিযোদ্ধা রাইফেলের ম্যাগাজিন খালি ভেবে ট্রিগার টিপ দেয়, যার ফলে এই মর্মান্তিক দৃশ্যের অবতারনা হয়। মুক্তিযোদ্ধাটি একজন এস,এস,সি পরীক্ষার্থী। মুকড়া স্কুল প্রাঙ্গনে ওকে সমাহিত করা হয়েছিল। স্থানীয় স্কুল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করলাম, তারা যেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তার নামে স্কুলটির নামকরন করে।

১৬ই ডিসেম্বর,১৯৭১ সালঃ দিনটা মেঘাচ্ছন্ন। কিছুটা ক্লান্তি ও বিষন্ন বোধ করতে লাগলাম।গতরাত্রের পরিকল্পনামাফিক মিত্র বাহিনীর এক স্কোয়াড্রন ট্যাংক’ খুলনার দিকে অগ্রসর হলো। কিন্তু ফরাফলের কোনখবর পেলাম না।

সকাল দশটা। শাহপুর স্কুলে কতকগুলো ছেলের সাথে দাঁড়িয়ে  ছিলাম। ক্যাপ্টন হুদার জীপ এসে থামতেই সে একটা দুষ্ট ছেলের মত লাফিয়ে পড়ে গভীর আবেগে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। এ-রকম করতে আগে তাকে কখনও দেখিনি। তার এই ব্যবহার দেখে খুবই বিস্মিত হলাম। সে এক রকম কাঁপতে কাঁপতে বললো, ‘অত্যন্ত সুখবর স্যার, পাক সৈন্যরা আত্মসর্মপন করেছে এবং ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল জ্যাকপ ইতিমধ্যে ঢাকা অবতরন করেছেন’।

সংবাদটা অবিশ্বাস্য মনে হলো। কেননা, কল্পনাও করতে পারিনি যে, ওই হিংস্র পশুগুলি এত তারাতারি আত্ম সর্মপন করবে। তবুও এ সংবাদটা শুনে আমার সারা দেহে তপ্ত রক্তস্রোত বইতে লাগলো। চিৎকার করে ছেলেদের উদ্দেশ্য বললাম, ‘আমরা যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছি’।

আমার জীবনে সবচেয়ে আনন্দঘন মুহূর্ত। ছেলেরা সবাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে চিৎকার করতে লাগলো। ওদের মধ্যে কেউ কেউ ডিগবাজি খেয়ে ঘাসের উপরে গরাগরি করতে লাগলো। সবাই এক সঙ্গে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো, ‘তোমার নেতা, আমার নেতা- শেখ মজিব।’

আমি এবং হুদা মিত্রবাহিনীর ৯নং ডিভিশনের সদর দপ্তরে গিয়ে মেজর জেনারেল দলবীর সিংহকে তাঁর বাহিনীর অপর দু’জন অধিনায়কসহ খোশ মেজাজে বসা দেখলাম। আমাদের দেখে তাঁরা সবাই উল্লসিত হলেন এবং আমাদের স্বাগত জানালেন।

সময় বেলা ১২টা। কামানগুলি নীরব। আমরা একটা ট্রানজিষ্টারের কাছে বসে ঢাকার খবরাখবর শুনতে লাগলাম। শুনলাম পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনীর অধিনায়ক লেঃ জেনারেল নিয়াজী তাঁর অধীনস্থ সমস্ত সৈন্য নিয়ে সকাল সাতটায় মিত্র-বাহিনীর লেঃ জেনারেল অরোরার নিকট আত্মসমর্পন করেছেন। একদিকে আমাদের ঐতিহাসিক বিজয়ের আনন্দ, অপরদিকে ওদের অপমানজনক পরাজয়ের তীব্র গ্লানি।

যাহোক, এদিকে খুলনাকে নিয়ে বড্ড দুর্ভাবনায় পড়লাম। তখন পর্যন্ত এখানকার শত্রুপক্ষের আত্মসমর্পন করার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। উত্তেজনায় জেনারেল দলবীর সিং টেবিল ধাপরে বললেন, যদি ওই শয়তানগুলো এখন আত্মসমর্পন না করে, তাহলে আমার নিকট যে গোলন্দাজ বাহিনী আছে, তা পাঠিয়ে দিয়ে ওদের মাটির সাথে মিশিয়ে দিব।’

সময়ের চাকাটা ঠিকমতই চলতে লাগলো। কিন্তু আমাদের সামনে যে শত্রুরয়েছে, তারা যেন স্থবির। সবাই আমরা বসে। প্রতি মুহূত আশা করছি এইবার বুঝি হানাদাররা আত্মসমর্পন করবে। সূর্য ডুবে গেল, কিন্তু আত্মসমর্পনের কোন আভাস পাওয়া গেল না। আজ ঢাকার শত্রুপক্ষ আত্মসমর্পন করলো। কিন্তু খুলনায় আত্মসমর্পন করতে ওরা অস্বীকৃতি জানালো। মনে হলো, খুলনায় শত্রুপক্ষের কমান্ডার অত্যন্ত শক্ত লোক। আমি আমার হেডকোয়ার্টারে ফিরে গেলাম।

রাতটা ভয়ানক অস্বস্তিতে কাটলো। আমরা কেউ ঘুমাতে পারলাম না। মিত্রবাহিনীর কামানগুলি আবার সত্রিুয় হয়ে উঠলো। মাঝে মাঝে প্রত্যুত্তরে শত্রুপক্ষের কাছ থেকেও জবাব আসছিল। ওদের গোলাবারুদ হয়তো শেষ হয়ে আসছে। আমি আশাবাদী ছিলাম যে, আগামীকালই আমরা বিজয়ীর বেশে খুলনায় প্রবেশ করতে পারবো। বিগত ন’মাসের স্মৃতিচারন করতে গিয়ে আজ আমার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগলো।

১৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালঃ গত রাতে ক্যাপ্টেন হুদার সাথে পরামর্শ করে ঠিক করলাম যে, মুক্তিবাহিনীর অধিকাংশ লোককে লেঃ মোহাম্মদ আলির তত্ত্বাবধানে দৌলতপুর রোড দিয়ে খুলনায় পাঠিয়ে দিতে হবে। ওদের ভেতর ষাটজন মুক্তিযোদ্ধাকে গাড়িতে চাপিয়ে প্রস্তুত করে রাখলাম, যেন ওরা নির্দেশ পাওয়া মাত্র আমাদের সাথে খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা হতে পারে। সকাল বেলা সবাই প্রস্তুত। চরম বিজয়ের অভিযানের উত্তেজনায় সবাই কাপঁছে। ক্যাপ্টেন হুদা, ডাঃ শাজাহান ও মোস্তফাকে সাথে নিয়ে সকাল সাতটায় মিত্রবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে গিয়ে পোঁছালাম। গাড়ীতে যেসব মুক্তিযোদ্ধা প্রস্তত করে রাখা হয়েছিল তাঁরা আমাদের পিছে পিছে রওনা হলো। রাস্তায় শত শত গাড়ীর ভীর। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কখন মিত্রবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে গাড়ী ছাড়ার সংকেত সবুজ বাতি জ্বলে উঠবে এবং খুলনার দিকে অগ্রসর হবে। মিলিটারী পুলিশ স্ট্যান্ডের নিকট সবার আগে আমাদের গাড়ী দাঁড় করালাম। ৯নং মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক হিসাবে আমাকে স্বীকৃতি দেয়ায় মিত্র বাহিনী আমাকে গাড়ী পার্ক করার অনুমতি দিল। অন্যথায় কোন বেসামরিক লোককে মিলিটারি পোষ্টের একশো গজের মধ্যে গাড়ী পার্ক করার অনুমতি দিল। অন্যথায় কোন বেসামরিক লোককে মিলিটারি পোষ্টের একশো গজের মধ্যে গাড়ী পার্ক করার অনুমতি দেয়া হতো না। পিছন দিকে চেয়ে দেখলাম অসংখ্য দেশী বিদেশী সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার গাড়ীর চারদিকে ভির করে আছে। আমি হেডকোয়ার্টার পর্যন্ত হেঁটে গেলাম। কারও উপর কারো নিয়ন্ত্রন ছিল না। সবাই ব্যস্ত-সমস্ত। বিজয়ের লগ্নটা আজ কত না প্রানবন্ত। প্রতিটি মুহুর্ত উত্তেজনাময়-ঐতিহাসিক। প্রতি শ্বাস-প্রশ্বাস বিজয়ের আনন্দে মুখর। বহু প্রতীক্ষিত স্বপ্নের ফলশ্রুতি। সবাইকে খুশি মনে হলো। কিন্তু অন্তর খুলে কেউ হাসতে পারলো না। মনের অস্থিরতায় সবাই আড়ষ্ট হয়ে এলো।

জেনারেল দলবীর সিং-এর সাক্ষাৎ করলাম। তিনি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। কেননা, প্রধান ষ্টাফ অফিসার ,আত্মসর্মনকারী পাকিস্তানী কমান্ডার নিয়ে ইতিমধ্যেই রওনা হয়েছেন। এখনও এসে পেঁছৈাননি। সময় অতি মন্থর গতিতে চলতে লাগলো। এক একটি মুহূর্ত যেন এক একটি ঘন্টা। মিত্রবাহিনীর ৯নং ডিভিশনের ষ্টাফ অফিসার কর্নেল দেশ পান্ডে জেনারেল দলবীর সিংকে বললেন, ‘বিগ্রেডিয়ার হায়াত খান ও তাঁর সাথের সাতজন এসে পোঁছে গেছেন’।

উত্তেজনার চরম মুহূর্ত। জেনারেল দলবীর সিং গভীর স্বরে হকুম দিলেন , ‘ওদের এখানে নিয়ে আসুন’।  আমরা হেডকোয়ার্টার বিল্ডিং- এর উপরের তলায় বসা ছিলাম। নিচের দিকে চাইতে দেখলাম সাংঘাতিক অবস্থা। সামরিক বাহিনীর ফটোগ্রাফাররা আত্মসর্মনকারী পাকিস্তানি কমান্ডারদের ফটো নেয়ার জন্য, ওরা গাড়ী থেকে নামার সাথে সাথে ঘিরে ধরলো। এত ভীর যে, নিয়ন্ত্রন করা কিছুতে সম্ভব নয়। উৎসাহী সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফাররা এতদিন ধরে পাগলের মত অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল।

যাহোক, পাকিস্তানী কমান্ডারদের নিয়ে আসা হলো। আমি চারদিকে তাকাচ্ছিলাম ওদের ভেতর আমার চেনা কেউ আছে কিনা। হ্যা ওদের ভেতর আমার চেনা দু’জন ছিল। একজনের নাম লেঃ কর্নেল ইমতিয়াজ ভয়ায়েচ। পাকিস্তানী মিলিটারী একাডেমিতে যখন আমি ক্যাডেট ছিলাম তখন ওখানে তিনি ক্যাপ্টন ছিলেন। অপর জন লেঃ কর্নেল শামস। তার সাথে আমার জানা শোনা ছিল। ব্রিগেডিয়ার হায়াতকে ও একবার কি দু’বার পশ্চিম পাকিস্তানে দেখেছি। তখন তাঁদের মনে হতো খুব ভদ্র, বিনয়ী। কিন্তু বাংলাদেশে তাঁরাই অভদ্র, অযোগ্য প্রমানিত হয়েছে। বসতে তাঁদের চেয়ার দেওয়া হলো। জেনারেল দলবীর সিং অত্যন্ত সৌজন্যমূলক ব্যবহার করলেন তাদের সাথে। বিজয়ী ও বিজিতের কোন সামঞ্জস্য রাখলেন না। তিনি ওদের চা-পানে আপ্যায়িত করলেন। জেনারেল দলবীর সিং-এর মার্জিত রুচিবোধ ও ব্যবহার দেখে সত্যিই আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। ব্রিগেডিয়ার হায়াতের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই যে উনি হচ্ছেন মুক্ত-কমান্ডার। আগে আপনাদেরই একজন ছিলেন।’

আত্মসমর্পনের খুঁটিনাটি বিষয় সমাপ্ত  হলো। ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান তার ব্রিগেড মেজরকে ডেকে বললেন, মেজর ফিরোজ, তুমি এখনই চলে যাও এবং সৈন্যদের হুকুম শুনিয়ে দাও, যে যেখানে আছে সেখানেই অস্ত্র সম্বরন করতে। ওদের বলে দিও আমরা আত্মসমর্পন করেছি’।

শেষের কথাগুলি যখন তিনি উচ্চারন করলেন, তখন তাঁর সারা মুখমন্ডলে বেদনা ও গ্লানির উৎকট রেখাগুলি প্রকট হয়ে উঠলো। বেলা এগারটার সময় মেজর ফিরোজ তার সাথের অন্যান্য অফিসারদের নিয়ে জীপে করে খুলনার দিকে রওনা হলেন। ঠিক তাঁর পিছনেই ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান। তাঁর পিছনে ৯নং ডিভিশনের একটা জীপ আমি ও লেঃ কর্নেল দত্ত পাশাপাশি বসা। মিঃ দত্তকে বেসামরিক গনসংযোগ অফিসারের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। আমাদের জীপের পিছনে ক্যাপ্টেন হুদা, মোস্তফা ও ডাঃ শাজাহান।

আত্মসমর্পনকারী পাক-সৈন্যারা রাস্তার দু’ধারে অবস্থান গেড়ে বসেছিল। এই রক্তপিপাসু নরখাদকরা আজ বন্দী। অবনত মস্তকে মন্থর গতিতে হেঁটে চলেছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে আত্মসমর্পনকারী ইতালীয় সৈন্যর মত হানাদাররা দীর্ঘ লাইন দিয়ে চলতে লাগলো। ধীরে ধীরে আমরা খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের ভেতর ঢুকলাম এখানে ব্রিগেডিয়ার হায়াত খানের হেডকোয়ার্টার। চারদিক শান্ত, নীরব। মিত্রবাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ারের তত্ত্বাবধানে আত্মসমর্পনকারী সৈন্যদল মার্চ করে এগিয়ে এলো। চেয়ারে বসে ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘ভদ্রমহোদয়গন, পূর্ব পাকিস্তানে বসে শেষবারের মত এক কাপ চা দিয়ে আপ্যায়ন করা ছাড়া দেবার মত আমার কিছুই নেই।’

‘মৃত পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে বাংলাদেশ বলবেন কি?’  আমি একথা বলতেই ব্রিগেডিয়ার হায়াত অসাহায়ের মত আমার দিকে চেয়ে রইলেন। উপায়ন্তর না দেখে নিতান্ত অনিচ্ছা স্বত্বেও তিনি তাঁর ভুল সংশোধন করে নিলেন। চা খেয়ে আমরা সবাই সার্কিট হাউসে যাবার জন্য প্রস্তুত হলাম। এই যাত্রাটা খুবই আনন্দকর। আমরা খুলনা শহরের কাছাকাছি আসতেই রাস্তার দু’পাশের লোকজন গগনবিদায়ী চিৎকারে আমাদের স্বাগতম জানালো। জয়বাংলা ধ্বনিতে চারদিক মুখরিত। আজ মনে হলো জয় বাংলা বাস্তব সত্য। প্রত্যেক বাড়ির চুড়ায়, দোকানে বাংলাদেশের পতাকা। প্রতিটি নারী-পুরুষ ও শিশুর হাতেই বাংলাদেশের পতাকা। হাত নেড়ে উল্লসিত জনতার অভিনন্দনের জবাব দিলাম। সবার মূখেই হাসি। শিগগিরই আমরা সার্কিট হাউজে পোঁছালাম। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা দলে দলে এদিকে আসতে লাগলো। সার্কিট হাউসের উপরে বাংলাদেশের পতাকা শোভা পাচ্ছে। বুকটা গর্বে ফুলে উঠলো। সমুন্নত পতাকার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে  রইলাম। হাজার হাজার উৎসুক মানুষ সার্কিট হাউস ঘিড়ে রয়েছে এবং সবাই সামনে আসার জন্য প্রানপন চেষ্টা করছে।

যে পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীরা নিরীহ বাঙালীদের উপর এতদিন অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছে, তাদের একনজর দেখার জন্য জনতা বাধঁভাঙা স্রোতের মত আসতে চাইলো। জনতার অসম্ভব ভীর নিয়ন্ত্রন করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু জনতার চাপ এত বেশী যে, মুক্তিযোদ্ধারা কিছুতেই ওদের সামলাতে পারছে না। সার্কিট হাউজের দরজায় নামতেই এত ভীড়ের মধ্যেও পিষ্ট হতে হতে জনতা আমাদের দেখার জন্য প্রানপন চেষ্টা করতে লাগলো। কেউ আনন্দে হাততালি দেয় কেউ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে, কেউবা পাগলের মত ছুটে আসে চুমু খায়। কি অপূর্ব দৃশ্য। মানবতার কি মহান বহিঃপ্রকাশ। সব হারাবার দুর্বিষহ জ্বালা ভূলে গিয়ে নতুন সূর্যকে কত আপন করে কাছে নিতে চায়। মহামানবের তীর্থসলিলে অবগাহন করে অবহেলিত জনতা আজ যেন নতুন প্রানের সন্ধান পেয়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ওরা  আজ মুক্ত, ওরা আজ স্বাধীন। প্রতিটি জিনিস আজ নিজস্ব। ইতিমধ্যেই একটা হেলিকপ্টার জেনারেল দরবীর সিংকে নিয়ে সাকির্ট হাউজে অবতরন করলো। উন্নত চেহারার অধিকারী জেনারেল দলবীর সিং সার্কিট হাউজ পর্যন্ত হেঁটে আসলেন এবং আত্মসমর্প পর্বের খুঁটিনাটি বিষয় ঠিক না করা পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করলেন। সবুজ ঘাসের উপর লাল কার্পেট বিছানো। তাঁর উপর একটি টেবিল ও একটা চেয়ার।

ঐতিহাসিক মুহুর্তটি সমাগত। সুশিক্ষিত আট হাজার পাকিস্তানী সৈন্য ও তাদের কমান্ডারদের আত্ম সমর্পন। যে দাম্ভিক পাকিস্তানী সৈন্যরা হিংস্র কুকুরের মত ঘেউ ঘেউ করতো, তারা আজ নিরীহ মেষশাবকের মত আত্ম সমর্পন করলো। জেনারেল দলবীর সিং চেয়ারে উপবিষ্ট। ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান তার সাথের আটজন কর্নেল নিয়ে মার্চ করে তাঁর সামনে এসে থামলেন। পাকিস্তানী কমান্ডার যখন সাকির্ট হাউস থেকে বেরিয়ে মার্চ করে আসছিল, তখন বাইরে আপেক্ষমান হাজার লোক আনন্দে   ফেটে পড়লো। কেউ হাততালি দেয়। কেউবা শিস দেয়। কি গ্লানিকর পরাজয়। কত বড় শাস্তি মূলক অনুস্ঠান। জেনারেল দলবীর সিং-এর পাশে দাঁড়িয়ে দেখলাম, পাকিস্তানী অপরাধীগুলি এটেনশান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনুষ্ঠান খুবই সাদাসিধা। জেনারেল দলবীর সিং আত্ম সমর্পনের দলিল পাঠ করলেন এবং পাক-বাহিনীর পরাজিত কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান মাথা নুইয়ে কম্পিত হাতে দলিলে স্বাক্ষর দিলেন। সোজা হয়ে ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান ও তাঁর সাথের অন্যান্য অফিসাররা কোমরের বেল্টে খুলে মিত্রবাহিনীর কাছে অর্পন করলেন। এই সময় সমস্ত ফটো গ্রাফার ফটো নেয়ার জন্য উঠে-পড়ে লেগে গেল। দেখে মনে হলো যেন একটা বিয়ের পর্ব। ঊর্ধ্বতন সামরিক অফিসারদের পক্ষে এই রকম গ্লানিকর আত্মসমর্পন আমি আর কখনও দেখিনি। অত্যন্ত অপমানজনক পরাজয়।

 

 

 

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৮। ৯নং সেক্টরে সংঘটিত যুদ্ধের অন্যান্যের বিবরণ বাংলা একাডেমী দলিলপত্র ১৯৭১

আতিকুল ইসলাম ইমন

<১০, ১৮., ৪২২৪২৭>

সাক্ষাৎকারঃ মেজর মেহেদী আলী ইমাম*
১৫-১০-১৯৭৪

 

