২। ১ নং সেক্টরে সংঘটিত যুদ্ধের আরোও বিবরণ | বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র |
——–১৯৭১
|
প্রতিবেদনঃ শামসুল ইসলাম
– বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র
১। জুন মাস:
(ক) তহশীল অফিস-
(১) ফেনী শহর
(২) খিতাবচর
(৩) পটিয়া
(৪) কানুনগোপাড়া
(৫) মৌলভীবাজার
(৬) আনোয়ার থানার দুইটি তহশীল অফিস।
(খ) গ্রেনেড চার্জ-
(১) নিউমার্কেট ৩ জন
(২) রেয়াজউদ্দিন বাজার ৫ জন
(৩) রেয়াজউদ্দীন বাজার ৩ জন
(৪) পাচঁলাইশ থানা ৩ জন
(৫) মিউনিসিপ্যালিটি, আলী মোল্লা চৌঃ আহত হয়।
(৬) রেয়াজউদ্দিন বাজার ৪ জন আহত।
২। জুলাই মাসঃ
(ক) তহশীল অফিস-
(খ) গ্রেনেড চার্জ-
১) নিউমার্কেট ৫ জন
(২) সদরঘাট ৭ জন নিহিত ১১ জন আহত
৩) কক্সবাজার ২ জন
(৪) আমিন মার্কেট ১ জন
(৫) রেয়াজুদ্দিন বাজার ২ জন আহত
(৬) রেয়াজুদ্দিন বাজার কেউ মারা যায়নি
(৭) চুনার গুদামের মোড় ১ জন।
(৮) জুবলী রোড ৩ জন
(৯) খাতুনগঞ্জ ৩ জন।
(গ) দালাল অপারেশন-
(১) পোপদিয়ার চেয়ারম্যান কাসেম-(এই অপরেশনে বোয়ালখারীর আবুল হাসান সাহায্য করিয়াছে)
(২) রাউজানের ফয়েজ আহমেদ ৮ জন ডাকাত মুহজুল্লাহ ও তৎপুত্র
(৩) চেয়ারম্যান দেলোয়ার সওদাগর বাড়ী জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, গাড়ীটিও,
(৪) চরকানাই-এর নাজির আহমদ
(৫) বোয়ালখালীতে দুইজন রাজাকার হত্যা।
৩। আগস্ট মাস:
(ক) গ্রেনেড চার্জ-
(১) রেয়াজুদ্দীন বাজার ২ জন
(২) নিউমার্কেট ২ জন
(৩) কোর্ট বিল্ডিং-বিস্ফোরণ হয় নাই
(৪) কলিজিয়েট স্কুল ২ জন
(৫) সিটি কলেজ ১ জন
(৬) চাইনিজ-ডেন্টিস্ট-কেউ মারা যায়নি।
(খ) দালাল অপারেশন-
(১) বধুপুরায় ৩ জন
(২) মালিয়ারায় ৭ জন
(৩) জিরিতে ৩ জন
(৪) সারেন্ডার রাইফেলসহ ৪ জন
(৫) বোয়ালখালীতে ১ জন
(৬) রাউজানে ১ জন
(৭) রাংগুনিয়ায় ৩ জন।
(গ) রাজাকার অপারেশন-
(১) জিরি মাদ্রাসায় ২১ জন রাজাকার নিহত, ১৬ টি রাইফেল
(২) বোয়ালখালীতে ১ জন রাজাকার
(৩) রাইজানে ৮ জন রাজাকার
(৪) ….২ জন রাজাকার, ২ জন পুলিশ ও চেয়ারম্যান নিহত।
(ঘ) অন্যান্য
(১) ১৩২০০০ ভোল্টের দুটো পাওয়ার পাইলন কলকারখানার মেইন ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই লাইন ধংস- ২৮ দিন সমস্ত কলকারখানা বন্ধ থাকে,
(২) কৈয়াগ্রাম ১ টি পুল বিনিষ্ট,
(৩) রেলের বিট উপড়ে ফেলার ট্রেন লাইনচ্যুত (দোহাজারী লাইন)।
৪। সেপ্টেম্বর মাস:
(ক) রাজাকার অপারেশন:
(১) কালারপুল থানা-২ জন রাজাকার, ৬ টি রাইফেল ও এমুনিশন
(২) লাখাড়া-তিনজন রাজার দুইটি রাইফেল
(৩) ধলঘাট ৭ জন মুজাহিদ
(৫) ধলঘাট-৭ জন মুজাহিদসহ মোট ২১ জন
(৬) জৈষ্টপুরা-১ জন রাজাকার
(৭) মিলিটারি পুলে ১ জন পাঞ্জাবী।
(খ) গ্রেনেড চার্জ-
(১) রেয়াজুদ্দিন বাজার-২ জন
(২) ষ্টেশন রোড-কেউ মারা যায়নি
(৩) লালদিঘীরপাড়-জামাতের মিছিলে ৭/৮ জন নিহিত।
(গ) দালাল অপারেশন-
(১) কোরাইল ডাংগায় এক জন
(২) লারোয়াতলীতে ১ জন
(৩) বোরলায় ১ জন
(৪) ধলঘাটে ১ জন
(ঘ) অন্যান্য
(১) ১টি পুল ধংস
(২) লাখাড়ায় signal wireless station সম্পূর্ণ ধংস করে দেওয়া হয়
(৩) কোরাইল ডেংা পাহাড়ে কাঠ কাটা নিষিদ্ধ করা হয়
(৪) ফসফরাস দিয়ে পেট্রোল পাম্প ধংস করে দেওয়া হয়।
৫। অক্টোবর মাস:
(ক) রাজাকার অপারেশন-
(১) কদুরখিল গ্রামের সকল রাজাকারদের বাড়ীঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
(২) পরদিন কদুরখিল গ্রামে ৫২ জন রাজাকার ও…… বন্দি
(৩) ধলঘাট রেলওয়ে স্টেশনে ট্রেন আক্রমণ- ২১ জন পুলিশ ও রাজাকার ধৃত
(৪) পশ্চিম পটিয়ায় ২ জন রাজাকার ও ৬টি ষ্টেনগান উদ্ধার
(৫) রাউজানে তিনজন রাজাকার
(৬) শিলচলে সাতজন পাঞ্জাবী সাহায্যকারী
(৭) বান্দরবন রাস্তায় চারজন পাঞ্জাবী
(৮) দুইজন মুজাহিদ।
(খ) দালাল অপারেশন-
(১) পশ্চিম পটিয়ায় ১ জন
(২) রাউজানে ৫ জন
(৩) রাংগুনিয়ায় ৩ জন।
(গ) অন্যান্য-
(১) একটি ট্রেন বিস্ফোরক দিয়ে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দেওয়া
(২) তিনটি কাঠের চালি……. দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়
(৩) কাঠ ব্যাবসায় ও চালনায় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়।
৬। নভেম্বর মাস:
(ক) রাজাকার-পাঞ্জাবী অপারেশন-
(১) টাউনে গ্রেনেড চার্জ করে তিনজন রাজাকার হত্যা
(২) পারুয়ায় গ্রেনেড চার্জ করে তিনজন মিজো ও একজন পাঞ্জাবী
(৩) মগদাইরে গ্রেনেড চার্জ করে একজন রাজাকার
(৪) ফজলপুরে গ্রেনেড চার্জ করে তিনজন রাজাকার
(৫) ধলঘাটে ট্রেন আক্রমণ করে…… জন মুজাহিদ
(৬) ধলঘাটে এম্বুশ- ৯ জন পাঞ্জাবী ও তিনজন মিলিশিয়া।
(খ) দালাল অপারেশন
(১) রাউজান ১ জন
(২) রাউজান ৪ জন
(গ) অন্যান্য-
(১) ট্রেন ইঞ্জিন লাইনচ্যুত করে দেওয়া হয়
(২) ২টি পুল নষ্ট করে দেওয়া হয়
(৩) ৪৪০০০ ভোল্টের ছোট ইলেকট্রিক লাইনটি নষ্ট করে দেওয়া হয়
(৪)১ টি কাঠের চালি ডুবিয়ে দেওয়া হয়
(৫) ১৩২০০০ ভোল্টের মেইন সাপ্লাই লাইনটিও নষ্ট করে দেওয়া হয়-মিল কারখানা আবার বন্ধ করে দেওয়া হয় (১৩ দিনের জন্য)।
ডাঃ মোঃ রাজিবুল বারী (পলাশ)
<১০, ২.২, ৬২–৬৮>
অনুবাদ
১নং সেক্টরের যুদ্ধ বর্ননা
(সাক্ষাৎকারঃ মেজর মাহফুজুর রহমান, বীর বিক্রম, ২৫ আগস্ট, ১৯৭৩)
৩ মে ১৯৭১ এ, হরিনা নামক স্থানে আমাদের জন্য একটি নতুন ক্যাম্প নির্বাচন করা হয়,যেটি ছিল ছিল সাবরুম থেকে ৫ মাইল দূরে। মেজর জিয়াউর রহমান (বর্তমানে বিগ্রেডিয়ার), মেজর শওকত আলী (বর্তমানে কর্নেল), মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) রফিক, ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) খালেক,ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) অলি, ক্যাপ্টেন(বর্তমানে মেজর) এনামুল হক, আমি, জনাব ইসহাক (এডমিনস্ট্রেশান অফিসার), জনাব মুরে (এমটিও),অসংখ্য এমসিএ সেখানে ছিল। পরবর্তীতে আরও অসংখ্য অফিসার,যেমন- স্কোয়াড্রন লিডার(বর্তমানে কর্নেল) শামসুল হক,মেজর(বর্তমানে লেফট্যানেন্ট কর্নেল) খুরশিদ, ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট(বর্তমানে স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান, ক্যাপ্টেন(বর্তমানে মেজর) মতিউর রহমান,ক্যাপ্টেন শামস (গত), ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট আবদুর রউফ, ফ্লাইং অফিসার শওকত সহ আরো অনেকে। এই স্থানটি হয়ে উঠে ১ নং সেক্টর হেডকোয়ার্টার এবং এর নেতৃত্বে ছিলেন মেজর(বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) রফিকুল ইসলাম।
এলাকাটি চিনতে ও এর সাথে লাগোয়া সীমানা পর্যবেক্ষনে এবং লোক নিয়োগে কিছুদিন সময় লাগে। কয়েকজন বিশ্বস্ত কর্মকর্তা আমাদের সেক্টরের হেডকোয়ার্টারে আসেন এবং আমাদের কিছু মাইন,এক্সপ্লোসিভস ইত্যাদি দেখান। ১০ মে মেজর (বর্তমানে বিগ্রেডিয়ার) জিয়াউর রহমান আমাকে আলীনগর বিএসএফ ঘাটিতে নিয়ে যান এবং সেখানে ক্যাপ্টেন পিকে ঘোষ (আলী) এর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। যিনি ছিলেন ওই ঘাটির কমান্ডার এবং আমাদের সৈন্যদের সাথে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অনেক অপারেশনের সাথে ছিলেন। আমাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয় একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে। পরদিন সকালে আমি তার সাথে শুভপুর ব্রিজে যাই এবং দেখতে পাই আমাদের সৈন্যরা তাদের শেষ চেষ্টা দিয়ে এটি দখলে রাখছে। আমি আমার কাজ পেয়ে যাই,যার কারনে আমার এখানে আসা। এবং সেটি হল যেকোন মূল্যে মুহুরিক রেল ব্রিজটি উড়িয়ে দিতে হবে। ১১ এপ্রিল রাত ১২ টার দিকে দুইজন পিএলেস সুবেদার সাবেদ আলী ও সুবেদার জালাল আহমেদের অধীনে ব্রিজের দিকে রওনা হই। আমার দলের সাহসী ইঞ্জিনিয়ার এনসিও জুলফিকার আলী ছিল আমার ডিমোলিটার। আমাদের অনুগত কিছু বাহিনী এর আগেও ব্রিজটি ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু দিনের বেলায় এটি সর্বক্ষন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও রাতের বেলায় রাজাকার ও তাদের সহযোগী বাহিনীর পাহাড়ায় থাকে। ফলে সবগুলো প্রয়াসই ব্যার্থ হয়েছিল। যাই হোক, পথিমধ্যে আমি কয়েকজন নিশস্ত্র সেন্ট্রি পাই যাদেরকে গ্রেফতার করে সাথে নিয়ে চলি আমাদের এক্সপ্লোসিভ বক্স গুলো বহন করার জন্য। ভোর প্রায় চারটার দিকে,যখন চাদের আলো প্রায় শেষ হয়ে আসছিল আমরা অনেক বাঁধা পেরিয়ে ব্রিজের কাছে চলে আসতে সক্ষম হই। প্রায় ১০-১৫ জন সাধারন নাগরিককে হাঁটাচলা ও গল্পগুজব করতে দেখতে পাই। পাকিস্তানি সেনা আছে কিনা তা বোঝার জন্য কয়েক মিনিট পর্যবেক্ষন করি। তারপর আর সময়ক্ষেপন না করে সরাসরি আমার কাজে নেমে পড়ি। কিন্ত প্রায় দশ মিনিটের মাথায় প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ জন স্থানীয় লোক ব্রিজের পাশে জড়ো হয় এবং চিৎকার করে আমাদের ব্রিজ উড়িয়ে দিতে বাঁধা দেয়। এমনকি তাদের মধ্যে অনেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে খবর দেয়ার ভয় দেখায়। এই চিৎকার গন্ডগোলের মাঝেও প্রায় ২০-২৫ মিনিট লেগে যায় ব্রিজের দুই পাশে এক্সপ্লোসিভগুলো ফিট করতে। তারপর আমি আমার প্লাটুনকে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে বলি এবং স্থানীয়দের এই মুহূর্তে স্থান ত্যাগ করতে বলি। কিন্ত বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও তারা আমার কথার কোন গুরুত্বই দেয় না। তারপর আমি সেফটি ফিউজ ফায়ার টি চালু করে দেড় মিনিট পর্যন্ত দৌড়ে দূরে চলে আসি। কানফাটা শব্দে ব্রিজের একপাশ ধসে পড়ে। পরবর্তীতে আমি আমার প্লাটুনের সাথে যোগ দেই এবং ক্যাম্প ত্যাগ করি। এই সকালেই শুভপুর ব্রিজে আক্রমন হয় এবং সেটি দখল করা হয়।
জুনে মেজর (বর্তমানে বিগ্রেডিয়ার) জিয়াউর রহমান বেঙ্গল রেজিমেন্ট ৮ E এর মূলভাগ এবং সেইসাথে সেক্টর ১ এর আরো কিছু বিচ্ছিন্ন ফোর্স মিলিয়ে তুরাতে একটি পরিপূর্ন নূতন ব্যাটেলিয়ন প্রস্তুত করেন। ক্যাপ্টেন খালেক, ক্যাপ্টেন সাদেক, ক্যাপ্টেন অলি, ক্যাপ্টেন এজাজ ছিলেন এই ফোর্সের সাথে। আমাকে ১ নাম্বার সেক্টর সাথে সাবরুমে ৩ নাম্বার সাবসেক্টর এর কমান্ডার করা হয়। ১ নাম্বার সাবসেক্টর টি ছিল বিলোনিয়ায় ক্যাপ্টেন শামস (গত) এর অধীনে। দুই নাম্বার সাবসেক্টর টি ছিল ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) মতিউর রহমান এর অধীনে যা অবস্থিত ছিল শোভাপুরের নিকট শ্রী-নগরে। তিন নাম্বারটি ছিল আমার অধীনে এবং এর অবস্থান ছিল রামগড়ের ঠিক বিপরীতে। চার নাম্বার সাবসেক্ট্ররটি ছিল ইপিআর সুবেদার খায়রুজ্জামানের অধীনে এবং যায়গাটির নাম ছিল তবলছড়ি, কাসালং এর উত্তরে। মেজর (বর্তমানে কর্নেল) শওকত সিলেটে পাচ নাম্বার সেক্টরের কমান্ড গ্রহন করেন। ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) এবং এডজুডেন্ট ফ্লাইট ল্যাফটেনেন্ট (বর্তমানে স্কোয়াড্রন লিডার) সুলতান আহমেদ ছিলেন ইনডাকটিং অফিসার।
আমি আমার সাব সেক্টরের অধীনে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন যায়গায় অপারেশান পরিচালনা করছিলাম যেমন রামগড়,চিকনাছড়া,হাইকু, নারায়নহাট,কারিরহাট,শুভপুর, জোরারগঞ্জ,মাস্তান নগর এবং মীরসরাই এর অধিকাংশ যায়গা যা ছিল বর্ডার এর ২০ মাইলের মধ্যে। গত ২-৩ মাসে আমার সাব সেক্টরের সেনারা কয়েকটি সফল অভিযানের মাধ্যমে শত্রুদের মাঝে ত্রাসের সৃষ্টি করে। গত তিন মাসে বিভিন্ন অপারেশনে হতাহতের সংখ্যা ছিল ৩০০ এর বেশী। আমার সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিক এবং পুরো সেক্টরের দোয়া আমাদের উপর ছিল কারন আমরা পরিপূর্ন সন্তুষ্টি সহকারে অপারেশন গুলো সম্পন্ন করতে পেরেছিলাম। বিগ্রেডিয়ার আনন্দ স্বরুপ পরবর্তীতে ১ নাম্বার সেক্টরের দায়িত্ব গ্রহন করেন এবং ২৮ আগস্ট ১৯৭১ সালে প্রথমবারের জন্য আমার সাবসেক্টর টি পরিদর্শন করেন এবং আমাদের অনুপ্রেরণা যোগান।
পরবর্তীতে আমাকে শ্রীনগরে ২ নাম্বার সাব সেক্টরের দায়িত্ব গ্রহন করতে বলা হয় যা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ন একটি স্থান। একাত্তরের ১৫ সেপ্টেম্বর,আমি আমার কিছু সাহসী পুরানো যোদ্ধা বন্ধু যেমন ক্যাপ্টেন পিকে ঘোষ,লেফট্যানেন্ট কর্নেল হিম্মত সিং সিও ৪ গার্ডস,ক্যাপ্টেন বাজওয়া একমাত্র আর্টিলারি অফিসারদের সাথে মিলিত হই। তারা সকলেই আমাকে সেখানে পেয়ে আনন্দিত ছিলেন। জনাব খায়রুদ্দিন এমসিএ-ইয়ুথ ক্যাম্প কমান্ডার এবং আফসারুদ্দিন ব্যারিস্টার, আরেকজন ক্যাম্প কমান্ডার (ব্ল্যাক শার্ট) আমার সাথে ক্যাম্পে দেখা করেন এবং আমার সাহায্য ও সহযোগিতা কামনা করেন। পরবর্তীতে আমরা ৪ টি দলের একটি অপারেশান চালনা করি পাকিস্তানি একটি ক্যাম্পে, চম্পকনগরে। যেখানে লেফন্যানেন্ট কর্নেল হিম্মত সিং নিজে আমার সাথে ছিলেন।
১৯ সেপ্টেমবর ১৯৭১ এ চারজন গার্ড স্থানান্তরিত করা হয় ১৪ রাজ রিফ, লেফট্যানেন্ট কর্নেল ওম প্রকাশ শর্মা বল্লভপুর ও চম্পকনগরে অপারেশানের জন্য একটি প্ল্যান তৈরী করেন। রাতের বেলার এই আক্রমনের জন্য দিনের বেলা রিহার্সেল করা হয়। ২১ সেপ্টেম্বর ভোর ৩ টা ত্রিশ মিনিটে দুইটি গ্রুপে ভাগ হয়ে সৈন্য রওনা হয়। যার একটি ছিল লেফট্যানেন্ট আবদুল হামিদের নেতৃত্বে বল্লভপুরে এবং আরেকটি ছিল আমার অধীনে চম্পকনগরে। আমরা একই সময়ে আক্রমন শুরু করি। আমাদের শেলিং আক্রমন ছিল ভয়াবহ যদিও তারাও খুব সহজ ছিল না। যদিও আমরা দ্রুত টার্গেট নিয়ন্ত্রনে আনতে পারি নি। আমাদের সকল শেল ই টার্গেটের আশেপাশে পড়ছিল এবং তারা প্রাণভয়ে পালাতে শুরু করে। আমরা তাদের বন্দি করতে ব্যর্থ হই। আমার একজন সিপাহী আহত হয় এবং রাজ গ্রুপের দুইজন সিপাহি আহত হয়।
৫ অক্টোবরে জনাব সামাদ,বাঙ্গলাদেশের এক্টিং ডিফেন্স সেক্রেটারি,জেনারেল সরকার, এবং বিগ্রেডিয়ার শাহ আমার ক্যাম্প পরিদর্শন করেন এবং চলমান অবস্থার পরিপূর্ন একটি রিপোর্ট দেখতে চান। গত কয়েক দিনে অসংখ্য ব্রীজ, বিদ্যুতের পাইলন ধ্বংস করা হয়। অসংখ্য সফল এমবুশ,রেইড, এসাল্ট চালনা করা হয়। এবং পরবর্তীতে আরো সহযোগী কিছু সংগঠন বল্লভপুর,মধুগ্রাম,শ্রী নগর এবং ছাগলনাইয়ার সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে দূরে সরে আসতে শুরু করে।
আমার একটি প্লাটুন পুলিশের সুবেদার রাফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে ছিল। তাকে কিছুদিন আগে আমি এফ এফ এর কিছু দল সহ বাংলাদেশের ভিতরে মিরেরসরাইতে পাঠাই। সেখানে সে ২ সপ্তাহ ছিল। প্রচুর সফল অপারেশন করে। এবং একদা এক পাকিস্তানী মেজরের কাটা মাথা নিয়ে হাজির হয়। ঐ অপারেশনগুলোতে আমাদের একজন সাহসী শিক্ষানবিশ এফ এফ নিহত হয়। নায়েক জুলফিকারের বাম কাঁধ উড়ে যায়। বেঙ্গল ৮ ই এর সিপাহি নুরুল আলমের পেট ও থাই এর পিছনের দিকটা উড়ে গেলেও অনেক কষ্টে সে নিরাপদে ফিরে আসে।
১৫ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট ভাই, কিছু ভিআইপি, জেনারেল নরেন্দর সিং, মেজর (বর্তমানে লে কর্নেল) নুরুল ইসলাম এবং আরও ৪০ জন অফিসার আমার ক্যাম্পে আসেন এবং আমার সৈন্যদের বাহবা দেন।
উত্তরে নালুয়া বিওপি পর্যন্ত আমার প্রতিরক্ষ বাড়াই। সেখানে চাঁদগাজির বেলনিয়া ও আলমিহাঁট পর্যন্ত অপারেশনের দায়িত্বে ছিলেন সাহসী ইপিআর এর জে সি ও সুবেদার লনই মিয়া। দক্ষিণে কারেরহাঁট – শোভাপুর পর্যন্ত আরেকজন সাহসীর দায়িত্বে ছিল। তিনি হলেন ই পি আর এর জেসি ও এন/সুবেদার রহমত আলি। আরও কিছু সাহসী জে সি ও ইপি আর এর এক্টিং সুব মেজর ফখরুদ্দিন, ৮ ই বেঙ্গলের সুবেদার সাবেদ আলি, ই পি আর এর সুবেদার আব্দুল গনি যারা কয়েক মাস ধরে প্রচুর সফল অপারেশন চালিয়েছেন এবং সুনাম কুড়িয়েছেন।
২১ শে অক্টোবর আমার তিন প্লাটুন বাংলাদেশের ভিতরে ধুঁকে পরে তিনটি ভিন্ন জায়গায় যথাক্রমে ফটিকছড়ি, নাজির হাঁট ও মীর সরাই এ স্বাধীন হবার শেষ দিন পর্যন্ত অপারেশন চালায়। একটি ছিল সুবেদার সাবেদ আলি -লে শওকতের অধীন। দ্বিতীয় টি এনআই সুবেদার রহমান এ ইউ লে ফারুক আহমেদের সাথে, আর তৃতীয়টি সুবেদার রফিকুল ইসলাম লে রকিবের সাথে।
২৪শে অক্টোবর আমার এলাকায় একটি সম্মেলন হয়। ব্রিগেডিয়ার সান্ধু কমান্ডার ৮৩ বিডীই, লে কর্নেল বিশলা সি ও ৮ বিহার, লে কর্নেল ভিড়ক কমান্ডার আর্টিলারি, মেজর বাজওয়া সমরগঞ্জের বিওপি কমান্ডার এবং আমি সেখানে ছিলাম। এর পড় আমরা সবাই বেলনিয়া বিওপি পর্যন্ত রেকু করি। কিছুদিনের ভেতর আমি আমার সাব সেক্টরের বাহিনীর তিন চতুর্থাংশ নিয়ে বেলনিয়ার কাছে চলে যাই। ৩০ অক্টোবর শান্তিরহাট এ ৮৩ বিডিই হেডকোয়ার্টারে সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিকের সাথে মিটিং করি। পরবর্তি অপারেশনের জন্য বাহিনীকে সতর্কতা আদেশ প্রদান করি। গুথুমা ও মোতাই বিওপি তে রেকু করি। ১ নভেম্বর ৩য় কনফারেন্সে অংশ নেই। লে জেনারেল সাগাত সিং ও মেজর জেনারেল হিরা সেখানে ছিলেন – তাদের সাথে বেলনিয়াতে প্রবেশের নিয়মিত আলোচনা করি।
বেলনিয়ার ৪ মাইল দক্ষিণে পরশুরামের নিকট রাস্তা ব্লক করার দায়িত্ব আমরা ৮৩ বিডিই এর কাছে থেকে পাই। এর উদ্যেশ্য ছিল আমাদের দক্ষিণ থেকে আক্রমণ ঠেকানো। মহুরি নদী বেলনিয়ার ভিতর সোজাসুজি উত্তর দক্ষিণ বরাবর গিয়ে এটিকে পূর্ব ও পশ্চিম দুই সেক্টরে বিভক্ত করেছে। পূর্ব দিকের ১ নং সেক্টরের কমান্ডার আমাকে বানানো হল। আর পশ্চিমের দায়িত্ব দেয়া হল ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) জাফর ইমামকে। ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের সাথে ক্যাপ্টেন হেলাল মুশেদের নেতৃত্বে ১০ ই বেঙ্গল ও ২ ই বেঙ্গলের একটি দল মোতায়েন ছিল। আমার ৪ টি দল ছিল। বেশিরভাগ ইপিআর এর ছেলেরা। লে মন্সুরুল আমিনের নেতৃত্বে ২টি দল ও আমার সাথে ২ টি। লে মন্সুরের ৬ পিআই কমান্ডার ছিল ই পি আর এর সুবেদার আজিজ, ই বেঙ্গলের হাবিলদার (বর্তমানে এন/সুবেদার) ইমাম, পুলিশের হাবিলদার (বর্তমানে এন/সুবেদার) এরশাদ। আমার সাথে ৬ জন ছিল। সুবেদার লনি মিয়া ই পি আর থেকে, এক্টিং সুবেদার মেজর ফখরুদ্দিন ই পি আর থেকে, সুবেদার আব্দুল গনি ই পি আর থেকে, হাবিলদার শহীদ ই পি আর থেকে, এন/সুবেদার নুরুজ্জামান ই পি আর এর এবং এন/সুবেদার দিন মোহাম্মাদ ই পি আর থেকে। লে মন্সুরের সাথে ৩’’ মর্টার ছিল ই পি আরের এন/সুবেদার মানিকের কাছে। আমার কাছে ৩’’ মর্টার টি ই বেঙ্গলে এন/সুবেদার সাইদ আহমেদের কাছে ছিল। আমার সেক্টরে ২ টি রাজপুট যুক্ত ছিল এবং ক্যাপ্টেন জাফরের সেক্টরে ছিল দগড়া।
৩/৪ নভেম্বর রাতে আমরা বেলনিয়াতে রেকু করি। ৬টি রোড ব্লক পজিশন ছিল আমার অধীনে আর ৬ টি ছিল ক্যাপ্টেন শামসের অধীনে। আশ্চর্যের বিষয় ছিল বর্ডারের ৫ মাইলের ভিতর রেকু করলেও আমাদের উপর কোন আক্রমণ আসল না। ১ নং সেক্টরের উপ অধিনায়ক ক্যাপ্টেন শামস এই দিন সন্ধ্যায় মৃত্যুবরণ করেন। সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিক ও বেলনিয়ার মেজর প্রধান তাকে দেখতে আসেন। বেলনিয়ার বাংলাদেশের অংশে তাকে দাফন করা হয়। লে মন্সুর এই সেক্টরের উপ অধিনায়ক নির্বাচিত হন।
৫ নভেম্বর ৫টা ৩০ মিনিটে আমরা বেলনিয়াতে প্রবেশ করি। আমাদের রোড ব্লকের শেষ পয়েন্ট ছিল সালিয়া দীঘি, পরশুরাম পি এস এর ২ মাইল দক্ষিণে, বর্ডারের ৫ মাইল ভিতরে বেলনিয়া ছাগল নাইয়া মেইন রোডের পাশে। ২ রাজপুতের একটি প্লাটুন ও আর্টিলারি ও পি আমার সাথে ছিল। তখন ছিল গভীর রাত এবং মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল যখন আমরা সেখানে প্রবেশ শুরু করি। রাস্তা পিচ্ছিল ছিল, অন্ধকারে একে ওপরকে হারিয়ে ফেলছিলাম, অনেকে ঠাণ্ডায় কাপাকাপি করছিলাম। রাত ১২ টার সময় আমরা গন্তব্যে পৌছালাম। তখন প্রচণ্ড ঝড় হচ্ছিল। আমরা অবস্থা নিতে শুরু করি এবং এখানে সেখানে গর্ত করতে থাকি। ঝরের কারণে আমাদের এফ এফ রা তাদের জি সি আই শিট আমাদের পচনে আনতে পারছিলনা। আসে পাশে যা কিছু ছিল তাই দিয়ে আমরা মোটামুটি একটা ডিফেন্স বানালাম।
পরের দিন ৬ নভেম্বর ৫ টা ৩০ মিনিটে গুথুমা বিও পি তে একটি পেট্রোল সম্ভবত রেকু করে ফিরছিল। তখন তারা সুবেদার লনি মিয়া পি আই এর আক্রমণে পড়ে শেষ হয়। ১০ টার দিকে শত্রুরা আমাদের ব্যাপারে জানতে পারে এবং চারদিক থেকে আক্রমণ শুরু করে। ঝরের ভিতর সারা দিন তারা আমাদের পরাস্ত করতে চেষ্টা করেও ব্যার্থ হয়। রাতে আমার লেফট ফরওয়ার্ড পি আই হাবিলদার শহীদ শত্রুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। কিন্তু শত্রুরা হতাহত হয় এবং তাদের লাশগুলো এলোমেলো ভাবে পড়ে ছিল।
৭ নভেম্বর ৪টা ৪৫ মিনিটে ১১ পাঞ্জাবের একটি দল আমার বামের হাবিলদার শহীদের অংশে আবার আক্রমণ করে। আক্রমণ করতে করতে তারা দলের মূল ঘাঁটি সালিয়া দীঘির কাছে পৌঁছে যায়। আমি বুঝিনি কি হয়েছে। আমি দেখছিলাম আমাদের ও শত্রুবাহিনী আমাদের দিকে দৌড়ে আসছে। শেষ পর্যন্ত শত্রুবাহিনী আমাদের ঘাঁটি পর্যন্ত আস্তে না পারলেও সালিয়া দীঘির পাশে আমাদের ঘাঁটি থিক ১০০ গজ দূরে আমাদের অবস্থানটি দখল করে নেয়। ৫ জন সেনা, ২ জন এফ এফ, পি আই কমান্ডার হাবিলদার শহীদ ধৃত হন এবং তাদের হত্যা করা হয়। ২ দিন ধরে ৭ টি লাশ সেখানে পড়ে ছিল। হাবিলদার শহীদ কে ফেনী জেলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাকে সেখানে গুলি করে হত্যা করা হয়। জেলে তার একজন ভাতিজা ছিল – সৌভাগ্যক্রমে স্বাধীনতার দিনটি পর্যন্ত সে জীবিত ছিল।
২ দিন ধরে আমি শত্রুদের থেকে আমার অবস্থান টি পুনরুদ্ধার করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারা যাচ্ছিলনা। গত ২ দিন ধরে শত্রুরা আমাদের উপর অনেক আক্রমণ চালিয়েছে। সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল ৮ নভেম্বর সন্ধ্যায়। পরশুরাম ও বেলনিয়া আমাদের অপারেশনে আসল। এই মুহূর্তে আমরা ছিলাম পিছনে – শুরু দক্ষিণে শত্রুরা আমাদের সামনে ছিল।
৯ নভেম্বর এক্টিং সুবেদার মেজর ফখরুদ্দিন ও ২ রাজপুটের লে কুমুদের প্লাটুন দক্ষিণ বেড়াবাড়িয়া গ্রামে আমাদের পুরনো অবস্থান যেটি হাবিলদার শহীদের অধীনে ছিল সেটই পুনরুদ্ধার হয়। শত্রুরা তাদের বা আমাদের মৃতদেহ কনটিকেই মাটিচাপা দেয়নি। আমরা ১৫ টি পচা লাশ সেখানে পেয়েছিলাম যেগুলোকে মশা, মাছি আর পোকা ধরে গেছিল। তাই একটি লাশ ও আমরা সনাক্ত করতে পারিনি। একটি লাশের পকেটে পবিত্র কুরান ছিল আর একটি কাগজে লেখা ছিল ‘২৪৮৪৫৪৭ সেপাই মুশ্তাক আহমেদ’। পালাবার সময়ে শত্রুপক্ষ প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ রেখে যায়। একটি ঝুরিতে লেখা ছিল ১১ পাঞ্জাব।
৯ নভেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় ৩টি শত্রু বিমান আমাদের অবস্থানের ওপর নাপাম বোমা বর্ষন করে। আমার একজন সেপাহি আহত হয়েছে। আর মেজর শহীদের দলের একজন আহত হয় এবং ঘটনাস্থলেই মারা যায়। ১০ নভেম্বর শত্রু পক্ষ চাতালিয়া ও কাপ্তান বাজার থেকে আক্রমণ চালায়। কিন্তু আমাদের অবস্থান থেকে আমাদের সরাতে ব্যার্থ হয়। আজ বিকেল সাড়ে ৩ টায় ৪টি বিমান দিয়ে আবারো আক্রমণ করে। সন্ধ্যায় চাতালিয়ায় ডান দিক থেকে একটি ব্যাটালিয়ন আক্রমণ করে। তাছাড়া সামনে সাতকুচিয়া আর বামে গুথুমা থেকেও আক্রমণ করে কিন্তু ব্যার্থ হয়। সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমাদের সাথে ছিলেন। শত্রুদের প্রচুর ক্ষয় ক্ষতি হয় এবং তারা ২/৩ মাইল পিছু হটে। পরেরদিন সকালে PAF CESNA আমাদের উপর দিয়ে ঘোরা শুরু করল এবং গোলা নিক্ষেপ শুকু করে। ১২ নভেম্বর শত্রু সেনারা গুথুমা ত্যাগ করে। ২ রাজপুট এর লে কর্নেল দত্ত ও সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিক আমাদের সাথে দেখা করলেন এবং বাহবা দিলেন। সালিয়া দীঘি থেকে আমি আমার বাহিনী নিয়ে এসে ১ মাইল দূরে আরও ভালো অবস্থান নিয়ে নিলাম।
বেলনিয়া হেডকোয়ার্টারে সকল অপি কমান্ডারদের নিয়ে একটি কনফারেন্সের আয়োজন করা হল। ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) জাফর ইমাম সেখানে ছিলেন। সফল যুক্ত অপারেশনের জন্য আমরা একে ওপরকে জড়িয়ে ধরলাম। মেজর জেনারেল হিরা আমাদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিলেন এবং আমাদের বাহবা দিলেন। আমাদেরকে আমাদের বর্তমান লাইন বেলনিয়া- ছাগল নাইয়া থেকে আরও এগিয়ে যাবার আদেশ দেয়া হল। আমরা আরও ২ মাইল এগিয়ে গেলাম। মোতাইখালের কাছে। আমাদের ডানে কেত্রাঙ্গা তে আর বামে বাঘমারা আর সামনে কাপ্তান বাজারে শত্রুদের শক্ত ঘাঁটি ছিল।
১৯ নভেম্বর বিডি ইহেড কোয়ার্টারে আরেকটি মিটিং করি। এখন আমরা একটি নতুন ১৮১ বিডিই এর অধীনে আসলাম সেটাতে দায়িত্বে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার আনন্দ সরূপ। লে কর্নেল হাসাবনিসের দায়িত্বে একটি নতুন ব্যাটালিয়ন ৬ জাত আমার বাহিনীতে যুক্ত হয়। আমার বাহিনী ও ৬ জাত নিয়ে বেলনিয়ার ৯ মাইল দূরে আমরা আমাদের ২ য় রোড ব্লক শুরু করি খেজুরিয়া বিওপি এর ভিতরে মহাম্মাদপুরের দক্ষিণে। শত্রুরা আমাদের বিপক্ষে ফিল্ড আর্টিলারি ব্যাবহার করছিল। জগতপুর গ্রামে শত্রু অবস্থানে আক্রমণ করি। ১০ রাজাকার ও ১৫ বালুশ আমাদের কাছে আত্তসমর্পন করে। সেই অপারেশনে ৬ যাতের একজন নায়েক নিহত হয়। চিতলিয়া, কাপ্তান বাজার, মহাম্মাদপুর, খেজুরিয়ার বেশীর ভাগ অপারেশনে আমরা সবাইকে আত্তসমর্পনে বাধ্য করি। Allied PT. 76 amphibious tks were used in our support on 24th November. আমজাদঘাঁট ও চাঁদগাজি বাজারে শত্রুপক্ষ শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। আমরা আমাদের গতি ধরে রাখি। ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত। এটি মৃধার বাজার পর্যন্ত। ছাগল নাইয়াতে আব্দুল কাদের মজুমদার নামে একজন খুব ভালো বেসামরিক ব্যাক্তি আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করেন। তিনি আমাদের সাথে যুদ্ধেও অংশ গ্রহণ করেন। গঙ্গাধড়বাজার, রেজুমিয়া ও ফেনী থেকে শত্রুরা পালিয়ে যেতে শুরু করে।
২৮ নভেম্বর শান্তির বাজার ১৮১ বিডিই হেড কোয়ার্টারে ব্রিগেডিয়ার আনন্দ সরূপের সাথে আরেকটি মিটিং করি। সেখানে সিও৬ যাত, সি ও ১৪ কুমাওন, সি ও ৩২ মোহর এবং আমাদের পরবর্তি কাজ বুঝিয়ে দেয়া হয়। এবারে আমাকে একটু বড় ও ঝুঁকি পূর্ন এলাকার দায়িত্ব দেয়া হল। আমার একটি প্লাটুন ছিল সুবেদার লনি মিয়াঁর নেতৃত্বে। তাদেরকে মাতুয়া গ্রামে অবস্থান নিতে বলা হল। এটি ছিল দখিন যশপুরে অবস্থিত শত্রুদের হেডকোয়ার্টারের নাকের ডগায়। তাই আমাদের এই প্লাটুনটিকে শত্রুরা সহজেই আক্রমণ শুরু করে। শত্রুরা একটি স্টিম রোলার এনে আমাদের ঐ এলাকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে থাকে।
কিন্তু আমরা সেটিকে ট্যাঙ্ক ভাবতে থাকি। কিন্তু স্থানীয়দের কাছে জানতে পারি এটি একটি রোড রোলার মাত্র। অনেকবার অনুরোধ করার পড় ব্রিগেডিয়ার আনন্দ সরুম আমাকে কিছু ফোর্স দিলেন। মেজর গুরুং এর বাহিনী থেকে গুরখা পি আই এর ৩২ মাহার আমাদের দেয়া হয়। সাথে সাথে সেটাকে আমি সুবেদার লনি মিয়াঁর পি আই এ যুক্ত করি। মাইন, পেট্রোল ও গোলাগুলির কারণে আমি প্রতিটি অবস্থানেই দেখতে যাই। তবে ঐ সময়ে মুভ করা কঠিন ছিল। কারণ সর্বত্রই শত্রু পক্ষের মাইন পোঁতা ছিল। এগুলোর সব গুলোকে নিষ্ক্রিয় করা সম্ভব ছিলোনা। ৩২ মাহারের এক নায়েক ৫৭ আর সি এল আনার সময় মাইনে পারা দেয় এবং তার ডান পায়ের কনুই থেকে হাঁটু পর্যন্ত উড়ে যায়। আমি আমার আর এম ও চট্টগ্রাম মেডিকেলের ৫ ম বর্ষের ছাত্র ডা শফিকুর রহমান ভুঁইয়া কে নিয়ে সেখানে যাই এবং প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাকে এ ডি এস মৃধার বাজারে পাঠানো হয়। এর কিছুক্ষণ পরই সুবেদার ফখরুদ্দিনের পি আই মাইনে আঘাত পান। ড্রেসিং করার মত একটি টুকরাও আমাদের কাছে ছিলোনা। একটি কম্বল দিয়ে ক্ষতটা পেঁচিয়ে তাকে ম্রিধার বাজারে পাঠানো হয়।
৩ ডিসেম্বর লে কর্নেল হর গোবিন্দ সিং ৩২ মোহরের সি ও তার ও জি পি আমার সাথে হেড কোয়ার্টারে দেখা করতে আসেন। তিনি শত্রুদের অবস্থানের একটি সম্পূর্ন ধারনা চাচ্ছিলেন। সেই রাতে তার গুর্খা পি আই যেটা আমার বাহিনীর সুবেদার পি ায় ফ্রন্টের সাথে যুক্ত ছিল তাদের অন্য একটি অপারেশনে যেতে বলা হয়। ফেরার সময় অকস্মাৎ একটি গুলিতে একজন ঘটনাস্থলেই নিহত হন। ছিরিঙ্গা দীঘিতে আমার বাহিনী ও মিত্র বাহিনীর মেজর গুরুং এর ৩২ মাহারের কিছু অংশ দিনব্যাপী আক্রমণ করে। ৫ ডিসেম্বর শত্রুরা প্রচুর মাইন রেখে পালিয়ে যায়। জায়গাটি সম্পূর্ন ক্লিয়ার করতে গেলে কয়েকজন বেসামরিক গাইড গুরুতর আহত হন।
সুবেদার মেজর মহিউদ্দিন নামে আমার একজন পিআই কমান্ড তার ডান পায়ে হাঁটুর নিচে গুলি খান। তাকে এ ডি এস মৃধাবাজারে পাঠানো হয়। এবং তার এম জি কমান্ডার এন/সুবেদার সফিউল্লাহ তার দায়িত্ব পান। ইতিমধ্যে আমাকে মুহুরি নদীর কাচজে রেজু মিয়া ব্রিজের নিকট পানুয়া (উত্তর) কাশীপুর ও নিজপানুয়া তে যেতে বলা হয়।
এখানে আমাকে বলা হয় আমার ডানে ৪ ই বেঙ্গল ফেনী থেকে চট্টগ্রামের দিকে আসছে আর ডানে বর্ডারের পাশ দিয়ে ৩২ মাহার আছে। আমরা ১৮১ বিডিইএর সাথে চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছিলাম। এখন আমি আমার পুরনো জায়গায় আসলাম যেখানে আমি আগে বহু অপারেশন চালিয়েছি। ৬ ডিসেম্বর আমি আমার দল নিয়ে করিয়া বাজারে পৌঁছালাম। সেখানে ৪ ই বেঙ্গলের লে মুমতাজের সাথে দেখা হয় যার দল ধুম ঘাটের দিকে যাচ্ছিল। এখানে এতদিন পড় নিয়মিত ই বেঙ্গল ট্রুপ্স দেখে আমি খুশি হলাম।
প্রথন বারের মত ১ নং সেক্টরের হেড কোয়ার্টার বাংলাদেশের ভেতরে পরশুরামে স্থাপিত হল। ঢাক – চট্টগ্রাম রোডের লম্বা যাত্রা পথে সেক্টর কমান্ডার মেজর এনামুল হোক চৌধুরীর সাথে দেখা হয়। তিনি ৩২ মাহারের সাথে যাচ্ছিলেন। দেখা হল গঙ্গাধর বাজারের কাছে। পথে সর্বাপুর ও অন্যন্য গুরুত্তপূর্ন ব্রিজ উড়িয়ে দেয়া হয়। নৌকায় জুরিন্দা দিয়ে ফেনী নদী পাড় হই। ৮ ডিসেম্বর মধ্য রাতে কারেরহাট পৌছাই।
৯ ডিসেম্বর সকালে আমাকে বলা হয় ৩২ মহার এর একটি দল মেজর ভাস্করের সাথে মেইন রোডে যেতে। ক্যাপ্টেন আলি নামে একজন আর্টিলাড়ি ও পি আমাদের সাঁথে ছিল। শত্রুরা ফেরার পথে আমাদের উপর বোমা বর্ষন করতে থাকে। যরাগঞ্জে পৌছাই ও আমার বাহিনী নিয়োগ করি। সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিক ও যরাগঞ্জে এম সি এ মীর মশাররফ হোসেন এখানে আমাদের সাথে যোগ দেন এবং আমাদের উৎসাহিত করেন। এহন ৩ টি দল তিন দিক দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। আমি আমার বাহিনী নিয়ে সীতাকুণ্ডের দিকে, মেজর গুরুংফ তার দল নিয়ে ঢাকা ট্রাঙ্ক রোড অক্ষে আর মেজর ভাস্কর রোডের ডান পাশ দিয়ে গ্রামের ভিতর দিয়ে।
সারা রাত হেঁটে ৩ টা ৪৫ মিনিটে আমি আমার বাহিনী নিয়ে বারাইয়াধালা র্যালি স্টেশনে পৌছাই। এখানে আমি আমার পুরনো বাহিনীকে খুঁজে পাই যারা লে রকিব, ফারুক ও শওকাতের সাথে অনেক আগেই বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল। সেটা ছিল অক্টোবরে। লে রকিব মীরের সরাইয়ে, লে ফারুক সীতাকুণ্ডে আর লে শাওকাত হাঁটহাজারিতে কাজ চালাচ্ছিলেন। আমি আমার পুরনো সাব সেক্টরের সবার সাথে দেখা হওয়ায় খুব অনন্দিত হলাম। লে শাওকাতের নাজিরহাটে কয়েকজন নিহত হওয়া ছাড়া বাকি সবাই অক্ষত আছে জেনে ভালো লাগলো।
সীতাকুণ্ডের প্রচুর শত্রু সৈন্য সমাবেশ হতে থাকল। এবার ব্রিগেডিয়ার আনাদ সরুম ৩২ মাহর কে একটি নতুন কাজ দিলেন। সীতাকুণ্ডের পিছন নিয়ে বাহিনী নিয়ে আমাকে যেতে বলা হল। মীর প্রকাশের অধীনে ৩১ যাতের একটি দলকে ভোর ৪ টার সময় রোড ব্লক করতে বলা হল – যাতে শত্রুরা পালিয়ে যেতে না পারে। লে কর্নেল হর গোবিন্দ সিং এর সাথে ৩২ মাহালের একটি দল ও মেজর গুরুং এর সাথে অন্য একটি দল সীতাকুণ্ড র্যালি স্টেশনে আক্রমণ করে। আক্রমণ রাতে করা হয়। এসময়ে অনেক সৈন্য অবস্থান ত্যাগ করেছিল। কিছু সৈন্য যারা আমাদের দিক দিয়ে পালানর চেষ্টা করছিল তাদেরকে আমরা আক্রমণ করি। কেউ নিহত হল, কেউ আত্ম সমর্পন করল। এখানে আমি লে মন্সুর ও লে ফারুক এর সাথে আবার দেখা হয়। তাদের সাথে আমি ৩ অক্ষে এগোতে থাকি। লে মন্সুর র্যালি লাইন, আমি ঢাকা ট্রাঙ্ক রোড ও লে ফারুক ডানে উপকূলীয় এলাকা দিয়ে এগোতে থাকি।
১৫ ডিসেম্বর আমরা কুমিরাতে পৌছাই এবং আমাদের সব সৈন্য সেখানে মোতায়েন করি। শত্রুরা আমাদের অবস্থানের উপর শেল নিক্ষেপ করছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে একটি শেল ক্যাপ্টেন আলির কাছে পরে। তিনি আমাদের আর্টিরালি ও পি – কিছুদিন ধরে আমাদের সাথে অপারেশন চালাচ্ছিলেন। তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান। আমার প্রথম এলাইড আর্টিলারি ও পি হল ক্যাপ্টেন দারকুন্দে – বেলনিয়াতে। ক্যাপ্টেন আলি ছিলেন আমাদের ২ য় আর্টিলারি যে আমার সাথে থাকত, ঘুমাত, খেত, অপারেশন করত এবং আমাদের মাটিতেই নিহত হল।
১৬ ডিসেম্বর ৭১, ৮ বিহারের লে কর্নেল বিশলা – যিনি ছিলেন আমার নিকটের সাব সেক্টর প্রতিবেশী – আমাকে অনুরধ করলেন তাকে সাহায্য করার জন্য এইবার চট্টগ্রাম শহর আক্রমণের ব্যাপারে। তার এলাকা ছিল ফয়েজ লেক – যেটা ছিল বিহারিদের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা যেখানে শত শত নিরীহ বাঙ্গালীকে জবাই করে মারা হয়েছে। ৩২ মাহারের সি ও আমাকে ছেড়ে যেতে চাইছিলেন না আর আমি আমার বাহিনীর সাথে মিশে গিয়েছিলাম। আমার সেক্টর কমান্ডারের অনুমতি ছাড়া আমি কাউকে সহায়তা করতে পারিনা। শত্রুরা তখনো এলোমেলো শেল নিক্ষেপ করে যাচ্ছিল। সর্বশেষ ভিক্টিম ছিলেন লে মন্সুরের বাহিনীর সুবেদার মাহফুজ ই পি আর। শেল পড়ার সাথে সাথে ঘটনাস্থলেই সে নিহত হয়। জেনারেল নিয়াজি তার বাহিনী নিয়ে আত্তসমর্পন করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হল।
এসডি / (মাহফুজুর রহমান)
৮ ই বেঙ্গল
২৫ আগস্ট, ১৯৭৩
নীলাঞ্জনা অদিতি
<১০, ২.৩, ৬৯–৭২>
সাক্ষাৎকারঃ নায়েক সুবেদার মনিরুজ্জামান
(২৪ আগস্ট ১৯৭৩)
৮ ই মে, সীমান্ত পার হয়ে ভারতে আশ্রয় নেই। হরিণাতে ২৪ ঘন্টা অবস্থানের পর মেজর জিয়াউর রহমানের আদেশে শুভপুর অঞ্চলে বল্লভপুর এলাকায় আসি। শুভপুর – বল্লভপুরে পাকসেনাদের সাথে ২২ দিন যুদ্ধ চলে। এখানে মেজর জিয়াউর রহমান ও ক্যাপ্টেন ঘোষ (BSF) যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন।
সংবাদদাতার মাধ্যমে জানতে পারলাম যে, পাকিস্তানী সৈন্যরা আমাদের উপর আক্রমণ চালাবে। যুদ্ধের শেষদিন রাতে তিনটা থেকে আমাদের মর্টার মেশিনগান দিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে ফায়ার শুরু করতে বাধ্য হই। ভোর ৫ টা থেকে ৮ টা পর্যন্ত আমাদের অন্যান্য ফোর্স শুভপুর হতে আমলীঘাট পর্যন্ত Defence Position ছাড়তে বাধ্য হয়। পাকিস্তানীদের Artillery 105mm এর গোলা মধুগ্রাম – আমলীঘাটে বৃষ্টির মত পরতে থাকে। আমাদের গোলাবারুদ শেষ করে আমরা সকাল ৯ টায় ভারতের আমলীঘাট এলাকাতে একত্রিত হই। ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন অফিসার ব্রিগেডিয়ার পান্ডের অধীনে আমাদের এক conference হয়। মেজর জিয়াউর রহমান ক্যাপ্টেন অলি ও অন্যান্য EPR বেঙ্গল রেজিমেন্টের JCO NCO এই conference এ উপস্থিত ছিলেন।
ব্রিগেডিয়ার পান্ডে বললেন যে, “আমার ৩০ বছরের চাকরী জীবনে অনেক বড় বড় যুদ্ধ দেখেছি কিন্তু শুভপুরের যুদ্ধের মত কোথাও দেখিনি। মুক্তিফৌজদের চিন্তার কোন কারণ নেই। এ হল যুদ্ধের প্রথম অধ্যায়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় এখনো বাকী আছে। যুদ্ধের দ্বিতীয় অধ্যায় আপনাদেরকে সম্পন্ন করতে হব। তৃতীয় অধ্যায়ে আপনারা অন্যের সাহায্য পেতে পারেন। বাংলাদেশের হিরো বানেগা ত মুক্তিফৌজ বানেগা। আওর কিছিকা হক নেহি হে। খোদা হাফেজ জয় বাংলা।
মেজর জিয়াউর রহমান আমাদের স্বান্তনা দেয়ার জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাদের সাথে ছিলেন। সন্ধ্যাবেলায় আমাদেরকে ঘন জঙ্গলের মধ্যে ক্যাম্প করার নির্দেশ দিয়ে তিনি চলে যান। ক্যাপ্টেন অলি আমাদের সাথে থেকে যান। এখানে কয়েকদিন অবস্থানের পর ছাগলনাইয়া থানার অন্তর্বর্তী চাঁদগাছী সাবসেক্টর গঠন করা হয়। এক কোম্পানি সৈন্য এবং Mortar Platoon নিয়ে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ১/ ২ তারিখে আমরা চাঁদ্গাছিতে Defence তৈরী করি। সেখান থেকে Commando Operation শুরু হয়ে যায়। ক্যাপ্টেন অলি Sub Sector Commander Second in Command ক্যাপ্টেন শহীদ শামসুল হূদা যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন যিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সদয় ব্যবহার করতেন। তিনি অত্যন্ত দয়ালু ছিলেন। যে কোন Operation কে জয়যুক্ত করতে তিনি নিজের সৈন্যদের উদবুদ্ধ করতেন এবং আপ্রাণ পরিশ্রম করতেন।
চাঁদগাজি ডিফেন্সে থাকাকালীন পাকিস্তানী সৈন্যদের এক ব্যাটেলিয়ান আমাদের উপর আক্রমণ করে (জুন মাসের ১৫ তারিখ)। সেই আক্রমণের দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়া হয়। পাকিস্তানী সৈন্যরা পিছু হটে যায়। সেইদিন আমাদের একটা Artillery Battery ছিল। ১৬ ই জুন পাকিস্তানী সৈন্যরা আবার এক ব্রিগেড সৈন্য নিয়ে আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। কিন্তু পাকিস্তানীরা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের অনেক লোক হতাহত হয়। পরাজয়ের গ্লাণি নিয়ে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। চাঁদ্গাছি দীঘিতে আমাদের Defence ছিল। দ্বিতীয় আক্রমণের দিন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সাবেক সিং উপস্থিত থেকে Command করেছিলেন।
১৬/১৭ জুন পাকিস্তানী সৈন্যরা সকাল ৮ টা থেকে তৃতীয়বার আক্রমণ শুরু করে। তৃতীয়বার আক্রমণে আমাদের Defence এর অবস্থানগুলোতে তারা fire করে। পাঁচ টার সময় তারা আমাদের Defence এর উপর রেকী আরম্ভ করে। তাদের একটা Commando Battalion হেলিকপ্টারযোগে আমাদের Defence এর তাদের সুবিধাজনক জায়গায় অবতরন করতে শুরু কর। তারা দালালদের মাধ্যমে propaganda করেছিল যে তাদের এক ব্যাটেলিয়ন commando তারা অবতরণ করাচ্ছে মুক্তিফৌজকে ধ্বংস করার জন্। রাত বারো টার সময় ক্যাপ্টেন শামসুল হূদার নির্দেশ অনুযায়ী Special Messenger আমাকে একটি চিঠি দেন। তাতে লেখাছিল এক ঘন্টার মধ্যে position ছেড়ে কৃষ্ণনগর বাজারে report করতে। সমস্ত গোলাবারুদ শেষ করে কৃষ্ণনগরে যাবার জন্য এই message পেয়ে messenger কে আমি গ্রেফতার করি এবং বললাম যে আমি নিজে শামসুল হূদার কাছে যাব এবং message clarify না করা পর্যন্ত তুমি এই জায়গা থেকে কোথাও যেতে পারবে না। আমি নিজে শামসুল হূদার সাথে সাক্ষাত করি। তিনি আমাকে বললেন “ এটা একটা আশ্চর্য ঘটনা।Defence ছাড়ার কথা আমি বলিনাই ব্রিগেডিয়ার সাবেক সিং বলেছেন।
আমার সন্দেহ হয়েছিল এটা পাকিস্তানি কোন গুপ্তচরের কাজ। ক্যাপ্টেন শামসুল হূদা টেলিফোনযোগে ব্রিগেডিয়ার সাবেক সিং কে বললেন যে আমাদের সৈন্যরা ডিফেন্স ছেড়ে যেতে রাজী নয়। এমতাবস্থায় আমি কি করব? ব্রিগেডিয়ার বললেন সবার কাছে আমার অনুরোধ জানিয়ে দেন তারা যেন অতি সত্বর নির্দিষ্ট স্থানে একত্রিত হয়ে যায় আমি সকালে তাদের সাথে সাক্ষাৎ করব। এই আদেশ অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা কৃষ্ণনগরে পৌঁছে।
ক্রিষনুগরে মেজর জিয়াউর রহমান উপস্থিত ছিলেন। তিনি একজন JCO কে জিজ্ঞেস করলেন Mortar Platoon? সে এখনো আসে নাই? সে বলল, এখনো আসে নাই। ঐ লোকটাকে জিয়াউর রহমান অত্যন্ত দুঃখের সাথে জিজ্ঞেস করলেন Mortar Platoon কে ছেড়ে তোমরা কেন এসেছ ? পরে আমি সেখানে পৌছলাম। জিয়াউর রহমান আমাকে জিজ্ঞেস করলেন মুনীর defence ছাড়তে কে বলেছে? আমি বললাম জানিনা স্যার। ক্যাপ্টেন হূদা মেজর জিয়াউর রহমান কে বললেন স্যার ভারতীয় সেনাবাহিনীর কমান্ডার আদেশে defence ছাড়তে হয়েছে। আপনি ব্রিগেডিয়ার সাবেক সিং এর সাথে এ ব্যপারে আলাপ করুন।
১৮ ই জুন ব্রিগেডিয়ারের একজন সহকর্মী অফিসার কৃষ্ণনগরে আসেন এবং বলেন যে, ব্রিগেডিয়ার সাহেব বিকেলে আসবেন। আপ্নারা কোন চিন্তা করবেন না। সমস্ত সৈন্য নিয়ে আমরা পংবাড়ি চলে গেলাম। সেখানে কিছুক্ষন অবস্থাণের পর ব্রিগেডিয়ার সাবেক সিং, মেজর জিয়াউর রহমান ক্যাপ্টেন রফিক। ক্যাপ্টেন অলি, ক্যাপ্টেন হূদা ক্যাপ্টেন হামিদ পংবাড়িতে আসেন। ব্রিগেডিয়ার সাবেক সিং প্রায় এক ঘন্টা সেখানে সবার উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেন। তিনি মর্টার কমান্ডোকে ডেকে পাঠান। ক্যাপ্টেন হামিদ আমাকে দেখিয়ে দেন। ব্রিগেডিয়ার আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন আব বহুত নারাজ হো গেয়া কিউ লরাই খতম নেহি হে বহুত লরাই কারনা হে। হাম পাকিস্তানী কা হাত মে ঘেরা জাওয়ান কো মারনে নেহি দেঙ্গা। তিনি আমাদের কে নানা উপদেশ দেন এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণে বাঙ্গালী অফিসারদের সাথে আলাপ আলোচনা করেন। সেখানে আমাদের সাধারন চা ও জলখাবার তিনি অত্যন্ত আনন্দের সাথে গ্রহণ করেন। তিনি একজন বিখ্যাত ও বিচক্ষণ সাহসী বুদ্ধিমান ও প্রকৃত কমান্ডার হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন।
পংবাড়িতে আমরা বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। পংবাড়ি থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলা কায়দায় অপারেশন চলতে থাকে। ছাগলনাইয়া থানা এলাকায় জুন মাসের শেষ ভাগে রিস্টমুখ / রিকশামুখ ক্যাম্প তৈরী করা হয়। এখানে অবস্থানকালিন গেরিলা যুদ্ধ চলতে থাকে। ১৪ আগস্ট ভোরবেলায় তিনটার সময় আমরা ক্যাপ্টেন হূদার আদেশে একটি কমান্ডো অপারেশন এর ব্যবস্থা গ্রহন করি। আমার মর্টার প্লাটুন চাঁদ্গাজিতে পাকিস্তানী সৈন্যদের ঘাঁটি আক্রমণের পরিকল্পনা নেয়। ভোর ৭ টা ৪০ মিনিটে আমার পায়ে একটা গুলি লাগে। তার ফলে আমার দ্বিতীয় ব্যক্তিকে দায়িত্ব দিয়ে আমি চিকিৎসা গ্রহণ করতে চলে যাই। সেইদিন পাক বাহিনীর মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই যুদ্ধের খবর বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল।
২৬ আগস্ট পাকিস্তানীরা ছাগলনাইয়া থানার আমজাদহাটে প্রতিরক্ষাব্যুহ তৈরী করে। মুক্তিযোদ্ধারা মর্টার প্লাটুনের সাহায্যে তাদের উপর গোলাবর্ষণ করে। পাকিস্তানিদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়। তারা মুহূরী নদী পার হয়ে খাদ্যদ্রব্য অস্ত্র শস্ত্র ফেলে পিছু হটতে থাকে। গুতুমা, পরশুরাম ছাগলনাইয়া অঞ্চলে এইভাবে যুদ্ধ চলতে থাকে। আমরা বিলেনিয়া এলাকাতে নোনাছড়ি ক্যাম্প স্থাপন করি। অক্টোবর মাসের ২০ তারিখ ১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিক সাহেবের আদেশে আমাকে Artillery OP ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৫৭ মাউন্টেন রেজিমেন্টে রিপোর্ট করতে হয়। সেখানে তিনদিন তাদের কমান্ড প্রসিডিউর শিক্ষা নিতে হয়। ২৪ অক্টোবর আমাকে অবজারভার ডিউটিতে পাঠানো হয়। সেটা হল কবেরহাটে পাক বাহিনীর সৈন্য অবস্থান, তার উপরে আর্টিলারির ফায়ার করানো – রাত দুইটার সময় নয়াটিলা অঞ্চল এলাকা থেকে ভোর ছটা থেকে আর্টিলারির ফায়ার করানো হয়। পাকিস্তানীদের অবস্থানগুলোর ওপর প্রথম মিডিয়াম রেজিমেন্টের ফায়ার আরম্ভ হয়। তখন আর্টিলারি কমান্ডিং অফিসার বলেছেন – “ আজ পাকিস্তানী কো মন ইয়াদ আয়েগা”।
আমার দায়িত্ব শেষ করে ২৪ ঘন্টা পরে আর্টিলারি কমান্ডারের কাছে পৌঁছি। কমান্ডিং অফিসার, ব্রিগেড কমান্ডার মেজর জেনারেল সেক্টর কমান্ডার সবাই আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। আমার সাথে সাক্ষাৎ হলে তারা আমাকে জিজ্ঞেস করেন এই কাজ সমাধা করতে আমার অসুবিধার কথা। পথে আমার অসুবিধার কথা তাদের বর্ণনা করলাম। সবকিছু বর্ণনা করা এখানে সম্ভব নয়।
ব্যাটারী কমান্ডার মেজর ওয়াতর সিং ক্যাপ্টেন বি কে ফালিয়া মেজর চৌধুরী তাঁদের সাথে অবস্থান করতে থাকি। তাঁরা আমাকে সর্বত ভাবে সাহায্য সহযোগীতা করেছেন। ১০ ই নভেম্বরে মুন্সিরহাট ফুলগাজি এই সমস্ত এলাকার যুদ্ধে পরশুরাম থানার অন্তর্গত অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছিল। কিন্তু পাক বাহিনী কোথা থেকে আক্রমণ চালাচ্ছে তার কোন সঠিক হদিস পাওয়া যাচ্ছিল না। তাদের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করলে একমাত্র OP ছাড়া কোন উপায় নেই। কমান্ডিং অফিসার সিদ্ধান্ত নিলেন পাক বাহিনীর অনুসন্ধান নিতে হবে। তিনি আমার কাছে জিজ্ঞেস করলেন মনির সাব কেয়া হোগা। আমি বললাম, আপনি আমাকে একটা ওয়ারলেস নিয়ে আবার আদেশ দেন আমি যাব। তিনি বললেন আপনার জীবনের ঝুঁকি কে নেবে ? আমি নিজেই ঝুঁকি নিয়ে যাব বলে বললাম। তিনি আমাকে বলেন নিজের ঝুঁকির কথা কাগজে লিখে দেয়ার জন্য। তিনি আমাকে একা যেতে দিলেন না। তারপর আমরা OP group চলে গেলাম সিদ্ধিনগর। একটা বৃক্ষের উপর রাত ১২ টা থেকে ভোর ৬ টা পর্যন্ত পাকিস্তানীদের অবস্থান জানার জন্য বসে থাকি। কিন্তু কোন সন্ধান না পেয়ে শেষ পর্যন্ত সেখান থেকে চলে গেলাম খেদাবাড়ি সৌভাগ্যবশত সেখান থেকে একটা উঁচু বৃক্ষ দেখতে পাই।
১৬ নভেম্বর আমরা artillery target record করছিলাম। দেখতে পেলাম ফেনী হতে একটা ট্রেন পরশুরামের দিকে যাচ্ছে। ট্রেন টা দেখে আমাদের অনেক সাহায্য হয়েছে। গাড়ি উত্তরদিকে যাচ্ছে। আমাদের কাজ অব্যাহত থাকে। Gun Ranging অবস্থায়। বোমা রেলওয়ে লাইনের ওপর পরে। রেল লাইনের একটা fish plate নষ্ট হয়ে যায়। ট্রেনটা যখন ফেরত আসে তখন ওখানে এসে তিনটা বগি পরে যায়। ওটা দেখে আমরা আশ্চর্য হয়ে যাই। পুরানো মুন্সিরহাটে পাকিস্তানীদের Artillery gun position এ মিত্রবাহিনীর গোলার আঘাতে gun position ও চালক উভয়েই ধ্বংস হয়।
১৭ ই নভেম্বর ভোর থেকে পাকিস্তানীরা মুন্সিরহাট ফুলগাজি পরশুরাম অঞ্চল ছেড়ে ফেনীর দিকে চলে যেতে বাধ্য হয়। ১৮ ই নভেম্বর ফুলগাজী মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। পাক বাহিনী ফেনী অঞ্চল থেকে long range কামানের সাহায্যে আত্মরক্ষা fire করে। এদিকে পরশুরাম অঞ্চলে পাক বাহিনীর ৬০/১০০ সৈন্য কয়েকজন অফিসার সহ মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। পাকিস্তানী সৈন্যগন ফেনী থেকে আর্টিলারি আক্রমন অব্যাহত রাখে। ১ লা ডিসেম্বর পর্যন্ত এভাবে যুদ্ধ চলতে থাকে।
আমি ২৭ শে নভেম্বর নিজের সেক্টরে ফেরত আসি। বর্তমানে নিজের মর্টার প্লাটুনের দায়িত্ব গ্রহন করি। মুন্সিরহাতের দক্ষিনে পাঠাননগরে অবস্থান করি। আমরা চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকি। ৩১ নম্বর জাঠ রেজিমেন্ট করেরহাট থেকে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
আমরা জোরারগঞ্জ মীরসরাই সীতাকুন্ড বারবকুন্ড কুমীরা ছোট কুমীরাতে ১৪ ই ডিসেম্বর রাতে ১২ ঘন্টা অবস্থান করি। ১৫ তারিখ ভোর ৩ টা থেকে অগ্রগতি শুরু হয়। সকাল ৭ টার সময় কুমীরা পৌঁছি। এখানে পাকিস্তানিদের সাথে তুমুল যুদ্ধ হয়। ৫৬ টা আর্টিলারি গান এর সাহায্যে আমাদের অগ্রগতি অব্যাহত থাকে। বেলা ৮ টার সময় কুমিরা টিবি হাসপাতাল পর্যন্ত পৌছলে পাকবাহিনী আত্মরক্ষা ফায়ার আরম্ভ করে যার ফলে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর অনেকে হতাহত হয়।
১৫ ই ডিসেম্বর বারটার সময় পাক বাহিনী আমাদের ওপর পালটা আক্রমনের প্রস্তুতি নেয়। রেকি গ্রুপ ধরা পরে। জাঠ রেজিনেন্টের মর্টারের ফায়ার। শেষবারের মত জয়ানরা ইচ্ছামত ফায়ার করে জয়যুক্ত হন। পাক বাহিনীর ঘাঁটিগুলোর ক্ষতিসাধন হয়। মেজর এডজ্যুটান্ট ৩১ জাঠ রেজিমেন্ট সংবাদ পাঠালেন মুক্তিবাহিনীকে মোবারকবাদ জানালেন।
১৬ ই ডিসেম্বর শুক্রবার পাক সেনারা আত্মসমর্পণ করে চট্টগ্রাম কুমীর সীতাকুন্ডে। চট্টগ্রামে মুক্তিবাহিনী উল্লাসে ফেটে পরে।
স্বাক্ষরঃ (এন এম মুনীরুজ্জামান)
২৪ – ৮ – ৭৩
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৩। ২ নম্বর সেক্টর ও ‘কে’ ফোর্সের যুদ্ধের বিবরণ। | সাক্ষাৎকারঃ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ* ১৯৭৪-১৯৭৫ |
……………… ১৯৭১ |
রানা আমজাদ <৭৩-৮৩>
ডাঃ মোঃ রাজিবুল বারী (পলাশ) <৮৪-১০৩>
ফকরুজ্জামান সায়েম < ১০৪- ১১৬>
মোঃ কাওছার আহমদ <১১৭-১১৯>
ডাঃ মোঃ রাজিবুল বারী (পলাশ) <১২০-১৩৬>
নীলাঞ্জনা অদিতি <১৩৬-১৪৫>
সাক্ষাৎকারঃ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ
সামগ্রিকভাবে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য আমি আমার যুদ্ধের এলাকাকে কয়েকটি সাব-সেক্টর-এ বিভক্ত করে নেই। আমার সাব-সেক্টরগুলি নিম্নলিখিত জায়গায় তাদের অবস্থান গড়ে তুলি।
(ক) গঙ্গাসাগর, আখাউড়া এবং কসবা সাব-সেক্টরঃ এর উপ-অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন। তার সঙ্গেছিল লেঃ ফারুক, ক্যাপ্টেন মাহবুব এবং সেকেন্ড লেঃ হুমায়ূন কবির। এখানে ৪র্থ বেঙ্গলের ডেল্টা কোম্পানী এবং ই, পি, আর-এর দুটি কোম্পানী ছিল। এদের সঙ্গে মর্টারের একটা দল ছিল। এই সাব সেক্টর কসবা, আখাউড়া, সাইদাবাদ, মুরাদনগর, নবীনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পর্যন্ত তাদের অপারেশন চালাত।
(খ) দ্বিতীয় সাব-সেক্টর ছিল মন্দভাগেঃ এর উপ-অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন গাফফার (বর্তমানে মেজর)। তার অধীনে চার্লি কোম্পানী এবং একটা মর্টারের দল ছিল। এ দলটি মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশন হতে কুটি পর্যন্ত তাদের অপারেশন চালাতো।
(গ) তৃতীয় সাব-সেক্টরে ছিল শালদা নদীঃ এর উপ-অধিনায়ক ছিলেন মেজর আবদুস সালেক চৌধুরী (মরহুম)। এর অধীনে এ কোম্পানী এবং ই,পি,আর-এর একটা কোম্পানী ছিল। এ দলটি শালদা নদী, নয়নপুর এবং বুড়িচং এলাকা পর্যন্ত তাদের অপারেশন চালাত।
(ঘ) চতুর্থ সাব-সেক্টর ছিল মতিনগরেঃ কমান্ডে ছিল লেঃ দিদারুল আলম। হেডকোয়ার্টার কোম্পানীর কিছুসংখ্যক সৈন্য এবং ই,পি,আর-এর একটা কোম্পানী গোমতীর উত্তর বাঁধ থেকে কোম্পানীগঞ্জ পর্যন্ত এই সাব-সেক্টরে অভিযান চালাতো।
(ঙ) গোমতীর দক্ষিণে ছিল নির্ভয়পুর সাব-সেক্টরঃ এর উপ-অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন আকবর এবং লেঃ মাহবুব। এ দলটির অপারেশন কুমিল্লা থেকে চাঁদপুর এবং লাকসাম পর্যন্ত ছিল।
(চ) রাজনগর সাব-সেক্টর ছিল সর্বদক্ষিণেঃ এ সাব-সেক্টরের উপ-অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম, ক্যাপ্টেন শহীদ এবং লেঃ ইমামুজ্জামান। এই সাব-সেক্টর বেলুনিয়া, লাকসামের দক্ষিণ এলাকা এবং নোয়াখালীতে অপারেশন চালাতো। এই সাব-সেক্টরে ৪র্থ বেঙ্গল এর ‘বি’ কোম্পানী, ই, পি, আর-এর ১টি কোম্পানী ও গণবাহিনীর লোক নিয়ে তৈরি এক সদ্যগঠিত কোম্পানী। জুলাই মাসে পাকিস্তানী সেনারা কসবা এবং মন্দভাগের পুনঃদখলের প্রস্তুতি নেয় এবং কুটিতে ৩১তম বেলুচ রেজিমেন্টের বাহিনী এবং গোলন্দাজ বাহিনী সমাবেশ করে। ক্যাপ্টেন গাফফারের অধীনে মন্দভাগ সাব-সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুসেনাদের মোকাবেলার জন্য তৈরি ছিল। জুলাই মাসের ১৯ তারিখে শত্রুসেনারা একটা কোম্পানী নিয়ে শালদা নদীতে নৌকাযোগে অগ্রসর হয়। সুবেদার ওহাবের নেতৃত্বে মন্দভাগ সাব-সেক্টরের একটা প্লাটুন মন্দভাগ বাজারের নিকট শত্রুদের এই অগ্রবর্তী দলটির উপর প্রচণ্ড আঘাত হানে। এ সংঘর্ষে শত্রুসেনারা সম্পূর্ণ হতবুদ্ধি হয়ে যায়। শালদা নদীর তীর থেকে সুবেদার ওহাবের প্লাটুন্টি শত্রুসেনার উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে অন্ততঃপক্ষে ৬০/৭০ জন লোক হতাহত হয় এবং অনেকেই নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ হারায়। এই আক্রমণে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা ৩১তম বেলুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ক কর্নেল কাইয়ূম, ৫৩ তম গোলন্দাজ বাহিনীর কুখ্যাত অফিসার ক্যাপ্টেন বোখারী, আরো তিন-চারজন অফিসার এবং ৮/১০ জন জুনিয়র অফিসার প্রাণ হারায়। ক্যাপ্টেন বোখারী ২৫ মার্চের পর থেকে কুমিল্লা শহরে অনেক হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী ছিল। তার মৃত্যুতে কুমিল্লাবাসীরা অত্যন্ত আনন্দিত হয়। শত্রুসেনারা শালদা নদীতে এই বিরাট পর্যুদস্তের পর তাদের বাহিনীকে পিছু হটিয়ে কুটিতে নিয়ে যায়। এবং আমি আমার ঘাঁটি মন্দভাগ ও শালদা নদীতে আরো শক্ত করে তুলি।
পাকিস্তানের ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলওয়ে লাইন সম্পর্কে জেনারেল টিক্কা খাঁ দম্ভ করে ঘোষণা করেছিল যে ওটা জুলাই মাসের মধ্যে খুলবে। তাঁর সেই আশা চিরতরে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। পাকিস্তান আমলে এই রেললাইনে ট্রেন চলেনি। ইতিমধ্যে জুলাই মাসে আমি খবর পাই যে, পাকবাহিনী বেলুনিয়াতে ঢোকার চেষ্টা করছে। আমি ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম কে নির্দেশ দেই যেন তাদেরকে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। এ সময় ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম ছাগলনাইয়াতে পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। পাকবাহিনী ছাগলনাইয়ার উপরে ফেনীর দিক থেকে চট্টগ্রাম সড়কের উপর আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে তাদের ২০/২৫ জন লোক হতাহত হয়। শত্রুসেনারা পিছু হটে যায়। কিন্তু তাঁর কয়েকদিন পরে পাকসেনারা ছাগলনাইয়ার দক্ষিণ থেকে ফেনী-চট্টগ্রাম পুরনো রাস্তায় অগ্রসর হয়। এবং ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের সৈনিকদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। আমাদের কিছুসংখ্যক হতাহত হওয়ায় এবং শত্রুদের গোলার মুখে টিকতে না পেরে ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম আমার কাছে পরবর্তী কর্মপন্থার নির্দেশ চেয়ে পাঠান। আমি ক্যাপ্টেন জাফর ইমামকে বলি ছাগলনাইয়া থেকে তাঁর সৈন্যদের সরিয়ে বেলুনিয়ার সাব-সেক্টর রাজনগরে আনার জন্য। আমাদের এই মুভে বেলুনিয়াতে অবস্থিত শত্রুসেনারা ঘিরে যাওয়ার আতঙ্কে বেলুনিয়া থেকে ফেনীতে পশ্চাদপসরণ করে এবং ফেনীতে তাদের প্রধান ঘাঁটি গড়ে তোলে। বেলুনিয়া শত্রুমুক্ত হওয়ায় আমি আমি বেলুনিয়াকে শত্রুকবল থেকে মুক্ত রাখার দৃঢ়মনস্থ করি। ক্যাপ্টেন জাফর ইমামকে বান্দুয়াতে (ফেনী থেকে ২ মাইল উত্তরে) এবং ইমামুজ্জামানকে তাদের নিজ নিজ কোম্পানী নিয়ে প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করার নির্দেশ দেই। বান্দুয়াতে সম্মুখবর্তী অবস্থান গড়ার পথ মুন্সিরহাটে ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের অধীনে আমার সেনাদল বেশ মজবুত প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তোলে। বেলুনিয়া একটি ১৭ মাইল লম্বা এবং ১৬ মাইল চওড়া বাঙ্কার। এই বেলুনিয়াতে আমরা যে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তুলি সে প্রতিরক্ষাব্যূহকে ধ্বংস করার জন্য পাকসেনারা এর পর থেকে যথেষ্ট চেষ্টা চালিয়ে যায়। পরবর্তীকালে অনেক যুদ্ধে তাদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি এবং সৈন্য হতাহত হয়। বেলুনিয়া সেক্টর পাকসেনাদের জন্য ভয়ংকর বিভীষিকা রূপ ধারন করে। এর সঙ্গে সঙ্গে এই স্থানের জনসাধারণও যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি ও কষ্ট স্বীকার করে। এখানকার জনসাধারণের কষ্টকে ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। পাকবাহিনীর গোলার আঘাতে প্রতিটি বাড়ি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ও অনেক নিরীহ লোক মারা যায়। কিন্তু স্থানীয় জনসাধারণ কোনদিনও তাদের মনোবল হারায়নি। যুদ্ধ যতদিন চলে ততদিনই তারা মুক্তি বাহিনীর অসামরিক ব্যবস্থাপনায় হাসিমুখে সাহায্য করে। অনেকক্ষেত্রে তারা সেনাবাহিনীর সাথে সাথে রক্ষাবুহ্য শক্তিশালী করার জন্য পরিখা খননে ও অন্যান্য কাজে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাহায্য করে। মে মাসে আমাদের মুন্সিরহাট ডিফেন্স এবং বান্দুয়ার অবস্থানটি বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠে। এ জায়গাটি আমরা এজন্যে প্রতিরক্ষা ঘাঁটির জন্য মনোনিত করেছিলাম। জায়গাটার সামনে কতগুলো প্রাকৃতিক বাধাবিঘ্ন ছিল যেগুলি শত্রুসেনার অগ্রসরের পথে বিরাট বাধাস্বরূপ। এতে শত্রুসেনাদের নাজেহাল করার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। আমাদের অবস্থানটি মুহুরী নদীর পাশ ঘেঁষে পশ্চিম দিক থেকে ছিলোনিয়া নদীকে ছাড়িয়ে পশ্চিম সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ব্যূহটি কমপক্ষে ৪ মাইল চওড়া ছিল। আমরা এই অবস্থানটি এইভাবে পরিকল্পনা করেছিলাম যে, শত্রুসেনাদের বাধ্য হয়ে আমাদের ঘাঁটি আক্রমণ করার সময় প্রতিরক্ষার শুধু সামনে ছাড়া আর কোন উপায়ে আসার রাস্তা ছিলনা। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী শত্রুসেনাদের আসার মনোনীত জায়গাগুলোতে এলে সবচেয়ে বেশি ধ্বংস করা যায়। পরবর্তীকালে আমাদের এ পরিকল্পনা ঠিকই কাজে লেগেছিল। যেসব জায়গা দিয়েই শত্রুরা আসার চেষ্টা করেছে যথেষ্ট হতাহত হয়েছে। এই সেক্টরে প্রথমে আমাদের সৈন্যসঙ্খ্যা ছিল দূ’কোম্পানী(৩০০ জনের মত) এবং কিছুসংখ্যক গণবাহিনী। শত্রুওসংখ্যা আমাদের চেয়ে সব সময় বেশীছিল এবং এছাড়া শত্রুদের ছিল শক্তিশালী অস্ত্র, গোলাবারুদ, বিমান বাহিনী ও ট্যাংক। আমাদের মুন্সিরহাটে প্রধান ঘাঁটি সম্বন্ধে শত্রুদের ধোঁকা দেওয়ার জন্য বন্দুয়া রেলওয়ে স্টেশনের কাছে ছিলোনিয়া নদীর উপর একটি অগ্রুবর্তী ঘাঁটি স্থাপনের নির্দেশ দেই। এটা ছিল ডিলেয়িং পজিশন। এ পজিশনের সামনে রাস্তা ও রেলের সেতুগুলি ধ্বংস করে দেয়া হয় যাতে শত্রুদের অগ্রসরে আরো বাধার সৃষ্টি হয়। শত্রুসেনার সম্ভবত অগ্রসরের রাস্তার পশ্চিম এবং পূর্ব পার্শ্বে রাস্তার দিকে মুখ করে আমরা বেশ কতগুল উঁচু জায়গায় এবং পুকুরের উঁচু বাঁধে শক্ত এবং মজবুত বাঙ্কার তোইরি করি এবং তাতে হালকা মেশিনগান এবং মেশিনগান লাগিয়ে দেই। এ ছিল একরকমের ফাঁদ যাতে একবার অবস্থানের ভিতরে অগ্রসর হলে দু’পাশের গুলিতে শত্রুসেনারা ফিরে যেতে না পারে। এসব বাঙ্কার এমনভাবে লুকানো ছিল যে সম্মুখ থেকে বোঝার কোন উপায় ছিল না।
৭ই জুনের সকাল। আমরা জানতে পারলাম শত্রুসেনারা ফেনী থেকে বেলুনিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ১০টার দিকে বন্দুয়ার আশে পাশে শত্রুসেনারা এসে জমা হতে লাগলো এবং প্রথম্বারের মত আমাদের পজিশনের উপর গোলাগুলি চালাতে লাগলো। আমার নির্দেশ ছিল যে শত্রুদের এই গোলাগুলির কোন জবাব যেন না দেয়া হয়। শত্রুসেনারা বন্দুয়া সেতুর উপর একটা বাঁশের পুল নির্মাণ করে যেমনি পার হওয়ার চেষ্টা করছিল, ঠিক সে সময় আমাদের অগ্রবর্তী ডিলেয়িং পজিশনের বীর সৈনিকরা তাদের উপর গুলি চালায়। এতে প্রথম সারিতে যে সব শত্রুসেনা সেতু অতিক্রম করার চেষ্টা করে তারা সবাই গুলি খেয়ে পানিতে পড়ে যায়। এ পর্যায়ে শত্রুসেনাদের অন্তত ৪০/৫০ জন লোক হতাহত হয়। এরপর শত্রুসেনারা পিছে হতে যায়। কিছুক্ষণ পর আবার প্রবল গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় তীব্র আক্রমণ চালায়। আমাদের ডিলেয়িং পজিশনের সৈনিকরা শত্রুদের আরো বহুসংখ্যক লোক হতাহত করে বীরত্বের সাথে আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকে কিন্তু আক্রমণ যখন আরও তীব্ররূপ ধারণ করে ডিলেয়িং পজিশন কে তারা পরিত্যাগ করে প্রধান ঘাঁটি মুন্সিরহাটে পিছু হটে আসে। শত্রুরা কিছুটা সফলতা লাভ করায় আরো প্রবল বেগে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং ছিলোনিয়া নদী পর্যন্ত অগ্রসর হয়। এখানে এসে তারা নদী পার হওয়ার সকল প্রস্তুতি নেয়। আমাদের প্রধান ঘাঁটি থেকে ৮০০ গজ সামনে আনন্দপুর নামক গ্রামে শত্রুসেনারা তাদের সমাবেশ ঘটাতে থাকে। নদী পার হয়ে আমাদের আক্রমণ করার জন্য শত্রুরা সকল প্রস্তুতি নিতে থাকে। নদী পার হবার পূর্ব মুহূর্তে কামানের সাহায্যে আমাদের ঘাঁটির উপর তারা প্রবল আক্রমণ আরম্ভ করে। তারা বৃষ্টির মতো গোলা আমাদের অবস্থানের উপর ছুড়ছিল। এ আকস্মিক আক্রমণ চালানোর উদ্দেশ্য আমরা ভালভাবেই বুঝতে পারছিলাম। এই সুযোগে পাকসেনারা নদী পার হবার জন্য নৌকা এবং বাঁশের পুলের সাহায্যে এগিয়ে আসতে থাকে। যদিও আমরা শত্রুদের কামানের গোলায় যথেষ্ট বিপর্যস্ত ছিলাম তবুও মানসিক দিক দিয়ে আমাদের সৈন্যদের মনোবল ছিল বিপুল। ওদের বেশ সংখ্যক সৈন্য নদী পার হয়ে আমাদের অবস্থানের ২০০/৩০০ গজ ভিতরে চলে আসে এবং কিছুসগখ্যক তখনও নদী পার হচ্ছিল। ঠিক সেই সময়ে আমাদের মর্টার এবং মেশিনগান গর্জে উঠে। আমাদের এ অকস্মাত পাল্টা উত্তরে শত্রুসেনারা অনেক হতাহত হতে থাকে। তবুও তারা বাধা বিপত্তি ডিঙ্গিয়ে প্রবল বেগে অগ্রসর হতে থাকে। আর আমাদের সৈনিকরাও তাদের ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতি করতে থাকে। তবুও টাটা নিঃসহায় অবস্থাতে ও দক্ষতার সাথে অগ্রসর হতে থাকে। কিন্তু আল্লাহ হয়তো অদের সহায় ছিলেন না। এ স্ময়ে তারা আমাদের সামনের মাইন ফিল্ডের মুখে এসে পড়ল। তাদের পায়ের চাপে একটার পর একটা মাইন ফাটতে আরম্ভ করলো। আমাদের চোখের সামনে অনেক শত্রুসেনা তুলোর মত উড়ে যেতে লাগলো। আমাদের গোপনে অবস্থিত পাশের মেশিনগাঙ্গুলির বৃষ্টির মতো গুলি ও মাইনের আঘাত তাদের মধ্যে একটা ভয়াভহ বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। শধু কয়েকজন শত্রু এসব বাধাবিপত্তির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে আমাদের কয়েকটি অগ্রবর্তী বাঙ্কারের সামনে পর্যন্ত পৌছায়, কিন্তু আমাদের সৈনিকরা গ্রেনেড হাঁতে তাদের জন্য প্রস্তুত ছিল এবগ তারা সেখানেই আমাদের গ্রেনেডের মুখে ধ্বংস হয়। এই বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে শত্রুসেনারা আর সামনে এগোতে সাহস পায়নি। যারা পিছনে ছিল তারাও এই সংকট জনক অবস্থা এবং ভয়াবহতা বুঝতে পেরে পিছন দিকে পলায়ন করতে শুরু করে। শত্রুসেনাদের পালাতে দেখে আমাদের সৈনিকরাও উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠে এবং আরো প্রবল গতিতে তাদের গুলি করে মারতে থাকে। আমাদের মর্টারও পসগচাদপসরণরত শত্রুদের উপর অনবরত আক্রমণ চালিয়ে তাদের হতাহত করতে থাকে। আমাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়ে ওদের খুব কম সৈন্য ছিলোনিয়া নদীর অপর পারে পিছু হটে যেতে সক্ষম হয়। এ সময় আমাদের উপর শত্রুসেনারা অনবরত কামানের গোলা চালিয়ে যাচ্ছিল যাতে তাদের বিপর্যস্ত ও পর্যুদস্ত যে সমস্ত অবশিষ্ট সৈনিক ছিল তারা নিরাপদে আরো পশ্চাৎঘাঁটি আনন্দপুর পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। এর কিছু পরে দুটোর সময় তাদের গোলন্দাজ বাহিনীর গোলাগুলি বন্ধ হয়ে যায়। সমস্ত যুদ্ধক্ষেত্রে নীরবতা নেমে আসে। আমরা কিছুক্ষণ আবার তাদের পুনঃআক্রমনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি কিন্তু পরে জানতে পাই যে তাদের অবস্থা সত্যি বিপর্যস্ত এবং তাদের মনোবল একেবারেই ভেঙ্গে গেছে। পুনঃআক্রমণের শক্তি আর তাদের নেই। সমস্ত যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের অন্ততঃপক্ষে ৩০০ জনের মৃতদেহ পাওয়া যায় এবং ছিলোনিয়া নদীতে কত ভেসে গেছে সেটারও হিসাব আমরা পাই না। পরে জানতে পারি যে পাকিস্তানীরা একটা ব্যাটালিয়নের চেয়েও বেশি সৈন্যদল নিয়ে এ আক্রমণ চালিয়েছিল এবং ব্যাটালিয়নের ৬০ ভাগের মত লোক নিহত বা আহত হয়েছে। এদের অনেকের কবর এখনও ফেনীতে আছে।
এর পর থেকে শত্রুসেনারা আনন্দপুরে স্থায়ী ঘাঁটি করার জন্য বাঙ্কার খোঁড়ার কাজ শুরু করে দিল। আস্তে আস্তে ওদের সৈন্যসংখ্যাও অনেক বেড়ে যেতে লাগল। আমরা খবর পেলাম ওরা প্রচুর অস্ত্র এবং নতুন সৈন্য চট্টগ্রাম এবং ঢাকা থেকে এনে সমাবেশ করছে। সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর কামান ও ট্যাঙ্ক তারা নিয়ে এসেছে। ৭ই জুনের বেলুনিয়া যুদ্ধের পর তাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এবং হতাহতের সংখ্যা দেখে পাকিস্তানীরা বুঝতে পেরেছিল যে আমি এই জায়গাতে তাদের সঙ্গে আবার সম্মুখ সমরে যুদ্ধের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং সে জন্য আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদেরকে আমি ফাঁদে ফেলার জন্য তৈরি ছিলাম। পাকসেনারা আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী অগ্রসর হয়ে সে ফাঁদে পা দিয়ে যথেষ্ঠ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। সেই কারণে ভবিষ্যতে যাই করুক খুব সতর্কতার সাথে কাজ করার প্রস্ততি নিতে থাকে। বেলুনিয়ার বিপর্যয় পাকিস্তানী সেনাদের সবাইকে বিচলিত করে তোলে। তারা এই সিদ্ধান্ত নেয়, যে কোন উপায়ে বেলুনিয়াকে পুর্নদখল করতেই হবে। তাই তাদের সৈন্য সমাবেশ চলতে থাকে। জেনারেল আব্দুল হামিদ খান, চীফ অফ স্টাফ স্বয়ং জুলাই মাসে ফেনীতে আসেন বেলুনিয়া যুদ্ধের প্রস্তুতি এবং পরিচালনার জন্য। আমি আমার প্রতিরক্ষার অবস্থান আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা করি। মন্দভাগ থেকে ক্যাপ্টেন গাফফারকে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট-এর ‘সি’ কোম্পানী নিয়ে এবং আরো কিছু মর্টার নিয়ে বেলুনিয়া সেক্টরে গিয়ে প্রতিরক্ষাব্যূহ আরো শক্তিশালী করে তোলার নির্দেশ দেই। যেহেতু আমার কাছে আর কোন সৈন্য ছিল না, তাই আমি এ তিনটি কোম্পানী দিয়ে জাফর ইমামকে শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য তৈরী থাকার নির্দেশ দেই। শত্রুরা আমাদের প্রতিরক্ষা থেকে মাত্র ৮০০ গজ দূরে গতিয়ানালার অপর পারে তাদের প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছিল। উভয়পক্ষে অনবরত গোলাগুলি বিনিময় হত, আর তাছাড়া শত্রুদের গোলন্দাজ বাহিনী আমাদের ঘাঁটির উপর অবিরাম শেলিং চালিয়ে যেত। আমাদের সৈনিকদের বাঙ্কার ছেড়ে বাইরে চলাফেরার উপায় ছিল না। কিন্তু শত্রুর এই গোলাগুলির এবং আর্টিলারী ফায়ারিং-এর মধ্যেও আমাদের বীর বঙ্গশার্দুলরা তাদের মনোবল হারায়নি এবং এতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। তারা এ গোলাগুলিকে যুদ্ধক্ষেত্রে বাজনার মত মনে করত। মাঝে মাঝে আমাদের সৈনিকরা পরিত্যক্ত গ্রামের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে শত্রুদের অনেক হতাহতও এবং অনেক সময় ১০৬ মিলিমিটার ট্যাঙ্কবিধ্বংসী-কামানের সাহায্যে তাদের বাঙ্কার উড়িয়ে দিয়ে আসত। এসব আকস্মিক আক্রমণাত্নক কার্যে শত্রুরা যথেষ্ট ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ত এবং তাদের যথেষ্ট হতাহত হত। তারপরই তারা শুরু করত গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে অবিরাম বৃষ্টির মত গোলাগুলি। এভাবে জুলাই মাসের ১৭ তারিখ পর্যন্ত চলল। পাকিস্তানীদের যুদ্ধের প্রস্তুতি দেখে ঐ এলাকার জনমনে যথেষ্ট ত্রাসের সৃষ্টি হয়। প্রথমবারের আক্রমণে যদিও জনসাধারনের বেশী ক্ষতি হয়নি, সেহেতু সেবার শত্রুসেনারা ছিল আমাদের হাতে পর্যুদস্ত। যুদ্ধের বিভীষিকা তারা প্রত্যক্ষভাবে সেবার দেখেছিল, কিন্তু এবারের পাকবাহিনীর প্রস্তুতির খবরে সত্যি তারা চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। এ সময় ছিল ভরা বর্ষা। সব জায়গাতে ছিল পানি। পানি ভেঙ্গে ছেলেমেয়ে নিয়ে শত্রুদের অকস্মাৎ আক্রমণের মুখে নিরাপদ জায়গায় সরে যাওয়া অসম্ভব হতে পারে। এ জন্য আমরা স্থানীয় লোকদের নির্দেশ দেই যাতে তারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আগেই দূরে সরে যায় বা সরে যেতে পারে। কেউবা সেচ্ছায় আর কেউবা নিরুপায় হয়ে বিপদের ঝুঁকি নিয়ে স্ব স্ব স্থানে রয়ে যায়। আমাদের সৈনিকরা প্রতিরক্ষাব্যূহের উন্নতি চালিয়ে যেতে থাকে। যে সব জায়গাতে শত্রুদের আমাদের অবস্থানের ভিতরে অগ্রসর হওয়ার সম্ভাবনা ছিল আমরা সেসব জায়গাতে মাইন লাগাতে থাকি। ১৭ জুলাই রাত ৮টায় আমাদের উপর শত্রুরা অকস্মাৎ আক্রমণ শুরু করে দেয়। প্রায় আধাঘন্টা পর তিনটা হেলিকপ্টার আমাদের অবস্থানের পাশ দিয়ে পিছনের দিক চলে যায়। চারিদিকে অন্ধকার ছিল এবং সঙ্গে সঙ্গে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। হেলিকপ্টারগুলো অবস্থানের পিছনে অবতরণ করার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের সৈনিকরা বুঝতে পেরেছিল যে শত্রুসেনারা প্রতিরক্ষা ব্যূহের পিছনে ছত্রীবাহিনী নামিয়েছে। আমাদের অগ্রবর্তী অবস্থানগুলো থেকেও খবর আসতে লাগল যে শত্রুরা মুহুরি ও ছিলোনিয়া নদীর পাড় দিয়ে এগিয়ে আসছে। ওদের সঙ্গে ট্যাঙ্কও আছে। অবস্থানের সামনে বিপুল সৈন্য নিয়ে শত্রুর আক্রমণের প্রতিরক্ষা আর পিছনে তাদের ছত্রীবাহিনী আমাদের সৈনিকদের পিছন থেকে ঘিরে ফেলার জন্যও প্রস্তুত। এরকম একটা সংকটময় অবস্থাতেও ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম এবং ক্যাপ্টেন গাফফার এবং লেঃ ইমামুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন শহীদের নেতৃত্বে সামান্য শক্তি নিয়েও যুদ্ধের জন্য আমাদের সৈনিকদের মনোবল ছিল অটুট। আমার সব অফিসার ঐ চরম মূহুর্তে তাদের সাহস এবং দৃঢ়প্রত্যয়ের পরিচয় দিয়েছিল। রাত তখন সাড়ে ৯টা। বৃষ্টি বেশ একটু জোরালো হয়ে উঠেছে। শত্রুরা তাদের অগ্রসর অব্যাহত রেখেছে। এ সময়ে ক্যাপ্টেন গাফফারের অবস্থানের পিছন থেকে শত্রুরা হামলা চালায়। ক্যাপ্টেন গাফফার এবং তার সৈনিকরা বীরত্বের সাথে শত্রুসেনাদের হামলা মোকাবেলা করে। প্রায় ১ ঘন্টা যুদ্ধের পর শত্রুসেনারা বেশ কিছু হতাহত সৈনিক ফেলে ক্যাপ্টেন গাফফারের অবস্থান থেকে বিতাড়িত হয়ে যায়। এ সময় ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের কোম্পানীর সামনেও শত্রুরা আক্রমণ চালায়। শত্রুদের ট্যাঙ্কগুলিও আস্তে আস্তে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে আসছিল। শত্রুদের কামানের গুলি সমস্ত অবস্থানের উপর এসে পড়ছিল। লেঃ ইমামুজ্জামান,যাঁর কোম্পানী সবচেয়ে বামে ছিল, সেখানেও শত্রুরা আস্তে আস্তে চাপ দিতে থাকে। ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম আমাকে এ পরিস্থিতির কথা জানায়। আমি বুঝতে পারলাম যে শত্রুসেনারা ডানে, বামে হেলিকপ্টারের সাহায্যে আমার প্রতিরক্ষাব্যূহের পিছনে পজিশন নিয়েছে এবং আস্তে আস্তে আমার সমস্ত ট্রুপসদের ঘিরে ফেলার মতলব এঁটেছে। শত্রুর চাপ আস্তে আস্তে বেড়েই চলছিল। উভয়পক্ষেরই হতাহত ক্রমেই বেড়ে চললো। তাদের অনেকেই আমাদের মাইন ফিল্ডের ভিতরে পড়ে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছিল, কিন্তু তবুও তারা অগ্রসর হচ্ছিল। ইতিমধ্যে আমার ৫ জন লোক নিহত ও ৩৫ জন লোক আহত হয়। এই অন্ধকারে সমস্ত অবস্থান জুড়ে চলছিল সম্মুখসমরে হাতাহাতি যুদ্ধ। যদিও শত্রুদের ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা আমাদের চেয়ে অনেক বেশী হচ্ছিল, তবুও আমার পক্ষে ৩০/৪০ জন- হতাহতের পরিমাণ খুবই মারাত্নক ছিল। তাছাড়া আমার সৈন্যসংখ্যা ছিল অনেক কম আর অস্ত্রশস্ত্রেও ছিলাম আমি তাদের চেয়ে অনেক দূর্বল। আমি বুঝতে পারলাম সকাল পর্যন্ত তারা যদি আমাকে এভাবে ঘিরে রাখতে পারে, তাহলে তাদের বিপুল শক্তিতে দিনের আলোতে এবং ট্যাংক ও কামানের গোলায় আমার সৈন্যদের সম্পূর্নরূপে ধ্বংস করে দেবে।
রাতের অন্ধকারে তাদের ট্যাঙ্ক এবং কামানের গোলা আমাদের উপর কার্যকরী হয়নি। কিন্তু দিনের আলোতে এসব অস্ত্র আমার অবস্থানের জন্য মারাত্নক হয়ে দাঁড়াবে। আমি ক্যাপ্টেন জাফর ইমামকে বর্তমান অবস্থান থেকে ডাইনে বা বামে সরে গিয়ে শত্রুদের এড়িয়ে পিছনে এসে চিতুলিয়াতে নতুন প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরী করার নির্দেশ দেই। এ নির্দেশ অনুযায়ী রাত ১টায় ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম, ক্যাপ্টেন শহীদ এবং ক্যাপ্টেন গাফফার তাদের স্ব স্ব দল নিয়ে শত্রুদের এড়িয়ে চিতুলিয়াতে নতুন প্রতিরক্ষা অবস্থানে পৌঁছে। পৌছার সঙ্গে সঙ্গে নতুন অবস্থানের জন্য তৈরী শুরু হয়ে যায়। তখন সকাল ৯টা কি ১০টা। আমি নিজেই যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিলাম লেঃ ইমামুজ্জামান এবং তার দলটি না পৌঁছানোর জন্য। যখন প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরী চলছিল আমি তিন-চারজন সিপাই সঙ্গে নিয়ে আগে অগ্রসর হয়ে যাই- শত্রুদের সম্বন্ধে জানবার জন্য। চেতুলিয়া থেকে বেশ কিছু দূর আগে মুন্সিরহাটের নিকট যেয়ে দেখতে পাই যে শত্রুরা সকাল পর্যন্ত মুন্সিরহাটে রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত দখল করে নিয়েছে এবং এর আগে আর অগ্রসর হওয়ার সাহস করেনি। তারা ভাবছিল যে আমাদের পিছনের পজিশনগুলো হয়ত এখনও আছে। আমরা যে রাত্রে এসব ঘাঁটি ত্যাগ করে চেতুলিয়াতে নতুন ব্যূহ রচনা করেছি এ সম্বন্ধে তারা সকাল ১০টা পর্যন্ত জানতে পারেনি এবং তারা খুব সতর্কতার সাথে অগ্রসর হচ্ছিল। আমি প্রায় ১টা পর্যন্ত আমার রেকি বা অনুসন্ধান শেষ করে চেতুলিয়াতে ফেরত আসি, ঠিক এই মুহূর্তে শত্রুদের আরো তিন চারখানা হেলিকপ্টার আসে এবং আমাদের অবস্থানের ৭০০/৮০০ গজ ডানে রেলওয়ে লাইনের উঁচু বাঁধের পিছনে অবতরণ করে। এছাড়া আরো দুটি হেলিকপ্টার আসে যেগুলি আমাদের বামে আধা মাইল দূরে একটা পুকুরের বাঁধের পিছনে অবতরন করে এবং সঙ্গে সঙ্গে সেদিক থেকে ভয়ংকর গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পাই। আমি বুঝতে পারলাম শত্রুরা আমার ট্রুপসদের চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে এবং আমাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান তখনও কিছুই তৈরী হয়নি। এ সময় ছিল আমার পক্ষে চরম মুহূর্ত। বাম থেকে গোলাগুলির আওয়াজ আরো প্রচন্ড হচ্ছিল। আমি তৎক্ষনাৎ সিদ্ধান্ত নেই এবং ক্যাপ্টেন জাফর, ক্যাপ্টেন গাফফারকে নির্দেশ দেই এখনই এই মুহূর্তে তাদের নিজ নিজ কোম্পানী নিয়ে বর্তমান অবস্থান পরিত্যাগ করার জন্য। আমি এবং আমার সমস্ত সৈন্যকে অবস্থানটি পরিত্যাগ করার আধা ঘন্টার মধ্যে শত্রুরা সেদিন আক্রমণ চালায়।