নয় নম্বর সেক্টর গঠন করা হয় খুলনায় কিছু অংশ, ফরিদপুরের কিছু অংশ এবং পুরো বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলা নিয়ে। এই সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর এম,এ,জলিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথমার্ধে মে মাসের শেষ পর্যন্ত এই সমস্ত এলাকায় আমি, লেঃ নাসির, ক্যাপ্টেন হুদা, লেঃ জিয়া যুদ্ধ পরিচালনা করছিলাম। মে থেকে জুলাই পর্যন্ত বরিশাল ও পটুয়াখালী আর্মি খুলনার সুন্দরবন এলাকায় লেঃ জিয়া এবং সীমান্তবর্তী এলাকায় ক্যাপ্টেন হুদা ছিলেন। জুলাইয়ের পর থেকে নয় নম্বর সেক্টর পুনরায় সংগঠিত করা হয় এবং বরিশাল জেলার দায়িত্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা ক্যাপ্টেন শাহজাহানকে (ওমর), পটুয়াখালী আমাকে, সুন্দরবন ও খুলনার কিছু অংশ লেঃ জিয়াকে দেয়া হয়। পিরোজপুর ও বাগেরহাট এলাকা সুবেদার তাজুল ইসলামকে এবং ক্যাপ্টেন হুদাকে খুলনার সীমান্তবর্তী অঞ্চলের দায়িত্ব দেয়া হয়। সেক্টর হেডকোয়ার্টার টাকীতে ছিলেন মেজর জলিল। এর এডজুট্যান্ট ছিলেন ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক ও মফিজ। এদের সাথে ছিল ক্যাপ্টেন আরেফিন। নয় নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান প্রশিক্ষণ শিবিরের প্রধান ছিলেন সুবেদার গোলাম আজম। নয় নম্বর সেক্টরের নৌবাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন চীফ পেটি অফিসার এম, ইউ, আলম। সন্দরবনে লেঃ জিয়ার অধীনে ছিলেন ফুল মিয়া ও মধু।

জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে আমি পটুয়াখালী জেলার ১০টা থানা এলাকার লোকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করি এবং প্রশিক্ষণ দিতে থাকি। কিন্তু আমাদের অস্ত্রের খুবই অভাব ছিল। তাই স্থির হল স্থানীয় এলাকার লোকদের যাদের বন্দুক আছে তা যোগাড় করতে হবে। বন্দুক বেশির ভাগ মুসলিম লীগারদের হাতে ছিল, তাই বাধ্য হয়ে রাতে আক্রমণ চালিয়ে বন্দুক ছিনিয়ে নিতে থাকি। অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াও আমাদের খাদ্যের অভাব ছিল। তাই বড় বড় মহাজনদের বাধ্য করি খাদ্যশস্য দিতে। মুক্তিযুদ্ধের জন্য লোক ভর্তি করা হতে থাকে। প্রথমে আমাদের কার্যকলাপ তিনটি থানার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। থানা তিনটি ছিল মঠবাড়িয়া, বেতাগী ও বামনা। এসময় আমার বাহিনীর হাতে ১৫/২০টা রাইফেল ও ৩০/৪০টা বন্দুক ছিল। কিন্তু গোলাবারুদের খুবই অভাব ছিল। আমরা এ সময় মাঝেমাঝে থানা আক্রমণ করে গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র ছিনিয়ে নিতে থাকি।

ইতিমধ্যে এক শ্রেণীর দুস্কৃতকারী মুক্তিযোদ্ধাদের নাম করে গ্রামে গ্রামে ডাকাতি শুরু করে দেয়। ফলে জনমনে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হয়। জনগণ সে সময় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম শুনলে ভয় পেয়ে যেত। আমি বুঝতে পারলাম জনগণকে দু®কৃতকারীদের হাত থেকে বাঁচাতে না পারলে আমাদের সংগ্রাম ও চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবে। জনসমর্থন ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ চালানো সম্ভব নয়।

পটুয়াখালী জেলার ১০টি থানার প্রতি দুটি থানা মিলিয়ে একটি করে জোন গঠন করি। পটুয়াখালীর যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব খারাপ। এক থানা থেকে আর এক থানার বেশ দূরত্ব ছিল। তাই এই সময় পটুয়াখালী জেলার মোট ৫টা জোন ছিল ও শুধু মঠবাড়িয়া থানার একটা জোন করা হয়। এক-একটা জোনে ১০/১৫টা বন্দুক ও ৪/৫টা রাইফেল দিয়ে বেশ কিছূ মুক্তিযোদ্ধা পাঠিয়ে দেই। তাদের কাজ ছিল কোন এলাকায় ডাকাতি আরম্ব হলে সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ডাকাতদের দমন করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধারা কোন এলাকায় ডাকাতি হবে শুনলে সঙ্গে সঙ্গে অনেক নৌকা নিয়ে সেখানে চলে যেত। ডাকাতদের পিছু ধাওয়া করা হত। এভাবে জনগনের মনোবল ফিরিয়ে আনা হয়। মুক্তিযোদ্ধারা যে এলাকা দিয়ে যেত, সেখানে ‘জয়বাংলা’ বঙ্গবন্ধু ‘জিন্দাবাদ’ ইত্যাদি শ্লোগান দিত। এসব শ্লোগান এবং অনেক নৌকা দেখে জনগনের মনে ধারনা হত এখানে অনেক মুক্তিযোদ্ধা এসে গেছে। এভাবে জনগনের মনে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে শ্রদ্ধার ভাব জাগানো হয়। ইতিমধ্যে থানাতে থানাতে আওয়ামীলীগ ও অন্যান্য স্বাধীনতাকামী জনগণের নিয়ে থানা সংগ্রাম পরিষদ পুনরায় গঠন করা হয়েছে।

ইতিমধ্যে আমি খবর পাই মেজর জলিল প্রাণে বেঁচে আবার পশ্চিম বাংলায় গেছেন এবং সেখানে অস্ত্রশস্ত্র যোগাড়ের চেষ্টায় আছেন। খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুরের কিয়দংশ এবং পটুয়াখালীকে নিয়ে একটা সেক্টর গঠন করা হয়েছে। এই সেক্টর ৯ নম্বর সেক্টর হিসাবে পরিচিত। এবং কমান্ডার হয়েছেন মেজর জলিল। আমি মেজর জলিলের কাছে লোক পাঠাই কিছু অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ পাওয়ার জন্য। কেননা, এ সময়ে আমার হাতে সামান্য কিছু রাইফেল ও বন্দুক ছিল কিছু কিন্তু গোলাবারুদ একেবারেই ছিল না। আমাদের অনেক সময় ৫০০ টাকা দিয়ে অনেক লোকের কাছ থেকে রাইফেল ও বেশকিছু টাকা দিয়ে গোলাবারুদ যোগাড় করতে হয়। তিনি আমাকে খবর পাঠান এ ব্যাপাওে চেষ্টা চালাচ্ছেন। তিনি আরও নির্দেশ দিয়ে পাঠান মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য।

আমি কোন সময়ে ব্যক্তিগতভাবে পটুয়াখালী ও বরিশাল ছেড়ে যাওয়া পছন্দ করিনি। আমার বিশ্বাস ছিল, এলাকার জনগণের সাথে ঠিকমত কাজ করলে এখান থেকেই আমি মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারব। জনগনই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত শক্তি। তাদেরকে নিয়ে সংগঠন গড়ে তুলতে পারলে আমরা শত্রুদের পর্যুতস্ত করতে সক্ষম হব। বার বার শত্রুকে আঘাত করে দুর্বল করে দিতে পারলেই আমাদেও লক্ষ্যে আমরা সহজেই পৌঁছাতে পারব। ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমি এলাকার জনগণকে ছেড়ে ভারতে যাইনি। তাদের মধ্যে থেকেই শত্রুদেও আঘাত করে পর্যুদস্ত করতে সক্ষম হয়েছিলাম।

মেজর জলিলের নির্দেশ পাবার পর আমি সমগ্র পটুয়াখালী জেলাকে ৫টি এলাকায় ভাগ করি এবং ৫ জনকে এর নেতৃত্ব দিই। বামনা-পাথরঘাটা থানার দায়িত্ব দিই আলমগীরের হতে। বেতাগী ও বরগুনা থানার দায়িত্ব থাকে হাবিলদার জলফু মিয়ার কাছে। আমতলী খেপুপাড়ার দায়িত্ব দিই নায়েব সুবেদার হাতেমের হাতে। গলাচিপা ও পটুয়াখালী ভার দিই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র হুদার হতে। মির্জাগঞ্জ ও বাউফলের দায়িত্ব দিই আলতাফ হায়দার ও হাবিলদার বাকেরের কাছে। এদেও আমি নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে সমগ্র এলাকায় রেকি কওে ঘাঁটি গড়ে তোলার নির্দেশ দেই। কেননা নিজেদের ঘাঁটি না গড়ে তুলতে পারলে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা যাবে না, এটা বুঝেছিলাম। আমার নির্দেশমত তারা নিজ নিজ এলাকায় চলে যায়। তাদের আমি বলি অস্ত্রশস্ত্র পেলেই তাদের পৌছে দিব। মঠবাড়িয়ার ও বামনা থানার কিছু অংশ নিয়ে বুকাবুনিয়াতে সদও দপ্তর স্থাপন করি, যেখানে আমার অধীনে সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মজিদ ছিল। এছাড়াও বুকাবুনিয়াতে মুক্তিযোদ্ধাদেও জন্য ট্রেনিং ক্যাম্প গঠন করি। স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরো নয় মাসই এখানে পটুয়াখালী জেলার উৎসাহী যুবকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হত এবং ক্যাম্পকে একটা স্থায়ী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে রুপান্তরিত করা হয়। যুদ্ধ চলাকালীন এই ক্যাম্প চারবার পাকসেনাদেও দ্বারা আক্রান্ত হয়। বুকাবুনিয়া ক্যাম্পের প্রশিক্ষণের দায়িত্বভার দিই সুবেদার আনসার আলীর হাতে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এখানে ছেলেদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। পাকসেনারা বুকাবুনিয়া ক্যাম্প আক্রমণ করার সাহস পায়নি। এছাড়াও পরবর্তীকালে মঠবাড়িয়া থানার রাজার হাট, বেতাগী থানার করুনায় মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি ট্রেনিং ক্যাম্প খোলা হয়। এই দুটি ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্ব ছিল যথাক্রমে নায়েক আজিজ ও হাবিলদার গোলাম মাওলার কাছে। পটুয়াখালী জেলার বিভিন্ন স্থানে আমার মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় প্রতিদিনই গেরিলা পদ্ধতিতে আক্রমণ চালিয়ে রাজাকার, পুলিশ ও পাকসেনাদের কাছ থেকে কিছু অস্ত্র ছিনিয়ে নিতে শুরু করে।

ইতিমধ্যেই আমি খবর পাই লেঃ জিয়া সুন্দরবনে আছেন এবং মেজর জলিল তার কাছে আমার জন্য অস্ত্রশস্ত্র পাঠিয়েছেন। আস্ত্রশস্ত্র যোগাড়ের জন্য রুহুল আমিনকে নিয়ে আমি লেঃ জিয়ার কাছে সুন্দরবনে যাই। সুন্দরবনের বগীতে ফুল মিয়া একটা ঘাঁটি গেড়েছেন। সেখানে রুহুল আমিনকে নিয়ে আমি ফুল মিয়ার সাথে দেখা করি। জানতে পারি লেঃ জিয়া সুন্দরবনের অন্য ক্যাম্প মধুর ওখানে গেছেন। দুইদিন পর লেঃ জিয়া বগীতে ফিরে এলে তাঁকে আমার প্রয়োজনীয় কথা জানাই। লেঃ জিয়া আমাকে ৭টা এস-এল-আর, ২০টা ৩০৩টা রাইফেল, ২টা এনারগা গ্রেনেড ও গোলাবারুদ দেন। এসব অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বুকাবুনিতে ফিরে আসি। ৬টি এলাকার দায়িত্ব যাদেও দিয়েছিলাম, তারা তাদের নিজ নিজ এলাকায় রেকি করে বুকাবুনিয়ায় এসেছিল। তাদের প্রত্যেককে আমি ১টা কওে এস-এল-আর ও ৬টা করে রাইফেল, গ্রেনেড ও গোলাবারুদ ভাগ করে দিই। তাদের আমি পাকবাহিনীর সাথে সরাসরি আক্রমণ যেতে নিষেধ কার। কেননা, সে সময়ে আমাদের শক্তি খুবই কম ছিল। পাকবাহিনীর পিছন দিক থেকে আক্রমণ করে ব্যস্ত রাখতে বলি। অমি তাদের আরও নির্দেশ দিই রাজাকার-আলবদরদের উপর হামলা করার জন্য। রাজাকার-আলাদররা আমাদের কার্যকলাপে বেশ বাধার সৃষ্টি করছিল এবং জনগনের উপর অত্যাচার করত। জনগনের সমর্থন পাবার জন্য আমাদের এসব কার্যকলাপের প্রয়োজন ছিল। আমি তাদের থানা আক্রমণ করার নির্দেশ দিই শত্রুদের ভীতসন্ত্রস্ত করার জন্য।

জুলাই মাসের মাঝামাঝি আমি প্রথম গুরুত্বপুর্ণ অপারেশন চালাই। বুকাবুনিয়ার ভৌগোলিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। পটুয়াখালী ও বরিশাল সীমান্তের মধ্যে পটুয়াখালীর বামনা ও বরিশালের মঠবাড়িয়া ও কাঁঠালিয়া থানার সীমান্তের মধ্যে অবস্থিত। বিশখালী নদী হয়ে কাঁঠালিয়া ও বামনা হয়ে বুকাবুনিয়া আসা যায়। বুকাবুনিয়া থেকে এক মাইল দূরে রাজারহাট অবস্থিত। রাজারহাটে দালালদেও প্রতিপত্তি ছিল খুব। আমি বুঝতে পারলাম। এদেও উপর হামলা না করলে আমরা নিশ্চিন্তে কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে পারব না। এইসব দালাল অনেক নিরীহ হিন্দুদের উপর অত্যাচার চালিয়ে হত্যা করেছিল। তাই একদিন আমরা অকস্মাৎ রাতে তাদের ঘাঁটিতে হামলা চালাই। আমাদের আক্রমণে তাদের ২ জন মারা যায় এবং ১৫ জনকে বন্দী করা হয়। এর ২/৩ দিন পর মঠবাড়িয়া থানা থেকে পুলিশ আসে। তারা কিছুদিন থেকে রাজারহাট ছেড়ে পালিয়ে যায়। এ আক্রমণের পর রাজারহাট আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসে। দালালদেও কার্যকলাপ বন্দ হয়ে যায়। আমাদের বুকাবুনিয়া ক্যাম্প ও নিরাপদ হয়।

মুক্তিযোদ্ধাদের এই প্রতিরোদের ফলে বুকাবুনিয়াতে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বেড়ে যায় এবং জনগনের মনোবল ও বেড়ে যায়। আগে যে এবটা গুজব ছিল যে বুকাবুনিয়াতে প্রায় ৪০০/৫০০ সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা আছে সেটা এখন সত্য বলে প্রমাণিত হয়। আশপাশের থানার পুলিশরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। বুকাবুনিয়ার মুক্তিবাহিনী সদর দফতরের গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়।

বামনা থানা থেকে পুলিশ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লোকজন ও রাজাকাররা এক সাথে বামনা বাজারে যেত। তারা নিরীহ জনগনের উপর অত্যাচার চালাত। দোকানে মিষ্টি ও চা খেয়ে পয়সা দিত না। এ খবর পাবার পর আমি তাদেও শাস্তি দিবার জন্য বামনা থানা ও বাজারের মধ্যে আগষ্টের প্রথম দিকের কোন একদিনে এ্যামবুশ পড়ে যায়। আমাদের আক্রমণে ওদেও ৭/৮ জন নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। ৫টা রাইফেল আমাদের হস্তগত হয়। এতে বামনা বাজারের লোকদের মনোবল অনেক বেড়ে যায়।

কাঁঠালিয়া থেকে ৩ মাইল দূর আমুয়াবাজার একটা গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। হাটের দিন পাসেনারা কয়েকজন রাজাকারকে নিয়ে বাজারের লোকদের মাইকে বলে যে মুক্তিযোদ্ধাদের যেন সহযোগিতা করা না হয়। তাদেরকে আক্রমণ করার জন্য কাঁঠালিয়া-আমুয়াবাজারের মধ্যে এক সেতুর নিকটে এ্যামবুশ পাতা হয়। এ ঘটনাটি ঘটে জুলাই মাসের শেষে। সেদিন ৫ জন পাকসেনা ১০ জন রাজাকারকে সঙ্গে নিয়ে সেতুর উপর উঠলে আমাদের এ্যামবুশ পড়ে যায়। এর ফলে ২ জন পাকসেনাসহ ৪ জন নিহত হয়। আমরা ৪টা রাইফেল দখল করি।

এই আক্রমণের পর কাঁঠালিয়া থানার রাজাকার এবং শান্তি কমিটির লোকদের মধ্যে ভীতির সঞ্চয় হয়। শান্তি কমিটির লোকেরা কাঁঠালিয়া ছেড়ে পালিয়ে যায়। ৪০ জন রাজাকার কাঁঠালিয়া কাঁঠালিয়া ছেড়ে যায়। ৫ জন রাজাকার আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়।

পটুয়াখালী থেকে পাকসেনারা পায়রা নদী দিয়ে বামনা-বরগুনা না গিয়ে অনেক ঘুর-পথে মির্জাগঞ্জের পাশ দিয়ে খালের মধ্যে দিয়ে লঞ্চে যেত। আগষ্টের প্রথম আমরা তাদের গতিবিধিতে বাধা দেবার জন্য মির্জাগঞ্জের নিকটে খালের দুধারে এ্যামবুশ পাতি। ১টি লঞ্চ করে যখন পাকসেনারা যাচ্ছিল তকন মির্জাগঞ্জের নিকটে আমাদের এ্যামবুশ পড়ে যায়। লঞ্চটি আমাদের হমলায় খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সঠিক হতাহতের সংখ্যা জানা না গেলেও পরে লোকমুখে জানা যায় যে, পাকসেনাদের ১০ জন নিহত হয়েছে।

বিশখালী নদীতে পাকসেনারা গানবোটে করে পাহারা দিত। রাতে তারা পাহারা দিত বলে আমাদের গতিবিধির জন্য অসুবিধার সৃষ্টি হয়। দিনের বেলায় তারা থানায় থানায় নামত এবং এলাকার অবস্থা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করত। নদী খব বড় থাকায় তারা আমাদের রাইফেলের আওতার বাইরে থাকতো, গুলিতে কিছু হত না। সেজন্য আগষ্টের শেষে পরিকল্পনা নিই দিনের বেলা যখন গানবোট থানার নিকট যাবে তখন আমরা নিকটে থেকে হমলা চালাব। সেইমত আমরা আগে থেকেই বামনা থানার নিকটে অবস্থান নিয়ে তৈরী থাকি। বিকেল ৫টার সময় যখন গানবোট তীরে আসে তখন আমরা শত্রুর গানবোটের উপর আচমকা গুলি চালাতে থাকি। এই গুলির জন্য তারা প্রস্তুত ছিল না। গানবোটের সারেং ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। ফলে গানবোটটা নদীর পাড়ে ধাক্কা খেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারা বামনায় না থেমে কাঁঠালীয়ার দিকে যায়। সেখানেও তারা এই ঘটনার সম্মূখীন হয়। এরপর শত্রুরা বন্দরে বা থানায় নামা বন্ধ করে দেয়, কিন্তু দিনেও রাতে নদীর মধ্যে দিয়ে চলাচল করতে থাকি।

আগষ্ট মাসের শেষ সপ্তাহে সমগ্র পটুয়াখালী এলাকায় আমরা আমাদের তৎপরতা বাড়িয়ে তুলি এবং পাকসেনাদের গতিবিধি অনেক কমে যায়। আগষ্টের শেষে মেজর জলিল ৫০ জন ট্রেইন্ড যুবককে আমর এলাকায় পাঠিয়ে দেন। তারা তাদের সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে আসে। তারা ২০টা এল-এম-জিও নিয়ে আসে। ইতিমধ্যে আমার অস্ত্রের সংখ্যা ২০০-তে দাঁড়ায় ও গোলাবারুদ অভাব কিছুটা পুরণ হয়। এই সময় আামি পটুয়াখালী জেলার দুই শহরে পটুয়াখালী ও বরগুনাতে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রবেশ করাই এবং তারা শহরে তাদের কার্যকলাপ শুরু করে। বরগুনা শহরের আশপাশের খাল দিয়ে বিশেষভাবে তৈরী সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারপযোগী গানবোট চলাচল করত। আমরা তার ইপর হামলা চালাতাম এবং প্রয়োজন হলে বরগুনায়া ঢুকে আক্রমণ চালাতাম। পাকসেনাদের অমরা সামনাসামনি আক্রমণ না চালিয়ে গেরিলা কায়দায় আক্রমণ চালাতাম।