এবারও শত্রুসেনারা আমাকে এবং আমার সেনাদলকে সামান্য মুহূর্তের জন্য ধরার সুবর্ণ সুযোগ আবার হারিয়ে ফেলে। হয়তবা এ ছিল পরম করুণাময় আল্লাহর আশীর্বাদ। আমি পরে জানতে পারি আমার অবস্থানের বাম থেকে যে গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলাম তা ছিল লেঃ ইমামুজ্জামানের সৈনিকদের সঙ্গে পাকসেনাদের সংঘর্ষ। পাকসেনারা হেলিকপ্টারযোগে বামে অবতরণ করেছিল সে সময় লেঃ ইমামুজ্জামানের সৈন্যদলের সামনে পড়ে যায়। এতে তাদের যথেষ্ঠ ক্ষয়ক্ষতি হয়। লেঃ ইমামুজ্জামান শত্রুদের প্রচন্ড আঘাত হেনে পরে বাম দিক দিয়ে পিছনে হটে আসে এবং আমার সঙ্গে মিলিত হয়। যদিও আমাকে অবস্থান পরিত্যাগ করতে হয়েছিল এবং পাকবাহিনী বেলুনিয়া পুনঃদখল করে নেয় তবুও শত্রুদের যা হতাহত হয় তা ছিল অপূরনীয়। আমাদের পশ্চাদপসরন একটা রণকৌশল ছিল। সৈন্য, অস্ত্র, গোলাবারুদ সবকিছুই ছিল নগণ্য। সে তুলনায় শত্রুদের শক্তি ছিল বিরাট। আমার তখনকার যুদ্ধের নীতি এবং কৌশলই ছিল শত্রুদেরকে অকস্মাৎ আঘাত হানা বা তাদেরকে প্রলোভন দেখিয়ে আমার মনোনীত জায়গা অগ্রসর হতে দেওয়া এবং তাদেরকে পর্যুদস্ত এবং ধ্বংস করা-শত্রুদের এভাবে ব্যতিব্যস্ত রেখে আস্তে আস্তে নিজের শক্তি আরো গড়ে তোলা এবং সংগঠনকে শক্তিশালী করা। অংকুরেই ধ্বংস হয়ে যাওয়াটা আমার উদ্দেশ্য ছিল না। এ পরিপ্রেক্ষিতে সব সংঘর্ষেই আমি পাক সেনাবাহিনী কে আঘাত হানতাম অতর্কিতে। আবার যখন যথেষ্ঠ ক্ষতিসাধন হত তখন অকস্মাৎভাবেই সংঘর্ষ এড়িয়ে অন্য জায়গায় চলে যেতাম। এতে শত্রুরা আরো মরিয়া হয়ে উঠত এবং পাগলের মত আমার নতুন অবস্থানে এসে আঘাত হানত। বারবারই এ রণকৌশল পুনরাবৃত্তি হত। যে সময় বেলুনিয়ার সম্মুখসমর চলছিল, ঠিক সে সময় আমি শত্রুর পিছনের এলাকায় আঘাত হানার জন্য তৈরী হচ্ছিলাম। আমার হেডকোয়ার্টারস-এ অন্ততঃপক্ষে চারহাজার গেরিলা সে সময় প্রশিক্ষণরত ছিল। এদেরকে আমি বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে বিশেষ বিশেষ ধরনের গেরিলা যুদ্ধের পদ্ধতিতে শিক্ষা দিচ্ছিলাম। একটি দলকে শিক্ষা দিচ্ছিলাম ডিমোলিসন (বিস্ফোরক) ব্যবহার- যাদের প্রথম উদ্দেশ্য ছিল দেশের অভ্যন্তরে যত রাস্তা ও রেলওয়ে সেতু আছে সেগুলি ধ্বংস করে দেওয়া- যাতে শত্রুরা অনায়াসে যাতায়াত করতে না পারে এবং বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে পাক সেনাদল তাদের রেশন ঠিকমত পোঁছাতে না পারে। এ ছাড়া এ দলটির আরো কাজ ছিল শিল্পক্ষেত্রে-কিছু মনোনীত শিল্পকে সাময়িকভাবে অকজো করে দেওয়া। বিশেষ করে ঐ সব শিল্প, যাদের তৈরী মাল পাকবাহিনী বিদেশে রপ্তানী করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে সক্ষম হবে। এসব শিল্প অকেজো করার সময় আমাকে অনেক সতর্কতার সাথে পরিকল্পণা করতে হয়েছে, যেহেতু সব শিল্পই আমাদের দেশের সম্পদ এবং এগুলি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিলে পরবর্তীকালে স্বাধীনতার পর আমাদের নিজেদেরই আবার সংকটের সম্মুখীন হতে হবে, সে কারণে প্রতিটা টার্গেট সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর পরিকল্পণাগুলিকে যথেষ্ঠ বিবেচনার সাথে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করতে হত এবং তারপরই সিদ্ধান্ত গ্রহন করতাম। শিল্পগুলিকে ধ্বংস না করে এগুলিকে সাময়িক অকেজো করার এক অভিনব পদ্ধতি আমি খুঁজে পাই। আমার সেক্টর-এর বেশীরভাগ শিল্প ঢাকার চারপাশে- ঘোড়াশাল এবং নরসিংদীতে অবস্থিত ছিল। আমি জানতে পেরেছি যে, এসব শিল্পের জন্য বৈদ্যুতিক শক্তি সাধারণত সাজিবাজার পাওয়ার হাউস ও কাপ্তাই থেকে পাওয়ার লাইনের মাধ্যমে আসে। আমি আমার গেরিলাদের প্রথম টার্গেট দেই ওই সব পাওয়ার লাইন উড়িয়ে দেওয়ার জন্য। প্রতি সপ্তাহে ২০টি টিম বিভিন্ন এলাকায় পাওয়ার লাইন ধ্বংস করতে থাকে। এর ফলে প্রায় ৭৫ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ শিল্প এলাকাগুলোতে বন্ধ হয়ে যায়। পাকবাহিনী নিরুপায় হয়ে প্রত্যক পাইলনের নীচে এন্টি-পার্সোনাল মাইন পুঁতে রাখত যাতে আমার লোকজন পাইলনের কাছে আসতে না পারে। তারা সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার হাউস থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে শুরু করে। আমি যখন এ খবর জানতে পারি, তখন সিদ্ধিরগঞ্জের সরবরাহ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ যাতে না যেতে পারে তার পরিকল্পনা করতে থাকি। আমার হেডকোয়ার্টাস থেকে তিনটি দলকে ঢাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ পদ্ধতি সম্বন্ধে সমস্ত তথ্য আনার জন্য প্রেরন করি। এক সপ্তাহের মধ্যে তারা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসন্ধান চালিয়ে যায় এবং আমাকে সমস্ত খবর পৌঁছায়। তারা আরো জানায়, পাকবাহিনীর একটি শক্তিশালী দল ট্যাঙ্কসহ সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রে আস্তানা গড়েছে। চতুর্দিকে বাঙ্কার প্রস্তত করে সে জায়গাটি পাহারা দিচ্ছে। সে কেন্দ্রটিকে অকেজো করতে হলে একটা বিরাট যুদ্ধের পর সেটিকে দখল করতে হবে। শত্রুঘাঁটি যেরূপ শক্তিশালী ছিল তাতে সফল হাওয়া সম্ভব হতেও পারে , নাও হতে পারে। আর তাছাড়া আমি প্রকৃতপক্ষে কেন্দ্রটি সম্পূর্ণরূপে উড়িয়ে দেওয়ার পক্ষেপাতী ছিলাম না। আমি এসব ভেবে অন্য পন্থা অবলম্বন করার জন্য চিন্তা করতে থাকি। এই সময়ে ওয়াপদার একজন ইঞ্জিনিয়ার আমার কেন্দ্র আসেন। তাঁর সঙ্গে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা হয়। আমার যে অনুসন্ধান দলটি খবরাখবর এনেছিল, তারা আসার সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রের একটা নীলনকশা ওয়াপদার প্রধান দপ্তর থেকে চুরি করে এনেছিল। আমি ইঞ্জিনিয়ার জনাব ভূইয়াকে এ নীলনকশা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহের একটা সম্পূর্ণ মডেল আমার হেডকোয়ার্টারে-এ তৈরীর নির্দেশ দেই। ইঞ্জিনিয়ার জনাব ভূঁইয়া আমার নির্দেশ অনুযায়ী ঢাকা, টঙ্গি, ঘোড়াশাল, নারায়নগঞ্জের বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনের একটা পূর্ণাঙ্গ মডেল তৈরী করেন। সে মডেলের উপর ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের সাথে আলোচনাকালে আমি বুঝতে পারি যে, ঢাকাতে মোট ন’টি জায়গাতে (পোস্তাগোলা, ডেমরা, হাটখোলা, জংসন, খিলগাঁও, মতিঝিল, ধানমণ্ডি, শাহবাগ, কমলাপুর, উলন) গ্রীড সাবস্টেশন আছে এবং এই সাবস্টেশনগুলি যদি আমরা ধ্বংস করে দিতে পারি তবে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। এও বুঝতে পারি যে, বিদ্যুৎ সরবরাহ সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে মোটামুটি তিনটি লাইনে আসে এবং যদি সবগুলো সাবস্টেশন একসঙ্গে উড়িয়ে না দেয়া যায়, তাহলে বিদ্যুৎ সরবরাহ অন্য পথ দিয়ে চলবে। ঢাকার এবং শিল্প এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ অকেজো করে দেওয়ার জন্য আমি জুলাই মাস থেকে ১৬টি টিম ট্রেইন করতে থাকি। এসব টিমে ৮ থেকে ১০ জন গেরিলাকে এভাবে ট্রেনিং দেই যাতে তারা সাবস্টেশন গুলির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি খুব কম সময়ের মধ্যে চিনে নিতে পারে এবং সেগুলো অনায়াসে ধ্বংস বা অকেজো করে দিতে পারে। ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা এমনভাবে করা হয় যাতে তারা এ কাজে সম্পূর্ন পারদর্শিতা অর্জন করে। দু’মাস ট্রেনিং-এর পর এসব টিমগুলোকে আমার হেডকোয়ার্টারে মডেলের উপর একটা পূর্ণাঙ্গ রিহার্সালের বন্দোবস্ত করি যাতে প্রত্যেকটা টিমের প্রতিটি ব্যক্তির তার কার্য সম্বন্ধে কোন সন্দেহ না থাকে। নিজ নিজ কার্য যাতে তৎপরতার সাথে করতে পারে সে জন্য এ ব্যবস্থা করা হয়। এ টিমগুলি কে আমি কসবার উত্তরে আমাদের যে গোপন প্রবেশপথ ছিল, সে পথে ঢাকাতে প্রেরন করি। টিমগুলি নবীনগর এবং রূপগঞ্জ হয়ে নদীপথে ঢাকার উপকন্ঠে পোঁছে এরা প্রথম তাদের রেকি (সন্ধানী) সম্পন্ন করে। অনুসন্ধানের পর জানতে পারে যে কতগুলো সাবস্টেশনে পাকিস্তানীরা ছোট ছোট আর্মি পাহারা দলের বন্দোবস্ত করেছে। আবার কোন কোনটিতে পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ কিম্বা রাজাকার দ্বারা পাহারার বন্দোবস্ত করেছে। দলগুলি তাদের সমস্ত সরঞ্জাম এবং অস্ত্র ঢাকাতে বিভিন্ন জায়গাতে লুকিয়ে রেখে বর্তমান অবস্থান সম্বন্ধে আমাকে খবর পাঠায় এবং নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে। আমি বুঝতে পারলাম যদিও কোন কোন জায়গায় ছোট ছোট পাহারার বন্দোবস্ত করা হয়েছে তবুও এগুলি ধ্বংস করার সুযোগ এখনই। এরপর পাহারা আরও সুদৃঢ় হওয়ার আশঙ্কা আছে। সে জন্য আর কালবিলম্ব না করে সবগুলো পাওয়ার সাবস্টেশন একযোগে অতিসত্বর ধ্বংস করার বা অকেজো করার নির্দেশ পাঠাই। আমার নির্দেশ পাওয়ার পর সব টিমই নিজ নিজ কমান্ডারদের নেতৃত্বে একযোগে জুন মাসের ২৭ তারিখের রাতে অকস্মাৎ তাদের আক্রমন চালায়। তারা এইসব আক্রমণে ধানমণ্ডি, শাহবাগ, পোস্তাগোলা, উলন, মতিঝিল, ডেমরা প্রভৃতি সাবস্টেশনগুলি ধ্বংস বা সাময়িক অকেজো করে দিতে সক্ষম হয়েছিল। আক্রমণের সময় আমার লোকদের সঙ্গে অনেক জায়গায় পাকসেনাদের সংঘর্ষ হয়- বিশেষ করে ধানমণ্ডি সাবস্টশনে। এই দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছিল রুমি। সে একাই স্টেনগান হাতে পাকসেনাদের উপর হামলা চালায় এবং সকলকে গুলি করে মেরে ফেলে। তার অসীম সাহসিকতার ফলে অন্যান্য লোকরাও উজ্জীবিত হয়ে ওঠে এবং পাকসেনাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং সাবস্টেশনটি ধ্বংস করে দেয়। এরূপ সংঘর্ষ শাহবাগ ও ডেমরাতে ঘটে। বাকি জায়গাগুলোয় আমার লোকেরা এমন অকস্মাৎভাবে সাবস্টেশনগুলির ভিতরে ঢুকে পড়ে যে পাকসেনারা বা পাকিস্তানী পুলিশেরা কিছু বোঝার আগেই তাদের হাতে বন্দী বা নিহত হয়। এ অপারেশন-এ অন্তত ৭৫ শতাংশ সফলতা লাভ করি। ঢাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ ২৪ ঘন্টার জন্য সম্পূর্ণ অচল হয়ে যায়। যদিও পাকিস্তানীরা বিমানযোগে সাবস্টেশনের যন্ত্রপাতি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নিয়ে আসে এবং কিছুটা সরবরাহ পুনরুদ্ধার করে-তবুও শিল্প এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ চিরতরে কমে যায়। এতে পাটকলগুলি চালাবার প্রচেষ্টা অনেকাংশে কমে যায়।
এ সময়ে আমি আরো জানতে পারি যে, প্রিন্স সদরুদ্দিন জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ঢাকায় আসছেন সরেজমিনে অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য। জেনারেল টিক্কা খান সে সময়ের প্রস্ততি নিচ্ছিল প্রিন্স সদরুদ্দিনকে বাংলাদেশের সবকিছু স্বাভাবিক অবস্থা দেখাবার জন্য। আমি তার এই প্রচেষ্টা বানচাল করার জন্য আরো পাঁচটি দল তৈরী করি। তাদের কাজ ছিল ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় গ্রেনেড বিষ্ফোরণ ঘটানো এবং অবস্থা যে স্বাভাবিক নয় সে সম্বন্ধে প্রিন্স সদরুদ্দিনকে বুঝিয়ে দেওয়া। পরিকল্পনা অনুযায়ী দলগুলি ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় বিষ্ফোরণ ঘটায়-প্রিন্স সদরুদ্দিনের অবস্থানকালে। সবচয়ে বড় বিষ্ফোরণ ঘটায় মতিঝিলে। আলম এবং সাদেক এ দুজন গেরিলা ১টা গাড়ীর ভিতরে ৬০ পাউন্ড বিষ্ফোরক রেখে মতিঝিল হাবিব ব্যাঙ্ক বিল্ডিং-এর সামনে বিলম্বিত ফিউজের মাধ্যমে ভয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটায়। এ বিস্ফোরণের ফলে হাবিব ব্যাঙ্কের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই ঘটনায় সমস্ত ঢাকা শহরে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। জনসাধারন সঙ্গে সঙ্গে সব কাজ কর্ম বন্ধ করে দেয়। সেদিন রাতেই প্রিন্স সদরুদ্দিন যখন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বিশ্রাম করছিলেন এ দলটি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের বারান্দায় আরেকটা বিস্ফোরক ভর্তি গাড়ী বিস্ফোরণ ঘটায়। চতুর্দিকে এসব বিস্ফোরণে জাতিসংঘে মহামান্য পর্যবেক্ষক বেশ ভাল করে বুঝতে পেরেছিলেন যে টিক্কা খান যাকে স্বাভাবিকভাবে দেখানোর চেষ্টা করেছে, তা স্বাভাবিক নয়। ঢাকার অপারেশন যখন চলছিল তখন আমি আমার বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনাদের এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলাদের মিলিত দল বিভিন্ন থানায় পাঠাচ্ছিলাম থানাগুলি দখল করে নেওয়ার জন্য। এই দিনগুলি ছিলো বিশেষ অসুবিধার-কারণ আমার ট্রেনিংপ্রাপ্ত ছেলেরাও সেনারা সবাই ছিল যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু ছিল না শুধু অস্ত্র আর গোলাবারুদ। অনেক চেষ্টা করেও গোলাবারুদ আর অস্ত্রের কোন ব্যবস্থা করতে পারছিলাম না।
আমাদের বন্ধুরা সবসময় আশ্বাস দিত ‘এই অস্ত্র এসে পড়ছে’। কোন সময় বলত ট্রেনে মালভর্তি হয়ে গেছে, বন্যার জন্য আসতে পারছে না, কেননা রেললাইন বন্ধ। আবার কোন সময় বলত ফ্যাক্টরিতে তৈরী হচ্ছে। এমনও সময় গেছে যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন পরিকল্পনা তৈরীর পর আমাদের সে পরিকল্পনা পরিত্যাগ করতে হতো অস্ত্রের অভাবে। নিজেদের কাছে যে সব অস্ত্র ছিল সেসবেরও গোলাবারুদ অত্যন্ত রেশনিং-এর পরেও প্রায় শেষ হওয়ার পথে ছিল। এ সময় সমস্ত মুক্তিবাহিনীতে হতাশার ভাব পরিলক্ষিত হয়। অনেক সময় বহু অনুরোধের পর হয়ত ৩০৩ রাইফেলের ৫ রাউন্ড করে গুলির সাহায্য পেতাম। এ ধরনের যুদ্ধের জন্য যা ছিল অতি নগণ্য। এসব অসুবিধা এবং সংকটের মধ্যেও আমরা ভেঙ্গে পড়িনি। আমি আমার সেনাদলকে নির্দেশ দেই, যে উপায়ে হোক আর যেখানেই হোক পাক বাহিনীকে এ্যামবুশ করে যা অতর্কিতে আক্রমন করে তাদের অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ ছিনিয়ে নিয়ে নিজেদেরকে সজ্জিত করে তুলতে হবে। এ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। সকলকে আত্ননির্ভরশীলতা এবং আত্নবিশ্বাস আরো বাড়াতে হবে। আমার এ নির্দেশ বেশ কাজে লাগে।সকলেই আবার পূর্ণ উদ্দ্যমে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে।
জুলাই মাসে টিক্কা খান আবার মন্দভাগ এবং শালদা নদী পুনর্দখল করার প্রচেষ্টা চালায়। পাকিস্তানীরা বেলুচ কুট্টি নামক জায়গায় সৈন্য সমাবেশ করে। আমাকে এ খবর আমাদের লোকেরা পৌঁছায়। আমি ক্যাপ্টেন গাফফারকে মন্দভাগের অবস্থান আরো এগিয়ে বাজারের নিকট অবস্থান শক্তিশালী করার নির্দেশ দেই। শত্রুসেনারা সকালে বেলুচ রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানীকে সামনে রেখে অগ্রসর হয়। সকাল সাড়ে দশটায় শত্রুসেনারা অবস্থানের অগ্রবর্তী স্থান পর্যন্ত অগ্রসর হয় এবং আমাদের মাইনফিল্ডের ভিতর আটকা পড়ে যায়। তবুও তারা অগ্রসর হতে থাকে। তারা যখন আমাদের থেকে ৫০ গজের মধ্যে এসে পড়ে, ক্যাপ্টেন গাফফারের সেনাদল তাদের উপর অকস্মাৎ গুলিবর্ষণ শুরু করে। শত্রুরা আমাদের অবস্থান এত সামনে আছে তা জানত না। চতুর্দিকের গুলিতে তাদের দুটি কোম্পানী সম্পূর্ণ ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং শত্রুসেনারা চারিদিকে ছুটাছুটি করতে থাকে। এতে তাদের নিহতের সংখ্যা আরো বেড়ে যায়। ৩১ বেলুচ কিছুক্ষন পর তাদর আক্রমন পরিত্যাগ করে। কিন্তু এক ঘন্টা পরে পাক সেনারা শলদা নদীর দক্ষিন তীরের সাথে আমাদের অবস্থানের ডান পাশ দিয়ে পিছনে আসার চেষ্টা করে। তারা যে এরূপ একটা কিছু করতে পারে ক্যাপ্টেন গাফফার তা পূর্বেই অনুমান করেছিল। এ জন্য ক্যাপ্টেন গফফার তৈরীও ছিল। সুবেদার ওহাবের অধীন একটি কোম্পানীকে সে আগে থেকেই শালদা নদীর দক্ষিণ তীরে এ্যামবুশ পজিশনটির ফাঁদে পড়ে যায়। নিরুপায় হয়ে তারা অবস্থানটির উপর প্রবল আক্রমণ চালায় কিন্তু আমাদের গুলির মুখে এ আক্রমণ ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আর উপায় না দেখে পরবর্তী আক্রমণ স্থগিত রেখে পাকসেনারা পিছু হটে যায়। ক্যাপ্টেন গাফফারের সেনাদল ও সুবেদার ওহাবের সেনাদল পশ্চাৎগামী শত্রুদের পিছনে ধাওয়া করে। এ সময় চতুর্দিক ধানক্ষেতে এবং অন্য জায়গায় বেশ পানি ছিল। শত্রুরা এসব পানি ভেঙ্গে পশ্চাদপসরণ করার সময় অনেক আহত ও নিহত হয়। যুদ্ধের শেষে সমস্ত যুদ্ধক্ষেত্রে খুঁজে আমরা অন্তত ১২০টা মৃতদেহ খুঁজে পাই এবং আরো অনেক মৃতদেহ যেগুলি পানিতে ছিল, খুঁজে পাওয়া যায় না। এ যুদ্ধের ফলাফল আমার পক্ষে অনেক লাভজনক ছিল। আমরা ৮টা মেশিনগান, ১৮টা হালকা মেশিনগান প্রায় দেড়শ (১৫০) রাইফেল, ২ টা রকেট লাঞ্চার, ২ টা মর্টার ও অজস্র গোলাবারুদ হস্তগত করি। আরো অনেক অস্ত্রশস্ত্র যেগুলি পানিতে ছিল সেগুলি খুঁজে পাওয়া যায়নি। মৃতদেহগুলির মধ্যে ১ জন ক্যাপ্টেন, ১জন লেফটেন্যান্ট এবং আরো কয়েকজন জুনিয়ার কমিশন্ড অফিসার কে সনাক্ত করা হয়। শত্রুরা এই সময় বৃষ্টি এবং বন্যার জন্য আমাদের হাতে বেশ নাজেহাল হচ্ছিল এবং তাদেরকে বাধ্য হয়ে গতিবিধি শুধু রাস্তায় সীমিত রাখতে হচ্ছিল। কিন্তু আমরা শত্রুদের এ দুর্বলতা সম্পুর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারছিলাম না যেহেতু তখন আমরা অস্ত্রশস্ত্রের দিকে দুর্বল ছিলাম-যদিও ইতিমধ্যেআমাদের বেশ সংখ্যক লোক ট্রেনিং পেয়ে প্রস্তুত ছিল। অস্ত্রের অভাবে এসব ট্রেনিং প্রাপ্ত লোকদের আমরা ভেতরে পাঠাতে পারছিলাম না। শত্রুরা আমাদের দুর্বলতা বুঝতে পেরে তাদের গতিবিধি আরো বাড়াবার জন্য জলযানের যোগাড় করতে লাগল- বাংলাদেশের যত লঞ্চ, স্টিমার, স্পীডবোট ছিল, সেগুলি দখল করে মেশিনগান ফিট করে এগুলিকে গানবোট হিসাবে ব্যবহার করতে লাগল।
আমাদের কাছে খবর আসে যে, শত্রুরা ‘পাক বে’ কোম্পানীকে তিনশত ফাইবার গ্লাস স্পীডবোট তৈরীর নির্দেশ দিয়েছে। নারায়নগঞ্জের ‘পাক বে’ ডকইয়ার্ডে এসব স্পীডবোট তৈরীর কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। এই ‘বে’ কোম্পানীর একজন অফিসারের ভাই আমার মুক্তিবাহিনীতে ছিল। সে এসে খবর দেয় যে এই স্পীডবোটে লাগাবার জন্য তিনশ ইঞ্জিন সদ্য আনা হয়েছে এবং সেগুলি ‘পাক বে’র গুদামে মওজুত রাখা আছে। আমি তৎক্ষণাৎ সেই ছেলেটিকে আরো দশজন গেরিলা মনোয়ন করার নির্দেশ দিই এবং এই সিদ্ধান্তে পৌঁছি যে, ফাইবার গ্লাস স্পীডবোট প্রস্তুত হয়ে গেলে শত্রুদের গতিবিধি অনেক গুণে বেড়ে যাবে, এই বর্ষার মওসুমে শত্রুসেনারা বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে পৌঁছাতে পারবে। তখন আমাদের মুক্তিবাহিনীর পক্ষে সুদূর গ্রামের গোপন অবস্থানগুলি অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে পড়বে। সে জন্য এই মেশিনগুলিকে এখনই ধ্বংস করে দিতে হবে। নির্দেশমত মনোনীত দলটিকে প্রশিক্ষণের পর নারায়ণগঞ্জ পাঠিয়ে দিই। নারায়ণগঞ্জ এসে তারা প্রথম ‘পাক বে’র গুদামটি রেকি (অনুসন্ধান) করে এবং জানতে পারে যে, দু’জন পুলিশ এবং দু’জন চৌকিদার যে গুদামটিতে মেশিনগান রাখা আছে সেখানে পাহাড়া দিচ্ছে। সেদিন সন্ধ্যায় আমার দলটি অতর্কিত পুলিশদের নিরস্ত্র করে ফেলে এবং পুলিশ ও চৌকিদারদের একটি কামড়ায় বন্ধ করে গুদামের তালা ভেঙ্গে গুদামে প্রবেশ করে। গুদামের ভিতরে ডিজেল এবং পেট্রোল ছিল। সেগুলি সব মেসিনের উপর ঢেলে দেয় এবং যে সব ফাইবার গ্লাস নৌকা প্রস্তুত ছিল তাতেও ঢেলে দেয়। এরপর অগ্নিসংযোগ করে বেড়িয়ে আসে। কয়েক সেকেণ্ডের ভিতর সমস্ত মেশিনে এবং ফাইবার গ্লাস নৌকাগুলিতে আগুন লেগে যায় এবং বিষ্ফোরণ ঘটে। এই বিষ্ফোরণে শত্রুদের সমস্ত মেশিন এবং ৩০০ নৌকা ধ্বংস হয়ে যায়।
এ অপারেশনের ফলে পাক বাহিনী তাদের গতিবিধি অনেকাংশ সীমিত করতে বাধ্য হয়। অপরদিকে এই অপারেশনের মুক্তিবাহিনীর পক্ষে সুদূঢ় গ্রামাঞ্চলে তাদের গোপন স্থান বিপদমুক্ত রাখা সম্ভব হয় এবং তারা সুযোগের সদ্ব্যবহার করে পাকসেনাদের উপর আক্রমন চালাতে থাকে।
২রা জুলাই সকাল সাড়ে ৫টায় সময় একটা দল মোঃ হুমায়ুন কবিরের নেতৃত্বে শত্রুদের লাটুমুড়া অবস্থানের উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায় এ আক্রমণে মার্টারের সাহায্যও নেইয়া হয়। আক্রমণে ফলে ১২ জন পাকসেনা নিহত অ ৪ জন আহত হয়।
কুমিল্লাতে আমাদের এ্যাকশন তীব্রতর হওয়ার জন্য পাকসেনারা কুমিল্লার উত্তরে গোমতী বাঁধের উপর তাদের অবস্থান তৈরী করে এবং এরপরে তারা তাদের কর্তৃত্ব আরও উত্তরে বাড়ানোর জন্য টহল দিতে শুরু করে। পাকসেনারা যাতে শহরের বাইরে কর্তৃত্ব পুনঃস্থাপন করতে না পারে সেজন্য আমি ‘বি’ কৌম্পানীর দু’টি প্লাটুনসহ কোটেশ্বর নামক স্থানে শক্তিশালি ঘাঁটি গড়ে তুলতে নির্দেশ দেই। পাকসেনারা ২/৩ দিন এই এলাকায় সম্মুখবর্তী জায়গায় তাদের টহল বজায় রাখে। এরপর ৪ ঠা জুলাই পাকসেনাদের একটি ভারী দল সকাল ৪ টার সময় আমাদের অবস্থানের আধামাইল পশ্চিম কোটেশ্বর গ্রামের ভিতর পর্যন্ত অগ্রসর হয়। সকাল ৪ টা ১৫ মিনিটে তারা আরো অগ্রসর হয়ে আমাদের ২০০/৩০০ গজের মধ্যে পৌঁছে। এ সময় আমাদের সৈন্যরা তাদের উপর গুলি চালায়। পাকসেনারা ২/৩ ঘন্টা প্রবল চাপ চালিয়ে যায় অগ্রসর হবার জন্য কিন্তু আমাদের গুলির মুখে বারবারই পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। এরপর তারা ৫০০/৬০০ গজ পিছু হটে গিয়ে আমাদের বামে ‘সারিপুরের’দিক থেকে আবার অগ্রসর হবার চেষ্টা করে। এবারও পাকসেনারা আমাদের গোলাগুলির সামনে টিকতে না পেরে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত হয়ে পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। এ সংঘর্ষে পাকসেনাদের কমপক্ষে ৩০জন হতাহত হয়। আমাদের ১ জন প্রাণ হারায়।
হোমনা থানা পাকসেনাদের জন্য সামরিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। ঢাকাতে যেসব গেরিলাকে পাঠাতাম অপারেশনের জন্য, তারাও এই হোমনা দিয়ে যাতায়াত করত। সে জন্য পাকসেনারা লঞ্চে করে সব সময় দাউদকান্দি থেকে হোমনা টহল দিয়ে আসত। আর হোমনায় দালাল পুলিশেরা পাকসেনাদের মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে খবরাখবর দিতো। এ পুলিশ স্টশনটি আমার আমার জন্য বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে জন্য এই থানাটি দখল করে নেয়ার জন্য আমি হাবিলদার গিয়াসকে নির্দেশ দেই। হাবিলদার গিয়াস তার সেনাদল ও স্থানীয় গেরিলাদের নিয়ে থানাটি আক্রমণ করার প্রস্তুতি নেয়। তারা খবর নিয়ে জানতে চায় যে, থানাতে বাঙালী দালাল পুলিশ ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশও যথেষ্ঠ আছে। থানা রক্ষার্থে পুলিশ থানার চতুর্দিকে বাঙ্কার তৈরী করেছে এবং কয়েকয়েকটা হালকা মেশিনগানও তাদের কাছে আছে। সম্পূর্ণ খবরাখবর নিয়ে হাবিলদার গিয়াস থানা আক্রমণের একটা পরিকল্পনা নেয়। ১লা জুলাই রাত ১১টার সময় হাবিলদার গিয়াস তার গনবাহিনী ও নিয়মিত বাহিনীকে নিয়ে থানাটি অতর্কিতে আক্রমণ করে। এ আক্রমণে পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশরা হালকা মেশিনগানের সাহায্য বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে আক্রমণের মুখে তারা সবাই নিহত হয়। হাবিলদার গিয়াস থানাটি দখল করে নেয়। এর ফলে থানার সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র তার হস্তগত হয় এবং আমাদের ঢাকা যাবার রাস্তাও শত্রুমুক্ত হয়।
আমাদের একটি প্লাটুন মিয়াবাজার থেকে ফুলতুলীতে টহল দিতে যায়। রাত ৩টার সময় তারা দেখতে পায় পাকসেনাদের ১টি জীপ এবং ২টি ট্রাক কুমিল্লা থেকে দক্ষিণের দিকে টহল দিতে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্লাটুনটি কুমিল্লা চট্টগ্রাম রাস্তার উপর এ্যামুশ-এর জায়গায়অ তারা ১টি মেসিনগান রাস্তার দুদিঙ্ক থেকে লাগিয়ে পাকসেনাদের জন্য অপেক্ষা করে। রাত সারে ৪টায় পাকসেনাদের গাড়ীগুলি মিয়াবাজার অবস্থানে ফেরত আসে। আসার পথে গাড়ীগুলি আমাদের এ্যামুশ-এ পড়ে যায়। এ্যামবুশ পার্টি খুব নিকটবর্তী স্থান থেকে মেশিনগান এবং হালকা মেশিনগানের গুলি চালিয়ে গাড়ীগুলি ক্ষতিগ্রস্ত করে দেয়। পাকসেনারা গাড়ী থেকে লাফিয়ে নীচে নামার চেষ্টা করে কিন্তু এতেও তাদের অনেক লোক মেশিনগানের গুলিতে হতাহত হয়। পাকসেনাদের কমপক্ষে ৩ জন অফিসার সহ ২১ জন নিহত ১৫ জন আহত হয়। পরে খবর পাওয়া যায় যে নিহতের মধ্যে ১ জন লেঃ কর্ণেলও ছিলেন। এ এ্যামবুস সময় পাকসেনারা কুমিল্লা বিমানবন্দর তাদের সাথীদের সাহার্য্যেথে কামানের সাহায্যে আমাদের এ্যামবুশ অবস্থানের উপর প্রচন্ড গোলা ছুঁড়তে থাকে। গোলার মুখে বেশীক্ষন টিকতে না পেরে আমাদের এ্যামবুশ পার্টি স্থানটি পরিত্যাগ করে পিছু হটে আসে।
জুলাই মাসের ১ লা তারিখে পাকসেনারা আবার তাদের শালদা নদী ও কসবা অবস্থানের ভিতরে যোগাযোগের স্থাপনের চেষ্টা চালায়। সকাল ১০টার সময় শালদা নদী থেকে পাকসেনারাদের একটি দল কসবার দিকে অগ্রসর হয়। এই দলটি কিছুদূর অগ্রসর হবার পর মন্দভাগের নিকট গফফারের ৪র্থ বেঙ্গলের ‘সি’ কোম্পানী, পাকসেনারা যখন তাদের অবস্থানের সামনে দিয়ে কসবার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, ঠিক সে সময় তাদের উপর অতর্কিত হমলা চালায়। পাকসেনারা আর অগ্রসর হতে পারে না এবং ছত্রভঙ্গে তাদের মৃতদেহগুলি ফেলেই শালদা নদীর অবস্থানে পালিয়ে যায়। পালানোর পথে আমাদের মর্টারের গোলাও তাদের যথেষ্ঠ ক্ষতিসাধন করে। এ সংঘর্ষে পাকসেনাদের ৮ জন আহত ও ৩ জন নিহত হয়।
পাকসেনারা জুলাই মাসের ৩ তারিখে ফেনী থেকে দুটি কোম্পানী নিয়ে বেলুনিয়ার দিকে অগ্রসর হয়। রাস্তায় তারা ‘শালদা বাজার’ নামক স্থানে সাময়িক অবস্থান নেয়। এই সংবাদ পেয়ে ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের ১টি প্লাটুন ৩ মর্টারসহ দুপর দুটার সময় শত্রুদের এই দলটির উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা এই আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। তাদের মনোবল বেলুনিয়াতে আগে থেকেই যথেষ্ট কমে গিয়েছিল। এ ছাড়া সে সময়ে বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টির মধ্যে সাময়িকভাবে বানানো ট্রেঞ্চগুলোতে থাকাও বেশ অসুবিধাজনক হয়ে পড়েছিল। অতর্কিত আক্রমণের ফলে মেশিনগান ও মর্টারের গোলাগুলিতে তদের অসংখ্য লোক হতাহত হয়। পরে জানা যায় যে, তদের অত্যন্তপক্ষে ৩০ জন লোক নিহত ও ২০ জন লোক আহত হয়েছে। পাকসেনারা এরপর শালদা বাজারের পার্শ্ববর্তী সাহেবনগর ও অন্যান্য গ্রামগুলি থেকে স্থানীয় লোকদের অন্য স্থানে চলে যেতে বলে। মতলববাজার এলাকাতে মুক্তিবাহিনীর একটি প্লাটুনকে লেঃ মাহবুব পাঠিয়ে দেয়। এই প্লাটুনটি মতলব এলাকায় গিয়ে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে। সেখানে তারা জানতে পারে মতলব থানাতে পাকিস্থানী পুলিশ এবং রেঞ্জার মোতায়েন করা হয়েছে। এ পুলিশের অত্যাচারে স্থানীয় লোকরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। পাকিস্থানী পুলিশরা স্থানীয় দালালদের সহয়তায় শাসনকার্য আয়ত্তাধীন আনার চেষ্টা করেছে। আমাদের দলটি মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে এই থানাকে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা থানার সম্বন্ধে সকল খবর যোগাড় করে। জুলাই মাসের ২ তারিখের রাতে গেরিলা দলটি থানার উপর আক্রমণ করে। পাকিস্থানী পুলিশ ও রেঞ্জাররা এই আক্রমণকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে কিন্তু তীব্র আক্রমণের মুখে ৫ জন পুলিশ নিহত এবং ৭ জন আহত হয়। ঠিক এই সময়ে গেরিলাদের নিকট যে হালকা মেশিনগানটি ছিল সেটা খারাপ হয়ে যায়। নিরুপায় হয়ে গেরিলা আক্রমণ পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। গেরিলাদেরও ১ জন নিহত হয়। কিন্তু এই আক্রমণের পর থেকে পাকিস্থানী পুলিশরা আর থানার বাইরে আসার সাহস পায়নি। সমস্ত মতলব থানা এলাকা মুক্তিবাহিনী আয়ত্তাধীন এসে যায়।
শালদা নদীতে আমাদের কার্যকলাপ সব সময় চালানো হচ্ছিল। মেজর সালেকের এক পেট্রল পার্টি খবর আনে যে রেলওয়ে সড়কের পূর্ব দিক দিয়ে একটি ছোট রাস্তা পাকসেনারা তদের শালদা নদী ও নয়ানপুর অবস্থানের মধ্যে যোগাযোগ করার জন্য ব্যবহার করে। মেজর সালেক ৫ জনের একটি ডিমোলিশন পার্টি পাঠিয়ে সেই রাস্তার উপর মাইন পুঁতে দেয়। ৯ই জুলাই সকাল সাড়ে ৫টার সময় পাকিস্থানীদের একটি প্লাটুন শালদা নদী থেকে নয়ানপুর যাবার পথে এইসব এন্টি-পার্সোনাল মাইনের উপর পড়ে যায়। মাইন বিষ্ফোরণে ১০ জন পাকসেনা নিহত এবং আরো অনেকে আহত হয়। পাকসেনারা বিপর্যস্ত হয়ে শালদা নদীতে ফিরে আসে।
৬ই জুলাই পাকসেনারা প্রায় ১টি ব্যাটালিয়ন নিয়ে মন্দভাগ বাজার পর্যন্ত অগ্রসর হয়। সেখান থেকে তারা সামনে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। আমাদের ‘এ’ কোম্পানি এবং ‘সি’ কোম্পানি মেজর সালেক এবং ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে পাকসেনাদের শালদা নদী এঙ্কলেভ এর ভিতর অগ্রসর হটে প্রচণ্ড বাঁধা দেয়। পাকসেনারা তাদের ফিল্ড আর্টিলারি মন্দভাগ বাজার পর্যন্ত নিয়ে আসে এবং কামানের সাহায্যে আমাদের অবস্থানের উপর এবং পার্শবর্তী গ্রামগুলোতে তীব্র গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এই গোলাবর্ষণে আমাদের ১১ জন আহত হয় এবং অন্তত ৩২ জন বেসামরিক ব্যাক্তি হতাহত হয়। পাকসেনারা তাদের আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকে এবং শালদা নদী এঙ্কলেভ দখল করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। আমাদের মুক্তিসেনারাও তাদের এ আক্রমণে তীব্র বাঁধা দিতে থাকে। যদিও আমাদের মর্টারের গোলা তাদের কামানের অবস্থান পর্যন্ত পৌছতে পারেনি তবুও মর্টারের গোলা এবং মেশিনগুলোতে তাদের আক্রমণ প্রতিহত হয়ে যায়। তারা পিছু হটে মন্দভাগ বাজারে অবস্থান নিতে বাধ্য হয়। মেজর সালেক পাকসেনাদের শালদা নদীর অবস্থানের বিরুদ্ধে তার কার্যকলাপ আরও তীব্রতর করার জন্য ৯ই জুলাই পাক অবস্থানের উপর ঘোরাফিরা করছিল, ঠিক সে সময় আমাদের কামানগুলি এবং মর্টার পাকসেনাদের অবস্থানের উপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এই গোলাবর্ষণ প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে চলে। এই অকস্মাৎ প্রচণ্ড মর্টার এবং কামানের গোলাবর্ষণে শত্রুরা হতভম্ভ হয়ে পড়ে। এতে তাদের অনেক হতাহত হয়। পরে জানতে পারা যায় যে এই গোলাগুলিতে ১৯ জন পাকসেনা নিহত এবং ১১ জন আহত হয়। একটি মেশিনগান বাঙ্কার সহ তিনটি বাঙ্কার ধ্বংস হয়। কামানের গোলার আঘাতে তাদের একটি এম্যুনিশন ডাম্প বিস্ফোরিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। এর পড় দিন একটি স্পিড বোট পাকসেনাদের নিয়ে শালদা নদী হয়ে পশ্চিম দিকে যাচ্ছিল। আমাদের পেট্রোল পার্টটি, যেটি আগে থেকেই শালদা নদীর পিছনে অবস্থান নিয়েছিল, তারা পাকবাহিনীর স্পীড বোট এম্বুশ করে। এম্বুশের সময় আমাদের গুলির আঘাতে স্পিড বোট ডুবে যায়। ১২ জন পাকসেনা গুলিতে না হয় পানিতে ডুবে মারা যায়। মরিতদের মধ্যে ১ জন মেজর ও ১ জন ক্যমাটেন ছিল এবং তাদের মদমর্যাদার ব্যাজ এম্বুশ পার্টি নিয়ে আসে। এম্বুশ পার্টি পানি থেকে একটি মেশিনগান, একটি ওয়ারলেস সেট এবং একটি ম্যাপ (যাতে শত্রুর অবস্থাগুলি চিনহিত ছিল) উদ্ধার করতে সমর্থ হয়। এর পরই পাকসেনাদের কামানের গোলা আমাদের দলের উপর পড়তে থাকে। আমাদের দল তখন বাধ্য হয়ে এম্বুশ স্থান পরিত্যাগ করে।
১০ই জুলাই পাকসেনারা একটি কোম্পানি নিয়ে বিকেল ৪তার সময় পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। পাকসেনারা শালদা নদীর উঁচু স্থান সাগরতলা স্থানটি দখল করার জন্য অগ্রসর হয়। তাদের সঙ্গে তাদের গোলন্দাজ বাহিনীও সহায়তা করে। কিন্তু সাগরতলা উঁচু অবস্থানের উপর আমাদের যে প্লাটুন টি ছিল সেটি এবং রেললাইনের পশ্চিমে আমাদের আরেকটা প্লাটুন তাদেরকে প্রচণ্ডভাবে বাঁধা দ্যায়। তাদের প্রায় ৩০/৪০ জন হতাহত হয়। এরপর তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে শালদা নদীতে নিজ অবস্থানে পালিয়ে যায়।
পাকিস্তানীদের একটি দল নবীনগরে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে। পাকসেনাদের নবীনগরে অবস্থানের পড় আমাদের নরসিংদী, ভৈরববাজার এবং কালীগঞ্জে যাতায়াতের রাস্তায় বাঁধার সৃষ্টি হয়। পাকসেনারা কয়েকজন স্থানীয় দালালের সহায়তায় মুক্তিবাহিনীর জন্য সমস্ত এলাকায় ত্রাসের সৃষ্টি করে। ক্যাপ্টেন আইনুদ্দিন এই এলাকাকে পুনরায় বিপদমুক্ত করার জন্য ১৬ জনের একটি দলকে হাবিলদার আওয়ালের নেতৃত্বে নবীনগর পাঠায়। হাবিলদার আওয়াল কষবার উত্তর দিয়ে অনুপ্রবেশ করে নবীনগরের ৩ মাইল পশ্চিমে তার গোপন ঘাঁটি স্থাপন করে। এরপর স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় পাকসেনাদের অবস্থান সম্পর্কে সম্পূর্ণ খবর যোগাড় করে। এর পর ৮ই জুলাই সকাল ৬টায় পাকসেনাদের নবীনগরের অবস্থানটির উপর অতর্কিত আক্রমণ করে। এ অতর্কিত আক্রমণের জন্য পাকসেনারা মোটেই প্রস্তুত ছিলোনা। তারা হকচকিয়ে যায় এবং আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি পাকসেনাদের ৭জন ও ৫জন দালালকে নিহত করতে সক্ষম হয়। সঙ্ঘর্ষে আমাদের ১ জন আহত হয়। আমি এসময় ঢাকাতে আরও কয়েকটি গেরিলা পার্টি পাঠাই। এই দলগুলি আগের প্রেরিত দলগুলির সাথে যোগ দ্যায় এবং ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ও পার্শবর্তী এলাকায় তাদের গেরিলা কার্যকলাপ চালিয়ে যায়। একটি দল জুলাই মাসের প্রথমেই পাকসেনাদের ছোট একটি এম্যুনিশন পয়েন্ট আক্রমণ করে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর ফলে পাকবাহিনী সমস্ত ঢাকাতে সান্ধ্য আইন জারি করে এবং ঢাকা শহরে প্রহরার ব্যাবস্থা করে। ঐ দিনই দুজন গেরিলা নিউমার্কেটের নিকট পাকসেনাদের একটি জিপের ভিতর গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। ফলে ১জন অফিসার ও ৩ জন পাকসেনা নিহত হয়। ৫ই জুলাই নারায়ণগঞ্জে ২ জন আর একটি দল গুলশান সিনেমা হলের পর্দার ভিতর ১টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। ফলে পর্দাটি সম্পুর্ন পুড়ে যায় এবং নিকতবর্তী ৫জন দালালও আহত হয়। সমস্ত নারায়ণগঞ্জে এবং ঢাকায় আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। ৪ঠা জুলাই দুপুর ১২টার সময় ৫জন গেরিলার একটি দল পাগলাটে বিদ্যুৎ সরবরাহ পাইল উড়িয়ে দ্যায়। ১০ জনের গেরিলার একটি দল নিউমার্কেটের নিকট পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ এবং পাকসেনাদের একটি মিলিত দলের উপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। ফলে ৮ জন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ ও ৪ জন পাকসেনা নিহত হয়।
এদিকে ১১ই জুলাই সকাল ৮টা থেকে অকস্মাৎ পাকসেনারা ভারি কামান এবং মর্টারের সাহায্যে আমাদের শালদা নদী অবস্থানের উপর প্রচণ্ড গোলাগুলি চালাতে থাকে। এই গোলাগুলির ফলে আমাদের শালদা নদী অবস্থানে বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। পাকসেনাদের গোলাগুলি সমস্ত দিন ধরে চলতে থাকে। মর্টার স্প্লিন্টারের আঘাতে ৪র্থ বেঙ্গলের হাবিলদার তাজুল মিয়া এবং সিপাই আব্দুর রাজ্জাক মারাত্মকভাবে আহত হয়। এছাড়াও দুজন বেসামরিক লোক নিহত ও ৮জন বেসামরিক লোক আহত হয়। কিন্তু বিকেলের দিকে গোলাগুলি বন্ধ হয়ে যায় এবং আক্রমণও হয়নি।
৯ই জুলাই পাকসেনারা আমাদের কোটেশ্বর অবস্থানের উপর সকাল ৬টায় আবার তাদের আক্রমণ শুরু করে। আমাদের কোটেশ্বর অবস্থানের সৈন্যরা মর্টার এবং কামানের সহায়তায় পাকসেনাদের এই আক্রমণের মোকাবিলা করে। পাকসেনারা প্রথমে দুটি কোম্পানি নিয়ে আক্রমণ চালায়। পরে আরও দুটি কোম্পানিকে শক্তি বৃদ্ধির জন্য নিয়ে আসে। ৩/৪ ঘণ্টা যুদ্ধের পড় আমাদের কামানের গোলায় এবং মেশিনগানের গুলিতে পাকিস্তানীদের আক্রমণ ব্যাহত হয়। এ যুদ্ধে পাকসেনাদের অন্তত ২৪/২৫ জন নিহত হয়। তারা আক্রমণ বন্ধ করে পিছু হটে যায়।
আমাদের Petrol পার্টি ৯ই জুলাই পাকসেনাদের কোম্পানি হেডকোয়ার্টার রেকি করে এবং অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারে। আমাদের কামানগুলি এই কোম্পানি হেডকোয়ার্টারের উপর প্রচণ্ড গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে। ফলে দুজন পাকসেনা নিহত এবং ৬জন আহত হয়। এর মধ্যে একজন অফিসার ও তার Signaller ছিল। স্থানীয় লোকেরা অফিসারটিকে কাঁধে ব্যাজ দেখে সনাক্ত করতে পেরেছিল। শত্রুদের মনোবল ভেঙ্গে গিয়েছিল।
১০ই জুলাই রাতে ক্যাপ্টেন গাফফার ৪র্থ বেঙ্গলের ‘সি’ কোম্পানি থেকে দুটি সেকশন সালদা নদীর পশ্চিমে কামালপুর এবং মাইঝখাইরের ভিতর এম্বুশ অবস্থানের ভিতর এসে পড়ে – ঠিক সে সময় পাকসেনাদের সম্মুখবর্তী অংশের উপর আমাদের সৈন্যরা গুলি চালাতে শুরু করে। অতর্কিত আক্রমণে পাকসেনারা হতভম্ভ হয়ে যায় এবং কিছু বোঝার আগেই তাদের অনেক লোক হতাহত হয়। ছত্রভঙ্গ হয়ে তারা পেছনের দিকে পালাতে শুরু করে। এঅবস্থাতেও তাদের অনেক হতাহত হয়। সঙ্ঘর্ষে পাকসেনাদের একজন মেজর, দুজন ক্যাপ্টেন ও ৮জন সিপাই নিহত হয়। আমাদের Ambush পার্টি ১টি MIGA মেশিনগান এবং Am-PRC-10 Wireless Set হস্তগত হয়।
হোমনাতে হাবিলদার গিয়াসের অধীনে যে মুক্তিবাহিনীর দলটি হোমনা থানায় আক্রমণ চালিয়ে অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নেয়, সেই দলটি এ এলাকাতেই তাদের ঘাঁটি গড়ে তোলে। এ দলটির কার্যকলাপে পাকবাহিনী নিকটবর্তী সমস্ত থানাগুলিকে আরও শক্তিশালী গড়ে তোলে। পাকসেনারা রাস্তার প্রত্যেকটি সেতুর উপর তাদের কড়া পাহারার ব্যাবস্থা করে। প্রতিটি হাঁট বাজার এলাকাতেও তারা ক্যাম্প তৈরি করে। এছাড়া নিকটবর্তী সমস্ত এলাকার চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের ডেকে ‘শান্তি কমিটি’ গড়ার কড়া নির্দেশ দ্যায়। প্রতিটি এলাকার চেয়ারম্যানকে স্থানীয় লোক নিয়োগ করে পাকসেনাদের অধীনে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে বাধ্য করে এবং তাদের কাজ করতে বাধ্য করে। কন স্থানীয় লোক যদি তাদের নির্দেশমোট কাজ করতে অস্বীকার করত, পাকসেনারা তাদের পিতামাতা বাড়িঘরের ক্ষতি করে বা ভয় দেখিয়ে তাদের নির্দেশমত কাজ করাতে বাধ্য করত। পাকসেনারা স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় হাবিলদার গিয়াসের দলটির সঠিক সন্ধান পায় এবং তাদের অবস্থিতি সম্বন্ধে পাকবাহিনীর মন্তব্য আমরা নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানতে পাই। তাদে ধারণা ছিল যে হোমনা এবং দাউদকান্দি এলাকাতে কমপক্ষে আমাদের ৬ হাজারেরও বেশী লোক কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এজন্য পাকসেনারা কখনো রাতে তাদের ক্যাম্পগুলির বাইরে আসতে সাহস পেতনা। এছাড়া কোন সময়েই দলে ভারি না হলে ক্যাম্পের বাইরে টহলে বের হতোনা। পাকসেনাদের ভীতসন্ত্রস্ত মানসিক অবস্থার জন্য আমাদের দলটির নির্বিঘ্নে কাজ চালিয়ে যেতে সুবিধা হয়। সপ্তাহে একদিন কি দুদিন লঞ্চের সাহায্যে পাকসেনাদের এসব ক্যাম্পে রসদ যোগানো হত। এ সংবাদ আমাদের দলটি জানতে পারে। ৬ই জুলাই দাউদকান্দি থানার অন্তর্গত মাসিমপুর বাজারের অর্ধমাইল পশ্চিমে জয়পুর গ্রামে শাখানদীর পাড়ে হাবিলদার গিয়াস তার দলটি নিয়ে পাকসেনাদের জন্য একটি এম্বুশ পাতে। সকাল ১০টার সময় পাকসেনাদের দুটি লঞ্চ দাউদকান্দির দিক থেকে গোমতী হয়ে এই শাখানদীতে আসে। লঞ্চগুলি এম্বুশের সামনে পড়তেই আমাদের দলটি অতর্কিতে গোলাগুলি ছুড়তে থাকে। পাকসেনারা নদীর ভিতর থেকে অ্যামবুশ দলটির উপর হামলা না করতে পারায় এবং তীরে অবস্থিত এম্বুশ পার্টির তীব্র গোলাগুলিতে লঞ্চগুলির যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় অনেক পাকসেনা হতাহত হয়। উপায়ান্তর না দেখে লঞ্চগুলি পিছু হটে যায় এবং দাউদকান্দির দিকে পালিয়ে যায়। পড়ে বিভিন্ন সূত্রে আমরা খবর পেয়েছি যে অন্তত ২০/২৫ জন পাকসেনা আহত বা নিহত হয়েছে। লঞ্চগুলি অ্যামবুশের ভিতর পড়ে যাওয়া সত্ত্বেও সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়া সম্বভ হয়নি, কারণ এম্বুশ পার্টির নিকট রাইফেল এবং হাল্কা মেশিনগান ছাড়া বড় অস্ত্র, যেমন রকেট কিংবা কামান ছিলোনা, তবুও এ এম্বুশের ফলাফল ছিল আমাদের বিশাল সাফল্য। ফলে পাকসেনারা এ এলাকায় চলাফেরা কমিয়ে দ্যায়। এতে আমাদের কর্তৃত্ব ও স্থানীয় লোকের মনোবল আরও বেড়ে যায়। এর পড় হোমনা ও দাউদকান্দি থানার জনসাধারণ সতস্ফুর্তভাবে আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে।
৪র্থ বেঙ্গলের ‘বি’কোম্পানির একটি প্লাটুন চৌদ্দগ্রাম এলাকায় পাকসেনাদের বিরুদ্ধে তাদের আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। পাকসেনারা কুমিল্লা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক খোলার জন্য তাদের প্রচেষ্টা দিন দিন বাড়িয়ে যাচ্ছিল। যাসব সড়ক সেতু আমরা ধ্বংস করে দিয়েছিলাম সেগুলি পুননির্মান করার চেষ্টা করছিল। ৯ই জুলাই সকাল ৮টায় আমাদের প্লাটুনটি চৌদ্দগ্রামের উতরে স্রকের উপর বালুজুরি ভাঙ্গাল্পুরের নিকট অ্যামবুশ পাতে। ১১টার সময় পাকসেনারা একটি সিআর বি ট্রাকে করে এবং দুটি জিপে রাস্তা দিয়ে আসে এবং ভাঙ্গালপুড়ের নিকট থামে। পুলটি মেরামত করার কাজের প্রস্তুতি চলতে থাকে। ঠিক সে সময়ে আমাদের এম্বুশ পার্টি তাদের উপর গোলাগুলি চালাতে থাকে। এর ফলে পাকসেনাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। অ্যামবুশ পার্টির গুলিতে তাদের অনেক হতাহত হয়। পাকসেনারা পুলের নিকট থেকে পিছু হটে অবস্থান নেয় এবং পড়ে চৌদ্দগ্রাম থেকে আরও পাকসেনা এসে তাদের সাথে যহ দ্যায়। এরপর পাকসেনারা আমাদের এম্বুশ অবস্থানের উপর আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। আমাদের দলটিও একটু পিছু হটে উঁচু জায়গায় আরও শক্ত অবস্থান গড়ে তোলে। পাকসেনারা ৩টার সময় মর্টার, কামান, মেশিন গানের সহায়তায় আমাদের অবস্থানের উপর আক্রমণ করে। আমাদের গুলিতে পাকসেনারা পর্যদুস্ত হয়ে ৩/৪ ঘণ্টা যুদ্ধের পড় বিকেল ৫টায় আক্রমণ পরিত্যাগ করে পিছু হটে যায়। যুদ্ধে পাকসেনাদের ৩০ জন নিহত ও ৬ জন আহত হয়। যুদ্ধক্ষেত্রের চারিদিক মৃতদেহগুলি বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ফেলে রেখে তারা পালিয়ে যায়। পাকসেনারা পিছু হটার পর আমাদের দলটি অনেক অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নেয় এবং শত্রুদের ক্ষতিগ্রস্ত ট্রাকটিও নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয় কিন্তু ট্রাকটির এত বেশী ক্ষতি হয়েছিল যে এটা আনা সম্ভব হয়নি এবং টট্রাকটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়া হয়। পাকসেনাদের যে দুজন দালাল যুদ্ধের সময় পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিল তারাও গুলিবিদ্ধ হয়। পাকসেনারা পিছু হটে যাবার পথ আমাদের দলটি তাদের ২/৩টি পেট্রল ও পর্যবেক্ষন ঘাঁটিতে অবস্থিত পাকসেনাদের তাড়িয়ে দেয়। বিকেল সাড়ে ৪টার সময় পাকসেনাদের একটি জঙ্গি বিমান যুদ্ধক্ষেত্র পর্যবেক্ষন করে এবং আমাদের দলটিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের দলটি সেখান থেকে একটু দূরে সরে যাওয়াতে জঙ্গি বিমানটি কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে চলে যায়। এ সঙ্ঘর্ষের পর ১০ই জুলাই সন্ধ্যায় একটি এম্বুশ পার্টি উক্ত অবস্থানের ১ মাইল দক্ষিণে লেঃ ইমামুজ্জামানের নেতৃত্বে আবার এম্বুশ পাতে। আমাদের ধারনা ছিল যে, পাকসেনারা আবার উক্ত সেতুর নিকট আসবে। ১০ই জুলাই সারাদিন পাকসেনাদের জন্য তারা অপেক্ষা করে থাকে কিন্তু আমাদের ধারনা মত সেদিন না এসে ১১ই জুলাই ১১টার সময় পাকসেনাদের একটা কোম্পানি দুটি গাড়ী সহ আস্তে আস্তে ভাঙ্গা সেতুর দিকে মিয়াবাজারের দিকে অগ্রসর হয়। পাকসেনারা যখন এম্বুশ অবস্থানের ভিতর পৌঁছে ঠিক সেই সময় এম্বুশ পার্টি তাদের উপর প্রচণ্ড গোলাগুলি চালাতে থাকে। এতে শত্রুদের বেশ হতাহত হয়। তারা পিছু হটে গিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালায় এবং উভয়পক্ষে যুদ্ধ সারাদিন ধরে চলতে থাকে। এ যুদ্ধে পাকসেনাদের ১০/১৫ জন আহত হয়। বিকেল ৩টায় পাকসেনারা যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করে আবার পিছু হটে যায়। আমাদের দলটি রাত ২টা পর্যন্ত পুনরায় আক্রমনের অপেক্ষায় থাকে। এরপর বালুজুরির ভগ্নাবশেষ সেতুটি সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হলে লেঃ ইমামুজ্জামান তার দলটি নিয়ে ঘাঁটিতে চলে আসে। আসার পথে চৌদ্দগ্রাম লাকসাম রোডের উপর বাংগোডার পশ্চিমে এবং চৌদ্দগ্রামের উত্তরে আরেকটা ভাঙ্গা ব্রিজের নিকট এন্টি ট্যাঙ্ক এবং এন্টি পার্সোনাল মাইন পেতে রাখে। মাইন পাতার সময় আমাদের কমান্ডো প্লাটুনের দুজন লোক দুর্ঘটনায় সামান্য আহত হয়।
এ সময় পাকিস্তানীরা ফেনী দিয়ে চট্টগ্রাম রেল লাইন পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করে। আমরা রাজনগর সাবসেক্টর থেকে ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম একটি প্লাটুন ও ইঞ্জিনিয়ার এর একটি দলকে এক্সপ্লোসিভ সহ মিয়াবাজারের দক্ষিণে পাঠিয়ে দেয়। এ দলটি সরিসদি রেলওয়ে ব্রিজ সম্বন্ধে খবরাখবর নেয় এবং গোমতীর নিকট সরিসদি রেলওয়ে ব্রিজটি আক্রমণ করার জন্য বেছে নেয়। কিছু সংখ্যক স্থানীয় দালাল পাকবাহিনীর অস্ত্র দিয়ে এই ব্রিজটি পাহার দিত। ১৩ই জুলাই রাত ১১টার সময় দলটি সরিসদি ব্রিজটি আক্রমণ করে। পাহারারত সশস্ত্র দালালদের কিছু নহত এবং বাকিদের তারিয়ে দিয়ে তারা ডিমলিশন লাগিয়ে ব্রিজটিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। এর ফলে পাকিস্তানীরা শুধু ফেনী এবং গুণবতীর মধ্যে ট্রেন মাঝে মাঝে চলাচল চালু রাখত। অবশ্য এর আগে ট্রেন চলাচল করতে পারত না। এ দলটি পাকিস্তানীদের নয়াপুর বি ও পি অবস্থানের উপর ৩ মর্টারের সাহায্যে আক্রমণ চালায়। এর ফলে দুজন পাকসেনা নিহত ও ৭ জন আহত হয়।
১৩ই জুলাই রাত ১০টায় পাকসেনাদের দত্তসার দীঘি এবং আমতলা অবস্থানগুলির ওপর ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বে দুটি দল আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণের পাকসেনাদের ১৫ জন আহত ও কিছু নহত হয়। শালদা নদীতে পাকসেনারা আবার নতুন করে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। ১১ই জুলাই পাকসেনারা আমাদের শালদা নদী অবস্থানের দিকে মারমুখী পেট্রলিং চালাতে থাকে। আমাদের সৈন্যরাও মেজর সালেকের নেতৃত্বে তাদের অবস্থানের সাহসের সঙ্গে পাকসেনাদের উপর লক্ষ রাখে। ১২ই জুলাই রাত ৮টায় পাকসেনারা প্রচণ্ডভাবে আমাদের সালদা নদী অবস্থানের উপর আক্রমণ চালায়। আমাদের ৪র্থ বেঙ্গলের এ কোম্পানি মেজর সালেকের নেতৃত্বে এ আক্রমণ মোকাবিলা করে। আমাদের সৈন্যদের গুলির আঘাতে পাকসেনাদের প্রচুর হতাহত হয়। তারা পর্যদুস্ত হয়ে আক্রমণ পরিত্যাগ করে রাত ১১টায় পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। সমস্ত রাত উভয় পক্ষে গোলাগুলি চলতে থাকে। ভোর ৫টায় পাকসেনারা একটি ব্যাটালিয়ন নিয়ে আবার সালদা নদীর দক্ষিণে গরঙ্গলা অবস্থানের উপর নতুনভাবে আক্রমণ শুরু করে। সেই সঙ্গে তারা আমাদের আশাবাড়ি অবস্থানেও হামলা চালায়। এই দুই আক্রমণ ও আমাদের মেশিনগানের গুলি ও মর্টারের গোলার সামনে তারা পর্যুদস্ত হয়। পাকসেনাদের অসংখ্য হতাহত হয়। দিনের আলোতে আমাদের সৈন্যরা বাঙ্কার থেকে অগ্রসরমান শত্রুদের হতাহত করে। পাকসেনারা তাদের আক্রমণ ভঙ্গ করে দিতে বাধ্য হয় এবং পিছু হটে যায়। আমাদের সৈন্যরা পলায়নপর শত্রুদের তাড়া করে। যুদ্ধের সময় আমাদের মর্টারের গোলাতে পাকসেনাদের চাপাইতে অবস্থিত একটি এম্যুনিশন এবং রেশন স্টোরে বিস্ফোরণ ঘটে, ফলে ২১ জন আহত ও কিছু সংখ্যক নিহত হয়। ঐ দিনই লেঃ হুমায়ুন কবিরের একটি দল পাকসেনাদের লাটুমুড়াতে যে অবস্থান ছিল তাঁর পিছনে অবস্থান চালায় এবং বেশ কয়েকজন আহত ও নিহত করে। পাকসেনাদের গসাইলস্থ বি ও পি র একটি টহলদার ক্যাপ্টেন গাফফারের একটি দল সন্ধ্যা ৬টায় মন্দভাগ বাজারের শত্রু অবস্থানের উপর এবং নক্তের বাজার শত্রু অবস্থানের উপর মর্টারের সাহায্যে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে পাকসেনাদের ১২ জন নিহত হয় এবং বেশ কয়েকটি বাঙ্কারও ধ্বংস হয়। পাকিস্তানীরা আমাদের মন্দভাগ অবস্থানের উপর কামানের সাহায্যে পাল্টা আক্রমণ চালায়। এতে আমাদের ১ জন নায়েক এবং ৩ জন সিপাই আহত হয়।
আমাদের স্পেশাল কমান্ডোরা জুলাই মাস্যা ৯,১০,১১ তারিখ ঢাকা শহরে তাদের কার্যকলাপ আরও তীব্র করে। গেরিলা কমান্ডার হাবিবুল আলম এবং কাজির নেতৃত্বে একটি ইম্প্রুভাইজড টাইম বোমা ফার্মগেঁটের নিকট পাঞ্জাবিদের ‘মাহরুফ রেস্টুরেন্টে’ স্থাপন করা হয়। এই রেস্টুরেন্টে পাকসেনারা এবং দালালরা সবসময় আসতো। নির্ধারিত সময় অনুযায়ী বোমাটি বিস্ফোরিত হয় এবং এতে ১৬ জন পাকসেনা কয়েকজন দালাল সহ হতাহত হয়। এর মধ্যে ৮ জন মারা যায় এবং ১২ জন আহত হয়। হলিক্রস কলেজ ভবনেও কিছু ক্ষতি হয়।
৪ জনের আরেকটি গেরিলা দল ডি আই টি ভবনের নিকট প্রহরা রত ২ জন পাকসেনাকে নিহত করে। এই পার্টি এর পড় সিদ্দিক বাজারের নিকট ১টি টহলদার পাকসেনাদলকে এম্বুশ করে এবং ২/৩ জন পাকসেনা এতে নিহত হয়। মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক , স্টেট ব্যাংক, নাজ সিনেমা হল, ওয়াপদা ভবন ইত্যাদি স্থানে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এসব ঘটনার ফলে সমস্ত ঢাকায় আতংকের সৃষ্টি হয়। পাকসেনারা ব্যাতিব্যাস্ত ও সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। ঢাকার স্বাভাবিক অবস্থাও সম্পুর্ন নষ্ট হয়ে যায় এবং এলাকাবাসীদের মনোবল আরও বেড়ে যায়।
জুন মাসে আমি যখন পাকসেনাবাহিনীর সঙ্গে সব ফ্রন্ট যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলাম সে সময় আমি বুঝতে পারলাম যদিও আমাদের যোদ্ধাদের আঘাতে পাকসেনাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছিল এবং যতই আমাদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছিল তবুও আমাদের চেয়ে তাদের শলি অনেক বেশী ছিল। বিশেষ করে যেখানে পাকসেনারা শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে বাঙ্কারে অবস্থান নেয় সেখান থেকে তাদেরকে বিতাড়িত করা আমাদের পক্ষে বিশেষ করে সব সময় সম্ভব হতনা। আমি সবসময়ে সংগঠিত গোলন্দাজ বাহিনীর অভাব আনুভব করতাম। বাংলাদেশে অবস্থিত পাকসেনাদের বেশ কয়েকটি গোলন্দাজ রেজিমেন্ট ছিল। এসব রেজিমেন্টে যেসব বাঙলাই নিযুক্ত ছিল ২৫শে মার্চের পড় অনেককে পাকসেনারা হত্যা ও বন্দি করে। আবার অনেকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচায় এবং পরে সেসব গোলন্দাজ বাহিনীর সৈন্যরা আমাদের সেক্টরে যোগ দেয়। তাদের আমি বিভিন্ন বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যুদ্ধে নিয়োগ করি। যুদ্ধে এসব সৈন্যরা যথেষ্ট সাহসেরও পরিচয় দিয়েছে। এসব সৈন্যদের নিয়ে আমি একটি গোলন্দাজ বাহিনী গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেই। এই পরিপ্রেক্ষিতে গোলন্দাজ বাহিনীর সব সৈন্যকে কনাবনে একত্রিত করা হয়। একটি নতুন রেজিমেন্ট গড়ে তোলার জন্য যথেষ্ট কষ্টের সম্মুখীন হটে হয় এবং সেই কষ্ট নতুন রেজিমেন্টটিকেও বহন করতে হয়। এদের কোন থাকার জায়গা ছিল না , খাওয়া এবং রানার কোন ব্যাবস্থাও ছিলোনা। রেজিমেন্টের জন্য বিভিন্ন রকমের প্রকৌশলী লোকের দরকার হয়, কিন্তু সব রকমের সৈন্য আমাদের ছিলোনা। তাছাড়া সবচেয়ে বড় জিনিস কামান এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদি যা একটি গোলন্দাজ বাহিনীর জন্য নিতান্ত প্রয়োজন ছিল। আমি পার্শবর্তী বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের মিলিটারি অধিনায়কদের সঙ্গে গোলন্দাজ বাহিনীর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং অস্ত্রের জন্য অনুরোধ জানাই। অনেক ছোটাছুটির পর তারা কয়েকটি ৩.৭ ইঞ্চি ছোট কামান আমাদের দেয়। এই কামানগুলি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়কার ছিল এবং সম্ভবত সেকেলে হিসাবে পরিত্যাক্ত ছিল কিন্তু তবুও এগুলি পাবার পড় আমার গোলন্দাজ বাহিনীর লোকদের মধ্যে একটি নতুন সাড়া জাগে। তারা তৎক্ষণাৎ এই কামানগুলি প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করে দেয়। প্রকৌশলী লোকের অভাব থাকায় বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং গণবাহিনী থেকে লোক ভর্তি করে তাদের ট্রেনিং দেয়া হয়। এসময় ক্যাপ্টেন পান্না পাকিস্তান থেকে কোন রকমে সীমান্ত অতিক্রম করে পালিয়ে এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। তিনি গোলন্দাজ বাহিনীর লোক ছিলেন। ক্যাপ্টেন পান্না রাত দিন খেতে আমাদের এই গোলন্দাজ বাহিনীকে ট্রেনিং করিয়ে শত বাঁধা বিপত্তি ডিঙ্গিয়ে মোটামুটি যুদ্ধের জন্য উপযোগী করে তোলেন। এভাবে বাংলাদেশের প্রথম গলন্দাজ বাহিনীর জন্ম হয়। জন্মের পর থেকে ফার্স্ট ফিল্ড রেজিমেন্ট বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে জুলাই মাস থেকে আমরা কয়েকটি সাবসেক্টরে কমান্ডার অপারেশনকে ফলপ্রসূ করে তোলে। বিশেষ করে সালদা নদী, কোনাবনে প্রথম এই রেজিমেন্ট এর সহায়তার জন্যই পাকবাহিনীর বারবার আক্রমণ ক্যাপ্টেন গাফফার এবং মেজর সালেক প্রতিহত এবং পর্যুদস্ত করতে সক্ষম হয়। ক্যাপ্টেন পাশার নেতৃত্বে আমাদের সদ্য ট্রেনিংপ্রাপ্ত গোলন্দাজ বাহিনীর সৈন্যরা অনেকসময় এমন ভাবে পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালিয়েছে যে গোলন্দাজ বাহিনীর ইতিহাসে তা বিরল। পাকসেনাদের নিকট ছিল অত্যাধুনিক কামান, আর সেসব কামানের গোলা নিক্ষেপের ক্ষমতা ছিল বেশী। সব সময় পাকসেনাদের চেষ্টা ছিল তাদের কামানের গোলাতে আমাদের এই ছোট পুরাতন কামানগুলিকে বিনষ্ট করে দেয়া। সেজন্য দিনরাত আমাদের প্রথম ফিল্ড রেজিমেন্ট কোন জায়গাতেই বেশিক্ষণ এক স্থানে থাকতে পারতোনা। সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানীদের অর্ধেক গোলা তাদের উপর পড়ে। তাছাড়া আমাদের পুরাতন কামানগুলির গোলা ক্ষেপণের দূরত্ব ছিল পাকিস্তানীদের অর্ধেকের কম। সে কারণে অধিকাংশ সময় আমাদের প্রথম ফিল্ড রেজিমেন্ট এর লোকেরা তাদের কামানগুলি মাথায় করে নিকটে বা পশ্চাতে দুর্গম রাস্তায় নিয়ে যেত এবং শত্রুদের উপর আক্রমণ করত। এসব আক্রমণের ফলে পাকসেনারা ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে পড়ত। ফার্স্ট ফিল্ড রেজিমেন্ট এর কৌশল কতকটা কমান্ডো ধরণের। পরবর্তী পর্যায়ে প্রথম ফিল্ড রেজিমেন্ট আমাদের মুক্তিবাহিনী যখন ডিসেম্বর মাসে ফেনী, নোয়াখালী এবং চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়, তখন কে ফোর্সের ৪র্থ বেঙ্গল, ১০ ম বেঙ্গল এবং ৯ম বেঙ্গলকে পাক বাহিনীদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সাহায্য করে। গোলন্দাজ বাহিনীর জন্য হবে এটা গৌরবের দৃষ্টান্ত।
জুলাই মাসের ১২ তারিখে লেঃ হুমায়ুন কবির সি এন্ড বি রাস্তার উপর একটি প্লাটুনের পেট্রল পাঠায়। এই পেট্রোলটি শত্রুর গতিবিধি সম্বন্ধে খবরাখবর নেবার জন্য কুটি পর্যন্ত অগ্রসর হয়। দুপুর দুটার সময় এই পেট্রোল পার্টি যখন কুটির নিকট দিয়ে টহল দিচ্ছিল তখন তারা দেখতে পায় অনেক গাড়িতে কুমিল্লা থেকে পাকিস্তানীরা সৈন্য সমাবেশ করছে। কুটিতে গাড়ী থেকে নেমে ওদের একটি ব্যাটালিয়নের মত দল মন্দভাগ বাজারের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আমাদের পেট্রোলটি বুঝতে পারে যে, এই পাকসেনারা নয়নপুর, মন্দভাগ বাজারের দলটি বাজারের দিকে এসে অবস্থান নেয় এবং দোকানের ভিতর বাঙ্কার তৈরি করতে থাকে। এছাড়া তাদের অবস্থানের চতুর্দিকে পাট এবং ধান কেটে পরিষ্কার করে ফেলে যাতে তাদের গুলি সামনে আমাদের অবস্থানে এসে পড়ে। এসব সংবাদ পেট্রোল হেডকোয়ার্টারে পৌঁছে। সংবাদ পাবার পর আমি পাকসেনাদের ঘাঁটিগুলি শক্তিশালী হয়ে ওঠার আগেই তাদের উপর আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নেই। ক্যাপ্টেন গাফফারকে ৪র্থ বেঙ্গলের সি কোম্পানি দিয়ে ফার্স্ট ফিল্ড রেজিমেন্টের কামানগুলি মন্দভাগ বাজারের নিকট পর্যন্ত অগ্রসর হয়। সন্ধ্যা হবার আগেই ছোট ছোট কয়েকটি দল পাঠিয়ে বাজারটি এবং শত্রু অবস্থানটি সম্পূর্ণ খবরাখবর নেয়। সন্ধ্যায় ক্যাপ্টেন গাফফার তাঁর কোম্পানি এবং ফার্স্ট ফিল্ড রেজিমেন্টের সহায়তায় মন্দভাগ বাজারের শত্রু অবস্থানের উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। আমাদের কামানগুলি গোপন পথে নৌকাযোগে বাজারের পার্শবর্তী গ্রামে অবস্থান নেয়। ক্যাপ্টেন গাফফারের আক্রমণের ঠিক পূর্ব মূহুর্তে কামাগুলি থেকে অতি নিকতবর্তী শত্রু অবস্থানের বাঙ্কারগুলি এবং বাজারের ঘরগুলিকে প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করতে থাকে, ফলে অনেক বাঙ্কার এবং ঘর ধ্বংস হয়ে যায় এবং বাজারে অবস্থিত পাকসেনারা আহত ও নিহত হয়। এত নিকট থেকে অতর্কিত কামানের গোলার আক্রমণ পাকসেনারা আশা করতে পারেনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকসেনাদের অন্তত ৬০/৭০ জন হতাহত হয়। পাকসেনাদের আর্তনাদ এবং চিৎকার আমাদের লোকরাও শুনতে পায়। কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের প্রতিরোধশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসে এবং তারা অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে যায়। দুঘণ্টা যুদ্ধের পর মন্দভাগ বাজার এবং অনেক অস্ত্রশস্ত্র ক্যাপ্টেন গাফফারের দখলে আসে। এর পরদিন আমাদের একটি পার্টি শালদা নদীতে এম্বুশ পাতে। পাকসেনাদের একটি স্পিডবোট দুপর ১টায় এম্বুশ পড়ে যায়। এম্বুশ পার্টির গুলিতে স্পিডবোটটি ধ্বংস হয়ে যায় এবং ২০ জন পাকসেনা হতাহত হয়। কেউ কেউ নদীতে পড়ে ভেসে যায়। এম্বুশ পার্টিটি পরে নিরাপদে মন্দভাগ অবস্থানে আসে। আমাদের হেডকোয়ার্টারে খবর পাই যে , দাউদকান্দিতে পাকসেনারা ফেরিঘাটের নিকটে ঘাঁটি স্থাপন করেছে। এখানে প্রায় দুকোম্পানির মত পাকসেনা বাঙ্কার নির্মান করে ঘাঁটিটি বেশ শক্তিশালী করে তোলে। এখানে পাকসেনারা ঢাকা-কুমিল্লাগামী প্রতিটি গাড়ি দাঁড় করিয়ে অনুসন্ধান চালায়। তাছাড়া নিকটবর্তী একটা স্পিডবোটে টহল দেয়। আমরা একটি প্লাটুন দাউদকান্দিতে পাঠিয়ে দেই। এদের সঙ্গে আরেকটি দল পাঠানো হয় সৈয়দনগর ওয়ারলেস স্টেশন এবং ইলিয়টগঞ্জ রাস্তার সেতু ধ্বংস করার জন্য। আমাদের দলগুলি দাউদকান্দিতে যেয়ে গৌরীপুর নামক স্থানে তাদের ঘাঁটি তৈরি করে। এরপর শত্রুদের গতিবিধি সম্বন্ধে খবর নেয়। ১৩ই জুলাই সন্ধ্যা ৮টার সময় প্লাটুনটি দাউদকান্দির উত্তরে গোমতী নদীতে পাকসেনাদের একটি টহলদারি স্পিডবোটকে এম্বুশ করে। এই এম্বুশে একজন লেফটেন্যান্ট এবং ২০ জন পাকসেনা নিহত হয়। অফিসারটির র্যাঙ্কের ব্যাজ এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসা হয়। এরপর এই দলটি পরদিন রাতে সৈয়দনগর ওয়ারলেস স্টেশন ধ্বংস করে দেয়। দলে ওপর অংশ ইলিয়টগঞ্জ নতুন সেতুটি ডেমলিশন লাগিয়ে দুটি স্প্যান উড়িয়ে দেয়। তাদের কাজ সম্পূর্ণ করে দলগুলো নিরাপদে হেডকয়ার্টারে ফেরত আসে।
কুমিল্লা-চাঁদপুর রাস্তায় হাজীগঞ্জের নিকট রামচন্দ্রপুরের ব্রিজ উড়িয়ে দেয়ার পর পাকসেনাদের যোগাযোগ ব্যাবস্থার বেশ অসুবিধা হয়। পাকসেনারা ঐ জায়গাতে ফেরীর বন্দোবস্ত করে। এই ফেরী যোগাযোগ বিনষ্ট করার জন্য লেঃ মাহবুব একটি কোম্পানি রামচন্দ্রপুরে পাঠায়। ৬ই জুলাই ভোরে এই দলটি রামচন্দ্রপুর ফেরিঘাটের নিকট এসে এম্বুশ পাতে। ঐ দিনই সকাল ৭টার সময় পাকসেনাদের একটি দল রামচন্দ্রপুর ফেরিঘাটে আসে। তাদের জিনিসপত্র তখন ফেরিঘাটে উঠছিল ঠিক সেই সময় এম্বুশ পার্টি তাদের উপর গুলি চালায়। এতে পাকসেনাদের ৪জন নিহত হয়। উভয়পক্ষে প্রায় ঘণ্টা খানেক গোলাগুলি চলে। গোলাগুলির সংবাদ পেয়ে চাঁদপুর থেকে পাকসেনাদের প্রায় দুই কোম্পানি সৈন্য সাহায্যের জন্য আসে। পাকসেনারা ফেরিঘাটের কিছু দূরে এসে গাড়ী থেকে নামে এবং এম্বুশ অবস্থানে অগ্রসর হবার জন্য প্রস্তুত হয়। ঠিক সেই সময়ে আমাদের অন্য এম্বুশ পার্টিটি তাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে পাকসেনারা সম্পূর্ণ ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং তাদের ৩১ জন নিহত এবং ৫৪ জন আহত হয়। আমাদের এন সি ও এবং একজন সিপাই গুরুতর আহত হয়। এরপর আমাদের দলটি এম্বুশ অবস্থান পরিত্যাগ করে। আসার পথে ৮ই জুলাই মুদ্দাফরগঞ্জ সড়কসেতুটি উড়িয়ে দিয়ে আসে। এর পর পাকসেনারা সেতুটির নিকতবর্তী কয়েকটি গ্রামে মর্টারের সাহায্যে গোলাগুলি করে। সে সময়ে পাকসেনাদের অভ্যর্থনার জন্য অনেক স্থানীয় দালাল শান্তি কমিটি সভার আয়োজক এবং মিছিল করে পাকসেনাদের অভ্যর্থনার জন্য এগিয়ে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই মিছিলের উপর গুলি চালিয়ে অনেককে তাদের হত্যা করে।
আমাদের চাঁদপুর কোম্পানি যোগাযোগ ব্যাবস্থা বিচ্ছিন্ন করার কার্যকলাপ আরও বৃদ্ধি করে। স্থানীয় লোকদের সহায়তায় হাজীগঞ্জ এবং লাকসাম, চাঁদপুর ও কুমিল্লার সি এন্ড বি রাস্তা ও রেলওয়ে সড়কের ২০০ গজ কেটে ধ্বংস করে দেয়া হয়। এ সময়ে পাকিস্তানীরা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ইঞ্জিনিয়ার, ইঞ্জিন ড্রাইভার এবং শ্রমিক এনে রাস্তা মেরামত করার চেষ্টা চালায়। আমাদের গেরিলারা এইসব পাকিস্তানী রেলওয়ে কর্মচারিদের মেরে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়। এর ফলে রেল এবং সড়ক যোগাযোগ সম্পুর্ন বন্ধ হয়ে যায়। নিরুপায় হয়ে ২৬শে জুলাই পাকবাহিনী একটি কোম্পানিকে চাঁদপুর থেকে এই এলাকায় পাঠায়। পাকসেনাদের এই কোম্পানিটি রেলওয়ে লাইনের সঙ্গে সঙ্গে লাকসামের দিকে অগ্রসর হয়। ঠাকুর বাজারের নিকট আমাদের একটি এম্বুশ পার্টি আগে থেকেই অবস্থান নিয়েছিল। দুপুর ২টার সময় পাকসেনাদের এই কোম্পানিটি যখন এম্বুশ অবস্থানের মাঝে আসে তখন আমাদের দলটি তাদের উপর আক্রমণ চালায়। ফলে পাকসেনাদের একজন জে সি ও সহ ২২জন পাকসেনা আহত হয়। পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে চাঁদপুর পলায়ন করে। এর পরদিন গেরিলারা মধু রেলওয়ে স্টেশনের নিকট রেলওয়ে এবং সড়ক সেতু ধ্বংস করে দেয় এবং যে পাকিস্তানী ইঞ্জিনিয়ার পরিদর্ষনের জন্য আসে তাকেও আহত করে।
আমাদের ঢাকার গেরিলা দল তাদের কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছিল। ব্রিটিশ সরকারের একটি পার্লামেন্টারি দল বাংলাদেশের সে সময়ের পরিস্থিতি সারেজমিনে জানার জন্য ঢাকায় আসে। এই দলটি ঢাকা ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলে অবস্থান করছিল। ২৪শে জুন সকাল সাড়ে ৭টায় হোটেলের ভিতরে লবিতে বসে বিমান বন্দরে যাবার অপেক্ষা করছিল। ঠিক সে সময়ে আমাদের ৩ জন গেরিলা হোটেলের সামনে বারান্দায় দুটি গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায় এবং পরিষদীয় দলটিকে ঢাকার পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করায়। এর কদিন পর আমাদের গেরিলারা জানতে পারে যে নারিন্দায় গউরিমা মন্দিরে পাকিস্তানীদের অনেক দালাল সমবেত হয়ে আলোচনার আয়োজন করছে। দালালরা যখন আলোচনায় ব্যাস্ত ঠিক সেই সময়ে আমাদের গেরিলারা আলোচনায় একটি বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে প্রায় ২০/২৫ জন পাক দালাল হতাহত হয়। ঢাকার গেরিলা দল টি এন্ড টি বিভাগের একজন পাকিস্তানী উর্ধতন কর্মচারির গাড়ীতে এম-১৪ মাইন দিয়ে বুবিট্র্যাপ লাগিয়ে রাখে। ফলে পাকিস্তানী অফিসারটি গাড়ীসুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। পাকিস্তানী অফিসাররা মাঝে মাঝে ধানমন্ডির সাংহাই চাইনিজ রেস্টুরেন্টে সান্ধ্যভোজে আসত। এই সংবাদ পাবার পর আমাদের একটি গেরিলা দল ৮ই জুলাই রাত ৯টায় পাকিস্তানী অফিসাররা সেখানে আসলে তাদের উপর গ্রেনেড ছোঁড়ে। ফলে ২/৩ জন পাকিস্তানী অফিসার নিহত হয়। পাকিস্তানী পুলিশরা এ সময়ে রাতে ট্যাক্সিতে বা জিপে ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় পেট্রলিং করত। এসব টহলদার পাকিস্তানী পুলিশদের এম্বুশ করার জন্য ঢাকার গেরিলা দল একটি পরিকল্পনা নেয়। তাদের গতিবিধি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ খবরাখবর নেয়া হয়। ১০ই জুলাই একটি পাকিস্তানী টহলদার পুলিশ পার্টি ধানমণ্ডির রাস্তা নং ২ এর দিকে যাচ্ছিল। গেরিলাদের একটি পার্টি তাদের পিছি নেয়। পুলিশের পেট্রোলটি ২ নং রাস্তার মোড়ে যখন তেদের গতি কমিয়ে দেয় ঠিক সে সময়ে গেরিলারা তাদের গাড়ীতে একটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটি ধ্বংস হয়ে যায়। এতে একজন অফিসার সহ ৫ জন পাকিস্তানী পুলিশ নিহত হয়। আমাদের গেরিলা দলটি নিরাপদে সে স্থানটি পরিত্যাগ করে। এর কদিন পর আমাদের আরেকটি গেরিলা দল নিউ বেইলি রোডে পাকবাহিনীর একটি জিপের ওপর এক্রমন চালায়। এই আক্রমণে ৩/৪ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং জিপটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত আমাদের গেরিলা দলটি পোস্ট অফিসের ভিতর বিস্ফোরণ ঘটায় এবং মণ্ডলপাড়া ও চৌধুরীবাড়ী ইলেকট্রিক সাবস্টেশনটি ১২ই জুলাই রাত সাড়ে ১০টার সময় ধ্বংস হয়। এছাড়া সিদ্ধির নগর ও আশুগঞ্জের সাথে একটি বৈদ্যুতিক পাইলন উড়িয়ে দেয়। সিদ্ধিরগঞ্জ এবং নরসিংদীর মাঝে দুটি বৈদ্যুতিক পাইলন ধ্বংস করে দেয়। এর ফলে কাঞ্চন এবং কালীগঞ্জের বেশ কয়েকটি শিল্প কারখানা বিদ্যুতের ওভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এর কিছুদিন পর ফতুল্লা এবং ঢাকার মাঝে পাগলা রেলওয়ে সেতুটি উড়িয়ে দেয়। ফলে নারায়ণগঞ্জ এবং ঢাকার মাঝে ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এসময়ে আমার হেডকোয়ার্টারে খবর আসে যে পাক সরকার পাক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই পরীক্ষাকে বানচাল করে দেয়ার জন্য আমরাও একটা পরিকল্পনা নেই। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী আমার হেডকোয়ার্টার থেকে ঢাকার গেরিলা দলগুলিকে নির্দেশ পাঠিয়ে দেয়া হয়। এই নির্দেশ অনুযায়ী পরীক্ষার দিন সিদ্ধেশ্বরী স্কুল এবং আরও অন্যান্য স্কুলে পরীক্ষার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটান হয়। ফলে খুব কম সংখ্যক ছেলেমেয়ে পরীক্ষা দেয়ার জন্য পরীক্ষা হলে আসে। ১৫ই জুলাই রাতে এই গেরিলা দল বকশীবাজারে অবস্থিত বোর্ড অফিস আক্রমন করে। ডিমলিশন দিয়ে বোর্ড অফিসের কিছু অংশ উড়িয়ে দেয়া হয়। তর ফলে বোর্ডের বেশ কিছু দলিল এবং কাগজপত্র ধ্বংস হয়ে যায়। এর ফলে এই পরীক্ষা প্রহসনে পরিণত হয় এবং অনেক ছাত্র ছাত্রী ইচ্ছাকৃতভাবেই পরীক্ষা বর্জন করে।
হাবিলদার গিয়াসের নেতৃত্বে আমাদের মুরাদনগরের দলটি ১৬ঈ জুলাই রাত ১টার সময় ইলিয়টগঞ্জের দেড় মাইল পশ্চিমে পুঁতিয়া গ্রামের সামনে কুমিল্লা-দাউদকান্দি সড়কের উপর কয়েকটি এন্টি ট্যাঙ্ক মাইন পুঁতে রাখে। পরদিন সকালে পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীনে একটি অয়াপদা ট্রাক মাইনের উপর বিস্ফোরিত হয়। ফলে ট্রাকটি ধ্বংস হয়ে যায়। ট্রাকে অবস্থানরত একজন পাকসেনা , দুজন রাজাকার ও ড্রাইভার সহ সবাই নিহত হয়। ফলে ৫জন পাকসেনা, ১ জন মেজর ও ৬জন রাজাকার নিহত হয়। এই সংবাদ পেয়ে কুমিল্লা থেকে পাকসেনারা ৩০টি গাড়িতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। পাকসেনাদের গাড়িগুলি ঘটনাস্থল থেকে অনেক দূরে এসে দাড়ায়।
সামনের গাড়ী থেকে বেশ কিছু সংখ্যক পাকসেনা নেমে আস্তে আস্তে ঘটনাস্থলের দিকে অগ্রসর হয়। তারা রাস্তার পাশ দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। অগ্রসর হবার সময় আমাদের পুঁতে রাখা এন্টি পার্সোনাল মাইনের বিস্ফোরণে তাদের ৬/৭ জন বিস্ফোরিত হয় এবং আরও অনেক আহত হয়। এরপর পাকসেনারা আর সম্মুখে অগ্রসর হয়নি। সমস্ত দিন পাকসেনারা মাইন ডিটেক্টরের সাহায্যে ঘটনাস্থলের চতুর্দিকে তন্ন তন্ন করে তল্লাশি চালায়। সমস্ত বেসামরিক যাতায়াতও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর পাকসেনারা পার্শবর্তী গ্রাম গুলিতে মুক্তি বাহিনীর সন্ধানে তল্লাশি শুরু করে। হাবিলদার গিয়াসের দলের একজন নায়েক মস্তফা কামাল স্থানীয় লোকদের সাথে মিশে পাকসেনাদের দুরবস্থা দেখে। দাউদকান্দি থেকে পশ্চিম নারায়ণগঞ্জে এবং দাউদকান্দি সড়কের উপর বাউসিয়ায় একটি গুরুত্তপূর্ণ সেতু ছিল। এই সেতুটি সম্পূর্ন কংক্রিটের তৈরি। এবং বেশ মজবুত। এই সেতুটি ধ্বংস করার জন্য জুলাই মাসের প্রথমে আমি মোঃ রফিক নামে বিশেষ ট্রেনিং প্রাপ্ত গেরিলাকে মনোনীত করি। তার সঙ্গে আরেকটি গেরিলাকে দিয়ে এই সেতু রেকি করার জন্য পাঠাই। মোঃ রফিক সেতুটি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে রেকি করে এবং একটি নকশা বানিয়ে নিয়ে আসে। এরপর অধ্যাপক মুনির চৌধুরীর ছেলে ভাষণের নেতৃত্বে ১০ জনের একটি ডিমোলিশন পার্টিকে রফিকে সঙ্গে নিয়ে বাউসিয়া সেতুটি ধ্বংস করার জন্য পাঠিয়ে দেই। এই দলটি প্রথম মুরাদনগরে গিয়ে তাদের স্থায়ী ঘাঁটি করে। এর পর তারা গোমতী নদী পাড় হয়ে বাউসিয়াতে পৌঁছে। সেখানে একদিন থাকার পর স্থানীয় গেরিলাদের সাহায্য নিয়ে ১২ই জুলাই রাতে বাউসিয়া সেতুতে ডিমলিশন লাগায়। কিন্তু ডেমলিশন বিস্ফোরণের সময় ইগ্নিশন ঠিকমত কাজ করেনা। ইত্যবসরে স্থানীয় ডালা চেয়ারম্যান এবং রাজাকার পাকবাহিনীদের খবর দেয়। পাকবাহিনী এবং রাজাকার অকস্মাৎ ভাষণের ডিমলিশন পার্টির উপর আক্রমণ চালায়। আক্রমণে ভাষণের দলের ৩ জন গেরিলা গুরুতরভাবে আহত হয়। এই ৩ জনের মধ্যে একজন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক কোরাইশই ও ছিল। গেরিলা দলটি ইগ্নিশন কাজ না করার দরুন সেতু উড়িয়ে দিতে ব্যার্থ হয়ে পাকবাহিনীর আক্রমণের চাপে অবস্থান পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এর ফলে আমাদের যথেষ্ট ক্ষতি হয়। যদিও আহত গেরিলাদের সঙ্গে আনতে সক্ষম হয় কিন্তু যেসব বিস্ফোরক সেতুটিতে লাগানো হয়েছিল সেগুলি উঠিয়ে আনা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এবং তারা ২৬০ পাউন্ড আই এন টি সেখানেই ফেলে রেখে হেড কোয়ার্টারে ফেরত আসে। এত বিরাট পরিমাণ আই এন টির শত্রুর হাতে পড়া ও নষ্ট হয়ে যাওয়া আমাদের পক্ষে একটা বিরাট ক্ষতির কারণ। ঐ সময়ে বিস্ফোরক দ্রব্যাদি আমাদের খুব কম ছিল। অনেক চেষ্টার পর হয়তো কিছু কিছু আমরা যোগাড় করতে সক্ষম হতাম। ধাকা-কুমিল্লা রাস্তা বন্ধ কোরে দেয়া আমার লক্ষ ছিল। সেই লক্ষ এইভাবে ব্যার্থতায় পর্যবসিত হওয়ায় আমি যথেষ্ট চিন্তিত হয়ে পড়ি। এবং পড় পরই আবার বিস্ফোরক জোগাড়ের চিন্তায় থাকি। ২/৩ সপ্তাহ পরে অনেক কষ্টে আবার কিছু পরিমাণ আই এন টি সংগ্রহ করতে সক্ষম হই। আই এন টি জোগাড়ের পড় আমি মোঃ রফিকে ডেকে পাঠাই। শেষ পর্যন্ত আমরা বাউসিয়ার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে সমর্থ হয়েছিলাম। লাটুমুরাতে লেঃ হুমায়ুনের নেতৃত্বে যে কোম্পানি অবস্থান নিয়েছিল সেই অবস্থানের উপর পাক বাহিনী তাদের চাপ অব্যাহত রাখে। লাটুমুরার অবস্থান থেকে আমাদের বিতাড়িত করার চেষ্টা করে। লেঃ হুমায়ুনের কোম্পানিটি পাক বাহিনীর প্রচণ্ড চাপের মুখেও তাদের অবস্থানটি সাহসের সঙ্গে ধরে রাখে। মুক্তিযোদ্ধারা এই অবস্থান থেকে প্রায়ই পাকসেনাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালাতে থাকে। ১৭ই জুলাই বিকেল ৪টায় আমাদের ও-পি দেখতে পায় যে লাটমুড়া থেকে একটি শত্রুদল চন্দ্রপুর শত্রুঅবস্থানের দিকে এগিয়ে আসছে। লেঃ হুমায়ুন কবির তৎক্ষণাৎ একটি প্লাটুন চন্দ্রপুরের রাস্তায় পাকসেনাদের এম্বুশ করার জন্য পাঠিয়ে দেয়। প্লাটুনটি চন্দ্রপুর থেকে একটু দূরে অবস্থান নিয়ে পাকসেনাদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। পাকসেনারা যখনি সেই অবস্থানে পৌঁছে ঠিক তখনি তাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালানো হয়। ফলে ৪জন পাকসেনা নিহত এবং আহত হয়। পাকসেনারা এম্বুশ থেকে বাঁচার জন্য লাটুমুড়ায় পলায়ন করে।
২০শে জুলাই সকাল ৯টার সময় একটি প্লাটুন পাকসেনাদের ইয়াকুবপুর , চন্দ্রপুর এবং বাগানবাড়ি অবস্থানের উপর অতর্কিত আক্রমণ করার জন্য পাঠানো হয়। এই প্লাটুনটি গোপন পথে গ্রামের ভিতর দিতে পাকসেনাদের অবস্থানের অতি নিকটে যেতে সমর্থ হয়। রেকি করার পড় তারা দেখতে পায় যে, পাকসেনাদের কিছু লোক বিভিন্ন বাঙ্কারের উপর বসে চা পান করছে, এবং তাদের প্রহরার ব্যাবস্থা শিথিল। এছাড়াও আরও ৩/৪ টি দল বাঙ্কারের উপর দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের একজন ও-পি গাছের উপর বসা ছিল। আমাদের প্লাটুনটি জঙ্গলের ভিতর দিয়ে অগ্রসর হয়ে তাদের বাঙ্কারগুলির উপর আক্রমণ চালায়। গোলগুলিতে যেসব পাকসেনা বাঙ্কারের উপর বসে চা পানে ব্যাস্ত ছিল এবং দাঁড়িয়েছিল তারা সঙ্গে সঙ্গে আহত ও নিহত হল। নিকতবর্তী একটি ঘর থেকে কিছু পাকসেনা বেরিয়ে আসে এবং বাঙ্কারের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে তারাও আহত ও নিহত হয়। এরপর পাকসেনাদের প্রতি এক্রমন করারা আগেই আমাদের প্লাটুনটি অবস্থান ত্যাগ করে নিজেদের এলাকায় নিরাপদে ফিরে আসে। এই সঙ্ঘর্ষের ফলে ১৩ জন পাকসেনা নিহত ও ১০ জন আহত হয়। আমাদের একজন গুরুতর ভাবে আহত হয়।
শালদা নদীতে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে ৪র্থ বেঙ্গলের এ কোম্পানি এবং সি কোম্পানি তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। পাকসেনারা শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন থেকে নারায়নপুরের দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করছিল। ১৭ই জুলাই তাদের একটি দল রেলওয়ে স্টেশনের প্রায় এক হাজার গজ দক্ষিণে মনোরা রেলওয়ে ব্রিজ পর্যন্ত অগ্রসর হয়। ব্রিজের কাছে এসে পাকসেনাদের দলটি ব্রিজের চতুর্দিকে বাঙ্কার তৈরির প্রস্তুতি নেয়। বেলা সাড়ে ১২টার সময় এ কোম্পানির একটি প্লাটুন মর্টার সহ পাকসেনাদের এই দলটির উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণের ফলে পাকসেনারা সম্পূর্ণ ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং তাদের বেশকিছু লোক আহত ও নিহত হয়। পাকসেনারা উপায়ান্তর না দেখে আবার শালদা নদীতে পিছু হটে যায়। পরদিন সকাল ৯টার সময় শালদা নদী থেকে পাকসেনারা আবার মনোরা ব্রিজের দিকে অগ্রসর হয়। সকাল ৯টায় আমাদের সৈনিকরা আবার তাদের বাঁধা দেয়। এবং পাকসেনাদের উপর মর্টার এবং কামানের গোলা নিক্ষেপ করে। ফলে পাকসেনাদের ৪জন লোক নিহত এবং ১০ জন আহত হয়। পাকসেনারা আর অগ্রসর না হয়ে পিছু হটে মনোরা ব্রিজের উত্তরে অবস্থা নেয়। ১৯শে জুলাই পাকসেনারা ব্রিজের দক্ষিণে আবার অবস্থান নেয় বাঙ্কার খোঁড়ার চেষ্টা করে। এবারো পাকিস্তানীরা আমাদের মর্টার , কামান এবং মেশিনগানের গোলাগুলিতে অনেক হতাহত হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। পরে স্থানীয় লোকের কাছে জানা যায় যে, পাকসেনারা আহত ও নিহত সঙ্গীদের নৌকায় করে পিছনে নিয়ে যায়। এদের সঠিক সংখ্যা সম্বন্ধে তাৎক্ষনিকভাবে সংবাদ জানা না গেলেও পরে যানা যায় ৮ জন নিহত এবং ১৪ জন আহত হয়। ২১শে সন্ধ্যায় ৪র্থ বেঙ্গলের এ কোম্পানির একটা প্লাটুন শালদা নদীর অবস্থানের ভিতর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। আক্রমণের ফলে ৮জন পাকসেনা নিহত ও ৭ জন আহত হয়। দেড় ঘণ্টা যুদ্ধের পর আমাদের দলটি শত্রু অবস্থান পরিত্যাগ করে নিরাপদে ঘাঁটিতে ফিরে আসে। এই আক্রমণের সাথে আমাদের ফার্স্ট ফিল্ড রেজিমেন্ট পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে বহু পাকসেনাকে হতাহত করে। জুলাই মাসে কুমিল্লায় পাকসেনারা স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল এবং কিছুটা সফলও হয়েছিল। এ সময় কুমিল্লা শহরের ভিবিন্ন স্থানে পাকসেনারা তাদের ক্যাম্প গড়ে তুলেছিল। এসব ক্যাম্প থেকে তাড়া ঘন ঘন টহল চালাত। কুমিল্লায় পাকসেনাদের এই তৎপরতা খর্ব করার জন্য আমাদের গেরিলাদের ২০ জনের একটি দল একটি ৩ ইঞ্চি মর্টারসহ কুমিল্লার উত্তরে অনুপ্রবেশ করে। ২০শে জুলাই সকাল সাড়ে ১০টার সময় গেরিলাদের এই দলটি কুমিল্লা শহরে পাকসেনাদের বিভিন্ন অবস্থানের উপর মর্টারের সাহায্যে গোলা নিক্ষেপ করে। একটি গোলা আজাদ স্কুলে, একটি গোলা সাধনা ঔষধালয়ের নিকটে, একটি গোলা গোয়ালপত্রীতে, একটি গোলা কালীবাড়ির নিকটে এবং একটি গোলা এস ডি ওর অফিসের নিকটে বিস্ফোরিত হয়। গোলাগুলি বিস্ফোরণের ফলে পাকসেনাদের মনোবল ভেঙ্গে যায় এবং ভিতসন্ত্রত হয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের দিকে ছোটাছুটি করতে থাকে। বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সদ্য আগত সেনারা মনোবল হারিয়ে ফেলে। অনেক পাকসেনা স্থানীয় লোকদের সেনানিবাসের রাস্তা জানতে চায়। আবার অনেকে ভয়ে ব্রিজের তলায় লুকিয়ে পরে। আবার কুমিল্লাতে যখন গেরিলারা তাদের তৎপরতা চালাচ্ছিল ঠিক সে সময়ে গেরিলাদের আর একটি দল চাঁদপুরেও তাদের তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। ১৭ই জুলাই রাত ১০টায় বাবুর হাটের পূর্বে কুমিল্লা-চাঁদপুর রাস্তায় আশিকাটি গ্রামের নিকট পাকসেনাদের একটি কনভয় যখন যাচ্ছিল তখন আমাদের গেরিলারা গাড়ীতে গ্রেনেড নিক্ষেপ করল। ফলে ৮ জন পাকসেনা নিহত ও আরও অনেকে আহত হয়। ১০শে জুলাই দুপুর ১টার সময় বাবুরহাটে পাকসেনাদের একটি গাড়ীর উপর গেরিলারা গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এর ফলে ৫ জন পাকসেনা নিহত ও ৭ জন আহত হয়।
১১ই জুলাই বিকেল সাড়ে ৬টায় ২ জন গেরিলা চাঁদপুর পাওয়ার স্টেশনের সামনে পাহারারত ২জন পাকসেনা ও ২ জন পাকিস্তানী পুলিশের উপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করে তাদের হত্যা করে।
চাঁদপুরে শান্তি কমিটির দালালদের একটি আলোচনা সভায় গ্রেনেড নিক্ষেপ করার পর ৭ জন দালাল আহত হয়। এ ছাড়াও ইলিয়টগঞ্জে পাকসেনাদের স্থানীয় এক দালালের লঞ্চে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এ সমস্ত কার্যকলাপের ফলে স্থানীয় লোকদের মনোবল আরও বেড়ে যায়। তাদের মুক্তিবাহিনীর উপর আস্থা আবার ফিরে আসে।
কসবার উত্তরে কাশিমনগর রেলওয়ে সেতুর নিকট পাকিস্তানীদের ডুটি প্লাটুন অবস্থা নিয়ে সেতুটি প্রহরার কাজে নিযুক্ত ছিল। এই সেতুটিকে ধ্বংস করার জন্য আমি ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনকে নির্দেশ দেই। নির্দেশ পেয়ে ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন সেতুটি রেকি করার জন্য ডিমলিশন এক্সপার্ট সহ একটি রেকি পাঠায়। এই রেকি পার্টি শত্রুঅবস্থান সম্বন্ধে এবং সেতুটি সম্বন্ধে বিস্তারিত খবর দিয়ে আসে। এরপর ১৮ই জুলাই রাত ২টায় একটি রেইডিং প্লাটুন ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে কাশিমপুর সেতুর উদ্যেশ্যে রওনা দেয়। রাত ৮টার সময় সেতুটির নিকতবর্তী পাক অবস্থানের উপর প্লাটুনটি আক্রমণ চালায়। আক্রমণের ফলে ১৭ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং যারা বেঁচে ছিল তাড়া অবস্থান ত্যাগ করে খাইরাতুল্লাতে পালিয়ে যায়। আমাদের রেইডিং পার্টি সেতুটিকে বিস্ফোরণ লাগিয়ে ধ্বংস করে দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের অবস্থান থেকে অনেক অস্ত্র উদ্ধার করে। আমি যখন কুমিল্লা ও নোয়াখালী এলাকায় যুদ্ধে ব্যাস্ত ছিলাম, সে সময় শত্রুদের খবরাখবর নেবার জন্য একটি ৬ ইন্টিলিজেন্স নেট স্থাপন করি। এদের দায়িত্ব ছিল শত্রুদের সম্বন্ধে বিস্তারিত খবর আমাদের নিকট প্রেরণ করে। বিশেষ করে এইসব ইন্টিলিজেন্স এ এমন কতগুলো লোক কাজ করত যাদের সম্বন্ধে কিছু কোথা বলার দরকার। যেমন লাটু মিয়া। সে কুমিল্লা সেনানিবাস হাসপাতালে মালীর কাজ করত। সে আমাদের খবর পাঠায় সেনানিবাসে পাকসেনাদের ডুটি ব্রিগেড আছে এবং সেখানে একটি ডিপ হেডকোয়ার্টার স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া ৫০০-৬০০ রাজাকার এবং রেঞ্জার মোতায়েন করা হয়েছে। সে আরও খবর পাঠায় কুমিল্লা সেনানিবাসের প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা খুবই উত্তম এবং মজবুত করা হয়েছে এবং এই প্রতিরক্ষাবুহ্য বাইরে উত্তরে গোরা কবরস্থান পর্যন্ত তৈরি করা হয়েছে।
কুমিল্লা বিমানবন্দরেও একটি ব্যাটালিয়ন শক্তিশালী প্রতিরক্ষা অবস্থান তৈরি করা হয়েছে।
কুমিল্লা এবং নোয়াখালী এলাকায় পাকসেনাদের শক্তি এক ডিভিশনেরও বেশী। কিন্তু পাকসেনাদের এত শক্তি থাকা সত্ত্বেও তাদের মনোবল বেশ কমে গেছে। সাধারণ সিপাইরা এই যুদ্ধের নইরাশ্যজনক ফলাফল সম্বন্ধে মন্তব্য করত। তাদেরকে জোর করে যুদ্ধে ব্যাবহার করা হচ্ছে। সে জন্য তাড়া যথেষ্ট অসন্তোষ প্রকাশ করত। তাদের মধ্যে পলায়নপর মনোভাব খুবই প্রবল। তাড়া যুদ্ধ এলাকা ছেড়ে নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যেতে ইচ্ছুক। আমাদেরকে আরও খবর পাঠায় যে, পাকসেনাদের হতাহতের সংখ্যা খুবই বেশী। শুধু সেনানিবাস হাসপাতালেই প্রায় ৫০০-৬০০ জন আহত সৈনিক চিকিৎসাধীন আছে। হাসপাতালে স্থানের অভাবে তাঁবুর ভিতরে অনেক আহত সৈনিককে রাখা হয়েছে এবং গুরুতর আহত সৈনিকদের পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। আহতের সংখ্যা এত বেশী হওয়ার জন্য সাধারণ মনোবল ভেঙ্গে পড়েছিল। কুমিল্লা শহরে আমাদের এবং পাকিস্তানীদের তৎপরতার ফলে লোকজন শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে পালিয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেক শহরবাসী পরিচয়পত্র ছাড়া শহরে বেড় হটে পারছেনা। কুমিল্লার উত্তরে পাকসেনারা আমাদের কোটেশ্বর অবস্থান পুনর্দখলের জন্য চেষ্টা চালায়। ২৪শে জুলাই পাকসেনাদের একটি কোম্পানিগঞ্জ পার হয়ে কোটেশ্বরের দিকে অগ্রসর হটে থাকে। সকাল ১০টায় পাকসেনাদের কোম্পানিটি যখন আমাদের অগ্রসর অবস্থানের সামনে পৌঁছে যায়, তখন আমাদের মুক্তিবাহিনী সৈনিকরা তাদের উপর মর্টার এবং হাল্কা মেশিনগানের সাহায্যে তাদের অগ্রসরে বাঁধা দেয়। আমাদের গোলাগুলিতে পাকসেনারা প্রচুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবুও পাকসেনারা তাদের আক্রমণের চাপ অব্যাহত রাখে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারাও সাহসের সাথে তাদের আক্রমণ পরিত্যাগ করে ২ ঘণ্টা পরে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এই সঙ্ঘর্ষের ফলে পাকসেনাদের ১৫জন হতাহত হয়। পাকসেনারা সমস্ত দিন আমাদের অবস্থানের উপর কামানের গোলা নিক্ষেপ করে।
ঐ দিনই কোটেশ্বর এবং কসবা অবস্থান থেকে দুই দল গেরিলা বুড়িচং থানার নিকট একটি সড়কসেতু, তিনটি বিদ্যুৎ পাইলন এবং কসবা এবং কসবার নিকট একটি রেলসেতু উড়িয়ে দেয়া হয়। বেলুনিয়াতে আমাদের সৈন্যরা যখন পাকিস্তানীদের সঙ্গে সম্মুখ সমরে লিপ্ত এবং পাকিস্তানীরা ফেনীর দিক থেকে বেলুনিয়া ব্রিজে প্রবেশ করার চেষ্টা করছিল ঠিক সেই সময়ে পাকসেনারাও আমাদের পেছনে ধ্বংসাত্মক চেষ্টা চালায়। তারা কিছু সংখ্যক দালালকে এই কাজে নিয়োগ করে। এইসব দালালকে মাইনসহ আমাদের অবস্থানের পিছনে পাঠায়। দালালরা আমাদের লাইনের পিছনে রাস্তায় ৬টা এন্টিপার্সোনাল এবং ৯টা এন্টিট্যাঙ্ক মাইন লাগায়। কিন্তু স্থানীয় জনসাধারণের সতর্কতার জন্যই এন্টিট্যাঙ্ক মাইনগুলিতে আমাদের কোন ক্ষতি হয়নি। মাইন পোঁতার খবরটি একজন স্থানীয় লোক আমাদের বেলুনিয়া হেডকোয়ার্টারে পাঠায়। খবর পাওয়ামাত্র হেডকোয়ার্টার থেকে আমাদের ডিমলিশন বিশেষজ্ঞ দল গাইডের সঙ্গে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে তৎক্ষণাৎ মাইনগুলি নিষ্ক্রিয় করে দেয়। আমরা স্থানীয় লোকদের পাকিস্তানী ধ্বংসাত্মক তৎপরতা সম্বন্ধে সজাগ থাকতে বলি। এরপর যখনি পাকিস্তানী দালালরা এরকম ধ্বংসাত্মক কাজের জন্য আমাদের অবস্থানের পিছনে আসার চেষ্টা করেছে স্থানীয় জনগণ তাদের প্রচেষ্টাকে ব্যার্থ করে দিয়েছে। জুলাই মাসের শেষের দিকে লেঃ মাহবুব মিয়াবাজার, চাঁদপুর, হাজীগঞ্জ ইত্যাদি এলাকাতে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে তৎপরতা জোরদার করে। পাকসেনারা মিয়াবাজারে যে ক্যাম্প করেছিল সেখান থেকে কুমিল্লা-চট্টগ্রাম রাস্তা আবার খোলার চেষ্টা করে। লেঃ মাহবুব মিয়াবাজার শত্রুক্যাম্পটি রেইড করার জন্য পাঠিয়ে দেয়। এই দলটি সন্ধ্যায় মিয়াবাজারের নিকট পৌঁছে যায়। সেখান থেকে তাদের একটি ছোট রেকি দল পাকসেনাদের অবস্থান সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর সংগ্রহ করে। রাত ১২টায় কমান্ডো দলটি গোপন পথে অগ্রসর হয়ে শত্রু অবস্থানের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এই অতর্কিত হামলার জন্য পাকিস্তানীরা মোটেই প্রস্তুত ছিলোনা। তারা দিগ্বিদিকজ্ঞ্যানশুন্য হয়ে যায়। আমাদের কমান্ডো দলটি এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে পাকসেনাদের বেশ কয়েকটি বাঙ্কার গ্রেনেড ছুড়ে উড়িয়ে দেয়। পাকসেনারা আক্রান্ত হয়ে ছোটাছুটি করতে থাকে এবং আমাদের সৈনিকদের গুলিতে প্রায় ২০ জন নিহত এবং ১০ জন আহত হয়। এক ঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর আমাদের কমান্ডো দলটি পাকসেনাদের প্রচুর ক্ষতিসাধন করে। শত্রুসেনাদের অবস্থান পরিত্যাগ করে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে চলে আসে। চাঁদপুরে পাকিস্তানীরা তাদের ঘাঁটি আরও শক্তিশালী করে তোলে। চাঁদপুরের এই ঘাঁটি থেকে তারা জায়গায় গাড়ীতে পেট্রলিং করত। এইসব পেট্রলিং এর জন্য ২-৩ টি ৩ টনের ট্রাক কনভয় এর আকারে ব্যাবহার করত। এইসব পেট্রলিং ভোরে, দুপুরে, সন্ধ্যায় এবং রাত ১২টার পর পাকসেনারা চালাত। এবং প্রত্যেক গাড়ির ব্যাবধান ৫০ থেকে ১০০ গজের মধ্যে। এই সংবাদ স্থানীয় গেরিলারা লেঃ মাহবুবের কাছে পৌঁছে দেয়। খবর পেয়ে লেঃ মাহবুব দুটি প্লাটুন ২০শে জুলাই চাঁদপুরের পূর্বে পাঠিয়ে দেয়। প্লাটুন দুটি চাঁদপুর থানার আশিকাটির নিকট এম্বুশ পাতে। পরদিন ভোর ৫টায় চাঁদপুর থেকে একটি পেট্রোল কনভয় আশিকাটির দিকে অগ্রসর হয়। কনভয়টি যখন এম্বুশ অবস্থানের মাঝে পৌঁছে যায় ঠিক তখনি আমাদের অ্যামবুশ পার্টি মেশিনগান এবং হাল্কা মেশিনগানের সাহায্যে গুলি চালায়। এর ফলে কনভয় এর প্রথম তিনটি জিপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে রাস্তা থেকে পড়ে যায় এবং অবশিষ্ট গাড়ীগুলিরও যথেষ্ট ক্ষতিসাধন হয়। পাকসেনারা গাড়ি থেকে নেমে পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের এম্বুশ পার্টির গুলিতে তাদের অন্তত ১০ জন নিহত এবং ২৫ জন আহত হয়। পাকসেনারা গুলির মুখে টিকতে না পেরে পালিয়ে যায়। ঐ দিন আশিকাটির ৩ মাইল পশ্চিমে সন্ধ্যায় আমাদের আর একটি এম্বুশ পার্টি পাকসেনাদের আর একটি কনভয়কে অ্যামবুশ করে। ফলে পাকসেনাদের ৩ জন নিহত এবং ৫ জন আহত ও একটি ট্রাক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ আমাদের এম্বুশ পার্টির হস্তগত হয়। এছাড়া একটি মটর সাইকেলও দখলে নেয়। এম্বুশের খবর পেয়ে পাকসেনারা তাদের হাজীগঞ্জ ক্যাম্প থেকে আমটি শক্তিশালী কোম্পানি আমাদের এম্বুশ পার্টিকে আক্রমণ করার জন্য পাঠিয়ে দেয়। এই কোম্পানিটি ১ ঘণ্টা পর ঘটনাস্থলে আসে। ততক্ষণে আমাদের এম্বুশ পার্টি সংঘর্ষ শেষে মোটামুটি প্রস্তুত হয়েই অপেক্ষা করছিল। পাকসেনারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের এম্বুশ পার্টি আবার তাদের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এর ফলে পাকসেনাদের ১২ জন নিহত ও ১০ জন আহত হয়। এরপর আমাদের দলটি অবস্থান পরিত্যাগ করে নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসে। পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল হাজীগঞ্জের নিকট নরসিংপুরে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে। এই ঘাঁটি থেকে পাকসেনারা ঐ এলাকার চতুর্দিকে ত্রাসের সৃষ্টি করে। এই ঘাঁটিকে আক্রমণ করার জন্য লেঃ মাহবুব নিয়মিত ও গণবাহিনীর একটি সম্মিলিত কোম্পানি পাঠিয়ে দেয়। এই কোম্পানিটি ১৭ই জুলাই তারিখ হাজীগঞ্জের দক্ষিণে তাদের অস্থায়ী গোপন অবস্থান তৈরি করে। এরপর পেট্রোল পাঠিয়ে পাকসেনাদের অবস্থান সম্বন্ধে তথ্য যোগাড় করে। ১৭ই জুলাই সন্ধ্যায় আমাদের কোম্পানিটি অতর্কিত পাকসেনাদের ঘাঁটির উপর আক্রমণ করে। আক্রমণের ফলে পাকসেনাদের ১৩জন নিহত ও অনেক আহত হয়। এরপর আমাদের কোম্পানিটি অতর্কিত পাকসেনাদের ঘাঁটির উপর আক্রমণ করে। আক্রমণের ফলে পাকসেনাদের ১৩ জন নিহত ও অনেক আহত হয়। এরপর আমাদের কোম্পানিটি নিরাপদে নিজ অবস্থানে ফিরে আসে।
ফরিদপুরে আমাদের গেরিলা দল তাদের কার্যকলাপ জুন মাস্যা চালিয়ে যাচ্ছিল। তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, তারা যেন বেসামরিক সাধন শাসন ব্যাবস্থা কে সম্পুর্ন অচল করে দেয়। এই প্ররিপ্রেক্ষিতে ১২জিন গেরিলারা চিকা নিদই এবং মুন্সেফ অফিস ধ্বংস করে সমস্ত অফিসিয়াল কাগজপত্র জ্বালিয়ে দেয়। ১৮ই জুলাই একটি দল গসাইরহাট থার দামুদিয়া পুলিশ ফাঁড়ির উপর আক্রমণ চালিয়ে ফাঁড়ি ধ্বংস করে দেয়। ফাঁড়ি থেকে ৫টি রাইফেল, প্রচুর গুলি এবং একটি ওয়ারলেস সেট দখল করে নেয়। গেরিলা দল দামুদিয়া তহশিল অফিস ও সার্কেল অফিস জ্বালিয়ে দেয়। এই ঘটনার দুদিন পর আরও একটি গেরিলা দল দামুদিয়া তহশিল অফিস ও সার্কেল অফিস জ্বালিয়ে দেয়। এই ঘটনার দুদিন পর আরও একটি গেরিলা দল ভেদরগঞ্জ থানা আক্রমণ করে দুজন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশকে আহত করে এবং একটি ওয়ারলেস সেট হস্তগত করে। সঙ্গে সঙ্গে তহশিল অফিস ও পালং থানার আঙ্গালিয়া বাজারে জুট গোডাউন আগুন লাগিয়ে ২৫ হাজার মণ পাট জালিয়ে দেয়া হয়। গেরিলারা আঙ্গালিয়া তহশিল অফিসও জ্বালিয়ে দেয়। এসব কার্যকলাপের ফলে মাদারীপুরের শাসনব্যাবস্থা অচল হয়ে যায়।
শালদা নদীতে এবং মন্দভাগে ক্যাপ্টেন গাফফার এবং মেজর সালেক পাকবাহিনীকে বার বার আঘাত করতে থাকে। আমাদের রেকি পার্টি খবর নিয়ে আসে যে, ২৪ শে জুলাই বিকেল ৩টার সময় পাকসেনারা নওগাঁও স্কুলে স্থানীয় দালালদের নিয়ে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। এই সংবাদ পেয়ে ক্যাপ্টেন গাফফার একটি প্লাটুন মর্টার সহ নওগাঁর নিকট পাঠিয়ে দেয়। বিকেল ৫টায় পাকসেনাদের ৫০-৬০ জন লোক ও স্থানীয় দালালরা স্কুল প্রাণগণে সমবেত হয়ে তাদের আলোচনা সভা শুরু করে। সভা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরই আমাদের প্লাটুনটি মর্তারের সাহায্যে পাকসেনাদের এই সমাবেশের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। ফলে আলোচনা সভা বেঙে যায় এবং পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পাকসেনাদের ৩০জন লোক ৭ জন দালালসহ নিহত হয়। আমাদের প্লাটুনটি নিরাপদে ফিরে আসে। পাকসেনারা শালদা নদীর দক্ষিণে মনোরা ভাঙ্গা রেলওয়ে সেতুটি মেরামত করার জন্য আবার চেষ্টা চালায়। ২৬শে জুলাই সকাল ১০টায় পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল তাদের শালদা নদী অবস্থান থেকে মনোরা সেতুর নিকট সমবেত হয়। এরপর সেতুর চতুর্দিকে তারা বাঙ্কার তৈরির প্রস্তুতি নেয়। সংবাদ পেয়ে মেজর সালেক মর্টারসহ একটি প্লাটুন পাকসেনাদের মনোরা সেতু থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্যে পাঠিয়ে দেয়। বিকেল ৪টায় আমদের দলটি আগরতলার নিকট অবস্থান নেয় এবং পাকসেনাদের উপর মর্টার এবং মেশিনগানের সাহায্যে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। আমাদের গোলাগুলিতে পাকসেনারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পরে এবং তাদের অনেক হতাহত হয়। মনোরা সেতু থেকে তারা পালিয়ে যায়। পরে বিশ্বস্ত সূত্রে আমরা জানতে পারলাম যে পাকসেনাদের কমপক্ষে ৪ জন নিহত এবং অনেক আহত হয়।
২৬শে জুলাই ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন একটা এম্বুশ পার্টি নওগাঁ এবং আক্সিনার মাঝামাঝি রাস্তায় এম্বুশ পাতে। পাকসেনাদের একটি দল নওগাঁর পথে সেই এম্বুশে পরে যায়। ফলে ৭ জন পাকসেনা নিহত ও ৪ জন আহত হয়। আমাদের একজন গুরুতরভাবে আহত হয়। প্লাটুনটি ফেরার পথে কল্যাণসাগরে আবার একটি এম্বুশ পেতে বসে থাকে। পাকসেনাদের একটি কোম্পানি সাইদাবাদ থেকে কসবার পথে সেই এম্বুশে পড়ে যায়। ফলে ২১ জন পাকসেনা ও ১ জন দালাল নিহত হয় এবং ৯ জন আহত হয়। পাক পেট্রোল পার্টির একটি ট্রাক ও ধ্বংস হয়। ঐ দিন ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের একটি কমান্ডো দল বগাবাড়িতে একটি রেলওয়ে ব্রিজ ও ২-৩ টি টেলিফোন পাইলন উড়িয়ে দেয়। আমরা যেসব গেরিলাদের ঢাকা এবং কুমিল্লার পশ্চিম ও ভৈরব বাজার এলাকায় পাঠাতাম, তারা কসবার উত্তর দিকে ছাতুরা ও নবীনগর হয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় কার্যকলাপ সম্বন্ধে খবরাখবর নেয়ার জন্য পাকসেনারা দালালদের নিযুক্ত করে এবং আমাদের অনুপ্রবেশের রাস্তাকে বন্ধ করার জন্য রাজাকারদের রাস্তায় এবং নদীপথে পাহারায় মোতায়েন করে। এই সব দালাল এবং রাজাকাররা আমার অপারেশনের জন্য অসুবিধার সৃষ্টি করে। দালালদের ধরার জন্য এবং রাজাকারদের সমুচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন ও লেঃ হারুন কে আমি নির্দেশ দেই। নির্দেশ অনুযায়ী ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন এবং লেঃ হারুন বিভিন্ন স্থানে তাদের লোকজনকে দালালদের বিরুদ্ধে সতর্ক করে দেয় এবং এম্বুশ পেতে রাখে। ২৫শে জুলাই সন্ধ্যায় নরসিংহের নিকট লেঃ হারুনের লোক পাকসেনাদের ৬ জন দালালকে এম্বুশ করে বন্দি করে। এদের নিকট ১৪ পাউন্ড বিস্ফোরক, ৩টি গ্রেনেড পাওয়া যায়। এর পরদিন আরও ৭ জন দালাল আমাদের এম্বুশে ধরা পরে এবং তাদের কাছ থেকে দুটি রাইফেল, ৪টি হ্যান্ড গ্রেনেড, ১টি ওয়ারলেস সেট এবং ১২০ রাউন্ড গুলি পাওয়া যায়। এর পর থেকে আমাদের এলাকাতে আর সাহস পায়নি। বন্দি দালালদের কাছ থেকে যানা যায় যে তাদেরকে পাকিস্তানী অফিসাররা প্রশিক্ষণ দিয়েছে এবং সঙ্গে করে এনে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের নিকট ছেড়ে দেয়। তাদের উপর নির্দেশ ছিল মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে যাওয়ার জন্য অন্যথায় তাদের পরিবার বর্গের উপর কঠোর ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হবে। এরপর রাজাকারদের শায়েস্তা করার জন্য ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন একটি কোম্পানি পাঠিয়ে দেয়। এই কমান্ডো কোম্পানিটি ছাতুরার নিকট রাজাকার ক্যাম্পের উপর ২৫শে জুলাই অতর্কিতে হামলা চালায়। হামলার ফলে ১৬ জন রাজাকার নিহত এবং ৫ জন আহত হয়। ঐ এলাকার রাজাকাররা ভিত হয়ে সম্পূর্ণভাবে আমাদের নিকট আত্মসমর্পণ করে। তারা পরদিন তাদের নেতাকে আমাদের ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয় এবং মুক্তিবাহিনীর সাথে সহায়তা করার অঙ্গীকার দেয়। এছাড়া অনেক রাজাকার মুক্তিবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। এর পর থেকে যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত এই এলাকার রাজাকারদের সক্রিয় সহায়তা মুক্তিবাহিনী সব সময় পেয়েছে। অনেক সময় রাজাকাররাই আমাদের গেরিলাদেরকে নিরাপদ রাস্তায় তাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছেছে। সি এন্ড বি রাস্তায় যে সেতুর নিচ দিয়ে আমাদের গেরিলারা নৌকায় যাতায়াত করত রাজাকাররা সেই সেতুর উপর পাকসেনাদের গতিবিধি সম্পর্কে সংকেত দিত। কোন সময় যদি পাকসেনারা ঐ জায়গায় টহলে আসতো তবে আগে থেকে হারিকেনের লাল আলো বা টর্চের সাহায্যে সংকেত দিয়ে আমাদের জানাত। আর ফলে এই রাস্তাটি আমাদের জন্য সম্পুর্ণ নিরাপদ হয়ে যায়।
মেজর সালেক একটি ডিমলিশন পার্টি ও একটি কমান্ডো প্লাটুনকে ২৮শে জুলাই রাত ২টার সময় হরিমঙ্গলে পাঠিয়ে দেয়। এই দলটি হরিমঙ্গলের নিকটে রেলওয়ে সেতুটির রেকি করে এবং সকাল সাড়ে ৬টা পর্যন্ত ডিমলিশন বানিয়ে সেতুটিকে উড়িয়ে দেয়। বিস্ফোরণের ফলে সেতুটির মাঝখানে ৪০ ফুটের একটি গ্যাপ সৃষ্টি হয়। এছাড়া সেতুটি দখন পাশে ২৭০ ফুট রেলওয়ে লাইন বারুদ লাগিয়ে নষ্ট করে দেয়া হয়। এর পরদিন এই ডিমলিশন পার্টি বিজন্মা রেলওয়ে সেতুটি বারুদ লাগিয়ে উড়িয়ে দেয়। ২৮শে জুলাই সকাল ৮তায় পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল বিজন্মা ব্রিজের নিকট পরিদর্শনে আসে। ঠিক সেই সময় আমাদের কামান তাদের উপর গোলাগুলি করে। ফলে পাকসেনাদের ৩ জন নিহত ও ৭ জন আহত হয়। পাকসেনারা সেই অবস্থান পরিত্যাগ করে কায়েক গ্রামের দিকে পলায়ন করে। এরপর পহেলা আগস্ট পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী কোম্পানি হরিমঙ্গল সেতুর নিকট অগ্রসর হয় এবং সেখানে তাদের ঘাঁটি গড়ার চেষ্টা করে। এবারো আমাদের সৈন্যরা তাদের অগ্রসরে বাঁধা দেয়। আমাদের সৈন্যদের গোলাগুলিতে পাকসেনাদের ৩০ জন হতাহত হয়। ফলে পাকসেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
কসবার টি আলির বাড়িতে পাকসেনাদের যে অবস্থান ছিল, সে অবস্থা থেকে পাকসেনারা চাল পর্যন্ত প্রায়ই যাতায়াত করত। এই সংবাদ লাটুমুরার নিকট লেঃ হুমায়ুন কবির সংগ্রহ করে। সে আরও জানতে পারে যে কাচা রাস্তায় পাকসেনাদের কমপক্ষে একটি কোম্পানি যাতায়াত করে। পাকসেনাদের এই দলকে আক্রমণ করার জন্য লেঃ কবির একটি প্লাটুন পাঠিয়ে দেয়। এই প্লাটুনটি এই প্লাটুনটি কল্যাণসাগরের নিকট ২৩শে জুলাই ভোর সোয়া ৪টায় এম্বুশ পড়ে যায়। আমাদের যোদ্ধাদের অতর্কিত গুলির আঘাতে পাকসেনাদের ২০জন নিহত ও ৮ জন আহত হয়। ১ জন স্থানীয় দালাল, যে পাকসেনাদের পথনির্দেশক ছিল, সেও মারা যায়। ২-৩ ঘণ্টা যুদ্ধের পড় পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং আমাদের লোকেরা অবস্থান তুলে নিজ ঘাঁটিতে ফেরত আসে।
কসবার উত্তরে পাকসেনাদের গোসাই স্থানে একটি শক্ত ঘাঁটি ছিল। এই ঘাঁটিতে অন্তত ৪০-৫০ জন পাকসেনা অবস্থান করছিল। আমাদের যেসব গেরিলা ঢাকার পথে যাতায়াত করত, এই অবস্থান থাকাতে তাদের যাতায়াতের গোপন পথে বিপজ্জনক হয়ে যায়। এই ঘাঁটিটি ধ্বংস করে দিয়ে যাতায়াতের গোপন পথে নিরাপদ করার জন্য আইনউদ্দিন ৪র্থ বেঙ্গলের ডি কোম্পানিকে পাঠায়। ডি কোম্পানি ৩১শে জুলাই রাত ১০টার সময় দক্ষিণ থেকে অগ্রসর হয়ে গোসাই স্থান অবস্থানের নিকট পৌঁছে। এই অবস্থানটি রেকি পূর্বেই করা ছিল। পাকসেনাদের অবস্থানটির দক্ষিণ হতে ডি কোম্পানি অতর্কিত আক্রমণ চালায়। আক্রমণের ফলে পাকসেনারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যায়। আক্রমণ ২-৩ ঘণ্টা চলে। ডি কোম্পানির সৈন্যরা বেশ কয়েকটি বাঙ্কার ধ্বংস করে দেয় এবং অন্তত ২০ জন পাকসেনাকে হতাহত করে। আক্রমণের প্রবল চাপে টিকতে না পেরে পাকসেনারা গোসাই স্থান পরিত্যাগ করে পিছনে পলায়ন করে।
শালদা নদীতে আমাদের সঙ্গে পাকসেনাদের সঙ্ঘর্ষ পুরো জুলাই মাস চলতে থাকে। ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে শালদা নদীর শত্রু অবস্থানটির উত্তর দিকে ৪র্থ বেঙ্গলের সি কোম্পানি মোটামুটি ঘিরে ফেলেছিল। এদিকে দক্ষিণ দিকে আগরতলা ও কাঁটামোড়ায় মেজর সালেক ৪র্থ বেঙ্গলের এ কোম্পানি দিয়ে পাকসেনাদের শালদা নদী অবস্থানের উপর চাপ দিয়ে যাচ্ছিল। পাকসেনাদের পিছন থেকে সরবরাহের রাস্তা একমাত্র নদী ছাড়া সবই প্রায় বন্ধ হয়ে গেছিলো। নদীপথেই লুকিয়ে মাঝে মাঝে পাকসেনাদের অবস্থানে রসদপত্র সরবরাহ করা হত। এই সরবরাহ পথে পাকসেনাদের এম্বুশ পেতে বসে থাকে। রাত ১টার সময় ৭-৮ টি নৌকায় প্রায় ১৫০ জন সৈন্য ও অন্যন্য সরবরাহ সহ পাকসেনারা তাদের শালদা নদী অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়। নৌকাগুলি যখন এম্বুশ অবস্থানের ভিতরে আসে আমাদের প্লাটুনটি মেশিনগানের সাহায্যে গুলি চালাতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে নৌকা ডুবে যায়। পাকসেনারাও পিছন হতে পাল্টা গোলাগুলি শুরু করে। সঙ্ঘর্ষ প্রায় অর্ধঘণ্টা স্থায়ী থাকে। এরপর পাকসেনাদের পিছনের নৌকাগুলি ফেরত চলে যায়। এই সঙ্ঘর্ষে পাকসেনাদের প্রায় ৬০-৭০ জন হতাহত হয় , ৪-৫ টি নৌকা ডুবে যায় এবং অনেক রসদ নষ্ট হয়। নৌকার আরোহী পাকসেনারা ডুবে যায়। পাকসেনাদের গুলিতে আমাদের ৪ জন নিহত ও একজন আহত হয়।
কুমিল্লার উত্তরে কালামছড়ি চা বাগানের নিকট পাকসেনাদের একটি ঘাঁটি ছিল। এখানে মাসাধিককাল ধরে পাকসেনা ও মুক্তি বাহিনীর মধ্যে সঙ্ঘর্ষ চলে আসছিল। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে অতিস্ট হয়ে পাকসেনারা কালামছড়ি চা বাগানে বাঙ্কার তৈরি করে। ২রা আগস্ট রাত ১২টার সময় লেঃ হারুনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি ক্ষুদ্র দল শত্রুঅবস্থানের উপর হামলা চালায়। পাকসেনাদের এক কোম্পানি সৈন্য কামান এবং মর্টারের সহায়তায় শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলেছিল। ২রা আগস্ট মুক্তিবাহিনীর অমর সাহসী ক্ষুদ্র দলটি হ্যান্ড গ্রেনেড ও ৩০৩ রাইফেলের সাহায্যে আক্রমণ চালায়। গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে শত্রুদের ১০টি বাঙ্কার ধ্বংস করে দেয়। পাকসেনারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ৫০ জন নিহত সঙ্গীকে ফেলে পিছনে গ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। সেখানেও গ্রামের লোক দ্বারা আক্রান্ত হয়ে অনেক পাকসেনা নিহত হয়। দুজন পাকসেনা আমাদের হাটে বন্দি হয়। এম জি আই এ ও মেশিনগান সহ অনেক অস্ত্রশস্ত্র এবং ২০-২৫ হাজার গুলি আমাদের হস্তগত হয়। এছাড়া অনেক খাদ্যসামগ্রী ও কাপড় আমাদের হস্তগত হয়। আমাদের পক্ষে দুজন মুক্তিসেনা নিহত হয়। জুলাই মাসে নোয়াখালীতে অপারেশনের জন্য ১৪ জন গণবাহিনীর গেরিলা গোপন পথে চৌদ্দগ্রামে আলোকরা বাজার হয়ে দক্ষিণ দিকে যাচ্ছিল। রাত ১টার সময় বাজারের নিকটে শত্রুদের একটি দল অতর্কিতে গেরিলাদের উপর আক্রমণ চালায়। আমাদের গেরিলারা সাহসের সঙ্গে আক্রমণের মোকাবিলা করে, কিন্তু শত্রুদের আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে ছত্রভঙ্গ হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। সঙ্ঘর্ষে আমাদের একজন গেরিলা নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। এবং বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র ফেলে তারা পালিয়ে আসে। হাবিলদার গিয়াসের নেতৃত্বে যে দলটি হোমনা থানায় অবস্থান করছিল সেই দলটি ২৮শে জুলাই রাতে হোমনা থানার সাঘুটিয়া (হোমনা, বাঞ্ছারামপুর, রামচন্দ্রপুরের সঙ্গমস্থল) লঞ্চঘাটে পাকবাহিনীর টহলদার একটি লঞ্চের উপর এম্বুশ ফাঁদে আটকা পড়ে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সুবেদার গিয়াসের দল আকস্মিকভাবে শত্রুদের উপর হামলা চালায়। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রায় ২০-২৫ মিনিট পর্যন্ত পাকসেনারা কোন জবাব দেয়না। দুর্ভাগ্যবশত রকেট লাঞ্চার কাজ না করায় সুবেদার গিয়াসের দল লঞ্চটাকে ডুবাতে সক্ষম হয়নি। ১ ঘণ্টা ধরে উভয় পক্ষে প্রচণ্ড সংঘর্ষ চলে। পাকসেনারা বিক্ষিপ্তভাবে মর্টারের গোলা ছুড়তে থাকে। সুবেদার গিয়াসের দলের এতে কোন ক্ষতি হয়নি। ১ঘন্টা সঙ্ঘর্ষের পর পাকসেনাদের লঞ্চটি পালিয়ে যায়। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের পিছে ধাওয়া করে। পাকসেনাদের হতাহতের সংবাদ সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা না গেলেও প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে প্রকাশ ক্ষতবিক্ষত লঞ্চটি দেড় ঘণ্টা হোমনা থানার ঘাটে নোঙ্গর করে থাকে। সেখানে বেশ কিছু আহতকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয় এবং অবশেষ অনেক মৃতদেহ সহ লঞ্চটি ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করে। জুলাই মাসে পাকসেনারা চট্টগ্রাম-কুমিল্লা রোড খুলতে চেষ্টা করে। এই সময় মাঝে মাঝে পাকসেনাদের শক্তিশালী দল এই রাস্তায় টহল দেয়ার জন্য আসত। চৌদ্দগ্রামের উত্তরে ও দক্ষিণে ইমামুজ্জামান এইসব পাকসেনাদের টহলদারি দলগুলোকে তাড়িয়ে দিত।
৩০ শে জুলাই সকাল ৭টায় ইমামুজ্জামানের একটা প্লাটুন চৌদ্দগ্রামের ৪ মাইল দক্ষিণে নানকরা নামক স্থানে এম্বুশ পাতে। এম্বুশ পার্টি সারাদিন অপেক্ষা করার পড় জানতে পারে যে জগন্নাথ দীঘির নিকট একটি জিপ টহলে বেরবার জন্য তৈরি হচ্ছে। এই জিপকে এম্বুশ করার জন্য অ্যামবুশ পার্টি তখনি তৈরি হয়ে যায়। সন্ধ্যাসাড়ে ৬টার সময় পাকবাহিনীর এই জীপটি চৌদ্দগ্রামের ডিকে অগ্রসর হয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের এম্বুশ অবস্থানে পৌঁছে। পৌছার সঙ্গে সঙ্গে অ্যামবুশ পার্টি জিপটির উপর মেশিনগান এবং হাল্কা মেশিনগান থেকে গুলি চালায়। গুলিতে ড্রাইভার আহত হয়। ৬ জন পাকসেনা জিপ থেকে লাফিয়ে নিচে নামে, কিন্তু তারাও আমাদের এম্বুশ পার্টি গুলিতে নিহত হয়। পরে এম্বুশ পার্টি একটি মৃত পাক সেনার পকেটে একটি চিঠি পায়। তা থেকে জানা যায় এই পাকসেনারা ২৯ তম বেলুচ রেজিমেন্টের সি কোম্পানির লোক। নিহত পাকসেনাদের নিকট হতে রাইফেল এবং যথেষ্ট গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। একজন আহত পাকসেনা আমাদের হাটে বন্দি হয়। এই অ্যামবুশের পর পাকসেনারা কুমিল্লা থেকে আরও সৈন্য চৌদ্দগ্রামে নিয়ে আসে এবং সারারাত ধরে আমাদের অবস্থানের উপর মর্টার এবং কামানের গোলা নিক্ষেপ করে। আমাদের লোকেরাও শত্রু অবস্থানের উপর মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করে। পরদিন ৩১শে জুলাই সকালে পাকিস্তানীদের একটি কোম্পানি চৌদ্দগ্রাম থেকে ও আর একটি কোম্পানি জগন্নাথ দীঘি থেকে ট্রাঙ্ক রোড হয়ে আমাদের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পাকসেনারা যখন আমাদের অবস্থানের ২০০ গজের মধ্যে পৌঁছে তখনি আমাদের এম্বুশ অবস্থান থেকে তাদের উপর অতর্কিত গুলি চালানো হয়। গুলির আঘাতে ২০ জন পাকসেনা রাস্তার উত্তরে এবং ৬ জন দক্ষিণে আহত ও নিহত হয়। পাকসেনারা কামানের গোলার সহায়তায় পিছনে সরে যেতে থাকে। এই সময়েও আমাদের গুলির আঘাতে আরও কিছু সৈন্য হতাহত হয়। এরপর আমাদের এম্বুশ পার্টি সেই অবস্থান পরিত্যাগ করে হরিশ্বরদার হাটের নিকট নতুন অবস্থান নেয়। এর দুদিন পড় দোসরা আগস্ট সকাল ৭তায় পাকসেনাদের একটি ব্যাটালিয়ন উত্তর, দক্ষিণ, পশ্চিম হতে হরিশ্বরদার হাটের দিকে অগ্রসর হয়। এই সময়ে আমাদের অবস্থানে লেঃ ইমামুজ্জামান আরও দুটি প্লাটুন পাঠিয়ে অবস্থানটি শক্তিশালী করে। পাকসেনারা হরিশ্বরদার হাটের নিকট অবস্থিত ৩টি ভাঙ্গা সে পর্যন্ত অগ্রসর হয় এবং সেখানে পিছন থেকে গোলাগুলি চালায়। আমাদের কোম্পানিটিও সাহসের সঙ্গে পাকসেনাদের আক্রমণকে প্রতহত করতে থাকে। সমস্ত দিনের যুদ্ধে পাকসেনাদের ২৫ জন হতাহত হয়। পাকসেনারা দোসরা আগস্ট রাতে প্রধান সড়কের উপর তাদের প্রতিরক্ষাবুহ্য তৈরি করে। এর পরদিন তাড়া ৩রা আগস্ট সমস্ত দিন ধরে পাকসেনাদের সাথে সঙ্ঘর্ষ চলে। ঐ দিন সন্ধ্যায় আমাদের কোম্পানিটি অবস্থা পরিত্যাগ করে তাদের ঘাঁটিতে ফিরে আসে।
পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল নয়ানপুর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় সুদৃঢ় ঘাঁটি করে অবস্থান করছিল। অনেক সময় এই অবস্থানের সঙ্গে অতীতে আমাদের যথেষ্ট সঙ্ঘর্ষ হয়। পাকসেনারা এই ঘাঁটিতে আরও বাড়িয়ে শালদা নদীর অবস্থান পর্যন্ত যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করছিল। মেজর সালেক পাকসেনাদের নয়ানপুর ঘাঁটি আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই ঘাঁটিতে পাকসেনাদের অন্তত এক কোম্পানির বেশী সৈন্য ছিল। পাকসেনারা স্টেশন ও নিকটবর্তী রেলওয়ে গুদাম এলাকায় তাদের সুদৃঢ় বাঙ্কার তৈরি করে। মেজর সালেক ভদের এই অবস্থানটি সম্বন্ধে বিস্তারিত খবরাখবর সংগ্রহ করে। এর পড় ৪র্থ বেঙ্গলের এ কোম্পানি এবং কিছু সংখ্যক গণবাহিনী নিয়ে রাত সাড়ে ১২টার সময় পাকসেনাদের অবস্থানের নিকট জমায়েত হতে থাকে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী রাত আড়াইটার সময় স্টেশনের ২০০ গজ উত্তরে রেললাইন পর্যন্ত প্রথম পর্যায়ে দখল করে নিতে সক্ষম হয়। এই সময়ে পাকসেনাদের গোলাগুলি ভীষণ তীব্র হতে শুরু করে এবং আমাদের সেনাদের আক্রমণ কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে। মেজর সালেক অন্য প্লাটুন অর্থাৎ যারা স্টেশনের দিকে ছিল তাদের আক্রমণ আরও তীব্র করার নির্দেশ দেয়। এই প্লাটুনটি পাকসেনাদের প্রবল গুলিবৃষ্টির মধ্যে রেললাইনের পাশ দিয়ে আস্তে আস্তে অগ্রসর হতে থাকে। এত প্লাটুনের লোকেরা রেলস্টেশনের ২৫ গজের মধ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। এবং পাকসেনাদের প্রায় ৬-৭টি বাঙ্কার উড়িয়ে দেয়। এই সময়ে স্টেশনের নিকটস্থ গুদাম এলাকা থেকে আমাদের লোকদের উপর তীব্র আক্রমণ শুরু হয়। অতর্কিত এই আক্রমণে আমাদের অনেক লোক হতাহত হয়। অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে। মেজর সালেকের পক্ষে আক্রমণ চালিয়ে যাওয়া আর সম্ভব হয় না। নিরুপায় হয়ে মেজর সালেক তার আহত ও নিহত সৈনিকদের নিয়ে পশ্চাতে হতে আস্তে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে আমাদের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ কোম্পানির ৭ জন নিহত ও ৯ জন আহত হয়। এই যুদ্ধে সৈনিকদের মনোবল কিছুটা করে যায়। পাকসেনার তাদের অবস্থান অক্ষত রাখতে সক্ষম হয়। আমার সেক্টরে এটাই ছিল প্রথম এবং সবচেয়ে মারাত্মক বিপর্যয় যাতে এতজন এক সাথে নিহত ও আহত হল।
ঢাকা এবং ঢাকার চারপাশে গেরিলারা তাদের কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছিল। ২৫শে জুলাই সকাল ৬টা পূবাইলের নিকট কালসজা স্থানে রেলওয়ে লাইনের ওপর বৈদ্যুতিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে একটি ট্রেন উড়িয়ে দেয়া হয়। ইঞ্জিন্সহ তিনটি রেলওয়ে বগি লাইনচ্যুত হয় এবং ইঞ্জিনে আগুন লেগে বিধ্বস্ত হয়। ট্রেনের আরোহী ৩০-৩৫ জন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ সেই সাথে নিহত হয়। বগিগুলি লাইনচ্যুত হয়ে পানিতে পড়ে যায়। গেরিলাদের আরেকটি দল ৪ঠা আগস্ট আড়াইহাজার থানার নিকট পাঞ্চকাপি সড়কসেতু এবং দরগাও সড়কসেতু উড়িয়ে দেয়। এর ফলে নরসিংদী – ডেমরার মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এদিকে ২৭শে জুলাই ৪ জনের একটি গেরিলা দল মতিঝিলের (পীরজঙ্গি মজার) নিকট বিদ্যুৎ সরবরাহ সাবস্টেশনের উপর আক্রমণ চালায়। পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ এই সাবস্টেশনটিকে পাহার দিচ্ছিল। গেরিলারা দুজন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশকে নিহত এবং বাকিদের নিরস্ত্র করে। তাড়া তালা ভেঙ্গে সাবস্টেশনে প্রবেশ করে ও সাব স্টেশনটি এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে ধ্বংস করে দেয়। ফলে মতিঝিল, কমলাপুর স্টেশন, শাহজাহানপুর , গোপীবাগে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। গেরিলা দলটি এরপর ফেরার পথে শাহজাহানপুরে রাজাকারদের দ্বারা আক্রান্ত হয়; কিন্তু সাহসের সঙ্গে পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে ৮-১০ জন রাজাকারকে নিহত করে নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসে। জুলাই মাসে শেষ সপ্তাহে আরে একটি গেরিলাদল সিদ্ধিরগঞ্জ এবং খিলগাঁও ও কমলাপুরের মাঝে বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনের পাইলন উড়িয়ে দেয়। ফলে টঙ্গি, কালীগঞ্জ প্রভৃতি শিল্প এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। ১৫ ই জুলাই পাগলা এলাকার গেরিলা দল ফতুল্লা এবং ঢাকার মাঝে একটি রেলওয়ে সেতু এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে উড়িয়ে দেয়। ফলে ঢাকা- নারায়ণগঞ্জ রেল যোগাযোগ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ফার্মগেটের নিকট পাকিস্তানীদের একটি চেকপোস্ট আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। কয়েকদিন গাড়িতে রেকি করার পড় তারা দেখতে পায় যে, পাহারারত মিলিটারি পুলিশ সব সময় মোটেই সতর্ক থাকে না। একদিন সন্ধ্যায় আলম, কাজি, গাজি এবং স্বপন নামের চার জন ঢাকার গেরিলা একটি গাড়ীতে ফার্মগেটে আসে। মিলিটারি চেক পোস্টের নিকটে পৌছার সময় তাদেরকে পাকসেনারা আস্তে নির্দেশ দেয়। তারা তাদের গাড়ীটি নির্দেশ অনুযায়ী দ্বিতীয় রাজধানীর দিকে মুখ করে রাস্তার পাশে দাড় করায়। চারজন পাকসেনা গাড়ীর দিকে চল্লাশির জন্য অগ্রসর হয়। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ী থেকে গেরিলারা তিনটি চায়নিজ স্টেনগান থেকে গুলি চালাতে থাকে। পাকসেনাদের অন্যান্য লোকও গাড়ীর দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। গেরিলা দল তাদের লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছোড়ে এবং তীব্র গতিতে গাড়ী চালিয়ে অবস্থান ত্যাগ করে। এ সঙ্ঘর্ষের ফলে পাকসেনাদের ৫ জন মিলিটারি পুলিশ আহত ও ৪ জন নিহত হয়। সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ফার্মগেট এবং কাওরান বাজার এলাকায় আতংকের সৃষ্টি হয়। ২রা আগস্ট ঢাকার গেরিলাদের আরেকটি দল ‘গ্যানিস’ এবং ‘ভোগ’ নামক দুটি বড় দোকানে গ্রেনেড ছুড়ে দোকান দুটির ক্ষতিসাধন করে।
লেঃ ইমামুজ্জামানের রেকি পার্টি সংবাদ নিয়ে আসে যে, পাকসেনাদের দুটি জিপকে রেশন এবং গোলাবারুদ সরবরাহের জন্য বালিয়াজুরি ভাঙ্গা ব্রিজের নিকট শত্রু অবস্থানের নিকট যেতে দেখা গেছে। লেঃ ইমামিজ্জামান তৎক্ষণাৎ একটি প্লাটুন জিপ দুটিকে এম্বুশ করার জন্য হরিসর্দার বালিয়াজুরি ব্রিজের নিকট পাঠিয়ে দেয়। লেঃ ইমামুজ্জামান প্লাটুনটি সঙ্গে সঙ্গে অবস্থান নিয়ে জিপের উপর রাইফেলের সাহায্যে গুলি চালাতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে পাকসেনাদের দুজন নিহত হয়। একটি জিপ মৃত সঙ্গীদের নিয়ে দ্রুত ঘুরে পালিয়ে যায়। অন্য জিপটির উপর প্লাটুনটি গুলি চালাতে থাকে। পাকসেনাদের রাস্তার পশ্চিম পাশে অবস্থান নিয়ে আমাদের প্লাটুনটির উপর গুলি চালাতে থাকে। তাদের গুলি ফুরিয়ে এলে তারা গাড়ি থেকে গুলি নেবার চেষ্টা করে – কিন্তু তাদের সে চেষ্টা ব্যার্থ হয়। এ আক্রমণে তাদের ৬ জন মারা যায়। পরে পাকসেনারা আমাদের এম্বুশ অবস্থানের উপর প্রচণ্ড গোলা ছুড়তে থাকে। বাধ্য হিতে আমাদের প্লাটুনটি অবস্থান পরিত্যাগ করে। শত্রুদের গাড়িটি বিধ্বস্ত হয়ে যায়। এরপর পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল দুপুর দেড়টার দিকে আমাদের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়। প্রচণ্ড সঙ্ঘর্ষে ১০ জন পাকসেনা নিহত এবং আরও কয়েকজন আহত হয়। পাকসেনারা বাধ্য হয়ে তাদের আক্রমণ পরিত্যাগ করে ফেরত চলে যায়।
মেজর সালেক ১০ই আগস্ট একটি প্লাটুন নিয়ে শালদা নদীর পশ্চিমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কুমিল্লা সি এন্ড বি রাস্তার নিকট শিলদাই গ্রামে তার গোপন ঘাঁটি স্থাপন করে। পরদিন স্থানীয় লোকের নিকট খবর পায় যে সি এন্ড বি রাস্তার উপর দিয়ে প্রতিদিন কুমিল্লা থেকে উজানিরশার পাক অবস্থানে ৩-৪ টি জিপ যাতায়াত করে। এই সংবাদ পেয়ে মেজর সালেক পাকসেনাদের জন্য সিএন্ড বি রাস্তায় একটা এম্বুশ পাতে। সমস্ত দিন ও রাত অপেক্ষা করার পরেও পাকসেনারা সেদিন আর আসেনি। বোঝা গেল যে হয়তো বা তাদের কোন ডালা বা রাজাকার আগে থেকেই এম্বুশ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছিল। অনেক অপেক্ষা করার পর রাস্তায় মাইন লাগিয়ে মেজর সালেকের দলটি তার ঘাঁটিতে রওনা হয়। পথে রসুল্গ্রামের নিকট একটি রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ চালায়। আক্রমণের সময় ক্যাম্প ভবনের ভিতর বেশ কয়েকটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। এই আক্রমণের ফলে ২০ জন রাজাকার নিহত ও ৩০ জন বন্দি হয়। এরপর দলটি নিজেদের অবস্থানে নিরাপদে ফিরে আসে।
শালদা নদী , মন্দভাগ এবং এর চতুর্দিকে আমাদের সৈন্যরা পাকসেনাদের উপর প্রায়ই আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। পাকসেনাদের হতাহতের সংখ্যাও দিন দিন আরও বেড়ে যাচ্ছিল। আমাদের আক্রমণের ফলাফল সম্বন্ধে দুটি সঠিক বিবরণ গ্রামবাসী মারফত জানতে পাই। শালদা নদীর শত্রু অবস্থানের উপর আমরা গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় গোলার আক্রমণ চালানোর ফলে আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে শত্রুপক্ষের অন্তত ৬০ জন নিহত হয়। বাধ্য হয়ে শত্রুরা স্টেশন ছেড়ে নয়ানপুর গ্রাম, শালদা নদী গোডাউন ইত্যাদি এলাকায় অবস্থান তৈরি করে। মন্দভাগেও শত্রু অবস্থানের ওপর আমাদের গোলার আক্রমণের ফলে পাকসেনাদের প্রায় ১৫০ জন হতাহত হয়। পাকসেনাদের একটি ১২০ এম এম মর্টারের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করা হয়। সন্ত্রস্ত পাকসেনারা বাধ্য হয়ে তাদের কামানের অবস্থানের পিছু হটিয়ে ব্রাহ্মণপাড়া নিয়ে যায়। আমাদের এম্বুশের ফলে শালদা নদুর রাস্তা পরিত্যাগ করা নাগাইশ হয়ে ব্রাহ্মণপাড়া থেকে একটি নতুন রাস্তা খোলার চেষ্টা করে। ১১ই আগস্ট পাকসেনাদের একটি কোম্পানি এই নতুন রাস্তায় আসে। আসার পথে নাগাইশ গ্রাম থেকে একজন স্থানীয় লোককে পথপ্রদর্শক হিসাবে নিয়ে আসে। এই লোকটি পরে আমাদের জানায় যে পাকসেনাদের মনোবল একেবারেই ভেঙ্গে গেছে। নৌকাতে আসার সময় অনেক সৈন্যই সামনে অগ্রসরে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। তাদের কমান্ডোরা অনেক ভাবে তাদের উৎসাহিত করার চেষ্টা চালায়। এছাড়াও তেদের অনেককে চিন্তিত ও বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। তারা তাদের পুরনো দাম্ভিক স্বভাব অনেকটা পরিত্যাগ করেছে। পাকসেনারা গ্রামবাসীদের সাথে মিশবার চেষ্টাও করছিল। শত্রুদের এই নতুন রাস্তার খবর পেয়ে মেজর সালেক একটি প্লাটুন পাঠিয়ে দেয়। প্লাটুনটি নাগাইশ গ্রামে পাকসেনাদের দুটি রসদ বোঝাই নৌকা ব্রাহ্মণপাড়া থেকে নয়ানপুরের দিকে যাচ্ছিল। আমাদের প্লাটুনটি তাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ করে এবং ১১ জন পাকসেনাকে নিহত করে নৌকাটি ডুবিয়ে দেয়।
কিছুক্ষণ পর পাকসেনাদের আরও ৩টি নৌকা শালদা নদী থেকে ব্রাহ্মণপাড়ার দিকে যাচ্ছিল। এই নৌকাগুলিকেও আমাদের এম্বুশ পার্টি শশিদল গ্রামের নিকট এম্বুশ করে এবং এতে ১০ জন পাকসেনা নিহত হয়। পরদিন পাকসেনাদের দুটি শক্তিশালী প্লাটুন আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের দমনে নাগাইশের দিকে অগ্রসর হয়। আমাদের প্লাটুনটি সংবাদ পেয়ে সুবেদার নজরুল ও নায়েব সুবেদার মনিরের নেতৃত্বে পাকসেনাদের এই দলটিকে নাগাইশ পৌছার আগেই অতর্কিত আক্রমণ করে ২৫ জন পাকসেনাকে নিহত করে। পাকসেনারা পিছু হতে যায়। ১৭ই আগস্ট ব্রাহ্মণপাড়া এই নদীপথ খোলার জন্য পাকসেনাদের একটি বিরাট দল নদীর পাড় দিয়ে অগ্রসর হয়। এবং সঙ্গে সৈন্য বোঝাই ৩টি নৌকাও অগ্রসর হয়। পাকসেনাদের এই দলটিকে আমাদের সৈন্যরা আবার এম্বুশ করে। অ্যামবুশের ফলে নৌকার আরোহী ১৮ জন পাকসেনা নিহত হয়। পাকসেনাদের যে দলটি পাড় দিয়ে আসছিল তাদের প্রবল চাপে বাধ্য হয়ে আমাদের সৈন্যরা পিছু হটে আসে। পাকসেনারা দুই তিনবার এম্বুশে পড়ার পরেও শালদা নদীর নাগাইশ-ব্রাহ্মণপাড়া যোগাযোগ খোলার চেষ্টা চালিয়ে থাকে। এই খাল ছাড়া পিছন থেকে শালদা নদীতে সরবরাহের আর কোন রাস্তা ছিল না।
১৯শে আগস্ট দুপুর ১২টার সময় পাকসেনাদের তিনটি নৌকা শালদা নদী থেকে ব্রাহ্মণপাড়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। এই নৌকাগুলি যখন ছোট নাগাইশের নিকট পৌঁছে তখন আমাদের সৈন্যরা নৌকাগুলির উপর আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা পালটা গুলি চালিয়ে আমাদের আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করে , কিন্তু আমাদের সৈন্যদের তীব্র আক্রমণের মুখে তাদের দুটি নৌকা ডুবে যায় এবং ২০ জন নিহত হয়। পিছনের নৌকাটি দ্রুত পিছনের ফিরে পাড়ে পৌঁছায়। পাকসেনারা নৌকা থেকে নেমেই আমাদের সৈন্যদের ওপর আক্রমণের চেষ্টা করে। প্রায় চার ঘণ্টা উভয় পক্ষে গোলাগুলি চলার পড় পাকসেনারা পিছু হটে যায়। ঐ দিনই বেলা ১টার সময় আমাদের কামানের গোলায় শালদা নদী গুদামে অবস্থিত পাকসেনাদের একটি বাঙ্কার ধ্বংস হয়। ফলে ৮জন পাকসেনা ঘটনাস্থলেই নিহত হয়।
মন্দভাগেও ৪র্থ বেঙ্গলের সি কোম্পানি অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে পাকসেনাদের চারটি বাঙ্কার ধ্বংস করে দেয়। ফলে ১১ জন নিহত ও তিনজন আহত হয়। লেঃ ইমামুজ্জামান পাকবাহিনীর হরিসর্দার হাটের অবস্থানের উপর তার চাপ রেখে যাচ্ছিল। এই চাপের ফলে পাকসেনাদের মনোবল দ্রুত ভেঙ্গে পড়েছিল। এই অবস্থানটিতে বরাবর অতর্কিত আক্রমণ এবং এম্বুশ চালানোর ফলে পাকসেনারা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে সব সময় সজাগ থাকত।
শত্রুদের এই অবস্থানটি মুক্ত করার জন্য একটি পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ভিতসন্ত্রস্ত পাকসেনাদের মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙ্গে দেয়ার জন্য অবস্থানটির নিকতবর্তী এলাকায় গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় যে, পাকসেনাদের এই অবস্থানটির ওপর মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ অবশ্যাম্ভাবি। ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট আক্রমণ করার জন্য অতিসত্বর হরিসর্দার হাটের দিকে উত্তর থেকে অগ্রসর হচ্ছে এবং তাদের সঙ্গে বন্ধুরাষ্ট্রের দেয়া অনেক কামানও আছে। এছাড়াও অনেক মুক্তিযোদ্ধা এ আক্রমণের জন্য একত্রিত হচ্ছে। এই ধরণের গুজব প্রায় ই পাকসেনাদের আমানগোন্ডা অবস্থানের এলাকায় প্রচার করা হচ্ছিল। এর ফলে পাকসেনাদের মনোবলে আরও ভাঙ্গন ধরে। ১৪ই আগস্ট আরও গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় যে, পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসেই এই আক্রমণ চালানো হবে। ১৪ই আগস্ট রাত ১০তার সময় লেঃ ইমামুজ্জামান কয়েকজন সিপাই আমানগোণ্ডার নিকটে গিয়ে লাইন পিস্তল এবং ২ ইঞ্চি মর্টারের সাহায্যে ইল্যুমিনেটিং প্যারাস্যুট বোমা ছোড়া হয় এবং কয়েক রাউন্ড গুলি চালানো হয়। এর পরদিন আমানগোন্ডা অবস্থানের নিকট পৌঁছে দেখা গেল যে, পাকসেনারা সমস্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান ছেড়ে রাতে ভয়ে পালিয়ে গেছে এবং এলাকাবাসী পাকসেনাদের পরিত্যাক্ত জিনিসপত্র সংগ্রহ করছে।
এ ছাড়াও পরে আমরা আরো অনেক সূত্রে জানতে পারি যে, মুক্তিবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ সম্বন্ধে পাকিস্তানীরা এত বেশী সন্দিহান এবং চিন্তিত হয়ে পড়েছিল যে, ১৩ই আগস্ট ঢাকা থেকে এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য এবং চারটি লাইট ট্যাংক কুমিল্লাতে আনা হয়। এই ব্যাটালিয়নটি বানাসিয়া থেকে গাজীপুর পর্যন্ত রেললাইনের পাশে প্রতিরক্ষা অবস্থান তৈরি করে, দুটি ট্যাংক কুমিল্লা বিমানবন্দরের নিকট মোতায়েন করে এবং বাকিগুলি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে রাখা হয়। কুমিল্লার সামরিক প্রশাসক ব্রিগেডিয়ার মাসুদ ঘোষণা করেন যে, যদি কোন বাঙ্গালী সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করে যে, মুক্তিবাহিনী তার বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে তবে তাকে সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। এইভাবে পাকবাহিনী তাদের দোষ মুক্তিবাহিনীর উপর চাপাবার প্রচেষ্টা চালায় এবং এইসব অভিযোগকে তাদের কাজে ব্যবহার করার চেষ্টা করে।
পাকসেনারা হোমনা থানায় একবার আক্রান্ত হবার পর এই থানাটিতে আবার পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ এবং কিছুসংখ্যক পাকসেনা মোতায়েন করে শক্তিশালী করে তোলে। থানাটিতে পাকসেনাদের অবস্থান শক্তিশালী হবার পর হোমনা এলাকায় মুক্তিবাহিনীর পক্ষে তাদের কার্যকলাপ চালিয়ে যাওয়াতে বাধার সৃষ্টি হয়। এই এলাকা আবার মুক্ত করার জন্য হাবিলদার গিয়াস থানাটিকে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথমে থানাটির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ খবর সংগ্রহ করে। স্থানীয় গেরিলাদেরকেও তার প্লাটুনের সঙ্গে একত্রিত করে। ১৫ই আগস্ট রাত ১২টার সময় আমাদের সম্মিলিত দলটি হোমনা থানার উপর অতর্কিত আক্রমণ করে। কিন্তু ২ ঘণ্টা তুমুল যুদ্ধের পর তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। যুদ্ধে তাদের ১০ জন নিহত ও ১৪ জন বন্দী হয়।
আমাদের দলটির দুজন আহত হয়। থানাতে ২৪টি রাইফেল, দুটি বন্দুক, ১৬টি বেয়োনেট, একটি ওয়্যারলেস সেট, দুটি টেলিফোন সেট, ১০টি গ্রেনেড ও দেড় হাজার গুলি আমাদের হস্তগত হয়। বন্দীদের থানা হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। হোমনা থানার বিস্তৃত এলাকা আমাদের নিয়ন্ত্রনে আসে। এর দুদিন পর হোমনা পতনের খবর পেয়ে পাকসেনাদের ৩টি দল মুরাদনগর থেকে হোমনার দিকে নৌকায় অগ্রসর হয়। মুরাদনগরে অবস্থিত আমাদের গেরিলারা এই সংবাদ পেয়ে যায়। স্থানীয় গেরিলা কমান্ডার মুসলেউদ্দিনের নেতৃত্বে দুপুর ২টার সময় নদীর পাড়ে অগ্রসরমান পাকসেনাদের জন্য এমবুশ পাতে।
মুরাদনগর থেকে ৮ মাইল দূরে সন্ধ্যা ৬টার সময় পাকসেনাদের নৌকাগুলি এমবুশে পড়ে যায়। আমাদের গেরিলাদের গুলিতে দুটি নৌকা ডুবে যায়। গোলাগুলিতে ১ জন ক্যাপ্টেনসহ ২৯ জন পাকসেনা এবং পাঁচজন রাজাকার নিহত হয়। আমাদের গেরিলারা ৩টি এমজি-৪২ এবং দুটি বেল্ট বক্স (৫০০ গুলিসহ), ৫০০ চাইনিজ রাইফেলের গুলি এবং ১টি ৩০৩-রাইফেল হস্তগত করে। অবশিষ্ট অস্ত্রশস্ত্র পানিতে ডুবে যাওয়ায় উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। কুমিল্লা থেকে তিন মাইল উত্তর-পূর্বে কংসতলাতে পাকসেনারা আগস্ট মাসে তাদের একটি ঘাঁটি স্থাপন করে। এই ঘাঁটিতে পাকসেনাদের অন্তত এক কোম্পানী শক্তি ছিল। পাকসেনাদের এই ঘাঁটির সংবাদ ক্যাপ্টেন মাহবুবের নিকট পৌঁছে। তিনি একটি পেট্রোল পার্টি পাঠিয়ে এই ঘাঁটি সম্বন্ধে বিস্তারিত খবর সংগ্রহ করেন। ১৬ই আগস্ট সন্ধ্যা ৭টায় ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে দুই প্লাটুন শত্রুঘাঁটির দিকে অগ্রসর হয়। রাত ২টায় ক্যাপ্টেন মাহবুবের দলটি পাকসেনাদের ঘাঁটির উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনীর সৈনিকেরা পাকঘাঁটির ভিতরে অনুপ্রবেশ করে পাকসেনাদের হতচকিত করে দেয়। তুমুল সংঘর্ষে কিংকর্তব্যবিমূঢ় পাকসেনাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। পাকসেনারা পর্যুদস্ত হয়ে তাদের ঘাঁটি ছেঁড়ে পালিয়ে যায়। আমাদের দলটি পলায়মান পাকসেনাদের খায়েশ বাজার এবং লক্ষ্মীপুর ঘাঁটি থেকেও হটতে বাধ্য করে। সমস্ত রাতের সংঘর্ষে পাকসেনাদের একজন অফিসারসহ ৩০ জন হতাহত হয়। এরপর আমাদের দলটি নিরাপদে তাদের কেন্দ্রে ফিরে আসে।
এর তিনদিন পর কুমিল্লার ১ মাইল উত্তরে আমাদের আরও একটি দল পাকসেনাদের জন্য একটি এমবুশ পেতে বসে থাকে। ২০শে আগস্ট রাত ৮টায় পাকসেনাদের একটি টহলদার প্লাটুন এই এমবুশের আওতায় পড়ে যায়। পাকসেনাদের প্লাটুনটি যখন পুরোপুরি আমাদের এমবুশ পার্টির সম্মুখে এসে যায় তখন আমাদের দলটি হালকা মেশিনগান এবং অন্যান্য অস্ত্রের সাহায্যে তাদের উপর গুলিবর্ষণ করে। পাকসেনারা অতর্কিত এই আক্রমণে হতচকিত হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করে। এই এমবুশে ১১ জন পাকসেনা নিহত এবং তিনজন আহত হয়। আমাদের দলটি পাকসেনাদের একটি এমজিআইএ মেশিনগান ও কয়েকটি জি-৩ রাইফেল দখল করে।
পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল জগন্নাথ দিঘীতে ঘাঁটি করেছিল। এই দলটি মাঝে মাঝে নিকটবর্তী চিয়ারা গ্রামে রাত্রিতে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করত। এই খবর আমরা পেয়ে যাই। ২৩শে আগস্ট মেজর জাফর ইমাম এই দলটিকে আক্রমণ করার জন্য দুটি প্লাটুন নিয়ে চিয়ারা গ্রামের নিকট পাকসেনাদের অপেক্ষায় অবস্থান করে। রাত সাড়ে ১২টায় জগন্নাথ দিঘী পাক অবস্থানের উপর মুক্তিযোদ্ধা একটি দল আক্রমণ চালায়। একই সঙ্গে চিয়ারা গ্রামে অবস্থিত পাকসেনাদের উপর মেজর জাফর ইমামের নেতৃত্বে আক্রমণ চালানো হয়। এই আক্রমণের ফলে চিয়ারা গ্রামে অবস্থিত পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং ২৪ জন পাকসেনা আমাদের মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত হয়। কিছু শত্রুসেনা আহত অবস্থায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। জগন্নাথ দিঘীতেও চারটি ব্যাঙ্কার আমাদের মুক্তিবাহিনী ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। নয়ানপুর রেল স্টেশনে পাকসেনাদের উপর ৪র্থ বেঙ্গলের ‘এ’ কোম্পানী এবং ‘সি’ কোম্পানী তাদের চাপ আরো জোরদার করে। ২৩শে আগস্ট সকাল ১১টায় উক্ত কোম্পানী দুটি মিলিতভাবে স্টেশনের উত্তর এবং দক্ষিণ দিক থেকে মর্টার ও ১০৬-রিকোয়েললেস রাইফেল নিয়ে পাক অবস্থানের উপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। ১০৬-রিকোয়েললেস রাইফেলের আঘাতে পাকিস্তানীদের বেশ ক’টি শক্ত ব্যাঙ্কার বিধ্বস্ত হয়। স্টেশনের কিছু দূরে একটি গুদাম ছিল। তার ভিতরেও পাকসেনারা ব্যাঙ্কার বানিয়েছিল। গুদামটিতেও রকেট মারা হয়। ফলে গুদামে আগুন ধরে যায়। রকেটিং-এর পর মর্টার এবং মেশিনগানের সাহায্যে শত্রু অবস্থানের উপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করা হয়। এই আক্রমণ এত সফল হয়েছিল যে, শত্রু অবস্থান থেকে ভীতসন্ত্রস্ত্র আর্তনাদ এবং চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। পাকিস্তানীরা আমাদের আক্রমণের জবাব দেবার সুযোগ পায়নি। শত্রুদের প্রকৃত হতাহতের সংখ্যা সে সময়ে জানা যায়নি। পরে আমরা গ্রামবাসী সূত্রে খবর পেয়েছি যে, আক্রমণে পাকসেনাদের যথেষ্ট হতাহত হয়েছে।
নোয়াখালী এবং বেলুনিয়াতে আমাদের সৈনিকরা এবং গেরিলা দল পাকসেনাদের নাজেহাল করে তুলেছিল। ২২শে আগস্ট পাকসেনাদের একটি দল সোনাগাজীর দিকে ট্রাকে অগ্রসর হচ্ছিল। আমাদের একটি দল রাস্তায় এন্টি-ট্যাংক মাইন পেতে ভোর ৫টায় পাকসেনাদের দলটিকে এমবুশ করে। মাইনের আঘাতে পাকসেনাদের তিনটি ট্রাক ধ্বংস হয় এবং সেই সঙ্গে তাদের ২০ জন সৈন্য নিহত হয়। এছাড়াও এমবুশ পার্টির গুলিতে প্রায় ৪০ জন পাকসেনা এবং রাজাকার হতাহত হয়। প্রায় এক ঘণ্টা যুদ্ধের পর আমাদের দলটি অবস্থান পরিত্যাগ করে নিরাপদে ফিরে আসে। এই ঘটনার দুদিন পর চৌদ্দগ্রাম এবং লাকসাম সড়কের উপর আমাদের গেরিলারা মাইন পুঁতে রাখে। পাকসেনাদের একটি ডজ গাড়ী মাইনের আঘাতে বিধ্বস্ত হয়। গাড়ীতে অবস্থানরত একজন অফিসার এবং একজন পাকসেনা নিহত হয়। একই সময় ফেনী থেকে একটি ট্রাক পাকসেনাসহ চৌদ্দগ্রামের দিকে আসছিল। আমাদের একজন গেরিলা ট্রাকের ভিতর একটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। প্রায় ২৫ জন পাকসেনা হতাহত হয়। অপরপক্ষে পাকসেনাদের গুলিতে আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শাহ্জাহান শহীদ হয় এবং একজন আহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়ে। গেরিলারা ফেনীর কাছে গুমদন্ডী রেলওয়ে লাইন ডিমোলিশন দিয়ে উড়িয়ে দেয়। ফলে ফেনী এবং কুমিল্লার মধ্যে ট্রেন যোগাযোগ সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ২১শে আগস্ট সকাল সাড়ে ৭টায় আমাদের একটি পেট্রোল পার্টি পাকসেনাদের একটি দলকে কুমিল্লার উত্তরে গাজীপুর রেলওয়ে সেতুর দিকে অগ্রসর হতে দেখে। আমাদের পেট্রোল পার্টিটি পুলের নিকট এমবুশ পেতে পাকসেনাদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। পাকসেনারা এমবুশ অবস্থানটির মধ্যে এসে যায় এবং আমাদের মুক্তিযোদ্ধা দ্বারা অতর্কিতভাবে আক্রান্ত হয়। এই আক্রমণে একজন লেফটেন্যান্ট সহ ছ’জন পাকসেনা নিহত হয় এবং অবশিষ্ট পাকসেনারা পালিয়ে বাঁচে। বহু অস্ত্রশস্ত্র এবং ম্যাপ আমাদের দখলে আসে।
৪র্থ বেঙ্গলের ‘সি’ কোম্পানী আগস্ট মাসের শেষের দিকে কুমিল্লার উত্তরে মন্দভাগ এবং সি-এন্ড-বি সড়কের উপর তাদের কার্যকলাপ জোরদার করে তোলে। ২৩শে আগস্ট রাত ১টায় ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে দুটি প্লাটুন মন্দভাগ বাজারের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। আক্রমণের সময় আমাদের সৈনিকেরা গ্রেনেড চার্জ করে পাকসেনাদের চারটি ব্যাঙ্কার ধ্বংস করে দেয়। এই আক্রমণে পাকসেনাদের অন্তত ২৫ জন নিহত এবং ১২ জন আহত হয়। আমাদের পক্ষে দু’জন মারাত্মকভাবে আহত এবং একজন শহীদ হন। ১ ঘণ্টা যুদ্ধের পর আমাদের যোদ্ধারা শত্রু অবস্থান পরিত্যাগ করে নিরাপদে ফিরে আসে। ২৫শে আগস্ট আমাদের একটি ডিমোলিশন পার্টি সি-এন্ড-বি সড়কের কালামোড়া সেতুতে প্রহরারত পাকসেনাদের আক্রমণ করে। সেতুটিকে আমাদের দলটি উড়িয়ে দেয়। ঐদিন ভোর ৫টায় পাকসেনাদের একটি জীপ দ্রুতগতিতে বিধ্বস্ত হয় এবং ঐ জীপের আরোহী তিনজন পাকসেনা নিহত হয়। আমাদের আরেকটি দল সি-এন্ড-বি রাস্তার উপর একটি এমবুশ পেতে রাখে।
২৫শে আগস্ট সকাল ৮টার সময় পাকসেনাদের একটি ডজ গাড়ী এমবুশের আওতায় এলে গাড়ীটি ধ্বংস করে দেয়া হয় এবং ডজের আরোহী চারজন পাকসেনাকে (একজন হাবিলদার ও তিনজন সিপাহি) বন্দী করা হয়। মুক্তিযোদ্ধারা এ যান থেকে ছ’টি রাইফেল, ২২৫ রাউন্ড গুলি, দুটি পিস্তল ও তিনটি গ্রেনেড হস্তগত করে। কুমিল্লার উত্তরে কামবাড়ি ও আম্রতলী এলাকায় পাকসেনারা প্রায়ই টহল দিতে আসত। পাকসেনাদের এই দলটিকে এমবুশ করার জন্য পরিকল্পনা নেয়া হয়। ২৫শে আগস্ট তারিখে আমাদের একটি প্লাটুন ক্যাপ্টেন দিদারুল আলমের নেতৃত্বে বিকেল চারটায় মর্টারসহ পাকসেনাদের টহল দেয়া রাস্তার পাশে এমবুশ পেতে বসে থাকে। সন্ধ্যা ছয়টার সময় পাকসেনাদের একটি কোম্পানী পার হয়ে জামবাড়ীর দিকে অগ্রসর হয়। এমবুশের নিকট পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে তাদের উপর প্রবলভাবে মর্টারের গুলিবর্ষণ করা হয়। পাকসেনারা এই আকস্মিত আক্রমণে ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাবার চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের এমবুশ পার্টি পলায়নপর শত্রুসেনাদের উপর মেশিনগান এবং হালকা মেশিনগানের সাহায্যে তাদের প্রতি আক্রমণ চালায়। এই এমবুশ ৩০ জন পাকসেনা নিহত এবং ১০ জন আহত হয়। অবশিষ্ট পাকসেনারা রাতের আঁধারে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়।
পাকসেনারা শালদা নদী এবং নয়নপুরে তাদের সরবরাহ নদীপথে পাঠাত। তাদের এই নদীপথ বন্ধ করার জন্য প্রায়ই পাকসেনাদের অবস্থানের পেছনে আমাদের এমবুশ পার্টি পাঠানো হতো। ২৩শে আগস্ট আমাদের এমবুশ পার্টি সেনেরবাজার অবস্থান নিয়েছিল। সকাল এগারোটায় পাকসেনাদের একটা নৌকা সেনেরবাজারের পশ্চিম পাড় ঘেঁষে আসতে থাকে। আমাদের এমবুশ পার্টি দ্রুত শত্রুর নৌকার উপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। এতে ৭ জন পাকসেনা নিহত হয়, অবশিষ্ট সৈন্যরা নৌকাটিকে তাড়াতাড়ি পশ্চিম তীরে ভিড়িয়ে নৌকা থেকে নেমে গ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। এই ঘটনার তিন দিন পর আমাদের আরেকটি টহলদার দল ব্রাহ্মণপাড়া গ্রামের নিকট পাকসেনাদের ছ’টি নৌকা নয়ানপুরের দিকে অগ্রসর হতে দেখে। প্রত্যেকটি নৌকায় ছয় থেকে আটজন করে পাকসেনা ছিল। টহলদার দলটি হাবিলদার সৈয়দ আলী আকবরের নেতৃত্বে সেনেরবাজারের নিকট নদীর পশ্চিম তীরে এমবুশ পেতে বসে থাকে। নৌকাগুলি যখন এমবুশের আওতায় আসে তখন আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা নৌকাগুলোর উপর মেশিনগানের সাহায্যে গুলিবর্ষণ শুরু করে। প্রথম নৌকাটি গুলির আঘাতে উল্টে যায় এবং তিনজন পাকসেনা নিহত হয়। অবশিষ্ট তিনজন আরোহী পানিতে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে। আমাদের আরেকটি দল সুবেদার নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে পলায়নপর পাকসেনাদেরকে নাগাইশ গ্রামের কাছে আক্রমণ করে এবং তাদের তিনটি নৌকা ডুবিয়ে দেয়। এতে আঠারজন পাকসেনা পানিতে ডুবে মারা যায়। শুধু দুটি নৌকা থেকে পাকসেনারা রক্ষা পায় এবং নয়ানপুরের দিকে পলায়ন করে। এই সংঘর্ষে আমাদের ছাত্র গেরিলা আবদুল মতিন বুলেটবিদ্ধ হয়ে শাহাদাৎ বরণ করেন।
২৭শে আগস্ট সকালে পাকসেনারা নয়ানপুরের পশ্চিম পাশে শশীদল গ্রামের নিকট তাদের সৈন্য সমাবেশ করে সেনের বাজারের দিকে অগ্রসর হয়। পাকসেনাদের এই দলটি মর্টারের গোলার সাহায্যে সেনের বাজারের উপর প্রচণ্ড আক্রমন চালায়। সমস্ত দিন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে প্রচণ্ড গুলি বিনিময় হয়। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় আমাদের সেনারা পাকসেনাদের আক্রমণকে প্রতিহত করে। পাকসেনারা অগ্রসর হতে ব্যর্থ হয়ে পিছু হটে যায়। পরে জানা যায় যে, এই সংঘর্ষে ১৫ জন পাকসেনা নিহত হয়।
২৮শে আগস্ট পাকবাহিনী ব্রাহ্মণপাড়া থেকে নৌকায় শালদা নদীর দিকে অগ্রসর হওয়ার পথে আবার আমাদের এমবুশ পার্টি দ্বারা আক্রান্ত হয়। এই এমবুশে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুসেনাদের পাঁচটি নৌকা ডুবিয়ে দেয়। এখানে একজন ক্যাপ্টেনসহ প্রায় ৩০ জন পাকসেনা হতাহত হয়। এর ফলে পাকসেনাদের জন্য নদীপথে অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলোতে সরবরাহ পুরোপুরিভাবেই বন্ধ হয়ে যায়।
৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘এ’ কোম্পানীর একটি টহলদার দল মাধপুর এলাকার নিকটে ২৭শে আগস্ট তাদের গোপন বেইস গড়ে তোলে। এখান থেকে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে কার্যকলাপ চালিয়ে যাবার জন্য সি-এন্ড-বি সড়কে তাদের লোক পাঠায়। ২৮ তারিখে সকাল সাতটায় খবর আসে যে, পাকসেনারা একটি জীপ ও ট্রাকে সি-এন্ড-বি সড়ক থেকে কাঁচা রাস্তায় মাধবপুরের দিকে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালানোর জন্য এগিয়ে আসছে। আমাদের টহলদার দলটি এই সংবাদ পেয়ে মাধবপুর গ্রামের বাইরে কাঁচা রাস্তায় যে পথে পাকসেনারা অগ্রসর হচ্ছিল সেখানে একটি এমবুশ পেতে বসে থাকে। এগারটার সময় পাকসেনাদের জীপ এবং ট্রাকটি এমবুশের আওতায় আসে। আমাদের এমবুশ পার্টি আক্রমন চালিয়ে গাড়ী দুটির মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে। এই এমবুশে ৯ জন পাকসেনা নিহত এবং ৬ জন আহত হয়। কিছুসংখ্যক পাকসেনা পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়।
আগস্ট মাসের শেষের দিকে কুমিল্লার দক্ষিণে আমাদের গেরিলারা তাদের কার্যকলাপ আরো জোরদার করে। ট্রেনিংপ্রাপ্ত একটি গেরিলা দল বরুরাতে তাদের বেইস-এ যাওয়ার পথে পাকসেনা এবং রাজাকার দ্বারা আকস্মিকভাবে আক্রান্ত হয়। এই সময় ফরিদগঞ্জ, হাজীগঞ্জ, দাউদকান্দি, চাগোরা প্রভৃতি জায়গায় পাকসেনাদের সঙ্গে গেরিলাদের সংঘর্ষে ১৬ জন পাকসেনা নিহত হয়। এসব সংঘর্ষে ২০টি রাইফেল এবং প্রচুর গোলাবারুদ আমাদের হস্তগত হয়। আগস্ট মাসের ২৯ তারিখে আমাদের মিয়ার বাজার সাব-সেক্টরে খবর আসে যে, পাকসেনারা লাকসাম থানার বুটচি গ্রামে সন্ধ্যা সাতটায় শান্তি কমিটির একটি সভা করার প্রস্তুতি নিয়েছে। এই সংবাদ পেয়ে ক্যাপ্টেন ইমামুজ্জামান সভাটি পণ্ড করার জন্য এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা পাঠিয়ে দেয়। পাকসেনা এবং রাজাকাররা সভা শুরু করলে আমাদের প্লাটুনটি তাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণের ফলে ৮ জন পাকসেনা, ৯ জন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ এবং ২০ জন রাজাকার হতাহত হয়। শান্তি কমিটির সভাটি আর অনুষ্ঠিত হতে পারে নি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে নিজেদের আশ্রয়ে ফিরে আসে।
২৫শে আগস্ট সকাল ৯টার সময় পাকসেনাদের একটি প্লাটুনকে ব্রাহ্মণপাড়া থেকে ধানদাইল গ্রামের দিকে অগ্রসর হতে দেখা যায়। আমাদের একটা পেট্রোল পার্টি দূর থেকে পাকসেনাদের অগ্রসর হতে দেখে ধানদাইল গ্রামে এমবুশ পাতে। পাকসেনারা এমবুশের ভিতর এসে গেলে তাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এতে ১ জন ক্যাপ্টেনসহ ১০ জন পাকসেনা নিহত হয়। অবশিষ্ট সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। পরদিন আমাদের এই টহলদার দলটি উত্তর নাগাইশ এবং ছোট নাগাইশ গ্রামের মাঝে মালদা নদীর পাড়ে এমবুশ পাতে। সকাল পাঁচটায় আমাদের এমবুশ দল পাকসেনাদের একটি টহলদার দলকে শালদা নদীর পূর্ব তীর ঘেঁষে অগ্রসর হতে দেখে। পাকসেনাদের এই দলটি তাদের কয়েকটা সরবরাহকারী নৌকাকে নয়ানপুর থেকে মন্দভাগের দিকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। এই দলটি আমাদের এমবুশ পার্টির আওতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের উপর আক্রমণ চালায়। সঙ্গে সঙ্গে দুটি নৌকা ধ্বংস এবং ১৪ জন লোক নিহত হয়। পাকসেনাদের ওপর পাহারা দল আমাদের এমবুশ পার্টির প্রতি পাল্টা গুলি চালায়। প্রায় এক ঘণ্টা উভয় পক্ষের মধ্যে গোলা বিনিময় চলতে থাকে। নয়ানপুর থেকে আরো দুটি নৌকায় পাকসেনারা তাদের দলটিকে আরো শক্তিশালী করার জন্য অগ্রসর হয়। প্রথম নৌকাটি আমাদের গুলিতে ডুবে যায় এবং ৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। অন্য উপায় না দেখে দ্বিতীয় নৌকার সৈন্যরা তীরে নেমে পালিয়ে যায়। এরপর পাকসেনারা সমস্ত দিন এবং রাত হরিমঙ্গল, শশীদল এবং সেনেরবাজারের দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে আমাদের সেনের বাজার এবং গৌরাঙ্গল অবস্থানের উপর গোলাবর্ষণ করতে থাকে। পরের দিন সকাল ৯টায় ৩০ জন পাকসেনা দুটি নৌকায় সেনের বাজার অবস্থানের দিকে আক্রমণের জন্য অগ্রসর হয়। অগ্রসর হওয়ার পথে আমাদের মেশিনগানের গুলিতে দুটি নৌকাই ডুবে যায় এবং সকল পাকসেনাই নদীতে ডুবে মারা যায়।
আগস্ট মাসের শেষে ঢাকাতে আমাদের গেরিলাদের শক্তি ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। তারা পাকসেনাদের ঢাকায় ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। পাকসেনারা প্রায়ই রাতে ঢাকা শহরে ট্রাকে করে টহল দিতে বেরুত। টহল দেয়ার সময় অনেক ক্ষেত্রে শহরবাসীদের উপর জঘন্য অত্যাচার চালাত। পাকসেনাদের রাতের এই তৎপরতা সীমিত করার জন্য আমাদের গেরিলারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যেসব রাস্তায় সাধারণত পাকসেনারা টহল দিতে গেরিলারা সেসব রাস্তার ওপর বেশ কয়েকদিন লক্ষ্য রাখে। কোন রাস্তায় কতটার সময় কতগুলো গাড়ী কত গতিতে চলে, কত ব্যবধান দুই গাড়ীর ভিতর বিরাজ করে প্রভৃতি তারা সংবাদ সংগ্রহ করে। ২৭শে আগস্ট রাত সাড়ে ১১টায় গ্রিন রোডের (স্টাফ কোয়ার্টারের বিপরীত দিকে) কতগুলো নির্মাণাধীন দোকানের ছাদে আমাদের গেরিলাদল এমবুশ পেতে বসে থাকে। গেরিলারা রাস্তার উপর গাড়ীবিধ্বংসী মাইন পেতে রাখে। এরপর এমবুশ পার্টি পাকসেনাদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। রাত প্রায় সাড়ে বারোটায় পাকসেনাদের ৪/৫টি বেডফোর্ড গাড়ী এবং জীপ তেজগাঁর দিক থেকে গ্রিন রোড হয়ে অগ্রসর হয়। প্রথম গাড়ীটি যখন এমবুশ সাইট-এর সেশপ্রান্তে পৌঁছে তখন একটি মাইন-এর আঘাতে গাড়ীটি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়। দ্বিতীয় গাড়ীটির চালক এই অবস্থা দেখে হতচকিয়ে পাশ কাটতে গিয়ে পার্শ্ববর্তী দালানের সঙ্গে ধাক্কা মারে, ফলে এই গাড়ীটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর পেছনে পেছনে পাকসেনাদের আরেকটি জীপ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে মাইনের আঘাতে সেটিও উল্টে যায়। যেসব পাকসেনা ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ীগুলোতে অক্ষত অবস্থায় ছিল তারা গাড়ী থেকে বেরুবার চেষ্টা করে এবং গুলিবর্ষণ করতে থাকে। আমাদের এমবুশ পার্টির গেরিলারা ছাদ থেকে তাদের উপর গ্রেনেড আক্রমণ চালায় এবং গুলি ছুড়তে থাকে। এর ফলে অধিকাংশ পাকসেনা হতাহত হয়। পেছন থেকে আরো একটি গাড়ীতে পাকসেনারা ঘটনাস্থলের দিকে অগ্রসর হয়। এবং গাড়ী থেকে নেমে আমাদের গেরিলাদের উপর আক্রমণ চালাবার চেষ্টা করে। আমাদের গেরিলারাও তাদের উপর পাল্টা আক্রমণ চালায়। পাকসেনাদের হতাহতের সংখ্যা যখন বাড়তে থাকে তখন কোন উপায় না দেখে তারা ক্যান্টনমেন্টের দিকে পালিয়ে যায়। গোলাগুলির শব্দে স্থানীয় জনসাধারণ তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। তারা ২৪ জন পাকসেনার মৃতদেহ ও ৪১ জনকে আহত অবস্থায় এবং দুটি বিধ্বস্ত ট্রাক এবং একটি জীপ রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে। আমাদের পক্ষে দু’জন সামান্য আহত হয়। আমাদের গেরিলারা কিছুসংখ্যক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গ্রিন রোডের পিছন দিকের নিচু জায়গা দিয়ে নিরাপদে চলে আসতে সক্ষম হয়। পরের দিন এই খণ্ডযুদ্ধ এবং পাকিস্তানীদের দুরাবস্থার কাহিনী হাজার হাজার মানুষ প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখে জানতে পারে। এই সংবাদ সমস্ত ঢাকায় মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ঢাকা শহরের মুক্তিকামী জনগণের মনে আশার সঞ্চার হয়। দুদিন পরে ঢাকার গেরিলারা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা বন্ধ করার জন্য নিউ মডেল ডিগ্রী কলেজে এবং আরো কয়েকটি কলেজে আক্রমণ চালায়। তারা পরীক্ষার খাতাপত্র জ্বালিয়ে দেয়। টঙ্গী এবং জয়দেবপুরের মাঝে দুটি বিদ্যুতের পাইলনও তারা উড়িয়ে দেয়। ২রা সেপ্টেম্বর রাতে পাকিস্তানীদের একটি জীপ যখন গ্রিন রোড দিয়ে যাচ্ছিল তখন আমাদের কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা জীপটির ভিতর গ্রেনেড নিক্ষেপ করে চারজন পাকসেনাকে নিহত করে। গ্রেনেড নিক্ষেপে জীপটির আংশিক ক্ষতি হয়।
এছাড়া ঢাকার গেরিলা দল পশ্চিম পাকিস্তানী একটি পুলিশের দলকে কলাবাগানের কাছে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে দশজনকে নিহত করে। কালিগঞ্জ-ডেমরা এবং কালিগঞ্জ-টঙ্গীর মধ্যস্থিত বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনের চারটি পাইলন উড়িয়ে দেয়। আমাদের আরেকটি গেরিলা দল রুপগঞ্জের নিকট নদীর পাড়ে পাকসেনাদের যাতায়াতের রাস্তায় একটি এমবুশ পেতে রাখে। ১লা সেপ্টেম্বর বিকেল ৫টায় কালিগঞ্জ থানার দারোগা, ৭০ জন পাকসেনা এবং ৭০ জন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ মুক্তিবাহিনীর সম্পর্কে তদন্তের জন্য ঢাকা থেকে কোন দূরবর্তী গ্রামে নৌকাযোগে যাচ্ছিল। নৌকাটি যখন এমবুশের আওতায় পৌঁছে তখন গেরিলারা নৌকার উপর হালকা মেশিনগান দ্বারা গুলি চালায়। গুলিতে নৌকার আরোহী পাকসেনা, পশ্চিম পাকিস্তানী এবং দারোগা নিহত হয় এবং নৌকাটি ডুবে যায়। ঢাকার আজিমপুরে গেরিলারা অতর্কিতে একটি রাজাকার দলের উপর আক্রমণ চালিয়ে চারজন রাজাকারকে নিহত এবং চারটি রাইফেল ও ৬০ রাউন্ড গুলি দখন করে। টঙ্গীতেও একটি রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে গেরিলারা কয়েকজন রাজাকারকে হত্যা করে চারটি রাইফেল দখল করে নেয়। ডেমরার নিকট আমাদের একটি গেরিলা দল ১৩ই আগস্ট বিকাল তিনটার সময় পাক বিমান বাহিনীর একটি জীপ এমবুশ করে ধ্বংস করে দেয়। এমবুশে ৪ জন বিমান বাহিনীর এবং সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সৈনিক নিহত হয়। তাদের কাছ থেকে অনেক কাগজপত্র, পরিচয়পত্র এবং কয়েকটি রিভলবার দখল করা হয়। দখলীকৃত কাগজপত্র আমাদের হেডকোয়ার্টারে গেরিলারা পাঠিয়ে দেয়।
আগস্ট মাসের শেষের দিকে পাকসেনাদের কোন গুপ্তচর আমাদের ঢাকার গেরিলাদের ধোলাই খাল ঘাঁটি পাকসেনাদের অবহিত করে। সংবাদ পেয়ে পাকসেনারা ২০/২৫টি ট্রাক ধোলাই খালে আমাদের ঘাঁটিটি আক্রমণের জন্য আসে। পাকসেনাদের অতর্কিত আক্রমণে আমাদের গেরিলারা কোন উপায় নে দেখে তাদের সঙ্গে সম্মুখসমরে লিপ্ত হয়। প্রায় ২ ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। সংঘর্ষে পাকসেনাদের প্রায় ৪০-৪৫ জন হতাহত হয় বলে খবর পাওয়া যায়। অপরদিকে আমাদের দু’জন গেরিলা মারাত্মকভাবে আহত হয়। প্রবল চাপের মুখে টিকতে না পেরে আমাদের গেরিলারা সাতঁরিয়ে ধোলাইখাল পার হয়ে ধোলাইখাল অবস্থানটি পরিত্যাগ করে। পিছু হটার সময় একটি ২’’ মর্টার, ৩টি ম্যাগাজিন খালে ফেলে দিয়ে আসতে বাধ্য হয়। পরদিন পাকসেনারা সেগুলি উদ্ধার করে এবং তাদের প্রচারের কাজে ব্যবহার করে। এর পরদিন আমাদের গেরিলারা সুত্রাপুর থানার আক্রমণ চালিয়ে দুজন পাকসেনাকে নিহত করে। সুত্রাপুরের সার্কেল ইন্সপেক্টর এবং ওসি গুরুতরভাবে আহত হয়।
আগস্টের শেষের দিকে আমাদের ২/৩ জন গেরিলা একজন মেজর ও দুইজন ক্যাপ্টেনকে (পাক গোলান্দাজ বাহিনীর) একটি জীপে করে আজিমপুরের নিকট এসে জীপ থেকে নেমে দূরে কোন এক বাড়িতে প্রবেশ করতে দেখে। কিছুক্ষণ পর সে বাড়ি থেকে চিৎকারের শব্দ শুনে আমাদের গেরিলারাও সেই বাড়িতে প্রবেশ করে। তারা বুঝতে পারে যে অফিসাররা ঐ বাড়ীর মহিলাদের শ্লীলতাহানির চেষ্টা করছে। তৎক্ষণাৎ গেরিলারা অফিসারদেকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। গেরিলারা পাক অফিসারদের মৃতদেহ দূরে অপেক্ষামাণ পাক জীপের মধ্যে রেখে দেয় এবং নিরাপদে সে স্থান পরিত্যাগ করে। পাক-পুলিশের একটি টহলদার দলকে আমাদের ধানমণ্ডির গেরিলারা প্রতিদিন ধানমণ্ডি সাত-মসজিদ রোড ও নিকটবর্তী রাস্তায় টহল দিতে দেখে। আমাদের গেরিলারা ২৫শে আগস্ট সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ১৮নং রোডের মোড়ে একটি চলন্ত গাড়ী থেকে স্টেনগানের গুলি দ্বারা ৯ জন পুলিশকে গুলি করে হত্যা করে। গুলির সংবাদ পেয়ে নিকটবর্তী টহলদারী পাকসেনারা জীপ নিয়ে গেরিলাদের পিছু ধাওয়া করে। গেরিলারা গাড়ী থেকে গুলি ছুড়ে জীপের ড্রাইভারকে নিহত করে। এসময় দ্রুত গতিসম্পন্ন চলন্ত জীপটি আয়ত্তের বাইরে চলে যায় এবং পার্শ্ববর্তী দেয়ালে প্রচন্ডভাবে ধাক্কা খেয়ে বিধ্বস্ত হয়। এর ফলে গাড়ীর আরোহী দুজন পাকসেনা নিহত এবং তিনজন আহত হয়। এই গেরিলাদের নেতৃত্ব দেয় রুমী (শহীদ, বীরবিক্রম)। পাকসেনারা পরে রুমীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় এবং তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে। আগস্টের ২৯ তারিখে ছ’জনের একটি গেরিলা দল ঢাকার সৈয়দাবাদ সেতুটি এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে উড়িয়ে দেয়। এর ফলে ঐ সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এসময় গেরিলারা একটি বাসে দুশো মণ পাটসহ লতিফ বাওয়ানী জুটমিলে যাওয়ার পথে বাসটিকে ধ্বংস করে দেয়। বরাইদের নিকট আরো তিন’শ মণ পাট ফসফরাস বোমা ফেলে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। গেরিলারা নারায়ণগঞ্জের জিএমসি ঘাটে পাঁচ হাজার বেল বহনকারী কামচাম ফ্ল্যাটটি ডুবিয়ে দেয়। আর-সি-এম জুটমিলের শ্রমিক (আমাদের একজন গেরিলা) ফসফরাস ৮০ গ্রেনেড নিক্ষেপ করে আর-সি-এম মিলের গুদামস্থিত প্রায় ১ লাখ মণ পাট জ্বালিয়ে দেয়। পরে জানা যায় যে, দমকল বাহিনীর সাতটি গাড়ী ৩/৪ ঘণ্টা চেষ্টা করেও সেই জ্বলন্ত পাটের অগ্নিনির্বাপণে ব্যর্থ হয়। ফলে সমস্ত পাট পুড়ে যায়।
৩০শে আগস্ট আমাদের গেরিলারা আড়াই হাজার থানা অতর্কিত আক্রমণ করে থানার দারোগাকে নিহত করে। গেরিলারা থানার সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসে। এর পরদিন গেরিলারা একজন পাক দালালের দু’লাখ টাকা মূল্যের সুতাবাহী নৌকা ডুবিয়ে দেয়। তারা থানা থেকে ৮টি রাইফেল, ৫টি শর্টগান এবং ৪০ রাউন্ড গুলি দখল করে। এই খবর পেয়ে নরসিংদী থেকে পাকসেনাদের একটি কোম্পানী ঘটনাস্থলের দিকে অগ্রসর হয়। আমাদের গেরিলারা আগে থেকেই এর জন্য প্রস্তুত ছিল। পুটিয়রের নিকট আমাদের একটি গেরিলা দল পাকসেনাদেরকে আক্রমণের জন্য এমবুশ পাতে। পাকসেনারা এমবুশের ফাঁদে পড়লে গেরিলারা গুলি চালায়। চার ঘণ্টা সংঘর্ষের পর ৩৩টি মৃতদেহ ফেলে পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে নরসিংদীর দিকে পালিয়ে যায়। যুদ্ধে পাকসেনাদের পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন সেলিমও নিহত হয়। মৃতদেহ থেকে পরিচয়পত্র অন্যান্য কাগজপত্র উদ্ধার এবং অনেক অস্ত্রশস্ত্র আমাদের গেরিলারা হস্তগত করে। গেরিলারা নরসিংদীর বিভিন্ন মিলে গ্রেনেড এবং মর্টারের সাহায্যে আক্রমণ চালিয়ে মিলের ভিতর সন্ত্রাসের সৃষ্টি করে। ফলে পাকসেনারা একে একে সব মিলগুলো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। পাকসেনাদের একটি দল ঝিনারদিতে (ঘোড়াশালের নিকট) তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। আগস্ট মাসের ১৩ তারিখ দুপুর আড়াইটায় আমাদের একটি গেরিলা দল পাকসেনাদের এই ক্যাম্পটিতে অতর্কিতে আক্রমণ করে। সাতজন পাকসেনা পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। গেরিলারা ঝিনারদি রেল স্টেশনটিকে ধ্বংস করে দেয়। স্টেশনের টেলিফোন যোগাযোগের সেটটিও তারা ধ্বংস করে দেয়। টিকিট ও অন্যান্য কাগজপত্রও তারা জ্বালিয়ে দেয়। ক্যাম্প থেকে আমাদের গেরিলারা একটি হালকা মেশিনগান, ১১টি রাইফেল, হালকা মেশিনগানের ৪৫০০টি গুলি, ১টি স্টেনগান, ১০০ রাউন্ড স্টেনগানের গুলি, ১৪টি বেল্ট, ২৬ জোড়া বুট, ১৭ ব্যাগ আটা, ১১ পেটি দুধের টিন এবং আরো অন্যান্য জিনিসপত্র দখল করে। কয়েকদিন পর পাকসেনারা গোপন সূত্রে খবর পেয়ে আমাদের গেরিলা ইউনিট হেডকোয়ার্টারে দু’দিক থেকে আক্রমণ করে। আমাদের গেরিলা দুর্জয় সাহসের সঙ্গে তাদের সে আক্রমণের মোকাবিলা করে এবং আক্রমণ প্রতিহত করে। দু’ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাকসেনারা পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। ১৪ই আগস্ট পাকসেনাদের একটি দল ঝিনারদি স্টেশনের কাছে একটি গ্রামে লুটতরাজের উদ্দেশ্যে আসে। এই খবর পেয়ে আমাদের একটি গেরিলা দল পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা তিনঘণ্টা যুদ্ধের পর দুটি মৃতদেহ ও কয়েকটি আহত সেনাকে ফেলে পালিয়ে গেলে আমাদের গেরিলারা নরসিংদী-তারাবো সড়কে পাঁচদোনার নিকট একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতুতে প্রহরারত পাকসেনাদের একটি দলের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণ প্রায় এক ঘণ্টা চলে। আমাদের আক্রমণ প্রবল হওয়ায় আহত পাকসেনাদের বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার শোনা যায়। এমন সময় চার ট্রাক পাকসেনা তাদের সাহায্যে সেখানে উপস্থিত হয়। পাকসেনারা ভারী অস্ত্রের সাহায্যে আমাদের গেরিলাদের আক্রমণ প্রতিহত করে। ভারী অস্ত্রের মোকাবিলা করতে না পেরে আমাদের গেরিলারা বাধ্য হয়ে পিছু হটে আসে। পাকসেনাদেরকে পাঁচটি মৃতদেহ উঠিয়ে নিয়ে যেতে দেখা যায়। পাকসেনারা নরসিংদীর নিকটস্থ আমাদের গেরিলা অবস্থানের খবর পেয়ে আগস্টের ২১ তারিখে প্রায় এক কোম্পানী শক্তি নিয়ে আমাদের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়। অগ্রসর হওয়ার পর পথিমধ্যে আমাদের একটি গেরিলা দল তাদেরকে অতর্কিতে আক্রমণ করে। প্রায় এক ঘণ্টা গোলাগুলির পর পাকসেনারা তাদের গোলাগুলি বন্ধ করে আমাদের অবস্থানের ২/৩ মাইল দূরে থাকতেই আর অগ্রসর না হয়ে পিছু হটে যায়।