অগষ্টের শেষের দিকে পাকসেনারা আমাদের মহিষপুর ক্যাম্পে আকস্মিকভাবে হামলা চালায়। মহিষপুর ছিল তালতলী বন্দরের নিকটে অবস্থিত। এখান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা আমতলী ও কুয়াকাটা থানায় হামলা চালাত। এ মহিষপুর থেকে বঙ্গোপসাগরের দূরত্ব ছিল খুবই কম। মহিষপুরের পিছনে জঙ্গলে ভর্তি ছিল। পাকসেনারা দালালদের কাছথেকে আমাদের মহিষপুর অবস্থানের খবর পেয়ে পটুয়াখালী থেখে লঞ্চে ও গানবোটে কওে মহিষপুরে আসে। পাকসেনারা ১টি দল মহিষপুর থেকে ৬/৭ মাইল দূরে নেমে হেঁটে আমাদের অবস্থানের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। অন্যান্য সৈন্যরা গানবোটে করে নদী হয়ে মহিষপুরের সামনে এস আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। সকাল টার সময় পাকসেনারা তিনদিক থেকে আক্রমণ চালায়। আমরা এ আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। নদীর ধার থেকে আক্রমণ হতে পাওে এ আশংকা আামাদের ছিল কিন্তু স্থলপথে আক্রমণ হবে এ আমাদের কল্পনাতীত ছিল। তাদের আমাদের আক্রমণে হতবুদ্ধি হয়ে দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে শত্রুদের মোকাবিলা করি। বরিশাল ও পটুয়াখালী এলাকা সম্বন্ধে পাকসেনাদের জ্ঞান ছিল খুবই কম এবং এ জন্যে তারা এখানে খুব ভীতি ছিল। হামলা মোকাবিলার করার সঙ্গে সঙ্গে পাশ্ববর্তী গ্রাম থেকে আমাদের সমর্থনে জনগণ চিৎকার শুরু কওে দেয়। এতে শত্রুরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে মহিষপুর এলাকা পালাতে শুরু করে। এ যুদ্ধে ১১ জন পাকসেনা ও ১১ জন রাজাকার নিহত ও অনেক আহত হয়। তারা অস্ত্রশস্ত্র ও প্রচুর গোলাবারুদ ফেলে পালিয়ে যায়। আমাদের দুজন শহীদ হন। যে দুজন শহীদ হয়েছিলেন তারা কৃষক। আকস্মিক আক্রমণে তারা হতবুদ্ধি হয়ে যান। মহিষপুর থেকে অবস্থান তুলে নিয়ে আমরা অন্যত্র চলে যাই। পাকসেনারা পরে এসে মহিষপুরের পার্শ্ববর্তী গ্রামটি জ্বালিয়ে দেয়।

আগষ্টের শেষে ১৬ বছরের এক মুক্তিযোদ্ধা পটুয়াখালী সার্কিট হাউসে অবস্থানরত পাকসেনাদের লক্ষ্য করে ২টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এতে তাদেও কেউ মারা না গেলেও বেশ কয়একজন আহত হয়।

সেপ্টম্বরের প্রথম সপ্তাহে পাকসেনারা পটুয়াখালীর নিকটবর্তী গ্রামে প্রবেশ কওে ৫/৭ জন যুবক-বৃদ্ধকে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে গ্রেপ্তার করে এবং তাদের মেরে ফেলবার জন্য নদীর পাড়ে নিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা এ খবর পেয়ে দ্রুত সে অবস্থানে গিয়ে পাকসেনাদের উপর গুলি চালায়। পাকসেনারা এতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বন্দীদের ছেড়ে পালিয়ে যায়। যাদের বন্দী করা হয়েছিল তাদের মধ্যে একজন নিহত হয়। এর ফলে জনগণের মনে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর আস্থা বেড়ে যায়।

সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বেড়ে যায় এবং তাদের গ্রুপগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় কারা কত ভাল অপারেশন করছে তাই নিয়ে। দালালরা গ্রাম ছেড়ে শহরে আশ্রয় নেয়। পাকসেনাদের গতিবিধি অনেক কমে যায়। পাকসেনাদের গ্রামে দেখলেই মুক্তিযোদ্ধারা তাদের উপর হামলা চালাত। পটুয়াখালী, বরগুনা ও ৮টি থানা সদর এলাকা ছাড়া সমগ্র পটুয়াখালী এলাকা ছাড়া সমগ্র পটুয়াখালী এলাকা আমাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

বস্তুতঃপক্ষে এই সময় পটুয়াখালী জেলার সমস্ত থানা দপ্তর ছাড়া বাকি সমগ্র এলাকা মুক্তিযোদ্ধারা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। সারা সেপ্টেম্বর মাসই দুর্জয় মুক্তিফৌজ ক্রমাগত শত্রুর উুপর ছোটখাটো হামলা চালায়। বস্তুতঃপক্ষে শহর ছাড়া সমস্ত এলাকায় শত্রুর গতিবিধি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ কওে দেয়। এই সময় সমস্ত মুক্তিফৌজের মধ্যে একটা চর্মরোগ গেখা দেয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা অবরুদ্ধ শত্রুর ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালাতে পারেনি। তথাপি এই মাসে মুক্তিফৌজ প্রায় শ’খানেক অস্ত্র শত্রুর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিল।

সেপ্টেম্বরের শেষার্ধ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আক্রমণ আবার জোরদার করতে শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ভেঙ্গে গেছে, অস্ত্র নেই-পাকসেনারা এটা মনে করে আবার গ্রামের দিকে ঢুকতে ব্যর্থ প্রয়াষ চালায়। এই সময় পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ জনগনের মধ্যে বিভ্রান্তি এবং ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টির জন্য প্রচারণা চালাতে থাকে যে, ‘তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধারা’ প্রকৃতপক্ষে ভারতের সৈন্য এবং হিন্দু। এরা মুসলমান ধর্ম, কৃষ্টি সমাজ ব্যবস্থা ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এই প্রচারণায় জনগন মোটেই বিভ্রান্ত হয়নি। কারন, মুক্তিযোদ্ধারা তাদেরই পরিচিত লোক।

মুক্তিযোদ্ধারা সর্বদা ভাবতো জয় তাদের সুনিশ্চিত। কারন পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কোণঠাসা হয়ে গেছে। তাই এই সময় মুক্তিযোদ্ধারা আগের মত অতটা সতর্ক থাকত না। এর পরিণতিতে অক্টোবর মাসের মাঝমাঝি বরগুনার দাক্ষিণে কুয়াকাটা কাছাকাছি একদল মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানী সৈন্যদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা বরগুনার দিকে আসছিল। চারটা নৌকায় করে অতর্কিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীরা তাদের উপর প্রচন্ড গোলাবর্ষণ শুরু করে। আক্রান্ত হয়ে বাধ্য হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা জঙ্গলের ভেতর ঢুকে পড়ে। পাকবাহিনীর প্রায় আড়াই দিন ধওে গুলি ছুঁড়তে থাকে। সেই গোলাগুলির সময় আমাদের কিছু অস্ত্রশস্ত্র নদীতে ডুবে যায়। সেখানে থাকাকালীন মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার-দাবারের ভীষণ অসুবিধা হয়।

সেখান থেকে আমরা বরগুনা শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকি। বরগুনা থেকে আড়াই মাইল দূওে পাকিস্তানী চেকপোষ্টের উপর মুক্তিযোদ্ধারা হামলা চালায়। চেকপোস্টের ১২ জন পাকিস্তানী সৈন্য ছিল। স্থানিয় জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধারা ঐ চেকপোস্টের ঘিড়ে ফেলে। রাত বারটার দিকে তাদের উপর আচমকা হামলা চালানো হয়। মাত্র দেড় ঘন্টার যুদ্ধে ঐ চেকপোস্ট মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে ফেলে। এখানে মুক্তিযোদ্ধারা ২৮ জনকে বন্দী করতে সক্ষম হয়-যার মধ্যে ৬ জন পাকসেনা ছিল, বাকি ছিল রাজাকার। এখানে একটা এল-এম-জি, ৭টা চাইনিজ ও ৩০৩টা রাইফেল, প্রচুর গুলি ও হ্যান্ড গ্রেনেড আমরা দখল করতে সক্ষম হই। বরগুনার শহরের নিকটে এত বড় একটা ক্যাম্প পতনের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে ত্রাহি ভাব সৃষ্টি হয়। পাকসেনারা খুব ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ, পটুয়াখালী থেকে একজন সুবেদার পালিয়ে ঢাকা যেতে চেষ্টা করে। কিন্তু পথে সে ধরা পড়ে।

অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে মেজর জলিল আমাকে ভারত যেতে বললেন। মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধির জন্য তিনি বেশ কিছুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা এবং অস্ত্রশস্ত্র পাঠিয়ে দেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি ভারতে যাবার পক্ষপাতি ছিলাম না। আমি মনে করতাম যে আমাদেও সত্যিকার আক্রমণাত্মক অভিযান শুরু হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলা কায়দায় তৎপরতা চালিয়ে পাকসেনাবাহিনীকে ভীতসন্ত্রস্ত রাখাটাই বেশী প্রয়োজন। যাই হোক, হেডকোয়ার্টারের নির্দেশে নভেম্বরের প্রথম দিকে আমি ভারত যেতে মনস্থির করে ফেললাম। যদিও আমার মুক্তিযোদ্ধারা মানসিক দিক হতাশ হয়ে পড়ছিল। তথাপি সমস্ত বেইস কমান্ডার্দেরকে ডেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলী লিখিতভাবে সবাইকে দিয়ে দিই এবং নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে আমি দবার আবহাওয়া দরুন যাওয়া স্থগিত রাখি। আমার ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রায় ৭০০ মুক্তিযোদ্ধা ছিল। আমি ৩৫০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে সামান্য অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে প্রায় দুহাজার নৌকাযোগে ভারতে পাঠিয়ে দিই। ৫/৭ দিন পর বাকি ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রায় ৮০০ শরণার্থী নিয়ে আমি ঈদুল ফিতরের দিনে ভারতে রওনা হই। নভেম্বরের শেষ নাগাদ। এই দুর্গম হথের মাঝে মাঝে ছিল পাকসেনাবাহিনীর গানবোটের পাহারা। এই অবস্থার মধ্যে দিয়ে অর্ধাহারে-অনাহাওে চলতে চলতে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ ভারতের হাসনাবাদ গিয়ে পৌঁছি।

স্বাক্ষরঃ মেহেদী আলী ইমাম

*১৯৭১ সালে ক্যাপ্টেন হিসাবে কর্মরত ছিলেন

আতিকুল ইসলাম ইমন

<১০, ১৮.২, ৪২৭-৪২৯>

সাক্ষাৎকারঃ লেঃ শামসুল আরেফিন*

২০//১৯৭৩

মুজিবনগরে বাংলাদেশ সেনানিবাসে হাজির হই ১১ ই মে। সেখান থেকে ফিল্ড কমিশন নিয়ে ৯ নং সেক্টরে পাঠিয়ে দেয়। খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী ৯ নম্বরের অধীনে ছিল। প্রথম হিঙ্গলগঞ্জ অপারেশন ক্যাম্পে আসি। এখানে দেড় মাস থাকি।

১৩ ই মে থেকে ৬ ই জুলাই পর্যন্ত আমি ক্যাপ্টেন হুদার নেতৃত্বে ৪টি অপারেশন যন-খাঞ্জিয়া বি-ও-পি, বসন্তপুর বি-ও-পি, কালিগঞ্জ থানা হেডকোয়ার্টার এবং উকশা বি-ও-পি (খুলনা)।

৭ ই জুলাই খলনা জেলার প্রধান হিসাবে আসি এবং খুলনা জেলার আশাশুনি থানার বড়দল এলাকায় (বাংলাদেশ) আমার ঘাঁটি স্থাপন করি। আমার সঙ্গে ১০০ জন এফ-এফ এবং ১৫ জন নিয়মিত বাহিনীর সদস্য ছিল। ১১ ই জুলাই পাইকগাছা থানার কপিলমুনির রাজাকার ঘাঁটি আক্রমণ করি। সারারাত যুদ্ধ করে আমরা ফিরে আসি। বড়দলে একটি ট্রেনিং সেন্টার খুলি এবং লোক ভর্তি করতে থাকি।

জুলাই মাসের শেষের দিকে আমার উপর নির্দেশ আশে মঙ্গলা পোর্ট আক্রমণ করবার জন্যে। ইতিমধ্যে ১০ জন ন্যাভাল কমান্ডোসহ একজন লিডিং সীম্যান (ফ্রান্স থেকে পালিয়ে এসেছিল), এম, বি, আলকে অস্ত্রসহ আমার কাছে পাঠানো হয়। ন্যাভাল ১১ জন মিলে মঙ্গলা পোর্টে রওনা হই। আমি কমান্ডিং অফিসার ছিলাম।সুসন্দরবনের ভিতর লাওতাড়াতে ঘাঁটিতে আসি, যেখানে পূর্বেই আমার কিছু বাহিনী ছিল। ৯ই আগস্ট রাত ১২/১ টার দিকে সাঁতার দিয়ে বাহিনী চলে আসে মঙ্গলা পোর্টের দিকে। সাঁতরে গিয়ে চুম্বক মাইন লাগিয়ে চলে আসে তিনটি জাহাজে। আধঘন্টা পর মাইন বিস্ফোরিত হয়, আমরা সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার ওপেন করি। আমরা সবাই নিরাপদে আসি। জাহাজ তিনটা ডুবে যায়। ১১ আগস্ট তারা পুনরায় যায়। সেদিন দুটি জাহাজ আমরা ধ্বংস করি। ঐ দিন গফুর নামে একজন ন্যাভালকে হারাই। তবে দু’দিন পর সে আমাদের ক্যাম্পে ফিরে আসে।

১২ ই আগস্ট ভোরে পাক নেভী দু’দিক থেকে আমাদের ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালায়। আমরা ওখান থেকে পিছু হটতে বাধ্য হই। আমরা মূল ঘাঁটিতে ফিরে আসি। মুল ঘাটিতে এসে প্রত্যেক থানাতে একটি করে ঘাঁটি তৈরীর জন্য ব্যাস্ত হয়ে পড়ি। রাজনৈতিক কর্মীসহ মুক্তিবাহিনী গঠন করে খুলনার দিকে অগ্রসর হতে থাকি। আমাকে সহায়তা করতে এম-সি-এ গফুর।

আগষ্ট মাসের শেষের দিকে খুলনা জেলার আশাশুনি থানাতে রাজাক্র ও পাকিস্তানী ডেককোয়ার্টার আক্রমণ করি। একদিন অবরোধ করার পর দ্বিতিয় দিনে সাতক্ষীরা থেকে পাকবাহিনীর এবং খুলনা থেকে নেভী এসে আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। ১২/১৪ ঘন্টা ধরে যুদ্ধ হয় ওদের সঙ্গে। পাকবাহিনী ২ জনকে ধরে ফেলে এবং মনোরঞ্জন হালদার নামে একজন মুক্তিসেনা মারা যায়। আমরা ৩ জন মিলিশিয়াসহ ১৬ জন ১৬ জন রাজাকারকে হত্যা করে ২৬ টি অস্ত্র উদ্ধার করি। পাকসেনারা পিছু হটে চলে যায়।

সেপ্টম্বর মাসের প্রথম দিকে পাইকগাছা থানার বাকাঘাটি পাকবাহিনী অতর্কিত আক্রমণ করে। ওখানে আমদের দলের দুজনকে ধরে নিয়ে যায়। একজন মারা যায় এবং ১ জন আহত হয়। আমরা বাকাঘাঁটি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাই। ৭ দিন পর বাকাঘাটি পুনরায় দখল করি। এসময় প্রধান উপদেষ্টা এবং সহকারী ছিলেন জনাব বাবর আলী (বর্তমানে জাতীয় পরিষদ সদস্য)।

এরপর ক্রমশ ঘাঁটির সংখ্যা বাড়াতে থাকি। হেডকোয়ার্টার বড়দল থেকে বদলী করে পাইকগাছা থানার হাতিয়ারডাঙ্গাতে নিয়ে আসি এবং ৪টি প্রশিক্ষন কেন্দ্র খুলি। মুক্তিবাহিনী এবং নেভী দুটরই ট্রেনিং হতো। সেপ্টম্বর মাসের শেষের দিকে পাইকগাছা গরুইখালি গ্রাম থেকে অস্ত্রসহ ২২ জন রাজাকারকে ধরে নিয়ে আসে ঐ মাসেই পাইকগাছা থানা আক্রম করি এবং স্তাফসহ ৬/৭ জন রাজাকারকে ধরে নিয়ে আসি।

অক্টোবর মাসের প্রথমে দুটি দল দু’দিকে পাঠাই- একটি দাকোপ থানায়, অন্যটি তালা থানাতে। দাকোপ থানার খাটালি গ্রাম থেকে ১৭ জন রাজাকারকে অস্ত্রসহ ধরে নিয়ে আমার বাহিনী তালা থানার দল ১৮ মাইল রাস্তার মোড়ে পাকবাহিনীর মুখোমুখি হয়। যশোর-পাটকেলঘাটা রাস্তা নষ্ট করে দেয়। যাবতীয় যোগাযোগ ব্যাবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে নির্দেশ আসে সুন্দরবনের ভিতর নিউজপ্রিন্ট মিল আক্রমণ করার জন্য। ওই ঘাঁটিতে বোট এবং শিপ ছিল ‘লালশেরা’। আমরা ওইগুলি ডুবিয়ে দিই মাইন দিয়ে। এখানে আমার ভাই আয়ুবআলী গাজি প্রধান সহকারী ছিল। ভাই পরবর্তীকালে মারা যায়।

অক্টবরের শেষের দিকে আবার মনহলা পাট আক্রমণ করি। এবার তিনটি শিপ ডুবিয়ে দেই। এসময় বাজুয়াতে আমাদের সাথে ভীষন যুদ্ধ হয়। আমাদের কোন ক্ষতি হয়নি। পাক পক্ষ বাজুয়া ঘাঁটি ছেড়ে চলে যায়। বাজুয়াতে আমাদের ঘাঁটি স্থাপন করে খুলনাতে অস্ত্রশস্ত্র পাঠিয়ে দিই আমাদের লোকের কাছে।

১৯ শে নভেম্বর পাকবাহিনীর ক্যাম্প কালিগঞ্জ থানা আমরা আক্রমণ করি। দিনটি ছিল ঈদের দিন। পাকবাহিনী বহু অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে কামান্ডিং অফিসার ছিলেন ক্যাপ্টেন হুদা।

২৫শে নভেম্বর কপিলমুনি পাইকগাছা থানা আমরা আক্রমণ করি। এখানে আমার প্রধান সহকারী ছিলেন মিঃরহমতুল্লাহ (নেভী), কামরুজ্জামান( টুকু) এবং বাবর আলী। তিনদিন যুদ্ধের পর ৩৫০টি রাইফেল উদ্ধারসহ ১০৭ জনকে গ্রেফতার করি। আমার ২ জন শহীদ হন ;ইয়ান্সনায়ক গাজী ও আনোয়ার ২ জন আহত হোন। এই সময় আমার আর একটি দল আশাসুনি থানা হেডকোয়ার্টার আক্রমণ করে। থানা ষ্টাফসহ দেড়শ’ রাইফেল, ২ জন পাঞ্জাবী পুলিশ, ৫৭ জন রাজাকার হরে নিয়ে আসে। আশাসুনি থানার ব্যাঙ্গদোহাতে আমার একটি দল আক্রমণ চালিয়ে ৩ জন পাঞ্জাবী পুলিশ ২ জন মিলিশিয়া এবং দেড়শ’ রাইফেলসহ ১০০ রাজাকার গ্রেফতার করা হয়।

২০ শে নভেম্বর আমার হেডকোয়ার্টার বৈঠাঘাটাতে স্থানান্তরিত করি। এসময় চালনা বাজারের সব রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। ২৮শে ডুমুরিয়া থানার বার আড়িয়া বাজার আক্রমণ করি। আজিজ সহ আমাদের ৩ জন মারা যায়। বিপুল অস্ত্রশস্ত্রসহ ১৬ জন রাজাকার আমরা ধরে নিয়ে আসি।

৮ই ডিসেম্বর মেজর জয়নাল আবেদীন ইঞ্জিনিয়ার আমার সাথে যোগ দেন। ১০ই ডিসেম্বর খুলনা বেতার ভবন আক্রমণ করি। সারারাত যুদ্ধ করি, কিন্তু জোয়ারের পানি আসার জন্য আমরা ফিরে আসি। আমাদের ২ জন আহত হয়।। এ সময় অয়ারলেস মারফত কর্নেল মঞ্জুর সাহেবের সাথে আমার যোগাযোগ হয় এবং তিনি খুলনা আক্রমণের পরিকল্পনা দেন। ১৫ই ডিসেম্বর ভোরবেলা খুলনা আক্রমণ করি। দু’ভাবে আক্রমণ করি একটি জলপথে অপরটি স্থলপথে। নদীপথে কামান্ডার ছিলাম আমি এবং স্থলপথে ছিলেন মেজর জয়নাল আবেদীন, বাবর আলী নেভী রহমতুল্লাহ। সকাল ৬টার দিকে খুলনা জেলা জয় করি এবং বাংলাদেশের পতাকা তুলে দিই ১৬ ই ডিসেম্বর। আমার বাহিনীর কিছু সেনা (৫ জন) মারা যায়।

বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাঞ্জাবী শোষণ থেকে মুক্তি লাভের জন্য অস্ত্র ধরি।

স্বাক্ষরঃ এম, আরেফিন

২৮-৩-৭৩

** পাকিস্তান মইলিটারী একাডেমিতে জেন্টেলম্যান ক্যাডেটরুপে প্রশিক্ষণ গ্রহনকালে সেখান থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।

আতিকুল ইসলাম ইমন

<১০, ১৮., ৪২৯৪৩৫>

সাক্ষাতকারঃ মোঃ নুরুল হুদা

১৮১৯৭৩

 

২৬শে এপ্রিল পাকবাহিনী পটুয়াখালী দখল করে ও নানা স্থানে তারা ব্যাপক আক্রমণ ও অত্যাচার আরম্ভ করে। নগন্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ওখানে অবস্থান করা আর সম্ভব হলো না। তাই অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষনের জন্য ভারত চলে গেলাম। পটুয়াখালী থেকে সুন্দরবন হয়ে ভারত যেতে আমাকে ও অপর দুজন সঙ্গী আতাহার ও ইউসুফকে অতিক্রম করতে হয়েছিল এক বিপদসঙ্কুল সুদীর্ঘ পথ। ভারত গিয়ে আমরা প্রথমে দেখা করলাম মেজর জলিল ও ক্যাপ্টেন হুদার সঙ্গে। তাঁরা তখন হাসানাবাদে। মে মাসের শেষের দিকে আমাদের ভর্তি করে দেয়া হলো ৯ নং সেক্টরের তকীপুর ক্যাম্পে। তখন তকীপুর ক্যাম্প ছিল ৯ নং সেক্তরের একমাত্র ক্যাম্প। ঐ অভ্যর্থনা ক্যাম্পে আমাদের নিয়ে মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৭০ জনে। কিছুদিন ওখানে থাকার পরে জুনের শেষের দিকে আমাদের পাঠানো হলো বিহারের চাকুলিয়া প্রশিক্ষন কেন্দ্রে। ওখানে আমাদের গেরিলা প্রশিক্ষন দেয়া হলো। ৬ সপ্তাহের গেরিলা প্রশিক্ষণ শেষ করে ফিরে এলাম ৯ নং সেক্টরে।

আগষ্ট মাসের এক রাত্রে আমরা বরিশাল সাব- সেক্টোরের জন্য নিযুক্ত কামান্ডার ক্যাপ্টেন ওমররের (শাজাহান) নেতৃত্বে বাগদা বর্ডার দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করলাম। আমরা বরিশালের বানারিপাড়া থানার বাড়াকুঠা স্কুলে শিবির স্থাপন করলাম। আসার পথে যশোরের একস্থানে আমরা পাকবাহিনীর বাঁধার সম্মুখীন হই। সংঘর্ষে লিপ্ত না হয়ে আমরা অন্য পথে অগ্রসর হই। আমরা যখন ফরিদপুরের হুলারহাটের কাছাকাছি, তখন আমরা একটি বিমান ও একটি গানবোট দ্বারা অনুসৃত হই। কিন্তু ক্যাপ্টেন ওমরের বিচক্ষনতার জন্য আমরা ওদের চোখে ধুলা দিয়ে বরিশালের দিকে অগ্রসর হতে সক্ষম হই। যেহেতু আমাদের সমস্ত তৎপরতা প্রধানতঃ বরিশাল জেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, সে জন্য আমরা পথিমধ্যে সমস্ত সংঘর্ষ এড়িয়ে যাই।

আমরা জেলায় প্রবেশ করের পরের দিনই পাতারহাটের অনতিদূরে ক্যাপ্টেন ওমরের নেতৃত্বে পাকবাহিনীর একটি গানবোট ও দুটি লঞ্চ আক্রমণ করি এবং প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে লিপ্ত হই। এই সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন পাকসৈন্য হতাহত হয়। ক্রমে ক্রমে আমাদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বরিশালের মুক্তিবাহিনীর ছোট ছোট দলগুলো একে একে ক্যাপ্টেন ওমরের একক নেতৃত্বে আমাদের সাথে যোগ দিল। আমাদের শক্তি আরও বেড়ে গেল। একে একে জয়শ্রী, উজিরপুর, বানারিপাড়া প্রভৃতি স্থানে সাফাল্যজনক অপারেশন চালানো হয়।

প্রথম দুটি স্থানে আমি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলাম না। গেরিলা কমান্ডো জামালের নেতৃত্বে আমি, নুরু, ওদুদ, হাকিম, ইসমাইল, সাখাওয়াত, আলতাফসহ ৮০ জনের একটি দল সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি বানারিপারায় অপারেশন চালাই। ৪ ঘণ্টা যুদ্ধের পর আমি, সাখাওয়াত, আলতাফ উইথড্রয়াল সংকেত পাওয়ার পর থানার ঘাট থেকে একটি লঞ্চ নিয়ে শিবিরে চলে আসি। এখানে বিপক্ষ দলের কয়েকজন হতাহত হয়। ওখানে কিছুদিন থাকার পর ক্যাপ্টেন অমরের কতগুলি যুদ্ধ সম্বন্ধীয় তথ্য অগুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট নিয়ে সেক্টর হেডকোয়ার্টারে চলে আসি। এখানে একজন লোকের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। তার সাহায্য না পেলে দুর্গম ও বিপদসঙ্কুল অরন্য সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাদের চলাচল ও তৎপরতা চালানো হয়ত অসম্ভব না হলেও অতটা সহজসাধ্য হোত না। এই লোকটির নাম রয়জদ্দিন- শিক্ষক আলোক থেকে বঞ্চিত।  এই লোকের কাছে আসি উজ্জ্বল দেশপ্রেমের নিদর্শন পেয়েছি। সুন্দরবন এলাকায় পাকবাহিনীর অবস্থান ও সম্ভাব্য আনাগনা ছিল তার নখদর্পণে। সুন্দরবনের দুর্গম ও অজ্ঞাত পথহ দিয়ে

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে মুক্তিবাহিনীর পথপ্রদর্শকের ভুমিকা পালন করতো। সুন্দরবন দিয়ে আসা যাওয়ার শাতাধিক পথ তার জানা ছিল। আমি এবং আমার তিনজ সঙ্গী কবীর, খালেক ও নওশের এই রয়জদ্দিন মাঝির সাহায্যে ভারত এসে পৌছাই। ভারতে এসে মেজর জলিল সঙ্গে দেখা করি। তিনি তখন থাকতেন টাকি সেক্টর হেডকোয়ার্টারে। গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রগুলি পেয়ে উনি খুশি হলেন। ঐদিনই উনি আমাকে একটা দল নিয়ে পটুয়াখালী জেলায় আসার জন্য প্রস্তুত হতে বলেন।

আমি ৬০ জনের একটি দল সংগঠন করলাম। সেপ্টেম্বর মাসের একরাতে আরও অন্যান্য দলসহ প্রায় ৪০০ মুক্তিযোদ্ধা রয়জদ্দিন মাঝির সাহায্যে সুন্দরবন দিয়ে সুন্দরবনের একটি ঘাঁটি বগির দিকে অগ্রসর হই। বগী পৌছাতে প্রায় ৮/১০ দিন লেগে যায়। আমাদের অভ্যর্থনা জানায় সুন্দরবন এলাকার কমান্ডার ক্যাপ্টেন জিয়া। বগী থেকে যার যার নির্দেশিত এলাকায় যাবার প্রস্তুতি নিতে থাকি।      পাকবাহিনী টের পায় আমাদের অবস্থান। গানবোট আক্রমণ চালায় আমাদের ক্যাম্পে। মর্টার সেলিং চালাতে থাকে অনবরত। কিন্তু আমাদের কাছে লং-রেইঞ্জ ফায়ারিং অস্ত্রশস্ত্র না থাকায় এল-এম-জি-আর, ৩০৩ রাইফেল নিয়ে নদীর কুলে পজিশন নিয়ে থাকি। ওরা প্রায় ২ মাইল দূর থেকে শেলিং করে। কাছে আসতে সাহস না পেয়ে ছ’ঘণ্টা অনবরত শেলিং করার পর গানবোট নিয়ে চলে যায়। রাতে আমরা আমাদের অবস্থান সুন্দরবনের আরো একটু ভেতরের দিকে সরিয়ে নিই। পরের দিন সকালে আবার গানবোট আক্রমণ চালায় এবং সকাল ১১ টার দিকে ওরা চলে যায়। সাত মাইল প্রশস্ত বগী নদীতে সন্ধ্যা ৭ টার দিকে পাড়ি শুরু কর এরাত ১০ তার ওপারে চলে আসি। যার যার দল নিয়ে এবং পথপ্রদর্শক নিয়ে আমরা আমাদের নির্দেশিত এলাকার দিকে পায়ে হেঁটে রওনা দিই।

সেক্টর হেডকোয়ার্টার থেকে প্রয়োজনীয় কতকগুলো কাগজপত্র দিয়ে মেজর জলিল আমাকে পটুয়াখালী জেলার সাব- সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মেহেদীর সাথে দেখা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন মেহেদী আলী ইমাম তখন ধামুরাহাটের কাছাকাছি বুকাবুনিয়ায় থাকতেন। তার ছদ্মনাম ছিল ক্যাপ্টেন কুমার।আমার তারিখটা থিক মনে নেই, তবে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে আমি আমার দল নিয়ে তাঁর সাথে দেখা করি। আমাদের পেয়ে তিনি খুশী হলেন। সাথে সাথে তিনি সকল এলাকা থেকে ছোট ছোট দলগুলোকে তাঁর হেডকোয়ার্টারে ডেকে পাঠালেন। সমস্ত জেলার ১০টা থানাকে তিনি মোট পাঁচটা ভাগে ভাগ করলেন। প্রতিটি জোনের জন্য একজন করে জোনাল কামান্ডার ঠিক করে দিলেন।

পটুয়াখালী ও গলাচিপা থানা নিয়ে জোন গঠন করা হয় দেয়া হয়েছিল আমার উপর। সবকিছু ঠিকঠাক হওয়ার পওে আমি আমার দল নিয়ে নির্দেশিত জায়গায় চলে আসি আমার সাথে যারা ছিল। সকলের নাম আমার মনে নেই। তবে যাদের নাম আমার মনে আছে তাদের নাম এখানে উল্লেখ করেছিঃ মোঃ নুরুল হুদা (কমান্ডা), হাবিবুর রহমান (শওকত সেকেন্ড- ইন-কমান্ড), খলিফা, মস্তফা, রবীন , ইউসুফ, সুলতান, হাবিব, শাজাহন , কুন্ড, গোমেস, ভূদেব, মান্নান, শরীফ, আবুল, জাহাঙ্গীর, ফোরকান, সুনীল, কাওসার; মন্মথন, লতিফ, আলম এবং অনেকে। মস্তাফা এবং কাওসার বুকাবুনিয়া থেকে আমাদের পথপ্রদর্শন করছিল।

ভারত থেকে আবদুল বারেক এম-সি-এ (পটুয়াখালী) আমাদেও মুক্তিবাহিনীর হিতাকাঙ্ক্ষী অনেকের নাম দিয়েছিলেন। সেই অনুসারে একদিন পানপট্টির মিঃ রবদের বাড়ী এসে উঠলাম আমি এবং মুস্তফা। রব সাহেব বিপুল উৎসাহ আমাদের সাথে সহযোগিতা করলেন। পনপট্টির একটি সাইকেনান শেলটাওে আমরা শিবির স্থাপন করলাম। ওখানে বসে পাক বাহিনীর বিভিন্ন ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালাবার পরিকল্পনা করতে থাকলাম। পটুয়াখালী জেলার পাক জান্তা প্রধান তখন মেজর ইয়ামীন। আমাদের অবস্থান তার কানে গেল। আমরা গলাচিলা থানা আক্রমণ করার সমস্ত পরিকল্পনা এবং মানচিত্র ঠিক করে ফেলেছি। ৪০ জনের একটি দল নিয়ে গলাচিপা থানা আক্রমণে রওনা হলাম। কিন্তু বাস্তব এবং প্রতিকূল অবস্থান পরিপ্রেক্ষিতে সে রাতে গলাচিপা থানা আক্রমণ করা হলা না। এখানে উল্লেখ্য যে, আমরা আমাদের অপারেশনগুলো বেশীর ভাগই রাতের দিকে করতাম।

পানপট্টির যুদ্ধঃ তাঁবুতে ফিরে এসেছি রাত তিনটায় ৫/৬ জন সেনট্টি রেখে, বাকী সকালে ঘুমিয়ে নিচ্ছি। ঐ দিন রাত ৪টায় (১৮-১১-৭১) গলাচিপা বন্দরের ৫ বৎসরের বাবলুর ঘুম ভেঙ্গে গেল। তার বাসার সম্মুখ থেকে অনেকগুলো বুটের শব্দ তার কানে এলো। ধড়মড়িয়ে উঠে বসল বাবলু। সাবধানে জানালাটা খুলে দেখল পাকদস্যুও এক বাহিনী বিপুল অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে হেঁটে যাচ্ছে। একটু পরেই কয়েকটা রাজাকারের চাপা আলোচনা থেকে ঝুঝতে পারলো পাকদস্যুরা আমাদের ক্যাম্প আক্রমণ করতে পানপট্টি যাচ্ছে। বাবলু ছিল গলাচিপা বন্দরে আমাদের একজন গুপ্তচর। আর তো বাবলুর বসে থাকা চলে না। পিছনের দরজা দিয়ে বাবলু আরম্ভ করল। এক নাগাড়ে ছয় মাইল দৌড়ে আমাদের শিবিরের উত্তর পাশের নদীটির পাওে ছুটে চলে এলো। দুর্ভাগ্য! ঘাটে খেয়া নেই। কিন্তু তাতে কি। বাবলু ঝাঁপিয়ে পড়ল নভেম্বরের ঠান্ডা নদীতে। সাঁতড়িয়ে চলে এলো এপার। আর একটা দৌড়। তারপর আমাদেও শিবির। আমাকে যখন বাবলু খবরটা দিল তখন সকাল ৬-৩০মিঃ। অন্য সকলে ঘুমে। শওকত ও উঠে গেল। ফল-ইন এর বাঁশি বাজিয়ে দিল শওকত সবাই ছুটে এল ফল-ইন-এ। সংক্ষেপে বুঝানো হল ব্যাপারটা। শওকতকে সাইক্লোন শেলটারের ছাদে। সেটা ছিল আমাদের ও-পি। বাইনোকুলার লাগিয়ে শওকত পাকবাহিনীর গতিবিধি সব বলে দিতে লাগল। আমি সেই অনুসাওে ঢেলে সাজালাম আমার দলের সবাইকে। আগে থেকেই আমাদের বাক্সক্ষার করা ছিল। আবুল ছিল প্রথম এল-এম-জি ম্যান। ভূদের, সুনীল ও শরীফ ছিল ওর গার্ড এবং সহকারী। সাইক্লোন শেলটারের ছিল দোতালা দালান।  দক্ষিন দিক থেকে একটা কাচা রাস্তা শেলটারের পশ্চিম পাশ ঘেঁষে সোজা উত্তর দিকে গলাচিপা দিকে চলে গেলে। এই রাস্তা ধওে কিছুদূও আসলে পানপট্টির সেই ছোট নদীটা সামনে পড়বে নদী পার হয়ে রাস্তা ধরে চলে গেলে একেবারে গলাচিপা পৌঁছা যায়। শেল্টারটার। সামনে একটা টিনের স্কুল তার পার একটা খালের কূলে কূলে কয়েকটা বাড়ি এবং ঠিক পশ্চিম পাশ্বের বাড়িগুলো লতাপাতায় ঘেরা- যা আমাদেরকে আড়াল আড়াল করে রেখেছিল। উত্তর দিকের সেই রাস্তাটার দু-পাশে একটু দূওে দু’একটা বাড়ি। পূর্ব দিকটার অনেকখানি জুড়ে ধানের মাঠ। দক্ষিন কোনে কাছাকাছি কোন বাড়ি নেই।

ও-পি থেকে শওকতের অবজারভেশন অনুযায়ী পশ্চিম দিকের শক্তি বাড়িয়ে দিলাম। রবিন, কুন্ড, মুস্তফা, কাওসার, গোমেস ওদেরকে রাখলাম পশ্চিম দিকের একটা বাড়ির পশ্চিম পাশে ৫০ গজ ব্যবধানে কভার করে। শওকতের তথ্য অনুযায়ী পাকসেনারা পশ্চিম দিক দিয়ে আমাদের মার্চ করতে পারে রবিনদের একটু দূরেই বাঁধ। আমাদের ক্যাম্পের পশ্চিম থেকে যদি খানসেনাদের আসতে হয় তবে ঐ বাঁধ পেরিয়ে আসতে হবে। শওকত দেখল খানসেনাদের একটা আমাদের সেন্টারের পশ্চিম পাশ দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। বাকী দু’দল পশ্চিম দিক থেকে আমাদের ক্যাম্পের দিকে আসছে। এই দুটোর একটা দল পশ্চিম দিকের একটা বাড়ির মধ্যে আত্মগোপন কওে রইল। বাকীটা ২৫/৩০জনে বিভক্ত হয়ে আগে-পাছে আমাদের ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ওদেও এই চতুর্থ দলে সর্বমোট প্রায় ৭০/৮০ জন খানসেনা ও দালাল সেনা।

শওকতের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য নিয়ে সকল পজিশনে আমাদেও প্লনটা জানিয়ে দিলাম। এস-এল-আর, ৩০৩ রাইফেল, ৩৬-এইচ-ই- গ্রেনেড নিয়ে সবাই মাটির সাথে লতাপাতার সাথে এক হয়ে গেছি আর এক দুই করে আসল সময়ের অপেক্ষা করছি। শওকতের কথাই ঠিক হলো, রবিনদের সামনের সেই বাঁধটার দিকে পাকসেনারা অগ্রসর হচ্ছে। প্রথম ব্যাচে ২৫/৩০ জন। ১৫/২০ জন  পশ্চিমা খান আর বাকীগুলো রাজাকার, পুলিশ। রবিনরা তাক করে শুয়ে আছে। অতি সতর্কতার সাথে খানদের দল বাঁধের উপর উঠে এসেছে। ৩/৪ জন বাঁধ পার হয়ে গেছে। অমনি রতনদেও দল ট্রিগার টিপল। গুডুম গুডুম কয়েকটা শব্দ এবং সাথে সাথে গোমেজ ছুড়ে মারল গ্রেনেড। ২টা পুলিশ ও ৬টা খানসেনা লুটিয়ে পড়ল। ছিটকিয়ে গেল খানদের দল। পুলিশ রাজাকাদের সামলাতে তাদেও বন্দুক উঁচিয়ে রাখতে হল। খানদের দল পিঁছিয়ে গেল খানিকটা । এটা ঘটল সকাল ৮ টার দিকে। আমরা চুপচাপ। শওকত আবার চলে গেল ওপিতে- দেখল ওদের গতিবিধি পাকা তিন ঘন্টা ধরে ওরা ওদের ছিটকিয়ে পড়া সাথীদের পশ্চিমে একটা বাড়ির আড়ালে একত্রিত করল। এর মধ্যেই খবর এলো ৩৭৫ জনের এই দলটি পরিচালনা করছেন পটুয়াখালী জেলার পাক জান্তা প্রধান মেজর ইয়ামিন নিজে। আমরা দলে ছিলাম ৬০জন মাত্র। অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে একটা এল-এম-জি, এস,এল আর, ৬টা স্টেনগান, ৩৫টা ৩০৩ রাইফেল। ওদের কাছে ২টা ২” মর্টার, ৭/৮ টা এল-এম-জি , চাইনিজ স্বয়ংক্রিয় রাইফেলসহ বহু আধুনিক হালকা অস্ত্রশস্ত্র। আমাকে খবরটা দিয়েছিল ওদেরই দলের একটা পুলিশ। প্রথমবারের গোলাগুলির সুযোগ পালিয়ে এসে আমাকে খবরটা দিয়ে সে আবার চলে গেল। একটু ঘাবড়ে গেলাম। কিন্তু মনের দূর্বলতা কাউকে টের পেতে দিলাম না। সকলকে সাহস দিয়ে চাঙ্গা রাখলাম। প্রথম দফান খানদেও হটিয়ে দিয়ে এবং ৮ জনের খতম করে প্রত্যোকের মনের আনন্দ লেগেছে।