আমাদের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করার প্রচেষ্টা চলতে থাকে। কিন্তু পাকসেনারাও খুব দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহের লাইনগুলো যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি মেরামত করে ফেলে। এর ফলে কিছুদিন বন্ধ থাকার পর শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো সীমিত পরিমাণে বিদ্যুৎ সরবরাহ পায়। পাকসেনাদের বিদ্যুৎ সরবরাহে আরো বিঘ্ন সৃষ্টির জন্য নতুন করে আরেকটি পরিকল্পনা নেয়া হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী তিতাস গ্যাসের পাইপলাইনের নকশা যোগাড় করি এবং পরীক্ষা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে, গ্যাসের পাইপ কেটে দিলে সিদ্ধিরগঞ্জ এবং ঘোড়াশালের বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রগুলো গ্যাসের অভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। হানাদার কর্তৃপক্ষ এইসব বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র চালাবার ব্যবস্থা করলে তাদের তেলের সংকট দেখা দেবে। পাইপলাইন উড়িয়ে দেবার জন্য নরসিংদী এবং রূপগঞ্জের গেরিলাদের নির্দেশ দেই। আমার নির্দেশ অনুযায়ী ২০শে আগস্ট রাত ১টায় নরসিংদী গেরিলা ইউনিটের ডিমোলিশন পার্টি তিতাস গ্যাস লাইন বারুদ লাগিয়ে উড়িয়ে দেয়। এই অপারেশন পুরাপুরি সফল হয়। বিস্ফোরণের ফলে প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা প্রায় ১০ মাইল দূর থেকে দেখা যায় এবং ৬/৭ মাইল দূর থেকে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শোনা যায়। ঘোড়াশালের উত্তরে সমস্ত এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। নরসিংদী, ঘোড়াশাল এবং পাঁচদোনাতে অবস্থানরত পাকসেনারা এই বিস্ফোরণের বিকট শব্দে ভীষণভাবে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং অনেকেই তাদের অস্ত্রশস্ত্র এবং জিনিসপত্র ফেলে ঢাকার দিকে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। পরে স্থানীয় লোকজনের মুখে শোনা যায় যে, পাকসেনারা ধারণা করেছিল ভারতীয় বিমান বোমা ফেলেছে। এর পরদিন আশুগঞ্জের নিকট কয়েক জায়গাতে পাইপ লাইন উড়িয়ে দেয়া হয়। এই গ্যাসের পাইপলাইন মেরামত করতে বেশ ক’দিন সময় লাগে। ততদিন শিল্প-কারখানাগুলো বন্ধ থাকে।
রূপগঞ্জের একটি গেরিলা দল ২২শে আগস্ট রাতে নরসিংদী এবং ঝিনারদি রেলস্টেশনের মাঝে রেল লাইনের নিচে মাইন পুঁতে রাখে। রাতে একটি ট্রেন দুটি বগিসহ সেখানে দিয়ে চলে যায়। ট্রেন এবং বগি দুটি চলে যাবার সাথে সাথেই মাইনটি বিস্ফোরণের হয়। এতে ট্রেনটির ক্ষতি না হলেও রেল লাইনের অনেকখানি ধ্বংস হয়। আমাদের বৈদ্যেরবাজার থানার গেরিলা দল সোনারগাঁও এবং সি-এন্ড-বি রোডের অনেক জায়গায় মাইন পুঁতে রাখে। ১৬ই আগস্ট রাতে পাকসেনাদের একটি ট্রাক মাইনের আঘাতে ধ্বংস হয় এবং সাথে সাথে ১১ জন পাকসেনা ও তিনজন রাজাকার নিহত হয়। ঢাকা-কুমিল্লা রাস্তার বাতেরচরের নিকটস্থ সড়কসেতুতে অবস্থানরত পাকিস্তানীদের ওপর আমাদের গেরিলারা ৩১শে আগস্ট অতর্কিত আক্রমণ চালায়। সংঘর্ষে কয়েকজন পাকসেনা এবং রাজাকার নিহত হয়। গেরিলারা সেতুটির ৬০ ফুট লম্বা স্প্যান উড়িয়ে দেয়। তার পরদিন রাতে ঢাকা-দাউদকান্দি সড়কে বারুনিয়া এবং ভবেরচর সেতু দুটিও বিস্ফোরক লাগিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়। ফলে ঢাকা-কুমিল্লা রাস্তা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়। পাকসেনারা ভবেরচর সেতুর যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করার জন্য ফেরীর বন্দোবস্ত করে। সেপ্টেম্বরের দু’তারিখে আমাদের গেরিলারা ফেরীঘাট আক্রমণ করে এবং ফেরীটি ধ্বংস করে দেয়। এই আক্রমণে ফেরী থেকে চারটি ব্যাটারী মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে নেয়।
নারায়ণগঞ্জ-দাউদকান্দি সড়কে গজারিয়াতে পাকসেনাদের একটি পোস্ট-চৌকি ছিল। সেপ্টেম্বরের ২ তারিখ রাত ৮টায় আমাদের গেরিলাদের একটি দল সেই চৌকি আক্রমণ করে। এক ঘণ্টা যুদ্ধে তিনজন ইপিকাফ নিহত ও একজন বন্দী হয়। এখান থেকে ২০০ রাউন্ড গুলিসহ ১১ জন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
ঢাকার মুন্সীগঞ্জ এবং মানিকগঞ্জ মহকুমার গেরিলারাও তাদের তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। গেরিলাদের একটি দল হরিরামপুর থানার নিকট পাকসেনাদের একটি লঞ্চ আক্রমণ করে। লঞ্চে পাকসেনারা হরিরামপুর অবস্থান থেকে তাদের সৈনিকদের জন্য রসদ নিয়ে যাচ্ছিল। এক ঘণ্টা গোলাগুলির পর ১১ জন পাকসেনা নিহত এবং আরো অনেকে আহত হয়। পাকসেনারা আর অগ্রসর হতে না পেরে লঞ্চ নিয়ে ঢাকার দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এর পরদিন হরিরামপুর থানার সেকেন্ড অফিসার এবং কয়েকজন পাকিস্তানী পুলিশ আমাদের গেরিলাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। পুলিশদের নিহত করে আমাদের গেরিলারা তিনটি রাইফেল দখল করে নেয়। ঘিওর থানাতেও পাকসেনারা একটি টহলদারী দলের উপর আমাদের গেরিলারা আক্রমণ চালিয়ে ৮ জন নিহত করে এবং ৮টি রাইফেল দখল করে। সেপ্টেম্বর মাসের ১ তারিখে নওয়াবগঞ্জ থানা আমাদের গেরিলারা আক্রমণ করে। এই আক্রমণে সেখানকার সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র গেরিলাদের হস্তগত হয়। আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে আমাদের গেরিলারা লৌহজং, শিবালয়, সিরাজদীখান এবং শ্রীনগর থানাগুলিতে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে পাক পুলিশ হত্যা করে এবং প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র দখল করে। সেপ্টেম্বরের ১ম সপ্তাহে শিবালয় থানার গেরিলা দল পাকসেনাদের একটি প্লাটুনকে টহল দেয়ার সময় এমবুশ করে। এই এমবুশে ১৩ জন পাকসেনা নিহত এবং আরো অনেকে আহত হয়। পাকসেনারা ঢাকা থেকে আরো সৈন্য এনে শিবালয়ে আমাদের গেরিলা দলটির ঘাঁটিতে ১৭ই সেপ্টেম্বর আক্রমণ চালায়। কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধের পর আমাদের গেরিলারা পাকসেনাদের পিছু হটিয়ে দিতে সক্ষম হয়। যুদ্ধে ১০ জন পাকসেনা এবং ১১ জন রাজাকার নিহত হয়।
১৯শে সেপ্টেম্বর আমাদের গেরিলারা মালোচিন বাজারে অবস্থানরত পাক পুলিশের একটি দলকে আক্রমণ করে ১৯ জন পাক পুলিশকে নিহত এবং তিনজনকে আহত করে। ঘোড়াশালের গেরিলা দল ৯ই আগস্ট রাতে আড়াইহাজার থানার নিকটে পুরিন্দা বিদ্যুৎ সরবরাহ সাবস্টেশনে আক্রমণ চালায়। এই ঘটনার দুই দিন পর সিদ্ধেশ্বরী-ঘোড়াশালের বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনের ক্ষতিসাধন করে। গেরিলা দল মাশরেকী জুট মিলস লিমিটেডের বিদ্যুৎ সরবরাহ সাবস্টেশনটিও ধ্বংস করে দেয়। ফলে ঐ এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কলকারখানাগুলি সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের গেরিলারা রূপগঞ্জের নিকট যে গ্যাসলাইন ধ্বংস করে দিয়েছিল পাকসেনারা পশ্চিম পাকিস্তানী প্রকৌশলীদের দ্বারা তা মেরামত করে নেয়। এই সংবাদ আমাদের হেডকোয়ার্টারে যথাসময়ে পৌঁছে। এই গ্যাসলাইনকে পুনরায় ধ্বংস করার জন্য একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করি। পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘোড়াশালের গেরিলাদেরকে গ্যাসলাইনটি মেঘনা নদীর মাঝে ক্ষতি করার জন্য নির্দেশ দেই। ঘোড়াশালের নিকট গ্যাসলাইনটি মেঘনা নদীর মাঝ দিয়ে গেছে। নির্দেশ অনুযায়ী গেরিলারা লাইনটির পথ গোপনে অনুসন্ধান করে। ৯ই সেপ্টেম্বর রাতে নৌকার সাহায্যে নদীর মাঝামাঝি জায়গায় যায় এবং প্রায় ১৫/২০ ফুট পানির নিচে অবস্থিত গ্যাস পাইপে ডিমোলিশন দ্বারা ‘ডিলে সুইচ’ (বিলম্বে কার্যকরী সুইচ)-এর সাহায্যে পাইপটি উড়িয়ে দেয়। ফলে গ্যাস পাইপের ভিতর পানি ঢুকে যায়। এতে গ্যাস সরবরাহ অনেক দিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। আড়াইহাজার থানার গেরিলারা জানতে পারে যে, পাকসেনারা কামানদি চরে তাদের একটি ঘাঁটি স্থাপন করেছে এবং স্থানীয় লোকদের উপর অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। তারা আরও জানতে পারে যে, পাকসেনারা নিকটস্থ গ্রাম থেকে মেয়েদের তাদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে অত্যাচার চালাচ্ছে। এই সংবাদ পেয়ে ২৯ জন গেরিলার একটি দল ১১ই সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় পাকসেনাদের ঘাঁটি আক্রমণ করে। ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাঁচজন পাকসেনা এবং ৬ জন রাজাকার নিহত হয়। অবশিষ্ট পাকসেনারা ক্যাম্প ছেঁড়ে পালিয়ে যায়। গেরিলারা ক্যাম্প থেকে মেয়েদের উদ্ধার করে তাদের স্ব স্ব বাড়িতে পৌঁছিয়ে দেয়।
পাকসেনারা সিরাজদীখান থানার আবদুস সালাম নামক আমাদের একজন গেরিলাকে গ্রেফতার করে তালতলা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। স্থানীয় প্রায় ৫০ জন গেরিলার একটি দল পরদিন রাত সাড়ে আটটায় এই ক্যাম্পটির উপর আক্রমণ চালায়। তারা প্রায় তিন ঘণ্টা যুদ্ধের পর একজন পাকিস্তানী সুবেদার-মেজরসহ কিছুসংখ্যক পাকসেনা, পাক পুলিশ ও রাজাকারকে হতাহত করে আবদুস সালামকে উদ্ধার করে আনে। এই ঘটনার একদিন পর নওয়াবগঞ্জ থানার গেরিলারা একটি লঞ্চকে (এম এল পয়েন্টার) পাকসেনা বহন করে নওয়াবগঞ্জের দিকে অগ্রসর হতে দেখে। ২৪শে সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ছ’টার সময় লঞ্চটি যখন গালিমপুরের নিকট পৌঁছে তখন আমাদের গেরিলারা লঞ্চটির উপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণের ফলে প্রথমেই পাকসেনাদের কিছু লোক হতাহত হয়। পাকসেনারা লঞ্চটিকে পিছু হটিয়ে পাড়ে অবতরণের চেষ্টা করে। আমাদের গেরিলারা আবার তাদের উপর আক্রমণ চালায়। যুদ্ধ ২৫ তারিখ দুপুর পর্যন্ত চলে। শেষ পর্যন্ত আমাদের গেরিলারা পাকসেনাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পর্যুদস্ত করতে সক্ষম হয়। যুদ্ধে পিএসএস ৯১৩৩ ক্যাপ্টেন জাফর আলী খান, সুবেদার আব্দুল্লা, ৪৪ জন পাকসেনা এবং একজন বাঙ্গালী পথপ্রদর্শক পুলিশ নিহত হয়। লঞ্চটিকে পরে ডুবিয়ে দেয়া হয়। আমাদের দু’জন গেরিলা আবদুর রহিম এবং মুহম্মদ আলী শহীদ হন। এই খবর পেয়ে পাকসেনারা আরেকটি লঞ্চে করে বড় খাল দিয়ে নওয়াবগঞ্জের দিকে অগ্রসর হয়। আমাদের গেরিলাদের ৪০ জনের আরেকটি দল পাকসেনাদের লঞ্চটিকে ২৬ সেপ্টেম্বর সকাল ৭টা ৩০মিনিটের সময় অতর্কিতে আক্রমণ করে। অতর্কিত আক্রমণের ফলে ৩ জন পাক সেনা নিহত এবং ৮ জন আহত হয়। পাকসেনারা লঞ্চটির দিক পরিবর্তন করে দ্রুত নাগালের বাইরে চলে যায়। ২৭শে সেপ্টেম্বর দুপুর ১টায় পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল নওয়াবগঞ্জের দিকে আবার অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। এই সংবাদ নওয়াবগঞ্জের গেরিলা হেডকোয়ার্টারে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ৫০ জনের একটি শক্তিশালী দল গালিমপুরের নিকট পাকসেনাদের জন্য একটি এমবুশ পেতে অপেক্ষা করতে থাকে। পাকসেনারা গালিমপুরে এমবুশের আওতায় পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গেরিলারা তাদের উপর আক্রমণ চালায়। আক্রমণে একজন ক্যাপ্টেনসহ ৩৫ জন পাকসেনা নিহত এবং অনেকে আহত হয়। অবশিষ্ট পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে তাদের কিছু আহত লোককে নিয়ে পালিয়ে যায়। আমাদের গেরিলারা একটি এলএমজি, ৩টি স্টেনগান, প্রচুর গুলি ও বেশ কিছু রাইফেল দখল করে। এর দু’দিন পর পাকসেনারা আরো শক্তিশালী হয়ে বড় খাল এবং আড়িয়াল বিল দিয়ে আবার অগ্রসর হবার চেষ্টা করলে আমাদের গেরিলারা অতর্কিত আক্রমণ করে। গেরিলারা তাদের এই চেষ্টাকেও ব্যর্থ করে দেয়। প্রায় তিনদিন ধরে পাকসেনারা অগ্রসরের চেষ্টা চালিয়ে যায়। তিনদিনের যুদ্ধে ২০ জন পাকসেনা নিহত এবং ৩০ জন আহত হয়। ওপর পক্ষে আমাদের একজন শহীদ এবং কিছু সংখ্যক গেরিলা আহত হয়। অক্টোবরের প্রথম তারিখ পর্যন্ত নওয়াবগঞ্জের সম্পূর্ণ এলাকা শত্রুমুক্ত হয় এবং মুক্তিবাহিনীর সম্পূর্ণ আয়ত্তে আসে। দোহার থানার পাকসেনারাও আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের চাপে দুর্বল হয়ে পড়ে। ২৭শে সেপ্টেম্বর পাকসেনাদের একটি দল মাগুরা বাজার থেকে তাদের রসদ নিয়ে দোহার থানার ক্যাম্পে যাবার পথে আমাদের গেরিলাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। আক্রমণে ১৪ জন পাকসেনা নিহত এবং ৮ জন আহত হয়। পাকসেনাদের সমস্ত রসদ মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। এরপর দোহার থানার পাকসেনাদের ক্যাম্পের সৈনিকরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং ক্যাম্পের বাইরে আসা বন্ধ করে দেয়।
২৪শে সেপ্টেম্বর লৌহজং থেকে নারায়ণগঞ্জগামী ১৮ হাজার মণ পাটবাহী একটি জাহাজ পদ্মা নদীতে ডুবিয়ে দেয়া হয়। অক্টোবর মাসে পাকিস্তানীরা আবার ঢাকাতে শান্তির পরিবেশ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে এবং ঢাকা শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করে তোলে। পাক সামরিক জান্তা সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য বাণিজ্য এবং শিল্প ক্ষেত্রকে উৎসাহিত করে তোলার চেষ্টা করে। এসময় আমরা ভবিষ্যতে ব্যাপক আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ফলে ঢাকা শহরে আমাদের গেরিলাদের কার্যকলাপও কিছুটা শিথিল করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু হানাদার বাহিনীর স্বাভাবিকীকরণের প্রচেষ্টার খবর পেয়ে আমরা আমাদের হেডকোয়ার্টার থেকে একটি গেরিলা দলকে একটি বিশেষ মিশনে প্রেরণ করি। আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী গেরিলাদল একটি গাড়ীর পেছনে ২৫ পাউন্ড এক্সপ্লোসিভ নিয়ে গাড়ীটিকে তদানীন্তন ইপিআইডিসি এবং হাবিব ব্যাংকের সামনে পার্ক করে রাখে।
সে সময় এই ব্যাংকে যথেষ্ট পরিমাণ পাকিস্তানী ব্যবসায়ীর আনাগোনা ছিল। এছাড়াও এই ব্যাংকটি পাকিস্তানীদের বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে অর্থ পাচারে সাহায্য করছিল। গেরিলারা দুপুর সাড়ে এগারটার দিকে গাড়ীতে ভর্তি বিস্ফোরকের বিস্ফোরণ ঘটায়। ফলে এই গাড়ীর পার্শ্ববর্তী পার্ক করা ১০/২০টি গাড়ী ধ্বংস হয় এবং হাবিব -ব্যাংকের বেশ ক্ষতি হয়। বিস্ফোরণে প্রায় ২৫ জন পাকিস্তানী ব্যবসায়ী আহত হয়। বিস্ফোরণের বিকট শব্দ এবং ধ্বংস দেখে মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার সমস্ত জনতা ছুটে পালায় এবং সকল ব্যবসা কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই গোটা এলাকা জনশূন্য হয়ে পড়ে। পাকিস্তানী ব্যবসায়ী মহলের মধ্যেও একটা আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান রেডিও’র ঢাকা কেন্দ্র থেকে এই বিস্ফোরণের ঘটনা স্বীকার করা হয়। হেডকোয়ার্টার থেকে দুটি ৮১ এম-এম মর্টারসহ একটি ডিটাচমেন্ট ঢাকাতে পাঠানো হয়। এই ডিটাচমেন্টকে ঢাকা বিমান বন্দর এবং ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় পাকসেনাদের ওপর এবং পাকিস্তানী বিমান বাহিনীর ঘাঁটির উপর রকেট নিক্ষেপ করার নির্দেশ দিয়ে পাঠানো হয়। আমাদের এই দলটি হেডকোয়ার্টার থেকে ঢাকার পূর্বে এসে তাদের বেইস স্থাপন করে। এরপর একটি ছোট রেকি (অনুসন্ধানী) দল বিমান বন্দর ও ক্যান্টনমেন্টের চতুর্দিকে ৩/৪ দিন অনুসন্ধান চালায়। এই সময় পাকসেনারা বিমান বন্দর এবং ক্যান্টনমেন্টের নিরাপত্তার জন্য পার্শ্ববর্তী এলাকায় বাঙ্কার তৈরি করে এবং টহল দিয়ে আমাদেরকে দূরে রাখার চেষ্টা করে। যেহেতু মর্টারের রকেট চার হাজার গজ দূরত্বের বেশী নিক্ষেপ করা যায় না এবং মর্টার ফায়ার করার সময় ফ্ল্যাশ দেখে এবং মর্টার পজিশন থেকে শব্দ শুনে পাকিস্তানী টহলদারী সৈনিকেরা এর অবস্থান খুঁজে বের করতে পারে সেহেতু অনুসন্ধান চালাবার পর আমাদের দলটি বাড্ডার নিকট থেকে ৯ই অক্টোবর রাত ১টা ৪০মিনিটের সময় মর্টারের গোলা নিক্ষেপ শুরু করে। ৬টি গোলা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের একটি লাইনের মধ্যে পড়ে। এতে ১৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। কয়েকটি গোলা বিমানবন্দরের নিকটে পড়ে কিন্তু কোন এয়ারক্রাফট-এর ক্ষতি সাধিত হয় নি। আরো কয়েকটি গোলা পাক টোব্যাকো কোম্পানীর ফ্যাক্টরিতে পড়ে। এতে ফ্যাক্টরির বেশ ক্ষতি হয়। কয়েকটি গোলা মহাখালী হাসপাতালের নিকটে রাস্তায় পড়ে। এই অতর্কিত মর্টার আক্রমণের ফলে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। পরে আমাদের কাছে খবর পৌঁছে যে, পাকিস্তানীরা ভেবেছিল মুক্তিবাহিনী ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করেছে। সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সমস্ত পাকসেনারা চতুর্দিকে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে- স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র এবং ট্যাংকসহ গুলশান এবং ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় সমস্ত রাত পাগলের মত ছুটাছুটি করতে থাকে এবং সারারাত গোলাগুলি চালায়। আমাদের দলটি আরো কয়েকটি গোলা নিক্ষেপ করে পাকসেনাদেরকে আরো ব্যতিব্যস্ত করে সেখান থেকে সরে পড়ে।
১১ই অক্টোবর দুপুর ১২টায় আমাদের গেরিলারা তিতাস গ্যাস পাইপ লাইন আবার বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেয়। ফলে ঢাকার গ্যাস সরবরাহ পুনরায় বন্ধ হয়ে যায়।
পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল পিলখানাতে অবস্থান করছিল। পিলখানার পাশের রাস্তা দিয়ে নিউ মার্কেটের দিকে পাকসেনাদের অনেক গাড়ী যাতায়াত করত। আমাদের আজিমপুরের গেরিলা দল সেই রাস্তায় মাইন পুঁতে রাখে। ১৬ই অক্টোবর রাত সাড়ে ৯টায় পাকসেনাদের একটা জীপ এই রাস্তায় টহল দেবার সময় মাইনের আঘাতে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে ৪ পাকসেনা নিহত এবং দুজন গুরুতরভাবে আহত হয়। এর একদিন পর দুজন পাক পুলিশ মিরপুর রোডে টহল দেবার সময় ধানমন্ডির নিকট আমাদের গেরিলাদের হাতে নিহত হয়।
ঢাকা শহরে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা এবং পাকসেনাদের নাজুক অবস্থা বিদেশী সংবাদ সংস্থাগুলি থেকেও ব্যাপক প্রচার করা হয়। এছাড়া এসব খবর ভয়েস অব আমেরিকা এবং বিবিসি থেকেও প্রচারিত হয়। ফলে হানাদার অধিকৃত এলাকার জনগণের মনেও মুক্তিসংগ্রামের সাফল্য সম্পর্কে নতুন আশার সৃষ্টি হয়।
৩০শে আগস্ট পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল শালদা নদীর দক্ষিণ প্রান্তে সমবেত হয় এবং বিধ্বস্ত রেলওয়ে সেতুর উপর বাঙ্কার তৈরি করার প্রস্তুতি নেয়। আমাদের একটি পেট্রোল পার্টি তাদের উপর গুলি চালিয়ে বেশকিছু পাকসেনাকে হতাহত করে। পাকসেনারা পিছু হটে যায়। পরদিন সকাল আটটায় পাকসেনারা অগ্রসর হয়ে আবার বাঙ্কার তৈরি করার চেষ্টা করে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর পুনরায় আক্রমণ চালায়। আক্রমণে ৬ জন পাকসেনা নিহত এবং আরো অনেক হতাহত হয়। এরপর পাকসেনারা তাদের গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। পাকসেনাদের ব্রাহ্মণপাড়ায় অবস্থিত কামানগুলি এরপর ৪র্থ বেঙ্গলের ‘এ’ কোম্পানীর অবস্থানের উপর ব্যাপকভাবে গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এতে আমাদের একজন সৈনিক শহীদ এবং ২/৩ জন আহত হয়। পাকসেনাদের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য কোনাবন থেকে ক্যাপ্টেন গাফফার ৪র্থ বেঙ্গলের ‘সি’ কোম্পানীকে চাঁদলাতে পাঠান। এই কোম্পানীটিও ৩০শে আগস্ট বিকেল ৪টায় পাকসেনাদের একটি দলের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করে একজন ক্যাপ্টেনসহ ১৯ জন পাকসেনা ও ২৪ জন রাজাকারকে নিহত করে। সংঘর্ষে অনেক পাকসেনা আহত হয়। পরে পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে ব্রাহ্মণপাড়ার দিকে পালিয়ে যায়। ফলে একটি হালকা মেশিনগান, ৩টি রাইফেলসহ অনেক গোলাবারুদ আমাদের সৈনিকরা দখল করে। এরপর দিন আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের একটি দলকে মন্দভাগ বাজারের পূর্ব পাশে শালদা নদীতে আক্রমণ করে। পাকসেনাদের এই দলটি নৌকাযোগে মন্দভাগ বাজারের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। আক্রমণে একটি নৌকা ডুবে যায় এবং ২০ জন পাকসেনা নিহত ও বেশ কিছু আহত হয়। পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। পাকসেনারা মন্দভাগ, সেনেরহাট, চাঁদলা প্রভৃতি এলাকায় অবস্থিত আমাদের অবস্থানের ওপর তাদের চাপ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করতে থাকে। ৩০শে আগস্ট বিকাল ৪টার সময় পাকসেনারা চারটি নৌকা বোঝাই করে এসে ছোট চাঁদলার নিকট অগ্রসর হবার চেষ্টা করে। আমাদের সৈনিকরা তাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে ১৫ জন পাকসেনাকে নিহত করে। এরপর সেনারা আমাদের অবস্থানের ওপর ব্রাহ্মণপাড়া এবং শাকুটিতে অবস্থিত মর্টার এবং কামানের সহায়তায় চড়াও হবার চেষ্টা করে। আমাদের সৈনিকরাও সাহসের সঙ্গে পাকসেনাদের এই আক্রমণ প্রতিহত করে। উল্লেখ্য যে, পাকসেনারা প্রায় তিন কোম্পানী সৈন্যশক্তি নিয়ে এই আক্রমণ পরিচালনা করে। সারা রাত ধরে আক্রমণ অব্যাহত থাকে। এই আক্রমণে একজন অফিসারসহ ৩০ জন পাকসেনা নিহত এবং বেশ কিছু আহত হয়। পাকসেনারা পরে ছত্রভঙ্গ হয়ে পশ্চাদপসরণ করে। আমাদের দু’জন মুক্তিযোদ্ধা গুরুতরভাবে এবং ৬ জন সামান্য আহত হয়। ৪ঠা সেপ্টেম্বর পাকসেনারা আমাদের চালনা ও শীতলা অবস্থানের ওপর দু’দিক থেকে আক্রমণ চালায়। সমস্ত দিন যুদ্ধের পর আমাদের সৈনিকরা পাকসেনাদের এই আক্রমণকে প্রতিহত করতে সমর্থ হয়। পাকসেনাদের পক্ষে অনেক হতাহত হয়- তবে সঠিক ক্ষতির পরিমাণ জানা সম্ভব হয় নি। পরাজয়ের গ্লানিতে পশ্চাদপসরণকারী পাকসেনারা মনের আক্রোশে ব্রাহ্মণপাড়া, ছোট চাঁদলা এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেয় ও নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা করে। দুই-তিন দিন বিরতির পর পাকসেনারা আবার আমাদের সেনেরহাট অবস্থানের দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করে। সেনেরহাট অবস্থানটি দখল করে নেবার জন্য পাকসেনারা সেনেরহাট পশ্চিমে এবং শালদা নদী স্টেশনের পশ্চিমে বিপুল সংখ্যক সৈন্যের সমাবেশ ঘটায়। তারা দু’দিক থেকে আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নেয়। পাকসেনাদের সমাবেশের কৌশল দেখে আমরা বুঝতে পারি যে, পাকসেনারা মন্দভাগের পশ্চিমে আশাবাড়ি পর্যন্ত আমাদের দখলকৃত সমস্ত এলাকা পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা নিয়েছে। এতে তাদের পক্ষে কসবা এবং মন্দভাগ পুনর্দখল করা সহজ হবে। পাকসেনাদের পরিকল্পনা বুঝতে পেরে আমরা সেনেরহাট অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করে তুলি। ৮ই সেপ্টেম্বর সকালে পাকসেনারা তাদের নয়ঘরে অবস্থিত ১২০ এম এম মর্টার, ব্রাহ্মণপাড়ায় অবস্থিত কামান এবং শশীদলে অবস্থিত ৩ ইঞ্চি মর্টারের সাহায্যে আমাদের সেনেরহাট অবস্থানের ওপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু করে-সঙ্গে সঙ্গে পাকসেনারা সেনেরহাট অবস্থানের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পাকসেনাদের কামানের গোলায় আমাদের বেশকিছু লোক শহীদ ও আহত হয়। পাকসেনাদের রকেট লাঞ্চারের গোলায় আমাদের ৪টি বাঙ্কার ধ্বংস হয়ে যায়। পাকসেনারা আমাদের অবস্থানের দেড়শ গজ পর্যন্ত অগ্রসর হতে সক্ষম হয়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও আমাদের সৈনিকরা এতটুকু মনোবল না হারিয়ে বরং দৃঢ়তার সঙ্গে পাকসেনাদের আক্রমণকে প্রতিহত করে। আমাদের সৈনিকদের গুলিতে অগ্রসরমান অনেক পাকসেনা হতাহত হয়। আমাদের মুজিব ব্যাটারী গোলন্দাজ বাহিনী পাকসেনাদের উপর গোলাবর্ষণ করে অনেক পাকসৈন্যকে হতাহত করে। পাকসেনারা সমস্ত দিন তাদের আক্রমণ চালিয়ে আমাদের প্রতিরোধ ব্যূহ ভেদ করতে না পেরে এবং তাদের অনেক হতাহত হওয়াতে সন্ধ্যায় তাদের আক্রমণ বন্ধ করতে বাধ্য হয় এবং পিছু হটতে বাধ্য হয়। এর পরদিন পাকসেনারা আমাদের মন্দভাগ এবং মইনপুর অবস্থানের ওপরও আক্রমণ চালায়। সেই আক্রমণও একইভাবে প্রতিহত করা হয়। যাবার পথে পরাজয়ের আক্রোশে সকাল সাতটার সময় পাকসেনাদের প্রায় দুই কোম্পানী সৈন্য প্রবল কামানের গোলার সহায়তায় আমাদের মইনপুরের অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। প্রায় দু’ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাকসেনাদের প্রায় ৪০ জন সৈন্য হতাহত হয়। আমাদের সৈন্যরা অসীম সাহসিকতার সঙ্গে সেই আক্রমণকেও প্রতিহত করে। আমাদের পক্ষে আমাদের অবস্থানে অবস্থান করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। ফলে বাধ্য হয়ে আমাদের সৈনিকরা সে অবস্থান পরিত্যাগ করে ৬০০ গজ পিছে বায়েকের নিকট জেলা বোর্ডের রাস্তায় নতুন অবস্থান গড়ে তোলে। পাকসেনারা এই অবস্থানের ওপরও আক্রমণ চালায়। তাদের সেই আক্রমণকে আমাদের সৈনিকেরা দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিহত করে। পাকসেনারা আর অগ্রসর হতে না পেরে পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। পাকসেনারা মনরা, বাগরা, নাগাইশ, দুশিয়া, আরাদুয়শিরা, ধান্দুহল, সিদলাই প্রভৃতি প্রায় একুশটি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় এবং নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা করে। ৯ই সেপ্টেম্বর রাতে ক্যাপ্টেন গাফফার একটি শক্তিশালী রেইডিং পার্টি ৩’’ মর্টার ও ৬৫ এমএমআরআর সহ পাকসেনাদের অবস্থানের দিকে পাঠিয়ে দেন। এই দলটি শালদা নদীর উত্তর তীর দিয়ে লক্ষিপুরস্থ পাকসেনাদের অবস্থানের পেছনে অনুপ্রবেশ করে এবং দু’দিন রেকি করার পর ১১ই সেপ্টেম্বর বিকাল পাঁচটার সময় পাকসেনাদের অবস্থানের অতি নিকটে পৌঁছে গোলা নিক্ষেপ শুরু করে। এতে শত্রুদের দুটি বাঙ্কার রকেটের গোলায় ধ্বংস হয়। গোলার আঘাতে ১১ জন শত্রুসৈন্য নিহত এবং ৭ জন আহত হয়। পাকসেনারা পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলি জ্বালিয়ে দেয় এবং বিক্ষিপ্তভাবে গ্রামের মধ্যে কামানের গোলাবর্ষণ করে। এরপর আমাদের রেইডিং পার্টি ১৪ই সেপ্টেম্বর সকাল ৮টায় কায়েকপুরে পাকসেনাদের আরো দু’টি বাঙ্কার রকেটের সাহায্যে ধ্বংস করে। এতে ১৬ জন পাকসেনা নিহত এবং ৮ জন আহত হয়। ১৫ই সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টার সময় আমাদের আরেকটি রেইডিং পার্টি লক্ষ্মীপুরের নিকট পাকসেনাদের দু’টি বাঙ্কার অতর্কিত আক্রমণ করে ধ্বংস করে দেয়। এতে ৩ জন পাকসেনা নিহত এবং ৮ জন আহত হয়। ১৯শে সেপ্টেম্বর সকাল ৬টায় লক্ষ্মীপুরস্থ পাকসেনাদের আরো দু’টি বাঙ্কার রকেটের গুলিতে উড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে দু’জন পাকসেনা নিহত এবং একজন আহত হয়।
ফরিদপুরে আমাদের মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা তাদের কর্মতৎপরতা অব্যাহত রাখে। ৩রা আগস্ট বিকাল ৪টার সময় আমাদের গেরিলারা মাদারীপুরের ভাঙ্গা এবং মুহাফিজ সেতুগুলোতে পাহারারত শত্রুসেনাদের উপর আক্রমণ চালায়। সে আক্রমণে তারা সেতুগুলো ধ্বংস করে দেয় ও ৭টি রাইফেল দখল করে। ১০ তারিখে মিঠাপুরের ডাকঘর এবং ইউসুফপুরের তহসীল অফিস জ্বালিয়ে দেয়। ১৪ তারিখ সকাল ৬টায় আমগ্রামের সমাদ্দার সেতু সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়। ঐ দিনই গেরিলারা আরেকটি দল পাকসেনাদের একটি গাড়ী মাদারীপুর-টেকেরহাট রাস্তায় গাটমাকির নিকট এমবুশ করে। গাড়ীটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে ৯ জন পাকসেনা আহত হয়।
২৭শে আগস্ট আমাদের একটি টহলদার দল পরাশুরাম থানার নিকট পাকসেনাদের একটি টহলদারী দলকে এমবুশ করে ৭ জন পাকসেনাকে নিহত করে। দুই ঘণ্টা সংঘর্ষের পর পাকসেনারা মর্টারের সাহায্যে আক্রমণ চালিয়ে আমাদের গেরিলাদের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে পালাতে সক্ষম হয়। আরেকটি দল ফেনী-বেলুনিয়া সড়কের উপর হাসানপুর সেতুটি ধ্বংস করে দেয়। শালদা নদীর নিকটে আমাদের একটি টহলদার দল দু’জন পাকসেনাকে রাতে টহল দিতে দেখে এমবুশ করে। এই এমবুশে দু’জন পাকসেনাই নিহত হয়। নিহত পাকসেনাদের পকেট থেকে পাওয়া কাগজপত্রে তাদের নাম পাওয়া যায়। এদের একজনের নাম হাবিলদার আবদুল আজিজ এবং অপরজনের নাম ছিল হাবিলদার রহমান গুল। ২০শে সেপ্টেম্বর বিকেল ৪টায় পাকসেনাদের একটি দল আমাদের শালদা নদী অবস্থানের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। ছোট পাহাড়ের উপর অবস্থিত আমাদের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় আমাদের সৈনিকদের প্রচণ্ড গোলাবর্ষণের ফলে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। ক্যাপ্টেন গাফফার একটি শক্তিশালী রেইডিং পার্টি নিয়ে ১৯শে সেপ্টেম্বর কায়েমপুরে পাকসেনাদের অবস্থানের পিছনে অনুপ্রবেশ করে। পরদিন ভোরে রেকি করার পর সকাল ১০টায় পাকসেনাদের পেছন দিকের অবস্থানের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। আক্রমণের ফলে পাকসেনারা হতভম্ব হয়ে পড়ে এবং আতঙ্কিত হয়ে ছুটাছুটি করতে থাকে। আমাদের রেইডিং পার্টির গুলিতে ৩২ জন পাকসেনা নিহত এবং ৭ জন আহত হয়। এরপর আমাদের দলটি আক্রমণ প্রত্যাহার করে শত্রু অবস্থান থেকে নিরাপদ দূরত্বে চলে আসে। পাকসেনাদের একটি দল কায়েমপুরে তাদের অবস্থানের দিকে নৌকাযোগে অগ্রসর হবার পথে আমাদের এমবুশ পার্টি তাদের উপরও অতর্কিত আক্রমণ চালায়। দুটি নৌকা আক্রমণের ফলে ধ্বংস হয়ে যায় এবং এতে ১৫ জন পাকসেনা নিহত হয়।
আমাদের সৈন্যরা পাকসেনাদের ওপর তাদের হামলা চালিয়ে যেতে থাকে।পাকসেনাদের চাপও আমাদের ওপর থেকে ধীরে ধীরে কমে যায়।পাকসেনারা তাদের বিপর্যস্ত অবস্থানগুলো বাঁচানোর জন্য ভারী তোপের সাহায্য আমাদের মন্দভাগ কোনাবন এবং শালদা নদীর অবস্থানের ওপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করে।এতে আমাদের ২-জন নন-কমিশন্ড অফিসার ও ১জন গোলন্দাজ বাহিনীর ও-পি শহীদ হয়।পাকসেনাদের একটি জঙ্গি বিমান ২৮শে সেপ্টেম্বর তাদের সেনাদের সাহায্যর জন্য দুপুর দুটো থেকে তিনটা পর্যন্ত আমাদের অবস্থানগুলোর ওপর ক্রমাগত আক্রমণ চালায়। পাকসেনাদের অবস্থানগুলো আমাদের আক্রমণে অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে আমরা বুঝতে পারি এবং তাদেরকে সম্পূর্ণ এই এলাকা থেকে হটিয়ে দেয়ার জন্য ২৭তারিখে একটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৮ তারিখ সাড়ে ১০টার সময় ৪র্থ বেঙ্গলের একটা শক্তিশালী দল উত্তর দিক থেকে কায়েমপুরের শত্রুঅবস্থানের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়।৪ঘন্টা স্থায়ী যুদ্ধের পর পাকসেনাদের ১৫জন নিহত এবং ৩০জন আহত হয়।আমাদের কিছু সংখ্যক যোদ্ধাও শহীদ এবং আহত হয়।আমাদের সৈন্যদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে পাকসেনারা তাদের কায়েমপুর ঘাঁটি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। আমাদের সৈন্যরা তাদের পরিত্যক্ত অবস্থান থেকে মেশিনগান, মর্টার ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র এবং প্রচুর গোলাবারুদ দখল করে নেয়।এখানে উল্লেখযোগ্য যে,সেপ্টেম্বর মাসের ৯তারিখে আমাদের সৈন্যরা এইসব অবস্থান গুলো থেকে শত্রুর প্রবল চাপের মুখে পর্যাপ্ত পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্রের অভাবে পিছু হটে আসতে বাধ্য হয়।ফলে শত্রুরা এইসব জায়গা দখল করে নেয়। এর এক সপ্তাহ পরেই আমরা পুনরায় পাল্টা আক্রমণ চালাই।এই পাল্টা আক্রমণের ফলে প্রায় ২০১ জন পাকসেনা নিহত এবং ৮৩জন আহত হয়,৭০টি ব্যাংকার ধ্বংস করা হয় এবং অসংখ্য অস্ত্রশস্ত্র আমাদের দখলে আসে। আমাদের ক্ষয়ক্ষতি ছিল সে তুলনায় অতি অল্প-১০জন শহীদ হয় এবং৬জন আহত হয়।আমাদের সৈনিকরা পাকসেনাদের দখলকৃত কায়েমপুরা, শ্রীপুর, মঈনপুর, কামালপুর, লক্ষ্মীপুর প্রভৃতি জায়গা পুনরুউদ্ধার করে।এরপর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ পর্যন্ত দাউসসহ মন্দভাগের পশ্চিমের বিস্তীর্ণ এলাকা সম্পূর্ণরুপে শত্রুমুক্ত করা হয়। এর ফলে পাকসেনাদের মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশন এবং তার পশ্চিমে আশাবাড়ি পর্যন্ত আমাদের দখলে থাকা এলাকা পুনরুদ্ধার সমস্ত আশাও পরিকল্পনা সম্পূর্ণরুপে ব্যর্থ হয়ে পড়ে এবং তারা হতাশ হয়ে পড়ে।
কসবার পশ্চিমে টি,আলীর বাড়ির নিকট অবস্থিত পাকসেনাদের অবস্থানগুলোর ওপর আমাদের সৈনিকরা ক্রমাগত চাপ বাড়িয়ে যাচ্ছিলো। ২৮শে আগস্ট ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন ৪র্থ বেঙ্গলের ডি কোম্পানি থেকে একটা প্লাটুন পাক অবস্থানের পিছনে পাঠিয়ে দেয়। আমাদের কাছে খবর ছিল পাকসেনারা তাদের অগ্রবর্তী অবস্থানগুলোতে নৌকার সাহায্য সরবরাহ কাজ চালাচ্ছে। এই প্লাটুনকে পাকসেনাদের সরবরাহকারি নৌকাগুলো এমবুশ করার দায়িত্ব দেয়া হয়। প্লাটুনটি ২৯ তারিখ সকালে পাকসেনাদের পেছনে জলপথের ওপরে এমবুশ লাগিয়ে বসে থাকে। বেলা ২-৪০মিনিটে পাকসেনাদের দুটি নৌকা সেদিকে অগ্রসর হয়।এমবুশের আওতায় আসার সাথে সাথে আমাদের সৈনিকরা তাদের ওপর আক্রমণ চালায়।প্রচণ্ড গোলাগুলির পর তাদের দুটি নৌকাই ডুবিয়ে দেওয়া হয় এবং সেই সঙ্গে ৩০জন পাকসেনাই নিহত হয়। আমাদের একজন সৈনিক শহীদ হয়। ৪র্থ বেঙ্গলের ডি কোম্পানির আরও দুটি প্লাটুন সেপ্টেম্বর মাসের ৫ তারিখ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত লাটুমুড়া,তাজিশ্বর,ফতেহপুর,চারনল,বগাবাড়ি প্রভূতি স্থানে পাকসেনাদের অতর্কিত আক্রমণ করে ৩৬ জন খানসেনা ও ১৭ রাজাকার নিহত হয় ও আহত করে।পাকসেনারা এই এলাকায় আমাদের সৈনিকদের আক্রমণাত্মক কার্যকলাপে অতিষ্ঠ হয়ে একটি শক্তিশালী দল তাজিশ্বর ও বগাবাড়ির দিক ১১ই সেপ্টেম্বর অগ্রসর হয়। পাকসেনাদের এই দলটির অগ্রসরের খবর আমাদের কাছে আগেই পৌঁছে যায়। ডি কোম্পানির দুটি প্লাটুন বগাবাড়ির নিকট পাকসেনাদের পথে এমবুশ পেতে বসে থাকে।১১তারিখ সকাল ৬টায় সময় অগ্রগামী পাকসেনা দলটি আমাদের এমবুশের আওতায় পড়ে যায়।আমাদের সৈনিকরা তাদের অতর্কিত আক্রমণ করে।প্রবল আক্রমণের মখে টিকতে না পেরে আবার পশ্চাদপসরণ করে। এই যুদ্ধের ফলে ১৫জন পাকসেনা নিহত হয় এবং দুজন আহত হয়। পাকসেনাদের এই এলাকায় বিপর্যস্ত অবস্থায় তাদের সাহায্যর জন্য ১৩ তারিখে পাকসেনাদের পাঁচটি জঙ্গি বিমান বিকেল পাঁচটার সময় আমাদের অবস্থানগুলোর ওপর এক ঘন্টাব্যাপী প্রচন্ড বোমাবর্ষণ করে। পাকসেনাদের বিমান হামলা আমাদের সৈনিকদের মনোবল ভাঙ্গতে পারেনি। তারা তাদের অবস্থান শত্রুর চাপের মুখেও অটল থাকে। পাকসেনাদের সংঘর্ষ উপরোল্লিখিত এলাকায় এর পরেও অব্যাহত থাকে।
পাকসেনাদের এই সেক্টরে আরও সৈন্য সমাবেশ করতে থাকে।তাদের অবস্থানগুলোর দিকে পাকসেনাদের অগ্রসর হওয়ার পথে বাধা দেওয়ার জন্য ৪র্থ বেঙ্গলের ডি কোম্পানি ১৬ই সেপ্টেম্বর শত্রু অবস্থানের মেহারী গ্রামে একটি এমবুশ পেতে বসে থাকে। ১৭তারিখ সকাল ৭টায় পাকসেনাদের একটি শক্তিশালি দল পশ্চিম দিক থেকে অগ্রসর হয়ে আমাদের আক্রমণের জন্য মেহারীতে আমাদের এমবুশ পার্টি তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করে। নিজেদের অবস্থানের এত কাছে তারা আক্রান্ত হবে তা তারা ভাবতেও পারেনি। ফলে এই আকস্মিক আক্রমণে তারা দিকবিদিক হারিয়ে ফেলে এবং ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়।পাক গোলন্দাজ বাহিনী কামানের গোলাতে তাদেরকে পালাতে সহায়তা করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাদের অনেক সৈন্য হতাহত হয়। এই এমবুশে পাকসেনাদের ২১জন নিহত এবং ৪৩জন আহত হয়। আমাদের সৈনিকদের নিরাপদে পিছু হটে আসতে সক্ষম হয়। ঐদিন রাত্রে আমাদের এই দলটি সায়েদাবাদের নিকট পাকসেনাদের একটা ঘাটিতে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে দুটো জীপ ও ১টি ৩টন গাড়ী ধ্বংস করে দেয়। এর পরদিন আমাদের রেইডিং পার্টি চারগাছা বাজারের নিকট পাকসেনাদের একটা টহলদার দলকে এমবুশ করে ২০জন পাকসেনাকে হতাহত করে। পাকসেনারা এই সংবাদ পেয়ে তাদের টহলদার দলের সাহায্যার্থে একটি শক্তিশালী দল তিন নৌকা বোঝাই করে চারগাছের দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু পৌঁছার আগেই আমাদের সৈনিকরা তাদেরকে শিমরাইলের নিকটে এমবুশ করে দুটি নৌকা ডুবিয়ে দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে দু নৌকা ভর্তি পাকসেনাদের সবাই নিহত হয়। এই সংঘর্ষে আমাদের ১জন সৈনিক শহীদ হন। আমাদের সৈনিকদের জন্য এই এলাকার পাকসেনাদের এহেন বিপর্যয়ের ফলে তারা পুনরায় আরো ব্যাপক ভাবে এই এলাকায় সৈন্য সমাবেশ ঘটায় এবং চাপ বৃদ্ধি করতে থাকে। এতে আমরা আরেক অসুবিধার সম্মুখীন হই। ঢাকাতে এবং ফরিদপুর যেসব গেরিলাদের পাঠানো হতো তারা এই এলাকার ভিতর দিয়ে যাতায়াত করতো। পাকসেনাদের তৎপরতার জন্য সমস্ত অনুপ্রবেশ পথগুলো প্রায় বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়। ২২শে সেপ্টেম্বর আমাদের ৬০জন গেরিলার একটি দল চারটি নৌকায় অনুপ্রবেশের পথে পাকসেনাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। ফলে দুটি নৌকা ডুবে যায়। চারজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয় এবং একজন আহত হয়।তিনটি স্টেনগান, চারটি রাইফেল এবং কিছুটাকা ও ১০০০গুলি পানিতে পড়ে হারিয়ে যায়। গেরিলারা আহত ও শহীদের নিয়ে আমাদের অবিস্থানে ফিরে আসে। এই রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমার পক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় আমি মেজর আইনুউদ্দিনকে যে কোন উপায়ে এই এলাকাকে পুনঃ মুক্ত করার জন্য নির্দেশ দেই। তাকে আরেকটি অতিরিক্ত দল দিয়ে তার শক্তি বৃদ্ধি করে কসবা থেকে নবীনগর পর্যন্ত আমাদের তৎপরতা বাড়িয়ে নেয়ার জন্য নির্দেশ দিই। পাকসেনাদের বিভিন্ন ঘাঁটির উপর বার বার আক্রমণ করে তাদেরকে এই এলাকা থেকে বিতাড়িত করার জন্য। সকল ব্যবস্থা নেয়া হয়।শক্তি বৃদ্ধি পাওয়াতে মেজর আইনুউদ্দীন তার তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। ১০/১২টির শক্তিশালী রেইডিং পার্টি কসবা, সাঈদাবাদ, চরগাছা প্রভৃত এলাকাতে পাঠিয়ে দেয়।এই রেইডিং পার্টিগুলো বিভিন্ন স্থানে পাকসেনাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে ২৫জন পাকসেনা নিহত এবং ৩০জনকে আহত করে ও১টি গাড়ী ধ্বংস করে। আমাদের পুনঃ পুনঃ আক্রমণের ফলে পাকসেনারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। আস্তে আস্তে এলাকাতে আমাদের সৈন্যরা পাকসেনাদের মনে ত্রাসের সৃষ্টি করে। ২৪শে সেপ্টেম্বর সকাল ৭-৩০টায় সময় পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল ১৭টি নৌকায় আমাদের একটা রেইডিং পার্টিকে আক্রমণ করার জন্য নবীনগরের দিকে অগ্রসর হয়। পাকসেনাদের নৌকাগুলো যখন বিদাকোর্ট গ্রামের নিকট পৌছায় তখন আমাদের সৈনিকরা তাদেরকে অতর্কিত আক্রমণ করে। এই আক্রমণে পাঁচটি নৌকা ডুবে যায় এবং অন্তত ২৫জন পাকসেনা নিহত এবং পঁয়ত্রিশজন আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের এই সকল আক্রমণে সে এলাকার সমস্ত জনসাধারণ স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে এবং বিপুল আনন্দে মুক্তিযুদ্ধাদেরকে অভিনন্দিত করে। এর কয়েকদিন পর ৩রা অক্টোবর পাকসেনাদের একটি লঞ্চ, গোলাবারুদ ও রসদ নিয়ে সাইদাবাদ যাবার পথে আমাদের মুক্তিযুদ্ধাদের দ্বারা মলুগ্রামে আক্রান্ত হয়। আক্রমণের ফলে লঞ্চটির গোলাবারুদ আগুন লেগে ডুবে যায়। সেই সঙ্গে ১০জন পাকসেনা নিহত হয় ও আহত হয়।আমাদের চারজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয় এবং দুজন আহত হয়। এই খবর পেয়ে পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল আরেকটি লঞ্চযোগে আমাদের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়। অগ্রসর হওয়ার পথে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা তাদেরকে পরগাছার নিকট আক্রমণ করে। প্রায় ২-৩ঘণ্টা যুদ্ধের পর অনেক পাকসেনা লঞ্চ থেকে ঝাঁপিয়ে পালাবার চেষ্টা করে এবং ডুবে যায়। পাকসেনাদের ৭০/৮০জন নিহত ও আরো অনেক আহত হয়। লঞ্চটির ও বেশ ক্ষতি হয় এবং বহু কষ্টে বাকী সৈন্যদের নিয়ে লঞ্চটি সেখান থেকে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। ঐদিন বিকেল ৫টায় পাকসেনাদের ২০টি নৌকা ও ৩টি স্পিডবোট আমাদের মুক্তিযুদ্ধাদের দ্বারা কসবার নিকট আক্রান্ত হয়। ফলে ৩য় পাঞ্জাবী রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লে:কর্ণেল জামান ও একজন ক্যাপ্টেন সহ ১২জন পাকসেনা নিহত হয় এবং তিনটি স্পীডবোট ও কয়েকটি ণৌকা ডুবে যায়।
সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে থেকে অক্টোবর প্রথম সপ্তাহ এই এলাকায় ছোট এমবুশ এবং ছোট ছোট আক্রমণের ফলে পাকসেনারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। ৩রা ও ৪ঠা অক্টোবরে চাতগাছা, মলুগ্রাম, কসবা প্রভূতি জায়গায় পাকসেনাদের অন্তত ২৫০ থেকে ৩০০ সৈনিক নিহত হয়। একটি লঞ্চ, তিনটি স্পিডবোট, ১০টি নৌকা ডুবে যায় কিংবা আমাদের দখলে আসে। একজন লে:কর্ণেলসহ বেশ কয়েকজন অফিসার নিহত হয়। এর ফলে এই এলাকায় পাকসেনাদের তৎপরতা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায় এবং তারা অনেক পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়।
কুমিল্লার দক্ষিণে এবং নোয়াখালী এলাকাতেও আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের তৎপরতা আরো জোরদার করে তোলে। ৩০শে আগস্ট সকাল ১০টায় লাকসাম থেকে পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল চৌদ্দগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। এই দলটি আমাদের অবস্থানের ২০০গজের মধ্যে পৌঁছলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধারা তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। উভয় পক্ষের মধ্যে সমস্তদিন ধরে গোলাগুলি চলতে থাকে। পাকসেনারা আক্রোশে রাস্তার চতুর্দিকের সমস্ত গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। প্রচণ্ড আক্রমণ সত্ত্বেও আমাদের সৈনিকরা নিজেদের অবস্থানে অটল থাকে। সমস্ত দিনের যুদ্ধে তাদের প্রায় ২০জন সৈন্য নিহত হয় এবং অনেক আহত হয়। তারা অগ্রসর হতে সক্ষম না হয়ে পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। পরদিন ল্যান্সনায়েক লোকমান আলী ও ল্যান্সনায়েক আহসান উল্লার নেতৃত্ব একটি ডিমোলিশন পার্টিকে চৌদ্দগ্রাম -বাংগোড়া-লাকসাম রাস্তা দিয়ে শত্রু সৈন্যদের চলাচলে বিঘ্ন ঘটাবার জন্য রাস্তার মাঝে মাঝে ডিমোলিশন দিয়ে ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য পাঠানো হয়। দলটি নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছানোর পর তাদের ডিমোলিশন কাজ শুরু হয়। কিন্তু স্থানীয় শান্তিকমিটি ও তাদের লোকেরা পাকসেনা কর্তৃক প্রতিশোধের ভয়ে রাস্তায় ডিমোলিশন লাগাতে বাধা দেয়। ল্যান্স নায়েক স্থানীয় লোকদেরকে দেশের বৃহত্তর স্বার্থের কথা বুঝিয়ে বলেন। বোঝানোর পর শান্তিকমিটির লোকেরা তাদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে সহযোগীতা করে। তারা নিজেরাই রাস্তা খুঁড়ে তিন জায়গাতে ৫০পাউন্ড জিলেটিন এক্সপ্লোসিভ এর ব্যাগ লাগায় এবং ৮০ফুট রাস্তা উড়িয়ে দেয়। এতে পার্শ্ববর্তী রাস্তার দুপাশের পানি রাস্তার খাদে প্রবেশ করে। ফলে চৌদ্দগ্রাম -লাকসাম যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ঐদিন রাতে আমাদের আরেকটি টহল দল কুমিল্লার দক্ষিণ পূর্বে আর একটি দল নাঙল কোট ও লাকসামের মাঝামাঝি রেললাইনের উপর মাইনপুঁতে একটি ইঞ্জিনসহ তিনটি রেলওয়ে বগী ধ্বংস করে দেয়। কাজলপুরের নিকট আরেকটি মালবাহী ট্রেন আমাদের পোঁতা মাইনের আঘাতে লাইনচ্যুত হয়।ফেনী ও লাকসামের মাঝে নাওতি স্টেশনের নিকট ডিমোলিশন লাগিয়ে রেললাইনের ১৪ফুট রাস্তা ধ্বংস করে দেয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লা -ফেনী রেললাইনের পাশে টেলিফোন লাইনের তার কয়েক জায়গায় কেটে দেয়। ৩রা সেপ্টেম্বর আমাদের আর একটি ডিমোলিশন পার্টি লালমাই ও জাঙ্গালিয়া স্টেশনের মাঝে রেলওয়ে রাস্তার উপর ডিমিলিশন লাগিয়ে রেললাইনের খানিকটা ঊড়িয়ে দেয় এবং জমুয়া ও বেতুরার রেভিনিউ অফিস পুড়িয়ে দেয়।
সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বেলুনিয়াতে পাকসেনারা তাদের তৎপরতা আরও বাড়িয়ে তোলে। ৬ই সেপ্টেম্বর পাক সামরিক জান্তা নয়নপুরের নিকট বিপুল পরিমাণ সৈন্য সমাবেশ করতে থাকে। ওইদিন রাত প্রায় ৩টার সময় পাক সেনাদের দুটি প্লাটুন সোলেনিয়া নদী অতিক্রম করে। আমাদের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করে। পাকসেনাদের দলটি নৌকা যোগে যখন নদী পার হওয়ার চেষ্টা করে তখন আমাদের অগ্রবর্তী দল তাদের অপর আক্রমণ চালায়। আক্রমণের ফলে ১৫ জন পাকসেনা নিহত এবং বেশ কিছুসংখ্যক আহত হয়। অবশিষ্ট সৈন্যরা মর্টারের গোলার সহায়তায় পশ্চাদপসরন করে। পরদিন বিকেল ৪টায় পাকসেনাদের আরেকটি শক্তিশালী দল আরও পশ্চিমে মহুরী নদী অতিক্রম করার চেষ্টা করে। এখানেও আমাদের অগ্রবর্তী অবস্থান থেকে তাদের অপর আক্রমণ চালানো হয়। গোলাগুলিতে পাকসেনাদের একজন অফিসার সহ ১৫ জন নিহত এবং প্রায় ২০ জন আহত হয়। পাকসেনারা তাদের আক্রমণ অব্যাহত রাখে এবং আমাদের অবস্থানগুলোর অপর প্রচন্ডভাবে কামানের গোলাবর্ষণ করতে থাকে। আমাদের সৈন্যরা টিকতে না পেরে অগ্রবর্তী অবস্থান পরিত্যাগ করে স্থায়ী অবস্থানে ফিরে আসে। পাকবাহিনী তাদের আক্রমণের চাপ অব্যাহত রাখে। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এই আক্রমণ চলতে থাকে। আমাদের বীর সৈনিকরা তাদের অবস্থান থেকে গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় পাকসেনাদের আক্রমণকে দেড় ঘণ্টার যুদ্ধে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। পাকসেনাদের অনেক হতাহত হয় ও পরে আমাদের পালটা আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এরপর পাকসেনারা পরশুরামের নিকট সৈন্য সমাবেশ করতে থাকে। প্রায় এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য পরশুরামে মোতায়েন করে। ৯ই সেপ্টেম্বর আমাদের খবর সংগ্রহকারী লোকেরা জানতে পারে যে পাকসেনারা বেশ কয়েকটি ১০৫ এর এম এম কামান সহ সালিয়ার নিকট অবস্থান নিচ্ছে। পাকসেনাদের তৎপরতা দেখে আমরা বুঝতে পারি যে মুহুরী নদীর পূর্ব পাড়ে তাদের অবস্থান পাকা করে নদী পার হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এছাড়া বিশ্বস্ত সূত্রে আমরা আরও জানতে পারি, যে কোন উপায়ে বেলুনিয়া এলাকা নিজেদের দখলে আনার জন্য তারা বদ্ধ পরিকর। ১০ই সেপ্টেম্বর সকাল ৯টা থেকে পাকসেনারা মহুরী নদী পার হয়ে প্রচণ্ড কালানের গোলার সহায়তায় আমাদের অবস্থানের অপর আক্রমণ চালায়। সমস্ত দিন যুদ্ধের পড় পাকসেনাদের এই আক্রমণকে আমাদের যোদ্ধারা প্রতিহত করে। বিপুল ক্ষয়ক্ষতির পড় আমাদের সৈনিকরা পাকসেনাদের আবার পশ্চিম তীরে পশ্চাদপসরণে বাধ্য করে। আমাদের সেনারা যখন পাকসেনাদের ওপর সম্মুখসমরে প্রতিআক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল সে সময়ে গেরিলাদের বেশ কয়েকটি দল পাকবাহিনীর পিছনে আঘাত হেনে তাদেরকে বিপর্যস্ত করে তোলে।
মতিগঞ্জে গেরিলা পাকসেনাদের একটি ক্যাম্পে অতর্কিতে আক্রমণ করে একজন অফিসারসহ ১১ জন পাকসেনাকে নিহত এবং ২০ জনকে আহত করে। পাকসেনাদের ক্যাম্প থেকে প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র দুটি মোটর সাইকেল, ৩টি রেডিও এবং তিনটি বাক্স ঔষধ দখল করে নেয়। আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা এই সঙ্ঘর্ষে শহীদ হয়। আরেকটি দল ১০ই সেপ্টেম্বর রাত ১০টায় নয়াপাড়ার শত্রুঘাঁটি আক্রমণ করে তাদেরকে সেখান থেকে বিতাড়িত করে। এখানেও আমাদের গেরিলারা বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নেয়। ওপর আরেকটি গেরিলা দল ফেনীর নিকট ফতেপুর রেলসেতু ডিমোলিশন লাগিয়ে উড়িয়ে দেয়। ফলে ৫০ ফুটের একটি খাদের সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে লাকসাম-ফেনীর মধ্যে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া ফেনী শহরেও আমাদের গেরিলারা গ্রেনেড নিক্ষেপ করে পাকসেনাদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। গেরিলারা ফেনী থেকে ফুলগাজী পর্যন্ত পাকসেনাদের টেলিফোন লাইন কেটে তাদের টেলিফোন যোগাযোগ ব্যাবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পাকসেনারা তাদের অগ্রবর্তী অবস্থানগুলোতে ফেনী থেকে ট্রলির সাহায্যে রসদ সরবরাহ করত। তাদের আই সরবরাহ বন্ধ করবার জন্য চিতলিয়ার নিকট ঘানিমোড় রেলসেতুটি উড়িয়ে দেয়ার জন্য আমাদের পাইওনিয়ার প্লাটুন পাঠানো হয়। এই প্লাটুনটি বিপদের ঝুঁকি নিয়ে রাতে পাকসেনাদের অবস্থানের পেছনে অনুপ্রবেশ করে। পরদিন সকালে তারা সেতুটি সম্পর্কে তথ্যানুসন্ধান চালিয়ে জানতে পারে পাকসেনারা সেতুটিকে কড়া প্রহরার ব্যাবস্থা করেছে। অতি কষ্টে তারা মহুরী নদী সাতরিয়ে রাতের অন্ধকারে সেতুটির নিচে ডিমোলিশন লাগিয়ে এই গুরুত্তপূর্ণ সেতুটি উড়িয়ে দেয়। এর ফলে ফেনী এবং বেলুনিয়াতে পাকসেনাদের ট্রলির সাহায্যে সরবরাহ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়।
শত্রুদের উপর আমাদের আক্রমণের চাপ অব্যাহত রাখা হচ্ছিল। ১১ই সেপ্টেম্বর আমাদের একটি শক্তিশালী দল কামানের সহায়তায় সন্ধ্যা ৭টায় পরশুরামের নিকট পাকঘাঁটির উপর অতর্কিতে আক্রমণ করে সাতজন পাকসেনাকে নিহত এবং পনের জনকে আহত করে। এর পরদিন আমাদের দুটি শক্তিশালী দল সালদার এবং জগন্নাথ দীঘির শত্রুঘাঁটির উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে চারজন পাকসেনাকে নিহত এবং অনেককে আহত করে। আমাদের এই পুনঃ পুনঃ আঘাতের ফলে পাকসেনারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং ফেনীর দক্ষিণে তাদের কামানের অবস্থান গড়ে তোলে। সেখান থেকে আমাদের অবস্থানের উপর প্রচণ্ড কামানের আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণের ফলে আমাদের অবস্থান বেশ কিছুটা বিপর্যয়ের মুখে পড়ে যায়। পাকসেনারা তাদের কামানের আক্রমণ অব্যাহত রাখে। তাদের এই কামানের ঘাঁটিগুলোকে ধ্বংস করে দেবার জন্য ১৪ই সেপ্টেম্বর তারিখের সকালে আমাদের একটি কোম্পানিকে তিনটি মর্টার সহ পাকসেনাদের অবস্থানের পেছনে পাঠানো হয়। গোপন পথে অনুপ্রবেশ করে এই দলটি ফেনী বিমান বন্দরের পশ্চিমে বিকেলে পৌঁছে এবং পাকসেনাদের ব্রিঞ্চিতে অবস্থিত কামানঘাঁটি সম্বন্ধে বিস্তারিত খবর সংগ্রহ করে রাত ১-৩০টায় পাক অবস্থানের উপর মর্টারের সাহায্যে অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা এই ধরণের আক্রমণের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলোনা। আক্রমণের ছাপে উপায়ান্তর না দেখে তারা ফেণীতে অবস্থিত তাদের অন্য গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যের আবেদন জানায়। ফেনী থেকে পাকসেনাদের কামানগুলো আমাদের অবস্থানের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। আমাদের দুর্ধর্ষ গোলন্দাজ বাহিনী পাকসেনাদের ফেনী অবস্থানের উপর পাল্টা আক্রমণ চালায়। দুঘণ্টা যুদ্ধের পড় আমাদের রেইডিং পার্টি পাকসেনাদের ১০ জনকে নিহত, ১৬ জনকে আহত এবং তাদের আরও বহু ক্ষতি সাধন করে নিরাপদে নিজেদের অবস্থানে ফিরে আসে। আমাদের কামানের আক্রমণ পাকসেনাদের ঘাঁটির যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করে এবং তারা তাদের গোলাবর্ষন বন্ধ করতে বাধ্য হয়। পড়ে আমরা জানতে পারি যে, আমাদের এই আক্রমণের ফলে পাকসেনাদের গোলন্দাজ ঘাঁটিতে ১১ জন পাকসেনা নিহত এবং ২৩ জন আহত হয়। ব্রিঞ্চিতে ৩ টি জিপ ধ্বংস হয়ে যায়। একটি কামানেরও মারাত্মক ক্ষতি হয়। ফানিতে পাকসেনাদের মনোবল অনেকটা ভেঙ্গে পড়ে। বিশেষ করে পাকসেনাদের সহকারী শান্তি কমটির সদস্য দালালরা ভয়ে ফেনী শহর পরিত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায়। অপরদিকে এই আক্রমণের ফলে আমাদের মুক্তিবাহিনী ও স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণের মানোবল আরো বৃদ্ধি পায়। এর পরদিন আমাদের একটি কোম্পানি সালদার শত্রুঘাটি রেইডিং করার জন্য পাঠানো হয়। সমস্ত দিন রেকি করার পড় রাত ৮-৩০ মিনিটে আমাদের কোম্পানিটি গোলন্দাজ বাহিনী এবং ৪ মর্টারের সহায়তায় পাকসেনাদের উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায় এবং প্রায় এক ঘণ্টা যুদ্ধের পর আমাদের সৈন্যরা পাকসেনাদের অগ্রবর্তী অবস্থানগুলো দখল করে নেয়। পাকসেনারাও তাদের গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে আমাদের অগ্রসর পথে বাঁধা দেবার চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের সৈনিকরা ক্ষিপ্রতা ও বীরত্বের সঙ্গে পাকসেনাদের অবস্থানের উপর তাদের হামলা অব্যাহত রাখে। পাকসেনাদের গোলন্দাজ বাহিনীর আক্রমণের ফলে আমাদের অগ্রসর পথে কিছুটা বাঁধা আসে। কিন্তু তবুও আমাদের সৈনিকরা ডান দিক থেকে তাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখে। সকাল পর্যন্ত সঙ্ঘর্ষে পাকসেনারা তাদের অবস্থান থেকে কিছুটা পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। আমাদের সৈনিকরা এই অবস্থানের পেছনে অবস্থিত একটি পেট্রোল ডাম্পও ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়। এতে প্রায় ২০/২৫ জন সেনা হতাহত হয়। শালদার অবস্থান থেকে পাকসেনাদের বিতাড়ির করার পর আমরা পরশুরামের নিকট অনন্তপুর গ্রামে পাকসেনাদের অবস্থানের উপর চাপ বাড়িয়ে তুলি। প্রথমদিন এই অবস্থানে আমাদের গোলন্দাজ বাহিনী আক্রমণ চালায়। ফলে ১০ জন পাকসেনা নিহত এবং আরও বেশ কিছু আহত হয়। এর একদিন পড় আবার অনন্তপুর গ্রামের অবস্থানের উপর আমাদের গোলন্দাজ বাহিনী আক্রমণ চালায়। ফলে ১৩ জন পাকসেনা নিহত ও ২ জন আহত হয়।
২৯শে সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭টার সময় ৪র্থ বেঙ্গলের ‘বি’ কোম্পানি পাকসেনাদের নয়ানপুর অবস্থানের উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে আমাদের গোলন্দাজ বাহিনীও সহায়তা করে। যুদ্ধ প্রায় ৩০ তারিখ রাত দুটো পর্যন্ত চলতে থাকে। ছয় ঘণ্টার যুদ্ধে আমাদের সৈনিকরা ১০ জন পাকসেনা নিহত, ১৫ জন আহত ও ৬ জনকে বন্দী করে। তাছাড়া অনেক অস্ত্রশস্ত্রও দখল করে নেয়। পাকসেনারা মাসীরহাট থিক আরও সৈন্য এনে শক্তি বৃদ্ধি করে আমাদের উপর পালটা আক্রমণ চালায়। আমাদের সৈনিকরা সাহসিকতার সাথে পড়ে আক্রমণের মোকাবিলা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদের বাহিনী গোলাবারুদ ফুরিয়ে এলে অবস্থান পরিত্যাগ করে নিরাপদে মূল অবস্থানে ফিরে আসে। এই সঙ্ঘর্ষে আমাদের পক্ষে একজন শহীদ ও ১১ জন আহত হয়। আমাদের যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকসেনাদের একটি সরবরাহকারী ট্রলি মুন্সীরহাট থেকে বেলুনিয়ার দিকে যাওয়ার পথে আমাদের সৈনিকদের পুঁতে রাখা মাইনের আঘাতে ধ্বংস হয়। ট্রলিতে বোঝাই গোলাবারুদ এবং রেশনও ধ্বংস হয়ে যায়।
এই ঘটনার দুদিন পর ১লা অক্টোবর রাত ১১টার সময় আমাদের একটি শক্তিশালী দল পাকসেনাদের মুন্সীরহাট অবস্থানের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চলায়। মুন্সীরহাট পাকসেনাদের জন্য বেলুনিয়া সেক্টরে অত্যন্ত গুরুত্তপূর্ণ ঘাঁটি ছিল। কারণ এই ঘাঁটির মাধ্যমে বেলুনিয়ার পশ্চিম দিকে তাদের অবস্থানগুলোতে সরবরাহ অব্যাহত রেখেছিল। বস্তুত সেই জন্যই আমাদের আক্রমণকে প্রতিহত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে তাদের অবস্থান পরিত্যাগ করে পালিয়ে যায়। এর পর দিন ২রা অক্টোবর পরশুরাম শত্রুঘাঁটির উপর আমাদের সৈনিকরা আক্রমণের চাপ বাড়াতে শুরু করে। পাকসেনারা বিপুল সংখ্যক সমাবেশ করে তাদের এই অবস্থানকে রক্ষা করার জন্য আমাদের উপরও পাল্টা আক্রমণ চালায়। আমাদের সৈনিকরা পাকসেনাদের পরশুরামের দিক থেকে এই পালটা এক্রমন দৃঢ়তার সাথে প্রতিহত করে। এতে পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পাকসেনাদের আক্রমণ প্রতিহত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অন্যান্য অবস্থান থেকে প্রায় ২/৩ কোম্পানি সৈন্য একত্রিত করে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া পাকসেনাদের উপর পুনরায় আক্রমণ চালাবার জিনয় নির্দেশ দেই। আমাদের সৈনিকরা পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের পিছু হটিয়ে দেয় এবং মুহুরি নদী অতিক্রম করে পরশুরামের পাকসেনাদের অনেকগুলো অবস্থান দখল করে নেয়। পাকসেনারা তাদের অবস্থানের উপর আক্রমণ হওয়াতে নিজেদের গোলন্দাজ বাহিনীকে সাহায্যের জন্য অনুরোধ জানায়। আমজাদনগরে অবস্থিত পাক গোলন্দাজ বাহিনী পরশুরামের উপর গোলাবর্ষণ শুরু করে। কিন্তু সৌভাগ্যবশত আমাদের আক্রমণের চাপ ও তাদের নিজেদের গোলার আঘাতে পাকসেনাদের অবস্থানটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রায় ৩০/৪০ জন পাকসেনা নিহত ও প্রচুর সংখ্যক সৈন্য আহত হয়। তারা উপায়ান্তর না দেখে তাদের পরশুরামের অবস্থানটি পরিত্যাগ করে পিছনে এসে নতুন করে অবস্থান নেয়। কয়েকদিনের যুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায় আমাদের সৈনিকদের কাছে বিপর্যস্ত হয়ে অঙ্কে ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে বেলুনিয়া ও পরশুরামের পাকসেনাদের মনোবল সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে যায়। পাকসেনাদের এহেন মোচনীয় অবস্থা দেখে আমরা তাদের উপর আমাদের চাপ অব্যাহত রাখি। ২রা অক্টোবর সন্ধ্যায় আমাদের একটি দল পাকসেনাদের শালদার অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালিয়ে ৯জন পাকসেনা নিহত করে এবং তাদের অনেক রসদ বিনষ্ট করে দেয়। পাকসেনারা তাদের অবস্থানগুলোকে রক্ষা করার জন্য ২রা বা ৩রা অক্টোবরের মধ্যবর্তী রাতে ফেনী থেকে মুন্সিরহাট ও চিতলিয়াতে আরও এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য সমাবেশ করে। ৩ তারিখ সকাল ৬টার সময় তাদের একটি শক্তিশালী দল আমাদের অনন্তপুর ও ধানীকুন্ডার অগ্রবর্তী অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়। ভারী কামা ও মর্টারের সাহায্যে তারা আমাদের অবস্থানগুলোতে প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করে এবং সেই সঙ্গে তাদের পদাতিক বাহিনীও আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা যখন অবস্থানের ৪০/৫০ গজের মধ্যে পৌঁছে, তখন আমাদের সৈনিকরা তাদের উপর প্রচণ্ড গুলি চালিয়ে প্রায় ২৫/৩০ জন পাকসেনাকে নিহত করে। পাকসেনারা হামলা চালিয়ে আমাদের অনন্তপুরের অবস্থানের দক্ষিণাংশের ট্রেঞ্চগুলো দখল করে নেয়। দক্ষনাংশে একটি হাল্কা মেশিনগান বাঙ্কারের উপর কামানের গুলি লেগে ধ্বংস হয়। এই আঘাতে আমাদের কয়েকজন সৈনিক শহীদ হয়। পাকসেনাদের এই প্রবল চাপ ও প্রচণ্ড কামানের গুলির মুখে প্রয়োজনীয় গোলাবারুদ ও অস্ত্রের ওভাবে টিকতে না পেরে আমাদের অগ্রবর্তির ঘাঁটির সৈনিকরা পিছু হটে মুখ্য অবস্থানে আসে। পাকসেনারা তাদের আক্রমণ আমাদের মুখ্য অবস্থানের উপরও চালাতে থাকে। এই সময় আমাদের গোলন্দাজ বাহিনী এবং মর্টারের গলাতে তাদের আক্রমণ প্রতিহত হয়ে যায়। মুখ্য অবস্থানের সামনে টিকতে না পেরে তারা ধীরে ধীরে পিছু হটতে চেষ্টা করে। আমাদের মুখ্য অবস্থান থেকে একটি শক্তিশালী দল তাদের উপর পাল্টা আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। আমাদের পাল্টা আক্রমণকারী দলটি আরও অগ্রসর হয়ে অনন্তপুর এবং ধানীকুন্ডা পুনর্দখল করে। পাকসেনাদের প্রায় ৪০/৫০ জন হতাহত হয়। আমাদের একজন শহীদ ও ৫ জন আহত হয়। পাকসেনারা মুজুমদারহাট ও চিতলিয়াতে তাদের অবস্থাগুলোতে আরও সৈন্য সমাবেশ করতে থাকে। আমরাও আমাদের চাপ অব্যাহত রাখি। ৪ঠা অক্টোবার তারিখ রাতে আমাদের একটি শক্তিশালী রেইডিং পার্টি পাকসেনাদের অবস্থানে অনুপ্রবেশ করে সকাল ছ’টা পর্যন্ত চিতলিয়ার নিকট পৌঁছে। সকাল ছ’টায় ৩” মর্টারের সহায়তায় চিতলিয়ায় পাকসেনাদের অবস্থানের দক্ষিণে অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। আধঘণ্টা পর্যন্ত আক্রমণের ফলে প্রায় ৩০ জন পাকসেনা হতাহত করে এবং একটি আর আর ধ্বংস করে দেয়। এরপর পাক অবস্থান থেকে শরে পড়ে নিরাপদে ফিরে আসে। ৬ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত আমাদের গোলন্দাজ বাহিনী পরশুরাম, মজুমদারহাট, চিতলিয়া এবং নোয়াপাড়ার উপর আক্রমণ চালিয়ে প্রায় ১০ জন পাকসেনা হতাহত করে। ১১ তারিখ সন্ধ্যা ৭টায় পাকসেনারা পরশুরাম ও মজুমদারহাটের দিক থেকে এক ব্যাটালিয়ন শক্তি সহ গোলন্দাজ বাহিনী ও ৩” মর্টারের সহায়তায় আমাদের অনন্তপুর অবস্থানের উপর পুনরায় আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা আমাদের অবস্থানের অতি নিকটে পৌঁছাতে সমর্থ হয়। কিন্তু আমাদের সৈনিকরা বীর বিক্রমে তাদের আক্রমণকে প্রতিহত করে। সমস্ত রাত আক্রমণ চালাবার পর পাকসেনাদের প্রায় ৩৫ জন সৈনিক নিহত হয়। স্কি প্রতিরোধ ব্যর্থ হয়ে এবং প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির জন্য পাকসেনারা তাদের মৃতদেহ ফেলে বোরে ছত্রভঙ্গ হয়ে পিছু হটে যায়। এই সাফল্যের ফলে আমাদের সৈনিকদের মনোবল আরও বৃদ্ধি পায়। ১৩ই এবং ১৪ই অক্টোবর পাকসেনারা আমাদের অবস্থানের এলাকায় তাদের তৎপরতা বাড়িয়ে চলে। ১৪ই অক্টোবর সালদরের নিকট পাকসেনাদের দুটি প্লাটুন আমাদের প্রতিরক্ষা মাইনের শিকার হয়। ফলে ১৮জন পাকসেনা নিহত হয়। ১৩ তারিখ সকাল ১০টার সময় আমাদের গোলন্দাজ বাহিনী পাকসেনাদের পরশুরাম অবস্থানের উপর গোলাবর্ষণ করে একটি মেশিনগান সহ পাঁচজন পাকসেনাকে ধ্বংস করে দেয়। পাকসেনারা ২/৩ দিন নীরব থাকার পর আবার তাদের তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। ১৬ই অক্টোবর আমাদের দুটি প্লাটুন বিকেল ৩-৩০ টায় পাকসেনাদের শালদার উপর আবার অতর্কিত আক্রমণ চালায়। ২০ মিনিটের এই আক্রমণের মুক্তিযোদ্ধারা ৫ জন পাকসেনাকে নিহত ও ১০ জনকে আহত করে নিরাপদে ফিরে আসে। ওইদিনই সাড়ে চারটার সময় আমাদের গোলন্দাজ বাহিনী পাকসেনাদের পরশুরাম অবস্থানে হামলা চালিয়ে ১০ জনকে আহত করে এবং একটি বাঙ্কার উড়িয়ে দেয়। পাকসেনারা ১৫ তারিখ সন্ধ্যা ৭টায় প্রায় এক ব্যাটালিয়ন সৈন্যশক্তি নিয়ে গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় আমাদের সাহেবনগর, চন্দনা এবং জঙ্গলখোলা অবস্থানগুলোর উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। প্রায় তিন ঘণ্টা যুদ্ধে আমাদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে পাকসেনারা পিছু হটে যায়। তাদের হতাহতের সংখ্যা জানা যায়নি।
কুমিল্লা দক্ষিণে জুলাই মাসের শেষের দিকে আমরা শত শত গেরিলাকে ট্রেনিং দিয়ে ভিতরে পাঠিয়ে দেই। এইসব গেরিলা কুমিল্লা, চৌদ্দগ্রাম, লাকসাম, হাজীগঞ্জ, বতরা, চাঁদপুর, ফরিদপুর প্রভৃতি জায়গাতে প্রবেশ করে নিজ নিজ জায়গায় বেইস তৈরি করে তোলে। আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে ফরিদগঞ্জে অবস্থিত আমাদের গেরিলাদের একটি প্লাটুন পাকসেনাদের একটি টহলদারি দলকে বোয়াল নামক স্থানে এম্বুশ করে। এক ঘণ্টা যুদ্ধের পর ১২ জন পাকসেনা নিহত ও ১৫ জন আহত হয়। বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র আমাদের গেরিলারা দখল করে নেয়। লাকসাম থানার সাহাপুর গ্রামে পাকসেনাদের একটি ছোট ঘাঁটি ছিল। লাকসামের গেরিলারা ৫ই আগস্ট সন্ধ্যা ৭টার সময় এই ঘাঁটির উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। আক্রমণে ১০ জন পাকসেনা নিহত ও ২ জন আহত হয়। আমাদের আরেকটি গেরিলা দলের দুটি প্লাটুন মিয়াবাজারের নিকট পাকসেনাদের একটি ঘাঁটির বিস্তারিত সংবাদ পায়। তিনটি প্লাটুন এর এই দলটি ৭ তারিখ রাত পৌনে ৩টার সময় সেই ঘাঁটিতে অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। প্রায় আধ ঘণ্টা যুদ্ধের ফলে ২৮ জন পাকসেনা নিহত এবং একজন অফিসার ও জেসিও সহ ১২ জন আহত হয়। বেশ কিছু সংখ্যক বাঙ্কার উড়িয়ে দেয়।
সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে চৌদ্দগ্রামের দক্ষিণে এবং কুমিল্লার দক্ষিণে কৃষ্ণনগর, কলাতলা, আমজাদহাট প্রভৃতি জায়গায় আমাদের গেরিলারা পাকসেনাদের উপর বিভিন্ন সময়ে আঘাত হেনে প্রায় ২০ জনকে নিহত ও ১৬ জনকে আহত করে। এসব সঙ্ঘর্ষে আমাদের ৩৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং ৩ জন আহত হয়। সেমটেম্বরের ২০ তারিখে আমাদের একটি গেরিলা দল চট্টগ্রাম-কুমিল্লার রাস্তায় জগন্নাথ দীঘির নিকট বাজানকারা সেতুটি উড়িয়ে দিয়ে সেতু থেকে কিছু উৎরে ১০ জন গেরিলা ও একটি নিয়মিত বাহিনীর পাকসেনাদের অপেক্ষায় এম্বুস পেতে বসে। সেতুটি ধ্বংসের সংবাদ পেয়ে ফেনী থেকে পাকবাহিনীর একটি শক্তিশালী দল সেতুর দিকে অগ্রসর হয়। সেতুতে পৌছার আগেই পাকসেনারা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের এম্বুশে পড়ে যায়। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে একজন অফিসার সহ ২৫ জন পাকসেনাকে নিহত করে। পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে ফেনীর দিকে পালিয়ে যায়।
পাকসেনারা লাকসামের নিকট হাসনাবাদ নামক এক জায়গায় তাদের একটি ঘাঁটি তৈরি করে। তাদের সঙ্গে বেশ কিছু সংখ্যক রাজাকারও ছিল। এই ক্যাম্প থেকে তারা চাঁদপুর-লাকসাম-কুমিল্লা রাস্তায় অনবরত টহল দিয়ে বেড়াতো। ফলে চাঁদপুরে এবং দক্ষিণ ঢাকা ও ফরিদপুরে অনুপ্রবেশকারী আমাদের গেরিলাদের জন্য আমাদের গেরিলাদের জন্য মারাত্মক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। এই ঘাঁটিটি ধ্বংস করে দেবার জন্য ক্যাপ্টেন মাহবুবকে নির্দেশ দেয়া হয়। ক্যাপ্টেন মাহবুব এই ঘাঁটিটি সম্পর্কে পুরোপুরি সংবাদ সংগ্রহ করে। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে ৪র্থ বেঙ্গলের ‘বি’ কোম্পানি ও গেরিলা সমন্বিত একটি শক্তিশালী দল লাকসাম এলাকায় অনুপ্রবেশ করে এবং পরদিন পাকসেনাদের হাসনাবাদ ঘাঁটির উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। ফলে প্রায় ২৫জন পাকসেনা ও ৩০ জন রাজাকার নিহত হয়। পাকসেনারা ক্যাম্প ছেড়ে কুমিল্লার দিকে পালিয়ে যায়। হাসনাবাদ অবস্থান থেকে অনেক অস্ত্রশস্ত্র আমাদের দখলে আসে। এই সঙ্ঘর্ষের একদিন পর আমাদের দলটি হাজীগঞ্জে অবস্থিত রাজাকারদের একটি বিরাট ট্রেনিং ক্যাম্পে আক্রমণ চালিয়ে ৩০ জন রাজাকারকে নিহত করে। এর ফলে আমাদের গুরুত্তপূর্ণ অনুপ্রবেশ পথটি আবার বিপদমুক্ত হয়। পাকসেনারা এই অঞ্চলে আমাদের ধ্বংস করার জন্য আরও সৈন্য সমাবেশ ঘটায়। তাদের এই ব্যাটালিয়ন চৌদ্দগ্রামে মোতায়েন হয়। পাকসেনাদের ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার একটি মাদ্রাসা বিল্ডিং এ স্থাপন করে। এইসব সংবাদ আমাদের কাছে স্থানীয় গেরিলাদের মারফতে পৌঁছে। পাকসেনাদের এই নতুন ব্যাটালিয়নটিকে আসার সাথে সাথেই ব্যাতিব্যাস্ত করে তোলার জন্য লেঃ ইমামুজ্জামান সেপ্টেম্বর মাসের ১০ তারিখে আমাদের মর্টার পল্টুন ও একটি গেরিলা দলকে চৌদ্দগ্রামে পাঠায়। আমাদের দলটি বিকেল পাঁচটায় চৌদ্দগ্রামের নিকট উপস্থিত হয়ে পাকসেনাদের হেডকোয়ার্টারের উপর মর্টারের গোলাবর্ষণ শুরু করে। বেশ কটি গোলা মাদ্রাসা ঘরের মধ্যে পড়ে। এর ফলে পাকসেনাদের প্রায় ৩০/৪০ জন হতাহত হয়। আমাদের একজন প্রত্যক্ষদর্ষী স্থানীয় গেরিলা আহতদের লাকসামের দিকে নিয়ে যেতে দেখে। পাকসেনারা কামানের সাহায্যে আমাদের অবস্থানের উপর গোলাগুলি চালায়। এতে কিছু বেসামরিক লোক নিহত হয়। এর দুদিন পড় পাকসেনাদের একটি দল হরসর্দার বাজারের নিকট স্থানীয় দালাল, শান্তি কমিটির লোকদের নিয়ে এক সভায় মিলিত হয়। এই সভা পণ্ড করে দেয়ার জন্য আমাদের একটি টহলদার দল পাকসেনাদের উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। ফলে একজন জেসিও সহ তিনজন পাকসেনা নিহত হয়। শান্তি কমিটির লোকেরা ভয়ে পালিয়ে যায়। পাকসেনারা সেপ্টেম্বর মাসেই চৌদ্দগ্রামের উত্তরে হরিসর্দার বাজারের নিকট পুনরায় নতুন করে তাদের ঘাঁটি তৈরি করার চেষ্টা চালায়। এই সংবাদ পেয়ে লেঃ ইমামুজ্জামান পাকসেনাদের সম্বন্ধে সম্পূর্ণ খবর সংগ্রহ করার জন্য রেকি দল পাঠায়। রেকি দলটি রাত ৯টার সময় খবর সংগ্রহ করে ফিরে আসে। তারা দেখতে পায় পাকসেনাদের প্রায় এক কোম্পানি শক্তি হরিসর্দার বাজারের উত্তরে ঘাঁটি তৈরি করার জন্য ট্রেঞ্চ খোঁড়ায় ব্যাস্ত। সংবাদ পেয়ে লেঃ ইমামুজ্জামানের ৪র্থ বেঙ্গলের ‘বি’ কোম্পানি এবং দুটি গেরিলা কোম্পানি নিয়ে মর্টারের সহায়তায় রাত সাড়ে চারটার সময় পাকসেনাদের অবস্থানের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। আমাদের তীব্র আক্রমণের ফলে পাকসেনাদের দুটি হাল্কা মেশিনগান পোস্ট ছাড়া সম্পূর্ণ অবস্থানগুলি পর্যুদস্ত হয়ে যায়। পাকসেনারা তাদের বাঙ্কার থেকে আক্রমণের চাপে পালাবার চেষ্টা করলে আমাদের সৈনিকরা তাদের নিহত করে। প্রায় ২৫ জন পাকসেনা রেঞ্জার সহ নিহত হয় ও অনেকে আহত হয়। দু’ঘণ্টা আক্রমণ চালাবার পর আমাদের সৈনিকরা নিরাপদে তাদের অবস্থানে ফিরে আসে। পরে পাকসেনারা তাদের আহত সৈনিক ও নিহতদের নিয়ে জিপে করে লাকসামের দিকে পালিয়ে যায়। প্রায় ৮টার সময় পাঁচটি হেলিকপ্টার করে পাকসেনাদের আরেকটি দল সেই অবস্থানের শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য আসে। শক্তি বৃদ্ধির পড় পাকসেনারা প্রায় ১০টার দিকে আমাদের অবস্থানের আক্রমণের জন্য অগ্রসর হয়। আমাদের অবস্থানটি পাকসেনাদের এই আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল। লেঃ ইমামুজ্জামানের নেতৃত্বে পাকসেনাদের আক্রমণকে আমাদের সৈনিকরা প্রতিহত করতে থাকে। আমাদের প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যেও পাকসেনারা আমাদের অগ্রবর্তী অবস্থানের নিকট পর্যন্ত আগ্রসর হতে সমর্থ হয়। এসময় আমাদের ৬’’ মর্টার ও ২’’ মর্টার তাদের উপর মারাত্মক আঘাত হানলে পাকসেনাদের আক্রমণ ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। শুধুমাত্র ক্ষুদ্র একটি পাকসেনা দল আমাদের ডান দিক দিয়ে যেতে সক্ষম হয়। কিন্তু লেঃ ইমামুজ্জামান সময়মত পাল্টা আক্রমণের ফলে তারাও নিহত হয়। ৫/৬ ঘণ্টা যুদ্ধের পড় আমাদের বীর সৈনিকরা সাফল্যের সঙ্গে তাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। এই যুদ্ধে একজন মেজর সহ ৩৮ জন পাকসেনা নিহত হয়। মর্টারের গোলার আঘাতে পাকসেনাদের অফিসার নিহত হবার পড় পাকসেনারা মনোবল হারিয়ে পশ্চিম দিকে পিছু হটে যায়। এর দুদিন পড় ১৩ই সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার সময় আমাদের একটি গেরিলা দল ফতেপুরের নিকট একটি রেলসেতু উড়িয়ে দেয়। এতে ৫০ফুট গ্যাপ সৃষ্টি হয়। ফলে লাকসাম-ফেনীর মধ্যে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বাডিসা এবং গোবিন্দ্যমাণিক্যর দীঘিতে পাকসেনাদের দুটি ঘাঁটি ছিল। লেঃ ইমামুজ্জামান ১৯ শে সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে পাঁচটার সময় এই দুটি পাক অবস্থানের উপর এক যোগে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে ৮১ এম এম মর্টার, ১৫ এমআরআর এবং মেশিনগান ব্যাবহার করা হয়। মাণিক্যর দীঘিতে অবস্থিত পাকসেনারা আমাদের আক্রমণের পূর্বাভাস পেয়ে সতর্ক হয়ে ছিল। ফলে সাতসা অবস্থানের শুধু দুটি বাঙ্কার ধ্বংস ও ৬ জন পাকসেনা আমাদের আক্রমণে নিহত হয়। আমাদের দুজন সৈনিক আহত হয়। বাডিসা ঘাঁটির উপর আমাদের আক্রমণ সম্পূর্ণ সফল হয়। আরআরএর গুলির আঘাতে প্রায় ৬টি বাঙ্কার ধ্বংস হয়। পাকসেনাদের ২০ জন নিহত ও ১২ জন আহত হয়। আমাদের আক্রমণকারী দলটি দুঘণ্টা পর নিরাপদে নিজেদের অবস্থানে ফিরে আসে। এই সঙ্ঘর্ষের চারদিন পর ২৩শে সেপ্টেম্বর ভোর ৫তার সময় একটি প্লাটুন ও ১৬ জন গেরিলা লেঃ ইমামুজ্জামানের নেতৃত্বে মর্টার এবং আরআর এর সাহায্যে আবার গোবিন্দমাণিক্য দীঘিতে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণের সময় আমাদের সৈনিকরা শত্রুর বেশ কিছু বাঙ্কার আর আর এর সাহায্যে ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়। ফলে প্রায় ১৫ জন পাকসেনা নিহত ও ১০ জন আহত হয়। এক ঘণ্টা যুদ্ধের পর আমাদের সৈনিকরা তাদের অবস্থানে ফিরে আসে।
পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল কুমিল্লার দক্ষিণে পায়েলগাছা থেকে নারায়নপুরের দিকে অগ্রসর হয় এবং নারায়নপুরের অনেকগুলো বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় এবং নারী ধর্ষণ করে। ২/৩ ঘণ্টা যাবত তাদের অত্যাচার চলে। নারায়নপুরের নিকট অবস্থিত আমাদের মাত্র ১৩ সদস্যের ছোট একটি গেরিলা দল পাকসেনাদের নারায়নপুরের দিকে অগ্রসর হতে দেখে। পরে এই দল পায়েলগাছায় রাস্তায় এম্বুশ পাতে। পাকসেনারা নারায়নপুরে অত্যাচার চালাবার পর ফেরার পথে তাদের এম্বুশের আওতায় পড়লে গেরিলারা আক্রমণ চালায়। আক্রমণে ১৪ জন পাকসেনা ও ২৮ জন রাজাকার নিহত এবং ১৩ জন পাকসেনা ও ১৬ জন রাজাকার আহত হয়। আমাদের বীর যোদ্ধারা তাদের গুলি শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রাণপণে আক্রমণ চালিয়ে যায়। এই এম্বুশে শেষ পর্যন্ত পাঁচজন গেরিলা শহীদ হয় এবং বাকি ৮ জন ফিরে আসতে সমর্থ হয়। শকিশালি পাকবাহিনীর দলের সঙ্গে ক্ষুদ্র এই গেরিলা বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণ এবং আত্নত্যাগ কোনোদিন ভুলে যাবার নয়।
চাঁদপুরের নিকট আকন্দহাট বাজারের নিকট আমাদের একটি কোম্পানি তাদের বেইস স্থাপন করে। স্থানীয় দালাল এবং রাজাকাররা পাকসেনাদেরকে এই বেইস সম্বন্ধে খবর দেয়। এই বাজারটির তিন দিকে পানি থাকায় আমাদের সৈনিকরা বেইসটিকে যথেষ্ট নিরাপদ মনে করত। ৬ই সেপ্টেম্বর সকাল ৬টার সময় পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল স্থানীয় দালালের সহযোগিতায় আমাদের এই বেইসটি আক্রমণের জন্য আসে। আক্রমণের সময় তাড়া নৌকার সাহায্যে খাল পাড় হয়ে বেইস-এ অগ্রসর হবার চেষ্টা করে। পাকসেনারা নিকতে পউছিলা আমাদের সৈনিকেরা তাদের উপর আক্রমণ চালায়। দু’ঘন্টার যুদ্ধে একজন মেজর সহ ৩৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। খাল পাড় হটে না পেরে এবং অনেক হতাহতের ফলে তাড়া ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আমাদের কোম্পানিটা পরে নিরাপদে সেখান থেকে অন্য বেইসে চলে আসে।
কুমিল্লার দক্ষিণে পাকসেনাদের কংসতলা ঘাঁটিটি আমাদের গেরিলা বাহিনীর যাতায়াতে বিশেষ অসুবিধার সৃষ্টি করছিল। এই ঘাঁটি থেকে পাকসেনাদের টহলদার দল আমাদের যাতায়াত পথে বিশেষ তৎপরতা চালাতো। এই ঘাঁটিটিকে ধ্বংস করে দেবার জন্য ক্যাপ্টেন মাহবুবকে নির্দেশ দেয়া হয়। বিশেষ তথ্য অনুসন্ধান করে ৫০ জনের একটি দল ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে ৩০শে সেপ্টেম্বর রাত ১টায় এই ঘাঁটিতে অনুপ্রবেশ করে আক্রমণ চালায়। তিন ঘণ্টা যুদ্ধের পড় সুবেদার শাহজামান সহ ১৬ জন পাকসেনা নিহত এবং ৮ জন আহত হয়। পাকসেনারা এই আক্রমণের ফলে এতোই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে যে , সেখান থেকে তাড়া তাদের অবস্থান পরিত্যাগ করে কুমিলায় চলে যেতে বাধ্য হয়। এর দুদিন পড় আমাদের ডিমোলিশন পার্টি পেপুলিয়া বাজারের নিকট লালমাই-সোনাজাজি সড়কের একটি সেতু বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেয়। পাকসেনারা এই রাস্তাটিকে ট্যাঙ্ক এবং গাড়ি চলাচলের জন্য পুনঃনির্মানের চেষ্টা করছিল। সেতুটি ধ্বংস করে দেবার পর তারা রাস্তা মেরামতের কাজ বন্ধ করে দেয়। আমাদের আরেকটি গেরিলা দল চান্দিনার নিকটে দোতুলাতে রাস্তায় মাইন পুঁতে পাকসেনাদের একটি গাড়ি ধ্বংস করে দেয়। এছাড়াও কুমিল্লার দক্ষিণে ও উত্তরে ১লা অক্টোবর থেকে ৩রা অক্টোবর আমাদের সঙ্গে বিভিন্ন সঙ্ঘর্ষে প্রাণছড়া, কোটেশ্বর, অজনাপুর, বিবির বাজার, আম্রতলী প্রভৃতি জায়গায় ২৫ জন পাকসেনা নিহত এবং ৮ জন আহত হয়।
আমাদের ৪১ জনের গেরিলা দল ১লা অক্টোবর তাদের ট্রেনিং শেষ করে রাত ৮টায় ঢাকার উদ্যেশ্যে রওনা হয়। কসবার দক্ষিণ দিক দিয়ে এই দুটি নৌকায় উজানের শাহ সেতুর নিকট পৌঁছে। পাকসেনাদের একটি টহলদারি দল রাত ১১টায় আমাদের দ্বিতীয় নৌকাটিকে দেখতে পায় এবং আক্রমণ চালায়। আক্রমণের ফলের আমাদের ৫ জন গেরিলা শহীদ ও তিনজন আহত হয়। ১৫টি রাইফেল ও ৫টি স্টেনগান পানিতে পড়ে হারিয়ে যায়। বাকি গেরিলারা অতি কষ্টে শত্রুদের নাগালের বাইরে চলে আসতে সক্ষম হয়। এই ঘটনার ৩ দিন পর লেঃ ইমামুজ্জামানের ৪ঠা অক্টোবর সকাল ৫টায় চৌদ্দগ্রামের পাঁচ মাইল উত্তরে হরিসর্দার বাজারে পাক অবস্থানের উপর ১০৬ এম এম আর আর ও ৮১ এম এম মর্টারের সাহায্যে আক্রমণ চালিয়ে শত্রুর ৭টি বাঙ্কার ধ্বংস করে ২৫ জন পাকসেনা ও ৭ জন রাজাকারকে হতাহত করে। মুক্তিযোদ্ধারা চৌদ্দগ্রামের তিন মাইল দক্ষিণে একটি সেতুও ধ্বংস করে দেয়। ৪ঠা ও ৫ ই অক্টোবর কুমিল্লার উত্তরে অজনাপুর ও জামবাড়ি এলাকায় আমাদের গেরিলারা পাকসেনাদের বেশ কটি টহলদারি দলকে আক্রমণ করে ১৫ জনকে নিহত ও ২০ জনকে আহত করে। আমাদের একজন শহীদ ও একজন আহত হয় কুমিল্লাতে গোমতী বাঁধে মাইন পুঁতে পাকসেনাদের ১টি জিপ ধ্বংস করে দেয়া হয়। সেইসঙ্গে একজন অফিসার সহ তিনজন পাকসেনা নিহত হয়। এছাড়া রামচন্দ্রপুর এবং বাঙ্গুরা ডাকঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়। হোমনা থানায় অবস্থিত পাকসেনাদের একটি দলের সঙ্গে তিন তারিখ রাত সাড়ে তিনটার সময় আমাদের একটি গেরিলা দলের সঙ্ঘর্ষ হয়। ৬ ঘণ্টা যুদ্ধে পাকসেনারা স্পম্পূর্ণ রূপে পর্যুদস্ত হয়ে পালিয়ে যায়। আমাদের গেরিলারা পাকসেনাদের দ্বারা বন্দি ১৯ জন ব্যাক্তিকে মুক্ত করে দেয় এবং ৯টি রাইফেল দখল করে। এরপর হোমনা এলাকা সম্পূর্ণরূপে আমাদের কর্তৃত্বে আসে। ৬ই অক্টোবর রাত তিনটার সময় পাকসেনাদের একটি দল দুর্লভপুরের নিকট আমাদের এম্বুশে পরে যায়। এই এম্বুশে একজন ইঞ্জিনিয়ার কোরের অফিসারসহ ১২ জন পাকসেনা নিহত হয়। পাকসেনারা গোমতীর উত্তরে আবার তাদের আধিপত্য পুনরুদ্ধারের জন্য তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। পাকসেনাদের এই তৎপরতাকে বাঁধা দেবার জন্য ক্যাপ্টেন দিদারুল আলম দুটি প্লাটুন পানছাড়ার এবং মোহনপুরে পাঠায়। এই প্লাটুনগুলো পাকসেনাদের চলাচলের রাস্তায় এম্বুশ পেতে অপেক্ষা করতে থাকে। ৮তারিখ রাতে পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল গোমতী পাড় হয়ে পানছাড়ার দিকে অগ্রসর হয়। সকাল ছ’টার সময় এই দলটি আমাদের এম্বুশের আওতায় আসে।
ফলে ২০ জন পাকসেনা নিহত ও ১০ জন আহত হয়। পরদিন পাকসেনাদের আরেকটি দল মনোহরপুরে আমাদের এম্বুশের আওতায় আসে এবং এম্বুশে ৬জন পাকসেনা নিহত হয়। ওইদিনই আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের আরেকটি দলকে বুড়িচং এর নিকট সাদেকপুরে জেরুইনে এম্বুশ করে। এম্বুশে একজন মেজর ও একজন ক্যাপ্টেন সহ ২০ জন পাকসেনা নিহত ও ৭ জন ই পি সি এ এফ নিয়ত হয়। নিহত একজন ক্যাপ্টেনের নাম সৈয়দ জাভেদ শাহ বলে পরে আমরা জানতে পারি। একজন পাকসেনা আমাদের হাতে বন্দিও হয়। এই সঙ্ঘর্ষে আমাদের একজন শহীদ এবং তিনজন আহত হয়। ৭টি রাইফেল আমরা দখল করে নেই। এর দুদিন পড় ১১ই অক্টোবর সকাল সাড়ে ১১টার সময় আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লার সার্কিট হাউস এবং গোমতীর চাঁদপুর ফেরীতে মর্টারের গোলাবর্ষন করে। কুমিল্লার সার্কিট হাউসে পাকসেনাদের মার্শাল ল’ হেড কোয়ার্টার ছিল। এর গোলাবর্ষনের ফলে প্রায় ৩৯ জন পাকসেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। শহরের ভিতরে ভসে মর্তারের গোলাবর্ষন করাতে পাকসেনাদের ভিতরে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। পরে আমরা জানতে পারি যে শহরে অবস্থিত অনেক টহলদার পাকসেনা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে তাদের অস্ত্রশস্ত্র ফেলে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের দিকে পালিয়ে যায়। আমরা জানতে পারি যে সার্কিট হাউসে গোলাবর্ষনের সময় সেখানে পাকিস্তানী ৯বম পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং উপস্থিত ছিলেন। অল্পের জন্য টনি আমাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পান। পাকসেনারা কুমিল্লা শহরে প্রকাশ্য দিবালোকে মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা এই আক্রমণের খবর পাকিস্তানী রেডিও থেকে প্রচার করে। তারা পাঁচজন সৈনিক নিহত ও ৩৯ জন আহতের কথা স্বীকার করে। আমাদের গেরিলারা কালির বাজার গ্রামে পাকসেনাদের একটি হেডকোয়ার্টারের সন্ধান পায়। এই সংবাদ পেয়ে লেঃ ইমামুজ্জামান একটি ৭৫ এম এম আর মেশিনগান ও হাল্কা মেশিনগান সহ একটি প্লাটুন পাঠিয়ে দেয়। এই প্লাটুনটি পথ প্রদর্শকের সহায়তায় পাকসেনাদের হেডকোয়ার্টারের নিকট রাতে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। ১২ই অক্টোবর ভোর ৫টায় আমাদের এই দলটি রকেট এবং মেশিনগানের সাহায্যে পাকসেনাদের এই হেডকোয়ার্টারে আক্রমণ করে একটি বিল্ডিং এ অবস্থিত দুটি বাঙ্কার সম্পূর্ণভাবে উড়িয়ে দেয়। ঐ অবস্থানের আরও পাকসেনারা রকেট হামলায় ইতস্তত পালাবার চেষ্টা করে। এমতাবস্থায় তাদের প্রতি মেশিনগানের সাহায্যে গুলিবর্ষন করে তাদের ১২ জনকে নিহত ও ৪ জনকে আহত করে। এরপর আমাদের দলটি নিরাপদে আমাদের অবস্থানে ফিরে আসে। এই ঘটনার একদিন পড় বাগাবাড়ি ও জাজিশ্বরে আরেকটা আক্রমণে ৭জন পাকসেনা ও ৫ জন রাজাকার নিহত হয়।
বুড়িচং থানার রাম নগর গ্রামে আমাদের গেরিলাদের একটি অবস্থান ছিল। পাকসেনারা স্থানীয় দালালদের নিকট সংবাদ পেয়ে ৮ই অক্টোবর দুপুরে একটি শক্তিশালী দল নিয়ে সেই অবস্থানের উপর আক্রমণ চালায়। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে এই আক্রমণের মোকাবিলা করে। দুপুর একটা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। যুদ্ধে পাকসেনাদের প্রায় ১৬ জন সৈনিক ও ১৪ জন রাজাকার নিহত হয়। পাক আক্রমণের চাপ বারতে থাকলে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অবস্থা পরিত্যাগ করে জাগলপুরে নতুন করে অবস্থান নেয়। পরদিন পাকসেনাদের আরেকটি শক্তিশালী দল সেই অবস্থানের উপরও আক্রমণ চালায়। প্রায় ৪ ঘণ্টা যুদ্ধ করে আমাদের যোদ্ধারা ৩৫ জন পাকসেনাকে হতাহত করে। এরপর সেই অবস্থান পরিত্যাগ করে প্রধান ঘাঁটিতে আসে। আসার পথে ৫জন পাকসেনা আমাদের হাতে বন্দী হয়। আমাদের ১জন শহীদ, ২ জন আহত এবং ১ জন বন্দী হয়।
আমাদের একটি প্লাটুন ১৫ তারিখ সকাল ৮টায় কুমিল্লার দক্ষিণে পাকসেনাদের একটি অবস্থানের আধ মাইল দূরে বারচর গ্রামে এম্বুশ পাতে। এক ঘণ্টা অবস্থানের পড় পাকসেনাদের একটি দল তাদের ঘাঁটিতে ফেরার পথে এই এম্বুশের আওতায় পরে। এম্বুশে ১২ জন নিহত ও ৩ জন আহত হয়। ওইদিনই বিকেলে মনোহরের নিকট পাকসেনাদের আরেকটি দলের উপর আমাদের সৈনিকরা আক্রমণ করে। পাকসেনাদের এই দলটি নিকটবর্তী একটি গ্রাম জ্বালিয়ে তাদের ঘাঁটিতে ফেরত যাচ্ছিল। দুদিন পড় ১৮ই অক্টোবর রমজানপুরে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা একটি এম্বুশ পাতে। রাত প্রায় সাড়ে তিনটার সময় একটি টহলকারী দল এই এম্বুশে পরে যায়। উভয় পক্ষে প্রায় আধঘণ্টা গুলি বিনিময় হয়। এতে ১০ জন পাকসেনা ও ১৮ জন রাজাকার হতাহত হয়। পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে মৃতদেহ ফেলে রেখে পালিয়ে যায়।
পাকসেনারা অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মিয়াবাজারের নিকট তাদের একটি ঘাঁটি স্থাপন করে। আগস্ট মাসে এই অবস্থান থেকে আমরা পাকসেনাদের তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলাম। পুনরায় এই ঘাঁটি স্থাপন করায় আমরা বুঝতে পারি যে পাকসেনারা আবার চট্টগ্রাম-কুমিল্লা রাস্তা খুড়বার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের এই পরিকল্পনা ব্যার্থ করার জন্য ক্যাপ্টেন মাহবুব একটি কোম্পানি পাকসেনাদের ঘাঁটি রেইড করার উদ্যেশ্যে তাদের নিজেদের বেইস থেকে রওনা হয়। রাত প্রায় ১১টার নিকট শত্রু ঘাঁটির নিকট পৌঁছে অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। প্রায় দেড় ঘণ্টা যুদ্ধের পড় দুজন পাকসেনা নিহত ও ৫ জনকে আহত করে আমাদের দলটি অবস্থান পরিত্যাগ করে। এর তিনদিন পড় ২০শে অক্টোবর ভোর ৪টার সময় মিয়াবাজারের আরেকটি শত্রু ঘাঁটির উপর আমাদের সৈন্যরা আক্রমণ চালায়। এই অকস্মাৎ আক্রমণে অয়াক্সেনারা বিপর্যস্ত হয়ে পরে। দুঘণ্টা যুদ্ধের ফলে প্রায় ২১ জন পাকসেনা নিহত এবং আহত হয়। পাকসেনাদের নিহত ও আহত সৈনিকদেরকে পরের দিন গাড়ীতে কুমিল্লার দিকে নিয়ে যেতে দেখা যায়। আমাদের দলটি যে রাস্তায় ফিরে আসে পাকসেনাদের ঘাঁটির কিছু দূরে সেই রাস্তার উপর মাইনের সাহায্যে এফ বুবি ট্র্যাপ লাগিয়ে আসে। পরদিন সকালে পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল সেই রাস্তায় খবরাখবর নেয়ার জন্য অগ্রসর হবার পথে বুবিট্র্যাপ এর কাছে পরে যায় এবং আমিন বিস্ফোরণের ফলে ১৬ জন পাকসেনা নিহত ও ৫ জন আহত হয়।
আমাদের আরেকটি দল ইমামুজ্জামানের নেতৃত্বে ২২শে অক্টোবর ভোর ৪টার সময় মর্টার এবং ১০৬ আর আর এর সহায়তায় হরিসর্দার রাজাপুরের পর পাকসেনাদের আরেকটি নতুন ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালায়। প্রায় ১২ ঘণ্টা যুদ্ধে আমাদের মর্টার, মেশিনগান এবং আর আর এর রকেট পাকসেনাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করে। আর আর এর সাহায্যে বেশ কটি বাঙ্কার আমাদের সৈন্যরা উড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। তাদের প্রায় ৩৫ জন হতাহত হয়। পাকসেনারা কুমিল্লা বিমান বন্দরে অবস্থিত কামানের সাহায্যে আমাদের আক্রমণকে প্রতিহত করে। প্রচণ্ড ক্যামনের আক্রমণের ফলে সন্ধ্যা ৬টার সময় আমাদের সৈনিকরা গোলার ওভাবে পিছু হটে আসতে বাধ্য হয়। আসার সময় পাকসেনাদের অবস্থানের নিকট রাস্তায় মাইন লাগিয়ে আসে। পরদিন সকালে মাইন বিস্ফোরণের ফলে ৭/৮ জন পাকসেনা আহত হয়। এর একদিন পর আমাদের আরেকটি দল সকাল ৭টার সময় চৌদ্দগ্রামের ১ মাইল উত্তরে পাকসেনাদের কালিরবাজার ঘাঁটির উপর মর্টার এবং আর আর এর সহায়তায় আক্রমণ চালায়। এই এক্রমনে প্রায় ১২ জন পাকসেনা হতাহত হয়। পাকসেনারা তাদের গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় আক্রমণকে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। এর কয়েকদিন পর পাকসেনাদের একটি টহলদারি দল চৌদ্দগ্রাম থেকে সাড়ে ৪মাইল দক্ষিণে আমাদের বাজারের নিকট আমাদের সৈন্যদের এম্বুশে পরে যায়। ফলে ৮ জন পাকসেনা নিহত হয়। ১৮ই অক্টোবর সন্ধ্যা সাড়ে ৫টার সময় আমাদের একটি শক্তিশালী দল মর্টারের এবং আর আর এর সহায়তায় পাকসেনাদের বডিসা ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালায়। প্রায় দেড় ঘণ্টার এই যুদ্ধে ২০ জন পাকসেনা হতাহত হয়। বাডিসা ঘাতের আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে পাকসেনাদের রাজাসার দীঘির অবস্থানের উপরও আক্রমণ চালানো হয়। এই আক্রমণের ফলে প্রায় ৬ জন নিহত এবং বেশ কটি বাঙ্কার আমাদের সৈন্যরা ধ্বংস করে দিতে সমর্থ হয়। আমাদের একটি ছোট দল আরিউরার নিকট রাস্তায় মাইন পুঁতে রাখে। পাকসেনারা বাডিসা এবং রাজাসার দীঘি আক্রমণের সংবাদ পেয়ে ৪/৫ গাড়ি ভর্তি সৈন্য নিয়ে সাহায্যরে জন্য সেদিকে অগ্রসর হয়। পথে পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে একটি ট্রাক ও একটি জিপ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে ১৮ জন পাকসেনা নিহত এবং ২ জন অফিসার সহ ৫ জন আহত হয়। এই এলাকাতে সর্বত্র আমাদের আক্রমণের তীব্রতার দরুন পাকসেনারা নাজেহাল হয়ে যায়। ফলে এই এলাকায় পুনঃপ্রাধান্য ফিরে পাবার আসায় ২০শে অক্টোবর বিকেল ৪টার সময় তাদের একটি শক্তিশালী দল হরিসর্দার ঘাঁটি থেকে আমাদের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়। এই দলটি কামানের প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে আমাদের অবস্থানের উপর আক্রমণ চালায়। আমাদের সৈনিকরা ৩ মর্টার এবং হাল্কা মেশিনগানের সাহায্যে পাকসেনাদের প্রচণ্ড আক্রমণে প্রতিহত করে। আমাদের গোলাগুলিতে অনেক পাকসেনা হতাহত হয়। পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। এই এলাকা থেকে আমাদের বিতাড়িত করার উদ্যেশ্য সেই সাথে বিফল হয়ে যায়।
আগস্ট মাসের প্রথম দিকে নোয়াখালী এলাকায় আমাদের গেরিলাদের শক্তি বৃদ্ধি পায়। অনেক গেরিলাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে নিজ নিজ এলাকাতে পাঠানো হয়। সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণের জন্য নোয়াখালী জেলাকে চারটি ভাগে বিভক্ত করে বেঙ্গল রেজিমেন্টের চারজন সুবেদারকে এইসব এলাকায় গেরিলা এবং নিয়মিত বাহিনীর সৈনিকদের তত্ত্বাবধানের ভার দেয়া হয়। সোনাইমুড়ি ফরিদগঞ্জ এলাকার সুবেদার আলি আকবর পাটোয়ারী, নোয়াখালী সদরের ভার সুবেদার লুতফর রহমান, দক্ষিণ ফেনীর ভার সুবেদার জব্বার এবং লক্ষ্মীপুর ও রামগতির ভার অন্য আরেকজন সুবেদারের প্রতি আরোপিত হয়। এলাকা বিভক্তির পর স্থানীয় কমান্ডাররা সম্মিলিত গেরিলা ও নিয়মিত বাহিনীর পূর্ণ সহযোগিতায় তাদের তৎপরতা বৃদ্ধি করে। সুবেদার আলি আকবর পাটোয়ারির নেতৃত্বে আমাদের আরেকটি গেরিলা দল গুণবতী ও সরিষাদি রেল স্টেশনে আক্রমণ চালিয়ে প্রায় ৩২ জন পাকসেনা ও রাজাকারকে হতাহত করে। সোনাইমুড়ির উত্তরে কাদের বাজারের নিকট পাকসেনাদের ১০টি দলকে এম্বুশ করে ৩ জনকে নিহত ও ১০ জনকে আহত করে নেয়। পাকিস্তানী রেঞ্জার ও রাজাকাররা রায়পুরের নিকট এল এম হাই স্কুলে একটি শিবির স্থাপন করে। ৬ই আগস্ট সন্ধ্যার সময় আমাদের গেরিলা দল শত্রুদের এই ঘাঁটির উপর অতর্কিতে আক্রমণ করে। ফলে ৯ জন রেঞ্জার হতাহত হয়। আমাদের একজন আহত হয়। এর দুদিন পর আমাদের আরেকটি গেরিলা দল পাকসেনা ও রাজাকারদের একটি দলকে লক্ষ্মীপুর থানার দালাল বাজারে এম্বুশ করে ১৫ জন শত্রুসেনাকে হতাহত করে। ১৪ই আগস্ট কোম্পানিগঞ্জ থানায় বসুর হাটের নিকট পাক মিলিশিয়াদের এম্বুশ করে প্রায় ৩০ জনকে হতাহত করে। তারা একটি টয়োটা জিপও ধ্বংস করে দেয়। সঙ্ঘর্ষে আমাদের একজন সিপাই নুরুন্নবি মারাত্মকভাবে আহত হয়। পাকসেনারা ৩০টি অটোমেটিক এম জি এর সাহায্যে গোলাগুলি চালায়। ১৮ই আগস্ট রামগড় থানার সেকেন্ড অফিসার এবং কয়েকজন দালালকে পাকসেনাদের ক্যাম্পে যাবার পথে নিহত করে।
পাক পুলিশ এবং রাজাকাররা লক্ষ্মীপুর থানার চন্দ্রগঞ্জ প্রতাপ হাই স্কুলে একটি ঘাঁটি তৈরি করে। ১৫ তারিখ রাত ১১টার সময় আমাদের সৈনিকরা এই ঘাঁটি আক্রমণ করে প্রায় ৪০ জন পাকসেনাকে হতাহত করে। এবং সেখান হতে তাদের তাড়িয়ে দেয়। ১৬ই আগস্ট সোনাইমুড়ি রেল স্টেশনের নিকট বাগাদিয়া রেল সেতু গেরিলারা উড়িয়ে দেয়। আমাদের গেরিলাদের এই সব তৎপরতায় পারসেনারা আরও ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে ওঠে। পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল বেগমগঞ্জ থানার সোনাপুর ও গোপালপুরের নিকট দালালদের কাছ থেকে আমাদের ঘাঁটির খবর জেনে ৩০শে আগস্ট সকালে আক্রমণের জন্য অগ্রসর হয়। পাকসেনাদের এই আক্রমণকে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সাথে প্রতিহত করে। প্রায় ৩/৪ ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাকসেনাদের ৪০ জন নিহত হয়। আমাদের সেনাদের প্রচণ্ড পাল্টা আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে তারা তাদের মৃতদেহগুলো ফেলেই পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। আই যুদ্ধে আমাদের সৈনিকরা ২০ টি অস্ত্র দখল করে। আমাদের একজন সিমাহী শহীদ হয়। এই ঘটনার দুদিন পর আমাদের সৈনিকরা মাইন পুঁতে সনাইমুড়ির নিকট বানোয়াইতে পাকসেনাদের একটি গাড়ি ধ্বংস করে। ফলে ১ জন পাকসেনা নিহত ও ৮ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়।
সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকসেনা ও রাজাকারদের একটি দল রামগঞ্জের নিকট তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে। সুবেদার আলী আকবর পাটোয়ারীর নেতৃত্বাধীন ২০শে সেপ্টেম্বর আমাদের একটি মুক্তিযোদ্ধা দল এই ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালায়। প্রায় দুঘণ্টা যুদ্ধে ১৪ জন পাকসেনা নিয়ত ও ১৭ জন আহত হয়। এর ৩ দিন পর ২৬শে সেটেম্বর সকালে ২৫০ সদস্যবিশিষ্ট পাকসেনা ও রাজাকারদের একটি দল রামগঞ্জ বাজারের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ৫০ সদস্যের একটি দল এই খবর পেয়ে রাজগঞ্জ বাজারের পূর্ব দিকে পাকসেনাদের জন্য একটি এম্বুশ পেতে রাখে। পাকসেনারা অগ্রসর হবার পথে এই অ্যামবুশে পরে যায়। ফলে ২০ জন পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হয় ও ২৭ জন আহত হয়। আহত পাকসেনা ও রাজাকারদের মাইজদি বেসামরিক হাসপাতালে ভর্তি করে। ২৫শে সেপ্টেম্বর আরও দুজন আহত পাকসেনা হাসপাতালে মারা যায়।
আমাদের অপর একটি গেরিলা দল লৌহজং থানার নিকট পদ্মা নদীতে ১৮ হাজার মণ পাট সহ কয়েকটি নৌকা ডুবিয়ে দেয়। এই পাটগুলো নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন পাটকলে ব্যাবহারের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। ফেনীর নিকট বারদিন সেতুটি ধ্বংস করে সদেয়া হয়। ফলে ফেনী ও কুমিল্লার মাঝে রাস্তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে।
রাজাকারসহ পাকসেনাদের একটি দল রামগঞ্জ থেকে লক্ষ্মীপুরের রাস্তায় ১০টি গাড়ীতে ১৯শে সেপ্টেম্বর অগ্রসর হচ্ছিল। এই সংবাদ পেয়ে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা সুবেদার আলী আকবর পাটোয়ারীর নেতৃত্বে মীরগঞ্জ এবং ফজলচাদ হাটের নিকট পাকসেনাদের কনভয়টিকে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই আকস্মিক আক্রমণের ফলে পাকসেনারা মারাত্মকভাবে ভিতসন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। পাকসেনারাও গাড়ী থেকে নিচে নেমে আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করে। উভয় পক্ষের মধ্যে সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত প্রচণ্ড যুদ্ধ চলতে থাকে। এই প্রচণ্ড যুদ্ধের ফলে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের এবং স্থানীয় জনসাধারণের মনোবল আরও সুদৃঢ় হয়। ওপর পক্ষে পাক সেনাদের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। আমাদের ৬০ সদস্যের একটি গেরিলা দল ১লা অক্টোবর রায়পুরে অবস্থিত রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের উপর আক্রমণ চালিয়ে ৪০ জন রাজাকারকে নিহত করে। ১০ই অক্টোবর পাকিস্তানীদের একটি রেঞ্জার দলের লক্ষ্মীপুর থেকে রামগঞ্জ যাবার পথে আমাদের গেরিলারা অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে রেঞ্জারদের একটি গাড়ী সম্পূর্ণ ধ্বংস করে। এতে একজন রেঞ্জার নিহত হয়। এর একদিন পর পাকিস্তানীদের একটি দল সনাইমুড়িতে তাদের গাড়ীতে আরোহণ করার সময় সুবেদার লুতফর রহমানের নেতৃত্বে আমাদের একটি গেরিলা দল তাদের উপর আক্রমণ চালায়। প্রায় দেড় ঘণ্টা গোলাগুলির পর ৬জন পাকসেনা নিহত হয় ও ৩ জন আহত হয়। অবশিষ্ট পাকসেনারা সোনাইমুড়ি থেকে পালিয়ে যায়। ১২ই অক্টোবর আমাদের গেরিলারা ফেনী থানার অন্তর্গত লেমুয়ার একজন কুখ্যাত দালালকে হত্যা করে। এই সংবাদ পেয়ে পরদিন সকালে পাকিস্তানীদের একটি শক্তিশালী দল ঐ এলাকায় আসে। এবং স্থানীয় জনসাধারণের উপর নৃশংস অত্যাচার শুরু করে। আমাদেরও ঐ এলাকার গেরিলারা পাকসেনাদের এই অত্যাচার বন্ধ করার জন্য প্রায় ৫০ জন একত্রিত হয়ে পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালায়। চারঘন্টা যুদ্ধের পর পাকসেনারা পলায়ন করে আত্মরক্ষা করে। প্রায় ৭ জন পাকসেনা ঐ যুদ্ধে গুরুতর আহত হয়। বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র আমাদের দখলে আসে।
জুলাই এবং আগস্ট মাস্যা আমাদের হেড কোয়ার্টার থেকে কয়েকশ গেরিলা ট্রেনিং প্রাপ্ত হয়ে অপারেশনের জন্য তৈরি হয়। এইসব গেরিলাদের বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে ফরিদপুর সদর এবং মাদারীপুর মহকুমার বিভিন্ন থানায় অপারেশনের দায়িত্ব অর্পন করা হয়। এইসব দলগুলোকে নবীনগর, দাউদকান্দি হয়ে নদীপথে তাদের নিজস্ব জায়গাতে পাঠানো হয়। ৩/৪ হাজার গেরিলা ছোট ছোট দলে গ্রাম্য পথে এবং নদীপথে পাকসেনাদের প্রতিরক্ষাবুহ্যে অনুপ্রবেশ করে তাদের নিজ নিজ গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। শুধু একটি দল যাওয়ার পথে হোমনার নিকট পাকসেনাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। পাকসেনাদের গুলিতে একটি নৌকা ডুবে যায়। ফলে ৪ জন গেরিলা শহীদ হয় এবং ৪ জন আহত হয়। ৩টি স্টেনগান ও ৫টি রাইফেল পানিতে পড়ে ডুবে যায়। নিজ নিজ জায়গায় পৌঁছে গেরিলা দলগুলো তাদের তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। এই সময়ে পাকসেনারা ফরিদপুর হয়ে বরিশালের রাস্তায় যাতায়াত করত। সেপ্টেম্বরে মাদারীপুরের একটি গেরিলা দল ভুরঘাটার নিকট একটি সড়ক সেতুতে আক্রমণ চালিয়ে সেতুটি উড়িয়ে দেয়। ফলে পাকসেনাদের বরিশাল যাতায়াতের রাস্তায় অসুবিধার সৃষ্টি হয়। এরপর গেরিলাদের আরেকটি দল নড়িয়া থানা আক্রমণ করে। সে সঙ্গে ডাকঘর ও রেজিস্ট্রি অফিস জ্বালিয়ে দেয়। ১,৫০০ মণ পাট ও তারা পুড়িয়ে দেয়। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে গেরিলারা ভেদরগঞ্জ থানা আক্রমণ করে সকল পশ্চিম পাক পুলিশকে নিহত করে। সেখানকার রেজিস্ট্রি অফিস, পোস্ট অফিস, কালেক্টর অফিস ইত্যাদি বন্ধ করে দেয়। এরপর কিছুদিনের মধ্যেই গেরিলারা পালং থানার রাজগঞ্জ এবং কোটালিপাড়ায় আক্রমণ চালিয়ে সমস্ত সরকারী অফিস ধ্বংস করে দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রায় চার হাজার মণ পাট জ্বালিয়ে দেয়। পরের সপ্তাহে গেরিলাদের একটি শক্তিশালী দল জাজিরা থানার রাজস্ব অফিস এবং রেজিস্ট্রি অফিস বন্ধ করে দেয় মাদারীপুরের অন্যন্য থানা আক্রমণ হওয়ার ফলে পাকসেনারা নড়িয়া থানাতে তাদের শক্তি বৃধি করে। এই থানার পাকসেনা ও পুলিশরা নিকটস্থ গ্রামে তাদের অকথ্য অত্যাচার চালায়। স্থানীয় গেরিলারা এই থানাটির শক্তি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ খবরাখবর সংগ্রহ করে। ৬ই সেপ্টেম্বর ৫০ জনের একটি গেরিলা দল রাত ৮টার সময় এই থানার উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। পাকসেনা ও পুলিশরা সব শক্তি দিয়ে থানাকে রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। প্রায় ৩ ঘণ্টা যুদ্ধের পর আমাদের গেরিলারা থানাটি দখল করে নিতে সমর্থ হয়। প্রায় ১৭ জন পাকসেনা ও পিলিশ নিহত হয় এবং বাকিরা পালিয়ে আত্মরক্ষা করে। থানার দারোগাও এতে নিহত হয়। থানা থেকে ৩০টি রাইফেল এবং একটি বেতার যন্ত্র গেরিলাদের হস্তগত হয়। গেরিলারা থানাটি ধ্বংস করে দেয়। গেরিলাদের আরেকটি দল ঝিকরগাছির নিকট বরিশাল-ফরিদপুর টেলিফোন লাইনের ৬শ’ গজ তাঁর নষ্ট করে দেয়। টেলিগ্রাফ বিভাগের টেকনিশিয়ানরা পাকসেনাদের পাহারায় টেলিফোন লাইনটি মেরামত করতে আসার পথে গেরিলাদের বসানো মাইন বিস্ফোরণে তাদের জিপটি ধ্বংস হয়ে যায়। পাকসেনাদের আরেকটি টহলদার দল মাদারীপুরের হাওলাদার জুট মিলের নিকট গেরিলাদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ায় চারজন পাকসেনা নিহত হয়। গেরিলারা মাদারীপুরের নিকট ঘাট মাঝিতে প্রায় ৩০/৪০ গজ রাস্তা কেটে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। মাদারীপুরের চড় মুগুরিয়ায় সরকারী পাট গুদামে আগুন লাগিয়ে প্রায় ৫০ হাজার মণ জ্বালিয়ে দেয়া হয়। মাদারীপুর- ফরিদপুর রাস্তায় সমাদ্দার ফেরিঘাটে একটি ফেরী অগ্নি সংযোগে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। একটি মটর লঞ্চ ও ধ্বংস করা হয়। এই মটর লঞ্চটি পাকসেনারা টহল দেয়ার কাজে ব্যাবহার করত। আমাদের গেরিলাদের এই সব ব্যাপক তৎপরতায় পাকসেনারা অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। ৬ই সেপ্টেম্বর পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল লঞ্চে মাদারীপুরের দিকে তৎপরতা আরও জোরদার করার জন্য আগ্রসর হয়। এই খবর আমাদের গেরিলারা আগেই পেয়ে যায়। ২০ জনের একটি গেরিলা দল পলং থানার রাজগঞ্জের নিকট নদীর তীরে পাকসেনাদের জন্য এম্বুশ পেতে বসে থাকে। সকাল ১০টার সময় লঞ্চটি আমাদের গেরিলা দলের এম্বুশের আওতায় এলে তৎক্ষণাৎ গেরিলারা তাদের উপর আক্রমণ চালায়। ফলে ১০/১২ জন পাকসেনা নিহত এবং বেশ কিছু আহত হয়। উপায়ান্তর না দেখে পাকসেনাদের লঞ্চটি শেষ পর্যন্ত পালিয়ে যায়। এর কয়েকদিন পড় পাকসেনারা আরও অধিক সৈন্য ফরিদপুর থেকে পালং থানায় মোতায়েন করে। ঐ এলাকার গেরিলারা পাকসেনাদের পালং থানার ঘাঁটির পুনর্দখলের পরিকল্পনা নেয়। গেরিলারা সঠিক সংবাদ নেয়ার পর জানতে পারে যে থানাতে প্রায় এক প্লাটুন পাকসেনা ও ৫০/৬০ জন পাক পুলিশ এবং রাজাকার রয়েছে। প্রায় ২/৩ শ’ গেরিলা একত্রিত হয়ে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ২১শে সেপ্টেম্বর রাত ১১টায় পালং থানার উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। প্রায় ৪ ঘণ্টা সম্মুখযুদ্ধের পর ঐ ঘাঁটি থেকে অনেক সংখ্যক পাকসেনা উপায়ান্তর না দেখে পালিয়ে যায়। গেরিলারা যুদ্ধে ৫০ জন পাকসেনা, রাজাকার ও পাকপুলিশকে নিহত করে। এর পর সম্পূর্ণ এলাকাটি আমাদের গেরিলাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
কুমিল্লার উত্তরে ৪র্থ বেঙ্গলের ‘সি’ কোম্পানি ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে এবং ‘এ’ কোম্পানি মেজর সালেক ও মেজর আইনুদ্দিনের নেতৃত্বে মন্দভাগ ও শালদা নদী এলাকার পাকসেনাদের উপর তাদের চাপ অব্যাহত রাখে। ফলে পাক সেনারা মন্দভাগ বাজার, লক্ষ্মীপুর ও সাইতসালা প্রভৃতি জায়গা সম্পূর্ণ রূপে পরিত্যাগ করে চান্দলা, পানছড়া ও সেনেরহাট ইত্যাদি জায়গায় তাদের ঘাঁটি পিছিয়ে নিতে বাধ্য হয়। পাকসেনারা পুনরায় তাদের পূর্বোক্ত অবস্থানগুলি দখল করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের সৈনিকদের সুদূর প্রতিরক্ষার সামনে তাদের চেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যার্থ হয়। তাদের সঙ্গে যখন আমাদের সৈনিকদের সম্মুখযুদ্ধ তীব্রভাবে চলছিল সেই সময়ে আমাদের গেরিলারাও পাকসেনাদের পশ্চাদে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিকট বিদ্যাকোটে আমাদের গেরিলাদের একটি দল পাকসেনাদের একটি টহলদার কোম্পানিকে এম্বুশ করে একজন অফিসারসহ ৫০ জন পাকসেনাকে নিহত করে। তাদের ৪টি নৌকাও ডুবিয়ে দেয়। গোসাইরহাট রেল স্টেশনের নিকট একটি রেল ইঞ্জিন মাইন দিয়ে উড়িয়ে দেয়। এসব সঙ্ঘর্ষে আমাদের গেরিলারা অনেক অস্ত্রশস্ত্র দখল করে। অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকসেনারা কসবার পশ্চিমে প্রায় দুই কোম্পানি সৈন্য সমাবেশ করে। পাক সমাবেশ আমরা বুঝতে পারি যে, কসবাকে পূর্ণ দখল করার জন্য তারা পরিকল্পনা নিয়েছে। আমরা তাদের সম্ভাব্য আক্রমণের মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুতি নেই। আমি আমদের কসবা অবস্থানের সাহায্যার্থে আমাদের প্রথম গোলন্দাজ ব্যাটারিকে অনুরূপভাবে মোতায়েন করি।
১৩ই অক্টোবর সন্ধ্যা ৫-৩০টায় পাকসেনারা গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় আমাদের অবস্থানের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। ৪র্থ বেঙ্গলের ‘ডি’ কোম্পানি বিপুল সাহস ও দৃঢ় আস্থার সঙ্গে এই আক্রমণের মোকাবিলা করে। প্রায় একঘণ্টা যুদ্ধের পর গলন্দাগ বাহিনীর সহায়তায় তীব্র পাল্টা আক্রমণের মুখে পাকসেনারা টিকতে না পেরে পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। যুদ্ধে প্রায় ৪৫ জন পাকসেনা হতাহত হয়। ১৫টি জি ও রাইফেল, একটি ৩’’ মর্টার এবং ৩৫০০ টি ৭.৬২ গুলি ও ৮টি ৩’’ মর্টারের গোলা আমাদের হস্তগত হয়। এছাড়াও ন’টি বাঙ্কার ধ্বংস করা হয়। এই প্রচণ্ড সংঘর্ষে আমাদের দুজন শহীদ হয় এবং একজন আহত হয়। পরে যানা যায় যে, পাকসেনারা এই আক্রমণে পঞ্চম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সৈন্য নিয়োগ করেছিল। পরদিন পাকসেনারা যখন কসবার পশ্চিম দিক থেকে আরও পিছু হটে যাচ্ছিল ঠিক সেই সময়ে আমাদের একটি প্লাটুন তাদের একটি দলকে অ্যামবুশ করে। এম্বুশে প্রায় ১৫ জন পাকসেনা এবং ১৫ জন রাজাকার নিহত হয়। আমাদের দু’জন সৈনিক শহীদ এবং একজন আহত হয়। আমাদের একটি হাল্কা মেশিনগান বিনষ্ট হয়।
এই সময়ে পাকসেনারা তাদের অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলিতে লঞ্চ ও নৌকার সাহায্যে রসদ সরবরাহ করত। নদীপথে জলযান বন্ধ করে দেয়ার জন্য আমি একটি গেরিলা দলকে বাঞ্জারাম থানার উজানচরের নিকট বিদ্যুৎ সরবরাহকারী পাইলনগুলো কেটে নদীতে ফেলে নদীপথে বাঁধা সৃষ্টি করার নির্দেশমত আমাদের গেরিলা দল একটু দূরে এম্বুশ পেতে অপেক্ষা করতে থাকে। পাইলন কাঁটার সংবাদ পেয়ে ৩/৪টি লঞ্চ ভর্তি পাকসেনা, মুজাহিদ ও রাজাকার নদীপথের এই বাঁধাগুলো পরিষ্কার করার জন্য আসে। পাকসেনারা যখন কাজে লেগে যায় ঠিক এমন অদূরেই এম্বুশ পেতে অবস্থানরত আমাদের গেরিলারা তাদের উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। ফলে প্রায় ৭০/৮০ জন পাকসেনা, মুজাহিদ এবং রাজাকার নিহত হয়। গেরিলাদের গোলার মুখে অবশিষ্ট পাকসেনা লঞ্চ নিয়ে পালিয়ে আত্মরক্ষা করে। এই বিপর্যয়ের কয়েকদিন পর পাকসেনারা প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ৫/৬ টি লঞ্চে বিপুলসঙ্খ্যক সৈন্য বিমান বাহিনীর সহায়তায় আমাদের উজানচরের ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালায়। আমাদের সৈনিকরা শুধু হাল্কা মেশিনগান, রাইফেল ও এস এল আর নিয়ে পাকসেনাদের এই বিপুল শক্তির বিরুদ্ধে সহাসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ চালায়। কিন্তু বিমান হামলায় টিকতে না পেরে অবশেষে অবস্থানটি পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এর তিনদিন পর ১১ই অক্টোবর বিকাল চারটায় আমাদের এই দলটি জানতে পারে যে, পাকসেনাদের একটি প্লাটুন লঞ্চ যোগে বাঞ্চারাম থানার আসাদনগর এলাকা লুট করার জন্য অগ্রসর হচ্ছে। এই খবর পেয়ে আমাদের গেরিলা দলটি পাকসেনাদের লঞ্চটিকে আসাদনগরে অ্যামবুশ করে। আম্বশে ৮ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং অন্যরা পলায়ন করে প্রাণ বাঁচায়। আমাদের গেরিলা দলটি হোমনা থানাতে পাকসেনারা পশ্চিম পাক পুলিশ মোতায়েন করে। আমাদের গেরিলা দলটি হোমনা থানাতে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে ৭জন পাক পুলিশকে নিহত করে এবং রাইফেল ও কয়েকশ রাউন্ড গুলি দখল করে নেয়।
পাকসেনারা কসবাতে বিপর্যস্ত হওয়ার পর কুমিল্লা থেকে চান্দলার নিকট সৈন্য সমাবেশ করে। পাকসেনাদের এই সমাবেশের মূল কারণ ছিল মন্দভাগকে পুনর্দখল করা। ৪র্থ বেঙ্গলের ‘সি’ কোম্পানি এই সময় মন্দভাগের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল। ১৮তারিখ রাত সাড়ে তিনটায় পাকসেনারা প্রায় এক কোম্পানী শক্তি নিয়ে আমাদের প্রতিরক্ষার উপর আক্রমণ চালাতে শুরু করে। প্রায় তিনঘণ্টা যুদ্ধের পর সকাল সাড়ে ছ’টা পর্যন্ত আমাদের সৈনিকরা এই আক্রমণকে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। পাকসেনারা প্রতিহত হয়ে আমাদের রক্ষাবুহ্যের সামনে থেকে গোলাগুলি চালাতে থাকে। বেলা দশটার সময় পাকসেনারা আরও দু কোম্পানি সৈন্য নিয়ে দুবার আক্রমণ চালায়। পাকসেনাদের এই শক্তিশালী দলগুলো গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় প্রবল বাঁধার মাঝেও সামনে অগ্রসর হতে থাকে। অগ্রসর হওয়ার সময় আমাদের সৈনিকদের গুলিতে তাদের অনেক হতাহত হয়। অবশেষে পাকসেনারা আমাদের প্রতিরক্ষাবুহ্য ভেদ করতে সক্ষম হয়। প্রায় দুঘণ্টা যাবত হাতাহাতি যুদ্ধে আমাদের দুর্ধর্ষ সৈনিকরা আমাদের প্রতিরক্ষাবুহ্যে প্রবেশকারী পাকসেনাদের সাফল্যের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে পর্যদুস্ত করতে সক্ষম হয়। পাকসেনারা তাদের মৃতদেহ ফেলে রেখেই পলায়ন করতে বাধ্য হয়। আমাদের প্রতিরক্ষাবুহ্যের চতুর্দিকে কর্দমাক্ত নিম্ন জলাভূমি দিয়ে পালাবার পথে তারা আরো অধিকভাবে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। আমাদের সৈন্যরা এই যুদ্ধে ৩৩ তম বেলুচ রেজিমেন্টের সেকেন্ড লেঃ পারভেজ খান সহ ৮ জন পাকসেনাকে বন্দি করে। এছাড়া একজন অফিসারসহ ৫০ জন পাকসেনা নিহত হয়। ৬টি এম জি আই এ -৩, কুড়িটি ৭৩৬২ চায়না রাইফেল, চারটি জি-৩ রাইফেল, একটি মর্টার, একটি হাল্কা পিস্তল, পাঁচটি সাবমেশিনগান, ১৫ বাক্স মেশিনগানের গুলি , ৩১টি ৯৪ এলাগা গ্রেনেড, ২০টি ৩৬ এইচই গ্রেনেড, ১০টি এম এম বোমা, অনেকগুলো বেয়োনেট, বেশকিছু জি-৩ রাইফেল ম্যাগাজিন, ১৫টি বিভিন্ন দলিলপত্রসহ বেশকিছু ফাইল আমাদের সৈন্যরা দখল করে নেয়। এই প্রচণ্ড যুদ্ধে আমাদের পাঁচজন সৈনিক গুরুতরভাবে আহত হয়, কেউ শহীদ হয়নি। তাদের এই বিপুল বিপর্যয়ের ফলে পর্যুদস্ত দিশেহারা পাকবাহিনী এফ ৮৬ জঙ্গিবিমান দিয়ে আমাদের অবস্থানে প্রায় ৪৫ মিনিটকাল ধরে মারাত্মকভাবে হামলা চালায়। পাকসেনার গোলন্দাজ ইউনিটের ভারী কামানের সাহায্যে শত শত গোলাবর্ষণ করতে থাকে। আমাদের এই অবস্থানটি দখল করতে না পেরে পাকসেনারা কিছু পিছনে গিয়ে পুনরায় আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ২০শে অক্টোবর পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল সকাল থেকে কামালপুরের নিকট আমাদের আরেকটি অবস্থানের উপর গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণেও তারা আমাদের শক্তিশালী প্রতিরক্ষাবুহ্যে ভেদ করতে না পেরে বিফল হয়। পাকিস্তানীদের একজন অফিসারসহ ৩০ জন সৈনিক নিহত হয়। বার বার ব্যার্থ হওয়ায় পাকবাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। পাকসেনারা ৩/৪ দিন ধরে আমাদের অবস্থান গুলোর দুর্বলতা সম্পর্কে অনুসন্ধান চালায়। ২৫ তারিখ অপরাহ্ণ ৩-৫ মিনিট থেকে মন্দভাগ , মঙ্গলপুর ও শ্রীপুরস্থ আমাদের অবস্থানগুলোর উপর বিকাল ৪-১০ পর্যন্ত এফ-৮৬ জঙ্গিবিমান প্রবল ভাবে হামলা চালায় এবং একই সঙ্গে গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় পাকসেনারাও এইসব অবস্থাগুলোর উপর প্রবল আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত চলতে থাকে। আমাদের সৈনিকরাও মনোবল না হারিয়ে পাকসেনাদের এই সম্মিলিত আক্রমণকে দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিহত করে। সঙ্ঘর্ষে পাকসেনাদেরও প্রায় ৫৮ জন সৈনিক হতাহত হয়। ফলে তাদের আক্রমণ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বাধ্য হয়ে পিছু হটে যায়। যুদ্ধে আমাদের দুজন সৈনিক শহীদ এবং ৯ জন আহত হয়।
আমরা যখন মন্দভাগে পাকসেনাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত এবং পাকসেনাদের প্রতিহত করার জন্য কসবার অবস্থান থেকে কিছুসংখ্যক সৈন্য নিয়ে মন্দভাগ অবস্থানকে শক্তিশালী করছিলাম ঠিক তখনি আমাদের কসবার অবস্থানের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে পাকসেনারা অগ্রসর হয়ে কসবার পুরনো বাজার পর্যন্ত পুনর্দখল করে নেয়।
সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে আমার সেক্টরের সৈনিকদের পুনর্গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়। নির্দেশ আসে কে-ফোর্স গঠনের, আমি আগে থেকেই মনস্থ করেছিলাম যে পাকসেনাদের উপর পুনঃ আক্রমণের পুর্বে আমার অধীনস্থ সৈনিকদের পুনর্গঠনের দরকার। গত ৪/৫ মাস ধরে অবিরাম যুদ্ধে এবং জীবন ধারণের নিত্য প্রয়োজন আহার নিদ্রা থেকে বঞ্চিত ও যুদ্ধ সামগ্রীর অপর্যাপ্ততা ইত্যাদি প্রবল প্রতিকূলতার দরুন তারা স্বাভাবিক কারণেই অত্যন্ত পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। সুতরাং পরবর্তী প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এছাড়া নতুন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিকদের নিয়ে এবং ৪র্থ বেঙ্গলের পুরনো ও অভিজ্ঞ সৈনিকদের নিয়ে আরও কয়েকটি ব্যাটালিয়ন গঠন করার ইচ্ছা ছিল। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি সাবসেক্টর কমান্ডারদের নিয়ে হেডকোয়ার্টার মেলাঘরে একটি কনফারেন্স করি। সে কনফারেন্স নিম্নোক্ত সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করা হয় –
ক) চতুর্থ বেঙ্গল থেকে পুরনো ও অভিজ্ঞ সৈনিক নিয়ে আরও দুটি ব্যাটালিয়ন করা হবে।
খ) ৪র্থ বেঙ্গলের ‘সি’ কোম্পানি ও হেডকোয়ার্টারের কিছু সৈনিক ৪র্থ বেঙ্গলেই থাকবে এবং তাদেরকে নিয়ে ৪র্থ বেঙ্গলকে পুনর্গঠন করা হবে। এই ব্যাটালিয়নটি পরিচালনার জন্য ক্যাপ্টেন গাফফারকে নিযুক্ত করা হল এই ব্যাটালিয়নটি পুনর্গঠন এবং পুনর্বিন্যাসের জন্য কনাবন বেইস এ একত্রিত করা হবে।
গ) ৪র্থ বেঙ্গলের ‘ডি’ কোম্পানি এবং ‘বি’ কোম্পানির কিছু সৈন্য নিয়ে নতুন করে ৯ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠন করা হবে। মেজর আইনুদ্দিনকে এই ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক নিযুক্ত করা হল। এই ব্যাটালিয়নটিকে কসবা বেইসু-এ পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাস করা হবে।
ঘ) ৪র্থ বেঙ্গলের এ কোম্পানি এবং বি কোম্পানির অবশিষ্ট সৈনিকদের নিয়ে ১০ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠন করা হবে। মেজর সালেক কে এই ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক নিযুক্ত করা হল। মেজর সালেক এবং ৪র্থ বেঙ্গলের এই কোম্পানি শালদা নদীতে যুদ্ধে লিপ্ত থাকায় তাঁকে তাঁর সৈন্য সহ বেলিনিয়াতে যাবার নির্দেশ দেয়া হল। ১০ম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে বেলুনই-রাজনগর বেইসু -এ পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাস করা হবে।
ঙ) ২নং সেক্টর অধিনস্ত সব যোদ্ধাদের তিন ভাগে বিভক্ত করা হবে। নবগঠিত ৪র্থ, ৯ম ও ১০ম রেজিমেন্টকে নিয়ে কে ফোর্স নামে ব্রিগেড গঠন করা হল।
চ) নবগঠিত কে ব্রিগেডির আলাদা হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে সেখানে স্টাফ অফিসার হিসেবে মেজর মতিন এবং ক্যাপ্টেন আনোয়ারুল আলমকে নিযুক্ত করা হল।
ছ) গেরিলা হেডকোয়ার্টার মেলঘরেই রাখা হবে। মেজর হায়দার আমার অধীনে গেরিলা স্টাফ অফিসার নিযুক্ত হল।
জ) ১৮টি সেক্টর কোম্পানি কোম্পানি হিসেবেই থাকবে এবং তারা কে ফোর্স হেডকোয়ার্টারের নির্দেশ মেনে চলবে। তাদেরকে সাধারণত কমান্ডো হিসেবে শত্রুপক্ষের পশ্চাতভাগে (গভিরাভ্যন্তরে) ধ্বংসাত্মক তৎপরতা চালাবার কাজে নিয়োগ করা হবে।
ঝ) গেরিলারা তাদের নিজ নিজ এলাকায় পাকসেনাদের নির্মূল করে নিজ নিজ এলাকা শত্রুমুক্ত করবে। পাকসেনাদের ছোট ছোট দলে বিচ্ছিন্ন করে তাদের শক্ত ঘাঁটিগুলোকে অনুরোধ করে আত্তসমর্পন করাতে বাধ্য করবে।
ঞ) কে ফোর্স ব্রিগেড কে পাকসেনাদের শক্তিশালী ঘাঁটিগুলিকে দখল করার কাজে নিয়োগ করা হবে এবং উদ্ধারকৃত মুক্ত এলাকার প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকবে।
ট) অক্টোবর মাসের ১৪ তারিখের মধ্যেই কে ফোর্স পুনর্গঠনের কাজ শেষ করা হবে।
ঠ) কে-ফোর্স পুনর্গঠনকালে পাকসেনারা যাতে তাদের হৃত মনোবল পুনরুদ্ধার না করতে পারে এবং প্রাধান্য বিস্তার সক্ষম না হয় সেজন্য কোম্পানিগুলো এবং কমান্ডোপ্লাটুনগুলো গেরিলাদের সহায়তায় ৪র্থ বেঙ্গলের অপারেশন এলাকায় নিয়োজিত থেকে শূন্যতা পূরণ করবে তাদের তৎপরতা অব্যাহত রাখবে।
ড) অস্ত্র, গোলাবারুদ ও অন্যান্য যুদ্ধ সরঞ্জাম যা কিছু আছে তা পুনরায় বিভিন্ন দলের মধ্যে সুষ্ঠুভাবে বণ্টন কিরা হবে।
ত) গোলন্দাজ বাহিনীর প্রথম ফিল্ড রেজিমেন্ট কে-ফোর্স এর অধীনে নিযুক্ত করা হল।
ণ) কে-ফোর্স এবং ২ নং সেক্টরের অধিনায়কত্ব যৌথভাবে আমার অধীনে থাকবে। আমার অবর্তমানে এই দুটি বাহিনী বিভক্ত হবে। কে-ফোর্সের অধিনায়কত্ব করবেন মেজর সালেক ও ২নং সেক্টরের অধিনায়কত্ব দায়িত্ব পালন করবেন।
কনফারেন্সের বর্নিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২নং সেক্টরের পুনর্বিন্যাস ও পুনর্গঠনের কাজ শুরু করা হয়। নিয়মিত বাহিনীর কোর্স-ফোর্স ব্রিগেড গঠন করার কাজে আমাদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। যেহেতু যুদ্ধসামগ্রীর যথেষ্ট অভাব ছিল বিশেষ করে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও পোশাকের; তবুও সংগঠনের কাজ মোটামুটি এগিয়ে চলে। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে ৯ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট কসবাতে; ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট শালদা নদীতে এবং ১০ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট বেলুনিয়াতে সঙ্ঘটিত হয়ে পুনরায় যুদ্ধের জন্য তৈরি হয়ে যায়। যুদ্ধে পুনঃনিয়োগের আগে এইসব ইউনিটগুলোকে তিন সপ্তাহের জন্য ব্যাপকভাবে সমন্বিত প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। অক্টোবর মাসের মাঝা মাঝিতে ৯ম বেঙ্গল ইউনিটকে পরিক্ষামূলকভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে পুননিয়োগের সিদ্ধান্ত নেই। এই সময়ে আমাদের সেক্টর ট্রুপ্স কসবা; মন্দভাগ প্রভৃতি এলাকায় ভীষণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। আমি এই সুযোগের সদব্যাবহার করে তাদেরকে সম্পূর্ণভাবে এই এলাকা থেকে বিতাড়িত করার সিদ্ধান্ত নেই। কসবার পূর্বাংশ ইতোমধ্যেই আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। পাকসেনারা সেখান থেকে পিছু হটে পূর্বেই পশ্চিমাংশে পুরানা বাজারের নিকট তাদের ঘাঁটি স্থাপন করেছিল। পাকসেনাদের এই ঘাঁটিটিও ৯ম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে আক্রমণের নির্দেশ দেই। নির্দেশ অনুযায়ী মেজর আইনুদ্দিন তাঁর ব্যাটালিয়নকে লাট মুড়ার পিছনে সমবেত করে এবং ২০শে অক্টোবর পর্যন্ত শত্রু অবস্থানের সমস্ত সংবাদ সংগ্রহ করে। শত্রু অবস্থানের তথ্য জানার পড় বোঝা যায় যে পাকসেনারা তাদের অবস্থানটি পূর্ব এবং দক্ষিন্মূখি করে অধিক শক্তিশালী করে তুলেছে। আমি মেজর আইনুদ্দিনকে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুই কোম্পানি দিয়ে উত্তর ঠিক থেকে পাক অবস্থানের উপর আক্রমণ করার নির্দেশ দেই। শত্রুসেনারা মনোযোগ অন্যদিকে পরিবর্তন করার জন্য একটি কোম্পানি দিয়ে কসবার দিক থেকে অবস্থানের উপর চাপ সৃষ্টি করার নির্দেশ দেই। শত্রুসেনারা মনোযোগ অন্যদিকে পরিবর্তন করার জন্য একটি কোম্পানি দিয়ে কসবার দিক থেকে অবস্থানের উপর চাপ সৃষ্টি করার নির্দেশ দেই। আরেকটি কোম্পানি রিজার্ভে থাকার আদেশ করি। ১ম ফিল্ড ব্যাটারিকে এই আক্রমণে সহায়তার জন্য মেজর আইনুদ্দিনের অধীনে দেই।
২২শে অক্টোবর ভোর সাড়ে ৫টার সময় পরিকল্পনা অনুযায়ী ৯ম রেজিমেন্ট পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালায়। প্রায় ১০ মিনিট তীব্র কামানের গোলার আক্রমণের পড় উত্তর দিক থেকে দুটি কোম্পানি লেঃ আজিজ ও সুবেদার মেজর শামসুল হকের নেতৃত্বে পাকসেনাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই অতর্কিত আক্রমণের জন্য পাকসেনারা প্রস্তুত ছিলোনা। প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে তাদের অবস্থানগুলো ভেঙ্গে পড়ে। তারা দিশেহারা হয়ে অবস্থান পরিত্যাগ করে পেছনের দিকে পালিয়ে যায়। ৩ঘন্টা যুদ্ধের পড় ৯ম রেজিমেন্ট পাকসেনাদের অবস্থানটি দখল করে নেয়। যুদ্ধে ২৬ জন পাকসেনা নিহত ও ১৮ জন আহত হয়। ১১টি এল এম জি, ১ টি পিস্তল সিগনাল, ৪০টি এইচই৩৬ গ্রেনেড, ৩টি ৯৪ এনার্গা, ৪৪টি প্লাস্টিক মাইন, ১টি ম্যাপ, ২টি র্যাঙ্কের ব্যাজ আমাদের হস্তগত হয়। এই যুদ্ধে আমাদের লেঃ আজিজ ও ৩ জন সৈনিক শহীদ হয় এবং ১৫ জন আহত হয়। পাকসেনাদের একটি ছোট দল পিছনে হটে গিয়ে ছোট একটি নালার পশ্চিম তীরে পুনরায় দ্রুত অবস্থান গড়ে তোলার চেষ্টা করে। পরদিন ভোর ৪টায় সুবেদার মেজর সামসুল হকের কোম্পানি পাকসেনাদের এই অবস্থানের উপর পুনরায় আক্রমণ চালায়। প্রচণ্ড আক্রমণের ফলে প্রায় ২অ জন পাকসেনা নিহত ও ২২ জন আহত হয়। বিপর্যস্ত হয়ে পাকসেনারা সম্পূর্ণরূপে পশ্চাতে হটে যায়। এই আক্রমণের ফলে সম্পূর্ণ কসবা আমাদের দখলে আসে। পাকসেনারা পিছু হটে গিয়ে মইনপুর, কাশেম্পুর, কামালপুর, গুড়গুইট প্রভৃতি জায়গায় তাদের নতুন অবস্থান তৈরি করে।
কসবা শত্রুমুক্ত করার পর ৯ম রেজিমেন্ট কৃশানপুর, বগাবাড়ি, ইয়াকুবপুর এলাকা জুড়ে তাদের নতুন বুহ্য তৈরি করে। এই অবস্থাগুলো থেকে পাট্রোল পার্টি ও শক্তিশালী রেইডিং পার্টি পাক অবস্থাগুলোর ওপর ক্রমাগত আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকে। ফলে ৭ই নভেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানের সঙ্ঘর্ষে ২২জন পাকসেনা নিহত ও ৩০ জন আহত হয়।
৪র্থ রেজিমেন্ট কোনাবনে তাদের বেইস-এ পুনর্গঠিত হওয়ার পড় অক্টোবর মাস্যা পুনরায় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। আমি এই ব্যাটালিয়নকে শালদা নদী থেকে পাকসেনাএর বিতাড়িত করার নির্দেশ দেই। শালদা এলাকার কমপ্লেক্স ট্যাক্টিক্যাল একটি খারাপ এলাকা বলে তাদেরকে পুরো ব্যাটালিয়ন হিসেবে আক্রমণ করার নির্দেশ প্রদান করি। কোম্পানি এবং প্লাটুনে ভাগ হয়ে প্রথম তৎপরতা চালিয়ে এলাকার উপর পুরা আধিপত্য অর্জন করার নির্দেশ দেই। এই নির্দেশের পড় ক্যামতেন গাফফার তাঁর মন্দভাগ অবস্থান থেকে শালদা নদীর পশ্চিমে ও উত্তরে ৪র্থ রেজিমেন্টের তৎপরতা বৃদ্ধি করে। অক্টোবর মাসের মাঝা মাঝি ৪র্থ রেজিমেন্টের একটি প্লাটুন কায়েমপুরের নিকট এম্বুশ পাতে। পাকসেনাদের প্রায় ৪০ জন সৈনিক এই এম্বুশে আক্রান্ত হয়। ফলে ১৫ জন পাকসেনা নিহত এবং অনেকে আহত হয়। এর ৩/৪ দিন পড় চতুর্থ বেঙ্গলের আরেকটি রেইডিং পার্টি পাকসেনাদের চত্তরা অবস্থানের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে রকেট লাঞ্চার দ্বারা একটি বাঙ্কার উড়িয়ে দেয় এবং ১৫ জন পাকসেনাকে হতাহত করে। এর কিছুদিন পড় নায়েব সুবেদার শিকদার আফজাল হোসেনের নেতৃত্বে ৪র্থ বেঙ্গলের একটি কোম্পানি পাকসেনাদের পিছনে অনুপ্রবেশ করে চাপিতলায় এম্বুশ পাতে। পরদিন ভোর ৪টার সময় পাকসেনাদের দুটি কোম্পানি তাদের অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলো শক্তিশালী করার জন্য অগ্রসর হচ্ছিল। পাকসেনাদের এই দলটি ভোর ৫টায় আমাদের এম্বুশে এসে যায়। প্রায় ৪ ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। যুদ্ধে ৫০ জন পাকসেনা হতাহত হয়। এই আক্রমণের পরপরই পাকসেনারা আমাদের অবস্থানের উপর জঙ্গি বিমান দিয়ে ৯-৪৫ মিনিট পর্যন্ত প্রচণ্ড আক্রমণ করে। আমাদের পক্ষে কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট পাকসেনাদের কামালপুর, মইনপুর, লক্ষ্মীপুর অবস্থানগুলোর উপর তাদের চাপ আরও জোরদার করে তোলে। ১১ই নভেম্বর আমাদের একটি শক্তিশালী রেইডিং পার্টি পাকসেনাদের কামালপুরের অবস্থানের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। হাড়ে ৯টা থেকে ১২টা পর্যন্ত এই আক্রমণে পাকসেনাদের ১৬ জন নিহত এবং ২২ জন আহত হয়। এর পরদিন সকাল সাড়ে ৫টায় ৪র্থ বেঙ্গলের আরেকটি কোম্পানি লক্ষ্মীপুর এবং শালদা নদী ফেরী এলাকা আক্রমণ করে দখল করে নেয়। যুদ্ধে প্রায় ১০০ জন পাকসেনা হতাহত হয়েছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়। আমাদের একজন সৈনিক শহীদ ও ৭জন আহত হয়। শত্রুদের কাছ থেকে ১৫টি রাইফেল, ৩টি এল এম জি , ১২টি এল এম জি বাক্রু দুটি পিস্তল, একটি ৪০ এম এম রকেট লাঞ্চার, ৭২টি ৬০টি এম এম বোমা, ৩টি টেলিফোন সেট, ৫টি ওয়ারলেস সেট ব্যাটারি, ১টি মেশিন গানের ব্যারেল এবং ৪টি ম্যাপ সহ অনেক যুদ্ধ সরঞ্জাম দখল করে নেয়। শালদা নদী ফেরী এবং লক্ষ্মীপুর এলাকা আমাদের দখলে আসার পর ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট কে শালদা নদী কমপ্লেক্স দখল করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়।
শালদা নদীর যুদ্ধ
শালদা নদী এলাকায় শত্রুদের ঘাঁটিটি খুবই শক্তিশালী ছিল। এই ঘাঁটির উত্তর দিক দিয়ে শালদা নদী প্রবাহিত হওয়ায় শত্রুদের উত্তর দিক থেকে সম্পূর্ণরূপে নিরাপদ ছিল। পূর্ব দিকে রেলওয়ে ষ্টেশন উঁচু রেললাইন সম্মুখবর্তী এলাকায় শত্রুদের নিরাপত্তার প্রাধান্য বিস্তার করে। পশ্চিমের গুদামঘরের উঁচু ভূমি তাদের শক্তিশালী ঘাঁটির নিরাপত্তার বেশ সহায়ক ছিল। এই অবস্থানটিকে নিয়মিত প্রথায় আক্রমণ করে সফল হওয়া দুষ্কর ছিল। শত্রুঘাঁটির এই সকল বৈশিষ্ট্য তাদের পক্ষে সহায়ক হওয়ার আমরা এই ঘাঁটিটিতে নিয়মিত প্রথায় আক্রমণ না করে অনিয়মিত পদ্ধতিতে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেই। শত্রুদের ঘাঁটিটি পর্যবেক্ষণের পর আমরা আরো জানতে পারি যে; শালদা নদীর তীর বরাবর আমাদের ঠিক সামনে তারা তারা চারটি বড় পরিখা খানন করেছিল। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঘাঁটিটিকে তিনদিক থেকে সাঁড়াশী আক্রমণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্যাপ্টেন গাফফার ও নায়েব সুবেদার সিরাজের নেতৃত্ব একটি প্লাটুন শালদা নদী রেলস্টেশনের পূর্বে পাহাড়ি এলাকায় অবস্থান নেয়। সুবেদার বেলায়েতের নেতৃত্বে আরেকটি প্লাটুন শালদা নদীতে শত্রুর ঘাঁটির বিপরীত দিকে অবস্থান নেয়। পাকসেনা যাতে আক্রমণের সময় আমাদের পেছন থেকে আঘাত না হানতে পারে সেজন্য সুবেদার ওয়াহেবের নেতৃত্বে একটি কম্পানী মঙ্গল মিয়ার অবস্থানের পেছনে নিরাপত্তা মূলক অবস্থান গ্রহন করে। এছাড়া পাকসেনাদের মনোযোগ অন্যদিকে আকর্ষণ করার জন্য চারটি ছোট রেইডিং পার্টিকে বড় ধুশিয়া , চান্দলা , গোবিন্দপুর , কায়েমপুর প্রভৃতি শত্রুঘাঁটির দিকে পাঠানো হয়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী এইসব রেইডিং পার্টিগুলো ১৫ই নভেম্বর রাতে পাকসেনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য শত্রুঘাঁটির উপর আক্রমন চালায়। সঙ্গে সঙ্গে পাকসেনারা শালদা নদী থেকে রেইডিং পার্টির উপর কামান ও মর্টারের সাহায্যে গোলাবর্ষণ করে। এই গোলাবর্ষণ সমস্ত রাত ধরে চলে এবং ভোরের দিকে বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের আক্রমণ শেষ হয়ে গেছে ভেবে পাকসেনারা পরদিন সকালে কিছুটা অসতর্ক হয়ে পরে এবং বিশ্রামের সুযোগ নেয়। এই সময় তাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহগুলো রাজাকার এবং ইপকাফ এর প্রহরাধীন ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যেঃ শত্রুরা সাধারণত রাতের বেলায় আমাদের সম্ভাব্য আক্রমণের জন্য যতটা সতর্ক থাকত দিনের বেলায় ততটা প্রস্তুত থাকত না।
এমতাবস্থায় আমরা তাদের এই অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে সকাল ৮ টার দিকে তাদের উপর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ি প্রচন্ড আক্রমন চালাই।
সুবেদার মঙ্গল মিয়ার দলটি পশ্চিম দিক থেকে শালদা নদী গুদামঘরের পরিখায় অবস্থানরত শত্রুদের উপর এবং নায়েব সুবেদার রিয়াজ পূর্বদিকের পাহাড়ী এলাকায় অবস্থান থেকে নদীর অপর দিকের পরিখাগুলোতে আর আর এর সাহায্যে শত্রুদের চারটি পরিখা ধ্বংস করে দেয়। এতে আমাদের যথেষ্ট সুবিধা হয় এবং পাকসেনারা সম্মুখবর্তী পরিখা ছেড়ে পিছু হটে যায়। সঙ্গে সঙ্গে সুবেদার বেলায়েত তাঁর সৈন্যদের নিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পরে এবং সাঁতরিয়ে অপর তীরে শত্রুদের সম্মুখবর্তী পরিত্যক্ত পরিখাগুলো দখল করে নেয় এবং কিছু সৈনিক সেইসব পরিখাতে রেখে সামনের দিকে আরো অগ্রসর হয়। অগ্রসর হওয়ার পথে সুবেদার বেলায়েত শত্রুসেনা কর্তৃক অতর্কিত আক্রান্ত হয়। নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে সুবেদার বেলায়েত বীরবিক্রমে সম্মুখভাগের শত্রু পরিখার ওপর গ্রেনেড চার্জ করে আরো কয়েকটি শত্রু বাঙ্কার ধ্বংস করে এবং শত্রু সৈন্য নিহত করে। সুবেদার বেলায়েত ও তার দলের প্রচন্ড আক্রমনে শালদা নদী তীরবর্তী এলাকা সম্পূর্ণ রূপে শত্রুমুক্ত হয়ে যায়। ফলে শালদা নদী রেলস্টেশনে অবস্থানরত পাকসেনাদের সঙ্গে শালদা নদী গুদামঘরে অবস্থানরত পাকসেনাদের যোগাযগ সম্পূর্ণ রূপে বিছিন্ন হয়ে যায় এবং তারা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পরে। পাকসেনারা আমাদের ওপর কামান কিংবা মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করার সুযোগ পাচ্ছিল না। কেননা আমাদের সৈনিক তাদের দু দলের মধ্যবর্তী স্থানে পৌঁছে যাওয়ায় তাদের গোলাবর্ষণে নিজেদের ই ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। গুদামঘরে অবস্থানরত পাকসেনারা বুঝতে পারে যে, তারা দু দিক থেকে সাঁড়াশি আক্রনের স্বীকার হয়ে মূল ঘাঁটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরেছে এবং তাদের পক্ষে এই আক্রমনের মুখে বেশীক্ষন টিকে থাকা সম্ভব নয়। এই সময় পাকসেনাদের একটি ওয়ারলেস মেসেজ আমাদের কাছে ধরা পরে। এতে তারা কর্তৃপক্ষকে জানায় যে মুক্তিবাহিনীর একটি ব্যাটেলিয়ন তাদের উপর প্রচন্ড আক্রমন চালাচ্ছ। তাদের পক্ষে এই ঘাঁটিতে বেশিক্ষন টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। এই ম্যাসেজ পাওয়ার পর পাকসেনাদের দুর্বলতা সম্পূর্ণ ভাবে বুঝতে পারি। তাদের মনোবল যে একেবারেই ভেঙ্গে পরেছে তা বেশ বোঝা যায়। সঙ্গে সঙ্গে সুবেদার মঙ্গল মিয়াকে তার আক্রমণ আরো জোরদার করার নির্দেশ দেই। এই প্রচন্ড আক্রমনে টিকতে না পেরে গুদামঘরে অবস্থানরত পাকসেনারা নয়নপুর রেলস্টেশনের দিকে পালাতে থাকে। সুবেদার মঙ্গল মিয়ার দলটি গুদামঘর এলাকা দখল করে নেয়। আরো কিছুক্ষন যুদ্ধ চলার পর সুবেদার বেলায়েত এবং নায়েব সুবেদার সিরাজের প্রচন্ড আক্রমনে শালদা নদী রেলস্টেশনে অবস্থানকারী পাকসেনারাও রেললাইন ধরে নয়নপুরের দিকে পালাতে থাকে। আমাদের সৈনিকরা পলায়নপর পাকসেনাদের উপর গুলি চালিয়ে অনেককে হতাহত করে। দুপুর নাগাদ সমস্ত শালদা নদী এলাকা শত্রুমুক্ত হয় এবং আমাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রনাধিনে আসে। পাকসেনারা যাতে আবার এই এলাকাটি দখল করে নিতে না পারে সেজন্য আমাদের অবস্থানটিকে শক্তিশালী করে তোলা হয়। পাকসেনারা নয়াপুর রেলস্টেশনের ঘাঁটি থেকে বেশ কয়েকবার এই অবস্থানের ওপর মর্টার ও কামানের আক্রমণ চালায় এবং এই অবস্থান টি পুনর্দখলের জন্য শালদী নদী গুদামঘরের দক্ষিনে কিচুসংখ্যক সৈন্য সমাবেশ করে। এই খবর পেয়ে সুবেদার বেলায়েত একটি দল নিয়ে পাকসেনাদের আক্রমণ কে প্রতিহত করার জন্য গুদামঘর এলাকায় আক্রমন চালায়। পাকসেনাদের আক্রমন প্রতিহত হয় এবং তারা পালিয়ে যা। কিন্তু একজন পাকসেনা আড়াল থেকে সুবেদার বেলায়েত কে লক্ষ্য করে গুঁলি ছোঁড়ে। সুবেদার বেলায়েতের মাথায় গুলি বিদ্ধ হয়। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে চিকিতসার জন্য ২ নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনী হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে হাসপাতালে পৌঁছার আগেই সে শাহাদাৎ বরণ করে। তার মত বীর সৈনিকের শহীদ হওয়াতে আমরা সবাই মর্মাহত হয়ে পরি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা বাংলাদেশ একজন মহান বীরকে হারালো। সুবেদার বেলায়েতের কীর্তি ও বিক্রমের কথা বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
শালদা নদী এলাকা দখল করা একটি দুঃসাহসী পরিকল্পনা ছিল। এই পরিকল্পনা অত্যন্ত অপ্রচলিত কৌশলের একটি বিরাট সাফল্য। এর ফলে কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মনবাড়িয়া পর্যন্ত সম্পূর্ণ এলাকা শত্রুমুক্ত হয়। বাংলাদেশ সরকার ক্যাপ্টেন গাফফার এবং শহীদ বেলায়েতকে কৃতিত্বপূর্ণ লড়াইয়ের জন্য বীরউত্তম উপাধিতে ভূষিত করেন। এই যুদ্ধে প্রচুর অস্ত্র শস্ত্র আমাদের হস্তগত হয়। এগুলার মধ্যে ২১ টা রাইফেল ৫ টা এল এম জি ৩ টা এম জি এই ৩ মেশিনগান ৩১ টা হাল্কা মেশিনগান ম্যাগাজিন ৪ টা রকেট লঞ্চার ১ টা এস এম জি ১ টা ওয়ারলেস সেট ২০২৫০ টি গুলি ২০০ টি ২” মর্টার বোমা ৩ টা টিলিফোন সেট ১ টা জেনারেল ২ টা এম জি ব্যারেল অনেক রেশন কাপড় চোপড় ম্যাপ ও বিভিন্ন ধরনের নথিপত্র আমাদের দখলে আসে। এই সব দলিলপত্র থেকে জানা যায় ৩০ তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের বি কোম্পানি ও ডি কোম্পানি পাকিস্তানীদের প্রতিরক্ষাব্যুহ নিয়োজিত ছিল। এই সংঘর্ষে প্রায় ৮০ / ৯০ জন পাকসেনা হতাহত হয় এবং ১২ জন পাকসেনা আমাদের হাতে জীবন্ত ধরা পরে। ভোর ৫ টা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত ১৬ ঘন্টা যুদ্ধে আমাদের ২ জন শহীদ ও ৮ জন আহত হয়।
শালদা নদী কমপ্লেক্স আমাদের হস্তগত হওয়ার পর পাকসেনারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এই এলাকা পুনর্দখলের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। পাকসেনারা চান্দলার নিকটে অন্যান্য এলাকা থেকে প্রচুর সৈন্য এনে সমাবেশ ঘটায়। ১৬ ই নভেম্বর রাত ২-১৫ মিনিটে পাকসেনারা প্রায় ২ ব্যাটেলিয়ন সৈন্যশক্তি নিয়ে আমাদের শালদা নদী মন্দভাগ কামালপুর মঙ্গল প্রভৃতি উস্থানের ওপর গোলন্দাজ বাহিনী ও মর্টারের সহায়তায় প্রচন্ড আক্রমন চালা। এই আক্রমন প্রায় ৩ / ৪ ঘন্টা ধরে চলতে থাকে। চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা অসীম সাহসিকতার সঙ্গে পাকসেনাদের এই প্রচন্ড আক্রমন কে প্রতিহত করে। সকাল পর্যন্ত যুদ্ধে পাকসেনাদের বিপুলসংখ্যক সেনা হতাহত হয় এবং উপায়ন্তর না দেখে পাকসেনারা আক্রমন পরিত্যাগ করে পিছু হটে যায়। এর একদিন পর আমাদের একটি ছোট দল মঙ্গলপুরের নিকট পাক সেনাদের ঘাঁটির উপর অতর্কিত আক্রমন চালিয়ে ১৭ জন পাকসেনাকে নিহত ও অনেককে আহত করে। আরেকটি রেইডিং পার্ট কাইয়ুমপুরে পাকসেনাদের অবস্থানের দুটি বাঙ্কার আর আর দিয়ে ধ্বংস করে দিয়ে ১৪ জন পাকসেনাকে নিহত করে। ২০ শে এবং ২১ শে নভেম্বর চতুর্থ বেঙ্গলের এ কোম্পানী এবং বি কোম্পানী মঙ্গলপুর এবং কায়েমপুরের উপর তাদের চাপ বাড়িয়ে তোলে। ২১ তারিখ সকাল ৯ টার সময় এই দুই কোম্পানী পাক অবস্থানের ওপর অতর্কিত আক্রমন চালায়। এই আক্রমনে ১৬ জন পাকসেনাকে নিহত এবং ৯ জনকে আহত করে। ১০৬ আর আর এর সাহায্যে পাকসেনাদের বেশ কটি বাঙ্কার উড়িয়ে দেয়া হয়। আমাদের সৈনিকরা অনেক অস্ত্র শস্ত্রও দখল করে নেয়। ২৩ শে নভেম্বর পাকসেনারা আমাদের মন্দভাগ অবস্থানটি পুনর্দখলের জন্য আবার তাদের সৈন্য একত্রিত করতে থাকে। দুপুর দুটোর সময় আমাদের একটি কোম্পানী পাকসেনাদের সমাবেশের উপর আক্রমন চালায়। ফলে পাকসেনাদের শালদা নদির নিকটে মনোরা রেলসেতুর নিকটবর্তী আমাদের অবস্থানগুলোর উপর প্রচন্ড আক্রমণ চালায়। মেশিনগান ১০৬ আর আর ও গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় পাকসেনারা অবস্থানের একটি বাঙ্কার ধ্বংস করতে সমর্থ হয়। আমাদের সৈনিকরা পাকসেনাদের আক্রমনকে প্রতিহত করতে সমর্থ হয় এবং তাদের বহু সৈনিক হতাহত হয়। আমাদের একজন সৈনিক শহীদ ও ৪ জন আহত হয়। একটি মেশিনগান গোলন্দাজ বাহিনির গুলিতে নষ্ট হয়ে যায়। ২৩শে নভেম্বর থেকে পাকসেনাদের সঙ্গে বেশ কটি খন্ডযুদ্ধে আমাদের সৈনিকরা শত্রুদের বিতাড়িত করতে সমর্থ হয়। এই এলাকায় শত্রুরা পর্যুদস্ত হয়ে বুড়িচং ও কুমিল্লার দিকে সরে যায়।
কয়েকদিন পর ৪র্থ বেঙ্গল কে শালদা নদী থেকে ফেনীর দিকে আক্রমণ চালানোর জন্য কে ফোরস এর অধীনে বেলুনিয়াতে স্থানান্তর করা হয়। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট কামালের অধীনে কয়েকটি সেক্টর কোম্পানি শালদা নদীতে রেখে ক্যাপ্টেন গাফফারের নেত্রৃত্বে চতুর্থ বেঙ্গল বেলুনিয়াতে কে ফরস এ যোগাযগ করে। ১০ ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট রাজনগরে তাদের পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাসের পর তাদেরকে দু সপ্তাহের জন্য প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করা হয়। ব্যপক প্রশিক্ষনের পর বেলুনিয়াতে পুনরায় তাদেরকে পুরানো প্রতিরক্ষা ঘাঁটিগুলতে পাঠানো হয়। এবং এই সেক্টরে তৎপরতা বাড়ানর নির্দেশ দেয়া হয়। এই সময় ১০ ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট কে মেজর জাফর ইমাম নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। পুনরায় রনক্ষেত্রে পৌছানোর পর ১০ ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট তাদের তৎপরতা বৃদ্ধি করে। ১৫ ই অক্টবর ১০ম বেঙ্গলের অনন্তপুর প্রতিরক্ষাব্যুহের সামনে পরশুরাম চিতলিয়া প্রভৃতি জায়গায় পাকসেনাদের ঘাঁটিগুলির ওপর ছোট ছোত আক্রমন চালিয়ে ২৪ জন পাকসেনাকে নিহত এবং ৩০ জন কে আহত করে। পাকসেনাদের ৩ টি বাঙ্কারো তারা ধ্বংস করে দেয় ১৮ ই অক্টোবর সকাল ৬ টার সময় পাকসেনাদের একটি প্লাটুন আমাদের ঘাঁটির দিকে অগ্রসর হবার পথে বেলুনিয়া নদীর পূর্ব তীরে আমাদের সৈনিকদের এম্বুশে পরে। ফলে ১২ জন পাকসেনা নিহত এবং ১৪ জন আহত হয়। ফুলগাজীর নিকট ১০ ম বেঙ্গলের পাইওনিয়ার প্লাটুন ঐ দিন ই রাস্তায় মাইন পুঁতে সকাল ১০ টার সময় পাকসেনাদের একটি ট্রাক ধ্বংস করে দেয়। ৭ জন পাকসেনা নিহত এবং ৩ জন আহত হয়। ২০ শে অক্টোবর আমাদের মর্টার ডিপারমেন্ট সন্ধ্যা ৬ টায় পাকসেনাদের অবস্থানে অনুপ্রবেশ করে চিতলিয়া অতর্কিত আক্রমন চালিয়ে ১২ জন পাকসেনাকে নিহত এবং ৭ জন কে আহত করে। ২৫ অক্টোবর আমাদের গোলন্দাজ বাহিনী পাকসেনাদের চিতলিয়া ঘাটির ওপর আক্রমন চালায়। ফলে ২ টি গাড়ি ধ্বংস হয়ে যায় এবং ৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। ২৬ শে অক্টোবর ভোর ৫ টার সময় ফুলগাজীর নিকট আমাদের একটি প্লাটুন পাকসেনাদের টহলদারী দলকে এম্বুশ করে ৯ জন পাকসেনা নিহত ও ৬ জন কে আহত করে। এই যুদ্ধে আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা কুটি মিয়া শহিদ হয়। ঐদিন ই পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল আমাদের ঘাঁটির সামনে এসে মাইন পোঁতার চেষ্টা করে। কিন্তু পাকসেনাদের এই দলটির সঙ্গে আমাদের একটি দলের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে ১২ জন পাকসেনা নিহত ও ৩০ জন আহত হয়। অবশিষ্ট পাকসেনারা আহত ও নিহতদের ফেলে ও অস্ত্র শস্ত্র রেখেই পালিয়ে যায়। ১০ম বেঙ্গলের তৎপরতার কারনে এই এলাকায় পাকসেনাদের বিপুল সমাবেশ ঘটানো হয়। তারা ১০ ম বেঙ্গলকে ধ্বংস করার জন্য প্রস্তুতি নেয়। ২৭ শে অক্টোবর চিতলিয়ার নিকট এক ব্যাটেলিয়নের অধিক শক্তির সমাবেশ ঘটায়। সন্ধ্যা ৬ টার সময় গোলন্দাজ বাহিনীর সয়ায়তায় পাকসেনাদের দুটো কোম্পানী অগ্রসর হয়ে আমাদের অগ্রবর্তী ঘাঁটি নীলক্ষ্মীর উপর প্রচন্ড আক্রমণ চালায়। আমাদের সৈনিকরা সাহসের সঙ্গে পাকসেনাদের আক্রমনে বাধা দেয়। কিন্তু প্রচন্ড আক্রমণের সামনে টিকতে না পেরে মূল ঘাঁটিতে ফিরে আসে। পাকসেনারা নিলক্ষ্মী অগ্রবর্তী ঘাটিটি দখল করে নেয়। পরদিন সকালে ১০ম বেঙ্গলের তিন কোম্পানী আমাদের গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় নীলক্ষ্মীর ওপর পালটা আক্রমণ চালায়। সকাল ১০ টা পর্যন্ত তিন ঘন্টা ধরে যুদ্ধ চলে। প্রচন্ড চাপে পাকসেনারা টিকতে না পেরে নিলক্ষ্মী ঘাঁটি পরিত্যাগ করে পিছু হটে যায়। আমাদের সৈনিকরা নিলক্ষ্মী পুনর্দখলের পর প্রতিরক্ষাব্যুহ (মালিবিলদ) ও গাবতলী পর্যন্ত সম্প্রসারিত করে। পরদিন সন্ধ্যা ৬ টায় আমাদের একটি প্লাটুন দুবলার চাঙ্গের নিকট একটি এম্বুশ পেতে বসে থাকে। পাকসেনাদের একটি দল বেলুনিয়া যাবার পথে সেই এম্বুশ এ পরে। আমাদের প্লাটুনটি পাকসেনাদের আক্রমন চালিয়ে ১৩ জন পাকসেনাকে নিহত করে এবং ২ জন পাকসেনাকে জীবিত বন্দী করে। এছাড়া অনেক অস্ত্র শস্ত্র দখল করে নেয়। নিলক্ষ্মীতে পাকসেনারা পর্যুদস্ত হয়ার পর পুনঃআক্রমনের প্রস্তুতি নেয়। ২৯ শে অক্টোবর ভোর ৪ টার সময় পাকসেনারা শালদার নয়াপুর এবং ফুলগাজি থেকে আমাদের প্রতিরক্ষা ঘাঁটির উপর কামানের সাহায্যে প্রচন্ড গোলাবর্ষণ শুরু করে। আমাদের কামানগুলিও পাকসেনাদের গোলার প্রত্যুত্তর দেয়। সকালে পাকসেনারা তিন দিক থেকে আমাদের ঘাঁটির উপর আক্রমন চালায়। প্রায় ৫ ঘন্টা যুদ্ধের পর আমাদের পালটা আক্রমণের মুখে পাকসেনাদের আক্রমণ বিপর্যস্ত হয়ে পরে। প্রচন্ড বাধার সামনে টিকতে না পেরে পাকসেনারা পিছন দিকে পালিয়ে যায়। সংঘর্ষে ৪০ জন পাকসেনা হতাহত হয়। অনেক অস্ত্র শস্ত্র আমাদের হস্তগত হয়। আমাদের দুজন সৈনিক শহীদ হয়।
এই সময় পাকসেনাদের প্রতিরক্ষা ঘাঁটি চিতলিয়া পরশুরাম ও বেলুনিয়া থানার নিকট ছিল। এসব ঘাঁটিগুলতে রেলওয়ে ত্রলির সাহায্যে পাকসেনারা ফেনী থেকে রসদ যোগাত। ৫ ই নভেম্বর রাতে আমাদের একটি রেইডিং পার্টি চিতলিয়ার দক্ষিনে রেলোয়ে লাইনের উপর এম্বুশ পাতে। ৬ ই নভেম্বর সকাল ৭ টায় পাকসেনাদের একটি ট্রলি আমাদের হেডিং পার্টির এম্বুশ এর আওতায় এসে যায়। ট্রলিটিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়া হয় এবং পাকসেনাদের একজন অফিসারসহ চারজন সৈনিক নিহত হয়। আমাদের রেইডিং পার্টি একটি হালকা মেশিনগান একটি রাইফেল একটি স্টেনগান একটি ব্লেন্ডিসাইড ২০০০ রাউন্ড গুলি ও ১০ টি ব্লেনডিসাইড গোলা হস্তগত করে। ১০ম বেঙ্গল পাকসেনাদের আক্রমণকে ব্যর্থ করার পর বেলুনিয়া থেকে পাকসেনাদের সম্পূর্ণ রূপে বিতাড়িত করার জন্য পালটা আক্রমনের প্রস্তুতি নেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ে পরশুরাম ও চিতলিয়ার মাঝে পাকসেনাদের সরবরাহ লাইনের সড়কটি বিচ্ছিন্ন করার প্রস্তুতি নেয়। ৬ ই নভেম্বর ১০ম বেঙ্গলের একটি কোম্পানী গোলন্দাজ বাহিনী ও মর্টারের সহায়তায় চিতলিয়ার উত্তরাংশে পাকসেনাদের প্রতিরক্ষাব্যুহের উপর প্রচন্ড আক্রমণ চালায়। প্রায় ৪ ঘন্টা যুদ্ধের যুদ্ধের পর ১০ম বেঙ্গলের কোম্পানী টি চিতলিয়ার উত্তরাংশ দখল করে নিয়ে সালিয়া এবং ধানীকুন্ডার মাঝখানে রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে পরশুরাম ও ফেনীর মধ্যে যোগাযগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দিতে সমর্থ হয়। এর ফলে বেলুনিয়ার উত্তরাংশের পাকসেনারা অবরুদ্ধ হয়ে পরে। একজন অফিসার সহ ১২ জন পাকসেনা যুদ্ধে নিহত এবং ৫ জন বন্দী হয়। অফিসারের পকেট থেকে প্রাপ্ত এম ও ফর্ম থেকে জানা যায় ১৫ তম বেলুচ জজিমেন্তের ক্যাপ্তেন এবং বেলুনিয়াতে সে সময় ১৫ তম বেলুচ রেজিমেন্ত আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই সংঘর্ষে আমাদের মর্টার প্লাটুন কমান্ডার হাবিলদার ইয়ার আহমদ শহীদ হয় এবং আরো ৫ জন আহত হয়। পাকসেনাদের মনোবল সম্পূর্ণ রূপে ভেঙ্গে পরে। পাকসেনারা চিতলিয়ার দক্ষিনে পশ্চাদপসরন করে। বিপুল অস্ত্রশস্ত্র আমাদের হস্তগত হয়। আমাদের চিতলিয়ার অবস্থানটি পুনর্দখলের জন্য পাকসেনারা ভোর ৫ টায় দু কোম্পানী সৈন্য নিয়ে প্রচন্ড আক্রমন চালায়। আমাদের কোম্পানীটি গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় অসীম সাহসের সঙ্গে এই আক্রমনের মোকাবিলা করে। আপ্রান চেষটাসত্বেও আমাদের সৈনিকদের গুলির সামনে এবং গোলন্দাজ বাহিনীর গোলার মুখে পাকসেনাদের এই আক্রমণ টি ব্যর্থ হয়ে যায়। ৩৫ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং অনেক আহত হয়। কয়েকটি হালকা মেশিন গান সহ অনেক অস্ত্রশস্ত্র আমাদের হস্তগত হয়। পাকসেনারা ছত্রভংগ হয়ে পিছু হটে যায়।
১০ম বেঙ্গল উত্তর চিতলিয়া দখলের পর তাদের তৎপরতা অব্যাহত রাখে। ৯ ই নভেম্বর রাত সারে ১১ টার সময় আমাদের একটি পেট্রোল পার্টি ৫ জন পাকসেনাকে বন্দী করে এবং একটি মেশিনগান ও ৪ টি চায়না রাইফেল দখল করে দেয়। ১০ম বেঙ্গলের দুটি কোম্পানী ৯ ই নভেম্বর রাত সাড়ে ১১ টার সময় পরশুরাম ও বেলনিয়া শত্রুঘাঁটির উপর অতর্কিত আক্রমন চালায়। আক্রমনে অনেক পাকসৈন্য নিহত হয় এবং বহু অস্ত্রশস্ত্র আমাদের হস্তগত হয়। চার ঘন্টা যুদ্ধের পর এই দুই ঘাঁটি আমাদের সৈনিকরা দখল করে নেয়। পাকসেনারা পরদিন আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহের উপর জঙ্গী বিমানের আক্রমণ চালায়। আমাদের সৈনিকরা ভারী মেশিনগানের সাহায্যে বিমান আক্রমনের পালটা জবাব দেয়। শত্রুদের একটি জঙ্গী বিমান আমাদের মেশিনগানের গুলিতে বিদ্ধ হয়ে শালিয়ার নিকট ভূপতিত হয়। বিমান আক্রমনে আমাদের দুজন সৈনিক শহীদ ও ৫ জন আহত হয়। এর পর দিন ১০ম বেঙ্গল আর দুটি কোম্পানী সকাল ১০ টায় চিতলিয়ার উপর গোলন্দাজ বাহিনির সহায়তায় আক্রমন চালায়। ৩ ঘন্টা যুদ্ধের পর আমাদের গোলন্দাজ বাহিনীর গোলা এবং মর্টারের গুলিতে শত্রুপক্ষের ব্যপক ক্ষতি হয় এবং চিতলিয়া রেল স্টেশন ধ্বংস হয়ে যায়। এখানে পাকসেনাদের অনেকে হতাহত হয়। আমাদের ৫ জন শহীদ ও ১৩ জন আহত হয়। শেষ পর্যন্ত চিতলিয়া আমাদের দখলে আসে। আমাদের সৈনিকরা শত শত অস্ত্র শস্ত্র অয়ারলেস সেট পোশাক রেশন প্রভৃতি দখল করে নেয়। ৪ দিনের যুদ্ধে ৫৭ জন পাকসেনা ও ১৫ জন ই পি সি এ এফ আমাদের হাতে বন্দী হয় এবং আরো অনেক হতাহত হয়। পাকসেনারা চিতলিয়া থেকে পালিয়ে মুন্সিরহাটের দক্ষিনে এবং পাঠাননগরের কাছে তাদের রক্ষাব্যুহ পুনরায় স্থাপন করে। তাদের মূল ঘাঁটি ফেনিতে পিছিয়ে নেয়। এই সময় ক ফোরস হেডকোয়ার্টার থেকে পুনঃআক্রমনের নির্দেশ আসে। এই নির্দেশ অনুযায়ী কে ফোরস হেডকোয়ার্টার কোনাবন অবস্থান থেকে দক্ষিন বেলুনিয়াতে স্থানান্তরিত হয় এবং বেলুনিয়া সেক্টরে চতুর্থ বেঙ্গল কেও এই যুদ্ধে নিয়োজিত করা হয়। নতুন নির্দেশ অনুযায়ী কে ফোরস অতি সত্বর ফেনী মুক্ত করার আদেশ দেয়া হয়। নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী চতুর্থ বেঙ্গল ফেনীর দিকে অগ্রসর হয়। চতুর্থ বেঙ্গল উত্তর দিক থেকে ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে ফেনির দিকে অগ্রসর হয়। ১০ম বেঙ্গল লক্ষ্মীপুর হয়ে ছাগলনাইয়ার দিকে অগ্রসর হয়। কে ফোরস এর দুই ব্যটেলিয়নের প্রচন্ড চাপে পাকসেনারা টিকতে না পেরে তাদের অগ্রবর্তী ঘাঁটি পাঠাননগর ও দক্ষিন মুন্সিরহাট ছেড়ে পেছন দিকে পালিয়ে যায়। ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে কে ফোরস ছাগলনাইয়া ও ফেনীর উপকন্ঠে পাকসেনাদের উত্তর পশ্চিম দিকে সম্পূর্ণ ভাবে ঘিরে ফেলে এবং পাকসেনাদের অবস্থানগুলোর উপায় গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে প্রচন্ড আক্রমন চালায় এই প্রচন্ড চাপে পাকসেনারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। আমাদের আক্রমনের চাপ আরো বাড়িয়ে দেয়া হয়। উপায়ন্তর না দেখে ৬ ই ডিসেম্বর পাকসেনারা তাদের অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ ফেলে শুভপুর সেতু হয়ে চট্টগ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। ৬ ই ডিসেম্বর দুপুরে কে ফোরস ফেনীকে শত্রুমুক্ত করে। ফেনীতে পাকসেনাদের অজস্র গোলাবারুদ আমাদের হস্তগত হয়। শত্রুরা পালাবার সময় ভুভপুর সড়ক ও রেলসেতু উড়িয়ে দেয়। যার ফলে পাকসেনাদের পিছু ধাওয়া করা কে ফোরসের পক্ষে অসুবিধা হয়ে পরে এবং তাদের অগ্রাভিযান বাধা প্রাপ্ত হয়। শুভপুর সেতু মেরামতের জন্য দুদিন সময় লেগে যায়। মিত্র বাহিনীর প্রকৌশলীরা একটি সেতু পুনঃনিরমান করে এবং এরপর সেতু ও নৌকার সাহায্যে চট্টগ্রামের দিকে কে ফোরস এর অগ্রাভিযান পুনরায় শুরু হয়। এই সময় আমি আহত হবার ফলে কে ফরস এর নেতৃত্ব মেজর সালেকের উপর ন্যাস্ত ছিল। কে ফোরস ফেনী থেকে করেরহাট পর্যন্ত পাকসেনাদের ছোটখাট রক্ষাব্যুহ দখল করে তাদের অগ্রাভিযান অব্যাহত রাখে এবং করেরহাট পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা শুরু করে। করেরহাট থেকে চট্টগ্রাম অগ্রসর হওয়ার জন্য নতুন একটি পরিকল্পনা নেয়া হয়। এই পরিকল্পনা অনুসারে চতুর্থ ও মুজিব ব্যাটারীকে (বাংলাদেশ প্রথম গোলন্দাজ বাহিনী) নিয়ে হিয়াকু ফটিকছড়ি নাজিরহাট হয়ে চট্টগ্রামের উত্তর পশ্চিম শত্রুবাহিনির উপর আক্রমন চালাবে এবং ১০ম বেঙ্গল ফেনী চট্টগ্রামের প্রধান সড়কে সীতাকুন্ড হয়ে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হবে। এই দ্বিমুখী অগ্রাভিযান চট্টগ্রামের উপকন্ঠে পৌছে চট্টগ্রাম শহরের উপর সাঁড়াশি আক্রমন চালাবে। পরিকল্পনা মত চতুর্থ বেঙ্গল মুজিব ব্যাটারি সহ হিয়াকুর দিকে ৭ ই ডিসেম্বর রাত ১২ টায় অগ্রসর হয়। পরদিন সকাল ৬ টায় হিয়াকু বাজারের নিকট পৌছার পর পাকসেনাদের একটি অগ্রবর্তী ঘাঁটির সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। পাকসেনাদের এই ঘাঁটিতে প্রায় ৪০ / ৫০ জন সৈনিক ছিল। তারা আমাদের বাধা দেয় কিন্তু আমাদের সৈনিক এবং গোলন্দাজ বাহিনীর আক্রমনে টিকতে না পেরে পাকসেনারা ফটিকছরির দিকে পালিয়ে যায়। ফলে হিয়াকু বাজার আমরা অতি সহজেই শত্রুমুক্ত করে নিজেদের দখলে আনি। হিয়াকু থেকে চট্টগ্রামের দিকে একটি কাঁচা রাস্তা গেছে। রাস্তাটি খুব ই খারাপ। সেই রাস্তা হয়ে পায়ে হেঁটে আমাদেরকে অগ্রসর হতেহয়। অগ্রসরের পথে নারায়ণহাটের নিকট পাকসেনাদের আরেকটি অবস্থানের সঙ্গে চতুর্থ বেঙ্গলের সংঘর্ষ হয়। পাকসেনাদের এ অবস্থানটিও আমাদের আক্রমনের চাপে টিকতে না পেরে ফটিকছড়ির দিকে পিছু হটে যায়। যাওয়ার সময় এটি কাঠের সেতু ধ্বংস করে দেয়। চতুর্থ বেঙ্গল ওই দিন রাতে নারায়নহাটে বিশ্রাম নেয়। ধ্বংসপ্রাপ্ত সেতুটি মেরামত করার পর আমাদের অগ্রযাত্রা পুনরায় শুরু হয়। পথে কাজীরহাটে পাকসেনারা আমাদের অগ্রাভিযানে বাধা দেয়ার জন্য পথে অনেক মাইন পুঁতে রাখে। এই মাইন গুলোকে সরিয়ে রাস্তা পরিস্কার করে আমাদের অগ্রসর হতে হয়। ১০ ই ডিসেম্বর ফটিকছরির উপকন্ঠে চতুর্থ বেঙ্গলের অগ্রাভিযান কে পাকিস্তানের ২৪ তম ফ্রন্টিয়ার রেজিমেন্ট বাধা দেয়। ফটিকছড়িতে পাকিস্তানীদের একটি শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। সেজন্য চতুর্থ বেঙ্গলের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন গাফফার পাকসেনাদের ঘাঁটিটি সম্বন্ধে পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য সংগ্রহ করে। এরপর চতুর্থ বেঙ্গল কে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়। একটি দল ফটিকছড়ির সন্নিকটে পাহারের দিকে রাস্তায় অগ্রসর হয় এবং প্রধান দলটি কাজীরহাট ফটিকছড়ি রাস্তার দিকে অগ্রসর হয়। ১১ ই ডিসেম্বর ৪ – ৩০ টায় এই দুটি দল সম্মিলিতভাবে দুদি্ক থেকে পাক অবস্থানের উপর আক্রমন চালায়। এই আক্রমনে তিকতে না পেরে রাত ১২ টার পর পাকসেনারা সমস্ত অস্ত্র শস্ত্র গোলাবারুদ বিছানাপত্র ফেলে পিছনের দিকে পালিয়ে যায় ফলে ফটিকছড়ি শ্ত্রুমুক্ত হয়। এই যুদ্ধে আমাদের দুজন শহীদ হয়। অপরদিকে শত্রুপক্ষের ৩০ / ৪০ জন হতাহত হয়। এই সময় খবর আসে যে পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল তাদের রামগড় অবস্থান পরিত্যাগ করে মানিকছড়ির পথে ফটিকছড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এই সংবাদ পেয়ে চতুর্থ বেঙ্গল থেকে দুটি প্লাটুন এবং মর্টার প্লাটুন এই দলটিকে বাধা দেবার জন্য মানিকছড়ির রাস্তায় পাঠানো হয়। আমাদের প্লাটুনগুলো পাকসেনাদের মানিকছরির রাস্তায় সাফল্যের সঙ্গে এম্বুশ করতে সমর্থ হয়। পাকসেনারা অতর্কিত আক্রান্ত হয়ে নাজিরহাটের দিকে পালিয়ে যায়। ১২ ই ডিসেম্বর ভোরে ফটিকছড়ি থেকে চতুর্থ বেঙ্গল চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। ২ / ৩ ঘন্টা পর প্রায় ৯ / ১০ তার সময় নাজিরহাট নদির পাড় থেকে পাকসেনারা আমাদের উপর প্রচন্ড আক্রমণ চালিয়ে আমাদের অগ্রযাত্রায় বাধা দেয়। ক্যাপ্টেন গাফফার নদীর নিকটস্থ একটি দোতলা বাড়ি থেকে পাকসেনাদের অবস্থানের তথ্য সংগ্রহ করে। কবরাখবর নিয়ে বোঝা যায় যে পাকিস্তানের ২৪ তম ফ্রন্টিয়ার ফোরস তাদের প্রায় তিনটি কোম্পানী ও বেশ কিছু সংখ্যক ইপিসিএ এফ সহ নাজিরহাট নদীর তীর বরাবর একটি শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে আছি। ১৩ ই ডিসেম্বর পাকসেনাদের সম্বন্ধে আরো তথ্য সংগ্রহ করা হয় এবং তার পর ই পাক অবস্থানের উপর গোলাবর্ষণ করা হয়। কিন্তু শত্রুদের অবস্থান এত শক্তিশালী ছিল যে চার ঘন্টা ধরে যুদ্ধ চালানোর পরো পাকসেনারা আমাদের আক্রমন কে প্রতিহত করে। সুতরাং এভাবে আক্রমন চালিয়ে কোন লাভ নেই মনে করে অন্য পন্থা অবলম্বনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এবং সেজন্য আমাদের সৈন্যদের কে কিছুটা পিছিয়ে নেয়া হয়। এই সময় একজন পাকসেনা আমাদের হাতে জীবিত ধরা পরে। জীবিত সেই পাকসেনার কাছ থেকে পাকসেনাদের প্রতিরক্ষাব্যুহ সম্বন্ধে আরো সঠিক খবর জানা যায়। সেখানে জানা যায় ২৪ তম ফ্রন্টিয়ার এর মেজর আশেক এই প্রতিরক্ষাব্যুহের নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই প্রতিরক্ষাব্যুহের সশক্তি প্রায় এক ব্যাটেলিয়নের মত। নদী বরাবর ব্যাটেলিয়ন টি অসংখ্য বাঙ্কার তৈরী করে তাদের প্রতিরক্ষাব্যুহ সুদৃঢ় করেছে। কিন্তু এদের নজ ফটিকছড়ির দিকে বেশি থাকাতে পশ্চিম ভাগ বেশী শক্তিশালি নয়। অতি অল্পসংক্যক সৈন্য দিয়ে পশ্চিমের চা বাগানের দিকে রক্ষাব্যুহ রচনা করা হয়েছে এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়ে পশ্চিমের চা বাগানের দিক থেকে পাকসেনাদের উপর আক্রমণের পইকল্পনা নেয়া হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী লেঃ শওকতের নেতৃত্বে গণবাহিনীর একটি কোম্পানী চারঘন্টা আগে নাজিরহাট ও চট্টগ্রামের রেলপথের মাঝে পাকসেনাদের অবস্থানের উপর অতর্কিত আক্রমন চালায়। এ আক্রমনে তারা এত হতভম্ব হয়ে পরেছিল যে আমাদের আক্রমনে বাধা পর্যন্ত দিতে পারেনি এবং শত্রুরা ঘুম থেকে উঠেই দেখতে পায় আমরা তাদেরকে পিছন দিক থেকে আক্রমণ চালিয়েছি। উপায়ন্তর না দেখে সবকিছু ফেলে তারা চট্টগ্রামের দিকে পালাতে থাকে। পালাবার পথে আমাদের মর্টারের এওং মেশিনগানের গুলিতে অনেক পাকসেনা হতাহত হয়। প্রায় ৪০ জন হতাহত পাকসেনাকে আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে পাই। ৮ জন পাকসেনা বন্দী হয় , ৪৯ জন ইপিসিএ এফ অস্ত্রশস্ত্র সহ আত্মসমর্পণ করে। প্রচুর গোলাবারুদ ও অন্যান্য জিনিসপত্র আমাদের হস্তগত হয়। রেশন বোঝাই কয়েকটি ট্রাকও আমাদের দখলে আসে। পালাবার সময় পূর্ব থেকে লেঃশওকতের গণ বাহিনির কোম্পানীও পাকসেনাদের উপর আক্রমন চালায় এবং অনেককে হতাহত করে। পাকসেনারা রাস্তা ছেড়ে গ্রামের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। ১৪ ডিসেম্বর নাজিরহাট সম্পূর্ণ রূপে শত্রুমুক্ত হয়। আমাদের একজন শহীদ ও এক জন সৈনিক আহত হয়। পাকসেনারা নাজিরহাট সড়ক সেতু আগে থেকেই ধ্বংস করে দিয়েছিল। সেজন্য নাজিরহাট থেকে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রযাত্রা একদিন দেরী হয়ে যায়। নাজিরহাটের স্থানীয় জনগনের সাহায্যে আংশিক পুনঃ নির্মাণ করা সম্ভব হয় এবং ১৫ ডিসেম্বর নাজিরহাট থেকে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রাভিযান পুনরায় শুরু হয়। সকালে হাটহাজারি পৌছার পর ১০ম বেঙ্গলের সাথে যোগাযোগ হয়। ১০ম বেঙ্গল মেজর জাফর ইমামের নেতৃত্বে সীতাকুন্ড হয়ে চট্টগ্রামের দিকে এগিয়ে আসছিল। হাটহাজারিতে যোগাযগের পর কে ফরস এর ১০ম বেঙ্গল ও চতুর্থ বেঙ্গল সম্মিলিতভাবে অগ্রসর হয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শ্ত্রুমুক্ত করে। ১৬ ই ডিসেম্বর সকালে এই সম্মিলিত বাহিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অগ্রসর হয়ে চট্টগ্রাম শহর আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। এই সময় বাংলাদেশ ফোরসেস হেডকোয়ার্টার আক্রমন স্থগিত রাখার নির্দেশ পাঠায়। আরো খবর আসে যে পাকসেনারা ওই দিন আত্মসমর্পণ করবে। ১৬ ই ডিসেম্বর ৪- ৩০ মিনিটে পাকসেনাদের এক ডিভিশন সৈন্য কে ফোরস এর কিট অস্ত্রশস্ত্র সহ আত্মসমর্পণ করে। পাকসেনাদের কে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ চট্টগ্রাম সেনানিবাস নৌঘাঁটি ট্রানজিট ক্যাম্প প্রভৃতি জায়গায় বন্দী করে রাখা হয়। সমস্ত চট্টগ্রাম কে ফোরস এর নিয়ন্ত্রণে আসে। সতঃস্ফুরত জনগণ বিজয়মাল্যে ভূষিত করে আমাদের বিজয়ী বীর সৈনিকদের নিয়ে বিজয় উল্লাসে শহর প্রদক্ষিণ করে।