আনুমানিক বেলা ১টার ওরা আমাদের ওরা আবার আমাদের তিনদিকে ঘিরে ফেলল । দক্ষিন। দিকটা খোলা রেখে পশ্চিম- উত্তর ও পূর্ব দিক থেকে ওরা আক্রমণ চালাল। পূর্বদিক দিয়ে ওরা আমাদের ক্যাম্পে আসতে পারবে না, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম। কারণ এ দিকটার ছিল ছিল অনেকখানি ধানের মাঠ। বহু দূরে থেকে ওদেরকে দেখা যাবে। ভয় হল উত্তর এবং পশ্চিম দিকটা নিয়ে। এই দুটো দিক শক্তিশালী করলাম। সব ধরনের ঝংকার তুলে বেপরোয়া হয়ে খানদের দল এগিয়ে আসতে লাগল। আমরাও মরীয়া হয়ে পাল্টা জবাব দিলাম। সুবিধা ছিল ধান খেতের মধ্যে পালিয়ে পালিয়ে আসলেও ওদের গতিবিধি দেখতে পাই। কিন্তু ওরা আমাদের টিকিটিরও সন্ধান পায় না। ওদের দল থেকে আর্তনাদেও শব্দ আমরা যতই শুনছি সাহস আমাদেও ততই বাড়ছে। তবুও ওরা থামে না। কয়েকটা ২” মার্টারের শেল আমাদও ট্রেঞ্চের আশেপাশে পড়ল। মাটি নরম থাকায় বাক্ট করল না সেগুলো।

ঠিক এমনি সংকটের সময়ে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিল আমাদের এল-এম-জি গ্রুপ। এল- এম-জি’টা নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল আবুল। চোরা একটা গলিপথ বিভিন্ন কোণে আরম্ভ করল ফায়ার। একবার পশ্চিম দিকের বাড়িগুলোর উপর, আবার একটা দৌড়ে সেখানে থেকে সওে এসে উত্তর দিকে ওদের পজিশন বারবার, আবার তার পর মুহুর্তে পূর্বে দিকে ওদের পরিশনের দিকে মুখ রেখে। ওদেরকে এস-এল-আর, স্টেনের স্বয়ংক্রিয় ফায়ারিং তো চালছেই। রাইফেল বসে নাই। গ্রেনেডও ফুটছে দুটো একটা। সে এক গগনবিদারী শব্দতান্ডব। সম্ভব হল না। রাইফেল ফেলে যে যেদিকে পারলো পালালো। অল্প কয়েকজন পা-চাটা বাঙ্গালী দালাল, তখনও মেজর ইয়ামিনের চারদিকে ঘুরছে। আমি ছিলাম পশ্চিম পাশ্বে আমাদের পজিশনের সবচেয়ে সামনের লাইনে। সিভিল ড্রেসে চীনা রাইফেল হাতে লম্বা একটা নজরে পড়ল। তার সাথে কয়েকটি খানসেনা। প্রায় এক হাজার গজ দূরে ছিল ওরা। তাক করে টিপলাম এস-এল-আরের শুয়ে পড়ল সিভিল ড্রেসধারী। ভাবলাম শেষ কিন্তু । শেষ হয় নাই। শুনেছি তিনিই ছিলেন মেজর ইয়ামিন। ঐ যে শুলেন আর উঠলেন গিয়ে ১ মাইল দূরে একটা নদীর পাড়ে, যেখানে তার জন্য স্পীডবোট তৈরী ছিল- অর্থাৎ প্রায় ১ মাইল পথ তিনি কখনও রোলিং কখনও ক্রলিং করে কোন রকমে কাদামাখা হয়ে স্পীডবোটে উঠে এক চস্পটে পটুয়াখালী।

ওদের আক্রমণের দ্বিতীয় পর্যায়ে আমরা প্রথম দিকে ওদের কয়েকজনেকে খতম করি এবং তার পূর্বে পরিকল্পনা অনুসারে তিনদিকে সমানে গুলি ছুড়া আরম্ভ করি, তার উপরে ছিল আবুলের এল-এম-জি চালানোর কৌশল। এতে করে ওরা আমাদের বিরাট বাহিনী ভেঙ্গে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। মোটামুটি বিকেল ৪ টার দিকে অপর পক্ষের আর কোন সাড়া শব্দ পেলাম না। যে যেখানে দিয়ে পেরেছে পালিয়ে বেঁচেছে। ৩০/৩৫ টা লাশ রেখে “মুক্তি বহুত হারামী হায়” বলে মামা আপন প্রাণ বাঁচা সারা বলে পৃষ্ঠাপ্রদর্শন করল।

আমাদের দলের রবিনের ডানহাতে একটা গুলি লেগেছিল। কিন্তু কাউকে না জানিয়ে গামছা দিয়ে বেঁধে সে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করছে। আমরা দলের অর্ধেকের বয়েস ছিল বিশের নীচে এবং কারো বয়সই ২৮- এর উপরে ছিল না। একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি যে, ২০-এর নীচের কচি ছেলেগুলো সবচেয়ে নয়, আমি যে ক’টা যুদ্ধের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলাম প্রায় সব যুদ্ধেও অভিজ্ঞতা থেকে এ কথা বলা যায়।

পল্লীর পর্ণকুটিরের আধা- শিক্ষিত অশিক্ষিত মানুষদের দেশপ্রেমের কোনদিন ভূলতে পারব না। তারা বন্দুক চালাতে পারে না। আধুনিক অস্ত্রের সামনে তারা তাই নিরূপায়। কিন্তু প্রাণের যে আবেগের পরিচয় তারা বিশেষ করে ঐ পানপট্টির যুদ্ধেও দিনে দেখিয়েছিল তার মর্যাদা দেবার মত যোগ্যতা আমার নেই। গ্রামবাসীরা জানতে, আমরা সকালে কিছু মুখে দিকে পারি নাই। পাক হানাদারদের রেইঞ্জের দূরের গ্রামে আমাদের জন্য মুড়ি, চিড়া, গুড়, শতে ডাব কেটে বালতি ভরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পৌঁছিয়ে দিয়েছিল। ছোট ছোট জঙ্গলের বাঁকে বাঁকে তারা আটার রুটি, গুড় এসব যে যেখানে পেরেছে পাঠিয়ে দিয়েছিল- নিয়ে এসেছিল। বিকেল ৫ টার সময় আসা আরম্ভ করল ভাত তরকারি, ডাল ইত্যাদি। এসকল খাদ্যসামগ্রী এত বেশী হাওে এসে জমা হল যে আমরা ১৫ দিন বসে খেয়েও শেষ করতে পারতাম না।

গলাচিপা আক্রমণঃ ৩/৪ দিন পর ঠিক করলাম তাদের ঘাটি আক্রমণ করতে হবে। শওকতকে প্রধান করে জাহাঙ্গীর, মোস্তাফা, হাব্বিসহ ৩৫ জনের দল পাঠালাম গলাচিপা আক্রমণ করতে। ওরা ঠিক পরিকল্পনা করল। মারা গেল বিপক্ষেও কয়েকজন। দিন শেষ হয়ে গেল। ওরা ফিওে এল শিবিওে। আবার পরিবল্পনা করল সেই রাতেই আক্রমণ করার । কিন্তু রাত আর আসতে পারলো না। দুপুরের দিকে সদলবলে থানা ছেড়ে পটুয়াখালী দিকে চম্পট। পেলাম রাতে। শওকত লাফিয়ে পড়ল। তখনই ১০ জনের একটা দল নিয়ে সে চলে গেল গলাচিপায়। পরের দিন বাকী সকলকে নিয়ে আমিও গিয়ে পৌঁছলাম। পটুয়াখালী থেকে জার্তিসংঘের একটা ছোট জাহাজে কয়েকজন পুলিশ দিয়ে মেজর ইয়ামিন একটা দল পাঠালেন পর্যবেক্ষণ করতে, অর্থাৎ গলাচিপা খবরাখবর সংগ্রহ করতে।

শব্দ শুনে রেডি হলাম। কিছুক্ষণ পর চোখ পড়ল জাতিসংঘের জাহাজটার গলাচিপা বন্দরের দিকে এগিয়ে আসছে। আমরা ওঁৎ পেতে থাকলাম। আওতার মধ্যে আসার সাথে সাথে আক্রমণ। প্রায় ১ মাইল এলাকা নিয়ে আমরা পজিশন নিয়েছিলাম। বাঙালী পুলিশগুলো তাদেও হাতের অস্ত্রশস্ত্র সব নদীতে ফেলে দিল। শেষ পর্যন্ত কূলে ভিড়ালো জাহাজটি। চেষ্টা করেছিল কাটিয়ে যেতেম কিন্তু পারল না। দখল করলাম জাহজটি। ওটার নাম ছিল ‘বাট্টি- মে-বি’। মালয়েশিয়ার লোক ছিল ক্রু। তাদের কাছ থেকে আমাদের এয়ার ফোর্স এর শাহজাহান, মজিদ, মিজান শিখে জাহাজটি চালাবার পদ্ধতি। মালয়েশিয়ানদের সসম্মানে জাহাজ থেকে উঠিয়ে যত্ন সহকারে তাদেরকে রাখলাম গলাচিপার একটি হোটেল। জাহজটাকে আমরা আমাদের যুদ্ধের কাজ ব্যবহার করলাম।

ডিসেম্বরের পাঁচ তারিখ। হাতেম আলী, আলমগীর, আজাদ, বারেক, ওদের সকালের নিকট ব্যক্তিগত চিঠি পাঠালাম পটুয়াখালী আক্রমণ করার প্ল্যান দিয়ে।

ডিসেম্বরর ১০ তারিখ। রাত ১০টার সময় বারেক তার দল নিয়ে পটুয়াখালীর উত্তর পার দিয়ে, আমি লোহালয়া অর্থাৎ পটুয়াখালীর পূর্ব দিক দিয়ে, হাতেম আলী ও আলমগীর দক্ষিন দিক দিয়ে এবং আজাদ পটুয়াখালীর পশ্চিম পার দিয়ে আক্রমণ চালাবে। পাঁচ কমান্ডারের একটা বৈঠক আহ্বান করলাম বগাবন্দরে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বগাবন্দার বাউফল থানার অন্তর্গত এবং পঞ্চম আলীর দল বাউফল থানা দখল করে নিয়েছিল। তখন পর্যন্ত গলাচিপা, বাউফল, বামনা ও বেগাতী থানা মুক্তিবাহিনীর দখলে।

খেপুপাড়া আক্রমণঃ ৬ই ডিসেম্বর আমরা খেপুপাড়া আক্রমণ করার পরিকল্পনা করলাম। জাহাজ এবং আরও একটা লঞ্চ নিয়ে রওয়ানা হলাম। খেপুপাড়ার ২ মাইল দূরে তিনটা দলে বিভক্ত হলাম শাজাহান (এয়ার ফোর্স-এর) যাবে জাহাজে। লঞ্চটা ওখানেই থাকবে। শাহজাহানের সাথে থাকবে এল-এম-জিসহ ১৫ জন রাইফেলধারী। সে খেপুপাড়া থানার ঘাটে জাহাজ ভিড়ায় স্বাভাবিক ভাবে। অন্যরা পজিশন নিয়ে থাকবে। থানার শত্রপক্ষ ভাববে তাদেরই গানবোট। জাহজটা অনেকটা গানবোটের মতই দেখতে। বিশেষ করে রাত্রে। পরিস্কার উর্দুতে শাজাহান থানার দারোগাকে ডাকবে এবং সকলকে জাহাজে উঠে আসার নির্দেশ দেবে। শাজানের দেহকৃতি পাঞ্জাবীদের মতই ছিল। শাজাহান পাকিস্তান আর্মির ক্যাপ্টেন অভিনয় করবে। জাহানের সামনে এসে শাজাহের নির্দেশ মতো ফল-ইন করবে। সাথে সাথে জাহজ থেকে এলমে-জি এবং রাইফেলের গুলিতে শেষ করা হবে সবগুলোকে। আমরা এর আগেই দুটো দল নিয়ে থানা ঘিরে ফেলব এবং থানার দিকে এলোপাতাড়ি গুলি করে থানায় পড়ব পরিকল্পনাটা ছিল এমনি সুন্দর। শওকতকে একটা ছোট খালের পুল পার হলে থানার উত্তর দিক দিয়ে পজিশন নিতে পাঠালাম। আমি একটা দল নিয়ে থানার পূর্ব দিক দিক দিয়ে একটা ছোট খালের পুল পার হয়ে থানার ৫০ গজের মধ্যে প্রস্তুত থাকব। শওকতের সাথে ইউসুফ, দেলোয়ার সহ ২৫ জনের একটা দল এবং আমার সাথে বাবুদা, হাবিব, রবীনসহ ২৫ জনের একটা দল। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, সরদার জাহাঙ্গীর একটা দল নিয়ে গলাচিপা এসেছিল। তার দলের সদস্য ছিল ৯জন । তারা আমার দলে যোগ দিয়ে দলকে শক্তিশালী করল। ক্যাপ্টেন মেহেদীর নির্দেশক্রমে গলাচিপা ও পটুয়াখালী থানার মুক্তিবাহিনীর অন্যান্য ছোট দলগুলিও আমার একক নেতৃত্ব মেনে নিয়ে কাজ করা শুরু করেছিল।

হাবীব খেপুপাড়ার ছেলে। সে সকলের সামনে, তার পিছনে আমি, আমার পিছনে বাবুদা। খেপুপাড়ায় কোনদিন যাইনি। হাবীব ছিল একমাত্র পথ-ঘাট চেনা ছেলে পুলের উপর উঠতে যাব, অমিন শত্রুপক্ষের পেট্রেল পার্টির সামনে পড়ে গেলাম। ওরা আমাদের উপর গুলি করল। কিন্তু আমাদের কারও গায়ে গুলি লাগাতে পারে নাই। তার পর আরম্ভ হল থানা থেকে গুলি করা করা। আমরা আর পার হতে পারলাম না। ওদিকে আমাদের জাহাজ থেকে পরিকল্পনা কার্যকরী হবার আগে গোলাগুলির শব্দ পেয়ে ওরাও থানার দিকে গুলি ছুড়ারো। আমরা সারারাত থানা ঘিরে রাখলাম। সকালে আমি চলে এলাম। শওকতের উপর সমস্ত ভার দিয়ে সমস্ত দল ওখান থেকে সরিয়ে আনলাম। চলে এলাম বাগবন্দর। আমার সাথে আনলাম বাবুদা, মাস্টার সাহেব, লতিফ, বাবুদা, ফোরকান, দেলোয়ার এদের কয়েকজনকে।

বগাবন্দর থেকে পাক জলযানের উপর আক্রমণঃ বগা এসে পৌঁছালাম ৮ তারিখ আট টার সময় পটুয়াখালী থেকে বগাতে টেলিফোন এলো যে পাক বাহিনী পালিয়ে যাচ্ছে। বগা তখন মুক্ত এলাকা ওখানে পঞ্চম আলীর দলের ১৫/১৬ জনের ঘাঁটি ছিল। আমাকে পেয়ে ওরা খুশী হল। বগা পোস্ট অফিসে অফিসে গিয়ে পটুয়াখালী সাথে যোগাযোগ করলাম। রাত নয়টার সময় দুটো লঞ্চে পাক জান্তারা দল ও দালালদের দল পালিয়ে আলস পটুয়াখালী থেকে। কিন্তু তাদের যেতে হবে বগাবন্দরের নদী দিয়ে। বাউফেল ফোন জানালাম সবকিছু। ফোন পেয়ে বাউফল থেকে একটা দল রওনা হলো বাগার দিকে।দুরত্ব ৮ মাইল পটুয়াখালী থেকে যথারীতি আমরা খবর পেতে থাকলাম। পটুয়াখালীর তকনকার ডি-সি আব্দুল আউয়ালের সাথে যোগাযোগ করলাম এবয় খবরের সভ্যতা প্রমাণ করলাম।

আমরা ২০ জনের মত লোক রাইফেল হাতে বগা নদীর কূলে পজিশন নিলাম। রাত দশটার সময় লঞ্চ দুটো আমাদের রেইঞ্জের মধ্যে এসে গেল। গুলি ছুড়লাম। ৩/৪ টা এল-এম-জির ব্রাশ। লঞ্চ দুটো রাখতে পারলাম না। ফুল স্পীড- এ চালিয়ে রেইঞ্জের বাইরে চলে গেল।

৯ তারিখ সকাল ৮টার সময় ভারতীয় বিমান বোম্বিং করল পটুয়াখালীতে। আমরা পটুয়াখালী চলে গেলাম। খবর পেয়ে অন্যান্য দলের কিছু কিছু মুক্তিবাহিনী চলে এসেছিল। থানা, পুলিশ ক্যাম্প সব দখলে নিয়ে নিলাম এবং প্রত্যেক পজিশন পয়েন্টে পড়া গার্ড মোতায়েন করলাম। ওদিকে পরের বারে খেপুপাড়া আক্রমণ করে এবং থানার সমস্ত অস্ত্রশস্ত্রসহ খেপুপাড়া থানা দখল করে নেয়। ৯ই ডিসেম্বরের মধ্যে আমরা পটুয়াখালী সমস্ত থানা সহ পটুয়াখালী কে মুক্ত ঘোষণা করলাম। তখন আমার কামান্ডে প্রায় ১৫০০ মুক্তিবাহিনী।

আতিকুল ইসলাম ইমন

<১০, ১৮., ৪৩৫৪৪১>

সাক্ষাৎকার শামসুল আলম তালুকদার

 

মে মাসের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিবাহিনী ক্যাপ্টেন জিয়ার নেতৃত্বে শরণখোলা থানা আক্রমন করলে পুলিশবাহিনী সাথে সাথে অস্ত্র দিয়ে- ৩২ টি রাইফেল এবং আরও অনেক গোলাগুলি পাওয়া গিয়েছিল। ওখান থেকে ক্যাপ্টেন জিয়া কিছু অস্ত্র আমাকে দেন এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার আজিজকে (ফুলমিয়া) দেন।

আমি আমার কিছু লোক, খাবার এবং অস্ত্র নিয়ে সুন্দরবনের ভোলা নদীর পশ্চিম পাড়ে শরণখোলা এবং চানপায়ে রেঞ্জ অফিসের মধ্যবর্তী স্থান ধানসাগর নামক অফিসের বিতরে প্রথম ঘাঁটি গাড়ি। পরিকল্পনা নিই গ্রাম আক্রান্ত হলে সবাইকে এই ঘাঁটিতে নিয়ে এসে পরবর্তীতে বাহিনীর উপর গেরিলা আক্রমণ চালাবো।

শরণখোলা থানা এবং মোড়লগঞ্জ থানার অঞ্চল অধিকাংশ হিন্দুগ্রাম। মওলানা ইউসুফের নেতৃত্বে জামাতে ইসলাম মুসলিম লীগ এবং অন্যান্য পাকিস্তান পন্থীরা ঐ এলাকায় লুটপাট শুরু করে। আমার দলের লোকজন দিয়ে প্রায় ১০ টি গ্র“প করে কিছু অস্ত্র দিয়ে পাহারার ব্যবস্থা করি। মাওলানা ইউসুফের দল শুধু লুট নয় নয় নারীদর্ষণও শুরু করে। আমরা প্রতিরোধ দিলে অবস্থা কিছুটা আয়ত্তে আসে। জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে শরনখোলা থানাতে রাজাকার বাহিনী তৈরী হয় রাজস্ব দল নিয়ে মোড়লগঞ্জ থানায় যায়। মধু থানাতে পৌঁছুলে আমি এবং মধু যৌথভাবে কাজ শুরু করি। ৪০ জন রাজাকার ইতিমধ্যে মোড়লগঞ্জ থানাতে আসে।

২রা জুন আমরা যৌথভাবে মোড়লগঞ্জ থানা আক্রমণ করি। ওখানে ভাসানী ন্যাপের সংগঠনিক সম্পাদক আবু বকর শহীদ হলেন। রাজাকার ৩ জন খতম হয়। ভোর হয়ে গেলে আমরা পিছু হটি। তারপর রাজাকাররা বাগেরহাট পালিয়ে যায়। প্রাথমিক অবস্থায় বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্নজন অস্ত্র নিয়ে গিয়েছিল। তার ফলে মোড়লগঞ্জ থানার সোনাখালী, ফুলহাতা হ্যামড়া, পাঁচগাঁও, ঢুলিগাতি গজারিয়া ইত্যাদি অঞ্চলে ডাকাতি শুরু হয় ব্যাপকভাবে। হিন্দুবাড়ি লুটপাট, নারীধর্ষণ করে তার সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলো। ক্যাপ্টেন জিয়া জুন মাসের মাঝামাঝি আমাদের সাথে যোগ দেন। তিনি তখন দক্ষিন অঞ্চলের সর্বাধিনায়ক হয়। আমি, হাবিলদার মধু এবং ক্যাপ্টেন জিয়া ১০০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ঐসব গ্রামে গিয়ে ৮ জন ডাকাত খতম করি এবং অস্ত্র উদ্ধার করি।