১১ ই এবং ১২ ই নভেম্বর ৯ম বেঙ্গলের “এ” কম্পানি ও “বি” কোম্পানী কৃষ্ণপুর ও বগাবাড়ি অবস্থান থেকে পাকসেনাদের অবস্থানের উপর আক্রমন চালিয়ে তাদেরকে কুমিল্লার দিকে আরো পিছু হটিয়ে দেয়। দুদিনের যুদ্ধে পাকসেনাদের ১৪ জন নিহত ও ৭ জন আহত হয়। আমাদের পক্ষে ২ জন শহিদ ও একজন আহত হয়। এই সময় চতুর্থ বেঙ্গল শালদা নদীর দিক থেকে পাকসেনাদের উপর প্রচন্ড আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। এই দুই ব্যাটেলিয়নের আক্রমণে পাকসেনারা পরাস্ত হয়ে শালদা নদী কসরা মন্দভাগ প্রভৃতি এলাকা সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করে নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে কুমিল্লাতে আশ্রয় নেয়। ডিসেম্বর মাসের ১ লা তারিখ কুমিল্লার উত্তর এলাকা সম্পূর্ণ রূপে শত্রু মুক্ত হওয়ার পর চারটি সেক্টর কোম্পানীকে এই এলাকা মোতায়েন রেখে ৯ ম বেঙ্গল কে কুমিল্লার দক্ষিন পূর্বে মিয়ারবাজার এলাকায় সমাবেশ করতে নির্দেশ দেয়া হয়। ডিসেম্বর মাসের ২ তারিখ ৯ ম বেঙ্গল মেজর আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে মিয়ারবাজারের দিকে অগ্রসর হয়। এই মিয়াবাজারে ক্যাপ্টেন মাহবুবের ছয়টি সেক্টর কোম্পানীও তাঁর সঙ্গে যোগ দেয়। ৩ রা ডিসেম্বর সকালে এই সম্মিলিত বাহিনী মিত্র বাহিনীর কামানের সহায়তায় মিয়াবাজারে পাকসেনাদের প্রতিরক্ষাব্যুহের উপর প্রচন্ড আক্রমন চালায়। পাকসেনারা এ আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে কুমিল্লার দিকে পিছু হটে যায়। মিয়াবাজার শত্রুমুক্ত করার পর ৯ম বেঙ্গলের একটি দলকে লাকসামের দিকে অগ্রসর হবার নির্দেশ দিয়ে মেজর আইনউদ্দিন কুমিল্লা আক্রমনের জন্য অগ্রসর হতে থাকে। যাত্রাপথে শত্রুর প্রতিরক্ষাব্যুহ ধ্বংস করে অগ্রাভিযানের গতি অব্যাহত রেখে ৪ ঠা ডিসেম্বরের ভোরে মেজর আইনউদ্দিনের দল কুমিল্লার বিমানবন্দর এলাকা পর্যন্ত পৌঁছতে সমর্থ হয়। কুমিল্লা বিমানবন্দরের নিকট পাকসেনাদের একটি শক্তিশালি ঘাঁটি ছিল। ৯ ম বেঙ্গল মিত্রবাহিনীর গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় এই ঘাঁটিটির উপর প্রচন্ড আক্রমন চালায়। পাকসেনারা এই আক্রমন প্রতিহত করতে না পেরে কুমিল্লা শহরের দিকে পালিয়ে যায়। দুপুর পর্যন্ত সমস্ত কুমিল্লা বন্দর এলাকা শত্রুমুক্ত হয় এবং নবম বেঙ্গলের দুটি কম্পানী কুমিল্লার দক্ষিন ও পূর্ব দিক ( রাজগঞ্জ বাজার) থেকে কুমিল্লা শহরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। ৯ ই ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকসেনাদের আরো বিতাড়িত করে ময়নামতির পথে রেলওয়ে ক্রসিং এলাকা পর্যন্ত শত্রুমুক্ত করে। ৯ ম বেঙ্গলের আক্রমনের মুখে টিকতে না পেরে কুমিল্লা শহরে অবস্থানরত পাকসেনা ময়নামতি সেনানিবাসের দিকে পালিয়ে যায়। এই সময় হাজার হাজার জনতা আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে পাকসেনাদের পেছনে অগ্রসর হয়। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে , পাকবাহিনির সাথে সম্মুখযুদ্ধে এ জেলা শহর টি সর্বপ্রথম মুক্তি বাহিনী কর্তৃক শত্রুমুক্ত হয়। ১০ ই ডিসেম্বর নবম বেঙ্গল কুমিল্লা শহরের রেলওয়ে ক্রসিং থেকে ময়নামতি ছাওনীর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এই অগ্রাভিযানের সময় মিত্র বাহিনীর ৩ টি ট্যাঙ্ক ৯ ম বেঙ্গলের সহায়তার জন্য মেজর আইনউদ্দিনের কমান্ডের অধিনে দেয়া হয়। রেলওয়ে ক্রসিং থেকে দেড় মাইল পশ্চিমে অগ্রসর হওয়ার পর ৯ ম বেঙ্গলের অগ্রবর্তী দলগুলি টেক্সটাইল মিল এলাকার সামনে পাকসেনাদের গোলাগুলির সম্মুখীন হয়। ৯ম বেঙ্গলের আরেকটি কোম্পানি কোর্ট বাড়ির পথে ময়নামতির দক্ষিন দিক থেকে অগ্রসর হচ্ছিল। এই দলটি মিল এলাকায় পাকসেনাদের গোলাগুলির সম্মুখীন হলেও অগ্রবর্তী দলগুলো পাকসেনাদের অবস্থান গুলো দখল করার চেষ্টা করে। কিন্তু একঘন্টা রেকি করার পর বোঝা যায় পাকসেনাদের অবস্থান গুলো খুব ই শক্তিশালী। অবস্থানগুলোতে মেশিনগান এবং ১০৬ আর আর বাঙ্কারের ভিতর রেখে কুমিল্লা – ময়নামতির রাস্তাকে সুদৃঢ় ভাবে প্রতিরক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছে। এই সংবাদ আমাদের অগ্রবর্তী দলগুলো মেজর আইনউদ্দিন কে অবগত করে। মেজর আইনউদ্দিন পাকসেনাদের অবস্থানগুলোর উপর চাপ অব্যাহত রাখার নির্দেশ দিয়ে আরো সম্মুখবর্তী অবস্থানে পাকসেনাদের সম্বন্ধে বিস্তারিত সংবাদ সংগ্রহ করে। সংবাদ সংগ্রহের পর সম্পূর্ণ ব্যাটালিয়ন দিয়ে মিত্র বাহিনির ট্যাঙ্কের সহায়তায় আক্রমন করার সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরদিন ভোরে মিত্র বাহিনীর ট্যাঙ্কগুলোকে সড়কের বা৬ দিক দিয়ে অগ্রসর হবার নির্দেশ দেয়। অপরদিকে ৯ম বেঙ্গল তাদের আক্রমণ আরো জোরদার করে। এ সাঁড়াশি আক্রমনের মুখে পাকসেনারা দারুন ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পরে। ১৫ ই ডিসেম্বর সকালে পাকসেনাদের সর্ব বাম দিকে সাদা পতাকা উড়তে দেখা যায় এবং কিছুক্ষন পর সেই জায়গা থেকে গোলাগুলিও বন্ধ হয়। মেজর আইনউদ্দিন সাদা পতাকা দেখে আক্রমণ স্থগিত রাখার নির্দেশ দেয় এবং শত্রুসেনাদের উদ্দেশ্যে আত্মসমর্পণের আদেশ দেয়। প্রায় আধা ঘন্টা পর গোলাগুলি স্তিমিত হয়ে এলে উতর দিকের পুকুর পাড়ের উঁচু বাঁধের উপর প্রায় ২৫/ ৩০ জন পাকসেনাকে অস্ত্রশস্ত্র সহ সাদা পতাকা হাতে সামনের দিকে অগ্রসর হতে দেখা যায়। মেজর আইনউদ্দিন তৎক্ষণাৎ সেইসব পাকসেনাদের আরো সামনে আসতে নির্দেশ দেয়। পাকসেনারা নির্দেশ মত মেজর আইনউদ্দিনের কাছে তাদের অস্ত্র শস্ত্র সমর্পণ করে। এই সময় হাজার হাজার স্থানীয় জনসাধারণ পাকসেনাদের ঘেরাও করে তাদেরকে বেঁধে ফেলে। বাকি পাকসেনারা যারা তখনো বাঁধ থেকে সামনের দিকে আসছিল তারা ভয়ে সামনের দিকে না এসে পেছনের দিকে পালাতে থাকে। মেজর আইনউদ্দিন তাদেরকে পুনরায় আত্মসমর্পণ করার আদেশ দেয়া সত্বেও পাকসেনারা নিজেদের বাঙ্কারে আশ্রয় নেয়। আত্মসমর্পণের আদেশ না মানায় মেজর আইনউদ্দিন ৯ম বেঙ্গল কে পুনরায় আক্রমনের নির্দেশ দেয়। প্রায় ৪০ ঘন্টা আক্রমনের পর শত্রু অবস্থানটি ৯ম বেঙ্গলের হস্তগত হয়। প্রায় ১৫০ জন পাকসেনা আত্মসমর্পণ করে। অবশিষ্ট পাকসেনা ময়নামতি ছাউনিতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। অনেক অস্ত্রশস্ত্র আমাদের হস্তগত হয়। পাকবাহিনীর ৩৯ তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এই অবস্থান প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল। অবস্থানটি শত্রুমুক্ত করার পর ৯ম বেঙ্গল ক্ষিপ্র গতিতে অগ্রসর হয় ময়নামতি সেনানিবাসের উপকন্ঠ পর্যন্ত শত্রুমুক্ত হয়। ৯ ম বেঙ্গল পাকসেনাদের শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যুহের সম্মুখীন হয়। পাকসেনারা ময়নামতি সেনানিবাসের উচু ভূমির সহায়তায় এই ঘাঁটি টিকে একটি দুর্গে পরিনত করেছিল। চতুর্দিকে পরিখা খনন এবং বাঙ্কার তৈরি করে প্রতিরক্ষাকে অত্যন্ত শক্তিশালী করে তুলেছিল।
৯ ম বেঙ্গল উত্তর ও দক্ষিন দিক থেকে ময়নামতি এলাকা সম্পূর্ণ রূপে ঘিরে ফেলে। কুমিল্লার হাজার হাজার গেরিলা ৯ ম বেঙ্গলের সঙ্গে যোগ দিয়ে পশ্চিম দিকে অবস্থান নিয়ে ময়নামতিকে ঢাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ১৫ তারিখ বিকেলে অবরোধ সম্পন্ন হয়। এ সময় পাকসেনাদের কে আত্মসমর্পণের আদেশ দেয়া হয়। পাকসেনারা সেই আদেশ প্রত্যাখ্যান করে তাদের প্রতিরক্ষার কাজে অটল থাকে। ময়নামতি ছাউনীতে চূড়ান্ত আক্রমনের জন্য ৯ম বেঙ্গল গেরিলা ও মিত্র বাহিনী প্রস্তুতি নেয়। ১৬ ই ডিসেম্বর ময়নামতি গ্যারিসন কমান্ডার আত্মসমর্পণের ইচ্ছা প্রকাশ করে সংবাদ পাঠায়। সেই দিন ই বিকেল ৪ টায় ময়নামতি গ্যারিসনে অবস্থানরত পাকসেনারা অন্যান্য জায়গার মত আনুষ্ঠানিকভাবে ৯ম বেঙ্গল এবং মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণের পর সমস্ত পাকসেনাকে বিভিন্ন জায়গাতে ৯ম বেঙ্গলের তত্বাবধানে স্থানান্তরিত করা হয় এবং তাদের অস্ত্র শস্ত্র বেঙ্গল লাইনে একত্র জমা করে। ৯ম বেঙ্গল আবার জয়ী হয়ে তাদের পুরান বেঙ্গল লাইনে ফিরে এসে বিজয় উল্লাসে ফেটে পরে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ন মাসের পূর্বে এখান থেকে যে চতুর্থ বেঙ্গলের সৈনিকরা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহন করার জন্য দেশ মাতৃকার প্রতি প্রাণের টানে ঝাঁপিয়ে পরেছিল সেই চতুর্থ বেঙ্গলের ই অধিকাংশ সৈনিক ও নতুন রিক্রুট করা সৈনিকদের নিয়ে যুদ্ধকালীন বিপর্যস্ত সময়ে ৯ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট গড়ে উঠেছিল।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৪। ২ নং সেক্টরে সংঘটিত যুদ্ধ সম্পর্কে অন্যান্যের প্রদত্ত বিবরণ |
বাংলা একাডেমীর দলীলপত্র
|
——–১৯৭১
|
আতিকুল ইসলাম ইমন
<১০, ৪.১, ১৪৬–১৪৮>
সাক্ষাৎকারঃ মেজর আইনউদ্দিন
গোপিনাথপুর এমবুশ (কসবা, কুমিল্লা)
সেপ্টম্বর মাসের প্রথম সাপ্তাহে খবর পেলাম যে, কুমিল্লা থেকে দুটি কোম্পানী পাকসেনা কসবা হয়ে সকাল ১০টার দিকে গঙ্গাসাগর আসবে। খবর পেয়ে মনতালি থেকে ৪৫ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ২টি মেশিনগানসহ এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু ছেলে নিয়ে রাতের বেলায়ই কোথায় কোথায় এম্বুশ করতে হবে তার স্থান নির্দিষ্ট করে দেই। স্থান হিসেবে গোপিনাথপুর গ্রামের কাছে রেললাইনের ব্রীজের উত্তর ও দক্ষিণে এম্বুশ করার কথা বলি। পাকবাহিনী এম্বুশ-এর আওতায় আসার পরপরই মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে আঘাত হানে। পাকসেনাদের দুটি কোম্পানীর মাত্র ১০/১২ জন বেঁচে যায়। এ এম্বুশের জন্য কৃতিত্বের অধিকারী ছিল হাবিলদার আবুবকর। এম্বুশকালে সেই পাকসেনাদের কাছ থেকে ১২টি এল এম জিসহ প্রায় দেড়শ’ অস্ত্র উদ্ধার করে। কিছু অস্ত্র পানিতে ডুবে যাওয়ায় উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এই এম্বুশে পাকবাহিনীর একজন মেজর নিহত ও একজন ক্যাপ্টেন আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে একজন আহত হয়। এই অপারেশনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বেড়ে যায়।
চারাগাছ অপারেশন (কসবা, কুমিল্লা)
আমি মনতলা (আগরতলা) থেকে এক কোম্পানী মুক্তিযুদ্ধাকে কসবা, নবীনগর, বাঞ্ছারামপুর এই তিনটি থানা অপারেশন করার জন্য অস্ত্র দিয়ে পাঠালাম। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে কোম্পানীতে ১৪৫ জন সৈন্য ছিল। কোম্পানী দেড় মাস ধরে উল্লিখিত থানাতে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন করে। একদিন পাকবাহিনীর একটি দল লঞ্চযোগে চারগাছ এলাকায় আসে এবং দু’দিন সেখানে থাকে। এ সংবাদ পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ওঁত পেতে থাকে। পাকসেনাদের ঐ লঞ্চটি যখন চাঁদপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে তখন মুক্তিযোদ্ধারা লঞ্চের পিছন দিক থেকে গুলি করতে আরম্ভ করে। পাকবাহিনী লঞ্চ দুটির গতি ঠিক করতে না পেরে এক যায়গায় আটকিয়ে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধাদের আঘাতে পাকসেনাদের অধিকাংশই খতম হয়। কিছু পাকসেনা সাতরিয়ে অন্য গ্রামে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ৪/৫ জন সৈন্য এসাইল বোটে করে লঞ্চ থেকে নেমে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা ঐ বোটটিকে গুলি করে ঘায়েল করে। পাকসেনারা প্রায় সবাই খতম হলেও একজন পাকসেনা বোটের মধ্যে লুকিয়ে ছিল। তাকে হাতেনাতে ধরার জন্য একজন মুক্তিফৌজ সাতরিয়ে এসাইল বোটের কাছে যেতেই পাকসেনাটি উঠে মুক্তিযোদ্ধাটিকে হত্যা করে। পরে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাটিকে হত্যা করতে সমর্থ হয়। দুটি লঞ্চের ভিতর যে সমস্ত পাকসেনা জীবিত ছিল তারা অয়ারলেসে সংবাদ পাঠায় তাদের উদ্ধার করার জন্য। পরে পাঁচটি লঞ্চভর্তি পাকসেনা আসে তাদের উদ্ধার করার জন্য।
(অক্টোবর মাসের প্রথম সাপ্তাহের ঘটনা)
** (১৯৭১ সালে এ সাক্ষাৎকার গৃহীত হয়। একাত্তরের মার্চে আইনউদ্দিন ক্যাপ্টেন হিসাবে কুমিল্লা সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে কর্মরত আছেন)
কালাছড়া চা বাগান অপারেশন (ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা)
লেঃ হারুন রশীদ কালাছড়া চা বাগান অপারেশন পরিচালনা করেন। এই চা বাগানটি এরপর সবসময় মুক্ত ছিল। এই মুক্তাঞ্চলটি বাংলাদেশের সেনাদের কাছে অতি প্রিয় ছিল, কারন পরবর্তীকালে এই চা বাগানটি পাকসেনারা আর কখনই নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেনি।
পাকসেনাদের একটি দল চা বাগানে অবস্থান করছে, লেঃ হারুনুর রশীদ এ খবর পেয়ে তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য লোক নিয়োগ করেন। পাকবাহিনীর দুটি কোম্পানী ওই বাগানে অবস্থান করছিল। লেঃ হারুনর রশীদের অধীনে দুটি কোম্পানী সৈন্য ছিল। নিয়মমাফিক পাক বাহিনীকে আক্রমন করতে হলে দুটি ব্যাটালিয়ন দরকার। কিন্তু লেঃ হারুন সাহস করে প্রস্তুতি নিলেন। দুটি কোম্পানীর একটির কামান্ডার ছিলেন শহীদ হাবিলদার হালিম এবং অপর কোম্পানীর দায়িত্বে লেঃ হারুন নিজে ছিলেন। হারুন রশীদই বলতে গেলে দুটি কোম্পানীর সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন। সে সময় অন্য কোন অফিসার না থাকায় হাবিলদার শহীদ হালিমকে একটি কোম্পানী পরিচালনার ভার দেয়া হয়।
একদিন রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি কোম্পানী দুটি দলে ভাগ হয়ে পাক অবস্থানের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা পাক অবস্থানে আঘাত হানলো। হাবিলদার হালিম যে কোম্পানী পরিচালনা করছিল ঐ কোম্পানীর একজন যোদ্ধা প্রথমেই শহীদ হওয়াতে তারা আর সামনে অগ্রসর হতে পারেনি। কিন্তু লেঃ হারুনর রশীদ তাঁর কোম্পানী নিয়ে পাকবাহীনির ক্যাম্প আক্রমণ করে। এ আক্রমনে পাকবাহিনীর অনেক সৈন্য হতাহত হয়। শেষ পর্যন্ত পাকবাহিনীর কিছু সৈন্য বাঙ্কারে আশ্রয় নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা বাঙ্কারে গ্রেনেড চার্জ করে অনেক পাকসেনাকে হত্যা করে। হাবিলদার হালিম তাঁর দলের একজন সেনা শহীদ হওয়ায় আর সামনে অগ্রসর হতে না পারায় লেঃ হারুনর রশীদ নিজের জায়গা দখল করে শহীদ হালিমের লক্ষ্যস্থলে অবস্থানরত পাকবাহিনীকে আক্রমণ করে এবং তাদের পর্যদস্ত করে স্থানটি দখল করে নেয়। ঐ সংঘর্ষে পাকবাহিনীর কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা এল-এম-জিসহ একশ অস্ত্র উদ্ধার করে। এই সংঘর্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের ৭ জন আহত ও দুইজন শহীদ হয়। পাকিস্তানীরা ২৭ জন সেনার মৃতদেহ পাওয়া যায়। যুদ্ধের পরদিন সকালে ঐ স্থানের সাধারণ নাগরিকরা ঐ সমস্ত পাকবাহিনীর মৃতদেহ বহন করে আনে। পরে তাদেরকে আমার তত্ত্বাবধানে দাফন করা হয়।
(অক্টোবর মাসের শেষের দিকের ঘটনা)
চন্দ্রপুর অপারেশন (কসবা ষ্টেশন থেকে তিন মাইল উত্তরে)
১৮ই নভেম্বর তারিখে ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার ‘তুলে’ আমাকে ডেকে বলেন যে, তারা যৌথ উদ্যোগে চন্দ্রপুর ও লাটুমুড়া হিল আক্রমণ করবে। সেখানে পাকিস্তানী সেনারা অবস্থান করছিল। আমাকে পরিকল্পনা করতে বলেন। আমি ব্রিগেডিয়ার সাহেবকেই পরিকল্পনা করার অনুরোধ জানালাম। তিনি পরিকল্পনা করলেন। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার সাহেবের পরিকল্পনা আমার মনঃপুত হলো না। কারন চন্দ্রপুর গ্রামের সাথেই ছিল লাটুমুড়া হিল (পাহাড়)। আর চন্দ্রাপুর আক্রমণ করলে লাটুমুড়া হিল থেকে পাকসেনারা আমাদের অতিসহজেই ঘায়েল করতে পারবে। কিন্তু তিনি আমার কোন কথা না মেনে বলেন, আমাদের আক্রমণে পাকবাহিনী পালিয়ে যাবে। তিনি ট্যাঙ্ক নিয়ে এসে রাত্রিতে টহল দিতেন যাতে পাকসেনারা বুঝতে পারে এলাইড ফোরস এর প্রচুর ট্যাঙ্ক আছে। আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে চন্দ্র পুর আক্রমণ করা হলো। আমি তাকে অনুরোধ করলাম আমার দলের যে ক’জন সৈন্য যাবে আপনাদেরও ততজন সৈন্য যেতে হবে। ব্রিগেডিয়ার সাহেব এ প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেলেন। ভারতীয় একটি কোম্পানীর নেতৃত্বে ছিলেন একজন মেজর। বাংলাদেশ বাহিনীর কোম্পানী পরিচালনা করেন লেঃ খন্দকার আব্দুল আজিজ। পরিকল্পনা মোতাবেক বাংলাদেশ বাহিনীর সেনারা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ভিতর দিয়ে এবং ভারতীয় বাহিনী ভারত সীমান্তের ভিতর দিয়ে ২২ শে নভেম্বর চন্দ্রপুর আক্রমণ করে। এই আক্রমণে বাংলাদেশ ও ভারতীয় বাহিনীর সৈন্যরাই শহীদ হয় বেশী। ভারতীয় বাহিনীর কোম্পানী কামান্ডার শিখ মেজর এবং তিনজন জুনিয়র কমিশন অফিসারসহ সর্বমোট ৪৫ জন সেনা ঐ যুদ্ধে শহীদ হয় এবং মুক্তিবাহিনীর শহীদ হয় ২২ জন। আহত হয় ৩৪ জন সৈন্য। আমাদের অফিসার লেঃ খন্দকার আবদুল আজিজ এই যুদ্ধে শহীদ হন। ২২ তারিখ রাত্রিতে চন্দ্রপুর আক্রমণ করলে পাকবাহিনীর সাথে সারারাত যুদ্ধ হয় এবং পাকবাহিনী শেষ পর্যায়ে পিছনের দিকে চলে যায়। পাকসেনা ও আমাদের যৌথ বাহিনী উভয়ই আরটিলারীর গোলাবর্ষণ করতে থাকে। আমাদের যৌথ বাহিনী যুদ্ধ করে চন্দ্রপুর দখল করে নেয় কিন্তু পুনরায় পাকবাহিনী চন্দ্রপুর দখল করে নেয়। ২৩ তারিখ বিকালে আমি চন্দ্রপুরে আহত ও নিহত সেনাদের আনবার জন্য কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে পাঠাই। কিন্তু তাদের কয়েকজন পাকবাহিনীর হাতে শহীদ হয়। মাত্র ৮ জনের মৃতদেহ নিজ এলাকায় ফিরিয়ে আনতে মুক্তিবাহিনী সক্ষম হয়।
যুদ্ধশেষে পাকবাহিনীর সেনারা মুক্তিবাহিনীর মৃতদেহগুলি আখাউড়া নিয়ে গিয়ে জনতাকে দেখান যে তারা মুক্তিবাহিনীকে হত্যা করেছে। তারা গৌরব অনুভব করে। ভারতীয় গান পজিশনে ৬ জন সৈন্য শহীদ হয়। এতে বোঝা যায় পাকবাহিনীর গোলাবর্ষণ ছিল খুব মাপের এবং দক্ষ সৈন্য দ্বারা পরিচালিত।
এই যুদ্ধের পর বাংলাদেশ বাহিনীর সেনাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। কারন এমনভাবে শহীদ আর কোন রণাঙ্গনে হয় নাই। মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ফিরিয়ে আনতে আমাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল।
(২২ শে নভেম্বরের ঘটনা)
ডাঃ মোঃ রাজিবুল বারী(পলাশ)
<১০, ৪.২.১, ১৪৮–১৫১>
(অনুবাদ)
Daturmura Theatre
(দাতুরমুড়া থিয়েটার)
১। দাতুরমুড়া – এটা বাংলাদেশ ও আগরতলা বর্ডার থেকে ১ মাইল দূরে। এটা কসবা পুলিশ স্টেশনের একটি গ্রামের নাম।। স্থানীয় ভাষায় কোন উঁচু জায়গার চারপাশে যদি নিচু এলাকা বা পানি বেষ্টিত থাকে তাহলে তাকে মুড়া বলা হয়। যে মুড়া সম্পর্কে বলছি সেই নামেই গ্রামটির নাম দাতুরমুড়া। ৯ মাস ধরেই এই এলাকাটি এবং তাঁর আশেপাশে পাকসেনাদের থেকে মুক্ত ছিল – এবং তাই মুক্তিযোদ্ধাদের থেকেও। এখানে মিলিটারি গুরুত্তপূর্ণ নয়। এখান দিয়ে কোন যোগাযোগ পথ ও চলে যায়নি। পাকসেনা ও তাদের দোসরদের ভয়ে গোপীনাথপুর, মানিয়ান্দ, নেমতাবাদ সদ্য আরও অনেক গ্রামের মানুষ এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। যুদ্ধের সময় এই জায়গাটি বাঙ্গালীদের জন্য বেহেস্ত বলা যায়।
২। লন্ডন থেকে মিসেস মেরির নেতৃত্বে একটি যুদ্ধ রীপোর্টার গ্রুপ সেক্টর কমান্ডার খালেদ মশাররফ কে অনুরধ করেন বাংলাদেশের ভেতরে কোথাও শুটিং এর থিয়েটার এর আয়োজন করার জন্য। প্রজেক্ট এর উদ্যেশ্য ছিল মুক্তিবাহিনীর কর্মকান্ড নিয়ে। সেই অনুযায়ী ২ নং সেক্টরের কমান্ডার সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর মুহাম্মাদ আইনুদ্দিণ কে মুক্তি বাহিনীর একটি বেস তৈরি করতে বলেন – এমন একটি জায়গায় যেটিতে শত্রু আক্রমণের সম্ভবনা নেই এবং যেখানে বিদেশী রীপোর্টাররা নিরাপদ। সুদূর লন্ডন থেকে আসা রীপোর্টারের দলটি আমাদের কার্যক্রমের ছবি তোলার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিল। কিন্তু সংগত কারণেই আমরা উৎসাহ দেখাচ্ছিলাম না। আমরা চাইনি একজন বেসামরিক রীপোর্টার – যে দেশের সম্পদ – শুধু তাঁর পেশাগত দক্ষতার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিক। আমাদের যুদ্ধের কারণ ছিল। এটা জাতীয় পর্যায়ের। আমরা বাঙ্গালীরা যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের মাত্রুভুমিকে স্বাধীন করতে না পারব – ততোক্ষণ আমরা বিনা বাঁধায় থাকার জন্য নিজেদের একটি ভূখণ্ড পাবনা – এবং স্বাধীন বাঙ্গালী জাতির স্বাধীন নাগরিক হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করতে পারবনা। অবশ্য কিছু ক্ষেত্রে জাতীয় কারণ ছাড়াও বিশেষ কারণ ছিল। সত্যি বলতে আমি আমার ইস্ত্রি ও দুই কন্যা – যারা আমার জীবনের সব – তাদের কাছে যেতে চাইছিলাম। তারা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এর ইস্পাহানী স্কুলে পাকসেনাদের কাছে বন্দী আছে। আমাকে এ দেশ থেকে দখলদার বাহিনীকে তাড়িয়ে আমার পরিবারকে মুক্ত করতে হবে। কিন্তু রিপোর্টারদের জন্য হয়তো এটি তাদের পেশাগত অথবা শখ – যাই হোক না কেন তারা হয়ত এর জন্য অনেক টাকাপয়সা পাবে। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের জীবন নিয়ে খেলতে পারি কিন্তু তাদের জন্য এটাসঠিক হবে বলে আমাদের কাছে মনে হয়নি। কিন্তু মিসেস মেরী, তাঁর ক্যামেরা ম্যান এবং রেকর্ডার কে মনে হল তারা ঝুঁকি নিয়ে হলেও যাবেন। আমি যতোই জীবনের ঝুঁকির কথা বলি তারা ততই তাদের শুটিং এর কথা বলছিল।
৩। সেক্টর কমান্ডারের কথা অনুযায়ী আমি একটি অস্থায়ী গেরিলা বেইজ তই করি। সেখানে নিম্নোক্ত ব্যাবস্থা ছিল –
ক) সেখানে কিছু রানার আয়োজন থাকবে যাতে মানুষ বুঝতে পারে গেরিলারা নিজেদের রান্না তৈরি করে।
খ) পাকিস্তানের অর্ডিনান্স ফ্যাক্টরি মার্ক চিনহিত কিছু গোলাবারুদের বাক্স থাকতে হবে – যেটা দেখিয়ে বলা হবে যে মুক্তিবাহিনীরা যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানী সৈন্যদের কাছ থেকে এগুলো ছিনিয়ে এনেছে।
গ) কিছু অপ্রস্তুত এলোমেলো বিছানা যেখানে এইমাত্র অপারেশন শেষ করে এসে মুক্তিযোদ্ধারা ঘুমাচ্ছে
ঘ) স্থানীয় প্রতিরক্ষা হিসেবে বেইজের চারপাশে কিছু ট্রেঞ্চ
ঙ) গাছের উপড়ে ১/২ জন মানুষ যারা ওয়াচম্যান হিসাবে কাজ করছে। এই প্রস্তুতির জন্য আমাকে ১ দিন ও ১ রাত সময় দেয়া হল। দিনের বেলায় আমি আমার সফরসঙ্গীদের নিয়ে এলাকাটি রেকু করি এবং দাতুরমুরা কে থিয়েটার হিসাবে নির্বাচন করি।
৪। আয়োজন- আমি সেই গ্রামে ৩” মর্টার সহ ১৫০ জনের একটি কোম্পানি পাঠাই । এক প্লাটুন (তিন প্লাটুন ও হেডকোয়ার্টার কোম্পানি দিয়ে একটি কোম্পানি হয়) ও কোম্পানি হেডকোয়ার্টার রা বেইজ তৈরি করে। বেইজের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন সুবেদার (বর্তমাএ সুবেদার মেজর) তাহের উদ্দিন শেখ। মর্টার দিয়ে আমি সুবেদার (বর্তমানে সুবেদার মেজর) শামসুল হক কে পাঠাই। একটি প্লাটুনকে দাতুরমুরার পশ্চিমে রামপুরে (ছোট) এম্বুশ করতে পাঠাই। আরেকটি প্লাটুনকে দাতুর মুড়ার উত্তরে পাঠাই। জগন্নাথপুরেও আরেকটি এম্বুশ পার্টি পাঠাই। সকল আয়োজন রাতে সঠিকভাবে নির্দিস্ট করা হয়। সকল আয়োজন শেষে সকাল ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে সেক্টর কমান্ডার ও রিপোর্টারদের সেখানে নিয়ে যাবার কথা ছিল এবং আমি সেই অনুযায়ী তাদের নিয়ে যাই।
৫। এটা ছিল সেপ্টেম্বর মাস।আমি তারিখ মনে করতে পারছিলাম না। কিন্তু এটা সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে ছিল। আমি মাধবপুরের কাছাকাছি একটি ঘাটে তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমি ঘাটের নিকট এগিয়ে গেলাম কিন্তু আমি কোন মেয়েকে দেখছিলাম না। তাদের নৌকা ঘাটের কাছাকাছি আসলে আমি একজন মহিলাকে দেখতে পাই কিন্তু তিনি ইউরোপীয় পোষাকে ছিলেন না। তিনি তাঁর পোশাক দিয়ে আমাকে বিস্মিত করেন। তিনি একটি হাফ শার্ট, একটি খাকি ট্রাউজারের সঙ্গে একটি জঙ্গল বুট পরিহিত ছিলেন। পোশাক দেখে মনে হল তার মতো একজন মহিলা একটি সৈনিকের মত কাজ করতে পারেন ।আমার সেক্টর কমান্ডার তাকে পরিচিত করিয়ে দিতেই তিনি হ্যান্ড সেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন এবং তার মুখে একটা হাসি দিয়ে বললেন ‘’হ্যালো কমান্ডার, আপনি ক্যামন আছেন? ‘’ আমি বললাম “ভাল, ধন্যবাদ”। তারপর আমি তার দলের অন্য দুই সদস্য সঙ্গে করমর্দন করলাম। তারা একটি স্ট্যান্ড, একটি স্টিল ক্যামেরা এবং একটি টেপ রেকর্ডার সাথে একটি মুভি ক্যামেরা বহন করছিল। মুভি ক্যামেরাটি অনেক ভারি ছিল। আমি এইসব ভারী লোড নিজেদেরই বহন করতে দেখলাম। আমরা এই যন্ত্র বহন করতে তাদের সাহায্য করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তারা প্রতিবারই ফিরিয়ে দিচ্ছিল আর বলছিল “আপনাকে ধন্যবাদ”।
৬। বেস থেকে ঘাট অবধি আসতে আসতে তিনি সেক্টর কমান্ডারের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত ছিলেন। একসময়ে তিনি আমার দিকে ঘুরে আমাকে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন। সত্যি বলতে, আমি তখন একটু ভয় পেয়ে গেলাম – অন্য কোন কারণে না – তার প্রশ্নের জন্য। আমরা বেসে পৌঁছানোর আগেই এক মুক্তিযোদ্ধা দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে সম্ভাব্য শত্রু এনকাউন্টার সম্পর্কে আমাদের অবহিত করল। তাকে সুবেদার (এখন সুবেদার মেজর) তাহের উদ্দিন শেখ শত্রুদের একটি কোম্পানী জগন্নাথপুর গ্রামে পূর্ব দিক থেকে আসছে এই তথ্য দিয়ে পাঠিয়েছেন। এটি আর শুটিং থিয়েটার থাকল না। আমরা বেস থেকে প্রায় ১০০ গজ ছিলাম। আমরা 3 ইঞ্চি মর্টারের ফায়ারিং শুনতে পেলাম। কমান্ডার আমাকে একটি হাসি দিলেন এবং বললেন “শামসু ইন একশন”। কমান্ডার মিসেস মেরীকে জিজ্ঞেস করলেন “এনকাউন্টার শুরু হয়েছে । আপনি কি এখনও আপনাকে সামনে নিয়ে যেতে জোর করবেন?” মিসেস মেরী বললেন “ওহ! অবশ্যই কর্নেল। ‘’ এই কথা বলতে না বলতেই দুই / তিনটি আর্টিলারি শেল আমাদের পাশে পড়ে। আমি দেখি টেপ রেকর্ডারে রেকর্ডিং শুরু হয়ে গেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম “ম্যাডাম, আপনি কি জানেন কে গুলি চালাচ্ছে? মিসেস মেরী বললেন “আমি স্পষ্টভাবে জানি পাকিস্তান আর্টিলারি । কারণ আপনার কোন আর্টিলারি নেই।
৭. শত্রুর স্বাভাবিক রেটে গুলি চালাতে শুরু করে। আমরা তড়িঘড়ি করে বেস পৌঁছলাম এবং মাটির দেয়ালের একটি বাড়ির ভিতরে লুকালাম। যাইহোক সেটা ছিল আমার থাকার ঘর – সেখানে একটি কম্বল, একটি বিছানার চাদর এবং একটি রাবার বালিশ ছিল। এটি মূলত একটি হিন্দু বাড়ি। এর এক পাশে কার্তিকের মুর্তি ছিল। একটি হাসের মূর্তিও ছিল । আর্টিলারি গোলাবর্ষণ অব্যাহত থাকল। আমি তাদের (সাংবাদিকদের) খালি নিরাপদে সরে যেতে দেবার ব্যাপারে ভাবছিলাম এমন সময় এক সিপাহি এসে জানাল যে শত্রুদের এক টি কোম্পানী আমাদের দ্বারা আটকা পড়েছে। আমি সে যা জানে তাঁর সবটা বলতে বলি। সিপাহী জানাল শত্রুরা একটি দেশী নৌকায় আমাদের অবস্থান থেকে আধ মাইল দূরে এবং আমাদের প্লাটুনের অস্ত্র সীমার বাইরে একটি খাল পারাপার হচ্ছিল। মর্টার পর্যবেক্ষকরা আক্রমণের এই সুযোগ মিস করতে চাইল না। শত্রুরা নৌকায় থাকায় মর্টার ফায়ারিং তেমন কাজ করতে পারছিলনা। কিন্তু বিশৃঙ্খলার বাইরে নয়টি নৌকার একটি ডুবে গেছিল এবং আমরা ভেবেছিলাম সব আরোহী মারা গেছে ।
৮. মিসেস মেরী সোজা ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন এবং সিপাহিকে বললেন তাকে সেই স্থানে নিয়ে যেতে। আমরা সবাই তাকে বোঝালাম যে ফায়ারিং এখনো চলছে। ইতি মধ্যে শত্রুরা দাতুর মুড়া ঠেকলে প্রায় ৬০০ থেকে ৮০০ গজ দূরত্বে একটি মুড়ায় পৌঁছেছে। আমি মিসেস মেরী ও তাঁর লোকদের একটি কাঁঠাল গাছের আড়ালে যেতে বলি। আমি মাথা নিচু করে এক সৈন্য থেকে অন্য সৈন্যের কাছে যেয়ে তাদের উৎসাহিত করছিলাম ও শত্রুদের জানার চেষ্টা করছিলাম। আমি দেখলাম মিসেস মেরী সর্বক্ষন আমাকে ফলো করছেন আর তাকে ফলো করছে তাঁর লোকজন(ফটোগ্রাফার এবং রেকর্ডার) । যে মুহূর্তে শত্রুরা আমাদের সনাক্ত করল সেই মুহুর্তে তারা আমাদের উপর আর্টিলারি আক্রমণ করে। সেসময় মুড়া থেকে মেশিনগানের গুলি আসতে লাগল আমাদের দিকে। শত্রু দেখা মাত্র আমাদের সৈন্যরা রাইফেল ও মেশিনগান দিয়ে তাদের উদ্যেশ্যে গুলি করতে থাকল যদিও সেগুলো ছিল রেঞ্জের বাইরে। তাই আমি তাদের গুলি করতে নিষেধ করি যেহেতু শত্রুরা রেঞ্জের বাইরে ছিল । কিন্তু তারা এতোটাই উজ্জীবিত ছিল যে যখনই শত্রুরা মেশিনগান চালাচ্ছিল তখনি আমাদের বাহিনী রাইফেল দিয়ে পাল্টা জবাব দিচ্ছিল। অনেক চেষ্টা করে আমি আমাদের গুলি করা থামাই।
৯. সেবাহিনীকে যখন জিজ্ঞেস করতাম তারা শত্রুদের কি করেছে তখন তারা সব সময় ই একটু বাড়িয়ে বলত। আমি যদি সংখ্যাটা নির্দিস্ট করে বলতে চাই তবে বলা যায় তারা যতজন এসেছিল সেটা আমাদের চেয়ে দ্বিগুণ শক্তিসম্পন্ন ছিল। গোলাগুলির পড় শত্রু বধের পরিমাণের উপর নির্ভর করে আমরা এই অনুমান করতাম। শত্রু যখন অবস্থান নিয়ে তখন গোলাগুলির শব্দ শুনে এটা করা যেতে পারে।
যাইহোক, মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তান বাহিনীর যুদ্ধের রেকর্ড সংগ্রহ করার জন্য এটি যথেষ্ট উপযুক্ত ছিল। সকল সময় কমান্ডার এবং আমি চিন্তায় ছিলাম হয়ত বা একটি শেলের স্প্লিনটারে এই ডেডিকেটেড প্রফেশনাল লোকগুলো আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারত। স্রস্টা তাদের রক্ষা করেছেন । যুদ্ধের প্রথমে যদিও তারা বুঝিয়েছেন যে তারা যুদ্ধ পরিবেশের সাথে অভ্যস্ত কিন্তু পরে দেখেছি তারা বেসামরিক নাগরিক দের মতই করেছেন ।
১০. এমনকি এই ঘটনার প্রায় দুই ঘণ্টা পড়ও আমি শুনিনি যে জগন্নাথপুর থেকে আমার সৈন্য প্রত্যাহার করা হয়েছে কিনা। আমি তাদের সম্বন্ধে চিন্তিত ছিলাম। সেই প্লাটুন ভেবেছিল যে তারা শত্রু দের ফাঁদে পড়ছে। সুতরাং তারা শত্রু অ্যামবুশ এড়াতে গোপীনাথপুর ও উত্তর মিনারকোটে একটি দীর্ঘ বাঁক তৈরি করে। সুবেদার (এখন সুবেদার মেজর) শামসুল হক ৩ ইঞ্চি মর্টার থেকে প্রায় ৩০ টি বোমা নিক্ষেপ করেন। এবং আসলে শত্রুরা খাল পারের পড় ঐ অবস্থানে নেমেছে। শত্রুর দিকে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি। বিকাল ৩ টা ৩০ মিনিটে খবর পাই শত্রুরা দাতুরমুরায় তাদের সৈন্যদের মুক্ত করার জন্য আরও কিছু সৈন্য পাঠিয়েছে। এই সময়ে সাংবাদিকরা তাদের কাজ করার জন্য যথেষ্ট সময় পেয়েছেন এবং তারা খুশি হয়েছিলেন। আমি আমার কোম্পানীকে সরিয়ে নিতে বললাম।
১১. এই এলাকাটি স্থানীয় এবং বাইরের লোকে পরিপূর্ণ ছিল। যে মুহূর্তে কামান এবং 3 ইঞ্চি মর্টার এবং ছোট অস্ত্র থেকে গুলি বিনিময় হচ্ছিল সেই সময়ে সাধারণ লোকজন আগরতলার দিলে পালাতে শুরু করেন। সেটি খুব চয়ংকর দৃশ্য ছিল। আমি খুব খারাপ অনুভব করছিলাম কিন্তু কিছু করার ছিল না। আমি একটি টেকসই শান্তির জন্য সাময়িক অসুবিধার বিষয়টি মেনে নিলাম। আমি দেখলাম ক্যামেরা ম্যানরা খাদ্য, রন্ধন সামগ্রী এবং প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ভারতে পলায়নরত দের ছবি তুলছিল। এমনকি গরু ও কুকুরও ভারতের মুখে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। দেখা গেল নারীরাও তাদের মাথায় ভারী বোঝা বহন করে বুকে পর্যন্ত গভীর জলের ভিতর দিয়ে হেঁটে জীবন নিয়ে পালাচ্ছিল।
১২। এই যুদ্ধ শুটিং এর জন্য আমরা অনেক কষ্ট ভোগ করি। মৃত্যুর ঝুঁকি প্রসারিত করি। কিন্তু সাংবাদিকরা টতাতেও সন্তুষ্ট ছিল না। তারা মুক্তিবাহিনীর টহল চলছে বা একটি অতর্কিত অ্যামবুশের আরো কিছু শুটিং চালতে চাইছিলেন। কমান্ডার সহ আমরা সকলে এটা দেখলাম। লেডি পরিচালক একটি টহল নেতৃত্ব দেবার সময় লেফটেন্যান্ট কর্নেল (এখন কর্নেল) খালেদ মোশাররফ (সেক্টর কমান্ডার) কে তাঁর মুভমেন্ট সংশোধন করে দিচ্ছিলেন। বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যাবার জন্য অনুরধ করেন। আসলে এত কিছুর পড় তার অনুরধ করার দরকার ছিলোনা। বরং আমি আমার কমান্ডারকে উপেক্ষা করে তাদের যেতে অনুরধ করছিলাম। এমন ধৈর্য দেখানোর জন্য কমান্ডারকে ধন্যবাদ। মিসেস মেরী তার প্রফেশনাল হাসি দিয়ে হ্যান্ড সেকের জন্য আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন এবং বললেন ‘ ধন্যবাদ ক্যাপ্টেন। আপনার জন্য শুভ কামনা। আশা করি আপনি শীঘ্রই আপনার পরিবারের কাছে ফিরে যেতে পারবেন।‘ মাধবপুর ঘাটে তিনি আমার কমান্ডারের সাথে আমাদের ছেড়ে যান।
অপরাজিতা নীল
<১০, ৪.২.২, ১৫১–১৫৩>
৯ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কুমিল্লা শহর দখল
মনতলি (আগরতলা) ক্যাম্প থেকে দু;কোম্পানী সৈন্য নিয়ে আমি সোনামুড়া (ভারত) গেলাম। ২৩শে নভেম্বর সোনামুড়াতে যে ভারতীয় সৈন্য ডিফেন্স নিয়েছিল তাদের কাছ থেকে আমি দায়িত্ব বুঝে নিয়ে বাংলাদেশের দিকে অগ্রসর হই। বাংলাদেশের ভেতর আরও দুটি কোম্পানী পূর্ব থেকেই অবস্থান করছিল। আমাকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে নির্ভয়পুর (ভারতে) যেতে এবং যত তারাতাড়ি সম্ভব কুমিল্লা দখল করার জন্য বলা হলো। আমি ১লা ডিসেম্বর নির্ভয়পুর গেলাম। সেখানে যাওয়ার পর ব্রিগেডিয়ার টম পান্ডে কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম রাস্তার মাঝে ডিফেন্স নিতে বললেন। আমাকে ভারী অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করা হলো। আমি ব্রিগেডিয়ারের নির্দেশ মত ৩ তারিখ রাতে চিওড়া গেলাম। আমরা পৌছালে চিওড়া বাজারে ভারতীয় যে এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য ডিফেন্স নিয়েছিল (পূর্ব থেকেই) তারা তখন অন্যত্র চলে গেল। পাক সৈন্যবাহিনী চিওড়া বাজারের উত্তর দিকে একটি বাজারে ডিফেন্স নিয়েছিল। চিওড়া পৌছানোর পর পরই পাকবাহিনী কোন রকম প্রতিরোধ না করেই পিছনের দিকে চলে গেল। ৫ই ডিসেম্বর সকালে বালুতুফা (কুমিল্লা শহরের পূর্ব পাশে) গিয়ে আমি আমার বাহিনী নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। আমি যখন বালুতুফা পৌছাই তখন সেখানে যে পাকসেনারা বাঙ্কারে ডিফেন্স নিয়েছিল তাঁর দুরত্ব ছিল মাত্র আট মাইল। আমি ভাবলাম যে, পাকসেনারা যে পাকা বাঙ্কারে ডিফেন্স নিয়ে আছে তাদের সরাসরি যুদ্ধ করা অল্পসংখ্যক সেনা নিয়ে সম্ভবপর নয়। তাই পাকসেনাদের পিছনের দিকে দিয়ে কুমিল্লা শহরে ৬ই ডিসেম্বর প্রবেশ করি। এর ফলে বালুতুফার পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং তারপরই আমি আমার বাহিনী নিয়ে কুমিল্লা শহরে প্রবেশ করি। কুমিল্লা শহরের পূর্ব দিক দিয়ে ঢুকে আমার কনভয় নিয়ে কুমিল্লা শহরের পশ্চিম দিকে ৭ই ডিসেম্বর দুপুর ১২টার দিকে পৌছালাম। দুপুর বারোটার দিকে আমার সঙ্গে ভারতীয় শিখ জাট-এর ব্যাটালিয়ন কমান্ডার টমসনের সঙ্গে ব্রীজের কাছে দেখা হয়। শিখ জাট ব্যাটালিয়ন কামান্ডারের কাজ ছিল কুমিল্লা বিমানবন্দর আক্রমণ করা। শিখ জাট ব্যাটালিয়ন কামান্ডার বিমানবন্দর আক্রমণ করেছিলেন ৬ই ডিসেম্বর রাতে। এই আক্রমণে শিখ জাট সেনাদের কয়েকজন আহত ও নিহত হয়। পাকসেনারা বিমানবন্দর ছেড়েচলে যায়। আমার কনভয় যখন কুমিল্লা শহরের পশ্চিমদিকে এগুচ্ছিল তখন শহরের হাজার হাজার জনতা আমাদেরকে স্বাগত জানাতে অগ্রসর হচ্ছিলো। আমি ভাবলাম এ সময় যদি পাকবাহিনী হঠাত করে আক্রমণ করে তবে আমার বাহিনীর পক্ষে ভিড়ের ভিতর সুষ্টুভাবে কাজ করা দুরহ হয়ে পড়বে। এই কথা চিন্তা করে আমি কনভয়ের সামনে এসে জনতাকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করতে এবং সামনে না আসতে অনুরোধ করলাম। আমি আরও বললাম যে, আমরা প্রথমে শহর সম্পূর্ণ শক্রুমুক্ত করি। কিন্তু জনতা একথা প্রথমে শুনতে নারাজ হওয়ায় বাধ্য হয়েই আমাকে তাদের উপর বলপ্রয়োগ করতে হলো। জনতা শেষ পর্যন্ত ফিরে গেল। তবে জনতা আমাদের উপর একটু মনঃক্ষুন্ন হলো।
৭ই ডিসেম্বর বিকাল পাঁচটায় জেনারেল আরোরা হেলিকপ্টারযোগে কুমিল্লা বিমানবন্দরে অবতরন করেন। ঐ সময় কুমিল্লা শহরের শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সকল স্তরের পুরুষ ও মহিলা ফুলের মালা হাতে করে রাস্তায় নেমে গেছে ভারতীয় ও বাংলাদেশ সেনাদের মালা দেয়ার জন্য।
আমি এ সময় সাধারণ পোশাক পরে বিমানবন্দরের গেটে এ দৃশ্য দেখছিলাম। এমন সময় জেনারেল আরোরা আমাকে ডেকে পাঠান। জেনারেল আরোরা আমাকে কুমিল্লা শহরের সম্পূর্ণ শান্তি-শৃংখলা আয়ত্তে আনার দায়িত্ব দিয়ে তিনি হেলিকেপ্টারে পুনরায় চলে গেলেন। এরপরই জনতা আমাকে চিনতে পারল। জনতা আমার গলায় মালা দেয়ার জন্য ভিড় জমালো। আমি ভিড় ঠেলে বের হয়ে আসলাম। ঐদিনই ৭ই ডিসেম্বর আমি শহরে এসেই সমস্ত সোনার দোকান সীল করে দিলাম। যতদিন পর্যন্ত না বাংলাদেশ সরকার থেকে কোন রকম আদেশ না আসে ততদিন পর্যন্ত পাক আমলের এস-পি, ডি-সিকে কাজ চালিয়ে যাবার নির্দেশ দিলাম।
এ সময় কুমিল্লায় তেমন কোন পুলিশ ছিল না। এম-পিকে সাহায্য করার জন্য বাংলাদেশ সেনারা সব সময় এগিয়ে আসত। তখনও পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করে নাই। পাকসেনারা সেকোন সময় আক্রমণ করতে পারে, সেজন্য সতর্ক থাকার জন্য নাগরিকদেরকে মাইকযোগে জানিয়ে দিলাম। বিমান আক্রমণ বা অনুরূপ ধরনের আক্রমণ হলে সবার বাড়িতে পরিখা খনন করার জন্য নির্দেশ দিলাম।
৭ তারিখ থেকে আমি আমার বাহিনী নিয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ করার জন্য ডিফেন্স নিয়েছিলাম এবং আক্রমণের প্রস্তুতিও নিচ্ছিলাম। কিন্তু ১৩ই ডিসেম্বর ভারতীয় হাইকমান্ড
থেকে জানানো হলো যে, কুমিল্লা সেনানিবাস আক্রমণ করতে হবে না। জেনারেল আরোরা প্রচারপত্র বিলি করছেন এবং রেডিওতে ঘোষণা করছেন যাতে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এই নির্দেশের পর আমি পাকসেনানিবাস আক্রমণ করার পরিকল্পনা বন্ধ করি। ১৬ তারিখে যখন পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করে তখন কুমিল্লা সেনানিবাসে উপস্থিত ছিলাম।
স্বাক্ষরঃ মেজর আইনউদ্দিন
২৬-১০-৭৩
আতিকুল ইসলাম ইমন
<১০, ৪.৩, ১৫৩–১৭০>
সাক্ষাৎকারঃ মেজর গাফফার
জুন মাসের শেষে শালদা এক রকম আমার নিয়ন্ত্রণেই ছিল আমি আমার নিজ সাবসেক্টর রেকি করে জানতে পারি, শালদা নদী গোডাউনে ৩০০০ মণের মত গম এবং চাল মজুদ আছে। খাদ্যসামগ্রীর প্রয়োজন আমাদের অতিরিক্ত ছিল। কেননা এতদিন পর্যন্ত স্থানীয় লোকের খাদ্যসামগ্রীর উপর নির্ভর করেই আমরা জীবনধারণ করছিলাম। তারা যা খেতে দিত তাই আমরা খেতাত জনসাধারণের এ সহযোগিতা না পেলে আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারতাম না। কিন্তু জনসাধারণের খাদ্য সাহায্য পর্যাপ্ত ছিল না। অনেক সময় আমাদের ফলমূল ও পানি খেয়েই জীবনধারণ করতে হয়েছিল।
শালদা নদী গোডাউনে খাদ্যসামগ্রীর কথা আমার সেক্টর কামান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফকে জানাই। তিনি আমাকে নির্দেশ দেন ৩০০০ মণ গম ও চাল যেন তাড়াতাড়ি সেক্টর হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আমি শালদা নদী গিয়ে ৩০টা নৌকা যোগাড় করে স্থানীয় এবং আমার সৈনিকদের সাহায্যে সমস্ত খাদ্যসামগ্রী নৌকাতে বোঝাই করি। কিন্তু স্থানীয় দালালরা আমাদের এ খাদ্যসামগ্রী সরানোর খবর কুটিতে অবস্থিত শক্রুসেনাদের জানায়। শক্রুরা কুটি থেকে গোলান্দাজ বাহিনীর সাহায্যে কামান থেকে আমাদের উপর গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এ গোলাগুলির মধ্যে আমরা সুন্দরভাবে আমাদের কাজ সম্পন্ন করি।
আমি কসবাতে দুটি কোম্পানী গঠন করি। একটি কোম্পানী ৪র্থ বেঙ্গল-এর ‘সি’ কোম্পানী নিয়ে গঠিত ছিল-অপর কোম্পানী ই-পি-আর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ এবং স্থানীয় লোকদের নিয়ে। আমি তাদের একমাস ধরে ট্রেনিং দেই এবং কোম্পানীতে অন্তর্ভুক্ত করি। তাদেরকে শক্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বিভিন্ন অপারেশনে পাঠাতে শুরু করি। ঐ সমস্ত গ্রামের লোকেরা শক্রুদের গতিবিধির খবর দিয়ে, খাবার দিয়ে, আশ্রয় দিয়ে, বস্ত্র দিয়ে আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করেছিল।
আমি কসবার উপর আমার নিয়ন্ত্রন চালিয়ে যেতে থাকি। শক্রুরা যখনই প্রবেশের চেষ্টা করেছে তখনই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে তারা পশ্চাদপসরণ করেছে। আমি ঐ এলাকার রেললাইন তুলে ফেলে, রেললাইনের সেতু ও রাস্তার সেতু ভেঙ্গে দিয়ে শক্রুদের যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেই। ইলেক্ট্রিক পাইলন, টেলিগ্রাফ ও টেলিফোনের থামও উড়িয়ে দেই। এ সমস্ত করার ফলে শক্রুরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হয়।
আমার কোন টেলিফোন সেট ছিল না। কিন্তু একমাসের মধ্যে শক্রুদের উপর হামলা চালিয়ে অনেক ক্যাবল ও টেলিফোন সেট দখল করি এবং তাঁর পরই আমি বিভিন্ন কোম্পানীর মধ্যে যোগাযোগ করার জন্য টেলিফোন লাইন স্থাপন করি। এর ফলে আমার বাহিনীকে নেতৃত্ব ও নির্দেশ দেওয়া আমার পক্ষে অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল) আমাদের নির্দেশ দেন, শক্রুদের সাথে সামনাসামনি লড়াই না করে তাদের উপর আচমকা আক্রমণ চালাবার। তিনি এয়াম্বুশ, রেইড ও সেতু ধ্বংস, যাতায়াতের ক্ষতিসাধন ইত্যাদির উপর জোর দেওয়ার নির্দেশ দেন। এর ফলে শক্রুদের ক্ষতি হবে ব্যাপক এবং সে অনুপাতে আমাদের ক্ষতি হবে সামান্য। এ কৌশল খুবই উপযোগি হয়েছিল। এতে আমাদের সৈনিকদের মনোবল বেড়ে যায়। প্রতিদিন প্রতিরাতে শক্রুদের ওপর আচমকা আক্রমণ চালিয়ে তাদের অনেকেই নিহত বা আহত করছিলাম। শক্রুরা এক স্থান থেকে আরেক স্থান গেলে আমরা এয়ম্বুশ পেতে বসে থাকতাম এবং শক্রুরা এম্বুশের ফাঁদে পড়লে তাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের ধ্বংস করতাম। আমি তাদের অবস্থানের উপর আক্রমণ চালাতাম প্রায় রাতেই। ফলে শক্রুরা রাত্রিবেলা বাঙ্কার থেকে বাইরে আসতো না। এমন কি দিনের বেলা এক প্লাটুন শক্তি ছাড়া তারা বের হতে চাইত না।
একদিন পাকসেনারা আমার ডানপাশের সাবসেক্টর মনতলির সাবসেক্টর কামান্ডার আইনউদ্দিনের বাহিনী দ্বারা এয়াম্বুশ ফাঁদে পড়ে আক্রান্ত হয়। শক্রুদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। তারা আহত এবং নিহত সৈন্যদের ১টা রেলওয়ে ট্রলিতে ভর্তি করে রেললাইনের ধার দিয়ে পালাতে থাকে। আমি তালতলা আড়াইবাড়ীতে এয়াম্বুশ পেতে তাদের উপর আক্রমণ চলাই। আবার আক্রান্ত হবার ফলে তাদের আহত ও মৃত সাথীদের ফেলে পলায়ন করে। পরবর্তী সময়ে পাকসেনারা তাদের মৃত সাথীদের কবর দেয়ার জন্যে গঙ্গাসাগরের এক কবরস্থানে জড় হয়েছে। আমার কয়েকজন গুপচর এসে আমাকে এ খবর জানায়। আমরা সঙ্গে সঙ্গে অবস্থান নিয়ে দেখতে পাই সত্যিই শক্রুরা কবরস্থানে জড় হয়েছে তাদের সাথীদের কবর দেবার জন্য। আমি ৩” মর্টার এবং ভারী মেশিনগানের সাহায্যে শক্রুদের উপর আকস্মাত গোলাগুলি ছুড়তে থাকি। ফলে পাকসেনারা তাদের পুরাতন মৃত সাথিদের সঙ্গে আরো কয়েকজন নতুন সাথীকে কবর দেয়।
পাকসেনারা তাদের ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে কুটি সড়কের উপরে এবং মুল ঘাঁটি স্থাপন করে আড়াইবাড়িতে টি, আলীর বাড়িতে। সে সময়ে সমগ্র শালদা নদী এলাকা নয়নপুর রেলওয়ে ষ্টেশন পর্যন্ত আমার নিয়ন্ত্রণে ছিল। তারা শলদা নদী পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে এবং সেজন্য এক কোম্পানী সৈন্যকে আড়াইবাড়ি থেকে জেলা বোর্ডের রাস্তা শালদা নদীর দিকে এগোতে থাকে। মনোলোবাগ রেলওয়ে ষ্টেশনের নিকট একটা প্লাটুন আগে থেকেই রেখেছিলাম। যখন শক্রুরা মনোলোবাগ রেলওয়ে ষ্টেশনের পাশের গ্রামে পৌছায় তখন তারা আমাদের এয়াম্বুশে পড়ে যায়। আমরা তাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে একটি জীপ এম ৩৮ এআই, একটি ৩/৪ টনের ডজ ধ্বংস করে দেই। একজন অফিসারসহ ১৭জন নিহত হয় এবং ২০ জনের মত আহত হয়। আমরা গাড়ি নিয়ে আসতে পারিনি, কেননা শক্রুরা গোলান্দাজ বাহিনীর সাহায্যে আমাদের উপর গোলাবর্ষণ করছিল। ফলে গাড়িগুলি পুড়িয়ে দেয়া হয়। পরে আমরা অনেক অস্ত্রশস্ত্র, টেলিফোন সেট, টেলিফোন ক্যাবল, শক্রুদের শুকনা রেশন, গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র উদ্ধার করি। শক্রুদের বিচানাপত্র উড়িয়ে দেয়া হয়। আমরা একটা স্যুটকেস পাই গাড়ির ভিতর থেকে। স্যুটকেসটি টাকা ভর্তি ছিল কিন্তু তাকাগুলি গোলাগুলির ফলে পুড়ে গিয়েছিল। আমি সমস্ত কিছু আমার সেক্টর কামান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের হাতে তুলে দেই। ঐ টাকা ভর্তি স্যুটকেসটি দেখে আমাদের ধারনা হয় ঐ পাকিস্তানী অফিসারটি এসব টাকা ব্যাংক থেকে লুট করেছিল। পরে তারা বারবার চেষ্টা করেছিল শালদা নদীর অবস্থান দখল করার কিন্তু তারা বারবারই পর্যুদস্ত হয়ে ফিরে যায়।
সমগ্র কসবা ও শালদা নদী এলাকা জুলাই মাস পর্যন্ত আমার নিয়ন্ত্রণে ছিল। লাটুমুড়া পাহাড়ী যায়গাটি আমার নিয়ন্ত্রণে রাখি। শক্রুর যদি লাটুমুড়া দখল করে নেয়, তবে ক্ষতি হবে। সেজন্য আমি একটি কোম্পানী তৈরী করে দুটি প্লাটুন সেখানে রাখি প্রতিরক্ষাব্যুহ শক্তিশালী করার জন্য। ফেনী মুন্সিরহাটে যাবার আগে কসবা সাব-সেক্টরের ভার ক্যাডেট হুমায়ুন কবিরের হাতে দিয়ে যাই।
ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের (বর্তমান মেজর) অধিনায়কত্বে মুন্সিরহাট ফেনী সাবসেক্টর একটা গুরুত্বপূর্ণ ও উত্তেজনাকর স্থান হয়ে দাঁড়ায়। ফেনী থেকে তিন মাইল দূরে চাগলনাইয়া, মুন্সিরহাট ও লক্ষীপুরে ১৭ মাইল লম্বা এবং ৮ মাইল প্রস্থ এই বিরাট অবস্থান জুড়ে বসে আছেন ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম ও তাঁর বাহিনী। পাকসেনারা এ অবস্থানের উপর বিরাট শক্তি নিয়ে চাপ দিতে থাকে। ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম তাঁর দু’জন অফিসার ও তিনটি কোম্পানি নিয়ে শক্রুদের কামান ও ট্যাঙ্কের সাথে চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ২ নং সেক্টরের অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফের কাছে ফেনী মুন্সিরহাট অবস্থান রক্ষা করা এক চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এ মুহূর্তে এখানে আরও শক্তির প্রয়োজন হয়ে পড়ে। রাত দু’টার সময় মেজর খালেদ আমার ক্যাম্পে আসেন। আমি তখন ক্যাম্পে ছিলাম না, অপারেশনের জন্য বাইরে ছিলাম। যখন একশন করে ফিরে আসি তখন দেখি তিনি ফেনীর একটা ম্যাপ খুলে চিন্তিত মুখে বসে আছেন। তাঁকে খুব চিন্তিত এবং বিষন্ন দেখাচ্ছিল।
তিনি ধীরে এবং দ্রুত ফেনী অবস্থানের পরিস্থিতির কথা বলে গেলেন এবং কি করা যায় তার একটা পরামর্শ চাইলেন। একটা কোম্পানী ফেনীতে দ্রুত পাঠিয়ে দিতে তাঁকে অনুরোধ করলাম। মেজর খালেদ আমাকে একটা কোম্পানীসহ সেখানে যাবার জন্য বললেন। আমি এটা আগেই বুঝেছিলাম কিন্তু কসবার ভার কার হাতে দেয়া যায় এ নিয়ে একটু দ্বিধা ছিল। কেননা কোন নতুন অফিসারের পক্ষে কসবা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভবপর ছিল না। যা হোক ক্যাডেট হুমায়ুন কবিরের হাতে ( বর্তমানে ক্যাপ্টেন) আমার ১ নং কোম্পানী ও কসবা সাবসেক্টরের ভার দিয়ে আমি সকালে একটি কোম্পানী নিয়ে ফেনীর দিকে রওয়ানা হই। যাবার সময় আমার ২নং কোম্পানীকে সমস্ত পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলি। আমি ক্যাডেট হুমায়ুন কবিরকেও সমস্ত পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলি এবং লাটুমুড়া অবস্থানের গুরুত্ব সম্পর্কে তাঁকে বলি। এ জায়গাটা ছিল পাহাড়ের উপর। এখান থেকে সমগ্র স্থান নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ ছিল। পাকসেনারা এ স্থান পুনরুদ্ধারের জন্য চেষ্টা চালাবে। কেননা এর আগে তারা অনেক বার চেষ্টা চালিয়ে সফল হতে পারেনি। কিন্তু অত্যান্ত আশ্চর্যের ব্যাপার আমরা কসবা ছেড়ে যাবার পর এক সাপ্তাহের মধ্যে শক্রুরা লাটুমুড়া দখল করে নেয় এবং ১নং কোম্পানীর কয়েকজন সাহসী যোদ্ধা এতে মারা যায়। নভেম্বর মাস পর্যন্ত পাকসেনারা লাটুমুড়ার উপর কতৃত্ব রেখেছিল। ভারত এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দুটি ব্যাটালিয়ন শক্তি নিয়ে নভেম্বর মাসে শক্রুদের সরিয়ে দিতে পারা যায়। শক্রুদের সরাতে ৩ জন অফিসারসহ ৪০ জন সৈন্য মারা যায় এবং ৬০ জনের বেশি আহত হয়। লাটুমুড়া অবস্থানের গুরুত্ব এ হতাহতের থেকেই বুঝা যায়। শক্রুদের কতজন মারা গিয়েছিল তা আমার জানা নাই।
যাই হোক, পরের দিন সকালে ২ নং কোম্পানীকে সাথে নিয়ে ফেনীর পথে রওনা দির। ৬ই জুন সন্ধ্যা ৫টার সময় বেলুনিয়া পৌছি। তারপর ১৪ মাইল কাদামাটির রাস্তা ভেঙ্গে আমি এবং আমার সৈন্যরা রাত ৮টার সময় মুন্সিরহাট নুতন বাজার পৌছি, যা জাফর ইমামের অবস্থান থেকে ৮০০ গজ দূরে ছিল। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আমরা কোন বিশ্রাম নেইনি এবং পেটেও কিছু পড়েনি। আমার কোম্পানীকে আমি এখানে বিশ্রাম নিতে বলি। তারপর আমরা ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের সাথে দেখা করার জন্য তাঁর ক্যাম্পের দিকে রওনা হই। তাঁর সাথে দেখা করে অবস্থানটি দেখি। প্রতিরক্ষাব্যুহ দেখে আশ্চর্যবোধ করি। প্রতিরক্ষাব্যুহ খুব শক্তিশালী ছিল না। মুল অবস্থানের ডানদিকে একেবারে ফাঁকা এবং খোলা অবস্থায় ছিল। বাঁয়ে অবস্থানরত লেঃ ইমামুজ্জামানের বাহিনীর সাথে জাফর ইমামের বাহিনীর দুরত্ব অনেক ছিল। এত দুর্বল অবস্থানের জন্য ক্যাপ্টেন জাফর ইমামকে দোষ দিতে পারি না কেননা সৈন্যসংখ্যা ছিল সীমিত। যাহোক প্রতিরক্ষাব্যুহকে সুদৃঢ় করার জন্য আমি ক্যাপ্টেন জাফর ইমামকে নিম্নোক্ত ব্যাবস্থা নিতে বলি।
(ক) আমার কোম্পানী থাকবে অবস্থানের ডানদিকে। দুটি প্লাটুন উপরে এবং ১টি প্লাটুন ভিতরে।
(খ) ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের বাহিনী তাঁর অবস্থানেই থাকবে কিন্তু সৈন্যদের আরো সংগঠিত করতে হবে। ডিফেন্স ভিতরেই নিতে হবে।
(গ) লেঃ ইমামুজ্জামান বাঁয়ে থাকবে কিন্তু দুরত্বটা কমিয়ে আনতে হবে। ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের বাহিনীর সাথে সংযোগ রাখতে হবে।
(ঘ) মুন্সিরহাটের নিকটে মূল অবস্থানের সাথে সংযোগ রেখে ক্যাপ্টেন শহীদের বাহিনী অবস্থান নেবে।
কিন্তু ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম আমার পরিকল্পনা মেনে নেয় না। আমি এরপর মেজর আমিনের কাছে যাই এ ব্যাপারে পরামর্শ নেবার জন্য। মেজর আমিন তখন ঐ অঞ্চলের কামান্ডার ছিলেন। মেজর আমিন ও ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম বুঝতে সক্ষম না হয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। মেজর খালেদ তখন সেখানে ছিলেন না।
সময় খুব সঙ্কটজনক থাকায় দেরি না করে আমি আমার একটা প্লাটুনকে ডানদিকে একিনপুরে অবস্থান নিতে বলি। ১টা প্লাটুনকে ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম ও লেঃ ইমামের ফাঁকা স্থানে অবস্থান নিতে বলি এবং আরেকটা প্লাটুন মুন্সিরহাটে অবস্থান নেয়। পাকসেনারা যেকোন মুহূর্তে আমাদের আক্রমণ করতে পারে। এই নতুন অবস্থানের পর মোটামুটি আশ্বস্ত হই কিন্তু পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। তার উপর আমাদের কোন ভারী অস্ত্রশস্ত্র ছিল না, কেবলমাত্র ৩ইঞ্চি ৮১ এম-এম মর্টার ছাড়া। শক্রুরা প্রতিদিন আমাদের উপর ছোট ছোট আক্রমণ চালাতে থাকে এবং আমরাও এম্বুশ এবং আচমকা আক্রমণ চালিয়ে তাদের পর্যুদস্ত করতে থাকি। শক্রুরা গোলান্দাজ বাহিনীর সাহায্যে কামান দিয়ে আমাদের উপর গোলা ছুড়তে থাকে এবং প্রতিদিন আমাদের কিছু কিছু লোক আহত হয়। শক্রুদের হতাহতের সংখ্যা ছিল প্রচুর। এ সময় মেজর খালেদ আমাদের অবস্থান দেখতে আসেন এবং আমি সমস্ত পরিস্থিতি তাঁকে খুলে বলি। আমি আমার পরিকল্পনার কথা তাঁকে বলি এবং তিনি আমার পরিকল্পনা মেনে নেন। কিন্তু এবারও ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম পরিকল্পনা মেনে নিতে রাজি হয় না। কিন্তু ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম স্থানীয় লোক হওয়ায় মেজর খালেদ তাঁকে আর চাপ দেয় না। যাই হোক, আমাকে আমার পুরাতন অবস্থানই রাখতে হলো। আমরা মেজর আমিনকে খাদ্য ও বস্ত্র সরবরাহের দিকে লক্ষ্য রাখতে বললাম। এ অবস্থানে আমরা কয়েকদিন অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। তখন ছিল বর্ষাকাল। রাস্তাঘাট কাদায় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অস্ত্রশস্ত্র ১৪ মাইল দূরে বেলুনিয়া থেকে কাঁদা ভেঙ্গে আনতে হত। এ অসুবিধা সত্ত্বেও মেজর আমিন যতখানি পেরেছেন আমার জন্য করেছেন। তিনি কাঁদার রাস্তা ভেঙ্গে যত দ্রুত অস্ত্রশস্ত্র ও খাবার পৌছানো যায় তার ব্যবস্থা করেছেন। ভারতীয় বাহিনীর গলান্দাজ বাহিনীর যাতে সাহায্য পাওয়া যায় তার চেষ্টা আমরা করেছিলাম কিন্তু তা সফল হয়নি। গোলান্দাজ বাহিনীর সাহায্য না পেলেও মিত্র বাহিনীর সেনারা মর্টারের সাহায্যে তাদের উপর গোলা ছুড়ছিল। এটা আমাদের মনোবল বাড়াতে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। আমার সৈনিকরা এত উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিল যে তারা বাঙ্কার ছেড়ে বেরিয়ে এসে বলতে থাকে, “স্যার ভারতী বাহিনী যদি আমাদের সাহায্য করে, তবে আমরা আজই ফেনী দখল করে নিতে পারব।” কিন্তু এটা যে সম্ভব নয় তা আমার সৈন্যদের বুঝানো মুশকিল হয়ে পড়েছিল।
আমাদের অস্ত্রশস্ত্র ছিলো পুরান আমলের এবং অতি সামান্য। সে তুলনায় শক্রুদের শক্তি ছিলো একটা ব্রিগেড, এক রেজিমেন্ট আর্টিলারী ও ট্যাঙ্ক বাহিনী। এ ছাড়া ছ’টি হেলিকপ্টার ছিল শক্রুসেনাদের এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাবার জন্য। মর্টার ছাড়াও কিছু মেশিনগান ও হালকা মেশিনগান আমাদের সঙ্গে ছিল।
যাহোক, আমরা আচমকা আক্রমণ চালিয়ে শক্রুদের ব্যাতিব্যস্তরাখছিলাম। আমরা প্রতিদিন তাদের অনেককেই হতাহত করছিলাম। তাদের শক্তি অত্যাধিক হওয়ায় তারা হতাহতের স্থান পূরণ করতে পারছিল। আমাদের হতাহতের সংখ্যা সামান্য হলেও তা পূরণ করতে আমরা সমর্থ ছিলাম না। আমরা চিন্তা করছিলাম শক্রুরা যেকোন মুহূর্তে প্রবল শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ‘৭১ এর ১৭ই জুন সকালে শক্রুরা গোলান্দাজ বাহিনীর কামানের সাহায্য নিয়ে আমাদের উপর আক্রমণ শুরু করেছিল। কামান ছাড়াও শক্রুদের আর-আর, মর্টার,মেশিনগান, চাইনিজ রাইফেল তো ছিলোই। আমাদের অবস্থানের অবস্থা থেকে সহজেই বুঝা যায় এ এক অসম যুদ্ধ। পাকিস্তানী সৈন্যরা ৭ ঘন্টা ধরে স্রোতের মত এগোতে থাকে। সাত ঘন্টা পর আমাদের হাতে চরম মার খেয়ে তারা পিছু হটে যায়। এমনকি তারা তাদের অনেক মৃতদেহ ইলোনিয়া নদী ও অন্যান্য স্থানে ফেলে রেখে পালায়। মৃতদেহগুলি পড়ে শকুন ও কুকুরে খায়।
পাকিস্তন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ খান তখন ঢাকাতে ছিলেন। ফেনীর খবর শুনে তিনি নিজে এর গুরুত্ব বুঝাবার জন্য ফেনীতে আসেন। তিনি ফেনীতে এসে ধারণা করেন মুজিবনগর আশেপাশেই আছে। সেহেতু মুন্সিরহাট দখল করার জন্য তিনি নিজে এবং দু’জন ব্রিগেডিয়ারকে নিয়ে আমাদের তিনজন ক্যাপ্টেন ও একজন লেফটেন্যান্টের বিরুদ্ধে লড়াই করে বুঝিয়ে দেন যে বঙ্গশারদুলরা তাদের থেকেও কম নয়। এ যুদ্ধ আমাদের জন্য এক বিশাল গৌরব। এ যুদ্ধে পাকিস্তানের এক ব্যাটালিয়নের নেতৃত্ব দেন ফ্রন্টিয়ার ফোরসের মেজর আশিফ, যার সাথে আমরা একসঙ্গে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ছিলাম।
এসময় আমাদের সেক্টর-২ এর কামাণ্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ খবর পাঠান যে, ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলের প্রধান জেনারেল আরোরা হেলিকপ্টার করে আমাদের অবস্থান দেখতে আসতে পারেন। তাঁর হেলিকপ্টারে গুলি না চালানোর নির্দেশ দেন। কিন্তু আমার মনে হয় পাকসেনারা এ খবর পেয়ে গিয়েছিল, ফলে তিনি আর আসতে পারেননি।
তখন ছিল বর্ষাকাল। ২০শে জুন সারাদিন সারারাত ধরে বৃষ্টি হচ্ছিল। ২১শে জুনের আকাশ ছিল মেঘলা এবং ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি সকাল থেকে অস্বস্তি বোধ করছিলাম। সমস্ত যুদ্ধক্ষেত্র জুড়ে বিরাজ করছিল অস্বস্তি। আমি ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের কাছে যাই সমস্ত পরিস্থিতি সম্বন্ধে আলোচনার জন্য। বিকেল ৫টা সময় আমি আমার অবস্থানে ফিরে আসি। আমি আমার সমস্ত
কামান্ডারকে ডেকে পাঠাই। রাত্রে আমরা আমাদের অবস্থানে আলো জ্বালাতাম না, কেননা আলো শক্রুদের দৃষ্টিগোচর হবার সম্ভাবনা ছিল। তাই খাওয়াদাওয়া আলো শেষ হবার আগেই সেরে ফেলতে হত। আমার বাঙ্গারে যখন ২টা রুটি ডাল সহযোগে খেতে বসেছি তখন হেলিকপ্টারের আওয়াজ শুনতে পাই। আমার আরদালী দৌড়াতে দৌড়াতে এসে খবর দেয় দুটি হেলিকপ্টার আমার হেডকোয়ার্টারের পিছনে উড়ছে- যা পশ্চিম দিক অর্থাৎ ভারতের দিক থেকে আসছে। আমি ভাবলাম ২৪ ঘন্টা অতিরিক্ত বৃষ্টি হবার জন্য হয়ত জেনারেল আরোরা কাল আসতে পারেন নি, আজ আস্তে আস্তে বৃষ্টি হচ্ছে তাই এসেছেন। এ চিন্তা করে কিভাবে সম্বর্ধনা জানাবো ভেবে হেলিকপ্টারের দিকে দৃষ্টি রাখি। হেলিকপ্টার দুটি নিচু দিয়ে ১৮০ ডিগ্রি যাবার পর দুটি দুদিকে যায়। ১টি হেলিকপ্টার বাঁ অবস্থানে পূর্বদিকে এবং অন্যটি আমার হেডকোয়ার্টারের উপর দিয়ে উত্তর দিকে ১০০০ গজ পর্যন্ত যায়। সন্দেহ জাগে দুটি হেলিকপ্টার দু’জায়গায় নামছে কেন? হঠাত আমার মনে সন্দেহ জাগে এবং আমার বিশেষ প্লাটুনের কামান্ডার নায়েক সুবেদার শহীদকে ডেকে পাঠাই। ১৫ মিনিট অতিক্রান্ত হবার পর দেখি দুটি হেলিকপ্টারই ভারতীয় সীমান্তের দিকে যাচ্ছে। হঠাত বাঁ দিক ও পিছন দিক থেকে গুলি আসতে থাকে। তখন ছিল অন্ধকার। শক্রুরা গ্রেনেড, এম-জি ও হালকা মেশিনগানের সাহায্যে আমাদের উপর গোলাগুলি ছুড়তে থাকে। আমি সহজেই বুঝতে পারি এটা পাকিস্তানী কমান্ডোদের কাজ। আমি বুঝতে পারি এটা জেনারেল আরোরার হেলিকপ্টার নয়, শক্রুরা হেলিকপ্টারের সাহায্যে পেছনে অবস্থান নিয়েছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে নায়েক সুবেদার শহীদ এবং ই-পি-আর এর সুবেদার ফরিদ আহমেদকে নির্দেশ দেই সমস্ত সৈন্যদের অতিসত্বর আমার নিকট হাজির করার জন্য। তারা সমস্ত পরিস্থিতি বুঝতে পারে এবং ১০ মিনিটের মধ্যে এসে খবর দেয়। আমি দ্রুততার সঙ্গে নতুনভাবে আমার বাহিনীকে সজ্জিত করি। প্রধান রাস্তা এবং রেললাইনের উপর তাদের অবস্থান নিতে বলি এবং আরও বলি আমি গুলি চালালে তোমরা গুলি চালাবে। এ রাত ছিল খুবই অন্ধকার এবং কোন কিছু দেখা যাচ্ছিল না। আমি আমার বাহিনীর দ্বিতীয় প্রধান (সেকেন্ড-ইন কামান্ড) সুবেদার খুরশিদ আলমকে উত্তর এবং পশ্চিম দিকের প্রতি নজর রাখতে বলি এবং আমি পূর্ব এবং দক্ষিণ দিকে নজর রাখি। পাক কামান্ডোদের হামলার অপেক্ষা করতে লাগলাম। এ আমার জিবনে এক চরম পরীক্ষা ছিল। একটু ভুল করলে আমরা সবাই ধ্বংস হয়ে যাব। সে রাতের কথা মনে পড়লে আজও আমার শিরন জাগে। এ সময়ে ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম আমার কাছে খবর পাঠান যে তিনি এফডিএল-এর (ফরোয়ার্ড ডিফেন্ডেড লোকালটি) পথ দিয়ে এগোচ্ছেন।
পাক গোলান্দাজ বাহিনী কামান, মর্টার, আর-আর-এর সাহায্যে আমাদের উপর অবিরাম বৃষ্টির মত গোলা ছুড়তে শুরু করে দিয়েছে। বৃষ্টির মত গুলাগুলি ২ ঘণ্টা ধরে চলে। কিন্তু আমরা তাদের সামনে অগ্রসরের চেষ্টা রুদ্ধ করে দেই। ইতিমধ্যে দ্বিতিয়বারের মত হেলিকপ্টারের সাহায্যে পাকবাহিনী পিছনে আবার তাদের কামান্ডোদের নামিয়েছে। রাত ৯টার সময় লেঃ ইমামুজ্জামানের কাছ থেকে খবর পাই তারা পাকসেনা কতৃক আক্রান্ত হয়েছে। ইতিমধ্যে মর্টার সেকসনের কামান্ডার সুবেদার জব্বার খবর পাঠায় যে, মর্টার সহযোগিতা করা আর সম্ভব নয়, কেননা ইতোমধ্যে সমস্ত মর্টার শেষ হয়ে গেছে। সাহায্য পাবার আশা না থাকায় আমি একিনপুর থেকে অবস্থান সরিয়ে নেই। লেঃ ইমাম আমাকে ফোনে খবর পাঠায় পাক কামান্ডোরা সামনে থেকে তাদের আক্রমণ চালিয়েছে এবং পাঠাননগরের দিকে এগোচ্ছে। তার কাছে আর গোলাবারুদ নেই। আমাকে সে অনুরোধ জানায় কিছু গোলাবারুদ যেন অতি সত্বর ইমামুজ্জামানের কাছে পাঠায়। লেঃ ইমাম আমাকে আরো জানায় ছাগলনাইয়া থেকে মুহুরী নদীতে যে প্রতিরক্ষাব্যূহ ছিল তা সন্ধ্যায় সরিয়ে নেয়া হয়েছে। যোগাযোগের অভাব হেতু সে এ খবর আগে পাঠাতে পারেনি। প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেঙ্গে যাওয়ায় সে ফুলগাজির দিকে চলে যাচ্ছে। আমি আমার ডাকপাশের বাহীনিকে অবস্থান তুলে নিয়ে মুহুরী নদী হয়ে ফুলগাজিতে অবস্থান নিতে বলি।
রাত ৯টার দিয়ে আমার হেডকোয়ার্টার কামাণ্ডোদের দ্বারা আক্রন্ত হয়ে। পাঠাননগর অগ্রসরমান শত্রুসেনারা বাঁ দিক এবং সামনের দিক দিয়ে আক্রমন চালায়। ইতিমধ্যে ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম আমার কাছে খবর পাঠায় ২নং সেপ্টেম্বর কমাণ্ডার মেজর খালেদ আমাদের অবস্থান নিয়ে ফুলগাজির পেছনে চিতরিয়ায় অবস্থান নিতে বলেছে। ঠিক সময়ে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, অন্যথায় আমরা সবাই শত্রুদের হাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতাম।
পাক কামণ্ডো এবং অন্যান্য সৈন্যরা আস্তে আস্তে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকেন। আমি দেখতে পেলাম শত্রুরা দুটি গ্রুপে বিভিক্ত হয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। প্রত্যেক গ্রুপে ২০/৩৫ জন শত্রুসেনা ছিল বাঁ দিকের গ্র“পটি ২০/৩৫ গজ দূরে এবং অন্যাটি ৩০/৪০ গজ দূরে। আমি এবং আমার সৈন্যরা সবাই এক সাথে শত্রুদের উপর ঝঁপিয়ে পড়লাম। তারাও আমাদের উপর গুলি চালাতে লাগল। গোলাগুলি বিনিময় আটাঘণ্টা ধরে চলল এবং শত্রুরা ৮টা মৃতদেহ ফেলে রেখে পিছনে সরে যেতে লাগল।
ইতিমধ্যে ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম দু’জন গুরুতরভাবে আহত মুক্তিযোদ্ধাকে প্রথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য আমার নিকট পাঠিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু আমাদের পার্শ্ববর্তী ঘাঁটি ফুলগাজীতে পৌঁছানোর কোন দ্রুত ব্যবস্থা ছিল না আমি তাদের আরও ১২ জন আহত মুক্তিযোদ্ধার সাথে পাকে ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিসে রেখে দেই। এরিয়া কামণ্ডার মেজর আমিন ফুলগাজী থেকে আমার হেডকোয়ার্টরে আসনে। আমি থাকে আমার অবস্থানের দ্রুতঅবনতির কথা জানাই। তিনি দ্রুত আহত সৈনিকদের পশ্চৎবর্তী ঘাঁটি ফুলগাজী-চিতলিয়াতে পৌঁছানো ব্যবস্থা করেন। আহত সৈনিকদের উপর যাতে হামলা না হয় তার জন্য তাদের সাথে একটা প্রহরা (এসকট) পার্টিও দেই।
তখন রাত সাড়ে দশটা। যুদ্ধ কিছু সময় হল থেমে আছে। যতদূর সম্ভব শত্রুরা সে সময় শক্তি সঞ্চয় ব্যস্ত ছিল। এ সময় ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম তাঁর ও তাঁর বাহিনীর অবস্থান তুলে নিয়ে আমার কাছে আসেন। আমার তাড়াতাড়ি দ্রুত পরিস্থিতি অবনতির কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিই আমি আমার অবস্থানে থাকব এবং ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম সৈন্যদের নিয়ে পার্শ্ববর্তী ঘাঁটি ফুলগাজীতে সরে যাবেন। সেই অনুযায়ী তিনি ফুলগাজীর দিকে রওনা দিলাম। ভোর ৪টা মধ্যে সমস্ত সৈন্য ফুলগাজীতে চলে যায়। এবং আমি ভোর সাড়ে ৫টার সময় আমি আমার অবস্থান পরিত্যাগ করে ফুলগাজীর দিকে রওনা দেই । আমাদের পার্শ্ববতী ঘাঁটিতে যাওয়াটা খুব সুন্দর ভাবে হয়েছিল সকালে ফুলগাজীতে মেজর খালেদ মোশাররফের সাথে দেখা হয়। তিনি সেখানে অবস্থান করেছিলেন। ফুলগাজী অত্যধিক ঘন বসতিপূর্ণ এলাকা হওয়ায় এখান থেকে শত্রুদের মোকাবিলা করা অসম্ভব ছিল, ফলে আমরা চিতলিয়া যাবার সিদ্ধান্ত নেই। যাবার আগে ফুলগাজী ব্রীজ উড়িয়ে দিয়ে একটা ডিলেইং পার্টি এবং চিতলিয়া আসি এবং নতুন অবস্থান তৈরি করি। আমি আমার বাহিনী নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ জেলাবোর্ড সড়র এবং রেললাইনের উপর অবস্থান নেই ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম তার বাহিনী নিয়ে পরশুরাম এলাকায় অবস্থান নেন। বাঁ দিকে বাহিনী নিয়ে প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তোলেন। এভাবে আমার দ্রুত চিতলিয়াতে প্রতিরক্ষাব্যুহ গড়ে তুলি।
ইতিমধ্যে পাকসেনারা ফুলগাজী ব্রীজ পর্যন্ত এগিয়ে পূর্বেই উল্লেখ করেছি ফুলগাজী ব্রীজ শত্রুদের এগোতে বাধা দেয়ার জন্য ধ্বংস করে দিয়েছিলাম। এ ব্রীজ এসে শত্রুরা বাধা পায় এবং ২৪ ঘণ্টারও বেশী সময় পর্যন্ত তারা আর এগোতে পারেনি ৪৮ ঘন্টা যাবৎ শত্রুদের বাধা দিতে থাকি, ফলে শত্রুরা অ্যাধিক গোলাবর্ষণ করতে থাকে। তাতেও ব্যর্থ হয়ে তারা হেলিকপ্টার ব্যবহার করে ব্রীজের এপারে আসে। চিতলিয়া যুদ্ধের দ্বিতীয় দিনে শত্রুরা হেলিকপ্টার সাহায্য মুহুরী নদী পার হয়ে আসে। এবং লেঃ ইমামুজ্জামানের বানিহীকে ঘিরে ফেলে। সে তাড়াতাড়ি তার বাহিনী পিছনে সরিয়ে নিয়ে যায়। যাবার আগে সে আমাকে জানাতে পারেনি। ডানদিকে আমার যে প্লাটুনটি ছিল, শত্রুদের গোলাগুলির মুখে তারা তাদের অবস্থান টিকে রাখতে পারে না। তারা অবস্থান ত্যাগ করে যায় এবং শত্রুরা সে অবস্থান দখল করে নেয়। ব্যাটলিয়ন হেডকোয়র্টার থেকে জানানো হয় অন্যান্যে প্রতিরক্ষাব্যূহতে সৈন্যরা ঠিকমতই অবস্থান নিয়ে আছে।
শত্রুরা ডাক এবং বাম দিক ও সম্মুখ থেকে আমার বাহিনীর উপর আক্রমন চালিয়ে যাচ্ছে। শত্রুর অবস্থান জানাবার জন্য নায়েক সুরেদার বেলায়েত হোসেনকে ডান দিকে পাঠাই এবং আমি নায়েক সুবেদার শহীদকে নিয়ে বাঁ দিকে যাই। আমি গিয়ে দেখতে পাই শত্রুরা মাত্র ৫০০ গজ দূরে এবং আমি সঙ্গে সঙ্গে মূল ঘাঁটিতে ফিরে আসি এবং দেখতে পাই নায়ক সুবেদার বেলায়েত হোসেন আমার জন্য অপেক্ষ করে দাঁড়িয়ে আছেন। সে জানায় আমাদের আগের অবস্থান থেকে শত্রুরা আক্রমণ চালাচ্ছে। বিকেল ৫ টা দিকে শত্রুরা তিনদিক থেকে আক্রমণ শুরু করে দেয়। আমরা আক্রমণ প্রতিহত করতে শত্রুরা আমাদের সমস্ত যোগাযোগ পথ বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু শত্রুসেনা ছাগলনাইয়া হয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে এবং আমাদের একমাত্র যোগাযোগ পথ পরশুরামের রেলওয়ে ব্রীজ ও সড়কসেতু ঘিরে রাখে।
৩৬ ঘণ্টার মধ্যে আমার বাহিনী কারো মুখে খাদ্য জোটেনি। আমরা অভুক্ত ছিলাম এবং গোলাবারুদ নিঃশেষ হয়ে আসছিল । আমি সেক্টর- ২ এর হেডকোয়ার্টারে খবর পাঠাই সত্বর খবার এবং গোলাবারুদ পাঠানোর জন্য, কিন্তু হেডকোয়ার্টার খবর পাঠায় যে ভারতীয় বাহিনীর গোলাগুলি দেবার যে কথা ছিল তা এখনও এসে পৌঁছেনি- সেহেতু আমি আমার অবস্থান তুলে নিয়ে যেন পরশুরাম চেকপোষ্টের দিকে এগিয়ে যাই।
অবস্থান তুলে নেবার নির্দেশ পেলেও শত্রুদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হবার ফলে আমি আমার বাহিনী তুলে নিতে পারছিলাম না। শত্রুরা ধীরে ধীরে আমাদের নিকটে চলে আসছিল। এ মুহুর্তে আমার বাহিনীকে জোগাড় করা মুস্কিল ছিল, কেননা শত্রুরা গোলান্দাজ বাহিনীর কামান বৃষ্টির মত আমাদের উপর গোলা ছুড়ছিল। আমার সে সময়ে গোলাবারুদ একরকম নিঃশেষ হয়ে এসেছিল। প্রতিটি রাইফেলের জন্য ১০ রাউন্ড এবং হালকা মেলিনগানের জন্য ৫০ রাউন্ডের বেশি গুলি ছিল না। আমি সব প্লাটুন কমাণ্ডারদের ডেকে পাঠাই এবং তাদেরকে রেললাইনের পূর্বদিকে সরে যাবার নির্দেশ দেই। যা হোক কোনক্রমে আমি আমার বাহিনীকে আমি নিরাপদে পরশুরামে নিয়ে আসতে সক্ষম হই। আমি সেখানে পৌঁছে দেখি হেডকোয়ার্টারের নির্দেশ অনুযায়ী ক্যাপ্টেন জাফর ইমামও তাঁর বাহিনী সরিয়ে নেবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন।
পরশুরামে থেকে অবস্থান তুলে নেবার কাজু দ্রুতগতিতে চলতে থাকে। কিন্তু শত্রুরা আমাদের অবস্থান পরিত্যাগের কথা জানতে পারে এবং আমাদের পিছু ধাওয়া করে। শত্রুরা বৃষ্টির মত আমাদের উপর গোলাগুলি চালাতে থাকে। আমরা দ্রুত খালে নেমে শত্রুরা গোলাগুলির হাত থেকে রক্ষা পাই। সকাল ৬টার মধ্যে আমরা নোয়াখালী হেডকোয়ার্টারে পৌছি।
নিদ্রহীন এবং অভুক্ত থাকার জন্য আমার বাহিনীর অর্ধেকের মত সৈন্য অসুস্থ হয়ে পড়ে। ২৬ শে জুনে সেক্টর- ২ এর কমাণ্ডার মেজর খালেদা নোয়াখালী হেডকোয়ার্টারে আসেন। তিনি এখানে সব কমাণ্ডারদের নিয়ে এক সভা করেন। তিনি আমাকে আমার বাহিনী নিয়ে ১২ ঘণ্টার মধ্যে শালদা নদীর কোনাবন এলাকায় যাবার নির্দেশ যেন। সে সময়ে পাকসেনারা এ এলাকায় খুব দিচ্ছিল। মেজর খালেদ এবং আমার বাহিনীর জন্য যাবনবাহনের ব্যবস্থা করে দেন।
২৭ শে জুন আমি আমার কসবা সাবক্টের হেডকোয়ার্টরে পৌঁছে। বসবাতে পৌছি। আমি আমার বাহিনী যেটা কসবায় রেখে গিয়েছিলাম, তাদের যোগাড় করতে থাকি। কসবায় এসে দেখি পানসেনারা গুরুত্বপূর্ণ লাটুমুড়া পাহাড়ী এলাকাটি সহ সমগ্র কসবা এলাকা দখল করে নিয়েছে। যহোক, আমি কোম্পানী যোগাড় করে শলদা নদী-নাবনের দিকে অগ্রসর হই। ক্যাপ্টনসা সালেক ছিলেন শালদা নদী সাবসেক্টরের কমাণ্ডার। মন্দভাগ- কোনাবনে আমাদের সৈন্যই ছিল না। শত্রুরা শালদা রেলওয়ে ষ্টেশন, ‘বায়েক’, মন্দভাগ রেলওয়ে ষ্টেশন দখল করে রেখেছিল। যাহোক আমি আমার হেডকোয়ার্টার স্থাপন করি। সে থেকে আমার সাবসেক্টর কোনবন সাবসেক্টর বলে পরিচিত ছিল। আমার সাবসেক্টর উত্তরে কসবা- জাদেশ্বর এবং দক্ষিণে ‘বায়েক’ নিয়ে বিস্তৃত ছিল। পূর্ব পশ্চিমে ছিল সি-এন্ড-বি সড়ক বারবার কোম্পানীগঞ্জ পর্যন্ত। আমি আমার সাবসেক্টর জুড়ে রেকি করি এবং কোম্পানী কমাণ্ডারদের নিয়ে কোম্পানীগুলিকে পুনর্গঠিত করে ফেলি। আমার প্রথম কর্তব্য হয়ে দাড়াঁল আমার বাহিনীকে নিয়ে একটা স্থাপন করা মনঃপূত মনে করিনি। তাই আমার হেডকোয়ার্টার কোনবনে স্থাপন করি।
৩০শে জুন সকাল শত্রুদের শক্তিশালী ঘাঁটি মন্দভাগ রেলওয়ে ষ্টেশন আক্রমন করি ৫ ঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর বেলা সাড়ে ১২ টা সময় শত্রুরা মন্দভাগ রেলওয়ে ষ্টেশন ছেড়ে চলে যায়। মন্দভাগ রেলওয়ে ষ্টেশন দখল করার পর ঐ দিনই আরও ৪/৫টা গ্রাম মুক্ত করে নেই । এভাবে আমি প্রতিরক্ষাব্যূহ ডিষ্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা গড়ে তুলি। সন্ধ্যা পর্যন্ত দু’বার শত্রুরা আমাদের উপর আক্রমণ চালায় কিন্তু তাদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর অনেক বার শত্রুরা চেষ্টা করেছিল এ এলাকা দখল করার জন্য কিন্তু পর করুণাময় আল্লাহর রহমতে তাদের প্রচেষ্টা দেশ মুক্তি হবার আগে পর্যন্ত সফল হয়নি। প্রায় ৪ লক্ষের মতো লোক পাকিস্তানী সৈন্যদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে পালিয়ে এসে এখানে আশ্রয় নেয় । তাদের আত্মত্যাগের কথা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস স্বর্ণক্ষরে লিখে রাখা দরকার। তারা আমাদের মনোবল অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। তারা অনেক কাজ আমাদের সাহায্যও করতে। পাকসেনারা মন্দভাগ রেলওয়ে ষ্টেশন থেকে বিতাড়িত হবার পর মন্দভাগ বাহিনী আশ্রয় নেয়। মন্দভাগ বাজার, আড়াইবাড়ি ও নয়নপুরে তারা সাঁজেয়া ও গোলন্দাজ বাহিনী নিয়ে আসে। আমার কোন অপরেশন করলেই গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্য আমাদের এলাকায় কামানের গোলা ফেলত।
এরপর আমি মন্দভাগ রেলওয়ে ষ্টেশনের দক্ষিন ‘ বায়েক’ গ্রাম দখল করার পরিকল্পনা নেই। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, আমার যখন বাঙ্কার থেকে উঠে আসতাম তখন এ গ্রামে অবস্থানরত শত্রুসেনারা আমাদের উপর গুলি ও ৮২- এম-এম চাইনিজ মার্টারের সাহায্য গোলা চালাত। ঐ গ্রাম আমি দখল করে নেই এবং শত্রুদের আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য প্রকিরক্ষাব্যূহ গড়ে তুলি।
এই দুই আক্রমণে আমার আমার বাহিনীর বেশ হতাহত হবার ফলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান কর্নেল এম, এ,জি ওসমানী নির্দেশ পাঠান সামসাসামনি যুদ্ধ না করার শত্রুদের ক্ষতিসাধন করার জন্য তিনি এ্যামবুশ এবং হঠাৎ করে আক্রমণ করার নির্দেশ দেন।
কর্ণেল ওসমানীর নির্দেশ পাবার পর আম আচমকা আক্রমণের পথকেই বেছে নেই এবং এতে প্রভূত সাফল্য লাভ করি। এ পরিকল্পনার জন্য ‘সি’ কোম্পানীর ১টা প্লাটুনকে নিয়োগ করি এবং ১টা কোম্পানী সুবেদার গোলাম আম্বিয়া নেতৃত্বে ১টা কোম্পানী ২নং সেক্টরের কমাণ্ডার মেজর খালেদ আমার নিকট পাঠান। সুবেদার গোলাম আম্বিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিল। পরে আমাকে ৪র্থ ইষ্ট বেঙ্গল- এর নেতৃত্ব দেয়া হয়। তখন আমি ১৫ আগস্টে ‘ডি’ কোম্পানী গঠন করি সুবেদার আম্বিয়ার কোম্পানীকে নিয়ে। এই দুই কোম্পানী স্বাধীনতার যুদ্ধে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিল। এই দুই কোম্পানীকে নিয়ে। থেকে বায়েক পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল এবং ক্যাপ্টন খালেকের সৈন্যারা কাটামোড়া থেকে গৌরাঙ্গাতলা ও নয়নপুর রেলওয়ে ষ্টেশন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল।
পূর্বেই উল্লেখ করেছি গেরিলা তৎপরতার জন্য আমি ১টা প্লাটুনকে নিয়োজিত রেখেছিলাম। বাছাই করা লোকদের এ কাজ নিয়োগ করি। এ কাজ নিয়োগ করি। এ কাজে আমি একজন অতি সাহসী জুনিয়ার অফিসারকে পাই। সে হচ্ছে সুবেদার ওহাব। তার নাম স্বাধীনতা যুদ্ধের পর্থপ্রদর্শক হিসেবে লিখিত থাকা উচিত। সে নিজের জীবনের মায়া, ত্যাগ করে সত্যি প্রকৃত বাঘের মত শত্রুদের উপর ছাঁপিয়ে পড়ত। সে কোনদিন কোন অভিযোগ আমার কাছে করে নাই। এমনকি অনেকদিন অভূক্ত অবস্থায় দিন কাটিয়েছে। তাকে যে কাজের ভার দেয়া হয়, তা সাফল্যের সাথে করে। কোন অপারেশন সে কোনদিন বিফল হয়নি। এ প্রসঙ্গে আমি আরেক জনের নাম কবর। সে হচ্ছে মর্টার সেকশনে সামসুল হক। তার নিখঁত সাহসিকতার কাজের জন্য আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল পাকসেনাদের বিপর্যস্ত কার। তার কাজের জন্যই সাবসেক্টর শত্রুদের জন্য করবস্থানে’ পরিণত হয়েছিল। পূর্বেই উল্লেখ করেছি দেশ শত্রুমুক্ত হওয়া পর্যন্ত দীর্গ ৯ মাস মন্দভাগ রেলওয়ে ষ্টেশনে ও তার আশেপাশের এলাকা শত্রুমুক্ত রেখেছিলাম।
আমি মুক্ত এলাকাগুলি নিয়ে একটা সাব- ডিভিশন করি। সেখানে বাজার, স্কুল, থানা বেসামরিক প্রশাসন চালু রাখার জন্য ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করি। মুক্ত এলাকা বাংলাদেশ পতাকা গৌরবের সাথে উড়তে থাকে। এ মুক্ত এলাকা দেখার জন্য দেশ-বিদেশে নাম করা সংবাদপত্র, টেলিভশন ও গন্যমাণ্যরা দেখতে আসতে থাকে। আমাদের পক্ষে সুবিধা হয়ে পরেছিল ঐ সমস্ত গণ্যমান্য ব্যাক্তিদের সম্স্ত কিছু দেখাতে এবং বুঝাতে। এ আমি মুক্ত এলাকার লোকের কথা স্বরন না করে পারি না। এদের অনেক শত্রুদের গোলার আঘাতে মারা গেছে বা গুরুত্বরভাবে আহত হয়েছে। তবুও তাদেররও মনোবল একটুও ভাঙ্গেনি। তারা আমাদের সর্বতোভাবে সাহায্য করে যেতে থাকে। তারা বাঙ্কারে গোলাবারুদ পৌছিয়ে দিত, মৃত শহীদের কবরের ব্যবস্থা করতো, আহত সৈনিকদের সেবা-শুশ্রƒষা করে খবরাখবর এনে দিত। এ খবরাখবর না পেলে শত্রুদের উপর ঠিকমক হামলা করতে পারতাম না। এদের সাহায্য নিয়েই আমি শত্রুসেনাদের উপরে আক্রমন চালিয়ে তাদের অনেক তাদের অফিসার ও সৈনিকদের শেষ করতে সক্ষম হয়েছিলাম।