জুন মাসের ২০/২২ তারিখ হবে পাঁচখানা গানবোট ও ২ টি জাহাজে করে প্রায় ৫০০ পাকসেনা এবং ৪০০ রাজাকার মোড়লগঞ্জে উপস্থিত হয়। মোড়লগঞ্জে আমাদের যে ঘাঁটি ছিল সেখান থেকে যাবতীয় অস্ত্র এবং সব বাহিনী নিয়ে আমি সুন্দরবনের পুরানো ঘাঁটিতে নিরাপদে চলে যাই। পাকসেনা এবং রাজাকাররা ওখানে গিয়ে আমাদের ক্যাম্প সহ বহু ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং অসংখ্য লোককে হত্যা করে। পরে রাজাকাদের রেখে পাকসেনারা চলে যায়। এরপরে আমরা সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প করা শুরু করি। ক্যাপ্টেন জিয়া এখান থেকে বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের আনোয়ার এবং হাবিদার আজিজ (ফুলমিয়া) ২০০-এর উপরে মুক্তিযোদ্ধা থানা আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের সাথে তিনি যোগাযোগ করেন এবং জুন মাসের শেষের দিকে রায়েন্দা থানা আক্রমণ করেন সুবেদার আজিজের নেতেৃত্ব। ওখানে আনোয়ার সহ আরও ক’জন শহীদ হন। ঐ মাসেই ক্যাপ্টেন জিয়া ভারতের চলে যান অস্ত্রের জন্যে।

শরণখোলা, মোড়লগঞ্জ থানাতে রাজাকারা ক্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে থাকে। হিন্দুসহ ন্যাপ এবং আওয়ামী লীগের সমর্থকদের বাড়িঘর ভোগদখল এবং নারীদের উপর অত্যাচার করতে থাকে। লোকজন ধরে হত্যা শুরু করে। এই অবস্থায় আমাদের বাহিনী নিয়ে কায়দার মাঝে মাঝে আক্রমণ চালাতে থাকি এবং বিক্ষিপ্তভাবে রাজারদের খতম করতে থাকি। ইতিমধ্যে হাজার হাজার লোক ঘরবাড়ি মান-ইজ্জত হারিয়ে সুন্দরবনে আশ্রয় নিতে থাকে ভারত যাবার জন্য।

ক্যাপ্টেন জিয়া ১৩ ই আগস্ট ভারত থেকে প্রচুর অস্ত্র নিয়ে এখানে আসেন । সেই সাথে ৫০ জন ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলা এবং ন্যাভাল কমান্ডো নিয়ে আসেন। ১৪ ই আগস্ট সুন্দরবন এলাকাতে তিনি সকাল মুক্তিযোদ্ধার কনফারেন্স ডাকেন। ওখানে তিনি বাংলাদেশে সরকারের নিয়োপত্র দেখান। সেখানে ৪ টি জেলার গেরিলা কমান্ডিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ ছিল। সভায় ১০০০-এর মত উপস্থিত ছিল। তিনি এই সভাতে সম্পূর্ণ যুদ্ধ পরিচালনা জন্যে কতগুলি বিভাগ এবং উপবিভাগুলি ছিলঃ (১) অপারেশন বিভাগ (২) খাদ্য বিভাগ (৩) অর্থ সংগ্রহ বিভাগ (৪) যোগাযোগ বিভাগ (৫) বেতন বিভাগ (৬) হাসপাতাল বা চিকিৎসা বিভাগ (৭) ভারতের সাথে যোগাযোগ বিভাগ (৮) শরনার্থী দেখাশোনা এবং পাঠানোর জন্যে বিভাগ (৯) ট্রেনিং বিভাগ (১০) রিক্রিুটিং বিভাগ। খুলনা জেলার যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সামরিক সাব- কমিটিও গঠন করা হয়। নিম্নলিখিত লোক নিয়ে কমিটি গঠিত হয় (১) ক্যাপ্টেন জিয়া- কমান্ডিং অফিসার (২) সেকেন্ড-ইন-কমান্ড- শামসুল আলম তালুকদার (৩) আবুল কালাম মহিউদ্দিন- সিকিউরিটি অফিসার (৪) আবুল আসাদ- অপারেশন অফিসার (৫) শহীদুল আলম বাদল- অস্ত্রগারের দায়িত্ব (৬) নূর মোহাম্মদ হাওলাদার- কনস্ট্রকশন বিভাগ (৭) মোস্তফা হেলাল খাদ্যের ভারপ্রাপ্ত। বাগেরহাট মাহকুমার জন্যঃ (১) নায়েক সুবেদার মধু কমান্ডিং অফিসার (২) সাতক্ষীরার আফজাল (৩) মোড়লগঞ্জ থানার জন্য আলী, (৪) শরণখোলা থানার জন্য হাবিলদার আজিজ (ফুলু) এছাড়া বাগেরহাটের উত্তর অঞ্চলে যোগাযোগের জন্য লোক নিযুক্ত করা হয়। বরিশাল ক্যাপ্টেন জিয়া হাবিলদার মধু এবং আজিজকে অস্ত্র ভাগ করে দেন এবং বাকি অস্ত্র নিজের কাছে রাখেন।

সুন্দরবনের ঘাঁটিকে খুলনা বিভাগের সামরিক হেডকোয়ার্টার ঘোষাণা করা হয়। ঐ সভাতেই ১৩ ই আগস্ট মোড়লগঞ্জ থানা আক্রমণ করা হবে বলে সিদ্ধান নেয়া হয়। ১৫ ই আগস্ট সন্ধ্যায় ক্যাপ্টেন জিয়া নিজেই ১০০-এর মত মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে মোড়লগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হন, মোড়লগঞ্জের পশ্চিম টাউন হাইস্কুল নামক স্থানে রাত ৩ টায় এসে পৌঁছান ১০০ লোককে পাঁচটি দলে বিভক্ত করা হয় । কুটিবাড়ি রাজাকার ঘাঁটি দখল করার জন্য এডজুট্যান্ট খোকনের উপর দায়িত্ব দেয়া হয়। কবিরাজ বিল্ডিং রাজাকার ঘাঁটি দখল করার জন্য নায়েক সুবেদার মধুর উপর ভার দেয়া হয়।সুকুমার বাবুর দালানে রাজাকার ঘাঁটি দখলের জন্য সুবেদার আজিজকে ভার দেওয়া হয় এবং অম্বিকা চরণ হাইস্কুলে রাজাকার ঘাটি দখল করার জন্য মোতাহারকে পাঠানো হয়। ক্যাপ্টেন জিয়া এবং আমি ২০ জন নিয়ে রিজার্ভে থাকি। ভোর ৪টার একই সাথে আক্রমণ চালানো হয়। সকাল ৯টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে, কিন্তু ঘাঁটি দখল করা সম্ভব হয় না। ইতিমধ্যে রায়েন্দা থানা থেকে এক লঞ্চ রাজাকার আসে মোড়লগঞ্জে। ক্যাপ্টেন জিয়া প্রতিরোধ করেন, রাজাকাররা পিছু হটে। ৯ টার পর ক্যাপ্টেন জিয়া নিজেই আমাকে সহ অম্বিকা হাইস্কুল আক্রমণ চালান। ওখানে গ্রেনেড ছুড়তে গেলে মুকুল (স্পেশাল গেরিলা কমান্ডা) এবং মোহরাবের হাত-পা ভেঙ্গে যায় রাজাকারদের গুলিতে। ক্যাপ্টেন জিয়া উত্তর দিক থেকে এল-এম-জি ব্রাশ চালিয়ে জানালা ভেঙ্গে ফেলে। আসাদ এবং হেললকে বিল্ডিংয়ে উঠিয়ে দেওয়া হয়। ভেনটিলেটারের ভিতর দিয়ে ২ জন গ্রেনেড ছুড়তে থাকে। গ্রেনেড ব্রাস্ট হলে বহু রাজাকার মরত থাকে, তবু তারা আত্মসর্মপন করেনি। পরবর্তীকালে ক্রমাগত ১০ টি গ্রেনেড ফেলা হয়। রাজাকাররা চিৎকার শুরু করে। ক্যাপ্টেন জিয়া উত্তর দিকের জানালা দিয়ে লাফিয়ে ঘরের ভিতর পড়ে স্টেনগান দিয়ে ব্রাশ ফায়ার শুরু করে। ৫ জনের সাথে সাথে মৃত্যু ঘটে ২২ জনকে হ্যান্ডস আপ করে বাইরে নিয়ে আসেন। বাইরে আরও ২ জনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। স্কুল তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষা হচ্ছিলো। ৮০০ ছেলেকে বাইরে বের করে দেওয়া হয়। যাবতীয় কাগজপত্র পানিতে ফেলে দেয়া হয়। আমি ক্যাপ্টেন জিয়া এক স্থানে বিশ্রাম নেবার অবসরে ব্যক্তিগত শত্রুটা থাকায় নায়েক সুবেদার মধুর নির্দেশে ৪ জন শিক্ষক সহ ২২ জন রাজাকারকে মধুর সাথে আমাদের বেশ কথাকাটি হয়। ফেরার পথে কুটিবাড়ি থেকে ২জন রাজাকার জলঙ্গ অবস্থায় পালাচ্ছিল, কিন্তু মাঠে কৃষকরা ধরে গরুর জোয়াল দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে পানিতে ফেলে দেয়। বেলা ১২ টার দিকে আমরা সবাই সুন্দরবনে যাত্রা করি। যাবার পথে প্রতিটি গ্রামের মানুষ আমাদের শুভেচ্ছা জানায় এবং চাল, ডাল, মুরগী, খাসি, দিয়ে নৌকা ভর্তি করে দেয়। পথের মাঝে শুনলাম পাকসেনারা এসে গোলাগুলি চালাচ্ছে মোড়লগঞ্জে। একটি ক্যাম্প আমরা দখল করি এবং ৪৪ টি রাইফেল উদ্ধার করি।

১৭ ই আগস্ট আমরা শুনলাম আওমী লীগ নেতা ডাঃ আব্দুল মজিদ, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মারুফ হোসেন ভাসানী ন্যাপের থানা সহ-সভাপতি সাহেব আলীকে পাকসেনারা ধরে এনে হত্যা করেছে। এছাড়া গ্রামের নিরীহ আরও বহুজনকে হত্যা করেছে ও ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। ঐ ক্যাম্পে জিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের কনফারেন্স ডাকেন এবং বরিশার জেলার কয়েকটি থানা আক্রমণ করার জন্য কয়েকটি দল গঠন করেন । সুবেদার আজিজ এবং লতিফের নেতৃত্বে ২০ জনের একটি দল ভান্ডারিয়া থানার জন্য, কমান্ডার হাবিবের নেতৃত্বে থানার জন্য পাঠান হয় । এছাড়া ক্যাপ্টেন জিয়ার নেতেৃত্ব ৫০ জনের একটি দল মঠবাড়িয়া থানা দখলের জন্য শরণখোলা রেঞ্জ অফিসার রওনা হয়। ভোরবেলায় পৌঁছাতেই গানবোটের শব্দ পাওয়া যায় শরণখোলা রেঞ্জ অফিসে সুবেদার ফুলুর নেতৃত্বে ১০০ জনের মত মুক্তিযোদ্ধা ছিল।

১৮ আগস্ট ভোর ভোলা নদীর দু’পারে মাত্র ১০ জন করে ২০ জন রেখে জিয়া সাবইকে সুন্দরবনের ভিতরে যাবার নির্দেশ দেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ৭টি গানবোটের ফরেস্ট অফিসের উত্তর দিকে এসে পড়ে। মোড়লগঞ্জে পাকসেনা এবং রাজাকাররা চরমভাবে মার খেলে তার প্রতিশোধ নেবার জন্য গানবোটগুলি পাঠানো হয়েছিণ। ৪ খানা গানবোট শরণখোলা রেঞ্জ অফিস অতিক্রম করে উত্তর দিকে যাবার পরে পরবর্তীতে ৩ খানা গানবোটের উপর ভোলা নদীর দুই পারে থেকে মুক্তিযোদ্ধারা গুলিবর্ষণ করে। সুবেদার গফফার রকেট লাঞ্চার থেকে গোলা নিক্ষেপ একটা গানবোট বিধ্বস্ত করে। গানবোটটি গুলি খেয়ে দক্ষিন দিকে ৩ মাইল পর্যন্ত গিয়ে ডুবে যায়। পরবর্তীকালে পাঞ্জাবীদের ৪ টি মরা লাশ নদীতে ভাসতে দেখা যায়। বাদবাকি ৬টি গানবোট থেকে খানসেনারা মর্টার, আর-আর, হেভী মেশিনগান, লাইট মেশিনগান থেকে আমাদের উপর প্রবলভাবে গোলাবর্ষণ করে এবং মুক্তিযোদ্ধারা ত্যারাব্যাকা হাট নামক স্থানে একত্রিত হয় এবং কাজার থেকে চিড়া মুড়ি কিনে খাওয়া-দাওয়া করে। ক্যাপ্টেন জিয়া এবং আমি শরণখোলা রেঞ্জ অফিস এবং বঘি ফরেষ্ট অফিস ও শরণখোলা থানার দক্ষিণ অঞ্চলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা জন্য ৫০ জন সাহসী মুক্তিযোদ্ধাকে সশস্ত্রভাবে রেখে আমাদেরকে গন্তব্যস্থান ধানসা রে চলে যাই। এই সময় তারা যেন কোন আক্রমণ না করে। পরবর্তীকালে বরিশাল জেলার বিভিন্ন থানাতে অপারেশন করার জন্য তাদের পাঠান হয়েছিল। তারা বীরত্বের সাথে সেসব জায়গায় অপারেশন করে এবং বহু রাজাকার ও খানসেনাকে হত্যা করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।

ক্যাপ্টেন জিয়া পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা কনফারেন্স ডাকেন এবং সেখানে এই সিদ্ধান্ত হয় যে খুলনা, পটুয়াখালী, বরিশালের কলেজ এবং স্কুলে যেসব ছেলে মেয়ে আছে তাদেরকে সুন্দরবনে নিয়েনতুন করে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং দিতে হবে। সেই অনুযায়ী ওখান থেকে ২০ মাইল দক্ষিণে হেলা নদী থেকে তাম্বল নদীতে ঢুকে তেতুলিবাড়ির খাল দিয়ে উত্তর দিকে ঢুকে ছোট খালের দুই পাশে সুন্দরী কাঠদিয়ে গোলাপাতার ঘর করি। প্রতম অবস্থায় খুলনা জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের হেডকোর্য়টার এখানেই করা হয়।

পরবর্তীকালে শরণখোলা থানার মুক্তিযোদ্ধাদের কামান্ড নিযুক্ত করা হয় সুবেদার আজিজের পরিবর্তে সুবেদার গফফারকে। কারণ আজিজ (ফুলমিয়া) ছিল অত্যন্ত অত্যাচারী। বিনা অন্যায় নিজের ইচ্ছামত অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে গুলি করে মেরেছে এবং সাধারণ মানুষের উপর অনেক অন্যায়-অত্যাচার করেছে। ক্যাপ্টেন জিয়া সুবেদার আজিজকে বন্দী করে ভারত পাঠিয়ে দেন। অন্যদিকে ক্যাপ্টেন জিয়া তাম্বুলবুনিয়া নদীর দুই পার্শ্বে ছোট খালগুলির মধ্যে ঘর তৈরী করার নির্দেশ দিলেন। এক এক গ্রুপের জন্য এক এক জায়গায় ব্যবস্থা করলেন। তাম্বুলবুনিয়া খালের পূর্বদিকে একটি খালে তিনি ছাত্রদের জন্য একটি ক্যাম্প তৈরী করেন। সেখানে অনেক জায়গা নিয়ে ট্রেনিং দেবার সুন্দরীগাছ কেটে একটি খোলা মাঠ তৈরী করলেন। সেই মাঠে বাংলাদেশী জাতীয় পতাকা তোলা এবং যুবকদের রীতিমত সামরিক কায়দায় ট্রেনিং দেয়া হত। উক্ত ছাত্রদের ক্যাম্পের দায়িত্ব হয়েছিল পরিতোষ কুমার ও লিয়াকত আলী খানের উপরে। একদিকে শারীরিক পরিশ্রম করে ট্রেনিং দেয়া হত, অন্যদিকে গেরিলা যুদ্ধ সম্পর্কে ক্লাস নেয়া হতো। সময় সময় সামরিক কায়দায় শারীরিক পানিশমেন্ট দেয়া হতো। উক্ত ছাত্রদের ক্যাম্পের সুন্দরী গাছ কেটে অনেক জায়গা নিয়ে পুকুর কাটা হয়েছে। টিনের দোচালা ঘর করা হয়েছিল। আসামীদের রাখার জন্য জেলখানা রাখা হয়েছে। খাদ্য রাখার জন্য গোডাউন ঘর করা হয়েছিল। আসামীদের দেখারশুনার জন্য জেলের কর্মকতা এবং ষ্টাফ নিযুক্ত করা হয়েছিল। ছাত্রদের ক্যাম্পে বিশ খানার মত বড় এবং ছোট নৌকা রাখা হয়েছিল। মাঝে মাঝে ক্যাপ্টেন জিয়া এবং আমি অতর্কিতে দেখাশুনার জন্য ক্যাম্প ভিজিট করতার। তাম্বুলবুনিয়া নদীর পাশ্বে তেতুলবাড়ীয়া হতে হেডকোয়ার্টার নিয়ে আসা হয়। সেখানে নানা প্রকার ঘর করা হলোঃ

(ক) খুলনা জেলা কমান্ডিং অফিসের জন্য অফিস ঘর তৈরী করা হলো। সেখানে সামরিক কায়দায় সব প্রস্তুতি নেয়া হল।

(খ) সহকারী অধিনায়কের জন্য অফিস করা হলে এবং টাইপিষ্ট ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হলো।

(গ) প্যারেড মাঠ তৈরী করা হলো। সেখানে যোদ্ধাদের একত্রিত করা এবং অপারেশন যাবার পূর্বে সব ফল-ইন-করিয়ে চারদিকে পাঠান হতো।

(ঘ) মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়ার জন্য আলাদা ক্যাম্প করা হয়েছিল। রান্না করার জন্য আলাদা লোক নিয়োগ করা হয়েছিল। আলাদা আলাদা গ্রুপ করে খাওয়ার ব্যবস্তা ছিল। রান্না পরিদর্শনের জন্য আলাদা লোক ছিল।

(ঙ) হাজার হাজর মুক্তিযোদ্ধার খাওয়ার জন্য একদল লোক নিযুক্ত করা হয়েছিল, যারা মাছ ধরে খাওয়াবে এবং অন্য আর এক দল ছিল, যারা হরিণ শিকার করে আনবে।

(চ) মুক্তিযোদ্ধাদের রোগ বা দুর্ঘটনাজনিত আঘাত নিরাময়ের জন্য ৪ জন বিজ্ঞ ডাক্তার ছিল এবং হাসপাতাল ও খোলা হয়েছিল। হাসপাতালে নানা ধরনের ঔষধ ছিল।

(ছ) সমস্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নানাবিধ সুবিধা দেয়ার জন্য গুদাম ছিল। গুদামে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র  ছিল, যা প্রয়োজন অনুযায়ী ওখানে থেকে দেওয়া হতো।

(জ) বিভিন্ন স্থানে থেকে নানা ধরনের জিনিসপত্র রাখার জন্য আলাদা একটি ঘর তৈরী করা হয়েছিল।  তার মান ছিল ইমার্জেন্সী ষ্টোর। ওখানে নানা ধরনের জিনিস জমা রাথা হয়েছিল। উক্ত মালপত্র  দেয়ার জন্য ৫ জনকে নিয়ে একটি ইমার্জেন্সী কমিটি গঠন করা হয়েছিল এবং একজন ইমার্জেন্সী  অফিসার নিযুক্ত করা হয়েছিল।

(ঝ) মহিলাদের জন্য আলাদা ক্যাম্প ছিল। সেখানে মহিলারা ট্রেনিং নিত। মহিলাদের কমান্ডার ছিল  খুরশিদ জানে আলম তালুকদার। মহিলারা প্রতিদিন প্রায় এক হাজারের মত রুটি তৈরী করত।  তারা কাপড়ও সেলাই করত। তাদেরকে ৩০৩ রাইফেল, এস-এল-আর, এস-এম,জি, এল-এম-জি  চালানোর প্রশিক্ষণ দেয়া হোত। নিজেরা নৌকা চালাতো।