আমি শালদা নদী রেলওয়ে ষ্টেশন শত্রুদের যাওয়া- আসা এবং রসদ সরবারাহের প্রতি লক্ষ্য রাখতাম। ৩৩ বেলুচ রেজিমেন্ট মন্দমেন্ট মন্দভাগ বাজারে ঘাটি গিরেছিল। কোম্পানীগঞ্জ থেকে স্পীডবোটের মাধ্যমে শালদা নদী হয়ে মন্দভাগ বাজার ও শালদা নদী ষ্টেশন অবস্থিক শত্রুদের ঘাঁটিতে তাদের রসদ আসতো সেদিনটি ছিল আমাদের জন্য খুব ভাল দিন। রাত দুটার সময় সুবেদার ওহার ও তার প্লাটুন নিয়ে বারদুরিয়াতে অবস্থিত শত্রুদের ঘাঁটি আক্রমণ করতে গিয়েছিলাম। এ্যাকশনে শেষ করে পরের দিন সকাল ৮ দিকে গুপ্তপথে আমাদেও অবস্থানে ফিরে আসছিলাম। সত্যিকথা বলতে কি আমার খুব ক্লান্ত ছিলাম সেজন্য একটি ঝোঁপের মধ্যে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। হঠাৎ করে ৩টা স্পীডবোটের আওয়াজ শুনতে পাই যা কোম্পানীগঞ্জ থেকে আসছিল। আমি নিশ্চিত ছিলাম এই স্পীডবোটের আহত সৈনিকদের নিয়ে আবার কোম্পানীগঞ্জ ফিরে যাবে। আমি এ ব্যাপারে সাহসী যোদ্ধা সুবেদার ওহারের সাথে আলোচনা করি এবং দ্রুত শালদা নদীর একটা নির্বাচিত এলাকার ঝোঁপে গিয়ে অবস্থান নেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। নদীর অপর পর্শ্বে অর্থাৎ পশ্চিম দিকে ওহারের অধীনে একটা সেকশন পাঠিয়ে দেই এ্যাম্বস পাতার জন্য এবং আমি নিজেই দুটো সেকশন নিয়ে নদীর পূর্বপাড়ে দুটি ভাগে ভাগ হয়ে এ্যামবুশ পাতি। আধাঘণ্টার মাধ্যমে মন্দভাগ থেকে স্পীডবোট আসার আওয়াজ শুনতে পাই। দুটো স্পীডবোট আমাদের ফাঁদে পা দেবার জন্য এগিয়ে আসছিল। আমি আমার সৈনিকদের নির্দেশ দেই আমি গুলি না ছোড়া পর্যন্ত যেন তারা কেউ গুলি না চালায়। দুটো স্পীডবোট ১৫০ গজের ব্যবধানে এগিয়ে আসতে থাকে। স্পীডবোটগুলি ছিল খোলা এবং প্রথম স্পীডবোটে দেখি ২/৩টি ছাতার নিচে লোক বসে আছে এবং পিছনেরটিতে অস্ত্রসজ্জিত হয়ে বোঝাই হয়ে আসছে। আমি নিশ্চিত হলাম প্রথম স্পীডবোটে ছাতার নিচে পাকসামরিক অফিসাররা বসে আছেন। নদী ছিল ৩০/৪০ গজ প্রশস্ত দুটি স্পীডবোটেই যখন আমার ফাঁদে পড়ে যায় তখন আমি শত্রুদের দিকে গুলি চালাই। সঙ্গে সঙ্গে আমার বাহিনীর লোকের শত্রুদের উপর এক সঙ্গে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এই গোলাবর্ষাণ চলে ৫ মিনিট ধরে এবং শত্রুরা এ আক্রমাণের কোন জবাব দেয়ার সময় পায়নি। শত্রুরা সবাই স্পীডবোট ছেড়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়। ১৪ জন শত্রুসেনার সবাই মারা যায়। আমি দেখি একজন শত্রুসেনা পানি থেকে আবার স্পীডবোটে ওঠার চেষ্টা করছে, সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে তার সে চেষ্টা ব্যার্থ করে দেয়া হলো। এটা এক সাফ্যজনক অপারেশন ছিল। আমরা দুটি এম-জি-আর -এ-৩, ১টা চাইনিজ রাইফেল, ২টা চাইনিজ ষ্টেনগান ১টা সামগ্র এলাকার আর্টিলারি ম্যাপ, ২টা পি-আর-সি, ১০টা অয়্যারলেস সেট আছে। আমার তার ব্যজটি ছিড়ে নেই আমরা দেখি একটা স্পীডবোট একজন মৃত পাকিস্তানী ক্যাপ্টেন পড়ে আছে। আমরা তার ব্যাজটি ছিড়ে নেই, আমরা দ্রুত অবসাহন তুলে নিয়ে আমাদের ক্যাম্পে দুপুর তিনটার সময়। এ ঘটনার ম্যাসেজ ধরেন) স্পীডবোটগুলিতে ৩৩ বালুচর ৫ জন অফিসার এবং অন্যান্য র্যাঙ্কের ৯জন ছিল। এদের মধ্যে ১জন লেঃ কর্নেল, ১ জন মেজর ১জন ক্যাপ্টেন ডাক্তার, ১ জন আর্টিলারি ক্যাপ্টন, একজন লেফটেন্যান্ট ছিলেন। এরা সবাই কুমিল্লা টাউনে বাঙালিদের উপরে অত্যাটার চালিয়েছিল, মা- বোনের ইজ্জত নষ্ট করেছিল এবং ধন- সম্পদ লুণ্ঠন করেছিল। পরে স্থানীয় রাজাকার ও হেলিকাপ্টারের সাহায্য মৃতদেহগুলি নিয়ে শত্রুরা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টর সৈন্যদের কবরস্থানে দিয়েছিল। মধ্যে কুখ্যাত ক্যাপ্টেন বোখারিও ছিল।
মক্ত এলাকায় আমার যে অবস্থানগুলি ছিল সে গুলি বায়েক গ্রাম, মন্দভাগ বাজার, কামালপুর, মঈনপুর, গৌবিন্দপুর এবং উদিশ্বর। শত্রুদের ঘাঁটি ছিল আমার এলাকার বিপরীতে কসবা, চাঁদলা, বড়ধুসিয়া, শালদা নদী রেলওয়ে ষ্টিশন ও নয়নপুর বাজারে। এসব এলাকা থেকে শত্রুরা আমাদের অবস্থানের উপর প্রায়ই গোলাগোলি চালাত। ছোট ছোট আক্রমণ, প্রতি-আক্রমণ, এ্যামবুশ ও রেইড দৈনন্দিন ব্যাপার ছিল। এতে শত্রুদের যতেষ্ট হতাহত হয়।
শত্রুসেনারা রাজাকারের কোম্পানীগঞ্জ-কুটি প্রধান রাস্তায় পাহাড়ায় মোতায়েন রাখে। রাজাকারের একটি দল আমার সাথে গোপন যোগাযোগ করে। তারা জানায় তাদের জীবনের নিরাপত্তা দেয়া হলে তারা আমার নিকট আত্মসমার্পন করবে এবং অনুমতি দিলে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেবে। কোম্পানীগঞ্জ- কুটি; সড়কের মধ্যে কালামোরায় ১০৩ ফুট লম্বা ১টা ব্রীজ ছিল। রাজাকাররা সে ব্রীজ পাহাড়া দিত। আমি আমার এক দূতের মাধ্যমে জানাই তাদেরকে হত্যা করা হবে না এবং প্রয়োজনে হলে মুক্তিবাহিনীতে নেয়া হবে। তাদের আরো জানাই কালামোরা ব্রীজ উড়ানোতে তাদের সাহায্যও প্রয়োজন হবে।
আগস্ট মাসের রাতে ব্রীজ ধ্বংস করার পরিকল্পনা নেই। পরিকল্পনা অনুযায়ী শত্রুদের বিভিন্ন ঘাঁটিতে ব্যস্ত রাখার জন্য সুবেদার ওহাবের নেতৃত্বে ৫টি এ্যাম্বশ দল পাঁচ জায়গায় প্রেরণা করি। রাত ১২টা থেকে ভোর পর্যন্ত তারা শত্রুদের অবস্থানগুলি যথা সাহেবপারা, শালদা নদী গোডাউন, চাঁদলা প্রভৃতি জায়গায় আম্বিয়ার নেতৃত্বে একটি প্লটুন কালামোরা ব্রীজে এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে রাত দু’টার সময় ব্রীজটি উড়িয়ে দেয়। এ কাজ এ কাজে রাজাকাররা আমাদের সাহায্য করে ৭ জন রাজাকার অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমার কাছে আত্মসমর্পণ করে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয় এবং দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত তারা আমার সাথেই ছিল।
শত্রুরা রসদ সরবারাহ করার জন্য এ রাস্তা দিয়ে যাবে আমরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম। সে জন্য এ কালামোরা। ব্রীজ থেকে ১০০ গজ দূরে কোম্পানীগঞ্জের দিকে এ্যামবুশ পেতে বসে বাকি। ভোরের দিকে শত্রুদের রসদ সরবারহকারী দুটো সৈন্যবোঝাই জীপ, দুটো ডজ, ৩ টা বেসরকারী গাড়ি, একটা বাস ও দুটা তিন টনের গাড়ি এ রাস্তা দিয়ে আসছিল। ব্রীজের কাছে এসে তা ভাঙ্গা দেখে তারা আবার ফিরে যাবার জন্য প্র¯ত্তত হবার আমরা আকস্মাৎ রকেট লাঞ্চনার , রাইফেল ও হালকা মেশিনগানের সাহায্যে শত্রুদের উপর আক্রমণ শুরু করি রকেট লাঞ্চারের সাহায্য শত্রুদের পাচঁটি গাড়ী ধ্বংস করে দেয়া হয়। ১৫ জন পাকসেনা নিহত এবং কতজন আহত হয়েছিল আমার জন্য নাই। ৩ জন জীবিত শত্রুসেনাকে আমরা ধরে ফেলি। এদের একজন হচ্ছে নায়েক সুবেদার বশির (সিন্ধি) আমরা কিছু গোলাগুলি, অস্ত্রশস্ত্র এবং জরুরী কিছু কাগজপত্র উদ্ধার করি। শত্রুরা গোলান্দাজ বাহিনীর সাহায্যে গোলাবর্ষণ শুরু করলে আমরা অবস্থান পরিত্যাগ করি। জীবিত শত্রুসেনাদের আমি মেলা পাঠিয়ে দেই। এরা ধৃত হবার ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বেরে যায়।
বাচ্চু নামে (ক্লাস নাইনে পড়ত তখন) অসীমসাহসী যুবক একটা হালকা মেশিনগান নিয়ে শালদা নদীর এক স্থানে এ্যামবুশ পেতে শত্রুদের একটা নৌকা উড়িয়ে দিয়। নৌকাতে অবস্থানরত পাকসেনা এতে মারা যায়।
শালদা নদীর পূর্বপারে মন্দভাগ গ্রামে আমদের দখলে ছিল। নদীর অপার পার আমাদের দখলে না থাকলেও শত্রুদের নিয়ন্ত্রণে ছিলোনা। নদীর ওপারে চাদলা গ্রামে শত্রুরা অবস্থান নিয়েছিল। শত্রুরা বার বার চাপ দিচ্ছিল মন্দভাগ দখল করে নেবার জন্য। আমরা ছোট ছোট ওয়্যারলেসের মধ্য দিয়ে ধরতে পারি শত্রুরা যে কোন মুহুর্তে মন্দভাগ আক্রমণ করতে পারে। ২১শে সেপ্টেম্বর শত্রুরা চাঁদলা থেকে চারটা নৌকায় করে মন্দভাগ আসছিল। মেজর দূররানির নেতৃত্ব ৩৩ বেলুচের নেতৃত্ব ‘বি’ এবং ‘ডি’ কোম্পানী এই নৌকা গুলিতে ছিল। শত্রুরা আক্রমণ করতে পারে বলে আমি বাছাই করা একটা প্লাটুনকে সুবেদার ওহাবের নেতৃত্বে মন্দভাগ শালদা নদীর উপরে অবস্থান নিতে বলি। আর একটা সেকশনকে গ্রামের এক পাশে আমার ডানদিকে এবং আরেকটা সেকশনকে বাম পাশে অবস্থান নিতে বলি। আমি অবস্থান নেই মধ্যখানে। আমি আমার বাহিনীকে নির্দেশ দেই আমি গুলি না ছাড়া পর্যন্ত যেন কেউ গুলি না চালায়। রাত্রি একটার সময় শত্রুরা মেজর দুরবানির নেতৃত্বে আমার অবস্থানের দিকে খাল নৌকাযোগে এগুতে থাকে। আমি তখন মন্দভাগ গ্রামে অবস্থানরত ডানপাশের বাহিনীকে নির্দেশ দেই শত্রুদের প্রতি গুলি ছোঁড়ার জন্য। শত্রুরা তখন নৌকা থেকে নেমে দুই ভাগে ব্রাকেন লাইন হয়ে এগুতে থাকে। তারপর যখন তারা আমার প্রতিরক্ষাব্যূহের ২০/২৫ গজের মধ্যে এসে গেছে, তখন আমরা সবাই তাদের উপর গুলিবর্ষণ করতে থাকি। এ গুলিবর্ষণের ফলে প্রথম সারির সবাই আহত- নিহত পড়ে যায় এবং পিছনেরও অনেকে হতাহত হয়। শত্রুরা বেগতিক দেখে তাদের আহত সৈনিকদের ও গোলাগুলি ফেলে পালিয়ে যায়। পশ্চদপসরনরত সৈনিদের লক্ষ্য করে মর্টারের সাহায্য গোলাবর্ষণ করা হয়। ফলে শত্রুদের কিছু আহত হয়। এ যুদ্ধে শত্রুদের ৬ জন আহত সৈনিকদের ধরে ফেলি। ২৬ জন মৃত শত্রুসেনাকে নিয়ে আসতে সক্ষম হই। এদের মধ্যে একজন লেফটেন্যান্ট ছিল। আমরা ৬টা এমজিআই- এ-৩ ৩৭ /৩৮ টা জি-৩ রাইফেল, ৫টা পিস্তল, চাইনিজ স্টেনগান ৮টা, ৩.৫ ইঞ্চি রকেট লাঞ্চার , ১টা ক্যমেরা, ১টা বাইনোকুলার, ২টা ক্যাম্পাস, ম্যাপ ও ৫/৬ হাজার গোলাগুলি দখল করে নেই। এ যুদ্ধে আমাদের ৪জন আহত হয়। পাক গোলান্দাজ বাহিনী আমাদের গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এ যুদ্ধে পৌনে পাঁচটা থেকে ছ’টা পর্যন্ত চলে আমার ধৃত ও নিহত সৈন্যদের সেক্টর-২-এর হেডকোয়ার্টারের মেলাঘরে পাঠিয়ে দেই। শত্রুরা বিপর্যস্ত হবার পর পরই তাদের বিমান বাহিনীর পাঁচটা স্যাবর জেট এসে ৪৭ মিনিট ধরে আমার মুক্ত এলাকায় স্ট্র্যাপিং করতে থাকে। এতে একজন সামান্য আহত হয়।
জাদিশ্বরে আমি আমার একটা মর্টার সেকশন রাখি নায়েক সুবেদার মঈনের অধীনে। তখন ছিল রমজান মাস। আমি সুবেদার মঈনের নির্দেশ দেই জাদিশ্বর থেকে কোন এক স্থানে বেছে নিয়ে সাহেববাড়িতে অবিস্থিত শত্রুসেনাদের অবস্থানে খাওয়ার সময় যেন আচমকা মর্টারের সাহায্য হামলা চালায়। তাকে যেদিন এ কজি করতে বলা হয়, যেদিন সে ব্যার্থ হয়। পরের দিন ভোররাতে সেহরী খাওয়ার সময় জাদিশ্বর থেকে খাল পার হয়ে নায়েক সুবেদার মঈন তার ৮জন সঙ্গীকে নিয়ে যায় মার্টর হামলা করার জন্য কিন্তু শত্রুসেনারা কোন গুপ্তচারের মাধ্যমে খবর পেয়ে আগে থেকেই এ্যাম্বশ পেতে বসে ছিল। তারা নায়েক সুবেদার মঈন ও তাঁর বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এরা সুবেদার মঈন ও তার দুজন সঙ্গীকে ধরে ফেলে। দুজন গুলি করে সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলে রেখে যায়। সুবেদার মঈনকে তারা নিয়ে যায় সুবেদার আম্বিয়া টেলিফোন যোগে এ বিপর্যয়ের বাংলাদেশ কথা জানায়। আমি তাকে সঙ্গে সঙ্গে তার প্লাটুন নিয়ে শত্রুদের ধাওয়ার জন্য। সে আমার কথামত তাঁর প্লাটুন নিয়ে শত্রুদের ধাওয়া করে। ফেলে শত্রুরা সেখানে নায়ের সুবেদার মঈনকে হাত পা বাধা অবস্থায় মেরে ফেলে পালিয়ে যায়। আমরা তাকে মুক্ত এলাকায় এনে সামরিক কায়দার সম্মান জানিয়ে সমাহিত করি।
নায়েব সুবেদার মঈন একজন সাহসী যোদ্ধা ছিলেন। তাকে কাজ দেয়া হত, সে কাজ দ্রুততার সাথে কাজ সম্পন্ন করতো। কোন নির্দেশ পাওয়ার পর, সে সেটা সম্পন্ন না করা পর্যন্ত শাস্তি পেতনা। অসমসাহসী এ যোদ্ধার কথা বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস স্বর্ণক্ষরে লিখে রাখা উচিত। তার জন্য বাংলাদেশ গর্ব করতে পারে। মন্দভাগ গ্রাম ও রেলওয়ে ষ্টেশন আমাদের নিয়ন্ত্রনে আনেক আগে থেকেই ছিল। মন্দভাগের শালদা নদী রেলওয়ে ষ্টেশনের গুরুত্ব ছিল অপারিসীম। এখান থেকেই কুমিল্লা-চট্টগ্রাম, কুমিল্লা-সিলেট ও কুমিল্লা- ঢাকা রেলপথে যেতে হয়। শালদা নদী রেলওয়ে ষ্টেশন ও বাজার ছিল একটা গুরুত্বপূর্ন বাণিজ্যিক এলাকা। ব্রাহ্মণবাড়িয়াম বুরিচ, কসরা এলাকায় শালদা নদী গ্রামের ডিষ্ট্রিক্ট বোর্ডের কাঁচা রাস্তা দিয়ে যেতে হয়। ফলে শালদা নদী রেলওয়ে ষ্টেশন ও গ্রামের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। সেক্টর- ২ এর কামণ্ডার কর্নেল খালেদ মোশাররফ সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে আমাকে শালদা নদী সাবসেক্টরর কমাণ্ডার মেজর সালেক চৌধুরী ক্যাপ্টন পাশা ও ক্যাপ্টন আশরাকে নিয়ে রেলওয়ে ষ্টেশনে আমার হেডকোয়ার্টারে এক আলোচনা সভা ডাকেন। তিনি আমাদের বলে, আমরা মন্দভাগ মুক্ত করেছি। শালদা নদী রেলওয়ে ষ্টেশন মুক্ত করতে পারলে আমাদের মুক্ত করতে পারলে আমাদের মুক্ত এলাকা বেড়ে যাবে এবং সামরিক ও অন্যান্য দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটি মুক্ত করতে পারলে শত্রুদের মনোবল ভেঙ্গে যাবে। সে মতে তিনি আমাদের শালদা নদী রেলওয়ে ষ্টেশন মুক্ত করার জন্য শত্রুদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে হামলা চালাবার নির্দেশ দেন এবং তিনি নিজে এ আক্রমণ পরিচালনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি আমার একটা কোম্পানী নিয়ে শালদা নদী রেলওয়ে ষ্টেশনের দিকে বায়েক গ্রামে অবস্থান নেই। ক্যাপ্টেন আশারাফ একটা কোম্পানী নিয়ে মন্দভাগ গ্রাম থেকে এগিয়ে শত্রুদের নয়নপুর ঘাঁটির দূরে অবস্থান নেন। মেজর সালেক সালেক খাল পার হয়ে শালদা নদী পার হয়ে একটা কোম্পানী নিয়ে শালদা নদী ষ্টেশন পশ্চিমে গোডাউনে অবস্থান নেন। ক্যাপ্টন নেন। আমাদের সাহায্য করার জন্য সুবেদার জববার তার মার্টন সেকসন নিয়ে আমার অবস্থানের পিছনে মন্দভাগ রেলওয়ে ষ্টেশনে অবস্থান নেয়া। পরিকল্পনা অনুযায়ী সকাল সাড়ে ৬টার সময় গোলান্দাজ বাহিনীর ক্যাপ্টেন পাশা অবস্থানের উপর গোলা ছুড়তে থাকে। মেজর সালেক, আশরাফ এবং আমি নিজ নিজ বাহিনী নিয়ে শত্রুদের অবস্থানের উপর নির্দিষ্ট সময়ে হামলা চালাই। শত্রুরা তাদের গোলান্দাজ ঘাঁটি বুড়িচং, কসবা, কুটি, থেকে আমাদের উপর অবিরাম গোলাবর্ষণ করতে থাকে। ক্যাপ্টেন আশরাফের আক্রমণে নয়নপুর গ্রামে অবস্থানরত পাকসেনারা নয়নপুর গ্রাম ছেড়ে শালদা নদীদক্ষিণ পাড়ে চলে যায়। নয়নপুর গ্রাম আমাদের দখলে চলে আসে। আমি আমার বাহিনী নিয়ে নয়নপুর গ্রামের রেলব্রীজ পর্যন্ত এগিয়ে যাই। মেজর সালেক শালদা নদী বাজার এবং গোডাউন দখল করে নেয়। শালদা নদীর দক্ষিণ পার্শ্বের বিলে শত্রুদের দৃঢ় অবস্থানের জন্য মেজর সালেক নদী রেলওয়ে ষ্টেশন পর্যন্ত এগুতে পারেননি। এ যুদ্ধ চলে সকাল সাড়ে ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। শত্রুরা তাদের তিনটি গোলান্দাজ ঘাঁটি থেকে আমাদের অবস্থানে ও মুক্ত এলাকায় অবিরাম গোলাবর্ষণ করতে থাকে। আমাদের গোলাবারুদ শেষ হয়ে যাবার ফলে মেজর সালেক তার অগ্রবর্তী অবস্থানে তুলে নিয়ে মন্দভাগে চজলে আসেন। ক্যাপ্টেন আশরাফ এবং আমার দখলকৃত জায়গা আমার দখলে রাখি। মেজর সালেক এবং ক্যাপ্টেন আশরাফ তাদের বাহিনী আমার অধীনে রেখে ২নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টারে চলে যায়। এই যুদ্ধ আমাদের নাম করা সাতারু সিরাজ সহ ৬জন সৈন্য পাকিস্তনী গোলাগুলি ফলে নিহত এবং আহত হয়। শত্রুদের হতাহতের সঠিক কোন পাওয়া গেলেও লোকমুখে আমার জানতে পেরেছি নয়নপুর রেলওয়ে ষ্টেশন হয়ে টেলিযোগে অনেক আহত এবং নিহত সৈনিকদের কুমিল্লা ক্যান্টলমেন্ট নিয়ে গেছে। এটাই ছিল প্রথম সামনাসামনি যুদ্ধ। এ যুদ্ধের পর পর আমার শত্রুদের সাথে সামনসামনি যুদ্ধ করার পথ বেছে নেই। সৈন্য এবং গণবাহিনীর ছেলেদের মনোবল এ যুদ্ধের পর বেড়ে যায়। গণবাহিনীর ছেলেরা যদিও এই সামনাসামনি যুদ্ধে কিছুটা ভীত হয়ে পড়েছিল, কিন্তু পরে তারা বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিল। এ যুদ্ধের পরেই মেজর সালেক এবং ক্যাপ্টেন আশরাফের কাছ থেক শালদা নদী সাব-সেক্টরের ভার নিয়ে নেই। শেষ অবধি দেশ স্বাধীন হাওয়া দুই সাবসেক্টর আমার অধীনেই ছিল। মেজর সালেক ছিলেন এক অসমসাহসী যোদ্ধা।
মন্দভাগ ও শালদা নদী সাবসেক্টরের মধ্যে শালদা নদী রেলওয়ে ষ্টেশনে শক্রদের একটা শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। আমি শালদা নদী সাব-সেক্টরের কামণ্ডার মেজর সালেক ও ক্যাপ্টেন আশরাফ সেক্টর-২ এর কমাণ্ডার কর্নেল খালেদ মোশারফের নির্দেশ যৌথভাবে শালদা নদী রেলওয়ে ষ্টেশনে শত্রুদের ঘাঁটির উপর পূর্বেই একবার হামলা চালিয়েছিলাম। কিছুটা সাফল্য লাভ করলেও শত্রুদের শালদা নদী রেলওয়ে ষ্টেশন থেকে বিতারিত করা সম্ভব হয়নি। এরপর মেজর সালেক শালদা নদী সাব-সেক্টরের ভার আমার হাতে ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র চলে যান। আমি চিন্তা করতে থাকি শত্রুদের কি করে শালদা নদী রেলওয়ে ষ্টেশন থেকে শত্রুদের শক্তিশালী ঘাঁটির অবস্থান পর্যবেক্ষন করার জন্য কালো শার্ট ও লুঙ্গি পড়ে কৃষকের বেশে শালদা নদীর রেলওয়ে ষ্টেশনের নদীর বিপরীত দিকে এক বিরাট বিরাট গাছের তলায় দাঁড়িয়ে শত্রুদের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করেছিলাম। সময় ছিল ঠিক সন্ধার আগে। শত্রুরা আমাকে দেখতে পায় এবং আমার উপর গোলাগুলি ছুড়াতে থাকে। নিম গাছের আরাল করে বসে থাকি। তাদের আমার পাশ দিয়ে চলে যেতে থাকে। সন্ধ্যার পর গোলাগুলি বন্ধ হলে আমি আমার ঘাঁটিতে ফিরে আসি।
শত্রুদের প্রতিরক্ষা অবস্থান পর্যবেক্ষণের পর বুঝাতে পারি শত্রুদের অবস্থান খুবই শক্তিশালী। নদীর তীর বারবার আমাদের অবস্থানের সামনে তারা চারটি বড় পরিখা খনন করছে। শালদা নদী গোডাউনের পাশ দিয়েও তারা এরকম শক্তিশালী পরীখা খনন করছে। এ অবস্থানে আমি আমি আমার শত্রুদের কাবু করার জন্য তিন দিক থেকে সাঁড়াশী আক্রমনের পরিকল্পনা নেই এবং নায়েক সুবেদার সিরাজের নেতৃত্বে শালদা নদী রেলওয়ে ষ্টেশনের পূর্বে পাহাড়ী জায়গা প্লাটুন পাঠাই। সুবেদার মঙ্গল মিয়াকে আর একটা প্লাটুন নিয়ে শালদা নদী গোডাউনের নিকটে গিয়ে অবস্থান নিতে বলি। সুবেদার বেলায়েতকে নিয়ে আর একটা প্লাটুন নিয়ে শালদা নদীতে শত্রুদের ঘাঁটির নদীর বীপরিতে অবস্থান নিতে বলি আমাদের যাতে শত্রুরা পিছন থেকে আক্রমণ করতে না পরে তার জন্য সুবেদার ওহাবের একটা কোম্পানীকে সুবেদার মঙ্গল মিয়ার পিছনে অবস্থান নিতে বলি। সঙ্গে সঙ্গে চারটা রেইডিং পার্টিকে শত্রুদের অন্যান্য অবস্থান যথা বড়ধূসিয়া , চাঁদলা, সাহেবেরবাড়ী গোবিন্দপুর ও কায়েমপুরের আগের ঘাঁটিতে রাতে হঠাৎ রেইড করার নির্দেশ দেই। হঠাৎ করে চারটা ঘাঁটিতে আক্রমনের পরিকল্পনা নিয়েছিলাম এ জন্য যে, এর ফলে শালদা রেলওয়ে ষ্টেশনে। অবস্থানরত শত্রুদের দৃষ্টি অন্যদিকে পড়বে। হঠাৎ করে চারটি ঘাঁটিতে আক্রমণ করলে তাদের ঐ চারটা অবস্থানকে রক্ষার জন্য তারা মর্র্টার ও কামানর গোলা আমাদের উপর নিক্ষেপ করবে। এভাবে তাদের মর্টার ও কামানের গোলা অনেক শেষ হয়ে যাবে। পরিকল্পনা মত ৭/৮ই অক্টোবর রাতে ৪টি রেইডিং পার্টি ক্রমান্বয়ে বড়ধূসিয়া, চাঁদলা কায়েমপুর ও সাহেববাড়ি গোবিন্দপুরে হামলা চালায়। এটা চলে সারারাত ধরে। শালদা রেলওয়ে ষ্টেশন থেকে শত্রুরা আমাদের এ্যামবুশ পার্টিগুলির উপর মর্টার ও কামানের নিক্ষেপ করতে থাকে। ভোরের দিকে এ আক্রমণ বন্ধ হয়ে যায়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, শত্রুরা রাতে আমাদের আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকত, কিন্তু দিনের বেলা তারা এতখানি প্রস্তুত থাকত না। দিনের বেলা ই-পি-সি-এ-এফ ও রাজাকারদের পাড়ারায় মোতায়েন করে তারা ঘুমাত, না হয় বিশ্রাম নিত।
৭/৮ই অক্টোবরের সকাল ৮টার সময় সম্মিলিতভাবে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। সুবেদার মঙ্গল মিয়া শালদা নদী গোডাউনের পরিখায় অবস্থানরত শত্রুদের উপর গোলাগুলি চালাতে থাকে। সুবেদার বেলায়েত নদীর পার থেকে ওপারে শত্রুদের পরিখার উপর ভীষণভাবে গোলাগুলি ছুড়তে থাকে। নায়েক সুবেদার সিরাজ পাহাড়ী অবস্থান থেকে শত্রুদের উপর আক্রমণ চালাতে থাকে। উভয়পক্ষের মধ্যেই প্রচণ্ড বিনিময় গুলি বিনিময় হতে থাকে। আমি আগেই পরিকল্পনা নিয়েছিলাম নদীর ওপারে পরিখাগুলি নষ্ট করে দিতে পারলে শত্রুরা টিকতে পারবে না। সে মতে নায়েক সুবেদার মোহাম্মদ হোসেন আর-আর- এর গোলা পরিখার উপর ফেলতে থাকে এবং এতে কাজ হয়। আর-আর এর দুটি গোলার আঘাতে নদীর পারে অবস্থিত চারটি পরিখার মধ্যে ২টি নষ্ট হয়ে যায় এবং শত্রুরা ঐ নষ্ট দুটি পরিখা ত্যাগ করে অন্য দুটিতে চলে যায়। সুবেদার বেলায়েত সঙ্গে সঙ্গে তার বাহিনীর কিছু লোক নিয়ে নদী সাঁতরিয়ে গিয়ে ভাঙ্গা পরিখায় অবস্থান নেয় এর ফলে শত্রুরা দুই ভপাগে বিভক্ত হয়ে যায়। শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনের অবস্থানরত শত্রুসেনাদের সাথে গোডাউনে অবস্থানরত শত্রুদের কোন সংযোগ থাকে না। শত্রুরা আমাদের উপর মার্টার ও কামানের গোলা ফেলতে পারছিল না। এতে তাদের অনেক ক্ষতি হত, কেননা আমাদের সৈন্যরা তাদের দুদলের মাঝে ঢুকে গেছে। শালদা নদী গোডাউনে অবস্থানরত বুঝতে পারে তাদের পক্ষে এঁটে ওঠা সম্ভব নয়। অন্য দিক থেকে সাহায্য না পাবার ফলে তারা গোডাউনের পার দিয়ে নয়নপুর রেলওয়ে স্টেশনে তাদের অবস্থানে পালিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মিয়া শালদা নদী গোডাউনটি দখল করে নেয়। দুপুর ১১টার সময় শত্রুদের একটি অয়ারলেস থেকে ম্যাসেজ আমি ধরি। তাতে তারা কতৃপক্ষকে জানায় মুক্তিবাহিনীর ১টা ব্যাটালিয়ান তাদের আক্রমণ করেছে। এ মুহূর্তে তাদের পক্ষে আর এ ঘাঁটিতে টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছে না।
এ ম্যাসেজ ধরার পরে আমার মনোবল বেড়ে যায়। আমি আমার শত্রুদের আরও তীব্রভাবে তাদের উপর আক্রমণ করার নির্দেশ দেই। আমি বুঝতে পারছিলাম তাদের মনোবল একেবারেই ভেঙ্গে গেছে। শত্রুরা এ ঘাঁটি ছেড়ে যেতে বাধ্য হবে যদি আমরা আক্রমণ চালিয়ে যাই। কিছুক্ষণ লড়াই চলবার পর শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থানরত শত্রুসেনারা ধীরে ধীরে রেললাইন বরাবর পরিখা দিয়ে নয়নপুর রেলওয়ে স্টেশনে তাদের ঘাঁটিতে পালিয়ে যেতে থাকে। আমি এবং আমার বাহিনী পরিখাতে অবস্তান নিয়ে পলায়নপর শত্রুদের উপর গুলি চালাতে থাকি। একজন পাকসেনার কথা আমার মনে পড়ে। সে ধীরমন্থর গতিতে একটি পরিখা থেকে অন্য পরিখা যাচ্ছিল। আমি তার উপর গুলি চালাই। দেখি আবার কিছুক্ষণ পর উঠে ধীরমন্থর গতিতে আবার এগিয়ে যাচ্ছে, আবার গুলি চালাই। এভাবে ২/৩ টি পরিখা পার হবার পর সে আর যেতে পারেনি। আমার মনে হয় আমাদের আক্রমণের সময়ই সে গুরুতর ভাবে আহত হয়েছিল যার জন্য সে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যেতে পারেনি।
এরপর আমরা সমগ্র শালদা নদী এলাকা দখল করে নিয়ে নিজেদের অবস্থানকে শক্তিশালী করে তুলতে থাকি যেন শত্রুরা আক্রমণ করে শালদা পুনর্দখল করে নিতে না পারে।
এরপর শত্রুরা নয়নপুর রেলওয়ে স্টেশন ঘাঁটি মর্টার ও কামানের গোলা বৃষ্টির মত আমাদের অবস্থানে ফেলতে থাকে। ইতিমধ্যে ভারতীয় বাহিনীর লেঃ জেনারেল সগৎ সিং আমাকে অভিনন্দন জানানোর জন্য মন্দভাগে আসেন। আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই।
এর মধ্যে শত্রুরা আমাদেরকে আক্রমণের জন্য শালদা নী গোডাউনের কাছে সমাবেশ হচ্ছে খবর পেয়ে সুবেদার বেলায়েত সে স্থানে যান। রেকি করার সময় একজন প্যারা-ট্রপস এর শত্রুদের একটি গাছের আরাল থেকে তাকে গুলি করে তাকে গুরুত্বর ভাবে আহত করে। জেনারেল সগৎ সিং- এর সাথে দেখা করে ফেলার পর আমি এ খবর পাই। সঙ্গে সঙ্গে তাকে চিকিৎসা করার জন্য সেক্টর-২ এর হাসপাতালে পাঠানো হয় কিন্তু পথিমধ্যে সে মারা যায়। তার মত বীর সৈনিকের মৃত্যুতে আমি মর্মাহত হয়ে পড়ি। তার মত বীরের মৃত্যুতে আমাদের বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ একজন মহান বীরকে হারায়।
শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন দখল একটা সাহসী পরিকল্পনা ছিল। আমি অবশ্য আশান্বিত ছিলাম যদি তাদের ঠিকমত আঘাত করা যায় এবং মনোবল ভেঙ্গে দেয়া যায়, তবে নিশ্চয়ই জিতব। এটা অত্যন্ত শক্ত এবং দুঃসাহসী কাজ ছিল।
শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন দখল করার পর আমরা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ সেখানে পাই। ২১ টা ৩০৩ রাইফেল, ৫টা হালকা মেশিনগান, এম-জি-আই-৩ ৩টা, ম্যাগাজিন বক্স ২টা, হালকা মেশিনগান ম্যাগাজিন ৩১টা, বেটাগান ২টা, রকেট লাঞাচার ৪০-এম এম ১টা, অয়্যারলেস সেট পি-আর-সি-৬২ একটা, হারিকেন ৪টা, গোলাবারুদ ২০,২৫০ টা, ২ ইঞ্চি মর্টার বোমা ২০০টা, ৬০-এম-এম মর্টার বোমা ৭২টা, ৩০৩ বল ১০ হাজার, ২ ইঞ্চি মর্টার বোমা ধোঁয়া ৪টা, টেলিফোন সেট ৩টা, জেনারেটর ১টা, পি-আর-সি-১০ অয়্যারলেস সেট ব্যাটারিসহ ৫টা, ট্রাঞ্জিস্টর ৩ ব্যান্ড ১ টা এবং বিভিন্ন ধরনের খাদ্য রসদ ও অসংখ্য কাপড় চোপর। এছাড়াও ব্যারেল হোল্ডার ২ টা , এম-জি স্পেয়ার ব্যারেল ২টা, ম্যাপ এবং বিভিন্ন ধরনের নথিপত্র। এসব দলিলপত্র থেকে জানতে পারি যে ৩০ পাঞ্চাবের ‘বি’ এবং ‘ডি’ কোম্পানী এখানে মোতায়েন ছিল। এ লড়াই ভোর পাঁচটা থেকে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত চলে। প্রায় ১৬ ঘণ্টা ধরে দু’পক্ষের তুমুল লড়াই চলে। এ যুদ্ধে আমার বাহিনীর ২ জন নিহত এবং ৮ জন আহত হয়। শত্রুদের প্রায় ১০০ জন যখন নিহত এবং ধৃত হয়। এর মধ্যে ১২ জনকে আমরা জীবিত অবস্থায় ধরে ফেলি। শত্রুদের কতজন আহত হয়েছিল তার সঠিক সংখ্যা না জানা গেলেও এটা নিশ্চিত যে তাদের অনেকেই আহত হয়েছিল।
শালদা রেলওয়ে স্টেশনে কৃতিত্বের সঙ্গে লড়াই করে শত্রুদের বিতাড়িত করার জন্য তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার সেনাবাহিনীর তরফ থেকে যুদ্ধকালীন সময়ে আমাকে বীরত্বসূচক হাই অর্ডার (গ্যালানট্রি এওয়ার্ড) সম্মানে সম্মানিত করে। স্বাধীন হবার পর এর নাম দেওয়া হয় বীরউত্তম। এ ছিল আমার সাবসেক্টরে কৃতিত্বপূর্ণ লড়াইয়ের একটি পুরস্কার।
মন্দভাগ শালদা নদী সাবসেক্টরে যেসব সেনা শত্রুদের সাথে লড়াইয়ে শহীদ হন, তাদের আমি কুলপাতড়া নামক স্থানে সমাধিস্থ করার ব্যবস্থা করি। এদের স্মৃতিচিহ্ন এখনও কুলাপাতড়ায় বিরাজ করছে।
শালদী নদী থেকে শত্রুদের পরাস্ত এবং বিতাড়িত হবার পর তারা বুড়িচং এবং কুমিল্লার দিকে সড়ে যায়। শালদা নদী মুক্ত করার পর মুক্তবাহিনীর একটা কোম্পানী ফ্লাইং অফিসার কামালের অধীনে রাখা হয়। শালদা নদী মুক্ত করার পর মুক্তিবাহিনীর একটা কোম্পানী ফ্লাইং অফিসার কামালের অধীনে রাখা হয়। এরপর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান কর্নেল এম.এ.জি ওসমানী (বর্তমান অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল) আমাকে ‘কে ফোর্সের ৪র্থ বেঙ্গলকে নিয়ে ফেনীর দিকে অগ্রসর হবার নির্দেশ দেন। সেই মত আমি আমার বাহিনী নিয়ে ফেনীর দিকে অগ্রসর হই। ফেনীতে অবস্থানরত শত্রুদের আক্রমণ করার জন্য আমি আমার বাহিনীকে ছাগলানাইয়া থেকে শুভপুর ব্রীজ পর্যন্ত শত্রুদের প্রতিরক্ষাব্যূহ ঘিরে অবস্তান নেওয়ার নির্দেশ দেই। সেই মত তারা অবস্থান নেয়। ‘ফোর্সের ১০ম বেঙ্গলের অধীনায়ক ক্যাপ্টেন নেবার নির্দেশ দেই। সেই মত অবস্থান নেয়। ‘ ফোর্সের ১০ম বেঙ্গলের অধীনায়ক ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম ছাগলনাইয়া থেকে লক্ষীপুর পর্যন্ত অবস্থান নেয়। ভারতীয় বাহিনীর দুটো ব্যাটালিয়ান আমাদের সাহায্য করার জন্য বিলোনিয়াতে অবস্থান নেয়। আমরা ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে অবস্থান শক্তিশালী উপর গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে গোলা চালাতে থাকি। শত্রুরা এতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। শত্রুদের মনোবল তখন একেবারেই ভেঙ্গে গেছে। শত্রুরা আমাদের গোলন্দাজ বাহিনীর আক্রমণে ভীত হয়ে ৬ই ডিসেম্বর ফেনীতে তাদের যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ ফেলে শুভপুর ব্রীজ হয়ে চট্টগ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। ৬ই ডিসেম্বর ফেনী শত্রুমুক্ত হয়। ফেনীতে আমরা অজস্র গোলাবারুদ হস্তগত করি। শত্রুরা শুভপুর হয়ে চট্টগ্রামে পালাবার সময় রেলব্রীজ ও শুভপুর সড়কের দুটোই ধ্বংস করে দিয়ে যায়। আমরা ফেনী দখল করার পর শত্রুদের পিছু ধাওয়া করি। কিন্তু শুভপুরের পারাপারে দুবার দুটো ব্রীজই ধব্বংস হবার ফলে আমাদের গতি বাধাপ্রাপ্ত হয়। আমরা শুভপুরে ব্রীজ মেরামতের জন্য দু’দিন অবস্থান করি। ভারতীয় বাহিনীর ইঞ্জিনিয়াররা দু’দিনে ব্রীজ পুন:নির্মাণ করে। তারপর আমরা নৌকা করে এবং ব্রীজের সাহায্যে শুভপুর পার হয়ে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হই। করেরহাটে রাত ৮টার সময় ‘কে’ ফোর্সের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার আনন্দস্বরূপের সভাপতিত্বে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ৪র্থ বেঙ্গল এবং মুজিব ব্যাটারীকে (বাংলাদেশের প্রথম গোলন্দাজ বাহিনী) নিয়ে আমি হিয়াকু, ফটিকছড়ি, নাজিরহাট হয়ে চট্টগ্রামের দিকে যাবে এবং ১০ম বেঙ্গল ও আরও দুটো ভারতীয় ব্যাটালিয়নকে নিয়ে বিগ্রেডিয়ার আনন্দস্বরূপ সীতাকুণ্ড হয়ে চট্টগ্রামে দিকে অগ্রসর হবেন। পরিকল্পনা নেয়া হয় চট্টগ্রামে একসঙ্গে মিলিত হয়ে আমরা একসঙ্গে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ব। পরিকল্পনা মত আমরা রাত ১২টার সময় রওনা দিলাম এবং সকাল সাড়ে ৬টায় হিয়াকু বাজের পৌঁছলাম। হিয়াকু বাজারে শত্রুদের একটা ডিলেয়িং প্লাটুন ছিল। তারা আমাদের বাধা দেয় কিন্তু আমাদের গোলন্দাজ বাহিনীর গোলাগুলির জন্য তারা অবস্থান তুলে নিয়ে ফটিকছড়িতে পালিয়ে যা। আমরা হিয়াকু সহজেই শত্রুমুক্ত করি। এরপরে রাস্তা ছিল খুবই বিপদসঙ্কুল। কোন কোন সময় আমাদের গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে অগ্রসর হতে হচ্ছিল। অগ্রসর হবার পথে বিবিরহাটের এবং হিয়াকুর মধ্যে চৌরাস্তার সামনে এক পাঞ্চাবী সেনা হাত তুলে আমাদের আসতে বলে। আমি আমার গাড়ি শত্রুসেনাটির উপর দিয়ে চালিয়ে দিই। এতে সে গুরুত্বরভাবে আহত হয় এবং চিকিৎসা করার জন্য পাঠাবার সময় পথিমধ্যে সে মারা যায়। শত্রুসেনাটি পথ হারিয়ে ছিল বলে আমার মনে হয়। নারায়ণহাটে এক রাত থাকি এবং বাহিনীকে আরো সংগঠিত করে পরের দিন সকালে ফটিকছড়ির দিকে অগ্রসর হই। পথে কাজিরহাটে দেখি এবং কাঠের ব্রীজ শত্রুরা ভেঙ্গে দিয়েছে। ব্রীজ মেরামতের জন্য আমাদের ৫/৬ ঘণ্টা সময় লাগে। কাজিরহাটে শত্রুরা আমাদের অগ্রসরে বাধা দেবার জন্য পথে অনেক মাই বসিয়ে রেখে গিয়েছিল। এসময়ের মধ্যে আমরা মাইনও সড়িয়ে ফেলি এবং আমরা ফটিকছড়ির দিকে অগ্রসর হতে শুরু করি।
ফটিকছড়িতে শত্রুদের এক কোম্পানী ই-পি-সি-এ-পি ও ২৪ তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের কিছু সৈন্য মোতায়েন ছিল। কাজিরহাট থেকে কিছুদূর এগিয়ে আমি আমার বাহিনীকে তিনভাগে ভাগ করে শত্রুদের অবস্থানে আক্রমণের জন্য এগিয়ে যাবার নির্দেশ দেই। একদল ফটিকছড়ির সন্নিকটে পাহাড়ের দিকের রাস্তায় অবস্থান নেয়। আর একদল মানিকছড়ি-রামগড় রাস্তার এক জায়গায় অবস্থান নেয। প্রধান দলটি ফটিকছড়ি কাজিরহাট রাস্তার শত্রুদের অবস্থানের নিকট অবস্থান নেয়। ১১ ডিসেম্বর বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটের সময় আমরা সম্মিলিতভাবে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। শত্রুরা আমাদের গোলাগুলির সামনে টিকতে না পেরে কিছু অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ বিছানাপত্র ফেলে পালিয়ে যায়। ফটিকছড়ি রক্ষার জন্য শুক্তিশালী অবস্থান নিতে বলি। সেই প্রধান চারটি সড়কের সামনে আমরা অবস্থান নেই। ফটিকছড়ির যুদ্ধে আমাদের দুইজন আহত হয়। পাকসেনাদের কতজন মারা গিয়েছিল তা জানা না গেলেও তাদের রক্ত মাখা জামা-কাপড় অনেক ফেলে রেখে গিয়েছিল। আমি মনে করি তাদের বেশ কিছু হতাহত হয়েছিল। এরপর শত্রুরা পিছু হটে নাজিরহাট থেকে আমাদের উপর মর্টারের সাহায্যে অবিরাম গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এর মধ্যে একজনের মারফত খবর পাই শত্রুরা রামগড়ে তাদের অবস্থান ছেড়ে দিয়ে মানিকছড়ি রাস্তা দিয়ে এগিয়ে আসছে। আমি আরো দুটো প্লাটুনকে মানিকছড়ি রাস্তায় আমাদের অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করার জন্য পাঠিয়ে দেই এবং মর্টারের সাহায্যে রামগড়ে শত্রুদের উপর গোলাবর্ষণ করতে থাকি। এতে তারা মানিকছড়ির দিকে না এগিয়ে অন্য পথে নাজিরহাটের দিকে পালিয়ে যায়।
এরপর আমি নাজিরহাটে শত্রুদের অবস্থান দেখার জন্য নাজিরহাটের দিকে যাই। নদীপারে এক দোতলা বাড়ি থেকে শত্রুদের অবস্থান রেকি করি এবং দেখি শত্রুরা নদীর ধার বরাবর শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে বসে আছে। মেজর আসিফের নেতৃত্বে ৩৪তম এফ-এম-রেজিমেন্টের ২টা কোম্পানী ও বেশ কিছু সংখ্যক ই-পি-সি-এ-পি নাজিরহাটে অবস্থান নিয়েছিল। ১৩ই ডিসেম্বর সন্ধ্যার সময় থেকে আমরা নদীর পার থেকে নাজিরহাটে শত্রুদের অবস্থানের উপর গোলাগুলি চালাতে থাকি। আমাদের লক্ষ্য ছিল এ আক্রমণে শত্রুরা যদি কিছুটা দুর্বল হয়ে পরে তাহলে আমরা সাঁতরিয়ে নদী পার হয়ে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ব। কিন্তু তাদের অবস্থান এত শক্তিশালী ছিল যে আমরা চারঘণ্টা ধরে যুদ্ধ চালাবার পরও তারা আমাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকে।
তখন বুঝতে পারি এভাবে আক্রমণ করে কোন লাভ হবে না। চারঘণ্টা আক্রমণ চালাবার পর আমি আমার বাহিনীকে উঠিয়ে দেই। এই সংঘর্ষ চলবার সময় আমরা একজন রাজাকারকে জীবিত অবস্থায় ধরে ফেলি। সে আমাকে জানায় উদালিয়া চা-বাগান থেকে শত্রুদের আক্রমণ করলে তারা এঁটে উঠতে পারবে না। সেই মত আমি উদালিয়া হয়ে শত্রুদের আক্রমণ করার পরিকল্পনা নেই। আমি লে: শওকতকে গণবাহিনীর ১টা কোম্পানী নিয়ে নাজিরহাট ও চট্টগ্রামের মধ্যকার একস্থানে অবস্থান নিতে বলি। সে আমার কথামত অবস্থান নেয়। আর একটা কোম্পানীকে নজিরহাট-চট্টগ্রাম রেললাইনের মাঝে একস্থানে অবস্থান নিতে বলি। তারাও আমার নির্দেশ মত অবস্থান নেয়। বার ঘণ্টা যুদ্ধ চালাবার পর অবস্থান তুলে নিয়ে আমি আমার লোকদের খাইয়ে নিয়ে উদালিয়ার দিকে অগ্রসর হই। রাতের মধ্যে অবস্থান ঠিক করে নিয়ে ১৪ই ডিসেম্বর ভোরে নাজিরহাটে শত্রুঅবস্থানের উপর আক্রমণ করি। তারা এত হকচকিত হয়ে গিয়েছিল যে তারা আমাদের আক্রমণে বাধা পর্যন্ত দিতে পারেনি। তারা ভেবে ছিল অবস্থান তুলে নেবার পর পুনরায় শক্তি সঞ্চয়ের জন্য আমাদের কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা সময় লাগবে। আমরা ভোরে যখন আক্রমণ চালাই তখন অনেকেই ঘুমাচ্ছিল। শত্রুরা ঘুম থেকে উঠে যখন তাড়াতাড়ি অবস্থান তুলে নিয়ে চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছিল, তখন পলায়নপুর পাকসেনাদের উপর মর্টারের সাহায্যে আক্রমণ চালানো হয়। এতে অনেক হতাহত হয়। ২৭জন পাকসেনা নিহত হয়। ৮ জন আহত সৈনিককে ধরা হয়। ৪৯ জন ই-পি-সি-এ-পি আমাদের কাছে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আত্মসমর্পণ করে। প্রচুর গোলাবারুদ, জিনিসপত্র, ১টা বেডফোর্ড ট্রাক (রেশন বোঝাই) আমাদের হস্তগত হয়। পাকসেনারা যখন পালাচ্ছিল, তখন পথে পূর্ব থেকেই অবস্থানরত লে: শওকতের গণবাহিনীর কোম্পানী ও রেলসড়কের কোম্পানী শত্রুদের পলায়নে বাধা দেয়। কিন্তু পাকসেনারা রেললাইন ও সড়কের মধ্যে দিয়ে চট্টগ্রামে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ১৪ই ডিসেম্বর নাজিরহাট মুক্ত হয়। এতে আমাদের একজন শহীদ ও চারজন আহত হয়। নাজিরহাটের ব্রীজটি মেরামত না করা পর্যন্ত আমি মর্টার, ভারী কামান, অস্ত্রশস্ত্র ও গাড়ি পার করতে পারছিলাম না। নাজিরহাটের বেসামরিক লোকের সাহায্যে ব্রীজটি পুন:নির্মাণ করিয়ে মর্টার, গাড়ি পার করিয়ে দেই।
নাজিরহাট মুক্ত করার পর আমি বাহিনী পুনর্গঠিত করে হাটহাজারীর দিকে অগ্রসর হই। ১৫ই ডিসেম্বর সকালে হাটহাজারী পৌঁছে ওখানে মেজর জাফর ইমামের সাথে যোগাযোগ হয়। তিনি সিতাকুণ্ড হয়ে ব্যাটালিয়ন নিয়ে চট্টগ্রামের দিকে এগিয়ে আসছিলেন। তারপর সম্মিলিতভাবে অগ্রসর হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যায়। ১৬ই ডিসেম্বর সকালে রেকি করে শত্রুদের আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হই। এমন সময় ‘কে’ ফোর্সের বিগ্রেডিয়ার আনন্দস্বরূপ ওয়ারলেসের মাধ্যমে নির্দেশ দেন পুনরায় নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত আক্রমণ বন্ধ রাখতে। বিকেল ৪-৩০ মিনিটের সময় পাকসেনারা আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তারা তাদের সমস্ত ব্যাজ, অস্ত্রশস্ত্র বিগ্রেডিয়ার আনন্দস্বরূপের নেতৃত্বে আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। পাকসেনাদের ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ, চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট, নেভাল বেইস ও ট্রানজিট ক্যাম্পে বন্দী করে রাখা হয়। চট্টগ্রাম আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসে। জনগণ আমাদের বিজয়মাল্যে ভূষিত করে এবং জয়োল্লাসে শহর ভ্রমণ করতে থাকে।
সর্বশেষে বলতে চাই তাদের কথা-যারা আমাদের বিশেষভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। মন্দভাগ ও শালদা নদী সাবসেক্টরে আমাকে যারা সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন তারা হলেন, কর্নেল খালেদ মোশাররফ, ক্যাপ্টেন মতিন, ক্যাপ্টেন মহসীনউদ্দিন আহমেদ, লে: এ কে ফজলুল কবির, ক্যাপ্টেন ডা: আক্তার হোসেন, লে: মোস্তফা কামাল, সুবেদার আ: ওহাব, নায়েব সুবেদার বেলায়েত (শহীদ), সুবেদার শহীদ, সুবেদার আম্বিয়া (বিডিয়ার), নায়েব সুবেদার আসদ্দর আলী (বিডিয়ার), সুবেদার আব্দুর রহমান, নায়েব সুবেদার মনির হোসেন, সুবেদার মেজর আ: জব্বার, সুবেদার মেজর মো: হেলাল উদ্দীন, নায়েব সুবেদার মো: হোসেন, নায়েব সুবেদার মঈনুল হোসেন, (শহীদ) নায়েব সুবেদার সিরাজ, সুবেদার ফরিদউদ্দিন (বিডিয়ার), পুলিশ ইন্সপেক্টর আব্দুর রাজ্জাক, মুক্তিযোদ্দা কাদের, মোজাম্মেল, ফিরোজ, মিজানুর, মোশাররফ, রবিউল ও আরো অনেকে। কর্নেল খালেদ মোশাররফ ছিলেন সেক্টর-২ এর অধিনায়ক। তিনি অনেক সময় আমাকে যথাযথ নির্দেশ দিয়ে আক্রমণের পরিকল্পনায় যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। সুবেদার বেলায়েত, সুবেদার মঈন বীরত্বের সাথে লড়াই করতে করতে শহীদ হন। তাদের কথা আমার চিরদিন মনে থাকবে। এ সমস্ত ব্যক্তির সাহায্য-সহযোগিতা না পেলে আমার পক্ষে কোনক্রমেই সম্ভব হত না মন্দভাগ ও শালদা নদীতে শত্রুদের পর্যুদস্ত ও পরাজিত করতে। মনে পড়ে আরেকজন স্থানীয় ডাক্তার জনাব জহুরুল হকের কথা- যিনি সব সময় আমার আহত সৈনিকদের চিকিৎসা করে ছিলেন। আরো মনে পড়ে শালদা নদী, মন্দভাগের জনগণের স্বত:স্ফূর্ত সাহায্য-সহযোগীতার কথা। তারা আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন, অনেক সময় খাদ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন, শত্রুদের অবস্থানের কথা জানিয়েছেন এবং গুলিরমুখে পড়েও তারা কোনদিন ভীত হননি। আমি এদের সবাইকে আমার কৃতিত্বপূর্ণ সংগ্রামের সাথী হিসেবে মনে করি। এদের সকলের সাহায্য-সহযোগিতার জন্য আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল শত্রুদের বিতাড়িত ও পর্যুদস্ত করা। আমি তাদের সবাইকে স্মরণ করি এবং কৃতিত্বপূর্ণ সংগ্রামের জন্য সালাম জানাই।
স্বাক্ষর: মেজর আবদুর গফফার
২১-০৮-১৯৭৩ ইং
* ১৯৭৩ সালে এ সাক্ষাৎকার গৃহীত হয়। জনাব গাফফার একাত্তরের মার্চে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টে এ্যডজুটেন্ট হিসাবে ক্যাপ্টেন পদে ছিলেন।
আতিকুল ইসলাম ইমন
<১০, ৪.৪, ১৭০–১৭১>
সাক্ষাৎকারঃ মেজর ইমামুজ্জামান
জুন মাসের ৭ তারিখে পাকিস্তানীরা প্রথমবারের মত ফেনী থেকে পরশুরামের দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করে তাদের অগ্রগতি প্রতিহত করা হয়। প্রায় ৩০০ জনের মত নিহত হয়। লাশগুলো এ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাবার সময় আমরা দেখতে পাই।
জুন মাসের ২১ তারিখের মধ্যে ওরা ১৭ বার আমাদের আক্রমণ চালায়। কিন্তু প্রতিবারই ওরে আক্রমণকে প্রতিহত করা হয়। ওদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। জুন মাসের ২১ তারিখে ৭টা হেলিকাপ্টার (সৈন্য বোঝাই) আমাদের পিছনে নামানো হয়। ভোর তিনটা/চারটার দিকে পেছনের এক ব্যাটালিয়ন কমান্ডো সৈন্য এবং সামনে থেকে পাক ব্রিগেডেরও অধিক সৈন্য ট্যাংক এবং গোলন্দাজ বাহিনীর সহযোগিতায় আমাদের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। আমাদের বহু লোক হতাহত হয়। উপায়ন্তর না দেখে মুহুরী নদীর পার ঘেঁষে ঘেঁষে ওদের প্রতিরক্ষাবূহ্য ভেতর দিয়ে বহু কষ্টে বের হয়ে আসলাম, আমাদের অনেকে হতাহত হয়েছিল। বেলুনিয়া পর্যন্ত ওরা আমাদের পিছু ধাওয়া করে। আমরা বেলুনিয়া চলে যেতে বাধ্য হই।
চৌদ্দগ্রামের সীমান্তে ক্যাম্প খুললাম। সেখান থেকে গেরিলা অপারেশন শুরু করা হয়। লাকসাম থেকে ফেনী রেলওয়ে লাইন এবং লাকসাম-চাঁদপুর রেলওয়ে এলাকায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য রাস্তার উপর মাইন পুঁতে রাখি। এসময় ডিনামাইট দিয়ে অনেক গাড়ি উড়িয়ে দেয়া হয়। সৈন্য বোঝাই অনেক ট্রেনের ক্ষতি সাধন করা হয়। জগন্নাথদিঘী, চিওড়া, চৌদ্দগ্রাম হরিসর্দার বাজারে পাকিস্তানী সৈন্যদের ঘাঁটিগুলোতে রেইড করা হয়।
অক্টোবর মাসে আমার কোম্পানী এবং মেজর জাফর ইমামের কোম্পানী নিয়ে দ্বাদশ বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠন করা হয়। নভেম্বর মাসের ২ তারিখে দ্বাদশ বেঙ্গল রেজিমেন্ট পেছন থেকে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর সহযোগিতায় পরশুরামের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালায়। সকালের মধ্যেই ৪ বর্গমাইল এলাকা আমরা মুক্ত করতে সক্ষম হই। ৪৪ জন সৈন্য একজন ক্যাপ্টেনসহ আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
পশুরামে আমরা ঘাঁটি স্থাপন করি। নভেম্বরের ১৯ ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে মুন্সিহাট-পাঠানগর অঞ্চলে আক্রমণ চালানো হয় এবং মুক্ত করা হয়। অনেক পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। অধিকাংশই পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ভারতীয় বাহিনী ঐ এলাকায় ৪টা ট্যাংক নিয়ে ঢুকেছিল।
ডিসেম্বর মাসের তিন তারিখে ফেনির উপরে আক্রমণ চালানো হয়। সকালের মধ্যে সমস্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী ফেনী ছেড়ে চলে যায়। ফেনী থেকে আমরা চৌমুহনীর দিকে রওয়ানা হলাম। সেখানে অনেক পাকিস্তানী সৈন্য ও রাজাকার ছিল। দু’দিন তুমুল যুদ্ধ চলে। পরে চৌহমুহনী মুক্ত হয়। প্রায় একহাজার রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। অনেক পাকিস্তানী সৈন্যও আত্মসমর্পণ করে।
৭ই ডিসেম্বর আমরা মাইজদীতে গেলাম। সেখানেও পাকিস্তানীরা বাধা দেয়। অনেক রাজাকার এবং পাকিস্তানী সৈন্য আত্মসমর্পণ করে। এই সমস্ত এলাকার দায়িত্ব মুক্তিবাহিনীর কাছে অর্পণ করে আমরা চট্টগ্রামের দিকে রওয়ানা হলাম।
ডিসেম্বর মাসের ১২ তারিখে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পৌঁছাই। ১৪ই ডিসেম্বর হাটহাজারী থানা দখল করা হয়। ডিসেম্বর ১৬ তারিখে খবর পাওয়া গেলো পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডোর কাছে আত্মসমর্পণ করবে। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানীরা চট্টগ্রামেও আত্মসমর্পণ করলো। মুক্তিবাহিনীতে অধিকাংশ স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র যোগ দিয়েছিল। তাছাড়া গরীব এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির যুবকরা নিঃস্বার্থভাবে যুদ্ধ করেছিল।
স্বাক্ষর: মেজর ইমামুজ্জামান
১০-০১-১৯৭৪ ইং
* লেঃ কর্নেল ইমামুজ্জামান ১৯৭১ সালের মার্চে লেফত্যানেন্ট হিসাবে কুমিল্লা সেনানিবাসে ছিলেন, ইমামুজ্জামানের এ সাক্ষাৎকারটি ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমীর পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হয়।
আতিকুল ইসলাম ইমন
<১০, ৪.৫, ১৭১–১৭৩>
সাক্ষাৎকারঃ লেঃ কর্নেল মোস্তফা কামাল
প্রশ্ন: আপনি ভারতে গিয়েছিলেন কবে?
উত্তর: আমি মে মাসের ১৫ তারিখে ভারত গিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে লে: মালেক গিয়েছিলেন। আমাদের দু’জনকে নেয়ার জন্য আমাদের সঙ্গে গাইড ছিল।
প্রশ্ন: আপনারা বরিশাল থেকে ঢাকা এলেন এবং কিভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া যায় সেই আন্ডারস্ট্যান্ডিং- এ আপনারা ঢাকা থেকে আগরতলা গেলে মে মাসে। সেখান থেকে আপনারা কোথায় গেলেন?
উত্তর: আগরতলা একটা বড় জায়গা। আগরতলার একটা জায়গার নাম সোনামুড়া। সোনামুড়া বর্ডার এলাকা। সেখানে ২নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ছিল। আমরা প্রথমে যাই এবং গিয়ে রিপোর্ট করি। আমার পরিচয় দেয়ার ফর্মালিটি যা করার সেগুলো হলো। খালেদ মোশারফ ২নং সেক্টরের চার্জে ছিলেন। তাকে মাঝে মাঝে নানা জায়গায় নানা সাবসেক্টরে যেতে হতো। সেদিনও তিনি গিয়েছিলেন, ফলে তার সাথে তখন দেখা হয়নি; কিছুদিন পরে দেখা হয়েছিল। তখন ছিলেন ক্যাপ্টেন হায়দার সাহেব- পরে লে: কর্নেল হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন তখনকার বলা চলে সেকেন্ড ইন কমান্ড সেক্টর তিনি ছিলেন ট্রেনিং সেন্টারের ইনচার্জ। ২নং সেক্টর হেডকোয়ার্টারে ট্রেনিং দেয়া হতো ছাত্রদের এবং যারা আর্মি পারসন না তাদের। গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং দেয়া হতো এবং তাদের অস্ত্র দিয়ে ভেতরে পাঠানো হতো। এই ট্রেনিং সেক্টরটা প্রথমে সোনামুড়ায় ছিল, পরে নানা দিক বিবেচনা করে মে মাসের শেষ সপ্তাহে সোনামুড়া থেকে মেলাঘরে স্থানান্তরিত করা হলো।
প্রশ্ন: আচ্ছা আমি তো মেলাঘরে ট্রেনিংটা সেন্টারে গিয়েছিলাম, কোন বিশেষ অস্ত্রের উপর দেয়া হতো নাকি সাধারণভাবে নানা অস্ত্রের উপর দেয়া হতো?
উত্তর: প্রথমে সময় কম থাকায় তাড়াতাড়ি ১৫/১৬ দিনের মধ্যে একটা রাইফেল ট্রেনিং দেয়া হতো। তারপর কিভাবে গ্রেনেড ছুড়তে হয়, কিভাবে প্রিকশন নিতে হয় এবং যারা ব্রীজ ধ্বংস করবে অর্থাৎ কিভাবে ব্রীজ ডিমোলিশন করতে হবে- এসব ট্রেনিং দেয়া হতো। প্রথম দিকে খুব তাড়াতাড়ি ট্রেনিং দিয়ে ভিতরে পাঠানো হতো।
প্রশ্ন: আপনি এখানে কয় মাস ছিলেন?
উত্তর: আমি ২/৩ মাস ছিলাম। এরপর আমাকে সেক্টর থেকে আগরতলায় বিগ্রেড হেডকোয়ার্টারে পাঠানো হয়।
প্রশ্ন: হেডকোয়ার্টারে কাজ কি ছিল?
উত্তর: যেহেতু বাংলাদেশ ফোর্সের হেডকোয়ার্টার ছিল কলকাতায় সেহেতু ইনসাইডে অর্থাৎ ইস্টার্ন সাইডে আমাদের ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার সাব হেডকোয়ার্টার হিসেবে কাজ করেছে- কলকাতাকে জেনারেল হেডকোয়ার্টার ধরলে এদিকের অর্থাৎ ইস্টার্ন সাইডের কো-অর্ডিনেশন করার জন্য যে সাব হেডকোয়ার্টার ছিল সেটার অবস্থান ছিল আগরতলায়। সেখানে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত লে: কর্নেল রব সাহেব। তিনি তখন সিলেটের এমপি ছিলেন। তিনি ছিলেন, মেজর আফতাব চৌধুরী ছিলেন, স্কোয়াড্রন লিডার শামসুল হক ছিলেন যিনি এখন ডাইরেক্টর জেনারেল, মিলিটারি সার্ভিসেস। তারপর একজন সিভিলিয়ান ডাক্তার ডা: আলী। ২নং সেক্টর থেকে আমাকে বলা হলো সেখানে যেতে হবে, তাই যেতে হয়েছিল। সেখানে জুলাই এর শেষের দিকে কিংবা আগস্টের প্রথম দিকে গিয়েছিলাম।
প্রশ্ন: ওখানে আপনার দায়িত্ব কি ছিল ?
উত্তর: যেহেতু বিডিএফ (বাংলাদেশ ফোর্সেস)-এর প্রধান কার্যালয় ছিল কলাকাতাতে এবং ইষ্টার্ন সাব হেডকোয়ার্টার ছিল আগরতলায় এই দুটোর মধ্যে কো-অর্ডিনেশনের জন্য। যেমন কোন অপারেশন প্ল্যান পাঠানো হলে সেটা কার্যকরী করা, বিভিন্ন সাব সেক্টরে প্ল্যান ম্যাসেজ ফরমে পৌঁছে দেয়া, যে অপারেশন তারা করছে, পরবর্তীতে তারা কি অপারেশন করবে সেগুলোর প্ল্যান তৈরি এবং সেটার প্রসেসিং ইত্যাদি করা হতো আমাদের ইষ্টার্ন সাব- হেডকোয়ার্টারে। সাব- হেডকোয়ার্টার আবার পরবর্তীতে এ সমস্ত ম্যাসেজ, প্ল্যান প্রোগ্রাম পৌঁছে দিতো বাংলাদেশ ফোর্সের প্রধান কার্যালয় কলকাতাতে।
প্রশ্ন: আপনারা কি ধরনের যুদ্ধ করছিলেন?
উত্তর: প্রথম দিকে গেরিলা যুদ্ধ, পরে দিকে অর্থাৎ একদম শেষের দিকে নিয়মিত যুদ্ধ- যাকে বলে সম্মুখযুদ্ধ হয়েছিল।
প্রশ্ন: আপনি ওখানে কতদিন ছিলেন?
উত্তর: ওখানে বেশ কিছুদিন ছিলাম। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আমি আবার মেলাঘরে চলে আসি।
প্রশ্ন: মেলাঘরে কিসের জন্য পাঠানো হয় আপনাকে ?
উত্তর: তখন অলরেডী যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ট্রেনিং- এর কাজ প্রায় শেষ। হয়তো তখন হেডকোয়ার্টার থেকে সেক্টরে বেশি প্রয়োজন ছিল সেজন্য সেক্টরে পাঠানো হয় আমাকে যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য। কেননা, তখন পুরোপুরি যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল, যাকে বলে কনভেনশনাল ওয়ার।
প্রশ্ন: আচ্ছা, ইন্ডিনিয়ান আর্মিদের সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল? যেমন- কোন কোন ক্ষেত্রে ইন্ডিয়ান আর্মিরা প্ল্যান- প্রোগ্রাম করেছিল, যেসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আর্মিদের মধ্যে মতান্তর ঘটেছে। আপনাদের সাথে এমন কিছু কি হয়েছিল?
উত্তর: দেখুন, কনভেনশনাল ওয়ারের আগে সবটাই বাংলাদেশ আর্মি প্ল্যান- প্রোগ্রাম করেছিল। বাংলাদেশ ফোর্সের যে হেড অফিস ছিল সেখানকার নিদের্শনাবলী চূড়ান্ত । তবে ইন্ডিয়ান আর্মি নানান দিক থেকে সার্পোট দিয়ে, যেমন আর্মস অন্যান্য জিনিসপত্র দিয়ে সাহায্য করেছে।
প্রশ্ন: আপনাকে আরেকটা প্রশ্ন রাখি। আপনি মে মাসে এত তাড়াতাড়ি ইন্ডিয়ায় যাওয়ার চিন্তাভাবনা নিয়েছিলেন কেন? কেননা, আমরা জানি তখন পুরো বাংলাদেশে যুদ্ধ চলছে। তখনও খোলাখুলি কোথাও বাংলাদেশ ফল করেনি, আপনি আগেই যেতে চেয়েছিলেন কেন?
উত্তর: তখন খণ্ড খণ্ড গেরিলা যুদ্ধ হয়েছিল। অলরেডি তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র খোলা হয়েছিল। তখন আমরা ভাবলাম একটা কিছু করতে হলে নিয়মিত বাহিনীর পক্ষে দেশের ভেতর থেকে করা সম্ভব নয়। দ্বিতীয় পক্ষের সাহায্য দরকার। সেই দ্বিতীয় পক্ষ যে ইন্ডিয়া তা আমরা ধরে নিয়েছিলাম এবং বেতার ও অন্যানো লোকের মারফত জানতে পেরেছিলাম। সেজন্যই ইন্ডিয়ায় যাওয়ার চিন্তা ভাবনা করি।
*প্রকল্প কর্তৃক ৮-১০-৭৯ তারিখে কুমিল্লা সেনানিবাসে গৃহীত সাক্ষাৎকার।
আতিকুল ইসলাম ইমন
<১০, ৪.৬, ১৭৩–১৭৫>
সাক্ষাৎকারঃ মেজর শহীদুল ইসলাম
এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি ভারতের একিনপুর (বিএসএফ ক্যাম্প) যাই। সেখানে অনেক এমসিএ, সাধারণ লোক, ইপিআর, পুলিশ সবাইকে দেখলাম। ফেনীর উত্তর অঞ্চল এবং বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন চলে আসে। পাকবাহিনী এসব এলাকার লোকদের নৃসংভাবে হত্যা করেছে, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। ওখানে ৭০৮০ জন লোক নিয়ে ছোটখাট কোম্পানী গঠন করি। আমার সাথে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রউফ ছিলেন। ওখানে আমরা গেরিলা কার্যকলাপ শুরু করে দেই মে মাস পর্যন্ত। আমরা পাকবাহিনীকে অতর্কিতে আক্রমণ করতাম, আবার ঘাঁটিতে ফিরে আসতাম। এখানে-ওখানে পাকবাহিনীকে ব্যতিবস্ত করে তুললাম। ভারতীয় কর্নেল (৯১ বিএসএফ) গুপ্ত, ক্যাপ্টেন মুখার্জী, মেজর প্রধান আমাদের সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেছেন। মেলাঘর-২ সেক্টরের অধীনে একিনপুর সাবসেক্টরে কাজ করতে থাকি। ইতিমধ্যে ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম (বর্তমান মেজর) কিছু সেনা নিয়ে এসে আমাদের সাথে যোগ দেন। ফেনীর মধ্যে সরিষাদি, বন্দুরা, মুন্সীরহাট, ফুলগাজি, ফেনী জুন মাস পর্যন্ত এসব এলাকাতে ব্যপকভাবে গেরিলা আক্রমণ আক্রমণ চালানো হয়। জুন মাসে আমরা সাবেক বিভিন্ন ইপিআর বিওপিতে অবস্থানরত পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে পাকসেনাকে হত্যা করেছি। আমরা হঠাৎ করে আক্রমণ করতাম- লোক ক্ষয় করে অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করে আবার ঘাঁটিতে ফিরে আসতাম। আমরা দু’ভাগে ভাগ হয়ে যেতাম, মাঝখানে থাকতো মর্টার। নির্দিষ্ট সময়ে মর্টার শেলিং শুরু হলে পাকবাহিনীরা পালাতে শুরু করলে আমরা গুলি শুরু করতাম। এভাবে বহু পাকসেনা মাঝে মাঝে মারা যেত। আমাদের কোন ক্ষতি ওরা করতে পারতো না। এত আকস্মিক আক্রমণ আমরা করতাম যে ওরা বুঝতেই বা ভাবতেই পারতো না। ২নং সেক্টরের প্রধান ছিলেন মেজর খালেদ মোশারফ। তিনি আমাদের হুকুম দেন ছাগলনাইয়াতে যাবার জন্য। জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে আমরা সমরগঞ্জ বিএসএফ ক্যাম্পে যাই। তারা আমাদের সাদরে অর্ভ্যর্থনা করলো। সরগঞ্জ থেকে ছাগলনাইয়ার বাঁশপারাতে (ফেনী) ঘাঁটি গাড়ি। বাঁশপাড়াতে আমরা প্রায় ১২০ জনের মতো ছিলাম। জুন মাসের শেষের দিকে আমরা ফেনীর দিকে মুখ করে শক্ত ঘাঁটি গড়লাম। প্রথম দিন যাবার দিনই পাঞ্জাবী সৈন্যের গুলি শুনতে পেলাম। পাঞ্চাবীরা ঐ পথেই এগিয়ে আসছিল গুলি করতে করতে। আমরা ভারী অস্ত্রের সাহায্যে গুলি শুরু করলে পাঞ্চাবীরা পালিয়ে যায়। আমরা নির্দিষ্ট স্থানে চলে আসি।
বেসামরিক লোকেরা আমাদের সার্বিকভাবে সাহায্য করে। চাল ও অন্যান্য জিনিসপত্র তুলে আমাদের জন্য নিয়ে আসতো। তারা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিল। জুন মাসের শেষের দিকে পাকবাহিনী ১৫/১৬টি গাড়ি করে আমাদের আক্রমণ করে। আমরা আগেই খবর পেয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের প্রায় দেড়শত সৈন্য দু’টি ভাগে ভাগ করে নেই- ডেপথ-এ মেজর জাফর ইমাম এবং আমি সামনে। আমি ভারী অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করি। পাকবাহিনী ৫০০ গজের মধ্যে চলে আসে। আমি সামনে থেকে ওদেরকে বেশ দেখতে পাচ্ছি। সারাদিন যুদ্ধ হবার পর পাকবাহিনী ফিরে যায়। ওদের পক্ষে ৬০৭০ জন মরতে দেখি। অদেখা আরও মৃত্যুর সংখ্যা ছিল তবে সামরিক সূত্রে অনেক লোক মারা গেছে শুনলাম। আমাদের কোন ক্ষতি হয়নি। জুলাই মাসের প্রথমেই পাকবাহিনী প্রচণ্ড আর্টিলারী এবং বহু সেনা নিয়ে আমাদের আক্রমণ করে। আমরা তিনটি ভাগে ভাগ হয়ে থাকি। আমি আগে, তার পাশে একটি এবং আমার পিছনে একটি রাখি আমার সাহায্যের জন্য। আমরা যখন ফায়ারিং শুরু করি তখন পাকবাহিনী আমাদেরকে সামনে ব্যস্ত রেখে দু’দিকে দুটো কোম্পানী ঘিরে ফেলতে থাকে। আমরা কিছুই জানতাম না। প্রায় পাশাপাশি যখন এসেছে তখন ওরা ফায়ারিং শুরু করে। আমরা আমাদের বিপদ বুঝতে পারি। সামনে দু’একজন সৈন্য সামান্য অস্ত্র রেখে বাকি সবাইকে আস্তে আস্তে পিছনে হাটতে বলি। আমরা যে পিছনে হটছি তা তারা বুঝতে পারেনি। কারণ দু’একজন অনবরত গুলি করেই যাচ্ছিল। ইতিমধ্যে পিছনের দলটি আমাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। আমি তাকে বাধা দিয়ে পিছনে সরে যেতে বলি। আমরা পিছনে একটি ভাল জায়গা দেখে পুনরায় ঘাঁটি গাড়ি। পাকবাহিনী এগিয়ে আসে পুল অতিক্রম করে। পাকসেনারা বাঁশপাড়া, পূর্ব ও পশ্চিম ছাগলনাইয়া, বেলুনিয়া, ছাগলনাইয়া, বাজার, কুমা সমস্ত গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে সম্পূর্ণ র্ধ্বস করে। বহু মানুষ গুলি করে হত্যা, মারধর করে। বহুকে ধরে নিয়ে যায়। আমরা পিছনে গিয়ে সবাই একত্র হয়ে ওদের উপর আক্রমণ করি তখন ওরা আর অগ্রসর হয়নি। জুলাই মাসেই আবার পাকবাহিনী আক্রমণ করে। দু’দিন ধরে যুদ্ধ হয় সবসময়। আমরা যেতে পারেনি, এমনকি পানি খাবারও অবসর ছিল না। সবসময় ব্যাপকভাবে ফায়ারিং চলছিল। আমরা টিকতে না পেরে পিছু হটি এবং ছাগলনাইয়ার বিত্তপিতে দীঘির ধারে ঘাঁটি ঘারি। দু’তিন দিন পর আবার সংঘর্ষ শুরু হয়। এখানেও আমরা টিকতে পারিনি, তারপর সমরগঞ্জের দু’তিন মাইল দক্ষিণে আমাদের সামরিক ছাউনি ছিল ওখানে চলে যাই। ওখানে এক সপ্তাহ বিশ্রাম নেই। কারণ একমাস যাবৎ গোসল ছিল না, খাওয়া-দাওয়া পায় তেমনি আছে। জুলাইআগস্ট মাসে আমরা আবার মধুগ্রামে পজিশন নেই। শুভপুর এবং ছাগলনাইয়ার মাঝামাঝি স্থান ছিল মধুগ্রাম। ১৫১৬ দিন ওখানে ছিলাম। একদিন পাকবাহিনীর একটি টহলদার পার্টিকে যারা ট্রাকে করে এসেছিল আক্রমণ করে সম্পূর্ণ শেষ করে দেই।
ওখানে দু’তিন দিন থাকি। তারপর আর একদিন আমরা পাকবাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হলাম। সামনে মেজর (বর্তমান কর্নেল) জিয়ার বাহিনী, পেছনে আমরা। পাকবাহিনীর সামনের দলকে সম্পূর্ণ ঘিরে ফেলে এবং এই সংঘর্ষে আমাদের বহু সৈন্য শহীদ হয়। আমরা যখন খবর পাই তখন আর অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়নি- আমরা পিছু হটে সামরিক ছাউনিতে ফিরে আসি।
আমরা আবার মধুগ্রামে অবস্থান নেই। তারপর সেখান থেকে মুন্সিরহাট। সমগ্র এলাকাটিকে কেন্দ্র করে আমরা পজিশন নেই। কুতুবপুর জাম্পপুরা বেলুনিয়া রেলওয়ে পর্যন্ত আমার দায়িত্ব ছিল। মাসটি বোধহয় আগস্ট হবে। ৩৪ দিন বাঙ্কার করতে চলে যায়। সামনে একটি সেকশন রাখি। বন্দুরা পুলের ওখানে একটি ছোট টিম রাখি। একদিন সকালে পাকসেনারা পুল অতিক্রম করে যাচ্ছিল। আমরা হঠাৎ আক্রমণ করে ১০১২ জন পাকসেনাকে হত্যা করি। পাকসেনারা ফিরে গিয়ে অধিক শক্তি নিয়ে পুনরায় আসে। আমরা পুরো রাস্তা মাইন পুতে রেখে ছিলাম- যাতে ট্যাঙ্ক পর্যন্ত আসতে না পারে। কিন্তু তবুও পাকবাহিনী আক্রমণ চালালো। ১০ টার দিকে আক্রমণ করে। পাকবাহিনী ইয়া আলী বলে অগ্রসর হচ্ছিল। আমরা সামনা সামনি ওদের দেখছিলাম। বহু পাকবাহিনী মারা যায় তবুও সামনে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা ছাড়েনি। আমাদের ৫৬ জন শহীদ হলো। কিছু আহত হয়। ওদেরকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেই। আমার সাথে লোকমান বলে এক সিপাই ছিল। সাথে এলএমজি ছিল। বাঙ্কারের চিদ্র দিয়ে ব্রাষ্ট এসে তারা মাথা সম্পূর্ণ উড়িয়ে নিয়ে যায়। সে তৎক্ষণাৎ মৃত্যৃবরণ করে। আমি বেঁচে যাই।
সেদিন পাকবাহিনী কিছুতেই সামনে অগ্রসর হতে পারেনি। বেলা ২টার দিকে ওরা ওখানেই পাকা বাঙ্কার করতে শুরু করে। বাঙ্কার করতে গেলেই আমরা গুলি করতাম। ওরা বাঙ্কার বন্ধ রাখেতো। এ সময় প্রায় মুষল ধারে বৃষ্টি হতো । আমরা বৃষ্টির মাধ্যমে যুদ্ধ করে যেতাম। একাই জমা ভিজতো আবার শুকাতো। ৫০০ গজের মধ্যে পাকবাহিনী এবং আমরা সামসমনি ১৫২০ দিন যুদ্ধ করি। ছোট খাট দুটো দেশের সামনসামনি যুদ্ধ বলা যেতে পারে। পাকবাহিনী পাকা বাঙ্কার করে আমাদের উপর দিনে রাতে অন্যান্য দিক দিয়ে বিভিন্নভাবে আক্রমণ চালায় কিন্তু সমস্ত জায়গায় আমাদের সেনাবাহিনী ছিল। সবরকমের চেষ্টা করেও আমাদের ডিফেন্স ওরা ভাঙ্গাতে ওরা পারেনি।
পাকসেনা এবং আমরা সামনসামনি থাকি। তখন পুরো বর্ষা। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছুই দেখা যায় না। পাকসোনারা এ অবস্থার সুযোগ নেয়। তারা দুটি দিয়ে ৬৭ গানবোটে সৈন্য পাঠিয়ে দেয়। পর পর চার হেলিকাপ্টারযোগে সন্ধ্যা সাড়ে ৭ থেকে ৮টার সময় আমাদের পিছনে সৈন্য নামিয়া দেয়। সামনে তো পাকসেনা ছিলোই। আমার বিপদে পড়–লাম কারুণ আমাদের গানপয়েন্ট ফেনীর দিকে সামনে, পিছনে, পাশে এবং গানবোট সব ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়ে। আমরা মেসেজ পেলাম পিছু হাটবার জন্য। কারণ এখানে থাকলে নিশ্চিত মৃত্যু ছিল। আমি আমার বাহিনী নিয়ে চলে গেলাম। আর যারা ছিল তারাও চলে আসে। আমার সংবাদ যারা বিশেষ পায় তারা আসার পথে পকিস্তানীদের গুলিতে আমার বাহিনীর ৪৫ জন আহত হয়।, তবে কেউ মারা যায়নি। আমরা সবাই একত্রিত হয়ে পুনরায় ভবিষ্যাৎ কর্মপন্থা ঠিক করি। ঠিক সময়ই আমাদের উপর হুকুম হয় সিগনালস টিম গঠন করার জন্য। কারণ, আসলে আমি সিগনালের মানুষ। আমি চলে আসি আগরতলাতে। ভারতীয় বাহিনীর সাহায্য আমি সিগনাল কোর গঠন করতে থাকি। সিগনালের অভাবেই অধিকাংশ যুদ্ধু সময়দানে আমার মার খাচ্ছিলাম। পরদিন যুদ্ধ করবার জন্য পুরো ব্রিগেডের জন্য সিগনাল টিম গঠন করি। ‘কে’ ফোর্স এবং এস ও ‘জেড’ ফোর্স’ নামে তিনটি ব্রিগেড গঠিত হয়। ‘কে ফোর্স এবং ‘এস ফোর্সের এবং সেই সঙ্গে জেড ফোর্সের জন্যও লোকজন সংগ্রহ করা হয়। ফ্লাইং অফিসার রউফ থাকেন এস ফোর্সের সাথে। আমি থাকি ‘কে’ ফোর্সের সাথে। আক্রমণ চালাই একযোগ। ফেনী মুক্ত করে ফেলী। পরবতীকালে ১০ম বেঙ্গলে আবার অস্ত্র ধরি সেকেন্ড হিসেবে। ক্রমশঃ অগ্রসর হতে থাকি। তারপর একের পর এক দখল করে চলি। চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকি। পুরো বিগ্রড নিয়ে চলিলাম। আমাদের সাথে ভারতীয় অনেক কোম্পানী ছিল। আমার আমরা ফৌজাদারহাট পর্যন্ত যাই- তখন যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যায় এবং পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। আমরা ওখানেই থেকে থেকে যাই। টিবি হাসপাতালের ২০ মাইলের মধ্যে চট্টগ্রাম। ওখানে পাকবাহিনী সাথে তার ব্যাপক বাহিনীর হারায়।
আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে গিয়েছি। পাকবাহিনী গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। বেসামরিক লোককে হত্যা করেছে, লুট করেছে, নারী ধ্বংস করেছে। গ্রামগুলোতে রাজত্ব কায়েম করেছিলো
স্বাক্ষরঃ শহীদুল ইসলাম
২৩.৩.৭৩
**১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমীর পক্ষ থেকে এ সাক্ষাতকার গ্রহণ করা হয়। মেজর শহীদুল ইসলাম একাত্তর সালে ক্যাপ্টেন পদে ছিলেন।
আতিকুল ইসলাম ইমন
<১০, ৪.৭, ১৭৫–১৭৮>
সাক্ষাৎকারঃ ক্যাপ্টেন হুমায়ুন কবির
১৭ ই মে আমাকে প্রথম অপারেশনে পাঠানো হয়। ক্যাপ্টেন গফফার সাহেবেই আর নেতৃত্ব দেন। কসবা, কুটিবাড়ি, আড়াইবাড়ি ইত্যাদি এলাকায় পাকসেনাদের ঘাঁটি ছিল। আমার লোক দিয়ে সমস্ত অবস্থান জেনে নিয়ে তাদের উপর অতর্কিত আক্রমনে পরিকল্পনা করি। তখন ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে। আমদের নির্দেশ ছিল হঠাৎ করে আক্রমণ করো এবং সরে এসো। আমরা দু’দলে বিভক্ত হয়ে একদলকে রক্ষণভাবে রাখি। দ্বিতীয় দল মর্টারের সাহায্যে পাকসেনাদের ঘাটিঁর উপর আক্রমণ চালায়। আমি ছিলাম ক্যাপ্টেন গফফারের সাথে মর্টারের শেলিং-এ। শেলিং করে আমরা চলে আসি। চলে আসার সময় পাকসোনারা গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে আমাদের ওপর প্রচণ্ড গোলাগুলি চালায়। আমরা সবাই ক্যাম্পে ফিরে আসি। পরে খবর পেয়েছিলাম ওদের ১৫ জনের মত মারা গিয়াছিল এবং প্রচুর গোলাবারুদের ক্ষতি হয়েছিল। এটাই ছিল আমার প্রথম অপারেশন। ক্যাম্পে সমস্ত সৈনিক দেখি শত্রুখতম বা আক্রমণ এক নেশার মধ্যে আছে। খাওয়া-দাওয়া অনিয়ম বা কাপড়-চোপড় অভাবে তাদের ছিল, কিন্তু এদিকে কারও খেয়াল ছিল না। শক্রর খোজ পেলে তারা তৎক্ষণাৎ আক্রমণ করার আনন্দে মেতে উঠত। তাদের দেশপ্রেম এত প্রবল হয়ে উঠছিল যে, মৃত্যৃভয়ও তাদের টলাতে পারেনি। কিছুদিনের মধ্যে আমাকেও এই নেশায় পেয়ে বসল। এরপর যখন কোন খবর পেতাম শত্রুকে আক্রমণ করার, তখন আমি আমার অধীনে অয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে গিয়ে পেট্রোলিং এ্যামবুশ এবং শত্রুর ওপর হঠাৎ আক্রমণ চলাতাম। এরপর ক্যাপ্টেন গফফার আমার অধিনায়কত্বে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে শত্রুর উপর ঝাপিঁয়ে পড়ার অনুমতি দিলেন।
কসবা হচ্ছে এমন একটি স্থান যার ভৌগলিক গুরুত্ব অপরিসীম। কসবা রেলওয়ে স্টেশন খেকে ভারতীয় সীমান্ত দেখা যায়। সীমান্তের পাশ দিয়ে ছোট ছোট পাহাড়। পাহাড়ে বেশ গাছ পালা ও আছে। মে মাসের ২২/২৩ তারিখে দিকে খবর পেলাম পাকসেনারা দুটি ট্রলি বোঝাই অস্ত্রশস্ত্র মন্দভাগ রেলওয়ে (কসবার নিকট) স্টেশন থেকে শালদা নদীর দিকে নিয়ে যাচ্ছে। রেলওয়ে ট্রলির দুই পাশ দিয়ে আক প্লাটুন পাকিস্তানী সেনা টহল দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। খবর পেয়ে দু সেকশন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আমি খালি গায়ে এবং লুঙ্গি পড়া অবস্থায় পাহাড়ের ধার দিয়ে গাচপালার ফাঁক দিয়ে আস্তে আস্তে মন্দভাগ রেলওয়ে ষ্টেশনের দিকে অগ্রসর হলামল। খালি গায়ে ছিলাম এই জন্য গেঞ্জি বা কোন কিছু পরে থাকলে তাদের নজরে পড়ে যেতে পারে। আমরা সকাল ৯টায় এসে মন্দভাগ গ্রামে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য এ্যামবুশ পেতে বসে থাকলাম। আধাঘন্টা পরেই দেখলাম সেনাবহিনীর লোকেরা ট্রলির দু’পাশে দিয়ে হেঁটে পাহারা দিতে দিতে নিয়ে যাচ্ছে। ট্রলি দু’টি মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সাজ্জিত ছিল। আমার হঠাৎ করে এলএমজি, এসএমজি’র সাহায্যে শত্রুদের উপর অতর্কিত গুলি ছুড়াতে লাগলাম। কয়েকজন পাকসেনা সঙ্গে সঙ্গে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই পাকসেনারা ট্রলির ওপাশে গিয়ে পজিশন নিয়ে আমাদের পের গোলাগুলি ছুড়তে লাগল। আমরা রকেট লাঞ্চারের সাহায়্যে ট্রলির উপর আঘাত হানলাম। এক্সপ্লোসিভ থাকায় লাঞ্চারের আঘাতে ট্রলির অস্ত্রশস্ত্র নষ্ট করে দেওয়া হয়। তারপর পাকসেনা আর্টিলারীর সাহায্যে আমাদের উপর অবিরাম গুলিবর্ষণ কর তাদের আহত জোয়ানদের নিয়ে পালিয়ে যায়। পাকসেনা পলিয়ে যাওয়ার পর আমি আমার কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধকে নিয়ে ঘটনান্থলে যাই। দেখি ভাঙ্গাচোরা অনেক অস্ত্র পড়ে আছে। এরমধ্যে কিছু ভাল অস্ত্র ছিল। আমার ঐ সমস্ত অস্ত্র নিয়ে ক্যাম্পে ফিরে আসি। এ এক দুঃসাহসিক অভিযান ছিল, যা আমার জীবনে অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে। উল্লেখযোগ্য যে, আমার বাহিনীর কেউ এ অপারেশনে মারা যায়ন্ কসবা মন্দভাগ রেলওয়ের দূরত্ব মাত্র দু’মাইল।
এরপর অনেক চোট খাটো অপারেশন করেছি যা আজ আর মনে নাই। তবে প্রায়ই অপারেশন করতাম।
জুন মাসের ৮ তারিখে ক্যাপ্টেন গফফার এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে বেলুনিয়া ক্যাম্পে চলে গেলাম। কসবা সাব-সেক্টরের ভার আমার উপরে পড়ল। আমার অধীনে এক কোম্পানীর বেশী মুক্তিযোদ্ধা রইল।
তৎকালীণ পূর্বপাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান ঘোষনা করলেন-ঢাকা-চট্রগ্রাম রেললাইন পুনরায় চালু করা হবে। ট্রেন মোটামুটি ঢাকা-চট্রগ্রাম লাইনের অন্য জায়গায় চলেলও আখাউড়া থেকে শালদা নদী পর্যন্ত কোন ট্রেন চলতো না। ঐ জায়গায় গুরুত্ব চিল অপরিসীম। টিক্কা খানের এ ঘোষণা শুনে সেক্টর ২ এর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ একদিন মেলাঘরে (সেক্টর ২ এর হেড কোয়ার্টার) সাব-সেক্টর কামাণ্ডারকে ডেকে পাঠালাম। তিনি আমাদের বললেন টিক্কা খান যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনুরুদ্ধার করতে চাচ্ছে। এটা যেন হতে না দেওয়া হয়্। আমি তাকে এ সম্পর্কে আশ্বাস দিলাম। আমি বললাম আমাদের জীবনে থাকতে এটা হবে না। যদি তারা ফিরিয়ে আনতে পারে তবে আমি অস্ত্র জমা দিয়ে দেব। এ প্রতিজ্ঞা আমি রেখেছিলাম। টিক্কা খানের এ ইচ্ছা কোন দিন পুরন হয়নি।
এরপর আমার বাহিনীর সাহায্যে শালদা নদী থেকে কসবা পর্যন্ত যত ছোট ছোট রেলওয়ে কালভার্ট, ব্রীজ ছিল, তা এক্সপ্লোসিভ দিয়ে উড়িয়ে দেয় হয়। টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ পাইলনও অনেক উড়িয়ে দেওয়া হয়। যার জন্য পাকসেনারা অনেক সময় যোগাযোগ থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়ে। ঢাকা-চট্রগ্রাম ট্রাষ্ক রোডের উপর ছোটখাট অনেক কালভার্টও গেরিলা বাহিনী পাঠিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয়। খানসেনারা যখন দেশের মধ্যে সাধারণভাবে অত্যাচার চালাচ্ছিল-খন এ দেশের কিছুসংখ্যক দালাল, রাজাকার, শান্তিবাহিনী লোকেরা যে কীর্তিকলাপ চালিয়েছে তার তুলনা নেই। পাকসেনারা অনেক আগেই এদেশে থেকে বিতাড়িত হয়ে যেত-যদি না এইসব কুলাঙ্গাররা এদের সাহায্য করতো। এই লোকেরা পাকসেনাদের মনোবল যোগাতো। পাকসেনারা এত ভীত হয়ে গিয়েচিল যে, তারা সামান্য কুকুর দেখলে পর্যন্ত ভয় পেত। তাদের ধারনা ছিল বাঙ্গালীরা যাদুবিদ্যা জানত। সেই হেতু তারা মুক্তিবাহিনীর কীর্তিকলাপকে যাদুবিদ্যার সাথে তুলনা করতো। তারা এত ভীত হয়ে গিয়েছিল যে, তাদের উপর একটি গুলি ছুঁঢ়লে তারা অবিরাম গুলিবর্ষণ করতো, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা ভাবত মুক্তিবাহিনী চলে গেচে। এই ঘৃণ্য দালালেরা পাকসেনাদের কাছ মেয়ে পাঠাতো তাদের লালসা চরিতার্থ করার জন্য। এই সমস্ত পশুদের অপরাধ পাকিস্তানী সেনাদের চেয়ে কমতো নয়ই, বরং বেশী। এদেরে কিছু কীর্তিকলাপ তুলে ধরছি। একবার এক বুড়ো পাকিস্তানীমনা লোক তার ১৬ বছরের নাতনীকে পাকিস্তানী সেনাদের কাছে বিয়ে দেবার চেষ্টা করছিল। আমরা এ খবর পেয়ে হঠাত করে তার বাড়ি ঘেরাও করে মেয়েটিকে উদ্বার এবং বুড়োকে শাস্তি প্রদান করি।
একবার দু’জন রাজাকার এক বিবাহিতা যুবতীর (সে পাকসেনাদর হাত থেকে পালিয়ে আসবার জন্য ভারতে চলে আসছিল) উপর পাশবিক অত্যাচার চালাবার জন্য তাকে ধরে ফেলে এবং তার ছ’মাসের বাচ্চা ছেলেকে পাটক্ষেতে ফেলে দেয় এবং তার উপর পাশবিক অত্যাচার চালায়। আমার এই ঘৃণ্য অপরাধের জন্য পরে তাদের ধরে এনে শাস্তি প্রদান করি। এদের নিষ্ঠুর অত্যাচারের ফলে বাচ্চা ছেলেটি মারা যায়। এক গ্রামের দরজির তিনটি বউ ছিল। সে পাকসেনাদের আমন্ত্রণ জানাত নিজ বাড়ীতে এবং বউদের অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করত। সে মুক্তিবাহিনীর খবরাখবর পকসেনাদের নিকট জানাত। আমি এ খবর জানতে পেরে তাকে ধরে এনে শাস্তি দেই।
অনেক নিরীহ শান্তিপ্রিয় লোক ভারতে চলে যেতো পাকসেনাদের হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য । কিন্তু এই দস্যুরা এই নিরীহ জনসাধারণের উপর অত্যাচার চালত। তাদের জিনিসপত্র কেড়ে নিত। এই রকম চার দস্যুকে আমরা ধরে শাস্তি দেই এবং তাদের মধ্যে একজন হিন্দুও ছিল।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, কিছু পাকিস্তানী দালাল শরনার্থীর বেশে ভারতে আসত এবং আমাদের খবর নিয়ে যেত। আমরা এ খবর জানার পর সর্তক হয়ে কিছু সন্দেহভাজন লোকের উপর তল্লাশি চালাই। তাতে দেখ যায, অনেক দালাল চালের মধ্যে গ্রেনেড বস্তার মধ্যে গ্রেনেড এবং অন্যান্য উপায়ে নানা ধরণের ধ্বংসাত্মক জিনিস নিয়ে আসত আমাদের ক্ষতি করবার জন্য। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, এক মহিলার উপর তল্লাশি চালিয়ে দেখা যায় যে, সে লাউয়ের ভিতরে গ্রেনেড নিয়ে এসেছে।
এইসব ঘৃণ্য দালাদের কীর্তিকলাপ যে কত জঘন্য ছিল তা বলবার নয়। তারা পাকসেনাদের মনোবল বাড়াবার জন্য যা করেছে, তা পাকিস্তানী সেনাদের থেকেও ঘৃণ্য। অনেক রাজাকার গ্রামে গ্রামে ডাকাতি করত। আমি আমার বাহিনীর লোকেরা যাতে নিরীহ জনসাধারণের কোন ক্ষতি না করে তা লক্ষ্য রাখতাম। কেউ কোন অপরাধ করলে শাস্তি দেওয়া তহো। একবার এক মুক্তিযোদ্ধা গ্রামে গিয়ে ডাকাতি করেছে। এ খবর শোনার পর তা পরীক্ষা করে সত্য প্রামাণিত হওয়ার তাকে শান্তি প্রদান করি। এ ব্যাপারে কোন ক্ষমা প্রদর্শন করা হত না।
*বাংলা একাডেমীর পক্ষ থেকে ১৯৭৩ সালে এ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়।
আতিকুল ইসলাম ইমন
<১০, ৪.৮, ১৭৮–১৮৪>
সাক্ষাৎকারঃ মেজর জাফর ইমাম
৬ই নভেম্বর হেডকোয়ার্টার আমাকে ডেকে পাঠালেন। তখন বেলুনিয়া পকেটটি পুরোপুরি পাকবাহিনীর দখলে ছিল।
আমাকে ডেকে বলা হলো, বেলনিয়া রেলওয়ে স্টেশন থেকে শুরু করে ফেনী পর্যন্ত এই পকেটটি মুক্ত করার ভার তোমার উপর দেওয়া হলো। পরশুরাম, চিতলিয়া, ফুলগাজী, বেলুনিয়া ও ফেনী এই বিশেষ স্থানগুলো তখন ছিল পাকবাহিনীর মজবুত ঘাঁটি। আমি এ জায়গাগুলো থেকে শত্রুদের পুরোপুরি বিতাড়িত করার জন্য দৃঢ়সংকল্প নিলাম। এই সংকল্পকে বাস্তবায়িত করার কাজ হতে নিলাম ৮ই নভেম্বর। এই দিনটি চিল আমার জীবনে একটি স্মরণীয় দিন। ১০ম বেঙ্গল ও ২য় বেঙ্গলের একটি কোম্পানীর সাথে গভীর আত্মবিশ্বাস ও অসীম মনোবল নিয়ে আমি এই গুরুত্বপূর্ণ কাজের প্রস্তুতি কাজের নিতে লাগলাম। ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের দলটি চিল ক্যাপ্টেন মোরশেদের অধীনে।
পরশুরাম ও বেলুনিয়াম পকেট থেকে শত্রুদের হটানোর ব্যাপারে মিত্র বাহিনীর জেনারেল হীরা আমায় চ্যালেঞ্জ করলো। আমি দৃঢ়ভাবে এ চ্যালেঞ্জ গ্রহন করলাম এবং অতি সুনিপুণভাবে এ অভিযানকে সফল করে তুলবোই। তাই দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় নিয়ে সামরিক কৌশলের অন্যতম কৌশল হিসাবে গোপন অনুপ্রবেশ দ্বারা শত্রুদের গোপন অবরোধ করার সিদ্বান্ত নিলাম।
এখানে একটা কথা উল্লেখযোগ্য যে, আমরা যে বাহীনি দ্বারা এ অভিযান শুরু করেছিলাম তারা পুরোপুরি সব দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ন ছিল। এই অভিযানে ১০ বেঙ্গলের ও ২য় বেঙ্গলের শতকরা ৮০ জন সৈন্য চিল পুরনো বেঙ্গল রেজিমেন্টর এবং বাকী শতকরা ২০ জন সদস্য ট্রেনিংপ্রাপ্ত। তাছাড়া মিত্র বাহিনী আমাদের এ অভিযানে অস্ত্রসস্ত্র দিয়ে সক্রিয় সহযোগিতায় করেছিল। রাতের অন্ধকারেই আমরা গোপন অনুপ্রবেশের কাজ শুরু করবো বলে সাব্যস্ত করলাম। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল রাতের মধ্যেই অনুপ্রবেশের কাজ শেষ করে ভোর হবার আগেই ওদের সাথে মোকাবিলা জন্য প্রস্তুতি নেওয়া।
নভেম্বর অন্ধকার শীতের রাত। টিপ টিপ করে হালকা বৃষ্টি পড়ছিল। হিমেল হাওয়ায় গাছের পাতায় যেন একটি অশরীরি শব্দ সৃষ্টি করছিল। মনে হচ্ছিল সমস্ত রাতটা যেন কিছুুর প্রতীক্ষায় আছে। রাত অনুমানিক ১০-৩০ মিনিট। আমাদের অনুপ্রবেশের কাজ শুরু করলাম। আমার এমন একটা এলাকা ঘেরাও করার অভিযানে নেমেছি যার তিনটা দিক ছিল ভারত সীমান্ত দ্বারা বেষ্টিত। আমরা এই ভারতের এক প্রান্তের সীমান্ত থেকে পরশুরাম চিতলিয়ার মাঝ দিয়ে অগ্রসর হয়ে ভারত সীমান্তের অপর প্রান্ত পর্যন্ত অবরোধ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমদের এই অবরোধ যদি সফল হয় তবে শত্রুরা সহজই ফাঁদে আটকা পড়বে।
অবরোধের কাজ শুরু হলো। অন্ধকার রাতে মুহুরী নদী ও চিলনিয়া নদীর কোথাও বুক পানি, কোথাও কোমর পানি, কোথাও বা পিচ্ছিল রাস্তা বাধা পেরিযে এগিয়ে চলছি সবাই। সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। অন্ধকার রাত। সামান্য কাছের লোককেও ভাল করে দেখা যাচ্ছিল না। কমাণ্ডার হিসাবে সবাইকে সুশৃংখলভাবে পরিচালিত করে আমাদের নির্ধারিত গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো সত্যই কষ্টকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবুও সব বাধাকে তুচ্ছ করে আমরা এগিয়ে চললাম এবং সাথে সাথে আমি আমার দলের অন্যান্য অফিসারদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চললাম। নিঃশব্দ হয়ে সবাই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পথ চলছি। কারো মুখে কোন কথা নাই। শত্রুরা ঘূর্ণাক্ষরেও জানতে পারলো না যে ওদের জালে আটকবার জন্য আমরা এগিয়ে আসছি। শত্রুরা যদি আমাদের এ অনুপ্রবেশ টের পায় তবে আমাদের সমস্ত পরিকল্পনাই বানচাল হয়ে যাবে, কারণ যুদ্ধক্ষেত্র গোপন অনুপ্রবেশ যদি অপরপক্ষ টের পায় তবে পরিকল্পিত অভিযান সফল করা সম্ভব হয় না। আমরা আরো অনেক পথ এগিয়ে এলাম। আমাদের এ কাজে বেশ সময় লাগছিল। কারণ অন্ধকার রাতে নির্ভুল পথে এগিয়ে যাওয়া সত্যিই বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার ছিল। এছাড়া আরো একটা ভয়ের সম্ভবনা ছিল। শত্রুদের লোকেরা রাতে বিভিন্ন জায়গায় পেট্রোলিং-এ ছিল। তাদের খপ্পরে পড়াও বিচিত্র ছিল না। সে ভয় আমাদের অমূলক ছিল না। আমরা যখন রেলওয়ে ও কাঁচা রাস্তার কাছাকাছি এগিয়ে এলাম তক্ষুণি দেখলাম শত্রুপক্ষের ডিউটিতে একটি দল রেললাইন ধরে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। আমরা টুপ করে লুকিয়ে গেলাম- কেউ বা রাস্তার আড়ালে, কেউ বা জমিনের আড়ালে। ওরা কিছুই টের পেল না। নিশ্চিত মনে গল্প করতে করতে চলে গেল। বিপদ কেটে গেল। এদিকে রাত বাড়ছে। আমি তাড়াতাড়ি আমার কোম্পানীর কমান্ডারদের সাথে যোগাযোগ করলাম। ওরা জানালো সব ঠিক আছে। ওরা নিরাপদেই অবরোধের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ভোর হবার বেশ বাকী নেই। আমরা আমাদের নির্ধারিত স্থানে হাজির হলাম এবং এর ফলে শত্রুদের পশুরাম ও চিতলিয়া ঘাঁটি পুরোপুরি আমাদের অবরোধের মাঝে আটকা পড়লো।