(ঞ) ভারত হতে যে সমস্ত নেভাল কমোন্ড আসত তাদের আলাদা ক্যাম্প ছিল। তাদের প্রতি ক্যাম্পের  পক্ষ থেকে স্পেশাল কেয়ার নেওয়া হতো।

(ট) হেডকোয়ার্টার সমস্ত অস্ত্র ক্যাম্পে যদিও ভাগ করে দিয়েছিল তবুও বিরাট অস্ত্রাগার ছিল। অস্ত্র  দেখাশুনা ও পরিক্ষা-নিরীক্ষার জন্য নেওয়া হতো।

গেরিলা ক্যাম্পঃ সুন্দরবনে দুই প্রকার ট্রেনিং দেয়া হতো। একদল ডাইরেক্ট ফাইট করবে। আর এক দল গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ পরিচালনা করবে। তাই গেরিলাদের জন্য একটি আলাদা ক্যাম্প তৈরী করা হয়েছিল। তার কমান্ডার ছিল শহীদ আলী। সেখানে কামডিং অফিসারের জন্য অফিস ছিল। প্যারেড গ্রাউন্ড ছিল। কোত ছিল। গুদাম ছিল খোনে প্রায় ৫ শত গেরিলা যোদ্ধা ছিল। অপারেশন যাবার পূর্বে তার হেডকোয়ার্টারে আসত এবং সেখান থেকে যাত্রা করত।

প্রত্যক্ষ সৈন্যদের ক্যাম্পঃ তাম্বুলবুনিয়া নদীর পূর্বে পার্শ্বে একটি খালের মধ্যে রীতিমত সামরিক বাহিনীর ক্যাম্প করা হলো। তার দায়িত্ব দেওয়া হলো বাংলাদেশের সি-এন-সি কর্নেল ওসমানীর স্পেশালিষ্ট আলতাফকে। তার অধীনে এক হাজারের মত সৈন্য ছিল। তারা অত্যন্ত সাহসী যোদ্ধা ছিল।

রেকি পার্টিঃ রেকি পার্টির কমান্ডার পরিতোষ কুমার পালকে করা হলো। হেডকোয়ার্টার থেকে ১৫ মাইল দক্ষিণে তাম্বুলকুনিয়ার পূর্বে পাশে পাঙ্গাশিয়া নামক খালের মধ্যে তাদের ক্যাম্প করা হলো। সেখানে হতে গানবোট, লঞ্চ বা জাহাজের গতিবিধি লক্ষ্য করে প্রতিদিন হেডকোয়ার্টারে রিপোর্ট পাঠানো হতো। মূলত তার উপর দায়িত্ব ছিল খুলনা এবং বরিশালের শক্রদের যোগাযোগ পর্যবেক্ষণ করা। হেডকোয়ার্টারে তৈরী করার পর এক মাসের মত সময় লেগেছিল সব ঠিক করে নিতে। তারপর যুদ্ধের পালা শুরু হলো।

বগিঃ বরিশালে-খুলানা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে বলেশ্বর নদী। এই নদী ৬ মাইলের মত প্রশস্ত বগি শরণখোলা থানার দক্ষিনে অঞ্চলে জনবহুল এলাকা সংলগ সুন্দরবন ফরেষ্ট অফিস। বলেশ্বর নদীর পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত এই বগিতে আমাদের যোগাযোগের প্রধান ঘাঁটি করা। বগিতে আমাদের মজবুত সৈন্য বাহিনী ছিল। গানবোটের সাথে প্রতিদিন যুদ্ধ চলত। শত চেষ্টা করেও গানবোট হতে পাক সেনারা তীরে উঠতে পারেনি।

বগির যুদ্ধঃ আগষ্ট মাসের দিকে বরিশালে-পটুয়াখালী-ফরিদপুর থেকে প্রায় এক লক্ষ শরণার্থী খানসেনা ও রাজাকারদের অত্যাচারে বগিতে আশ্রয় নিল। এমনি এক সময় হঠাৎ ৫ খানা গানবোট বগিতে আমাদের ক্যাম্পের উপর গুলি চালায়। তারা বলেশ্বর নদী হতে সব স্বয়ক্রিয় অস্ত্র দিয়ে গুলি করে। মর্টার ও আর-আরের গুলিতে মাটি কেঁপে উঠেছিল। তখন আমাদের মাত্র ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা ৫ খানা গানবোটের মোকাবেলা করে। যখন গানবোট তীরের দিকে আসতে থাকে তখন মুক্তিযোদ্ধারা চুপচাপ। গানবোট যখন নদীর কিনারে আসে এবং খানসেনারা তীরে উঠবার জন্য গানবোটের উপরে ওঠে, ঠিক এমনি সময়ে মুক্তিবাহিনী এল-এম-জির ব্রাশ ফায়ার করে-অনেক খানসেনার মারা যায়। দুইদিন যাবৎ যুদ্ধ চলে, কিন্তু তারা তীরে উঠতে পারেনি।

এদিকে গানবোট ভয়ে শরণার্থীরা গ্রাম ছেড়ে বগি নদী পার হয়ে সুন্দরবনে মধ্যে প্রবেশ করে। ৪জন শরনার্থী মারা যায় মর্টারের গুলিতে। অনেক ছোট ছেলেমেয়ে হারিয়ে যায়। পরবর্তীকালে ক্যাপ্টেন জিয়া ও আমি ২৫ জন লোক নিয়ে একটি কমিটি গঠন করি এবং তাদের ভারতে পাঠাবার ব্যবস্থা করি।

ভারত থেকে ৯নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর জলিল ১৫/২০ দিন অন্তর শত শত মুুক্তিযোদ্ধাকে বগিতে পাঠাতেন এবং অস্ত্র পাঠাতেন। আমরা তাদের বরিশাল জেলায় কমার্ডি অফিসার ক্যাপ্টেন শাহজান ও পটুয়াখালী জেলায় কমান্ডিং অফিসার ক্যাপ্টেন মেহেদীর নিকট কাঠকাটা নৌকায় অতি সাবধানে পাঠাতাম। যুদ্ধের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এরূপ চলত।

শরণখোলা রেঞ্জ অফিসঃ এটাও মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ঘাঁটি ছিল। এটাকে বলা হতো পশ্চাৎভূমি। হেডকোয়ার্টার হতে এসে প্রথম এখানে স্থান নেয়া হতো, তারপর নির্দেশ অনুসারে যাত্রা করা হতো। এখানে স্থানীয় জনসাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য পাঠাতো। শরণখোলা রেঞ্জ অফিস হতে উত্তর দিকে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার ধরে আনতো এবং বিচার-আচার করা হতো।

পাকিস্তান হাটের যুদ্ধঃ একদিন শোনা গেল ‘পাকিস্তান’ নামক একটি হাট রয়েছে শরণখোলা থানায়। সেখানে রাজাকাররা জনসাধারণের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। তখন শহীদ আসাদ মাত্র ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আক্রমণ করে। দেড়শত রাজাকার রয়েছে ওখানে। দুইঘন্টা যুদ্ধ চলে। মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের হটিয়ে দিতে ৩ জনকে বন্দী করে নিয়ে আসে এবং দুটি রাইফেল পায়।

তাফলবাড়িতে যুদ্ধঃ তাফলবাড়িতে আমাদের একটি ক্যাম্প ছিল। রাজাকার এবং পাঞ্জাবী পুলিশরা হঠাৎ ক্যাম্পে আক্রমণ করে এবং ক্যাম্পের চারদিকে ঘিরে ফেলে। দীর্ঘ তিন ঘন্টা যুদ্ধ চলে। ইতিমধ্যে বগি ক্যাম্প হতে ২০ জন নিয়ে যখন পিছন হতে আক্রমন চালানো হয়, তখনি পাকসেনারা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। ৪ জন রাজাকার মারা যায়। ১০ টি রাইফেল উদ্ধার করা হয়।

বরিশালে মাপলাজাড়ঃ বরিশালে জেলায় মাঠবাড়িয়া থানায় মাপলাজাড় নামক স্থানে ব্যাপক অত্যাচার করে এবং সেখানেকার জনসাধারণ খুব অসুবিধা ভোগ করে। বগি ক্যাম্প হতে ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা রাত্রে গোপনে এক বাড়িতে আশ্রয় নেয়। বেলা ১০ টার সময় পাঞ্জাবী পুলিশ এবং রাজাকার ৫০ জন গ্রামে এস ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিতে থাকে। মাত্র ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা কায়দায় আক্রমণ করে। সেখানে ১০ জন শত্রু প্রাণ হারায় এবং বাকীরা পালিয়ে যায়। ৫ জনকে বন্দী করে নিয়ে আশা হয় এবং ১২ টি রাইফেল উদ্ধার করা হয়।

 

 

আতিকুল ইসলাম ইমন

<১০, ১৮.৫, ৪৪১-৪৪২>

সাক্ষাৎকারঃ ডা: মোহাম্মদ শাহজাহান

 

মেজর জলিলকে ৯ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত করা হয় এবং হাসনাবাদ ৯ নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টার স্থাপন করা হয়। তারপর হাসনাবাদ থেকে টাকীতে হেডকোয়ার্টার স্থানান্তরিত করা হয় এবং স্বাধীনতার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত সেখানে হেডকোয়ার্টার ছিল।

টাকীর নিকটবর্তী তাকিপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খোলা হয়। শাহ জাহান মাষ্টার টাউন শ্রীপুর হাইস্কুলে হেড মাষ্টার ছিলেন। তিনি তার এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন। সে এলাকার ছেলে এবং যারা আমাদের সাথে ছিল সবাইকে নিয়ে প্রথম তাকিপুরে ট্রেনিং শুরু হয়।

প্রথম দিকে আমাদের খাবার সমস্যা প্রকট ছিল। সেখানে প্রায় ১৮২ জন মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং নিচ্ছিল। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী প্রথম অবস্থায় আমাদের অনেক সাহায্য করেছে। ৭২ ব্যাটালিয়ান বি-এস-এফ’র কমান্ডার মুখার্জীর সহযোগিতার কথা অবিস্মরণীয়।

খারাপ খাদ্য, পানীয় এবং খারাপ অবস্থায় থাকার জন্য অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধার জ্বর এবং নানারকম পেটের অসুখ শুরু হয়। এদের চিকিৎসার জন্য বি-এস-এফ থেকে (৭২ ব্যাটালিয়ান) ঔষধ সাহয্য দেয় হয়। আমি নিজে সে মুক্তিয়োদ্ধাদের চিকিৎসার ভার নিয়েছিলাম।

দিন দিন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা রাড়তে লাগল। জুন মাসে প্রথম ভারতে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা ট্রেনিং শুরু হয় বিহারে। আমরা প্রথম বেইস বিহারে পাঠাই তাকিপুর থেকে। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত গেরিলা বিহারে থেকে ফিরে আসলে আমাদের তৃতীয় ক্যাম্প বাকুন্দিয়াতে খোলা হয়। এখানে কেবল ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলাদের রাখা হত।

আমাদের দ্বিতীয় ক্যাম্প ছিল হিংগলগঞ্জে। এটা খোলা হয় জুন মাসে। এখানে থেকেই ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা সর্বপ্রথম খুলনার কালীগঞ্জ থানা আক্রমণ করে (জুন) এবং সফলতা অর্জন করে। তারপর মাঝে মাঝে এখানে থেকে ভিতরে গিয়ে ছোটখাট অপারেশন চালাত।

আমার সাথে কয়েক জন মেডিক্যালের ছাত্র ছিল। তাদের মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র জহিদ, মজিবর এবং চট্রগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র সরল এবং মৃণাল এদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

প্রথমদিকে প্রত্যেকটা ক্যাম্পের সাথে একটি করে আউটডোর ছিল। কয়েকটা স্পেশাল বেড রাখা হতো কেবলমাত্র গুরুতরভাবে আহত রোগীদের জন্য। এখানে থেকে পরে আমরা ভারতীয় হাসপাতালে পাঠিয়ে দিতাম। তারা এ ব্যাপারে আমাদেরকে যথেষ্ট সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। উল্লিখিত চারজন ছেলে চারটি ক্যাম্পের মেডিক্যাল অফিসার হিসাবে কাজ করছিল। আমি প্রত্যেকটি ক্যাম্প থেকেই পরিচালনা কর হত। তাই প্রায়ই আমাকে সেখানে যেতে হতো।

সেপ্টেম্বর মাসে টাকীতে সর্বপ্রথম ১৫ বেডের হাপাতাল খোলা হয়। এখানে অস্ত্রোপচারের কোন ব্যবস্থা ছিল না। প্রকৃতপক্ষে একটা ট্রানজিট হসপিটাল এর কাজ করত-আহত মুক্তিযোদ্ধাদের। এখানে রাখা হত ফার্ষ্ট এইড দেয়ার জন্য এবং পরে ভারতীয় হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হত। ২২ শে নভেম্বর কালীগঞ্জ থানা মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে। একই সাথে শ্যামনগরও দখল করা হয়। হিংগলগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা শ্যামনগর ও কালীগঞ্জে ঘাঁটি স্থাপন করে।

২৩/২৪ সেপ্টেম্বর বাকুন্দিয়া থেকে মুক্তিযোদ্ধারা সাতক্ষীরার দিকে অগ্রসর হয়। সাতক্ষীরার প্রায় ১১ মাইল দূরে কুলিয়াতে পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধ ৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে।

২৪ নভেম্বর কালীগঞ্জ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা কুলিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে এগিযে আসে। কুলিয়ার যুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ছয়জন আহত হন। ৬ই ডিসেম্বর মেজর জয়নাল আবেদীন আমাদের সেক্টরে যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। ৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবহিনী পিছূ হটতে শুরু করে এবং খুলনার দিকে চলে যায়।

৩রা ডিসেম্বর থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বিভিন্ন এলাকা মুক্ত করতে থাকে।

৬ই ডিসেম্বর একটি লঞ্চ এবং একটা গানবোট নিয়ে জনাব নুরুল ইসলাম মঞ্জুর ৪০০ মুক্তিযোদ্ধা সমভিব্যহারে বরিশালে দিকে রওনা হয়ে যান। ১০/১১ই ডিসেম্বর তারা বরিশাল পৌছেন। ইতিমধ্যে বরিশালের সাবসেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন ওমর বরিশাল দখল করে নিয়েছিলেন।

খুলনা শত্রুমুক্ত হয় ১৭ই ডিসেম্বর। খুলনাতে পাকিস্তানী সেনাবাহীর অধিনায়ক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান। তিনি ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশে-ভারত যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করেন।

 

 

আতিকুল ইসলাম ইমন

<১০, ১৮.৬, ৪৪২>

সাক্ষাৎকারঃ রাজিনা আনসারী

নভেম্বর মাসে আমি বুকাবুনিয়া পেীঁছি। জনাব আলমগীর বুকাবুনিয়ায় এক হিন্দুবাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। ট্রেনিং শেষ হবার পর আমি আলমগীর সাহেবের সাথে কয়েকটি অপারেশনে অংশগ্রহন করি। তাঁর নেতৃত্বাধীনে আমি পটুয়াখালী, আমতলী, পাথরঘাট ইত্যাদি স্থানে পাকসেনাদের সাথে সম্মুখসমরে অবর্তীণ হই।

আমতলী থানা অপারেশনঃ আমতলী থানা অপারেশনের কথা আমার আজও মনে আছে। ৫০ জনের একটি দল নৌকায় করে আলমগীরের নেতৃত্বে বুকাবনিয়া থেকে আমতলী থানা আক্রমণ করার জন্য ভারতের দিকে রওনা দেয়। আমিও ঐ দলের সদস্য ছিলাম। পরদিন রাত ৮ টায় বুকাবুনিয়া থেকে ২৪/২৫ মাইল দুরে অতমলীতে পৌঁছি। আমতলী এলাকার আরও ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা আমাদের সাথে অংশগ্রহন করেন। আমরা ১০০ জন মিলে রাত ১ টার সময় আমতলী থানা আক্রমণ করি। আমাদের সাথে ছিল ২ টা হালকা মেশিনগান ও রাইফেল। আমতলী থানায় পাকসেনা, রাজাকার ও পুলিশ মিলে ছিল ১৫০ জনের মত। রো আমাদের প্রচন্ডভাবে বাধা দেয়। আড়াই ঘন্টা ধরে উভয়পক্ষের মধ্যে প্রচন্ড গোলাগুলি চলে। আমি আমার মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের যুদ্ধের সময় মনোবল বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করি। এ যুদ্ধে পাকসেনাদের ২০ জন নিহত এবং অনেক আহত হয়। এরপর আমরা নিরাপদে আমতলী অবস্থান পরিত্যাগ করে বুকাবুনিয়া চলে আসি। আমাদের কেউ এ যুদ্ধে নিহত হননি।

এছাড়া আমি আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা- শুশ্রুষা  করি। ক্লান্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবাযতœ ছাড়াও তাদের থাক-খাওয়ার সুবন্দোবস্ত করার দায়িত্ব আমার উপর ছিল। স্বাধীন হবার পর ক্যাপ্টেন মেহেদী আমাকে আমার বাব-মার কাছে পাঠিয়ে দেন।

স্বাক্ষর – রাজিনা আনসারী

আতিকুল ইসলাম ইমন

<১০, ১৮., ৪৪৩৪৪৪>

সাক্ষাৎকারঃ স, , বাবর আলী

২৪-৬-১৯৭৩

১৫ই মে খুলনা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমার ভোমরা বর্ডারে কাষ্টমস হাউসে আমরা বাঙালী ই-পি আর ও পুলিশদের নিয়ে একটি শিবির খুলি।

মে মাসের প্রথম দিকে পাক-মিলিটারী অতর্কিতে বেলা ১০ টার দিকে এই শিবির আক্রমণ করে। কিন্তু পাক-মিলিটারী ১ ঘন্টা যুদ্ধ চলার পর পিছু হটতে বাধ্য হয়।

তারপরের দিন পাক-মিলিটারী পনরায় উক্ত ঘাঁটি আক্রমণ করে। ঐ আক্রমণ অত্যন্ত প্রবল হওয়ার আমরা উক্ত শিবির পরিত্যাগ করে ভারতে ইটিন্ডিয়া নামক স্থানে এস উঠি এবং একটা শিবির স্তাপন করি। এই যুদ্ধে আমাদের কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কিছুদিন পরে পাক-মিলিটারী ভোমরা ক্যাম্প পরিত্যাগ করায় আমরা পুনরায় ভোমরা ক্যাম্পে আসি।

১৯৭১-এর ১৮ ই মে পাক-সেনারা বিপুল বিক্রমে আমাদের ভোমরা শিবির দখল করার জন্য আসে। গভীর রাত্রে তারা আমাদের শিবির আক্রমণ করে। বৈকাল ৫ টার সময় মিলিটারীর হটে যাওয়ার পর এই যুদ্ধ শেষ হয়। এই যুদ্ধে পাক-মিলিটারীর বহু অফিসার ও সৈন্য নিহত হয়। আমরা পাকসেনা ২ জন ক্যাপ্টেন ও একজন সৈনিকের লাশ আনতে সক্ষম হই। আমাদের পক্ষেও ২ জন শহীদ হন।

১৯৭১- এর জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ১১ জনের একটা দল নিয়ে মাত্র ৪ টি রাইফেল, ১১ টা গ্রেনেড ও কয়েকটি বেয়োনেট নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তর ঢুকি। জুনের ১০ তারিখে টাকী ক্যাম্পে ফিরে যাই।

১৯৭১-এর ১২ই জুন গভীর রাতে ইছামতী নদী পার হয়ে দেবহাটা থানার টাউন শ্রীপুর গ্রামের মিলিটারী ঘাঁটি আক্রমণ করতে যাই, কিন্তু গিয়ে দেখি ঐ ঘাঁটিতে কোন মিলিটারী নেই। রাত্রে আমরা ঐ গ্রামেই অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু শান্তি কমিটির লোকেরা খবর পেয়ে ভোর না হতেই আমাদেরকে ঘেরাও করে ফেলে। মৃত্যু ছাড়া কোন গতি না দেখে মিলিটারী সাথে গুলি বিনিময় শুরু করি। প্রায় ৫ ঘন্টাকাল যুদ্ধ চলার পর ১৯ জন মিলিটারীরর লাশ ফেলে রেখে মিলিটারীরা পিছু হটে যায়। আমাদের পক্ষে কাজল, নাজমুল ও নারায়ণসহ ৭ জন নিহত নিহত ও ১০/১৫ জন আহত হয়। ইছামতী নদী সাঁতরিয়ে আমরা টাকীতে ফিরে আসি। এ যুদ্ধ হয় ১৩ ই জুন।

এর কয়েকদিন পর প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশের ভিতরে ঢুকি এবং আশাশুনি থানার বড়দল নামক স্থানে শহীদ কাজলের নামনুসারে কাজলনগর শিবির খুলি।

বড়দলের এই শিবির পাকসেনারা সন্ধান পেয়ে আক্রমণ করে। পাকসেনারা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত থাকায় এবং আমাদের কাছে আক্রমণ প্রতিহত করার মত অস্ত্র না থাকায় পালিয়ে যাই।

জুলাই মাসে গড়ুইখালীতে রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করি এবং প্রচুর ৩০৩ রাইফেল ও গুলি উদ্ধার করি। এই মাসের শেষের দিকে পাইকগাছা থানা আক্রমণ করি। পুলিশ বিনাশর্তে আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং আমরা তাদের যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র দখল করি।

আশাশুনি থানার কেয়ারগাতি নামক স্থানে আমরা আর একটা নতুন শিবির স্থাপন করি। শিবির স্থাপনের কয়েকদিন পরেই গানবোটসহ পাকসেনারা শিবির দখল করার চেষ্টা করলে সেখানে বিপুল সংঘর্ষ হয়। অবশেষে আমরা পিছু হটতে বাধ্য হই। পাকসেনারা ও রাজাকাররা কেয়ারগাতি, জামালনগর, গোয়ালডাঙ্গা, ফকরাবাদ এই কয়টি গ্রাম সম্পূর্ণরূপে পুড়িয়ে গেয়। ইতিমধ্যে বিশ্বকবি শিবির, বঙ্গবন্ধু শিবির, শহীদ নারায়ণ শিবির, কবি নজরুল শিবির, শেরেবাংলা শিবির, সোহরাওয়ার্দী শিবির, শহীদ নাজমুল শিবির প্রভৃতি শিবির স্থাপন করি এবং এ সকল শিবিরে ছেলেদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিতে থাকি। এই সময় মুজিব বাহিনীর হাই কমান্ডের নির্দেশে ভারতের দেরাদুনে মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। তারপর প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র নয়ে বাংলাদেশের ভিতরে প্রবেশ করি।

১৯৭১- এর আগষ্ট মাস থেকে আমরা চালনা ও মংলা বন্দরে বিদেশী শিপ, গানবোট ও খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের লালশিয়া জাহাজসহ কয়েকটা বার্জ ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হই।

১৫ই সেপ্টেম্বর পাইকগাছা থানার রাডুলী ইউনিয়নের বাঁকা গ্রামে পাকসেনা ও রাজাকাররা মিলিতভাবে কয়েকটি গানবোটসহ আমাদের শিবির আক্রমণ করে। তারা অতি সন্তপর্ণে এই আক্রমণ চালায়। দুই ঘন্টা গুলিবিনিময়ের পর আমরা পিছু হটি। এই যুদ্ধে কামরুল (খোকন), মালেক, এনায়েত আইনুদ্দীন, শঙ্কর শহীদ হয়। অপর পক্ষে পাকসেনা ও রাজাকারদের বহু সৈন্য ও রাজাকার নিহত হয়।

১৭ই সেপ্টেম্বর আশাশুনি থানার গোয়ালডাঙ্গা নামক স্থানে রাজাকার ও প্যারামিলিশিয়া রাহিনীর সাথে এক সম্মুখ সমর হয়। এই যুদ্ধে প্রায় ৪০/৫০ জন রাজাকার ও প্যারামিলিশিয়া নিহত হয় এবং আমরা ৭০/৭৫টি রাইফেল উদ্ধার করি। আমাদের পক্ষে এই যুদ্ধে মনোঞ্জন শহীদ হয়।

খুলনা জেলার আশাশুনি থানার চাপড়ায় রাজাকারদের একটা শক্তিশালী ঘাটি ছিল। প্রত্যেক সপ্তাহে ১/২ বার আমরা এই ঘাটিতে আক্রমণ চালাতাম ও অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করতাম।

১৯৭১- এর অক্টোবরের মাঝামাঝিতে খুলনা জেলার তালা থানার মাগুরাতে একটা শিবির স্থাপন করি। ঐ মাসের শেষদিকে সূর্যাস্তের একটু আগে কয়েক গাড়ী মিলিটারী অতি সন্তর্পণে এসে আমাদের শিবির ঘেরাও করে। আমরা মিলিটারীর আক্রমণ প্রহিত করার চেষ্টা করলে তা ব্যাহত হয়। ফলে আমরা পিছু হটি। এই যুদ্ধে সুশীল, আকবর, বক্কার শহীদ হয়। পাকসেনারা চলে গেলে মাগুরায় এক কবরে এক কবরে ৩টি লাশ সমহিত করা হয়।

খুলনা জেলার পাইকগাছা থানার কপিলমুনিতে রাজাকার ও প্যারামিলিশিয়াদের একটা মজবুত ঘাটি ছিল। ইতিপূর্বে আমরা এই ঘাঁটি আক্রমণ করে ব্যর্থ হই। নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে আমাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে ঐ ঘাঁটি আক্রমণ করি। ৭২ ঘন্টা দিবারাত্রি সমানে যুদ্ধ চলার উক্ত ঘাঁটির পতন হয়। এই যুদ্ধে মোট ১৫২ জন প্যারামিলিশিয়া, রাজাকার ও খানসেনা নিহত হয়। আমাদের পক্ষে গাজী, আনোয়ার (আনু) শহীদ হয় এবং খালেক, তোরাবসহ কয়েকজন আহত হয়।

ডিসেম্বরের ১২ তারিখে আমরা খুলনা শহরের ১০ মাইলের ভিতরে পৌঁছাই এবং ২/১ জন করে শহরের ভিতরে খোঁজখবরের জন্য ঢুকিয়ে দেই। ১৪ই ডিসেম্বর তারিখে খুলনা বেতারের মিলিটারী ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালাই। ইতিমধ্যে যশোর ক্যান্টমেন্টের পতন হয় এবং সেখানকার যাবতীয় মিলিটারী খুলনায় এসে আশ্রয় নেয়। ইতিমধ্যে আমরা বেশ কয়েকবার খুলনা ঢুকতে গিয়ে ব্যর্থ হই।

১৬ই ডিসেম্বর সারারাত যুদ্ধ করার পর ১৭ই ডিসেম্বর সকাল নয়টায় আমরা খুলনা শহরে প্রবেশ করতে সক্ষম হই এবং খুলনা শহীদ হাদিস পার্কে অনুষ্ঠানিকভাবে আমি প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলে মুক্তিবাহিনীর অভিবাদন গ্রহন করি।

স্বাক্ষরঃ স, ম, বাবর আলী

বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সদস্য

২৪-৬-৭৩

আতিকুল ইসলাম ইমন

<১০, ১৮., ৪৪৪৪৪৭>

সাক্ষাৎকারঃ ক্যাপ্টেন (অবঃ) নূরুল হুদা

মেজর জলিলকে ৯ নং সেক্টরের দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রাথমিক পর্যায়ে পাক ঘাটিঁ শ্রীপুর, বসন্তপুর এবং কৈখালি দখলের জন্য তার বিপরতে টাকী, হিঙ্গলগঞ্জ এবং শমসের নগর মুক্তিবাহিনীর ঘাটি নির্মাণের পরিকল্পনা নিলেন। তিনি প্রথমে টাকীতে হেডকোয়ার্টর স্থাপন করে পরে হিঙ্গলগঞ্জে আমার নেতৃত্বাধীন প্রথম বেইস ক্যাম্প স্থাপন করেন। পাকসেনাদের শক্ত ঘাঁটি ছিলো শংকরা শ্রীপুরা, দেবহাটা, খানজী, উকসা এবং কৈখালী। আমি বসন্তপুর পাক ঘাটিঁ আক্রমণ সিদ্ধান্ত নিই। একই সময়ে টাকী বেইস থেকে শ্রীপুর পাক ঘাঁটির অক্রমণে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। হাবিলদার সোবহান ইছামতি পেরিয়ে ‘রকী’ করে সকল তথ্য সংগ্রহ করলেন।

১২/১৩ জুন রাতে আমি মুক্তিবাহিনীর একটি প্লাতুন নিয়ে পাক ঘাঁটির দিকে অগ্রসর হই। অপরদিকে ইছামতী পেরিয়ে হাবিলদার সোবাহান এবং শাজাহানের নেতৃত্বে একটি করে প্লাটুন শ্রীপুর পাক ঘাঁটির দিকে অগ্রসর হয়। আমাদের এই দুটো দলই রাত ১২ টার পর অকস্মাৎ পাক ঘাঁটি আক্রমণ করে বসে। পাকসেনারা এই আক্রমণের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। তারা ভাবতেও পারেনি, এই দুর্যোগের রাতে প্রমত্তা ইছামতি নদী পেরিয়ে আমরা তাদেরকে আক্রমণ করতে পারি। আমাদের তীব্র আক্রমনের মুখে পাকিস্তানীরা চরমভাবে মার খায়। সংঘর্সে ২০ জন পাকসেনা নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়। আমরা ৫০ টি রাইফেল, দুটি এল-এ-জি, এবং বেশকিছু গোলাবারুদ উদ্ধার করি। অপরদিকে জনাব শাজাহানের নেতৃত্বে শ্রীপুরেও মুক্তিবাহিনীর আক্রমন সফল হয়। পাকসেনাদের হতাহতের সংখ্যা জানা না গেলেও মুক্তিবাহিনী ৩৫ টি রাইফেল এবং বেশকিছু গোলাবারুদ উদ্ধার করে। দুটি অপারেশনে কোন ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই আমরা ভোরবেলা মূল ঘাঁটিতে ফেরন্ত আসি।

জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমি মুক্তিবাহিনীর ১৬০ জন লোক নিয়ে পাক ঘাঁটি খাঞ্জি বি-ওপি, আক্রমণ করি। রাত ১০ টায় আমি আমার বাহিনী নিয়ে লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হই। আমার বাহিনীকে তিনটি কলামে বিভক্ত করি। ডান দিকে এটি কলাম নিয়ে আমি নিজে রইলাম। বামদিকে কলামাটিতে লেঃ বেগ এবং হাবিলদার সোবাহান রইলেন। অপর কলামটি ‘ কাটআফ’ পার্টি হিসেবে থাকলো। বি-ও-পিতে পাকসেনাদের শক্তি ছিল দুই প্লাটুন। আমাদের তিনটি কলামাটি যথাযথ স্থানে পৌঁছে গেলো। প্রথমে নায়েক সুবেদার গুফর ৩” মর্টারের সাহায্যে পকিস্তানী অবস্থানের উপর গোলা নিক্ষেপ করা শুরু করেন। উভয় পক্ষের ব্যাপক সংঘর্ষ ৩০ মিনিট স্থায়ী হয়। আমাদের তীব্র আক্রমণের মুখে পাকসেনা পালিয়ে সাতক্ষীরা এবং দেবহাটার মধ্যস্থলে পারুলিয়া নামক স্থানে আশ্রয় নেয়। আহত অবস্থায় ৪ জন পাকসেনা বন্দি হয়। নিহতে সংখ্যা সঠিক জানা যায়নি। আমরা পাকসেনাদের কাছ থেকে ২”মর্টার, এস-এম-জি, ৭৬২ চায়নিজ রাইফেল এবং বেশকিছু গোলাবারুদ ও রেশন- সামগ্রী উদ্ধার করি। এই বিজয় মুক্তিবাহিনী সদস্যদের মনোবল বহু গুণে বৃদ্ধি পায়।

আমি হিঙ্গলগঞ্জে ঘাঁটি স্থানের কিছুদিনের মধ্যে উকসা পর্যন্ত আমার ঘাঁটি বিস্তৃত করি। আগস্ট মাসের শেষের দিকে পাকসেনারা উকসা ঘাঁটি আক্রমণ করে। আমরাও প্রস্তুত ছিলাম। ফলে শেষ পর্যন্ত পাকসেনারা দারুণ ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এই অপারেশন সম্পর্কে বাংলার মুক্ত এলাকা থেকে প্রকাশি ‘বিপ্লবী বাংলাদেশে’ পত্রিকায় ‘উকসা- গোবিন্দপুরে নয় গোবিন্দপুর মুক্ত’ শিরোনাম সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল।

২০ শে আগস্ট তারিখে আমি ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে শ্যামনগরে আক্রমনের জন্যে অগ্রসর হই। লেঃ বেগ, সুবেদার ইলিয়াস, নায়েব সুবেদার গফুর, হাবিলদার সোবাহান আবদুল হক প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধাগণও আমার সাথে ছিলেন। উকসা হেডকোয়ার্টার থেকে রওয়ানা হয়ে রাত দু’টায় আমরা শ্যামনগর শত্রুব্যূহের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। শ্যামনগর ওয়াপাদা কলোনীতে অবস্থানরত পাকসেনাদের একটি প্লাটুন ছিলো। পাকসেনা প্রতিরক্ষা অত্যন্ত সুদৃঢ়। আমি আমার বাহিনীকে তিনটি কলামে ভাগ করি এবং একটি কলামে আমি নিজে থাকি। সড়কের অপর পাশে একটি কলামের সঙ্গে রইলেন লেঃ বেগ। নায়েব সুবেদার আবদুল গফুর ও হাবিদার সোবাহান রইলেন অপর অলামে। আমাদের অস্ত্র ছিলো ৮ টি এল-এম-জি এস- জি ১২ টি, ২”মর্টার ৩টি এবং অবশিষ্ট এস-এল-আর ও রাইফেল।

রাত দুটোর পরই নায়েব সুবেদার গফুর ২” মর্টার নিয়ে প্রথম পাক অবস্থানের উপর আঘাত হানতে শুরু করেন। এদিকে পাকসোনাদের প্রচন্ড বাধা অতিক্রম করে আমি ও লেঃ বিগ কিছুতেই সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারছিলাম না। রাত ৪ টার দিকে কালিগঞ্জ থেকে পাকসেনাদের আর একটি প্লাটুন নির্বিবাদে শ্যামনগর চলে আসে। উভয়পক্ষে প্রচন্ড সংঘর্ষ চলতে থাকে। দু’ পক্ষেরই মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সকাল ৯ টায় শ্যামনগর আমাদের নিয়ন্ত্রণের আসে। সংঘর্ষে ৪জন পাকসেনা নিহত এবং ৪ জন আহত অবস্থায় আমাদের হাতে বন্দী হয়। এই সংঘর্ষের পর শ্যামনগর থানা আমাদের নিয়ন্ত্রণে এলেও সুবেদার ইলিয়াসসহ ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা এই যুদ্ধে শহীদ হন এবং ৬ জনকে পাকসোনারা ধরে নিয়ে যায়। সকালে ২৫ জন রাজাকার আত্মসমর্পন করে। আমরা শ্যামনগর থানায় স্বাধীন বায়লার পতাকা উত্তোলন করি। স্বাধীন বাংলা থেকে প্রকাশিত ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার ২১ আগস্ট ১৯৭১-এর সংখ্যা এ সম্পার্কিত সংবাদ পরিবেশ করা হয়েছিল।

ফ্রগম্যানের তৎপরতাঃ ৯নং সেক্টরের ফ্রগম্যানরা নদীপথে তৎপরতা চালিয়ে বেশ সাফল্য অর্জন করতে থাকে। এইসব দক্ষ ফ্রগম্যানরা ভারতীয় তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

ফ্রগ্যম্যনদের ৩০ জনের একটি দলকে আসাদুল্লাহর নেতৃত্বে শমসেরনগর পাঠানো হয়। উক্ত দলটি মঙ্গল ও চালনা বন্দরে পাকিস্তানী বাণিজ্যিক নৌকা বাহিনীর উপর হামলা চালানোর জন্যে প্রস্তুতি নিতে থাকে। অপর দল ক্যাপ্টেন জিয়ার নেতৃত্বে ত্রিকোণ দ্বীপে যেখানে পাকিস্তানীদের গোপন ঘাঁটি আছে বলে মনে কার হচ্ছিলো সেখানে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রতিকূল আবহাওয়া এবং অন্যান্য বাস্তব অসুবিধার জন্যে ‘ত্রিকোণে দ্বীপে হামলা চালনো। এরপর সিদ্ধান্ত সম্ভব না হলেও, প্রথম দল চালানো এবং মঙ্গলাতে পরিকল্পনা অনুসারে সাফল্যের সাথে আক্রমণ চালায়। এরপর সিদ্ধান্ত হলো, ১৬ই সেপ্টেম্বর হামলা চালালো হবে। চালনা বন্দরে তখন ৮টি জাহজ এলোমেলোভাবে নোঙ্গর করা ছিল। এটি জাহজের জন্যে দু’জন করে ফ্রহম্যান নির্দিষ্ট করা হলো এবং চারটি করে মোট আটটি ‘লিম্পেট মাইন’ প্রতি দলে দেয়া হলো।

সেপ্টেম্বরের ১৫/১৭ তারিখ ২টা ৩০ মিনিটে ১৬ জন ফ্রগম্যান পশুর নদীতে নেমে পড়ে। ১৪ জন ফ্রগম্যানকে রির্জাভে রাখা হলো। রাত তখন ৪টা বেজে ৩০ মিনিট। দ্রুতগতিতে ১৬ জন ফ্রগম্যান ৮টি জাহজে ‘ লিম্পেট মাইন’ লাগিয়ে চলে আসে ভোর ৫ টা ভেজে ৩০ মিনিট চালনা বন্দর থেকে গগনিবিদারী আওয়াজ শোনা যায় অত্যন্ত সফল ঐ অভিযানে ৮টি জাহজের মধ্যে সেদিন ৭ টি জাহাজই ধ্বংস হয়েছিল।

১৬ই অক্টোবর নৌাবাহিনীর আলমের নেতৃত্বে চালনা বন্দর আর এক বড় রকমের অভিযান চালানো হয়। এই অভিযানে ফ্রগম্যানরা চারটি জাহাজ ধ্বংস করেছিলো। জাহাজ চারটির মধ্যে বিশেষ করে ‘লাইটনিং’ এবং ‘আল- মুরতজা’র ধ্বংসের কথা উল্লোখযোগ্য। এই অপারেশনে ফ্রগম্যান আনোয়ারের সাহসিকতা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়।

নৌবাহিনীর রহমতুল্লাহর নেতৃত্বে ফ্রগম্যান অপর দল নভেম্বর মাসেও অত্যন্ত সফল অভিযান চালায়। রহমতুল্লাহ নৌবাহিনীর একজন দক্ষণ অফিসার। তাঁর আত্মত্যাগ, সাহসিকতা, নিরলস নিষ্ঠা এ দেশের মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।

অক্টেরর মাসে ৯ নং সেক্টরের বেশ কয়েকটি তরুণ অফিসার যোগদান করেন। লেঃ মোহাম্মদ আলী লেঃ আহসান উল্লাহ এবং লেঃ শচীদ্রর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। অফিসার তিনজন আমার নেতৃত্বে কালিগঞ্জ, পারুলিয়া প্রভৃক্তি স্থানের অভিযানের গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালনা করেন।

কালিগঞ্জ অপারেশনঃ নভেম্বরের ২০ তারিখে কালিগঞ্জে পাকবাহিনীর সাথে সংঘর্ষ হয়। কালিগঞ্জ ওয়াপদা কলোনীতে পাকসেনাদের একটি কোম্পানী অবস্থান করছিলো। এছাড়া ছিলো পশ্চিমা রেঞ্জার এবং বেশ কিছু রাজাকার। আমি আমার বাহিনী নিয়ে হেডকোয়ার্টার ইকসা থেকে রওনা হয়ে লক্ষ্যস্থলের নিকট এসে পৌঁছি। এই সময়েএকটি কলাম নিয়ে লেঃ আহসান উল্লাহ এবং আয়েব সুবেদার সোবহান শত্রুঘাঁটির কাছাকাছি এসে পড়েন। সাথে ছিলো মাত্র দু’টি প্লাটুন। ২০/২১ শে নভেম্বর ভোর ৫ টায় আমরা পাকসেনাদের উপর হামল চালাই। মিত্রবাহিনীর ৩য় রাজপুত্র হিঙ্গলগঞ্জ থেকে আমাদেরকে আর্টিলারী সাপোর্ট দেয়। ভোর ৫ টা থেকে সকাল ৭টা পর্যস্ত উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ চলে। এই দু’ঘন্টা স্থায়ী সংঘর্ষে কোন পক্ষেরই কোন হতাহতের সংবাদ পাওয়া যায়নি। তবে প্রায় ৪০ জন পাকসেনা মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। লেঃ আহসানউল্লাহ নিজেই ২২ জন পাকসেনাকে বন্দী করেন। নায়েব সুবেদার গফুর ও ৬ জন খানসেনাকে বন্দী করেন। কালিগঞ্জ শত্রুমুক্ত হয়।

Top of Form