আমরা শত্রুরা চিতলিয়া ঘাঁটির দিক থেকে যাতে কোন প্রকার আক্রমণ না আসতে পারে তার জন্য প্রতিরোধ গড়ে তুললাম। ভোর হয়ে আসছিল। আমরা প্রতিরোধের সকল ব্যবস্থা শেষ করতে লাগলাম। বাঙ্কার খোঁড়ার কাজ শুরু হলো। এবং অন্যান্য সব ব্যবস্থাও করলে লাগলাম। পথশ্রমে ও ক্ষুধার তাড়নায় সবাই ক্লান্ত। তবুও বিশ্রামের সময় নেই। ভোরের আলো ফুটবার আগেই প্রতিরোধের কাজ শেষ করতে হবে, তাই প্রাণপণে সবাই কাজ করতে লাগলাম। ভোর হলো। আমরাও সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে গেলাম। শত্রুরা আমাদের অবরোধের মাঝে। এ সফলতার খবরটা জেনারেল হীরাকে জানাতে ইচ্ছা হলো। ওয়ারলেসে হীরাকে জানালাম যে শত্রুদের আমরা পুরোপুরি জালে আটকিয়েছি। খবরটা শুনে জেনারেল হীরা আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো। ধন্যবাদ দেবার সময় খুশিতে তার বার বার কথা আটকে যাচ্ছিল। আমি আমার চ্যালেঞ্জে জিতেছি বলে জে: হীরা ব্যক্তিগতভাবেও আমাকে প্রচুর ধন্যবাদ জানালো। এদিকে ভোরে আলোয় চারদিক আলোকিত হয়ে উঠছিল। ভোরের আলোয় চারদিকে ভালো করে দেখতে লাগলাম। তারপর বুঝতে চেষ্টা করলাম যে শত্রুরা আমাদের অনুপ্রবেশ টের পেয়েছে কিনা। কিন্তু না। তা বোঝার কোন উপায় নেই। চারিদিক নীরব। কোথাও মানুষের কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না।
বেলুনিয়া থেকে রেললাইনের সাথে সমান্তরালভাবে কাঁচা রাস্তাও চলে এসেছে ফেনী পর্যন্ত। এই রাস্তার পাশেও আমাদের বেশকিছু বাঙ্কার গড়ে উঠেছে। বাঙ্কারে বসে সবাই সামনের দিকে চেয়ে আছি। বেশ কিছু সময় কেটে গেল। হঠাৎ দূর থেকে একটা ট্রলির আওয়াজ অস্পষ্ট শুনতে পেলাম। শব্দটা চিতলিয়ার দিক থেকেই আসছে বলে মনে হলো। রেললাইন ও রোডের কাছে বাঙ্কারে যারা ডিউটিতে ছিল তাদের মধ্যে নায়েব সুবেদার এয়ার আহমদ ছিল খুবই সাহসী। যুদ্ধের প্রথম থেকেই সে আমার সাথে থেকে নির্ভীকতার সঙ্গে লড়াই করে আসছিল।
ট্রলিটা এগিয়ে আসছে। সবাই প্রতিক্ষায় বসে রইল। আস্তে ট্রলির শব্দটা আরো কাছে এগিয়ে আসছে। আমরা পরিষ্কারভাবে দেখতে পেলাম কয়েকজন সৈন্য বেশকিছু অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে এগিয়ে আসছে। ওরা নিশ্চিত মনে আসছে। ওরা বুঝতেও পারেনি ওদের শত্রু এত কাছে রয়েছে।
এক, দুই, তিন… মিনিটের কাটা ঘুরতে লাগল। ট্রলিটা একেবারে কাছে এসে গেলো। এয়ার আহমদ ও তার সঙ্গীদের হাতের অস্ত্রগুলো একসঙ্গে গর্জে উঠলো। মুহূর্তের মধ্যে জায়গাটা ধোঁয়ায় ঢেকে গেল। অনবরত ফায়ারিং-এর শব্দে চারিদিক মুখরিত হয়ে উঠলো। শত্রুরা অনেকেই পালাতে চাইলো কিন্তু তা সম্ভব হতে আমরা দিলাম না। একজন শত্রুও প্রাণে বাঁচতে পারলো না। আনন্দে এয়ার আহমেদ ও তার সঙ্গীরা ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে চিৎকার করে উঠলো। উত্তেজনায় আনন্দে ওদের সারা শরীর কাঁপছিল।
ফায়ারিং-এর শব্দ শুনে চিতলিয়া ও পশুরাম ঘাঁটির শত্রুরা মনে করলো ট্রলিটা হয়তো বা কোন মুক্তিবাহিনীর গেরিলার দলের হাতে পড়েছে। প্রকৃত অবস্থাটা তারা কিন্তু বুঝতে পারেনি। তখন দুদিক থেকেই শত্রুরা আক্রমণ করতে শুরু করলো।
এদিকে এয়ার আহমদ আনন্দে বাঙ্কার ছেড়ে উঠে দৌড়ে গেল অদূরে পড়ে থাকা শত্রুদের মৃত অফিসারটির কাছে। গোলাগুলির কথা যেন মুহূর্তের মধ্যে ভুলে গেল। অফিসারের পকেট থেকে সে পিস্তলটি উঠিয়ে নিল। তারপর তাকে টেনে নিয়ে আসতে লাগলো নিজ বাঙ্কারের দিকে। ঠিক তক্ষুণি শত্রুদের চিতলিয়া ঘাঁটির দিক থেকে একটি বুলেট এসে বিঁধলো এয়ার আহমেদের মাথায়। চোখের সামনেই দেখতে পেলাম ও শরীরটা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেল। ঢলে পড়লো বাঙ্কারের মুখে। রক্তে ঢেকে গেলে ওর জয়ের আনন্দে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠা মুখটা। নিজের জান দিয়ে এয়ার আহমেদ শত্রুদের ঘায়েল করেছে। কিন্তু এর শেষ দেখে যাওয়া তার কপালে সইলো না।
৯ই নভেম্বর। সেদিন ওকে হারিয়ে বেদনায় মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলাম। একজন বীরকে হারিয়ে মর্মাহত হয়ে পড়েছিলাম ঠিকই তবুও কর্তব্যের ডাকে সাড়া দিয়ে এয়ার আহমেদের রক্তের বদলা নেবার জন্য শত্রুদের হামলার যোগ্য প্রত্যুত্তর দিয়ে চললাম, শত্রুর আক্রমণের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়ে চললাম। শত্রুরা সারাদিন ধরে আমাদের বিভিন্ন পজিশনের উপর তুমুলভাবে আক্রমণ চালালো।
সারাদিন কেটে গেল। বৃষ্টির মত আর্টিলারী আর শেলিং-এর শব্দে আশেপাশের নীরব এলাকা কেঁপে উঠতে লাগলো। ক্রমে রাত হয়ে এলো। অন্ধকার রাত। শত্রুরা এবার পশুরাম ঘাঁটি থেকে আমাদের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করলো। আমাদের জোয়ানরা তার পাল্টা জবাব দিয়ে চললো। পরশুরাম থেকে এ আক্রমণের আকার ছিল অতি ভয়ঙ্কর। ওরা এমনভাবে আমাদের জালে আটকা পড়েছে যে, বের হবার কোন পথই নেই। ওরা বুঝতে পারলো এটা ওদের জীবন-মরণ সমস্যা। তাই তারা প্রাণপণে লড়ে যেতে লাগলো। কিন্তু ওদেরকে আমাদের জাল ছেড়ে বের হতে দিলাম না। আমরা তাদের সকল চেষ্টাই ব্যর্থ করে দিতে লাগলাম।
শত্রুদের বেলুনিয়া ও পরশুরাম ঘাঁটিতে যারা ছিল তারা শুধু প্রতীক্ষায় ছিল। যে করেই হোক ওরা চিতলিয়া থেকে সাহায্য ও যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে লাগলো- কিন্তু আমরা তা ব্যর্থ করে দিলাম। ওদের এই প্রাণপণ লড়াইয়ের জবাব দিয়ে আমরা শত্রুদের পরশুরাম আক্রমণ প্রতিহত করি।
তারপর ভোর হলো। ওরা আমাদের উপর অনবরত শেলিং ও ফায়ারিং করতে লাগলো। আমরা উচিত জবাব দিয়ে চললাম।
সেদিন বেলা ৪টার সময় হঠাৎ রা আমাদের উপর বিমান হামলা শুরু করলো। কিন্তু ওরা এতে আমাদের বিশেষ কোন ক্ষতি করতে পারলো না। এবার আমরা আরো সতর্কতা অবলম্বন করলাম।
সেদিন গেল। তার পরের দিনও আগের দিনের মতই ফায়ারিং ও শেলিং চললো। দুপক্ষ থেকেই সমানে আক্রমণ ও প্রতিআক্রমণ চললো। ওদের শুধু একটিই উদ্দেশ্য, হয় চিতালিয়ার সাথে যোগাযোগ না হয় পলানো। কিন্তু সে মুহূর্তে পলানো ছাড়া তাদের আর কোন পথই আসলেই ছিল না। শুধু ফায়ারিং ও শেলিং-এর শব্দে মাঝে মাঝে সে এলাকার প্রকৃতি আর গাছপালা যেন কেঁপে কেঁপে উঠছিল, অনেক সময় এক মিনিটও বিরাম ছিল না। শব্দের জন্য অতি কাছের লোকের কথাও শোনা যেত না।
সেদিন বেলা ৩-৫০ মিনিট। হঠাৎ দেখলাম তিনটা শত্রু বিমান আমাদের এলাকায় উড়ে আসছে। এসেই ওরা সে এলাকার উপর বোম্বিং করতে শুরু করলো। অনেক ঘরবাড়ি পুড়ে যেতে লাগলো। চারিদিকে দাউ দাউ করে বাড়িঘরে আগুন জ্বলছে। ওরা বেশ নিচু হয়েই বোম্বিং করছিল। যদিও আমাদের কাছে অস্ত্রশস্ত্র বহু ছিল কিন্তু বিমান বিধ্বংসী কামান আমাদের ছিল না। আমরা তাই শেষরক্ষা হিসেবে এমএমজিকে এ কাজে ব্যবহার করতে লাগলাম। যেহেতু ওরা জানতো আমাদের কোন বিমান বিধ্বংসী কামান নেই, তাই নিশ্চিত হয়ে নিচু দিয়ে বিমান চালাচ্ছিল।
সবাই অপেক্ষায় আছি। কখন আমাদের এমএমজির আওতায় বিমানগুলো আসে। আর দেরী হলো না। এমএমজি’র আওতায় এসে গেল বিমানগুলো। মুহূর্তে গর্জে উঠলো এমএমজি। দুটি বিমান উড়ে চলে গেল ওদের সীমানায়। আর একটি ফিরে যেতে পারলো না। শূন্যে ঘুরপাক খেয়ে ছিটকে পড়লো মাটিতে। জোয়ানরা চেঁচিয়ে উঠলো উল্লাসে। সেদিন ছিল নিঃসন্দেহে ১০ম ও ২য় বেঙ্গলের সংগ্রামী দিনগুলোর একটি স্মরণীয় দিন। কোন যুদ্ধের ইতিহাসে হয়তো বা এর আগে এমএমজি দিয়ে কোন বিমানকে ভূপাতিত করা হয়নি- আমরা তাই করতে পেরেছি। গর্বে সবার সবার বুক ভরে উঠলো। এই কৃতিত্বপূর্ণ ঘটনাটা সে এলাকার জনসাধারণের মনে রেখাপাত করেছিল বেশী। তাদের মুখে মুখে ফিরতে এ কথা। আমাদের জন্য ওরাও যেন গর্বিত।
সেদিনই মিত্রবাহিনীর জেনারেল হীরা অয়ারলেসে আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন জানান। সেদিন রাতে আমরা মিত্রবাহিনীর সক্রিয় ও গোলন্দাজ বাহিনীর সহযোগীতায় শত্রুদের বেলুনিয়া ও পরশুরাম ঘাঁটির ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালালাম। ওরা আমাদের হামলার মুখে বেশীক্ষণ টিকতে পারলো না। ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল ওরা। শত্রুদের শতকরা ৮০ ভাগ সৈন্যই আমাদের আক্রমণে প্রাণ দিল। রাতের মধ্যেই আমরা পরশুরাম ও বেলুনিয়া দখল করতে সক্ষম হলাম।
অভাবনীয় ও অবর্ণনীয় এক দৃশ্য দেখলাম ওদের পরিত্যক্ত ঘাঁটিতে গিয়ে। চারিদিকে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে অসংখ্য লাশ। ধানক্ষেত, বাঙ্কারে, বাঙ্কারের অদূরে খালের পানিতে কোথাও ফাঁক নেই। যারা আহত হয়ে পালাতে চেয়েছিল তারা শরীরের অসমর্থতার জন্য পারেনি। অসহায়ভাবে কাতরাচ্ছিল বাঁচার আশায়। আহত এসব সৈন্যদের চিকিৎসা করা আমাদের কর্তব্য- তাড়াতাড়ি তার ব্যবস্থা করতে বললাম, কিন্তু ওদের মাঝে বেশীরভাগ সৈন্য মারা গেল। মাত্র ৩/৪ জন বাঁচতে পারলো। আমরা সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় প্রচুর গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্রসহ ৪৯ জনকে বন্দী করতে সক্ষম হয়েছিলাম। তাদের সাথে এদেরও বন্দী করা হলো।
পরশুরাম ও বেলুনিয়া ঘাঁটির এ মর্মান্তিক পরিণতিতে শত্রুরা ভেঙ্গে পড়লো। চিতলিয়া ঘাঁটির শত্রুরা মনে হলো এতো ভয়ানক নিরাশ হয়ে পড়লো। ওরা পালিয়ে গেল মুন্সীরহাটে।
আমরা আস্তে আস্তে আরো এগিয়ে আসতে লাগলাম এবং ওদের প্রকৃত অবস্থাটা বুঝে আরো কিছু কায়দা বের করতে চাইলাম। এবারে আমরা অবস্থা বুঝে পুরনো কায়দা হিসেবে গোপন অনুপ্রবেশ করার পরিকল্পনা নিলাম। আমরা নীলক্ষেতে ঘাঁটি করে ওদের ফুলগাজী ঘাঁটির উপর চাপ সৃষ্টি করবো- যাতে ওরা দুর্বল হয়ে পালাতে বাধ্য হবে হয়তো। নীলক্ষেতে মজবুত ঘাঁটি করে বসলাম। ওরা আমাদের পরিকল্পনাটা টের পেল মনে হয়। তাই তারা চিতলিয়ায় ঘাঁটি ছেড়ে সবাই ফুলগাজীতে এসে মিললো। আমরা তখন সরাসরি ফুলগাজীর উপর চাপ সৃষ্টি করলাম। এরা অবস্থা বুঝতে পারলো। ব্যাপার সুবিধের নয় ওদের জন্য। ওরা একেবারে সব ঘাঁটি ছেড়ে বান্দুরা রেল স্টেশনের কাছে এসে ঘাঁটি স্থাপন করলো।
আমরা আরো এগিয়ে আসলাম। কালিহাট ও পাঠানণগর থেকে আমরা শত্রুদের মুখোমুখি হয়ে ঘাঁটি স্থাপন করলাম। আমাদের দক্ষিণ দিকে ছিল সোনাগাজী। সেখানে আমরা আগেই গেরিলা বাহিনী পাঠিয়ে সব ঠিক করে রেখেছিলাম। ওরা এখন আমাদের তিনদিক দিয়েই চাপের ভিতর পড়েছে। তখন বাধ্য হয়ে সোনাগাজী দিয়ে পালাতে চাইবে, সেহেতু আমরা সে ওদের জন্য ইচ্ছা করে মুক্ত রেখেছি আর গেরিলা বাহিনী রেখেছি গোপনে, যাতে তারা পালাতে গেলেই ওদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হবে। কিন্তু বাস্তবতা তা হলো না। ওরা আমাদের প্রচণ্ড চাপ সহ্য করতে না পেরে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ হয়ে লাকসাম চলে গেল এবং এতেও ওদের অধিক সংখ্যক সেনাই পালাতে সক্ষম হলো।
৬ ডিসেম্বর আমরা ফেনী মুক্ত করলাম। ফেনীর এতদিনকার গুমোট ও ধোঁয়াটে আকাশে স্বাধীনতার পতাকা উড়লো। অগণিত জনতার শ্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠলো। দীর্ঘ ৯টি মাস পরে মুক্ত বাতাসে সবাই দাঁড়িয়ে স্বস্তির নি:শ্বাস ফেললো। ফুলের মালা আর জনতার বরণডালার আতিশয্যে আমরা সেদিন অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। দু’ চোখ শুধু বারে বারে পানিতে ভরে উঠেছিল। মাথায় বাংলা মায়ের অশ্র“ভেজা আশীর্বাদ নিয়ে বাংলাদেশের সবুজ সূর্য আঁকা পতাকা ছুঁয়ে শহীদ এয়ার আহমেদের মতো লাখো লাখো বীর শহীদদের আমরা অবনতচিত্তে স্মরণ করলাম। কিন্তু আমাদের আরো অনেক কাজ বাকী, অভিভূত হয়ে বসে থাকার কথা নয়।
আর দেরী করলাম না। সবাই আমরা মার্চ করে নোয়াখালীর দিকে রওনা দিলাম। নোয়াখালীর সদর মুক্ত করতে যেয়ে আমরা সেদিন বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিলাম প্রচুর। কিন্তু তা যদি পাক সৈন্যদের দ্বারা হতো তবে বোধহয় সান্ত্বনা পেতাম। তারা ছিল বর্বর আর ঘৃণ্য রাজাকার আর আলবদরের দল। ওরা নানাভাবে আমাদের বাধা দিয়েছে, কিন্তু আমাদের অগ্রগতি তারা রুদ্ধ করতে পারেনি। আমরা তাদের সব বাধা ডিঙ্গিয়ে ওদের সমূলে ধ্বংস করে নোয়াখালীর সদর মুক্ত করলাম।
আমরা ক্ষমা করিনি সেই ঘৃণ্য আলবদর আল রাজাকারদের। তারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে দেশের সাথে, নিজের মায়ের সাথে। অস্বীকার করেছে নিজের রক্তকে। তাই ওদের হত্যা করতে কারো এতটুকু বুক কাঁপেনি। কারণ ওরা ক্ষমার যোগ্য নয়। নিজের মায়ের বুকফাটা কান্নায় হৃদয় টলেনি যাদের, নিজের বোনের নির্যাতনের মানবতার সামান্য উদাহরণ দেখাতে পারেনি যারা, নিজের ভাইকে হত্যা করতে হাত কাপেনি এতটুকু ওদের। ওদের ক্ষমা করা যায় না। দেশের সাথে, নিজের অস্তিত্বের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তবুও বিবেকের দংশনে জ্বলেপুড়ে মরেনি ওরা। ওরা কি মানুষ? পলাশীর যুদ্ধে মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আবার তার পুনরাবৃত্তি ঘটলো।
৯ই ডিসেম্বর আমরা নোয়াখালী মুক্ত করলাম। নোয়াখালীর মুক্ত নীল আকাশে সূর্য আঁকা পতাকায় আমরা বিশ্বের স্বাধীনতাকামী মানুষদের সালাম জানালাম। সে সময়ক্ষার আনন্দ আর অনুভূতি ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। সফলতার আনন্দে আর দেশ মুক্তির আনন্দে সবাই শুধু কেঁদেছিল। দলে দলে জনতা মালা হাতে ভিড় জমালো শুধু একনজর আমাদের দেখার আশায়। সেদিন আমরা সবাই শুধু বাঙ্গালী এই পরিচয়ে অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম।
আমি শুধু অবাক হয়ে ভাবছিলাম এই আমার দেশবাসী। এরা কত ভালবাসে আমাদের। তাইতো ওদের জন্য আমাদের দেশমুক্ত করার জন্য সংগ্রামে নেমেছি আমরা। এরা আমার বাবা মা-বোন, এদের আনন্দে আমরাও মিশে গেলাম তাই একান্ত হয়ে। সেদিন শুধু আমি এই জেনেছি আমার একটি পরিচয়। আমি বাঙ্গালী, এই বাংলাদেশ আমার, এরা সবাই আমার আপন। একই স্নেহ ভালবাসা একই সংস্কৃতি কৃষ্টি ও সভ্যতার বাঁধনে আমরা বন্দী। কাউকে কেউ অস্বীকার করতে পারি না। ওদের মত আমিও দেশের মাটিকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসি। ভালবাসি দেশের এই দুর্ভাগা মানুষগুলোকে।
৬ই ডিসেম্বর ফেনী মুক্ত হলো, তারপর নোয়াখালীর সদর এলাকা। শত্রমুক্ত করলাম ৯ই ডিসেম্বর, কিন্তু বিশ্রামের অবকাশ হলো না। ইতিমধ্যে আদেশ এলো চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য। চট্টগ্রাম শত্রুমুক্ত করতেই হবে। আমার কাছে যখন এ আদেশ এলো তখন আমি ফেনীতে। চিটাগাং ফেনী থেকে প্রায় ৬৫ মাইল দূরে। তখন চিটাগাং এবং তার পাশ্ববর্তী প্রায় সমস্ত এলাকাই শত্রুদের কবলে ছিল। এসব স্থানে তারা বেশ মজবুত ঘাঁটি করে বসেছিল। সংখ্যায় শক্তিতে তারা বেশ শক্তিশালী হয়েই আছে।
সেদিনই চট্টগ্রাম অভিমুখে রওনা দেবার সমস্ত কাজ শুরু করলাম। দেরী করার সময় ছিল না। প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে আমরা সেদিন দুপুর নাগাদ রওনা দিলাম চট্টগ্রাম অভিমুখে। পিচঢালা একটানা পথ চলে গেছে সম্মুখ বরাবর। আমাদের এ অভিযানে ১০ বেঙ্গলের জোয়ানেরা ছাড়া মিত্রবাহিনী জোয়ানদের পূর্ণ ও সক্রিয় সহযোগিতা ছিল। যদিও সমস্ত কিছু পরিচালনা ও পরিকল্পনা করার দায়িত্ব আমরাই নিয়েছিলাম। অবশ্য এর কারণ ছিল যে, বাংলাদেশের সমস্ত পথঘাট ও প্রয়োজনীয় অনেক কিছু আমাদেরই জানা।
বেলা বাড়ছে। আমরা সবাই এগিয়ে যাচ্ছি। নিশ্চিন্তে চলার অবকাশ ছিল না। পথে দুশমনের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে অভিযান বিলম্ব হচ্ছিল। আমরা এতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলাম না। সব বাধা প্রতিরোধ ডিঙ্গিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম গন্তব্যস্থল অভিমুখে। থেমে থাকলে চলবে না। অভিযান সফল করতেই হবে।
১৩ই ডিসেম্বর। আমরা তখনো গন্তব্যস্থলের অনেক দূরে। আর ৪ মাইল দূরেই কুমিরা। এখানেও শত্রুরা বেশ শক্তিশালী ঘাঁটি করে আছে। আমরা বেলা প্রায় ১২টায় কুমলার অদূরে এসে পৌঁছলাম। এরপর আর সামনে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হলো না। কুমীরায় অবস্থিত শত্রুদের ঘাঁটি থেকে আমাদের উপর প্রবল আক্রমণ শুরু হলো। আমরাও প্রবলভাবে ওদের এ আক্রমণের জবাব দিয়ে চললাম। কিন্তু সামনে অগ্রসর হওয়া সমীচীন মনে করলাম না। তখন মিত্রবাহিনীর বিগ্রেডিয়ার আনানস্বরূপের তরফ থেকে আমার কাছে আর একটি বিকল্প আদেশ এলো। আনানস্বরূপ আমাকে বললো, ‘তুমি ১০ম বেঙ্গলের চার্লি কোম্পানী ও মিত্রবাহিনীর দলকে রেখে কুমীরা পাহাড় পার হয়ে হাটহাজারী অভিমুখে রওনা হয়ে যাও।’
আমি সেই অনুযায়ী ১০ম বেঙ্গলের চার্লি কোম্পানী লে: দিদারের অধীনে রেখে এবং মিত্রবাহিনীর কোন সহযোগিতা ছাড়া আমার ১০ম বেঙ্গল নিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকারেই কাজ শুরু করতে মনস্থ করলাম।
আমরা যখন ফেনী থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখে রওনা হয়েছিলাম সেই সময়েই চতুর্থ বেঙ্গলের একটি দল ক্যাপ্টেন গফফারের অধীনে পরিচালিত হয়ে চিটাগাং-রাঙ্গামাটি রোড ধরে হাটহাজারী অভিমুখে রওনা হয়ে গিয়েছিল। আমরা কুমীরা পাহাড় পার হয়ে গোপনে হাটহাজারী আক্রমণের পরিকল্পনা নিলাম। সন্ধ্যার সাথে সাথে আমরা সব ঠিক করে রওনা দিলাম। ডিসেম্বরের শীতের সন্ধ্যা। অন্ধকার হওয়ার সাথে সাথে শীতের মাত্রাও যেন বাড়ছিল। কিন্তু সেসব ভাববার অবকাশ ছিল না। এ রাতের অন্ধকারেই, শীতের সাথে মিতালী পাতিয়ে আমাদের এগয়ে যেতে হবে। পাড়ি দিতে হবে অচেনা অজানা পথ। এ পথে আমরা একেবারেই নতুন। পাহাড়ী বন্দুর পথ। কোথাও ঢালু, কোথাও উঁচু-নীচু। কোথাও বা ছোট ছোট খাল। চারিদিকে গাছগাছালির ভিড়। অন্ধকার যেন তাই আরো নিবিড় লাগছিল। সাথে আমাদের ভারী অস্ত্রশস্ত্র। নিজেদের চলতেই কষ্ট হচ্ছিল। তার উপর এসব ভারী বোঝা নিয়ে চলা বড়ই দুঃসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু তবুও অতিক্রম করতেই হবে আমাদের।
আমরা তাই পথ চলছি। অতি কষ্টে নিঃশব্দে ঝিঁ ঝিঁ পোকার একটানা ডাক। মাঝে মাঝে পথ ভুলে যাচ্ছিলাম। আবার পিছিয়ে এসে চলছিল সঠিক পথে। এ পাহাড়ী পথে কোথাও তেমন মানুষজনের সাড়া পেলাম না। শুধু মাঝে মাঝে দু’একটা পাহাড়ী কুটিরে কিছু লোকের দেখা পেলাম। তাদের কাছ থেকে পথ চিনে নিয়ে পথ চলতে লাগলাম। ক্রমশ: রাত বাড়ছে। ঠিক কত জানি না। ক্ষুধায়, পথশ্রমে সবাই ভীষণ ক্লান্ত। কিন্তু অন্ধকারে অচেনা, অজানা স্থানে কোথায নেব বিশ্রাম। তাছাড়া এখন সময় নেই বিশ্রামের।
রাত শেষ হলো। চারিদিকে ভোরের আলো ফুটছে। গাছগাছালির পাতার ফাঁকে ফাঁকে ভোরের সূর্যের আলো পরশ বুলিয়ে যাচ্ছিল। ভোরের পাখীদের কলতানে বনাঞ্চলে মুখরিত হয়ে উঠছিল। দিনের আলোয় সবাই যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। পথঘাট চলতে আর চিনতে কিছুটা সুবিধা হবে হয়তো এবার। তাই মিনিট দশেক সবাই একটু বিশ্রাম নিলাম। তারপর…। আবার যাত্রা শুরু হলো। আগের পথ চলার অভিজ্ঞতাগুলো ডিঙ্গিয়ে চললাম। বেলা বাড়ছে। মাথার উপর সূর্যের তাপ ক্রমশ বাড়ছে। আমরা প্রায় পাহাড়ের শেষপ্রান্তে। আর একটু এগুলেই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা।
দুপুর ১২টা বেজে ৫ মিনিট। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পৌঁছে গেলাম। শত্রুরা তখন হাটহাজারী পুলিশ স্টেশনে ছিল। আমরা এখানে পৌঁছেই শত্রুদের প্রকৃত অবস্থা জানতে তৎপর হলাম। ওরা কি পরিমাণে, কোথায় কোথায় কি ধরনের শক্তি নিয়ে আছে, সর্বাগ্রে তা আমাদের জানা দরকার। কিন্তু তৎক্ষণাৎ সেটা জানতে চেষ্টা করা ঠিক হবে না। তাই চুপচাপ নিজেদের অবস্থা সুদৃঢ় করতে লাগলাম। আমরা সেখানে বাজার করে পজিশন নিয়ে বসতে শুরু করলাম। ইতিপূর্বে চতুর্থ বেঙ্গলের যে দল চিটাগাং-রাঙ্গামাটি রোড ধরে হাটহাজারী অভিমুখে রওনা হয়েছিল তারা কোথায়, কদ্দূর অগ্রসর হয়েছে তা জানার জন্য আমি তিনজন লোকের একটা দলকে গোপনে সে রাস্তা ধরে পাঠালাম। বেশীক্ষণ লাগলো না। ওরা খবর নিয়ে এলো। ওরা হাটহাজারীর প্রায় ৩/৪ মাইল দূরে ঘাঁটি ফেলেছে। আমি তখন ওদের সাথে যোগাযোগ করলাম এবং প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী পরস্পরের সাথে আদান-প্রদান করলাম। ক্রমে রাত হয়ে আসছিল। আমরা চুপচাপ রাতটা কাটানো মনস্থ করলাম। বুঝতে পারলাম ওরা আমাদের অবস্থা সম্বন্ধে কিছু জানতে পারেনি। চুপচাপ ১৪ ডিসেম্বর রাত কেটে গেল। আমরা সকাল হওয়ার সাথে সাথেই শত্রুদের প্রতিউত্তর আসলো। বোঝা গেল ওরা বেশ মজবুত ভাবেই হাটহাজারীতে ঘাঁটি করেছে। আমরাও তাই দুপুর নাগাদ ওদের উপর আক্রমণ চালালাম। ওরা আমাদের আক্রমণের প্রচণ্ড সহ্য করতে না পেরে আত্মসমর্পণ করতে রাজী হলো। ২৪-এফএফএর ‘বি’ কোম্পানীর মেজর হাদীসহ সবাই আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করলো। আমরা তখন হাটহাজারী ছাড়িয়ে গিয়ে নয়াপাড়া ক্যান্টনমেন্টের উপর প্রচণ্ড চাপ দিতে লাগলাম। ইতিমধ্যে ক্যাপ্টেন গফফারের অধীনে পরিচালিত চতুর্থ বেঙ্গলের দলটিও আমাদের সাথে এসে মিলিত হলো। ওদিকে মিত্রবাহিনী ও লে: দিদারের অধীনে ১০ বেঙ্গলের যে চার্লি কোম্পানী ছিল তারা ১৫ই ডিসেম্বর কুমীরার উপর প্রচণ্ড হামলা চালায়। কুমীরার শত্রুরা এ আক্রমণের মুখে বেশিক্ষণ টিকতে পারলো না। তারা পালিয়ে তাদের পরবর্তী ঘাঁটি ফৌজদারহাটে গিয়ে মিলিত হলো। আমাদের চার্লি কোম্পানী ও মিত্রবাহিনী আরো এগিয়ে গেল। আমাদের মত তারাও ফৌজদারহাটের শত্রুদের উপর চাপ সৃষ্টি করতে লাগলো। বার বার তাদের আত্মসমর্পণ করার জন্য ঘোষণা করতে লাগলাম। কিন্তু তবুও আত্মসমর্পণ করতে রাজী হলো না। কিন্তু আমরা জানতাম আত্মসমর্পণ ওদের করতেই হবে। এছাড়া ওদের কোন পথই নেই।
১৬ই ডিসেম্বর সকাল। নিয়াজীকে নির্দিষ্ট সময় দেয়া হলো আত্মসমর্পণের জন্য। নির্দিষ্ট সময়ের বেশ কিছু পরে নিয়াজী আত্মসমর্পণ করলো। বাংলাদেশের প্রত্যেক রণাঙ্গনেই মিত্র ও আমাদের মুক্তিবাহিনীর অধিনায়কদের হাতে পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করলো।
আতিকুল ইসলাম ইমন
<১০, ৪.৯, ১৮৪–১৯০>
সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার মেজর লুৎফর রহমান
৩রা জুন: বজরার কুখ্যাত দালাল পাক সামরিক বাহিনীর অন্যতম সাহায্যকারী, নিরীহ গ্রামবাসীর ধনসম্পদ লুণ্ঠনকারী দানব সেরাজুল ইসলাম (ছেরু মিয়া-বজরা) এর অত্যাচারে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে তারই প্রভাবে এতদঞ্চলে বহু নিরীহ জনগণ রাজাকারে পরিণত হয়। তাই মেজর (বর্তমানে কর্নেল) খালেদ মোশারফ সাহেবের নির্দেশক্রমে ৩রা জুন রাতে বজরা স্কুলের পূর্ব দিকে তার গোপন আড্ডাখানায় অতর্কিত আক্রমণ করি।
কিন্তু সুচতুর দালাল ছেরু মিয়া টের পেয়ে পূর্বেই আত্মগোপন করে। তার ৪ জন সহকারী আমাদের হাতে ধরা পড়লে তাদেরকে হত্যা করা হয়। এদের মৃত্যুর পর এতদঞ্চলে আর তেমন কোন অত্যাচার হয়নি এবং ছেরু মিয়ারও তেমন কোন সন্ধান করতে পারিনি। অবশ্য দেশ মুক্ত হবার পর এই কুখ্যাত দালাল মীরজাফর মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে এবং প্রকাশ্যে জনসাধারণের রায়ে তাকে হত্যা করা হয়।
৬ই জুন: বহু নিরীহ গরীব লোককে প্রলোভন দিয়ে মাইজদীতে রাজাকারে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হতো। সিপাই শাহজাহানকে পাঠালাম মাইজদীতে রাজাকার ট্রেনিং ক্যাম্পে হাতবোমা নিক্ষেপ করার জন্য।
শাহজাহান অতি গোপনে ও কৌশলে রাজাকার ট্রেনিং ক্যাম্পে ঢুকে হাত বোমা নিক্ষেপ করে। এতে রাজাকার কমান্ডার ও আরও দুইজন নিহত হয়। সিপাই শাহজাহান তাদেরকে হত্যা করে অসীম সাহসের পরিচয় দিয়ে বীরত্বের সাথে ফিরে আসতে সক্ষম হয়।
১১ই জুন: চন্দ্রগঞ্জ রাস্তায় পাকবাহিনীর চলাফেরা অনেকাংশে বেড়ে যাওয়ায় চন্দ্রগঞ্জের পুলটি উড়িয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেই। পুলের উভয় পাশে পাক বাহিনীর মেশিনগান মোতায়েন থাকা সত্ত্বেও পুলটি উড়িয়ে দিতে সক্ষম হই।
ইতিমধ্যে খবর পেলাম যে, আমাকে ধরার জন্য নোয়াখালীর পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ মোটা টাকার পুরস্কার ঘোষণা করেছে। গোপালপুর চৌধুরী বাড়ীর নসা মিয়া যদিও পাকবাহিনীর সঙ্গে আপাতদৃষ্টিতে যোগাযোগ রক্ষা করতেন কিন্তু মূলত তিনি আমাদেরকে গোপনে গোপনে পাক হানাদার বাহিনীর সমস্ত গোপনীয় তথ্য জানাতেন। সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর স্বার্থেই তিনি পাঞ্জাবীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে আমাদেরকে সাহায্য করতেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় তার চতুরতা ধরে ফেলে পাক হানাদাররা। তারা গোপালপুর আক্রমণ করে তাকে জঘন্যভাবে হত্যা করে।
এই নসা মিয়ার নিকটই আমি জানতে পারি যে আমাকে ধরার জন্য পাক বাহিনী মোটা টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে এবং অল্পদিনের মধ্যে তারা আমাদের মারাত্মকভাবে আক্রমণ করবে। আমি নসা মিয়ার নিকট এ খবর পাওয়ার পর আমিশাপাড়া ক্যাম্প তুলে নেই এবং অন্যান্য ক্যাম্প থেকেও সমস্ত সৈন্য তুলে নিয়ে সেনবাগের প্রতাপপুর নামক গ্রামে আত্মগোপন করি। অবশেষে ১৮ই জুন পাকসেনারা ১ ব্যাটালিয়ন সৈন্য নিয়ে আমাকে ও আমার দলবলকে ধরার জন্য আমিশপাড়া-বজরা সড়ক, সোনাইমুড়ি-চাটখিল রোড, চট্টগ্রাম-খিলপাড়া সড়ক দিয়ে একই সময় অগ্রসর হন। অবশেষে তারা আমাদের পাত্তা না পেয়ে চলে যায়।
২১শে জুন: হাবিলদার মতিন অতর্কিতে দালালবাজার রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে একজন মিলিশিয়াসহ ১৬ জন রাজাকারকে হত্যা করে তাদের ক্যাম্প তছনছ করে দেয়।
২৩শে জুন: আপানিয়া পুলের নিকট কয়েকজন দালালসহ দু’জন পাকসেনা ইতস্তত ঘোরাফেরা করতে থাকে। সম্ভবত সতী মা-বোনদের ইজ্জত নষ্ট করার উদ্দেশ্যে ঘোরাফেরা করছিল; ঠিক সেই মুহূর্তে নায়েক সুবেদার শামসুল ও হাবিলদার মন্তাজ সেখানে উপস্থিত হয়ে পাকসেনা দু’জনকে খতম করে। অবশ্য দালালরা পালিয়ে যায়। এখানে শামসুল হক ও মন্তাজ অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দিলে স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের মনোবল অত্যন্ত দৃঢ় হয়।
২৪শে জুন (বগাদিয়ায় পুনরায় বিস্ফোরণ ও যুদ্ধ): নায়েক শহীদ বগাদিয়ার নিকটে রাস্তার উপর মাইন বসিয়ে কিছুদূরে সরে থাকে। কিছুক্ষণ পর পাকবাহিনী এক প্লাটুন সৈন্য একটা ট্রাকে চলতে থাকলে মাইন বিস্ফোরণে গাড়িখানা সামান্য নষ্ট হয়। পরে মুহূর্তে কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। যুদ্ধে কোন ক্ষয়ক্ষতি তেমন হয়নি।
২৫শে জুন: রাতে হাবিলদার মতিন লক্ষ্মীপুর বাগবাড়ি ক্যাম্পে মর্টারের সাহায্যে আক্রমণ করেও কয়েকজনকে আহত করে।
২৬শে জুন: সুবেদার ওয়ালী ওয়ালীউল্লা কাফলাতলী রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে কয়েকজন রাজাকারকে হত্যা করে ক্যাম্পটি তছনছ করে দেয়। ইতিমধ্যে শত্রুর কয়েকজন গুপ্তচর হাতেনাতে ধরা পড়ে। অপরদিকে সুবেদার শামসুল হকের হাতে একজন রাজাকার কমান্ডার ধরা পড়ে।
২৭শে জুন: আমি ভারত হতে পুনরায় বিস্ফোরণ ও গোলাগুলি নিয়ে আসি।
৩০শে জুন: হাবিলদার মতিনের নেতৃত্বে এবক প্লাটুন মুক্তিসেনা লক্ষ্মীপুর থেকে কালীরবাজার অগ্রগামী খানসেনাদের প্রচণ্ড আক্রমণ করলে কয়েকজন হতাহত হয়। পাকসেনা কালীরবাজারে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায়।
১৭ই জুলাই: রামগঞ্জের উত্তরে নরিমপুর হতে এক কোম্পানী পাক রেঞ্জার্স ও রাজাকার দল অগ্রসর হতে থাকলে হাবিলদার জাকির হোসেনের নেতৃত্বে এক প্লাটুন মুক্তি সেনা তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বেশ কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর শত্রুরা রাজাকারের দুটি মৃত দেহ ফেলে দৌড়ে প্রাণ বাঁচায়। পরে হাবিলদার জাকির হোসেন মৃত রাজাকারদ্বয়ের দাফনের ব্যবস্থা করে।
১৯শে জুলাই: কয়েকজন রাজাকার হানাদার বাহিনীর এক কোম্পানি সৈন্য মান্দারই বাজারে ক্যাম্প করেছিল। আমি উক্ত ক্যাম্প আক্রমণের জন্য সুবেদার ওয়ালিউল্লাকে আদেশ করি। ওয়ালিউল্লা, আহবিলদার মতিন ও শাহাবুদ্দিন মান্দারিতে শত্রু ঘাঁটির উপর আক্রমণ করে। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর দুজন জোয়ান শহিদ হন।
২৩ শে জুলাই (পুনরায় সাহেবজাদা পুল চূর্ণবিচূর্ণ ): পাকবাহিনী সাহেবজাদা পুল মেরামত করে পুনরায় নোয়াখালীর সাথে এর রেল যোগাযোগ স্থাপন করে। আমি নায়েক আবুল হোসেন ও সুবেদার শামসুল হককে নিয়ে পুলটি নষ্ট করতে যাই। সেখানে কিছু রাজাকার ও মিলিশিয়া পাহারারত ছিল। তাদেরকে আমাদের দিকে আকৃষ্ট করার জন্য গোলাগুলি আরম্ভ করি। অপরদিকে নায়েক আবুল হোসেন পুলের নীচে গিয়ে বিস্ফোরণ দ্রব্য লাগিয়ে সড়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পরই বিরাট আওয়াজে পুলটি ধ্বংস হয়ে যায় এবং নোয়াখালীর সাথে রেল যোগাযোগ পুনরায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
২৬ শে জুলাই: এদিন সুবেদার ওয়ালীউল্লাকে নরিমপুর পাঠাই রেকি করার জন্য। ওয়ালীউল্লা নরিমপুর পৌঁছলে কয়েকজন পাক দালাল (অস্ত্রহীন) সুবেদার ওয়ালীউল্লাকে অতি কৌশলে ঘিরে ফেলে ও বন্দী করে। তৎক্ষণাৎ সুবেদার ওয়ালীউল্লা পিস্তল দিয়ে একজন দালালকে গুলি করে জীবনরক্ষার্থে প্রাণপণে উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত পালাতে সক্ষম হয়।
১৪ আগস্ট (বসুরহাট যুদ্ধ): নোয়াখালী জেলার পশ্চিমাংশ থেকে পূর্বাংশে পাকবাহিনীর সৈন্যদের আনাগোনা বেশী পরিলক্ষিত হয়। এসময় চারদিক থেকে মুক্তিসংগ্রাম অধিকতর শক্তিশালী হতে থাকে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল অনেকগুণ বেড়ে যায়।
আমি বাছাই করা যোদ্ধাদের এক প্লাটুন মুক্তিসেনাকে নায়েক সুবেদার শামসুল হকের নেতৃত্বে পাঠাই বাবুরহাটে খান সেনাদের নির্মূল করার জন্য। অদম্য সাহসী বীরযোদ্ধা শামসুল হক এখানে খান সেনাদের উপর চরম আক্রমণ করে শত্রুর জীপ নষ্ট করে দেয় এবং কয়েকজনকে হত্যা করে। এ যুদ্ধে আমার দু’জন বীরযোদ্ধা শহীদ হন এবং দু’জন গুরুতরভাবে আহত হয়। সিপাহী নূরনবীর বৃদ্ধাঙ্গুল গুলির আঘাতে উড়ে যায়।
১৬ই আগস্ট (পুনরায় আপানিয়া পুল ধ্বংস): পাকবাহিনীর দ্বারা নতুন মেরামত করা আপানিয়া পুলটি নায়েক শহীদ ধ্বংস করে দেয় ও লাকসাম- নোয়াখালী যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
২৬ শে আগস্ট: মিলিশিয়া ও রাজাকার বাহিনীর একটি বিরাট দল আমিনবাজার থেকে আমিশাবাজার দিকে অগ্রসর হচ্ছে এ খবর পাবার পর আমরা তাদের চতুর্দিক দিয়ে ঘেরাও করার পরিকল্পনা করি। সুবেদার ওয়ালীউল্লাকে ত্রিমুখী আক্রমণ করার নির্দেশ দিলাম। নির্দেশক্রমে সুবেদার ওয়ালীউল্লাহ ত্রিমুখী আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। আমি নিজে এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে পিছন দিক থেকে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। শত্রুরা আমিনবাজারের দিকে অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে সুবেদার ওয়ালীউল্লা ত্রিমুখী শুরু করে। ফলে শত্রুরা পিছনে হটতে থাকলে আমি পিছন থেকে আক্রমণ করি। আক্রমণ চারিদিকে থেকে চলতে থাকে। কাজেই শত্রুরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। এদিকে জনসাধারণও ছত্রভঙ্গ হয়ে চারিদিকে দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে। ফলে আমাদের পক্ষে গুলি করা বিরাট প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। এ যসুযোগে শত্রুরা হাতের অস্ত্র ফেলে জনসাধারণের মধ্যে মিশে যায় এবং অনেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ছয়জন রাজাকার নিহত হয় ও কয়েকজন আহত হয়। আমরা উক্ত ছয়জন রাজাকারের লাশ কাচিহাটিতে দাফন করি। রাজাকার মাওলানা মিজানুর রহমান অক্ষত অবস্থায় অস্ত্রসহ আমাদের হাতে ধরা পড়ে। তার নিকট থেকে পাক বাহিনীর অনেক গোপন তথ্য সংগ্রহ করি। পরে তাকে হত্যা করে তারও দাফনের ব্যবস্থা করি। এখানে কয়েকটি চীনা রাইফেলও আমাদের হস্তগত হয়।
১০ই সেপ্টম্বর: রাজাকার ও পাকবাহিনী গোপালপুর সড়কে মুক্তিবাহিনীর গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য এবং সময়মত খবর দেবার জন্য ছোট একটি ছেলেকে নিয়োজিত করে। ছেলেটিকে তারা কিছু টাকা পয়সাও দিয়েছিল। কিন্তু গোপালপুর সড়কে সন্দেহভাজনভাবে ঘোরাফেরা করতে থাকলে গোপালপুরের ডা: আনিস তাকে ধরে ফেলে এবং তাকে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে কাজ করানোর বাধ্য করে।
ইতিমধ্যে আমি বন্ধুরাষ্ট্র ভারতে চলে যাই সমরাস্ত্র সংগ্রহ করতে। জনাব মেজর (বর্তমানে কর্নেল) খালেদ মোশাররফ আমাকে এ্যামুনিশন ও বিস্ফোরণ দ্রব্য সরবরাহ করেন এবং বিভিন্ন সময়ে গেরিলা পদ্ধতিতে মুক্তিযোদ্ধের রণকৌশল সম্বন্ধে অবহিত করেন।
আগস্ট- সেপ্টম্বর মাসে নোয়াখালী জেলায় রাজাকার আর আলবদরের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। সেজন্য নোয়াখালীর পরিষদ সদস্যগণ আমাকে পরামর্শ দিলেন কয়েক ভাগে ভাগ করে অন্যান্যদের হাতেও দায়িত্ব অর্পণ করে মুক্তিযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করার জন্য। আমি নতুন সমরাস্ত্র নিয়ে ভারত থেকে দেশে ফিরলাম। বহু ছাত্র-শ্রমিক ট্রেনিং শেষে দেশে ফেরে। আমি সদর মহকুমাকে চার ভাগে ভাগ করি-
(ক) দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের দায়িত্ব নিলাম আমি নিজে।
(খ) পূর্ব-দক্ষিণের দায়িত্ব দিলাম ওয়ালীউল্লাকে।
(গ) পূর্ব-উত্তরের দায়িত্ব দিলাম নায়েক সুবেদার শামসুল হককে।
(ঘ) পশ্চিম-উত্তরের দায়িত্ব দিলাম নায়েক সুবেদার ইসহাককে।
২রা ওক্টোবর: ছাত্র কমান্ডার একরাম- এর নেতৃত্বাধীন একটি গ্রুপ রামগঞ্জে রাজাকারদের আক্রমণ করে, অপরদিকে সুবেদার ইসহাক পানিয়ালা বাজার আক্রমণ করে ৪জন রাজাকার খতম করে। ৩ রা অক্টোবরে কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার আবুল বাশার বিপুল শহর থেকে বগাদিয়া যাবার সময় সুবেদার শামসুল হকের হাতে বন্দী হয়। সুবেদার শামসুল হক তার কাছ থেকে পাকবাহিনীর গোপন তথ্য সংগ্রহ করে তাকে মেরে ফেলে।
১৮ই ওক্টোবর: নায়েক সুবেদার ইসহাক শামসুন্নাহার হাই স্কুলে অবস্থানরত রাজাকার ক্যাম্পে অতর্কিত আক্রমণ করে কয়েকজন রাজাকারকে হতাহত করে ও ৫টি রাইফেল উদ্দার করে। অপরদিকে নায়েক সুবেদার ওয়ালীউল্লা দালাল বাজার রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ করতে গেলে দেখতে পায় যে রাজাকারকে লুণ্ঠিত কাপড় বন্টনে ব্যস্ত। সেই অবস্থাতেই তিনি তাদেরকে চরম আঘাত হেনে কয়েকজনকে হতাহত করেন। অবশিষ্ট রাজকাররা পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। পরে লুণ্ঠিত কাপড় মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এখানেও ৫টি রাইফেল উদ্ধার করা হয়।
মীরগঞ্জে রাজাকারের আত্মসমর্পণ: মীরগঞ্জে রাজাকাররা আত্মসমর্পণের জন্য আমার নিকট দু’খানা পত্র পাঠায়। প্রথম পত্র আমি মোটেই বিশ্বাস করতে পারিনি। দ্বিতীয় পত্রখানা পাবার পর এ্যাডভোকেট আখতারুজ্জামান সাহেবকে পাঠালাম আত্মসমর্পণের শর্ত নির্ধারণ ও মধ্যস্থতা করার জন্য। সুবেদার ওয়ালীউল্লাকে পাঠালাম সতর্কতার সহিত আত্মসমর্পণ করানোর জন্য। পূর্বশর্ত অনুযায়ী রাজাকাররা লাইন ধরে অস্ত্ররেখে দু’হাত উপরে তুলে নায়েক ওয়ালীউল্লার নিকট আত্মসমর্পণ করে। সংখ্যায় ছিল মোট ৩৭ জন রাজাকার ও ২৭ জন পুলিশ। কয়েকদিন তাদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করার পর ৫/৭ জনকে ভাগ ভাগ করে মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন প্লাটুনে দেয়া হয়। এদের মধ্যে দু’জন পুলিশ পুনরায় বিশ্বাসঘাতকতা করে। অবশ্য তারা পুনরায় মাইজদিতে ধরা পড়লে সেখানেই গুলি করে দেয় নায়েক সুবেদার ওয়ালীউল্লা।
২৩ শে অক্টোবর (প্রধান দালাল ননী চেয়ারম্যান ধৃত): লক্ষ্মীপুরের প্রধান দালাল ননী চেয়ারম্যানের অত্যাচারে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়। লুটতরাজ, নারী ধর্ষণ, গণহত্যা, বাড়ি পোড়ানো, হানাদার বাহিনীকে মুক্তিবাহিনীর সন্ধান দেয়াই ছিল তার পেশা। অবশেষে বীর সাহসী যোদ্ধা নায়েক সুবেদার ওয়ালীউল্লা জালালের প্লাটুন নিয়ে এই কুখ্যাত দালাল বাহিনীর উপর আক্রমণ করে জীবিত অবস্থায় বাঙ্গালীর বিশ্বাসঘাতক দালাল ননী চেয়ারম্যানকে বন্দী করে। তার বন্দী হবার খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে কয়েক হাজার মানুষ সেখানে উপস্থিত হয়। সমস্ত মানুষের উপস্থিতিতে তার নিজ বন্দুক দিয়ে তাকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। ক্রুদ্ধ জনতা তার লাশ নিয়ে কয়েক ঘণ্টা ধরে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মনের রাগ মিটায়।
২৯ শে অক্টোবর (সোনাইমুড়ি-চাটখীর যুদ্ধ): পাক বাহিনীর বেলুচ রেজিমেন্ট লাকসান থেকে কামান ও রকেটের সাহায্যে ফায়ার করতে করতে সোনাইমুড়ি থেকে চাটখীল সড়কের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এমন সময় ছাত্রদলসহ আমরা বাধা দিলে তুমুল লড়াই শুরু হয়। প্রায় ২/৩ ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। শত্রুপক্ষের কয়েকজন হতাহত হয়। শত্রুরা শেলিং করে হতাহত সৈন্যদের পার করে। হানাদার বাহিনীর শেলিং-এ একই বাড়ির ৫ জন নিরীহ লোক মারা যায়।
১০ই নভেম্বর: চন্দ্রগঞ্জের নিকটবর্তী রাস্তায় মাইন বসানো হয়। পাকবাহিনীর এক ট্রাক আটা লক্ষ্মীপুরে যাবার সময় ট্রাকটি মাইনের আঘাতে নষ্ট হয় এবং ড্রাইভার নিহত হয়।
১৩ই নভেম্বর: আমার নিজ প্লাটুন নিয়ে লক্ষ্মীপুর রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ করি। এ আকস্মিক আক্রমণে বহু রাজাকার হতাহত হয়। এখানে জনসাধারণ বিশেষভাবে আমাদেরকে সাহায্য করেন।
১৭ই নভেম্বর: সুবেদার ওয়ালীউল্লা মধ্যরাতে রামগঞ্জে অতর্কিত আক্রমণ করে রামগঞ্জের রাজাকার ক্যাম্প নিশ্চিহ্ন করে দেন।
২৯ শে নভেম্বর: পশুবাহিনী একখানা ভ্যানে দু’জন স্ত্রীলোককে নিয়ে যাবার সময় বগাদিয়ার নিকট হাবিলদার আউয়াল গাড়িটি আক্রমণ করে। এ সময় পিছনের দিকে শত্রু বাহিনীর আরও কিছু সৈন্য সেখানে উপস্থিত হয়। আমিও আমার প্লাটুন নিয়ে আক্রমণ করি। ২/৩ ঘণ্টা যুদ্ধের পর তারা স্ত্রীলোক দু’জনকে রেখেই পলায়ন করে। পরে উক্ত স্ত্রীলোকদ্বয়কে তাদের আত্মীয়ের নিকট পৌঁছিয়ে দেওয়া হয়।
৩০ নভেম্বর: সাহেবজাদা পুল মেরামত করার সময় পাকবাহিনীর লোকজন হাবিলদার নূর মোহাম্মদ -এর হাতে মার খেয়ে পুল মেরামত বাদ দিয়ে পালিয়ে যায়।
১লা ডিসেম্বর: চন্দ্রগঞ্জ বাজারের সামান্য উত্তরে হাবিলদার রুহুল, আমি ও ছাত্র কমান্ডার সফি আলোচনা করি। এমন সময় আহত ছোট একটি ছেলে খবর দিলো যে পাঞ্চাবী সৈন্যরা চন্দ্রগঞ্জে আসছে। হাবিলদার রুহুল আমিনকে প্রস্তুতি নিতে বললাম। ইতিমধ্যে পাক-সৈন্য পৌঁছে গেছে। হাবিলদার রুহুল আমিন শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এ সময় আমার হাতে কোন অস্ত্র ছিল না। শুধু আমার বাহিনীকে কমান্ড করতে লাগলাম। শুরু হলো তুমুল যুদ্ধ। ছাত্রদলের একমাত্র কমান্ডার সফি ও অন্যান্য কয়েকজন ব্যতীত সবাই সড়ে পড়লো। এ সময় আমি, ছাত্রদলের সফি এবং আওয়ামীলীগের বিশিষ্ট কর্মী আব্দুর রব চন্দ্রগঞ্জ বাজারের উত্তর-পূর্ব দিকে দাঁড়িয়ে যুদ্ধের পরিস্থিতি দেখছিলাম। হঠাৎ শত্রুবাহিনীর কয়েকজন সৈন্য আমাদের কাছাকাছি এসে পড়ে। আমরা পিছনে সড়ি। তখন এল-এম-জি টার্গেট আমাদের দিকে। ছাত্রনেতা সফির হাত থেকে এল-এম-জি টা নিয়ে আমি তৎক্ষণাৎ একটা ব্রাশ মারলাম। ব্যাপারটা ঘটে গেল খুবই দ্রুত। মুহূর্তের মধ্যে গর্জে উঠলো পাকবাহিনীর আগ্নেয়াস্ত্রগুলো। ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটতে লাগলো পাকবাহিনীর বুলেট। এ সময় আমার হাতের এল-এম-জি ম্যাগাজিন শূন্য। মৃত্যু অবধারিত ভাবলাম। কিন্তু এমন আমাদের জোয়ানরা শত্রুদের উপর পিছন থেকে আক্রমণ করে, ফলে শত্রুরা ইতস্তত- বিক্ষিপ্তভাবে গুলি ছুড়তে থাকে। এমন সময়ে আমরা ক্রলিং করে পলায়ন করি। এভাবে আমরা মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পাই।
৪ঠা ডিসেম্বর: ইঞ্জিনিয়ার নায়েক আবুল হোসেন- এর নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধাকে নির্দেশ দিলাম যে তারা যেন সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পুলগুলি ধ্বংস করে দেয়। তাদের সাহায্যের জন্য প্রত্যেক জায়গায় এ্যামবুশ পার্টি পাঠানো হলো। রাতে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পুলগুলি ধ্বংস করা হলে পাকবাহিনী খুবই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং কুমিল্লার দিকে পালাতে থাকে। পলায়ন পর পাকসেনাদের সঙ্গে জায়গায় জায়গায় এ্যামবুশরত মুক্তিবাহিনীর খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ হয়।
৫ই ডিসেম্বর: হাবিলদার আব্দুল লতিফকে এক প্লাটুন মুক্তিফৌজ দিয়ে লাকসাম-নোয়াখালী সড়কে শত্রুদের পলায়ন রোধ করার জন্য পাঠাই। কিন্তু তখন ফিরে এসে জানালেন যে, আক্রমণের ভয়ে পাকবাহিনী রাস্তা ছেড়ে গ্রামের ভিতর দিয়ে পলায়ন করেছে।
৬ই ডিসেম্বর: হাবিলদার আব্দুল মতিন খবর পাঠালেন যে লক্ষ্মীপুর ও রায়পুরে তুমুল যুদ্ধের পর ১০৮ জন রাজাকারকে নিহত করে লক্ষ্মীপুর সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত করা হয়েছে এবং রায়পুরও মুক্তিবাহিনীর আয়ত্তাধীন। এ খবার পাবার পর আমার জোয়ানদের মনোবল অনেকগুণ বেড়ে যায়।
৭ই ডিসেম্বর: এই দিন নোয়াখালীর রাস্তায় রাস্তায় বেড়িয়ে পড়ে হাজার হাজার আবালবৃদ্ধবণিতা। সকলের মুখে শ্লোগান আর শ্লোগান। হাতে স্বাধীন বাংলার পতাকা। নতুন সূর্যের উদয় হলো নোয়াখালীতে।
৩ রা ডিসেম্বর: প্রোগ্রাম অনুযায়ী ভোর ছ’টায় আমরা আক্রমণ করলাম সোনাইমুড়ি। রাজাকারদের সাথে গুলি বিনিময় হচ্ছে। এদিকে হাজার হাজার জনতা বিজয় উল্লাসে মেতে উঠেছে। অবশেষে ৬৩ জন রাজাকারকে নিহত করে সোনাইমুড়ি দখল করা হলো। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, কোন এক অসতর্ক মুহূর্তে বীর যোদ্ধা হাবিলদার নূর মোহাম্মদ এবং ছাত্রনেতা সালেহ আহমদ এ যুদ্ধে শহীদ হন। সোনাইমুড়ি মুক্ত হবার পর আমরা বজরা আক্রমণ করি এবং বজরা মুক্ত করে চৌমুহনী অভিমুখে রওনা হই। এখানেও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। চৌমুহনী আক্রমণের কয়েক ঘণ্টা পর বহু রাজাকার নিহত হয় এবং অবশিষ্ট রাজাকার আমাদের হাতে বন্দী হয়। চৌমুহনীতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়তে থাকে। এসময় নায়েক সুবেদার ওয়ালীউল্লা ও শামসুল হক এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন এবং চৌমুহনী আক্রমণে সাহায্য করেন। এ সময় মেজর জাফর ইমাম চৌমুহনীতে তাঁর বাহিনী নিয়ে উপস্থিত হন এবং পরে যৌথ শক্তিতে মাইজদী আক্রমণ করে তা মুক্ত করা হয়।
এ যুদ্ধে আহত হয়ে আজও নায়েক সুবেদার ইসহাক ও হাবিলদার জালাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এভাবে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হয়। আমাদের এ যুদ্ধে জনসাধারণ যথেষ্ট সাহায্য করেন, বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয়, খাদ্য ও অন্যান্য সাহায্য করে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করেন। বাংলার মুক্তিযোদ্ধা দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে এটাই প্রমাণ করেছে যে তারা কাপুরুষ নয়। তারা সম্মুখসমরে যথেষ্ট দক্ষতার অধিকারী।
স্বাক্ষর: সুবেদার মেজর লুৎফর রহমান
১৮-০৯-১৯৭৩ ইং
নীলাঞ্জনা অদিতি
<১০, ৪.১০, ১৪৬–১৪৮>
সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার আবদুল ওয়াহাব বীর বিক্রম
আমি এপ্রিল মাসেই ভারতের সোনামুড়াতে চলিয়া যাই এবং সেখান হইতে ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে দেবীপুর আসি। তখন সি কোম্পানীর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন গাফফার। আমি তখন সি কোম্পানীর ৭ নং প্লাটুনের প্লাটুন কমান্দার ছিলাম। এইখানে পুরো কোম্পানি লইয়া আমরা কয়েকটি অপারেশন করি। আমি আমার নিজস্ব প্লাটুন লইয়াও ছোটখাটো কয়েকটা অপারেশন করি।
১২-৪-৭১ তারিখে খবর পাইলাম যে, ৭ জন পাকসৈন্য রেললাইন ধরিয়া শালদা নদীর দিকে অগ্রসর হইতেছে। তখন আমি আমার প্লাতুন লইয়া সেইদিকে অগ্রসর হই। গিয়াই দেখিতে পাই তাহারা অনেক দূর আগাইয়া গিয়াছে। তখন আমি আমার প্লাটুন লইয়া মন্দভাগ রেল স্টেশনের উত্তর দিকে দীঘিরপাড় নামক স্থানে এমবুশ বসাই। তাহারা যখন পুনরায় ওই রাস্তা হইয়া ফিইতেছিল তখন আমরা তাহাদের উপর আক্রমন করি। আমার আক্রমনে সেখানে ১৮ জন নিহত হয়, ৯ জন আহত হয়। বাকি লোক পলায়ন করিতে সক্ষম হয়, পরে আমরা দেবীপুর চলিয়া যাই।
২৫-৪-৭১ তারিখে ২২ জন জোয়ান লইয়া বাংলাদেশে প্রবেশ করি। চালনা নামক গ্রামে আসার পর আমাদের রাত্রি হইয়া যায়। তাই সেখানকার জনগনের সহযোগীতায় সেখানেই রাত্রি যাপন করি। পরের দিন ভোর ৪ টার সময় সেখান হইতে রওয়ানা হইয়া শিতলাই নামক গ্রামে যাই। সেখান হইতে আমি নিজে গিয়া সি এন্ড বি রোড রেকি করিয়া আসি। রাত্রিতে শালঘর নামক স্থানে সি এন্ড বি রাস্তায় এমবুশ লাগাই। রাত্র ১১ টার সময় কুমিল্লা হইতে ২৭ খানা গাড়ি লইয়া পাকসৈন্য সিলেটের দিকে অগ্রসর হইতে থাকিলে আমি আমার প্লাটুন লইয়া তাহাদের উপর হামলা চালাই। আমার এই আক্রমনে তাহাদের ১০ টা গাড়ি সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৮ টি গাড়ি আংশিক ক্ষতি হয়। তাহাতে বহূ পাকসৈন্য হতাহত হয়। বাকিগুলি চলিয়া যায়। পরের দিন সকাল ১০ ঘটিকার সময় পুনরায় আমি দেবীপুর চলিয়া আসি।
১৩-৫-৭১ তারিখে খবর পাই যে, প্রায় ২০০ জন পাকসৈন্য রেললাইন হইয়া গাড়িতে করিয়া শালদা নদীর দিকে অগ্রসর হইতেছে। তখন আমি আমার প্লাটুন লইয়া মন্দভাগ রেল স্টেশনে গিয়া তাহাদের উপর আক্রমন করি। আমাদের আক্রমনে প্রায় ২৫ জন মারা যায়। বাকীগুলি তখন পজিশন নেয়। এমতাবস্থায় তাহাদের মালপত্রের গাড়িতে আগুন লাগিয়া যায়। তখন তাহারা সেখান হইতে পলায়ন করে। এই আগুন তিনদিন পর্যন্ত জ্বলিতেছিল।
১৭-৫-৭১ তারিখে আমি আমার প্লাটুন লইয়া পৃথক হয়ে পরি। তখন আমার কমান্ডে ৫০ জন লোক ছিল। তাহাদেরকে লইয়া মন্দভাগ (কোনাবন) রেল স্টেশন এরিয়ায় ডিফেন্স করি।
২১-৫-৭১ তারিখে পাকসৈন্যরা ২ টা গাড়ি লইয়া শালদা নদির দিকে অগ্রসর হইতে থাকিলে আমি তাহাদের উপর আক্রমন করি। তাহাতে তাহাদের ২ টা গাড়ি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয় ও ৯ জন সৈন্য মারা যায়।
১৮-৬-৭১ তারিখে ৪০ জন সৈনিকের একটি পেট্রল পার্টি তাহাদের বিজলি তার মেরামতের জন্য শালদা নদী হইতে কসবার দিকে অগ্রসর হইতে থাকিলে আমি আমার জোয়ান লইয়া তাহাদের উপর অতর্কিত ভাবে আক্রমন চালাই। আমার এই অতর্কিত আক্রমনে ৯ জন পাকসৈন্য নিহত হয়। বাকী সৈন্যগন আমাদের তীব্র আক্রমনে টিকিতে না পারিয়া পিছনে হটে।
২০-৬-৭১ তারিখে আমরা আমাদের মন্দভাগ ডিফেন্স ছাড়িয়া পূর্বোল্লিখিত ডিফেন্স দেবীপুর চলিয়া যাই। তখন বর্তমান মেজর গাফফার সাহেব সেখান হইতে ডিফেন্স লইয়া বেলুনিয়ার দিকে চলিয়া যান। দেবীপুর যাওয়ার পর আমার জোয়ানের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ২০০ জন।
২৭-৬-৭১ তারিখে ১৮ জন পাকসৈন্য কসবা হইতে ইমামবাড়ির দিকে যাইতেছিল। তখন আমি আমার ১২ জন জোয়ান লইয়া কসবা রেল স্টেশনের নিকট তাহাদের উপর আক্রমন করি। আমার এই আক্রমনে তাহাদের ১৭ জন সৈনিক নিহত হয়। মাত্র ১ জন সৈনিক বাঁচিয়া যায়। আমরা তখন তাহাদের লাশ আনিবার জন্য অগ্রসর হইলে কসবা হইতে পাকসৈন্যর আর একটি পার্টি ফায়ার করিতে করিতে অগ্রসর হলে আমরা পিছনে হটি। পরে এখান হইতে কিছু অস্ত্র উদ্ধার করি।
৮-৭-৭১ তারিখে বর্তমান মেজর গাফফার সাহেব বেলুনিয়া হইতে ফিরিয়া আসিয়া কোনাবনে পুনরায় হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে।
৯-৭-৭১ তারিখে গাফফার সাহেব দেবীপুর হইতে আমার প্লাতুনকে কোনাবন লইয়া আসেন। ঐ তারিখ রাত্রিতেই আমি গাফফার সাহেবকে বলি যে, পাঞ্জাবিরা রেশন লইয়া প্রতি সপ্তাহে শালদা ও মন্দভাগের দিকে যায়। আমি সেখানে গিয়া তাহাদেরকে আক্রমন করিব।
১০-৭-৭১ তারিখেই আমি ১৮ জন লোক লইয়া শালদা নদীর দিকে অগ্রসর হই। মঈনপুর নামক জায়গায় গিয়ে দেখতে পাই কয়েকখানা নৌকা ও স্পীডবোট লইয়া তাহারা মন্দভাগের দিকে অগ্রসররত। তখন আমি তাহাদের হইতে ১৩ শত গজ দূরে। তাই ঐ সময় তাহাদেরকে আক্রমন করিতে পারিনাই। পরে আমি নিজে গিয়া এমবুশ লাগাইবার জায়গা রেকি করিয়া আসি। আমি পরে আমার জোয়ানদেরকে লইয়া সেখানে এমবুশ বসাই। বিকাল আড়াইটার সময় তাহারা ফিরিতেছিল। তখন আমি তাহাদের ওপর আক্রমন চালাই। ঐ সময় তাহারা আমার নিকট হইতে ২৫ গজ দূরে ছিল। তাহাদের স্পীডবোটে ২ জন লে; কর্নেল ২ জন মেজর, ২ জন ক্যাপ্টেন ১ জন নায়েব সুবেদার ৩ জন সিপাই ও ১ জন অবাঙ্গালি ব্যবসায়ী। আমার তীব্র আক্রমনে তাহাদের স্পীডবোট ছিন্নভিন্ন হইয়া পরে। ফলে সবাই নিহত হয়। এখান হইতে একটা অতি প্রয়োজনিয় ম্যাপ, ১ টা ওয়ারলেস সেট ৩ টা MGIA-3 সহ আরো কয়েকটি অস্ত্র উদ্ধার করি। আমরা চালিজা যাওয়ার পর পাকসৈন্য আসিয়া তাহাদের মৃতদেহ উদ্ধার করে। পরে তাহারা জানিতে পারে যে, ক্যাপ্টেন বোখারীসহ অন্যান্য উচ্চপদস্থ অফিসারদিগকে আমি হত্যা করিয়াছি তখন তাহারা ঐ এয়াকায় প্রকাশ করে যে যে লক সুবেদার ওয়াহাব সাহেবের মৃত লাশ লইয়া আসিবে তাহাকে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হইবে।
১৮-৭-৭১ তারিখে নওগা নামক জায়গায় পাক ডিফেন্সের ও পি পোস্টে আক্রমন করি। প্রকাশ থাকে যে, ঐদিন ২ জন অফিসার ১ জন জেসিও ও ৩ জন সান্ত্রি তাহাদের ওপি পোস্টে আসিয়া চারিদিক লক্ষ্য করিতেছিল। ওই সময় ই আমি তাহাদের উপর আক্রমন চালাই। আমার তীব্র আক্রমনে ২ জন অফিসার, ১ জন জেসিও ও ২ জন সেপাই নিহত হয়। বাকী ১ জন সেপাই আহত হইয়া ওপি পোস্ত এর উপর হইতে নিচে পরিয়া যায়।
৭-৮-৭১ তারিখে আমি আমার প্লাটুন লইয়া মন্দভাগ গ্রাম এলাকায় পাক বাহিনীর শক্ত ডিফেন্সের উপর আক্রমন চালাই। আমারর তিব্র আক্রমনে পাক বাহিনি তাহাদের প্রায় ১০০ টি বাঙ্কার ছারিয়া পিছু হটে। যাওয়ার পথে তাহারা বহূ এম্যুনিশন ফেলিয়া যায়। আমার এই আক্রমনের সময় মেজর আজিজ পাশা তাহার মুজিব ব্যটারি ও বর্তমান সুবেদার মেজর শামসুল হক তাহার ৩” মর্টারের সাহায্যে সর্বপ্রকার সাহায্য করেন।
২৪-৮-৭১ তারিখে আমি কয়েকজন জোয়ান লইয়া সিএন্দবি রোডের কালামুড়া ব্রিজ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করিয়া ফেলি। এখানে যত রাজাকার ছিল তাহারা আমাদের সহিত একত্রিত হয়। তাহাদেরকে কোনাবন পাঠাইয়া দিয়া আমরা কালুমুড়া ব্রীজের ২ মাইল দক্ষিণে মাধবপুর ও মীরপুরের মাঝখানে এমবুশ করি। তারপর দেখা যায় পাকসৈন্য ভর্তি ২ টা টেস্ট বাস, ৩ টা জিপ ও ২ টা ডজ অগ্রসর হইতেছে। তখন আমি আমার প্লাটুন লইয়া তাহাদের উপর প্রচন্দ আক্রমন চালাই। আমার এই তীব্র আক্রমনে ৭ টা গাড়ি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হইয়া যায়। তাহাদের বহূ সৈনিক মারা যায়। ৪ জন পাকসৈন্যকে অস্ত্রশস্ত্র সহ জ্যান্ত ধরিয়া ফেলি। পরে রাজাকারটাকে রাখিয়া বাকি ৩ জন পাকসৈন্যকে ভারতে পাঠাইয়া দেই।
২৮-৮-৭১ তারিখে কোম্পানিগঞ্জ হইতে প্রায় ১৫০ জনের মত রাজাকার ও পাকসৈন্য মহেশপুর লুটপাট করার জন্য আসে। আমি তখন তাড়াতাড়ি আমার পার্টি লইয়া গ্রামটির চারিদিকে এমবুশ করিয়া তাহাদের উপর আক্রমন চালাই। আমাদের এই আক্রমন বিকাল ৫ ঘটিকা পর্যন্ত চলে। শেষে আমাদের আক্রমনে ৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। বাকী সবাই লুটের মাল ফেলিয়া পলায়ন করিতে সক্ষম হয়। বিকাল ৫ ঘটিকার সময় আমরা কোনাবনের দিকে অগ্রসর হই। কিছুদুর যাওয়ার পর দেখিতে পাই মীরপুর ও মাধবপুর এলাকা পাকবাহিনি জ্বালাইয়া দিতেছে। অনেক দূর হইতে আগুনের লেলিহান শিখা ও ধোঁয়া দেখা যাইতেছিল। তখন আমরা সেইদিকে রওয়ানা হই। মাধবপুর উপস্থিত হইয়া অতি তাড়াতাড়ি এমবুশ পাতিয়া তাহাদের উপর আক্রমন চালাই। আমাদের আক্রমনে তাহারা পিছু হটে কিছুসংখ্যক লোক সেখানে হতাহত হয়। রাত্রি ১০ টার দিকে আমরা চালনা নামক গ্রামের এক বাড়িতে গিয়া উঠি তখন তাহারা তাড়াতাড়ি আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করে। খাওয়া দাওয়ার পর রাত্র ৩ ঘটিকার সময় আমাদের ডিফেন্স মন্দভাগে ফিরিয়া আসে।
৩০-৮-৭১ তারিখে খবর পাইলাম যে, চালনা গ্রামে পাক বাহিনী প্রবেশ করিয়া ডিফেন্স করিয়াছে। এই খবর পাইয়া ঐ দিনগত রাত্রিতেই আমি আমার ৫০ জন জোয়ান লইয়া সেখানে গিয়ে উপস্থিত হই। সুবেদার শামসুল হক সাহেব ও তখন ২ টা মর্টার সহ ১ টি সেকশন লইয়া আমাকে সাহায্য করার জন্য আসেন। ভোরের দিকে আমি তাহাদের উপর গুলি করি। আমার চারিদিকের আক্রমনে ১৩ জন রাজাকার সাঁতরাইয়া পালাইয়া যায়। সারাদিন যুদ্ধ চলার পর রাত্রির অন্ধকারে কয়েকজন পাকসৈন্য পালাইয়া যায়। বাকি ১ জন ক্যাপ্টেন ১৫ জন সিপাই ২৯ জন রাজাকার ঘটনাস্থলেই মারা যায়। এখানে আমরা ৭ টি বড় নৌকা মালসহ দখল করিয়া ফেলি। ৬ টা এল এম জি, ম্যাগাজিন বাক্স ৬ টা, এল এম জি ম্যাগাজিন ৭২ টা, রাইফেল ১২ টা, ৮১০ টা বুলেট উদ্ধার করি। সাঁতরাইয়া যাওয়া রাজাকারদের ভিতর শিতলাই গ্রামের জনগন ৬ জনকে খতম করিয়া ফেলে। বাকী রাজাকারদেরকে আবদুল হক কোনাবন পৌঁছাইয়া দেয়। শেষে আমরা চালনাতেই ডিফেন্স করি।
২-৯-৭১ তারিখে পাকসৈন্যরা নৌকাযোগে চারিদিকে জ্বালাইতে আমাদের দিকে অগ্রসর হয়। তাহারা জয়দ্ধনি দিতে দিতে আগাইয়া আসিতেছিল। তাহারা যখন আমাদের এমবুশের ভিতর আসিয়া পরে তখন আমরা তাহাদের উপর আক্রমন চালাই আমাদের তীব্র আক্রমনে তাহাদের তিনখানা নৌকা ডুবিয়া যায়। বহূ পাকসৈন্য নিহত হয়। শেষে তাহারা আর্টিলারির সাহায্যে আমাদের উপর ভীষন ফায়ার চালায়। এই আক্রমনে আমাদের পক্ষে আজাহার আলী শহিদ ও সিপাই আব্দুস সাত্তার আহত হন। সেখানে সারাদিন রাত্রি থাকার পর ৩-৯-৭১ তারিখে আমরা আমাদের ডিফেন্স তুলিয়া কোনাবন চলিয়া যাই।
১৫-১০-৭১ তারিখে আমাদের প্রায় ১ ব্যাটেলিয়নের মত মুক্তিযোদ্ধা শালদা নদী পাক ডিফেন্স তোলার জন্য চেষ্টা করে কিন্তু পারে নাই। তাহাদের পিছনে তখন মুজিব ব্যাটারি ছিল। শেষে তাহারা অকৃতকার্য হইয়া পিছনের দিকে চলিয়া যায়। ঐ সময় আমার অসুখ থাকায় আমি তাহাদের সহিত যোগদান করিতে পারিনাই।
১৮-১০-৭১ তারিখে বিকালে আমি আমার প্লাটুন লইয়া মন্দভাগ বাজারের পশ্চিম দিকে দেউশ নামক জায়গায় ডিফেন্স লই। ১৮-১০-৭১ তারিখে ১ কোম্পানী পাকসৈন্য অন্যদিকে যাওয়ার পথে আমাদের ডিফেন্সের মাঝে আটকাইয়া যায়। তখন আমি আমার প্লাটুন লইয়া তাহাদের উপর আক্রমন চালাই। আমাদের আক্রমনে ১ জন মেজর, ১ জন লেঃ সহ প্রায় ১০০ জন পাকসৈন্য নিহত হয়। চারজন আহতকে চিকিৎসার জন্য কোনাবন পাঠাইয়া দেই। ঐ দিন আমরা পাকবাহিনীর বহূ মৃত লাশ উদ্ধার করি। পাক বাহিনীর মৃত লাশ হইতে আমরা বহূ টাকা পয়সা ঘড়ি কলম উদ্ধার করি। এগুলি আমরা জোয়ানদেরকে দিয়া দেই। সেখানে আমরা ৬ টি এমজিআই – এ-৩, ৭ টি এল এম জি, ৭০ টা জি ৩ রাইফেল, ১ টা ৬০ এমএম মোটর, ৩ টা ৮৩ এম এম বি সি, ১ টা ওয়ারলেস সেট ৩ টা , টেলিফোন ৩ টা , ২” মর্টার, ১ জন হাবিলদারের পকেট থেকে তিনশত ডলার, কয়েকটা ট্রানজিস্টার উদ্ধার করি। পরদিন সকালে পাকবাহিনি আমাদের উপর বিমান হামলা করে। এ সময়ও তাহারা আমাকে ধরিয়া দেবার জন্য ৫০ হাজার টাকা ঘোষনা দেয়। প্রকাশ থাকে যে, ১৯ তারিখেই আমাকে ৪র্থ বেঙ্গলের সি কোম্পানির কমান্ডারের দায়িত্ব দেয়া হয়।
২৩-১১-৭১ তারিখে আমি আমার পুরো কোম্পানী লইয়া শালদা নদীতে তিন দিক হইতে আক্রমন করি। আমি নিজে ৮ নং প্লাটুন লইয়া পাকা ডিফেন্সের উপর হামলা চালাই। আমি তখন একটা এলএমজি ও ওয়ারলেস সেট বহন করিয়া চলিতাম। ৬০ এমএম ও ২” মর্টার বহন করার জন্য অন্য লোক ছিল। আমি নিজে এই অস্ত্রের সাহায্যে তাহাদের ৫ টা পাকা বাঙ্কার উড়াইয়া দেই। আমাদের এই আক্রমনের মাঝেই আমি বর্তমান মেজর গফফার সাহেবের সহিত অয়ারলেসে আলাপ করিতেছিলাম। ঐ সময় আমার অয়ারলেসে আলাপ করিতেছিলাম। ঐ সময় আমার ওয়ারলেসে পাকসেনাদের কথা ধরিতে পারি। তখনই আমি ওয়ারলেসের মাধ্যমে পাকসেনাদের গালি দিতে থাকি এবং বলি যে, তোরা আমাদেরকে জানিস না, আমরা বেঙ্গল রেজিমেন্টের লোক তখন পাকসেনারা ভয় পাইয়া পিছনে হটিতে থাকে। এই সুযোগে আমরা তাহাদের উপর আরো প্রচন্ড বেগে আক্রমন চালাই। তখন তাহারা আরো তাড়াতাড়ি পিছনে হটে। আমাদের এই আক্রমনে ৫০ জন পাকসৈন্য নিহত হয়। ১ জন রাজাকারসহ ৪ জন পাকসেনাকে বন্দী করিয়া ফেলি। পাক বাহিনি হটিয়া যাবার পর আমরা এখান হইতে বহূ অস্ত্র শস্ত্র ও মালামাল উদ্ধার করি।
*বাংলে একাডেমীর পক্ষ থেকে এই সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়।
নীলাঞ্জনা অদিতি
<১০, ৪.১১, ১৪৬–১৪৮>
সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার গোলাম আম্বিয়া
৭ ই জুন এক এমবুশে ৩ জন পাকসেনা নিহত হয়। ১২ ই জুন সিঙ্গারবিল এলাকায় এমবুশে ১৩ জন পাকসেনা নিহত ও ২ জন আহত হয়। ১৬ ই জুন এক এমবুশে ৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। ২০ শে জুন আর এক এমবুশে ২ জন নিহত হয়। ২৩ শে জুন রাজাপুর ব্রীজ মেরামতকারি দলের উপর আমরা এমবুশ করি। এতে ২/৩ জন সাধারন নাগরিকসহ ২৭ জন মারা যায়। কয়েকজন আহত হয়। ২৪ শে জুন কাশিমপুর এলাকায় এমবুশে ১৭ জন নিহত হয়। ঐ তারিখে রূপা এলাকায় এমবুশে ২৮ জন নিহত হয়। ২৫ জুন কালাছরা চা বাগান এলাকায় আমরা আক্রমন করি। এই আক্রমনে তাদের ৪৪ জন নিহত হয়। ২৬ শে জুন রেইডে ঐ এলাকায় তিনজন নিহত হয়। ২৭ শে জুন আর এক এমবুশে ওদের ১৬ জন নিহত হয়।
২ রা জুলাই রূপা গ্রাম এলাকায় এমবুশে ১৯ জন নিহত হয়। ৪ ঠা জুলাই সিঙ্গারবিল ব্রীজ মেরামত করতে সাধারণ নাগরিকসহ ৩০ জন নিহত হয়। কালাছড়া চা বাগান এলাকায় এক রেইডে ৪ জন নিহত হয়। ১২ জুলাই মেজর খালেদ মোশাররফ আমাকে দুটো প্লাতুন নিয়ে কুলাপাথর যাবার নির্দেশ দেন।
শালদা নদী এলাকায় ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে দুটো কোম্পানি ছিল। তাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য আমাকে কুলাপাথরে পাঠান হয়। চট্টগ্রাম আখাউড়া রেলওয়ে যোগাযোগ ব্যাহত করার জন্য আমি এক প্লাতুন নিয়ে কোনাবনে আসি। চাটুয়াখোলা প্লাটুন হেডকোয়ার্টার ছিল। ক্যাপ্টেন গাফফার আমাকে পেয়ে খুব খুশী হন।
১৬ ই জুলাই চাটুয়াখোলা থেকে এক এমবুশে একজন ক্যাপ্টেনসহ ৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। আমাদের হাবিলদার তৈয়ব আলী গুলির আঘাতে শহিদ হন।
৯ ই আগস্ট বানিয়ারূপে এমবুশে ১৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। ১২ ই আগস্ট লক্ষ্মীপুর গ্রাম এলাকায় এমবুশে ৪ জন পাকসেনা নিহত হয়।
২৪ শে আগস্ট কালামুড়া ব্রীজ ধ্বংস করা হয়। ৭ জন রাজাকারকে রাইফেলসহ ধরা হয়। ২৭ শে আগস্ট পাক দালাল তবদীল হোসেনকে ধরা হয় এবং বিস্ফোরকের সাহায্যে উড়িয়ে দেয়া হয়। সে আশেপাশে ২৯ জন যুবতীকে পাক অফিসারদের সরবরাহ করেছিল। তাকে মেরে তার ছেলেমেয়েদের খবর দেয়া হয়েছিল। তার মেয়ে এসে আমাকে বলে যে যে আমার পিতা নয়। ২৮ শে আগস্ত মাইজবার গ্রামে এক রেইডে ৩৬ জন পাকসেনাকে খতম করা হয়। ২৯ শে আগস্ট একটি রাজাকারকে রাইফেল সহ ধরা হয়।
২২ শে আগস্ট শ্রীপুর এলাকায় এমবুশে ২ জন পাকসেনা খতম হয়। ২৫ শে সেপ্টেম্বর লক্ষ্মীপুরে ২ জন খতম করা হয়। ২৭ শে সেপ্টেম্বর ১ জন কে খতম করা হয়। ৯ ই অক্টোবর রেইডে লক্ষ্মীপুর এলাকায় ৪ জন পাকসেনা খতম করা হয়। ১৫০০ এম্যুনিশন, ১২ টা গ্রেনেড, ৬ টা চীনা রাইফেল, ১ টা স্তেনগান উদ্ধার করা হয়। ১০ ই অক্টোবর পানিয়ারুপে ৮ জনকে হত্যা করা হয় রেইড চালানো হয়। একজন সিপাহী মমতাজ শাহাদাত বরন করেন। ১৯ শে অক্টোবর কামালপুর রেইডে ৪ জন নিহত হয়। ২১ শে অক্টোবর কামারপুর এলাকায় ১ জন পাক অফিসার একজন অপারেটরকে হত্যা করা হয়। রেইডে ২৪ শে অক্টোবর কামালপুর এমবুশে ৩ জনকে হত্যা করা হয়। ২৬ শে অক্টোবর কামালপুর এলাকায় ৪ জনকে হত্যা করা হয়। ৩১ শে অক্টোবর লক্ষ্মিপুর এলাকায় ৪ জন রাজাকারকে হত্যা করা হয়।
২ রা নভেম্বর মঈনপুরে ৫ জন পাকসেনা ও ৩ জন রাজাকারকে হত্যা করা হয়। ১১ ই নভেম্বর মইনপুর ও কামালপুরে দুটো অপারেশনে মর্টারের সাহায্যে ১৬ জন পাকসেনা নিহত ও ১২ জন আহত হয়। ২০ শে নভেম্বর লক্ষ্মীপুর ও মইনপুর রেইডে ৬ জন পাকসেনা ও ২ জন রাজাকার নিহত হয়। ২১ শে নভেম্বর লক্ষ্মীপুরে মর্টারের সাহায্যে রেইডে ৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। ১১০০ এম্যুনিশন ও একটি চীনা রাইফেল উদ্ধার করা হয়। ঐদিন ই আমাদের আর্টিলারি ফায়ারে ওদের ১১ জন নিহত হয় মঈনপুর এলাকাতে ২২ শে নভেম্বর তাদের আর্টিলারি ফায়ারে তারু মিয়া আমাদের একজন ইপি আর শাহাদাত বরন করেন।২৪ শে নভেম্বর পানিয়ারুপে এমবুশে ১০ জন পাকসেনা নিহত হয়। ২৫ শে নভেম্বর লক্ষ্মীপুর এমবুশে ৩ জন নিহত হয়।
১৩ ই ডিসেম্বর ধবম নামক জায়গায় ডিফেন্স করি। ১৪ ই ডিসেম্বর নাজিরহাটে রেইড করা হয়। ১৩ জন পাকসেনা নিহত হয়। ১৬ ই ডিসেম্বর নাজিরহাট দখল করি এবং পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করে।
স্বাক্ষরঃ সুবেদার গোলাম আম্বিয়া ২০-৭-৭৬
নীলাঞ্জনা অদিতি
<১০, ৪.১২, ১৪৬–১৪৮>
সাক্ষাৎকারঃ মেজর দিদার আতাউর হোসেন
অক্টোবরে বাংলাদশ সেনাবাহিনীর অফিসার হওয়ার পর আমাকে কে ফোর্সের অন্তর্ভুক্ত করে যুদ্ধ এলাকায় পাঠানো হল। নভেম্বরের ১/২ তারিখের রাতে তুমুল বৃষ্টির মধ্যে আমাদের ৩ তা কোম্পানী এবং ২ য় বেঙ্গলের আরো একটা কোম্পানি নিয়ে বেলুনিয়া পকেটে যেতে হয়। পরশুরাম ও ফুলগাজির মাঝামাঝি পাকিস্তানীদের দুটি ক্যাম্পের মধ্যে প্রায় ১২০০ গজের গ্যাপ ছিল। এই গ্যাপের মধ্য দিয়ে রাতারাতি বাঙ্কার খুঁড়ে আমরা অবস্থান নিয়ে ফেলি। ভোরবেলা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটা পেট্রোল পার্টি এই পথে আসে। এই পেট্রল পার্টি আসছিল ফেনী ও বেলুনিয়া রেললাইন দিয়ে একটি ট্রলিতে করে। ট্রলি যখন ঠিক আমাদের পজিশন এর ১০০ গজ দূরে এসে পরে তখনই তাদের উপর আমরা হামলা চালাই। ট্রলিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন লেফতেন্যান্ট ছিল। তার সাথে আর ১০ জন ছিল। তাদের সবাইকে অখানে আমরা ঘায়েল করি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পজিশন ছিল উত্তর দিকে বেলুনিয়া দক্ষিন দিকে ফুলগাজী এলাকা। তারা ধরেই নিয়েছিল এটা বোধ হয় একটা মুক্তিবাহিনীর এমবুশ। গোলাগুলির সঙ্গে সঙ্গে ফুলগাজী থেকে পাকিস্তানীদের রিইনফোরসমেন্ট চলে আসে। প্রায় ৪০/৫০ জন পাকসৈন্য আমাদের দিকে এগুতে থাকে হামলা চালানোর জন্য। ওরা যখন আমাদের রেঞ্জের মধ্যে চলে আসে তখন আমাদের সম্পূর্ণ ডিফেন্স রেল লাইনের পূর্ব পশ্চিম দিক এবং বেলুনিয়া ফেনী সড়ক যেটা রেল লাইনের সমান্তরাল এই দুই পজিশন থেকে একি সঙ্গে আমরা আক্রমন চালাই। আক্রমনে পাকিস্তানীদের ৪০ জনের বেশি হতাহত হয় এবং ৬/৭ জন বোধ হয় পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এই সকল এমবুশে আমাদের পিছনে যে পাকিস্তানি পজিশন ছিল তারা শঙ্কিত হয়ে পরে। এবং তারা আমাদের মধ্য দিয়ে ব্রেক থ্রো করার চেষ্টা করে। তারা সেইদিন রাতেই পালাবার চেষ্টা করে কিন্তু ব্যর্থ হয়। পাকিস্তানীদের বেশীর ভাগই আমাদের হাতে ধরা পরে এবং সেদিন রাতেই ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনি পাকিস্তানী পজিশন এর উপর প্রচন্ড গোলাবর্ষণ করে। পরের দিন বেলুনিয়া থেকে পরশুরাম পর্যন্ত সম্পূর্ণ এলাকাটি হানাদার বাহিনী মুক্ত হয়। এটা ছিল নভেম্বরের ঘটনা।
প্রশ্নঃ পরবর্তীতে সব সময়ি কি এটা আপনাদের দখলে ছিল?
উত্তরঃ বস্তুতপক্ষে এর আগেও এই এলাকা আমাদের দখলে ছিল। বেলুনিয়ায় মুহূরী নদির পশ্চিম দিক থেকে নিয়ে শালদা নামে একটা স্থান পর্যন্ত বলা যায় সব সময়ি আমাদের দখলে ছিল। আর বর্তমান এয়াকা দখলের পর আমাদের এলাকা প্রায় তিনগুন বেড়ে গেল। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, এই এলাকাতে আমরা যখন তিনদিন পর্যন্ত একটানা পাকিস্তানি বাহিনির সঙ্গে যুদ্ধ করি তখন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর বিমান আমাদের উপর হামলা চালায়। সেই বিমান হামলায় আমাদের দশ/বার জনের মত সৈন্য শহিদ হয় এবং ১৫/১৬ জনের মত আহত হয়।
এখানে আমাদের ডিফেন্স খুব স্ট্রং ছিল এবং মনোবল ও খুব দৃঢ় ছিল। সেই অটুট মনবলের জন্যই সময়মত এবং যথাযথ খাওয়াদাওয়া না পেলেও সৈন্যরা সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে গেছে। পরবর্তী সময়ে ইন্ডিয়ান কোর কমান্ডার স্বগত সিং ব্যক্তিগতভাবে আমাদের এলাকা পরিদর্শনে আসেন এবং কমান্ডিং অফিসারকে অভিনন্দন জানান।
প্রশ্নঃ খাদ্যের ব্যপারে আপনাদের কিরকম অসুবিধা ছিল? খাবার কি ঠিকমত সরবরাহ হত না?
উত্তরঃ আমরা খাবার পেতাম। আমাদের ব্যাটেলিয়নের খাবার দেয়ার দায়িত্ব ছিল ইন্ডিয়ানদের তরফ থেকে। তবে আমাদের ব্যাতেলিয়নের যত সৈন্য অথরাইজড ছিল তার দ্বিগুন লোক আমাদের ব্যাটেলিয়নে ছিল। র কারন ছিল। মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে আমরা লোকজন সংগ্রহ করতাম এবং তাদেরকে আমাদের সঙ্গে রাখতাম। ফলে আমাদের সবাইকে যে মাসিক ভাতা দেয়া হত সেটা এবং যে খাবার নির্দিষ্ট ছিল তা শেয়ার করতে হত।
বেলুনিয়ায় নোয়াখালীর এমপি খাজা আহাম্মদ এবং তার লোকজনের সঙ্গে আমাদের খুব একটা সৌহার্দ্য ছিলনা। ফলে বেলুনিয়ার আওয়ামী লিগের তরফ থেকে তেমন কন সহযোগিতা পাইনি। তবে বেলুনিয়ার স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে সব সময় খুবই সহযোগীতা পেতাম। এ সময়ের একটা ঘটনার কথা আমার মনে পরে। আমাদের সৈন্যরা গিয়ে একটা এমবুশ করে পাকিস্তানি পজিশনের পেছনে সেটা ছিল অক্টোবরের শেষের দিকে। নিলকি নামে একটা গ্রাম ছিল সেখানে পাকিস্তানিদের বেশ ক্ষতি হয়। সেই গ্রামে আমি ছিলাম। সংঘর্ষের পরে আমি যখন চলে আসি সেইদিনই অর্থাৎ পরদিন ভোরবেলা পাকিস্তান সেনাবাহিনি সেই গ্রামটা জ্বালিয়ে দেয় এবং ৪০/৫০ জন লককে নৃশংসভাবে হত্যা করে। তার মধ্যে ১৪ বছরের ছেলে ও ৮০ বছরের বৃদ্ধ ছিল। এই খবরতা পাওয়ার পর আমি মানুশিকভাবে খুব দুঃখ পাই এবং রাতের বেলা আবার ফেরত যাই সেই গ্রামে। গ্রামবাসীরা আমাদের দেখে শোকে ভারাক্রান্ত না হয়ে তারা আমাদেরকে আরো উৎসাহিত করতে থাকে। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তারা আমাদের সর্বপ্রকার সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে।
সেই রাতে একজন বৃদ্ধা তিনি তার গরুর দুধ দুইয়ে আমাদেরকে দিলেন। অথচ তাঁরই নাতিকে সকালে পাকিস্তানি সৈন্যরা মেরে ফেলেছে। তিনি বলছিলেন যে, আমার নাতি গেছে ত কি হয়েছে। দেশ যদি একদিন স্বাধীন হয় তবে আমি সবাইকে ফিরে পাব। তোমাদের মাঝেই আমার নাতিকে পাব। গ্রামবাসীদের এই মনোবল আমাদেরকে শত্রুহননে আরো উৎসাহিত করে।
প্রশ্নঃ আমরা এমনও শুনেছি যে, মুক্তিবাহিনী গ্রাম থেকে আক্রমন চালালে পরবর্তী পর্যায়ে পাকিস্তানি সৈন্য সেই গ্রামে হামলা চালাত সেই কারনে গ্রামবসীরা খুব ভয়ে ভয়ে থাকত। কিন্তু পরে যখন মুক্তিবাহিনী বিজয় হওয়া শুরু হল তখহন গ্রামবাসীরা দ্বিগুন উৎসাহে সাড়া দিতে লাগল। আপনাদের এই বিজয়গুলি গ্রামবাসীদের মনে কি রকম সাড়া জাগিয়েছিল?
উত্তরঃ এই প্রশ্নে আমি শুধু বলব, বেলুনিয়ার পর থেকে ফেনী এবং পরবর্তী পর্যায়ে চট্টগ্রামের দিকে যখন আমরা অগ্রসর হই তখন কোন ট্রেঞ্চ বাঙ্কার আমাদের লোকদের খনন করতে হয়নি গ্রামবাসিরা কোদাল নিয়ে এসে আমাদের সহযোগীতা করত, পাকিস্তানী সেনাবাহিনির গোলার আঘাতে গ্রামবাসিরাও হতাহত হত কিন্তু তবু তারা এগিয়ে আসত। তাদের মনোবল ছিল অটুট। গ্রামবাসীর মনোবল কত অটুট ছিল সে সম্পর্কে আমি এখানে একতা ঘটনার উল্লেখ করব। দিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ইন্ডিয়ান একটি পেট্রোল পার্টি পাকিস্তানি পজিশনের পিছনে চলে যায়। পাকিস্তানীরা দেখতে পেয়ে তাদের উপর অবিরাম গোলাবর্ষণ করে। এক সময় ইন্ডিয়ান পেট্রল পার্টির গোলাবারুদ ফুরিয়ে যাচ্ছিল সে সময় তারা খবর পাঠায় গোলাবারুদ সরবরাহের জন্য। আমাদের গ্রামের লোকজন সেই গোলাবারুদ বহন করে নিয়ে যায় প্রায় সাত মাইল পথ অতিক্রম করে। পরে ভারতীয় পেট্রল এ যে অফিসার ছিল তার সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি তখন বলেছিলেন যে, যে দেশের লোকজনের মনোবল এত শক্ত তারা স্বাধীন না হয়ে পারে না। তিনি আরো বলেন যে, ভারতীয়বাহিনীর যে নিয়মিত সাপ্লাই কোর আছে তারাও বধ হয় যুদ্ধক্ষেত্রে এত তাড়াতারি গোলাবারুদ্দ সরবরাহ করতে পারত না যতটা তাড়াতারি করেছে তোমাদের গ্রামবাসীরা।
প্রশ্নঃ এই যুদ্ধের আর কোন উল্লেখযোগ্য দিক আছে কি?
উত্তরঃ উল্লেখ করার আছে। এই যুদ্ধের পরে যখন আমরা পাকিস্তানি ট্রেঞ্চ ও বাঙ্কারে তল্লাসি চালাই তখন আমরা একটি ধর্ষিত মহিলার লাশ পাই। বাঙ্কারের পাশে মহিলার সঙ্গে একটি মৃত বাচ্চা ছিল। পাকিস্তানীরা যে কি চরম বর্বরতা দেখিয়ে গেছে সেগুলি আজ আমরা ভুলে গেছি যার জন্য আজকাল আমরা মুক্তিযুদ্ধকে মনে করি একটি দুর্ঘটনা।
প্রশ্নঃ এছাড়া পাকিস্তানি বর্বরতার আর কোন ঘটনা মনে পড়ে কি?
উত্তরঃ আমি ঢাকায় দেখেছি ২৫ শে মার্চের পরে বাঙ্গালির মৃতদেহ কিভাবে রাস্তায় রাস্তায় পরে ছিল এবং আমাদের এনকাউন্টারে আমরাও পাকিস্তানী লাশ এভাবে রাস্তায় ফেলে রেখে যেতাম এটা আমাদের একটা প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ ছিল। এই সংঘর্ষের পরে পাকিস্তানিরা পুরো বেলুনিয়া ছেড়ে যেতে বাধ্য হয় এবং ফেনীতে গিয়ে পজিশন নেয়।
ফেনিতে আমরা সামনাসামনি ডিফেন্সে দু সপ্তাহের কিছু বেশী থাকি। এখানে প্রায়ই পেত্রলিং হত গোলাগুলি হত মাঝে মাঝে ওরা আমাদের ডিফেন্সের উপর আক্রমন করত এবং পাকিস্তানিদের প্রতিটি আক্রমনই এখানে প্রতিহত করা হয়েছিল এবং ফেনি পুরপুরি ফল করে ডিসেম্বরের ৪/৫ তারিখে। সে সময় পাকিস্তানীরা ফেনী ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। কারন পাকিস্তানিদের পিছনের সঙ্গে সকল যোগাযোগ সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। আমাদের গেরিলারা সে সময় পাকিস্তানীদের খুব নাজেহাল করছিল। ৫ ই ডিসেম্বরের ভোরে তারা রাতারাতি চলে যায় লাকসামের দিকে। ভরবেলা আমরা দেখলাম পাকিস্তানী ডিফেন্স শুন্য। এর আগে আমাদের একটি পেট্রোল পার্টি গিয়েছিল। তারা ফেরার পথে পরিখায় অবস্থানরত রাজাকারদের পাকড়াও করে। তারা এখনো জানত না যে, পাকিস্তানী আর্মি ভেগে গেছে। ফেনির মুলত সেদিনই পতন ঘটে। সেদিন সত্যি ই আমাদের আনন্দের দিন ছিল। আমার মনে সব সময় একতা ইচ্ছা ছিল যে মৃত্যুর আগে যেন অন্তত বাংলাদেশের একটি শহর মুক্ত স্বাধীন দেখে যেতে পারি।
এরপর আমাদের নোয়াখালির আনাচে কানাচে যেতে হয় পাকিস্তানি সেনার কিছু অবস্থানকে মুক্ত করতে। এখানে একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল এই যে, চৌমুহনি ও মাইজদী কোর্টে রাজাকারদের রেজিসটেন্স। রাজাকারদের দুর্ভেদ্য ব্যুহ নাকি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চাইতেও ভাল ছিল। রাজাকারদের বড় বড় নেতারা ও কিছু হাফ ফোরস চৌমুহনী ও মাইজদী কোর্টের দালান কোঠায় উঠে পজিশন নিয়ে আমাদের বেশ ক্ষতি সাধন করে। তারা সহজে সারেন্ডার করেনি। শেষ পর্যন্ত আমাদের বল প্রয়োগ করে সারেন্ডার করতে হয়। এর পর আমাদের ব্যাটেলিয়ন মুভ করে চিটাগং এর দিকে। চিটাগং এর দিকে আমরা এডভান্স করি ৯ ই ডিসেম্বর থেকে।
চিটাগং এর দিকে যখন আমরা এডভান্স করি তখন সীতাকুন্ডে পাকিস্তানিরা আমাদের প্রতিরোধ করে।
১০ তারিখে আমরা সীতাকুন্ডে পৌছাই। এরপর যখন আমরা কুমীরার কাছাকাছি আসলাম তখন আমাদের দুই ব্যাতেলিয়নকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। একটা অংশ আমাদের শিওর নেতৃত্বে তিন কোম্পানীসহ পাহাড়ের উপর দিয়ে চিটাগং ইউনিভার্সিটির দিকে যায়। সেখানে বহু পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে। আমাকে রাখা হল ইন্ডিয়ান আর্মির সঙ্গে ঢাকা চিটাগং ট্রাঙ্ক রোডে। ভারতীয় দুটো ব্যাটেলিয়নের সঙ্গে আমাদের অংশগ্রহন করতে হয়। একটা হল কুমীরায়। সেখানে দুদিন পাকিস্তানী আর্মি আমাদের সম্মিলিত বাহিনীর আক্রমন প্রতিহত করে। তৃতীয় দিন আমরা রাতে ডান ফ্ল্যাঙ্ক দিয়ে ঢুকে পরি। এই গ্রুপে শুধু মুক্তিবাহিনী ছিল অর্থাৎ আমার কোম্পানিই ছিল। আর ছিল ১ নম্বর সেক্টরের একতি কোম্পানী। আমরা পাকিস্তানি ডান ফ্ল্যাঙ্ক দিয়ে যখন চলে আসি তখন তদের সঙ্গে আমাদের প্রচুর গোলাগুলি হয়। এতে আমাদের বেশ হতাহত হয়। সে সময় পাকিস্তানিরা কুমীরা ছেড়ে পিছু হটতে শুরু করে এবং আমরা পাকব্যুহে ঢুকে পরি। এই সময় ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনী ভুলবশতঃ আমাদের উপর গোলাবর্ষণ করে। আমাদের ব্যাটেলিয়ন তখন খাকি ড্রেস পরত। ভারতীয়রা মনে করেছিল পাকিস্তানী সৈন্য আর তাই তারা গোলাবর্ষণ করেছিল। যাই হোক তারা তাড়াতাড়ি শুধরে নেয়। কারন একজন ইন্ডিয়ান ওপি ছিলেন যাকে আমি চিনতাম। তিনি আমাকে এবং আমার লককে চিনতে পেরেছিলেন। ফলে তেমন কন ক্ষতি আমাদের হয়নি। দু একটা গোলা পরেছিল কিন্তু কোন হতাহত হয়নি। তবে হতাহত হতে পারত যদি কোন ভারতীয় অফিসার আমাদের না চিনতেন। কুমীরার পরের রেজিস্ট্যান্স টা হয় এখন যেখানে তার এক মাইল উত্তরের। সেখানে ১৬ ই ডিসেম্বর যখন সারেন্ডার আরম্ভ হয়েছে পাকিস্তান আর্মির দুইজন অফিসার সর্ব প্রথম আমার ডিফেন্সে এসে সারেন্ডার করে। তখন আমি ইন্ডিয়ান আর্মিকে খবর দেই। কমান্ডিং অফিসার এবং একজন ব্রিগেডিয়ার আসেন। আত্মসমর্পণকারী দুজন পাকিস্তানি অফিসারের একজন হচ্ছেন গোলন্দাজ বাহিনীর ক্যাপ্তেন ইফতেখহার আর একজন লেঃ ছিলেন তার নামটা আমি ভুলে গেছি। উনি বোধ হয় ৪৬ ই এম এর। ১৭ ই ডিসেম্বর যখন ইন্ডিয়ান আর্মি মুভ করল চিটাগং শহরে তখন ইন্ডিয়ান আর্মি সিদ্ধান্ত নেয় যে, আমাদেরকে ঢুকতে দেবে না; আমরা পরে ঢুকব। ইন্ডিয়ান ৩২ মাহারের সি ও ছিলেন লে; কর্নেল হরদেব সিং যেহেতু আমি তার সঙ্গে ছিলাম তিনি ব্রিগেড কমান্ডার এর আদেশ অমান্য করে বলেন যে, আমি ত্র সঙ্গে যাব। এবং আমার কোম্পানী নিয়ে ১৭ তারিখেই চিটাগং শহরে মুভ করি।
প্রশ্নঃ সেদিনই কি পাকিস্তান আর্মি সারেন্ডার করে?
উত্তরঃ জ্বী।
এখানে আনুষ্ঠানিক ভাবে কোন সারেন্ডার করানো হয়নি। পাকিস্তানি সেনার যে ২৪ এফ এফ ব্যাটেলিয়ন এখানে তাদেরকে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে আনা হয় এবং তারা সেখানে সারেন্ডার করে। আমি এই কলজে পড়াশুনা করেছি আর সেই কলেজেই পাকিস্তানি আর্মি সারেন্ডার করছে এটা আমার কাছে খুব আনন্দের বিষয় ছিল। এখানে উলেখযোগ্য যে, আমার সিইও যিনি ছিলেন লেঃ কর্নেল জাফর ইমাম উনি ২৪ এফ এফ এ ছিলেন। তারি ব্যাটেলিইয়ন এখানে সারেন্ডার করল আমাদের কাছে এটা বেশ আনন্দের ব্যপার ছিল। তাকে যখন তার ব্যাটেলিয়ন এর লোকজনকে দেখতে হল তখন অনেকেই কান্নাকাটি করল। লেঃ কর্নেল জাফর ইমামের ব্যাটসম্যান নানা কথা জিজ্ঞেস করতে করতে অঝোরে কাঁদতে থাকে।
প্রশ্নঃ আপনাদের ফরমেশন এ যেসব গেরিলা বা এফ এফ ছিল তাদের সঙ্গে কিভাবে সমন্বয় সাধন করতেন?
উত্তরঃ আমার ব্যাতেলিয়ন কমান্ডার প্রথমে সাবসেক্টর কমান্ডার ছিলেন। তিনি সাবসেক্টর চালাতেন। তারপর তিনি যখন ব্যাটেলিয়ন কমান্ডার হলেন তখন সাবসেক্টর কমান্ডার হলেন একজন সিভিলিয়ান – ক্যাপ্টেন মজিবল হক। তিনি পরে এবং এখনো বোধ হয় ট্রেনিং কলেজের প্রিন্সিপ্যাল। তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খুব ভাল ছিল। আমরা একসঙ্গে কাজ করতাম, লোকাল যারা গেরিলা ছিল তারা আমাদের অর্ডার নিয়ে কাজ করত। কারন মজিবুল হক আমাদের সাথে আগে কাজ করেছিল তাই আমাদের কোন অসুবিধা হত না। আমরা তাদের যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারতাম।
প্রশ্নঃ ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে কিভাবে সমন্বয় সাধন করা হত? সম্পর্ক কেমন ছিল?
উত্তরঃ এমনিতে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালই ছিল। তবে আমাদের সেনাবাহিনী চায়নাই যে, ৩ রা ডিসেম্বর থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করুক। সেদিন আমাদের অনেক লোকই কেঁদেছিল।
প্রশ্নঃ ইতিমধ্যে, আপনার কথায় দেখতে পাচ্ছি যে, অনেকখানি জায়গা পুনঃদখল করে ভিতরে পৌঁছে গেছেন?
উত্তরঃ জ্বী, আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, আরো হয়ত দুবছর লাগবে কিন্তু বাংলাদেশ একদিন স্বাধীন হবেই হবে।